উজানের ঢেউ পর্ব-০৬

0
408

#উজানের_ঢেউ ( ৬ )
কলমে✍️ #রেহানা_পুতুল
” নারীই নারীর প্রধান শত্রু। নারীই নারীর সর্বনাশী ও সর্বগ্রাসী!”

কথাটি মনে হতেই ঝট করে ফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলাম।

কতটা পাষাণ ও নারীলোভী হলে একজন পিতা সন্তানের শর্তও ত্যাগ করে দিতে পারে অবলীলায়। এটা কল্পনা করতেই আমার দুকান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো বিদ্যুৎ গতিতে। সারা শরীর জমে গেলো হিমশীতল বরফখন্ডের ন্যায়। আমি অবসাদগ্রস্ত তনুমন নিয়ে পা টেনে টেনে ঘরের পিছনের মাটির দাওয়ায় গিয়ে বসে পড়লাম।

মা,রাবু,বাবা ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন। তারা এতক্ষণ অপেক্ষায় ছিলেন ঘটনার সত্যতা জানার জন্য। আমি সবই জানালাম তাদের। বাবা চলে গেলেন আমার উপর বোবা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। বাবা মনে হয় আমাকে শান্তনা দেওয়ার কোন ভাষাই খুঁজে পেলেন না। রাবু আমার পিঠের উপরে সহমর্মিতার হাত রাখলো। মা দপ করে জ্বলে উঠলো লন্ঠনের ন্যায়। হায় হায় সুরে বললেন রাবুকে লক্ষ্য করে,

” রাবু দেখছিস কি অমানবিক! কি অ- মানুষের বাচ্চা অ- মানুষ ! দুনিয়ার বুকে আমি এই প্রথম দেখলাম, সন্তানের আশাও ছেড়ে দেয় কোন পিতা। তাও কোন বাধা কোন কারণ ছাড়াই। খাঁটি কথা হলো রাজনকে সে নিলে পালতে হবে তো শিরিনের। তাই রাজি হয়নি। কি স্বার্থপর! কি হারামির ঘরের হারামী!”

” আহ! আম্মা থামো তো! তুমি যে এসব বলতেছো সেই আশুর বাচ্চার আশু কানে শুনতেছে? আর শুনলেই বা তার কি যায় আসে।”

” এই কিসের থামাথামি? এই রত্না ওঠ। বোরকা পর। থানায় যাবো। চৌদ্দশিকের ভাত খাওয়াবো তারে আমি। ঘরে বউ রেখে লুকিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করার সাধ হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাইয়ে দিমু। ওহ! তার আগে তার মাকে ফোন দিয়ে কিছুকথা শুনাই। কেমন বেজন্মা পেটে ধরেছে? কেমন শিক্ষাদীক্ষা দিয়েছে? ”

আমি মাকে থামিয়ে বললাম,

” মা তাতে লাভটা কি হবে শুনি? মানুষ পরিবেশের কারণেও বখে যায়। তাতে পিতামাতার কোন দোষ থাকে না। এমন নজির তো আমাদের বাড়িতেই আছে। উনারা সবাই ভালো মনের মানুষ। খারাপ সেই মাত্র।

আর এই পৃথিবীতে জোর করে সব হয়। কিন্তু কারো মন পাওয়া যায়না। আমি তার ওই প্রাণহীন অস্তিত্বের কাছে আর যেতে চাইনা। বরং তার ওই চামড়ার শরিরের পাশে আমার ছায়াটুকুও যেনো আর না পড়ে কখনো, সেটাই প্রার্থনা করো।

সুতরাং বিপদে আমাদের মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। বুঝে শুনে পা ফেলতে হবে। উত্তেজিত হলে লসের পাল্লাটা আমাদেরই ভারী হবে মা।”

রাবু জ্ঞানগর্ভ ধাঁচে বলল,

” হ্যাঁ আম্মা। আপা ঠিকই বলছে। কই যেনো পড়ছিলাম,

‘ প্রীতির পাখি খুন হয় পুরুষের হাতেই।’ আজ সেটাই ফলে গেলো আমার বোনটার জীবনে।”

আমি রাবুর হাতের পিঠে আমার হাতখানি রাখলাম সম্মতি জানিয়ে। এবং মাকে বললাম,

” যেই দেহের ভিতরে কোনো হৃদয় নেই। সেই হৃদয়হীন দেহ নিয়ে হয়তো চলা যায়। কিন্তু বাঁচা যায়না।”

মা চলে গেলেন ভারি ভারি পা ফেলে। রাজন কান্না শুরু করলে রাবুও চলে গেলো তার কাছে।

প্লিজ🙏#রেহানা_পুতুল পেইজে👉 like ও Follow দিয়ে আমাকে বাঁচার আনন্দটুকু দিতে আলসেমি করবেন না। আজ যদি মরে যাই।তখন আফসোস করবেন এই মানুষটার আকুতির কথা মনে করে।🥲

অসহ্যকর অপমান,ব্যর্থতা, গ্লানি,উপেক্ষা, যাতনা,অবসাদ,ক্ষোভ, আমাকে পিষে ফেলছে অহর্নিশ। কেমন নারী আমি! নিজের পুরুষটাকে নিজের করে আটকে রাখতে পারলাম না। উড়ে এসে জুড়ে বসে গেলো তৃতীয়জন। দখল করে নিলো পূর্ণ অধিকারে সসম্মানে। চিন্তা করতেই গা গুলিয়ে আসলো আমার। তীব্র ঘৃণায় সারা শরীর রি রি করে উঠলো।

অনুভূতিগুলো অবশ হয়ে এলো। কিন্তু এমন হলে চলবে না। আমাকে রুখে দাঁড়াতে হবে। গর্জে উঠতে হবে। নাহ। তাকে পাওয়ার জন্য নয়। নিজেকে মজবুত করে তৈরি করার জন্য। আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য। স্বপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য। নিজেকে ভালোরাখার জন্য। আমার সন্তানকে একটা সুন্দর পৃথিবী উপহার দেওয়ার জন্য।

তার দুদিন পর বাবা,মা,রাবুসহ বসলাম। বাবার দিকে চেয়ে বললাম,

” বাবা ও আমাকে নিতে চাইলেও আর আমি ফিরে যাবনা তার জীবনে। এটা ফাইনাল।”

“কারো জীবনে উপেক্ষিত থেকে কোর্মা কাবাব খাওয়ার চেয়ে, মর্যাদার জীবনে থেকে শাক ভর্তা খাওয়া অনেক ভালো। ”

গর্বের সুরে বলল আমার বাবা।

” বাবা,তিনমাস হয়ে গেলেতো কাবিনের প্রাপ্য টাকা পাবই। সেই টাকার সাথে আমার ব্যাংকের একাউন্টের টাকাগুলোও তুলে ফেলব। পাশাপাশি আমার কিছু গয়না তো আছেই। লাগলে সেগুলোও বেচে দিবো।”

” কি করতে চাস আগে শুনি?”

“সার্টিফিকেট তুলে কোন চাকরিতে জয়েন হতে পারি। কিন্তু তা করলে রাজনের সমস্যা হয়ে যাবে কিছুটা। মা কয়দিক সামলাবে। তাই ভাবছি একটা ছোটখাট ব্যবসা শুরু করবো। আমাদের পরিবারেরও সাপোর্ট হবে কিছুটা। যেহেতু আমি পরিবারের বড় মেয়ে। তাই দায়িত্ব কিছু আমাদের উপরেও বর্তায়।”

” কি ব্যবসা করবি তুই গ্রামে থেকে?”

” কেনো বাবা? আমাদের চৌরাস্তায় অনেক মেয়েরা,নারীরা বিজনেস করছেনা? ”

” তা অবশ্য করছে। তুই পারবি মা?”

” বাবা তোমাদের দোয়া থাকলে বিশ্ব জয় করতে পারবো। সেখানে কয়েকজনেই তো বিউটি পার্লার, কাপড়ের দোকান,ঔষধের দোকান,ট্রেইলার্স, ফাস্টফুড়ের দোকান করছে। আমার স্কুল লাইফের বান্ধবী আঞ্জুমানতো ফাস্টফুডের দোকান করছে। এবং ভালোই চলছে। ওতো মাত্র ইন্টারমিডিয়েট পাশ। মা,রাবু তো ওকে চিনেই। তাহলে অনার্স পাশ করে আমি কেনো পারবনা। এবার মাস্টার্সও কমপ্লিট করে ফেলব। ”

” হুম আমরা চিনি।” সমস্বরে বলল মা ও রাবু।

” বাবা জব করলে অন্যের কমান্ডে চলতে হবে রুটিন মাফিক। আর বিজনেস করলে আমার ফ্রিডম থাকমে নিজের হাতে। রাজনকে নিয়েও অসুবিধা হবেনা। তাকেও কেয়ার করতে পারবো। আরেকটা বড়দিক হলো কলেজ পাশ করে ফেললে রাবুও সময় দিতে পারবে আমার সাথে। অনার্সে তেমন চাপ নেই পড়াশোনার সাবজেক্ট বুঝে।”

আমার কথা শুনে রাবু খুশিতে টগবগিয়ে উঠলো। বলল,

” ইয়েহ। আমি রাজী। বাইরে কাজ করতে আমার হেব্বি লাগে। ঘরের কাজ করতে বিরক্ত লাগে।”

মা পাশ থেকে ধমকে উঠে,

” এহহ! ঘরের কাজ করে কত উল্টায়া ফেলছে উনি। খাওয়ার পরে এক থালা সরাতেই উনার দশ মিনিট লাগে। এক কুইড়া পয়দা করছি আমি।”

বাবা কিছুক্ষন থম মেরে রইলেন গাম্ভীর্যপূর্ণ মুখাবয়ব নিয়ে। অতঃপর বললেন,

” আচ্ছা ঠিকাছে। মন যেভাবে যেটাতে সায় দেয় সেটাই কর। নয়তো সাইন করতে পারবিনা। আমাদের চৌরাস্তা হলো শহরমুখী। এখানে বর্তমান বাজারে বড় অংংকের টাকা লাগবে। একাউন্ট থাক। গয়নায়ও হাত দিসনা। আমি দেখি কত ম্যানেজ করতে পারি।”

” তোর বাবা ঠিক বলছে। ওসব থাক।”

” মা তাহলে মাসে মাসে যে টাকা জমা দিতে হয় একাউন্টে। তা এখন কই পাবো? আগে তো সেই দিতো।”

” তোর বাবা দিবে এখন। ”

” আমি আবেগাপ্লুত হয়ে বাবা বলে বাবার হাত ধরলাম। বাবা আমার মাথাকে আলতো করে বুকের একপাশে চেপে ধরলেন।মাথায় হাত বুলিয়ে ভরসা দিলেন।”

আমার ভিতরটা বেশ হালকা লাগছে। এতদিন মনে হতো বহুকাল ধরে আমার কোনো আজন্ম শত্রু বৃহৎ আকারের এক প্রস্তরখন্ড আমার বুকের জমিনে ফেলে রেখেছে। আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো বুঝি। আজ বাবা ও আমার মা বোন মিলে তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে সেই বিশাল প্রস্তরখন্ড সরিয়ে দিলো।

তার পরেরদিন সকালে আমরা নাস্তা খেয়ে উঠলাম। মা রান্নার জোগাড় করছে। নয়ন স্কুলে চলে গিয়েছে। রাজন খেলছে মাটিতে বসে। বাবা বড় বাজারে গিয়েছে। আমার মোবাইল বেজে চলছে। উঠে গিয়ে রিসিভ করলাম অবাক চোখে। আমার একমাত্র বড় জা লায়লা ভাবির
ফোনকল। ফিচলে হেসে মনে মনে বললাম,

এতটা দিন খবর নেয়নি। এখন কোন দুঃখে সে আমাকে ফোন দিলো।
রিসিভ করলাম। হ্যালো ভাবি বলে সালাম দিতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো জোরালো কান্নার আওয়াজ।

” রত্না একবার আয়। বাবা মরে যাচ্ছে। তোর ও রাজনের কথা বলছে। আম্মা তোকে ফোন দিতে বলল। আল্লাহর দোহাই লাগে সব ভুলে একজন মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের শেষ ইচ্ছা পূরণ কর আইসা। বোন দ্রুত আয়।”

একদমে বললেন লায়লা ভাবি।

আমি নমনীয় স্বরে বললাম,

” ভাবি সে আমাকে উকিল নোটিশ দিয়েছে। তার সামনে আসা কি ঠিক হবে?”

কান্নারত কন্ঠে বলল ভাবি,

” ওরে আল্লাহ! এতকথা ক্যামনে বলি। সে নাই। ওই শিরিন ও নাইরে বোন। এই ভিতরে কতকিছু ঘটে গেলো। আল্লাহ! সব বলব তোকে। জলদি আয়। ”

” ভাবি যত দ্রুত সম্ভব বাবাকে শেষ দেখার জন্য আমি আসছি রাজনকে নিয়ে। ”

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে