প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-০৬

0
367

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-০৬
__________________
“বুবু! রাগান্বিতা বুবু! উডো বুবু তুমার নামে চিডি আইছে, বুবু উডো জলদি ডাকপিয়ন ডাকতাছে বুবু উডো হয়ালে,

পর পর কয়েকবার রাগান্বিতার কানের কাছে ঝুঁকে কথাগুলো বলছে লুবনা। রাগান্বিতাদের গ্রামের একটা বাচ্চা মেয়ে। রাগান্বিতাকে অনেকই ভালোবাসে।

কতক্ষণ আগে ইমতিয়াজ চলে যাওয়ার পর নিজের রুমে এসে বিছানায় শুয়ে ইমতিয়াজের বলে যাওয়া কথাটা ভাবতে ভাবতে কখন যে রাগান্বিতার চোখ লেগে গিয়েছিল তাই বুঝতে পারে নি।রাগান্বিতা নড়ে চড়ে উঠলো, চোখ খুলে তাকাতেই সামনে লুবনাকে দেখে হতভম্ব হয়ে বললো,
“তুই এখানে?”
“বুবু উডো তুমার নামে চিডি আইছে ডাকপিয়ন ডাকতাছে।”
“চিঠি।”
“হ আমি তোমাগো বাড়ির উঠান দিয়া যাইতেছিলাম তহনই আইছে আমারে কইলো তুমারে ডাইকা আনতে তাই আইছি। বাড়িতে রেজওয়ান দাদাবাবুরে ছাড়া আর কাউরেই দেহি না।”

রাগান্বিতা উঠে বসলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“ঠিক আছে তুই যা আমি দেখছি।”
“আচ্ছা বুবু।”

বলেই লুবনা চলে গেল। আর রাগান্বিতাও বেশি না ভেবে দ্রুত উঠে চললো নিচে।

আজকে ডাকপিয়ন হিসেবে অন্য আরেকজন এসেছে গত দুই’দিন যে লোকটা এসেছিল সে আজ আসে নি। একটা মাঝ বয়সী ছেলে এসেছে। রাগান্বিতা খানিকটা বিচলিত মুখ নিয়ে এগিয়ে গেল ডাকপিয়নের সামনে সে যেতেই রাগান্বিতার দিকে খামে ভরা চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে শুদ্ধ ভাষায় বললো ডাকপিয়ন,
“আপনার নামে চিঠি এসেছে।”

রাগান্বিতা কিছুক্ষণ ডাকপিয়নের দিকে তাকিয়ে থেকে চিঠিটা নিলো। বললো,
“ধন্যবাদ।”

ডাকপিয়ন একটা ছোট্ট সই নিয়ে যেতে নিলো। রাগান্বিতা তাকে ডাকলো। বললো,
“আচ্ছা শুনুন,

ডাকপিয়ন দাঁড়িয়ে পড়লো। পিছন ঘুরে সাবলীল কণ্ঠে বললো,
“জি বলুন?”
“চিঠিটা কোথা থেকে আসছে এই সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?”

ডাকপিয়ন খানিকটা চমকালো কথাটা শুনে। অবাক স্বরে বললো,
“না। আমি তো খালি ডাকবাক্স থেকে নিয়ে আসি আর ঠিকানা মাফিক পৌঁছে দেই। তবে একটা অবাক করার বিষয় কি জানেন? আপনার চিঠিটা কোথা থেকে আসে তার ঠিকানা ওই চিঠিতে দেয়া নেই শুধু আপনাদের এই বাড়িটার ঠিকানাই দেয়া ছিল। বিষয়টা সত্যি অবাক জনক। যাইহোক আমার দেরি হচ্ছে। যেতে হবে আরো অনেক জায়গায় যেতে হবে তো।”

“ঠিক আছে। ধন্যবাদ আপনায়।”

ডাকপিয়ন আর কিছু না বলে চলে গেল। রাগান্বিতাও চিঠিটা হাতে নিয়ে ঢুকে গেল ভিতরে। কে যে দিচ্ছে চিঠিগুলো। এই গ্রামেরই নয়তো। আচ্ছা ডাকপিয়ন মিথ্যে বলছে না তো এমনও তো হতে পারে ঠিকানা দেয়া ছিল কিন্তু ডাকপিয়ন জানাতে চাইছে না। রাগান্বিতা তার মাথায় চাপড় মারলো কিসব ভাবছে ডাকপিয়ন ঠিকানা বলতে চাইবে না কেন অদ্ভুত? চিঠি পেয়ে পেয়ে মাথা পুরোপুরি বোধহয় গেছে রাগান্বিতার। রাগান্বিতা এসব ভাবতে ভাবতে সদর দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই তাকে আবার ডাকতে এলো লুবনা। বললো,
“বুবু, নদীর ওইপারে যাইবা শাপলা তুলতে?”

রাগান্বিতা দাঁড়িয়ে পড়লো। বললো,
“এখন।”
“হ আমি যামু তুমি আগের বার কইছিলা না শাপলা তুলতে গেলে তোমায় ডাকতে।”

রাগান্বিতা কতক্ষণ ভাবলো। বললো,
“ঠিক আছে তুই দাঁড়া আমি আসছি।”
“ঠিক আছে বুবু।”

রাগান্বিতা চলে গেল উপরে। রেজওয়ান নিজ রুমে ঘুমাচ্ছে। বাবা বারণ করেছে যতদিনে পুরোপুরি সুস্থ না হচ্ছে ততদিনে বাড়ির বাহিরে না যেতে। ঘড়িতে তখন প্রায় এগারোটা বাজে। রাগান্বিতার বাড়িতে একজন কাজের লোক আছে ওনার নাম মিলিতা বেগম বয়স উনপঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। রাগান্বিতা মাঝে মাঝে ওনাকে সুন্দরী দাদিমা বলে ডাকে। কিশোরী বয়সে মহিলাটি দেখতে খুব রূপবতী ছিলেন এখনও গায়ের রঙ পুরো দুধের মতো ফর্সা। ছোট বেলা থেকেই রাগান্বিতা,কুহু আর রেজওয়ানকে উনিই বড় করেছেন। অত্যাধিক ভালোবাসেন, তাই তো কুহুর মৃত্যুতে তিনি বড্ডই আঘাত পান। রাগান্বিতা চিঠিটা তার রুমে রেখে ছুঁটে যায় রন্ধনশালার দিকে মানে রান্নাঘরে দাদিমা তখন দুপুরের ভোজনের জন্য কাটাকাটি করছিলেন। বয়সটা বেশি হলেও দাদিমার হাতের রান্না এখনও দারুণ। রাগান্বিতা ওনায় কাজ করতে সবসময়ই সাহায্য করে। রাগান্বিতা এগিয়ে গেল দাদিমার দিকে। ওনার গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
“দাদিমা আমার না খুব শাপলা খেতে ইচ্ছে করছে।”

রাগান্বিতার কাজে মুচকি হেসে বললো,
“লুবনার লগে যাইবা কিন্তু তোমার বা’জানে যদি আইয়া পরে।”
“বাবা এখন আসবে না তুমি তো জানো বাবা রোজ যোহরের আযানের কতক্ষণ আগে বাড়ি আসে আমি তার আগেই চলে আসবো।”
“গ্রামের মানু তো ভালা না দুপার বেলা তোমারে দেখলে।”
“কেউ দেখবে না। আমি তাহলে যাই।”
“আমি মানা করলে তুমি হুনবা বুঝি।”

হাসে রাগান্বিতা। দাদিমার গালে একটা চুমু একে বলে,
“তুমি মানা করবা বুঝি।”

দাদিমাও হেঁসে ফেলে আজ অনেকদিন পর তিনি হাসলেন। রাগান্বিতা উঠে দাঁড়ালো। বললো,
“আমি তাড়াতাড়িই চলে আসবো তুমি চিন্তা করো না। আর রেজওয়ান দাদাভাইর ঘুম ভাঙলে ওরে কিছু খেতে দিও।”
“আচ্ছা ওসব তোমার ভাবোন লাগবো না।”

মুচকি হাসে রাগান্বিতা অতঃপর হাল্কা একটু তৈরি হয়ে সে চলে যায় লুবনার সাথে বাড়ির পিছন দিকের রাস্তা হয়ে জামতলা পেরিয়ে।
——

“বল তো মোকলেস এই গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরীর নারীর নাম কি?”

বৈঠা হাতে নৌকায় দাঁড়িয়ে থাকা ইমতিয়াজ কথাটা জিজ্ঞেস করলো মোকলেসকে। মোকলেস নৌকার একদম কর্নারে বসেই বলে উঠল,
“রাগান্বিতা আফা।”
“ওনার একটা বোন ছিল না।”
“হ কুহু আফায় উনিও সুন্দর ছিল জানো ইমতিয়াজ ভাই।”
“তাই বুঝি?”
“চোখ দুইডা কি সুন্দর ছিল খালি মায়া আর মায়া।”

ইমতিয়াজ হেঁসে ফেলে। বলে,
“মায়ার তুই কি বুঝিস রে?”

মোকলেস হাসে। বলে,
“গ্রামের হগলে কইতো তাই কইলাম।”

ইমতিয়াজ আবারও হাসে। মনে মনে আওড়ায়,
“রাগান্বিতার চেয়ে বেশি নয়।”

“ওই মোকলেস যাবি?”
আচমকা লুবনার কণ্ঠটা কানে আসতেই সামনে তাকালো ইমতিয়াজ। তার যেন বিশ্বাস হলো না রাগান্বিতা এসেছে। তাও সাজহীনভাবে। রাগান্বিতাকে এর আগে যতবার দেখেছে ইমতিয়াজ প্রতিবারই সাজসজ্জিতভাবে। সকালে যখন দেখেছিল তখনও সেজেগুজে ছিল। হাতে চুড়ি, গলায়,কানে গহনা, চোখে কাজল শাড়িটাও অন্যভাবে পড়তো। কিন্তু এখন একটা লাল রঙা কাপড় পড়েছে তাও গ্রামীণ স্টাইলে হাত গলা খালি দু’কানে শুধু ছোট্ট দুটো কানের দুল তবে কাজলটা আছে আর লাল রঙা ঠোঁট, খোপা করা চুল।খারাপ লাগছে না খুব একটা। সাধারণের মাঝেও অসাধারণ লাগছে তাকে।

এদিকে রাগান্বিতা দেখছে ইমতিয়াজকে। ছেলেটা লুঙ্গি আর ফতুয়া পড়েছে মাথায় গামছা বাঁধা চোখে চশমা নেই, মাথা ভর্তি এলেমেলো চুল, হাতে বৈঠা দেখতে পুরোই অন্যরকম লাগছে আর খাঁটি মাঝি বলে মনে হচ্ছে। এদের ভাবনার মাঝে মোকলেস লুবনাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“তুই আবার কোমনে যাবি?”
“ওইপারে যামু শাপলা আনতে।”
“ওরে বাবা সক কত হাপলা আনতে যাইবে তোরে নিমু না।”

এবার রাগান্বিতা বললো,
“নিবি না কেন তাড়াতাড়ি নৌকা চালা আমরা যাবো।”

কণ্ঠটা যেন রাগান্বিতা আফার মতো লাগলো। মোকলেস এবার ভালোমতো রাগান্বিতার দিকে তাকালো। চোখ বড় বড় করে বললো,
“আফা আমনেও যাইবেন?”
“হ এখন বেশি কথা না বলে দ্রুত চল।”
“আচ্ছা আহেন আফা।”

বলে নৌকা থেকে নামলো মোকলেস। ইমতিয়াজ নৌকার ওই মাথায় দাঁড়ানো। ইমতিয়াজ আর মোকলেস ওরা দুজন নৌকা নিয়ে ওদিকটায় ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করে ছিল। তবে রাগান্বিতারা যে এই মুহূর্তে এখানে আসবে এটা সে ভাবে নি। ইমতিয়াজ রাগান্বিতাকেই দেখে গেল অনেকক্ষণ। মোকলেস নামতেই লুবনা আর রাগান্বিতা উঠে বসলো নৌকায়। নৌকার মাঝখানে বসলো দুজন। রাগান্বিতা প্রশ্ন করলে ইমতিয়াজকে,
“আপনি কি নৌকা চালাবেন এখন?”

ইমতিয়াজের হুস ফিরলো। বললো,
“হুম।”

রাগান্বিতা অবাক হয়ে বললো,
“কখনো চালিয়েছেন নৌকা?”

খুব স্বাভাবিকভাবে বললো ইমতিয়াজ,
“না তো এই প্রথম।”

ইমতিয়াজের কথা শুনে হোঁচট খেল রাগান্বিতা। বললো,
“ডুবিয়ে মারতে চাইছেন নাকি?”
“আমি মরতে দিবো না তো। এখানে মেরে দিলে লাশ পাওয়া যাবে কি।”

রাগান্বিতা হতভম্ব হয়ে বললো,
“কি?”
“আপনি যেটা শুনেছেন সেটাই।”
“আমায় মেরে ফেলবেন?”
“আপনি চাইলে দিতেও পারি।”
“আপনি কি পাগল?”
“হতে পারি।”

তাজ্জব বনে যায় রাগান্বিতা। এ ছেলের সাথে নিশ্চয়ই কোনো ভূত-টূত আছে না হলে এসব কি বলে। রাগান্বিতার ভাবনার মাঝে হেঁসে ফেলে ইমতিয়াজ জোরে চেঁচিয়ে বলে,
“ওই মোকলেস, হলো তোর।”

মোকলেস নৌকাটা ঠেলতে ঠেলতে বললো,
“এই তো দড়ি খুইলা দিছি ভাই। উডমু?”
“ওঠ তাড়াতাড়ি। নয়তো তোর রাগান্বিতা আফা ভাবছে তারে ডুবাইয়া মাইরা ফালামু।”

মোকলেস নৌকা চড়ে বসলো। হাল্কা হেঁসে বললো,
“কি যে কন ভাই!”

ইমতিয়াজ নৌকা চালাতে চালাতে বললো,
“আমি বলি নাই তো তোর রাগান্বিতা আফা বলেছে।”

মোকলেস এবার তাকায় রাগান্বিতার দিকে। বলে,
“ভয় নাই আফা ইমতিয়াজ ভাই অনেক ভালা নৌকা চালায় কাইলগো তো আমায় নৌকায় কত জায়গায় ঘুরালো।”

মোকলেসের কথা শুনে রাগান্বিতা ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে কড়া কণ্ঠে বললো,
“তার মানে আপনি আমায় মিথ্যে কথা বলেছেন?”

ইমতিয়াজ বৈঠা বাইতে বাইতে বলে,
“সুন্দরী নারীদের সাথে দু’একটা মিথ্যে কথা বলাই যায়। এতে কোনো ক্ষতি হয় না বরং ভালোই হয়।”

রাগান্বিতা অবাক হয়ে বলে,
“ভালো কিসে?”
“ওই যে তার ভয় মাখা মুখটা দেখা যায়। দেখতে কিন্তু দারুণ লাগে আপনি কখনো দেখেছেন? দেখেননি আমি জানি।”

রাগান্বিতা আর কিছু বলে না এ ছেলে যে চরম বদমাশ তা সে ভালো মতোই বুঝতে পেরেছে।

#চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে