Sunday, August 24, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 476



প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-১৪

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-১৪
________________
গায়ে হলুদ লাগিয়ে নিশ্চুপে বাড়ির উঠানে বসে আছে রাগান্বিতা। বুক ভরা দীর্ঘশ্বাস ব্যতীত আর কিছু ফিল হচ্ছে না। সেই দীর্ঘশ্বাসের ভিড়েই গায়ে কলসি ভরা ঠান্ডা পানি ঢালা হলো গায়ে, করানো হলো গোসল। গায়ে বয়া হলুদগুলো নিমিষেই একটু একটু করে মুছে যাচ্ছিল শরীর থেকে। রাগান্বিতা তার চোখ বন্ধ করে নিলো। সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠলো সেই ভরসন্ধ্যা বেলা বাঁশির সুর শুনে দেখতে যাওয়া সেই ইমতিয়াজ সিকদারকে। রাগান্বিতা চোখ খুলে ফেললো এটা কি ঠিক হচ্ছে বিয়ের আসরে অন্য পুরুষের চেহারা ভেসে ওঠা। রাগান্বিতা চোখ খুলে ফেললো আর ভাবলো না কিছু।

অন্যদিকে কলাগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল ইমতিয়াজ সে এসেছিল এক ঝলক হলদে রাঙা রাগান্বিতাকে দেখতে। এক ঝলক দেখলো। নিচু স্বরে আওড়ালো,
“তুমি এত মায়াবী কেন রাগান্বিতা! তোমাকে দেখলেই আমার বড্ড মায়া লাগে।”

ইমতিয়াজ কথাটা বলেই চলে গেল। হঠাৎই রাস্তার পথে দেখা মিললো রাগান্বিতার বাবার সাথে তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল রেজওয়ান দুজনেই বিয়ের কাজে ব্যস্ত। ইমতিয়াজ তেমন কিছু না বলেই পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলো তাদের, কিন্তু যাওয়া আর হলো না তাকে ডাকলেন রাগান্বিতার বাবা। বললেন,
“এই ছেলে তুমি ইমতিয়াজ না এখানে কি করছো?”

ইমতিয়াজ এগিয়ে গেল স্পষ্ট ভাষায় বললো,
“জি জমিদার সাহেব আমি ইমতিয়াজই,ইমতিয়াজ সিকদার।”
“হুম ঠিক আছে, ঠিক আছে। এখানে কি করছো?”
“তেমন কিছুই করছি না আসলে কাল চলে যাবো তো তাই একটু গ্রাম ঘুরতে বেরিয়ে ছিলাম কিন্তু কখন যে আপনাদের বাড়ির পিছনে চলে এসেছি বুঝতে পারিনি তাই চলে যাচ্ছি আপনাদের বিব্রত করার জন্য দুঃখিত!”

রাগান্বিতার বাবা কেন যেন মুগ্ধ হলেন ইমতিয়াজের কথা শুনে কত সহজে সত্যি কথা নিরদ্বিধায় বলে দিল আবার ক্ষমাও চাইলো। রাগান্বিতার বাবা হাল্কা একটু হাসলেন বললেন,
“ঠিক আছে কোনো ব্যাপার না। কাল বিয়েতে কিন্তু অবশ্যই এসো।”
“জি অবশ্যই আসবো। রাগান্বিতাও বলেছিল আমি যেন বিয়েটা খেয়ে যাই। আমি বিয়ে খেয়েই চলে যাবো। যতই হোক জমিদার কন্যার বিয়ে না আসলে হয়।”
“হুম এসো।”
“জি আজ তাহলে আসি জমিদার সাহেব?”
“হুম এসো।”

ইমতিয়াজ আর দাঁড়ালো না চলে গেল সামনে। তবে যাওয়ার আগে রেজওয়ানের দিকে তাকিয়ে এক ঝলক মিষ্টি হেঁসেছিল রেজওয়ানও হেঁসেছে। ইমতিয়াজ বাড়ির বাহিরে বেরিয়ে গেল। দূর থেকে বাড়ির বারান্দার পথ পেরিয়ে ভেজালো শরীরে গামছা পেঁচিয়ে যাওয়া রাগান্বিতা তা খেয়াল করলো। সে বুঝেছে ইমতিয়াজ এসেছিল কিন্তু তার সাথে দেখা হলো না। কিন্তু সে তো জানলো না, আড়ালে একঝলক তাকে দেখেই চলে যাচ্ছে ইমতিয়াজ!’
——–
রাতের আকাশ জুড়ে ঝলমল করছে তারা, চাঁদ উঠেছে মাঝখান দিয়ে। গাছের পাতা নড়ছে বারংবার। কি ছমছমে ব্যাপার! রাগান্বিতা দাঁড়িয়ে আছে তার রুমের জানালার ধারে। কাল এমন সময় বুঝি সে থাকবে শশুর বাড়ি। মাহাদ নামের ছেলেটি হয়ে যাবে তার স্বামী। রাগান্বিতার কেন যেন খারাপ লাগছে মাহাদকে তার স্বামী হিসেবে মানতে, কেন যেন মেনে নিতে ইচ্ছে করছে না। রাগান্বিতার ইমতিয়াজকে বড্ড মনে ধরেছে তার জন্য মনটা কাঁদছে। একটা ষোলো বয়সী কন্যার মাথায় এসব ভাবনা আসা কি আধও সঠিক। সে বুঝি ভুল করছে যা হওয়ার নয় তা নিয়ে ভাবছে এগুলো ঠিক হচ্ছে না। রাগান্বিতা চোখ বন্ধ ফেললো।

.
একটা সুন্দর সকাল। বিয়ের আমেজে চারপাশ মুখরিত। বাড়ির উঠানে এক কর্নারে ইট পেতে চুলা বানিয়ে বড় বড় ডেগে বিয়ের রান্নার কাজ চলছে। পর পর দুটো ইটের চুলোয় রান্না হচ্ছে। গ্রামের সকলে হাতে হাতে কাজ করছেন। বাবুর্চিও ডাকা হয়েছে। রাগান্বিতার চাচা মজিদ তালুকদার দারুণ রান্না করেন গ্রামগঞ্জের কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান পড়লেই সবার আগে তাকে ডাকা হয়। সেও ভাবে নি হঠাৎ করেই ভাইজান রাগান্বিতার বিয়ে দিয়ে দিবে। তবে আবার ভাবলো বুঝি বড় মেয়েটার কার্যক্রমের ভয়ে।’

দুপুর ঠিক বারোটা। কাটফাটা রোদ্দুর উঠেছে গ্রাম জুড়ে। গরমের তৃষ্ণায় বুঝি সবারই প্রাণ যায় যায়। সেই রোদের তাপেই বাড়ির উঠানে পা রাখলো ইমতিয়াজ। পড়নে তার সাদা পাঞ্জাবি। চুলগুলো গোছানো, চোখে চশমা নেই। চশমাটা সবসময় ঠিক লাগে না ইমতিয়াজের মাঝে মধ্যে মাথা ব্যাথা করলে পড়ে। আর কতক্ষণ পরই রাগান্বিতার বিয়ে কাজী সাহেবও ইতিমধ্যে এসে পৌঁছেছে রাগান্বিতাদের বাড়ির উঠানে। রান্নার কার্যক্রম প্রায় শেষের দিকে ফিন্নি চড়িয়েছেন তারা তাও হয়ে এসেছে। খাবার শেষে ফিন্নি দেয়া এখানকার একটা রিচুয়াল বলা যায়। সব বিয়ের ক্ষেত্রেই ফিন্নিটা মাস্ট থাকবেই।

ইমতিয়াজ এদিকে সেদিক ঘুরে তাকিয়ে চলে গেল বাড়ির ভিতরে। হাতে তার একগুচ্ছ গোলাপ ফুল। ইমতিয়াজ নিরদ্বিধায় সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো ঘর ভর্তি মানুষের আনাগোনা থাকায় তাকে কেউ তেমন নজরে আনলো না।’

দুপুরের রোদ্দুরে পোড়া গরমের মাঝে হাতে পাখা নিয়ে আতিব আর গ্রামের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা গোল হয়ে বসে আছে রাগান্বিতার পাশে। রাগান্বিতাকে বাতাস করছে তারা। রাগান্বিতার বুকটা কেমন যেন করে উঠলো তার মনে হলো আবার বুঝি কেউ এলো। পরান পাখি বড্ড ছটফট করছে তার। সেই ছটফটের মাঝেই তার রুমের দরজায় নক করলো কেউ। স্পষ্ট স্বরে ভেসে আসলো এক পুরুষালির কণ্ঠ। কানে বাজলো কেউ বললো,
“আসবো?”

রাগান্বিতা থমকে গেল বিয়ের ভাড়ি সাজ আর গাড়ো চোখের কাজল নিয়ে সে তাকালো দুয়ারের দিকে। সাদা পাঞ্জাবি পরিধিত চশমা বিহীন দেখা মিললো সেই মানুষটির। সে দেখলো, গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ছেলেটার দিকে। কি সাহস ছেলেটার এভাবে এসে পড়লো তার রুমে। কেউ দেখে ফেলার ভয়ডর নেই নাকি। রাগান্বিতা চোখের ইশারায় ভিতরে আসতে বললো। ইমতিয়াজ এলো, রাগান্বিতা ধীরে ধীরে লাল বেনারসি ধরে বিছানা ছেড়ে নামলো। ইমতিয়াজ তার চোখের তৃষ্ণা মিটালো। লাল রঙা বেনারসি শাড়ি, গা ভর্তি গহনাগাঁটি, কোমড়ে বিছা, হাত ভর্তি সোনার অলংকার, নাকে অলংকার, ঠোঁটে লিপস্টিক, কাজল কালো চোখ। রাগান্বিতার এই রূপ যেন নিমিষেই গোটা এক পুরুষজাতি ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে। মেয়েটা এত বেশি সুন্দর কেন?

ইমতিয়াজ চোখ সরিয়ে ফেললো। নীরবে বললো,
“আপনার এই রূপের কাছে আমার আনা এই হাতের গোলাপও বুঝি তুচ্ছ লাগছে রাগান্বিতা।”

রাগান্বিতা কিছু বলে না তাকায় ইমতিয়াজের হাতের ফুলগুলোর দিকে। বলে,
“আমার জন্য?”

সম্মতি জানায় ইমতিয়াজ। বলে,
“হুম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না আনাই ঠিক ছিল। আপনি নিজেই তো একটা জলন্ত ফুল।”

রাগান্বিতা এবারও এ কথার জবাব দেয় না। নিজের হাতটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
“এনেছেন যখন দিন আমায়।”

ইমতিয়াজ দিল। বললো,
“একটু সাবধান কাটা ছাড়িয়েছি তাও আল লাগতে পারে।”
“একটু না হয় লাগুক ক্ষত। আপনায় তো আর পাওয়া হলো না আপনার দেয়া ফুলের আঘাতই না হয় নিলাম।”

ইমতিয়াজ হাসে। ফিস ফিস করে বলে,
“ইমতিয়াজ যে খুব ধারালো অস্ত্র ষোড়শী কন্যা যাকে ধরতে গেলে ক্ষত ছাড়া আর কিছুই মিলতো না।”

রাগান্বিতা এবার দমলো না। নিজেও ফিস ফিস করে বললো,
“ইমতিয়াজ পাথর হলে রাগান্বিতাও সেই পাথরে ফুঠে ওঠা ফুল হতো। মিলন হলে আঘাত শেষে সেই অস্ত্রের ধার কমিয়ে প্রেমের ফুল ফোটাতো।”

ইমতিয়াজ দু’কদম পিছিয়ে গেল। বিস্মিত স্বরে বললো,
“ইমতিয়াজের মায়াতে বেশি আটকিয়েও না মেয়ে, সে যে ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই দিতে পারবে না।”

কথাটা বলেই আর দাঁড়ালো না ইমতিয়াজ দ্রুত নিচে চলে এলো। রাগান্বিতা ঠায় দাঁড়িয়ে শুধু দেখেই গেল ইমতিয়াজের যাওয়াটা আচমকাই হাতে কাটা বিঁধলো রাগান্বিতার সে তাকালো তার হাতের দিকে বাম হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। আঘাত লেগেছে। রাগান্বিতা স্তব্ধ হয়ে আঘাত প্রাপ্ত আঙুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনি কাঁটার আঘাতই দিলেন ইমতিয়াজ,ভালোবাসার সুভাস আর ছড়াতে পারলেন না।”
—-

সময় গড়ালো দুপুর ছাড়িয়ে বিকেল হওয়ার পূর্বাভাস আসছে। চিন্তিত মুখে বসে আছে সবাই কারন বরপক্ষের আসার কোনো নাম গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না। কথা ছিল যোহরের নামাজ সেরেই বিয়ে পড়ানো হবে। কিন্তু যোহর পেরিয়ে আসর চলে আসলো তাও তাদের খবর নেই। রাগান্বিতার বাবার মাথায় হাত সে কিছু বুঝতে পারছে না। কাশেমকে পাঠিয়েছে মাহাদের বাড়ি খবর আনতে। অনেক্ক্ষণ পর কাশেম ছুটে আসলো। থমথমে কণ্ঠে বললো,
“সর্বনাশ হইয়া গেছে ভাইজানেরা মাহাদকে নাকি খুঁইজ্জা পাওয়া যাচ্ছে না কাল রাইত থেইক্কা।”

সঙ্গে সঙ্গে পুরো জমিদার বাড়ি থমকে গেল। রাগান্বিতার বাবা পড়ে যেতে নিলেন তাকে ধরলো রেজওয়ান। এটা কি হলো! এখন মেয়েটার জীবনটার কি হবে? বিয়ে ভেঙে যাওয়া মেয়েকে কেউ কি আর বিয়ে করতে চাইবে! কিন্তু মাহাদ গেল কই! হঠাৎ করে নিখোঁজ হলো কেন!’

#চলবে……

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-১৩

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-১৩
________________
বাড়ি জুড়ে উৎসবের মেলা। গায়ে হলুদের তোড়জোড় চলছে সকাল থেকে। লাল, নীল, হলুদসহ নানা রঙের রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো হয়েছে রাগান্বিতাদের বাড়ির উঠোনটা। গ্রামের আশপাশের মেয়ে বউরা ভীড় করছে রাগান্বিতাদের বাড়ির চারদিকে। গায়ে হলুদের জন্য হলদি, গিলা, মেহেন্দি পাতা, পান সুপুারিসহ ল্যাম দিয়ে সাজানো হচ্ছে ডালা। কোলে কলসি চেপে আম গাছের মাঝখানের ডালসহ পাতা দিয়ে কলসির মুখের ভিতর দিয়ে খানিকটা ঢেকে বাড়ির উত্তর দিকের বড় খালটায় দিকে যাচ্ছে সবাই পানি আনার জন্য। সেই পানি দিয়েই, রাগান্বিতার গায়ে হলুদ মাখিয়ে গোসল করানো হবে।’

বিয়ের তোড়জোড়ে পুরো তালুকদার ভিলা মেতে উঠেছে। রাগান্বিতার বাবা সকাল থেকেই এটা ওটা নিয়ে কাজ করেই যাচ্ছেন রেজওয়ানও বসে নেই। তালুকদার ভিলার কাজের লোক রামুকেও খবর দেয়া হয়েছিল কিন্তু তার বাবা অনেক অসুস্থ থাকায় আসতে পারি নি।’

বাড়ির উঠানে পাটা পুঁতা বিছিয়ে হলুদ,গিলা আর মেহেন্দি পাতা বাটছেন রাগান্বিতার দাদিমা, সঙ্গে নারীরা তাদের প্রচলিত হয়লা গান করছেন। আনন্দে মাতয়ারা হচ্ছে পুরো তালুকদার ভিলা। ছোট ছোট বাচ্চারা নাচছে মন খুলে, গ্রামবাসীরা কাজ করছে আনন্দ নিয়ে।

গায়ে হলুদ রঙের একটা শাড়ি পড়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে রাগান্বিতা। হলদে ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে তাকে। রাগান্বিতার মন ভালো নেই তার বড্ড খারাপ লাগছে এই মুহূর্তে তার বিয়ে করার একদমই কোনো ইচ্ছে নেই। কিন্তু বাবা, রাগান্বিতা তার গালে হাত দিলো বাবার দেয়া চড়টা সে মনে করলো এমনটা নয় রাগান্বিতা খুব বেশি আঘাত পেয়েছে বাবার চড় দেয়ার জন্য তার খারাপ লাগছে তার থেকে তার বাবা কিছু লুকাচ্ছে বলে।

রাগান্বিতা বুঝেছে কোনো এক অজানা ভয়ের কারণে তার বাবা তাকে বিয়ে দিতে চাইছে সঙ্গে এই কেশবপুর ছাড়ার জন্য বলছে। কিন্তু এমন কি থাকতে পারে যার জন্য তার বাবা তাকে দূরে সরানোর জন্য এতটা উতলা হয়ে গেছে। তাকে পাঠানো ওই চিঠিগুলো কে লেখে এটাই বুঝতে পারছে না রাগান্বিতা? এই গ্রামের যে কেউ নয় এটা সে বুঝেছে। তবে কোথাকার সে?”

রাগান্বিতার রুম কড়া নাড়লো। রাগান্বিতা পিছন ঘুরলো তার রুমের দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে আতিক। মুখটা শুঁকনো। রাগান্বিতা এগিয়ে গেল। ধীর স্বরে বললো,
“কিছু কি বলবি?”

আতিক তার দিকে একটা চিরকুট এগিয়ে দিয়ে বললো,
“এইডা আমনের জন্য আফা।”

রাগান্বিতা নিলো। বিস্মিত হলো খুব। বললো,
“এটা কোথায় পেলি তুই?”

আতিক কিছু বললো না দৌড়ে ছুটে গেল নিচে। রাগান্বিতা ডাকলো একবার কিন্তু তাও সে দাঁড়ালো না। রাগান্বিতা চিঠিটার দিকে চেয়ে রইলো অনেকক্ষণ। তার রাগ হলো, নাকি ভালো লাগলো, নাকি অবাক হলো, নাকি ঘাবড়ে গেল কোনোটাই বুঝলো না। কারণ এই মুহূর্তে তার মধ্যে এই চিরকুটের প্রতি কোনো অনূভুতি কাজ করছে না। রাগান্বিতা তাও চিরকুটটা খুললো। দুইটা অক্ষর লেখা ছিল শুধু,
“ঠিক দ্বিপ্রহর!’

রাগান্বিতা শব্দ দুটো উচ্চারণ করলো তবে বেশি ভাবলো না। এই বাক্যের হাতের লেখা ভিন্ন এ ব্যক্তি সে নয়। এবার রাগান্বিতার টনক নড়লো এ যখন সে নয় তাহলে কে? রাগান্বিতার ভাবনার মাঝেই দাদিমা রুমে হাজির হলেন। বললেন,
“রাগান্বিতা আহো তোমারে এহন হলুদ মাখানো হইবো।”

রাগান্বিতা চমকে উঠলো হাত থেকে চিরকুটটা পড়ে গেল তার। পরমুহূর্তেই পা দিয়ে সেটা চেপে ধরে দাদিমার দিকে ঘুরে তাকালো। বললো,
“তুমি যাও আমি আসছি।”
“রাগ হইও না বুবু দেখবা তোমার জীবনডা অনেক সুখের হইবো।”

রাগান্বিতা শুনলো মাথা নাড়িয়ে বললো,
“আমি রাগ হই নি আমি বুঝেছি তোমরা কোনো কারণে আমার ভালোর জন্যই এই বিয়েটা দিতে চাইছো। বাবাকেও বলে দিও আমার তার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই।”

রাগান্বিতার বাবা শুনলেন কারণ সে মেয়ের রুমের দরজার বাহিরেই যে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মাত্রই আসলেন তিনি দাদিমার পিছন পিছন রাগান্বিতার অবস্থাটা বুঝতে। রাগান্বিতার বাবা জানে তার মেয়ে খুশি নেই তারপরও কি করার। রাগান্বিতার বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওখান থেকে চলে গেলেন।’

এদিকে দাদিমা। বললো,
“চলো তাইলে এহন? তোমারে গায়ে হলুদ করান লাগবো।”
“হুম আসছি আমি তুমি যাও।”

দাদিমাও শুনলেন আর জোর না করে বললেন,
“ঠিক আছে। একটু তাড়াতাড়ি আইয়ো।”
“হুম আমি এক্ষুনিই আসছি।”

দাদিমাও আর কথা না বারিয়ে চলে গেলেন। দাদিমা যেতেই রাগান্বিতা পায়ের নিচ থেকে চিরকুটটা বের করে তার পড়ার টেবিলের ডয়ারের ভিতরে রাখলো। তারপর আর না ভেবে দ্রুত ছুটে গেল নিচে।
—–

নিজের সেই ছোট্ট কুঁড়েঘরের নিচে মাটিতে মাথার নিচে দুই হাত দিয়ে শুয়ে আছে ইমতিয়াজ। কাল রাগান্বিতার বিয়ে। এই বিয়ে খেয়েই সে চলে যাবে। শহরের তার ব্যবসার না জানি তাকে ছাড়া কি অবস্থা হচ্ছে। ইমতিয়াজ মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারে আছে অবশ্য আছে বললে ভুল হবে সে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েই এখানে এসেছে আর ক’দিন পর রেজাল্ট দিলো বলে। রাগান্বিতার সাথে ইমতিয়াজের বয়সের তুলনা করলে গুনে গুনে সে রাগান্বিতার থেকে ৯ বছরের বড়। আর মাহাদের সাথে প্রায় ১০ বছরের ওই সেইম সেইমই ধরা যায়। ইমতিয়াজ তার মাথা ঝাঁকড়ালো এগুলো কি ভাবছে সে। মাঝে মাঝে নিজের কিছু উদ্ভট কথা শুনলে ইমতিয়াজের বড্ড রাগ উঠে নিজেই নিজেকে খুন করার ইচ্ছে জাগে। কিন্তু তাকে তো খুন হলে চলবে না।

ইমতিয়াজের বাড়ি দৌড়ে আসলো মোকলেস। বললো,
“ইমতিয়াজ ভাই রাগান্বিতা আফার গায়ে হলুদে যাইবেন না?”

ইমতিয়াজের কোনো হেলদোল দেখা গেল না। সে নিশ্চুপ স্বরে বললো,
“না মাইয়া মানুষের গায়ে হলুদে যাইয়া আমরা কি করতাম?”

মোকলেস হাসলো। ইমতিয়াজের পাশে শুয়ে বললো,
“জানেন ভাই আমনে যহন আমার মতো কইরা কতা কন আমার যে কি ভালো লাগে? কালই চইল্লা যাবেন ভাইজান?”

প্রচন্ড মন খারাপ হলো মোকলেসের। ইমতিয়াজ মোকলেসের মাথায় হাত বুলালো। বললো,
“আরে মন খারাপ করিস কেন আমি আবার আসবো তো?”
“সত্যি আইবেন ভাইজান?”

ইমতিয়াজ আশ্বাস দিলো। বললো,
“হুম।”

মোকলেস খুশি হলো। আচমকাই ইমতিয়াজকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আমনে খুব ভালো ভাইজান।”

ইমতিয়াজ অবাক হলো মিটমিট করে হাসলো শুধু কিছু বললো না। তবে তার মাথায় ঘুরছিল মোকলেসের বলা কথাটা “আমনে খুব ভালো ভাইজান!”
—-
(১)❝পুসকুনি পূবপাড় কালা দলা মাটি,
সেই মাটিতে জন্ম হইছে মেন্দিনাগাছটি
মেন্দি গাছটির আড়ালে রাগান্বিতা-মাহাদ দুইজনে
হাতে বাঁশি মুখে পান বাজায় বাঁশি মাহাদ চান!❞

(২)❝নতুনও পুসকুনির পাড়ে ভুয়া রইলাম সাইরে সাইরে
ও পানো সখিরে আমি কি ফুল ভাসাইলাম জলে
সেই না ফুলের রেনু খাইয়া রাগান্বিতা গেল পাগল হইয়া।❞

(৩)❝আম্বুলতলা বইয়া বিবি তাম্বুরা টানায়
ফুলোতলা বইয়া বিবি বাবাজানরে বোলায়
বাবাজানের দুয়ারদারে রেশমের বান্দন
তাইয়ার তলে যাইয়া বিবি জুড়িলো কান্দন

বাবায় কইছে,
কাইন্দো না, কাইন্দো না বিবি বেলা হইলো শেষ
জলদি কইরা মেলা করো আপোনার ওই দেশ।

কদ্দুরহানে যাইয়া বিবি ফিরা ফিরা চায়
আজ বুঝি বাবাজানের দালান খালি হইয়া যায়।❞

রাগান্বিতার গায়ে হলুদ মাখাতে মাখাতে এ ধরনের নানা রকমের হয়লা গান গাইছেন গায়ের ভাবি, বউ, দাদিরা। সঙ্গে নারকেল গাছের শলার একটু অংশ নিয়ে রাগান্বিতার হাতে মেহেন্দি লাগানো হচ্ছে। দুটো হাত ভরিয়ে দিচ্ছে সবাই মিলে। রাগান্বিতা ঠায় বসে আছে চুপচাপ কেমন যেন নিজেকে বড্ড অনুভূতিহীন লাগছে। কোথাও গিয়ে বড্ড খারাপ লাগছে কেউ বুঝি ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাকে । হঠাৎই হাল্কা হাওয়া উঠলো। রাগান্বিতার ভিতরটা বুঝি থমকে গেল। সে আশেপাশে তাকালো তার মনে হলো ‘কেউ বুঝি এসেছে তার আশেপাশে, বড় আপন কেউ।”

চলবে……

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-১২

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-১২
________________
হঠাৎই ইমতিয়াজের কণ্ঠটা কানে বাজতেই রাগান্বিতা থেমে গেল। তার পা আঁটকে গেল ওখানেই সে নীরবে পিছন ঘুরে বললো,
“জি বলুন,

ইমতিয়াজ সময় নিলো দু’মিনিট চার’মিনিট করে কতক্ষণ সময় গেল। রাগান্বিতা খানিকটা বিরক্তি নিয়ে বললো,
“কি হলো আপনি কিছু বলছেন না কেন?”

ইমতিয়াজ আর দ্বিধা করলো না ফট করেই বলে উঠল,
“আপনি বেশি ঘর থেকে বের হবেন না। আপনাকে দেখলেই আমার বড্ড বাজে অনুভূতি হয়।”

ইমতিয়াজের কথা শুনে রাগান্বিতা কি বলবে বুঝতে পারলো না। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে মুচকি হেঁসে বললো,
“আমি কোনো সাহায্য কারী নই যে আপনার বাজে অনুভূতি কমানোর জন্য বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিবো।”
“তাহলে সবসময় কাছে থাকুন না।”
“আপনি রাখতে পারলে ঠিক থেকে যেতাম।”

বলেই রাগান্বিতা আর দাঁড়ালো না ফট করে কি বলে ফেললো তার কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে। অন্যদিকে রাগান্বিতার কথা শুনে ইমতিয়াজ হেঁসে ফেললো। রাগান্বিতার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে নিম্ন স্বরে বললো,
“কদিন পর যার বিয়ে সে রাখতে পারার কথা বলছে বিষয়টা দারুণ তো।”

ইমতিয়াজ নদীর দিকে ঘুরে তাকালো ঢেউয়ের পানে চাইলো, বাতাস হচ্ছে প্রকৃতি জুড়ে কি সুন্দর হৃদয়টাকে ফুড়ফুড়ে করছে। ইমতিয়াজ তার চোখ বন্ধ করে মনে মনে আওড়ালো,
“কাছে আসলে যে সব জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাবে তুমি কি তা সইতে পারবে রাগান্বিতা?”
——

সন্ধ্যার দিকে নিজ রুমে ল্যাম জ্বালিয়ে বসে আছে রাগান্বিতা। ল্যামের বিন্দু বিন্দু আলোর পানে চেয়ে আছে নীরবে। কি যেন ভাবছে? ইমতিয়াজ নামটা যেন খুব বেশিই হৃদয়ে গেঁথে গেছে। কি এক জ্বালায় পড়লো রাগান্বিতা! ছেলেটা কেন আসলো তাদের গ্রামে। আর কি কোনো গ্রাম ছিল না তাদেরটাই দেখলো। রাগান্বিতার কিছু ফিল হচ্ছে মন বড্ড চাইছে ইমতিয়াজ থাকুক সারাক্ষণ, সর্বক্ষণ তার পাশে। ছেলেটা বুঝি পাগল করে দিলো রাগান্বিতাকে। আচ্ছা প্রেমে পড়া কি এত সহজ। সেই ক’দিন আগে প্রথম দেখলো বিকেলের লগ্নে বাঁশি বাজাতে থাকা সেই ইমতিয়াজকে না শুধু ইমতিয়াজ না ইমতিয়াজ সিকদারকে। রাগান্বিতা আনমনে হেঁসে ফেললো। এমন সময় তার রুমে কড়া নাড়লো তার বাবা। সঙ্গে বললেন তিনি,
“রাগান্বিতা তুমি কি ঘরে আছো?’

রাগান্বিতা পুরো দমে চমকে উঠলো। নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে হতভম্ব হয়ে বললো,
“জি বাবা।”

রাগান্বিতার বাবা ভিতরে ঢুকলেন বিছানায় বসে নিশ্চুপে বলতে লাগলেন,
“আমারে ভুল বুঝিস নারে মা এই বিয়েটা হওয়া খুব দরকার। তোকে যে এই গ্রাম ছাড়তেই হবে। তোর ভালোর জন্যই এই বিয়েটা দিচ্ছি। মাহাদ খুব ভালো ছেলে দেখবি তুই ভালো থাকবি সুখেও থাকবি। পড়াশোনা করার তোর ইচ্ছে থাকলে মাহাদ পড়াবে তোকে বলেছে আমায়। তুই রাগ করিস না রে মা। বাবা তোর ক্ষতি চায় না রে।”

বাবার কথা শুনে বড্ড খারাপ লাগলো রাগান্বিতার কতক্ষণ আগে ইমতিয়াজকে নিয়ে তার ভাবনার কথা মনে পড়তেই ভিতরটা কেমন করে উঠলো সে ভুলেই গেছিল তার যে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। রাগান্বিতা টেবিল ছেড়ে বাবার দিকে এগিয়ে গেল আলতোভাবে বাবার পায়ের কাছে বসে বললো,
“কিসের ভয় পাচ্ছো বাবা আমায় বলো না?”
“সব কথা যে জানতে নেই মা।”
“আমায় বলো বাবা আমি বিয়ে করবো কিন্তু তার আগে আমায় সবটা বলো বাবা! লুকানোর বিষয়টা কি বুবুকে নিয়ে?”

রাগান্বিতার বাবা মাথা নাড়ালেন যার অর্থ হ্যাঁ। রাগান্বিতা যেন পুরোদমে অবাক হলো বাবার কথা শুনে তার মানে তার আন্দাজটা ঠিক ছিল। রাগান্বিতা আরেকটু জোর দিয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করলো,
“বুবু কি তবে আত্নহত্যা করে নি বাবা?”

রাগান্বিতার বাবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“জানি না।”

রাগান্বিতা হতাশ হলো উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
“তুমি কি কাউকে সন্দেহ করছো?”
“না।”
“তাহলে কি বিষয় নিয়ে বুবুর কথা বলবে।”

রাগান্বিতার বাবা কিছু বলবে এরই মাঝে তাকে ডাকলো রেজওয়ান। চেঁচিয়ে বললো,
“বাবা, বাবা কোথায় তুমি?”

রেজওয়ানের কথা শুনে রাগান্বিতা, রাগান্বিতার বাবা দুজনেই যেন চমকে উঠলো। দ্রুত বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“রেজওয়ানের আবার কি হলো?”

রাগান্বিতা আর রাগান্বিতার বাবা দুজনেই হন্তদন্ত হয়ে রুম থেকে বেরুলেন। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে বললো রাগান্বিতার বাবা,
“কি হয়েছে তুমি এভাবে চেচাচ্ছো কেন?”
“কেন চেচাচ্ছি সেটা তোমার গুনোধর ছোট মেয়েকেই জিজ্ঞেস করো।”

রাগান্বিতা যেন অবাক তার ভাইয়ের কথা শুনে বিস্ময়কর চেহারা নিয়ে রেজওয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
“কি করেছি আমি দাদাভাই?”
“তোর নামে কোথা থেকে ঘন ঘন চিঠি আসে রাগান্বিতা?”

রাগান্বিতার পিলে যেন চমকে উঠলো ভাইয়ের কথা শুনে। তার নামে চিঠি আসে এটা তার ভাই কি করে জানলো সে ঘন ঘন চিঠি আসার কথাটা তো কাউকে বলে নি। শুধু ওই একটার কথাই বলে ছিল শুধু বাবাকে। রাগান্বিতার বাবা রাগান্বিতার দিকে একপলক তাকিয়ে রেজওয়ানের দিকে মুখ করে বললো,
“ঘন ঘন কই ওর নামে তো একটাই চিঠি এসেছে।”

উত্তরে বাবার দিকে একটা চিঠি এগিয়ে দিয়ে বললো,
“শুধু একটা না বাবা ওর নামে আরো চিঠি এসেছে।”

রাগান্বিতার বাবা এবার রাগান্বিতার দিকে এগিয়ে গেল বাবার চাহনী দেখে রাগান্বিতা মাথা নিচু করে ফেললো। রাগান্বিতার বাবা রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“এসব কি সত্যি রাগান্বিতা?”

রাগান্বিতা চুপ। রাগান্বিতাকে চুপ থাকতে দেখে ধমকের স্বরে জিজ্ঞেস করলো রাগান্বিতার বাবা,
“কি হলো কথা বলছো কেন এর আগেও চিঠি পেয়েছো তুমি?”

রাগান্বিতা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালো সঙ্গে সঙ্গে তার গালে স্ব-জোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো মোতালেব তালুকদার। উপস্থিত সবাই যেন স্তব্ধ বনে গেল এমনকি রেজওয়ানও সে ভাবে নি চিঠির জন্য রাগান্বিতার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিবে বাবা। রাগান্বিতার বাবা রেগে গিয়ে উচ্চস্বরে বললেন,
“তোমার নামে বার বার চিঠি এসেছে অথচ তুমি আমাদের জানানোর প্রয়োজন মনে করো নি। বেশি বড় হয়ে গেছো নাকি।”

রাগান্বিতা ছলছল দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে রইলো বাবার মুখের দিকে। সামান্য কয়টা চিঠি আসার জন্য তার বাবা তাকে মারলো। এখানে তার কি দোষ সে কি কাউকে বলেছিল তার নামে চিঠি পাঠাতে। রাগান্বিতার বাবা চেঁচিয়ে কাশেমকে ডাকলো। কাশেম দরজার সামনেই দাড়ানো ছিল তাই দেরি না করে দৌড়ে ছুটে এসে বললো,
“এই তো আমি কন সাহেব?”
“তুই এক্ষুণি মাহাদদের বাড়ি যাবি ওর বাবাকে বলবি বিয়ে একসপ্তাহ পর নয় কাল বাদে পরশুই দিয়ে দিবো। রাগান্বিতাকে পরশুদিন এ বাড়ি থেকে বিদায় দেয়া হবে। কোনো কিছু নিয়ে যেন তারা চিন্তা না করে সবটা আমি বুঝে নিবে।”

কাশেম মাথা নুড়িয়ে বললো,
“আইচ্ছা সাহেব।”

কাশেম আর দাঁড়ালো না দ্রুত পা চালালো মাহাদদের বাড়ির যাবার জন্য। রাগান্বিতার বাবা রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বললো,
“এই বিষয় নিয়ে আমরা আর কোনো কথা বলবো না যে যার ঘরে যাও।”

রাগান্বিতার বাবা চলে গেলেন। বাবা যেতেই রেজওয়ান তার হাতের চিঠিটা টেবিলের উপর রাখলো ছুটে গেল বাবার পিছু পিছু বাবা এত তাড়াহুড়ো করছে কেন বিয়েটা নিয়ে?”

রাগান্বিতা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। দূরের রন্ধনশালা থেকে বেরিয়ে দাদিমা অনেক আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ কিন্তু এগিয়ে গেলেন না দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেল। আর রাগান্বিতা মাথা তুলে তাকিয়ে এগিয়ে গেল চিঠিটার দিকে।

কতক্ষণ আগে ডাকপিয়ন এসেছিল তাদের বাড়ির সামনে কিন্তু আজ রাগান্বিতার কাছে চিঠি পৌঁছানোর আগেই রেজওয়ান বাড়ির ভিতর ঢুকে ডাকপিয়নকে জিজ্ঞেস করে এখানে কি? তখনই বলে রাগান্বিতার নামে চিঠি এসেছে। রেজওয়ান চিঠিটা নেয় অন্যকেউ থাকলে দিতো না। কিন্তু রেজওয়ানের রাগ সম্পর্কে ডাকপিয়ন অবগত ছিলেন তাই দিয়ে দেন। ডাকপিয়ন যেতে নিলেই রেজওয়ান প্রশ্ন করে “এমন চিঠি কি আরো এসেছে রাগান্বিতার নামে?” তখন ডাকপিয়ন “হয় আরো আইছিল” বলে দেয়। ব্যস তাতেই রেজওয়ান রেগে যায়। তার বোনের নামে বার বার চিঠি আসে অথচ তারা জানেই না।”

রাগান্বিতা কতক্ষণ চিঠিটার দিকে তাকিয়ে থেকে চিঠিটা হাতে নিলো খাম খুলে দেখলো। সেখানে লেখা,
“কি এক অদ্ভুত ব্যাপার! একখানা মুখ দেখার জন্য হৃদয়টা করছে বড্ড হাহাকার। দেখা কি দিবে সখি? নাকি না দেখেই যৌবন করবো পার!’

রাগান্বিতা লেখাটা পরেই চিঠিটা দুমড়ে মুচড়ে ফেললো। শক্ত করে চেপে ধরে ছুট লাগালো নিজের রুমে। এই চিঠিদাতাকে খুঁজে বার করতেই হবে তাকে। যেভাবে হোক বার করতেই হবে! কে বার বার চিঠি পাঠাচ্ছে তার নামে?”

#চলবে….

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-১১

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-১১
________________
পাত্রপক্ষের সামনে শাড়ি গহনাগাটি পড়ে বসে আছে রাগান্বিতা। চুপচাপ আর লাজুক লাজুক ভাবটা মুখে থাকলেও ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড রকমের রেগে আছে রাগান্বিতা। তবে সে বুঝতে পেরেছে কালকে রাগের চোটে করা পাগলামিটা আর বাবাকে প্রেমপত্রখানা দেখানোর জন্যই আজ এমনটা হয়েছে। রাগান্বিতা চুপটি করে বসে আছে, তাকে দেখতে আসার মতো তেমন কিছু নেই সবাই জানে তালুকদার বাড়ির দুই রূপবতী কন্যার কথা। তারা তো এসেছে সোজা পাকাকথা বলার জন্য খুব শীঘ্রই বিয়ে পড়িয়ে তারা তাদের বউমাকে ঘরে উঠাতে চাইছেন। পাত্রের নাম মাহাদ। পড়াশুনায় বিএ পাস বর্তমানে বাবার বিশাল ব্যবসা সামলায়। দেখতে শুনতে মোটামুটি। মাহাদের বাবা কাদের ব্যাপারী টেবিলের ওপর থাকা মিষ্টির বাটি থেকে একটা মিষ্টি মুখে পুড়ে বললো,
“তালুকদার সাহেব তাইলে সামনের একখান ভালো দিন দেইখাই রাগান্বিতা আর আমার পোলা মাহাদের চাইরহাত এক কইরা দেই।”

রাগান্বিতার বাবা বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললেন,
“ঠিক আছে।”

রাগান্বিতার বাবার কথা শুনে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ উচ্চারণ করলো মাহাদের বাবা। পকেট থেকে একটা সুন্দর সোনার আংটি বের করে পড়িয়ে দিল রাগান্বিতার হাতে। রাগান্বিতা নীরবে হজম করে নিলো পুরো বিষয়টা।
—–

প্রকৃতিতে বিকেলের লগ্ন চলছিল। বর্ষণ হচ্ছিল সারাগ্রাম জুড়ে। রাগান্বিতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ বর্ষণের খানিক ফোঁটা ফোঁটা এসে লাগছে তার মুখে শরীরও ভিজাচ্ছে অল্পস্বল্প। রাগান্বিতার মন ভালো নেই। তার বিয়ে হতে চলেছে সাতদিনের মধ্যে এত দ্রুত সবটা হয়ে যাবে এ যেন কল্পনাও করতে পারে নি রাগান্বিতা। রাগান্বিতার মন খারাপটা ঠিক কোন জায়গায় তাই বুঝচ্ছে না বাবাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে এটার জন্য দুঃখ হচ্ছে নাকি অন্যকোনো কারণ এটাই ধরতে পারছে না সে। তবে তার জানামতে পরিবারকে ছেড়ে যেতে হবে এই জন্য খারাপ লাগতে পারে এছাড়া আর তো কোনো কারণ দেখছে না। সাইকেলের বেল বাজলো রাগান্বিতা চমকে উঠলো তবে ভাবলো না চরম রাগ হচ্ছে। এই চিঠির জন্যই আজ তার এভাবে বিয়ে হতে চলেছে। রাগান্বিতার ভাবনার মাঝেই ওর মাথায় হাত বুলালো দাদিমা। রাগান্বিতা পাশ ফিরে তাকালো বললো,
“আচ্ছা দাদিমা বাবা কি এভাবে হুট করে আমার বিয়ে ঠিক করে কাজটা ঠিক করলো। আমার তো সামনে এসএসসি এক্সাম ছিল বাবার তো স্বপ্ন ছিল অনেক আমায় নিয়ে। তাহলে এমনটা কেন করলো?”

দাদিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“ভয়ে!’

দাদিমার কথা শুনে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো রাগান্বিতা,
“ভয়ে! কিসের ভয়ে?”
“ঠিক ভয়ও কওন যাইবো না দুশ্চিন্তাও হইতে পারে।”

দাদিমার কথা শুনে আর একটু অবাক হলো রাগান্বিতা। বললো,
“আমায় একটু বুঝিয়ে বলবে কি নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে বাবা?”
“মাইয়া মানুষদের বেশি স্বপ্ন দেখতে নাই। বিয়া কইরা স্বামী সংসার এসব নিয়াই থাকতে হয়। বিয়ার সময় বিয়া না করলে পরে ঝামেলা হয় তুমি বুঝবা না।”

রাগান্বিতা কি বলবে বুঝচ্ছে না। অনেকক্ষণ চুপ থেকে আচমকাই বলে উঠল,
“বুবু কিভাবে মারা গেল তুমি তা জানো?”

সঙ্গে সঙ্গে চোখে মুখে ভয়ের আতংক ফুটে উঠলো দাদিমার। দাদিমার রিয়েকশন দেখে আবারও বললো রাগান্বিতা,
“কি হলো দাদিমা বলো আমায় সেদিন সকালে বুবুর রুমে তুমি তো আগে গিয়েছিলে বুবু কি সত্যি আত্মহত্যা করেছিল নাকি,

রাগান্বিতা আরো কিছু বলবে এরই মাঝে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ধমকের স্বরে বললো রাগান্বিতার বাবা,
“রাগান্বিতা।”

বাবার চিৎকার শুনে রাগান্বিতা থমকে গেল এর আগে কখনোই তার বাবা তার সাথে এতটা উচ্চস্বরে কথা বলেনি। রাগান্বিতা তাকিয়ে রইলো তার বাবার মুখের দিকে। রাগান্বিতার বাবা এগিয়ে আসলেন কড়া কণ্ঠে বললেন,
“এক সপ্তাহ পর বিয়ে কে কি করলো কিভাবে মরলো সেটা নিয়ে না ভেবে তোমার আগামী জীবনটা কিভাবে হবে তা নিয়ে ভাবো। কুহুর বিষয়টা নিয়ে আমি আর কোনোদিন তোমার মুখে কিছু শুনতে চাই না।”
“কিন্তু বাবা,,

রাগান্বিতার বাবা হাত দেখিয়ে রাগান্বিতাকে থামিয়ে বললো,
“চুপ করো কোনো কিন্তু নেই এক সপ্তাহ পর তোমার বিয়ে তুমি সেই বিয়ে নিয়েই থাকবে। বিয়ের পর মাহাদ চাইলে তুমি পড়াশোনা করবে নয়তো করবে না এটাই আমার শেষ কথা।”

বাবার কথা শুনে অনেক বড় আঘাত পেল রাগান্বিতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“ঠিক আছে তুমি যা বলবে তাই হবে।”

রাগান্বিতা চলে গেল। দাদিমা ছলছল দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ রাগান্বিতার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনিও চলে গেলেন। আর রাগান্বিতার বাবা আকাশ পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কি যে শুরু হলো তার সংসারে?’
——-

চুংগা দিয়ে নিভে যাওয়া মাটির চুলায় ফুঁ দিচ্ছে ইমতিয়াজ। বাহিরে ঝিরিঝির করে অল্প বৃষ্টি পড়ছে। আগের চেয়ে রেশ অনেক কম। বর্ষার মৌসুমে খিচুড়ি খাওয়ার দারুণ স্বাদ। তাই ইমতিয়াজ খিচুড়ি রান্না করছে। ফুঁ দেওয়ার পর চুলা জ্বলতেই ইমতিয়াজ শুঁকনো ডাল দিলো চুলার মুখে সঙ্গে সঙ্গে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো আগুন। এমন সময় তার বাড়ি ছুটে আসলো মোকলেস হতভম্ব গলায় বললো,
“জানো ইমতিয়াজ ভাই কি হইছে?”

ইমতিয়াজ খিচুড়ি নাড়তে নাড়তে বললো,
“কি হয়েছে?”
“আইজগো রাগান্বিতা আফারে দেখবার আইছিল ওনার নাকি বিয়া হইবো কয়দিন পর।”

মোকলেসের কথা শুনে একটুও চমকালো না ইমতিয়াজ। উল্টো বললো,
“ভালো তো। সুন্দরী মেয়েদের বেশিদিন বাপের বাড়ি রাখতে নাই বিয়ে দিয়ে শশুর বাড়ি পাঠানো উচিত নাইলে কার নজর লেগে যায় বলা যায়।”
“তাই বইল্লা এতো হয়ালে বিয়া দিয়া দিবো।”
“ভালো ছেলে পেলে দিবো না। তা নাম কি ছেলের?”
“মাহাদ।”
“নিশ্চয়ই জমিদারের ছেলে?”
“হ।”
“ভালো। আচ্ছা শোন খিচুড়ি রান্না করছি তোর চেনাজানা যত ছেলেপেলে আছে নিয়া আয় আজ সবাই একসাথে খিচুড়ি খাবো।”

মোকলেস খুশি হলো। বললো,
“আচ্ছা ভাই।”

ইমতিয়াজ আর কিছু বললো না জোরে জোরে খিচুড়ি নাড়তে লাগলো। চোখ মুখের ভঙ্গি খুবই স্বাভাবিক তার।
——

পরেরদিন সকাল ৭টা,,
চুপিচুপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে নদীর পাড়ে হাঁটতে গেল রাগান্বিতা। তার কিছু ভালো লাগে না, বার বার মনে হচ্ছে দাদিমা আর বাবা বুঝি তার থেকে কিছু লুকাচ্ছে। কিন্তু কেন কিছু লুকাচ্ছে। রাগান্বিতার হাঁটতে হাঁটতেই নজরে আসলো নদীর এক কোনায় নৌকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইমতিয়াজের দিকে তবে আজ আর লুঙ্গি ফতুয়া পড়ে নি। শহুরে পোশাক পড়েছে চোখে চশমা গায়ে পাতলা চাদর।রাগান্বিতার এই ছেলেটাকে বড্ড ভালো লাগে, কেন লাগে জানা নেই। ওই যে কথায় বলে না ‘নিষিদ্ধ জিনিসের উপরই মানুষের ঝোঁক বেশি’! রাগান্বিতা চুপচাপ চলে যাচ্ছিল হঠাৎই ইমতিয়াজ বলে উঠল,
“কথা না বলেই চলে যাচ্ছেন যে?”

রাগান্বিতার পা আঁটকে গেল। সে বুঝে না এই ছেলেটা তাকে না দেখেও তার উপস্থিতি টের পায় কি করে? রাগান্বিতা পিছন ঘুরলো। বললো,
“না বাড়িতে বলে আসি নি বাবা জানলে রাগ করবে।”
“ওহ আচ্ছা। শুনলাম বিয়ে নাকি ঠিক হয়ে গেছে।”
“হুম দাওয়াত রইলো আসবেন কিন্তু।”
“জি অবশ্যই সময় থাকলে আপনার বিয়ে খেয়েই আমি গ্রাম ছাড়বো মানে চলে যাবো।”

খানিকটা খারাপ লাগলো রাগান্বিতা। নিশ্চুপ স্বরে বললো,
“চলে যাবেন গ্রাম দেখা হয়ে গেছে?’
“হুম আর কত থাকবো ওদিকে শহরে আমার ব্যবসা লাটে উঠছে।”

ইমতিয়াজের কথা শুনে রাগান্বিতা হেঁসে ফেললো। বললো,
“তাইলে তো আপনায় দ্রুতই যেতে হয়।”
“হুম সপ্তাহ খানেকের মতো আছি তার মধ্যে আপনার বিয়েটা হলে খেতে পারবো নয়তো আমায় যেতে হবে।”

ইমতিয়াজের কথা শুনে রাগান্বিতার হাসি থেমে গেল। গম্ভীর এক আওয়াজে বললো,
“চিন্তা নেই সপ্তাহের মধ্যেই হয়ে যাবে সেটা আপনি খেয়েই যেতে পারবেন।”
“ওহ আচ্ছা তাইলে তো দারুণই খবর।”
“নৌকা নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?”
“কোথাও যাচ্ছি না এখানেই দাঁড়িয়ে আছি চুপচাপ।”
“ওহ। আচ্ছা যাই এখন বাবা জেনে গেলে সমস্যা হবে।”
“ঠিক আছে যান।”

রাগান্বিতা আর দাঁড়ালো না দ্রুত চলে আসতে নিলো নদীর পাড় থেকে। হঠাৎই ইমতিয়াজ ডেকে উঠলো। মধুর কণ্ঠে শুধালো,
“রাগান্বিতা শুনছেন একটা কথা ছিল?”

#চলবে…..

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-১২
________________
হঠাৎই ইমতিয়াজের কণ্ঠটা কানে বাজতেই রাগান্বিতা থেমে গেল। তার পা আঁটকে গেল ওখানেই সে নীরবে পিছন ঘুরে বললো,
“জি বলুন,

ইমতিয়াজ সময় নিলো দু’মিনিট চার’মিনিট করে কতক্ষণ সময় গেল। রাগান্বিতা খানিকটা বিরক্তি নিয়ে বললো,
“কি হলো আপনি কিছু বলছেন না কেন?”

ইমতিয়াজ আর দ্বিধা করলো না ফট করেই বলে উঠল,
“আপনি বেশি ঘর থেকে বের হবেন না। আপনাকে দেখলেই আমার বড্ড বাজে অনুভূতি হয়।”

ইমতিয়াজের কথা শুনে রাগান্বিতা কি বলবে বুঝতে পারলো না। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে মুচকি হেঁসে বললো,
“আমি কোনো সাহায্য কারী নই যে আপনার বাজে অনুভূতি কমানোর জন্য বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিবো।”
“তাহলে সবসময় কাছে থাকুন না।”
“আপনি রাখতে পারলে ঠিক থেকে যেতাম।”

বলেই রাগান্বিতা আর দাঁড়ালো না ফট করে কি বলে ফেললো তার কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে। অন্যদিকে রাগান্বিতার কথা শুনে ইমতিয়াজ হেঁসে ফেললো। রাগান্বিতার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে নিম্ন স্বরে বললো,
“কদিন পর যার বিয়ে সে রাখতে পারার কথা বলছে বিষয়টা দারুণ তো।”

ইমতিয়াজ নদীর দিকে ঘুরে তাকালো ঢেউয়ের পানে চাইলো, বাতাস হচ্ছে প্রকৃতি জুড়ে কি সুন্দর হৃদয়টাকে ফুড়ফুড়ে করছে। ইমতিয়াজ তার চোখ বন্ধ করে মনে মনে আওড়ালো,
“কাছে আসলে যে সব জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাবে তুমি কি তা সইতে পারবে রাগান্বিতা?”
——

সন্ধ্যার দিকে নিজ রুমে ল্যাম জ্বালিয়ে বসে আছে রাগান্বিতা। ল্যামের বিন্দু বিন্দু আলোর পানে চেয়ে আছে নীরবে। কি যেন ভাবছে? ইমতিয়াজ নামটা যেন খুব বেশিই হৃদয়ে গেঁথে গেছে। কি এক জ্বালায় পড়লো রাগান্বিতা! ছেলেটা কেন আসলো তাদের গ্রামে। আর কি কোনো গ্রাম ছিল না তাদেরটাই দেখলো। রাগান্বিতার কিছু ফিল হচ্ছে মন বড্ড চাইছে ইমতিয়াজ থাকুক সারাক্ষণ, সর্বক্ষণ তার পাশে। ছেলেটা বুঝি পাগল করে দিলো রাগান্বিতাকে। আচ্ছা প্রেমে পড়া কি এত সহজ। সেই ক’দিন আগে প্রথম দেখলো বিকেলের লগ্নে বাঁশি বাজাতে থাকা সেই ইমতিয়াজকে না শুধু ইমতিয়াজ না ইমতিয়াজ সিকদারকে। রাগান্বিতা আনমনে হেঁসে ফেললো। এমন সময় তার রুমে কড়া নাড়লো তার বাবা। সঙ্গে বললেন তিনি,
“রাগান্বিতা তুমি কি ঘরে আছো?’

রাগান্বিতা পুরো দমে চমকে উঠলো। নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে হতভম্ব হয়ে বললো,
“জি বাবা।”

রাগান্বিতার বাবা ভিতরে ঢুকলেন বিছানায় বসে নিশ্চুপে বলতে লাগলেন,
“আমারে ভুল বুঝিস নারে মা এই বিয়েটা হওয়া খুব দরকার। তোকে যে এই গ্রাম ছাড়তেই হবে। তোর ভালোর জন্যই এই বিয়েটা দিচ্ছি। মাহাদ খুব ভালো ছেলে দেখবি তুই ভালো থাকবি সুখেও থাকবি। পড়াশোনা করার তোর ইচ্ছে থাকলে মাহাদ পড়াবে তোকে বলেছে আমায়। তুই রাগ করিস না রে মা। বাবা তোর ক্ষতি চায় না রে।”

বাবার কথা শুনে বড্ড খারাপ লাগলো রাগান্বিতার কতক্ষণ আগে ইমতিয়াজকে নিয়ে তার ভাবনার কথা মনে পড়তেই ভিতরটা কেমন করে উঠলো সে ভুলেই গেছিল তার যে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। রাগান্বিতা টেবিল ছেড়ে বাবার দিকে এগিয়ে গেল আলতোভাবে বাবার পায়ের কাছে বসে বললো,
“কিসের ভয় পাচ্ছো বাবা আমায় বলো না?”
“সব কথা যে জানতে নেই মা।”
“আমায় বলো বাবা আমি বিয়ে করবো কিন্তু তার আগে আমায় সবটা বলো বাবা! লুকানোর বিষয়টা কি বুবুকে নিয়ে?”

রাগান্বিতার বাবা মাথা নাড়ালেন যার অর্থ হ্যাঁ। রাগান্বিতা যেন পুরোদমে অবাক হলো বাবার কথা শুনে তার মানে তার আন্দাজটা ঠিক ছিল। রাগান্বিতা আরেকটু জোর দিয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করলো,
“বুবু কি তবে আত্নহত্যা করে নি বাবা?”

রাগান্বিতার বাবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“জানি না।”

রাগান্বিতা হতাশ হলো উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
“তুমি কি কাউকে সন্দেহ করছো?”
“না।”
“তাহলে কি বিষয় নিয়ে বুবুর কথা বলবে।”

রাগান্বিতার বাবা কিছু বলবে এরই মাঝে তাকে ডাকলো রেজওয়ান। চেঁচিয়ে বললো,
“বাবা, বাবা কোথায় তুমি?”

রেজওয়ানের কথা শুনে রাগান্বিতা, রাগান্বিতার বাবা দুজনেই যেন চমকে উঠলো। দ্রুত বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“রেজওয়ানের আবার কি হলো?”

রাগান্বিতা আর রাগান্বিতার বাবা দুজনেই হন্তদন্ত হয়ে রুম থেকে বেরুলেন। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে বললো রাগান্বিতার বাবা,
“কি হয়েছে তুমি এভাবে চেচাচ্ছো কেন?”
“কেন চেচাচ্ছি সেটা তোমার গুনোধর ছোট মেয়েকেই জিজ্ঞেস করো।”

রাগান্বিতা যেন অবাক তার ভাইয়ের কথা শুনে বিস্ময়কর চেহারা নিয়ে রেজওয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
“কি করেছি আমি দাদাভাই?”
“তোর নামে কোথা থেকে ঘন ঘন চিঠি আসে রাগান্বিতা?”

রাগান্বিতার পিলে যেন চমকে উঠলো ভাইয়ের কথা শুনে। তার নামে চিঠি আসে এটা তার ভাই কি করে জানলো সে ঘন ঘন চিঠি আসার কথাটা তো কাউকে বলে নি। শুধু ওই একটার কথাই বলে ছিল শুধু বাবাকে। রাগান্বিতার বাবা রাগান্বিতার দিকে একপলক তাকিয়ে রেজওয়ানের দিকে মুখ করে বললো,
“ঘন ঘন কই ওর নামে তো একটাই চিঠি এসেছে।”

উত্তরে বাবার দিকে একটা চিঠি এগিয়ে দিয়ে বললো,
“শুধু একটা না বাবা ওর নামে আরো চিঠি এসেছে।”

রাগান্বিতার বাবা এবার রাগান্বিতার দিকে এগিয়ে গেল বাবার চাহনী দেখে রাগান্বিতা মাথা নিচু করে ফেললো। রাগান্বিতার বাবা রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“এসব কি সত্যি রাগান্বিতা?”

রাগান্বিতা চুপ। রাগান্বিতাকে চুপ থাকতে দেখে ধমকের স্বরে জিজ্ঞেস করলো রাগান্বিতার বাবা,
“কি হলো কথা বলছো কেন এর আগেও চিঠি পেয়েছো তুমি?”

রাগান্বিতা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালো সঙ্গে সঙ্গে তার গালে স্ব-জোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো মোতালেব তালুকদার। উপস্থিত সবাই যেন স্তব্ধ বনে গেল এমনকি রেজওয়ানও সে ভাবে নি চিঠির জন্য রাগান্বিতার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিবে বাবা। রাগান্বিতার বাবা রেগে গিয়ে উচ্চস্বরে বললেন,
“তোমার নামে বার বার চিঠি এসেছে অথচ তুমি আমাদের জানানোর প্রয়োজন মনে করো নি। বেশি বড় হয়ে গেছো নাকি।”

রাগান্বিতা ছলছল দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে রইলো বাবার মুখের দিকে। সামান্য কয়টা চিঠি আসার জন্য তার বাবা তাকে মারলো। এখানে তার কি দোষ সে কি কাউকে বলেছিল তার নামে চিঠি পাঠাতে। রাগান্বিতার বাবা চেঁচিয়ে কাশেমকে ডাকলো। কাশেম দরজার সামনেই দাড়ানো ছিল তাই দেরি না করে দৌড়ে ছুটে এসে বললো,
“এই তো আমি কন সাহেব?”
“তুই এক্ষুণি মাহাদদের বাড়ি যাবি ওর বাবাকে বলবি বিয়ে একসপ্তাহ পর নয় কাল বাদে পরশুই দিয়ে দিবো। রাগান্বিতাকে পরশুদিন এ বাড়ি থেকে বিদায় দেয়া হবে। কোনো কিছু নিয়ে যেন তারা চিন্তা না করে সবটা আমি বুঝে নিবে।”

কাশেম মাথা নুড়িয়ে বললো,
“আইচ্ছা সাহেব।”

কাশেম আর দাঁড়ালো না দ্রুত পা চালালো মাহাদদের বাড়ির যাবার জন্য। রাগান্বিতার বাবা রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বললো,
“এই বিষয় নিয়ে আমরা আর কোনো কথা বলবো না যে যার ঘরে যাও।”

রাগান্বিতার বাবা চলে গেলেন। বাবা যেতেই রেজওয়ান তার হাতের চিঠিটা টেবিলের উপর রাখলো ছুটে গেল বাবার পিছু পিছু বাবা এত তাড়াহুড়ো করছে কেন বিয়েটা নিয়ে?”

রাগান্বিতা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। দূরের রন্ধনশালা থেকে বেরিয়ে দাদিমা অনেক আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ কিন্তু এগিয়ে গেলেন না দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেল। আর রাগান্বিতা মাথা তুলে তাকিয়ে এগিয়ে গেল চিঠিটার দিকে।

কতক্ষণ আগে ডাকপিয়ন এসেছিল তাদের বাড়ির সামনে কিন্তু আজ রাগান্বিতার কাছে চিঠি পৌঁছানোর আগেই রেজওয়ান বাড়ির ভিতর ঢুকে ডাকপিয়নকে জিজ্ঞেস করে এখানে কি? তখনই বলে রাগান্বিতার নামে চিঠি এসেছে। রেজওয়ান চিঠিটা নেয় অন্যকেউ থাকলে দিতো না। কিন্তু রেজওয়ানের রাগ সম্পর্কে ডাকপিয়ন অবগত ছিলেন তাই দিয়ে দেন। ডাকপিয়ন যেতে নিলেই রেজওয়ান প্রশ্ন করে “এমন চিঠি কি আরো এসেছে রাগান্বিতার নামে?” তখন ডাকপিয়ন “হয় আরো আইছিল” বলে দেয়। ব্যস তাতেই রেজওয়ান রেগে যায়। তার বোনের নামে বার বার চিঠি আসে অথচ তারা জানেই না।”

রাগান্বিতা কতক্ষণ চিঠিটার দিকে তাকিয়ে থেকে চিঠিটা হাতে নিলো খাম খুলে দেখলো। সেখানে লেখা,
“কি এক অদ্ভুত ব্যাপার! একখানা মুখ দেখার জন্য হৃদয়টা করছে বড্ড হাহাকার। দেখা কি দিবে সখি? নাকি না দেখেই যৌবন করবো পার!’

রাগান্বিতা লেখাটা পরেই চিঠিটা দুমড়ে মুচড়ে ফেললো। শক্ত করে চেপে ধরে ছুট লাগালো নিজের রুমে। এই চিঠিদাতাকে খুঁজে বার করতেই হবে তাকে। যেভাবে হোক বার করতেই হবে! কে বার বার চিঠি পাঠাচ্ছে তার নামে?”

#চলবে….

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-১০

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-১০
________________
আকাশটা মেঘলা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবে হবে এমন। গাছের ভিড়ে কেউ বসে বাঁশি বাজাচ্ছে। সেই কেউটা হলো ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে কিছু বলছে না চুপচাপ শুনছে শুধু ইমতিয়াজের বাজাতে থাকা বাঁশির সুর। বেশ লাগছে তার। বেশ কিছুক্ষণ সময় পার হতেই ইমতিয়াজ তার বাঁশি বাজানো থামালো চার সেকেন্ড যেতেই বলে উঠল,
“এতক্ষণ যাবৎ দাঁড়িয়ে আছেন আপনার কি পা ব্যাথা করছে না?”

রাগান্বিতা যেন চমকে উঠলো। সে দেখেছে, সে যতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে ছিল তার একবারও ইমতিয়াজ পিছনে ঘুরে তাকায় নি তাহলে বুঝলো কি করে সে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। রাগান্বিতা কৌতুহলী কিছু বলবে এরই মাঝে ইমতিয়াজ পিছন ঘুরলো। বললো,
“কি হলো কথা বলছেন না যে।”

রাগান্বিতা আশেপাশে তাকিয়ে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে গেল ইমতিয়াজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,
“সরুন।”

ইমতিয়াজ বিনা বাক্যে গাছের আড়াল থেকে সরলো ইমতিয়াজ সরতেই রাগান্বিতা ইমতিয়াজের বসার স্থানটি দখল করে নিলো। বললো,
“আপনি বুঝলেন কি করে আমি আপনার পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম?”

ইমতিয়াজ হাসে রাগান্বিতার কথা শুনে। বলে,
“আমার যে হৃদয় কাঁদে।”

ইমতিয়াজের কথার অর্থ না বুঝে রাগান্বিতা বললো,
“মানে?”
“সব মানের অর্থ বুঝিয়ে দিলে আপনি কি করবেন।”
“দেখুন আপনি সব কথা ঘুরিয়ে বলবেন না তো সেই শুরু থেকেই দেখছি আপনি কথা বলেন কেমন একটা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে।”

ইমতিয়াজ উচ্চস্বরে হেঁসে বলে,
“আপনি হয়তো জানেন না আমার প্যাচাতেই ভালো লাগে।”

রাগান্বিতা কথার প্রসঙ্গ পাল্টানো। বললো,
“এখানে কি করছেন?”
“আপনার আসার অপেক্ষা।”
“আমার অপেক্ষা?”
“হুম।”
“কেন বলুন তো?”
“কেন করবো না বলুন তো।”

চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো রাগান্বিতা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“আপনি একটা বাজে লোক।”

ইমতিয়াজ হেঁসে মৃদু স্বরে জবাব দিল,
“আমি জানি।”

—–
সন্ধ্যার আলাপনে মুখরিত চারপাশ। ঝিঁঝি পোকারা ডাকছে উচ্চস্বরে। বিকেল জুড়ে মেঘলাময় আবহাওয়া থাকলেও বৃষ্টি আর নামে নি। রাগান্বিতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ, মৃদু বাতাসে তার চুলগুলো উড়ছে কিছু একটা অনুভব করতে চাইছে হৃদয় কিন্তু পারছে না। রাগান্বিতা কি ইমতিয়াজের কথা ভাবছে, শুরু থেকেই রাগান্বিতার ইমতিয়াজকে ঠিক কেমন যেন লাগছে অদ্ভুত ভয়ংকর বলে একটা মনে হয়। আচমকাই রাগান্বিতার বারান্দায় সেদিনকার মতো একটা কবুতর ছুটে আসলো এসে বসলো সোজা বারান্দায় রেলিংয়ের সামনে। রাগান্বিতা চমকে উঠলো আচমকাই। কবুতর তার কাছে এসেই জোরে জোরে শব্দ করতে লাগলো। রাগান্বিতা খানিকটা ঘাবড়ে গেল কিন্তু পরমুহূর্তেই এগিয়ে গেল সামনে পুনরায় সেদিনকার মতো কবুতরটার পায়ে কাছে একটা চিঠি পেল। রাগান্বিতা সেদিনকার ভেবে খানিকটা কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটা নিল। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে চিঠিটা খুললো। চিঠিটা খুলতেই সেখানে লেখা দেখলো,

“সে কি জানে তার হাসিটা কত সুন্দর?
তার মায়াবী আঁখিতে প্রেমে পড়ছি প্রতিনিয়ত।”
আমি যা চাই সে কি তা দিবে আমায়
ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছি যে,
একটু বাঁচিয়ে নিবে তো প্রিয়। শোনো না একটা কথা, বিরহে যে অন্তর পুড়ে হচ্ছে ছাই।”

~ ইতি,
নিষ্ঠুর এক প্রেমিক পুরুষ!’

ব্যাস আর কিছু লেখা নেই। রাগান্বিতা হতভম্ব এবার বাড়াবাড়ি হচ্ছে। রাগে চোয়াল শক্ত হলো রাগান্বিতার। কে এই চিঠিদাতা তাকে যে করেই হোক জানতে হবে। কাল গ্রামের প্রতিটা শিক্ষিত পুরুষের হাতের লেখা দেখবে রাগান্বিতা। তাকে জানতেই হবে কে এই প্রেমিক পুরুষ। রাগান্বিতা দৌড়ে তার রুম থেকে বের হলো। বাবাকে জানালো গ্রামের প্রতিটা ছেলের হাতের লেখা দেখতে চায় এমনকি ইমতিয়াজেরও। মেয়ের আচমকা এমন রক্তচন্ডি মুখ দেখে চরম অবাক রাগান্বিতার বাবা। মেয়ের কাছে কারণ জানতে চাইলেও বলে নি কিছু।’

অতঃপর কথা মতো সকাল হতে না হতেই গ্রামের সব শিক্ষিত ছেলেদের হাতের লেখা পরীক্ষা করা হলো কিন্তু কারো হাতের লেখার সাথেই রাগান্বিতার কাছে আসা চিঠিটা মিললো না। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা কিন্তু তাও কারো হাতের লেখা রাগান্বিতার চিঠিটার সাথে মিললো না। রাগান্বিতা হতাশায় পঞ্চমুখ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো বাড়ির সদর দরজার সামনে। গ্রামের প্রায় সবাইকে দিয়েই কিছু লেখানে হলো কিন্তু কিছুই মিললো না। পরিশেষে তালুকদার বাড়িতে আসলো ইমতিয়াজ। সবার তার দিকে চেয়ে রইলো ইমতিয়াজ জানে না এখানে গ্রামের সব ছেলেদের হাতের লেখা কেন পরীক্ষা করা হচ্ছে। ইমতিয়াজ ঢুকেই সোজা চলে গেল রাগান্বিতার সামনে। রাগান্বিতার বাবা পাশেই দাঁড়ানো ছিল।

গ্রামের সবাই একে একে চলে গেলেন যে যার বাড়ির উদ্দেশ্যে। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“আমাকে এখানে কেন ডাকা হয়েছে জমিদার সাহেব?”

রাগান্বিতার বাবা কিছু বলার আগেই রাগান্বিতা বলে উঠল,
“আপনার হাতের লেখা দেখতে চাই।”

ইমতিয়াজ যেন চরম অবাক হলো, এইটা কোনো কথা। গ্রাম শুদ্ধ পুরুষদের হাতের লেখা নেওয়ার কোনো মানে হয় নাকি। ইমতিয়াজ বললো,
“কারনটা কি জানা যায়?”

রাগান্বিতা গম্ভীর আওয়াজে বলে,
“না।”
“তাইলে আমি আমার হাতের লেখা দিবো না।”

এবার রাগান্বিতার বাবা বললো,
“কেন দিবে না?”

ইমতিয়াজ এবার তাকায় রাগান্বিতার বাবার মুখের দিকে। বলে,
“এটা পুরোই অযুক্তিকর একটা বিষয়। কারণ ছাড়া হাতের লেখা কেন নিবেন? আর এই যে সকাল থেকে আপনারা গ্রামের শিক্ষিত ছেলেদের হাতের লেখা নিচ্ছেন কেন নিচ্ছেন এটা বলবেন না।”

রাগান্বিতা বললো,
“একটা ছেলে আমায় মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে তাই কে পাঠিয়েছে জানার জন্য হাতের লেখা পরীক্ষা করা হচ্ছে।”

ইমতিয়াজ যেন চরমভাবে চমকে উঠলো রাগান্বিতার কথা শুনে। অদ্ভুত স্বরে বললেন,
“কি?”
“হ্যাঁ এটাই এর জন্য কারণ বলতে চাইছি না আপনিও কাউকে বলবেন না এবার হাতের লেখা দিন।”

ইমতিয়াজ আর দ্বিধা করলো না। সামনে টেবিলের ওপর রাখা থেকে কাগজ নিলো। কলম ধরে বললো,
“কি লিখবো?”

রাগান্বিতা অনেকক্ষণ চুপ থেকে নিজের হাতে থাকা চিঠিটাই দিয়ে বসলো ইমতিয়াজকে। বললো,
“এটাই লেখুন পুরোটাই লেখুন।”

ইমতিয়াজ চিঠিটা দেখলো, পড়লো অদ্ভুত দৃষ্টিতে চাইলো রাগান্বিতার দিকে। ইমতিয়াজের চাহনী দেখে আবারও বললো,
“কি হলো লেখুন?”

ইমতিয়াজ দোনোমনা করলো। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললো,
“লিখছি।”

রাগান্বিতা তাকিয়ে রইলো ইমতিয়াজ লেখার দিকে পরেই চোখ সরিয়ে ফেললো। ইমতিয়াজ কলম নাড়াতে নাড়াতে ধীরে ধীরে লিখলো রাগান্বিতার দেয়া পুরো কথাটা।

অনেকক্ষণ সময় গড়ানো। ইমতিয়াজের লেখা শেষ হলো সে কাগজটা ভাজ করে কলমটা টেবিলের উপর রেখে এগিয়ে গেল রাগান্বিতার দিকে। বললো,
“নিন।”

রাগান্বিতা নিলো। ইমতিয়াজ চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলো নিচের দিকে তাকিয়ে। রাগান্বিতা পর পর লেখাগুলো মেলালো। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো লেখাগুলোর দিকে। রাগান্বিতাকে এত মনোযোগ দিয়ে লেখা পড়তে দেখে বললো রাগান্বিতার বাবা,
“লেখা কি মিলিছে?”

রাগান্বিতা ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বললো,
“না বাবা।”

রাগান্বিতা চলে গেল ইমতিয়াজ দেখলো তা। রাগান্বিতা যেতেই রাগান্বিতার বাবা ইমতিয়াজের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
“আমি খুব দুঃখিত মেয়েটা কাল রাত থেকেই কেন যেন পাগলামি করছে। না কিছু বলছে, না কিছু শুনছে। ওর হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।”

ইমতিয়াজ দু’কদম এগিয়ে গিয়ে বললো,
“আরে আরে কি করছেন আপনি? সমস্যা নেই আমি কিছু মনে করি নি। ভালো থাকবেন আজ যাই।”

বলেই ইমতিয়াজ আর না দাঁড়িয়ে চলে গেল বাহিরে। জোরে নিশ্বাস ফেললো মুহুর্তেই। যেতে যেতে আওড়ালো,
“মেয়েটা পাগল হলো নাকি।”

অন্যদিকে, সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে ইমতিয়াজের লিখে যাওয়া আবার দেখলো। হাতের লেখা মেলে নি এটা সত্যি কথা৷ তবে ইমতিয়াজ লেখাগুলোর পরে আরো দু’লাইন লিখেছিল তা হলো,

“প্রেমপত্র উন্মোচনের বুদ্ধিটা দারুণ। কিন্তু সে যে এই গ্রামেরই তা জানলেন কি করে?”
—-

আজ বৃহস্পতিবার। জমিদার বাড়িতে কিসের যেন তোড়জোড় চলছে। রেজওয়ান এখন পুরোপুরি সুস্থ। ভেবেছিল দুতিনদিনের মাঝে শহরে চলে যাবে কিন্তু তার বাবা কোন এক কারণের জন্য আরো কিছুদিন থাকতে বলছে। তাই থেকে গেছে।

রাগান্বিতার ঘুম ভাঙলো সকাল আটটার দিকে আজ নামাজ সেরে একটু ঘুমিয়েছিল রাগান্বিতা। সকালে ঘুম ভাঙে দাদিমার ডাকে আর উঠেই শুনে কোন গ্রামের চেয়ারম্যান বাড়ির ছেলে নাকি তাকে দেখতে আসবে। হুট করে এমন খবর শুনে রাগান্বিতার ভিতরটা যেন কেমন করে উঠলো? থমথমে গলায় বললো,
“হুট করে বাবা এ কেমন সিদ্ধান্ত নিল? আর কেনই বা নিল?”

#চলবে…..

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-০৯

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-০৯
________________
মাথা নিচু করে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাগান্বিতা আর তার সামনেই রাগে মাথা গরম করে দাঁড়িয়ে আছে রাগান্বিতার বাবা। রাগান্বিতা চুপ থাকায় রাগান্বিতার বাবা প্রশ্ন করলো,
“তুমি ওই দুপুরবেলা বাড়ির বাহিরে কেন গিয়েছিলে রাগান্বিতা?”
“আমি কোথাও যাই নি বাবা।”
“মিথ্যে বলছো তুমি। পাশের বাড়ির রফিক তোমায় দেখেছে তুমি শাপলার বিলের ওদিকে গেছিলে।”

এবার আর মিথ্যে বলতে পারলো না রাগান্বিতা। কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে বললো,
“আমি দুঃখিত বাবা। কিছু শাপলা আনতে গিয়েছিলাম। আমার ভুল হয়ে গেছে আমি আর কখনো তোমায় না বলে কোথাও যাবো না।”

মেয়ের দুঃখিত মুখ দেখলেই কেমন একটা হয়ে যায় রাগান্বিতার বাবা আজও তাই ঘটলো তবে প্রকাশ করলেন না। খানিকটা রাগী রাগী কণ্ঠে বললেন,
“ঠিক আছে এবারের মতো তোমায় ক্ষমা করলাম কিন্তু পরেরবার এমনটা যেন আর না হয়।”

বাবার কথা শুনে মাথা নিচু করেই নরম গলায় বললো রাগান্বিতা,
“ঠিক আছে বাবা।”

রাগান্বিতার বাবা চলে গেল। বাবা রুম পর্যন্ত যেতেই রাগান্বিতা আড় চোখে তা দেখলো। হঠাৎই আকাশে ভয়ংকরভাবে গর্জে উঠলো কতক্ষণ যাবৎ হয়ে থাকা কালো আকাশ বেয়ে হতে লাগলো বর্ষণ। রাগান্বিতা দৌড়ে ছুটে গেল সদর দরজার সামনে রিনিঝিনি শব্দ করে হতে লাগলো বৃষ্টি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখতে লাগলো রাগান্বিতা।
—–
রাগান্বিতার বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে নদীর ভিড়ের আঁকাবাকা রাস্তা পেরিয়ে বর্ষার মাঝে কোথাও একটা হেঁটে যাচ্ছে ইমতিয়াজ। বৃষ্টির পানিতে তার পুরো শরীর ভিজে চৌচির। ইমতিয়াজের কোনো হেলদোল নেই সে তার মতো হেঁটে যাচ্ছে। মূলত একটা বাড়ির দিকে। খানিকটা জঙ্গলের মতো একটা জায়গা একপাশে গাছপালা আর আরেকপাশে ছোট্ট নদী বয়ে চলছে। দূর সীমানা দিয়ে লঞ্চ জাহাজ চলতে দেখা যায় মাঝে মাঝে। ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর মাটির তৈরি পুরোটা তবে উপরে ছনের আচ্ছাদন। ইমতিয়াজ হাঁটতে হাঁটতে সেই বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো শুয়ে পড়লো কাঁদায় জমানো বাড়ির সামনের ছোট্ট উঠানটায়। আশেপাশে কেউ নেই পুরো নির্জন আর নির্জীব একটা জায়গা। মাঝে নদীর মধ্যে বয়ে চলা ঢেউয়ের শব্দ শোনা যায়। ইমতিয়াজ তার মাথার নিচে দু’হাত দিয়ে আয়েশ করে শুয়ে রইলো। চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো নিমিষেই। সঙ্গে সঙ্গে একটা মেয়ের প্রতিচ্ছবি ভেসে আসলো। সে কি যেন বলে খুশি মনে দৌড়াচ্ছে। ইমতিয়াজও হাসি হাসি মুখ নিয়ে বলে, “দাড়া বলছি।” কিন্তু মেয়েটা শোনে না এক পর্যায়ে ছুটাছুটি করে শুধু। ইমতিয়াজ চোখ খুলে ফেললো বুকের ভিতরটা খা খা করছে তার। দীর্ঘ শ্বাসে নিশ্বাস হচ্ছে ভাড়ি। ইমতিয়াজ চোখ খুলে আকাশ পানে তাকিয়ে থেকেই বললো,
“এই নগরের কোথাও ভালোবাসা নেই। এই নগরে আছে শুধু খুন আর খুন সঙ্গে তাদের শরীর ভেজা রক্ত। বিষাক্ত এই নগরীতে প্রেম কখনোই কাম্য নয় ইমতিয়াজ। কখনোই নয়। এ নগরে প্রেম মানেই মৃত্যু।

বলেই উচ্চস্বরে হেঁসে ফেলে ইমতিয়াজ।

——
নতুন একটা দিনের শুরু। মুয়াজ্জিনের নামাজের আহ্বানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে বাহিরে। ফজরের আযান দিচ্ছেন তিনি। রাগান্বিতা ঘুমিয়ে ছিল হঠাৎই কারো ডাকার শব্দ কানে আসলো। কেউ ডাকছে তাকে সঙ্গে বলছে,
“রাগান্বিতা উডো হয়ালে ফজরের আযান দিতাছে।”

রাগান্বিতা নড়েচড়ে উঠলো। ঘুম ঘুম গলায় বললো,
“দাদিমা আর একটু ঘুমাই।”
“নামাজ পইড়া আবার ঘুমাবা আনে এহন তো উডো।”

এবার রাগান্বিতা আর কথা না বারিয়ে ধীরে ধীরে শোয়া থেকে উঠে বসলো। চোখ ডলতে ডলতে বললো,
“উঠেছি আমি।”

দাদিমা খুশি হলেন। বললেন,
“তাড়াতাড়ি আহো আজ আমরা একলগে নামাজে খাড়ামু।”

দাদিমার কথা শুনে রাগান্বিতাও খুশিমাখা মুখ নিয়ে বললেন,
“ঠিক আছে তুমি যাও আমি আসছি।”
“আইচ্ছা তাড়াতাড়ি আইয়ো।”
“হুম আসছি তুমি কলপাড়ে দাড়াও গিয়ে।”
“ঠিক আছে।”

দাদিমা চলে গেলেন। দাদিমা যেতেই রাগান্বিতা কতক্ষণ এদিক সেদিক ঘাড় মুড়িয়ে গায়ের ওপর থেকে কাঁথাটা সরিয়ে বিছানা ছেড়ে নামলো। রাগান্বিতার খুব পুরনো দিনের অভ্যাস সে ফজরের এই সময় বিছানা থেকে উঠেই তার রুমের পুকুরের ওদিকটার জানালা খুলে ফেলে। আজও তার ব্যতিক্রম কিছু হলো না রাগান্বিতা হেঁটে গিয়ে জানালা খুলে দিলো। জানালাটা খুলতেই সামনের একটা গাছের গোড়া থেকে কে যেন ছুটলো রাগান্বিতা ঘুমের ঘোরে থাকায় বিষয়টা তেমন নজরে আসলো না। রাগান্বিতা তার গায়ে জড়ানো কাপড়টা ঠিক করে আস্তে আস্তে চললো কলপাড়ের দিকে। রাগান্বিতা নামতে নামতে তার বাবা অলরেডি নামাজের জন্য বেরিয়ে পড়েছেন। রেজওয়ান অসুস্থ থাকায় বাড়ির বাহিরে আর যায় নি। ঘরে বসেই তার নামাজ পড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাগান্বিতা তার মাথায় কাপড় জড়িয়ে এগিয়ে গেল তারপর দাদিমা আর রাগান্বিতা একসাথে ওজু করে বাড়ির ভিতর চললো। বাড়ির নামাজের কক্ষে দুজন একসাথে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়ালো।

নামাজ শেষে মোনাজাত পড়ে রাগান্বিতা অনেকক্ষণ বসে রইলো। পাশেই দাদিমা আরো অনেকক্ষণ মোনাজাত পড়ছেন মোনাজাত দিতে দিতে কুহুর কথা ভেবে কান্নায় চোখ ভেসে আসলো তার। কুহুর জন্য দোয়া করলেন খুব। রাগান্বিতা পুরোটাই বুঝতে পেরেছে তবে কোনো শব্দ করে নি পুরোটা সময় চুপচাপ দাদিমার কান্নাটা শুনে গেছে। রাগান্বিতার মাঝে মাঝে নিজেকে বড্ড পাষাণ মনে হয় তার বোনটা চলে গেল কতগুলো দিন চলে গেল অথচ তার চোখে পানি আসছে না। রাগান্বিতা মাঝে মাঝে ভেবে পায় না সে এতোটা কঠিন কেন? কারো মৃত্যুতেও তার চোখে পানি আসে না কেন? তার বড্ড খারাপ লাগে,লেগেছে, এখনো লাগছে বোনের হুট করে মৃত্যুটা কেন যেন সে মেনে নিতে পারি নি। হয়তো বোনটা নিজ ইচ্ছে মারা গিয়েছিল বলে এমনটা হয়েছে। রাগান্বিতা চুপচাপ বসে রইলো, আজ আর তার ঘুম আসবে না। আচমকাই পিছনের বাগানটা দিয়ে কি যেন চলে যাওয়ার শব্দ আসলো। শব্দটা কানে আসতেই রাগান্বিতা একবার পিছন ঘুরেও ছিল কিন্তু কিছু দেখে নি।

সময় গড়ালো। দাদিমা তার চোখের পানি মুছে নামাজ ছেড়ে জায়নামাজ নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ভাজ করতে লাগলেন দ্রুত রাগান্বিতাও উঠে দাঁড়ালো। হঠাৎই তার কি যেন মনে পড়লো সে দাদিমাকে প্রশ্ন করলো,
“তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করবো দাদিমা?”

দাদিমাও স্বাভাবিকভাবে জবাব দিলেন,
“হুম কর।”
“কাল তুমি আমার শাপলা ফুলের অলংকারের সাজ দেখে ওভাবে ঘাবড়ে কেন গিয়েছিলে দাদিমা?”

দাদিমা যেন চমকে উঠলেন আবার। হাত থেকে জায়নামাজটা পড়ে গেল নিচে। মুহুর্তেই ভয়ংকরভাবে কাঁপলেন তিনি। দাদিমার রিয়েকশন দেখে আবার বললো রাগান্বিতা,
“কি হলো তোমার?”

দাদিমা নিজ থেকে জায়নামাজটা উঠিয়ে থর থর করে বললেন,
“তোমারে তো কাল কইছিলাম ওই বাড়ির মুন্নার মাইয়াডারে,

পুরো কথা শেষ করার আগেই রাগান্বিতা বললো,
“তুমি আমায় মিথ্যে বলো নি তো দাদিমা?”

দাদিমা খানিকটা দূরে সরে গেলে কাঁপা কাঁপা স্বরে বললেন,
“মিছা কি কমু।”

রাগান্বিতা দাদিমার মুখোমুখি দাঁড়ালো চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি আমার থেকে কিছু একটা লোকাচ্ছো। সত্যি কিছু লোকাচ্ছো না তো দাদিমা?”

দাদিমা সরে গেলেন আবার। বললেন,
“না কি লুকামু কও তেমন কিছু হইলে তোমারে কইতাম তো তোমার আব্বাজানে আইয়া পড়বো চা বানানো লাগবো আমায়। আমার যাওন লাগবো রাগান্বিতা।”

বলেই এক প্রকার পালিয়ে চলে গেল দাদিমা। আর রাগান্বিতা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দাদিমার যাওয়ার তার কেন যেন মনে হচ্ছে দাদিমা তার থেকে কিছু একটা লোকাচ্ছে? কিন্তু কি লোকাচ্ছে? আর কেনই বা লোকাচ্ছে ওই সামান্য শাপলা ফুলের মাঝে কি এমন লোকানোর মতো থাকতে পারে?’ ভেবে পেল না রাগান্বিতা।
—–

প্রায় আট নয়দিন পর স্কুলের পথে পা বারিয়ে ছিল রাগান্বিতা। কিন্তু সারাদিন কোনোকিছুই ভালো লাগে নি তার কেমন একটা একঘেয়েমি ভাব নিয়ে চলে গেল স্কুলের সময়টা। রাগান্বিতা হাতে বই নিয়ে একা পথে হাঁটছে। তার সহপাঠীরা অনেক আগেই চলে গেছে সে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে হাঁটার কারণে সবার থেকে পিছনে পরে গেছে। তবে এসবে তার কোনো মাথা ব্যাথা নেই। দাদিমার সেই ঘাবড়ানোর বিষয়টা নিয়ে এখনো ভাবছে রাগান্বিতা সে এটাই বুঝচ্ছে না দাদিমা তার থেকে কেন কিছু লোকাচ্ছে, নাকি লোকাচ্ছে না তার সন্দেহ করাটা ভুল হয় নি তো। কিন্তু দাদিমার ভয় পাওয়ার ফেসটা আজ সকালের সেই ভয়ার্ত চাহনী বড্ড বেশি ভাবাচ্ছে রাগান্বিতা। রাগান্বিতার ভাবনার মাঝেই আচমকাই কিসের যেন সুর ভেসে আসলো কানে। রাগান্বিতা দাঁড়িয়ে পড়লো সুরটা তার চেনা সে এর আগেও একবার এই সুরটা শুনেছে। রাগান্বিতা বেশি না ভেবেই আশেপাশে চোখ বুলালো হঠাৎই তার চোখ গেল একটা গাছের গোড়ার সামনে কেউ একজন বসে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে। রাগান্বিতার বুঝতে বাকি রইলো না মানুষটা যে ইমতিয়াজ?’

রাগান্বিতা আনমনেই এগিয়ে যেতে লাগলো ইমতিয়াজের কাছে। কেন যাচ্ছে জানে না? কিন্তু তার মন বলছে একবার যা কাছে গিয়ে পাশে বস তোর মন ভালো হয়ে যাবে।’

#চলবে…..

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-০৮

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-০৮
________________
সন্ধ্যা নেমেছে প্রকৃতি জুড়ে। জানালা বেয়ে ধেঁয়ে আসছে বাতাস। বিছানায় এলেমেলোভাবে পাগল বেশে পায়ে শিকল বাঁধা অবস্থায় খাটে বসে আছে রাগান্বিতা। ইলিয়াসের ইনজেকশন পুস করার পর মাত্রই ঘুমটা ভাঙলো তার। রাগান্বিতা আশেপাশে তাকালো আস্তে আস্তে পায়ের শিকল নিয়েই খাট থেকে নিচে নামলো সে। খাটের নিচেই ছিল একটা বাক্স। রাগান্বিতা বাক্সটা বের করলো, কতগুলো শুকিয়ে যাওয়া শাপলা ফুলের অলংকার দেখলো। সেগুলো হাতেও নিলো খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। অদ্ভুদ স্বরে নিস্তব্ধ হয়ে বললো,
“দেখেছো ইমতিয়াজ তোমার সেই সাজিয়ে দেওয়া শাপলা ফুলের অলংকার আমি আজও ফেলি নি। তাহলে তুমি আজও কেন আসছো না?”

আচমকাই দরজার খোলার আওয়াজ আসতেই রাগান্বিতা ঘাবড়ে গিয়ে সামনে তাকালো আবারও ইনজেকশন পুস করা সেই ডাক্তারকে দেখে উত্তেজিত হয়ে বললো,
“আপনি আবার আমায় ইনজেকশন দিতে এসেছেন?”

ইলিয়াস ছোট্ট একটা শ্বাস ফেললো। রামুর মুখে শাপলার বিলের পর আর কিছু শুনতেই পারলো না ইলিয়াস তার আগেই রামুকে যেতে হয়েছে। বলেছে বাকিটা নাকি কাল বলবে? কিন্তু ইলিয়াসের ধৈর্য্য হচ্ছে না। তার কেন যেন মনে হচ্ছে রাগান্বিতাকে ঠান্ডা মাথায় জিজ্ঞেস করলে সেই সবটা বলবে তাকে। ইলিয়াস এখনো বুঝলো না রাগান্বিতার দাদিমা রাগান্বিতার ওই ফুলের সাজ দেখে কেন ঘাবড়ে গিয়েছিলেন?’

ইলিয়াস ধীরে ধীরে রাগান্বিতার কাছে এগোতে লাগলো সাথে ধীর কণ্ঠে বললো,
“তুমি ভয় পেও না রাগান্বিতা আমি কোনো ইনজেকশন দিবো না তোমায়।”

রাগান্বিতা শুনতে চাইলো না ভয়ে ভয়ে দেয়ালের সাথে নিজেকে গুটিয়ে নিতে লাগলো। ইলিয়াস রাগান্বিতাকে আশ্বাস দেয়ার জন্য তার হাতের ইনজেকশনটা রাগান্বিতাকে দেখিয়ে দূরে সরিয়ে রেখে বললো,
“এই দেখো আমি তোমায় ইনজেকশন দিবো না এটাকে রেখে দিলাম আমি তো তোমার সাথে শুধু একটু কথা বলতে এসেছি।”

ইলিয়াসের কথা শুনে রাগান্বিতা ভয়ার্ত কণ্ঠে চেঁচিয়ে বললো,
“আমি কারো সাথে কথা বলবো না। আপনি বাবাকে ডাকুন। বাবা! বাবা!”

ইলিয়াস হতাশ হলেন আবারও আশ্বাস দিতে বললো,
“তোমার বাবা আসবে রাগান্বিতা তুমি এভাবে চেঁচিও না প্লিজ।”

রাগান্বিতা এবার খিল খিল করে হেঁসে উঠলো। নিজে নিজে বললো,
“আপনি দেখি বোকা ডাক্তার সাহেব, মৃতব্যক্তি কখনো ফিরে আসে নাকি।”

ইলিয়াস যেন ছোট খাটো একটা ধাক্কা খেল রাগান্বিতার কথা শুনে। তবে কি রাগান্বিতা জানে পাঁচ বছর আগেই তার বাবা কোনো এক কারণে মারা গিয়েছিল! যদি জেনেই থাকে তাহলে সারাক্ষণ বাবা বাবা বলে চেঁচায় কেন?’ ইলিয়াসের ভাবনার মাঝেই রাগান্বিতা আবার বলে উঠল,
“জানেন ডাক্তার সাহেব আজ না আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি।”

ইলিয়াস ধীরে ধীরে রাগান্বিতার সামনাসামনি বসে বললো,
“কি স্বপ্ন?”

রাগান্বিতা হাসি হাসি মুখ করে বললো,
“আমার ইমতিয়াজ ফিরে এসেছে।”

ইলিয়াস রাগান্বিতার সাথে আর একটু নরম হলো। খুবই শান্ত স্বরে বললো,
“এই যে তুমি সারাক্ষণ ইমতিয়াজ, ইমতিয়াজ করো এই ইমতিয়াজ আসলে কে? তোমার কি হয়?”

রাগান্বিতা উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
“ইমতিয়াজ আমার স্বামী আমাদের বিয়ে হয়েছিল জানেন।”

ইলিয়াস যেন আরেকটা ধাক্কা খেল রাগান্বিতার কথা শুনে। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার স্বামী ছিল। ওদের বিয়ে কি হয়েছিল! রাগান্বিতা কি সত্যি বলছে! নাকি ভুলভাল বকছে। ইলিয়াস রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোমাদের বিয়ে হয়েছিল?”
“হুম! কেন আপনি জানেন না?”
“না কিভাবে জানবো কেউ তো বলে নি। আচ্ছা তুমি আমায় বলবে তোমাদের কিভাবে বিয়ে হয়েছিল তোমার কি সব মনে আছে?”

মাথা নাড়ায় রাগান্বিতা। বলে,
“হুম মনে থাকবে না কেন?”
“তাহলে শোনাও আমায়! তুমি বলবে কিভাবে তোমার আর ইমতিয়াজের বিয়ে হয়েছিল?”

রাগান্বিতা চুপ করে রইলো। যার অর্থ সে বলবে না। ইলিয়াস এতক্ষণ পর নজরে গেল রাগান্বিতার হাতে শাপলা ফুলের শুকিয়ে যাওয়া অলংকারের দিকে। ইলিয়াস হাত দিয়ে ছুঁতে নিলো তা সঙ্গে সঙ্গে রাগান্বিতা চেঁচিয়ে বললো,
“ওগুলো ছুঁবেন না ওগুলো আমায় ইমতিয়াজ দিয়েছে।”

ইলিয়াসের যেন চোখ ভেসে উঠলো ফুলগুলো দেখে সেই কবেকার ফুল রাগান্বিতা এখনো যত্ন করে রেখে দিয়েছে। ওদের মাঝে এত প্রেম ছিল তাহলে ইমতিয়াজ কোথায় গেল? আর গেল তো গেল এখনো ফিরে কেন আসছে না? সে কি জানে না রাগান্বিতা তাকে ছাড়া ভালো নেই!’

ইলিয়াস উঠে দাঁড়ালো না তাকে এই স্টোরির পুরোটা জানতেই হবে এক্ষুণি সে রামুর কাছে যাবে। রাগান্বিতার দাদিমা সেদিন কেন রাগান্বিতার ফুলের সাজ দেখে ঘাবড়ে গিয়েছি তা তাকে জানতেই হবে। আর ইমতিয়াজও বা গেল কই! এসব না জানতে পারলে ইলিয়াসের ঘুম আসবে না! শান্তি মিলবে না! ইলিয়াস এসব ভেবেই রাগান্বিতার রুম থেকে বেরিয়ে গেল দরজা আঁটকে ছুটে গেল রামুর বাড়ির দিকে। তাকে শেষটা জানতেই হবে।’

এদিকে,
রাগান্বিতা তাকিয়ে আছে ফুলগুলোর দিকে।কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে একদিন ইমতিয়াজের বলা একটা কথা মনে করলো যেখানে ইমতিয়াজ তাকে বলেছিল,
“জানো তো রাগান্বিতা, প্রেম মানে হলো এক আসমান যন্ত্রণা তাও দেখো মানুষ বেছে বেছে সেই প্রেমে পড়বেই যেমন আমি পড়েছি।”
_________________

১৯৮১ সালে! সেদিন দুপুরে রাগান্বিতা আর তার দাদিমাকে নিয়ে তেমন একটা ভাবে নি। গোসল সেরে এসে বিছানায় রাখা সেই ইমতিয়াজের ফুল দিয়ে বানানো অলংকারগুলো সযত্নে তার রুমে থাকা ছোটমোটো একটা বাক্সে ভরে খাটের তলে রেখে দিল। ফুলগুলো কালো আর নেতিয়ে গেছে পুরো। হঠাৎই সাইকেলের বেল বাঝার শব্দ কানে ভেসে আসলো রাগান্বিতার। রাগান্বিতা যেন চমকে উঠলো এক মুহূর্তের জন্য হলেও তার মনে হলো ডাকপিয়ন এসেছে। রাগান্বিতা দৌড়ে ছুটে গেল জানালার ধারে, তাকালো বাহিরে সাইকেল এসেছিল ঠিকই তবে ডাকপিয়ন ছিল না অন্য আরেকটা ছেলে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল কোথায় যেন। রাগান্বিতা যেন সস্থির নিশ্বাস ছাড়লো। তার মনে পড়লো তখন কার সেই ডাকপিয়নের দিয়ে যাওয়া চিঠিটার কথা সে তো প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। রাগান্বিতা এগিয়ে গেল তার রুমের ড্রয়ারটার দিকে। বেশি না ভেবেই ড্রয়ারটা খুলে চিঠিটা বের করলো। ভাজটা খুলেই পড়তে লাগলো আজ বেশ বড় করেই লেখা আছে কিছু। রাগান্বিতা বিছানায় বসেই চিঠিটা পড়তে লাগলো,

“আমাদের একটা বিকেল হবে,
গন্ধে গন্ধে প্রেম ছড়াবে;
নদীর পাড়ে নৌকা বইবে
পাখিতে গাইবে গান।
তুমি যদি একবার বলো ভালোবাসো
আমি নিরদ্বিধায় দিতে পারি নিজের এই ঠুনকো প্রাণ!’

আমাদের একটা বিকেল হবে
বাতাসে তার প্রেম ছোঁয়াবে;
হৃদয়ে দিবে টান।
আমি তো এক নিষ্ঠুর প্রেমিক পুরুষ
তুমি চাইলেই নিতে পারো আমার এই নিষ্ঠুর জান।”

ইতি,
~ নিষ্ঠুর এক প্রেমিক পুরুষ!’

‘নিষ্ঠুর’ কথাটা যেন চরম ভাবে ভাবালো রাগান্বিতাকে। আজ প্রথম যেন চিঠি পড়ে তার বড্ড হাসি পেল। কে এই প্রেমিক? জানতে চায় সে! কিন্তু কিভাবে জানবে। হঠাৎ বাবার হাক শোনা গেল তিনি রাগান্বিতাকে ডাকছেন সাথে। বলছেন,
“রাগান্বিতা, রাগান্বিতা। দ্রুত নিচে আসো।”

রাগান্বিতা যেন চমকে উঠলো তার বাবা হঠাৎ এভাবে কেন ডাকছেন? কি ঘটলো আবার! বাবা জেনে যায় নি তো সে শাপলা কুড়াতে বেরিয়ে ছিল?’

চলবে…….

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-০৭

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-০৭
________________
ঢেউয়ের স্রোতে ভাসছে নৌকা। বৈঠা হাতে নৌকা চালাচ্ছে ইমতিয়াজ মাঝে বারংবার দেখছে রাগান্বিতাকে। মেয়েটাকে বড্ড বেশিই যেন অন্যরকম লাগছে এখন। ইমতিয়াজ বৈঠা বাইতে বাইতে বলে উঠল,
“তা আজ হঠাৎ সাজ বিহীন বাহিরে নামলেন। দেখে তো বোঝাই যাচ্ছে না আপনি জমিদার বাড়ির সেই রূপবতী ছোট কন্যা।”

রাগান্বিতা বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“কেন ভালো লাগছে না বুঝি?”
“না সেটা নয় একটু অন্যরকম লাগছে তবে খারাপ লাগছে না। আপনারা তো সুন্দরী জমিদার কন্যা আপনাদের খারাপ লাগতে পারে নাকি।”

খানিকটা বিরক্তি নিয়ে বললো রাগান্বিতা,
“কথায় কথায় রূপবতী বলবেন না তো শুনতে ভালো লাগে না।”

ইমতিয়াজ হাসে। মোকলেসকে নিয়ে রাগান্বিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ভালো মানুষের দাম রইলো না রে মোকলেস আজকাল সুন্দর জিনিসকেও সুন্দর বলা নিষিদ্ধ।”

রাগান্বিতা চোখ রাঙানোর দৃষ্টিতে তাকালো ইমতিয়াজের দিকে। বললো,
“সুন্দর মানেই ভয়ংকর এটা জানেন নিশ্চয়ই।”

ইমতিয়াজ এবার ভাড়ি উচ্চস্বরে হাসলো। বললো,
“আপনি বড্ড হাসাতে পারেন রাগান্বিতা। সমস্যা নেই একটা কথা জেনে রাখুন, এই ইমতিয়াজের ভয়ংকর জিনিসের উপরই আকর্ষণ বেশি।”
“আপনার সাথে কথায় পারা যাবে না।”
“আপনি এত সুন্দর করে কথা বলেন যে উত্তর না দিয়েই পারি না।”

রাগান্বিতা চুপ হয়ে যায় আর কিছু বলে না। এই ছেলেরা বড্ড বেশিই বদমাশ। ইমতিয়াজ নদীর পানির দিকে তাকায়। ঢেউয়ের তালে তালে চলতে থাকে। এভাবে চলতে চলতে তারা এসে পৌঁছালো বিপুল সৌন্দর্যে ঘেরা এক শাপলার বিলে। যেখানে রয়েছে শুধু কারি কারি শাপলা। কি সুন্দর রঙ তাদের! রাগান্বিতা মুগ্ধ হলো এত সুন্দর সুন্দর শাপলা দেখে। ইমতিয়াজ নৌকা চালানো হাল্কা থামালো। বললো,
“হাতে শাপলা কুড়াবেন নাকি?”

রাগান্বিতা মুখে জ্বলজ্বল করা এক হাসি নিয়ে বললো,
“এটা তুলার জন্যই তো এতটা পথ বাবার থেকে দিলাম ফাঁকি।”

ইমতিয়াজ যেন এতক্ষণে বুঝলো রাগান্বিতা কেন তার সাজগোছ পাল্টে বেরিয়েছে। ইমতিয়াজ ডাটিসহ শুধু পাতাটা ছাড়িয়ে হাতে করে একটা সুন্দর লাল রঙের শাপলা তুলে আনলো। বৈঠা দিলো মোকলেসের হাতে। তারপর ফুলটার দিকে তাকিয়ে রাগান্বিতাকে উদ্দেশ্য বললো,
“একটু সাজবেন নাকি।”

রাগান্বিতা অবাক হলো। অবাক হয়েই বললো,
“সাজবো মানে?”

ইমতিয়াজ তার হাতের শাপলার নিচের অংশ মানে ডাটিটাকে মাঝ বরাবর করে মাঝখান থেকে ছিঁড়ে দুইভাগ করে দিলো। খুব সুন্দর ডিজাইনের মতো করে ডাটিটার দুই অংশকে ভাগ ভাগ করলো তবে পুরোপুরি ছিড়লো না। রাগান্বিতা শুধু দেখতেই ছিল বিষয়টা আর তার পিছনে লুবনা নিজের মতো করে শাপলা কুড়াতে লাগলো। ইমতিয়াজ শাপলার ডাটির অংশটুকু সুন্দর মতো সাজিয়ে শাপলার ফুলটাকে পুরোপুরি মেলে দিলো তারপর রাগান্বিতার গলায় মাপটা আন্দাজ মাফিক ডাটির দুই অংশটুকু গিট দিলো তারপর রাগান্বিতার দিকে ফুলটা এগিয়ে দিয়ে বললো গলায় পড়ে নিন।

রাগান্বিতা শুধু তাকিয়েই ছিল ইমতিয়াজের হাতের দিকে। শাপলার ফুলটা দিয়ে গলার অলংকার বানিয়েছে ইমতিয়াজ। রাগান্বিতার কোনো হেলদোল না দেখে আবারও বললো ইমতিয়াজ,
“কি হলো ধরুন?”

রাগান্বিতা নিলো। রাগান্বিতা ফুলটা নিতেই ইমতিয়াজ বললো,
“এবার গলায় পড়ে নিন।”

রাগান্বিতা বিনা বাক্যে পড়ে নিলো। ইমতিয়াজ যেন খুশি হলো এতে। ইমতিয়াজ চাইলে নিজ থেকেই ওটা পড়িয়ে দিতে পারতো রাগান্বিতাকে কিন্তু দিলো না। অদ্ভুত একটা বিষয় ফুলটা পুরোপুরি রাগান্বিতার গলার মাপ মতো হয়েছে। ইমতিয়াজ আশেপাশে তাকালো পর পর ছোট ছোট দেখে আরো দুটো লাল টুকটুকে শাপলা নিলো। সুন্দর মতো ফুলদুটোকে মেলে দিয়ে রাগান্বিতার দুই কানে পড়ে নিতে বললো। তার কানে থাকা ছোট ছোট অলংকারের সাথে গুঁজে দিয়েছে ফুলদুটো এতে আরো বেশি মায়াবীময় যেন হয়ে উঠলো রাগান্বিতার মুখখানা। দুই হাতেও পড়েছে শাপলা। ইমতিয়াজ এক মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো রাগান্বিতার মুখের দিকে। খুবই স্বল্প আওয়াজে বললো,

‘মেয়েটাকে এত সুন্দর লাগছে কেন!’

ইমতিয়াজ আবারও আশেপাশে তাকালো তবে এবার আর শাপলা তুললো না শাপলার আশেপাশে কিনারায় থাকা ছোট কিছু ফুল তুলে সেগুলো মাঝখান থেকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে একটার ভিতর আরেকটা রেখে বানিয়ে ফেললো মাথায় দেওয়ার মতো একটা অলংকার। ইমতিয়াজ জিনিসটা রাগান্বিতার হাতে দিয়ে মুখে বললো না ইশারায় নিজের মাথাটা দেখিয়ে পড়ে নিতে বললো। রাগান্বিতাও বিষয়টা বুঝতে পেরে নিরদ্বিধায় পড়ে নিলো। এবার যেন পুরোপুরি পারফেক্ট লাগছে রাগান্বিতাকে। ইমতিয়াজ বেশ অনেক্ক্ষণ তাকিয়ে রইলো রাগান্বিতার দিকে। লাল শাড়ি, গলায় লাল রঙের শাপলার হার, কানে শাপলার দুল, হাতে শাপলার ব্যাচলেট, মাথায় ছোট ছোট ফুলের মায়াবী আলিঙ্গনের ছড়াছড়ি,লাল রঙা ঠোঁট। ইস বড্ড বেশিই যেন সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে।’

ইমতিয়াজ মনে মনে আওড়ালো,
“তোমার এই ভয়ংকর রূপ কখন যেন আমায় মেরে দেয় রাগান্বিতা।”

মোকলেসের ডাক শোনা গেল। আকাশে মেঘ করেছে যখন তখন বৃষ্টি নামবে। মোকলেস নৌকা চালাতে চালাতে বললো,
“ইমতিয়াজ ভাই বৃষ্টি আইবো মনে হয় নৌকা কি ওইপার নিয়া যামু।”

রাগান্বিতারও যেন হুস ফিরলো। সেও যেন এতক্ষণ কোন ঘোরে আঁটকে ছিল। ইমতিয়াজের ধ্যান ভাঙলো এসব কি ভাবছিল সে। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার থেকে চোখ সরিয়ে ফেললো। আকাশপানে তাকিয়ে খানিকটা চেঁচিয়ে মোকলেসকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“বৈঠা আমার কাছে দে,

মোকলেস দিলো ইমতিয়াজও দ্রুত বৈঠা হাতে নৌকা চালাতে লাগলো। আকাশে ভয়ংকরভাবে মেঘ করেছে যখন তখন বৃষ্টি পড়বে। ইমতিয়াজ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো রাগান্বিতা আর লুবনা ওদের শক্ত করে বসতে বললো। ওরা বসলো। অতঃপর যে পথ দিয়ে এসেছিল সেই পথ দিয়েই দ্রুত ছুটতে লাগলো ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা তখনও তার গায়ের অলংকার নিয়ে ভাবছিল। আনমনেই মুচকি হেঁসে উঠলো। তার হাসিটা বুঝি দেখলো ইমতিয়াজ। তবে আপাতত বেশি ভাবলো না।’

প্রায় আধ ঘন্টার রাস্তা বিশ মিনিটে আসলো ইমতিয়াজ। অনেক দ্রুতই আসলো তারা। নৌকা কিনারায় আসতেই মোকলেস দ্রুত নেমে নৌকা বাঁধলো ঘাটে। তারপর একে একে নামলো লুবনা আর রাগান্বিতা ইমতিয়াজও নামলো শেষে। খানিকটা ফিস ফিস করে রাগান্বিতার কানের কাছে নিজের মুখটা নিয়ে বললো,
“প্রেম বড্ড ভয়ংকর রাগান্বিতা,আপনি সইতে পারবেন না।”

ইমতিয়াজ চলে গেল আর রাগান্বিতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো ওখানে। ছেলেটা তাকে কি বলে গেল? সে কি প্রেমে পড়েছে না তো তাহলে বললো কেন কথাটা! লুবনা ডাকলো রাগান্বিতাকে। বললো,
“বাড়ি যাইবা না বুবু! বৃষ্টি নামবো তো।’

রাগান্বিতার হুস আসলো। লুবনার দিকে তাকিয়ে বললো,
“হুম যাবো তো চল যাই।”

রাগান্বিতা আর একবার ইমতিয়াজের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে চলে গেল নিজেদের বাড়ির দিকে। অন্যদিকে ইমতিয়াজ সেও ঘুরলো পিছনে। এক অদ্ভুত হাসি দিয়ে বললো,
“জগৎ জুড়ে যেন শুধুই ভয়ংকর সব প্রেমের খেলা, হয় শুরু নয় সব শেষ।”

খিলখিল করে হাসলো ইমতিয়াজ। মাথায় থাকা গামছাটা খুলে চুলগুলো ঝেড়ে ঠিক করলো। তারপর কোমড়ের সাথে এতক্ষণ যাবৎ আঁটকে রাখা তার চশমাটা বের করে পড়ে নিলো চোখে। অদ্ভুত স্বরে বললো,
“তুমি কি প্রেমে পড়েছো ইমতিয়াজ?”

ইমতিয়াজ নিজে নিজেই জবাব দিলো,
“হবে হয়তো।’

——
বাড়িতে নিজের রুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে রাগান্বিতা। ফুলের তৈরি এত সুন্দর অলংকারে আজই প্রথম যেন দেখছে নিজেকে। রাগান্বিতা ভাবলো তখনকার ইমতিয়াজকে। ছেলেটা যেন পুরোই অন্যরকম। কিন্তু তখনকার কথাটা? রাগান্বিতার ভাবনার মাঝে তার রুমে হাজির হলো মিলিতা বেগম মানে দাদিমা। খানিকটা উৎসাহের সঙ্গে বললেন,
“শাপলা আনো নাই রাগান্বিতা?”

রাগান্বিতার হুস আসলো। পিছ ফিরে বললো,
“হুম এনেছি তো দাদিমা ওই রন্ধনশালায় রেখেছি গিয়ে দেখো।”

দাদিমা বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো রাগান্বিতার দিকে। আচমকাই রাগান্বিতার মাঝে কার যেন প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলো তার সামনে। কিছু একটা ভেবেই ভয়ংকর এক চোখ নিয়ে চেঁচিয়ে বললো দাদিমা,
“এগুলো তুমি কি পড়ছো রাগান্বিতা? তাড়াতাড়ি খুলে ফেলো?”

হুট করেই দাদিমার এমন কথা শুনে রাগান্বিতা যেন চমকে উঠলো। বললো,
“কেন কি হয়েছে দাদিমা? আমায় ভালো লাগছে না।”
“তুমি এগুলান খুলো হয়ালে।”

বলেই এগিয়ে গিয়ে রাগান্বিতার গা থেকে শাপলা ফুলের অলংকার খুলে ফেলতে লাগলেন দাদিমা। উত্তেজিত হয়ে গেলেন তিনি। দাদিমার এমন রিয়েকশনে রাগান্বিতা যেন কিছুই বুঝলো না। সে বার বার দাদিমাকে শান্ত করতে করতে বললো,
“তুমি এমন করছো কেন? আমি সব খুলে ফেলছি দাঁড়াও।”

রাগান্বিতা সব খুলে ফেললো। এমনিতেও সে এগুলো খুলতো এখন। দাদিমা ফুলগুলোকে দূরে সরিয়ে রেখে বললো,
“আর কহনো ওইসব পড়বা না, ওগুলায় হাপ থাকে জানো।”

রাগান্বিতা যেন এতক্ষণে বুঝলো দাদিমার উত্তেজিত হওয়ার কারনটা। রাগান্বিতা হাল্কা হেঁসে বললো,
“তুমিও না দাদিমা ওসবে সাপ আসবে কোথা থেকে আমি তো দেখেই পড়েছি।”
“ছোডো ছোডো হাপ থাকে তুমি জানো না। পাঁচবাড়ির আগে মুন্নার মাইয়াডা এমন শাপলা গলায় দিয়া মইরা গেছে। আর কহনো পড়বা না আমারে কও?’
“আচ্ছা ঠিক আছে। পড়বো না। মুন্নার মেয়ে কে? আমি তো এসব শুনিনি।”
“তহন তুমি ছোডো ছিলা তাই হুনো নাই আর পড়বা না কিন্তু ওগুলান।”
“আচ্ছা দাদিমা তুমি ভয় পেও না আর পড়বো না আমি।”

দাদিমা যেন এতক্ষণে শান্ত হলেন। কপাল জুড়ে থাকা ঘামটা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে বললো,
“নাইয়া আও আমি খাওন দিতাছি।”
“ঠিক আছে দাদিমা।”

রাগান্বিতার উত্তর পেতেই রুম থেকে বের হলেন দাদিমা। হাত পা তার এখনো কাঁপছে।

রাগান্বিতা বিষয়টা দেখলো কিন্তু সে সত্যি বুঝলো না। দাদিমা কি সত্যি ওইকারণে তার সাজ দেখে ঘাবড়ে গেলেন নাকি অন্যকিছু! বেশি ভাবলো না রাগান্বিতা।”

#চলবে…..

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-০৬

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-০৬
__________________
“বুবু! রাগান্বিতা বুবু! উডো বুবু তুমার নামে চিডি আইছে, বুবু উডো জলদি ডাকপিয়ন ডাকতাছে বুবু উডো হয়ালে,

পর পর কয়েকবার রাগান্বিতার কানের কাছে ঝুঁকে কথাগুলো বলছে লুবনা। রাগান্বিতাদের গ্রামের একটা বাচ্চা মেয়ে। রাগান্বিতাকে অনেকই ভালোবাসে।

কতক্ষণ আগে ইমতিয়াজ চলে যাওয়ার পর নিজের রুমে এসে বিছানায় শুয়ে ইমতিয়াজের বলে যাওয়া কথাটা ভাবতে ভাবতে কখন যে রাগান্বিতার চোখ লেগে গিয়েছিল তাই বুঝতে পারে নি।রাগান্বিতা নড়ে চড়ে উঠলো, চোখ খুলে তাকাতেই সামনে লুবনাকে দেখে হতভম্ব হয়ে বললো,
“তুই এখানে?”
“বুবু উডো তুমার নামে চিডি আইছে ডাকপিয়ন ডাকতাছে।”
“চিঠি।”
“হ আমি তোমাগো বাড়ির উঠান দিয়া যাইতেছিলাম তহনই আইছে আমারে কইলো তুমারে ডাইকা আনতে তাই আইছি। বাড়িতে রেজওয়ান দাদাবাবুরে ছাড়া আর কাউরেই দেহি না।”

রাগান্বিতা উঠে বসলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“ঠিক আছে তুই যা আমি দেখছি।”
“আচ্ছা বুবু।”

বলেই লুবনা চলে গেল। আর রাগান্বিতাও বেশি না ভেবে দ্রুত উঠে চললো নিচে।

আজকে ডাকপিয়ন হিসেবে অন্য আরেকজন এসেছে গত দুই’দিন যে লোকটা এসেছিল সে আজ আসে নি। একটা মাঝ বয়সী ছেলে এসেছে। রাগান্বিতা খানিকটা বিচলিত মুখ নিয়ে এগিয়ে গেল ডাকপিয়নের সামনে সে যেতেই রাগান্বিতার দিকে খামে ভরা চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে শুদ্ধ ভাষায় বললো ডাকপিয়ন,
“আপনার নামে চিঠি এসেছে।”

রাগান্বিতা কিছুক্ষণ ডাকপিয়নের দিকে তাকিয়ে থেকে চিঠিটা নিলো। বললো,
“ধন্যবাদ।”

ডাকপিয়ন একটা ছোট্ট সই নিয়ে যেতে নিলো। রাগান্বিতা তাকে ডাকলো। বললো,
“আচ্ছা শুনুন,

ডাকপিয়ন দাঁড়িয়ে পড়লো। পিছন ঘুরে সাবলীল কণ্ঠে বললো,
“জি বলুন?”
“চিঠিটা কোথা থেকে আসছে এই সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?”

ডাকপিয়ন খানিকটা চমকালো কথাটা শুনে। অবাক স্বরে বললো,
“না। আমি তো খালি ডাকবাক্স থেকে নিয়ে আসি আর ঠিকানা মাফিক পৌঁছে দেই। তবে একটা অবাক করার বিষয় কি জানেন? আপনার চিঠিটা কোথা থেকে আসে তার ঠিকানা ওই চিঠিতে দেয়া নেই শুধু আপনাদের এই বাড়িটার ঠিকানাই দেয়া ছিল। বিষয়টা সত্যি অবাক জনক। যাইহোক আমার দেরি হচ্ছে। যেতে হবে আরো অনেক জায়গায় যেতে হবে তো।”

“ঠিক আছে। ধন্যবাদ আপনায়।”

ডাকপিয়ন আর কিছু না বলে চলে গেল। রাগান্বিতাও চিঠিটা হাতে নিয়ে ঢুকে গেল ভিতরে। কে যে দিচ্ছে চিঠিগুলো। এই গ্রামেরই নয়তো। আচ্ছা ডাকপিয়ন মিথ্যে বলছে না তো এমনও তো হতে পারে ঠিকানা দেয়া ছিল কিন্তু ডাকপিয়ন জানাতে চাইছে না। রাগান্বিতা তার মাথায় চাপড় মারলো কিসব ভাবছে ডাকপিয়ন ঠিকানা বলতে চাইবে না কেন অদ্ভুত? চিঠি পেয়ে পেয়ে মাথা পুরোপুরি বোধহয় গেছে রাগান্বিতার। রাগান্বিতা এসব ভাবতে ভাবতে সদর দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই তাকে আবার ডাকতে এলো লুবনা। বললো,
“বুবু, নদীর ওইপারে যাইবা শাপলা তুলতে?”

রাগান্বিতা দাঁড়িয়ে পড়লো। বললো,
“এখন।”
“হ আমি যামু তুমি আগের বার কইছিলা না শাপলা তুলতে গেলে তোমায় ডাকতে।”

রাগান্বিতা কতক্ষণ ভাবলো। বললো,
“ঠিক আছে তুই দাঁড়া আমি আসছি।”
“ঠিক আছে বুবু।”

রাগান্বিতা চলে গেল উপরে। রেজওয়ান নিজ রুমে ঘুমাচ্ছে। বাবা বারণ করেছে যতদিনে পুরোপুরি সুস্থ না হচ্ছে ততদিনে বাড়ির বাহিরে না যেতে। ঘড়িতে তখন প্রায় এগারোটা বাজে। রাগান্বিতার বাড়িতে একজন কাজের লোক আছে ওনার নাম মিলিতা বেগম বয়স উনপঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। রাগান্বিতা মাঝে মাঝে ওনাকে সুন্দরী দাদিমা বলে ডাকে। কিশোরী বয়সে মহিলাটি দেখতে খুব রূপবতী ছিলেন এখনও গায়ের রঙ পুরো দুধের মতো ফর্সা। ছোট বেলা থেকেই রাগান্বিতা,কুহু আর রেজওয়ানকে উনিই বড় করেছেন। অত্যাধিক ভালোবাসেন, তাই তো কুহুর মৃত্যুতে তিনি বড্ডই আঘাত পান। রাগান্বিতা চিঠিটা তার রুমে রেখে ছুঁটে যায় রন্ধনশালার দিকে মানে রান্নাঘরে দাদিমা তখন দুপুরের ভোজনের জন্য কাটাকাটি করছিলেন। বয়সটা বেশি হলেও দাদিমার হাতের রান্না এখনও দারুণ। রাগান্বিতা ওনায় কাজ করতে সবসময়ই সাহায্য করে। রাগান্বিতা এগিয়ে গেল দাদিমার দিকে। ওনার গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
“দাদিমা আমার না খুব শাপলা খেতে ইচ্ছে করছে।”

রাগান্বিতার কাজে মুচকি হেসে বললো,
“লুবনার লগে যাইবা কিন্তু তোমার বা’জানে যদি আইয়া পরে।”
“বাবা এখন আসবে না তুমি তো জানো বাবা রোজ যোহরের আযানের কতক্ষণ আগে বাড়ি আসে আমি তার আগেই চলে আসবো।”
“গ্রামের মানু তো ভালা না দুপার বেলা তোমারে দেখলে।”
“কেউ দেখবে না। আমি তাহলে যাই।”
“আমি মানা করলে তুমি হুনবা বুঝি।”

হাসে রাগান্বিতা। দাদিমার গালে একটা চুমু একে বলে,
“তুমি মানা করবা বুঝি।”

দাদিমাও হেঁসে ফেলে আজ অনেকদিন পর তিনি হাসলেন। রাগান্বিতা উঠে দাঁড়ালো। বললো,
“আমি তাড়াতাড়িই চলে আসবো তুমি চিন্তা করো না। আর রেজওয়ান দাদাভাইর ঘুম ভাঙলে ওরে কিছু খেতে দিও।”
“আচ্ছা ওসব তোমার ভাবোন লাগবো না।”

মুচকি হাসে রাগান্বিতা অতঃপর হাল্কা একটু তৈরি হয়ে সে চলে যায় লুবনার সাথে বাড়ির পিছন দিকের রাস্তা হয়ে জামতলা পেরিয়ে।
——

“বল তো মোকলেস এই গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরীর নারীর নাম কি?”

বৈঠা হাতে নৌকায় দাঁড়িয়ে থাকা ইমতিয়াজ কথাটা জিজ্ঞেস করলো মোকলেসকে। মোকলেস নৌকার একদম কর্নারে বসেই বলে উঠল,
“রাগান্বিতা আফা।”
“ওনার একটা বোন ছিল না।”
“হ কুহু আফায় উনিও সুন্দর ছিল জানো ইমতিয়াজ ভাই।”
“তাই বুঝি?”
“চোখ দুইডা কি সুন্দর ছিল খালি মায়া আর মায়া।”

ইমতিয়াজ হেঁসে ফেলে। বলে,
“মায়ার তুই কি বুঝিস রে?”

মোকলেস হাসে। বলে,
“গ্রামের হগলে কইতো তাই কইলাম।”

ইমতিয়াজ আবারও হাসে। মনে মনে আওড়ায়,
“রাগান্বিতার চেয়ে বেশি নয়।”

“ওই মোকলেস যাবি?”
আচমকা লুবনার কণ্ঠটা কানে আসতেই সামনে তাকালো ইমতিয়াজ। তার যেন বিশ্বাস হলো না রাগান্বিতা এসেছে। তাও সাজহীনভাবে। রাগান্বিতাকে এর আগে যতবার দেখেছে ইমতিয়াজ প্রতিবারই সাজসজ্জিতভাবে। সকালে যখন দেখেছিল তখনও সেজেগুজে ছিল। হাতে চুড়ি, গলায়,কানে গহনা, চোখে কাজল শাড়িটাও অন্যভাবে পড়তো। কিন্তু এখন একটা লাল রঙা কাপড় পড়েছে তাও গ্রামীণ স্টাইলে হাত গলা খালি দু’কানে শুধু ছোট্ট দুটো কানের দুল তবে কাজলটা আছে আর লাল রঙা ঠোঁট, খোপা করা চুল।খারাপ লাগছে না খুব একটা। সাধারণের মাঝেও অসাধারণ লাগছে তাকে।

এদিকে রাগান্বিতা দেখছে ইমতিয়াজকে। ছেলেটা লুঙ্গি আর ফতুয়া পড়েছে মাথায় গামছা বাঁধা চোখে চশমা নেই, মাথা ভর্তি এলেমেলো চুল, হাতে বৈঠা দেখতে পুরোই অন্যরকম লাগছে আর খাঁটি মাঝি বলে মনে হচ্ছে। এদের ভাবনার মাঝে মোকলেস লুবনাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“তুই আবার কোমনে যাবি?”
“ওইপারে যামু শাপলা আনতে।”
“ওরে বাবা সক কত হাপলা আনতে যাইবে তোরে নিমু না।”

এবার রাগান্বিতা বললো,
“নিবি না কেন তাড়াতাড়ি নৌকা চালা আমরা যাবো।”

কণ্ঠটা যেন রাগান্বিতা আফার মতো লাগলো। মোকলেস এবার ভালোমতো রাগান্বিতার দিকে তাকালো। চোখ বড় বড় করে বললো,
“আফা আমনেও যাইবেন?”
“হ এখন বেশি কথা না বলে দ্রুত চল।”
“আচ্ছা আহেন আফা।”

বলে নৌকা থেকে নামলো মোকলেস। ইমতিয়াজ নৌকার ওই মাথায় দাঁড়ানো। ইমতিয়াজ আর মোকলেস ওরা দুজন নৌকা নিয়ে ওদিকটায় ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করে ছিল। তবে রাগান্বিতারা যে এই মুহূর্তে এখানে আসবে এটা সে ভাবে নি। ইমতিয়াজ রাগান্বিতাকেই দেখে গেল অনেকক্ষণ। মোকলেস নামতেই লুবনা আর রাগান্বিতা উঠে বসলো নৌকায়। নৌকার মাঝখানে বসলো দুজন। রাগান্বিতা প্রশ্ন করলে ইমতিয়াজকে,
“আপনি কি নৌকা চালাবেন এখন?”

ইমতিয়াজের হুস ফিরলো। বললো,
“হুম।”

রাগান্বিতা অবাক হয়ে বললো,
“কখনো চালিয়েছেন নৌকা?”

খুব স্বাভাবিকভাবে বললো ইমতিয়াজ,
“না তো এই প্রথম।”

ইমতিয়াজের কথা শুনে হোঁচট খেল রাগান্বিতা। বললো,
“ডুবিয়ে মারতে চাইছেন নাকি?”
“আমি মরতে দিবো না তো। এখানে মেরে দিলে লাশ পাওয়া যাবে কি।”

রাগান্বিতা হতভম্ব হয়ে বললো,
“কি?”
“আপনি যেটা শুনেছেন সেটাই।”
“আমায় মেরে ফেলবেন?”
“আপনি চাইলে দিতেও পারি।”
“আপনি কি পাগল?”
“হতে পারি।”

তাজ্জব বনে যায় রাগান্বিতা। এ ছেলের সাথে নিশ্চয়ই কোনো ভূত-টূত আছে না হলে এসব কি বলে। রাগান্বিতার ভাবনার মাঝে হেঁসে ফেলে ইমতিয়াজ জোরে চেঁচিয়ে বলে,
“ওই মোকলেস, হলো তোর।”

মোকলেস নৌকাটা ঠেলতে ঠেলতে বললো,
“এই তো দড়ি খুইলা দিছি ভাই। উডমু?”
“ওঠ তাড়াতাড়ি। নয়তো তোর রাগান্বিতা আফা ভাবছে তারে ডুবাইয়া মাইরা ফালামু।”

মোকলেস নৌকা চড়ে বসলো। হাল্কা হেঁসে বললো,
“কি যে কন ভাই!”

ইমতিয়াজ নৌকা চালাতে চালাতে বললো,
“আমি বলি নাই তো তোর রাগান্বিতা আফা বলেছে।”

মোকলেস এবার তাকায় রাগান্বিতার দিকে। বলে,
“ভয় নাই আফা ইমতিয়াজ ভাই অনেক ভালা নৌকা চালায় কাইলগো তো আমায় নৌকায় কত জায়গায় ঘুরালো।”

মোকলেসের কথা শুনে রাগান্বিতা ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে কড়া কণ্ঠে বললো,
“তার মানে আপনি আমায় মিথ্যে কথা বলেছেন?”

ইমতিয়াজ বৈঠা বাইতে বাইতে বলে,
“সুন্দরী নারীদের সাথে দু’একটা মিথ্যে কথা বলাই যায়। এতে কোনো ক্ষতি হয় না বরং ভালোই হয়।”

রাগান্বিতা অবাক হয়ে বলে,
“ভালো কিসে?”
“ওই যে তার ভয় মাখা মুখটা দেখা যায়। দেখতে কিন্তু দারুণ লাগে আপনি কখনো দেখেছেন? দেখেননি আমি জানি।”

রাগান্বিতা আর কিছু বলে না এ ছেলে যে চরম বদমাশ তা সে ভালো মতোই বুঝতে পেরেছে।

#চলবে…..

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-০৫

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-০৫
______________
থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে পুরো জমিদার বাড়ি জুড়ে। বাড়ির উঠানেই চেয়ার পেতে বসে আছে রাগান্বিতার বাবা মোতালেব তালুকদার। তার পাশেই ছাতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাশেম ব্যাপারী। কাশেম হলো মোতালেবের এসিস্ট্যান্ট সবসময় মোতালেব তালুকদারের সঙ্গে সঙ্গেই থাকে। কিছু জরুরি কাজের জন্য গত দু’দিনের ছুটি নিয়ে নিজের গ্রামে গিয়েছিল কাশেম আজই এসেছে। রাগান্বিতা দাঁড়িয়ে আছে তাদের বাড়ির সদর দরজার সামনে। ইমতিয়াজ আসবে এখন? তার বাবা খবর পাঠিয়েছে ইমতিয়াজকে এখানে আসার জন্য বলা হয়েছে। রাগান্বিতা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎই জমিদার বাড়ির পরিবেশটা কেমন যেন করে উঠলো। গাছের পাতা নড়লো, ধূলো উড়লো হাল্কা। বাড়ির একদম সামনে থাকা কালো গেটটা খুলে বাড়ির ভিতর পা রাখলো ইমতিয়াজ। চোখের চশমাটা ঠিক করলো একবার। বাড়ির সামনেই বড় বড় অক্ষরের লেখা ছিল ‘তালুকদার ভিলা’। ইমতিয়াজ মনে মনে পড়েও ছিল একবার। ইমতিয়াজ ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলে রাগান্বিতাদের বাড়ির ভিতরে। বেশি দূর হাঁটা লাগলো না, তার আগেই চোখ পড়লো বাড়ির উঠানে বসে থাকা রাগান্বিতার বাবার দিকে। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার বাবার সামনে গিয়েই হাত উঠিয়ে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম জমিদার সাহেব।”

রাগান্বিতার বাবাও এক গম্ভীর আওয়াজে জবাব দিলেন,
“ওলাইকুম আসসালাম। তুমিই ইমতিয়াজ?”

সরল কণ্ঠে বললো ইমতিয়াজ,
“জি আমি ইমতিয়াজ, ইমতিয়াজ সিকদার।”
“আগে তো এই গ্রামে তোমায় কখনো দেখি নি।”
“আসলে আমি শহরে থাকি আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমার বাবা মা আমায় নিয়ে শহরে গিয়েছিলেন। আমি শহরেই থাকি কিছুদিনের জন্য গ্রামের বাড়ি ঘুরতে এসেছি।”
“একা?”
“জি।”
“কোথায় উঠেছো?”
“ওই সামনেই জায়গাটার নামটা ঠিক জানা হয় নি।”
“তোমার বাবার নাম?”
“নাম বললে হয়তো আপনি চিনবেন না আপনার দাদা বা বাবা হয়তো চিনতেন। আমার বাবার নাম মোশারফ সিকদার।”

মোতালেব তালুকদার সত্যি চিনলেন না কিন্তু অবাক হলেন ইমতিয়াজের বলা তার দাদা আর বাবার চিনতে পারার কথাটা শুনে। খানিকটা অবাক হয়ে বললো রাগান্বিতার বাবা,
“আমার বাপ-দাদা তোমার বাবাকে চিনে এটা তুমি জানলে কি করে?”
“বাবা বলেছে আপনার দাদার নাম মেহেরআলী তালুকদার তো আর আপনার বাবার নাম সোবহান তালুকদার তাই না।”

মোতালেব যেন না চাইতেই হতভম্ব হয়ে গেলেন ইমতিয়াজের কথা শুনে। তার দাদার নাম তো তারই ঠিকভাবে মনে নেই অথচ এই ছেলে তার দাদার নাম গড়গড় করে বলে দিল। মোতালেব তালুকদার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলেন ইমতিয়াজের দিকে। বললেন,
“তুমি কে বলো তো?”

খানিকটা হাসলো ইমতিয়াজ ফের জবাব দিলো,
“এই মাত্রই তো বললাম আমি ইমতিয়াজ, ইমতিয়াজ সিকদার।”

খানিকটা তাজ্জব বনে গেলেন মোতালেব তালুকদার। তবে নিজেকে সামলালেন গম্ভীর আওয়াজে বললেন,
“পরশু তুমি সন্ধ্যার দিকে সামনের ওই জঙ্গলটায় গেছিলে?”
“জি জমিদার সাহেব। বাঁশি বাজাচ্ছিলাম।”
“সন্ধ্যার সময় কে বাঁশি বাজায়?”
“এই কথাটা রাগান্বিতা মানে আপনার মেয়েও বলেছিল। আমিই বাজাই।”
“নিজেকে কি খুব চালাক ভাবছো?”
“একদমই না। ওইদিন মনটা খুব চাইছিল বাঁশি বাজাতে তাই বাজিয়েছিলাম।”
“মন চাইলেই অসময়ে জঙ্গলে গিয়ে বাঁশি বাজাবে। যদি তোমার মন মানুষ খুন করতে চায় তখন?”

ঝটপট জবাব ইমতিয়াজের,
“করে দিবো।”

সঙ্গে সঙ্গে মোতালেব, কাশেম আর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রাগান্বিতা পুরো তাজ্জব বনে গেল। রাগান্বিতা তো বলেই ফেললো,
“ছেলেটা কি পাগল!”

রাগান্বিতার বাবা খুব অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো ইমতিয়াজের মুখের দিকে। বললো,
“কি বললে তুমি?”
“না মানে আজ পর্যন্ত এই জিনিসটা কখনো করতে ইচ্ছে হয় নি। ইচ্ছে হলে হয়তো করে দিতাম তাই বললাম। আমায় আবার খুনি ভাববেন না কিন্তু জমিদার সাহেব।”

রাগান্বিতার বাবা কি বলবেন বুঝতে পারছে না। ছেলেটা তার সামনে খুন করার বিষয়টা নিয়ে এত ইজিলি কথা কি করে বলতে পারছে। ছেলেটা কি সহজ সরল বোকা টাইপের। রাগান্বিতার বাবা ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোমার মন চাইলে তুমি সত্যি মানুষ খুন করতে পারবে?”
“আসলে হয়েছে কি জমিদার সাহেব খুন বিষয়টা আমি কখনো সেইভাবে বড় করে দেখিনি তাই কথাটা বলে ফেললাম। তবে মানুষ খুন করা এত সহজ নাকি।”

লাস্ট কথাটা রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বললো ইমতিয়াজ। মেয়েটা শাড়ির আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। মনে হচ্ছে তারই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। ইমতিয়াজ দৃষ্টি সরালো। বললো,
“আরো কি কিছু জানার আছে জমিদার সাহেব?”
“তুমি কি করো?”
“পড়াশুনা তবে আমার নিজস্ব একটা ব্যবসা আছে পড়াশোনার পাশাপাশি আমি সেই ব্যবসাটাও করি।”
“কিসের ব্যবসা?”
“তাঁতের।”
“আচ্ছা পরশু রাতে যে একটা ছেলের খুন হয়েছিল এ সম্পর্কে তুমি কিছু জানো?”
“জানি বলতে শুনেছি আমি তো আর ছেলেটাকে চিনি না কখনো দেখিই নি। তবে শুনেছি খুন হয়েছিল নাকি।”

আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না মোতালেব তালুকদার। শুধু বললেন,
“ঠিক আছে তুমি এবার যেতে পারো,আবার ডাকলে এসো।”
“ঠিক আছে জমিদার সাহেব আসসালামু আলাইকুম।”
“হুম ওলাইকুম আসসালাম।”

ইমতিয়াজ আর দাঁড়ালো না দু’পলক রাগান্বিতাকে দেখেই বেরিয়ে গেল। রাগান্বিতাও দেখলো তা। ইমতিয়াজ যেতে সেও চলে গেল বাড়ির ভিতরে। অন্যদিকে রাগান্বিতার বাবা তাকিয়ে রইলো ইমতিয়াজের যাওয়ার পানে। ছেলেটার কথাবার্তা ঠিক কেমন যেন ঠেটকো তার তবে কারো কাছে তা প্রকাশ করলেন না। হঠাৎ যেন কি একটা মনে পড়লো রাগান্বিতার বাবা হাল্কা উচ্চ স্বরে বলে উঠলেন,
“ইমতিয়াজ দাঁড়াও।”

ইমতিয়াজ দাঁড়িয়ে পড়লো। কিছু একটা ভাবতে ভাবতে পিছন ঘুরলো। খানিকটা ভ্রু-কুচকে বললো,
“জি বলুন।”
কাশেমকে ডাকলো মোতালেব তালুকদার। বললো,
“পোলাডারে ভিতরে নিয়া যা কাশেম সঙ্গে রাগান্বিতাকে বলবি কিছু মিষ্টি আর পানি দিতে তুই তো জানিস আমাদের পরিবারে একটা নিয়ম আছে মেহমানদের খালি মুখে বিদায় দিতে নেই।”

ইমতিয়াজ শুধু শুনে গেল জবাবে কিছু বলবে কিন্তু রাগান্বিতার বাবা বলতে দিলেন না। কাশেম ইমতিয়াজকে ভিতরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলো ইমতিয়াজও আর বারণ করতে না পেরে চললো কাশেমের পিছু পিছু। তবে যাওয়ার আগে রাগান্বিতার বাবার দিকে তাকালো খুব তার মনে হলো,
“জমিদার সাহেব বোধহয় খুব ভালো মানুষ।”
—–
ডাইনিং টেবিলের পাশেই ছিল একটা জানালা। জানালার পাশে বিশাল একটা গাছ। গাছটার উচ্চতা হয়তো দোতলার ছুঁই ছুঁই। ইমতিয়াজ চেয়ারে বসে আছে তার সামনেই বাটিতে করে মিষ্টি আর পানি রাখা রাগান্বিতা মাত্রই তার সামনে এসব রেখে গেছে। ইমতিয়াজের মোটেও এসব খাওয়ার ইচ্ছে নেই। কাশেম বসে আছে ইমতিয়াজের সামনে। ইমতিয়াজ খাচ্ছে না বলে বললো,
“কি হইলো আমনে দেহি খাইতাছেন না কিছু?”
“আমার আসলে মিষ্টিটা ওতোটা পছন্দ না। মিষ্টি পছন্দ না বলেই আমি রোজ নিমগাছের ডাল দিয়ে দাঁত মাজি।”

কাশেম যেন অবাক হলো ইমতিয়াজের কথা শুনে। বললো,
“আমনে হাছা কন?”
“হুম। কতক্ষণ আগেও মেজে আসলাম তেমারর বিশ্বাস না হলে মোকলেসকে জিজ্ঞেস করতে পারো।”
“তাইলে আমনে এহন মিষ্টি খাইবেন না?”
“তুমি খেয়ে ফেলো।”

এই বলে সামনের গ্লাসটার পানি থেকে কিছুটা পানি খেল ইমতিয়াজ। তারপর বললো,
“তারপর জমিদার সাহেব কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবে আমি খেয়েছি।”
“মিছা কতা কমু।”
“মিথ্যা কথা কই আমি তো খেলাম।”
“কই খাইলেন?”
“এই যে পানি খেলাম এবার তুমি ঝটপট মিষ্টিগুলো খেয়ে ফেলো তো।”

কাশেমের মিষ্টি খুব পছন্দ তাই আর লোভ সামলাতে না পেরে সব মিষ্টি ধপাধপ খেয়ে ফেললো। ইমতিয়াজ মিষ্টি হাসলো এতে। হঠাৎ কাশেমের ডাক পড়লো রাগান্বিতার বাবা তাকে ডাকছেন। কাশেমও দ্রুত পানি খেয়ে ছুট লাগালো বাহিরে। ইমতিয়াজ বসে রইলো অল্প কিছুক্ষণ জানালার বাহিরটা আর বাড়ির ভিতরের আশপাশটায়ও একটু চোখ বুলালো অতঃপর উঠে দাঁড়ালো ইমতিয়াজ এবার তাকে যেতে হবে। ইমতিয়াজ তার গায়ের শার্টটা ঠিক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে বসলো। কোনোদিক আর তাকিয়েই চলে যেতে লাগলো সে। সদর দরজা পর্যন্ত যেতেই রাগান্বিতার কণ্ঠ শোনা গেল। সে বললো,
“আপনি মিষ্টিগুলো খেলেন না কেন?”

ইমতিয়াজ দাঁড়িয়ে পড়লো। রাগান্বিতার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তার কাজলকালো আঁখিতে আমি খুব মায়া দেখেছি,
মিষ্টি তো পছন্দ নয় তাই আমি তিতাতেই সন্তুষ্টতা উপভোগ করেছি।”

ইমতিয়াজ দাঁড়ালো না। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের কথাটার অর্থ না বুঝতে পেরে বললো,
“মানে?”

ইমতিয়াজ কি আর এর মানে বলবে, বলবে না তো তাই যেতে যেতেই বলে গেল,
“সবকিছুর মানে যে খুঁজতে নেই কুমারী রাগান্বিতা।”

চলবে…..