Saturday, August 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 473



উজানের ঢেউ পর্ব-১০

0

#উজানের_ঢেউ ( ১০)
কলমে✍️ #রেহানা_পুতুল
আমি সাইন কোথায় করবো? পেপারস দেন।”
সে অসহায় মুখে মায়া মায়া কন্ঠে আমাকে বলল,

” নাহ! রত্না প্লিজ! আমার কিছু কথা শোনো সাইন করার আগে।”

“এটা কোন দয়া দাক্ষিণ্য করার স্থান নয়। মানুষের দয়া হবে মানুষের জন্য। কোনো অমানুষের জন্য নয়। কোন কাপুরুষের কথা শোনাও আমাদের সবার অন্যায় হবে।”

আমার অসহিষ্ণু কন্ঠের বলিষ্ঠ কথাগুলো শুনেই, উকিল পেপারস এগিয়ে, দেখিয়ে দিলো কোথায় কোথায় সাইন করতে হবে।

সে আমাদের কারো কাছেই এতটুকু আশ্রয় পেলনা। কূল হারা মাঝির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। আমি সাইন করে দিলাম। সেও সাইন করে দিলো নিরুপায় হয়ে। রাজনের উপরে তার কোন দাবী নেই। সেটাও লিখিতভাবে জানিয়ে দিলো।

আসার সময় দেখলাম, সে আমাকে ঘাড় ঘুরিয়ে পলকহীন চোখে দেখছে। তার সারামুখে ছিলো অনুশোচনার গাঢ় আবরণ। সম্পূর্ণ কাজ শেষ করে আমরা বাড়ি ফিরলাম শেষ বিকেলে। বাবা আমাদের সবাইকে বাইরে লাঞ্চ করালো। আমি খেতে না চাইলেও বাবার আদেশ অমান্য করার মতো সাহস ছিলনা। তাই বাবার অনুগত ও বাধ্য কন্যা হয়ে খেতে হলো।

ঘরে ঢুকেই রাবু বলল,

” আপা তোর আগের মতো রূপ দেখেই তার মাথা নষ্ট হয়ে গেলো। তাই তোকে আবার ফিরে পেতে চাইছে। বুঝতে পেরেছিস? ”

” না বোঝার কিছুই নেই। আমরা সবাই এটা বুঝতে পেরেছি।”

রাবু বলল,

” যে পুরুষদের কাছে মনের চেয়ে রূপের কদর বেশী। রূপের পসরা দেখলেই যাদের যৌবন খলবলাইয়া উঠে। এমন কুরুচিপূর্ণ পুরুষদের সকাল বিকাল আসতে যেতে গু’য়ের স্যান্ডেল দিয়া তাদের চাবকানো উচিত।”

ধুম করে আমার মুখ দিয়ে হাসি বেরিয়ে গেলো রাবুর কথা শুনে। বললাম,

” ভালো বলছিস। লাইক কমেন্ট সবই দিলাম তোকে। যা।”

রাবু আমাদের সবার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তাক করলো। বলল,

” আচ্ছা, এই বেয়াদবটা কোন শাস্তি পাবেনা?”

মা রাবুকে বলল,
” তুই কি শাস্তি দিতে চাস?”

রাবু বলল,

” আমি কেন শাস্তি দিব? দিবে তো আপা।”

বাবা পাশ থেকে বলল,
” শাস্তি আমরা দিতে হবে না তাকে। আর কি লাভ হবে দিয়ে। মনে রাখবি, কাউকে দৌড়াতে গেলে একই সমান পথ তোরও দৌড়াতে হবে। হয়রানি আছে। সবর করে আল্লাহর উপর ছেড়ে দিতে হয়। তিনিই সবচেয়ে শক্তিশালী বিচারক। তিনি ছাড় দেন,কিন্তু ছেড়ে দেন না।”

আমি বাবার কথায় মত প্রকাশ করলাম,

” ‘রিভেঞ্জ অব নেচার’ বলে একটা কথা আছে। যা অলরেডি সে পেয়েছে। এবং হয়তো আরো পাবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। নিজের জন্মদেওয়া সন্তান বড় হলে চোখের সামনে এখানে ওখানে দেখবে। কিন্তু তার মুখে বাবা ডাক শুনবে না। তাকে বুকে জড়িয়ে নিতে পারবে না। এটার উপরে আর কোন শাস্তি বরাদ্দ থাকতে পারে না একজন পিতার জন্য। আর যে জন্মভিটা থেকে চিরদিনের জন্য অধিকার হারালো। উচ্ছেদ হলো। মৃত পিতার মুখ দেখতে পেলনা। ত্যাজ্যপুত্র তকমা এঁটে গেলো তার জীবনে। এসব কি কম মনে করছিস। তার চেহারা সুরতের হাল দেখেছিস? আমাকে একদিন বলেছে ভাঙ্গাচোরা বেড়ার ঘরের মতো লাগে দেখতে। তাকে কেমন লাগে? তাকে তো বহু পুরোনো ঘূণে ধরা বাঁশের মতো লাগল দেখতে।”

রাবু টেবিল চাপড়ে বলল,

” আপা ঠিক বলছিস। তোকে লাইক কমেন্ট দিলাম। শোধবোধ। ”

তারপর সপ্তাহ খানেক কেটে গেলো,
মাহমুদ ভাই কোনভাবেই আর যোগাযোগ করছে না। এটা আমাকে অল্পস্বল্প হলেও ভাবিয়ে তুলল। কোন অসুখ বিসুখ হলো নাকি উনার। ফোন দিব দিব করেও সংকোচে আর দেয়া হয়নি।

আমি ও আঞ্জুমান মিলে পার্লারের জন্য বড় একটি রুম পেয়ে গেলাম। ওয়াশরুম তো আছেই। ততটা যুতসই মনে হলোনা। তবে প্রাইমারি লেভেলের জন্য মন্দ নয়। টাকা বাবার কাছেই গচ্ছিত আছে। আমাকে দিতে চেয়েছে। আমিই নেইনি। যখন যা লাগে বাবার থেকে নিয়ে নিয়ে পার্লারের যাবতীয় জিনিসপত্র কিনে নিচ্ছি। বাবা দায়িত্ব নিয়ে রঙ মিস্ত্রি দিয়ে অফ হোয়াইট কালার রঙ করিয়ে দিলো। পার্টিশন দিয়ে একপাশে সরু লম্বা রুম বের করা হলো। ফেসিয়াল ও বিভিন্ন রূপ চর্চার জন্য একটা সিট ফেলতে হবে তাই। পুরো রুম নতুনের মতো চকচক করছে। এভাবে একমাস লেগে গেলো রুমটাকে পুরোপুরি লেডিস বিউটি পার্লারের উপযোগী করে তুলতে। নেইমপ্লেট রেডি। আকর্ষণীয় নাম দিলাম। ‘অঙ্গসাজ’।

তবে যত যাই করছি। বিয়ের বিষয় টা ভুলিনি। এ নিয়ে বাবা ও মায়ের উপরে আমার ক্ষোভ ও অনুযোগ রয়েছে। এটা মা ধরতে পেরেছে। যেহেতু আমি শুনেই গিয়েছি।

এক সকালে মা আমাকে ডেকে নিলো নয়নকে দিয়ে। বাবাও রয়েছে পাশে।
মা বাবার উপস্থিতিতেই বলল,

” মা শোন,তোর বয়স অল্প। যতই স্বাবলম্বী হোস না কেনো,দিনশেষে একজন সঙ্গীর প্রয়োজন রয়েছে জীবনে। কে কতদিন বাঁঁচবে তা আগে থেকে কেউই বলতে পারবেনা। পাশে দুটো ভরসার হাত থাকা দরকার। মাথার উপরে বটবৃক্ষের মতো একজনের নিরবিচ্ছিন্ন ছায়ার দরকার। তোর আব্বা তোর বিয়ে ঠিক করেছে। তবে ফাইনাল হয়নি। তোর মতামত নিয়েই কথা দিবে তাদের। আর অবশ্যই বিয়ে হবে ইদ্দতের চারমাস দশদিন সম্পন্ন হওয়ার পরেই। তোকে আরো পরেই জানাতাম। কিন্তু রাবু বলে ফেলছে। তাই আমরাও জানালাম তোকে। ”

” পাত্র কে বাবা? আর যেই হোক। আমি আগে নিজে শক্তভাবে দাঁড়াই। তারপরে দেখা যাবে। ”

” পাত্র আমাদের অচেনা। আমিও দেখিনি। আমার এক ব্যবসায়ীক বন্ধুর ভাইয়ের ছেলে। চট্রগ্রাম ব্যবসা করে নাকি। বিপত্নীক। স্ত্রী মারা গিয়েছে হঠাৎ করে। ছোট একটি কন্যা সন্তান রয়েছে।সব মিলিয়ে আমার কাছে ঠিকঠাক মনে হলো। সেও সন্তানের গুরুত্ব বুঝবে। তুই বুঝবি। যেহেতু দুজনেরই সন্তান রয়েছে।”

” বাবা আমি আপনার পছন্দকে সম্মান করি। আমি একবার পাত্রের সাথে দেখা করবো। তারপর জানাবো। তাও এখন নয়। কয়দিন পর। মনের দিক থেকে আমি ভালো নেই বাবা।”

” আচ্ছা সময় নে তুই মা। সমস্যা নেই। আর পার্লার কবে চালু করবি?”

” এ মাসের শেষে মিলাদ দিবো। তারপরের মাসের এক তারিখ থেকেই বিসমিল্লাহ বলে চালু করবো। একজন বিউটিশিয়ান ও রেডি। নাম সাংমা। পাহাড়ি মেয়ে। ”

” খুব ভালো। তাহলে আমি মিলাদ পড়ানোর জন্য হুজুরকে বলে রাখবো। আমাদের মসজিদের আতিক হুজুরকে বলব।”

বাবা মায়ের সামনে থেকে সরে গেলাম। তাদের সামনে স্বাভাবিক থাকলেও আমার কেমন যেন বেশ খারাপ লাগছে। মাহমুদ ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে। হঠাৎ করে উনার কি হলো বুঝে উঠতে পারছি না। কারো কাছে বলতেও পারছি না। আমার নতুন কর্ম জীবনের বিষয়টাও উনার অজানা। তার এটা জানার অধিকার আছে কাজিন হিসেবে। সে এই ভিতরে বাড়িও এলনা আর। আমি চাই মিলাদের দিন তিনি উপস্থিত থাকুক। যার জন্য আরাধনার মন্দির সাজিয়ে প্রতিক্ষার প্রহর গুনছে বসন্তের পর বসন্ত। সেই মাহমুদ ভাইয়ের প্রার্থনার হাত উঠুক তার পানকৌড়ি’টার জন্য।

অলস দুপুরে মোবাইল বেজে উঠলো। রাজনের বড় চাচী লায়লা ভাবির ফোন। সবার খোঁজ খবর নিলাম। এরপর উনি বিস্মিত স্বরে বললেন,

” শোন। ঘটনা তো রমরমা। তোর জন্য খুশীর খবর এটা।”

আমার আর তর সইলো না। ব্যস্তসমেত হয়ে জানতে চাইলাম,

” কি হয়েছে ভাবি?”

” আরেহ কি হইতে আর বাকি? সব খবর ত পাই। শিরিন এই বাড়ির ময়নারে বলে। ময়না আইসা আমাদের বলে। ময়নারে শিরিন মানা করে আমাদের না বলার জন্য। কিন্তু ময়না বাদুনি আমাদের না বলে থাকতে পারেনা। এই দুটার খাতির তো বহু আগ থেকেই।
এদিকে আম্মার শারিরীক কন্ডিশনও ভালো না। ধর যত যাই হোক। মায়ের কাছে তো সন্তান। মন পোড়েই ওই ইবলিশের জন্য।”

” আজব ভাবি। আসল কথা না বলে সাইড কথায় চলে যাচ্ছেন। ”

” বলছি। শুন, শিরিন জিন্দেগীতেও মা হইতে পারব না। এবার বুঝুক কত ধানে কত চাল। আর বারো মাসে বছর না আঠারো মাসে বছর।”

আমি চমকে উঠলাম। একজন নারী কোনদিন মা হতে পারবে না। এটা যে কতবড় শূন্যতা,কত বড় যন্ত্রণা সেই নারীর জন্য। আমি তো নারী। তাই আমি বুঝি। বললাম,

” কি বলছেন ভাবি? সত্যিই তো? কিভাবে এটা সিউর হলো তারা?”

” শিরিনের নাকি পিরিয়ড বন্ধ হইছে পাঁচ সপ্তাহ চলছে। এই ভিতরে তার তলপেট ব্যথা আরম্ভ হয়। পরে হাসপাতালে নেয়। টিউমার হইছে নাকি জরায়ুর মুখেই। তো জরায়ু নাকি কাইটা ফালায়া দিতে হইছে। জরায়ু না থাকলে বাচ্চা ক্যামনে হইবো আর?”

” হায় আল্লাহ! এদিকে সেতো লিখিতভাবে রাজনের অধিকার ছেড়ে দিয়েছে। তারমানে চিরদিন নিঃসন্তান হয়েই বাঁচতে হবে।”

” ওই তুই আফসোস করস ক্যান? আমার তো খুশী লাগতাছে। যে আমার পবিত্র চরিত্রে কলংকের দাগ লাগায়া দিলো। তার জিন্দেগীর এমন দুর্দশাই হওয়া উচিত।”

” তা ঠিক ভাবি। নাহ। আমি কেবল একজন মেয়ে হয়ে অন্য একটা মেয়ের এই বিষয়টা অনুধাবন করলাম। এইই।”

” শোন। খবর আরেক টা আছে। জালিমে নাকি বিদেশ নাকি যাইতে পারব না আর। গার্মেন্টসে নাকি অল্প বেতনের চাকরি করে। রাহিমা আপার বাসায় আছে। শিরিনও নাকি সুস্থ হইলে চাকরি করবো গার্মেন্টসে। তার পরিবারের কেউই তার সাথে যোগাযোগ করে না। আছিলো বাবার সংসারে রাজকন্যার মতন। আর এখন চলে রাহিমা আপার বাসায় চাকরানির মতন। আহ! কি দূর্গতির জিন্দেগী হ্যাগো দুইজনের।”

ভাবির থেকে কথা বলে বিদায় নিলাম। প্রলম্বিত স্বাস ফেললাম এই ভেবে,

প্রতিটি মানুষের জীবনেই কোন না কোনভাবে উজানের ঢেউ আসে। উল্টো স্রোতের মতো ভেসে যায় জীবনের উজান ঢেউয়ের তোড়ে।
সাঁতরে টিকে থাকতে পারে কয়জন আমার মতো। দুমড়ে মুচড়ে যায় আশরাফুল ও শিরিনের মতো। টিকে থাকতে পারাটাই সফলতা। হেরে যাওয়াটাই চরম ব্যর্থতা। তাদের এই জীবনের জন্য তারাই দায়ী। তাই ছারখার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার জীবনের জন্য আমি দায়ী নই। আমি নিদোর্ষ ছিলাম। নিরপরাধ ছিলাম। তাই আমি ঘুরে দাঁড়াতে পারছি।

সময়,পরিবেশ,পরিস্থিতি এখন আমার অনুকূলে। কথায় আছে,

” সময় হলো অর্থ সম্পদের মতন। আজ তোমার কাল আমার।”

কেবল সময়ের সদ্ব্যবহার করা জানতে হয়। মাকে সব জানালাম। মাও আফসোস করলো কিছুটা।

এদিকে মনস্থির করলাম পরেরদিন মাহমুদ ভাইকে সরাসরি ফোন দিবো। ফেসবুকে বোবা ভাষায় ডিটেইলস বলা সম্ভব নয়।

নিরালা দুপুরে মাহমুদ ভাইকে ফোন দিলাম। সালাম দিলাম। তিনি সালামের জবাব দিয়েই বললেন,

” অভিনন্দন পানকৌড়ি। নতুন জীবনে পদার্পণ করতে যাচ্ছিস। শুনে খুব ভালো লাগল। ”

আমি ধরে নিলাম হয়তো পার্লারের কথা মিন করেই এটা বলেছে। কারো কাছ থেকে শুনতেই পারে। এটা লুকোচুরির বিষয় নয়।আমি মুঠোফোনর এ-প্রান্তে মৃদু হেসে বললাম,

” দোয়া করবেন আমার জন্য। মাহমুদ ভাই আপনি কবে আসবেন বাড়িতে?”

তিনি অনুজ্জ্বল হাসি দিয়ে বললেন,

” দোয়া তোর একার জন্য নয় শুধু। তোদের দুজনের জন্যই। তা তোর হবু বরের নাম কিরে পানকৌড়ি? ”

মুহূর্তেই আমার হাসিহাসি মুখে ভর করলো প্রগাঢ় নৈঃশব্দ্যতা ও বেদনার স্তুপ।

চলবে.. ১০

উজানের ঢেউ পর্ব-০৯

0

#উজানের_ঢেউ ( ৯)
কলমে✍️ #রেহানা_পুতুল
তাহলে রাবুর কথা সত্যি হলে, আমার বিয়ে কার সাথে ঠিক করলো বাবা, মা? কার সাথে?

এলোমেলো ভাবনায় জড়ানো পায়ে সামনের উঠানে গেলাম মাকে না দেখতে পেয়ে। মা উঠানে বসে বটি দিয়ে নারকেল শলা নিচ্ছে পাতা ছাড়িয়ে। আমি শলাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছি হাতে তুলে। মা বিছানা ঝাড়ু তৈরি করবে এই নারকেল শলাগুলো দিয়ে। রাজন অন্যদিকের এক চাচীর কাছে রয়েছে। নয়ন সেই উঠানে ফুটবল খেলছে অন্যদের সাথে। রাজন মুগ্ধ দর্শক হয়ে একমাত্র মামার খেলা উপভোগ করছে উৎসুক দৃষ্টিতে।
খুউব মন চাচ্ছে মাকে জিজ্ঞেস করি রাবুর বলা কথাটা। এমন কল্পনার সূতো ছিঁড়ে যায় উঠানে রাবুর পদধ্বনি দেখতে পেয়েই।

আমি পাশে থাকায় রাবু মার সাথেও কথা বলেনি। সোজা ঘরে ঢুকে গেলো। রাবুর চেহারার বেশ দেখে দমে গেলাম। তাকে জিজ্ঞেস করতে গেলেই এখন তেড়ে আসবে। মা কাজ করতে করতে বলল,

” তোর বোনের কি হয়েছে? সকাল থেকেই দেখি গাল ফুলিয়ে রাখছে বেলুনের আকারে?”

আমি সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গেলাম। সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্য প্রস্তুত হলাম।
বললাম,
” আমি জানি কারণ টা।”

” কি হইছে আবার ঢংগীর? উনার আহ্লাদীপানার শেষ নাই। জ্বালাইয়া মারলো আমারে। ”

মায়ের কন্ঠে রাবুকে নিয়ে বিরক্তির রেশ।
বললাম,
“আমি রাতে ওর গালে থাপ্পড় মারছি। জোরেই দিলাম। তবে থাপ্পড় ছিলো একটাই।”

মায়ের হাত থেমে গেলো। নেমে গেলো বটি থেকে। সন্ধিৎসু চোখে চাইলেন আমার দিকে। জিজ্ঞেস করলেন,

” করছেটা কি হারামজাদি? বোনের হাতেও চড় খাইতে হলো?”

” রাবু গত সন্ধ্যায় আমার সাথে ফাজলামি করছে। ”

” কি করছে কবি তো? ”

” আমি আসছি শোকের বাড়ি থেকে। মন মেজাজ খারাপ। নামাজ পড়ে জায়নামাজে বসে বসে দুরুদ পড়ছি তসবিহ হাতে। ও পট করেই বলে উঠলো,
আপা তোর বিয়ে। আব্বা ঠিক করছে। আমরা সবাই রাজী। ”

আড়চোখে লক্ষ্য করলাম,

আমার কথা শুনেই মায়ের চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। রাবুর উপর ক্ষেপে গেলো। মা বলল,

” তাহলে ঠিক করেছিস। কিসে খোঁটায় মনে হয় তারে। বদের হাড্ডি একটা। মন চায় আমিও গিয়ে চেঁচা দিই। ”

” আমি তো ভাবছি রাবু আমার নামে বিচার দিবে তোমার কাছে। কিন্তু দেখলাম চুপ। বিষয়টা ব্রেনে ধরলনা মা।”

মা চুপ রইলো। রাবু শুনতে পেলো আমার কথা। উঠানে এসে ঠোঁট উল্টিয়ে কপাল কুঁচকে বলল,

” আম্মার কাছে বলিনাই, তারমানে এই না আমি মিথ্যা কইছি।”

আমি তব্দা খেলাম রাবুর কথা শুনে। নিমিষেই মায়ের ফর্সা নাক মুখ লাল হয়ে গেলো। মা বটি ফেলে উঠে গিয়ে রাবুর দুই গালে দুই থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন। গজগজ করে রাবুকে বললেন,

” এই বান্দরনী। ফিডার খাস?কিসের পড়াশুনা করিস? সামান্য আক্কেলজ্ঞান নাই। কি বলছে তোর বাপে তোরে? পঁচা পুঁটি কোথাকার। পেটে কথা হজম হয়না। ঘর থেকে বাইর হইয়া যা বলছি।”

মায়ের কথা শুনে বুঝলাম রাবুর বলা সত্যি না হলেও মিথ্যে নয়। সত্য মিথ্যার মাঝামাঝি কিছু একটা হবে। রাবু দুই পা দিয়ে আছাড়ি পিছাড়ি করে মারতে লাগল ঘরের টিনের বেড়ার মাঝে। আমি বিশেষ ঘাটালাম না রাবুকে। ক্ষেপানো ব্যক্তিকে দরদ দেখাতে গেলে প্রশ্রয় পেয়ে সে আরো বেশি ক্ষেপে যায়।
#রেহানা_পুতুল পেইজে 👉Like ও Follow দিয়ে আমাকে বাঁচার পূর্ণ আনন্দটুকু দিবেন। প্লিইজ।🙏🥲💚
উঠানের কাজ সব গুছিয়ে নিলাম। মা খোয়াড়ে হাঁসমুরগি ঢোকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। পুকুরঘাটে গেলাম হাতমুখ ধোয়ার জন্য। পারুল ভাবির সাথে দেখা হলো। ভাবির চোখের চাহনিতে কৌতুক খেলা করছে।

নিচু গলায় জানতে চাইলাম,

” এই ভাবি কাল যে বললে আমার বিয়ে। আব্বা ঠিক করছে। এটা তুমি কিভাবে জানো?”

ভাবি চারদিকে নজর বুলিয়ে নিলো। নেত্রপল্লব না ফেলেই বলল,

” আমার দেবর মাহমুদ আমার কাছে চুপিচুপি বলছে তোকে বিয়ে করবে। প্রস্তাব পাঠাবে কাকার কাছে।সেতো তোরে আগে থেকেই লাভ করে।”

” তাহলে বললে যে বাবা ঠিক করছে?”

” ওটা বাড়ায়া বলছি। কাকা জানেই না। মাইন্ড করিস না তুই।”

পারুল ভাবি চলে গেলো। আমি ঘাটের উপরের সিঁড়িতে উঠে কিয়ৎক্ষণ দাঁড়ালাম। মুখ তুলে গগনপানে চাইলাম। মাথার উপরে বিস্তৃত রক্তিম আকাশ। শারদীয় সাঁঝলগ্ন। অপূর্ব, অকল্পনীর মন ভালো করা দৃশ্য। তবুও মন ভার হয়েই রইলো। পৃথিবীর সব সৌন্দর্য ম্রিয়ম্রাণ লাগছে আমার কাছে। চারপাশের প্রকৃতিতে ভর করছে ক্রমশ গা ছমছমে নির্জনতা। হাঁটা ধরলাম পা বাড়িয়ে ঘরের দিকে।

সন্ধ্যার পরে ইউটিউব ও গুগল দেখে নোটপ্যাডে পার্লারের জিনিসপত্রের লিস্ট লিখে নিলাম সিরিয়াল করে। যদিও বেশ সময় লাগলো বুঝেসুঝে লিখতে। লিখা শেষে আঞ্জুমানকে ফোন দিলাম। জানালাম। সে বলল,

” রত্না, শুন দোস্ত, হুট করে কিছু কিনে ফেলিস না। আগে পার্লারের জন্য রুম ঠিক হোক। আর তুই পারলে কাল মার্কেটে আয় একবার। এখানে আমার পরিচিত পার্লার রয়েছে। সরাসরি কথা বলব তুই আমি। কি কি শুরুতেই লাগবে। এবং কি কি পরে হলেও চলবে। এসব জেনে নিলে তোর জন্য সহায়ক হবে। ”

” ভালো বলছিস আঞ্জুমান। প্রাণঢালা ভালোবাসা নিসরে। কিনবনা তো। জাস্ট লিখে রাখছি। কিনব তো পরেই। কাজ এগিয়ে রাখা বলে যাকে। ”

কিছুক্ষণ কথা বলে আঞ্জুমান থেকে বিদায় নিলাম। মনের ভিতর উসখুস করছে বিয়ের বিষয়টা নিয়ে। মা বাবা যেহেতু নিজ থেকে কিছু বলেনি। বরং মনে হলো লুকিয়ে রাখছে কিছু। তাই তাদের জিজ্ঞেস করার বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলি। রাবু থেকেই বিষয়টা ক্লিয়ার হতে হবে। কিন্তু রাবুকে এখন কিভাবে কোনমুখে জিজ্ঞেস করবো। সেটা বড় প্রশ্ন। সবমিলিয়ে একটা বাজে কাণ্ড ঘটে গেলো। বিচ্ছিরি অবস্থা। রাবুর জন্য মন পুড়ছে অতিরিক্তভাবে। বেচারি আমার জন্য দুজনের হাতে মার খেলো। ভারি অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গেলাম। ভেবে রাখলাম, দু তিনদিন যাক। রাবুও একটু নরমাল হউক। তখন জেনে নেওয়া যাবে। এত অস্থির হয়ে এখন কোন লাভ নেই।

আমি ও রাবুর মাঝখানে রাজন ঘুমিয়ে আছে। রাবু কোন কথাই বলছেনা আমার সঙ্গে। বিছানার একপাশ হয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছে। আমার ঘুম আসছে না। সত্যি বলতে সেই নিশি রাতের নিস্তব্ধতায় মাহমুদ ভাইয়ের কথাগুলো বারবার উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলো মনের আরশিতে। চাইলেও সরাতে পারছিনা তাকে। ভোলার জন্য ঘুমের ট্যাবলেট ইপনিল খাই। তন্দ্রাঘোরে হেলে পড়ি অল্পসময়ের ব্যাবধানেই।

পরেরদিন রাজনকে মায়ের কাছে রেখে বেরিয়ে পড়ি। আঞ্জুমানের ফাস্টফুড দোকানে যাই। ও জোর করে অনেক কিছু খাওয়ালো। পরে ওকে নিয়ে সেই পার্লারে যাই। অনেক না জানা কিছু জানলাম। সঞ্চিত হলো নতুন অভিজ্ঞতা।

দুইদিন পর রাতে মাহমুদ ভাই ফেসবুকে মেসেজ দিলো।

” কেমন আছিস পানকৌড়ি? কবে দিবি ডুব সাঁতার। আসবি কবে আমার কাছে?”

আমাকে ছোটবেলা থেকে প্রকাশ্যেই পানকৌড়ি বলে ডাকে মাহমুদ ভাই। আমি পুকুরে গোসল করতে নামলে একঘাটে ডুব দিয়ে আরেকঘাটে গিয়ে ভেসে উঠতাম মরা মাছের মতো। এদিকে অন্যরা আমাকে পানিতে এদিক সেদিক চেয়ে খুঁজতো। মাহমুদ ভাই দু চারদিন দেখে গিয়েছে। এমন এক দুপুরে মাকে বলে উঠে, চাচী,

” ওর স্বভার দেখি পানকৌড়ি’র মতন। ডুব দিয়ে অন্যদিকে গিয়ে ভেসে উঠে। ওর নাম দিলাম আমি পানকৌড়ি। নামটা সুন্দর না চাচী? ”

মা হেসে সায় দিতো মাহমুদ ভাইয়ের কথায়। মায়ের বড় ছেলে নেই বলে মাহমুদ ভাইকে মা বেশী ভালোবাসে। মা তখন বলছে,

“তুই নাম দিছিস। তাই তুই ডাকিস বাপ ওই নামে। আর কারো ডাকার দরকার নেই।”

তখন মাহমুদ ভাই আমার চুলের ঝুঁটি ধরে টান মেরে,

” কিরে পানকৌড়ি, তোর নামের নিবন্ধন তো করে ফেললাম। তোর আপত্তি আছে?”

আমি বত্রিশ দাঁতের পাটি মেলে ধরে খিলখিলিয়ে হেসে উঠতাম। কিছুই বলতাম না। একদৌড়ে অন্যদিকে ছুট দিতাম চঞ্চল চড়ুই পাখির মতো। এই গল্প আমার আজকালকার নয়। কিশোরীবেলার।

আমি মেসেজ সিন করে চুপ করে আছি। খানিক পরেই মনে যা আসলো লিখলাম। কিছু একটা ভেবে কেটে দিলাম। মাহমুদ ভাইয়ের আইডি থেকে পূনরায় মেসেজ এলো,

” এতসময় যা টাইপিং করেছিলি। লিখে এগেইন সেন্ড কর। কুইক।

“আপনি কি বেকার মাহমুদ ভাই? আর কোন কাজ নেই? আমি টাইপিং করেছি। তাও ফলো করেছেন?”

” আমি তোর চিরদিনের ফলোয়ার।জীবনের ফলোয়ার। ফলো যে করতেই হয় পানকৌড়ি। ”

” কে পানকৌড়ি? কিসের পানকৌড়ি? আমার সুন্দর একটি নাম রয়েছে। রত্না।”

**” তুই আমার যৌবন কালের উড়ন্ত পানকৌড়ি, তোতে মন ডুবছে সারাক্ষণ।
তুই সকাল সন্ধ্যাকালে, চুপটি করে বসে থাকিস, আমার হৃদয় বৃক্ষ শাখে।

তুই দুষ্টমিতে মেতে, বরষার একলা দুপুরে,
শিস দিয়ে যাস আমার,সরস প্রেমের ক্ষেতে।” **

মাহমুদ ভাইয়ের এই কাব্যিক নিবেদনে কি রিপ্লায় দিব বুঝে উঠতে পারলাম না।
“শুভরাত্রি ” বলে অফলাইনে চলে এলাম। কিন্তু নিজের অজান্তে,অনাগ্রহে সুপ্ত চিত্তখানি তাকে নিয়ে কল্পনায় ফানুস উড়াতে লাগলো। একদিকে মাহমুদ ভাইয়ের আকুল করা হাতছানি। আরেকদিকে বাবা নাকি বিয়ে ঠিক করলো। মানসিক টানাপোড়েন ও দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগতে লাগলাম। আহ! বেঁচে উঠাই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে আমার জন্য

দুদিন কেটে গেলে একটু আধটু করে রাবু আমার সাথে কথা বলা শুরু করলো। তবে সেই পরিবেশটা আমিই ক্রিয়েট করেছি। রাবুকে বুকে টেনে নিয়ে স্যরি বলেছি। এটা ওটা বানিয়ে সামনে নিয়ে গিয়েছি। রাবুও বুঝতে পারলো আমারো ভুল ছিল না ওকে চড় মারাতে।

একসপ্তাহ হলো ডিভোর্সের তিনমাস পূর্ণ হয়েছে। রাজনের বাবা আমাকে ফোনদিয়ে কখন কবে কোর্টে থাকতে হবে জানিয়ে দিলো। এবং এও বলল সেই সব কাগজপত্র গুছিয়ে রেড়ি করে রাখবে। আমি আচ্ছা বলে রাখলাম। গুরুত্বপূর্ণ কথার বাইরে একটি শব্দও সে উচ্চারণ করেনি। নিশ্চিত হলাম শিরিন তাড়া দিয়ে এটা করাচ্ছে। নয়তো কখন আবার সে আমাকে নিয়ে যায়। রিস্ক থেকে যায়।

আজ একটি চিরবন্ধন আনুষ্ঠানিকভাবে ছিন্ন হবার দিন। ভিতর টা কেনো জানি পুড়ে খাঁক হয়ে যাচ্ছে। আমার জন্য নয়। আমার রাজনের জন্য। ব্রোকেন পরিবারের সন্তান হয়ে সে বেড়ে উঠবে। বেঁচে থাকবে পিতৃ পরিচয়হীন হয়ে। ভাবতেই কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো।

আমরা সবাই গেলাম কোর্টে। সে এবং তার রিলেটিভ দুজন পুরুষ ছিলো। আমি এদের তেমন চিনিনা। আমি মুখ না ঢেকেই মাথায় হিজাব বেঁধে ছিলাম। রাবু চোখের ইশারায় আমাকে বলছে, আশরাফুল নাকি বারবার আমার মুখের দিকে দেখছে। সে লেনদেন নিয়ে ঝামেলা করলো না। প্রাপ্য টাকা পুরোটাই দিলো। রাজনের জন্য মাসান্তে খরচ কত দিবে। তাও চুড়ান্ত হলো। আমি তার দিকে একপলকও চাইনি। বরং সজাগ ছিলাম দৃষ্টি যেনো না পড়ে। সেটাও নাকি সে পরখ করে দেখছে। এমন হীন আর কুৎসিত মানসিকতার মানুষের দিকে ভুল করে তাকাবার রুচিবোধ নষ্ট হয়ে গিয়েছে সেই কবেই।

সে হঠাৎ করে আমাকে অনুরোধের ভঙ্গিতে বলে উঠলো,

” রত্না আমি একটু কথা বলতে চাই তোমার সাথে একাকী।”

” আমি প্রয়োজন মনে করিনা একদম।”

বিরস কন্ঠে অন্যদিকে চেয়ে বললাম গলায় তেজের ঝাঁপি ঢেলে। সে মা,বাবার কাছে মাফ চেয়ে আরজি করলো আমাকে যেনো বলে, তার সাথে কথা বলতে।

আমার পক্ষের কেউই তার ভুলানো কথায় গলে গেলো না।
আমি কোর্টে উকিলকে বললাম,

” আমি সাইন কোথায় করবো? পেপারস দেন।”

সে অসহায়ের মতো মুখ করে মায়া মায়া কন্ঠে আমাকে বলল,

” নাহ! রত্না প্লিজ! আমার কিছু কথা শোনো সাইন করার আগে।”

চলবে..

উজানের ঢেউ পর্ব-০৮

0

#উজানের_ঢেউ ( ৮)
কলমে #রেহানা_পুতুল
রাবু ঈষৎ হেসে বলল,
” আপা তোর বিয়ে। আব্বা ঠিক করেছে। আম্মাও রাজী। আমিও রাজী। নয়ন কে আমরা হিসেবে ধরিনা। রাজন তো ল্যাদা। তুই কি আব্বা আম্মার পছন্দকে ইগনোর করতে পারবি?সো বিয়ের সানাই বাজবেই। রাবু এবার নাচবেই। আগেতো পিচ্চি ছিলাম।কুদাকুদি করতে পারিনাই। এবার খেলা হবে।”

আমি বোকা বোকা স্তব্ধ চাহনিতে কেবল ফ্যালফ্যালিয়ে চেয়ে রইলাম রাবুর দিকে।

জায়নামাজের বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। হাত লম্বা করে কষে এক চড় বসিয়ে দিলাম রাবুর বাম গালে। রাবু ভূত দেখার মতো চমকে গেলো অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটাতে। একহাত দিয়ে চড় খাওয়া গাল চেপে ধরলো। জলপূর্ণ টলমল চোখে চাইলো আমার পানে। নিরবে পা ঘুরিয়ে প্রস্থান নিলো আমার সম্মুখ হতে। ছোট বোনকে চড় মেরেছি। তা নিয়ে আমার মাঝে তেমন খারাপ লাগা কাজ করছেনা। বরং ক্রোধের দাবানলে জ্বলছি আমি। একশো চুল্লীর উত্তপ্ত অনলে জ্বলে পুড়ে ভষ্ম হয়ে যাচ্ছে আমার অন্তরটা। কষ্টরা দলা পাকিয়ে আছে হৃদয়ের অন্তপুরে। চিনচিন ব্যথা করে উঠলো বুকের বাঁ পাশটা।

কথায় আছে ‘যাহা কিছু রটে কিছু না কিছু হলেও বটে।’ পারুল ভাবি বলল। রাবু বলল। তারমানে ব্যাপারটি আংশিক হলেও সত্যি। অভিমানী মনে ভিতর থেকে দরজা ভিড়িয়ে দিলাম। বিছানায় কাত হয়ে পড়লাম। সূক্ষ্ণভাবে চিন্তা করছি ও নিজেকে নিজে প্রশ্ন করছি,

আমি কি বাবা মায়ের জীবনে বাড়তি বোঝা হয়ে গেলাম? আমাকে নিয়েই তাদের এত অশান্তি? আমার অনুমতির থোড়াই কেয়ার করে বাবা মা এত বড় সিদ্ধান্ত কিভাবে নিতে পারলো? কিভাবে? লাইফ আমার। ভালোটাও আমার। মন্দটাও আমার। তাহলে আমার মতামত এত গুরুত্বহীন হয় কিভাবে তাদের কাছে?

নিজেই আবার উত্তর মিলিয়ে নিলাম নিজের মতো করে। পরক্ষণেই ফের ভেবে উঠলাম, যত যাইহোক। আমার উপরে কারো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারবেনা। এখনো ডিভোর্সই কার্যকর হয়নি। সেখানে কিসের বিয়ে? কার সাথে? বললেই হলো? আমি আগে স্বনির্ভর হবো। বলার মতো একটা পরিচয় তৈরি করবো। তার আগে অন্যকিছু আমার ভাবনায় আনতে রাজি নই আমি।

সন্ধ্যা বিদায় নিলো বহু আগেই। রাত বাড়ছে প্রকৃতির নিয়মে। পেটের ভিতরে ক্ষুধারা উৎপাত শুরু করে দিয়েছে বিক্ষিপ্তভাবে। উঠে গেলাম ভাত খাওয়ার রুমে। হাত থেকে ভাতের প্লেট পড়ে গেলো। ঝনঝন আওয়াজ শুনে মা উঠে এলো।

বলল,
” আমি তোদের রুমের সামনে গেলাম। দেখলাম দরজা বন্ধ। তাই চলে এলাম। সে বাড়ির কি অবস্থা? ওই হারামি দেখছে তোকে? খাসনাই সেখানে কিছু?”

মায়ের সব জিজ্ঞাসার জবাব দিলাম অল্পবাক্যে চাপাস্বরে। মা বুঝে নিলো আমার মন খারাপ সেই বাড়ির পরিস্থিতির জন্যই। মা বলল,

” আচ্ছা ভাত খেয়ে নে। মন খারাপ করে কি আর হবে। কপালের লিখন যায়নাকো খন্ডন। এটা মুরুব্বিগণ বলছেন। সময় সব ঠিক করে দিবে। বাড়িতে আমাদের একটা পারিবারিক ঐতিহ্য আছে তেমন অর্থকড়ি না থাকলেও। তাই কেউ পিছনে কানাঘুঁষা করলেও আমাদের সামনে তেমন কিছুই বলার সাহস পায়না। নয়তো তেমন পরিবার হলে মানুষের কত টিপ্পনী শুনতে হতো। ”

মা চলে গেলো আমার সামনে থেকে। আমি ভাত খেয়ে উঠলাম। বিয়ের বিষয়ে মাকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও পারিনি। কথাটা বারবার গলা অবধি এসে কাঁটার মতো আটকে গিয়েছে। কারণ এই ভেবে, মা যেহেতু নিজ থেকে বলেনি, আমি আগ বাড়িয়ে বলাটা ঠিক হবে না হয়তো।

ভাত খেয়ে উঠে নয়ন কে আমার রুমে ডাকলাম। নয়ন আমার আদরের একমাত্র আকাঙ্ক্ষিত ছোটভাই। এই কয়দিন সেই নয়নকে একবারও বুকে জড়িয়ে নিইনি।মমতার পরশ দিইনি। নিজের হাতে আগের মতো মুখে তুলে খাইয়ে দিইনি। নয়ন ও কেমন দূরে দূরে রয়েছে আমার থেকে। জীবনের উপর আকস্মিক আঘাত হানা পরিস্থিতিতে নিজের বিধ্বস্ত জীবনেরই বেহাল দশা। সেখানে ভাইয়ের দিকে ফিরে চাইবার জো ছিল না। নয়নের মাথায় ও পিঠে বোনের স্নেহমাখা পরশ দিতে লাগলাম। তার পড়াশোনার খবর নিলাম।

সবশেষে জিজ্ঞেস করলাম,

” রাবু বলল আমার বিয়ে। তুই কি এমন কিছু জানিস ভাই?”

নয়ন শুকনো মাটিতে হোঁচট খেলো যেনো। আমার চোখের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি ফেলল। অবুঝের মতো করে বলল,

” নাতো আপা। আমি এমন কিছুই জানিনা। আমি আর তুমি তো তোমার শ্বশুর বাড়িতেই ছিলাম সারাদিন।”

” তা ঠিক। তার আগে পরে এমন কিছু শুনেছিস ভাই?”

” আরেহ দূর। নাতো। আমি যাই। গেম খেলতেছি। তোমার জন্য আমি হেরে যাবো এখন।”

নয়নের মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললাম,

” আচ্ছা যা। আর শোন, আমি যে একথা জিজ্ঞেস করছি তোকে। এটা কাউকেই বলবিনা। রাবুকেও না।”

নয়ন ঘাড় হেলে সম্মতি জানালো, আচ্ছা বলব না বলে।

আমি নানাভাবে বাবা মার কথোপকথন আড়িপেতে শোনার চেষ্টা করলাম। রাবুর বলা কথার সত্যতা যাচাই করতে। কিন্তু এমন কিছুই শুনলাম না। রাবুকে চড় মারলাম আমি। সে মায়ের কাছে সেটা নিয়ে নালিশ করল না আমার নামে। সব কেমন গোলমেলে লাগছে।

রাতে শুয়ে গেলাম রাজনকে ঘুম পাড়িয়ে। আমার মাথায় বর্তমানে কেবল একটা বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছে লাটিমের মতন। তা হলো আমার ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে। ফেসবুকে লগ ইন করলাম বহুদিন পর। আঞ্জুমানকে মেসেজ দিয়ে তার মোবাইল নাম্বার চাইলাম। নাম্বার পেয়ে রাতেই আঞ্জুমানকে ফোন দিলাম। মাঝরাত পর্যন্ত ওর সাথে কথা বললাম। সদ্য ঝড়ে তছনছ হওয়া জীবনের কাহিনী পুরোটাই বললাম পুরোনো ক্লাসফ্রেন্ডকে। লুকিয়ে লাভ কি। আজ নয় কাল সবাই জানবে। রত্না ডিভোর্সি। রত্না সিংগেল মাদার। আঞ্জুমান সব শুনে বিমূঢ় হয়ে গেলো।
আশ্বাস দিলো,

” আমি তোকে যেভাবে যা পারি হেল্প করব। গুঁড়িয়ে যাসনা দোস্ত। তুই নিজ থেকে তোর লাইফের সব বলাতে আমার ভীষণ ভালোলাগছে। অনেকে আছে,বলেনা। ভয় পায়। তুই সাহসী বরাবরই। স্যালুট তোকে।”

আমি বললাম,
” সত্য লুকানোর মতো ভীরু কাপুরুষ নয় এই রত্না।
“সত্যি অপ্রিয় হলেও সুন্দর। মিথ্যা প্রিয় হলেও কুৎসিত। সত্যের একটা নিজস্ব ক্ষমতা আছে। আলাদা সৌন্দর্য আছে। হোক না তা যতই করুণ। ”

আঞ্জুমানকে শুভরাত্রি জানিয়ে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম। পরেরদিন সকালে বাবার সাথে দেখা করলাম দোকানে যাওয়ার আগে। মাও পাশে ছিলো।

” বাবা,আমি কি বিজনেস করবো ডিসাইড করছি।”

” খুব ভালো। তা কি করবি? ”

” বাবা রাতে আমার কলেজফ্রেন্ড আঞ্জুমানের সাথেও কথা বললাম। আমি পার্লার দিবো ঠিক করেছি। ”

” মন্দ নয় এটা। চৌরাস্তা শহরমুখী স্থান। চলবে ভালো সেন্টারমতে নিতে পারলে। তুই পারবি তো? টাকা পয়সার বিষয় কিন্তু মা?”

” ইনশাআল্লাহ পারব বাবা। অনার্সে পড়ার সময় শখ করে বিউটি পার্লারের কাজ শিখেছি না। এটাই আমার মন টানছে। এতে সিকিউরিটিও পাকাপোক্ত। লেডিস বিউটি পার্লারগুলোতে মেল পারসন নো এলাও। শুরুতে একজন বিউটিশিয়ান নিযুক্ত করবো। আঞ্জুমানের পরিচিত মেয়ে আছে নাকি। ও বলল। এছাড়া পাশাপাশি আমিতো বিউটিশিয়ানের কাজ জানিই। আর কি কি কিনতে হবে ডেকোরেশনের জন্য,তা ইউটিউব দেখে জেনে নিব। রাজনও আমার সঙ্গে থাকতে পারব। বাসার মতই হয় পার্লারগুলোর সিস্টেম। ”

” ঠিকাছে তুই প্রস্তুতি নে। এদিকে তিনমাস ঘনিয়ে আসছে। সেই টাকাগুলোও হাতে আসুক।”

” হুম। আমিতো এখনি বলছি না বাবা। রুম পেতেও তো সময় লাগবে। আঞ্জুমান রুম দেখবে আজ থেকেই। তুমিও খুঁজো। ”

” আচ্ছা। আমিও পরিচিত লোক লাগিয়ে দিবো মার্কেট প্লেসের পাশেই একটা রুম খোঁজার জন্য।”

বাবা চলে গেলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। যাক কি করবো সেটা ঠিক হয়ে গেলো। নয়তো অনেক নারীর বা মেয়েদের এই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে হয় বহুদিন। কিন্তু ভিতরে আবারও একটা ধাক্কা খেলাম। কই বাবাও তো বিয়ে নিয়ে কিছুই বলল না। তাহলে রাবু, পারুল ভাবি সিরিয়াস মুডে অমন কথাটা শুনালোই বা কেনো আমাকে।

কিন্তু সত্যি হলে তো মায়ের কাছে অভিযোগ দেয়ার কথা। এমন ভাবনায় আমার অনুভব, অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেলো। মস্তিষ্কে কোন কাজই করছে না। রাবু কলেজে চলে গেলো। আমার সাথে কথা বলেনা রাত থেকেই। মা খেয়াল করেনি। নয়তো জিজ্ঞেস করতো। ঠিক করলাম কলেজ থেকে বিকেলে আসুক রাবু। নিরিবিলি জিজ্ঞেস করবো বিষয়টা।

সেদিন অপরাহ্নের দিকে আমার মুঠোফোন বেজে উঠলো। অচেনা নাম্বার। হ্যালো বলে সালাম দিলাম,
ওপাশ থেকে নিরবতা ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছেনা।

” কথা না বললে ফোন দেয়ার মানেটা কি? অভদ্র কোথাকার।”

হালকা মেজাজে বললাম।

” কারো কাছে সারাজীবন অভদ্র থাকতে চাই। সেই সুযোগটাওতো মুহূর্তের জন্যও পাইনি। কেবল বঞ্চিত করেই গেলো সে আমাকে।”

চকিতে বিষম খেলাম।
” মাহমুদ ভাই আপনি। চুপ করে ছিলেন কেনো?”

” মোবাইলে এই প্রথম তোর কন্ঠ শুনলাম। ভারী মিষ্টি! ভারী কোমল! যেনো সদ্য প্রষ্ফুটিত হওয়া রক্তগোলাপ। মাশাল্লাহ!”

আমি ইতস্তত বোধ করতে লাগলাম। মনে হলো মাহমুদ ভাই আমার লজ্জাবনত রাঙা অধরখানি দেখে মিটিমিটি হাসছে। ঠোঁট কামড়ে বললাম,

” কি বলবেন বলেন?”

” ভণিতা না করেই বলি। তোর সব আমি শুনেছি। তোকে নিয়ে আমার অনুভূতি একই কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। জনমভর তাই থাকবে। বিশ্বাস করানোর জন্য যে কোন শর্ত মাথা পেতে নিতে রাজি আছি। ভাগিনা হিসেবে রাজনকে তো এমনিতেই অনেক স্নেহ করি। এখন তোদের মা ছেলের দায়িত্ব পেলে আমি নিজেকে সুখী মনে করবো। ”

আমি অতি আশ্চর্যন্বিত কন্ঠে বললাম,

” কি বলছেন এসব মাহমুদ ভাই? মাথা ঠিক আছে? নইলে হেমায়েতপুরে যান। ”

” প্লিজ পানকৌড়ি। একবার প্রসন্ন হও আমার প্রতি। পৃথিবীর সব পুরুষ এক নয়। যদি তাই হতো তাহলে তোর মা,আমার মা,কিভাবে যুগের পর যুগ একজন মানুষের ছায়ায় বেঁচে আছে? সুখে আছে?”

মাহমুদ ভাইয়ের এই কথার মমার্থ উদঘাটন করতে পারলাম সফলভাবেই। আসলেই তো তাই। জগতের সবাই যেমন ভালো নয়। তেমনি সবাই মন্দ ও নয়। তবুও দোনোমোনো শুরু করলাম।

” আমি এখন রাখছি মাহমুদ ভাই। ভালো লাগছে না ।”

” আচ্ছা সময় নে। আমি কাকার সাথে কথা বলব। মাকেও জানাবো। ”

” আমার সম্মতি ছাড়া?”

” হুমম তোর তোর সম্মতি ছাড়াই। ভালোবাসার মূল্য কেউ না দিলে জোর করে আদায় করে নিতে হয়। ন্যাড়া বেলতলায় একবারেই যায়। বারবার নয়।”

আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ব্যক্তিত্বপূর্ণ কন্ঠে বলল মাহমুদ ভাই। এদিকে আমাকে প্রতিউত্তর দেয়ার সুযোগটুকুও দিলনা তিনি। চট করেই লাইন কেটে দিলো মোবাইলের।

আমি কেমন যেনো গোপনে শিহরিয়া উঠলাম। এই অনুভূতি আমার পরিচিত। অতি চেনা। বিয়ের পর রাজনের বাবার কথা শুনলে, স্পর্শ পেলে এমন হতো। তিরতির করে কাঁপতাম গাছের কচি শাখার ন্যায়। অবশ্য মাহমুদ ভাইয়ের কথা শুনেও দু একবার এমন হয়েছে। তখন ছিলো আমার বাড়ন্ত বয়স। দৃষ্টিজুড়ে যাই দেখতাম সবই ভালোলাগতো। কি মানুষ,কি ফুল,কি পাখি। সবই। দুরন্তপনায় মেতেছিলাম রাতদুপুর। থাক। সেসব রোমাঞ্চকর বেলা অবেলার কথা নাই বা বলি। নয়তো নষ্টালজিক হয়ে যাবো।

মুহূর্তেই নিজের মনকে ব্যস্ত রাখার জন্য নানা আয়োজন করি। যেনো মাহমুদ ভাইয়ের প্রস্তাবে টলে না যাই। অবাক করার বিষয় হলো মাহমুদ ভাইয়ের কথামতে, উনি এখনো কাউকে জানায়নি আমার কথা।

তাহলে রাবুর কথা সত্যি হলে, আমার বিয়ে কার সাথে ঠিক করলো বাবা, মা? কার সাথে?

চলবে..

উজানের ঢেউ পর্ব-০৭

0

#উজানের_ঢেউ ( ৭)
কলমে✍️ #রেহানা_পুতুল
“ভাবি যত দ্রুত সম্ভব বাবাকে শেষ দেখার জন্য আমি আসছি রাজনকে নিয়ে।”

ভাবি ফোন রেখে দিলো। আমি আহত কন্ঠে মাকে বিষয়টা বললাম। মা বাবাকে মোবাইলে জানালো। বাবা যেতে বলল। তবে একা যেতে বারণ করলো। এবং এটাও বলে দিলো মাকে, সাবধানতা অবলম্বন করেই যেনো তাদের বাড়িতে থাকি। যেহেতু বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন ও নাজুক।

মা বলল,

” রাবুকে নিয়ে যা। রাজনকে রাখতে পারবে সে। তুই যেভাবে বললি, তাতে বেশি সুবিধা ঠেকল না আমার কাছে। ”
রাবুকে ডাক দিয়ে যেতে বললাম আমার সঙ্গে। রাবু চনচনিয়ে উঠল।
বলল,

” আমি যাবনা ভাই। মাফ চাই। আমার আজ জরুরী ক্লাস আছে কলেজে। ওই কুত্তাদের বাড়িতে কে যায়। আমার মাথা বিগড়ে গেলে বাজে আচরণ করে ফেলব ওদের সাথে। সো তার চেয়ে বেটার,তুই নয়নকে নিয়ে যা। মাত্র সেভেনে পড়ে ও। ভোলাভালা নাদান শিশু। চুপচাপ থাকবে রাজনকে নিয়ে।”

আমি গোমড়া মুখে মার দিকে চাইলাম। মা আমাকে ইশারা দিলো চুপ থাকতে।

রাবুকে বলল,

” নয়নকে আমার কাছে পাঠা। তুই যা তোর ব্যারিস্টারি পড়তে।”

রাবু বিরক্তিকর কন্ঠে মাকে বলল,

” তুমি পারনা যেতে? তোমার তো বেয়াই লাগে।”

” আগের মতো হলে আমি কেন, আমরা সবাই যেতাম। কিন্তু যেখানে আমার মেয়ের ভাত উঠে গেলো সেই সংসার থেকে। ওসব আজরাইলের দুয়ারে কে যায়। ”
প্লিজ #রেহানা_পুতুল পেজে like ও Follow দিয়ে আমাকে বাঁচার আনন্দটুকু দিবেন। 🙏🥲

নয়ন মায়ের তাড়া পেয়ে পুকুর থেকে গোসল করে এলো। অল্পক্ষণেই শার্ট প্যান্ট পরে নিলো। আমিও গোসল করে তড়িঘড়ি করে রেডি হলাম। মা রাজনকে রেডি করে দিলো। বাবা বাজার থেকে এলাকার পরিচিত সিএনজি পাঠিয়ে দিলো বাড়িতে। গ্রামের পথেঘাটে শহরের মতো জ্যাম নেই। ভিড় নেই। জটলা নেই। তাই হোসেনপুর গ্রামে পৌঁছাতে আমাদের সময় লাগলো না।

তাদের উঠানের একপাশে কয়েকটি কুকুর অনবরত ঘেউ ঘেউ করে ডেকে যাচ্ছে। একটি কাক গলা ফাটিয়ে ককর্শ স্বরে ডেকে যাচ্ছে। ছোট ছোট কিছু বাচ্চা ঢিল ছুঁড়ে মারছে তাকে তাড়াবার জন্য। আমি গলা উঁচিয়ে দেখলাম, কাকটি স্থান পরিবর্তন করলো নিজেকে আত্মরক্ষার চেষ্টায়। তবে চলে গেলনা। হয়তো অভুক্ত কুকুরটি বুঝতে পেরেছে আজ এ বাড়িতে মাংস রান্না হবে।

ঘরের ভিতর থেকে গুমরে গুমরে কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। রাজনের দাদাকে ঘরের সামনের রুমে মাটিতে বড় একটা বেতের পাটিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। বন্ধ চোখে উনার জীর্ণশীর্ণ দেহখানি নির্জীবের মতো পড়ে আছে। আমি বাবা বলে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। পাশে একটি বাটিতে পানি ও চা চামচ রাখা ছিলো।
উনার মুখে দুই চামচ পানি দিলাম।
ধরা গলায় মিনতি করে বললাম,

” বাবা আমি রত্না। কখনো যদি কোন ভুল করে থাকি আমাকে মাফ করে দিবেন আল্লারওয়াস্তে।”

তারপরেই উনার হৃৎকম্পন থেমে গেলো চিরতরে। সাঙ্গ হলো এক মানব সন্তানের ইহলীলা। বাড়ির অন্য মুরুব্বিরা উনার মাথার নিচ থেকে বালিশ সরিয়ে নিলো। আগেই প্রস্তুত রাখা একরঙা বিছানার চাদর দিয়ে উনাকে আপাদমস্তক ঢেকে দিলো। আমি ঢুকরে কেঁদে উঠলাম। তবে জানিনা আমার কন্ঠ ও কথা শোনার মতো শ্রবণশক্তি উনার ছিলো কিনা।

তার আগেই কিন্তু রাজনের দাদী নয়নের কোল থেকে রাজনকে টেনে নিলো। তার গালে কপালে অজস্র চুমু খেয়ে বলল,

দাদুভাই দাদাকে দোয়া করে দাও। মাথায় হাত বুলিয়ে দাও। বলে রাজনের কচি হাতখানিকে তার দাদার মাথায়,মুখে বুলিয়ে নিলো বার কয়েক।

মৃত বাড়ি। শোকের কলরবে চারপাশ মুখরিত। থেকে থেকে অশ্রু বির্সজন দিচ্ছে রাজনের দাদী ও ফুফুরা। রাজনের চার ফুফু। রাজনের বাবা সবার ছোট ও আদরের। অধিক স্নেহ মমতা পেয়েই নাকি সে উচ্ছনে গিয়েছে তাদের ভাষ্যমতে। বাড়িতে সবাই উপস্থিত রয়েছে একজন ছাড়া। রাহিমা আপা ঢাকা থেকে আসলেই লাশ দাফন সম্পন্ন হবে। আমার ভাসুর শহীদ ও অন্যান্য বাকি আয়োজনে ব্যস্ত।

শিরিনের পরিবারের সবাই আছে। তার মা, বোনের জামাইয়ের জন্য আকূল হয়ে বিলাপ করছে। আমার বিশ্বাস ছিলো শিরিন ও তার নব্য স্বামী রাহিমা আপাসহ একসাথেই আসবে। যেহেতু তারা তার বাসায় ছিলো আমার জানামতে। আমার বিশ্বাস উবে গেলো। রাহিমা আপা,তার স্বামী ও তার ছেলেমেয়েরা এলো ঢাকা থেকে। বাকি দুজন নেই। আমার চোখ কপালে উঠে গেলো। হতবিহ্বল হয়ে গেলাম আমি।

পারিবারিক বেদনার চেয়ে ব্যক্তিগত বেদনা,ক্রোধ আমাকে ঘিরে আছে।
লাশ দাফন হয়ে গেলো। বাড়ির অন্যদিকে রান্না হলো মৃতের পরিবারের জন্য। নয়নের ক্ষুধা লেগে গেলো। গাইঁগুই করছে আমার কাছে এসে। পরে তাকে রাজনের চাচাতো বোন ভাত, মাংস, মাষকলাইয়ের ডাল এনে দিলো টেবিলে।

আমাকে রাজনের দাদী ও ফুফুরা জোর করলো খেতে। আমি বিপুল অনাগ্রহ প্রকাশ করলাম খেতে। এবং খেলামও না।

শেষ বিকেল হয়ে গিয়েছে। ঝিমানো প্রকৃতিতে রোদের তেজ মৃদু হয়ে এলো। চলে যেতে হবে। সত্যিটা জানা জরুরী। আমি লায়লা ভাবিকে নিরালায় ডেকে জিজ্ঞেস করলাম ভাবি,

“বাবার লাশ দেখতে তার ছোট ছেলে এলনা কেন? কেমন সন্তান সে?”

লায়লা ভাবি আমার হাত ধরে বাঁশঝাড়ের পিছনে নিয়ে গেলেন। দুঃখ ও ক্ষোভ মিশ্রিত চাপানো স্বরে বললেন,

” বাড়ি ভর্তি লোকজন। ক্যামনে বলিই সব। সন্তান না শয়তান বল ওই লুইচ্চারে। সংক্ষেপ কইরা বলি। বাড়িতে আসেনাই, কারণ বাবা তাকে সব সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে দিছে রেজিষ্ট্রি অফিসে গিয়াই। ত্যাজ্যপুত্রও করে দিছে কাগজে কলমে। সবাইকে বলছে তার মরামুখ ও যেনো সে না দেখতে আসে। এইই।
কারণ তোমারে ছাইড়া দিলো সে
।আর রাজনরেও চায়না তার জীবনে।

আর বাকিটা হলো আজাদ ভাই নাকি বিদেশ থাকতেই শিরিনের বিয়া ঠিক করছে ঢাকার কোন বাড়িওয়ালার ছেলের লগে। তো এখন তো পুরাই বেইজ্জতি হইলো সে। উনি ঢাকায় গিয়া কৌশলে শিরিন ও তারে খুঁইজা বাইর করছে। তারপরে লোকজন নিয়া ইচ্ছামতো নাকি মারলো। শিরিনরেও নাকি মারছে। দুজনেই হাসপাতালে ভর্তি ছিলো কতদিন। এখন নাকি নরসিংদী তার কোন বন্ধুর বাসায়। আমার কাছেতো তোর নাম্বার আছে। কখন কি হয় তোরে জানামু। আবার এরা দুই বোনের পরিবার ফোনে ফোনে দুই গ্রামে থেকে কি যে তুমুল ঝগড়া হইতো। কি বাজে কথা বলতো একজন আরেকজনকে। বলার মতো নয়। ”

ভাবির কথা শুনে আমি তাজ্জব বনে গেলাম। বিস্মিত কন্ঠে বললাম,

” কি বলছেন ভাবি! সব সম্পত্তির থেকে বঞ্চিত? ত্যাজ্যপুত্র? বেধড়ক মার? কি ভয়ংকর অবস্থা! অবশ্য এসব তার পাওনা তাই পেয়েছে। যেমন কর্ম তেমন ফল। ঠিকই করেছে বাবা। জন্মদাতা পিতাকে না দেখতে পারার মতো দূর্ভাগ্য আছে আর পৃথিবীতে?”

ভাবি পরিতাপের সাথে দম ফেললেন। বললেন,

” সেটাই। তুইতো এখন চলে যাইবি। ভালো থাকিস। আমারে ভুল বুঝিস না। তোকে আমি বোনের মতই জানিরে।”

” ভাবি আপনার সাথে আমার কোনকালেরই দ্বন্ধ নেই। আর সেই পথও রইলো না আর। আচ্ছা, ভাবি লুইচ্চা কেনো বললেন তারে?”

লায়লা ভাবি চোরের মতো লুকানো চোখে এদিক সেদিক চাইলেন। ফিসফিস করে বললেন,

” তোর মায়ের কসম দিয়ে বলছি, আমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করিস না ভুলেও। তার চরিত্রেও সমস্যা। সে তোকে বিয়ে করার আগে আমার শরিরের স্পর্শকাতর জায়গাগুলোতে বাজেভাবে হাত দিতো সুযোগ পেলেই। সত্যি বলতে একদিন জোর করে ধর্ষণ ও করছে আমারে। তোর ভাইও এটা জানেনা। আমাকে সে হুমকি দিয়ে দিছে। তাই ডরে বলিনাই। চুপ মাইরা ছিলাম। আজ সে তোর জীবনে নাই।তাই বলতে বাধ্য হইছি। তুই আরেকজন কে বিয়ে নিস বইন। ”

ভাবির কাছে ওকথা শুনেই আমার বমি আসার অবস্থা হলো ঘৃণায়। ধিক্কার! এমন জঘন্য ও হীন চরিত্রের মানুষের জন্য। ভাবি তার ও শিরিনের প্রেম নিয়ে কিছু বলতে গেলেই থামিয়ে দিলাম।

” ভাবি সে আমার জীবনে অভিশাপ। তার নোংরা নিষিদ্ধ সুখের গল্প শুনে আমার বিশুদ্ধ সময়টাকেও কলংকিত করার কোন রুচিবোধ নেই আমার। মাঝে মাঝে আপনাদের খবর নিবো।”

ওদের সবার কাছে বলে বিদায় নিয়ে চলে এলাম আমাদের বাড়ি।

বাড়ির কাচারি ঘরের সামনেই নেমে পড়লাম। নয়ন রাজনকে নিয়ে ঘরের দিকে চলে গেলো। আমি বোরকা খুলে নিলাম। পুকুর ঘাটে গিয়ে মাগরিবের নামাজ পড়ার জন্য অজু করে নিলাম। উঠে আসার সময় ঘাটে সেই পারুল ভাবির সাথে দেখা। উনি আমাকে দেখেই কেমন রহস্যভরা চোখে হাসলেন।

বলে উঠলাম,

” আমি মরা বাড়ি থেকে আসলাম। মন বেজায় খারাপ। আর তুমি হাসছো ভাবি? ভূতে ধরছে নাকি তোমাকে?”

” সেটা তোর বিষয়। আমি হাসছি একটা কঠিন সুখবরর আছে। তাই। ”

আমি কন্ঠে দারুণ অনীহা প্রকাশ করে বললাম,

” চাইলে বলতে পারো। শোনার তেমন ইচ্ছে নেই। গেলাম”

” কাকা তোর বিয়ে ঠিক করেছে। মশকরা নয় রত্নু।”

আমি একমুহূর্ত আর সেখানে দাঁড়ালাম না। ধুপধাপ পায়ে ঘরের ভিতরে ঢুকলাম। নামাজ পড়ে নিলাম। তসবিহ গুনছি মৃত শ্বশুরের জন্য। মনটা হাহাকার করছে উনার সান্নিধ্যে কাটানো মুহূর্তগুলোকে স্মরণ করে। আহা মানব জনম। ইহজগতে আমরা ক্ষণিকের অতিথি। তবুও আমাদের দম্ভ,অহমিকা ও স্বার্থপরতার অন্ত নেই।পারুল ভাবির কথা গায়ে মাখলাম না। এর মনে যখন যা আসে তাই বলে ফেলে। তামাসার বিষয়কেও পারুল ভাবি সিরিয়াস মুডে বলতে পারে।

রাবু আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। কিছু বলবে বলবে ভাব তার মুখমন্ডলে। বললাম,

” কিরে কিছু বলবি? কোন আকাম করছিস নাকি?”

রাবু ঈষৎ হেসে বলল,

” আপা তোর বিয়ে। আব্বা ঠিক করেছে। আম্মাও রাজী। আমিও রাজী।নয়ন কে আমরা হিসেবে ধরিনা। রাজন তো ল্যাদা। তুই কি আব্বা আম্মার পছন্দকে ইগনোর করতে পারবি?সো বিয়ের সানাই বাজবেই। রাবু এবার নাচবেই। আগেতো পিচ্চি ছিলাম।কুদাকুদি করতে পারিনাই। এবার খেলা হবে।”

আমি বোকা বোকা স্তব্ধ চাহনিতে কেবল ফ্যালফ্যালিয়ে চেয়ে রইলাম রাবুর দিকে।

চলবে.. ৬

উজানের ঢেউ পর্ব-০৬

0

#উজানের_ঢেউ ( ৬ )
কলমে✍️ #রেহানা_পুতুল
” নারীই নারীর প্রধান শত্রু। নারীই নারীর সর্বনাশী ও সর্বগ্রাসী!”

কথাটি মনে হতেই ঝট করে ফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলাম।

কতটা পাষাণ ও নারীলোভী হলে একজন পিতা সন্তানের শর্তও ত্যাগ করে দিতে পারে অবলীলায়। এটা কল্পনা করতেই আমার দুকান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো বিদ্যুৎ গতিতে। সারা শরীর জমে গেলো হিমশীতল বরফখন্ডের ন্যায়। আমি অবসাদগ্রস্ত তনুমন নিয়ে পা টেনে টেনে ঘরের পিছনের মাটির দাওয়ায় গিয়ে বসে পড়লাম।

মা,রাবু,বাবা ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন। তারা এতক্ষণ অপেক্ষায় ছিলেন ঘটনার সত্যতা জানার জন্য। আমি সবই জানালাম তাদের। বাবা চলে গেলেন আমার উপর বোবা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। বাবা মনে হয় আমাকে শান্তনা দেওয়ার কোন ভাষাই খুঁজে পেলেন না। রাবু আমার পিঠের উপরে সহমর্মিতার হাত রাখলো। মা দপ করে জ্বলে উঠলো লন্ঠনের ন্যায়। হায় হায় সুরে বললেন রাবুকে লক্ষ্য করে,

” রাবু দেখছিস কি অমানবিক! কি অ- মানুষের বাচ্চা অ- মানুষ ! দুনিয়ার বুকে আমি এই প্রথম দেখলাম, সন্তানের আশাও ছেড়ে দেয় কোন পিতা। তাও কোন বাধা কোন কারণ ছাড়াই। খাঁটি কথা হলো রাজনকে সে নিলে পালতে হবে তো শিরিনের। তাই রাজি হয়নি। কি স্বার্থপর! কি হারামির ঘরের হারামী!”

” আহ! আম্মা থামো তো! তুমি যে এসব বলতেছো সেই আশুর বাচ্চার আশু কানে শুনতেছে? আর শুনলেই বা তার কি যায় আসে।”

” এই কিসের থামাথামি? এই রত্না ওঠ। বোরকা পর। থানায় যাবো। চৌদ্দশিকের ভাত খাওয়াবো তারে আমি। ঘরে বউ রেখে লুকিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করার সাধ হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাইয়ে দিমু। ওহ! তার আগে তার মাকে ফোন দিয়ে কিছুকথা শুনাই। কেমন বেজন্মা পেটে ধরেছে? কেমন শিক্ষাদীক্ষা দিয়েছে? ”

আমি মাকে থামিয়ে বললাম,

” মা তাতে লাভটা কি হবে শুনি? মানুষ পরিবেশের কারণেও বখে যায়। তাতে পিতামাতার কোন দোষ থাকে না। এমন নজির তো আমাদের বাড়িতেই আছে। উনারা সবাই ভালো মনের মানুষ। খারাপ সেই মাত্র।

আর এই পৃথিবীতে জোর করে সব হয়। কিন্তু কারো মন পাওয়া যায়না। আমি তার ওই প্রাণহীন অস্তিত্বের কাছে আর যেতে চাইনা। বরং তার ওই চামড়ার শরিরের পাশে আমার ছায়াটুকুও যেনো আর না পড়ে কখনো, সেটাই প্রার্থনা করো।

সুতরাং বিপদে আমাদের মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। বুঝে শুনে পা ফেলতে হবে। উত্তেজিত হলে লসের পাল্লাটা আমাদেরই ভারী হবে মা।”

রাবু জ্ঞানগর্ভ ধাঁচে বলল,

” হ্যাঁ আম্মা। আপা ঠিকই বলছে। কই যেনো পড়ছিলাম,

‘ প্রীতির পাখি খুন হয় পুরুষের হাতেই।’ আজ সেটাই ফলে গেলো আমার বোনটার জীবনে।”

আমি রাবুর হাতের পিঠে আমার হাতখানি রাখলাম সম্মতি জানিয়ে। এবং মাকে বললাম,

” যেই দেহের ভিতরে কোনো হৃদয় নেই। সেই হৃদয়হীন দেহ নিয়ে হয়তো চলা যায়। কিন্তু বাঁচা যায়না।”

মা চলে গেলেন ভারি ভারি পা ফেলে। রাজন কান্না শুরু করলে রাবুও চলে গেলো তার কাছে।

প্লিজ🙏#রেহানা_পুতুল পেইজে👉 like ও Follow দিয়ে আমাকে বাঁচার আনন্দটুকু দিতে আলসেমি করবেন না। আজ যদি মরে যাই।তখন আফসোস করবেন এই মানুষটার আকুতির কথা মনে করে।🥲

অসহ্যকর অপমান,ব্যর্থতা, গ্লানি,উপেক্ষা, যাতনা,অবসাদ,ক্ষোভ, আমাকে পিষে ফেলছে অহর্নিশ। কেমন নারী আমি! নিজের পুরুষটাকে নিজের করে আটকে রাখতে পারলাম না। উড়ে এসে জুড়ে বসে গেলো তৃতীয়জন। দখল করে নিলো পূর্ণ অধিকারে সসম্মানে। চিন্তা করতেই গা গুলিয়ে আসলো আমার। তীব্র ঘৃণায় সারা শরীর রি রি করে উঠলো।

অনুভূতিগুলো অবশ হয়ে এলো। কিন্তু এমন হলে চলবে না। আমাকে রুখে দাঁড়াতে হবে। গর্জে উঠতে হবে। নাহ। তাকে পাওয়ার জন্য নয়। নিজেকে মজবুত করে তৈরি করার জন্য। আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য। স্বপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য। নিজেকে ভালোরাখার জন্য। আমার সন্তানকে একটা সুন্দর পৃথিবী উপহার দেওয়ার জন্য।

তার দুদিন পর বাবা,মা,রাবুসহ বসলাম। বাবার দিকে চেয়ে বললাম,

” বাবা ও আমাকে নিতে চাইলেও আর আমি ফিরে যাবনা তার জীবনে। এটা ফাইনাল।”

“কারো জীবনে উপেক্ষিত থেকে কোর্মা কাবাব খাওয়ার চেয়ে, মর্যাদার জীবনে থেকে শাক ভর্তা খাওয়া অনেক ভালো। ”

গর্বের সুরে বলল আমার বাবা।

” বাবা,তিনমাস হয়ে গেলেতো কাবিনের প্রাপ্য টাকা পাবই। সেই টাকার সাথে আমার ব্যাংকের একাউন্টের টাকাগুলোও তুলে ফেলব। পাশাপাশি আমার কিছু গয়না তো আছেই। লাগলে সেগুলোও বেচে দিবো।”

” কি করতে চাস আগে শুনি?”

“সার্টিফিকেট তুলে কোন চাকরিতে জয়েন হতে পারি। কিন্তু তা করলে রাজনের সমস্যা হয়ে যাবে কিছুটা। মা কয়দিক সামলাবে। তাই ভাবছি একটা ছোটখাট ব্যবসা শুরু করবো। আমাদের পরিবারেরও সাপোর্ট হবে কিছুটা। যেহেতু আমি পরিবারের বড় মেয়ে। তাই দায়িত্ব কিছু আমাদের উপরেও বর্তায়।”

” কি ব্যবসা করবি তুই গ্রামে থেকে?”

” কেনো বাবা? আমাদের চৌরাস্তায় অনেক মেয়েরা,নারীরা বিজনেস করছেনা? ”

” তা অবশ্য করছে। তুই পারবি মা?”

” বাবা তোমাদের দোয়া থাকলে বিশ্ব জয় করতে পারবো। সেখানে কয়েকজনেই তো বিউটি পার্লার, কাপড়ের দোকান,ঔষধের দোকান,ট্রেইলার্স, ফাস্টফুড়ের দোকান করছে। আমার স্কুল লাইফের বান্ধবী আঞ্জুমানতো ফাস্টফুডের দোকান করছে। এবং ভালোই চলছে। ওতো মাত্র ইন্টারমিডিয়েট পাশ। মা,রাবু তো ওকে চিনেই। তাহলে অনার্স পাশ করে আমি কেনো পারবনা। এবার মাস্টার্সও কমপ্লিট করে ফেলব। ”

” হুম আমরা চিনি।” সমস্বরে বলল মা ও রাবু।

” বাবা জব করলে অন্যের কমান্ডে চলতে হবে রুটিন মাফিক। আর বিজনেস করলে আমার ফ্রিডম থাকমে নিজের হাতে। রাজনকে নিয়েও অসুবিধা হবেনা। তাকেও কেয়ার করতে পারবো। আরেকটা বড়দিক হলো কলেজ পাশ করে ফেললে রাবুও সময় দিতে পারবে আমার সাথে। অনার্সে তেমন চাপ নেই পড়াশোনার সাবজেক্ট বুঝে।”

আমার কথা শুনে রাবু খুশিতে টগবগিয়ে উঠলো। বলল,

” ইয়েহ। আমি রাজী। বাইরে কাজ করতে আমার হেব্বি লাগে। ঘরের কাজ করতে বিরক্ত লাগে।”

মা পাশ থেকে ধমকে উঠে,

” এহহ! ঘরের কাজ করে কত উল্টায়া ফেলছে উনি। খাওয়ার পরে এক থালা সরাতেই উনার দশ মিনিট লাগে। এক কুইড়া পয়দা করছি আমি।”

বাবা কিছুক্ষন থম মেরে রইলেন গাম্ভীর্যপূর্ণ মুখাবয়ব নিয়ে। অতঃপর বললেন,

” আচ্ছা ঠিকাছে। মন যেভাবে যেটাতে সায় দেয় সেটাই কর। নয়তো সাইন করতে পারবিনা। আমাদের চৌরাস্তা হলো শহরমুখী। এখানে বর্তমান বাজারে বড় অংংকের টাকা লাগবে। একাউন্ট থাক। গয়নায়ও হাত দিসনা। আমি দেখি কত ম্যানেজ করতে পারি।”

” তোর বাবা ঠিক বলছে। ওসব থাক।”

” মা তাহলে মাসে মাসে যে টাকা জমা দিতে হয় একাউন্টে। তা এখন কই পাবো? আগে তো সেই দিতো।”

” তোর বাবা দিবে এখন। ”

” আমি আবেগাপ্লুত হয়ে বাবা বলে বাবার হাত ধরলাম। বাবা আমার মাথাকে আলতো করে বুকের একপাশে চেপে ধরলেন।মাথায় হাত বুলিয়ে ভরসা দিলেন।”

আমার ভিতরটা বেশ হালকা লাগছে। এতদিন মনে হতো বহুকাল ধরে আমার কোনো আজন্ম শত্রু বৃহৎ আকারের এক প্রস্তরখন্ড আমার বুকের জমিনে ফেলে রেখেছে। আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো বুঝি। আজ বাবা ও আমার মা বোন মিলে তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে সেই বিশাল প্রস্তরখন্ড সরিয়ে দিলো।

তার পরেরদিন সকালে আমরা নাস্তা খেয়ে উঠলাম। মা রান্নার জোগাড় করছে। নয়ন স্কুলে চলে গিয়েছে। রাজন খেলছে মাটিতে বসে। বাবা বড় বাজারে গিয়েছে। আমার মোবাইল বেজে চলছে। উঠে গিয়ে রিসিভ করলাম অবাক চোখে। আমার একমাত্র বড় জা লায়লা ভাবির
ফোনকল। ফিচলে হেসে মনে মনে বললাম,

এতটা দিন খবর নেয়নি। এখন কোন দুঃখে সে আমাকে ফোন দিলো।
রিসিভ করলাম। হ্যালো ভাবি বলে সালাম দিতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো জোরালো কান্নার আওয়াজ।

” রত্না একবার আয়। বাবা মরে যাচ্ছে। তোর ও রাজনের কথা বলছে। আম্মা তোকে ফোন দিতে বলল। আল্লাহর দোহাই লাগে সব ভুলে একজন মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের শেষ ইচ্ছা পূরণ কর আইসা। বোন দ্রুত আয়।”

একদমে বললেন লায়লা ভাবি।

আমি নমনীয় স্বরে বললাম,

” ভাবি সে আমাকে উকিল নোটিশ দিয়েছে। তার সামনে আসা কি ঠিক হবে?”

কান্নারত কন্ঠে বলল ভাবি,

” ওরে আল্লাহ! এতকথা ক্যামনে বলি। সে নাই। ওই শিরিন ও নাইরে বোন। এই ভিতরে কতকিছু ঘটে গেলো। আল্লাহ! সব বলব তোকে। জলদি আয়। ”

” ভাবি যত দ্রুত সম্ভব বাবাকে শেষ দেখার জন্য আমি আসছি রাজনকে নিয়ে। ”

চলবে..

উজানের ঢেউ পর্ব-০৫

0

#উজানের_ঢেউ ( ৫)
কলমে✍️ #রেহানা_পুতুল
“আম্মা আসসালামু আলাইকুম।”
তিনি সালামের উত্তর দিয়েই অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

” শিরিন কি তোমাদের বাড়িতে? বুলি জিগাইতে কইলো। কলেজ থেইকা নাকি বাড়িতে যায়নাই এখনো। আর কোনদিন নাকি এমন লেট হইনাই। টাইমমতেই নাকি বাড়িত চইলা যায় আমার বোনঝি টা।”

তিনি এটা জিজ্ঞেস করার উপযুক্ত কারণ রয়েছে। কেননা এই শিরিন কে কয়েকবার আমাদের বাড়িতে এনেছি। আতিথেয়তার কোনো ঘাটতি ছিলো না। সেও আমাদের বাড়িতে বেড়ানো কে দারুণ উপভোগ করতো।

” আপনার ছেলেকে বলেন না তার কলেজে গিয়ে খোঁজ নিতে। নাকি কোনো বান্ধবীর বাড়িতে গেলো শিরিন আপা ?”

” আশু তো বাড়িত নাই। তারলগে তোমাগো বিষয় নিয়া যে কথা কমু,সেই সুযোগও পাইতেছি না। এখন তার মোবাইল তো বন্ধ পাইতাছি। আর শিরিনের হাতে তো মোবাইল নাই। বাড়িতে অন্যদের মোবাইল ব্যবহার করে সে। কি দুঃশ্চিন্তার বিষয় কওতো। আমার বোন হজম হইয়া যাইতেছে আজাদের ডরে।”

আম্মা হায় হুতাশ করতে করতে মোবাইল রাখলেন।

” কে রে রত্না?”

রাজনের দাদী ফোন দিলো বলে, বিষয়টা জানালাম মাকে। মা গুরুত্বহীনভাবে
‘ওহ’ শব্দটি উচ্চারণ করলেন। এবং অন্যদিকে গিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হলেন।নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎ জীবন যেখানে অনিশ্চয়তায় মুখোমুখি। সেখানে অন্যের মেয়েকে নিয়ে নাক গলানোর মতো আগ্রহটুকু মায়ের মাঝে অবশিষ্ট নেই।

এদিকে আমি বুঝে নিলাম যেহেতু আজাদ ভাই বাড়িতে। তাই শিরিন আপা মনে হয় তার রাজকুমারের সাথে পালিয়েছে। কারণ তিনি কুয়েত থাকতেই শুনেছি এবার বাড়ি আসলেই শিরিন আপার বিয়ে দিয়ে দিবেন।

পিতৃহীন সংসারে আজাদ ভাই শিরিনের অন্যতম অভিভাবক। তাদের পরিবারে উনি বড় ছেলে ও একমাত্র মোটা অংকের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা অপেক্ষাকৃত আশরাফুলদের চেয়ে অনেক ভালো। এবং পারিবারিক স্ট্যাটাসও যথেষ্ট উঁচু। নামকরা বাড়ি। কাজিনগর গ্রামের বিখ্যাত কাজি বাড়ি। এবং তাদের আলোচিত বড় দিঘিটার নামও কাজী দিঘি। বর্ষাকালে এই দিঘিতে মাছ ধরা ও,নৌকা বাইচ নিয়ে হয় নানান উৎসবমুখর আয়োজন। দূর দূরান্ত থেকে মৎস প্রিয় সৌখিন লোকজন বড়শী বাইতে আসে পালা করে। আমিও বেড়াতে গিয়ে একবার শিরিন আপাসহ সাঁতরে মাঝদিঘি অবধি চলে গিয়েছি। আমাদের অনুরোধে ঘাটের পাকা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তা ফ্রেমবন্দী করেছে আজাদ ভাইরে স্ত্রী মালাভাবি।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। ঝুপ করে আঁধার নেমে আসছে ধরনীর কোলজুড়ে। সূর্য ডুবু ডুবু। রক্তিম আকাশ। নানা উজ্জ্বল রঙের ছড়াছড়ি আকাশের বুক জুড়ে। দেখে মনে হচ্ছে কোন নিঁখুত কারিগর বহুকাল ধরে তার নিপূন হাতে চিত্রিত করেছে এই অভূতপূর্ব মোহনীয় দৃশ্য। আমি অপার মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছি গগনপানে। সত্যিই স্রস্টার সৃষ্টিগুলোর সৌন্দর্যর কাছে মানুষের সকল সৃষ্টি অতি ক্ষুদ্রকায়। অতি সামান্যই।

” মন বেশি খারাপ নাকি রত্না?”

চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলাম চেনাকন্ঠটি কর্ণগোচর হতেই।

” ঢাকা যাননি এখনো মাহমুদ ভাই?”

” নাহ। কাজ ছিলো বাড়িতে। কাল সকালে যাবো। তোর সাথে একটু কথা ছিলো রত্না”

” মাহমুদ ভাই জানেন তো আমার মনের অবস্থা শোচনীয়। বেশী ইম্পর্ট্যান্ট কথা না হলে আপাতত শুনতে চাচ্ছি না। আমি তো আছি। আপনি আবার বাড়ি এলে শুনব।”

” আচ্ছা মানলাম তোর কথা। তাহলে তোর সেল নাম্বার টা দে। ঢাকা গিয়ে অবসর হয়েই বলব।”

” বুঝলাম না। কি এমন কথা। নাম্বার নিয়ে গিয়ে বলতে হবে?”

নিরানন্দ মুখে অবশ কন্ঠে বললাম আমি।

” দিবি কিনা সেটা বল? ”

নাম্বার দিয়ে পার করলাম মাহমুদ ভাইকে। কথা পেঁচিয়ে উনাকে আটকে রাখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে বা অভিলাষ নেই আমার। মাহমুদ ভাই কিছুদূর গিয়ে পা থামিয়ে দিলেন। আমি নিরস ভঙ্গিতে চেয়ে রইলাম মাহমুদ ভাইয়ের দিকে। জিজ্ঞেস করলাম,

” কি হয়েছে মাহমুদ ভাই। পায়ে কাঁটা বিঁধলো নাকি?”

” হুম। আসবি বিষ কাঁটাটা ছাড়িয়ে দিতে?”

আকুতি ভরা কন্ঠে বললেন মাহমুদ ভাই।
আমি পা চালিয়ে গেলাম উনার কাছে। রক্তের চাচাতো ভাই। হৃদয়ের টান তো আছেই। কই দেখি বলে উনার পায়ের দিকে ঝুঁকে গেলাম। উনি আমার দুবাহু ধরে দাঁড় করিয়ে নিলেন। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

” থাক। তোর কষ্ট করতে হবে না। অন্ধকার হয়ে গিয়েছে চারপাশ। ঘরে চলে যা। নিজের দিকে খেয়াল রাখিস।”

নাক সিঁটকে বললাম,

” বুঝলাম না। আপনিই তো ডাকলেন। আবার চলে যেতে বলছেন। ভুয়া নাকি? ”

উনি সারামুখে দুর্বোধ্য হাসির প্রলেপ মেখে বললেন,

” আমার কোন জিনিসটা তোর কাছে রিয়েল মনে হয়েছে এই পর্যন্ত? বলতে পারবি রত্না? সঠিক মানুষকে বুঝতে শিখ। ”

মাহমুদ ভাই নিরবে প্রস্থান নিলেন আমার নয়নসম্মুখ হতে। আমি চলে এলাম ঘরে ভাবলেশহীনভাবে।

নয়ন ও রাবু পড়ায় মনোনিবেশ করলো। মা খাঁচা থেকে সদ্য জন্ম নেওয়া মুরগীর ফুটফুটে বাচ্চাগুলোকে দেখছে ঠিকঠাক আছে কিনা। মায়ের পাশে বসে রাজন মুরগীর বাচ্চাগুলোকে খেলনা ভেবে ধরার চেষ্টা করছে কৌতুহলী চোখে। বাবা দোকানে।

আমি ঘটে যাওয়া নিজের অপ্রত্যাশিত ঘটনা নিয়ে শত প্রশ্নের মুখোমুখি। কি হলো? কেনই বা হলো? নিজের সন্তানের কথা একটিবারও ভাবলো না সে। পিতা এমন জঘন্য হয়? এমন ও কি ঘটে কারো জীবনে? জীবন তো দেখি আসলেই নাটকের চেয়েও নাটকীয়।

এমন অজস্র জিজ্ঞাসারা ঝাঁকে ঝাঁকে আমার উপরে হামলে পড়েছে। আমি নিষ্পেষিত, কাবু হয়ে যাচ্ছি। ভাবনার দরিয়ায় নিমজ্জিত হয়েও কোন থই খুঁজে পেলাম না। উপুড় হয়ে শুয়ে আছি। রূপ চর্চা, ত্বকের যত্ন নিতেও ভুলে গিয়েছি আজকাল। আয়নায় নজর পড়তেই দেখি আমার ফুলো ফুলো গাল দুটো চুপসে গিয়েছে রোদে পড়া পুইঁয়ের লতার ন্যায়। অথচ কয়দিন আগেও আমাকে দেখে বাড়ির বোন ভাবিরা মজাচ্ছলে বলাবলি করছিলো।

” কিরে রত্না। রাবু আর তুই দেখি একবয়েসী হয়ে গেলি। লাউয়ের কচি ডগার মতন কেমন তরতরিয়ে তোর সৌন্দর্য বেড়েই চলছে। কি খাস আর কি মাখস ওই অঙ্গে? ওই গালে?”

একদিন মা শুনেছিলি অমন কিছু। মা তড়িতেই তেতে উঠল। গরম কন্ঠে বলল,

” আমার মেয়ের রূপ নিয়ে তোদের এত জ্বলে কেনো শুনি? পানি পড়া দিয়ে যাবি ওর জন্য। নইলে তোদের মুখে ফোসকা পড়বো। এই বলে দিলাম। ”

আমিই তখন মাকে মৃদু ধমক দিয়ে থামালাম।
রাত আনুমানিক দশটা হবে। রাজনকে হরলেক্স আর ডাল খিচুড়ি খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি। আমাদের ঘরের চাপানো দরজা ঠেলে পাশের ঘরের এক জেঠিমা এলো। পিছনের রুমে ঢুকলো। আমিও গেলাম তার পিছন দিয়ে কিছু শুনার উদ্দেশ্যেই। উনার মেয়ে আসমা ও শিরিন একই কলেজে ডিগ্রীতে পড়ে। লক্ষ্য করলাম, উনি ফিসফিসিয়ে মাকে কি যেনো বলছে, আমাকে দেখেই মুখ বন্ধ করে ফেললেন।

” আরেহ ভাবি বলেন তো। ওর কথা ওকি না শুনে থাকবে? ”

প্রবল উৎকন্ঠার স্বরে বলল আমার মা।

উনি দাঁড়িয়ে গেলো। আমার হাত ধরে বলল,

” ওহ রত্নু। কি শুনলাম এইটা। তোর খালাতো ননদ শিরিন নাকি তোর জামাইয়ের লগে ভাগছে। এখন নাকি ঢাকায় আছে। নারায়ণগঞ্জে তোর ননদ রাহিমার বাসায়। ওই বাসায় নাকি কাজি আইনা বিয়া করছে দুজনে। ”

আমি অবিশ্বাসের ঢংয়ে বললাম,

” ভুল শুনছেন জেঠি। ওর অন্য ছেলের সাথে রিলেশন। আমি জানি। তারসাথেই ভেগে গেলো হয়তো। ”

” আমি আসমারে পাঠাইতাছি। শুইনা নে। আহারে মা। তোর কপাল পুড়ল বুঝি। ওই মাইয়া জাইনা শুইনা ক্যামনে বিয়াতো ভাইয়ের ঘরে ঢুকলো। ”

জেঠিমা আফসোসের ঝড় তুলতে তুলতে ঘরে চলে গেলেন। পাঁচ মিনিটের ব্যবধানেই আসমা এলো আমাদের ঘরে। রাবুও উঠে এলো। আসমা যা বলল রাজনের বাবা ও শিরিন সম্পর্কে। তাতে বিশ্বাস না করার সব পথই রুদ্ধ হয়ে গেলো। আসমা এও বলল,দোষ বেশী রাজনের বাবার। শিরিনের বয়স কম। খালাতো ভাইয়ের আবেগের বশে মজে গিয়েছে। আসমা চলে গেলো তাদের ঘরে।

আমাদের ঘরের পরিবেশ মরা বাড়ির মতো হয়ে গেলো। মনে হলো একসাথে কয়েকটা লাশ পড়ছে। রাবু কান্না করছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। নয়ন নিরীহভাবে বসে আছে বই বন্ধ করে। মা বিলাপের সুরে কাঁদছে। আমিও নিজের আবেগকে দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলাম। ভিতর থেকে ঠেলেঠুলে অশ্রুরা দল বেঁঁধে নেমে পড়লো আমার দুচোখের পাড়ে। অঝোরে কাঁদলাম গভীর রাত অবধি। বিছানার এপাশ ওপাশ করেও ঘুম এলনা দু’চোখ জুড়ে।

যন্ত্রণার বিষাক্ত কারাগারে আমি এক নিরপরাধ আসামি। আমার মুক্তি মিলবে কিভাবে? কার হাতে? এ আমার অজানা। থরে থরে নীল বিষাদ এখন আমার প্রতি প্রহরের সঙ্গী।

নির্ঘুম রজনী শেষে ঊষালগ্নেই বিছানা ছাড়লাম। মায়ের রুমে উঁকি দিলাম। মা নামাজ শেষে মিহি সুরে কোরান তেলওয়াত করছেন। ভিতরটা হুহু করে উঠলো আচমকাই। বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম,শরীরের আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘোর আলস্য ভঙ্গিতে।

সামনে ক্লান্ত দৃষ্টি যেতেই দেখি,
আমাদের মাঝারি আকারের নারকেল গাছের শাখার মাঝ বরাবর চুপটি করে বসে আছে একটি হুতোম পেঁচা। বেজার মুখ করে আমার চোখ বরাবর ঠায় চেয়ে আছে পেঁচা পাখিটি। তবে আজকের মতো ওকে আর কোনদিন এতটা একেলা এতটা নিঃসঙ্গ লাগেনি আমার কাছে। একে আমি ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি মাঝে মাঝে। ঠিক এই সময়টুকুতেই। প্রভাতকাল ফুরিয়ে গেলেই সে উড়াল দিতো অন্যপ্রান্তে। আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে ওর ভিতরটা জানবার। পড়বার। ওর ওকি হৃদয়টা দুঃখে কাতর! কষ্টে লণ্ডভণ্ড! ঠিক আমারই মতো।

খেয়াল হলো চারপাশ আলোয় ভরে যাচ্ছে। কলপাড় থেকে অজু করে এসে নামাজ পড়লাম। জায়নামাযের উপর কাত হয়ে আবারও ঢুকরে কেঁদে উঠলাম। বুকের ভিতরে যেনো দুঃখের দরিয়া। শুধুই অথই জল আর জল। জীবনের উপরে যেই উজানের ঢেউ হামলে পড়লো অকল্পনীয়ভাবে। আমি কি পারবো,রাজন কে নিয়ে জীবন স্রোতের বিপরীত দিক হতে আসা এই উজানের ঢেউয়ের বিরুদ্ধে সাঁতরে কূলে এসে বাঁচতে?

আমার গুমরানো কান্নার আওয়াজ পেয়ে মা দরজায় এসে দাঁড়ালো। গমগমে স্বরে বললেন,

কান্নাকাটি থামা। গুটিয়ে বসে না থেকে রাজনের বাপরে একটা ফোন দে। বিষয় টা সিউর হওয়া জরুরী।

মা চলে গেলো। মায়ের কথাকে গুরুত্ব দিয়ে উঠে গেলাম। রুমে গিয়ে চেয়ারে বসলাম হেলান দিয়ে। আমার পঁচিশ বয়সের দেহখানি ন্যূজ হয়ে আছে নব্বই বছরের অশীতিপর বৃদ্ধার ন্যায়। হেলান না দিয়ে বসা দুষ্কর।

#রেহানা_পুতুল পেইজে, 👉like ও follow দিবেন গল্পের নোটিফিকেশান পেতে।

চরম অনীহা নিয়ে তাকে ফোন দিলাম। প্রথমবার রিসিভ না হলেও দ্বিতীয়বার রিসিভ হলো। যেহেতু চেনা নাম্বার। আর এতক্ষণে সব জেনে গিয়েছি। সেটাও বুঝতে তার অসুবিধা হলো না। তাই রিসিভ করে কিঞ্চিৎ নোয়ানো স্বরে আমাকে বলল,

” আমি খুউব সর‍্যি রত্না। ক্ষমা করে দিও। যা শুনেছো ঠিক শুনেছো।”

” যে পুরুষ ঘরে যুবতী স্ত্রী ও নিষ্পাপ শিশুকে রেখে পরকিয়ায় লিপ্ত হয়। তার মুখে সর‍্যি ও আমার নাম ধরা মানায় না। হাস্যকর লাগে।”

” আমি কোন পরকিয়ায় লিপ্ত হইনি। শিরিন কে ভালোবাসি তার ছোটবেলা থেকেই। মাঝখানে নিরুপায় হয়ে তোমাকে বিয়ে করতে হয়েছে। এর জন্য দায়ী কিছুটা আম্মা আব্বাও। এটার কাহিনী পরে বলব তোমাকে শুনতে চাইলে।”

” শোনার কোন রুচিবোধ আমার নেই। আমার যা হওয়ার তাতো হয়েছেই। এখন শুধু বলেন রাজন কোথায় থাকবে? কিভাবে থাকবে?”

সেই ঝরঝরে কন্ঠে স্বাভাবিক সুরেই বলল,

” আমি তোমার ছেলেকে কেড়ে নিব না। পিতার দাবি নিয়ে তার সামনে কোনদিন দাঁড়াবনা। এটা তিনমাস হয়ে গেলে ডিভোর্স কার্যকরের দিন লিখিতভাবেই সাইন করে দিবো। এবং কাবিনের পুরো টাকাও কড়ায় গণ্ডায় তোমাকে বুঝে দিবো। মাসে মাসে রাজনের খরচ ও দিবো। আশাকরি কোন ঝামেলা করবেনা। ”

“নারীই নারীর প্রধান শত্রু। নারীই নারীর সর্বনাশী ও সর্বগ্রাসী!” কথাটি মনে হতেই ঝট করে ফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলাম।

চলবে..

উজানের ঢেউ পর্ব-০৪

0

#উজানের_ঢেউ ( ৪)
কলমে ✍️ #রেহানা_পুতুল
” আপা! এটা ডিভোর্স লেটার। উকিল নোটিশ পাঠিয়েছে তোর পেয়ারের স্বামী আশরাফুল!”

আল্লাহ গো! কি বলিস তুই বলে, মা বিষ্ফোরিত চোখে রাবুর দিকে চাইলো। কাঠের চেয়ারের হাতল ধরে দপ করে বসে পড়লো। মায়ের চোখ দুটো পারে তো অক্ষিকোটর হতে বেরিয়ে পড়ার উপক্রম। আমার মায়ের চোখেমুখে পাগল পাগল দশা৷

বাবা নির্বাক হয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন। ছোট ভাই নয়ন বেকুবের ন্যায় এদিক ওদিকে তাকাতে লাগলো।
আমার গোটা পৃথিবী দুলে উঠলো ভূমিকম্পের ন্যায়। আকস্মিক চোখের সামনে অমানিশার আঁধার দেখছি। যেনো কোথাও কোনো আলো নেই।

মনে হলো কোনো ঐশ্বরিক শক্তিবলে আড়ালে থেকে কেউ একজন গোটা পৃথিবীর সমস্ত আলো নিভিয়ে দিয়েছে এক লহমায়। এক নিকষ কালো গুহার গভীরে যেতে যেতে আমি উপস্থিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ি। রাগান্বিত স্বরে রাবুকে বলি,

” এটা অবিশ্বাস্য! এটা মিথ্যা! তুই আবার পড় বলছি। মন দিয়ে ভালো করে পড়। ”

রাবু আমার দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইলো। তার দু’চোখ বোবা অশ্রুজলে টইটুম্বুর হয়ে গেলো। আমার দিকে খামটি এগিয়ে দিয়ে,

” তুই পড় আপা।”

রাবুর হাত বদল হয়ে আমার কাঁপা কাঁপা হাতে চলে এলো খামটি। আমি থরথর করে কাঁপছি আর ভাবছি। এ যেনো হয় মিথ্যে কিছু। এ যেনো হয় আমাদের সবার ভ্রম। রাবু আমার পাশ ঘেঁষে বসে রইলো। আমি পূর্ণ মনোযোগ সহকারে বার দুয়েক পড়লাম। শিশুর প্রথম বর্ণ চেনার মতো করে প্রতিটি অক্ষর, শব্দ ধরে ধরে পড়লাম।

বুঝলাম। বিশ্বাস করলাম। এ কোনো দুঃস্বপ্ন নয়। নয় কোনো মরিচীকা। নয় কোনো মিছে ছলনা। নয় কোন এপ্রিল ফুলের ধোঁকাবাজি।

এ দিনের আলোর মতো সত্যি। চাঁদ তারার মতো সত্যি। কিন্তু এই সত্যির ভার এত বেশি যে , আমি বহন করতে পারছিনা। আমি পরাভূত। আমার মানসিক ও শারিরীক শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে ক্রমশই। অসাড় হয়ে আসছে মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ। আমি রাবুর গলা পেঁচিয়ে ধরি। গুমরে কেঁদে উঠি। আমার শরিরের সমস্ত ভার রাবুর উপরে ছেড়ে দিই। রাবু চিৎকার করে উঠে,

” এই আপা। এইই। আম্মা আপা অজ্ঞান হলো নাকি?”

তারপর আর কিছুই আমার মনে নেই। জ্ঞান ফিরে এলে দেখি তখন সকাল। জানালা গলিয়ে সূর্যিমামার উঁকিঝুঁকি। পিটপিট চোখে এদিক সেদিক তাকালাম। রাজন আমার গায়ের উপর মাখামাখি করছে। রাজনকে বুকে চেপে ধরলাম বাবা বলে। বাবা,রাবু,মা আমার রুমে এলো। বিয়ের আগে আমাদের দুই বোনের জন্য এই রুমটাই বরাদ্দ ছিলো। বিয়ের পর এলেও এই রুমেই থাকি রাবু সহ। তবে ওই হারামিটা সহ যে দু চারবার আসা হয়েছে,তখন রাবু দাদীর রুমে ঘুমাতো।

রাবু আমাকে বলল,

” আপা গত সন্ধ্যায় তুই সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলি। তার দুই ঘন্টা পরে আমরা ঘরোয়া টোটকা প্রয়োগ করে তোর জ্ঞান ফেরাই। তখন আবার ঘুমিয়ে গিয়েছিলি তুই। রাজনকে তার খাবার খাইয়েছি রাতে৷তোকে কিছু খাওয়ানো যায়নি তবে। ”

বাবা বিছানার কাছে এসে আমার শিয়রের পাশে দাঁড়ালেন। আমার মাথায় পিতৃস্নেহের পরশ বুলালেন। দৃঢ় কন্ঠে বললেন,

” পৃথিবীতে কোনো সমস্যাই চিরস্থায়ী নয়।সেটা যতবড় সমস্যাই হোক না কেনো। মনে রাখবি, সকল সমস্যা সমাধানের পথ স্রস্টা আমাদের জন্য রেখেছেন। সুতরাং ঘাবড়ে যাসনা। মচকে যাসনা। এই অনাকাঙ্ক্ষিত দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণাই একদিন তোর শক্তি হয়ে তোকে আআত্মবিশ্বাসী করে তুলবে৷”

বাবার যুক্তিবাদী কথাগুলো এত ভালো লাগলো মনের মধ্যে। এত প্রেরণা পেলাম। বলে বোঝাতে পারবো না। বাবা আদেশ করে আরো বললেন,

” উঠে যা। কাজা হলেও নামাজটা পড়ে নে অযু করে। আল্লাহর কাছে শান্তি প্রার্থনা কর। নাস্তা খেয়ে নে। আমি দোকানে গেলাম।”

বাবা চলে গেলেন,মা এতসময় নিরব ছিলেন। মায়ের এই একটা বিশেষ দিক বা গুণ বলাই শ্রেয়,

বাবা কাউকে কিছু বলার সময় মা বাবার গুণমুগ্ধ শ্রোতা হয়ে যান। বাবাও মায়ের এই বিষয়টা মূল্যায়ন করেন।

মা এবার হই হই করে উঠলেন। আমার উপরে নয়। তাদের পুরো পরিবারের উপরে। মা মনের সাধ মিটিয়ে তাদের উপর অনুযোগ ও ক্ষোভ বর্ষণ করতে লাগলেন বিরতিহীনভাবে। থেমে আমাকে বললেন ,

” তুই হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা খেয়ে নে। তারপর জামাইরে একটা ফোন দে। কাহিনীটা কি আমাদের জানা দরকার। মগের মুল্লুক পেয়েছে নাকি। আইন আদালত বলে কিছু নাই দুনিয়াতে?”

” মা থামো। আমি ফ্রেস হয়েই ফোন দিচ্ছি। মোবাইলে চার্জ নেই। নয়ন মনে হয় গেম খেলেছে। ”

মা হনহনিয়ে চলে গেলেন রুম থেকে। রাবুও রাজনকে আদর করে চলে গেলো। কলেজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে তার। আমি রাজনকে কোলে নিয়ে ঘরের বাইরে গেলাম। তাকে পাশে দাঁড় করিয়ে নলকূপ থেকে হাতমুখ ধুয়ে নিলাম। রাজন সারাক্ষণ আমাকে নয়নে হারায়। হারাবেই বা না কেনো। চোখের সামনে পেয়েছেই শুধু মাকে। বাবাকে পেয়েছে অতিথির মতন।

সামান্য নাস্তা খেয়ে নিলাম অনিচ্ছা সত্ত্বেও। ঘরের পরিবেশ বাড়াবাড়ি রকমের থমথমে। দিনের মুখরিত কলরবেও আমাদের ঘরে বিরাজ করছে প্রগাঢ় নৈঃশব্দ্যতা। কারো মুখের দিকে তাকানো যায়না। নয়ন আলোভোলার মতো এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি করছে। রাবুর মুখ বিষন্নতায় ছেয়ে আছে। যেনো গুমোট হয়ে থাকা মেঘলা আকাশ। কালক্ষেপণ না করেই বজ্রপাত হবে।

তবে তার চেয়েও তেতে আছে বেশি মায়ের মেজাজ। যেনো কড়া রৌদ্রতাপে শুষ্ক খড়ের স্তুপ। আগুনের সংস্পর্শ পেলেই জ্বলে উঠবে দাউদাউ করে।

আর আমার জীবন কোন অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিক্রম হচ্ছে, তা কেবল এই আমিই জানি। দরজা বন্ধ করে বিছানার এককোণে গিয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে বসলাম। তার নাম্বারে ডায়াল করতে গিয়েই থমকে গেলাম। ক্ষণকাল ভাবলাম। মন সায় দিলোনা তাকে ফোন দিতে। তার কন্ঠ শুনতে।

” যে যাবার সে কোন কারণ ছাড়াই চলে যাবে। আর যে থাকার সে অকারণেই থেকে যাবে।”

প্রথম বাক্যটি তার জন্য। দ্বিতীয় বাক্যটি মাহমুদ ভাইয়ের জন্য। সুতরাং তাকে পিছু ডেকে অযথা যুক্তিখণ্ডন করা বোকামির সামিল।

শাশুড়ীকে ফোন দিলাম। রিসিভ হলো। সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করলাম। শয্যাশায়ী স্বশুরসহ বাকি সবার খোঁজখবর নিলাম। উনার কন্ঠস্বরের স্বতঃস্ফূর্ততা দেখে মনে হলো সবই উনার অজানা।

” আম্মা আমার কিছু জরুরী কথা আছে আপনার সাথে।”

উনি উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইলেন। আমি আশরাফুল সম্পর্কে জা জানি যতটুকু নিজে দেখেছি, সবই জানালাম শান্ত কন্ঠে। এবং উকিল নোটিশের বিষয়টাও বললাম। ফোনের ওপাশের নিরবতা দেখে আম্মা বলে ডাক দিলাম। যদিও বুঝতে পারলাম উনি স্বাভাবিক নেই। উনি হঠাৎ ধ্যানভঙ্গ ঋষির মতো চমকানো স্বরে হু বলে সাড়া দিলেন মরাকন্ঠে।

অপরাধীর ভঙ্গিতে করুণ কন্ঠে আমাকে বললেন,

” মারে! কিসব হুনাইলা। আমার মাথার উপ্রে যেনো সাত আসমান ভাইঙ্গা পড়ছে। এর আগে খোদা আমারে তুইলা নিলনা ক্যান জমিন থেইকা। ওই খোদা সাক্ষী। তুমি বলার আগে কিছুই জানতাম না। পশুটা ছোডকাল হইতেই বেয়াড়া স্বভাবের। কয়বছর ধইরা তো বিদেশেই থাকে। তার বাপের সকাল বিকাল দম যায়। হিসাবে ধরেনা৷ বড় ভাই থাকে তার সংসার নিয়া। ভাবিতো পরের মাইয়া। যা একটু মান্য করে আমারেই। আমার নাতির লাইগা দিল জ্বলে। তোমার আনার কথা কইলেই জবাব দিতো,

মা রত্না কিছুদিন তাদের বাড়িতে বেড়াক না। সারাবছর তো তোমাগো ঘরের কাজকর্মের জন্য যেতেও পারেনা বাবার বাড়ি। আমিও বুঝ নিলাম। আরো মনে করলাম,তোমাকে আমি ফোন দিয়া আনলে সে মনে করবো তার বউরে খাটাইতে আনছি।

এখন তো দেখি ঘটনা অন্যকিছু। কি চামার! কি জালিম! কি বর্বর! রূপ কইমা গ্যালে বউ খেদায়া দেয়। ছাইড়া দেয়। আমি বাপের জনমেও হুনিনাই। আসলেই শেষ জমানায় আইসা পড়ছি। তুমি একটু সবর করো বউ। আমি তার লগে কথা কই তোমারে জানামু। আশা করি অল্প সময়ের মধ্যেই তুমি একটা সদুত্তর পাইবা আমার থেইকা। ”

মোবাইল রাখলাম কথা বলা শেষ হলে। আম্মার কথায় অনুধাবন করতে পারলাম,সত্যিই সবই উনার অজানা।

রুমের হার্ডবোর্ড এর দেয়ালে ঝুলানো চিত্রকর্মটির দিকে দৃষ্টি পড়তেই বুক চিরে দীর্ঘস্বাস বেরিয়ে এলো বিশাল আক্ষেপ নিয়ে। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হওয়া এক যুবতী গৃহবধূ। বয়স অল্প। জীবনকে রাঙিয়ে তোলার বয়স। হাতে ধরা তার ছোট্ট খোকাবাবু। তার বেখেয়ালি মায়া মায়া চাহনিটা নিবদ্ধ রয়েছে নদীর স্রোতের উল্টো দিক থেকে আসা ঢেউয়ের পানে। অর্থাৎ বইয়ের ভাষায় উজানের ঢেউ বলে যাকে। সেই ছলাৎ ছলাৎ আছড়ে পড়া উজানের ঢেউয়ের কাল্পনিক শব্দ যেনো আমার হৃৎপিণ্ডটাকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে দানবীয় কায়দায়।

তার এক সপ্তাহ পরে আমার মোবাইল বেজে উঠলো উচ্চস্বরে। সময়টা ছিলো ঝিমিয়ে আসা অবসন্ন বিকেল। পাখিরা নীড়ে ফিরে যাচ্ছে সমস্ত দিনের লেনাদেনা চুকিয়ে। ব্যস্তসমেত হয়ে রিসিভ করলাম।

“আম্মা আসসালামু আলাইকুম।”

সালামের উত্তর দিয়ে অস্থির গলায় বললেন আম্মা,

” শিরিন কি তোমাদের বাড়িতে? বুলি জিগাইতে কইলো। কলেজ থেইকা নাকি বাড়িতে যায়নাই এখনো। আর কোনদিন নাকি এমন লেট হইনাই। টাইমমতেই নাকি বাড়িত চইলা যায় আমার বোনঝিটা।”

চলবে।

উজানের ঢেউ পর্ব-০৩

0

#উজানের_ঢেউ ( ৩)
#কলমে ✍️ #রেহানা_পুতুল
আম্মা ফোন নিয়ে তাদের কাছাকাছি গেলো। তখন আশরাফুল ও শিরিনের উচ্ছ্বল হাসি শোনা গেলো। আমি বিষম খেলাম। কই আমার সাথে তো এমন করে সে প্রানবন্ত হাসি দিয়ে কথা বলেনি কখনো। বিশেষ করে এবার বাড়ি আসার পর।

ঠিক ওই মুহূর্তে তাদের দুজনের হাসিকে আমার কাছে সীসার মতো ঠেকলো। নিমিষেই মনে হলো কোন চেনারূপী অচেনা পাষণ্ড আমার কর্ণকুহরে ফুটন্ত গরম সীসা ঢেলে দিচ্ছে।

” শিরিন নে। আশুর বউ তোর লগে কথা কইবো। ”

শিরিন ফোন ধরেই,

” কি ভাবি, আশু ভাই দেশে আসার পর আমারে ভুলেই গেলা? নিখোঁজ তুমি। ”

মধুর হেসে বলল শিরিন। আশরাফুলকে তার মা ও নিকটজনেরা আশু বলেই ডাকে।

গ্রামে প্রচলিত কথা ,স্বামীর বাড়ির কুকুর বিড়ালকেও নাকি সম্মান করতে হয়। আপনি করে সম্বোধন করতে হয়। তাই শিরিন বয়সে আমার ছোট হলেও আপনি করেই বলি। বিয়ের পর এই খালাতো ননদটাকে অনেক আপন করে পেয়েছি। আমার শাশুড়ী ও বুলি খালা, এই দুইবোনের ঘনিষ্ঠতা অনেক। দুই বাড়ির যাতায়াতও অধিক। বলা যায় অন্তরে অন্তরে মাখামাখি। বুলি খালা আসতে প্রায়ই শিরিনকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতো। কারণ শিরিন উনার সর্বকনিষ্ঠ আদরের সন্তান। যুবতী মেয়েকে একা নির্জন বাড়িতে রেখে আসা সমীচীন নয়। অপরদিকে আমার শ্বাশুড়িও বলতো নিয়ে আসার জন্য। এভাবেই শিরিনের সাথে আমারও সখ্যতা ঘটে।এবং তা আজকের এই সময় পর্যন্ত বহমান থাকে বহতা নদীর স্রোতের মতই।

খুব চতুর ও বুদ্ধিমতী মেয়ে শিরিন। কিন্তু চালচলনে যথেষ্ট শালীন ও মার্জিত। রূপেও আগুন সুন্দরী আমার চোখে। শিরিন কথাচ্ছলে কখনো সখনো তার গোপন প্রণয়ের গল্প শুনাতো আমায়।

আমি বিবশ হয়ে শুনতাম শিরিন ও সেই অজানা,অদেখা যুবকের শিহরণ জাগানো প্রণয়কাব্য। তখন নিজেই দূর বনের উদাস পাখি হতে যেতাম। তার আবেগ অনুভূতিকে প্রশ্রয় ও আশ্রয় দিয়ে বলতাম,

” যে আপনাকে এত ভালোবাসে। সে যেনো এ জনমে একবার হলেও পায় আপনাকে।”

অবশ্য শিরিন তখন কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতনা। কেবল অবুঝের ন্যায় চুপ হয়ে থাকতো।

মুঠোফোনের এপ্রান্ত থেকে নরম হেসে শিরিনকে বললাম

” ভুলার সুযোগ কই শিরিন আপা? প্রিয়জনদের ভোলার উপায় তো নেই। আপনার আশু ভাই আসার পর কাজের ব্যস্ততা বেড়ে গেলো। এইই।”

” হ্যাঁ। বুঝি বুঝি। সব বুঝি গো সখী। ”

এভাবে সামান্যক্ষণ কথা বলে বিদায় নিলাম। পরিস্থিতি অনুকূলে নয় বলে মূল প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলাম। শিরিনকেও বুঝতে দিলাম না কথা বলতে চাওয়ার কারণটুকু।

মাস খানেক পর টের পেলাম নতুন কিছু। আমার পরিবর্তন। মায়ের রুমের স্টিলের আলমারির লম্বা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। যুগের বিবর্তনের মতো ধীরে ধীরে আমার দৈহিক সৌন্দর্য ফিরে এলো। চেহারাও ঝলমলে হয়ে উঠলো ভোরের টলটলে কুয়াশার মতো। আমড়ার খোসার অপার কল্যাণে কৃষ্ণকায় কেশগুলো বেশ সিল্কি ও ঝরঝরে হলো। মুঠিভরে আলগোছে সেগুলোকে ঘাড়ের একপাশ করে বুকের উপর নিয়ে এলাম। রেশমি সুতোর ন্যায় মুগ্ধ চোখে কেশগুলো উলটে পালটে দেখলাম। পা হতে মাথা অবধি সুচারু চাহনিতে চাইলাম। নাহ। আশরাফুলের ভাষায় এখন আর আমাকে ভাঙ্গাচোরা নড়বড়ে বেড়ার ঘর মনে হয়না। এখন তো দেখি রত্নাকে দামী প্রাসাদ মনে হচ্ছে। কিংবা রাজকীয় সাজে সজ্জিত কোনো অট্রালিকা। তবে এর পুরো কৃত্বিত্ব আমার মা জননীর।

মা রোজ ডিম,দুধ,মাছ,ফলমূল থেকে শুরু করে খাদ্যতালিকায় সুদৃষ্টি রেখেছে বলেই এমনতরো সম্ভব হয়েছে। এসবই বাজারের কেনা নয়। আমাদের নিজেদেরই। টাটকা ও বিশুদ্ধ শতভাগ। নয়তো আমার শারীরিক গঠন হতো বস্তির জীর্ণকুটিরের ন্যায়। সত্যি, একজন মা হলো সংসার ও সন্তানদের প্রাণ। আলহামদুলিল্লাহ। নিয়ম করে সযতনে টানা একমাসের পরিচর্যায় আমি এখন আগের সেই টগবগে লাস্যময়ী রত্না। আমার পরিশ্রম সার্থক। বাকি বিষয় সময় সাপেক্ষ। ভেবে চিন্তে প্ল্যান করে এগোতে হবে। এবার আর আশরাফুল মুখ ফেরাতে পারবে না নিশ্চয়ই। তার ভালোবাসায় না হয় ভুলেই যাবো সেদিনের বৃহৎ অপমানটকু। স্বামীর অফুরন্ত ভালোবাসা থাকলে সব মানিয়ে নেয়া যায়। মেনে নেওয়াও সম্ভব।

আয়না থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিতেই চোখ গেলো জানালার বাইরে। মায়ের রুমের জানালা বরাবর চাচীদের ঘরের এক রুমের জানালা। বলা যায় দুই ঘরের দুই রুমের দুই জানালা মুখোমুখি। যেনো একে অপরকে পাহারা দিচ্ছে। একি! এক জোড়া পুরুষ চোখ আমার দিকে মুগ্ধতা নিয়ে অবিকল চেয়ে আছে।

আমি তব্দা খেয়ে গেলাম। হতচকিত হয়ে তার কাছে এগিয়ে গেলাম। অর্থাৎ আমাদের জানালার ধারে গিয়ে দুহাত দিয়ে গ্রীল ধরে দাঁড়ালাম।
#রেহানা_পুতুল পেইজে প্লিজ লাইক ও ফলো দিয়ে আমাকে প্রেরণা দিবেন লেখা চলমান রাখতে। আপনারা খালি গল্প পড়ে চলে যান। দুঃখ। 🥲

চিরচেনা চোখদুটো নতুন করে কি দেখছে আমার মাঝে। এটা আমার বোধগম্য হলোনা। আমিও আংশিক বিরক্তি নিয়ে তারপানে ঠায় চেয়ে রইলাম। আমার জড়তাহীন সাহসী দৃষ্টি দেখে এবার সে মেলানো ঠোঁট মেলে ধরলো। রহস্যময় সুরে বলল,

” নয়ন আমার সার্থক আজি এ দিবসে।
ভালো হতো কেউ এসে যদি বসতো খানিক পাশে।”

” বাড়িতে কবে এলেন মাহমুদ ভাই?”

” কাল। আগের মতই তুই আমার নজর বন্দী হয়ে গেলি। তুই যেমন তোকে নতুন করে আবিষ্কার করেছিস এতক্ষণ ধরে। আমিও তেমনি তোকে দেখে চমকিত! শিহরিত! পুলকিত!”

ঘোর লাগা কন্ঠে বলল মাহমুদ ভাই।

” এইই মাহমুদ ভাই, আমি কি চিড়িয়াখানার কোন বিরল প্রাণী? এভাবে ড্যাবড্যাব করে দেখছেন বেকুবের মতো?”

“ঠিক ধরেছিস। তোকে অস্ট্রেলিয়ার জংগল থেকে ধরে আনা হয়েছে। ফাজিল রয়ে গেলি আগের মতোই। ডানপিটেও কম ছিলিনা। কেবল এই মানুষটাকেই বুঝলিনা। ”

” বুঝাবুঝির নেই কাজ। আমি ভালো আছি আমার স্থানে।”

” নেই তো কাজ। তো খই ভাজ। হ্যাঁ কাল বাড়িতে এসেই তোর ভালো থাকার গল্প শুনলাম পারুল ভাবির কাছে। খুউব সুখেই আছিস।”

কন্ঠে অভিমান অনুযোগ মিশিয়ে বলল মাহমুদ ভাই।

অমন বাক্যখানি শুনে চোখ তুলে চাইবার কোনো জো রইলনা। সপাটে বন্ধ করে দিলাম জানালার দুই কপাট। পারুল ভাবি রেডিও স্টেশন ও বাচাল উপাধি এমনি এমনি পায়নি।বুঝলাম।

বন্ধ জানালার বাহির হতে কানে ভেসে এলো মাহমুদ ভাইয়ের হেঁড়ে গলা।

” বলবো না গো…আর কোনদিন ভালোবাসো মোরেএএ…।”

মাহমুদ ভাই ছোটবেলা থেকেই আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু পাত্তা পেতনা। পরে চালাকি করে সরাসরি বাবার কাছে তার মাকে দিয়ে প্রস্তাব দিয়েছে। তার বিশ্বাস ছিলো বিয়ে হলে ভালোবাসাটা হয়ে যাবে। বাবা একশব্দে বিনা দ্বিধায় সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে। তখন মাহমুদ ভাই পুরোদমে বেকার ছিলো। চলাফেরা ছিলো ছন্নছাড়া বাউণ্ডুলের ন্যায়। পরে সেই ক্ষোভে মাহমুদ ভাই গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে। শহরে ব্যবসা শুরু করেছে। এখন বড় ব্যবসায়ী। মাহমুদ ভাই আজো বিয়ে করেনি। সেই গল্প বলতে গেলে আরেক ইতিহাস।

” এই আপা তোর জামাই আসলেই খারাপ মানুষরে। তোরে ভুজুংভাজুং বুঝায়া পার করাই ছিলো তার অসৎ অভিলাষ। এতদিন হয়ে গেলো সে তোকে নিতে আসছেনা। বা যেতেও বলছেনা। কি আজব পুরুষ! ভেবে দেখ।”

” দাঁড়া,আরো দু চারদিন দেখি। তারপর নিজেই চলে যাবো। দেখবি তোর বোনের জেল্লা রূপ দেখেই বেচারা কাত হয়ে যাবে এইবার। বিদেশে রাতদিন সাদা চামড়ার মেয়েদের দেখে দেখে অভ্যস্ত। তাই গ্রামে এসে আমার গায়ের রঙকে তার কাছে কৃষ্ণবর্ণা মনে হয়েছে। সহজভাবে নিতে পারেনি।”

” হইছে আপা থাক। আর স্বামীর স্তুতি গাইতে হবেনা। ভালো বুঝেছিস আর ভালো বলেছিস। মনকে প্রবোধ দিচ্ছিস না আমাকে বুঝাচ্ছিস তা তুই বেশ জানিস।”

“এই রাবু চুপ কর মেয়ে। বেশী পাকনামো শিখেছিস আজকাল। তুই দেখি মানুষের মন বিষিয়ে তুলতে ওস্তাদ।এভাবে কেউ বলে নিজের বোনকে?”

মায়ের ঝাড়ি খেয়ে কলেজে পড়া রাবু চুপ হয়ে গেলো। মুখ ভেংচিয়ে উঠানের দিকে পা বাড়ালো।

তার তিনদিন পর সন্ধ্যা মিলিয়ে গেলে বাবা দোকান থেকে বাড়ি এলো। হাতে একটি লম্বা সাইজের পাতলা খাম। মরামুখে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো সেটা।

” কি এটা বাবা?”

” কি জানি। ডাকযোগে এলো তোর নামে। এই যে তোর পুরো নাম লিখা। জাহানারা আখতার রত্না। লোক নাকি দুপুরেই আমাদের বাড়িতেই এসেছে। তোদের কাউকে না পেয়ে সামনে উত্তর ঘরের খালিদকে পেয়ে তার হাতেই নাকি দিলো।”

আমিও নিলাম সযতনে। ভাবলাম যেহেতু ব্যাংকে আমার একাউন্ট আছে। সেই রিলেটেড কিছু হবে হয়তো।

মা,রাবু,নয়ন ও আমাদের সামনে এলো। মায়ের দৃষ্টি বিভ্রান্ত। সারামুখে ক্লান্তির ছাপ। রাবু টান মেরে নিয়ে খামের মুখ খুলল আস্তে করে। ভালোকরে পড়লো। রাবু বিদুৎ শক খেলো মনে হলো। ভয়ংকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আমার দিকে।

” আপা! এটা ডিভোর্স লেটার। উকিল নোটিশ পাঠিয়েছে তোর পেয়ারের স্বামী আশরাফুল!”

চলবে…

উজানের ঢেউ পর্ব-০২

0

#উজানের_ঢেউ ( ২)
কলমে ✍️ #রেহানা_পুতুল
শুনে মা নিদারুণ কন্ঠে বলল,
” একদম বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছিস। কারো সামনে খড়কুটো হয়ে থাকার চেয়ে আড়ালে এসে জীবের মতো থাকা উত্তম।”

আশরাফুলের কিছু নিষ্ঠুর কথা আমার মৌনাকাশে রাশি রাশি মেঘপুঞ্জ হয়ে ভাসতে লাগলো অবাধ আধিপত্য নিয়ে। এর শেষ পরিণতি কি আমি জানিনা।

মায়ের সামনে থেকে সরে গেলাম। রূপচর্চা ও ত্বকের যত্ন, প্রাকৃতিক উপাদান দিয়েই শুরু করলাম। কৃত্রিমতায় আমি আবার স্বল্প বিশ্বাসী। ফেসপ্যাক বানিয়ে সারামুখে ও ঘাড়ে লাগিয়ে নিলাম যত্ন করে। হাতে পায়ে কাঁচা হলুদ,মধু,চালের গুঁড়োর প্যাক লাগিয়ে নিলাম আলতো করে।

সুশ্রী থেকে বিশ্রী হয়ে আসা কেশগুলোতে দিলাম কাঁচা আমড়ার খোসা বাটা ও হাঁসের ডিমের মিশ্রণ দিয়ে তৈরি পেস্ট।
টক আমি ভীষণ পছন্দ করি। তাই নার্সারি থেকে এই আমড়া গাছের চারাটি এনে পাঁচ বছর আগে আমাদের ঘরের একপাশে লাগিয়ে ছিলাম। আজ আমার জীবনে এই আমড়া বৃক্ষটার ঔদার্যতা দেখে নিজেই আপ্লুত। আনত দৃষ্টিতে গাছটার দিকে আরেকবার চাইলাম। সেদিন কত যে মায়ের বকুনি শুনেছি। তার স্পষ্ট কারণও রয়েছে। সেদিকে আর না যাই।

দশ মিনিট অপেক্ষা করে পুকুর ঘাটে চলে গেলাম গোসল করতে। হাঁটু অবধি উদাম পায়ে,হাতে,কোমরে, বুকে, পেটে,পিঠে নতুন একটি ক্যামেলিয়া সাবান ঢলে নিলাম। গা মাজুনিটা ধুন্দলের খোসা দিয়ে তৈরি। তাও আমাদের গাছের ধুন্দলের। রেডিমেড মাজুনি নস্যি এটার কাছে। সাবানের সুবাস আমার ছোটবেলা থেকেই অন্যরকম ভালোলাগে। নতুন সাবানের প্যাকেট সবসময় আমিই খুলি। সাবানের সাথে সাথে প্যাকেটটাও নাকে চেপে ধরি। নিঃশ্বাস ভরে ঘ্রাণ নিই। এ নিয়ে দাদীজান খুউব তামাশা করতো।

মাকে ডেকে বলতো,
“ও রত্নের মা। তোমার রত্নরে বিয়া দিবা সাপুন সওদাঘরের লগে। যেনো হারাদিন সাপুনের খুশবু নাকে লাগায়া রাখতে পারে। ”

পাশ থেকে রাবু নাক কুঁচকে দাদীকে ক্ষেপিয়ে বলতো,

“এই বুড়ি কিচ্ছু ঠিকভাবে বলতে পারেনা। রত্নারে কয় রত্ন। সাবানরে বলে সাপুন।”

আহারে আমার সারল্যমাখা মায়াবী মুখের দাদীজান। আজ বেঁচে থাকলে বিপন্ন আমাকে দেখে কেঁদেকেটে বুক ভাসাতেন।
#রেহানা_পুতুল পেইজে লাইক ও ফলো দিয়ে প্রেরণা দিবেন প্লিজ।
পুকুরের অপরঘাট থেকে আমাকে দেখছে এক চাচি ও ভাবি। চাচী চলে গেলে চাচাতো ভাবি পারুল গলায় আওয়াজ তুলে বলতে শুরু করলো,

” আমার কথা কাজে লাগছে এবার রত্না? কত বললাম, রূপ যৌবন ধরে রাখ স্বামী সোহাগী হতে হলে। গতর খাটুনি দিয়া শ্বশুর বাড়ির সবার নজর কাড়া যায়। কিন্তু এক পুরুষের অন্তর পাওয়া যায়না। সেই হলো স্বামী। কানেই নিতিনা আমার কথা। ফুঁ মেরে উড়িয়ে দিতি শুকনো পাতার মতন। বলতি, আজাইরা বলি আমি। স্বামীর মন পেতে এসবের দরকার হবে কেনো। সে কি প্রেমিক নাকি তোর। রসিয়ে রসিয়ে ভংচং করে তার মন ভুলাতে হবে। বলি কি রত্না, স্বামীর জাত হলো প্রেমিকের চেয়েও ডেঞ্জারাসরে। এইসব পাষাণ হৃদয় তোর জন্য ঠিক ততদিন গলবে। যতদিন তোর রূপের চুল্লীতে আগুন জ্বলবে। বুঝলি। বেশিরভাগ পুরুষজাতি হইলো রূপের বেসাতি করে। অন্তরের নয়। তুই দেখসনা, নানান ছুতোয় বুইড়া খাটাইস বেটারা অল্প বয়েসী নারীকে বউ করে। কেনো করে? তুই নিজেরে জিজ্ঞেস করে দেখ একবার। ”

পাটের দড়ি পাকানোর মতো করে চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলে থামলো পারুল ভাবি। আমি ঝিম মেরে তেতো ঔষধের ন্যায় ভাবির সবকথা হজম করলাম। করতেই হলো। কারণ ভাবি একদন্ডও ভুল বলেনি।

কিন্তু ভাবি কিভাবে সত্যিটা জানলো বা বুঝলো। সেটা জানার বিশেষ আগ্রহ আমার চিত্তে উদয় হলনা। মন্দ কিছু হাওয়ার বেগে দশকান রটে যায়। কেবল গোপনে বললাম,

তুমি ঠিকই বলছ ভাবি। এদের মতো স্বামী নামক পুরুষদের জন্য সৌন্দর্যের ডালি আর রূপের পসরা সাজিয়ে বসে থাকতে হয় বারবনিতাদের মতো। স্বামী নামক মানুষটির উপর আমার অগাধ বিশ্বাস,শ্রদ্ধা ও ভরসা তলিয়ে গেলো মহাকালের অতলান্তে। আমার ধারণাও পাল্টে গেলো জীবন নিয়ে। তাই শুধু দৈহিক সৌন্দর্যই নয়,তার পাশাপাশি নিজেকেও আত্মনির্ভরশীল করে তুলবো মজবুত করে।

‌ঝুপঝাপ করে সাঁতরে গোসল সেরে নিলাম। ঘরে এসে দেখি আমার একমাত্র শিশু রাজন খেলছে। শত বিষাদেও রাজনের মুখের সরল হাসি আমাকে এনে দেয় অনাবিল সুখ ও প্রশান্তি। মা তাকে গোসল করিয়ে এখন সঙ্গ দিচ্ছে খেলার সাথী হয়ে। এত প্রাণোচ্ছল দৃশ্য দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। আমার পরিবারের কারো কাছেই আমি উপেক্ষার আভাস পাইনি এখন পর্যন্ত।

আর হোসেনপুর থাকতে অর্থাৎ আশরাফুলদের বাড়ি থাকতে রাজনের সবকিছু আমার একা সামলাতে হতো। বড় জা লায়লা একা হাতে তার ভিন্ন একার সংসার চালায়। চার সন্তানের দেখভাল,সবজি বাগান করা, একপাল রাজহাঁস ও বেশকিছু মুরগী পালা, এক ঝাঁক কবুতর পালা,অবসরে ময়দার চুটকি সেমাই বানানো, সন্ধ্যায় নাস্তা তৈরি, নকশী কাঁথায় রঙিন সুতোর ফোঁড় ও অনান্য গৃহকার্য নিয়েই তার বেলা ফুরোয়। ফুরসত মেলেনা আমার দিকে চেয়ে দেখার।

শ্বশুরের ভিটায় আছি শাশুড়ী, তাদের ছোট ছেলে আশরাফুল,আমি ও রাজন। মোট পাঁচজন। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি না হলেও এদের গৃহস্থালি কাজ নেহাৎ কম নয়। দশজনের পরিবারের সাথে তুলনা করা যায়। লায়লা ভাবির সমান কাজ করতে হয় আমার। কিন্তু আমি এত কাজ করে অভ্যস্ত নয়। নিপুণাও নই। তাই শ্বশুর শাশুড়ীর মন যুগিয়ে চলার জন্য কায়িক শ্রম দিয়ে নিজের দিকে ফিরে চাইবার অবকাশটুকু মেলেনা। এটাই বোধ হয় জীবনের বড় একটা ভুল হয়ে গিয়েছে আমার। সিলিং ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে চুলের পানি ঝেড়ে নিলাম ভালো করে। মা উঠে গেলো কাজের ব্যস্ততায়।

রাজনের দিকে দুহাত প্রসারিত করতেই আমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো । আধো আধো বোলে তার ভাষা তো আমিই বুঝি। অবুঝ শিশুর খলবল করা হাসি, নিষ্পাপ মধুর চাহনি, আহ্লাদ করে চোখ ভেজানো,অভিমান করে জেদ করা, অনর্গল ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে ভুলভাল শব্দ বলার মাঝেও যে অবর্ণনীয় শান্তি ও স্বর্গীয় আনন্দ লাভ করা যায়। এই নিগুঢ় সত্য মা না হলে কোনদিন উপলব্ধি করতে পারতাম না। সত্যিই মাতৃত্ব মহান। মাতৃত্ব ত্যাগের। মাতৃত্ব বিসর্জনের।

বাবাসহ দুপুরে খেতে বসলাম। গ্রামে বাড়ির নিকটবর্তী বাজারেই বাবার দোকান। ব্যস্ততার জন্য এর আগে বাবা আমার সাথে কথা বলতে পারেনি। তখন বাবা আশ্বাস দিয়ে কিছুকথা বললো আমাকে।

যার সারাংশ হলো,

স্বার্থ আর বিভেদের পৃথিবীতে সবাই ছেড়ে গেলেও সন্তানকে কখনোই বাবা মা ফেলে দেয়না। সেই ছোট্টবেলার মতই আগলে রাখে। সত্যি বলতে তখন আমি অনেক বেশি আবেগাপ্লুত হয়ে গিয়েছি। আমার আঁখিকোণ ছলছল করে উঠলো নির্ভরতার আশ্রয়কেন্দ্রটি পেয়ে। বাবার সাথে কথায় তাল মেলালো মা,রাবু,ছোটভাই নয়ন।

আমি আসার পর হতে আশরাফুল একবারও ফোন করেনি। আমিও করিনি। আমি কেনো করবো। আমিতো তার কাছে উপেক্ষিত! নিগৃহীত! আমি নারী। এর চেয়ে বড় সত্যি আমি একজন মানুষ। আমারও আত্মমর্যাদা বোধ রয়েছে। ব্যক্তিত্ব রয়েছে। সে নিজের জন্ম দেওয়া শিশুপুত্রেরও খবর নেয়নি। মনে পড়লো,

‘ আউট অব সাইট আউট অব মাইন্ড ‘ কথাটি। কিন্তু আমি সবসময় এটা মানতাম না। মনে হতো, চোখের আড়াল হলেতো মনের আরো কাছাকাছি চলে আসে প্রিয়জন। হায়! দেখি বচনটাই সত্যি। আমিই মিথ্যা।

সবার কুশলাদি জানার জন্য আমিই নিজ থেকে ফোন দিলাম শাশুড়ীর ফোনে। তিনি তো মূল বিষয় জানেন না। তাই স্বভাব সুলভ কন্ঠেই কথা বলছেন। পাশ থেকে কয়েকজনের হাসিঠাট্টা শুনতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

“আম্মা বাড়িতে মেহমান এলো মনে হয়। আপনার ছেলেরও কথা শোনা যাচ্ছে।”

” হ। বুলি আসছে। তোমার ছোট খালা শাশুড়ী। তার পালা হাঁস ভুনা কইরা আর রুটি বানায়া আনছে সবার জন্য। আরো এটা সেটা আনলো।”

” খালাম্মা একা আসছে আম্মা ?”

” নাহ। শিরিনও আসছে। তার নাকি কলেজ বন্ধ এখন।”

তখন মনে হলো শিরিন আপাকে ফোন দিয়ে বিষয়টা শেয়ার করবো। দেখি কি পরামর্শ দেয় তার খালাতো ভাইয়ের হৃদয় হরণ করার জন্যে।

বললাম,
” আম্মা শিরিন আপার কাছে মোবাইলটা দেন। একটু কথা বলি।”

” খাড়াও দিতাছি। তোমাদের ননদ ভাবির তো আবার গলায় গলায় ভাব। শিরিন আশুর সাথে কথা বলতাছে। ”

আম্মা ফোন নিয়ে তাদের কাছাকাছি গেলো। তখন আশরাফুল ও শিরিনের উচ্ছ্বল হাসি শোনা গেলো। আমি বিষম খেলাম। কই আমার সাথে তো এমন করে ও প্রানবন্ত হাসি দিয়ে কথা বলেনি কখনো। বিশেষ করে এবার বাড়ি আসার পর।

চলবে…

উজানের ঢেউ পর্ব-০১

0

#উজানের_ঢেউ ( ১)
#কলমে ✍️ #রেহানা_পুতুল
” আমার কেনো জানি আজকাল তোমার উপর মন বসেনা।”
হঠাৎ তার মুখে নির্দয় বাক্যটি শুনে আশ্চর্য হওয়ার চেয়ে অধিক লজ্জাই পেলাম। ঘোর অপমানিত বোধ করলাম। কোনো স্বামী যখন স্ত্রীকে মুখের সামনে এমন কথা বলেই ফেলে। সে স্ত্রীর জন্য এর চেয়ে বড় লজ্জার আর কিছুই হতে পারেনা। নিতান্তই সহজ সরল কয়েকটি শব্দ মাত্র। তবুও শব্দগুলোর ধার ক্ষুরের চেয়েও শাণিত ঠেকলো আমার কাছে। আমি লজ্জা পেয়েও ওর চোখের সামনে থেকে পালানোর চেষ্টা করলামনা। বেহায়ার মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। কেউ কেউ বলে বেহায়া না হলে নাকি ভালোবাসা পাওয়া যায়না। ওকে যে প্রচন্ড ভালোবাসি আমি।
দৃষ্টি নামিয়ে নিচুগলায় জানতে চাইলাম,

” আমি কিভাবে চললে মন বসবে আপনার? বলেন? ”

সে চঞ্চল সুরে বলল,

” জানিনা। এসব বলে কয়ে হয়? তোমার চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছে। গায়ের রঙ তামাটে হয়ে গিয়েছে। দৈহিক গঠন ও অনাকর্ষণীয়। তোমাকে আজকাল কেমন ভাঙ্গাচোরা বেড়ার ঘরের মতো লাগে দেখতে। ”

” তাহলে আর কেনো জানি বললেন কেনো? কারণতো আপনার রেড়িই আছে দেখছি।”

” যা ভাবো তুমি।”

” তবে কি আমি বাবার বাড়ি চলে যাবো?”

” কি করবে তা তুমিই ভালো জানো।”

” আমি জানলে, বুঝলেতো আপনার মতন করেই চলার চেষ্টা করতাম। আমিতো জানি আমরা স্বামী স্ত্রী। যেমনই হইনা কেনো দুজনের দুজনকে সবসময় ভালোলাগবে।”

” তুমি আসলেই একটা ক্ষ্যাত গাইঁয়া মেয়েলোক। কেবল গাধার মতন সংসারের সবকাজ করতে পারলেই হয়না। পুরুষের রূচি বুঝে তাকে নিজের করে ধরে রাখার কৌশলটুকুও জানতে হয়। যেটা তুমি জানইনা।”
দারুণ তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে বলল সে।

” তাহলে আমি আজ থেকে চেষ্টা করে দেখবো।” ধীর গলায় বললাম।

সে কিছু বললনা আর। আমার উপর প্রগাঢ় বিরক্তি প্রকাশ করে বাড়ির সামনের দিকে চলে গেলো।

#রেহানাপুতুল পেইজে like ও Follow দিয়ে প্রেরণা দিবেন কলম চলমান রাখার জন্য। প্লিজ।

আমি তৎক্ষনাৎ ড্রেসিং টেবিলের বড় আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তীক্ষ্ণ চাহনিতে নিজের পেলব অঙ্গখানির দিকে তাকালাম। নাহ আশরাফুল একদন্ডও মিথ্যে বা ভুল কিছু বলেনিতো। আমার নজরকাড়া আঁখিতলে কালি জমে গিয়েছে। ফর্সা গায়ের রঙ পাংশুটে আকার ধারণ করেছে। দিঘলকেশী চুল উসকোখুসকো হয়ে গিয়েছে। মা হওয়ার জন্য তলপেটে বুকে মাতৃত্বের উজ্জ্বল দাগ পড়ে গিয়েছে। কলুর বলদের মতো খেটে খেটে রূপ লাবন্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এমনতো হয়েছে তাদের সংসারে খেটে খেটেই।

আশরাফুল এটা কেনো একবারও ভাবলোনা। বিয়ের সময়তো আমি তার পছন্দই ছিলাম। দেখেশুনেইতো সে বিয়ে করলো আমাকে। সুডৌল বুকের দিকেও একবার চাইলাম। হেলে গেলো নাকি আশরাফুলের ভাষ্যমতে?
আশরাফুলের কথাগুলো কি আমার জীবনে আগাম ঝড়ের পূর্বাভাস? ভেবেই হতাশ মনে ঘরের বাইরে পা রাখলাম। শাশুড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি পিছনের উঠানে বেতের মোড়া তৈরি করছেন। আমার চোখমুখে দুঃখী দুঃখী ছাপ দেখে নিজ থেকেই জানতে চাইলেন,

” ঝগড়া করে এলে নাকি জামাইয়ের লগে?”

“নাহ আম্মা।”

” তাহলে মুখ অমন ছাঁইরঙা হইয়া আছে ক্যান? তোমাগো বাড়ির থেইকা মোবাইল আইছেনি? কারো অসুখ বিসুখ নাকি?”

” নাহ আম্মা। বাড়ির জন্য মন পুড়তেছে। কয়দিনের জন্য যেতে চাই।”

প্রসংগ পাল্টিয়ে ফেললাম, হুট করে শাশুড়ীকে বিষয়টা জানানো ঠিক হবেনা ভেবেই।
আম্মা বললেন,

” আমি না হয় যেতে দিবো। কিন্তু আশরাফুল বিদেশ থেইকা আইলো মাসখানেক হইলো কেবল। সে যাইতে দিবো তোমারে? তারে জিগাও আগে।”

” আম্মা উনি মনে হয় যেতে দিবে। তেমন কিছুই মনে হলো।”

” যার বউ তার আপত্তি না থাকলে আমাদেরও কোনো আপত্তি নেই।”

সরস হেসে বললেন আম্মা।
বিয়ের আগে চাচাতো, খালাতো,মামাতো বোনদের কাছে শুনতাম, বেশিরভাগ বিবাহিত মেয়েদের জীবনে এক আতংকের নাম হলো শাশুড়ী।
আমিও বিশ্বাস করতাম তখন ওদের মুখের অভিব্যক্তি দেখে। কিন্তু বিয়ের পরে আমার এই বিশ্বাস ও ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হলো। বরং প্রমাণ হতে যাচ্ছে কারো কারো জীবনে স্বামীও হতে পারে এক আতংকের নাম। যদি তাই না হতো, তাহলে কোনকালে কে শুনেছে,চেহারা ভেঙ্গে গেলে,গায়ের রঙ নষ্ট হলে, দৈহিক সৌন্দর্য কমে গেলে স্ত্রীর উপর মায়া কমে যায় স্বামীর। ভালোবাসা মিলিয়ে যায় বাতাসার ন্যায়।

সেদিন বেলা না ফুরোতেই কাপড়চোপড় গুছিয়ে আমার একমাত্র দুই বছরের ছেলে রাজনকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেলাম একাই। যাবার আগে সলাজ নয়নে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
“আপনি কি চান আমি আর ফিরে আসি আপনার জীবনে?”

” আমার জীবনের কথা ভুলে যাও। কিন্তু এই সংসারের জন্য ফিরে এসো।”

ও এতটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাক্যটা উচ্চারণ করলো। শুনে মনে হলো ও নিজেই যেনো একশো শাবল দিয়ে খুঁড়ে খুঁড়ে আমার বুকের ভিতরে একটা বিষাদের গভীর কূয়ো খনন করে দিয়েছে। আর মনে মনে উল্লাস করে বলছে,
” রত্না যত ইচ্ছে তোমার দুঃখ,বেদনাকে এই কুয়োর মাঝে স্তুপাকারে সঞ্চিত রাখতে পারবে। কোন সমস্যা হবেনা। উগরে বের হবেনা। কেউ জানবেনা।”

” কোন পরিচয়ে ফিরে আসবো এ সংসারে? ”

” উদ্ভূত! তোমার আদিখ্যেতা দেখলে বাঁচিনা। কোন পরিচয়ে আসবে মানে? যে পরিচয়ে এতদিন ছিলে সেই পরিচয়ে আসবে। তোমাকে কি আমি তাড়িয়ে দিচ্ছি নাকি?”

পাষাণের মতো ও যখন কথাগুলো বলল,
ওই মুহূর্তে আমি ওর চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করেছি। দেখলাম সেখানে জমা রয়েছে আমার জন্য রাশি রাশি উপেক্ষা,অনাদর,অসম্মান। কথা বাড়ালাম না আর। পা বাড়িয়ে হাঁটা ধরলাম। ও রাজনকে কোলে নিয়ে আমার পায়ে পায়ে হেঁটে এলো বড় রাস্তার মোড় পর্যন্ত। রিকসায় তুলে দিলো। করুণার মত হাত বাড়িয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিলো কিছু টাকা। আমি নিরুপায়। নিতে হলো আমার একমাত্র ছেলের কথা ভেবেই।

বাবা, মা, ভাইবোনেরা আমাকে দেখে কিছুটা চমকে গেলো। তবে ভড়কে গেলনা। শাশুড়িকে বলা কথাটাই ওদেরও বলতে হলো। নয়তো কথার মিল না থাকলে ঝামেলা হতে পারে। আশরাফুলকেও তাই শিখিয়ে দিলাম। পরিস্থিতি নিজেই সামলে নেয়ার উপায় খুঁজতে লাগলাম।

রাজনকে ঘুম পাড়িয়ে ভাইবোনের পড়ার রুমে ঢুকলাম। বুক সেলফ থেকে বুদ্ধদেব বসুর প্রথম নাট্যগ্রন্থ ‘ তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ বইটা নিলাম। কলেজে পড়ার সময় এই বইটা কিনেছি। বইয়ের পাতা উল্টিয়ে চলে গেলাম কাঙ্ক্ষিত পাতায়। যেখানে বর্ণিত আছে অসাধারণ সুন্দরী বারবনিতা ‘তরঙ্গিণী’ র কথা। যাকে পুরুষবধের প্রেম,ছলা,কলা,ভক্তির সবক শেখানো হয়। যে হয় ছলা কলায় শীর্ষে। যার অঙ্গুলী হেলনে যে কোনো পুরুষোত্তমের হৃদয় হেলতে সময় নেয় না অনুক্ষণের।

আশরাফুলের মতো পুরুষদের অন্যতম উদ্দেশ্যই হলো নারীর রূপের স্তুতি গাওয়া। এরা জীবনের সুখ আহরণ করে নারীর বাহ্যিক রূপসুধা থেকে। এদেরকে তুলনা করা যায় উড়ে উড়ে মধু খাওয়া ভ্রমরের সাথে। এরা হীরের কদর বোঝেনা। ঠুনকো আঘাতে গুঁড়িয়ে যাওয়া চকচকে কাঁচকে খুব গুরুত্ব দেয়। অতি মূল্যবান মনে করে যত্ন করে।

পড়া শেষে বই রেখে দিলাম। ইউটিউবে রূপচর্চা, শরির চর্চা,স্কিন কেয়ার,মেনিকিউর,পেডিকিউর,ত্বকের যত্ন,বডি ফিটনেস যা আছে একেএকে সবগুলো ভিডিও দেখলাম। বড় মার্কেটে গেলাম ছোটবোন রাবুকে সঙ্গে করে। সব ধরনের ক্রিম এবং প্রয়োজনীয় সব উপাদানগুলো কিনে নিলাম। নিয়ম করে সকাল, বিকাল, রাতে রূপচর্চা করতে লাগলাম। দুদিন না যেতেই মায়ের নজরে পড়ল বিষয়টা। মা কিঞ্চিৎ অবাক হলো।

কৌতুহল নিয়েই জিজ্ঞেস করল,
” কিরে রত্মা। আচম্বিতে নিজের যত্ন নিচ্ছিস? জামাই কিছু বলছে নাকি তোর চেহারাসুরত নিয়ে?”

আমার ভিতরটা নড়ে উঠলো মায়ের কথা শুনে। এইতো হলো শ্রেষ্ঠ মা। সন্তানকে নিয়ে যার অনুধাবন ক্ষমতা সবার চেয়ে বেশী। দোনোমোনো শুরু করলাম ইতিউতি চেয়ে।

” প্রবাসী জামাই দেশে। তুই চলে এলি একা বাবার বাড়ি। আমার দিলে খচখচানিটা তখনই শুরু হয়েছে। তোকে চোখে চোখে রাখছি। মনে মনে দেখছি। নিশ্চিত হওয়ার জন্য।”

উদ্বেগ নিয়ে বলল আমার মা। আমি নরম গলায় মাকে বললাম,

” মা ওর নাকি এখন আমার প্রতি কোনো টান কাজ করেনা। আমার জন্য ওর দু’চোখভরা অবজ্ঞা দেখেছি। তাই তার আড়ালে চলে এলাম। আগের মতো কিছুটা হলেও নিজের রূপ-মাধুর্য ফিরিয়ে আনার ঐকান্তিক চেষ্টায়।”

শুনে মা নিদারুণ কন্ঠে বলল,

” একদম বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছিস। কারো সামনে খড়কুটো হয়ে থাকার চেয়ে আড়ালে এসে জীবের মতো থাকা উত্তম।”

আশরাফুলের কিছু নিষ্ঠুর কথা আমার মৌনাকাশে রাশি রাশি মেঘপুঞ্জ হয়ে ভাসতে লাগলো অবাধ আধিপত্য নিয়ে। এর শেষ পরিণতি কি আমি জানিনা।

চলবে।