Sunday, August 24, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 475



প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-৩২+৩৩

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩২
________________
ফজরের ধ্বনি কানে আসতেই ঘুমটা ভেঙে গেল রাগান্বিতার সে আধশোয়া হয়ে উঠে বসলো। আশেপাশে তাকালো কিছুক্ষণ। চোখের ঘুমটা পুরোপুরি যেতেই রাগান্বিতা তাকালো ইমতিয়াজের ঘুমন্ত মুখের দিকে। কি মায়া ভরা ওই মুখখানায়! রাগান্বিতা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ইমতিয়াজের মুখের দিকে। ধীর স্বরে বললো,“আপনায় ভীষণ ভালোবাসি প্রিয় কখনো ছেড়ে যাবেন না তবে যে আমি পাগল হয়ে যাবো। আপনায় যে কেন এতো ভালোবাসি আমি নিজেও জানি না। আপনার চোখ দুটোতেই আমি বড্ড মায়া দেখি, আপনার কণ্ঠস্বর প্রতিবার যেন আমার কানে মধুর সুরেলা হয়ে ভাসে আর আপনার বিশ্বস্ত বুকখানা ইস! আমি যতবার ওই বুুকখানায় মাথা রাখি কি যে শান্তি অনুভব হয় আপনায় বোঝানো যাবে না। আপনার একটুখানি অবহেলায় আমি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাই আমায় কখনো অবহেলা কইরেন না। তবে যে আমি জীবিত থেকেও মৃত ঘোষিত হবো।”

একা মনে অনেককিছু বললো রাগান্বিতা। চট করেই তার হুস আসলো তাকে নামাজ আদায় করতে হবে। রাগান্বিতা ইমতিয়াজকে ডাকলো। বললো,“শুনছেন, উঠুন জলদি নামাজ পড়তে যাবেন না।”

কয়েকবার ডাকতেই ইমতিয়াজের হুস আসে। যে দ্রুত উঠে বসে। বলে,“কি হয়েছে বউ?”

রাগান্বিতা হাল্কা হেঁসে বলে,“কিছু না দ্রুত উঠুন নামাজ পড়তে হবে।”

ইমতিয়াজ শুনলো সে দ্রুত বিছানা থেকে নেমে চলে যায় বাথরুমে। কতক্ষণ পেরিয়ে দ্রুত টুপি আর পাঞ্জাবি পড়ে বেরিয়ে যায়। ইমতিয়াজ যেতেই রাগান্বিতা ঢুকে বাথরুমে।
—–
ফজরের নামাজ আদায় করে জানালার ধারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে রাগান্বিতা। ধীরে ধীরে আধারে মেশা প্রকৃতিটা হলো আলোকিত। পাখিরা ডানা ঝাপটাচ্ছে দূর আকাশে। গাছের পাতা নড়ছে। রাগান্বিতার মন চাইলো এই প্রকৃতির মাঝে উঠানটায় একটু হাঁটতে। রাগান্বিতা আর দেরি করলো না সে বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে। কক্ষ থেকে বের হতেই রাগান্বিতার নজরে আসলো সেই তালাবদ্ধ করা কক্ষটার দিকে। যেটা বর্তমানে আর তালাবদ্ধ থাকে না। প্রায় মাসখানেক আগে যখন রাগান্বিতা তাদের বাড়ি থেকে এসেছিল তখনই দেখে তালাবদ্ধ করা কক্ষটা খোলা। অন্যান্য কক্ষগুলোর মতই এটাও পরিপাটি ছিল। তবে রাগান্বিতা বুঝেছিল তারা আসার আগেই কেউ কক্ষটা পরিষ্কার করে ছিল। রাগান্বিতা জিজ্ঞেস করেছিল এই কক্ষটায় আগে কি ছিল। ইমতিয়াজ বলে, ‘ময়লা সয়লা থাকতো। যা এখন সরিয়ে ফেলা হয়েছে।’ রাগান্বিতাও আর ঘাটে নি। রাগান্বিতা আলতো পায়ে নানা কিছু ভাবতে ভাবতে বাড়ির ভিতর থেকে বের হলো। মুক্ত খোলামেলা পরিবেশটায় প্রাণ খোলা নিশ্বাস নিয়ে হাঁটতে লাগলো। হঠাৎই রাগান্বিতার নজরে আসলো রবিনকে। লোকটা হাতে কি নিয়ে যেন বাড়ির পিছনের দিকটায় যাচ্ছে। রাগান্বিতা কৌতুহলী পিছু নিলো রবিনের কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো ডালপালা মিশ্রিত জায়গাটার কাছে আসতেই রবিনকে আর দেখতে পেল না রাগান্বিতা। রাগান্বিতা আশেপাশে তাকালো কিন্তু না কেউ নেই। তবে লাস্টবার ওই জমানো ডালপালা একটু নড়তে দেখেছিল।’

রাগান্বিতা আর একটু এগোবে এরই মাঝে পিছন থেকে বলে উঠল ইমতিয়াজ,“বউ।”

রাগান্বিতা আর এগোতে পারলো না। সে পিছন ফিরে তাকালো। বললো,“জি, আপনি চলে এসেছেন।”

ইমতিয়াজ দু’কদম এগিয়ে এসে বললো,“হুম। তুমি ওখানে কি করছো?”

রাগান্বিতা কথাটা চেপে গেল। বললো,
“কিছু করছিলাম না তো সকালের প্রকৃতিতে একটু হাঁটতে ইচ্ছে হলো তাই হাঁটছিলাম।”
“ওহ আচ্ছা এদিকে আসো।”

রাগান্বিতা এগিয়ে গেল। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার কাঁধ ধরে বললো,“চলো আমার সাথে আমরা একটু পর বের হবো।”

বলেই রাগান্বিতার হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগলো ইমতিয়াজ। রাগান্বিতাও আর কিছু বলতে পারলো না তবে কৌতুহল একটা রয়েই গেল। এই রবিনকেও মাঝে মধ্যে কেমন যেন লাগে রাগান্বিতার। সেদিন রাতের ঘটনাটা হুট করে মনে পড়লো তার।

বাড়ির ভিতর ঢুকতেই সর্বপ্রথম নজরে আসলো রবিনকে। রবিন রন্ধনশালা থেকে বেরিয়ে এসেছে। রাগান্বিতা তাকে দেখেই তড়িৎ চমকে উঠলো। মাত্রই না রবিনকে সে বাহিরে দেখলো এরই মাঝে বাড়ির ভিতর আসলো কি করে! রাগান্বিতা আশপাশ না ভেবেই রবিনকে প্রশ্ন করলো,“আপনি কি এই মাত্র বাহিরে গিয়েছিলেন চাচা?”

রাগান্বিতার আচমকা প্রশ্নে রবিন অপ্রস্তুত অনুভব করলো। সে দ্রুত জবাব দিলো,“কই না তো আমি তো এহনই আইলাম।”

রাগান্বিতা আর কিছু বলতে পারলো না তবে কি সে ভুল দেখেছিল তখন। কিন্তু তার স্পষ্ট মনে পড়ছে রবিন হাতে করে কি নিয়ে যেন বাড়ির পিছনে যাচ্ছিল। রাগান্বিতাকে চিন্তিত দেখে ইমতিয়াজ প্রশ্ন করলো,“কিছু কি হয়েছে?”

রাগান্বিতা নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,“না কিছু হয় নি।”

ইমতিয়াজও আর কোনো প্রশ্ন করলো না।’
—-
সকালের নাস্তা সেরে নিজ কক্ষে তৈরি হচ্ছিল রাগান্বিতা। কালো রঙের জামদানী শাড়ি, হাতে সোনার চুড়ি, গলায় ভাড়ি অলংকার, চুলগুলো খোঁপা করা, চোখে গাঁড়ো কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক।

ইমতিয়াজ কক্ষে ঢুকলো। রাগান্বিতা খানিকটা চমকে তাকালো তার দিকে। ইমতিয়াজ দাঁড়িয়ে পড়লো দুয়ারের সামনে। এক অদ্ভুত গভীর চাহনী নিয়ে তাকিয়ে রইলো রাগান্বিতার দিকে। একটা মানুষকে কালো রঙের শাড়িতে এত বেশি চমৎকার দেখাতে পারে জানা ছিল না বুঝি ইমতিয়াজের। ইমতিয়াজ কেমন ঘোর লাগানো দৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে গেল রাগান্বিতার দিকে। রাগান্বিতা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। ইমতিয়াজ এগিয়ে এলো। রাগান্বিতার চোখের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ সুরে শুধালো,
“এত সেজো না বউ আমি যে পাগল হয়ে যাবো।”

রাগান্বিতা লজ্জায় মাথা নুইয়ে বললো,
“আপনার চোখে এমন প্রেম দেখার জন্য হলেও আমি বার বার সাজতে প্রস্তুত।”
“আমি বুঝেছি তুমি ভালো থাকতে দিবে না আমায়?”
“সাজলে বুঝি মানুষ ভালো থাকে না।”
“কেউ থাকে কি না জানি না তবে আমি থাকি না। এই যে এখন মাতাল মাতাল লাগছে, মস্তিষ্কের শব্দভান্ডারে শয়তান হানা দিচ্ছে এর দায় কে নিবে?”
“আমি তো আপনার বিয়ে করা বউ আমাতে ভয় কিসের!”
“মনের গহীনে হাজারো শব্দ, হাজারো কথা,লক্ষ কটি ভয় অথচ তোমায় বলতে গেলেই কোনো শব্দ খুঁজে পাই না। ফাঁকা ফাঁকা লাগে সবটা। এমনটা কেন হয় বউ?”
“আমি জানি না।”

হেঁসে ফেলে ইমতিয়াজ। আস্তে করে রাগান্বিতা গায়ে জড়ানো সকল অলংকার খুলে ফেলে। রাগান্বিতা অবাক হয়ে বলে,
“এগুলো খুলছেন যে,
“তোমায় কাল বলেছিলাম না আমরা বিলাসবহুল নয় সাধারণ ভাবে কিছুদিন সংসার করবো।”

রাগান্বিতা কিছু বললো না। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার গায়ের অলংকার খুলে গলায় চিকন একটা লকেট সমৃদ্ধ চেইন, দু হাতে দুটো চিকন চুড়ি আর কানে ছোট দুটো দুল পড়িয়ে দিল। তারপর ব্যাগে রাখা একটা সাদামাটা শাড়ি বের করলো। কিন্তু পরক্ষণেই রাগান্বিতাকে একপলক দেখে বললো, “আজ থাক কাল পড়ো। এতটুকু যন্ত্রণা আমি সইতেই পারি।”

শেষ কথাটার অর্থটা ঠিক বুঝলো না রাগান্বিতা। তবে কিছু জিজ্ঞেস করে নি আর। মুখ থেকে আপনাআপনি বেরিয়ে আসলো তার,“অদ্ভুত একটা লোক।”

রাগান্বিতাকে হাল্কা ভাবে সাজিয়ে ইমতিয়াজ করুণ চোখে তাকিয়ে রয় ওর মুখের দিকে। মনে মনে বলে, “তোমার কি মনে হয় না তুমি আমার শহরে এসে ভুল করেছো?” উত্তর এলো না। তবে ইমতিয়াজ এও জানে এই কথাটা রাগান্বিতাকে বললে রাগান্বিতা জবাবে বলতো, “কেন বলুন তো”। ঠিক তখনই ইমতিয়াজ রাগান্বিতাকে উত্তর দিতো,-
“তোমার শহর ভীষণ সুন্দর,
নয়নে জুড়ায় আঁখি।
আমার শহর বেজায় তীক্ষ্ণ,
বিষণ্ণতায় মাখা মাখি!”

সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা থমকে যেত। কেমন বিষণ্ণ মাখা চাহনী নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতো। আর সেই চাহনী দেখে ইমতিয়াজ ক্ষত বিক্ষত হতো। কি এক দারুণ অবস্থা।
—-
ঢাকার নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। রবিনকে জানানো হয়েছে তারা কিছুদিনের জন্য দূরে কোথাও যাচ্ছে সে চাইলে তার বউ বাচ্চাকে নিয়ে ইমতিয়াজদের বাড়িতে থাকতে পারে। রবিনও মেনে নেয়। বার বার বাড়ি যাওয়া আবার ফিরে আসা বড্ড ঝামেলার লাগে রবিনের।’

রাগান্বিতা নদীর এপার থেকে ওপারে তাকালো। আশেপাশেও তাকালো। মানুষ খুব কম। বেলা বেশি না সকাল আটটা বাজে। চারপাশ পুরো নিরিবিলি। রাগান্বিতা প্রশ্ন করলো,“আমার কিসে চড়ে যাবো?”

উত্তরে ইমতিয়াজ জবাব দিলো,“ট্রলারে।”
কিছুক্ষণের মাঝেই একটা ট্রলার আসলো রাগান্বিতাদের সামনে। ইমতিয়াজ তাকে নিয়ে সেই ট্রলারে উঠলো। রাগান্বিতা পুরো ট্রলারে চোখ বুলাতেই অবাক হলো। কারণ পুরো ট্রলারে মানুষ হিসেবে ছিল তারা তিনজন। ইমতিয়াজ, সে আর ট্রলার চালক। আর বাকি যারা ছিল তারা কেউই মানুষ না।

#চলবে….

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩৩
________________
হা হয়ে তাকিয়ে আছে রাগান্বিতা পুরো ট্রলারের দিকে। কারণ তার সামনে রয়েছে দুটো গরু একটা বাছুর, তিনটে ছোট ছোট ছাগল,দুটো মোরগ, দুটো মুরগী সঙ্গে তাদের ছানা পোনা, দুটো বড় বড় হাঁস তাদের একটা ছাও(বাচ্চা), সঙ্গে একটা টিয়াপাখি, গরু আর ছাগল বাদে বাকি সবগুলোই খাঁচায় বন্দী। গরু ছাগল দড়ি দিয়ে বাধা। ট্রলারে জায়গা নেই তেমন। অথচ মানুষ হিসেবে আছে তারা তিনজন বাকি যারা আছে তাদের একজনও মানুষ না। রাগান্বিতার এই মুহূর্তে ঠিক কেমন প্রতিক্রিয়া দেয়া উচিত বুঝতে পারছে না। ইমতিয়াজ স্বাভাবিক। যেন এটা খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়। নিত্যদিনের ব্যাপার। ট্রলারের কর্নারের দিকটায় চেয়ার পেতে পাশাপাশি বসে আছে ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতা। ট্রলার চলছে তার আপন গতিতে। কোথায় যাচ্ছে রাগান্বিতা জানে না। রাগান্বিতা নদীর পানির দিকে তাকালো। ঢেউয়েরা ছুটছে তুমুল বেগে। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের মুখের দিকে তাকালো। খুব অদ্ভুত কণ্ঠে বললো,“আমরা কি আর ফিরবো না?”

ইমতিয়াজ একপলক রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বললো,“যদি বলি না ভয় পাবে খুব।”

রাগান্বিতা নিজেকে ধাতস্থ করলো। অবাক হয়েই বললো,
“ভয় পাবার কি আছে?”
“সত্যিই নেই?”
“আমি তো দেখি না।”
“তুমি দেখো না,নাকি দেখতে চাও না।”
“আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন বলুন তো।”
“তোমায় আমি খুন করবো বউ।”

সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ শব্দে হেঁসে ফেললো রাগান্বিতা। শব্দটা এতটাই জোরে ছিল যে নিকাবের আর ট্রলারের শব্দের ভিড়েও ইমতিয়াজ খুব ভালো ভাবে টের পেল। ইমতিয়াজ বিস্মিত কণ্ঠে বললো,“তুমি ভয় পাচ্ছো না?”

রাগান্বিতা আরো কিছুক্ষণ হাসলো। মিনিট দুই যেতেই থেমে বললো,“আপনার কথায় আমি কখনোই ভয় পাই না। উল্টো আপনার কথা শুনলেই আমি নতুন করে প্রেমে পড়ে যাই।”

ইমতিয়াজ তাজ্জব বনে গেল। কি সাংঘাতিক কথা! মেয়েটা তার খুন শব্দের মধ্যেও ভালোবাসার ছোঁয়া পায়। ইমতিয়াজ নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
“আমায় এত বিশ্বাস কেন করো বউ? জানো না মানুষকে বেশি বিশ্বাস করতে নেই।”
“দুনিয়ার সবাইকেই অবিশ্বাস করলে জীবনটা রঙিন হবে কি করে বলুন।”
“তুমি রঙিন জীবন চাইছো ওদিকে আমার নিজের জীবনই অন্ধকারে টইটম্বুর।”
“আগে ছিল মানছি। কিন্তু এখন আর থাকবে না আমি আছি তো রঙিন করার দায়িত্ব আমার।”

মৃদু হাসে ইমতিয়াজ। বলে,
“তুমি কি জানো দিনে দিনে আমি বড্ড ভীতু হচ্ছি?”
“আমি মেয়ে হয়ে ভীতু হই না আর আপনি ছেলে হয়ে ভীতু হচ্ছেন। এত ভয় কিসের আপনার?”
“তোমায় বলবো না বলে দিলেই আমি ধ্বংস।”

রাগান্বিতা এবার কি বলবে বুঝতে পারছে না। প্রায়শই ইমতিয়াজের এমন শেষ কথায় আঁটকে যায় রাগান্বিতা। প্রতিউত্তরে কিছুই বলতে পারে না।আজও তার ব্যতিক্রম কিছু হলো না। রাগান্বিতা চুপ হয়ে গেল। হঠাৎই আবার বলে উঠলো ইমতিয়াজ,
“তুমি কি মানবে একদিন তুমি আমায় খুন করতে চাইবে?”

সঙ্গে সঙ্গে চোখে মুখে বিস্ময়ের ছায়া ফুটে উঠলো রাগান্বিতার। যদিও রাগান্বিতার নিকাবের কারণে চোখ দুটো ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ইমতিয়াজ। তবুও ওই চোখ দেখেই ইমতিয়াজ অনেককিছু বুঝলো। রাগান্বিতা কেমন এক দৃষ্টি নিয়ে থমথমে কণ্ঠে বললো,“আমি আপনায় কেন খুন করতে চাইবো। আপনায় খুন করার আগে যেন আমি ঝলসে যাই।”

বিনিময়ে ইমতিয়াজ আর কিছু বলে না। উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। বুকচাপা এক দীর্ঘশ্বাস বের হয়। ইমতিয়াজ আকাশ পানে তাকিয়ে বলে,- শুরু যেমন হয় শেষও তেমনি ঘটে। সৃষ্টি যখন হয়েছে ধ্বংস তখন অনিবার্য! শুধু দেখার পালা ধ্বংসের পথটা কতদূর। খুব দূরে নাকি অতি নিকটে!’

নিজ ভাবনার মাঝে কাঁধে কারো স্পর্শ অনুভব করলো ইমতিয়াজ। সে তাকালো। রাগান্বিতা তার কাঁধে মাথা দিয়েছে। ইমতিয়াজ কি ভেবে যেন বলে উঠলো,“আমি চাইবো বউ তোমার আমার পথটা যেন বহুকালের দীর্ঘ হয়।”

রাগান্বিতা নিকাবের আড়ালে মুচকি হাসলো। এতক্ষণ পর মানুষটা দারুণ কিছু বললো। রাগান্বিতা ঠোঁটে হাসি রেখেই বললো,“তা তো হবেই। এই রাগান্বিতা এত দ্রুত আপনার পিছু ছাড়বে না।”
—-
চারঘন্টার পথ অতিক্রম করে ইমতিয়াজদের ট্রলার এসে থামলো একটা ছোট্ট দ্বীপের মতো জায়গাতে। রাগান্বিতা পুরো জায়গাতেই চোখ বুলালো। একটা গোলাকার বৃত্তের মতো জমি। যার পুরোটায় সবুজ ঘাসে ভর্তি। সামনের দূরের দিকের একাংশে রয়েছে অসংখ্য বড় বড় গাছ। মাঝখানে ফাঁকা। আর গোলাকার বৃত্তের চারপাশে নদীর। দূরদূরান্তে কিছু দেখা যাচ্ছে না। এক কথায় বিশাল নদীর মাঝে একটা ছোট্ট গোলাকার দ্বীপ। রাগান্বিতা ইমতিয়াজ ট্রলার ছেড়ে নামলো। রাগান্বিতা আবারও আশপাশটা দেখলো। এখানে তারা থাকবে কই তাই বুঝচ্ছে না রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার হাত ধরলো। ট্রলার চালককে বললো,“আপনি এখানে থাকুন আমি একটু আসছি।”

এই বলে রাগান্বিতাকে নিয়ে চললো ইমতিয়াজ। হেঁটে আসলো একদম ওইমাথায়। অনেকখানি এগোতেই রাগান্বিতা দেখলো। চারপাশে গোল করে বেড়া দিয়ে রয়েছে নারকেল, সুপারি আর কলা গাছের শুকনো পাতা। বেড়ার কারনে ওপাশে কি আছে দেখা যাচ্ছে না। ইমতিয়াজ হেঁটে এসে মাঝ বরাবর দাঁড়ালো। তারপর হাত দিয়ে দুদিকের মাঝখান বরাবর বেড়া ফাঁক করে দিলো সঙ্গে সঙ্গে রাগান্বিতা দেখতে পেল। ফকফকা মাটির উঠান। উঠানের সামনেই একটু দূরে একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর। খড়ের তৈরি ছাউনী তার। চারপাশে দেয়াল হিসেবে রয়েছে মাটি। ঘরে ঢোকার আগে উপরে খড়ের চাউনী থাকলেও চারপাশে বেড়া নেই। জমিনের মাটি থেকে একটু উঁচুতে ঘরটা। সামনে দুটো মাটির তৈরি সিঁড়িও আছে। রাগান্বিতা সামনে যত আগাচ্ছে তত মুগ্ধ হচ্ছে। চারপাশ এত সুন্দর কেন! তাদের সামরাজ্যের ওই জমিদার ভিটার চেয়েও কি নিদারুণ সুন্দর দেখাচ্ছে এই কুঁড়েঘরটা। রাগান্বিতা “বিসমিল্লাহ” বলে ঘরে প্রবেশ করলো। চারপাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়তো বৃষ্টি হবে। বাতাস বইছে পুরো প্রকৃতি জুড়ে। রাগান্বিতাকে ঘরের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে ইমতিয়াজ বললো,“তুমি এখানে চুপটি করে দাঁড়াও আমি বাকিদের থাকার ব্যবস্থা করছি। এই বলে চলে গেল ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা চেয়ে রইলো। চারপাশ দেখলো, তাদের ঘরে কর্নারের হাতের বামদিকের মাথাতেই আছে একটা বিশাল পেয়ারার গাছ। ডানদিকের কয়েককদম পেরিয়েই নদীর পাড়। যেখানে ঘাটলা আছে। ঘাটলার পাশে বিশাল রেন্টিগাছ। রেন্টি গাছের সাথে রয়েছে একটা কালো কুচকুচে রঙের নৌকা বাঁধা। ঢেউয়ে সেটা ভাসছে। তবে বর্তমানে রাগান্বিতা তা দেখতে পায় নি। ঘাটের অন্যপাশে বসার জন্য তক্কা দিয়ে বানানো উঁচু বেঞ্চ। তাদের ঘরটা দ্বীপের মাঝে নয় কর্নারে। যার কারনের নদীর ঘাট একটু নিকটে। কম করে হলেও বিশ পা এগোতে হবে। ইমতিয়াজ এগিয়ে আসলো সঙ্গে করে নিয়ে আসলো তিনটে গরু আর তিনটে ছাগল। তাদের রাখার জন্য বামদিকের পেয়ারা গাছের পরে অনেকখানি জায়গা ফাকা রেখে লম্বা ঘর বানানো। সেটার ছাউনীও খড় দিয়ে বানানো। ইমতিয়াজ তাদের সেই ঘরে বেঁধে রাখলো। কোথা থেকে যেন ঘাস এনে রাখলো সামনে তাঁরাও আনন্দে খেতে থাকলো। ইমতিয়াজ আবার গেল ট্রলারের কাছে এবার ফিরে এলো হাঁস মুরগী নিয়ে। সেগুলোর জন্য তৈরি আছে সুন্দর মাটির খোঁপ। হাঁসমুরগীকে ট্রলারে বসে খাওয়ানো হয়েছিল তাই আজ আর বার না করে সোজা খোঁপে ঢুকিয়ে দিয়ে সামনে থেকে মাটির দরজা আঁটকে দিল তক্কা দিয়ে। ঘরের সামনেই বাঁশের সাথে বেঁধে খাঁচায় ভরে ঝুলিয়ে রাখা হলো টিয়াপাখি। ইমতিয়াজ শিখিয়ে দিলো। বললো,“সবুজপাখি আমার বিবিকে বলো,“বউ স্বাগতম”!”

পাখিটি শুনলো মিনিট দুই যেতেই বলে উঠলো,“বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম।”

রাগান্বিতা আপনাআপনি হেঁসে ফেললো। পুরোটা যেন স্বপ্ন লাগছে মনে হচ্ছে চোখ খুলতেই এই দারুণ স্বপ্নটা ভেঙে যাবে। যা এই মুহূর্তে রাগান্বিতা মোটেও চাচ্ছে না। রাগান্বিতা কতক্ষণ আগেই তার বোরকা হিজাব খুলে ফেলেছে যার দারুণ ইমতিয়াজ রাগান্বিতার শেষের হাসিটা দেখতে পেল। মনে মনে আওড়ালো, “তোমার এই হাসি যেন কোনো হাসি নয় বউ, এ আমার বিস্মিত বুকটা ঠান্ডা করার এক অদ্ভুত মায়াজাল। যা আমায় বার বার ভেঙে গুঁড়িয়ে আবার শক্তপক্ত করে।”

বুকে হাত দিয়ে মৃদু হাসলো ইমতিয়াজ।’
—-
ইমতিয়াজ রাগান্বিতা ঘরের ভিতর প্রবেশ করলো। রাগান্বিতা দেখতে পেল একটা ছোট চৌকি। সঙ্গে কিছু আসবাবপত্রও আছে বোঝাই যাচ্ছে তারা আসার আগে ইমতিয়াজ এখানে এসে অনেককিছু গোছগাছ করে গেছে। তারজন্যই চারপাশ এত পরিপাটি। ধীরে ধীরে প্রকৃতি আরো রঙ বদলালো, মেঘাচ্ছন্ন আকাশটা হলো আরো গাড়ো। ধীরে ধীরে ধরনী জুড়ে বর্ষণ শুরু হলো। এই যেন অন্যরকম বর্ষণ, বোধহয় প্রেম বর্ষণ।

~ ধরণী জুড়ে হচ্ছে নির্জীব এক খেলা
দুপুর হয়েও যেন দেখাচ্ছে সন্ধ্যাবেলা
মাটি নদী মিশে হচ্ছে ঘর্ষণ
প্রকৃতি জুড়ে যেন নেমেছে এক অদ্ভুত প্রেমবর্ষণ!

#চলবে…..

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-৩০+৩১

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩০
________________
সময়ের স্রোতে ভাসমান প্রকৃতি। দিনগুলো যেন কেমন কাটছে বিষণ্ণতায়। চারপাশ কেমন আবছা আবছা। দিনরাত বুঝি অন্ধকারে ডুবে থাকে এমন। রাগান্বিতা প্রায়শই খেয়াল করছে কোনো এক বিষয় নিয়ে ইমতিয়াজ চিন্তিত থাকে। আগের চেয়ে কথাও কম বলে। কেমন যেন এড়িয়ে এড়িয়ে চলে তাকে। প্রথম প্রথম বিষয়টা রাগান্বিতার নজরের না আসলেও ইদানীং আসছে। মানুষটার কি হয়েছে জানার জন্য রাগান্বিতার প্রতিদিনই অস্থিরতা কাজ করে। রাগান্বিতা প্রায় সময়ই দেখে ইমতিয়াজ গভীর রাতে না ঘুমিয়ে পালঙ্কের পাশে নিচে বসে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কেমন বিষণ্ণমাখা চাহনী! মনে হয় হাজার বছর যেন তাকে দেখেনি ইমতিয়াজ। অথচ তারা রোজই একেঅপরের মুখোমুখি হয়। এই তো দু’দিন আগে। রজনীর শেষ প্রহর চলছিল। আচমকাই রাগান্বিতার ঘুম ভেঙে যায় সে চোখ খুলেই দেখতে পায় ইমতিয়াজ তার দিকে তাকিয়ে আছে। বিষয়টা দেখেই চট করে শোয়া থেকে উঠে বসে রাগান্বিতা দ্রুত নিচে নেমে আসে। ইমতিয়াজ নীরব, চুপচাপ। কোনো ভাবাক্রান্ত নেই। সে পালঙ্কের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বসে রয় চুপচাপ। কেমন নির্বিকার, বিষণ্ণ দেখাচ্ছে তাকে। রাগান্বিতা পালঙ্ক থেকে নেমেই পাশে বসে ইমতিয়াজের খানিকটা নিস্তব্ধ স্বরেই বলে,
“আপনার কি কিছু হয়েছে?”

ইমতিয়াজ নির্বিকার হয়ে জবাব দেয়,
“কি হবে!”
“আপনাকে প্রায় দেখি আপনি গভীর রাতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন।”
“তোমার কি অসস্থি লাগে? তাহলে কাল থেকে আর তাকাবো না।”

রাগান্বিতা হতাশ হলো সে ওইভাবে কথাটা বলতে চায় নি। রাগান্বিতা হতাশ হয়েই ইমতিয়াজের হাতটা নিজের হাতের মুঠোতে নিলো। নরম কণ্ঠে বলে,
“আপনার কি হয়েছে বলুন আমায়? ইদানীং আপনায় খুব চিন্তিত দেখায়।”
“আমার কিছু ভালে লাগে না বউ।”
“কেন?”

ইমতিয়াজ চুপ। রাগান্বিতা আবার প্রশ্ন করে,
“ব্যবসায় কি কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“হয়েছিল অনেকদিন আগে একজনের পণ্য মানে শাড়ি আমার এক সহকারী ভুল করে আরেকজনকে দিয়ে দেয়। যা এখন ঠিক হয়ে গেছে।”
“তাহলে এখনও চিন্তিত কেন থাকেন?”

কেমন একটা হয়ে যায় ইমতিয়াজ। সে নিস্তব্ধ হয়ে ঠলে পড়ে রাগান্বিতার বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাগান্বিতাকে। রাগান্বিতা প্রথমে একটু ঘাবড়ালেও সামলে নেয় নিজেকে। ইমতিয়াজের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে নীরব সুরে শুধালো,
“আপনার কি হয়েছে বলুন না আমায়?”

ইমতিয়াজ কেমন একটু করে যেন বললো,“আমার যন্ত্রণা হয় বউ। চারপাশ ছারখার হয়। আমি কেমন বিষের জ্বালায় জ্বলছি। দাউদাউ করে অন্তর পুড়ছে প্রতিনিয়ত।”

রাগান্বিতা থমকে যায় ইমতিয়াজের এমন কোথায়! কান্না আসতে চায় ভিতর থেকে। মানুষটা এত কি নিয়ে কষ্ট পাচ্ছে। রাগান্বিতা ছলছল দৃষ্টিতেই বলে,
“এমনটা কেন হচ্ছে বলুন আমায়?”

