Sunday, August 24, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 477



প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-০৪

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-০৪
______________
নিজের রুমের বিছানায় বসে আছে রাগান্বিতা। তার সামনেই খাটের ওপর পড়ে আছে তখনকার চিঠিটা। রাগান্বিতা বুঝচ্ছে না পর পর দু’দিন তার সাথে এসব হচ্ছে টাকি এমন চিঠিগুলো সব পাঠাচ্ছে কে? যে পাঠাচ্ছে সে কি তাকে চিনে? জেনেশুনেই এসব পাঠাচ্ছে কি? কিন্তু রাগান্বিতার কেন কাউকে মনে হচ্ছে না এসব সে পাঠাতে পারে। কে হতে পারে যে তাকে এসব পাঠাচ্ছে? নানান প্রশ্ন রাগান্বিতার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কিন্তু উত্তর যেন কোনোভাবেই মিলছে না। রাগান্বিতা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো রুমে মধ্যে পায়চারি করতে লাগলো বারংবার। হঠাৎই ইমতিয়াজের ফেসটা ভেসে আসলো সামনে রাগান্বিতা ভাবলো তার বাবাকে বোধহয় এই ছেলেটার কথা বলা উচিত সাথে কালকের ওই সন্ধ্যাবেলা তার জঙ্গলে যাওয়ার বিষয়টাও। এই ইমতিয়াজ ছেলেটাও কেমন যেন অদ্ভুত। কিছু জিজ্ঞেস করলে ঠিক ভাবে উত্তর দেয় না খাপছাড়া টাইপের। তবে ছেলেটার হাসি। না চাইতেও আনমনে হেঁসে ফেললো রাগান্বিতা। পরক্ষণেই নিজের মুডটা ঠিক করলো সে, বিড় বিড় করে বললো,
“এসব কি ভাবছিস রাগান্বিতা?’

হঠাৎই বাহিরে সোরগোল শোনা গেল? রাগান্বিতা চমকে উঠলো আবার। পলক ফেলে বললো,
“আবার কি হলো?”

রেজওয়ানের মাথা ফেটে গেছে। মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে অনেক। রাগান্বিতা ভাইয়ের এমন অবস্থা দেখে দৌড়ে আসলো। হতভম্ব কণ্ঠে বললো,
“দাদাভাই এসব কি করে হলো?”

রেজওয়ান আশেপাশে তাকিয়ে বললো,
“পড়ে গিয়েছিলাম।”

রেজওয়ানের কথার মাঝেই গ্রামের একজন লোক তালিবুল ইসলাম বললো,
“আমি ক্ষেতের জমিতে চাষ করতাছিল হঠাৎ দেহি রেজওয়ান সাহেব মাথায় হাত দিয়া কেমন যেন ঝিমাইতে ঝিমাইতে হাঁটতাছিল একটু ভালোভাবে তাকাইতেই দেহি মাথা দিয়া রক্ত পড়তাছে তাই হয়ালে নিয়া আইলাম।”

তালিবুলের কথা শুনে রাগান্বিতাও কৃতজ্ঞতার সাথে জানালেন,
“আপনায় ধন্যবাদ চাচা।”
“ঠিক আছে আমি তাইলে যাই এহন।”
“জি চাচা।’

তালিবুল চলে গেলেন সাথে আরো দু’চারজন লোকও। সবাই যেতেই রাগান্বিতা রেজওয়ানকে ধরে ধীরে ধীরে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেল। বললো,
“খুব ব্যাথা পেয়েছো তাই না দাদাভাই?”

রেজওয়ান মাথায় হাত রেখে বলে,
“একটু।”

রেজওয়ানকে তার রুমে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল রাগান্বিতা তারপর আতিবকে পাঠালো ডাক্তারকে আনানোর জন্য। ডাক্তার আসার আগে একটা কাপড় আর পানি নিয়ে দ্রুত ভাইয়ের রুমে আসলো রাগান্বিতা। রেজওয়ান তখনও মাথায় হাত দিয়ে বসা ছিল বিছানায়। রাগান্বিতা এগিয়ে এসে বসলো তার ভাইয়ের পাশ দিয়ে। বললো,
“এবার সত্যি করে বলো তো দাদাভাই এসব কি করে হলো?”

রেজওয়ান তার বোনের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি সত্যিই পড়ে গেছিলাম।”
“আমায় মিথ্যা বোঝাতে এসো না দাদাভাই তাড়াতাড়ি বলো কি করে হলো? কারো সাথে মারপিট করেছো?”

উত্তরে ‘না’ বোধক মাথায় নাড়ায় রেজওয়ান। ভাইয়ের উত্তর পেয়ে রাগান্বিতা আস্তে করে কপাল থেকে ভাইয়ের হাতটা ছাড়িয়ে আনে। বেশ জায়গা দিয়ে কেটে গেছে কপালের বামদিকটা। রাগান্বিতা আঘাতের অংশটুকু ছেড়ে তার আশপাশের জায়গাটা ধীরে ধীরে পানি দিয়ে পরিষ্কার করতে থাকে। হাতে লেগে থাকা রক্তটুকুও মুছতে মুছতে বলে,
“তাহলে কি হয়েছিল বলো আমায় এতটা কপাল কাটলো কি করে?”

এবার রেজওয়ান বলতে লাগলো,
“আমি বাড়িই ফিরছিলাম। আমাদের বাড়ির ওই পিছনের দিকটায় জামতলা ছাড়িয়ে ওই দূরে একটা পুকুর আছে না ওখানে আমি আর রানা আড্ডা দিচ্ছিলাম। পরে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে বাড়ির পথে আসছিলাম তুই তো জানিস রানাদের বাড়ি পুকুরটার ডানদিকে আর আমাদের বা’দিকে তাই ও ওদের বাড়ির দিকে যাচ্ছিল আর আমি আমাদের বাড়ির দিকে। আমি পুকুরটা পেরিয়ে কেবল জামগাছতলার ওদিকটায় আসলাম তখনই আচমকা কে যেন এসে আমার মাথায় আঘাত করলো আমি কিছু বুঝে ওঠার আগে পালিয়েও গেল আমি শুধু ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা দেখেছি একটা কালো রঙের চাদর পড়া ছিল মানুষটা এর বেশি কিছু দেখি নি। তবে এতটুকু বুঝেছিলাম আমাকে মারার ইচ্ছে ছিল না শুধু ওই একটা বারি দিয়েই চলে গেছে।”

রাগান্বিতা ভেবে পেল না এমনটা কে করতে পারে? রাগান্বিতা খুব কঠোর কণ্ঠে বললো,
“তুমি এর আগে কারো সাথে ঝগড়া করছিলে দাদাভাই?”
“না আমার নগদে কারো সাথেই ঝগড়া হয় নি। আর তুই জানিস আমি এতদিন শহরে ছিলাম তাহলে ঝগড়া হবে কার সাথে।”

ভাইয়ের কথা শুনে রাগান্বিতা অনেকক্ষণ ভেবে বললো,
“তাহলে মারলো কে?”
“সেটাই তো বুঝচ্ছি না।”

রাগান্বিতা খুব আপসেটের সঙ্গে বললো,
“কিছুদিন যাবৎ আমাদের সাথে কিসব ঘটছে দাদাভাই? বুবুটা মারা গেল, মুরতাসিনও খুন হলো আবার তোমায় কেউ মারলো এগুলো করছে কে?”
“আরে তুুই বেশি ভাবছিস কুহুর মৃত্যুটায় তুই আপসেট তো তাই এসব ভাবছিস আর মুরতাসিনের সাথে তো আমাদের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই।”

রাগান্বিতা কিছু বলে না। তবে মনে মনে আওড়ালো,
“তোমায় সবটা বলতে পারছি না দাদাভাই। গত দুইদিন যাবৎ সবকিছুই কেমন এলেমেলো হচ্ছে তিনটে চিঠি, মুরতাসিনের মৃত্যু আর নতুন ওই ছেলেটার আগমন সবকিছুই আমার কেমন যেন লাগছে দাদাভাই।”

রাগান্বিতার ভাবনার মাঝেই রেজওয়ান বললো,
“কি ভাবছিস?”
“আচ্ছা দাদাভাই আমাদের কি কোনোকালে কোনো শত্রু ছিল?”

রেজওয়ান খানিকক্ষণ চুপ রইলো রাগান্বিতার কথা শুনে। একটু ভেবে বললো,
“এসব তো জানি না।”

রাগান্বিতা আর কিছু বলে না। এরই মাঝে আতিব হাজির হলো ডাক্তারকে নিয়ে। ডাক্তার আসতেই রাগান্বিতা সরে গিয়ে দাঁড়ালো সাইডে। আর ডাক্তার দেখতে লাগলো রেজওয়ানকে।
——

রাত সাড়ে আটটা! আকাশ জুড়ে কেমন যেন ধূসর রঙের মেঘ বইছিল। বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে ছিল রাগান্বিতার বাবা। উনি কিছু ভাবছিলেন। গত সাতদিন থেকে তার বাড়ি থেকে বোধহয় শোকের ছায়া যাচ্ছেই না। আজ আবার ছেলেটা আঘাত পেল। রাগান্বিতার মা নেই। রাগান্বিতা যখন খুব ছোট ছিল তখনই মারা যায়। রাগান্বিতার বাবা সেই থেকে তিন ছেলেমেয়ে নিয়েই আছেন। ছেলেমেয়েদের অভাব তিনি কখনোই বুঝতে দেয় নি। ছেলেটাকে শহরে পাঠিয়ে পড়াশোনা করাচ্ছেন, কুহু মেয়েটা শান্তসৃষ্ট আর ভীতু টাইপের থাকায় শহরে রাখার কথা কখনোই ভাবে নি রাগান্বিতার বাবা। তবে রাগান্বিতাকে নিয়ে ভেবেছিলেন। মেয়েকে উকিল বানানোর তার একটা ইচ্ছে ছিল অবশ্য ছিল বললে ভুল হবে এখনো আছে। ‘মেয়েদের বেশি পড়াশোনা করতে নেই’ এই চিন্তাধারা থেকে সবসময়ই বিরত থাকতেন রাগান্বিতার বাবা। তিনি চান রাগান্বিতাকেও তার চিন্তা ধারার মতো একজন পুরুষের হাতে তুলে দিতে। যে তাকে পড়াশোনা করিয়ে উকিল বানানোর স্বপ্নটা পূরণ করবে। কিন্তু কুহুর মৃত্যুতে যেন সবটা এলেমেলো হয়ে গেল। কেমন যেন খাপছাড়া লাগছে সবটা। তার মনে হচ্ছে সে বুঝি তার সন্তানদের ওপর তার ইচ্ছেগুলো চাপিয়ে দিতে চাইছেন জোর করে। কুহুর বিয়ে ঠিক হয়েছিল। মেয়েটা বিয়েতে রাজি ছিল কি না রাগান্বিতার বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন কুহুও বলেছিল রাজি সে। কিন্তু হঠাৎ কি হলো যে মেয়েটা বিষ খেল এটাই বুঝলো না রাগান্বিতার বাবা। মেয়েটা যদি একবার মুখ ফুটে তার সমস্যার কথা জানাতো তবে হয়তো রাগান্বিতার বাবা তার নিজের সবটা দিয়ে সেই সমস্যার সমাধান করতেন। বিয়ে ভাঙার কথা বললেও মেনে নিতেন নিরদ্বিধায়।“কিন্তু মেয়েটা কি করলো?”

রাগান্বিতার বাবার চোখ ভেসে উঠলেন চোখের কোনে পানি জমেছে তার। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলো রাগান্বিতা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনুমতি চাইলো তার বাবার থেকে। বললো,
“বাবা আসবো?”

রাগান্বিতার বাবা দ্রুত তার চোখ মুছে নিলেন। বললেন,
“হুম আয়।”

রাগান্বিতা এগিয়ে গেল তার বাবার কাছে বেশি না ভেবেই বাবার পায়ের কাছে বসে বললো,
“তুমি কাঁদছিলে তাই না বাবা?”

রাগান্বিতার বাবা শুঁকনো হাসলেন। বললেন,
“না তো। চোখে কি যেন একটা পড়েছে।”

রাগান্বিতা বাবার হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
“বুবুকে নিয়ে খুব ভাবছো। তাই না বাবা?”

এবার খানিকটা নরম হলেন রাগান্বিতার বাবা। বললেন,
“তোর বুবুকে বোধহয় আমি খুব একটা ভালোবাসতাম না তাই না রাগান্বিতা?”

রাগান্বিতা অবাক স্বরে বললো,
“এসব কি বলছো বাবা? তুমি তো আমাদের দুই ভাইয়ের থেকে বুবুকে সব চেয়ে বেশি ভালোবাসতে।”
“বাসতাম তাই না। আচ্ছা তোর বুবুটার মনে কি কোনো কষ্ট ছিল রে রাগান্বিতা যার জন্য এমন করে চলে গেল।”

রাগান্বিতার কষ্ট লাগলো। চোখ ভেসে উঠছে তার। রাগান্বিতা নিজেকে সামলালো। বললো,
“আমি সত্যি জানি না বাবা বুবু এমনটা কেন করলো?”

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রাগান্বিতার বাবা। বললেন,
“যাক বাদ দে। রাতে খেয়েছিস?”
“তুমি না খেলে কি করে খাই বাবা।”
“আচ্ছা তোকে আর রেজওয়ানকে আজ আমি নিজ হাতে খাইয়ে দিবো কেমন।”
“ঠিক আছে বাবা।”

কিছুক্ষণের নীরবতা চললো দুজনের মাঝে। হঠাৎই রাগান্বিতা বললো,
“তোমায় কিছু বলার ছিল বাবা হয়তো আগেই জানানো উচিত ছিল কিন্তু সুযোগ আর পরিস্থিতির অভাবে বলা হয় নি।”

রাগান্বিতার বাবা মেয়ের দিকে তাকালেন। বললেন,
“কি কথা?”

রাগান্বিতা কিছুটা সময় নিয়ে বললো,
“আসলে হয়েছিল কি বাবা কাল সন্ধ্যার দিকে আমি আনমনেই বুবুর কথা ভাবতে ভাবতে জঙ্গলের দিকে চলে যাই। তখনই ওই বটগাছটার নিচে একটা ছেলে বাঁশি বাজাতে ছিল। তখন আমি এগিয়ে গিয়ে,

এই বলে কালকের সব ঘটনা খুলে বললো রাগান্বিতা তার বাবাকে। রাগান্বিতার বাবাও মন দিয়ে সবটা শুনলেন। একটু গম্ভীর আওয়াজে বললেন,
“ছেলেটার নাম কি?”

দ্রুত জবাব রাগান্বিতার,
“ইমতিয়াজ বাবা, ইমতিয়াজ সিকদার।”
—–

ভোরের ফুড়ফুড়ে আমেজ। নিমগাছের ডাল দিয়ে পুকুরপাড়ে বসে দাঁত মাজছিল ইমতিয়াজ। এমন সময় তার কাছে দৌড়ে আসলো ছোট্ট একটা পিচ্চি ছেলে নাম মোকলেস। ও দৌড়ে এসে বললো,
“ইমতিয়াজ ভাই আমেনেরে জমিদার সাহেব হয়ালে তাগো বাড়ি যাইতে কইছে।”

মোকলেসের কথা শুনে ইমতিয়াজ মোটেও অবাক হয় নি। বোধহয় সে জানতো তাকে ডাকা হবে। ইমতিয়াজ কি ভেবে যেন এক রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বললো,
“ঠিক আছে।”

#চলবে……

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-০৩

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-০৩
______________
দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে রাগান্বিতা। চোখে মুখে অশেষ চিন্তার ছাপ। উঠানে কান্নার রোল পড়েছে কারণ মুরতাসিনের বাবা মা এসেছেন। ছেলের এমন অকাল মৃত্যুটা তারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। রাগান্বিতার বাবা যেন ওনাদের কষ্টটা বুঝলেন মেয়ে মরা শোক এখনো তো যায় নি তার। রাগান্বিতা আর দাঁড়ালো না চুপচাপ ঢুকে গেল বাড়ির ভিতরে। অন্যমনস্ক হয়ে হেঁটে গেল নিজের কক্ষে। কিছু ভালো লাগছে না চারপাশটা কেমন যেন রহস্য রহস্য ঠেকছে তার কাছে। মুরতাসিনকে এমন নয় রাগান্বিতা চেনে না। ঠিক দুদিন আগে তার কক্ষে ঢিল ছুড়ে ছিল এতে রাগান্বিতা প্রচুর রেগে যায় অনেক বকাঝকাও করে কিন্তু তাও ছেলেটা শোনে না প্রায়সই তাকে বিরক্ত করতো। কখনো হাত ধরার সাহস করে নি, কিন্তু কাল রাগান্বিতা বোনের কথা চিন্তা করতে করতেই বাহিরে বেরিয়েছিল তখন মুরতাসিন অনেক সাহস নিয়ে তার হাতটা ধরে, তাকে ভালোবাসি বলেছিল। রাগান্বিতা এতে খুবই ক্ষিপ্ত হয়ে যায় মুরতাসিনের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে উল্টো সে মুচড়ে ধরে মুরতাসিনের হাত সাথে হুমকি দেয় ফের যদি এমন কিছু বলে তাহলে সে তার বাবাকে বলে দিবে। মুরতাসিনের চোখে মুখে ভয় ছিল তখন সাথে হাতে ব্যাথা পাচ্ছে তারও আর্তনাদ ছিল। রাগান্বিতা মুরতাসিনের আর্তনাদ ভরা চোখ দেখে ছেড়ে দেয় তার মনে হয়েছিল মুরতাসিন আর তার সাথে এসব বিষয় নিয়ে কিছু বলবে না। কিন্তু আজ সকালে, পুকুর পাড়ে নাইতে নেমেছিল সে। রাগান্বিতাদের বাড়ির পুকুরপাড়ে গোসল করার জন্য ছেলেমেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা পুকুরপাড় আছে। মেয়েদের পাড়টায় চারপাশ কালো পলিথিন দিয়ে বেড়া দেয়া থাকে। রাগান্বিতা কেবলই পুকুরে নেমেছিল নাইবার জন্য তখনই কোথা থেকে যেন মুরতাসিন হাজির হয়। রাগান্বিতা প্রচন্ড ক্ষেপে যায় এতে। আটপাচ কিছু না ভেবেই নাওয়া ছেড়ে ছুট লাগায় মুরতাসিনের দিকে। কিন্তু মুরতাসিন তখন পালিয়ে বাঁচে। এসব কথা রাগান্বিতা ভেবেছিল তার বাবাকে বলবে কক্ষেও গিয়েছিল একবার কিন্তু বোনের শোকে বাবা খুব মর্মাহত ছিল বিধায় আর বলা হয় নি। কিন্তু রাগান্বিতা এটা ভেবে পাচ্ছে না মুরতাসিনকে কেউ কেন মারলো। তার জন্য নয়তো। কিন্তু তার জন্য কেউ কেন এভাবে একটা মানুষকে খুন করবে। রাগান্বিতা নিচে পড়ে থাকা সেই রক্তে ভেজা চিঠিটা আবার দেখলো। রক্তে পুরো জ্বলজ্বল করছে লেখাটা “সে নিষিদ্ধ ছিল”।

এই নিষিদ্ধ জিনিটা ঠিক কি? কোনো মানুষ নাকি অন্যকিছু। রাগান্বিতা কি ভেবে যেন সকালের সেই ডাকপিয়নের কাছ থেকে পাওয়া চিঠিটার হাতের লেখা আর এই রক্তে ভেজা চিঠিটার হাতের লেখাটা মিলালো। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুঝলো, এই দুটো চিঠির হাতের লেখা ভিন্ন। রাগান্বিতা বিষয়টা ধরতে পেরেই মনে মনে আওড়ালো,
“তাহলে কি এই দুই চিঠির মালিক দুটো ভিন্ন মানুষ!”
____

প্রকৃতি জুড়ে আজ রোদ উঠেছে। পাখিরা উড়ছে, বাতাসে শোকের ছায়া শেষে যেন হাল্কা হাল্কা আলো এসেছে। রাগান্বিতা বাড়ির উঠানে হাঁটছিল। সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে রাগান্বিতা স্কুলে যাচ্ছে না। রাগান্বিতা এবার মাধ্যমিক দিবে। বয়স তার ষোল হলেও মেয়েটা সাহসের দিক দিয়ে তার বাপ ভাইদের মতো। শুধু কুহু একটু ভীতু টাইপের ছিল। রাগান্বিতা তার শাড়ির আঁচলটা ধরে হাঁটছে আর নানা কিছু ভাবছে। হঠাৎই রাগান্বিতার কি যেন একটা মাথায় আসলো সে এগিয়ে যেতে লাগলো কালকের সেই জঙ্গলটার দিকে রাগান্বিতার বিশেষ ভুল না করলে তার মনে হচ্ছে কালকের সেই ছেলেটার সাথে তার আজও দেখা হবে। হলোও তাই রাগান্বিতা কালকের সেই আগের জায়গাটায় আসতেই নজরে আসলো তার কালকের সেই ছেলেটাকে। ছেলেটার নামটা যেন কি ছিল? কিছুক্ষণ ভাবতেই মনে পড়লো রাগান্বিতার। ছেলেটার নাম ইমতিয়াজ। ছেলেটা আজও দাঁড়িয়ে আছে কালকের সেই বড় গাছটার নিচে। ওই বড়গাছটার নামই ছিল বটগাছ। মানে মুরতাসিনের মৃত্যুর সেই স্থানটা। রাগান্বিতা আশেপাশে তাকালো না নিচে কোনো রক্তের দাগ টাগ দেখছে না। রাগান্বিতা যখন এসব ভাবতে ব্যস্ত ছিল ঠিক তখনই ইমতিয়াজ পিছনে ঘুরলো। সামনেই রাগান্বিতাকে দেখে বললো,
“আরে জমিদার কন্যা রাগান্বিতা যে আপনি এখানে?”

রাগান্বিতা জবাব দেয় না। শুধু তাকিয়ে থাকে ইমতিয়াজের মুখের দিকে। তার কি এই ছেলেটাকে সন্দেহ হচ্ছে। রাগান্বিতাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইমতিয়াজ আবার বলে,
“শুনলাম কাল রাতে নাকি আপনাদের গ্রামের কাকে যেন খুন করা হয়েছে কথাটা কি সত্যি?”

এবার রাগান্বিতা মুখ খুললো মাথা নাড়িয়ে বললো,
“হুম। আর লাশটা কোথায় পাওয়া গেছিল জানেন?”

বেশ আগ্রহ নিয়ে বললো ইমতিয়াজ,
“কোথায়?”
“আপনি যে গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছেন ঠিক সেই গাছটার নিচে।”

সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠলো ইমতিয়াজ। দ্রুত গাছটার থেকে সরে এসে বুকে ফু দিলো। ইমতিয়াজের কান্ডে রাগান্বিতা না চাইতেও হেঁসে দিলো। রাগান্বিতার হাসি দেখে চোখ মুখ কুঁচকে বললো ইমতিয়াজ,
“আমি কিন্তু ভয় পাই নি পায়ে কি যেন একটা লাগলো তাই সরে এসেছি।”

রাগান্বিতা হাসতে হাসতে জবাব দিলো,
“হুম বুঝেছি।”
“কি বুঝেছেন দেখুন আপনি যা বুঝেছেন তা কিন্তু আমি বোঝাতে চাই নি।”

ইমতিয়াজের কান্ডে রাগান্বিতা আরো হাসলো। তার হাসি থামছে না। ইমতিয়াজকে আর একটু ভয় দেখাতে বললো রাগান্বিতা,
“আপনি জানেন আমাদের গ্রামে ভূত আছে।”

ইমতিয়াজ স্বাভাবিকভাবে জবাব দিলো,
“তাই বুঝি।”
“হুম।”
“আপনার কি মনে হয় আমি ভূতে ভয় পাই?”
“পেতেও তো পারেন যেভাবে ভয়ের চোটে সরে আসলেন।”

ইমতিয়াজ মাথায় চুলকায়। বলে,
“আপনি আমায় চিনেন না তাই বলছেন যেদিন চিনে যাবেন সেদিন কিন্তু আপনি ভয় পাবেন।”

ইমতিয়াজের এবারের কথায় রাগান্বিতার হাসি থেমে গেল ছেলেটা কি বললো ঠিক বুঝলো না। রাগান্বিতা তার হাসি থামিয়ে প্রশ্ন করলো,
“মানে?”
“কাল আপনায় একটা কথা বলেছিলাম সব কথার মানে খুঁজতে নেই।”
“আপনি কি এখানে একা আছেন?”
“বলবো কেন!”

উত্তর খুঁজে পায় না রাগান্বিতা। সত্যি তো ছেলেটা তাকে সব প্রশ্নের এত উত্তর দিবে কেন? রাগান্বিতা আবার চুপ হয়ে যাওয়ায় ইমতিয়াজ বলে,
“আচ্ছা আমরাও তো কাল সন্ধ্যার দিকে এখানে ছিলাম খুনটা নাকি রাত আটটার দিকে হয়েছে তা আপনার বাবা মানে জমিদার সাহেবকে বলেছিলেন আপনি কাল এখানে এসেছিলেন আর আমায় দেখেছেন।”

রাগান্বিতা অনেকক্ষণ চুপ থেকে জবাব দেয়,
“না বলা হয় নি।”
“ওহ আচ্ছা। আমি ভেবেছিলাম বলেছিলেন হয়তো। তা ছেলেটাকে চিনতেন আপনি?”
“হ্যাঁ চিনতাম প্রায়সই দেখা হতো।”
“ভালো ছেলে ছিল বুঝি।”
“ভালো না ছাই এক নাম্বারের অভ..

বলতে গিয়েও থেমে গেল রাগান্বিতা। ইমতিয়াজের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনায় বলবো কেন?”

হেঁসে ফেলে ইমতিয়াজ। চোখের চশমাটা হাত দিয়ে নাড়িয়ে বলে,
“খুব সুন্দর।”

অবাক হয়ে বলে রাগান্বিতা,
“কি?”
“আপনায় বলবো কেন।”

হঠাৎই সাইকেলে বেল বাঝার আওয়াজ আসলো। ইমতিয়াজ বললো,
“কোনো ডাকপিয়ন এসেছে বুঝি?”

রাগান্বিতা বিড় বিড় করে বললো,
“আবার ডাকপিয়ন তার নামে আবার কোনো চিঠি আসলো না তো।”

রাগান্বিতা দাঁড়ালো না। কি ভেবে থড়থড় করে বললো,
“আমায় যেতে হবে।”

ইমতিয়াজও কোনো প্রশ্ন করলো না শুধু বললো,
“ঠিক আছে যান।”

রাগান্বিতা যেতেই ইমতিয়াজ তাকালো সামনের বটগাছটার দিকে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সেও চলে গেল তার গন্তব্যের স্থানে।
—–

রাগান্বিতা বাড়ি ঢুকতেই দেখলো সত্যি সত্যিই একজন ডাকপিয়ন তাদের বাড়ির উঠানে এসেছে। আশেপাশে কেউ নেই বিধায় লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। রাগান্বিতা পিছন থেকে হেঁটে যেতেই তাকে নজরে আসলো ডাকপিয়নের। খুব অস্থির কণ্ঠে চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
“আমনের নামে চিডি আইছে?”

রাগান্বিতা অবাক হলো সত্যি সত্যিই তার নামে আবার চিঠি এসেছে। রাগান্বিতা বেশি না ভেবে চিঠিটা হাতে নিলো ডাকপিয়নও তার একটা ছোট্ট সই নিয়ে সাইকেল নিয়ে চলে গেল। এমন সময় সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো রাগান্বিতার বাবা,
“কে আসছিল রাগান্বিতা?”

রাগান্বিতা খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে চিঠিটা শাড়ির আঁচলে লুকালো। বললো,
“ডাকপিয়ন আসছিল বাবা।”
“ হঠাৎ ডাকপিয়ন কেন আসলো?”

রাগান্বিতা হেঁটে এগিয়ে গেল তার বাবার দিকে।বললো,
“তেমন কিছু না বাবা একটা ঠিকানা জানতে চেয়েছিল।”
“ওহ আচ্ছা। বাহিরে বেশি বেরিও না রাগান্বিতা গ্রামের পরিস্থিতি জানোই তো।”
“বাবা মুরতাসিনের খুনটা কে করলো খুঁজে বের করবে না?”

ছোট করে জবাব দিলো রাগান্বিতার বাবা,
“দেখি। শোনো আমি একটু বাজারের দিকে যাবো বাড়ি ছেড়ে কোথায়ও যাবে না ঠিক আছে।”
“আচ্ছা বাবা।’

রাগান্বিতার বাবা চলে গেলেন। রাগান্বিতাও আর কিছু বললো না। তার কি বলা উচিত ছিল কালকের ওই ছেলেটা আর তার জঙ্গলে যাওয়ার বিষয়টার কথা। রাগান্বিতা তার হাতের চিঠিটা আবার দেখলো বাড়ির ভিতরে ঢুকতে ঢুকতেই চিঠিটা খুলো। চিঠিটা খুলতেই লেখা দেখলো। যেখানে লেখা ছিল,

“আমি প্রেমহীন নগরে লিখতে বসেছি
এক বিষাক্ত উপন্যাস
তুমি ছুঁয়ে দিলে একবার, দেখে নিও আমি পিছু ছাড়বো না আর”

#চলবে…..

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-০২

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-০২
_________________
অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাগান্বিতা চিঠিটার দিকে। এটা কেমন চিঠি ছিল? আর লিখলোই বা কে? কোনো নাম তো লেখা নেই। রাগান্বিতা চিঠিটার এদিক ওদিক নাড়িয়ে দেখলো কিন্তু তেমন কিছুই লেখা মিললো না। হঠাৎই কিসের যেন একটা সুর রাগান্বিতার কানে বেজে উঠলো কেউ কি বাঁশি বাজাচ্ছে। সময়টা তখন প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে নিভু নিভু অন্ধকার নামছে চারপাশে। বাঁশির সুর সামনের কোথা থেকেই যেন আসছে এই সন্ধ্যাবেলার অসময়ে বাঁশি বাজাচ্ছে কে? রাগান্বিতা কৌতুহলী চিঠিটা হাতে নিয়েই এগিয়ে গেল সামনে। সে সামনে যত এগোচ্ছে বাঁশির সুরটা যেন ততই মিষ্টি মধুর আর খুব নিকটে শোনাচ্ছে। রাগান্বিতা এগিয়ে আসতেই আশপাশের থমথমে প্রকৃতিটা নড়েচড়ে উঠলো বাতাস বইলো হঠাৎ। রাগান্বিতা এগিয়ে আসতে আসতে তার দেখা মিললো খানিকটা জঙ্গলের মতো ঘেরা জায়গা একটা। রাগান্বিতাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে বনজঙ্গলের মধ্যে ঘেরা সবচেয়ে বিশাল গাছটার কাছে কেউ বসে আছে। সেখান থেকেই বাঁশির সুরটা আসছে। রাগান্বিতা আওয়াজ করলো। শক্তপক্ত কণ্ঠে বললো,
“কে! কে ওখানে?”

প্রথমে উত্তর মিললো না। শুঁকনো পাতার উপর দিয়ে যাওয়ায় খচখচ শব্দ করে আওয়াজ করলো রাগান্বিতা। ইচ্ছেকৃত নয় তার হেঁটে যাওয়ার জন্য শব্দ হয়েছিল মাত্র। রাগান্বিতা আবার বললো,
“এই ভর সন্ধ্যাবেলা বাঁশি বাজাচ্ছেন কেন?”

এবার যেন উত্তর আসলো। বাঁশি বাজানো বন্ধ হলো। এক অনাকাঙ্ক্ষিত পুরুষয়ালী ভাড়ি কণ্ঠে সুধালো কেউ,
“কেন এই গ্রামে কি কেউ এই সময় বাঁশি বাজায় না।”

প্রতিউত্তরে খুব দ্রুত জবাব রাগান্বিতার,
“না বাজায় না। কে আপনি?”

মানুষটা এবার বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। গায়ে জড়ানো পাতলা চাদর তার ভিতর টিশার্ট, কালো জিন্স, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, হাল্কা ফর্সা গায়ের রঙ, মাথায় ভর্তি সিল্কি চুল। রাগান্বিতা ছেলেটিকে দেখেই দ্রুত প্রশ্ন করলো,
“কে আপনি? আগে তো এই গ্রামের কখনো দেখি নি।”

এক গাল মিষ্টি হাসি দেয় ছেলেটি। দু’পা এগোতে এগোতে বলে,
“আমি ইমতিয়াজ, ইমতিয়াজ সিকদার।”
“তো এখানে কি করছেন?”
“কিছু করছি না তো আমি শহরে থাকি কিছুদিনের জন্য গ্রামের বাড়ি ঘুরতে এসেছি।”
“আপনার গ্রামের বাড়ি এইটা।”
“হবে হয়তো।”
“মানে?”
“সব মানের যে উত্তর খুঁজতে নেই রাগান্বিতা।”

এবার যেন রাগান্বিতা খানিকটা অবাক হলো। দু’বার পর পর পলক ফেলে বললো,
“আপনি আমার নাম জানেন?”
“হুম জানি তো এই রেশবপুরের এমন মানুষ আছে নাকি যে জমিদার বাড়ির দুই কন্যাকে কেউ চেনে না। আপনি তো ছোটজন তাই না।”

রাগান্বিতা জবাব দেয় না। উল্টো প্রশ্ন করে,
“আপনি এই গ্রামেরই?”
“হয়তো।”
“আপনি কি এই ভর সন্ধ্যাবেলা আমার সাথে মসকরা করছেন? হয়তো, হবে এসব বলে।”

উচ্চস্বরে হাসে ইমতিয়াজ। রাগান্বিতাকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে খুব স্বল্প স্বরে বলে,
“আবার দেখা হবে।”

ইমতিয়াজ চলে যায় দিয়ে যায় এক রহস্যময়ী হাসি। রাগান্বিতা বেশ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ছেলেটা এভাবে বললো কেন? রাগান্বিতার ভাবনার মাঝেই ইমতিয়াজ যেতে যেতে আবার বললো,
“সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে এখনই আযানের ধ্বনি আসবে দ্রুত বাড়ি যান। আপনি হয়তো জানেন এই জায়গাটা খুব একটা ভালো না।”

রাগান্বিতা পিছন ঘুরলো কিন্তু ইমতিয়াজ দাঁড়ায় নি কথাটা বলেই চলে গেছে। রাগান্বিতাও আর দাঁড়ালো না হাতের চিঠিটায় আর একবার দৃষ্টি দিয়েই চলে গেল। চারপাশ তখন সন্ধ্যার নিভু নিভু আঁধারে পারি জমাচ্ছে আচমকা একটা গাছ বেয়ে কি যেন পড়লো, কাঠবিড়ালি বোধহয়। আযান দিলো, সন্ধ্যা হলো। নামাজের উদ্দেশ্যে পুরুষরা মসজিদে আর মহিলারা ঘরে জায়নামাজের পাটি বিছালো।
___

রাত আটটা। নিজের পড়ার টেবিলে বসে আছে রাগান্বিতা হাতে তার বিকালের আসা সেই চিঠিটা। কে লিখেছে, কেন লিখেছে, তাকেই কেন দিয়েছে, সে কি এই চিঠি দাতাকে চিনে নানান কিছু মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে রাগান্বিতার। তার ওপর কুহুর মৃত্যু। কুহুর বিয়ে ঠিক হয়েছিল। সব ঠিক থাকলে ঠিক দু’দিন আগেই কুহুর বিয়েটা হয়ে যেত আজ সে শশুর বাড়ি থাকতো কিন্তু এখন কোথায় আছে আপাটা। রাগান্বিতা জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার বোনটা কি এই বিয়েতে রাজি ছিল না তাই বিষ খেয়েছিল কিন্তু সে যখন কুহুকে জিজ্ঞেস করেছিল তখন তো তার আপা খুশি ছিল। ছেলেও নাকি পছন্দ হয়েছিল। তাহলে?’

রাগান্বিতা নানা কিছু ভাবতে থাকলো কিন্তু সব কথার মাঝের শেষে গিয়ে একটা কিন্তু রয়েই গেল। বোনটার বিষ খাওয়ার তেমন কোনো কারণই পাচ্ছে না রাগান্বিতা। রাগান্বিতা যখন এসব ভাবছিল সেই মুহূর্তে তার জানালার কাছে এসে কে যেন চেঁচাচ্ছিল৷ রাগান্বিতা খানিকটা চমকে উঠলো এতে দ্রুত টেবিল থেকে সরে কৌতুহলী জানালার কাছে ছুটে গেল দেখলো তার জানালার পাশে একটা পায়রা এসেছে। রাগান্বিতার কক্ষের জানালা হাল্কা ভিড়ানো ছিল বিধায় ভিতরে ঢুকতে পারছিল না। রাগান্বিতা তার কক্ষের জানালা হাল্কা খুলে দিল সঙ্গে সঙ্গে পায়রাটা ভিতরে ঢুকে ছুট্টে গিয়ে বসলো রাগান্বিতার টেবিলটায়।

এক মুহূর্তের জন্য হলেও পায়রাটার হুট করে ভিতরে আসায় বেশ চমকে উঠে রাগান্বিতা। রাগান্বিতা এগিয়ে যায় পায়রাটার দিকে। মূলত পায়রাটা হলো একটা বার্তা পাঠানো পায়রা। রাগান্বিতা পায়রাটার পায়ের দিকে তাকালো। কিছু একটা নিয়ে এসেছে পায়রাটা। রাগান্বিতা ধীরে ধীরে পায়রাটাকে ধরে পায়ের সাথে আটকানো সুতাটা খুললো। একটা চিঠি পেল। রাগান্বিতা চিঠিটা পায়রার পা থেকে বের করতেই পায়রাটা ধারাম করে উড়ে গেল। আর থাকলো না। রাগান্বিতা পায়রাটার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে মনে মনে আওড়ালো,
“আবার চিঠি।”

রাগান্বিতা চিঠিটা খুললো। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলো। কারণ তাজা রক্তের গন্ধ পেয়েছে রাগান্বিতা। রাগান্বিতা ঘাবড়ে গিয়ে দু’পা পিছিয়ে যায়। তার সমস্ত শরীর ভয়ে কেঁপে ওঠে। এভাবে রক্তে মাখানো কাগজ কে পাঠালো তাকে। এরই মাঝে বাহির থেকে চেঁচানো আওয়াজ শোনা গেল খুন!খুন বলে কারা যেন চেচাচ্ছে!”

রাগান্বিতা চিঠিটার দিকে একপলক তাকিয়ে দ্রুত ছুটে গেল বাহিরে। শয়নকক্ষ থেকে তখনই বের হলো রাগান্বিতার বাবা আর ভাই রেজওয়ান। তারাও এগিয়ে যেতে লাগলো বাড়ির বাহিরে।’

জমিদার বাড়ির উঠানে ভিড় পড়েছে আবার। পাশের গ্রামের রমিজ উদ্দিনের ছেলে মুরতাসিন নাকি খুন হয়েছে? কে বা কারা যেন চাকুর আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে তার শরীর। রক্ত গড়াগড়ি খাচ্ছে জমিদার বাড়ির উঠানে। রাগান্বিতা বাড়ির সদর দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকলো, উঠানে নামলো রেজওয়ান আর তার বাবা। মোতালেব তালুকদার জিজ্ঞেস করলো,
“এসব কি করে হলো?”

মোতালেব তালুকদারের কথা শুনে একটা বুড়ো লোক এগিয়ে এসে বললো,
“তালুকদার সাহেব সন্ধ্যাহালেই মনে হয় এই ঘটনা ঘটছে ওই যে আমনেগো বাড়ির সামনের যে জঙ্গলডা আছে না হেয়ানে পোলাডারে কেডা যেন মাইরা থুইয়া গেছে।”
“লাশটা আগে দেখলো কে?”

একটা ছোট্ট বাচ্চা এগিয়ে এসে বললো,
“আমি দেখছি।”

সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কারণ ছেলেটা মিথ্যে কথা বলছে। দেখেছে ছেলেটির বাবা মিন্টু মিয়া। সবাই তাই জানে। মিন্টু মিয়া ছেলের মুখ চেপে ধরলো। বললো,
“তালুকদার সাথে ওর কথায় কিছু মনে কইরেন না। পোলাডা অনেক বদমাইশ হইছে। আমিই আগে দেখছি লাশটা।”

মোতালেব তালুকদার মিন্টুর প্রথম কথায় বেশি গুরুত্ব দিলেন না। পরের কথার প্রতিউত্তরে বললেন,
“তুমি ওই আটটা বাজে ওই জঙ্গলে কি করতে গেছিলা মিন্টু?”

মিন্টু ঢোগ গিলে বললো,
“আমার ছোট মাইয়াডা বিয়ালে ওদিকে গেছিল একখান জুতা হালাইয়া থুইয়া আইছিল। ওইডা খুঁজতেই গেছিলাম মাইয়াডা অনেক কানতে ছিল তাই বাধ্য হইয়া গেছিলাম তালুকদার সাহেব তহনই বড় বডগাছের লগে এই পোলাডারে দেখছি হেরপরই হগলডিরে ডাইক্কা আইন্না নিয়া আইলাম পোলাডারে,

মোতালেব কিছু বললো না এতে। অনেকক্ষণ ভেবে বললো,
“পোলার বাপেরে খবর দেছো কেহো?”

একজন এগিয়ে এসে বললো,
“হ তালুকদার সাহেব।”

এদিকে,
রাগান্বিতা ভাবছে অন্যকিছু মুরতাসিনরে কেউ কেন মারলো? আর তার কাছে আসা রক্তে ভেজা কাগজটা এটাও বা কে দিল! আচ্ছা দুইটা ঘটনার পিছনে একটা মানুষরই হাত আছে নাকি। রাগান্বিতা মনে করলো তখনকার কাগজটায় রক্ত দিয়ে কি লেখা ছিল। কিছুক্ষণ ভাবতেই মনে পড়লো সেখানে ছোট ছোট করে লেখা ছিল,

“সে নিষিদ্ধ ছিল।”

#চলবে…..

___________________

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-০১

0

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীমলেখিকা
— পর্বঃ০১

“রাগান্বিতা! এই রাগান্বিতা! উঠ জলদি তোর নামে চিঠি এসেছে। উঠে দেখ। আমার কথা কি শুনতে পাচ্ছিস? রাগান্বিতা, এই রাগান্বিতা!”

আচমকাই কারো কণ্ঠ শুনে শোয়া থেকে উঠে বসলো একটি মেয়ে। এলেমেলো চুল,চোখের নিচে কালো দাগ, গায়ের জামাটাও বেশ জায়গা দিয়ে ছেঁড়া, পালঙ্কের সাথে লাগিয়ে পায়ে শিকল বাঁধা। মেয়েটি আশেপাশে তাকালো তার পালঙ্কের পাশ দিয়েই সাদা পৃষ্ঠায় লেখা একটা চিঠি রাখা। মেয়েটি চিঠিটা উঠালো এদিক সেদিক দেখে চিঠিটা খুললো সঙ্গে সঙ্গে একটা লেখা দেখলো,
“আমি ফিরে এসেছি রাগান্বিতা, দেখো রাগান্বিতা আমি ফিরে এসেছি।”

লেখাটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি চেঁচিয়ে উঠলো। বাবা, বাবা বলে চেঁচিয়ে উঠল সে উচ্চস্বরে। সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশের মানুষজন দৌড়ে আসলো কিন্তু মেয়েটির বাবা আসলো না কারণ মেয়েটির বাবা মারা গেছে আরো পাঁচবছর আগে। মেয়েটি এলেমেলোভাবে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে হাতে তালি দিতে দিতে বলতে লাগলো শুধু,
“বাবা, ইমতিয়াজ ফিরে এসেছে বাবা। দেখো আমার নামে চিঠি পাঠিয়েছে। বাবা।”

সবাই চিঠিটা দেখলো একটা সাদা পৃষ্ঠা ছাড়া কিছুই লেখা নেই সেখানে। ততক্ষণে রাগান্বিতাদের বাড়ির কাজের লোক রামু ডাক্তার নিয়ে হাজির। ডাক্তারের নাম ইলিয়াস। মাঝ বয়সী একটা ছেলে। ইলিয়াস দ্রুত ভিতরে ঢুকলো। ডাক্তারকে দেখে বিছানায় বসে থাকা মেয়েটি আরো চেঁচিয়ে উঠলো আশপাশের মহিলাদের রাগান্বিতাকে শক্ত করে ধরার ইশারা করলো ইলিয়াস। মহিলারা তাই করলো, মেয়েটিকে শক্ত করে চেপে ধরতেই মেয়েটি চেচাতে লাগলো আরো। বললো,
“তোমরা এভাবে আমায় ধরেছো কেন ছাড়ো বলছি।”

কিন্তু কেউ ছাড়লো না। ইলিয়াস দ্রুত একটা ইনজেকশন পুস করলো মেয়েটির হাতে। ধীরে ধীরে মেয়েটা শান্ত হলো। কিন্তু তখনও বলতে ছিল।’
“তোমরা ছাড়ো আমায়। বাবা, ইমতিয়াজ ফিরে এসেছে বাবা,তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো ইমতিয়াজ ফিরে এসেছে।’

বলতে বলতে নেতিয়ে পড়লো মেয়েটি। সময় গড়ালো ঘর হলো শান্ত মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়লো। মেয়েটি ঘুমাতেই ঘর থেকে একে একে বের হলো সবাই। কেউ কেউ বলতে লাগলো,
“আহারে মাইয়াডার এমন অবস্থা আর দেহোন যাইতাছে না বাপ ভাই সব তো মইরা গেল আর মাইডাও পাগল হইয়া এমন পইড়া আছে। কার যে নজর লাগছিল এই জমিদার বাড়িতে সব পুরা ধ্বংস কইরা দিলো। সামনে যে কি হইবো মাইয়াডার কে জানে?”

বলতে বলতে সবাই প্রায় আফসোস করে চলে গেল বাহিরে। শুধু যায় নি ইলিয়াস আর রামু। রামুর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। রাগান্বিতার অবস্থাটায় তার খুবই খারাপ লাগছে। আর ইলিয়াস সেও নীরবে তাকিয়ে রইলো রাগান্বিতার মুখের দিকে। মেয়েটার সাথে কি হয়েছিল তা জানার জন্য দিনে দিনে যেন তার অস্থিরতা আরো বাড়ছে। প্রায় ২০ মিনিটের মতো রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে থাকলো ইলিয়াস। হঠাৎ রামু বললো,
“ডাক্তার বাবু বাইরে যাইবেন না?”

ইলিয়াসের হুস আসলো খানিকটা হতভম্ব হয়ে বললো,
“হুম যাবো চলো।”

রামু আর ইলিয়াস বের হলো রাগান্বিতার কক্ষ থেকে। কক্ষ থেকে বেরিয়ে দরজাটা পুনরায় সামনে থেকে আঁটকে দিলো রামু। তালাটা আঁটকে দিল মুহুর্তেই। রামু তার চোখ মুছলো ইলিয়াস তখনও রামুর পাশে দাঁড়ানো কিছু একটা ভাবছিল। রামুর তালা আটকানো শেষ হতেই ইলিয়াসকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“লন যাই।”

হাঁটতে শুরু করলো রামু আর ইলিয়াস। হঠাৎ ইলিয়াস প্রশ্ন করলো রামুকে,
“তোমায় একটা প্রশ্ন করবো রামু?’

রামুও হাঁটতে হাঁটতে জবাব দিলো,
“হুম কন,
“রাগান্বিতার সাথে কি হয়েছিল রামু?”

রামু দাঁড়িয়ে পড়লো। রামুকে দাঁড়াতে দেখে ইলিয়াস আবার প্রশ্ন করলো,
“কি হলো রামু? আমায় বলো গত পাঁচ বছর যাবৎ থেকে আমি রাগান্বিতার চিকিৎসা করছি এখনও জানতে পারি নি রাগান্বিতার সাথে ঠিক কি হয়েছিল? আমি তো শুনেছি মেয়েটা আগে এমন ছিল না তাহলে পাঁচ বছর আগে কি এমন ঘটলো যে মেয়েটা এমন পাগল হয়ে গেল। আর ইমতিয়াজই বা কে?”

রামু জবাব দেয় না। শুধু থরথর করে এতটুকু বলে,
“আমি এগুলান জানি না ডাক্তার বাবু।”
“তুমি মিথ্যে বলছো রামু তুমি এই রাগান্বিতাদের বাড়ি আরো দশ বছর থেকে কাজ করছো তাহলে তুমি কিভাবে জানো না আমায় বলো আমি শুনতে চাই এই জমিদার বাড়ির ঘটনা। সবাই বলে কার নাকি নজর লেগেছিল এই জমিদার বাড়িতে। এটা কি সত্যি?”

এবার রামু মুখ খুললো। বললো,
“এসব কিছু আমি জানি না ডাক্তার বাবু। পাঁচ বছর আগে আমি ছয় মাসের লাইগ্যা ছুটি নিয়া আমগো বাড়িতে গেছিলাম তখনই কি জানি হইছিল তবে ইমতিয়াজ নামের এক পোলা এই জমিদার বাড়ি আইছিল আমার লগে দেহাও হইছিল।”

রামুর কথা শুনে ইলিয়াস নড়েচড়ে উঠলো। উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
“তার মানে ইমতিয়াজ নামের সত্যি সত্যিই কেউ ছিল রাগান্বিতার জীবনে।”
“হ।’
“তাহলে ছেলেটাকে আনছো না কেন আজই খবর দেও ছেলেটাকে ছেলেটা আসলেই তো রাগান্বিতা ঠিক হয়ে যাবে মনে হয়। এত বছরে তুমি এই কথা আজকে আমায় বলছো রামু,
“আগ্গে হইছে কি ডাক্তার বাবু?’

রামু আরো কিছু বলবে এরই মাঝে রাগান্বিতার রুম থেকে বিকট শব্দের একটা আওয়াজ আসলো ইলিয়াস আর রামু দুজনেই চমকে উঠলো এতে। হতভম্ব হয়ে বললো ইলিয়াস,
“আওয়াজটা রাগান্বিতার রুম থেকে এলো না রামু।”

রামুও দ্রুত জবাবে বললো,
“হয়।”
“চলো দ্রুত।”

দৌড়ে ছুটলো ইলিয়াস আর রামু। দরজা খুলতেই দেখলো রাগান্বিতা এখনও ঘুমিয়ে আছে তাহলে শব্দটা আসলো কিসের তখনই একটা গ্লাস পড়ে থাকতে দেখলো তারা। আর জানালা বেয়ে ছুটতে দেখলো একটা বিড়ালকে। দৃশ্যটা দেখেই বুঝেছে তারা শব্দটা কিসের ছিল আর কিভাবে হলো। রামু আবার দরজা আঁটকে দিল। তালাবদ্ধ করে আবার হাঁটতে লাগলো দুজন।’

বিছানায় বেঘোরে ঘুমানো ছিল রাগান্বিতা। তার খাটের পাশেই ছিল একটা ছোট্ট টেবিল। টেবিলের ওপর কিছু এলেমেলো বই আর একটা ঝুলি। ঝুলির মধ্যে ছিল অনেকগুলো সাদা, নীল, সবুজসহ নানা রঙের চিঠি আর চিরকুট। ঝুলিটার ঢাকনা ছিল আলগা। মাত্রই বিড়ালটা সেই ঝুলিটার ওপর দিয়ে যাওয়ার কারণে ঢাকনাটা পড়ে যায় নিচে। হঠাৎই বাহির থেকে একটা দমকা হাওয়া আসতেই ঝুলির ভিতর থেকে একটা চিরকুট পড়লো নিচে। যেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল,

“প্রিয় রাগান্বিতা”
___________________________

সাল ১৯৮১। বড় বোনটা মারা গেছে আজ ৭দিন হলো। গ্রামের নাম রেশবপুর। বাড়ির নাম তালুকদার ভিলা। বিশাল জমিদার বাড়ির দুই কন্যা কুহু আর রাগান্বিতা। বড় বোনের নাম কুহু আর ছোটজনের নাম রাগান্বিতা। রেশবপুর গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরী দুই নারী কুহু আর রাগান্বিতা। কুহুর মুখে ছিল মায়াতে ভরা আর রাগান্বিতা নামের মতো মানুষটাও ছিল শক্তপক্ত আর রাগের তেজ। দেখতেও ছিল অত্যাধিক সুন্দর। চোখে সবসময় থাকতো তার গাড়ো কাজল দেয়া।’

প্রকৃতি ছিল খুব থমকানো। গাছের শুকনো পাতায় ভড়পুর বাড়ির আঙিনা উঠান। জমিদার বাড়ির মালিকের নাম মোতালেব তালুকদার। তারই দুই কন্যা কুহু আর রাগান্বিতা। এছাড়াও একজন সুদর্শনীয় যুবক ছেলে আছে যার নাম রেজওয়ান। ৭ দিন আগে বোনকে যখন দাফনের জন্য নেওয়া হয়েছিল রাগান্বিতা তখন দাড়ানো ছিল তাদের বাড়ির দোতলার বারান্দায়। চোখে মুখে ছিল শক্ত ভাব। আজও সেই জায়গাতেই দাঁড়ানো। সাতদিন আগে বোনটা হুট করেই বিষ খেয়ে মারা গেল, বিষ খাওয়ার কারণ এখনো ঠিকভাবে বোঝা যায় নি, কারণ কুহুর পরিবারগত কোনো সমস্যাই ছিল না। না তাদের মাঝে এমন কোনোকিছু ঘটেছিল যার জন্য কুহু বিষ খেতে পারে। তারপরও কিছু তো একটা ঘটেছিল কুহুর সাথে যার জন্য মেয়েটা বিষ পান করে মারা গেল। রাগান্বিতা পণ করেছে বোনের মৃত্যুর রহস্য সে জেনেই ছাড়বে। এত সহজে বিষয়টাকে হাল্কাভাবে নেয়া হবে নাকি। বাবা যতই সম্মানের জন্য বিষয়টা লুকিয়ে রাখুক তাকে তো জানতেই হবে বোনটা কেন মারা গেল?’

রাগান্বিতা যখন এসব ভাবতে ব্যস্ত ঠিক সেই মুহূর্তেই তাদের বাড়ির উঠানে সাইকেলে চড়ে ডাকপিয়ন আসলো। রাগান্বিতার নামে নাকি একটা চিঠি এসেছে। রাগান্বিতা অবাক হলো কথাটা শুনেই। একটা আট বছরের বাচ্চা ছেলে দৌড়ে এসে বললো রাগান্বিতাকে,
“ছোটো আফা আমনের নামে চিডি আইছে ডাকপিয়ন আমনেরে ডাকতাছে।”

রাগান্বিতা খানিকটা বিরক্ত প্রকাশ করলো এতে। বললো,
“আতিব তোকে না বার বার বলেছি আমার সামনে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলবি। আর কে পাঠিয়েছে চিঠি?”

আতিব খানিকটা নিচু স্বরে বললো,
“তা তো জানি না ছোডো আফা আমনেরে ডাকপিয়ন ডাকে চিডি গিয়া নিয়া আহেন।”

রাগান্বিতা বিরক্ত হলেও এবার আর কিছু বললো না। এ আতিবকে তো পরে দেখে নিবে। আগে চিঠিটা কে দিলো দেখতে হবে। রাগান্বিতা নেমে পড়লো নিচে। নিচে নামতেই সাইকেলে বসা এক ডাকপিয়নকে দেখলো রাগান্বিতা যা দোতলায় দাড়িয়েও দেখে ছিল। রাগান্বিতা নীরবে এগিয়ে গেল। রাগান্বিতা যেতেই ডাকপিয়ন তাকে চিঠিটা দিয়ে একটা সই নিয়ে চলে গেল। ডাকপিয়ন যেতেই রাগান্বিতা চিঠিটা খুললো। চিঠিটা খুলতেই লেখা দেখলো সে।’

“মেঘ করেছে মনের ভিড়ে,
তোমার তো দেখা নাই,
আমি তো এক নিস্তব্ধ মানুষ
তোমার খোঁজ কোথায় পাই?”

#চলবে…..

ভালোবাসিবো খুব যতনে পর্ব-৪৮ এবং শেষ পর্ব

0

#ভালোবাসিবো_খুব_যতনে
#Ayrah_Rahman
#last_part

___________________

প্রায় চার বছর পর…

রাত প্রায় আট’ টা। তাহরিম এখনো বাড়ির বাহিরে, তালুকদার বাড়ির সবাই সোফার রুমে বসে খবর দেখছিলাম। আমার যেমন টেনশন হচ্ছে তার চেয়ে ও বেশি আনন্দ হচ্ছে।

” বাবাহহ ”

হঠাৎ ছোট্ট প্রাজ্ঞের ডাক শুনে দরজার দিকে তাকালো সবাই। ক্লান্ত শরীর নিয়ে তাহরিম দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। পূর্ণা আর তাহরিমের ছোট্ট ছেলে তাহমিদ তালুকদার প্রাজ্ঞ।

আমি কোল থেকে ছেলেকে নামাতেই
ছেলেটা গুটি গুটি পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। তাহরিম হাঁটু গেড়ে বসে ছেলেকে কোলে তুলে গালে চুমু খেতে খেতে সোজা ভেতরে প্রবেশ করলো। বাপ যে হারে ছেলেকে চুমু দিচ্ছে ছেলেও একই হারে বাপ কে চুমু দিচ্ছে।

আমি ভ্রু কুঁচকে বাপ বেটার পিরিতি দেখছিলাম। ঘামে ভিজে জুবুথুবু অবস্থা হয়ে আছে তাহরিমের, এতোক্ষণ হয়তো কেন্দ্রেই ছিলো।

আজ নতুন করে সংসদ নির্বাচন হয়েছে। আর উনি এবারেও মন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত।

আমি উঠে রান্নাঘরে চলে গেলাম।

তানজিম দৌড়ে গিয়ে তাহরিম কে জরিয়ে ধরে বলল,

” কনগ্রেচুলেশন নিউ মন্ত্রী সাহেব, আমি জানতাম আমার ভাইকে কেউ টপকাতে পারবেই না! ”

তাহরিম প্রাজ্ঞের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তানজিমের দিকে তাকালো,

” এভাবে লাফাচ্ছিস কেন? বিয়ে করেছিস কয়দিন পর বাচ্চার বাপ হবি এখনো তোর লাফানো যায় না! ”

তানজিম ভ্রু কুঁচকে তাহরিমের দিকে তাকিয়ে বলল,

” বিয়াই হই আমি তোমার, সম্মান দিয়ে কথা বলো। আর দরকার হলে বাপ বেটি মিললা লাফামু, শত হোক আমার মেয়ে নাম করা তালুকদার বাড়ির বড় বউ হবে, একট্রা টেলেন্ট তো থাকবেই! তাই না বউ! ”

বলেই মেহবুবার দিকে তাকিয়ে চোখ মারলো, বেচারী মেহবুবা পারে না তো মাটি খুঁড়ে ভিতর ভেতরে ঢুকে যায়। বেচারীর এমনিতেই লজ্জা বেশি অল্পতেই গাল দুটো লাল হয়ে যায় তার উপর তানজিমের এমন বিহেভ!

আমি ট্রে তে শরবত নিয়ে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করতে করতে বললাম,

” হয়েছে হয়েছে এতো নাটক করতে হবে না আগে আমার ছেলে টাকে বড় হতে দাও, আর তানজিম, আমার বোন টাকে যেখানে সেখানে লজ্জায় ফেলবে না ”

তানজিম মাথা দুলিয়ে বলে উঠলো,

” জোওও হুকুম ভাবিজান ”

” এই যে আমার বিয়াই মশাই কোথায়? মিষ্টি তো আমরাও পাওনা, শত হোক ছেলের শশুর বাড়ি বলে কথা ”

দরজা থেকে চেনা কন্ঠ শুনতে পেয়ে সবাই দরজার দিকে তাকালো,

রুদ্র ভাই আর ইলমি দাঁড়িয়ে আছে, রুদ্র ভাইয়ের কোলে রুদ্র ভাই আর ইলমির একমাত্র ছেলে রওশান তালুকদার। বয়স তার সবে তিন হলো। আর ইলমির কোলে মিনি মানে আমার ছোট্ট বিল্লি টা। আমার কাছে থেকে মিনি কে নিয়ে ওই এতোদিন দেখাশোনা করতো।

” আমি তো তাহরিম ভাইয়ের ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দেবো তুমি বরং অন্য কোন মেয়ে দেখো রুদ্র ভাই ”

রুদ্র খানিকটা এগিয়ে এসে তানজিম এর মাথায় টোকা দিয়ে বলল,

” তোর মেয়েকে আমার বাড়ির বউ করব না যাহ, আমি তো তাহরিমের মেয়েকে ছেলের বউ করবো ”

তাহরিম ভ্রু কুঁচকে রুদ্রের দিকে তাকালো,

” আমার মেয়ে আসলো কোথ থেকে? ”

রুদ্র সোফায় বসতে বসতে বলল,

” ওমা নেই তো কি হয়েছে, হবে তো, তখন বিয়ে করাবো”

তাহরিম বিরবির করে বলল,

” সে গুড়ে বালি ”

আমাদের কথার মাঝে মা আর বাবা হলেন নিরব দর্শক।

আমি একে একে মা, বাবা, তানজিম, মেহবুবা, রুদ্র ভাই আর ইলমি কে শরবত দিলাম, হাতে একটা গ্লাস নিয়ে এগিয়ে গেলাম তাহরিম তালুকদার এর দিকে।

হাতে গ্লাস টা দিয়ে প্রাজ্ঞ কে কোলে নিতে গেলে তাহরিম আমাকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে বাবার পাশে সোফায় বসলেন।

বেশ অনেক ক্ষন আড্ডার পর,

বেশ রাত হয়েছে বলে তানজিম আর মেহবুবা নিজেদের ঘরে গেলো। মেহবুবা এখন ছ’মাসের প্রেগন্যান্ট। ডাক্তার বলেছে মেয়ে বাবু হবে। তাই তার এতো লাফানো।

রুদ্র আর ইলমি ও দোতলায় রুমে গেলো।

মা ও উঠে নিজের রুমে চলে গেলো। আমি ওরা দুজনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিজের রুমে গেলাম। এখানে এখন থাকা মানে নিজের ইজ্জত নিজে খোয়ানো।

বাবা শরবত খাওয়া অফ করে আড় চোখে তাহরিমের দিকে তাকালো। ছেলে তার পাশে বসা মানেই বেফাঁস কথা বলা, এক বিন্দু বাপ বলে তো দাম ই দেয় না উল্টো এমন এমন কথা বলবে যে বাপ হয়ে নিজেই লজ্জায় পড়ে যায় অথচ এই বেহায়া ছেলের কিছু ই হয় না।

তাহরিম প্রাজ্ঞের দিকে তাকিয়ে বাবার উদ্দেশ্যে বলল,

” শরবত টা শেষ করো, এমনিতেই তো শরীরে শক্তি নাই তার উপর বাঁধিয়েছো ডায়বেটিস, আবার চিনি দেওয়া শরবত ও খাচ্ছো, এমন বুড়োকে কি মন্ত্রী তাহরিম তালুকদারের মা পছন্দ করবে? লুক আমার মা কতটা এট্রাক্টিভ, বিউটিফুল আর গর্জিয়াস আর তুমি! ভুঁড়ি ওয়ালা কাকু, মানায়! বলো? ”

প্রথম কথা গুলো জোরে বললেও পরের কথা গুলো বেশ আস্তেই বলল তাহরিম যা শুধু মাত্র বাবার কান পর্যন্তই পৌঁছালো।

বাবা শরবত খাওয়া থামিয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ধরে বলল ,

” এই বেয়াদব ছেলে! আমি তোর বাপ হই বন্ধু না। আমার তো মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় তাহরিম! তুই কি আসলেই আমার ছেলে তো? আমি তো এতো বেহায়া ছিলাম না, তুই কই থেকে এমন লাগাম ছাড়া হলি? ”

তাহরিম বাবার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,

” আমি কার ছেলে সেটা তো আমার থেকে ভালো তোমার জানার কথা মিস্টার তাপস তালুকদার! বাট আই হেভ এ গভীর প্রশ্ন ”

তাপস তালুকদার ভ্রু কুঁচকে ছেলের দিকে তাকালো,

” কি? ”

” আমার তো এখন সন্দেহ হচ্ছে! আসলে আমি তোমার ছেলে তো? ”

তাপস তালুকদার রাগী দৃষ্টি তাহরিমের দিকে তাকিয়ে বলল,

” কি বলতে চাস তুই বেয়াদব ছেলে! ”

” আমার কি দোষ! প্রশ্ন টা তুমি আগে করেছো! ”

” আমি তো কথার কথা বলেছি ”

” আমিও তো সিরিয়াসলি বলেছি ”

তাপস তালুকদার বসা থেকে উঠতে উঠতে ছেলের দিকে রাগী রাগী চোখ করে বলল,

” তুই থাক আমি ই গেলাম, ইজ্জত বাঁচানো ফরজ আর তোর সাথে থাকলে অকালেই আমার সেটা হারাতে হবে ”

তাহরিম ও বসা থেকে দাড়াতে দাঁড়াতে বলল,

” ছিইই মিস্টার তালুকদার, একজন বিশিষ্ট সমাজ সেবক, গুনী একজন মন্ত্রী, ইনোসেন্ট একটা ছেলেকে এতো বড় অপবাদ দিতে পারলেন! আপনার ঠোঁটে মুখে বাজলো না! আমি আপনার ইজ্জত নিয়ে টানাটানি করি? ছিইই ”

” এই শোন তাহরিম, তুই আমার বাপ না আমি তোর বাপ, একটা মানুষ এতো অভিনয় কিভাবে করতে পারে? হাউ ইজ দিস পসিবল? ”

তাহরিম সিরিয়াস হবার ভান করে বলল,

” বাবাআআআ ”

” বল ”

” তোমার আরেকটা নাতনি দরকার না? একটা হয়েও যেন ঘরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে, উমম এক কাজ করো, প্রাজ্ঞ কে তুমি রাখো ”

বলেই প্রাজ্ঞ কে তাপস তালুকদার এর কোলে দিয়ে সিড়ি উঠতে উঠতে বলল,

” বাবা প্রাজ্ঞ আজ তুমি তোমার দাদাভাই এর কাছেই থাকো আমি বরং তোমার খেলার সাথী আনার ট্রাই করি, কেমন! ”

প্রাজ্ঞ বাপের কথা কি বুঝলো জানা নেই তবে মাথা হেলিয়ে দাদার কাঁধে রাখলো, মানে সে দাদার সাথে ই থাকবে।

তাহরিম হাসলো, ছেলেটা হয়েছে একদম বাপের বাধ্যগত। বাপ যা বলে তাই।

তাহরিম তাপস তালুকদার এর উদ্দেশ্যে একটা ফ্লাইং কিস দিয়ে সিড়ি বেয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।

বেচারা তাপস তালুকদারের কিছু বলার ভাষা নেই,
প্রাজ্ঞের দিকে তাকিয়ে বলল,

” দোয়া করি ভাই, তুই যেন তোর বাপের মতো হোস, তোর বাপ যেমন সারাটা জীবন আমাকে জ্বালালো তুই ও তোর বাপ কে জ্বালাবী! ”

বলেই নাতিকে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।

___________

পূর্ণ ওই যে দেখো তোমার পিছনে তেলাপোকা!

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তেলাপোকার দিকে না তাকিয়ে তাকালো তাহরিমের দিকে। ভ্রু কুচকে বলল,

” তোও আমি কি করবো? ”

তাহরিম ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে গেলো, আমতা আমতা করে বলল,

” আবব না, বললাম আর কি! এখন কি করবে এটাকে? ”

আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম, দাঁতে দাঁত চেপে বললাম ,

“এক কাজ করি তেলাপোকা টা ধরে আপনার জন্য তেলের মধ্যে দিয়ে কড়কড়ে করে ভাজি করে আপনাকে পরিবেশন করি। কেমন? ”

আমার কথায় তাহরিম হকচকিয়ে উঠলো, ফলশ্রুতিতে তার কাশিও উঠে গেলো।

তার ধারণার ও বাইরের উত্তর ছিলো এটা।

কাশি থামিয়ে চোখ বড়ো বড়ো তাকিয়ে বলল,

” ইয়াক থুওও, কি জঘন্য কথা বার্তা! খাটাশ মেয়ে কোথাকার! ”

আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললাম,

” ইয়াহ আই নোওও ”

বলেই বিছানা ঠিক করতে লাগলাম,

তাহরিম বিরবির করে বলল,

” আনরোমান্টিকের বস্তা একটা ”

” আমি এমনই! ”

তাহরিম বিছানায় বসতে বসতে বলল,

” কোথায় ভাবলাম তেলাপোকা দেখে ভয় পেয়ে আমাকে একটু জরিয়ে ধরবা, একটু রোমান্স করবো! তা না, কি ঘোড়ার ডিম মার্কা কথা বলে মুডের চব্বিশ টা বাজিয়ে দিলা! ধুররর ”

আমি তাহরিমের সামনে গিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম,

” শুনুন, আপনি ভুলে যাবেন না, একটার বাপ হয়েছেন, ক’দিন পর ছেলের বিয়ে দেবেন, এসব রোমান্সের ভুত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে বিছানা ঠিক করে দিসি ঘুমান, বুড়ো বয়সে ভীমরতিতে পেয়েছে ”

তাহরিম হুট করেই আমার হাতে টান দিয়ে নিজের কোলের উপরে বসিয়ে কোমড় চেপে ধরে বলল,

” ঘরে এমন সুন্দরী আর মায়াবতী বউ থাকলে কি কেউ বুড়ো হয়, সবে তো একটা হলো, ডজন খানেক হোক তারপর না হয় বয়সের কথা চিন্তা করা যাবে! ”

আমি ভ্রু কুঁচকে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,

” প্রাজ্ঞ কোথায়? ”

উনি আমার ঘাড়ে নাক ঘষতে ঘষতে বলল,

” বাবার কাছে ”

আমি কিছু বললাম না…

” বউ ”

উনার এমন নেশাক্ত কন্ঠে কেঁপে উঠলাম,

” হুমম ”

” আজকের রাত টা আমার করে দিবি বউ? ”

উনার হাত টা খানিকটা আলগোছে ছাড়তেই আমি দৌড়ে বেলকনিতে এসে দাড়ালাম, বুকের মাঝে কেমন যেন মন্দিরের ঘন্টার মতো বেজে চলল। কি ভিষণ অস্থিরতা। শ্বাস প্রশ্বাস যেন ক্রমশই পাল্লা দিয়ে ভারী হয়ে চলল। তাকালাম দুর ল্যাম্পোস্টের আলোতে।

উনি রুমের লাইট অফ করে আমার পিছনে এসে দাড়ালো, অন্ধকারে উনার শক্ত পোক্ত হাত রাখলো আমার পেটের উপর যার শীতলতা কাপড়ের উপর থেকে ই টের পাচ্ছি আমি, অন্তর্দেশ কেঁপে উঠলো খনেখনে।

এ কেমন বাজে অনুভূতি!

আমার হাত ধরে ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে বেলকনির রেলিঙের সাথে চেপে ধরলো। আমি মাথা নিচু করে আছি, উপরে তাকানোর সাহস কেন যেন হচ্ছে না।

” বউ ”

“………….”

” তাকা না আমার চোখের দিকে ”

” নাহ ”

” এমন তো নয় যে আজ আমাদের প্রথম রাত! এতো লজ্জা পাচ্ছো কেন? ”

আমি তাকালাম উনার চোখের দিকে, জ্বলজ্বল করতে থাকা চোখের মনি উনার ভীষণ ভাবে টানে আমায়, তাকিয়ে থাকতে পারি না, চোখ জ্বালা ধরে। কিভাবে বোঝায় আমি তাকে?

” হাজার বছর পার হলেও আপনার প্রতি আমার অনুভুতি গুলো সেই প্রথম দিনের মতোই হবে মন্ত্রী সাহেব, সদ্য জন্ম নেওয়া অনুভূতিরা যেমন ছন্ন ছাড়া, বাঁধা হীন আপনার প্রতি আমার অনুভূতি গুলো ঠিক এমন ই বাঁধন হীন। আপনার ওই চোখে আমি যে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি না মন্ত্রী সাহেব! এর জন্য কি আমার শাস্তি হওয়া উচিত? আমার চোখ গুলো কেমন বন্ধ হয়ে আসে, আপনার গায়ের গন্ধ কেমন যেন মাতাল মাতাল লাগে, নেশা ধরে যায়, এই অপরাধে কি আমার শাস্তি হওয়া উচিত? বলুন না মন্ত্রী সাহেব? ”

আমার আকুতি ভরা কন্ঠ শুনে উনি হাসলেন,

উনি মুচকি হেসে আমার আরোও কাছে আসলেন, মাঝে এক ইঞ্চি দুরত্ব ও অবশিষ্ট নেই। আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে নেশাক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

” তোমার শাস্তি প্রাপ্য বউজান, আমাকে এতো বেশি ভালোবাসার শাস্তি, আমাকে আগলে রাখার শাস্তি, আমার চোখের মায়ার পড়ার শাস্তি, আমার গন্ধে মাতাল হবার শাস্তি, আমার জীবন টা এতো সুন্দর করে সাজিয়ে রাখার শাস্তি, আমার বাচ্চার মা হবার শাস্তি, আমাকে নিজের ভালোবাসায় বেঁধে ফেলার শাস্তি, তোমার জন্য আমার খেতে শান্তি নেই, বসে শান্তি নেই, ঘুমিয়ে ও শান্তি নেই, সব কিছু তোমার দখলে নেওয়ার শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে বউ জান ”

কিছু টা থেমে.

আর তোমার শাস্তি হলো..

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে উনার দিকে তাকালাম,

উনি মুচকি হেসে বললেন,

আমার একটা প্রিন্সেস লাগবে বউ, ঠিক তোমার মতো ”

আমি মাথা নিচু করে আছি,

উনি মাথা ঝুকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

” আমি কি ধরেই নেবো নিরবতা সম্মতির লক্ষন! ”

উনি হুট করে আমাকে কোলে তুলে নিলেন, আমি চমকে তাকালাম উনার চোখের দিকে। কোলে তুলেই রুমের দিকে হাটা শুরু করলো।

…..আর ভেতরে যাবো না আমরা…..

সুখে থাকুক মন্ত্রী সাহেব আর পূর্ণার দুষ্টু মিষ্টি সংসার….

সমাপ্ত….

ভালেবাসিবো খুব যতনে পর্ব-৪৭

0

#ভালেবাসিবো_খুব_যতনে
#Ayrah_Rahman
#part_47

_________________

দেখতে দেখতে প্রেগন্যান্সির আট মাস পেরিয়ে ন’মাসে পড়লো সপ্তাহ খানিক হলো আর সপ্তাহ খানিক পর ই ডেলিভারির ডেট দেওয়া হয়েছে , শরীর টা আগের তুলনায় অনেক ভারী লাগে, হাটতে চলতে বেশ সমস্যা ও হয়, পানি তে পা দুটো ফুলে বেলুন হয়ে গেছে, আগের থেকে অনেক মোটাও হয়েছি, আয়নার সামনে দাড়ালে নিজেকে বেলুন বেলুন ফিল হয় সাথে তো মুড সুইং আছেই।

আমার আর মন্ত্রী সাহেব এর রুম দোতলা থেকে নিচ তলায় সিফট হয়েছে। এ কয়েক মাসে আমি মন্ত্রী সাহেব এর বেশ কিছু অদ্ভুত প্রশ্নের ও সম্মুখীন হলাম।

এই তো কয়েকদিন হলো,

উনি রাতে ঘুমাবার আগে বিছানা পরিষ্কার করছিলেন আর আমি সোফায় বসে উনার কাজ পর্যবেক্ষন করছিলাম। হঠাৎ উনি আমার কাছে এসে গা ঘেঁষে বসলেন,

” বউজাআআআনন”

এমন লম্বা সম্বোধনে আমি ভ্রু কুঁচকে উনার দিকে তাকালাম,

” কিছু বলবেন? ”

উনি আরেকটু গা ঘেঁষে বসে বলল,

” আচ্ছা বউজান, একটা বাচ্চা হতে দশ মাস টাইম কেন লাগবে বলো? তাহলে আমি আমার স্বপ্ন পূরন করবো কিভাবে? ”

” মানেহ এটা কেমন প্রশ্ন? ”

“শোনো একটা বাচ্চা হতে সময় লাগে দশ মাস তাহলে আরেকটা হতে মিনিমাম দশ মাস এভাবে যদি এগারো টা বাচ্চা হয় তাহলে তো এগারো বছর লাগবে, মানে একজন বড় হতে হতে আরেকজন বুড়ো হয়ে যাবে, তাহলে আমি আমার ফুটবল টিম কিভাবে বানাবো? ”

আমি বিস্ফোরণ দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকালাম, মানেহ কি! এগারো টা বাচ্চা! একটা পালে কে? আবার এগারো টা!

আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

” এক কাজ করেন এগারো টা লাগবে তো আপনার? ছয়টা আমার পেটে থেকে বের করবো আর বাকি পাঁচ টা আপনার পেটে দিয়ে দিবো কেমন? ”

উনি খানিকটা নড়েচড়ে উঠে কিছু টা ভেবে বললেন,

” হুমম কথা টা মন্দ বলো নি, তার চেয়ে ভালো হবে জমজ জমজ হলে, তিন বছরেই হয়ে যাবে! এগারো বছর লাগলো না সময় ও বেঁচে গেলো! ”

আমি ঠাস করে নিজের হাত দিয়ে কপালে একটা চাপড় দিয়ে বিরবির করে বললাম,

” আমার কপাল, সবই আমার কপাল, এই পাগলের পাল্লায় পড়ে আমি জানি কোন দিন সেন্টি মেন্টাল হয়ে যায়! ”

আমি সোফার কিনারায় ধরে ধীরে ধীরে উঠে দাড়ালাম, আমাকে দাঁড়াতে দেখে উনি তৎক্ষনাৎ উঠে আমাকে ধরে বিছানায় বসালেন।

আমি ধীরে ধীরে সুয়ে পড়লাম, এই পাগলের সাথে আরেকটু কথা বললে আমি সত্যি ই পাগল হয়ে যাবো।

উনি আমার পাশে সুয়ে আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন,

” বউ ঘুমিয়ে গেছো? ”

আমি কোন উত্তর দিলাম না।

” ও বউ, কথা বলো না! ”

আমি চোখ খুলে বললাম,

” কি সমস্যা? এমন করতাছেন কেন? সারাদিন জ্বালিয়ে খায়েশ মিটে নাই? আবার রাতে জ্বালাচ্ছেন! এখন তো পার্টি অফিসেও যান না সারাদিন বাসায় বসে টই টই করে ঘুরেন আর আমাকে জ্বালান, একবার খালি আমার বাচ্চা টা বের হোক, তারপর জ্বালানি কাকে বলে আর কত প্রকার আপনাকে বুঝাবো আপনার বাচ্চা আপনার কাছে দিয়ে আমি আরাম করবো তখন বুঝবেন কত ধানে কত চাল! ”

উনি আমার হাত ধরে আঙুল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ইনোসেন্ট ফেস করে বলল,

” বউ জান তুমি কি রাগ করছো? ”

” আমার কিন্তু প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তাহরিম তালুকদার, আপনি সরেন আমি ঘুমাবো ”

উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

” ঠিক আছে ঠিক আছে, ঘুমাও আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি ”

উনি হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম বুঝতে ই পারি নি।

হঠাৎ মাঝ রাতে পায়ে কারো স্পর্শ পেয়ে ঘুম টা ছুটে গেলো, মাথা উচিয়ে দেখলাম, আবছা আলোতে উনি আমার পায়ের কাছে বসে কি যেন করছে।

একটা সাদা টি শার্ট আর সাদা প্যান্ট পরা, চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে দেখতে পুরো বাচ্চাদের মতো লাগছে। ঝুঁকে কিছু একটা করছে।

” এইই কি করছেন আপনি এতো রাতে? ”

উনি খানিকটা মাথা উচিয়ে বললেন,

” পায়ে গরম সরিষার তেল মেজে দিচ্ছি, এ সময় ত্বক অনেক শুষ্ক আর রুক্ষ থাকে সরিষার তেল টা দিলে স্কিন আর ড্রাই হয় না, স্কিন ভালো থাকে। ”

আমি কপাল কুঁচকে বললাম,

” এই মাঝ রাতে এই অকাজ করতে ইচ্ছে হয়েছে আপনার? আসেন ঘুমান তো, রাখুন এটা ”

” তুমি ঘুমাও, আমার কাজ শেষ হলে আমিই আসবো ”

আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করলাম, উনার এই ছোট ছোট কাজ, ছোট্ট ছোট্ট কেয়ার গুলো আমার ভীষণ ভালো লাগে। ক’জন ই বা বোঝে এসব!

এই পর্যন্ত তো অনেক বার চেক আপ করিয়েছি ডাক্তারের কাছে কিংবা ডাক্তার বাড়িতে এসেও চেক আপ করেছে কিন্তু কোন বার ই উনি আমাকে জিজ্ঞেস করতে দেন নি যে বাচ্চা ছেলে নাকি মেয়ে। উনার মতে আল্লাহ যা খুশি হয়ে দিয়েছে তাই আলহামদুলিল্লাহ। এটা না হয় সারপ্রাইজ ই থাকুক।

উনি সারাক্ষণ বাসায় ই থাকে, কিছু কাজ থাকলে সেটা বাসায় ই করে আর বাইরের গুলো আপাতত কুশন ই সামলাচ্ছে আর কুশনের সাথে তানজিম ও মাঝে মাঝে থাকছে।

বাবা ব্যবসার কাজে অস্ট্রেলিয়ায় আছেন আর মায়ের বোন অসুস্থ হওয়াই কাল বিকেলেই গ্রামে গেছে আজ বা কাল চলে আসবে। আমাকে এই অবস্থায় রেখে মায়ের ও যেতে সায় ছিলো না। তবে বাড়িতে মন্ত্রী সাহেব আর কাজের কিছু মানুষ থাকায় উনি গেলেন।

আমি তখন নিজের ঘরে বসে বাদাম খাচ্ছিলাম আর মন্ত্রী সাহেব ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলো। তানজিম হয়তো মাত্র ই এসেছে বাইরে থেকে, ড্রয়িং রুমে থেকে ওর গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

হঠাৎ পেটে চিনচিন ব্যথার উপস্থিতি টের পেলাম।
প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও ধীরে ধীরে যেন ব্যাথা টা বেড়েই চলল। সহ্য করতে পারছি না, পেটে হাত দিয়ে নিচে বসে পড়লাম। গলা দিয়েও স্বর বের হচ্ছে না।

হাতের কাছে গ্লাস ছিলো যা ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিতেই গ্লাস পড়ার আওয়াজে মন্ত্রী সাহেব আর তানজিম দৌড়ে আসলো।

উনি দরজা তেই থমকে গেলো, ঠিক কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না, অনুভূতি শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে আমি ব্যথায় ছটফট করছি। তানজিম দৌড়ে মন্ত্রী সাহেব এর কাছে গিয়ে বলল,

” ভাইয়া তাড়াতাড়ি ভাবি কে নিয়ে গাড়ি তে নিয়ে আসো, হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে ”

এতোক্ষণে যেন উনার হুস ফিরলো,
দৌড়ে এসে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়ি তে বসালেন,

আমার মাথা উনার কোলের উপরে, ব্যাথায় আমার জান যায় যায় অবস্থা।

উনি আমার হাতে হাত ঘষে গরম রাখার চেষ্টা করছে, কাতর কন্ঠে বারবার বলছে,

” বউ একটু কষ্ট করো, আরেকটু ধৈর্য ধরো এক্ষুনি পৌঁছে যাবো, একটু ”

” আমি আর পারছি না মন্ত্রী সাহেব! আমি হয়তো আর বাঁচবো না ”

” হুসসস আজাইরা কথা বলবে না বউ, তোমাকে ছাড়া আমি অসহায়, এমন কথা মুখেও আনবে না ”

আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম,

” আমার কিছু হয়ে গেলে আপনি আমার বাচ্চা কে আগলে রাখবেন মন্ত্রী সাহেব, আমার বাচ্চা কে মায়ের কাছে দিয়ে আপনি একটা সুন্দর মেয়ে দেখে বিয়ে করবেন কেমন? কিন্তু আমার একটা অনুরোধ রাখবেন! ”

তাহরিমের শুধু রাগ ই উঠছে কিন্তু কি করবে বেচারা, বউ কে এই মুহূর্তে কিছু বলতে ও পারছে না।

দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

” হে বলো কি অনুরোধ! ”

আমার কাঁদতে কাঁদতে হিচ’কি উঠে গেলো,

ফুফাতে ফুফাতে বললাম,

” আপনি যাকে ইচ্ছে তাকেই বিয়ে করেন আমার কোন আপত্তি নেই তবে ( উনার বুকের দিকে ইশারা করে) এই জায়গাটা শুধু আমার, এখানে মাথা রাখার অধিকার আমার, এটা কাউকে দিয়েন না প্লিজ! ”

সামনে থেকে তানজিম বেশ শব্দ করে ই হেসো উঠলো,

লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে বলল,

” ভাই, ভাবি জান তো সেই হিংসুক রে, তোর বউ তো এমনই হওয়া উচিত ”

তাহরিম দাঁতে দাঁত চেপে তানজিম কে উদ্দেশ্য করে বলল,

” খুব হাসি পাচ্ছে না তোর? বের করছি হাসি তোর, আমার বাচ্চার সব গুলা ডায়াপার তোরে দিয়ে পরিষ্কার করামু দাড়া ”

তানজিমের মুখ টা চুপসে গেলো এক নিমিষেই,

” এই না না ভাই, আমি আর কিছু বলব না ”

বলেই তানজিম চুপ করে গেলো।

প্রায় দশ মিনিটের মাথায় তারা হসপিটালে পৌছালো, তানজিম আগেই ফোন করে ওটি রেডি রাখতে বলেছিলো, যার জন্য ওরা হসপিটালে পৌঁছাতে ই আমাকে নিয়ে ওটিতে ঢুকে গেলো।

ওটির দরজা বন্ধ হয়ে গেলো।

তাহরিম বাইরে মাথা নিচু করে বসে আছে, তানজিম ওর পাশেই বসে আছে। মিরাকে ফোন করা হয়েছে আর কিছু ক্ষনের মাঝে ই চলে আসবে।

মেহেরিন শিকদার ও রওনা দিয়ে দিয়েছে।

” ভাইয়া টেনশন করিস না, দেখবি মা আর বাচ্চা দুজন ই সুস্থ ”

চলবে….

ভালোবাসিবো খুব যতনে পর্ব-৪৫+৪৬

0

#ভালোবাসিবো_খুব_যতনে
#Ayrah_Rahman
#part_45

_________________

মাথায় বেশ চিনচিনে ব্যথা অনুভুত হচ্ছে, যা ঘুমের মাঝেই অনুভব করতে পারছিলাম। হঠাৎ মনে হলো মন্ত্রী সাহেব এর কথা, উনি কোথায়? ঠিক আছেন তো?

কিছু মানুষের মাঝে মাঝে ই এমন অনুভব হয়, যা সে ঘুমের আগে দেখে ঘুমায়, কোন কাহিনি কিংবা ঘটনা, তার রেশ টা ঘুমের মধ্যে ও থাকে আবার ঘুম থেকে জাগার পর ও কিছু ক্ষন থাকে, পরবর্তী তে আস্তে আস্তে সবটা ঠিক হয়ে যায়।

উনি কোথায়?
কথাটা মাথার মাঝে প্রেসার পরতেই আরোও বেশি ব্যথা হওয়া শুরু হলো, কপালে কুঁচকে চোখ খোলার চেষ্টা করছি, শরীরে তো বিন্দু পরিমান শক্তি ও অবশিষ্ট নেই মনে হচ্ছে, তবুও মনের জোরে চেষ্টা চালালাম।

পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালাম। চোখের সামনে মন্ত্রী সাহেব কে এক ঝলক দেখেই মন শান্ত হয়ে গেলো। তবে উনাকে দেখা মাত্র ই মন যতটা না শান্ত হয়েছে তার চেয়ে বেশি অশান্ত হয়ে উঠলো।

এ কি অবস্থা তার! চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়ে ফুলে আছে, মনে হচ্ছে কত রাত অঘুম তার কেটেছে! আচ্ছা উনি কি কান্না করেছে? তাহলে চোখ ফোলা কেন? পাঞ্জাবির উপরের সবগুলো বোতাম খোলা, আর চুল! সেটা তো উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে।

নিজের প্রতি এতো অযত্ন কেন তার!

নিজের অবস্থান বুঝতে পেরে এদিক ওদিক তাকাতে গিয়ে খেয়াল হলো মাথা টা বেশ ভারি লাগছে, মনে হচ্ছে মাথার উপর দশ কেজি ভরের কিছু চাপানো। হাত নাড়াতে গিয়ে দেখলাম এক হাতে ক্যানুলা করা, সেলাইন চলছে।

অন্য হাতে মাথায় হাত দিতেই হাতেও ব্যন্ডেজ দেখতে পেলাম সাথে মাথায় ও ব্যান্ডেজ এর অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম। চুল মনে হয় একটা ও নেই! তবে চুলের জন্য আফসোস হলো না কেন জানি!

বেঁচে আছি! এই ঢেরর, তার উপর আমার সামনে মন্ত্রী সাহেব জীবিত এবং সুস্থ আছে এর চেয়ে বেশি পাওয়ার কি আছে।

আমাকে চোখ খুলতে দেখেও উনি সোফাই বসে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, একটু নড়চড় ও করছে না, অবাক হলাম খুব।

আচ্ছা উনি কি রেগে আছেন আমার উপর?

মুখ খুললাম কথা বলার জন্য কিন্তু আফসোস অক্সিজেন মাস্ক লাগানো মুখে।

এক হাত দিলাম অক্সিজেন মাস্কের উপর সরাবো বলে, কিন্তু তখন ই কানে ভেসে আসলো কারো গম্ভীর কন্ঠ,

” খবর দার মাস্কে হাত দিবে না মিফতাহুল পূর্ণা ”

হাত থেমে গেলো আমার, ধীরে ধীরে তাকালাম তার দিকে, রাগে নাকের পাটা ফুলে আছে, পারছে না আমার বিছানা থেকে উঠিয়ে একটা ঢিল দিতে।

আমি ঢুল গিললাম।

” একদম মাস্ক খুলার চেষ্টা করবে না, নচেৎ খুব খারাপ হয়ে যাবে! ”

হঠাৎ দরজা দিয়ে একজন ডক্টর আর একজন নার্স প্রবেশ করলো ভেতরে..

তাহরিম কে দেখে ডক্টর কুশন বিনিময় করলো,

” গুড মর্নিং ডক্টর ”

” গুড মর্নিং ইয়াং ম্যাম, তোমার ওয়াইফ এখন কেমন? ”

উনি এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে ডক্টরের দিকে তাকালেন,

” মাত্র ই জ্ঞান ফিরলো ”

ডক্টর হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

” ইন শা আল্লাহ ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তার কোন কারণ নেই ”

” হুম ”

উনি সোফায় বসে মোবাইল দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন,

ডক্টর আমার দিকে এগিয়ে এসে মুচকি হেসে বলল,

” এখন কেমন লাগছে? ভালো? ”

আমি মাথা দিয়ে ইশারা করলাম, মানে ভালো লাগছে।

” গুডড ”

নার্সের দিকে ঘুরে তাকে উদ্দেশ্যে করে বলল,

” যা যা মেডিসিন আছে সেগুলো ই খাওয়াও আর অক্সিজেন মাস্ক টা খুলে ড্রেস টা চেঞ্জ করে দিও ”

নার্সটা মাথা দুলালো,

” ঠিক আছে স্যার ”

” আর উনার সকল দায়িত্ব আপনার, ভালো ভাবে যত্ন করবেন ”

নার্স এক পলক মন্ত্রী সাহেব এর দিকে তাকিয়ে পুনরায় ডাক্তার এর দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল,

” আবব জি স্যার অবশ্যই ”

নার্সের অবস্থা দেখে ডাক্তার হাসলো, যা আমার চোখ এড়ালো না। বুঝলাম না কিছু! আমার কেন জানি মনে হচ্ছে নার্স টা মন্ত্রী সাহেব কে কোন ভাবে ভয় পাচ্ছে।

ডক্টর চলে যেতেই নার্স টা আমার কাছে আসলো, আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম তাকে। বয়স টা কত আর হবে! এই পঁচিশ – ছাব্বিশ, চোখে মুখে একটা চটপটে ভাব। এটা ভালো লাগলো কিন্তু পরবর্তী সোফায় বসে থাকা মন্ত্রী সাহেব এর দিকে চোরা চোখে বেশ কয়েক বার তাকালো যা আমার মোটেও ভালো লাগলো না।

আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম তার দিকে। মেয়েটা এগিয়ে এসে অক্সিজেন অফ করে আমার অক্সিজেন মাস্ক টা খুলার সাথে সাথে ই বলে উঠলাম,

” বিয়ে হয়েছে তোমার? ”

মেয়েটা চোখ বড়ো বড়ো করে আমার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল,

” হে? ”

আমি ধীরে ধীরে বললাম,

” বিয়ে হয়েছে তোমার? ”

মেয়েটা অবাক হয়েই উত্তর দিলো,

” হুমম ”

” বিয়ে হয়েছে যখন আরেকজনের জামাইয়ের দিকে চোরা চোখে তাকাও কেন? ”

মেয়েটা অবাকের চরম পর্যায়ে গিয়ে বলল,

” হে? ”

আমি বেশ বিরক্ত হলাম, মেয়েটা কি হে ছাড়া কিছু বলতে পারে না নাকি? আজব..

” আরে কি হে হে করছো? বললাম তোমার বিয়ে হয়ে গেছে কয়েক দিন পর হালি হালি বাচ্চার মা হবে, এখনো অন্যদের জামাইর দিকে কু দৃষ্টি দাও কেন? এটা মোটেও ভালো না আর না আমি ভালো মেয়ে! আমার জামাইর দিকে আরেকবার যদি তাকাও আমার পাশের বেড টা তোমার নামে করে দেবো বলে দিলাম, যদিও এখন আমি অসুস্থ বেশি কথা বলতে পারি না ”

কথা গুলো বলতে বেশ বেগ পেতে হলো তবুও কথা গুলো না বললেই নয়, আমার জামাইর দিকে কু দৃষ্টি দেয়, কত বড়ো সাহস!

মেয়েটা আমার দিকে অবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো কিন্তু কিছু ই বলল না।

মন্ত্রী সাহেব তো এক ধ্যানে ফোন ঘাটছে চারপাশে কি হচ্ছে তাতে আর বিন্দু মাত্র ধ্যান নেই। কেয়ামত হলেও তার কিছু যাবে আসবে না।

মেয়েটি মন্ত্রী সাহেব এর সামনে গিয়ে আমতাআমতা করে বলল,

” স্যার আপনি যদি একটু বাইরে যেতেন! ”

কারো কন্ঠ শুনতে পেয়ে চোখ তুলে তাকালো তাহরিম, ভ্রু কুঁচকে বলল,

” কেন? ”

” আবব না মানে, আপুর ড্রেস চেঞ্জ করাবো তো তাই ”

” তো করান চেঞ্জ! আমি কি আপনার হাত বেঁধে রেখেছি? ”

মেয়েটা বেশ হকচকিয়ে উঠলো, আমতাআমতা করে বলল,

” নননা মানে, না গেলে চেঞ্জ করাবো কি করে ”

” বউ আমার, তারমানে বউয়ের সব আমার। আমার সামনে চেঞ্জ করাতে প্রবলেম এর তো কিছু দেখছি না ”

নার্স মেয়েটা এবার কাঁদো কাঁদো দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো,

নার্স বি লাইক :- ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি! এই দুই পাগলের মধ্যে আমি ই কেন পড়লাম? দুনিয়ায় কি আর কোন নার্স ছিলো না! হুয়াই মি?

মেয়েটার অবস্থা দেখে এখন আমার ই হাসি পাচ্ছে। আহারে বেচারী!

মেয়েটাকে দাঁড়িয়ে থাকতো দেখে তাহরিম তালুকদার উঠে বাহিরে চলে গেলো।

আর যাওয়ার আগে গম্ভীর কন্ঠে বলে গেলো,

” যা করবে সাবধানে, ওর একটু কিছু হলে আজকের অটি টা তোমার নামে করে দেবো, মাইট ইট! ”

মেয়েটা ঢুক গিলল,
একজনে পাশের বেড আর আরেকজনে অটি! তাকে মারার এতো ষড়যন্ত্র করে কেন এরা!

মেয়েটা আমার কাছে এসে মাথা টা আলতো হাতে ধরে উঠে বসিয়ে চেঞ্জ করে আবার সুইয়ে দিলো।

মেয়েটা আমার পাশে দাঁড়িয়ে উসখুস করতে করতে বলল,

” আপু একটা কথা বলি? ”

আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম,

” আমি না এতো ক্ষন যাবত ভাবছিলাম এমন একটা হাফ পাগল আর সাইকো মানুষের সাথে একটা মেয়ে কি করে থাকতে পারে আর উনি কি না বর্তমান তরুণ সমাজের আইডল!

আপনার স্বামী একখান মানুষ ই আপু, বাপ রে বাপ, আপনাকে যখন হসপিটালে নিয়ে আসছিলো তখন উনি হুসে ছিলেন না, মাথায় হালকা চোট পেয়েছিলেন, যখন ই উনার জ্ঞান ফিরলো তখন থেকে ই শুরু হলো উনার পাগলামি!

একবার কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারাবার দশা আবার রাগে হসপিটাল জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি। আমাদের ডাক্তার রা ও ভয়ে ভয়ে ছিলো কখন জানি পুরো হসপিটাল টাই জ্বালিয়ে দেয় কারণ উনার একটা ইশারাই যথেষ্ট।

কিন্তু যখন ই আপনাকে দেখেছি আমার ধারণা পুরোপুরি ভাবে পাল্টে গেলো, আসলে আল্লাহ বুঝে শুনেই জুরি মেলান! ”

বলেই মেয়েটা চলে গেলো, আর আমি শুয়ে শুয়ে মেয়েটার কথা ভাবছি,

আচ্ছা, মেয়েটাকে কি কোন ভাবে আমাকেও অপমান করে গেলো?..

চলবে….

#ভালোবাসিবো_খুব_যতনে
#Ayrah_Rahman
#part_46

_________________

” এই মন্ত্রী সাহেব কথা বলছেন না কেন আমার সাথে? এমন করছেন কেন হে? এখন মনে হচ্ছে মরে গেলেই ভালো হতো, এটলিস্ট এভাবে কাউকে কথা বলার জন্য রিকুয়েষ্ট করা লাগতো না! ”

পর পর দু দুটো থা*প্পড়ে গাল টা জ্বলে উঠলো আমার,

” আহহ্ ”

হুট করে ই আমার চিবুকে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

” মানুষ মনে হয় না আমাকে তোর? মে’রে ফেলতে চাস আমাকে ? আর কত যন্ত্রণা দিবি বল তো আমাকে? পা’গল তো বানিয়েছিস এখন কি পা’গলা গারদে দিতে চাস?”

আমি ব্যাথা ভুলে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি উনার দিকে, চোখ মুখ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি ঝরছে। কথা বলতে বলতে চোখ টা ছলছল করে উঠলো, কাঁদছেন উনি? কিন্তু কেন?

চোখের পানি আড়াল করে আমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে চিবুক ছেড়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে আমি পিছনে থেকে শান্ত কন্ঠে বলে উঠলাম,

” কাঁদছেন মন্ত্রী সাহেব? এতো তুখোড় একজন রাজনীতি বিদ আর এতো শক্ত মনের মানুষ ও যদি কাঁদে তাহলে বাকিরা কি করবে? মরে তো যাই নি, বেঁচে আছি, ইন শা আল্লাহ সুস্থ হয়ে যাবো! আপনার এমন মুখ দেখলে কি আমার ভালো লাগবে বলুন! ”

উনি পিছনে ফিরে তাকালেন, ততক্ষণে আমি উঠে বসলাম। আমার কাছে এসে হুট করে ই জরিয়ে ধরে ফুপিয়ে উঠলো,

আমি মুচকি হেসে মাথায় হাত হাত বুলাতে বুলাতে বললাম,

” হুররর কি করে এসব? বাচ্চাদের মতো কাঁদছেন আপনি? ”

উনি আমার ঘাড় থেকে মুখ তুলে গালে আলতো হাতে স্পর্শ করে বলল,

” সসসরি বউজান! বেশি ব্যাথা লাগছে? ”

আমি ভ্রু কুঁচকে উনার হাতটা উপরে তুলে বললাম,

” নাআআ তো, ব্যথা কেন লাগবে! নিজের হাত টা দেখেছেন? এতো শক্ত! আমার গাল মনে হলো ফাটিয়ে দিলেন, দেখেন তো রক্ত বের হয়েছে কি না!”

উনি আমার গাল টা ভালো করে দেখে টুপ করে একটা চুমু খেয়ে বলল,

” উহুম রক্ত তো বের হয় নি, তবে এবার ঠিক আছে ”

আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,

” আরেক গালে কে দিবে? আমার কি আরোও দশ বারোটা জামাই আছে নাকি যে ওদের দিয়ে দেওয়াবো? ”

উনি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেঁসে উঠলেন,

আমার নাক টায় টোকা দিয়ে বলল,

” বড্ড পেকে গেছো পূর্ণ! এতো পাঁকা পাঁকা কথা না বলে নিজের যত্ন নিবেন! আপনি কিন্তু এখন একা নন, বুঝলেন? ”

আমি ভ্রু কুঁচকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,

” একা নই মানে কি? আরোও কেউ আছে নাকি আমার সাথে? ”

তাহরিম ভ্রু কুঁচকালো,

” তুমি জানো না? ”

” কি জানবো মন্ত্রী সাহেব? কিছু জানার কথা ছিলো নাকি? ”

তাহরিম অবাক হয়ে বলল,

” তুমি সত্যি ই জানো না? ”

আমি বেশ বিরক্ত হয়ে বললাম,

” কি জানবো টা কি? না বললে বুঝব কি করে? ”

তাহরিম দীর্ঘ শ্বাস ফেলল, নিজের কপালে নিজে চাপড় দিয়ে বিরবির করে বলল,

” আমার ই বোঝা উচিত ছিল এটা আমার বউ সয়ং তাহরিম তালুকদার এর বউ! সবার বউয়ের সাথে তো আমার বউ এর একটু তো পার্থক্য থাকবেই! ”

আমি বিরক্ত হলাম, কাজের কথা কিছু ই বলছে না আজাইরা ফাউ প্যাচাল পারছে.

” আপনি কি বলবেন মন্ত্রী সাহেব? ”

তাহরিম সোজা হয়ে আমার দিকে ঘুরে বসলো,

” আচ্ছা পূর্ণ, তোমার কি বেশ কয়েকদিন যাবত নিজেকে অন্য রকম ফিল হয় না? এই ধরো নাকে উটকো গন্ধ টাইপ! ”

আমি খানিক্ষন বেক্কেল এর মতো তাহরিম তালুকদার এর দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নেড়ে বললাম,

” কই না তো, কোন গন্ধ ই লাগে না তবে বেশ কয়েক দিন যাবত মুড টা ভালো পাচ্ছি না, হুট করে ই রেগে যাচ্ছি তো হুট করে ই কান্না পাচ্ছে, তো তাতে কি হলো ”

মন্ত্রী সাহেব এবার নিজেও বিরক্ত হলো,

” এই তোমার কয় মাস যাবত পি*রি*য়ড অফ? ”

” আরে আর বইলেন না, এই নিয়া বেশ টেনশনে আছি, গত ২ মাস যাবত হচ্ছে না কি কর… ”

হুট করেই থেমে গেলাম আমি, অবাক চোখে মন্ত্রী সাহেব এর দিকে তাকালাম,

উনি উৎসুক দৃষ্টি তে আমার দিকে তাকিয়ে আছে,

আমার হাত চলে গেলো পেটে, আমি অবাক দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে ইশারা করলাম, আমি যা ভাবছি তাই নাকি?

উনি হেঁসে উঠলেন, আমি ছলছল চোখে তাকিয়ে আছি উনার দিকে, আমার এতো এতো কথার ঝুলি যেন মূহুর্তে ই ফাঁকা হয়ে গেছে, কথা গুলো যেন ভেতর থেকে দলা পাকিয়ে আসছে। বুকের মাঝে যেন সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ এর আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি এই কি তাহলে প্রথম মা হওয়ার অনুভূতি?

আমি মাথা নিচু করে আছি,

” কি হলো পূর্ণ কিছু বলো! খুশি হওনি তুমি? ”

আমি চোখ তুলে তাকালাম,

” কিছু বললেন? ” আমার শান্ত কন্ঠ,

” বললাম কিছু বলো! ”

” কি বলব? আচ্ছা আমি কি সত্যি ই প্রেগন্যান্ট? ”

” আগে শুনতাম কেউ মা হলে নাকি সে নিজেই বুঝতে পারে অথচ আমার বউ দেখো! পুরো দেশ জেনে বসে আছে যে তাহরিম তালুকদার এর বাচ্চা হবে, পুরো এলাকায় মিষ্টি বিতরণ শেষ এতোক্ষণে আমার বউ জিজ্ঞেস করে সে প্রেগন্যান্ট নাকি! সবই কপাল আমার! ”

” এই যে আসবো নাকি গর্ভবতী মহিলা? ”

দরজায় দাঁড়িয়ে কথা টা বলে উঠলো কেউ,
তাকিয়ে দেখি ইলমী দাঁড়িয়ে আছে,

আমি তাকাতেই ইলু মুচকি হেসে ভেতরে ঢুকলো,

” কিরে গর্ভবতী নারী, তুই যে পোয়াতি আগে বললি না তো! ”

আমি কিছু বলতে নিবো হুট করে ই মন্ত্রী সাহেব বলে উঠলো,

” সে তো নিজে ই জানতো না, মাত্র জানলো তাও আবার আমাকে প্রশ্ন করছে সে প্র্যাগন্যান্ট নাকি! ”

ইলু হু হু করে হেঁসে উঠলো,

” বুঝতে হবে ভাইয়া এটা আমার বান্ধবী, পৃথিবীতে মাত্র এক পিছ ই আছে! ”

ওদের কথা বলার মাঝেই তানজিম মোবাইল হাতে কেবিনে ঢুকলো পাশে চোখে চশমা পড়া একটা মেয়ে,

” কেমন আছো আমার ভাতিজার আম্মু? ”

আমি তানজিমের দিকে তাকালাম,

” তুমি কি করে বুঝলে যে ভাতিজাই হবে? ভাতিজি ও তো হতে পারে! ”

তানজিন তাহরিমের হাতে একটা ভিডিও অন করে মোবাইল টা দিয়ে সিটে বসতে বসতে বলল,

” রক্তের টান বুঝো তো! আর বাচ্চার চাচার মন কখনো ভুল বলে না ভাবিজান! আমার ভাতিজা ই হবে, ওকে নিয়ে খেলব, ঘুরবো আর মেয়ে পটাবো দুই চাচা ভাতিজা মিলে! মেয়েদের পিছনে লাইন মারবো ”

” ওহহ আচ্ছা এই ব্যসপার! কিন্তু আমি তো মেয়ে চাই, ঠিক আমার মতো শান্ত, নম্র-ভদ্র, রুচিশীল, ইনোসেন্ট একটা মেয়ে ”

আমার কথা শুনে ইলমীর কাশি উঠে গেলো, কোন ভাবে কাঁশি থামিয়ে বলল,

” তুই ইনোসেন্ট! আর এটাও বিশ্বাস যোগ্য তুই শান্ত? হাউ ফানি ইয়ার! টুডে’স বেস্ট জোক্স! ”

আমি বিরক্তি দৃষ্টিতে ইলুর দিকে তাকিয়ে বললাম,

” তুই চুপ থাক! বেশি কথা বলিস তুই ”

আমি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে তাকালাম,

” ও কে? ”

” তোমার ভবিষ্যত জা ”

তানজিম কিছু বলার আগেই তাহরিম মোবাইলের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই বলল।

আমি মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

” এই যে হবু জা এদিকে এসো ”

মেয়েটা আমার কাছে এলো,

” নাম কি তোমার? ”

মেয়েটা এক হাতে চশমা ঠিক করতে করতে বলল,

” মেহবুবা রহমান ”

মেয়েটার শান্ত এবং ধীর কন্ঠ।

” কোন ইয়ার? ”

” সেকেন্ড ”

” কোন সাবজেক্ট এ আছো? ”

” ইংরেজি লিটারেচার ”

” বাহ্ বেশ ভালো। আমার জা হিসেবে তোমাকে পছন্দ হয়েছে, তুমি পাশ ”

তানজিম মেহবুবার উদ্দেশ্যে বলল,

” ঘরের কর্তী যখন তোমাকে পাশ মার্ক দিয়েছে তার মানে তোমার চাকরি কনফার্ম ”

বলেই হেসে উঠলো, সাথে আমি আর ইলমী ও। মেয়েটা বেশ লজ্জা পেলো, বোঝাই যাচ্ছে বেশ লাজুকে স্বভাবের।

আমি উকি দিয়ে তাহরিম তালুকদার কি ভিডিও দেখছে তা দেখার চেষ্টা করলাম,

উনি খবর দেখছেন যেখানে ঐ দিনের চক্রান্তের কাহিনি টা সুস্পষ্ট ভাবে দেখানো হচ্ছে আর আনোয়ার হোসেন এর জবান বন্দি যেখানে সে নিজেই স্বীকার করছে ঐ দিনের এক্সিডেন্ট এর কাজ টা উনার ই, আদালতের ঘোষণা অনুযায়ী এটেন্ড টু মাডার কেইসে তার উপর একজন স্ব নাম ধন্য রাজনীতি বিদ আর বর্তমান মন্ত্রী কে মারার ইচ্ছা পোষণ করার কারণে যাবত জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

উনি ভিডিও অফ করে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালো আমি চোখ দুটো ছোট ছোট করে উনার দিকে ই তাকিয়ে আছি,

” কি হয়েছে এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? ”

” আনোয়ার হোসেন এতো সহজে নিজের দোষ স্বীকার করলো কিভাবে? ”

উনি মুচকি হেসে বললেন,

” ঘাস কেটে তো আর মন্ত্রী হই নি! ঘটে বুদ্ধি তো আছেই ”

___________

হসপিটালে থাকতে হয়েছে দশ দিন, মন্ত্রী সাহেব এর মতে পুরোপুরি সুস্থ না হয়ে বাড়ি যাওয়া যাবে না।

ডাক্তার শুধু একদিন বলে ছিলো,

এই সময় মাকে একটু বেশি খেতে হবে, তার উপর এতো বড়ো একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেলো, শরীর দুর্বল তাই খাবারের পরিমান টা বাড়াতে হবে।

ব্যস হলো আর কি, খাবারের অত্যাচার তো আছেই। একটা খেতে না খেতেই আরেকটা নিয়ে হাজির! জামাই খাইয়ে গেলে আছে মা তারপর উনি খাইয়ে গেলে আসে বাবা! এক গাধা ঠেসে খাইয়ে যায় তার কিছু ক্ষন পর আসে আমার পরানের বান্ধবী! আর আমার দেবর মহাশয় বসে বসে এদের অত্যাচার দেখে আর মজা নেয়।

বুঝলাম না একটা মেয়ের উপর এতো খাবারের অত্যাচার কি নারী নির্যাতনের মধ্যে পড়ে না? পুলিশ কি এসব দেখে না নাকি!

চলবে…

ভালোবাসিবো খুব যতনে পর্ব-৪৩+৪৪

0

#ভালোবাসিবো_খুব_যতনে
#Ayrah_Rahman
#part_43

_________________

” আপু, তাহরিম ভাইয়ার বিপদ হবার সম্ভাবনা আছে, কেউ হয়তো ভাইকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করছে, তুমি জলদি কিছু করো নয়তো বিপদ বাড়বে, যতটা সম্ভব ওরা গাড়ি তে কিছু একটা করেছে ”

কথাটা শোনা মাত্র ই বেশ বিচলিত হলাম। সামনে নির্বাচন, যদিও মন্ত্রী নির্বাচন হয়ে গেছে তবুও চাপ কম নয়। ফোন করেছে আমার জুনিয়র একজন অফিসার, আমাকে বোন বলে আমিও তাকে ভাই বলেই মনে করি। ওকেই বলেছিলাম মন্ত্রী সাহেব কোথায় যায় কি করে সব খবর আপডেট আমাকে দিতে।

আমি কানে ফোন রেখে ড্রয়ার থেকে গাড়ির চাবি টা নিয়ে বললাম,

” তুমি একটু দেখো উনি যেন গাড়ি তে না উঠতে পারে আমি আসছি, আর আমি উনাকে ফোন করছি, তুমি ও সাবধানে থাকো ”

” আচ্ছা ”

আমি দরজার কাছে আসতেই মাথা টা কেমন যেন চক্কর দিয়ে উঠলো, কিন্তু তাতে বেশি একটা গুরুত্ব দিলাম না, বেরিয়ে গেলাম বাইরে, বাইরে এসে দেখি বাবার গাড়ি টা দাড় করানো। মাত্র ই বাবা বাসায় আসলো। আমি চটজলদি গাড়ি তে উঠে স্টার্ট দিয়ে উনার নাম্বারে কল করলাম, কিন্তু কল বাজছে কিন্তু উনি পিক করছেন না। টেনশনে আমার হাত পা যেন বরফ হয়ে যাচ্ছে।

গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে গাড়ি চালাতে লাগলাম পার্টি অফিসের উদ্দেশ্যে। লোক টা এতো কেয়ারলেস কেন? একটা মানুষ এতো কেয়ারলেস কি করে হতে পারে? বারবার ফোন করে ই যাচ্ছি অথচ ফোন পিক ই করছে না, মেজাজ টা একদিকে চরম খারাপ হচ্ছে আর আরেক দিকে টেনশনে হাত পা অবস হয়ে আসছে। কিছু হইনি তো? ঠিক আছেন তো উনি? বার বার নেগেটিভ চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।

প্রায় আধা ঘণ্টার রাস্তা পনেরো মিনিটের ভেতরে এসে পৌছালাম।

আশেপাশে অনেক খুঁজলাম, অফিসের ভেতরে গিয়েছিলাম উনিও নেই উনার গাড়ি ও নেই কোথাও। চিন্তাই আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে। মানুষ টার কিছু হলো না তো। আরেক টু আগে কেন আসলাম না! হয়তো তাকে অক্ষত পেয়ে যেতাম। বেশ কান্না পাচ্ছে, কি করব বুঝতে পারছি না, ফোন টাও ধরছে না।

আমি মুখে হাত দিয়ে হাটু ভাজ করে নিচে বসে ফুপিয়ে উঠলাম। মনে মনে শুধু এটাই ভেবে যাচ্ছি কেউ যদি উনাকে মে’রে ফেলার প্ল্যান করে! কিছু হয় নি তো? আমি কি করে থাকবো এই মানুষ টাকে ছাড়া?

মুখে হাত দিয়ে ই ফুপাতে লাগলাম।

” পূর্ণ? ”

আমার কান পর্যন্ত ডাক টা না পৌছালেও মনে হলো কেউ আমাকেই ডাকছে।

” পূর্ণ কি হয়েছে তোমার? এভাবে বসে আছো কেন? ”

আমি চমকে তাকালাম সামনের দিকে, আমার থেকে কিছু টা সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আমার দিকে ই তাকিয়ে আছে।

উনাকে অক্ষত দেখে যেন আমার দেহে প্রান এলো, আর কোন দিকে না তাকিয়ে ঝাপিয়ে পড়লাম তার বুকে, ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না গুলো যেন দলা পাকিয়ে আসছে। গাল বেয়ে নেমে আসছে অঢেল বর্ষন।

উনি আমার মাথায় হাত দিয়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,

” কি হয়েছে পূর্ণ? তুমি এভাবে কাঁদছো কেন? আর তুমি পার্টি অফিসের সামনে কি করো? তোমার তো এখন বাসায় থাকার কথা ”

আমি নাক টানতে টানতে মাথা তুলে তাকালাম, হুট করে ই মেজাজ টা খারাপ হয়ে গেলো, উনাকে ধাক্কা দিয়ে আমি সোজা হয়ে দাড়ালাম।

হুট করে ধাক্কা টা উনি সহ্য করতে পারে নি, তাই ধপ করে বসে পড়লো, উঠে দাড়িয়ে পাঞ্জাবি ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,

” কি ভুত চাপলো মাথায় আজ? এমন অদ্ভুত বিহেভিয়ার করছো কেন পূর্ণ? ”

আমি চোখ গরম করে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,

” ফোন কোথায় আপনার? ”

আমার কথা শুনে তাহরিম দ্রুত পকেটে হাত দিয়ে ফোন বের করে অন করে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে পূর্ণার নাম্বার থেকে প্রায় ২০+ মিসড কল।

তাহরিম জিভে কামড় দিয়ে মিনমিনে কন্ঠে বলল,

” সররি বউ, হাতের চাপ লেগে কখন যে সাইলেন্ট হয়ে গেছে বুঝতেই পারি নি, কিন্তু এতো জরুরি কি হলো যে এতো গুলো ফোন করলা? ”

আমি চোখ গরম করে তাকিয়ে বললাম,

” দরকার অদরকার সেটা পরের বিষয় আগে আপনি বলেন, ফোন ব্যবহার করেন কেন? ফোন যদি সাইলেন্ট ই রাখতে হবে তাহলে কাল থেকে আর ফোন আনার ই দরকার নেই, অযথা বোঝা বাড়িয়ে লাভ নেই, ঠিক বলি নি মন্ত্রী তাহরিম তালুকদার? ”

উনি খানিকটা এগিয়ে এসে মিনমিনে কন্ঠে বললেন,

” সরি তো বউ, আর করবো না এমন! এই যে কানে ধরছি ”

বলেই কানে ধরতে যাবে আমি আশেপাশে তাকিয়ে দেখি অনেকেই তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে,

আমি তাহরিম এর হাত ধরে বললাম,

” ভুলে যাবেন না এটা পাবলিক প্লেস আর আপনি একজন সম্মানিত ব্যক্তি , এসব বাচ্চামি পাবলিক প্লেসে আপনাকে মানায় না মন্ত্রী সাহেব! ”

কথা টা বলে ঘুরে গাড়ির দিকে যেতে নিবো কি জানি কি হলো তখন হুট করেই ভীষণ কান্না পেলো। এমন শুধু আজ নয় বেশ অনেক দিন যাবত ই মুড সুইং হচ্ছে। হুট করে ই রেগে যাচ্ছি তো আবার হুট করে ই কান্না পাচ্ছে, মানে কোন কারণ ছাড়াই।

আমি ফুপিয়ে উঠলাম,

তাহরিম দৌড়ে এসে আমাকে এক হাতে জরিয়ে ধরে বলল,

” কি হয়েছে বউ জান? তুমি এমন করছো কেন হুম? কি হয়েছে বলো আমাকে? কি জন্য কান্না করছো? কষ্ট হচ্ছে কোথাও? ”

উনি আমাকে নিয়ে গাড়ি তে উঠতে যাবে আমি বললাম,

” এটায় না, আমি আমার গাড়ি তে যাবো! ‘

উনি পাল্টা আমাকে কোন প্রশ্নই করলেন না, আমার মুড অফ দেখে হয়তো কিছু ই বললেন না, আমাকে জরিয়ে ধরে আমার আনা গাড়িতে বসিয়ে নিজেও বসে স্টার্ট দিলো আর ড্রাইভার কে বলল গাড়ি টা ভালো ভাবে চেক করে বাসায় নিয়ে আসতে।

উনি গাড়ি চালাচ্ছে হঠাৎ আমার কেন জানি মনে হলো আমাদের গাড়ি টা কেউ ফলো করছে পেছনে থেকে।

” মন্ত্রী সাহেব? ”

” হুম বউ ”

” আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে আমাদের গাড়ি টা পিছনে থেকে কেউ ফলো করছে ”

উনি আমার কথা শুনে লুকিং মিরর দিয়ে পিছনে তাকালো, একটা কালো মাইক্রো আমাদের পিছনে।

উনি বাসার গলিতে না ঢুকে অন্য একটা রাস্তায় ঢুকলো কিন্তু মাইক্রো টা তো পিছনে পিছনে ই আসছে।

” বলছিলাম না, মাইক্রো টা ফলো করছে! ”

উনি স্পিড বাড়িয়ে একটা রাস্তায় উঠলো,
গাড়ি ব্রেক করতে গিয়ে মনে হলো ব্রেক টা যেন কাজ করছে না, তাহরিম বারবার ব্রেক চাপছে কিন্তু কোন ভাবেই কাজ করছে না। তাহরিম বুঝতে পারলো কেউ হয়তো ওদের অনুপস্থিতিতে গাড়ির ব্রেক নষ্ট করে দিয়েছে।

আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছি তাহরিম তালুকদার এর দিকে, এমন নয় যে আমি বুঝি নি ব্রেক নষ্ট হয়ে গেছে। আমি বুঝতে পেরেছি, আমার বেঁচে থাকা থেকে উনার বেঁচে থাকা টা বেশি জরুরি তাই উনাকে যে করেই হোক গাড়ি থেকে ফেলতে হবে নয়তো উনি যদি আমার মনোভাব বুঝতে পারে তাহলে কখনোই আমি আমার কাজটা করতে পারব না।

” কি হয়েছে আপনার? মুখ টা এমন পাংশুটে করে রেখেছেন কেন? ”

উনি আমার দিকে কাতর চোখে তাকালেন,

” বউজান… ”

” হুম বলেন”

” তোমার সাথে হয়তো এই জীবনে আমার আর কথা নাও হতে পারে কিন্তু জেনে রেখো খোদা তায়ালা যদি সাত টা জনম আমাকে দেয়, সেই সাত জনমেই প্রিয়তমা হিসেবে আমি তোমাকেই চাইবো, আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি পূর্ণ, ভীষণ ভালোবাসি ”

আমি নিজের সিট বেল্ট খুলে উনার দিকে খানিকটা ঝুঁকে দরজার সাইড দিয়ে মাথা হেলিয়ে জরিয়ে ধরলাম উনাকে,

এক হাত দিয়ে দরজার বাটন চাপ দিয়ে দরজা খুললাম অপর হাত দিয়ে উনাকে আলতো করে জরিয়ে ধরে আলতো হাসলাম,

” এমন করে বলছেন কেন মন্ত্রী সাহেব? আমি আপনার, সাত জনমে ও আপনার ই থাকবো, আমি ছাড়া অন্য কারো কথা মাথায় আনবেন তো আপনার পিন্ডি চটকাবো, এই বলে দিলাম”

কথা বলতে বলতে উনার সিট বেল্ট ও খুলে দিলাম, উনি সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে, রাস্তা টা বেশ নির্জন তাই সমস্যা হচ্ছে না। সামনেই বেশ ঢালু একটা জায়গা আর নিচ দিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত, এটাই হয়তো কাজ করার সঠিক সময়,

” ভালো থাকবেন মন্ত্রী সাহেব, আর আমাকে ভুলে যাবেন না কিন্তু.. ”

উনি কিছু বলার আগেই দরজা খুলে উনাকে বেশ জোরেই ধাক্কা দিলাম, উনি কিছু বুঝে উঠার আগেই উনি পরে যায় গাড়ি থেকে। আমি সিটে বসে গাড়ি টান দিলাম, মোবাইল বের করে ক্যাবলাকান্তের নাম্বারে কল করতেই দু এক রিং হবার পর ধরলো,

” কুশন তুমি শহর থেকে উত্তর দিকের গ্রাম সাইডে একটা নারিকেল বাগান আছে তার পাশের রাস্তার ধারে তোমার স্যার পরে আছে দ্রত আসো ”

গাড়ি তখন আউট অফ কন্ট্রোল, সামনেই একটা বড় বট গাছ,

আর হয়তো আমার কাছে সময় বেশি নেই, ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পিছনে তাকালাম যদি উনাকে একটি বার দেখতে পাই! কিন্তু আফসোস শেষ দেখা টা হয়তো আর হবে না।

ভাবতে ভাবতে ই গাড়ি এসে স্ব জোরে আঘাত করলো বট গাছ টার দেহে, সামনের কাচ ভেঙে গেলো, মাথায় প্রচন্ড আঘাত লাগাই মনে হলো গরম কিছু ঘাড় বেয়ে নেমে আসছে, আবছা চোখে হাত দিলাম ঘাড়ের পেছনে, সামনে আনলাম হাত টা, লাল রঙে রাঙা হয়ে গেলো হাত..

ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে এলো দুটি চোখের পাতা, হয়তো এটাই আমার জীবনের অন্তিম মূহুর্ত…

চলবে..

#ভালোবাসিবো_খুব_যতনে
#Ayrah_Rahman
#part_44

_________________

” আমাদের জীবনে এমন অনেক সময় আসে যখন আমাদের শক্ত থাকতে ভীষণ কষ্ট হয় তবুও থাকতে হয়। জীবনে সবসময় সব কাজে মিরাক্কেল হয় না, ভাগ্য কে মেনে নিতে হয় আর উপর ওয়ালার উপর বিশ্বাস রাখতে হয়। এটা বিশ্বাস রাখা দরকার সবসময় মিরাক্কেল হবে না, অবশ্যই খোদা তায়ালা সর্বোত্তম পরিকল্পনা কারী, সে নিশ্চয়ই সব কিছু ভেবে ই করছেন এবং যাতে তোমার মঙ্গল সেটাই করবেন উনি, বিশ্বাস রাখো তাহরিম, ভেঙে পড়ো না ”

তাহরিমের কাঁধে হাত রেখে ধীরে ধীরে মেহেরিন তালুকদার কথা গুলো বলল। তাহরিম মাথা নিচু করে হসপিটালের করিডরে বসে আছে, মাথায় তার ব্যান্ডেজ। গাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় বেশ আঘাত পেয়েছিলো সে , জ্ঞান হারিয়ে ছিলো তখন ই।

জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে হসপিটালের বেডেই আবিষ্কার করে তাহরিম। হাতে পায়ে ও চোট লাগে তার, জ্ঞান ফিরতেই শুরু হলো তার পাগলামি, বারবার একই প্রশ্ন, ” পূর্ণ ঠিক আছে তো? তার পূর্ণ কোথায়? কেমন আছে তার পূর্ণ ? ”

যার উত্তর ডাক্তার রা দিতে পারছিলো না যার দরুন আরো বেশি পাগলামি শুরু হয়েছিলো তার , পুরো হসপিটালের সমস্ত ডাক্তার আর নার্স, রোগীরা পর্যন্ত ছলছল চোখে তাকিয়ে ছিলো তাহরিমের দিকে, তার করা পাগলামির সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো, কে না চেনে তাকে। সদ্য হওয়া তরুন মন্ত্রী তাহরিম তালুকদার। ডাক্তার রা এক প্রকার বাধ্য হয়ে ই তাহরিম কে অটির সামনে নিয়ে এসেছে। একজন শক্ত সামর্থ্যবান রাজনীতিবীদ, যার কন্ঠে শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যায় হাজার তরুনের। বড় বড় পদস্থ কর্মকর্তাদের ও চোখের ইশারায় বসিয়ে রাখে আজ সেই তরুন মন্ত্রী তাহরিম তালুকদার কে যেন চেনার উপায় নেই। মিনমিনে কন্ঠ আর অসহায় চাহুনি ই বুঝিয়ে দিচ্ছে আজ সে কতটা অসহায় তাও একজন নারীর জন্য।

একজন নারী, কি না পারে! এত গাম্ভীর্য পূর্ণ একজন পুরুষ কেও এক নিমিষেই অসহায় বানিয়ে দিলো! পাগল বানিয়ে দিলো এক নিমিষেই। যার পাগলামির সাক্ষী সাধারণ জনগণ।

তাহরিম কে অটির সামনে বসাতেই সে একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেলো সে, একটা কথাও বলল না, এক পলক অটির দরজার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বসলো। একদম নিস্তব্ধ সে, নিস্তব্ধতা যেন ঘিরে ধরলো চারপাশ থেকে।

তাহরিমের ভেতরে কি পরিমাণ ঝড় বয়ে যাচ্ছে একমাত্র সেই জানে, পুরুষ মানুষের নাকি কাঁদতে নেই, তবে আজ তাহরিমের ইচ্ছে করছে তার পূর্ণর হাত টা জড়িয়ে কাঁদতে ভীষণ ভাবে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। অসহায়, আজ সে বড্ড অসহায়।

তালুকদার বাড়ির প্রায় সবাই ই উপস্থিত হসপিটালে।

নিজের পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে পাশে তাকালো তাহরিম। তানজিম কে দেখে আবার নিচের দিকে ই তাকালো তাহরিম। তানজিম কিছু টা হলেও বুঝতে পারছে তাহরিম এর মনের অবস্থা!

” ভাইয়া? ”

তাহরিম কোন রেসপন্স করলো না।

” ভাইয়া তুমি চিন্তা করো না, পূর্ণা আপু সুস্থ হয়ে যাবে, দেখো তুমি! কিছু হবে না আপুর”

তাহরিম তানজিম এর দিকে তাকালো।

তানজিম জোর পূর্বক হেসে বলল,

” ভাইয়া চল একটা প্ল্যান করি, পূর্ণ আপু সুস্থ হলে আমরা সবাই মিলে রাঙ্গামাটি যাবো নাকি কক্সবাজার যাবে? কোন টা? আচ্ছা ভাইয়া বলো তো আপু কোথায় চয়েস করবে,? রাঙামাটি নাকি বান্দরবান আর নাকি কক্সবাজার? আমার তো মনে হচ্ছে রাঙামাটি! ”

তাহরিম ছলছল চোখে তানজিম এর দিকে তাকালো,

” জানিস তানজু, তোর আপুর এই অবস্থার জন্য আমি দায়ী! সব আমার জন্য হয়েছে। আমি যদি ফোন টা ঠিক মতো পিক করতাম তাহলে হয়তো এটা হতো না, ও না আমাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে গাড়ির ভেতরে ই রয়ে গেল, আমি না একদম বুঝতে পারি নি ও আমার সাথে এমন টা করবে, এতো খারাপ কেন বল তো ও? পূর্ণ কি জানে না, ওকে ছাড়া আমি অসহায়! আমি বাঁচতে পারব না ওকে ছাড়া! ও তো জানতো এটা বল! তাহলে কেন আমাকে এভাবে মারার প্ল্যান করলো? আমাকে যদি সরাসরি ই বলতো তাহলে আমি হাসতে হাসতে মৃত্যু কে বরণ করতাম, এতো বড়ো শাস্তি কেন আমাকে দিলো, বল না তানজু? ওকে আমি ক্ষমা করবো না কক্ষনো ক্ষমা করব না ”

তানজিমের কাঁধে মুখ ঘষে কথা গুলো বলতে বলতে চোখ দিয়ে অঝোর পানি পড়তে লাগলো, কাঁধে ভিজা ভিজা অনুভব হওয়ায় তানজিম ঢের বুঝতে পারলো তার ভাই আজ বড্ড বেশি ই ভেঙে পড়েছে। এমন অসহায় ভাবে সে কখনো তার ভাই কে দেখে নি কাঁদতে তো দুরর, মন খারাপ ও করে ও কথা বলে নি তাহরিম কোনদিন।

কিছু ক্ষন নিরবতা পালন করার পর তানজিম বলে উঠলো,

” হুসস ভাইয়া এভাবে কেউ কাঁদে? ঠিক হয়ে যাবে তো আপু ”

” তানজিম ঠিক ই বলেছে ভাইয়া, পূর্ণা খুব স্ট্রং , ও ঠিক ই সুস্থ হয়ে যাবে,, আপনি শুধু শুধু ই টেনশন করছেন! ”

পরিচিত কারো কন্ঠ শুনতে পেয়ে ঘাড় উঁচিয়ে তাকালো সেই দিকে,

ইলমী দাড়িয়ে আছে, পাশেই রুদ্র অবাক চোখে ইলমীর দিকে তাকিয়ে আছে।

তাহরিম ইলমীর দিকে তাকালো, মেয়েটার চোখ মুখ ফুলে লাল হয়ে আছে, বোঝাই যাচ্ছে কেঁদে কেটে বন্যা বানিয়ে ফেলেছে, তবুও একটা জিনিস তাহরিমের ভালো লাগলো, ইলমী নিজের অবস্থা ই করুন তার উপর সে আবার তাহরিম কে শান্তনা দিচ্ছে।

রুদ্র অবাক, রুদ্র পূর্ণার এক্সিডেন্টের কথা জানার সাথে সাথে ই ইলমী কে বলেছিলো কারণ সে তখন ইলমির সাথে ই ছিলো, কথাটা শোনার সাথে সাথে ই ইলমী এই যে কান্না শুরু করলো হসপিটালে পৌছানোর আগ পর্যন্ত সেই কান্না বহাল ছিলো।

হসপিটালে ঢুকতে ঢুকতে ই চোখের পানি মুছে তাহরিমের সামনে এসে শান্তনা দেওয়া তে রুদ্র বেশ অবাক।

তাপস তালুকদার আর মেহেরিন তালুকদার গেছেন বাসায়, রাতের খাবার রেডি করতে। সে জানে আজ কেউ ই হসপিটাল ছেড়ে কোথাও যাবে না তাই, হসপিটালে ই খাবার নিয়ে আসতে হবে।

অপারেশন শুরু হবার প্রায় ঘন্টা ৩ পর অটির লাইট অফ হলো, দরজা খুলে ডক্টর বেরিয়ে আসলো,

ডক্টর বের হতেই ইলমী ছুটে ডক্টর এর কাছে গিয়ে দেদারসে একের পর এক প্রশ্ন ছুড়তে লাগলো ,

” ডক্টর পূর্ণ কেমন আছে? কি হয়েছিলো? কোথায় ব্যথা পেয়েছে? ঠিক আছে তো ও? আমি কি ভেতরে যেতে পারব? নাকি অবজারভেশনে রাখবেন? ”

” মিস, আপনি একটু চুপ করুম আমি বলছি ”

ডক্টরের কথায় ইলমী চুপ করে গেলো,

” জি বলুন ”

” মিসেস পূর্ণার অপারেশন টা সাকসেসফুল হলেও এই মুহূর্তে কিছু ই বলতে পারছি না আমরা কারণ উনি আঘাত টা মাথায় পেয়েছে, আমাদের ধারনা উনি হয়তো সাময়িক স্মৃতি হারিয়ে ফেলতে পারে কিংবা প্যারালাইসড ও হতে পারে, কিন্তু এটা শুধু ই আমাদের অনুমান, এমন টা না ও হতে পারে তবে খোদার অশেষ রহমতে দুই জন ই বেঁচে আছে! ”

রুদ্র খানিকটা এগিয়ে এসে বলল,

” দুই জন মানে? ”

ডক্টর ভ্রু কুঁচকে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল,

” কেন আপনারা জানেন না? মিসেস তালুকদার প্রেগন্যান্ট ”

রুদ্র চোখ বড়ো বড়ো করে ইলমীর দিকে তাকালো, ইলমী যেন ডক্টর এর কথা শুনতেই পেলো না এমন ভাবে রুদ্রের দিকে তাকালো,

রুদ্র পিছনে তাকিয়ে দেখে তাহরিম এক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে, আর তানজিম মুখে হাত দিয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে রুদ্রের দিকে তাকালো,

তাহরিম কে ধাক্কা দিয়ে বলল খুশিতে চিৎকার দিয়ে বলল,

” ভভভাই শুনেছিস! আমি চাচ্চু হবো! ছোট ছোট হাত পা নাড়িয়ে খেলবে আর আমি কাঁধে তুলে দৌড়াবো।

তানজিম লাফিয়ে উঠে বলল,

” আমি চাচ্চু হবোওও ”

চলবে…

ভালেবাসিবো খুব যতনে পর্ব-৪১+৪২

0

#ভালেবাসিবো_খুব_যতনে
#Ayrah_Rahman
#part_41

_________________

” পূর্ণা আপু তোমার একটা নাম্বার ওদের হাতে চলে গেছে! ইমিডিয়েটলি তোমার নাম্বার টা বন্ধ করে দিতে হবে নয়তো ওরা তোমার লোকেশন বের করে ফেলবে ”

এইটুকু মেসেজ পড়ে তাহরিম ভ্রু কুঁচকালো। বিছানায় লেপটপ নিয়ে কাজ করছিলো তাহরিম আর আমি ওয়াসরুমে, হঠাৎ মেসেজ টোন বাজায় তাহারিম ঘাড় ঘুরিয়ে মোবাইলের দিকে তাকালো, এমন একটা নোটিফিকেশন দেখে তাহরিম কৌতুহল বশত মেসেজ টা অপেন করলো। এটা ঠিক বিনা অনুমতি তে কারো পার্সোনাল জিনিস ধরা ঠিক না তবুও তাহরিম ধরলো।

তাহরিম তালুকদার আর কিছু না ভেবে রিপ্লাই মেসেজে লিখলো,

” কোন নাম্বারের কথা বলছো? আমার তো অনেক নাম্বার ই ”

তাহরিম এটা লিখে চুপ করে বসে রইলো, সে ভাবছে পূর্ণা কি তার কাছে কিছু লুকাচ্ছে? সে কি আদৌও জার্নালিস্ট তো? হাজারো অহেতুক প্রশ্ন এসে ভর করতে লাগলো তাহরিম।

প্রায় মিনিট দুয়ের মাঝেই পুনরায় মেসেজ টোন বেজে উঠলো, তাহরিম মেসেজ টা অপেন করে ভ্রু কুঁচকালো।

” আপু ওই যে আপনার হাইড নাম্বার যেটা ওইটা, 019******** এটা ”

তাহরিম ভ্রু কুচকে নাম্বার টাই দেখছে! কেন জানি তার নাম্বার টা ভীষণ পরিচিত মনে হচ্ছে, কোথায় যেন নাম্বার টা দেখেছে,

ভাবলো, যদি পরিচিত হয় তাহলে নিশ্চয় ই নিজের মোবাইলে সেইভ থাকবে।

কথা টা চিন্তা করে তড়িঘড়ি করে নিজের ফোন বের করে নাম্বার টা টুকে নিলো।

পুরো নাম্বার টা টুকতেই স্ক্রিনে ভেসে আসলো একটা নাম ” অপরিচিতা ”

তাহরিম ভ্রু কুঁচকে ভাবতে লাগলো এই অপরিচিতা টা জানি কে? হঠাৎ মনে হলো ঠিক এই নাম্বার থেকেই তার ফোনে মেসেজ আসতো বিভিন্ন সতর্ক বার্তা। তার মানে এটা পূর্ণার কাজ, কিন্তু কথা হলো এসব কথা পূর্ণা জানতো কিভাবে?

পূর্ণা কি আসলেই জার্নালিস্ট নাকি অন্য কেন পেশায় আছে?

” আপনি আমার ফোন দিয়ে কি করছেন মন্ত্রী সাহেব? কেউ ফোন করেছিলো বুঝি? ”

ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে চুল মুছতে মুছতে কথা টা বললাম, উনি আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ফোন টা খাটের উপর রাখলো,

আমি বারান্দায় গিয়ে তোয়ালে টা রেখে বিছানায় এসে বসলাম,

” কি হলো কথা বলছেন না কেন? কেউ ফোন দিয়েছিলো? ”

” নাহ্ ”

” ওহ আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি বসুন আমি নিচে গেলাম ”

কথাটা বলেই আমি উঠে দাড়িয়ে চলে আসতে নিলে হঠাৎ উনি আমার পিছনে থেকে ডেকে উঠলেন,

” পূর্ণা দাঁড়াও ”

আমার পা থমকে গেলো, তৎক্ষনাৎ পিছনে ফিরে তাকালাম।

” কিছু বলবেন? ”

” তুমি কি সত্যি ই জার্নালিস্ট নাকি অন্য কোন প্রফেশনে আছো? ”

তাহরিম তালুকদার এর কথা শুনে আমি খানিকটা চমকে উঠলাম,

আমতাআমতা করে বললাম,

” হহঠাৎ এই প্রশ্ন? আপনি তো জানেন ই আমি একজন সাংবাদিক তাহলে? ”

” হুম বুঝতে পেরেছি ”

উনি নিজের ফোন টা অন করে কিছু একটা বের করে আমার দিকে তাক করলো,

আমি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে দেখি একটা নাম্বার, কিন্তু যখন ই নাম্বার টা খেয়াল করলাম আমার মাথায় যেন আসমান ভেঙে পড়লো, একটা বড়ো সরো ঢুক গিলে উনার দিকে তাকালাম,

উনি এক ভ্রু উঁচু করে আমার দিকে ই তাকিয়ে আছে,

আমি তাকানো মাত্র ই উনি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,

” কি? এই নাম্বার টা চেনো? ”

আমি চমকে উঠলাম, এখন কি বলব আমি? এটা যে আমার নাম্বার!

আমি কোন কথায় বলছি না।

উনি মুচকি হেসে বললেন,

” জানো এই নাম্বার থেকে অনেক বার আমাকে সতর্ক বার্তা পাঠানো হ’য়েছে। আমি অনেক বার ট্রাই করেছি ব্যক্তি টি কে তা জানার জন্য কিন্তু তার হদিস আমি পাই নি, যদিও চাইলে আমি ঠিক ই বের করতে পারতাম কিন্তু আমি ইচ্ছে করে ই করি নি ”

আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি,

আমাকে চুপ থাকতে দেখে তাহরিম তালুকদার হাসলো,

” আমি জানি এটা তোমার নাম্বার! আমি এও জানি তুমি শুধু নামে একজন সাংবাদিক, তবে তোমার আসল পরিচয় টা ও আমার কাছে অজানা নয়, মিস মিফতাহুল পূর্ণা ”

আমি আবারো চমকে তাকালাম উনার দিকে,
উনি জানতেন আমি কে?

আমার অবাক হয়ে তাকানো দেখে উনি হাসলেন,

” আমি কি ঘোড়ার ঘাস কেটে মন্ত্রী হয়েছি? ঘটে একটু তো বুদ্ধি আছে আর এতো এতো কুটনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে টিকে থাকতে হলেও তো বুদ্ধি লাগবে তাই না? ”

আমি মাথা নাড়ালাম।

উনি আবারও বলতে শুরু করলো,

” তোমার পেশা সম্পর্কে আমি অনেক আগে থেকে ই অবগত , প্রধান গোয়েন্দা অফিসার আপনি সেটা আমি জানি, কখন থেকে জানি বলুন তো? ”

আমি আনমনে ই বলে উঠলাম,

” কখন? “.

” যেদিন আপনি আর পূর্ণা মিস্টার মিয়াজি কে ধরতে গিয়েছিলেন ঠিক সেদিন থেকে, আপনার হাবভাবে আমার মোটেও একজন সাংবাদিক মনে হয় নি, কারণ একজন সাংবাদিক নিঃসন্দেহে সাহসী তবে তারা এসব দুঃসাহসিক কাজ করবে না, সেদিন খোঁজ নিয়ে ই জানতে পারি আমার বউ একজন গোয়েন্দা অফিসার। সেদিন বেশ অবাক হয়ে ছিলাম, এমন বাচ্চা একটা মেয়েকে এত বড় পদ কেন দিলো যেখানে এতো এতো সিনিয়র মানুষ আছে! পরে বুঝলাম আমার বউয়ের ঘটে সব টা এখন আর গোবর নেই এখন তা পঁচে জৈব সার হয়ে যাচ্ছে , সব ই আমার সাথে থাকার ফল,

একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য তাই না? ”

আমি ভ্রু কুচকে তাকালাম, লোকটা কি আমার প্রসংশা করলো নাকি অপমান করলো ঠিক বুঝতে পারলাম না।

আমি আঙুল উচিয়ে বললাম,

” শুনোন! আমাকে অপমান করার চেষ্টা ও করবেন না, ফলাফল ভালো হবে না বলে দিচ্ছি! ”

তাহরিম ভ্রু কুঁচকে বলল,

” তা কি করবে শুনি? ”

” দেখুওওন..

” দেখাও”

তাহরিমের শান্ত কন্ঠ শুনে আমি হকচকিয়ে উঠলাম,
পরবর্তী তে নাক মুখ কুচঁকালাম.

” ছিইই অসভ্য কোথাকার! ”

বলেই নাক মুখ কুঁচকে বের হয়ে গেলাম রুম থেকে, পিছনে থেকে শুনতে পেলাম, তাহরিম তালুকদার এর এতক্ষণ চেপে রাখা হাসির শব্দ।

আমার মুখে ও অজান্তেই ফুটে উঠলো হাসির রেখা,

আমি হাঁটতে হাঁটতে মা বাবার রুমের সামনে আটকে গেলাম,

” মা আসবো? ”

ভেতর থেকে উত্তর এলো,

” এসো ”

আমি ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম, মা বসে বসে বই পড়ছে, একটা মানুষ এতো বই কিভাবে পড়ে আমি ঠিক জানি না, সারাদিন ই কি কেউ পড়তে পারে না কি? হউক সে টা গল্পের বা উপন্যাস টাইপ তবুও তো।

আমাকে দেখা মাত্র ই মা বইটা অফ করে উঠে বসলো,

” বসো পূর্ণ ”

আমি গিয়ে মা এর সামনে বিছানার উপর আসন পেতে বসলাম,

” কি হয়েছে মুড অফ নাকি পূর্ণ? ”

আমি মুখ গোমড়া করে ই বললাম,

” নাহ্”

” উহুম আমার তো মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে! তাহরিম কিছু বলেছে? ”

” মা জানো তোমার ছেলে সারাক্ষণ আমার পিছনে লেগে থাকে আর খোঁচাতে থাকে, আমাকে খোঁচা দেওয়ার একটা অপশন ও সে মিস করে না, বলো তো কেমন ডা লাগে? ”

আমার কথা শুনে মা বেশ সিরিয়াস হয়ে বলল,

” ঠিক ই তো, কাজ টা একদম ঠিক হচ্ছে না, আচ্ছা আমি তাহরিম কে বলব নে যে আমার মেয়ের সঙ্গে আর এমন না করতে ”

আমি মুচকি হাসলাম।

” আমার নামে আর কি কি বিচার আছে সব বলো আম্মু কে ”

পিছনে থেকে কারো কন্ঠ শুনতে পেয়ে আমি আর আম্মু পিছনে তাকালাম।

তাহরিম দরজার মধ্যে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বুকের উপর হাত দুটো ভাজঁ করে ভ্রু কুচকে দাঁড়িয়ে আছে।

আমি লাফ দিয়ে আম্মুর সাইডে চলে গেলাম, কখন জানি পিছনে থেকে এসে মাথায় ঠাস করে মারে,,,

চলবে….

#ভালোবাসিবো_খুব_যতনে
#Ayrah_Rahman
#part_42

_________________

” তাহরিম তুমি পূর্ণ কে এত জ্বালাও কেন হুম,? আমার মেয়েটা কত ভালো একটা মেয়ে আর তাকে তুমি জ্বালাও, কাজ টা কি তুমি ঠিক করো? ”

তাহরিম দু পা সামনে এগিয়ে আসলো, ভ্রু কুঁচকে চোখ দুটো ছোট ছোট করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

” আমি তোমাকে জ্বালায়?

কিছু টা থেমে মাথা এলিয়ে বলল,

” ঠিক আছে আর জ্বালাব না, কথাটা মনে রাইখো, মনে থাকে যেন মিস পূর্ণা! পরে আবার কথা ঘুরাবা না কিন্তু ”

বলেই বাঁকা হেসে চলে গেলো রুম থেকে। আমি ভেবলার মতো তাকিয়ে আছি তার যাওয়ার দিকে!

এক পলক মায়ের দিকে তাকাতেই দেখলাম মা ঠোঁট টিপে হাসছে, আমি তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে নেমে দৌড়ে নিজের রুমে এসে দেখি উনি ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবির বোতাম লাগাচ্ছে। আমাকে দেখে ও যেন দেখছে না এমন ভাব।

আমি দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে ওনার পিছনে পিছনে ঘুরছি। মানে উনি যেখানে ই যাচ্ছে আমি ওনার পিছনে পিছনে, রাগ করেছেন মশাই তাই ভাবছি কি করা যায়, বিচার দেওয়া টা মনে হয় ঠিক হয় নি!

আমি কাঁদো কাঁদো দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,

” কথা বলছেন না কেন আমার সাথে? ওওওই মন্ত্রী সাহেব ”

উনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল গুলোতে হাত চালাতে চালাতে বলল,

” কেউ একজন বলেছিলো আমি নাকি তাকে জ্বালাই তাই আজ এখন এই মূহুর্তে থেকে আর জ্বালাবো না ”

বলেই উনি ড্রয়ার থেকে ঘড়ি বের করে পড়তে পড়তে আয়না দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

” কারো যদি নিজের নখ কামড়ানো শেষ হয় তাহলে আমার নখ গুলোও বড় হয়েছে, চাইলে ধার হিসেবে দিতে পারি নখ গুলো ”

আমি নখ কামড়ানো অফ করে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,

” হে? কি বললেন? নখ ও কি ধার দেওয়া যায় না কি? ”

আমার কথার পাত্তা না দিয়ে পকেটে হাত দিয়ে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে চলে গেলো, বলেও গেলো না কোথায় গেলো!

বিরবির করে বললাম,

” আহহ মরণ, ঢং দেখলে বাঁচি না বাপু, কিসের এতো ভাব রে তোর, আসছে কোথাকার কোন মহারাজা উনাকে আমার সালাম করে চলতে হবে, খাটাশ কোথাকার! নিজেকে কি যে মনে করে, পূর্ণার সাথে ভাব দেখাতে আসছে, আমি আলাভোলা মেয়ে বলে এই ব্যাটার সংসার করছি নয়তো এই ঝগড়ুটের সংসার কোন মেয়েই করতো না, নিতান্তই আমি নরম মনের মেয়ে আর বোকা বলে! ”

পরবর্তী তে নিজের মনকে প্রশ্ন করলাম,
” আমি কি আদৌও বোকা আর আলাভোলা?”

মন উত্তর দিলো,

” অবশ্যই তুই বোকা আর একটা ভদ্র, শান্ত আর ইনোসেন্ট একটা মেয়ে! ”

পশ্চিমে সূর্য টা ঢলে পড়েছে সেই কখন, আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে আকাশের ওপারে, অস্তমিত সূর্যের দিকে ই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি, অদ্ভুত কারণে এই সময় টা আমার ভীষণ ভালো লাগে।

হালকা বাতাস দোলা খেয়ে যাচ্ছে শরীরে, পাখি রা নিজেদের নীড়ে ফিরে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে ভেসে আসছে কিচির মিচির শব্দ। আলতো হাসলাম।

সেই যে ভাব দেখিয়ে গেলো মন্ত্রী সাহেব এখনো পর্যন্ত একটা খোজঁ ও নিলো না, বাড়ি তে যে একটা বউ ফেলে রেখে গেছে সেই খেয়াল কি তার আছে?

হাতে থাকা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছু ক্ষন। ফোন দিবো নাকি দিবো না, দোটানায় পড়ে গেলাম, পরবর্তী তে মন কে শক্ত করে, ডায়াল করলাম মন্ত্রী সাহেব এর নাম্বারে..

তাহরিম তখন পার্টি অফিসে, একটা মিটিং শেষ করে মাত্রই বসলো, সামনে মেয়র নির্বাচন, প্রায় প্রতিদিন ই তার নিকট বিভিন্ন পার্টির লোক এসে ভীড় করে।

আপাতত তার সামনেই বসে আনোয়ার হোসেন, এইবার মেয়র পদে দাড়াবে সে, তাহরিম ব্যক্তিগত ভাবে লোকটা কে বেশ একটা পছন্দ করে না, লোকটা বেশ ধুরন্ধর প্রকৃতির যা তাহরিমের মোটেও পছন্দ না।

” মিস্টার আনোয়ার আপনি আমার থেকে বয়সে অনেক বড়, আমি আপনাকে সম্মান করি, রাজনীতিতে ও আমার আগেই আপনার আগমন তাই বলে এই ভাববেন না আপনার সকল অন্যায় প্রস্তাব আমি গ্রহন করবো, আপনি যদি মনে করে থাকেন আমি আপনার এই প্রস্তাব মেনে নেবো তাহলে তাহরিম তালুকদারকে আপনি চিনতেই পারেন নি ”

তাহরিম বেশ শান্ত কন্ঠেই কথা গুলো বলে সামনে তাকালো, আনোয়ার হোসেন নিজের পাকাঁ দাড়ি তে হাত বুলাতে বুলাতে বাকাঁ হাসলো,

” আপনি বেশ বুদ্ধিমান ছেলে তাহরিম তালুকদার। আপনার মতো সৎ থেকে আজ পর্যন্ত কেউ গদিতে বেশিদিন টিকতে পারে নি, টেবিলের উপর দিয়ে কিছু না নেন তবে নিচ দিয়ে নিতে হয় এটা এখন ট্রেন্ড হয়ে গেছে তাহরিম তালুকদার , আমার প্রস্তাব টা মেনে নেন আপনার ও সুবিধা সাথে আমার ও”

কথাটা বলেই ঘাড় ঘুরিয়ে আনোয়ার হোসেন এর এসিস্ট্যান্ট কে ইশারা করতেই একটা বিফ কেস টেনে টেবিলে রাখলো।

তাহরিম ভ্রু কুঁচকে তাকালো সে দিকে,

আনোয়ার বিফ কেস এর পিন খুলল, বিফকেস টা খুলতেই তাহরিমের সামনে দৃশ্য মান হলো এক বিফ কেস ভর্তি টাকা।

আনোয়ার হোসেন বিফ কেস টা তাহরিমের দিকে ঠেলে দিতেই তাহরিম মুচকি হেসে বিফকেট টা নিজের কাছে টেনে নিলো, যা দেখে আনোয়ার হোসেন বাঁকা হাসলো,

তাহরিম বিফকেস টা ভালো ভাবে দেখেই সেটা বন্ধ করে দিলো, আর সেটাকে ঠেলে আনোয়ার হোসেন এর দিকে দিয়ে বলল,

” সব ট্রেন্ডে তাহরিম তালুকদার গা ভাসায় না মিস্টার আনোয়ার। আমার গদির চিন্তা না হয় আমাকেই ভাবতে দেন, আপনারা এতো কিছু ভাবলে আমি কি ভাববো? আর এতো টাকা আমাকে না দিয়ে গরীব মানুষ দের উপকারে কাজে লাগান তাহলে মানুষ আপনাকে এমনি তেই ভালোবেসে ভোট দেবে, সেটার জন্য এমপি মন্ত্রী দের দরবারে কুকুরের মতো ঘুরতে হবে না, আর তাদের ভোট চুরির জন্য পেমেন্ট করতে হবে না, এ গুলো আপনার কাছে ই রেখে দেন মিস্টার আনোয়ার হোসেন, আর আজ আসেন তাহলে! ”

তাহরিমের কথা শুনে আনোয়ার হোসেন রেগে তাহরিমের দিকে তাকিয়ে বলল,

” কাজ টা আপনি ভালো করলেন না তাহরিম তালুকদার! এর জন্য আপনাকে পস্তাতে হবে কথাটা মনে রাইখেন ”

বলেই বসা থেকে উঠে আনোয়ার হোসেন গটগট পায়ে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।

আনোয়ার হোসেন এর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তাহরিম হাসলো, দিনে যে কত অফার আসে এসব এর! মাঝে মাঝে ভীষণ হাসি পায় তার।

আনোয়ার হোসেন যাওয়ার সময় কুশন ভেতরে ঢুকলো, আনোয়ার হোসেন কে এভাবে রেগে বেরিয়ে যেতে দেখে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার দিকে,

পরবর্তী তে তাহরিম এর তাকিয়ে সে দিকে ই এগিয়ে গেলো,

হাতে থাকা মোবাইল টা এগিয়ে দিলো তাহরিমের দিকে,

” কে? ”

” ভাবি ফোন দিতে বলেছে ভাই, আপনাকে নাকি অনেক বার কল করেছে আপনি নাকি ফোন ধরেন না তাই বাধ্য হয়ে আমার ফোনে কল করেছে বলল আপনাকে যেন বলি ভাবি কে এক্ষুনি কল দিতে, তাড়াতাড়ি কথা বলুন ”

তাহরিম কিছু একটা ভেবে বলল,

” তুমি ফোন দিয়ে বলো, ভাই এখন ব্যস্ত কথা বলতে পারবে না ”

কুশল ঢোক গিলে বলল,

” আমি? ”

” হ্যা তুমি! কেন কোন সমস্যা?

” আবব না, আমি ই কেন? ”

তাহরিম চোখ রাঙিয়ে বলল,

” যা বললাম তাই করো ”

কুশন কাপাঁ কাঁপা হাতে ডায়াল করলো পূর্ণার নাম্বারে, ফোন টা লাউড স্পিকারে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো..

চারপাশে অন্ধকার হয়ে এসেছে, হঠাৎ রিংটোন বাজতেই আমার চোখ যায় ফোনের দিকে,

স্ক্রিনে ক্যাবলাকান্ত নাম টা দেখে ভ্রু কুঁচকালাম,

” হ্যা ক্যাবলাকান্ত বলো, তোমার ভাই কই? ”

কূশন কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,

” ভভাবি, ভাই তো মিটিং এ, এখন কথা বলতে পারবে না ”

” জোর করে মোবাইল টা তার কাছে দিয়ে আসো, এহহ আসছে আমার নেতা মশাই, সব নেতা গিরি ছুটামু আমি, বাড়ি তে বউ রাইখা বাইরে গিয়ে নেতা গিরি করে ! লবন ছাড়া করল্লা কোথাকার! ”

পূর্ণার কথা গুলো কানে যেতেই তাহরিমের কাশি উঠে গেলো, কাশতে কাশতে পানির গ্লাস মুখে নিয়ে ইশারা করলো কুশন কে, মোবাইল রেখে বাইরে যেতে, বেচারা কে ইশারা করতে দেরি হলো কিন্তু মোবাইল রেখে দৌড় লাগাতে দেরি হয় নি! তাহরিম তার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল, কেন যে ছেলেটা পূর্ণা কে এত ভয় পায়!

মোবাইলের দিকে এক পলক তাকিয়ে সেটা কে কানে ধরলো, গম্ভীর কন্ঠে বলল,

” কি হয়েছে তোমার? এত বার কল করছো কেন হে? আমি না তোমাকে জ্বালায়? তাহলে আবার আমাকে ফোন করো কেন হে? ”

” আমি আমার জামাইকে ফোন দিসি, আমার দশটা না পাঁচ টা না একটা মাত্র জামাই! আমি ফোন দিলে আপনার কি? আপনার এতো জ্বলে ক্যা? আমার জামাইকে আমি জ্বালাবো! এহহহ আসছে আমার সাথে নেতা গিরি করতে! শুনুন মন্ত্রী সাহেব এই পূর্ণার সাথে নেতা গিরি করতে আসবে না, আমার একটা আর্টেক্যাল আপনার মন্ত্রী গিরি বের করবে কিন্তু ”

” তুমি কি কোন ভাবে আমাকে থ্রেট দিচ্ছো নাকি পূর্ণ? তুমি আমার মতো এতো ভালো আর নীতি বান মন্ত্রী কে থ্রেট দিচ্ছো! ”

” হুওও ধরতে পারেন থ্রেট, আপনি এখন বাসায় আসবেন ”

” আসবনা আমি ”

” আপনি আসবেন আর আসার সময় দুটা আইসক্রিম নিয়ে আসবেন ”

তাহরিম ভ্রু কুঁচকালো,

” দু’টা কেন? আমি আইসক্রিম খাবো না ”

” আমি কখন বললাম আপনার জন্য? দু’টা তো আমার জন্য ই, তাড়াতাড়ি আসেন ”

” পারব না, আসব না আমি কাজ আছে ”

” এখন আপনি না আসলে পরে আমাকেও বাসায় পাবেন না মনে রাইখেন ”

বলেই পূর্ণ ফোন কেটে দিলো,

তাহরিম কান থেকে ফোন নামিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলো,

পাগলি একটা..

চলবে…

ভালেবাসিবো খুব যতনে পর্ব-৩৯+৪০

0

#ভালেবাসিবো_খুব_যতনে
#Ayrah_Rahman
#part_39( সারপ্রাইজ)
_______________

” মন্ত্রী সাহেব, মন্ত্রী সাহেব আপনি কোথায়? মন্ত্রী সাহেব.. ”

নাহ কারো কোন শব্দ ই পাচ্ছি না,

ভীষন গরম লাগার কারণে গায়ের সাদা কোট টা খুলে রাখলাম,

অন্ধকারেই হেটে চলছি পুরো ঘরে, হঠাৎ হাতে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলাম, মনের মধ্যে ধীরে ধীরে যত বাজে চিন্তা এসে ভর করতে লাগলো।

স্পর্শ গুলো যেন আরও গাঢ় থেকে গাঢ় হতে লাগলো, নাকে এসে লাগলো অতিব পরিচিত ঘ্রান, গন্ধ টা চিনতে আমার বিন্দু মাত্র সমস্যা হলো না কারণ এই ঘ্রান মন্ত্রী সাহেব এর ছাড়া আর কারো নয়,

স্পর্শ গুলো যেন হাত ছেড়ে পেটে এসে থামলো, পেটের মাঝে আলতো হাতে স্লাইড করার জন্য আমার সারা শরীর যেন কাটা দিয়ে উঠলো, অসম্ভব রকমের কাঁপতে লাগলাম, সমস্ত শরীরের শক্তি যেন ধীরে ধীরে কমে আসছে, আমার পিছনেই কারো অস্তিত্ব টের পাচ্ছি, আমি খানিকটা পিছিয়ে যেতেই আমার পিঠ গিয়ে ঠেকলো উনার বুকে, উনার উষ্ণ নিশ্বাস আমার গলা ঘাড়ে আছড়ে পড়ছে,

আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম,

” মমমন্ত্রী সসসাহেব ককি করছেন টা কি? ”

উনি আমার কথার কোন রুপ উত্তর না করে এক হাতে ঘাড়ের চুল গুলো সরিয়ে গাঢ় ভাবে কিস করতেই আমার সমস্ত সত্তা কেঁপে উঠলো তৎক্ষনাৎ। বুঝতে পারছি না কি অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে আমার মাঝে! আমি আর ভর সামলাতে না পেরে নিজের শরীর পিছনে হেলিয়ে দিলাম যা বুঝতে পেরে মন্ত্রী সাহেব পাঁজা কোলে তুলে নিলেন,

” বউজান!! ”

উনার নেশাক্ত কন্ঠে কেঁপে উঠলাম আমি, উনার বুকে মাথা রেখে ধীরে ধীরে উত্তর দিলাম,

” হুম ”

” আজকের রাত টা শুধু আমার নামে করে দেবে কি বউজান?”

ভীষণ নেশাক্ত কন্ঠে কথা টা বললেন উনি, আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে এলো শীতল স্রোত, কেঁপে কেঁপে উঠলাম ক্ষণে ক্ষণে।

আমার নিরবতা যেন সম্মতির লক্ষন ভেবে নিয়ে মুচকি হেসে এগিয়ে গেলেন রুমের দিকে।

_______________

সকালের সূর্যের তীক্ষ্ণ রশ্মি চোখে মুখে আছড়ে পড়তেই পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালাম,

চোখ খুলতেই সামনে তাকিয়ে দেখি মন্ত্রী সাহেব আধশোয়া হয়ে এক মনে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে ই তাকিয়ে আছে, প্রথমত আমি খানিকটা ভয়ই পেয়ে গেলাম,

ভয় পাওয়ার নির্দিষ্ট কারণ ও আছে , সকাল সকাল ঘুম থেকে জেগেই যদি কেউ দেখে কেউ তার দিকে এভাবে ভুতের মতো তাকিয়ে আছে ভয় পাওয়া টা কি স্বাভাবিক নয়?

আমি উনার দিকে তাকালাম। কাল রাতের কথা মনে পড়তেই আমার মাঝে জেঁকে ধরলো এক ঝাঁক লজ্জা আর অস্বস্তি।

আমার অবস্থা বুঝতে পেরে উনি ঠোঁট কামড়ে হেসে আমার দিকে খানিকটা ঝুকে এসে বলল,

” বউজান, তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো? গাল দুটো কেমন ধীরে ধীরে স্ট্রবেরি হয়ে যাচ্ছে! ”

বলেই সরে এসে আমার দিকে তাকিয়ে আবারো হাসলেন,

আমার লজ্জা আর অস্বস্তির পরিমাণ টা যেন দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেলো,

আমি তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে মনে হলো গায়ে বেড সিট ছাড়া কিচ্ছু নেই, আর বেড সিট মন্ত্রী সাহেব পিছন দিকে টেনে ধরে আছে, আমি রাগী দৃষ্টি তে উনার দিকে তাকাতেই সুন্দর মতো বেডসিট টা ছেড়ে দিলেন,

আমি সোজা ওয়াসরুমে চলে আসলাম, বেসিনের আয়নার সামনে দাড়াতেই আমার চক্ষু চড়ক গাছ, গলায় বেশ অনেক জায়গা কালো হয়ে ফুলে গেছে, এবার আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে ,

কাঁদো কাঁদো দৃষ্টিতে নিজেকে একবার পর্যবেক্ষন করে নিলাম,

” মন্ত্রীর বাচ্চা মন্ত্রী, খচ্চর কোথাকার আমার শরীর টা যেন বার্গার পাইছিলো, কেমনে কামড়াইছে! আমি এখন বাইরে যামু কেমনে? সবার সামনে কিভাবে যামু আমি? কেউ যদি দেখে কি ভাববে! বান্দরের খালাতো ভাই কোথাকার!”

শরীরে পানি পড়তেই যেন সারা শরীর জ্বলে উঠলো, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম এই কামড়ের প্রতিশোধ যদি আমি না নিছি আমার নাম ও পূর্ণা না হুহ্।

গোসল শেষ করে বাইরে আসতেই নজরে এলো মন্ত্রী সাহেব এর ঘুমন্ত মুখ, আহ্ কি শান্তির ঘুম! বের করছি আপনার ঘুৃম!

আমি উনার সামনে গিয়ে ভালো ভাবে দেখলাম আসলে উনি ঘুমিয়ে ছে কি না।

হঠাৎ হাতের টান অনুভব করতেই কিছু বুঝে উঠার আগেই আমি সোজা পড়লাম উনার উপর,

মুখ তুলে উনার দিকে তাকাতেই নজরে এলো উনার মুখের বাঁকা হাসি।

” কি সুন্দরী লুকিয়ে লুকিয়ে এভাবে দেখার মানে কি? মানলাম আমি অনেক হ্যান্ডসাম তাই বলে এভাবে নজর দেওয়া কি ঠিক? ”

উনার কথা শুনে আমি মুখ বেকিয়ে বললাম,

” এহহ হ্যান্ডসাম না ছাই! শুনোন ফর্সা হলেই কেউ সুন্দর হয় না হুহ্, আসছে!..

উনি এক ভ্রু উঁচু করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

” তাই নাকি? আমি হ্যান্ডসাম না? ”

” না ”

” ওকে ঠিক আছে, এই অসুন্দর মানুষের সাথে ই আজকে সারাদিন এভাবে লেপ্টে থাকতে হবে ”

আমি চোখ বড়ো বড়ো করে বললাম,

” কিহহ?”

” তোমার শাস্তি”

” ঠিক আছে ঠিক আছে ছাড়ুন, আপনি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড হ্যান্ডসাম, ঠিক আছে ছাড়ুন এবার ”

” ছাড়বো? ”

” হুম ”

” ঠিক আছে ছাড়বো তার আগে গুড মর্নিং কিস টা দিয়ে দাও ”

আমি ভ্রু কুচকে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,

” কি দিবো? ”

” গুড মর্নিং কিস! ”

হঠাৎ মাথার মাঝে এক শয়তানি বুদ্ধি চেপে আসলো,

” ঠিক আছে, আপনি চোখ বন্ধ করেন ”

আমার কথা মতো উনিও সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেলল, আমি ও মুখ টা উনার গালের কাছে নিয়ে গিয়ে হুট করে একটা জোরে সরে কামড় বসিয়ে দিলাম,

হঠাৎ এমন হাওয়াতে উনি বেশ হকচকিয়ে উঠে হাত আলগা করে দিলেন আর আমি এই সুযোগে উঠে দাড়িয়ে সোজা দরজার বাইরে,

উনি তৎক্ষনাৎ শোয়া থেকে উঠে গালে হাত দিয়ে ভ্যাবলার মতো আমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো, উনি ঠিক বুঝতে পারছেন না এখানে হচ্ছে টা কি?

গালে চিনচিন ব্যথা অনুভুত হওয়াই উনি চোখ কুঁচকে ফেলল,

আয়নার সামনে গিয়ে দাড়িয়ে গাল থেকে হাত সরাতেই উনি নিজের লাল হয়ে যাওয়া গাল বিশিষ্ট মুখ টা দেখতে পেলেন,

মুখ খানিকটা কুঁচকে বিরবির করে বলতে লাগলো,

” হুয়াট দা হেল, এটা কি করলো? মুখটার বারোটা বাজিয়ে দিলো, আমি তো লাভ বাইট চাই নাই, কিস চাইছি, ও কি কানে কম শুনলো নাকি ইচ্ছে করে ই দিলো ”

উনি ফ্রেস হয়ে খাবার টেবিলে আসলেন, আমি তখন টেবিলে খাবার দিচ্ছি ,

আমি এক পলক উনার দিকে তাকালাম, বেচারার গালে দাঁতের দাগ অনেকটা গর্ত হয়ে কেটে গেছে আর ফুলেও আছে,

আমি মুচকি মুচকি হাসতে লাগলাম,
উনি আমার দিকে রাগী দৃষ্টি তে তাকিয়ে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো,

আমি উনার প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে ঠোঁট চেপে হেসে বললাম,

” ব্যথা কি বেশি করছে? আহারে একদম ফুলে গেছে ”

উনি শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো যা দেখে আমি শুকনো ঢুক গিলে বললাম,

” হে হে হে আমি তো যাস্ট বলতে চাইছিলাম, ব্যথা করলে ব্যথার ঔষধ খাবেন না কি? এভাবে তাকাবেন না তো ভয় লাগে তো ”

উনি অবাক হয়ে বললেন,

” তুমি ও ভয় পাও? ”

” কেন না পাওয়ার কি আছে আজব! ”

” না আমি আর ও ভাবছিলাম তুমি হয়তো হিটলারের বংশ ধর! ”

আমি রাগী দৃষ্টি তে তাকিয়ে বললাম,

” আমি হিটলারের বংশ ধর? ”

উনি খাবার মেখে আমার দিকে লোকমা দিতে দিতে বললেন,

” না না কে বলল তুমি শুধু হিটলারের বংশ ধর সাথে জঙ্গলি বিড়াল! ”

আমি লোকমা মুখে নিয়ে গাল ফুলিয়ে চিবুতে লাগলাম, আসলে এখন আমার ঝগড়া করার মুড নাই, খিদে পাইছে। আর উনি খাবার মেখে নিজেও খাচ্ছে আমাকে ও খাওয়াচ্ছে, বলতে গেলে এটা উনার প্রত্যাহিক অভ্যাস।

খাবার মেখে প্রথম লোকমা আমার মুখে দেবে, এবার হোক সেটা বাড়ি তে কিংবা অন্য কোথাও, আগে প্রচুর লজ্জা লাগলেও এখন সব স্বাভাবিক ই লাগে।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে উনি রুমে চলল এলেন, আমি টেবিলের সব কিছু গুছিয়ে রুমে আসতেই উনি আমাকে ডেকে উঠলেন,

” বউজান! ”

আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে উত্তর দিলাম,

” হুম ”

“তোমার নামে একটা বিজ্ঞপ্তি দিব !”

আমি ভ্রু কুচকে উনার দিকে ঘুরে তাকাতেই উনি মুচকি হেসে বলে উঠলেন,

” তাতে লিখা থাকবে ” এই মানুষ টিকে কেউ গ্রহন করবেন না, এই মানুষটা শুধু আমার ! আমার শুধু এই মানুষটাকেই লাগবে! এই মানুষটা ছাড়া আমি একদম একা , বড্ড অ’সহায় বউজান !”

আমি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম একান্ত আমার শুদ্ধতম শুভ্র পুরুষ টার দিকে, ভীষণ ভালোবাসি এই মানুষ টাকে আমি..

চলবে…

#ভালেবাসিবো_খুব_যতনে
#Ayrah_Rahman
#part_40
_________________

” মিস্টার রুদ্র তালুকদার! আপনি কি কিছু বলবেন নাকি এই ভর সন্ধ্যায় আমাকে সং সাজিয়ে বসিয়ে রাখার জন্য এখানে ডেকে এনেছেন? ”

রুদ্র নিজেকে প্রস্তুত করে ইলমীর দিকে তাকালো। আজ সে ভেবেই এসেছে আজ ইলমী কে তার মনের কথা বলবে কিন্তু কি দিয়ে শুরু করবে ঠিক ভেবে পাচ্ছে না। আজ সে নিজে থেকে ই একটা ক্যাফে বুক করে ইলমী কে আসতে বলেছে, কিন্তু এখন কোন কথায় সে বলতে পারছে না।

ইলমী আপাদমস্তক ভালো করে রুদ্র কে পর্যবেক্ষন করে নিলো, রুদ্র যে বেশ নার্ভাস সে বুঝতে পেরেছে।

মেয়েদের নাকি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বেশ একটিভ, কেউ তাকে পছন্দ করলে সেটা নাকি মেয়েরা চট করেই ধরে ফেলতে সক্ষম।

রুদ্র আমতাআমতা করে বলল,

” আআজকে ততোমাকে সুন্দর লাগছে ”

ইলমী ভ্রু কুঁচকে তাকালো নিজের দিকে আজ যে আহামরি কিছু পরে এসেছে তা কিন্তু না, সচরাচর যা পরে আজও তাই পরেছে একটা টপস আর জিন্স সাথে স্কার্ফ।

নিজেকে পর্যবেক্ষন শেষে ভ্রু উচিয়ে বলল,

” আজ সুন্দর লাগছে তার মানে অন্য আর সব দিন সুন্দর লাগে না তাই তো? ”

রুদ্র চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো ইলমীর দিকে, সে তো এটা মিন করে কথা বলে নি তবে ইলু তো কথার উল্টো মিনিং বের করে ফেলল,

” আরে না না, আমি এটা বলি নি, আমি বলতে চেয়েছি তোমাকে সবসময় ই সুন্দর লাগে আজ কমপ্লিমেন্ট টা করলাম আর কি! ”

” হুম, বাট আপনি নিশ্চয়ই এটা বলতে আজ আমাকে ডাকেন নি, কি বলতে ডেকেছেন সেটা বলেন ”

রুদ্র আমতাআমতা করে বলল,

” আআসলে ইলমী.. ”

ইলমী ভ্রু কুঁচকে বলল,

” আসলে নকলে না করে তাড়াতাড়ি বলে দেন কি বলবেন ”

” আই থিংক.. ”

” ইউ থিংক? ”

” ইলমী আই থিংক আই লাভ ইউ ”

ইলমী পরিপ্রেক্ষিতে কোন রিয়েক্ট করলো না, সে ভেবেই রেখেছে রুদ্র তাকে এমন কোন কথায় বলবে।

রুদ্র উৎসুক দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে ইলুর দিকে, হয়তো ইলু কিছু বলবে কিন্তু তার আশায় এক বালতি পঁচা পানি ঢেলে দিয়ে ইলু হুট করে দাড়িয়ে বলল,

” আমি আজ আসি ”

বলেই ইলু গটগট পায়ে বের হয়ে আসতে লাগলো, ইলুর পিছনে পিছনে রুদ্র ছুট লাগালো,

” এই ইলমী শোনো, উত্তর তো দিয়ে যাও! ”

রুদ্র ইলমীর পথ আটকে দাঁড়ালো, ইলমী ভ্রু কুচকে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল,

” কি সমস্যা? পথ আটকাচ্ছেন কেন? ”

” তুমি আমার কথার উত্তর না দিয়ে চলে যাচ্ছো কেন? ”

” আপনি কি এমন বলেছেন যে আমাকে তার উত্তর দিতে হবে? ”

” ওই যে বললাম, আই লাভ ইউ! ”

ইলু দীর্ঘ শ্বাস ফেলে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল,

” যেই ছেলে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করতেই মাস পেরিয়ে যায়, সামান্য ভালোবাসি কথা টা মুখ দিয়ে বের করতে এতো নার্ভাসনেস, এতো সংকোচ! সেই ছেলের সাথে আমি রিলেশনে জড়াবো না, আর তাকে তো মোটেও ভালোবাসব না, যান তো “.

রুদ্র অসহায় দৃষ্টি তে ইলমীর দিকে তাকালো, সে তো চেষ্টা করেছে কিন্তু এতো নার্ভাস লাগে যা বলার বাহিরে, অন্য সব কাজ সে একা হাতেই সামাল দিতে পারে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই ভালোবাসা থেকে সেটা প্রকাশ করা সত্যি ই খুব কঠিন।

ইলু রুদ্র কে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো রুদ্র মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো আসলে ইলুর করা প্রশ্নের একটার ও কোন উত্তর নেই তার কাছে,

রুদ্র আনমনে হাটতে হাটতে পাশেই একটা পার্কের বেঞ্চিতে বসলো গিয়ে, দৃষ্টি তার এখনো মাটিতেই নিবদ্ধ, হঠাৎ কেউ তার পাশে বসে মুখের সামনে পানির বোতল ধরতেই চমকে উঠলো সে,

ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকাতেই দেখতে পেলো ইলুর রাগে লাল হয়ে যাওয়া মুখ খানি।

” একটা মানুষ কতটা হাঁদারাম হলে নিজের ভালোবাসার মানুষ রাগ করে চলে গেলে দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে সেটা দেখে? ”

রুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালো ইলমীর দিকে, ইলমী কি তাকে ইনসাল্ট করছে?

” এই মেয়ে তুমি কি আমাকে অপমান করছো? ”

ইলু চোখ দুটো ছোট ছোট করে বলল,

” অপমান কোথায় করলাম? যাই হোক পানি টা খান ”

” তুমি না চলে গিয়েছিলে? ”

ইলমী ভ্রু কুচকালো,

” এখন কি আবার চলে যাবো? ”

রুদ্র বাচ্চাদের মতো মাথা ঝাকিয়ে বলে উঠলো,

” না নাহ্ ”

ইলমী রুদ্রের দিকে আরোও চেপে বসলো,

” আপনি কি ছোট বেলা থেকে ই এমন? ”

” কেমন? ”

” কিছু না ”

” আমার উত্তর কিন্তু দিলে না তুমি! ”

ইলমী ঠোঁট এলিয়ে হাসলো,

” কেন আপনি বোঝেন না? মেয়েদের নিরবতাই সম্মতির লক্ষণ ”

রুদ্র ইলমীর হাত চেপে ধরে হাসলো।

_________________________

” মন্ত্রী সাহেব? ”

” হুম বলো ”

” একটা কথা বলব? ”

” হুম বলো এতে আবার অনুমতি নেবার কি আছে? ”

” রাজনীতি ছেড়ে দিলে হয় না, বাবার সাথে ব্যবসা দেখা শুনা করবেন! ”

তাহরিম মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকালো।

বিছানায় হেলান দিয়ে উনি ফোন ঘাটছিলেন, মোবাইল টাকে বিছানায় ছুড়ে দিয়ে আমাকে টেনে বিছানায় বসিয়ে বলল,

” হঠাৎ এই কথা? ”

আমি ঠোঁট ভিজিয়ে বলতে লাগলাম,

” না মানে আমি এটা বলতে চাচ্ছি যে রাজনীতি জিনিস টা আমার কাছে কখনোই ভালো লাগে নি। রাজনৈতিক কারণে মানুষ পাখির মতো মানুষ মারে, এদের ভেতরে দয়া ভালোবাসা কিছু নেই আছে শুধু প্রতিহিংসা। আপনি রাজনীতি ছেড়ে দেন ”

আমার কথা শুনে উনি হাসলেন মনে হলো আমার কথা শুনে উনি মজা পেলেন,

আমাকে টেনে উনার কাছে নিয়ে মাথাটা উনার বুকে রাখতেই আমার মাথায় বিলি কাটতে কাটতে বলল,

” উহুম তোমার ধারণা ভুল রাজনীতি মোটেও খারাপ না। রাজনীতি তখনই খারাপ হবে সেটা যদি তুমি খারাপ কোন কাজে তা ব্যবহার করো।আর কে বলেছে রাজনীতিবীদদের মনে ভালোবাসা নেই? এই যে আমার কথাই দেখো না! আমি আমার বউজানকে কত্ত ভালোবাসি! ”

আমি কিছু বললাম না চুপচাপ মাথা এলিয়ে শুয়ে রইলাম উনার বুকে।

হঠাৎ আমার ফোন টা বেজে উঠতেই আমি তড়িঘড়ি করে উঠে বসলাম, উনি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,

” কি হয়েছে? ফোন ই তো বাজছে ট্রেন ছেড়ে দেয় নি তো! ”

আমি মোবাইল খুজতে খুজতে বললাম,

” কোন জরুরি দরকার ও তো থাকতে পারে ”

উনি কিছু বললেন না, আমি মোবাইল টা বের করে স্ক্রিনে তাকাতেই ভ্রু কুঁচকে গেলো। ফোনটা তৎক্ষনাৎ কেটে দিয়ে সোজা ফোন সাইলেন্ট করে আবার উনার বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম।

উনি চোখ ছোট ছোট করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

” কি হলো এটা? ”

” কি হলো? ”

” আমিও তো সেটাই জিজ্ঞেস করলাম কি হলো? ফোন রিসিভ করলে না কেন? ”

” ইম্পর্টেন্ট কল তো তাই রিসিভ করলাম না, যা হোক কথা না বাড়িয়ে মাথায় বিলি কেটে দেন তো, ভালো লাগছিলো ”

” হ্যা সেটাই জামাইয়ের সেবা পেতে তো ভালোই লাগে তাই না? ”

আমি চোখ বন্ধ করে ই মুচকি হেসে বললাম,

” হুম সেটাই ”

” তোমার গর্ব করা উচিত পূর্ণ! ”

আমি ফট করে ই চোখ খুলে ঘাড় উচিয়ে উনার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললাম,

” কেন? ”

” এই যে তোমার স্বামী তোমাকে কত ভালোবাসে! এতো বড় নাম করা মন্ত্রী হয়েও বউয়ের মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে, বউয়ের সব কথা মনোযোগ সহকারে শুনে!”

” হুম পরে? ”

” কিন্তু দুঃখ একটাই, আমার বউটা আমাকে ভালোবাসে ও না, ভালেবাসি বলেও না! ”

আমি মুচকি হাসলাম,

বুঝলেন জামাইজান, আপনাকে ভালোবাসতে আমার সাত জনমের দরকার নেই, আমার এই এক জনমেই আমি আপনাকে ভালোবেসে যেতে চাই”

চলবে,,