Saturday, August 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 474



প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-৫০ এবং শেষ পর্ব

1

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৫০(অন্তিম পর্ব)
________________
বর্তমান,
ইলিয়াসের চোখ বেয়ে কখন থেকে যে পানি পড়ছে তা তার জানা নেই। রামুও কাঁদছে। তার বউও দুয়ারের কর্নারে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল চেপে কাঁদছে। স্বামীর মুখে এ গল্প সে বহুবার শুনেছে। যতবার শুনেছে ততবারই কান্নায় ভেঙে পড়েন। কি! নির্মম ছিল সেই কাহিনি। এক ষোড়শী কন্যার সাথে কি বিরহ ঘটে গেল ভাবতেই বুক দক করে ওঠে তাদের। রামু ইলিয়াসের দিকে তাকিয়ে বললো,“ডাক্তার বাবু আমনেও কান্দেন?”

ইলিয়াস চমকে ওঠে সে টের পায় নি কখন তার চোখ বেয়ে পানি ঝরছিল। ইলিয়াস আচমকা উঠে দাঁড়ালো। তার বুকে যন্ত্রণা হচ্ছে। এত কষ্ট ছিল রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজের মাঝে ভাবতেই পারছে না। সে ভেবেছিল ইমতিয়াজ বেঁচে আছে। সে ফিরে আসবে। কিন্তু কি শুনলো শেষে! এক মৃত ব্যক্তি ফিরে আসার অপেক্ষা করছে এই রেশবপুরের রাগান্বিতা। ইলিয়াস হেঁটে গেল রাগান্বিতার থাকা সেই ছোট্ট কুটির ঘরে। পিছনে রামু তাকিয়ে রইলো। রামু মাঝে মাঝে ভাবে,“যদি সত্যি ইমতিয়াজ ফিরইয়া আইতো তাইলে খুব ভালা হইতো। কিন্তু মরা মানু কি আর কহনো ফিরা আহে!”

নিঝুম বিকেল তখন। রাগান্বিতা এলেমেলো ভাবে নিজ কক্ষে বসে আছে। নীরব থমথমে মুখ। তার পাশেই ইমতিয়াজের লিখে যাওয়া চিরকুটের ঝুড়ি। ইলিয়াস ভিতরে ঢুকলো। রাগান্বিতা ভয় পেল এতে। ইলিয়াস নরম স্বরে বললো,“ভয় পেও না আমি তোমায় কিছু করবো না।”

রাগান্বিতা নিশ্চুপ রইলো কিছু বললো না। ইলিয়াস রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে রইলো অনেকক্ষণ। তার কান্না আসছে। এত কষ্ট তো লাগার কথা নয়। তাও ইলিয়াসের কষ্ট হচ্ছে। হঠাৎই ইলিয়াসের চোখ গেল ইমতিয়াজের লিখে যাওয়া একটা চিরকুটের দিকে। যেখানে ইমতিয়াজ লিখেছিল,
“তুমি আমার ধ্বংসের শেষ অধ্যায়ের গরমিল।”

আরেকটা উঠালো সেখানে লেখা ছিল,
“আমাদের আরো আগে কেন দেখা হলো না বউ,যতটা আগে দেখা হলে আমাদের আর বিচ্ছেদ হতো না।”

ইলিয়াস কথাটা পড়ে আরো ভেঙে পড়লো। কি ভালোবাসা ছিল এই ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতার মাঝে অথচ মাঝে কত বারণ। ইমতিয়াজ এমন অসংখ্য চিরকুট লিখে গেছে রাগান্বিতাকে। আর শেষে একটা প্রেমপত্র। যেটা বোধহয় রাগান্বিতা এখনও পরে নি। ইলিয়াস তক্ষৎনাৎ বেরিয়ে আসলো। চোখ মুছতে মুছতে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। তার এখন সর্বপ্রথম কাজ হলো রাগান্বিতাকে ঠিক করা। লাগলে বিদেশি ডাক্তাদের সাথেও যোগাযোগ করবে ইলিয়াস। তবুও সে রাগান্বিতাকে ঠিক করেই ছাড়বে। রাগান্বিতাকে আবার আগের রূপে এনেই ছাড়বে ইলিয়াস। ইলিয়াস তার জীবনের সকল ডাক্তারির পড়াশোনা লাগিয়ে দিল রাগান্বিতার পিছনে। বড় বড় ডাক্তারদের সাথে এ বিষয়ে কথাও বলে। সে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয় রাগান্বিতার সাথে। টুকিটাকি কথাও বলে। রাগান্বিতার সাথে এমন ব্যবহার করে যেন সত্যি সত্যিই ইমতিয়াজ ফিরে আসবে আবার। রাগান্বিতাও বন্ধু হয়ে যায় তার সাথে। সময় চলতে থাকে আবার।’
——-
সাল ১৯৯১, ৬ই নভেম্বর। দেখতে দেখতে ইমতিয়াজের মৃত্যুর পুরো দশবছর কেটে গেল। রাগান্বিতা এখন পুরোপুরি সুস্থ। তার সব মনে পড়ে গেছে। তার মস্তিষ্ক আবার আগের মতো কাজ করছে। পাঁচবছর আগেই একটু একটু করে ঠিক হচ্ছিল। তার মনে পড়ছিল তার বাবা বেঁচে নেই। পরে রাগান্বিতার সব স্মৃতি মনে পড়তেই সে টানা তিনদিন চেঁচিয়ে কাঁদে। তাকে সামলায় রামুর বউ। তারপর আর কাঁদে না। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়। তবুও রাগান্বিতা ইমতিয়াজকে ভোলে না। কল্পনায় হলেও সে রোজ ইমতিয়াজের সাথে কথা বলে। কত অভিযোগ, কত অভিমান করে তার হিসাব নেই!’

শীতল সকাল! রাগান্বিতা আজ ব্যস্ত। সে কোথাও যাবে। কোথায় যাবে রামুকে বলে নি। রামুর একটা মেয়ে আর এক ছেলে আছে। রাগান্বিতাকে মামুনি বলে ডাকে। রাগান্বিতা বর্তমানে গ্রামের একজন গন্যমান্য ব্যক্তি। গ্রামের কোনো অসুবিধা হলেই তাকে ডাকা হয়। সে পরামর্শ দেয়। ছাব্বিশ বয়সী এক রমনীর প্রতিভা দেখে তারা সবাই বিমোহিত। মেয়ে পুরো বাবার মতো হয়েছে। তবে রাগান্বিতার সামনে বড় একটা নিষিদ্ধ শব্দ হলো “বিয়ে”! অনেক বয়স্ক মানুষ তাকে নতুনভাবে বিয়ে দেয়ার কথা বলে কিন্তু রাগান্বিতা রাজি হয় না। যেদিন এ বিয়ের কথা উঠবে সেদিন রাতেই সে ইমতিয়াজকে স্বপ্ন দেখবে। রাগী রাগী চেহারা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা খুব হাসে। বলে,“বিয়ে করবো না। তবে আপনার এই চেহারা দেখার জন্য হলেও আমি বিয়ের কথা শুনবো। শুধু শুনবো।”

“মামুনি কোথায় যাও তুমি?”

হঠাৎই রামুর দুই ছেলেমেয়ের কথা শুনে রাগান্বিতা পিছনে তাকায়। নিকাব বেঁধে বলে,
“একটু হাঁটতে যাবো।”
“এই হকাল বেলা।”
কথাটা বলেই মুখে হাত দিল রামুর ছেলে। ঠোঁটে কামড় দিয়ে বললো,
“থুড়ি হকাল না সকাল হবে।”

রাগান্বিতা হাসে। দু’টোর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
“হা তোমরা ভালো মতো থেকো। রামুভাই আর ভাবিকে জ্বালাবে না ঠিক আছে।”

এই বলে একটা ব্যাগ নিলো রাগান্বিতা। ব্যাগের ভেতর ধারালো ছুরি আর একটা চিঠি। অতঃপর রাগান্বিতা বেরিয়ে যায়। রামুর বউ দেখে তাকে। দুয়ারের কাছে দাঁড়িয়ে বলে,
“যাইতাছো বোইন?”

রাগান্বিতা মৃদু হেঁসে যেতে যেতে জবাব দেয়,“হুম।”

রামুর বউ নির্মল চোখে তাকিয়ে থাকে। আটকায় না। কারণ সে জানে রাগান্বিতা তার আটকানো শুনবে না। রাগান্বিতা প্রতিবছর এই নভেম্বরের ৬ তারিখ কোথাও যায়। এটা গত তিনবছর যাবৎ হচ্ছে। পরে শুনেছিল এই দিনেই ইমতিয়াজ মারা যায়। রাগান্বিতা যাওয়ার পথে তাদের বাড়ির দিকে যায় তার বাবা, বোন, দাদিমা সবার কবর দেখে। শুধু ভাইটার দেখে না। যত যা ঘটেছে সব তো এই নিকৃষ্ট ভাইটার জন্যই। রাগান্বিতা নদীরঘাটে যায় নৌকায় বসে। এখন ঢাকা যাওয়ার জন্য ট্রেনের পাশাপাশি বাসও চলে। রাগান্বিতা আজ বাসে যাবে ঢাকা। সময়টা তখন সকাল ৬টা। রাগান্বিতা বাসে উঠলো। গিয়ে বসলো বাসের একদম শেষের সিটে জানালার পাশে। ঢাকা যেতে তার প্রায় মধ্যম দুপুর হবে। বাস চলতে শুরু করলো। রাগান্বিতা ব্যাগ থেকে চিঠিটা বের করলো, উম না! চিঠি না এটা হলো প্রেমপত্র। যেটা রাগান্বিতা ১০ বছর আগের সেদিনের ভয়ানক রাতে পড়তে পারে নি। সুস্থ হওয়ার পর পরে। এই চিঠিটা রোজ রাতে একবার করে পড়ে, রাগান্বিতা ঘুমায়। কেমন শান্তি শান্তি অনুভব হয় তার। রাগান্বিতা ভাবলো এখনও একবার পড়বে। আবার ভাবলো, না একবার না ঢাকা যেতে যেতে যতবার পড়া যায় ততবার পড়বে।’

রাগান্বিতা চিঠিটা খুললো। তার মনে পড়লো একদিন রাতে ইমতিয়াজ তাকে বলেছিল,
“তুমি চিঠি ভালোবাসো বউ?”
তখন রাগান্বিতা উত্তরে বলে,
“উম চিঠি না প্রেমপত্র।”
যার বিনিময়ে ইমতিয়াজের উত্তর আসে,“কোনো একদিন তোমায় নামে বিশাল প্রেমপত্র পাঠাবো বউ, তুমি পড়ে নিও!”

ইমতিয়াজ সেই কথা রাখে। সেই বিষাদের মাঝেও সে লেখে একখানা প্রেমপত্র। রাগান্বিতা পড়তে শুরু করলো। যেখানে প্রথমই লেখা ছিল,

“প্রিয় রাগান্বিতা”
আমার রাগান্বিতা। কেমন আছো প্রিয়! নিশ্চয়ই ভালো আছো। তোমাকে ভালো থাকতে হবে। আমি কে জানো তো। আমি হলাম তোমার এক নিষ্ঠুর প্রেমিক পুরুষ ইমতিয়াজ সিকদার। যে তোমার জীবনটা হঠাৎ এলেমেলো করে দিলো। আমি কখনো প্রেমপত্র লেখি নি। তবে ছোট খাটো চিরকুট, কবিতা লিখি। কবিতা লিখি বলে আমায় আবার কবি ভেবো না। আমি কিন্তু কবি নই। আমি প্রেমপত্র লেখছি। প্রেমপত্রের শুরুটা কিভাবে করতে হয় তাও জানি না তবুও আমি লেখছি। এই বিষাদময় সময়ে তোমার জন্য চিঠি লিখছি। উম্ না, চিঠি নয় প্রেমপত্র। আমি জানি তুমি এই প্রেমপত্র খুব শীঘ্রই খুলবে না। তোমার সময় লাগবে। ওই বছর পাচেক পর বা তারও বেশিদিন পড় খুলবে। যখন খুলবে তখন কি তোমার মনে থাকবে এই ইমতিয়াজের কথা! অবশ্যই থাকবে। কেন থাকবে না। আমি কি ভুলে যাওয়ার মতো একটা মানুষ। আর কারো কাছে ভুলে যাওয়ার মতো মানুষ হলেও অবশ্যই তোমার কাছে তা নই। মানুষ পৃথিবীতে দু’টো মানুষকে কখনো ভোলে না। এক শত্রু, দুই ভালোবাসার মানুষ। আমি তো তোমার দুটোই ছিলাম। জানো তো ভালোবাসা হিসাব করে হয় না। তবুও অনেকেই ভালোবাসার হিসাব করতে চায়। আমিও চেয়েছিলাম তাই বোধহয় সব এলেমেলো হয়ে গেল। আমি হিসাবে গড়মিল করে বসলাম। এই রাগান্বিতা, তুমি কি জানো তুমি পুরো ফুলের মতো পবিত্র, বাতাসের মতো স্নিগ্ধ, আকাশের মতো শীতল, কি মায়ময়ী চাহনি তোমার, ঘন কালো লম্বা কেশ,ওষ্ঠদুটো ইস আমি কল্পনা করেও প্রেমে পড়ে যাই। তুমি এত সুন্দর কেন মেয়ে! তোমার সুমধুর কণ্ঠ শোনার জন্য আমি যেন বার বার ফিরে ফিরে আসি। এবার বোধহয় ফিরবো না। তবে এ না ফেরার আফসোস নেই। আমাদের দেখা তো হবে। হয়তো এভাবে নয় অন্যভাবে। এই ধরো,
কখনো তোমার চুলের সাজে,
নয়তো আকাশের তাঁরার মাঝে,
হয়তো বৃষ্টি ফোঁটার ভাঁজে ভাঁজে।

শোনো না, যখনই আকাশ বেয়ে বৃষ্টি নামবে,
তুমি তোমার চুলগুলো খুলে দিবে। শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজে, বৃষ্টিতে নাইতে নামবে। আমি দূর থেকে তোমায় দেখবো। আমি দূর থেকেই তোমায় ছুঁয়ে দিবো। দূরের ছোঁয়ায় কিন্তু দারুণ মজা। আমি সেই মজা বার বার পেতে চাই। সুযোগ কি পাবো! তুমি দিবে নিশ্চয়ই। আমি কি অবহেলা করার মতো একটা মানুষ। অবশ্যই তোমার কাছে তা নই।

শোনো না, যখন বৃষ্টিতে ভিজবে দয়া করে হলেও আমায় একটু মনে করবে। ঘৃণার নজরে নয়, একটু ভালোবাসার ছোঁয়ায়। মনে করবে তো বউ! যতই হোক আমি তো মনে না করার মতো মানুষ নই। বাকিদের কাছে হলেও তোমার কাছে কিন্তু তা নই।

আমি তো মরেই যাচ্ছি। তবুও মনে হয় দূর থেকে তোমায় দেখে আমি ভালো থাকবো। কখনো রোদের মাঝে বসবে না। তোমার একটা বদঅভ্যাস কি জানো? তুমি রোদ দেখলেই বসে পড়ো। একদম বসবে না। কালো হয়ে যাবে। আমার রাগান্বিতা কালো হোক এ আমি চাই না। তুমি সবসময় সুন্দর থাকবে। মাঝে মাঝে চুলে খোঁপা করে বেলিফুল লাগাবে, লালটুকটুকে শাড়ি পড়বে, লাল চুড়ি পড়বে তোমায় না লাল শাড়িতে দারুন লাগে। এত সুন্দর কেন লাগে? এই সুন্দর কি শুধু আমারই লাগে নাকি আরো অনেকের কাছেই লাগে। অবশ্যই লাগাতে দিবে না। মনে রাখবে তুমি শুধু আমার আর কারো না। শোনো না আমি চার লাইনের একটা ছন্দ সাজিয়েছি তবে তোমার জন্য নয় নিজের জন্য। রাগ করলে কি! অবশ্যই করবে না আমি জানি। আসলে কি বলো তো মাঝে মাঝে নিজেকে নিয়েও লিখতে হয়। যতই হোক রেশবপুরের সবচেয়ে সুন্দর রমণীটি ইমতিয়াজ সিকদারের প্রেমে পড়েছে এ কি চারটে খানে কথা বলো। ওসব বাদ দেও ছন্দটা শোনো,

গভীর রাতে, বিষাদ ঢুকেছে ঘরে,
কান্না ভেজা চোখে আমার তোমারে মনে পড়ে।”
কি দুঃখ! কি বিষাদ! কি নিদারুণ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে শরীর,
তবুও আমার খালি তোমারেই মনে পড়ে।

কি প্রেম ছিল সখি! দেখাইতে না পারিলাম তোমায় এ আফসোস আমার চিরকাল রবে। তোমার কথা ভাবিবার পরই আমার শরীর জুড়ে খালি রক্ত ঝরে।আমার খালি তোমারে মনে পড়ে।”

ক্ষমা চাইবো কি সখি! বুঝিতে পারি না আর।
এ কেমন যন্ত্রণা!
বিচ্ছেদের ছোঁয়ায় পুরো শরীর মোর একটু একটু করে যাচ্ছে মরে,
আমার খালি তোমারেই মনে পড়ে।”

আহ! কি লিখলাম বলো তো খালি আবোল তাবোল শব্দ যত। চারলাইন বলেছিলাম কত কি লিখে বসলাম। মুছতে ইচ্ছে করছে না থাকুক কেমন!

আচ্ছা শোনা না রাগান্বিতা। এতকিছু তো লিখে দিলাম। প্রেমপত্র দিলাম। হলো কি না জানি না। এবার বলো, আমায় ভালোবাসবে তো। যতই হোক আমি কি ভালো না বাসার মতো একজন মানুষ! অবশ্যই তোমার কাছে তা নই। আমায় কিন্তু ভালোবাসাই যাই। ভালোবাসার ক্ষেত্রে আমার কোনো খামতি নেই। আমায় নিয়ে হাজার অভিযোগ করবে আমি মেনে নিবো কিন্তু ভালোবাসার অভিযোগ আমি মানবো না। ভালোবাসি, ভালোবেসো, সঙ্গে ভালো থেকো কেমন!’

একটা ছোট্ট কবিতা লিখলাম। এ কবিতার কথাগুলো আমার আফসোসের একটুখানি পূর্ণতা হোক,

“আমাদের বহুদিন দেখা হবে না
যুগ পাল্টে যাবে,সময় বদলে যাবে
তবুও আমাদের দেখা হবে না।

টেলিফোনের যুগটিও বোধহয় যাবে বদলে
সময়ের সাথে সাথে মানুষও বদলাবে
কত মানুষ হারাবে, কত মানুষের জন্ম হবে
অথচ আমাদের দেখা হবে না।

গাছের পাতারা দিনে দিনে রঙ বদলাবে
কিছু গাছ মরে যাবে, কিছু যাবে ক্ষয়ে,
বৃক্ষের বীজ ভেঙে আবার নতুন বৃক্ষরা জন্ম নিবে। অথচ আমাদের দেখা হবে না।

কেন হবে না দেখা? প্রকৃতি এত নিষ্ঠুর কেন বলো! যদি পৃথিবী তার নিয়ম ভেঙে একটু অনিয়ম করে আর একটিবার আমাদের দেখা করাতো তবে কি জগতের কোনো ক্ষতি হতো? হতো বোধহয়!

আমার অন্তরে অন্তরে শুধু বিষাদের শোক
আমি মনের গহীন থেকে বলছি,
আমাদের আর একটিবার দেখা হোক!’

ইস! যদি একটু হতো…..

ইতি,
নিষ্ঠুর এক প্রেমিক পুরুষ
ইমতিয়াজ সিকদার।’

এই নিয়ে পঞ্চমবারের মতো চিঠিটা পড়ে। চিঠিটা বুকে জড়িয়ে ধরলো রাগান্বিতা। জোরে এক নিশ্বাস ফেললো।’

“আফা আমরা আইয়া পড়ছি”

হঠাৎই বাসের কন্ডাকটরের কথা শুনে তড়িৎ চমকে উঠলো রাগান্বিতা। দ্রুত নিজেকে সামলে বললো,“জি আচ্ছা।”

রাগান্বিতা বাস থেকে নামলো। আনমনাই হেঁটে মোটর গাড়ি ডাকলো। গাড়ি থামলো সে উঠে বসলো। গাড়ি চলতে শুরু করলো আবার। সময় যেন কেমন করে বদলে যায়। এই যে ঢাকার শহর দশবছরের কতটা বদলেছে। রাস্তাঘাটও বদলেছে শুধু বদলায় নি ইমতিয়াজের তৈরিকৃত বাড়ি। বাসস্ট্যান্ড থেকে ইমতিয়াজের বাড়ি আসতে প্রায় ঘন্টাখানেক লাগে।’

বেলা দেড়টা। রাগান্বিতা দাঁড়িয়ে আছে ইমতিয়াজের বাড়ির সামনে। চারপাশ নির্জীব আর থমথমে। রাগান্বিতা বাড়ির সামনে থাকা টবের নিচ থেকে চাবিটা নিলো। দুয়ার খুলে ভিতরে ঢুকলো। চারপাশ এলেমেলো ধুলোতে ভরপুর। রাগান্বিতা ভিতরে ঢুকলো পুরো বাড়িটায় একা একা হাঁটলো। শেষে গিয়ে থামলো নিচে টেবিলটার কাছে। টেবিলের একটু দূরেই একটা আলমারির মতো আছে সেটা খুললো। খুলতেই দেখা মিললো ইমতিয়াজের কিনে যাওয়া সেই টেলিফোনটা। সামনেই চিরকুটে লেখা,“শুধুমাত্র তোমার জন্য বউ।”

রাগান্বিতা চিরকুটে হাত বুলালো। পরমুহূর্তেই টেলিফোন উঠিয়ে আপনাআপনি বলে উঠল,“হ্যালো শুনছেন, আমি রাগান্বিতা বলছি।”

অপরপাশে কিছুই শোনা গেল না তবুও রাগান্বিতা একা মনে কিছুক্ষণ কথা বললো। তারপর পুনরায় যত্ন করে টেলিফোন চিরকুট রেখে দিলো। এটা প্রতিবছরই করে। তিনবছর আগে এগুলো দেখতে এসে কেঁদেছিল এখন আর কাঁদে না।

রাগান্বিতা দশমিনিটের মতো সেখানে থেকে কপাট আঁটকে আবার বেরিয়ে পড়লো। এই বাড়িতে এখন কেউ থাকে না। রবিন তার বউকে নিয়ে দূরে থাকে। ইমতিয়াজের ব্যবসায় বানিজ্য বন্ধ। ইমতিয়াজ নাকি রবিনের নামে ব্যবসা দিয়ে যায় কিন্তু রবিন তা রাখে না। বন্ধ হয়ে পড়ে আছে সব। রাগান্বিতা পুরো বাড়িটায় একবার চোখ বুলালো এই উঠানেই সে আর ইমতিয়াজ একসাথে সাইকেলে চড়ে ছিল। কি সুন্দর মুহূর্ত ছিল তখন। রাগান্বিতা ভাবলো না এগিয়ে গেল মৃন্ময়ীর কবরের দিকে। সেখানে গিয়ে কবরের দোয়া পাঠ করে বললো,“আপা আমার ভাইকে ক্ষমা করে দিয়েন। সে খুব অন্যায় করেছে আপনার সাথে। শাস্তিও পেয়েছে তবুও আপনি পারলে ক্ষমা করে দিয়েন তারে।” এমন অনেক কিছু বলে রাগান্বিতা বেরিয়ে গেল। ইমতিয়াজের কবুতরটা আর নেই। মারা গেছে। বাড়ি পিছনেই দাফন করা হয় তাকে। রাগান্বিতা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এখনও একটা শেষ জায়গায় যাওয়া বাকি তার। রাগান্বিতা নদীরঘাটে গেল। একটা বড়সড় ট্রলার তার একার জন্য নিলো। আসা যাওয়ার দুটোরই খরচ দিবে। সাথে এও বলে গিয়ে চারঘন্টার মতো তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তার বিনিময়ে যত খরচ লাগবে তাও দিতে প্রস্তুত। ট্রলার চালক রাজি হন রাগান্বিতা ট্রলার নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। উদ্দেশ্য একটাই জায়গার নাম “প্রেমনগর”! সেখানেই তার ইমতিয়াজ আছে।

প্রায় ঘন্টা চারেকপর রাগান্বিতা পৌঁছালো প্রেমনগর। কথা মতো ট্রলার চালকে চার ঘন্টা অপেক্ষা করতে বললো। সাথে এও বললো সে যেন ট্রলার থেকে না নামে। ট্রলার চালক রাজি হলো। রাগান্বিতা ট্রলার ছেড়ে অনেকটা দূরে আসতেই তার বোরকা হিজাব খুলে ফেললো। সে লাল টুকটুকে শাড়ি পড়েছে, খোঁপায় বেলীফুল লাগিয়েছে, হাতে লাল চুড়ি। রাগান্বিতা তার বোরকা ঘরের সামনে রেখে চলে গেল। সবটা আগের মতোই আছে ঘাটপাড়ে সেই নৌকা বাঁধা, শেওলায় ভরপুর। বাড়ির সামনে টিয়াপাখির সেই শূন্য খাঁচাটা পড়ে। রাগান্বিতার খারাপ লাগলেও কাঁদলো না। আচমকা কোথ থেকে যেন সেই টিয়া পাখিটা এসে বলে উঠল,“বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম!”

তড়িৎ চমকে উঠলো রাগান্বিতা। আনমনেই হেঁসে ফেললো। রাগান্বিতা সেই বাঁশি বাজার জায়গাটায় গেল সেখানে ইমতিয়াজের কবরখানা। রাগান্বিতা খালি পায়ে ভিতরে ঢুকলো। বেশি না ভেবেই কবরের পাশে শুয়ে পড়লো। মাথার নিচে হাত দিয়ে মিষ্টি সুরে বললো,“আমি কি খুব দেরি করেছি। করে নি বোধহয়।”

এসব বলে একা একা গল্প জুড়ে দিল রাগান্বিতা। তখন সন্ধ্যা হওয়ার নিভু নিভু আলো হচ্ছিল। মাঝ আকাশে পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছিল। আর একটা সুন্দরী রমনী, একটা কবরের পাশে শুয়ে শুয়ে গল্প করছিল। দূরের ডালে বসেছিল টিয়াপাখি বোধহয় সে সবটাই বুঝছিল। রাগান্বিতা গল্প করতে করতে হঠাৎ বলে উঠল,

“আচ্ছা আপনি তো আমার বাবা, ভাই, দাদিমা, বোন সবাইকে মারলেন সেই হিসেবে আমার উচিত ছিল আপনায় ঘৃণা করা অথচ আমি আপনায় ঘৃণা করতে পারি না। কেন পারি না বলুন তো।” পরমুহূর্তেই সে কেমন একটু করে বলে উঠল,
“মরা মানুষরে যদি আরেকবার ফিরাইয়া আনা যাইতো। তাইলে আমি পৃথিবীর সব চাইয়া সুখী মানুষ হইতাম! তাই না কও!”

সব চলতে থাকলো। সুন্দরী রমনী শুয়ে রইলো। কথা বলতে থাকতো একা একা। গাছের পাতারা নড়ছিল, আকাশটা লালচে হচ্ছিল। দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল একটি ট্রলার। রাগান্বিতা চোখ বন্ধ করে ফেললো। হঠাৎই তার মনে হলো কেউ বুঝি ফিস ফিস করে বললো,
“প্রিয় রাগান্বিতা। আমার রাগান্বিতা। তুমি শুধু আমার প্রিয় রাগান্বিতা।”

~ সমাপ্ত!’
——————
সাল ২০১৮! সিনেমা হলে তুমুল উত্তেজনা। সবার চোখে পানি। কি নিদারুণ যন্ত্রণার কাহিনি ছিল প্রিয় রাগান্বিতা। তাদের সবারই একটাই কথা যদি ইমতিয়াজ ফিরে আসতো। কেন এলো না ফিরে!ধীরে ধীরে সিনেমা হল খালি হলো সবাই চোখে পানি নিয়ে বেরিয়ে গেল। সিনেমাটি তাদের হৃদয় নাড়িয়ে দিয়েছে। ইমতিয়াজের বলা কিছু কথার মাঝে একটা কথাই বলছে সবাই। এই শহরে প্রেম মানেই মৃত্যু! কি বিষাদময় কাহিনি!

“সিনেমা তো শেষ এখনো বসে আছেন বাড়ি যাবেন না।”

আচমকা এক লোকের কণ্ঠ শুনে অষ্টাদশী এক মেয়ে ঘুরে তাকালো। চুড়িদার পড়া মেয়েটি। নাম তার রাগান্বিতা। রাগান্বিতা উঠে দাঁড়ালো। ঘোর তার এখনও কাটে নি কি ভয়ানক কাহিনি ছিল প্রিয় রাগান্বিতা। এই কাহিনি রাগান্বিতা এর আগেও শুনেছে। তার বাবা লিখেছেন। তার বাবার নাম ইলিয়াস বয়াতি। পেশায় ডাক্তার হলেও তিনি জীবনে একটি বই লিখেছেন যার নাম প্রিয় রাগান্বিতা। ইলিয়াস যে আসল রাগান্বিতার চিকিৎসা করে। ইলিয়াস সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে যে কাহিনি শুনেছে তা নিয়ে বই লিখবেন। কতজন পড়বে তা ঠিক না থাকলেও নিজের কাছে কাহিনিটি জীবন্ত রাখার জন্য তিনি বই বের করবেন। বইটি ১০ বছর আগে প্রকাশিত হয়। আর দশ বছর পর মুভি বের হয়। বইটা জনপ্রিয়তা পায়। বইয়ের শেষে তিনি রামুর নাম উল্লেখ করেন। বইয়ের শেষেও লিখে দেন। সাংবাদিকদের সাথেও বলেন, এই কাহিনি তার ডাক্তারি জীবনের সেরা কাহিনি ছিল। তাই তিনি এটার বই বের করার সিদ্ধান্ত নেন। ইলিয়াস এও বলেন তিনি বিয়ের করার পরই সিদ্ধান্ত নেন। তার ঘরে যে কন্যা সন্তান হবে তার নাম রাখবেন রাগান্বিতা। তাই রাখেন ইলিয়াসের বিয়ের দশ বছর পর রাগান্বিতার জন্ম হয়। সেই রাগান্বিতাকে তিনি আসল রাগান্বিতার মতোই তৈরি করেন। যদিও শুধু নাম দিলেই হয় না। তার মেয়েকে তিনি বার বার রাগান্বিতার কাহিনি বলেছেন, পড়িয়েছেন। আজ সিনেমাও দেখাতে পাঠিয়েছেন।

কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে একা একা হাঁটছে অষ্টাদশী কন্যা রাগান্বিতা। চোখে মলিনতা, কানে যেন বাজছে ইমতিয়াজের বলা কথা, আমাদের আবার দেখা হবে দেখে নিও। সত্যি কি এমনটা হয়! হয় না তো। হলে তো কবেই হতো। রাগান্বিতা তার বাবার মুখে শুনেছিল আসল রাগান্বিতাও নাকি আর নেই। কোনো এক নভেম্বরেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেনি নাকি। না হলে আসল রাগান্বিতার সাথে দেখা করা খুব ইচ্ছে ছিল তার। কি বিষাদ! রাগান্বিতার কোথাও কোথাও মনে হয়েছে। ওই কাহিনিতে বোধহয় সেই ছিল। তার পূর্বজন্মের কাহিনী। যদিও এসব বলতে কিছু নেই। তবুও তার মনে হয়েছে। বাবা প্রায় বলতো তাকেও নাকি কিছুটা আসল রাগান্বিতার মতো দেখতে। আচ্ছা তার নাম তো রাগান্বিতা। তাহলে তার মতো যদি কোনো পুরুষ এসে বলতো আমি ইমতিয়াজ। বেশ হতো। রাগান্বিতা হেঁসে ফেললো। প্রকৃতি সন্ধ্যা নামার মুখে। হঠাৎই আকাশ পথ গর্জে উঠলো। রাগান্বিতা চমকে উঠলো বোধহয় বৃষ্টি নামবে। তাই হলো। বলতে না বলতেই বৃষ্টি নামলো। রাগান্বিতা মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে কি করবে বুঝতে পারছে না। সে ছাতা আনে নি। হঠাৎই কোথা থেকে যেন একটা ছেলে এসে তার মাথায় ছাতা ধরলো। শক্তপক্ত কণ্ঠে বললো,“এই ভরসন্ধ্যা বেলা বৃষ্টিতে ভিজছেন কেন?”

রাগান্বিতা ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। গায়ে টিশার্ট, কালো প্যান্ট, চোখে চশমা,মাথায় ঝাকড়া চুল। রাগান্বিতা বিষম খেলো। ছেলেটি বললো,“কি হলো! কথা বলছেন না কেন?”

রাগান্বিতা অবাক চোখে বললো,
“কে আপনি?”

তখনই ছেলেটি মিষ্টি হেঁসে জবাব দিলো। বললো,
“আমি ইমতিয়াজ, ইমতিয়াজ সিকদার।”

#সমাপ্ত!
————————–

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-৪৯

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৪৯(শেষ অংশ)
________________
সাল ১৯৮০। ডিসেম্বর দশ। কনকনে শীতে পঞ্চমুখ সারা বাংলা। কুহেলিকার সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ এই শীতেই। তাকে পাঠানো প্রথম চিঠি।
“মেঘ করেছে মনের ভিড়ে,
তোমার তো দেখা নাই,
আমি তো এক নিস্তব্ধ মানুষ
তোমার খোঁজ কোথায় পাই?”
সে’বারই প্রথম ডাকপিয়ন তালুকদার ভিলায় যায় মৃত্যুর বার্তা নিয়ে। কুহেলিকার মৃত্যু। কুহেলিকাকে প্রায় চিঠি পাঠাতাম আমি। অদ্ভুত বিষয় কুহেলিকা প্রেরককে না দেখেই তার প্রেমে পড়ে যায়। লুকিয়ে রাখে ইমতিয়াজের পাঠানো সব চিঠি। কুহেলিকার কাছে ইমতিয়াজ ছিল আরফান মজুমদার। তাদের দেড় মাসের প্রেম আলাপ চলে। এরপর হঠাৎ একদিন ইমতিয়াজ জানে কুহেলিকা ঢাকার বাড়িতে আসছে তার মামার বাড়ি। তখনই ছিল সুযোগ কুহেলিকার সতিত্ব নষ্ট করার।

রাগান্বিতার মনে পড়লো কিছু সেই শীতে কুহু আপা বায়না ধরে সে ঢাকার বাড়িতে যাবে। মামাকে নাকি খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। কাজের সুবাদে রাগান্বিতার মামা স’পরিবার নিয়ে ঢাকা থাকতেন। রাগান্বিতা অজানা কারণে তাকে পছন্দ করতো না। কুহেলিকা সেই শীতে তাকেও সঙ্গে যাওয়ার কথা বলে ঢাকাতে কিন্তু সে রাজি হয় না। রাগান্বিতার আফসোস হলো সে কেন যায় নি। গেলে বোধহয় এতকিছু ঘটতো না। আবার মনে হয় বোধহয় সে যাবে না জেনেই যাওয়ার কথা বলেছিল কুহু আপা। রাগান্বিতা আবার চিঠি পড়তে শুরু করলো। ইমতিয়াজ লিখেছিল,

‘কুহেলিকা ঢাকা আসে। আমাদের দেখা হয়। কথা হয়। তোমার আপা আমাতে এতটাই মুগ্ধ ছিল যে আমার এক কথাতেই বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। যা ছিল তার জীবনের চরম ভুল। এটা ঠিক আমাদের বিয়ে হয়। মিথ্যে বিয়ে যার কোনো অস্ত্বিত্ব ছিল না। তবে তোমার আপার কাছে সেই সময় সবই সত্যি ছিল। তোমার আপাকে আমি কখনো স্পর্শ করি নি। তাকে আমি ছুঁতে দেয় নি নিজেকে। আমার স্পর্শ কেমন এটা তাকে কখনো বুঝতে দেয় নি আমি। কারন আমার পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। তোমার আপা জানতো না সে রাতের আধারে কার সাথে রাত্রিযাপন করতো। আরফান মজুমদার। এ নামের একজন সত্যি মানুষ ছিল। ছেলেটাও তোমার ভাইয়ের মতো নারীতে আসক্ত ছিল। সেই রাতে থাকতো তোমার বোনের কাছে। তোমার মামার বাড়ি গিয়েই লুকিয়ে রাতের আধারে রাত্রি যাপন করতো কুহেলিকার সঙ্গে আবার কুহেলিকার ঘুম ভাঙার আগেই চলে আসতো। ভাবো ঠিক কতটা নিকৃষ্ট ছিলাম আমি। একটা নিরীহ মেয়েকে অন্য একটা পুরুষ দিয়ে। ছিঃ। সেসময় আমি প্রতিহিংসা নিয়ে এতটাই জর্জরিত ছিলাম ভুল জেনেও সে কাজই করি বারংবার। অবশ্য একে ভুল বলে না বলে অপরাধ।

প্রতি রাতেই তোমার বোনের চোখ কাপড় দিয়ে বন্ধ থাকতো। এ তো ইমতিয়াজেরই একটা কথা ছিল। তোমার বোন সবটা অন্ধের মতো বিশ্বাস করে মেনে নিতো। ঠিক কতটা ভালোবাসতো সে আরফান মজুমদারকে। সময় চলতে লাগলো শীত শেষে গরমের ছোঁয়া তখন মৃদু মৃদু আসছে। হঠাৎ কুহেলিকা বুঝতে পারে সে মা হয়ে চলেছে। তক্ষৎনাৎ সে চিঠি লেখে ইমতিয়াজ মানে আরফান মজুমদারকে। আর আরফান মজুমদার সে তো দিব্যি খুশি সেই চিঠি পেয়ে। ব্যস! সে’বারই চিঠি লিখে বসে তাদের সম্পর্ক ছিল মিথ্যে, বিয়েটাও ছিল মিথ্যে, শুধুমাত্র কুহেলিকার শরীর ভোগ করার জন্য এতকিছু করে আরফান মজুমদার। চিঠি পেয়ে তোমার বোন ভেঙে পড়ে ওদিকে বাড়িতে তোমার বাবা তার জন্য ছেলে দেখছেন। শেষে কোনো উপায় না পেয়ে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। কুহেলিকার কাহিনি এখানেই শেষ। তার সাথে রাতযাপন করা আরফান মজুমদারকেও আমি মেরে ফেলি। কারণ প্রমাণ রাখা যাবে না। এরপরই ঘটে গেল আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনা। প্রেমের মতো ভয়ংকর কিছু পা দিয়ে ফেলার ঘটনা। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমার তোমাকে দেখতে যাওয়াই ছিল আমার বিরাট ভুল। তোমার বোন যেমন আমায় না দেখেই প্রেমে পড়ে ভুল করেছিল আমিও তেমন তোমায় দেখতে গিয়ে ভুল করেছিলাম। কল্পনা অনুযায়ী কুহেলিকার মৃত্যুর সাতদিনের মাথাতেই আমি যাই রেশবপুরে। উদ্দেশ্যে একটাই তালুকদার ভিলার শেষ ধ্বংসটা নিজ চোখে দেখা।”

সময়টা তখন সন্ধ্যা। আচমকাই তোমাদের বাড়ির সেই গাছতলায় বসে বাঁশি বাজাতে শুরু করি। এটা নিছকই শখ ছিল। আমি বুঝেনি তুমি তখন আসবে। আমি বাঁশি বাজাতে বাজাতে ভাবছিলাম তোমার জন্য আমি কি হবো আরফান মজুমদার তো হওয়া যাবে না অন্যকিছু হবো তবে ইমতিয়াজ সিকদার নয়। এক যুক্তিযুক্ত সুন্দর নাম খুঁজছিলাম তখন। ঠোঁটে ছিল বাঁশির সুর। ঠিক সেই মুহুর্তেই হঠাৎ কে যেন শক্তপক্ত কণ্ঠে এসে বললো,“কে! কে ওখানে?”

এটা তার প্রথম কথা ছিল। যার উত্তর আমি দেই নি দ্বিতীয় কথা ছিল,“এই ভর সন্ধ্যাবেলা বাঁশি বাজাচ্ছেন কেন?”

এবার উত্তর দেই। তার তিন নাম্বার প্রশ্নের বেলায় যখন আমি তার দিকে উঠে তাকায়। তুমি বিশ্বাস করবে না বউ,“তোমারে দেখিলাম না যেন আমার সর্বনাশ হইয়া গেল!”

কি অপরূপ সেই রমণী। ডাগর ডাগর গাড়ো কাজলে ঘেরা আঁখিযুগল। চোখে ভয়ানক তেজ। তার চোখ দেখেই মনে হয়েছিল আমি শেষ, আমি নিঃস্ব। তাকে দেখেই শুরুতেই ভুল করে বসি। তার কে আপনি? প্রশ্নের জবাবে বলে ফেলি নিজের আসল নাম, ‘আমি ইমতিয়াজ, ইমতিয়াজ সিকদার’। অথচ কথা ছিল আমি তার কাছে ইমতিয়াজ সিকদার হবো না। হবো অন্যকিছু! যেখানে শুরুটাতেই ভুল ছিল সেখানে শেষটা কি করে পরিপূর্ণ হতো বলো। তোমায় দেখেই আমি বুঝেছিলাম তুমিই রাগান্বিতা কারণ তোমায় আমি আগে না দেখলেও তোমার সম্পর্কে অনেকটাই জেনেছিলাম। কল্পনায় কিছু সাজিয়েও ছিলাম কিন্তু তুমি ছিলে আমার কল্পনারও অধিনে।’

কুহেলিকাও যথেষ্ট অপরূপ সৌন্দর্য্যের অধিকারী ছিল কিন্তু রাগান্বিতার মাঝে যে ভয়ানক এক চাহনী ছিল তা এক নিমিষেই আমার হৃদয়হরণ করে নেবার মতো দৃষ্টি। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়,“তোমার মতো রূপবতী মেয়েদের বুঝি আমার মতো নিষ্ঠুর মানুষদের ধ্বংস করার জন্যই জন্ম হয়।” না হলে আমি তো গিয়েছিলাম খুন করতে, নিজে খুন হতে নয়।’

তবুও নিজেকে সামলেছি। তোমার মায়া থেকে বহুবার নিজেকে আঁটকে রাখতে চেয়েছি। বার বার নিজেকে বুঝিয়েছি এ শহরে প্রেম মানেই মৃত্যু। তবুও আমি ব্যর্থ। প্রকৃতিও বুঝি আমার ধ্বংসই চেয়েছিল। সে রাতেই আমি খুন করে বসি মুরতাসিন নামক এক ছেলেকে। যার সাথে আমার কোনোকালেও কোনো যোগাযোগ ছিল না। তারই রক্ত দিয়ে আমি তোমায় চিরকুট পাঠায় “সে নিষিদ্ধ ছিল”! এই খুনটা করার কোনো পরিকল্পনাই আমার ছিল না। কিন্তু তোমার সাথে দেখা করার পর ফেরার পথে আমার দেখা হয় মুরতাসিনের সাথে। হাঁটার দেখাদেখি শুধু। তখন মোকলেস বলে, “জানো ইমতিয়াজ ভাই এই পুলাডা রাগান্বিতা আফারে খালি বিরক্ত করে হেইদিন দেহি রাগান্বিতা আফা নাইতে গেছে হেও পিছন পিছন যায়।” ব্যস মোকলেসের এতটুকু কথা শুনেই আমার মস্তিষ্ক এলেমেলো হয়ে যায়। এমন রাগ হয় মনে হয় তুমি আমার সম্পত্তি, তোমার ওপর অধিকার শুধু আমার আর কারো নয়। সে রাতেই খুন করে বসি মুরতাসিনকে। ওকে মেরে ঝুলিয়ে রাখি ওই বড় গাছের সাথে। তখন তোমাদেরই গ্রামের একটা ছোট বাচ্চা ছেলে দেখে ফেলে অন্ধকার থাকে বিধায় আমার চেহারা দেখে নি। তবে ছেলেটির বাবা তা চেপে গিয়ে তার মেয়ের জুতো হারিয়ে গেছে এমন কিছু একটা বাহানা দেয়।’

তোমার ভাইয়ের মাথায় আঘাতটাও আমি করি। তাকে দেখলেই রাগ উঠতো। তাই মেরে বসি সেদিন। তুমি হয়তো খেয়াল করো নি তোমার ভাইয়ের সাথে আমার যতবার দেখা হয়েছে ততবারই আমার হাতের মুঠো শক্ত ছিল। মুখে হাসি থাকলেও ভিতরে ছিল বিক্ষোভ। তোমার বাবা মুরতাসিনের খবরাখবর বলতে আমায় ডাকলেন এই প্রথম সাক্ষাৎ তোমার বাড়ি আর তোমার বাবার সঙ্গে। অচেনা মানুষ। তবুও চেনা ছিলাম কুহেলিকার জন্য।

আমি তোমায় চিঠি পাঠাতাম। আমাদের নানাভাবে আলাপ হতো। কখনো নৌকা চড়ে, কখনো বাঁশির সুরে গাছের নিচে পাশাপাশি বসে। তোমার নামের চিঠির শেষে লেখা থাকতো নিষ্ঠুর এক প্রেমিক পুরুষ। আমি ভেবেছিলাম তুমিও কুহেলিকার মতো চিঠির প্রেমে পড়বে। কিন্তু তুমি তা পড়লে না। করলে কি সারাগ্রাম বাসির হাতের লেখা পরীক্ষা করে বসলে তোমার বাবাও জেনে বসলো চিঠির কথা। তিনি তোমার বিয়ে ঠিক করলেন। এ ছিল আমার পরিকল্পনার বাহিরে। এখন নিশ্চয়ই ভাবছো চিরকুট চিঠি যেহেতু আমিই লিখেছি তবে হাতের লেখা কেন মেলে নি। আমার একটা প্রতিভা ছিল তা হলো আমি মানুষের হাতের লেখা দেখে হুবহু লিখে ফেলতে পারতাম। কুহেলিকাকে যে হাতের লেখা পাঠাতাম ভুলবশত সেই হাতের লেখা দিয়ে ফেলি সেদিন। বুঝতে পারি নি তোমায় দেখলেই কেমন ঘোরে হারিয়ে যেতাম। সবই ঠিক ছিল। কারণ কুহেলিকাকে শেষ করার আগে আমি সবই নিজের কাছে আনি কিন্তু কোনোভাবে হয়তো একটা থেকে যায় আর ওই একটাই আমার ধ্বংসের সূচনা হয়। তবে সামলে নিয়েছিলাম। আরফান মজুমদার আমার বন্ধু বলে কাটিয়ে দিলাম। তুমিও বিশ্বাস করে নিলে। এটা তো পরের কথা ছিল।

তোমার বাবাও বোধহয় কুহেলিকা চিঠি পেত এটা জেনে যায় তুমিও পাচ্ছো উনি ঘাবড়ে গিয়ে বিয়ে ঠিক করেন। মাহাদ, মাহাদকে আমিই পাঠিয়েছিলাম তোমায় বিয়ে করাতে। কথা ছিল বিয়ের পর বাসর রাতেই তোমায় খুন করবে কিন্তু হলো না। কোনোভাবে তোমার ভাই বুঝে ফেলে মাহাদই বোধহয় মৃন্ময়ীর ভাই। কিন্তু এটা মিথ্যে ছিল। কিভাবে ধরলো জানা নেই। তোমার ভাই ইমতিয়াজকে চিনতো না। নামও জানতো না শুধু জানতো মৃন্ময়ীর একটা ভাই আছে। মাহাদকেই সেই ভাই ভেবে বসে। বিয়ের দিন রেজওয়ানই মাহাদকে গুম করে। তারপরের টা তো জানোই। আমি বাধ্য হয়েই তোমায় বিয়ে করে করতে চাই। তোমার বাবাও রাজি হয় পরিস্থিতিই এমন ছিল। তোমার ভাই জানলোই না যার হাতে বোনকে দিচ্ছে সেই আসল শক্র।’

মনে মনে তোমায় দেখে আকৃষ্ট হলেও ভিতরে একটাই ইচ্ছে ছিল তোমায় খুন করা। মাহাদকে দিয়ে হবে ভেবেছিলাম কিন্তু তার আগেই রেজওয়ান ওকে মেরে ফেলে। বিয়ের দিন তোমায় যেমন কাটামিশ্রিত গোলাপ দিয়েছিলাম, কুহেলিকাকেও দিয়েছিলাম। কুহেলিকা কাটার আঘাত সইতে পারে নি তুমি সয়ে নিয়ে ছিলে। আমি বুঝে ছিলাম তুমিও আমার মতো প্রথম দেখায় আমাতে মুগ্ধ হয়েছো। এ বিষয়ে আমার ধারণা নেই ঠিক কি দেখে তুমি আমাতে মুগ্ধ হয়েছিলে। তবে ইচ্ছে ছিল একদিন বিকেলে চা খেতে খেতে প্রশ্ন করবো, কিন্তু তা আর হলো না।

আমাদের বিয়ে হলো। তোমায় নিয়ে ঢাকায় এলাম। জাহাজে বসেও তোমায় মারার সুযোগ ছিল কিন্তু মারতে পারি নি। আমি প্রতি রাতেই ভাবতাম তোমায় খুন করবো কিন্তু পারি নি। তুমি আমাতে এতটাই মুগ্ধ ছিলে, আমার ওপর তোমার এত বিশ্বাস ছিল যা আমায় একবারও তোমায় মারতে দেয় নি। কুহেলিকাও আমায় বিশ্বাস করেছিল তবু্ও তাকে মেরেছি কিন্তু তোমায় কেন পারছি না। এসব ভেবে আমি কেমন একটা হয়ে যাচ্ছিলাম। বোনের কবরটা দেখলেই আমি ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাই। তুমি সেদিন রাতে রবিন চাচার সঙ্গে যার কণ্ঠ শুনেছিলে সে আমিই ছিলাম। কবরটাও আমার বোন মিনুর ছিল। রবিন চাচার আম্মার নয়। তোমার কণ্ঠ পেতেই সেদিন আমি ছুট্টে আসি তুমি যতক্ষণ রবিন চাচার সঙ্গে কথা বলেছিলে সেই সুযোগ আমি বাড়ি আসি। তোমায় খুঁজতে ছিলাম এমন বাহানা দেই।

এরপর আমরা রেশবপুরে গেলাম তারপর জানলাম দাদিমা নাকি তোমার সেই শাপলারসাজ নিয়ে ভয় পেয়েছিলেন। আমি বুঝেছিলাম উনি বোধহয় কিছু জানেন। কুহেলিকাকে আমিই শাপলার অলংকার পাঠিয়েছিলাম। দেখা হয় নি তবে পাঠিয়ে ছিলাম। সেজেছিল নিশ্চুই আর দাদিমা দেখেন তা। আমার ভয় হলো তুমি কিছু জেনে যাবে। সে রাতেই আমি দাদিমার কক্ষে কিছু খুঁজবো ভেবেছিলাম। কিন্তু যাওয়ার পথে দেখা হয় রেজওয়ানের বন্ধু মনজুর সাথে। সে কি নিয়ে যেন জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে আমি তার পিছু নেই তখনই দেখি জঙ্গলের মধ্যে সুরঙ্গের মতো বানিয়ে হাজারো বেআইনি অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে তোমার ভাই। আমি যখন ফিরবো তখনই মনজুর সাথে দেখা হয় আমার। ও ঘাবড়ে যায় আমায় দেখে। দুজনের মধ্যে দস্তাদস্তি হয়। তখনই ও ভাড়ি কিছু দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করে। আমিও তখন কি দিয়ে যেন ওকে মারি পাশেই নদী ছিল আমি বুঝতে পারি নি ও পরে যায়। আমিও নিচে লুটিয়ে পড়ি। মনজু সাঁতার জানলেও বোধহয় আমার ওকে আঘাত করার কারনে সাঁতরে তীরে আসতে পারে নি। ও মারা যায়। তোমার ভাই ওর নিখোঁজে বিপাকে পড়ে। কারণ ওর বেআইনি ব্যবসার বেশিরভাগ হিসাবনিকাশ কোন সুরঙ্গের কোন চাবি সবই মনজু জানতো। তাই ওকে তখন চিন্তিত দেখাতো। বন্ধুর হারানোর শোকে নয় তার ব্যবসা বিপদগ্রস্ত হচ্ছে সেই শোকে। এসব আমি পুলিশকে বলে যাবো ওনারা বেআইনির সব অস্ত্র উদ্ধার করে নিবে। আমরা রেশবপুর থেকে ফিরে এলাম। দিনে দিনে তোমার ওপর আমার আসক্তি আরো বাড়ে। তুমিহীনা বাঁচা কঠিন। ভয় হতে শুরু করে যদি তুমি সবটা জেনে যাও। তোমার জানার অন্যতম মাধ্যম ছিল আমার সেই দোতালার তালাবদ্ধ ঘর। কারন সুরঙ্গে যা ছিল তার সবটাই আগে এই তালাবদ্ধ ঘরে থাকতো। তাই সেখানের সব সরিয়ে বাড়ির পিছনে সুরুঙ্গের মতো বানাই তাও তুমি দেখে ফেললে।

যেসব রাতগুলোতে তুমি দেখেছিলে আমি তোমার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি সেই সব রাতেগুলোতেই আমার হাতে ধারালো অস্ত্র ছিল। আমি প্রতিবার ভেবেছি তোমায় খুন করবো। গলার কাছে কতবার ছুরি ধরেছি কিন্তু পারি নি। তোমার ঘুমন্ত মুখখানা দেখলেই আমি কেমন হয়ে যেতাম। খালি খালি লাগতো নিজেকে। এরপর তোমার থেকে দূরত্ব রাখা শুরু করি। তুমি আমার অবহেলা নিতে পারতে না। কাঁদতে। তোমার কান্নাও আমার সহ্য হতো না। আমি কি করবো ভেবে পাই না। চারপাশ খালি কেমন লাগতো! জানো যে রাতে আমি তোমায় জড়িয়ে ধরে বসেছিলাম একটু শান্তি শান্তি লাগছিল। কিন্তু পরে আবার সেই অশান্তি। আমি বুঝেছিলাম তোমায় খুন করা আমার কাম্য নয়। তোমায় খুন করার চেয়ে আমার নিজেকে খুন করাটা সহজ লেগেছিল। এরপরই সিদ্ধান্ত নেই প্রেমনগর যাবো। কিছুদিন সব ভুলে ভালো থাকবো। আমার জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠদিন ছিল প্রেমনগরের ওই সাতটা দিন। তোমায় খুব ভালোবাসি বউ। যতটা ভালোবাসলে নিজেকে খুন করার মতো সিদ্ধান্ত নেয়া যায় তার থেকেও বেশি ভালোবাসি। তুমি আমার জন্য কি ছিলে তা যদি তোমায় বোঝাতে পারতাম।’

প্রেমনগর থেকে ফিরে এসে তুমি জানো দাদিমা অসুস্থ, ওনার অসুস্থতার কারণও আমি ছিলাম। সেদিন ঘাটপাড়ে আমার কথাতেই মোকলেস একটা মাকড়সা রাখে, দাদিমা তা দেখে ভয়ে পানিতে পড়ে যান। ভেবেছিলাম পানিতে পড়ে মারা যাবেন কিন্তু না কোন এক মহিলার জন্য বেঁচে যান হয়ে যান অসুস্থ। ভয়টা এতটাই পেয়েছিলেন যে পড়ে মারা যান। দাদিমার মৃত্যুতে তুমি আমায় ধরে যখন কাঁদলে আমি তখন অনুভব করি আমি ভুল করেছি প্রতিহিংসার চাপে পড়ে দুটো মানুষকে খুন করে আমি ভুল করেছিলাম। কুহেলিকাকে মারা আমার ঠিক হয় নি। কিন্তু যতদিনে বুঝেছি ততদিনে সব শেষ।

“আমি একটা মানুষের সাথে বাঁচার জন্য তিনটা মানুষকে খুন করলাম তবুও বাঁচতে পারলাম না। এ আফসোস আমার আজীবন রয়ে যাবে বউ।”

দাদিমাকে মেরেছিলাম ভয়ে তুমি জেনে যাবে এই ভয়ে। ওনায় মারার পর সিদ্ধান্ত নেই আমি রেজওয়ানকে মেরে ফেলবো ওর আবার বিয়েও ঠিক হয় আমি চাই নি ওই মেয়েটা একটা নিকৃষ্ট জীবন পাক। ভেবেছিলাম ওকে মেরে তোমায় নিয়ে ভালো থাকবো। শান্তি মতো বাঁচবো। বোনের স্বপ্নে রাতে ঘুম হতো না আমার কতরাত নির্ঘুম কাটিয়েছি তার হিসাব নেই। রেজওয়ানকে মারবো এটা ভেবেই যেন প্রশান্তি পেয়েছিলাম। একটা মানুষকে খুন করার কি যে শান্তি অনুভব হয় সেদিন রাতে জানো না। সে রাতেই তোমায় নিজ হাতে খাইয়ে দেই। সেই রাতেই আমি তোমার জন্য টেলিফোন কিনি। উপহার হিসেবে দেয়ার ইচ্ছে ছিল। শুনেছিলাম মেয়েদের টেলিফোনের কণ্ঠস্বর নাকি মধুর শোনায়। তোমার কণ্ঠ এমনিতেই মধুর ছিল তাও টেলিফোনে কেমন কণ্ঠ হয় জানার খুব ইচ্ছে ছিল। হলো না আফসোস থেকে গেল।’

কে জানতো এভাবে সবটা এলোমেলো হয়ে যাবে। রেজওয়ানকে মারার সময় ছিল মাগরিবের নামাজের ওয়াক্ত। তোমায় বাবা বেরিয়ে যান নামাজের জন্য সেই সুযোগ আমি বাড়ি ঢুকি রেজওয়ান বের হবে তার আগেই তার বুকে ছুরি চালাই। হতভম্ব সে। তখনই বলে ফেলি আমি মৃন্ময়ীর ভাই। মনে পড়ে কিছু। ও হতভম্ব হয়ে যায় আরো। বাঁচিয়ে রাখার জন্য অনুরোধ করে কিন্তু শুনি নি। নৃশংসভাবে ওকে খুন করি। আমি বুঝে নি তোমার বাবা এসে পড়বেন। খুব জোর চশমা ফেলে গেছিলেন তিনি। ওনাকে দেখে আমার মাথা এলেমেলো হয়ে যায়, তোমায় হারানোর ভয় জাগে আরো। শেষে গিয়ে কিছু বুঝতে না পেরে ওনার গলায় পোঁচ দিয়ে বসি। তখনই তুমি হাজির এক নিমিষে সব শেষ। তোমার হাতে কুহেলিকার চিঠি। আমি বুঝেছি তুমি সব জেনে গেছো।

যাকে হারানোর ভয়ে আমি তিনটা খুন করলাম সেই হারিয়েই ফেললাম। তোমার চোখে সেই ঘৃণা আমায় এক নিমিষে ধ্বংস করে দিলো। আমি যখন ছুরি ফেলে বেরিয়ে আসি। চারপাশে একটা কথাই বাজছিল “আমাদের আর মিলন নেই।”

এমনটা কেন হলো বউ! আমি তো এমনটা চাই নি। এত ছোট কেন ছিল আমাদের গন্তব্য আর একটু বড় হতে পারতো না। তুমি এগুলো কোনোদিন জানতে না, এটা হতো না। আজ নয় কাল ঠিকই জানতে তবে এত দ্রুত জেনে যাবে এমনটা চাই নি। কেন জানলে বউ, কেন জানলে। আমি তোমায় নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম। আমার জীবনটায় আফসোস ছিলো খালি, আমি জীবনে কিছু হতে পারি নি। না পারলাম ভালো ছেলে হতে, না পারলাম ভালো ভাই হতে আর না পারলাম ভালো স্বামী। আমি মন থেকে চাইবো আমাদের আবার দেখা হোক। সেই দেখাতেও তুমি আমার হও। আমি তখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বামী হয়ে দেখাবো তোমায়।

রাগান্বিতার চোখ ভেসে আসলো টপ টপ করে পানি পড়ছে চোখ বেয়ে। কাগজের অংশও ফুলে আছে ইমতিয়াজও বুঝি কেঁদে ছিল এখানে। রাগান্বিতা পড়তে লাগলো,

আমাদের দেখা হওয়ার কথা ছিল না তাও হলো। বিয়ে হলো, ভালোবাসাও হলো, বিচ্ছেদ কেন হলো বউ। আর একটু সময় কি আমরা একসাথে থাকতে পারতাম না। তুমি তো সব জেনেছো এখন মানতে পারতে কি আমায়। পারতে না যতই হোক আমি তিনটি নিরীহ মানুষকে মেরে ফেলেছি তোমার আপা,তোমার দাদিমা আর তোমার বাবা। এরা নির্দোষ ছিল। আমার কষ্ট হচ্ছে বউ। আমি জানি তুমি আমায় খুুন করতে আসবে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তুমি আমায় মারতে না পারলেও আমি নিজেকে মেরে ফেলবো। প্রতিহিংসা নিয়ে বাঁচা যায় না বউ। আমি পারি নি তুমিও পারতে না। আমি জানি তুমি আমায় আঘাত করতে পারবে না। তাই আমি নিজেই নিজেকে আঘাত করবো ভেবেছি। বাবার সেই রাজকীয় তলোয়ারই হবে আমার শেষ মৃত্যুর অস্ত্র। আমরা আর একবার মুখোমুখি হবো তারপরই সব শেষ। আমি চরিত্রহীন ছিলাম না বউ। আমি তুমি ব্যতীত কাউকে ছুঁই নি। কুহেলিকার সন্তানের বাবা আমি ছিলাম না তবুও তার চোখে আমিই কলঙ্কিত।’

আমি তোমায় ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি,কেন বাসলাম এত ভালো। তুমি কি আমায় ভুলে যাবে অবশ্যই ভুলবে না। আমি ভুলতে দিবো না। আমার মৃত্যু হলেও তোমার আমার থেকে মুক্তি নেই।

তোমার তো বৃষ্টি পছন্দ
আমি না হয় মেঘ হবো;
তোমার তো সমুদ্র পছন্দ
আমি না হয় ঢেউ হবো;

তবুও তোমায় ভুলতে দিবো না
আমি যে শুধু তোমারই রবো।’

আমি পাপী ছিলাম সত্য। তবে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা মিথ্যে ছিল না। আমায় কোনোদিন ভুলে যাইও না। আমি ফিরবো বউ, আজ হোক কাল আমাদের দেখা হবে। হয়তো এভাবে নয় অন্যকোনো রূপে তবুও আমাদের দেখা হবে দেখে নিও। দেখা হবেই। আমার হৃদয়খানা যন্ত্রনায় ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাক,তবুও তুই রাগান্বিতা আমার হয়ে থাক। রক্তমাংস মাটিতে গিলে খাক। তবুও সারা শরীর জুড়ে শুধু তোমারই গন্ধ থাক।’

ইতি,
ইমতিয়াজ সিকদার।

শেষটা পড়েই রাগান্বিতা জ্ঞান হারায় সে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যায় নিচে। যখন জ্ঞান ফেরে তখন তার মানসিক ভারসাম্য নেই। সে সব ভুলে যায়। মনে থাকে শুধু দুটো জিনিস। যার একটির নাম ছিল ইমতিয়াজ সিকদার আর দ্বিতীয়টি তার বলা একটি কথা, “আমি ফিরবো বউ, আমি ফিরবো। দেখে নিও আমাদের আবার দেখা হবে।”

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#TanjiL_Mim♥️

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-৪৮

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৪৮(প্রথম অংশ)
________________
স্তব্ধ চারপাশ। ছ্যাত ছ্যাত শব্দ করে গাছের পাতা নড়ছে। রাগান্বিতা এখনও পাথর হয়ে বসে ইমতিয়াজকে বুকে জড়িয়ে। ঘন্টা দুই তো হবেই ইমতিয়াজ মারা গেছে। তার নিশ্বাস চলছে না। রবিন দুয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে, চোখ বেয়ে অজস্র পানি পড়ছে। শেষমেশ তাই ঘটলো পোলাডা যা ভাবছিল! রবিনের গোংরানির শব্দ কানে আসতেই রাগান্বিতা রবিনের দিকে তাকিয়ে বললো,“হুস কাঁদে না। আমার ইমতিয়াজের কিছু হয় নি।”

রবিনের অন্তর দিয়ে যেন আরো কঠিন ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। রাগান্বিতা কথাটা বলেই আবার কেঁদে ওঠে। নয়নে ভরা অশ্রু নিয়ে বলে,“চাচাজান আমার ইমতিয়াজ শেষমেশ মইরাই গেলো।”

ইস! কি যন্ত্রণাদায়ক লাগলো কথাটা রবিন চাচার বুকে। কি উত্তর দিবে তিনি রাগান্বিতার। মিনিট পাঁচ যেতেই পুলিশ আসলো। তারা ইমতিয়াজকে নিয়ে যাবে। রাগান্বিতা নিতে দিবে না। তার একটাই কথা, সে ইমতিয়াজকে নিতে দিবে না। কিন্তু পুলিশ শুনলো না রাগান্বিতাকে ছুঁতে যাবে। তার আগেই রবিন চাচা বারণ করলেন। তারা থেমে যায়। রবিনের বউ আসে রাগান্বিতাকে ধরে। পুলিশ টেনে ছিঁচড়ে ইমতিয়াজকে নিয়ে গেল। রাগান্বিতা চিৎকার দিয়ে কাঁদলো। বললো,“আমার ইমতিয়াজকে নিবেন না।”

রবিন কাঁদলো। তার বউও কাঁদলো রাগান্বিতাকে ধরে। রাগান্বিতা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,“চাচি আম্মা আমার ইমতিয়াজরে রাইখা যাইতে কন!”

চাচি কি বলবে ভেবে পায় না। সময় গড়ায় ইমতিয়াজ চলে যায়। হঠাৎই বাতাসের ধাক্কায় টেবিলের উপর থেকে একটা চিরকুট পড়ে। যেখানে লেখা ছিল,“আমি তোমাকে খুন করতে এসে, নিজেই খুন হয়ে গেলাম বউ!”

রাগান্বিতা চিরকুট জড়িয়ে ধরে কাঁদে নিরালায় উঠে দাঁড়ায়। টেবিলের কাছে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। চাচা চাচি তখন নিচে। রাগান্বিতা ভাবে কাঁদছে কেন? তার তো কাঁদার কথা নয়। গত তিনটে দিন সে নিজেকে বুঝিয়েছে যাই হোক না কেন সে কাঁদবে না। অথচ সে কি না পাগলের মতো কাঁদছে। ইমতিয়াজ নেই ভাবতেই পারছে না। অথচ রাগান্বিতা এসেইছিল ইমতিয়াজকে খুন করতে। খুনটা তার করার কথা ছিল কিন্তু ইমতিয়াজ নিজেই নিজেকে মেরে ফেলেছে ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে রাগান্বিতার। রাগান্বিতা জোরে জোরে নিশ্বাস ফেললো। হঠাৎ তার চোখ যায় কালো রঙের ডাইরিটার দিকে। ইমতিয়াজের ডাইরি। রাগান্বিতা পৃষ্ঠা উল্টায়। একদম শেষের পৃষ্ঠায় লেখা থাকে। তোমার যত কৌতুহল, যত যা জানার ইচ্ছে সব আমি পাতাল সেই কক্ষে রেখে যাচ্ছি। সময় করে পড়ে নিও কেমন! এবারের মতো বিদায় বউ, তবে আমি চাইবো আমাদের আবার দেখা হোক। ভুল করে হলেও আমাদের আরেকবার দেখা হোক। এ জন্মে না হোক পরজন্মে। আমি জানি এ চাওয়ার কোনো অর্থ নেই। তবুও আমি চাইলাম। পাবো না জেনেও চাওয়ার মাঝে একটা শান্তি আছে। আমি সেই শান্তি নিয়ে গেলাম। তুমি খুব ভালো থেকো।”

ইতি,
~ তোমার নিষ্ঠুর এক প্রেমিক পুরুষ
“ইমতিয়াজ সিকদার”

রাগান্বিতা ইমতিয়াজের ডাইরিটা বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। তার আপন বলতে কেউ রইলো না। এ জীবনে তবে কি রইলো তার। কেউ না।”
—–
নিশিরাত। গা ছমছমে পরিবেশ তখন। ইমতিয়াজের পুরো বাড়িটা তখন নির্জীব। ইমতিয়াজ নেই, আর আসবেও না। রাগান্বিতার আর অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে যাবে না। কেউ ঘুম থেকে জাগিয়ে বলবে না ‘বউ, উঠো দ্রুত খাবে জলদি’। হঠাৎই রাগান্বিতার কি যেন মনে পড়লো ইমতিয়াজ তাকে সেদিন খাবার খাইয়ে দেয়ার রাতে কি যেন বলেছিল। একটু চিন্তা করতেই মনে পড়লো রাগান্বিতার ইমতিয়াজ তাকে বলে ছিল,শোনো না বউ কাল তোমায় একটা উপহার দিবো বিশেষ উপহার।”

কিন্তু সেই কাল তো আর এলো না কি দিতে চেয়েছিল ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা উঠে দাঁড়ালো। নিজেকে কেমন যেন লাগছে। তার শরীরে এখনো ইমতিয়াজের গায়ের রক্ত মাখানো। রাগান্বিতা এলেমেলো পায়ে হেঁটে গেল বাহিরে। গায়ের গহনাগাঁটি সব এলেমেলো ভাবে পড়ে রইলো নিচে। খোঁপা চুল খুলে গেছিল। চাচি কোনোরকম বেনুনি করে দিয়েছে। রাগান্বিতা এলেমেলোভাবে চললো। সদর দরজা খুললো। চাচি দেখলো রাগান্বিতাকে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,“কই যাও?”

রাগান্বিতা এক নির্বিকার চোখে তাকায় চাচির দিকে। তবে কিছু বলে না নিজ মনে চলে যায়। চাচির বুকটা দক করে ওঠে সেই মিষ্টি স্বভাবের রূপসী মেয়েটা কেমন হয়ে গেল। বড্ড মায়া লাগছে চাচির। তিনি শাড়ির আঁচল মুখে চেপে কাঁদলেন।

রাগান্বিতা হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে সেই পাতালকক্ষের দুয়ারের কাছে। এই কক্ষই যেন তার পুরো জীবনটা তছনছ করে দিলো। কিন্তু কি করার সত্য তো সত্যই আজ নয় কাল তা প্রকাশ পেতই। কতকাল আর লুকিয়ে রাখতো ইমতিয়াজ। জোরে নিশ্বাস ছাড়লো। রাগান্বিতার আন্দাজ অনুযায়ী এই কক্ষ এখন খোলা। রাগান্বিতা নিচে বসে ডালপালা সরালো। ভাবা অনুয়ায়ী ছোট দুয়ারটা খোলাই পেল টেনে খুললো দুয়ার। বেশি কিছু না ভেবেই ঢুকে পড়লো ভিতরে। একটুও ভয় লাগছে না রাগান্বিতার সে সেদিনের মতো একটা মশাল হাতে ভিতরে ঢুকলো। অনুভূতি শূন্য, তবে জানার কৌতূহল অনেক। সেও তো জানতে চায় কেন ইমতিয়াজ এত কিছু করলো।

রাগান্বিতা সুরঙ্গের নিচে নেমেই বিশাল সেই কক্ষ আবার চোখ বুলালো। আজও চারপাশে আগুন জ্বলছে। নিভু নিভু আগুন। রাগান্বিতা পুরো জায়গাটাকেই উপেক্ষা করে ছুটে গেল টেবিলের কাছে। খোঁজার প্রয়োজন পড়ে নি আর টেবিলের উপরই দুটো সাদা খামে ছিল দুটো চিঠি। যার একটার উপরে লেখা ছিল প্রেমপত্র। অন্যটা ফাঁকা কিছু লেখা নেই। রাগান্বিতা বুঝে ফাঁকাটাতেই সব রহস্য লেখা। রাগান্বিতা কাঁপা কাঁপা হাতে সেই খামটাই হাতে নেয় আগে। স্তব্ধ হয়ে চেয়ারে বসে হাতের মশাল রাখে টেবিলের পাশেই লোহা দিয়ে তৈরি দেয়ালের সাথে আটকে রাখা চক্রের মতো একটা জিনিসে। নামটা ঠিক জানা নেই। রাগান্বিতা কাঁপা কাঁপা হাতে খাম থেকে চিঠিটা বের করলো। বড় বড় পুরো দুটো পৃষ্ঠায় এপিট ওপিট করে লেখা। বোঝাই যাচ্ছে অনেক বড় কাহিনী। রাগান্বিতা পড়া শুরু করে। যেখানে প্রথমেই লেখা ছিল,

“কোথা থেকে কি শুরু করবো বুঝতে পারছি না। শুরু থেকে শুরু করলেই বোধহয় ঠিক হবে। এটাকে ছোট খাটো জীবনের গল্পও বলা যায়। এক নিষ্ঠুর প্রেমিক পুরুষের গল্প। তার জন্মই হয়েছিল বোধহয় নিষ্ঠুরতার জন্য। তোমার কি মনে আছে রাগান্বিতা সেদিন রাতে তোমায় আমি একটা গল্প বলেছিলাম। এক রাজা আর তার দুই রানীর গল্প। সেই গল্পের শেষে আমি তোমায় বলেছিলাম রাজার ছেলে পালিয়ে আসে শুরু করে একার জীবন। কিন্তু সেই গল্পের শেষটা সত্যি ছিল না। রাজার ছেলে ফিরে তো আসে কিন্তু সঙ্গে নিয়ে একটি মেয়ে আর দুটো খুনের বোঝা। রাজার সেই দ্বিতীয় স্ত্রীর কন্যা তার নাম ছিল মৃন্ময়ী। আমি ওকে ডাকতাম মিনু বলে। আমার সৎবোন ছিল। সৎবোন হলেও একটা আশ্চর্যের বিষয় হলো মৃন্ময়ী আমায় ভালোবাসতো আপন ভাইয়ের মতো, সম্মান করতো বড় ভাইয়ের মতো। আমাকে যখন প্রায় রাতে খেতে দেয়া হতো না ও লুকিয়ে লুকিয়ে নিয়ে আসতো আমার জন্য খাবার। প্রায় রাতে বায়না করতো। ভাইয়া আমায় তোমার কোলে করে রাতের চাঁদ দেখাবে। আমি দেখাতাম। এমন অনেক রাত গেছে বাড়ির সবাইকে লুকিয়ে আমরা রাতের আধারে বাহিরে ঘুরতে গেছি। কতশত আনন্দ করেছি। জীবন চলছিল, বাবার লাঞ্ছনা, সৎমায়ের অত্যাচার, এর-ওর কথা, মার, ক্ষুধার যন্ত্রণা তবে দিন শেষে বোনটার ভালোবাসা ছিল আমার একমাত্র বেঁচে থাকার কারণ। সবই ঠিক ছিল। হঠাৎ একরাতে বোনটা হন্তদন্ত হয়ে কক্ষে এসে বললো,“ভাইয়া ওঠো আর ঘুমানোর প্রয়োজন নেই তুমি এক্ষুণি এখান থেকে দূরে কোথাও পালিয়ে যাবে।”

আমি হতভম্ব হয়ে যাই বোনের সেই কথা শুনে। আমি ভীতু স্বরে বলি,“কেন কি হইছে মিনু?”

