প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-০২

0
387

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-০২
_________________
অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাগান্বিতা চিঠিটার দিকে। এটা কেমন চিঠি ছিল? আর লিখলোই বা কে? কোনো নাম তো লেখা নেই। রাগান্বিতা চিঠিটার এদিক ওদিক নাড়িয়ে দেখলো কিন্তু তেমন কিছুই লেখা মিললো না। হঠাৎই কিসের যেন একটা সুর রাগান্বিতার কানে বেজে উঠলো কেউ কি বাঁশি বাজাচ্ছে। সময়টা তখন প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে নিভু নিভু অন্ধকার নামছে চারপাশে। বাঁশির সুর সামনের কোথা থেকেই যেন আসছে এই সন্ধ্যাবেলার অসময়ে বাঁশি বাজাচ্ছে কে? রাগান্বিতা কৌতুহলী চিঠিটা হাতে নিয়েই এগিয়ে গেল সামনে। সে সামনে যত এগোচ্ছে বাঁশির সুরটা যেন ততই মিষ্টি মধুর আর খুব নিকটে শোনাচ্ছে। রাগান্বিতা এগিয়ে আসতেই আশপাশের থমথমে প্রকৃতিটা নড়েচড়ে উঠলো বাতাস বইলো হঠাৎ। রাগান্বিতা এগিয়ে আসতে আসতে তার দেখা মিললো খানিকটা জঙ্গলের মতো ঘেরা জায়গা একটা। রাগান্বিতাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে বনজঙ্গলের মধ্যে ঘেরা সবচেয়ে বিশাল গাছটার কাছে কেউ বসে আছে। সেখান থেকেই বাঁশির সুরটা আসছে। রাগান্বিতা আওয়াজ করলো। শক্তপক্ত কণ্ঠে বললো,
“কে! কে ওখানে?”

প্রথমে উত্তর মিললো না। শুঁকনো পাতার উপর দিয়ে যাওয়ায় খচখচ শব্দ করে আওয়াজ করলো রাগান্বিতা। ইচ্ছেকৃত নয় তার হেঁটে যাওয়ার জন্য শব্দ হয়েছিল মাত্র। রাগান্বিতা আবার বললো,
“এই ভর সন্ধ্যাবেলা বাঁশি বাজাচ্ছেন কেন?”

এবার যেন উত্তর আসলো। বাঁশি বাজানো বন্ধ হলো। এক অনাকাঙ্ক্ষিত পুরুষয়ালী ভাড়ি কণ্ঠে সুধালো কেউ,
“কেন এই গ্রামে কি কেউ এই সময় বাঁশি বাজায় না।”

প্রতিউত্তরে খুব দ্রুত জবাব রাগান্বিতার,
“না বাজায় না। কে আপনি?”

মানুষটা এবার বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। গায়ে জড়ানো পাতলা চাদর তার ভিতর টিশার্ট, কালো জিন্স, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, হাল্কা ফর্সা গায়ের রঙ, মাথায় ভর্তি সিল্কি চুল। রাগান্বিতা ছেলেটিকে দেখেই দ্রুত প্রশ্ন করলো,
“কে আপনি? আগে তো এই গ্রামের কখনো দেখি নি।”

এক গাল মিষ্টি হাসি দেয় ছেলেটি। দু’পা এগোতে এগোতে বলে,
“আমি ইমতিয়াজ, ইমতিয়াজ সিকদার।”
“তো এখানে কি করছেন?”
“কিছু করছি না তো আমি শহরে থাকি কিছুদিনের জন্য গ্রামের বাড়ি ঘুরতে এসেছি।”
“আপনার গ্রামের বাড়ি এইটা।”
“হবে হয়তো।”
“মানে?”
“সব মানের যে উত্তর খুঁজতে নেই রাগান্বিতা।”

এবার যেন রাগান্বিতা খানিকটা অবাক হলো। দু’বার পর পর পলক ফেলে বললো,
“আপনি আমার নাম জানেন?”
“হুম জানি তো এই রেশবপুরের এমন মানুষ আছে নাকি যে জমিদার বাড়ির দুই কন্যাকে কেউ চেনে না। আপনি তো ছোটজন তাই না।”

রাগান্বিতা জবাব দেয় না। উল্টো প্রশ্ন করে,
“আপনি এই গ্রামেরই?”
“হয়তো।”
“আপনি কি এই ভর সন্ধ্যাবেলা আমার সাথে মসকরা করছেন? হয়তো, হবে এসব বলে।”

