Saturday, August 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 469



মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-৩২+৩৩

0

#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩২
আজকের দিনটা বেশ সারপ্রাইজিং ছিল মীরার জন্য। শেহজাদ ও-কে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে যাওয়ার পর কলিগদের থেকে শুরু করে স্টুডেন্টদের ভালোবাসায় মন সিক্ত হয়েছে তার। আজকের দিনে যে কয়টা ক্লাস নিয়েছে, প্রতিটা ক্লাস থেকে কিছু না কিছু গিফট তো পেয়েছেই। সাথে স্টুডেন্টদের আন্তরিক শুভেচ্ছা। তারমধ্যে প্রত্যেকের থেকে ফুলের তোড়াও উপহার পেয়েছে। ভার্সিটির অফিস টাইম শেষে মীরা অপেক্ষা করছে শেহজাদের জন্য। মীরার কলিগ দুজনের মধ্যে কনক ম্যাম নিজের ব্যাগ গুঁছিয়ে বেরোবে তখন হাস্যরসে বলে,
“হাসবেন্ডের জন্য অপেক্ষা করছো? আমারও এমন হতো। বিয়ের প্রথম দিকে। কষ্ট করে হলেও নিতে আসবেই।”

মীরা মৃদু হাসে। সাবিহা ম্যামও সাথে তাল মেলায়,
“আমার জন বড্ড অলস। সকালে দিয়ে যায় তারপর বিকেলে এই ট্রাফিক ঠেলে তার নিতে আসতে মোটেও ইচ্ছে করে না। তাই আমি উবার ডেকে চলে যাই। কনক ম্যামের তো এখন নিজস্ব গাড়িই আছে।”

“গাড়ি থাকলেও কী! অলসতার জন্য ড্রাইভিং শিখতে পারলাম না।”

“রিল্যাক্সে বাড়ি ফিরতে পারলে শেখার থেকে না শেখাই ভালো। তবে সেফটির জন্য শেখা থাকা উচিত।”

মীরা ওদের কথায় এবার প্রত্যুত্তর করে,
“আমিও উনাকে ট্রাফিকের কথা বলেছিলাম, কিন্তু শোনেনি। ভালোই হয়েছে, উবার বা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে একটু কেয়ারফুল থাকতে হয়।”

“হুম। থাকো তবে। উবার কাছাকাছি চলে এসেছে। গেলাম।”

সাবিহা ম্যাম চলে গেলেন। কনক ম্যামও ফোন আসাতে কথা বলতে বলতে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়েন।

প্রায় আধঘণ্টা পর শেহজাদ কল করলে মীরা নিজের অফিস রুম থেকে আজকের উপহার গুলো নিয়ে বেরোয়। সে গাড়ির কাছে পৌঁছালে, ড্রাইভিং সিটে বসে শেহজাদ গাড়ির ফ্রন্ট সিটের ডোর খুলে দেয়। মীরা গাড়িতে বসেই আগে নিজের ব্যাগ ও ফুলগুলো পিছনের সিটে রেখে তারপর ডোর লক করে। শেহজাদ সরু দৃষ্টিতে এসব দেখছে। মীরা সোজা হয়ে বসলে শেহজাদ জিজ্ঞাসা করে,

“এতো ফ্লাওয়ার?”

“হ্যাঁ স্টুডেন্টরা দিলো। সুন্দর না দেখুন? লিলি ফ্লাওয়ারের দুটো রঙের দুটো তোড়া। তারপর ডিফরেন্ট কালারের ডেইজি ফ্লাওয়ারের একটা তোড়া। খোঁপায় দেখুন। (মীরা হালকা পিছ ঘুরে তার খোঁপা দেখালো) একটা কালো গোলাপ ও দুইটা লাল গোলাপ। হলুদ ও হালকা গোলাপি ও সাদার মিশেলেরও গোলাপ দিয়েছে। তোড়াগুলোর মধ্যে রেখে দিয়েছি। আসলে তিনটা খোঁপায় পড়িয়ে দিলো বলে তোড়াটা খুলতে হলো।”

শেহজাদ গাড়ি স্টার্ট করে বলে,
“ওয়াও! ভার্সিটিতে কোয়াইট ফেমাস তুমি!”

মীরা এটাকে কম্পিলিমেন্ট হিসেবে নিলেও শেহজাদ মোটেও এটা প্রশংসাবাদ দেয়নি। মীরা খুশি মনে বলে,

“ফেমাসের জন্য না। বিয়ের পর আজকে ফার্স্ট ক্লাস নিলাম। ওরা নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করেছে। ওরা খুব ফ্রেন্ডলি।”

“ইয়াস্টারডে তো আমিও ভার্সিটিতে গেলাম। তো?”

মীরা এবার শেহজাদের বলার ধরণ খেয়াল করে। সামান্য ঘুরে বসে শুধায়,
“আপনি কি জে*লাস? আপনার স্টুডেন্টরা আপনাকে কেন ফুল দিলো না তাই জন্য?”

শেহজাদ থতমত খেয়ে চো*রা নজরে একবার তাকিয়ে কণ্ঠে স্বাভাবিকতা এনে বলে,
“অফকোর্স নট। জাস্ট আস্কিং। ফ্লাওয়ার এসব ফিমেইল ফ্যাকাল্টিদেরকেই স্টুডেন্টরা দেয়। তোমার স্টুডেন্টদের ম্যাক্সিমাম কি ফিমেইল?”

“না। এভারেজ। কিছু ক্লাসে মেয়ে বেশি, কিছুতে ছেলে বেশি। আপনি তো বুঝেনই।”

“হুম। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করি?”

“করুন।”

“যখন তুমি আমার স্টুডেন্ট ছিলে, তখন তোমার আমাকে কেমন মনে হতো? লিটারেলি আমি দেখি স্টুডেন্টরা আমাকে দেখলে কেমন রো*বটের মতো থেমে যায়। লিফটে এমনটা বেশি হয়। করিডরে তো জলদি করে সালাম দিয়ে পাশ কা*টা*তে পারলেই যেন বেঁচে যায়, এমন ভাবে চলাচল করে।”

মীরা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে অতি স্বল্প আওয়াজে নিজে নিজেই বলে,
“ভার্সিটির ফার্স্ট দিন আপনাকে ফার্স্ট দেখেই তো আমি সহ আমার বান্ধবীরা ক্রা*শ খেয়ে বসেছিলাম! এটা এখন কীভাবে বলি!”

শেহজাদ নিজের প্রশ্নের জবাব না পেয়ে ফের শুধায়,
“বললে না?”

“ও ও হ্যাঁ।!

মীরা দ্রুত সোজা হয়ে বসে। শেহজাদেে দিকে তাকালে শেহজাদ ইশারায় বলতে বলে সামনের দিকে ফিরে ড্রাইভ করতে থাকে। মীরা বলেই ফেলে,
“আপনি তো ডিপার্টমেন্টের মেয়েদের ক্রাশ ছিলেন!”

শেহজাদ মীরার দিকে সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হেসে বলে,
“তোমারও?”

“না না। আমার ক্রাশ হতে যাবেন কেন! আমি সবার কথা বলছি।”

মীরা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে ঠোঁট কা*ম*ড়ে সিটে গা এলিয়ে দেয়। অতঃপর ঠিক হয়ে আবার গাড়ির সামনে রাখা পানির বোতল নিয়ে পানি খায়। শেহজাদ ওর অস্থিরতা দেখে মুচকি হেসে কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে বলে,
“যেদিন আমার মেয়ে পৃথিবীতে এলো, সেদিন ক্লাসে সবাইকে নিউজটা দিতেই সবাই চমকে উঠেছিল। মেয়েরা একযোগে আস্ক করে বসে, ‘স্যার আপনি ম্যারিড?’ সেদিনি আমার টিএ অফিস আওয়ারে এসে ব্যাপারটা নিয়ে আমাকে বলছিল। ডিপার্টমেন্টের মেয়েরা নাকি আজ অনেক দুঃখী।”

মীরা বলে,
“আমরা কিন্তু আপনার মেয়ে হওয়াতে অখুশি হয়েছিলাম, তেমনটা না। আসলে আপনাকে দেখে মনে হতো না আপনি ম্যারিড। তাছাড়া ফেসবুকে আপনার রিলেশনশিপটা হাইড করা। নিজেও কখোনো বলেননি। হঠাৎ করে বেবির খবর পেলে শকড তো হবেই।”

“হুম বুঝলাম। বাদ দাও টপিক। সামনে মেবি ছোটো জ্যাম পড়বে। টায়ার্ড হলে ঘুমাতে পারো।”

মীরা চুপ করে সিটে হেলান দিয়ে থাকলো।

_______

রাতের ডিনার করে মীরা, ফ্রিশাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিজেও ফ্রিশার পাশে ঘুমিয়ে পড়েছে। শেহজাদ রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত বই পড়ে হঠাৎ খেয়াল হলে মীরাকে খুঁজতে ফ্রিশার ঘরে গিয়ে দেখে মা-মেয়ে দুজনে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। শেহজাদ হালকা হেসে ভিতরে গিয়ে ফ্রিশার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে আদুরে ঠোঁ*ট ছুঁইয়ে দেয়। অতঃপর মীরাকেও। মীরা খানিক নড়েচড়ে উঠলে দুজনের গায়ে চাদর টেনে দিয়ে লাইট নিভিয়ে শেহজাদ সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। নিজের রুমে এসে শেহজাদও লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়ে।

পরদিন সকালে ফজরের আজানের সময় মীরার ঘুম ভাঙলে নিজেকে ফ্রিশার ঘরে দেখে উঠে বসে। চোখ লেগে যাওয়াতে এখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। উঠে আস্তে আস্তে নিজের রুমে গিয়ে দেখে শেহজাদ ঘুমাচ্ছে। মীরা মৃদু স্বরে ডাকে। তারপর দুজনে একসাথে নামাজ পড়ে। মীরা কফি বানিয়ে আনে। মীরা ড্রাইকেক খেতে খেতে বলে,
“রাতে কীভাবে চোখ লেগে গেছে। টেরই পাইনি।”

শেহজাদ মীরার দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলে,
“টায়ার্ড ছিলে। হয় এরকম।”

“হুম। আজ কিন্তু আমার সকালে ক্লাস নেই। আমি পড়ে যাব।”

“আচ্ছা। ড্রাইভার ফ্রিশাকে স্কুলে ড্রপ করে তোমাকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দিবে।”

মীরা মাথা নেড়ে কফি শেষ করে দুটো মগ ও বাটি নিয়ে কিচেনে চলে যায়। সবার জন্য নাস্তা বানাবে আজ।

_______

আজও মীরা ফ্রিশাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে সেখানেই ঘুমিয়ে গেছে। শেহজাদ, গতদিনের মতো ফ্রিশাকে দেখতে ও মীরাকে খুঁজতে গিয়ে ওদের গায়ে চাদর টেনে রুমের আলো নিভিয়ে চলে আসতে নিবে তখন দরজায় মিসেস শাহিদাকে দাঁড়ানো দেখে। উনার হাতে পানির বোতল। মিসেস শাহিদা শুধালেন,

“মীরা এখানেই ঘুমিয়ে গেছে? তুললে না ও-কে?”

“থাক। ঘুমাক। আপনিও শুয়ে পড়ুন।”

“হুম। গতকালকেও দেখলাম মীরা এখানে ঘুমাচ্ছে। ভাবলাম ঝামেলা হলো কী-না?”

“না ফুফিজান। ঝামেলা হবে কেন? ও টায়ার্ড তাই ঘুমিয়ে পড়েছে।”

“আচ্ছা। সব ঠিক থাকলেই ভালো।”

মিসেস শাহিদা চলে যান। শেহজাদও নিজের রুমে চলে আসে।

গতদিনের মতো মীরা আজও ভোরে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে ফ্রিশার ঘরে আবিষ্কার করে নিজে নিজেই বলতে থাকে,

“আরে আমার এই স্বভাব কি যাবে না! বিছানায় একটু গা এলালেই ঘুমে তলিয়ে যাই! স্যার কী ভাবছেন এখন কে জানে! বাড়ির অন্যকেউ নোটিশ করলে তো ভালো দেখাবে না। নাহ্ কাল থেকে ঘুমানো যাবে না।”

মীরা উঠে নিজের রুমে যায়।

______

নিজের ক্লান্তির ধারাবাহিকতা রেখে মীরা পরদিনও একই কাজ করে! ঘুমিয়ে পড়ে। শেহজাদ আজকেও ফ্রিশার রুমে গিয়ে এই অবস্থা দেখে বিড়বিড় করে বলে,
“এই মেয়ে এতো ঘুমকাতুরে কেন? আজকেও ফুফিজান দেখলে কেমন হবে ব্যাপারটা! নাকি আমিও এখানেই থেকে যাব?

কিছু একটা ভেবে শেহজাদ চট করে মীরাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয়। ঘুমের মধ্যেই মীরা ধড়ফড়িয়ে উঠে চোখ খুলে নিজেকে শেহজাদের কোলে দেখে ভয়ার্ত স্বরে প্রশ্ন করে,

“কী হয়েছে? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”

মীরার ভয়ার্ত আঁখিযুগল বলছে, আচমকা ঘুম ভেঙে যাওয়াতে মীরা পরিবেশ বুঝতে পারছে না। শেহজাদ নরম স্বরে বলে,
“রিল্যাক্স। তুমি আজও এখানে ঘুমিয়ে পড়েছিলে। প্রথমে ভেবেছিলাম আমিও থেকে যাব এখানে কিন্তু চাই না ফুফিজান আজও দেখুক। আগামীকাল না আমরা তোমাদের বাড়িতে যাব? তাই ভেবেছিলাম, তোমার ঘুম না ভাঙিয়ে নিয়ে যাই।”

মীরা বুকে হাত দিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
“না মানে সরি। আমি আজ ঘুমাব না ঘুমাব না করে আবার ঘুমিয়ে গেছি। আসলে আমি কিন্তু এতো জলদি ঘুমাই না। ফোন কাছে থাকলে তো বারোটারও বেশি বাজে ঘুমাতে। আচ্ছা নামান আমাকে।”

“কেন? একেবারে রুমে নিয়ে নামাই।”

“আমি তো জেগেই গেছি। নামিয়ে দেন।”

শেহজাদ কোনো কথা না বলে নিশ্চুপে মীরাকে কোলে নিয়েই হাঁটতে থাকে। বাহিরে শীতল হাওয়া তবে বৃষ্টি আসার ভাব হলেও হয়তো আসবে না। শেহজাদের নিরবতায় মীরা খানিক কেঁপে ওঠে। ব্যালকনির দরজা দিয়ে আসা ঠান্ডা হাওয়ার পরিবেশটা বেশ আকাঙ্ক্ষিত! প্রণয়ের হাওয়া দুটি হৃদয়ে এসে ভীড়েছে তারই বহিঃপ্রকাশ যে এ!

চলবে ইনশাআল্লাহ,

ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৩
বৃহস্পতিবার, ভার্সিটি থেকে ফিরে শেহজাদ ও মীরা, ফ্রিশাকে নিয়ে মীরার বাবার বাড়িতে আসে। পৌঁছানো মাত্রই মীরার পরিবার তখন থেকেই আপ্যায়নে ব্যাস্ত। শেহজাদকে যেন মৌ*মা*ছির মতো ঘিরে ধরেছে। অবশেষে রাতের খাবারের শেষে শেহজাদ জামাই আদর থেকে আজকের মতো ছুটি পেলো। শেহজাদ মীরার রুমে এসে বিছানায় বসে। মীরা এখনও রুমে আসেনি। পাশের রুমে ভাবিদের সাথে গল্প করছে। ফ্রিশা, মৃদুলা ও নিহানদের সাথে খেলছে। ফ্রিশা আজ মৃদুলার সাথেই ঘুমাবে। মৃদুলাও ফ্রিশার মতো আলাদা ঘরে ঘুমায়। কিছুক্ষণ গল্প করার পর মীরার বড়ো ভাবি শারমিন বললেন,

“মীরু, তুমি এবার তোমার ঘরে যাও। ভাইয়া ঘরে একা আছেন। ফ্রিশার চিন্তা করো না। ও মৃদুলার সাথে খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে যাবে।”

“যাই ভাবি। ওদের একবার বলে যাই।”

এই বলে মীরা সেখান থেকে ওঠে মৃদুলার ঘরে গেল। তারপর ফ্রিশা ও মৃদুলার উদ্দেশ্যে বলল,
“জলদি ঘুমিয়ে পড়ো। বেশিক্ষণ খেলবে না কিন্তু। যাও শুয়ে পড়ো।”

মৃদুলা আদুরে মুখ করে বলল,
“প্লিজ ফুপি। আরেকটু।”

“না মৃদু। রাত এগারোটা বাজে, বাবু।”

এবার ফ্রিশাও এলো।
“প্লিজ, ফেইরিমাম্মাম। একটু খেলব। ফাইভ মিনিটস।”

“কাল সকালে খেলবে, বাচ্চা। অনেক রাত হয়েছে তো।”

“প্লিজ প্লিজ প্লিজ! ফাইভ মিনিটসই তো।”

মীরা গালে হাত দিয়ে বিছানায় বসে বলে,
“তোমাদের ফাইভ মিনিট ফিফটি মিনিট হতে সময় লাগবে না। খেলো! তারপর যখন মৃদুর আম্মু লা*ঠি নিয়ে আসবে! তখন এমনিই সোজা হয়ে যাবা।”

মৃদুলা ও ফ্রিশা মুখে হাত দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠে। মীরা হতাশ হয়ে সেখান থেকে চলে আসে। মৃদুলা ও ফ্রিশা আবার তাদের ওয়ার্ড গেম খেলতে শুরু করে।
_____

মীরা রুমে এসে দেখে শেহজাদ কপালে ও চোখের উপর হাত দিয়ে শুয়ে আছে। মীরা বসে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“আপনি ঘুমিয়ে গেছেন?”

শেহজাদ চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে লম্বা করে শ্বাস নিয়ে বলে,
“না। এমন অবস্থায় ঘুম আসে!”

ভ্রুকুঞ্চন করে তাকায় মীরা। ফের শুধায়,
“কেমন অবস্থায়?”

“এইযে দেখো! প্রায় গলা পর্যন্ত খাবার উঠে আছে। দুই-তিন দিক থেকে প্লেটে খাবার দিতে থাকলে আমি কী করব বলোতো? তুমি তো একটু বলতে পারতে।”

মীরা ফোন হাতে নিয়ে বলে,
“আমি কী বলব? জামাই আদর করবে না? আপনার জামাই আদরে আমি কথা বললে আমি বুঝি ধ*ম*ক খাব না? সবার সামনে ব*কা খেতে কার ইচ্ছে করে বলুন তো?”

শেহজাদ একটু উঠে বসে চুপ করে থাকে। মীরা ফোন রেখে শেহজাদের মুখের দিকে চেয়ে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞাসা করে,
“গ্রিনটি খাবেন? ভালো লাগবে।”

“আনো।”

মীরা উঠে গ্রিনটি বানাতে চলে যায়। অতঃপর পাঁচ মিনিট পর দুইটা মগে গ্রিনটি নিয়ে হাজির হয়। তারপর শেহজাদের দিকে একটা মগ এগিয়ে দিয়ে বলে,
“নিন। গ্রিনটি আগে অনেক খেতাম। তারপর কফি খাওয়া শুরু করেছি। তাও মা গ্রিনটি খায় বলে বাড়িতে আনা হয়।”

“থ্যাংকিউ।”

শেহজাদ মগটা নিয়ে এক চুমুক খেয়ে জিজ্ঞাসা করে,
“ফ্রিশা ঘুমিয়েছে?”

“না! পাঁচ মিনিটের নাম করে ওরা পঞ্চাশ মিনিট খেলবে। তারপর বড়ো ভাবি যাবে এরপর সোজা হয়ে ঘুমাবে। আমার দিকে ওরা কিউট কিউট ফেস করে তাকিয়ে সবসময় পার পেয়ে যায়! আমিও মোটেও স্ট্রিক্ট হতে পারি না!”

মীরা মুখ ফুলিয়ে গ্রিনটিতে চুমুক দিচ্ছে। শেহজাদ খানিক হেসে বলে,
“ভাবির থেকে ট্রেনিং নাও।”

“তা লাগবে না। ফ্রিশা এখানেই একটু এমন করবে। বাসায় ফিরলে ঠিক হয়ে যাবে। একদিনই তো।”

“হুম।”

তারপর দুজনেই গ্রিনটি শেষ করলে মীরা মগগুলো রেখে আসে। মীরা বিছানা গুছাতো গুছাতে শেহজাদ রুমের ভিতরে কয়েক চক্কর হেঁটে শুয়ে পড়ে।

______★

দিনকে দিন ওদের সম্পর্কে বন্ধুত্বটা প্রকট হচ্ছে। যদিও ভালোবাসার প্রকাশ এখনও প্রচ্ছন্ন! সময়ের চক্রে দুই মাস পেরিয়ে গেছে। এখন আগষ্ট মাসের শেষোর্ধ। প্রকৃতি শরতের অনন্য রূপে সেজে ওঠছে। নীল অম্বরে পেঁজা তুলোর মতো মেঘমল্লার ভেসে বেড়ায়। কিছু জায়গায় কাশফুলের সমারোহ দেখা যায়। তাই বলে বর্ষার দাপট কিন্তু শেষ হয়নি! খানিক কালোমেঘের রাজত্বও দৃশ্যমান হয় অম্বরপটে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টিও ঝড়ে। আজ ফ্রিশার ৬তম জন্মদিন। মীরা আজ ভার্সিটি থেকে ছুটি নিয়েছে। সকাল সকাল নাস্তার সাথে সাথে ফ্রিশার জন্য ক্ষীরও বানিয়েছে, যা ফ্রিশার পছন্দের খুব। তারপর শেহজাদ ভার্সিটিতে চলে গেলে, মীরা ফ্রিশাকে নিয়ে ঘুরতে বেরোয়। সাথে মিসেস শাহিদা ও আবিরও আছে। যাচ্ছে জাতীয় শিশুপার্কে। ফ্রিশা খুব এক্সাইটেড। শিশুপার্কে ঘোরাঘুরির পর তাঁরা যাবে চিড়িয়াখানায় ঘুরতে। যদিও খুব বেশি সময় ঘুরবে না। আজ কোনো ছুটির দিন না। তাই দুই স্থানেই ভীড় তুলনামূলক কম হবে। প্রথমেই শিশুপার্কে পৌঁছে ফ্রিশা ছুটে ছুটে বিভিন্ন রাইডে উঠতে যাচ্ছে। মীরা ওর পিছু ছুটছে সাথে ভিডিও করছে। রাতে এসব শেহজাদকে দেখাবে। ফ্রিশার চোখে-মুখে উজ্জ্বলতা ও উৎফুল্লতার হাসি। দুপর হতেই চারজন শিশুপার্ক থেকে বেরিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়ে রওনা করে চিড়িয়াখানার উদ্দেশ্যে। কিছুটা জ্যাম থাকায় দেড় ঘণ্টার মতো লেগেছে। বিকেল প্রায় তিনটার দিকে চিড়িয়াখানায় পৌঁছে পরিচিত কিছু প*শুর খাঁচা ঘুরে, পা*খিদের দেখতেই দুই ঘণ্টা শেষ। সিং*হের খাঁচার সামনে গিয়ে ফ্রিশা ‘লা*য়*ন! লা*য়*ন’ বলে চিৎকারও করেছে। বেচারি, বা*ঘের দেখা না পাওয়াতে মাঝে বেশ মন খারাপও করেছিল। প*শু-পাখি সব দেখলেও মীরা ইচ্ছে করেই ও-কে সা*প দেখাতে নেয়নি। তার নিজেরই ভয় করে, সেখানে ফ্রিশাকে নিবে! সারাদিন ঘোরাঘুরি করার পর ফ্রিশার মন বেশ আনন্দিত কিন্তু শরীর অবসন্ন। ফেরার পথে গাড়িতেই মীরার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। মীরা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় ছয়টা বেজেছে। চিড়িয়াখানা থেকে কাছেই। বাড়ির প্রায় কাছাকাছি আসতেই শেহজাদ মীরাকে কল করে। মীরা ফোন রিসিভ করে সালাম দিতেই শেহজাদ সালামের জবাব দিয়ে বলে,

“তোমরা এখন কোথায়?”

“এইতো কাছাকাছি। আপনি কি বেরিয়েছেন?”

“হ্যাঁ আজ একটু জলদি বেরিয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি চলে আসব। ফ্রিশার জন্য কিছু নিব বলে শপিংমলে এসেছি।”

“ও আচ্ছা। কী নিবেন?”

“ভাবছি ওর পছন্দের প্রিন্সেস গাউন নিব সাথে একটা ব্ল্যাক-হোয়াইট টেডি। দুই বছর ওর জন্মদিনে কিছু করা হয়নি।”

মীরা ফ্রিশার মুখপানে চেয়ে মুচকি হেসে বলে,
“ফেরার পথে বেকারি শপ থেকে সন্দেশ, ছানা, রসমালাই এসব নিয়ে আসবেন। কেক আমি গিয়ে বানাব। আর হ্যাঁ, আইসক্রিমও।”

শেহজাদ হেসে বলে,
“আচ্ছা আনব। মা-মেয়ে দুজনেই মিষ্টি পা*গ*ল! ফ্রিশা মনে হচ্ছে তোমার সঙ্গদোষে মিষ্টির প্রতি আরও অ্যাডিক্টেড হয়ে গেছে।”

মীরার দৃষ্টি সরু হলো। সে বলল,
“হলে হয়েছে। আপনার সমস্যা কী? আপনাকে আনতে বলেছি আনবেন।”

মীরা খট করে ফোন কেটে দেয়। পাশে বসা মিসেস শাহিদা মুচকি হাসেন। শেহজাদ ফোনের দিকে চেয়ে হেসে স্বগতোক্তি করে,
“পুরো বাচ্চাদের মতো রাগ করে এই মেয়ে! কে বলবে এই মেয়ে ভার্সিটির টিচার আবার ছয় বছরের এক বাচ্চার মা হয়েছে?”

অতঃপর শেহজাদ শপিংমলে ঘুরে প্রিন্সেস ড্রেস পছন্দ করে।

________

রাতে ড্রয়িংরুমে ঘরোয়া পরিবেশে টেবিল সাজানো হয়েছে। মীরার বাবা-মাও এসেছেন। সাথে মৃদুলাও। মীরা ফ্রিজ থেকে একটু আগের বানানো কেকটা বের করে আনলো। তারপর ফ্রিশাকে তৈরি করতে গেলো। শেহজাদের আনা প্রিন্সেস ড্রেস ও মীরার আনা পার্লস ব্রেসলেট ও নেকলেসে ফ্রিশাকে বেশ সুন্দর লাগছে। লালচে-বাদামী চুলে ক্রাউনও পড়েছে সে। মীরা আয়নায় তাকিয়ে বলে,

“হাই প্রিন্সেস।”

“ফেইরিমাম্মাম, অ্যাম অ্যাই লুক লাইক অ্যা বেবি ফেইরি?”

“ইয়েস, বাচ্চা। ইউ আর মাই কিউট বেবি ফেইরি। লেটস গো। এভরিওয়ান ইজ ওয়েটিং।”

ফ্রিশা একহাতে তার ড্রেস উঁচু করে এগিয়ে চলছে। মীরা ওর আরেক হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তারপর ড্রয়িংরুমে সবার সাথে কেক কা*টে ফ্রিশা। প্রথম বা*ইট সে তার ফেইরিমাম্মামকে দেয় তারপর তার বাবাকে। এরপর বাকিদেরও কেক খাওয়ায়। ফ্রিশাকে সবাই গিফট দিয়েছে সাথে দোয়া তো আছেই। কেক খাওয়ার পর সবাই এদিকে গল্প করছে, ওদিকে মীরা রান্নাঘর থেকে খাবারগুলো ডাইনিংয়ে এনে রাখছে। মলি জাহান মেয়ের কাছে যান। মাকে দেখে মীরা একটুকরো মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে নিজের কাজ করছে। তিনি মেয়েকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করেন,

“শেহজাদ কি তোকে মন থেকে মানতে পেরেছে?”

মীরা কপাল কুঁচকে জবাব দেয়,
“মেনে নিবে না কেন? কী যে বলোনা তুমি, মা!”

মীরা আবার কাজে হাত দিলে মিসেস মলি জাহান আবারও মেয়েকে থামিয়ে নিজের মুখোমুখি দাঁড়া করিয়ে বলেন,
“দেখ আমার চিন্তা হয়।”

“উফ মা, সব ঠিকই তো চলছে। আমাদের সম্পর্কে সব স্বাভাবিকই চলছে, যেমনটা অন্যান্য স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে থাকে। তুমি অযথা চিন্তা করছো। যাও তো। ড্রয়িংরুমে গিয়ে সবার সাথে বসো। আমি বাকিগুলো এনে সবাইকে ডাকছি।”

মিসেস মলি জাহান মেয়ের কথা মেনে নিয়ে সেখান থেকে চলে আসেন। কিন্তু তার চিন্তা কমে না। কারণ মীরা তার মায়ের সাথে যাই শেয়ার করে সব ফ্রিশাকে নিয়ে। শেহজাদকে নিয়ে যেন বলেই না। তাই উনার মনে ভয় ঢুকেছে।

________

খাওয়া-দাওয়া ও আড্ডার পর্ব শেষে সবাই ঘুমোতে চলে গেছে। শেহজাদ ও মীরা নিজেদের রুমে যেতেই শেহজাদ বলে,
“ওয়েট, তোমার জন্য কিছু এনেছি।”

“কী?”

শেহজাদ প্রত্যুত্তর না করে কাভার্ড থেকে একটা ব্যাগ বের করে মীরার হাতে দেয়। মীরা ব্যাগ থেকে একটা ছোটো বক্স বের করে। যা একটা ঘড়ির বক্স। ডিজিটাল ঘড়ি। মীরা খুশি হয়ে বলে,

“ওয়াও! কখন নিলেন?”

“ফ্রিশার জন্য ড্রেস কেনার সময় ভাবলাম তোমার জন্য কিছু নিব। কী নিব কী নিব ভেবে ঘড়ির কথাই মা*থায় আসলো। শাড়ির কথা ভেবেছিলাম কিন্তু তোমার যদি পছন্দ না হয়? ঘড়ি তো তোমার পছন্দ খুব।”

মীরা কয়েক সেকেন্ড শেহজাদের চোখের দিকে চেয়ে থেকে বলে,
“আপনি আমার জন্য যা পছন্দ করবেন, তা চোখ বন্ধ করে আমি পছন্দ করে নিব।”

অতঃপর কালক্ষেপণ না করে মুহূর্তের মধ্যে শেহজাদকে জ*ড়িয়ে ধরে। শেহজাদ কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে কথার লুকানো অর্থ বুঝে নিজেও মীরাকে নিজের সাথে আগলে নেয়।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-৩০+৩১

0

#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩০
সন্ধ্যার দিকে ভার্সিটি থেকে ফিরে শেহজাদ বাড়িতে প্রবেশ করবে এমন সময় ড্রাইভার তার গতি রোধ করতে ডাকে। শেহজাদ দাঁড়ালে ড্রাইভাে বলে,
“স্যার, একটা কথা বলতাম। যদি কিছু মনে না করেন।”

“বলেন।”

“স্যার, আমার মনে হয় আজকে ফ্রিশামনির স্কুলে কিছু হইছে।”

শেহজাদ ভ্রু কুঁচকায়। সন্দিগ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শুধায়,
“কী হয়েছে?”

“সকালে ফ্রিশামনি ও ছোটো ম্যাডামরে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার প্রায় আধাঘণ্টার মতো পর ছোটো ম্যাডাম গাড়িতে এসে বসেন। তার মুখটা বেজার দেখাইতেছিল। তারপর আমারে ১০০ টাকা দিয়ে বলছিলেন চা-পানি খেয়ে আসতে। এরপর সে গাড়ি লক করে অনেকক্ষণ বসে আছিল। আমি বাইরে চা-পানি খাইতে গিয়া স্কুলের দারোয়ানের থেকে শুনছি ভিতরে নাকি গার্ডিয়ান মহিলাদের মধ্যে কিছু একটা ঝামেলা হইছিল। প্রিন্সিপ্যালরেও নাকি আসতে হইছে।”

দারোয়ানের কথা শুনে শেহজাদ চিন্তায় পড়ে গেল। কী এমন হয়েছিল সেখানে? আর মীরার মুখই বা কেন ভার ভার লাগছিল? সব প্রশ্নের জবাব মীরাই তাকে দিতে পারবে। শেহজাদ ড্রাইভারকে বলে,

“আচ্ছা। আপনি যান। আমি দেখছি। থ্যাংকিউ। ”

শেহজাদ এরপর বাড়ির দিকে অগ্রসর হয়। বাড়িতে প্রবেশ করেই দেখে, ড্রয়িংরুম ও হলে মীরা ও ফ্রিশা ছুটাছুটি করছে। দুজনের মুখে লেগে আছে, প্রাণখোলা হাসি। মিসেস শাহিদা, আবিরকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে সেখানে আনছেন। আবিরও মাথা কাত করা অবস্থায় হাসছে। মিসেস শাহিদা বারবার ওদের দৌঁড়াতে সাবধান করছিলেন। শেহজাদ যত্র দাঁড়িয়ে এসব দেখছিল, তখনি হঠাৎ ছুটতে ছুটতে ফ্রিশা এসে তার বাবার আড়ালে লুকায়। মীরা ও-কে ধরতে এসে শেহজাদকে দেখে থেমে যায়। তারপর ইতস্তত করে শুধায়,

“আপনি কখন এলেন?”

“এইতো মাত্র।”

ফ্রিশা হাঁপাতে হাঁপাতে ও হাসতে হাসতে বলে,
“ফেইরিমাম্মাম, ধরো আমাকে। পারবে না।”

মীরা ইশারায় ফ্রিশাকে থামতে বলার পর শেহজাদকে বলে,

“আপনি রুমে যান। আমি শরবত নিয়ে আসছি।”

শেহজাদ, ফ্রিশার মাথায় হাত বুলিয়ে ও-কে দৌঁড়াতে নিষেধ করে রেস্ট করতে বলে। অতঃপর উপরে রুমে চলে যায়। মীরা জলদি করে লেবুর শরবত তৈরি করে রুমে নিয়ে যায়। রুমে গিয়ে দেখে শেহজাদ শার্ট খুলে হ্যাঙারে রাখছে। এই বাড়িতে এসেছে তিন দিন হলো কিন্তু আজকেই প্রথমবার শেহজাদকে এভাবে দেখছে। কিছুটা হলেও ব্রীড়ার আভাস ফুটে উঠলো তার চেহারায়। মীরা তৎক্ষণাৎ মাথা নিচু করে বলে,

“নিন শরবতটা খেয়ে নিন।”

মীরা শরবতের গ্লাসটা ডেস্কে রেখে চলেই যাচ্ছিল, শেহজাদ ডাকে।
“মীরা!”

দাঁড়ায় মীরা। হালকা পাশ ঘুরে কিন্তু এখনও মাথা উঁচু করেনি। শেহজাদ শুধায়,
“আজ ফ্রিশার স্কুলে কী হয়েছিল?”

মীরা থতমত খেয়ে শেহজাদের দিকে তৎপর হয়ে দৃষ্টি ফেলে। অতঃপর দ্রুত দৃষ্টি নামিয়ে বলে,
“কিছু হয়নি তো!”

“কিছু হয়নি?”

“না। সব ঠিক আছে।”

“সত্যি? কিছু লুকাচ্ছ না তো?”

মীরার গলার স্বর খানিক কাঁপছে। সকালের কথাগুলো সব তার মস্তিষ্কের নিউরনে একে একে আ*ঘা*ত করছে। তারপরও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায় অটল সে।

“না। কিছু লুকাচ্ছি না। কী লুকাব আবার!”

শেহজাদ সেকেন্ডের মধ্যে মীরার খুব কাছাকাছি এসে হেঁচকা টানে মীরা ও তার মধ্যকার দূরত্ব দূর করে ফেলে। মীরার ডান বাহু খুব শক্ত করে ধরে শক্ত কণ্ঠে বলে,

“আই হেইট দিস। আমার থেকে কিছু লুকাবে না। পরবর্তীতে যদি আমি সত্যটা জেনেই যাই, তবে লুকাও কেন? ডোন্ট ডু দ্যাট।”

আচমকা কাণ্ডে মীরা হকচকিয়ে গেল। বিহ্বল ও বিস্ময়ের দৃষ্টিতে শেহজাদের চোখ-মুখের পানে চেয়ে আছে। প্রায় ত্রিশ সেকেন্ডের মতো সময় গড়ানোর পর শেহজাদ পুনরায় একই প্রশ্ন করে,

“কী হয়েছিল?”

মীরা নজর নামিয়ে ফ্লোরের দিকে চেয়ে ঢোক গিলে বলে,
“ওসব কথা কেন এখানে তুলছেন বলুন তো? বাদ দিন। আপনি বাহিরে থেকে এসেছেন, রেস্ট করুন।”

“তুমি বলবে? নাকি আমি স্কুলের প্রিন্সিপ্যালকে কল করব?”

মীরা অবাক হয়ে দ্রুত বলে ওঠে,
“আরেহ্ না না। এসবের কী দরকার? ঝামেলা মিটে গেছে, আমি নিজে মিটিয়েছি। এভরিথিং ইজ ফাইন নাউ।”

শেহজাদ, মীরাকে ছেড়ে খানিক সরে আসে। চোখ বন্ধ করে দুই হাত দিয়ে নিজের মুখমণ্ডল মুছে নিয়ে মিনতির সুরে বলে,
“প্লিজ টেইল মি, হোয়াট হ্যাপেন্ড এট দ্যা স্কুল?”

মীরা হতাশ হলো। শেহজাদ না শোনা পর্যন্ত তাকে শান্তি দিবে না, তা সে বুঝে গেছে। তারপর মীরা সংক্ষেপ করে ঘটনাটা বলে। সব শুনে শেহজাদ রেগে যায়। প্রত্যুত্তরে বলে,

“রিডিকুলাস! হোয়াই আর দো সোয়িং সো মাচ কনসার্ন এবাউট আস? ইটস আওয়ার লাইফ এন্ড আওয়ার চয়েজ। দে হ্যাভ নো রাইট টু ইনসাল্ট ইউ লাইক দ্যাট।”

শেহদের মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে মীরা তাকে নিয়ে বিছানায় বসায়। তারপর শরবতের গ্লাসটা এনে দিয়ে বলে,

“শরবতটুকু খেয়ে নিন। তারপর শান্ত হোন।”

“দে আর… ”

“হুশ। আগে শরবতটা শেষ করবেন। তারপর কথা। জলদি করুন তো।”

শেহজাদ মীরার মুখের দিকে চেয়ে গ্লাসটা নিয়ে শরবত খাচ্ছে তখন মীরা বলে,
“আমি কিন্তু তাদেরকে মোটেও ছাড় দেইনি। প্রতিটা কথার পাই টু পাই জবাব দিয়েছি এবং তাদের মুখ বন্ধ করেছি। তাও তারা অযথা তর্ক করতে আসছিল। তখন প্রিন্সিপাল এসে বাকিটা হ্যান্ডেল করে নিয়েছেন। ওসব নিয়ে আপনাকে এত ভাবতে হবে না।”

শেহজাদ খালি গ্লাসটা মীরার হাতে দিয়ে মৃদু হেসে বলে,
“এরপর থেকে কিছু হলে আমাকে অবশ্যই জানাবে। আই নো, ইউ আর অ্যা স্টং গার্ল, বাট ইউ আর অলসো অ্যা হিউম্যান। হিউম্যান হ্যাভ ফিলিংস। এন্ড দে ফিল ব্যাড।”

মীরা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। শেহজাদ হালকা হেসে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। কাভার্ড থেকে টাওয়াল ও টিশার্ট, ট্রাউজার বের করে শাওয়ার নিতে যাবে, তখন হঠাৎ থামে। অতঃপর মীরার কাছে ফিরে আসে। মীরা ফ্লোরের দিকে চেয়ে হাতের খালি গ্লাসটাতে ন*খের দ্বারা মৃদু শব্দের সৃষ্টি করছিল। শেহজাদ মীরার কাছাকাছি এসে হাতের টাওয়াল ও পোষাকগুলো বিছানায় রেখে নিজের দুই হাত মীরার দুই গা*লে রাখে। হাতের আঁজলায় মীরার মুখটাকে উঁচু করে কপালে উষ্ণ ঠোঁ*টের স্পর্শ এঁকে তৎক্ষণাৎ সরে আসে। আকস্মিক ঘটে যাওয়া ঘটনায় মীরারর অক্ষিগোলক বৃহৎ আকার ধারণ করেছে। হতবাক সে। শেহজাদ মুচকি হেসে টাওয়াল গলায় ঝুলিয়ে পোষাকগুলো নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। মীরা ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে নিজে নিজেই বলে,

“অ্যাম অ্যাই ড্রিমিং? হি রিয়েলি কেম ব্যাক টু কি*স মি!”

চলবে ইনশাআল্লাহ,

#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩১
রাতের খাবার শেষে মীরা ফ্রিশাকে ঘুম পাড়িয়ে রুমে আসতেই দেখে শেহজাদ কারও সাথে ফোনে কথা বলছে। সেও চুপিচুপি ওয়াশরুমে চলে যায়। ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই দেখে শেহজাদ বিছানায় বসে আছে। হাতে তার কিছু একটা আছে। মীরা সেখানে আসতেই শেহজাদ উঠে দাঁড়িয়ে হাতের নীল বক্সটা মীরার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ইটস ফর ইউ।”

মীরা কৌতুহলী হয়ে চেয়ে শুধায়,
“জুয়েলেরি বক্স! হঠাৎ জুয়েলারি কেন?”

“এমনিতেই।”

“বাহ্! এমনিতেই কেউ আবার জুয়েলারি দেয়?”

মীরার কথা বলার ধরণে শেহজাদ হাসলো। মীরাও হেসে জুয়েলারি বক্সটা খুলে দেখলো তাতে ছোটো সিম্পল একটা ডায়মন্ড প্যান্ডেট, ম্যাচিং টপ এয়ারিং ও একটা সিম্পল ডায়মন্ড ব্রেসলেট। মীরা অবাক হয়ে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে শেহজাদের পানে চেয়ে বলে,

“আপনার পছন্দ তো খুব সুন্দর।”

“থ্যাংকস। ক্যান ইউ ট্রাই ইট নাউ?”

মীরা চোখে হেসে শেহজাদের চোখের দিকে তাকায়। শেহজাদের চোখের দ্যুতি বলছে, মীরা যেন এখন একবার এগুলো পড়ে দেখায়। মীরাও সায় দিয়ে হুট করে শেহজাদের হাত ধরে তাকে সহ আয়নার সামনে যায়। অতঃপর টুল টেনে বসে বলে,

“আপনিই না হয় পরিয়ে দিন। আপনি পছন্দ করে এনেছেন।”

শেহজাদ একটু চিন্তিত হলো। ফের শুধালো,
“তোমার পছন্দ হয়নি? না হলে বলো, ডিজাইন চেঞ্জ করা যাবে।”

মীরা আশ্চর্য দৃষ্টিতে আয়নাতে পড়া শেহজাদের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে প্রশ্ন ছুড়ে,
“আমি কখন বললাম যে আমার পছন্দ হয়নি? আমি বললাম, আপনি এনেছেন আপনি পরিয়ে দিন।”

“ওহ আচ্ছা!”

“থাক। আমিই পড়ে নিচ্ছি।”

মীরার কণ্ঠে অভিমানের আভাস! সে নিজেই বক্স থেকে এয়ারিং বের করছে। তখন শেহজাদের মনে হলো, মীরা হয়তো রাগ করেছে। সে বিষয়টা বুঝে মীরার হাত থেকে এয়ারিংটা নিয়ে নেয়। তারপর বলে,

“সরি। ডোন্ট বি আপসেট প্লিজ। ইট ওয়াজ মাই ফল্ট। আই ওয়াজ কনফিউজড সো…”

শেহজাদ, মীরার কানের ফুঁ*টোতে খুব কসরত করেই এয়ারিং পড়াতে সক্ষম হয়। এদিকে মীরা ঠোঁট চেপে হাসছে। শেহজাদ দুই কানে এয়ারিং পড়িয়ে আয়নায় তাকাতেই মীরাকে হাসতে দেখে। অতঃপর চোখ ছোটো ছোটো করে বলে,

“এখানে হাসার কিছু নেই। তুমি ব্যাথা পাবে ভেবে সাবধানে পড়াচ্ছিলাম। নিজেও তো মাঝেমাঝে সাডেন আহ উহ করে ওঠছিলে! ইট ওয়াজ স্কেরি।”

মীরা মুখ ঢেকে খানিক সময় হেসে নিয়ে ফের আয়নায় তাকালে দেখতে পায়, শেহজাদের দৃষ্টি ও ভাবভঙ্গির বদল তো হয়নিই বরং আরও সরু হয়েছে দৃষ্টি। মীরা ইশারায় সরি বলে বাকিগুলো পড়াতে বলে মুখ একদম স্বাভাবিক করে রোবটের মতো বসে থাকে। শেহজাদ মীরার গলা থেকে চেইনটা খুলে তাতে প্যান্ডেট ঢুকিয়ে আবার চেইনটা পড়িয়ে দেয়। তারপর ডান হাতে ব্রেসলেট পড়িয়ে বলে,

“ডান। এন্ড ইউ লুকিং সিম্পলি গর্জিয়াস।”

মীরা আয়নায় গভীর ভাবে নিজেকে দেখলো। তার এলোমেলো চুলে এই সাঁজে বুঝি তাকে গর্জিয়াস লাগছে মানুষটার কাছে! নিজের কাছে তো কা*কের বাসা লাগছে! মীরা বলেই ফেলে,

“সিধা মুখে বলেই দিন কা*কের বাসা! সেটাকে ফ্যান্সিভাবে গর্জিয়াস বলার কী আছে!”

শেহজাদের মুখ কুঁচকে গেলো। হঠাৎ মীরার কী হলো যে, এমনভাবে কথা বলছে!
“তোমার কী হয়েছে, মীরা? নাকি আমিই তোমার কথা বুঝতে পারছি না? আর ইউ আপসেট? সকালের ঘটনাতে?”

মীরা উঠে দাঁড়িয়ে শেহজাদের দিকে ফিরে বলে,
“আরে না। এমনিই। আমি কথা বলিই এভাবে। এতদিন হয়তো আপনি আমার কথার মাঝে ফর্মালিটি পেয়েছেন। থাক বাদ দিন সেসব। আপনার গিফট আমার খুব পছন্দ হয়েছে। থ্যাংকিউ সো মাচ। ইটস সো প্রিটি। আই লাভ ইট।”

“মাই প্লেজার। এখন ঘুমাও। সকালে তোমার ক্লাস আছে তো?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ। উফ এই কয়দিন রেস্ট করে ভুলেই গেছি। জানেন, ভার্সিটিতে থাকতেও এমন হতো। শুক্রবার ও শনিবার ছুটি কাটানোর পর রবিবার দিন যদি সকালে ক্লাস থাকতো, ওই দিনটা আমার সকালে উঠতে যে কী কষ্ট হতো! বাকি চারদিন নিজেই উঠতে পারতাম কিন্তু রবিবার দিনটাই আম্মু না ডাকলে উঠতেই পারতাম না।”

শেহজাদ হালকা হেসে বলে,
“ওকে যাও এবার।”

এই বলে শেহজাদ নিজেও শুয়ে পড়লো। মীরা বক্সটা গুছিয়ে রেখে আসে।

________

সকাল সকাল মীরার তাড়াহুড়ো করে তৈরি হচ্ছে। শেহজাদ ব্যালকনি থেকে রুমে এসে মীরার অবস্থা দেখে। মীরাকে আজ অন্যরকম সুন্দর লাগছে। কর্মজীবী পরিপূর্ণা নারী। আজ সে শাড়ি পড়েছে। লাল-নীলের মিশেলে সিল্ক শাড়ির সাথে ফুল স্লিভস ও কলার নেক ব্লাউজ। চুলে নামিয়ে খোঁপা করেছে। না খোঁপায় কোনো ফুল এসব লাগায়নি! কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছে, বেড়াতে না! লিপস্টিকের কালারটাও খুব মাইল্ড। চশমার কারণে এতোটা দূর থেকে চোখে কাজলের অবস্থা বুঝা যাচ্ছে না যদিও! শেহজাদের মনে হচ্ছে, আজকে মীরাকে অন্যদিনের তুলনায় আলাদাই লাগছে। শেহজাদ ব্যালকনির দরজার সাথে বুকে হাত গুঁজে হেলান দিয়ে জিজ্ঞাসা করে,

“এতো তাড়াহুড়ো করছো কেন?”

“করব না? এখান থেকে ভার্সিটি পৌঁছেতে কতো সময় লাগে তা আমি জানিনা। যদি লেট হয়ে যায়?”

“হবে না। আস্তে আস্তে তৈরি হও। আমি তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসব।”

মীরা ঘড়ি পড়া থামিয়ে অবাক কণ্ঠে বলে,
“আপনার ভার্সিটি থেকে তো আমারটা দূরে। আপনি কেন নামাবেন?”

“কেন? কী সমস্যা?”

“আমাকে নামিয়ে আবার ব্যাক করবেন। তারউপর বাংলাদেশে ট্রাফিক জ্যামের কোনো বিশ্বাস নেই। আপনার লেট হবে। দরকার নেই।”

শেহজাদ নিজের ল্যাপটপ ব্যাগে ঢুকাতে ঢুকাতে বলে,
“কী দরকার আর কী দরকার নেই, সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি যখন বলেছি আমি তোমাকে ড্রপ করবো তো, আমিই ড্রপ করব। এন্ড পিকও আমিই করব। রেডি হয়ে নাস্তার টেবিলে এসো।”

শেহজাদ ব্যাগ গুছিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। মীরা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। শেহজাদ তাকে অর্ডার করে গেল! অতঃপর সে নিজে নিজে স্বগতোক্তি করে,
” আমি যখন বলেছি আমি তোমাকে ড্রপ করবো তো, আমিই ড্রপ করব! হুহ্! আপনার ভালোর জন্যই বলেছিলাম। একদিন ড্রপ করে যখন জ্যামে ফাঁসবেন, তখন বুঝবেন। আমার আর কী! রিল্যাক্সে যাব।”

মীরা তারপর জলদি করে সব গুছিয়ে নিয়ে গতকাল রাতে শেহজাদের দেওয়া গিফট গুলো পড়ে নেয়। বিয়ের পর আজকে প্রথম নিজের কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছে। মানুষজন মুখে না বললেও হাবভাবে ঠিকই বিবাহিতের লক্ষণ দেখতে চাইবে। আয়নায় নিজেকে দেখে মুচকি হেসে বিছানার উপর রাখা স্কার্ফটা জায়গামতো গুছিয়ে বেরিয়ে যায়। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে গেলে স্কার্ফটা জড়িয়ে যেত। যেহেতু আজ নিজের স্বামীর সাথে যাচ্ছে তাই এটার দরকার নেই।

_____
নাস্তার টেবিলে বসে মীরা, ফ্রিশাকে বলে,
“শোনো বাচ্চা, কেউ যদি তোমাকে পড়ালেখা ছাড়া ব্যাড কিছু বলে তাহলে শুনবে না। সেখান থেকে চলে আসবে। মনে থাকবে?”

ফ্রিশা বিষয়টা বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থেকে ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিয়ে বলে,
“ওকে ফেইরিমাম্মাম। আমি গুড গার্ল।”

“ইয়াহ বাচ্চা, ইউ আর।”

মীরা ও-কে পাশ থেকে জড়িয়ে আবার খাওয়া শুরু করে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-২৮+২৯

0

#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৮
“তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো, ছেড়ে দেবো না (২)
ওরে ছেড়ে দিলে সোনার গৌর আর পাবো না।
ক্ষ্যাপা ছেড়ে দিলে সোনার গৌর আর পাবো না না না না ছেড়ে দেবো না।
তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো, ছেড়ে দেবো না। (২)
কথা: দ্বিজ ভূষণ
সুর: বৈষ্ণব কীর্তন
শিল্পী: লোপামুদ্রা মি
(বাকিটা নিজ দায়িত্বে ইউটিউবে শুনে নিবেন।)

গান শেষ হতেই রাইমার টি*ম্পনি!
“কাকে হৃদমাঝারে রাখবিরে, মীরা? আমাদের বল।”

মীরা নিজের ভ্রদ্বয় কুঁচকে ফেলে বলে,
“তোর কপালে শ*নির দশা লেগেছে বুঝতে পেরেছি! দাঁড়া!”

মীরা উঠতে নিলে রাইমা পা*লানোর প্রস্তুতি নিয়ে বলে,
“ক্লাম ডাউন, বেইব। চি*ল! তুই মুখে না বললেও এখানে সবাই বুঝতে পারছে!”

“তুই! তোকে তো! কোথায় কী বলতে হয় তোকে আজকে উ*ত্তম-মধ্য*ম দিয়ে শেখাতে হবে দেখছি।”

মীরা উঠে ছুটতে নিবে তৎক্ষণাৎ শেহজাদ ওর ডান হাতের কব্জি ধরে থামায়। ওইদিকে নিধি, রাইমাকে আটকিয়ে ইশারায় মীরা ও শেহজাদের দিকে ইশারা করে। অতঃপর নিধি, রাইমা সহ সবাই মিটিমিটি হাসছে। শেহজাদ সকলের দিকে নজর বুলিয়ে কণ্ঠে কিয়ৎ রাগী ভাব এনে বলে,

“সিট ডাউন!”

মীরা ভয় না পেলেও কিছুটা লজ্জা পায়। তারপর শেহজাদ হাত ছেড়ে দিলে চুপচাপ সে শেহজাদের পাশে বসে পড়ে। এরপর আসে বাচ্চাদের কবিতা আবৃতির পালা। মৃদুলার কণ্ঠে বাংলা কবিতা ও ফ্রিশার কণ্ঠে ইংরেজি রাইম। পালাক্রমে চারজন বাচ্চা সদস্য মিলে বিভিন্ন গানের তালে যেভাবে পেরেছে নেচে সবাইকে হাসিয়েও ছেড়েছে।

_______

বিকেলে আসরের নামাজের পর মীরার পরিবার বেরোনোর প্রস্তুতি নেয়। একটু পরেই বের হবে। মীরার মা বলেন,
“শেহজাদ বাবা, তোমরা তো আজকে গেলে না। বৃহস্পতিবার কিন্তু অবশ্যই যাবে।”

“আপনি চিন্তা করবেন না, আন্টি। আমরা যাব।”

এরপর মীরার বাবা বলেন,
“তোমরা এলেই আমরা কাছের আত্মীয়-স্বজনদের আবার দাওয়াত করব। বিয়ের দিন তো জামাইয়ের সাথে ঠিক ভাবে পরিচিত হতে পারলো না।”

শেহজাদ সম্মতিসূচক হাসে। মীরা তার বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে হালকা ভাবে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আই মিস ইউ। এতোদিন ইন্ডিয়াতে থেকেও এতোটা মিস করিনি যতোটা এই দুইদিনে করেছি।”

মীরার মা মলি জাহান, মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আবেগী স্বরে বললেন,
“বিয়ে এমনি, মা। বিয়ের আগে যতো দূরেই থাকো, সেটার সাথে বিয়ের পরের সময়কার অনেক পার্থক্য।”

মায়ের ভেজা লোচনদ্বয় দেখে মীরার নেত্রকোণও ভিজে ওঠলো। মাকে জড়িয়ে আবেগময় পরিবেশের সৃষ্টি হলো। সেখানে উপস্থিত সকলেরই মন ভার ভার। হুট করে রাইমা ফ্রিশার কাছে গিয়ে কানে কানে কিছু বলে, ফ্রিশাে হাত ধরে মীরার কাছে নিয়ে আসে। ফ্রিশা মীরার ওড়না ধরে আকুল কণ্ঠে বললে,

“ডোন্ট ক্রাই, ফেইরিমাম্মাম। আই লাভ ইউ।”

মীরা তার মাকে ছেড়ে হাঁটি গেড়ে মেয়ের সামনে বসে। অতঃপর দুই হাতের আঁজলায় ফ্রিশার আদুরে মুখখানি আগলে বলে,
“আই লাভ ইউ টু, ফ্রিশামনি।”

“সো ডোন্ট ক্রাই। ইফ ইউ ক্রাই, দেন ফ্রিশা উইল স্টার্ট ক্রায়িং।”

“না, বাচ্চা। তোমার ফেইরিমাম্মাম কাঁদবে না। এই দেখো, আমি হাসছি।”

মীরা মুচকি হাসলে ফ্রিশাও হেসে মীরাকে জড়িয়ে ধরে। সবার মাঝে অন্যরকম আনন্দ পরিলক্ষিত হয়। কিছুটা দূর থেকে শেহজাদ নিষ্পলক এই দৃশ্য অবলোকন করে চলেছে। তার নেত্রপল্লব ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। হঠাৎ এক ফোঁটা অশ্রুবিন্দু তার বুকে ভাজ করে রাখা হাতে পড়তেই তৎক্ষণাৎ পিছনে ঘুরে চোখ মুছে অন্যত্র চলে যায়। নিজেকে কিছুটা সময় একা রাখতে চায় সে।

_____

প্রায় মিনিট দশেক পর শেহজাদ নিচে নেমে সবার সাথে মীরার পরিবারকে বিদায় দিলো। এরপর এলো রাইমা ও কুঞ্জর পালা। মীরা, শেহজাদ ও ফ্রিশা, এয়ারপোর্টে ওদেরকে ছাড়তে যায়। এয়ারপোর্টে পৌঁছে রাইমা, মীরাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“আই উইল মিস ইউ ব্যাডলি, ইয়ার। তুই কিন্তু ইন্ডিয়াতে অবশ্যই আসবি। আর আমাদের প্ল্যানিংটা মনে আছে তো তোর? একসাথে পিএইচডি করতে যাব। আর আমার বিয়েতে যদি তুই না আসিস তবে আমি ছাদনাতলায় যাবই না। তোর বেচারা কুঞ্জদা তখন আইবুড়ো থেকে যাবে!”
(আমি সঠিক জানিনা যে ছেলেরা আইবুড়ো থাকে কী-না?)

পাশ থেকে কুঞ্জ বলে,
“প্লিজ, বোন। বিয়েতে এসো। নয়তো তোমাে বান্ধবীকে তো চেনোই। যা বলে তাই করবে।”

মীরা ও শেহজাদ হেসে ওঠলো। ফ্রিশা ওদেরকে দেখে হাসছে। মীরা বলে,
“চিন্তন করবেন না, ভাইয়া। আপনার বিয়েটা হওয়ানোর জন্য হলেও আমরা যাব।”

তারপর আরও কিছুক্ষণ থেকে ওদের ফ্লাইটের সময় হয়ে গেলে ওদের বিদায় দিয়ে মীরা, শেহজাদরা চলে আসে।

_______

পরদিন সকালবেলা শেহজাদ ভার্সিটির জন্য তৈরি হচ্ছে। মীরা ডাইনিং টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে রুমে এসে বলল,
“নাস্তা রেডি। আসুন।”

এই বলে সে চলেই যাচ্ছিলো। শেহজাদ ও-কে থামায়। তারপর বিস্মিত হয়ে মীরার চুলের দিকে আঙুল তা*ক করে শুধায়,
“তোমার চুলে ফ্লোউর লেগে আছে। যু*দ্ধ করেছ নাকি!”

মীরা অবাক হয়ে আয়নার সামনে যেয়ে নিজের অবস্থা দেখে চোখ ছোটো ছোটো করে বলে,
“এটা ফ্রিশামনির কাজ! ও একটু আগে ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে এসেছিল। তারপর থেকে মুখ চেপে হাসছিল। দেখেছেন! কী দুষ্টু!”

“ফ্রিশা? রিয়েলি? ও তো কিচেনে যায় না। গেলেও মেবি খুব রেয়ার।”

শেহজাদের অবিশ্বাস্য কণ্ঠ শুনে মীরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে,
“আমি রান্না করার সময় নিজের মা*থায় আটা কেন লাগাবো? আর শুনুন, আপনার মেয়ে উপযুক্ত মানুষের অভাবে এতোদিন দুষ্টমি করতে পারেনি। এখন আমার মতো ভোলাভালা ফেইরিমাম্মাম পেয়ে দুষ্টমি করছে। কাল রাতে আমার সামান্য চোখ লেগে যাওয়াতে, আমার হাতে কালার পেন দিয়ে আমার নাম লিখে দিয়েছিল। দেখেন (নিজের জামার হাতা সামান্য উঠিয়ে)।”

শেহজাদ এবার হাসলো। ফের বলল,
“আসলেই সে দুষ্টমি করার জন্য উপযুক্ত মানুষ পেয়েছে!”

শেহজাদকে হাসতে দেখে মীরাও হাসে। তারপর মীরা লেগে থাকা আটা ঝেড়ে নিয়ে দুজনে একসাথে ডাইনিংটেবিলে যায়। সেখানে গিয়ে মীরা সবার সামনে পরোক্ষভাবে বলে,

“আজ না রান্নাঘরে ঘূর্ণিঝ*ড় হয়েছিল! তারপর বয়াম থেকে আটা উড়ে এসে আমার মা*থায় লেগেছে।”

মিসেস শাহিদা বুঝতে না পেরে শুধালেন,
“রান্নাঘরে ঘূর্ণিঝ*ড়! কী বলছো?”

“হ্যাঁ, ফুফিজান! ঘূর্ণিঝ-ড়ের নাম ফ্রিশা! তাই না, বাচ্চা?”

ফ্রিশা মুখ চেপে হাসছিল। এবার মুখ থেকে হাত সরিয়ে প্রকাশ্যে হাসতে হাসতে বলে,
” তোমাকে খুব ফানি লাগছিল, ফেইরিমাম্মাম।”

মীরা সরু দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
“ওহ তাই! তোমাকেও লাগিয়ে দেখব?”

“ওকে, লেটস গো!”

ফ্রিশা চেয়ার ছেড়ে উঠেও গেছে। ফ্রিশার এক্সাইটমেন্ট দেখে, মীরা বোকার মতো বলে,
“আরে…. আমি তো ফান করে বলেছি, বাচ্চা। খেতে বসো তুমি। চুল নোং*রা করার কোনো দরকার নেই।”

“শ্যাম্পু করে ফেলব। চলো।”

“না না। বসো তুমি। দেখো, আজকে সবার জন্য ডিমরুটি, সবজি ও চিকেন ভুনা করেছি। ডিফরেন্ট ব্রেকফাস্ট। টেস্ট করে বলোতো, কেমন হয়েছে?”

ফ্রিশা চেয়ারে বসে প্লেট এগিয়ে এনে রুটি ছিঁ*ড়ে মুখে দিয়ে কয়েক সেকেন্ড পর বলে,
“ওয়াও! ইটস ইয়ামি। আমাকে এরকম রুটিই বানিয়ে দিবে। কতো সুন্দর পুরো রুটিতে ছোটো ছোটো হোল।”

মীরা বেশ খুশি হয়। বাকি সবার দিকে তাকালে দেখে, তাঁরাও মজা করে খাচ্ছে। ড: আকবর রেহমান বলেন,
“মীরা, তুমি সপ্তাহের ছুটির দিন গুলোতে এগুলো বানাতে পারো। প্রতিদিন তো একই রকম ব্রেকফাস্ট ভালো লাগে না। ছুটির দিনে ডিফরেন্ট কিছু হলো।”

ফ্রিশা প্রতিবাদ করে বলে ওঠলো,
“আমি প্রতিদিন খাব।”

“তুমি প্রতিদিনই খাবে, ফ্রিশামনি। আমি তো ব্রেডের কথা বলছিলাম। তোমার মাম্মাম তো প্রতিদিন সবার জন্য বানাতে পারবে না। তারও ক্লাস আছে।”

“ওহ ওকে।”

ফ্রিশা মন খারাপ করে আস্তে আস্তে খাচ্ছে। মীরা তা লক্ষ্য করে বলে,
“তোমার জন্য প্রতিদিন বানাব। এখন জলদি খাও। ক্লাস আছে তো তোমার। আজ তোমাকে আমি নিয়ে যাব।”

ফ্রিশা খুশি হয়ে তাড়াতাড়ি খেতে থাকে। শেহজাদ মেয়েকে ও স্ত্রীকে দেখে নিরবে হেসে খাওয়াতে মনোযোগ দেয়।

________

ফ্রিশাকে নিয়ে ফ্রিশার স্কুলে এসেছে মীরা। ফ্রিশার ছুটি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছে মীরা। সেখানে আসা অন্য বাচ্চাদের গার্ডিয়ানরা হঠাৎ ফ্রিশার সাথে অচেনা গার্ডিয়ান দেখে মীরাকে এসে জিজ্ঞাসা করে,

“হ্যালো। আমি ফ্রিশার ফ্রেন্ড আনিতার মা।”

ফ্রিশা একা একা বসে ফোন ঘাটছিল। অচেনা কারও কণ্ঠে পরিচিত হওয়ার আভাস পেয়ে মৃদু হেসে জবাব দেয়,
“হ্যালো। আমি ফ্রিশার ফেইরিমাম্মাম।”

“ফেইরিমাম্মাম? সেটা আবার কী?”

“ও আমাকে ডাকে। এমনিতে আমি ওর মাম্মাম।”

“মাম্মাম? কিন্তু ফ্রিশার মা তো দুই বছর আগেই মা*রা গেছেন। তাহলে আপনি কে?”

মীরা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। জবাব দিতে কয়েক মূহুর্ত ভাবছে। কিন্তু অপরপাশের মহিলাটি তার অধৈর্য চেতনার পরিচয় দিয়ে ফের শুধায়,
“তাহলে কি আপনি ফ্রিশার স্টে*পমাদার!?”

চমকে উঠলো মীরা। অপরপাশের মহিলাটির কণ্ঠস্বরটা কেমন আশ্চর্যান্বিত ও উঁচু শোনালো মীরার কাছে। মুখশ্রীতেও কেমন একটা তাচ্ছিল্য ভাব ফুটে উঠেছে তার। মহিলাটির দৃষ্টিতে মীরার জন্য যেন উপহাসের অস্পষ্ট ছাঁপ দেখা যাচ্ছে। আরও ৪-৫ জন মহিলা এসে মহিলাটির পাশে দাঁড়ালো। মীরা নিজেকে ধাতস্থ করে জবাব দিলো,

চলবে ইনশাআল্লাহ,

#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৯
মীরা নিজেকে ধাতস্থ করে জবাব দিলো,
“আপনাদের ভাষায় আমি স্টে*পমা*দারই। আপনারা বলুন তো? এর মানে কী?”

উপস্থিত মহিলারা একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে একজন জবাব দিলো,
“কী আবার? বাবা দ্বিতীয় অথবা একাধিক বিয়ে করলে তারা সৎ মা হয়।”

আরেকজন বলে,
“এটা জিজ্ঞাসা করার কী আছে বুঝলাম না!”

মীরা তাচ্ছিল্য হেসে জবাবে বলে,
“স্টে*পমা*দার কি সবসময় নেগেটিভ হয়?”

“আপা, আপনি কী বলতে চাইছেন? আশেপাশে কী দেখেন না? খবরের কাগজ, নিউজ দেখেন না? মোস্ট অফ দ্যা টাইম নেগেটিভই হয়।”

একজন মহিলার জবাবে মীরা হাসলো। অতঃপর প্রত্যুত্তর করলো,
“জবাব তো আপনি দিয়েই দিলেন। মোট অফ দ্যা টাইম। নট অল টাইম। ধরলাম, ৯০% খারাপ হয়। ৫% খারাপ-ভালোর মাঝামাঝি। আর ৫% ভালো। এই রেশিওটা কেন আসছে জানেন? আপনাদের জন্য। নিজে তো স্বামীর আগের ঘরের বাচ্চা থাকলেও দেখবেন না! আবার কেউ যদি নিজের স্বামীর আগের ঘরের সন্তানকে আগলে রাখতে চায়, তাকেও বাজে কথা বলবেন। আবার নিজে সেধে গিয়ে কুম*ন্ত্রণা দিয়ে আসবেন। কিন্তু কেন? কারও সৎ মা হওয়া আর হাসবেন্ডের দ্বারা চিটেড হওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে বুঝলেন!”

আরেক মহিলা বলে ওঠে,
“আমাদের শেখাতে আসবেন না। বাচ্চাসহ পুরুষকে মানুষ কেন বিয়ে করে তা আমাদের ভালো করে জানা আছে।”

মীরা শক্ত চোয়ালে জোরপূর্বক হেসে শুধায়,
“ওহ তাই? তা কেন করে?”

“কেন আবার! টাকা-পয়সা দেখে। ফ্রিশাদের তো অবস্থা ভালো। হাইক্লাস সোসাইটির। লোভে তো পড়বেনই।”

মীরা সাথে সাথে প্রশ্ন তোলে,
“আমাকে দেখে কী আপনার লো ক্লাস মনে হয়? আমাকে চেনেন আপনি? কতোটুকু জানেন আমার সম্পর্কে?”

“আপনাকে চিনে আমরা কী করব! আপনিই তো কথা বাড়াচ্ছেন।”

“আমি কথা বাড়াচ্ছি? নাকি আপনাদের মধ্যে একজন এসেছিলেন পরিচিত হতে। নাকি আমি গিয়েছিলাম? এখন কি তবে এটিটিউট বলবেন? এটিটিউট হলে হোক, তাও কারও সাথে যেচে কথা বলতে গিয়ে তাকে ইনসাল্ট তো করি না। আমার ক্লাস নিয়ে যেহেতু কথা উঠলো তখন আমি নিজে যেচেই বলে দেই। আমার ফ্যামিলি মিডেলক্লাস কিন্তু উনারা আমার কোনো অভাব রাখেনি। ফ্রিশার বাবা যেই প্রাইভেট ভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন, আমি সেখান থেকে অনার্স কম্পিলিট করে ইন্ডিয়ার এক ওয়েল নোওন ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছি। তারপর সেখানে ১ বছরের জব অভিজ্ঞতাও আছে আমার। এখন তো একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে লেকচারারও। আমি মিডেলক্লাস হলেও আমার ডেজিগনেশন কিন্তু হাই ক্লাস। ক্লাস বিবেচনার ৩টা উপায়ের আমি ২ উপায়ে হাই ক্লাস। হাইলি এডুকেটেড এন্ড গুড মেন্টালিটি। কিন্তু আপনারা হয়তো হাইক্লাস সোসাইটি থেকে বিলং করেন কিন্তু মনমানসিকতা অনেক নিচু। এখন মানসিকতার সাথেই কিন্তু শিক্ষাটাও আসে। একজন অশিক্ষিত ব্যাক্তির মন-মানসিকতা যদি উন্নত হয় তবে সে সম্মানের পাত্র। কিন্তু একজন শিক্ষিত ব্যাক্তির নিচু মন-মানসিকতা হলে সে ধি*ক্কারের পাত্র। বলে না? দু*র্জন বিদ্যান হলেও পরিত্যাজ্য! আপনারাই তো যদি বাচ্চাদের বাসায় কখোনো নিজে পড়ান তবে পড়িয়েছেন। কিন্তু ভেবে দেখেছেন, যে আপনি নিজেই দু*র্জন! তাই অন্যের ক্লাস বিবেচনার আগে নিজের ক্লাস বিবেচনা করে নিবেন।”

মীরার উচিত কথা যেন সেই মহিলাদের গায়ে আ*গু*ন ধরিয়ে দিয়েছে! উনারা তেলে-বেগুনে জ্ব*লে উঠে কিছু বলতে নিতেই সেখানে স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল ও একজন ম্যাম হাজির হোন।

“সাইল্যান্ট। এটা স্কুল। কোনো নাটক-মঞ্চ না যে এভাবে চিৎকার, চেঁচামেচি করবেন!”

প্রিন্সিপ্যাল ফের বললেন,
“আমার পিয়ন আমাকে বলেছে। আপনারা সবাই জোট হয়ে একজনকে ইনসাল্ট করছেন।”

তাদের মধ্যে একজন বলে ওঠলো,
“আমরা তো কথা বলছিলাম। উনিই তো শুরু করলো।”

“আমি কিছুটা শুনেছি। ফ্রিশার বাবা আবার বিয়ে করলে আপনাদের কী? উনাদের ব্যাপার উনারা বুঝে নিবেন। আমরা তো প্রে করতে পারি। সবাই তো নেগেটিভ হয় না। যারা পজেটিভ, তাদের কাছে আপনাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য নজরও হার্ট করে। আই থিংক, আপনারা বুঝতে পেরেছেন।”

তারপর প্রিন্সিপ্যাল চলে যান। মীরাও সেখানে দাঁড়ায় না। গাড়িতে গিয়ে বসে। কান্না আসছে তার। কিছুক্ষণ আটকানোর চেষ্টা করে, ড্রাইভারকে বলে,

“ভাইয়া, আপনি একটু আশেপাশে থেকে ঘুরে আসুন। এই টাকাটা রাখুন, চা-পানি খেয়ে আসুন।”

ড্রাইভার লোকটা একবার তাকিয়ে মীরার মুখের অবস্থা দেখে টাকাটা নিয়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। মীরা ঝরঝর করে মুখ চেপে কেঁদে ফেলে। আজকের কথাগুলো তার খুব খারাপ লেগেছে। কী এমন করেছে যে সেখানে সবাই তাকে খারাপ নজরে দেখছে! কিছু সময় পর চোখ মুছে লম্বা শ্বাস নিয়ে তার মাকে কল করে। মলি জাহান তখন সবজি কা*টছিলেন। ফোনের রিংটোন কানে আসতেই তিনি নিহানকে ডেকে ফোনটা দিয়ে যেতে বলেন। নিহান একছুটে এসে দাদিকে ফোন দিয়ে আবার একছুটে চলে যায়। মলি জাহান স্ক্রিণে মীরার নাম দেখে হাস্যজ্জ্বল মুখ নিয়ে ফোন রিসিভ করেন। অপরপাশ থেকে মেয়ের ভাঙা কণ্ঠে সালাম আসলে তিনি সালামের জবাব দিয়ে শুধান,

“কী হয়েছে, মীরু? তোর কণ্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন?”

“মা, আমি যদি কখোনো খারাপ হয়ে যাই?”

মীরার কণ্ঠে জড়তা স্পষ্ট বুঝতে পেরে মলি জাহান ফের জিজ্ঞেসা করলেন,
“তুই খারাপ হতে যাবি কেন? কী হয়েছে স্পষ্ট করে বল।”

“মা! বড়োমা তো তোমার নিজের বোন ছিল, তাই তুমি বড়ো ভাইয়াকে দেখে রেখেছ। কিন্তু ফ্রিশার মায়ের সাথে তো আমার কোনো র*ক্তের সম্পর্ক নেই। তাহলে যদি আমি কোনোদিন অন্যসব স্টে*পমা-দারদের মতো ফ্রিশার সাথে রুড বিহেভ করে ফেলি!”

মলি জাহান এবার কিছুটা হলেও মেয়ের মন খারাপের কারণ আন্দাজ করতে পারলেন। তিনি শান্ত স্বরে বললেন,
“আমি জানি তুই হবি না। এসব নিয়ে ভাবার কী দরকার! কার ভাগ্যে কী আছে আমরা তো জানিনা। তুই বর্তমানে ফোকাস কর। ভবিষ্যৎ এমনিই সুন্দর হবে।”

মীরার ওষ্ঠকোণে কিছুটা হাসির রেখা ফুটে ওঠলো। সে বলল,
“আই লাভ ইউ, মা।”

“লাভ ইউ, সোনা।”

“রাখছি। তুমি যা করছিলে করো।”

মীরা ফোন রেখে লম্বা করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে একটু সময় ঘুমানোর কথা ভাবলো। ঘাড়ের কাছে কম্ফোর্টার দিয়ে চোখ বন্ধ করলো।

_________

ফ্রিশাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে মীরা। পানি-জুস খেয়ে একটু বসে। তারপর ফ্রিশাকে ইউনিফর্ম বদলে শাওয়ার নিয়ে আসতে বলে, নিজেও শাওয়ার নিতে চলে যায়। শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে বিছানায় রাখা ফোনটাকে ভাইব্রেট হতে দেখে সেটাকে উঠিয়ে দেখে শেহজাদের নাম্বার থেকে কল আসছে। মীরা রিসিভ করে সালাম দিলে, শেহজাদও জবাব দিয়ে বলে,

“ফ্রিশাকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছ?”

“হ্যাঁ। একটু আগেই। এসেই ও-কে শাওয়ারে পাঠিয়ে নিজেও শাওয়ার নিয়ে বের হলাম।”

“ওহ ওকে। তবে কিছু হালকা-পাতলা খেয়ে নাও তোমরা।”

“আচ্ছা। আপনার কি এখন গ্যাপ?”

“হুম। ১০ মিনিট। ব্যাক টু ব্যাক দুটো ক্লাস আজ। আচ্ছা রাখছি। তোমরা রেস্ট করো।”

“ক্লাস শেষে লাঞ্চ করে নিয়েন।”

“হুম।”

শেহজাদ তারপর ফোন রেখে দেয়। মীরা লাজুক হেসে আয়নার সামনে তোয়ালে নিয়ে চুল মুছতে বসে। আয়নায় নিজেকে দেখে আরেকদফা লজ্জা পেয়ে যায়। তার গালের অংশ ঈষৎ র*ক্তবর্ণ হয়ে আছে। মাথা নুইয়ে মৃদু হেসে আয়নার সামনে থেকেই উঠে যায়।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-২৬+২৭

0

#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৬
দুইদিন পর শেহজাদ কারও কথা তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে প্লেনে চড়ে বসে। প্রায় তিন বছর পর সে নিজ জন্মভূমিতে যাচ্ছে। শেষবার সে তার মায়ের সাথে বাবার লা*শ নিয়ে বাংলাদেশ গিয়েছিল। আজ একা যাচ্ছে। তাও মনের ভেতর অভিমানের গাড়ো আস্তর নিয়ে। প্লেনে বসে শেহজাদ ভাবছে, সে তো চাইলেই পারতো সব ভুলে ফিওনার সাথে আগের মতো সব ঠিক করে নিতে। কিন্তু করলো না কেন? নিজের উত্তর নিজেই পায় না। শুধু নিজেকে ছোটো মনে হচ্ছে। সে তো হাসিল করায় বিশ্বাসি নয়। সে বিশ্বাস করে ভালোবাসা দিয়ে জয় করা। তবে ফিওনা তাকে হাসিল করতে এতোকিছু কেন করলো? এসব ভাবতে ভাবতে নিজের উপর তার রাগ হচ্ছে। অতঃপর মনকে শান্ত রাখতে প্লেনের লম্বা জার্নিতে ঘুমানোটাই উত্তম মনে করলো।
এদিকে ফিওনা এয়ারপোর্টের ফ্লোরে বসে নিজের দাদি ও শেহজাদের মাকে জড়িয়ে কাঁদছে। সে তো খুব ভালোবাসে। যেভাবেই হোক, সে চেয়েছিল নিজের ভালোবাসা নিজের হয়ে থাকুক। ভালোবাসাতে নাকি সবকিছু জায়েজ? তবে সে তো শুধু তিনটা সত্য আড়াল করেছিল!
কিছু সময় পর ফিওনা কিছুটা শান্ত হলে শেহজাদের মা আদুরে কণ্ঠে বলেন,

“ডোন্ট ওয়ারি। হি উইল বি ব্যাক। হি জাস্ট অ্যা লিটল বিট এংরি। এভরিথিং উইল বি ফাইন।”

ফিওনা জবাবে কিছু বলতে পারলো না। অতঃপর শেহজাদের মা ও ফিওনার দাদি, ফিওনাকে এয়ারপোর্ট থেকে বাড়িতে নিয়ে আসে।

_____

বাংলাদেশে এসেই শেহজাদ ভার্সিটিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে জয়েন করে। সেমিস্টার ব্রেক শেষ হতেই সেও নতুন কর্মক্ষেত্রে মানিয়ে নিতে থাকে। ড: আকবর রেহমান ও মিসেস শাহিদা এতে বেশ খুশি। উনারা এখনও শেহজাদের এখানে আসার পেছনের কারণ সম্পর্কে অবগত নয়। দেখতে দেখতে এক মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন একটা খবর পায়। খবরটা এতোটাই ভ*য়ংক*র সুন্দর ছিল যে শেহজাদ ভার্সিটিতে নিজের ডেস্কেই বিস্মিত হয়ে বসে রয়। সে বাবা হচ্ছে। ফিওনা তিন মাসের প্রেগন্যান্ট। এই খবরটা তার মা, তাকে দিয়েছে। খবরটা শুনে শেহজাদ নিজের অনুভূতি ঠিক বুঝতে পারলো না। কিন্তু তার খুব সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে। এক নিমিষেই সব ভুলে হোয়াটসএপে ফিওনাকে কল লাগায়। ফিওনাও যেন এটারই অপেক্ষা করছিল। সঙ্গে সঙ্গে ফোন রিসিভ করে নিরব থাকে। অপরদিকে শেহজাদ চুপ। দুই পাশে পিনঃপতন নিরবতা বিরাজ করছে। দুজনেই চাইছে, অপরপক্ষ আগে কিছু বলুক। কিন্তু কিছু সময় পর ফিওনা আর শান্ত থাকতে পারলো না। সে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। শেহজাদ ঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে শীতল কণ্ঠে শুধালো,

“হোয়াই আর ইউ ক্রায়িং?”

কান্নারত স্বরে ফিওনা জবাব দিলো,
“ডোন্ট ইউ নো?”

“আই নো।”

“দেন, হোয়াই ডু ইউ স্টে সাইলেন্ট?”

ফিওনার কণ্ঠে অভিযোগ ও অভিমানের ভীড়। শেহজাদ হালকা হেসে বলল,
“ডাক্তার কী বলল? ফার্স্ট টাইম মি*সক্যা*রেজের জন্য কোনো হেলথ ইস্যু?”

ফিওনা আবারও একই ভুল করলো। সে এবারও রি*স্কের কথা আড়াল করে গেল । যদিও রি-স্ক সামান্য। ভেবেছে ডাক্তারের বলা মতো চললে সেটা ঠিক হয়ে যাবে। শেহজাদ বলেছে, সে প্রায় সাড়ে তিন পর ফিরে আসবে। এই সেমিস্টারটার সবে দেড় সপ্তাহ হয়েছে। ফিওনা তাতে ভিষণ খুশি।
সময়ের চক্রে সাড়ে তিন মাস সময়টাও পেরিয়ে গেল। আর মাত্র কিছু দিন পর ফিওনার প্রেগন্যান্সি সাত মাসে পড়বে। সে ইতোমধ্যে জেনে গেছে, তার মায়ের রোগটা সে পেয়েছে! তবে সেটা অতোটা ক্ষতিকর পর্যায়ে নেই। তার জড়ায়ুতে ছোটো একটা টি*উমা*র হয়েছে। ডাক্তার বলেছে, বাচ্চা জন্মের সময় টি*উ*মারও অপসারণ করা হবে। এখন সে কোনোভাবেই চায় না শেহজাদ আমেরিকায় আসুক এবং বিষয়টা জানুক। সে শেহজাদকে আসতে নিষেধও করে কিন্তু শেহজাদ চায় এই সময়ে তার স্ত্রীর পাশে কিছুটা সময় হলেও থাকতে। তাই সে আসে।
শেহজাদ আমেরিকায় আসার পর যে কয়টাদিন শেহজাদ আমেরিকায় ছিল, ততোদিন ফিওনা খুব কৌশলে জড়ায়ুর টি*উ*মা*রের ব্যাপারটা লুকিয়ে গেছে। শেহজাদের মাও এই সম্পর্কে অবগত নন। এদিকে ফিওনার দাদি অনেক অসুস্থ। তার জন্য আলাদা নার্স রাখা হয়েছে। ফিওনা ও শেহজাদের মা চায়, বাচ্চা জন্মের পর ওরা বাংলাদেশে যাবে। শেহজাদ যতদিন আমেরিকায় ছিল ততোদিন ফিওনার সবরকম যত্ন সে করেছে। ফিওনা কোনো না কোনো ভাবে শেহজাদকে ব্যস্ত রেখেছে যাতে শেহজাদ খোঁজ না করতে পারে। এতে ফিওনার বেস্টফ্রেন্ড ফিওনাকে সাপোর্ট করেছে! শেহজাদও সন্দেহ করেনি কারণ সে ভেবেছিল, ফিওনা নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত ও লজ্জিত। তারপরও নিশ্চয়ই একই ভুল সে করবে না।
খুব দ্রুতই শেহজাদের দেশে ফেরার সময় এগিয়ে এসেছে। নির্দিষ্ট সময় পর শেহজাদ দেশে ফিরেও এলো। তারপর সব তার নিজ নিজ গতিতে চলতে লাগলো। শেহজাদ ফিরে আসার এক মাস পর হঠাৎ গভীর রাতে শেহজাদের হোয়াটসএপে কল এলো। বলা বাহুল্য যে, শেহজাদ ওই সময়টাতে সবসময় ফোনের ডাটা অন করে রাখতো। কারণ প্রেগন্যান্সির শেষ তিন মাস ও প্রথম তিন মাস খুব ক্রুশিয়াল। খুব সাবধানে থাকতে হয়। শেহজাদ আমেরিকায় তার পরিচিত, নিকটস্থ এক ড্রাইভারকে আগে থেকে বলে রেখেছে যাতে যেকোনো সময় দরকারে তাকে পাওয়া যায়।
হঠাৎ ফোনের রিংটোনে শেহজাদের ঘুম ছুটে যায়। তার মস্তিষ্কে আগে থেকে সেট করা মাঝরাতের সতর্কতায় দ্রুত ফোন রিসিভ করে। ফোনের অপরপাশ থেকে শুনতে পায়, ফিওনার ডেলিভারি পেইন ওঠেছে। কথাটা শোনামাত্র শেহজাদের শ*রীরে যেন হিমশীতল হাওয়া বয়ে গেল। সে কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে মায়ের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পায়। তদ্রূপ আর সময় ব্যয় না করে আমেরিকার পরিচিত ড্রাইভারকে ফোন করে ফিওনাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে বলে। এতোকিছুর মধ্যে শেহজাদ এক মূহুর্তও শান্তি পাচ্ছে না। অস্থিরতার পারদ যেন তার মাত্রা অতিক্রম করে ফেলছে! সে গিয়ে তার ফুফা ও ফুফিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে খবরটা জানায়। মিসেস শাহিদা, শেহজাদকে ধৈর্য ধরতে ও দোয়া করতে বলেন। ফজরের আজান হতে এখনও ঘণ্টাখানেক বাকি।

ফজরের পর ধরণীতে ভোরের শুভ্র আলো ফুটতেই শেহজাদের কাছে সুসংবাদ আসে। সে কন্যাসন্তানের পিতা হয়েছে। সি*জা*রের মাধ্যমে ফিওনা সুস্থ ভাবে কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছে। প্রথম বাবা হওয়ার সংবাদে শেহজাদ নিজের খুশি, আনন্দ মুখে বা অভিব্যক্তিতে ব্যক্ত করতে পারছে না। নিজের কাছে নিজেকে সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে গণ্য হচ্ছে তার।
ড: আকবর রেহমান খুশিতে আমেরিকার ফ্লাইটের চারটা টিকেট কে*টে ফেলেছে। তার নাতনী হয়েছে বলে কথা! আজ রাতেই তারা রওনা হবে।
_____

আমেরিকায় পৌঁছে প্রথমবারের মতো নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে শেহজাদ যেন চোখের পলক ফেলতেই ভুলে গেছে। মেয়েকে কোলে নিয়ে সে সময়জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে অবস্থা। বিষয়টা শেহজাদের মা, ফুফা-ফুফি ও ফিওনার বেস্টফ্রেন্ড মারিয়া দেখে মিটিমিটি হাসে। অতঃপর শেহজাদের মা এগিয়ে গিয়ে নিজের ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলেন,

“এবার আমাদের নাতনীকে আমাদেরও একটু দাও। তুমি একটু ফিওনার সাথেও বসে কথা বলো। আসার পর একটু ‘এখন কেমন আছ?’ এটুকুতে কথা সেড়ে মেয়েকে নিয়ে পড়েছ। যাও এবার।”

এদিকে ফিওনা তার বেস্টফ্রেন্ডের হাজবেন্ড পিটারকে বলছে,
“শেহজাদ শুড নট নো দিস। বি কেয়ারফুল।”

“ইয়াহ। ডোন্ট ওয়ারি এবাউট দিস। এভরিথিং ইজ ফাইন। এন্ড ইউ আর ফাইন।”

শেহজাদ ফিওনার কাছে এসে পিটার বলা কথাটা শুনে হাস্যজ্জ্বল মুখে শুধায়,
“হোয়াট হ্যাপেন্ড?”

ফিওনা ও পিটার দুজনেই ভড়কে যায়। পিটার কী বলবে ভাবতে ভাবতেই ফিওনা জবাব দেয়,
“একচুয়ালি, টুডে দে আর গোয়িং টু ডিসচার্জ মি। সো…”

“ওহ। ওকে। থ্যাংকস পিটার। ইউ হেল্পড আস সো মাচ।”

পিটার মৃদু হেসে বিদায় জানিয়ে চলে যায়। শেহজাদও ফিওনার পাশে বসে।
______
আমেরিকায় নিজের স্ত্রী, নবজা*তক কন্যা ফ্রিশার সাথে দুইদিন থেকে শেহজাদকে ফিরে আসতে হয়। আস্তে আস্তে সময় পেরোয়। ফ্রিশাও বড়ো হতে থাকে। কয়েক মাস পর ফিওনার দাদির মৃ*ত্যু হলে, শেহজাদ সবাইকে বাংলাদেশে আনার ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশে এসে ফ্রিশাও একটু একটু করে বড়ো হতে থাকে। দেখতে দেখতে ফ্রিশার দুই বছর পেরোলে শেহজাদের মাও না ফেরার দেশে চলে যান। শেহজাদের বাবার পাশেই শেহজাদের মাকে শায়িত করা হয়।
সুখ-দুঃখ সবমিলিয়ে যেমন জীবন, তেমনি সময়ে সাথে সবকিছুকে স্বাভাবিকে আসতে হয়। ফ্রিশার তিন বছর বয়সে ফিওনা আবার প্রেগন্যান্ট হয়। এবারও আগের মতোই সমস্যা তবে আরও গুরুতর। প্রেগন্যান্সির তিন মাসেই টি*উ*মার অনেকটা বড়ো হয়ে গেছে। এবার শেহজাদ সবটা জানতে পারে। সে সত্যি ভাবতে পারেনি, ফিওনা তার থেকে এতবড়ো ঘটনা আড়াল করে যাবে। সবাই মিলে ফিওনাকে এ*বরশ*নের কথা বললেও ফিওনা নারাজ। কেন যেন তার মনে হচ্ছিল, এবার শেহজাদ তাকে মাফ করবে না। তাই এব*রশ-ন সে করতে চায় না। তারপর সাত মাসে পড়ার আগেই প্রচণ্ড পেটে ব্যাথা নিয়ে হসপিটালে ভর্তি হলে, ওটাই ছিল ফিওনার শেষ সময়।

ফ্ল্যাশব্যাক এন্ড,,

শেহজাদ অতীতের স্মৃতি থেকে বেরিয়ে চশমা খুলে টেবিলে রাখলো। রাত এখন অনেক গভীর। রুমের দিকে উঁকি দিয়ে বুঝলো মীরা এতক্ষণে গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন। সে নিজে নিজে স্বগোতক্তি করে বলে,

“আমি চাইনি ফিওনার জন্য তোমার মনে কোনোরকম নেগেটিভ কিছু আসুক, মীরা। চাইলেই সবটা বলতে পারতাম। কিন্তু কী হতো? ফিওনা তো কখোনো তোমার লাইফ কম্পলিকেটেড করতে ফিরবেও না। তাহলে কেন আমি তোমার মনে থাকা ওর জন্য সম্মানটা নষ্ট করব? তুমি আর ফিওনা দুজনেই নিজেদের আলাদা আলাদা সময়ে আমার জীবনে এসেছ। কারও টাইমের সাথে কারওটায় মিল নেই। আমি চাই না তুমি ফিওনাকে খারাপ ভাবো। সে যা করেছে আমায় ভালোবেসে করেছে। যদিও সেসবকে আমি সাপোর্ট করি না। এটা তো সত্যি, ও আমাকে ওর নিজের চাইতেও বেশি ভালোবেসেছে। আমি সত্যি ফরচুনেট পার্সন। বাট অলসো আনফরচুনেট। এতো ভালোবাসা পেয়েও ভালোবাসার মানুষটাকে প্রকৃতির কঠোর সত্যতে হারিয়ে ফেলেছি।”

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে শেহজাদ উঠে দাঁড়ালো। শব্দহীন পায়ে রুমে প্রবেশ করে বিছানার ফাঁকা স্থানে শুয়ে পড়লো।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
লেখা এলোমেলো আমিও বুঝতে পারছি। অতীতটা যতো সংক্ষিপ্তে শেষ করা যায় করেছি।
আগামী পর্ব বুধবার আসবে এবং অতীত আজকেই শেষ। আমি গতকালই পর্ব দিতাম। অনেকটা লেখা ছিল। ফের রেস্ট নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে গেছি।
ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৭
পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো মীরার। ভোরের আবছা আলোয় রাতের অন্ধকার এখনও পুরোপুরি দূর হয়নি। জানালা দরজা লাগানো ও পর্দা দেওয়া থাকায় অন্ধকারে থৈ থৈ। শুধু দেয়ালে ডিজিটাল ঘড়িটায় সংখ্যা জানান দিচ্ছে এখন সময় ৪টা বেজে ১৪ মিনিট। ফজরের আজান পড়ে গেছে। মীরা বেড সাইড টেবিলের ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে শেহজাদের দিকে তাকালো। শেহজাদকে দেখে মনে হচ্ছে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। মীরা মনে মনে ভীষণ প্রফুল্ল হলো। সে মৃদু স্বরে শেহজাদকে ডাকলো। প্রথমবার ডাকে উঠলো না। বারকয়েক ডাকতে শেহজাদের ঘুম হালকা হয়ে এলো। শেহজাদ পিটপিট করে চোখ মেলে কুঁচকানো ভ্রু নিয়ে বলল,

“সকাল হয়ে গেছে?”

“হ্যাঁ তো। আজ আপনার আগে আমার ঘুম ভাঙলো। গতকাল আপনাকে বলেছিলাম, আমাকে ভোরে ডেকে দিবেন, কিন্তু দেখুন। আমিই আপনাকে ডাকলাম।”

শেহজাদ ঈষৎ তন্দ্রাভাব নিয়েই হালকা হাসলো। তারপর বলল,
“যাও নামাজের জন্য প্রস্তুত হয়ে এসো।”

মীরাও বিনিময়ে মুচকি হেসে ওযু করতে যায়।

নামাজ শেষে মীরা জিজ্ঞেসা করে,
“আপনার কি কালকেই ছুটি শেষ?”

“হ্যাঁ।”

“আমার তো পরশু পর্যন্ত ছুটি। ভেবেছিলাম আব্বু-আম্মুর কাছে আমি, আপনি, ফ্রিশা একদিন থেকে আসব। আজকে তো উনারা আসবেন। ওইযে বিয়ের পরদিন বা দুইদিন পর যায় যে।”

মীরার চোখে-মুখে বিষণ্ণতার মেঘ এসে ভিড়েছে। শেহজাদ নরম কণ্ঠে বলল,
“বৃহস্পতিবার যাব। তুমি নিজেও তো ক্লাস মিস দেওয়ার সাইড এফেক্ট বুঝো।”

মীরা ভেবে দেখলো। অতঃপর বলল,
“হুম। আচ্ছা। বৃহস্পতিবার যাব। এখন ফ্রিশার ঘরে গিয়ে দেখি?”

উঠতে উঠতে শেষোক্ত কথা বলতেই শেহজাদ বলল,
“ও-কে ৬টার দিকে ডেকো। সবে তো ৫টা বাজে। এক কাজ করো, আমার জন্য ব্ল্যাক কফি বানিয়ে নিয়ে এসো আর যদি তুমিও ব্ল্যাক কফি পছন্দ করো তবে তোমার জন্যও। বানাতে পারবে?”

মীরার মুখশ্রীতে প্রথমে হাসির রেখা ফুটলেও শেহজাদের শেষোক্ত কথায় চোখ ছোটো ছোটো করে প্রত্যুত্তর করলো,
“আপনার কী মনে হয়? আমি অক*র্মা! সামান্য কফিও বানাতে পারি না?”

“আই ডিডেন্ট মিন দ্যাট। একচুয়ালি সবাই কফি সুন্দর করে বানাতে পারে না। মাঝখানে বাড়িতে একজন এক্সট্রা মেইড রেখেছিল, সে কফির স্বাদকে বিস্বাদ করে ফেলতো।”

শেহজাদের সেল্ফ এক্সপ্লেনেশন শুনে মীরা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“আচ্ছা বুঝেছি। যদিও আমি ব্ল্যাক কফি তেমন একটা পছন্দ করি না। কিন্তু বানাতে পারি। প্রচণ্ড মা*থাব্যথা হলে তখন ব্ল্যাক কফি মাঝেমধ্যে খাই।”

“আচ্ছা। বানিয়ে নিয়ে আসো তবে।”

মীরা কয়েক সেকেন্ড ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে শেহজাদের কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে কফি বানাতে চলে যায়। মীরা যেতেই শেহজাদ নিজের চেপে রাখা হাসি এবার মুক্ত করে। নিঃশব্দে হেসে বুকশেলফের কাছে যায়।

_______
দুপুরের আগে মীরার পরিবার, রাইমা ও কুঞ্জ মীরার শ্বশুরবাড়িতে আসে। মিসেস শাহিদা ও মীরা মিলে সার্ভেন্টের সাহায্যে আপ্যায়নের সব ব্যাবস্থা করে ফেলেছে। প্রথমেই মীরা সবার জন্য আপেলের ঠান্ডা ঠান্ডা শরবত পরিবেশন করে। তারপর একে একে হালকা কিছু নাস্তা। রাইমা মীরার ব্যস্ততায় দেখে মীরাকে টেনে এক জায়গায় এনে অভিমানী স্বরে বলে,

“তুই আমার সাথে কথাই বলছিস না। কাজেই লেগে আছিস!”

রাইমার অভিমানী মুখ। মীরা ওর গা*ল টেনে দিয়ে হেসে বলে,
“বল বল। তোরা সবাই মাত্র এলি। তাই ভাবলাম রেস্ট নে তারপর কথা বলব।”

“রেস্ট নেওয়া লাগবে না। সময় নেই। আজ সন্ধ্যায় ফ্লাইট। এখান থেকে সরাসরি আমি আর কুঞ্জ এয়ারপোর্টে যাব।”

“কী বলিস! আজকেই?”

“হ্যাঁ রে। তোর বিয়ের জন্য তিন দিন প্লাস রবিবার তো ছুটিই। কালকে মাস্ট জয়েন করতে হবে।”

মীরা মন খারাপ করে বলে,
“আবার কবে দেখা হবে! বিয়ের ব্যস্ততায় তোর সাথে ঠিকমতো কথাই হলো না।”

“পরেরবার আবার আমার বিয়েতে দেখা হবে। বুঝলি। তাছাড়া ভিডিওকল তো করবই। তুই নিজেই কিন্তু এগুলো আমাকে বলে এসেছিলি।”

মীরা ও রাইমা দুজনেই মন খারাপের রেশে নিরব হাসে। মীরা বলে,
“তোর যা মন! বিয়ে যে কবে করবি তার ঠিক নেই। বেচারা কুঞ্জদা….”

রাইমা জলদি করে মীরাকে থামিয়ে বলে,
“৩১ ডিসেম্বর আমার বিয়ে। এবার ফিক্সড। তোর জন্য তো আলাদা করে স্পেশাল কার্ডও বানিয়ে এনেছি। ওয়েট, নিয়ে আসছি।”

মীরাকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রাইমা ছুট লাগায়। রাইমা যাওয়ার কয়েক সেকেন্ড পর শেহজাদ কোলে করে সিয়ামকে এনে বলে,

“ফ্রিশা, মৃদুলা ও নিহান ও-কে এতোবার বলল খেলতে। কিন্তু সে আমাকে ডেকে ইশারায় তোমাকে দেখাচ্ছে। তোমার কাছে আসবে। নাও তোমার ভাতিজাকে।”

মীরা আদুরে মুখ করে সিয়ামকে কোলে নিতেই সিয়াম হাতে তালি দেয়। মীরা ও শেহজাদ হালকা শব্দ করে হেসে ওঠে। তখনি রাইমা, কুঞ্জকে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলে,

“এই যে আমাদের বিয়ের কার্ড। আর তোর বিয়ের গিফট। আমার বিয়েতে তোকে, জিজুকে ও ফ্রিশুমনিকে এটাই পড়তে হবে কিন্তু!”

মীরা সন্দিহান হয়ে গিফট বক্সটা দেখে তা ধরে শুধায়,
“কী আছে এতে?”

“আছে কিছু। আগে কার্ডটা দেখ তারপর তোর ঘরে গিয়ে আরাম করে ওটা খুলবি।”

মীরা, শেহজাদের হাতে মাঝারি বড়ো আকৃতির গিফট বক্সটা কোনোরকমে দিয়ে বিয়ের কার্ডটা খুলে। সত্যি সত্যি রাইমা ও কুঞ্জর বিয়ে। মীরা রাইমাকে জড়িয়ে ধরে শুভ কামনা জানিয়ে গিফ্টবক্স সহ ওদেরকে নিয়ে নিজেদের রুমে যায়। অতঃপর সুন্দর করে আনবক্স করে দেখে তার মধ্যে একটা ডার্ক এ্যাশ রঙের পাজামা-পাঞ্জাবি, ডার্ক এ্যাশ রঙের লতানো ডিজাইনের বোনারসি ও ফ্রিশার জন্য একটা এ্যাশ রঙের নেটের উপর ডিজাইনার লেহেঙ্গা। মীরা উপহার গুলো দেখে একদম হা হয়ে গেলো। সে অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে,

“এতোকিছু তোকে কে করতে বলেছে? হ্যাঁ!”

রাইমা ভাব নিয়ে বলে,
“আগে বল, পছন্দ হয়েছে? অবশ্য আমার চয়েজ বলে কথা!”

“তোর পছন্দ করা কিছু আমার পছন্দ হবে না? অনেক পছন্দ হয়েছে। কিন্তু এতোকিছু কেন করতে গেলি!”

শেহজাদও তাল মেলায়,
“ইয়াহ, রাইমা। এসবের দরকার ছিলো না। তুমি ইন্ডিয়া থেকে নিজের বেস্টফ্রেন্ডের জন্য এসেছ।”

রাইমা বলে,
“আপনার বউকে দেখবেন, কী করে! আমার বিয়েতে নাকি সে বিয়ের শাড়ি দিবে! আমি ও-কে অনেক কষ্টে বুঝিয়েছি। বিয়ের শাড়ি আমি আমার মায়ের পছন্দে নিব। মা আমার জন্মের পর থেকে কোনো শাড়ি দোকানে গেলেই আমার জন্য বিয়ের শাড়ি দেখে। তাতে আপনার বউ মেনেছে। এখন সে কী করে, তাতো আমি জানিনা। তবে আমি কেন পিছিয়ে থাাকব? হুহ্!”

মীরা ও-কে চি*ম–টি কে**টে বলে,
“হয়েছে। চুপ কর। তোর বিয়েতে আমিও আমার পছন্দের কিছু দিব। তবে তোর গিফটা খুব কিউটরে। থ্যাংকিউ ইয়ার।”

মীরা, রাইমাকে জড়িয়ে ধরলে। রাইমা বলে ওঠে,
“দূরে যা এবার। তোর বরের অধিকার আমি নষ্ট করলে জিজু পরে আমার উপর রাগ করবে। তুই দূরত্ব বজায় রাখ।”

রাইমার কথা শুনে শেহজাদ থতমত খেয়ে কিছু একটা বাহানা করে সিয়ামকে নিয়ে সেখান থেকে সটকে পড়ে। তা দেখে রাইমা শব্দ করে হাসলে মীরা কপট রাগ দেখিয়ে ও-কে দু ঘা লা*গিয়ে দেয়। কুঞ্জও রাইমাকে ইশারায় থামতে বলে।

______

দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই ফ্যামিলি আড্ডায় বসেছে। কথায় কথায় শারমিন, নিধি ও রাইমা মিলে মীরাকে গা*ন গাইতে বলে। মীরা বারবার নাকচ করলে শেহজাদ যখন বলে,
“সবাই বলছে যখন গাও।”

মীরার মনে শিতল হাওয়া বয়ে যায়। যা তার লোমকূপ পর্যন্ত বইয়ে গেছে। লাজুক হেসে মীরা গা*ন ধরে….

চলবে ইনশাআল্লাহ,

ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-২৫+২৬

0

#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৫
শেহজাদকে নিরব দেখে ভীত হলো ফিওনা। মনের অভ্যন্তরের ঝড়ের বহিঃপ্রকাশ তার নেত্রকোণ বেয়ে সরু অশ্রুরেখা ও রক্তিম মুখাবয়বই প্রকাশ করে চলেছে অবিরত। কান্নার শব্দগুলো যেন কণ্ঠস্বরকে রুদ্ধ করে রেখেছে। শত চেষ্টার পরও গলা দিয়ে একটা শব্দও বের করতে পারলো না সে। এদিকে শেহজাদ বুঝতে পারছে না, সে কী করবে? ৬ বছরের বেশি সময় যাবত পরিচয় কিন্তু কখোনো ফিওনার জন্য তার তেমন কোনো অনুভূতি হয়নি। সে নিজের মনকে শান্ত করতে রোড সাইডের উঁচু জায়গায় বসলো। অতঃপর ফিওনাকে প্রশ্ন করলো,

“আর ইউর ফাদার এন্ড গ্র্যান্ডমা এওয়ার অফ দিস? (তোমার বাবা আর দাদি কি এটা জানেন?)”

ফিওনা বড়োসড়ো ঢোক গিলে, কোনোমতে বলল,
“দে নোও, আই লাভ ইউ। বাট এবাউট রিলিজিয়ন, আই ডিডেন্ট ডিসকাস উইথ দেম।”

“ওহ!”

প্রত্যুত্তর করো শেহজাদ ফের ভাবনায় ডুব দিলো। ফিওনার কণ্ঠস্বর তার কাছে স্বাভাবিক শোনায়নি। ফিওনার মুখের দিকে তাকালে লক্ষ্য করে, মুখশ্রীতে রক্তিমাভাব ফুটে ওঠেছে। বিকেলের শেষ সময়, সূর্যের তেজ মিয়িয়ে আছে। তাছাড়া আমেরিকায় এখন বসন্ত ঋতু। শীতের মৃদু আমেজ ও বসন্তের স্নিগ্ধতায় ভরপুর। তাহলে এই র*ক্তিম আভার কারণ কি শঙ্কা? হবে তাই হয়তো! এই ভেবে শেহজাদ ফিওনাকে বলল,

“লেটস গো।”

ফিওনা হতবুদ্ধির মতো শুধায়,
“হোয়ার?”

শেহজাদ উত্তর দিলো না। নিজেই ফিওনার হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ফিওনাও নিরবে তাল মিলিয়ে চলতে লাগে। তারপর শেহজাদ ফিওনাকে নিয়ে নিজের বাড়ির কাছে আসে। ফিওনাকে বাড়ির ভেতরে যেতে বলে সে কোথাও একটা চলে যায়। ফিওনা দুরুদুরু হিয়ায় শেহজাদের বাড়ির ভেতরে ঢোকে। অদূর ভবিষ্যতে কী হতে চলেছে তা সম্পর্কে ধারণা করতেও তার হৃদয় বারংবার কেঁপে ওঠছে। শেহজাদের বাবা-মা, ফিওনাকে দেখে খুশিই হয়। উনারা এখনও ফিওনার এখানে আসার কারণ জানেনা। ভেবেই নিয়েছে প্রত্যেকদিনের মতো আজও ফিওনা গল্প করতে এসেছে। প্রায় কিছু সময় পর হঠাৎ কলিংবেল বেজে ওঠে। শেহজাদের মা উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখেন, শেহজাদ ফিওনার বাবা ও দাদিকে সাথে করে নিয়ে এসেছে। শেহজাদের মা উনাদের হাসিমুখে স্বাগত করেন। তারপর ছেলেকে জিজ্ঞাসা করেন,

“আজ কোনো কিছু আছে নাকি? হঠাৎ স্যার ও আন্টিকে নিয়ে এলে।”

“ওয়েট করো, মা। এখনি জানতে পারবে।”

শেহজাদ মাকে নিয়ে সবার কাছে যায়। সেখানে গিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলে,
“ফিওনা চেইঞ্জড হার রি*লিজি**য়ন টু ম্যারি মি। নাউ ইউ গাইজ টেল মি, হোয়াট শুড আই ডু? আই ডোন্ট নো হাউ টু রিয়াক্ট। (আমাকে বিয়ে করার জন্য ফিওনা তার ধ*র্ম পরিবর্তন করেছে। এখন আপনারা বলুন, আমি কী করব? আমি বুঝতে পারছি না, কী প্রতিক্রিয়া দিব।)”

উপস্থিত সকলের চোখে মুখে বিস্ময়ের রেশ। সবাই একযোগে ফিওনার দিকে দৃষ্টি স্থাপন করলো। ফিওনা ভীত অবস্থায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। ফিওনার বাবা প্রফেসর হ্যারি লম্বাশ্বাস নিয়ে বললেন,

“ইটস হার চয়েজ। সি ইজ ম্যাচিওর এনাফ টু মেইক হার অওন ডিসিশন। এন্ড আই রেসপেক্ট দ্যাট। (এটা তার পছন্দ। সে তার নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যথেষ্ট ম্যাচিওর। আর সেটাকে আমি সম্মানও করি।)”

ফিওনা অশ্রসিক্ত নয়নে ছুটে এসে নিজের বাবার বুকে আ*ছ*ড়ে পড়ে। ফিওনার দাদিও ছেলে ও নাতনীর কাছে এসে নিজের সাথে আগলে নিয়ে চোখের জল ছেড়ে বললেন,
“আই অলসো রেসপেক্ট হার ডিসিশন।”

শেহজাদ প্রতিক্রিয়াহীন ভাবে নিজের বাবা-মায়ের দিকে তাকায়। উনাদের থেকে ইশারায় উত্তর জানতে চাইলে শেহজাদের মা জবাবে বলেন,
“ফিওনাকে পুত্রবধূ করতে আমার কোনো প্রবলেম নেই। নাউ ইটস ইউর চয়েজ। ডু ইউ একসেপ্ট হার এজ অ্যা ওয়াইফ? অর নট? বিকজ ইউ আর সাপোসড টু লিভ উইথ হার ফর লাইফ।”

শেহজাদের বাবাও, নিজের স্ত্রীর সাথে সহমত পোষণ করেন। শেহজাদ খানিক সময় নিয়ে উপরের দিকে চেয়ে ঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ওকে। আই উইল ম্যারি হার।”

শেহজাদ ছাড়া সবার মাঝে এক আনন্দ অনুভূতি খেলে গেল। শেহজাদের বাবা, এখনি বিয়ে পড়ানোর জন্য চেনা এক হুজুরকে ফোন করতেও চলে গেছেন। সবার উৎসুকতা ও খুশি দেখে শেহজাদ হালকা হাসে। তারপর একটু একা থাকতে নিজের ঘরের দিকে যায়। বিয়ে করার ক্ষেত্রে তার নিজস্ব কোনো পছন্দ ছিল না। পরিবার যাকে ঠিক করবে, তাকেই বিয়ে করতো। এখানে তার পরিবার রাজি এবং সে একটা মেয়ের পছন্দকেও গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু তার খারাপ লাগছে এই কারণে যে, এই বিয়েটা হওয়ার পেছনের ঘটনাটা। সত্যি কি তার জন্য ফিওনার ডিভোর্স হয়েছিল? সে কারও জীবন নষ্ট হওয়ার কারণ হয়েছে, এটাই তার মনকে বারবার ক্ষ*ত-বিক্ষ*ত করে চলেছে।

রাত ৯টার পর হুজুর এসে বিয়ে পড়িয়ে দিয়ে যায়। রেজেস্ট্রি আগামীকাল হবে। ফিওনা পুরোটা সময় খেয়াল করছিল, শেহজাদের মধ্যে কোনো উচ্ছাস নেই। তাই ফিওনা নিজ থেকে এসে শেহজাদের পাশে বসে হাত ধরে বলে,

“টেক ইউর টাইম। ওয়ান ইয়ার, টু ইয়ার অর মোর। কিন্তু এট লাস্ট, বি মাইন। আই লাভ ইউ।”

শেহজাদ মুচকি হেসেছিল শুধু। সেদিনের পর সময় অনেক দ্রুত বইতে শুরু করলো। শেহজাদ পিএইচডির জন্য এডমিশন নেয়। প্রফেসর হ্যারিই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। ফিওনা ও শেহজাদের বিয়ের পাঁচ মাস পর, হঠাৎ প্রফেসর হ্যারির হার্ট অ্যা*টা*কে মৃ*ত্যু হয়। ওই সময়টাতে ফিওনা ও তার দাদি ভিষণ রকমের ভেঙে পড়েন। শেহজাদ, উনাদেরকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসে। বিয়েটা আরও চার মাস আগে হলেও সেদিন থেকেই শেহজাদ ও ফিওনার সংসার জীবন শুরু হয়। পিতৃবিয়োগের শোক কাটিয়ে ফিওনা আগের মতো নিজের ফ্যাশন ডিজাইনিং কোর্সে যোগ দেয়। আস্তে আস্তে সময়ের সাথে সব স্বাভাবিক হতে থাকে। বছর ঘুরতেই শেহজাদের বাবাও না ফেরার দেশে চলে যান। তখন অবশ্য আরেকটা দুর্ঘটনাও ঘটেছিল। যা তখন শেহজাদকে জানানো হয়নি। ফিওনার ২ মাসের প্রেগন্যান্সির মি*সক্যা*রেজ হয়ে গিয়েছিল। এমন একটা দিন যে শেহজাদ পিতৃবিয়োগের বেদনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেই সাথে নিজের অনাগত সন্তানকেও হারিয়েছে। তাছাড়া শেহজাদ ও ফিওনা জানতোই না প্রেগন্যান্সির ব্যাপারে। হসপিটালে শেহজাদের বাবার মৃ*ত্যু ও লা*শ নিয়ে দৌড়াদৌড়িতে শেহজাদ শুধু ফিওনাকে পেটে ব্যাথার জন্য হসপিটালে ভর্তি করিয়ে বাবার দিকটার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সেদিনই ফিওনার মিস*ক্যা*রেজ হয়! এবং ফিওনা সবার মনের অবস্থার কথা চিন্তা করে ডাক্তারদের অনুরোধ করে যেন এই খবর আর কাউকে না জানায়।
সময়ের পরিক্রমায় আরও তিন বছরের মতো পেরিয়ে যায়। শেহজাদ পিএইচডি শেষ করে সবে একটা ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিয়েছে। এরইমধ্যে ড: আকবর রেহমান ও মিসেস শাহিদা, শেহজাদকে কয়েকবার পরিবারসহ বাংলাদেশে আসতে বলেছেন। শেহজাদ প্রথমে এই বিষয়ে তেমন ভাবেনি। কিন্তু হঠাৎ একদিন একটা শপিংমলে ফিওনার এক্স হাজবেন্ড মাইকেলের সাথে দেখা হয়। মাইকেল নিজের পূর্বের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চায়। তখন সে মাইকেলের থেকে জানতে পারে, মাইকেল ফিওনার সাথে কোনো রুড বিহেভিয়ার বা চি*ট প্রথমে করেনি। বরং ফিওনাই মাইকেলের প্রতি উদাসীন ছিল। ওদের বিয়ের কয়েকদিন পর যখন মাইকেল লক্ষ্য করেছিল, ফিওনা ঘ*নিষ্ঠ মুহূর্তে আবেগহীন থাকে। তখন মাইকেল কারণ জিজ্ঞাসা করলে ফিওনা বলে দিয়েছিল যে, সে ঝোঁকের বশে বিয়েটা করেছে এবং সে মাইকেলকে ভালোবাসে না। তাই তার থেকে ভালোবাসা আশা না করতে। মাইকেল তারপরেও প্রায় অনেকদিন চেষ্টা করে ফিওনার মনে তার জন্য ভালাবাসার সৃষ্টি করতে। কিন্তু শেষে হার মেনে নিজেও ভালো থাকার উপার খুঁজে নেয়। মাইকেল এটাও বলে যে, ফিওনা যাকে মন-প্রাণ দিয়ে প্রথম থেকে ভালোবেসে এসেছে, সে কেউটা শেহজাদ। তাই মাইকেল শেহজাদের প্রতি একটা ক্ষোভ মনে পুষে রেখেছিল। এজন্যই সেদিন নিজের এরেঞ্জ করা পার্টিতে শেহজাদ ও ফিওনাকে দেখে প্রচণ্ড রে*গে গিয়েছিল। তারপর সেই পোস্টটাও রাগের বশেই দিয়েছিল। মাইকেল তো মাফ চেয়ে চলে যায় কিন্তু রেখে যায় শেহজাদের মনে প্রশ্নদের মূল। শেহজাদ বাড়ি ফিরে প্রথমেই ফিওনাকে নিজের সামনে বসিয়ে প্রশ্ন করে,

“হু ওয়াজ দ্যা হোস্ট অফ দ্যা পার্টি দ্যাট নাইট?”

ফিওনা আঁতকে ওঠে। নিজেকে যথাসাধ্য স্বাভাবিক রেখে বুঝতে না পারার মতো করে শুধায়,
“হুইচ পার্টি?”

শেহজাদ চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত রেখে বলে,
“আই নো, ইউ আর ওয়েল এওয়ার অফ দ্যাট। সো প্লিজ। টেল দ্যা ট্রুথ। আমাদের নিয়ে যেদিন কথা উঠলো। মাইকেল সিন*ক্রি*য়েট করলো। সেই পার্টির হোস্ট কে ছিল?”

ফিওনা অন্যদিকে ঘুরে অস্থির হয়ে কম্পনরত স্বরে জবাব দিলো।
“আই ডোন্ট নো। ইট ওয়াজ অ্যা রেনডম পার্টি। লেট ইট বি।”

“নো। আই অ্যাম নট, ফিওনা।”

শেহজাদ, ফিওনার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। একহাতে ফিওনার হাত ও আরেক হাতে ফিওনার থুতনিতে ধরে মুখ উঁচু করে চোখে চোখ মেলায়। ফের শুধায়,
“আই ওয়ান্ট টু নো দ্যা ট্রুথ থ্রো ইউর ভয়েস। (আমি তোমার মুখ থেকে সত্য জানতে চাই।)”

ফিওনা শেহজাদের চোখে স্পষ্ট ক্রোধ দেখতে পেলো। এটাও বুঝতে পারলো যে শেহজাদ জেনেই তাকে প্রশ্ন করছে। সে হতাশা মিশ্রিত নিঃশ্বাস ছেড়ে মাথা নিচু করে বলে,

“সরি। ইয়াহ, ইট ওয়াজ মাইকেল’স পার্টি, এন্ড আই নিও ইট। সরি, শেহজাদ।”

শেহজাদ ফিওনার হাত ছেড়ে বিছানায় মাথা নিচু করে বসে। হাতের আঙুল গুলো একবার মুষ্টিমেয় করছে তো আবার খুলছে। এমন অবস্থাতেই প্রশ্ন ছুঁ*ড়ে দেয়,

“কেন করলে এটা? টু ম্যারি মি? এজন্য আমার ক্যারেক্টারে আঙুল তুলে?”

ফিওনা ব্যকুল হয়ে শেহজাদের পায়ের কাছে বসে। মায়াভরা চাহনিতে বলে,
“নো নো শেহজাদ। তুমি ভুল জানো। আই জাস্ট ওয়ান্টেড হিম টু নো দ্যাট আই ওয়াজন্ট স্যাড বিকজ অফ দ্যা ডিভোর্স। আই অ্যাম হ্যাপি। ইউ আর অলওয়েজ বাই মাই সাইড। দ্যাটস ইট। (আমি চেয়েছিলাম সে জানুক যে বিবাহবিচ্ছেদের কারণে আমি দুঃখে নেই। আমি খুশি। তুমি সব সময় আমার পাশে আছ)”

শেহজাদ তাচ্ছিল্য হাসে। অতঃপর বলে,
“ঝোঁকের বশে বিয়ে করলে। দেন সাডেনলি ইউ রিয়েলাইজ, ইউ আর নট এভেল টু লাভ হিম। তারপর ডিভোর্স! এই সবকিছুর মধ্যে আমি কেন মাইকেলের কাছে কা*ল*প্রি*ট হলাম?”

ফিওনা শঙ্কা ও লজ্জায় মুখ হাত দিয়ে আড়াল করে নেয়। এসবকিছু শেহজাদের জানার কথা না। তাহলে কী শেহজাদ তার ডায়েরি পড়লো। সে দ্রুত ড্রয়ার চেক করে দেখলো, ডায়েরি তার স্বস্থানেই আছে। এটা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই শেহজাদ ছোঁ মে*রে ডায়েরিটা নিয়ে বলল,

“এখন আমি সব দেখব। আর কি কি তুমি লুকিয়েছ।”

“প্লিজ, শেহজাদ। নো। গিভ ইট ব্যাক টু মি। প্লিজ।”

শেহজাদ শুনলো না। ফিওনা আরও কয়েকবার বলল, ছি*নিয়েও নিতে চাইলো। কিন্তু শেহজাদ আজ নিজের সিদ্ধান্তে অটল। সে ডায়েরি নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেল। ফিওনা ব্যর্থ হয়ে সেখানেই বসে কাঁদতে থাকে। তাদের চার বছরের বিবাহিত জীবনে এই প্রথমবার সে শেহজাদকে রাগ করতে দেখছে। তাও যেন রাগের স্ফুলিঙ্গ বেড়েই চলেছে। ফিওনা খোলা বারান্দা দিয়ে আকাশপানে চেয়ে উপরওয়ালার কাছে আর্জি জানালো,

“প্লিজ, আল্লাহ। হেল্প মি। আমি শেহজাদকে ভালোবাসি। রিয়েলি ভালোবাসি।”

শেহজাদ, তার বাবার স্টাডি রুমে ঢুকে ডায়েরিটা পড়তে শুরু করলো। ফিওনা এখানে শুধু নিজের ইচ্ছা ও সিক্রেট গুলোই লিখে রাখে। দৈনন্দিন সব লিখে না।
রাত দশটায় শেহজাদ নিজের রুমে আসে। শেহজাদের মা ও ফিওনা দুজনেই সেখানে ছিলেন। শেহজাদের মা উদ্বিগ্ন হয়ে শুধালেন,

“শেহজাদ, তুমি ঠিক আছ? দেখ যা হয়েছে, ভুলে যাও। চার বছর তো তোমরা ভালোই ছিলে। কিছু সত্য আমরা কেউ জানতাম না। তারপরও তো ভালো ছিলাম, বলো? কিছু সত্য সামনে না আসাই ভালো।”

শেহজাদ রো*ব*টের মতো বলে,
“জানো মা, আমার ইউনিভার্সিটিতে এই সেমিস্টার আজকে শেষ হলো। তাই শপিংমলে গিয়েছিলাম, তোমাদের জন্য শপিং করতে। কিন্তু যা জানতে পারলাম তাতে আমার কাছে… মা, তোমার ছেলের বউয়ের যে মি*সক্যা*রেজ হয়েছে, এটা জানতে?”

শেহজাদের মা অবাক হয়ে ফিওনার দিকে তাকায়। তারপর অবাকমিশ্রিত কণ্ঠে জবাব দেয়,
“মি*সক্যা*রেজ? কবে? ও প্রেগন্যান্ট হলো কবে?”

“ও নিজেও জানতো না যে প্রেগন্যান্ট। বাবার মৃত্যুর দিন মি*সক্যা*রেজ হয়েছিল। আমিই তো ও-কে পেটব্যথা নিয়ে হসপিটালে এডমিট করেছিলাম। তখন ডাক্তার বলেছিল, ফুড প*য়জ*নিংয়ের জন্য পেইন হচ্ছে। এতকিছু আমার থেকে লুকানোর মানে কী? বেবিটাতো আমারও ছিল।”

শেহজাদের মা ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে পাশ থেকে আগলে নিলেন। শেহজাদ ফের বলল,
“মা, আমি স্পেস চাই। আমি ফুফিজানের কাছে যাব। নিজের দেশে যাব। প্লিজ আমাকে আটকাবে না। এখানে থাকলে ওর সাথে সম্পর্ক আরও তিক্ত হবে। আমি পরশু ফ্লাইটেই চলে যাব। টিকিট বুক করাও হয়ে গেছে।”

ফিওনা ও শেহজাদের মা হতবাক হয়ে শেহজাদের দিকে চেয়ে আছে। ফিওনা কাঁদতে কাঁদতে শেহজাদের পায়ে পড়তে নিলে শেহজাদ সরে যায়। ফিওনা বলতে থাকে।
“প্লিজ, ডোন্ট গো। অাই অ্যাম সরি। আমি ভুল করেছি। লাস্টবার মাফ করে দাও।”

শেহজাদ কিছু না বলে ড্রয়ার থেকে নিজের পোষাক নিয়ে অন্য ঘরে চলে যায়।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৬
দুইদিন পর শেহজাদ কারও কথা তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে প্লেনে চড়ে বসে। প্রায় তিন বছর পর সে নিজ জন্মভূমিতে যাচ্ছে। শেষবার সে তার মায়ের সাথে বাবার লা*শ নিয়ে বাংলাদেশ গিয়েছিল। আজ একা যাচ্ছে। তাও মনের ভেতর অভিমানের গাড়ো আস্তর নিয়ে। প্লেনে বসে শেহজাদ ভাবছে, সে তো চাইলেই পারতো সব ভুলে ফিওনার সাথে আগের মতো সব ঠিক করে নিতে। কিন্তু করলো না কেন? নিজের উত্তর নিজেই পায় না। শুধু নিজেকে ছোটো মনে হচ্ছে। সে তো হাসিল করায় বিশ্বাসি নয়। সে বিশ্বাস করে ভালোবাসা দিয়ে জয় করা। তবে ফিওনা তাকে হাসিল করতে এতোকিছু কেন করলো? এসব ভাবতে ভাবতে নিজের উপর তার রাগ হচ্ছে। অতঃপর মনকে শান্ত রাখতে প্লেনের লম্বা জার্নিতে ঘুমানোটাই উত্তম মনে করলো।
এদিকে ফিওনা এয়ারপোর্টের ফ্লোরে বসে নিজের দাদি ও শেহজাদের মাকে জড়িয়ে কাঁদছে। সে তো খুব ভালোবাসে। যেভাবেই হোক, সে চেয়েছিল নিজের ভালোবাসা নিজের হয়ে থাকুক। ভালোবাসাতে নাকি সবকিছু জায়েজ? তবে সে তো শুধু তিনটা সত্য আড়াল করেছিল!
কিছু সময় পর ফিওনা কিছুটা শান্ত হলে শেহজাদের মা আদুরে কণ্ঠে বলেন,

“ডোন্ট ওয়ারি। হি উইল বি ব্যাক। হি জাস্ট অ্যা লিটল বিট এংরি। এভরিথিং উইল বি ফাইন।”

ফিওনা জবাবে কিছু বলতে পারলো না। অতঃপর শেহজাদের মা ও ফিওনার দাদি, ফিওনাকে এয়ারপোর্ট থেকে বাড়িতে নিয়ে আসে।

_____

বাংলাদেশে এসেই শেহজাদ ভার্সিটিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে জয়েন করে। সেমিস্টার ব্রেক শেষ হতেই সেও নতুন কর্মক্ষেত্রে মানিয়ে নিতে থাকে। ড: আকবর রেহমান ও মিসেস শাহিদা এতে বেশ খুশি। উনারা এখনও শেহজাদের এখানে আসার পেছনের কারণ সম্পর্কে অবগত নয়। দেখতে দেখতে এক মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন একটা খবর পায়। খবরটা এতোটাই ভ*য়ংক*র সুন্দর ছিল যে শেহজাদ ভার্সিটিতে নিজের ডেস্কেই বিস্মিত হয়ে বসে রয়। সে বাবা হচ্ছে। ফিওনা তিন মাসের প্রেগন্যান্ট। এই খবরটা তার মা, তাকে দিয়েছে। খবরটা শুনে শেহজাদ নিজের অনুভূতি ঠিক বুঝতে পারলো না। কিন্তু তার খুব সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে। এক নিমিষেই সব ভুলে হোয়াটসএপে ফিওনাকে কল লাগায়। ফিওনাও যেন এটারই অপেক্ষা করছিল। সঙ্গে সঙ্গে ফোন রিসিভ করে নিরব থাকে। অপরদিকে শেহজাদ চুপ। দুই পাশে পিনঃপতন নিরবতা বিরাজ করছে। দুজনেই চাইছে, অপরপক্ষ আগে কিছু বলুক। কিন্তু কিছু সময় পর ফিওনা আর শান্ত থাকতে পারলো না। সে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। শেহজাদ ঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে শীতল কণ্ঠে শুধালো,

“হোয়াই আর ইউ ক্রায়িং?”

কান্নারত স্বরে ফিওনা জবাব দিলো,
“ডোন্ট ইউ নো?”

“আই নো।”

“দেন, হোয়াই ডু ইউ স্টে সাইলেন্ট?”

ফিওনার কণ্ঠে অভিযোগ ও অভিমানের ভীড়। শেহজাদ হালকা হেসে বলল,
“ডাক্তার কী বলল? ফার্স্ট টাইম মি*সক্যা*রেজের জন্য কোনো হেলথ ইস্যু?”

ফিওনা আবারও একই ভুল করলো। সে এবারও রি*স্কের কথা আড়াল করে গেল । যদিও রি-স্ক সামান্য। ভেবেছে ডাক্তারের বলা মতো চললে সেটা ঠিক হয়ে যাবে। শেহজাদ বলেছে, সে প্রায় সাড়ে তিন পর ফিরে আসবে। এই সেমিস্টারটার সবে দেড় সপ্তাহ হয়েছে। ফিওনা তাতে ভিষণ খুশি।
সময়ের চক্রে সাড়ে তিন মাস সময়টাও পেরিয়ে গেল। আর মাত্র কিছু দিন পর ফিওনার প্রেগন্যান্সি সাত মাসে পড়বে। সে ইতোমধ্যে জেনে গেছে, তার মায়ের রোগটা সে পেয়েছে! তবে সেটা অতোটা ক্ষতিকর পর্যায়ে নেই। তার জড়ায়ুতে ছোটো একটা টি*উমা*র হয়েছে। ডাক্তার বলেছে, বাচ্চা জন্মের সময় টি*উ*মারও অপসারণ করা হবে। এখন সে কোনোভাবেই চায় না শেহজাদ আমেরিকায় আসুক এবং বিষয়টা জানুক। সে শেহজাদকে আসতে নিষেধও করে কিন্তু শেহজাদ চায় এই সময়ে তার স্ত্রীর পাশে কিছুটা সময় হলেও থাকতে। তাই সে আসে।
শেহজাদ আমেরিকায় আসার পর যে কয়টাদিন শেহজাদ আমেরিকায় ছিল, ততোদিন ফিওনা খুব কৌশলে জড়ায়ুর টি*উ*মা*রের ব্যাপারটা লুকিয়ে গেছে। শেহজাদের মাও এই সম্পর্কে অবগত নন। এদিকে ফিওনার দাদি অনেক অসুস্থ। তার জন্য আলাদা নার্স রাখা হয়েছে। ফিওনা ও শেহজাদের মা চায়, বাচ্চা জন্মের পর ওরা বাংলাদেশে যাবে। শেহজাদ যতদিন আমেরিকায় ছিল ততোদিন ফিওনার সবরকম যত্ন সে করেছে। ফিওনা কোনো না কোনো ভাবে শেহজাদকে ব্যস্ত রেখেছে যাতে শেহজাদ খোঁজ না করতে পারে। এতে ফিওনার বেস্টফ্রেন্ড ফিওনাকে সাপোর্ট করেছে! শেহজাদও সন্দেহ করেনি কারণ সে ভেবেছিল, ফিওনা নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত ও লজ্জিত। তারপরও নিশ্চয়ই একই ভুল সে করবে না।
খুব দ্রুতই শেহজাদের দেশে ফেরার সময় এগিয়ে এসেছে। নির্দিষ্ট সময় পর শেহজাদ দেশে ফিরেও এলো। তারপর সব তার নিজ নিজ গতিতে চলতে লাগলো। শেহজাদ ফিরে আসার এক মাস পর হঠাৎ গভীর রাতে শেহজাদের হোয়াটসএপে কল এলো। বলা বাহুল্য যে, শেহজাদ ওই সময়টাতে সবসময় ফোনের ডাটা অন করে রাখতো। কারণ প্রেগন্যান্সির শেষ তিন মাস ও প্রথম তিন মাস খুব ক্রুশিয়াল। খুব সাবধানে থাকতে হয়। শেহজাদ আমেরিকায় তার পরিচিত, নিকটস্থ এক ড্রাইভারকে আগে থেকে বলে রেখেছে যাতে যেকোনো সময় দরকারে তাকে পাওয়া যায়।
হঠাৎ ফোনের রিংটোনে শেহজাদের ঘুম ছুটে যায়। তার মস্তিষ্কে আগে থেকে সেট করা মাঝরাতের সতর্কতায় দ্রুত ফোন রিসিভ করে। ফোনের অপরপাশ থেকে শুনতে পায়, ফিওনার ডেলিভারি পেইন ওঠেছে। কথাটা শোনামাত্র শেহজাদের শ*রীরে যেন হিমশীতল হাওয়া বয়ে গেল। সে কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে মায়ের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পায়। তদ্রূপ আর সময় ব্যয় না করে আমেরিকার পরিচিত ড্রাইভারকে ফোন করে ফিওনাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে বলে। এতোকিছুর মধ্যে শেহজাদ এক মূহুর্তও শান্তি পাচ্ছে না। অস্থিরতার পারদ যেন তার মাত্রা অতিক্রম করে ফেলছে! সে গিয়ে তার ফুফা ও ফুফিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে খবরটা জানায়। মিসেস শাহিদা, শেহজাদকে ধৈর্য ধরতে ও দোয়া করতে বলেন। ফজরের আজান হতে এখনও ঘণ্টাখানেক বাকি।

ফজরের পর ধরণীতে ভোরের শুভ্র আলো ফুটতেই শেহজাদের কাছে সুসংবাদ আসে। সে কন্যাসন্তানের পিতা হয়েছে। সি*জা*রের মাধ্যমে ফিওনা সুস্থ ভাবে কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছে। প্রথম বাবা হওয়ার সংবাদে শেহজাদ নিজের খুশি, আনন্দ মুখে বা অভিব্যক্তিতে ব্যক্ত করতে পারছে না। নিজের কাছে নিজেকে সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে গণ্য হচ্ছে তার।
ড: আকবর রেহমান খুশিতে আমেরিকার ফ্লাইটের চারটা টিকেট কে*টে ফেলেছে। তার নাতনী হয়েছে বলে কথা! আজ রাতেই তারা রওনা হবে।
_____

আমেরিকায় পৌঁছে প্রথমবারের মতো নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে শেহজাদ যেন চোখের পলক ফেলতেই ভুলে গেছে। মেয়েকে কোলে নিয়ে সে সময়জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে অবস্থা। বিষয়টা শেহজাদের মা, ফুফা-ফুফি ও ফিওনার বেস্টফ্রেন্ড মারিয়া দেখে মিটিমিটি হাসে। অতঃপর শেহজাদের মা এগিয়ে গিয়ে নিজের ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলেন,

“এবার আমাদের নাতনীকে আমাদেরও একটু দাও। তুমি একটু ফিওনার সাথেও বসে কথা বলো। আসার পর একটু ‘এখন কেমন আছ?’ এটুকুতে কথা সেড়ে মেয়েকে নিয়ে পড়েছ। যাও এবার।”

এদিকে ফিওনা তার বেস্টফ্রেন্ডের হাজবেন্ড পিটারকে বলছে,
“শেহজাদ শুড নট নো দিস। বি কেয়ারফুল।”

“ইয়াহ। ডোন্ট ওয়ারি এবাউট দিস। এভরিথিং ইজ ফাইন। এন্ড ইউ আর ফাইন।”

শেহজাদ ফিওনার কাছে এসে পিটার বলা কথাটা শুনে হাস্যজ্জ্বল মুখে শুধায়,
“হোয়াট হ্যাপেন্ড?”

ফিওনা ও পিটার দুজনেই ভড়কে যায়। পিটার কী বলবে ভাবতে ভাবতেই ফিওনা জবাব দেয়,
“একচুয়ালি, টুডে দে আর গোয়িং টু ডিসচার্জ মি। সো…”

“ওহ। ওকে। থ্যাংকস পিটার। ইউ হেল্পড আস সো মাচ।”

পিটার মৃদু হেসে বিদায় জানিয়ে চলে যায়। শেহজাদও ফিওনার পাশে বসে।
______
আমেরিকায় নিজের স্ত্রী, নবজা*তক কন্যা ফ্রিশার সাথে দুইদিন থেকে শেহজাদকে ফিরে আসতে হয়। আস্তে আস্তে সময় পেরোয়। ফ্রিশাও বড়ো হতে থাকে। কয়েক মাস পর ফিওনার দাদির মৃ*ত্যু হলে, শেহজাদ সবাইকে বাংলাদেশে আনার ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশে এসে ফ্রিশাও একটু একটু করে বড়ো হতে থাকে। দেখতে দেখতে ফ্রিশার দুই বছর পেরোলে শেহজাদের মাও না ফেরার দেশে চলে যান। শেহজাদের বাবার পাশেই শেহজাদের মাকে শায়িত করা হয়।
সুখ-দুঃখ সবমিলিয়ে যেমন জীবন, তেমনি সময়ে সাথে সবকিছুকে স্বাভাবিকে আসতে হয়। ফ্রিশার তিন বছর বয়সে ফিওনা আবার প্রেগন্যান্ট হয়। এবারও আগের মতোই সমস্যা তবে আরও গুরুতর। প্রেগন্যান্সির তিন মাসেই টি*উ*মার অনেকটা বড়ো হয়ে গেছে। এবার শেহজাদ সবটা জানতে পারে। সে সত্যি ভাবতে পারেনি, ফিওনা তার থেকে এতবড়ো ঘটনা আড়াল করে যাবে। সবাই মিলে ফিওনাকে এ*বরশ*নের কথা বললেও ফিওনা নারাজ। কেন যেন তার মনে হচ্ছিল, এবার শেহজাদ তাকে মাফ করবে না। তাই এব*রশ-ন সে করতে চায় না। তারপর সাত মাসে পড়ার আগেই প্রচণ্ড পেটে ব্যাথা নিয়ে হসপিটালে ভর্তি হলে, ওটাই ছিল ফিওনার শেষ সময়।

ফ্ল্যাশব্যাক এন্ড,,

শেহজাদ অতীতের স্মৃতি থেকে বেরিয়ে চশমা খুলে টেবিলে রাখলো। রাত এখন অনেক গভীর। রুমের দিকে উঁকি দিয়ে বুঝলো মীরা এতক্ষণে গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন। সে নিজে নিজে স্বগোতক্তি করে বলে,

“আমি চাইনি ফিওনার জন্য তোমার মনে কোনোরকম নেগেটিভ কিছু আসুক, মীরা। চাইলেই সবটা বলতে পারতাম। কিন্তু কী হতো? ফিওনা তো কখোনো তোমার লাইফ কম্পলিকেটেড করতে ফিরবেও না। তাহলে কেন আমি তোমার মনে থাকা ওর জন্য সম্মানটা নষ্ট করব? তুমি আর ফিওনা দুজনেই নিজেদের আলাদা আলাদা সময়ে আমার জীবনে এসেছ। কারও টাইমের সাথে কারওটায় মিল নেই। আমি চাই না তুমি ফিওনাকে খারাপ ভাবো। সে যা করেছে আমায় ভালোবেসে করেছে। যদিও সেসবকে আমি সাপোর্ট করি না। এটা তো সত্যি, ও আমাকে ওর নিজের চাইতেও বেশি ভালোবেসেছে। আমি সত্যি ফরচুনেট পার্সন। বাট অলসো আনফরচুনেট। এতো ভালোবাসা পেয়েও ভালোবাসার মানুষটাকে প্রকৃতির কঠোর সত্যতে হারিয়ে ফেলেছি।”

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে শেহজাদ উঠে দাঁড়ালো। শব্দহীন পায়ে রুমে প্রবেশ করে বিছানার ফাঁকা স্থানে শুয়ে পড়লো।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-২৩+২৪

0

#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৩
কফির মগ হাতে রুমের আলো নিভিয়ে শেহজাদ ও মীরা ব্যালকনিতে যায়। গ্রিলহীন খোলা ব্যালকনিতে মুখোমুখি চেয়ার পাতা, মধ্যিখানে ছোট্ট একটা টেবিল। চারপাশে সব অন্ধকারে আবৃত। কেবল মাথার উপর বিস্তৃত অম্বরে লাখো তারকারাজির মাঝে এক অর্ধচন্দ্রমার রাজত্ব চলছে। যার স্নিগ্ধ আলোকরশ্মি জোৎস্না স্বরূপ পৃথিবীর ঘন অন্ধকারকে দূর করার আপ্রাণ প্রয়াস করে চলেছে। মীরা চাঁদের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলে,

“বলুন এবার।”

শেহজাদ কফির মগে এক চুমুক দিয়ে বলে,
“আমার তো মনে হচ্ছে, আমার স্টোরি শোনার জন্য তুমি অনেকদিন ওয়েট করে ছিলে!”

মীরা ফিক করে হেসে ফেলে বলে,
“আপনার ও ফিওনা আপুর লাভ স্টোরি জানার জন্য পুরো ডিপার্টমেন্ট উৎসুক ছিল। পুরো ডিপার্টমেন্টের মধ্যে মেয়েরাই বেশি। ”

শেহজাদও হালকা হাসে। ফের বলে,
“কিন্তু এটা তো লাভ স্টোরি না!”

“মানে? লাভ স্টোরি না হলে একটা মেয়ে নিজের সব ছেড়ে আপনার কাছে চলে এসেছে?”

মীরার কণ্ঠে বিস্ময়। শেহজাদ লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করে,
“আমি তাকে ভালো বাসতাম না কিন্তু সে ভালোবাসতো। ফিওনা ছিল আমার ইউনিভার্সিটির প্রফেসরের মেয়ে এন্ড ভার্সিটিতে ওয়ান ইয়ার সিনিয়র। আমার এইচএসসির পর বাবা-মা ও আমি আমেরিকা শিফট হই। সেখানেই ভার্সিটিতে ভর্তি হই। আমেরিকায় শিফট হওয়ার পর আমরা যেই বাড়িটিতে উঠেছিলাম, সেটার একটা বাড়ি পরেই ছিল প্রফেসর হ্যারিসনের বাড়ি। ফিওনার বাবা তিনি। প্রফেসর হ্যারিসন তার মা ও মেয়ের সাথে সেখানে থাকতেন। ফিওনার মা ওর জন্মের সময় মা**রা যান। তারপর স্যার আর বিয়ে করেননি। তিনি নিজের কাজ, রিসার্চ, পাবলিকেশন এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। আমার ইউনিভার্সিটিতে এডমিশনের জন্য বাবাকে তিনি অনেক হেল্প করেছিলেন। সেই সুবাদে আমাদের দুই পরিবারে একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ইউনিভার্সিটিতে ফিওনা আমার সাথে খুব মিশতে চাইতো। অফডে বা ফ্রি টাইমে আমাদের বাড়িতেও চলে আসতো। আমার সাথে গল্প করতে চাইতো। আমি এসব নিয়ে ভাবতাম না। আমি নিজের পড়াশোনাতেই মনোযোগ দিতাম। এভাবেই তিন বছর পেরিয়ে যায়। তখন ফিওনার গ্রাজুয়েশন কম্পিলিট। একদিন ফিওনা আমাকে কল করে বলে ব্রেক টাইমে ভার্সিটির এক জায়গায় দেখা করতে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম যাব না। তাই ব্রেক টাইমে যাইনি। তারপর ছুটির পর কী ভেবে ওইদিক দিয়ে বাড়িতে যাওয়ার ওয়েটা ইউজ করেছিলাম। ওটা একটু লম্বা পথ। সচরাচর সেখান দিয়ে যেতাম না। সেখানে গিয়ে দেখলাম, ফিওনা একা সেখানে বসে ছিল। তখন উইন্টার সিজন। বিকেলবেলা, সন্ধ্যা নামবে নামবে ভাব। হিম শিতল বাতাসে শুষ্ক পাতার ধ্বনি জনমানবহীন পরিবেশটা কেমন অদ্ভুত! ফিওনা ছাড়া আশেপাশে কেউ নেই। ফিওনাকে একা বসে থাকতে দেখে আমি এগিয়ে গিয়েছিলাম। ওর পাশে যথেষ্ঠ দূরত্ব রেখে বসেছিলাম। আমি বসা মাত্রই ও আধো বাংলায় বলে উঠেছিল,
‘খুব লেট করে ফেলেছ, শেহজাদ!’
ওর মুখে প্রথমবার নিজের মার্তৃভাষা শুনে আমি অবাক হয়ে তার দিকেই চেয়ে ছিলাম। তারপর ও ফিরলো আমার দিকে। হঠাৎ আমার হাত ধরে হাসি মুখে বলেছিল,
‘আই রিয়েলাইজ আই অ্যাম নট ইম্পরট্যান্ট ফর ইউ। নেক্সট উইক ইউ আর ইনভাইটেড।’
ওর কথা ও মুখের হাসির সাথে চোখের ভাষার মিল ছিল না। আমি কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলে, নেক্সট উইক নাকি ওর বিয়ে। কথাটা বলে ও দেরি করে না। সাথে সাথে উঠে চলে যায়। একবারও পেছনে ফেরেনি।”

থামে শেহজাদ। মীরা হা করে বোকার মতো চেয়ে আছে। আলোক স্বল্পতার কারণে এটা শেহজাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। শেহজাদ এবার কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে নিরব হয়ে রয়। মীরা উৎকণ্ঠিত হয়ে শুধায়,
“তারপর কী হয়েছিল, স্যার?”

“তারপর আর কি! ফিওনার বিয়ে!”

“বিয়ে? আপনার সাথে?”

“না।”

“এ্যাঁ! তাহলে কার সাথে? কী বলতেছেন আপনি? ফিওনা আপুর সাথে আপনার বিয়ে হয়নি?”

শেহজাদ হাত থেকে কফির মগ রেখে চেয়ারে কম্ফোর্টেবল ভাবে বসে আবার বলতে শুরু করে,
“আমি সেদিন বাড়ি ফিরে ফিওনার সেদিনকার বিহেভিয়ার গুলো ভাবছিলাম। সকালে ফোনে তার কণ্ঠে একটা এক্সসাইটমেন্ট, ভয় ছিল যা বিকেলে ছিল না। কিন্তু এসব ভাবনা-চিন্তা আমার বেশি লং টাইমের জন্য হয়নি। কারণ আমার মনে ওর জন্য কোনো ফিলিংস ছিল না। আমার দিন আর পাঁচটা সাধারণ দিনের মতোই চলছিল। দুইদিন পর প্রফেসর হ্যারিসন ইনভাইটেশন কার্ড নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসেন। সেদিন উইকেন্ড ছিল। ফিওনা তার এক ক্লাসমেটকে বিয়ে করছে। খুব তাড়াহুড়ার মধ্যে। স্যার বলছিলেন যে ফিওনা হুট করে তাকে বিয়ে কথা বলে আর যাকে বিয়ে করবে তার নামও বলে। তারপর…”

কথার মাঝেই মীরা থামায় শেহজাদকে। সে জিজ্ঞেসা করে,
“ফিওনা আপু না আপনাকে পছন্দ করতো? তাহলে অন্য ছেলেকে বিয়ে করার কথা বলল কীভাবে? তাও ক্লাসমেট। মানে বুঝলাম যে আপনি ইগনোর করাতে সে হার্ট হয়েছিল কিন্তু বিয়ের জন্য ছেলে সে নিজেই সাজেস্ট করেছিল?”

“হ্যাঁ করেছিল। সে রেনডমলি ছেলে পছন্দ করেছিল। সে ছিল ইউনিভার্সিটিতে মোস্ট ফেমাস এন্ড এট্রাক্টিভ গার্ল। সবার ক্রাশ বলা যায়। অতিরিক্ত সুন্দরী। তাই সে রেনডমলি নিজের এক ক্লাসমেটকে চুজ করেছিল বিয়ে করার জন্য। যাকে চুজ করেছিল, সেই ছেলে ফিওনাকে প্রপোজ করা ছেলেদের মধ্যেই একজন। বলা যায়, সবার শেষে প্রপোজ ওই ছেলেই করেছিল।”

“তারপর কী হলো? আপনি কি ফিওনা আপুর সাথে কথা বলেননি?”

“না! আমি কেন কথা বলব? ওর বিয়ে ও করবে। আমি গেস্ট হিসেবে ফ্যামিলি নিয়ে জাস্ট বিয়ে এটেন্ড করেছিলাম। বিয়ের আগ পর্যন্ত ফিওনা আমার দিকে চেয়ে কয়েকবার হাসি বিনিময়ও করেছিল। তারপর তার বিয়ে হয়ে যায়। এরপর এক বছর আমার সাথে ফিওনার কোনো দেখা-সাক্ষাত বা কথা হয়নি। শুনেছিলাম, অন্য শহরে হাসবেন্ডের সাথে শিফট হয়েছে। আমার গ্রাজুয়েশন শেষ হয়। তিন মাস জব করে মাস্টার্সে ভর্তি হই। তারপর হঠাৎ একদিন বিকেলে ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরে দেখি ড্রয়িংরুমে মায়ের সাথে বসে ফিওনা ও তার দাদি গল্প করছে। তাকে হঠাৎ অনেকদিন পর দেখে অবাক হলেও আরও বেশি অবাক হই তার চোখের নিচে ডার্কসার্কেল, রুক্ষতায় ভরা চেহারা। আগের ফিওনার সাথে মিলাতে পারছিলাম না। ফিওনা আমাকে দেখে দৌড়ে এসে হুট করেই জড়িয়ে ধরেছিল। আমি তখন পুরো ব্যাপারটাতে রোবটের মতো স্টিল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ফিওনা কাঁদছিল। আমি কিছুক্ষণ পর বিষয়টা বুঝতে পেরে ও-কে সোজা করে দাঁড়া করিয়ে কী হয়েছে? জানতে চাইলে সে জানায়, তার হাসবেন্ডের সাথে তার ডিভোর্স হয়ে গেছে। তাদের নাকি মতের মিল হচ্ছিল না। তার হাসবেন্ড তাকে মেন্টালি টর্চার করছিল। তারপর অন্য এক মেয়ের সাথে টাইমস্পেন্ড করতো। তখন ও-কে কী বলব আমি বুঝতে পারছিলাম না। মা এসে তখন ও-কে নিয়ে যায়। এরপর পরেরদিন ও-কে নিজের ক্লাসে দেখে আমি আরেকদফা অবাক হয়েছিলাম। ও নিজ থেকে আমার পাশে এসে বসেছিল। হাই-হ্যালো এতটুকুই। ধীরে ধীরে ও আগেরমতো প্রাণবন্ত হতে শুরু করে। যেখানেই ঘুরতে যাবে, আমাকে জোর করে হলেও নিয়ে যাবে। এমন একটা অবস্থা যে রাতে ঘুমানোর সময়টুকু ছাড়া বাকি সময় ও আমার সাথেই থাকতো। বাবা-মায়ের সাথেও ওর খুব মিষ্টি সম্পর্ক হওয়াতে ও অনায়াসে স্টাডি, আড্ডা যাই করুক উনারাও বাধা দিতেন না। স্যারও এদিকে নিশ্চিন্ত। মেয়ের ডিভোর্সের পর মেয়েকে নিয়ে তিনি খুব দুশ্চিন্তায় ভুগতেন। হাই ব্লাডপ্রেশার ও হার্টে প্রবলেম ছিল উনার। তাই ফিওনাকে আমার সাথে হাসি-খুশি থাকতে দেখে তিনি কিছুটা হলেও নিশ্চিন্তে ছিলেন।”

শেহজাদ আবারও থামে। এবার উঠে দাঁড়ায়। শেহজাদকে উঠতে দেখে মীরা প্রশ্ন করে,
“কী হলো? উঠলেন কেন?”

“পানি খাব। তুমি তো শুনছ, আর আমি বলছি।”

মীরা অবাক হয়ে বলে,
“এতটুকু বলতে আপনার পানি খেতে হবে? ক্লাস লেকচারের সময় তাহলে কী করেন? তখন তো পানি লাগে না।”

“মীরা!”

“ওকে ওকে। আপনি বসুন। আমিই পানি নিয়ে আসছি।”

এই বলে মীরা বিড়বিড় করে শেহজাদকে ব*কতে ব*কতে পানি আনতে রুমে যায়। রুমে গিয়ে দেখে জগে পানি নেই। এতে সে আরও বিরক্ত হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে নিচে ডাইনিং থেকে পানি আনতে যায়।
শেহজাদ চেয়ারে বসে আকাশপানে নিরন্তর চেয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আর বলে,

“ফিওনা! ইউ ওয়ার সো স্টাবর্ন!”

চলবে ইনশাআল্লাহ,

#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৪
মীরা তড়িঘড়ি করে পানি নিয়ে ফিরে আসে। শেহজাদের সামনে পানিভর্তি গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলে,
“নিন, পানি।

শেহজাদ ধন্যবাদ জানিয়ে মীরার হাত থেকে পানির গ্লাস নিয়ে পানি খেল। সে খালি গ্লাসটা টেবিলে রাখা মাত্রই মীরা অতিআগ্রহী কণ্ঠে বলে ওঠে,
“এরপর কী হয়েছিল? বলুন।”

“কী?”

শেহজাদের কণ্ঠে কেমন গা ছাড়া ভাব। মীরা ভ্রুকুঞ্চন করে শুধায়,
“কী মানে কী? এরপরের ঘটনা বলুন। বিয়ে কীভাবে হলো সেসব।”

শেহজাদ লম্বাশ্বাস নিয়ে মলিন হাসে। তার হাসি যদিও মীরার দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে গেছে। সে বলতে শুরু করল,
“এরপর সময় পেরিয়ে গেছে। আমাদের মাস্টার্স শেষ হয়। আমার ও ফিওনার দুজনের মাঝে ফ্রেন্ডশিপটা অনেক গাঢ়ো হয়েছিল। তারপর ফিওনা আমায় প্রপোজ করে। আমাদের ধর্ম আলাদা ছিল বলে আমি না করে দিয়েছিলাম। তারপর সে জানায় সে ইসলাম গ্রহণ করবে, তাও আমাকেই বিয়ে করতে চায়। ফিওনার বাবা ও গ্যান্ডমাও রাজি। তারপর আর কী! বিয়ে হলো। তারপর ভালোই চলছিল সব। আমি জবের সাথে সাথে পিএইচডি করতে ভর্তি হই আর ফিওনা নিজের ফ্যাশন ডিজাইনের একটা শখকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে কোর্সে ভর্তি হয়। এরপর কয়েক মাস পর ফিওনার বাবা হঠাৎ হার্ট অ্যা*টা*কে মা*রা যান। বছর খানেক পর আমার বাবাও অফিসে নিজের ডেস্কেই সাডেন স্ট্রোক করেন, তিনিও না ফেরার দেশে চলে যান। তারপরই ফুফা ও ফুফিজান আমাকে বলেছিলেন দেশে আসতে। উনারা খুব রিকোয়েস্ট করেছিলেন। তখন আবিরের অবস্থা অনেক ক্রিটিক্যাল ছিল। মেন্টাল সাপোর্ট ও পাশে থাকার জন্য আমাকে, মাকে ও ফিওনাকে দেশে আসতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি একাই এসেছিলাম। দেশে এসে এক মাস পর জানতে পারি ফিওনা প্রেগন্যান্ট। আমার মা ও ফিওনার গ্র্যান্ডমা ছিল বলে উনারাই সব দেখছিল। আমিও যেতে পারছিলাম না। তারপর ফ্রিশার জন্ম হলো। এইতো কাহিনী।”

মীরা গালে হাত দিয়ে বলে,
“আমি ভাবলাম আরও কতোকিছু! যার জন্য আপনার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল! যাইহোক, ঘুমাবেন না?”

শেহজাদ অন্ধকারের মাঝে আঁধারাচ্ছন্ন অন্তরীক্ষের পানে চেয়ে নিরব দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে। মুখে জবাব দেয়,
“আমার এখন ঘুম পাচ্ছে না। নেটে একটু রিসার্চ করব। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।”

“ওকে। আমি ঘুমোতে গেলাম। আপনিও বেশি রাত জাগবেন না। ঘড়িতে কিন্তু বারোটা বাজে। যদিও আমিও লেটনাইট জাগি, কিন্তু আজ টায়ার্ড লাগছে। গুডনাইট।”

“গুডনাইট।”

মীরা চলে যায়। মীরা চলে যাওয়ার পর শেহজাদ ল্যাপটপটা এনে বসে। কিন্তু তার মন ল্যাপটপে নেই। তার মন পড়ে আছে অতীত স্মৃতিতে। সে ইচ্ছে করেই ওই ঘটনাগুলো মীরাকে বলেনি। ঘটনাগুলো শুধু সে নিজে, ফিওনা ও তাদের ক্লোজ কিছু ফ্রেন্ডসরা বাদে কেউ জানেনা। পরিবারের কেউ তো নয়ই।
শেহজাদ ভাবতে থাকে সেদিনের কথা, যার জন্য সে ফিওনাকে বিয়ে করেছিল।

ফ্ল্যাশব্যাক,
ফিওনা জোর করে শেহজাদকে একটা নাইটক্লাবের লেটনাইট পার্টিতে নিয়ে এসেছে। বলেছিল দুই বছরের এতো প্রেশার থেকে মুক্ত আজ তাই একটু সময় আনন্দ করবে। আজ তাদের মাস্টার্সের গ্রাজুয়েশনের দিন ছিল। ফ্রেন্ডসদের সাথে গেটটুগেদারের পর ফিওনা জেদ করে, জোর করে শেহজাদকে নিয়ে এসেছে। এতো গা*ন-বাজনার মাঝে শেহজাদ একটু দূরে সোফায় একা বসে আছে। কিছুক্ষণ পর পর শেহজাদ ফিওনার ফোনে কল করছে, মেসেজ করছে যে এবার বাড়ি ফিরতে হবে। কিন্তু ফিওনা দূর থেকে ইশারায় বারবার বলছে, সে আরও কিছু সময় থাকতে চায়। শেহজাদের এসব ভালো লাগছে না। সে ফোনে গেইমস খেলছিল তখন ফিওনা শেহজাদের জন্য অরেঞ্জ জুস নিয়ে এসে বলে,

“ওয়ান্না ড্রিংক? ইটস অরেঞ্জ জুস।”

“ওকে। পার্টি ডান? উই নিড টু গো ব্যাক হোম।”
(আচ্ছা। পার্টি শেষ। আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে।)

“ইয়াহ। জাস্ট অ্যা লিটল হোয়াইল।”
(হ্যাঁ। আর একটু সময়।)

ওদের কথা-বার্তার মাঝেই সেখানে ফিওনার এক্স হাজবেন্ড মাইকেল, একটা মেয়ের সাথে এসে উপস্থিত হয়। এসেই ফিওনাকে দেখে আপত্তিকর কিছু বলা শুরু করে। তখনি শেহজাদ আওয়াজ তুললে সে ফিওনার সাথে শেহজাদকে জড়িয়ে বাজে কথা বলতে শুরু করে। মাইকেল চিৎকার করে পার্টির সব গান-বাজনা বন্ধ করিয়ে সবাইকে শুনিয়ে যা মুখে আসে তাই বলে যায়। শেহজাদের এসব সহ্য হয় না। এক পর্যায়ে শেহজাদের সাথে মাইকেলের হা*তা-হা*তি লেগে যায়। ফিওনা ও মাইকেলের গার্লফ্রেন্ড ডায়না খুব কষ্টে ওদেরকে আলাদা করে ছুটিয়ে আনে। ফিওনা কাঁদছে। শেহজাদ হাঁপাতে হাঁপাতে রাগে বলে,

“আই টোল্ড ইউ, লেটস গো হোম। বাট ইউ! ইউ ওয়ার নট লিসেনিং টু মাই ওয়ার্ড।”
(আমি বলেছিলাম, চলো বাড়ি যাই। কিন্তু তুমি! তুমি আমার কথায় কান দিলে না।)

ফিওনা ক্রন্দনরত অবস্থায় শেহজাদকে জড়িয়ে ধরে। শেহজাদ কিছুক্ষণ ফিওনার মাথায় হাত বুলিয়ে এরপর সোফায় বসায়। টেবিলে রাখা জুসের গ্লাসটা তুলে ফিওনাকে সাধলে ফিওনা মাথা নাড়িয়ে খাবে না জানালে শেহজাদ নিজেই একশ্বাসে খেয়ে নেয়। কিন্তু সে জানতো না যে জুসের গ্লাস বদল হয়ে গিয়েছিল! কিছুক্ষণ পর ফিওনা ও শেহজাদ দুজনেই নিজেদের স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল না বলে ফিওনা কোনোরকমে ক্লাবে দায়িত্বরত স্টাফদের সাহায্যে রেস্ট করার জন্য রুম বুক করে।

সকালে ঘুম থেকে আগে শেহজাদই উঠে। সে নিজের পাশে ফিওনাকে দেখে বিস্ময়ে হতচকিত হয়ে লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে যায়। অবাক নয়নে আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারে তারা অন্যকোথাও আছে। ফিওনার দিকে একবার তাকায়, দেখে জামাকাপড় এলোমেলো। তৎপর দৃষ্টি সরিয়ে শেহজাদ সোফায় মাথায় হাত দিয়ে বসে। রাতের ঘটনা মনে করতে চাইলে মাইকেলের সাথে হা*তা-হা*তির পর সে জুস খায়, তারপরের কিছু তার মনে নেই। নিজের উপর প্রচণ্ড রাগে ও মাথাব্যথা হওয়ার কারণে টেবিলের উপরে থাকা গ্লাস দুটো ফ্লোরে ছু*ড়ে ফেলে। কাঁচভাঙার শব্দে ফিওনার ঘুম ছুটে গেলে সে উঠে বসে। তারপর জিজ্ঞাসা করে,

“হোয়াট হ্যাপেন্ড?”

শেহজাদ জবাবে কিছু বলতে চাইলো না। গতকাল সে এখানে আসতে তো চায়নি তারপর আসার পর থেকে এতোবার বলার পর ফিওনা যেতে রাজি হয়নি। ফিওনার উপরও তার অনেক রাগ হচ্ছে। সে নিজের চুল ঠিক করে ফোনটা নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ে।

বাড়ি ফেরার পর শেহজাদকে তার বাবা-মায়ের অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় কিন্তু তার কোনো জবাব ছিল না। সে কোনোরকমে ব্যাপারটা সামলে নিজের রুমে চলে আসে। এরপর সারাদিন, এমনকি দুপুরে খাওয়ার জন্যও বের হয় না। নিজের কাছেই নিজেকে খারাপ মনে হচ্ছে তার। তার সেখানে যাওয়াই উচিত হয়নি। ফিওনাকেও সবসময় আশকারা দেওয়াটা তার অনেক বড়ো ভুল ছিল। নিজের এইসব সেল্ফ রিয়েলাইজেশনে সে অনেক অনুতপ্ত।
বিকেলে তার কাছে ফিওনার দুটো মেসেজ আসে। একটা ছবি ও মেসেজে লেখা, “প্লিজ মিট উইথ মি এস সুন এস পসিবল।” শেহজাদ এবার ছবিটা দেখে। তাতে যখন ফিওনা এসে শেহজাদকে জড়িয়ে ধরেছিল সেই সময়ের ছবি। মাইকেলের টুইটার থেকে পোস্ট করা। এখানে মাইকেল ক্যাপশনে লিখেছে, “সি লেফ্ট মি ফর দ্যাট রিজন, এন্ড আই ডিড দ্যা সেম।”

ছবিটা দেখে শেহজাদ মস্তিষ্কের নিউরন গুলো যেন ধপধপ করছে। সে ফোনটা ছুঁ*ড়ে ফেলতে চেয়েও ফেলল না। চোখ বন্ধ করে কয়েক মুহূর্ত বসে থেকে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
ফিওনার বলা স্থানে গিয়ে দেখে ফিওনা বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে আছে। শেহজাদ এগিয়ে যেতে চেয়েও গেল না। এসবকিছু ফিওনাদের কালচারে স্বাভাবিক বলেই তো গতকাল রাতে ফিওনা তার কথা মানেনি। এখন নিজেই ভি*ক*টিমের মতো বসে আছে। শেহজাদকে দেখে ফিওনাই এগিয়ে এলো। এসেই হুট করে শেহজাদের পা জড়িয়ে বসে পড়লো। সে আধো বাংলায় বলল,

“আমি ভুল করেছি। প্লিজ ফরগিভ মি। আমি সব ঠিক করব।”

শেহজাদ দ্রুত ফিওনাকে নিজের থেকে সরিয়ে বলে,
“কী ঠিক করবে তুমি? লেট ইট বি।”

“নো শেহজাদ। আই নো ইটস নট অ্যা স্মল থিংস ফর ইউ। সো আই হ্যাভ অ্যা সলিউশন।”

শেহজাদ নিজের দুই হাত দ্বারা মুখমণ্ডল অর্ধেক আবৃত করে হতাশার দৃষ্টিতে অন্যদিকে তাকায়। আচমকা তার কর্ণকুহরে এমন কিছু আসবে তা সে কল্পনাও করেনি। ফিওনা বলে,
“আই লাভ ইউ। আই ওয়ান্না ম্যারি ইউ। এন্ড আই অ্যাম রেডি টু ডু এভরিথিং টু ম্যারি ইউ। প্লিজ প্লিজ, শেহজাদ। ডোন্ট রিজেক্ট মি। আই লাভ ইউ সো মাচ।”

শেহজাদ তৎক্ষণাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে হতবাক নয়নে ফিওনার পানে চেয়ে আছে। ফিওনা অধীর হয়ে অস্থির ভঙ্গিতে শেহজাদের জবাবের অপেক্ষা করছে। কিন্তু শেহজাদ এখনও নিজের অবাক হওয়ার রেশ থেকেই বেরোতে পারেনি। ফিওনা অধৈর্য কণ্ঠে ফের বলে ওঠে,

“অ্যা ফিউ মোমেন্টস এগো, বিফোর ইউ কেইম, আই রিসিভড ইসলাম।”
(কয়েক মুহূর্ত আগে, তুমি আসার আগে, আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি।)

শেহজাদ যেন এবার অবাক হওয়ার চরম সীমানায়! তার কাছে বিষয়গুলো খুব জটিল লাগছে। কী করবে না করবে সব গু*লিয়ে যাচ্ছে তার।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-২১+২২

0

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২১
শেহজাদরা মীরাকে নিয়ে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেছে। ফ্রিশা গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ফ্রিশার মাথা মীরার কোলে আর পা শেহজাদের কোলে। গাড়ি শেহজাদদের বাড়ির গেইটে ঢুকতেই শেহজাদ বলে,

“ও-কে এবার কোলে নিতে হবে। তুমি একটু ও-কে ধরে বসিয়ে দাও।”

মীরা খুব নমনীয় ভাবে ধীরে ধীরে ফ্রিশাকে সিটে হেলান দিয়ে বসায়। গাড়ি থামলে শেহজাদ আগে নেমে তারপর ফ্রিশাকে নামিয়ে কোলে নেয়। অতঃপর মীরাকে বলে,
“তুমি ভেতরে আসো, আমি ফ্রিশাকে ওর রুমে রেখে আসি।”

মীরা মৃদু হেসে ইশারায় সম্মতি দেয়। শেহজাদ যেতেই মিসেস শাহিদা এসে মীরার পাশে দাঁড়ান। তারপর নরম স্বরে বলেন,
“তুমি কিছু মনে করো না।”

মীরা বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলো,
“কী মনে করব, আন্টি?”

“এইযে শেহজাদ তোমার সাথে বাড়ির ভেতর ঢুকলো না। নতুন বর-কনে তো একসাথে প্রথমবার বাড়িতে প্রবেশ করে।”

মীরা হেসে মিসেস শাহিদাকে প্রত্যুত্তর করে,
“এটা কোন কারণ হলো? হ্যাঁ তবে আপনার কনসার্ন আমি বুঝতে পারছি। নববিবাহিতা তার স্বামীর হাত ধরেই নতুন ঘরে প্রবেশ করে। সাথে থাকে নতুন পরিবেশ, নতুন সংসার, নতুন মানুষদের নিয়ে একরাশ ভয় ও আশা। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তো সেটা আলাদা। আমি আপনাদের খুব ভালো করে জানি। তাছাড়া বিয়েটা করেছিও ওই বাচ্চাটার জন্য, যাকে ঘুমন্ত অবস্থায় স্যার ভেতরে নিয়ে গেলেন। এখন এখানে যদি আমি কিছু মনে করে বসে থাকি, তা তো শোভনীয় না।”

মিসেস শাহিদা হেসে একবার স্বামীর দিকে দেখে নিয়ে বলেন,
“তোমার স্যার ঠিক কথাই বলেছিলেন। তুমি খুব বুদ্ধিমতি ও বুঝদার মেয়ে। এসো ভেতরে এসো।”

মীরা মুচকি হেসে মিসেস শাহিদা ও ড: আকবর রেহমান এর সাথে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে।

_______
কিছুক্ষণ গল্প ও ভিডিও কলে ড: আকবর রেহমানের ভাই-বোনের পরিবারের সাথে পরিচয় পর্ব চলেছে। তারপর মিসেস শাহিদা নিজে মীরাকে শেহজাদের বেডরুমে দিয়ে গেছেন। তারপর তিনি সার্ভেন্টকে দিয়ে মীরার সুটকেস ও খাবার পাঠিয়ে দিয়েছেন । মীরা রুমের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে পুরো ঘরটা সূক্ষ্ণ ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ঘরটা বড়ো ও বেশ ছিমছাম। আজ তাদের বিয়ের রাত হিসবে সাজানোও নেই। শুধু ঘরে থাকা ২-৩টা ফুলদানিতে তাজা ফুল রাখা। ঘরটার ব্যালকনি দক্ষিণমুখী, সেইসাথে জানালাও। উত্তর পাশে ওয়াশরুম, ড্রেসিংটেবিল ও কাঠের আলমারি। ওয়াশরুমের সাথে পূর্ব পাশে দুই সিটের সোফা ও ছোটো টেবিল রাখা। পশ্চিম পাশে স্টাডি ডেস্ক ও বুকশেলফ। ঘরের এক জায়গায় একটা ইজি চেয়ারও রাখা। পূর্ব পাশের দেয়ালে বিশাল জায়গা করে সাদা শিফন পর্দা লাগানো। মীরার কৌতুহল হলো। কারণ ঘরের এমন স্থানে পর্দা থাকার তো কথা না। কারণ জানালাতো দক্ষিণ দিকে। মীরা সেদিকে এগুতে নিলে দরজার নব ঘুরানোর শব্দে পেছনে ফিরে। শেহজাদকে দেখে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। হঠাৎই তার মাঝে যেন ইতস্তততার পসরা এসে হাজির। কোনোরকমে সালাম দিয়ে নিরব থাকে। শেহজাদও সালামের জবাব দেয়। অতঃপর নিজের মনোযোগ রুমের চারিপাশে ঘুরিয়ে বলে,

“খাবার রাখা আছে। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও। ওখানে তো সবার মাঝে খেতে পারোনি।”

মীরা মাথা নেড়ে কিয়ৎ মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে,
“আপনি খাবেন না?”

“আমি তো সেখানে খেয়েছি। সবাই একে একে খাওয়াতে খাওয়াতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খেয়েছি। তুমি ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও।”

এই বলে শেহজাদ বুকশেলফের দিকে এগোলো। মীরা লক্ষ্য করলো শেহজাদ ফ্রেশ হয়েই এসেছে। মীরা নিজের সুটকেস থেকে থ্রিপিস বের করে ওয়াশরুমে চলে যায়।

প্রায় আধঘণ্টা পর মাথায় তাওয়াল পেঁচিয়ে ওয়াশরুম থেকে ফিরে মীরা দেখে শেহজাদ স্টাডি ডেস্কে বসে বই পড়ছে। মীরার রুমে আসার শব্দে শেহজাদ বই থেকে নজর সরায়। মীরার দিকে চেয়ে শুধায়,

“এই রাতে শাওয়ার নিয়েছ?”

মীরার ধিমি স্বরে জবাব,
“জি স্যার। টায়ার্ড লাগছিল।”

“ভালো করেছ। তবে হেয়ার ড্রায়ারটা ফ্রিশার বেডরুমে। ওয়েট অ্যা মিনিট। আমি এনে দিচ্ছি।”

মীরা মাথা নাড়ে। শেহজাদ রুম থেকে বের হয়ে গেলে মীরা চুল থেকে তাওয়াল খুলে ভালো করে চুল ঝেড়ে নেয়। তারপর খাবারের ঢাকনা খুলে দেখে নেয়। ইতোমধ্যে শেহজাদ ফিরে আসে।

“এইযে হেয়ার ড্রায়ার। তারপর খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আমি ঘুমাতে যাচ্ছি।”

“আচ্ছা।”

মীরা হেয়ার ড্রায়ারটা নেয়। শেহজাদও গিয়ে বিছানার এক পাশে শুয়ে পড়ে। মীরা সময় নিয়ে চুল শুকিয়ে নেয়। অতঃপর খেয়ে নামাজ পড়ে নিজেও বিছানার আরেক কোনায় শুয়ে পড়ে।

________

বেশ সকাল সকাল মীরার ঘুম ভেঙে যায়। দেখে শেহজাদ তার পাশে বসে কফি খাচ্ছে আর ফোন স্ক্রল করছে। শেহজাদের ভাবসাব দেখে মীরা ভেবে বসলো, সে হয়তো খুব লেট করে ঘুম থেকে ঘুম থেকে উঠেছে। তারপর তাড়াহুড়ো করে উঠে বসে সামনের দেয়ালে ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখে এখনও ছয়টাও বাজেনি। অতঃপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। শেহজাদ মীরার ছটফটে ও তাড়াহুড়ো করে উঠে বসার দৃশ্য ঠিকি লক্ষ্য করেছে। সে নিরবে হেসে মীরাকে ডেকে বলে,

“মীরা, তুমি লেইট করে ঘুম থেকে উঠোনি। অ্যাই ওয়েক আপ আর্লি এভরি মর্নিং। নাউ গো এন্ড ফ্রেশেন আপ।”

মীরা উঠে যায়। ফ্রেশ হয়ে এসে নামাজ পড়ে বিছানায় বসে। শেহজাদকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“স্যার, আপনি প্রতিদিন যে সময় উঠবেন, আমাকেও প্লিজ ডেকে দিবেন।”

“ইয়ার অফকোর্স। আজকেই দিতাম বাট দেন অ্যাই থট ইউ ওয়ার টায়ার্ড। কাল থেকে তোমাকেও আর্লি মর্নিং উঠতে হবে।”

মীরা হালকা হেসে আয়নার সামনে গিয়ে চুল ঠিক করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। গতকাল রাতে মিসেস শাহিদা তাকে বলেছিলেন, কোনটা কার রুম। সেই অনুসারে ফ্রিশার রুমে গিয়ে দেখে ফ্রিশা বড়ো টেডিকে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। মীরা মুচকি হেসে ফ্রিশার পাশে বসে। তারপর ওর মাথায় হাত বুলায়। পুরো রুমটা হালকা গোলাপি রঙের। দেখতেও সুন্দর। খেলনা, টেডি সব সাজানো। মীরা দেখলো ফ্রিশা নড়ে ওঠেছে। সে তৎপর হয়ে নিজের হাত সরিয়ে নেয়। তারপর সেখান থেকে উঠে রান্নাঘরে যাওয়ার মনস্থির করে। সে শুনেছে, এই বাড়ির রান্নাবান্না সব সার্ভেন্ট দেখাশোনা করে। কিন্তু আজ তার এই বাড়িতে প্রথম দিন। তাই ভাবলো, সবার জন্য কিছু না কিছু স্পেশাল রান্না তো করতেই পারে। যা ভাবা সেই কাজ। রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো সবকিছু খুব সাজানো। কোন কন্টিনারে কী রাখা, সব গোছানো। এতে মীরা বেশ খুশিও হয়ে গেছে। অতি সহজেই হাতের কাছে সব পেয়ে গেছে। প্রথমেই বানালো পায়েশ। তারপর কী বানাবে ভাবতে ভাবতে সার্ভেন্ট এসে হাজির হয়। সার্ভেন্ট অবাক হয়ে বলে,

“ম্যাডাম, আপনি এখানে? কিছু লাগবে?”

মীরা নিজের ভাবনার সমাধান পেয়ে গিয়ে অত্যন্ত খুশি হয়ে বলে,
“হ্যাঁ। আপনি একটু আমাকে বলুন তো, এই বাড়ির সবাই ব্রেকফাস্টে কী খায়?”

“পাউরুটির সাথে ডিম মাঝে দিয়ে খায় আর ফলের সাথে ওটস। সাথো ফলের জুসও।”

“ওহ। প্রতিদিন এগুলোই?”

“জি। বড়ো স্যার ও ম্যাডামের ডায়াবেটিস আছে তো। আর ছোটো স্যার ও ফ্রিশামনিরও এগুলাই পছন্দ। ছোটো স্যার তো বিদেশে ছিল আবার ফ্রিশামনির মা মানে ছোটো স্যারের প্রথম পক্ষের বউও তো বিদেশের। উনারা সকালে ভাত-রুটি খায় না।”

সার্ভেন্টটার কথা শুনে মীরা হাসার চেষ্টা করে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে। আজকের নাস্তা আমি বানাব।”

সার্ভেন্ট অবাক হয়ে মুখে হাত দিয়ে বলে,
“কী বলেন ম্যাডাম! আমরা থাকতে আপনি কেন করবেন? আপনি কালকেই এখানে নতুন আসলেন। আপনি ঘরে গিয়ে রেস্ট করুন, ম্যাডাম।”

“আজকে আমিই নাস্তা বানাব। উনারা যা পছন্দ করে তাই বানাব। প্লিজ। আপনি বাধা দিবেন না।”

“কিন্তু ম্যাডাম…”

“কোনো কিন্তু না। প্লিজ। আমি সবসময় এই সময়ও পাব না। প্রতিদিন তো আপনারাই করবেন।”

সার্ভেন্ট রাজি হয়। তারপর সে রান্নাঘরেই দাঁড়িয়ে মীরার কাজ দেখতে থাকে। মাঝেমধ্যে কিছু লাগলে এগিয়েও দিচ্ছে।

__________

খাবার টেবিলে সবাই একসাথে বসেছে। মীরা এখনও কাউকে জানায়নি যে রান্না আজ সে করেছে। কিন্তু হঠাৎ করেই একটা দুর্ঘটনা ঘটলো….

চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২২
ব্রেকফাস্ট টেবিলে সবাই যখন হাসি-খুশি ভাবে খাচ্ছে, তখন হঠাৎই ফ্রিশার হাঁচি শুরু হয়ে গেলো! লাগাতার হাঁচি দিয়েই যাচ্ছে সে। আচমকা এমন হওয়াতে উপস্থিত সকলে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। খাওয়া রেখে শেহজাদ উচ্চস্বরে সার্ভেন্টকে ডাকে। সার্ভেন্ট ছুটে এসে ভয়ার্ত স্বরে নিজের উপস্থিতি জানান দিলে শেহজাদ ক্রুদ্ধ স্বরে শুধায়,

“খাবারে পিনাট ছিল? তুমি জানোনা? ফ্রিশার পিনাটে এলার্জি?”

সার্ভেন্ট কেঁপে ওঠলো। ভীরু দৃষ্টিতে মীরার দিকে একবার চেয়ে মাথা নিচু করে রাখে। মীরা ভড়কে গেলেও তার জন্য আরেকজন দোষ না করে দোষী হবে, তা তো মানতে পারে না। সে অনুতপ্ত স্বরে বলল,
“আজকের খাবার আমি বানিয়েছি। সরি, আমি জানতাম না যে ফ্রিশার পিনাটে এলার্জি। জানলে আমি সত্যি দিতাম না।”

শেহজাদ দাঁতে দাঁত চেপে নিজের ক্রোধ আয়ত্তে আনার প্রয়াস করে। কিন্তু তার মনে হচ্ছে সে ব্যার্থ হবে! অতঃপর কিছু না বলে কালক্ষেপণ না করে ফ্রিশাকে কোলে করে নিয়ে উপরে ফ্রিশার রুমে চলে যায়।
শেহজাদ, ক্রন্দনরত ফ্রিশাকে নিয়ে চলে গেলে মীরা পিছু যেতে নিলে মিসেস শাহিদা ও-কে আটকায়। তিনি বলেন,
“তুমি এখনি যেয়ো না। শেহজাদ রেগে আছে। পিনাটে ফ্রিশার এলা*র্জি আছে। শরীরে র‍্যাশে ভরে যায়। অনেক ইচিং হয়। রাতে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারে না।”

মীরার খুব খারাপ লাগে। তার জন্য এতটুকু বাচ্চা কতো কষ্ট পাচ্ছে। মীরা ক্লেশবোধ নিয়ে বলে,
“আমি জানলে সত্যি পায়েসে পিনাট দিতাম না। আমি তো পায়েসটা আরও সুস্বাদু করার জন্য বাদামের পেস্ট করে দিয়েছিলাম। আমার মা আমার জন্য এভাবে দেয়। এই টেস্টটা আমার পছন্দে বলে ভেবেছিলাম আপনাদের জন্যও বানাই। কিন্তু এরকম যে হবে তা কল্পনাও করতে পারিনি।”

মিসেস শাহিদা, মীরার দিকটা বুঝলেন। তিনি মীরার মাথায় হাত বুলিয়ে নমনীয় স্বরে বললেন,
“আমি বুঝতে পারছি। তুমি জানলে অবশ্যই করতে না। ফ্রিশার স্পেসিফিকলি কাজুতে এলা*র্জি বেশি। কাঠবাদামে অল্প। খুব বেশি পরিমানে কাঠবাদাম খেলে তাহলে ই*চিং হয়। কিন্তু কাজুতে অনেক বেশি।”

“আমি এরপর থেকে খেয়াল রাখব। ওর আর কীসে কীসে এলা*র্জি সব আপনার কাছ থেকে জেনে নিব। এখন একটু যাই প্লিজ। দরজার বাহির থেকেই দেখব কী অবস্থা।”

“আচ্ছা যাও। তবে বলবো যে কথা বলো না। শেহজাদের রাগ সম্পর্কে তোমার কিছুটা হলেও ধারণা থাকার কথা।”

“হুম।”

মীরা দ্রুতপদে ফ্রিশার ঘরের দিকে অগ্রসর হলো। মিসেস শাহিদা মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। বিয়ের একদিন না পেরোতেই এমনটা হতে হলো! শেহজাদের মনে এ নিয়ে কোনো পরিবর্তন না হয়!

_____

পাঁচ মিনিটের বেশি সময় যাবত মীরা দরজার বাহিরে দাঁড়ানো। শেহজাদ ফ্রিশাকে একটা ইন*জেক*শন পুশ করে এখন মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হাতের কিছু স্থানে লাল লাল র‍্যাশ দেখা যাচ্ছে। ফ্রিশা কিছুক্ষণ অস্থির হয়ে চুলকিয়ে আস্তে আস্তে ঘুমে নেতিয়ে পড়েছে। মীরা দেখলো ফুলের মতো বাচ্চাটার অশ্রুভেজা পাঁপড়ি ও গালের অংশ। কতোটা কষ্ট পেয়েছে সে! মীরার নয়নযুগলে এবার বর্ষা নামলো। মা হওয়ার প্রথম দিনেই তার জন্য বাচ্চাটাকে এতো কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। সামনে কী সে পারবে? ভেবেই মনে ভয়ে-ভীতিরা মাকরশার জালের মতো ছড়াতে শুরু করলো। নিজের ভাবনা-চিন্তার মাঝে এতোটাই ডুবে আছে যে শেহজাদ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তার খেয়ালই নেই! শেহজাদ কিয়ৎক্ষণ আনমনা মীরাকে পর্যবেক্ষণ করে হাতের চুটকি বাজিয়ে মীরার মনোযোগ ফেরায়। মীরা থতমত খেয়ে তাকালে শেহজাদ শান্ত স্বরে বলে,

“ও এখন ঘুমাচ্ছে। আমি ইন*জেক*শন দিয়ে দিয়েছি।”

কথাটা বলে শেহজাদ যত্র দাঁড়িয়ে রইলো। মীরা আড়ষ্টতা ভেঙে বলল,
“বিশ্বাস করুন, আমি জানলে কখোনো করতাম না। আমার পিনাট খুব পছন্দ তাই দিয়েছিলাম। সরি।”

শেহজাদ গম্ভীর স্বরে জবাব দেয়,
“নেক্সট টাইম খেয়াল রেখো।”

অতঃপর দ্রুত প্রস্থান করে। মীরা গুটিগুটি পায়ে ফ্রিশার রুমে গিয়ে ওর মাথার কাছে বসে। তারপর ওর এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিয়ে, র‍্যাশের জায়গাগুলোতে লাগানোর জন্য মলম আনতে সার্ভেন্টকে পাঠায়।

________

সন্ধ্যাবেলা। ধূসর মেঘের আড়ালে অর্ধচন্দ্রমা লুকোচুরি খেলছে। মৃদু জোৎস্না ব্যালকনির গ্রিল গলে অন্ধাকারাচ্ছন্ন স্থানে আসছে। শেহজাদ মেয়ের ঘরে এসে দেখে মীরা সেখানে বসেই বই পড়ছে। দুপুর থেকে শেহজাদ মীরাকে নিজের আশেপাশে কোথাও দেখেনি। খাবার টেবিলেও না। এমনকি দুপুরে যখন ফ্রিশার সাথে দেখা করতে এসেছিল, তখনও মীরা ছিল না। এরপর তো সে একটা কাজে বাহিরে গিয়েছিল। শেহজাদ হালকা কাঁশির আওয়াজ করে, যার দরুণ মীরা বই থেকে মনোযোগ সরিয়ে সম্মুখে তাকায়। শেহজাদকে দেখে ফ্রিশাও বলে ওঠে,

“বাবা, দেখো আমি ড্রয়িং করছি।”

শেহজাদ হালকা হাসি দিয়ে এগিয়ে এলো।
“খুব সুন্দর হয়েছে। তোমার শরীর এখন কেমন লাগছে, মা?”

“অ্যাই অ্যাম ফাইন, বাবা। ফেইরিমাম্মাম আমাকে আবার পায়েস করে খাইয়েছে। এবার কোনো ই*চিং হয়নি। সি, অ্যাই অ্যাম ফাইন।”

শেহজাদ প্রশান্তচিত্তে হাসলো। মেয়ের মাথায় চু*মু এঁকে শুধালো,
“এখন কি র‍্যাশে ই*চিং হচ্ছে?”

“না, বাবা। দাদুমনি বলল, তুমি নাকি ফেইরিমাম্মামের সাথে রাগ করেছ? ফেইরিমাম্মাম তো জানতো না। তাই না?”

শেহজাদ মীরার পানে এক পলক চেয়ে নিরুত্তর রইল। ফ্রিশা পুনরায় বলল,
“ফেইরিমাম্মামকে সরি বলো, বাবা।”

মীরা অবাক হয়ে ফ্রিশাকে দেখে। দ্রুত কণ্ঠে বলে ওঠে,
“না না, ফ্রিশামনি। এটার কোনো দরকার নেই। উনার তো কোনো দোষ নেই। তোমাকে ঐ অবস্থায় দেখে ভয় পেয়েছিল, বাচ্চা।”

ফ্রিশা নিজের কথায় অটল। মীরার কথা সে শুনবে না।
“সরি বলো, বাবা। নাহলে আমি তোমার সাথে কথা বলব না।”

ফ্রিশার জেদ তো তার বাবাকে মানতেই হবে। শেহজাদ মীরার চোখের দিকে আরও একবার তাকায়। অতঃপর ধীর কণ্ঠে সরি বলে সেখান থেকে উঠে যায়। ফ্রিশা উচ্ছাসিত হয়ে মীরাকে জড়িয়ে ধরে গালে চু*মু দিয়ে আবার আঁকতে বসে।

_________

প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর মীরা ফ্রিশার সাথে খেলা করে, মিসেস শাহিদার সাথে গল্প করে ও নিজের মা-ভাবিদের সাথে ফোনে কথা বলে এখন তার ও শেহজাদের বেডরুমে যায়। মিসেস শাহিদা বলেছেন, শেহজাদকে খাওয়ার জন্য ডেকে আনতে। মীরা গিয়ে বলল,
“ফুফিআন্টি আপনাকে ডাকছেন।”

শেহজাদ ল্যাপটপ থেকে নজর সরিয়ে মীরাকে দেখলো। তারপর বলল,
“এখানে এসে বসো।”

“কোথায়?”

মীরার প্রশ্নটা যে কতোটা অবান্তর তা মীরা পরক্ষণেই বুঝতে পারলো যখন শেহজাদ তার দিকে শিতল দৃষ্টিতে তাকায়। এরপর মীরা শেহজাদের পাশে গিয়ে বসলে শেহজাদ মীরার দিকে ঘুরে বসে। তারপর জিজ্ঞাসা করে,

“তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছ?”

মীরা হতচকিত হয়ে তাকায়। তারপর আস্তে করে বলে,
“ভয় না, স্যার। প্রথমদিন আমার অজানায় এমন একটা দুর্ঘ*টনা ঘটে যাবে তা আমি ভাবতেও পারিনি। আমার নিজের কাছেই খুব খারাপ লাগছে।”

“ফ্রিশা কিন্তু তোমাকে নিয়ে খারাপ কিছু ভাবেনি। আমি তখন একটু রেগে ছিলাম কিন্তু পরে তোমার দিক থেকে বুঝলাম, তুমি জানলে এমনটা করতে না।”

কথাটা বলে শেহজাদ হালকা হাসলো। সেই সাথে মীরাও। মীরা প্রশ্ন করলো,
“ফ্রিশার এই মিষ্টি দিকটা ওর মায়ের দিক থেকে পেয়েছে, তাই না?”

“না! ওর দাদী ও ফুফির দিক থেকে। ওর মা বিয়ের আগে অন্যরকম ছিল। বিয়ের পর ও বদলেছে।”

মীরা জানার আগ্রহ থেকে জিজ্ঞাসা করলো,
“কেমন ছিলেন তিনি?”

“ডিনার করে এসে বলব। তোমাকে ফুফিজান কেন পাঠিয়েছে তাই তো ভুলে গেছ!”

মীরা জলদি জিভ কা*ম*ড়ে বলে,
“ইশ সরি! খেয়ালই ছিল না। চলুন।”

বলে মীরা উঠে দাঁড়ায়। শেহজাদ কিঞ্চিত হেসে মীরার সাথে ডাইনিংয়ে যায়।

________

খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষে ফ্রিশার বায়না, তার বাবা ও ফেইরিমাম্মাম দুজনে তাকে ঘুম পারাবে। মেয়ের এমন আদুরে বায়না দুজনের কেউই ফেলতে পারলেন না। অতঃপর শেহজাদ ও মীরা ফ্রিশার হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ফ্রিশার ঘরে যায়। যদিও ফ্রিশা কোলে উঠতে চাইছিল কিন্তু শেহজাদ রাজি না। রাতে খাওয়ার পর একটু হাঁটাহাঁটি করতে তো হয়। তাই এই পন্থা।
ঘুমোনোর আগে ফ্রিশাকে ঔষুধ খাইয়ে দেয় শেহজাদ। অতঃপর সে মেয়েকে ইংলিশ কবিতা শোনায়। শেহজাদের কণ্ঠে ইংলিশ কবিতা শুনে মীরা কোনোরকমে হাসি আটকে রেখেছিল। এই লোক যে কবিতাও শোনাতে পারে তা তার ধারনারও বাহিরে ছিল। ঔষুধের প্রভাবে ফ্রিশা জলদিই ঘুমিয়ে পড়ে। ফ্রিশা ঘুমানোর পর শেহজাদ মীরাকে বলে,

“কফি করে নিয়ে এসো। তোমাকে আজ একটা স্টোরি শোনাব।”

“আপনার ও ফিওনা আপুর?”

“হ্যাঁ।”

মীরা মুচকি হেসে কফি বানাতে যায়।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-১৯+২০

0

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৯
মাগরিবের নামাজ শেষে মীরা হলুদ রঙের জামদানী শাড়ি পড়ে বিছানায় বসেছে। মীরার বড়ো ভাবি মীরার চুড়ি ও ফুলের গহনাগুলো এনে রাখে। রাইমাও ও-কে সাজানো শুরুই করেছে তখন হুট করে জিনিয়া একটা মাঝারি আকৃতির বোলে উষ্ণ গরমপানি নিয়ে হাজির। মীরা ও রাইমার প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি জিনিয়ার দিকে। ওদেরকে আরও এক ধাপ অবাক করে দিয়ে জিনিয়া পানির বোল নিয়ে মীরার পায়ের কাছে মেঝেতে বসে পড়লো। অতঃপর মীরার পা ধরে পানিতে রাখলো। তৎক্ষণাৎ মীরা হকচকিয়ে পা সরিয়ে নিতে চাইলে জিনিয়া বলে,

“আরে আরে পা সরাচ্ছিস কেন? আমি পেডিকিউর করব তো!”

“হ্যাঁ?”

“হ্যাঁ রে হ্যাঁ। পানিতে শ্যাম্পু, লবন ও লেবুর রস দিয়ে এনেছি। এখনও মিক্স করিনি। সরি! ওয়েট মিক্স করে নিই।”

জিনিয়া পানিতে হাত ডুবিয়ে ফেনা তৈরি করে বলে,
“১০ মিনিট এভাবে বসে থাক। তারপর বাকি প্রসিডিউর করব।”

মীরা ক্লান্ত স্বরে বলে,
“এখন পা ডুবিয়েই রাখতে হবে?”

“হ্যাঁ হবে। তুই তো বসেই আছিস। রাইমা তোর মেইকআপ করে দিতে দিতে আমার কাজও শেষ হয়ে যাবে।”

রাইমা বলে,
“ঠিক বলেছ, জিনিয়া। বসেই থাকবি তো ও যা করতে বলছে কর। তারপর তোর সাজ হয়ে গেলে আমাদের জন্য বসে থাকবি।”

“আচ্ছা কর।”

জিনিয়া এবার উঠে গিয়ে নিজের মুখের মেইকআপ করতে বসে। আর বলে,
“মানুষের পা অনেক সেনসিটিভ। পায়ের বিভিন্ন স্থানে ম্যাসাজ করলে ব*ডির আদারস অর্গান সুস্থ থাকে। তাছাড়া তুই যতোই বলিস যে পার্লারে যাবি না বলে কিছু কম স্ট্রেস হবে। তা কিন্তু হবে না। ভাই, আমি তো বিয়ে করেছি। বসে থাকতে থাকতে কোমড় আর কোমড় থাকে না। তারউপর আনকম্ফর্টেবল শাড়ি-জুয়েলারি। সাউন্ডস প্রবলেম তো আছেই! তোর খালি মনে হবে, ‘আমি কখন এসব থেকে মুক্তি পাব আর ঘুমাব!’ তাই পেডিকিউরের মধ্যে হালকা একটু ম্যাসাজ থাকলে না, কিছুটা রিলিফ লাগে। এটা অবশ্য উচিত ফাংশনের পর করা। পার্লারেও কিন্তু এটা প্রবাইড করে।”
(পেডিকিউর পায়ের সৌন্দর্যের জন্য করা হলেও ম্যাসাজিংটা ইফেক্টিভ।)

মীরা জিনিয়াকে কাছে ডেকে মাথায় একটা চু*মু এঁকে দিয়ে বলে,
“ইউ আর সো কেয়ারিং। অ্যাই লাভ ইউ, জিনু!”

“লাভ ইউ টু, মীরু! এখন চুপচাপ বসে থাক। ভাবি, তোর জন্য ফ্রেশ ম্যাংগো জুস আনছেন।”

রাইমা হাঁক ছেড়ে বলে ওঠে,
“ভাবি, আমার জন্যও প্লিজ।”

নিধি আম কা*টতে কা*টতে প্রত্যুত্তর করে,
“আচ্ছা। সবার জন্যই আনব। ওদিকে হলুদের টেবিল সাজানোর সব কম্পিলিট হয়েছে কী-না তাও দেখতে হবে।”

রাইমা মুচকি হেসে বলে,
“এই ফার্স্ট আমি মুসলিম বাংলাদেশি বিয়ে এটেন্ড করছি। কুঞ্জকে বলেছি সব যেন ক্যামারেয়াতে কভার করে। বেচারা, হয়তো দৌড়াদৌড়ির উপরই আছে!”

“আরে করতে দাও। ছেলেদের কাজই এসব করা। এখন থেকে ট্রাই করলে ফিউচারেও তোমার সব কথা মানবে।”

মীরা বলে ওঠে,
“এই জিনু, থাম ভাই! তুই রাইকে চিনিস না! কুঞ্জদাকে ও যেভাবে নাকে দম করে রাখে! নেহাত কুঞ্জদা বলেই ও-কে মেনে চলছে। তুই আর ও-কে এসব করতে ইনকারেজ করিস না।”

জিনিয়া ভাব নিয়ে বলে,
“কতো দরদ উতলে উঠছে তোর, মীরু! শোন, এদের বশে রাখতে হলে একটু ডমিনেটিং হতেই হয়। তাছাড়া ভালোও তো বাসি। কেয়ারও করি। তুইও আস্তে আস্তে শিখেই যাবি।”

জিনিয়া ও রাইমা হেসে ওঠে একে অপরের সাথে হাতে তালি দেয়। মীরা মাথায় হাত দিয়ে হালকা হেসে নিরব থাকে। অতঃপর তার সাজ চলতে থাকে।

________

শেহজাদদের বাড়িতে হলুদের কোনো ফাংশন কিছু হচ্ছে না। মূলত শেহজাদের এসব পছন্দ না। ফ্রিশা জানতে পারলে জেদ করতে পারে ভেবে শেহজাদ নিষেধ করেছে যেন ফ্রিশাকে এই বিষয়ে না জানানো হয়। মিসেস শাহিদাও মেনে নেন। কারণ, এতসব কিছু দেখাশোনা করার জন্যও তো মানুষ লাগে। ড: আকবর রেহমানের ছোটো ভাই ও বোন কেউই দেশে থাকেন না। উনারা কানাডা, অস্ট্রেলিয়াতে সেটেল।
শেহজাদ নিজের রুমে বসে বসে ল্যাপটপে আর্টিকেল দেখছে। হুট করে ফ্রিশা এক বাটি হলুদ নিয়ে এসে শেহজাদের গালে লাগিয়ে দেয়। হকচকিয়ে উঠে শেহজাদ। বাবাকে এতো আশ্চর্য হতে দেখে ফ্রিশা খিলখিল করে হেসে ওঠে। সে বলে,

“আজ তো হলুদ লাগাতে হয়, বাবা। তাই আমিই তোমাকে লাগিয়ে দিলাম।”

শেহজাদ কিছুক্ষণ মেয়ের পানে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ভ্রুকুঞ্চন করে শুধায়,
“তোমাকে এসব কে বলেছে?”

“ফেইরিমাম্মামের ফ্রেন্ড বলেছে।”

“কখন?”

“একটু আগে আমি দাদুমনিকে বললাম ফেইরিমাম্মামকে কল করতে। তখন কলটা ফেইরিমাম্মামের ফ্রেন্ড রিসিভ করে। জানো বাবা, সেখানে অনেক সাউন্ড হচ্ছিলো। তখন বলেছে আজ নাকি হলুদ লাগায়। আমাকে তো ফেইরিমাম্মামের ছবিও দেখিয়েছে। সি লুকস সো প্রিটি। লাইক অ্যা রিয়েল ফ্লাওয়ার ফেইরি। তোমারও তো হলুদ লাগাতে হবে। তাই আমিও দাদুমনিকে বলে আন্টিকে (সার্ভেন্ট) দিয়ে হলুদ আনিয়েছি।”

শেহজাদ হালকা হেসে মেয়েকে নিজের কাছে এনে কোলে বসিয়ে বলে,
“ওহ আচ্ছা। শোনো মাম্মাম, হলুদ লাগানো মেন্ডেটরি না। যার যার চয়েজ। ইয়েস, ইট হ্যাজ মেডিসিনাল ভেলু এন্ড ইট ইজ সো ইফেক্টিভ।”

ফ্রিশা কৌতুহলী হয়ে শুধায়,
“তাহলে তুমি কেন লাগাতে চাও না, বাবা?”

শেহজাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে জবাব দেয়,
“এমনিই। অ্যাই ডোন্ট লাইক ইট। তুমি এখন যাও, ঘুমিয়ে পড়ো। রাত দশটার বেশি বাজে।”

ফ্রিশা মুখ ভার করে হলুদের বাটি নিয়ে চলে আসে। মিসেস শাহিদা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সবটাই শুনলেন। শেহজাদ গায়ে হলুদ এসব পছন্দ করে না, তারও একটা কারণ আছে। সে এটা চাইলেও ভুলতে পারে না।

এদিকে সন্ধ্যা আটটা থেকে টানা বসে থাকতে থাকতে মীরার প্রচণ্ড ক্লান্ত। ফুলের সাজে তাকে ফ্রিশার সম্বোধিত ফেইরির মতোই লাগছে। মীরার কলিগরাও কিছুক্ষণ আগেই হলুদ লাগানোর পর খাওয়া-দাওয়া করে বিদায় নিয়ে চলে গেছে। এখন মেহেদী আর্টিস্ট ওর এক হাতে মেহেদী পড়াচ্ছে। এদিকে ফটোগ্রাফারের যেন সব ক্যাপচার করতে হবে! মুখ থেকে হাসি সরানোই যাবে না। মীরা তার বড়ো ভাবিকে ডেকে বলে,

“ভাবি, আমি এখান থেকে উঠতে চাই। ইমরান, জায়েদদের বলো গান এসব বন্ধ করাতে।”

মীরার খালাতো বোন জান্নাত এসে বলে,
“কী বলো, আপু? মাত্রই সবাই হলুদ দিয়ে শেষ করলো। এখন মেহেদী পড়ানোর ফাংশন হচ্ছে তো।”

“কর তোরা। আমি রুমে যাব। আমার ব্যাকপেইন প্রবলেম আছে।”

মেহেদী আর্টিস্ট বলে,
“আপু, মেহেদীটা পড়ানো পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করুন। দুইজন মিলে দুহাতে মেহেদী পড়ানো শেষে আপনাকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিব।”

মীরা ক্লান্ত দৃষ্টিতে নিজের হাতের দিকে চেয়ে বলে,
“আরেকজনকে ডাকুন। আর জলদি করুন, প্লিজ।”

মেহেদী আর্টিস্ট তার সাথে আসা আরও দুইজন আর্টিস্টদের মধ্যে আরেকজন আর্টিস্টকে ডেকে আনেন। অতঃপর যত দ্রুত সম্ভব কাজ করতে থাকেন।

_________

রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি সময়ে মীরা বাড়ির ছাদের স্টেজ থেকে উঠে নিজের রুমে আসতে পেরেছে। দুই হাত ভর্তি তার মেহেদী। কোনো রকমে বিছানার সাথে বালিশে হেলান দিয়ে বসে হাত উঁচু করে রাখে। হাতের উপরের পৃষ্টের মেহেদী এখনও ভেজা। রাইমা, জিনিয়া, নিধি, শারমিন, জান্নাত, মীরার মামাতো বোন, ভাবি, চাচাতো বোনদের সবারই দুই হাতের চার পৃষ্টের মধ্যে দুই দুই করে মেহেদী পড়া শেষ। মেহেদী আর্টিস্ট তিন জন ছাড়াও ভাবি ও কাজিনরা নিজেরা নিজেরাও মেহেদী পড়েছে।
কিন্তু ওদের মধ্যে ক্লান্তি ভাবটা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তখনি মিসেস মলি জাহান এক গ্লাস কুসুম গরম দুধ এনে মীরাকে বলে,

“নে এটা খেয়ে নে। ক্লান্তি কম লাগবে।”

মীরা অসহায় চোখে চেয়ে বলে,
“আমি ফ্রেশ হতে পারলে আমার ক্লান্তি কম লাগবে। কিন্তু মেহেদী না শুকানো অবধি পারছি না।”

“শুকিয়ে যাবে। তুই আগে গ্লাসের দুধটুকু খা। তারপর তোকে আমি খিচুড়িও খা*ইয়ে দিব।”

“মা! আবার খাবারও! আমি খাব না।”

মলি জাহান মৃদু ধ*মকে উঠলেন। তিনি বললেন,
“চু*প! খাবিনা মানে কি! খেতে হবে। খিচুড়ি রান্নাটা দেরি করে হয়েছে বলে স্টেজে বসার আগে খাওয়াতে পারিনি। এখন চুপচাপ খেয়ে নিবি নয়তো তোর বাবাকে বলব। গ্লাসটা ধর।”

মিসেস মলি জাহান, মীরার হাতে দুধের গ্লাসটা ধরিয়ে দিয়ে খাবার আনতে গেলেন। মীরার মা যেতেই রাইমা দুষ্টুমি করে বলে,

“তোকে এনার্জি গেইন করতে হবে, বেবি! নয়তো কালকে এনার্জি পাবিনা তো!”

রাইমার কথা শুনে রুমে থাকা মীরার ভাবিরা, কাজিনরা ও বান্ধবী সবাই হেসে ওঠে। জিনিয়া আবার আরেকধাপ এগিয়ে বলে,
“স্যারকে ফোন করব? না মানে তোর হাতের মেহেদী দেখাতে। আমার বিয়ের সময় তো…”

মীরা রাগ দেখিয়ে জিনিয়াকে থামিয়ে জিনিয়াকে নিজের কাছ থেকে ধা*ক্কা দিয়ে বলে,
“চু*প! বেশ*রমের দল। আর একটা এমন টাইপের কথা বললে রুম থেকে বের করে দিব।”

“আচ্ছা যা বললাম না। তবে কাল রাতে কিছু লাগলে আমাদের নির্দ্বিধায় কল করতে পারিস। মানে এডভাইস আরকি! যতোই হোক, স্যারের বাসায় তো আমরা তোর সাথে যেতে পারব না।”

“থাম না প্লিজ। আম্মু আসবে এখনি।”

“ওকে। বাট কল কিন্তু…”

মীরা এবার চোখ রাঙালে জিনিয়া থেমে গেলেও রুমে থাকা সবার মাঝে যেন হাসি একপ্রকার ম*হামা*রির মতো ছড়িয়ে পড়ে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২০
মিষ্টি গোলাপি রঙের বেনারসি পড়ে স্টেজে বসে আছে, মীরা। মীরাকে ঘিরে তার কাজিনরা, ভাবিরা, বন্ধু-বান্ধব ও কলিগরা হাস্যরসে মেতে আছে। চলছে ফটোশুট। এখনও বরযাত্রী এসে পৌঁছায়নি। চারিদিকে মরিচবাতির আলোকসজ্জায় কৃষ্ণাভ সায়াহ্নে যেন অজস্র তারাদের মেলা বসেছে। ঝলমলে সন্ধ্যা আজ মুখরিত নতুন অধ্যায় রচনাতে। পবনে তার আলাদা ছোঁয়া। মীরার ওষ্ঠকোণে ফুটে আছে স্নিগ্ধ হাসি। বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য একটা কমিউনিটি সেন্টারের রুফটফ পুরোটা বুকিং করা হয়েছে। একদম টপ রুফটফে বর ও কনের জন্য কম্বাইন্ড স্টেজ। এদিকে কুঞ্জ প্রথম থেকেই সবটা ক্যামেরায় রেকর্ড করছে। তাকে কিঞ্চিত ক্লান্তও দেখাচ্ছে। ব্যাপারটা রাইমার নজর এড়ায়নি। সে খাবার এনে মীরাকে খাইয়ে আবার খাবার নিয়ে এসেছে। এবার সে ঘুরে ঘুরে কুঞ্জকে খাওয়াচ্ছে। সেইসাথে ঝ*গড়া তো ফ্রি! স্টেজ থেকে ওদের এই খুনশুঁটি দেখে বাকিরাও হাসছে। মীরার এক ফ্রেন্ড বলে,

“সত্যিরে, রাইমা মেয়েটা অনেক কিউট। বিকেলে যার সাথে ঝ*গ*ড়া করে শেষ! রফাদফা অবস্থা! এখন দেখ, তাকে নিজ হাতে খাওয়াচ্ছেও।”

মীরা হেসে বলে,
“ও এমনি। কখোনো উড়নচণ্ডী তো কখোনো আদুরে ও যত্নশীল। দ্যাটস হোয়াই অ্যাই লাভ হার এন্ড মিস সো ব্যাডলি।”

জিনিয়া, মীরার কাঁধে সামান্য ধা*ক্কা দিয়ে রম্যস্বরে বলে,
“স্যার থাকতে তুই রাইমাকে মিস করিস! ছি ছি মীরা!”

জিনিয়ার সাথে উপস্থিত সকলে হেসে ওঠে। মীরা ও-কে দুই ঘা লাগিয়েও সেরেছে। হঠাৎই সোরগোল পড়ে গেল। একে একে মীরার পাশ থেকে সকলে উঠে নিচে নামলো। রুফটফের গেইটে বরপক্ষ এসেছে। মীরার ফ্রেন্ড ও কাজিনরা গেইট ধরলেও ফ্রিশা তার বাবার হাত ছেড়ে ছুটে ভেতরে চলে এসেছে। তারপর মৃদুলার হাত ধরে টপ রুফটফে একাকি বসে থাকা মীরার কাছে যায়। মীরাকে দেখা মাত্রই ফ্রিশা গালে হাত দিয়ে বলে ওঠে,

“ইউ আর লুকিং সো বিউটিফুল, ফেইরিমাম্মাম! লাইক অ্যা কুইন।”

মীরা মুচকি হাসে। অতঃপর হাত বাড়িয়ে ফ্রিশাকে কাছে ডাকে। ফ্রিশা ও মৃদুলা, দুজনেই গিয়ে মীরার দুইপাশে বসে। মীরা ওদেরকে দুইহাতে আগলে নিয়ে প্রথমে মৃদুলা ও পরে ফ্রিশাকে বলে,

“মাই বার্বিডল এন্ড মাই প্রিন্সেস।”

দুজনের ললাটে উষ্ণ ঠোঁ*টের স্পর্শ এঁকে দেয়। ফ্রিশা বলে,
“জানো ফেইরিমাম্মাম, বাবাকে কিংয়ের মতো লাগছে। গোল্ডেন শিওয়ানি! গোল্ডেন ব্রুজ।”

“বাচ্চা, ওটা শেরওয়ানি। প্রিন্সেসের বাবা তো কিং হয়ই।”

“ইয়েস, এন্ড প্রিন্সেসের ফেইরিমাম্মাম কুইন হয়।”

ফ্রিশা আদুরে ভঙ্গিতে মীরার দিকে তাকায়। মীরা যেন মুগ্ধ। তার দৃষ্টি এক মায়াবি মুখশ্রীতে রুদ্ধ হয়েছে। অক্ষিকোণে জলবিন্দুদের উপস্থিতি ঝর্ণা বয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। মীরা টিসুর সাহায্যে আড়ালেই তা মুছে নিলো। ফের বলল,

“তুমি টায়ার্ড তো। ওয়েট, আমি জুস আনাচ্ছি।”

মীরা কাউকে বলে জুস আনালো। ফ্রিশা এক ঢোকে খেয়েও নিয়েছে।

গেইটের ঝামেলা দীর্ঘসময় স্থায়ী হয়নি। ড: আকবর রেহমান কোনো বাক্যব্যয় ছাড়াই মিটিয়ে নিয়েছেন। সবাই এখন শেহজাদকে নিয়ে স্টেজে আসে। মীরার পাশে বসানো হয় তাকে। আসার পথে শেহজাদ মাথা উঁচু করেনি। দেখেনি মীরাকে। তার জন্য এটা দ্বিতীয় বিয়ে হলেও এভাবে বরবেশে বিয়েটা এবারই প্রথম। সবার সামনে মীরার সাথে চোখাচোখি হলে যদি মীরা অস্বস্তিতে পড়ে! তাই নিরবে এসে পাশে বসেছে। ফ্রিশা ওদের মাঝে বসে বলে,

“বাবা, দেখো। ফেইরিমাম্মামকে কত সুন্দর লাগছে। একদম কুইন কুইন। তুমি কিং, ফেইরিমাম্মাম কুইন আর আমি প্রিন্সেস।”

শেহজাদ মেয়ের দিকে একবার চেয়ে নিরব হাসে। মীরাও ফ্রিশার হাত ধরে নত মস্তকে লাজুক হাসে। সামনে দাঁড়িয়ে কুঞ্জ ওদের তিনজনের একটা সুন্দর ক্যান্ডিড ছবি ক্যাপচার করে নিয়েছে। ভাড়া করা ক্যামেরাম্যান এবার ছবি তোলার জন্য ওদেরকে নিজের ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাকতে বলে। অনেক অনেক ছবি তোলা হয়। এখন মীরার বাবা রফিক তালুকদার ও ড: আকবর রেহমান কাজিকে নিয়ে স্টেজের কাছে আসে। কাজি সবকিছু লিখে ও বলে প্রথমে শেহজাদকে ‘কবুল’ বলতে বলে। শেহজাদ চোখ বন্ধ করে। অক্ষিপটে ভেসে উঠে তার প্রথমা স্ত্রীর মুখখানা। ওষ্ঠকোণে তার স্নিগ্ধ হাসি। নিঃসন্দেহে ফিওনা সুন্দরী। হবে নাই বা কেন? রাশিয়ান মা ও আমেরিকান বাবার মেয়ে সে। ভেসে উঠে ফিওনা তার বিয়ের সাজে। হালকা বেবি পিংক গাউনে। শেহজাদের কল্পনায় ফিওনা বলছে,

“মাই ইমেনস লাভ ফর ইউ উইল নেভার ইন্ড। বাট মাই লাভ ওয়ান্টস ইউ টু বি ভেরি হ্যাপি এন্ড লিভ উইথ লাভ। (তোমার প্রতি আমার অসীম ভালোবাসা কখনো শেষ হবে না। কিন্তু আমার ভালোবাসা চায় তুমি খুব সুখে থাকো এবং ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকো।)”

ফ্রিশার ডাকে চোখ খুলে শেহজাদ।
“বাবা, ‘কবুল’ বলো? হোয়াট আর ইউ থিংকিং?”

শেহজাদ মেয়ের দিকে একবার চেয়ে নিরব হাসে। মীরাও ফ্রিশার হাত ধরে নত মস্তকে লাজুক হাসে। সামনে দাঁড়িয়ে কুঞ্জ ওদের তিনজনের একটা সুন্দর ক্যান্ডিড ছবি ক্যাপচার করে নিয়েছে। ভাড়া করা ক্যামেরাম্যান এবার ছবি তোলার জন্য ওদেরকে নিজের ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাকতে বলে। অনেক অনেক ছবি তোলা হয়। এখন মীরার বাবা রফিক তালুকদার ও ড: আকবর রেহমান কাজিকে নিয়ে স্টেজের কাছে আসে। কাজি সবকিছু লিখে ও বলে প্রথমে মীরাকে কবুল বলতে বললে মীরার নেত্রকোন বেয়ে দুই ফোঁটা অশ্রকণা টুপ করে তার নিজের হাতেই পড়ে। ধিমি স্বরে তিনবার ‘কবুল’ পড়ে পাশে দাঁড়ানো ছোটো ভাবিকে জড়িয়ে নিরবে অশ্রুপাত করতে থাকে। সবার মাঝে আলহামদুলিল্লাহ র*ব ওঠে।
অতঃপর শেহজাদকে ‘কবুল’ বলতে বলে। শেহজাদ চোখ বন্ধ করে। অক্ষিপটে ভেসে উঠে তার প্রথমা স্ত্রীর মুখখানা। ওষ্ঠকোণে তার স্নিগ্ধ হাসি। নিঃসন্দেহে ফিওনা সুন্দরী। হবে নাই বা কেন? রাশিয়ান মা ও আমেরিকান বাবার মেয়ে সে। ভেসে উঠে ফিওনা তার বিয়ের সাজে। হালকা বেবি পিংক গাউনে। শেহজাদের কল্পনায় ফিওনা বলছে,

“মাই ইমেনস লাভ ফর ইউ উইল নেভার ইন্ড। বাট মাই লাভ ওয়ান্টস ইউ টু বি ভেরি হ্যাপি এন্ড লিভ উইথ লাভ। (তোমার প্রতি আমার অসীম ভালোবাসা কখনো শেষ হবে না। কিন্তু আমার ভালোবাসা চায় তুমি খুব সুখে থাকো এবং ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকো।)”

ফ্রিশার ডাকে চোখ খুলে শেহজাদ।
“বাবা, ‘কবুল’ বলো? হোয়াট আর ইউ থিংকিং?”

শেহজাদ মেয়ের কৌতুহলী ও উদ্বেগী মুখাবয়ব পর্যবেক্ষণ করে মীরার দিকে তাকায়। মীরা মুদিত নয়নে নত মস্তকে বসে নিজের আঙুল খুঁটছে। দৃষ্টি স্থির রেখেই শেহজাদ ‘তিন কবুল’ বলে দেয়। অতঃপর সবার মাঝে আনন্দ ধ্বনি। মিষ্টি মুখ করাচ্ছে একে অপরকে।
তারপর মীরার কাজিনরা আয়না ও ওড়না নিয়ে আসে। আয়নাটা ফ্রিশার হাতে দেয়। অতঃপর তিনজনের মাথাে উপর ওড়না ছড়িয়ে দিয়ে একই সাথে আয়নায় মুখ দেখানোর ব্যবস্থা করে। গোলাকার আয়নায় একই সময়ে ভেসে উঠে তিনটি মুখচিত্র। ফ্রিশা উচ্ছাসিত কণ্ঠে বলে,

“কিং, কুইন এন্ড লিটল প্রিন্সেস!”

ফ্রিশার মতো বাকিরাও খুশি। ওড়না সরানোর পর হঠাৎই মীরার কর্ণকুহরে কারও অপ্রত্যাশিত ডাক বেজে ওঠে। মীরা ও শেহজাদ দুজনেই সম্মুখে তাকিয়ে দেখে বর্ণ দাঁড়ানো। বর্ণর বুকের সাথে বেল্ট দিয়ে আগলে রাখা তার ছেলে বর্ষণ ও হাতে লাল গোলাপের তোড়া। বর্ণর পেছনে তার বাবা-মা। বর্ণ এগিয়ে এসে হাসি মুখে বলে,

“বেস্ট উইশেস ফর ইউ গাইজ। অ্যাই উইল প্রে দ্যাট বোথ অফ ইউর লাইভস উইল বি ফিলড উইথ লাভ এন্ড হ্যাপিনেস। হ্যাপি ম্যারিড জার্নি।”

বর্ণ গোলাপের তোড়াটা সামনে বাড়িয়ে দেয়। মীরা ও শেহজাদ উঠে দাঁড়িয়ে একে-অপরের পানে তাকায়। অতঃপর মিষ্টি হেসে তোড়াটা নিয়ে বলে,

“থ্যাংকিউ বর্ণ। তোমার জন্যও অনেক অনেক শুভ কামনা।”

“আজ রাতেই আমার ফ্লাইট। এবার সাথে করে বাবা-মাকেও নিয়ে যাচ্ছি। কিছুদিন সেখানে থেকে আসবে। স্যার, আপনার কথা অনুযায়ী আমি বর্ষণের মায়ের সাথে কথা বলেছি। অ্যাই হোপ, সেখানে গিয়। সব সলভ হয়ে যাবে।”

শেহজাদ মুচকি হেসে বলে,
“বেস্ট অফ লাক।”

বর্ণর বাবা এসে মীরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“নিজের ছেলের কর্মকাণ্ডে আমরা খুবই লজ্জিত। মাফ করে দিও মা।”

মীরা দ্রুত বলে ওঠে,
“না না আঙ্কেল। আপনি কেন মাফ চাচ্ছেন! আমার ভাগ্যে ছিল বলেই হয়েছে। আমি এখন আর বর্ণর প্রতি অভিযোগ রাখিনি। আমি চাই ও সুখে থাকুক।”

বর্ণর মা তার ছেলের কাছ থেকে নাতিকে নিজের কোলে নিয়ে মীরাে কাছে এগিয়ে আসে। বলে,
“একবার ও-কে কোলে নিবে? দোয়া করে দিও যেন ওর মধ্যে ওর বাবার কোনো খারাপ দোষ না আসে।”

মীরা, বর্ষণকে কোলে নিলো। বর্ষণের চেহারায় তাে বাবা মুখশ্রীর ছাঁপ স্পষ্ট। জাপানি মায়ের থেকে হয়তো শুধু নাকটাই পেয়েছে। মীরা, বর্ষণে কপালে আদরের স্পর্শ এঁকে বলে,
“ভালো মানুষ হও, ভালো থেকো।”

তারপর শেহজাদও বাচ্চাটাকে কোলে নিলো। আদর করে বর্ণর কোলে দিয়ে বলল,
“ভালো থেকো।”

বর্ণ ও তার বাবা-মা বিদায় নিয়ে চলে যায়। মীরা ও শেহজাদ দুজনে একসাথে ফ্রিশাকে আগলে নিয়ে একে-অপরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-১৭+১৮

0

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৭
মীরা হালকা সাজে তৈরি। শেহজাদ ও ড: আকবর রেহমানও কিছুক্ষণ আগে এসে পৌঁছেছেন। মীরার মামা, চাচারাও এসেছেন। ফ্রিশা একটু আগেই ঘুম থেকে উঠে গেছে। এখন সে মৃদুলা, নিহান ও সিয়ামের সাথে এখন খেলছে। এদিকে মীরা নিজের ঘরে দরজা এঁটে একাকি বসে আছে। সে ভীষণ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। এখনো তো ফ্রিশার সাথে কথা হয়নি। ওর ইচ্ছে, সম্মতি বুঝে উঠতে পারেনি। যদি ফ্রিশা এতে খুশি না হয় তবে? যদি ফ্রিশা রাজি না হয় সে কী করবে? ভেবে ভেবেই অস্থির হলো। তখনি দরজায় খটখট আওয়াজ হলে উঠে দরজা খুলে সে। বাহিরে তার ছোটো ভাবি দাঁড়ানো। নিধি রম্যস্বরে বলল,

“চলো ননদী। তোমার ডাক পড়েছে।”

মীরার ওষ্ঠকোণে অজান্তেই হাসি ছড়ায়। মীরা রুম থেকে সবে বেরিয়েছে আর হুট করে ফ্রিশা এসে মীরার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে। মীরা থমকায়। মাথায় হাত রাখে বাচ্চা মেয়েটার। এই মেয়েটার দ্বিতীয় মা হতে চলেছে সে? পারবে তো? যদি অজান্তেই কষ্ট দিয়ে ফেলে? ভয় হচ্ছে তার। হঠাৎ তার হৃদয় অজানা ভয়ে ব্যকুল হলো।
ফ্রিশা মাথা হালকা উঁচু করে খিলখিল ধ্বনিতে শুধায়,

“তুমি আমার মামনি হবে ফেইরি আন্টি?”

“মামনি?”

“ইয়াহ মামনি। দাদুমনি বলেছিল তুমি আমাকে মায়ের মতো ভালোবাসবে। তুমি আমার মা হবে। আমার সাথে থাকবে। দাদুমনিও আমাকে ভালোবাসে। তাই দাদুমনিকে আমি দাদুমনি ডাকি। তোমাকেও মামনি ডাকব।”

ফ্রিশা কী বুঝে এটা বলেছে মীরা জানেনা। তবে এতে মীরার একটুও খারাপ লাগলো না। সে মুচকি হেসে বলে,
“হুম। আমি তোমার মামনি হবো, বাচ্চা। আর ইউ হ্যাপি?”

“ইয়েস। অ্যাই অ্যাম সো হ্যাপি, মামনি।”

মীরার মন শান্ত হলো। প্রশান্তি স্থান দখল করলো ব্যকুল অস্থিরতার। নিধি মুচকি হেসে শুধায়,
“তো ফ্রিশার মামনি? এবার যাওয়া যাক?”

মীরা নিরব হাসলো। অতঃপর ফ্রিশার হাত ধরে পা বাড়ালো।

ড্রয়িংরুমে সবাই কথা বলছে কিন্তু একমাত্র শেহজাদ মাথা নিচু করে বসে আছে। এইনগেজমেন্টের তারিখটা হঠাৎ করে এগিয়ে আনার মূল কারণ সে নিজেও জানেনা। রেস্টুরেন্টে মীরার সামনে বসেই তার মনে হয়েছে এবং সে ফটাফট সেটা করেও ফেলেছে। কিন্তু এখন এর কারণ সে আবিষ্কার করতে পারছে না। তবে ফ্রিশার প্রফুল্লিত মুখশ্রী দেখে মনে হয়েছে, যা হচ্ছে আর যাই হোক খারাপ হচ্ছে না। সত্য তো এটাই যে সে বিয়েটা ফ্রিশার জন্যই করছে। তার জীবনে ভালোবাসা কখোনোই বিয়ের আগে তো আসেনি।

নিধি মীরাকে এনে শেহজাদের পাশে বসালো। মীরা আবার ফ্রিশাকে নিজেদের মাঝে বসিয়েছে। ড: আকবর রেহমান বলেন,

“সবাই এখানে রয়েছে। তাহলে রিং সিরেমনি শুরু করা যাক?”

রফিক তালুকদার হালকা হেসে সম্মতি দিলেন। মিসেস শাহিদা রিং বক্সটা শেহজাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,

“শেহজাদ, এই নাও আংটি। মীরার অনামিকায় পড়িয়ে দাও।”

শেহজাদ, মিসেস শাহিদার হাত থেকে আংটির বক্সটা নিলো। আংটির দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকাতেই পাশে বসা ফ্রিশা মীরার হাত টেনে এগিয়ে এনে বলল,

“বাবা, নাও পড়াও।”

মীরা শেহজাদের দিকে তাকালো তদ্রুপ শেহজাদও। ফের দ্রুত দৃষ্টি নামিয়ে মীরার অনামিকায় আংটিটা পড়িয়ে দিলো। ফ্রিশা আবার বলে,
“ফেইরি আন্টি, সরি সরি। মামনি, তুমিও বাবাকে রিং পড়াও।”

শেহজাদ মেয়ের মুখে ‘মামনি’ ডাক শুনে খানিক হকচকাল। মেয়ে তার এখনি মীরাকে মায়ের দার্জা দিয়ে বসেছে। মীরাকে রিং নিধি এগিয়ে দিলো। ফ্রিশা এবার তার বাবার হাত এগিয়ে আনলো। অতঃপর মীরা নত মস্তকেই আংটি পড়িয়ে দিলো। সবাই খুব খুশি। আলহামদুলিল্লাহ পড়ছে সকলে।

———

ছাদে দাঁড়িয়ে আছে মীরা ও শেহজাদ। আঁধারে ঢাকা সুবিশাল অম্বরে ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। বাতাসেও কেমন শীতলতা। ঝড় হওয়ার আশঙ্কা আছে। নিরবতার ক্ষীণ সুতা কে*টে শেহজাদ প্রশ্ন করে,

“আর ইউ হ্যাপি?”

মীরার অবিচল দৃষ্টি সম্মুখে। সে অনড়ভাবে জবাব দেয়,
“ইয়াহ। এটলিস্ট ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।”

শেহজাদ বিস্মিত হলো। শুধালো,
“ঠকে যাওয়া মানে?”

“মানে হচ্ছে, জীবনে ঠকে যাওয়ার থেকে কষ্ট আর কিছুতে নেই।”

“এজন্যই তুমি রাদিবকে বলেছিলে, তাকে বিয়ে করার থেকে বিপত্নীক কাউকে বিয়ে করা উত্তম?”

মীরা এবার ঘাড় ঘুরালো। অন্ধকারে শেহজাদকে দেখা না গেলেও সে ভ্রুঁ কুঁচকে চেয়ে বলল,
“রাদিব আপনাকে এগুলোও বলেছে?”

“ইয়াহ।”

মীরা ঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“কথাটা আমি মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলাম। অবশ্য রাদিবের সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার আগেই আকবর স্যার আমাকে আপনাকে বিয়ে করা ও ফ্রিশার মা হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। আমি তখন দোটানায় ছিলাম। তাই সময় যেভাবে যা চাইছে সেভাবেই চলছিলাম। দেন আমি রিয়েলাইজ করলাম, আপনি অন্তত আমাকে ধোঁকা দিবেন না! সেই সাথে আমি একটা বাচ্চার মা হতে পারব। একটা বাচ্চাকে আগলে রাখতে পারব।”

“এত বিশ্বাস?”

হাসলো মীরা। ফের বলল,
“বিশ্বাস জিনিসটা না মন থেকে আসে।”

শেহজাদও হালকা হাসলো।
________

সময়ের পরিক্রমায় আরও এক সপ্তাহ চলে গেছে। সামনের শুক্রবার বিয়ের ডেইট ধার্য করা হয়েছে। সামনের সপ্তাহের জন্য মীরা ভার্সিটি থেকে তিন দিনের ছুটি নিয়েছে। তাই ওই তিন দিনের ক্লাস গুলো আগেই এক্সট্রা ক্লাস হিসেবে করিয়ে নিচ্ছে। এই সপ্তাহটা তার ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যেই যাবে। স্টুডেন্টদের কুইজও নিতে হবে। মীরার কলিগ কনক ম্যাম বলেন,

“মীরা, বিয়ের আগে এত প্রেশার যে নিচ্ছো, বিয়েতে সিক হয়ে যাবে তো। আমি তো শুনলাম তুমি বৃহস্পতিবার তোমার টিউমারিক ফাংশনের দিনও ক্লাস নিবে!”

মীরা পিসি থেকে নজর হটিয়ে কনক ম্যামের দিকে একবার তাকায়। তারপর হালকা হেসে আবার কাজ করতে থাকে। মীরার আরেক কলিগ সাবিহাও সেখানে উপস্থিত। সাবিহা বলে,
“এই সময় রিল্যাক্স করতে হয়। তাহলে স্কিণে গ্লো আসে। বেশি বেশি ঘুমাতে হয়। আর তুমি কী-না এক্সট্রা প্রেশার নিচ্ছো!”

মীরা এবার পিসির সামনে থেকে চেয়ার ঘুরিয়ে বলে,
“বৃহস্পতিবার তো আমার মাত্র একটা ক্লাস। তাও সেটা সাড়ে বারোটার দিকে। ওটাকে এগিয়ে সকাল সাড়ে আটটায় এনেছি। স্টুডেন্টদের এই দিনে ক্লাস কম থাকে। তাও ওদের কয়েকজনের নাকি পরবর্তী ক্লাস দুইটার দিকে। কতোটা সময় বসে থাকবে। ওরা যে আমার জন্য এতোটা করেছে, তার জন্য আমি গ্রেটফুল। ক্লাস নিয়ে বাড়ি চলে যাব। তারপর গিয়ে শাওয়ার, নামাজ, খাওয়া শেষে ঘুম দিয়ে উঠব।”

সাবিহা অবাক হয়ে শুধায়,
“সাজবে না?”

“না। সন্ধ্যায় জাস্ট শাড়ি ও ফ্লাওয়ার অর্নামেন্ট পড়ে ছাদে চলে যাব।”

“কী বলো? ছবি উঠাবে না? সাজবে না তাতে?”

“না গো। অবশ্য রাই ও জিনিয়া এসে আমাকে না সাজিয়ে ছাড়বে না! কিন্তু পার্লার এসবে যাব না। হেবি মেইকওভার নিব না। ইভেন আমি তো ভেবেছি বিয়ের সাজেও পার্লারে যাব না!”

সাবিহা এবার মুখ বন্ধ করতেই ভুলে গেছে! সে মুখে হাত দিয়ে কনক ম্যামকে বলে,
“ম্যাম, ওর কথা শুনেছেন? কী বলছে এই মেয়ে! আমার বিয়েতে আমি যতসম্ভব বেস্ট মেইকআপ আর্টিস্টের কাছে সেজেছি। তারপরও মনে হচ্ছিলো আরেকটু সুন্দর হলে পারফেক্ট হবে।”

কনক ম্যাম হেসে বলেন,
“মীরা পুরো আমার কিয়ারার মতো। কিয়ারার হেবি মেইকওভার পছন্দই না। ওদের স্কুলের ফাংশনে যখন ডান্স করে তখন ওর ফ্রেন্ডরা একেকজন পার্লার থেকে সেজে আসে। আর কিয়ারা! এতো নরমাল সাজে যে মনে হয় এর থেকে না সাজাও ভালো। ওর মেইকআপের প্রতি এত অনীহা!”

মীরা হেসে বলে,
“আমার কিন্তু অনীহা না, ম্যাম। আমি একটু ফ্রেশ লুক চাচ্ছি। রাই ও জিনিয়াই সেটা ক্রিয়েট করে দিতে পারবে। ফাউন্ডেশনের আস্তর লাগানোর ইচ্ছে নেই। তাছাড়া যেই গরম!”

“তা ঠিক বলেছ। যতোটা সিম্পল থাকা যায়, ততোটা শান্তি লাগবে।”

সাবিহা বলে,
“আমি তোমার ফ্রেশ ব্রাইডাল লুক দেখার জন্য সো এক্সাইটেড। দেখবে আমিই সবার আগে গিয়ে বসে আছি!”

তিনজনের মধ্যে হাসির ফোয়ারা ছুটলো।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৮
ক্লাসের গ্যাপে নিজের অফিস রুমের ডেস্কে বসে কাজ করছিল মীরা। তখন পিয়ন এসে জানায়, কেউ তার সাথে দেখা করতে এসেছে। মীরা আসতে অনুমতি দিয়ে দেয়। সচরাচর এভাবে কেউ আসার অনুমতি চায় না। কে এসেছে তবে? মীরা বেশি একটা ভাবলো না। নিজের কাজে মন দেয়। দুইটা ক্লাসের কুইজের খাতা গুলো দেখে ফেলছিল। হঠাৎ তার কর্ণকুহরে বাচ্চা কণ্ঠ পৌঁছানো মাত্রই তৎক্ষণাৎ মাথা উঁচু করে তাকায়। সামনে মিসেস শাহিদা ও ফ্রিশা দাঁড়ানো। ফ্রিশার পড়নে স্কুল ইউনিফর্ম। ফ্রিশা ছুটে এসে মীরার কাছে দাঁড়ালে, মীরা আগলে নিয়ে অবাক কণ্ঠে শুধায়,

“তুমি স্কুল থেকে এখানে এসেছ, বাচ্চা?”

“ইয়েস, মামনি।”

এবার মিসেস শাহিদা মুচকি হেসে চেয়ার টেনে বসে বলেন,
“তোমার মেয়ের জোড়ালো বায়না, সে আজ তার ফেইরি আন্টি ওরফে মামনির ভার্সিটিতে যাবেই। আর ফ্রিশার জেদ মানে তো!”

মীরাও হাসে। তারপর ফ্রিশার গাল টেনে দিয়ে হাসি মুখে মিসেস শাহিদাকে বলেন,
“ওর জেদই যে আপনার দিনটা মাতিয়ে রাখে তা তো বুঝতেই পারছি।”

মিসেস শাহিদা হেসে অফিস রুমটার চারিপাশে নজর দেয়। রুমে আরও দুটো ডেস্ক আছে কিন্তু এখন এখানে তারা তিনজন বাদে কেউ রুমে নেই। মীরা পিয়নকে ডেকে চা-নাস্তার ব্যবস্থা করতে বলে সাথে ফ্রিশার জন্য ক্যান্টিন থেকে জুস ও বার্গার আনতে পাঠায়। ফ্রিশা আশেপাশে দেখে প্রশ্ন করে,

“মামনি, তোমার রুমে আর কেউ নেই কেনো? বাবার রুমে তো আরেকটা আঙ্কেল আছে।”

“আছে তো। উনারা ক্লাসে আছেন, বাচ্চা। চলে আসবেন।”

ফ্রিশার বিরামহীন প্রশ্ন,
“ফেইরি আন্টি, তোমার রেড ভালো লাগে?”

“রেড? উম.. হ্যাঁ। কেন? তোমার ভালো লাগে না?”

“লাগে কিন্তু অল্প।”

মীরার হালকা হেসে অবাক হওয়ার ভান করে বলে,
“তাই? তা হঠাৎ তোমার রেডের কথা মনে পড়লো কেন?”

“জানো মামনি, কাল তোমার জন্য শাড়ি কিনেছে দাদুমনি। দাদুমনি শুধু রেড শাড়ি দেখছিল। কিন্তু আমার ভালো লাগছিল না। আমি একটা পিঙ্ক শাড়ি দেখালাম। দাদুমনি বলে, তোমার নাকি রেডটাই পছন্দ হবে।”

মীরা মিসেস শাহিদার দিকে তাকায়। মিসেস শাহিদা বলেন,
“ও আসলে এই জন্যই এসেছে। লাল বেনারসি ওর একটাও পছন্দ হচ্ছে না। হেবি ডিজাইন হলে তো আরও আগে না।”

মীরা হেসে বলে,
“তাহলে রেড বাদ। পিঙ্ক তো অনেক সুন্দর। ফ্রিশারটাই ফাইনাল।”

ফ্রিশা খুশিতে ডগমগিয়ে ওঠে। মীরাকে জড়িয়ে ধরে গালে তার আদরের বহিঃপ্রকাশ করে বলে,
“দেখেছ দাদুমনি, ফেইরি আন্টির আমারটাই পছন্দ হয়েছে।”

মিসেস শাহিদা ও মীরা একে-অপরের দিকে চেয়ে হাসে। মিসেস শাহিদা প্রশ্ন করেন,
“ফ্রিশা, তুমি তোমার মামনিকে একবার মামনি বলছ আবার ফেইরি আন্টি বলছ যে?”

“আমার কাছে ফেইরি ডাকটা ভালো লাগে। তাই দুটো মিক্স করে ডাকি।”

“তুমি তো ফেইরি মামনিও ডাকতে পারো?”

“পারব?”

প্রশ্নটা ফ্রিশা মীরাকে করলো। মীরা মাথা হেলিয়ে সায় দিলে ফ্রিশা কিঞ্চিত ভেবে বলে,
“ফেইরি মাম্মাম বলব? ইটস সো কিউট!”

ইতোমধ্যে নাস্তা চলে এসেছে। মীরা হেসে বলে,
“আচ্ছা সেসব বলবেনে। এখন খেয়ে নাও। চলো তোমাকে হাত-মুখ ধুইয়ে আনি।”

মীরা, মিসেস শাহিদা ও ফ্রিশা ওয়াশরুম থেকে হাত-মুখ ধুয়ে আসলো। অতঃপর হাসি-কথাতে নাস্তা খেয়ে নিলো।

_______

এদিকে শেহজাদের কাছে রাদিবের নাম্বার থেকে অনবরত বানোয়াট মেসেজ আসছে। শেহজাদ শুধু দেখছে আর ভাবছে, একটা মানুষ কতোটা নিম্ন শ্রেণীর হলে এতোটা উঠেপড়ে লাগতে পারে। এবার শেহজাদ এসবের এক*শন নিতে সাইবার ক্রা*ই*ম (যদিও জানিনা) সেক্টরে যোগাযোগ করে। রাদিবের ঝামেলা কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে।

এদিকে শেহজাদ আজ বর্ণকে ইউনিভার্সিটিতে দেখেছে। শেহজাদ তাকে দেখে স্বাভাবিক বিহেভ করলেও বর্ণ তা করেনি। কেমন একটা এড়িয়ে গেছে। শেহজাদও সেসব নিয়ে খুব একটা ভাবেনি। তার ফুফিজান তাকে জানিয়েছে, ফ্রিশাকে সাথে নিয়ে তিনি ফ্রিশার জেদে মীরার ভার্সিটি গিয়েছেন। মেয়ের জেদের কারণটাও সে বুঝে গেছে। হালকা হেসে নিজের কাজে মন দেয়। শেহজাদের ক্লাস আর আধঘণ্টা পর। আজকে সে একটা কুইজ নিবে। তার প্রশ্ন করা প্রায় শেষ। শুধু আর দুটো প্রশ্ন বাকি। এমন সময় দরজায় নক হলে সে উঠে গিয়ে লক খুলে। দেখে বর্ণ। বর্ণর চোখ-মুখে ফুটে আছে মলিনতা। শেহজাদ নিজের জায়গায় এসে বসে। বর্ণও চেয়ার টেনে বসে চুপ করে আছে। শেহজাদই প্রথমে প্রশ্ন করে,

“পিএইচডির মাঝে এলে?”

“জি স্যার।”

“কাজ শেষ? তিন বছরের তো স্কলারশিপ থাকে।” (আমার ধারনা থেকে)

“কিছুটা বাকি, স্যার। একটা কাজে এসেছিলাম। সেটা হলো না। তাই আবার চলে যাওয়ার আগে একটু ভার্সিটিতে আসলাম।”

“ওহ আচ্ছা।”

আবার দুজনেই নীরব। বর্ণ ইতস্তত করে খানিক সময় নিয়ে শুধায়,
“স্যার, আপনি নাকি আবার বিয়ে করছেন?”

“হ্যাঁ।”

“মীরা কে?”

শেহজাদ মাথা নুইয়ে হাসে। অতঃপর বলে,
“ইউ নো ইট ওয়েল, বর্ণ!”

বর্ণর সাথে শেহজাদের চোখাচোখি হয়। কেমন নিষ্প্রাণ তার আঁখিযুগল। শেহজাদ আবার বলে,
“তুমি নিজে সব নষ্ট করেছ। এখন মীরার লাইফে কী হলো তা নিয়ে না ভেবে নিজের ফিউচারে ফোকাস করো।”

“জি স্যার। থ্যাংকিউ স্যার।”

বর্ণ উঠে দাঁড়ায়। শেহজাদও উঠে দাঁড়িয়ে শুধায়,
“শুনলাম তোমার এক ছেলে আছে? আমি বলব, যদি সম্ভব হয় ছেলের মাকে ফিরিয়ে আনো। তোমাকে ভালোবাসার মানুষ শতশত আসলেও তোমার ছেলেকে ভালোবাসতে হয়তো কাউকে তুমি নিজের লাইফে নাও পেতে পারো। তোমাদের ডিভোর্স তো হয়নি?”

“না স্যার। হয়নি। সেপারেশনে আছি। আপনার কথাটা আমি ভেবে দেখব। আসি, স্যার।”

শেহজাদ মুচকি হাসে। বর্ণ সালাম দিয়ে চলে যায়। শেহজাদ চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর তাড়াহুড়ো করে নিজের কাজ শেষ করে ক্লাসে চলে যায়।

______

দেখতে দেখতে আজ বৃহস্পতিবার। মীরা সকালে ক্লাস শেষ করে বেরিয়েছে মাত্র। এদিকে রাইমা তাকে কল করেছে যাতে এয়ারপোর্ট থেকে তাকে রিসিভ করে। জীবনে প্রথমবার সে বাংলাদেশে আসছে। মীরা তাকে কতোবার বলেছে আগে আগে আসতে, কিন্তু রাইমার তো স্বভাবেই নেই সেটা। ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে মীরা উবার ডেকে উঠে পড়েছে। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ। ঋতুভেদে গ্রীষ্মকাল যায় যায় হলেও আদোও কি যায়! তীব্র গরমে ও ক্লান্তিতে শরীর নেতিয়ে যায় যায় অবস্থা। মীরা এই সামান্য পথেও বারকয়েক ঘুমে ঢলে পড়েছে! অবশেষে এয়ারপোর্টে পৌঁছে। এয়ারপোর্টে গিয়ে রাইমাকে খুঁজে পেতে খুব একটা সমস্যা হয়নি। রাইমা ও কুঞ্জ একসাথে এসেছে। কুঞ্জ আগে একবার বাংলাদেশে এসেছিল বলে তার কিছুটা ধারনা ছিল।
অতঃপর তিনজনে উবারে বসা। ড্রাইভার সহ তিন জন মনোযোগী শ্রোতার উদ্দেশ্যে চলছে রাইমার বিরামহীন কথার ফুলঝুরি। মীরা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গেছে। ঘাড়ের কাছে কম্ফি কুশন দেওয়া ছিল বলে ঘুম যেন আরও ঝেঁকে এসেছে। কুঞ্জ বলে,

“রাই, মেয়েটা টায়ার্ড। সন্ধ্যা থেকে ওকে এক্টিভ থাকতে হবে। ঘুমাক।”

“উপস সরি। কতোদিন পর সামনাসামনি দেখছিলাম তো। তাই কথাগুলো আর কন্ট্রোল রাখতে পারিনি।”

“বুঝলাম। এখন ভালো মেয়ের মতো বসে বসে কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনো। মীরার ফোনের ম্যাপ বলছে আর বেশি সময় লাগবে না।”

এমনিতে হলে রাইমা ইচ্ছে করে কথা প্যাঁচাতো। কুঞ্জর সাথে কথার ভুল ধরে সে খুব মজা পায়। এরপর যখন কুঞ্জ মাফ চায় তখন অট্টোহাসিতে ফে*টে পড়ে। কিন্তু আজ মীরার ক্লান্ত ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখে আর ইচ্ছে হলো না। নিজেও এক হাতে মীরার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

_______

বাড়ি ফিরে মীরা ফ্রেশ হয়ে, নামাজ পড়ে, খেয়ে ঘুমাতে চলে গেছে। এদিকে মলি জাহানের সাথে রাইমার বেশ সখ্যতা হয়ে গেছে। রাইমা নিজের কথার ঝুড়ি খুলে বসেছে। তাতে শারমিন, নিধি সহ মীরার চাচি, ফুফি, মামি, খালারাও যোগ দিয়েছে। দুপুরের খাবার খেয়ে যেন তাদের আড্ডার আসর বসেছে।
সন্ধ্যার আধঘণ্টা আগে মীরা ঘুম থেকে উঠে দ্রুত আসরের নামাজ পড়ে নিলো। তারপরেই দরজায় অনবরত ঠকঠক আওয়াজে বুঝে গেল কে এসেছে! দরজা খুলে দেখে তার সন্দেহই সত্যি। রাইমা হাতে বড়ো একটা প্লেটে করে কয়েক ধরনের ফ্রুট কে*টে সাজিয়ে নিয়ে এসেছে। আম, কলা, আঙুর, ড্রা*গ*ন, লিচু, তরমুজ, জাম, আপেল ও নাশপাতি। মীরা দরজা খুলতেই প্লেটটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,

“ফিনিশ দিস।”

মীরা অবাক হয়ে প্রশ্ন ছুড়ে,
“মানে!”

“মানে সিম্পল। লক্ষী মেয়ের মতো প্লেটের সব ফ্রুট তোকে খেতে হবে।”

মীরা হা করে রাইমার মুখের দিকে চেয়ে আছে। রাইমা ওর মুখে এক টুকরো আপেল পু*ড়ে দিয়ে মুখটা বন্ধ করে দিলো। অতঃপর বলল,
“ফ্রুটে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট আছে। তোর স্কিনের জন্য বেস্ট। দুই-তিন দিন ধরে যা যাবে! সো ফিনিস দিস। বায়!”

এই বলে রাইমা রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে বাহির থেকে দরজার শিটকিনি সিস্টেম দিয়ে লাগিয়ে দিলো। মীরা অলস ভঙ্গীতে ফলভর্তি প্লেটের দিকে চেয়ে আছে।

চলবে ইনশাআল্লাহ

মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-১৫+১৬

0

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৫
দেখতে দেখতে দুটো দিন পেরিয়ে গেছে। আজ সোমবার। বাহিরে তপ্ত রোদ। সূর্যের ক্ষোভ, রাগ যেন ধরণীতে তাপদাহ সৃষ্টি করছে। কিছুক্ষণ ছাতা বা ছাউনি ছাড়া দাঁড়ালে মনে হবে শ*রীরের চা*ম*ড়া ঝ*ল*সে যাচ্ছে। মীরা সবে মাত্র ভার্সিটিতে এসে পৌঁছেছে। আর আধঘণ্টা পরেই তার ক্লাস। সে ডিপার্টমেন্টের করিডোরে গিয়ে নিজের অফিস রুমের কাছে যেতেই খুব পরিচিত এক চেহারা দেখে যথাস্থানে থেমে যায়। ব্যাক্তিটি যে তার কর্মক্ষেত্র পর্যন্ত পৌঁছে যাবে, এতটাও কল্পনা করেনি। ব্যাক্তিটি এগিয়ে এসে ঠিক তার মুখোমুখি দাঁড়ায়। শুধায়,

“কেমন আছো, মীরু?”

মীরা জবাবের পরিবর্তে প্রশ্ন ছুড়লো,
“আপনি এখানে কেন এসেছেন?”

“তোমার সাথে দেখা করতে, মীরু। তুমি তো আমার নাম্বার বারবার ব্লক করে দিচ্ছ। তারপর তো তোমার নাম্বারে কলও ঢুকছে না।”

মীরা আশেপাশে চোখ বুলালো। দুই-একজন স্টুডেন্ট টিচারদের জন্য অপেক্ষা করছে বা এমনিতে দাঁড়ানো। লোক সমাগম কম হলেও এখানটায় প্রতিটা টিচারদের বিচরণ থাকে। তাই বাহিরে বাকবিতণ্ডা না করে নিজের অফিস রুমের লক খুলে প্রবেশ করলো। সাথে বর্ণও! মীরার অন্য দুই কলিগ এখন রুমে নেই। একজন ক্লাসে আছে। আরেকজনের আজকে ক্লাস আরও পরে তাই আরেকটু পর আসবে। মীরা দরজা লক করে নিজের চেয়ারে বসে বলল,

“দেখুন প্লিজ, এটা আমার কর্মক্ষেত্র। এখানে ঝামেলা করবেন না। আপনার সাথে কথা বাড়াতে আমি ইচ্ছুক না। আপনার নাম্বার বারবার ব্লক করছি কেন? কেন নিজের নাম্বার বন্ধ করে রেখেছি? নিশ্চয়ই আমি চাইছি না, আপনার সাথে কথা বলতে। তারপরও কেন আমার পেছনে পড়ে আছেন?”

“ভালোবাসি বলে!”

‘ভালোবাসি’ শব্দটা যেন মীরার কর্ণে উত্তপ্ত লা*ভার ন্যায় শোনালো। তৎক্ষণাৎ নয়নে বারিধারা ভর করলো। ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
“আপনার ওই পিছলে যাওয়া জবানে এই শব্দটা উচ্চারণও করবেন না। আপনার জবান খনিকেই রং বদলায়। অন্তত কাউকে ভালো তো আপনি বাসতেই পারেন না। শুধু নিজেকে ভালোবাসতে পারেন। আপনার ভালোবাসা হচ্ছে চোখের মায়া!”

মীরার চোখে চোখ মেলাতে পারল না বর্ণ। নত মস্তকে মিনতি করে বলে,
“আমি একটা ভুল করে ফেলেছি। আসলে বুঝতে পারিনি। ওখানে গিয়ে আমি টোটালি একা হয়ে পড়েছিলাম, তারপর মিটুসুকোর সাথে পরিচয়। তারপর….”

“থামুন। আপনার প্রেমকাহিনী শুনতে চেয়েছি আমি? আপনি আপনার লাইফে কী করবেন না করবেন আপনার ব্যাপার। আমাকে আর সেসবে দয়া করে টানবেন না। একবার যখন রাস্তা আলাদা হয়েছে, তো হয়েছেই।”

বর্ণ করুণ দৃষ্টিতে চাইলো কিন্তু মীরা সেটাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। বর্ণ ফের বলল,
“শুনলাম বিয়ে করছ?”
মীরা জবাব দিতে না চাইলেও দিলো। কারণ বর্ণকে বোঝাতে হবে সে অতীতে আটকে নেই।
“হ্যাঁ।”
“শেহজাদ স্যারকে?”

মীরা কপাল কুঁচকে তাকালো। ফের বলল,
“সব তো তবেই জেনেই এসেছেন। তাহলে প্রশ্ন করে নিজের ও আমার সময় নষ্ট করছেন কেন?”

“মীরা, উনি তোমার স্যার হয়।”
“হুম তো?”

“মীরা, উনার একটা বাচ্চাও আছে। পাঁচ বছরের।”

বর্ণ যতটা বিস্ময় নিয়ে কথাটা বলেছে, মীরা ঠিক ততোটাই সরল কণ্ঠে জবাব দিলো।
“হ্যাঁ জানিতো।”

“তুমি তাও বিয়ে করবে?”

“আমি তো বাচ্চাটার জন্যই বিয়ে করছি। সো প্লিজ, এভাবে বাচ্চা আছে বলে ভয় দেখানোর কোনো মানেই হয় না।”

“ওকে ফাইন। তুমি বাচ্চার জন্য বিয়ে করছ তো? তাহলে প্লিজ আমার লাইফে ব্যাক করো। আমার বাচ্চা তো আরও ছোটো। মাত্র ছয় মাস। ওর মা ও-কে ছেড়ে চলে গেছে।”

মীরার মুখশ্রী তৎক্ষণাৎ কঠোরে রূপ নিলো। এতক্ষণ কিছুটা হলেও শান্ত হয়ে বিতৃষ্ণা নিয়ে জবাব দিচ্ছিলো। কিন্তু এবারে! চোখ বন্ধ করে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে এনে বলে,
“আপনার মতো গি*র*গি*টির কাছে ফিরব আমি? স্বপ্নেও না। আমার তো মনে হয়, আপনার স্ত্রীও আপনার ফিদরত বুঝে গেছে। আপনার সুন্দর মুখশ্রী ও যত্নশীল ব্যবহারের আড়ালে লুকানো মানুষটাকে চিনে গেছে। আপনার মনে আছে? আপনি কী কী করতেন? কতোটা পজেসিভ, কেয়ারিং ছিলেন আমার প্রতি! তখন যে কেউ দেখলে বলতো, এমন ভালোবাসা বিরল। আমি তো এতেই আটকে গিয়েছিলাম। যেই বর্ণ আমাকে সামান্যতম স্যাড ফেইসে দেখতে পারতো না, সেই বর্ণ আমাকে দুঃখের সাগরে ধা*ক্কা দিয়ে নিজে সুখে থাকতে চলে গেছিল। ভুলিনি আমি। শিক্ষা হয়েছে। আমি কিন্তু আপনাকে তখনও কোনো অভিযোগ করে কাঠগড়াতে দাঁড়া করাইনি। সবসময় চঞ্চল আমি, শুধু নিরব হয়েছি। ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেনও আপনি, সেটাকে ভেঙেছেনও আপনি। আমি কোথায়? শুধু তাল মিলিয়েছিলাম। সেসময় কোনো মেয়ে আপনার ডেস্পারেট ভালোবাসাতে তাল না মিলিয়ে থাকতে পারতো বলে আমার মনে হয় না। কারণ মেয়েরা তেমন লাইফ পার্টনারই তো চায়। আমার সব শর্ত মেনে নিয়েছিলেন। আমি গতানুগতিক রিলেশন চাইনি, তাও মেনে নিয়েছিলেন। আমি অসুস্থ হলে রাত-বিরেতে হোস্টেলের বাহিরে এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন মনে আছে?
এখন বুঝতে পারছেন? কতোটা গভীর ভাবে আপনি আমায় ভেঙেছেন? যার প্রতিক্রিয়াতে আমি নিরবতা বেছে নিয়েছি।”

“মীরা, অ্যাই অ্যাম সরি। প্লিজ মীরা। একটা সুযোগ দাও। আমি কখোনো তোমাকে কষ্ট দিবো না।”

মীরার মাথার নিউরন গুলো ধপধপ করছে। তার ক্লাসের আর ১০ মিনিট আছে। কলিগের ক্লাসের সময় শেষ। এখনি হয়তো চলে আসবেন। মীরা অনুনয় করে বলল,

“প্লিজ, চলে যান। আমাকে আমার মতো ছেড়ে দিন। খুব খুব ভালো আছি আমি। আজ আপনার প্রস্তাবে রাজি হলে, আমি এটুকুও ভালো থাকব না। যেই আমি চোখ বন্ধ করে আপনাকে ট্রাস্ট করতাম, সেই আমি আপনাকে বিন্দু পরিমানও ট্রাস্ট করতে পারব না। এর কষ্ট বোঝেন? আমি হাত জোড় করে অনুরোধ করছি। আপনার জন্য দোয়া করব যেন সত্যি সত্যি কাউকে মৃত্যু পর্যন্ত আগলে রাখার মতো ভালোবাসতে পারেন এবং তার থেকেও তেমন অপার ভালোবাসা পান। সেই কেউ টা আমি নই, বর্ণ!”

বর্ণ একদৃষ্টিতে মীরার পানে চেয়ে থেকে শান্ত কণ্ঠে বলে,
“একটা রিকুয়েস্ট রাখবে?”
“বলুন।”
“একটা গান গাও না। শুধু একবার। লাস্টবার। আমি চলে যাব। আর আসব না।”
মীরা কয়েক সেকেন্ড নিরুত্তর চেয়ে থেকে একটা গানের কলি ধরলো,
“কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে,
কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে,
তোমারে দেখিতে দেয় না।
মোহ মেঘে তোমারে দেখিতে দেয় না,
মোহ মেঘে তোমারে অন্ধ করে রাখে
তোমারে দেখিতে দেয় না,”

“গাইলাম। এবার প্লিজ… আমার কলিগ চলে আসবে।’

বর্ণ উঠে দাঁড়ালো। মলিন হেসে বলল,
“ভালো থেকো, মীরু। আমার মতো ভাঙতে তোমার জীবনে কেউ না আসুক।”

মীরা মুচকি হাসলো। বর্ণও দরজা খুলে বেরোবে তখনি মীরার কলিগ কনক ম্যাম রুমে প্রবেশ করলেন। অফিস রুমে অপরিচিত পুরুষকে দেখে মীরাকে প্রশ্ন করলেন,

“মীরা, কে উনি?”

মীরা ততক্ষণে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়েছে। কৃতিম হেসে বলে,
“আমার ভার্সিটির সিনিয়র ভাই। আমরা সেম ফ্যাকাল্টির আন্ডারে রিসার্চ করেছি। ভাইয়া, কয়েকদিন আগে জাপান থেকে ছুটিতে এসেছেন। ওখানে পিএইচডি করছেন তো। যখন শুনলেন আমি এখানে জয়েন করেছি, তখন দেখা করতে আসলেন।”

“ওহ আচ্ছা। পিএইচডি করে কি দেশে ফিরবেন?”
(বর্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন)

বর্ণ কৃতিম হেসে প্রত্যুত্তর করে,
“এখনও শিউর না। দেখি জীবন কোথায় নিয়ে যায়।”

“বেস্ট অফ লাক। ভালো থাকবেন।”

বর্ণ এরপর সৌজন্য দেখিয়ে চলে যায়। মীরাও নিজের ক্লাসে যাওয়ার জন্য সব গুছিয়ে নেয়। মাথাব্যাথার দ্রুত কার্যকরের একটা টা*ফ-নিল খেয়ে নিলো। অতঃপর ক্লাসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়।

_________

শেহজাদ নিজের অফিস রুমে বসে পিসিতে কিছু কাজ করছে। হঠাৎ হোয়াটসএপে মেসেজ আসে। মেসেজ টোন বেজে উঠলে হাতের কাজটা শেষ করে চেক করে। অপরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজ। সেখানে কিছু স্ক্রিনশট। কারও কথোপকথনের স্ক্রিনশট। শেহজাদ খুলে দেখলো না। ফোন সাইলেন্ট করে ক্লাসের জন্য চলে গেল।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৬
ক্লাস থেকে ফিরে শেহজাদ, ফোন চেক করে দেখলো ওই একই নাম্বার থেকে কিছু মেসেজও। মেসেজগুলোতে নিজেকে শুভাকাঙ্ক্ষী বলে সম্ভোধিত। খানিক কৌতুহলের বসেই শেহজাদ স্ক্রিনশট গুলো চেক করলো। চেক করে বুঝলো মীরার সাথে কারও কনভার্সেশন। এতে মীরার চরিত্রে দা*গ লাগবে এমন কিছু। শেহজাদ সবগুলো পড়লো। অতঃপর কিঞ্চিত ভেবে সবগুলো ছবি মীরাকে ফরোয়ার্ড করে দিলো। মীরারও তখন ক্লাস ব্রেক। লাঞ্চ বক্স বের করেছে সবে। রুমে তার কলিগ কনক ম্যাম নেই। উনার এখন ক্লাস। আরেক কলিগ সাবিহা ম্যাম আছেন। মীরা, সাবিহা ম্যামের সাথে টুকটাক কথা ও হাসি বিনিময় করে বক্স খুলেছে খাবে তখনি মোবাইলে টুং শব্দ হয়। স্ক্রিণে শেহজাদের মেসেজ ভেসে উঠতে দেখে কিঞ্চিত চিন্তিত হয়। শেহজাদ স্যার তো তাকে মেসেজ করে না। রাতের বেলা শুধু ফ্রিশার সাথে কথা বলার জন্য কল করে। মীরা বক্সটা বন্ধ করে মেসেজটা আগে দেখে। সবগুলো স্ক্রিনশট দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ! কারণ মেসেজ গুলোর ৬০% এডিটেড। এসব রাদিবের সাথে মেসেজিং। মীরা বিহ্বল দৃষ্টিতে মোবাইলের স্ক্রিণের পানে নিরন্তর চেয়ে রইল। সাবিহা ফোনে একটা নিউজ দেখে মীরাকে মৃদু স্বরে ডেকেও সাড়া না পেয়ে উঠে আসে। সাবিহা, মীরার কাঁধে হাত রাখলে মীরা চমকে উঠে। আকস্মিক মীরাকে হকচকিয়ে উঠতে দেখে সাবিহা সন্দিহান হয়ে শুধায়,

“কী হলো? হোয়াই আর ইউ স্কেয়ার্ড?”

মীরা দ্রুত নিজেকে সামলে বলে,
“নাথিং। আমি একটু বাহিরে থেকে আসছি।”

“খাবে না?”

“তুমি খেয়ে নাও। আমার একটা ইম্পরট্যান্ট কল করতে হবে।”

“ওকে।”

মীরা রুম থেকে বেরিয়ে লিফটে উঠলো। অতঃপর ছাদে গেল। সেখানে গিয়ে খানিক ফাঁকা জায়গা দেখে দাঁড়িয়ে শেহজাদকে কল লাগায়। শেহজাদও ফ্রি ছিল। সে রিসিভ করতেই মীরা সালাম দিয়ে বিরামহীন বলতে লাগে,

“দেখুন স্যার, ওসব মেসেজিং, স্ক্রিনশট সব এডিটেড। আমার নরমাল কথা-বার্তাকে এভাবে এডিট করেছে। ইয়েস, অ্যাই এগ্রি, রাদিব নামের লোকটার সাথে আমার পরিচয় ছিল। এমনকি কথাও হতো। লেট নাইট কথাও হতো। সে নিজেই কল করতো, নিজেই নক করতো। আমি বাধ্য হয়ে কথা বলতাম কারণ তার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু সে আমার মেসেজ গুলোকে যেভাবে এডিট করেছে সেসব কিছুই না। আপনি চাইলে নিজে আমার হোয়াটসআপ চেক করতে পারেন।”

শেহজাদ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে হালকা হাসে। মীরার অস্থিরতা সম্পর্কে তার ধারনা আছে। নিজের সম্পর্কে মিথ্যা কিছু জানতে পারলে সে অস্থির হয়। আরও অনেক কিছুতে সে অস্থির হয়। শেহজাদ বলে,

“রিল্যাক্স। আজ দেখা করে সব ক্লিয়ার করা যাবে। হাইপার হওয়ার কিছু নেই।”

মীরা চোখ বন্ধ করে অস্বস্তিকর নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। তারপর আকাশের পানে চেয়ে বলে,
“থ্যাংক ইউ স্যার। কোথায় দেখা করব?”

“ওয়েলকাম। ভার্সিটি শেষে সেদিনকার সেম রেস্টুরেন্টে।”

“ওকে স্যার।”

মীরা কল কেটে ছাদে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রাদিবের মেসেজ গুলো দেখে তাচ্ছিল্য হাসলো। এই রাদিব তার পেছনে আঠার মতো পড়েছে তো পড়েছেই!

________

রেস্টুরেন্টে মুখোমুখি বসে আছে শেহজাদ ও মীরা। খাবার অর্ডার করা হয়েছে। শেহজাদ লক্ষ্য করলো মীরা কেমন উদাসীন। সে জিজ্ঞাসা করে,

“হোয়াট হ্যাপেন্ড, মীরা?”

মীরা পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো। তার সামনে বসে থাকা ব্যাক্তিটিকে নিগূঢ় দৃষ্টিতে অবলোকন করে ভাবতে লাগলো, এই লোকটা তাকে বিশ্বাস করেছে। তার মুখের কথাতেই মেনে নিয়েছে। একটা সম্পর্কে বিশ্বাসটাই মূল ভিত্তি। পরক্ষণেই তার মনে পড়লো, বর্ণও তো তাকে বিশ্বাস করতো! এবং বিশ্বাসটা তো বর্ণ নিজেই ভেঙেছে। এসব মনে পড়তেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মীরা। তারপর বলল,

“আপনি নিজে আমার হোয়াটসআপ চেক করে দেখুন।’

“ইটস নট নিডেড, মীরা। অ্যাই ট্রাস্ট ইউ।”

নিজের অজান্তেই ঈষৎ কেঁপে উঠলো মীরা। শেষ তিনটা শব্দ অতি সাধারণ হলেও এর তীব্রতা বেশ অসাধারণ। মীরা টেবিলে রাখা পানির বোতল থেকে এক ঢোক পানি খেয়ে বলে,

“প্লিজ স্যার। অ্যাই ইনসিস্ট। আপনি চেক করলে আমি শান্তি পাব।”

শেহজাদ ঈষৎ শব্দ করে হাসলো। তারপর বলল,
“মীরা, তোমার মনে আছে? একবার তুমি আমার সাবজেক্টের মিড পরীক্ষাতে নাম্বার কম পেয়েছিলে? আসলে ওটা আমার টিএ এর গোনায় ভুল ছিল। তোমার ৪ নাম্বার বেড়েছিল। তুমি এসে বলাতে আমি চেক না করেই নাম্বার বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু নাম্বার বাড়ানোর পরেও তুমি যাচ্ছিলে না। কারণ, আমি চেক করিনি। অস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলে। বারবার বলছিলে চেক করে দেখতে। আমিও বারবার বলছিলাম, ইটস নট নিডেড। বাট ইউ আর সো স্টাবর্ন। আফটার দ্যাট, অ্যাই চেইকড ইট। আমি কিন্তু জানতাম তুমি অতো কম মার্কস পাবে না। খাতা তো আমিই চেক করেছিলাম।”

মীরা লাজুক হাসলো। শেহজাদ মীরার ফোন নিয়ে রাদিবের সাথে মেসেজ গুলো চেক করলো। পাশাপাশি রাদিবের মেসেজ এডিট করার কারণটা মীরা তাকে বলতে লাগলো। সব শুনে শেহজাদ বুঝলো রাদিব মীরাকে নিচু করতে চায়। সে ফের শুধালো,

“রাদিব বলল, তুমি আজ বর্ণর সাথে দেখা করেছ। বর্ণ দেশে ফিরেছে?”

অবাক হয় মীরা। বর্ণর দেশে আসার কথা রাদিব কীভাবে জানলো? আর আজ দেখা হয়েছে সেটাই বা কীভাবে? মীরা বলল,
“জি স্যার। বর্ণ কিছুদিন আগেই দেশে ফিরেছে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে সে বিভিন্ন নাম্বার থেকে বারবার আমাকে কল করছিল। আমি ব্লক করতে করতে পরে সিমকার্ডটাই খুলে ফেলেছি। আজ তো ভার্সিটিতে চলে এসেছিল। তারপর সবকিছু ভালো ভাবে শেষ করে তাকে বিদায় জানিয়েছি। কিন্তু এগুলো রাদিব কীভাবে জানে?”

“দ্যাটস মাই কোশ্চেন। মেবি বর্ণর হঠাৎ দেশে আসাতেও রাদিবের হাত আছে। ইউ শুড আস্ক হিম।”

“বর্ণকে?”

“ইয়াহ।”

মীরা বর্ণর নাম্বারের ব্লক খুলে কল করলো। প্রথমবার রিং হতেই বর্ণ রিসিভ করে খুশিমনে বলতে শুরু করে,

“মীরা, তুমি কল করেছ? তুমি আমাকে….”

মাঝপথেই থামায় মীরা। ফোন লাউডে দেওয়া। বর্ণর সব কথা শেহজাদও শুনতে পাবে। মীরা প্রশ্ন ছুড়ে,
“আপনি রাদিবকে চিনেন?”

বর্ণ হতাশ হয়। অতঃপর মলিন স্বরে উত্তর করে,
“হুম। ওয়ান উইক এগো, হি নকড মি। অ্যাই ডোন্ট নো, হাউ হি নো মি এন্ড ম্যানেজ মাই ফেসবুক একাউন্ট। হি ইন্ট্রোডিউস হিম এজ মাই ওয়েল উইশার এন্ড হি টোল্ড মি দ্যাট ইউ আর ম্যারিং শেহজাদ স্যার।”

মীরা শেহজাদের দিকে তাকায়। শেহজাদও তাকায়। মীরা বর্ণের উদ্দেশ্যে বলে,
“রাদিবের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু তার কুকীর্তি আমার সামনে চলে আসাতে, আমি বিয়েটা ভেঙে দিয়েছি। তারপর থেকে সে নানাভাবে চেষ্টা করছে আমার ক্ষতি করতে। আমার ফ্যামিলির কাছে এসেও আমার নামে মিথ্যা কথা রটিয়ে গিয়েছিল। স্টে এওয়ে ফর্ম হিম। ইট উইল বি বেটার ফর ইউ। গুড লাক, বর্ণ!”

বর্ণকে কোন প্রত্যুত্তর করার সুযোগ না দিয়ে মীরা কল কেটে দেয়। বর্ণ কিছু বলতে চাচ্ছিলো। কল কেটে যাওয়াতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যালকনির ইজিচেয়ারা শরীর এলিয়ে দেয়।

মীরা শেহজাদকে বলে,
“সব ক্লিয়ার, স্যার। রাদিব আমাকে খারাপ প্রুভ করতে চাইছে।”

“এর ব্যবস্থাও করা হবে। মানহা*নি করতে চেয়েছে সে। রিল্যাক্স। এখন খাবার চলে আসবে। গরম গরম খেয়ে নাউ।”

মীরা স্বস্তির হাসি হাসে, সাথে শেহজাদও।

________

বাড়ি ফিরে মীরা আরেক দফা অবাক হয়। তার ঘরে ফ্রিশা ঘুমিয়ে আছে। মীরা অবাক হয়ে তার বড়ো ভাবিকে ডাকে। মীরার ডাকে ফ্রিশা কিঞ্চিত নড়ে ওঠে। শারমিন এসে বলে,

“আস্তে কথা বলো। ফ্রিশা গাড়িতেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল। তোমার ভাই ও-কে কোলে করে এনে শুইয়ে দিয়েছে।”

ভাবির কথা যেন মীরার মাথার উপর দিয়ে গিয়েছে। সে সন্দিগ্ধ প্রশ্ন ছুড়ে।
“ভাইয়া, ফ্রিশাকে নিয়ে এসেছে মানে?”

এর জবাব দিলো মিসেস শাহিদা রেহমান। তিনি এসে হাসি মুখে বলেন,
“হঠাৎই আমার কাছে ফোন আসলো, আমি যেন ফ্রিশাকে নিয়ে জলদি তোমাদের বাসায় চলে আসি। আমিও তাই করলাম। গাড়িতে আসতে আসতে ফ্রিশা ঘুমিয়ে গেছে।”

মীরা মিসেস শাহিদাকে দেখে ও তার কথা শুনে আরো অবাক হয়। সে সালাম দিয়ে ফের শুধায়,
“আমি বুঝতে পারিনি, আন্টি। কিছু হয়েছে?”

নিধি এসে হাস্যজ্জ্বল কন্ঠে বলে,
“হবে গো ননদিনী। যাও জলদি এই লাল শাড়িখানা পড়ে আসোতো (হাতে তার লাল জামদানী শাড়ি)।”

হঠাৎ কী হচ্ছে মীরা বুঝতে পারছে না। এতো রাতে শাড়িই বা পড়বে কেন? আর ফ্রিশা ও মিসেস শাহিদাই বা কেন এসেছে? মীরার মনে প্রশ্নদের অস্থির পদচারণা। মীরাকে এভাবে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে শারমিন হেসে বলে,

“তোমার এইনগেজমেন্ট হবে আজ।”

চমকে উঠে মীরা! বিস্ময়ে কিয়ৎক্ষণ বাকরুদ্ধ থাকে। ফের হড়বড়িয়ে শুধায়,
“আজ! মানে এটা কখন সিদ্ধান্ত হলো? আমি তো কিছুই জানতাম না। শুক্রবার না বলা হয়েছিল?”

“বলা হয়েছিল কিন্তু তোমার মেয়ের বাবা ঘণ্টা খানেক আগে কল করে বলল যেন আমরা এখানে আসি। সে ও তার ফুফা একসাথে আসবে।”

মিসেস শাহিদার কথাগুলো মীরা মিলাতে পারলো না। ঘণ্টা খানেক আগেই তো ফ্রিশার বাবা মানে শেহজাদ স্যার তাকে উবার ডেকে উঠিয়ে দিলো। বলেছিল, আজ কাজ আছে বলে এগিয়ে দিতে পারছে না! তাহলে এখন? এসব সে কী শুনছে? ধীরে বিছানায় বসলো সে। পাশ ফিরে ঘুমন্ত ফ্রিশাকে দেখলো। তার বিছানায় এক প*রীর বাচ্চা আদুরে ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছে। মীরা পলকহীন বাচ্চাটার দিকে চেয়ে থাকলো। আচমকা তার মস্তিষ্ক তাকে জানান দিলো, মিসেস শাহিদা শেহজাদকে “তোমার মেয়ের বাবা” বলে সম্বোধন করেছে। তৎক্ষণাৎ তার লোমকূপ পর্যন্ত কেঁপে উঠলো। হৃদযন্ত্র তার স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা বেশি পাম্প করছে। দ্রুত নিজেকে সামলাতে উঠে গিয়ে বেড সাইড টেবিলে রাখা পানির বোটল থেকে পানি পান করে।
মীরার এই অস্থির অবস্থা দেখে মিসেস শাহিদা, শারমিন, নিধি মুচকি হাসছে। পেছনে সদ্য আসা মীরার মা মিসেস মলি জাহান নিজ ওড়নার কোনা দিয়ে খুশিমিশ্রিত অশ্রুজল মোছেন।

চলবে ইনশাআল্লাহ,