ও তখন ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে বলে,
“এত কথা বলো না ভাইয়া যা বলছি তাই করো।”
“কিন্তু আমি যামু কই?”

মিনু কি যেন ভাবে তারপর আমাকে নিয়ে যায় ওর কক্ষে। আমাকে লুকিয়ে রাখে ওর পালঙ্কের নিচে। আমি তিনদিন ছিলাম ওর পালঙ্কের নিচে লুকিয়ে। সেই তিনদিন সবাই খুঁজে আমাকে কিন্তু পায় না। কারণ কেউ ভাবতেও পারে না আমি মিনুর কক্ষে থাকতে পারি। সবাই ভেবে নেয় আমি পালিয়ে গেছি। পরে শুনেছিলাম সেদিন রাতে নাকি আমারই বাপ আর তার দ্বিতীয় বউ ফন্দি আটে আমায় খুন করার। আর তা আড়াল থেকে শুনে ফেলে মিনু। তিনদিন পর, মিনু বলে আমায় এক ভয়ংকর কথা, বলে,“শান্তি মতো বাঁচতে হলে খুন করতে হবে ভাইয়া। তুমি খুন করবা তোমার বাপরে আর আমি খুন করবো আমার আম্মারে। এরা দুজনেই খারাপ।”

সেই ১৪ বয়সী এক কন্যার মুখে এমন কথা শুনে আমি তো বিমোহিত। আমি খুব ঘাবড়ে যাই এতে। ও নিজের মাকে খুন করার কথা বলে। মিনু বয়সে ছোট হলেও তোমার মতো জেদি আর ন্যায়বান ছিল। অন্যায়ের সাথে কখনো আপোষ করতো না। ও সব শোনে ওর নানা আর ওর মা কিভাবে আমার মাকে ঠকিয়ে আমার বাবাকে বিয়ে করে। তার সাথে আমার মায়ের করা অন্যায় সব জানে। আর একটা কথা জানো আমার আম্মা আত্মহত্যা করে নি। তার খাবারে বিষ মিশিয়ে খুন করে আমার সৎমা। এটাও আমি মিনুর মুখ থেকেই শুনি। এ কথা শোনার পরই অজানা শক্তি পাই। সেই রাতেই বাবার রাজকীয় তলোয়ার দিয়ে খুন করে ফেলি বাবাকে। সে ছিল আমার জীবনের প্রথম খুন। আর মিনু খুন করে একসাথে ওর আম্মাকে। আমরা দুজন সে রাতেই কিছু সোনাগয়না টাকাপয়সা নিয়ে পাড়ি জমাই ঢাকাতে। কি করবো, কোথায় থাকবো কিছু জানি না। কিন্তু ছোট বোনটা আমায় সাহস দেয়। সঙ্গে বলে,“আজ থেকে আমরা খুব ভালো থাকবো ভাইয়া, তুমি আর কখনো কষ্ট পাবে না। আজ থেকে তুমি মুক্ত। আমরা ভালো থাকবো একসাথে আর কোনো দুঃখই আমাদের ছুঁতে পারবে না।”

এখান থেকেই মোড় নিয়েছিল আমাদের জীবন। আমরা ঢাকা এসে বাঁচার চেষ্টা করি। কখনো গাছের নিচে, কখনো বসতি ঘরে, কখনো ফুটপাতে। এমন কোনো কাজ নেই যা আমি করি নি। সোনাগয়না আনলেও সেগুলো বিক্রি করার সাহস হয় নি। কে কি ভেবে বসে। এটাও মিনুর কথা ছিল। ছোট ছিল। মানুষ কিভাবে নিতো। চুরি করে এনেছি এসব ভেবে না আবার জেলে ভরে দেয়। ধীরে ধীরে ঠিক হলো সবটা। ছোট বোনটাকে স্কুলে ভর্তি করি। ও পড়াশোনাতেও খুব ভালো ছিল। আমি পড়াশোনা করি নি। আমি সবসময় অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলতাম কিন্তু মিনু আমায় শিখিয়েছে, সব সময় শুদ্ধ ভাষায় কথা বলবে ভাইয়া। রোজ রাতে ওকে স্কুলে যা পড়াতো ও সেগুলো আমায় পড়াতো। আমি ভার্সিটি,কলেজ কোথাও যাই নি। তবে এসবের পড়াশোনা আমি করেছি আমার বোন আমায় শিখিয়েছে। আমার বোনের ইচ্ছে ছিল সে বড় হয়ে ভালো কিছু করবে নিজের পায়ে দাঁড়াবে।

জীবন চলছিল শুরুর দিকে বিষাদ থাকলেও পরে সব ঘুচে গেল। এর মাঝে দেখা হলো রবিন চাচার সঙ্গে উনি অত্যন্ত ভালোমানুষ আজ আমার যা হয়েছে এত বড়বাড়ি, ব্যবসা বানিজ্য সব ওনার জন্য। বাবার মতো স্নেহ করতেন আমায় আর মৃন্ময়ীকে। সব ঠিক ছিল। তবে হঠাৎ এসবের মাঝে ঘটে গেল এক ভয়ানক ঘটনা। আমার বোনের সাথে পরিচয় হয় তোমায় ভাই রেজওয়ান তালুকদারের। তারা একই ভার্সিটিতে ছিল। আমার বোন এক ক্লাস নিচে। তাদের প্রেমের সম্পর্ক হয়। এসব আমি কিছু জানতাম না। তারা গোপনে বিয়ে করে একসাথে থাকতো। বোনটা বিয়ের পরে জানে তোমায় ভাই ছিল নারীতে আসক্ত, সঙ্গে বেআইনি অস্ত্র পাচারে নিযুক্ত। আমার বোনকে সে ভালোবাসে নি। শুধু ব্যবহার করে তার শরীরটাকে। তাও সে নিজে একা করে নি ভোগ করিয়েছে আরো অনেকজনকে।

রাগান্বিতার নিশ্বাস আঁটকে আসলো এগুলো সে কি পড়ছে। তার দাদাভাই এত ঘৃণ্য ব্যক্তি ছিল। রাগান্বিতা বিশ্বাস করতে পারছে না। রাগান্বিতা আবার পড়তে শুরু করলো,

“আমার বোন হঠাৎ ১০দিন যাবৎ নিখোঁজ হয়। খুঁজে পায় নি কোথাও। আমি দিশেহারা হয়ে পরি। দশদিন পর বিপদগ্রস্ত অবস্থায় তাকে পাই একটা ছোট্ট কুটির ঘরে। পুরোই পাগল। আমার বোনের পুরো শরীরটাকে গরম ছু*রি দিয়ে বহুবার আঘাত করা হয় তার পিঠেও চাবুকের আঘাত থাকে। কি নির্মম ছিল সেই দৃশ্য যদি তুমি দেখতে। আমার বোন এত সাহসী ছিল তাও তোমায় ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসার জন্য হেরে গেল। মিনু সব জেনে যাওয়ার পর ফিরে আসতে চাইলেই তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। সমানে কয়েকজন মিলে গনধর্ষন চালায়। রাগান্বিতা খেয়াল করলো এখানে চোখের পানির জন্য ফুলে আছে পৃষ্ঠাটা। রাগান্বিতা বুঝেছে ইমতিয়াজ লিখতে লিখতে কেঁদে ফেলেছিল রাগান্বিতার রুহু কেঁপে উঠলো। এত নির্মম ছিল তার ভাই।

“সে ঘটনার দুইদিন পরই আমার বোন বিষ খেয়ে মারা যায় তার নিথর দেহের কথা ভাবলেই আমার কলিজা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় বউ, আমি নিতে পারি না। যন্ত্রনায় আমার সারা অঙ্গ বুঝি ঝলসে যায়। তখনই সিদ্ধান্ত নেই ধ্বংসের পরিবর্তে ধ্বংস চাই। খুন নয় মানসিক যন্ত্রনা। আমি যে যন্ত্রণা পেয়েছি সেই যন্ত্রণা আমি দিতে চাই রেজওয়ানকে। তখনই রেজওয়ান সম্পর্কে সব জানি। জানার মাঝেই বেরিয়ে আসে রেজওয়ানের দুই বোনের নাম রাগান্বিতা আর কুহেলিকা। ক্রোধে ফেটে দুজনকেই মেরে ফেলার ফন্দি আঁটি আমি।”

#চলবে….

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-৪৬+৪৭

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৪৬
________________
সেই ঘটনার পর মাঝখানে কেটে গেল তিনটে দিন। রেশবপুরে পুলিশ এসেছিল এই ভরসন্ধ্যা বেলা গ্রামের জমিদার মশাই আর তার পোলার মৃত্যুতে সবাই শোকাহত। কি থেকে কি হয়ে গেল কেউ বুঝচ্ছে না। রাগান্বিতা তাদের সদর দুয়ারের সামনে বসা। চোখ মুখ স্বাভাবিক যেন কিছু হয় নি। রাগান্বিতা গত তিনটে দিনের একটা দিনও কাঁদে নি। সে তার বাবার কথা রেখেছে রাগান্বিতা কাঁদে নি। একদম শক্ত ছিল। গ্রামের মানুষরা তো অবাক। বাপ, ভাই মইরা গেল অথচ রাগান্বিতা কেমনে এত স্বাভাবিক থাহে। বাড়িতে পুলিশ এসে রাগান্বিতাকে জিজ্ঞেস করেছিল সে এ বিষয় কিছু জানে কি না। উত্তরে রাগান্বিতা বলে, না সে কিছু দেখে নি সে আসার আগেই কেউ তার বাপ আর ভাইকে মেরে ফেলে গেছে। অবাক করার একটা বিষয় হলো রাগান্বিতা ইমতিয়াজের ফেলে যাওয়া সেই ছুরিটাও লুকিয়ে ফেলে। এরপর কেটে গেল তিনটে দিন।

স্তব্ধ হয়ে বসে আছে রাগান্বিতা। ক্রোধ আর প্রতিহিংসায় চোখ দুটো জর্জরিত। রাগান্বিতা ভেবে ফেলেছে সে খুন করবে। যে ছুরি দিয়ে ইমতিয়াজ তার বাবা আর ভাইকে মেরেছে সেই ছুরি দিয়েই সে খুন করবে ইমতিয়াজকে। রামু পাশে দাঁড়িয়ে রাগান্বিতার। চোখ বেয়ে পড়ছে তার নোনা পানি। এগুলা কি ঘটে গেল তাদের সাথে ভাবতেই কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে রামুর। রামু রাগান্বিতার পাশে বসলো। চোখ মুছতে মুছতে বললো,“এগুলান কি ঘইট্টা গেল আফা? এহন কি হইবো আমগো?”

রাগান্বিতা তাকালো রামুর মুখের দিকে। বললো,“কেঁদো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

রামু তাও থামলো না তার কান্না পাচ্ছে খুব। এত কষ্ট বোধহয় জীবনেও পায় নি রামু। মোতালেব তালুকদার যথেষ্ট ভালো মানুষ ছিলেন তাকে কত ভালোবাসতো। তার পরিবারকেও ভালোবাসতো। অথচ সেই মানুষটাকেই কেউ কিনা নিঃসংশয়ভাবে খুন করলো। কে করলো কেমন ঘৃণ্য কাজ। রামু রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বললো,“ইমতিয়াজ ভাই তো আইলো না আফা। উনি কি জানে নাই এহানের ঘটনা?”

রাগান্বিতা শান্ত স্বরে বললো,
“হয়তো জানে নি জানলে নিশ্চয়ই আসতো।”
“তুমি একটা চিডি লেখতা আফা।”

রাগান্বিতা জবাব দেয় না কেমন এক দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। হেঁসে হেঁসে বলে, “আবার চিঠি। তুমি কি জানো রামু এই চিঠি কতটা ভয়ংকর একটা জিনিস।”

রামু চরমভাবে অবাক হলো রাগান্বিতার কথা শুনে। বললো,“চিডিতে আবার কি ভয়ংকর আফা?”

রাগান্বিতা আবারও হাসে। বলে,“আছে ভয়ংকর কিছু তুমি বুঝবা না। আচ্ছা শোনো কাল সকালে আমি চলে যাবো। তুমি কি এই বাড়িতে থাকবা?”

রামু ভয়ে ভয়ে বলে,“আমার খুব ভয় লাগতেছে আফা।,”

রাগান্বিতা বলে,
“তাইলে থাকার দরকার নেই তুমিও কাল বাড়ি চলে যেও।”
“আর এই বাড়ির কি হইবো?”
“কিছু হবে না। আমি থাকবো এখানে।”
“তুমি থাকবা কেমনে?”
“পরে বলবো।”
রামুও আর প্রশ্ন করে নি।

পরের দিন। ফজরের ধ্বনি শুনতেই সদর দুয়ারের মেঝেতে শুয়ে থাকা রাগান্বিতা উঠে বসলো। গত তিনদিন রাত্তির যাবৎ সে মেঝেতেই ঘুমিয়েছে। রামু কতবার ঘরের ভিতর গিয়ে ঘুমাতে বললো কিন্তু রাগান্বিতা শুনলো না। রাগান্বিতা দ্রুত কলপাড়ে গেলো চোখে মুখে পানি দিলো। গায়ের সব অলংকার বাড়ির এখানে ওখানে পড়ে আছে। তবে রামু সব গুছিয়ে রেখেছে। রাগান্বিতা ফজরের নামাজ পড়লো। পুরো বাড়ি জুড়ে বিষণ্ণতা চারপাশে কেউ নেই একমাত্র রাগান্বিতা ছাড়া। কুহু আপা নেই, দাদিমা নেই, বাবা নেই, ভাই নেই আছে শুধু রাগান্বিতা। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে রাগান্বিতার মনে হচ্ছে ইমতিয়াজ তাকে কেন মারলো না? মারতে তো তাকেই এসেছিল তবে তাকেই কেন বাঁচিয়ে রাখলো। রাগান্বিতা তার কক্ষের আলমারি খুললো। শুনেছে অপরাধীদের নাকি সাদা পোশাক পড়িয়ে শাস্তি দেয়া হয়। রাগান্বিতাও আজ অপরাধ করবে। স্বামী হত্যা করার মতো এক যগন্যতম অপরাধ। নিশ্চয়ই এই অপরাধ করার পর তাকেও সাদা পোশাক পড়িয়ে ফাঁসিতে ঝুলানো হবে। রাগান্বিতা আলমারি সাঁতরে তার মায়ের একটা শাড়ি বের করলো। লোকে বলে মায়ের শাড়িতে নাকি মেয়েদের খুব সুন্দর দেখায়। রাগান্বিতারও উচিত নিজেকে সুন্দর দেখানো। পুরো রানীর মতো সেজেগুজে সে স্বামী হত্যা করতে যাবে। কত সুন্দর না বিষয়টা। হেসে ফেলে রাগান্বিতা। সাদা শাড়ির মত বদলালো। সে নজরকাড়া সৌন্দর্যে ঘেরা একটা জামদানী শাড়ি বের করলো। গায়েও জড়িয়ে নিল। গা, হাত, পা ভর্তি সোনার অলংকার জড়ালো, চোখে দিল গাড়ো কাজল। চুলগুলো খোঁপা করে ফুল লাগালো। যেকোনো পুরুষ রাগান্বিতার রূপ দেখে এক নিমিষেই ঘায়েল হয়ে যেতে পারে তেমন সাজলো রাগান্বিতা। রামু দেখলো রাগান্বিতার সেই ভয়ংকর সাজ। তার বুকটা ধক করে উঠলো রাগান্বিতা এগুলো কি করছে? বাপ ভাইয়ের মৃত্যুর শোকে পাগল হয়ে গেল নাকি। সে ছুট্টে বেরিয়ে গেল তার ভয় হচ্ছে রাগান্বিতার এহেম কান্ড দেখে। রাগান্বিতা সেজেগুজে আবার আলমারি খুললো বের করলো ইমতিয়াজের রেখে যাওয়া সেই ছুরিটা। এখনো রক্তের রঙে লাল হয়ে আছে ছুরিটা। রাগান্বিতা গায়ে কালো চাদর জড়ালো। নিজেকে ঢেকে নিলো পুরোপুরি। ছুরিটাকে চাদরের আড়ালে রেখে চোখে ভয়ংকর রাগ নিয়ে সে বেরিয়ে পড়লো। উদ্দেশ্য স্বামী হত্যা। তার বাপ ভাইয়ের খুনের প্রতিশোধ নেয়া।

রামুর গ্রামের মানুষজন নিয়ে আসতে আসতে রাগান্বিতা বেরিয়ে যায়। রামু ভয়ংকর ভাবে ঘাবড়ে যায় হঠাৎ করে হলো কি তার রাগান্বিতা আপার!’
—–
তখন বাজে দুপুর তিনটে। রাগান্বিতা এলেমেলো পায়ে ঢাকার রেলস্টেশন থেকে বের হলো। বাড়ির গন্তব্য আর বেশিদূর নয়। রাগান্বিতা সামনে যত এগোচ্ছে একটু একটু করে বুঝি তার শক্তি কমছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলাচ্ছে। তার বাবার নিথর দেহ, ভাই আর আপার মুখখানা মনে করছে। নির্জন একটা রাস্তা আশেপাশে কেউ নেই। রাগান্বিতা একা একা হাঁটছে। এমন সময় কোথা থেকে যেন তাকে ঘিরে ধরলো কয়েকটা বখাটে ছেলে। তাকে উদ্দেশ্য করে সামনের দুটো ছেলে বললো,“সুন্দরী রমণী এই ভরদুপুরে যাচ্ছো কই?”

রাগান্বিতার ক্ষিপ্ত চাহনি। তার একঝলকের চাহনি দেখেই সামনের দুটো ছেলে ঘাবড়ে গেল। এমন ভয়ানক চাহনি বুঝি এ জীবনে কখনো দেখে নি। পিছনে দাড়িয়ে থাকা ছেলেগুলো বললো,“আইবা নাকি আমাগো কাছে তোমার রূপের আগুনে নিজেদের জ্বালাতে চাই।”

ব্যস রাগান্বিতা ক্রোধে ভরা চোখ দুটো বুঝি আরো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো মাথা থেকে চাদর সরালো। চাদরের আড়াল থেকে বের করলো ধারালো অস্ত্র। রাগান্বিতা ওই ছেলেটার দিকে এগিয়ে এগিয়ে যেতে বললো,“আজ তোর সব জ্বালা আমি একদিনে মিটাবো।”

আচমকা রাগান্বিতার এহেম ভয়ানক রূপে ঘাবড়ে গেল সব ক’টা ছেলে। একটা সাহস দেখাতে কাছে আসতেই ধারালো ছুরি দিয়ে হাতে আঘাত করে বসলো রাগান্বিতা। সঙ্গে সঙ্গে কলকলিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসলো ছেলেটার হাত থেকে। আর কেউ সাহস করে এগোতে পারলো না রাগান্বিতার দিকে। সবকটা ভয় নিয়ে পালালো। কিছু সময় যেতেই রাগান্বিতা নিজেকে সামলালো। চাদর দিয়ে ঢেকে নিলো নিজের মুখ আর ছুরি। কতদূর এগিয়ে হাতের ইশারায় ডাকলো মোটরগাড়ি। গাড়ি থামলো রাগান্বিতা ঠিকানা বলে উঠে বসলো। একটু একটু করে ছুটে যেতে লাগলো নিজের গন্তব্যের দিকে। হঠাৎই রাগান্বিতা খেয়াল করলো গাড়ির চালক বার বার পিছন ঘুরে তার দিকে কেমন দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছে। রাগান্বিতা বিষয়টা বুঝতে পেরেই হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,“আর একবার যদি তোর ওই চোখ নিয়ে পিছনে তাকাস তবে ওই চোখ আমি উপড়ে ফেলবো। পরবর্তীতে এই সুন্দর পৃথিবী দেখার জন্য তোর চোখ থাকবে না।”

গাড়ি চালক ঘাবড়ে গেলেন। কি ঝাঁজ ছিল রাগান্বিতার সেই কথায়! চালক পরবর্তীতে আর রাগান্বিতার দিকে তাকানোর সাহস করে নি।”

রাগান্বিতা নিশ্চুপে বসে রইলো। ভাবলো, এই দুনিয়ার মানুষগুলো বড্ড নোংরা। এরা খালি নারীদের শরীরের প্রেমে পড়ে, মনের প্রেমে পড়তে জানে না।”
——
ঘন্টা দেড় যেতেই মোটর গাড়ি এসে থামলো ইমতিয়াজের বাড়ির সেই গেটের সামনে রাগান্বিতা নামলো। শাড়ির আঁচল থেকে পয়সা বের করে দিলো গাড়ির চালকের দিকে। চালক টাকা নেয়ার পাশাপাশি রাগান্বিতার হাতটা বাজে ভাবে স্পর্শ করলো। রাগান্বিতা ক্ষিপ্ত হয়ে বাম হাতে থাকা ছুরিটা বের করে চালকের হাতে আঘাত করে বসলো। চালক চমকে উঠলেন। রক্ত পড়া চেপে ধরলেন দ্রুত। রাগান্বিতা ভয়ংকর এক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,

পরবর্তীতে কোনো নারীর দিকে কুনজরে তাকানো আর বাজে স্পর্শ করার আগে এই ক্ষতের কথা মনে করবি, মনে করবি কোনো এক নারী তোর দৃষ্টি আর চরিত্র সংযত করার একটা সুযোগ দিয়েছে। চালক ঘাবড়ে গেলেন কিছু বলবে তাও পারলো না। এক ষোড়শী নারীর মাঝে এত তেজ সে এর আগে দেখেনি। চালক পয়সা নিয়ে চলে গেল। রাগান্বিতা ভিতরে ঢুকলো, চারপাশ পুরো থমথমে। তিনদিনেই বুঝি চারপাশ মরে গেছে এমন লাগছে। রাগান্বিতা একটু একটু করে হেঁটে যাচ্ছে ভিতরে। হাতে তার শক্ত করে চেপে ধরা ভয়ংকর অস্ত্র। চোখে মুখে প্রতিহিংসার ছাপ।”

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৪৭
________________
থমথমে পরিবেশ। চারপাশ কেমন গম্ভীর। মনে হয় ভুতুড়ে কিছু। পুরো বাড়িটা নিস্তব্ধ। এমন লাগছে বাড়িতে কেউ নেই। রাগান্বিতা একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে ভিতরে। পশ্চিমা আকাশ বেয়ে তখন কতগুলো কালো কাক ছুটে যাচ্ছিল। মেঘাচ্ছন্ন আকাশটাও কেমন থমথমে দেখাচ্ছে। রাগান্বিতার নিশ্বাস আঁটকে আসছে। সে যতটা সাহস নিয়ে বাড়ির গেট পর্যন্ত আসছিল। ঠিক ততটাই দূর্বল হয়ে হাঁটছে। সামনে যত এগোচ্ছে তত যেন তার আর ইমতিয়াজের কাটানো সুন্দর সুন্দর মুহুর্তের কথা মনে পড়ছে। তার মনে হচ্ছে সে যা দেখেছে, যা পড়েছে সব মিথ্যে একটাও বাস্তব নয়। বুকের ভেতর মোচর দিয়ে উঠলো। কি নিদারুণ যন্ত্রণা হচ্ছে। রাগান্বিতা দূর্বল হলো তার হাত পা অবশ হয়ে আসছে। কিন্তু রাগান্বিতা দমলো না। নিজেকে প্রস্তুত করলো যা ভেবে এসেছে তাই করবে। রাগান্বিতার পুনরায় চোখে মুখে ক্রোধ ফুটে উঠলো। সদর দুয়ারের কাছে এসে জোরে নিশ্বাস ফেললো। রাগান্বিতা সদর দুয়ার ধাক্কা মারবে তার আগেই বাহির থেকে এক ভাড়ি বাতাস এসে দুয়ার খুলে দিল। রাগান্বিতা অবাক হলো বাড়ির দরজা খোলা কেন! ভিতরে কি কেউ নেই! রাগান্বিতা তার বাম পা’টা আগে দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। পুরো বাড়ির নিচটা ফাঁকা। কেমন ছমছমে পরিবেশ। রাগান্বিতা উপরে উঠে গেল তাদের কক্ষ দেখলো না ইমতিয়াজ বা রবিন চাচা কেউই নেই। তবে কি ইমতিয়াজ পালিয়েছে। হঠাৎই প্রথম দিনের সেই তালাবদ্ধ কক্ষ থেকে কিসের যেন শব্দ আসলো।রাগান্বিতা কোতুহলী সেই কক্ষের দুয়ারের কাছে গেল। এবারও একই ঘটনা ঘটলো রাগান্বিতা দুয়ারের বারি দেয়ার আগেই সেটা খুলে গেল। রাগান্বিতা হাতে অস্ত্র নিয়ে কক্ষে পা রাখলো গায়ের চাদর নিচেই ফেলে এসেছে। রাগান্বিতা কক্ষের দুয়ার খুলতেই দেখলো। কক্ষের একদম সোজাসুজি তারই চোখের সামনে টেবিলের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে ইমতিয়াজ। এলেমেলো মুখ,অগোছালো চোখ, কেমন ক্লান্তকর শরীর। ইমতিয়াজকে দেখেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো রাগান্বিতার। তার আবারও মন চাচ্ছে, তার সাথে ঘটে যাওয়া গত তিনটে দিনের ঘটনা সব মিথ্যে হোক, নয়তো স্বপ্ন হোক, এমন বিচ্ছিরি স্বপ্ন রাগান্বিতা কখনোই দেখতে চাইবে না। রাগান্বিতা মায়া মায়া নিয়ে ভিতরে পা রাখবে এরই মাঝে তার সামনে ভেসে আসলো তার আপার মুখ, সে মা হতে চলেছিল ইমতিয়াজ সেই সন্তানের বাবা, বিচ্ছিরি বিষয়। ভিতর কাঁপলো রাগান্বিতার না এটা অন্তত মিথ্যে হোক। আরফান অন্যকেউ হোক। তাকে হীনা ইমতিয়াজ অন্যকাউকে ছুঁয়েছে ভাবলেই এই ছুরি দিয়েই নিজের কলিজা কেটে ফেলতে ইচ্ছে করছে রাগান্বিতার। রাগান্বিতা আবার নিশ্বাস ফেললো। অস্ত্র হাতে পা রাখলো ভিতরে। সঙ্গে সঙ্গে ভেসে আসলো বাবার সেই নিথর দেহ, ভাইয়ের সেই ভয়ানকভাবে আঘাত প্রাপ্ত শরীরটা। রাগান্বিতা এবার সংযত হলো। শক্ত করে ছুরিটা চেপে ধরলো। রাগে মাথার রগ ফুলে যাচ্ছে। তার ইচ্ছে হলো ইমতিয়াজকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই সোজা তার বুকে আঘাত করা। রাগান্বিতা এগিয়ে গেল ইমতিয়াজের দিকে। ইমতিয়াজ তখনও একইভাবে বসা, সে এখনো তাকায় নি রাগান্বিতার দিকে। রাগান্বিতা এতে খানিকটা অবাক হলো ইমতিয়াজ কি টের পায় নি সে এসেছে। রাগান্বিতা যখন ইমতিয়াজের থেকে এক হাত দূরে তখন ইমতিয়াজ তাকালো রাগান্বিতার দিকে। ইমতিয়াজের দৃষ্টি দেখতেই থমকে গেল রাগান্বিতা। কেমন মায়াভরা ওই মুখে। ইমতিয়াজ স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,“আমি জানতাম তুমি আজ আসবে, আমায় খুন করার জন্য হলেও তুমি আসবে।”

রাগান্বিতা কি বলবে বুঝতে পারছে না। ইমতিয়াজ দ্বিধাহীন বলে,“কোথায় আঘাত করবে বলো তো গলায় নাকি বুকে। আমি চাইবো তুমি ঠিক আমার এই বাম পাশের বুকের মধ্যখানে আঘাত করো।”

রাগান্বিতার হাত কেঁপে উঠলো ইমতিয়াজের কথা শুনে। কিন্তু নিজেকে সামলালো। চোখেমুখে পাষাণের ছাপ এনে ধারালো ছুরিটা ইমতিয়াজের গলা বরাবর রেখে বললো,“কথার তালে ভুলাতে চাচ্ছেন?”

ইমতিয়াজ হাসে। কি নিদারুণ দেখায় সেই হাসি। বলে,“তোমার রূপ বলছে আজ আমার ধ্বংস নিশ্চিত।”

রাগান্বিতা বিষম খায়। কিছু বলতে পারে না।
ইমতিয়াজের পাশে ছিল রাজকীয় একটা তলোয়ার। এটা কারো বুকে একবার ঢুকিয়ে দিলেই সে শেষ। ইমতিয়াজ তার পাশে থাকা সেই বিশাল তলোয়ারটা রাগান্বিতার দিকে দিয়ে বলে,“ছুরি নয় তুমি এইটা দিয়ে আঘাত করো আমি কিছু মনে করবো না।”

রাগান্বিতার রুহুটা বুঝি কেঁপে উঠলো এতে। সে তাকিয়ে রইলো ইমতিয়াজের দিকে। ইমতিয়াজ আবার বললো,“কি হলো ধরো? তোমার ভাইকে যে অস্ত্র দিয়ে মেরেছি সেই অস্ত্র আমার গায়ে ছোঁয়াবে না। এইটা ধরো।”

বলে রাগান্বিতার হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে তার তলোয়ারটা দিলো। রাগান্বিতা নিলো। এবার ইমতিয়াজ আবার বললো,
“এবার মারো।”
“আপনার কি ভয় হচ্ছে না?”
“ভয় কিসের! এমনটা যে হতো এটা বোধহয় আমি জানতাম। তবে এত দ্রুত চাই নি। এবার মারো তো কথা বেশি হয়ে গেলে মায়া বেড়ে যাবে।”

রাগান্বিতা মৃদু হাসে। তলোয়ারটা ইমতিয়াজের ডানদিকের বুকে তাক করে বললো,“আপনার কি মনে হচ্ছে আমি আপনায় খুন করতে পারবো না?”

ইমতিয়াজ আবার হাসে। নিজের হাত দিয়ে তলোয়ারের মুখটা ডানদিকের বুক থেকে বামদিকে দিয়ে বলে,“তোমার কি মনে আছে বউ তোমায় সেদিন প্রেমনগর যাওয়ার পথে আমি বলেছিলাম। তুমি কি মানবে একদিন তুমি আমায় খুন করতে চাইবে?”

রাগান্বিতার শরীর কাঁপছে। ইমতিয়াজ আরো বলে, তোমার মনে আছে তুমি সেদিন চোখে মুখে বিস্ময়ের ছায়া নিয়ে কি বলেছিলে।”

রাগান্বিতা নিরুত্তর। ইমতিয়াজ বলে,আমি বলছি তুমি বলেছিলে,“আমি আপনায় কেন খুন করতে চাইবো। আপনায় খুন করার আগে যেন আমি ঝলসে যাই।”

সঙ্গে সঙ্গে রাগান্বিতার হাত থেকে তলোয়ার পড়ে গেল। ইমতিয়াজ চেয়ে রইলো তার পানে। রাগান্বিতা স্তব্ধ হয়ে বসে পড়লো ইমতিয়াজের সামনে। চোখে পানি চলে এসেছে তার। রাগান্বিতা ছল ছল দৃষ্টি নিয়ে বললো,“এমনটা কেন করলেন ইমতিয়াজ?”

ইমতিয়াজের বিস্মিত চেহারা। থমথমে মুখ। কণ্ঠস্বরে অস্থিরতা। সে বললো,
“আমি বাধ্য ছিলাম।”
“কিসের বাধ্যতা?”
“তোমায় বলতে বাধ্য নই আমি।”
“শেষটা তো এমন হওয়ার কথা ছিল না।”
“তুমি আমার অগোচরে আমার তৈরি পাতালকক্ষে গিয়ে ভুল করেছো।”
“আমায় একটু ভালো কেন বাসলেন না ইমতিয়াজ?”
“তোমায় ভালো না বাসলে আজ কুহুর পাশের লাশটা তোমার থাকতো।”

তড়িৎ বুকটা কেঁপে উঠলো রাগান্বিতার। কত সহজে কথাটা বলে দিলো ইমতিয়াজ। ইমতিয়াজ মাথা নুইয়ে নীরব স্বরে শুধালো, “আমার হৃদয় চিঁড়ে বললে যদি তুমি বিশ্বাস করো আমি তোমায় ভালোবাসি তবে আমি তাই করতে রাজি।”

রাগান্বিতা স্তব্ধ বনে গেল। ধীরে ধীরে নিজেকে সামলালো চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো,“আমি সব ভুলে যাবো ইমতিয়াজ আপনি হীনা আমি নিজেকে কল্পনাও করতে পারি না। বিশ্বাস করুন আমি সব ভুলে যাবো। আপনি আমার বাবা ভাইকে কেন মেরেছেন আমি কোনোদিন প্রশ্ন করবো না। কোনোদিন জানতেও চাইবো না এর কারণ। আমি আপনায় নিয়ে বাঁচতে চাই। আপনি শুধু এতটুকু বলুন আমার আপা আপনার জন্য কলঙ্কিত হয় নি আরফান মজুমদার আপনি নন। আপার পাঠানো চিঠিটাও আপনার জন্য নয়। এতটুকু বলুন এগুলো মিথ্যে। আমি কথা দিচ্ছি আমি সব ভুলে যাবো গত তিনটে দিন যা যা হয়েছে আমি সব ভুলে যাবো। আমি ভুলে যাবো আমার রেশবপুরে কেউ ছিল। শুধু আপার বিষয়টা মিথ্যে হোক। আমার আপা ফুলের মতো পবিত্র ছিল। আপনি একবার মুখ ফুটে বলুন, বউ এটা মিথ্যে কুহু আমার জন্য মরে নি। কলঙ্কিতও আমার জন্য হয় নি।”

ইমতিয়াজ নিরুত্তর। রাগান্বিতার চোখে মুখে শেষ আশা ইমতিয়াজকে পাওয়ার। কিন্তু সেই আশাও আর রইলো না। ইমতিয়াজ মাথা নিচু করে বললো,
“মিথ্যে বললে যদি সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যেত তবে আজ আমি মিথ্যে বলে তোমায় নিয়ে আরেকবার বাঁচার স্বপ্ন দেখতাম।”

রাগান্বিতার পুরো শরীর জুড়ে এক ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল। কি সাংঘাতিক শোনালো ইমতিয়াজের কথাটা। আচ্ছা সত্য এত তীক্ষ্ণ কেন! রাগান্বিতার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে নিজেকে বড্ড অসয়হায় লাগছে। কি কষ্ট হচ্ছে যদি কাউকে বোঝানো যেত। ইমতিয়াজ বললো,
“আরেকটা সত্যি শুনবে বউ? সবই তো জেনেছো এটাও জানা উচিত। এটা শুনলে বোধহয় তুমি আমায় মারতে আর দেরি করবে না।”

রাগান্বিতা তাকালো। আরো সত্যি আর কি সত্যি থাকতে পারে। ইমতিয়াজ বললো,
“তোমার দাদিমাকেও আমিই মেরেছি।”

রাগান্বিতার পায়ের নিচে মাটি বুঝে সরে গেল। এ কি বলে ফেললো ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা অস্পষ্ট স্বরে বললো,
“দাদিমাকেও আপনি মেরেছেন?”
“হা উনি তো মাকড়সা ভয় পেতেন। সেই মাকড়সার ভয় দেখিয়েই ওনাকে মেরেছি। উনি অনেকটা জানতেন ভয় ছিল তুমি জেনে যাবে।”

রাগান্বিতার ঘৃণা আসলো। তড়িৎ গতিতে ইমতিয়াজের শার্টের কলাট চেপে ধরে বললো,
“আপনি এতটা নিষ্ঠুর কি করে হলেন?”
“আমি শুরু থেকেই নিষ্ঠুর ছিলাম।”
“আমার নিজের ওপর ঘৃণা হচ্ছে এই আপনায় আমি ভালোবাসতাম।”

ইমতিয়াজ কিছু বলে না। চুপ করে রয়। সময় যায়। রাগান্বিতা ভিতরে ভিতরে ঢুকরে মরছে। একদিকে প্রতিহিংসা অন্যদিকে ভালোবাসা। রাগান্বিতা আবার ইমতিয়াজের দিকে তাকায়। কলাট ছেড়ে দেয় কেমন শূন্যতায় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। এটা তো সত্যি, এত সত্যের মাঝেও একটা কঠিন সত্য হলো ইমতিয়াজের প্রতি রাগান্বিতার ভালোবাসা। ভালোবাসা তো মিথ্যে ছিল না। ভালোবাসার মানুষকে কি আঘাত করা যায়! রাগান্বিতা তাকায় ছলছল দৃষ্টি নিয়ে বলে,
“এমনটা কেন করলেন ইমতিয়াজ?”
“বলে দিলে কি আমি আবার তোমায় আগের মতো পাবো। তুমি পারবে আবার আগের মতো আমায় ভালোবাসতে। যখনই তুমি আমার কাছাকাছি আসবে তখনই তোমার বাবা আর ভাইয়ের মুখটার কথা মনে পড়বে। তুমি পারবে না আমার কাছাকাছি হতে। তোমার আপা, তার মৃত্যু। না। আমাদের আর মিলন নেই।”

কথাটা বুঝি পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট কথা ছিল। কি বিচ্ছিরি শোনালো “আমাদের আর মিলন নেই।”

রাগান্বিতা ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে অসহায় স্বরে বললো,“আমার কি করা উচিত বলুন আমাকেও মেরে ফেলুন ইমতিয়াজ? এই বিচ্ছিরি পৃথিবী আমার জন্য নয়। আমাকেও খুন করুন।”

সঙ্গে সঙ্গে ঘটে গেল আরেক বিস্মিত ঘটনা। রাগান্বিতার পাশে থাকা তলোয়ারটা উঠিয়েই নিজের বুকের ভিতর তলোয়ার ঢুকিয়ে দিলো ইমতিয়াজ। ইমতিয়াজের আকস্মিক কান্ডে রাগান্বিতার রুহু কেঁপে উঠলো। এ কি করে বসলো ইমতিয়াজ। ইমতিয়াজের মুখ দিয়ে কলকলিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসলো। রাগান্বিতা দিশেহারা হয়ে পড়লো। এটা কি করলো ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা সব ভুলে ছুটে গেল ইমতিয়াজের কাছে। ইমতিয়াজের মাথাটা বুকে চেপে ধরলো। চারপাশ কেমন ঘুরছে। এত রক্ত সে কি করে বন্ধ করবে। রাগান্বিতা অগোছালো স্বরে বললো,“এটা কি করলেন আপনি? আমায় ছেড়ে চলে যাইয়েন না ইমতিয়াজ।”

ইমতিয়াজ মিটমিট চোখে রাগান্বিতার দিকে তাকালো অস্পষ্টভাবে বললো,“আমার সব মিথ্যের মাঝে তোমায় ভালোবাসাটা সত্যি ছিল বউ। প্রতিহিংসা নিয়ে বাঁচা যায় না। গত সাতটা মাস এই যন্ত্রণা আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে। আমি চাইনা তুমিও সেই যন্ত্রণা সহ্য করো। আমার এ জীবনে বিশাল একটা আফসোস রয়ে গেল বউ, তুমি আমার হয়েও আমার হইলা না।”

ব্যস আর কিছু শোনা গেল না। ইমতিয়াজ নামক নিষ্ঠুর মানুষটা আর রইলো না। রাগান্বিতা থ মেরে বসে রইলো। আচমকা কি ঘটে গেল। তার চারপাশ ঘুরছে। ইমতিয়াজ আর নেই। তাকে বউ বউ বলে ডাকা মানুষটা আর নেই। পুরো কক্ষে রক্তে ভরপুর। রাগান্বিতার শরীর, শাড়ি সব ইমতিয়াজের শরীরের রক্তে টুইটুম্বর। রাগান্বিতা পাথর হয়ে গেল। তাদের শেষটা এমন কেন হলো! সে তো এমনটা চায় নি। কেন হলো এমনটা! রাগান্বিতা আচমকা চিৎকার দিয়ে উঠলো। বললো,“এমনটা করতে পারেন না আপনি, আমায় ছেড়ে যেতে পারেন না। ইমতিয়াজ আমি আপনায় ভীষণ রকম ভালোবাসি। কেন হলো এমনটা! কেন করলেন এমনটা!

রাগান্বিতা চিৎকার দিয়ে কাঁদলো। তার কাঁদার শব্দে বুঝি ইমতিয়াজের পুরো বাড়ি ভুমিকম্পের মতো কেঁপে উঠলো। চারপাশে যেন একটা কথাই তখন ঘুরপাক খাচ্ছিল,কেন হলো এমনটা? কেন হলো শেষটা এত বিষাদময়? কেন কেন!

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#TanjiL_Mim♥️

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-৪৪+৪৫

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৪৪
________________
“বউ শুনো, উঠো দ্রুত। খাবে চলো এভাবে না খেয়ে ঘুমাতে নেই। বউ শুনছো আমার কথা, উঠো দ্রুত।”

লাগাতার রাগান্বিতাকে কথাগুলো বলতে লাগলো ইমতিয়াজ। কিন্তু রাগান্বিতা উঠছে না। কতক্ষণ আগেই কক্ষে ঢুকে রাগান্বিতার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলতে লাগলো ইমতিয়াজ। ইমতিয়াজ আবার ডাকলো। রাগান্বিতা নড়েচড়ে উঠলো। ঘুম ঘুম চোখে, চক্ষু দুটো ডলতে ডলতে বললো,“কি হলো এভাবে ডাকছেন যে?”

ইমতিয়াজ পালঙ্কে বসলো। নরম কণ্ঠে শুধালো,
“ওঠো দ্রুত খাবে চলো।”

রাগান্বিতা দোনামনা করলো যার অর্থ সে খাবে না তার খেতে ইচ্ছে করছে না। ইমতিয়াজ শুনলো না রাগান্বিতাকে শোয়া থেকে উঠিয়ে বললো,“আজ তোমার কোনো কথা শুনছি না। তুমি প্রায় না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আমি ডাকতে চাই কিন্তু পারি না। কিন্তু আজ শুনবো না উঠো দ্রুত আমি নিজ হাতে খাইয়ে দিবো চলো আমার সাথে।”

বলেই রাগান্বিতাকে কোলে তুলে নিলো ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা চমকে উঠলো, ঘাবড়ে গিয়ে ইমতিয়াজের হাতখানা শক্ত করে চেপে ধরলো। হতভম্ব স্বরে বললো,
“কি করছেন পড়ে যাবো তো।”

ইমতিয়াজ হাসে। রাগান্বিতাকে নিয়ে বাহিরে বেরোতে বেরোতে বলে,
“আমার শক্ত হাত তোমায় কখনো ফেলতে দিবে না।”

রাগান্বিতা মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো ইমতিয়াজের মুখের দিকে। মানুষটা যতবার তার সঙ্গে কিছু বলে ততবারই রাগান্বিতা মুগ্ধ হয়। আজও হয়েছে। না এই মানুষটার মাঝে কোনো খুঁত থাকতে পারে না। রাগান্বিতা মুচকি হেঁসে গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
“আমায় কি খুব ভালোবাসেন আপনি?”

ইমতিয়াজ দাঁড়িয়ে পড়ে। উত্তর দেয় না। কিছুক্ষণ যেতেই বলে,
“ভালোবাসা প্রকাশ করতে নেই।”

রাগান্বিতা কিছু বলে না। ইমতিয়াজ পুনরায় হাঁটা ধরে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে। রাগান্বিতাকে বসিয়ে দেয় চেয়ারে। নিজেও বসে। হাত ধোঁয়। খাবার প্লেটে বাড়তে বাড়তে বলে,
“এই রঙিন পৃথিবীতে তুমিহীনা কেউ আপন নেই আমার বউ। যারা ছিল তারা সবাই চলে গেছে তুমি কখনো যেও না। আমি মরে যাবো তবে।”

রাগান্বিতা স্তব্ধ। কি বলবে উত্তর খুঁজে পায় না। কেন পাচ্ছে না নিজেও জানে না। ইমতিয়াজ খাবার প্লেটে বেড়ে নিজ হাতে ভাত মাখলো। এক লোকমা খাবার রাগান্বিতার মুখের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,“হা কর।”

রাগান্বিতা নিরদ্বিধায় তার মুখ খোলে। পুড়ে নেয় ইমতিয়াজের হাতে মাখানো এক লোকমা খাবার। অমৃতের মতো লাগে সেই খাবার। এত সুস্বাদু কেন! রাগান্বিতা আবার নিজেকে বোঝালো,“এই মানুষটার ওপর অবিশ্বাস করাও বুঝি পাপ।”

ইমতিয়াজ একের পর এক খাবার মুখে পুড়ে দেয় রাগান্বিতার। রাগান্বিতাও খেতে থাকে। হঠাৎ বলে,
“আপনি খাবেন না?”
“আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”
“কেন?”
“এমনি।”
“আমি খাইয়ে দেই?”

ইমতিয়াজ বারণ করবে ভাবলো, আজ তার জীবনের একটা নিষ্ঠুরতম দিন। ভেবেছিল আজ রাতে না খাইয়েই ঘুমাবে। কিন্তু রাগান্বিতার আবদার কি সে ফেলতে পারে। ইমতিয়াজ মৃদু হেসে বলে,“তুমি খাইয়ে দিলে আমি বিষ পান করতেও রাজি।”

রাগান্বিতা নিরুত্তর। চুপচাপ। কি বলবে আবারও ভেবে পায় না। আজ তার হলোটা কি ইমতিয়াজের কথার উত্তর কেন দিতে পারছে না।

রাতটা বেশ চমৎকার কাটলো। ইমতিয়াজ রাগান্বিতা একে অপরকে খাইয়ে দিয়ে। জড়িয়ে ধরে একসাথে ঘুমালো। ইমতিয়াজ ঘুমালেও রাগান্বিতা ঘুমায়নি। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে দেখছে ওই সুরঙ্গের মতো জায়গাটায় কি আছে ততক্ষণ পর্যন্ত তার শান্তি মিলবে না। তাকে জানতেই হবে ওখানে কি আছে?”
—-
নভেম্বর ২, ১৯৮১! শীত ভেজা সকাল। কুয়াশা পড়েছে বাহিরে। বাড়ির উঠানের সবুজ ঘাসের ডগায় শিশির জমেছে খানিকটা। রাগান্বিতা গায়ে একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায় অপেক্ষা করছে রবিনের। রাগান্বিতা ধরে নিয়েছে ওই জায়গাটার চাবিটা কেউ যদি তাকে দিতে পারে তা একমাত্র রবিনই দিতে পারবে। কারণ কাল রাতে রাগান্বিতা দেখেছে রবিনের পকেটেই ওই চাবিটা আছে। রাগান্বিতা আন্দাজ করছে রবিন রোজই ওখানের চাবিটা নিয়ে বাড়ি আসে এবং রাতে দেখতে যায়। আজ রাগান্বিতাও দেখবে কোনো না কোনো উপায়ে রবিনের কাছ থেকে চাবিটা নিবেই। বলে না হোক, না বলে নিবে তবুও নিবে। আজ ইমতিয়াজ বাড়ি থাকবে না কোথাও একটা যাবে। যদিও রাগান্বিতাকে এই কথাটা বলে নি ইমতিয়াজ। কিন্তু কাল রাতে সে শুনেছে। ইমতিয়াজের তাকে কিছু না বলাটাও একটা সন্দেহের বিষয়। কিছু তো একটা লুকাচ্ছেই ইমতিয়াজ। রাগান্বিতার হুস ফিরলো ইমতিয়াজের ডাকে। তাকে বললো,“বউ আমি যাচ্ছি তুমি সাবধানে থেকো।”

রাগান্বিতা একটু ছলছল দৃষ্টি নিয়ে তাকালো ইমতিয়াজের দিকে। বললো,“আজ এতো তাড়াতাড়ি যাচ্ছেন।”

ইমতিয়াজ রাগান্বিতাকে কাছে টেনে নেয়। বলে,“আমায় খুব মনে করো তাই না?”

রাগান্বিতা জবাব দেয় না। ইমতিয়াজ বলে,“শোনো না বউ কাল তোমায় একটা উপহার দিবো বিশেষ উপহার।”

রাগান্বিতা অবাক হয়ে বলে,“কি উপহার?”

ইমতিয়াজ হেঁসে বলে,“উপহার কি আগে বলতে আছে! কাল বলবো তুমি অপেক্ষায় থেকো।”

এই বলে রাগান্বিতার কপালে এক গভীর চুমু কাটে ইমতিয়াজ। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,“আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এই স্পর্শ তোমার আমার ভালোবাসার শেষ স্পর্শ হবে।”

তক্ষৎনাৎ নিজের কথার উপর নিজেই চমকে উঠলো ইমতিয়াজ। এ কি বলে ফেললো সে। এ কথা তো বলার ছিল না। রাগান্বিতা নির্বিকার চেয়ে রইলো ইমতিয়াজের মুখের দিকে। মনে হলো সে বোধহয় শুনতে পায় নি ইমতিয়াজের কথাটা। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি কি রাগ করলে?”

রাগান্বিতার শীতল চাহনি। কেমন একটু করে যেন বললো,“না।”

ইমতিয়াজ সস্থির নিশ্বাস ফেলে বলে,“তুমি মানো বা না মানো এই ইমতিয়াজ এত সহজে তোমার পিছু ছাড়বে না। মরে গেলেও না।”

রাগান্বিতা এবার মুখ খুলে সরল চাহনি নিয়ে বলে,“রাগান্বিতা বুঝি ছেড়ে যাচ্ছে।”

ইমতিয়াজ কেমন যেন হয়ে গেল। বুকের মধ্যেখানে কেমন একটু করে উঠলো। যন্ত্রণা হলো বুঝি কোথাও। সে বললো,“আমার খুব ভয় লাগে,আমায় কখনো ছেড়ে যেও না বউ।”

ইমতিয়াজ আর দাঁড়ালো না। রাগান্বিতার উত্তরেও অপেক্ষা করলো না। চলে গেল। আচমকা বুকটা জ্বলে উঠলো। কি যন্ত্রণা হলো যে!’

সদর দুয়ার ছেড়ে বাহিরে আসতেই রবিন ভিতরে ঢুকলো। ইমতিয়াজের সঙ্গে দেখা হলো। রবিন জিজ্ঞেস করলো,“যাইতাছো?”

ইমতিয়াজ বললো,“হুম যাবো কতক্ষণ পর।”
রবিন আবার বললো,
“না গেলে হইতো না?”
“আমি সুন্দরভাবে রাগান্বিতাকে নিয়ে বাঁচতে চাই চাচা।”
“যদি ও কোনোদিন জানে?”
“জানবে না। আমি সব লুকিয়ে ফেলবো। ফিরে এসেই আমি চিরতরে ঐ পাতালকক্ষে ঢোকার সকল দুয়ার বন্ধ করে দিবো।”

রবিন নির্বিকার চাহনি নিয়ে তাকিয়ে রইলো ইমতিয়াজের দিকে। ইমতিয়াজ যেতে নিলো আবার পিছন ফিরে বললো,“আমি রাগান্বিতাকে নিয়ে সুন্দর মতো বাঁচতে পারবো তো চাচা?”

রবিন চাচা কিছু বলবে তার আগেই ইমতিয়াজ চলে গেল এবারও অপেক্ষা করলো না উত্তরের। রবিন চাচা উত্তর দিতে গিয়েও থেমে গেলেন পলকবিহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ইমতিয়াজের যাওয়ার পানে। কেন যেন তার কান্না আসছে! পোলাডা সেই ছোট বেলা থ্যাইক্কাই খালি কষ্ট পায় কিন্তু কখনো বাঁচার জন্য এমন আকুতি করতে দেখেনি চাচা।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা রাগান্বিতা চেয়ে রইলো ইমতিয়াজের দিকে। হঠাৎ করে কি যে হলো তার বোঝা গেল না। কেমন যেন সবকিছু খালি খালি লাগছে। মনে হচ্ছে সবকিছু বুঝি তার থেকে হারিয়ে যাবে।

রাগান্বিতা জোরে নিশ্বাস ফেললো। শ্বাস নিতে বোধহয় কষ্ট হচ্ছে। এমন বিচ্ছিরি অনুভূতি হওয়ার কারণটাই মাথায় আসছে না রাগান্বিতার।”

রেশবপুরে গন্যমান্য মানুষের সাথে রেজওয়ানের বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা বলছেন মোতালেব তালুকদার। মির্জাপুরের জমিদার সুলতান ব্যাপারীর একমাত্র কন্যার তৃধার সঙ্গে বিয়ে দিতে চাচ্ছেন রেজওয়ানকে। মেয়ে দেখা হয়ে গেছে। মেয়ে অপরূপ সৌন্দর্য্যের অধিকারি। কথাবার্তাও সুন্দর। রেজওয়ানের পছন্দ হয়েছে মেয়ে। তাই আর দেরি না করে যতদ্রুত সম্ভব বিয়েটা দিতে চাচ্ছেন মোতালেব তালুকদার। বাড়িটাও ফাঁকা ফাঁকা ঠেকছে বউ আসলে বাড়িটা আবার বোধহয় মেতে উঠবে। নাতি নাতনিরা তাকে দাদাজান, দাদাজান বলে ডাকবে দারুণ শোনাবে কিন্তু। আনমনাই হেঁসে ফেললেন মোতালেব তালুকদার।

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৪৫
________________
রন্ধন শালায় কাজ করছে রবিন। রাগান্বিতা দাঁড়িয়ে আছে রন্ধন শালার দুয়ারের কাছে। দৃষ্টি তার রবিনের জামার বুকপকেটের দিকে। রবিনের গায়ে ফতুয়া আর লুঙ্গি পড়া। রবিন তাকালো রাগান্বিতার দিকে। বললো,
“কিছু কি কইবা রাগান্বিতা?”

রাগান্বিতা রন্ধন শালার ভিতরে ঢুকলো। মৃদু স্বরে বললো,“আমি কি কিছু করবো চাচা?”

চাচা মৃদু হেসে বললেন,“না লাগবো না আমি একাই সব পারুম।”

রাগান্বিতা অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললো,“চাচা শরবত বানাবো খাবেন?”

রবিন চাচা বেশ অবাক হয়ে বললো,
“এহন শরবত খামু।”
“বানাতে ইচ্ছে হচ্ছে তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

রবিন চাচা বেশি ভাবলেন না। মিষ্টি হেঁসেই বললেন,“আইচ্ছা বানাও।”

রাগান্বিতা খুশি হলো। বললো,“আমি এক্ষুণি বানিয়ে আনছি।”

চলে গেল রাগান্বিতা। রবিন চাচা তার দিকে তাকিয়ে হাসলো। সামান্য শরবত বানাতে বলতেই এত খুশি হলো মাইয়াডা। বড় ভালা মাইয়া। ইমতিয়াজ পোলাডায় খালি খালি বাঁচতে চায় না। মৃদু হেসে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রবিন চাচা।

টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে দু’গ্লাস শরবত বানাচ্ছে রাগান্বিতা। সে কাজটা ঠিক করছে কি না জানে না। তবে ওই জায়গায় কি আছে জানতে হলে এই কাজটা করতেই হবে রাগান্বিতার। রাগান্বিতা শরবত বানাতে বানাতে হঠাৎই তার শাড়ির আঁচলে বেঁধে রাখা একটা কাগজ বের করলো। সেই কাগজের ভিতর ছিল কবিরাজের বানানো একটা ঔষধ। এটা খেলে মানুষ খুব গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়। ১২ ঘন্টার আগে তার ঘুম ভাঙে না। ইমতিয়াজের ঠিক মতো ঘুম হয় না এসব ভেবে এবার এনেছিল রাগান্বিতা তবে ব্যবহার করা হয়নি। কখনো ভাবে নি এইভাবে কাউকে ঘুমের ঔষধ খাওয়াবে। রাগান্বিতার বড্ড বুক ধুকপুক করছে। কি থাকতে পারে ওই জায়গাটায়।”

যথারীতি শরবত বানিয়ে রাগান্বিতা ছুটে গেল রবিন চাচার কাছে। তারপর একগ্লাস শরবত রবিন চাচার দিকে দিয়ে বললো,
“খান চাচা।”

রবিন নিলো। এক চুমুক দিয়েই বললো,“ভালো বানাইছো তো।”

মৃদু হাসলো রাগান্বিতা। বললো,“আপনার পছন্দ হয়েছে চাচা?”

রবিন চাচা আরেক চুমুক দিয়ে বললো,“হুম অনেক।”

রাগান্বিতা মুচকি হাসলো। রবিন পুরোটা শেষ করে দ্রুত নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। কতক্ষণ যেতে না যেতেই তার ভীষণ ঘুম ঘুম পেল। রাগান্বিতা প্রশ্ন করলো,“আপনার ঘুম পাচ্ছে চাচা ঢুলছেন যে।”

রবিন রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বললো,
“হ কেমন জানি লাগতাছে?”
“কাল রাতে কি চাচি ঠিক ভাবে ঘুমাতে দেয় নি চাচা।”

চাচা হেসে ফেললেন। বললেন,
“তুমিও না কি যে কও। কাইল তো আমি যাওনের আগেই বউ ঘুমাইয়া পড়ছে।”
“ওহ আচ্ছা। চাচা আপনি এক কাজ করুন নিজের ওই কক্ষে গিয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিন। আমি বাকি কাজ করে দিচ্ছি।”

রবিন চাচা শুনলেন তার অসম্ভব ঘুম পাচ্ছে। চাচা ঢুলতে ঢুলতে তার কক্ষে গেলেন। রাগান্বিতা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। এগুলো কি করছে! অন্যায় করছে তবুও উপায় নেই। ওই জায়গাটার কৌতুহল কিছুতেই কাটাতে পারছে না রাগান্বিতা।”

চাচা যাওয়ার মিনিট দশ যেতেই রাগান্বিতা ছুটে গেল রবিন চাচার কক্ষে। গিয়ে দেখলো পালঙ্কে আধমরা হয়ে শুয়ে আছেন। রাগান্বিতা এগিয়ে গেল। বুকপকেট থেকে চাবিটা বের করলো। সঙ্গে বললো,“আমায় ক্ষমা করে দিয়েন চাচা।”

কথাটা বলেই চাবিটা নিয়ে দ্রুত বাহিরে বেরিয়ে আসলো রাগান্বিতা। তার বুক কাঁপছে, হাত কাঁপছে, অস্থিরতায় চারপাশ বুঝি ধেঁয়ে যাচ্ছে।”
—-
ট্রেনে বসে আছে ইমতিয়াজ। চোখে মুখে ক্রোধের প্রতিচ্ছবি। আজ যাই ঘটুক। এই হতাশা শেষ করেই বাড়ি ফিরবে ইমতিয়াজ। ইমতিয়াজ চোখ বন্ধ করে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে ভেসে আসলো একটা মেয়ের প্রতিচ্ছবি। বিষের শিশি পড়ে রইলো নিচে, পাশেই নিথর হয়ে পড়ে থাকা সেই ভয়ানক দৃশ্য। যে দৃশ্য ইমতিয়াজের পুরো জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক দৃশ্য ছিল। ইমতিয়াজ চোখ খুলে ফেললো। বললো,“আজই তোর শেষ দিন। আমি আর কারো জীবন নষ্ট হতে দিবো না। পাষাণ মানুষের জন্য কখনো ফুলের মতো মানুষদের জন্ম হয় না। আজও হবে না।”

ইমতিয়াজ চেয়ে রইলো বাহিরে। একটু একটু করে সে ছুটে যাচ্ছে তার গন্তব্যের দিকে। প্রতিহিংসার আগুন বুঝি আজই শেষ হবে।
—-
ডালপালায় ভর্তি সেই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছে রাগান্বিতা। কেমন যেন লাগছে। কোনো ভয়ানক কিছু দেখে ফেলবে না তো। আচমকাই একটা কাক কা কা করে উঠলো রাগান্বিতা আরো কেঁপে উঠলো সে আশেপাশে তাকালো, না দূরদূরান্তে কেউ নেই। রাগান্বিতা জোরে নিশ্বাস ফেললো সে মোটেও ভীতু নয় তবে কেন যেন আজ ভীষণ ভীতু হচ্ছে। রাগান্বিতা নিচে বসলো ডালপালা সরালো। সেই দরজাটা নজরে আসলো। রাগান্বিতা কাঁপা কাঁপা হাতে চাবি দিয়ে দরজাটা খুললো। সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে থাকা কালো আধার বুঝে ধেঁয়ে আসলো। রাগান্বিতা বেশি না ভেবেই আস্তে আস্তে সুরঙ্গের ভিতরে ঢুকলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার মিললো প্রথমে। রাগান্বিতা ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নামলো। কতটুকু নামতেই দেখলো দু’ধারে মশালে আগুন জ্বালানো। রাগান্বিতা সাহস নিয়ে একটা মশাল হাতে নিলো। সুরঙ্গের দুয়ার আঁটকে দিল। তবে তালা দিলো না। রাগান্বিতা শাড়ির আঁচল দিয়ে তার নাকমুখের ঘাম মুছতে মুছতে নিচে নামলো। বেশ গভীরে এই জায়গাটা। রাগান্বিতা সিঁড়ি বেয়ে অনেকদূরে নামলো হঠাৎই দেখতে পেল বিশাল এক কক্ষ তার চারপাশে শুধু হেরিকেন জ্বলছে সঙ্গে দেয়ালে দেয়ালে মশাল। কিছুটা গুপ্তধন লুকিয়ে রাখার মতো জায়গা। রাগান্বিতা পুরো কক্ষে চোখ বুলালো। কিচ্ছু নেই পুরোটা ফাকা। হঠাৎই নজর গেল তার থেকে অনেক দূরে একদম কর্নারে একটা টেবিল আর চেয়ারের দিকে। রাগান্বিতা একটু একটু করে সেই টেবিলের কাছে গেল। এই ফাঁকা ঘরে রবিন চাচা আর ইমতিয়াজ কি করে। রাগান্বিতা টেবিলের কাছে গিয়ে কিছু পুরনো খাতা আর কাগজপত্র ছাড়া কিছুই দেখছে না। রাগান্বিতা হতাশ হলো সে কি খামোখাই ভুলভাল ভাবছিল। আচমকাই কোথ থেকে যেন একটা কবতুর আসলো কক্ষে। রাগান্বিতা ভয়ংকরভাবে চমকে উঠলো এতে। সে ঘাবড়ে গিয়ে পিছিয়ে গেল, টেবিলের সাথে ধাক্কা লাগতেই কিছু বই আর কাগজপত্র গড়িয়ে পড়লো নিচে। রাগান্বিতা তাকিয়ে রইলো কবতুরটার দিকে এটা তো সেই কবুতর যেটা রেশবপুরে বসে তাকে প্রায় চিরকুট দিতো। রাগান্বিতা পায়ের দিকে তাকালো আজও কি যেন নিয়ে এসেছে কবুতরটা। রাগান্বিতা এগিয়ে গেল কিন্তু কবতুর ছুট লাগালো। রাগান্বিতা বুঝেছে এ বার্তা তার জন্য নয়। কবুতর সারা কক্ষে ছুটলো তার পিছু রাগান্বিতা। আচমকাই আগুনের ফুলকিতে গা লাগলেই আহত হয় কবুতর সে ছিটকে পড়ে গেল নিচে। রাগান্বিতা ঘাবড়ে যায় দ্রুত ছুটে যায়। কোলে তুলে নেয় কবুতরকে বলে “এত ভয় পাবার কি আছে আমি তোকে মেরে ফেলবো নাকি।”

এই বলে গায়ে হাত বুলাতে লাগলো রাগান্বিতা। কবুতর চুপচাপ রইলো। রাগান্বিতা কবতুরটাকে টেবিলের উপর রেখে নিচে পড়ে থাকা সব খাতাপত্রগুলো উঠালো। হঠাৎই চোখ গেল একটা খামের দিকে। সে উঠালো। খুললো। পৃষ্ঠার প্রথম লেখাটা পড়তেই তার বুক কেঁপে উঠলো। যেখানে লেখা ছিল,
কুহেলিকা শুনছো তোমার নামে আজই শেষ চিঠি লিখছি। তুমি বারণ করেছিলে আমি যেন আর তোমার নামে চিঠি না লিখি আমি শুনেছি আজকের পর আর তোমায় চিঠি লিখবো না।”
~ ইতি,
আরফান মজুমদার।”

রাগান্বিতা সব কিছু দেখতে লাগলো। একটা কালো রঙের ডাইরি নজরে এলো। রাগান্বিতা খুললো। মাঝপৃষ্ঠায় এলো। যেখানে লেখা ছিল, তোমার মৃত্যু আমার হাতেই লেখা কুহেলিকা। তবে তোমায় আমি নিজ হাতে মারবো না। তুমি মরবে একা একাই তোমাকে মরতে বাধ্য করবো আমি। আমার প্রতিহিংসার প্রথম মানুষ হবে তুমি এরপর তোমার বোন রাগান্বিতা। তাকেও তোমার মতো মারবো প্রথমে চিঠি, তারপর প্রেম, মিথ্যে বিয়ে, কলঙ্কিত শরীর, আর পরিশেষে মৃত্যু। এই শহরে প্রেম মানেই মৃত্যু। তোমাকেও মেরেছি তোমার বোনকেও মারবো।”

রাগান্বিতার পুরো শরীর বুঝি নিস্তেজ হয়ে গেল এক নিমিষে। তার মানে সেদিন ইমতিয়াজ তাকে মিথ্যে বলেছিল আসলে আরফান মজুমদার ইমতিয়াজই। রাগান্বিতার বিশ্বাস হচ্ছে না। চারপাশ ঘুরছে। রাগান্বিতা পৃষ্ঠা উল্টালো। আবারও লেখা দেখলো,

আজ তোমার মৃত্যুর ষষ্ঠদিন চলছে। কাল সপ্তম দিন। আর কালই আমি যাচ্ছি রেশবপুর। তোমার বোনকে দেখতে। অবশ্য তোমার বোনের চেয়ে তোমার মৃত্যুতে তোমার পুরো পরিবার কেমন কাতরাচ্ছে তা দেখার ইচ্ছে আমার বেশি। তোমার বোনের মৃত্যুতে আমি তোমাদের বাড়িতেই থাকবো। তার মৃতদেহের দাফন আমি নিজ চোখে দেখবো তোমারটা তো দেখা হয় নি কিন্তু তারটা দেখবো। ঠিক দেখবো।”

রাগান্বিতার হাত থেকে ডাইরিটা পড়ে গেল। সেই ভরসন্ধ্যা বেলা বাঁশির সুর শুনে দেখতে যাওয়া মানুষটাই নাকি তার বোনের মৃত্যুর কারণ ছিল। আর সে কি না সেই মানুষটাকেই প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেললো। ঘৃণা হচ্ছে রাগান্বিতার। নিজের উপরই ঘৃণা হচ্ছে, তাহলে কি তাকে বিয়ে করাটাও একটা ছক ছিল। তবে কি তাদের বিয়েটাও মিথ্যে ছিল। পরক্ষণেই ভাবলো না বিয়েটা তো তার বাবার প্রিয় কাজী সাহেব দিয়েছিল সে মিথ্যে হতে পারে না। তার থেকেও বড় কথা বিয়েটা তো ইমতিয়াজের সাথে নয় মাহাদের সাথে হওয়ার কথা ছিল। তবে কি মাহাদকে বিয়ের দিন ইমতিয়াজই নিখোঁজ করে পরে মেরে ফেলে। রাগান্বিতার মাথা ঘুরছে। এসব কি দেখে ফেললো। শেষমেশ কি না এত ভালোবাসার মানুষটাই মিথ্যে হলো। রাগান্বিতা যেন আজ বুঝলো ইমতিয়াজ তাকে বার বার কেন বলতো। আমায় এত বিশ্বাস করো না বউ?”

রাগান্বিতার বিশ্বাস হচ্ছে না। না এগুলো সব মিথ্যে। ইমতিয়াজ এমন হতে পারে না। তাকে ঠকাবে না। ইমতিয়াজ তাকেই ভালোবাসে। আরফান মজুমদার ইমতিয়াজ নয়। কিছুতেই নয়। ইমতিয়াজ তো বলেছিল আরফান মজুমদার তার বন্ধু ছিল। হতেই পারে এগুলো সব আরফান মজুমদার করেছে। এই জায়গাটাও আরফান মজুমদারের। হুম হতেই পারে। রাগান্বিতা দিশেহারা হয়ে পড়লো। তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ইমতিয়াজকে চাই তার, সে সরাসরি সব জিজ্ঞেস করবে। রাগান্বিতা আবার নিচটা দেখলো চোখ গেল তারই আপার হাতে লেখা চিঠির দিকে। রাগান্বিতা কাঁপাকাঁপা হাতে চিঠিটা উঠালো। দেখলো সেখানে লেখা,
“আমি মা হতে চলেছি আরফান। আর আপনি বলছেন আমাদের পুরো বিয়েটাই মিথ্যে ছিল। এমনটা কেন করলেন আমার সাথে! আমার দোষ কি ছিল! আমাকে এভাবে কলঙ্কিত কেন করলেন! কলঙ্কিত করার জন্যই বুঝি এভাবে গোপন বিয়ে করতে বলেছিলেন। আপনি এত নিষ্ঠুর ছিলেন আরফান। আপনার যদি আমাকে মারারই ইচ্ছে ছিল তবে নিজ হাতে গলা টিপে মারতেন এভাবে কলঙ্কিত কেন করলেন আরফান।”

রাগান্বিতা চিঠি হাতে ঠায় বসে পড়লো। সে কাঁদতে চাচ্ছে কিন্তু কাঁদতে পাচ্ছে না। তার চোখে পানি আসছে না অথচ বুক ফেটে যাচ্ছে। টেবিলের উপর থাকা কবুতরটা আচমকাই ডানা ঝাপটাতে গিয়ে নিচে গড়িয়ে পড়লো। রাগান্বিতা দেখলো পায়ে আঁটকে থাকা চিরকুটটা নিলো। কিছু দেখতেই তার কলিজা বুঝি কেঁপে উঠলো। রাগান্বিতা আর দাঁড়ালো না কুহুর লেখা শেষ চিঠিটা হাতে নিয়েই সে ছুট্টে বের হলো। যতদ্রুত সম্ভব তাকে রেশবপুরে যেতে হবে। রাগান্বিতার গায়ে জড়ানো ছিল শাড়ি, চুড়ি, ভাড়ি অলংকার। চুলগুলো ছিল শক্ত করে খোঁপা করা। রাগান্বিতা আটপাঁচ কিছু না ভেবেই গায়ে কালো রঙের লম্বা চাঁদর পেঁচিয়ে কিছু পয়সা-কড়ি নিয়েই বেরিয়ে গেল। তার মাথা কাজ করছে না। বার বার মন থেকে চাইছে সে যা দেখেছে সব মিথ্যে হোক। এটার কোনোটাই বাস্তব নয়। তার ইমতিয়াজ এতটা পাষাণ কিছুতেই হতে পারে না।”

রাগান্বিতা ঢাকার বাড়ি ছেড়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। নিথর পড়ে রইলো ইমতিয়াজের বাড়ি। রবিন নিস্তেজ হয়ে শুয়ে রইলো পালঙ্কে। তার অগোচরে কতকিছু ঘটে গেল সে টেরও পেল না।”
—–
তখন প্রকৃতি জুড়ে সন্ধ্যা নেমেছে। চারপাশ থমথমে আর নিশ্চুপ। গ্রামের সবাই মাগরিবের নামাজ পড়তে ব্যস্ত। রাগান্বিতা গরুর গাড়ি ছেড়ে নামলো দৌড়ে গেল বাড়ির ভিতরে গা থেকে কালো চাদরটা খসে পড়লো ঠিক বাড়ির উঠানে। পুরো প্রকৃতি তখন নির্জীব। কেমন ভয়ানক লাগছে চারপাশটা। রাগান্বিতা সদর দুয়ার দিয়ে ভিতরে ঢুকলো সঙ্গে সঙ্গে এক ভয়ানক দৃশ্য দেখে ফেললো যা দেখা একদমই কাম্মো ছিল না রাগান্বিতার। রাগান্বিতা দেখলো তারই বাবা মোতালেব তালুকদারের গলায় ধারালো ছুড়ি দিয়ে গলায় পোছ দিয়ে ফেলেছে ইমতিয়াজ। পুরো পৃথিবী বুঝি এক নিমিষেই থমকে গেল রাগান্বিতার। সে ঠায় বসে পড়লো। ইমতিয়াজ দেখতে পেল রাগান্বিতাকে। অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো সে। রাগান্বিতার বাবার নিথর দেহ লুটিয়ে পড়লো নিচে। পুরো গলা কাটা মুরগীর মত ছটফট করতে লাগলেন তিনি। রাগান্বিতা তার বাবার দিকে তাকিয়ে কেমন অসহায় লাগছে নিজেকে। রাগান্বিতার বাবা তাকিয়ে রইলেন রাগান্বিতার দিকে। ধীরে ধীরে তার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেল সে বুঝেছেন সে থাকছে না আর এই পৃথিবীতে। রাগান্বিতার বাবা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন তবে চোখ দুটো রাগান্বিতার দিকে। রাগান্বিতা নিশ্চুপ, নির্বিকার তার হাত থেকে পড়ে গেল কুহুর চিঠি। ইমতিয়াজের নজরে পড়লো তা। হাত থেকে ছুরি পড়ে গেল নিচে। ঝনঝনিয়ে শব্দ হলো তাতে। এবার রাগান্বিতার দৃষ্টি গেল তার বাবার থেকে কয়েক কদম দূরে লুটিয়ে পড়ে থাকা রাগান্বিতার ভাই রেজওয়ান তালুকদারের দিকে। তার পুরো শরীর একটা জলজ্যান্ত দানব যেভাবে হামলা করে ঠিক সেভাবে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। রাগান্বিতা এবার তাকালো ইমতিয়াজের দিকে তার পুরো শরীর রক্তে ভেজা। বোঝাই যাচ্ছে কতটা প্রতিহিংসা নিয়ে মেরেছে তার জলজ্যান্ত দুটো প্রিয় মানুষ বাবা আর ভাইকে। রাগান্বিতার দৃষ্টি ছিল ভিন্ন রোজকারের দৃষ্টি থেকে একদমই ভিন্ন। ইমতিয়াজ এই দৃষ্টি আগে দেখে নি। দু’জনেই চেয়ে রইলো একে-অপরের দিকে, ইমতিয়াজ দাঁড়ালো না আর তার আনা ছুরি রেখেই সে বেরিয়ে গেল বাহিরে। রাগান্বিতা স্তব্ধ হয়ে দেখলো একবার তার ভাইয়ের লাশ আর একবার তার বাবার। মনে করতে লাগলো কবতুরের পায়ে লেখা চিরকুটটার কথা। যেখানে লেখা ছিল,
“ভাই রেজওয়ান ভাইরে কি আইজগোই মারবেন?”

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#TanjiL_Mim♥️

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-৪২+৪৩

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৪২
________________
হন্তদন্ত হয়ে ইমতিয়াজের লেখা একটা পৃষ্ঠা খুঁজছে রাগান্বিতা। চোখে মুখে অশেষ আতঙ্কের ছাপ। না এমন কিছুই হতে পারে না। রাগান্বিতা পাগলের মতো খুঁজছে সেদিনের লেখাটা। যে লেখা ইমতিয়াজ তারই সামনে তাদের বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে লিখেছিল। যেদিন গ্রামের সকল শিক্ষিত ছেলেদের হাতের লেখা নিয়েছিল রাগান্বিতা আর সেদিন ইমতিয়াজের হাতের লেখাটাও নিয়েছিল। সেদিন ইমতিয়াজ চিঠির শেষে বাড়তি দু’লাইন লিখেছিল,“প্রেমপত্র উন্মোচনের বুদ্ধিটা দারুণ। কিন্তু সে যে এই গ্রামেরই তা জানলেন কি করে?”

সেই লেখা রাগান্বিতা খুব যত্ন করে রেখেছিল নিজের কাছে। শেষ কথাটা যে কতবার রাগান্বিতা পড়েছে তার হিসাব নেই। কিন্তু আজ সেই হুবহু হাতের লেখা আসলো তার আপার চিঠিঘর থেকে। ভাবলেই সব লন্ডভন্ড হচ্ছে। রাগান্বিতা কোথাও ভুল করছে না তো তাই হাতের লেখা মিলালোর জন্যই এমন হন্তদন্ত হয়ে সেই লেখাটা খুঁজছে কিন্তু পাচ্ছে না। হঠাৎই রাগান্বিতার মনে হলো সে লেখাটা বোধহয় ঢাকার বাড়িতে রেখে এসেছে। রাগান্বিতার অস্থিরতা বাড়ছে। তার বুক ধুকপুক করছে এটা কি দেখে ফেললো তার অশান্তি লাগছে। মন থেকে চাইছে এই লেখার সঙ্গে যেন ইমতিয়াজের লেখা না মিলে। আর তাছাড়া তার আপার যে ছেলের সঙ্গে আলাপ ছিল তার নাম তো আরফান মজুমদার। তাহলে হাতের লেখা মিলে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। সে নিজেই ভুলভাল ভাবছে। রাগান্বিতা যখন এসব ভাবতে ব্যস্ত ঠিক তখনই রাগান্বিতার কক্ষের দুয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে বললো ইমতিয়াজ,
“বউ।”

“বউ” শব্দটা কানে আসতেই রাগান্বিতার রুহু সমেত যেন কেঁপে উঠলো। রাগান্বিতা ঘাবড়ে গেল। আরফানের লেখা চিরকুটটা দ্রুত লুকিয়ে পিছন ফিরে তাকালো। ইমতিয়াজ এগিয়ে আসলো। ইমতিয়াজ যত এগিয়ে আসছে রাগান্বিতা তত ঘাবড়াচ্ছে। তার বুক কাঁপছে, হৃদয় লাফাচ্ছে, অস্থিরতায় চারপাশ বুঝি নড়েচড়ে উঠছে। এ কেমন অসহ্যকর অনুভূতি! রাগান্বিতা নিতে পারছে না।

ইমতিয়াজ রাগান্বিতার চোখ-মুখের হাবভাব পর্যবেক্ষণ করলো। শীতল সুরে শুধালো,
“কিছু কি হয়েছে বউ? তোমায় খুব অস্থির দেখাচ্ছে।”

রাগান্বিতা কেমন এক ছলছল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো ইমতিয়াজের দিকে। হাতে তখনও আরফানের পাঠানো চিরকুটটা। খুব শক্ত করে মুঠোবদ্ধ করে চেপে ধরলো চিরকুটটা। ইমতিয়াজ আবার বললো,
“কি হলো তুমি কথা বলছো না কেন?”

রাগান্বিতা তাও কিছু বললো না। তার কেমন সবটা এলোমেলো লাগছে। রাগান্বিতা অনেক ভেবে প্রশ্ন করলো,“আরফান মজুমদার নামে আপনার কোনো বন্ধু আছে?”

ইমতিয়াজ থমকে গেল। এ কি প্রশ্ন করে বসলো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ অবাক হয়ে বললো,“কেন?”

রাগান্বিতা বিতৃষ্ণা নিয়ে বললো,“যে প্রশ্নটা করলাম তার উত্তর দিন না আপনার কোনো বন্ধু আছে বা ছিল আরফান মজুমদার নামে?”

ইমতিয়াজ স্তব্ধ হয়ে পালঙ্কে বসলো। মিনিট দুই যেতেই বললো,“হুম ছিল।”

সঙ্গে সঙ্গে দমে গেল রাগান্বিতা। ঠান্ডা পরিবেশ। রাগান্বিতা এগিয়ে গিয়ে বললো,“সে কই?”

ইমতিয়াজ মাথা নিচু করে বললো,“বেঁচে নেই।”

রাগান্বিতা এবার ইমতিয়াজের পাশে পালঙ্কে বসলো। স্তব্ধ হয়ে বললো,
“মারা কি করে গেল?”
“জানা নেই। তবে জানো ও না প্রায় আমার হাতের লেখার কিছু চিরকুট নিতো। কাকে যেন পাঠাতো আমার জানা নেই।”

রাগান্বিতার এবার যেন সবটা ঠিক লাগছে। চারপাশ ফুলের মতো সুবাসিত মনে হচ্ছে। মনের সব অস্থিরতা এক নিমিষেই গায়েব হয়ে গেল। শান্তি লাগলো বুঝি অন্তরে। ইমতিয়াজ প্রশ্ন করলো, তা তুমি হঠাৎ ওর নাম জানতে চাইলে কেন? তুমি জানতে ওকে।”

চমকে উঠলো রাগান্বিতা। এবার কি বলবে? রাগান্বিতা আচমকা কেঁদে উঠলো। ইমতিয়াজ ভড়কে গেল। বললো,
“আরে আরে তুমি কাঁদছো কেন?”

ইমতিয়াজ তার হাতের পিছনে লুকিয়ে রাখা চিরকুটটা বের করলো। এগিয়ে দিল ইমতিয়াজের দিকে। বললো,
“আরফান মজুমদার এই চিরকুটটা আপাকে দিয়েছিল।”

ইমতিয়াজ চিরকুটটা দেখলো। অনেকক্ষণ ধরে দেখলো। চমকে বললো,“এই হাতের লেখা তো আমার।”

ইমতিয়াজ তাকালো রাগান্বিতার দিকে। রাগান্বিতা বললো,“আমায় খুন করুন?”

ইমতিয়াজ কয়েককদম পিছনে চলে গেল। হতভম্ব হয়ে বললো,
“এসব কি বলছো?”
“আপনায় নিয়ে আমার আর ভুলভাল চিন্তা আসার আগে আমার মরণ হোক। কঠিন এক মৃত্যু। যে স্ত্রী তার স্বামীকে এক পলকে অবিশ্বাস করে তার ভয়ংকর মৃত্যু হোক।”

ইমতিয়াজ নিশ্চুপ হয়ে গেল। রাগান্বিতাও চুপ। চারপাশ থমথমে, বিষণ্ণ। কি এক বিচ্ছিরি পরিবেশ!’
—-
এরপর কেটে গেল টানা পনের দিন। মাঝে ইমতিয়াজ একবার জরুরি কাজে শহরে গিয়েছিল আবার ফিরেও আসে। রেজওয়ানকে বাড়িতে দেখা যায় না তেমন। বাড়িতে ঢুকলেই নাকি সব কেমন লাগে দাদিমা নেই, কুহু নেই। প্রাণ প্রিয় বন্ধুটাও নেই। কিছু ভালো লাগে না রেজওয়ানের কষ্ট হয়। কিন্তু ধরা দিতে চায় না। পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায় রাগান্বিতা বুঝে তা। নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।”

নিঝুম রাত। বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। ইংরেজি মাস সেপ্টেম্বর ছাড়িয়ে অক্টোবরে পা রেখেছে। শীতের আবহাওয়া বুঝি আসছে। রাগান্বিতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। কাল তারা চলে যাবে দাদিমা, কুহু আপা, বাবা, দাদাভাই, রামুদা সবাইকে ছেড়ে চলে যাবে রাগান্বিতা। রাগান্বিতা এই পনের দিনে রোজ বিকেলে যেত দাদিমা আর কুহুর কবর স্থানে। কত অভিযোগ করতো! কুহুকে খালি বকতো। কেন সে তাকে কিছু বলে নি? কেন জীবিত থাকতে জানালো না আরফান মজুমদারের কথা। রাগান্বিতা ভেবেছিল কোনোদিন আপার সঙ্গে অন্যায় করা ব্যক্তিটির সাথে দেখা হলে নিজ হাতে খুন করবে। কিন্তু তা আর হলো না কারণ লোকটা আরো আগেই মারা গেছে। এই জন্যই বলে যে যেমন করে তার সঙ্গে ঠিক তেমনই হয়।”

বারান্দায় রাগান্বিতার পাশে এসে দাঁড়ালো ইমতিয়াজ। নীরব স্বরে বললো,
“বৃষ্টি দেখছো?”
“না শুনছি।”
“একা একা ভালো লাগে শুনতে?”
“একা কই আপনি আছেন তো।”
“আমি তো মাত্র এলাম।”
“আমিও মাত্রই শুনতে বসেছি।”

হাসে ইমতিয়াজ। বলে,
“দিনে দিনে বড্ড বেশিই ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছো তুমি।”

রাগান্বিতা অবাক হয়ে বলে,
“কেন কি করেছি আমি?”
“কিছু করো নি আমি ভেবে নিয়েছি।”
“উল্টোপাল্টা ভাবা কিন্তু ঘোর অন্যায়।”
“তোমায় নিয়ে যাই ভাবি তাই ন্যায়।”

লাজুক হাসে রাগান্বিতা। হাত পাতে বৃষ্টির পানিতে। বৃষ্টির পানি গায়ে লাগতেই শরীর থরথর করে কেঁপে ওঠে। শীতের ছোঁয়ায় গায়ের পশম যায় দাঁড়িয়ে। ইমতিয়াজের গায়ে জড়ানো ছিল একটা কালো রঙের পাতলা চাদর। ইমতিয়াজ সেটা তার গা থেকে সরিয়ে রাগান্বিতার গায়ে জড়িয়ে দিলো। বললো,
“শীত আসছে তোমার কি লাগবে বলো?”
“কিচ্ছু চাই না আমি শুধু আপনি থাকলেই চলবে।”

ইমতিয়াজ কি মিষ্টি হাসি দিল। রাগান্বিতার কথাটা যেন বেশ চমৎকার শোনালো। কথাটা যেন আবার বাজলো ইমতিয়াজের কানে। কি সুন্দর বললো, “কিচ্ছু চাই না আমি শুধু আপনি থাকলেই চলবে”!
—-
বর্তমান,
“সত্যি কথাটা দারুণ শোনালো, কিচ্ছু চাই না আমি শুধু আপনি থাকলেই চলবে।”

ইলিয়াসের কথা শুনে রামু তাকালো ইলিয়াসের দিকে। বললো,“ডাক্তার বাবু আমনে বহেন আমি রাগান্বিতা আফারে খাওন দিয়াই।”

ইলিয়াস শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো রামুর দিকে। বললো,
“পুরোটা তো শেষ করলে না।”

রামু কেমন এক দৃষ্টি নিয়ে মায়া মায়া কণ্ঠে বললো,
“খাওনডা দিয়াই তারপর শেষ করতাছি।”

রামু কথাটা এমন ভাবে বললো যে ইলিয়াস আর বারণ করতে পারলো না। বললো,ঠিক আছে যাও তাড়াতাড়ি এসো।”

রামু চলে গেল। ইলিয়াস বসে রইলো। ভাবলো,“সবই তো ঠিক ছিল। ইমতিয়াজকে নিয়ে ভাবনাটাও ভুল হলো। আরফান মজুমদার আলাদা ব্যক্তি ছিল। ইলিয়াস ভেবেছিল ইমতিয়াজই আরফান মজুমদার হবে। কিন্তু পরে তো শুনলো না আরফান মজুমদার আলাদা কেউ। আর রাগান্বিতাও সব ভুলে স্বাভাবিক হয়ে গেল। তাহলে পরে কি ঘটলো? যে রাগান্বিতা পাগল হয়ে গেল। আর ইমতিয়াজ সে কেন হারালো। তার তো হারানোর কথা নয়।”

ইলিয়াস বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। রামু রাগান্বিতার ঘরে খাবার দিয়ে আসলো। মেয়েটা নীরব, চুপচাপ বসে আছে পালঙ্কে। রামুর চোখ ভেসে আসলো। যতবার রাগান্বিতার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা ভাবে ততবার তার হৃদয় কাঁদে। বার বার মনে হয় নিয়তি এত নিষ্ঠুর কেন ছিল!”

অতীত,
“ভালো থাকিস মা। আমাদের জন্য ভাবিস না বাড়িতে রামু আছে,রেজওয়ান আছে এছাড়াও গ্রামের মানুষজন আছে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরাও ঠিক থাকবো। আর কিছুদিন গেলেই রেজওয়ানের জন্য বউ আনবো। ব্যস তাহলেই পরিবারটা আবার একটু একটু করে গুছিয়ে যাবে।”

রেশবপুরের ঘাটপাড়ে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বললো রাগান্বিতার বাবা রাগান্বিতাকে। রাগান্বিতা শক্ত হয়ে দাড়িয়ে। কাঁদছে না। রেজওয়ান দূরে দাঁড়িয়ে। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার পাশে। মোতালেব তালুকদারের বলা সব কথাই শুনেছে সে।”

সময় গড়ালো নৌকায় চড়ে বসলো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ মোতালেব তালুকদারের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ভালো থাকবেন জমিদার সাহেব।”

বিনিময়ে মোতালেব তালুকদারও মৃদু হেসে বলে,
“তোমরাও ভালো থেকো।”

নৌকা একটু একটু করে চলে গেল সূদুরে।’

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৪৩
________________
সময়গুলো বড্ড বেমানান। চারপাশ কেমন ঝাপসা ঝাপসা। রাগান্বিতার প্রতিদিনটা কাটছে একা একা। দাদিমার কথা ভাবলেই কান্না আসে তার। কিন্তু কাঁদে না। রাগান্বিতা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর কাঁদবে না। বাবার কথাটা রাখতে হবে তাকে। রাগান্বিতারা রেশবপুর থেকে এসেছে আজ পুরো ত্রিশদিন কেটে গেল। রবিন তার বউ বাচ্চাকে তাদের বাড়িতে রেখে এসেছে রাগান্বিতারা রেশবপুর থেকে ফিরে আসার আগেই। রাগান্বিতা এতে খানিকটা অভিমানও করেছিল কিন্তু রবিন বলেছে পরে আবার আনবে। ইমতিয়াজ আবার কেমন একটা হয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে তেমন একটা থাকছে না সেই সকালে যাচ্ছে আবার রাত করে ফিরছে। কখনো দেখা হচ্ছে, কখনো হচ্ছে না। রাগান্বিতা ঘুমিয়ে পড়ছে। তবে প্রত্যেক সকালে ইমতিয়াজের বুকে নিজেকে ঠিকই দেখছে। মনে মনে মুচকিও হাসছে। মানুষটা তাকে খুব ভালোবাসে এটা বুঝে গেছে রাগান্বিতা। হয়তো কাজের চাপে সময় দিতে পারছে না।

ইমতিয়াজ কিছু একটা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছে কিন্তু কি তা, এটা ধরতে পারছে না রাগান্বিতা। রাগান্বিতার খারাপ লাগে, কেমন যেন একাকিত্ব ঘিরে ধরছে তাকে।’

বুধবার রাত ন’টা। বাড়িতে হাঁটছে রাগান্বিতা। রবিন রন্ধনশালায় আছে এক্ষুণি চলে যাবে। রাগান্বিতা নিচে নেমে এলো। রবিন তখন হাতে করে একটা ব্যাগ টেবিলের উপর রেখে বললো,“রাগান্বিতা আমি বাড়ি গেলাম তুমি খাইয়া দাইয়া শুইয়া পইড়ো আইজগো ইমতিয়াজের আওনের দেরি হইবো।”

রাগান্বিতাও বেশি কিছু না ভেবে বললো,
“ঠিক আছে। সাবধানে যাবেন।”

রবিন মুচকি হেসে বলে, “তুমি খুব ভালা রাগান্বিতা। সাবধানে থাইকো আমি গেলাম।”

মৃদু হাসে রাগান্বিতা। রবিন টেবিলের উপর থেকে ব্যাগটা নিয়ে চলে গেল বাহিরে। ব্যাগের নিচে ছিল রবিনের একটা রুমাল সেটা গড়িয়ে পড়লো নিচে। রবিন খেয়াল না করে শুধু ব্যাগটা নিয়েই বেরিয়ে গেল। রাগান্বিতাও তার পিছু পিছু গেল সদর দুয়ারখানা আটকে দিতে। রাগান্বিতা দুয়ারের কাছে দাঁড়িয়ে আবারও বললো,“সাবধানে যাবেন চাচা।”

বিনিময়ে রবিন মৃদু হেসে বললো, ঠিক আছে দুয়ার আটকাইয়া দেও।”

রাগান্বিতা দিল। এটা রোজই করে রাগান্বিতা দুয়ার আঁটকে দেয় এরপর রবিন যায়। না হলে নাকি তার মনের ভিতর খচখচ করে এমনটা বলে রবিন। রাগান্বিতাও মেনে নেয়।

রাগান্বিতা দরজা আটকে নিজের কক্ষে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হয়। টেবিলের কাছ দিয়ে যেতেই নিচে রবিনের রুমালটা নজরে আসলো রাগান্বিতার। সে দ্রুত রুমালটা উঠালো। এটা রবিন চাচার খুব পছন্দের রুমাল তার বউ বানিয়ে দিয়েছে। রাগান্বিতা একবার ভাবলো রুমালটা কাল দিবে আবার ভাবলো বেশিদূর যায় নি বোধহয় যদি রুমাল না পেয়ে সারারাত দুশ্চিন্তা করে। রাগান্বিতা রুমালখানা নিয়ে সদর দুয়ার খুললো। অন্ধকার রাত। তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। সেইদূরে চলে গেছে রবিন। রাগান্বিতা রবিন চাচা বলে ডাক দিবে। কিন্তু তার আগেই রাগান্বিতা দেখলো রবিন চাচা বাড়ির গেটের কাছে না গিয়ে পিছনের দিকে যাচ্ছে। হাতে হেরিকেন। রাগান্বিতার খটকা লাগলো এই রাতের বেলা রবিন চাচা ওদিকে কোথায় যাচ্ছে। বাহিরে শীতের আমেজ নেমেছে নভেম্বরের প্রথম রাত চলছে। এক ঠান্ডা বাতাস রাগান্বিতার পুরো শরীর নাড়িয়ে দিলো। রাগান্বিতা চোখ বন্ধ করে দাঁড়ালো। আচমকাই রাগান্বিতার খোপা করা চুলটা খুলে গেল। সে শক্ত করে চুলটা বাঁধতে বাঁধতে পিছু নিলো রবিনের। রাগান্বিতা দেখতে চাচ্ছে রবিন চাচা যাচ্ছে কই!”

রাগান্বিতা ধীরে ধীরে পিছু নিলো রবিনের। দুরত্ব খুব অল্প। রবিন বাড়ির পিছন দিকটায় এসেই আশেপাশে তাকালো। রাগান্বিতা দ্রুত বাড়ির দেয়ালের পিছনে লুকানো। রাগান্বিতা দেখলো সেই ডালপালা জুড়ে থাকা লাঠিগুলো সরাচ্ছে রবিন। রাগান্বিতার বুঝতে সময় লাগলো রবিন কি করতে চাইছে। রবিন দ্রুত দ্রুত ডালগুলো সরিয়ে একটা দরজার মতো ঢাকনা খুললো সঙ্গে সঙ্গে ভিতর থেকে গভীর আঁধার বুঝি ধেঁয়ে আসলো বাহিরে। রাগান্বিতা স্তব্ধ বিস্মিত, বাড়ির পিছনে এমন সুরঙ্গের মতো আছে এটা তো সে জানতোই না। রাগান্বিতার সন্দেহের বীজ আবার লাগলো। ভাবলো,“তবে কি এই কারণেই ইমতিয়াজ তাকে এদিকে আসতে বারণ করেছিল। নাকি ইমতিয়াজও এটা সম্পর্কে কিছু জানে না।”

রবিন তার পকেট থেকে একটা চাবি বের করলো। তারপর ঢাকনা খুলে ভিতরে গিয়ে ঢাকনার দুয়ার আবার আঁটকে দিল। পড়ে গেল কিছু ডালপালা। রাগান্বিতা যেন তার চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। তার মানে সেদিন বিকালেও রবিন এটার ভিতর ঢুকে যাওয়ায় রাগান্বিতা আর তাকে দেখতে পায় নি। কিন্তু এটার ভিতর আছে কি। রাগান্বিতা এগিয়ে গেল ডালপালা সরালো কিন্তু ঢাকনা খুলতে পারলো না কারণ চাবি নেই। রাগান্বিতার অস্থিরতা আর কৌতুহল দুটোই বেড়ে গেল। তার জানা চাই এটার ভিতর কি আছে কিন্তু চাবি কই! একই অন্ধকার। তারওপর চারপাশ কেমন থমথমে। রাগান্বিতা হতাশ হয়ে ওখান থেকে ফিরে এলো। সে কি এ বিষয়ে ইমতিয়াজকে কিছু জিজ্ঞেস করবে আবার ভাবলো না তাকেই আগে দেখতে হবে ওটার ভিতর কি আছে।”
—–
রবিন হাতে হেরিকেন আর ব্যাগ নিয়ে ভিতরে আসলো সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো। বিশাল একটা কক্ষ। চারপাশে হেরিকেন জ্বলছে। একখানা টেবিল আর একখানা চেয়ার শুধু। রবিন হেরিকেন হাতে এগিয়ে গেল কারো সামনে। কেউ আছে সেখানে। রবিন কতদূর যেতেই ভাড়ি কণ্ঠে শুধালো কেউ,“রাগান্বিতা কি জেগে আছে চাচা?”

রবিন পিছন থেকেই বললো,“হয় তবে কইয়া আইছি তুমার জন্য বইয়া না থাকতে খাইয়া দাইয়া যেন হুইয়া পড়ে।”

এবার পিছন ঘুরলো ইমতিয়াজ। চোখে মুখে অশেষ রাগের ছাপ। চোখ দুটো অসম্ভব লাল। রবিন ঘাবড়ে যায় ইমতিয়াজের সেই চোখ জোড়া দেখে। বলে,
“যা হইছে তা কি ভোলন যায় না?”

ইমতিয়াজ জবাব দেয় না। রবিন দাঁড়িয়ে রয়। অনেকক্ষণ যাওয়ার পর ইমতিয়াজ একটা ছবিতে হাত বুলিয়ে বলে,
“আজ রাত ১২টায় ওর মৃত্যুর পুরো একবছর পূরণ হবে তাই না চাচা।”

রবিন মাথা নিচু করে বলে,“হয়।”
—-
চিন্তিত মুখ। থমথমে চেহারা। চারপাশ কেমন ঘুরছে। ওই সুরঙ্গের মতো জায়গাটার ভিতর কি আছে জানতে চায় রাগান্বিতা তাকে জানতেই হবে। ইমতিয়াজ কি এ সম্পর্কে অবগত নাকি অবগত নশ। আচ্ছা রবিন চাচা তাদের আড়ালে কোনো বেআইনি কাজ করছে না তো। রাগান্বিতার পিলে চমকে উঠলো তার অস্থিরতা বাড়ছে। সেই চারঘন্টা যাবৎ এসবই ভাবছে সে। আচমকাই কারো কণ্ঠ বুঝি কানে বাজলো। কেউ বললো,“আমি কাল এক জায়গায় যাবো রাগান্বিতাকে দেখে রেখো।”

রাগান্বিতা জানালার আড়াল দিয়ে উঁকি মারলো। কণ্ঠটা চেনা। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের চেহারাটা দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে যেন আরো চমকে গেল তার মানে ইমতিয়াজও জানে ওই জায়গাটার সম্পর্কে। রাগান্বিতা ঘামছে। অজানা এক ভয় তাকে গ্রাস করছে। তবে কি সত্যি সত্যি ইমতিয়াজ তার থেকে কিছু লুকিয়েছে। কিন্তু কি লুকিয়েছে? কেনই বা লুকিয়েছে!’

ইমতিয়াজ বাড়ির ভিতর ঢুকলো না। রবিনকে সঙ্গে নিয়ে কোথায় যেন গেল। রাগান্বিতা নিচে বসে পড়লো। কি চলছে তার আড়ালে? রবিন আর ইমতিয়াজ এরা দুজন যে তার আড়ালে কিছু করছে এটা বেশ বুঝতে পেরেছে রাগান্বিতা। কিন্তু কি সেটা?”

রাগান্বিতা আনমনে বিড়বিড় করে বললো,
“আপনি যা তা যদি মিথ্যে হয়, আমি মানবো কেমন করে।”

পরক্ষণেই মাথা নাড়ালো রাগান্বিতা নিজেকে বোঝালো হতেই পারে ওখানে তাদের ব্যবসার কোনো কিছু ছিল। ইমতিয়াজ বলে নি,হয়তো বলবে। হয়তো কাজের জন্য সময় হয়ে উঠছে না। হতেই পারে। হা এমনটাই হয়েছে। আগের বারও ভাবনায় ভুল হয়েছিল এবারও হবে। রাগান্বিতা অপেক্ষা করবে ইমতিয়াজের বলার। তবে তার আগে সে দেখতে চায় ওখানে কি আছে?”

সময় গড়িয়ে গেল। রাগান্বিতা ঠায় বসে রইলো নিচে। তখন পুরো গভীর রাত। কিছু খোলার আওয়াজ আসলো। রাগান্বিতা কেঁপে উঠলো সে দ্রুত বসা থেকে উঠে পালঙ্কে শুয়ে পড়লো। রাগান্বিতা চাচ্ছে না ইমতিয়াজ তাকে এভাবে দেখুক।”

ইমতিয়াজদের বাড়িতে একটা গোপনীয় জানালা আছে যেটা দিয়েই ইমতিয়াজ রোজ রাতে বাড়িতে ঢোকে। রাগান্বিতা ঘুমিয়ে পড়ে বিধায় আর সদর দুয়ার খোলা হয় না। ইমতিয়াজও দুয়ার নাড়িয়ে শব্দ করে না।”

ইমতিয়াজ জানালা আঁটকে। বাড়ির ভিতর ঢুকলো সে নতুন টেলিফোন কিনে এনেছে। তবে এক্ষুণি চালানো যাবে না একটু সময় লাগবে। রাগান্বিতা দেখলে খুব খুশি হবে। তবে এখন সে দেখাবে না। পরশু দেখাবে। ইমতিয়াজ টেবিল থেকে একটু আড়ালে টেলিফোনটা লুকিয়ে রাখলো। একটা চিরকুট রাখলো। যেখানে লেখা ছিল,“শুধুমাত্র তোমার জন্য বউ।”

ইমতিয়াজ মিষ্টি হেঁসে। আড়াল করলো সেটা। পরশু বিহীন দেখানো হবে না।

ইমতিয়াজ দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে নিলো উপরে হঠাৎই নজর গেল টেবিলের ওপর সব খাবার সাজানো তারমানে রাগান্বিতা আজও না খেয়ে ঘুমিয়েছে। ইমতিয়াজ ভাবলো আজ আর বউয়ের ভোলা ভোলা ঘুমে জড়ানো মুখখানা দেখে চুপ থাকবে না। আজ সে নিজ হাতে বউকে খাইয়ে দিবে।

ইমতিয়াজ খুশি মাখা মুখ নিয়ে উপরে ছুটে গেল। আজ বোধহয় সে খুব খুশি। কোনো এক কাজের সমাধানের সন্ধান বুঝি পেয়ে গেল।”

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#TanjiL_Mim♥️

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-৪০+৪১

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৪০
________________
বিষণ্ণ চারপাশ। নিস্তব্ধ পরিবেশ। কান্নার শব্দ নেই তেমন। বাড়ির পিছনে পুকুরঘাটের পাশে মশারি টানিয়ে চারপাশ বিছানার চাদর দিয়ে লেপ্টে শেষ গোসল করানো হচ্ছে দাদিমাকে। রাগান্বিতা মশারির বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে, তার অন্তর পুরে ছারখার হচ্ছে, ইচ্ছে করছে মাটির ওপর শুয়ে হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাঁদতে। সেই ছোট বেলা থেকে এই মানুষটা রাগান্বিতাকে অনেক যত্ন করেছে। মায়ের চেয়েও বোধহয় বেশি স্নেহ আর ভালোবাসা দিয়েছে। মাকে তো দেখে নি রাগান্বিতা দেখেছে দাদিমাকে। কুহু আপাকেও দারুণ ভালোবাসতো দাদিমা। রাগান্বিতাকে কতবার বাবার ঝার খাওয়া থেকে রক্ষা করেছে, কতবেলা নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে তার হিসাব নেই। সেই মানুষটা আর নেই। ভাবলেই কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে রাগান্বিতার। রাগান্বিতা নিজের ডান হাতটা মুখের চেপে ধরলো কেঁদে উঠলো আবার, তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এত কষ্ট সহ্য হচ্ছে না। দাদিমা কিছু বলতে চাইছিলেন, কি বলতে চাইলেন এই আফসোস যাচ্ছে না রাগান্বিতার। সে আরো আগে কেন এলো না এখানে, কেন আসতে পারলো না দাদিমার কাছে। এই শোক রাগান্বিতাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। যন্ত্রণায় পুরো শরীর বুঝি তীর তীর করে কাঁপছে। রাগান্বিতা ওখান থেকে সরে এলো। আর সইতে পারছে না। কুহু আপার মরণের সময় রাগান্বিতা কাঁদে নি। সে শক্ত ছিল, রাগ ছিল বলা যায় তাই বুঝি কাঁদতে পারে নি। কিন্তু আজ এতটা ভেঙে গেল রাগান্বিতা নিজেকে সামলাতেই পারছে না। রাগান্বিতা বাড়ির ভিতর ঢুকলো ইমতিয়াজ তখন কবর খননের কাজে বাহিরে। দাদিমার শেষ ইচ্ছে ছিল নাকি, কুহুর বামপাশে তাকে যেন কবর দেয়া হয়। কুহু আপা ছোট্ট কাল থেকে দাদিমার বুকের ডানপাশে শুয়ে থাকতে পছন্দ করতো। মোতালেব তালুকদার সেই ইচ্ছে রাখছেন। কুহুর বামপাশে কবর খনন করছেন দাদিমার জন্য।

রাগান্বিতা ঘরের সদর দরজা পর্যন্ত আসতেই দেখা মিললো মোতালেব তালুকদারের সঙ্গে। তিনি রাগান্বিতাকে দেখেই বললেন,
“রাগান্বিতা শুনো,

রাগান্বিতা দাঁড়িয়ে পড়লো। বাবার দিকে অশ্রুভেজা আঁখি নিয়ে তাকালো। সেই শক্তপক্ত রাগান্বিত মেয়েটার চোখে অশ্রু দেখে ভিতরটা মোচর দিয়ে উঠলো রাগান্বিতার বাবার। নিজেকে সামলালেন তিনি। রাগান্বিতা হেঁটে আসলো। মাথা নুইয়ে দাড়ালো। মোতালেব তালুকদার শক্ত গলায় বললেন,
“এত কাঁদছো কেন?”

রাগান্বিতা বাবার দিকে তাকালো তারও চোখ ভেজা। কি আশ্চর্য না। বাবা নিজেও কাঁদতে অথচ আমায় প্রশ্ন করছে এত কাঁদছো কেন! এখন রাগান্বিতা যদি প্রশ্ন করে,তুমি কেন কাঁদছো বাবা?” কিন্তু রাগান্বিতা প্রশ্নটা করলো না। রাগান্বিতার বাবা শক্ত পক্ত গলায় বললেন,
“শোনো রাগান্বিতা আজ কিছু কথা বলি তোমায়। জীবনে কোনো ক্ষেত্রে নিজেকে বেশি ভাঙতে দিবে না। শক্ত থাকবে ঘরের খুঁটির মতো। মনে রাখবে জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। তোমারও থাকবে না আমারও থাকবে না। মৃত্যু চিরন্তন সত্য আজ নয় কাল এটা ঘটবেই। আজ দাদিমা গেছেন, কাল আমিও যাবো। আজ তোমায় একটা আদেশ দিলাম, আমি মারা গেলে তুমি এক ফোঁটাও চোখের পানি ফেলবে না। শক্ত রাখবে নিজেকে। জীবনে কখন কি ঘটে যায় বলা যায় না। কখনো ভেঙে পড়বে না, নিজেকে শক্ত রাখবে সবসময়। জীবনের জটিল মুহুর্তগুলোর সময় নিজেকে ওই আকাশের মতো শীতল মনে করবে। চেষ্টা করবে নিজেকে আকাশের মতো স্থির রাখার। দেখো না হাজার ঝড় বৃষ্টি গেলেও আকাশ সবসময় তার জায়গায় স্থির থাকে। তুমিও তেমন থাকবে। তোমার নামটা আমি রাগান্বিতা কেন রেখেছি জানো,

রাগান্বিতা এবার বেশ আগ্রহ নিয়ে বললো,“কেন?”

রাগান্বিতার বাবা সরল কণ্ঠে বলে উঠলেন আবার,
“তুমি ছোট থেকেই শক্তপক্ত ছিলে সহজে কাঁদতে না। ব্যাথা পেলেও কাঁদতে না যে জিনিসটা আমার ভীষণ ভালো লাগতো। তোমার চোখে ছিল আগুন, কেউ অন্যায় করলে তুমি তার দিকে যে দৃষ্টি নিয়ে তাকাতে তা আমি এই রেশবপুরের কোনো নারীর চোখে দেখিনি। তাই আমি তোমার নাম রেখেছিলাম রাগান্বিতা। এই নামের কোনো অর্থ নেই। তোমার নামটা হলো অর্থহীন তবে এর ওজন কিন্তু ভাড়ি। সেই তুমি আজ এভাবে ভেঙে পড়ছো আমি নিতে পারছি না। তুমি আর কাঁদবে না। আর যদি কাঁদতে হয় তাও লোকসমাজে কাঁদবে না। মনে রাখবে, আনন্দ ভাগ করতে হয় সবার সামনে, কিন্তু কাঁদতে হয় আড়ালে। সবাইকে চোখের পানি দেখাতে নেই। বুঝেছো আমি কি বলেছি,

রাগান্বিতা তার চোখের পানি মুছে নিল। মাথা উঁচু করে বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,“বুঝেছি বাবা।”

রাগান্বিতার বাবা জোরে একটা নিশ্বাস ফেললন। মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
“তোমায় হাজার বছর বাঁচতে হবে রাগান্বিতা, এভাবে কাঁদলে চলবে না। কাঁদতে হলে একা কাঁদবে, মনে রাখবে মানুষের চোখের পানি অতীব মূল্যবান জিনিস এই জিনিস দেখার সৌভাগ্য সবাইকে দিতে নেই।”

রাগান্বিতা অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো বাবার মুখের দিকে। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে বাবা কত শক্ত হয়ে কথাগুলো বললো। রাগান্বিতা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,“আমি তোমায় জড়িয়ে ধরবো বাবা?”

মোতালেব তালুকদার থমকে গেলেন। এত বছরের জীবনে এমন আবদার কোনোদিনও করে নি রাগান্বিতা। নিরুত্তর মোতালেব তালুকদার। রাগান্বিতা আবার বললো,“কি হলো বাবা আমি কি তোমায় জড়িয়ে ধরবো একবার।”

মোতালেব তালুকদার শক্ত গলায় উত্তর দিলেন এবার, “না।”

আহত হলো রাগান্বিতা। কারো ডাক শোনা গেল সেই সময়। মোতালেব তালুকদারকে ডাকছে। মাদরাসায় পড়ুয়া কিছু হাফেজ ছেলেরা এসেছে কোরআন শরীফ পাঠ করার জন্য।

রাগান্বিতা বাবার যাওয়ার পানে শুধু তাকিয়ে রইলো। একটু জড়িয়ে ধরতে দিলে কি খুব ক্ষতি হতো বাবার। অন্যদিকে মোতালেব তালুকদার ভাবছেন, মেয়েকে জড়িয়ে ধরতে দেন নি এই কারণেই যে, এই মুহূর্তে মেয়েকে জড়িয়ে ধরতে দিলে মোতালেব তালুকদার নিজেকে শক্ত রাখতে পারতেন না। এত কড়া কড়া কথা বললেন। অথচ যদি নিজেই রাখতে না পারে সেই কথা। তবে মেয়ে রাখবে কেমন করে। পৃথিবীতে সবসময় নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী অন্যকে কথা শোনানো উচিত। নিজে যেটা পারবো না সেটা অন্যকে বোঝানো নিতান্তই নিজেকে বড় দেখানোর একটা অযুহাত। যা একটা সময় ভয়ংকর বিপদে ফেলতে পারে। মেয়ে অভিমান করেছে এটা বুঝেছেন মোতালেব তালুকদার। তবুও উপায় নেই, কিছু কিছু জিনিসকে মাঝে মধ্যে ছেড়ে দিতে হয়। অপেক্ষা করতে হয় দ্বিতীয় সুযোগের।
—-
সন্ধ্যা ৭ঃ০০টা। নিজ কক্ষের জানালা দিয়ে কুহু আপার পাশের কবরখানার দিকে তাকিয়ে আছে রাগান্বিতা। নিঃশব্দে চোখ বেয়ে পানি পড়ছে তার। দুটো প্রাণের মানুষ, কাছের মানুষ কি সুন্দর মাটির নিচে শুয়ে আছে। আর সে জমিনের বুুকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখছে। দুনিয়া এত কঠিন কেন, সৃষ্টির কেন শেষ হয়। সৃষ্টিদেরকে আজীবন অমর রাখতে পারলো না আল্লাহ। তাহলে কত সুন্দর হতো। কোনো দুঃখ থাকতো না। রাগান্বিতার কাঁধে কারো স্পর্শ পাওয়া গেল। চেনা সেই স্পর্শ। রাগান্বিতা ঘুরলো না। তবে এই স্পর্শ যে ইমতিয়াজের এটা বুঝতে বাকি নেই রাগান্বিতার। ইমতিয়াজ আওড়ালো,“বউ।”

রাগান্বিতার ঠোঁটে কথা নেই। সে চুপচাপ। ইমতিয়াজ আবার বললো,“আমার সঙ্গে কথা বলবে না বউ।”

রাগান্বিতা না ঘুরেই স্থির কণ্ঠে বললো,“আপনি কাল আমায় মিথ্যে কেন বললেন, যে দাদিমা আমায় ছেড়ে যাবে না।”

ইমতিয়াজ নিরুত্তর! এখন কি বলবে। ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,“মাঝে মধ্যে কিছু ভালোর জন্য আমাদের মিথ্যে কথা বলতে হয় বউ।”

এবার ঘুরে তাকালো রাগান্বিতা। চোখে পানি নেই তার। তবে লাল হয়ে আছে। রাগান্বিতা বললো,
“কি ভালো হয়েছে?”
“ওই যে তুমি ঢাকার বাড়ি থেকেই মন খারাপ করে আসো নি। পুরো পথটা তো হাসিতে ছিলে। তুমি সারারাস্তায় মন খারাপ করে আসতে আমারও তো কষ্ট হতো। তাই আমি কিছু সময়ের জন্য স্বার্থপর হয়েছি। নিজের দিকটা দেখেছি। নিজেকে কিছুটা সময় ভালো রাখারই চেষ্টা করেছি।”

রাগান্বিতা আর কিছু বললো না। সে নিরদ্বিধায় জড়িয়ে ধরলো ইমতিয়াজকে। শক্ত করে ধরলো। ইমতিয়াজ অনুভব করলো সেটা। কিছু বললো না। স্থির। চুপচাপ। নিরিবিলি পরিবেশ। কোনো শব্দ নেই। রাগান্বিতার চোখ বেয়ে পানি জড়লো তবে তাতেও শব্দ আসলো না। সে বললো,
“আমার কি করার উচিত এখন?”

ইমতিয়াজ নীরব কণ্ঠে শুধালো,
“কিছু না। যেভাবে আছো সেভাবেই থাকো।”
“আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে।”
“আমি বুঝতে পারছি তাও শান্ত থাকো।”
“আমি চিৎকার দিয়ে কাঁদতে চাচ্ছি কিন্তু পারছি না।”
“বাবা বারণ করেছেন।”
“আপনি শুনেছিলেন সবটা।”
“হুম। দুয়ারের কর্নারে দাঁড়ানো ছিলাম তখন।”
“বাবা কি কিছু ভুল বলেছেন?”
“একদমই না।”
“কিন্তু আমার তো ইচ্ছে হচ্ছে আমি চিৎকার দিয়ে কাঁদি।”
“সব ইচ্ছে পূরণ করতে নেই।”
“আমি মানতে পারছি না।”
“সত্য তো মানতে একটু সময় লাগবে।”
“আমি আপনায় সারারাত জড়িয়ে ধরে থাকবো?”
“তুমি ছাড়তে চাইলেও আমি ছাড়ছি না।”

এমন অনেক কথা বললো না দুজন। রাত অনেক গভীর হলো। কিন্তু তাদের কথা শেষ হলো না। রাগান্বিতা কাঁদলো না। তার চোখের পানি আস্তে আস্তে কমে গেল। কষ্ট পাওয়া বন্ধ হলো। কি আশ্চর্যকর যাদু ছিল জানে না রাগান্বিতা। রাগান্বিতা প্রশ্ন করলো হঠাৎ,
“পা ব্যাথা করছে না?”
“তোমার যন্ত্রণার তুলনায় কম।”
“আপনার যন্ত্রনা হচ্ছে না?”
“হচ্ছে তো তোমায় দেখাতে চাচ্ছি না। মানুষ হারানোর শোক আমিও বহুবার পেয়েছি বউ। তুমি তো জানো।”

রাগান্বিতা চুপ। ইমতিয়াজও আর কিছু বললো না।রাগান্বিতা চোখ বন্ধ করে ফেললো, তখনই দাদিমার বলা সেই শেষ শব্দ দুটো কানে বাজলো। রাগান্বিতা মিলালো। চি,ডি মানে চিঠি। রাগান্বিতা গভীর এক ভাবনায় ভেবে মনে মনে বললো,“তবে কি দাদিমা আমার জন্য কোনো চিঠি লিখে গেছেন! কি থাকতে পারে সেই চিঠিতে কোনো বিষাদময় বার্তা নয় তো।”

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৪১
________________
সকাল সকালই তালুকদার ভিলাতে হাজির হলো তাদের বাড়ির পুরনো সদস্য রামু। যে এ বাড়িতে কাজ করে। পরিবারের কিছু সমস্যার কারণে এতদিন ছুটিতে ছিল। দাদিমার খবর শুনেই হাজির হলো তালুকদার ভিলাতে। রামু সদর দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই সর্বপ্রথম দেখা মিললো ইমতিয়াজের সঙ্গে। সকাল সকাল কোথায় যেন যাচ্ছে ইমতিয়াজ। কথা হলো না কোনো শুধু একপলক রামুকে দেখেই চলে যায় ইমতিয়াজ। রামুও চিনতে না পেরে চলে যায় ভিতরে। রামুর চোখে পানি টলটল করছে দাদিমা অত্যন্ত ভালো একজন মানুষ ছিলেন তাকে খুব ভালোবাসতো। রামু সোজা চলে যায় মোতালেব তালুকদারের কক্ষে।

নিজ কক্ষের পালঙ্কে চুপচাপ বসে আছে মোতালেব তালুকদার দৃষ্টি তার বাহিরে যদিও কিছু দেখা যাচ্ছে না তবুও তিনি তাকিয়ে আছেন। কাল সারারাত সে ঘুমায় নি। শক্ত হয়ে বসে ছিলেন চুপচাপ। এভাবে হুট করে কন্যা যাওয়ার ছ’মাসের মাথাতেই মা সমতুল্য মানুষটাও চলে যাবেন ভাবতে পারে নি মোতালেব তালুকদার। চোখের চশমা খুলে চোখের পানিটুকু মুছলেন। এমন সময় তার কক্ষের দুয়ারে কড়া নাড়লো রামু। বললো,
“চাচা আব্বা আমি কি ঘরে আমু?”

বহুদিন পর রামুর কণ্ঠ কানে আসতেই পিছন ঘুরলেন মোতালেব তালুকদার। নিঃস্ব স্বরে বললেন,“আয়!”

রামু ভিতরে ঢুকলো। রামুর ভালো নাম রতন। কিন্তু সবাই ওকে রামু বলে ডাকে। রামু সোজা গিয়ে মোতালেব তালুকদারের পাশে বসলো। কান্নাভেজা কণ্ঠে বললো,“এগুলান কি হইয়া গেল চাচা আব্বা? কুহু আফাও হঠাৎ কইরা চইলা গেল এখন দাদিমাও এগুলান কেন হইলো চাচা আব্বা?”

বলতে বলতে রামু কেঁদে উঠলো। মোতালেব তালুকদার রামুর মাথায় হাত বুলালেন। বললেন,“কাঁন্দিস না কানলে কি মানুষ গুলা ফিইরা আইবো। তোর মায় কেমন আছে?”

রামু চোখের পানি মুছে বললো,“ভালাই।”
—–
চি’ ডি! রাগান্বিতা চিডি! ঘুমের ঘোরে কাল দাদিমার শেষ বার্তাটুকু কানে বাজতেই হকচকিয়ে উঠলো রাগান্বিতা। ঘুমটা ভেঙে গেল আচমকা। আশেপাশে তাকালো কোথাও ইমতিয়াজ নেই। বোধহয় বাহিরে গেছেন। রাগান্বিতা তার উত্তেজিত মনটাকে দমালো। আগে সামলালো নিজেকে। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেললো কয়েকবার। কিছুক্ষণ বসে থেকে হনহনিয়ে ছুটে গেল বাহিরে। বাহিরে যেতেই দেখা রামুর সঙ্গে। রামু প্রশ্ন করলো, “রাগান্বিতা আফা তুমি কেমন আছো?”

রাগান্বিতা দাঁড়িয়ে পড়লো। বললো,
“ভালো তুমি?”
“মিছা কতা কও আফা তুমি ভালো আছো।”

রাগান্বিতা চুপ হয়ে গেল। রামুও কিছু বললো না। রাগান্বিতা প্রশ্ন করলো,“তোমার বাড়ির সবাই ভালো আছে তো?”

রামুও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“হ ভালাই আছে। আম্মাও আইতে চাইছিল আমি আনি নাই।
“যাক ভালো করেছো এমনিতেই অসুস্থ মানুষ।”
“হুম আফা।”
“আচ্ছা আমি একটু আসছি।”
“আচ্ছা আফা যাও।”

রাগান্বিতা আর দেরি না করে হেঁটে গেল। রামু চেয়ে রইলো তার পানে। রাগান্বিতা হনহনিয়ে নিচে নেমে এসে সোজা চলে যায় দাদিমার কক্ষের দিকে। দুয়ারের কাছে আসতেই বুকটা থমকে গেল রাগান্বিতার। বুক ফেটে কান্না আসতে চাইলো তার কিন্তু রাগান্বিতা নিজেকে সামলালো। বোঝালো শক্ত হতে হবে নিজেকে। রাগান্বিতা জোরে নিশ্বাস ফেলে কক্ষের দুয়ার খুলে ভিতরে ঢুকলো। পুরো কক্ষে চোখ বুলালো। তার মনে হচ্ছে দাদিমা বুঝি তার সামনের ওই পালঙ্কে বসে বলছে,“তুমি আইছো রাগান্বিতা এত দেরি করলা কেন আইতে?”

রাগান্বিতার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি হলো। মনে মনে বললো,“আমি খুব দেরি করে ফেলেছি দাদিমা। কেন করলাম দেরি। তুমি আর একটু অপেক্ষা করতে পারলে না আমার জন্য।”

কথাটা মনে মনে বলে তো দিল কিন্তু উত্তর আসলো না। রাগান্বিতা আস্তে আস্তে পুরো কক্ষে চোখ বুলালো। দাদিমা কি সত্যি তার জন্য চিঠি রেখে গেছে। রাগান্বিতা পুরো কক্ষে খুঁজলো, বিছানার চাদর, দাদিমার আলমারিতে, দাদিমার কাপড়ের ভাজে ভাজে, আলমারির ওপর, আলমারির ওপর থাকা বাক্সপেটরা, ঘরের আনাচে-কানাচেতে সব জায়গায় কিন্তু কোথাও কিছু পেল না। রাগান্বিতা নিরাশ হয়ে পালঙ্কে বসে পড়লো। তবে কি সে ভুল ভাবলো দাদিমা কোনো চিঠি লিখে যায় নি তার জন্য। রাগান্বিতা চোখ বন্ধ করে ফেললো।
—–
রেশবপুরে থাকা সেই ছোট্ট কুঁড়েঘরের সামনে বসে আছে ইমতিয়াজ। এই বাড়িটাতেই ইমতিয়াজ সর্বপ্রথম থেকেছিল রেশবপুরে এসে। আকাশটা পরিষ্কার। উঠুনটা নিরিবিলি। ইমতিয়াজের সব কিছু এলেমেলো লাগছে। সবটা কেমন এলেমেলো হয়ে গেল। সে যখন প্রথম এই রেশবপুরে পা রেখেছিল তখন তার মাথায় ছিল কি ভাবনা, এক বিষাক্ত ভাবনা নিয়ে সে এখানে পা রেখেছিল। ভেবেছিল সব ধ্বংস নিজের হাতে করবে। অথচ আজ সে দেখছে ধ্বংসের খেলা খেলতে এসে সে নিজেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বাঁচার জন্য মনটা আনচান করছে। কি নিদারুণ এক যন্ত্রণা! ইমতিয়াজের হঠাৎ হঠাৎ ইচ্ছে হয় সব ছেড়েছুড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে। রাগান্বিতাকেও সঙ্গে নিবে না। হয় কষ্ট হোক তাও নিবে না। আবার ভাবে এটা করেও তো শান্তিতে থাকতে পারবে না। ইমতিয়াজ নিঃস্ব হয়ে বসে রইলো। একা মনে আওড়ালো,
“তোমার চোখে ঘৃণা দেখার আগে আমার মরণ হোক বউ।”
—-
রাগান্বিতার কিছু একটা মনে পড়লো। একদিন দাদিমা তাকে বলে ছিল,
“জানো রাগান্বিতা এই যে আমার পালঙ্কের তলায় থাকা ট্রাঙ্কটা দেখতে পাইতাছো এইডারে আমি খুব যত্নে রাহি। আমি মরণের পর যখন এই ট্রাঙ্কটা খুলবা দেখবা আমি তোমার আর কুহুর জন্য কতকিছু গুছাইয়া রাখছি।”

রাগান্বিতা যেদিন খুব অবাক হয় মশকরা করে ট্রাঙ্কটা খুলতেও যায় কিন্তু দাদিমা খুলতে দেয় না। এরপর রাগান্বিতা আর কখনো এটা নিয়ে ভাবে নি। এই কথা যেদিন দাদিমা বলেছিল তখন কুহুও ছিল। চট করেই কথাগুলো মাথায় আসতেই রাগান্বিতা পালঙ্কের নিচটা দেখলো দাদিমার ট্রাঙ্কটা তখনও সেখানে। রাগান্বিতা দ্রুত ট্রাঙ্কটা পালঙ্কের নিচ থেকে বের করে পালঙ্কের উপরে রাখলো। ছোট্ট তালাবদ্ধ ছিল সেটা। চাবিটা আলমারিতেই থাকার কথা। রাগান্বিতা আবার আলমারিতে হাত দিল একটু খুঁজতেই চাবিটা পেয়ে গেল। রাগান্বিতার কেন যেন হাত কাঁপছে তার মনে হচ্ছে দাদিমা এই ট্রাঙ্কেই তার জন্য চিঠি রেখে গেছে। রাগান্বিতা ট্রাঙ্কটা খুললো। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসলো তার আর কুহুর কিছু ছোট বেলার স্মৃতি। তাদের কিছু ছোট ছোট জিনিসপত্র ছোট বেলার জামা, খেলনা, একটা আঁকার খাতা সব গুছিয়ে রেখেছে দাদিমা। আঁকার খাতাটা কুহুর। কুহু ছোট বেলা থেকেই আঁকাআকি খুব পছন্দ করতো। রাগান্বিতার এসব দেখে আবার চোখ ভিজে আসলো। দাদিমা তাদের কত ভালোবাসতো। দাদিমার যখন পনের বছর বয়স তখন তার বিয়ে হয় বিয়ের তিনবছরের মাথাতেই তার স্বামী মারা যান কোনো সন্তান ছিল না। তারপর থেকেই দাদিমা এখানে থাকেন। বিয়ে দেওয়ার কথা বললেও তিনি আর বিয়ে করেন নি। রাগান্বিতা, কুহু আর রেজওয়ানকে নিয়ে ভালো ছিলেন। জীবন কাটিয়ে দিলেন এমন ভাবেই। পরে অবশ্যও একদিন জানা গিয়েছিল, দাদিমা তার স্বামীর অসুস্থের সময় কথা দিয়েছিলেন তাকে ব্যতীত আর কোনো পুরুষকে তিনি স্বামী হিসেবে মানবেন না। সেই কথা রাখতেই এতকাল দাদিমা একা ছিলেন।

সব জিনিসগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতেই পরিশেষে একটা চিঠি পেল রাগান্বিতা। দ্রুত চিঠিটা বের করলো। পড়তে লাগলো। যেখানে শুরুতেই লেখা ছিল,

আমার রাগান্বিতা দাদিমা। এই চিডিহান আমি শুধু তুমার জন্য লেখছি। তুমারে অনেক কিছু জানানোর ইচ্ছে হইলো আমার। তুমার লগে আর দেখা হইবো কি না জানি না। তুমার আব্বায় আমারে যতই মানা করুক আমার মনে হয় তুমার কুহুর ব্যাপারে হগল কথা জানা উচিত। তুমি হেদিন আমারে জিগাইছিলা আমি হাপলা দেইখা কেন ডরাইছি। কারণ তুমি যেমন ভাবে হাপলা দিয়া হেইদিন হাজজিলা ঠিক হেমনভাবেই একদিন কুহুও হাজজিল। আমি ভয় পাইছিলাম। কেন পাইছিলাম আমি নিজেও জানি না। তাও খুব ভয় পাইছিলাম। মনে হইলো কুহুর নাহান তুমার ওপরও বুঝি কারো কালো ছায়া পড়ছে। হেরপর একদিন তুমি চিডি পাও হেইয়া নিয়া গ্রামের হগল মানুষরে ডাকলা ওইদিন মোতালেবও খুব ভয় পাইছিল কারণ এই রহম চিডি কুহুও পাইছিল। কেউ ওর নামে চিডি পাডাইতো। এই চিডির কথা কুহুই লেখছিল। ওর ঘরে আমি চিঠি পাই হেইহানে এডি লেখা ছিল। কুহু দুইহান চিডি লেখছিল যার একখান তুমি পড়ছিলা আর একখান আমার ট্রাঙ্কে আছে। আরো একটা পৃষ্ঠায় কিছু লেহা আছে। একখান শুকনা কাটাওয়ালা গোলাপফুলও আছে। ফুলডা মনে হয় কুহুরে যে পোলাই পেমের ফান্দে ফালাইছিল হেয় দিছিল। তুমিও চিডি পাও কুহুও পাইছে এইয়া দেইখা মোতালেব ভয়ে তোমার বিয়া ঠিক করে। ওয় ভাবে ওর কোনো শত্রু মনে হয় এমন করছে। কিন্তু কেডা করছে ধরতে পারে নাই। তুমি যহন এই চিডিডা পড়বা আমিও মনে হয় তহন থাকমু না। আমি খুব অসুস্থ। মনে হয় বেশিদিন বাঁচমু না। তুমি ভালো থাইকো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজরে নিয়া সবসময় ভালো থাইকো। আমারে ভুইলা যাইও না। আমি কিন্তু তুমারে খুব ভালোবাসি দাদিমা। ভালো থাইকো কেমন!

ইতি,
তোমার দাদিমা।”

চোখ ভেসে উঠলো রাগান্বিতার। চিঠিটা বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, “কখনো ভুলমু না দাদিমা তোমারে কি ভোলা যায় কও।”

রাগান্বিতা ট্রাঙ্কের ভিতর একটা চিঠি, একটা চিরকুট আর একটা কাঁটাওয়ালা শুঁকনো গোলাপফুল পেল। ফুলটা ধরতে গিয়েই কাঁটার আঘাত পেল রাগান্বিতা। মনে পড়লো সেই বিয়ের দিন ইমতিয়াজও তাকে দেওয়া একটা কাটাওয়ালা গোলাপের আঘাতের দৃশ্যের কথা। কিন্তু বেশি গুরুত্ব দিলো না। কুহুর চিঠিটা পড়লো। সে কাউকে লিখেছিল,

প্রিয় আরফান,
আপনার দেয়া শাপলাফুলগুলো খুবই সুন্দর হয়েছে। শাপলার অলংকার দিয়ে আমি সেজেছিলাম। দাদিমা দেখে কি প্রশংসা করলো কিন্তু আপনি দেখতে পেলেন না। শুনুন হুটহাট এমন চিঠি দিবেন না কেউ দেখে ফেললে তখন। আপনার সাথে দেখা করতে আমি শীঘ্রই শহরে যাবো। কেমন। ততদিন ভালো থাকবেন।

ইতি
আপনার কুহেলিকা।

রাগান্বিতা এবার সেই চিরকুটটা হাতে নিলো আরফানের দেয়া বোধহয়। চিরকুটটা খুলতেই সেখানে লেখা দেখলো,

“মেঘ করেছে মনের ভিড়ে,
তোমার তো দেখা নাই,
আমি তো এক নিস্তব্ধ মানুষ
তোমার খোঁজ কোথায় পাই?”

সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলো রাগান্বিতা এই চিঠি তো সেও পেয়েছিল প্রথম চিঠি ছিল। কথাটা এক থাকলেও হাতের লেখা ভিন্ন।

রাগান্বিতা আরো চারপাঁচবার কথাটা পড়লো। কেন পড়লো নিজেও জানে না তবে তার মনে হচ্ছে এই হাতের লেখা সে চেনে। এই হাতের লেখা সে আরো চারপাঁচবার বা তারও বেশি দেখেছে খুব কাছ থেকে দেখেছে, আচমকাই বুকটা কামড়ে উঠলো রাগান্বিতার। সে কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,
“ইম..তিয়াজ!”

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#TanjiL_Mim♥️

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-৩৮+৩৯

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩৮
________________
নিজেদের ব্যাগপত্র নিয়ে সবেমাত্র ঢাকার বাড়িতে পা রাখলো ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতা। সদর দুয়ারের সামনেই দাড়ানো ছিল রবিন আর ওর বউ। রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ ধীরে ধীরে হেঁটে আসলো তাদের সামনে। সদর দুয়ারের কাছে এসেই বলো ইমতিয়াজ,
“কেমন আছো চাচা?”
“ভালা। তুমি?”
“ভালোই। চাচিও সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে যে কেমন আছেন চাচি?”

চাচি মিষ্টি হাসলেন। ইমতিয়াজের গালে আলতো স্পর্শ করে বললো,“ভালাই আছি। তুমরা কেমন আছো?”

ইমতিয়াজ মৃদু হেসে জবাব দিলো,“ আমরাও ভালো।”
এরপর রাগান্বিতাকে উদ্দেশ্য করে বললো ইমতিয়াজ,“ইনি রবিন চাচার বউ রাগান্বিতা।”

রাগান্বিতা এগিয়ে আসলো। নিকাবের আড়ালে মিষ্টি গলায় বললো,“আসসালামু আলাইকুম চাচি ভালো আছেন?”

চাচি মৃদুস্বরে বললেন,“হ ভালোই আহো ঘরে আহো।”

রাগান্বিতাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির ভিতর চলে গেল চাচি। আর ইমতিয়াজ রবিনকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“ব্যবসার অবস্থা কেমন চাচা?”
“ভালাই। তুমি কি এহন যাইবা দ্যাখতে?”

ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“দেখি।”

ভিতরে ঢুকলো ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা তখন সিঁড়ি বেয়ে নিজ কক্ষে যাচ্ছিল। তখনই পিছন থেকে ইমতিয়াজ বলে উঠল,
“বউ শুনো,

রাগান্বিতা দাঁড়িয়ে পড়লো। দ্রুত কয়েককদম নিচে নেমে এসে বললো,“জি বলুন।”

ইমতিয়াজও এগিয়ে আসলো খানিকটা কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বললো,“আমার একটা কাজ আছে কাজটা সেরেই আমি আসছি। তুমি চিম্তা করো না আমার আসতে একটু দেরি হবে।”

রাগান্বিতা চিন্তিত স্বরে বললো,“কোথায় যাবেন? মাত্রই তো এলেন এখনই যাবেন। কাজটা কি খুব জরুরি?”

ইমতিয়াজ মাথা নাড়িয়ে বললো,“হুম।”
রাগান্বিতা আর বারণ করলো না। বললো,“ঠিক আছে সাবধানে যাবেন কাজ সেরে দ্রুত চলে আসবেন কেমন।”

ইমতিয়াজ মৃদু হেসে বললো,“ঠিক আছে।”
ইমতিয়াজ আশেপাশে তাকালো তারপর চট করেই রাগান্বিতার কপালে চুমু কেটে বললো,“ভালোবাসি বউ, ভীষণ ভালোবাসি তোমায়।”

কথাটা বলেই ঝড়ের গতিতে চলে গেল ইমতিয়াজ। আর রাগান্বিতা লজ্জায় লাল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো চুপচাপ। পরক্ষণেই মৃদু হেসে অগ্রসর হলো নিজ কক্ষে যাওয়ার জন্য।

সময় গড়ালো, দুপুর পেরিয়ে বিকেল হলো। তাও ইমতিয়াজের খবর নেই। যদিও ইমতিয়াজ বলেছিল তার ফিরতে দেরি হবে তবুও বিকেল গড়িয়ে কত সময় চলে যাচ্ছে। মানুষটা রাস্তায় কিছু খেয়েছে কি না কে জানে। সেই সকালবেলা চা নাস্তা করেছিল মাত্র এরপর আর কিছু খেয়েছে কি না কে জানে। রাগান্বিতার খুব চিন্তা হচ্ছে। রাগান্বিতা বার বার বাড়ির সদর দরজার দিকে তাকাচ্ছে। চাচি বিষয়টা লক্ষ্য করলেন মুচকি হেসে বললেন,“চিন্তা কইরো না ইমতিয়াজ আইয়া পড়বো নে।”

বিনিময়ে রাগান্বিতা আমতা আমতা করে বললো,
“চিন্তা করছি না চাচি।”

চাচি মিষ্টি হেঁসে বললেন,
“এগুলান চেহারা দেখলে বোঝন যায়।”

বলেই নিজের শয়নকক্ষে চলে গেল চাচি। তার বাচ্চাটা কাঁদছে, বোধহয় ঘুম থেকে উঠে গেছে। রাগান্বিতা খানিকটা লজ্জা পেল চাচির কথা শুনে।
——
গ্রামের নাম আনন্দপুর। ঢাকা থেকে বেশ দূরে তার অবস্থান। সেই গ্রামেরই সবচেয়ে বড় জমিদার বাড়িটির নাম সিকদার মঞ্জিল। এককালে বিপুল প্রাচুর্যে ঘেরা ছিল এই বাড়ি। অথচ আজ সেই বাড়ি পরিত্যাক্ত কেউ ভুলেও এই বাড়ির ত্রিসীমায় আসে না। বাচ্চাদের ছোট থেকেই এখানে আসতে নিষেধ করেন তাদের বাবা মা। তাদের ধারণা এ বাড়িতে ভূত প্রেত আছে। বহুবছর আগে এ বাড়ির জমিদার মতিন সিকদার আর তার দ্বিতীয় বউ যমুনা বেগম খুন হন। সেই থেকেই এ বাড়ি পরিত্যাক্ত! বাড়িতে যত মানুষ ছিল তারাও সেই মৃত্যুর পর আতঙ্কে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যান। এরপর থেকেই অযত্ন আর অবহেলার কারণে বনজঙ্গলে ভরে ভুতুড়ে ভুতুড়ে হয়ে গেছে চারপাশ।

জং ধরা গেটের শিঁকল খুলে সিকদার মঞ্জিলে পা রাখলো ইমতিয়াজ। ক্যাচ ক্যাচ করে আওয়াজ হলো কেমন। দু’একজন দূর থেকে দেখলো। ইমতিয়াজ বেশি না ভেবেই তার চটি(জুতা) খুলে আস্তে করে চলে গেল ভিতরে। বাড়ির ডানদিকে একটা সরু রাস্তা আছে ইমতিয়াজ সেই পথ ধরেই হেঁটে গেল। হাঁটতে হাঁটতে দেখা মিললো একটা সুন্দর পরিপাটি বেড়া দেয়া কবরস্থান। এই বাড়ির বাকি সব স্থান অগোছালো থাকলেও এই জায়গাটা পরিষ্কার। ইমতিয়াজ বেড়ার একপাশ খুলে কবরের দোয়া পাঠ করে ভিতরে ঢুকলো। তারপর বসলো সোজা মৃত ব্যক্তিটির পায়ের কাছ দিয়ে। আলতো করে পায়ের দিকের ওপরের মাটি স্পর্শ করে বললো,
“আম্মা, আমার প্রাণের আম্মা। আমি এসেছি আম্মা। তোমার ছেলে ইমতিয়াজ এসেছে, তুমি কি আমার লগে কথা কইবা না আম্মা। এইবার আমি আইতে খুব দেরি করছি তুমি খুব রাগ করছো তাই না। জানো আম্মা তোমারে দেহার জন্য আমার মনডা ছটফট করে। এমনে কেন চইল্যা গেলা আম্মা। আইজ তুমি বাইচ্যা থাকলে আমার জীবনডা এমন বিষণ্ণমাখা হইতো তুমি কও। আমি প্রতিহিংসায় জ্বলছি আম্মা।”

এমন নানা কিছু বলতে লাগলো ইমতিয়াজ। চারপাশে সে ছাড়া আর কেউ ছিল না। পুরো নিরিবিলি পরিবেশ। ইমতিয়াজের জায়গায় অন্যকেউ থাকলে এতক্ষণে ভয়েই কেঁপে যেত। অথচ ইমতিয়াজ একদম স্বাভাবিক। যেন মনে হচ্ছে মায়ের পাশে বসে সে গল্প করছে। আর তার মা আদুরে হাতে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নীরবে সেই গল্প শুনছে। অথচ বাস্তবে তেমন কিছুই হচ্ছে না এ ভয়ার্ত পরিবেশে একাই বক বক করছে ইমতিয়াজ। কতকিছুই যে বলছে সে ছাড়া আর কেউই শুনছে না।

অনেক সময় পার হলো। বিকেল শেষে সন্ধ্যা নামার সময় আসলো। ইমতিয়াজ তখনও বসা তার আম্মার কবরের পাশে। কারো আওয়াজ শোনা গেল। এক বৃদ্ধলোক বললো,
“তুমি কেডা এই সন্ধ্যাহালে এহানে কি করো?”

ইমতিয়াজের হুস ফিরলো। সে ঘুরে তাকালো। সামনে দেখলো কিছু মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে। আরেকটা লোক বললো,
“এই জায়গাডা ভালা না। তুমি এহিনে ঢুকছো হেই কহন, আর আহোনা দ্যাইখা আমরা সবাই মিল্লা খুঁজতে আইছি। তুমি কেডা কও তো তোমারে এর আগেও দেখছি এহানে আইয়া কান্দো। কি হইছে তুমার?”

মাগরিবের আজানের শব্দ শোনা গেল। সবাই কিছুটা আতঙ্ক নিয়ে বললো,
“আর বইয়া থাইকো না লও আমগো লগে।”

ইমতিয়াজ শুনলো আস্তে আস্তে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। তারপর বেড়াভেদ করে বাহিরে এসে আবার বেড়া আঁটকে দিলো। মৃদু আওয়াজে বললো,“আমি তাইলে যাই আম্মা। আবার সময় করে দেখতে আসবো কেমন। এবার আর দেরি হবে না।”

বলেই চলে আসলো ইমতিয়াজ। লোকগুলাও সঙ্গে সঙ্গে বের হইলো তার। যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলো ইমতিয়াজকে,“তুমি কেডা কও তো এই বাড়ির কেউ লাগো।”

ইমতিয়াজ বাড়ির বাহিরেই সেই জং ধরা শিকলটা পুনরায় আটকে গম্ভীর এক আওয়াজে বললো,“আমি ইমতিয়াজ সিকদার।”

কথাটা বলেই চটি পড়ে চলে যায় ইমতিয়াজ। বাকিরা নিজেদের মধ্যে বলতে থাকে, ইমতিয়াজ সিকদার আবার কেডা?”

তখনই সেই বৃদ্ধ লোকটি বলে,“ইমতিয়াজ সিকদার হইলো মতিন সিকদারের প্রথম বউয়ের পোলা। যে কবরডার পাশে বইসা পোলাডা কানছিল ওইডা এই পোলার আম্মার কবর।”

সঙ্গে সঙ্গে বিস্মিত নজরে তাকিয়ে থাকে সবাই ইমতিয়াজের যাওয়ার পানে। বলে,“এই সেই ইমতিয়াজ সিকদার যে কি না হেই ছোডোহালে বাপের অত্যাচারে ঘরদুয়ার ছাইড়া চইল্লা গেছিল।”

বৃদ্ধ লোকটি বললো,“হয়। একখান কতা কি জানো এই ইমতিয়াজ জায়োনের তিনদিন পরই খুন হয় মতিন সিকদার আর হের দুই নাম্বার বউ যমুনা বেগম।”

একলোক বললো,“হুনছিলাম মতিন মিয়ার নাকি একখান মাইয়াও আছিল হেয় গেল কই?”

বৃদ্ধ লোকটি হাঁটতে হাঁটতে বললো,“হের কতা জানি না খুনের হওয়ার পর তোন আর খবর পাওন যায় নাই। মাইয়াডা ছোডো আছিল ইস্কুলে পড়তো কি হইছিল হেইদিন রাইতে কে জানে। ইমতিয়াজের থ্যাইক্কা দুই বছরের ছোডো আছিল। গ্রামের হগোলে কইছিল যে বা যারা খুন করছিল হেই মনে হয় মাইডারেও খুন টুন কইরা নদীর পানিতে হালাই থুইছে নইলে নিজের লগে লইয়া গেছিল। জানি না মাইয়াডার কি হইছিল।
—-
মধ্যরাত! নিজ কক্ষে বসে আছে রাগান্বিতা। ইমতিয়াজের অপেক্ষা করছে সে। সেই কখন বেরিয়েছে এখনো খবর নেই। কখন আসবে ইমতিয়াজ! দুয়ার খোলার আওয়াজ পাওয়া গেল। রাগান্বিতা তৎক্ষনাৎ দুয়ারের পানে তাকালো। দেখলো খানিকটা এলেমেলো চুল আর ক্লান্তিকর চেহারা নিয়ে হাজির হলো ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা দ্রুত পালঙ্ক থেকে নেমে এগিয়ে গেল ইমতিয়াজের দিকে। বললো,“অবশেষে আপনি এলেন।”

ইমতিয়াজ ভিতরে ঢুকলো ক্লান্ত মুখখানা নিয়ে বসলো পালঙ্কে। রাগান্বিতা দ্রুত ইমতিয়াজের জন্য পানি এনে দিলো। বললো,“পানি খান।”

ইমতিয়াজ নিষ্পলক চোখে রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে পানিটা নিল। ঢক ঢক করে পুরো পানিটা গিলে বললো, আমরা কাল রেশবপুরে যাবো বউ।”

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩৯
________________
“রাগান্বিতা হুনো জীবনে হগল মানুরে বিশ্বাস করবা না। সব মানুষ কিন্তু ভালা হয় না।”

প্রচন্ড কঠিন গলায় কথাটা বললো দাদিমা। দাদিমার কথা শুনে রাগান্বিতা বিস্মিত গলায় বললো,“কেন দাদিমা কি হইছে?”

দাদিমা ক্ষিপ্ত মেজাজ নিয়ে বললো,
“তুমি কোনো কথা কইবা না তুমার লগে আমার আড়ি। তুমারে এতবার কইলাম বাড়িত আও তাও আও না আমার লগে আর কোনো কথা কইবা না।”
“দাদিমা শুনো,

রাগান্বিতা বহুবার ডাকলো কিন্তু দাদিমা ফিরে তাকালেন না। হনহনিয়ে চলে গেলেন কোথায়। রাগান্বিতা হেঁটে গেলো সামনে কিন্তু কালো ছায়া ছাড়া আর কিছুই দেখলো না। রাগান্বিতা চেঁচিয়ে ডাকলো, “দাদিমা, দাদিমা কোথায় তুমি!” কিন্তু না দাদিমার আর খোঁজ নেই কণ্ঠ শোনা গেল না তার।

ঘুমের মধ্যে আচমকাই হকচকিয়ে উঠে বসলো রাগান্বিতা। আশেপাশে তাকাতেই বুঝলো সে ইমতিয়াজের পাশে নিজ কক্ষে বসে আছে। তার মানে সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। ইমতিয়াজের ঘুমটা ভেঙে গেল রাগান্বিতাকে হতভম্ব দেখে প্রশ্ন করলো,“কি হয়েছে বউ?”

রাগান্বিতা ছলছল দৃষ্টিতে ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইমতিয়াজ আবার প্রশ্ন করলো,
“কি হয়েছে বাজে স্বপ্ন দেখেছো?”

রাগান্বিতা মাথা নাড়ালো। আতঙ্ক নিয়ে বসে রইলো। দাদিমা তাকে ছেড়ে গেল কোথায়! রাগান্বিতার মাঝে অজানা এক ভয় অনুভব হলো। সে ইমতিয়াজকে বললো,“আমার দাদিমা কোথায় যেন চলে গেছেন আমায় ছেড়ে?”

ইমতিয়াজ বিস্মিত হলো সে দ্রুত পালঙ্ক থেকে নেমে রাগান্বিতার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে খাইয়ে দিল রাগান্বিতাকে। রাগান্বিতাও ঢকঢক করে পুরো পানিটা খেল। ভয়ে ভয়ে বললো,
“আমার দাদিমা আমায় ছেড়ে কোথাও চলে যাবেন না তো?”

ইমতিয়াজ রাগান্বিতার পাশে বসলো। আশ্বাস দিতে বললো,
“ভয় পেও না কোথাও যাবে না তোমার দাদিমা।”

রাগান্বিতা তাও শান্ত হতে পারলো না। তার কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
“আমরা কখন যাবো?”
“এই তো ভোরের আলো ফুটলেই।”

রাগান্বিতা থরথর করে কাঁপছে। ইমতিয়াজ বিষয়টা বুঝতে পেরে রাগান্বিতাকে কাছে আনলো মাথাটা বুকে চেপে ধরে বললো,
“এত ভয় পেও না কিছু হয় নি। তুমি শুধু একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছো আর কিছু না।”

রাগান্বিতার চোখে পানি চলে আসলো। এই স্বপ্নের ইঙ্গিত তো ভালো নয়। রাগান্বিতা মৃদু স্বরে বললো,
“আপনি সত্যি বলছেন আমার দাদিমা কোথাও যাবে না তো আমায় ছেড়ে।”

ইমতিয়াজ রাগান্বিতার মাথায় হাত বুলাতে বললো,
“না কোথাও যাবে না।”

কথাটা বলে মাথায় হাত বুলাতে লাগলো ইমতিয়াজ। সঙ্গে ভাবলো “কোথাও যাবে না” কথাটা বলে তো দিল। কিন্তু রাগান্বিতার বাবার চিঠি তো অন্য কথা বলছে। ইমতিয়াজ আনন্দপুর থেকে ফিরতেই একটা চিঠি পায় যেটা ছিল রাগান্বিতার বাবার। দাদিমার অবস্থা ভালো নয়, এ কথাও স্পষ্ট লেখা ছিল চিঠিতে তাই তো ইমতিয়াজ রেশবপুরে যাওয়ার কথা বলে। রাগান্বিতাকে আপাতত কিছু জানাতে চাচ্ছে না ইমতিয়াজ। সোজা বাড়ি গিয়েই না হয় দেখুক।

ধীরে ধীরে রাগান্বিতা শান্ত হলো। ইমতিয়াজের বুকে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়লো। ইমতিয়াজও রাগান্বিতকে নিয়েই শুয়ে পড়লো। মাথায় বিলি কাটতে লাগলো আপনমনে। আকাশের চাঁদটা তখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল জানালা দিয়ে। ইমতিয়াজ তাকিয়ে রইলো সেই চাঁদটার পানে। খানিকটা মেঘ জমেছে তার চারপাশে। বোধহয় বৃষ্টি হবে। ইমতিয়াজ হঠাৎই বিড়বিড় করে বললো,
“মেঘ বলেছে বৃষ্টি হবে
আকাশটা তাই অন্ধকার;
মনের মাঝে ঝড় উঠেছে
তাকে হারানোর আশঙ্কার।”
—–
সকালের ট্রেনে চড়েই রেশবপুরের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালো রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। রাস্তায় সে কি কথা রাগান্বিতার। বাড়ি গিয়ে দাদিমাকে চমকে দিবে, জড়িয়ে ধরে এটা বলবে সেটা করবে,প্রেম নগরের ওই জায়গাটার বর্ণনা করবে, টিয়াপাখির সেই মিষ্টি ডাকটার কথা তো সবার আগে বলবে। এমন নানা কিছু বলছে রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ শুধু শুনে যাচ্ছে উত্তরে শুধু হুম, হা, ঠিক আছে এসব বলছে। মেয়েটার উত্তেজনা দেখে ইমতিয়াজ ভিতরে ভিতরে গুমরে মরছে, সে কি ভুল করলো আবার কিন্তু বললেও তো ঠিক হতো না। সারারাস্তায় মেয়েটা গুমরে থাকতো তা দেখে ইমতিয়াজের আরো হৃদয় পুড়তো। ইমতিয়াজের কেন যেন মনে হচ্ছে সে একের পর এক ভুল করছে। অথচ সঠিক কি তাও বুঝচ্ছে না। কি এক বিচ্ছিরি ব্যাপার।

আগেরবারের তুলনায় এবার বুঝি বেশ দেরি হচ্ছে রেশবপুর যেতে রাগান্বিতা খুব উত্তেজিত হয়ে বলছে,“এখনো আমরা যাচ্ছি না কেন?”

ইমতিয়াজ আলতো হাতে রাগান্বিতাকে ক্যাভিনের পালঙ্কে বসালো। নীরব স্বরে বলল, “এত উত্তেজিত হয়ো না।”

রাগান্বিতা চুপটি করে বসে রইলো। বোধহয় সত্যি একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছে।’

সময় চললো কয়েক ঘন্টা পেরোতেই রাগান্বিতারা ট্রেন পেরিয়ে নৌকায় এসে পৌঁছালো রেশবপুরের ঘাটের কাছে। রাগান্বিতা দ্রুত দ্রুত নৌকায় ছেড়ে নামলো সে পারুক দৌড়ে ছুটে যাক বাড়ি। কিন্তু পারছে না। ইমতিয়াজ আসলো রাগান্বিতার পাশে দাঁড়ালো কিন্তু আশেপাশে কোনো গরু বা মহিষের গাড়ি দেখছে না এবার তারা যাবে কিভাবে। মিনিট দশ যেতেই একটা ছোট্ট গরুর গাড়ির দেখা মিললো রাগান্বিতা দ্রুত ছুটে গিয়ে বসলো সেই গাড়িতে তাড়া দিয়ে বললো,“দাদুভাই, তাড়াতাড়ি তালুকদার ভিলায় নিয়ে চলুন।”

গাড়িচালক রাজি হলো। ইমতিয়াজ উঠে বসলো। মেয়েটার এত উত্তেজনা একটুপরই কমে যাবে কথাটা ভাবলেই ইমতিয়াজের খারাপ লাগছে। দেখতে দেখতে দেড়ঘন্টার মাথায় এসে গরুরগাড়ি পৌঁছালো তালুকদার ভিলার সামনে। রাগান্বিতা আগেই গরুর গাড়ি থেকে নামলো বাড়ির ভিতরটায় তাকাতেই কেমন যেন বিষণ্ণ বিষণ্ণ লাগলো। বুকটা আচমকাই কেঁপে উঠলো। সে ইমতিয়াজকে রেখেই ছুটে গেল বাড়ির ভিতরে। উচ্চকণ্ঠে বলতে লাগলো,“দাদিমা, দাদিমা, আমি এসেছি দাদিমা।”

বাড়ির ভিতর ঢুকতেই বুকটা থমকে গেল রাগান্বিতার। কারণ বাড়ির মধ্যে অনেক মানুষের মুখ। রাগান্বিতা স্তব্ধ হয়ে গেল, আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকলো। আতঙ্কের স্বরে বললো,“কি হয়েছে, তোমরা সবাই এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

ততক্ষণে ইমতিয়াজও সদর দুয়ারে পা রাখলো। একটু দূরেই চিন্তিত মুখে বসে আছে রাগান্বিতার বাবা। ইমতিয়াজ সেদিকে গেল। ভিতর কক্ষেই মহিলাদের ভীড়। রাগান্বিতা সেই কক্ষেই গেছে মাত্র। ইমতিয়াজ মোতালেব তালুকদারের কাছে দাঁড়িয়ে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম জমিদার সাহেব।”
মোতালেব তালুকদার ঘুরে তাকালেন মিনমিনিয়ে বললে,
“ওলাইকুম আসসালাম। ভালো আছো বাবা?”
“জি ভালো। দাদিমা কেমন আছেন?”

উত্তরে ছলছল দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি। দৃষ্টি দেখেই বোঝা গেছে দাদিমা ঠিক নেই।

উপস্থিত সবার দিকেই বিস্মিত নজরে তাকিয়ে আছে রাগান্বিতা। এরই মাঝে আতিব দৌড়ে এসে কান্নাভেজা স্বরে বললো,
“আফা তুমি আইছো আফা দেহো দাদিমা কতা কয় না খালি হগলডির দিকে তাকাইয়া থাহে।”

আতিবের কথা শুনে বুঝি এক নিমিষেই রাগান্বিতার সব উত্তেজনা বন্ধ হয়ে গেছে। পা দুটো অবশ হয়ে আসছে। তড়িৎ গতিতে তার হৃপিন্ডটা বুঝি কেঁপে উঠলো। সবাই সামনে থেকে সরে গেল পালঙ্কের পাশেই নিচে শুয়ে আছে দাদিমা। রাগান্বিতা দৌড়ে গেল। থরথর কণ্ঠে বললো, “তুমি এভাবে শুয়ে আছো কেন দাদিমা কি হয়েছে তোমার?”

দাদিমা কিছু বলতে পারলেন না শুধু ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলেন রাগান্বিতার মুখের দিকে তার ঠোঁট কাঁপছে কিছু একটা বলতে চাইছেন তিনি কিন্তু বলতে পারছেন না। রাগান্বিতার কথার মাঝে ওর এক সহপাঠি মিলি এসে বললো,“কয়দিন আগে দাদিমা নাইতে গিয়া পানিতে পইড়া গেছিল হেরপর থেইকাই অসুস্থ। আইজগো বেশি খারাপ।”

রাগান্বিতা কিছু বললো না শুধু শুনেই গেল। রাগান্বিতা দাদিমার দিকে তাকিয়ে বললো,“আমার উপর রাগ করছো দাদিমা আমার সাথে কথা কইবা না।”

দাদিমা চেষ্টা করছেন সে কিছু বলতে চাইছেন দুই তিনটা শব্দ বের হচ্ছে মুখ থেকে কিন্তু সেই শব্দগুলো এত অল্প স্বরে বলছে যে রাগান্বিতা কিছু শুনতে পাচ্ছে না। রাগান্বিতা তার কানটা দাদিমার নিকট নিলো। দুটো শব্দ শুনতে পেল শুধু,“চি ডি”

রাগান্বিতা আসার তিনঘন্টা পরই দাদিমা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। তার অসমাপ্ত কথাটা শেষ করার অনেক চেষ্টা করলেন কিন্তু পারলেন না। কান্নার রোল পড়লো পুরো তালুকদার ভিলায়। আজরাইল বুঝি অনেক আগে থেকেই ঘুরপাক খাচ্ছিল দাদিমার পুরো কক্ষে শুধুমাত্র রাগান্বিতা আসার শেষ ইচ্ছেটুকু পূরণ করার জন্যই বুঝি এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলো। সবার কান্নার শব্দ পেতেই ছুটে আসলেন মোতালেব তালুকদার আর ইমতিয়াজ শোনা গেল ”দাদিমা আর নেই”। ভেঙে পড়লেন মোতালেব তালুকদার ইমতিয়াজ তাকে ধরলো। মা সমতুল্য মানুষটা আর নেই। ভাবতেই বুকে ছিঁড়ে যাচ্ছে মোতালেব তালুকদারের। শেষমেশ দাদিমা সত্যি সত্যি তাকে কিছু না বলে চলে গেল। রেজওয়ান ছুটে আসলো। চারপাশ কেমন ধোঁয়াশায় পরিণত হলো। রাগান্বিতা স্তব্ধ তার কান্নার শব্দ আসছে না। আচমকাই দাদিমাকে জড়িয়ে ধরে সে কেঁদে উঠলো। পুরো তালুকদার ভিলা বুঝি কেঁপে উঠলো রাগান্বিতার সেই কান্নার শব্দে। ইমতিয়াজের ভিতরটা কেঁপে উঠলো। ধারালো ছুরির আঘাত লাগলো বুঝি বুকে। কি মর্মান্তিক সেই যন্ত্রণা!’

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#TanjiL_Mim♥️

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-৩৬+৩৭

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩৬
________________
নিকষ কালো অন্ধকারে ঘেরা চারপাশ। ঘরের ভিতর ল্যাম জ্বলছে। বাহিরে ঝিরিঝিরি শব্দে বৃষ্টি হচ্ছে। রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ বসে আছে কুঁড়েঘরের সামনে মাটির সিঁড়ির ওপর পা রেখে। উপরে ছাউনি থাকায় বৃষ্টির পানি লাগছে না তাদের গায়ে। রাগান্বিতার পাশেই রয়েছে হেরিকেন। আলো দিচ্ছে তাদের। রাগান্বিতা আবদারের স্বরে বললো,
“শুনুন এবার বাড়ি ফিরে একটা টেলিফোন কিনবেন। বাবার সাথে কথা বলবো। কতদিন হয়ে গেল বাবার সাথে চিঠি বিলি হয় না।”

প্রতিউত্তরে শুধু এতটুকুই বলে ইমতিয়াজ,
“আচ্ছা।”
“জি। বাবাকেও বলতে হবে টেলিফোন কেনার কথা। বাবা বোধহয় আমায় ভুলেই গেছে না হলে চিঠি লেখে নি কেন?”
“এখন বোধহয় লিখেছে আমরা তো বাড়ি নেই ডাকপিয়ন নিশ্চয়ই রবিন চাচার কাছে চিঠি দিয়ে গেছে।”
“আপনি সত্যি বলছেন?”
“মনে হচ্ছে।”

রাগান্বিতা জোরে একটা নিশ্বাস ফেললো। বললো,
“দাদিমাকে আজ সকালে স্বপ্নে দেখেছিলাম আমায় বাড়ি যেতে বলছে।”
“আচ্ছা যাবো আনে।”

রাগান্বিতা খুশি হয়ে বললো,
“সত্যি যাবেন।”
“হুম।”

রাগান্বিতা ইমতিয়াজের ডান হাতখানা শক্ত করে চেপে ধরলো। কাঁধে মাথা দিয়ে বললো,
“আমি কি চাই জানেন?”

ইমতিয়াজ সামনের দিকে চোখ রেখেই বলে,
“কি বলো,”
“আমি চাই, আমাদের জীবনটা এভাবেই যেন সাদাসিধে ভাবে কেটে যাক। কখনো ঝড় না আসুক।”

আকাশে তখন প্রবলবেগে একটা বিদ্যুৎ চমকালো। মেঘটাও গর্জে উঠলো। ইমতিয়াজ মৃদু হাসলো। মনে মনে বললো,“প্রকৃতি বোধহয় এমনটা চায় না।”

ইমতিয়াজ রাগান্বিতার দিকে তাকালো। চোখ মুখ খুশিতে পুরো জ্বলজ্বল করছে। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার কপালে কাছে থাকা চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিলো। তারপর রাগান্বিতার হাতে থাকা কাঁচের চুড়িগুলোতে হাত বুলিয়ে বললো,
“আর আমি কি চাই জানো?”

রাগান্বিতা অতি আগ্রহ নিয়ে বললো,
“কি চান বলুন!”

ইমতিয়াজ বৃষ্টির পানে তাকালো। বললো,
“আমি চাই, আমি তোমার হাতের শখের ভাঙা চুড়ি হবো। না তুমি পড়তে পারবে, না তুমি ফেলতে পারবে বউ।”

রাগান্বিতা বিস্মিত নজরে তাকালো ইমতিয়াজের দিকে। বললো,“ভাঙা চুড়িই কেন?”

ইমতিয়াজ মৃদু হেসে রাগান্বিতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,“এমনি।”
——
সময়গুলো অতিদ্রুত চলতে থাকলো। দেখতে দেখতে কেটে গেল পুরো ছ’টা দিন। এই ছ’দিন যেন সময়গুলো কেটেছে পুরো স্বপ্নের মতো। রোজ নৌকা নিয়ে নদীর চারিপাশে ঘুরে বেড়ানো। মাছ ধরা, রান্না করা, একসাথে গোসল করা। বিকেল হলে পুরো দ্বীপের মাঝে ছোটাছুটি করা, দোলনায় দোলা, ইমতিয়াজের বাঁশির আওয়াজ শোনা সবই যেন অন্যরকম ছিল। গরু ছাগলকে নিয়ে আশেপাশে চড়ানো এটাও ছিল দারুণ। রাগান্বিতা যেন এ জীবনেই পুরো আনন্দিত ছিল। এর মধ্যে যেটা সবচেয়ে মিষ্টিমধুর ছিল তা হলো ভোর হলেই টিয়াপাখির ডেকে ওঠা, বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম। জীবন যেন ভীষণ সুন্দর!
.
নতুন একটা সকাল! প্রকৃতি জুড়ে তখন হিমশীতল বাতাস বইছিল। মোরগ ডাকছিল। টিয়া পাখিটাও ডাকছিল। রাগান্বিতা প্রতি সকালের মতো আজও নামাজ সেরে কোরআন পাঠ করছিল। ইমতিয়াজ আজ আর ঘুমায় নি। সে চেয়ে চেয়ে শুধু দেখছিল রাগান্বিতাকে। মেয়েটা নিষ্পাপ কিন্তু সে পাপী কথাটা ভাবলেই কলিজাটা কেঁপে ওঠে ইমতিয়াজের। ভয় এসে গ্রাস করে তাকে। কি যে যন্ত্রণার, তা বলার মতো নয়। দিন যত এগোচ্ছে ইমতিয়াজের যন্ত্রনাও বুঝি একটু একটু করে বাড়ছে। সহ্য করা দিনে দিনে বুঝি দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আচ্ছা যদি এমনটা হতো, যে কিছুই হতো না। ইমতিয়াজ মাথা নাড়ালো। কিছু কি হয়েছে হয় নি তো তাহলে! খামোখাই আবোলতাবোল। দিনে দিনে কেমন একটা হয়ে যাচ্ছে ইমতিয়াজ! স্বপ্ন বুনছে, আবার ভাঙছে! হতাশ হচ্ছে আবার সামলে নিচ্ছে!’

….
রেশবপুরে নিজ কক্ষে বসে আছে রাগান্বিতার বাবা মোতালেব তালুকদার। কিছুদিন হলো রেজওয়ানের জন্য মেয়ে দেখছেন তিনি। কিন্তু মন মতো কোনো পাত্রীই পাচ্ছেন না। এর মধ্যে ঘটে গেল আরেকটা ঘটনা দাদিমা পুকুরপাড়ে নাইতে গিয়ে হোটচ খেয়ে পড়ে গেছিলেন পানিতে। কাছে পাশের বাড়ির মোর্শেদের মা থাকায় বেঁচে যান। কিন্তু ভয় যে একটা কঠিন পেয়েছেন তা বোঝা গেছে। সেই পড়ে যাওয়ার দিন থেকে মানুষটা বিছানায়, ঠিকভাবে উঠতেও পারে না। ডাক্তার ডাকা হয়েছিল। ডাক্তার আড়ালে নিয়ে বললেন দাদিমার গুরুতর অসুখ করেছে। শহুরে ডাক্তার দেখালে বোধহয় সুস্থ হতেন। দাদিমাকে শহরে নেয়া দুষ্কর ব্যাপার ছিল তাই রেজওয়ানকে বলে শহুরে ডাক্তারকে গ্রামের আনার ব্যবস্থার করেন। তাও লাভ হয় নি। অবস্থা তেমন ভালো নয়। বর্তমানে দুশ্চিন্তা গ্রস্ত মোতালেব তালুকদার। মা সমতুল্য মানুষটার জন্য বড্ড মন কাঁদে তার। রাগান্বিতাকে দেখতে চাচ্ছেন খুব। তাই বর্তমানে টেবিলে বসে চিঠি লিখছেন রাগান্বিতার জন্য যদি মেয়েটাকে একটা বার দাদিমার কাছে আনা যায়।

প্রিয় কন্যা,
কেমন আছো তুমি। আশা রাখি আল্লাহর রহমতে জামাইকে নিয়ে সুখেই আছো। বহুদিন পরে তোমার নামে চিঠি লিখতে বসেছি। কি লিখবো ভেবে পাচ্ছি না হুটহাট এমন সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে যে আমি নিজেই খুব হতাশাগ্রস্ত! রেজওয়ানের জন্য মেয়ে দেখছিলাম। কিন্তু এর মধ্যে ঘটে গেল দুষ্কর একটা ব্যাপার তোমার দাদিমা নাইতে গিয়ে পড়ে গেছিলেন পানিতে। সেই থেকেই অসুস্থ তোমার দাদিমা। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে কথাটা বলছি তোমায় দিনে দিনে তোমার দাদিমার অবস্থা খুবই গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তোমায় খুব দেখতে চাচ্ছেন। যদি পারো তবে জামাইকে নিয়ে রেশবপুরে এসে দেখে যেও। পারলে কাল পরশুর মধ্যেই রওনা দিও আর কিছু লিখতে পাচ্ছি না। ভালো থেকো।’

ইতি,
তোমার বাবা।’

কথাগুলো লিখে কলম চালানো থামালেন রাগান্বিতার বাবা। এমন সময় তার কক্ষের দুয়ারের সামনে হাজির হলো কাশেম। হাল্কা কাশি দিয়ে বললো,
“আমু সাহেব?”

কাশেমের কণ্ঠটা কানে আসতেই দুয়ারের পানে তাকালেন মোতালেব তালুকদার। বললেন,
“হুম আয়।”

কাশেম ভিতরে ঢুকলো। বললো,“আমারে নাকি খুঁজতাছিলেন?”

মোতালেব তালুকদার নিরুত্তর চাহনি নিয়ে চাইলেন। যা দেখে কাশেম বললো,“চিন্তা কইরেন না দাদিমা ঠিক হইয়া যাইবো আনে।”

দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন মোতালেব তালুকদার। হাতে লেখা চিঠিটা ভাজ করে খামে ভরে ঠিকানা লিখে কাশেমের হাতে দিয়ে বললো,
“চিঠিডা পোস্ট অফিসে দিয়া আয়। সাবধানে যাইস।”
“আইচ্ছা সাহেব।”

চলে গেল কাশেম। আর মোতালেব তালুকদার আকাশ পানে চাইলেন। কিসের যেন খুব ভয় পাচ্ছেন তিনি। ইদানীং ঘুমালে খুব উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখছেন। সেই সেদিনই দেখলেন, দাদিমা তাকে কিছু না বলে কোথায় যেন চলে যাচ্ছেন। কতবার ডাকলেন দাদিমাকে কিন্তু দাদিমা ঘুরেই তাকালেন না।”

বড় কষ্ট লাগছে মোতালেব তালুকদারের। এই স্বপ্নের অর্থ তো ভালো নয়। চিন্তা লাগছে খুব।
—–
পরন্ত বিকেলের মিষ্টিমধুর সুন্দর সময়। রাগান্বিতা ইমতিয়াজ শুয়ে আছে সবুজ ঘাসের বুকে। তাদের ঘিরে ছুটছে হাঁস, মুরগী আর ছাগলের একটা বাচ্চা।
ইমতিয়াজ আকাশ পানে তাকিয়ে শুধালো,
“কাল সকালে আমাদের নিতে ট্রলার আসবে সবকিছু গুছিয়ে রেখো কেমন!”

রাগান্বিতার মনটা কথাটা শুনেই খারাপ হয়ে গেল। মন খারাপ নিয়েই বললো,
“কালই চলে যাবো আর ক’টা দিন থাকলে হতো না।”
“না প্রেমনগরে বেশিদিন থাকতে নেই। মায়া পড়ে গেলে।”
“পড়লে পড়তো কি এমন ক্ষতি তাতে।”

ইমতিয়াজ গম্ভীর এক আওয়াজে বললো,
“একটা কথা সবসময় মাথায় রাখবে জীবনে কোনোকিছুর প্রতিই বেশি মায়া জন্মাতে দিবে না। এই মায়া বড্ড ভয়ংকর জিনিস। দুঃখ ছাড়া বেশি কিছু দেয় না।”
“মায়াতে ভালোবাসা থাকে।”
“যেদিন মায়া ছাড়াতে কষ্ট হবে সেদিন বুঝবে।”

রাগান্বিতা আর কিছু বলে না। চুপ হয়ে যায়। চোখে মুখে এক গম্ভীরতার ছোঁয়া ভেসে ওঠে। ইমতিয়াজ আবার বলে,“রাগ করলে?”

রাগান্বিতা জবাব দেয় না। ঠিক সেই মুহুর্তেই আকাশ পথ বেয়ে ছুটে গেল সাতটি রঙে আবদ্ধ হওয়া রংধনু। ইমতিয়াজ হাত দিয়ে তা দেখিয়ে বললো,
“তুমি আমার জীবনে আসা ঠিক ওইরকম সাতরঙা রংধনুর রঙ।”

রাগান্বিতা তাকালো। চট করেই অভিমানটা গায়েব হয়ে গেল। সে হাসলো। বললো,
“আর আপনি আমার জন্য এই সাতরঙার ভিড়ে থাকা বিশাল আকাশ।”

ইমতিয়াজ রাগান্বিতার থুতনিতে আলতো স্পর্শ করে বলে,
“হাসি ফুটলো তবে বউয়ের মুখে।”

আবারও হাসে রাগান্বিতা। বলে,
“হাসাতে জানানো মানুষটা গম্ভীর মুখে থাকতে দেয় কই।”
“তুমি কি জানো তুমি আমার জন্য স্নিগ্ধতার সকালে ফুটে ওঠা এক পদ্মফুল বউ যাকে যতই দেখি মন ভরে না।”

লাজুক হাসে রাগান্বিতা। কি মায়াময়ী লাগে সেই হাসি!’

#চলবে….

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩৭
________________
আকাশ কেঁপে বাহিরে ঘন বর্ষণ হচ্ছে। বর্ষণের চাপে মাটিরা ভিজে চিপচিপে হচ্ছে। খড়ের ছাউনিতেও শব্দ শোনা যাচ্ছে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকে কতক্ষণ কতক্ষণ পর বাহিরে আলো এসে পরিবেশটা দেখাচ্ছে। ইমতিয়াজ দাঁড়িয়ে আছে জানালার ধারে রাগান্বিতা ঘুমে বিভোর। ইমতিয়াজের মাথায় কিছু চলছে, তার দিনকাল ভালো যাচ্ছে না কেমন বিষণ্ণ বিষণ্ণ লাগে চারপাশ। জীবনে সে অনেক বড় ভুল করে বসেছে। অবশ্য ভুল বললেও ভুল হবে। সামনে কি করে ফেলবে তারও ঠিক নেই। কিছু তো করতেই হবে নয়তো শান্তি ছাড়া এভাবে বাঁচবে কিভাবে! মাঝে মাঝে ইমতিয়াজের মনে হয় এভাবে বাঁচার চেয়ে মরে যাওয়া সুন্দর। কিন্তু ইদানীং মরতেও ইচ্ছে হয় না, সারাক্ষণ ইচ্ছে করে রাগান্বিতার সাথে সংসার করতে। তাকে নিয়ে নতুন করে বাঁচতে– আচ্ছা এই চাওয়া কি খুব অন্যায়। নয় তো। ইমতিয়াজ জোরে নিশ্বাস ফেললো। চোখের কোণে পানি জমলো তার। আম্মার কথা আজ বড্ড মনে পড়ছে। ইমতিয়াজ চোখ বন্ধ করে বললো,“আম্মা কতদিন হয়ে গেল তোমায় দেখি না, কতগুলো বছর পার হলো। জীবনটা কি একটু ভিন্ন রকম হতে পারতো না। তুমি যদি একটু বুদ্ধিমান হইতা, কবিরাজরে বিশ্বাস না কইরা আব্বারে বিয়া না দিতা তবে আজ আমার গল্পটা ভিন্ন হইতো। কেন করলা এমন অবুঝের মতো ভুল। জীবন তো শেষ হয়ে যাচ্ছে, হৃদয়ে কষ্ট লাগে আম্মা। কি একখান অবস্থা! আমায় যারা ভালোবাসে তারাই খালি আমারে রাইখ্যা চইল্লা যায় কেন আম্মা। আমি কি শুরু থেকেই খারাপ আছিলাম কও। জানো আম্মা আমার এখন খালি বাঁচতে মন চায়। রাগান্বিতাকে নিয়া ছোট্ট সংসার করতে ইচ্ছা করে। মেয়েটা আমারে কত ভালোবাসে জানো। তুমি কি ওই আকাশে বইসা দেখো আম্মা। আমি এইবার বাড়ি গিয়া তোমার কাছে যাবো অনেকদিন হইয়া গেছে তোমারে দেখতে যাই না। আমার লগে কথা কইবা তো আম্মা একবারও কথা কও না আমিই শুধু একলা একলা কথা কই! আম্মা তোমার শরীরের ঘ্রাণ কতযুগ ধরে পাই না। আমারে শেষবার বুকে সেই কবে নিছিলা। তোমার আমারে একটুও মনে নাই তাই না। তোমার মনে নাই জমিনের বুকে তুমি একটা পোলা থুইয়্যা গেছো। কত নিষ্ঠুর হইয়া আমারে একা রাইখ্যা থুইয়া গেলা আম্মা। তোমারে আমি বাঁচাইতে পারলাম না। আমি কাউরেই বাঁচাইতে পারি না। খালি মারি।”

চোখ ভিজে আসলো ইমতিয়াজের। বুকে যন্ত্রণা উঠলো আচমকা। কতকিছু একা মনে বলে ফেললো ছেলেটা। প্রকৃতির ঝড়ের সাথে সাথে বুঝি ইমতিয়াজের বুকেও ঝড় উঠেছে। প্রবলবেগের ঝড়। কেউ তার যন্ত্রণা বুঝচ্ছে না, কেউ না। কাঁধে কারো শীতল স্পর্শ অনুভব করলো ইমতিয়াজ হকচকিয়ে উঠলো এতে। দ্রুত চোখ মুছতে নিলো সে। এরই মাঝে রাগান্বিতা শীতল সুরে শুধালো,“ভেজা চোখ আড়াল করতে চাইলেই কি সব আড়াল করা যায় প্রিয়। আমি আপনার সব কথা শুনে নিয়েছি।”

ইমতিয়াজ আর পারলো না নিজেকে সামলাতে সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রাগান্বিতাকে। বললো,“আমার আম্মাডারে আইন্না দিবা বউ আমার না তারে খুব দেখতে মন চায়।”

রাগান্বিতা নিরুত্তর। এই কথার কোনো উত্তর কি এই জগতে আছে, নেই তো। রাগান্বিতা কেন পৃথিবীর কোনো মানুষই মৃত ব্যক্তিকে ফিরিয়ে আনতে পারে না। রাগান্বিতার চোখ বেয়ে পানি ঝড়লো। ইমতিয়াজ যেন এই প্রথম অবুঝের মতো তার কাছে একটা আবদার করে বসলো। যে আবদার পূরণ করার সাধ্য রাগান্বিতার নেই। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের পিঠে হাত বুলালো বললো,“এভাবে ভেঙে পড়বেন না আমি তো আছি দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।”

ইমতিয়াজ নীরব। তার মুখে কোনো কথা নেই। আকাশে বিদ্যুৎ চমকালো আবার। বৃষ্টি হচ্ছে প্রবল বেগে। ঘর জুড়ে অন্ধকার আর হৃদয় জুড়ে বিষণ্ণতা নিয়ে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। রাতটা বুঝি বড্ড বেশিই যন্ত্রণার কাটলো।’

শীতল ছোঁয়ায় পঞ্চমুখ চারপাশ। চারপাশে ঠান্ডা বাতাস বইছে। সেই বাতাস ঘরে এসে ঠেকছে। বৃষ্টি থেমেছে ঘন্টাখানেক হবে। রাগান্বিতা বসে আছে ইমতিয়াজের মাথার কাছে। কাল সারারাত সে ঘুমায় নি তার কোলে মাথা দিয়ে ইমতিয়াজ ঘুমিয়ে ছিল আর রাগান্বিতা জেগে জেগে ইমতিয়াজের মাথায় বিলি কেটে দিয়েছে শুধু। মানুষটার কত যন্ত্রণা ভাবলেই কষ্ট লাগছে রাগান্বিতার। পালঙ্কের পাশে থাকা ইমতিয়াজের হাত ঘড়িটা দেখলো ভোর পাঁচটা বাজে নামাজ আদায়ের সময় হয়ে গেছে।’

রাগান্বিতা আরো কিছুক্ষণ বসে থেকে ডাকলো ইমতিয়াজকে। বললো,“শুনছেন, উঠুন জলদি। নামাজ পড়বেন না। আম্মার জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করবেন। উঠুন তাড়াতাড়ি।”

ইমতিয়াজ নড়েচড়ে উঠলো। মাথাটা ভাড় ভাড় ঠেকছে তার। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার দিকে তাকালো। বললো,“নামাজ পড়বে?”

রাগান্বিতা মাথা নাড়িয়ে বললো,“জি উঠুন।”

ইমতিয়াজ বিনা বাক্যে উঠে বসলো। রাগান্বিতা পালঙ্ক থেকে নেমে হেরিকেনটা জ্বালালো। চারপাশ এখনো তেমন পরিষ্কার হয় নি। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বললো,“নদীর ঘাটে যাওয়ার কোনো দরকার নেই তুমি এখানে বসো আমি বালতি ভরে পানি নিয়ে আসছি। বৃষ্টি পড়েছে চারপাশ কাঁদা হয়ে রয়েছে। পড়ে গেলে তাই তুমি বসো আমি পানি নিয়ে আসি।”

ইমতিয়াজ পালঙ্ক থেকে নেমে রন্ধন শালায় রাখা বালতিটা হাতে নিয়ে বাহিরে বের হলো। বাহিরে তখন আবছা আলো বইছে। দেখা যাচ্ছে অনেকটা। রাগান্বিতা টিয়াপাখির পাশ দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,“সাবধানে যাবেন।”

ইমতিয়াজ কথাটার জবাব না দিলেও শুনতে পেয়েছে ঠিকই। মিনিট পনের যেতেই ইমতিয়াজ বালতি ভরে পানি নিয়ে রাখলো পিড়ার ওপর(মাটির সিঁড়ি)। ইমতিয়াজ বালতিটা রেখে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,“আমি ওজু করে এসেছি তুমিও আসো। আমি অপেক্ষা করছি।”

রাগান্বিতা মাথা নাড়িয়ে মৃদুস্বরে বললো,“ঠিক আছে।”
——
ঘড়িতে তখন আটটার কাটায় ছুঁই ছুঁই। ইমতিয়াজ তাদের ব্যাগপত্র গুছাতে ব্যস্ত। আসবাবপত্রের কিছুই নিবে না এমনটা ভেবেছে ইমতিয়াজ। রাগান্বিতাও বারণ করে নি। মাঝে মাঝে এখানে আসবে এমন পরিকল্পনা তার। ট্রলারের আওয়াজ শোনা গেল। ট্রলারটা সোজা এসেছে নদীরঘাটপাড়ে যার দরুন এত নিকটে আওয়াজটা পাওয়া যাচ্ছে। ইমতিয়াজ রাগান্বিতাকে তাড়া দিল। বললো,“দ্রুত বোরকা হিজাব পড়ে নেও বউ, আমি বাকিদের গুছিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।”

রাগান্বিতা মাথা নুইয়ে হেঁসে বললো,“ঠিক আছে।”

….
“কি গো বন্ধুরা এই সাতদিন মজা পাইছো তো খালি ঘুরাঘুরি সঙ্গে খাওন আর খাওন।”

গরুর রশি খুলতে খুলতে কথাগুলো গরু-ছাগলকে উদ্দেশ্য করে বললো ইমতিয়াজ। তারা বুঝলো কি না বোঝা গেল না। তবে ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে থেকেছে ঠিকই। এই গরু’ছাগলগুলো এক লোকের কাছ থেকে ভাড়ায় এনেছিল ইমতিয়াজ, হাঁস-মুরগীও তেমন। খালি টিয়াটা নিজ টাকায় কিনে আনা। এরও একটা বিশেষ কারণ আছে। ইমতিয়াজ গরু-ছাগলগুলোকে সঙ্গে করে চলে গেল ট্রলারের উদ্দেশ্যে। এই সাতদিনে খেয়ে খেয়ে ভালোই মোটা হয়েছে গরুর ছাগলগুলো। কি অবস্থা। প্রেমনগর ছেড়ে যেতে চাচ্ছে না গরুছাগল, ইমতিয়াজ ঠেলে ঠেলে নিয়ে গেল ওগুলোকে। হাঁস-মুরগী খাঁচায় থাকায় বেশি সমস্যা হয় নি। খুব সহজেই নিয়ে রাখলো ট্রলারে। চারপাশ গুছিয়ে ইমতিয়াজ ঘরে ঢুকতেই দেখলো রাগান্বিতা বোরকা হিজাব পড়ে তৈরি। সে বললো,“হয়ে গেছে তোমার?”

রাগান্বিতাও তাদের কুটিরে থাকা ছোট্ট আয়নাটায় একবার নিজেকে দেখে বললো,“জি চলুন।”

ইমতিয়াজ রাগান্বিতার হাত ধরে বাহিরে আনলো। তখনই টিয়াপাখিটা বলে উঠল,“বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম।”

রাগান্বিতা নিকাবের আড়ালে হাসলো। বললো,“একে ট্রলারে নিবেন না?”

ইমতিয়াজ খাঁচা থেকে পাখিটা বের করতে করতে বললো,“না।”

রাগান্বিতা অবাক হয়ে বললো,
“কেন?”
“কারণ একে মুক্ত করে দিবো ওই আকাশে।”
“আমাদের সঙ্গে কেন নিবেন না?”
“সবাইকে সঙ্গে নিতে নেই।”

এই বলে পাখিটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু কাটলো ইমতিয়াজ। সঙ্গে বললো,“তোকে বলেছিলাম না রোজ সকালে যদি নিয়ম করে তিনবার বলতে পারিস বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম তবে সাতদিন পর তোর মুক্তি। কি কথা রাখলাম তো। সবসময় ভালো থাকিস। আমাদের ভুলিস না কেমন। রোজ তিনবেলা খাইয়েছি মনে রাখিস কিন্তু।”

বলে আরো একবার টিয়ার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা এবার বুঝলো ইমতিয়াজ কেন পাখিটাকে ছেড়ে দিতে চাইছে। রাগান্বিতা আর মন খারাপ করলো না। নিকাবটা হাল্কা উঠিয়ে পাখির কপালে চুমু কেটে। শীতল সুরে বললো,“ভালো থাকিস সবসময়।”

অতঃপর ইমতিয়াজ রাগান্বিতা দুজনেই দু-হাতে টিয়াটাকে ধরে উড়িয়ে দিল আকাশে। সঙ্গে সঙ্গে টিয়া পাখিটি মুক্ত আকাশে ডানা ঝাপটাতে লাগলো। আবারও চেঁচিয়ে বলতে বলতে গেল,“বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম।”

রাগান্বিতার চোখে পানি চলে এতো। কত সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত কাটালো তারা। স্মৃতি হয়ে থাকবে সব।’

অবশেষে নদীরঘাটপাড়ে গিয়ে ট্রলারে উঠলো রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। তারা উঠতেই ট্রলার চলতে শুরু করলো। একটু একটু করে তারা চলে আসতে লাগলো প্রেমনগর ছেড়ে। রাগান্বিতার চোখ ভেসে আসছে, কি সাধারণ জীবনযাপণ করলো এই কয়দিন। জীবন যে কি নিদারুণ সুন্দর ছিল গত সাতদিন। নৌকাটা নজরে আসলো, ঘাটপাড়ের বড় গাছটার সঙ্গে এখনো বাঁধা, ঢেউয়ের স্রোতে ভাসছে। মুক্ত আকাশে কিছু পাখি উঠছে, সেই দূরে দোলনাটা দেখা যাচ্ছে, ইমতিয়াজের বাঁশি বাজানোর সেই গাছটাও নজরে আসলো। ছোট্ট কুঁড়েঘরটা পড়ে রইলো একা, সামনেই ঝুলে রইলো শূন্য হওয়া সেই টিয়াপাখির খাঁচাটা। রাগান্বিতা যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণই তাকিয়ে রইলো প্রেমনগরের দিকে পাশেই ইমতিয়াজ দাঁড়ানো। হঠাৎই রাগান্বিতা কেমন এক বিষণ্ণ সুরে আওড়ালো,
“আমরা আবার কবে আসবো এখানে?”

ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“প্রকৃতি যেদিন আবার চাইবে।”

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#TanjiL_Mim♥️

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-৩৪+৩৫

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩৪
________________
শিশির ভেজা একটা সকাল। বাতাসের ধ্বনি ধ্বনিতে ভেসে বেড়াচ্ছে একটা মিষ্টিমধুর সুরেলা কণ্ঠ। পুরো নির্জন মাখা সকালের প্রকৃতিরা সেই ধ্বনি শুনছে মন দিয়ে। বাড়তি কোনো শব্দ নেই, নেই কোনো কোলাহল। আছে শুধু এক রূপবতী রমণীর কণ্ঠে ভাসা কোরআনের সুর। রাগান্বিতা কোরআন শরীফ পাঠ করছে। অনেক আগেই সে আর ইমতিয়াজ উঠে একসাথে ফজরের নামাজ পড়ে। ইমতিয়াজ নামাজ আদায় করেই ঘুমিয়ে যায় কিন্তু রাগান্বিতা ঘুমায় নি। সে বাড়ি থেকে আসার সময় সঙ্গে করে কোরআন শরিফ নিয়ে আসে। রাগান্বিতা প্রায়শই নামাজ আদায় করে কোরআন পাঠ করে। আজও করছে। চারপাশ চুপচাপ আর নিরিবিলি। মাঝে দু’ একবার খোপের ভিতর থাকা মোরগের ডাক শোনা গেলেও পরে আর যায় নি তেমন। রাগান্বিতা জানালার ধারে মুখ করে চৌকির উপর বসে কোরআন পাঠ করছে। বাহিরেই খাঁচায় বন্দী করা তাদের সঙ্গে থাকা টিয়া পাখিটি চোখ বুজে ঝিমাচ্ছে। ধীরে ধীরে সময় গড়ালো। রাগান্বিতা তার কোরআন পাঠ শেষ করে মনে মনে কিছু দোয়া দরুদপাঠ করে ইমতিয়াজের কপালে ফুঁ দিয়ে দিলো। ইমতিয়াজ ঘুমে মগ্ন থাকায় তেমন টের পায় নি আর। রাগান্বিতা কোরআন শরিফ বন্ধ করে চুমু কাটলো দু’বার। তারপর এগিয়ে যায় সামনেই উচু তাকের কাছে সেখানে কোরআন শরীফ রেখে আবার এগিয়ে আসে ইমতিয়াজের দিকে। সকালের নাস্তা বানাতে হবে। কিন্তু তার আগে ঘর ঝাড়ু দিতে হবে। রাগান্বিতা ঘর ঝাড়ু দিয়ে, ঝাড়ু হাতে বের হলো বাহিরে সঙ্গে সঙ্গে শীতল ভেজা সকালের বাতাসেরা তাকে ছুঁয়ে দিলো। রাগান্বিতা চোখ বন্ধ করে ফেললো। সকালের এই মুহূর্তটা তার দারুণ লাগলো। রাগান্বিতা বেশিক্ষণ না দাঁড়িয়ে কোমড়ে আচল বেঁধে তাদের কুঁড়েঘরের সম্পূর্ণ আঙিনাটা একবার ঝাড়ু দিলো। তারপর রান্নাঘরের দিকে গেল। কুঁড়েঘরের ভিতরে ঢুকে হাতের ডানদিকে একটা দুয়ার আছে সেই দুয়ারের পরেই মাটির উনুন পেতে রন্ধনশালা বানানো। চুলার পাশেই জ্বালানোর জন্য ছিল শুঁকনো কিছু ডালপালা। রাগান্বিতা দেশলাই দিয়ে মাটির চুলা বা উনুন জ্বালালো। সর্বপ্রথম ছোট্ট পাতিল পেতে পানি দিলো গরম করার জন্য। রাগান্বিতা গরম গরম পরাটা আর দুধ চা বানাতে চাচ্ছে সকালের নাস্তা হিসেবে।
—-

“তুমি আমায় ভুলে গেছো তাই না”
“আমায় এভাবে ভুলে কি করে গেলে দা..”

সঙ্গে সঙ্গে হকচকিয়ে উঠলো ইমতিয়াজ। ঘুমটা ভেঙে গেল আচমকা। ইমতিয়াজ আশেপাশে তাকালো। জোরে একটা নিশ্বাস ফেললো। তখনই জানালার ফাঁক দিয়ে দেখতে পাওয়া টিয়াটা বলে উঠল,“বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম!” রাগান্বিতাও শুনতে পেল টিয়ার কথাটা লজ্জায় নুইয়ে গেল। টিয়ার মুখে কথাটা শুনলেই তার কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে। ইস্! ইমতিয়াজ এ কি শিখালো টিয়াটাকে। আনমনেই হেঁসে ফেললো রাগান্বিতা।

এদিকে, ইমতিয়াজ সেও তাকিয়ে রইলো টিয়াটার দিকে। অনেক্ক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে ধীরে ধীরে নিজেকে করলো শান্ত। তারপরই গলা খাগাড়ি দিয়ে ডাকলো,
“বউ, এই বউ, কোথায় তুমি?”

রাগান্বিতা তক্ষৎনাৎ তার কাজ রেখে দৌড়ে আসলো। এক হাতে আঠা মাখানো। রাগান্বিতা চিন্তিত স্বরে বললো,“কি হলো, কি হলো?”

রাগান্বিতার কণ্ঠ শুনেই ইমতিয়াজ তাকালো রাগান্বিতার দিকে। কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি (গ্রামীণ স্টাইলে পড়া),হাতে অল্প কিছু কাঁচের চুড়ি, মাথায় একপাশে সিঁথি কেটে চুলগুলো খোঁপা করা, দু’কানে ছোট্ট পুঁতির দুল, গলায় ছোট্ট একটা চেন সঙ্গে লাল রঙা ঠোঁটে রাগান্বিতাকে পুরো ভিন্নরকম লাগছে। ভাড়ি গহনাগাঁটি ছাড়াও এই সাধারণ শাড়িতেও কত মায়াবী দেখাচ্ছে রাগান্বিতাকে। ইমতিয়াজ পলকবিহীন তাকিয়ে রইলো রাগান্বিতার দিকে।

ইমতিয়াজকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার প্রশ্ন করলো রাগান্বিতা,“কি হলো কিছু বলছেন না কেন! কি হয়েছে? এভাবে ডাকছিলেন যে।”

ইমতিয়াজ রাগান্বিতার চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। বললো,“কি হবে কিছুই হয় নি। কোথায় ছিলে তুমি?”

রাগান্বিতা কিছুটা এগিয়ে এসে বললো,
“সকালের নাস্তা করছিলাম তো।”
”তুমি জানো তোমায় না দেখে আমার কত খালি খালি লাগছিল?”

রাগান্বিতা হাসে। বলে,“আপনিও না তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে আসুন আমি খাবার তৈরি করছি।”

রাগান্বিতা চলে গেল। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে শুধালো,
“আজ তোমায় খুব সুন্দর দেখাচ্ছে বউ!”

রাগান্বিতা কথাটা শুনতে পেলেও বিনিময়ে কিছু বললো না। মুচকি হেঁসে চলে গেল চুলার পিটে।’

ইমতিয়াজ আরো কিছুক্ষণ চৌকিতে বসে থেকে বের হয় কুঁড়েঘর থেকে। জোরে নিশ্বাস ফেলে প্রকৃতির বুকে। তারপর হেঁটে যায় হাঁস-মুরগী আর গরু-ছাগলের কাছে। গরুর ছাগলদের ঘাস দিয়ে। হাঁস-মুরগীর খোপ খুলে দিলো, সঙ্গে সঙ্গে হাঁস-মুরগী বেরিয়ে এসে তাদের ছোট্ট ছোট্ট পা নিয়ে চলতে শুরু করলো। হাঁস দু’টো আর তাদের এক বাচ্চাটা দৌড়ে ছুটে গেল পানির কাছে। মুরগীর জন্য চাল এনে খেতে দিলো ইমতিয়াজ। সঙ্গে বললো,
“তোদের এখানে এনেছি কেন জানিস যাতে মনে হয় এই ছোট্ট দ্বীপে আমি রাগান্বিতা শুধু নই। তোদের মতো আরো কিছু প্রাণী আছে যারা গুনগুন করে আমাদের এই ছোট্ট সংসারে ঘোরাফেরা করবে। সঙ্গে মনে হবে এই প্রকৃতির সবটা নির্জীব নয়। সতেজও আছে।”

রাগান্বিতার হাঁক শোনা গেল। সে একটু উচ্চস্বরেই বললো,“আপনার কি হয়েছে? আমার কিন্তু রান্না প্রায় শেষ।”

ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়ালো। রাগান্বিতাকে বললো,“এই তো হয়ে গেছে আমি ঘাটপাড় থেকে এক্ষুণি মুখ ধুয়ে আসছি।”

রাগান্বিতা শুনলো। বললো,“আচ্ছা জলদি আসবেন।”
—–

ইমতিয়াজ হাতমুখ ধুয়ে ঘরে পা রাখতেই রাগান্বিতা হাসি মুখে তার দিকে গামছা এগিয়ে দিলো ইমতিয়াজও নিলো। বললো,“ধন্যবাদ বউ।”

রাগান্বিতা বিনিময়ে হাল্কা হাসে। বলে,“পাটি কি ঘরের ভিতর বিছাবো নাকি বাহিরে?”

উত্তরে নিজের মুখখানা গামছা দিয়ে মুছে বললো ইমতিয়াজ,“বাহিরে।”

কুঁড়েঘরের সামনেই দুয়ারের একটু কিনার দিয়ে মাটির মেজেতে পাটি বিছিয়ে পাশাপাশি বসে আছে রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ তাদের সামনেই রয়েছে দু’কাপ দুধ চা আর একটা প্লেটে কিছু গরম গরম তৈলাক্ত পরাটা। ইমতিয়াজ একটা পরাটা হাতে নিয়ে গোল করে ভাজ করে দুধ চায়ের সাথে ভিজিয়ে খেতে শুরু করলো। রাগান্বিতাও খেতে লাগলো। তবে তার আগে জিজ্ঞেস করলো,“কেমন হয়েছে?”

ইমতিয়াজ রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বললো,“দারুণ!”

রাগান্বিতা অবাক স্বরে বললো,
“কিন্তু আপনি তো এখনও খান নি?”
“তুমি রান্না করেছো মানেই সেটা দারুণ হবে।”
“মানুষকে কিভাবে কথার জালে ফাঁসানো যায় তার উপর পড়াশোনা করেছিলেন বুঝি।”

হাসে ইমতিয়াজ। বলে,
“তুমি ফাঁসলে না তো?”
“কে বলেছে ফাঁসি নি, আমি তো সেই কবেই ফেঁসে বসে আছি। আজও জানলেন না আপনি?”

চায়ের কাপে চুমুক দিলো ইমতিয়াজ। বললো,
“জানি তো তাও তোমার মুখে শুনতে ভালো লাগে।”
“আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন আমি প্রতিবার বিভোর হয়ে যাই।”
“তোমাকে বিভোর বানানোর জন্যই বোধহয় আমার জন্ম।”
“আপনি কি জানেন প্রিয় আমার প্রায় মনে হয় আমার সৃষ্টি আপনার জন্যই। আপনি ছাড়া বোধহয় আমি অসম্পূর্ণ।”

ইমতিয়াজ বিনিময়ে কিছু বলে না। ইচ্ছে করে চুপ করে রয়। তবে তার বলতে খুব মন চাচ্ছে,
“আমার তো মনে হয় আমার বিনাশের অস্ত্র বুঝি তোমার হাতে।”

কিন্তু ইমতিয়াজ বললো না। রাগান্বিতার ঠোঁটে থাকা হাসিটাকে এই মুহূর্তে কোনোভাবেই মিলিয়ে দিতে চায় না ইমতিয়াজ। সে একটা সিদ্ধান্ত নিলো, রাগান্বিতার সাথে উল্টোপাল্টা আর কোনো কথাই সে বলবে না। ইমতিয়াজ এ ক’দিনে হারে হারে টের পেয়েছে, রাগান্বিতাকে দুঃখ দেয়া ইমতিয়াজের কম্ম নয়!”
——
সময়টা প্রকৃতি মেপে বোধহয় সকাল দশটা। রাগান্বিতা ইমতিয়াজ নৌকায় চড়ে কোথায় যেন এসেছে। বর্তমানে নদীর মাঝে বইঠা রেখে পানিতে ভাসছে। ইমতিয়াজের হাতে মাছ ধরা জাল। রাগান্বিতা কিছুটা অবাক স্বরেই বললো,
“আপনি কি মাছ ধরতে চাচ্ছেন?”

ইমতিয়াজ নদীর এদিকে সেদিক তাকিয়ে বললো,“হুম।”

কথাটা শেষ করেই হাতের জালটাকে বিছিয়ে ছুঁড়ে মারলো নদীর পানিতে। রাগান্বিতা একটু চমকে উঠলো এতে। মনে মনে বললো,“আপনি মাছ ধরতেও জানেন?”

ইমতিয়াজ রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললো,“একটু আকটু।”

খানিকটা কম্পন সৃষ্টি হয় রাগান্বিতার মাঝে। ধীরে স্বরে বলে,“মানুষটা তার মনে মনে বলা কথাগুলোও বুঝতে পারে কি করে?”

ইমতিয়াজ হাল্কা হাসে। ধীরে ধীরে উঠাতে শুরু করে নদীতে বিছিয়ে দেওয়া মৎস্য আটকানো তার জালটাকে।

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩৫
________________
দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে চুলাতে। রাগান্বিতা মাছ ভাজছে, তার পাশেই বসে আছে ইমতিয়াজ। দৃষ্টি তার রাগান্বিতার দিকেই। কতক্ষণ আগেই ইমতিয়াজের প্রথম জালেই একটা বড় মাছ আর কিছু ছোট ছোট মাছ ধরা পড়েছে। দু’জন মানুষের জন্য যা ছিল যথেষ্ট। ইমতিয়াজ পরর্বতীতে আর জাল ফেলে নি নদীতে। চারপাশটা একটু ঘুরে চলে আসে তাদের ছোট্ট কুটিরে। রাগান্বিতা ফিরেই দ্রুত মাছ কেটে রাঁধতে বসে। ইমতিয়াজ পাশে বসে শুধু দেখছে রাধুনী রাগান্বিতাকে কথা বলছে না কোনো চুপচাপ শুধু দেখেই যাচ্ছে।

….
রাগান্বিতার রান্না শেষ হলো। ভাত,মাছ ভাজা, ডাল, সঙ্গে ইমতিয়াজের কোথা থেকে যেন নিয়ে আসা লাউশাক রান্না করেছে রাগান্বিতা। দারুণ ঘ্রাণ বেরিয়েছে রান্না থেকে।’

রাগান্বিতা তার ঘেমে যাওয়া মুখটাকে মুছলো। কাজ তার প্রায় শেষ এবার শুধু ঘরটা একবার ঝাড়ু দিলেই হয়ে যাবে। রাগান্বিতা চুলার চারপাশটা গুছিয়ে পরিপাটি করলো, রান্নার আসবাবপত্রগুলো ঘরের ভিতর নিয়ে সাজিয়ে রাখলো তাকে। তারপর ঝাড়ু নিয়ে পুরো ঘর ঝাড়ু দিল। মাটির সিঁড়িতে ময়লা নিয়ে বাহিরে বের হতেই ইমতিয়াজ এগিয়ে আসলো হাতে গরু ছাগলকে খাওয়ানোর জন্য ঘাস নিয়ে। সে ঘাস নিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলো,“তোমার কি হয়ে গেছে বউ?”

রাগান্বিতা মাথা উঁচু করে কপালের ঘামটুকু পুনরায় মুছে বললো,“এই তো শেষ। আপনার হলো?”

ইমতিয়াজ দাঁড়িয়ে বললো,“হুম। আমি এগুলো রেখে আসছি আজ দুজন একসাথে গোসল করবো।”

রাগান্বিতা মৃদু হেসে জবাব দিলো,“ঠিক আছে।”

সময় গড়ালো। ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতা হাতে করে গামছা আর জামাকাপড় নিয়ে হেঁটে গেল নদীরঘাটে। দুজনের হাতে নিমপাতার ডাল। দুজনেই ডাল দিয়ে দাঁত মাজছে। রাগান্বিতা তার তিতা তিতা মুখখানা নিয়ে বললো,
“এগুলো দিয়ে আপনি কি করে দাঁত মাজেন কি তিতা?”
“তিতা কই? আমার তো লাগে না।”

চোখ মুখ কুঁচকে তাকালো রাগান্বিতা যা দেখে ইমতিয়াজ হাসলো। জামাকাপড় ঘাটের পাশে উঁচু বেঞ্চিটাতে রেখে ঘাটপাড়ে নামলো দুজন। ইমতিয়াজ আগে এরপর রাগান্বিতা। বাঁশের তৈরি সুন্দর ঘাট। রাগান্বিতা ঘাটে বসলো। হাত দিয়ে পানি স্পর্শ করে কুলি করলো। এরপর সামনের দিকে তাকালো। দূরদূরান্তে শুধু নদীতে থাকা পানি আর পানি।

কাছেই নদীর ঢেউয়ে নৌকাটা বড় গাছের পিঠে ভাসছে। ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতা মিষ্টি আলাপে হাসাহাসি করছে আর নাইছে। পানিও ছিটাচ্ছে একে অপরের গায়ে। রাগান্বিতা বললো,“আপনি একটা পাগল।”

ইমতিয়াজ হাসতে হাসতে জবাব দিলো,
“জানি তো তুমি করেছো।”
“উম, আমার বয়েই গেছে আপনাকে পাগল বানাতে উল্টো আপনি পাগল বানিয়েছেন।”
“এক ষোড়শী কন্যার মাঝে এত প্রেম আমি এর আগে দেখেনি।”
“আমি কিন্তু বেশ সাহসী।”
“মানুষ খুন করতে পারবে?”

রাগান্বিতা ফট করেই বলে দিল,“আপনি বললে ঠিক পারবো।”

উচ্চ শব্দে হেঁসে দিলো ইমতিয়াজ। রাগান্বিতাও হাসলো। কি মিষ্টি মধুর সময় কাটলো দুজনের এই নিরিবিলি প্রকৃতিতে। পাখি ছুটছিল ধবধবে সাদা রঙের বিশাল আকাশে।’

যোহরের নামাজ আদায় করে দুজনেই সকালের ন্যায় খেতে বসলো কুঁড়েঘরের দুয়ারের কাছে। রাগান্বিতা হাতে হাতপাখা দিয়ে ইমতিয়াজকে বাতাস করছে,ইমতিয়াজ বারণ করেছিল বটে কিন্তু রাগান্বিতা শোনে নি। ইমতিয়াজ তৃপ্তি পেয়ে খাচ্ছে মাছ, ডাল, ভাত আর শাক। রাগান্বিতার রান্নার হাত চমৎকার। ইমতিয়াজের অনেক পছন্দের।’

খাবার সেরে বিছানায় শুয়ে দুজন গল্প করলো কিছুক্ষণ এরপর বিকেল হতেই নামাজ পড়ে হাঁটতে বের হলো দুজন। আকাশটা সুন্দর। চারপাশ শুঁকনো। কাল সেই বৃষ্টিটার পরে কড়া রোদ পড়ায় সব শুকিয়ে গেছে। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের হাত ধরলো। আহ্লাদী স্বরে বললো,
“এই জায়গাটার নামটা তো জানা হয় নি।”
“এত জেনে কি করবে থাকুক না কিছু অজানা।”
“কেন থাকবে?”
“থাকলে কি খুব ক্ষতি হবে?”
“না। তবে বললে আমি খুশি হবো।”
“তবে বোধহয় আজ তোমায় খুশি করা হলো না আমার।”

খানিকটা অভিমান জমলো রাগান্বিতার। সে মুখ কালো করে বললো,“নামটা বললে কি হতো?”
“তুমি যে আমায় ফেলে আসতে তখন।”
“আসবো না আমি আপনি হীনা এদিকে কখনো আসবো না।”

ইমতিয়াজ এবার ভাবলো। বললো,
“নাম কি দেয়া যায় বলো তো?”

ইমতিয়াজের কথা শুনে অবাক হয়ে বললো রাগান্বিতা,
“কেন, নাম দিবেন কেন, এই জায়গার নাম নেই।”
“আছে তো প্রেমনগর। এই জায়গার নাম প্রেমনগর।”

রাগান্বিতা হেঁসে ফেলে। বলে,
“যা খুশি জায়গার নাম কখনো এমন হয়। প্রেমনগর।”
“কেন হয় না আচ্ছা বাদ দেও ওদিকে চলো।”

বলেই এগিয়ে চললো ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতা। কতদূর হাঁটতেই কিছু গাছপালার মধ্যে ঢুকে পড়লো রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। মাঝখানের গাছ দুটোতে কাঠের সঙ্গে দড়ি বেঁধে দোলনা বানানো। রাগান্বিতা জিনিসটা দেখেই বললো,“বসি?”

ইমতিয়াজ মৃদু হেসে বললো,“হুম বসো তোমার জন্যই বানানো।”

রাগান্বিতা দৌড়ে গিয়ে বসলো। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার পিছনে দাঁড়িয়ে হাল্কা ধাক্কা দিলো। সঙ্গে সঙ্গে রাগান্বিতা সামনে পিছনে দুলতে লাগলো। অদ্ভুত এক ভালোলাগা গ্রাস করলো রাগান্বিতাকে। সে হাসলো উচ্চ শব্দে হাসলো। সেই হাসি যেন ইমতিয়াজের হৃদয় নাড়িয়ে দেয়ার মতো কাজ করলো। ইমতিয়াজ দেখে গেল রাগান্বিতাকে। হাল্কা স্বরে আওড়ালো,“কি নিদারুণ হাসি তোমার। এই হাসিতেই আমি নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি বারংবার। অন্তর পুরে ছারখার হচ্ছে যে কতবার তা যদি তুমি জানতে।”

ইমতিয়াজ কয়েকমুহুর্ত রাগান্বিতার পিছনে দাঁড়িয়ে থেকে কথাগুলো ভেবে হঠাৎই সরে গেল। গিয়ে বসলো নদীর ধারের একটা বড় গাছের সাথে হেলান দিয়ে। তবে রাগান্বিতার কাছ দিয়েই ছিল। ইমতিয়াজের পড়নে ফতুয়া আর লুঙ্গি। মাথায় গামছা পেঁচানো। ইমতিয়াজ একপলক রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে কোমড়ের কাছে ফতুয়ার আড়ালে লুকিয়ে রাখা বাঁশিটা বের করলো। তারপর পূর্বাংশের আকাশটার পানে চেয়ে ঠোঁট ছোঁয়ালো বাঁশির ফাঁকে দু’হাতের আঙুলও ছোঁয়ালো বাঁশির শেষ প্রান্তের দিকের ফাঁকে ফাঁকে। ধীরে ধীরে সুর আনলো। প্রকৃতি জুড়িয়ে কি মুগ্ধনীয় আওয়াজ হলো চারিপাশে। নিস্তব্ধ প্রকৃতিটা বুঝি হঠাৎ করেই সতেজ হয়ে উঠলো। পাখিরা ছুটে এসে বসলো গাছের ডালে। তাদেরও মন কাড়লো বুঝি ইমতিয়াজের বাঁশির সুর। মনে মনে বোধহয় বলছিল,“এত সুন্দর কেন!”

রাগান্বিতা তার দোলনা দুলানো বন্ধ করলো আচমকা। সেই ভরসন্ধ্যাবেলার প্রথম আলাপের বাঁশির সুর ঝনঝন করে যেন বেজে উঠলো রাগান্বিতার কানে। রাগান্বিতা মুগ্ধ হলো, মনটা প্রবল স্রোতের মতো প্রেমদুয়ারের কাছে ছিটকে গেল। কি প্রবল ধাক্কা লাগলো হৃদয়ে। রাগান্বিতা বুকে হাত দিল। সে আবার প্রেমে পড়লো বুঝি ইমতিয়াজের। দোলনার দড়িতে কপাল ছুঁয়ে মনে মনে আওড়ালো, “ছেলেটা এত মুগ্ধনীয় কেন! আমি বার বার হারিয়ে যাই।”

অনেকক্ষণ সময় চললো ওমন। রাগান্বিতা দোলনায় বসে বাঁশির সুর শুনলো আর ইমতিয়াজ গাছের পিঠে হেলান দিয়ে বাঁশি বাজাতে থাকলো। তবে তারা কিন্তু পুরোপুরি একা ছিল না তাদের সঙ্গে ছিল গাছের ডালে বসে থাকা কিছু নাম না জানা পাখি। তারাও মগ্ন ছিল বাঁশির সুরে।

রাগান্বিতা উঠে দাঁড়ালো, অনেক তো হলো দূরে বসা এবার না হয় কাছে যাওয়া যাক। রাগান্বিতা নীরবে গিয়ে বসলো ইমতিয়াজের পাশ দিয়ে। নদীতে তখন প্রবল স্রোতের শব্দ শোনা গেল। ইমতিয়াজ চোখ বন্ধ করে বাঁশি বাজাতে থাকলো মন দিয়ে। যেন আজ পুরো মনটাই আঁকড়ে ছিল বাঁশির ভিড়ে। রাগান্বিতা গালে হাত দিয়ে এক ধ্যানের তাকিয়ে রইলো ইমতিয়াজের মুখশ্রীর দিকে। কি নিষ্পাপ লাগছে ওই মুখখানা। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে রাগান্বিতার ইচ্ছে হচ্ছে,“এই সময়টা যদি এখানেই থেমে যেত, ওই পাখিগুলোও ওখানে বসে থাকতো, এই মুগ্ধনীয় পরিবেশটার যদি কোনো পরিসমাপ্তি না ঘটতো তবে না কতই ভালো হতো। রাগান্বিতা প্রাণ ভরে শুধু ইমতিয়াজকেই দেখে যেত। এই দেখা বুঝি জনম জনমেও শেষ হবে না রাগান্বিতার। একটা মানুষ দেখার এত তৃপ্তি রাগান্বিতা এর আগে কখনো অনুভব করে নি। ক্ষণে ক্ষণে সে টের পাচ্ছে সে মরছে, ইমতিয়াজের প্রতি গভীর আসক্তিতায় সে দিনে দিনে মারা পড়ছে।”

ইমতিয়াজের কণ্ঠ শোনা গেল। সে বাঁশি বাজানো থামিয়ে নরম স্বরে বললো,“এভাবে তাকিয়ে থেকো না গো, আমি যে পুরোই সর্বহারা হয়ে যাবো বউ।”

রাগান্বিতার টনক নড়লো। গালের হাত সরিয়ে ধ্যানময়ী গলায় বললো,
“আমিও যে হচ্ছি তার বেলা।”

জবাব দেয় না কেউই কারো কথার। ধীরে ধীরে সময়ের সাথে সাথে প্রকৃতিও রঙ বদলালো। রাগান্বিতা ইমতিয়াজ পাশাপাশি, কাছাকাছি বসা। দৃষ্টি তাদের নদীর ভিড়ে আকাশের মাঝে থাকা লাল রঙা সূর্যটার দিকে। চারপাশ পুরো রক্তিম আগুনের আলোর মতো চকচকা। বোঝাই যাচ্ছে সন্ধ্যা নামছে। একটা ধমকানো বাতাস ছুইলো ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতাকে। ইমতিয়াজ আচমকা বলে উঠল,
“জানো তো রাগান্বিতা, প্রেম মানে হলো এক আসমান যন্ত্রণা তাও দেখো মানুষ বেছে বেছে সেই প্রেমে পড়বেই যেমন আমি পড়েছি।”

রাগান্বিতার দৃষ্টি প্রকৃতির দিকে থাকলেও ইমতিয়াজের কথাটা খুব ভালোভাবেই শুনেছে। মুচকি হেসে ইমতিয়াজের কাঁধে মাথা দিয়ে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে স্বল্প স্বরে আওড়ালো,
“আমিও।”

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#TanjiL_Mim♥️