উচ্চস্বরে হাসে ইমতিয়াজ। রাগান্বিতাকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে খুব স্বল্প স্বরে বলে,
“আবার দেখা হবে।”

ইমতিয়াজ চলে যায় দিয়ে যায় এক রহস্যময়ী হাসি। রাগান্বিতা বেশ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ছেলেটা এভাবে বললো কেন? রাগান্বিতার ভাবনার মাঝেই ইমতিয়াজ যেতে যেতে আবার বললো,
“সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে এখনই আযানের ধ্বনি আসবে দ্রুত বাড়ি যান। আপনি হয়তো জানেন এই জায়গাটা খুব একটা ভালো না।”

রাগান্বিতা পিছন ঘুরলো কিন্তু ইমতিয়াজ দাঁড়ায় নি কথাটা বলেই চলে গেছে। রাগান্বিতাও আর দাঁড়ালো না হাতের চিঠিটায় আর একবার দৃষ্টি দিয়েই চলে গেল। চারপাশ তখন সন্ধ্যার নিভু নিভু আঁধারে পারি জমাচ্ছে আচমকা একটা গাছ বেয়ে কি যেন পড়লো, কাঠবিড়ালি বোধহয়। আযান দিলো, সন্ধ্যা হলো। নামাজের উদ্দেশ্যে পুরুষরা মসজিদে আর মহিলারা ঘরে জায়নামাজের পাটি বিছালো।
___

রাত আটটা। নিজের পড়ার টেবিলে বসে আছে রাগান্বিতা হাতে তার বিকালের আসা সেই চিঠিটা। কে লিখেছে, কেন লিখেছে, তাকেই কেন দিয়েছে, সে কি এই চিঠি দাতাকে চিনে নানান কিছু মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে রাগান্বিতার। তার ওপর কুহুর মৃত্যু। কুহুর বিয়ে ঠিক হয়েছিল। সব ঠিক থাকলে ঠিক দু’দিন আগেই কুহুর বিয়েটা হয়ে যেত আজ সে শশুর বাড়ি থাকতো কিন্তু এখন কোথায় আছে আপাটা। রাগান্বিতা জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার বোনটা কি এই বিয়েতে রাজি ছিল না তাই বিষ খেয়েছিল কিন্তু সে যখন কুহুকে জিজ্ঞেস করেছিল তখন তো তার আপা খুশি ছিল। ছেলেও নাকি পছন্দ হয়েছিল। তাহলে?’

রাগান্বিতা নানা কিছু ভাবতে থাকলো কিন্তু সব কথার মাঝের শেষে গিয়ে একটা কিন্তু রয়েই গেল। বোনটার বিষ খাওয়ার তেমন কোনো কারণই পাচ্ছে না রাগান্বিতা। রাগান্বিতা যখন এসব ভাবছিল সেই মুহূর্তে তার জানালার কাছে এসে কে যেন চেঁচাচ্ছিল৷ রাগান্বিতা খানিকটা চমকে উঠলো এতে দ্রুত টেবিল থেকে সরে কৌতুহলী জানালার কাছে ছুটে গেল দেখলো তার জানালার পাশে একটা পায়রা এসেছে। রাগান্বিতার কক্ষের জানালা হাল্কা ভিড়ানো ছিল বিধায় ভিতরে ঢুকতে পারছিল না। রাগান্বিতা তার কক্ষের জানালা হাল্কা খুলে দিল সঙ্গে সঙ্গে পায়রাটা ভিতরে ঢুকে ছুট্টে গিয়ে বসলো রাগান্বিতার টেবিলটায়।

এক মুহূর্তের জন্য হলেও পায়রাটার হুট করে ভিতরে আসায় বেশ চমকে উঠে রাগান্বিতা। রাগান্বিতা এগিয়ে যায় পায়রাটার দিকে। মূলত পায়রাটা হলো একটা বার্তা পাঠানো পায়রা। রাগান্বিতা পায়রাটার পায়ের দিকে তাকালো। কিছু একটা নিয়ে এসেছে পায়রাটা। রাগান্বিতা ধীরে ধীরে পায়রাটাকে ধরে পায়ের সাথে আটকানো সুতাটা খুললো। একটা চিঠি পেল। রাগান্বিতা চিঠিটা পায়রার পা থেকে বের করতেই পায়রাটা ধারাম করে উড়ে গেল। আর থাকলো না। রাগান্বিতা পায়রাটার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে মনে মনে আওড়ালো,
“আবার চিঠি।”

রাগান্বিতা চিঠিটা খুললো। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলো। কারণ তাজা রক্তের গন্ধ পেয়েছে রাগান্বিতা। রাগান্বিতা ঘাবড়ে গিয়ে দু’পা পিছিয়ে যায়। তার সমস্ত শরীর ভয়ে কেঁপে ওঠে। এভাবে রক্তে মাখানো কাগজ কে পাঠালো তাকে। এরই মাঝে বাহির থেকে চেঁচানো আওয়াজ শোনা গেল খুন!খুন বলে কারা যেন চেচাচ্ছে!”

রাগান্বিতা চিঠিটার দিকে একপলক তাকিয়ে দ্রুত ছুটে গেল বাহিরে। শয়নকক্ষ থেকে তখনই বের হলো রাগান্বিতার বাবা আর ভাই রেজওয়ান। তারাও এগিয়ে যেতে লাগলো বাড়ির বাহিরে।’

জমিদার বাড়ির উঠানে ভিড় পড়েছে আবার। পাশের গ্রামের রমিজ উদ্দিনের ছেলে মুরতাসিন নাকি খুন হয়েছে? কে বা কারা যেন চাকুর আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে তার শরীর। রক্ত গড়াগড়ি খাচ্ছে জমিদার বাড়ির উঠানে। রাগান্বিতা বাড়ির সদর দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকলো, উঠানে নামলো রেজওয়ান আর তার বাবা। মোতালেব তালুকদার জিজ্ঞেস করলো,
“এসব কি করে হলো?”

মোতালেব তালুকদারের কথা শুনে একটা বুড়ো লোক এগিয়ে এসে বললো,
“তালুকদার সাহেব সন্ধ্যাহালেই মনে হয় এই ঘটনা ঘটছে ওই যে আমনেগো বাড়ির সামনের যে জঙ্গলডা আছে না হেয়ানে পোলাডারে কেডা যেন মাইরা থুইয়া গেছে।”
“লাশটা আগে দেখলো কে?”

একটা ছোট্ট বাচ্চা এগিয়ে এসে বললো,
“আমি দেখছি।”

সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কারণ ছেলেটা মিথ্যে কথা বলছে। দেখেছে ছেলেটির বাবা মিন্টু মিয়া। সবাই তাই জানে। মিন্টু মিয়া ছেলের মুখ চেপে ধরলো। বললো,
“তালুকদার সাথে ওর কথায় কিছু মনে কইরেন না। পোলাডা অনেক বদমাইশ হইছে। আমিই আগে দেখছি লাশটা।”

মোতালেব তালুকদার মিন্টুর প্রথম কথায় বেশি গুরুত্ব দিলেন না। পরের কথার প্রতিউত্তরে বললেন,
“তুমি ওই আটটা বাজে ওই জঙ্গলে কি করতে গেছিলা মিন্টু?”

মিন্টু ঢোগ গিলে বললো,
“আমার ছোট মাইয়াডা বিয়ালে ওদিকে গেছিল একখান জুতা হালাইয়া থুইয়া আইছিল। ওইডা খুঁজতেই গেছিলাম মাইয়াডা অনেক কানতে ছিল তাই বাধ্য হইয়া গেছিলাম তালুকদার সাহেব তহনই বড় বডগাছের লগে এই পোলাডারে দেখছি হেরপরই হগলডিরে ডাইক্কা আইন্না নিয়া আইলাম পোলাডারে,

মোতালেব কিছু বললো না এতে। অনেকক্ষণ ভেবে বললো,
“পোলার বাপেরে খবর দেছো কেহো?”

একজন এগিয়ে এসে বললো,
“হ তালুকদার সাহেব।”

এদিকে,
রাগান্বিতা ভাবছে অন্যকিছু মুরতাসিনরে কেউ কেন মারলো? আর তার কাছে আসা রক্তে ভেজা কাগজটা এটাও বা কে দিল! আচ্ছা দুইটা ঘটনার পিছনে একটা মানুষরই হাত আছে নাকি। রাগান্বিতা মনে করলো তখনকার কাগজটায় রক্ত দিয়ে কি লেখা ছিল। কিছুক্ষণ ভাবতেই মনে পড়লো সেখানে ছোট ছোট করে লেখা ছিল,

“সে নিষিদ্ধ ছিল।”

#চলবে…..

___________________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে