প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-০৪

0
347

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-০৪
______________
নিজের রুমের বিছানায় বসে আছে রাগান্বিতা। তার সামনেই খাটের ওপর পড়ে আছে তখনকার চিঠিটা। রাগান্বিতা বুঝচ্ছে না পর পর দু’দিন তার সাথে এসব হচ্ছে টাকি এমন চিঠিগুলো সব পাঠাচ্ছে কে? যে পাঠাচ্ছে সে কি তাকে চিনে? জেনেশুনেই এসব পাঠাচ্ছে কি? কিন্তু রাগান্বিতার কেন কাউকে মনে হচ্ছে না এসব সে পাঠাতে পারে। কে হতে পারে যে তাকে এসব পাঠাচ্ছে? নানান প্রশ্ন রাগান্বিতার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কিন্তু উত্তর যেন কোনোভাবেই মিলছে না। রাগান্বিতা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো রুমে মধ্যে পায়চারি করতে লাগলো বারংবার। হঠাৎই ইমতিয়াজের ফেসটা ভেসে আসলো সামনে রাগান্বিতা ভাবলো তার বাবাকে বোধহয় এই ছেলেটার কথা বলা উচিত সাথে কালকের ওই সন্ধ্যাবেলা তার জঙ্গলে যাওয়ার বিষয়টাও। এই ইমতিয়াজ ছেলেটাও কেমন যেন অদ্ভুত। কিছু জিজ্ঞেস করলে ঠিক ভাবে উত্তর দেয় না খাপছাড়া টাইপের। তবে ছেলেটার হাসি। না চাইতেও আনমনে হেঁসে ফেললো রাগান্বিতা। পরক্ষণেই নিজের মুডটা ঠিক করলো সে, বিড় বিড় করে বললো,
“এসব কি ভাবছিস রাগান্বিতা?’

হঠাৎই বাহিরে সোরগোল শোনা গেল? রাগান্বিতা চমকে উঠলো আবার। পলক ফেলে বললো,
“আবার কি হলো?”

রেজওয়ানের মাথা ফেটে গেছে। মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে অনেক। রাগান্বিতা ভাইয়ের এমন অবস্থা দেখে দৌড়ে আসলো। হতভম্ব কণ্ঠে বললো,
“দাদাভাই এসব কি করে হলো?”

রেজওয়ান আশেপাশে তাকিয়ে বললো,
“পড়ে গিয়েছিলাম।”

রেজওয়ানের কথার মাঝেই গ্রামের একজন লোক তালিবুল ইসলাম বললো,
“আমি ক্ষেতের জমিতে চাষ করতাছিল হঠাৎ দেহি রেজওয়ান সাহেব মাথায় হাত দিয়া কেমন যেন ঝিমাইতে ঝিমাইতে হাঁটতাছিল একটু ভালোভাবে তাকাইতেই দেহি মাথা দিয়া রক্ত পড়তাছে তাই হয়ালে নিয়া আইলাম।”

তালিবুলের কথা শুনে রাগান্বিতাও কৃতজ্ঞতার সাথে জানালেন,
“আপনায় ধন্যবাদ চাচা।”
“ঠিক আছে আমি তাইলে যাই এহন।”
“জি চাচা।’

তালিবুল চলে গেলেন সাথে আরো দু’চারজন লোকও। সবাই যেতেই রাগান্বিতা রেজওয়ানকে ধরে ধীরে ধীরে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেল। বললো,
“খুব ব্যাথা পেয়েছো তাই না দাদাভাই?”

রেজওয়ান মাথায় হাত রেখে বলে,
“একটু।”

রেজওয়ানকে তার রুমে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল রাগান্বিতা তারপর আতিবকে পাঠালো ডাক্তারকে আনানোর জন্য। ডাক্তার আসার আগে একটা কাপড় আর পানি নিয়ে দ্রুত ভাইয়ের রুমে আসলো রাগান্বিতা। রেজওয়ান তখনও মাথায় হাত দিয়ে বসা ছিল বিছানায়। রাগান্বিতা এগিয়ে এসে বসলো তার ভাইয়ের পাশ দিয়ে। বললো,
“এবার সত্যি করে বলো তো দাদাভাই এসব কি করে হলো?”

রেজওয়ান তার বোনের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি সত্যিই পড়ে গেছিলাম।”
“আমায় মিথ্যা বোঝাতে এসো না দাদাভাই তাড়াতাড়ি বলো কি করে হলো? কারো সাথে মারপিট করেছো?”

উত্তরে ‘না’ বোধক মাথায় নাড়ায় রেজওয়ান। ভাইয়ের উত্তর পেয়ে রাগান্বিতা আস্তে করে কপাল থেকে ভাইয়ের হাতটা ছাড়িয়ে আনে। বেশ জায়গা দিয়ে কেটে গেছে কপালের বামদিকটা। রাগান্বিতা আঘাতের অংশটুকু ছেড়ে তার আশপাশের জায়গাটা ধীরে ধীরে পানি দিয়ে পরিষ্কার করতে থাকে। হাতে লেগে থাকা রক্তটুকুও মুছতে মুছতে বলে,
“তাহলে কি হয়েছিল বলো আমায় এতটা কপাল কাটলো কি করে?”

এবার রেজওয়ান বলতে লাগলো,
“আমি বাড়িই ফিরছিলাম। আমাদের বাড়ির ওই পিছনের দিকটায় জামতলা ছাড়িয়ে ওই দূরে একটা পুকুর আছে না ওখানে আমি আর রানা আড্ডা দিচ্ছিলাম। পরে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে বাড়ির পথে আসছিলাম তুই তো জানিস রানাদের বাড়ি পুকুরটার ডানদিকে আর আমাদের বা’দিকে তাই ও ওদের বাড়ির দিকে যাচ্ছিল আর আমি আমাদের বাড়ির দিকে। আমি পুকুরটা পেরিয়ে কেবল জামগাছতলার ওদিকটায় আসলাম তখনই আচমকা কে যেন এসে আমার মাথায় আঘাত করলো আমি কিছু বুঝে ওঠার আগে পালিয়েও গেল আমি শুধু ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা দেখেছি একটা কালো রঙের চাদর পড়া ছিল মানুষটা এর বেশি কিছু দেখি নি। তবে এতটুকু বুঝেছিলাম আমাকে মারার ইচ্ছে ছিল না শুধু ওই একটা বারি দিয়েই চলে গেছে।”

রাগান্বিতা ভেবে পেল না এমনটা কে করতে পারে? রাগান্বিতা খুব কঠোর কণ্ঠে বললো,
“তুমি এর আগে কারো সাথে ঝগড়া করছিলে দাদাভাই?”
“না আমার নগদে কারো সাথেই ঝগড়া হয় নি। আর তুই জানিস আমি এতদিন শহরে ছিলাম তাহলে ঝগড়া হবে কার সাথে।”

ভাইয়ের কথা শুনে রাগান্বিতা অনেকক্ষণ ভেবে বললো,
“তাহলে মারলো কে?”
“সেটাই তো বুঝচ্ছি না।”

রাগান্বিতা খুব আপসেটের সঙ্গে বললো,
“কিছুদিন যাবৎ আমাদের সাথে কিসব ঘটছে দাদাভাই? বুবুটা মারা গেল, মুরতাসিনও খুন হলো আবার তোমায় কেউ মারলো এগুলো করছে কে?”
“আরে তুুই বেশি ভাবছিস কুহুর মৃত্যুটায় তুই আপসেট তো তাই এসব ভাবছিস আর মুরতাসিনের সাথে তো আমাদের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই।”

রাগান্বিতা কিছু বলে না। তবে মনে মনে আওড়ালো,
“তোমায় সবটা বলতে পারছি না দাদাভাই। গত দুইদিন যাবৎ সবকিছুই কেমন এলেমেলো হচ্ছে তিনটে চিঠি, মুরতাসিনের মৃত্যু আর নতুন ওই ছেলেটার আগমন সবকিছুই আমার কেমন যেন লাগছে দাদাভাই।”

রাগান্বিতার ভাবনার মাঝেই রেজওয়ান বললো,
“কি ভাবছিস?”
“আচ্ছা দাদাভাই আমাদের কি কোনোকালে কোনো শত্রু ছিল?”

রেজওয়ান খানিকক্ষণ চুপ রইলো রাগান্বিতার কথা শুনে। একটু ভেবে বললো,
“এসব তো জানি না।”

রাগান্বিতা আর কিছু বলে না। এরই মাঝে আতিব হাজির হলো ডাক্তারকে নিয়ে। ডাক্তার আসতেই রাগান্বিতা সরে গিয়ে দাঁড়ালো সাইডে। আর ডাক্তার দেখতে লাগলো রেজওয়ানকে।
——

রাত সাড়ে আটটা! আকাশ জুড়ে কেমন যেন ধূসর রঙের মেঘ বইছিল। বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে ছিল রাগান্বিতার বাবা। উনি কিছু ভাবছিলেন। গত সাতদিন থেকে তার বাড়ি থেকে বোধহয় শোকের ছায়া যাচ্ছেই না। আজ আবার ছেলেটা আঘাত পেল। রাগান্বিতার মা নেই। রাগান্বিতা যখন খুব ছোট ছিল তখনই মারা যায়। রাগান্বিতার বাবা সেই থেকে তিন ছেলেমেয়ে নিয়েই আছেন। ছেলেমেয়েদের অভাব তিনি কখনোই বুঝতে দেয় নি। ছেলেটাকে শহরে পাঠিয়ে পড়াশোনা করাচ্ছেন, কুহু মেয়েটা শান্তসৃষ্ট আর ভীতু টাইপের থাকায় শহরে রাখার কথা কখনোই ভাবে নি রাগান্বিতার বাবা। তবে রাগান্বিতাকে নিয়ে ভেবেছিলেন। মেয়েকে উকিল বানানোর তার একটা ইচ্ছে ছিল অবশ্য ছিল বললে ভুল হবে এখনো আছে। ‘মেয়েদের বেশি পড়াশোনা করতে নেই’ এই চিন্তাধারা থেকে সবসময়ই বিরত থাকতেন রাগান্বিতার বাবা। তিনি চান রাগান্বিতাকেও তার চিন্তা ধারার মতো একজন পুরুষের হাতে তুলে দিতে। যে তাকে পড়াশোনা করিয়ে উকিল বানানোর স্বপ্নটা পূরণ করবে। কিন্তু কুহুর মৃত্যুতে যেন সবটা এলেমেলো হয়ে গেল। কেমন যেন খাপছাড়া লাগছে সবটা। তার মনে হচ্ছে সে বুঝি তার সন্তানদের ওপর তার ইচ্ছেগুলো চাপিয়ে দিতে চাইছেন জোর করে। কুহুর বিয়ে ঠিক হয়েছিল। মেয়েটা বিয়েতে রাজি ছিল কি না রাগান্বিতার বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন কুহুও বলেছিল রাজি সে। কিন্তু হঠাৎ কি হলো যে মেয়েটা বিষ খেল এটাই বুঝলো না রাগান্বিতার বাবা। মেয়েটা যদি একবার মুখ ফুটে তার সমস্যার কথা জানাতো তবে হয়তো রাগান্বিতার বাবা তার নিজের সবটা দিয়ে সেই সমস্যার সমাধান করতেন। বিয়ে ভাঙার কথা বললেও মেনে নিতেন নিরদ্বিধায়।“কিন্তু মেয়েটা কি করলো?”

রাগান্বিতার বাবার চোখ ভেসে উঠলেন চোখের কোনে পানি জমেছে তার। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলো রাগান্বিতা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনুমতি চাইলো তার বাবার থেকে। বললো,
“বাবা আসবো?”

রাগান্বিতার বাবা দ্রুত তার চোখ মুছে নিলেন। বললেন,
“হুম আয়।”

রাগান্বিতা এগিয়ে গেল তার বাবার কাছে বেশি না ভেবেই বাবার পায়ের কাছে বসে বললো,
“তুমি কাঁদছিলে তাই না বাবা?”

রাগান্বিতার বাবা শুঁকনো হাসলেন। বললেন,
“না তো। চোখে কি যেন একটা পড়েছে।”

রাগান্বিতা বাবার হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
“বুবুকে নিয়ে খুব ভাবছো। তাই না বাবা?”

এবার খানিকটা নরম হলেন রাগান্বিতার বাবা। বললেন,
“তোর বুবুকে বোধহয় আমি খুব একটা ভালোবাসতাম না তাই না রাগান্বিতা?”

রাগান্বিতা অবাক স্বরে বললো,
“এসব কি বলছো বাবা? তুমি তো আমাদের দুই ভাইয়ের থেকে বুবুকে সব চেয়ে বেশি ভালোবাসতে।”
“বাসতাম তাই না। আচ্ছা তোর বুবুটার মনে কি কোনো কষ্ট ছিল রে রাগান্বিতা যার জন্য এমন করে চলে গেল।”

রাগান্বিতার কষ্ট লাগলো। চোখ ভেসে উঠছে তার। রাগান্বিতা নিজেকে সামলালো। বললো,
“আমি সত্যি জানি না বাবা বুবু এমনটা কেন করলো?”

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রাগান্বিতার বাবা। বললেন,
“যাক বাদ দে। রাতে খেয়েছিস?”
“তুমি না খেলে কি করে খাই বাবা।”
“আচ্ছা তোকে আর রেজওয়ানকে আজ আমি নিজ হাতে খাইয়ে দিবো কেমন।”
“ঠিক আছে বাবা।”

কিছুক্ষণের নীরবতা চললো দুজনের মাঝে। হঠাৎই রাগান্বিতা বললো,
“তোমায় কিছু বলার ছিল বাবা হয়তো আগেই জানানো উচিত ছিল কিন্তু সুযোগ আর পরিস্থিতির অভাবে বলা হয় নি।”

রাগান্বিতার বাবা মেয়ের দিকে তাকালেন। বললেন,
“কি কথা?”

রাগান্বিতা কিছুটা সময় নিয়ে বললো,
“আসলে হয়েছিল কি বাবা কাল সন্ধ্যার দিকে আমি আনমনেই বুবুর কথা ভাবতে ভাবতে জঙ্গলের দিকে চলে যাই। তখনই ওই বটগাছটার নিচে একটা ছেলে বাঁশি বাজাতে ছিল। তখন আমি এগিয়ে গিয়ে,

এই বলে কালকের সব ঘটনা খুলে বললো রাগান্বিতা তার বাবাকে। রাগান্বিতার বাবাও মন দিয়ে সবটা শুনলেন। একটু গম্ভীর আওয়াজে বললেন,
“ছেলেটার নাম কি?”

দ্রুত জবাব রাগান্বিতার,
“ইমতিয়াজ বাবা, ইমতিয়াজ সিকদার।”
—–

ভোরের ফুড়ফুড়ে আমেজ। নিমগাছের ডাল দিয়ে পুকুরপাড়ে বসে দাঁত মাজছিল ইমতিয়াজ। এমন সময় তার কাছে দৌড়ে আসলো ছোট্ট একটা পিচ্চি ছেলে নাম মোকলেস। ও দৌড়ে এসে বললো,
“ইমতিয়াজ ভাই আমেনেরে জমিদার সাহেব হয়ালে তাগো বাড়ি যাইতে কইছে।”

মোকলেসের কথা শুনে ইমতিয়াজ মোটেও অবাক হয় নি। বোধহয় সে জানতো তাকে ডাকা হবে। ইমতিয়াজ কি ভেবে যেন এক রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বললো,
“ঠিক আছে।”

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে