উজানের ঢেউ পর্ব-০৪

0
397

#উজানের_ঢেউ ( ৪)
কলমে ✍️ #রেহানা_পুতুল
” আপা! এটা ডিভোর্স লেটার। উকিল নোটিশ পাঠিয়েছে তোর পেয়ারের স্বামী আশরাফুল!”

আল্লাহ গো! কি বলিস তুই বলে, মা বিষ্ফোরিত চোখে রাবুর দিকে চাইলো। কাঠের চেয়ারের হাতল ধরে দপ করে বসে পড়লো। মায়ের চোখ দুটো পারে তো অক্ষিকোটর হতে বেরিয়ে পড়ার উপক্রম। আমার মায়ের চোখেমুখে পাগল পাগল দশা৷

বাবা নির্বাক হয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন। ছোট ভাই নয়ন বেকুবের ন্যায় এদিক ওদিকে তাকাতে লাগলো।
আমার গোটা পৃথিবী দুলে উঠলো ভূমিকম্পের ন্যায়। আকস্মিক চোখের সামনে অমানিশার আঁধার দেখছি। যেনো কোথাও কোনো আলো নেই।

মনে হলো কোনো ঐশ্বরিক শক্তিবলে আড়ালে থেকে কেউ একজন গোটা পৃথিবীর সমস্ত আলো নিভিয়ে দিয়েছে এক লহমায়। এক নিকষ কালো গুহার গভীরে যেতে যেতে আমি উপস্থিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ি। রাগান্বিত স্বরে রাবুকে বলি,

” এটা অবিশ্বাস্য! এটা মিথ্যা! তুই আবার পড় বলছি। মন দিয়ে ভালো করে পড়। ”

রাবু আমার দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইলো। তার দু’চোখ বোবা অশ্রুজলে টইটুম্বুর হয়ে গেলো। আমার দিকে খামটি এগিয়ে দিয়ে,

” তুই পড় আপা।”

রাবুর হাত বদল হয়ে আমার কাঁপা কাঁপা হাতে চলে এলো খামটি। আমি থরথর করে কাঁপছি আর ভাবছি। এ যেনো হয় মিথ্যে কিছু। এ যেনো হয় আমাদের সবার ভ্রম। রাবু আমার পাশ ঘেঁষে বসে রইলো। আমি পূর্ণ মনোযোগ সহকারে বার দুয়েক পড়লাম। শিশুর প্রথম বর্ণ চেনার মতো করে প্রতিটি অক্ষর, শব্দ ধরে ধরে পড়লাম।

বুঝলাম। বিশ্বাস করলাম। এ কোনো দুঃস্বপ্ন নয়। নয় কোনো মরিচীকা। নয় কোনো মিছে ছলনা। নয় কোন এপ্রিল ফুলের ধোঁকাবাজি।

এ দিনের আলোর মতো সত্যি। চাঁদ তারার মতো সত্যি। কিন্তু এই সত্যির ভার এত বেশি যে , আমি বহন করতে পারছিনা। আমি পরাভূত। আমার মানসিক ও শারিরীক শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে ক্রমশই। অসাড় হয়ে আসছে মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ। আমি রাবুর গলা পেঁচিয়ে ধরি। গুমরে কেঁদে উঠি। আমার শরিরের সমস্ত ভার রাবুর উপরে ছেড়ে দিই। রাবু চিৎকার করে উঠে,

” এই আপা। এইই। আম্মা আপা অজ্ঞান হলো নাকি?”

তারপর আর কিছুই আমার মনে নেই। জ্ঞান ফিরে এলে দেখি তখন সকাল। জানালা গলিয়ে সূর্যিমামার উঁকিঝুঁকি। পিটপিট চোখে এদিক সেদিক তাকালাম। রাজন আমার গায়ের উপর মাখামাখি করছে। রাজনকে বুকে চেপে ধরলাম বাবা বলে। বাবা,রাবু,মা আমার রুমে এলো। বিয়ের আগে আমাদের দুই বোনের জন্য এই রুমটাই বরাদ্দ ছিলো। বিয়ের পর এলেও এই রুমেই থাকি রাবু সহ। তবে ওই হারামিটা সহ যে দু চারবার আসা হয়েছে,তখন রাবু দাদীর রুমে ঘুমাতো।

রাবু আমাকে বলল,

” আপা গত সন্ধ্যায় তুই সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলি। তার দুই ঘন্টা পরে আমরা ঘরোয়া টোটকা প্রয়োগ করে তোর জ্ঞান ফেরাই। তখন আবার ঘুমিয়ে গিয়েছিলি তুই। রাজনকে তার খাবার খাইয়েছি রাতে৷তোকে কিছু খাওয়ানো যায়নি তবে। ”

বাবা বিছানার কাছে এসে আমার শিয়রের পাশে দাঁড়ালেন। আমার মাথায় পিতৃস্নেহের পরশ বুলালেন। দৃঢ় কন্ঠে বললেন,

” পৃথিবীতে কোনো সমস্যাই চিরস্থায়ী নয়।সেটা যতবড় সমস্যাই হোক না কেনো। মনে রাখবি, সকল সমস্যা সমাধানের পথ স্রস্টা আমাদের জন্য রেখেছেন। সুতরাং ঘাবড়ে যাসনা। মচকে যাসনা। এই অনাকাঙ্ক্ষিত দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণাই একদিন তোর শক্তি হয়ে তোকে আআত্মবিশ্বাসী করে তুলবে৷”

বাবার যুক্তিবাদী কথাগুলো এত ভালো লাগলো মনের মধ্যে। এত প্রেরণা পেলাম। বলে বোঝাতে পারবো না। বাবা আদেশ করে আরো বললেন,

” উঠে যা। কাজা হলেও নামাজটা পড়ে নে অযু করে। আল্লাহর কাছে শান্তি প্রার্থনা কর। নাস্তা খেয়ে নে। আমি দোকানে গেলাম।”

বাবা চলে গেলেন,মা এতসময় নিরব ছিলেন। মায়ের এই একটা বিশেষ দিক বা গুণ বলাই শ্রেয়,

বাবা কাউকে কিছু বলার সময় মা বাবার গুণমুগ্ধ শ্রোতা হয়ে যান। বাবাও মায়ের এই বিষয়টা মূল্যায়ন করেন।

মা এবার হই হই করে উঠলেন। আমার উপরে নয়। তাদের পুরো পরিবারের উপরে। মা মনের সাধ মিটিয়ে তাদের উপর অনুযোগ ও ক্ষোভ বর্ষণ করতে লাগলেন বিরতিহীনভাবে। থেমে আমাকে বললেন ,

” তুই হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা খেয়ে নে। তারপর জামাইরে একটা ফোন দে। কাহিনীটা কি আমাদের জানা দরকার। মগের মুল্লুক পেয়েছে নাকি। আইন আদালত বলে কিছু নাই দুনিয়াতে?”

” মা থামো। আমি ফ্রেস হয়েই ফোন দিচ্ছি। মোবাইলে চার্জ নেই। নয়ন মনে হয় গেম খেলেছে। ”

মা হনহনিয়ে চলে গেলেন রুম থেকে। রাবুও রাজনকে আদর করে চলে গেলো। কলেজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে তার। আমি রাজনকে কোলে নিয়ে ঘরের বাইরে গেলাম। তাকে পাশে দাঁড় করিয়ে নলকূপ থেকে হাতমুখ ধুয়ে নিলাম। রাজন সারাক্ষণ আমাকে নয়নে হারায়। হারাবেই বা না কেনো। চোখের সামনে পেয়েছেই শুধু মাকে। বাবাকে পেয়েছে অতিথির মতন।

সামান্য নাস্তা খেয়ে নিলাম অনিচ্ছা সত্ত্বেও। ঘরের পরিবেশ বাড়াবাড়ি রকমের থমথমে। দিনের মুখরিত কলরবেও আমাদের ঘরে বিরাজ করছে প্রগাঢ় নৈঃশব্দ্যতা। কারো মুখের দিকে তাকানো যায়না। নয়ন আলোভোলার মতো এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি করছে। রাবুর মুখ বিষন্নতায় ছেয়ে আছে। যেনো গুমোট হয়ে থাকা মেঘলা আকাশ। কালক্ষেপণ না করেই বজ্রপাত হবে।

তবে তার চেয়েও তেতে আছে বেশি মায়ের মেজাজ। যেনো কড়া রৌদ্রতাপে শুষ্ক খড়ের স্তুপ। আগুনের সংস্পর্শ পেলেই জ্বলে উঠবে দাউদাউ করে।

আর আমার জীবন কোন অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিক্রম হচ্ছে, তা কেবল এই আমিই জানি। দরজা বন্ধ করে বিছানার এককোণে গিয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে বসলাম। তার নাম্বারে ডায়াল করতে গিয়েই থমকে গেলাম। ক্ষণকাল ভাবলাম। মন সায় দিলোনা তাকে ফোন দিতে। তার কন্ঠ শুনতে।

” যে যাবার সে কোন কারণ ছাড়াই চলে যাবে। আর যে থাকার সে অকারণেই থেকে যাবে।”

প্রথম বাক্যটি তার জন্য। দ্বিতীয় বাক্যটি মাহমুদ ভাইয়ের জন্য। সুতরাং তাকে পিছু ডেকে অযথা যুক্তিখণ্ডন করা বোকামির সামিল।

শাশুড়ীকে ফোন দিলাম। রিসিভ হলো। সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করলাম। শয্যাশায়ী স্বশুরসহ বাকি সবার খোঁজখবর নিলাম। উনার কন্ঠস্বরের স্বতঃস্ফূর্ততা দেখে মনে হলো সবই উনার অজানা।

” আম্মা আমার কিছু জরুরী কথা আছে আপনার সাথে।”

উনি উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইলেন। আমি আশরাফুল সম্পর্কে জা জানি যতটুকু নিজে দেখেছি, সবই জানালাম শান্ত কন্ঠে। এবং উকিল নোটিশের বিষয়টাও বললাম। ফোনের ওপাশের নিরবতা দেখে আম্মা বলে ডাক দিলাম। যদিও বুঝতে পারলাম উনি স্বাভাবিক নেই। উনি হঠাৎ ধ্যানভঙ্গ ঋষির মতো চমকানো স্বরে হু বলে সাড়া দিলেন মরাকন্ঠে।

অপরাধীর ভঙ্গিতে করুণ কন্ঠে আমাকে বললেন,

” মারে! কিসব হুনাইলা। আমার মাথার উপ্রে যেনো সাত আসমান ভাইঙ্গা পড়ছে। এর আগে খোদা আমারে তুইলা নিলনা ক্যান জমিন থেইকা। ওই খোদা সাক্ষী। তুমি বলার আগে কিছুই জানতাম না। পশুটা ছোডকাল হইতেই বেয়াড়া স্বভাবের। কয়বছর ধইরা তো বিদেশেই থাকে। তার বাপের সকাল বিকাল দম যায়। হিসাবে ধরেনা৷ বড় ভাই থাকে তার সংসার নিয়া। ভাবিতো পরের মাইয়া। যা একটু মান্য করে আমারেই। আমার নাতির লাইগা দিল জ্বলে। তোমার আনার কথা কইলেই জবাব দিতো,

মা রত্না কিছুদিন তাদের বাড়িতে বেড়াক না। সারাবছর তো তোমাগো ঘরের কাজকর্মের জন্য যেতেও পারেনা বাবার বাড়ি। আমিও বুঝ নিলাম। আরো মনে করলাম,তোমাকে আমি ফোন দিয়া আনলে সে মনে করবো তার বউরে খাটাইতে আনছি।

এখন তো দেখি ঘটনা অন্যকিছু। কি চামার! কি জালিম! কি বর্বর! রূপ কইমা গ্যালে বউ খেদায়া দেয়। ছাইড়া দেয়। আমি বাপের জনমেও হুনিনাই। আসলেই শেষ জমানায় আইসা পড়ছি। তুমি একটু সবর করো বউ। আমি তার লগে কথা কই তোমারে জানামু। আশা করি অল্প সময়ের মধ্যেই তুমি একটা সদুত্তর পাইবা আমার থেইকা। ”

মোবাইল রাখলাম কথা বলা শেষ হলে। আম্মার কথায় অনুধাবন করতে পারলাম,সত্যিই সবই উনার অজানা।

রুমের হার্ডবোর্ড এর দেয়ালে ঝুলানো চিত্রকর্মটির দিকে দৃষ্টি পড়তেই বুক চিরে দীর্ঘস্বাস বেরিয়ে এলো বিশাল আক্ষেপ নিয়ে। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হওয়া এক যুবতী গৃহবধূ। বয়স অল্প। জীবনকে রাঙিয়ে তোলার বয়স। হাতে ধরা তার ছোট্ট খোকাবাবু। তার বেখেয়ালি মায়া মায়া চাহনিটা নিবদ্ধ রয়েছে নদীর স্রোতের উল্টো দিক থেকে আসা ঢেউয়ের পানে। অর্থাৎ বইয়ের ভাষায় উজানের ঢেউ বলে যাকে। সেই ছলাৎ ছলাৎ আছড়ে পড়া উজানের ঢেউয়ের কাল্পনিক শব্দ যেনো আমার হৃৎপিণ্ডটাকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে দানবীয় কায়দায়।

তার এক সপ্তাহ পরে আমার মোবাইল বেজে উঠলো উচ্চস্বরে। সময়টা ছিলো ঝিমিয়ে আসা অবসন্ন বিকেল। পাখিরা নীড়ে ফিরে যাচ্ছে সমস্ত দিনের লেনাদেনা চুকিয়ে। ব্যস্তসমেত হয়ে রিসিভ করলাম।

“আম্মা আসসালামু আলাইকুম।”

সালামের উত্তর দিয়ে অস্থির গলায় বললেন আম্মা,

” শিরিন কি তোমাদের বাড়িতে? বুলি জিগাইতে কইলো। কলেজ থেইকা নাকি বাড়িতে যায়নাই এখনো। আর কোনদিন নাকি এমন লেট হইনাই। টাইমমতেই নাকি বাড়িত চইলা যায় আমার বোনঝিটা।”

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে