Saturday, August 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 470



মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-১৩+১৪

0

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৩
নতুন দ্বীপশিখা প্রজ্জ্বলিত হতে শুধু কিছু ধাপ বাকি। বৈঠকের সবার উৎসুক দৃষ্টি মীরার উপর নিবদ্ধ। মীরা এতে যেন দোটানার সাথে অস্বস্তিতেও পড়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগেই সে, ড: আকবর রেহমানের সাথে ফোনে কথা বলেছে। জেনেছে, শেহজাদ স্যার মীরার বিষয়ে জানেনা। মীরা তখন অবাক হয়েছিল কিন্তু পরে জানতে পারলো, মেয়ে দেখেছে জানে কিন্তু মেয়েটা কে তা জানেনা। এগুলো রোমন্থন করে মীরার অস্বস্তি লাগছে। শেহজাদ স্যার কী ভাববে তার ব্যাপারে? কেমন এক গুমোট অনুভূতিরা লতার মতো তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে। মীরার বাবা ফের শুধালেন,

“তোমার মতামত বলো। আমার ও তোমার মায়ের আপত্তি নেই। আমি বিশ্বাস করি, তুমি তোমার মায়ের মতোই কোমল।”

মীরা ভেবে চিন্তে সময় নিয়ে বলল,
“ফ্রিশার মা হতে আমার আপত্তি নেই। ও অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় আলাদা। কিন্তু ওর বাবা! উনি আমার স্যার। আমাদের দুজনের জন্যই ব্যাপারটা অস্বস্তিকর। আমি স্যারের সাথে কথা বলব। উনি যা ভালো মনে করেন। আমি আমার মায়ের অন্য কোনো দিক পেয়েছি কী-না জানিনা কিন্তু এক মা-হারা সন্তানকে আগলানোর গুণ ঠিকই পেয়েছি।”

মীরার বড়ো ভাই মলিন হাসলো। মীরার মা তার আপন মা না। সৎ মা! সম্পর্কে খালাও হয়। রুবেলের যখন তিন বছর বয়স তখন তার জন্মদাত্রী মায়ের আচমকা স্ট্রোকে মৃত্যু হয়েছিল। তারপর কিছুদিন পর তার নানা-নানি নিজেদের নাতির কথা ভেবে তাদের ছোটো মেয়ের সাথে বড়ো মেয়ের স্বামীর আবার বিয়ে দেন। মলি জাহান, রুবেলকে কখোনো নিজের ছেলের চেয়ে কম মনে করেননি। মলি জাহান মীরার পাশে এসে বসলেন। অতঃপর মাথায় হাত রেখে স্নেহের স্বরে বললেন,

“অন্যান্য বাবা-মায়েরা, কখোনো চান না তাদের আদরের মেয়েকে বাচ্চা আছে এমন লোকের সাখে বিয়ে দিতে। কিন্তু আমরা এখন চাইছি। তোর বড়ো ভাই তো, ভার্সিটিতে গিয়ে তোর ডিপার্টমেন্টের কিছু স্টুডেন্টদের থেকে কৌশলে খবরও নিয়ে এসেছে। তোর স্যার অনেক ভালো মনের মানুষ। তুই বিয়ে করতে রাজি না হলে হয়তো উনারা অন্য কোথাও খুঁজবে। কিন্তু যদি সেই অন্য মেয়ে, ফ্রিশাকে ভালোবাসতে না পারে? আমার তোর উপর ভরসা আছে। কেন জানি বাচ্চাটাকে প্রথমবার দেখেই খুব মায়া কাজ করছিল। ভেবেছিলাম হয়তো মায়ের আদরে বাচ্চাটা এত মায়াবি, এত সুন্দর, এত মিষ্টি। কিন্তু যখন মিসেস শাহিদা বললেন, ওর মা নেই। বুকটা ভীষণ ভার হয়ে গিয়েছিল।”

মীরা অপলক তার মায়ের মুখের আদলে চেয়ে আছে। তার খারাপও লাগছে কারণ মাঝে সে এই মায়ের, বাবার উপরই খুব অভিমান করেছিল। মীরা বুঝতে পারে, উনাদের দিক দিয়ে উনারা ঠিক। ভুল যদি কেউ হয় সেটা যারা ক্ষতি করতে চায় এবং পরিস্থিতি। মীরা হুট করে মৃদু হেসে মাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর বলে,
“অ্যাই অ্যাম লাকি টু হ্যাভ ইউ গাইজ।”

রুবেল ও মারুফ, তাদের মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে পাশ থেকে আগলে নেয়। রফিক তালুকদার পাশ ফিরে কনিষ্ঠ আঙুলির দ্বারা নেত্রকোনে জমে উঠা জলবিন্দুদের মুছে নেয়। শারমিন ও নিধি একে-অপরের দিকে চেয়ে মুচকি হাসে।

________

শেহজাদ একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে। বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত ক্লাস নিয়ে সে বেরিয়েছিল। এখন ঘড়িতে পাঁচটা বিশ বাজে। বসে বসে সে বারবার হাতঘড়িতে সময় দেখছে। তার হাবভাবে দেখে মনে হচ্ছে যেন সে ঘণ্টা যাবত কারও জন্য অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছে। কিন্তু বাস্তবে কিন্তু তা না। মিনিট দশেক হয়েছে এসেছে। বাহিরে তুমুল বৃষ্টি। গাড়ি থেকে নামতেই সে খানিক ভিজেছে। এখন এসির বাতাসে টেনেও গেছে। তার অস্থিরতার কারণ হচ্ছে যার সাথে দেখা করতে এসেছে সে। শেহজাদের অস্থিরতা দেখে ওয়েটার দ্বিতীয় দফায় আসলো।

“স্যার, কিছু অর্ডার করবেন? চা অর কফি?”

শেহজাদ ভাবলো। তারপর বলল,
“ইয়াহ। ওয়ান কাপ অফ স্ট্রং কফি উইথ লেস সুগার।”

ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে যায়। শেহজাদ ফের দরজার দিকে এবং ঘড়ি দেখছে। ফোনটাও চেক করছে।

এদিকে মীরা অনেকটা সময় উবারের জন্য অপেক্ষা করে একটু আগে উবারে উঠেছে। বৃষ্টির কারনে রাস্তায় জ্যাম। বৈশাখ মাসে তেমন একটা বৃষ্টি না হলেও দুইদিন যাবত হচ্ছে। গতকাল খুব অল্প হয়েছিল। আজও দুপুর অবধি আকাশ রোদে ঝলমল করছিল। হুট করে বৃষ্টি নামলো। লাগাতার আধাঘণ্টা যাবত বৃষ্টি হচ্ছে। জামা ও পাজামার নিচের অংশ একটু ভেজা। গুগোল ম্যাপে দেখল, আর পাঁচ মিনিট লাগবে গন্তব্যে পৌঁছাতে। আজ তার ভার্সিটিতে ক্লাস নেওয়ার তৃতীয় দিন ছিল। নতুন নতুন চাকরির পরিবেশ। আবার যাচ্ছেও নিজের ইউনিভার্সিটির টিচারের সাথে দেখা করতে। অস্বস্তির পারদ সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছে গেছে। মীরা দেখল জ্যাম ছুটেছে। আর পাঁচ মিনিটে পৌঁছে যাবে। সেখানে গিয়ে কী কী বলবে, মনে মনে তারই হিসাব কষে নিচ্ছে।

শেহজাদ কফি শেষ করে ওয়েটারকে ডেকে কফির বিলটা দিয়ে দিল। কারও জন্য অপেক্ষা করার মধ্যে কিছু খেয়েছে তা না বুঝানোই ভালো। মীরা রেস্টুরেন্টের কাচের দরজা খুলে ঢুকলো। হন্তদন্ত হয়ে ঢোকার কারণে দরজার সাথের চেয়ারের সাথে পায়ের কনিষ্ঠ আঙুলে লেগে গেছে। চোখ-মুখ খিঁচে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়ালো তারপর ব্যাথাতুর নিঃশ্বাস ছেড়ে সামনে অগ্রসর হলো। শেহজাদ চেয়ারের শব্দেই সেদিকে তাকিয়েছিল। তারপর মীরা এদিকে আসতেই টেবিলের দিকে নজর ফেরালো। মীরা এসেই প্রথমে সালাম দেয়। শেহজাদও সালামের উত্তর দিয়ে জোরপূর্বক হাসে। দুজনেরই ওষ্ঠকোণে কৃতিম হাসি। মীরা বলল,

“এক্সট্রেমলি সরি, স্যার। হঠাৎ বৃষ্টি তারউপর জ্যামে আটকা পড়ে লেইট হয়ে গেছে।”
“ইটস অকে। কফি?”
“হ্যাঁ?”
“কফি নিবে?”
মীরা প্রথমে বুঝতে পারেনি। যখন বুঝলো সে বোকার মতো প্রশ্ন করেছে তখন ভীষণ লজ্জিত হলো। কিন্তু তার কফি পান করতে ইচ্ছে করছে না। ভার্সিটিতে সকাল থেকে তিন কাপ কফি সে অলরেডি খেয়েছে। তাই ইতস্তত করে বলল,

“চা হলে ভালো হতো। কফিও চলবে।”

শেহজাদ ওয়েটারকে ডেকে দুই কাপ চা সাথে চিকেন কর্ন সূপ ও চিকেন মাশরুম সালাদ অর্ডার করলো। মীরা কোলের উপর দুই হাত চেপে বসে আছে। এতক্ষণ যা প্র্যাকটিস করছিল, এখন সব ভুলে গেছে। শেহজাদ মীরাকে দেখে বুঝলো, মীরা অস্বস্তিতে আছে। নিজেই শুধালো,

“স্যার ও ফুফিজান আমাকে সব বলেছে। আমি নিজেও বিয়ে করতে চাইনি। ইভেন আমি তোমার ব্যাপারে থ্রি ডেইস হলো জেনেছি। রিসেন্টলি ফ্রিশাকে প্রতিমাসের রুটিন চেকআপ করার পর ভার্সিটিরই এক সাইকোলজিস্টের কনসাল্ট করেছিলাম। উনার সাজেশনে বেসিক্যালি আমি বিয়েতে মত দিয়েছি। বাট স্যার যে তোমাকে চুজ করেছে জানতাম না। স্যার বলল, ফ্রিশা তোমাকে অনেক পছন্দ করে। ফ্রিশাও বলেছে। বাট ইউ হ্যাভ চয়েজ। ইফ ইউ ওয়ান্ট দেন…!”

মীরা নিজের শুষ্ক ঠোঁট জোড়াকে জিহ্বার সাহায্যে অতি সন্তপর্ণে ভিজিয়ে নিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলে,
“আমার অন্য কোথাও চয়েজ নেই। ফ্রিশাকে আমার ফ্যামিলিও পছন্দ করেছে। আমার ফ্যামিলির এতে সায় আছে।”

শেহজাদ ঘাড় নাড়লো। ততক্ষণে ওদের অর্ডারকৃত খাবার চলে এসেছে। চা টা পরে আসবে। শেহজাদ ইশারায় মীরাকে নিতে বলল। খাওয়ার সময়টাতে দুজনে কথা বলল না। খেতে খেতে ওরা নিজেদের কথা গুছাচ্ছে। খাওয়া শেষে চা আসলে শেহজাদ শুধালো,

“ফ্রাস্ট টিচিং এক্সপেরিয়ান্স কেমন লাগছে?”
মীরা মৃদু হেসে বলে,
“কোয়াইট গুড। আপনাদের স্ট্রাগলটা বুঝতে পারছি।”

খানিক হাসির পরিবেশ সৃষ্টি হলো।
“তোমার রেজাল্ট তো অনেক ভালো দেখলাম। আমাদের ভার্সিটিতেও হতে পারতো। এজ অ্যা এক্স স্টুডেন্ট সিজিপিএ ৩.৮ হলেই এনাফ।”
“এখানে হওয়ার পর মনে মনে হলেও চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন সার্কুলার ছিল না।”
“হুম। চাইলে পরেরবার ট্রাই করতে পারবে। এখন এক্সপেরিয়ান্স গেদার করো। নিজের ভার্সিটিতে টিচিং করা আরও চ্যালেঞ্জিং।”
“জি স্যার।”

কথা বলতে বলতে চা পান করাও শেষ। শেহজাদ বলে,
“ওকে চলো। সন্ধ্যা হয়ে আসবে। বৃষ্টিও থেমে গেছে।”
“জি স্যার।”

মীরা উবারে কল করতে চাইলে শেহজাদ বলে,
“উবার আসতে সময় লাগবে। এমনিতেও বৃষ্টি হয়েছে। আমি তোমাকে কিছুদূর ড্রপ করে দিচ্ছি।”
মীরা ফের দোটানাতে পড়লো। তাকে ভাবতে দেখে শেহজাদ ফের বলে,
“যেখানে বিয়ে হচ্ছে, সেখানে সামান্য ড্রপ করা নিয়ে না ভাবাই ভালো।”

এই কথার পর মীরার কি কিছু বলার থাকে? সে ইশারায় হ্যাঁ বলে শেহজাদের সাথে চলতে থাকে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৪
দুইদিন পর, মীরা ফ্রিশার সাথে ফোনে কথা বলছে। প্রায় ঘণ্টা খানেক হতে চলল তাদের কথোপকথন। তখন অন্য এক অচেনা নাম্বার থেকে বারবার বিরামহীন কল আসছে। মীরা তা দেখে বিরক্ত হয়ে আবার ফ্রিশার কথা বলছে। এদিকে ফ্রিশার চোখে ঘুম চলে এসেছে। কথন বলার এক পর্যায়ে তার কোনো আওয়াজ না পেয়ে মীরা হালকা হেসে ফোন রেখে দেয়। অতঃপর কফি বানাতে যায়। লাইট কফির সাথে মধু মিশিয়ে খেলে তার ঘুম ভালো হয়। ঘড়িতে এখন রাত এগারোটা। মীরার বড়ো ভাবি, খাবারগুলো ফ্রিজে রাখছে। সে মীরাকে বলে,

“মীরু, তোমার ভাইয়ার জিজ্ঞাসা করছিল, কাল তো শুক্রবার। তাহলে কথা বলে কালকেই আংটি বদল এগুলো হয়ে যাক। তারপর সামনের শুক্রবার বিয়ে…!”

মীরা কিঞ্চিত ভাবলো। জবাবে বলল,
“এখন না। এখন ভার্সিটিতে এড-ড্রপের কার্যক্রম চলছে। তারপর ক্লাস রিসিডিউলিং। এগুলো চলছে। আমার নিজেরও একটা ক্লাসের ক্লাস টাইম চেঞ্জ হয়েছে। আরও হয় কী-না! তাছাড়া আমি ফ্রিশার মনের কথাও বুঝতে চাই। আমার সাথে টাইম স্পেন্ড করতে পছন্দ করে বলেই যে মায়ের জায়গা দিয়ে দিবে, এমনটা তো না। হতেও পারে আন্টি হিসেবে পছন্দ করে। কিন্তু মায়ের জায়গাটা খুব সেনসিটিভ। এক সপ্তাহে যদি মনে হয়। তাহলেই বাকি সব। বিয়ের পরও কিন্তু দিনের ১০ ঘণ্টা আমি ওর সাথে থাকতে পারব না। এটাও তো বুঝতে হবে।”

“আচ্ছা। আমি তোমার ভাইকে বলব। এখন যে কফি খাচ্ছ, ঘুম হবে? তোমার তো কাল ছুটি।”

“তুমি তো জানোই, আমি মধু দিয়ে কফি খেলে ঘুম আরও ঝেঁকে আসে।”
“তা ঠিক। আচ্ছা খাও তবে। সিয়াম এখনও ঘুমাচ্ছে না। তোমার ভাইয়ের সাথে জেগে জেগে ফোন দেখছে।”

মীরা হাসলো। তারপর কফি করে নিজের ঘরে চলে আসলো। এসে দেখলো আবারও ফোন বাজছে। ওই একই অচেনা নাম্বার থেকে। মীরা ভাবলো, হয়তো কোনো স্টুডেন্ট। কিন্তু এত রাতে! ক্লাসে তো বলাই হয়েছে যে কোনো দরকার হলে অফিস আওয়ারে আসতে। আর যদি অফিস আওয়ারে আসতে না পারে তবে রাত আটটার আগে কল করতে। এখন বাজে এগারোটা। ফার্স্ট সেমিস্টারের স্টুডেন্টরাই এই কাজগুলো বেশি করে। মীরা ফোন রিসিভ করে সালাম দিয়ে প্রশ্ন করলো,

“কে বলছেন?”

অপরপাশ থেকে শোনালো,
“চিনতে পারছ না, মীরা?”

মীরার ভ্রুদ্বয় কুঁচকে এলো। সে সন্দিহান কণ্ঠে বলল,
“হেয়ালী না করে আপনার পরিচয় দিন। এত রাতে একটা মেয়েকে এতবার ফোন করাটা কোন ধরনের ভদ্রতা?”

“তিন বছরে ভুলে গেলে? এখন কণ্ঠও চিনতে পারছ না? ভালোই তো আপডেট হয়েছ! হ্যাঁ?”

মীরা থমকে যায়। তার শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে গেছে। ফোনটা হাতে নিয়ে আবার চেক করে দেখলো, বাংলাদেশি নাম্বারই। সে তবে বাংলাদেশে এসেছে? অপরপাশ থেকে আবারও শোনালো,

“মনে পড়েছে? নাকি ডিটেইলস ইনট্রো দিতে হবে? তুমি চাইলে দিতেই পারি, মীরু।”

চোখ বন্ধ করে দুই বার বড়ো করে শ্বাস নিয়ে ফের নিঃশ্বাস ছেড়ে কঠোর কণ্ঠে শুধালো,
“হঠাৎ আমাকে মনে পড়লো, ভাইয়া? এতোবার লাগাতার কল করেই যাচ্ছেন! ১২ বার! খুব জরুরী দরকার?”

“বাহ্ বেশ দরকারের কথা বলছ। যেন আমি তোমার অপরিচিত।”

“আমি কি বলেছি, আপনি আমার অপরিচিত? আপনি আমার ভার্সিটির সিনিয়র ভাই। অপরিচিত হতে যাবেন কেন?”

বর্ণ বাঁকা হাসলো। ফের শুধালো,
“শুধু এটুকুই? আর কিছু না?”

মীরা তাচ্ছিল্য হেসে খানিক অভিনয় ধরলো।
“এতটুকুই তো! আর কী থাকবে? আপনি বলুন, কেন কল করেছেন?”

বর্ণর কাছে জবাবটা মনঃপূত হলো না। সে জেনেছিল, মীরা মুভঅন করেছে। সামনে তার বিয়ে। কিন্তু মীরা তো খুব ইমোশনাল ফুল একটা মেয়ে। সে নিশ্চয়ই নিজের এক সময়ের ভালোবাসার মানুষটার কণ্ঠ শুনে আবেগে ভেসে যাবে! এমনটা আশা করেও আশাহত হলো বর্ণ। নিজের আকাঙ্ক্ষাকে খানিক দমন করার বৃথা চেষ্টা করে শুধালো,

“কেমন আছ?”

মীরার এবার স্বতঃস্ফূর্ত জবাব। সেই জবাবে নেই কোনো মলিনতা আর নেই কোনো ঠেকে যাওয়ার ভাব।
“আলহামদুলিল্লাহ্‌। অনেক ভালো আছি, ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন?”

বর্ণ থতমত খেয়ে গেলো। সেও কি মীরার মতো এভাবে নির্দ্বিধায় বলতে পারবে? না পারবে না। কারণ সে ভালো নেই। গতকালই সে তার ছয় মাসের শিশুপুত্রকে নিয়ে জাপান থেকে এসেছে। আবার চলে যাবে।
এদিকে বর্ণকে চুপ থাকতে দেখে মীরা তাচ্ছিল্য হাসে। সে মনে মনে বলল, ‘বে*ই*মা*নরা সুখেই থাকে।’ কিন্তু মুখে বলল,

“ভাইয়া, কোনো কথা না থাকলে ফোনটা রাখব। অ্যাই অ্যাম সো টায়ার্ড।”

হুট করে বর্ণ বলে ফেলল,
“অ্যাই ওয়ান্ট ইউ ব্যাক, মীরা।”

হকচকাল মীরা। হঠাৎই নিজের কর্ণকুহরে প্রবেশ করা শব্দগুচ্ছ সে শুনেও এর গুরুত্ব ঠাওর করতে পারলো না। বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে শুধালো,

“হোয়াট?”
“ইয়েস, অ্যাই ওয়ান্ট ইউ ব্যাক। প্লিজ মীরা।”
মীরা তৎক্ষণাৎ তেতে ওঠলো। ক্রোধে বিহ্বল হয়ে বলতে লাগলো,
“আর ইউ সি*ক? আর ইউ গন ম্যা*ড? হাউ কুড ইউ বি সো সেইমলেস?”

“দেখো মীরা, ভুল তো মানুষই করে। আমিও করেছি। আসলে আমি….!”

“স্টপ। নো মোর ওয়ার্ডস। আমাকে পুতুল পেয়েছেন না? যখন মন চাইবে খেলবেন, তারপর মন ভরে গেলে ছুড়ে ফেলে দিবেন। ফের আবার খেলতে ইচ্ছে হলে খেলবেন! শুনে রাখুন মিস্টার বর্ণ আহমেদ, এই মীরা কোনো পুতুল নয়। সে এখন আর তিন বছর আগের মীরা নয়। সে বদলেছে। আমূলে বদলেছে। এন্ড থ্যাংকস টু ইউ। আপনার কারণেই আমার এই সুন্দর বদল হয়েছে। ফারদার আমাকে কল করবেন না।”

“মীরা, প্লিজ শুনো… মীরা!”

মীরা এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে কল কে*টে নাম্বার ব্লক করে দেয়। এদিকে বর্ণ বার বার ট্রাই করেও মীরার নাম্বারে কল লাগাতে পারছে না। সে রেগে নিজের ফোনটা ছুড়ে ফেলে। এই শব্দে বর্ণর ছেলে বর্ষণের ঘুম ছুটে যায়। সে কেঁদে উঠলে বর্ণ বিরক্ত হয়ে নিজের মাকে ডাকে।

কল কেটে মীরা মুখ ঢেকে মাথা নিচু করে বসে আছে। না, সে কাঁদছে না। বরং আফসোস হচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে। তার জীবনে আবারও কেন অতীতের ছায়া ধেয়ে আসছে? নিজের মত সবকিছু খুব সুন্দর করে গুছিয়েই তো নিয়েছিল। তার ক্যারিয়ার নিয়ে সব স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। তার পরিবার খুশি। বিয়েও করতে চলেছে এক ভালো মনের মানুষকে। একটা ছোটো বাচ্চার মায়ের পরিচয় পেতে চলেছে। সে উপলব্ধি করলো, তার কপালের রগ গুলো ধপধপ করছে। মাথাব্যথা যে আবারও তাকে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিবে তা বুঝে ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার কফির সাথে একটা মাইল্ড ডো*জের স্লি*পিংপি-ল ও দুটো প্যা*রাসিটে*মল খেয়ে নিলো। টা*ফনি*ল তার পছন্দ না। কারণ টা*ফনি*লের অভ্যাস লেগে গেলে সেটার সাইড এ*ফেক্টও ভুগতে হবে। তারপর সে আলো নিভিয়ে মশারি দিয়ে শুয়ে পড়লো। নিজের ব্রেণকে বর্ণ সম্পর্কিত কিছুই চিন্তা করতে দিলো না।

__________

শেহজাদ, ফ্রিশাকে নিয়ে বাগানে কিছু ছোটো ছোটো চারা গাছ লাগাচ্ছে ও অন্যান্য গাছের মাটি ঠিক করে দিচ্ছে। কিছু ফুল ও ফলের গাছ নার্সারি থেকে কিনে এনেছে। গাছের যত্নের জন্য তাঁরা মালি রাখে না। টাইমপাস হিসেবে গার্ডেনিং বেশ ভালো একটা উপলক্ষ। কিছু গাছ ম*রে গেছিল, তাই সেসবের বিপ্লেসমেন্টে নতুন ও অন্যান্য গাছের চারা এনেছে। ফ্রিশা, পানির পাইপলাইনের ছোটো লিকেজের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ দুষ্টমি করে শরীরে কাঁদা মাখিয়ে এসেছে। শেহজাদ খানিক রাগ দেখিয়ে ওকে ব*কে,

“তোমাকে নিষেধ করেছিলাম না? তাও ওখানে গিয়েছ কেন?”

“সরি বাবা। আমি তো পাইপের ফুঁটোটা বন্ধ করতে গিয়েছিলাম!”

শেহজাদ আর কী বলবে! ফ্রিশাকে বাসার ভেতরে নিয়ে যায়। মিসেস শাহিদা ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিলেন। ফ্রিশার অবস্থা দেখে তিনিও রাগ করেন। অতঃপর ওকে ড্রেস চেঞ্জ করতে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিলেন। সার্ভেন্টকে ডেকে বললেন ফ্রিশার নোংরা করা কাপড় গুলো পরিষ্কার করে দিতে। শেহজাদ নিজের ঘরের দিকে যেতে নিলে মিসেস শাহিদা ডাক দিলেন।

“শেহজাদ, মীরার ফ্যামিলি জানালো এইনগেজমেন্টের ব্যাপারটার সামনের শুক্রবার করতে। আজ বা কালকের কথা বলাতে মীরা নাকি ভার্সিটির কাজের জন্য পিছিয়েছে।”

“ঠিক আছে সমস্যা নেই। বাকিটা আপনারা বুঝে নিন।”

শেহজাদও ফ্রেশ হতে চলে যায়। বেলা বারোটা বেজে গেছে। নামাজে যেতে হবে।

__________

সারাদিন মীরা ফোনে ফ্লাইট মুড দিয়ে রেখেছিল। ওয়াইফাই অন ছিল তাই জরুরী কিছু থাকলে ইমেইল ও হোয়াটসএপে সেরে নিয়েছে। রাতে ফ্লাইট মুড অফ করতেই প্রায় ঘণ্টা খানেক পর আবারও আরেকটা অচেনা নাম্বার থেকে কল আসা শুরু। মীরা এবার আর ফোন তুলল না। ফের ব্লক করলো।
আজ রাতেও ফ্রিশার সাথে কথা বলছে মীরা। হঠাৎ ফ্রিশা জিজ্ঞাসা করে,

“ফেইরি আন্টি, তোমার মন খারাপ?”

“না তো। কেন বাচ্চা?”

“ঠিক মতো কথা বলছ না।”

শেহজাদ পাশেই বসা ছিল। মেয়ে তো তার ফোন দিয়েই কথা বলছে। সে বলল,
“ফ্রিশা, তুমি এখন ঘুমাতে যাও। কাল আবার কথা বলো। আন্টিরও মেবি ঘুম পাচ্ছে।”

ফ্রিশা তার বাবার কথা শুনে মীরাকে জিজ্ঞাসা করে,
“তোমার ঘুম পাচ্ছে, ফেইরি আন্টি?”

মীরা কী বলবে না বলবে ভেবে শেহজাদের সাথে হ্যাঁ মিলালো। বলল,
“সরি ফ্রিশামনি, আন্টির একটু মাথা ধরেছে। কাল গল্প করব হ্যাঁ?”

“ওকে। টেক রেস্ট, ফেইরি আন্টি। গুড নাইট।”
“গুড নাইট, ফ্রিশামনি।”

মীরা ফোন কে*টে সবার আগে সিমকার্ড খুলে ফেলল। তারপর ফোন বন্ধ করে রাখলো।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-১২

0

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১২
মীরার বাবা-মা ও ভাই-ভাবিরা স্তব্ধ হয়ে গেল। তারা একে-অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। মীরার ছোটো ভাই মারুফ বলল,
“স্যার, আমি আপনাকে যথেষ্ঠ সম্মান করি। আপনার কাছে কি প্রস্তাবটা একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে না?”

“প্রস্তাবটা অন্যরকম সেটা আমিও মানি। কারণ, অন্যকারও স্বামীর স্ত্রী হওয়া সহজ কিন্তু অন্যকারও বাচ্চার মা হওয়া সহজ না। মাকে মমতাময়ী হতে হয়। বাঙালি মেয়েরা নিজের সন্তানের প্রতি মমতাময়ী হলেও স্বামীর পূর্বের স্ত্রীর সন্তানের প্রতি মমতাময়ী হতে পারে না। কিন্তু তাও আমি প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। কারণ মীরাকে আমার অন্যরকম মনে হয়েছে। সে গতানুগতিক ধারার না।”

ড: আকবর খানিক থামলেন। ফের কিছু বলবে তার আগে মীরার বাবা বলেন,
“দেখেন স্যার, মীরা যেহেতু আমার মেয়ে। সেইক্ষেত্রে মেয়ের জন্য ভালো কিছু দেখা আমার কর্তব্য। আমার মেয়েকে বিবাহিত ছেলের সাথে কীভাবে…! তাছাড়া মীরাকে আপনার অন্যরকম লাগলেই কি ও কারও সৎমা হিসেবে ভালো হবে? আমাদের সমাজে অনেক মেয়ে আছে যারা সৎমায়েদের কার্যক্রম শুনে কষ্ট পায়। কিন্তু পরবর্তীতে যখন ওরাই কারও সৎমা হয় তখন সেম কাজটাই করে।”

ড: আকবর রেহমান করুণ নয়নে চাইলেন। অতঃপর মলিন স্বরে বললেন,
“জানিনা, আমার কেন মনে হয়েছে। কিন্তু সেদিন ও-কে দেখার পর সত্যি মনে হয়েছিল। আমি সাথে সাথে প্রস্তাবও দিয়ে ফেলেছিলাম। এইতো কিছুদিন আগেও মীরা ভার্সিটিতে গিয়েছিল, কাজ শেষে ফ্রিশার সাথে কিছু কোয়ালিটি টাইম কাটিয়ে এসেছে।”

এবার রফিক তালুকদার ভ্রুকুঞ্চন করলেন। সতর্ক হয়ে শুধালেন,
“কোনদিন?”
“কিছুদিন আগে। জব ইন্টার্ভিউর জন্য এসেছিল তখন।”

মীরার বাবা এবার ভাবনায় পড়ে গেলেন। বিগত দিনগুলোর সব ঘটনা একে একে তার মস্তিষ্কে জড়ো হচ্ছে। দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোর প্রচেষ্টায় ফের একবার হতাশ হলেন। ভাবলেন, মেয়ের এখানেই পছন্দ। তাইতো ওসব কথা বলেছিল। এখন মেয়ের সাথে অমত করলে বরং হিতে বিপরীত হতে পারে। মীরার বাবা বললেন,

“মীরা রাজি হলে আমরাও রাজি।”

কিন্তু আপত্তি করল মীরার ছোটো ভাই মারুফ। সে বলল,
“কিন্তু বাবা? হতেও তো পারে মীরা বাচ্চা ভালোবাসে বলে ওই বাচ্চা মেয়েটাকে আদর করে। অন্যকারও বাচ্চার মা হওয়া সহজ কাজ নয়।”

মারুফকে জবাব দিল রুবেল। সে মলি জাহানের দিকে চেয়ে বলে,
“মীরা পারবে। ও ঠিক মায়ের মতো আগলাতে জানে।”

দৃষ্টি করুণ হলো রুবেলের। অক্ষিপল্লব ভারি হলো। সেইসাথে মলি জাহানেরও। রুবেল উঠে যেতেই মলি জাহানও আড়ালে চলে গেলেন। রফিক তালুকদার, উনার স্ত্রী ও বড়ো ছেলেকে উঠে যেতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এরপর ড: আকবর রেহমান ও রফিক তালুকদার আসরের নামাজ পড়তে মসজিদে গেলেন।

রুবেল ঘরে গিয়ে মীরাকে হোয়াটসএপে কল করে। মীরাকে সে নিজ থেকে অনুরোধ করবে। নিজের ঘরে আসার পথে মৃদুলার সাথে ফ্রিশাকে খেলতে দেখে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। বাচ্চাটা তো মৃদুলারই বয়সি হবে। তাহলে আরও ছোটো বয়সে মাকে হারিয়েছে।
মীরা ল্যাবে কাজ করছে। ইন্ডিয়ার সময়ে এখন বিকেল সাড়ে চারটা ছুঁইছুঁই আর বাংলাদেশের সময়তে পাঁচটা বাজতে চলল। কে*মি*কেল রি*য়াকশনের প্রসেসিং চলছে তাই মীরা অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ বড়ো ভাইয়ের কল আসাতে রাইমাকে বলে ফোন হাতে ল্যাব থেকে বেরোয়। মীরা বলে,

“হ্যাঁ ভাইয়া, বলো।”
রুবেল নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
“ওই ছোটো বাচ্চাটার মা হবি?”
“কোন বাচ্চা?”
ভাইয়ের মুখে হঠাৎ বাচ্চার কথা শুনে মীরা বুঝতে পারল না।
“ওই যে ফ্রিশা। ফুলের মতো বাচ্চাটার জীবনে মায়ের ভালোবাসা নিয়ে যেতে পারবি?”

মীরার বুক ধ্বক করে ওঠে। তার বড়ো ভাই এসব কীভাবে জানলো? প্রশ্নরা ঘুরপাক খাচ্ছে ভীষণ। জিভ দিয়ে নিজের শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয় ভিজিয়ে নিয়ে ফের শুধায়,
“তোমাকে এসব কে বলেছে?”
“তোর ডিপার্টমেন্টের চেয়ারপার্সন। স্যার আজকে আমাদের বাসায় এসেছেন।”

মীরা অবাক হয়ে গেল। কিয়ৎ মুহূর্ত কিছু বলতে পারলো না। রুবেল অস্থির হয়ে বলে,
“রাজি হয়ে যা মীরু! ফুলের মতো বাচ্চাটাকে নিজের আঁচলে আগলে নে। অন্য যেসব পাত্র আসছে তাদের থেকে ওই বাচ্চার বাবা অন্য সবদিকে এগিয়ে। কিন্তু পিছিয়ে একদিকেই, যে সে বিপত্নীক এবং এক বাচ্চার বাবা। আমি তোকে এই পিছিয়ে থাকা দিকটার জন্যই বলব। বল মীরু?”

“ভাইয়া, আমি পড়ে কথা বলছি। দেশে এসে কথা বলছি। বাবা-মাকে বলে দিও, আমার জব হয়ে গেছে। আমি সামনের সপ্তাহে দেশে ফিরব। ”

শেষোক্ত কথাটা শুনে রুবেল বেশ খুশি হয়। কিন্তু বোনের অস্বস্তি আন্দাজ করতে পেরে আর কথা না বাড়িয়ে অভিনন্দন জানিয়ে ফোন কে*টে দিলো। তারপর বাড়ির সবাইকে খবরটা জানাতে যায়।
ফোন ডিসকানেক্ট হওয়ার পর মীরা কী করবে বুঝতে পারছে না। একবার মনে হচ্ছে হ্যাঁ বলে দিক। ফের পরক্ষণেই মনে হচ্ছে, শেহজাদ স্যার কী ভাববেন! অস্বস্তিতে পড়ে যাচ্ছে নিমিষেই। তারপর নিজেকে শান্ত করতে ব্রিথ ইন ব্রিথ আউট টেকনিকটা প্রয়োগ করে নিজের কাজে গেল।

বাড়ির সবাই সহ ড: আকবর ও তার স্ত্রী মীরার জবের খবর শুনে খুব খুশি হয়। মীরা নিজে না জানানোতে মিসেস মলি জাহান একটু কষ্ট তো পেলেনই। কিন্তু তার মনে হলো, অন্যের মিথ্যে কথায় প্রভাবিত হয়ে তিনি মেয়েকে এত কিছু না বললেও পারতেন।

খেলতে খেলতে নিহান ফ্রিশাকে কা*ম*ড় দিয়ে বসলো। ফ্রিশার তারস্বরে চিৎকারে মিসেস শাহিদা সহ মলি জাহান, শারমিন, নিধি ছুটে গেল। নিধি তো বুঝেই গেছে এ তার বাঁ*দ*র ছেলের কাজ। ছেলেকে টেনে এনে দুয়েক ঘা ইতোমধ্যে লাগিয়েও দিয়েছে। নিহানও এখন চিৎকার করে কাঁদছে। মিসেস শাহিদা ও শারমিন টেনে ছাড়িয়ে নিয়েছে ওদের। মিসেস শাহিদা বলেন,

“ও কি বুঝে? এতটুকুন বাচ্চা। তুমি মা*র*লে কী-ভাবে?”
“ওর বাজে স্বভাব হয়ে গেছে। সবাইকে কা*ম*ড়াবে ও মা*রবে। বাবা, দাদা-দাদী ও বড়োমা-বড়োবাবার আহ্লাদে আরও বে*য়া*দব হচ্ছে। সিয়াম তো কী সুন্দর ভদ্র হয়ে থাকে।”

মলি জাহান ধ*ম*ক দিলো নিধিকে।
“থামো তুমি। ফ্রিশার হাতে স্যাভলন লাগিয়ে দাও। র*ক্তের ছাঁপ দেখা যাচ্ছে।”

নিধি দ্রুত ফ্রিশাকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে স্যাভলন বের করে তুলোতে নিয়ে আস্তে আস্তে লাগাতে থাকে। স্যাভলনের জ্বা*লাপো*ড়ার কারণে ফ্রিশা নিজেই কাতর হয়ে হাতে ফুঁ দিচ্ছে। নিধি আদুরে কণ্ঠে বলে,

“সরি বাচ্চা। আমি ওই বাঁ*দ*রকে আজ আচ্ছামতো বকে দিব।”

ফ্রিশা তার মিষ্টি কণ্ঠে বলে,
“নো আন্টি। হি ইজ সো কিউট। আমি ওর গাল টি*পে দেওয়াতে ও কা*ম*ড় দিয়েছে। ইট ওয়াজ মাই ফল্ট।”

নিধি কয়েক সেকেন্ড ফ্রিশার পানে নিরন্তর চেয়ে থাকে। তারপর ফ্রিশা চোখের সামনে হাত নাড়ালে দ্রুত দৃষ্টি হটিয়ে হেসে তুলোটা ফেলে দেয়।

________

শেহজাদ আমেরিকা থেকে ফিরে সব বাড়িতে ঢুকতেই ফ্রিশা ছুটে যায়। শেহজাদও মেয়েকে পরম আদরে কোলে তুলে নেয়। তারপর শুরু হয় ফ্রিশার কথা। কথায় কথায় সে বলে ফেলে,
“জানো বাবা, নতুন মাম্মামের বাসায় কতো মানুষ। সবাই আমাকে অনেক আদর করেছে। আমার মতো একটা কিউট গার্ল ও দুইটা কিউট বেবি বয়ও আছে। একটা বেবি বয় আমার হাতে ব্যাথা দিয়েছিল। এই দেখো (হাত দেখিয়ে)। তারপর বেবিটার আম্মু ও-কে মে-রে*ছেও! বেবিটাতো গালে হাত দেওয়াতে রেগে গিয়েছিল বলো। তারপর বেবিটার আম্মুটা আমার হাতে মেডিসিন লাগিয়ে দিয়েছে।”

শেহজাদ মেয়ের কথা শুনে খুব অবাক হয়। তার অনুপুস্থিতিতে সবাই এতো দূর এগিয়ে গেছে! ফ্রিশার মধ্যেও বেশ উৎসাহ দেখা যাচ্ছে। সে কী আদৌ বুঝে, নতুন মাম্মাম মানে কী? শেহজাদ হতাশ হয়। তারপর তার ফুফিকে ডাকে।

“ফুফিজান!”

মিসেস শাহিদা, উনার ছেলের ঘরে ছিলেন। শেহজাদের ডাক শুনে সেখানে আসেন।
“তুমি এখনও এখানে দাঁড়িয়ে? ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট করো। আর ফ্রিশা, তোমার বাবা এখন টায়ার্ড না? কোল থেকে নেমে পড়তে বসো। কয়েকদিন পর পরীক্ষা তোমার। আমি কিন্তু তোমার লেখা চেক করব।”

“যাচ্ছি দাদুমনি। বাবাকে স্টোরি বললাম। বাবা, গো এন্ড রেস্ট।”

এই বলে ফ্রিশা কোল থেকে নেমে ছুটে চলে যায়। ফ্রিশা যেতেই শেহজাদ ক্লান্ত কণ্ঠে শুধায়,
“কাল আপনারা কোথায় গিয়েছিলেন?”

মিসেস শাহিদা খানিক ঘাবড়ালেন। অতঃপর কণ্ঠে স্বাভাবিকতা প্রকাশ করে বললেন,
“তোমার ফুফা, যেই মেয়ের কথা বলেছিল, সেই মেয়ের বাড়িতে।”
“কেন? কী লাভ?”
“তুমি অযথা হতাশ হচ্ছো শেহজাদ। সেই মেয়েটির পরিবার কিন্তু অনেকটাই রাজি। এখন মেয়ে দেশে ফিরলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে। আমার কিন্তু শতভাগ মনে হচ্ছে, মেয়েটি রাজি হয়ে যাবে। ফ্রিশাকে তো পছন্দ করে মেয়েটা।”
“আপনারা কার কথা বলছেন?”

শেহজাদের কণ্ঠে সন্দেহের সুর। মিসেস শাহিদা কথা কা*টাতে চাইলেন।
“সেটা তুমি পরে ঠিকই জানতে পারবে। আগে তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাক। এখন যাও গিয়ে ফ্রেস হয়ে রেস্ট করো।”

এটা বলেই আর কালক্ষেপণ না করে মিসেস শাহিদা দ্রুত স্থান ত্যাগ করলেন। শেহজাদ পিছু ডাকলেও ফিরলেন না। অতঃপর শেহজাদ ঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হয়। যাওয়ার আগে সার্ভেন্টকে ডেকে দশ মিনিট পর কড়া করে কফি বানিয়ে পাঠাতে বলে। এখন সে এসব নিয়ে ভাবতে নারাজ। যা হবে পড়ে দেখা যাবে।

_________

মীরা ও রাইমা কফি নিয়ে ব্যালকনির ফ্লোরে ম্যাট বিছিয়ে বসে কাচের থাই গ্লাসে পিঠ ঠেকিয়ে রেখেছে। দুজনের নিরন্তর দৃষ্টি আকাশের ওই থালার মতো শুভ্র রঙের পূর্ণ চন্দ্রের দিকে। সব লাইট বন্ধ করে চাঁদের জোৎস্না উপভোগ করছে দুই বান্ধবী। পাশে সাউন্ড বক্সে সফট মিউজিক টোন বাজছে। নীরবতার সুতা কে*টে রাইমা ভাবলেশহীন কণ্ঠে শুধায়,

“আমাদের আর দেখা হবে না। তাই না?”

মীরা রাইমার দিকে ফিরলো। কাল সন্ধ্যায় তার ফ্লাইট। রাইমার নীরবতাই তাকে ওর কষ্টটা বুঝিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটা তো নীরব থাকার মতোই না! মীরা বলে,
“হবে। দূরত্বে কী বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়? তুই সারাজীবন আমার প্রিয় রাই হয়ে থাকবি। আমিও মাঝেমাঝে তোকে দেখতে না বলে চলে আসব।”

“সত্যি আসবি?”
“হুম।”
আবারও নীরবতা। মীরা ঝাপসা দৃষ্টিতে ফের আলোকিত চাঁদকে দেখতে থাকে। রাইমার চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রুজল তার কফির মগে টুপ করে পড়লো।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-১১

0

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১১
কলিংবেল চেপে অপেক্ষা করতে থাকে মীরা। ঘড়িতে এখন চারটা বেজে উনিশ মিনিট। জ্যামে বড্ড ফেঁসে গেছিলো। মেট্রোর কাজ ও সেইসাথে রাস্তা মেরামতের জন্য জ্যাম। দরজা খুলল মীরার মা মিসেস মলি জাহান। মীরা লক্ষ্য করল, তার মায়ের চেহারার হাবভাব সুবিধার না। মীরা শুধালো,
“কী হয়েছে মা?”

মলি জাহান কোনো জবাব না দিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। মীরা ভেতরে এসে ড্রয়িংরুমে উুঁকি দিয়ে দেখল, তার বাবা কপালে হাত দিয়ে বসে আছেন। মীরা ঘুরে চলে যেতে নিলে রফিক তালুকদার ডাকেন। মীরা দাঁড়ালে তিনি মেয়ের দিকে না তাকিয়েই বলেন,

“তোমার বিয়ে এবার তুমি নিজে ঠিক করো। তুমি নিজে যেমন ছেলে পছন্দ করবে, আমি এবং আমরা তাতেই রাজি। ছেলের যদি আগে বিয়েও হয়ে থাকে তাতেও কোনো বাধা দিব না।”

মীরা কোনো প্রত্যুত্তর না করে সেখান থেকে সরে আসে। নিজের ঘরে গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। বিছানায় গা এলিয়েছে মাত্র তখনি হঠাৎ দরজায় ধুমধা*ম শব্দে কপাল কুঁচকে বিরক্তিতে উঠে বসে। দরজা খুলতেই নিজের গালে সপা*টে চ*ড় পড়ার অনুভূতি হলো তার। আচমকা কাণ্ডে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গালে হাত দিয়ে সামনে দাঁড়ানো নিজের মায়ের পানে বিরতিহীন চেয়ে রইল। মিসেস মলি জাহান ক্রুদ্ধ কণ্ঠে কাঁপতে কাঁপতে বলেন,

“তোর যদি পছন্দ থেকেই থাকে তবে আমাদের এত অপমান করালি কেন? নিজের নিচু মানসিকতার কথা বাহিরের মানুষকে বললি কেন? আমরা কি তোর উপর কোনোকিছু জোর করে চাপিয়েছি? তুই বলেছিস, তোর কোনো পছন্দ নাই। তাই আমরা ছেলে দেখেছি। মানুষের বয়স কি বসে থাকে? বাসায় অবিবাহিত বিবাহযোগ্যা মেয়ে থাকলে আশেপাশের মানুষ কি খুব ভালো বলে?”

মীরার নেত্রযুগল ভারী হলো। উপচে উঠেছে জলরাশি। মনে হচ্ছে সাগরে জোয়ার এসেছে। ঝাপসা দৃষ্টিতে মায়ের পেছনে দুই ভাবিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। তাঁরা ইশারায় কিছু বলছে কিন্তু মীরা বুঝতে পারছে না। তার মা, যে কী-না তার গালে থা*প্প-ড় দেওয়া তো দূর, একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর গায়ে হাতও তুলেনি! সেই মা আজ তাকে..!
মীরাকে চুপ থাকতে দেখে মিসেস মলি জাহান ফের অশ্রসিক্ত নয়নে চেয়ে বাঁজখাই গলায় শুধালেন,

“কে সেই লোক? যাকে তুই… ছিহ্! আমার বলতেও বাধছে। আমার মেয়ে এমন করতে পারে তা আমার কল্পনাতেও আসছে না। ওই ঘটক আজকে রাদিব ও তার বউকে নিয়ে এখানে এসেছিল। রাদিবের বউ নিজ মুখে বলেছে, তুই নাকি ও-কে ব্ল্যা*ক-মেই-ল করে এসব করিয়েছিস। তোর এক বিবাহিত লোকের সাথে সম্পর্ক আছে। এটা তুই নিজে রাদিবকে বলেছিস। এইসব কিছু ওরা আজকে পাত্রপক্ষের সামনে বলেছে। তুই একটা মেয়ের সংসার ভাঙছিস! রাদিব তো নিজের উপর আনা মিথ্যা আরোপ পরিবারের কথা চিন্তা করে মেনে নিয়েছে। কিন্তু আমাদের মান-সম্মানের কী হবে? ভেবেছিস একবারও?”

মীরা কিছু বলার মত ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। এতোকিছু কী হলো? কীভাবে হলো? কিছুই তার মস্তিষ্ক নিতে পারছে না। মীরা ধপ করে বিছানায় বসলো। মীরার মা কাঁদতে কাঁদতে হাঁপাচ্ছেন। শারমিন এগিয়ে এসে জোর করে শাশুড়িকে সেখান থেকে নিয়ে যায়। নিধি মীরার ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে কিছুক্ষণ আগের সব কাহিনী খুলে বলে। সব শুনে মীরা তার ভাবিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

“বিশ্বাস করো ভাবি, আমার সাথে এখন কারো সম্পর্ক নেই। তোমরা তো বর্ণর কথা জানতে। বর্ণর পর আমি কারো সাথে কোন সম্পর্কে যাইনি। আর সংসার ভাঙ্গা! আমি ওরকম মেয়েই না। হ্যাঁ, সেদিন আমি রাদিবকে রাগের মাথায় বলে ফেলেছিলাম যে আমি ও-কে বিয়ে না করে যদি এক বিপত্নীক ও এক বাচ্চার বাবাকেও বিয়ে করি, তাও ভালো। কিন্তু সে যে আমার কথার এই অর্থ বের করে সেটাকে রাঙিয়ে বিশ্রি ভাবে প্রেজেন্ট করবে! আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি।”

নিধি হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
“কি বলব বলো? রাদিব যে তোমার উপর প্রতি*শো*ধ নেওয়ার জন্য এই খেল খেললো, সেটা তো আমি ও বড়ো ভাবি বুঝতেই পেরেছি। ওরা আমাদেরকে যা নয় তাই বলে গেল। নিজের ছেলে-মেয়েদের সম্পর্কে এসব কথা শুনলে কোন বাবা-মা ঠিক থাকতে পারে বলো?”

“তাই বলে আমাকে এরকমটা ভেবে নিবে? উনারা উনাদের মেয়েকে চেনে না? উনাদের মেয়ে কারো সংসার ভাঙার মত মেয়ে এটাই ভাবল? তাহলে তো আমি বর্ণর সংসারই ভাঙতে পারতাম। আমি কি পারতাম না? বর্ণর স্ত্রীকে বলতে? বর্ণ আমাকে চিট করেছে সেটা? আমি কি করেছি?”

“তুমি শান্ত হও। আমি তোমার ভাইকে বলেছি। ভাবিও বড়ো ভাইয়াকে বলবেন। রাতে বাবা-মাকে বুঝাব সবাই। কেঁদো না তুমি।”

নিধি নিজে মীরার চোখ মুছিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ বুকে আগলে রেখে একা থাকতে দিয়ে চলে যায়। মীরা দরজা লাগিয়ে বারান্দায় গিয়ে ফ্লোরে বসে। যান্ত্রিক শহরে মন বোঝার মানুষের অভাব হলেও ভুল বোঝার মানুষের অভাব হয় না। মীরা কিছু সময় পশ্চিম আকাশ পানে কাতর নয়নে চেয়ে থেকে। তার দৃষ্টিতে একরাশ অভিমানে ভরপুর। আকাশের দিকে চেয়ে থাকলে নিজেকে হালকা লাগে। তারপর উঠে গিয়ে অজু করে এসে নামাজে বসে।

______

রাস্তায় রাদিবকে বেশ অনেকটা উৎফুল্লিত দেখে হতাশ হয় জুলি। আজ রাদিবের হু*মকিতে বাধ্য হয়ে মিথ্যা কথা বলতে হয়েছে তাকে। তাদের বিয়ের দুইটা সপ্তাহ পেরোলেও, রাদিব তাকে আগের মত ভালোবাসে না। ভালোবাসা পেতে আজ সে একটা মেয়ের নামে মিথ্যা বলে আসলো। তার খারাপ লাগছে কিন্তু কী করবে? অনেক ভালোবাসে যে! জুলি ভাবতে থাকে, ‘আমরা যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি, আঘা*তটা সেখান থেকেই পাই! এই তবে ভালোবাসা!’ জুলি সিটে মাথা এলিয়ে নির্নিমেষ জানালা দিয়ে বাহিরে চেয়ে থাকে।

রাদিব ফুরফুরে মনে বসে কানে হেডফোন গুজে গান শুনছে। মীরা তাকে যা অপমান করেছে, সব কড়ায়গণ্ডায় শোধ করে দিয়ে এসেছে। মীরা তাকে তার পরিবারের কাছে খারাপ বানিয়েছে, সে মীরাকে পরিবার ও বাহিরের মানুষের সামনে খারাপ বানিয়ে দিয়ে এসেছে। এখন সে নিজেকে জয়ী ভাবছে।

________

দুইদিন যাবত মীরা ঘর থেকে বের হয় না। কখোনো শারমিন বা কখোনো নিধি এসে ওর খাবার ঘরে দিয়ে যায়। আজ ইন্টার্ভিউ আছে তাই সবকিছু একসাথে নিয়ে বের হলো। শারমিন তা দেখে প্রশ্ন করে,

“ইন্টার্ভিউ দিয়ে বাড়িতে আসবে না?”

“না ভাবি। ওখান থেকেই চলে যাব।”

“কী বলো! তোমার ফ্লাইট তো সন্ধ্যায়। এত সময় কী করবে?”

“যাই করি সময় কেটে যাবে। আসি ভাবি।”

এবার নিধি আটকাতে চাইলে মিসেস মলি জাহান কঠিন স্বরে বলেন,
“শারমিন, নিধি, যে যেতে চাচ্ছে তাকে আটকানোর প্রয়োজন নেই। যেতে দাও।”

নিধি কিছু বলতে নিবে তখনি মীরা মলিন হেসে ইশারায় মানা করে। অতঃপর বেরিয়ে পড়ে।

_______

সেমিস্টার ব্রেকে শেহজাদ, ফ্রিশা ও ড: আকবর তার স্ত্রী-ছেলেকে নিয়ে আমেরিকায় গিয়েছেন। উদ্দেশ্য ড: আকবরের ছেলে আবিরকে ডাক্তার দেখানো। উনারা জানেন যে আবির কখোনো স্বাভাবিক হবে না। কিন্তু তাও চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এরইমধ্যে একটু হালকা ঘোরাফেরাও হয়ে যাবে। ফ্রিশা তার বাবার সাথে নানাভাই ও মায়ের দাদুর ক*বর দেখতে এসেছে। এখানকার ক*বর গুলোতে সব প্লাস সাইন দেওয়া। ফ্রিশা প্রশ্ন করে,

“বাবা, এখানে ক*বরে প্লাস সাইন কেন? মাম্মামেরটাতে তো নেই।”
শেহজাদ হালকা হেসে জবাব দেয়,
“এখানে যাদের ক*বর দেওয়া হয়েছে, সবাই অন্য ধর্মের তাই। এটা রিলিজিয়াস মেটার।”

কিন্তু ফ্রিশার মনের কৌতুহল দমেনি। সে পালটা প্রশ্ন করে,
“ওরা তো মাম্মামের পাপা ও দাদুমনি। তাহলে একইরকম না কেন?”

“তুমি বড়ো হলে বুঝবে, বাচ্চা। এটা মনে রাখো, ইন দিস ওয়ার্ল্ড, দেয়ার ইজ সো মেনি রিলিজিয়ন। সব রিলিজিয়নে একজন বিধাতাকে বিভিন্ন নামে ডাকে। যার যার বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে। যেমন, আমরা এক আল্লাহকে মানি। তাই আমরা মুসলিম।”
(এলার্ট: আমি কোনো ধর্মকে হার্ট করতে চাই না। ফ্রিওনা রূপান্তরিত মুসলিম। ফ্রিশার মনের প্রশ্নকে যতটা সহজ করে উত্তর করা যায় করেছি।)

ফ্রিশা মিষ্টি করে হেসে বাবার হাত ধরে চলে আসে।

_______

ড: আকবর আজকে মীরাদের বাড়িতে এসেছেন। সাথে এসেছে তার স্ত্রী, পুত্র ও নাতনী ফ্রিশা। শেহজাদ এই ব্যাপারে কিছু জানে না। শেহজাদ এখনও আমেরিকা থেকে ফেরেনি। একটা কাজে আটকে পড়েছে। ড: আকবর তার স্ত্রী-ছেলে ও নাতনীকে নিয়ে গতকাল ফিরে এসেছে। তিনি এসেছেন মীরার বাবার সাথে কথা বলতে। প্রথমে এসেই নিজের পরিচয় দেওয়াতে মীরার পরিবার তাদেরকে সাদরে আপ্যায়ন করে। মিসেস শাহিদা বলেন,

“আমরা এখানে একটা উদ্দেশ্যে এসেছি। আপনারা প্লিজ বিব্রত হবেন না। বিষয়টা ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখবেন আশা করি।”

মিসেস মলি জাহান স্বামীর মুখপানে একবার চেয়ে হালকা হেসে বলেন,
“আপনি বলেন, আপা। আমরা কিছু মনে করব না।”

মিসেস শাহিদা তার ছেলে ও নাতনীকে দেখিয়ে বললেন,
“ও হচ্ছে আমাদের একমাত্র ছেলে আবির। আর ও(ফ্রিশাকে দেখিয়ে) হচ্ছে ফ্রিশা। আমার ভাইয়ের ছেলের ঘরের নাতনী। ফ্রিশার বাবা মানে আমার ভাতিজা শেহজাদও মীরার টিচার। শেহজাদ অ্যাসিসট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে আছে। ভাই-ভাবি আমেরিকার সিটেজেনশীপ পাওয়ার পর শেহজাদ আমেরিকায় গিয়ে অনার্সে ভর্তি হয়। তারপর সেখান থেকে একেবারে পিএইচডি করে আমাদের অনুরোধে দেশে আসে। ভাই-ভাবিও পরে চলে এসেছিল। উনারা এখন আর বেঁচে নেই। শেজজাদও আমাদের ছেলেই। আমাদের নিজেদের ছেলে তো জন্ম থেকে এমন। এই শেষ বয়সে শেহজাদ ও ফ্রিশা আছে বলেই আমরা কিছুটা ভালো আছি।”

কথা বলতে বলতে মিসেস শাহিদা হালকা হাতে টিসু দিয়ে চোখ মুছলেন। উপস্থিত সবাই নীরব। মিসেস মলি জাহান ফ্রিশাকে নিজের কাছে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন,

“ওর মা কোথায়?”

“দুই বছর আগে নিজের জেদ আঁকড়ে দ্বিতীয় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে ও-কে মা-হারা করে চলে যায়।”

মিসেস মলি জাহান আফসোস করেন। নিধি ও শারমিন আড়ালে দাঁড়িয়ে কিছু একটা সন্দেহ করছে। মীরার ভাইয়েরা বসে থেকে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। নিধি কিছু একটা ভেবে ফ্রিশাকে মৃদুলার সাথে খেলার কথা বলে নিয়ে যায়। এবার ড: আকবর রেহমান বলেন,

“জানিনা আপনারা কীভাবে কী নিবেন। আমাদের স্বা*র্থপরও ভাবতে পারেন। আসলে আমরা নিজেদের স্বার্থেই এসেছি।”

মিস্টার রফিক তালুকদার এবার সন্দিহান হলেন। তিনি প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শুধালেন,
“জি বলেন।”

“আমরা শেহজাদের জন্য মীরার হাত চাইতে এসেছি। ফ্রিশার জন্য একটা মায়ের সন্ধানে এসেছি। যে শেহজাদ ও ফ্রিশার জীবনের অপূর্ণতা পূর্ণ করবে।”

মীরার বাবা-মা ও ভাই-ভাবিরা স্তব্ধ হয়ে গেল। তারা একে-অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-১০

0

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১০
চৈত্রের শেষ দিন। আজ ফ্রিওনার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। ছুটির দিন হওয়ায় শেহজাদ, ফ্রিশা ও ফ্রিশার দাদুমনি, দাদুভাই, চাচ্চুকে নিয়ে এক পরিচিত এতিম খানায় এসেছে। এতিম বাচ্চাদের জন্য আজ শেহজাদ দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করেছে। আসছে পর থেকে ফ্রিশা বাচ্চাদের সাথে খেলছে। শেহজাদ দাঁড়িয়ে থেকে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে সেই দৃশ্য দেখছে। হুট করে ফ্রিশা দৌড়াদৌড়ির মধ্যে একটা ইটের সাথে লেগে পড়ে যায়। ফ্রিশা কান্না করার আগেই শেহজাদ তা দেখে ছুটে যায়। হাঁটু ও হাতের কনুই ছিঁ*লে র*ক্ত বের হচ্ছে। আরও কয়েক জায়গাতেও ব্যাথা পেয়েছে। ওখানে ইটের সুড়কিও ছিল। ফ্রিশা ইতোমধ্যে ঠোঁট ভেঙে কাঁদছে। শেহজাদ ওকে কোলে করে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসায়। তারপর গাড়িতে থাকা ফার্স্টএইড বক্স থেকে তুলো ও সেভলন নিয়ে আস্তে আস্তে ড্রেসিং করছে। মিসেস শাহিদা তার অসুস্থ ছেলের হুইলচেয়ার আগলে গাড়ির কাছে আসেন। তারপর ফ্রিশার কা-টা স্থান দেখে আফসোস করে বললেন,

“ইশ! কতোটা ছিঁ*লে গেছে দেখেছ! বারবার মানা করার পরেও সেই দৌড়াদৌড়ি করছেই। এখন ব্যাথাটা কে পেল? শেহজাদ, চলো বাড়ি ফিরে যাই। তোমার ফুফাকে কল করে আসতে বলি। বাচ্চাদের খাওয়াও তো শেষ। ফ্রিশাকে এখন মেডিসিন খাওয়াতে হবে। নয়তো জ্বর এসে যাবে।”

“হ্যাঁ। আমি ওকে মেডিসিন খাইয়ে দিচ্ছি। আপনি ওর কাছে থাকুন। স্যারকে আমি ডেকে আনছি।”

শেহজাদ ফ্রিশাকে সিটে ঠিক করে শুইয়ে দিয়ে হাঁটুর নিচে কুশন দিয়ে চলে যায়। একটু পর ড: আকবর রেহমানকে ডেকে নিয়ে এসে গাড়িতে উঠে বাড়ি ফিরে আসে।

___________

শনিবার দুপুরের দিকে মীরার কাছে ইন্টার্ভিউয়ের জন্য মেইল এসেছে। সোমবার তার ইন্টার্ভিউ। মীরা লাঞ্চ ব্রেকে মেইলটা দেখে রাইমাকে জানাতে চাইলো। রাইমা সবে স্যান্ডুইচে কয়েক বা**ই*ট দিয়েছে। তখন সামনে বসা মীরাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঞ্চন করে প্রশ্ন ছু*ড়ে,

“কী-রে? খাচ্ছিস না কেন?”

বলে আবার খেতে লাগে। মীরা ইতিউতি করে বলে,
“আসলে, আমি কালকে ঢাকা যাব।”

রাইমার মুখে খাবার থাকায় সে ইশারায় কারণ জানতে চায়। জবাবে মীরা বলে,
“সোমবারে ইন্টার্ভিউ আছে।”

রাইমা চকিতে চাইলো। মুখের খাবারটা গিলে হড়বড়িয়ে শুধায়,
“ইন্টার্ভিউ মানে? কী-সের?”

“ভার্সিটিতে এপ্লাই করেছিলাম। ওরা ডেকেছে।”

“কবে করলি? আমাকে তো বললি না।”

রাইমা উতলা হয়ে আছে। সেইসাথে তার অভিমান মিশ্রিত সুর। মীরা লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“দেখ রাই, তুই তো জানিস সব। আব্বু-আম্মু দেশে ফিরতে বলছে। ফোন করলেই বলে। জিনিয়া পরশু রাতে জানালো একটা ভালো বি ক্যাটাগরির প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির সার্কুলার ছেড়েছিল এবং ওইদিনই এপ্লাইয়ের লাস্ট ডেইট ছিল। ও একপ্রকার জোর করেই এপ্লাই করিয়েছে। তাছাড়া আমিও তো ভালো অপশন খুঁজছিলাম। এটা ভালোই লাগলো। আমি এ ক্যাটাগরির প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে পড়াশোনা করেছি। সেখানে সিজিপিএ ৩.৮ মানে অনেক ভালো রেজাল্ট। টিচিং প্রফেশনটা ভেবেছিলাম যদিও বা কখোনো জয়েন করি তবে পিএইচডি করলে তারপর। এখন জিনিয়ার কথায় ভেবে দেখলাম মন্দ হয় না ব্যাপারটা।”

রাইমা হতাশচিত্তে স্যান্ডুইচে কা**ম*ড় দিয়ে বলে,
“ওকে, তবে চলে যাচ্ছিস?”

মীরা মলিন দৃষ্টিতে চাইলো। রাইমা দৃষ্টি নিচু করে ফের বলে,
“অবশ্য যেতে তো একদিন হবেই। কতোদিন আর একা অন্য একটা দেশে পড়ে থাকবি!”

“প্লিজ ইয়ার। এভাবে মুখ ভাড় করে থাকিস না।”

মীরার করুণ স্বরে রাইমা ছোটো করে হেসে বলে,
“আমি তোর কারণে কষ্ট পাইনি। কিন্তু তোকে ছাড়া থাকতে হবে এটা ভেবে খারাপ লাগছে। কষ্ট হচ্ছে। অভ্যাস হয়ে গেছিস তুই। তিন বছর হতে চলল আমাদের ফ্রেন্ডশিপের। তোর মনে আছে? প্রথমদিন? আমরা দুজন বাঙালি। বাকিরা আমাদের ভাষা ঠিকঠাক বুঝে না। অন্যকারও সাথে মন খুলে কথাও বলতে পারতাম না। তখন তোর সাথে নিজের ভাষাতে কথা বলে শান্তি পেতাম। তারপর থিউরির সব ক্লাস শেষ হওয়ার পর জাস্ট রিসার্চের সময় এই ছোটো ফ্লাটে চলে আসলাম। রিসার্চের জন্য ভার্সিটির ল্যাবে রাত ৯-১০টা অবধিও মাঝেসাঝে থাকতে হতো। দুই বছর হবে এই ফ্লাটটাতে।”

মীরার চোখে পানি জমলো। যেকোনো সময় গাল গড়িয়ে দরিয়া বইতে সময় নিবে না। রাইমারও একই অবস্থা। রাইমা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

“এখন ইমোশোনাল না করে খা তো। টাইম নেই।”

অতঃপর সে মাথা নিচু করে দ্রুত খেতে লাগলো। মীরা হালকা হেসে খেতে শুরু করে।

________

ইন্টার্ভিউ দিয়ে মীরা বের হলো। ইন্টার্ভিউ ভালোই হয়েছে। এটাতে টিকে গেলে আরেকটা ইন্টার্ভিউ হবে। ৪-৫দিনের ছুটিতে এসেছে। ছুটি নিবে বলে রবিবারও সন্ধ্যা অবধি জব করে তারপর রাত আটটার ফ্লাইটে দেশে এসেছে (যদিও এসব আন্দাজ করে বলা)। কালকে একবার ভার্সিটিতেও যেতে হবে।

বাড়ি ফিরে মীরা হতবাক! ভাবির কাছ থেকে জানলো ঘটক কিছু ছেলের ছবি ও বায়োডাটা নিয়ে এসেছে। এবারে আবার প্রথম ঘটক। দ্বিতীয় জনকে আর বলেনি। শারমিন বলে,

“এবারে সব প্রবাসী ছেলের বায়োডাটা নিয়ে এসেছে।”

মীরা সাফসাফ মানা করে দেয়,
“আমি প্রবাসী বিয়ে করব না। আমি দেশে জবের জন্য ইন্টার্ভিউ দিতে এসেছি, দেশে জব করলে হাসবেন্ড প্রবাসে থাকবে এটা কেমন? দ্বিতীয়বার যারা দেখতে এসেছিল, ওদের তো আমাকে নিয়ে দুটো প্রবলেম ছিল। আমি জব করি আবার ইন্ডিয়াতে। যদিও আমি ওদের মনোভাবে বুঝেই বলেছিলাম যে ওই জবটাই করব। ওদের আমার জব করাটা নিয়েই আসল আপত্তি ছিল। কিন্তু এখন আমি যখন পিএইচডি করব, তখন তো প্রবাসী কাউকে বিয়ে করলে সে আমার জন্য নিজের জব ছেড়ে সেই দেশে শিফট হবে না। প্রবাসীদের ফ্যামিলি বউকে চোখে চোখে রাখে। আবার হাজারটা রোস্ট্রিকশন। দেখব যে আমাকে বাড়ি থেকে বেরোতেই দিবে না।”

নিধি ও শারমিন বিষয়টা ভাবলো। অতঃপর নিধি বলল,
“তুমি বাবাকে এখন কিছু বলো না। চুপচাপ থাকো। যেই কাজের জন্য এসেছ, সেটা করো।”

শারমিনও হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলিয়ে বলে,
“হুম। ঠিক তাই। তাছাড়া কয়েকদিন পর নতুন সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হবে। তার আগেই সব ফাইনাল করতে হবে। তাই মনে হয় যদি সিলেক্ট হয় তবে দ্রুতই হবে। তুমি সেসব চিন্তা করো না। ফ্রেশ হয়ে আসো। তারপর খেয়ে নাও। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে।”

“হুম।”

মীরা নিজের ঘরে ফ্রেশ হতে চলে যায়।

বিকেলে মীরার বাবা মীরাকে ডেকে জানায়,
“আগামীকাল তোমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। তৈরি থেকো।”

মীরা খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে বলে,
“আসুক। আমি কাল একবার ভার্সিটিতে যাব। কাজ আছে।”

রফিক তালুকদার পালটা কিছু বলবেন, তার আগেই মীরা সেখান থেকে চলে আসে। আসর ও মাগরিবের নামাজ পড়ে একটু ঘুমাবে।

_______

শেহজাদ আজ ফ্রিশার ক্লাস শেষে স্কুল থেকে সরাসরি ভার্সিটিতে নিয়ে এসেছে। কারণ, মিসেস শাহিদা উনার ছেলে শাদিবকে নিয়ে হসপিটালে যাবেন। ফ্রিশা তো একা বাড়িতে থাকতে পারবে না। তাই নিয়ে এসেছে। এখানে এসে ফ্রিশা বেশ খুশি। কিছুটা সময় তার বেশ আনন্দেই কে*টেছে। বাড়ি ফেরার সময় ফ্রিশা তার দাদাভাইকে বলে,

“দাদাভাই, আমি কিন্তু কালকেও আসব।”

শেহজাদ সামনে ড্রাইভ করতে করতে প্রশ্ন ছু*ড়ে,
“কেন? আজ তোমার দাদুমনি ছিলেন না বলে নিয়ে এসেছি। কালকে তো তিনিই তোমাকে আনতে যাবেন।”

ড: আকবর বলেন,
“আহ্হা শেহজাদ, আসুক না। আমিই ড্রাইভারকে বলে ও-কে আনিয়ে নিব। আজকে ও কতো অানন্দ করেছে।”

“কী দরকার? ফুফিমনি বাসায় একা থাকবেন। তাছাড়া ওর হোমওয়ার্কগুলো বাকি থেকে যাবে। আজকেও তো করেনি।”

“থাকুক। কালকে ও আগে আমার কাছে বসে হোমওয়ার্ক করবে। তারপর খেলবে।”

“পরে কিন্তু প্রতিদিন আসতে জেদ করবে!”

ফ্রিশা দ্রুত জবাব দেয়,
“করব না। প্রমিস। প্লিজ বাবা। জাস্ট ফর টুমোরো।”

শেহজাদ হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
“ওকে। বাড়ি ফিরে আগে সব হোমওয়ার্ক শেষ করবে।”

ফ্রিশা খুশি হয়ে আনন্দ ধ্বনি করে তার দাদাভাইকে জড়িয়ে ধরে। শেহজাদ লুকিং মিররে তা দেখে হালকা হাসে।

______

মীরা ভার্সিটিতে এসেছে কিছু পেপারওয়ার্ক করতে। চেয়ারপার্সনের রুমের বাহিরে ফ্রিশাকে দেখে কিছুটা অবাক হয়। ফ্রিশা তাকে দেখে ছুটে এসে উৎফুল্ল চিত্তে বলে,

“হাই আন্টি। হাউ আর ইউ?”

মীরা একটু নিচু হয়ে ফ্রিশাকে আদর করে বলে,
“অ্যাই অ্যাম ফাইন। হাউ আর ইউ বার্বিডল?”

“এতোগুলা হ্যাপি!”

ফ্রিশার জবাবে ও জবাব দেওয়ার ভঙ্গিতে মীরা হেসে ফেলে। মীরা ওর ড্রেসআপ দেখে জিজ্ঞাসা করে,
“তুমি স্কুল থেকে এসেছ?”

“হুম। বাবা তো রাজিই হচ্ছিল না। দাদাভাই বলাতে রাজি হয়েছে।”

“ওহ আচ্ছা।”

“তুমি ক্লাস করতে এসেছ?”

মীরা হেসে জবাব দেয়,
“না বাচ্চা। আমি একটা কাজে এসেছি। একটু পর চলে যাব।”

ফ্রিশা মন খারাপ করে বলে,
“কিছুক্ষণ থাকো না। আমি তোমার সাথে খেলব। আন্টিরা বিজি এখন।”

মীরা ভাবলো কিছু। তার মা পইপই করে বলে দিয়েছেন যেন বিকেল চারটার আগে বাসায় আসে। এখন ঘড়িতে প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। ফ্রিশার সাথে কিছু সময় থাকতে পারবে। অতঃপর রাজি হয়ে গেল মীরা। নিজের কাজটা শেষ করতে আগে চেয়ারপার্সনের অফিস রুমে যায়। ড: আকবর রেহমান, মীরাকে দেখে খুব খুশি হোন। ফ্রিশা ছিল বলে তিনি মীরাকে আজকে কাজ ছাড়া বেশি কিছু বলেননি। তারপর মীরা ও ফ্রিশা ভার্সিটি ট্যুর দিতে বেরিয়ে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করার পর ওরা ভার্সিটির কাছে এক রেস্টুরেন্টে যায়। খাওয়া-দাওয়া শেষে মীরার হঠাৎ সময়ের কথা খেয়াল হলে সে ফোনের স্ক্রিণে সময়ের দিকে নজর দেয়। প্রায় দুপুর দুইটার ঘর ছুঁইছুঁই। মীরা তড়িঘড়ি করে ফ্রিশাকে বলে,

“ফ্রিশা, চলো। আন্টির এবার যেতে হবে। নয়তো আন্টির মা আন্টিকে ব*কবে।”

ফ্রিশা মুখ ছোটো করে বলে,
“এখনি চলে যাবে?”

“হুম। তোমার বাবাও তো তোমাকে খুঁজেছিল। তোমার দাদাভাই কলও করেছিল। বেশি দেরি করলে টেনশন করবে তো।”

“ওকে চলো।”

মীরা, ফ্রিশাকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে ভার্সিটিতে যায়। এদিকে শেহজাদ চেয়ারপার্সনের রুম থেকে অস্থির পায়ে বেরিয়ে ফোন কানে নিয়ে লিফ্টের দিকেই আসছিল। তখনি মীরার ফোন বেজে ওঠে। মীরা তখন সবে লিফ্ট থেকে নামবে। ব্যাগ থেকে ফোন বের করতে করতে লিফ্ট থেকে নামা মাত্রই কেউ একজন ছোঁ মে*রে ফ্রিশাকে নিজের কাছে নিয়ে নিয়েছে। মীরা চকিতে তাকালে শেহজাদকে দেখে স্বস্থি পায়। কিন্তু শেহজাদের চোখ-মুখ মোটেও স্বাভাবিক না। তৎক্ষণাৎ শেহজাদ কিছুটা রূঢ় স্বরে শুধায়,

“হোয়ার ডিড ইউ টেক ফ্রিশা?”

মীরা খানিক চমকে ওঠে। তারপর আমতা আমতা করে বলে,
“আসলে স্যার! একটু রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম।”

“আমার পারমিশন নিয়েছ?”

মীরা মাথা নাড়ে। শেহজাদ একই স্বরে আবার প্রশ্ন ছুড়ে,
“তাহলে?”

এবার ফ্রিশা উত্তর দেয়। তার বাবা যে তার আন্টির উপর রাগ করেছে তা সে বুঝতে পেরেছে। তাই বলে,
“আমি আন্টিকে বলেছিলাম। অ্যাই ওয়াজ হাঙ*রি, বাবা। প্লিজ বাবা, ডোন্ট বি এং*রি।”

শেহজাদ নিভলো। চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিয়ে ফের চোখ মেলে বলে,
“ওকে। থ্যাংক ইউ, মীরা। অ্যাই উইল হ্যান্ডেল হার।”

মীরা জোরপূর্বক সৌজন্য হাসে। তারপর ফ্রিশা আদর করে বায় বলে চলে আসে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে চারটা বেজে গেছে। মীরা দ্রুত কলিংবেল চা*পে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-০৯

0

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৯
রাদিবের সাথে বিয়ে ভাঙার সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। মীরার দিনগুলো তার প্রত্যাহিক রুটিনেই চলছে। বাড়িতে ফোন করলেই ‘কবে দেশে জব নিবে’ এই প্রশ্নই করতে থাকে। এর জবাব নেই মীরার কাছে। ভালো জব সে পাচ্ছে কিন্তু এখনটার মতো রিসার্চ ফেসিলিটি পাচ্ছে না। এই জবটা তার মাস্টার্সের রিসার্চ ফ্যাকাল্টি সাজেস্ট করেছিল। তাই এত জলদি সিদ্ধান্তে যেতে রাজি হচ্ছে না।

মীরার বাবা রফিক তালুকদার বিকেলে ব্যালকনিতে বসে পেপার পড়ছেন। নিধি এসে তার শ্বশুরকে চা দিয়ে যায়। চিনি ছাড়া রংচা খান তিনি। শ্বশুরকে চা দিয়ে ব্যালকনি থেকে যেতেই নিধির কানে কলিংবেলের শব্দ ভেসে আসে। সে চটপটির মা*খাচ্ছিল। মৃদুলাকে কার্টুন দেখতে দেখে ডাক দেয়,

“মৃদু। এদিকে আসো তো, মা। দরজাটা খুলে দাও তো।”

মৃদুলা ছুটে এসে দরজা খুলে দিলো। অতঃপর বাহিরে দাঁড়ানো লোকটাকে দেখে মুখ বাঁকালো। নিধি প্রশ্ন ছুড়ে,
“কে এসেছে?”

“ফুপ্পির জন্য আ*বোলতা*বোল ছেলে ধরে আনা লোকটা!”

মৃদুলার এহেনো সম্বোধনে দরজার বাহিরে দাঁড়ানো ঘটক লোকটা ভড়কে গেলেন। নিধি থতমত খেয়ে ফের বলে,
“মৃদু, এভাবে বলে না। যাও তুমি কার্টুন দেখো।”

মৃদুলা মুখ ভে*ঙচি দিয়ে ছুটে চলে গেল। নিধি মাথায় ওড়না টেনে সদর দরজায় কাছে আসে। তারপর জোরপূর্বক হাসি টেনে বলে,
“ওর কথায় কিছু মনে করবেন না। বাচ্চা মানুষ। আপনি ভেতরে আসুন। বাবা ড্রয়িংরুমের বারান্দায় আছেন।”

ঘটক লোকটা সামান্য ইতস্তত করে ভেতরে ঢুকে ড্রয়িংরুমের বারান্দায় চলে গেলেন। তারপর রফিক তালুকদারকে লম্বা করে সালাম দিয়ে সামনের চেয়ারটাতে বসলো। রফিক তালুকদার ভ্রুকুটি করলেন। হাতের পেপারটা ভাজ করে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে শুধালেন,

“হঠাৎ কোনো বলা-কওয়া ছাড়া যে আসলেন?”

ঘটক লোকটা দেঁতো হেসে বলেন,
“আপনি আর কিছু জানাইলেন না। তাই নিজেই আসলাম।”

রফিক তালুকদার বললেন,
“প্রত্যকবার তো কিছু না কিছু গড়বড় করেন। এবার কী নিয়ে এসেছেন?”

লোকটা সামান্য দমে গেলেন। ফের দ্বিগুণ উৎসাহ যুগিয়ে বললেন,
“এবার একটা পাত্রের খোঁজ পেয়েছি। ছেলের আগের একটা বিয়ে ছিল। কিন্তু বউটা ভালো পড়েনি, বলে ছেড়ে দিয়েছে। অনেক ভালো জব করে ছেলে। মাসে এক লাখের মতো ইনকাম। ছেলেদের নিজস্ব….. ”

রফিক তালুকদার হাত উঁচিয়ে ঘটককে থামতে বললেন। অতঃপর ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন,
“এতদিন তাও অবিবাহিত ছেলেদের লিস্ট এনেছিলেন। আর আজকে কী-না এক বিবাহিত ছেলের সম্বন্ধ এনেছেন?”

ঘটক খানিক কাঁচুমাচু স্বরে বললেন,
“আপনার মেয়ে তো বলল সে বিবাহিত লোক, এক বাচ্চার বাপ হলেও বিয়ে করতেও রাজি!”

রফিক তালুকদার এবার উঠে দাঁড়ালেন। হাতে থাকা ভাজ করা পেপার সবেগে ছুড়ে মা*রলেন। ফের একই স্বরে বললেন,
“আজেবাজে কথা বলবেন না। আপনাকে আমার মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজতে হবে না। বেরিয়ে যান।”

ঘটকও উঠে দাঁড়ালেন। তিনি কটাক্ষ করে বললেন,
“নিজের মাইয়ারে আগে জিজ্ঞাসা করেন। কার ঘর ভাইঙা নিজেরটা বাঁধানোর স্বপ্ন দেখতাছে? রাদিব ছেলেটা পাত্র হিসেবে ভালোই ছিল। তারে আপনার মাইয়াই এইসব বলছে।”

তারপর ঘটক দ্রুত পায়ে প্রস্থান করে। রফিক তালুকদার হতবাক হয়ে কিয়ৎক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর স্বর উঁচু করে নিজের স্ত্রীকে ডাকলেন। মীরার মা মিসেস মলি জাহান আসরের নামাজ পড়ে সবে শুয়ে ছিলেন। আরেকটু পর হাঁটতে বেরোবেন। হঠাৎ স্বামীর ক্রদ্ধ কণ্ঠস্বরে বিচলিত হয়ে উঠে বসলেন। তড়িঘড়ি করে সেখানে গেলেন। রফিক তালুকদার খানিক চোটপাট করলেন। ফের বললেন,

“মেয়েকে কল করো। কাকে কী বলে বেড়াচ্ছে?”

“তুমি রাগ করছ কেন? ঘটক তো কত কিছুই বলে। আর রাদিবের কর্মকাণ্ড তো সবটাই দেখেছি।”

“আমি কিছু শুনতে চাই না। তাকে দেশে ফিরতে হবে।”

এই বলে রফিক তালুকদার হনহনিয়ে চলে গেলেন। মিসেস মলি জাহান কপালে হাত দিয়ে বসে পড়লেন। অতঃপর নিজের কপালের দোষ গাইতে লাগলেন!

_______

প্রতি মাসে একবার করে ফ্রিশার রুটিন চেকআপের জন্য শেহজাদকে হসপিটালে আসতে হয়। জন্ম থেকেই ফ্রিশার হার্ট দুর্বল। হার্টে ফুটো। চেকআপ করিয়ে ইমিডিয়েট রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের সামনে বসে আছে শেহজাদ। ফ্রিশা ডাক্তার টেবিলের পেপারওয়েট নিয়ে খেলা করছে। ডাক্তার হাসিমুখে বললেন,

“মেডিসিন কন্টিনিউ করছে। এখনও কোনো প্রবলেম নেই। তবে ও-কে মানসিক চাপ দিবেন না।”

“ডাক্তার, সার্জারি লাগবে?”

“এখনও না। ছোটো আ*র্টারিয়াল সে*প্টাল ডি*ফেক্ট তো। আপনাআপনি সেড়ে যায়। ছোটো বাচ্চা তারওপর। নিয়ম মেনে চললেই হবে।”

“থ্যাংকিউ ডাক্তার।”

শেহজাদ উঠে ডাক্তারের সাথে হ্যান্ডশ্যাক করে ফ্রিশাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ফ্রিশা হসপিটালের করিডোরে হাঁটতে হাঁটতে বলে,
“ডোন বি টেনসড, বাবা। অ্যাই ওন্ট লিভ ইউ।”

শেহজাদ হালকা হাসে। তার মেয়ে সময়ের আগে কতোকিছু বুঝতে শিখেছে। মা হারা সন্তানরা একটু বেশি বুঝদার হয় কী-না! হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠলো দুজনে। ফ্রিশা আনমনে বাহিরের দিকে চেয়ে থেকে বলে,
“আমার মম ফিরে আসবে না, বাবা? অ্যাই মিস হার।”

শেহজাদ জবাব দিতে পারে না। কী জবাব দিবে? ইদানীং মেয়েটা তার কেমন মুষড়ে পড়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে চুপচাপ ড্রাইভ করতে থাকে।

_____

জিনিয়া হুট করে মীরাকে মেসেজ দিয়ে বলে,
“মীরু? তোর মাস্টার্সের সিজিপিএ কতো?”

মীরা কিঞ্চিত ভাবুক হয়। হঠাৎ বান্ধবী তার সিজিপিএ নিয়ে পড়লো কেন? তৎক্ষণাৎ জিনিয়া হোয়াটসএপে কল দিয়ে বসলো। জিনিয়া ফের একই প্রশ্ন শুধালে মীরা সন্দিহান হয়ে জবাব দেয়,
“৩.৮৭। কিন্তু কেন?”

“অনার্সেরও তো কাছাকাছি ছিল তাই না?”

“হ্যাঁ, ৩.৮১ ছিল। কিন্তু কেন?”

জিনিয়া এবার বিপুল উৎসাহ নিয়ে বলে,
“ভার্সিটির ফ্যাকাল্টি হবি?”

মীরা পুরো হাঁ হয়ে গেল। ফের শুধালো,
“কী বলছিস তুই?”

“হ্যাঁ রে। একটা বি ক্যাটাগরির প্রাইভেট ভার্সিটির সার্কুলার দেখলাম। ৩.৮ হলেই এপ্লাই করা যাবে। তুই ট্রাই করতে পারিস। তুই তো খুব সুন্দর করে বুঝাতে পারিস। আমার কত প্রবলেম সলভ করে দিয়েছিস।”

মীরা পাত্তা দিলো না। বলল,
“এজন্য আমি ফ্যাকাল্টি হবো! আমার সবসময় রিসার্চের ইচ্ছে।”

জিনিয়া অবাক কণ্ঠে বলে,
“ফ্যাকাল্টিরা রিসার্চ করে না? পা* গলের মতো কথা বলিস না। এতে আরও ভালো হবে। তুই এখনি সিভি পাঠিয়ে দে। আর শনিবারের ফ্লাইটে চলে আয়। আজ বৃহস্পতিবার। রবিবার তো এমনিতেই তোদের ছুটি।”

মীরা বলল,
“আমি ভেবে নেই।”

“কোনো ভাবাভাবির কিছু নেই। এখুনি সিভি পাঠাবি। সময় নেই দোস্ত। একটা ভার্সিটির লেকচারার হতে পারা কতো ভাগ্যের জানিস? জলদি কর। আমার যদি তোর মতো সিজি থাকতো তবে আমি কখন সিভি পাঠিয়ে বসে থাকতাম!”

“আচ্ছা দেখছি।”

“এতো দেখতে হবে না। আমি তোকে লিংক পাঠাচ্ছি। তুই এখনি পাঠাবি। রেফারেন্সের জন্য আকবর স্যারকে নক কর। স্যার তো অনার্সে তোর রিসার্চ ফ্যাকাল্টি ছিলেন।”

জিনিয়া খুব উৎসাহিত কিন্তু হঠাৎই আকবর স্যারের নাম শুনে মীরা চমকে ওঠে। স্যারকে নক করতে সে ইতস্তত করছে। কিন্তু জিনিয়ার জোরাজুরিতে বাধ্য হয়। জিনিয়া সবসময় নাছোড়বান্দা। নিজে যা বলবে তা করিয়েই ছাড়বে। মীরা অবশেষে মেইল করে থামলো। জিনিয়াও ইতোমধ্যে কল ডিসকানেক্ট করেছে। রাইমা বাহিরে গিয়েছিল। ওর কী একটা দরকার ছিল। রাইমা এসে এক গাদা চকলেট ছড়িয়ে বলল,

“নে মীরু। কতোগুলো চকলেট।”

মীরা ভ্রু কুঁচকে বলে,
“কে দিলো?”

“তোর কুঞ্জদা। দিল্লিতে এসেছে। কী-সের অফিসের কাজে বলল। একটা হোটেলে ওঠেছে। দুই-তিন দিন থাকবে বলল। হুট করে বলল বেরোতে। তুই ওয়াশরুমে ছিলি বলে না বলেই চলে গিয়েছিলাম।”

“ওহ।”

মীরা একটা কিটক্যাট নিয়ে আনমনে খোসা ফেলে খাচ্ছে। দৃষ্টিতে কোনো নড়ন নেই। মীরার অবিচল দৃষ্টি দেখে রাইমা শুধায়,
“তোর আবার কী হয়েছে? চকলেট খাচ্ছিস কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে উচ্ছে খাচ্ছিস!”

মীরার সম্বিৎ ফিরলো। সে প্রত্যুত্তর করলো,
“না। কিছু না।”

“তাহলে স্মাইল কর বেব।”

রাইমা খুব খুশিমনে চকলেট খাচ্ছে। মীরা ওর দিকে চেয়ে ভাবছে, কী করে কথাটা বলবে?

চলবে ইনশাআল্লাহ,

ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-০৮

0

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৮
মীরা বুঝতে পারলো তার আফসোস হচ্ছে। ছেলেদের মিঠে কথায় গ*লে যাওয়া উচিত হয়নি। বর্ণের বেলায় ঠকে গিয়ে আবারও উচিত হয়নি। কথায় আছে না? অতিভক্তি চো*রের লক্ষণ! কেন যে বুঝলো না রাদিবের এই অতিভক্তি ও যত্ন দেখানো! আবার নিজের সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মানটাও বেড়ে গেছে। ভাগ্যিস আকদ ও এইনগেজমেন্টের কথা সে রিজেক্ট করে এসেছিল। কিছুটা শান্তিও লাগছে মনে। ফোনের অপরপাশের মেয়েটার ডাকে মীরা ভাবনার জগৎ থেকে ফিরলো। মেয়েটা রাদিবের ফোন থেকে হোয়াটসঅ্যাপে কল করেছিল তাই রিসিভ করা মাত্রই সেটাকে ভিডিও কলে পরিবর্তন করে নিয়েছিল। মেয়েটা বলল,

“রাদিবকে আমি অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে আজকে এই হোটেলে এনেছি। তারপর ওকে ইনট*ক্সিকে*টেড করে ফোনের লক খুলিয়ে আপনাকে কল করেছি। কিছুদিন যাবত সে আমাকে ইগনোর করছিল। ফোন করলে ব্যস্ততা দেখাতো। আমি ওর এক বন্ধুর থেকে সবটা জেনে ওর বন্ধুর সহায়তায় এই কাজ করেছি। এক মাস আগে আমাকে ও জোর করে এবর্শনও করিয়েছে। তারপর থেকেই ওর কেয়ারিং ভাবটা কমতে থাকলো। তখনও ততটা ভাবিনি। কারণ নতুন নতুন প্রমোশোন হয়েছে। কিন্তু এখন! সে আমাকে ছুড়ে ফেলে দিতেও দুইবার ভাবেনি।”

মীরা ঢোক গিলে ঈষৎ পলক ঝাপটালো। তারপর এক নিঃশ্বাসে বলল,
“ধন্যবাদ আপু। ভালো থাকবেন।”

এটা বলে মীরা কল কাটতে নিয়েও কিছু একটা ভেবে একটা স্ক্রিনশট নিয়ে রাখলো। মেয়েটাকে যে রাদিব কোমড় পেঁচিয়ে ধরে আছে তা স্পষ্ট। তারপর কল কেটে হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বিছানায় ধপ করে মাথা নিচু করে বসলো। প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছে তার। মাথার শিরায় শিরায় সূক্ষ্ণ ব্যাথার উদ্ভব হচ্ছে। রাইমা, মীরাকে ডাকতে এসে এভাবে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো। পাশে গিয়র বসে, পিঠে হাত রেখে ডাকলো,

“মীরু? কী হয়েছে?”

মীরা মাথা তুলল। তার চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। রাইমা উৎকণ্ঠা নিয়ে শুধালো,
“তোর চোখ লাল কেন? মাথাব্যথা না-কি?”

মীরা ইশারায় হ্যাঁ বুঝালে রাইমা ড্রয়ার খুলে প্যা*রাসিটে*মল বের করে মীরার হাতে দেয়। তারপর ডাইনিং থেকে পানি ও প্লেটে করে একটু চিকেন সবজি ও তান্দুরি রুটি এনে দিয়ে বলে,
“একটু খেয়ে মেডিসিন খা।”

“না খাব না। খেতে ইচ্ছে করছে না।”

অতঃপর সে ঔষুধের স্ট্রিপ থেকে ঔষুধ বের করতে নিলে, রাইমা হাত ধরে শা*সনের সুরে বলল,
“না খেয়ে তোকে আমি মেডিসিন নিতে দিব না। খেতে তো হবেই। হুট করে মাথাব্যথা শুরু হলো কেন? তুই না জিজুর সাথে কথা বলছিলি?”

মীরা ঔষুধের স্ট্রিপটাই ছুড়ে ফেলল! অতঃপর শক্ত কণ্ঠে বলল,
“বিয়ের আগে কীসের জিজু? বিয়ে হয়েছে আমার? নাকি আমার অনামিকায় কোনো আংটি দেখতে পাচ্ছিস? তাহলে কানের মা*থা খাচ্ছিস কেন?”

মীরার এই হুট করে রেগে যাওয়ার কারণটা রাইমা বুঝলো না। এমন কী বলেছে যে মীরা আ*হত বা*ঘি*নীর মতো অ*গ্নিশর্মা হয়ে গেছে! রাইমা নরম কণ্ঠে শুধালো,
“এতো রেগে যাচ্ছিস কেন? জিজুর সাথে ঝ*গড়া হয়েছে?”

“ফের জিজু বলছিস? মানা করেছি না আমি?”

মীরার কণ্ঠের তীব্রতায় ভড়কে গেল রাইমা। সন্দিগ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
“আচ্ছা বলব না। কিন্তু হয়েছেটা কী? ঝ-গড়া করেছিস?”

“না! মানুষ ঝ*গড়া করে তার নিজের মানুষের সাথে। রাদিব আমার কেউ না। ভবিষ্যতেও কেউ হবে না।”

মীরার উত্তরেও কেমন হেয়ালী! রাইমা বুঝল না কিছুই। ফের প্রশ্ন করে,
“আরে ইয়ার! ক্লিয়ারলি বল। আমি এমন আধা-ভাঙা কথা বুঝি না।”

“হি ইজ অ্যা চি*টা*র। হি ট্রাইড টু চি*ট অন মি।”

“কীভাবে চি*ট করলো?”

“সে একটা মেয়েকে চি*ট করে আমাকে বিয়ে করতে এসেছিল। মেয়েটার এ*বর্শনও করিয়েছে। আমার সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে নিজের ভেতরের নোংরামো হাইড করতে চেয়েছিল। বাট ফাইনালি, আমি বেঁচে গেছি। সময় থাকলে সব সত্য জেনে গেছি।”

রাইমা হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো। মীরা ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করে। মাথাব্যথায় টনটন করছে। পানিভর্তি গ্লাস এক নিঃশ্বাসে শেষ করে দিলো। তারপর ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,

“একটু ঘুমাব। ভালো লাগছে না।”

রাইমার হুঁশ ফিরলো। সে অসন্তোষ স্বরে বলল,
“তুই না খেয়ে ঘুমাতে পারবি না। একটু হলেও খাবি। তারপর ঔষুধ খেয়ে ঘুমা। আমি না শুনব না।”

মীরার মাঝে খাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। অতঃপর রাইমা নিজে জোর করে রুটি ছিড়ে মীরার মুখে ঢুকিয়ে দিলো। মীরা বিরক্ত হয়ে বাধ্য হয়ে খাচ্ছে। ইতোমধ্যে রাইমার টেপরেকর্ডার চালু! রাদিবকে যা নয় তাই বলে সাবান ছাড়া ধুয়ে দিচ্ছে। মীরা অতিষ্ঠ হয়ে বলে,

“কুঞ্জদা তোকে সহ্য করে কীভাবে? বেচারার কানের পো-কা তো মনে হয় একটাও বেঁচে নেই।”

রাইমা বাঁকা হেসে বলে,
“তোর কুঞ্জদা, তার কাকা মানে আমার পিসোকে খুব ভালোবাসে তো। তাই পিসো যা বলেছে চোখ বন্ধ করে মেনে নিয়েছে। এমনিতেও সে আমাকে পছন্দ করতো।”

“হয়েছে থাম। আমি ঘুমাব। তুই তো এখন ঘুমাবি না।”

রাইমা ফুরফুরে মেজাজে প্লেট নিয়ে উঠে বলে,
“নোপ। আমি এখন নে*টফ্লিক্সে মুভি দেখব। কাল রবিবার ইয়ার। এতো জলদি ঘুমাব না।”

মীরা প্যা*রাসিটে*মল ও একটা স্লি*পিংপি-ল পানি দিয়ে গিলে হালকা মাথা নেড়ে শুয়ে পড়ে। রাইমাও আলো বন্ধ করে দরজা ভিড়িয়ে চলে যায়। মীরা চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে ভাবলো, এখনি ব্যাপারটা শুধরে নেওয়া উচিত। তাই তার বড়ো ভাইয়ার হোয়াটসএপে সেই স্ক্রিণশটটা পাঠিয়ে লিখলো,

“মুখে মধু, অন্তরে বি*ষ কাউকে আমি নিজের লাইফে চাই না। বাকিটা তোমরা বুঝে নিও।”

অতঃপর ফোন বন্ধ করে রেখে তন্দ্রায় ডুবে যায়।
_______

মীরার ঘুম ভাঙে খুব ভোরে। ঘুম ভাঙার পর পাশে রাইমাকে না দেখে বুঝে যায় যে মেয়েটা ছোটো ম্যাট্রেসটাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। মীরা উঠে ফ্রেশ হয়ে অজু করে নামাজ পড়ে নেয়। অতঃপর কফি বানায়। কফি খেতে খেতে ব্যালকনিতে যায়। খোলা হাওয়ার স্নিগ্ধতায় মন মোহনায় মুগ্ধতা ঝড়ে পড়ে। সেখানে টবে লাগানো শুভ্র ও গোলাপি কাঠগেলাপের মিষ্টি সুঘ্রাণ অনুভব করে। সাদা কাঠগেলাপ তিনটে ফুটে আছে আর গোলাপিটার দুটো। রাতে মনে হয় বৃষ্টি হয়েছিল। গাছের পাতা ভেজা। ব্যালকনির রেলিংও ভেজা। তা স্বত্বেও সেখানে কনুই ভর দিয়ে দাঁড়ায়। কফি পান করতে করতে সম্মুখের অনন্ত গগনে দৃষ্টি স্থির রেখে সময়টা উপভোগ করে। এখানে দাঁড়িয়েই বেশ অনেকটা সময় পেরোলো। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে ডিম ও সবজি দিয়ে ফ্রাইড রাইস তৈরি করে তার সাথে কিনে আনা ফ্রোজেন করক কাবাব বের করে চারটা ভেজে নিলো। তারপর রাইমাকে টেনে তুলে ফ্রেশ হতে পাঠালো।

খাওয়া-দাওয়া শেষে মীরা ফোন অন করে দেখে তার দুই ভাই, ভাবিদের ও রাদিবের নাম্বার থেকেও সব মিলিয়ে প্রায় শ খানেক মেসেজ ও মিসডকল। লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে সে কল ব্যাক করে। মীরার ছোটো ভাবি কল রিসিভ করে প্রথমেই বলে,

“রাদিব সম্পর্কে তুমি এসব কীভাবে জানলে? রাদিব তো এসব অস্বিকার করছে।”

মীরা জবাবে তাচ্ছিল্য করে বলে,
“সে অস্বিকার করলেই বুঝি সত্যটা মিথ্যে হয়ে যাবে? আমি ভিডওকলে সব দেখেছি এবং শুনেছিও। মানুষ নে*শার ঘোরে সত্যি কথা বলে। সে বলছিল সে ওই জুলি মেয়েটাকে ভালোবাসে, আবার আমাকেও! আমার এত বড়ো মনের ছেলেকে বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। যে দুটো মেয়েকে বিয়ে নক করেই ভালোবাসে!”

“তুমি বাবার সাথে কথা বলো। কাল রাতে তোমাকে কত কল দিলাম। ধরলে না।”

“মাথাব্যথা করছিল তাই ঘুমিয়ে ছিলাম।”

“আচ্ছা। বাবার সাথে কথা বলো।”

মিস্টার রফিক তালুকদার ফোন কানে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন,
“তুমি শিউর তো? রাদিব বলছে ওই মেয়ে নাকি তাকে খাবারের সাথে কিছু মিশিয়ে তারপর নিয়ে গেছে।”

“হ্যাঁ। মেয়েটা তাই করেছে। তাছাড়া আর কী করবে? নিজে ঠকেছে বলে কি আরেকটা মেয়েকেও ঠ*ক-তে দিবে? কথোপকথন তো আমি শুনেছি। দেখেছিও।”

মীরার জবাব শুনে মিস্টার রফিক তালুকদার হতাশ নিঃশ্বাস ফেললেন। কথা না বাড়িয়ে বললেন,
“ঠিক আছে।”

অতঃপর কল ডিসকানেক্ট করে দিলেন। মীরা শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে কেবল উঠবে তখন আবারও ফোন বেজে ওঠে। দেখে রাদিব কল করেছে। মীরা বিরক্ত হয়ে কে*টে দিতে চেয়েও রিসিভ করলো। কানে ধরে বসে রইল। রাদিব বলছে,

“মীরা, ওসব মিথ্যা। জুলি আমাকে ফাঁসাচ্ছে। ওর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। ওই মেয়েটা আমাকে ডিস্ট্রাভ করে। বিশ্বাস করো, আমার সাথে ওর কোনো সম্পর্কই নেই। আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

মীরার ভীষণ রাগ হলো। কিন্তু তা প্রকাশ না করে ভাবলেশহীন জবাব দিলো,
“তো আমি কী করব? আপনার মন যত ইচ্ছা, যাকে ইচ্ছা ভালোবাসেন। এক মনে দুটো কেন? হাজার জনকে জায়গা দিন। তাতে আমার কিছু যায় আসে না।”

“মীরা বুঝার চেষ্টা করো।”

“কী বুঝব? আর আপনি আমার কাছে এত সাফাই গাচ্ছেন কেন? আপনার সাথে আমার এইনগেজমেন্টও হয়নি। অযথা সময় নষ্ট করছেন। তার থেকে ভালো, জুলিকে বিয়ে করে সুখী হোন।”

রাদিব ডেস্পারেট হয়ে জবাব দেয়,
“তোমার সাধারণতায় আমি প্রেমে পড়ে গেছি। আমি ভালোবেসে ফেলেছি। জুলি প্রতিহিং*সা থেকে এসব করছে।”

“থামেন প্লিজ। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না। আপনাকে বিয়ে করার থেকে এক বিপত্নীক, এক বাচ্চার বাবাকেও বিয়ে করা ভালো! অন্তত তার মনে কারও জন্য ভালোবাসা থাকলে সেটা তার মৃত স্ত্রীর জন্যই থাকবে। পবিত্র সেটা।”

কথাটা বলে মীরা নিজেই চমকে ওঠে। কথায় কথায় সে কী বলে ফেলল! অস্বস্তিতে আর কথা বলার জোর নেই। জলদি করে কল কে*টে নাম্বার ব্লক করে দিলো। ফের মাথা নিচু করে, মুখে হাত চেপে নিজের বলা শেষোক্ত কথাগুলো ভাবতে লাগলো।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-০৭

0

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৭
মীরার চলে যাওয়ার দিন উপস্থিত। সন্ধ্যার ফ্লাইটে দিল্লিতে চলে যাবে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই জানতে পারলো, আজকেও তাকে ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে। বিরক্ত হলো মীরা। মায়ের সাথে কিছুক্ষণ চোটপাট করে বাবাকে কল লাগালো। রিসিভ হলে প্রথমেই বলে বসে,

“তুমি জানো না? আজকে আমি চলে যাব? আজকে কীভাবে আমাকে দেখতে আসবে?”

মিস্টার রফিক তালুকদারের শান্ত জবাব,
“এখন মাত্র সকাল সাড়ে আটটা বাজে। ওরা সাড়ে দশটা বা এগারোটায় আসবে। তুমি সময় পাবে।”

“তোমাদের কাজকর্ম দেখলে মনে হয় আমি বোঝা হয়ে গেছি। যাও মেনে নিলাম। জাস্ট দেখে যাবে। নাথিং মোর। এতো শর্ট ইন্ট্রোডাকশনে আমি কবুল বলবও না আর সাইনও না। মনে রেখো।”

কথাগুলো শেষ করে খট করে ফোন কে*টে দেয় মীরা। বিরক্ত লাগছে তার। রাগে এখনি বেরিয়ে যেতে মন চাচ্ছে। মীরার বড়ো ভাবি শারমিন আসে। এসে পাশে বসে বলে,
“রাগ করো না। শুধু দেখে যাবে। আগের তিনটাও তো হয়নি। এবারেরটা যদি ভালো হয় শুধু কথা এগুবে।”

“জানি ভাবি। কিন্তু আমার বারবার পাত্রপক্ষের সামনে বসতে ভালো লাগে না। দুই সপ্তাহে কতবার বসলাম!”

“তোমার বিয়ের হুকুম হলে দেখবে এমনেই বিয়ে হয়ে যাবে।”

“হুম।”

শারমিন হাসলো। অতঃপর বলল,
“যাও তো তৈরি হয়ে নাও। গোসল করে আগে মা-থা ঠাণ্ডা করো।”

মীরাও হাসে। ফের বলে,
“যাচ্ছি।”
“বিকেলে চলে যাওয়ার জন্য ব্যাগ গুছিয়েছ?”
“কিছুটা। তুমি তো জানো, আমি আগে ব্যাগ গুছাতে পারি না।”
“জানি তো। তারপর কিছু না কিছু ফেলেই যাও। একদম তোমার বড়ো ভাইয়ের মত! তুমি গোসলে যাও, আমি গুছিয়ে দিচ্ছি।”

মীরা খুশি হয়ে ভাবিকে হালকা করে জড়িয়ে ধরে জামা-কাপড় নিয়ে গোসলে চলে যায়।
_______

এবার পাত্রপক্ষের মাঝে কোনো খুঁত পেলেন না মীরার বাবা। বিয়েতে রাজি হয়ে গেলেন তিনি। পাত্র এক মাল্টিন্যাশনাল কম্পানির ম্যানেজার পদে রিসেন্টলি পদোন্নতি হয়েছে। বাবার কথায় এবার আর মীরা কোনো কথা বলল না। তবে সে এখন কোনোরকম বন্ধনে যাবে না। আজকে ইন্ডিয়া যাবে, তারপর দুইমাস পর আসবে। তখন যা হওয়ার হবে। ছেলেপক্ষের মাঝে কিঞ্চিত অসন্তোষ দেখা গেলেও পাত্র রাদিব রাজি হলো। সে বলল,

“মিস মীরা যেহেতু চাচ্ছেন না তাহলে পরেই হোক।”

মীরা জোরপূর্বক হাসলো। রাদিব ছেলেটা এমনিতে ভালো কিন্তু একটু বেশি গায়ে পড়া। যখন আলাদা কথা বলতে দিলো তখন অতিরিক্ত সৌন্দর্যের বর্ণনা করছিল। যা মীরার কাছে খানিক অতিরঞ্জিতই লেগেছে। তাও এবার কিছু বলল না। ছেলেপক্ষকে মীরার মা ও ভাবিরা দুপুরে খাইয়ে ছেড়েছেন। ছেলের বড়ো বোন মীরার জব এড়িয়া ও ইন্ডিয়াতে ভাড়া করা ফ্লাট, রুমমেট সব সম্পর্কে খুঁটে খুঁটে তথ্য নিয়েছে। মীরা অনিচ্ছাসত্ত্বে সব ইনফোরমেশন ধৈর্য সহকারে দিয়েছে।

ছেলেপক্ষ চলে যাওয়ার পর মীরার মা শুরু করেছে, কেন অন্তত আংটি পড়িয়ে রাখল না। মীরা কয়েকবার বলেও থামাতে না পেরে ৩টা বাজেই বাড়ি থেকে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে। যেতে দেড়-দুই ঘণ্টা লাগবে। এখনও দুই ঘণ্টা বাকি। কী করবে না করবে ভেবে এয়ারপোর্টের কাছে থাকা এক ফ্রেন্ডকে আর্জেন্টলি ডাকে। মীরার ফ্রেন্ড পার্থনা একা বাড়িতে ঘুমাচ্ছিল। তার স্বামী অফিসে। আর শ্বশুর-শাশুড়ি গ্রামের বাড়িতে। মীরার কল পেয়ে চলেও আসে। তারপর দুই বান্ধবী মিলে রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া, গল্প-গুজব করে সময় পার করে ফেলে।

________
ফ্রিশার জ্বর কমেছে। শেহজাদ এইজন্য একদিন ছুটি নিয়েছে। যাতে ফ্রিশার মন খারাপ কমে। সারাদিন ফ্রিশার। নিজের হাতে রান্না করে ফ্রিশাকে খাইয়েছেও। কিছু আইটেম সে রান্না করতে পারে। চিজি পাস্তা, বাটার চিকেন ইত্যাদি। ফ্রিশারও এসব খুব পছন্দ। সারাদিনে ফ্রিশাকে কাঁধছাড়া করেনি। বাচ্চা মেয়েটাও অনেক খুশি। নিজের হাতে খাইয়ে দেওয়া থেকে বাহিরে ঘুরতে যাওয়া সব। সারাদিন পর শেহজাদ ফ্রিশাকে ঘুম পাড়িয়ে রকিংচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে। তখন ড: আকবর রেহমান আসেন। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলেন,

“প্রতিদিন ওকে এভাবে সময় দিবে?”

শেহজাদ সোজা হয়ে বসে। শ্রান্ত চাহনি ফেলে বলে,
“আপনি কী বলতে চাইছেন?”

“তুমি তা ঠিকই বুঝতে পারছ শেহজাদ।”

শেহজাদ পাল্টা প্রশ্ন করে,
“সৎমা কি সত্যি আমার মেয়েকে ভালোবাসতে পারবে?”

“আমরা তেমনটাই দেখে বিয়ে করাব।”

শেহজাদ বুঝলো, সে তার ফুফা-ফুফিকে বুঝাতে পারবে না। তাও একটা শেষ চেষ্টা করল।
“কেউ কেনো তার মেয়েকে এক বিবাহিত, বাচ্চা আছে এমন লোকের সাথে বিয়ে দিবে? কী লাভ তাতে? অর্থ-সম্পত্তি?”

“তুমি একটু বেশি ভাবো। আমি এক মেয়েকে দেখে রেখেছি। এখন তোমরা দুজন রাজি হলে মেয়ের পরিবার রাজি করানো কোনো ব্যাপার না।”

শেহজাদ অবাক হলো ভীষণ। সে তৎক্ষণাৎ বিস্ময়াভিভূত স্বরে শুধালো,
“আপনি কি তবে সবাইকেই জোর করবেন? জোর করে এক মেয়েকে রাজি করাবেন আমাকে বিয়ে করতে?

ড: আকবর রেহমান ভড়কালেন। তিনি তো মীরাকে অনুরোধ করেছে মাত্র। তিনি জবাবে বললেন,
“তুমি ভুল বুঝছ শেহজাদ। আমি জোর করব কেন? রিকুয়েস্ট করেছি জাস্ট। মেয়েটা ভেবে, চিন্তে জবাব জানাক। তারপর কথা আগাবো।”

শেহজাদ এবার কাটকাট স্বরে বলল,
“আপনি কাউকে কোনো প্রকার জোর করবেন না। জোর করার পর রাজি হলেও, পরবর্তীতে আফসোস করে আমার মেয়েকে কষ্ট দিবে। যা আমি সহ্য করব না।”

ড: আকবর রেহমান বোঝাতে চাইলেন,
“আমি জোর করছি না। তোমাকেও বলছি ভেবে দেখো।”

“দেখব।”

ড: আকবর রেহমান হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে চলে গেলেন।

________

প্রায় দশ-বারো দিন পর। মীরা ও রাইমা সবে ল্যাব থেকে ফ্লাটে পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে কিনে আনা খাবারগুলো একে একে সাজাচ্ছে। তখন মীরার ফোনটা বেজে উঠলে, রাইমা হইহই করে ওঠে। রম্যস্বরে বলে,
“যা যা। বাকিটা আমি সাজিয়ে নিব। জিজাজি কল করেছে। উনাকে ওয়েট করাস না। বেচারা দিনে শুধু নিয়ম করে তিনবার তোকে কল করে।”

“চুপ থাক।”

মীরা আলতো শাসালো। রাইমা পাত্তা না দিয়ে বলে,
“ওমা! আমি বললেই শুধু দোষী হয়ে যাই তাই না? নিজে যখন কথা বলিস।”

“দেখ, আমি কথা বলতে চাই না। এখন কল কেটে দিলেও অভদ্রতা দেখায়। সকালে ল্যাবে ঢুকব তখন কল করে। কোনোমতে ব্যস্ততা দেখিয়ে পার করি। দুপুরে কল দিলে প্রথমবারে ধরি না। এখনও তাই করব। আমাকে এভাবে বাচ্চাদের মতো ট্রিট করাটা পছন্দ না। বর্ণও করত। কিন্তু কী হলো? ধোঁ*কা দিলো তো।”

রাইমা ওর কাঁধ জড়িয়ে আদুরে স্বরে বলে,
“চি*ল ইয়ার। পুরোনো কাসুন্দি ঘেটে কী লাভ বল? জিজাজি কল করেছে, যা কথা বল। কয়দিন পর তো বিয়েই।”

“আজ এতো জলদি কেন কল দিবে? প্রতিদিন তো আরও পরে কল দেয়।”

“আগে দেখ তো। যা জলদি যা।”

রাইমা, মীরাকে একপ্রকার ঠেলেই পাঠিয়ে দিলো। মীরা ক্লান্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে ধীর পায়ে রুমে গেল। বিছানার উপর থেকে ফোনটা তুলে রিসিভ করে কানে নিলো। অতঃপর যা শুনলো তাতে তার শরীরের র*ক্ত হিম হয়ে ওঠলো। প্রত্যুত্তর করতে যেন ভুলে গেল।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

রিচেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-০৬

0

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৬
মীরা তৃতীয়বারের মত পাত্রপক্ষের সামনে বসলো। এবার আর শাড়ি পড়ল না। পাত্রপক্ষ নাকি এবার সব মেনে নিয়েছে। কিন্তু পাত্রের কাণ্ডে মীরা বাবাই আর মত দিতে পারছেন না। কারণ পাত্র সুস্থ না। দেখতে সুস্থই লাগে কিন্তু যখন মীরাকে দেখে পাত্রের মা বললেন তাদের পছন্দ হয়েছে, তখনি পাত্র বসা থেকে উঠে ছুটে আসে মীরার দিকে। মীরা ভড়কে যায়। এসেই মীরার হাত ধরে কেমন অদ্ভুত ব্যবহার করতে থাকে। মীরা হাত ছাড়িয়ে ভয়ে সোফাতে ভর দিয়ে সোফা সহ খানিক পিছিয়ে গেলে পাত্র এসে মীরার পা ধরে বাচ্চাদের মতো বলে,

“কী সুন্দর পা! এই পা আমি মাটিতে রাখব না!”

মীরার বাবা রফিক তালুকদার তৎক্ষণাৎ পাত্রের বাবার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়েন।
“ভাইসাহেব, এসব কী? আপনার ছেলে এমন পাগলামি করছে কেন?”

পাত্রর বাবা আমতা আমতা করছেন। তা দেখে মীরার বাবা ঘটককে উুুঁচু স্বরে বললেন,
“আপনি জানতেন না?”

ঘটকও হকচকিয়ে চেয়ে আছে। সে শুনেছে ছেলের মাথায় একটু সমস্যা। কিন্তু একি! পাত্রের মা বড়ো মুখ করে বলেন,
“বিয়ে করাবেন না বলে দিলেই তো হয়। অপমান করার কী আছে? চলে যাচ্ছি আমরা। এই উঠো সবাই।”

রফিক তালুকদার হাত জোড় করে বললেন,
“হ্যাঁ প্লিজ। আমার মেয়ে ফেলনা নয়। সে স্বাবলম্বী এবং খুব ভালো ভাবে চলতে পারে।”

বাবার কথাটা মীরার চোখে জল এনে দিল। সে ছলছল নয়নে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে চোখে চোখ পরতেই মাথা নিচু করে চলে গেল।

পাত্র পক্ষ চলে গেলে রফিক তালুকদার ঘটককে বলেন,
“আপনি না পারলে বলে দিন, আমি অন্য ঘটক দেখব।”

ঘটক বলেন,
“পরেরবার ভালো পাত্র আনব ভাইসাহেব। চিন্তা করবেন না। আমি যদি জানতাম, তবে কি পা*গল ছেলে আনতাম? বলেন। পরশু ভালো পাত্র আনব।”

ঘটকও বিদায় নিলেন। মীরার মা, মীরার বাবার কাছে এসে বললেন,
“তুমি চিন্তা করো না। আর এত তাড়াহুড়ো করো না। তাড়াহুড়ো করছ বলেই এমন হচ্ছে। ঘটক যা পারছে তাই আনছে।”

মীরার বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
“তোমার মেয়ে এবার গেলে আর কবে আসবে ঠিক আছে? তাইতো অন্তত ছেলে পছন্দ হলে আকদ করিয়ে রাখব।”

“যা ভালো বুঝো। বারবার মেয়েটাকে পাত্রপক্ষের সামনে বসাতে আমার ভালো লাগে না।”

মীরা কিছুক্ষণ নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে বই নিয়ে বসল। হুমায়ূন আহমেদের “চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস” বইটা পড়তে শুরু করে। আগে কিছুটা পড়েছিল এখন তারপরের থেকে পড়ছে। পড়তে পড়তে সময় চলে যাচ্ছে বুঝতেই পারেনি।

_______

আজ ফ্রিশা মনম*রা হয়ে বসে আছে। আজ স্কুলে সব বাচ্চাদের প্যারেন্টসরা গিয়েছিল। ফ্রিশার সাথে ওর দাদুমনি গিয়েছিল। ফ্রিশার সব বন্ধুরা তাদের মা অথবা বাবাদের সাথে সুন্দর সময় পার করেছে। অনেকের তো বাবা-মা দুজনেই এসেছিল। সবাই বাবা-মাকে নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছে। ফ্রিশা স্টেজে উঠে বাবা সম্পর্কে বলার পর মা সম্পর্কে বলার আগেই কেঁদে ফেলেছিল। স্কুল থেকে ফেরার পর ফ্রিশা দুপুরেও খায়নি, এখন রাত হয়ে গেছে তাও না। শেহজাদকে আজ এক জরুরী কাজে যেতে হয়েছিল। বাড়ি আসতে আসতে রাত নয়টা বেজে গেছে। এসেই শুনে ফ্রিশা খায়নি। দরজা লাগিয়ে বসে আছে। শেহজাদ ফ্রিশার রুমে গিয়ে কয়েকবার দরজা নক করল, নাম ধরেও ডাকল। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই। মিসেস শাহিদা বললেন,

“একটু আগেও সাড়া দিয়েছে। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে গেছে। তোমার কাছে রুমটার চাবি আছে না? খুলো তো।”

শেহজাদ চট করে নিজের ঘরে চাবি আনতে গেল। চাবিটা আলমারির ভেতরে ছিল। ফ্রিশার রুম তো কখোনো লক করা হয় না তাই চাবিটাও হাতের কাছে ছিল না। চাবি এনে দরজা খুলে দেখে ফ্রিশা মেঝেতে নিজের বড়ো টেডিবিয়ারের পেট জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। গালের কাছে কান্নার ছাঁপ সুস্পষ্ট। শেহজাদ মেয়েকে এভাবে দেখে কষ্ট পেলো। মেয়ে তার বড্ড জিদ্দি। ঠিক তার মতো। অবশ্য ফ্রিওনাও জিদ্দি ছিল। শেহজাদ ফ্রিশাকে কোলে তুলতে গিয়ে ঘাবড়ে যায়। গা গরম। এসির বাতাসেও যদি গা এত গরম থাকে তাহলে তো বুঝাই যায় ভীষণ জ্বরে সেন্সলেস। শেহজাদ চিৎকার করে সার্ভেন্টকে ডেকে বলে,

“এখুনি আমার ঘর থেকে ফার্স্টএইড বক্স নিয়ে এসো।”

সার্ভেন্ট দ্রুত ছুটে যায়। শেহজাদ, ফ্রিশাকে কোলে তুলি বিছানায় শুইয়ে এসি অফ করে ফ্যান ছাড়ে। মিসেস শাহিদা পানিভর্তি বাটি ও রুমাল নিয়ে আসে। সার্ভেন্ট ফার্স্টএইড বক্স নিয়ে আসলে শেহজাদ থার্মোমিটার বের করে জ্বর মেপে দেখে ১০২ ডিগ্রি। সে ফের বলে,

“ও তো কিছু খায়নি। খালি পেটে ঔষুধ দেওয়া যাবে না। সূপ করো ইমেডিয়েটলি।”

মিসেস শাহিদা তন্মধ্যে ফ্রিশার মুখে জলের ছিঁটা দিয়ে জলপট্টি শুরু করেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সূপ রান্না হলে ঠান্ডা করে একটু করে মুখে দেয়। ফ্রিশা খেতেই চাচ্ছে না। বিড়বিড় করে কিছু বলছে। শেহজাদ কান পেতে শোনে। ফ্রিশা ‘মা! মা!’ করছে। শেহজাদ হতাশ হলো। মেয়েকে সব দিতে পারলেও মা তো দিতে পারবে না। মিসেস শাহিদাও কান পেতে শুনলেন। অতঃপর অসহায় কণ্ঠে বললেন,

“আজকের ফাংশনে সবার বাবা-মা এসেছিল। সবাই নিজেদের বাবা-মাকে নিয়ে কিছু না কিছু বলেছে। কিন্তু ফ্রিশা তার মা সম্পর্কে কিছু বলতে পারেনি। কান্না করে দিয়েছে। ও মায়ের অভাব খুব অনুভব করে। একটু ভাবো শেহজাদ। মেয়েটার জন্য হলেও।”

শেহজাদ শুনেও শুনলো না। মেয়েকে বুকে আগলে কিছুটা জোড়াজোড়ি করে কয়েক চামচ সূপ খাইয়ে তারপর ঔষুধ খাইয়ে দিয়েছে। এরপর নিজের ঘরে গিয়ে রকিং চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। আজ রবিবার। ক্লাসের সিডিউল বেশ ছিল। ভাবতে লাগল যেদিন ফ্রিওনা এই পৃথিবীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। ফ্রিওনা সেদিন শেহজাদের হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল,

“অ্যাই অ্যাম ভেরি স্টাবর্ন। দিস ইজ হোয়াই, টুডে অ্যাই অ্যাম লিবিং মাই ডটার এন্ড হাসবেন্ড। প্লিজ ম্যারি এগেইন এন্ড গেট অ্যা নিউ মাদার ফর হার। হু উইল লাভ হার এজ ওয়েল এজ ইউ।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল শেহজাদ। এই চৈত্রমাসের শেষ দিনই ছিল ফ্রিওনার শেষ দিন। বসন্তের শেষ দিনেই চলে গেল তার জীবনের বসন্ত। মাঝেমাঝে খুব রাগ হয়, ফ্রিওনা এত জেদি কেন ছিল! এতটা একরোখা!

চলবে ইনশাআল্লাহ,

রিচেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-০৫

0

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৫
মীরার বিস্ময় এখনও কা*টেনি। ড: আকবর রেহমান ফের বলেন,
“ফ্রিশা খুব একা একা থাকে। ওর দাদুমনির সাথে যেটুকু সময় থাকার থাকে। তারপর নিজের মতো। শেহজাদও ওকে খুব একটা টাইম দিতে পারে না। বাসায় আসলেও কাজ ও ল্যাপটপেই বসে থাকে। মায়ের অভাবটা খুব বেশি কষ্ট দেয় ওকে। ওর ড্রয়িং খাতার ছবি দেখলেই বুঝা যায়। মাঝেমাঝে ও একা একা কথাও বলে।”

মীরা ঢোক গিলে নিজেকে ধাতস্থ করে ফ্রিশার দিকে দৃষ্টি ফেলে। পুতুলের মত বাচ্চাটা সবার সাথে কী সুন্দর মেতে আছে। দেখে মনেই হবে না বাচ্চা মেয়েটার হৃদয়ের অন্তস্থলে এক রাশ দুঃখ লুকিয়ে আছে। মীরা আকুল হয়ে শুধায়,

“ওর মায়ের কী হয়েছে?”

“মা*রা গেছে!”

মীরার বুকটা কেঁপে ওঠল। সাথে সাথে দোয়া পড়ল। তারপর প্রশ্ন করল,
“কী হয়েছিল?”

ড: আকবর রেহমান লম্বা নিঃশ্বাস ফেললেন। অতঃপর জবাব দিলেন,
“ফ্রিশার জন্মের সময় ফ্রিওনার কিছু প্রবলেম ছিল, যা ফ্রিওনা তখন কাউকে জানায়নি। পরে সেটা টিউমারে রূপ নেয়। টিউমার থেকে ক্যান্সার। ফ্রিওনার মায়ের মৃত্যুও এই কারণেই হয়েছিল।”

“উনি চিকিৎসা করায়নি?”

“নাহ্!”

মীরা ব্যকুল হয়ে জানার আগ্রহে আছে। ড: আকবর রেহমানের কণ্ঠে ঝড়ে পরে এক রাশ হতাশা। তিনি বলেন,

“নিজের অসুস্থতা ও প্রকাশ করতে চাইত না। শেহজাদও ঠিক তেমনটাই। ফ্রিওনার যখন গুরুতর অবস্থা তখন সে দ্বিতীয়বার প্রেগন্যান্ট। এইতো প্রায় আড়াই বছর আগের কথা। তখন তিন মাসের প্রেগন্যান্সি। শেহজাদ তখনি জানতে পারল সবটা। ফ্রিশার জন্ম আমেরিকাতে হওয়াতে ফ্রিওনা সবটা লুকাতে পেরেছিল। ফ্রিওনার প্রথম প্রেগন্যান্সি জানার কিছুদিন আগেই শেহজাদ বাংলাদেশে এসে ভার্সিটিতে জয়েন করেছিল। চাইলেও সব ছেড়ে যেতে পারছিল না। তখন ফ্রিওনার বাবা, দাদী ও শেহজাদের বাবা-মা আমেরিকায় ওর কাছেই ছিল। তাই শেহজাদ অনেকটা নিশ্চিন্তে ছিল। ফ্রিওনা নিজের আসল প্রবলেমের কথা কাউকে জানতে দেয়নি। সে ভেবেছিল এটা ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু যখন সেকেন্ড প্রেগন্যান্সির সময় শেহজাদ সব জানতে পারল তখন ফ্রিওনাকে বারবার বলা হয়েছে, বেবি এ*বোর্ট করে ট্রিটমেন্ট করাতে। কিন্তু ফ্রিওনা এতোটাই জেদি যে সে দরকার পরলে সব ছেড়ে চলে যাওয়ার হু*মকি পর্যন্ত দিয়েছে। তারপর আর কী! প্রেগন্যান্সির সেভেন মান্থে ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশনে ওকে হসপিটালে এডমিট করা হয়।”

থেমে একটু দম নিল ড: আকবর রেহমান। মীরা অস্থির হয়ে আছে। শরীর কাঁপছে তার। সে অধৈর্য হয়ে শুধায়,

“তারপর?”

এরইমধ্যে মীরার ডাক পরল। জিনিয়া ডাকছে ছবি তোলার জন্য। ড: আকবর রেহমান বলল,
“যাও, ছবি তুলো। বাকিটা তুমি হয়তো আন্দাজ করতে পারছ।”

মীরা ঠোঁট কা*ম*ড়ে লম্বা শ্বাস নিলো। ওই সময়টা নিজে কল্পনা করতে নিলেও ঘাবড়ে উঠছে মীরা। অতঃপর ঘাড় নেড়ে, আঁচল দিয়ে কপালের ঘর্ম বিন্দুদের মুছে নিয়ে বন্ধুদের দিকে এগুলো। জিনিয়া মীরাকে টেনে এনে বলে,

“ধর ক্যামেরা ধর। স্যারের সাথে সুন্দর একটা ছবি তুলে দে। তারপর ফ্রিশার সাথেও।”

মীরা বিনাবাক্যে ক্যামেরা নিয়ে ঠিকঠাক করে ছবি তুলে দিল। এরপর জিনিয়া মীরার হাত থেকে ক্যামেরা নিয়ে মীরাকে স্যারের পাশে দাঁড়াতে বলল। মীরা একটু ইতস্তত করছিল কিন্তু এখন ছবি না তুললেই বরং অস্বস্তিকর লাগবে। তাই ওষ্ঠকোণে কৃতিম হাসি রেখে ছবি তুলল। একটা ছবি তোলার পরেই ফ্রিশা উচ্ছাসিত হয়ে বলে ওঠল,

“আমিও আন্টি ও বাবার সাথে ছবি তুলব।”

জিনিয়া সায় দিয়ে বলে,
“অবশ্যই। তুমি দাঁড়াও বেবি। আন্টি তুলে দিচ্ছি।”

মীরা ও শেহজাদ দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে গেল। অন্যকারও বেলায় ফ্রিশা এই জেদ করেনি। নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিল। শেহজাদ বলে,
“তোমরা তুলো। আমি আর তুলব না।”

কিন্তু ফ্রিশা জেদ ধরেছে।
“না বাবা। তোমাকে তুলতেই হবে। প্লিজ বাবা প্লিজ।”

মীরাও জিনিয়াকে চোখের ইশারায় না করলে, জিনিয়া বরং আরও বলে,

“স্যার, আপনি ফ্রিশার কাঁধে এক হাত রাখুন। আর মীরাও।”

জিনিয়া বলতে দেরি কিন্তু ফ্রিশা ওদের এক হাত নিজের কাঁধে রাখতে দেরি করে না। তৎক্ষণাৎ মীরা ও শেহজাদ দুজনেই চকিত দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকায়। জিনিয়া তার পটু হাতে মূহুর্তেই সেটা ক্যাপচার করে নিল। তারপর ওরা দৃষ্টি সরিয়ে সামনের দিকে তাকালে আরেকটা ছবি তুলে নেয়। ছবি তোলা শেষে শেহজাদ বলে,

“অ্যাই ফিল সো হ্যাপি টু মিট অল অফ ইউ। হ্যাভ ফান। বায়। টেক কেয়ার।”

সবাই উষ্ণ বিদায়বার্তা দিয়ে শেহজাদদের বিদায় দেয়। এরপর মীরা ও তার বন্ধুরা আগে থেকে বুকড করা রেস্টুরেন্টে যায়।

_______

বাড়ি ফিরে মীরা ফ্রেশ হয়ে আজকের দিনের ছবিগুলো দেখছিল। পরপর ফ্রিশা ও শেহজাদ স্যারের সাথে ছবি দুটো দেখে কিয়ৎ সময় ব্যয় করে। ছবিটা দেখেই কেমন অস্বস্তি হতে থাকে তার। তৎপর জলদি করে ফোনের স্ক্রিণ অফ করে চোখ বুজে নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে ধাতস্থ করে নেয়। হালকা মাথা ধরেছে। চা খেতে হবে। চটজলদি রান্নাঘরে গিয়ে চু*লোয় চায়ের জন্য গুড়ো দুধ গুলিয়ে বসাল। তখন নিধি ও শারমিন রান্নাঘরের কাছেই ছিল। নিধি বলল,

“চা বানাচ্ছ? তাহলে আমার ও ভাবির জন্যও বানিও।”

শারমিন হাসতে হাসতে বলে,
“আমার ও নিধির চা তো নিধির চা-খো*র বি*চ্ছুটাই অর্ধেক খেয়ে ফেলে। এটুকুন বাচ্চার চায়ের এত নে*শা!”

নিধিও হেসে উঠে বলে,
“আর বলো না ভাবি, সে তো বিকেল হলেই আমাকে নজরে নজরে রাখে। মাঝেমধ্যে বিকেলে তুমি-আমি যে ওকে লুকিয়ে চা খাই তা সে বুঝতে পেরে গেছে।”

“নিহানের দেখাদেখি সিয়ামও চামচ দিয়ে চা খেতে চায়।”

মীরা আরও দুধ গুলিয়ে ও সাথে তরল দুধও দিয়ে দিয়েছে। ভাবিদের কথা শুনে মিটিমিটি হাসছেও। তার ছোটো ভাইয়ের সাড়ে তিন বছরের ছেলে নিহানটা একদম তার ফুফির মতো চা-খো*র হয়েছে। বড়ো ভাইয়ের দেড় বছরের ছেলেটাও নাকি চা খেতে চায়! ভাবা যায়! মীরা তিন কাপ চা বানিয়ে নিল। ভাবিদের দিয়ে নিজেও নিয়ে সাথে বসল। আড্ডায় আড্ডায় চা খাওয়া শেষ করে আবার নিজের ঘরে চলে গেল।

________

মিসেস শাহিদা রেহমান, স্বামীকে চিন্তিত দেখে পাশে এসে বসলেন। অতঃপর শুধালেন,
“কী হয়েছে? কিছু নিয়ে চিন্তিত?”

ড: আকবর রেহমান নিজের স্টাডিরুমে চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে ছিলেন। স্ত্রীর কণ্ঠস্বরে ঠিক হয়ে বসলেন। ম্রিয়মাণ স্বরে বললেন,

“হ্যাঁ। তোমাকে বলেছিলাম না একটা মেয়ের কথা? যার সাথে কাল ভার্সিটিতে কথা হলো।”

“হ্যাঁ। কী হয়েছে?”

“মেয়েটার সাথে পার্কে আজও দেখা হলো। সবটা বললাম। জানিনা কী সিদ্ধান্ত নিবে। তবে একজন অবিবাহিতা মেয়ে কি এই প্রস্তাবে রাজি হবে? তা নিয়ে সন্দিহান আমি।”

মিসেস শাহিদাও বললেন,
“এটা ঠিক বলেছ। হয়তো রাজি হবে না। কিন্তু তুমি ওই মেয়েকেই কেন বললে?”

“কারণ মেয়েটা সফট হার্টের। আমার রিসার্চ স্টুডেন্ট ছিল। বেশ ডেডিকেটেড। রেজাল্টও ভালো। রিসার্চ স্টুডেন্টদের সাথে অনেকটা সময় আড্ডাও হতো, তখন এসব বিষয় উঠলে ওকে বলতে শুনতাম যে, ‘মেয়েরা অন্যের বাচ্চাকে তো বেশ আদর-যত্ন করে কিন্তু স্বামীর আগের ঘরের সন্তানকে সহ্য কেন করতে পারে না? আগের ঘরেররই তো সন্তান। আগের স্ত্রীর বিয়োগেই তো বিয়ে করেছে। জেনেই তো বিয়ে করেছে। এমন তো না যে স্বামী তাকে চি*ট করে অন্য মহিলাকে তার সংসারে ঢুকিয়েছে।’ ওর চিন্তা-ধারা সুন্দর। সাথে ওর অতীতও জানি আমি। যাকে মীরা ভালোবাসত, সেই বর্ণও আমার মাস্টার্সের রিসার্চ স্টুডেন্ট ও লাস্টবার জিটিএ ছিল। বর্ণ জাপানে গিয়ে বিয়ে করে নিল, তারপর মীরাও মাস্টার্স করতে ইন্ডিয়া চলে গেল।”

ড: আকবর রেহমান থামলেন। চিন্তা হচ্ছে তার। যদি মীরা রাজি নক হয়? মিসেস শাহিদা বললেন,
“মীরা রাজি হলেও, ওর পরিবার? তাছাড়া শেহজাদ? কী যে হবে! এতে চিন্তা ভালো লাগে না। বয়স হয়েছে। কখন কী হয়ে যায়।”

মিসেস শাহিদা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে ফ্রিশার খাওয়ার সময় হওয়াতে চলে যান।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

রিচেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-০৪

0

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪
সকাল নাস্তা করে মীরা ইন্টারনেটে কিছু জবের সার্কুলার চেক করল। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ার সবাই আজ বাড়িতে। তাইতো বেশ জমজমাট আয়োজন। বিকেলে আবার ভার্সিটির কিছু ফ্রেন্ডদের সাথে মীরার দেখা করার কথা। সবাই আজ রবীন্দ্র সরোবরের ওখানে বিকেলবেলা ছবি-টবি তুলে একটা রেস্টুরেন্টে বসবে, আড্ডা দিবে। জুম্মার নামাজের পর বাড়ির পুরুষ সদস্যরা ফিরলে একসাথে লাঞ্চ করার পর, বেরোনোর জন্য তৈরি হতে মীরা বেশ সুন্দর একটা কালো কটন সিল্ক শাড়ি বের করে পড়ে নিল। শাড়িটা তাকে রাইমা গিফট করেছিল। সাথে কালো পাথরের বড়ো ঝুমকো ও চুড়ি। লম্বা ঢেউ খেলানো চুলগুলোকে সামনে দিয়ে ঢিলে করে এনে খোঁপা করে সেট করে নিল। চোখে কাজল, ঠোঁটে হালকা নুড শেইডের লিপস্টিক, হালকা মেকআপের ছোঁয়ায় সাজ শেষ করে কালো পার্সটা নিয়ে মা, ভাবিদের বলে বেরিয়ে পরল। আগে থেকেই উবারে বলা ছিল। বাড়ি থেকে বের হয়ে সামনের গলি পেরিয়ে রোডে উবার অপেক্ষা করছে। গাড়িতে উঠবে তখন গলির ফুলের দোকানে সাদা গোলাপ দেখে তিনটে কিনে নিল। তারপর খোঁপায় লাগিয়ে নিজেকে ফোনের ক্যামেরায় দেখে একটা সেলফি তুলে সেটা রাইমাকে হোয়াটসআপ করে দিল।

এদিকে শেহজাদ ল্যাপটপের মধ্যে ডুবে আছে। ফাইনাল পরীক্ষার প্রশ্ন আগামীকাল করবে। আজকে কিছু আর্টিকেল রিসার্চ করছে। ফ্রিশা সারাদিন বাসায় থেকে থেকে বোর হয়ে বাবার কাছে এসে হাজির। আবদার করে বসল,

“বাবা, চলো না ঘুরতে যাই।”

শেহজাদ ল্যাপটপেই মুখ গুঁজে বলে,
“উহুম। তুমি দাদুমনির সাথে যাও।”

“চলো না বাবা।”

শেহজাদ নরম স্বরে বলল,
“দেখছ তো কাজ করছি।”

ফ্রিশা এবার জেদ ধরে রইল। সে যাবেই যাবে। তখন মিসেস শাহিদা রেহমান এসে বললেন,
“নিয়ে যাও না। এত কাজ করে কী হবে? মেয়েটা সপ্তাহে দুটো দিন তোমাকে কাছে পায়, তাও তুমি কাজে ডুবে থাক।”

শেহজাদ লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“সবসময় তো আপনি নিয়ে যান। আজকেও নিয়ে যান না।”

ফ্রিশা বলে ওঠল,
“আজ আমরা সবাই যাব। তুমি, দাদুমনি, দাদাভাই ও চাচ্চুও। ওইযে বাসার সামনে লেক আছে ওখানে।”

মিসেস শাহিদা রেহমানও বললেন,
“রাজি হয়ে যাও শেহজাদ। চলো ঘুরে আসি।”

“আচ্ছা চলুন।”

ফ্রিশা খুশিতে লাফিয়ে উঠে বাবার গালে চু*মু এঁকে ছুটে তৈরি হতে গেল। শেহজাদ হালকা হেসে ল্যাপটপ বন্ধ করে রাখল।

_________

রবীন্দ্র সরোবরের লেক পাড়ে বন্ধুদের সাথে ছবি তোলা ও ছবি তোলা দেখাতে ব্যস্ত মীরা। মীরার ভার্সিটি লাইফের বেস্টফ্রেন্ড জিনিয়া আজ ওর হাত ছাড়ছেই না। আড্ডা মশগুলে ঝালমুড়ি যেন আরও জমে গেছে। জিনিয়া মীরাকে বেশ কয়েকটা সুন্দর ছবি তুলে দিয়েছে সেই সাথে মীরাও জিনিয়াকে। গ্রুপ ছবি আরেকটু পর তোলা হবে। জিনিয়া মীরাকে নিয়ে কয়েক হাত দূরে বসে গল্প জুড়ে দিয়েছে। জিনিয়া এরইমধ্যে বলে,

“ভাই, বিয়ে করে বড্ড ফেঁসে গেছিরে। যেখানেই যাই হাসবেন্ডটাকে সাথে করে নিতেই হবে। আজকে ওকে অনেক রিকুয়েস্ট করে রেখে এসেছি। আগের লাইফটাই ভালো ছিল না-রে?”

“তা ঠিক বলেছিস। কিন্তু ভাইয়া তো তোকে কত ভালোবাসে।”

“তোর ভাইয়া আমাকে ভালোবাসে বলেই তো আমি ফেঁসে গেছি। তার ভালোবাসার সাগরে ডুবে ডুবে আজ হাবুডুবু খাচ্ছি। না হলে দেখ আমার ক্রা*শগুলো যা জোস জোস ছিল!”

মীরা হাতে আ*লতো মে*রে বলে,
“চুপ। তোর বিয়ে হয়েছে না? এসব বলবি না। এখন বলার কথা আমার কিন্তু বলছিস তুই!”

“তো বল। তোর ক্রা*শগুলাকে কি তুই ভুলে গেছিস? তারমধ্যে কিন্তু ভার্সিটির হ্যান্ডসাম শেহজাদ স্যারও ছিল! যখন উনি প্রথম প্রথম ভার্সিটি জয়েন করেছিল….!”

মীরা তৎপর হয়ে আশেপাশে চেয়ে জিনিয়ার মুখে হাত দিয়ে চে*পে বলে,
“থাম থাম! আস্তে বল। উনি বিবাহিত। একটা কিউট ডলের মত বেবিও আছে। এসব বলিস না।”

“ও তাই! তুমি যে উনার ক্লাসে বসে হাঁ করে উনার দিকে তাকিয়ে থাকতে!”

মীরা অস্বিকার করে বলে,
“মোটেও না। আমি পড়া বুঝতাম। উনি অনেক ভালো বুঝায়।”

“হয়েছে বুঝেছি। ওই বর্ণ ভাইয়ের পাল্লায় পরে তুমি ক্রা*শ-টাশ থেকে দূরে সরে গেছ। কিন্তু ওই লোক একটা চি*ট বের হলো।”

হুট করে মীরার মন খারাপ হয়ে গেল। সে সামনের জলরাশির দিকে দৃষ্টি সরিয়ে উদাস কণ্ঠে বলল,
“বাদ দে প্লিজ। ও আমার জীবনের এক বি*ষাক্ত অতীত। যদি বুঝতাম তবে ভার্সিটির প্রায় লাস্টের দিকে এসে এভাবে ফেঁসে যেতাম না।”

জিনিয়া মীরাকে পাশ থেকে জড়িয়ে বলে,
“অতীত ভুলতে বর্তমানে কাউকেতো স্থান দে। সে তো বউ নিয়ে বেশ আছে। জাপানে এখন। জাপানে গিয়েই সেখানকার মেয়ে বিয়ে করে নিয়েছে। সে তো দেড় বছরের ভালোবাসা মনে রাখেনি। তুই কেন সেটা মনে রাখবি। আগের মত ফুলে ফুলে মেতে থাক মীরা। তোকে মূর্ছিত ভালো লাগে না।”

জিনিয়ার কথা শুনে মীরা আলতো হাসলো। অতঃপর চকচকে রৌদ্রময় নীল অম্বরে চেয়ে চোখ বুজল। না তার এখন আর বর্ণের জন্য কষ্ট হয় না। কিন্তু জীবনে ঠকে যাওয়ার আফসোস হয়। হঠাৎ একটা কাগজের প্লেন এসে মীরার চোখে লাগে। মীরা আকস্মিকভাবে চোখ মেলে দেখে নিল কাগজের প্লেনটা। অদূরের লালচে বাদমী চুলে দুই ঝুটি করা এক ছোটো বাচ্চা মেয়ে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জিনিয়া তার হাসবেন্ডের সাথে চ্যাটিংয়ে হঠাৎই ব্যস্ত হয়ে পরেছে। মীরা উঠলে জিনিয়া ওর দিকে চেয়ে বলে,

“কী হলো?”

“কিছু না। তুই কথা বল।”

মীরা কাগজের প্লেনটা উঠিয়ে হাসিমুখে বাচ্চাটার কাছে যায়। তারপর হাঁটু গেড়ে বসে বাচ্চাটার গালে হাত দিয়ে বলে,

“কী কিউট তুমি। মাশাআল্লাহ।”

বাচ্চাটা ভয়ে ভয়ে বলে,
“সরি আন্টি। আমি ইচ্ছে করে করিনি। তুমি বকো না।”

“কে বকবে তোমাকে? এত কিউট পুতুলকে বকবে কে বলো তো?”

বাচ্চাটা খুশি হয় ভীষণ। সে মীরার গালে হাত দিয়ে বলে,
“তোমাকে ফেইরিটেলের ফেইরির মত লাগছে। ইউ আর সো প্রিটি।”

মীরা মিষ্টি হাসলো। তখনই একজন পুরুষ, বাচ্চাটির নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ছুটে এলো। এসেই বাচ্চাটিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

“ফ্রিশা, তুমি একা একা এসেছ কেন? দেখছ না কত মানুষ? যদি হারিয়ে যাও?”

মীরা সামনের লোকটাকে দেখে উঠে দাঁড়াল। অতঃপর চুপ করে রইল। ফ্রিশা বলল,
“রিল্যাক্স বাবা। আমি প্লেন দিয়ে খেলছিলাম। দেখো, খেলতে খেলতে এই আন্টির চোখে প্লেন লেগে গেছে।”

শেহজাদ এবার সামনের রমণীটির দিকে তাকাল। কালো শাড়িতে রমণীটিকে সে চিনে। শেহজাদ বলল,
“মীরা!”

মীরা সালাম দিয়ে হাসিমুখে বলল,
“জি স্যার।”

“ও সরি। ফ্রিশা ইনটেনশনালি করেনি।”

“ইটস ওকে স্যার। বুঝতে পেরেছি আমি।”

ফ্রিশা দুজনের মুখের দিকে চেয়ে সন্দিহান হয়ে শুধায়,
“ডু ইউ নো ইচ আদার?”

তখন পেছন থেকে একজন বলে ওঠল,
“হ্যাঁ ফ্রিশা। তোমার বাবা ও এই আন্টি একে-অপরকে চেনে।”

ফ্রিশা পেছনে ঘুরে দেখে তার দাদুভাই কথাটা বলেছে। সাথে দাদুমনি ও হুইলচেয়ারে বসা চাচ্চুও এসেছে। ফ্রিশা কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করে,

“কীভাবে?”

মীরা ওর কৌতহল মেটাতে বলে,
“তোমার বাবা ও দাদুর স্টুডেন্ট আমি।”

“ও আচ্ছা। তুমি খুব প্রিটি আন্টি। মাম্মামের পর ইউ আর অ্যা প্রিটি গার্ল।”

মীরা কথাটাকে সহজভাবেই নিল কারণ প্রতিটা সন্তানের কাছে তার মা সবচেয়ে সুন্দর। কিন্তু সহজভাবে নিতে পারল না শেহজাদ। সে ফ্রিশাকে তাড়া দেখিয়ে বলল,

“চলো ফ্রিশা। আন্টিকে বায় বলো।”

ফ্রিশা হালকা মন খারাপ করে বায় বলে চলে যেতেই নিবে তখনি কয়েকটা কন্ঠস্বর একত্রে ডেকে ওঠল,

“স্যার! স্যার! দাঁড়ান।”

শেহজাদ পেছনে ঘুরে দেখে চৌদ্দ-পনেরো জনের গ্রুপ তাকে ডাকছে। সবাই ছুটে এসে শেহজাদকে ঘিরে ধরে। বাহানা ছবি তুলবে। প্রথমে গ্রুপ সেলফি। সেলফিতে ড: আকবর রেহমান, তার স্ত্রী-পুত্র ও ফ্রিশাও সামিল। তারপর সবার সাথে সিঙ্গেল ছবি। মীরা একটু সরে দাঁড়ালো। হুড়োহুড়ি শেষ হলে সেও ছবি তুলবে।

মীরার পাশে এসে দাঁড়ালেন ড: আকবর রেহমান। তিনি মীরাকে শুধান,
“কেমন আছো মীরা?”

মীরা আচমকা থতমত খেয়ে যায়। তার অস্বস্তি হচ্ছে। তাও সৌজন্যতার বশে বলে,
“আলহামদুলিল্লাহ স্যার। আপনি?”

“আলহামদুলিল্লাহ। প্রস্তাবটা ভেবে দেখলে?”

মীরা কেঁপে ওঠল। এখান থেকে সরে যাওয়ার জন্য মাথা নিচু করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। ড: আকবর রেহমান আবারও বললেন,

“এই ছোটো বাচ্চাটাকে দেখো। তুমি রাজি হলে ও মা পাবে। আমি জানি তুমি গতানুগতিক সৎমাদের মত হবে না।”

হকচকিয়ে চাইলো মীরা। আকস্মিক শোনা অপ্রত্যাশিত শব্দগুচ্ছ তার মস্তিষ্ক গুলিয়ে ফেলছে। মনের গহ্বরে উদিত হচ্ছে অসংখ্য প্রশ্নের বাহার। কী করবে মীরা?

চলবে ইনশাআল্লাহ,