ইমতিয়াজ বলে না। তবে মনে মনে ঠিকই আওড়ায়,“আমার যন্ত্রণার কথা যদি তোমায় বলা যেত তবে বোধহয় আমার চেয়ে সুখী আর কেউ হতো না। আমি বিতৃষ্ণায় আবদ্ধ বউ।”

সেদিন ইমতিয়াজ আর কিছু বলে না। রাগান্বিতাও আর প্রশ্ন করে না। তবে রজনীর শেষ হওয়ার পুরোটা সময় ইমতিয়াজ জড়িয়ে ধরে থাকে রাগান্বিতাকে। যেন ছেড়ে দিলেই রাগান্বিতা বুঝি পালিয়ে যাবে।

সেদিনের পর টানা দু’দিন ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতার তেমন সংস্পর্শে আসি নি। এমন কি তাদের দেখাও হতো কম। ইমতিয়াজ গত দু’দিন খুব বেশি দেরি করে বাড়িতে আসতো। রাগান্বিতা অপেক্ষা করতো কিন্তু ইমতিয়াজ আসতো না। ইমতিয়াজের জন্য অপেক্ষা করতে করতে রাগান্বিতা ঘুমিয়ে যেত। সকালে উঠেও রাগান্বিতা ইমতিয়াজকে দেখতো না তবে ইমতিয়াজ যে রাতে তার পাশে এসে শুতো এটা বেশ বুঝতো কারণ ইমতিয়াজ প্রতিদিন তার পরিধিত পোশাক পালঙ্কের কর্নারে রেখে চলে যেত। ইমতিয়াজের দু’দিনের অবহেলাতেই রাগান্বিতা খুব কষ্ট পাচ্ছে। তবে রাগান্বিতা জানে ইমতিয়াজও তার মতো কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু দিনে দিনে এমন অবহেলা কেন করছে এইটুকুই বুঝচ্ছে না রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ রাগান্বিতাকে পড়াশোনার কথা বলেছিল অনেকদিন আগে। কিন্তু রাগান্বিতা বলেছে সে আর পড়াশোনা করতে চায় না। ইমতিয়াজও জোর করে নি আর। তবে পড়াশোনা যে একেবারে বাদ দিয়েছে এটা বললেও ভুল হবে। ইমতিয়াজ অনেকগুলো বই এনেছিল রাগান্বিতার জন্য। সেগুলো প্রায়শই পড়ে রাগান্বিতা। ইমতিয়াজের টেবিলেও অসংখ্য বই আছে। ইমতিয়াজ উপন্যাস পড়তে খুব পছন্দ করে। রাগান্বিতা আগে এসব পড়তো না কিন্তু এখন পড়ে বেশ লাগে তার। তবে দিন শেষে ইমতিয়াজের অবহেলা বেশ পোড়ায় তাকে।

জোরে নিশ্বাস ফেলে নিজের গত কয়েকমাসের দিনগুলোর কথা ভাবলো রাগান্বিতা। আচমকা ইমতিয়াজের অবহেলায় সে যেন তিলে তিলে শেষ হচ্ছে। হঠাৎই সাইকেলের বেল বাজার আওয়াজ আসলো। রাগান্বিতা বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু তাও তাকালো না। আবারও শব্দ হলো রাগান্বিতা তাকালো না এরপর বেশ কয়েকবারই আওয়াজ আসলো এবার বিরক্ত নিয়ে তাকাতেই সামনে ইমতিয়াজকে দেখে বিস্মিত হলো রাগান্বিতা। এইসময় ইমতিয়াজ এখানে। ইমতিয়াজ হাতের ইশারায় রাগান্বিতাকে নিচে নামতে বললো। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের একটুখানি ইশারাতেই বুঝি প্রাণ ফিরে পেল। সে দৌড়ে ছুটে গেল নিচে। রবিন তখন ঘরের ভিতর কাজ করছিল। রবিনের বউয়ের ছেলে হয়েছে। সে এখন দ্রুত দ্রুতই কাজ সেরে বাড়ি চলে যায়।’

রাগান্বিতা ছুট্টে এসে সামনে দাঁড়ালো ইমতিয়াজের। ইমতিয়াজ তখন তাকিয়ে থাকে রাগান্বিতার দিকে। রাগান্বিতাও তাকায়। দুজনেই চুপচাপ। কথা দুজনেই বলতে চাচ্ছে কিন্তু দু’দিনের অধিক দুরত্বেই কোথায় যেন সংকোচতা কাজ করছে। কিছু সময় পার হওয়ার পরও যখন ইমতিয়াজ কিছু বলছিল না ধীরে ধীরে রাগান্বিতার ঠোঁটে জড়ানো হাসিটা মিলিয়ে গেল। সে মন খারাপের দৌলতেই প্রশ্ন করলো,
“কিছু কি বলবেন আমায়?”

উত্তরে ইমতিয়াজ বলে,“বলতে তো অনেক কিছুই চাই তোমায় কিন্তু সংকোচতার জ্বালায় বলতে আর পারছি কই।”

রাগান্বিতা ছলছল দৃষ্টিতে তাকায় ইমতিয়াজের দিকে। একটু কাছে এগিয়ে চোখে চোখ রেখে বলে,“আমি তো আপনার কাছের মানুষ আমাতে কথা বলতেও আপনার এত সংকোচতা কেন প্রিয়।”

ইমতিয়াজ কিছু বলতে পারে না। সে অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলে,“সাইকেলে বসবে বউ, চলো একটু কাছাকাছি হয়ে আশপাশটা ঘুরি।”

রাগান্বিতা বিনা সংকোচে সাইকেলের সামনে বসে। মনে মনে খুব খুশি হয়। ইমতিয়াজও খুশি হয়। সে সাইকেল চালিয়ে তাদের পুরো বাংলো বাড়িটির চারপাশটা ঘোরে। বাড়ি চারপাশটায় বনজঙ্গল আর গাছপালা ছাড়া তেমন কিছুই নেই। তবে বাড়ির পিছনের দেয়ালের একটা অংশে অনেকগুলো জমানো গাছের ডালপালা দেখছিল রাগান্বিতা। এদিকটায় তেমন একটা আসে না রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ বলে ছিল বাড়ির বাহিরে খুব একটা না যেতে। একই তো সুন্দরী বউ তারওপর বনজঙ্গল কখন কি ঘটে বলা যায়। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের কথায় সেদিন খুব হেঁসেছিল। তবে কথা রেখেছিল ইমতিয়াজের। সে বার হয় নি খুব একটা বাহিরে।

সারাবিকালটা দু’জনে কাছাকাছি থাকলেও কোথাও যেন দূরত্বতা, ছিল কথা না বলতে পারার সংকোচতা। এমনটা কেন হচ্ছিল বুঝচ্ছিল না রাগান্বিতা। সে তো কথা বলতে চায় কিন্তু কোথাও গিয়ে যেন আটকাচ্ছিল খুব। ইমতিয়াজেরও বুঝি এমনই হচ্ছিল।
—-
সময় চললো বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। পুরো প্রকৃতি হচ্ছিল লালচে। ইমতিয়াজ বাড়ির সদর দরজার সামনে এসে সাইকেল থামালো। রাগান্বিতা নামলো, গিয়ে বসলো বাড়ির সদর দরজার সামনে থাকা ছোট ছোট সিঁড়িগুলোর ওপর। তার যে কি পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে বোঝানো যাবে না। ইমতিয়াজ বুঝলো রাগান্বিতার বিষয়টা সে সাইকেলটাকে এক কর্নারে রেখে বসলো রাগান্বিতার পাশ দিয়ে একটু দূরত্ব নিয়ে। এবার তার সংকোচতা বুঝি কমলো। সে প্রশ্ন করলো,
“মন খারাপ হচ্ছে?”

রাগান্বিতা চুপ। ইমতিয়াজ বলে,
“অভিমান করেছো খুব তাই না।”

রাগান্বিতা এবারও চুপ। ইমতিয়াজ খানিকটা অস্থিরতা নিয়ে বলে,
“আমার সাথে কথা বলবে না বউ?”

রাগান্বিতা এবার ঘুরে থাকালো ইমতিয়াজের দিকে। আচমকাই কেঁদে উঠলো। ইমতিয়াজ বুঝলো। মাথা নিচু করে বললো,
“এভাবে কেঁদো না গো বউ,তোমার কান্নায় যে আমার অন্তর পুঁড়ে ছারখার হয়ে যায়।”

তাও থামে না রাগান্বিতা। কিছুটা সময় পার হওয়ার পর রাগান্বিতা বলে,
“আমার ভুলটা কোথায় বলুন না আমায় এমন অবহেলা কেন করছেন?”

বলতে বলতে আবার কাঁদলো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ এবার গা ঘেঁষে বসলো রাগান্বিতার৷ নিজের হাতের মুঠোতে রাগান্বিতার ডান হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে বললো,“তোমার কোনো ভুল নেই, সব ভুল আমার।”

ছলছল আঁখিতে ইমতিয়াজের দিকে তাকালো রাগান্বিতা। বললো,“কেন করছেন এমনটা?”

উত্তর দেয় না ইমতিয়াজ। অন্যদিকে সদর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা রবিন ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতার বিষয়টা লক্ষ্য করলো সে বোধহয় খানিকটা হলেও আন্দাজ করতে পারলো ইমতিয়াজের বিষয়টা। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। রাগান্বিতা মেয়েটা খুবই ভালো মনের একটা মেয়ে। যেমন রূপ তেমনই মিষ্টি স্বভাবের অধিকারি। এমন মেয়েকে যেকোনো পুরুষই হৃদয় দিতে বাধ্য। ইমতিয়াজও দিয়ে ফেলেছে। যেটা তাকে ক্ষণে ক্ষণে দুঃখ দিচ্ছে। রবিন চলে গেল। ইমতিয়াজ হঠাৎই বললো,
“কিছুদিনের জন্য দূরে কোথাও পালিয়ে যাবে বউ?”

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩১
________________
মাগরিবের নামাজ সেরে জায়নামাজটাকে জায়গা মতো রেখে সবেমাত্র পালঙ্কে বসলো রাগান্বিতা।মাথায় তখনও তার কাপড় মুড়ানো। রাগান্বিতা কিছুক্ষণ জানালার বাহিরে তাকিয়ে রইলো। একটু একটু করে সন্ধ্যা নামার নিঝুম হওয়া প্রকৃতিটা দেখলো। এক শীতল হাওয়া বয়ে গেল তার শরীর ছুঁয়ে। রাগান্বিতা চোখ বন্ধ করে জোরে এক নিশ্বাস ফেললো। মাথায় মোড়ানো কাপড়টা সরিয়ে সে পশ্চিমা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,“হে আল্লাহ্ আমার মানুষটাকে আপনি সবসময় ভালো রাইখেন। তার সকল দুঃখ কষ্ট আমারে দিয়েন আর আমার জীবনের সকল সুখ তারে দিয়েন।”

কথাগুলো বলে একা মনে অনেকক্ষণ আকাশ পানে তাকিয়ে রইলো রাগান্বিতা। ধীরে ধীরে সময় এগোলো। রাগান্বিতা এগিয়ে গেল তার কক্ষের আলমারির দিকে। বোরকা, হিজাব, নিকাব বের করলো তাকের ওপর থেকে। ইমতিয়াজ নামাজ আদায় করতে গেছে। যাওয়ার আগে রাগান্বিতাকে বলে গেছে, “তুমি নামাজ পড়ে তৈরি থেকো বউ আমরা বের হবো। তোমার আমার জন্য কিছু পোশাক কিনবো। তারপর নিরুদ্দেশ হবো কিছুদিনের জন্য। যেখানে তুমি আমি ছাড়া আর কেউ থাকবে না।”

রাগান্বিতাও মেনে নেয়। রাগান্বিতা তার খোঁপা করা ঘনকালো লম্বা চুলগুলো আবার শক্ত করে বেঁধে নিলো। বোরকা, হিজাব, নিকাব পড়ে নিজেকে বাহিরের যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করলো। শহরে আসার পর রাগান্বিতা তেমন কোথাও যায় নি। ঢাকাশহর ঘুরে দেখারো ইচ্ছে জাগে নি কখনো। কিন্তু আজ যখন ইমতিয়াজ ঘুরতে নিয়ে যাবে বললো তার খুব আনন্দ হয়েছে। মনে মনে ভেবে নিয়েছে তার প্রতি ইমতিয়াজের অবহেলা বুঝি কমলো।’

কক্ষের দুয়ারে কড়া নাড়ার আওয়াজ আসলো। কেউ মিষ্টি সুরে শুধালো,“তোমার হয়েছে বউ?”

রাগান্বিতা মৃদু হাসলো। বললো,“জি।”
কারন সে বুঝেছে ইমতিয়াজ চলে এসেছে।
—–
রাতের প্রকৃতি তখন থমথমে। নিঝুম প্রকৃতির ভিড়ে বড় মোটরগাড়িতে চড়ে এগোচ্ছে ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতা। দুজনেই চুপচাপ। রাগান্বিতা বাহিরের প্রকৃতি দেখছে সে জানে না ইমতিয়াজ তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। রাতের মুগ্ধনীয় বাতাস তাদের বারংবার ছুঁয়ে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে পথ পেরিয়ে বাজারের ভেতর দিয়ে ছুটলো গাড়ি। মানুষের ভিড় দু’দিকে। রাগান্বিতা নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসলো গাড়িতে। কতদূর গিয়েই গাড়ি থামানো হলো। ইমতিয়াজ রাগান্বিতা দুজনেই বেরিয়ে আসলো বাহিরে। সামনেই বিশাল এক মেলা বসেছে। শহুরে মেলা। গ্রামে থাকতে রাগান্বিতা একবার তার সহপাঠীদের সাথে মেলায় গিয়েছিল তাও তেমন কিছু না দেখে ফিরে এসেছে। বাবার বারণ ছিল কি না। ইমতিয়াজ মোটরগাড়ি থেকে নেমে রাগান্বিতার হাত ধরলো। বললো,“মেলার ভিতর ভিড় থাকবে আমার হাত কোনোভাবেই ছাড়বে না কিন্তু।”

রাগান্বিতা শুনলো মাথা নাড়িয়ে সমর্থনও করলো। অতঃপর রাগান্বিতা ইমতিয়াজ আস্তে আস্তে প্রবেশ করলো শহুরে মেলার ভিতর। নানান রঙের দোকানপাট আর মানুষের ভিড়। এত মানুষের মজলিসে রাগান্বিতা তেমনভাবে কখনোই আসে নি। চারপাশে মানুষ গিনগিন করছে। রাগান্বিতার গায়ে কোনো পরপুরুষের স্পর্শ না লাগে তাই ইমতিয়াজ খুব সযত্নে রাগান্বিতাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। রাগান্বিতা চারপাশটায় চোখ বুলালো নাগরদোলা, মাটির তৈরি খেলনা, শাড়ি চুড়িসহ অনেকগুলো খাবারের দোকান দেখলো। সেই দূরে দেখা মিললো বায়োস্কোপের। রাগান্বিতা কখনো বায়োস্কোপে চোখ দিয়ে ছবি দেখে নি। সে উত্তেজিত হয়ে ইমতিয়াজকে আবদার করলো,
“চলুন না বায়োস্কোপ দেখি।”

ইমতিয়াজ তাকালো বায়োস্কোপের দিকে। বেশি না ভেবেই বললো,“তোমার বায়োস্কোপ ভাল লাগে?”

রাগান্বিতা তার উজ্জ্বল মাখা কাজলকালো চোখদুটো নাড়িয়ে বললো,“হুম খুব। চলুন না যাই।”

ইমতিয়াজ রাজি হলো। বললো,“ঠিক আছে চলো।”

রাগান্বিতা প্রচন্ডরকম খুশি হলো। ইমতিয়াজ প্রাণ ভরে তা দেখলো। রাগান্বিতা ছুট্টে গিয়ে বায়োস্কোপওয়ালে বললো,“বায়োস্কোপ দেখবো চাচা।”

লোকটি খুশি হলো। ইশারায় বায়োস্কোপের সামনে থাকা গোলআকৃত্তির জিনিসটাকে দেখিয়ে ওখানে চোখ দিতে বললো। রাগান্বিতাও ইমতিয়াজকে নিয়ে বসলো নিচে। বললো,“আসুন একসাথে দেখি।”

এক ষোড়শী নারীর বায়োস্কোপ দেখার এত উত্তেজনা, এত আগ্রহ দেখে ইমতিয়াজ আর কিছু বলতে পারলো না। রাগান্বিতা চোখ রাখলো বায়োস্কোপের ভিতর। ইমতিয়াজও রাখলো। এরই মাঝে বায়োস্কোপওয়ালাও তার সুরেলা কণ্ঠ নিয়ে বললো, এ এক রাজা-রানির গল্প। রাগান্বিতা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে এবং শুনতে লাগলো।বায়োস্কোপওয়ালা বলে উঠল,

‘কী চমৎকার দেখা গেল এইবারেতে আইসা গেল, রাজার রাজ্য দেখেন ভালো। কী চমৎকার দেখা গেল।’- এ সুর আর ছন্দের তালে তালে ধারা বিবরণী দিতে লাগলেন বায়োস্কোপওয়ালা। কাঠের বাক্সে চোখ লাগিয়ে গানের তালে ছবি দেখার দৃশ্যকেই বায়োস্কোপ বলে। খঞ্জনি আর গানের তালে তালে বাক্সের ভেতর পাল্টে যায় ছবি। এক রাজা আর এক রানীর গল্প। রানী ছিল এক গরীব ঘরের মেয়ে। রানীর নাম মেহেরুন্নিসা। রাজা নবাব উদ্দিন। রানীর জন্ম গরীব ঘরে হলেও সে ছিল অত্যাধিক সুন্দরী এক যুবতী কন্যা।’

হঠাৎই একদিন রাজা শিকার করতে গিয়ে দেখা হয় রানীর সাথে। প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে যায় রাজা। রানীও মুগ্ধ হয় রাজাকে দেখে। এখান থেকেই শুরু হয় এদের প্রেম কাহিনি। এক রাজা, এক রানী, তাদের বনজঙ্গল, পশুপাখি,রাজকীয় বাড়ি এমন নানা রঙের ছবি দেখিয়ে সুরে সুরে কাহিনী বলতে লাগলো বায়োস্কোপওয়ালা। ধীরে ধীরে সেই কাহিনীর গল্পের জগতেই হারিয়ে যায় রাগান্বিতা ইমতিয়াজ। গল্পের এক পর্যায়ে দেখায় রাজার মা ষড়যন্ত্র করে মেহেরুন্নিসার সাথে। ছেলেকে ভুল বুঝিয়ে নিজের কাছে আনতে চায় কিন্তু পারে না। অনেক বাঁধা পেরিয়ে শেষে মিলন ঘটে রাজা-রানীর। আর এখানেই বায়োস্কোপের কাহিনী শেষ হয়।”

পুরো দৃশ্য দেখে রাগান্বিতা কখনো মুগ্ধ হয়েছে, কখনো হেঁসেছে, কখনো রাগ করেছে, তো কখনো কেঁদেছে। গোটা একটা সিনেমা দেখলো এমন। পুরো দৃশ্য শেষ হতে বায়োস্কোপ থেকে চোখ সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো রাগান্বিতা ইমতিয়াজ। গল্পের শেষে মিলন ঘটায় রাগান্বিতা বেজায় খুশি। ইমতিয়াজ বায়োস্কোপওয়ালাকে কিছু কড়ি দিলো। সে খুশি হলো।

ইমতিয়াজ রাগান্বিতাকে নিয়ে ছুটে যায় অন্যদিকটায়। রাগান্বিতাও যায়। যেতে যেতে বলে,“কাহিনীটা দারুণ ছিল তাই না?”

ইমতিয়াজও মৃদু হেঁসে বলে,“হুম। তোমার ভালো লেগেছে?”

রাগান্বিতা খুশি মাখা মুখে ইমতিয়াজের হাতটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে বললো,“হুম প্রচুর।”

ইমতিয়াজ খুশি হলো। রাগান্বিতার চোখ দু’টো আর কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝতে পেরেছে ইমতিয়াজ। মেয়েটা আজ দারুণ খুশি।’

সময় চললো। রাগান্বিতা ইমতিয়াজ মুগ্ধনীয় মুহুর্ত কাটালো। রাগান্বিতাকে নিয়ে কিছু পোশাকের দোকানে ঢুকলো ইমতিয়াজ। খুবই সাদামাটা টাইপের শাড়ি কিনলো, চোখে দেয়ার জন্য কাজল, একটা লিপস্টিক, লাল টুকটুকে রঙের আলতা আর রঙ বেরঙের কিছু রেশমী চুড়ি। এক পাতা টিপ কেনার ইচ্ছে থাকলেও পরে কেন যেন কিনলো না। রাগান্বিতা শুধু দেখেই গেল ইমতিয়াজের কান্ড। ইমতিয়াজ নিজের জন্য কিনেছে কিছু লুঙ্গি, সাদা মাটা ফতুয়া, দুটো গামছা আর গায়ে মাখানো আতর। রাগান্বিতা বুঝে না এসব কেন কিনলো ইমতিয়াজ। সে তো এগুলো পরে না। শেষবার তার বাড়িতে বসে ওই প্রথম শাপলা দিয়ে সাজানোর দিন নৌকায় বসে ইমতিয়াজকে লুঙ্গি ফতুয়ায় দেখেছিল রাগান্বিতা এরপর আর দেখে নি। ইমতিয়াজ এখন আর চশমা পড়ে না। এতে অবশ্য রাগান্বিতার কোনো দ্বিধা নেই কারণ ইমতিয়াজকে চশমা ছাড়াই চমৎকার দেখায়।’

অনেকটা সময় একসাথে কাটালো। ঝালমুড়িও খেল দুজন। নাগরদোলাতেও চড়েছিল। রাগান্বিতার সে সময় কি ভয়! বুক ধড়ফড় করার বিষয়টা এখনো যায় নি মনের ভিতর থেকে। রাগান্বিতাদের বাড়ি ফিরতে প্রায় অনেকটা রাত হলো। তারা খুব আনন্দ করলো একসাথে। রাগান্বিতা ভুলেই গেল দু’দিন ধরে তার আর ইমতিয়াজের মাঝে দূরত্বের অবহেলা চলছিল। রাতে বাড়ি এসে দুজন একসাথে রাতের ভোজন করলো। রবিন ছিল না। খেতে বসেও রাগান্বিতার সে কি কথা! সারা সন্ধ্যার ঘটে যাওয়া তার ভালো লাগা, বুক ধড়ফড় করা, বায়োস্কোপের কাহিনী সব একের পর এক বলতে লাগলো। ইমতিয়াজও তার তালে তাল দিলো। খুশি মনে এটা ওটা বললো। সময়টা যেন দারুণ গেল দুজনের।’
—–
রজনীর তখন মধ্যভাগ চলছিল। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে ছিল কথা তার তখনো শেষ হয় নি। ইমতিয়াজ তার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো আর মন দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাগান্বিতার কথা শুনছিল। হঠাৎই রাগান্বিতা বললো,
“একটা কথা বলবো?”

চট করেই ইমতিয়াজ তার চোখ খুললো। বললো,“এতক্ষণ ধরে কি বলছিলে?”

রাগান্বিতা তার ঠোঁটে কামড় দিলো। মাথা উঁচকিয়ে হেঁসে জবাব দিলো,
“এতক্ষণ অনেকগুলো কথা বলছিলাম। এখন একটা কথা বলবো।”

ইমতিয়াজ হেঁসে দেয় রাগান্বিতার কথা শুনে। বলে,
“জি বলুন মহারানী আপনার একটা কথা কি?”

রাগান্বিতা খানিকটা লজ্জা পায়। মিষ্টিভাবে বলে,
“কাল আমরা কোথায় যাবো?”
“হুম,নিরুদ্দেশ হবো।”
“জায়গার নাম নেই।”
“গিয়ে বলবো।”
“এখন বললে কি হবে?”
“কিছুই না।”
“তাহলে বলুন।”
“বললাম তো গিয়ে বলবো।”

রাগান্বিতা আর ঘাটলো না। মেনে নিয়ে বললো,
“ঠিক আছে। আচ্ছা, আজ যে আমরা পোশাক কিনলাম আমরা কি ওগুলো ওখানে গিয়েই পড়বো।”
“হুম। শোনো কোনো গহনা নিবে না।”

রাগান্বিতা অবাক হয়ে বলে,
“কেন?”
“আমরা বিলাসিতা নয় বউ সাধারণভাবে কয়দিন সংসার করবো।”
“আপনি ঠিক কি চাইছেন বলুন তো?”

ইমতিয়াজ জোরে নিশ্বাস ফেলে দুইহাতে রাগান্বিতাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বললো,
“বলবো না বলে দিলে মজা আছে নাকি।”

রাগান্বিতা চুপ করে মাথা দিয়ে রইলো ইমতিয়াজের বুকে বিনিময়ে আর কিছু বলে না। অনেক্ক্ষণ পর চোখ বুঝে বলে,“আপনি হয়তো জানেন না প্রিয়,আপনায় মাঝে মাঝে আমার বড্ড রহস্যময় লাগে।”

ইমতিয়াজ বুঝি শুনলো রাগান্বিতার কথা। অনেকক্ষণ নীরব থেকে একা মনে আওড়ালো,“আমি যে কে, জানতে হলে ধূসর রঙের সেই পাতাটা তোমায় পড়তে হবে বউ, যে পাতাটা আমি লুকিয়ে রেখেছি গহীন অন্ধকারের এক পাতাল কক্ষে।”

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#TanjiL_Mim♥️

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-২৮+২৯

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-২৮
________________
ভোরের আলো সদ্য ফুটছে ধরণী জুড়ে। কিচিরমিচির পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। শীতল বাতাস ছুটছে অন্দরমহল ঘিরে। তালুকদার ভিলাটা বিশাল বড়। পুরো রেশবপুরে এই একটাই বিশাল বাড়ি আছে যার নাম তালুকদার ভিলা। এটা একটা পুরনো বাড়ি রাগান্বিতার বাবার দাদারও আগের আমলের বাড়ি। বছর শেষে রঙ দেয়া আর জিনিসপত্রের মেরামত করা হয় শুরু।’

রাগান্বিতা দাড়িয়ে আছে কুহুর কক্ষের সামনে। কেমন যেন বুক কাঁপছে। অস্থির অস্থির লাগছে। জোরে নিশ্বাস ছাড়লো রাগান্বিতা। কুহু মারা যাওয়ার পর রাগান্বিতা ভুলেও একঘরে পা রাখে নি। তার আপার ওপর ভীষণ রাগ ছিল,ক্ষোভ ছিল, আজও আছে। আপা তার কাছে অনেককিছু লুকিয়ে চলে গেছে এটা কি আপার অন্যায় ছিল না। এভাবে বিষ খেয়ে মরে গেলেই কি জীবনের সব যান্ত্রিকতা শেষ হয়ে যায়। মরে গিয়ে আপা কি খুব ভালো আছে। রাগান্বিতা আস্তে করে কুহুর কক্ষের দুয়ারের কপাট খুললো। ভিতরে ঢুকতেই আপার গায়ের গন্ধ যেন নাকে ভাসলো। রাগান্বিতার বুকটা হু হু করে কেঁপে উঠলো। কান্না আসতে চাইলো ভিতর দিয়ে। রাগান্বিতার তার আপাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতো। অথচ তার আপাই তাকে কিছু না বলে এভাবে পালিয়ে গেল। রাগান্বিতা আশেপাশে তাকালো পালঙ্কের দিকে চাইলো। তার মনে হচ্ছে তার আপা পালঙ্কেই শুয়ে আছে আর সে ডাকতে এসেছে। রাগান্বিতা চোখ বন্ধ করে নিলো। ভাবলো এমনই এক সকালের কথা। রাগান্বিতা সেদিন প্রথম চা বানিয়েছিল বাড়ির সবার জন্য। কি আনন্দকর মুহুর্ত ছিল সেই দিনটা।সেই সকালটা।”

চায়ের কাপ হাতে কুহুর কক্ষের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে রাগান্বিতা। ঠোঁটে তার মিষ্টি হাসি। কুহু কেবলই বই পড়ে শুয়ে ছিল পালঙ্কে। সেই মুহুর্তেই রাগান্বিতা ছুট্টে গিয়ে বললো,
“আপা, এই আপা উঠো জলদি দেখো আমি চা বানিয়ে এনেছি।”

কুহুর ঘুমে বে’ঘাত ঘটলো খানিকটা। সে কাঁথা মুড়ি দিয়ে অন্যদিকে ফিরে বললো,
“এখন খাবো না তুই পরে নিয়ে আসিস।”

রাগান্বিতা তাও গেল না অনেক সাধার পরও কুহুকে উঠতে না দেখে রাগান্বিতা চলে যায় কুহুর আয়নার দিকে। চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে বললো,
“আপা তোর আলমারি থেকে আমি একটা ডাইরি নিলাম পড়ে আবার দিয়ে যাবো।”

সঙ্গে সঙ্গে লাফ মেরে উঠলো কুহু। কুহু আলমারিতেই তার বেশিরভাগ ব্যাক্তিগত ডাইরি লুকিয়ে রাখতো। কি যে লিখতো কে জেনে। রাগান্বিতা সেদিন একটা ডাইরি নিয়ে পুরো অন্দরমহল ছুটেছে আর তার পিছন পিছন কুহু। ডাইরির কিছু দেখি নি রাগান্বিতা শুধুমাত্র আপাকে ক্ষেপাতে ছুটেছিল। কি সুন্দর মুহুর্ত ছিল হাসি আর উল্লাসে ভরা। অথচ আজ সব ফাঁকা।’

রাগান্বিতা তার চোখ খুললো। কান্না ভেজা গলায় বললো,“এভাবে ছেড়ে না গেলে কি একদমই চলতো না আপা।”

রাগান্বিতা আশেপাশে তাকিয়ে সোজা চলে যায় আলমারির কাছে। নিশ্বাস কেমন ভাড়ি হয়ে আসছে তার। রাগান্বিতা আলমারি খুললো সঙ্গে সঙ্গে আপার গায়ে জড়ানো কিছু শাড়ি নজরে পড়লো। রাগান্বিতা হাত বুলালো শাড়িতে। একটা শাড়ি বুকে জড়িয়ে ধরে মুখ চেপে কাঁদলো। এত যন্ত্রণা নাহি সহে। রাগান্বিতা শাড়িতে চুমু কাটলো। নীরবে বললো,“তুই খুব খারাপ আপা। এভাবে চলে গিয়ে একদম ঠিক করিস নি। দাদিমা যা বলেছে তা যদি সত্যি হয় আমি তবে তাকে ছাড়বো না আপা, খুঁজে বের করে নিজ হাতে খুন করবো দেখে নিস। আমার পবিত্র আপাটাকে যে কলঙ্কিত করেছে তাকে আমি কিছুতেই ছাড়বো না কিছুতেই না।”

রাগান্বিতা শাড়ি ছেড়ে পুরো আলমারি দেখলো। অদ্ভুত ব্যাপার আপার লেখা একটা ডাইরিও এখানে নেই। সব গেল কই। দাদিমা সরিয়ে দেয় নি তো। রাগান্বিতার নিজেকে অসহায় লাগলো। রাগান্বিতা নিচে বসে পড়লো। সবকিছু কেমন শূন্যতায় আঁকড়ে ধরলো। রাগান্বিতা নির্বিকার, নির্লিপ্ত। তার মনে হচ্ছে আপার সাথে রাগ দেখিয়ে সে এ কক্ষে এতদিন না এসে ভুল করেছে। হঠাৎই আলমারির একদম নিচের তাকে থাকা একটা শাড়ির দিকে নজর গেল রাগান্বিতার। শাড়িটা খয়েরি রঙের। এই শাড়িটা রাগান্বিতা কুহুর দুজনের পছন্দের ছিল কিন্তু বাবা এনেছিল একটা। একবার ঝগড়াও হয়েছিল এর জন্য কিন্তু পরে রাগান্বিতায় দিয়ে দেয় শাড়িটা। রাগান্বিতা শাড়িটা বের করতেই একটা চিঠি খোসে পড়লো নিচে। রাগান্বিতা স্তব্ধ হয়ে চিঠিটা ওঠালো সাদা খামের মাঝে লেখা চিঠিটা। রাগান্বিতা তার চোখের পানি মুছে চিঠিটা খুললো। পড়তে লাগলো যেখানে প্রথমেই লেখা ছিল,
“প্রিয় বোন!
তুই যখন আমার এই লেখাটা পড়বি তখন বোধহয় আমি আর এই দুনিয়াতে থাকবো না। আমি জানি তুই ভীষণ রাগ করবি আমার ওপর, হয়তো কবরটাও দেখতে যাবি না। কিন্তু কি করবো বোন আমি যে নিরুপায়। মৃত্যু ছাড়া আমার যে আর কোনো উপায় নেই। আমি যে কলঙ্কিত!

রু’হুটা যে কেঁপে উঠলো রাগান্বিতার ‘আমি যে কলঙ্কিত’ কথাটা দেখে। তার আপা কলঙ্কিত নয়। রাগান্বিতার কথাটা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে। রাগান্বিতা আবার চিঠিতে চোখ বুলালো। লেখা দেখলো,

বিয়ের আগে কখনো কোনো মানুষকে ভালোবাসবি না বোন। ভালোবাসা খুব যন্ত্রণার হয় যদি মানুষটা সঠিক না হয়। আমি ভালোবেসেছিলাম একটা মানুষকে। তার নাম ছিল আরফান মজুমদার। শহরে থাকতো। মানুষটাকে আমি বিশ্বাস করে ঠকেছিলাম। আমাদের বিয়ে হয়েছিল কিন্তু পরে জানি ওটা নাকি কোনো বিয়েই ছিল না। শুধুমাত্র একটা সাদা কাগজে আমার আর তার সই ছিল। নিজের সবটা দিয়ে যাকে ভালোবাসলাম, যার সন্তানের মা হতে চলেছিলাম সেই মানুষটা যখন বলে আমাদের বিয়েটা নাকি মিথ্যে ছিল শুধুমাত্র আমাকে ভোগ করার জন্য এত নাটক। অথচ বিয়ের আগে একবারও মনে হয় নি মানুষটা আমাকে ব্যবহার করছে। আমায় নিয়ে খেলছে। এত নিখুঁত অভিনয় ছিল তার। কষ্ট হচ্ছে বোন, তোদের ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে। বুকটা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে তাও ছেড়ে যেতে হচ্ছে। সবসময় ভালো থাকবি। নিজের খেয়াল রাখবি। কখনো বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে কাউকে ভালোবাসবি না। বাবা তোর জন্য যাকে আনবে তাকেই বিয়ে করবি, ভালোবাসবি। আপার মতো ভুল করিস না কখনো। কতটা যন্ত্রণা নিয়ে যে পৃথিবী ছাড়ছি বোন যদি তোকে বোঝানো যেত। তোকে শেষ বারের মতো একবার জড়িয়ে ধরার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সময় যে নেই। আজ চললাম ভালো থাকিস। নিজের যত্ন নিস পারলে আপাকে ক্ষমা করিস।

ইতি,
তোর অভাগী আপা
কুহুু”

এক বুক হাহাকার নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো রাগান্বিতা। চিঠিটা জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে বললো, আপা, আমার প্রিয় আপা! যন্ত্রণায় ছটফট করছে, হৃদয়টা কাতরাচ্ছে। কেমন যেন চারপাশ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে রাগান্বিতার। এতদিনের রাগ নিয়ে জমানো কান্না বুঝি আজ বাঁধ ভাঙলো।

রাগান্বিতার এইভাবে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠার দৃশ্যটা বুঝি দুয়ারের কাছে দাড়িয়ে কেউ দেখলো। মুখ চেপে নিঃশব্দে কাদলো খুব।’
—-
সকালের রোদ মুখে পড়তেই ঘুমটা ভাঙলো ইমতিয়াজের। চোখ মেলে তাকিয়ে আশেপাশে রাগান্বিতাকে না দেখে আস্তে করে মাথাটা চেপে ধরে উঠে বসলো সে। এরই মাঝে হাতে চায়ের কাপ নিয়ে ভিতরে ঢুকলো রাগান্বিতা। চোখ দুটো কেমন ফুলে গেছে। ইমতিয়াজ চেয়ে রইলো তার দিকে। রাগান্বিতা চায়ের কাপ টেবিলে রেখে। ইমতিয়াজের মুখোমুখি এসে পালঙ্কে বসলো। ইমতিয়াজ প্রশ্ন করলো,
“কি হয়েছে?”

রাগান্বিতা জবাব দেয় না। ছলছল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে শুধু ইমতিয়াজের মুখের দিকে। ইমতিয়াজ চিন্তিত স্বরে শুধায়,
“কি হয়েছে বলো আমায়?”

আচমকাই ইমতিয়াজকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ হতভম্ব। রাগান্বিতা কাঁদলো। শক্ত করে ইমতিয়াজকে চেপে ধরে অনেক কাঁদলো। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেল। ইমতিয়াজ নির্বিকার। অনেকক্ষণ চুপ থাকলো দুজনেই। শুধুমাত্র রাগান্বিতার গোঙানো ছাড়া কিছুরই শব্দ শোনা গেল না। ইমতিয়াজও কোনো প্রশ্ন করলো না মিনিট দশেক। সে অনুভব করলো রাগান্বিতার কান্নার স্বরে তার ভিতরটা জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। চারপাশ ছারখার হচ্ছে। এত যন্ত্রণা তো আগে অনুভব হয় নি ইমতিয়াজের।’

ধীরে ধীরে প্রকৃতি হলো পুরোপুরি শান্ত। রাগান্বিতা ইমতিয়াজকে ছাড়লো এবার বুঝি একটু হাল্কা লাগছে নিজেকে। রাগান্বিতা তাকালো ইমতিয়াজের দিকে। মানুষটাকে জড়িয়ে ধরলেই আলাদা শান্তি অনুভব করে রাগান্বিতা। রাগান্বিতা দেখলো, ইমতিয়াজ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ইমতিয়াজ প্রশ্ন করলো এবার। বললো,
“হাল্কা লাগছে?”

মাথায় নাড়ায় রাগান্বিতা। যার অর্থ হা লাগছে। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার চোখের পানি হাত দিয়ে মুছতে মুছতে বললো,
“এবার বলো কি হয়েছে?”

রাগান্বিতা মাথা নুইয়ে বললো,
“আপা!’

ইমতিয়াজ বিস্মিত হয়ে বললো,“আপা মানে কুহু।”
আবারও মাথা নাড়ায় রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ বলে,
“আপার কথা মনে পড়েছে?”

নিষ্পলক চোখে ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলে রাগান্বিতা,
“আপনি জানেন আমার আপা বিষ খেয়ে আত্নহত্যা করেছিল।”

চমকে উঠলো ইমতিয়াজ। অবাক স্বরে বললো,“কেন?”

রাগান্বিতা বলবে ভেবেও কেন যেন চেপে গেল। মাথা নিচু করে বললো,“জানি না। হঠাৎই বিষ খায়।”

ইমতিয়াজ আর কিছু বলে না। অনেকক্ষণ চুপ থাকে। পরে প্রশ্ন করে,
“পুলিশকে জানানো হয় নি?”
“না বাবার সম্মানহানির ভয়ে চেপে গেছেন।”

হঠাৎই মাথায় হাত দিয়ে আহ্ করে উঠলো ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা ঘাবড়ে গেল উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
“কি হলো?”
“যন্ত্রনা হচ্ছে।”

রাগান্বিতা খেয়াল করলো ইমতিয়াজের কপাল দিয়ে আবার রক্ত বের হচ্ছে। রাগান্বিতা হতভম্ব স্বরে বললো,“রক্ত!”

#চলবে….

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-২৯
________________
বিষণ্ণতায় ঘেরা চারপাশ। কবিরাজ হাকিমকে আবারও ডাকা হলো তালুকদার ভিলাতে। সকাল সকাল এমন ঘটনায় সবাই হতভম্ব। ইমতিয়াজের মাথা দিয়ে আবার রক্ত বের হচ্ছে এটা তো ভালো লক্ষণ নয়। কবিরাজ বলেছে যত দ্রুত সম্ভব ইমতিয়াজকে শহরে নেয়ার জন্য। দাদিমার ইচ্ছে ছিল রাগান্বিতাদের জন্য নিজ হাতে পিঠা বানিয়ে খাওয়াবে কিন্তু এ ইচ্ছে বোধহয় এবার আর পূরণ হলো না। কবিরাজ পুনরায় ইমতিয়াজের মাথায় বাঁধা পট্টি খুলে নতুন করে জড়িবুটি দিয়ে পট্টি বেঁধে দিলো। তার ধারণা মাথায় অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হওয়ার কারণে এমনটা হয়েছে। কবিরাজ তার পটলিটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। পালঙ্কেই বসা ছিল ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা, দাদিমা দূরে দাঁড়িয়ে। মোতালেব তালুকদার পালঙ্কের কর্নারে বসা। রেজওয়ান নেই এখন। সে ফজরের নামাজের পর যে বেরিয়েছে আর ফেরে নি। কবিরাজ মোতালেব তালুকদারের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তালুকদার সাহেব জামাইডারে যত হয়ালে পারেন শহরে পাডাইয়া দেন। জখম কিন্তু খুব গভীর। হয়ালে চিকিৎসা না করাইলে বিপদ হইতে পারে।”

তালুকদার সাহেব চিন্তিত হলেন। বেশি না ভেবেই দুপুরের ট্রেনেই ওদের শহরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। রাগান্বিতা তার ব্যাগপত্র গোছানোর তোড়জোর করলো। বাকিরা একে একে কক্ষ থেকে বের হলো। দাদিমা চললেন এদের জন্য রান্না করতে।’

রাগান্বিতা উত্তেজিত হয়ে তার ব্যাগপত্র গোছানোর কাজটা করছে৷ ইমতিয়াজ তাকিয়ে আছে তার দিকে। হাবভাব দেখছে। মেয়েটা বড্ডই তাড়াহুড়ো করছে। ইমতিয়াজ ধীরে সুস্থে পালঙ্ক থেকে নামলো। মাথাটায় এত বেশি যন্ত্রনা হচ্ছে যে এখন ইমতিয়াজের অসহ্য হচ্ছে। হাতের কাছে বদমাশটাকে পেলে না আচ্ছা করে দিতো দু’গা। ইমতিয়াজ গিয়ে জানালার দিকে তাকালো। চিক চিক করা রোদ্দুরেরা ছুঁয়ে দিলো তাকে। ইমতিয়াজ তাকালো কুহুকে শুয়ে রাখা কবরের ওদিকটায়। তেমন কিছু নজরে আসছে না তার৷ ইমতিয়াজ একা মনে আওড়ালো,
“তুমি বিষ খেয়েছিলে কুহেলিকা! খুব যন্ত্রণা হয়েছিল নিশ্চয়ই।”

রাগান্বিতা এগিয়ে এসে ইমতিয়াজের কাঁধে হাত রাখলো। নরম গলায় বললো,
“উঠে আসলেন যে, শুয়ে থাকুন না।”

ইমতিয়াজ নীরব চোখে তাকালো রাগান্বিতার দিকে। শীতল সুরে বললো,
“তুমি এতো ভেবো না আমায় নিয়ে। আমার কিছু হয় নি।”
“জানি তো কিছু হয় নি। তাও শুয়ে থাকুন। আর বেশি কথা বলবেন না। আমার মনে হয় আপনি আমার সাথে এত কথা বলছিলেন বলেই মাথায় চাপ সৃষ্টি হওয়ার কারনে রক্ত বের হচ্ছিল।”

ইমতিয়াজ কিছু বলে না। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের হাত ধরে নিয়ে আসলো। ইমতিয়াজও বাধ্য হয়ে এগিয়ে আসো। রাগান্বিতা ইমতিয়াজকে বসিয়ে দিলো পালঙ্কে। পুরোটা সময় ইমতিয়াজ শুধু দেখেই গেল রাগান্বিতা। হঠাৎই রাগান্বিতার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
“তুমি তোমার আপাকে খুব ভালোবাসতে তাই না বউ?”

রাগান্বিতা দু’মিনিটের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল ইমতিয়াজের প্রশ্নে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে বললো,
“হুম বাসতাম তো খুব বাসতাম। আপা তো আমার প্রাণ ছিল।”

ইমতিয়াজ কিছু বলে না আর রাগান্বিতা মৃদু হেঁসে বললো শুধু,“শুয়ে থাকুন।”

ইমতিয়াজ শুয়ে পড়লো। রাগান্বিতা নরম হাতে তার মাথায় হাত বুলালো।
—-
হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ঢুকলো রেজওয়ান। চিন্তিত মুখ তার। কারন কাল থেকে তার বন্ধু মনজুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শেষবার কাল বিকেলে রেজওয়ানের সাথে দেখা হয়েছিল। প্রাণ প্রিয় বিশ্বস্ত বন্ধুটা হঠাৎ কোথায় গেল বুঝতে পারছে না রেজওয়ান। আজ ফজরের নামাজে মসজিদে আসতে না দেখেই কেমন যেন লাগে রেজওয়ানের কারণ মনজু কখনোই সুস্থ থাকতে নামাজ কাযা করে না। রেজওয়ান চিন্তিত হয়ে মনজুদের বাড়ি যায়। গিয়ে শোনে মনজু নাকি কাল রাত থেকেই বাড়ি ফেরে নি। কোথায় গেছে কে জানে! রেজওয়ান সদর দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই মুখোমুখি হলো মোতালেব তালুকদারের। তিনি রেজওয়ানকে হন্তদন্ত হয়ে ভিতরে ঢুকতে দেখে গম্ভীর আওয়াজে বললেন,“রেজওয়ান দাঁড়াও।”

রেজওয়ান দাঁড়িয়ে পড়লো। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,“জি বাবা।”

মোতালেব তালুকদার এগিয়ে আসলেন। রেজওয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“কিছু কি হয়েছে? তোমায় খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে।”

রেজওয়ান প্রথমে ভেবেছিল কথাটা চেপে যাবে। কিন্তু পরে ভাবলো না থাক। সে সরাসরিই বললো,
“আসলে বাবা আমার বন্ধু মনজুকে কাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওর বৃদ্ধ বাবা-মা খুব চিন্তা করছেন তাই আর কি।”

মোতালেব তালুকদার চরমভাবে অবাক হলেন। বললেন,
“খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে। কোথায় গেছে?”
“সেটাই তো বুঝচ্ছি না। ও বলেছিল ও আজ থেকে আমার সাথে কৃষিকাজে যোগ দিবে।”

মোতালেব তালুকদার কিছু বললেন না। তবে চিন্তিত হলেন খুব। জলজ্যান্ত ছেলেটা গেল কোথায়?”
—–
নদীর ঘাটে বাক্সপেটরা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতা। ইমতিয়াজের ইচ্ছে ছিল গতবারের মতো এবারও তারা জাহাজে করে শহরে যাবে। কিন্তু মাথার জখম বড্ড বেশিই জ্বালাতন করছে। ভাড়ি লোহা জাতীয় কিছু দিয়ে মেরেছিল কি না কে জানে। রাগান্বিতা তার দাদিমা, বাবা আর ভাইকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কথা বললো। মনকে শক্ত রাখলো। কথা শেষে গিয়ে বসলো নৌকায়। ইমতিয়াজও মোতালেব তালুকদার আর দাদিমার সাথে দু’মিনিটের মতো কথা বললো। রেজওয়ানের দিকে তাকাতেই বুঝলো ছেলেটা কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করছে। অবশ্য সে শুনেছিল মনজু নামের রেজওয়ানের কোন প্রিয় বন্ধুকে নাকি কাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আর এ গ্রামের কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানেই তো ভাবলো না ইমতিয়াজ। সে শুঁকনো হেঁসে রেজওয়ানকে বললো,“ভালো থাকবেন ভাইজান।”

বিনিময়ে রেজওয়ানও হাল্কা হেঁসে বললো,“তুমিও ভালো থেকো। আমার বোনটার খেয়াল রেখো সঙ্গে নিজেরও। মাথার জখমটা ভালোভাবে দেখিয়ে নিও। আর সাবধানে যেও।”

ইমতিয়াজ হাল্কা হেঁসে বললো শুধু,
“জি ভাইজান।”
“এভাবে বলার দরকার নেই। আমরা তো সমবয়সই তুমি করে বললেই হবে।”

ইমতিয়াজও বিনিময়ে বলে শুধু,“ঠিক আছে।”

অতঃপর সবাইকে বিদায় জানিয়ে শহরের বাড়িতে পাড়ি জমালো রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ।’

রাগান্বিতারা বসতেই নৌকা ধীরে ধীরে চলতে লাগলো তার গন্তব্যের দিকে। বোরকা পরিধিত রাগান্বিতা নিকাবের আড়ালে বেরিয়ে থাকা তার আঁখিযুগল নিয়ে তাকিয়ে থাকলো বাবা, ভাই আর দাদিমার দিকে। না জানি আবার কবে দেখা হবে। দাদিমা তার চোখ মুছলেন বোঝাই যাচ্ছে কাঁদছে। মানুষটা রাগান্বিতাকে এত ভালোবাসে যা বলার বাহিরে। রাগান্বিতাও বাসে। খুব বাসে।’

ইমতিয়াজ তাকিয়ে আছে নদীর পানির দিকে। সেখানে কি যেন ভাসছে। সে বেশি গুরুত্ব দিলো না মাছটাছ হবে বোধহয়। ইমতিয়াজের মাথা ঘুরছে, সে ঝাপসা চোখে তাকালো নদীর ঘাটের দিকে। দু’মুহুর্তের জন্য হলেও তার মনে হলো কুহু বুঝি তাদের বিদায় জানাতে এসেছে। কি সাংঘাতিক ভাবনা! ওদিকে মেয়েটা শুয়ে আছে মাটির নিচে।’

ইমতিয়াজের অবস্থাটা খেয়াল করলো রাগান্বিতা। সে ইমতিয়াজের হাত ধরে বললো,“শরীর খারাপ লাগছে?”

ইমতিয়াজ মাথা নাড়ায়। বলে,
“খানিকটা।”

রাগান্বিতা চিন্তিত স্বরেই আশ্বাস দিয়ে বলে,
“একটু ধৈর্য্য ধরুন দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।”

ইমতিয়াজ বিনিময়ে কিছু বলে না। তবে মনে মনে আওড়ায়,“সত্যি কি ধৈর্য্য ধরলে সব ঠিক হয়ে যায়!”
—–
সময় গড়ালো। দেখতে দেখতে কেটে গেল টানা পনের দিন। এই পনের দিন ইমতিয়াজের সেবার কাজেই নিয়োজিত ছিল রাগান্বিতা। গ্রাম থেকে ফিরেই সোজা ডাক্তারের কাছে যাওয়া। তারপর তার কথা অনুযায়ী সব করা। ইমতিয়াজ শুধু মুগ্ধ হয়ে এ ক’দিন দেখেছে তার বউকে। মেয়েটা তাকে এত বেশি ভালোবাসে কেন, কে জানে! সে নিজেও যে ভালোবাসতে শুরু করে নি এমনটা নয়। রোজ রাতেই সে রাগান্বিতার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে,
“মেয়েটা তাকে পাগল বানিয়েই ক্ষ্যান্ত হলো শেষে।”

তবে এসবের মধ্যে ঘটে যায় আরেকটা ঘটনা। যা ঘটে রেশবপুরে। রাগান্বিতাদের ফিরে আসার ঠিক দু’দিন পরই নদীর পানিতে ভেসে ওঠে মনজুর লাশ। লাশটা ভেসে গিয়েছিল আটপাড়ার ওদিকটায়। গ্রামবাসীরা এবার বেশ আতঙ্কে আছেন খালি গ্রামে মৃত্যু ঘটছে। প্রথমে মুরতাসিন, এরপর মাহাদ আর এখন মনজু। পুলিশ কেসটা নিয়েছে তদন্ত চলছে তবে এখনও কিছু জানা যায় নি। রেজওয়ান অনেকটা ভেঙে পড়েছে। তার প্রানপ্রিয় বন্ধুটার এমন মৃত্যুতে সে সত্যি শোকাহত। শোকের জন্য ঘর বন্দীও থেকেছে দু’দিন। গ্রামবাসীদের কারো কারো ধারণা গ্রামে বুঝি ভূত প্রেতের উপদ্রব হয়েছে যার কারণে এইসব অনৈতিক কাজকর্ম হচ্ছে। কেউ কেউ তো কুহুর হঠাৎ মৃত্যুতেই বুঝি গ্রামের দূর্দশা হয়েছে এসবও বলছে। কিন্তু আসলে কি ঘটছে তা তো কেউই জানে না!’

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]

#TanjiL_Mim♥️

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-২৬+২৭

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-২৬
________________
থমথমে চেহারা নিয়ে বসে আছে রাগান্বিতা। মুখে কথা নেই। নির্জীব চুপচাপ পরিবেশ। রাতের আকাশটাও বুঝি গেল থমকে। রাগান্বিতার পানে তাকালো দাদিমা। অশ্রুভেজা চোখ নিয়েই বললেন তিনি,
“রাগান্বিতা,

রাগান্বিতা ছলছল দৃষ্টিতে তাকালো দাদিমার পানে। চোখদুটোতে কেমন পানি টলমল করছে। দাদিমা বললেন,
“কাইন্দো না রাগান্বিতা।”

রাগান্বিতা আরো অনেকক্ষণ চুপ থাকলো। কিছু ভেবে প্রশ্ন করলো,
“আপার কার সাথে সম্পর্ক ছিল?”
“জানি না।”
“আপারে তো কখনো সেইভাবে কোনো মানুষের সাথে কথা বলতে দেখি নি। আপা তো ঘর থেকেই বের হতো না। গ্রামের অনেক মানুষই তো আপারে ঠিকভাবে চিনতো না। তাহলে?”
“এগুলান কিছু জানি না।”

রাগান্বিতা আবার চুপ হয়ে গেল। তার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। রাগান্বিতা নিজের চোখ মুছলো। শান্ত গলায় বললো,
“এগুলো সব মিথ্যে আমার আপা পবিত্র ছিল। তুমি মিথ্যে কথা বলছো।”
“মিথ্যে কইলেই সব সত্য মিথ্যে হইয়া যায় না রাগান্বিতা।”

রাগান্বিতা দমে গেল সত্য এত কঠিন কেন। রাগান্বিতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার প্রশ্ন করলো,
“আর শাপলার সাজ।”

এবার যেন থমকে গেলেন দাদিমা এই কথা কি রাগান্বিতাকে বলা ঠিক হবে। মোতালেব তো বারণ করেছিল।’

“কি হলো কথা বলছো না কেন?”
“হাপলার লগে কুনো কতা আছিল না।”
“তুমি ভয় কেন পেয়েছিলে সত্যি করে বলো?”
“তুমারে কইছিলাম তো ওসবে পোকামাকড় সাপকোপ থাহে।”

রাগান্বিতার কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে তীক্ষ্ণ হলো। সে জোরালো গলায় বললো,“মিথ্যে বলো না দাদিমা।”

দাদিমা তাও চুপ করে রইলেন। ভিতরে ভিতরে কি যেন ভাবছেন। রাগান্বিতা দাদিমার হাবভাব প্রখর করলো। বললো,
“তুমি আজও ভয় পাচ্ছো কি লুকাচ্ছো আমার থেকে বলো দাদিমা, আপার সাথে জড়িত নয় তো।”

এবার যেন আরো ঘাবড়ে গেলেন দাদিমা। এবার কি বলবেন তিনি। রাগান্বিতা দাদিমার হাত ধরে বসলো। নিজেকে ধাতস্থ করে প্রশ্ন করলো,
“আমি জানি বাবাও কোনো এক ভয়ের কারণে আমায় দ্রুত বিয়ে দিতে চেয়েছিল বাবার সেদিনকার থাপ্পড় দেয়াটা আমায় নিশ্চিত করেছে তা। আমি জানি তুমি সব জানো আমায় বলো দাদিমা।”

দাদিমা ঘাবড়ে গিয়ে বলে উঠলেন,“তুমার আব্বায় না করছে।”

রাগান্বিতা এবার পুরোপুরি নিশ্চিত হলো তার মানে এদের মাঝে সত্যি কোনো কথা লুকানো আছে। রাগান্বিতা বললো,“তার মানে আমি যা ভেবেছিলাম তাই সত্যি তোমরা আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছো।”

দাদিমা নিজের কথার জালে যেন নিজেই ফেঁসে গেলেন। আজ বোধহয় কোনো কথাই আর লুকানো যাবে না। রাগান্বিতা আবারও প্রশ্ন করলো,“আমায় সবটা খুলে বলো দাদিমা, আমি বাবাকে কিছু বললো না।”

দাদিমা অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললো,“একদিন কু..

আর কিছু বলার আগেই সদর দরজার সামনে দিয়ে এক বিকট শব্দ আসলো দাদিমা রাগান্বিতা দুজনেই যেন চমকে উঠলো। দাদিমা বললেন,“এত জোরে শব্দ আইলো কিসের কেউ পইড়া গেল নাকি।”

রাগান্বিতা দাদিমা দুজনেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো। দরজার সামনেই ইমতিয়াজকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে দুজনেই থমকে গেলেন। রাগান্বিতা তো স্তব্ধ হয়ে ছুট্টে গেল সামনে ইমতিয়াজের মাথাটা নিজের কোলে রেখে উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
“এসব কি করে হলো?”

তখনই দাদিমা দেখলেন ইমতিয়াজের কপাল চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। দাদিমা ঘাবড়ে গেলেন। বললেন,
“এহনো রক্ত পড়তাছে রাগান্বিতা হয়ালে কবিরাজ গো ডাহা লাগবো তুমি নাতজামাইরে নিয়া কক্ষে যাও আমি এখনই মোতালেবরে ডাকতাছি।”

দাদিমা থরথর করে বেরিয়ে গেলেন। আর রাগান্বিতার শরীর কাঁপছে। বুকে যন্ত্রণা হচ্ছে। ইমতিয়াজের এমন অবস্থা হলো কি করে? কে মারলো তাকে।”
——
রাত জুড়ে বিষণ্ণতা। পালঙ্কে শুয়ে আছে ইমতিয়াজ তার পাশেই কবিরাজ হাকিব বসা। ইমতিয়াজের কপালের অংশটায় বেশ খানিকটা জায়গায় জখম হয়েছে কেউ ভাড়ি কোনো বস্তু দিয়ে আঘাত করেছে। কবিরাজ তার হাতে বানানো কিছু জড়িবুটি দিয়ে মাথায় পট্টি বেঁধে দিল ইমতিয়াজের। সাথে ঔষধ দিলেন কিছু। ক্ষত স্থানে পানি লাগাতে বারণ করেছেন। ইমতিয়াজের পাশেই মোতালেব তালুকদার, কাশেম আর দাদিমা বসা। রাগান্বিতা কিছুটা দূরে আর দুয়ারের কাছ দিয়ে রেজওয়ান দাঁড়ানো তাদের কারো মাথাতেই আসছে না ইমতিয়াজের এমন অবস্থা হলো কি করে! কবিরাজ উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,
“কপাল দিয়া অনেকখানি রক্ত পড়ছে। ফাইট্টাও গেছে অনেকখানি শহরে নিলে মনে হয় বেশি ভালো হইতো। আমার যা দেওয়ার দিলাম আজ রাতে এমনই থাকুক পারলে কাইলগো শহরে নিয়া দেখাইয়েন।”

কবিরাজের কথা শুনে চিন্তিত হয়ে গেলেন সবাই। মোতালেব কাশেমরে ইশারায় কবিরাজকে বাহিরে নিয়ে যেতে বললো। কাশেমও তাই করলো। ওনারা যেতেই মোতালেব প্রশ্ন করলো,
“এসব কি করে হলো জামাই?”

ইমতিয়াজ রাগান্বিতার দিকে তাকালো মেয়েটার চোখ ছলছল করছে। ইমতিয়াজ দৃষ্টি সরালো মোতালেবের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি জানি না কে করলো। কিছুক্ষণ আগে আমি বাড়ির দিকেই ফিরছিলাম রাস্তায় হঠাৎই কে জেনো সামনে এসে ভাড়ি কিছু দিয়ে কপালে আঘাত করলো। আমি বুঝে ওঠার আগেই পালিয়ে গেল রাস্তায় অন্ধকার থাকায় আমি তার মুখ দেখতে পায় নি। তবে মনে হয় গায়ে চাদর জড়ানো ছিল।”

এবার যেন রেজওয়ানের খটকা লাগলো তার সাথেও তো এমন ঘটনা ঘটেছিল। তবে কি সেই চাদর পড়া ব্যাক্তিটি ইমতিয়াজকেও আঘাত করলো। কিন্তু কেন! যদিও তাকে আঘাত করার কারণটাও আজও জানে নি রেজওয়ান।’

ইমতিয়াজের কথা শুনে চিন্তিত হলেন রাগান্বিতার বাবা। এর আগে রেজওয়ানের সাথেও এমন ঘটনা ঘটেছিল। কে যে পিছন থেকে আঘাত করছে কে জানে। রাগান্বিতার বাবা ভাবছেন মেয়ে জামাইকে এখানে বেশিদিন রাখাটা বোধহয় ঠিক হবে না। তার চেয়ে বরং কালই এরা চলে যাক। রাগান্বিতার বাবা কিছু বলবেন তার আগেই রাগান্বিতা বললো,
“বাবা তুমি অনুমতি দিলে আমরা কালই চলে যাই। কবিরাজ দাদু তো বললেন ওনাকে শহরের ডাক্তার দেখালে ভালো হবে।”

রাগান্বিতার বাবা বুঝলেন। নির্বিকার হয়ে বললেন,
“হুম তাই করো। সাবধানে থেকো।”

শেষের কথাটা ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বললেন মোতালেব তালুকদার। অতঃপর রাগান্বিতার বাবা উঠে দাঁড়ালেন কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে গেলেন কক্ষ থেকে রেজওয়ানও তার পিছু পিছু গেল। একটু এগিয়েই বাবার মুখোমুখি হয়ে বললো,
“বাবা এবার আমাদের বিষয়টা খুঁটিয়ে দেখা উচিত। আমার মনে হচ্ছে আমায় আর ইমতিয়াজকে আঘাত করা ব্যক্তিটি একজনই।”

রাগান্বিতার বাবা ছেলের কথার গুরুত্ব দিলেন কাঁধে হাত দিয়ে আশ্বাস দিয়ে বললেন,“দেখছি।
—–
কক্ষে দাদিমা ইমতিয়াজের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,“চিন্তা কইরো না সব ঠিক হইয়া যাইবো।”

উত্তরে শুধু শুঁকনো হাসলো ইমতিয়াজ। দাদিমা বেরিয়ে গেলেন ইশারায় রাগান্বিতাকে বুঝালাম নাতজামাইর খেয়াল রাখতে। সবাই চলে যাওয়ার পরও রাগান্বিতা বেশ কিছুক্ষণ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো। ইমতিয়াজ দৃষ্টি রাখলো রাগান্বিতার দিকে। শীতল সুরে বললো,
“বউ,

রাগান্বিতা জবাব দিলো না সে এগিয়ে গিয়ে নিজেদের কক্ষের দুয়ার দিলো। তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে আসলো ইমতিয়াজের দিকে। পুরোটা সময় রাগান্বিতার দিকেই তাকিয়ে ছিল ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের কাছ দিয়ে বসলো। কপালে হাত ছুঁয়ে বললো,
“খুব জ্বলছে তাই না।”
“একটু।”
“আপনি এতো রাতে বাহিরে কেন গিয়েছিলেন?”
“মোকলেসের সাথে কথা বলতে।”
“এই রাতের বেলা।”
“ও ডেকেছিল।”
“কেন?”
“বললে তুমি রাগ করবে।”
“করবো না বলুন।”
“তুমি রাগ করবেই।”
“বললাম তো করবো না বলুন,
“তাস খেলা দেখতে।”

সঙ্গে সঙ্গে রাগান্বিতা রেগে উঠলো। উচ্চস্বরে বললো,
“আপনি এই রাতের বেলা তাস খেলতে গেছিলেন।”
“উম না খেলতে নয় শুধু দেখতে আমি ওসব খেলি না।”

রাগান্বিতা রাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো আয়নার কাছে যেতে যেতে বললো,
“আপনি কি পাগল এই রাতের বেলা তাস খেলা দেখতে গেছিলেন।”
“তুমি বলেছিলে রাগ করবে না তাও করছো।”

রাগান্বিতা একে একে তার গায়ের অলংকার খুলতে লাগলো। তীক্ষ্ণ স্বরে সুধালো,
“আপনি বলুন এটা কি রেগে যাওয়ার মতো কথা নয়।”

ইমতিয়াজ মাথা নিচু করলো অপরাধী সুরে বললো,
“ভুল হয়ে গেছে, এমনটা আর হবে না। আমি কথা দিচ্ছি আমি আর কখনো ওসব দেখতে যাবো না।”

রাগান্বিতা মনে মনে খুশি হলো নিজের খোঁপা করা লম্বা চুলগুলো খুলে চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে বেনুনী করলো। ইমতিয়াজ মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখলো তা। কেমন যেন নেশালো গলায় শুধালো,“তুমি এত সুন্দর কেন বউ?”

ইমতিয়াজের নেশা লাগানো কথাটা কানে বাজতেই কেমন এক শীতল হাওয়া বয়ে গেল রাগান্বিতার মাঝ দিয়ে। সে এগিয়ে আসলো পালঙ্কে বসলো। ইমতিয়াজের চোখে চোখ রেখে আদুরে গলায় বললো,
“আপনার চোখ দুটো সুন্দর তাই সুন্দর লাগে।”

ইমতিয়াজ হাসে। বলে,
“তোমাকে দেখতে দেখতেই কবে যেন আমি পাগল হয়ে যাই।”
“উম! মিষ্টি মিষ্টি কথাতে রাগান্বিতা কিন্তু ভুলবে আজ আপনি অন্যায় করেছেন আমায় না বলে তাস খেলা দেখতে গেছেন।”
“তুমি ঘরে ছিলে না তার জন্যই তো।”
“আমায় ডাকা যেত না।”
“ডাকলে আমায় যেতে দিতে বুঝি।”
“অন্যায় করে মুখে মুখে তর্ক করা ঠিক না।”
“আমায় কি ক্ষমা করা যায় না?”
“ঠিক আছে করে দিলাম তবে আর যেন এই ভুল না হয়। এবার ঘুমিয়ে পড়ুন। মাথা ব্যাথা করছে নিশ্চয়ই।”
“তুমি আমার পাশে থাকলে এসব ব্যাথা আমার অনুভব হয় না বউ।”

আচমকা কেঁদে ফেললো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল এতে। বললো,
“আরে আরে তুমি কাঁদছো কেন?”
“আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম জানেন,
“কি ভেবে ছিলে মরে…

কথাটা শেষ করতে পারলো না ইমতিয়াজ তার আগেই ইমতিয়াজের মুখ চেপে ধরলো রাগান্বিতা। বললো,
“এভাবে বলবেন না। আপনি কেনো বুঝেন না আপনার এসব কথায় আমার বড্ড আঘাত লাগে, যন্ত্রণা হয়।”

ইমতিয়াজ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো শুধু রাগান্বিতার চোখের দিকে। মেয়েটা দিনে দিনে তার প্রতি বড্ড আবেগী হয়ে যাচ্ছে। এটা কি ঠিক হচ্ছে! ইমতিয়াজ মনে মনে আওড়ালো,“আমায় এতো ভালোবেসো না বউ, কখনো বড় আঘাত দিলে সইবে কেমন করে।”

#চলবে…

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-২৭
________________
সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে পুরো কক্ষ জুড়ে। রাতের আকাশের জোৎস্না ভরা আলো ছুঁচ্ছে খুব করে। পালঙ্কে চুপচাপ শুয়ে আছে ইমতিয়াজ। তার পাশে রাগান্বিতা বসা। কথা নেই কারো মুখে। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের ক্ষত স্থানে হাত ছোঁয়ালো। বললো,
“কেন যে আপনি যেতে গেলেন বাহিরে?”

ইমতিয়াজ চুপ সে নির্বিকার ভংগিতে আস্তে করে তার মাথাটা রাগান্বিতার কোলে রাখলো শীতল সুরে বললো,
“মাথায় হাত বুলিয়ে দেও বউ বহুদিন কেউ হাত বুলায় না।”

রাগান্বিতা একটু দোনামনা করলো। বললো,
“আপনার ব্যাথা লাগলে?”
“লাগবে না।”

রাগান্বিতা শুনলো আস্তে আস্তে ইমতিয়াজের চুলগুলোতে বিলি কাটতে লাগলো। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার কোমড় জড়িয়ে ধরলো। খুব আদুরে সুরে বললো,
“একটা গল্প শুনবে বউ?”

রাগান্বিতা তখন শীতল অনুভূতিতে পঞ্চমুখ। চোখ বন্ধ করছিল আচমকাই। ইমতিয়াজের স্পর্শ বরাবরই তাকে ভিন্ন রকম অনুভূতি দেয়। সে চোখ খুললো। বললো,
“জি বলুন,

ইমতিয়াজ তার চোখ বন্ধ করে শান্ত স্বরে বলতে লাগলো,
“এক দেশে এক রাজা ছিল তার ছিল দুই বউ। বড় বউয়ের কোনো সন্তান ছিল না। সে ছিল একটু বোকা টাইপের যে যা বলতো তাই বিশ্বাস করে নিতো, এক কবিরাজ ছিল সে বলেছিল রানীর দোষেই নাকি রাজা কখনো বাবা হতে পারবে না। রানী ভেঙে পড়ে রাজাকে বললো আরেকটা বিয়ে করতে। রাজা প্রথমে রাজি না হলেও পরবর্তীতে রানীর চাপে পড়ে বিয়ে করেন। নিয়ে আসেন অসম্ভব সুন্দরী এক রানীকে। রানী দেখতে যত সুন্দর ছিল মনটা ছিল তার চেয়েও বিষে ভরা। পরে জানা যায় কবিরাজের মেয়েই ছিল রাজার দ্বিতীয় রানী। রাজা বুঝতে পারে নি দ্বিতীয় রানীর ভিতরে কি চলছে। রাজা বিয়ে করার দু’সপ্তাহের পরই জানা গেল রাজার প্রথম স্ত্রী মা হতে চলেছেন। রাজপ্রাসাদ জুড়ে সে কি উৎসব। মাতামাতি, রাজা তো খুব খুশি। রাজা রানীকে বোঝালেন তুমি খামোখায় আমায় আরেকটা বিয়ে করালে। কিন্তু রানীর কোনো আফসোস ছিল না এতে সে রাজার দ্বিতীয় স্ত্রীকে ছোট বোনের মতো ভালোবাসতেন। কিন্তু রাজার দ্বিতীয় রানী সেভাবে বাসতে পারলেন না। রানীর এত আনন্দ সে দেখতে পারতো না। কিভাবে রাজার সন্তান সম্ভবা বউকে মেরে ফেলবে সেই ফন্দি আটতো। কিন্তু সফল হতে পারলো না একবারও। দেখতে দেখতে রাজার প্রথম রানীর সন্তান হলো একটা ফুটফুটে ছেলে সন্তান। সবাই বলতে লাগলো ছেলে নাকি হুবহু রাজার মতো দেখতে হয়েছে। এ কথা শুনে রাজার দ্বিতীয় রানী ক্রোধে ফেটে গেল রাজপ্রাসাদের এত সুখ তাও আবার রাজার প্রথম রানীকে নিয়ে তার সহ্য হলো না। ধীরে ধীরে তার মস্তিষ্ক হলো ক্ষিপ্ত। সে ফন্দি আটলো রানীর খাবারে বিষ মিশিয়ে তাকে মেরে ফেলবে। তার সন্তানকে গলা চেপে মেরে ফেলার ফন্দি আটলো। কিন্তু তাতেও অসফল হলো। তখন রাজাকে বোঝালো রানীর সন্তান তার নয় অন্যকারো। সে নাকি প্রায়শই রাজার প্রথম স্ত্রীকে রাতের আধারে বাহিরে যেতে দেখতো। প্রথম প্রথম এ কথা রাজা বিশ্বাস না করলেও পরে সত্যি সত্যিই একদিন রাতের আধারে প্রথম রানীকে বাহিরে যেতে দেখে রাজা ক্ষিপ্ত হলো। প্রথম রানীকে তিনি ভালোবাসতেন খুব কিন্তু কথায় বলে না,“সব সম্পর্কেই তৃতীয় ব্যক্তিটি খুব ভাগ্যবান হয়। এখানেও তাই হলো।”

ইমতিয়াজের গলা আঁটকে আসলো। রাগান্বিতা নিশ্চুপে প্রশ্ন করলো,
“তারপর কি হলো?”
“রানীকে নির্যাতন করা শুরু করলো তার ওতটুকু সন্তানকেও ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলো রাজা। বিষ খাওয়ার ফন্দি করার কথা বললে রাজা রাজি হয় না। বলে এভাবে মেরে দিলে তার নাকি শরীরের জ্বালা মিটবে না। রাজা প্রায়শই প্রথম রানীর সাথে ঝগড়া করে। রানী এত বলে সে রাতে কারো সাথে দেখা করে নি তাও রাজা বিশ্বাস করে না। সেদিন রাতে তাদেরই কাজের লোক মজনু নামের এক লোকের সাথে দেখা করে সে বলে তার মা খুব অসুস্থ তাকে যেতে হবে রানী বিশ্বাস করে কিছু পয়সা কড়ি গুজে খানিকটা এগিয়ে দেয় তখনই রাজা দেখে। পরে মজনুকে ডাকা হলে উল্টো কথা বলে,প্রথম রানীর নামে আগে বসে যায় চরিত্রহীনের দাগ। রানীকে করা হলো এক ঘরে। রানী ধরতে গেলে এতিম ছিল বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করে ছিল রাজাকে। রানীর বাবা এটা মেনে না নিয়ে ত্যাগ করলো তার কন্যাকে। তাই কোথাও যাওয়ার মতো জায়গা ছিল না। রাজপ্রাসাদেই পড়ে রইলো সন্তানকে নিয়ে।

সময়ের সাথে সাথে ছেলে বড় হয়। কিন্তু রানীর প্রতি অত্যাচার কমলো না। রানীকে অর্ধনগ্ন করে মারতো তারই ছেলের সামনে। এত জ্বালা রানী আর সহ্য করতে পারলো না সে ছেলের মায়া ত্যাগ করে বিষ খেয়ে আত্নহত্যা করলো। ছেলে কাঁদলো তার জন্য কিন্তু রাজা সে যেন খুব খুশি হলো। এরপর শুরু হলো রানীর সন্তানের উপর অত্যাচার। রাজা আর রাজার দ্বিতীয় রানী দুজন মিলে মারতো, ঠিক মতো খেতেও দিতো না,কনকনে শীতেও খালি গায়ে শুয়ে কাঁপতো ছেলে। সে যে কি যন্ত্রনার বলে বোঝানো যাবে না। তাও সহ্য করতো। এতিম ছেলে কোথায় যাবে তাই কষ্ট সহ্য করেই রাজপ্রাসাদে পড়ে থাকতো। বাবা থাকতেও তার অধিকার ছিল না তাকে বাবা ডাকার। রাজার ছেলে মেনে নিলো। এরই মধ্যে রাজার দ্বিতীয় রানীর মেয়ে সন্তান হলো। সবাই খুশি হলো। রাজা দিনরাত পার করে সেই সন্তানের সেবা করতো। আর ছেলে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতো। ভাবতো তাকেও কবে তার বাবা এভাবে আদর করবে কিন্তু করতো না। তারপর ছেলে একদিন সিদ্ধান্ত নিলো সে আর রাজার প্রাসাদে থাকবে না তাই পালিয়ে আসলো ওখান থেকে। শুরু করলো নতুন জীবন। একার জীবন। একার জীবন খুব সুখের হয় তাই না বউ?”

রাগান্বিতার চোখ ভেসে উঠলো। দু’ফোটা চোখের জল গড়িয়ে পড়লো ইমতিয়াজের গালে। ইমতিয়াজ বুঝলো সে রাগান্বিতাকে ছেড়ে চাইলো রাগান্বিতার মুখের দিকে। বললো,
“তুমি কাঁদছো?”

রাগান্বিতা নির্বিকার স্বরে বললো,
“রাজার ছেলেটা আপনি ছিলেন তাই না?”

ইমতিয়াজ জবাব দেয় না। তবে রাগান্বিতা ইমতিয়াজের চোখ দেখেই বুঝলো সবটা। যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ইমতিয়াজকে। চোখে মুখে ঠোঁট ছোঁয়ালো বারংবার। বললো,
“জীবন খুব ব্যাথা দিয়েছে আপনায় তাই না।”

ইমতিয়াজ মৃদু হাসলো। বললো,
“মাত্র যে তুমি শক্ত করে জড়িয়ে ধরলে এতবার ভালোবাসার পরশ দিলে এতেই সব ব্যাথা কমে গেছে আমার।”

রাগান্বিতা তার চোখের পানি মুছলো। ছলছল নয়নে বললো,
“আপনায় আর কোনোদিন ব্যাথা পেতে দিবো না আমি। দেখবেন আমরা এখন থেকে খুব সুখে থাকবো। গুছিয়ে একটা সুন্দর সংসার গড়বো।”

ইমতিয়াজ কিছু বলে না। সে থাকে চুপচাপ। চেয়ে চেয়ে দেখে শুধু রাগান্বিতার পাগলামি, বার বার পলক ফেলার মুহুর্তটা। হঠাৎই রাগান্বিতার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে ইমতিয়াজ,
“এই যে আমি প্রতিনিয়ত তোমায় দেখছি, তোমাতে হারিয়ে যাচ্ছি, অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে ,নিজের সর্বনাশ দেখতে পাচ্ছি এটাকে কি প্রেম বলে না।”

রাগান্বিতা থমকে গেল। ইমতিয়াজ কি তার প্রেমে পড়ার কথা বললো। রাগান্বিতা কোনো প্রশ্ন করলো না। ইমতিয়াজ আবার বললো,
“আমি ভেবেছিলাম তোমায় ভালোবাসবো না কিন্তু আজ দেখছি তোমায় ভালো না বেসে থাকা যাবে না।”

রাগান্বিতা লাজুক হাসলো। নতুন করে আবার যেন প্রেমে পড়লো ইমতিয়াজের। লোকটা ভাড়ি বদমাশ। তাকে লজ্জায় না ফেলে ছাড়বে না। ইমতিয়াজ আর একটু লজ্জা দিতে বললো রাগান্বিতাকে,
“তোমাকে লজ্জায় পড়তে দেখলে না আরো দারুণ লাগে বউ।”
“আপনি এবার থামুন তো।”
“না থামবো না কাছে আসো চুমু দিবো।”

খানিকটা কেঁপে উঠলো রাগান্বিতা। বললো,
“না লাগবে না।”

ইমতিয়াজ চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
“বারে তুমি যদি আমায় হুটহাট চুমু দিতে পারো আমি দিলে লাগবে না কেন?”

রাগান্বিতা কিছু বলে না। সে চুপ করে থাকে। লোকটা বুঝি আজ লজ্জায় ফেলেই মেরে ফেলার ফন্দি আটছে। ইমতিয়াজ হাসলো। মনে মনে আওড়ালো,“তোমার লাজুক মুখে এত বেশি মায়া কেন বউ, আমি বুঝি সত্যি সত্যিই পিছলে গেলাম। মরণ দুয়ারে বোধহয় পা বাড়ালাম।”
—–
ফজরের ধ্বনি শোনা গেল রাগান্বিতা আস্তে করে শোয়া থেকে উঠে বসলো। ইমতিয়াজকে উঠাবে ভেবেও আবার উঠালো না। রাগান্বিতা কক্ষ থেকে বের হলো, সোজা চলে গেল কলপাড়ে সেখানে দাদিমাও ছিলেন। বাবা আর রেজওয়ান বেরিয়ে গেলে মসজিদের উদ্দেশ্যে।

রাগান্বিতা ওজু করে নামাজ আদায় করলো। ইমতিয়াজের জন্য দু’হাত তুলে দোয়া চাইলো আল্লাহর দরবারে। ইমতিয়াজ তখনও ঘুমিয়ে ছিল মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে তার। রাগান্বিতা কি ভেবে যেন নামাজ সেরে আবার কক্ষ থেকে বের হলো। সে সোজা চলে গেল কুহুর কক্ষে। রাগান্বিতা আর কুহুর কক্ষ ছিল আলাদা। রাগান্বিতার কেন যেন মনে হলো কুহুর কক্ষে গেলে সে জানতে পারবে কুহুর কার সাথে সম্পর্ক ছিল। কুহু ডাইরি লিখতে খুব ভালোবাসতো কে জানে হয়তো ডাইরির ভাঁজেই পেতে পারে কুহুর কিছু অজানা তথ্য।

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]

#TanjiL_Mim♥️

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-২৪+২৫

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-২৪
________________
রৌদ্রময় সকাল! ফজরের নামাজ সেরে পুনরায় আরেকবার ঘুমিয়ে ছিল রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ ফজরের সময় বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর আর এসেছিল কি না জানে না রাগান্বিতা। হঠাৎই কিছু একটা ভেবে নড়েচড়ে উঠলো রাগান্বিতা। আশেপাশের কোথাও ইমতিয়াজকে না দেখে খানিকটা চিন্তিত হয়েই পালঙ্ক ছেড়ে নামলো সে। সিঁড়ি বেয়ে নামতেই দেখা মিললো দাদিমার সাথে। তাকে দেখেই দাদিমা মিষ্টি হেঁসে বললেন,
“তুমি উডছো রাগান্বিতা।”
“হুম বাবা কোথায় দাদিমা?”
“তোর আব্বা তো হকাল হকালই হাডে গেছে বাজার করনের লাইগ্যা।”
“ওহ আচ্ছা আর দাদাভাই?”
“ওয় তো চাষাবাদে গেছে জমির ফসল দেহার লাইগ্যা।”

দাদিমার কথা শুনে রাগান্বিতা অবাক স্বরে এদিক সেদিক তাকিয়ে বললো,
“দাদাভাই চাষাবাদ করে কবে থেকে?”
“মেলাদিন(বেশিদিন) হয় নাই হুনছি এহন থেইকা গ্রামেই থাকবো তোর আব্বায় আর শহরে যাইতে দিতে চায় না।”
“ওহ।”
“হয় তুমি এখন যাও চোহে মুহে পানি দিয়াও আমি খাওন বাড়তাছি।”
“ঠিক আছে।”

দাদিমা রন্ধনশালার দিকে এগিয়ে গেলেন আর রাগান্বিতা আশেপাশে তাকিয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে উঠানের কলপাড়ের দিকে আসলো। এই ইমতিয়াজটা সকাল সকাল গেল কই! রাগান্বিতার মনটা বড় অস্থির লাগছে। রাগান্বিতা দিনে দিনে হারে হারে টের পাচ্ছে প্রেম বড্ড ভয়ংকর জিনিস। মানুষটাকে এক পলক না দেখলেই কেমন অস্থির অস্থির লাগে। রাগান্বিতা কলের গোঁড়ায় এসে দাঁড়াতেই আচমকাই এক বাঁশির সুর কানে ভেসে আসলো। রাগান্বিতা ধড়ফড়িয়ে উঠলো এ তো সেই মানুষটারই বাঁশির সুর। রাগান্বিতা যেন ঠাহর করতে পারলো ইমতিয়াজ কোথায় আছে রাগান্বিতা আর দেরি করলো না কলগোড়া ছেড়েই ছুট লাগালো বাহিরে।

ইমতিয়াজের সঙ্গে রাগান্বিতার প্রথম দেখা হওয়া প্রথম দিনের সেই জায়গা আর সেই বিশাল গাছটার নিচে বসে আজও বাঁশি বাজাচ্ছে ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা দূর থেকেই নিজের পায়ের গতি কমিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে ছিল ইমতিয়াজের দিকে। সেদিনকার সেই দিনটা আর আজকের দিনটার মধ্যে কত তফাৎ! রাগান্বিতা ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে আনমনা বসলো ইমতিয়াজের পাশ দিয়ে। ইমতিয়াজ তখনও নিজ মনে বাঁশি বাজাতে ছিল। কি মুগ্ধনীয় শব্দ তার রাগান্বিতা চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে লাগলো তা। হঠাৎই বাঁশি বাজানো থামিয়ে দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়েই বললো ইমতিয়াজ,
“কারো অনুমতি ছাড়া তার পাশে বসে বাঁশির সুর শোনা কিন্তু ঘোর অন্যায় জমিদার কন্যা।”

রাগান্বিতা যেন ধড়ফড়িয়ে উঠলো এক মুহূর্তের জন্য হলেও চরমভাবে অবাক হয়েছে সে। রাগান্বিতা নিজেকে দমালো। বললো,
“বাঁশির সুর কানে আসাটা অন্যায় নয়।”
“ঘরে বসে শুনলে অন্যায় নেই ছুটে এসে শুনলে ঘোর অন্যায়।”

রাগান্বিতা কি বলবে বুঝতে পারছে না। পরমুহুর্তে কি ভেবে জবাব দিলো,
“যে বাঁশি বাজাচ্ছিল তার ওপর আমার অধিকার আছে।”

ঝটপট প্রশ্ন ইমতিয়াজের,
“কিসের অধিকার?”
“সে আমার একজন নিজস্ব মানুষ। আর নিজস্ব মানুষের ওপর কিসের অধিকার থাকতে পারে তা নিশ্চয়ই আপনায় বুঝিয়ে বলতে হবে না।”

ইমতিয়াজ হেঁসে ফেলে মেয়েটা কিভাবে বলে দিল “সে তার নিজস্ব মানুষ’’! ইমতিয়াজ শীতল সুরে বললো,
“তুমি এত সুন্দর করে কথা বলো না রাগান্বিতা, আমি যদি প্রেমে পড়ে যাই আমার তো ভয় লাগে।”

রাগান্বিতা শব্দ করে হাসে আয়েশ করে ইমতিয়াজের পাশে বসে বলে,
“বউকে ভালোবাসতে ভয় কিসের?”
“তুমি বুঝবে না।”
“বুঝিয়ে বললে কে বুঝবে না শুনি!”

অভিমানী স্বরে শুধালো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার নাকের ডগায় হাল্কা স্পর্শ করে বললো,
“সবাই বুঝবে কিন্তু তুমি বুঝবে না।”

রাগান্বিতার রাগ হলো সে রাগ নিয়ে মুখ ভাড় করে বসে রইলো। আর ইমতিয়াজ তার কান্ডে হাসলো। শীতল সুরে বিড়বিড়িয়ে বললো,
“তুমি কি বিশ্বাস করবে বউ, খুন না করেও আজ আমি খুনি হয়েছি।
ভালোবাসবো না ভেবেও ভালোবাসতে শুরু করেছি!”

রাগান্বিতা ইমতিয়াজের দিকে কেমন এক চাহনী নিয়ে তাকালো। ভ্রু-জোড়া কুঁচকে বললো,
“কিছু কি বললেন আপনি?”

ইমতিয়াজ উদাসীন সুরে আবার শুধালো,
“আমি তোমায় অনেক কিছু বলি বউ, কিন্তু তুমি শুনো না। আমি আঘাতপ্রাপ্ত মানুষ বউ, তুমি আমার প্রতি এত অনুরাগী হও না।”
“ভালোবাসতে বারণ করছেন আমায়?”
“এত বড় সাধ্য আমার কই!”
“তবে নিজে ভালোবাসতে চাইছেন না কেন?”
“আমি ভালোবাসতে শুরু করলে তুমি সইতে পারবে না।”
“কেন পারবো না?”

ইমতিয়াজ জবাব দেয় না। উল্টো বলে,
“তুমি কি জানো বউ, আমি তোমার চোখে আমার মরণ দেখি!’

স্তব্ধ হয়ে গেলো রাগান্বিতা। চোখদুটো আচমকাই কেমন একটা করে উঠলো বুকটা থমকে উঠলো মুহূর্তেই। রাগান্বিতা তার ভেজা ভেজা আঁখি নিয়ে বলে,
“আপনি এভাবে কথা কেন বলেন, আমার যে খারাপ লাগে।”

ইমতিয়াজ বুকে জড়িয়ে ধরে রাগান্বিতাকে। মিষ্টি হেঁসে বলে,
“তুমি এভাবে কেঁদো না, আমি ব্যাথা পাই!”

রাগান্বিতা আর কিছু বলতে পারলো না চুপ হয়ে গেল ওখানেই। এই মানুষটা এমন কেন। অভিমানের ক্রোধে ভাসলো রাগান্বিতা! আর ইমতিয়াজ ভিতরে ভিতরে কি যে ভাবলো বোঝা গেল না।’
____________________________

“রামু! দ্রুত দরজা খোলো, তুমি এভাবে কাহিনির অর্ধেক বলে বাথরুমে যেতে পারো না। আমি কাল শেষ রাতে কখন ঘুমিয়ে গেলাম, তুমি ডাকবে না আমায়! রামু কি হলো! বের হও বলছি!”

লাগাতার রামুর বাথরুমের দরজা ধাক্কাচ্ছে আর কথাগুলো বলছে ইলিয়াস। তার মাথা ভন ভন করছে এই গল্পের শেষটা জানার জন্য মনটা অস্থিরতায় ধেয়ে আসছে তার। কালরাতে কাহিনি শুনতে শুনতে কখন যে চোখ দুটো বুজিয়ে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গিয়েছিল ইলিয়াস সেটা বুঝতে পারে নি। সকালে ঘুম ভাঙতেই রামুর বউকে ডেকে জানতে পারে রামু বাথরুমে গেছে। তাই তো ছুটে আসলো এখানে। ইলিয়াস আবারও দরজা ধাক্কালো। জোরে আওয়াজ করে বললো,
“তুমি কি বাহিরে আসবে রামু নাকি আমি দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকবো।”

এবার রামু পারুক কেঁদে ভাসিয়ে দিক। এই কোন পাগলকে সে রাগান্বিতার কাহিনি বলতে বসেছিল। তাকে শান্তি মতো বাথরুমও করতে দিবে না নাকি। রামু আরো দশমিনিটের মতো সময় নিয়ে বের হলো। একরাশ আক্রোশ নিয়ে বললো,
“আমারে কি আমনে শান্তি মতো একটু ইয়ে করবাও সময় দিবেন না ডাক্তার বাবু!’
“তোমার ইয়ে টিয়ে বাদ দেও আগে কাহিনি বলো। তোমার কাহিনির চক্করে আমার রাতে ঘুম হয়নি জানো তুমি। সকালেও তো ধড়ফড়িয়ে উঠলাম পুরো।”
“আমার কি দোষ আমনেই তো ঘুমাইয়া গেছিলেন।”

ইলিয়াস কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“ঠিক আছে ওসব বাদ দেও। এবার যদি পুরো কাহিনি না বলে কোথাও গিয়েছো তো ইনজেকশন দিয়ে আমিও তোমায় রাগান্বিতার মতো পাগল বানিয়ে দিবো।”

রামু অবাক হয়ে গেল ডাক্তার ইলিয়াসের কথা শুনে এগুলান কোনো ডাক্তারে কয়! রামু শুকনো ঢোক গিলে বললো,
“এমনে কেউ কয়?”
“তুমি বড্ড বকছো দ্রুত বলো, ইমতিয়াজ গেল কই! রাগান্বিতা কিভাবে পাগল হয়ে গেল! ওর বাবাও বা মারা গেলেন কি করে! তার থেকেও বড় কথা রাগান্বিতাকে চিঠিগুলো দিতো কে, ইমতিয়াজ নাকি অন্যকেউ! আর দাদিমার রাগান্বিতা শাপলার অলংকারের সাজ দেখে ভয় পাবার কারণটাও এখনও বলো নি তুমি! তার থেকেও বড় প্রশ্ন ইমতিয়াজ যদি কুহুকেই ভালোবাসতো তাহলে রাগান্বিতাকে বিয়ে করলো কেন?”

রামু বেশি না ভেবেই জবাব দিলো,
“কেন আবার মাহাদকে খুঁইজ্জা পাওন যাচ্ছিল না বইলা।”

চমকে আবার প্রশ্ন করলো ইলিয়াস,
“আরো একটা প্রশ্ন মাহাদকে মারলো কে? ইমতিয়াজ! যাতে রাগান্বিতাকে বিয়ে করতে পারে।”
“না। একখান কথা কি জানেন ডাক্তার বাবু এই মাহাদরে যে মারছিল হেও বাইচ্চা নাই আর!”

ইলিয়াসের মাথা ঘুরে উঠলো কথা শুনে। এত রহস্য কেন। ইলিয়াস তাড়া দিল। চেঁচিয়ে বললো,
“কাহিনি কও রামু!”

রামু ভয় পেয়ে গেল। দ্রুত হাত মুখ ধুয়ে তার ঘরের সামনের জায়গাটা দেখিয়ে বললো,
“আমনে ওইখানে যাইয়া বহেন আমি এক্ষুণি আইতাছি পুরা কাহিনি শেষ কইরাই এবার দম ফালামু আমি।”

ইলিয়াস নিজেকে শান্ত করলো। আর দেরি না করে চলে গেল রামুদের ঘরের দুয়ারের সামনে। বসলো পিড়িতে।’

রামুদের ঘর থেকে রাগান্বিতাদের সেই তালুকদার ভিলাটা দেখা যায় বছর পাচেক আগেই রামু এখানে ঘর বানিয়েছিল চাইলে জমিদার বাড়িতে থাকতে পারতো কিন্তু অজানা কোন ভয়ের কারণে থাকতে পারলো না। পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে আছে তালুকদার ভিলাটি। তালুকদার ভিলার সামনেই ছোট্ট কুঁড়েঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে রাগান্বিতাকে। এটাও পাঁচবছর আগেরই তৈরি। রাগান্বিতাকে সবাই ছেড়ে ছুঁড়ে গেলেও রামু পারে নি যেতে। রাগান্বিতার জন্যই রামু তার নিজ গ্রাম ত্যাগ করে এখানেই বউ নিয়ে থাকছে। তবে একেবারে কাছে নয় একটু দূরে। ধুলোতে জর্জরিত নিজ বাড়িটাকে জানালা দিয়ে চেয়ে দেখলো রাগান্বিতা। চোখের নিচে কালো দাগ, এলেমেলো চুল, ময়লাযুক্ত ছিঁড়ে যাওয়া পোশাক আর পায়ে শিকল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। দৃষ্টি তার ওই বাড়িটার দিকে। রাগান্বিতা এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে বাড়িটার পানে। রাগান্বিতার কাজই ওই বাড়িটার দিকে কোনো কারণ ছাড়াই ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। রাগান্বিতা বিড় বিড় করে বললো,
“তুমি কবে ফিরবে ইমতিয়াজ! আমি যে আজও তোমার অপেক্ষায় বসে। কতদিন হয়ে গেল তোমার মুখের সেই বউ বউ ডাকখানা আমি শুনি না।”

চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো রাগান্বিতার! তবে উত্তর আর মিললো না।
____________________________
১৯৮১ সালে! বড় সেই বিশাল গাছটায় এখনো পাশাপাশি বসে রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা এখনো মন খারাপ করে ইমতিয়াজের বুকে মাথা দিয়ে বসে আছে। ইমতিয়াজ নড়েচড়ে উঠলো। বললো,
“আর কত মন খারাপ করবে বউ, আমি তো তোমার পাশেই বসে!’

রাগান্বিতা ইমতিয়াজের বুক থেকে মাথাটা ওঠালো। বললো,
“আপনি একটা বদমাশ লোক!”

ইমতিয়াজ হেঁসে জবাব দেয়,
“জানি তো!”

আক্রোশে ফেটে বলে রাগান্বিতা,
“না জানেন না।”

আবারও হাসে ইমতিয়াজ। বলে,
“ঠিক আছে। এবার ওঠো জলদি সকাল থেকে কিছু খেয়েছো দেখে তো মনে হচ্ছে না। চলো দ্রুত কিছু খেয়ে নিবে,

উঠে দাঁড়ালো রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। দুজনই চললো তালুকদার ভিলার উদ্দেশ্যে। ইমতিয়াজ যেতে যেতে বললো আবার,
“কথায় কথায় শুধু এভাবে রাগ দেখালে কিন্তু হবে না বউ। মাঝে মাঝে ভালোও বাসতে হবে।”
“মাঝে মাঝে কেন, আমি তো আপনায় রোজই ভালোবাসি।”

ইমতিয়াজ মিষ্টি একটা হাসি দিলো, রাগান্বিতার গাল টিপে বললো,
“তুমি একটা পাগল বউ,

কপাল কুঁচকে জবাব দিলো রাগান্বিতা,
“আপনি করেছেন, আমার কোনো দোষ নেই।”

ইমতিয়াজ চুপ হয়ে গেল। সে বুঝেছে আজ রাগান্বিতা বেশ ক্ষেপেছে তার একটা কথাও মাটিতে ফেলতে দিবে না। তার আগেই উত্তর হাজির!’

#চলবে…..

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-২৫
________________
কড়া রোদ্দুরে আচ্ছন্ন চারপাশ। ইমতিয়াজ বাড়ি নেই মোকলেসের সাথে দেখা করতে গেছে। রন্ধনশালায় রান্না করছে রাগান্বিতা আর দাদিমা। রাগান্বিতার মাথায় কিছু প্রশ্ন ঘুরছে সে চাইছে দাদিমাকে বলতে। সে কুহুর বিষয় নিয়েই কিছু বলবে কিন্তু দাদিমা আধও কিছু বলবে কি না জানে না রাগান্বিতা৷ দাদিমার সেদিনকার তার সাজ দেখে তার ওপর রেগে যাওয়া আর ভয় পাওয়ার বিষয়টা এখনো প্রায়সই মাথায় ঘোরে। রাগান্বিতার মনে হচ্ছে আজ দাদিমাকে জিজ্ঞেস করলে সে নিশ্চয়ই কিছু বলবে। অনেক ভেবে রাগান্বিতা সিদ্ধান্ত নিলো প্রশ্নটি সে করবেই। রাগান্বিতা প্রশ্নটি করবে এরই মাঝে দাদিমা বলে উঠলেন,
“জানো রাগান্বিতা তুমি যাওনের পর একখান ঘটনা ঘটছে।”

রাগান্বিতা নিজের প্রশ্নটি ধামাচাপা দিল। নরম কণ্ঠে বললো,
“কি ঘটনা?”
“মাহাদরে কেডা জানি মাইরা ফেলছে। তুমি যাওনের দিনই রাত্তির বেলা মুজিবর গো বাড়ির পিছনের ডোবায় মাহাদের লাশখানা ভাইসয়া উঠছিল। কি যে মায়া লাগজিল রাগান্বিতা তুমারে বুঝবার পারমু না। কে যে করলো! কে জানে!

রাগান্বিতা স্তব্ধ স্বরে বললো,
“পুলিশ আসে নি।”
“আইছিল মাহাদ নাকি হাতার(সাঁতার) জানতো না হের লাইগ্যা বেশি আগায় নায়।”
“কিন্তু মুজিবর চাচাদের ডোবায় তো পানি কম থাকে পড়লে মরে যাওয়ার কথা তো নয়।”
“ওইদিন নাকি বেশি আছিল।”

রাগান্বিতা চুপ রইলো তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে! মাহাদ নিখোঁজ হওয়ার পর তার সাথে ইমতিয়াজের বিয়ে হওয়াতে তার খুব আনন্দ হয়েছিল। কিন্তু মাহাদের মৃত্যু সে ভাবে নি। রাগান্বিতা নিশ্চুপে ‘আমি একটু আসছি’ বলে বাড়ি থেকে বের হলো। একটু হাঁটতেই দেখা মিললো ইমতিয়াজের তার দিকেই এগিয়ে আসছে। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার সামনে দাঁড়াতেই রাগান্বিতা থমথমে গলায় বললো,
“জানেন মাহাদ আর নেই কে যেন মেরে ফেলেছে।”

ইমতিয়াজ থতমত খেয়ে গেল। বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“কে মারলো?”

রাগান্বিতা জবাব দেয় না তার মনে হচ্ছে তার জন্যই মাহাদকে কেউ মেরে দিয়েছে। রাগান্বিতা ছলছল দৃষ্টি নিয়ে ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার জন্যই মারা গেছে মাহাদ।”

ইমতিয়াজ আশেপাশে তাকালো। না কেউ নেই। সে রাগান্বিতার হাত ধরলো। নিশ্চুপ স্বরে বললো,
“এসব তুমি কি বলছো?”

হঠাৎই কেঁদে উঠলো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ চমকে উঠলো রাগান্বিতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আমার সাথে চলো।”
“আমি মাহাদের খুনি।”

রাগান্বিতার মুখ চেপে ধরলো ইমতিয়াজ। বললো,
“হুস,চুপ! একটাও কথা না।’

রাগান্বিতা চুপ হয়ে গেল তার মাথা ভনভন করছে বার বার নিজেকেই মাহাদের খুনি মনে হচ্ছে। তাকে যদি মাহাদ বিয়ে করতে না আসতো তাহলে হয়তো মাহাদ আজ বেঁচে থাকতো। তার জন্য মাহাদের জীবনটা এভাবে নষ্ট হয়ে গেল। ভাবলেই বুক চিঁড়ে কান্না আসছে রাগান্বিতার।’

নদীর ঘাটে ঢেউ চলছে প্রবল। ইমতিয়াজ রাগান্বিতাকে নিয়ে নদীর ঘাটে এসেছে। আশপাশে জনশূন্যহীন কেউ নেই। দূরদূরান্তে শুধু ট্রলার আর নৌকা যাওয়া দেখা যায়। নদীর ঘাটের ডানদিকটায় মাটির একটা সরু রাস্তা যায়। দুই পাশে সারি সারি তালগাছ। যার একপাশে নদী আর অন্যপাশে মাঠ। মাঠের ওপার মুন্না মিয়াদের বাড়ি। নদীর দিকের তালগাছের সারির আগে রয়েছে এক বিশাল বড় রেন্টিগাছ। সেই রেন্টি গাছের নিচে পাশাপাশি বসে আছে রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা এখনো ফোঁপাচ্ছে। ইমতিয়াজ এবার বিরক্ত নিয়ে ধমক দিলো। বললো,
“এভাবে কাঁদতে থাকলে মানুষ তো ভাববে আমি তোমায় মেরেছি। তারপর লোকে নারী নির্যাতনে আমাকে জেলে দিক।”

রাগান্বিতা তাও নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হলো। আরও কতক্ষণ ফোপালো। ধীরে ধীরে পরিবেশ হলো শান্ত। কারো মুখে কোনো কথা নেই। ইমতিয়াজ এবার পরিস্থিতি বুঝে নরম কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,“এবার বলো কি হয়েছে?”

রাগান্বিতা নির্জীব। চুপচাপ। মুখে কোনো কথা নেই। ইমতিয়াজ আবার প্রশ্ন করলো,“তুমি কি কিছু বলবে?”

রাগান্বিতা এবার মুখ খুললো। বললো,“আমার কাছে প্রায়সই কারো লেখা চিঠি আসে সে নিজেকে নিষ্ঠুর বলে দাবি। বিয়ের আগে আমি অনেকগুলো চিঠি পেয়েছি। চিঠির জন্যই সেদিন গ্রামের সব শিক্ষিত ছেলেদের ডাকি তাদের হাতের লেখা দেখি আপনাকেও তো ডাকা হয়েছিল।”

ইমতিয়াজ শুনলো,কিছু ভাবলো। বললো,
“তারপর।”
“কিন্তু কারো সাথে ওই চিঠির হাতের লেখা মিলে নি।”

ইমতিয়াজের মাঝে তেমন কোনো হেলদোল দেখা গেল না। সে স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করলো,
“এতে মাহাদের খুনের কি সম্পর্ক?”
“আপনি বুঝতে পারছেন না আমার মনে হচ্ছে ওই চিঠি দাতাই মাহাদকে মেরেছে।”
“নাও হতে পারে।”

রাগান্বিতা নিজেকে ধাতস্থ করলো। চোখের পানিটুকু মুছে বললো,
“মানে?”
“মানেটা খুব সোজা হতেই পারে অন্যকেউ মেরেছে।”
“আপনি বুঝছেন না চিঠির লেখাগুলো খুব ধারালো ছিল।”
“আমার মনে হয় না চিঠিদাতা এমন কিছু করবে।”
“আপনি এতটা নিশ্চিত কি করে হচ্ছেন?”
“আমি নিশ্চিত নই মনে হলো তাই বললাম।”

রাগান্বিতা কিছু বলে না সে ভেবেছিল চিঠির কথাগুলো ইমতিয়াজকে বললে ইমতিয়াজ তাকে কটু কথা শোনাবে কিন্তু ইমতিয়াজ এমন কিছুই করলো না। কিন্তু কেন? রাগান্বিতার ভাবনাটা বুঝি ইমতিয়াজ বুঝলো। সে বললো,
“আমি সেদিনই আঁচ করতে পেরেছিলাম কেউ তোমার নামে প্রেমপত্র দিচ্ছে। আর তুমি তাকে খুজচ্ছো। এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। তুমি সুন্দরী, তোমাকে হাজার ছেলে চাইবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এখন তুমি বিবাহিত। আমার মনে হয় না তোমার নামে আর কোনো চিঠি আসবে আর যদি আসে আমায় বলবে আমি এর ব্যবস্থা নিবো।”

রাগান্বিতা নিখুঁত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ইমতিয়াজের মুখের দিকে। বিয়ের পর আর একটাই চিঠি এসেছিল রাগান্বিতার কাছে রাগান্বিতা কথাটি চেপে গেল কিন্তু ভাবলো পরে আর কোনো চিঠি আসলে সে চেপে যাবে না চিঠি সমেত দেখাবে। রাগান্বিতা আশেপাশে তাকালো। না কেউ নেই, সে আচমকাই ইমতিয়াজের গালে চুমু খেল। মিষ্টি হেঁসে বললো, “আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ স্বামী।”

ইমতিয়াজ আকস্মিক কান্ডে কিছুটা চমকে উঠলো। নিজেকে ধাতস্থ করলো, তবে কিছু বললো না। মেয়েটাকে যত দেখে তত অবাক হয় ইমতিয়াজ,“মেয়েটা তাকে এত ভালোবাসে কেন?”

কিছু সময় যেতেই মোকলেসের হাক শোনা গেল নদীর পাড়ে রঙিন নৌকা নিয়ে ঘুরছে। মোকলেস এগিয়ে আসলো ইমতিয়াজকে দেখে বললো,
“ভাই আমনে এহানে কি করেন?” রাগান্বিতা আপাও দি আছে।”

ইমতিয়াজ, রাগান্বিতা একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলো মোকলেসকে কি বলবে উত্তর খুঁজে পায় না। ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“তোর জন্যই বসে ছিলাম।”

মোকলেস অবাক হলো। বললো,
“আমার জন্যে,
“হ তোর নৌকায় চড়বো।”

মোকলেস কথা বাড়ালো না নৌকাটাকে ইমতিয়াজদের অনেকটা কাছে নিয়ে এসে বললো,
“হাচা(সত্যি) উডবেন ভাই। এহন তো ঠাডা পড়া রোদ্দুর।”
“তাতে কি নদীতে হাওয়া নেই।”
“তা একটু আছে,
“তাইলে আবার কি চল। রাগান্বিতা উঠো!’

রাগান্বিতা বিনা বাক্যে উঠে দাঁড়ালো। ইমতিয়াজের হাত ধরেই সে নৌকায় চড়ে বসলো। দুজন একসাথে অনেকটা সময় পার করলো। মোকলেস নৌকা চালাতে চালাতে শাপলার বিলে চলে আসলো। তবে আজ শাপলা নেই। কিছু লতা ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। ইমতিয়াজ বললো,
“আজ শাপলা থাকলে তোমায় আবার সাজাতাম বউ?”

রাগান্বিতার মুখটা খানিকটা কালো হয়ে গেল। সে খুশি হতে চেয়েও খুশি হতে পারলো না। ইমতিয়াজ প্রশ্ন করলো,“কি হলো?”

রাগান্বিতা মাথা নিচু করে জবাব দিলো,
“দাদিমা শাপলাফুল দিয়ে সাজতে বারণ করেছেন।”

ইমতিয়াজ খানিকটা ভড়কালো। প্রশ্ন ছুড়লো আবার,
“কেন?”
“জানি না। আপনি সেদিন যখন শাপলা দিয়ে সাজিয়েছিলেন দাদিমা তা দেখেন। খুব অদ্ভুত আচরণ করেন! কি নিয়ে যেন ভয় পেয়েছিলেন খুব। সাথে আমায় বারণ করেছেন আমি যেন আর শাপলা দিয়ে না সাজি।”

ইমতিয়াজ কিছু বললো কি যেন ভাবলো রাগান্বিতা প্রশ্ন করলো,“কি ভাবছেন।”

ইমতিয়াজ তাকালো নদীর দিকে শুঁকনো মুখে জবাব দিলো,
“ফুলের সাথে কিসের ভয়?”
“পোকামাকড়ের কথা বলেছিলেন।”

ইমতিয়াজ আর ভাবলো না এতটুকু বললো শুধু,“ওহ আচ্ছা।”
—-
রাতের খাবার সেরে দাদিমার কক্ষে ঢুকলো রাগান্বিতা। দাদিমা তখন পালঙ্কের চাদর ঠিক করছিলেন। রাগান্বিতার উপস্থিতি টের পেতেই দাদিমা প্রশ্ন করলেন,
“কিছু কইবা রাগান্বিতা?”

রাগান্বিতা এগিয়ে আসলো। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জোরালো কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,“আমি সব জানতে চাই দাদিমা।”

দাদিমা হতভম্ব হয়ে গেলেন। কাঁপা কাঁপা স্বরে বললেন,
“কি জানবার চাও?”
“এই যে তুমি সেদিন আমার শাপলার সাজ দেখে কেন ঘাবড়ে গিয়েছিলে?”

দাদিমা থমকে হাসলেন। বললেন,
“হেদিনই(সেদিনই) তো কই ছিলাম শাপলা ফুলে পোকামাকড় থাহে।”
“তুমি মিথ্যে বলো না। আমি কিন্তু সবটা জেনেই ছাড়বো। আমার মন বলছে তুমি কুহু আপার বিষয়েও কিছু জানো।”

এবার যেন আরো ঘাবড়ে গেলেন দাদিমা। কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। রাগান্বিতা ক্ষিপ্ত মেজাজ। সে আজ জেনেই ছাড়বে। রাগান্বিতা দাদিমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমায় সব বলো।”

দাদিমা শাড়ির আঁচল চেপে কাঁদলেন। রাগান্বিতার বুকটা হঠাৎই কেঁপে উঠলো। সে দাদিমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“তুমি কাঁদছো কেন দাদিমা?”

দাদিমা চুপ রইলেন। রাগান্বিতা দাদিমাকে নিয়ে জানালার পাশে বসলো। জানালার কপাট খুলতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার পরিবেশটা নজরে আসলো প্রথম। তারপর আকাশের চাঁদখানা দেখা গেল। রাগান্বিতা কিছু বললো না দাদিমা অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“কুহুরে কেউ মারে নাই রাগান্বিতা। কুহু তোর আব্বার মুখে চুনকালি মাখাইয়া মইরা গেছে। নিজেই নিজের পাপ ধুইতে বিষ খাইছে।”

রাগান্বিতার চোখ থমথমে, গলায় কণ্ঠস্বর গেল থেমে। আপা বাবার মুখে চুনকালি দিয়েছে। রাগান্বিতা থমথমে গলাতেই বললো,
“আপা কি করছিল?”

মুখে আঁচল চেপে বললো দাদিমা,
“কুহু পোয়াতি আছিল।”

থমকে গেল রাগান্বিতা। পায়ের মাটিটা বুঝি সরে যাচ্ছিল এক মুহূর্তের জন্য। কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বের হলো। সে স্তব্ধ! তার আপা বিয়ের আগে, না না! রাগান্বিতার বিশ্বাস হলো না তার আপা কলঙ্কিত নয়! কিছুতেই এটা হতে পারে না। দাদিমা মিথ্যে বলছে। তার আপা পবিত্র ছিল। মৃত বলে কি যা খুশি তাই শুনে নিয়ে বিশ্বাস করে নিবে রাগান্বিতা!

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ!]

#TanjiL_Mim♥️

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-২২+২৩

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-২২
________________
হাসিমাখা মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে রাগান্বিতা ইমতিয়াজের মুখের দিকে। তার যেন বিশ্বাসই হলো না কাল তারা রেশবপুরে যাবে শুনে। রাগান্বিতা ছলছল দৃষ্টি নিয়ে ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনি সত্যি বলছেন আমরা কাল রেশবপুরে যাবো?”

ইমতিয়াজ রাগান্বিতার মাথায় হাত বুলালো শীতল সুরে সুধালো,
“হুম। বউয়ের কষ্টে বুক ফাঁটে বউ!’’

রাগান্বিতা যেন খুশি হলো টুক করে ইমতিয়াজের গালে ঠোঁট ছুঁয়ে বললো,
“আপনি খুব ভালো ইমতিয়াজ।”

ইমতিয়াজ মিষ্টি হেঁসে জবাব দেয়,
“আর তুমি মায়াবী!’
“আপনি আমার ঠোঁটের হাসি।”
“তুমি তো নিষ্ঠুর নও কি করে বলবো তোমায় ভালোবাসি।”
“চোখের পলকে, হাসির ঝলকে অথবা চিঠির ভীড়ে আপনি বলে দিয়েন আমি বুঝে নেবো।”
“তুমি চিঠি ভালোবাসো বউ?”
“উম! চিঠি নয় প্রেমপত্র!’

লাজুক স্বরে বললো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ হাসলো বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“কোনো একদিন তোমার নামের বিশাল প্রেমপত্র পাঠাবো বউ তুমি পড়ে নিও।”
“কত শব্দের দিবেন?”
“তুমি কত শব্দের চাও বলো,
“কথা যেন না ফুড়ায় শেষ হয়েও যেন শেষ না হয় এমন প্রেমপত্র দিয়েন। শব্দ আপনি গুছিয়ে নিয়েন।”
“ঠিক আছে। এখন ঘুমাও রাত কিন্তু কম হয় নি।”

চোখ বুঝে ফেলে রাগান্বিতা। বলে,
“আপনিও ঘুমান।”
“হুম ঘুমাচ্ছি তুমি আগে ঘুমাও,

রাগান্বিতা শুনলো চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করলো মুহুর্তেই। ইমতিয়াজ মাথায় হাত বুলাতে লাগলো তার। রাগান্বিতা সুখের সাগরে যেন ভাসলো। লোকটা বড্ড বেশিই যত্ন নেয় তার।

রাতের আকাশে পাড়ি জমানো চাঁদটা তখন উঁকি মারছিল ঘরে। ইমতিয়াজ তাকালো রাগান্বিতার মুখশ্রীর দিকে। বিড়বিড় করে বললো,
“এমন মায়াবী মুখখানার ধ্বংস করি কেমন করে!”

অনেকক্ষণ যেতেই, রাগান্বিতা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ইমতিয়াজ আস্তে আস্তে শোয়া থেকে উঠে বসলো। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে রইলো আরো কতক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে নিজের কক্ষ থেকে বের হলো লম্বা কপাটটা দিল আস্তে করে বন্ধ করে। ইমতিয়াজ নিজ কক্ষ থেকে বেরিয়ে এগিয়ে যায় তালাবদ্ধ সেই রুমটার দিকে। চাবিটা পাশেই পায়ের কাছে থাকা একটা বড় টবের নিচে রাখা ছিল। ইমতিয়াজ তালা খুলে ভিতরে ঢুকলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজ করছিল কক্ষটাতে। ইমতিয়াজ তালাবদ্ধ কক্ষটা ভিতর থেকে আঁটকে চললো একদম সোজা। সাঁতরে দেশলাই বের করে ল্যাম জ্বালালো। ল্যামটা রাখলো সামনের টেবিলটার কাছে। চেয়ার পেতে বসলো সামনে। রুমটা ঘুটঘুটে অন্ধকারে আবদ্ধ থাকায় তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। চারপাশ অন্ধকার মাঝখানে শুধু একটা টেবিলের উপর ছোট্ট ল্যাম জ্বালানো। ইমতিয়াজ নিজের দু’গাল চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে বসে রইলো অনেকক্ষণ। নিশ্বাস ফেললো জোরে। চোখ খুলে একটা খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে চিরকুট বানালো। হাতের বলপেন নিয়ে লিখতে শুরু করলো কিছু। সে লিখলো,
“আমি ধ্বংস, কিন্তু সে আমাতেই মুগ্ধ!
“আমি ভয়ংকর, সে শীতল।”
“আমি খুনি, সে নিরপরাধ।”
“আমি যে প্রতিহিংসার আগুনে গড়া এক নিষ্ঠুর পাপী, সে কেন বুঝচ্ছে না এমন পাপী মানুষদের কখনো ভালোবাসতে নেই, কখনোই না।”

কথাগুলো লিখেই চিরকুট ভাজ করলো। সযত্নে রাখলো টেবিলের পাশেই থাকা ছোট্ট একটা ঝুলির মধ্যে। সেখানে আরো কতগুলো এমন চিরকুট লেখা ছিল। ইমতিয়াজ সেই চিরকুটগুলোতে হাত বুলিয়ে আবার কিছু লিখতে শুরু করলো। লেখা শেষ হতেই ল্যাম হাতে এগিয়ে যায় রুমের ডানদিকটায় যেখানে বিশাল একটা জানালা আছে। ইমতিয়াজ জানালাটা খুলে দিতেই বাহিরের বাতাস এসে ছুঁয়ে দিল তারে, নিভিয়ে দিতে নিলো তার হাতের ল্যামটাকে। কিন্তু নিভলো না ইমতিয়াজ হাত দিয়ে আটকালো তাহারে। কতক্ষণ পের হতেই হঠাৎ কোথা থেকে যেন উড়ে আসলো ইমতিয়াজের সেই কবুতরটা। ইমতিয়াজ খাবার খাওয়ালো তাকে। তারপর সেকেন্ড চিরকুটটা বেঁধে দিলো কবুতরের পায়ে। বিড়বিড়িয়ে কি যেন বললো! কবুতর চলে গেল। ইমতিয়াজ তার পানে চেয়ে রইলো বহুক্ষণ!’
—-
পরেরদিন,
বেশ সকাল সকালই রাগান্বিতার বাবা জানতে পারলেন আজ নাকি তার মেয়ে জামাইরা আসবে। কথাটা শোনা মাত্রই তিনি ছুটে যান দাদিমার ঘরে। মানুষটা রাগান্বিতার শোকে অনেকটা অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। রাগান্বিতা আসবে শুনেই সে যেন সতেজ হলেন, রান্নাবান্নার কাজে হাত ছোঁয়ালেন। খবরটা দিয়ে গেছে মোকলেস,, বলেছে সকালে নাকি তার কাছে একটা কবুতর এসে একটা চিঠি দিয়ে গেছে। রাগান্বিতার বাবার হাতেই চিঠিটা দিয়েছিল মোকলেস। সেখানে ইমতিয়াজ লিখেছিলো,
আসসালামু আলাইকুম জমিদার সাহেব। আশা করি আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন। আমরা আগামীকাল বৃহঃস্পতিবার আসছি, দাদিমাকে আমার সালাম জানাবেন সঙ্গে বলবেন ভালো ভালো রান্না করে রাখতে তার রাগান্বিতা আসছে।

ইতি
ইমতিয়াজ!’

রাগান্বিতার বাবা প্রচন্ড খুশি হয়েছেন অবশেষে তার প্রাণপ্রিয় কন্যা তার দুয়ারে পা রাখবে। চিঠিতে আগামীকাল থাকলেও বৃহস্পতিবার আজকে। তবে চিঠি লেখার তারিখ অনুয়ায়ী হয় কালকে।”

‘বাবা’ হঠাৎই রেজওয়ানের ডাক শুনে পিছন ঘুরলেন মোতালেব তালুকদার। তাকে ঘুরতে দেখেই রেজওয়ান প্রশ্ন করলো,
“বাড়িতে হঠাৎ কিসের তোড়জোড় শুরু হলো বাবা?”
“রাগান্বিতা আসবে আজকে!’

বাবার কথা শুনে চোখে মুখে হাসির রেখা ফুটলো রেজওয়ানের। উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
“সত্যি বাবা।”
“হুম ইমতিয়াজ বার্তা পাঠিয়ে ছিল।”
“আমি তবে বাজার থেকে ওর জন্য ভালো ভালো খাবার, ফলমূল নিয়ে আসি বাবা?”
“হুম যাও সঙ্গে করে মিষ্টি আনতে ভুলো না কিন্তু।”
“আচ্ছা বাবা।”

বলেই বেরিয়ে পড়লো রেজওয়ান। রেজওয়ান শহরে গিয়ে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে সব নিয়ে চলে এসেছে। আজ চারদিন হয়েছে এসেছে। একবার ভেবেছিল বোনের কাছে যাবে একবার কিন্তু পরে আবার কি ভেবে যেন যায় নি।
—–
এবারের যাত্রাপথের মাধ্যম হিসেবে ইমতিয়াজ ট্রেনটাকে বেছে নিয়েছে। তার ইচ্ছে সন্ধ্যার মধ্যেই রেশবপুরে পৌঁছানো। তাই সকাল সকালই বেরিয়ে পড়েছে। এদিকটা থেকে বের হতেই বড় বিপাকে পড়তে হয় ওদের যেমন লেগেছে সময় তেমন ক্লান্তিকর পরিশ্রম। ঢাকার শহরের যাত্রাপথ বড্ডই কঠিন লাগে রাগান্বিতার। এত মানুষ আশেপাশে থাকে। গ্রামের যাত্রাপথ যেন এর চেয়ে সোজা। বগির সিটে বোরকা পরিধিত বসে আছে রাগান্বিতা। আর তার পাশেই ইমতিয়াজ। প্রকৃতির মুগ্ধ করা বাতাস তাদের ছুঁয়ে দিচ্ছে বারংবার। রাগান্বিতা চেয়ে চেয়ে শুধু পথগুলো দেখলো কি সুন্দর এই দেশখানা। মাঠে মাঠে গরু -মহিষ, উঁচু উঁচু গাছ সঙ্গে নীল আকাশ।

সময় গড়ালো ওরা ট্রেন ছেড়ে নৌকায় উঠলো। নদীতে জোয়ার ভাটার উপদ্রব থাকায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা লাগলো। বেশ কয়েকঘন্টা নদীতেও কাটানো হলো তাদের আসার পথে দু’দিনের খাবার নিয়ে এসেছিল তারা যদি কোনোভাবে নৌকার বেড়া জ্বালে আঁটকে পড়ে তখন। প্রথম জোয়ার ভাটার তান্ডব দেখে রাগান্বিতা তাই ভেবেছিল আজ তারা বাড়ি যেতে পারবে না। কিন্তু পারলো! ওরা যখন রেশবপুরের নদীর ঘাটে এসে পৌঁছালো তখন বিকেল প্রায়। ইমতিয়াজ দ্রুত মাঝির পাওনা মিটিয়ে চললো এগিয়ে। এবার লাস্ট বাহন তাদের গরুর বা মহিষের গাড়ি। যেটা সরাসরি রাগান্বিতাদের বাড়ির সামনে নিয়ে যাবে। ইমতিয়াজ অনেক খুঁজে একটা বড়সড় মহিষের গাড়ি ভাড়া করলো। রাগান্বিতাও উঠে বসলো। চোখ বেয়ে যেন তার অশ্রু গড়ালো কতদিন পর নিজ জন্মস্থানের হাওয়ার গন্ধ পেল। রাগান্বিতা চুপটি করে বসে রইলো, আর গাড়ির পিছন দিকটার এদিকটাতেই ইমতিয়াজ বসা। গ্রামের প্রকৃতির দিকে চোখ বুলাচ্ছিল সে। সঙ্গে হঠাৎই বিড়বিড় করে বললো,

এ সেই গ্রাম, যে গ্রাম আমায় নিঃস্ব করেছে,
শেষ সর্বস্ব হারিয়ে করে দিয়েছে ফকির।”

পরমুহূর্তেই রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে আবারো ধীর স্বরে বললো ইমতিয়াজ,

আবার এই গ্রামই সঙ্গে দিয়েছে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসার এক রমনী, সে রমনী পাষাণ মন গলাতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। একটু একটু করে ভরিয়ে দিচ্ছে সব। তবুও কভু কি পারবে পুরোপুরি সবটা ঘোচাতে, খামতি কমিয়ে নতুন প্রেমের সূচনায় মোড়াতে!’
—-

সদর দরজার সামনে পায়চারি করছে রাগান্বিতার বাবা। মন, চোখ-মুখে যেন বড্ড অস্থিরতার ভাব। মেয়েটাকে একটুখানি দেখার জন্য বড্ড ব্যাকুল বাবা। কখন যে আসবে কে জানে!” হঠাৎই বাড়ির সামনে এসে একটা মহিষ গাড়ি থামলো। রাগান্বিতার বাবা ছুট্টে এগিয়ে গেলেন,,

#চলবে…..

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-২৩
________________
বাবাকে দেখেই মহিষের গাড়ি থেকে নেমে ছুট্টে এগিয়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো রাগান্বিতা। রাগান্বিতার বাবা মৃদু হাসলেন। চোখের পানি আসলেও মুছে নিলেন নিমিষেই। মিষ্টি সুরে সুধালেন,
“কেমন আছো মা? কতদিন পর তোমারে দেখলাম।”

রাগান্বিতা চোখে পানি রেখেই বললো,
“ভালো বাবা। তুমি কেমন আছো?”
“আমিও ভালো আছি।”

রাগান্বিতা তার বাবাকে ছাড়লেন। ইমতিয়াজ এগিয়ে এসে মোতালেব তালুকদারের পা ছুঁতে নিলেই হাত দুটো ধরে উঠিয়ে নিলেন। ইমতিয়াজকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“পায়ের হাত দেয়ার দরকার নেই ইমতিয়াজ, তুমি তো শুধু আমার মেয়ের জামাই নও আমার ছেলেও।”

রাগান্বিতার বাবার কথা শুনে তেমন কোনো রিয়েকশন দিলো না ইমতিয়াজ। শুঁকনো হেঁসে বললো,
“ভালো আছেন তো আগের চেয়ে শুঁকনো দেখাচ্ছে।”

রাগান্বিতার বাবা মুখে হাসি রেখেই উত্তর দিলেন। বললেন,
“ওসব কিছু না। বয়স বাড়ছে আর কত তরতাজা থাকবো। চলো ভিতরে চলো,

এই বলে রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজকে ভিতরে নিয়ে গেলেন রাগান্বিতার বাবা। সর্বপ্রথমই দেখা মিললো রেজওয়ানের সাথে রাগান্বিতা তার ভাইকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“কেমন আছো দাদাভাই কতদিন পর তোমায় দেখলাম?”

রেজওয়ান হাসলো,খুশি মনে রাগান্বিতাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
“ভালোই আছি। তুই কেমন আছিস?”
“ভালো দাদাভাই।”

রাগান্বিতার উত্তর শুনে রেজওয়ান তাকালো ইমতিয়াজের দিকে। বললো,
“কেমন আছো আমার বোনটা তোমায় জ্বালাচ্ছে না তো?”

ইমতিয়াজ হেঁসে জবাব দিলো,
“না আপনার বোন খুবই ভালো। আমার বড্ড খেয়াল রাখে।”

ইমতিয়াজের কথা শুনে শুধু হাসে রেজওয়ান আর কিছু বলে না। ওরা ভিতরে চলে যায়।
——
রাগান্বিতার কক্ষে দাঁড়িয়ে আছে ইমতিয়াজ। পুরো কক্ষটায় চোখ বুলাচ্ছে সে। রাগান্বিতা নিচে আছে, দাদিমার কাছে গেছে। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার কক্ষের আয়নার দিকে তাকালো বার কয়েক নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে পলক ফেলে বিড় বিড় করে বললো শুধু,
“কুহু কি এই আয়নাতেই নিজের মুখশ্রী দেখতো! হবে হয়তো!”

ইমতিয়াজ আয়না থেকে সরলো চলে গেল সামনের জানালাটার দিকে। পর্দাটা সরালো আগে সঙ্গে সঙ্গে শেষ বিকেলের শীতল বাতাস এসে ছুয়ে দিলো তাকে। বাতাসের ছোঁয়ায় চোখ বন্ধ করলো ইমতিয়াজ। হঠাৎই চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার,
“একটা নিথর দেহ, তার পানে ছলছল চোখ নিয়ে অপরাধী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইমতিয়াজ স্তব্ধ হয়ে ছুট্টে এসে লুটিয়ে পড়লো নিথর দেহটার সামনে। চারপাশটা যেন এক নিমিষেই ধ্বংস হয়ে গেল। ভিতর থেকে ধ্বংস হলো ইমতিয়াজ। তখনই কে যেন যেন কানের পাশে ঝনঝন শব্দে বললো,
“প্রতিশোধ চাই, প্রতিশোধ চাই ইমতিয়াজ। এক ধ্বংসে সবটার ধ্বংস চাই।”

“এই যে শুনছেন?”

আচমকাই রাগান্বিতার ভয়েসটা কানে বাজতেই হকচকিয়ে উঠলো ইমতিয়াজ। তার চোখ দুটো তখন ধারণ করেছিল লাল বর্ণ, প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে উঠছিল শরীর। দু’হাতের মুঠো করছিল শক্ত। নিজেকে সামলাতে সে হচ্ছিল ব্যর্থ।

রাগান্বিতা এগিয়ে আসলো পিছন থেকে কাঁধে হাত রাখলো ইমতিয়াজের। রাগান্বিতার হাতের স্পর্শ পেতেই পুনরায় চোখ বন্ধ করে নিলো ইমতিয়াজ। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে লাগলো মুহূর্তেই। রাগান্বিতা কি যেন ভাবলো হুট করেই পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো ইমতিয়াজকে। শীতল সুরে বললো,
“আর কতক্ষণ পিছন ঘুরে থাকবেন, এবার তো আমার পানে তাকান আমি যে অধিক আগ্রহে আপনার অপেক্ষায় বসে।”

জবাব আসলো না। ধীরে ধীরে ইমতিয়াজ শান্ত হলো। মুঠো করে থাকা হাতটা ঢিলে হয়ে গেল। সে চাইলো, মুচকি হেঁসে পিছন ঘুরলো। জড়িয়ে বুকে আনলো রাগান্বিতাকে। অভিমানী সুরে বললো,
“তুমি আমার অভিমান বুঝো না বউ?”

রাগান্বিতার অবাক স্বরে বললো,
“মানে।”
“ইমতিয়াজ কি কোনোদিন তোমার মানের জবাব দিয়েছে যে আজ দিবে।”
“কিন্তু না বললে বুঝবো কেমন করে?”

রাগান্বিতার থুতনী ধরে মাথাটা উঁচু করলো ইমতিয়াজ। চোখে রাখলো চোখ, ঠোঁটের অতি নিকটে এসে শীতল সুরে সুধালো,
“আমার চোখের ভাষা না বুঝলে তুমি আমায় কি করে বুঝবে বউ?”

দ্রুততার সঙ্গেই রাগান্বিতার জবাব,
“আমি আপনায় বুঝি! এই যে মাত্র আপনি জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছিলেন কোনো কথা ভেবে দুঃখ পাচ্ছিলেন, আপনার রাগ হচ্ছিল,হাতের মুঠো শক্ত করে নিজের রাগ দমালেন এগুলোর সবটাই আমি বুঝি ইমতিয়াজ।”

মুহূর্তের মধ্যে ইমতিয়াজ থমকে গেল ছিটকে পিছন সরে আসলো দু’কদম। বললো,
“তুমি মিথ্যে বলছো!”

রাগান্বিতা উচ্চস্বরে হেঁসে ফেলে। নিরদ্বিধায় বলে,
“জানি তো। ওটা তো আপনায় চমকানোর জন্য বলেছিলাম।”

ইমতিয়াজের বিশ্বাস হলো না সে আবার প্রশ্ন করলো। বললো,
“তুমি সত্যি বলছো?”
“তা নয় তো কি! আর তাছাড়া আচমকাই আপনার রাগ আসবে কেন?”
“রাগ তো আমার আসছিল।”
“কেন?”

ইমতিয়াজের শীতল চাহনী!
“তুমি কক্ষে আসতে এত দেরি কেন করছিলে বউ?”

রাগান্বিতা লাজুক হাসলো। এতক্ষণে বুঝলো ইমতিয়াজ কেন তার ওপর অভিমান আর রাগ করছিল। রাগান্বিতা মিষ্টি হেঁসে বললো,
“আমাকে খুব ভালোবাসেন ইমতিয়াজ সাহেব?”

বুকের কোথাও এসে যেন কথাটা বারি খেল ইমতিয়াজের। সে উত্তর দিতে পারলো না। আবার চুপও থাকলো না। রাগ নিয়ে বললো,
“তোমায় বলবো না।”

আবার হাসে রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বলে,
“একদম হাসবে না বউ,তুমি হাসলে আমার অসুখ অসুখ লাগে।”

রাগান্বিতা হাসি থামিয়ে দেয়। বলে,
“অনেক হয়েছে এবার চলুন আমি শরবত আর কিছু শুঁকনো খাবার নিয়ে এসেছি।”

বলেই ইমতিয়াজের হাত ধরে পালঙ্কের কাছে নিয়ে গেল রাগান্বিতা। খাবার দেখিয়ে বললো,
“দাদিমা পাঠালেন খেয়ে নিন।”

ইমতিয়াজ একবার রাগান্বিতার মুখশ্রী আর আরেকবার খাবারের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি খেয়েছো?”
“না আপনি আগে খান তারপর আমি খাবো।”

ইমতিয়াজ শুনলো না রাগান্বিতার হাত ধরে পালঙ্কে বসিয়ে বললো,
“চলো একসাথে খাই।”

রাগান্বিতা মিষ্টি হাসলো। যেন সে জানতো বিষয়টা। রাগান্বিতা আশ্বাস দিয়ে বললো,
“আপনি খান আমার তেমন খিদে নেই নৌকায় বসে তখন খেয়েছিলাম না।”
“সে তো সেই কখন খেয়েছো এখন আবার খাও।”

ইমতিয়াজ শরবতের গ্লাসটা হাতে নিলো রাগান্বিতার মুখের কাছে ধরে বললো,
“খাও,

রাগান্বিতা আর বারণ করতে পারলো না একটুখানি খেয়ে নিলো। বললো,
“এবার আপনি খান।”

ইমতিয়াজ অনেকক্ষণ গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে রইলো তার মোটেও খেতে ইচ্ছে করছে না। কেমন গলাটা আঁটকে আঁটকে আসছে। ইমতিয়াজকে খেতে না দেখে আবারও বললো রাগান্বিতা,
“কি হলো আপনি খাচ্ছেন না কেন?”

এবার খেল ইমতিয়াজ। একটুখানি খেয়ে বললো,
“তোমায় একটা প্রশ্ন করবো বউ?”

রাগান্বিতা নিরদ্বিধায় বললো,
“জি বলুন!’
“আমি শুনেছিলাম তোমার নাকি আর একটা বড় বোন ছিল কিন্তু তাকে তো দেখি নি এখনো। কোথায় সে?”

নিমিষেই রাগান্বিতার হাসি মাখা মুখটা চুপসে যায় স্তব্ধ স্বরে বলে,
“নেই সে।”

অবাক স্বরে বলে ইমতিয়াজ,
“নেই মানে কোথায় গেছে?”

ইমতিয়াজের প্রশ্নে হুট করেই উঠে দাঁড়ালো রাগান্বিতা, আচমকাই ইমতিয়াজের হাত ধরে বললো,
“চলুন আমার সাথে দেখাচ্ছি।”

ইমতিয়াজও উঠে দাঁড়ালো। বিনা বাক্যে এগিয়ে চললো সে রাগান্বিতার পিছন পিছন। যেন সে ভেবেছিল রাগান্বিতা এমন কিছুই করবে।”

—–
গাছের পাতাতে ভরপুর পরিবেশ। কেমন যেন নিস্তব্ধ সব। গত দিনগুলোতে বৃষ্টি না হওয়ায় মাটিগুলো পুরোই শুকনো আর ফেটে ফেটে গেছে এমন। রাগান্বিতাদের বাড়ির রন্ধনশালা পেরিয়ে হাতের ডান দিকটা ছুট্টে যাচ্ছিল রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। শেষ বিকেলের জন্য সব কেমন যেন ছমছমে লাগছে। রাগান্বিতা অনেকটা পথ হেঁটে এসে বাঁশ দিয়ে বেড়া দেয়া একটা কবরস্থানের সামনে দাঁড়ালো। ইমতিয়াজের পা ওখানেই থেমে গেল। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের হাতটা ছেড়ে পায়ের চটি খুলে কবরের দোয়া পাঠ করে ভিতরে ঢুকলো। নিশ্চুপ স্বরে বললো,
“এই যে মাটির নিচটা দেখছেন, এখানেই আমার বোন কুহু শুয়ে আছে। আমাদের মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে দূরে যেখান থেকে আর কখনো ফিরে আসবে না আপা। কখনোই আসবে না।”

বলেই কবরের পাশে লুটিয়ে পড়লো রাগান্বিতা। বোনের মৃত্যুর পর আজ প্রথম তার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়লো। তার বুকটা কেঁদে উঠলো আচমকা। বোনের সাথে কাটানো কিছু খুনশুঁটির মুহূর্ত ভেসে আসলো চোখের সামনে।”

রাগান্বিতার কান্না দেখে আরো দু’পা পিছিয়ে গেল ইমতিয়াজ। বুকে ব্যাথা অনুভব করছে সে। রাগান্বিতার চোখের অশ্রু সে কেন সহ্য করতে পারছে না! কেন!’

ইমতিয়াজ কুহুর কবরের পানে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
“তুমি কি দেখছো কুহেলিকা আমি এসেছি! তোমার অসমাপ্ত সেই প্রেমের গল্পের বিষাক্ত প্রেমিক ফিরে এসেছে তুমি কি দেখতে পাচ্ছো তাকে! আচ্ছা তোমার কি রাগ হচ্ছে না আমার উপর! মনে হচ্ছে না এই পাষাণ মানুষটাকে ভালোবেসে তুমি ভুল করেছিলে! এক ভয়ংকর চরম ভুল! আচ্ছা তোমার বোনকে বললে কি সে বিশ্বাস করবে,
“আমি তোমার দূরে থেকেও কাছের কেউ ছিলাম!”

ইমতিয়াজ রাগান্বিতার পানে তাকালো মেয়েটা এখনো কাঁদছে। হঠাৎই সেদিকে এগিয়ে আসলো রেজওয়ান বোনকে কাঁদতে দেখে ছুটে আসলো সে। দৌড়ে গিয়ে ধরলো বোনকে। চোখে পানি তারও জমলো। ইমতিয়াজ শুধু দেখে গেল দুই ভাইবোনকে মুখ ফুটে কিছু বললো না আর।’

#চলবে……

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-২০+২১

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-২০
________________
কতক্ষণ থ মেরে দাঁড়িয়ে থেকে মুহূর্তেই ফিক করে হেসে ফেললো রাগান্বিতা৷ এতে ইমতিয়াজ কি অবাক হলো মটেও হলো না সে শুধু চেয়ে রইলো রাগান্বিতার হাসি জোড়ানো ঠোঁটের দিকে। গম্ভীর আওয়াজে বললো,
“কি হলো হাসছো যে? ভয় লাগে নি তোমার।”

রাগান্বিতা তার হাসি থামালো দু’কদম এগিয়ে গেল ইমতিয়াজের দিকে। হাল্কা একটু উঁচু হয়ে ইমতিয়াজের কানের কাছে ঠোঁটটা নিয়ে শীতল সুরে সুধালো,
“ভালোবাসার মানুষকে কেউ কখনো খুন করতে পারে নাকি ইমতিয়াজ সাহেব?”

ইমতিয়াজ আওড়ালো, চোখের পলক ফেললো বার কয়েক স্তব্ধ সুরে গাইলো,
“তুমি জানলে কি করে আমি তোমায় ভালোবাসি?”

আবার হাসে রাগান্বিতা নিজের কক্ষের দুয়ারের দিকে এগিয়ে গিয়ে আবার পিছন ফিরে বললো,
“আমি তো জানি আপনি আমাকেই ভালোবাসেন আপনার সন্দেহ থাকলে কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন এতে আমি কিছু মনে করবো না। হাত মুখ ধুয়ে ওযু করে কক্ষে আসুন আমি অপেক্ষা করছি।”

রাগান্বিতা চলে গেল। আর ইমতিয়াজ কেবল হা হয়ে তাকিয়ে রইলো রাগান্বিতার যাওয়ার পানে। বললো,
“মেয়েটা বড্ড অন্যরকম।”

ইমতিয়াজ এবার হাতের কোদালটা কাঁধে তুলে এগিয়ে যেতে লাগলো তাদের কক্ষ থেকে আরো দু’ কক্ষ পরে। কোদালটা মাটি কাটার কাজে রবিন নিয়ে গিয়েছিল কাল। আজ সকালেই কাদা মিশ্রিত বাহিরের দুয়ারের ধারে যে রেখেছিল আর বাড়ির ভিতরে আনা হয় নি। একটু আগে আকাশের অবস্থা বুঝতে ইমতিয়াজ দুয়ার খুলেছিল তখনই তার নজরে আসলো তাই ওটাকে নিয়ে উপরে আসছিল কাঁদা থাকায় আর কাঁধে তোলেনি। তবে হাতে তার কাঁদা লেগেছে একটু!’
—–
ইমতিয়াজ হাত পা ধুইয়ে ওযু করেই তাদের কক্ষে ঢুকলো। রাগান্বিতা তখনও বিছানায় বসে। ইমতিয়াজ গামছা হাতে ভিতরে গিয়ে তাড়া দিয়ে বললো,
“এখনো ঘুমাও নি কেন বউ?”

রাগান্বিতা চোখ তুলে তাকালো। খানিকটা লাজুক সুরে সুধালো,
“দাদিমা বলেছিলেন আজ রাতে যেন আমি আপনার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করি সঙ্গে আপনি রুমে এলে আপনার পা ধরে সালাম দেই।”

বলে উঠে গিয়ে পা ধরে সালাম দিতে নিলো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ সরে গেল রাগান্বিতাকে ধরে উঠিয়ে বললো,
“তোমার স্থান আমার পায়ে নয় বউ আমার বুকে।”

রাগান্বিতা মুগ্ধ হলো। ইমতিয়াজ দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো রাগান্বিতাকে। রাগান্বিতা সালাম দিলো ইমতিয়াজও সালামের জবাব দিয়ে বললো,
“চলো দু’রাকাত নফল নামাজ আদায় করে আসি।”

রাগান্বিতা খুশি হলো কারণ কথাটা সেও বলতো ইমতিয়াজকে। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের থেকে সরে কাছেই টেবিলের উপর রাখা জায়নামাজ দুটো নিয়ে বিছিয়ে দিলো নিচে। ইমতিয়াজ টেবিলের ড্রয়ার খুলে টুপিটা নিয়ে মাথায় দিলো। দুজন একসাথে নামাজে দাঁড়ালো নফল নামাজ আদায় করলো। শ্রুতি মধুর একটা সময় পার করলো।’
—–
আকাশটা তখন ঘন কালো মেঘে ঢাকা ফজর হতে এখনো ঢের দেরি। রাগান্বিতা ইমতিয়াজ পালঙ্কে বসা। দুজনেই চুপচাপ কারো মুখে কথা নেই। হঠাৎই রাগান্বিতা বললো,
“আপনার জন্য গ্লাসে করে দুধ রেখেছিলাম কিন্তু এখন আর খাওয়া যাবে না ঠান্ডা হয়ে গেছে।”

ইমতিয়াজ খানিকটা হাসলো। বললো,
“সমস্যা নেই রেখেছো যখন দেও।”
“ঠান্ডা দুধ ভালো লাগবে না তো।”
“তুমি বললে আমি নিরদ্বিধায় বিষও পান করতে পারি বউ ওটা তো সামান্য ঠান্ডা দুধ মাত্র।”

ইমতিয়াজের কথায় খানিকটা রেগে গেল রাগান্বিতা। ভাড়ি কণ্ঠে বললো,
“আপনি বড্ড খারাপ জানেন, মাঝে মধ্যে এমন সব কথা বলেন আমার বড্ড রাগ লাগে।”

ইমতিয়াজ হাসলো। আলতো হাতে রাগান্বিতাকে নিজের কাছে টানলো। মাথাটা বুকে ঠেকিয়ে বললো,
“আমার বুকটা বড্ড জ্বলছে বউ, তুমি কি সারিয়ে দিতে পারবে?”

রাগান্বিতা যেন থমকে গেল দু’হাতে শক্ত করে ইমতিয়াজকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“জ্বলছে কেন?”
“আগে একা থাকতাম জ্বলতো না তুমি আসার পর থেকে জ্বলছে।”

রাগান্বিতার যেন কি হলো সে ইমতিয়াজের বুকে চুমু কাটলো। ঠোঁট ছুঁয়ে ইমতিয়াজের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আর জ্বলবে না ভালোবাসার পরশ দিয়ে দিয়েছি না দেখবেন এখন থেকে সব ভালো হবে।”

ইমতিয়াজ অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল রাগান্বিতার চোখের দিকে কি যে ভাবলো কে জানে। ধীরে ধীরে সে কেমন যেন হয়ে গেল আস্তে করে রাগান্বিতার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে অল্প করে সুধালো,
“তুমি বড্ড ভালো বউ।”

রাগান্বিতা মিষ্টি হাসে। বলে,
“আপনিও।”

ইমতিয়াজ হঠাৎ করেই ছোট বাচ্চাদের মতো রাগান্বিতার বুকে মাথা রাখলো। রাগান্বিতাও দু’হাতে আঁকড়ে ধরলো। দুজনেই নীরব থাকলো বহুক্ষণ। তবে ইমতিয়াজ মনে মনে আওড়ালো,
“তুমি ভুল জানো বউ আমি ভালো নই। আমি যে বড্ড নিষ্ঠুর। আমি তো ভেবে পাই না তুমি এই নিষ্ঠুর পুরুষটাকে এত ভালোবাসলে কি করে! তোমার ভালোবাসা কি আমায় ভালো থাকতে দিবে। কেন যেন আমি তোমার চোখে বার বার আমার সর্বনাশই দেখি রেকশপুরের কাদম্বিনী।”

ধীরে ধীরে সময় গড়ালো ফজরের ধ্বনি কানে আসলো প্রকৃতি হতে লাগলো পরিষ্কার।’

——
সময় ছুটলো অনেকটা। দেখতে দেখতে দু’সপ্তাহ পেরোলো। এই দু’সপ্তাহে অনেকটাই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে রাগান্বিতা। পুরো বাড়ির রঙই পাল্টে ফেলেছে আশেপাশে থাকা যত আগাছা ছিল সব উপড়ে ফেলেছে এখন আর ভুতুড়ে ভুতুড়ে লাগে না। বাড়ির বাহিরের চারিদকে কিছু সুন্দর সুন্দর ফুলগাছ লাগিয়েছে রাগান্বিতা। ফুল ফুটতেও শুরু করেছে। এখনই সে ফুলের সুভাস পুরো বাড়ি জুড়ে ঘুরে। সারাদিন রাগান্বিতা বাড়িতে একাই থাকে রবিন শুধু কাজ করে চলে যায়। রাগান্বিতা বলেছিল একদিন তার বউকে নিয়ে এখানে আসতে কিন্তু রবিন বলে,
“তার বউটা নাকি পোয়াতে তাই এখন আসতে পারবে না।” রাগান্বিতাও মেনে নিয়েছে।’

নিস্তব্ধ বিকেল। বাড়ির বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে রাগান্বিতা প্রকৃতি জুড়ে কিছুক্ষণ পর পর গা ছুঁয়ে বাতাস বইছে। বাতাসে রাগান্বিতার কালো কেশগুলো উড়ছে। হঠাৎই সাইকেলের বেল বাজার আওয়াজ আসলো রাগান্বিতা সামনে তাকালো দেখলো তাদের বাড়ির দিকে এক ডাকপিয়ন আসছে। মুহূর্তেই বুকটা কেমন করে উঠলো। ডাকপিয়ন চেঁচিয়ে বললো,
“চিঠি এসেছে, চিঠি এসেছে!’

রাগান্বিতা আর দেরি করলো না। মাথায় লম্বা করে ঘোমটা টেনে ছুটে আসলো নিচে। যথারীতি তার হাতে চিঠি দিয়ে ছোট্ট একটা সাইন নিয়ে ডাকপিয়ন চলে গেল। রাগান্বিতা এপিট ওপিঠ উল্টে চিঠিটা বের করলো। সাথে সাথে গাড়ো কালিতে লেখা দেখলো। কেউ লিখেছে,

“তোমার নামে আর চিঠি লিখবো না বধূ
অনেক হয়েছে আর না
এবার তো জানো শুধু তুমি আমার ছাড়া আর কারো না!”

~ নিষ্ঠুর এক প্রেমিক পুরুষ!’

বুকটা আঁতকে উঠলো রাগান্বিতার আবার সেই পুরুষ। রাগান্বিতার বুকটা হাল্কা কাঁপলো। এরই মাঝে পিছন থেকে বললো কেউ,
“বউ।”

রাগান্বিতা পিছন ঘুরলো এই সময় ইমতিয়াজকে দেখে বড্ড অবাকই হয়েছে সে। চিঠিটা লুকিয়ে ফেললো দ্রুত এগিয়ে এসে বললো,
“এই সময় আপনি এখানে?”
“হ্যা, তোমার বাবা চিঠি পাঠিয়েছে দেখো।”

রাগান্বিতা চেয়ে রইলো ইমতিয়াজের হাতের দিকে চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো তার সে দৌড়ে গিয়ে বললো,
“কই দেখি!”

রাগান্বিতার হাতে চিঠিটা দিলো ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা ওখানে দাঁড়িয়েই চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করলো। তার বাবা লিখেছে,

প্রিয় কন্যা,
প্রথমেই আমার সালাম নিও। আশা করি তুমি শহরে ভালোই আছো। নিজেকে মানিয়ে নিতে পেরেছো। তুমি বাড়িতে নেই আজ চৌদ্দটা দিন আর পনেরটা রাত গেল। তোমায় বড্ড মনে পড়ে কন্যা। মনে হয় কতবছর জেনো তোমায় দেখি না। তোমার দাদিমার শরীরটা ইদানীং ভালো যাচ্ছে না তোমায় খালি দেখতে চাচ্ছে। এমনিতেও বিয়ে দু’দিন পেরোতেই মেয়েরা নাইওর আসে তুমি এলে না। এতে অভিযোগ নেই কোনো পথ তো কম না। সুযোগ পেলে একবার জামাইবাবাকে নিয়ে এসো রেশবপুরে। তোমায় ছাড়া আমার বাড়িটা যেন পুরোই শূন্য। পরিশেষে বলবো ভালো থেকো, জামাইয়ের খেয়াল রেখো, মনে রেখো, বিয়ের পর মেয়েদের সর্বপ্রথম কাজ হলো নিজ স্বামীর সেবা যত্ন করা তাকে ভালো রাখা। তুমিও রাখছো নিশ্চয়ই! তাকে কভু কষ্ট দিও না। আবারও বলবো, সুযোগ মিল্লে এসো তোমার আর জামাইয়ের অপেক্ষায় রইলাম,

ইতি
তোমার বাবা।”

বাবার চিঠি পড়ে রাগান্বিতার চোখে পানি চলে আসলো। বাবা তাকে কতটা ভালোবাসে কতটা ব্যাকুল হচ্ছে তার জন্য তা যেন এই চিঠিতেই প্রকাশ পেল। ইমতিয়াজ এগিয়ে এলো রাগান্বিতা চোখের পানি মুছে বললো,
“কেঁদো না বউ আমরা শীঘ্রই যাবো।”

রাগান্বিতা ছলছল দৃষ্টিতে ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বললো,
“সত্যি নিয়ে যাবেন।”

মাথায় নাড়ায় ইমতিয়াজ। বলে,
“হুম।”

রাগান্বিতার চোখে আবার পানি আসলো শক্ত-পোক্ত মেয়েটা আজ বড্ড কাঁদছে। ইমতিয়াজ তার দিকে তাকিয়ে গাল দুটো চেপে ধরে শীতল সুরে বলে উঠল হঠাৎ,
“তুমি কাঁদলে আমার হৃদয়ে বড্ড ব্যাথা লাগে বউ। তুমি কি চাও আমি ব্যাথা পাই।”

রাগান্বিতা দ্রুত চোখ মুছতে মুছতে বললো,
“এই দেখুন চোখ মুছে ফেলেছি। আমি আর কাঁদবো না। আপনার ব্যাথাতে যে আমিও ব্যাথা পাই।”

ইমতিয়াজ হাসলো। মিনমিনিয়ে বললো,
“ওহে সখি গো অন্তর জুড়ে মোর এতো প্রেম
দেখাইতে না পারি তোমায়! এ যে কি যন্ত্রণার একবার যদি শুধাইতে পারতাম তোমায়!’

#চলবে……

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-২১
________________

নিকষকালো অন্ধকারে ঘেরা চারপাশ। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে বহুক্ষণ হয়েছে। রাগান্বিতা মাগরিবের নামাজ সেরে জানালার ধারে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে কতক্ষণ যাবৎ, বাবার জন্য বড্ড মন খারাপ করছে তার। ইমতিয়াজ নামাজের জন্য বেরিয়েছে আর ফেরে নি। তবে দ্রুত চলে আসবে বলে গেছে। রাগান্বিতা নীরবে চুপচাপ তাকিয়ে রইলো বাহিরে, ঘন কালো অন্ধকার ছাড়া তেমন কিছুই নজরে আসছে না। রাগান্বিতা ভাবছে, ইমতিয়াজের প্রতি বড্ড বেশিই যেন আসক্ত হয়ে গেছে সে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো ভয় বা দ্বিধা নেই রাগান্বিতার। সে মনে করে, বাঙালি নারী হোক বা অন্য কোনো শ্রেণির নারী সব বিবাহিত মেয়েদেরই উচিত তার স্বামীর প্রতি আসক্ত থাকা তাকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করা। কুহু আপা প্রায়ই বলতেন মা নাকি বাবার প্রতি সবসময় আসক্ত ছিলেন তাকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। আম্মার মৃত্যুতেও নাকি বাবা প্রচুর কেঁদেছিলেন। বউকে খুব ভালোবাসতো কি না। রাগান্বিতা মনে মনে বিশ্বাস করে নিয়েছে ইমতিয়াজ তাকে প্রচন্ড রকম ভালোবাসেন। প্রকাশ না করলেও বাসেন। তার চোখ, তার কথা বলার ধরন সবকিছুই যেন তাকে ভালোবাসার কথা মনে করিয়ে দেয়। মুখে বললেই যে ভালোবাসা হয় এমনটা নয়, মুখে না বলেও মানুষ আড়ালে আবডালে তার প্রিয় মানুষকে প্রচুর ভালোবাসতে পারেন। রাগান্বিতাকে আড়ালেই ভিতর থেকেই বড্ড ভালোবাসেন ইমতিয়াজ তা না হলে এত যত্ন করতো নাকি। রাগান্বিতার মন খারাপটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল এই ইমতিয়াজ নামটাই যে একটা বিশাল ভালোলাগা। মানুষটার কথা ভাবলেই রাগান্বিতার মনটা ভালো হয়ে যায়। হঠাৎই নিচে কাকে যেন হেরিকেন হাতে বাড়ির বামদিকটায় থাকা এক ঘনজঙ্গলের দিকে যেতে দেখলো রাগান্বিতা। তার মনে হলো ওটা বুঝি রবিন। রাগান্বিতা কি ভেবে যেন নিজের কক্ষ থেকে বের হলো, তাকে দেখতে হবে ওটা রবিন কি না আর রবিন হলেও এই রাত-রেরাতে হেরিকেন হাতে যাচ্ছে কোথায়!’

রাগান্বিতা ছুট্টে গেল নিচে দূর থেকেই সে বুঝতে পারলো ওটা রবিনই। কিন্তু রবিন এইসময় যাচ্ছে কই! রাগান্বিতা ভালোমতো তার মাথাটা ঘোমটা দিয়ে ঢেকে নিলো তারপর আস্তে আস্তে চলতে লাগলো রবিনের পিছন পিছন। রবিন হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে থামলো এক কবরস্থানের সামনে। রাগান্বিতা দেখলো তা হঠাৎই রবিন কাকে যেন বলে উঠল,
“তুমি এহানে আছো আর আমি তোমারে সারাজায়গায় খুঁজি।”

প্রতিউত্তরে কবরস্থানের পাশে বসে থাকা ব্যাক্তিটি বললো,
“এত খোঁজার কি আছে?”
“এক বেডায় আইছিল কইলো এবারের মালগুলান নাকি ভালো হয় নাই।”
“ভালো হয় নি মানে,
“আসলে কাশিমম্মা ভুল করছে একখান আজগর মিয়ার মাল মতিন মিয়ারে দিয়া দিছে।”
“তুমি খেয়াল করো নি?”
“আমি তখন বাড়িত ছিলাম।”
“আচ্ছা আমি দেখছি তুমি যাও।”
“এই রাত্তির বেলা একলা একলা কবরস্থানে বইয়া থাকা ঠিক হইবো না।”

ব্যক্তিটি তাও শুনলো না অনেকক্ষণ বসে রইলো। আলতো করে কবরস্থানের মাটিতে হাত বুলালো। রবিন মন খারাপ করে বললো,
“মৃত মানুষ কি আর ফিরা আহে কও?”
“জানি তো আসে না। ও আজ বেঁচে থাকলে খুব ভালো হইতো তাই না কও!’
“হুম। মাইয়াডা খুব ভালো আছিল! তোমারেও কত ভালোপাইতো।”

জবাব দিলো না ব্যক্তিটি। অন্যদিকে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে রবিন যে কারো সাথে কথা বলছে তা বেশ বুঝতে পেরেছে রাগান্বিতা কিন্তু কি বলছে আর কাকে বলছে তা কিছুই দেখতে বা শুনতে পাচ্ছে না। হঠাৎই গাছের পাতা নড়তেই কিছু একটা আচ করতে পেরেই রবিনকে উদ্দেশ্য করে বললো ব্যক্তিটি,
“হেরিকেনের লাইট নিভাও ওখানে কেউ আছে গিয়ে দেখো।”

রবিন যেন চমকে উঠলো দ্রুত হেরিকেনের আলো কমিয়ে তাকালো ওদিকে। চেঁচিয়ে বললো,
“কে ওখানে?”

আচমকাই রবিনকে চেঁচিয়ে উঠতে দেখে ঘাবড়ে গেল রাগান্বিতা পরক্ষণেই নিজেকে সামলে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে বললো রাগান্বিতা,
“রবিন চাচা আমি রাগান্বিতা।”

রবিন কণ্ঠটা শুনতেই ধড়ফড়িয়ে উঠলো। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বললো,
“বউমা আপনি এহানে কি করেন? তাড়াতাড়ি বাড়িত চলেন রাত দুপুারে এইসব জায়গায় থাকা ঠিক না।”

রবিন কবরস্থান থেকে সরে এসে দাঁড়ালো রাগান্বিতার কাছে। রবিন কিছু বলার আগেই রাগান্বিতা প্রশ্ন করলো,
“আপনি এই জায়গায় কি করছিলেন চাচা?”

রবিন কি বলবে বুঝতে পারছে না। কথা পাল্টে বললো,
“বাড়ির সামনে চলেন তারপর বলতাছি।”
“আপনার সাথে কি কেউ ছিল রবিন চাচা?”

রবিন থরথর করে জবাব দিলো,
“কই কেউ ছিল না তো আমি একাই ছিলাম।”
“কিন্তু আমার কেন যেন মনে হলো আপনি কারো সাথে কথা বলছিলেন।”
“হ বলতাছিলাম তো?”

রাগান্বিতা আগ্রহ নিয়ে বললো,
“কে ছিল?”

রবিন নিশ্চুপ স্বরে বললো,
“আমার মা।”

—–
হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো ইমতিয়াজ। চোখে মুখে খানিকটা চিন্তিত ভাব। এই রাগান্বিতা গেল কই! ইমতিয়াজ সারাবাড়ি খুজলো কিন্তু কোথায় পেল না। এবার ইমতিয়াজ রবিন চাচাকে ডাকলো।”
“রবিন চাচা, রবিন চাচা।”

সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। ইমতিয়াজ আবারও চিন্তিত স্বরে রাগান্বিতাকে ডাকলো। বললো,
“রাগান্বিতা, রাগান্বিতা তুমি কোথায়?”

এরই মাঝে সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বললো রাগান্বিতা,
“আমি এখানে!’

ইমতিয়াজ দ্রুত রাগান্বিতার দিকে দৌড়ে গেল হতভম্ব হয়ে বললো,
“কোথায় ছিলে তুমি কত জায়গায় খুঁজেছি তোমায় জানো তুমি।”

রাগান্বিতা মাথা নত করেই বললো,
“আমি দুঃখিত। আমি আসলে একটু,

কিছু বলার আগেই রবিন বললো,
“রাগ হইও না ইমতিয়াজ ওই বাড়ির পিছনে একটা পুকুর আছে না ওইখানে গেছিলাম রাগান্বিতা একটু জেদ করছিল তাই জন্যে।”

ইমতিয়াজ তার রাগ কমালো। বললো,
“এই রাত-বেরাতে পুকুরপাড়।”

রাগান্বিতা এগিয়ে আসলো। ইমতিয়াজের হাত ধরে বললো,
“আমি দুঃখিত আমি আসলে ভুল করে ওই জঙ্গলের ওদিকটায় গিয়েছিলাম আপনি শুনলে রাগ করবেন তাই রবিন চাচা ওসব বলছেন।”

ইমতিয়াজ শুনলো। চিন্তিত হয়ে উঁচু আওয়াজে বললো,
“ওই জায়গাটা ভালো নয় তুমি এই রাতের বেলা ওখানে কেন গিয়েছিলে বউ?” যদি তোমার কোনো ক্ষতি হতো।”
“আমার কিছু হয় নি। আমি ঠিক আছি। আমি জানতাম না ওই জায়গাটা ভালো না। একা একা ভালো লাগছিল না তাই হাঁটতে বেরিয়েছিলাম কখন যে ওদিকটা গেলাম বুঝতে পারি নি। রবিন চাচা বললো পর জানলাম।”

ইমতিয়াজ শান্ত হলো। আর বেশি কিছু না ভেবে বললো,
“ঠিক আছে এবারের মতো তোমায় কিছু বললাম না কিন্তু আর কখনো ওখানে যাবে না রাতের বেলা তো একদমই না।”

রাগান্বিতা মাথা নাড়িয়ে বললো,
“ঠিক আছে।”

ইমতিয়াজ হাল্কা হাসলো। রবিন ওখান থেকে চলে গেল। ইমতিয়াজও তার বউকে নিয়ে উপরে উঠলো। আসার সময় বাজার থেকে গরম গরম পেঁয়াজু আর আলুর চুপ নিয়ে এসেছিল ইমতিয়াজ। কিন্তু রুমে ঢুকেই রাগান্বিতাকে না পেয়ে চিন্তিত হয়ে গেছিল। ইমতিয়াজ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে বললো,
“তোমার জন্য বাজার থেকে গরম গরম পেয়াজু আর আলুরচপ কিনে এনেছিলাম এতক্ষণে বোধহয় ঠান্ডা হয়ে গেছে।”
“আমি গরম আনি।”
“বেশি ঠান্ডা হয়ে গেলে তাই করতে হবে।”
—–

রাতের ভোজন শেষ করে বিছানায় শুয়ে আছে রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। ইমতিয়াজের বুকে মাথা দেয়া রাগান্বিতা। হঠাৎই ইমতিয়াজ প্রশ্ন করলো। বললো,
“তুমি আমায় খুব ভালোবাসো তাই না বউ?”

রাগান্বিতা মিষ্টি হেঁসেই জবাব দেয়,
“হুম বাসি তো! কেন আপনি বাসেন না?’

ইমতিয়াজ জবাব দেয় না। উল্টো আবার বলে,
“আমায় এত ভালো কেন বাসো বউ?”

রাগান্বিতা ইমতিয়াজের বুক থেকে নিজের মাথাটা উঠালো। চাইলো ইমতিয়াজের চোখের দিকে, ইমতিয়াজও চাইলো। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়েই বলে উঠল,
“আমি যে আপনায় ভালোবাসি কেন বাসি জানি না। শুধু জানি আপনায় ভালোবাসাতেই আমার প্রকৃত সুখ। সবচেয়ে বড় কথা আপনায় ভালোবাসতে আমার ভালো লাগে তাই ভালোবাসি। আমি আপনায় সারাজীবন ভালোবেসে যেতে চাই ইমতিয়াজ।”

বলেই পুনরায় ইমতিয়াজের বুকে মাথা রাখলো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ শুধু শুনেই গেল রাগান্বিতার কথা জবাবে কিছু বললো না। অনেকক্ষণ নীরবতা চললো দুজনের মাঝে। হঠাৎই নীরবতা ভেঙে ইমতিয়াজ বললো,
“নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিও আমরা কাল রেশবপুরে যাবো।”

#চলবে…..

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-১৮+১৯

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-১৮
________________
থমথমে চেহারা নিয়ে তাকিয়ে আছে রাগান্বিতা সামনের কবতুরটার দিকে। তার মাথায় ঢুকছে না এখানে কে চিঠি পাঠাবে। রাগান্বিতা এগিয়ে গেল কবুতরটার দিকে ছুঁতে চাইলো বার বার কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো রাগান্বিতার হাতে কবুতরটা ধরা দিচ্ছে না এবার। সে এদিক সেদিক চোখ বুলাচ্ছে শুধু। রাগান্বিতা কবুতরটার হাবভাব ঠিক বুঝচ্ছে না চিঠি নিয়ে যখন এসেছে তখন তাকে নিতে দিচ্ছে না কেন! কবুতর টা বেশ কিছুক্ষণ এক স্থানে দাঁড়িয়ে ছিল রাগান্বিতা ছুঁতে গেলেই ছুটে যাচ্ছিল অন্যদিকে। শেষমেশ রাগান্বিতা কবুতর ধরার হাল ছেড়ে দিল বোধহয় কবুতরটা তার রাস্তা গুলিয়েছে। রাগান্বিতা পালঙ্কে বসে রইলো চুপচাপ। কবুতরটা অনেকক্ষণ বসে থেকে আবার ছুটে চলে গেল। রাগান্বিতা জাস্ট হা হয়ে তাকিয়ে রইলো কবুতরটার যাওয়ার পানে।

“কান্ডটা ঠিক কি হলো তাই যেন বুঝলো না! কবুতর এলো চিঠি নিয়ে অথচ চিঠি না দিয়েই চলে গেল। অদ্ভুত তো!’

কবুতর যাওয়ার তিন সেকেন্ডের মাথাতেই রুমে প্রবেশ করলো ইমতিয়াজ। শান্ত স্বরে বললো,
“খাবার তৈরি নিচে চলো রাগান্বিতা।”

রাগান্বিতা খানিকটা চমকে উঠলো কারণ সে তখনো কবুতরটার কথা ভাবছিল। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের দিকে তাকালো ভাবলো ইমতিয়াজকে কবতুরের কথাটা বলা উচিত। তাই করলো। সে চিন্তিত স্বরে বললো,
“জানেন তো এই মাত্র একটা ঘটনা ঘটেছে।”

ইমতিয়াজ রাগান্বিতার দিকে এগিয়ে আসলো। খানিকটা অবাক স্বরে বললো,
“কি ঘটনা?”
“মাত্র একটা কবুতর এসেছিল কোনো এক বার্তা নিয়ে কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো আমি তাকে ছুঁতে পারি নি যতবার ধরতে গেছি ততবারই পালিয়ে গেছে। এমনটা কেন করলো?”

ইমতিয়াজ হাসলো। বললো,
“এই সামান্য একটা বিষয় নিয়ে তুমি চিন্তা করছো।”

ইমতিয়াজের কথা শুনে আহ্লাদী স্বরে বললো রাগান্বিতা,
“বারে করবো না বার্তা নিয়ে আসলো অথচ না দিয়েই চলে গেল এমনটা কেন হলো এর আগে তো এমন হয় নি।”

ইমতিয়াজ রাগান্বিতার পাশে বসে ওর হাত ধরে মৃদুস্বরে বললো,
“মানুষ তো প্রায়সই তার গন্তব্য ভুলে যায় ওটা তো মাত্র পাখি ছিল।”

ইমতিয়াজের কথায় এক শীতল ভরা চাহনী নিয়ে তাকালো রাগান্বিতা ইমতিয়াজের চোখের দিকে। বললো,
“তার মানে আপনি বলছেন পাখিটা তার ঠিকানা ভুলে গিয়েছিল।”
“হুম। ভুলে যাওয়া কি অস্বাভাবিক কিছু?”
“তাও ঠিক।”
“তুমি কি ঘাবড়ে গিয়েছিলে?”

টনক নড়লো রাগান্বিতার। নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই বললো,
“না তবে একটু অবাক হয়েছি তাই ভাবছিলাম।”
“বুঝেছি আর ভাবাভাবির প্রয়োজন নেই চলো নিচে খাবে।”

রাগান্বিতা শুনলো নিজের মাথায় ঘোমটা দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বললো,
“ঠিক আছে। চলুন,
“হুম তুমি হাঁটো আমি আমার জামাটা বদলে আসছি। ভয় নেই নিচে চাচা আছে,

রাগান্বিতা আর কিছু বললো না। হেঁটে যেতে যেতে বললো শুধু,
“ঠিক আছে। দ্রুত আসুন।”
“হুম যাও তুমি। আমি আসছি।”

রাগান্বিতা চলে গেল। রাগান্বিতা যেতেই ইমতিয়াজ তার রুমের দুয়ারটা আঁটকে দিয়ে জানালার দিকে এগিয়ে গেল। চুপ করে দাঁড়ালো কিছুসময় এরই মাঝে উড়ে যাওয়া সেই কবতুরটা আবার ফিরে এসে বসলো ইমতিয়াজের কাঁধে। কারণ সেটা যায় নি এতক্ষণ বাড়িরই আশেপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। ইমতিয়াজ কাঁধ থেকে পাখিটা হাতে নিয়ে আস্তে করে পায়ে থাকা চিঠিটা নিলো। চিঠিটা নিতেই পাখিটা পুনরায় ইমতিয়াজের কাঁধে চড়ে বসলো। ইমতিয়াজ চিঠিটা খুললো। অনেক্ক্ষণ তাকিয়ে রইলো চিঠিটার দিকে। পড়লো কিছু। তার দৃষ্টি ছিল স্থির ইমতিয়াজ চিঠিটা পুনরায় ভাজ করে মুঠোয় চেপে রাখলো। মনে মনে বললো,
“ভাবনাটাই তবে সত্যি হলো!’

ইমতিয়াজ এগিয়ে গেল তার টেবিলটার ড্রয়ার থেকে একটা ঠোংগা বের করে কবুতরের খাবার গম বের করলো। গম দেখেই কবুতর ডানা ঝাপটালো ইমতিয়াজ ঠোংগা থেকে গম বের করে টেবিলের উপর একটা ছোট্ট বাটিতে রাখলো। সঙ্গে সঙ্গে কবুতর টা ইমতিয়াজের কাঁধ ছেড়ে উড়ে বসলো টেবিলের উপর। তারপর নিজের ঠোঁট দিয়ে ঠুকরিয়ে ঠুকরিয়ে খেতে শুরু করলো গম। ইমতিয়াজের কবুতর খুব পছন্দ। ছোট বেলা থেকেই এই কবুতরটা আসতো ইমতিয়াজের ঘরে ইমতিয়াজ তাকে গম খাওয়াতো। খাওয়া শেষ হলেই আবার উড়ে যেত। এভাবে করতে করতে একটা বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক গড়েছে ইমতিয়াজের সাথে কবুতরটার। এখন তো খিদে পেলেই ছুটে আসে। খুব উপকারী কবুতর। ইমতিয়াজও অনেক যত্ন করে কবুতরটাকে।
—–
আসন পেতে খাবার নিয়ে নিচে বসে আছে রাগান্বিতা। সচরাচর নিচে বসে তেমন একটা খাবার খাওয়ার অভ্যাস নেই রাগান্বিতার। বাড়িতে বসে টেবিল চেয়ারে বসেই খাওয়া হতো। রাগান্বিতার বাবা ছিলেন একটু বিদেশি টাইপের, রাগান্বিতা শুনেছিল একসময় নাকি বিদেশিনীদেরে সাথে তার বাবার বেশ ভাব ছিল কিন্তু সময়ের সাথে সেই ভাব বিনিময় সব ঘুচে যায়। তবে কিছু অভ্যাস আজও বদলাতে পারে নি রাগান্বিতার বাবা। গ্রামের আর সব ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা মা’দের আব্বা আম্মা বলে ডাকে কিন্তু রাগান্বিতার বাবা শিখিয়েছেন আব্বাকে বাবা বলা আর আম্মাকে মা। রাগান্বিতার বাবা বেশ কিছু দেশের ভাষা জানতেন পড়াশোনাতেও বেশ পটুছিলেন। কিন্তু রাগান্বিতার মা ছিল একটু সাধারণ পড়াশোনা খুব বেশি জানতেন না। উনি সবসময় অশুদ্ধ ভাষাতেই কথা বলতেন। রাগান্বিতার বাবাও তার বউয়ের সাথে তার মতো করেই কথা বলতেন যেমনটা দাদিমার আর গ্রামের অশিক্ষিত মানুষদের সাথে করেন। তবে রাগান্বিতা আর রেজওয়ানকে সবসময় শুদ্ধ ভাষাই শিখিয়েছেন। মায়ের আদর রেজওয়ান আর কুহু কিছুটা পেলেও রাগান্বিতা তেমন পায় নি। জোরে নিশ্বাস ছাড়লো রাগান্বিতা। তার কাছে ভাষা বলতে বাবার মুখের ভাষাই সেরা।”

“এখনও খাওয়া শুরু করো নি কেন?”

হঠাৎই ইমতিয়াজের ভয়েসটা কানে বাজতেই নিজের ভাবনা থেকে বের হলো রাগান্বিতা। স্থির দৃষ্টি নিয়ে তাকালো ইমতিয়াজের দিকে। ইমতিয়াজের চোখে চশমা নেই গায়ের সাদা রঙের ফতুয়া আর সাদা পায়জামা পড়া খুবই সাধারণ তবে অসাধারণ লাগছে রাগান্বিতার কাছে। রাগান্বিতা দৃষ্টি সরালো। বললো,
“আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”

ইমতিয়াজ হাল্কা হাসলো। বসলো রাগান্বিতার পাশ দিয়ে। বললো,
“খিদে পেলে খেয়ে নিবে আমার জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই।”

রাগান্বিতা হাল্কা মাথা নোয়ালো লাজুক কণ্ঠে বললো,
“দাদিআপা মানে দাদিমা বলেছিলেন বিয়ের পর নাকি জামাই বউকে একসাথে খেতে হয়। জামাই না খেলে বউকে তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়।”

ইমতিয়াজ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলো রাগান্বিতার দিকে। মেয়েটাকে বড্ড বেশিই লাজুকতায় ধরেছে তবে খারাপ লাগছে না। ইমতিয়াজ মৃদু হেসে বললো,
“চলো খাই।”
“জি।”

রাগান্বিতা ইমতিয়াজকে খাবার এগিয়ে দিল। ইমতিয়াজও নিলো। তারপর দুজন একসাথে করে খেতে শুরু করলো খাবার ।’
——
নিঝুম বিকেল! প্রকৃতি খুব বিষণ্ণ, নিরিবিলি আর চুপচাপ। রাগান্বিতা বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির জন্য বড্ড মন খারাপ হচ্ছে বাবা, দাদাভাই, দাদিমা সবাইকে তার খুব মনে পড়ছে। ইচ্ছে করছে ছুট্টে চলে যাই তাদের কাছে। রাগান্বিতার খারাপ লাগলো। ঘরে ইমতিয়াজ ঘুমাচ্ছে। বোধহয় রাতে মোটেও ঘুম হয় নি তার। বাড়ির পরিবেশটা একটু বেশিই ছমছমে কেমন যেন। রাগান্বিতা ভিতু নয় বেশ সাহসী তারপরও এমন একটা জায়গায় ইমতিয়াজ একা থাকতো ঠিক কেমন যেন লাগলো। আচমকা আকাশের মেঘ বদলালো, এমনিতেও হাল্কা কালো ছিল এখন পুরো দমেই কালো হয়ে গেল। মেঘে ঢেকে গেল পুরো আসমানটা। আশপাশের পুরো গাছপালা নড়েচড়ে উঠলো বাতাস বইতে লাগতো তীব্র গতিতে। বালি আসছিল পুরো ঘরভরে। রাগান্বিতা চোখ বন্ধ করে ফেললো তার অবাধ্য ঘন কালো লম্বা চুলগুলো উড়তে লাগলো আপনাআপনি। ঘোমটা পড়ে যাচ্ছিল বারংবার। বিরক্ত লাগলেও তার বাতাসটা ভালো লাগছিল। ইমতিয়াজ হঠাৎই ছুটে আসলো ‘রাগান্বিতা, রাগান্বিতা’ বলতে বলতে চলে আসলো দ্রুত। ঘুমটা তার মাত্রই ভাঙলো। প্রকৃতির থমকানোর খানিকটা ঘাবড়ে ছিল সে। ইমতিয়াজ ছুট্টে এসে থেমে গেল বারান্দার দুয়ার পর্যন্ত এসেই রাগান্বিতার সেই মোহনীয় সৌন্দর্য দেখেই চোখ আঁটকে গেল তার। স্থির হলো চোখ, আঁটকে গেল শরীর। কি যেন এক মায়া সৃষ্টি হলো ঠিক বুঝলো না ইমতিয়াজ!’

রাগান্বিতা পিছন ঘুরলো। ইমতিয়াজকে দেখেই একটু চমকালো। এগিয়ে এসে বললো,
“আপনার ঘুম ভেঙে গেছে?”

কেমন এক ঘোরলাগানো স্বরে বললো ইমতিয়াজ,
“তুমি ঘুমাতে দিচ্ছো কই।”
“আমি আঁটকে রাখলামও বা কই?”
“রেখেছো তো তোমার ওই চুলে, কানে ঝুলানো দুলে, হাতের কাঁকনে, গলার গহনে, চোখের ওই মায়াবী ধরনে। এতভাবে আঁটকে রেখে বলছো, আটকালাম কই! এ কিন্তু ভাড়ি অন্যায়!’

রাগান্বিতা লজ্জা পেল। তবে দমলো না মাথা নুইয়ে হাসতে হাসতে বললো,
“আপনার দৃষ্টি ভালো না তাই আঁটকে যান।”

ইমতিয়াজ এগিয়ে যায়। রাগান্বিতার থুতনি ধরে মাথাটা উচু করে বললো,
“আমি তোমার চোখে বার বার আমার সর্বনাশ কেন দেখি বউ?”

রাগান্বিতা চমকালো, ভড়কালো, অবাক হলো খুব। এ বুঝি প্রেমকথন ছিল! রাগান্বিতা লাজুক হয়ে মিষ্টি হেঁসে কেমন করে যেন জড়িয়ে ধরলো ইমতিয়াজের বুক!’

#চলবে…..

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-১৯
________________
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইমতিয়াজ, হঠাৎ করেই রাগান্বিতার জড়িয়ে ধরার বিষয়টার জন্য সে মোটেও প্রস্তত ছিল না। রাগান্বিতা ইমতিয়াজকে জড়িয়ে ধরলেও ইমতিয়াজের হাত ছিল স্থির সে ধরে নি রাগান্বিতাকে। ইমতিয়াজের বুকের ভিতর টিপ টিপ করে শব্দ হচ্ছে। রাগান্বিতা তো তার বুকেই মাথা রেখে দাড়িয়ে আছে ‘মেয়েটা নিশ্চয়ই শুনতে পাচ্ছে তার বুুকের ধুকপুকানি। রাগান্বিতা চোখ বন্ধ করে মুচকি হাসলো। আকাশে তখন প্রবল বেগে বিদ্যুৎ চমকালো রাগান্বিতা হাল্কা একটু ঘাবড়ে গিয়ে ইমতিয়াজকে আর একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রাগান্বিতার ডান কানটা তখন ইমতিয়াজের বুকের ধুপকানি খুব সুন্দরভাবেই শুনতে পাচ্ছিল সে বুঝেছিল ইমতিয়াজের বুক কাঁপছে। সেই বুঝি প্রথম মেয়ে ছিল যে ইমতিয়াজকে জড়িয়ে ধরলো।

অনেক্ক্ষণ যাওয়ার পরও যখন রাগান্বিতা ইমতিয়াজকে ছাড়ছিল না তখন ইমতিয়াজেরও যেন কি হলো সে চোখ বন্ধ করে জড়িয়ে ধরলো রাগান্বিতাকে। আকাশ পথ বেয়ে তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামছিল, কি সুন্দর এক মুহুর্ত! প্রকৃতি জুড়ানো ঠান্ডা বাতাস বইছিল তখন। বাতাসের সংস্পর্শতা রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজকে নাড়িয়ে দিচ্ছিল খুব। অনেকক্ষণ পর রাগান্বিতা মুখ খুললো। শীতল সুরে বললো,
“আপনার বুকখানায় আমার এত শান্তি কেন লাগছে ইমতিয়াজ ছাড়তে একটুও ইচ্ছে করছে না।”

ইমতিয়াজ চোখ বন্ধ করেই মুচকি হাসলো। বললো,
“ওটা তো তোমারই স্থান যতপারো শান্তি নেও আমি কিছু মনে করবো না বউ।”

রাগান্বিতার শরীর জুড়ে এক হিমশীতল হাওয়া বয়ে গেল যেন। সে হাসলো, আনমনা মুচকি হাসলো। কেমন এক অদ্ভুত শান্তি শান্তি লাগছে রাগান্বিতার, যা এর আগে কখনো লাগে নি।’

——-
রাত প্রায় সাড়ে আট’টা। পুরো বাড়ি জুড়ে অন্ধকার। বাহিরে প্রবল বেগে ঝড় চলছে। বাড়িতে বর্তমানে রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ ছাড়া কেউ নেই। রবিন চাচা তার বাড়িতে গিয়েছে, বিকেলের আবহাওয়া দেখেই ইমতিয়াজ বুঝেছিল রাতে ঝড় উঠবে তাই ঝড়ের আগেই যেন রবিন বাড়ি যেতে পারে তাই পাঠিয়ে দিয়েছে তার বউ বাচ্চাও অপেক্ষা করছে কি না। ইমতিয়াজ চুপটি করে নিজ রুমের পালঙ্কে বসে আছে পুরো রুমে অন্ধকার কিন্তু সে বিষয়ে তার কোনো আক্ষেপ নেই উল্টো এই অন্ধকারে বসে থাকতেই বড্ড ভালো লাগছে। কিছু একটা ভাবছে ইমতিয়াজ, নিজেকে বড্ড এলেমেলো লাগছে সে বুঝি সবটা গুলিয়ে ফেলছে নিজের পুরো গন্তব্যই যেন গুলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। হঠাৎই দুয়ার খোলার শব্দ আসতেই দুয়ারের দিকে তাকালো ইমতিয়াজ বাসন্তী রঙের লাল পাড়ের শাড়ি, মাথায় ঘোমটা, হাতে অলংকার, গায়ে অলংকার সঙ্গে ল্যাম হাতে রুমে প্রবেশ করলো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ মুগ্ধ হয়ে শুধু তাকিয়েই রইলো ওর পানে। কি এক অদ্ভুত অনূভুতি কিছুতেই দমানো যাচ্ছে না। ইমতিয়াজ দৃষ্টি সরিয়ে ফেললো। রাগান্বিতা এগিয়ে আসলো ল্যামটা টেবিলের কর্নারে রেখে বললো,
“এভাবে অন্ধকারে বসে কি করছেন? খাবেন না।”

ইমতিয়াজ উত্তর দিলো না উল্টো প্রশ্ন করলো,
“তুমি এত সুন্দর কেন রাগান্বিতা?”

গাড়ো কাজলের আঁখিজোড়া নিয়ে শীতল দৃষ্টিতে ইমতিয়াজের দিকে তাকালো রাগান্বিতা। ধীর স্বরে লাজুকতা নিয়ে বললো,
“আপনার বউ বলে।”

কি এক উত্তর! পাল্টা কিছু বলতেই পারলো না ইমতিয়াজ। সে চুপ করে রইলো। অনেকক্ষণ পর বললো,
“তোমার এখানে অসুবিধা হচ্ছে না তো আমি কিন্তু কাল থেকে বাসায় থাকবো না দুপুরে আসতেও পারি নয়তো একবারে রাতে আসবো তোমার ভয় করবে না তো।”

রাগান্বিতা চুপ করে রইলো। রাগান্বিতাকে চুপ থাকতে দেখে আবারও বললো ইমতিয়াজ,
“কি হলো কথা বলছো না যে ভয় করবে বুঝি।”

রাগান্বিতা হাসলো। বললো,
“আপনি বোধহয় আমার সম্পর্কে সবকিছু এখনো জানেন নি রাগান্বিতা একা থাকতে ভয় পায় না।”
“খুব ভালো। চলো একসাথে খাই?”

কথাটা বলেই ইমতিয়াজ পালঙ্ক থেকে নামলো রাগান্বিতাও নামলো তারপর দুজন চললো নিচে একসাথে রাতের খাবারটা শেষ করার জন্য। বাহিরে তখনও তুমুলবেগে বৃষ্টি হচ্ছিল।’

—–
জানালার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে রাগান্বিতার বাবা। আকাশে ঘনকালো মেঘেরা ঝাপটে ধরে আছে। রাগান্বিতার বাবার ধারণার মতে তাদের এদিকে ঝড় বৃষ্টি না আসলেও আকাশের অবস্থা দেখে তিনি বেশ ধরে নিয়েছেন শহরের ওদিকে বেশ ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। রাগান্বিতার বাবার এসব ধারণা কখনোই ভুল হয় না। জোরে নিশ্বাস ফেললো রাগান্বিতার বাবা। মেয়েটা বাড়ি নেই দুইরাত হতে চললো। বুকের ভিতর খাঁ খাঁ করছে চারপাশ যেন শূন্য শূন্য লাগছে। রাগান্বিতার বাবার রুমটা থেকে কুহুর কবরটা দেখা যায় সেই বাঁশ ঝারের মধ্যে মেয়েটা শুয়ে আছে। না জানি কিভাবে আছে মেয়েটা। চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো রাগান্বিতার বাবা। মেয়ের বাবাদের বুঝি বড্ড জ্বালা।’

“বাবা আসবো?”

হঠাৎই রেজওয়ানের কণ্ঠটা কানে আসতেই দ্রুত চোখের পানি মুছে ফেললেন মোতালেব তালুকদার। ঘন নিশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে বললেন,
“জি বললো,

রেজওয়ান এগিয়ে আসলো। বাবার পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
“বহুদিন তো হলো বাবা আমি গ্রামে এসেছি এবার তো আমার শহরে যাওয়া উচিত।”

রেজওয়ানের কথা শুনে অনেকক্ষণ চুপ থাকলেন মোতালেব তালুকদার। দৃষ্টি শান্ত রেখে বললো,
“তুমিও চলে যাবে রেজওয়ান।”

বাবার কথা শুনে বেশ খারাপ লাগলো রেজওয়ানের। সে বললো,
“আমি চলে আসবো বাবা আমার কিছু জিনিসপত্র আছে ওখানে ওগুলো নিয়েই চলে আসবো তোমায় একা থাকতে হবে না। আমি ফিরে এসে দুজন একসাথে জায়গা জমি দেখবো চাষাবাদ করবো। ঠিক আছে বাবা।”

মোতালেব তালুকদার যেন খুশি হলেন। বললেন,
“তুমি সত্যি বলছো গ্রামেই থাকবে তুমি।”
“হ্যাঁ বাবা। আমি থাকবো না পড়াশোনাও তো শেষ চাকরি করার ইচ্ছে থাকলেও এখন আর করবো না তোমার সাথেই থাকবো এখানে এসে কিছু করবো।”

রেজওয়ানের মাথায় হাত বুলালেন মোতালেব তালুকদার। বললেন,
“ঠিক আছে। তুমি ফিরে এলেই তোমার জন্য একটা লাল টুকটকে বউ খুঁজে আনবো আমি।”

এক্ষেত্রে কিছু বলে না রেজওয়ান লাজুক হাসে শুধু। যা দেখে রাগান্বিতার বাবা মিষ্টি হেঁসে বলে,
“তা কবে যেতে চাইছো শহরে?”

রেজওয়ান বেশি সময় না নিয়েই বললো,
“কালই যাই বাবা।”
“কিন্তু আকাশের যে অবস্থা।”
“চিন্তা করো না প্রকৃতি ঠিক-ঠাক থাকলেই যাবো বাবা।”

—–
রাত তখন একটু গভীরে। বলতে গেলে আজ রাগান্বিতার আর ইমতিয়াজের বাসররাত। কিন্তু রুমের মাঝে নেই কোনো সুভাশ্বোতা আর নাহি আছে রুমের কোনো সাজসজ্জা। তাও খারাপ লাগছে না রাগান্বিতার। সে চুপচাপ বসে আছে পালঙ্কে। দাদিমা আসার আগে অনেককিছু বলেছিল তাকে। দাদিমার কথা মতো একগ্লাস দুধও জোগাড় করে রেখেছে রাগান্বিতা। নিজেকে সাজিয়েছে একটু ভিন্নভাবে। বাসন্তী রঙটা রাগান্বিতার অনেক প্রিয় তাই তো এটাই পড়েছে। বাহিরে বৃষ্টি পড়া থেমেছে। তবে বাতাস বিদ্যমান। আজই প্রথম রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ একই পালঙ্কে একই সঙ্গে ঘুমাবে। রাগান্বিতা মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে বড্ড সংশয় লাগছে মনে। কেমন একটা ঝিম ঝিম ভাব। বলতে বলতে সময় গড়ালো। ঠকঠক শব্দ করে রুমে এগিয়ে আসছিল কেউ। রাগান্বিতা ভাবলো ইমতিয়াজ এসেছে। সে মাথা নিচু করে চুপটি করে বসে রইলো। ঠকঠক শব্দটা ধীরে ধীরে আরো যেন বেড়ে গেল। রাগান্বিতার এবার কেমন যেন লাগলো এভাবে শব্দ করে ইমতিয়াজ তো কখনো হাঁটে না। আর হাঁটলেও এতক্ষণে তো ঘরে চলে আসার কথা। ঠকঠক শব্দটা কানে আবার বাজলো। রাগান্বিতা সে কি ভেবে যেন পালঙ্ক ছেড়ে নামলো। আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে লাগলো সামনে। ঘরে তো সে আর ইমতিয়াজ ছাড়া কেউ নেই তবে ঠকঠক শব্দটা করছে কে! ইমতিয়াজই করছে কি!

নানাবিদ ভাবনা ভেবে হাতে ল্যামটা নিয়ে চললো রাগান্বিতা। ঘরের দুয়ার খুলে যেই না বের হবে এরই মাঝে দুয়ারের সামনে এসে দাঁড়ালো ইমতিয়াজ৷ এতে খানিকটা ভড়কে গিয়ে দু’পা পিছিয়ে যায় রাগান্বিতা। রাগান্বিতার রিয়েকশন দেখে বললো ইমতিয়াজ,
“কি হলো কোথায় যাচ্ছো তুমি?”

রাগান্বিতা থরথর করে বললো,
“কে যেন বাহিরে ঠকঠক করে আওয়াজ করছিল?”

ইমতিয়াজ হাসে। নিজের হাতের কোদালটা দেখিয়ে বলে,
“ঠকঠক সে তো এ করছিল।”

রাগান্বিতা এবার তাকালো ইমতিয়াজের হাতের কোদালটার দিকে। অবাক স্বরে বললো,
“আপনি এইসময় হাতে কোদাল নিয়ে কি করছিলেন?”

ইমতিয়াজ গম্ভীর আওয়াজে বলে,
“যদি বলি তোমায় খুন করতে আসছিলাম বউ।”

চলবে……

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-১৭

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-১৭
________________
জোৎস্না ভরা আলো। নদীতে থৈ থৈ করছে পানি। ঢেউয়ের স্রোতে ভাসছে কতকিছু। জাহাজ ছুটছে নিজ মনে। পরিবেশটা চুপচাপ। এমনই চুপচাপ পরিবেশে জাহাজের এক কিনারায় পা ঝুলিয়ে বসে ছিল রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। এখনো বসে আছে তারা তবে রাগান্বিতা ঘুমিয়ে পড়েছে কখন যে কথা বলতে বলতে ইমতিয়াজের কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো বুঝতে পারে নি। ইমতিয়াজের হাত খুব শক্ত করে ধরে আছে রাগান্বিতা। কোনো দ্বিধা নেই তার মাঝে কেমন শক্ত করে ধরে আছে। ইমতিয়াজের দৃষ্টি রাগান্বিতার সেই হাতের মাঝেই “মেয়েটা এত দ্রুত তাকে এত বিশ্বাস করছে কি করে? খুব গভীর ভাবেই কি ইমতিয়াজের প্রতি আসক্ত হচ্ছে রাগান্বিতা। আচমকাই রাগান্বিতার মাথাটা ইমতিয়াজের কাঁধ থেকে সরে যেতে নিলো সঙ্গে সঙ্গে ইমতিয়াজ ধরলো তাকে নিচে পানিগুলো কেমন জোরে জোরে ভেসে যাচ্ছে কেউ পড়ে গেলে আর বাঁচার উপায় নেই। ইমতিয়াজ কতক্ষণ কি যেন ভাবলো এরই মাঝে রাগান্বিতা চোখ খুলে নিস্তব্ধ স্বরে বললো,
“ইমতিয়াজ কি সত্যি আঘাত দিতে জানে প্রিয়?”

ইমতিয়াজ যেন থমকে গেল রাগান্বিতার কথা শুনে।কথার অর্থটা যেন ধরতে পারলো না। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“মানে?”
“মানে কিছু না আমায় নিয়ে কেভিনে চলুন। পড়ে গেলেই তো মরে যেতাম খুঁজে আর পেতেন না।”

বলেই হেঁসে ফেললো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ শুধু ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে ছিল রাগান্বিতার চোখের দিকে। বোধহয় বুঝলো কিছু তবে জবাবে কিছু বলে নি। নীরবতা নিয়ে অনেকক্ষণ কাটার পর ধীরে সুস্থে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো ইমতিয়াজ রাগান্বিতাকেও উঠালো মেয়েটার তখন পড়ে যেতে নিতেই ঘুমটা হাল্কা হয়ে গেছিল। ইমতিয়াজ হাত ধরে রাগান্বিতাকে নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
“আমায় এত বিশ্বাস করছো কেন?”

রাগান্বিতা ঘুমু ঘুমু কণ্ঠতেই বলে,
“বারে আপনি আমার মনের মানুষ আপনায় আমি বিশ্বাস করবো না। জানেন আপনায় যেদিন প্রথম ওই সন্ধ্যেবেলা বাঁশি বাজাতে দেখেছিলাম সেদিনই আপনার প্রতি আমি একটা টান সঙ্গে কেমন একটা অনভূতি অনুভব করি। ধীরে ধীরে অনুভূতিগুলো বেড়ে যায়। ভেবেছিলাম আপনার বিরহ নিয়েই সারাজীবন কাটাতে হবে। কিন্তু দেখুন কি এক আশ্চর্যকর বিষয় শেষমেশ আপনার সাথেই বিয়ে হয়ে গেল। আমার ভাগ্যে বোধহয় আপনিই ছিলেন।”

রাগান্বিতার প্রত্যেকটা কথাই মন দিয়ে শুনলো ইমতিয়াজ জবাবে কিছু বললো না। ইমতিয়াজ রাগান্বিতাকে নিয়ে এসে কেভিনে শুয়ে দিল। বললো,
“ঘুমাও বাকি কথা কাল হবে।”

রাগান্বিতা মিষ্টি হাসে। বলে,
“আপনিও ঘুমান।”

রাগান্বিতার পাশে বসে ইমতিয়াজ। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
“ঘুমাবো তুমি আগে ঘুমাও।”

রাগান্বিতা শুনলো। ইমতিয়াজের হাতের স্পর্শে এক অজানা ভালোলাগা অনুভব করলো রাগান্বিতা। চোখ বুজে নিলো নিমিষেই। মনে মনে ভাবলো,
“সে বুঝি সত্যি খুব ভাগ্যবতী।”

সময় গড়ালো রাগান্বিতা ঘুমিয়ে পড়লো ইমতিয়াজ বসে ছিল পুরোটা সময়। তার মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে বুঝি সবটা এলেমেলো হয়ে যাচ্ছে। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না।
—–
ভোরের প্রভাতি আলো। প্রকৃতি ধীরে ধীরে হচ্ছিল পরিষ্কার। রাগান্বিতা অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠে নামাজ সেরে নেয় গায়ের গহনাগাটি খুলে ব্যাগে ভরেছে তারও আগে। ইমতিয়াজ কেভিনে নেই নামাজ সেরে কোথায় যেন গেছে তাকে বলেছে সবটা গুছিয়ে নিয়ে বোরকা পড়ে তৈরি হতে আর কিছুক্ষণের মাঝেই তারা ঢাকায় পৌছাবে। রাগান্বিতাও শোনে বর্তমানে গায়ে হাল্কা কিছু গহনা আর শাড়ি পড়া। রাগান্বিতা চিরুনী দিয়ে তার প্যাচিয়ে যাওয়া চুলগুলো আঁচড়িয়ে খোপা করতে ব্যস্ত এখন। এমন সময় কেভিনের দরজায় নক করলো ইমতিয়াজ। মৃদুস্বরে বললো,
“আসবো?”

রাগান্বিতা মাথায় শাড়ির আঁচলটা দিয়ে বললো,
“জি আসুন।”

ইমতিয়াজ ভিতরে ঢুকলো লাল টুকটকে শাড়িতে রাগান্বিতাকে কি মায়াবী দেখাচ্ছে। ইমতিয়াজ দৃষ্টি সরিয়ে তার হাতে করে আনা এক কাপ চা আর একটা বিস্কুটের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললো,
“খেয়ে নেও। আমি বাহিরে আছি। খেয়ে তৈরি হয়ে আমায় ডেকো।”

উত্তরে রাগান্বিতা শুধু মাথা নাড়ালো। ইমতিয়াজ বেরিয়ে গেল। রাগান্বিতা মুচকি হেঁসে বেডে বসলো। তারপর খেতে লাগলো ইমতিয়াজের দিয়ে যাওয়া চা আর বিস্কুট।’
—-

বাড়ির উঠানে থমথমে চেহারা নিয়ে বসে আছে মোতালেব তালুকদার। মাহাদের মৃত্যুটা যেন কেমন সবটা এলেমেলো করে দিলো। দুশ্চিন্তার পাহাড় যেন আরো বেড়ে গেল ‘মেয়েটা সুখে থাকবে তো’ কথাটা যেন বারংবার মাথায় বারি মারছে মোতালেব তালুকদারের। তার কাঁধে হাত রাখলো দাদিমা। বললেন,
“চা খাবি না?”
“কিছু ভালো লাগছে না তুমি খাও গিয়ে।”

দাদিমা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন,
“পোলাডারে কে মারতে পারে জানো কিছু।”

‘না’ বোধক মাথায় নাড়ায় রাগান্বিতার বাবা সাথে নিম্নস্বরে বলে,
“কে মারলো জানতে না পারলেও কেন যেন মনে হচ্ছে রাগান্বিতার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার জন্যই কেউ মেরে দিয়েছে। এখন যদি ইমতিয়াজেরও কেউ ক্ষতি করে তখন!”

মোতালেব তালুকদার খানিকটা ঘাবড়ালেন। মোতালেবের কথাগুলো ঠিক শুনলো না দাদিমা। তাই প্রশ্ন করলেন,
“কিছু কইলি?”

চমকে উঠলো রাগান্বিতার বাবা। দাদিমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“না। তুমি বরং ঘরে যাও।”

দাদিমা শুনলেন আর কথা না বারিয়ে চলে গেল বাড়ির ভিতর। অন্যদিকে দরজার সামনে মাত্রই এসে দাঁড়িয়ে ছিল রেজওয়ান ভেবেছিল বাবাকে শহরে যাওয়ার কথাটা বলবে কিন্তু আর বলতে পারলো না। সে বুঝেছে বোনের চিন্তায় বাবা খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্থ।’
—-
পুরনো একটা বাড়ি, খুবই পুরনো বাড়িটা। বাড়িটার আশপাশের দূর দূরান্ত পর্যন্ত তেমন কোনো বাড়িঘর নেই। আশেপাশে ঘোর জঙ্গল টাইপের। গাছপালায় ভরপুর। কিছুটা গা ছমছমে বিষয়। রাগান্বিতা আশেপাশে তাকিয়ে বললো,
“আপনি এখানে একা থাকতেন?”

ইমতিয়াজ মাথা নাড়িয়ে বললো,
“হুম। তবে একজন আছে যে আমায় মাঝে মাঝে রান্নাবান্না করে দিয়ে যায়। ভিতরে চলো দেখতে পাবে।”

রাগান্বিতা শুনলো আশপাশ দেখতে দেখতেই এগিয়ে গেল। বাড়ির উঠানে শেওলা জমেছে বোঝাই যাচ্ছে অনেকদিন যাবৎ এখানে কি কেউ ছিল না। রাগান্বিতা বুঝতে পেরেছে তাকে অনেক কাজ করতে হবে এই জায়গা ঘর সবটা গোছাতে হবে। রাগান্বিতা ধীরে সুস্থ এগিয়ে গেল ভিতরে। বাড়ির দরজার সামনে আসতেই রাগান্বিতা বললো,
“আপনার এখানে একা থাকতে ভয় করতো না?”

ইমতিয়াজ খানিকটা হাসে। বলে,
“না। অভ্যাস হয়ে গেছে তোমারও হয়ে যাবে দেখে নিও।”

রাগান্বিতা পাল্টা কিছু বললো না। ইমতিয়াজ দরজায় নক করলো। বললো,
“রবিন চাচা দরজা খুলো।”

ইমতিয়াজের ডাকার চার মিনিটের মাথাতেই দৌড়ে আসলো রবিন। দরজা খুললো দ্রুত। বললো,
“ইমতিয়াজ তুমি আইছো?”

ইমতিয়াজও হাল্কা হেঁসে বললো,
“হুম।”

হঠাৎই রবিনের নজরে আসলো বোরকা পরিধিত এক রমণীর দিকে। সে বেশ অবাক হয়ে বললো,
“এ কে?”
“তোমার বউমা চাচা।”

সঙ্গে সঙ্গে যেন বড় ধরনের ধাক্কা খেল রবিন চাচা। অদ্ভুত স্বরে বললো,
“তুমি বিয়ে করছো ইমতিয়াজ?”

উত্তরে এক শব্দে জবাব দিলো ইমতিয়াজ,
“হুম।”


ইমতিয়াজের পিছু পিছু বাড়ির ভিতর ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো রাগান্বিতা। পর পর কয়েকটা রুম পার হতেই একটা রুম ছিল তালাবদ্ধ। সব রুমের দরজা খোলা এটার তালাবদ্ধ কেন কথাটা মাথায় আসলেও খুব বেশি ভাবলো না রাগান্বিতা। ধীরে ধীরে চলছিল ইমতিয়াজের পিছন পিছন। সবার মাঝখানে একটা রুম ছিল ইমতিয়াজ রাগান্বিতাকে নিয়ে সেই রুমটাতেই ঢুকলো। রাগান্বিতাও ঢুকলো। দেয়ালের এক কর্নারে ছোট্ট একটা খাট। খাটের পাশে ছোট্ট টেবিল তাতে কিছু বই রাখা। পেপার পেন্সিল আঁকাআকির সরঞ্জামও ছিল। খাটের বিপরীতেই বিশাল একটা জানালা। পর্দা দেয়া শুধু, ইমতিয়াজ সর্বপ্রথম জানালার পর্দাগুলো সরালো সঙ্গে সঙ্গে দিনের ফুড়ফুড়ের আলো এসে সোজা এসে পড়লো রুমে। পুরো রুম হলো চকচকে। ছোট ছোট আসবাবপত্র আর একটা কাঠের আলমারী ছিল রুমে। পুরো রুমটাকেই চোখ বুলালো রাগান্বিতা। রুমটা তার ঠিক কতটুকু ভালো লেগেছে জানা নেই। হঠাৎই ইমতিয়াজ বললো,
“তুমি বসো আমি একটু আসছি।”

রাগান্বিতা খানিকটা থমথমে গলায় বললো,
“কোথায় যাচ্ছেন?”

ইমতিয়াজ হাসে খানিকটা কাছে যায় রাগান্বিতার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“কেন ভয় করছে বুঝি!”

রাগান্বিতা দু’কদম সরে এসে বললো,
“না তো।”

মৃদু হাসে ইমতিয়াজ। বলে,
“বুঝেছি। তুমি বসো আমি দেখি রবিন চাচা কতদূর কি গোছাচ্ছেন খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে তো।”
“আমি রান্না করি?”
“করবে তো তবে এখন নয় পরে।”

রাগান্বিতা আর কিছু বললো না। ইমতিয়াজ চলে গেল। ইমতিয়াজ যেতেই রাগান্বিতা তার বোরকা নিকাব খুলে রাখলো খাটে। খোঁপা করা চুলগুলো আলগা হয়ে আপনাআপনি খুলে গেছিল। সেগুলো হাত দিয়ে আবার খোঁপা করতে করতে হঠাৎই বাড়ির জানালায় একটা কবুতর আসলো। পায়ে তার চিঠি। কবুতরটিকে দেখেই বুকটা যেন দক করে উঠলো রাগান্বিতার। থমথমে গলায় বললো,
“আবার চিঠি!’

#চলবে……

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-১৫+১৬

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-১৫
________________

স্তব্ধ হয়ে আছে পুরো বিয়ে বাড়ি। রাগান্বিতার বরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কথাটা যেন ঝড়ের গতিতে পুরো রেশবপুরে ছড়িয়ে গেছে। রাগান্বিতার বাবা মাথায় হাত দিয়ে তাদের বসার ঘরে বসে আছেন। এবার কি হবে? এভাবে বিয়ে ভেঙে যাওয়া মেয়েটাকে কে বিয়ে করবে এই ভেবেই শরীর খারাপ করছেন। রেজওয়ানও চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে বাবাকে ধরে তারও মাথা কাজ করছে না। যেদিন থেকে কুহুটা মারা গেল সেদিন থেকে একটার পর একটা বাজে ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে তাদের সাথে।

আশেপাশে লোকজনও গোল হয়ে বসে আছে। সামনেই দরজার কাছ দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ইমতিয়াজ। দৃষ্টি তার নীরব কি হলো না হলো সব যেন তার মাথার উপর দিয়ে গেল। রাগান্বিতা কি কথাটা শুনেছে তার বরকে যে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আচ্ছা রাগান্বিতার মনের অবস্থাটা ঠিক কেমন এখন জানার জন্য মনটা বড্ড ছটফট করছে ইমতিয়াজের। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনোভাবেই রাগান্বিতার রুমে যাওয়া যাবে না তাকে।”

বলতে বলতে আসরের আযানের ধ্বনি শোনা গেল। সবাই বেশ আফসোস করছেন আবার কেউ কেউ কানাফুসা শুরু করে দিয়েছেন। রাগান্বিতার বাবা সবটাই নীরবে হজম করে নিচ্ছেন। এত সুন্দরী রমনীর কপালটা শেষ পর্যন্ত এমন কেন হলো? এবার বিয়ে ভাঙা এই মেয়েটাকে কে বিয়ে করবে। রাগান্বিতা বাবা বেশ ভেঙে পড়লেন। বললেন,
“তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে আমার মেয়েটাকে বিয়ে করবে?”

বাবার আর্তনাদটা যেন রাগান্বিতার কানে বাজলো। সে মাত্রই তার রুম থেকে বেরিয়ে এসেছিল। বাবার আর্তনাদে তার ভিতরটা নড়ে উঠলো তার বাবা এইভাবে আহাজারি করছে। মাহাদ এমনটা কেন করলো? কেন নিখোঁজ হলো? কেউ কি নিখোঁজ করিয়েছে নাকি ইচ্ছে করে নিখোঁজ হয়েছে।

রাগান্বিতার বাবার কথা শুনে একজন লোক বললো,
“এগুলান আমনে কি কইতাছেন জমিদার সাহেব? আমগো লগে আমনেগো যায় নাকি।”

রাগান্বিতার বাবা আরো ভেঙে পড়লেন। আর্তনাদ ভরা কণ্ঠে বললেন,
“আমি এখন কি করবো আমার মেয়েটার যে গোটা জীবনটাই নষ্ট হয়ে যাবে। এভাবে বিয়ের আসরে বর না আসার কলঙ্ক যে আমার মেয়েটাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। তোমাদের কিছু দেখতে হবে না শুধুমাত্র একটা ভালো ছেলে হলেই হবে আমার মেয়েটাকে একটু যত্নে রাখতে পারলেই হবে বাকিটা আমি দেখে নিবো।”

তাও কেউ শুনলো না সবাই মাথা নিচু করে রইলেন। এবার রাগান্বিতার নিজেকে বড্ড ঠুনকো মনে হচ্ছে বাবা এইভাবে অসহায়ের মতো সবার কাছে ভিক্ষা চাচ্ছে। বর আসে নি এক্ষেত্রে মেয়েটার কি দোষ? যদি তার আর জীবনে বিয়ে না হয় না হোক কিন্তু বাবাকে এভাবে দেখতে পারবে না রাগান্বিতা। রাগান্বিতা তার মাথার ঘোমটাসহই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। সবার দৃষ্টি তার দিকে গেল মুখটা ঘোমটা দিয়ে ঢাকা থাকায় চেহারা দেখা যাচ্ছিল না। ইমতিয়াজও খেয়াল করলো বিষয়টা। রাগান্বিতা তার বাবার কাছে এগিয়ে গেল তারপর বাবার পাশে বসে বলতে নিলো,
“বাবা।”

এরই মাঝে ইমতিয়াজ এগিয়ে এসে বললো,
“আপনার দ্বিধা না থাকলে রাগান্বিতাকে আমি বিয়ে করতে চাই জমিদার সাহেব।”

সঙ্গে সঙ্গে পুরো প্রকৃতি যেন আবার রঙ বদলালো। রাগান্বিতাসহ আশেপাশের সবাই বেশ অবাক হয়ে তাকালো ইমতিয়াজের মুখের দিকে। রাগান্বিতার বাবা বসা থেকে উঠে আসলেন। ইমতিয়াজের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,
“তুমি সত্যি আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চাও ইমতিয়াজ?”

মাথা নাড়ায় ইমতিয়াজ। বলে,
“জি।”

ইমতিয়াজের কথায় রাগান্বিতার কেমন যেন অনুভূতিপূর্ন একটা ফিলিংস আসলো। সে শুধু এক নজর ইমতিয়াজের দিকে তাকালো। ইমতিয়াজও এক নজর রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তবে তার আগে আমি একবার রাগান্বিতার সাথে কথা বলতে চাই?”

ইমতিয়াজের কথা শোনা হলো রাগান্বিতার বাবাও আর উপায় না পেয়ে রাজি হলেন এই বিয়ে দিতে। সবাইকে জানানো হলো আসরের নামাজের পরই ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতার বিয়ে পড়ানো হবে। আপাতত সবাই আসরের নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে মসজিদে যাচ্ছেন। ইমতিয়াজও যাবে তবে তার আগে রাগান্বিতার সাথে দু’দন্ড কথা বলতে চায় সে।
—-
প্রকৃতি আজ চুপচাপ। ঘুটঘুটে নীরবতার মধ্যে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুজন রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। রাগান্বিতার মাথায় ঘোমটা তখনও দেয়া ইমতিয়াজ তার পিছনে দাঁড়ানো। ইমতিয়াজ কিছু বলার আগেই রাগান্বিতা বললো,
“আপনি সত্যি আমায় বিয়ে করতে চান ইমতিয়াজ?”

ইমতিয়াজ বেশি ভাবলো না। দ্রুত জবাব দিলো,
“আপনি রাজি থাকলে আমার তো আপত্তি করার কারণ দেখছি না। তবে আপনার আমার বিষয়ে কিছু জানা উচিত রাগান্বিতা। আমি শহরে থাকি এটা তো আপনি জানেন বিয়ের পর আপনাকেও আমার সঙ্গে শহরে থাকতে হবে। শহরে আমার একটা বাড়ি আর নিজস্ব ব্যবসা আছে। মা বাবা নেই আমি একাই থাকি। বলতে পারেন আপনার সংসার আপনার নিজেকেই একা গুছিয়ে নিতে হবে। আপনি যদি রাজি থাকেন তবেই সবটা সম্ভব।”

রাগান্বিতা চুপ করে রইলো ইমতিয়াজের কেউ নেই তার যেন খারাপ লাগলো কথাটা শুনে। নিজেকে দমিয়ে বললো রাগান্বিতা,
“আপনি যদি আমায় একটু সাহায্য করেন আমি ঠিক সবটা গুছিয়ে নিতে পারবো।”

বিনিময়ে ইমতিয়াজ শুধু এতটুকু বলে,
“আছি আমি।”

ব্যস ইমতিয়াজের এতটুকু কথাতেই রাগান্বিতার ঠোঁটের হাসির রেখা ফুটে উঠলো। পুরো বিষয়টা যেন স্বপ্নের মতো লাগছে। রাগান্বিতা ফিল করছে সে প্রেমে পড়ছে গভীর ভাবে ইমতিয়াজ নামক প্রেমরোগে আসক্ত হচ্ছে ধীরে ধীরে।’

রাগান্বিতা মুচকি হাসলো। বললো,
“আঘাত তো দিবেন না ইমতিয়াজ?”

রাগান্বিতা প্রশ্ন করলেও ইমতিয়াজ তার উত্তর দিলো না। কেননা ইমতিয়াজ অনেক আগেই রুম থেকে বেরিয়ে গেছে। সে বুঝেছে রাগান্বিতার এই বিয়ে করতে কোনো আপত্তি নেই। আর এমনিতেও সে বুঝতে পেরেছে রাগান্বিতা একটু হলেও তার প্রতি আসক্ত হয়েছে।’
—-

আসরের নামাজ সেরেই। কাজী এসেই কবুল বলার মাধ্যমে বিয়ে হয়ে গেল রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজের। উপস্থিত সবার প্রথমে একটু কেমন কেমন লাগলেও পরবর্তীতে তেমন কিছু আর ভাবে নি। রাগান্বিতার দাদিমার অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন ইমতিয়াজের দিকে। ছেলেটা ভালো হবে তো রাগান্বিতার জন্য। দেখে ভালোই মনে হচ্ছে। তাও মনের মধ্যে কেমন একটা অসস্তিকর অনুভূতি হচ্ছে।’

বেলা ঘুরলো সিদ্ধান্ত নেয়া হলো এই রাতের আধারেই জাহাজে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাবে রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। রাত আটটায় জাহাজ ছাড়বে। রাগান্বিতা কাঁদলো তার দাদিমা, বাবা আর ভাইকে ধরে। ইমতিয়াজ শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল তখন। কুহুর কথা বড্ড মনে পড়ছে রাগান্বিতার। বোনটা থাকলে আজকের ঘটনাগুলো বোধহয় অন্যরকম হতো।

সন্ধ্যা ৭ঃ০০টা।
নদীর ঘাটে জাহাজের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাগান্বিতা, ইমতিয়াজ, মোকলেস এবং রাগান্বিতার পরিবার। মোকলেস কাঁদছে। সে ইমতিয়াজকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আবার আইবেন তো ভাই?”

ইমতিয়াজ মুচকি হেসে বললো,
“হুম। সবসময় ভালো থাকিস।”

মোকলেস শুধু জড়িয়ে ধরে কেঁদেই গেল উত্তরে কিছু বললো না। এবার রাগান্বিতার বাবা এগিয়ে এলেন ইমতিয়াজের দিকে ওর হাত ধরে বললো,
“তুমি তো জানো বাবা তোমাদের বিয়েটা কেমন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে দিলাম। আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো একটু আগলে রেখো যত্নে রেখো। বড় মেয়েটা চলে যাওয়ার পর ওই মেয়ে হিসেবে একমাত্র সম্বল ছিল। তোমাকে আমার প্রথমদিনই ভালো লেগেছিল। তাই তো তোমার হাতেই মেয়েকে তুলে দিলাম। ক্ষোভ রেখো না কোনো সুখে শান্তিতে থেকো দুজন। আর সময় হলেই আমার মেয়েটাকে নিয়ে চলে এসো এখানে।”

ইমতিয়াজ আশ্বাস দিলো। বললো,
“চিন্তা করবেন না আমি আছি ওর পাশে।”

রাগান্বিতার বাবা যেন একটু শক্ত হলেন আরাম পেলেন বুকে। ইমতিয়াজের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“সবসময় ভালো থেকো বাবা।”

ইমতিয়াজ একটু হাসে শুধু। অতঃপর সময় গড়ালো ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতা এগিয়ে গেল জাহাজের দিকে। রাগান্বিতাও তার বাবা আর ভাইকে শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরে চললো ইমতিয়াজের সঙ্গে। তাদের জন্য গোটা একটা কেভিন বুক করা হয়েছে। আচমকাই রাগান্বিতা জাহাজে উঠতে গিয়ে হোঁচট খেল সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরলো ইমতিয়াজ। চোখাচোখি হলো দুজনের রাগান্বিতা বললো,
“আঘাত তো পেতে দিলেন না, শুধু শুধু শুরুতে ভয় দেখালেন কেন?”

ইমতিয়াজ হাসে। রাগান্বিতার কাজল কালো চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“মানুষ না পাওয়া জিনিসকে ভুলতে কত কথা বলে কাজললতা তুমি বুঝবে না।”

রাগান্বিতা মুগ্ধ হলো এই প্রথমবার ইমতিয়াজ তাকে ‘তুমি’ বলে সম্মোধন করলো এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল রাগান্বিতার মাঝে। আজ বুঝি পুরো দমেই রাগান্বিতা ইমতিয়াজের হয়ে গেল।”

#চলবে…..

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-১৬
________________
রাতের আধারে ঘনিয়ে এসেছে চারপাশ। মুক্তদানার মতো চিকচিক করছে পানি। চাঁদ উঠেছে আকাশ ছুয়ে খানিকটা মেঘলাময়। বৃষ্টি হবে হবে এমন। জাহাজ ছুটছে আপন গতিতে। ইমতিয়াজ দাঁড়িয়ে আছে জাহাজের এক কর্নারে রেলিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে দৃষ্টি তার নিচের ঢেউগুলোর দিকে। আচ্ছা সাঁতার না জানা একটা জীবন্ত মানুষকে পানিতে ফেলে দেওয়ার পর তার যে কষ্টটা হয় সেটা কি খুবই যন্ত্রণাদায়ক হয়। হয়তো হয়। ইমতিয়াজ তার ভাবনা বদলালো তাকালো আকাশ পথে। সে কি খুব ভয়ংকর! হতে পারে অথচ সেই ভয়ংকর মানুষটাকেই রাগান্বিতার মতো এত সুন্দরী একটা মেয়ে বিয়ে করে ফেললো। কত নিরদ্বিধায় তার সঙ্গে তার বাড়ি ছুটছে। মেয়েটার কি একটুও ভয় লাগছে না আচমকা একটা অচেনা মানুষের সাথে অচেনা শহরে পারি জমাতে। রাগান্বিতা কেভিনে আছে ইমতিয়াজ তাকে জানিয়ে এসেছে কোনো দ্বিধা নেই সে নিশ্চিতে এখানে ঘুমাতে পারে। আজ রাতে তারা একে অপরের সাথে কোনো কথা বলবে না যদি রাগান্বিতা না চায় লাগলে যা বলার আজকের পরই বলবে। ইমতিয়াজের এ কথার পিঠে রাগান্বিতা কিছু বলে নি চুপচাপ ছিল। ইমতিয়াজও আর না বকে চলে আসে বাহিরে এরপর থেকে বাহিরেই আছে। বলতে গেলে মধ্যরাত চলছে। কি সুন্দর জোৎস্না ভরা আলো। আশেপাশে কেউ নেই একমাত্র ইমতিয়াজই দাঁড়িয়ে আছে বাহিরে। ইমতিয়াজ জোরে একটা নিশ্বাস ফেললো। তারপর চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভাবলো,

একটা মেয়ে, তার মুখে কি সুন্দর হাসি। একটা বাড়ির পিছনের আশেপাশে দৌড়াচ্ছে আর বলছে,
“আসো, আসো,আসো না। তুমি কিন্তু আমার জন্য আজও নূপুর আনো নি। তুমি বার বার কেন ভুলে যাও। এর পরের বার ভুলে গেলে আমি কিন্তু তোমায় ক্ষমা করবো না।”

আচমকাই হাতে কারো একটুখানি স্পর্শ পেতেই চমকে উঠলো ইমতিয়াজ। দ্রুত হাত সরিয়ে ফেললো। ইমতিয়াজের এমন কান্ডে খানিকটা হাসে রাগান্বিতা। বলে,
“আরে ভয় পাচ্ছেন কেন আমিই তো!’

ইমতিয়াজ তাকালো পুরো বিয়ের সাজেই তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ কিছুটা অবাক হয়ে বললো,
“তুমি এখনো ঘুমাও নি কেন?”
“ঘুম আসছে না।”

উত্তরে ইমতিয়াজ আর কিছু বলে না। রাগান্বিতা নদীর দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকালো রাতের ফুড়ফুড়ে বাতাস তাকে ছুঁয়ে দিলো। রাগান্বিতা চোখ বন্ধ করে পুরো বাতাসটা ফিল করলো। ইমতিয়াজ মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো রাগান্বিতার মুখের দিকে রাতের চক চক করা জোৎস্না ভরা আলোতে রাগান্বিতাকে যেন আরো বেশি মাধুর্যপূর্ণ লাগছে। মেয়েটা একটু বেশি সুন্দর।

ইমতিয়াজ রাগান্বিতা পাশ দিয়ে দাঁড়ালো। বললো,
“আমার বউটা একটু বেশি সুন্দর।”

রাগান্বিতা কথাটা শুনতেই চোখ খুলে ফেললো ‘আমার বউটা’ কথাটা যেন তড়িৎ গতিতে তার কানে বেজে উঠলো। রাগান্বিতা মুচকি হাসলো। বললো,
“ওই চাঁদের থেকে নয়।”

ইমতিয়াজ চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললো,
“যদি বলি তুমি মিথ্যে বলছো। তুমি চাঁদের থেকেও বেশি সুন্দর।”
“আপনি বানিয়ে বলছেন।”
“তুমি মানো কিন্তু বলতে চাইছো না।”

রাগান্বিতা কি বলবে বুঝতে না পেরে হেঁসে ফেলে। রাগান্বিতার হাসি দেখে ইমতিয়াজ বুকে হাত দিয়ে বললো,
“ওভাবে হেঁসো না তো আমার বড্ড লাগে।”

রাগান্বিতা এবার ইমতিয়াজের চোখের দিকে তাকালো। বললো,
“আমার যে আরো লাগে।”
“মানে?”

এবার উচ্চ স্বরে হাসে রাগান্বিতা। বলে,
“মানেটা আরেকদিন বলবো।”
“আজ বললে কি হবে।”
“আপনার আগ্রহ কমে যাবে।”
“আগ্রহ কমবে কেন?’’
“বলে দিলেই বুঝে যাবেন।”
“তুমি আমায় চেনো না আমি,

আর কিছু বলার আগেই রাগান্বিতা ইমতিয়াজের ঠোঁট চেপে ধরলো। বললো,
“হুস, সমস্যা নেই চিনে নেবো। আপনি তো এখন আমারই।”

রাগান্বিতার এতটুকু কথার মাঝে ইমতিয়াজের ভিতরটা কেমন করে উঠলো। সে দ্রুত দু’কদম পিছিয়ে গেল রাগান্বিতার থেকে। বললো,
“আমি এখন তোমারই তাই না রাগান্বিতা।”

খানিকটা লাজুকভাব নিয়ে বলে রাগান্বিতা,
“হুম।”

এরপর এদের মাঝে অনেকক্ষণ নীরবতা চলে দুজনেই দাঁড়িয়ে থাকে রেলিং ধরে। কথা আর বলে না।”

সময় চললো। হঠাৎই রাগান্বিতা আবদার করে বললো,
“চলুন বসি।”
“এখানে?”
“হুম।
“আজ থাক এভাবে গা ভর্তি গহনাগাঁটি নিয়ে এখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না তুমি বরং কেভিনে যাও।”
“আপনার কি ভয় করছে?”

ইমতিয়াজ জবাব দেয় না। রাগান্বিতা আবার বলে,
“আমার কিন্তু করছে না আপনি আছেন তো। আর এখানে কেউ নেই। চলুন বসি।”

ইমতিয়াজ আর বারণ করতে পারলো না। মেয়েটা এত দ্রুত তাকে এত বিশ্বাস করে নিলো। অতঃপর তারা গিয়ে বসলো জাহাজের এক কিনারায় পা ঝুলিয়ে। এতরাতে এভাবে বসে থাকাটা ঠিক কতটা যুক্তিযুক্ত ইমতিয়াজ জানে না। কিন্তু আশেপাশে কেউ নেই সমস্যা হবে না হয়তো।”

জাহাজ ছুটছিল তার নিজ গতিতে। রাগান্বিতা ইমতিয়াজ পাশাপাশি বসে। দুজনেই চুপচাপ রাগান্বিতা বললো,
“পরিবেশটা সুন্দর না।”

উত্তরে শুধু এতটুকুই বলে ইমতিয়াজ,
“হুম।”
—-

রাগান্বিতার রুমে বসে ওর একটা শাড়ি জড়িয়ে ধরে কাঁদছে দাদিমা। মেয়েটা চলে গেল, রাগান্বিতার এভাবে বিয়ে হয়ে যাবে এটা কখনো ভাবে নি দাদিমা। কুহুর বিষয়টা ভাবলে আজও তার বুক ফাঁটে।

“এভাবে কাঁদছো কেন?”

দাদিমা চমকে উঠলেন সামনেই রাগান্বিতার বাবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন,
“কই কানতাছি নাতো চোহে কি জানো একটা গেছে।”

রাগান্বিতার বাবা বিছানায় বসলেন। বললেন,
“পোলার কাছ থেকে লুকাইয়া লাভ আছে কও।”

এবার দাদিমা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। আরো উচ্চস্বরে কাঁদলেন। বললেন,
“মনডা বড্ড কানতাছে রে মোতালেব নাতিডা এমনে চইল্লা গেল।”
“ভয় পাইও না নামাজ পইড়া দোয়া কইরো দেখবা সব ভালো হইবো।”
“কুহুর কথা ভাবলেই মনডা ভয়ে কাইপ্পা উঠে রে।”

মোতালেব দ্রুত বললো,
“হু চুপ তাহো কেউ শুইন্না ফেলবো। ওর কথা কাউরে কবা না রাগান্বিতারে তো নাই।”
“একবার কইলে ভালো হইতো না।”
“আগে হইলে বলতাম কইয়ো কিন্তু এহন তো ওর বিয়া হইয়া গেছে আর বলা লাগবে না।”
“ওই পোলাডার হাতে তুইল্লা দেওয়া কি ঠিক হইলো মোতালেব।”

জোরে একটা নিশ্বাস ফেললো মোতালেব। বললো,
“আর কি করতাম কও উপায় কি আর ছিল। তবে ছেলেডা মনে হয় ভালোই হইবো। আমি রাগান্বিতার জন্য ওই পোলাডার চোখে মায়া দেখছি।”

মোতালেবের কথা শুনে ফট করেই বলে উঠলেন দাদিমা,
“আমরা যা চোহে দেহি তা কি সবসময় হাছা হয় মোতালেব।”

মোতালেব জবাব দিলেন না। এমন সময় হঠাৎই বাহিরে শোরগোল শোনা গেল। কারা যেন চেঁচিয়ে বলছে, কেডা জানি আবার খুন হইছে তালুকদার সাহেব?”

এত রাতে আচমকাই এমন বার্তা শুনতেই বুকের ভিতর দক উঠলো দাদিমার। আর মোতালেব তালুকদার যেন অবাক হলেন। দ্রুত রাগান্বিতার রুম থেকে বেরিয়ে নিচে ছুটে গেলেন। দাদিমাও বেরিয়ে আসলেন রাগান্বিতার বাবার পিছু পিছু।

হতভম্ব হয়ে রুম থেকে বের হলো রেজওয়ান, বোনের চিন্তায় সেও ঘুমাতে পারছিল না। রেজওয়ান বের হতেই বাবাকে নজরে আসলো তার। কিছুটা চিন্তিত কণ্ঠে বললো,
“বাহিরে শোরগোল শুনছো বাবা?”
“হুম তা শুনেই তো আসলাম চলো তো দেখি,

বলেই রেজওয়ান আর মোতালেব তালুকদার চললো বাড়ির বাহিরে। বাড়ির উঠানে ভিড় পড়েছে আবার। এমন ভিড় দেখে খানিকটা আন্দাজ করতে পেয়েছেন রাগান্বিতার বাবা। রেজওয়ান সরাসরি জিজ্ঞেস করলো সবাইকে,
“কি হয়েছে?”

একজন বললো,
“কি কমু রেজওয়ান বাবা মুজিবর গো বাড়ির পিছনের ডোবায় একটা পোলার লাশ ভাইসা উঠছে কে যেন মাইরা হালাই থুইছে।”

রেজওয়ান অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
“কার লাশ?”

সবাই সরে গেল লাশের কাছ থেকে। লাশের চেহারাটা দেখতেই রাগান্বিতার বাবা যেন থমকে গেলেন। কারন লাশটা আর কারো নয় মাহাদের!’

#চলবে……