Saturday, August 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 471



মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-০৩

0

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩
ব্যালকনির গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে মীরা। আজ আবারও পাত্রপক্ষ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাতে মীরার দুঃখ নেই। বরং আনন্দ হচ্ছে এরকম মনোভাব পোষণকারী পরিবার থেকে আগেই বেঁচে গেছে। যদি উনারা নিজেদের মনোভাব লুকিয়ে বিয়ে পর্যন্ত চলে যেত তাহলে? কিন্তু মাঝেমাঝে বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকালে নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয়। নিজের অতীতের জন্য তাদেরকে কষ্ট দিয়ে ফেলল না-তো? দীর্ঘশ্বাস ফেলল মীরা। রাতের আঁধারে তারকাময়ী আকাশটা বড্ড সুন্দর দেখাচ্ছে। তার মাঝে একটা চ্যাপ্টা আকৃতির শুভ্র চন্দ্রমা। একাকি নির্জনে, নীরবে এই সৌন্দর্যের মোহ যেকাউকে মোহিত করবে। আচমকা ফোনের রিংটোনে ঘোর কাটে মীরার। ব্যালকনির দরজার কাছেই বুক সেলফের উপর ফোনটা রাখা ছিল। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে, হোয়াটসএপে তার ইন্ডিয়ার বান্ধবী, রুমমেট ও কলিগ রাইমার কল এসেছে। মীরা ফোন রিসিভ করে ‘হ্যালো’ বলতেই অপরপাশ থেকে ভেসে আসে,

“কবে আসবি ইয়ার? অ্যাই রিয়েলি মিস ইউ।”

“আসব। দুই সপ্তাহের ছুটি তো। আর ছয় দিন বাকি।”

রাইমা উৎসাহী হয়ে জিজ্ঞাসা করল,
“আজ না তোকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল? কী বললো তারা? আশীর্বাদের ডেট ফিক্সড করে গেছে?”

“না। রিজেক্ট করে গেছে।”

রাইমা যেন ভীষণ অবাক হলো। সে বিস্ময়ের কণ্ঠে বলল,
“ওমা! কেন? সেইবারে না হয় বুঝলাম যে ওরা কম বয়সী মেয়ে চেয়েছে। এইবার তো ঘটককে আগে থেকেই বলে রেখেছিল। তাহলে?”

মীরা ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমার খুঁত আছে। আমি ইন্ডিয়াতে জব করি। তাই বলে রিজেক্ট করে গেল।”

রাইমা যেন হঠাৎই উত্তেজিত হয়ে পরল। ফুঁসে উঠে বলে,
“ধুয়ে দিসনি ওদের? সবসময় মেয়েদের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা স্বভাব হয়ে গেছে। আমার তো মন চায় কানের নিচে একটা দিই। জন্মেছে তো এক নারীর গর্ভে। তাও নারীর চরিত্রের বিচার করে। আবার নিজে নারী হয়েও।”

“থাম তুই। সবে ল্যাব থেকে এসেছিস। রেস্ট কর। বায়।”

রাইমা আরও কিছু বলতে চাইছিল তার আগেই মীরা কল কেটে দিল। রাইমা হতাশ হয়ে বলে,
“ওই স্বরবর্ণ না ব্যঞ্জনবর্ণটাকে হাতের কাছে পাই শুধু! আচ্ছা মত ভ*র্তা করব! হুহ্!”

রাইমা তারপর ফ্রেশ হতে চলে যায়।

মীরা তার মায়ের ঘরে যায়। সেখানে বাবা-মা দুজনেই আছে। মীরা বলে,
“আমি আর পাঁচ দিন পর চলে যাব। তোমরা এর মধ্যে কিছু করতে পারলে করো নয়তো এইবারের ছুটিতে সম্ভব না।”

মীরার বাবা মিস্টার রফিক তালুকদার গম্ভীর স্বরে বলেন,
“তুমি দেশেই জবের খোঁজ করছ না কেন? ইন্ডিয়া অত দূরে যাওয়ার কী দরকার?”

“খুঁজব। ওই বায়োটেক ল্যাবটা ভালো। অভিজ্ঞতা হবে ভালো। সিভিতে ভালো ইম্পেক্ট ফেলবে।”

মেয়ের কথায় মিস্টার রফিক তালুকদার সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি রুষ্ট স্বরে বললেন,
“আজকেও ওরা ফিরে গেল, ইন্ডিয়ার জবের কারণে।”

বাবার কথাটা শুনে মীরা ভ্রুকুটি করে। সে জবাবে বলে,
“মোটেও না। তাদের প্রবলেম, চাকরি নিয়ে। ওরা আমার চরিত্রে প্রশ্ন তুলেছে। শোনো বাবা, চরিত্র হচ্ছে নিজের কাছে। যে ধরে রাখতে জানে, সে দেশ-বিদেশের যেখানেই থাকুক নিজের চরিত্রের উপর আঁচ আসতে দেয় না। ওদের বিয়ের আগেই এত সন্দেহ তো বিয়ের পর কী করবে?”

মীরার মা মিসেস মলি জাহান, মেয়েকে ইশারায় থামতে বলছেন। মীরা এবার মাকে বলে,
“বারবার এসব ভালো লাগে না। আমি আর পাঁচদিন আছি, তার মধ্যে বিয়ে ঠিক করতে পারলে করো। তারপর আমি চলে যাব। পরেরবার আসলে বিয়ের কাজ। আর আমি দেশেও জবের ট্রাই করব।”

এটুকু বলে মীরা হনহনিয়ে বাবা-মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে এসে দরজা দেয়। মীরার বড়ো ভাবি শারমিন, তার শ্বশুর-শাশুড়ির ঘরের বাহিরেই ছিল। সে ভেতরে গিয়ে বলে,

“মা-বাবা, ওর উপর এত রাগ করবেন না। বিয়ের হুকুম হলে তো বিয়ে হবেই।”

মিসেস মলি জাহান শান্ত স্বরে বললেন,
“জানি মা। কিন্তু মেয়ের বিয়ের আগ পর্যন্ত চিন্তা যে কমে না। তোমারও তো মেয়ে আছে। সেও বড়ো হবে। তখন তোমারও এমনই চিন্তা হবে। দেখা যাক কী হয়।”

শারমিন নীরব সম্মতি দিয়ে চলে আসে। শারমিন তার পাঁচ বছরের মেয়ে মৃদুলাকে পাঠায় তার ফুফির ঘরে পড়তে। মৃদুলাও খুশিমনে পড়তে যায়।

_______

শেহজাদ তার বাড়িতে পা রাখা মাত্রই এক ছোটো পাঁচ বছরের পুতুলের মত লালচে বাদামী চুলের বাচ্চা দৌঁড়ে এসে ‘বাবা’ বলে জড়িয়ে ধরে। শেহজাদও খানিক নিচু হয়ে বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“সারাদিন কী কী করলে মাম্মাম? হোমওয়ার্ক কম্পিলিট করেছ?”

বাচ্চা মেয়েটা কপালে হাত দিয়ে বলে,
“উফ বাবা! সবসময় শুধু পড়াশোনা তোমার। আমার হোমওয়ার্ক দেয় অল্প একটু। ওটা আমি স্কুল থেকে ফিরেই দাদুমনির সাথে করে ফেলি।”

মেয়ের কথা শুনে শেহজাদ হাসে। তার সারাদিনকার ক্লান্তি নিমিষেই শেষ।
(এখানে শেহজাদকে ‘তুমি’ সম্বোধনে লিখা ও নামের সাথে কোনো পদবী উল্লেখ না করাতে এভাবে লিখা।)

শেহজাদ বলল,
“এইতো গুড গার্ল। তোমার দাদুমনি কোথায়?”

“দাদুমনি চাচ্চুর ঘরে। চাচ্চুর সেলাইন শেষ। বদলে দিচ্ছে।”

“আচ্ছা তুমি খেল। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।”

শেহজাদ তার মেয়েকে কোল থেকে নামিয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়।

***

রাতের খাবারের সময় শেহজাদ ও তার পরিবারের সবাই একসাথে হয়েছে। রাত দশটা বাজে। শেহজাদের মেয়ে ফ্রিশা আগেই খেয়ে নিয়ে এখন ড্রয়িং করছে। খেতে খেতে শেহজাদের ফুফা ড: আকবর রেহমান বলেন,

“ফ্রিশাকে দেখো শেহজাদ। ওর কথা ভেবে হলেও থেকে যাও। তুমি কি চাও, ও একা একা বড়ো হোক?”

শেহজাদ তাকালো না। এক ধ্যানে খাচ্ছে। ড: আকবর রেহমান নিজের স্ত্রীকে ইশারা করলেন। উনার স্ত্রী শাহিদা রেহমান বলেন,

“এমন জেদ করছ কেন? আমেরিকায় তুমি কাকে পাবে? ভাই-ভাবীও তো জীবিত নেই।”

শেহজাদ এবার খাওয়া থামাল। অতঃপর বলল,
“তাহলে আপনারা জেদ ছেড়ে দিন। আমিও কোথাও যাব না।”

“তুমি চাও না, ফ্রিশা মায়ের আদর পাক?”

ড: আকবর রেহমানের প্রশ্নে শেহজাদ সরাসরি জবাব দেয়,
“না! চাই না। ওর নিজের মা ছাড়া কেউ ওকে মায়ের আদর দিতে পারবে না। তাছাড়া একটা মেয়েকে আমি শুধু ফ্রিশার মা হিসেবে তো আনত পারব না। তাই না? বিয়ে করতে হবে আমার। আমি ফ্রিওনাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসতে পারব না।”

মিসেস শাহিদা রেহমান বললেন,
“একা এভাবে কতদিন থাকবে। আমরা চলে গেলে তুমি আর ফ্রিশা একদম একা হয়ে যাবে।”

“আপনারা তাহলে এতদিন কী-সের আশায় ছিলেন? খারাপ লাগলে আগেই সরি। আপনাদের একজনের কিছু হলে অন্যজন কী-ভাবে থাকবেন?”

“কথার জালে জড়িও না শেহজাদ। ফ্রিওনাও কিন্তু মৃত্যুর সময় ফ্রিশার জন্য মায়ের আবদার করে গিয়েছিল। সেই সাথে তোমার জীবনেও একজন ভালোবাসার মানুষের।”

শেহজাদ প্লেটের খাবারের শেষটুকু খেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“আপনারা আমায় কথার জালে জড়াচ্ছেন। আমি নিজের জন্য ভালোবাসার মানুষ যদিও খুঁজে পাই কিন্তু কোথাও ফ্রিশার জন্য মা খুঁজে পাব না। বারবার এক কথা বলবেন না। নাহলে কিন্তু আমি বাধ্য হব।”

শেহজাদ উঠে চলে গেলে, ড: আকবর রেহমান ও উনার স্ত্রী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
রিচেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-০২

0

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২
ফাগুন হাওয়া এসেছিল মীরার জীবনে। উচ্ছলতা প্রিয় মীরা যেখানে কলেজ দাপিয়ে ভার্সিটির প্রাঙ্গণে মুখর ছিল। যার কণ্ঠে মাধুর্যতা ঝড়ত। বসন্ত উৎসবে মীরার কণ্ঠে ফাগুনের গান ছাড়া যেন অসম্পূর্ণ। সেই মীরার জীবনে ফাগুনের ছোঁয়া এসে তাকে রিক্ত করে চলে গেল! এইযে প্রকৃতিতে চৈত্রমাস, এখনও অবধি সে বসন্ত বন্দনা করেনি। আমূল পাল্টে গেছে সে।
এসব কিছু ভাবতে ভাবতে ডাক পরলো মীরার। শাওয়ারের নিচে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। তারপর চেঞ্জ করে বেরিয়ে আসল। বেরিয়ে দরজা খুলে দেখল তার ছোটো ভাবী নিধি হাতে শাড়ি নিয়ে দাঁড়ানো। নিধি বলল,

“নাও ননদী। শাড়িটা সুন্দর করে পড়ে নাও।”

মীরা শাড়ির দিকে একবার তাকায়। বেশ সুন্দর শাড়ি। বাসন্তী রংয়ের জামদানি শাড়ি। রংটা তার একসময়কার ভীষণ প্রিয়র তালিকায় ছিল। কিন্তু এই প্রিয় রংটাই এখন তার পড়তে ইচ্ছে করে না। মীরা দুর্বল কন্ঠে বলল,

“এই শাড়িটা পড়ব না ভাবী। নিয়ে যাও।”

নিধি শাড়িটার দিকে একবার ভালো করে দেখে মীরার দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ের সুরে বলে,
“ওমা! শাড়িটা পড়বে না কেন? কী সুন্দর রংটা। তোমার গায়ে কিন্তু খুব সুন্দর মানাবে। তাছাড়া তোমার পছন্দের রং বলে কথা।”

মীরা বিড়বিড় করে বলল,
“তাই জন্যই তো পড়ব না। এই রং যে একবার আমার ধ্বং*সের কারণ হয়েছে! কী করে ভুলি সব!”

মীরাকে অন্যমনস্ক দেখে নিধি ওর চোখের সামনে হাত নাড়িয়ে শুধায়,
“কী হলো? কোথায় হারালে? নেও শাড়িটা পড়ে নাও।”

“ভাবি, শাড়ি পড়ার কী দরকার? থ্রি-পিস পড়লেই তো হয়ে যায়।”

নিধি মুখে হাত দিয়ে ভণিতা করে বলে,
“কি যে বলোনা তুমি! যেই তুমি শাড়ি বলতে পাগল ছিলে! সেই তুমি কী-না শাড়ি পড়বে না! শাড়ি পড়তে অস্বীকার করছ? শোনো, এসব চলবে না। মা বলেছেন, তোমায় শাড়ি পড়তেই হবে।”

মীরা তার ভাবির সামনে থেকে সরে গিয়ে বিছানায় বসে হতাশা মিশ্রিত কন্ঠে বলে ওঠে,
“কী লাভ বলো তো? আগেরবারও তো পড়লাম শাড়ি। কোন কি লাভ হয়েছে? অযথাই এসব করছ। আগেরবারের প্রবলেম কি ছিল? মেয়ের বয়স বেশি। শাড়িতে কি আমার বয়স ঢেকে যাবে ভাবি?”

নিধির চেহারার খুশি ভাবটা নিমিষেই উবে গেল। সে মীরার পাশে এসে বসে। অতঃপর মিহি স্বরে বলে,
“সব সময় এত নেগেটিভ ভাবো কেন? সব সময় তো একই রকম নাও হতে পারে তাই না? ভালো কিছুও হতে পারে। আগেরবার যেই পরিবার তোমায় দেখতে এসেছিল সেই পরিবার সম্বন্ধে বাবা খুব একটা খোঁজ খবর নেননি। ঘটক বাবাকে মন ভোলানো কথাবার্তায় ভুলিয়ে ফেলেছিল। ওরা চাইছিল ১৭-১৮ বছর বয়সের বাচ্চা মেয়ে। ঘটক এসব আমাদের জানায়নি। তাই তো ঘটকটাই এবার বদলে ফেলা হয়েছে। নতুন ঘটক খোঁজখবর নিয়ে পাত্রের খোঁজ বলেছে। বয়স বেশির কথা এবার ঘটককে পইপই করে জানানো হয়েছে। এবার তোমাকে ওসব বিড়ম্বনায় পরতে হবে না। তাই সুন্দর করে তৈরি হয়ে নাও তো। কথায় আছে, ‘আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী।’ বুঝেছ? আর আমাদের মেয়ের গুণ, কোন দিক দিয়ে কম? কোনো দিক দিয়ে খামতি নেই।”

শেষোক্ত লাইন নিধি একটু মজা করেই বললো। উদ্দেশ্য তার মীরার মুখে হাসি ফোটানো। হলোও তাই। মীরা হালকা হাসলো। নিধি এবার তাড়া দিয়ে দেয়াল ঘড়িতে একবার চোখ বুলিয়ে বলল,

“এই জলদি তৈরি হয়ে নাও তো। বেশি একটা সময় নেই। তুমি একা শাড়িটা পড়তে না পারলে আমাকে বলো আমি পড়িয়ে দিচ্ছি। অবশ্য আমি জানি তুমি শাড়ি ভালোই করতে পারো।”

“আমি পড়তে পারবো ভাবি।”

“আচ্ছা তবে আমি গেলাম। রান্নাঘরের কাজগুলো একটু গুছিয়ে দেখি। তুমি কিন্তু জলদি তৈরি হয়ে নিবে। পরে কিন্তু মা এসে আমাকে ব*কবে। কেন আমি তোমাকে তৈরি করা রেখে রান্নাঘরে গিয়েছি!”

নিধি উঠে যেতে যেতে কথাটা বলল। মীরা কৃত্রিম হেসে মাথা নাড়ায়। তারপর দরজা লাগিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে। ভালো লাগছে না তার। কেন যেন মনে হচ্ছে, এইবারও কোন একটা ঝামেলা হবে। আর তারপর ছেলেপক্ষ তাকে প্রত্যাখান করে চলে যাবে। তাও মায়ের কথায় এক প্রকার বাধ্য হয়েই সে তৈরি হতে চলল। দেখা যাবে কী হয়।

_________

বায়োটেকনোলজি ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড: আকবর রেহমান তার রিসার্চ স্টুডেন্টদের কাজ দেখে এসে নিজের অফিস কক্ষে বসলেন। এখন বিকেল চারটার মত বাজে। তিনি তার জুনিয়র কলিগ অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ড: শেহজাদ নেওয়াজকে কল করলেন। ড: শেহজাদ নেওয়াজ সবে আজকের দিনের লাস্ট ক্লাস শেষ করে নিজের অফিস কক্ষে গেছেন। ব্যাগ নিয়ে তিনি বেরোবেন তখনই কল আসাতে রিসিভ করে সালাম দিলেন। চেয়ারম্যান স্যার বলেন,

“তোমার ক্লাস শেষ শেহজাদ?”

“ইয়েস স্যার।”

“কাম টু মাই রুম।”

ড: শেহজাদ ভাবলেন হয়তো স্টুডেন্ট ড্রপ লিস্ট চাইবে। আজকেই তো সাবজেক্ট উইথড্র করার শেষ দিন ছিল। তাই তিনি সেই লিস্টটা নিয়ে চেয়ারম্যান স্যারের রুমে গেলেন। ড: শেহজাদকে দেখে চেয়ারম্যান স্যার বললেন,

“বসো শেহজাদ।”

ড: শেহজাদ হাতের কাগজটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
“স্যার, হেয়ার ইজ স্টুডেন্ট ড্রপ লিস্ট এন্ড অল ডিটেইলস। অ্যাই অলসো ইমেইলড ইউ।”

“ওকে। নাউ লিসেন টু মি। অ্যাই হ্যাভ সামথিং ইমপর্টেন্ট টু টক।”

“শিউর স্যার। প্লিজ টেইল।”

“দেখো শেহজাদ, আমি ভূমিকা করে বলব না। কিন্তু এভাবে চলতে পারে না।”

ড: শেহজাদের মুখশ্রীতে কিঞ্চিত বিরক্তির আভাস ফুটে ওঠল। তিনি এক কথায় বললেন।
“বাট স্যার ইটস টাইম টু রিটার্ন। আমি আমেরিকায় ফিরতে চাই।”

“আমি তোমাকে আবারও বলব, প্লিজ স্টে। স্টুডেন্টদের তোমাকে সত্যি প্রয়োজন।”

“থাকতেই এসেছিলাম কিন্তু ব্যাক্তিগত কারণে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে, নাউ ইটস হাই টাইম টু ফোকাস অন মাই ক্যারিয়ার।”

এটা বলেই ড: শেহজাদ আর কালক্ষেপণ না করে উঠে গেলেন। ড: শেহজাদ চলে যেতেই ড: আকবর রেহমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারে চোখ বন্ধ করে মাথা এলিয়ে দিলেন। অনেক কাঠখড় পু*ড়িয়ে তিনি ড: শেহজাদকে এই ডিপার্টমেন্টে এনেছিলেন যাতে স্টুডেন্টরা উপকৃত হয়। বেশ দায়িত্ববান ও চৌকস ছেলে। আস্তে আস্তে ডিপার্টমেন্টের পুরোনো অভিজ্ঞতা সম্পন্ন শিক্ষকরা চলে যাচ্ছেন। এডজাংক্ট ফ্যাকাল্টি আনতে হচ্ছে।

ড: শেহজাদ চেয়ারম্যান স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে গিয়ে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বেরোতে বেরোতে আমেরিকার যে ইউনিভার্মিসিটিতে এপ্লাই করেছেন সেখানকার মেইল এসেছে কী-না দেখে নিলেন।

_______

পাত্রপক্ষের সামনে বসে আছে মীরা। পাত্রের মা ও বোন মীরাকে বেশ বিচক্ষণতার সাথে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। এদিকে পাত্রও যে তাকে পলকহীন দৃষ্টিতে দেখতে তা তার অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাত্রের বোন বলে ওঠলেন,

“মেয়ের বয়স বেশি শুনলাম। তা তোমার বয়স কত?”

মীরা মাথা নিচু রেখেই নম্র স্বরে জবাব দিলো,
“ছাব্বিশ বছর এক মাস।”

“বাহ! মাস সহ বলে দিলে। যাতে একটু বেশি না ভেবে ফেলি? তা শুনেছি তুমি নাকি চাকরি করো। কোথায় চাকরি করো? বিয়ের পরও কি চাকরি করবে নাকি? ”

মীরা এবার মাথা উঠাল। পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে প্রত্যুত্তর করল,
“হ্যাঁ আমি চাকরি করি। আর বিয়ের পরও চাকরি করব। আমি ইন্ডিয়াতে একটা বায়োটেক ল্যাবে আছি।”

মীরার জবাব শুনে পাত্র-পক্ষের মাথায় যেন ব*জ্রপাত হলো! তাদের চোখের মনি যেন অক্ষিগোলক ছেড়ে বেরিয়ে আসবে! পাত্রের মা আঁতকে উঠে শুধালেন,

“ইন্ডিয়াতে? আবার বিয়ের পর চাকরিও করবে?”

উনার এহেনো স্বর ও প্রশ্ন শুনে মীরার ভীষণ হাসি পেলো। তাও সে হাসলো না। হাসলে তো তাকে অভদ্রের অ্যাখ্যা দিয়ে বসবে! সুন্দর করে জবাব দিল,

“কেন আন্টি? কী হয়েছে তাতে?”

“কী আর হবে বলো? আমাদেরই বোঝার ভুল ছিল। বয়স্ক মেয়ে এতদিন কি বাড়িতে শুধু শুধু বসিয়ে রাখবে! কোন কারণ ছিল তাই তো বসে আছে।”

মীরা তাদের কথার ধরন বুঝলেও ইচ্ছে করেই না বোঝার ভান করে প্রশ্ন করলো,
“কী কারন ছিল আন্টি? না মানে আপনারা বললেন কারণ ছিল, কারণটা তো আমার জানা নেই। যদি বলতেন তাহলে সুবিধা হতো।”

“থাক মা, আর কথা বাড়িও না। যা বোঝার বুঝে গেছি।”

পাত্রের মায়ের কথা শুনে মীরাও বুঝে গেল, কী হতে চলেছে? তাই সে মুচকি হাসলো। তার বাবা-মায়ের মুখের দিকে এক পলক চেয়ে ভারী দুঃখ বোধ করল। বড্ড বাজে ভাবে ফেঁসে গেছেন উনারা।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
রিচেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। রেসপন্স করবেন প্লিজ।

মন মোহনায় ফাগুন হাওয়া পর্ব-০১

0

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#সূচনা_পর্ব

ভার্সিটির নিজ ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান স্যারের থেকে বিয়ের প্রস্তাবে ভড়কে উঠল মীরা। শ্রদ্ধেয়, বয়োজ্যেষ্ঠ, পিতৃস্থানীয় কারও কাছ থেকে এমন প্রস্তাব সত্যি চমকে দেওয়ার মত। তাছাড়া স্যারের কাছ থেকে তো এমনটা মীরা স্বপ্নেও আশা করেনি। মীরা ঘামছে। কনকনে শীতল রুমেও মনে হচ্ছে সে অ*গ্নিকু*ণ্ডের পাশেই বসা! নাকি বাহিরের চৈত্রের তীব্র তাপ রুমের শীতলতাকে ছাঁপিয়ে যাচ্ছে! কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসছে তার। অপরপাশের চেয়ারে বসা চেয়ারম্যান স্যার মীরার জবাবের জন্য অধীর আগ্রহে আছেন।

কিছুক্ষণ আগে,,
প্রায় তিন বছর পর নিজের ভার্সিটিতে পা দিয়েছে মীরা। ভার্সিটির করিডোরে ঘুরে ঘুরে দেখছে। যেসব ফ্লোরে তাদের ডিপার্টমেন্টের ক্লাস হয় সেখানেও ঘুরে ঘুরে লুকিং গ্লাসে টিচারদের ক্লাস নেওয়া দেখছে। করিডোরে স্টুডেন্টদের বিচরণ। সবার মাঝে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে সে। তার অতীতের দূরন্তপনা, হাসি-আনন্দ সব। করিডোরের কেউ তাকে লক্ষ্য করছে না। যে যার মত মেতে আছে নিজ নিজ বন্ধুদের সাথে। সব দেখে মীরার চোখে জল ভর করল। আলতো হাতে তা মুছে নিয়ে পা বাড়াল ডিপার্টমেন্টের দিকে। টিচারদের সাথে দেখা করতে। পুরনো অনেক শিক্ষকরা চলে গেছেন। কেউ পিএইচডি করতে তো কেউ অন্য কোন ভালো অপশন পেয়ে সেখানে। শিক্ষকদের মাঝেও অনেক নতুন মুখ দেখা যাচ্ছে। যাদের সাথে মীরার পরিচয় নেই। সে সবচেয়ে প্রিয় ম্যামদের সাথে প্রথমে দেখা করল। সবাই খুশি। ক্যারিয়ার প্ল্যানিং জানার পর শেষে একটাই প্রশ্ন,

“বিয়ে কবে করছি?”

প্রশ্নকর্তার কাছে খুব সহজ একটা প্রশ্ন, কিন্তু জবাবটা উত্তরদাতার কাছে বেশ কঠিন। মীরা মুচকি হেসে বলে,

“সময় হলে করব ম্যাম।”

সবার শেষে দেখা করতে যায় ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান স্যার প্রফেসর ডঃ আকবর রেহমান স্যারের সাথে। ডিপার্টমেন্টের সব স্টুডেন্টদের উনি অনেক স্নেহ করেন। সে অনুসারে ছেলে-মেয়েরাও উনাকে বেশ শ্রদ্ধা করে। স্যার বেশ আন্তরিক। স্যারের অফিস কক্ষে গিয়ে নিজের পরিচয় দেওয়ার আগেই স্যার বলে ওঠেন,

“আরে মীরা! কেমন আছো?”

মীরা মিষ্টি হেসে চেয়ার টেনে বসে জবাব দেয়।
“আসসালামু আলাইকুম স্যার। আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন স্যার?”

“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। এই বয়সে আর কতটুকু ভালো থাকি বলো? তাও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তোমার কী খবর?”

“মাস্টার্স শেষ করে এক সপ্তাহ হলো দেশে এসেছি।”

“চাকরির জন্য এপ্লাই করেছ?”

“না স্যার এখনো করিনি। আসলে আমি ইন্ডিয়াতে একটা জব করছি। ছুটিতে এসেছি। বাবা-মা খুব করে জোর করলেন, তাই আসলাম। ”

প্রফেসর ডঃ আকবর রেহমান হালকা হাসলেন। তারপর বললেন,
“বিয়ের জন্য কি? বাবা-মায়েদের এই এক মহাচিন্তা। ছেলে-মেয়েদের বিয়ে নিয়ে।”

“জি স্যার তেমনটাই।”

“তা কবে বিয়ে করছ?”

মীরা নম্র হেসে জবাব দিল,
“যখন সময় হবে তখন করব স্যার। আমার বিয়ে নিয়ে অত চিন্তা নেই।”

“বিয়ের জন্য কেমন ছেলে পছন্দ? কোন পছন্দ আছে নিজস্ব? যার জন্য দেরি করছো?”

স্যারের এই প্রশ্নে মীরা চুপসে যায়। মনে হচ্ছে স্যার তার মনের কথা ধরে ফেলেছেন। মলিন হয়ে যায় তার মুখশ্রী। নিচু স্বরে বলে,
“না স্যার। আমার তেমন পছন্দ নেই। ভালো মনের মানুষই যথেষ্ঠ।”

“ওয়েল। এটা ঠিক, ভালো মনের মানুষ হলে ধন-সম্পদ, প্রাচুর্য ও অন্য কোনো কমতি থাকলেও সব হার মেনে যায়। আবার অনেকের অঢেল থাকার পরেও খারাপ মনের মানুষের পাল্লায় পরে সব শেষ হয়ে যায়।”

মীরা কিঞ্চিত হাসল। মীরাও স্যারের সাথে একমত। স্যারের একটা মাত্র ছেলে তাও সুস্থ না। শারীরিক ও মানসিক প্র*তিব*ন্ধী। দেশ-বিদেশে ঘুরে স্যার তার ছেলের অনেক চিকিৎসা করিয়েছে কিন্তু সুফল পায়নি। স্যারের ছেলে এখন শয্যাশায়ী। মুখ দিয়ে খেতেও পারে না, নড়াচড়াও করতে পারে না। তার স্ত্রীর জড়ায়ুর টিউমারের চিৎসার পর আর সন্তান হবে না জেনেও তিনি আরেকবার বিয়ে করেননি।
মীরা বলে,

“জি স্যার। বলে না, দুষ্ট গো*রুর চেয়ে শূণ্য গোয়াল ভালো।”

প্রফেসর ডঃ আকবর রেহমান বলেন,
“মীরা, তোমার জন্য আমার কাছে একটা প্রস্তাব আছে। বিয়ের প্রস্তাব। তুমি ভেবে দেখতে পারো। আমার বাড়ির বউ হবে? আমাদের অপূর্ণতা মিটাবে?”

থমকে গেল মীরা। চেয়ারম্যান স্যারের কথাগুলো তার অবিশ্বাস্য লাগছে। সে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছে। আকাশ-পাতাল চিন্তা-ধারা করে চলেছে।

-_-_-_-_-_-

“কী হলো মীরা? কী ভাবছ? রাজী তুমি?”

চেয়ারম্যান স্যারের ডাকে ঘোর ভাঙ্গে মীরার। হকচকিয়ে উঠে সে। মস্তিষ্কে সমস্ত কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। যেখানে সে গুছিয়ে কথা বলার জন্য স্টুডেন্ট লাইফে ও চাকরিক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ, সেই মীরা কথা গোছাতে পারছে না। অবশ্য এটা আজকে তার সাথে প্রথমবার হচ্ছে না! মীরা জিভ দিয়ে ঠোঁট হালকা ভিজিয়ে ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলে,

“আসলে স্যার….!”

“সময় নাও। ভাবো। তোমার বাড়ির লোকদের সাথে কথা বল তারপর সিদ্ধান্ত নাও। যেহেতু জীবনের একটা বড়ো সিদ্ধান্ত নিতে চলেছ।”

মীরা জোরপূর্বক হেসে এখান থেকে উঠতে চাইছে। কিন্তু কী বলে উঠবে সেটাই ভাবতে পারছে না। মাথা এতটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে কী বলবে! তখনই কক্ষে পিয়নের আগমন ঘটে। মীরা তড়িঘড়ি করে বলে,

“স্যার, আজ তাহলে আমি উঠি। ভালো থাকবেন।”

“আচ্ছা। তুমিও ভালো থেকো। আর ভেবো কিন্তু কথাটা।”

মীরা ওষ্ঠকোণে কৃতিম হাসি রেখে বেরিয়ে যায়। স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে এতক্ষণ আটকে রাখা অস্বস্তিকর নিঃশ্বাসটা মুক্ত করে। চেয়ারম্যান স্যারের প্রতি থাকা সম্মানের স্তরটা ধীরে ধীরে কেমন যেন ফিঁকে হতে শুরু করেছে। খানিক এলোমেলো পায়ে ডিপার্টমেন্টাল করিডোর থেকে বেরিয়েই যাচ্ছিল তখন হঠাৎই কারও সাথে বেখেয়ালিতে ধাক্কা লেগে পরে যেতে যেতে বেঁচে যায়। কেউ তাকে ধরেছে। পিটপিট করে মুদিত নয়নজোড়া খুলে নিজের সেভিয়রকে দেখার প্রয়াস করে। তৎক্ষণাৎ ভড়কে যায়। এ কি! ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে স্ট্রিক্ট, ফ্রেন্ডলি, মুডি, সমাজছাড়া স্যার তার হাত ধরে পরে যাওয়া রোধ করেছে। মীরা ধড়ফড়িয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। অতঃপর তোঁতলানো স্বরে বলে,

“স..সরি স্যা..স্যার! অ্যাই ডিডেন্ট নোটিশ!”

“ইটস অকে। নেক্সট টাইম, ইউ মাস্ট নোটিশ।”

“অকে স্যার।”

মীরা দ্রুত ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে লিফ্টের বোতামে প্রেস করে অপেক্ষা করতে থাকে। তার হাত কাঁপছে। আজকে কী হচ্ছে এসব! এত অস্বস্তিতে কেন পরছে? তখনি আবারও সেই স্যারের কণ্ঠ কানে আসে। তিনি দূর থেকেই জিজ্ঞেসা করেন,

“হুইচ সেমিস্টার?”

মীরা ভয়ে ভয়ে পেছনে ঘুরে। অতঃপর ঢোক গিলে ভদ্রতা সূচক একটু এগিয়ে বলে,
“স্যার, আমি এক্স স্টুডেন্ট।”

“ওও! সো, দ্যাটস হোয়াই অ্যাই অ্যাম আনএবেল টু রিকল ইউর নেম। বাট ইউর ফেস ইজ সামহোয়াট ফেমিলিয়ার।”

স্যারের ঠোঁটে হাসির রেখা দেখে মীরার স্বস্থি মিলে। স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায়ও এই স্যারের সামনে খুব একটা পড়তে চাইতো না সে। স্যারের ভয়ংকর চোখের চাহনি তাকে অস্বস্তিতে ফেলত। যেন চোখ দিয়েই গি*লে ফেলবে। মীরা হালকা হেসে বলে,

“কেমন আছেন স্যার।”

“অ্যাম গুড। হাউ এবাউট ইউ? শেখরদের ব্যাচ? তুমি ভালো গান গাইতে পারো। রাইট?”

স্যারের নাম মনে নেই কিন্তু যতোটা মনে আছে তা দেখেও মীরা বলতে বাধ্য এই লোকের স্মৃতিশক্তি প্রখরের চেয়েও প্রখর। মীরা উত্তর দেয়,

“জি স্যার। আমি মীরা তারান্নুম।”

স্যার হাসলেন। অতঃপর বললেন,
“কী করছ এখন?”

“ইন্ডিয়াতে একটা বায়োটেক ল্যাবে আছি।”

“অনেকদিন পর ভার্সিটিতে আসলে তাই না? তোমাকে দেখেছিলাম, করিডোরে লুকিং গ্লাস দিয়ে ক্লাসরুমের ভেতরে উুঁকি দিচ্ছিলে।”

স্যারের কথা শুনে দাঁত দিয়ে জিভ কা*টে মীরা। সে যে এই লোকের ক্লাসেও লুকিং গ্লাসে নজর দিয়েছিল! মীরা লাজুক হেসে বলে,

“স্যার আসলে এখানে ক্লাস করা, আপনাদের লেকচার সব মিস করছিলাম। এটা তো ট্রু যে, স্টুডেন্টরা তাদের স্টুডেন্ট লাইফ তখনই মিস করে যখন তারা স্টুডেন্ট লাইফ ছেড়ে বেরিয়ে আসে।”

“ইয়াহ। ইভেন, মি অলসো। যখন আমেরিকায় যাই তখন ইউনিভার্সিটির এড়িয়াতেই ম্যাক্সিমাম থাকা হয়। তা তুমি কি দেশে জবের জন্য ট্রাই করছ?”

“না স্যার। এখনও না। ট্রাই করব। ভালো জব পেলে ভেবে দেখব।”

“অকেই। বেস্ট অফ লাক। ভালো থেকো। ”

“স্যার আপনিও ভালো থাকবেন। দোয়া করবেন স্যার। আসি।”

স্যার হালকা হেসে চলে যান। মীরা আবারও লিফ্টের বোতাম প্রেস করে। তারপর লিফ্ট আসলে গ্রাউন্ডে নেমে আসে। কিছুক্ষণ সেখানে বসে থাকে। না চাইতেও চেয়ারম্যান স্যারের কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। মনের মধ্যে তিক্ত স্বাদ অনুভব করছে। তখনি ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখে মা কল করেছে। ফোন রিসিভ করে কানে নিতেই ফোনের অপর পাশ থেকে মীরার মা মিসেস মলি জাহান বলে ওঠেন,

“কোথায় তুই? কখন আসবি? ভুলে গেছিস? আজকে বিকেলে যে তোকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। এইবার কিন্তু আমি তোর কোন টালবাহানা শুনব না। তোর বাবাকে আর রাগাস না।”

মায়ের কথা শুনে মীরা পিলারের সাথে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। ক্লান্ত স্বরে বলে,

“আসছি মা।”

মীরার মা আরো কিছু বলতো, তার আগেই মীরা ফোন কে*টে উঠে দাঁড়ায়। এরপর ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে সিএনজি ডেকে উঠে বসে। এই এক সপ্তাহের মধ্যে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার সে পাত্রপক্ষের সামনে বসবে। মেয়ের বিয়ে নিয়ে এত তাড়া তার বাবা-মায়ের! অথচ মীরার পিঠাপিঠি কোন বোনও নেই। সিএনজি চলতে লাগলো তার আপন গতিতে। মীরা ক্লান্ত হয়ে বসে পেছনে ছুটে চলা রাস্তা দেখছে। বাহিরে সূর্যের তেজ প্রখর। মনে হচ্ছে সব ঝলসে যাবে। যা তার হৃদয়ের দ*গ্ধতাকে আরও কাঁচা করে তুলছে।

বাড়িতে ফিরে মায়ের বাণী শুনতে শুনতে নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে শাওয়ার নিতে চলে যায়। মিসেস মলি জাহান একটু রুষ্ট হলেন। তিনিও নিজের ঘরে চলে গেলেন। শাওয়ারের নিচে বসে মীরা ভাবতে থাকে তার অতীত জীবন….

চলবে ইনশাআল্লাহ,

চলো না হারিয়ে যাই পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

0

#চলো_না_হারিয়ে_যাই
লেখকঃ জয়ন্ত_কুমার_জয়
#অন্তিম_পর্ব

জোছনার আলোয় মিষ্টির বু”কের উঁচু অংশবিশেষ স্পর্শ বোঝা যাচ্ছে।বিষণ্ণ শত চেষ্টা করেও সেখান থেকে চোখ সরাতে পারলো না।বিষণ্ণ বুঝতে পারলো নিজেকে সামলা রাখা আর সম্ভব না।দাবানলে ঝাপ দিয়ে নিজেকে পুড়িয়ে ফেলার সময় হয়ে এসছে।বিষণ্ণ তার কাঁপা কাঁপা হাত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মিষ্টির দিকে,ঠিক তখনি মিষ্টি শোয়া থেকে উঠে বসলো।

বিষণ্ণ হকচকিয়ে নিজের হাত সরিয়ে নিলো।মিষ্টি কান্না করছে।কান্না করতে করতে সে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।বিষণ্ণর নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে।ছিঃ এটা কি করতে গিয়েছিলাম?

বিষণ্ণ রুম থেকে বেড় হয়ে দেখলো মিষ্টি বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে।তার শরীর ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে।বোঝাই যাচ্ছে সে কান্না করছে।

বিষণ্ণ মিষ্টির পাশে দাঁড়ালো। নিজেকে তুচ্ছ এবং নর্দমার মতো নোংরা মনে হতে লাগলো বিষণ্ণর।মিষ্টির অশ্রুসিক্ত মুখ দেখে বিষণ্ণ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বললো

” মিষ্টি,আমি বুঝতে পারিনি কতবড় ভুল করতে যাচ্ছিলাম।আমার মাথা কাজ করছিলো না,প্লিজ আমায় মাফ করে দাও ”

মিষ্টি চোখের জল মুছে বললো ” বিষণ্ণ একটা সত্যি কথা বলবি? ”

” আমি তোমার কখনো মিথ্যা বলি না ”

” তুই কি আমায় রাস্তার মেয়ে ভাবিস, যাকে ইচ্ছে করলেই ছোঁয়া যায়?তুই তো জানিস কতবড় মানসিক অবস্থা দিয়ে যাচ্ছি,জেনেও এত নীচু ভাবনা তোর মনে এলো? ”

মিষ্টির মুখে এরুপ একটা কথা শুনে বিষণ্নর মনে হতে লাগলো কেউ যেন ওর বু’কে ছু”রি বিঁধে দিয়েছে।মিষ্টি কি আজীবন তাকে এভাবেই ভুল বুঝে যাবে?কখনোই কি বুঝতে চেষ্টা করবে না? কথা সহ্য করতে না পেরে বিষণ্ণর চোখে জল চলে এলো।

বিষণ্ণকে চলে যেতে বাঁধা দিলো না মিষ্টি।ভোরের আলো দৃশ্যমান হবার পর মিষ্টি ঘরে গেলো।দেখলো ঘরে বিষণ্ণ নেই।মিষ্টি ঘুরে ঘুরে বিষণ্ণকে পুরো বাড়িতে খুঁজলো।কোথাও না পেয়ে মিষ্টি বুরো দাদুর ঘরে টোকা দিলো।সঙ্গে সঙ্গে তিনি দরজা খুলে বেড়িয়ে এলেন।মিষ্টি চিন্তিত গলায় বললো

” দাদু ঘরে বিষণ্ণ আছে? ”

তিনি চোখ মুখ কুঁচকে বললো ” ও তো বাড়িতে চলে গেলো।তোমায় জানায়নি? ”

” কিহ? বাড়িতে গেছে! কখন? ”

” অনেক্ক্ষণ হলো।তোমায় বলে যায়নি? ”

মিষ্টি হতভম্ব এবং বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

_________

বিষণ্ণকে বাড়িতে দেখে বিষণ্ণর বাবা বললো ” তুমি বাড়িতে আসবে আমায় জানিয়েছো? এখানকার অবস্থা জানো তুমি? গাঁধার মতো একটা কাজ করলে যে ”

বিষণ্ণ চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।বিষন্নর মা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বিষন্নর বাবাকে বললো ” বাড়ির ছেলে বাড়িতে আসবে না? কি এমন হবে আসলে? ”

বিষণ্ণর বাবা রেগেমেগে বললেন ” তোমার ছেলে তো এখানে পূজা করে গেছে,তাই না ”

” ছেলেটার মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে।এখন রাগারাগি থামাও তো ”

এটা বলে বিষণ্ণকে নিয়ে বিষণ্ণর মা ঘরে গেলেন।ঘরে গিয়ে বললেন

” কি হইছে বিষণ্ণ? তুই তো জানিস এখানের ঝামেলা এখনো চলছে,তবুও চলে আসলি কেন? ”

বিষণ্ণর চোখে জল দেখে তিনি হকচকিয়ে বললেন ” তুই কান্না করছিস কেন? কি হইছে? মিষ্টির সাথে কোনো ঝামেলা হইছে কি? ”

বিষণ্ণ ছোট বাচ্চার মতো ভ্যা ভ্যা করে কান্না করতে করতে বললো ” মিষ্টি সবসময় আমায় ভুল বুঝে মা ”

ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো ” কি ভুল বুঝলো? ”

বিষণ্ণর কান্না থামছে না।রেগে গিয়ে তিনি বললেন

” ছোট বাচ্চার মতো প্যান প্যান না করে কি হইছে বল ”

মায়ের ধমক শুনে বিষণ্ন চুপ হয়ে গেলো।মিনমিন করে বললো ” কি হইছে বলতে পারবো না,লজ্জাজনক ঘটনা ”

” জরিয়ে ধরছিস? না চু’মু? ”

বিষণ্ণ প্যাঁচার মতো মুখ করে বললো ” ধরে নাও সেরকমই কিছু।আচ্ছা মা মিষ্টি এতো গাঁধি কেন?এই বুদ্ধি দিয়ে কিভাবে পরিক্ষায় টপ করে?এত্তো ভালোবাসি সেটা কি ও বুঝে না? ”

” এই ব্যাপার।তা মেয়েটাকে রেখে চলে এলি, ও তো একা ভয় পেয়ে যাবে ”

” রাগ লাগছিলো খুব।বলছে আমার নাকি নীচু ভাবনা।তুমি বাবাকে বলে ওকে আনার ব্যবস্থা করো ”

” সরাসরি এই বাড়িতে নিয়ে আসবো নাকি? ”

” না। ওর একটা শিক্ষা হওয়া দরকার।আমার মতো ওকে কেউ ভালোবাসবে না সেটা ওকে বুঝাতে হবে ”

ছেলের পাকনামি কথা এড়িয়ে বিষণ্ণর মা ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো।বিষণ্ণ চেঁচিয়ে বললো ” আমার কথা কেউ শুনতে চায় না কেন?যথেষ্ট বড় হইছি তবুও আমার সিরিয়াস কথা কেউ পাত্তা দিবে না এটা কেমন কথা!”

মিষ্টি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে।মিষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিষণ্ণর মা।মিষ্টি বললো ” আন্টি বিষণ্ণর সাথে একটু কথা বলায় দাও “।বিষণ্ণর মা বিষণ্ণর ঘরের সামনে মিষ্টিকে রেখে নিচে নেমে এলো।মিষ্টি বিষণ্ণর রুমের দরজায় টোকা দিলো।বিষণ্ণ দরজা খুলে মিষ্টিকে দেখে শক খাওয়ার মতো অবস্থা হলো।অজানা একটা আনন্দে চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।

কিন্তু না,এখন তো খুশি হলে চলবে না।রাগ দেখাতে হবে,প্রচন্ড রাগ।বিষণ্ণ প্রায় দরজা বন্ধ করবে তার আগেই মিষ্টি দরজা ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢুকলো।বিষণ্ণ যতটা সম্ভব মুখ গম্ভীর করে বললো

” এখানে কি চাই ”

” তোকে ”

মিষ্টির এমন উত্তরে বিষণ্ণ মুখ ভোতা করে দাঁড়িয়ে রইলো।রাগ দেখাতে এখন কি করা উচিত? ঘরের কোনো বস্তু মেঝেতে আছাড় মা”রলে কি রাগ প্রকাশ পাবে? যেমন ভাবনা তেমনি কাজ।

মিষ্টি ভ্রু কুঁচকে বললো ” এইটা কি হলো? ”

” কি হইছে? ”

” কোলবালিশ মেঝেতে আছাড় দিচ্ছিস কেন?রাগ দেখাচ্ছিস নাকি? ”

বিষণ্ণ হকচকিয়ে গেল।এ কেমন মেয়ে! রাগ দেখাচ্ছি বুঝতে যখন পেরেছে তখন সেটা এভাবে কেউ বলে নাকি? এই মেয়ে দেখি রাগকে সম্মান করতে জানেনা।বিষণ্ণ চোখ মুখ কুঁচকে বললো

” নীচু মনমানসিকতার ছেলেরা এমনেই বালিশ ছোটাছুরি করে ”

” না বলে চলে এসছিস কেন? ”

” তোমায় বলে আসতে হবে নাকি?নীচু মনমানসিকতার ছেলে চলে আসলো না থাকতো সেটায় কার কি আসে যায় ”

বিষণ্ণর এমন বাচ্চা স্বভাব দেখে মিষ্টির হাসি পেলো।এইজন্যই তো ওকে এতোটা ভালোলাগে।মিষ্টি বিষণ্ণর খুব কাছে এসে দাঁড়ালো।বললো

” ভালোবাসিস? ”

বিষণ্ণর সব রাগ-অভিমান ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেলো।মিষ্টির মুখে ভালোবাসা শব্দটা শুনে বিষণ্ন ফ্রিজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।মিষ্টি বললো

” তুই অনেক ভালো একটা ছেলে রে বিষণ্ণ।তোর এসব বাচ্চাসূলভ আচরণ সবসময় আমার ভালোলাগতো।আমি জানি তুই আমায় ভালোবাসিস ”

” আমি কাউকে ভালোবাসিনা ”

” আমি তোকে কত্তটা ভালোবাসি সেটা তুই কখনোই জানবি না রে ছোট গাঁধা।ভেবেছিলাম সেরাতে তোকে ভালোবাসার কথাটা বলবো।কিন্তু তার আগেই জীবনের কালো অধ্যায় নেমে এলো।সত্যি বলতে আমি ইচ্ছে করেই তখন তোকে বাজে সব কথা বলেছি।যেন কষ্ট পেয়ে তুই আমায় ভুলে যাস।আমার মতো বাজে একটা মেয়ে তোর যোগ্য না রে ”

” আমার ভালোবাসায় বিশ্বাস রাখো? ”

” হু রাখি তো।সামান্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসায় যে ছেলে স্যারের বাড়ির জানালার ক্লাস ভেঙ্গে আসে,কলেজ থেকে রেস্ট্রিক্টেড হয়,প্রেমিকার গায়ে হাত রেখেছে বলে সাইকোর মতো বাড়িতে ঢুকে খু”ন করে আসতে পারে,তার ভালোবাসায় বিশ্বাস না রেখে থাকতে পারি? ”

বিষণ্ণ মিষ্টির কাছে এসে ওর হাত দুটো বু’কে শক্ত করে ধরে বললো ” মিষ্টি বিশ্বাস করো,তুমি আমার কাছে আগে যেমন পবিত্র ছিলে,এখনও ঠিক সেরকমই পবিত্র আছো ”

মিষ্টির চোখে জল চলে এলো।অশ্রুসিক্ত চাহনিতে বললো ” সবটা বুঝি রে,তবুও নিজের কাছে নিজেকে নর্দমার মতো মনে হয় ”

বিষণ্ণ মিষ্টিকে থামিয়ে দিলো।মিষ্টি কিছু বলতে যাবে তার আগেই মিষ্টিকে বু’কে জড়িয়ে নিয়ে বিষণ্ণ বললো

” চলো না হারিয়ে যাই ”

_____________

কে’টে গেলো চারটা বছর।বিষন্ন এখন বাবার ব্যবসা সামলায়।চারটা বছরে বিষণ্ণ খুব সময়ের জন্য হেসেছে।সেই হাসিটাও মিথ্যা হাসি।সবসময় কেমন যেন একটা ব্লেকের মধ্যে থাকে।মাথায় সবসময় একটা কথাই ঘুরপাক খায়,চলো না হারিয়ে যাই।

মিষ্টির সাথে বলা শেষ কথাটা ছিলো চলো না হারিয়ে যাই।আশ্চর্যের ব্যাপার মিষ্টি কথারা রেখেছে।সে হারিয়ে গেছে,শুধু সাথে নেয়নি বিষণ্ণকে।রেখে গেছিলো একটা চিঠি।বিষণ্ণ রোজ ঘুমানোর আগে চিঠিটা বু’ক পকেট থেকে বেড় করে।চিঠির লেখাগুলিতে হাত বুলায়…..

বিষন্ন,তোর বয়স অল্প।এই বয়সে আবেগ বেশি থাকায় ঠিক ভুল বুঝার ক্ষমতা থাকে না।প্রথম প্রথম তোর কাছে আমাকে পবিত্র লাগলেও সময়ের সাথে সাথে তুই আমার প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে ফেলবি।এটাই নিয়ম।যতই ম্যাচিউর হবি তোর মধ্যে আমার জন্য একটা ঘৃণা তৈরী হবে।শুধু তোর না,আমি নিজেও তোর সামনে নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবে উপস্থাপন করতে পারবো না।আমি জানি তুই সমাজ কি বললো এসবে পরোয়া করিস না।কিন্তু দিনশেষে আমরা তো সেই সমাজেই থাকি।আমার জন্য তোর গোটা পরিবারকে লোকের কথা শুনতে হবে।আমাদের বিয়েতে লোকজন এসে বলাবলি করবে,”এই মেয়ে তো কলঙ্কিনি।বিয়ের আগে ধর্ষিত হয়েছে “।এসব কথা তুই,আমি কেউ ই আটকাতে পারবো না।যতদিন বেঁচে থাকবো এসব কথা শুনতেই হবে।ভবিষ্যতে আমাদের সন্তানের উপরেও এর প্রভাব পড়বে।ওরা একটা ব্যক্তিত্ববান মা হারাবে।এতোসব নেগেটিভিটি শুধু শুধু তুই কেন নিবি?আমি অন্তত তোর কাছে আজীবন পবিত্র থাকতে চাই রে ছোট গাঁধা।প্লিজ আমায় ভুল বুঝিস না।আর হ্যা,এই চিঠিটা পাওয়ার সময় হয়তো আমি অনেক দুরে থাকবো,ভেবে নিস তোর আশেপাশেই আছি।আমার খুব কান্না পাচ্ছে রে ছোট গাঁধা।চলে যাওয়ার সময়টাতে তোকে দেখার ভাগ্যটাও হলো না।তুই সেরাতে কেন আমায় একটু জড়িয়ে করলি না,কেন হাতে হাত রাখলি না? কেন আমায় বু’কে জড়িয়ে নিলি না?ভালোবাসার মানুষের প্রতিটা এতটুকু জোরটাও খাটাতে পারলি না?এতো বোকা কেন তুই?।তোকে আর কখনোই ছোট গাঁধা বলে ডাকতে পারবো না ভেবে ভিষণ কষ্ট হচ্ছে।তোর ভালোবাসার স্পর্শ আমার আর পাওয়া হলো না রে।ভালো থাকিস আমার সুপার হিরো।আর হ্যা,সুন্দর একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিস কেমন?

প্রত্যেকবার চিঠিটা পড়ার সময় বিষণ্ণর চোখ বেয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,তুমি চাইলেই আমরা দুজন হারিয়ে যেতে পারতাম।তুমি সেটা করোনি।একাই হারিয়ে গেলে।তাতে কি,তোমার স্মৃতি তো হারাতে দিই নি!

———–সমাপ্ত—————

চলো না হারিয়ে যাই পর্ব-১০

0

চলো_না_হারিয়ে_যাই [১০]
লেখকঃ জয়ন্ত_কুমার_জয়

বিষণ্ণ বিড়বিড় করে বললো ” মিষ্টি আপু,কোলবালিশ ছাড়া আমার ঘুম আসে না।আজ রাতের জন্য তুমি আমার কোলবালিশ হবে? ”

কথাটা শুনতেই মিষ্টির মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো।বিষণ্ণ এসব কি বলছে? মিষ্টি হকচকিয়ে উঠে বসলো।যতটা সম্ভব কর্কষ গ’লায় বললো

” কোলবালিশ হবো মানে? কি বলছিস এসব? ”

বিষণ্ণ আমতা আমতা করে বললো ” না মানে কোলবালিশ ছাড়া ভালোলাগে না তো,আচ্ছা লাগবে না তুমি ঘুমাও ”

” খবরদার যদি গায়ে হাত রাখছিস তো খবর আছে বলে দিলাম ”

বিষণ্ণ শুকনো মুখ করে ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়লো।মিষ্টি লক্ষ্য করলো ঘন্টাখানেক পার হয়ে যাওয়ার পরেও বিষণ্ণর ঘুম আসছে না।শুধু ইদুরের মতো নড়াচড়া করছে।মিষ্টির একটু করুণা হতে লাগলো বিষণ্নর জন্য।ছেলেটার বোধহয় সত্যিই কোলবালিশ ছাড়া ঘুম আসে না।মিষ্টি হালকা স্বরে ডাকলো

” বিষন্ন,ছটফট করছিস শুধু, ঘুম আসছে না বুঝি? ”

” না আসলে কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেছে তো, তাই হয়তো ঘুম আসছে না ”

মিষ্টি লজ্জায় ইতস্তত করে বললো ” আচ্ছা ঠিক আছে।তখন যেটা হতে বললি সেটায় আমি রাজি ”

মিষ্টি কিসে রাজি হওয়ার কথা বলছে বিষণ্ন বুঝতে না পেরে বললো ” কিসে রাজি? বুঝলাম না ”

মিষ্টি প্যাচার মতো মুখ করে বললো ” কিছু না। যা ভাগ,ছোট্ট গাধার বাচ্চা ”

মিষ্টির খুব রাগ লাগছে।লজ্জা কাটিয়ে মুখ ফুটে বলার পরেও বিষণ্ণ বুঝলো না! এতো সর্ট টাইম মেমোটি কেন ওর।গাধা ছেলে একটা।বেশ কিছুক্ষণ যাওয়ার পরেও বিষণ্ণর কোনো জবাব না পেয়ে মিষ্টি আবারো বললো

” তুই কি এখনও বাচ্চা নাকি? এতো বড় হয়েও তোর কোলবালিশ লাগে? ”

” ছোট বেলার অভ্যাস,ছাড়তে পারিনা তো ”

বিষণ্ণ বুঝতে পারলো মিষ্টি তার কোলবালিশ হওয়ার শর্তে রাজি,তবুও সে বুঝেও না বোঝার ভান করছে।বিষণ্ন চায় মিষ্টি নিজের মুখেই তাকে জ”রিয়ে ধরার কথা বলুক।কিন্তু এবারেও মিষ্টি কিছু বললো না।বিষণ্ণর ভারী মন খারাপ হতে লাগলো।সাথে ভয় ও হতে লাগলো এই ভেবে যে বেশি পাকনামি করতে গিয়ে মিষ্টিকে জরিয়ে ধরে ঘুমানোর ইচ্ছেটা বুঝি আর সত্যি হলো না।

বিষণ্ণর ভাবনা ঠিক।মিষ্টি নিজ থেকে কিছুই বললো না।বিষণ্ণর ভিষণ আফসোস হতে লাগলো,কেন তখন মিষ্টির কথায় সায় দিলাম না? ইশারা বুঝেও মা বোঝার ভান করলাম কেন?

বিষণ্ণ একপলক মুখ উঁচিয়ে মিষ্টিকে দেখার চেষ্টা করলো।গোল গোল চোখ,ফোলা গা”ল,পাতলা ঠোঁ”ট দেখে বিষণ্ণর শরীরে একটা শিহরন জেগে উঠলো।মনে হতে লাগলো এই একজোড়া পাতলা ঠোঁ”টের স্পর্শ না পেলে জীবন বৃথা,পুরো মহাজগৎ বৃথা।

বিষণ্ণ মনে মনে আইন্সটাইনকে তীব্র গালাগাল দিলো।টাইম ট্রাভেল থিউরিটার বাস্তব রুপ করে দিয়ে গেলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো?তাহলে অন্তত মিষ্টির ইশারাকে কাজে লাগানো যেতো।

কিন্তু মিষ্টিকে কে বোঝাবে?ওর স্পর্শ আমি খুব করে চাইছি।যে চাওয়ার মাধ্যমে মানবসভ্যতা টিকে আছে সেরকম চাওয়া না,যে চাওয়ায় আপন ধ্বংস হয়ে যায়,নিজের বলতে আর কিছুই থাকে না,তোমার কাছে সেই চাওয়াটাই আমার প্রাপ্য।তোমার স্পর্শে যে আমি জ্বলে পুড়ে ভস্ম হতে চাচ্ছি সেটা কি তুমি বুঝতে পারো?দেবে কি সেই আগুনটুকু?লজ্জা ভুলে আর একটিবার কি বলবে ” আচ্ছা ঠিক আছে।তখন যেটা হতে বললি সেটায় আমি রাজি? “।

মিষ্টি ঠো’ট টিপে নিঃশব্দে হাসছে।বিষণ্ণর অবস্থাটা বুঝতে পেরে মিষ্টি বললো

” কোলবালিশ বু’কে জড়িয়ে ধরে ঘুমাস নাকি শুধু বালিশে হাত পা রাখিস,কোনটা? ”

বিষণ্ণর বু’ক ধক করে উঠলো।মিষ্টি কি সত্যিই এটা বললো? শেষমেশ একটা সুযোগ কি সত্যিই পাওয়া গেলো? বিষণ্ণ চোখ বড়বড় করে বললো

” তোমার অসুবিধা না হলে শুধু হাতটা রাখবো ”

” আচ্ছা ”

বিষণ্ণ তার ঠকঠক করে কাঁপতে থাকা হাত মিষ্টির হাতের ওপর রাখলো।র”ক্তপ্রবাহ বাড়তে লাগলো।শরীরের প্রতিটা কোষ যেন জেগে উঠলো।মিষ্টি বললো

” শুধু হাত রাখবি, মনে থাকবে তো? ”

বিষণ্ণর শরীর এতোই অবস হয়ে আসলো যে কিছুই বলতে পারলো না।বিষন্নর চুপ থাকা দেখে মিষ্টি মুখ ভোতা করে বললো ” আর হ্যা,যদি দেখছি উল্টাপাল্টা যায়গায় হাত রাখছিস তাইলে কিন্তু খু”ন করে ফেলবো,মাথায় থাকে যেন কথাটা ”

কথাটা বলে মিষ্টি চিৎ হয়ে শুতেই বিষণ্ণর হাত স্লাইড করে মিষ্টির পে’টে স্পর্শ করলো।পে”টে হাত পড়তেই বিষণ্ণর শরীরে কারেন্ট বয়ে যেতে লাগলো।মুহুর্তেই চারপাশটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য অন্ধকার হয়ে গেলো।আশ্চর্যের বিষয় হলো মিষ্টি কিছু বলছেও না,চোখ বন্ধ করে আছে।

বিষণ্ণর মাথার চুল দাঁড়িয়ে গেছে।নিজেকে সামলে রাখা যে বড্ড কঠিন হয়ে পড়ছে।জানালা দিয়ে জোছনার আলো এসে পড়ছে মিষ্টি বু’ক এবং পে”টের খানিকটা যায়গায়।ওড়না সরে যাওয়ায় জোছনার আলোয় মিষ্টির বু”কের উঁচু অংশবিশেষ স্পর্শ বোঝা যাচ্ছে।বিষণ্ণ শত চেষ্টা করেও সেখান থেকে চোখ সরাতে পারলো না।বিষণ্ণ বুঝতে পারলো নিজেকে সামলা রাখা আর সম্ভব না।দাবানলে ঝাপ দিয়ে নিজেকে পুড়িয়ে ফেলার সময় হয়ে এসছে।বিষণ্ণর কাঁপতে কাঁপতে তার হাত রাখলো মিষ্টির……..

চলবে?

চলো না হারিয়ে যাই পর্ব-০৯

0

চলো_না_হারিয়ে_যাই [৯]
লেখকঃ জয়ন্ত_কুমার_জয়

বিষণ্ণ দু’হাত গা”লে রেখে দাঁড়িয়ে আছে।তার সামনেই বিস্মিত এবং হতভম্ব অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে বিষণ্ণর বাবা।বিষণ্ণ গা”ল চেপে ধরেই মিনমিন স্বরে বললো

” বাবা তোমায় তো বললাম ওই ছেলেটা একটা মেয়েবাজ,ও…. ”

বিষণ্ণর পুরে কথা শেষ না হতেই বিষণ্ণর বাবা কর্কষ গলায় বললো ” চুপ,দুইটা চ”র খেয়েও শিক্ষা হয়নি? এখনো কথা বলছো কি করে! বিষয়টা জানাজানি হলে তোমার জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে,বুঝতে পারছো সেটা? ”

বিষণ্ণ মুখ ভোঁতা করে বললো ” ও মিষ্টির দিকে হাত বাড়িয়েছে,এর থেকেও ভয়ঙ্কর কিছু করার ইচ্ছে ছিলো ”

বিষণ্নর বাবা চোখ বড়বড় করে বললো ” আমার ছেলে এই বয়সে এতোটা ভয়ঙ্কর হয়ে গেছে আমি তো ভাবতেই পারছি না ”

বিষণ্নর বাবার পাশেই ম্যানেজার দাঁড়িয়ে, তিনি গর্ব করে বললেন ” ঠিক সময়ে তোমায় গাড়িতে না তুললে এতোক্ষণে উকিল খুঁজতে হতো ”

কথা শেষ হতেই ম্যানেজারের দিলে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো বিষণ্ণর বাবা।রাগী দৃষ্টি দেখে ম্যানেজার চুপসে গেলেন।বিষণ্ণর বাবা গর্জনের স্বরে বললো

” বিষণ্ণ ওই ছেলের বাড়িতে গেলো,সাইকোর মতো ওকে মা”রলো আর আপনি জানেন ই না? কোথায় ছিলেন তখন? ”

ম্যানেজার আমতা আমতা করে বললো ” মাফ করবেন স্যার,আসলে খিদে পেয়েছিলো খুব।খাওয়ার সময়টুকুতেই এতোকিছু হয়ে গেলো! ”

বিষণ্নর বাবা দাঁত কিটিমিটি করলো,পারলে ম্যানেজারের গ”লা চেপে ধরলে ভালো লাগতো।বিষণ্ন মুখ ভোঁতা করে বললো

” বাবা তুমি এতো হাইপার হচ্ছো কেন,আমি তো অন্যায় কিছু করিনি ”

বিষণ্ণর কথায় সায় দিয়ে ম্যানেজার বিষণ্নর বাবাকে বললো ” স্যার যাই বলেন,বিষণ্নর মধ্যে আপনি আপনি একটা ব্যাপার আছে,বাড়িতে গিয়ে একটা ছেলেকে কু”পিয়ে চলে আসলো, ভাবা যায়! ”

এমন সময় বিষণ্ণর বাবার ফোনটা বেজে উঠলো।ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বিষণ্ণর মা বললো

” বিষণ্ণকে ফোন দাও ”

বিষণ্ণর বাবা মুখ ভোতা করে ফোনটা এগিয়ে দিলো।বিষণ্ণ বললো

” হ্যালো মা ”

” হু,ছেলেটা কি করেছে? বাড়িতে গিয়ে এসব করলি,কত বিপদ হতে পারতো? ”

” সরি মা,ও মিষ্টির সাথে যা করছে সেটা জানার পর মাথা ঠিক রাখতে পারিনি ”

” মিষ্টির সাথে কি করছে? ”

” ফোনে বলতে পারবো না,বাড়ি গিয়ে বলছি ”

বিষণ্ণর বাবা সাইড থেকে বললো ” হুহ,উনি বাড়ি যাওয়ার কথা বলতেছে,যা করছো আগামী কত বছর এই পাহাড়ে থাকতে হবে সেটাই দেখো ”

বাবার কথা শুনে বিষণ্ন হকচকিয়ে গেলো।মায়ের কল কে’টে দ্রুত জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।চারদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়ের চূড়া! বিষণ্ণ আঁতকে উঠে বাবার কাছে গিয়ে বললো

” বাবা এটা কোথায় এসছি?আমরা পাহাড়ে কেন? ”

” যা করছো তারপর শহরে থাকার কথা ভাবছো কিভাবে ”

” মানে কি? আমি পাহাড়ে লুকিয়ে থাকবো? অসম্ভব, আর তাছাড়া তুমি চাইলেই তো সব সামলে দিতে পারো ”

” সব সামলে দিতে পারি জন্যই এতো বড় কাজ করতে তোমার হাত কাঁপেনি।তোমার একটা শিক্ষা হওয়া দরকার ”

” কিহ! তুমি শিক্ষা দেওয়ার জন্য আমায় এখানে আঁটকে রাখবা? ”

বিষণ্ণর বাবা হ্যাসূচক মাথা নেড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো।বিষণ্ণ মুখ ভোতা করে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইলো।

ঘর থেকে বেড়োতেই ম্যানেজার বললো ” স্যার ওসি মেইল করছে ”

” কি বললো? ”

” বলছে কয়েকটা দিন একটু লুকিয়ে থাকতে ”

বিষণ্ণর বাবা চোখ সরু করে বললো ” ওসিকে ফোন করো ”

ম্যানেজার দ্রুত ফোন করলো।ফোন রিসিভ হতেই বিষণ্ণর বাবা বললো ” আমার ছেলে লুকিয়ে থাকবে কেন?আপনি আছেন কি করতে ”

” স্যার একটু বোঝার চেষ্টা করেন,ছেলের বাড়ির সামনের সিসি ফুটেজে বিষন্নকে দেখা গেছে। বিষয়টা সামলাতে একটু সময় লাগবে স্যার ”

বিষণ্ণর বাবা ফোন কা”টলো।চুল অর্ধেকটা পাক ধরা একজন বয়স্ক লোক এসে বিষণ্ণর বাবাকে বললো

” সে কি কোথায় চললে? ”

” বাসায় যাচ্ছি চাচা। বিষণ্ণ হঠাৎ এমন একটা কাজ করে বসলো,ও কিছুদিন এখানে থাকবে ”

” তুমি একদম ভাববে না,আমি ওদের দেখেশুনে রাখবো রাখবো ”

_________

মিষ্টি বারান্দায় দাঁড়াতেই বুঝতে পারলো সে পাহাড়ের মাঝে একটা বাড়িতে।পাশের ঘরে কে যেন অস্ফুটে স্বরে কথা বলছে।মিষ্টির শরীর দূর্বল,নিজেকে সামলে দরজাটায় হাত দিতেই দরজা খুলে গেলো।ঘরে একটা ছেলে মেঝেতে উবু হয়ে বসে আছে।

মিষ্টি ভয়েভয়ে বললো ” কে আপনি? ”

বিষণ্ণ চমকে দরজার দিকে তাকালো।বিষণ্ণকে দেখে মিষ্টি ধাক্কার মতো খেলো।বিস্মিত হয়ে বললো

” বিষণ্ণ তুই! ”

বিষন্ন মিষ্টিকে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে মিষ্টির পাশে বসে বললো ” তুমি উঠে এলে কেন,তোমার রেস্ট দরকার ”

মিষ্টির বিষ্ময় যেন কাটছেই না।মিষ্টি বললো

” চারপাশে পাহাড়ের চূড়া দেখছি,আমরা কি পাহাড়ে? ”

” হ্যা।অনেক অবাক হইছো তাই না? আমিও প্রথমে বুঝতে পারিনি,মাত্র জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম ”

” এটা কার বাড়ি?আমি এখানে কেন? ”

” এটা বাবার বাগান বাড়ি। বাবা চা বাগান দেখতে আসলে এখানে থাকেন ”

” আমি এখানে কিভাবে?কিছুই তো বুঝতে পারছি না ”

” তোমায় হসপিটাল থেকে বাবা কি”ডন্যাফ করে নিয়ে এসছে ”

” কিহ? ”

” এখনি এতোকিছু জানতে হবে না।সময় হলে ঠিকি সব জানবে ”

কথাবার্তার এই পর্যায়ে একজন বয়স্ক লোক এসে বললো ” আপামনির ঘুম ভাঙ্গছে! ”

মিষ্টি বেকার মতো বিষণ্ণর দিকে তাকিয়ে রইলো।বিষণ্ণ বললো ” দাদু খাওয়ার কিছু আছে?খুব খিদে পেয়েছে ”

” আছে আছে,তোমরা আসবে শুনে পাহাড়ি মুরগী কিনে আনছি, খেলে আজীবন ভুলতে পারবা না ” বলেই তিনি বাইরে চলে গেলেন।

বিষণ্ণ মিষ্টির চোখে চোখ রেখে বললো ” মিষ্টি একটা কথা বলবে? ”

মিষ্টি ভ্রু কুঁচকে বললো ” আমি তোর সিনিয়র, নাম দরে ডাকছিস কেন? ”

বিষণ্ণ মুখ ভোতা করে বললো ” সরি ”

” হু,কি বলতে চাইলি?”

বিষন্ন সু”ইসাইড করার বিষয়ে বলতে গিয়েও আর বললো না।মিষ্টি এখন মানসিক ভাবে দূর্বল।এসব বললে মানসিক ভাবে আরো ভেঙ্গে পড়বে।

সন্ধায় বারান্দায় মোড়া পেতে বিষণ্ণ মিষ্টি দু’জনই বসে আছে।আকাশে অর্ধেক চাঁদ। চারদিকটা ঘন গাছগাছালিতে ভরা।আকাশে বিশাল পাহাড়ের চূড়াগুলি দেখতে দানবের মতো দেখাচ্ছে।মোটামুটি কুয়াশা পড়েছে।পাহাড়ে ঠান্ডার রেশ দ্রুতই পাওয়া যায়।

দু’জনার গায়েই পাতলা চাদর,হাতে চায়ের কাপ।বিষণ্ণ চায়ে চু’মুক দিতে দিতে বললো

” হাত কা”টার সময় ব্যথা পাও নি? ”

” একটু চিনচিন ব্যথা হচ্ছিলো ”

” তোমার তো সাংঘাতিক সাহস,আমি ম”রে গেলেও তো হাতে চা”কু বসিয়ে দিতে পারবো না,বাপ্রে, এটা আমার দারা অসম্ভব ”

বিষণ্ন এমন ভাবে কথাটা বললো যে মিষ্টির হাসি পেয়ে গেলো।হেসে বললো

” আমার ঘর তো তালা দেয়া ছিলো,ঢুকলি কিভাবে? ”

” দরজা ভেঙ্গে ”

” ওই ভারী দরজা কে ভাঙ্গলো? ”

” কে আবার আমি ভাঙছি ”

” এহহ,তুই আর দরজা! হইছে থাক বিশ্বাস হইছে ”

বিষণ্ণ মুখ ভোতা করে বললো ” তুমি বিশ্বাস করলে না? আন্টিও ছিলো ওখানে ”

” এখন ঠিক করে বল তো এখানে কেন আমরা? ”

বিষণ্ণ এক এক করে সব কথা বললো।কিভাবে দেয়াল বেয়ে জায়ানের ঘরে ঢুকেছে,কিভাবে গ”লায় ছু”ড়ি বসিয়েছে সবটা বললো।মিষ্টি হতভম্ব হয়ে সবটা শুনছে।বিষণ্ণ সবটা বলা শেষ করতেই মিষ্টি চোখ ছানাবড়া করে বললো

” যা যা বললি সেসব কি সত্যি? তুই জায়ানকে খু”ন করছিস? ”

” হু ”

মিষ্টি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো তারপর নীচু স্বরে জিগ্যেস করলো

” তুই জায়ানের কে”টে দিছিস! এটাও সত্যি? ”

বিষণ্ণ ভ্রু কুঁচকে বললো ” কে’টে দিছি মানে? ”

মিষ্টি ইতস্তত করে বললো ” উমম, নাহ কিছু না ”

” জায়ানের কে”টে দিছি মানে? বুঝলাম না, কি বললে আবার বলো ”

মিষ্টি মুখ ভোতা করে বললো ” আরে ছোট গাধা একটু আগেই তো বললি জায়ানের নাকি ওইটা কে’টে দিছিস,সেটাই বললাম,সত্যিই কে”টে দিছিস কিনা ”

বিষণ্ণ লজ্জায় মুখ অন্যদিকে করে বললো ” ইয়ে মানে,রাগ সামলাতে পারিনি “।মিষ্টি একই সাথে প্রচন্ড বিস্ময় এবং হাসি পাচ্ছে।

রাতে শুতে গিয়ে মিষ্টি দ্বিতীয় দফায় হকচকিয়ে গেলো।দেখলো বিষণ্ণ ঘা’ড়ে একটা কোলবালিশ তার হাতে একটা বালিশ নিয়ে দরজার কাছে গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মিষ্টি বললো

” কিরে বিষণ্ণ,বালিশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ”

বিষন্ন বালিশ দুইটা মেঝেতে রেখে বললো ” মিষ্টি তোমার পাশে আমায় শু”তে দিবে? ”

মিষ্টি রাগী দৃষ্টিতে তাকালো বিষণ্ণর দিকে।বিষণ্ণ আমতা আমতা করে বললো ” সরি,মিষ্টি আপু আমি তোমার পাশে ঘুমাবো ”

মিষ্টি শক খাওয়ার মতো চমকে বললো ” মা..মানে কি,কি বলছিস তুই মাথা ঠিক আছে তোর? ”

” না ঠিক নেই।প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে।ওই বুড়োর নাক ডাকার শব্দে ঘুম আসছে না আমার।তোমার পাশে শুতে দাও না প্লিজ ”

” অসম্ভব,যা বাইরে গিয়ে ঘুমা ”

” বাইরে তো কুয়াশা, ঠান্ডা খুব ”

” তাহলে মেঝেতে শুয়ে পড় ”

” মেঝেতে শুইছিলাম,ইদুর ঘুরঘুর করে ”

মিষ্টি নিজের মাথার চুল টেনে বললো ” তোর সাথে আমি বেড শেয়ার করে থাকবো কেমনে ”

” তুমি তোমার মতো আমি আমার মতো ঘুমাবো।প্লিজ শুতে দাও না,আমার ঘুম পাচ্ছে খুব ”

মিষ্টি ইতস্ত করে বললো ” ঘুমের মাঝে আমার জামাকাপড় ঠিক থাকে না ”

মিষ্টি ভেবেছিলো এটা বললে বিষণ্ণ তার সাথে থাকার বায়না ভুলে যাবে।কিন্তু সেটা হলো না বিষণ্ণ বললো

” ঘুমালে আমি কিচ্ছু টের পাইনা।তোমার কাপর সরলেও যা না সরলেও তা ”

মিষ্টি মুখ ভোতা করে বললো ” আচ্ছা ঠিক আছে ”

বিষণ্ণর চেখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।সঙ্গে সঙ্গে সে বিছানায় বালিশ রেখে শুয়ে পড়লো।মিষ্টি বেশ কিছুক্ষণ বিষণ্ণর দিকে তাকিয়ে বললো

” এই বিষণ্ণ ”

বিষণ্ণ ঘুমের ঘোরে বললো ” হু ”

” কোলবালিশদটা মাঝে রাখ ”

” ওটা রাখলে শোয়ার যায়গা থাকবে না ”

অগত্যা মিষ্টি শুয়ে পড়লো।বিষণ্ণ বিড়বিড় করে বললো ” মিষ্টি আপু,কোলবালিশ ছাড়া আমার ঘুম আসে না।তোমায় কোলবালিশ বানাই? ”

চলবে?

চলো না হারিয়ে যাই পর্ব-০৮

0

চলো_না_হারিয়ে_যাই [৮]
লেখকঃ জয়ন্ত_কুমার_জয়

ঘরের মেঝেতে র”ক্তের স্রোত।মিষ্টির নিথর দে’হ মেঝেতে পড়ে আছে।

হসপিটালে মিষ্টিকে যখন নেওয়া হয় তখন মিষ্টি একদম নুয়ে গেছে।দ্রুত তিনজন নার্স মিষ্টিকে কোথায় যেন নিয়ে গেলো।মিষ্টির মা অঝোরে কান্না করছে,মিষ্টির বাবা নির্বাক।

কিছুক্ষণ বাদে ডাক্তার এসে বললো ” র’ক্ত যে হারে বেড়িয়েছে,আর একটু দেরি হলে হয়তো প্রেগ”ন্যান্সিটা ড্রপ যেতো।তবে আমরা এখনো সিওর বলতে পারছি না।বেবি জন্ম নিলে প্রতিবন্ধী হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল ”

কথাটা শুনে মিষ্টির বাবা,মা’য়ের পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেলো।প্রেগ”ন্যান্সি মিস যাবে মানে কি? ডাক্তার কি মিষ্টির বদলে অন্য কোনো মেয়ের কথা ভুলে এখানে এসে বলছে? মিষ্টির বাবা চোখ থেকে চশমা সরিয়ে বিষ্মিত হয়ে বললো

” আপনার মনে হয় ভুল হচ্ছে,আমার মেয়ে প্রে”গন্যান্ট না তো! ”

ডাক্তার ভ্রু কুঁচকে বললো ” কি বলেন! আমরা তো টেস্ট করে দেখলাম, উনি প্রেগ”ন্যান্ট!রোগীকে দেখেই বুঝেছি প্রে”গন্যন্ট,শরীর ফোলা ফোলা ভাব।সে যাই হোক,রোগী এখন মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত,কিছুক্ষণ পর আমার কেবিনে একবার আসবেন ”

কথাটা বলে ডাক্তার চলে গেলো। মিষ্টির বাবা চোখ বড়বড় করে মিষ্টির মায়ের দিকে তাকালো।মিষ্টির মা থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে,কিছু বলছে না।মিষ্টির বাবা কাঁপা গলায় বললো

” এটা কি বললো ডাক্তার! মিষ্টি এরকম একটা কাজ করেছে! আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না ”

” ডাক্তার ভুল বলছে,আমাদের মেয়েকে আমরা চিনি তো,এরকম কিছু মিষ্টি কখনোই করবে না ”

মিষ্টির বাবা লক্ষ্য করলো বিষণ্ন নেই। তিনি আশেপাশে বিষণ্নকে খুঁজলেন,পেলেন না।মিষ্টির মাকে বললেন ” মিষ্টির ওই বন্ধুটা কই? ”

মিষ্টির মা চোখ মুছে বললো ” তাই তো,বিষণ্ন কই গেলো! ”

___________

ফাঁকা রাস্তায় বিষণ্ন হাঁটছে।তার শার্ট ভিজে আছে র”ক্তে।শার্টটা খুলে কো ম’রে বাঁধতে বাঁধতে বিষণ্ন হাটছে মাথা শূণ্য অবস্থায়।পকেট থেকে বেড় করলো সাদা কাগজটা।কাগজে মিষ্টির এলোমেলো হাতের লেখা।

কাগজটার দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ ঠো’ট বাকিয়ে হাসলো।এ হাসি হতাশার,দুঃখের,রাগের।কাগজটা পেয়েছিলো মিষ্টির হাতে।দরজা ভেঙ্গে বিষণ্ণ যখন মিষ্টির কাছে আসে তখন তার বাম হাতের মুঠোয় কাগজটা ছিলো।বিষণ্ণ কাগজটা নিয়ে পকেটে রেখেছিল।হাসপিটালে মিষ্টিকে যখন নার্সরা নিয়ে গেলো তখন বিষণ্ণ কাগজটা খুললো।কাগজে এলোমেলো অক্ষরে লেখা

আমি আর সইতে পারছি না বাবা।আমার পে’টে অবৈধ সন্তান বড় হচ্ছে।সেরাতে আমি যখন অজ্ঞান ছিলাম তখন জায়ান আমার দূর্বলতার সুযোগ নিয়েছে,ফল স্বরুপ আমি প্রেগন্যান্ট।জায়ান পুরে বিষটা অস্বীকার যাচ্ছে।আড়ষ্টে,ঘৃনায়,লজ্জায় কথাটা কিছুতেই তোমাদের বলতে পারিনি।নিজের কাছেই নিজেকে নর্দমার মতো মনে হতো।আর লিখতে পারছি না,হাত থেকে র”ক্ত বেরোচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে।ভালো থেকো তোমরা।

বিষণ্ন এই নিয়ে লেখাটা তিনবার পড়লো।খুব সম্ভব কাল সকালের নিউজের হেডলাইন হতে যাচ্ছে জায়ান।বিষণ্ণ লক্ষ্যই করেনি প্রাইভেট কারে বসে দু’জন লোক তার উপর নজর রাখছে।বিষণ্ণ যখন কাগজের দিকে তাকিয়ে মিষ্টির কথা ভাবছে ঠিক সেই মুহুর্তে হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন বিষণ্ণর মুখ চেপে ধরলো।বিষণ্ণ কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্যুট পড়া একজন বিষণ্ণকে গাড়িতে তুললো।

___________

মিষ্টির বাবা সকাল থেকে ডাক্তারকে রিকুয়েষ্ট করেও মিষ্টির সাথে দেখা করার সুযোগ পাচ্ছে না।একপর্যায়ে রেগে গিয়ে মিষ্টির বাবা বললো ” আমাকে আমার মেয়ের সাথে দেখা করতে দিচ্ছেন না কেন? ”

” আসলে রোগীর অবস্থা খুব ক্রিটিক্যাল,এখন কাউকে দেখা করতে দেওয়া সম্ভব না ”

কথাটা বলেই ডাক্তার চলে গেলো বোর্ড কনফারেন্স।সব ডাক্তার,নার্স সেখানে অপস্থিত।সিনিয়র ডাক্তার গম্ভীর স্বরে বললো ” এতো লোকের চোখ এড়িয়ে রোগীকে নিয়ে নিয়ে চলে গেলো! রোগীর বাবা তো অস্থির হয়ে গেছে মেয়েকে দেখার জন্য ”

উপস্থিত ডাক্তারদের মধ্যে একজন বললো ” এবার পুলিশকে খবর দেওয়া উচিত ”

” পুলিশকে খবর দিলে,আর মেয়ের বাবা যদি বেকে বসে তাহলে আমাদের লাইসেন্স কা”টা যাবে।এ তো ভারী মুশকিলে পড়া গেলো।মেয়েটিকে কিডন্যাফ করা হয়েছে।এসব জানাজানি হলে বুঝতে পারছেন কি হবে? ”

মিষ্টির যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দেখলো সে লাল টকটকে চাদর বিছানো একটা বিছানায় শুয়ে আছে।ওঠার চেষ্টা করলো,হাতে ব্যাথা থাকার কারণে উঠতে পারলো না।চারদিক দমকা হাওয়া।জানালা দিয়ে চোখ যতদূর যায় সব কুয়াশায় ঘেরা।

মিষ্টি বিড়বিড় করে বললো এটা কোন যায়গা?আমি এখানে কেন? আশপাশের পরিবেশ বেশ স্যাঁতস্যাঁতে।মিষ্টির শরীর ধীরে ধীরে হীম হয়ে এলো…..

চলবে?

চলো না হারিয়ে যাই পর্ব-০৭

0

চলো_না_হারিয়ে_যাই [৭] 💛
লেখকঃ জয়ন্ত_কুমার_জয়

গলিতে মিষ্টির সাথে কি আদৌও শারীরিক সম্পর্ক করা হয়েছিলো? এতটুকু ভাবতেই বিষণ্ণর শরীর কাঁপুনি দিয়ে একটা শিহরন বয়ে গেলো।

সে রাতের পর থেকে মিষ্টি কেমন যেন অগোছালো হয়ে গেলো।সারাক্ষণ চুপচাপ ঘর অন্ধকার করে বসে থাকে।বিষণ্ণ সবসময় মিষ্টির আশেপাশে থাকার চেষ্টা করে,কিন্তু লাভ হয় না।মিষ্টি তার পাশে কাউকেই সহ্য করতে পারছে না।

_________

ঘর নিকষ অন্ধকার করে মিষ্টি খাটের পাশে বসে আছে।সত্যিটা সবাইকে বলে দেওয়া উচিত?মিষ্টি পারছে না সহ্য করতে পারছে না বলতে।এমন সময় দরজায় খটখট শব্দ হলো।মিহি স্বর ভেসে এলো ” মিষ্টি মা,দরজা খোল।দেখ জায়ান তোর সাথে দেখা করতে এসছে ”

মিষ্টি চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ালো।ঠিকমতো হাঁটার শক্তিটাও তার নেই।হেলেদুলে দরজাটা খুললো মিষ্টি।জায়ান মিষ্টির মা’কে বললো ” আন্টি আমি ওর সাথে একটু আলাদাভাবে কথা বলবো ”

” হ্যা বাবা, দেখো তো ও কথা বলে কিনা।আমি রোজ এতো ডাকাডাকি করি,গল্প করার চেষ্টা করি,ও কিচ্ছু বলে না। শুধু কেঁদেই চলেছে ”

অতটুকু বলতে বলতেই মিষ্টির মা হু হু করে কেঁদে ফেললো।জায়ান ঘরে ঢুকলো।জায়ানকে দেখে মিষ্টির প্রচন্ড রাগ,ঘৃণা একই সঙ্গে ভয় হচ্ছে।জায়ান বেশ স্বাভাবিক স্বরে বললো

” কেমন আছো মিষ্টি? ”

মিষ্টি কান্নামিশ্রিত স্বরে রেগেমেগে চেঁচিয়ে জবাব দিলো ” আবার কেন এসছেন?ওকে মা”রতে? বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন না তাহলে কেন এমনটা করলেন? ”

জায়ান কঠিন স্বরে বললো ” মিষ্টি প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো আর কতবার বলবো?অজ্ঞান অবস্থায় তোমায় দেখে আমার মাথা ঠিক ছিলো না ”

” আপনি আর একটা কথাও বলবেন না।একটা কুকুরের সাথে আপনার কোনো পার্থক্য নেই ”

” তুমি তাহলে বাচ্চাটার এবর্শন করাবে না? সে না করলে,এটা তোমার ব্যাপার।তবে আমি তোমায় বিয়ে করবো না এটা তো ভালো করেই জানো।সমাজে নষ্টা মেয়ে হয়ে বেঁচে থাকতে পারবে তো? ”

জায়ানের কথায় মিষ্টির শরীরে যেন আগুন ধরে গেলো।জায়ানের গা”লে কষিয়ে এক চ”র বসাতেই জায়ান টেবিলের সাথে ধাক্কা খয়েে টেবিলে থাকা কাঁচের একটা গ্লাস মেঝেতে পড়ে ভেঙ্গে গেলো।জায়ানের শার্টের কলার চেপে ধরো মিষ্টি অগ্নি দৃষ্টিতে চেয়ে বললো

” তোকে আজ আমি মে”রেই ফেলবো শু”য়ারের বাচ্চা।মেয়েদের শরীর নিয়ে খেলিস! ”

এই পর্যায়ে চেঁচাচেমিতে মিষ্টির মা মিষ্টির ঘরে এসে দেখে মিষ্টি জায়ানের শার্টের কলার চেপে ধরেছে।মিষ্টির মা মিষ্টিকে আটকানোর আগেই জায়ানের নাক বরাবর প্রচন্ড একটা ঘু”ষি আছড়ে পড়লো! মিষ্টির থেকে জায়ানকে ছাড়িয়ে নিয়ে মিষ্টির মা জায়ানকে নিয়ে বাইরে চলে গেলো।মিষ্টি ঘরের মেঝেতে বসে পাগলের মতো চিৎকার করে কান্না করছে।

বসার ঘরে বিষণ্ণ বসে আছে।বিষণ্ণর ঠিক সামনের সোফায় মিষ্টির মা কেঁদে কেঁদে বলছে ” বিষন্ন বাবা,কিছু একটা উপায় বল না!হাসিখুশি মেয়েটা আমার দিনদিন পাগলের মতে হয়ে হচ্ছে! দেশের এতো বড়বড় সাইক্রিয়েটিস্ট দেখালাম,কিছুই তো হচ্ছে না! ”

বিষণ্ণ দুঃখী স্বরে বললো ” মিষ্টির অসুস্থতা আরো বেড়েছে? কালকেও তো ভালো দেখলাম।আমার সাথে দু একটা কথাও বললো ”

” আজ জায়ান এসছিলো।ও জায়ানকে পাগলের মতো মা”রধর করেছে।আমার এতো চঞ্চল মেয়েটার কি হয়ে গেলো বলতে পারিস! ”

এতটুকু বলে মিষ্টির মা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।বিষণ্ণ কাছে বসে ওনাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে বললো ” আন্টি তুমি কেঁদো না প্লিজ।এখন আমাদের মনকে শক্ত রাখতে হবে।মিষ্টিকে আমি সুস্থ করে তুলবোই। তুমি দেখো।প্লিজ কেঁদো না ”

” মিষ্টির বাবার দিকে তাকানো যাচ্ছে না।লোকটা দুইদিন ধরে কিচ্ছু খাচ্ছে না।সারাক্ষণ মিষ্টির কথা বলে ঝুরঝুর করে কান্না করে ”

এমন সময় মিষ্টির ঘর থেকে প্রচন্ড হুটোপুটির শব্দ হতে লাগলো।বিষণ্ণ ছুটে গেলো মিষ্টির ঘরের দিকে।দরজার কাছে গিয়ে চেচিয়ে মিষ্টিকে ডাকছে,কিন্তু মিষ্টি কোনো জবাব দিচ্ছে না।শুধু পাগলের মতো চিৎকার করছে আর বারবার বলছে, ” আমি একটা নষ্ট মেয়ে।আমি নষ্ট মেয়ে ”

মিষ্টির অবস্থা ভালো না বুঝে মিষ্টির মা বিষণ্নকে বললো ” বিষণ্ণ দরজা ভাঙ্গতে হবে।মিষ্টি নিশ্চিয়ই খারাপ কিছু করে ফেলবে।তুই দরজা ভাঙ্গার ব্যবস্থা কর ”

দরজা অনেক হেভি মেটালে তৈরি। সহজে ভাঙ্গা সম্ভব না।তবুও বিষণ্ণ দরজায় হাত লাগিয়ে ধাক্কা দিয়ে খোলার চেষ্টা করলো।হঠাৎ মিষ্টি চুপ হয়ে গেলো।একদম পিনপতন নীরবতা দেখে বিষণ্ণর শারা শরীর হিম হতে শুরু করলো।প্রচন্ড গতীতে শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করতে করতে হঠাৎ চোখ পড়লো দরজার নিচ দিয়ে গড়িয়ে আসা র”ক্ত প্রবাহের দিকে!মিষ্টির চিৎকার হঠাৎ থেমে গেলো!মেঝে থেকে র”ক্ত গড়িয়ে বেড় হচ্ছে! তবে কি মিষ্টি!

মিনিট দুয়েক ধাক্কার পর দরজার একটা পাল্লা ভাঙ্গতে সক্ষম হয় বিষণ্ণ।ভাঙ্গা পাল্লাটার মধ্যে দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকতেই মিষ্টিকে দেখে বিষণ্ণর হাত পা অবস হয়ে গেলো!সারা ঘরের মেঝেতে র”ক্তের স্রোত।মিষ্টির নিথর দেহ মেঝে পড়ে আছে…….

চলবে?.

চলো না হারিয়ে যাই পর্ব-০৬

0

চলো_না_হারিয়ে_যাই [৬] ❤️
লেখকঃ জয়ন্ত_কুমার_জয়

লা’শটার কথা মনে হতেই তীব্র একটা গন্ধ নাকে ভেসে এলো।মিষ্টি আতঙ্ক সামলাতে না পেরে সাহস করে পিছু তাকালো।পেছন ফিরতেই লাল টকটকে একটা চোখ মিষ্টি দেখতে পেলো।সেই চোখে কয়লার একটা টুকরাতে ধকধক করে আগুন জ্বলছে।সেই ধকধক করে পু’ড়তে থাকা চোখ থেকে কালো ধোঁয়া বেড় হচ্ছে!

এমন একটা দৃশ্য দেখে মিষ্টি প্রচন্ড একটা চিৎকার দিয়ে গলির রাস্তায় ধপ করে পড়ে গেলো। ছায়া ধীরে ধীরে মিষ্টির শরীর ঝুঁকে মিষ্টিকে পরখ করে নিচ্ছে…

___________

রাতে খাবার টেবিলে মুখ কালো করে বসে আছে বিষণ্ণর বাবা।তার ঠিক সামনেই বিষণ্ণর মা বসে বসে ঘুমে হাই তুলছেন।হাই তোলা দেখে বিষণ্ণর বাবা রেগেমেগে বললেন

” এতোবড় হা মেলে হাই দিচ্ছো কেন?গ”লার ভিতরের অর্ধেকটা দেখা যায় ”

এমন কথা শুনে বিষণ্ণর মা মুখ ভোতা করে বললো ” তো কি করবো?তোমার মতো প্যাচার মুখ করে বসে থাকবো?”

” তর্ক করছো কেন? আমি রেগে আছি বুঝতেছো না? ”

বিষণ্ণর মা আবারো হাই তুলে বললেন ” যত অকাজে তোমার রাগ”

বিষণ্ণর বাবা চরম হতভম্ব হয়ে বললেন ” ছেলের জন্য শখ করে মাছ কিনে আনতাম,আর এখন শুনতেছি ও বাইরে গেছে।এখানে রাগ করাটা অকাজের? ”

” আর কতবার বলবো মিষ্টির মা ফোন করেছিলো, ওখানে গেছে ”

” আবার মিষ্টি!এই মেয়েটা ওর সিনিয়র,ওর সাথে কিসের এতো কিসের বন্ধুত্ব?আর এতো রাতে কেন ওর বাবা ডেকেছে? ”

” মিষ্টি বাড়িতে নেই।ওর নাকি ফোনটাও বন্ধ।বিষণ্ণকে বলতেই ও ছুটে গেলো ওকে খুঁজতে ”

” বাহ্,আর তুমি খুঁজতে যেতে দিলে?ওই মেয়ে কোথায় বিষণ্ণ কেমনে জানবে?এতো রাতে আমার ছোট্ট ছেলেটাকে একা যেতে দিলে?”

” বারণ করছিলাম,শুনেনি।আর ও বাইরে থেকে পড়াশোনা করছে,রাতের শহরে চলাচল ও ভালোই পারে।তোমার মতো না ”

বিষণ্ণর বাবা রেগে সামনে রাখা মাছের বাটিটা ফেলে দিলেন।এমন ভাবে ফেলে দিলেন যেন নিচে পড়ে ভেঙ্গে না যায়।বাটি ফেলে বিষণ্ণর বাবা বুঝতে পারলো সে বিশাল বড় অন্যায় করে ফেলেছে।শুধু শুধু রেগে আছি এটা দেখানোর জন্য এতো কষ্টের রান্না ফেলে দেওয়া ঠিক হয়নি।বিষণ্ণর বাবা আর কিছু না বলে ঘরে চলে এলেন।

বিছানার পাশে পায়চারি করতে করতে তার ম্যানেজারকে ফোন দিয়ে বললেন

” আপনাকে যে বিষণ্ণকে খুঁজতে বললাম,ওকে খুঁজে পেয়েছেন? ”

” জি পেয়েছি।ওর মেসের কাছেই দেখা পাইছি।ও এখন পাগলের মতো মিষ্টি নামের একটা মেয়েকে খুঁজছে ”

” ফোনটা বিষণ্ণকে দাও ”

খানিক্ষন বাদে ম্যানেজার বললো ” স্যার কথা বলতে রাজি হচ্ছে না।বললো,আরেকবার ফোন দিলে আছাড় মেরে ভেঙ্গে ফেলবে ”

” আচ্ছা ঠিক আছে,আপনি ওর সাথে থাকুন।ওকে নজরে রাখুন ”

” জি স্যার,আপনি একদম ভাববেন না।রাখি স্যার,বিষণ্ণ একটা রিক্সায় উঠতেছে ”

ফোন রেখে ম্যানেজার দৌড়ো বিষণ্ণর কাছে গিয়ে বললো ” কোথায় যাচ্ছো? ”

” মিষ্টির বাড়িতে ”

” রিক্সা কেন? আমার সাথে গাড়ি আছে ”

এটা শুনে বিষণ্ন দ্রুত রিক্সা থেকে নেমে বললো ” কোথায় গাড়ি?”

” গলির মোড়ে ”

কথা শেষ না হতেই বিষণ্ণ গলির মোড়ের দিকে প্রবল গতিতে দৌড়াতে লাগলো।ওর দৌড় দেখলে মনে হবে কুকুরের দল ওরে কা”মড়ে দিতে পিছে লাগছে।পেছন পেছন ম্যানেজার ও দৌড়াচ্ছেন।

মিষ্টির বাড়ির সামনে গাড়ি থামলো।বিষণ্ণ মিষ্টির বাড়িতে ঢুকলো।মেইন গেট খোলাই ছিলো।বাড়িতে ঢুকেই বিষণ্ণ পাগলের মতো চেঁচিয়ে বললো ” আন্টি…..আন্টি….কই তুমি, আন্টি ”

সিঁড়ির উপর থেকে মিষ্টির মা এগিয়ে এসে বিষণ্ণকে ইশারায় চেচামেচি বন্ধ করতে বললো।বিষণ্ণ কয়েক সেকেন্ডে সিঁড়ি বেয়ে মিষ্টির মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।মিষ্টির মা বললো

” মিষ্টি ঘরে ঘুমাচ্ছে,ওর শরীর খারাপ ”

মিষ্টি ঘরে আছে, কথাটা শুনে বিষণ্নর বু’ক থেকে যেন বড় একটা পাথর সরে গেলো।বিষণ্ন বড় বড় শ্বাস ফেলে বললো ” আমি মিষ্টিকে দেখে আসি ”

” কথা বলিস না,ডাক্তার বলছে ওকে না ডাকতে ”

” আচ্ছা ”

একথা বলে বিষণ্ণ মিষ্টির ঘরে গেলো।গিয়ে দেখলো মিষ্টি বিছানার মাঝখানে শুয়ে আছে।বিষণ্ণ খুব সাবধানে মিষ্টির পাশে বসলো,আলতো ভাবে মিষ্টির কপালে হাত রাখলো।বিষণ্ণর চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল টপটপ করে মিষ্টির কপালে পড়লো এবং সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টির চোখ আর ঠো’ট খানিকটা কেঁপে উঠলো।মিষ্টির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না শুনে বিষণ্নর টেনশনে মাথা খারাপের মতো অবস্থা হয়েছিলো।মনে হাজারটা খারাপ চিন্তা হয়েছিলো,একা একটা মেয়ে রাতে বাইরে,যোগাযোগ করা যাচ্ছে না এমন অবস্থায় টেনশন হওয়াটা স্বাভাবিক।

হঠাৎ একটা পুরুষালি কন্ঠ ভেসে এলো ” চিন্তা করবেন না মিষ্টির কিছু হয়নি।ডাক্তার দেখিয়েছি আমি ”

বিষন্ন চমকে আশেপাশে তাকালো।দেখলো সোফায় একটা ছেলে বসে আছে।ফর্সা,কপালের অর্ধেক অব্ধি চুলে ঢাকা,দেখতে বেশ সুপুরুষ।বিষণ্ণ লক্ষ্যই করেছি ঘরে অন্যকেউ আছে।বিষণ্ণ ছেলেটিকে এক দেখাতেই চিনতে পারলো।ছেলেটির বাসা মিষ্টির বাড়ি থেকে কয়েকটা বিল্ডিং পরেই।কলেজ যাওয়ার সময় মাঝেমধ্যে তাকে দেখা যায় ফরমাল ড্রেস পড়ে অফিসে যাচ্ছে।কিন্তু ছেলেটা এখানে কি করছে?

বিষণ্ণ জিগ্যেস করলো ” আপনি! ”

ছেলেটি কিছু বলার আগেই মিষ্টির মা হাতে এলটা প্রেসক্রিপশন নিয়ে ঘরে ঢুকলেন।টেবিলে কাগজটা রেখে বিষণ্ণকে বললেন ” তুই ছিলি কোথায়?মিষ্টি মনে হয় তোর সাথেই দেখা করতে গেছিলো ”

” হ্যা,কিন্তু ওর কি হইছে? অসুস্থ হলো কিভাবে?”

” আর বলিস না,সর্বনাশ হয়ে যেতে পারতো।ও একটা গলির কাছে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে রাস্তায় পড়ে গেছিলো।সি টাইফুন গলিতে তোর মেস? ”

” হ্যা ”

” তাহলে তো তোর সাথে দেখা করতেই গেছিলো। তুই মেসে ছিলি না? ”

” না, আমি বাড়িতে ছিলাম।ওকে খুঁজে পেলে কিভাবে? ”

” ড্রাইভার আমায় ফোন করে বললো মিষ্টি একটা গলিতে গেছে অনেক্ক্ষণ হলো,এখনও আসছে না। শুনে তো আমি ড্রাইভারকে রাগ হলাম যে কেন একা ছাড়লো।ড্রাইভার বললো মিষ্টি নাকি সাথে যেতে বারন করছে।কেমন বেকুব ড্রাইভার পুষতেছি বল! ”

” তারপর? ”

“এটা শুনেই তোকে ফোন দিলাম,জায়ানকেও ফোন দিলাম।শেষে জায়ান গিয়ে ড্রাইভারকে নিয়ে গলিতে খুঁজে ওকে নিয়ে এলো।কি সর্বনাশটা হতে পারতো বল তো? আমার তো ভাবলেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে ”

বিষণ্ণ একপলক জায়ানের দিকে তাকালো।ছেলেটাকে তার কেমন যেন লাগছে।জায়ান বললো

” আন্টি,চআমি এখন যাই,মিষ্টির ঘুম ভাঙ্গলে আমায় জানায়েন। কাল অফিস আছে ”

” তোমায় এতো রাতে ডিস্টার্ব করলাম ”

” আরে আন্টি কি যে বলেন না।আপনাদের আমি নিজের মনে করি।কাল অফিস যাওয়ার পথে মিষ্টিকে দেখে যাবো।কোনো প্রয়োজন হলে বলবেন।আজ আসি,”

এটা বলে জায়ান চলে গেলো।মিষ্টির মা জায়ানের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন।এতে বিষণ্ণ বিরক্ত হয়ে বললো

” এমনে তাকায়া কি দেখো? মেয়ে বিদায় দিচ্ছো নাকি? ”

” এমন একটা ছেলের সাথে মেয়ের বিদায় দিতে পারলেও শান্তি ”

কথাটা যেন বিষণ্ণর মাথা ফুটো করে ওপায় দিয়ে বেড় হলো।বিষণ্ণ মুখ গম্ভীর করে বললো ” মানে? কি বলো তুমি ”

” ছেলেটা কত ভদ্র তাই না রে? ”

বিষণ্ণ মুখ ভেতা করে চুপ করে রইলো।মিষ্টির মা বললো ” প্রাইভেট একটা ভার্সিটির লেকচারার। ব্যবহার অত্যন্ত নিপুণ ”

মিষ্টির মায়ের মুখে এমন কথা শুনে বিষণ্ণর প্রচন্ড রাগ লাগছে।আন্টি কোনোভাবে কি মিষ্টির সাথে এই ছেলের বিয়ের বিষয়ে কিছু ভাবছে নাকি? এমনটা হলে ওই ছেলেরে শুধু এলাকা না,কিকরে শহর ছাড়াতে হয় বিষণ্ণর ভালো করেই জানা আছে।মিষ্টির মা বললো

” এই বিষণ্ণ ”

” হু ”

” ছেলেটার পাশে মিষ্টিকে মানাবে বলতো? ”

বিষন্ন প্যাচার মতো মুখ করে বললো ” ছেলেটার পাশে মিষ্টি কেন দাঁড়াবে বরং মিষ্টির পাশে ওই ছেলেটাকে ইদুরের মতো লাগবে। গণেশের পায়ে ইদুরের মতো ”

” কি যে বলিস তুই।ছেলেটা কত নম্র! ”

” হুদাই এসব বলবা না তো।মিষ্টির পাশে ওকে মানাবে না।আচ্ছা আঙ্কেল কই? ওনারে জানাইছো? ”

” ,তারপর বলেও দিছি ওকে পাওয়া গেছে ”

” আঙ্কেল আসছে? ”

” দশটার দিক আসে।ও উপন্যাস নিয়ে ব্যস্ত।এই বয়সে নাকি উপন্যাস লিখবে।তুই কি থাকবি? গেস্ট রুম খুলে দিই? ”

” থাকবো না,মিষ্টির ঘুম ভাঙ্গলে একটু কথা বলে চলে যাবো ”

” কখন ভাঙ্গবে সে আশায় বসে থাকবি?”

” আমার সমস্যা হবে না ”

” আচ্ছা,আমি তাহলে ঘরে গেলাম।ওর ঘুম ভাঙ্গলে আমায় ডাকিস ”

” আচ্ছা ”

আন্টি চলে গেলো।বিষণ্ণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে আন্টিকে দেখছে।আন্টিকে বিষণ্ণর ভিষন কাছের একজন মনে হয়।উনিও বিষণ্ণকে নিজের ছেলের মতোই দেখেন,বিশ্বাস করেন।বিশ্বাস না করলে একা একটা মেয়ের রুমে নির্দিধায় রেখে যান? আন্টির এমন বিশ্বাস দেখে বিষণ্ণর মাঝে মাঝে বড্ড অসহায় বোধ হয়।

মিষ্টির ঘুম ভাঙ্গলো এগারোটায়।এরমধ্যে মিষ্টির বাবা এসে মেয়েকে দেখে গেছেন।তিনি বেলকনিতে বসে গল্প লিখছেন।ঘুম ভাঙ্গতেই বিষণ্ণ মিষ্টিকে ধরে বিছানায় আধশোয়া করে শুইয়ে দিলো।মিষ্টি চোখ মেলে বিষণ্ণকে দেখে আচমকা জরিয়ে ধরে চেঁচিয়ে বললো

” ছায়া…একটা ছায়া…..লাল চোখ….চোখে আগুন…. ”

এসব বলতে বলতে মিষ্টি ভয়ে বিষণ্ণকে আরো জোরে জরিয়ে ধরলো।বিষণ্ণর পিঠে মিষ্টির ন’খ বসে গেছে।বিষণ্ণ মিষ্টিকে শান্ত করার চেষ্টা করলেও লাভ হচ্ছে না।মিষ্টি বারবার শুধু ছায়ার কথা বলছে।ইতোমধ্যে মিষ্টির বাবা,মা ঘরে এলেন।মিষ্টি বাবাকে দেখে জরিয়ে ধরলো।জরিয়ে ধরে একই কথা বারবার বলছে,ছায়া…ছায়া!

মিনিট পনেরো পর মিষ্টি কিছুটা স্বাভাবিক হলো।বিষণ্ণ ওর কপালে হাত রেখে দেখলো কপাল জ্বরে পুরে যাচ্ছে।শরীর কাঁপছে থরথর করে।

মিষ্টি এক হাতে বাবার হাত অন্য হাতে বিষণ্ণর হাত চেপে ধরে বসে আছে।বিষণ্ণ বললো

” মিষ্টি আপু!তোমার এখনো ভয় করছে? আমি আছি আঙ্কেল আন্টি সবাই এখানে আছে।কিসের ভয়? কিচ্ছু হয়নি, এই যে দেখো ”

মিষ্টি হিক পেরে কান্না করছে।কিছুক্ষণ পর কান্নার বেগ একটু কমলো।মিষ্টি কান্নামিশ্রিত স্বরে বললো

” একটা ছায়া আমায় দেখছিলো ”

বিষণ্ণ মিষ্টির হাতে হাত রেখে বললো ” এখন এসব বলতে হবে না।তুমি রেস্ট নাও।কিচ্ছু হয়নি।তুমি ভুল দেখছো।কোনো ছায়া ছিলো না,ওইটা ড্রাইভার নইলে জায়ান ভাই ছিলো।অন্ধকারে তুমি ছায়া দেখছো।এখন তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো তো,চোখ বন্ধ করো ”

মিষ্টি বাচ্চা মেয়ের মতো সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করলো।কিন্তু বিষণ্ণর হাত ছাড়লো না।মিষ্টির মা চেষ্টা করলো বিষণ্ণর হাত ছাড়িয়ে নিতে,কিন্তু পারলো না।মিষ্টির আতঙ্ক এখনো কাটে নি।বিষণ্ণ বললো ” আন্টি ও হাত ধরে থাক,আমি খাটের পায়ায় হেলান দিয়ে বসে থাকবো সমস্যা নাই।হাত ধরে থাকলে ওর ভয়টা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকে “।সারারাত বিষণ্ণ নির্ঘুম অবস্থাতে বসে রইলো।

ভয়ের ব্যাপারটা যে এতোটা গভীরে পৌঁছাবে কেউ আশা করেনি।তিনদিন ধরে মিষ্টি একদম চুপচাপ হয়ে গেছে।তেমন কথা বলে না।সবসময় শুধু বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে।এরমধ্যে তিন চারজন পীর ফকির এসে গলায় হাতে তাবিজ বেঁধে দিয়েছেন।মিষ্টির এই অবস্থা দেখে যতটা না মিষ্টির বাবা মা ভেঙ্গে পড়েছে তার থেকে বেশি ভেঙ্গে পড়েছে বিষণ্ণ।সে সারাদিন সারারাত মিষ্টির একটা হাত ধরে বসে থাকে।চোখে সবসময় অশ্রু।বিষণ্ণর বাবা মা এসে বিষণ্ণকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো।বিষণ্ণ কিছুতেই যায়নি। মিষ্টির এই অবস্থার জন্য বিষণ্ণ নিজেকে দায়ি করছে।বিষণ্ণর মনে হচ্ছে তারজন্যই মিষ্টি এখন ভয়ঙ্কর এক জগতে বাস করছে।

মিষ্টিকে দুইজন সাইক্রিয়েটিস্টি দেখানো হলো।তারা মিষ্টির অবস্থা দেখে একটাই বললেন,কিছুটা সময় দিন।মানসিক ভাবে সে প্রচন্ড দূর্বল।

ওনারা আরেকটা কথাও বলেছেন।সেটা শোনার পর থেকে বিষণ্ণর মাথায় আগুন দগদগ করে জ্বলছে।সে শুধু অপেক্ষা করছে মিষ্টির সুস্থ হওয়ার জন্য।সাইক্রিয়েটিস্টি বলছে ” মিষ্টির মস্তিষ্কে ভয় বিষয়টা গভীর ভাবে ঢুকে গেছে।সাথে হয়তে অন্য কোনো ঘটনাও সেরাতে তার সাথে ঘটে গেছে,হতে পারে সেটা শা”রিরীক কোনোকিছু।যার জন্য ও নিজে নিজেই সুস্থ হওয়ার চেষ্টাটাও করছে না।

চলবে?

এই গল্পের শেষ কোথায় পর্ব-০৫

0

এই_গল্পের_শেষ_কোথায়
পর্ব—-০৫
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।

অর্পা আর আয়ুশের উদ্দেশ্য ছিলো রোদ্দুরকে খু*ন করা।ওরা দুজন রাতেই প্ল্যান করে রেখেছিলো যে রোদ্দুরকে পৃথিবী থেকে চিরকালের জন্য সরিয়ে দেবে।তখন আর অর্পা আর আয়ুশের ভেতরে কোনো বাঁধা থাকবে না।গেট থেকে বাড়ির ভেতরে ঢোকার পরের কোনো ঘটনাই মনে পড়ছে না অর্পার।

অর্পা আর আয়ুশ চেয়েছিলো রোদ্দুরকে খু*ন করতে।কিন্তু অদ্ভুতভাবে আয়ুশ কিকরে খু*ন হলো।আর সেটাও কিনা ওর নিজের বাড়িতে।ঐ রাতে আর কি ঘটেছিল অর্পা মনে করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে!কিন্তু ব্যর্থ হয়!

অর্পা এরপরে ওর রুমে ফিরে এলো।এসে বিছানার ওপরে শুয়ে পড়লো।পাশেই রোদ্দুর অঘোরে ঘুমাচ্ছে।

পরের দিন সকালবেলা।তুতুলের ডাকে ঘুম ভাঙে অর্পার।বিছানা থেকে উঠে বসলো অর্পা।তুতুল ওর মাকে প্রশ্ন করে

—মা আমার ঘরে গিয়েছিলে তুমি?

—কেনো রে,কি হয়েছে ?

—আগে বলো আমার ঘরে গিয়েছিলে কিনা তুমি?

—হ্যাঁ গিয়েছিলাম তো!

—তুমি কি আমার ঘর থেকে কিছু সরিয়েছো?

—তুতুল আমি কিন্তু সত্যি কিছু বুঝতে পারছি না,কি বলতে চাইছো তুমি?

তুতুল ওর মায়ের দিকে এগিয়ে আসলো।এরপরে নিজের চোখদুটো বড়ো করে অর্পাকে বলতে লাগলো

—মা আমার কেবিনেটে একটা শার্ট ছিলো,আর এখন ঐ শার্টটা আমি কোথাও দেখতে পাচ্ছি না।বলো তুমি কি করেছো?

অর্পা নিজের মেয়ের কথা শুনে রীতিমত অবাক হয়ে যায়,সেই সাথে প্রচন্ড ভয়ও পেলো।তুতুল আগে কখনো এইভাবে কথা বলেনি ওর সাথে।ওর মতো শান্তশিষ্ট একটা মেয়ে এতোটা এগ্রেসিভ হয়ে উঠলো কিকরে সেটাই বুঝতে পারছে না।অর্পা তুতুলকে আশ্বস্ত করার জন্য বলে

—-এতোটা উত্তেজিত হয়ো না সোনা,আমি বুঝতে পারছি না একটা শার্ট নিয়ে এতো কিসের প্রবেলেম তোমার?

—প্রবেলেমটা আমার নয় তোমার।তাই তো তুমি শার্টটা চুরি করেছো।আমার ঘর থেকে বিনা অনুমতিতে আমার জিনিসে হাত দেওয়ার সাহস কোথা থেকে পেলে তুমি?

—তুতুল।এবার কিন্তু বেশী বাড়াবাড়ি হচ্ছে।এমন কোনো কাজ করো না,যাতে তোমাকে আমায় শাসন করতে বাধ্য হতে হয়।

—আমার শার্ট কি করেছো আগে সেটা বলো!আমি আমার শার্ট ফেরত চাই।

—আমি তোমার ঐ শার্ট পুড়িয়ে ফেলেছি!শুনতে পেরেছো আমার কথা তুমি!

—কি তুমি শার্টটা পুড়িয়ে ফেলেছো,
এটা তুমি কেনো করেছো মা?

—একটা শার্টের জন্য তুমি নিজের মায়ের জন্য যেটা করছো সেটা কি ঠিক।আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাও।আমার তোমার সাথে কোনো কথা নেই।

তুতুল অর্পাকে অবাক করে দিয়ে একটা ঘরে রাখা একটা চিনামাটির ফুলদানি ছুড়ে মারলো।অর্পা আর্তনাদ করে মেঝের ওপরে বসে পড়ে।অমনি বাহির থেকে রোদ্দুর ছুটে আসলো।রোদ্দুর গিয়ে অর্পাকে সামলায়।অর্পাকে বিছানার ওপরে বসিয়ে তুতুলের দিকে এগিয়ে গেলো।

—তুতুল এটা কি করেছো তুমি!
নিজের মাকে হার্ট করেছো,এই মানুষ করেছি তোমায় আমি?

তুতুল কোনো কথা না বলে দাঁড়িয়ে আছে।

—কি হলো কথা বলছো না কেনো,
আজ সারাটা দিন তুমি নিজের ঘরে বন্দী হয়ে থাকবে।আর এটাই তোমার পানিশমেন্ট।

এই বলে তুতুলকে নিয়ে ওর ঘরের দিকে চলে গেলো রোদ্দুর।

রাতের বেলা।

অর্পা আর রোদ্দুর ওদের বিছানার ওপরে বসে আছে।অর্পার মাথায় একটা মোটা ব্যান্ডেজ।ওর মাথাটা রোদ্দুরের কাঁধের ওপরে।দুচোখ দিয়ে অশ্রুজল গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

—আবার কান্না করছো,
বাচ্চা মেয়ে বুঝতে পারেনি একটা ভুল করে ফেলেছে।এই নিয়ে এতো কষ্ট পেয়ো না তো!

—আমি তুতুলের কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছি না রোদ্দুর।

—তাহলে?

—সব আমার নিজের পাপের ফল।আমার পাপের ফল ভোগ করতেই হবে আমায়।

—তুমি আবার কি পাপ করেছো?

—আমি চাইলেও সেসব কথা এখন বলতে পারবো না তোমায়।আচ্ছা মেয়েটাকে ওর ঘরে আটকে রেখেছো সেই কখন থেকে।কাজটা কি ঠিক হলো?

—একদম ঠিক হয়েছে?
ওর বোঝা উচিত কতো বড়ো ভুল করেছে ও।

—একটু আগেই তুমি না বললে ছোটো মানুষ ভুল করে ফেলেছে।আমরা তো আর ওর মতো অবুঝ নই।ছাড়ো আমায়।ওর ঘরে গিয়ে একটু দেখে আসি।

—আচ্ছা ঠিক আছে যাও।খাবারগুলো খেয়েছে কিনা চেক করে দেখো।

এরপরে অর্পা তুতুলের ঘরের দিকে গেলো।দরজাটা খুলতেই অর্পা দেখতে পায় তুতুল ঘুমিয়ে আছে।পাশেই ওর মোবাইল ফোনটা।অর্পা এগিয়ে যায় তুতুলের দিকে।ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহার করে ফোনের লকটা খুলে ফেললো।এরপর ফাইল ম্যানেজারে ঢুকে চেক করতে লাগলো।সেরকম কিছুই পেলো না।ছবির গ্যালারীতে ঢুকে এক এক করে ছবিগুলো চেক করতে লাগলো।হঠাৎ একটা ছবি দেখে অর্পার চোখজোড়া আটকে যায়।নিজের চোখকে যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না অর্পা।

আয়ুশের স্ত্রী ডাহুকের সাথে তুতুলের বেশ কিছু ছবি।ডাহুকের সাথে তুতুলের কবে দেখা হলো আবার?ওদের তো একে অপরকে চেনারই কথা নয় কখনো।কি হচ্ছে এসব?

চলবে…..