Saturday, August 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 472



চলো না হারিয়ে যাই পর্ব-০৪

0

চলো_না_হারিয়ে_যাই ❤️ [৪]
লেখকঃ জয়ন্ত_কুমার_জয়

বিষণ্ণ খাম খুললো।দেখলো সেখানে স্পষ্ট লেখা, শিক্ষকের বাড়িতে গিয়ে বেয়াদবি করিবার মতো ধৃষ্টতার শাস্তি স্বরুপ সামনের বছরের ভর্তি কার্যক্রম বাতিল করা হইলো।

নামঃবিষণ্ণ
রোল নম্বর-২০৪

বিষন্ন ভয়ে ভয়ে সামনের কালো ব্লেজার পরিহিত লোকটির দিকে তাকালো।ব্লেজার, কালো ফ্রেমের চশমা পরিহিত লোকটি বিষণ্নর বাবা।বিষণ্ন যে ভয়টা করেছিলো সেটাই হলো।এইটুকু ব্যাপারে শুধু শুধু বাবাকে ডাকার কোনো মানে হয়?শুধু কলেজ কেন,তার ছাত্রত্ব আজীবনের মতো বাতিল করে দিলেও বিষণ্ণর কোনো সমস্যা ছিলো না।সমস্যাটা হয়েছে তার বাবাকে ডেকে এনে।বাবা সব সহ্য করতে পারেন,কিন্তু ছেলের নামে কেউ রিপোর্ট করবে সেটা মেনে নিতে পারেন না।

বিষণ্ণর বাবা চোখ থেকে চশমাটা খুলে হাতে নিলেন।প্রিন্সিপাল বললেন

” বিষণ্নকে এর আগে আমি নিজেই কয়েকবার ওয়ার্নিং দিয়েছি শুধুমাত্র মিষ্টি আর অপুর জন্য ”

বিষণ্ন বুঝতে পারলো খাটাস প্রিন্সিপাল তার এতোদিনের করা কুকর্মের ঝুলি শেষ না করে ছাড়বে না।বাবা বললেন

” অপু কে? ”

” কলেজের রাজনীতি টাজনীতি করে।আমায় খুব শ্রদ্ধা করে।ওর কথায় বিষণ্ণকে লাস্ট বারের মতো ছেড়েছিলাম ”

বাবা ভ্রু কুঁচকে বললো ” লাস্ট বার মানে?এর আগেও কিছু করেছিলো নাকি?

” লাস্টবার তো ও লাইব্রেরি থেকে বই চুরি করেছে ”

বাবা তার ভারী স্বরে বললেন ” আপনার হয়তো ভুল হচ্ছে। বিষণ্ন চুরির মতো নিম্নস্তরের কাজ কখনো করবে না ”

প্রিন্সিপাল প্রচন্ড অবাক হলো।তার থেকেও বেশি অবাক হলাম আমি।কারণ বই চুরির দায়ে প্রিন্সিপাল আমাকে একটা পেপারে সাইন করিয়ে নিয়েছিলেন।যেখানে লেখা ছিলো ভবিষ্যতে এমন কাজ করলে আমায় এক্সপেল্ট করে দেওয়া হবে।সেখানে বাবার সাক্ষর নিতে বলেছিলো।আমি পাকনামি করে বাবার বদলে সেখানে নিজেই সাইন করে দিয়েছিলাম।

তখন বেঁচে গেলেও এখন যে চিপায় পড়ে গেছি বেশ বুঝতে পারছি।প্রিন্সিপাল আমার দিকে তাকালেন।ওনার চোখে চোখ পড়তেই আমি গাধার বাচ্চার মতো একটা হাসি দিলাম।প্রিন্সিপাল বুঝতে পেরেছেন সাইনটা আমার পাকনামিতে করা।বাবা বললেন

” ওকে এক্সপেল্ট করেছেন জেনে খুশি হয়েছি।এখন আসি ”

একথা বলে বাবা প্রিন্সিপালের রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন।আমিও বাবার পিছু পিছু বেড় হলাম।ক্যাম্পাসের বেশিরভাগ ছেলে-মেয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে আমাকে আর বাবাকে দেখছে।

বাবা একটা রিক্সায় উঠে বসলেন,অথচ ক্যাম্পাসে বাবার বাইক দেখলাম দাড় করানো।বাইক ছেড়ে রিক্সায় কেন উঠলেন ঠিক বুঝলাম না।আমিও চুপচাপ তার পাশে গিয়ে বসলাম।মৃদু স্বরে বললাম

” বাবা আমি জানি তুমি খুব রেগে আছো।আমি ইচ্ছে করে এসব করিনি বিশ্বাস করো।সেদিন…. ”

পুরো কথা শেষ না করতেই বাবা আমায় থামিয়ে দিয়ে বললো ” যা বুঝলাম, তুমি এখানে পড়াশোনা বাদে সবকিছুই করছো।প্রিন্সিপাল ডেকে তোমার নামে রুপোর্ট দিচ্ছে।তুমি বুঝতে পারছো আমার অবস্থানটা কোথায় নামিয়েছো? ”

” পারছি ”

” মেসে গিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বাড়িতে চলে আসবে।আর হ্যা, প্রিন্সিপাল মিষ্টি নামের একটা মেয়ের কথা বলছিলো।মিষ্টি কে? ”

আমতা আমতা করে বললাম ” আমার বান্ধবী ”

” শুধুই বান্ধবী? ”

আমি লজ্জা পেয়ে বললাম ” হ্যা ”

” তোমার বয়সে থাকতে কেউ জিগ্যেস করলে আমিও বলতাম তোমার মা আমার বান্ধবী হয় ”

বাবা কি বোঝাতে চাইছে সেটা বুঝতে পেরে বললাম ” বাবা কি যে বলো,ওসব কিছুই না ”

” না হলেই ভালো ”

তারপর অনেক্ক্ষণ কে’টে গেলো দু’জনই চুপ থাকলাম।রিক্সা আমার মেসের সামনে থামলো।রিক্সা থেকে নেমে বাবার দিকে করুন দৃশ্য নিক্ষেপ করে বললাম

” বাবা আমি জানি তুমি হার্ট হইছো।তবুও বলছি,একটু প্রিন্সিপালকে বলবে প্লিজ? ”

যেন কিছুই জানেনা এমন একটা ভাব করে বাবা বললো ” কি বলবো ”

” উনি যেন আমার এক্সপেল্ট লেটারটা উঠিয়ে নেয়,প্লিজ ”

বাবা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন ” জিনিসপত্র গুছিয়ে কাল সকালে চলে আসবে।আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিবো ”

বাবা চলে গেলো।আমি মুখ ভাড় করে মেসে ঢুকলাম।ঢুকতেই দেখলাম মেস মালিক করিম ভাই দাঁড়িয়ে আছে।আমায় দেখে মুখ কালো করে বললো

” এসব কি? তোমরা নাকি ছাঁদে রাতবিরাতে নেং’টু হয়ে নাচটাচ করো?পাশের বাড়ির দুইজন আমাকে রিপোর্ট দিছে ”

মনে মনে বড় একটা হাফ ছাড়লাম।ভাগ্য ভালো বাবা আমার সাথে মেসে আসেননি।এসে এসব শুনলে জানিনা এখন আমার কি অবস্থা হতো।করিম ভাই বললো

” রিয়াদের লুঙ্গি খুলে দিছো কেন? ”

এমনিই মেজাজ খারাপ।তারমধ্যে এসব প্যানপ্যানানি সহ্য হলো না।চেঁচিয়ে বললাম ” আমি এখন রুমে গিয়ে ইম্পরটেন্ট একটা কল করবো।আপনার লুঙ্গি যদি কো’মড়ে রাখতে চান তাইলে চুপ থাকেন।নইলে ওরা কাল রাতে যা দেখছে,সেটা দিনের আলোয় আবার দেখাবো ”

একথা বলে রুমে আসলাম।করিম ভাই এমনি হলে সামান্য ব্যাপারে অনেক সময় ধরে বকবক করেন।কিন্তু আজ চুপ রইলেন।

বিছানায় ধপ করে শুয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে মিষ্টিকে ফোন করলাম।ফোন ওয়েটিং।রাগে বিছানায় উঠে বসলাম।এই ভর দুপুরে মিষ্টি কার সাথে কথা বলছে?

————-

জায়ানের সাথে কথা বলার মুহুর্তে মিষ্টি লক্ষ্য করলো বিষণ্ণ বারবার কল করেই যাচ্ছে।বিরক্ত হয়ে মিষ্টি জায়ানকে বললো

” এখন ফোন রাখি!একজন কল করছে বারবার ”

” কে কল করছে? বিষণ্ন? ”

মিষ্টি একটু অবাক হয়ে বললো ” হ্যা,কিন্তু আপনি জানলেন কিকরে? ”

” হাহাহা,তোমার পিছে তো ও আঠার মতো লেগে থাকে।তাই বললাম ”

” ও আঠার মতো লেগে থাকে না।আমরা অনেক ভালো বন্ধু ”

” আরেহ,তুমি রাগ করছো নাকি? আমি এমনি জাস্ট মজা করে বললাম ”

” এমন মজা আমার পছন্দ না।আমি লক্ষ্য করেছি বিষণ্ণকে আপনি সবসময় অন্যভাবে ট্রিট করে কথা বলেন ”

” আচ্ছা ম্যাডাম আমার ভুল হইছে।এখন ওরে ফোন ব্যাক করো দেখো কি বলে ”

মিষ্টি জায়ানের কল কে’টে বিষণ্ণকে কল করলো।সাথে সাথেই বিষণ্ণ কল রিসিভ করে হুমকির স্বরে বললো

” কার সাথে কথা বলছিলা,কে ফোন করছে? ”

” জায়ান ”

” জায়ানটা আবার কে ? ”

” আমার ক্লাসমেট ”

” ওর সাথে এতোক্ষণ ধরে কিসের কথা? ”

মিষ্টি কিছুটা বিরক্তির স্বরে বললো ” ওর সাথে কিসের কথা সেটা তুই শুনে কি করবি? আর দেখতেছিস আমি ফোনে কথা বলতেছি,তাও এক নাগাড়ে ফোন দিয়েই যাচ্ছিস ”

বিষণ্ন নমনীয় স্বরে বললো ” সরি ”

” তোকে দেখছি আজকাল কিছুই বলা যাবে না।মেয়েদের মতো কথায় কথায় রাগ কেন করিস? ”

” জানোই তো রাগ করি,তবুও রেগে কথা বলো কেন ”

” ওলে বাবালে,আমার পিত্তি বাবুতারে আর রাগ দেখাবো না ”

ওপাশ থেকে বিষণ্ণর হাসির শব্দ ভেসে এলো।মিষ্টি ধমক দিয়ে বললো ” পিচ্চির বাচ্চা হাসি থামা ”

” আচ্ছা থামালাম।এখন জায়ানের সাথে কি নিয়ে কথা হচ্ছিল?”

” এমনিই, ক্লাসে আসিনি কেন সেটা বলতে ফোন দিছে ”

” তুমি ক্লাসে না গেলে ও ফেন দিয়ে খোঁজ নেয়? ”

” হু।আমার একদম বিরক্ত লাগে।ওর মুখের উপর তো আর কে’টে দিতে পারিনা। তুই ফোন দেওয়াতে ভালোই হলো ”

” আর ভালো! আমায় কলেজ থেকে বেড় করে দিছে জানো? ”

মিষ্টি বিস্মিত হয়ে বললো ” বেড় করে দিছে মানে?”

” হ্যা।বাবাকেও ডেকেছে। বাবার সামনে লেটার হাতে ধরিয়ে দিছে ”

” এই দারা তো,জাস্ট এক মিনিট,”

এটা বলেই মিষ্টি গেলো বাবার রুমে।গিয়ে দেখলো বাবা অফিসে চলে গেছে।বাবাকে না পেয়ে মুখ ভোতা করে ফোন কানে দিয়ে বললো

” বিষণ্ন ”

” হু ”

” বাবাকে তো কাল বলছিলাম স্যারের সাথে কথা বলতে!”

” আঙ্কেল বললেই বা কি,ওনার কথায় কি হবে? ”

” আরে ছোট গাধা, প্রিন্সিপাল স্যার বাবার ক্লাসমেট ভুলে গেছিস নাকি ”

” এখন আমার কিছু মনে থাকে না ”

” তুই চিন্তা করিস না।আমি বাবাকে বলে একটা কিছু করিয়ে নিবো। আঙ্কেল যে এসছিলো কিছু বলছে?খুব রাগ করছে তাই না? ”

” একটু একটু করছে।এতক্ষণে বোধহয় ভুলেও গেছে।বাবা রাগ বেশিক্ষণ মনে রাখেন না।বাবার সর্বোচ্চ রাগ করে থাকার রেকর্ড ৪ ঘন্টা ১০ মিনিট ”

” রাগের আবার সময় ও হয়! ”

” রাগটা করেছিলো মায়ের উপর।মা’কে লাল শাড়ি পড়তে বলছিলো,আর মা পড়ছিলো হলুদ শাড়ি।এই নিয়ে ঝগড়া।বাবা রেগে বলছিলো,হলুদ শাড়িতে তোমায় কলা বউয়ের মতো লাগছে।তখন মা রেগে বললো,হ্যা ঠিক বলছো।আর সেই কলার লোভেই তো সাদা বাদরটা গ’লায় ঝুলে পড়লো।বাবাকে সাদা বাদর বলায় বাবা করলো রাগ!চার ঘন্টা কারো সাথে কথা বলেনি ”

এসব ঘটনা শুনে মিষ্টি খিলখিল করে হাসছে।মিষ্টির হাসি বিষণ্ন মুগ্ধ হয়ে শুনছে।মনে মনে ভাবছে,মেয়েটার হাসি এতো সুন্দর কেন?খুব ইচ্ছে করছে ওর সামনে বসে থেকে ওর হাসি দেখি!

মিষ্টি একটা বিষয় খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করেছে যে সে যতক্ষণ বিষণ্ণর সাথে কথা বলে ততক্ষন খুব ভালো একটা সময় কাটে।এই ছেলেটা একটু অন্যরকম।ওর সাথে কথা বলাতেও শান্তি!

বিষণ্ণ বললো ” তুমি কলেজে আসোনি কেন? ”

” পে’টে ব্যাথা ”

বিষণ্ন বিস্মিত হয়ে বললো ” পে’টে ব্যাথা এতোক্ষন বলোনি কেন,খুব ব্যাথা?হঠাৎ করে ব্যাথা কেন করবে। কাল রাতে কি খাইছো ”

” হঠাৎ না।চার পাঁচদিন থেকে ”

” বলোনি তো।ঔষধ খাচ্ছো?ডাক্তার দেখাইছো? ”

” এমনেই ঠিক হবে।কাল পরশুর মধ্যে ”

” এমনে ঠিক হলে এতোদিন হয়ে যেতো।আমি আসবো? ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই? ”

মিষ্টি নিজের কপালে হাত রেখে বললো ” তোরে তো সাধে পিচ্চি গাধা বলি না।বড় হলে বুঝবি ব্যাথা কেমনে ভালো হয়।সব ব্যাথার কারণ বলা যায় না ”

বিষণ্ণ কিছু বললো না।সম্ভবত পিচ্চি বলায় সে রাগ করেছে।সে রাগটাও ঠুমকো।বিষণ্ণ নিজেও চায় মিষ্টির মুখে পিচ্চি ডাক শুনতে।একবার কথায় কথায় মিষ্টি বলেছিলো,যা তোকে আর পিচ্চি ডাকবো না।সত্যি সত্যিই মিষ্টি বিষণ্নকে দুইদিন পিচ্চি বলে সম্বোধন করেনি।তৃতীয় দিনের দিন বিষণ্ণ একটা চুলের খোঁপা বাঁধানো কা’টা নিয়ে বাড়িতে হাজির।কা’টাটা আমার খোপায় রেখে মুখ ভোতা করে বলেছিলো ” এই পচা মেয়ে,তুমি পিচ্চি ডাকো না কেন? তোমার মুখে পিচ্চি ডাকটা না শুনলে ভালোলাগেনা।মুখেই শুধু রাখ দেখাই,কিন্তু মনে মনে ভালোই লাগে।সব কথা তোমায় বলা লাগে কেন?আসল পিচ্চি তো তুমি।না বললে কিছুই বুঝো না ”

মিষ্টি ভুলেই গেছিলো সে বিষণ্ণর সাথে ফোনে কথা বলছে।হুশ ফিরলো ফোনের ওপাশ থেকে বিষণ্ণর রাগি স্বরে।বিষণ্ণ বলছে

” কথা বলো না কেন? হ্যালো,হ্যালো,কথা শোনা যাচ্ছে না? ”

” হু যাচ্ছে। বিষণ্ণ শোন,সন্ধায় দেখা করবি? ”

” কোথায়? ”

” তোর যেখানে পছন্দ।প্রথমে আমার বাড়িতে আসবি।তারপর একসাথে তোর পছন্দের কোথাও যাবো ”

” আচ্ছা ”

” হু,ফোন রাখলাম ”

” আমি তাহলে সন্ধার আগেই চলে আসবো।যেখানে যাবো ভাবছি সেখানে সন্ধায় যেতে হয় ”

” আচ্ছা ”

ফোন কা’টলাম।পে’ট ব্যাথা বাড়তে লাগলো।ওয়াসরুমে গিয়ে প্যাডটা চেঞ্জ করে আসলাম।এখন কিছুটা স্বস্তি লাগছে।

বারান্দায় য়েতেই বিষণ্নর কথা মনে পড়লো।এই ছেলেটার কথা আমার সারাক্ষণ কেন মনে পড়ে বুঝতে পারি না।বাবাকে ফোন করে বলতে হবে প্রিন্সিপালের সাথে দ্রুত যেন কথা বলে।

ঠিক করলাম বিষণ্ণকে আমার মনের বড় সত্যিটা জানাবো।কথাটা বলা মাত্র ওর রিয়েকশনটা কেমন হবে? ও কি খুব অবাক হবে? নাকি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলবে,তুমি প্রেম করবা? প্রেম মানে কি বুঝো?

চলবে?
🥰

চলো না হারিয়ে যাই পর্ব-০৩

0

চলো_না_হারিয়ে_যাই ❤️ [৩]
লেখকঃ জয়ন্ত_কুমার_জয়

মিষ্টি ঠো’ট বাকিয়ে বললো ” কি’স করতে চাসনি? তাহলে কি করতে চেয়েছিলি?তার থেকে বেশি কিছু? ”

বিষণ্ন বিষ্ময়ে চোখ বড়বড় করে একপলক তাকালো মিষ্টির দিকে।তারপর মাথা নিচু করে রইলো।বিষণ্নকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলতে পেরে মিষ্টির মনে বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দ হতে লাগলো।

বিষণ্ন প্রসঙ্গ পাল্টাতে চোখে মুখে গম্ভীর ভাব এনে বললো ” তোমার কি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে? ”

বিষণ্নর কথায় মিষ্টি ভ্রু কুঁচকে বললো ” হ্যা তো।তুই জানিস না? ”

বিষণ্নর মনে হতে লাগলো কেউ যেন ওর বুকে বিশাল এক পাহাড় তুলে দিয়েছে।মুহুর্তেই বিষণ্নর মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেলো।বিষণ্ন নির্লিপ্ত গলায় বললো

” আচ্ছা আমি যাই ”

একথা বলেই বিষণ্ণ ছুটে ছাঁদ থেকে নেমে গেলো।নামার পথে সিঁড়িতে বার কয়েক ধাক্কাও খেলো।মিষ্টির থেকে দ্রুত সরে আসার কারণ হলো বিষণ্ণর খুব কান্না পাচ্ছে।মিষ্টি হয়তো জানেনা,তার সহজ ভাবে বলা কথাটা বিষণ্নর বেঁচে থাকার শেষ ইচ্ছেটাও শেষ করে দিয়েছে।

———-

বিষণ্নকে ছুটে বেড়িয়ে যেতে দেখে মিষ্টির মা বিষন্নকে কয়েকবার ডাকলেন।বিষণ্ন কিছু না বলে এক হাতে চোখের জল মুছতে মুছতে বেড়িয়ে গেলো।ব্যাপার কি বুঝতে মিষ্টির মা ছাঁদে আসলেন।দেখলেন মিষ্টি ছাঁদের রেলিঙ ধরে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তিনি মিষ্টির দিকে এগিয়ে আসছেন।পায়ের শব্দ পেয়ে মিষ্টি চোখের জল মুছলো।চোখ মোছার বিষয়টা মিষ্টির মা টের পেলেন।কাছে আসতেই মিষ্টি হাসি মুখে মায়ের দিক ফিরলো।মিষ্টির গালে এখনো কয়েক ফোঁটা জল জমে আছে। মা জিগ্যেস করে বললো

” মিষ্টি,কি হয়েছে তোর ”

মিষ্টি মুচকি হাসার ভান করে বললো ” কি আবার হবে। কিছুই তো হচ্ছে না ”

” তোর কলেজের ছেলেটার বিয়ের প্রস্তাবে না করে দিলি কেন বলবি?তোদের তো আগে থেকেই সম্পর্ক ছিলো ”

মিষ্টি চোখ মুখ শক্ত করে বললো ” ওনার সাথে আমার সম্পর্ক কে বলছে তোমায়?আমি কখনো বলছি?উনি ছ্যাচড়ার মতো পিছু ঘুরছে আর তোমরা ভেবে নিয়েছো ওনার সাথে আমার সম্পর্ক আছে।এমনটা যদি ভাবো তাহলে তো পুরো এলাকার ছেলের সাথে আমার সম্পর্ক আছে ”

মিষ্টির এমন উত্তরে মিষ্টির মা ভরকে গেলো।আমতা আমতা করে বললো ” উনি যে রাতে ফোন দিতো! ”

” উনি আমার স্যার হন।মুখের উপর তো ফোন কে’টে দিতে পারিনা ”

” একটু ভালোভাবে বললেও তো পারিস।এতো রাগ কেন তোর? ”

” তো কি করবো?বিষণ্নও তোমার মতো একই কথা ভেবে বসে আছে।ওরে কতবার বলছি,তবুও বারবার এক কথা বলে।দেইখো ওরে একদিন এমন মা’র মা’রবো! “।মিষ্টির রাগী চেহারা দেখে মিষ্টির মা আর কিছু বললেন না।

মিষ্টির বাবা ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বই পড়ছেন।অফিস থেকে দুপুরের খাবারের জন্য তিনি বাড়িতে আসেন।খাওয়া শেষে কিছুক্ষণ উপন্যাস পড়েন।আজকেও পড়ছেন।এমন সময় মিষ্টির মা এসে ঘরের দরজা লাগিয়ে দিলেন।মিষ্টির বাবা এখন উপন্যাসের শুরুর দিকে,বেশ ইন্টারেস্টিং একটা কাহিনি চলছে।ত্রিমুখী প্রেম।এমন ইন্টারেস্টিং কাহিনির মাঝ পথে উপন্যাসের বই উধাও হয়ে গেলো।তিনি ধরফর করে দাঁড়ালেন।মিষ্টির মা বললো

” বই আমি নিছি।মিষ্টিকে নিয়ে একটা কথা বলবো মনোযোগ দিয়ে শুনো ”

মিষ্টির বাবার রাগ এখন আকাশচুম্বী।রাগ সামলে বললেন ” তোমায় হাজারবার বলেছি পড়ার সময় বই কেড়ে নিবে না ”

” ধুর,রাখো তো তোমার গল্প।বুড়ো বয়সে এতো প্রেমের গল্প কি পড়ো তুমি ”

তিনি কঠিন চোখে তাকিয়ে বললেন ” কি বলবে বলে বই দিয়ে চলে যাও ”

” বলছি,তুমি আগে কাছে বসো।জোরে বলা যাবে না ”

” হু বসছি।বলো ”

” কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করছি মিষ্টি মন খারাপ করে ঘরে বসে থাকে।ঠিক মতো কলেজ যায় না,কান্না করে ”

” এই বয়সে এমন হয়।আমি তো ওর বয়সে দিনে দুইবার ম’রে যেতে চাইতাম ”

” সবসময় ফাজলামো করবে না ”

” আচ্ছা ”

” মিষ্টির মনে হয় কোনো ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে ”

” তো? ”

” তো মানে?তোমার মেয়ে প্রেম করছে,আর তোমার কাছে এটা স্বাভাবিক লাগছে? ”

” প্রেম তো খারাপ কিছু না।স্বর্গীয় একটা ব্যাপার ”

” হ্যা এমন স্বর্গীয় যে মেয়ে রোজ কান্না করছে ”

মিষ্টির বাবা চশমার ফাঁকে তাকিয়ে বললো ” তুমিও তো আমায় কম কাদাও নি। মনে আছে? সামান্য বিষয়ে কথা বলা বন্ধ করে দিতা।তখন আমার কান্না যেমন তুমি বুঝোনি তেমনি মিষ্টির কান্নাও ওই ছেলে বুঝতে পারছে না। যখন পারবে তখন আর কাঁদতে দিবে না ”

” ধুর ছাই,তোমায় বলাই ভুল হইছে ”

একথা বলে মিষ্টির মা হনহন করে বেড়িয়ে গেলেন।মিষ্টির বাবা বিছানা থেকে উপন্যাসের বইটা হাতে নিয়ে কোন যায়গা থেকে পড়া বাদ দিয়েছিলেন সেটা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে গেলো।খানিক্ষনবাদেই মিষ্টিকে রুমের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে দেখে তিনি ডাকলেন।মিষ্টি বাবার পাশে এসে বসলো।উঁকি দিয়ে বললো

” কি পড়ো? ”

” উপন্যাস ”

” এসব উপন্যাসে কি পাও বলোতো?বিষণ্নও কিসব গল্প,উপন্যাস লেখে।আমার দেখেই বিরক্ত লাগে ”

” তুই কি ব্যস্ত? ”

” কই না তো ”

” তাহলে বস।একটু গল্প করি ”

” হু বসলাম।গল্প শুরু করো ”

” আমি একটা উপন্যাস লিখবো ভাবছি।সেখানে তোর বয়সী একটা মেয়ের ক্যারেক্টার আছে ”

” ভালো তো ”

” মেয়েটা প্রায় সময় মন খারাপ করে থাকে,কান্না করে।আচ্ছা তোর কখনো কান্না পায় না? ”

” না তো। আমি সুখী মেয়েদের একজন।আমার কান্না পাবে কেন? ”

” এই বয়সে কান্না করার মতো অনেক ব্যাপার ঘটে।তবে জানিস তো,এসব মন খারাপ বেশিক্ষণ থাকে না ”

মিষ্টি মনে মনে বেশ মজা পাচ্ছে।সে বুঝতে পেরেছে যে তাকে ইঙ্গিত করেই বাবা এসব বলছে।অথচ এমন ভাবে বলছে যে বোঝার কোনো উপায় নেই।বাবার এমন ইঙ্গিতে কথা বলা দেখে মিষ্টি খুব মুগ্ধ হয়।মিষ্টির কাছে তার বাবা সবচেয়ে বুদ্ধিমান এবং সাহসী একটা পুরুষ।মিষ্টি ঠিক করে নিয়েছে তার জীবনসঙ্গীকেও অতি বুদ্ধিমান হতে হবে।তারপর বিয়ের পর বুদ্ধিমান জামাইকে দিয়ে বাবাকে জব্দ করাবে।ভবিষ্যতে যে এমনটা হবে সেটাও মিষ্টি জানে।কারণ মিষ্টি যে ছেলেটাকে পছন্দ করে,নাম জায়ান,সেও খুব বুদ্ধিমান একটা ছেলে।তাকে দিয়ে বাবাকে সহজেই ধরা সাঁই করা যাবে।

কিন্তু কান্নার কথা বাবা জানলো কি করে?মা বলেছে? মা দেখি আজকাল সব কথাই বাবাকে বলে দেয়।মিষ্টি বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বাবাকে বললো ” তোমার উপন্যাসের মেয়েটার কষ্ট শীঘ্রই কমে যাবে বাবা। তুমি এসব নিয়ে ভেবো না তো।পৃথিবীতে এক ধরনের মানুষ আছে যাদের কাজ হলো কথার জালে অন্যকে মুগ্ধ করা।তুমি তাদের দলের একজন।চিন্তা তোমায় মানায় না ”

একথা বলে মিষ্টি বাবার গা’লে আদর করে টিপে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো।

———

বিষণ্নর চোখ টকটকে লাল হয়ে আছে।পরপর তিনটা সিগারেট শেষ করে চতুর্থ নাম্বার সিগারেট ধরিয়েছে এমন সময় ফোন বেজে উঠলো।ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মিষ্টির মা বললো

” এই শোন,কই তুই? ”

” মেসে ”

” তোকে একটা কাজ দিবো করবি?”

বিষণ্ন সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললো ” কি কাজ?”

” ৮ ঘন্টার ডিউটি।একজনকে চোখে চোখে রাখতে হবে।পারবি না? ”

এমন প্রস্তাব শুনে বিষণ্নর খুব রাগ হতে লাগলো।একদিকে গ্লাস ভাঙ্গার জন্য পানিশমেন্ট অন্যদিকে মিষ্টির বিয়ে ঠিক হইছে,এসব ভেবেই বিষণ্নর আঁটসাঁট অবস্থা তার মধ্যে এমন প্রস্তাবে বিষণ্ণ রাগ কন্ট্রোল করে বললো

” আমার পরিক্ষা আছে আন্টি,এতো সময় তো দিতে পারবো না ”

মিষ্টির মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো ” তাহলে কি আর করার!তীতুকেই বলতে হবে ”

তীতু তো মিষ্টির বান্ধবী।তীতুকে দিয়ে কার উপর নজরদারি করাবে আন্টি?ঘটনাটা কি জানার মনের মধ্যে কিছুটা আগ্রহ জমতে লাগলো।বিষন্ন বললো ” তো কার উপর নজর রাখতে হবে? ”

” মিষ্টির উপর ”

বিষণ্ণ জরোসরো হয়ে বসলো।গম্ভীর হয়ে বললো ” কেন? ও কি করছে? ”

” কি করছে জানার জন্যই নজর রাখতে হবে। তোর তো পরিক্ষা। তুই পড় ”

” আরে আরে দাঁড়াও ফোন কেটো না ”

” কি? ”

” আমি থাকতে তীতু কেন? আমিই পারবো।তুমি বলো ”

” শোন বিষণ্ণ,এক মুখে কখনো দুই কথা বলবি না ”

” ভুল হয়ে গেছে ম্যাডাম।এখন বলো কি করতে হবে ”

” মিষ্টির উপর নজর রাখবি।কলেজে প্রাইভেটে সব যায়গায়,এক মুহুর্ত চোখের আড়াল করবি না।ও কি করছে আমায় দশ মিনিট পরপর জানাবি ”

বিষণ্ণ অবাক হয়ে বললো “কিন্তু কেন? ”

” তোকে বলা ঠিক হবে না। তুই এখনো ছোট ”

বিষণ্ণ মুখ ভোতা করে বললো ” আমি ছোট না।কলেজে পড়ি। তুমি বলো ”

” আমার মনে হয় মিষ্টি কাউকে ভালোবাসে।কাকে ভালোবাসে তুই খোঁজ নিয়ে জানাবি ”

বিষণ্ণ খাপছাড়া হেসে বললো ” মিষ্টি যাকে ভালোবাসে তার সাথেই তো বিয়ে ঠিক করছো তোমরা।কৌশিক স্যার।জানোনা নাকি?”

” তোর মাথা ঠিক আছে?বিয়ে ঠিক করলাম কখন ”

বিষণ্ণ চোখমুখ কুঁচকে বললো ” মিষ্টি যে তখন বললো ”

” ও মজা করে বলছে।জানিস ই তো ওর মজা করার অভ্যাস আছে।কৌশিক স্যারের সাথে ওর কোনো সম্পর্ক নাই।মিষ্টি ওনাকে ছ্যাচড়া বলছে ”

কথাগুলো বিষণ্ণর কাছে দ্রাম দ্রাম শব্দে বাজতে লাগলো।আন্টি যা বলছে সব কি সত্যি? কৌশিক স্যারের সাথে বিয়ে ঠিক হয়নি?ওনার সাথে কোনো সম্পর্কও নেই?আন্টি কি এটাই বললো? আমি ঠিক শুনছি তো? বিষণ্ণ উৎকন্ঠা চেপে বললো

” আন্টি কি বললে আরেেবার বলো প্লিজ ”

” এক কথা কয়বার বলবো? ”

নাহ,আন্টি তো এবারেও একই কথা বলছে।বিষন্ন হাসি চেপে রেখে চেঁচিয়ে বললো ” আন্টি দাড়াও,একটু পর ফোন দিচ্ছি ”

একথা বলে বিষন্ন ফোন কে’টে দিলো।পাগলের মতো দিশাহীন একটা ব্যাপার বিষণ্ণর মধ্যে কাজ করছে।মনে হচ্ছে পৃথিবীতে তার চেয়ে সুখী মানুষ খুব কম আছে।আনন্দে বিষণ্ণ কতক্ষণ যে ছাঁদে লাফালাফি করেছে সেদিকে কোনো হুস নেই।হুস ফিরলো মেসের তিনটা বড় ভাইয়ের ডাকে।তারা ঘুম জরিত কন্ঠে কড়া গলায় বললো

” সবাই ঘুমাচ্ছে দেখোস না? বান্দরের মতো লাফাস কেন? ”

বিষণ্ণ আনন্দ চেপে রাখতে না পেরে বড়ভাইদের সাথে নিয়ে লাফালাফি করতে শুরু করলো।বিষণ্ণ এখন যেন আর নিজের মধ্যে নেই।সিনিয়র ভাই রিয়াদ বারবার বলছে

” ব্যাডা লুঙ্গি ছাড়,গিট খুলে যাবে।লুঙ্গির নিচে কিছু পড়ি নাই।খুলে গেলে সর্বনাশ ”

কিন্তু সেই আকুতির কথা বিষণ্ণর কান অব্ধি গেলো না।লাফালাফির এক পর্যায়ে সিনিয়র ভাই রিয়াদের লুঙ্গি সত্যি সত্যিই খুলে নিচে পড়ে গেলো।সেই লুঙ্গি নিয়ে বিষণ্ণ ওর নিজের কো’মড়ে বাঁধলো।রিয়াদ লজ্জায় দুইহাতে লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করতে লাগলো।সুযোগ পেয়ে সাথে থাকা বাকি দুজন রিয়াদের নে’ংটু অবস্থার পটাপট পিক তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

পরেরদিন প্রিন্সিপালের রুমের মাঝে বিষণ্ণ করুণ মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।বিষণ্নর হাতে একটা খাম।প্রিন্সিপাল বললেন

” খামটা খুলে দেখো ”

বিষণ্ণ খাম খুললো।দেখলো সেখানে স্পষ্ট লেখা, শিক্ষকের বাড়িতে গিয়া বেয়াদবি করিবার মতো ধৃষ্টতার শাস্তি স্বরুপ হিসেবে সামনের বছরের ভর্তি কার্যক্রম বাতিল করা হইলো।

নামঃবিষণ্ণ
রোল নম্বর-২০৪

চলবে?

চলো না হারিয়ে যাই পর্ব-০২

0

চলো_না_হারিয়ে_যাই
#পর্ব_২
লেখকঃ জয়ন্ত_কুমার_জয়

মিষ্টি আপুর কো”মরে হাত রাখতেই আমার সারা শ”রীর শিউরে উঠলো।আকষ্মিক যে ব্যাপারটা ঘটলো সেটায় আমি প্রচন্ড ধাক্কার মতো খেলাম।আমার মাথা শূন্য হয়ে গেলো,দেখলাম মিষ্টির চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে।

আমি সরে দাঁড়ালাম।নিজেকে খুব তুচ্ছ আর নিকৃষ্ট মনে হতে লাগলো।মিষ্টি আপু চোখের জল মুছতে মুছতে বললো
” বিষণ্ন! তুই আমার সাথে এসব….”

বাকিটুকু বলার আগেই মিষ্টি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।আমি বুঝতে পারছি না কি করবো।আমি থতমত খেয়ে বললাম

” এই মিষ্টি,তুমি প্লিজ কান্না থামাও,আমি বুঝতে পারিনি।আমি….”

মিষ্টি হাত ইশারায় আমার কথা থামিয়ে দিয়ে অগ্নি দৃষ্টিতে চেয়ে বললো ” বিষন্ণ তুই আমার চোখের সামনে থেকে সর। নইলে আমার মতো খারাপ কিন্তু কেউ হবে না ”

মিষ্টি যে প্রচন্ড রেগে আছে সেটা বেশ বুঝতে পারলাম।তাই কিছু না বলে ওর ঘর থেকে বেড়িয়ে এলাম।

মেসের ছাদে চুপচাপ বসে আছি।সারা শরীর ঘামছে।এমন নিকৃষ্ট একটা ভাবনা আমার মাথায় এলো কিভাবে এই ভেবে কান্না করতে ইচ্ছে করছে।এই সবকিছু হয়েছে ওই লেকচারারের জন্য।

প্রচন্ড রাগে সাপের মতো ফস ফস করতে করতে উপস্থিত হলাম মিষ্টিকে দেখতে আসা সেই লেকচারারের বাড়িতে।বাড়ির গেইটে মোটা নেমপ্লেটে লেখা কৌশিক।লেখাটায় কষে একটা ঘু’ষি বসিয়ে দিলাম।এতে নেমপ্লেটের কিছু না হলেও আমার হাতের যে বারোটা বেজে গেছে সেটা বেশ বুঝতে পারলাম।হাত পে’টের সাথে চেপে ধরে প্রচন্ড ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলাম।

ঘুম ভাঙ্গলো পরেরদিন সকালে।ফোনে সময় দেখলাম দশটা পনেরো বাজে।আজ ক্লাস ১২ টায়।ফোনের দিকে হাত বাড়াতে টের পেলাম ডান হাত নাড়াতে পারছি না।কাল রাতের ঘু’সিটা বড্ড জোরে দিয়ে ফেলছি।

কলেজে ঢুকে আমার প্রথম কাজ মিষ্টিকে খোঁজা।মিষ্টিকে খোঁজা তেমন কঠিন কোনো কাজ না।ও বেশিরভাগ সময় লাইব্রেরিতে,নইলে ক্যাম্পাসের বাঁধানো মাঝারি সাইজের লিচু গাছটার নিচে বসে থাকে।

অবাক করার ঘটনা হলো আজকে মিষ্টি লাইব্রেরিতে বা লিচু গাছের কোথাও নেই।মিষ্টির দুইটা বান্ধবীর কাছ থেকে জানতে পারলাম মিষ্টি আজ কলেজে আসেনি।

হঠাৎ কানে ভেসে এলো কেউ যেন আমায় ডাকছে।আশেপাশে তাকালাম।দেখলাম আমার ঠিক পেছনেই দুঃখ বিলাশ চত্তরে লিওন ভাই বসে আছে।লিওন ভাই কলেজের রাজনীতির সাথে আঁটসাঁট ভাবে জরিত।কাছে যেতেই উনি বললেন

” কাল রাতে তুই কই ছিলি? ”

আমি নির্লিপ্ত স্বরে বললাম ” মেসে ”

লিওন ভাই আমার হাতের দিকে তাকিয়ে বললো ” তোর হাতে ব্যান্ডেজ কেন? কাঁচ লেগে কে’টে গেছে নাকি?”

আমি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম ” আরে না,কাঁচ আসবে কই থেকে।মেসে রান্না করতে গিয়ে একটু পু’ড়ে গেছে ”

লিওন ভাই ঠো’ট বাকিয়ে হেসে বললো ” কাল রাতে কৌশিক স্যারের বাড়িতে গিয়ে নিচ তলার সবকটা গ্লাস ভেঙ্গেছিলি কেন? ”

কথাটা শুনে আমি বেশ অবাক হলাম।একথা লিওন ভাইয়ের তো জানার কথা না।তবুও যতটা সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললাম

” কৌশিক স্যারের বাড়ির গ্লাস আমি কেন ভাঙ্গবো ”

লিওন ভাই অট্ট হেসে বললো ” সিসি ক্যামেরার বলে যে একটা ডিভাইস আছে সেটা হয়তো তোর অজানা ”

সাথে সাথেই আমার শরীর কেমন যেন হিম হয়ে আসলো।সত্যিই তো!তবে কি সিসি ক্যামেরায় আমায় দেখা গেছে?লিওন ভাই বললো

” মাস্ক পড়া থাকলেও ওইটা যে তুই ছিলি সেটা আমি জানি।তুই ফেঁসে গেছিস বিষণ্ন,বড্ড বড় ভুল করে ফেলছিস।কাল প্রিন্সিপাল তোকে ডেকেছে ”

” আমায় কেন ডেকেছে? ”

” কি জানি।কলেজ থেকে বহিষ্কার করে দিতেও পারে।এমনটাই তো শুনলাম ”

আমি আর কিছু বললাম না।যদি এটা প্রমাণ হয় যে আমিই গ্লাস ভেঙ্গেছি, তাহলে আমায় কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হবে এটায় কোনো সন্দেহ নেই।আমি এতো বোকার মতো একটা কাজ করলাম কিভাবে!সিসি ক্যামেরার কথা আমার মাথাতেই ছিলো না।এই মুহুর্তে মিষ্টির সাথে কথা বলা প্রয়োজন।আমি যেকোনো ঝামেলায় পড়লে মিষ্টিই আমার শেষ সম্বল।সে কিভাবে যেন আমায় সব ঝামেলা থেকে ঠিক বেড় করিয়ে আনে।আমার বিশ্বাস মিষ্টি এবারেও আমায় ঠিক সামলে নিবে।কিন্তু কাল রাতে যা করছি সেটা নিয়ে ও এমনেই অনেক রেগে আছে।

এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে মিষ্টিদের বাড়ির সামনে আসলাম।মিষ্টিকে ফোন করতে গিয়ে দেখি নাম্বার ব্লোক করে দিয়েছে।সোশাল সব যায়গা থেকে ব্লোক! দারোয়ান আমায় দেখে গেইট খুলে দিলো।বাড়িতে ঢুকে দেখি মিষ্টির মা রান্না করছেন।ওনা কাছে গিয়ে বললাম

” আন্টি এটা কি রান্না করছো? ”

আন্টির হাসি মিষ্টির মতোই অসম্ভব সুন্দর।মিষ্টি সম্ভবত আন্টির কাছ থেকেই এতো সুন্দর করে হাসতে শিখেছে।আন্টি হেসে বললো

” পিঠা বানাচ্ছি।খেয়ে যাবি কিন্তু ”

” আচ্ছা খাবো।তার আগে বলো মিষ্টি আপু কই ”

” ও মনে হয় ছাঁদে গেছে।গিয়ে দেখ ”

মিষ্টি ছাঁদের মাঝখানো রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে।বিষণ্ন দুহাতে মিষ্টির পা চেপে ধরে বসে আছে।পা চেপে ধরে বারবার বলছে ” মিষ্টি আমার ভুল হইছে।এমনটা আর হবে না।প্লিজ এবারের মতো মাফ করে দাও ”

প্রতিত্তোরে মিষ্টি মুখ ভোতা করে দাঁড়িয়ে আছে,কিছুই বলছে না।বেশ কিছুক্ষন এভাবে পা চেপে বসে থেকেও যখন মিষ্টির রাগ করছে না তখন বিষণ্ন ভ্যা ভ্যা করে কান্না করতে করতে বললো

” আমি একটা ঝামেলা করে ফেলছি।তুমি হেল্প না করলে আমায় কলেজ থেকে বেড় করে দিবে ”

মিষ্টি মুখ ভোতা করেই বললো ” বেড় করলে করবে।আমি কি করবো ”

মিষ্টির কথা শুনে বিষণ্নর মুখটা প্যাচার মতো হয়ে গেলো।মিষ্টি যদি সত্যিই কিছু না করে তাহলে তো নির্ঘাত কলেজ থেকে বের করে দিবে! এসব ভেবে বিষণ্ন আগের থেকেও জোরে শব্দ করে কান্না করতে করতে বললো

” নায়ায়ায়া,তুমি এটা করতে পারো না।বাবা যদি জানতে পারে যে স্যারের বাড়িতে হাম’লা করার জন্য আমায় কলেজ থেকে বেড় করে দিছে তাহলে আমায় পেঁয়াজের মতো কুচিকুচি করে কে’টে পিঁয়াজু বানায় খেয়ে ফেলবে।তুমি আমায় বাঁচাও প্লিজ,তোমার সব প্রাক্টিকেল আমি লিখে দিবো প্রমিজ ”

বিষণ্নর এমন কথা শুনে মিষ্টির প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে।অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখে বললো ” পা ছার।ভ্যা ভ্যা করে কান্না করতেছিস কেন?তুই তো দেখি বাচ্চাই থেকে যাবি সারাজীবন ”

বিষণ্ন বাধ্য ছেলের মতো মিষ্টির পা ছেড়ে উঠে দাড়ালো।মিষ্টি কঠিন স্বরে বললো

” এই টুুকুতেই চোখের জলে নাকের জলে এক করে ফেলছিস।চোখ মোছ ”

বিষণ্ন সঙ্গে সঙ্গে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছলো।বিষণ্নর এমন বাচ্চা ভাব দেখে মিষ্টির খুব হাসি পাচ্ছে।এই ছেলেটাকে দেখলে কেউ মনেই করবে না কলেজে পড়ে।মিষ্টি মৃদু স্বরে বললো

” এখন বল কি হইছে ”

” কৌশিক স্যারের বাড়িতে কাল রাতে গিয়ে নিচের ফ্লোরের সব গ্লাস ভেঙ্গে আসছি ”

মিষ্টি ভ্রু কুঁচকে বললো ” তুই ভাঙ্গবি গ্লাস! আর সেটা আমার বিশ্বাস করতে হবে? ”

বিষণ্ন আমতা আমতা করে বললো ” না মানে আমি বাইরে দাঁড়ায় ছিলাম।দুইটা পিচ্চিরে দিয়ে বাড়িতে ঢিল ছুড়ায়ে নিছি ”

” তুই থাকতে পিচ্চিদের দিয়ে ঠিক ছুড়িয়েছিস কেন? ”

বিষণ্ন মুখ ভেতা বলে বললো ” আমি অনেক কয়বার চেষ্টা করছি।গ্লাসে না লেগে অন্য যায়গায় লাগে।তাই পিচ্চি দুইটারে দিয়ে গ্লাস ভাঙ্গায় নিছি ”

” তা হঠাৎ গ্লাস ভাঙ্গতে গেলি কেন? ”

বিষণ্ন এর উত্তরে কি বলবে বুঝতে পারছে না।বিষণ্ন চাইলেও বলতে পারছে না যে ” তোমায় দেখতে এসছে, আর সেটা সহ্য করতে পারিনি জন্য রেগে গ্লাস ভেঙ্গে এসছি”।বিষণ্ণর চুপ থাকা দেখে মিষ্টি বললো

” কি হলো বল? ”

বিষণ্ণ চোখ মুখ কুঁচকে বললো ” উনি কেন তোমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে?এটা আমার মোটেও সহ্য হয়নি।তাই ”

” উনি বিয়ের প্রস্তাব আনলে তাতে তোর সমস্যা কি? ”

বিষণ্ণর ইচ্ছে করছে মিষ্টির দুই গা’ল টিপে লাল করে দিতে।এই মেয়েটা এতো কিছু বুঝে,অথচ বিষণ্ন যে ওকে এতো এতো পছন্দ করে সেটা কেন বুঝে না?

মিষ্টি বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো ” আজকাল তোর দেখি সাহস বাড়ছে।স্যারের বাড়ির গ্লাস ভাঙ্গছিস,সিনিয়র আপুদের কি’স করার ট্রাই করিস ”

মিষ্টির মুখে এই কথা শুনে বিষণ্নর মাথা দিয়ে ধোঁয়া বেড় হওয়ার মতো অবস্থা হলো।কপাল বেয়ে ঘাম পড়তে লাগলো।বিষণ্ন লজ্জিত ভঙ্গিতে বললো

” ইয়ে মানে,আসলে, মানে বিশ্বাস আমি ওসব করতে চাইনি ”

মিষ্টি ঠো’ট বাকিয়ে বললো ” কি’স করতে চাসনি? তাহলে কি করতে চেয়েছিলি?তার থেকে বেশি কিছু? ”

বিষণ্ন বিষ্ময়ে চোখ বড়বড় করে একপলক তাকালো মিষ্টির দিকে।তারপর মাথা নিচু করে রইলো।বিষণ্নকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলতে পেরে মিষ্টির মনে বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দ হতে লাগলো।

চলবে?

চলো না হারিয়ে যাই পর্ব-০১

0

চলো_না_হারিয়ে_যাই [১]
লেখকঃ জয়ন্ত_কুমার_জয়

” মাঝরাতে মিষ্টি আপুর সাথে ভয়ঙ্কর অন্যয় করার সিদ্ধান্ত নিলাম।চু’মু খাওয়ার থেকেও ভয়ঙ্কর কাজটা আজ রাতেই করবো ”

চিন্তাভাবনার এই পর্যায়ে ফোনটা বেজে উঠলো।স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলাম মিষ্টি আপু কল করেছে।মিষ্টিকে আপু বলছি কারণ মিষ্টি আমার এক ব্যচ সিনিয়র।রিসিভ করতেই ফোনের ওপাশ থেকে রাগী হুংকার ভেসে এলো

” এ পিচ্চির বাচ্চা!কই তুই? ”

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী একটা মেয়ের মুখে এরুপ কথা শুনে আমার কিঞ্চিৎ মন খারাপ হলো।মৃদু স্বরে বললাম

” আমি পিচ্চি না। কলেজে পড়ি ”

আরো কঠিন স্বরে জবাব এলো ” সারাদিন ধরে ফোন করছি, ফোন বন্ধ কেন? সমস্যা কি তোর? ”

আমার মনে মনে ভিষণ রাগ হতে লাগলো।এই মেয়েটা কি সত্যিই বুঝেনা আমার সমস্যা কি?সব কথা কি বলে বুঝাতে হবে?।
রাগ সামলে বললাম ” চার্জ ছিলো না ”

” আজ আমায় দেখতে আসবে এটা তুই জানতিস না?তোকে কাল কতবার করে বললাম আসার জন্য! আসলি তো না’ই,তার উপর ফোনটাও সারাদিন বন্ধ করে রেখেছিস।তোর হাতে আর ১৫ মিনিট সময় আছে।এরমধ্যে তোকে আমার সামনে দেখতে চাই ”

এতটুকু বলেই মিষ্টি আপু ফোন কে’টে দিলো।আমি মাঝরাস্তায় মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।সৃষ্টিকর্তা এই মেয়েটাকে রুপ আর রাগ দুটোই একসাথে উপুড় করে ঢেলে দিয়েছেন।

১৫ মিনিটের মধ্যে ওর সামনে না গেলে আমার কপালে যে ভয়ঙ্কর কিছু অপেক্ষা করছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি।পরিস্থিতি আগের মতো হলে এতোক্ষণে আমি দৌড় লাগাতাম।কিন্তু আজ তেমনটা করলাম না।

পরিস্থিতি আগের মতো নেই কারণ মিষ্টি আপুকে আজ ছেলেপক্ষ দেখতে এসছে।ছেলেটা মিষ্টি আপুর কলেজের লেকচারার।যত সম্ভব বিয়ে এতোক্ষণে ঠিক হয়ে গেছে।কারণ মিষ্টি আপুর সাথে ওই লেকচারারের আগে থেকেই পরিচয় আছে।প্রেমের পরিচয় বলা যায়।অথচ তার পিছে ঘুরঘুর করে ঘুরতে থাকা আমি যে তাকে মন দিয়ে বসে আছি সে বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই!

আর ঠিক এই কারণেই ঠিক করেছি মিষ্টি আপুর সাথে আজ রাতে ভয়ঙ্কর একটা অন্যায় করবো।যেটা গালে চু’মু খাওয়ার থেকেও ভয়ঙ্কর।যেটা করলে মিষ্টি আপু একান্তই আমার হয়ে থাকবে।যদিও পরিবারের সবাই জানতে পারলে কেলেঙ্কারি ব্যাপার হয়ে যাবে,তবে এতে ক্ষতি নেই।ভালোবাসায় কেলেঙ্কারি থাকাটা দোষের কিছু না।

রাত বাজে ১১টা।মিষ্টি আপুর পরিবারের সবাই এতোক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই।আমি দাঁড়িয়ে আছি তাদের বিশাল বড় গেইটের সামনে।দারোয়ান হাই তুলতে তুলতে বললো

” আপনের জইন্য ঘুমাইতে পারতাছি না ”

বিষ্মিত হয়ে বললাম ” আমি কি করলাম? ”

দারোয়ান বিরক্তি নিয়ে বললো ” ম্যাডাম বইলা দিছে আপনে আইবেন।হের জন্যই তো জাইগ্গা আছি ”

আর কিছু না বলে বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম।মিষ্টি আপু যথেষ্ট রেগে আছে বুঝতে পারলাম।দরজার সামনে এসে কলিংবেল চাপলাম।ভাবতে লাগলাম ভয়ঙ্কর কাজটা কোথা থেকে শুরু করবো।মনের মধ্যে একটা শিহরণ কাজ করতে লাগলো।গা ছমছমে একটা ব্যাপার।

দরজা খুললো মিষ্টির মা।আমাকে দেখে তিনি অসহায় ভঙ্গিতে বললেন ” তোমার কপালে আজ খুব দুঃখ আছে ”

আন্টির কথায় আমার তেমন ভাবান্তর হলো না।কারন আজ আমি যা করবো তাতে দুঃখটা আমার না,মিষ্টির কপালে নাচছে।আন্টিকে বললাম

” খুব রাগ করে আছে নাকি? ”

উনি গম্ভীর স্বরে বললেন ” যা কিছু হয়ে গেলো! রেগে তো থাকবেই ”

আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না ” যা কিছু ” টা আসলে কি।জানার চেষ্টাও করলাম না।আন্টিকে বললাম ” আন্টি যাই, মিষ্টি আপুর সাথে দেখা করে আসি ”

একথা বলে সিড়ি বেয়ে মিষ্টির ঘরের দিকে গেলাম।দরজার কাছে দাড়িয়ে বড়বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে হালকা করে নিলাম।তারপর দরজায় টোকা দিলাম।

খানিক্ষন বাদেই দরজা খুললো।দরজার ওপাশে ঘুমঘুম চোখে দাঁড়িয়ে আছে মিষ্টি।কি আশ্চর্য্য! ঘুমন্ত অবস্থায় মিষ্টিকে একদম রাজকুমারীর মতো লাগছে।অমিল শুধু একটাই।রাজকুমারীদের চোখের কাজল লেপ্টে যায় না,আর মিষ্টির কাজল লেপ্টে আছে।ঘুমের কারণেই বোধহয় লেপ্টে গেছে।তাছাড়া শাড়িটাও এলোমেলো।পাড়ের কাপড়টা আর একটু উপরে উঠলেই হাঁটু দেখা যাবে এমন অবস্থা।পে’টের বেশিরভাগ অংশ দৃশ্যমান হয়ে আছে।মিষ্টির লম্বাটে গর্তের না”ভিটার থেকে চোখ সরাতে আমার বেশ কষ্ট হলো।

মিষ্টি আপু ঘুম জরিত স্বরে বললো ” ঘুম পাচ্ছে।এখন যা ”

একথা বলে দরজা বন্ধ করবে তার আগেই আমি দরজা ঠেলে মিষ্টির শ’রীর ঘেঁষে ভেতরে ঢুকলাম।মিষ্টি আপু অনেকটা হকচকিয়ে গেলো।এতো শ’রীর ঘেঁষে রুমে ঢোকায় মিষ্টির চোখের ঘুম যেন উধাও হয়ে গেলো।

মিষ্টি আপু চোখ সরু করে বললো ” তোকে রুমে ঢুকতে বলছি? এভাবে হুটহাট রুমে ঢুকে পড়িস কেন? ”

আমি মুচকি হেসে বললাম ” তোমার রুমে ঢুকতে আবার পারমিশন লাগে নাকি? ”

মিষ্টি কিছু বললো না। রাগান্বিত চোখে শুধু বারবার দেখতে লাগলো।

রাত এখন ১২টার কাছাকাছি।এরমধ্যেই মিষ্টির রাগ গলে জল হয়ে গেছে।এই মেয়েটা যত দ্রুত রাগে তার থেকেই দ্রুত সময়ে সেই রাগ চলে যায়।কত অদ্ভুত সব বিষয় এই মেয়েটার মধ্যে আছে!

এই মুহুর্তে মিষ্টি আমার সামনের সোফায় দুই পা তুলে খিলখিল করে হাসছে।আমি ওকে নাটকের রাজকুমারের অভিনয় করে দেখাচ্ছি।রাজকুমারের এই চরিত্রটা তেমন হাসির না,তবুও মিষ্টি খুব হাসে।ওর হাসি দেখে আমারও হাসতে ইচ্ছে করলো।

ঠিক করলাম ভয়ঙ্কর অন্যায় কাজটা এখনই করবো।একপা একপা করে মিষ্টির কাছে এসে দাঁড়ালাম। মিষ্টি হাসি থামিয়ে বললো

” কি হলো থামলি কেন? ”

” আপু আমি তোমার সাথে একটা অন্যায় কাজ করবো।ভয়ঙ্কর অন্যায় ”

মিষ্টি আপুর ঠোঁ”টে এখনো হাসি লেগে আছে।সে এখনো বুঝতে পারছে না আমি কোন অন্যায়ের কথা বলছি। বললো

” কি অন্যায়? ”

আমি মিষ্টি আপুর আরো কাছাকাছি এসে দাঁড়ালাম।ওর ডান হাতে আমার হাত রাখলাম।বললাম

” অনেক অপেক্ষা করেছি আর সম্ভব না।তোমায় নিজের করে নিতে এই অন্যায়টা আমার করতেই হবে ”

একথা বলে মিষ্টি আপুর কো”মরে হাত রাখলাম।মুহুর্তেই আমার সারা শ”রীর শিউরে উঠলো।আকষ্মিক যে ব্যাপারটা ঘটলো সেটায় আমি প্রচন্ড ধাক্কার মতো খেলাম।আমার মাথা শূন্য হয়ে গেলো,দেখলাম মিষ্টি……

চলবে?

উজানের ঢেউ পর্ব-১৬ এবং শেষ পর্ব

1

#উজানের_ঢেউ (পর্ব ১৬ ও সমাপ্তি)
কলমে✍️ #রেহানা_পুতুল
তীক্ষ্ণ স্বরে মাহমুদ ভাই বলল,
” আমাদের রাবুকে ব্ল্যাকমেইল করেছে তার ভালোবাসার মানুষটা। মানে ওর প্রেমিক। তার জীবনের প্রথম অনুভূতি! প্রথম প্রণয়! তার প্রেমিকটা বড় স্বার্থপর! সিরিয়াস রকমের ধড়িবাজ! সেই প্রেমিকটাকে মন প্রাণ দিয়ে রাবু আজ রিক্ত! নিঃস্ব! ”

মুহূর্তেই দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়ে গেলো। মা ও বাবার মুখের উদ্বিগ্নতা,মমতা উবে গেলো কর্পূরের ন্যায়। এবং তার বদলে তাদের মুখাবয়বে স্থায়ী হলো রা*গ ও বিরক্তি। রাবু মাথা হেঁট করে বসে আছে। বাবার শাণিত দৃষ্টি রাবুর দিকে। মা অগ্নিমূর্তি ধারণ করলো। রক্তচক্ষু নিয়ে রাবুকে কর্দয ভাষায় বকুনি দিতে লাগলো গমগমে কন্ঠে।

মাহমুদ ভাই মাকে অধিকারসুলভ ভঙ্গিতে থামিয়ে দিলেন। বাবা মায়ের বড় ছেলে নেই বলে মাহমুদ ভাইর কিছুটা আধিপত্য আছে আমাদের পরিবারে। সেই প্রশ্রয়টুকু তারাই উনাকে দিয়েছে। এটার পিছনে কিছু ছোট বড় কারণও রয়েছে। সেসব বাকি থাকুক আজ। মাহমুদ ভাই রাবুকে বললেন,

” রাবু কথা বল। চুপ করে থাকা কোন সমস্যার সমাধান বয়ে আনতে পারে না।”

রাবু থম মেরে আছে মেঘাচ্ছন্ন গুমোট আকাশের ন্যায়। রাবু ভুল করে ভুল কাউকে মন দিয়ে বসে আছে। হৃদয়ে প্রচণ্ড আঘাত পেলো। প্রাপ্তি হলো সেই ছেলের সাথে তার কাটানো অম্লমধুর স্মৃতিগুলো। এই ভেবে রাবুর জন্য আমার দুঃখবোধ হচ্ছে। আমি মাহমুদ ভাইকে বললাম,

” মাহমুদ ভাই, আপনি যদি রাবু থেকে সব জেনে থাকেন,তাহলে আপনি ই বলেন।”

তখন মাহমুদ ভাই বলল,

রাবু কলেজে উঠার পর এক ছেলের সাথে সম্পর্ক শুরু হয়। আপনাদের ফোন দিয়েই সেই ছেলের সাথে সে যোগাযোগ করতো। দেখা হতো কলেজে মাঝে মাঝে। তো সেদিন রাবু ও সেই ছেলে মিলে সিনেমা দেখার কথা ছিলো। রাবু কলেজ শেষে রিকশা নিয়ে সেই ছেলের বলা স্থানে যায়। জায়গাটা নাকি নিরব ছিলো।

রাবু রিকশা থেকে নামলে দুটো ছেলে তাকে একটি রুমে নিয়ে আটকে ফেলে। তাদের মুখ ঢাকা ছিলো। খোলার পরেও রাবু তাদের চিনতে পারেনি। রাবুর কোন ক্ষতি করেনি তারা। কারণ তারা ছিলো ভাড়াটে। তারা রাবুকে দিয়েই দুই লক্ষ টাকা চায় আপনাদের কাছে। ব্ল্যাকমেইল করার উদ্দেশ্যেই ছিলো টাকা ও আপনাদের মান সম্মান নষ্ট করা।

আমি গতকাল সকালেই গ্রামে চলে আসি। থানায় গিয়ে পুরো বিষয় পুলিশদের অবগত করি। এবং পুলিশদের সঙ্গে নিয়েই বাকি সব কাজ সম্পন্ন করি।সেই একাউন্ট নাম্বারে দুই লক্ষ টাকা জমা দিই। পুলিশ তাদের পুরো বিষয় খুলে বলে সহযোগিতা করার জন্য। আমি ও দুজন পুলিশ ব্যাংকের পাশে নিচে লুকিয়ে থাকি। পুলিশ নাম্বার দিয়ে রাখে ব্যাংকে। যেনো টাকা নিতে এলেই মিসকলড দেয়। বেশ কিছু সময় পার হয়ে যায়। তারপর রাবুকে তারা ব্যাংকের সামনে ছেড়ে দেয়। টাকা তুলতে গেলে মিসকলড় আসে। পুলিশ দ্রুতগতিতে ব্যাংকে প্রবেশ করে এবং টাকা নিতে আসা ব্যক্তিদের আটক করে থানায় নিয়ে যায়। তারা অপরাধ স্বীকার করে। বলে তাদেরকে ঠিক করেছে চয়ন নামের একটি ছেলে। তাদের দিয়ে কৌশলে মিথ্যে বলিয়ে চয়নকে থানায় আনা হয়।

রাবু তখন ভালোবাসার মানুষের বিভৎস রূপ দেখে কেঁপে উঠে ভূমিকম্পের ন্যায়। আমিও বিস্মিত হই শুনে। চয়নকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে স্বীকারোক্তি দেয়,

তার খালা জুলেখা তাকে অনেক অনুনয় বিনয় করে রাজী করে। তারও খুব টাকার দরকার। তখন সে খালার কথায় গলে যায়। সে ধরা পড়ে যাবে এটা বুঝতে পারেনি। কন্ট্রাক্ট করে সেই দুইজন কিডন্যাপার পাবে পঞ্চাশ। তারা দুই জা নিবে পঞ্চাশ। আর এক লক্ষ নিবে চয়ন ব্যবসা করার জন্য।

আর চয়নের সাথে রাবুর পরিচয় আগে থেকেই ছিলো। কেননা চয়ন জেঠির ভাগিনা। আসা যাওয়া ছিলো আমাদের বাড়িতে। তবে আমি চয়নকে আজ গতকাল প্রথম দেখেছি। দেখতে সুবোধ বালক।

তবে এর মূল হোতারা এটা করেছে আমার জন্যই। কয়দিন আগে যে আমি রূঢ় বিহেভিয়ার করেছি। সেজন্যই নিজেদের ভিতরে আক্রমণাত্মক পশুটা জেগে উঠেছে। এই হলো ঘটনা।

মাহমুদ ভাই থামলেন। নিজেই উঠে গিয়ে টেবিল থেকে নিয়ে এক গ্লাস পানি খেলেন গলা তুলে। ফের এসে চেয়ারে বসলেন। মা বললেন,

” চিন্তা কর হারামজাদির কাজ কারবার। শত্রুর লগে পিরিত করতে গেছে উনি। বাবা তোর টাকা পাইছিস ?”

” টাকা তখনই নিয়ে ফেলছি চাচী।”

বাবা কিছুই বলল না কেন জানি। উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো বিমর্ষ চিত্তে। রাবু বিমূর্ত নয়নে আমার দিকে চাইলো। আমি রাবুকে বললাম,

” চয়ন যে কেমন ছেলে আর তোর জন্য সঠিক নয়। তাতো চাক্ষুষ প্রমাণ পেলিই। ঘৃণা কর জঘন্যটাকে।”

রাবুর মুখে কোন রা নেই। অবনত দৃষ্টিতে নিঃশব্দ পায়ে আমাদের সামনে থেকে চলে গেলো। মা ভারি ভারি পা ফেলে বাইরে গেলে গৃহকর্মে মনোযোগ দেওয়ার জন্য।

আমিও রুমের বাইরে পা রাখলাম যাওয়ার জন্য। পিছন হতে আমার হাতে টান পড়লো বড়শীর মতন। ঘাড় হেলিয়ে বললাম,

” কি মাহমুদ ভাই?”

” এই ফাজিল মেয়ে? লজ্জা করে না,হবু বরকে ভাই বলতে? ভাই শব্দটি আর একটিবারও তোমার মুখে শুনতে চাইনা আমি। ”

” আচ্ছা বলব না। হাত ছাড়েন না। উহু! কেউ এসে পড়বে তো?”

” জ্বিনা ম্যাডাম। এখন এই রুমে কেউই আসার নেই। কেউই আসবে না। হাত ছাড়ব তখন। বিয়ে করবে কবে, বলবে তুমি যখন।”

আমি মাহমুদ ভাইয়ের মুষ্টিবদ্ধ হাত থেকে আমার হাতকে ছাড়ানোর জন্য মোচড় দিচ্ছি। কিছু বলছি না। তিনি বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন, এক লহমায় আমার বুকের উপর থেকে পিনপিনে পাতলা জর্জেট ওড়নাটি সরিয়ে নিলো।

সেইক্ষণে আমার চোখে মুখে কোন কাঠিন্যতা এলনা। কোন তেজ ছড়িয়ে পড়ল না। কেবল অস্তমিত সূর্যের মতো আমার সমস্ত অনূভুতি মিলিয়ে গেলো এক লহমায় কোন সূদুরে। আমি বিবশ হয়ে দু’ নয়ন মুদে ফেললাম। উনি ওড়নাটাকে আমার মাথার উপরে দিয়ে বলল,
“বলনা বধূ কবে সাজবে? কবে বুকে আসবে?”

দেখলাম উনি নাছোড়বান্দা হয়ে আছেন। কিছু একটা না বলা পর্যন্ত আমার কাছ থেকে নড়বেন না।

বললাম,
” আমি জানিনা। আপনার ইচ্ছা।”

নিমিষেই উনার চোখের কোণে সুখের ফল্গুধারা বয়ে যেতে লাগল। আমার নাকের সাথে উনার নাক ঘষে বলল,

” মিষ্টি বউটা আমার। থাকো। আমি কিছুক্ষণ পরে ঢাকায় যাচ্ছি। একবারে বিয়ের সময় আসব।”

তার পরেরদিন দুই পরিবার বসে বিয়ের দিন চুড়ান্ত করে নিলো। একমাস পর বিয়ে। আমি নিয়মিত পার্লারে যাচ্ছি। পার্লার এগিয়ে যাচ্ছে ঠিকঠাকমতো। কাস্টমার বাড়ছে। নিজেকে আত্মপ্রতিষ্ঠা করতে পারব। এই বিশ্বাস আমার মনে স্থায়ী আসন গেঁড়েছে।

ডিভোর্স মানেই নারীর অবহেলা নয়। ডিভোর্স মানেই নারীর জীবন শেষ হয়ে যাওয়া নয়। নারী বাঁচুক সম্মানের সাথে আত্বনির্ভরশীল হয়ে।

একদিন নিজ থেকেই রাজনের বড় চাচী লায়লা ভাবিকে ফোন দিলাম। আলাদা আলাদা করে তাদের ঘরের সবার ভালোমন্দ খবর নিলাম। একসময় তাদের কত আপন ছিলাম।
জীবন ও জগত বড়ই রহস্যময়। তার রঙ্গখেলা বোঝার সাধ্য কারোই নেই। আপনকে পর করে দেওয়া,পরকে আপন বানিয়ে দেওয়া যেন তার হাতের তুড়ি মাত্র।

রাজনের দাদী নাকি আজকাল প্রায় শয্যাশায়ী হয়ে যায়। বিড়বিড় করে রাজনের কথা বলে সবার সাথে। রাজনকে দেখার আকুলতা প্রকাশ করে। আশরাফুল পঙ্গুত্ব বরণ করে নিয়েছে। লাঠি ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলাফেরা করে। কোন কাজকর্ম করতে পারেনা। নিজের অক্ষমতা ও দূর্গতির জন্য নিয়তিকেই দায়ী করে। প্রায় তাদের উপোস থাকতে হয়। সে ও শিরিন নাকি এখন বাড়িতেই থাকে অনাহুতের মতো। সন্তানের লাঞ্চিত জীবন দেখে করুণা করে বাড়িতে আশ্র‍য় দেয়া হয়েছে তাদের। শিরিনের ও আশরাফুলের দাম্পত্য নামেই ঝুলে আছে কলাবাদুড়ের ন্যায়। শিরিন চাকরি খুঁজতেছে হন্যে হয়ে। নিজের জন্য হলেও তার টাকার দরকার। টাকা পথ চলার শক্তি। টাকা বেঁচে থাকার অবলম্বন।

কারণ সে তার বাবার পরিবার থেকেও বিতাড়িত। তার বড় ভাইয়ের বাধা অতিক্রম করে চাইলেই তার মা বোনেরা তাকে কোনভাবে সাহায্য করতে পারেনা। বাড়িতে যেতে বলতে পারে না। তার ভাই বিদেশ থাকে। কিন্তু লোক লাগিয়ে রেখেছে। শিরিন বাড়িতে আসলেই যেনো তাকে জানানো হয়।

লায়লা ভাবির সাথে কথা শেষ করলাম। নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে তপ্তস্বাস বেরিয়ে এলো আক্ষেপ ও আফসোসের। এই আক্ষেপ আশরাফুলের জন্য নয়। শিরিনের জন্য নয়। করিমন ও জুলেখা জেঠির জন্য নয়। একজন মানুষ হিসেবে মানুষের জন্য। স্রস্টার সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের জন্য।

বিয়ে নিয়ে নানান ব্যস্ততায় দুই পরিবারের একমাস গত হলো। আজ আমার আরেকটি নব জীবন সূচিত হলো। ঘরোয়া আয়োজনে সবার উৎফুল্লতায়, আনন্দমুখর পরিবেশে গায়ে হলুদ ও বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেলো। রাবুও ছিলো বেশ প্রানবন্ত। এই ভিতরে সে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। কেটে গেলো তার জীবনে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবলীলার প্রভাব। রাজন ঘুরে ঘুরে আমাকে দেখছে অদ্ভুত চোখে। আমি রাজনকে কোলে তুলে অঝোরে কাঁদলাম নিজের অতীত স্মরণ করে।

বিকেলে আমাকে কোলে করে সেই ঘরে নিয়ে গেলো মাহমুদের বড় বোনের জামাই।কেননা কয়েক হাত ব্যবধানে দুই ঘর। তাই গাড়ি নিষ্প্রয়োজন। গ্রামে এই রীতি। বউ পায়ে হেঁটে স্বামীর ঘরে ঢুকবে না।
আমি আমার শ্বাশুড়িকে পা ছুঁয়ে সালাম দিলাম। তিনি হেসে উঠে বললেন,

” হইছে থাক। ঘরের মাইয়া ঘরে আইছে। এত নিয়ম মানামানিতে আমি নাই। সালাম ত এমনেই কত দেস। রুমে যাইয়া বইসা থাক মা।”

বড়াম্মু মানে শ্বাশুড়ির কথা শুনে ঘোমটার ভিতর আমার মুখে এক চিলতে প্রশান্তি দোল দিয়ে গেলো ধানের শিষের মতো।

রাত বেড়ে যাচ্ছে। আঁধার ঘন হচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা ঘুরে এগারোটায় চলে গেলো। বধূ সাজে সজ্জিত আমি। ফুলসজ্জার মাঝ বরাবর বসে আছি। মাহমুদ ভাই বর বেশে রুমে ঢুকলো। দরজা বন্ধ করে দিলো। আমার হৃৎপিণ্ড ধুকপুক করছে ক্রমাগত। মাহমুদ ভাইকে আজ অন্যরকম সুন্দর লাগছে। যা এর আগে কখনো লাগেনি আমার চোখে। হঠাৎ করেই চেনা মাহমুদ ভাইকে কেমন অচেনা লাগছে। আমি গোপনে পুলকিত হচ্ছি। আবার ভারি সংকোচ ও লাগছে।

মাহমুদ ভাই বিছানায় উঠে এলো আমার হাত টেনে নিয়ে উষ্ণ চুমু খেলো। মাথার উপর থেকে ঘোমটা নামিয়ে নিলো। পলকহীন নেশাতুর চাহনিতে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলো অবিকল। পরক্ষণেই আমার পানকৌড়ি বলে,
আমার খোলা ঘাড়ে তার চিবুক ঠেকিয়ে ধরলো। মাহমুদ ভাইয়ের ভারি গরম নিঃস্বাস আমি টের পাচ্ছি। অস্থির হয়ে উঠছি। আমার সমস্ত অনুভূতি অবশ হয়ে আসছে। উনি অধরজোড়াকে ঘাড় থেকে ধীরে ধীরে গলার সামনের অংশে বুকের মাঝে নিয়ে এলেন। আমি লাজুকলতার মতো মিইয়ে যাচ্ছি বুঁজে আসা আঁখিদ্বয় নিয়ে।

বাইরে মাঝারি দমকা হাওয়া বইছে। বাঁশঝাড়ের শাখায় শাখায় ঘর্ষণ হচ্ছে। একটা অশরীরী আওয়াজ ভেসে আসছে সেখান হতে৷ আমার শরীর হিম হয়ে আসছে। মাহমুদ ভাইদের ঘরের পিছন বরাবর এই বাশঁঝাড়টা। আমার শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে দিলাম তার উপরে।

শুধু তার পূর্বে মৃদু উচ্চারণ করলাম,

” মাহমুদ ভাই কি করছেন? বলে। ”

উনি নিরবতা ভাঙ্গলেন। দুষ্টমিষ্ট শিহরিত চোখে বললেন,

” ওই দেখো কারে কি কয়? স্বামীকে বলে ভাই। ইচ্ছে ছিলো এই মধুর রজনী উতলা করব মুখে কথা না বলেই। এই রাত তোমার আমার। কথা হবে না। শুধু কাজ আর কাজ হবে বিরতিহীনভাবে বন্য উল্লাসে। ”

আমি কিছুই বলতে পারছি না। তবে টের পাচ্ছি কিছু। মাহমুদ ভাই আমার মাঝে একান্ত সুখে বিভোর হয়ে আছে। সুখের নির্যাস নিতে তিনি ডুবুরির মতো সারা শরীরে হাতড়ে বেড়াচ্ছে হাতের ও দুই ঠোঁটের নিবিড় আলিঙ্গনে। একে একে সব গহনা উনি খুলে ফেলল। ওড়না সরিয়ে নিলো। শাড়ির আঁচল সরিয়ে বক্ষ উন্মোচন করল। তারপর আমার আর কিছুই মনে নেই। সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই নিজেকে আবিষ্কার করি মাহমুদ ভাইয়ের কোলে আমার মাথা। ধড়পড়িয়ে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল সেরে নিলাম। রাবুকে ফোন দিয়ে রাজনকে কাছে আনালাম। আমার কাছে রেখে দিলাম রাজনকে। মাহমুদ ভাই সেদিন আমাকে দেখলেই কেবল কামুক হাসি দিয়ে চোখ টিপ মারতো।

তার তিনদিন পর মাহমুদ ভাই ঢাকা চলে গেলো। সুযোগ পেলেই আমাকে ভিডিও কল দিচ্ছে। ফাজলামো করছে। মাহমুদ ভাইকে দেখলেই মনে হয়,

এমন নির্মল আর সতেজ মনের কাউকে ভালো রাখার জন্য হলেও জীবনের শেষ মুহূর্তে অবধি তার পাশে থাকতে হবে।

আমাদের দাম্পত্যের তিনমাস চলছে। দুই পরিবারের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক এখন আরো আন্তরিক। আরো বোঝাপড়ার। করিমন ও জুলেখা জেঠি তাদের অপরাধ স্বীকার করেছে পুলিশের কাছে। প্রাপ্য সাজা পেয়েই তারা মুক্তি পেয়েছে। আমার রাজন দুই পরিবারের আদরে,যত্নে বড় হচ্ছে। মাহমুদ ভাই আমার চেয়েও বেশী রাজনের প্রতি দায়িত্বশীল। মাহমুদ ভাইকে আমি আজকাল বড় বেশী ভালোবেসে ফেলার এটাই বড় কারণ। একজন মায়ের কাছে তার সন্তান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। খোদায় দেওয়া নেয়ামত।

সাংমা আমাকে জানাল। নতুন বিউটিশিয়ান পেয়ে গিয়েছে। মেয়েটা কাল থেকে চাকরিতে জয়েন দিবে। সকালেই চলে আসবে। এটা শুনে মাহমুদ ভাই বলল,

” সমস্যা নেই। আসুক। তুমি পার্লার ভাড়া,ও তাদের দুজনের সেলারি দিতে কোন মাসে আটকে গেলে আমিতো আছি। ”

শুনে অফুরন্ত ভালোলাগায় ভরে গেলো মনটা। পরেরদিন পার্লারে গেলাম ফুরফুরে মেজাজে। ভিতরে ঢুকেই চিরচেনা মুখটি দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। সেও লজ্জাবনত চোখে বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইলো আমার দিকে। সাংমা একবার শিরিনকে একবার আমাকে দেখছে।

যেই শিরিন আমাকে বন্ধুর মতো ভাবতো। পোশাকে,চলনে বলনে ছিলো যার ঠাটবাট। সেই শিরিনকে দেখতে এখন আমার চেয়েও বয়েসী মনে হচ্ছে। সেই শিরিন এখন আমাকে ম্যাডাম বলে ডাকবে। আমার দেওয়া বেতনে সে দিনানিপাত করবে। ভাবতে আমারই খারাপ লাগছে। আমি শিরিনকে তাড়িয়ে দিলাম না। কারণ মনুষ্যত্ববোধ আর মানবিকতার বীজ ছোটবেলায় মা বাবা আমার মাঝে বুনে দিয়েছে। পরে সাংমা থেকে জেনে নিলাম কিভাবে শিরিনকে পেলো। আমার বিষয়টা গোপন রাখলাম সাংমার কাছে।
কেবল বললাম,

“ওকে চিনি আমি।”

“নিজের দূর্বলতা কারো কাছে প্রকাশ করা মানেই নিজেকে তার কাছে দূর্বল করে তোলা। ”

আজ মাহমুদ বাড়ি এলো। বললাম,

” আমাকে নদীর পাড়ে নিয়ে যাবেন? আর কেউ না। কেবল আমরা দুজন। আমি উজানের ঢেউ দেখব। এখন তো বর্ষাকাল। দেখা যাবে। তাইনা?”

মাহমুদ ভাই আমার কোমর পেঁচিয়ে ধরলো। নিজের সাথে ভিড়িয়ে নিলো। দু’চোখের পাতায় কোমল চুমু খেলো।বলল,
” তাই হবে আমার পানকৌড়ি। কালই চলো মেঘনার ঘাটে।”

সময়টা শ্রাবণ মাসের কোন এক মধ্য দুপুর। আমি আর মাহমুদ ভাই মেঘনার পাড়ে বসে আছি খুব কাছাকাছি হয়ে। মাথার উপরে উদার আকাশ। তার বুক চিরে দু’ ডানা মেলে উড়ে গেল একটি শঙ্খচিল।

বিস্তৃত প্রান্তর। দিগন্ত জুড়ে স্বচ্ছ জলরাশি। দু’চোখ যেদিকে যায়। তাতে পানি আর পানি। সেই উথাল-পাথাল পানিতে খেলা করছে ছোট বড় ঢেউ। আমি ভাবছি জীবনের উজানের ঢেউ সবার উপরেই আছড়ে পড়ে। এটাকে মোকাবিলা করে টিকে থাকতে পারে কজন। পারলেও কি সবাই একভাবে পারে? কজন আমার মতো সাঁতার কেটে কূল ছুঁতে পারে সফলতার সঙ্গে। সবার জীবনে কি মাহমুদরা থাকে? জীবনের এই উজানের ঢেউ হানা দিয়েছে আশরাফুল, শিরিন,রাবু,আমি,করিমন,জুলেখা,চয়ন সবার জীবনেই।

আমার ভাবনার ইতি ঘটে মাহমুদ ভাইয়ের নরম ডাকে।

“এই তোমার চুলগুলোকে সাবধানে রাখতে পারনা? এত অবাধ্য কেনো?”

” আমার চুলে কি করেছে আপনাকে?”

” কি করেনি? বারবার আমার মুখের উপর বেসামাল হয়ে তেড়ে আসছে। সরে বসো। খোঁপা করে ফেলো নইলে।”

আমি কপাল কুঁচকে হুহ, করে সরে গেলাম তার পাশ থেকে। একটু পরেই উনি আমার বাহু ঝাঁকিয়ে টেনে ধরে বলল,

” এই রত্না দেখো দেখো,ওই যে উজান ঢল আসছে স্রোতের বিপরীত দিক হতে। দেখছ? এই উজান ঢলেই কত মানুষ হয় বাস্তুহারা। নিঃশ্চিহ্ন হয়ে যায় তাদের জীবনের সব। ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে কজন।”

মাহমুদ ভাইয়ের কাঁধের উপর আমি মাথা এলিয়ে দিলাম। উজান স্রোতের ভয়াল ঢেউয়ের দিকে এক আশ্চর্য দৃষ্টিতে ঠায় চেয়ে আছি ধ্যানমগ্ন ঋষির ন্যায়।

সমাপ্তি।

উজানের ঢেউ পর্ব-১৫

0

#উজানের_ঢেউ ( ১৫
কলমে✍️ #রেহানা_পুতুল
” এই পুলিশ কেন? মাহমুদ কই তুই বাবা?”
” চাচী এখন একটা নাটক হবে আমাদের বাড়িতে। সেই নাটকটি জমাতে উনাদের ভূমিকা শতভাগ। সবাই আসুন বাইরে।”

আমার কাছ থেকে ছিটকে সরে গিয়ে মাকে বলল মাহমুদ ভাই।”

চিন্তাগ্রস্ত কন্ঠে মা জানতে চাইলো,

” কিসের নাটক বাবা ? কিছুই তো বুঝতেছি না?”

মাহমুদ ভাই মায়ের কথার জবাব দিল না। হাত উঁচিয়ে ইশারায় বাবা,মাকে তাদের পিছনে যেতে বলল। আমরা সবাই তাদের পিছুপিছু সন্তপর্ণে এগোতে লাগলাম বিড়াল পায়ে। পুলিশ চারজনকে নিয়ে মাহমুদ ভাই বাড়ির শেষ প্রান্তে চলে গেলো। জুলেখা ও করিমন অর্থাৎ সেই দুই জেঠিদের ঘরের সামনে গিয়ে থামলো। পুলিশ দুজন করে চারজন ভাগ হয়ে গেলো দুই ঘরের সামনে।

মাহমুদ ভাই মাকে ও আমাকে কানে কানে শিখিয়ে দিলো,তাদের দরজায় নক করার জন্য। কারণ অন্য পুলিশ বা মাহমুদ ভাইয়ের কন্ঠ শুনলে তারা দরজা খুলবে না। তারা ঘরের ঢেলার একপাশে কিছুটা আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মা ও আমি সেই অনুযায়ী কাজ করলাম। করিমন জেঠিদের দরজা খুলল তার স্বামী। মা বলল,

” ভাবিরে একটু ডাক দেন ভাই কষ্ট করে। জরুরী দরকার।”

জেঠা জেঠিরে ঘুম থেকে ডেকে উঠালো। অমনি পুলিশ তিনপায়ে এগিয়ে এলো।জেঠির হাতে হাতকড়া পরিয়ে ফেলল। নরম সরম হলেও হিংসুটে জেঠি কেঁপে উঠলো ঝড়ো হাওয়ায় দুলতে থাকা সুপারি গাছের মতন।

আমি ডাকলাম জুলেখা জেঠিকে। উনার ছোট ছেলে তাকে ডেকে আনলো দরজায় আমার অনুরোধে। বাকি দুজন পুলিশ একই কায়দায় এগিয়ে এলো। উনার হাতে হাতকড়া পরিয়ে নিলো। উনি চেঁচিয়ে উঠলেন ঝাঁঝালো স্বরে। তুই তোকারি শুরু করলেন পুলিশের সাথে। দুই ঘরের সব মানুষের নিদ্রা ভঙ্গ হলো। এবং সবাই জড়ো হয়ে গেলো একত্রে।

বিদুৎ চলে এলো। উঠানোর হাই ভোল্টেজের বাল্ব জ্বলে উঠলো। মাহমুদ ভাই এগিয়ে এলো। মা নির্বিকার চোখে বাড়ির দুই জাকে দেখতে লাগলো। মায়ের চোখের ভাষা এমন,

একি কুৎসিত বিদঘুটে রূপ তোমাদের। একি নগ্ন কার্যকলাপ। অথচ যুগ যুগ ধরে এই একই বাড়িতে আমরা পাশাপাশি বাস করে আসছি। ভালোতে ছিলাম। মন্দতে ছিলাম। মমতায়,আন্তরিকতায়। সঙ্গী হয়ে। আপন হয়ে। বোন হয়ে। বছর দুয়েকের তিক্ততায় তোমরা এত হিংস্র হয়ে উঠলে? নারী হয়ে নারীর উপর জুলুমের পাঁয়তারা করলে? ধিক জানাই ধিক! ওয়াক থু করে মা এক দলা থুথু ছুঁড়ে মারলো মাটিতে।

তাদের দুই পরিবারের লোক, মাহমুদ ভাই ও পুলিশকে জিজ্ঞেস করলো ক্ষেপানো স্বরে,

” বুঝলাম না। নিখোঁজ হইলো হেগো মাইয়া। আবার ফিরাও পাইলো। কিন্তুক আপনারা অবলা মাঝবয়েসী দুই নারীকে কেন এই রাইতের কালে এরেস্ট করলেন? হাতকড়া খুলেন কইতাছি। ”

মাহমুদ ভাই নিঃশ্চুপ। তবে চোখের চাহনি রুক্ষ,বিরক্তিকর ও র’ গ*চ* টা।

পুলিশ বলল,
” আমরা আইন অমান্যকারী নই। ভঙ্গকারী নই। আমরা আইন রক্ষাকারী। আইনকে যথাযথ সম্মান করতে জানি। এই দুজন নারী অন্যায়ভাবে বিনা কারণে রাবু নামের মেয়েটিকে ব্ল্যাকমেইল করালো। উপযুক্ত প্রমাণ হাতে রয়েছে। তাই এখন থানায় নিয়ে যাচ্ছি তাদের দুজনকে। যা বলার আপনারা কাল থানায় গিয়ে নির্দোষ প্রমাণ করে ছাড়িয়ে নিয়ে আসবেন।”

ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা সবাই বেহুঁশ হওয়ার উপক্রম। আমরা নারী জাতি এত কেন এতটা প্রতিশোধ পরায়ন? কেন এত জেলাসী? ওহ নো! মাথা ভনভন করছে আমার।

সেই নিরব নিশির আঙিনা সরব হয়ে উঠল বাড়ির কিছু মানুষের পদাচারণায়। অদূরে হাসনাহেনার গাছের উপরে একঝাঁক ঝিঁঝি পোকা এই জ্বলছে। এই নিভছে। দারুণ পিনিক লাগছে দেখতে।

মাহমুদ ভাইয়ের বড় ভাবি পারুলও আছে একপাশে দাঁড়িয়ে। মামা বেকুবের মতো চেয়ে আছে দুই জেঠির দিকে।

তখন সেই দুই জেঠি আহত কন্ঠে বলে উঠলো পুলিশের দিকে চেয়ে,

” অসম্ভব! আল্লাহর দোহাই লাগে, রাবুর বিষয়ে আমরা কিছুই জানিনা। আমাদের মান খোয়াবেন না। আমরা কেন এসব করাবো? আমাগো ছাইড়া দেন পুলিশ বাবাজিরা। এসব মাহমুদের কাম। ওই বেশী ভালা পোলা না। ”

তখন ঘরের ভিতর থেকে জেঠির মেয়ে মেরিনা বলে উঠলো,

” জ্বি স্যার। আমার আম্মা, চাচী ঠিক বলছে। মাহমুদ ভাই করছে এই কাজ। কারণটাও শুনেন। মাহমুদ ভাই রাবুকেও পছন্দ করে। রাবুকে ব্ল্যাকমেইল করেছে। যেন রাবুর চরিত্রে স্পট পড়ে যায়। তার আর কোথাও বিয়ে হবে না। তখন মাহমুদ ভাই তাকে বিয়ে করবে। দুই বোনকে তার দুইপাশে রাখবে।”

মুহূর্তেই বাবা ককর্শ কন্ঠে ধমকে উঠলো তাকে। এবং তেড়ে যাচ্ছে মেরিনার দিকে। তার আগেই মাহমুদ ভাই দু পা এগিয়ে গেলো। মেরিনার একহাত পিছনে নিয়ে উল্টিয়ে ধরলো। কন্ঠস্বরকে মাঝারি উচ্চতায় রেখে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,

” মেয়ে মানুষের গায়ে হাত দেয়া খুব বাজে বিষয়। নইলে তোকে এখন জ্যান্ত পুঁতে ফেলতাম তোদের ঘরের ভিটাতেই। নিজে বিয়ে বসতে চেয়েছিস আমার কাছে। পারিসনাই দেখে অন্যের নামে বদনাম রটিয়ে জ্বালা মিটাতে চাস। নাহ?”

মেরিনা কুঁকিয়ে উঠলো। মেরিনার স্বামী এসে মাহমুদ ভাইয়ের নাকমুখে ঘুষি মেরে বসল ধুম করে। মাহমুদ ভাই উল্টো তাকে লাথি মেরে বসল। সে পেটে হাত চেপে ধরে সরে গেলো। মাহমুদ ভাই পুলিশদের অনুরোধ করে বলল,

” আপনারা উনাদের নিয়ে যান।”

তারা দুই জেঠিকে গাড়িতে তুলে ফেলল। গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার আগে মাহমুদ ভাই গাড়ির সামনে গিয়ে তাদের বলল সবাইকে শুনিয়ে,

” আপনারা ধরা পড়তেন না। কিন্তু যেই নাটক সাজিয়েছেন, তা প্ল্যান মোতাবেক হয়নি। সেয়ানের উপরেও তো সেয়ানা আছে। যাকে দিয়ে চাল দিয়েছেন দাবার গুটি। সে ব্যর্থ হয়েছে। আপনাদের লোক হলেও সব হুড়হুড় করে উগরে দিয়েছে। কারণ প্রাণের ভয় সবার আছে। মানুষ সবচেয়ে বেশী নিজেকেই ভালোবাসে। মেয়ে মানুষের বুদ্ধি আসলেই পুরুষের হাঁটুর নিচে থাকে। শুনতে তিতা লাগলেও এটাই সত্যি। আর আপনারা কেন করেছেন? সেটা আমি যেমন জানি। তেমনি আপনারাও দুজন জানেন। ”

পুলিশ গাড়ি ছেড়ে দিলো। আমরা সবাই আমাদের ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। তাদের দুই ঘরের মানুষ এক হয়ে গেলো। জটলা বেঁধে তারা চেঁচামেচি শুরু করলো। অভিসম্পাত দিতে থাকলো মাহমুদ ভাইকে।

উজানের ঢেউ সবার জীবনেই আছড়ে পড়ে কমবেশি। এই কঠিন সত্য আরেকবার উপলব্ধি করতে সক্ষম হলাম আমি।

মাহমুদ ভাই গালে হাত দিয়ে মাকে বলল,
” নাটক দেখেছেন চাচী?”

” দেখলাম। এত কাছের মানুষজন থেকে এত বিষাদের নাটক আমার কল্পনাতীত ছিলো বাবা।”

নিদারুণ স্বরে বলল মা।

নাটক শেষ হয়নিতো চাচী। আরো যে বাকি আছে।”

মা চমকানো দৃষ্টিতে মাহমুদ ভাইয়ের দিকে চাইলেন। বাবা বললেন,

” তাতো তখন তোমার কথা শুনেই বুঝলাম। আগে নাকমুখে বরফ ঘঁষে ভাত খেয়ে নাও।”

” নাহ কাকা। ঘরে যাবো। ফ্রেস হবো। খাবো। আমি খুব টায়ার্ড। আপনারা সবাই এখন ঘুমিয়ে যান। সকালে বাকি বিষয় জানাবো। সবার উপরেই ধকল গেলো।”

মাহমুদ ভাই চলে গেলো তাদের ঘরে। যাওয়ার আগে সবার অলক্ষ্যে আমার দিকে চাইলো। ক্লান্ত নেত্রপল্লব দুটিকে একবার বুঁজে নিলো। আমি কিছু কল্পনা করলাম। মাহমুদ ভাই যেন আমাকে ছুঁয়ে বলছে,

” প্রথম যেদিন দেখেছিলাম তোর ওই মায়াবী চোখ।
সেদিন হতে তোকে ভালবাসি, তুই আমার সুখ।
তুই আমার সকাল সন্ধ্যা, তুই আমার ভোর।
তুই আমার সকল নেশা,তুই আমার ঘোর। ”

গোপনে রোমাঞ্চিত হলাম। ভালোলাগার মানুষকে কল্পনা করলেও এত সুখ। তা আগে কখনো টের পাইনি।

রাতে আমরা রাবুকে কেউই কিছু বললাম না। কিছু জানতেও চাইলাম না। রাবুও দরকার না হলে আমাদের কারো সাথে কোন কথা বলেনি।
রাবুসহ নৈশভোজ সেরে যার যার বিছানায় চলে এলাম।

রাবু রুমে এসে ঘুমন্ত রাজনের গালে গাল ঠেকিয়ে ধরলো আদুরে ভঙ্গিতে। আমাদের অপেক্ষা সকালের। আমি রাবুকে পরখ করে দেখলাম অনুসন্ধিৎসু চোখে। রাবুর সারামুখজুড়ে একাকীত্বের ছাপ। শূন্যতা, অভিমান,দোটানা রাবুকে অক্টোপাসের মতো ঘিরে আছে। কোন গভীর দুঃখবোধ রাবুকে কাবু করে ফেলছে। কোন কবি লেখক এখন এই রাবুকে দেখলে একটা মন খারাপের গল্প নয়তো কবিতা রচনা করে ফেলতে পারতো।

ভুল করে হলেও আমার অচেতন মনে একবার মনে হলো,

” রাবু কি শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছে? না না। একি ভুলভাল ভাবছি আমি। ”

পরেরদিন সকালে মামার তাড়া আছে বলে চলে গেলো। নয়ন স্কুলে চলে গেলো। রাবুর কলেজ খোলা। মন খারাপ বলে যাবে না জানিয়ে দিলো।

মা বলল,
” থাক একদিন না গেলে এমন ক্ষতি হবে না। পুষিয়ে নিতে পারবে পরে।”

বাবা আমাকে বলল,

” মাহমুদ তো এখনো এলনা। একটু ডেকে আন মা। আমি দোকানে যেতে হবে। বাকি বিষয় আশয় ওর থেকে শুনে নিই। দুই লক্ষ টাকা কে কার জন্য দেয়। কত মহান আমার ভাতিজাটা।”

মা পাশ থেকে বলল বাবাকে,

” আপনার যা কথা। রত্না এখন কি ওদের ঘরে যায়? যাওয়া মানায়? কয়দিন বাদেই বউ হয়ে যাবে ওদের ঘরে। আমিই গিয়ে ডেকে আনতেছি।”

মাহমুদ ভাই নাস্তা করে আমাদের ঘরে এলো। আমার রুমে উঁকি দিলো চোরের মতো। সেইক্ষণে আমার মুখ দিয়ে অজান্তেই বেরিয়ে এলো,

” মাহমুদ ভাই,আপনাকে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে ভালো লাগছে। মজনু সেজেছেন কার জন্য?”

তিনি হঠাৎ করে কিছু পাওয়ার মতো চাইলেন আমার দিকে। উনার চোখের পাড়ে খেলা করছে ছলচাতুরী। ভাবুকের মত করে বললেন,

” থ্যাংকস গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশনটা দেওয়ার জন্য।”

আমি নাক কুঁচকে ঠোঁট বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

“কি? বুঝিনি।”

উনি আমার নাক টিপে দিয়ে বললেন,

“এটা ফুলসজ্জার সময়ের কাজ।তখন বলব।”

আমি আড়ষ্ট হয়ে নিজের দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললাম।

” ওরে ঢংগীরে আমার। একবার কেবল পাই কাছে। সংঘর্ষ কারে বলে বুঝিয়ে দিব। রাবুকে নিয়ে এদিকে আয়। ”

আমি,মা,বাবা,রাবু,মাহমুদ ভাই বসা। মাহমুদ ভাই বলল,

” এই রাবু। তুই নিজের মুখেই সব বল। পরে আমার পার্ট আমি বলছি।”

রাবু নিচু মাথায় ঠায় বসে আছে আসামীর মতো। মুখ খুলছে না। মা রাবুকে ঠান্ডা মেজাজে বলল,

” কিরে বল? কিভাবে কি হলো? কে তোকে ব্ল্যাকমেইল করলো? কিছুই তো আগামাথা বুঝতেছি না। এই দুইদিনে আমাদের কেয়ামতের আলামত দেখা হয়ে গেছে৷ ”

রাবু তবুও মেলানো ঠোঁট মেলছে না। সং হয়ে বসেই আছে দুই হাঁটু ভাঁজ করে কুণ্ডলী পাকিয়ে। সম্ভবত বাবার সামনে বেশ সংকোচবোধ করছে।

তখন মাহমুদ ভাই বলে উঠলো,

” বুঝেছি। আমারই শুরু করতে হবে।”

” হ্যাঁ বাবা। তুই বল তো কাহিনীর আগাগোড়া? তোর কাকা দোকানে যেতে হবে। তাড়া আছে।”

তীক্ষ্ণ স্বরে মাহমুদ ভাই বলল,

” আমাদের রাবুকে ব্ল্যাকমেইল করেছে তার ভালোবাসার মানুষটা। মানে ওর প্রেমিক। তার জীবনের প্রথম অনুভূতি! প্রথম প্রণয়! তার প্রেমিকটা বড় স্বার্থপর! সিরিয়াস রকমের ধড়িবাজ! সেই প্রেমিকটাকে মন প্রাণ দিয়ে রাবু আজ রিক্ত! নিঃস্ব! ”

চলবে.. ১৫

উজানের ঢেউ পর্ব-১৪

0

#উজানের_ঢেউ ( ১৪)
কলমে✍️ #রেহানা_পুতুল
মা বুক চাপড়ে গগন কাঁপিয়ে আর্তনাদ করছে। আমরা সবাই অশ্রুবিলাপে ভেসে যাচ্ছি আমাদের চঞ্চল চড়ুয়ের মতো নিখোঁজ রাবুটার জন্য।

বাড়ির অনান্যরাও এগিয়ে এসেছে আমাদের এই ঘোর সংকটে। যাদের সাথে আমাদের বিবাদ। সেই দুই জেঠি ও এক জেঠাও এগিয়ে এলো আমাদের ঘরে। আক্ষেপ ও আফসোসে তাদের দুই জায়ের কপালে শত ভাঁজ বিদ্যমান।

বাবা আমার এক মামাকে নিয়ে থানায় চলে গেলো জিডি করার জন্য। আমি কান্না করতে করতে জড়ানো স্বরে মাহমুদ ভাইকে জানালাম। ততক্ষণে মাহমুদ ভাই ঢাকার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছেন। মাহমুদ ভাই বাকরুদ্ধ কন্ঠে বললেন,

” কি বলছিস এটা! আমি আর স্থির থাকতে পারছি না। ব্যাক আসাও সম্ভব নয়। এখানে জরুরী কাজ আছে কাল। এই সময় তো গ্রামে যাইনা। কাল গেলাম কেবল তোর সাথে দেখা করতেই। আমার যত যা করণীয় সবই করবো। কাকাকে থানায় যেতে বল। বসে থাকলেই ক্ষতির সম্ভাবনা প্রবল। কেননা, রাবু তরুণী একটা মেয়ে।”

” এজন্যই তো রুহটা কবজ হয়ে যাচ্ছে মাহমুদ ভাই।”

মোবাইল রেখে দিলাম। আমি ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করছি,

হঠাৎ করে আমার প্রাণচঞ্চল বোনটা কই গেলো? নাকি নিখোঁজ হলো? হলেও কি সেই কারণ? নাকি কোন নষ্ট ছেলের দলের খপ্পরে পড়ে গেলো? নাকি কোন মলম পার্টি বা অজ্ঞান পার্টির কবলে? নাকি কেউ প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে রাবুকে ইউজ করলো? নাহ কি সব আবোলতাবোল ভাবছি। মা বিছানার উপরে বসে আছে হাত পা ছড়িয়ে। মায়ের বেশ উম্মাদিনীর মতো। নয়নকে বুকে লেপ্টে ধরে আছে মা।

বাড়ির অনান্যদের দিকে চেয়ে মা অস্ফুট স্বরে বলল,

” আমার রাবুটারে কি ভালোভাবে ফিরে পাবো না আমার বুকে?”

তারা মায়ের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে শান্তনার বুলি শুনালো যত যা পারলো। মা ও আমার ফোনে সব নিকট আত্মীয় দূরাত্মীয়রা ফোন দিতে লাগল রাবুর খোঁজ নেওয়ার জন্য।

বাবা ও মামা চলে চলে এলো থানা থেকে। বাবা নির্জীবের ন্যায় বসে আছে কাঠের চেয়ারের হাতল ধরে। মামা আমাদের সবাইকে শুনিয়ে বলল,

পুলিশ আমাদের থেকে প্রয়োজনীয় সব তথ্য নিয়েছে রাবু সম্পর্কে। পুলিশ আরো বলছে কাউকে সন্দেহ হলে যেন তার নামে মামলা দিই। দুলাভাই বলল, আপনাদের সাথে কারোই মারাত্মকভাবে দ্বন্দ্ব নেই। অল্পস্বল্প আছে বাড়ির জায়গা নিয়ে। তখন সেই দুই জেঠি ও জেঠা ছিলনা কিন্তু।

তার কিছুক্ষণ বাদেই বাবার ফোন বেজে উঠলো। অচেনা নাম্বার। বাবা রিসিভ করলো। লাউড স্পিকার দেওয়া। আমরা উপস্থিত সবাই বাবার সেলফোনের দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছি হা হয়ে।

বাবা হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো রাবুর কন্ঠ,

” আব্বা আমি রাবু। তোমরা চিন্তা করো না আমার জন্য। আমার কোন সমস্যা হয়নি। কিন্তু আমি অন্যরকম একটা বিপদে আছি আব্বা।”

মা, রাবুউউ… বলে চিৎকার দিতে গেলেই আমি নিজের ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে মাকে,

হিসসসস… বলে চোখ দিয়ে ইশারায় চুপ করিয়ে দিই।

” কি বিপদ আম্মা? তুই কই গেলি? কই আছিস? ”

” আব্বা এখন এত কথা বলার সময় নাই। আমি একটা ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার দিতাছি। এখানে কাল সকালে দুই লক্ষ টাকা পাঠিয়ে দিও। নয়তো আমি তোমাদের কাছে আসতে পারব না। ”

” কি কস আম্মা? আমি এত টাকা কই পাবো?”

” বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল বাবা।”

” আপার টাকা আছে না? সেগুলো পাঠায়া দাও। নয়তো মাহমুদ ভাইরে বল ব্যবস্থা করে দিতে। আব্বা মনে রেখো, টাকা যত দেরিতে দিবে, আমাকে তত দেরিতে পাবে। আর এটা কাউকেই জানাবে না দয়া করে।”

” আচ্ছা জানাব না। পাঠিয়ে দিব আম্মা।”

আব্বার কথা শেষ না হতেই পট করে লাইন বিচ্ছিন্ন হলো। ওপাশ থেকে রাবুর আর কোন কথা শুনা গেল না। সেই নাম্বারে আমরা অজস্রবার ফোন দিলাম। কিন্তু সুইচড অফ পেলাম। বাবার মোবাইলে একটা বেসরকারি ব্যাংকের একাউন্ট নাম্বার এলো মেসেজের মাধ্যমে। আমরা সবাই নির্বাক হয়ে গেলাম। বাড়ির ছোট বড় যারা ছিলো, তারা সবাই হায়-হুতাশ করতে করতে বেরিয়ে গেলো।

মামা,বাবা,মায়ের অনুমতিক্রমে মাহমুদ ভাইকে সব জানালাম। মাহমুদ ভাই বলল,

” তোরা এত অধৈর্য হস না। একাউন্ট নাম্বার টা আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে দে। এবং ফোন আসা নাম্বারটাও দিয়ে রাখ। আর তোর টাকায় হাত দিতে হবে না। টাকা আমি ব্যবস্থা করে দিবো।”

আমি উৎকন্ঠা ও ভীরু কন্ঠে বললাম,

” সত্যি সত্যি দুই লক্ষ টাকা সেই একাউন্টে পাঠিয়ে দিবেন?”

তিনি অসিহষ্ণু কন্ঠে বললেন,

” উদ্ভূত তো! রাবুর চেয়ে দুই লাখ টাকা বেশী? একজন মানুষের জীবনের চেয়ে কখনোই অর্থ বেশী মূল্যবান হতে পারে না। মনে রাখবি,
” অর্থ সম্পদ মানুষের জন্য। মানুষ অর্থ সম্পদের জন্য নয়।”

তোরা স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা কর। কাকা ও চাচীর দিকে খেয়াল রাখিস। আমি এদিকটা দেখছি। এবং রাবুকে নিয়ে কালই বাড়ি ফিরবো যত দ্রুত সম্ভব। ”

আমরা সবাই একে অপরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করলাম। রাবু ও পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের জল্পনা কল্পনার অন্ত নেই। নানান প্রশ্ন, বহুমুখী জিজ্ঞাসা নিজেরা নিজেদের করছি। মামা বলল,

” মাহমুদ ছেলেটা বিচক্ষণ ও দূরদর্শী। সে মনে হয় ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু আঁচ করতে পেরেছে। এখন আমাদের সবর করা ছাড়া আর কোন গতি নেই। নামাজ পড়ে দোয়া করেন রাবুর উপর যেনো কোন নির্যাতন না হয়।”

আমি মামাকে বললাম,

” মামা খেয়াল করেছেন,রাবুর কন্ঠটা কেমন জড়ানো ও অসংলগ্ন ছিলো?”

” খেয়াল না করার কি? ওকে দিয়ে কেউ সামনে থেকে কথাগুলো বলিয়েছে। মোটকথা রাবু বিপদে আছে। এটাই বড় সত্যি এখন।”

মায়ের মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। বোধহীন, প্রাণহীন পাথরের ন্যায় মা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে আমাদের মুখপানে। একজন মায়ের জায়গায় এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক।

সেদিন আমাদের সবার নির্ঘুম রাত কাটল দূর্বিষহভাবে। রাতে কেউই কিছু খাইনি আমরা, মামা ও রাজন ছাড়া। পাখি ডাকা প্রভাতেই সবাই বিছানা ছাড়লাম। ক্ষুধাটা বেশ উৎপাত শুরু করেছে পেটের ভিতরে। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সবাই রেডিমেড নাস্তা খেয়ে নিলাম। ঘরে কিছু বানানোর মতো মানসিক ও শারিরীক শক্তি কারোর মাঝেই অবশিষ্ট নেই। তাই মামা বাজারে চলে গেলো। গরম গরম খাস্তা পরোটা ও নেহারি নিয়ে এলো। সাথে বুটের ডাল ভুনা।

আমাদের প্রতিটি প্রহর কাটছে রুদ্ধশ্বাসকর প্রতিক্ষায়,চরম উত্তেজনা ও দুর্ভাবনায়। ভোর গড়িয়ে দুপুর শুরু হলো। চারপাশ আলোকিত করে কমলা রঙের রোদ উঠেছে। সেই রোদ্দুরের কড়া ঝাঁঝকে উপেক্ষা করেও আমি পার্লারে চলে গেলাম রাজনকে নিয়ে।

যাওযার পর সাংমা আমাকে বলল,

” ম্যাডাম আমাদের পার্লার তো একটু একটু করে এগোচ্ছে। আপনি মাঝে মাঝে আসতে পারেন না বাবুর জন্য। আমি প্রায়ই হিমশিম খেয়ে যাই। কাস্টমার অপেক্ষা করে একজন দেখে চলে যায় কাজ না করিয়েই। এতে পার্লারের রেপুটেশন খারাপ হয়ে যাবে।”

” তো কি করতে বলছ সাংমা?”

” বলছিলাম কি,
আরেকজন বিউটিশিয়ান হলে একদম ঠিক হয় এখন। তখন আপনি না আসলেও চলবে।”

” কোথায় পাবো বিশ্বস্ত মেয়ে?”

” আপনি দায়িত্ব দিলে আমি খুঁজে বের করতে পারব ম্যাডাম।”

উমমম.. বলে একটু সময় ভাবলাম। দেখলাম সাংমার বলাটা অমূলক নয়। সামনে বিয়ে হলেও পার্লারে রোজ সময় দেয়া যাবে না। আর বেতন আপাতত জমা টাকা থেকেই চালিয়ে নিবো। ব্যবসা দাঁড় করাতে হলে শুরুতে ঢালতে হয় পকেট থেকে। কথায় আছে, টাকায় টাকা আনে। টাকা না খরচ করতে পারলে টাকা কখনো ধরা দেয়না হাতের মুঠোয়। এমন ভাবনা শেষে মিনিট পাঁচেকের ব্যবধানেই বললাম তাকে,

” ঠিকাছে। তুমি খুঁজে একটা মেয়েকে জয়েন দিয়ে দাও। সমস্যা নেই।”

কাজের ফাঁকে ফাঁকেই বাবা,মাকে কল দিচ্ছি রাবুর কোন খোঁজ পেল কিনা। জবাব আসে, নাহ। দুঃশ্চিন্তা গাঢ় হয় তখন মনের ভিতর। মাহমুদ ভাইকে একবার কল দিলাম। উনি বলল,আর যেনো কল না দিই উনাকে। উনি খুব পেরেশানিতে আছে।

ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরি। বাবাও দোকান থেকে চলে এসেছে। মায়ের চুপসানো মুখে তাকানো যায়না। নয়নের মলিন মুখের অবস্থাও খড়কুটোর মতো হয়ে আছে। মা অনুযোগ করে বলল আমাকে,

” তোর বাবা থানায় গিয়েছে। কিন্তু তারা কোন সন্ধান বের করতে পারেনি এখনো। মাহমুদ কে ফোন দিলে কেটে দেয়। আজ দুইদিন একটা বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে কই আছে একাকী। আল্লাহ মালুম। বুকটা আমার খানখান হয়ে যাচ্ছে। ”

আমাকে বলা মাহমুদ ভাইয়ের কথাটা বাবা,মাকে বললাম।

নিশুতি রাত। প্রকৃতির গায়ে ঢলে পড়লো পল্লীর গা ছমছমে নির্জনতা । বিদুৎ চলে গেলো। ঘরে ঘরে দ্বীপ ও লন্ঠন জ্বলে উঠলো। চারপাশ জুড়ে ভুতুড়ে পরিবেশ। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যাচ্ছি আমরা। আমাদের সবার হৃৎপিণ্ডের প্রতি ভাঁজে ভাঁজে যন্ত্রণার বুদবুদেরা ফেনা তুলছে থেকে থেকে।

ঠিক এমনক্ষণে ঘরের দরজায় অচেনা কিছু ভারি ভারি পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমরা হুড়মুড়িয়ে দরজা খুলে দাঁড়ালাম সবাই। দেখলাম মাহমুদ ভাই, চারজন পুলিশ।এবং তাদের পাশে জড়োসড়ো হয়ে আছে রাবু। রাবু এসে মায়ের বুকে লুটিয়ে পড়ল। রাবুকে নিয়ে ব্যস্ত মা, বাবা,নয়ন। পুলিশরা এদিক সেদিক তাকাচ্ছে।

প্লিজ 👉 #রেহানা_পুতুল পেজে 👉 লাইক ও ফলো দিয়ে বাঁচার আনন্দটুকু দিবেন।🙏💚

এই সুযোগে মাহমুদ ভাই আমার পাশে এসে নিরবে দাঁড়ালো। আবছা অন্ধকারে চোখ টিপ মেরে আস্তে করে বলল,

“বিয়ের ডেট কবে ফেলব পানকৌড়ি? আর কতকাল বিরহে পুড়ে পুড়ে ছাঁই করবা?”

” আপনি এত অসভ্য,নিলজ্জ্ব কেনো?”

মা পাশ থেকে বিস্মিত ও ভয়ার্ত চোখে উঠলো,

” এই পুলিশ কেন? মাহমুদ কই তুই বাবা?”

” চাচী এখন একটা নাটক হবে আমাদের বাড়িতে। সেই নাটকটি জমাতে উনাদের ভূমিকা শতভাগ। সবাই আসুন বাইরে।”

আমার কাছ থেকে ছিটকে সরে গিয়ে মাকে বলল মাহমুদ ভাই।

চলবে.. ১৪

উজানের ঢেউ পর্ব-১৩

0

#উজানের_ঢেউ ( ১৩)
কলমে✍️ #রেহানা_পুতুল
শুনে মা তৎক্ষনাৎ ক্ষিপ্র গতিতে গর্জন করে উঠলো তাদের উদ্দেশ্যে। আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। আর যাইহোক। মাহমুদ ভাইকে বিয়ে করা যাবে না কিছুতেই। নয়তো মানুষের ধারণা ও বাস্তব মিশে একাকার হয়ে যাবে জল ও নুনের মতো। মানুষ চারদিকে রিউমার ছড়িয়ে দিবে। একলাই রবো আজীবন।

আমি রুমের ভিতর থেকে তাদেরকে বলা মায়ের তেজস্বী বাক্যগুলো শুনছি।
মা তাদের বলছে,

” আপন জেঠাতো ভাইয়ের সঙ্গে রিকশায় চড়া কোন দোষ হতে পারে না। সারা বাড়ির কেউই এই নিয়ে কিছুই বলল না। তোমরা কেন বলছ, বুঝি না মনে করছ? আর আমার মেয়েকে তার স্বামী স্ব-ইচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছে। কারণ সে তার খালাতো বোনকে বিয়ে করেছে রিলেশন করেই। রত্নার সাথে মাহমুদের কোন রিলেশন আগে ছিল না। এখনো নেই। মাহমুদ রত্নাকে পছন্দ করে রত্না স্কুলে পড়ার সময় থেকেই। মাহমুদ রত্নাকে আগেও বিয়ে করতে চেয়েছে। এখনো চাচ্ছে। এবং তাদের দুজনের বিয়ে ঠিকও হয়েছে আমাদের দুই পরিবারের সম্মতিতেই।”

মা কথাগুলো বলে থামলো। এ ঘর ও ঘর হতে কয়েকজন মানুষ আমাদের উঠানে এগিয়ে এলো। তবে কেউই মুখে রা টুকু করছে না। নিরব দর্শক ও শ্রোতা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। সেই দুজনের একজন রুষ্ট কন্ঠে বলে উঠলো,

” ওহ! তাইলে এই কাহিনী। নাহ? তলে তলে গজার মাছ? মাহমুদের বাপ নাই। মা সিধাসাধা। সে শহরে ব্যবসা করে। ভালো আয় রোজগার করে। এই সুযোগে মাইয়ারে লেলাই দিলা মাহমুদের পিছনে?”

উনার কথা শেষ না হতেই মাহমুদ ভাইয়ের বজ্রকন্ঠ আমার কর্ণগোচর হলো। আমি জানালার ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে উঠানে তাকালাম। দেখলাম মাহমুদ ভাই তাদের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। তার সারামুখে ভয়ার্ত রূপ। চোখদুটো নে* শা*গ্রস্তের মতো লাল হয়ে আছে। ঘাড়ের র’গগুলো ফুলে টানটান হয়ে আছে।

তারা মাহমুদ ভাইকে দেখে ভূত দেখার মতো ঘাবড়ে গেলো। মাহমুদ ভাই বাড়িতে আছে এটা জানলে তারা কস্মিনকালেও আমাদের দুয়ারে পা রাখত না। উচ্চস্বরে কথা বলার সাহসও দেখাতো না।

মাহমুদ ভাই শক্ত চোয়ালে দাঁত কিড়মিড়িয়ে রাশভারী কন্ঠে তাদের দিকে চেয়ে বলছে,

” আপনারা দুজন মহিলা মানুষ। আমার মায়ের বয়েসী। সম্পর্কে চাচী হোন আমার। কাকাদের সাথে আপনাদের দুই পরিবারের বিরোধ চলছে ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে। আমাদের সাথে আত্মীয়তা করতে চেয়েছেন। হয়নি। তাই অহেতুক গুজব ছড়াচ্ছেন রত্না ও আমাকে নিয়ে। সম্মান হারাতে না চাইলে এক্ষুনি এখান থেকে চলে যান বলছি। আর ভালো করে শুনে যান। দ্বিতীয়বার যদি আমার কানে রত্না সম্পর্কে নেগেটিভ কিছু আসে। আমি তাদের সবার জিহবা টেনে ছিঁড়ে ফেলব। কেউই ছাড় পাবে না আমার হাত থেকে। আমাদের বিয়ের দাওয়াত খেয়ে যাবেন। ”

সেই দুজন মহিলা টু শব্দটিও করল না আর। নিচু মাথায় ভেজা বিড়ালের মতো মাহমুদ ভাইয়ের পাশ কেটে চলে গেলো। আমি ওড়না দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরলাম। মিটমিটিয়ে হেসে মনে মনে বললাম, ওরে আমার বীরপুরুষ রে। তোমার গলায় আমি মালা দিবো বলছি?

দেখলাম মাহমুদ ভাই আমাদের ঘরের ভিতর ঢুকলো লম্বা লম্বা পা ফেলে। জানালা থেকে সরে গেলাম দ্রুত। মাহমুদ ভাই নয়ন নে বলছে,

” নয়ন, রত্না পার্লারে গিয়েছে?”

” নাহ ভাইয়া। আপু ঘরেই আছে।”

” উহু শিট! ” বলে উঠলেন মাহমুদ ভাই। হয়তো এই ভেবে, আমি কথাগুলো শুনে কষ্ট পেলাম।

নয়ন আমার রুমে আসল। সুখ সুখ কন্ঠে বলল,

” আপু, মাহমুদ ভাইয়া আসছে আমাদের ঘরে।”

” তো? আমি কি নাচবো ধেই ধেই করে? এই নয়ন, মাহমুদ ভাই কিভাবে জানল এদের কথা?”

” আপুনি, আমি চুপিচুপি মাহমুদ ভাইয়ার জানালায় গিয়ে বলছি এটা?”

” কি বলছিস?”

” বলছি ভাইয়া, উত্তর ঘরের জেঠিমারা আম্মুর সাথে ঝগড়া লাগছে তোমাকে ও আপুকে নিয়ে।”

” তারপর?”

” তারপর মাহমুদ ভাইয়া গেঞ্জি গায়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো।”

” তোকে কে পাঠালো তাকে খবর দিতে?”

” বারে? কে পাঠাবে আবার। রাবুপু তো কলেজেই। আমিই গেলাম বুদ্ধি করে।তোমাদের না বিয়ে হবে? ”

” কি বুদ্ধিমান ভাইরে আমার। যা ভাগ বলছি। ফাজিল কোথাকার। আচ্ছা শোন,মাহমুদ ভাই মার সাথে কি কথা বলছে? ”

” তোমার বিয়ে নিয়ে।”

নয়ন চলে গেলে আমি তার পিছন দিয়ে উঠে গেলাম। মাহমুদ ভাই কথার প্রসঙ্গ চেঞ্জ করলেন। আমার দিকে চেয়ে আদেশের সুরে,

” কিরে পার্লারে গেলিনা কেনো? ”

” আমার ইচ্ছে।”

” আমি কি বলছি আমার ইচ্ছে? ত্যাড়া আনসার দিচ্ছিস কেনো? কি হয়েছে? মুখ অমাবস্যা হয়ে আছে কেনো? ”

আমি মুখ নামিয়ে রাখছি মাটির দিকে। পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে উঠানের মাটি উঠাচ্ছি।

মাহমুদ ভাই সেটা লক্ষ্য করলেন। বললেন,

” উঠানে তোকে কূয়ো বানাতে কে বলছে?”

আমি পা থামিয়ে নিলাম। একটু পরেই মা,নয়ন, মাহমুদকে ভাইকে শুনিয়ে মিনমিনিয়ে বললাম,

” আমি জেঠিদের সব কথা শুনেছি। আমার লাইফে কাউকে দরকার নেই। সারাজীবন আশেপাশের মানুষ বাঁকা চোখে দেখবে। নিন্দা করে কথা শুনাবে। এত অপমান নিয়ে ভালো থাকা যায় না। ”

বলেই দ্রুতপদে তাদের সম্মুখ ত্যাগ করলাম। মাহমুদ ভাই মাকে বলছে,

” চাচী ও এটা কি বলল? এই রত্না শুন বলছি ”
বলে আমার পিছু নিলো। আমি দরজা ভিড়িয়ে দিতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম উনার বাহুশক্তির কাছে। উনি রুমের ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমার মাথায় রাগ চড়ে গেলো তখন। মাহমুদ ভাইয়ের দিকে রোষপূর্ণ দৃষ্টি ফেললাম।

” কাল রিকসায় চড়লাম। তাতেই এত কিছু। আর এখন দিনে দুপুরে আপনি আমার রুমে। কেউ দেখলে কি ভাববে? ছিহঃ! বেরিয়ে যান বলছি। আমি ড্রেস চেঞ্জ করবো। বের হবো। ”

” আমার সামনেই চেঞ্জ করবি তুই। কারন আমি তোর ফিয়ন্সে এখন।”

উদ্যত স্বরে বলল মাহমুদ ভাই।

তখন আমি নিজের উপর কন্ট্রোল রাখতে পারি নি। মাহমুদ ভাইয়ের দিকে একটা কাঁচের গ্লাস ছুঁড়ে মারি টেবিলের উপর থেকে নিয়ে। উনি ক্যাচ ধরার মতো গ্লাসটি ধরে ফেলল। হেসে দিয়ে আমাকে মানানোর ভঙ্গিমায় বলল,

” আরেহ! আরেহ! করে কি, করে কি? এই তোর মাথায় গোবর নাকি? তুই কিসের নারী উদ্যোক্তা হবি। আর অন্য কেউ বলছে এসব? তারা কেন বলছে এসব? তা তুই যেমন জানিস। আমিও জানি। পুরো বাড়ির সবাই জানে। থার্ড পারসনের কথা ধরে বসে থাকলে লাইফে কিছুই করতে পারবিনা। যেই লাউ সেই কদুই রয়ে যাবি।”

” হ্যাঁ। হইছে। আমার মাথায় সব গোবর। আমি কদু বনাম লাউ। এবার রক্ষা করেন আমাকে। যান তো প্লিজ। লেট হয়ে যাচ্ছে। ”

” গোবরকে সারে রূপান্তরিত করতে হবে আমার কাছে নিয়ে। নয়তো তোর ভবিষ্যৎ অন্ধকার।”

” তাতে আপনার কি?”
হেয়ালী করে বললাম।

” আমার কি মানে? আমারই তো সব। গ্লাস এটা যে মারলি। যদি আমার কপালে পড়তো? দস্যি মেয়ে কোথাকার। ”

এই বলে উনি আমার খুব কাছে চলে এলেন। ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়ালেন গা ঘেঁষে। আমার কপালে উড়ে আসা বেপরোয়া চুলগুলোকে হাত দিয়ে কানের পিছনে গুঁজে দিলেন। হাতের চার আঙ্গুলের উল্টো পিঠ দিয়ে আদূরে স্পর্শ দিলেন গালের এক পাশে। গালের উপর হতে আঙ্গুলগুলো বুলিয়ে নিলেন চিবুক পর্যন্ত। আমি আবেশিত হয়ে চোখে বন্ধ করে ফেললাম। বুক ধড়পড় করছে আমার বিদ্যুৎ গতিতে। হার্টবিট বেড়ে গেলো।

মাহমুদ ভাই আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসিফিসিয়ে বললেন,

” পানকৌড়ি। তুমি যে আমাকে লাইক করো,লাভ করো,মিস করো,ফিল করো। তা এই মুহূর্তে প্রমাণ হয়ে গেলো। ধরা পড়ে গেলে। পালিয়ে বাঁচতে পারবেনা পাখি। খাঁচায় বন্ধী হতেই হবে। সো বাহানা দিয়ে লাভ নেই। তুমি আরেকটু আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠো। তারপরেই বিয়ে হবে। বিকেলে ঢাকা চলে যাবো। মেসেজ দিও। কথা হবে। টেইক কেয়ার।”

এরপর মাহমুদ ভাই চলে গেলো রুম থেকে। আমি আবার দরজা বন্ধ করে দিলাম। কেমন উদাস উদাস লাগছে। ভাবছি সত্যিই তো। আমিও তো মাহমুদ ভাইকে এখন পছন্দ করি। অযথাই ছেলেমানুষী করি। অকারণেই হেয়ালী করি। মনে মনে নিজের উপর বিরক্ত হলাম। তবে আগে পার্লারটা একটা অবস্থায় যাক তারপর।

রাজন এলোমেলো পায়ে আমার কাছে এলো। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলাম। মা এসে জিজ্ঞেস করলো মাহমুদ ভাইয়ের সাথে কি কথা হলো। মাকে আস্বস্ত করলাম সব ঠিক আছে বলে। মা মনে মনে শুকরিয়া আদায় করলেন। মায়ের অভিব্যক্তি তাই জানান দিচ্ছে।

সেদিন আর বের হলাম না। এত উচাটন মন নিয়ে পার্লারে যাওয়া সম্ভব হয়নি। সাংমাকে ফোন দিয়ে বলে দিলাম,যাবনা।

না চাইলেও আশরাফুল ও তাদের পরিবারের কথা মনে পড়ে গেলো । শিরিনের কথা মনে পড়লো। মনে আমাদের সবাইকেই পড়ে। শক্রকেও মনে পড়ে। তবে আসল বিষয় হলো কাকে কিভাবে মনে পড়ছে। সেটাই। সব মানুষকে একই পরিপ্রেক্ষিতে মনে পড়েনা।

কাউকে মনে পড়ে শ্রদ্ধ্যায়, কাউকে ঘৃণায়,কাউকে ভালোবাসায়, কাউকে বিরক্তির সাথে, কাউকে নিদারুণ উপেক্ষায়, কাউকে করুণায়,কাউকে পরম মমতায়,কাউকে অতি যতনে অতি সংগোপনে।

গোধূলীঝরা পড়ন্ত বিকেল। চারপাশ মুখরিত ছোট বড় সবার কলরবে। যে যার মতো বিকেলকে উপভোগ করছে। রাবু এখনো কলেজ থেকে ফেরেনি। ক্রমশ আমাদের উদ্বিগ্নতা বেড়ে চলছে হুহু করে। বাবাকে ফোনে জানানো হলো। বাবা বাড়ি চলে এলো। রাবুর কাছে মোবাইল নেই। কলেজে মোবাইল নিয়ে যাওয়া নিষেধ। আমি নয়নকে নিয়ে রাবুর কলেজে গেলাম রাজনকে মায়ের কাছে রেখে। কলেজ বন্ধ। গেটের দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করেও রাবুর কোন সন্ধান মেলেনি। অবসাদগ্রস্ত মনে দুই ভাইবোন বাড়ি ফিরে এলাম। সম্ভাব্য সব স্থানে রাবুর খোঁজ নিলাম। কোন খোঁজ মিলল না।

মা বুক চাপড়ে গগন কাঁপিয়ে আর্তনাদ করছে। আমরা সবাই অশ্রুবিলাপে ভেসে যাচ্ছি আমাদের চঞ্চল চড়ুয়ের মতো নিখোঁজ রাবুটার জন্য।

চলবে.. ১৩

উজানের ঢেউ পর্ব-১২

0

#উজানের_ঢেউ ( ১২)
কলমে✍️ #রেহানা_পুতুল
ফোন রিসিভ হলো না। আমি হতাশ ও বিরক্ত হলাম বাবার উপরে। এভাবে একা একজন মেয়েমানুষ কতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারে। উঠে দাঁড়ালাম। ব্যাগ হাতে নিলাম। চলে যাবার উদ্যত নিতেই আমার সামনে ধুমকেতুর মতো উপস্থিত হয়ে গেলো বাবার সেই কাঙ্ক্ষিত পাত্র।

আমি ভয়ানকভাবে হোঁচট খেলাম গোপনে। সপ্তাচার্য দেখার মতো বিষ্ফোরিত নয়নে তারদিকে চেয়ে রইলাম। বড় কালো সানগ্লাস দিয়ে পুরো চোখদুটো ও নাকের অধের্ক ঢাকা। তাই তাকে আধো চেনা আধো অচেনা লাগছে আমার কাছে। এ যেনো সন্ধ্যার আলো আঁধারি খেলা।

সে দাঁড়িয়েই আছে আমার মুখ বরাবর টেবিলের সামনে। তার হাত দুটি পিছনে। আমিও দাঁড়িয়ে রইলাম। পাশের টেবিলে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। এই ছেলেটাকেই ত পাশের টেবিলে দেখলাম। কিন্তু সেখানে অন্য অপরিচিত দুজন লোক বসা। আমি কিছুই বললাম না তাকে।

চেয়ার সরিয়ে পা বাড়াতেই সে তার দুহাত পিছন থেকে সামনে নিয়ে এলো। আমার দিকে টকটকে রক্তিম গোলাপ গুচ্ছটি বাড়িয়ে ধরলো। আমি হাত বাড়িয়ে নিলাম না। বরং অপরিচিত ও বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম তারদিকে। সে এবার চোখ থেকে সানগ্লাস সরিয়ে নিলো। স্থির দৃষ্টিতে অবিকল চেয়ে রইলো আমার মুখপানে।

আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম তাকে দেখেই। চেয়ার সরিয়ে পা বাড়ালাম চলে যাওয়ার জন্য। সে মুরগী ধরা চোরের মতো খপ করে আমার এক হাত ধরে ফেলল। দুষ্টমিষ্ট চোখে ইশারা দিলো বসার জন্য। মুখে কিছু বলছে না। আমি দপ করে চেয়ারে বসে পড়লাম। সেও মুখোমুখি বিপরীত চেয়ারে বসল এবার। গোলাপগুলো এগিয়ে ধরলো আমার দিকে। আমি নিলাম না। গোপনে ক্রোধে ফুঁসে উঠছি সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের ন্যায়। সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। বাবা কি গেম খেলল আমার সাথে? আসার কথা কে। আর এলো কে।

সে টেবিলের দিকে একটু ঝুঁকে বসল। যত্ন করে আমার দুহাত টেনে নিলো। গোলাপ গুচ্ছটি জোর করে আমার হাতের মুঠোয় পুরে দিলো।
ভরাট অথচ কোমল কন্ঠে বলল,

” নিরপরাধ ফুলের অপরাধ কি পানকৌড়ি? চেনা মানুষ থেকে ফুল নেয়া নিষেধ নাকি? ”

আমি তাতানো সুরে বললাম,

” এসব কি হচ্ছে মাহমুদ ভাই? আপনি এমন র‍্যাব সেজে এখানে কেন?”

” কাউকে দ্বিধায় ফেলার জন্য। যতটুকু পসিবল অচেনা গেটাপ নিলাম। দেখিস না আজ চুল ও উল্টো করে আঁচড়ানো। তোর পছন্দ হয়নি বুঝি ? ”

” উফফস ! মাহমুদ ভাই। কৌতুক ছাড়েন। পাত্র কই? আপনি কেন এলেন?”

” এই পাত্রকে তোমার পছন্দ হচ্ছে না পানকৌড়ি? সেই পাত্র চরের জমিনে ধান কাটতে গিয়েছে।”

” নাহ। একদম হচ্ছে না। আপনার মধু মধু কথা ও আবেগ আমার কাছে টক টক লাগছে খুউব।”

” আমার তাতে কিছুই যায় আসে না। আমার হাত থেকে ফুল উপহার নিতে চাইলি না কেন? অন্য কেউ দিলে তো ঠিকই নিতি।”

” এতই যখন বুঝেন। তখন কেন এলেন আমার সাথে দেখা করতে এত ছল চাতুরী করে? ”

” আমি কারো সাথে দেখা করতে আসিনি। কাউকে দেখতে আসছি।এবং সারপ্রাইজড় দিতে আসছি। ”

” হাহ!আমার মাঝে দেখার কি আছে? অদ্ভুত! ”

” হ্যাঁ। অদ্ভুত! কিম্ভুত! লাল সাদা যত ভূত আছে এই বাংলার গাছে গাছে। সব ভূত। কি আছে আর কতটা আছে,তা কেবল এই মন জানে। এই হৃদয় জানে। আর কেউ জানতে হবেনা। নো নিড।”

আচম্বিতে এমন সিচুয়েশন আমি হজম করতে পারছি না। আবারো উঠে যেতে লাগলাম। মাহমুদ ভাই আস্তে করে ধমকে উঠলেন। বললেন,

” এখানে কোন সিনক্রিয়েট করবি না বলছি। বাইরে গিয়ে কিংবা বাড়ি গিয়ে যা ইচ্ছে করিস আমার সাথে। কি খাবি চুজ কর।”

ওয়েটার শুরুতেই মেন্যু লিষ্ট দিয়ে গেলো। বললাম,

” বিষ খাবো। দিতে পারবেন বিষ?”

” তুই চাইলে আমি বিষ কেন,সবই এনে দিতে পারবো। ”

পরে তিনি তার পছন্দমতো মেন্যু অর্ডার করলেন। বললাম,

” আমাকে ঘটনা ক্লিয়ার করেন। নয়তো খাবনা।”

” খেয়ে নে আগে । পরে ডিটেইলস বলছি।”

” আপনি এত পসেসিভ কেন আমার প্রতি?”

কপাল ভাঁজ করে বললাম মাহমুদ ভাইকে।

” তুই আমার আজন্ম অধিকার। তাই। তোর সংসার টেকেনি আমি পাবো বলেই। বিধাতা চায়নি এক মহা প্রেমিকের বিশুদ্ধ লাভ বিফলে যাক এভাবে। তাই সময় এখন আমার অনুকূলে চলে এসেছে।”

লাচ্ছি ও শর্মা খেয়ে আমি বাইরে চলে এলাম। উদ্দেশ্য পার্লারে যাবো। রিকশা খুঁজছি। মাহমুদ ভাই পিছন দিয়ে এসে পাশে দাঁড়ালেন। বললেন,

” বিল দিতে গেলাম। অমনি ফাঁকি দিয়ে না বলে বেরিয়ে গেলি? তুই আসলেই একটা পানকৌড়ি। চল তোর পার্লার দেখবো। ভিতরে যাওয়া যাবে একটু? দেখব কেমন কি করেছিস। ”

উনি রিকশা ডেকে উঠে বসলেন। আমি উঠতে চাচ্ছিনা। দাঁড়িয়ে আছি। মাহমুদ ভাই কৌশল করে আমাকে ডাকলেন।

” এই রত্না উঠো না।”

” মামি উঠেন না। রইদের মইধ্যে মামা বইসা আছে।”
বলল রিকশাওয়ালা।

আমি রিকশায় উঠে বসলাম। চোখ কটমটিয়ে চাইলাম মাহমুদ ভাইয়ের দিকে। চোখের পলক না ফেলতেই মাহমুদ ভাই চোখ টিপ মারলেন আলতো হেসে। নিরস ভঙ্গিতে বললাম,

” বলেন ত মূল কাহিনি। কিভাবে কি হলো? আমার ভীষণ অস্বস্তি ও অসহ্য লাগছে।”

” কাকে? আমাকে? না পুরো পরিস্থিতিটাকে?”

” সবকিছুকেই।”

” তারমানে এই ভিতরে আমিও আছি।”

” যা বুঝেন আপনি। এবার বলেন।”

” শোন,বাড়িতে গিয়ে এটা কাকা ও চাচীর থেকে শুনে নিস। ”

” আপনি বললে কি সমস্যা।”

” আমি তোকে দেখার পর সব ভুলে বসে আছি। ”

রিকশা থেকে নেমে উনাকে নিয়ে পার্লারে ঢুকলাম। উনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখলেন উৎফুল্ল চিত্তে। বললেন,

” আমি স্যাটিসফাইড তোর এমন উদ্যমতায়। সাপোর্ট দিব সারাজীবন। ”

মাহমুদ ভাই খানিক বসল পার্লারে। এক গ্লাস পানি খেলো আমার হাতে।

আমি বললাম,

” মাহমুদ ভাই। আমি আজ পার্লারে থাকব না। বাড়ি চলে যাবো। রাজন বাড়িতে রয়েছে। আর আমার খারাপ লাগছে।”

এই বলে আমি বেরিয়ে এলাম পার্লার থেকে। সাংমা রয়েছে ভিতরে। উনিও আমার পিছন দিয়ে উঠে এলেন।
বললেন,

” আয় একসঙ্গেই যাই। তোর পার্লারের ‘ অঙ্গসাজ’ নামটা দেখে আমার একটা কথা বারবার মনে হচ্ছে।”

আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু চোখে চাইলাম মাহমুদ ভাইয়ের দিকে। তিনি শিহরিত চোখে বললেন,

” গোপন কিছু থাকনা গোপনে
ক্ষণ হলে শুধাব তোর প্রাণে।”

আমি সংকোচবোধ করলাম। উনি রিকশা ডেকে নিলে উঠে বসলাম দুজনে। উনি আমার একহাত পেঁচিয়ে ধরলেন। বললেন,

” বিয়ের ডেট কবে ফেললে তোর সুবিধা হবে বল?”

” কিসের বিয়ে মাহমুদ ভাই? আমার বিয়ের দরকার নেই। কোন পুরুষকেই আমার জীবনে জড়াতে চাই না।”

উনি অধিকারসুলভ কন্ঠে বললেন,

” তুমি কি বলবা কবে হলে তোমার ভালো হয়? নাকি আমার ইচ্ছেমতো ডেট ফেলব মা,কাকা,চাচীর সাথে আলাপ করে?”

” আমি স্বৈরাচারী কারো বউ হবনা। যে কেবল অধিকার খাটায়। অন্যের চাওয়া পাওয়ার কথা ভাবে না। মূল্যায়ন করে না।”

এরপর পুরো পথ মাহমুদ ভাই আর কোন কথা বলেনি আমার সাথে। চুপচাপ ছিলো বিরহে পোড়া ক্লান্ত ডাহুকের মতো।

উনি বাড়ির কাছাকাছি পথেই নেমে গেলো রিকশা ভাড়া মিটিয়ে। আমাকে বলল,

” তুই চলে যা। আমিসহ কেউ দেখলে কথা উঠবে এখন।”

” আপনি কই যাবেন? ”

” আমি বাজারে যাবো। ঘরের জন্য কিছু ফলমূল কিনবো। মার মেডিসিন নিতে হবে।”

আমি ঘরে গেলাম। রাজন কে বাবা আমার, বলে কোলে তুলে নিলাম। তারপর হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেস হলাম। জামাকাপড় চেঞ্জ করলাম। রেস্ট নিলাম কিছুক্ষণ। দেখলাম ঘুরেফিরে মা, রাবু,নয়ন আমার সামনে আসছে কিছু শোনার অপেক্ষায়।

আমি মেঘমুখ করে থাকাতে কিছু জিজ্ঞেস করছে না তারা আমাকে। আমিও নিরব আছি কিছু না বলে।

সন্ধ্যায় বাবা আসলে জিজ্ঞেস করলাম,

” বাবা কই তোমার পছন্দের পাত্রতো এল না? ”

” কেন মাহমুদ ঢাকা থেকে আসেনি মা?”

” হুম আসছে। কাহিনী টা কি বাবা?”

” যেই ছেলে তোর বিয়ের জন্য প্রস্তাব দিয়েছে। তা সবই ঠিক ছিলো। পরে আমরা তাকে মানা করে দিয়েছি।”

” কেন বাবা?”

” কারণ তার পর মাহমুদের মা এলো আমাদের কাছে প্রস্তাব নিয়ে। এবং মাহমুদ আমাকে ফোন দিয়ে বলল, সে তোর দায়িত্ব নিতে চায় রাজনসহ। সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে বলল তারা। তাদের মা ছেলের কথা হিসেবে আমরা বুঝে নিলাম, রাজন আমাদের চোখের সামনেই থাকবে। কেউ তাকে ও তোকে অবহেলা ও অনাদর করার সুযোগটুকু পাবে না। তারাতো রাজন কে এমনিতেই অনেক আদর করে।

পরে মাহমুদ বলল সেই ছেলে সেজে তোর সাথে দেখা করতে আসবে চমকে দেওয়ার জন্য। আমাদের বারবার অনুরোধ করছে যেনো তোকে না বলি। আর যেই নাম্বারে কথা বলছিস। সেটা মাহমুদ নতুন কিনেছে। যা আগে তুই জানতি না। শার্টের কালার ইচ্ছে করেই মিথ্যে বলছে তোকে,কনফিউজড করার জন্য। ও তোকে জানায়নি। কিন্তু সব আমাদের সাথে শেয়ার করেছে মা। আমার ভাতিজা টা অনেক ভালো রে মা।”

রাবু ও নয়ন হেসে কুটিকুটি হচ্ছে পাশে। মা ও হাসছে। আমি বাবাকে আরো বললাম,

” আমার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে হয়নি তোমাদের কারো কাছে?”

পাশ থেকে রাবু ও মা বলল,

” আমরা এটা মাহমুদ কে বলেছি ভালো করেই। সে বলল,তুই নাকি লজ্জায় প্রকাশ করিস না। কিন্তু তুই ও তাকে চাস। পছন্দ করিস।”

” মাহমুদ ভাই এমন মিথ্যা বানোয়াট কিছু বলতে পারলো? আমি কাউকেই বিয়ে করব না। কাউকেই না।”

ক্রোধান্বিত হয়ে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। রাতে ভাত খেলাম না মাহমুদ ভাইয়ের উপর অভিমান করে।

তার পরেরদিন দুপুরে বাড়ির দুজন মহিলা এলো আমাদের ঘরে । টনটনে গলায় মাকে বলল,

” ছিহ! রত্নার মা এইসব কি শুনতাছি?”

” কি হইছে ভাবি?”

বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো মা।

” কি হইতে আর বাকি? বাড়ির নাম কাম সব ডুবলো এবার। তোমার বড় মাইয়ার নাকি মাহমুদের লগে বিয়ার আগ থেইকাই প্রেম চলতাছে। গতকাইল তো তারে মাহমুদের লগে রিকশায় ঘুরাঘুরি করতে কেউ কেউ দেখলই। মাহমুদের কাছে বিয়া বসনের লাইগাই নাকি সে নিজের সংসার ভাঙ্গনের ব্যবস্থা করছে? কি ছিনালগিরি শুরু হইলো দুনিয়াতে। আল্লাহ! রহম করো।”

শুনে মা তৎক্ষনাৎ ক্ষিপ্র গতিতে গর্জন করে উঠলো তাদের উদ্দেশ্যে। আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। আর যাইহোক। মাহমুদ ভাইকে বিয়ে করা যাবে না কিছুতেই। নয়তো মানুষের ধারণা ও বাস্তব মিশে এক হয়ে যাবে জল ও নুনের মতো। মানুষ চারদিকে রিউমার ছড়িয়ে দিবে। একলাই রবো আজীবন।

চলবে.. ১২

উজানের ঢেউ পর্ব-১১

0

#উজানের_ঢেউ (১১)
কলমে✍️ #রেহানা_পুতুল
মুহূর্তেই আমার হাসিহাসি মুখে ভর করলো প্রগাঢ় নৈঃশব্দ্যতা ও বেদনার স্তুপ।
কেন বুকের ভিতরে এমন পাক খাচ্ছে আমি যেন বুঝেও বুঝি না। আমার মুখ দিয়ে কোন শব্দই উৎসারিত হচ্ছে না। শব্দরা এসে ঘাপটি মেরে বসে আছে গলার মাঝে। একটা হিসেব মেলাতে খুউব কষ্ট হচ্ছে। আমার মৌনতা টের পেয়ে ওপাশ হতে আবারো ভেসে এলো মাহমুদ ভাইয়ের গম্ভীর ডাক।

” এই পানকৌড়ি? চুপ হয়ে গেলি যে?এনি প্রবলেম? ”

নিজেকে একটু সামলে নিলাম। বললাম,

” মাহমুদ ভাই আমি তো ভেবেছি, আপনি আমার পার্লারের কথা শুনেই অভিনন্দন জানিয়েছেন। ”

তিনি এবার উজ্জ্বল হাসি দিলেন। উৎসুক চমকিত কন্ঠে বললেন ,

” ওরেব্বাস! আমার পানকৌড়ি দেখি অলরাউন্ডার হয়ে যাচ্ছে। এটা তো জানতাম না। ডিটেইলস শুনি তো?”

আমি উনাকে এ টু জেড সবই জানালাম। এবং পারলে যেনো মিলাদে উপস্থিত থাকে, অনুরোধ করে বললাম। উনি বলল,

” মিলাদে না থাকতে পারলেও তোর বিয়েতে থাকবো প্রমিজ।”

” আমার বিয়ে ঠিক হওয়াতে আপনি খুব হ্যাপি তাইনা?”

মাহমুদ ভাই ওপাশে থম মেরে রইলেন। একটু পরে বললেন,

” কাকা ঠিক করেছে। তুই রাজী হলি। হ্যাপি না হয়ে উপায় কি?”

” উপায় থাকলে কি করতেন? ”

” যা করণীয় আমার। সবই করতাম। কানাকড়িও বাকি রাখতাম না।”

“আমি রাজি বিয়েতে। কে বলল আপনাকে?”

” কাকা কি তোর মত না নিয়েই পাত্র ঠিক করলো?”

” আমার মত নেওয়া পর্যন্ত এখনো যায়নি। সূচনাতেই আছে বিষয়টা। আর ধারণা করে সব বলা ঠিক নয় মাহমুদ ভাই।”

অভিমান করে ফোন লাইট কেটে দিলাম তড়িতেই। বিলম্ব না করে তখনই মাহমুদ ভাই বারবার ফোন দিচ্ছে। আমি রিসিভ না করেই মোবাইলের সুইচড অফ করে দিলাম।

👉 #রেহানা_পুতুল পেইজে 👉 like ও Follow দিতে কি সমস্যা আমি বুঝিনা। অথচ শতশত জন গল্প পড়েন।

ফোন অন করার পর দেখলাম মাহমুদ ভাই আর কোন ফোন দিলনা। কোনভাবেই যোগাযোগ করছে না।

দিন ফুরালো। নতুন মাসের আগমনী বার্তা শুরু হলো। নিজেকে আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুখ স্বপ্নে আমি বিভোর। পার্লারে মিলাদ পড়ানো হলো পরিবারের সবার সরব উপস্থিতিতে। কিছু নিকটজনও ছিলো আমাদের। আঞ্জুমানও ছিলো তার স্বামীসহ। মিষ্টি বিতরণ করা হলো। সবকিছু সুন্দরভাবে ভাবগাম্ভীর্যের সাথে সম্পন্ন হলো আমার বাবার তদারকিতেই।

পার্লারের নিউ বিউটিশিয়ান সাংমাও ছিলো। সাংমার সাথে পরিচিত হলাম। উচ্চবংশীয় রাখাইন মেয়ে সাংমা। টেনে টেনে বাংলা বলে। উপভোগ করলাম তার বাংলা বলার ধরন দেখে।

দেখতে দেখতে মাস চলে গেলো। পার্লার নিয়মানু্যায়ী চলছে। বলা যায় খরগোশ গতিতে। জনপ্রিয় পার্লারগুলো ফেলে নতুন এটায় কাষ্টমার না আসা বা কম আসাই যুক্তিসঙ্গত। কেউ কেউ পার্লারের কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুঁ মেরে চলে যায়। তখন সাংমা বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে চায়। আমি হাস্যোজ্জ্বল মুখে সাংমাকে আস্বস্ত করি। বলি,

” যতটুকু কাজ করবে পুরো ডেডিকেশান নিয়েই করবে। দেখবে নাম ছড়িয়ে যাবে জনেজনে। তখন সময় তোমাকে কত কাষ্টমার উপহার দিবে। জিরোবার অবকাশটুকুও পাবে না। এটাই সিস্টেম। এটাই নিয়ম। ”

সাংমা মুগ্ধ চোখে আমার দিকে চেয়ে রয়। বেদবাক্যের মতো মনোযোগী শ্রোতা হয়ে শুনে নেয় আমার বলা কথাগুলো।

হাতেগোনা কাষ্টমার নিয়ে আমার মাঝে উৎকন্ঠা কাজ করছে না একটুও। কারণ বাবা বলছে,
ক্ষুদ্র কিংবা বৃহৎ হোক যে-কোন ব্যবসায় প্রথম ছয়মাস লাভের আসা করাটাই বোকামী। বরং লস হতে পারে এটাই হাসিমুখে মেনে নিতে হবে।

প্রতিদিন নাস্তা খেয়ে রাজনকে নিয়ে পার্লারে চলে যাই। একবারে সন্ধ্যায় ফিরি। মাঝে মাঝে শুক্রবার কলেজ বন্ধ থাকে বলে রাবু সেদিন আসে।
রোজ দু একবার ‘ অঙ্গসাজ’ এ আমাকে সঙ্গ দিয়ে যায় আঞ্জুমান। আঞ্জুমানের সাথে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। স্কুল কলেজে অতটা ছিলনা। সে একটু চাপা স্বভাবের মেয়ে ছিলো। পড়াশোনায় ভালো ছিলনা বলে সবসময় লাস্ট বেঞ্চ ছিলো তার প্রিয়।

জীবনে পথচলায় কখন কাকে কোন কাজে লাগে,কার সাথে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হবে। এই ভবিষ্যৎদ্বানী মনিষীগণও বলতে পারবে না।

একদিন বাবা, মা, রাবু, নয়ন আমার রুমে এলো। আমি জিজ্ঞাসু চোখে চাইলাম তাদের দিকে।

মা বললেন,

” তুই বললি সেই পাত্রের সাথে দেখা করবি। কই কিছু তো জানালি না আমাদের। আমরাও ইদ্দতের সময়কাল শেষ হয়নি বলে তোকে ঘাটালাম না। ”

” মা, ঠিক এই সময়টা শেষ হওয়ার জন্যই আমিও অপেক্ষা করছি। আর পার্লারটাও গুছিয়ে নিলাম এই ভিতরে।ব্যাস।”

পাশ থেকে বাবা আন্তরিক কন্ঠে বলে উঠলো,

” এখন তো ইদ্দতের তিনমাস শেষ হয়েছে। চার মাস চলছে। তাহলে আসছে শুক্রবারে দেখা কর সেই ছেলের সাথে। ফোনে কথা বলে নিবি আগে? নাকি বলিস?”

” বাবা সেদিন দেখা করার আগেই নাম্বার দিও। এখন লাগবেনা। দেখা করেই যা বলার বলব। আলাদা করে ফোনে কিছু বলা অনাবশ্যক মনে করি আমি।”

” ঠিকাছে মা। যা ভালো মনে করিস।”

” আপা তুই একা যাবি। আমিও আসব তোর সাথে? ”

” নাহ। লাগবে না। আমি একাই মিট করব তার সাথে।”

” বাবা উনিতো চট্রগ্রাম থেকেই আসবে। তুমি উনাকে বলে দিও চৌরাস্তা ‘ আয়োজন’ রেস্টুরেন্টেই আমি থাকব। যেহেতু একই জেলার। আশাকরি সে ভালো করেই এসব চিনে।”

তারা আমার সামনে থেকে চলে গেলো। আমার খুব অস্বস্তি লাগছে। একা একজন মেয়ে হয়ে আননোন একজন পুরুষের সাথে দেখা করবো। কিন্তু এছাড়া উপায় নেই। কাউকেই পাশে রাখা যাবেনা। আমি তাকে এমনভাবে কিছু কথা বলব,যেনো সে নিজ থেকেই বিয়ে ভেঙ্গে দেয় কিছু একটা বলে।

কথায় আছে ‘ যাকে একবার কুমিরে কামড়ায়,সে ঢেঁকি দেখলেও ভয় পায়।’
তাই মন সায় দিচ্ছেনা অন্যকারো সাথে গাঁটছড়া বাঁধার। লাইফে অচেনা,অজানা কাউকে সঙ্গী করবো, এই সাহস আমার মাঝে বিলীন। বরং পুরুষকে নিয়ে ভয়,অবিশ্বাস, দ্বিধা, অনাগ্রহ, দুর্ভাবনা এসব আমাকে আকঁড়ে থাকে সবসময়। কি কথা বলব তাও মনস্থির করে নিয়েছি।

ঘটনাটি তার একদিন পরের। সময়টা সাঁঝক্ষণ ফুরিয়ে যাবার পর। আমি রাজনকে নিয়ে ঘরে পা রাখলাম মাত্র। আমার জেঠাতো বোন আসমা হন্তদন্ত পায়ে ছুটে এলো আমাদের ঘরে। আমরা সবাই বুভুক্ষুর ন্যায় হা হয়ে চেয়ে আছি আসমার মুখচ্ছবির দিকে।

” চাচী,রত্না বু খবর পাইছো?”

” না কিসের খবর?”
অবাক কন্ঠে বলল মা।

” রাজনের আব্বু গতকাল নাকি এক্সিডেন্ট করছে মারাত্মকভাবে। ঢাকা সায়েদাবাদে। রাস্তা পার হতে গিয়ে। পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি নাকি এখন। শুনলাম আজ এক পায়ের হাঁটু পর্যন্ত কেটে ফেলেছে ডাক্তাররা।”

” তুই এতখবর কিভাবে জানিস?”

মা জানতে চাইলো চোখ কপালে তুলে।

আমি স্ট্যাচু হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। কারো নির্মম পরিণতি শোনার অধীর অপেক্ষায়। রাবু বসা থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো। বলল,

“মারহাবা। এইতো বিধির খেলা।”

মা রাবুকে হালকা ধমক দিলো। আসমা বিপুল আক্ষেপের সুরে বলল,

” আমি রত্না বুর শশুর বাড়ির মায়ার থেকে শুনলাম। আমি মায়া, শিরিন একই কলেজে ডিগ্রীতে পড়ি। শিরিনের সাথে মায়ার বন্ধুত্ব ছোটবেলা থেকেই। যেহেতু তার খালার বাড়ির মেয়ে। সেই সুবাদেই তো সই পাতলো দুজনে। আশরাফুল ভাই জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেলো চাচী। কোন কাজকর্মই নাকি আর করে খেতে পারবে না।”

রাবু চনচন গলায় বলে ফেলল,

” এই আসমা আপা। কে বলছে পারবে না। বসে বসে ভিক্ষা করতে পারবে। টিভিতে দেখনা,ঢাকা শহরে ভিক্ষুকদের ইনকাম ফাটাফাটি। টাকা জমিয়ে নদীর ওপারে খোলামুড়াতে জায়গাও কিনতে পারে তারা।”

মা গরম চোখে রাবুর দিকে চাইলেন। বললেন,
“কোন মানুষকে নিয়ে এমন উপহাস করা ঠিক নয়। বুঝলি। ত্যাঁদড় মেয়ে কোথাকার। আজ যদি তোর বোন তার ঘরে থাকতো? তখন কি এসব বলতে পারতি?”

” ইসসরে! আমার বোন তার ঘরে থাকলে এমন হতইনা। সে ঢাকা কেনো যেতো? সেতো গ্রামে থাকা শেষ হলে আবার বিদেশ চলে যেতো। সব আল্লাহর ইশারা। বুঝছো আম্মা।”

আসমা চলে গেলো। আমার মাথা কেমন ঝিম মেরে আছে। মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে কোষে অজস্র পোকারা কিলবিল করছে। এমন অসহ্য লাগছে কেন বুঝিনা। হৃদয়ের গভীর হতে কেবল একটা লম্বা দীর্ঘস্বাস বেরিয়ে এলো। মা রাজনকে কোলে নিলো। আমি ফ্রেস হয়ে পোশাক চেঞ্জ করলাম। নিজের অজান্তেই মাহমুদ ভাইয়ের কথা মনে হলো। চাইলেই আমি মেসেজ দিতে পারি। কিন্তু আমি দিবনা। এতে আমার দূর্বলতা প্রকাশ পাবে। উনি থাকতে পারলে আমি কেন পারব না। আমিতো উনাকে ভালোবাসিনি। স্বপ্নের বালুচরে ঘর বাঁধিনি। ভেবে ভেবে বিনিদ্র রজনী কাটাইনি। হুহ!

চট করেই শিরিনের কথা মনে হলো। আমার সাথেই শিরিনের খুব ভাব ছিলো। মানুষকে আপন করার আশ্চর্য ক্ষমতা রাখে এই মেয়েটা। কি যে হবে এখন তার। অথচ কত ধনী ঘরের মেয়ে। দিন না গড়াতেই জীবন তাকে নিংড়িয়ে দিলো। পিষে ফেলল শিল পাটার মসলার মতো। উহু!

শিরিনকে কৌতুক করে একদিন বললাম,

” আপনি মাদ্রাসা থেকে ইন্টার পাস করেছেন। মানে আলিম পাশ। এখন পড়তেছেন ফাজিল এ। মানে বি.এ। ভুলেও ফুলহাতা, থ্রি কোয়াটার হাতা ছাড়া শট হাতার কামিজ পরেন না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। মাথা থেকে কখনো ওড়না পড়েনা। নড়েনা। এককথায় বলতে গেলে অতিরিক্ত শালীন ও ধর্মীয়রীতি মেনে চলা একজন মেয়ে। যে কোন ছেলের সাথে হুট করে কথা বলেন না। সামনে আসেন না। এসবই অত্যন্ত সুন্দর শিরিন আপা। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো বিয়ের আগে কোনো ছেলের সাথে রিলেশনে জড়ানো তো আমাদের ইসলামে নিষিদ্ধ। গর্হিত। তাহলে লোকচক্ষুর অন্তরালে চুটিয়ে প্রেম করা কি আপনার সাজে বা মানায়?”

শিরিন সেদিন আমার গাল টিপে মুচকি হেসে বলল,

” ক্ষুধায় মানে না বাসি পঁচা ভাত। প্রেমে মানে না জাত বেজাত। অনুভূতি, আবেগের কাছে মোরালিটি তুচ্ছ। হার মানে। বুঝলে রঙিলা বধু।”

আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না শিরিনের এমন লজিক শুনে।

আজ শুক্রবার। যেহেতু পাত্রকে মানা করে দিবো। তাই অতিরিক্ত পরিপাটি সাজলাম না। পার্লারে যেমন আসি নিত্যদিন। তেমন হালকা সাজেই আসলাম। ফোন দিলাম না তাকে। মেসেজে জানিয়ে দিলাম সময়টা। আর চেনার সুবিধার জন্য দুজন দুজনের পোশাকের কালার টা জেনে নিলাম। তাও লিখার ভাষায়। কিছুটা নারভাসনেস কাজ করছে মনের ভিতর। এই প্রথম লাইফে কারো সাথে এভাবে মিট করতে এলাম। অস্বস্তিও লাগছে বেশ। বুকে ফুঁ দিয়ে নিলাম দোয়া দুরুজ পড়ে। রেস্টুরেন্টের ভিতরে প্রবেশ করলাম। আগেও একবার এসেছি এখানে। এক ভাই ভাবির সাথে।

আমার চোখে মেরুন রঙের সানগ্লাস। বেশী রোদে বা সুপারশপে যেতে এই সানগ্লাস আগে ইউজ করতাম। আমি সানগ্লাসের ভিতর দিয়ে চারদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলাম। কিন্তু সেই নিদিষ্ট কালারের শার্ট পরা কাউকেই দেখতে পেলাম না। তবে কর্ণারের গোল টেবিলটাতে দেখলাম একজন সুদর্শন ছেলে বসা। একপাশ থেকে দেখা যাচ্ছে তাকে। কালো চেকের টির্শাট। চোখে সানগ্লাস। হাতে দামী ঘড়ি জ্বলজ্বল করছে। পরনে ব্রাউন কালারের জিন্স। পায়ে সুন্দর ক্যাডস পরা। তার সামনে একগুচ্ছ ফুলের তোড়া। দেখতে ভালোলাগার মতো। একপাশে ঘুরে সে মোবাইলে কথা বলছে। তাই মুখ দেখতে পেলাম না। কন্ঠ ও শুনতে পেলাম না।

আমি তার পাশের টেবিলে গিয়ে বসলাম। হয়তো পাত্র জ্যামে পড়েছে। যেহেতু দূর হতে আসবে। এই ভেবে অপেক্ষা করতে লাগলাম। মোবাইল হাতে নিয়ে তাকে এবার ফোন দিলাম মেসেজ না দিয়ে। পাশের টেবিলে তাকাতেই দেখি সেই ছেলে নেই। হয়তো বেরিয়ে গিয়েছে।

ফোন রিসিভ হলো না। আমি হতাশ ও বিরক্ত হলাম বাবার উপরে। এভাবে একা একজন মেয়েমানুষ কতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারে। উঠে দাঁড়ালাম। ব্যাগ হাতে নিলাম। চলে যাবার উদ্যত নিতেই আমার সামনে ধুমকেতুর মতো উপস্থিত হয়ে গেলো বাবার সেই কাঙ্ক্ষিত পাত্র।

চলবে.. ১১