ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-০৫

0
1835

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি

পর্ব-০৫

দোতলা বিল্ডিংটার বাইরের আবরণটা খুবই স্যাঁতসেঁতে ধরনের। সবুজ রঙের শ্যাওলা যেন রাজত্ব করছে পুরো দেওয়াল জুড়ে । আর ভেতর থেকে ভেসে আসছে নানান আওয়াজ । বাড়ির ঠিক সামনে একটা পুকুর আছে। পুকুরের স্বচ্ছ জলে সাঁতরে বেড়াচ্ছে হাঁসের ঝাঁক। খানিক বাদে বাদেই ডাকছে প্যাঁক প্যাঁক শব্দ করে। পুকুরের চারপাশটা গাছগাছালিতে ভরপুর। একদম ছায়াঘেরা পরিবেশ যাকে বলে। দখিনা হাওয়ায় দোল খেতে খেতে উপরনিচে করছে গাছগুলির পাতলা ডালপালাগুলো। কয়েকটি নাম না জানা পাখি এ ডাল থেকে ও ডালে উড়ে বেড়াচ্ছে আর খানিক বাদে বাদেই ডাকছে মনকাড়া সুরে।

বিল্ডিংটির দক্ষিণ পাশ জুড়ে নারকেল গাছের সারি। হাওয়ায় দোল খাচ্ছে পাতাগুলি। নারকেল গাছের সারির শেষ মাথায় একটা খামারের মতো। উপরের অংশে একটা সাদা পলিথিনের মতো কিছু একটা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। সম্ভবত বৃষ্টির পানি যাতে ভেতরে প্রবেশ না করে তাই এই ব্যবস্থা! খানিক বাদে বাদেই মুরগির ডাক জানান দিচ্ছে তাদের অবস্থানের। একটা দুটো মুরগি আবার উঠোন জুড়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। খাবার দেখলেই অমনি তা গোগ্রাসে গিলছে যেন!

উঠোনের এক পাশে একটা পেয়ারা গাছ। পেয়ারা এখনও ধরেনি। ফুল এসেছে সবেমাত্র। গাছটির পাশেই খোলা উঠোনে তিনটা বাচ্চা মেয়েছেলে মাটির তৈরী হাড়ি পাতিল নিয়ে খেলছে। সবার মুখ হাসি হাসি। একটা পিচ্চি চমৎকার চুলোও বানিয়েছে! আর সেখানেই একটা মিষ্টি বাচ্চা মেয়ে পাতিল বসিয়েছে। যেন সত্যিকারের রান্না করছে বাচ্চা মেয়েটা!

‘পিউ! এই পিউ!’ চিৎকার ভেসে আসলো পুরনো বিল্ডিংটার ভেতর থেকে। আর সেই শব্দ শুনেই পিচ্চি বাচ্চার দলের রাঁধুনী বাচ্চা মেয়েটার মুখে পড়েছে ভয়ের ছাপ। তড়িঘড়ি করে সে বলল, ‘এই তোরা খেল। আমি যাচ্ছি। মা ডাকছে ।’ এটুকু বলেই সে দিল ভোঁ দৌড়। অন্য দু’জন বাচ্চা তার ছুটার পানে মুখ হা করে তাকিয়ে রইল।

ঘরের ভেতরে ঢুকেই পিউ বলল, ‘মা, ডেকেছ?’

নীলা তার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের মুখের কাঠিন্য আর ধরে রাখতে পারছে না। কেমন অসহায় মুখ করে তাকিয়ে আছে মেয়েটা । মনে হয় খুব ভয় পেয়েছে মা বকবে বলে। তারপর যথাসম্ভব চোয়াল শক্ত করে নীলা বলল, ‘সারাদিন খেলা আর খেলা। একটু পরেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামবে। সেই খবর কি তোর আছে? পড়তে যে বসতে হবে তা কি জানিস না তুই?’

ফাইজা বেগম নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসে পিউকে কাছে টেনে কপালে একটা চুমু দিয়ে নীলাকে প্রশ্ন করলেন, ‘কী রে! কী হয়েছে? এমন করে বকছিস কেন মেয়েটাকে ?’

‘মা, তুমি ওকে আশকারা দিতে দিতে খুব বাড় বাড়িয়ে দিয়েছ। এখন মেয়েটা আমার কথা শুনলে তো!’ নীলা বলল, আক্ষেপের সুরে।

আবির আর সাবরিনা সন্ধ্যার নাশতার জন্য রুম থেকে চোখ কচলাতে কচলাতে বেরিয়েছে মাত্র। আবির হুট করেই বলতে শুরু করল, ‘আপা, তোমরা মা, মেয়ে মিলে আমাদের শান্তি একেবারেই নষ্ট করে দিচ্ছ। একটু শান্তিতে যে দুপুরে ঘুমাব তার কোনো জো নেই। সকাল নেই , বিকাল নেই, তুমি তোমার মেয়েকে নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দাও। এসব নিত্যদিনের ঝামেলা আর ভালো লাগে না।’

ফাইজা বেগম চোখমুখ কঠিন করে তাকালেন আবিরের দিকে। বললেন, ‘বড় আপার সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সেই ভদ্রতাটুকুও বোধহয় লোপ পেয়েছে তোমার!’

সাবরিনা আবিরের পাশে এসে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে ডান হাত রেখে তাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘মা, তুমি খুব বেশি করো। তোমার জন্যই তো আপা এখানে এসে পড়ে আছে। বিয়ে দিয়েছ যখন শ্বশুরবাড়ি না থেকে এখানে কি?’

‘আর এখানে যখন আছেই তখন এভাবে আমাদের শান্তি নষ্ট করার তো কোনো মানে নেই। তাই না ,সাবরিনা?’

‘হুম, একদম ঠিক বলেছিস, ভাইয়া। সাবরিনা সম্মতি দিল।

‘এই তোরা, আমার মেয়েকে নিয়ে একটাও বাজে কথা বলবি না। এটা ওর বাপের বাড়ি। ও যখন-তখন, এমনকি যতদিন ইচ্ছা, দরকার হলে সারাজীবন থাকবে। তোদের সমস্যা হলে তোরা দুইজন বের হয়ে যা।’ ফাইজা বেগম উঁচু গলায় বললেন।

‘এটা আপার বাপের বাড়ি হলে আমাদেরও বাপের বাড়ি। আমরা কেন বের হব?’ আবির ও সাবরিনা সমস্বরে বলল।

নীলা চিন্তিত সুরে বলল, ‘মা, তুমি আর কথা বাড়িও না। চলো তোমার রুমে চলো। প্রেসার বেড়ে গেলে খুব সমস্যা হয়ে যাবে। তার উপর আমার ভাইটা এত কষ্ট করে উপার্জন করে। সংসারের খরচ চালাতে তো রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে ।’

আবির বলল, ‘বাবার সঞ্চয়পত্রের টাকা দিয়েই তো ব্যাবসা শুরু করেছে। এখানে এতো কনসার্ন হওয়ার কি আছে?’

ফাইজা বেগম বললেন, ‘আমার বড় খোকা যখন ব্যাবসা শুরু করে তখন তার বয়স কত ছিল আর বিশ হবে হয়তো। আর তোদের বাবার সঞ্চয় বলতে ছিল কেবলই লাখ খানেক টাকা। এর পর আমার বড়ো খোকা সবকিছু নিজের চেষ্টাতেই করেছে। এসব যে দিনরাত গিলছিস আরাম-আয়েশ করে এসবকিছু আমার বড় খোকার পরিশ্রমের মাধ্যমে উপার্জন করা টাকা। তার কষ্টের উপার্জন।’

‘বাবার সঞ্চয় না থাকলে তো কিছুই করতে পারতো না, ভাইয়া । তখন আমাদের ভিক্ষা করতে হতো।’ আবির বলল, দম্ভভরে।

‘ভিক্ষা করলেও তোদের করতে হতো না। করতো আমার বড়ো খোকা। তোদের জন্য তো সে জীবনে বিন্দুমাত্র আনন্দ করতে পারল না। জীবনটা সে বিসর্জন দিয়েছে তোদের জন্য, তোদের আয়েশের জন্য। তারপরেও তোদের মধ্যে বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতাবোধটুকুও নাই। আমার ভাবতেই অবাক লাগে তোরা দুইজন আমার সন্তান!’ ফাইজা বেগম আহত কণ্ঠে বললেন।

নীলা তার মাকে একপ্রকার টানেতে টানতে রুমে নিয়ে গেল। পিউ ডাইনিং টেবিলের এক কোণায় দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। তার খুব খারাপ লাগে বাসায় ঝগড়া লাগলে। অথচ তাদের ঘরে হরহামেশায় ঝগড়া লেগে থাকে। কখনোই যেন মুক্তি মেলে না! শুধুমাত্র বড়ো মামা বাসায় থাকলে একটু শান্তি মেলে। তাও মামাতো বেশিরভাগই বাইরে থাকেন। পিউর ইচ্ছে হয় বড়ো মামা যদি সব সময় বাসায় থাকতেন তবে হয়তো ঝগড়া হতো না। ছোট মামা আর আন্টি তো বড়ো মামার সামনে খুব একটা মুখ নাড়ে না। পিউ বুঝতে পারে না তার ছোট মামা আর আন্টি তাদের মায়ের সাথে সারাক্ষণ মুখে মুখে তর্ক করে অথচ বড়ো মামার সামনে কেমন যেন ভালো মানুষ হয়ে থাকে। পিউর দ্বিধা কখনোই কমে না। তাছাড়া, তাকেও গালমন্দ করে সব সময় । পিউর খুব খারাপ লাগে কিন্তু কেন এমন করে তারা তার কারণ সে কোনোভাবেই খুঁজে পায় না। অনেকবার বড়ো মামাকে এই বিষয়টা সে বলতে চেয়েছে কিন্তু তার মা তাকে সব সময় থামিয়ে দেয়। বড়ো মামাকে বললে নিশ্চয়ই এমনটা হতো না।

ছোট্ট পিউর ছোট্ট মনটাতে এমনই নানান প্রশ্নের খেলা চলে অহরহ! কিন্তু কোনোটারই উত্তর সে পায় না। সংসারের জটিলতা বিশুদ্ধ মস্তিষ্ক যে ধারণ করতে পারে না! ছোট্ট পিউই তার উদারহরণ।

নীলা মাকে তার রুমে রেখে এসে কিচেনে গিয়ে ঝটপট নাশাতা রেডি করে ফেলল। তারপর আবির আর সাবরিনাকে টেবিলে দিয়ে তাদের জন্য ট্রে তে করে নাশতা নিয়ে গের মায়ের রুমে।

নাশতা খেতে খেতে পিউ প্রশ্ন করল, ‘মা, ছোট মামা তোমাদের সাথে ওরকম করে কথা বলে কেন?’

নীলা মেয়ের কথা শুনে হতবাক হয়ে গেল। কিন্তু মুহূর্তেই নিজের মুখে কাঠিন্য এনে বলল, ‘পিউ, এসব বড়োদের কথা। তুমি এসব নিয়ে একদম ভাববে না।’

পিউ কী যেন ভাবল! তারপর বলল, ‘বড়ো মামা এলে তাকে জিজ্ঞেস করব। ঠিক আছে মা?’

নীলা এবার ধমকে উঠল। বলল, ‘পিউ, তোমাকে কতো করে বলেছি, বড়োদের কথায় একদম নাক গলাবে না। আমার ভাইয়ের কানে যেন এসব না যায় । বুঝেছ?’

ফাইজা বেগম বিরক্তির সুরে বললেন, ‘আহ্, নীলা! বাচ্চা মেয়েটাকে এভাবে কথায় কথায় ধমকাও কেন?’

‘মা এখন থেকে যদি রাশ টেনে না ধরি তবে আবির আর সাবরিনার পথে চলতে শুরু করবে। আর একবার চলতে শুরু করলে রাশ টেনেও কোনো কাজ হবে না। কথায় আছে না, কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ পাকলে করে ঠাস ঠাস।’

ফাইজা বেগম হতাশ গলায় বললেন, ‘ঠিক বলেছিস। তবে আমি তো কখনো এরকম শিক্ষা দিইনি আমার সন্তানদের। তবে কেন ওরা দুজন এমন হলো?’

নীলা বুঝতে পারছে তার মা খুব কষ্ট পাচ্ছে। মাঝেমধ্যে কষ্ট চেপে রাখাটা অসম্ভব হয়ে পড়ে । তখন না চাইতেও চোখ নিজের কাছে জমানো গ্লানিটুকু জলধারারূপে বিসর্জন দেয়। অশ্রু বিসর্জনের পর মানব মনের গ্লানিটুকুও বোধহয় খানিকটা কমে যায়। ঠিক যেন বৃষ্টিবর্ষণের পর মেঘমুক্ত হাস্যোজ্জ্বল আকাশ ভারমুক্ত হয় নিজের কষ্ট থেকে।

আর তাই খাবার শেষ হতেই নীলা পিউকে বলল তাদের রুমে গিয়ে বই নিয়ে পড়তে বসতে। পিউ লক্ষ্মী বাচ্চার মতো হেঁটে চলে গেল ।

তারপর নীলা মাকে আশ্বস্ত করতে বলল, ‘মা, হাতের পাঁচ আঙ্গুল সমান না হওয়ার উদাহরণ তোমাকে দেব না। তুমি আমার চাইতে অনেক বেশি দুনিয়া দেখেছ। সবকিছু বুঝো, জানো। তবে একটা কথা তোমাকে বলতেই হচ্ছে মা, সন্তানের খারাপ হওয়ার পেছনে সব সময় পিতা মাতার দোষ থাকে না। তবে এটা ঠিক যে, ওরা এসব নোংরামো শিখেছে চাচা-চাচীদের কাছ থেকে। ওরা যেমন সারাক্ষণ ঝগড়া করে বেড়ায়, তেমনি আমার এই ভাই-বোন দুটোও তাদের কাছ থেকেই এই শিক্ষা লাভ করেছে। আবার এটাও ঠিক যে, তারা শক্তের ভক্ত নরমের যম। দেখ না, চাচা-চাচীদের সামনে কেমন মিনমিনে ভান ধরে থাকে।’

‘সে যাইহোক, ব্যর্থতা আমার । আমি আমার সব সন্তানকে ঠিকমতো মানুষ করতে পারলাম না। তোদের বাবা আমাদের ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমানোর পর থেকে আমি আসলে তোদের ঠিকমতো দেখাশুনা করতে পারি নাই। উল্টে তোরাই আমার দেখাশুনা করেছিস।’ এটুকু বলেই ফাইজা বেগম নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন। চোখ থেকে টপ টপ করে অবাধ্য অশ্রুরা ঝরে পড়ছে।

আবির আর সাবরিনা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শুনার চেষ্টা করল মা তাদের ব্যাপারে কী বলছে! মায়ের চোখের জল তাদের হৃদয় স্পর্শ করল না। আর এই চরম সত্য প্রকাশ পেয়েছে তাদের বিরক্তমাখা, কুঞ্চিত ভ্রু যুগল দেখে।

কী নিষ্ঠুর পৃথিবী! কী নিষ্ঠুর এই পৃথিবীর কিছু মানব সন্তানেরা! জন্মদাত্রী জননীর চোখের জল তাদের স্পর্শ করতে পারছে না। ঠিক কী দিয়ে গড়া তাদের হৃদয়খানি! বড্ড দেখতে ইচ্ছে হয়। ইস্পাত কঠিন হৃদয় কি তবে সত্যিই আছে?

‘না, মা। এখানে তোমার কোনো ব্যর্থতা নেই। যে খারাপ হওয়ার সে এমনিতেই খারাপ হবে। তার জন্য খারাপের কোনো উদারহণ থাকতে হয় না। জানোই তো খারাপ কিছু শেখাতে হয় না। আর মানুষকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খারাপ করে তার লোভ। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আবির আর সাবরিনার মধ্যে লোভের উপস্থিতি প্রকট।’ নীলার চোখেও জল, সে মায়ের চোখ মুছতে মুছতে কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল।

আবির আর সাবরিনা বোনের কথা শুনে ক্রোধে ফেটে পড়ল। কিন্তু এই মুহূর্তে খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না ভেবে চলে গেল নিজেদের রুমে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে