চন্দ্রা আর দাঁড়াতে পারলো না স্থির হয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।
রুম থেকে বেরোতেই একজনের সাথে খুব জোরে ধাক্কা খেল সে সামনের মানুষটিকে দেখে সে আরো চমকে গেলো। তার সামনে দাড়িয়ে সিরাজ। সিরাজকে দেখে মনে হলো না সে খুব একটা চমকেছে….
চন্দ্রা চমকের পর চমক পেয়ে স্তব্দ হয়ে চেয়ে রইলো সিরাজের দিকে।
সিরাজ পকেটে হাত ঢুকিয়ে বাঁকা হাসি দিয়ে বলল “কি সুইটহার্ট কেমন আছো..?আমি কে বলো তোহ তোমার..?দাড়াও আমিই বলে দিচ্ছি আমি হলাম তোমার ওয়ান অ্যান্ড ওনলি সুইট দেবর।”
চন্দ্রা চমকের পর চমক পেয়ে স্তব্দ হয়ে চেয়ে রইলো সিরাজের দিকে।
সিরাজ চন্দ্রার মাথা থেকে পা অবধি ভালো করে দেখে বলল “আগের থেকে অনেক সুন্দরী হয়েছ দেখছি।রূপ তোহ ঝড়ে ঝড়ে পড়ছে অঙ্গ দিয়ে।”
চন্দ্রার রাগে ঘৃণায় শরীর রিরি করে উঠল।ইতিমধ্যে রাগে চোখ লাল হয়ে উঠেছে তার।যেই মানুষটাকে সে দুচক্ষে সহ্য করতে পারে না। তারই কিনা বড়ো ভাইয়ের বউ সে..?নিজের ভাগ্যের উপর ভীষন রকম রাগ হলো তার। চুপচাপ রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে রইল সিরাজের দিকে।
সিরাজ তা দেখে চন্দ্রকে বলল “ইস এতদিন বাদ আমায় দেখে লজ্জায় চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে দেখছি তোমার।”
চন্দ্রার একটু কাছে এসে মুখটা হালকা কানের কাছে নিয়ে বলল ” তা এতো রূপকি শুধু ভাইয়ার জন্য..?না মনে আমি কিন্তু ভাইয়ার থেকে বেশি তোমার…..”
কথাটা পূরণ হতে দিলো না চন্দ্রা নিজের গায়ের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে গালে একটা কষিয়ে থাপ্পড় মারলো সিরাজের।
সিরাজ গালে হাত দিয়ে মুখ শক্ত করে যখনই চন্দ্রাকে কিছু বলতে যাবে ওমনি পিছন থেকে আওয়াজ এলো…
“আরে দুই ভাবী দেবর মিলে কি গল্প হচ্ছে এখানে..?”
সিরাজ চন্দ্রা দুজনেই চমকে পিছনে তাকালো সিয়ামের হাসি মুখ দেখে তোহ মনে হচ্ছে না সে কিছু শুনেছে বলে। সিরাজ সস্তির নিশ্বাস ছাড়ল নাহ তাকে সচেতন থাকতে হবে আরও নইলে এতো বছরের পরিকল্পনা মাটিতে মিশতে বেশি সময় লাগবে না।কিন্তু সেই বা কি করবে এতদিন বাদ চন্দ্রাকে সামনে থেকে দেখে সে হুশ হারিয়ে ফেলেছিল।কাল থেকে সুযোগে ছিলো চন্দ্রাকে একটু একা পাওয়ার।
সিরাজ খানিক হেসে সিয়ামকে উদ্দেশ্য করে বলল “ও কিছু না ব্রো..ভাবী দেবর মিলে একটু খুনসুটি করছিলাম। আফটার অল একমাত্র ভাবী আমার। তাই না ভাবীইইই।”
এই বলে চন্দ্রার দিকে তাকাতেই চন্দ্রা একপলক সিয়ামের দিকে তাকিয়েই এক ছুটে নীচে চলে গেলো।
সিয়াম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল চন্দ্রার যাওয়ার পানে তার কোনো জানি মনে হচ্ছে কিছু তোহ একটা ঘটেছে তার অজান্তে”
সুরাজ সেই দেখে সিয়ামকে বললো “ভাবী মনে হয় আমার কথায় লজ্জা পেয়েছে, দেখ কেমন দৌড়ে চলে গেলো”
সিয়াম সিরাজের দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় উত্তর দিলো “হম হয়তো”।
________________________________
বিকেল ৫ টা
চন্দ্রা হাতে দু কাপ কফি নিয়ে দোতলায় সিয়ামের ঘরে ঢুকলো।এই ঘরটা চন্দ্রার ভীষন পছন্দ হয়েছে কি সুন্দর চারিদিক খোলামেলা। ব্যালকনিটাও অনেকটা বড়ো আর বেশ নতুনত্ব ধরনের আসবাবপত্র চারিদিকে। চন্দ্রা ঘরটা ঘুরে দেখতে দেখতে মনে পড়লো যার জন্য সে এসেছে ঘরের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে চন্দ্রা ভাবলো আরেহ লোকটা কই গেলো..? এই ঘরে তার কোনো জামাকাপড়ও দেখছি না।
চন্দ্রা রুমের দরজা দিয়ে বেরিয়ে একজন সেরভেন্টকে ডেকে ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো “আচ্ছা এই ঘরের লোকটা কই আপনি জানেন..? মানে আসেপাশে কোথাও দেখেছেন..?”
সার্ভেন্টটা চন্দ্রার দিকে একটা কেমন ভাবে তাকালো তাকানোরই কথা বিয়ের পর কোনো বউ কি তার বরকে এইভাবে খোঁজে..?
সার্ভেন্টটা একটু গম্ভীর গলায় উত্তর দিলো “ওই যে নিচের ডানপাশের ঘরটা দেখছেন। ওইটাই বড়োসাহেবের ঘর।”
চন্দ্রা অবাক হলো তাহলে এই এতো সুন্দর করে গোছানো ঘরটা কার…? সার্ভেন্টকে কিছু জিজ্ঞেস করার উদ্দেশ্যে বলতে গিয়েই দেখলো সেখানে কেউ নেই। চন্দ্রার এই ঘরের সবকিছুই কেমন অদ্ভুত ঠেকছে কি হচ্ছে কিছুই সে বুঝতে পারছে না।আর সুইটি বেগমই বা কই..?চন্দ্রা মাথায় জোর দেওয়ার চেষ্টা করলো নাহ সেই যে তাকে ডেকে লাঞ্চ দিলো তারপর তোহ তাকে কোথাও দেখাই যাচ্ছে না।
চন্দ্রা এসব ভাবতে ভাবতেই নীচে সিয়ামের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল।কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে দরজায় হালকা টোকা দিলো।
ভিতর থেকে সিয়ামের আওয়াজ এলো “দরজা খোলা আছে”
চন্দ্রা দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে দেখলো সিয়াম হুইচেয়ারে বসে একটা বই পড়ছে। চন্দ্রকে দেখে হালকা হেসে বলল “অরেহ আপনি সারাদুপুর কোথায় ছিলেন..?”
চন্দ্রা আমতা আমতা করে বলল “আসলে মনটা একটু খারাপ ছিল তাই ছাদে গিয়ে বসেছিলাম।”
সিয়াম বলল “বেশ করেছেন।মাঝে মধ্যে নিজেকে সময় দেওয়া ভালো।তবে আপনার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে।”
চন্দ্রা বেশ অবাক হলো তার সাথে আবার কি জরুরী কথা..?
সিয়াম এবার চন্দ্রার হাতে দুটি কফি মগ দেখে বলল “উম এটা কি আমার..?”
চন্দ্রা তাড়াহুড়ো করে বলল “ওই মানে আমি এই সময়ে কফি খাই তাই মনে হলো আপনারা জন্যেও নিয়ে আসি।”
সিয়াম হালকা হেসে কফি মগ টা নিয়ে চন্দ্রাকে বলল “বসুন আপনারই তোহ রুম”।
চন্দ্রা এবার কৌতূহল চেপে না রাখতে পেরে সিয়ামকে জিজ্ঞেস করে ফেললো “আচ্ছা ওই উপরের রুমটা কার যেই রুমে কাল রাতে ছিলাম..?”
সিয়াম কফি মগ টা পাশে রেখে দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করলো “ওই রুমটা আমারই।কিন্তু বিগত তিন বছর ধরে আমি আর ওই উপর রুমে থাকি না।কারণ টা নিশ্চই বিস্তারিত বলে দিতে হবে না আপনাকে।”
চন্দ্রা এবার হালকা লজ্জিত হল আসলেই তোহ তার মাথাতেই আসেনি এই পা নিয়ে সিয়ামের উপর নীচ করা অসম্ভব।
চন্দ্রা কথা ঘোরাতে বলল “তা আপনি কিছু জরুরী কথা বলবেন বলছিলেন..?”
সিয়াম এবার সিরিয়াস ভাবে বলল “দেখুন আমি আপনাকে দেখে যা বুঝলাম আপনি হয়তো জানতেন না বিয়ের আগে আমার ব্যাপারে।সেই কোথায় পরে আসি।তবে আপনাকে দেখে আমি যা উপলব্ধি করলাম আপনি যেমন জীবনসঙ্গী চেয়েছেন আমি সেইরকম নই মানে আর চারপাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো। তাই অনেক ভেবে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপনাকে আর এই সম্পর্কে আটকে রাখবো না। আমি যত দ্রুত সম্ভব আমাদের ডিভোর্সের ব্যাবস্থা করছি।তবে এই কাজ গুলো হতে বেশ খানিকটা সময় লাগে তাই সেই কটা মাস আপনাকে আমায় সহ্য করতেই হবে ম্যাডাম”
চন্দ্রা অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো সিয়ামের দিকে হ্যাঁ এটাই তো সে চায় তবে এখন সে খুশি হতে পারছেনা কেনো..?সে তোহ কাল রাতেই ভেবেনিয়েছিল সিয়ামকে সে নিজেই ডিভোর্সের কথা বলবে।তাহলে এই কয়েক ঘন্টায় এমন কি হলো তার মন এমন আনচান করছে।
চন্দ্রার গভীর ভাবনা দেখে সিয়াম আস্তে করে উচ্চারণ করলো “চন্দ্রাবতী”
চন্দ্রা সেই গভীর ভাবনা অবস্থাতেই উত্তর দিল “হুম”
চোখের পলকেই চন্দ্রার ধ্যান ফিরলো বড়ো বড়ো নিশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলো “এক্ষুনি আপনি আমায় কি নামে ডাকলেন…?”
সিয়াম সেই সকালের মতো মনভোলানো হাসি দিয়ে বলল “চন্দ্রাবতী”
চন্দ্রার আবার সকালের মত অনুভূতি হলো সে চোখ শক্ত করে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে বলল “আর এইনমে আপনি আমায় ডাকবেন না ” বলেই উঠে চলে যেতে নিলে
সিয়াম উচ্চস্বরে বলে উঠলো “আচ্ছা তা নাহয় ডাকলাম না। কিন্তু স্বামী – স্ত্রী না হই বন্ধু হয়ে তোহ থাকতেই পারি এইকয়টা মাস তাই না..?”
চন্দ্রা সিয়ামের কথা শুনে দরজার গোড়ায় দাড়িয়ে পড়লো কিছুক্ষণ সময় নিয়ে পিছনে ঘুরে শক্ত গলায় বলল….
সিয়ামের কোনো হেলদোল দেখা গেলো না।সে আগের মতই বসে রইলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাতে ভীষণ জ্বালা অনুভব করলো।এবার বোধহয় তার অবাক হওয়ার পর্যায় শুরু হলো সে মনে মনে বললো “অবাক নোং ২”|
সে দেখলো চন্দ্রা একটা ফাস্ট এইড বক্স থেকে তুলো নিয়ে ওষুধ লাগাচ্ছে তার ক্ষতস্থানে। তার কারনই তার হাতের এই জ্বালাপোড়া।সিয়াম এবার সব ব্যাথা ভুলে হ্যাঁ করে তাকিয়ে রইল চন্দ্রার দিকে।একটু বেশি ব্যাথা পেতেই খেয়ালের দুনিয়া থেকে বেরিয়ে এলো সিয়াম। তার নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এলো “আহঃ”
চন্দ্রা এবার ঘাবড়ে গেলো,উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলো “সরি সরি আমি বুঝতে পারিনি।আপনার কি খুব বেশি লাগছে..?”
সিয়ামের হাতে ব্যাথায় চেয়ে বেশি এখন কোনো জানি সুখ সুখ বেশি লাগছে…সে মুচকি হেসে বললো “যেচে কাঁচের সাথে ধাক্কা খেয়েছি ক্ষত তোহ হওয়ারই ছিল।”
চন্দ্রা প্রতিউত্তরে কিছু বলতে পারলো না আস্তে আস্তে ফু দিয়ে ক্ষত জায়গায় ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল। সে বুঝতেই পারলো না কারোর মুগ্ধতার দৃষ্টি তার উপর পড়ছে। মানুষটা একটু একটু করে তার বেড়াজালে আটকে ফেলছে চন্দ্রকে।
চন্দ্রা খাবার টা সিয়ামকে দিয়ে চলে গেলো নীচে। সে নতুন বউ সারাক্ষণ রুমের ভিতর থাকলে বাড়ির মেহমানরা বিভিন্ন রকম কথা বলবে।
নীচে যেতেই চন্দ্রা দেখতে পেলো সুইটি বেগম অনেকগুলি মহিলার মাঝে বসে হাসিঠাট্টা করছেন। চন্দ্রাকে দেখতে পেয়েই হাত ধরে নীচে নিয়ে এসে সবার মাঝের সোফায় বসিয়ে দিলেন।
এক এক করে সুইটি বেগম সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন চন্দ্রার।পাশের সোফা থেকে এক ভাবী সুইটি বেগমকে উদ্দেশ্য করে বললেন “হ্যাঁরে সুইটি মেয়ের বাড়ি থেকে কি কি দিলো রে…?”
চন্দ্রা এতক্ষণ মুখ নীচু করে বসে থাকলেও এবার মুখ তুলে সুইটি বেগমের দিকে চাইলো ভরসার দৃষ্টিতে। সুইটি বেগমে কি বুঝলেন তিনি সেই ভাবীকে উদ্দেশ্য করে বললেন “না ভাবী আমরা কিছুই নিইনি।ওইটুকু জিনিস নিয়ে আমরা আর কি করবো বলো যেখানে আমাদের কাছে সমুদ্র সমান আছে।”
অন্যসব মেহমানরা এসব নিয়ে হাসিমসকরা শুরু করে দিলেন। কথাটা তাই আর বেশি দূর এগোলো না।
কিন্তু চন্দ্রার ঠিকই গায়ে লাগল কথাটা আচ্ছা সুইটি বেগম তার হয়ে কথা বললেন নাকি তার পরিবারকে অপমান করে..?
এসব ভাবনা বাদ দিয়ে চন্দ্রা সুইটি বেগমকে হালকা কাছে ডেকে কানে কানে বলল “মনি আমি কি এখন এখান থেকে উঠতে পারি..?মাথাটা ভীষণ ধরেছে।”
সুইটি বেগম বললেন “হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চই তুমি যাও জল খাবার খেয়ে নাও।এখন আরও কত মাথা ব্যাথা হবে।”
চন্দ্রা শেষের কথার অর্থ বের করতে পারলো না তাই বললো “আরও কত মাথা ব্যাথা মানে কি মনি..??”
সুইটি বেগম হেসে চন্দ্রার মাথায় হাত দিয়ে বললেন “কিছু না মা যাও তুমি খেয়ে বাইরের বাগান থেকে একটু ঘুরে এসো মন ভালো হয়ে যাবে।
চন্দ্রা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়িয়ে বাগানের দিকে চলে গেলো।
চন্দ্রার এই সুইটি বেগমকে এই বাড়িতে আসা থেকেই কেমন জানো ঠেকছে।তার চরিত্র টা ঠিক কেমন সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না। চন্দ্রা আর বেশি মাথার উপর জোর না দিয়ে বাগানের একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলো। চারপাশ দেখে তার মন ভালো হয়ে গেলো । খুব সুন্দর পরিপাটি ভাবে সাজানো বাগানটা তারপর হরেক রকমের বিদেশি ফুল সযত্নে রাখা।চন্দ্রার ফুলের বিষয়ে অল্পসল্প চর্চার কারণে তার চিনতে অসুবিধে হলো না তবে সে সবকটা চিনতেও পারলো না।
হঠাৎই চন্দ্রার মনে হলো কারোর দৃষ্টি চন্দ্রার উপর পড়ছে।সে এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখলো নাহ একজন মালি ছাড়া আর তহ কেউ নেই বাগানে। সেই মালিও নিজের মনে মাটি ঠিক করছে নতুন চারা লাগবে বোধহয়। চন্দ্রার কেমন যেনো ঠেকলো মনে সে আর বেশিক্ষণ সেখানে না দাড়িয়ে ফিরত এলো বাড়ির ভেতর। এখন তার এক কাপ কড়া কফির খুব দরকার।কিন্তু কাকে বলবে সে এখন বানিয়ে দিতে সে নিজে তহ পারে না বানাতে।এই রান্না জিনিসটা তার কাছে ভীষণ অপছন্দের একটা কাজ।
আশেপাশে সার্ভেন্টকে খুঁজতে লাগলো চন্দ্রা। তখনই এক সার্ভেন্ট এসে বলল “ম্যাম আপনি আমাকে খুঁজছিলেন..?”
চন্দ্রা অবাক হয়ে বললো “হ্যাঁ কিন্তু আপনি কি করে জানলেন..?” সার্জেন্ট আমতা আমতা করে বললো “আমার মনে হলো আপনি নতুন বউ দরকার তহ থাকতেই পারে তাই না..?”
চন্দ্রা ঠোঁট গোল করে বললো “ওও, হ্যাঁ দরকার তহ আছে এক কাপ কড়া কফি আমার রুমে পাঠিয়ে দিন প্লিজ”
সার্ভেন্ট মাথা নেড়ে কিচেনের দিকে চলে গেলো।
চন্দ্রার এই সময় পুরো বাড়িটা ঘুরতে মন চাইলেও তার মনে হলো অসুস্থ মানুষটিকে দেখে আসা উচিৎ তার একবার যদি কিছু দরকার পরে।নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক চন্দ্রা কোথাকার কে কাল রাত অবধি তহ সে মানুষটাকে চিনতও না আর এখনই মানুষটার জন্য খারাপ বোধ হচ্ছে তার। তবে একই কি বলে স্বামী – স্ত্রীর টান..??
মনের সাথে একপ্রকার লড়াই করেই চন্দ্রা সিয়ামের ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকলো। ঢুকেই দেখলো সিয়াম বিছানায় বসে ল্যাপটপে কিছু করছে।তার সামনের কিছুটা চুল কপালে পরে আছে চোখে একটা হোয়াইট ফ্রেমের চশমা।
চন্দ্রার বুকটা যেনো এবার ধড়াস করে উঠলো।আগেও তহ সে কতো হ্যান্ডসাম ছেলে দেখেছে কই এরকম তহ লাগেনি তার। চন্দ্রার এবার মনে হলো নাহ এই পুরুষের মত নিখুঁত গড়ন সে খুব কমই মানুষের দেখেছে।চন্দ্রার মনের নেগেটিভ সাইড এবার বলে উঠলো কিন্তু কি হলো এতো সুন্দর হয়ে সেই তহ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না।নিজের কাজ বেসিক কাজ গুলো করতেও অন্যের সাহায্য লাগে।সে কিকরে চন্দ্রার ভার নেবে..?শেষে কিনা তার পরিবার এরাম একটা ছেলের সাথে তার…
এরই মধ্যে একটা পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে এলো “আরে আপনি ওখানে দাড়িয়ে কেনো ভিতরে আসুন।”
চন্দ্রা কিছুটা এগিয়ে বিছানার থেকে একটু দূরে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো “এখন ঠিক আছেন তহ..?কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তোহ..?”
সিয়াম চন্দ্রার কোথায় হালকা হাসলো।চন্দ্রা এবার লক্ষ করলো সিয়াম যে শুধু সুদর্শন তাই নয়, সে হাসলে বাঁ গালে একটা ছোট্ট সুন্দর টোল পড়ে। চন্দ্রা সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে বাইরের দিকে তাকালো নাহ তার কোনো মায়ায় আটকানো যাবে না।তাকে বেরোতেই হবে এখন থেকে। তার পরিকল্পনা যে অনেক দূরের। চন্দ্রা নিজের মনকে বোঝালো এই লোকটার জন্য সে যাই করছে সবটাই মনুষত্বের খাতিরে সে হৃদয়হীনা নয় তাই।
তারও মনের কোণে যে এক শতাংশ হলেও সুপ্ত অনুভূতি জেগেছে সেই কথা সে মানতে নারাজ।
চন্দ্রার ধ্যান ভাঙলো একটি ডাকে কেউ যেনো পৃথিবীর সবটুকু মাধুর্য্য মিশিয়ে উচ্চারণ করলো “চন্দ্রাবতী”
চন্দ্রার শিরায় শিরায় কাঁপন ধরলো কতো বছর হয়ে হলো এইনামে তাকে ডাকে না কেউ।
চন্দ্রা আর দাঁড়াতে পারলো না স্থির হয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।
রুম থেকে বেরোতেই একজনের সাথে খুব জোরে ধাক্কা খেল সে সামনের মানুষটিকে দেখে সে আরো চমকে গেলো। তার সামনে দাড়িয়ে……
দুজনই দৌড়ে এসে সিয়ামের ঘরে এসে পৌঁছাল। এসে যা দেখলো তাতে দুজনেই হতভম্ব।
সিয়াম নীচে মেঝেতে পরে আছে।তার হাত লেগে পাশে রাখা ফ্লাওয়ার বাস টা টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে আর তার জলেই ভেসে যাচ্ছে গোটা ঘরময়। সিয়ামের হাত ও কিছুটা কেটে রক্ত বেরিয়েছে তার দরুণ অর্ধেক জল লাল হয়ে আছে।
এই বিকট আওয়াজ শুনে দৌড়ে এসেছে পাশের ঘর থেকে সুইটি বেগমের দুই ছেলে মেয়ে সিয়া ও সিরাজ।
সিয়া ভাইয়ের এই অবস্থা দেখে আতকে উঠল দৌড়ে গিয়ে ভাইকে তোলার চেষ্টা করলো।
সুইটি বেগম এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার এগিয়ে গিয়ে সিয়ার হাত টেনে বললো “পাগল হয়ে গিয়েছিস,কত কাঁচ পড়ে দেখছিস..? আয় সরে আয় তাড়াতাড়ি।”
সিয়া মায়ের দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো “মা ভাইয়ার অবস্থা দেখছো তহ এখনও সরে থাকতে বলবে..?”
সুইটি বেগম আশপাশ চোখ ঘুরিয়ে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন “আহ্হা আমি কি এমনি এমনি বারণ করছি নাকি তোকে..? ওর কেটেছে এবার তোরও কাটবে ওই জন্যই তহ বলা।দ্বারা সার্ভেন্ট কে ডেকে পরিষ্কার করিয়ে দি তাহলেই তহ মেটে।”
এবার সিয়াম হালকা উঠে বসে বললো “হ্যাঁ সিয়া মনি ঠিকই বলেছে এর মধ্যে এলে তোরও কেটে যেতে পারে তুই বরং নীচে গিয়ে কাউকে পাঠাবার ব্যাবস্থা কর”
সিয়া করুন চোখে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে নীচে চলে গেলো।এই ভাই টাকে সে একটু বেশিই ভালোবাসে যদিও সে আর সিরাজ সিয়ামের থেকে পাঁচ বছরের ছোট।তাও তার নিজের ভাইয়ের থেকে এই ভাইয়ের প্রতি টান বেশি।আর থাকবে নাই বা কেন..?ছোট থেকেই তার মাকে দেখে এসেছে তার থেকে তার ভাই সিরাজকে সবসময় বেশি প্রায়োরিটি দেওয়া হয়। এমনকি খেতে বসলেও। যদিও তার এখন এসব গা সয়া। কিন্তু এত কষ্টের মধ্যেও তার একটুকরো ভালোবাসার জায়গা ছিলো এই সিয়াম ভাইয়া।ছোট থেকেই তার সব আবদার এই ভাইয়ের কাছে। ভাইয়াও কম নাকি একটিমাত্র বোন বলে তাকে সবসময় রাণীর মতো রাখার চেষ্টা করে। সে জানে তার খালামনির খুব একটা পছন্দের নয় তার এই মেয়ে তাই সিয়ামই সেই ছোট্ট থেকে ওকে আগলে আগলে রাখে।
চন্দ্রার এবার অপরাধবোধ হলো ভীষণ।তার জন্যেই আজ লোকটার এই অবস্থা।কি হতো একটু হেল্প করে দিলে। মানুষটা তহ তারই স্বামী।মন এবার শব্দটা উচ্চারণ করলো “স্বামী”।কত স্বপ্ন ছিলো তার জীবন সঙ্গীকে নিয়ে সব কিনা এক মুহুর্তে ওই ফ্লাওয়ার বাসের মত ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো এক ধাক্কায়।চন্দ্রার ধ্যান ভাঙলো সিয়ার কর্কশ গলায় শব্দে
“কেমন বউ হ্যাঁ তুমি..?নিজের স্বামীর এইটুকু খেয়াল রাখতে পারো না..?তোমার দ্বারা না হলে আমাদের কাউকে ডেকে দিতে তাহলে তো আজ এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো না।”
অন্যসময় হলে চন্দ্রা রেগে দুটো কথা শুনিয়ে দিত কিন্তু এখন পারলো না মনের ভিতর থেকে কেউ যেনো বলছে অপরাধ তোর চন্দ্রা তোর জন্যই এইসব হয়েছে।চন্দ্রা তাই চুপচাপ সব কথা শুনে নিল।
তখনই সার্ভেন্ট সিয়ামকে ওঠাতে গিয়ে বলে উঠল “আপনারা একটু ধরলে ভালো হয়।”
সিয়া এগোতেই সুইটি বেগম তার হাত টেনে ধরে বললেন “তোর যাওয়া লাগবে কেন ওর বউ আছে এখন ও যাক তুই গেলে খারাপ দেখাবে।”
কিন্তু ওই পরিস্থিতিতে সুইটি বেগমের কথাটাই সবার কানে তিক্ত ঠেকলো।
সিয়াম এবার বলে উঠলো “না না করার দরকার লাগবে না।উঠতে পারবো আমি একাই।”
বলে সিয়াম যেই উঠতে গেলো সার্ভেন্টএর হাত ধরে ওমনি এক হাত পিছল খেলো।সিয়াম সামলাতে না পেরে পড়ে ফির যেতে নিলেই একটি হাত ওকে চেপে ধরলো। ব্যাথায় চোখ বন্ধ করে নেওয়া সিয়াম চোখ খুলে দেখলো এ আর কেউ নয় গতকালই তার বিয়ে করে আনা সদ্য বউ।
চন্দ্রা এবার সিয়ামকে উদ্দেশ্য করে বলল “আসুন আমি সাহায্য করছি আপনাকে। ধীরে ধীরে উঠুন।”
সকালের ব্যাবহারের পর এই ব্যাবহার একদমই অপ্রত্যাশিত ছিলো সিয়ামের কাছে।
সিয়ামকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে সার্ভেন্ট জায়গাটা পরিষ্কার করতে লাগলো।
সুইটি বেগম দৌড়ে এলেন বিছানায় সিয়ামের হাত মুখ ধরে বললেন “আহহারে আমার ছেলেটা অনেক লেগেছে না।তুই কাউকে ডাকলি না কেন..?আর বউ তহ তহ ওকেই বললে পারতি”
সিয়াম হালকা হেসে সুইটি বেগমের হাত টা নিজের হতে নিয়ে বললো “আহঃ মনি শুধু শুধু চিন্তা করছো কিছু হয়নি আমার ”
সুইটি বেগমে দুঃখের সাথে বললেন “না হলেই ভালো বাবা।আমি নীচে গিয়ে তোর জন্য জল খাবার পাঠাচ্ছি।খেয়ে নিস কেমন।”
সিয়াম মুচকি হেসে মাথা নাড়ালো।
চন্দ্রার জানি না কেনো এটা শুধুই দেখানো আদিক্ষেতা মনে হলো।তাও গায়ে না মেখে ঘর থেকে সবাই চলে যাওয়ার পর সেও বেরিয়ে গেলো।
সিয়াম দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লো নাহহ মেয়েটা শুধুই তার মনুষ্যতববোধ দেখিয়েছে এর বেশি কিছুই না।
চন্দ্রা ঘরে প্রবেশ করতেই দেখলো সিয়াম বিছানায় আধশোয়া হয়ে বেলকনির খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
চন্দ্রা আসতে করে এসে খাবারের প্লেট টা টেবিলে রেখে সিয়ামের উদ্দেশ্যে বললো “আপনি ফ্রেশ হবেন.? আমি সাহায্য করে দেবো.?
সিয়াম একভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো “নাহ তার দরকার নেই সিয়া একটু আগে এসে করে দিয়ে গেছে।”
চন্দ্রা মাথা নেড়ে বললো “আচ্ছা তবে খেয়ে নিন।মনি আপনার জন্য খাবার পাঠিয়েছেন।”
সিয়ামের কোনো হেলদোল দেখা গেলো না।সে আগের মতই বসে রইলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই হতে ভীষণ জ্বালা অনুভব করলো।এবার বোধহয় তার অবাক হওয়ার পর্যায় শুরু হলো মনে মনে বললো “অবাক নোং ২”|
বাসর ঘরে নিজের স্বামীকে হুইলচেয়ারে আসতে দেখে হতভম্ব চন্দ্রা।তাকে যে বলা হয়েছিল ছেলের কোনো সমস্যা নেই উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে তারউপর বেশ সুদর্শন। তার তখনই বুঝে নেওয়া উচিত ছিল তার মতো একটা মেয়েকে তোহ আর আর চার পাঁচটা স্বাভাবিক বাড়িতে বিয়ে দেবে না।
আচ্ছা স্বাভাবিক বাড়ি বলতে চন্দ্রা কি মনে করছে..? এই প্রশ্নের উত্তর সে মনের কাছে পেলো না।
সামনে থেকে এক পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে এলো “আপনি বোধহয় ক্লান্ত খুব যান ফ্রেশ হয়ে আসুন আগে ”
চন্দ্রার এখন মনের অবস্থা সে নিজেই কল্পনা করতে পারছে না শুধু মনে হচ্ছে তার পরিবার তাকে এরাম ভাবে বানের জলে ভাসিয়ে দিল..? ভিতর থেকে আবার একটি শব্দ উঠে এলো “পরিবার” হাহ তার জীবনে এর এই নামে কোনো জিনিস আছে নাকি..?
মাথা থেকে এসব ঝেড়ে চন্দ্রা ব্যাগ থেকে একটা শাড়ী বের করে চেঞ্জ করতে চলে গেলো।
এই ফাঁকে সিয়াম ও নিজের জামা বদলে ঘরের জামা পড়লো।এখন এসব তার নিজে থেকেই অভ্যাস হয়ে গেছে কাউকে আর দরকার লাগে না নিজের কাজের জন্য।
সিয়াম এবার ঘড়ির দিকে তাকালো একটা বেজে চার।সিয়াম এবার বাথরুম এর দরজার দিকে তাকালো প্রায় একঘন্টার উপর হয়ে গেছে চন্দ্রা এখনও বেরোয়নি।সিয়াম কিছুএকটা ভেবে বার্থরুম সামনে গিয়ে দু একবার ডাক দিল চন্দ্রার নাম ধরে.. নাহ কোনো সাড়াশব্দ নেই। সিয়াম এবার উপায় না পেয়ে যেই দরজা ধাক্কাতে গেলো ওমনি বাথরুমের দরজা খোট করে খুলে গেলো।
সিয়ামের এইসময় মনে হলো মেয়েটা একটু বেশিই সুন্দর। নাহ তার মোটেই উচিত হয়নি এত সুন্দর হওয়া এইজো সিয়াম এবার আটকে পড়লো একজনের মায়ায় এর দায়ভার কে নেবে..?
উত্তর যেনো ভিতর থেকেই এলো “তোরই তহ বউ”
সিয়াম মুচকি হেসে সামনে ছেড়ে দাড়ালো। চন্দ্রা চুপচাপ গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। আপাতত তার ঘুমের ভীষণ প্রয়োজন এক ঘণ্টা ধরে কেঁদে আর জলে ভিজে শরীর গরম করে ফেলেছে সে।
সিয়াম এর এবার একটু খারাপ লাগলো।মেয়েটার কি তাকে পছন্দ হয়নি..? সে কি জানতোনা তার এই পায়ের ব্যাপারে..? কিন্তু তার কাছে যেটুকু খবর আছে মেয়ের বাড়িতে এই সব খবর আগেই দেওয়া হয়েছিল তারা জেনেবুঝেই তাদের মেয়েকে এ ঘরে দিয়েছেন।
সিয়াম বেশি না ভেবে আস্তেধীরে গিয়ে বিছানায় একপাশে শুয়ে পড়লো।যদিও হুইচেয়ার থেকে উঠতে একটু কষ্ট হলো তাও মুখে টু শব্দ করলো না।মেয়েটা যদি জেগে যায় এই ভয়ে। সাধারণত ঘুমনোর সময়টা তার খালামণি তাকে সাহায্য করে বিছানায় যেতে তাই বেশি কষ্ট হয় না তার কিন্তু এখন থেকে তহ…..কথাটা মাথায় আসতেই বিছানায় পাশে শুয়ে থাকা চন্দ্রার দিকে চোখ পড়লো তার। মেয়েটা সম্ভবত ঘুমিয়ে গেছে মুখে মেকআপ নেই ফর্সা হওয়ার দরুন গালে নাক টকটকে লাল হয়ে গেছে।
সিয়াম বোধহয় এবার বুঝতে পড়লো চন্দ্রা বাথরুমে এতক্ষণ কি করছিলো। তার মন এক্কেবারে বিষিয়ে গেলো অপরাধ বোধে।মেয়েটা তাহলে আসলেই জানতো না তার পায়ের কথা নইলে নিজের বাসর রাতে কেউ এরাম আচরণ করে..?
সিয়াম এক পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো।সে তহ চায়নি কোনরকম সম্পর্কে জড়াতে।তার খালামণি আর খালাতো ভাই বোন যাদের সিয়াম নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে তাদের কথা শুনে জোরালো।তার আর আছেই বা কে এই তিন জন ছাড়া।মা – বাবা সেই যে দেশের বাইরে গেলো এর ফিরলোই না দেশে কি হয়েছে এখনও ঠিক মতো জানে না সিয়াম তার খালামণি বলে তাদের নাকি অনেক বড় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল তাই কাউকে আর বাঁচানো যায়নি। তারপর থেকে এই তিন জনই সব তাদের সাথেই বেড়ে ওঠা খালামণিই এখন তার মা আর এই মানুষটার কথা অমান্য করার কথা সিয়াম ভাবতেও পারে না।
_______________________
সকাল ৭ টা
চন্দ্রা চোখ মেলে সামনে একটি সুদর্শন পুরুষকে দেখে ঘাবড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তার খেয়ালে এলো এটি তহ তার স্বামী কিন্তু কাল রাতের কথা মাথায় আসতেই মাথায় আগুন চোরে গেলো।পাশে শুয়ে থাকা লোকটিকে তার সহ্য হচ্ছে না কোনো সে নিজেই জানে না। রাগে গজগজ করতে করতে একটা সুন্দর জামা নিয়ে চলে গেলো শাওয়ার নিতে।
চন্দ্রা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে দেখলো সিয়াম বিছানায় বসে আছে।সে সিয়ামকে পাত্তা না দিয়ে আয়নার সামনে চুল মুছতে লাগলো।
সিয়াম মুগ্ধতার দৃষ্টি চন্দ্রার দিক থেকে সরিয়ে একটু ইতস্তত করে বললো “একটু সাহায্য করবেন প্লিজ আমার হুইচেয়ারটাতে বসতে”
চন্দ্রার এবার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল চিরুনি টা শব্দ করে রেখে পিছন ফিরে সিয়ামের দিকে আঙুল তুলে বললো “একদম ন্যাকামি করবেন না। আপনি যে এইরাম পঙ্গু আগে জানাননি কেন..? বিয়েটা ভেঙ্গে যেত বলে.? হাহ বলির পাঁঠা হিসেবে আপনার আমাকেই পারফেক্ট মনে হলো না..? যেই শিক্ষিতা সুন্দরী মেয়ে দেখেছেন ওমনি ল্যাজ নেড়ে নেড়ে বিয়ে করতে চলে গেলেন। আপনারাও বোধহয় ওই প্রবাদের বিশ্বাসই যে সোনার আংটি বেকা হলেও সেটা সোনা।তাই তোহ খুশিতে লাফিয়ে লাফিয়ে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করতে চলে গেলেন।”
রাগে দুঃখে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলো চন্দ্রা রুমের দরজা দিয়ে। সিয়াম দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো এরাম কিছু একটা আসা করেছিল সে তাই বেশি কিছু মনে হয়নি তবে চন্দ্রার “পঙ্গু” কথাটা ভীষণ গায়ে লেগেছে। লাগবারীই কথা সে তহ পঙ্গু।
সে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে তিন বছর আগের কথা ভেবে যখন সব স্বাভাবিক ছিল তার নামের সাথে এই পঙ্গু ট্যাগ টা যোগ ছিলো না।
এখন তহ সারাজীবনের জন্য এই ট্যাগ টা তাকে সহ্য করতেই হবে এখন থেকেই নয় অভ্যাস শুরু হলো তার।
চন্দ্রা চোখ মুছে নিচে এলো । সিয়ামের খালামণি সব স্টাফদের ইনস্ট্রাকশন দিচ্ছে কেমন করে কি সাজাবে বারবার সবাইকে বলে দিচ্ছে ঘরে নতুন বউয়ের যেনো কোনো অসুবিধা না হয়।
চন্দ্রার সব কিছুই যেনো এখানকার তিক্ত লাগছে।মনে হচ্ছে এই বুঝি দম আটকে এলো।
সিয়ামের খালামণি এবার এগিয়ে এলো চন্দ্রার দিকে। চন্দ্রার মুখটি তুলে বললো এইরকমই একটা ফুটফুটে মেয়ে চেয়েছিলাম আমার ছেলের জন্য কিন্তু কি আর করার সবই কপাল।
চন্দ্রার লাস্ট কটা শব্দ জানো কেমন ঠেকলো কানে তাও ওসব পরোয়া না করে খালামণিকে বললো “আপনি কে হোন ওনার..?আর এ বাড়িতে কজন থাকে..?না মনে এতো বড়ো বাড়ি তাই আর কি…!!
সিয়ামের খালামণি উরফে সুইটি বেগম হেসে যেই কিছু বলতে যাবে ওমনি সিয়ামের ঘর থেকে এক বিকট শব্দ এলো।
চন্দ্রা সুইটি বেগম সহ নিজের সব স্টাফ চমকে উপরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সুইটি বেগম আর অপেক্ষা না করে চন্দ্রা কে বলেলেন বউ চলো তহ দেখি।
দুজনই দৌড়ে এসে সিয়ামের ঘরে এসে পৌঁছাল। এসে যা দেখলো তাতে দুজনেই হতো হতভম্ব।
হসপিটালে বেশকিছুদিন হয়ে গেছে প্রজ্জ্বলিনীর। তার বেবিকে প্রি-ম্যাচিয়্যুর হওয়ার দরুণ আইসিইউতে অবজার্বভেশনে রাখা হয়েছে। হসপিটালে উজান, প্রিয়মা বেগম ছাড়া বাকি সবাই চলে গেছে। তবে দর্শিনী নিয়মিত হসপিটালে আসে বোনকে দেখতে। মাঝে মধ্যে বোনের পছন্দের খাবার রান্না করে নিয়ে আসে। আদিবা নিয়মিত দর্শিনীর সঙ্গে আসে! উদ্দেশ্য একটাই প্রেমিক পুরুষের দেখা পাওয়া। আবিদ আজ তাদেরকে হসপিটালে ড্রপ করে নিজের অফিসে চলে গেছে।
প্রজ্জ্বলিনী এখন সুস্থ আছে! স্বামী সন্তানকে নিয়ে যথেষ্ট ভালো আছে। তার ছোট বেবিকে বেশির ভাগ সময় আইসিইউতে রাখা হয়। শুধু ফিডিং করানোর সময় হলে একজন নার্স এসে তাকে দিয়ে যায়। প্রজ্জ্বলিনী তখন নিজের বেবিকে দীর্ঘ সময়ের জন্য রেখে দিতে পারে। হসপিটালে সর্বদা উজান নয়তো প্রিয়মা বেগম প্রজ্জ্বলিনীর সঙ্গে থাকে। ডক্টর নিহালসহ ইন্টার্ন গুলো এসে মাঝে মধ্যে মা-ছেলের হেলথ চেকআপ করে যায়। যখন নিহাল আসে তাদের সঙ্গে বেশকিছুক্ষণ কথা বলে সময় কাটায়। প্রজ্জ্বলিনী আইসিইউতে থাকাকালীন উজান প্রায় বেহুশ হওয়ার মতো হয়ে গেছিলো। নিহাল উজানের কর্মকাণ্ড বলে বিস্তর হাসাহাসি করে। প্রজ্জ্বলিনীও সব শুনে হেসে ফেলে, আর ভাবে সত্যিই উজানের মতো ছেলে লাখে একটা পাওয়া যায়।
আদিবা এখানে আসার সুবাদে নিহালকে দেখতে পায়। মাঝে মধ্যে নিহালের সঙ্গে কথা হয় তার। পরশুদিন দর্শিনী আদিবাকে খুঁজতে গিয়ে নিহালকে আদিবার সঙ্গে কথা বলতে দেখেছে। নিহাল এবং আদিবা তখন একে অপরকে জড়িয়ে ছিল অনেকটা ক্লোজ ভাবে। ইতিমধ্যে দর্শিনী ধারণা করে ফেলেছে তারা হয়তো লাভ বার্ডস। কিন্তু আদিবাকে সরাসরি জিগ্যেস করেনি দর্শিনী। হঠাৎ জিগ্যেস করলে আদিবা লজ্জা পাবে ভেবেই করেনি! হয়তো পরে আদিবা নিজেই বলবে; এটা ভেবে বিষয়টিকে গোপন করে যায় দর্শিনী। তবে তারা যদি সত্যি লাভ বার্ডস হয়ে থাকে তবে দর্শিনী দুজনকে সাপোর্ট করবে। নিহাল অনেক ভালো মানুষ! আদিবার জন্য একদম পারফেক্ট ম্যাচ হবে।
প্রজ্জ্বলিনী ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বোনকে দেখে খুশি হয়। প্রিয়মা বেগম তখন নাতীকে কোলে নিয়ে ছিলেন। উজান তখন প্রজ্জ্বলিনীকে ধরে ধরে বেডে শুয়ে দেয়। পরবর্তীতে উজান নিজেও পাশের বেডে শুয়ে পড়ে। দর্শিনী বোনের সঙ্গে টুকটাক কথা বলে প্রহরকে কোলে নেয়। উজান প্রজ্জ্বলিনীর ছেলের নাম প্রহর মাহিরাদ চৌধুরী রাখা হয়েছে। উজান রেখেছে নামটা। দর্শিনীর কোলে উঠে প্রহর মিটমিট করে তাকায়। দর্শিনী এখন প্রহরের পরিচিত মুখ বলতে গেলে! কারণ সে এই কয়েকদিন নিয়ম করে দর্শিনীকে দেখেছে। দুজনের মধ্যে ভাব জমেছে বেশ। তাদেরকে দেখে প্রজ্জ্বলিনী মিষ্টি করে হাসে। বেডের উপর দর্শিনীর রান্না করা বিরিয়ানি দেখে প্রজ্জ্বলিনী চামচে করে মুখে দেয়। উজান সবার জন্য ক্যান্টিন থেকে খাবার আনিয়েছিল। প্রজ্জ্বলিনী সেটা খেয়েছে তবুও দর্শিনী রান্না করে আনলে সব ছেড়ে বোনের রান্না খেয়ে দেখে। রান্নাটা সুন্দর ছিল। প্রজ্জ্বলিনী বোনের প্রশংসা করে বলে,
‘বিরিয়ানি সুন্দর ছিল! আবিদ কী চলে গেছে তোকে রেখে?’
‘হ্যাঁ, উনার নাকি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে আজকে! তাই আমাকে আর আদিবাকে রেখে গেলো।’
‘তোর ননদিনী কোথায়? কোচিং এ চলে গেছে?’
‘এসেছে! তার কোচিং আছে। আমারও ভার্সিটি আছে আজকে। এখান থেকে বের হয়ে যাবো।’
‘একা যাওয়ার প্রয়োজন নেই। উজান আছে পৌঁছে দিবে।’
দর্শিনী দেখল পাশের বেডে উজান শুয়ে আছে। আবিদ তাকে রেখে গেছে, উজান তাকে আজ ভার্সিটিতে পৌঁছে দিবে ভেবে। কিন্তু উজানকে দেখে আজ যথেষ্ট ক্লান্ত মনে হচ্ছে। হসপিটালে থাকাকালীন উজান, প্রজ্জ্বলিনী আর বেবির দেখাশোনা করতে গিয়ে রাত জেগে থাকে। এজন্য একটু সুযোগ পেলেই সে ঘুমানোর চেষ্টা করে। দর্শিনীর তাকে দেখে মায়া লাগল। সে প্রজ্জ্বলিনীর উদ্দেশ্যে বলে,
‘থাক ভাইয়ার রেস্ট প্রয়োজন। যখন দেখি সবসময় দৌঁড়ের উপর থাকে। আমরা রিক্সায় চলে যেতে পারবো সমস্যা নেই।’
প্রজ্জ্বলিনী বোনের কথায় সম্মতি দেয়। তখনি কেবিনের দরজা ঠেলে আদিবা ভেতরে আসে। পরপরই দরজায় নক করে নিহাল আর একজন নার্স আসে। নিহালের হাতে রয়েছে মেরুন রঙের ফাইল! সেখানে প্রজ্জ্বলিনীর যাবতীয় রিপোর্ট রয়েছে। নিহাল সব চেক করে নার্সকে বেশ কয়েকটি ঔষধ দিতে বলে। শেষে বেবিকে চেকআপ করে নিহাল বেড়িয়ে যেতে প্রস্তুত হয়। তখন প্রজ্জ্বলিনী নিহালকে উদ্দেশ্যে করে বলে,
‘নিহাল ভাই, তুমি কী এখন ফ্রী আছো?’
‘আপাতত ফ্রী! কেনো কিছু প্রয়োজন?’
প্রজ্জ্বলিনী উজানের দিকে একবার তাকিয়ে বলে,
‘প্রিয়কে ভার্সিটিতে পৌঁছে দিতে পারবে? আর ভার্সিটির পাশেই আদিবার কোচিং! দুজনকে উজানই পৌঁছে দিতো কিন্তু সে ঘুমিয়ে পড়েছে।’
নিহাল স্বহাস্যে বলে উঠে,
‘গ্রাউন্ড ফ্লোরে অপেক্ষা করুক দুজন! আমি এগুলো রেখে আসছি।’
নিহাল কেবিন থেকে বের হয়ে যায়। আদিবা, দর্শিনী দুজনে সবাইকে বাই বলে গ্রাউন্ড ফ্লোরের উদ্দেশ্যে চলে যায়। নিহাল নিজের কেবিনে গিয়ে এপ্রোন খুলে ওয়ালেট নিয়ে বেড়িয়ে আসে। আদিবা, দর্শিনী লিফ্ট থেকে নেমে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নিহালের গাড়ির সামনে অপেক্ষা করতে থাকে। একটুপরে নিহাল আসে। সে গাড়ির লক খুলে আদিবা, দর্শিনীকে গাড়িতে উঠতে বলে। তারা দুজন পেছনে উঠে বসে। নিহাল তখন গাড়ি স্টার্ট দিয়ে মেইন রোডের দিকে যেতে থাকে।
.
আবিদ গুন্ডা ছেলেগুলোকে কিছুদিন আঁটকে রেখেছিল। কিন্তু অজানা শত্রুকে চিহ্নিত করতে পারেনি। ছেলেগুলো মুখ খুলেছে ঠিকই কিন্তু শত্রু লোকটি অনেক চালাক! লোকটি ছেলেদের অগোচরে আদেশ করতো। এখনো ফেস পযর্ন্ত রিভিল করেনি। তাদেরকে নতুন নতুন এজেন্টের মাধ্যমে কাজের আদেশ দেওয়া হতো। তাই সঠিকভাবে তারা চিনেনা। আবিদ বুঝে গেছে শত্রু চেনাজানা কেউ, নাহলে এতো গোপনীয়তা কেনো থাকবে? তাছাড়া আবিদ দর্শিনীকে আড়ালে রাখে। লোকটি বাইরের মানুষ হয়ে দর্শিনী সম্পর্কে কীভাবে সব জানবে?
আবিদ সেই ছেলেদের থেকে যাবতীয় সব তথ্য নিয়ে তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছে। তবে ছেলেগুলো আবিদের হয়ে কাজ করবে বলেছে। আবিদ তাদেরকে আরো বলেছে, যখনি আননোন কেউ তাদের সঙ্গে কন্ট্যাক্ট করতে চাইবে; আবিদকে যেন সরাসরি জানায়। ততদিন ছেলেগুলোর তথ্য অনুসারে আবিদের লোকজন সেই শত্রুর খোঁজ করতে থাকবে। তারা আবিদকে আস্বস্ত করেছে, লোকটি দ্বিতীয়বার কন্ট্যাক্ট করতে চাইলে জানাবে! যেহেতু আবিদ তাদেরকে সাহায্য করেছে। তাছাড়া তাদের ফ্যামেলীকে নিরাপত্তা দিবে বলেছে তাই তারা আবিদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আবিদ সিক্রেট প্লেসের যাবতীয় কাজ শেষ করে শিক্ষা বোর্ডে প্রেস কনফারেন্সের উদ্দেশ্যে চলে যায়।
.
চৌধুরী বাড়িতে,
এই কয়েকমাসে আসফির জীবনে পরিবর্তন হয়েছে। বাড়ির চেয়ে অফিসের দেখাশোনা বেশ ভালোভাবে করে আসফি। ইদানীং চৌধুরী বাড়ির সবাই আসফির এই পরিবর্তনে বেশ অবাক হয়। সবাই আসফির সফলতায় যথেষ্ট খুশি। শাহরিয়ার চৌধুরী চায় আসফি অন্য ভাইয়েদের মতো বিয়ে করে সংসারজীবন শুরু করুক। কিন্তু আসফি কিছুদিন আগে কানাডা যাওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খবরটা শবনম ফুপির মতো সবার কাছে গোপন রেখেছিল আসফি। আপাতত সে ভিসার জন্য অপেক্ষা করছে। কিছুদিন পরেই তার ভিসা রেডি হয়ে যাবে তখন সে কানাডা চলে যাবে দীর্ঘ সময়ের জন্য! এ ব্যপারে কেউ জানেনা। কিন্তু আজ অনুসা বেগম আসফির রুম গোছাতে গিয়ে জেনে গেছেন। আসফি ফোনে কাউকে বলছিল তার কানাডা যাওয়ার ব্যপারে। মাকে রুমে দেখে আসফি বিস্মিত ছিল। সবটা শুনে অনুসা বেগম আসফির জন্য কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করেছেন। আসফি তখন নির্বিকার ছিল! পরে মাকে জড়িয়ে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে সবাইকে জানাতে নিষেধ করে দেয়। অনুসা বেগম শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বলেন,
‘কেনো চলে যাবি, বাবা? আমাদের ছেড়ে তুই থাকতে পারবি আসফি?’
‘মা! আমি সারাজীবনের জন্য যাচ্ছি না। এতো কান্নাকাটি করার কিছু নেই! শুধু চার-পাঁচ বছরের জন্যই।’
‘চার-পাঁচ বছর শুধু হয়?’
আসফি নিশ্চুপ রইল। অনুসা বেগম আবার বললেন,
‘কেনো যাচ্ছিস? তোকে ছাড়া এই বাড়ি ফাঁকা ফাঁকা লাগবে। যাস না আসফি মায়ের কথা রাখবি না তুই?’
‘আমার ক্যারিয়ারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মা। তাছাড়া আমি তাড়াতাড়ি ফিরবো। তুমি কী আমার ভালো চাওনা বলো? লক্ষ্মীটি কাউকে জানিও না এখুনি প্লীজ।’
পুরো কথাটা বলে আসফি নিশ্চুপ রইল। তার এভাবে যাওয়ার আসল কারণটা সে কাউকে বলতে চায়না। কিছু কিছু কারণ থাক না নিজের কাছে লুকানো। কী দরকার কাউকে জানানোর! সে মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বেড়িয়ে যেতে চাইল। তাকে আরো দ্রুত কানাডার ভিসা পেতে হবে। সে যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দেশে থাকবে না। তাকে আরো দ্রুত চলে যেতে হবে। পরিবারের মায়ায় সে আঁটকে থাকতে চায় না। তার প্রাণখুলে নিঃশ্বাস নেওয়া অতীব জুরুরি। এখানে, এই বাড়িতে থেকে যেটা সম্ভব হচ্ছে না।
#চলবে
[ গল্প শেষের পথে! তিন-চারটা পর্ব হবে সম্ভবত। এজন্য একটু সময় নিয়ে শেষ করতে চাইছিলাম। সবাই ভুলত্রু’টি মানিয়ে নিবেন প্লীজ ]
#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪১
মীরার বাবা-মা, ভাই-ভাবি সবাই হসপিটালে এসে পৌঁছেছে। মীরার দুই ভাবি মিলে মীরার মাকে সামলে রাখছে। অপারেশন থিয়েটারের বাহিরের মহল বেশ ভারী। সেটাকে আরও ভারী করতে শেহজাদের ফোনে কল আসে। শেহজাদ একটু দূরে গিয়ে কল রিসিভ করতেই মিসেস শাহিদা হড়বড়িয়ে বলে ফেলেন,
“শেহজাদ, ফ্রিশাকে পাওয়া যাচ্ছে না। তোমার গাড়ি থেকেই কেউ ফ্রিশাকে কি*ডন্যা*প করে নিয়ে গেছে।”
কথাগুলো শেহজাদের কানে যেন অবিশ্বাস্য ঠেকলো। সে অস্থির হয়ে উত্তেজিত স্বরে বলে,
“হোয়াট! ফ্রিশাকে পাওয়া যাচ্ছে না মানে কী? আমি গাড়ির চাবি কনক ম্যামকে দিয়ে এসেছিলাম। সেখান থেকে মিসিং কীভাবে হয়?”
মিসেস শাহিদার পাশে দাঁড়িয়ে কনক ম্যাম কথাগুলো লাউড স্পিকারে শুনছিলেন। তিনি জবাবে বলেন,
“মিস্টার শেহজাদ, আই অ্যাম এক্সট্রেমলি সরি। আমি গাড়ির কাছে গিয়ে দেখি গাড়ির ডোর খোলা ও ফ্রিশা সেখানে নেই। তারপর দারোয়ান ও পুলি*শ আশেপাশে অনেক খুঁজেছে কিন্তু পায়নি। এখনও খোঁজ জারি আছে। সিসিটিভিতে দেখা গেছে একটা মুখোশধারী লোক এসে ফ্রিশাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে গেছে।”
শেহজাদ কথাগুলো শুনে আন্দাজ করে ফেলেছে, এই কাজ কার হতে পারে। সে রাগে ফোন মাটিতে ছুঁড়ে ফেলতে নিয়েও থেমে গেলো। ফোনে জলদি করে ফ্রিশার লোকেশন চেক করতে শুরু করে। বলা বাহুল্য যে, শেহজাদ ফ্রিশার হাতঘড়ি ও মীরার হাতঘড়িতে ট্র্যাকিং মাইক্রোচিপ ইনস্টল করে রেখেছিল। যবে থেকে মুরাদকে দেখেছে তবে থেকে সে সাবধানতা অবলম্বন করে রেখেছিল। শেহজাদ লোকেশন দেখলো ফ্রিশার লোকেশন গাজিপুরের দিকে যাচ্ছে। শেহজাদ দ্রুত হসপিটাল থেকে বেরোতে নিলে মীরার বড়ো ভাই রুবেল এসে বলে,
“আমিও যাচ্ছি তোমার সাথে।”
“আপনি এখানে থাকুন। দরকার পড়তে পারে।”
শেহজাদ দ্রুত কথাটা বলে বেরিয়ে পড়ে। রবেলও সাথে সাথে বেরোয়। তারপর বলে,
“মারুফ আছে। তোমার সাথে এখন আমার যাওয়াটা জরুরী আমি মনে করি। চলো।”
শেহজাদও আর কথা বাড়ায় না। একটা সিএনজিতে উঠে পড়ে। পু*লিশের কাছে লোকেশনটাও পাঠিয়ে দেয়। পু*লিশ সেটাকে গাজিপুর থা*নাতে ইনফর্ম করে দেয়।
_____
এদিকে মুরাদ ও রাদিব ফ্রিশাকে নিজেদের ডেরায় নিয়ে পৌঁছায়। ফ্রিশাকে একটা চেয়ারের সাথে বে*ধে রেখে সন্ধ্যার চা-নাশতা সাড়ছে, এমন সময় পু*লিশ ভ্যানের হুইসেলের শব্দে টনক নড়ে তাদের। রাদিব ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে শুধায়,
“মামা, পু*লিশ এখানে আসছে নাকি?”
মুরাদও শব্দটা খেয়াল করে চিন্তিত সুরে বলে,
“আমরা তো এখানে এসেছি দুইদিন হলো। তারমধ্যে আজকে ছাড়া এমন কিছুতো করিনি। মনে হয়, আশেপাশের কোথাও কিছু হয়েছে।”
“আমার কিন্তু ভয় লাগছে, মামা। এই পু*লিশের থেকে বাঁচতে চো*রাই পথে ইন্ডিয়া চলে গিয়েছিলাম।”
“তুই বেশি বুঝিস। বাচ্চাটাও তো তেমন কোনো শব্দ করেনি। অজ্ঞান হয়ে আছে। তাহলে আশেপাশের মানুষজনেরও আলাপ পাওয়ার কথা না। পু*লিশ অন্য কোথাও এসেছে হয়তো।”
এই বলে মুরাদ নিশ্চিন্তে খাচ্ছে। মুরাদরা যেখানে সাময়িক নিজেদের আস্তানা গেড়েছে তা একটা নির্মাণাধীন ভবন। ভবন মালিককে মোটা অঙ্ক বুঝিয়ে ৩-৪ দিনের জন্য মাঝের দিকের একটা রুম ভাড়া নিয়েছে। এদিকে পু*লি*শ নিজেদের গাড়ি কিছুটা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে থামায় যাতে ওরা বুঝতে না পারে। লোকেশন এই নির্মাণাধীন ভবনেই দেখাচ্ছে। শেহজাদরাও গাজিপুর শহরে ঢুকছে কেবল। কিছুটা সময় লাগবে। পু*লিশ সদস্যরা সাবধানতা অবলম্বন করে রেলিং ছাড়া সিঁড়ি দিয়ে তিন তালায় উঠে সেই রুমটার দরজায় জোড়ে জোড়ে বা*ড়ি দিতে থাকে।
দরজায় হঠাৎ তীব্র জোড়ালো শব্দে আঁতকে উঠে মুরাদ ও রাদিব। রাদিবের মুখ থেকে চা ছিটকে পড়ে তার মামার গায়ে! মুরাদের সেদিকে তোয়াক্কা নেই। সে ভীত হয়ে পড়েছে। রাদিব ভয়ার্ত স্বরে হড়বড়িয়ে বলতে থাকে,
“পু..লি..শ! মামা, পু..লিশ এসেছে? এ..খন কী হবে? খবর পেল কীভাবে? মামা, তুমি চুপ করে আছো কেন? কিছু করো। পু*লিশ তো আমাদের ধরে ফেলবে!”
মুরাদ ঢোক গিলে ফিসফিস করে বলে,
“চুপ করে থাক। কোনো কথা বলবি না। পু*লিশ কী-না বুঝব কী করে? সন্দেহের বশত এসেছে নাকি!”
“আমি জানিনা, মামা। কেন যে তুমি এই পুচকেটাকে তুলে আনলে! উফ! এখন কী হবে?”
“চল কোথাও লুকিয়ে পড়ি! একটা জানালাও নেই যে পালাব! বাথরুমটাতে চল।”
ওদের কথোপকথনের মধ্যেই পু*লিশ সদস্যরা দরজা ভে*ঙে ফেলেছে। ভেতরে এসে মুরাদ ও রাদিবকে আটকও করে ফেলেছে। মুরাদ ও রাদিব পুরো হতভম্ব হয়ে গেছে। পু*লিশরা ফ্রিশাকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে।
শেহজাদ ও রুবেল থানায় পৌঁছে দেখে ফ্রিশা মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। শেহজাদ দৌঁড়ে গিয়ে ফ্রিশাকে কোলে তুলে নিলে ফ্রিশা অভিমানী স্বরে বলে,
“তুমি কোথায় গিয়েছিলে, বাবা? আই ওয়াজ ওয়েটিং।”
শেহজাদের আঁখিযুগলে জল ভিড় করছে। সে ধরা গলায় বলে,
“সরি, মাম্মাম। এক্সট্রেমলি সরি। তোমাকে রেখে যাওয়া ঠিক হয়নি আমার।”
“ওকে। সরি গ্রেন্টেড। ফেইরিমাম্মাম কোথায়? আমরা যাব না?”
শেহজাদ এবার জবাব দেওয়ার শব্দ পাচ্ছে না। ফ্রিশা উৎসুক ভাবে চেয়ে আছে। কীভাবে বলবে যে তার ফেইরিমাম্মামের অবস্থা ভালো না। শেহজাদের নিরবতায় ফ্রিশা আবারও প্রশ্ন করলে রুবেল এগিয়ে এসে ফ্রিশাকে বলে,
“এই দেখো, মামা এসেছি। তোমাকে তোমার ফেইরিমাম্মামের কাছে নিয়ে যাব।”
“চলো তবে। এখানে কেন আছি আমরা? পু*লিশ আঙ্কেলটা বলল বাবা আসলে যাব। চলো লেটস গো।”
রুবেল জোরপূর্বক হেসে ফ্রিশাকে নিজের কোলে নেয়। শেহজাদ এবার ইন্সপেক্টরের সাথে দেখা করে রাদিব ও মুরাদের সেলের কাছে যায়। রাদিব ও মুরাদকে দেখে শেহজাদ ঘৃণামিশ্রিত স্বরে বলে,
“তোদের লজ্জা হয় না। না? আবারও আমার ফ্যামিলির পেছনে পড়েছিস? মীরার মা-থায় আ*ঘা*ত তোরাই করেছিস তাই না?”
রাদিব মাথা নিচু করে বসে থাকলেও মুরাদ উঠে এসে বলে,
“হ্যাঁ। তোর বউ-বাচ্চা দুটোকেই তোর থেকে সরাতে চেয়েছি। মনে আছে আমাকে?”
শেহজাদ তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে,
“তোকে মনে থাকবে না? তোর মতো বা*স্টা*র্ড, পা*ভা*-র্টকে ভুলি কী করে? তুই তো টিচার জাতিকে ক*লঙ্কিত করেছিলি। অতো বছর আগেই যদি তোকে নিজ হাতে শেষ করতে পারতাম, তবে আজ এসব হতো না। এবার দেখবি তোর কী হয়। এটেম্প টু মা*র্ডা*র এন্ড কি-ডন্যা*পিং কে*সে রেস্ট অফ দ্যা লাইফ পু*লি*শ কাস্টাডিতে থাকবি। আমি এটা মাস্ট এনশিউর করব।”
মুরাদ বিশ্রি হেসে বলে,
“পারবি না। আবারও পালাব।”
এটা বলতেই পু*লি*শ ইন্সপেক্টর মু*রা*দের গালে কষে চ*ড় বসিয়ে দেয়। তারপর শেহজাদকে নিয়ে সে*ল থেকে বেরিয়ে আসে। যেহেতু পু*লি*শের সামনেই স্বিকারোক্তি দিয়ে ফেলেছে তাই আগামীকালই ওদের কোর্টে তোলা হবে।
শেহজাদ ও রুবেল, ই*ন্সপে*ক্টরকে ধন্যবাদ দিয়ে রওনা করে। ইতোমধ্যে মীরার অপারেশন শেষ হয়েছে।সাকসেসফুলও হয়েছে। এখনও জ্ঞান ফেরেনি। ডাক্তার বলেছে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফিরে আসবে। কিছু প্রবলেম হতে পারে, সেটা ট্রিটমেন্ট করলে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। অটির বাহিরে অপেক্ষারত সবার মধ্যে কিছুটা স্বস্তির হাওয়া বয়। শেহজাদও ফোন করে ফ্রিশাকে পেয়েছে জানিয়ে দিয়েছে।
________
হসপিটালে পৌঁছে ফ্রিশা মীরাকে এভাবে দেখে খুব কেঁদেছে। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গিয়েছিল। মীরারও তখন জ্ঞান ফিরেছে। ডাক্তার তাকে মাথায় চাপ নিতে মানা করেছে তাই ফ্রিশাকে শেহজাদ সরিয়ে নিয়ে এসেছে। মিসেস শাহিদা ফ্রিশাকে দেখে রাখছেন। মীরার মা মলি জাহান মেয়ের কাছে বসে আছেন। আজ তার মেয়েটার জন্মদিন! আর আজই সে মৃ*ত্যুর কাছাকাছি থেকে গিয়ে এসেছে। মীরা অক্সিজেন মাস্ক খোলার চেষ্টা করলে মলি জাহান বাধা দেন। বলেন,
“তোর কথা বলতে হবে না। চুপ করে থাক। ডাক্তার তোকে চাপ নিতে ও কথা বলতে মানা করেছেন।”
মীরা হাত সামান্য উঠিয়ে মায়ের চোখের পানি মুছিয়ে দিতে চাইলো। মলি জাহান এবার আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলেন না। ঝরঝর করে মেয়ের সামনেই কেঁদে ফেললেন। শারমিন ও নিধি কেবিনের বাহির থেকে দেখে এসে শাশুড়িকে শান্ত করতে করতে বাহিরে নিয়ে আসে। মলি জাহান বেরিয়ে আসলে শেহজাদ একা কেবিনে প্রবেশ করে। মীরা তা দেখে আবারও কথা বলতে মাস্ক খুলতে চাইলে শেহজাদ থামিয়ে দিয়ে বলে,
“কথা বলো না। ফ্রিশা এখন ঠিক আছে। তুমিও জলদি ঠিক হয়ে যাও। তারপর আমরা এখান থেকে চলে যাব।”
মীরা কিছুটা অবাক হয়। হাতের ইশারায় কৌতুহল প্রকাশ করলে শেহজাদ মৃদু স্বরে বলে,
“তোমার সব ডকুমেন্ট চেয়েছিলাম মনে আছে?”
মীরা চোখের পলক ফেলে হ্যাঁ বুঝালে শেহজাদ বলে,
“আমি আমেরিকায় তোমার পিএইচডি করার জন্য এপ্লাই করে দিয়েছি। আমিও আমেরিকায় আগে যেখানে ফ্যাকাল্টি ছিলাম, সেখানে জয়েন করব। ফুফাও এতোদিন অনেক রিসার্চ বেইসড ইউনিভার্সিটিতে অফার পেয়েছিল, একটা একসেপ্ট করে নিয়েছে। আমরা সবাই আমেরিকায় চলে যাব।”
মীরা অবাক হয়ে চেয়ে আছে। এতোকিছুর জন্যই তবে এতোদিন এতো লুকোচুরি! শেহজাদ দেখছে মীরা কিছুটা উত্তেজিত হচ্ছে। সাথে সাথে শেহজাদ বলে,
“প্লিজ প্লিজ উত্তেজিত হয়ো না। তুমি সুস্থ হও। সব বলব তোমাকে। কিছু লুকাব না। আই অ্যাম সো সরি। এখন শান্ত হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করো। প্লিজ প্লিজ।”
মীরা শান্ত হলো। আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ করলো। নার্স এসে একটা ঘুমের ইন*জে*কশন দিয়ে গেলো।
________
পরদিন কোর্টে মুরাদ ও রাদিবের যাবজ্জীবন কারাদ*ণ্ড হয়েছে। ওদের আগেও পু*লিশ রেকর্ড থাকলেও যাবজ্জীবন কারাদ*ণ্ডের রেকর্ড ছিলো না বলে মৃ*ত্যুদ*ণ্ড দেওয়া হয়নি। শেহজাদ কোর্ট থোকে সরাসরি হসপিটালে এসেছে। মীরার কলিগরা ও মীরার ভার্সিটির টিচাররা মীরাকে দেখতে এসেছে। মীরার অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। ডাক্তার বলেছে চার-পাঁচ দিন হসপিটালে থাকতে হবে। তারপর ডিসচার্জ দিবে। ফ্রিশাও হসপিটাল ছেড়ে যেতে চাইছে না। মিসেস শাহিদা জোর করেও নিতে পারছেন না। কনক ম্যাম ও সাবিহা ম্যাম শেহজাদের সাথে কথা বলতে আসে।
“আই অ্যাম সরি, মিস্টার শেহজাদ।”
“আপনি সরি কেন বলছেন, ম্যাম। ইটস নট ইউর ফল্ট। অল ফল্ট ইজ মাইন। আই ওয়াজ ইরেসপন্সিবল। আমার আইডিয়াতে ছিল কোনো খারাপ ঘটনা ঘটতে পারে বাট….”
“আপনারও দোষ না, মিস্টার শেহজাদ। ইটস অল ডেসটিনি। এখন মীরা জলদি সুস্থ হয়ে যাক, এটাই দোয়া করি।”
শেহজাদ সৌজন্য হাসে। কনক ম্যাম ও সাবিহা ম্যামও বিদায় বলে চলে আসে।
_________
পাঁচ বছর পর,,
মীরা ভার্সিটি থেকে ফিরতেই সবাই একসাথে বলে ওঠে,
“সারপ্রাইজ!”
মীরা অবাক হয়ে চেয়ে দেখে, তার বাবা-মা, দুই ভাই-ভাবি, ভাতিজা-ভাতিজি সবাই এসেছে। মীরার চোখে খুশিতে পানি চলে এসেছে। মীরা ছুটে গিয়ে তার বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে শুরু করে,
“তোমরা? অ্যাম আই ড্রিমিং? রিয়েলি তোমরা এসেছ?”
পেছন থেকে শেহজাদের কোলের দুই বছরের ছেলে বাচ্চা বলে,
“ইউ আল(আর) নত(নট) ড্রিমিং, মাম্মা!”
মীরা আবেগে হাঁটু গেড়ে বসে দুই ছেলে-মেয়ের কপালে চু*মু দিয়ে জড়িয়ে ধরে। তারপর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কেক কাটা হয়। তারপর মীরা ফ্রেশ হয়ে এসে একসাথে ডিনার করে।
________
অনেকদিন পর নিজের বাবা-মা, ভাই-ভাবিদের পেয়ে মীরা অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করেছে। রুমে এসে দেখে শেহজাদ, মিশকাতকে ঘুম পাড়িয়ে ফেলেছে। এখন শেহজাদ টেরেসে দাঁড়িয়ে আছে বাহিরের দিকে মুখ করে। মীরা গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“কী হয়েছে?”
শেহজাদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“পাঁচ বছর আগে আজকের দিনটা আমি ভুলতে পারিনা।”
মীরা এবার শেহজাদকে ছেড়ে দিয়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
“প্রতি বছর এভাবে মুখ কালো করে থাকলে হয়? ভুলে যান সব। আমরা ভালো আছি। হ্যাপি আছি। দেখুন। আমাদের পুরো পরিবার আমাদের সাথে। আমি ঠিক করেছি ওদেরকে একেবারে আমেরিকায় নিয়ে আসবো।”
“আমিও তাই চাই।”
“জানি জানি।”
“একটা কথা বলি?”
“বলুন। পারমিশন নিচ্ছেন কেন?”
“আই লাভ ইউ! আমি তোমাকে ভালোবাসি, মীরা!”
মীরা হালকা হেসে আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে চোখে চোখ রেখে বলে,
“কেউ একজন বলেছিল, মুখে না বললেও কাজেকর্মে বুঝে নিতে হয় ভালোবাসা। আমিও বুঝে নিয়েছি।”
শেহজাদও হালকা হেসে মীরা ললাটে ঠোঁ*ট ছোঁয়ায়। মীরা আবার শেহজাদকে জড়িয়ে ধরলে ঘর থেকে মিশকাতের কান্নার সুর ভেসে আসে। মীরা ফিক করে হেসে ফেলে বলে,
“ছেলে আপনার রোমান্টিকতার দু*শ*মন বুঝলেন! যাই আমি।”
মীরা ঘরে চলে আসে। শেহজাদ সেখানেই দাঁড়িয়ে বুকে হাত গুঁজে বলে,
“এটাই তো ভালোবাসা। মুখে প্রকাশ না করলেও যা মন মোহনায় ঠিকি ফাগুন হাওয়া রূপে বয়ে বেড়ায়!”
#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪০
আরও সপ্তাহ খানেক পেরিয়েছে। বাহ্যিক ভাবে সব স্বাভাবিক চললেও স্বাভাবিক নেই মীরা ও শেহজাদের মাঝে। শেহজাদ কেমন গুমোট হয়ে থাকে। তারউপর প্রচুর ব্যস্ততা দেখায়। মীরার সাথে যেন স্বস্তিতে পাঁচ মিনিট বসে কথা বলার সময়টাও হয় না। শেহজাদের এই হঠাৎ পরিবর্তন মীরার কাছে কেমন দুর্বিষহকর ঠেকছে। সারাদিন পর একটু হাসি বিনিময় করে কিছুক্ষণ কথা বলাটাও যেন এখন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সপ্তাহ জুড়ে এই প্রতিচ্ছবি দেখে মীরা সিদ্ধান্ত নিলো, সে আজ ফ্রিশার সাথে ঘুমাবে। তাহলে নিশ্চয়ই শেহজাদ আসবে! এসে তাকে নিয়ে যাবে। যা ভাবা তা করলোও সে। ফ্রিশাকে ঘুম পাড়িয়ে বারবার ঘড়িতে সময় দেখছে। ঘড়ির কাটা ঘুরতে ঘুরতে সাড়ে এগারোটা ছুঁই ছুঁই। কিন্তু শেহজাদের কোনো পাত্তা নেই! অস্থির হয়ে উঠে মীরা। একবার ভাবলোও যে গিয়ে দেখে আসবে কিন্তু পরক্ষণেই মন বদল করে ফেলে। নিজের অভিমান ধরে রেখে আর না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সকালে দেখা যাবে শেহজাদের প্রতিক্রিয়া কী হয়। অতঃপর রাগ করে জোর করে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।
এদিকে শেহজাদ নিজের পরিচিত গো*য়েন্দা বিভাগের লোকজনদের সাথে যোগাযোগ করে অনেক তথ্যই জানতে পেরেছে। মুরাদের পারিবারিক ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে বেরিয়ে আসে, রাদিব! রাদিব মুরাদেরই চাচাতো বোনের ছেলে! রাদিব বিগত ৭ মাস যাবত পলা*তক। রাদিবের স্ত্রীর একটি পুত্র সন্তান হয়েছে। রাদিবের পরিবারের সাথে রাদিবের যোগাযোগ নেই। শেহজাদ কিছু একটা আন্দাজ করে নিয়েছে এই মামা-ভাগ্নের উদ্দেশ্য। এর জন্য সেও তৈরি। অতঃপর ঘড়িতে সময় দেখে। ঘড়ির কাঁটা দেড়টা ছুঁই ছুঁই। মীরাকে রুমে না দেখে কিঞ্চিত ভ্রু কুঁচকালো। ফের দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই মীরা নিজেদের বেডরুমে গিয়ে দেখে শেহজাদও উঠে পড়েছে। দুজনে নিরবেই একসাথে নামাজ আদায় করে নেয়। মীরা রুম থেকে কোনো কথা না বলেই বেরিয়ে যেতে নিলে শেহজাদ ডাকে থামে। শেহজাদ বলে,
“তোমার অনার্স, মাস্টার্সের সব ডকুমেন্ট দিয়ে যেও।”
কপাল কুঁচকে তাকায় মীরা। জিজ্ঞাসা করে,
“কেন?”
“কেন আবার কেন? দিতে বলেছি দাও।”
“আমি কারণটা জানতে চাইছি আপনার থেকে।”
“জানতে পারবে। এখন ডকুমেন্ট গুলো দাও। জাস্ট একটু ওয়েট করতে হবে। ট্রাস্ট মি। ইট উইল বি বেটার ফর ইউ।”
মীরা শেহজাদের চোখে-মুখের ভাব দেখে বুঝলো শেহজাদ কিছু তো লুকাচ্ছে। বিষয়টা তার মনে কষ্ট দিলেও সামনাসামনি প্রকাশ করলো না। আর কথা না বাড়িয়ে ডকুমেন্ট গুলো বের করে দিয়ে চলে গেলো। শেহজাদ ডকুমেন্ট গুলো হাতে নিয়ে মীরার চলে যাওয়া দেখে ভেতর থেকে হতাশ তিক্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে বসে। নিজে নিজে ধিমি স্বরে বলতে থাকে।
“আবারও সময় এসেছে এই দেশ ছাড়ার। এবার সবাইকে নিয়ে।”
শেহজাদ আমেরিকায় যেখান থেকে সে গ্রাজুয়েশন করেছে সেখানে মীরার পিএইচডি ডিগ্রির স্কলারশিপের জন্য আবেদন করে দেয়। সেই সাথে নিজেও এতোদিন আসা অফারটা গ্রহণ করে নেয়।
_______
ফেব্রুয়ারি মাস। মীরার জন্মদিন আজ। সকালে ঘুম থেকে উঠে শেহজাদের থেকে সর্বপ্রথম জন্মদিনের শুভেচ্ছা পেয়েছে সে। তারপর একে একে সবার থেকে। ফ্রিশার থেকে খুব সুন্দর একটা ফ্যামিলি ড্রয়িং পেয়েছে। এরপর ভার্সিটিতে এসে স্টুডেন্টদের থেকেও। পুরোটাদিন মীরার খুব ভালো কেটেছে। আজ সে বাবার বাড়িতে যাবে। সেখানে থাকবে। শেহজাদ হাফ দিনের ছুটি নিয়ে ফ্রিশাকে নিয়ে মীরাকে ভার্সিটি থেকে পিক করে নিয়ে যাবে।
ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে মীরা শেহজাদকে কল করলো। শেহজাদ রিসিভ করতেই মীরা বলল,
মীরা ভার্সিটির গেইটের কাছে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে। দুপুরের সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ছে। রোদের তিব্রতা তেমন একটা না। হঠাৎই মাথায় জোড়ালো কিছু আ*ঘা*তে চোখের সামনে সব অন্ধকার দেখতে লাগলো, মীরা! তৎক্ষণাৎ সে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। ভার্সিটির সামনে হট্টগোল পড়ে গেল আচমকা ঘটনায়। আঘা*তকারী মুখোশধারী ব্যাক্তিকে পথচারীরা ধাওয়া করেও ধরতে পারলো না! পুরো ভার্সিটিতে খবরটা ছড়াতে সময় লাগে না। ইতোমধ্যে শেহজাদও এসে পৌঁছেছে। ভার্সিটির সামনে গাড়ি থামাতেই এতো ভীড় দেখে শেহজাদের মন কেমন একটা করে ওঠলো। সে ফ্রিশাকে গাড়ির ভেতর বসতে বলে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে ভীড় ঠেলে ভেতরে এসে দেখে মীরা মাটিতে র*ক্তা*ক্ত অবস্থায় পড়ে আছে! শেহজাদ পা যেন যত্র থেমে গেলো। নিজের চোখকে তার বিশ্বাস হচ্ছে না। কণ্ঠস্বর যেন পুরোপুরি রুদ্ধ তার! তখনি অ্যাম্বুলেন্সের হর্ণে লোকজন একপাশে সরে যাচ্ছে। মীরাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলবে তখন শেহজাদ বলে ওঠে,
“অ্যাই অ্যাম হার হাজবেন্ড। অ্যাই ওয়ান্ট টু গো উইথ হার।”
মীরার ডিপার্টমেন্টের কলিগরাও এতে সহমত প্রকাশ করে। মীরাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে শেহজাদ মীরার কলিগ, কনক ম্যামকে নিজের গাড়ির চাবি দিয়ে বলে,
“আমার মেয়েকে আপনাদের কাছে রাখুন প্লিজ। ও হার্টের প্যাশেন্ট। মীরাকে এই অবস্থায় দেখলে সহ্য করতে পারবে না।”
কনক ম্যাম এগিয়ে এসে বলেন,
“আমরা দেখে রাখব। আপনি দ্রুত যান।”
শেহজাদ সময় নষ্ট না করে অ্যাম্বুলেন্সে উঠে গেলো। অ্যাম্বুলেন্স চলে যেতেই কনক ম্যাম ও সাবিহা ম্যাম শেহজাদের গাড়ির কাছে যেতেই দেখে গাড়ির দরজা খোলা! ভেতরে ফ্রিশা নেই! উনারা ঘাবড়ে গিয়ে হতবুদ্ধির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। কী করবে না করবে ভাবতে ভাবতেই দারোয়ানকে বলে আশেপাশে খোঁজ লাগাতে। ভার্সিটির অথারিটির কাছেও খবর পৌঁছে গেছে। পু*লিশ কমপ্লেনও ফাইল করা হয়েছে। কিন্তু ভার্সিটির ভেতরে ও আশেপাশে রাস্তায় অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাঁরা ফ্রিশাকে খুঁজে পায় না। ভার্সিটি অথারিটি গেইটের কাছে সিসিটিভি চেক করে দেখতে পায়, প্রথম দফায় একজন মু*খোশধারী লোক মীরাকে আ*ঘা*ত করে পালিয়েছে। তারপর একই বেশে একজন শেহজাদের গাড়ির দরজায় টোকা দেয়। ফ্রিশা গ্লাস নামালে স্প্রে করে গাড়ির দরজা খুলে ফ্রিশাকে নিয়ে একটা মাইক্রোতে করে চলে যায়। উনারা জুম করে মাইক্রোর নাম্বারটা নোট করতে পেরেছে কোনোভাবে। সেটা পু*লিশকে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে রাদিব ও মুরাদ, ফ্রিশাকে অজ্ঞান করে নিজেদের ডেরায় নিয়ে যাচ্ছে। তাদের ধারণা, মীরাকে যেভাবে আ*ঘা*ত করেছে, তাতে মীরা বাঁচবে না। এখন শেহজাদের মেয়েকেও শেহজাদের থেকে দূরে করে পুরানো প্র*তিশো*ধ তুলতে চায় মুরাদ! রাদিব গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে শুধায়,
“মামা, তুমি এই পুচকে মেয়েকে কেন তুলে আনলে? আমাদের তো মীরাকে নিয়ে টার্গেট ছিলো।”
মুরাদ গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে ক্রুর হেসে জবাব দেয়,
“বুঝলে রাদিব, এই শেহজাদের বোনের জন্য এতো বছর আমি সবকিছু থেকে দূরে। তোমার থেকে শেহজাদ সম্পর্কে জেনে প্রথমে সন্দেহ হচ্ছিলো। তারপর আজকে যখন সামনাসামনি দেখলাম, তখন সবকিছু মিলে গেলো। তাই নিজের প্র*তিশো*ধ কীভাবে বাকি রাখি?”
মুরাদের ধ*ম*কে রাদিব তার বক্তব্য শেষ করতে পারলো না। মুরাদ বলে,
“স্টপ! ওকে মা*র*ব না। পা*চা*র করে দিব! শেহজাদ সারাজীবন নিজের মেয়েকে খুঁজে ফিরবে। স্ত্রী-সন্তান হারিয়ে এবার ব*দ্ধপা*গল হবে! হাহাহা!”
মুরাদের ক্রুর হাসিতে রাদিবও তাল মেলায়।
_________
হসপিটালে আনার পর মীরাকে ডাক্তার চেকআপ করে জানায় অপারেশন করতে হবে, ব্রেন হেমারেজের চান্স বেশি। শেহজাদ যেখানে যা সাইন করার করে মীরাকে দ্রুক অপারেশন করতে বলে। মীরাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলে শেহজাদ করিডোরের ফ্লোরে মুখ ঢেকে হাঁটুগেড়ে লুটিয়ে পড়ে। বারবার নিজেকে দোষ দিতে থাকে, কেন আর পাঁচটা মিনিট আগে পৌঁছাতে পারলো না! এদিকে এই ঘটনা টিভিতে নিউজ হচ্ছে। সেখান থেকে জানতে পেরে মিসেস শাহিদা আঁতকে উঠে শেহজাদকে কল করে। শেহজাদ নিজেকে কিছুটা সামলে ফোন রিসিভ করতেই মিসেস শাহিদা ঘাবড়ানো কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন,
“শেহজাদ, শেহজাদ! তোমরা ঠিক আছো? কোথায় তোমরা এখন?”
শেহজাদের গলা দিয়ে কথা যেন বের হতে চাইছে না। সে বেশ সময় নিয়ে ঢোক গিলে দুঃসংবাদটা জানাতে উদ্ধত হয়। এদিকে মিসেস শাহিদা অনবরত ‘হ্যালো! হ্যালো!’ করেই চলেছেন। শেহজাদ বলে,
“ফুফিজান! মীরা!”
“হ্যাঁ, মীরা! কী হয়েছে? কোথায় ও? কথা বলাও আমাে সাথে।”
#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৮
ইন্ডিয়া থেকে ফেরার পর সপ্তাহ খানেকের মতো পেরিয়ে গেছে। মীরা ও শেহজাদ দুজনেরই ইউনিভার্সিটি খুলে দিয়েছে। দুজনে আবার আগের মতো কাজে ব্যস্ত। বিগত মাসগুলোর রুটিন অনুসারে শেহজাদ মীরাকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দেয় তারপর নিয়েও আসে। কয়েকদিন পর শেহজাদের জন্মদিন। মীরা কিছু গিফট কিনবে। অনেক ভেবে ভেবে ডিসাইড করলো কী কিনবে। অনলাইনে অর্ডার করবে একবার ভেবেও নিজেই একটা ক্লাস রিসিডিউল করে শপিংমলে চলে গেলো। স্বচক্ষে দেখে কেনার মধ্যে একটা প্রশান্তি তো কাজ করে। শপিংমলে এসে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মতো সময় ব্যয় করে অতঃপর সে একটা সুট পছন্দ করতে পেরেছে! নিজের এই সময়জ্ঞান নিয়ে হেলাফেলার বিষয়টা বুঝে নিজে নিজেই বলে,
“উনি আসলে চুপ করে থেকে শুধু এক্সপ্রেশণ দিতেন। কতো রকমের এক্সপ্রেশন! চোখ ছোটো ছোটো করা, ভ্রু কুঁচকে থাকা, বারবার হাতঘড়ি দেখা, পায়ে জোড়ে শব্দ করা, এদিক-ওদিক হাঁটা! কেন যে বুঝে না? মেয়েদের শপিং করতে একটু তো সময় লাগেই। আমরা কাপড়ে সুতা পর্যন্ত চেক করি!”
মীরার বিড়বিড় করার মধ্যে এক মহিলা সেলসওমেন এসে জিজ্ঞাসা করেন,
“এনিথিং রং, ম্যাম?”
সেলসওমেনটি মিষ্টি হেসে সম্মতি দিয়ে সুটটি নিয়ে কাউন্টারে চলে যায়। এরপর বিল পে করে মীরাও সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর আরও আধ ঘণ্টার মতো সময় ব্যয় করে ফ্রিশার জন্য একটা টপস কিনে শপিংমল থেকে বেরিয়ে আসে। উবার ড্রাইভারকে কল করলে ড্রাইভার তাকে কিছুটা সামনে যেতে বলে। বাধ্য হয়ে মীরা তাই করতে সামনে এগুচ্ছে। তখনি হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে একটা গাড়ি তীব্র গতিতে রং সাইড থেকে এসে মীরাকে ধাক্কা দিবে দিবে তৎক্ষণাৎ এক বৃদ্ধ রিকশাচালক মীরাকে টান দিয়ে সাইডে নিয়ে আসে। আচমকা ঘটনায় মীরা হতবাক! কী থেকে কী হচ্ছিলো সব তার বুঝার বাহিরে। আশেপাশের লোকজনও জড়ো হয়ে গেছে। কয়েকজন লোক গাড়ির পেছনে ছুটতে ছুটতে ধরতে না পেরে ফের ফিরে এসেছে। রিকশাচালক লোকটা জিজ্ঞাসা করেন,
জড়ো হওয়া লোকজনও অনেকে অনেক কথা বলছে। মীরা কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে রিকশাচালকটাকে বলল,
“চাচা, আমার সাথে একটু ওই সামনের গাড়িটা পর্যন্ত আসবেন? আপনার রিকশাও সাথে করে আনেন।”
রিকশাচালক তাই করলো। সামনে গিয়ে মীরা উবার ড্রাইভারকে না করে তার প্রাপ্য ভাড়াটা মিটিয়ে বিদায় করে দিয়ে রিকশাতে চেপে বসে। এখন আর সে ভার্সিটিতে যাবে না। একেবারে বাড়িতে ফিরবে। বাড়ির সামনে এসে নেমে রিকশাচালককে এক হাজার টাকার নোট দেয়। রিকশাচালক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলে মীরা মুচকি হেসে বলে,
“আপনি এমনিতে নিতেন না। তাই আপনার রিকশায় করে আসলাম। আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন। এর কাছে সামান্য টাকা কিছুই না।”
“কিন্তু মা, আমার ভাড়া তো এতো হয় নাই। ১৫০-২০০ টাকার বেশি তো ভাড়া হইতো না। আপনে আমারে হাজার টাকা দিয়েন না।”
“চাচা, প্লিজ। এটা নিতে মানা করবেন না। আমি খুশি হয়ে দিচ্ছি।”
“কিন্তু মা, এতো টাকা!”
“এটা কিছুই না। আপনি প্লিজ রাখেন। আজকে বাড়িতে ভালো কিছু নিয়ে যাবেন। আমি নিজেও বাজার করে দিতে পারতাম। কিন্তু আমার একটু তাড়া ছিল ফেরার জন্য। আরেকটু লেট হলে সিগন্যালে পড়লে অনেক দেরি হয়ে যেত।”
রিকশাচালকটির চোখ ভিজে ওঠলো। তিনি গলায় ঝুলানো গামছা দিয়ে চোখ মুছে নিয়ে বললেন,
“আল্লাহ আপনের ভালো করুক, মা। অনেক ভালো থাকেন। দীর্ঘায়ু হোক আপনের।”
এই বলে মীরার মাথায় হাত বুলিয়ে রিকশাচালকটি চলে যান। মীরা হেসে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে মোবাইলের স্ক্রিণে সময় দেখলো পাঁচটা বাজে। শেহজাদ এখন ভার্সিটি থেকে বোরোবো। সে দ্রুত শেহজাদকে টেক্সট করে জানিয়ে দিল যে সে চলে এসেছে। তবে আজকের ঘটনাটা শেহজাদকে সে জানাতে চায় না। কারণ শেহজাদ অনেক রাগ করবে। ব*কাব*কিও করবে। যতোই হোক, শেহজাদের রাগকে সে ভয় পায়!
এদিকে নিজেদের আস্তানায় গাড়ি পার্ক করে লোকটি গাড়িতে দুই-তিনটে লা*থি মে*রে আস্তানা প্রবেশ করে। চেয়ার টেনে বসে। টেবিলের বিপরীত পাশে বসা একজন তার মুখের অবস্থা দেখে বুঝতে পারলো এবারও অসফল হয়ে ফিরে এসেছে। বিপরীত পাশে বসা মানুষটি জিজ্ঞাসা করলো,
“এবারও কিছু করতে পারোনি?”
এবার যেন লোকটির রাগ বর্ষে ওঠলো। টেবিলে সজো*ড়ে আ*ঘা*ত করে বলল,
“এবারও পারলাম না, মামা! এবারও ব্যার্থ হলাম। তিন তিন বার বেঁচে গেছে। আজকে তো সাথে ওই শেহজাদও ছিল না।”
টেবিলের বিপরীতে বসা মানুষটি হাসলেন। ফের বললেন,
“ভাগ্য ওই মেয়ের সাথে আছে বুঝলে। আরও কতোবার এটেম্প্টে সফল হও দেখো!”
“মামা, তুমি এসব বলছো? তুমি? তুমি অন্তত এসব বলো না। আমি ওই মীরাকে সুখে থাকতে দিব না। কিছুতেই না।”
কথাগুলো বলে রাগে ফুঁসছে লোকটি। লোকটির মামা এবার উঠে এসে লোকটিক কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“শান্ত হও, রাদিব! এসব করতে সময় দিতে হয়। তুমি খুব অল্প সময়ে পরপর তিন বার অ্যা*টা*ক করে বসেছ। এখন ওদের সন্দেহ হলে ওরা আরও সতর্ক হয়ে যাবে।”
“কিন্তু মামা, আমি ওই মীরার এই সুখ সহ্য করতে পারছি না। কতোকিছু করলাম। বর্ণকে উসকেও ওর বিয়েটা আটকাতে পারলাম না। আমার জীবন নষ্ট করে নিজে সুখে থাকবে? তা আমি হতে দিব না।”
“শান্ত হও, রাদিব। কিছুদিন কোনো অ্যা*কশন নিও না। ওরা সব স্বাভাবিক ভাবতে শুরু করলে আবার করা যাবে।”
কথাটা বলে রাদিবের মামা সেখান থেকে চলেই যাচ্ছিলেন, তখন রাদিব তাকে ডাক দিয়ে বলে,
“তোমার উচিত এবার বাড়ি ফেরা। ১২ বছর হলো দেশ ছেড়েছ। এবার যখন দেশে ফিরেছো তখন বাড়ি চলো।”
লোকটি শক্ত কণ্ঠে বলল,
“তুমি খুব ভালো করেই জানো, আমি এখানে ফিরেছি শুধুমাত্র তোমার কথায়। নয়তো ফিরতাম না। তাছাড়া তোমার মা আমাকে ঘৃণা করে। নিজের কাজে ফোকাস করো। কাজ শেষ হলে আমি আবার ফিরে যাব।”
এই বলে লোকটি সেখান থেকে চলে গেলো। রাদিবও এরপর চলে যায়।
________
দুইদিন পেরিয়ে গেছে। আগামীকাল শেহজাদের জন্মদিন। মীরা কিছু প্ল্যানিং করছে। আজকে একটা এক্সট্রা ক্লাস করিয়ে আগামীকালকের একটা ক্লাস কমিয়ে রাখবে তারপর জলদি বাড়ি চলে আসবে। ফ্রিশার পাশে বসে বসে মীরা এসব ভাবছিল। তখন ফ্রিশা বলে ওঠে,
“হোয়াট আর ইউ থিংকিং, ফেইরিমাম্মাম?”
মীরা ভাবনার সুতো ছিঁড়ে ফ্রিশার দিকে চেয়ে মিষ্টি হেসে বলে,
“কাল তোমার বাবার বার্থডে তো। কী করা যায় ভাবছি।”
ফ্রিশা ভীষণ এক্সসাইটেড হয়ে গেল। সে জিজ্ঞাসা করে,
“কী করবে?”
ফ্রিশা তার বাবার গালে চু*মু এঁকে বই-খাতা গুছিয়ে রেখে শুয়ে পড়ে। এরপর মীরা ও শেহজাদ কিছুক্ষণ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে ঘুমিয়েও পড়ে।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৯
আজ সকালে মীরার ক্লাস না থাকলেও বিকেলের একটা ক্লাস স্টুডেন্টদের সাথে কথা বলে ক্লাসটা সকালে নিয়ে এসেছিল। যাতে করে জলদি ফিরতে পারে। অবশেষে ঘড়ির কাঁটা তিনটার ঘরে ছুঁই ছুঁই। মীরা ভার্সিটি থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করেছে।
এদিকে শেহজাদ নিজের অফিস রুমে বসে চিন্তায় মগ্ন। আজ ব্রেকের সময় সে একটু বেরিয়েছিল। তখন হঠাৎ একজনকে দেখে পুরোনো কিছু তিক্ত অতীত মনের কোণে উঁকি দেয়! এতো বছর পুরোনো স্মৃতি সব মনে পড়ে যায়। অতঃপর সে গাড়ি থেকে নেমে আশেপাশে লোকটাকে খুঁজেছিল। কিন্তু পায়নি। তারপর হতাশ হয়ে আবার ভার্সিটিতে ফিরে আসে। সেই থেকে বিষয়টা কোনোভাবেই তার মস্তিষ্ক থেকে বেরোচ্ছে না। দীর্ঘ ভারী নিঃশ্বাস ছেড়ে আজকের দিনের শেষ ক্লাসের জন্য তৈরি হয়ে নিলো।
_______
বাড়ি ফিরে মীরা তড়িঘড়ি করে সব রান্না করছে। সার্ভেন্টরা আগে থেকে অনেকটাই গুছিয়ে রেখেছিল বলে এখন রান্না করে শান্তি পাচ্ছে। ফ্রিশা একটা শাড়ি হাতে রান্নাঘরে এসে বলল,
“ফেইরিমাম্মাম,”
মীরা রান্নার দিকে মনোযোগ দিয়েই প্রত্যুত্তর করে। ফ্রিশা এরপর বলে,
“আমি রেড শাড়ি পড়ব?”
“পড়ো।”
“তাহলে পড়িয়ে দাও।”
মীরা এবার ফ্রিশার দিকে নজর ফেরালো। ফ্রিশার হাসিমাখা উৎসাহী চেহারা দেখে মীরাও মৃদু হাসে। তারপর আদুরে স্বরে বলে,
“উম, তুমি যদি এখন শাড়ি পরে বসে থাকো তাহলে তুমি টায়ার্ড হয়ে যাবে। সোয়েটিং হবে। যখন বাবাকে সারপ্রাইজ দিবে, তার আগে চট করে পড়িয়ে দিব। ওকে?”
” ওকে। ”
“তাহলে এখন যাও, প্র্যাকটিস করো।”
ফ্রিশা মীরার হাত ধরে হালকা নিচু হতে ইশারা করে। মীরা কৌতুহলের বশে নিচু হলে ফ্রিশা ও-কে চট করে একটা চু*মু দিয়ে ছুটে পালায়। ফ্রিশার এই আদুরে কাণ্ডে মীরা হেসে ফেলে। সেখানে উপস্থিত সার্ভেন্ট দুজনও হাসে। একজন বলে,
“ছোটোম্যাডাম, আপনারে আর ফ্রিশামনিরে দেইখা মনেই হয় না যে আপনে তার সৎ মা! আইজকাল এতো আদর তো আপন মাও করে না।”
মীরা কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে আবার রান্নায় চামচ নাড়তে নাড়তে মুচকি হেসে বলে,
“জরুরী না যে মা হতে হলে জন্ম দিতে হবে। তাছাড়া ফ্রিশাকে ভালো না বেসে থাকা যায় নাকি? তোমরা ওইদিকটা গুছিয়ে ফেলো তো। আর প্লেট-বাটিগুলো নামিয়ে ক্লিন করে ফেলো।”
সার্ভেন্টরাও বুঝলো যে মীরা এই বিষয়ে কথা বাড়াতে ইচ্ছুক না। ওরা জলদি করে সেখান থেকে কাজে লেগে পড়ে। সার্ভেন্টরা রান্নাঘর ছাড়তেই মীরা হাতের কাজ থামিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজে নিজেই বলে,
“মাকে তো কেউ কখোনো এসব বলেনি। আজকাল জামানাই এমন যে ভালো ব্যবহার করলেও সন্দেহ হয়!”
আফসোস করে নিজেই হাসে। অতঃপর দ্রুত কাজ শেষ করতে থাকে।
______
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে শেহজাদ সবার আগে তার ফুফিজানের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। মিসেস শাহিদা হঠাৎ করে শেহজাদকে নিজের রুমে বিনা নক করে ঢুকতে দেখে কিছুটা অবাক হন। তিনি বিছানায় বসে তসবিহ পড়ছিলেন। অতঃপর ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করেন,
“কী হয়েছে, শেহজাদ? হঠাৎ আমার রুমে আসলে?”
শেহজাদ চেয়ার টেনে মিসেস শাহিদার কাছে বসে। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে থাকে। মিসেস শাহিদা উদগ্রীব হয়ে নিজের ভাতিজাকে দেখছেন। কয়েক মুহূর্তের পর শেহজাদ চেয়ার ছেড়ে ফ্লোরে বসে নিজের ফুফির কোলে মাথা রাখে। এতে যেন মিসেস শাহিদা ভীষণ অবাক হয়ে যান। হঠাৎ কী এমন হলো যে শেহজাদ এতোটা ভেঙে পড়েছে? ভেঙে না পড়লে তো শেহজাদ এমনটা করে না। শেষবার ফিওনার মৃ*ত্যুর সময় তার কোলে মাথা রেখেছিল। মিসেস শাহিদা উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করেন,
“কী হয়েছে, বাবা? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”
শেহজাদ চোখ বন্ধ করে জবাবে বলে,
“আজকে ওই লোকটাকে দেখেছি, ফুফিজান।”
“কোন লোকটা?”
“যার জন্য আমার আপু সু*ই*সা*ই*ড করেছিল!”
মিসেস শাহিদা কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেন প্রত্যুত্তর করতে ভুলে গেছেন। কিছু সময় পরে তিনি ফের শুধালেন,
“মুরাদ?”
“হ্যাঁ ফুফি। ওই জা*হিল মুরাদ!”
শেহজাদের কণ্ঠে তীব্র রাগের বহিঃপ্রকাশ। মিসেস শাহিদা তড়িঘড়ি করে আবার প্রশ্ন করেন,
“কোথায় দেখলে? এতো বছর পর? এতো বছর পর আবার কেন ফিরে এসেছে?”
“জানিনা আমি। আমি তাকে দেখে গাড়ি থেকে নামতে নামতেই সে হারিয়ে গেছে। আবাে কেন ফিরে এসেছে আমি জানিনা। কিন্তু এবার ও-কে পেলে আমি ছাড়ব না! আমার ফ্যামিলির দিকে চো*খ তু*লেও তাকাবে তো আমি ওর লা*-শ ফেলে দিব।”
মিসেস শাহিদা ঘাবড়ে গেলেন। তার ভাতিজার রাগ যে খুব খারাপ! নিজের বোনের ঝু*ল*ন্ত লা*-শ সামনে দেখে অতো বছর আগে সত্যি সত্যিই তো মুরাদকে নিজ হাতে খু*-ন করতে গিয়েছিল পর্যন্ত! মিসেস শাহিদা তড়িঘড়ি করে বলেন,
“শোন, বাবা। এসব কিছু করিস না। আগে থেকে পু*লি*শে বলে রাখ। কিন্তু মা*থা গরম করে কিছু করিস না।”
“ফুফিজান, ওই লোকটা….”
“চুপ! চুপ! যা হয়ে গেছে গেছে। তুমি তো সানিয়াকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। এখন তোমাকে যারা আছে তাদের কথা ভাবতে হবে। শান্ত হও। স্বাভাবিক থাকো। এখন নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হও। বাড়ির আর কেউ যেন বুঝতে না পারে। যাও।”
শেহজাদ অনিচ্ছাসত্ত্বে মেনে নিলো। তারপর নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। শেহজাদ চলে যেতেই মিসেস শাহিদা নিজের আলমারির গোপন ড্রয়ার খুলে একটা ডায়েরি বের করলো। এটা শেহজাদের দুই বছরের বড়ো বোন সানিয়ার ব্যাক্তিগত ডায়েরি। সানিয়া ছোটো থেকেই তার ফুফির পা*গ*ল ছিল। সবকিছু শেয়ার করতো কিন্তু বড়ো হতে হতে সন্তান যেমন নিজের প্রাইভেসি বুঝতে শুরু করে তারপর কথা শেয়ার করা বন্ধ করে দেয়, তেমনি সানিয়াও। ইউনিভার্সিটিতে উঠে প্রেমে পড়ে এক ইয়াং ল্যাব ডেমোনিস্ট্রট মুরাদ আহমেদের। ওদের প্রেম অনেক গভীর হয়ে গিয়েছিল। সানিয়া অনেক দুর্বল মনের একটা মেয়ে ছিল। কিন্তু মুরাদ ছিল চতুর। সে সানিয়ার সাথে সম্পর্কে গিয়েছিল সানিয়ার প্রোপার্টি ও সৌন্দর্যের মোহে পড়ে। সানিয়া যেদিন জানতে পারে সে বিয়ের আগেই কনসিভ করে ফেলেছে! সেদিন সে মুরাদকে বিষয়টা জানালে মুরাদ তাকে আশ্বাস দেয় বিয়ে করার। দুই পরিবারের মধ্যে কথা-বার্তার মাধ্যমে বিয়েও ঠিক হয়। সানিয়ার পরিবার প্রথমে রাজি হচ্ছিলো না কারণ মুরাদদের সাথে তাদের মিলে না। কিন্তু সানিয়ার জেদে অবশেষে রাজি হয়েই গিয়েছিল। সানিয়া খুব খুশি ছিল কিন্তু মুরাদের মনে যে অন্য পরিকল্পনা তা সানিয়া ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি। মুরাদ আগে থেকেই বিবাহিত ছিল! এই সত্যটা জানতে পারে সানিয়ার ফুফা মানে ড: আকবর রেহমান। তিনি গায়ে হলুদের দিনই সত্যটা জানতে পেরে বিয়ে ভেঙে দেন। কিন্তু সানিয়া এটা মেনে নিতে পারেনি। সে তো কাউকে এখনও জানায়নি যে সে দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা! সে কোনোভাবেই কারও কথা বিশ্বাস করতে পারছিল না। ভালোবাসায় এতোটাই অ*ন্ধ হয়ে গিয়েছিল যে চোখের সামনে মুরাদ ও মুরাদের স্ত্রীর ছবি দেখেও তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। তার মনে হচ্ছিল, সবাই ইচ্ছে করে তাদের বিয়েটা ভাঙতে চাইছে। সানিয়া নিজের বিশ্বাসে অটল থেকে নিজেকে রুমবন্ধি করে কাঁদতে কাঁদতে মুরাদকে বহুবার কল করেছিল। অনেকক্ষণ পর মুরাদ কল রিসিভ করেও। তারপর নিজ মুখেই সব সত্য স্বিকার করে নিয়েছিল। মুরাদ নিজের মোহ ও লালসার কথা জানালে সানিয়া সেটা সহ্য করতে পারে না। তখন সে আ*ত্মহ*ন*নের পথ বেছে নিয়েছিল। তার আগে সানিয়া প্রতিদিনকার রুটিনের মতো নিজের ডায়েরিতে লিখে যায় ও সেই সাথে বাড়ির সবার জন্য একটা চিঠিও রেখে যায়। সানিয়ার মৃত্যুর পর অনেক জলঘোলা হয় এই নিয়ে। এলাকাবাসীর কাছে সানিয়ার প্রেগন্যান্সির ব্যাপারটা আড়াল থাকতে পু*লি*শকেও অনুরোধ করা হয়েছিল। শেহজাদ এখনও জানে না যে তার বোন প্রেগন্যান্ট ছিল। ওই সময়ে শেহজাদের অবস্থাও খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মানসিক ভাবে প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলো। তাই শেহজাদের বাবা-মা শেহজাদকে নিয়ে দেশ ছাড়েন। আমেরিকাতে শেহজাদের ট্রিটমেন্ট ও স্টাডি একসাথে চলতে থাকে।
ডায়েরিতে হাত বুলিয়ে পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে দীর্ঘ বেদনাময় নিঃশ্বাস ছাড়েন মিসেস শাহিদা। আবারও অতীতের কালো ছায়া কেন ফিরে এসেছে? শেহজাদ তো প্রিয়জনদের হারাতে হারাতে ক্লান্ত। আবার কেন?
_______
রাত নয়টার দিকে মীরা সবকিছু সাজিয়ে জোড় করে শেহজাদকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে আসে। শেহজাদ আসতে চাচ্ছিলো না। তার মাথা ধরেছে খুব। কিন্তু ফ্রিশার এক্সাইটমেন্টের কথা বলে মীরা শেহজাদকে আনতে পেরেছে। ফ্রিশা ও মীরা মিলে একত্রে নাচ ও গান করলো। মীরা গান গেয়েছে আর ফ্রিশা নাচ করেছে। শেহজাদ শুধু জোরপূর্বক মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখেছে পুরোটা সময়। এতে তার একটুও মন লাগছে না। মিসেস শাহিদা এটা লক্ষ্য করে মীরাকে ডেকে বলেন,
“মীরা, আমার মনে হয় শেহজাদের শরীরটা একটু খারাপ। তুমি ও-কে খাবার দাও। ও একটু রেস্ট করুক।”
মীরা এবার ভালো করে শেহজাদের দিকে লক্ষ করলো। এখানে আনার সময়ই বলেছিল শরীর ভালো লাগছে না। মীরা তাই আর দেরি না করে সবাইকে খাবার বেড়ে দেয়। শেহজাদ অল্প খেয়ে সবার আগে উঠে যায়। মীরা সেদিকে উদাস হয়ে চেয়ে আছে। অন্তত একটু কমপ্লিমেন্ট সে আশা করেছিল। মিসেস শাহিদা নরম সুরে বললেন,
“শরীর খারাব তো। তুমি এটা নিয়ে কষ্ট পেয়ো না। তুমিও তো ক্লান্ত। খাওয়া শেষ করে তুমিও রুমে চলে যাও। রেস্ট করো। এগুলো সার্ভেন্টরা গুছিয়ে নেবে। আজকে ফ্রিশাকে আমি ঘুম পাড়িয়ে দিব।”
ফ্রিশা তার দাদুমনির কথা শুনে খুশি হয়ে বলে,
“ইয়ে” দাদুমনি, তুমিও আজ আমার সাথে ঘুমাবে। হ্যাঁ?”
“আচ্ছা, বাচ্চা। জলদি খাবারটা ফিনিশ করো তো।”
ফ্রিশা কথা শোনে। মীরা খাওয়া শেষ করে ফ্রিশাকে গুড নাইট উইশ করে রুমে চলে যায়। গিয়ে দেখে শেহজাদ ঘুমিয়ে গেছে। টেবিলে স্লি*পিংপি*লের স্ট্রিপ থেকে একটা ঔষুধ নেই। তার মানে ঔষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছে। মীরাও কী করবে! সেও মন খারাপ করে পাশে শুয়ে পড়ে।
#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৬
রাত্রির ১০টা বেজে ১০ মিনিট। মীরা, শেহজাদ ও ফ্রিশা শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে প্লেনে চড়ে বসেছে। রাইমার শ্বশুরবাড়ি থেকে কলকাতা এয়ারপোর্ট মাত্র মিনিট বিশেকের দূরত্ব। ফ্রিশার সিটবেল্ট চেক করে মীরা সিটে গা এলিয়ে বসেছে। ভাবতে শুরু করে বিয়ে বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে রাইমার সাথে কথোপকথন,
“রাই, শোন না। আমরা এখনই বেরোবো। ১০টা ১৫ তে শিলিগুড়ির ফ্লাইট। দার্জিলিং যাচ্ছি।”
“এই সবেমাত্র আমি জানলাম। তোর জিজু হুট করেই সারপ্রাইজ দিলো।”
রাইমা একটু মজা করে আলতো ধা*ক্কা দিয়ে বলল,
“বাহ বাহ। জিজু তবে হানিমুনের সারপ্রাইজও দিলো! সো রোমান্টিক ইয়ার।”
মীরা ওর মাথায় টো*কা দিয়ে বলে,
“আরে না রে। আমি রাগ করেছিলাম। বলেছিলাম তার সাথে ফিরব না। তাই এটা করলো।”
রাইমার চোখ-মুখ উজ্জ্বলতা ভর করলো। সে খানিক গা ঘেঁষে ফিসফিস করে মীরার কানে বলল,
“তুই বলিস আর না বলিস, জিজু তোকে ভালোবাসে। মুখে না বললে কী হবে, কাজে তো বুঝাই যায়।”
মীরা ব্রীড়ামিশ্রিত হেসে পাত্তা না দেওয়ার ভাব ধরে বলে,
“হয়েছে! থাম এবার। আমরা বেরোবো। ভালো থাকিস, ইয়ার।”
রাইমা ও মীরা দুজন-দুজনকে জড়িয়ে ধরলো। তখন সেখানে শেহজাদ ও ফ্রিশা আসে এবং ওরা তিন জন বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
পূর্বে ঘটিত ঘটনার কল্পনার ইতি টেনে মীরা, ফ্রিশার দিকে মনোযোগ দেয়। ফ্রিশা জানালা দিয়ে তাকে রাতের ঝিকিমিকি শহর দেখাচ্ছে। পুরো কোলকাতা শহরটা যেন এক হাতের সমান দেখা যাচ্ছে। এভাবেই ১ ঘণ্টা ১০ মিনিটের জার্নি শেষে শিলিগুড়ির বাগডোগরা বিমানবন্দরে ওরা অবতরন করে। রাত অনেকটা হয়ে যাওয়াতে এয়ারপোর্টের কাছেই হোটেলে রাত্রিযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়।
________
শীতের সকাল, ঘন কুয়াশাচ্ছাদিত আবহাওয়া। উলের নরম শাল গায়ে জড়িয়ে জানালার পর্দা সরালো মীরা। শেহজাদ সবেই বাহিরে গেলো গাড়ি ঠিক করতে। ওরা আগে দুধিয়া পাহাড় দেখতে যাবে। তারজন্য শিলিগুড়ি শহরে গিয়ে সেখান থেকে রওনা হবে। শহরটাও খানিক দেখে, সেখানেই নাস্তা সেড়ে নিবে। মীরা মুচকি হেসে ফ্রিশাকে ঘুম থেকে তুলতে বিছানার কোণায় বসে। শীতল পরিবেশ পেয়ে ফ্রিশা বি*ড়ালছা-নার মতো ব্ল্যানকেট জড়িয়ে আরামে ঘুমাচ্ছে। মীরা ওর চুলে হাত বুলিয়ে আলতো স্বরে ডাকে। ফ্রিশা নড়েচড়ে আবারও ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়। ফের কয়েকবার ডাকার পর ঘুম ভাঙে ফ্রিশার। আড়মোড়া ভেঙে মায়ের কোলে মাথা দিয়ে আলসেমি করছে। মীরা বলে,
“তোমার বাবা এখুনি চলে আসবে, সোনা। ফার্স্ট ফার্স্ট রেডি হয়ে নাও তো, বাচ্চা। আমরা ঘুরতে বেরোবো।”
“ফেইরিমাম্মাম, আই অ্যাম ফিলিং স্লিপি।”
“উঁহু। গেট আপ। রেডি হতে হবে। আমরা আজকে অনেক জায়গায় ঘুরবো। অনেক কিছু দেখব।”
অগ্যতা ফ্রিশা মুখ কালো করে উঠে ফ্রেশ হয়ে আসলো।
_______
শিলিগুড়িতে নাস্তা-পানি সেড়ে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি এই উভয় জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গড়ে উঠা একটি মহানগর হচ্ছে শিলিগুড়ি। এটি প্রধানত চা, কাষ্ঠ ও পর্যটনকেন্দ্রের জন্য পরিচিত। শহরের উঁচু টিলাতে দাঁড়িয়ের দূরের সবুজ পাহাড় ও চা বাগান যেন নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আভাস দেয়। এখনও কুয়াশা পুরোপুরি কে*টে ওঠেনি। ঘড়িতে সকাল আটটা বাজে বাজে এমন। একটা সিএনজি টাইপ গাড়ি ঠিক করে মীরা, শেহজাদ ও ফ্রিশা উঠে পড়লো দুধিয়ার উদ্দেশ্যে। শিলিগুড়ি শহর থেকে ৪০-৪৫ মিনিট গাড়ির পথ দুধিয়া। দুধিয়ার পাহাড় থেকে নেমে এসেছে বালাসন নদী। আর সেই নদীর পাড়ে সবুজ উপত্যকা। এক দিকে পাহাড় আরেক দিকে চা বাগান। অনেকেই এখানে পিকনিক করতে এসেছে। বেশ পর্যটন প্রিয় জায়গা। নদীর জলের গভীরতা খুব কম হওয়ায়, পা ডুবিয়ে চোখ বন্ধ করে দুই দিকে দুই হাত মেলে লম্বা শ্বাস নিয়ে প্রকৃতির বিশুদ্ধতম সব বায়ু দ্বারা ফুসফুসকে প্রশান্ত করতে ব্যাস্ত মীরা। পেছন থেকে শেহজাদ এটা নিজ ফোনে ক্যাপচার করে নেয়। মীরার দেখাদেখি ফ্রিশাও যায়। দুই মা-মেয়ের একই ভঙ্গিও ক্যামেরায় ধরা পড়ে। সেখানে কিছুক্ষণ থেকে বালাসন ব্রিজে তিনজন ছবি তুলে নেয়। এক পর্যটকের সহায়তা নিয়ে বালাসন ব্রিজে ও বালাসন নদীতে পা ডুবিয়ে তিন জনের দুইটা ফ্যামিলি ফটো উঠিয়ে নেয় আকাশ-পাহাড়ের নীল, সাদা, সবুজ রংকে সাক্ষী রেখে। ফ্রিশাও কিন্তু দারুণ ফটোগ্রাফার! বাবা-মায়ের কাপল ছবিতো সেই তুলে দিয়েছে। ঘণ্টা দুয়েক সেখানে কাটিয়ে রওনা করে “বেঙ্গল সাফারি পার্কের” উদ্দেশ্যে। প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছায় বেঙ্গল সাফারিপার্কে। এই সাফারিপার্কের বৈচিত্র্যময় গাছ-গাছালি, প্রাণীকুল, সবেতে পর্যটক সবুজের অরণ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে বাধ্য। সাফারিপার্কের ভেতরে ঘোরার জন্য গাড়ি ভাড়া করতে হবে। আরও দুয়েকজন একক পরিবার সেখানে থাকাতে একসাথে একটা গাড়ি ভাড়া করে ফেলে। এদের মধ্যে এক দম্পতির ৪ বছরের একটা বাচ্চা ছেলে আছে। আরেক দম্পতির বাচ্চা নেই। ৪ বছরের দিহান ও ফ্রিশার মাঝে অল্প সময়েই সখ্যতা গড়ে ওঠেছে। ওরা গাড়ি পেছনের সিটে বসে জানালা দিয়ে সব দেখছে। দিহানের মা দিশাও খুব মিশুক। আরেকজন নবনী। নবনী ও তার স্বামী প্রদীপ ক্যামেরা আড়ালে ভিডিও করছে। পশু-পাখির সামনে ক্যামেরা আনা ঠিক না। এই সাফারিপার্কে ভ্রমণের মাঝে বিভিন্ন পশু-পাখি দেখে ফ্রিশা ও দিহানের প্রশ্নের কমতি নেই। ওদের প্রশ্নের তোড়ে সবার মাঝে হাসির ফোয়ারাও ছুটেছে কয়েক দফা।
দুপুর গড়িয়ে বিকেলে পড়লে ওদের ঘুরাঘুরি শেষ হয়। একটা রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়ে শেহজাদ বলে,
“দার্জিলিং যেতে ট্রেন তো সন্ধ্যা ৬টা ১৫তে। এখন বাজে ৪টা ১০। হাতে দুই ঘণ্টা আছে। আমি চেয়েছিলাম সিপাই ধুরা চা বাগানে একটু ঘুরে আসতাম। যদিও শীতের সময়। খুব দ্রুত সন্ধ্যা নামে।”
মীরা আশংকিত কণ্ঠে শুধায়,
“সেখানে গেলে ট্রেনের টাইম মতো স্টেশনে পৌঁছাতে পারব?”
“ম্যাপে তো দেখলাম এখান থেকে সিপাই ধুরা চা বাগানে যেতে ৫০ মিনিট সময় লাগে। এখন যদি ১ ঘণ্টাও লাগে তবে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। ড্রাইভারকে ফার্স্ট ড্রাইভ করতে বলতে হবে। সেখানে ১০-১৫ মিনিট থেকে ফিরে এলাম।”
“আপনি যা ভালো বুঝেন করেন। আমি অতো বুঝি না।”
“আচ্ছা। তোমরা এখানে বসো। আমি গাড়ি ঠিক করে আসি।”
শেহজাদ গাড়ি ঠিক করতে যায়। ফ্রিশা আশেপাশে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
“আমরা এখন চা বাগনে যাব, ফেইরিমাম্মাম?”
“তোমার বাবা তো তাই বলল, বাচ্চা। জানিনা কী করেন।”
ফ্রিশা আবার চুপ করে বসে আশেপাশে নজর বুলাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর শেহজাদ ফিরে এসে বলে,
“চলো শিলিগুড়ি শহরেই ফিরে যাই। রিক্স নিয়ে কী দরকার? শিলিগুড়ি মার্কেট থেকে হালকা পাতলা কিছু কেনাকাটার ব্যবস্থাও করা যাবে। ”
“আচ্ছা চলুন তবে। ফ্রিশারও টায়ার্ড লাগছে।”
“আমি শিলিগুড়ি শহরে যাওয়ার জন্য গাড়ি ঠিক করে এসেছি। এসো।”
এরপর ওরা তিনজন শিলিগুড়ি যাওয়ার জন্য গাড়িতে চড়ে বসে।
_________
সন্ধ্যা ৬টা ১২ মিনিট, দার্জিলিং মেইল ট্রেনে বসে আছে ওরা। ট্রেন এখুনি ছেড়ে দিবে। মানুষজন দ্রুত পায়ে ট্রেনে উঠায় ব্যাস্ত। ফ্রিশা, মীরার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। মীরা ট্রেনের জানালাটা সামান্য খোলা রাখলো। ট্রেন ছেড়ে দিলে পুরো বন্ধ করে দিবে। ট্রেন ছাড়লে বেশ হাওয়া আসবে। শীতের রাত। কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় ফ্রিশার ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। সিটে চোখ বন্ধ করে মাথা এলিয়ে রেখেছে। চিনচিনে ব্যাথাও করছে মাথার সামনের ও ডান পাশের দিকটায়। শেহজাদ জিজ্ঞেসা করে,
“কিছু স্ন্যাকস আনব? এখনও তো ট্রেন ছাড়েনি।”
মীরা চোখ মেলে দ্রুত কণ্ঠে নিষেধ করে বলে,
“না না। দরকার নেই। পড়ে ট্রেন ছেড়ে দিলে কি পিছু দৌঁড়াবেন নাকি? এক-দেড় ঘণ্টার জার্নিতে না খেলে ম-রে টরে যাব না। মেয়ে তো ঘুমাচ্ছেই।”
শেহজাদ হেসে বলে,
“কিছু হবে না। এখনও মানুষ আসছে।”
“দরকার নেই তো। বাই চান্স ছেড়ে দিলো? ৬টা ১৯ বাজে। পরে কি দিল ওয়ালে দুলহানিয়া ও চেন্নাই এক্সপ্রেস মুভির মতো কাজল ও দীপিকার মতো আপনি দৌঁড়াবেন আর আমি শাহরুখের মতো ট্রেনের দরজায় হাত বাড়িয়ে দিব? অতো সিনেম্যাটিক হতে পারব না। আপনার কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। চুপ করে বসে থাকুন।”
কথাগুলো বলে মীরা আবারও চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে ফ্রিশার মাথায় হাত বুলাচ্ছে। পাশ থেকে এক লোক শেহজাদকে উদ্দেশ্য করে খানিক হাস্যরসে বলে,
“দাদা, আপনার ওয়াইফ মনে হচ্ছে একটু বেশি স্ট্রিক্ট। রসকষহীন। আপনার জীবন তো….”
লোকটা নিজের বাক্য সম্পূর্ণ করতেই পারল না, তার আগেই মীরা ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে ওঠে,
“আমার মধ্যে রসকষ আছে কি-না তা জেনে আপনি কী করবেন? মানুষের পারিবারিক কথার মধ্যে আপনি ঢুকতে যান কেন? নিজের মতো থাকেন না।”
মীরাকে হঠাৎই রেগে দিতে দেখে শেহজাদ ওর পাশে বসে ধীরস্বরে বলে,
“কী হয়েছে তোমার? রেগে যাচ্ছ কেন? লোকটা এমনিতেই বলেছে।”
মীরা চোখ-মুখ কুঁচকে ঝাঁঝালো স্বরেই বলল,
“আপনি চুপ করে বসুন। কোথাও যাওয়া লাগবে না। বিরক্ত লাগছে আমার।”
মীরাকে আবারও চোখ বন্ধ করে মাথায় হেলিয়ে বসে থাকতে দেখে শেহজাদ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে শুধালো,
“তোমার শরীর খারাপ লাগছে?”
হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ায় মীরা।
“মাথাব্যাথা?”
আবারও ইশারাতেই জবাব দেয়। শেহজাদ ব্যাগ থেকে ঔষুধের বক্স থেকে ঔষুধ বের করে পানির বোতলের সিপ খুলে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“নাও। এটা খেয়ে নাও।”
মীরা চোখ খুলে ঔষুধ দেখে হাতে নিয়ে খেয়ে নেয়। ফের চুপ করে থাকে। শেহজাদ কপালে লাগানোর বাম বের করে মীরার কপালের দুইপাশে লাগিয়ে আস্তে আস্তে মালিশ করে দেয়। চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই মীরার ওষ্ঠকোণে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। এরপর শেহজাদ জানালাটা পুরোপুরি বন্ধ করে পাশের সিটের লোকটাকে নম্রস্বরে বলে,
“কিছু মনে করবেন না। আমার স্ত্রী একটু অসুস্থ। তাই ওভাবে বলেছে।”
“আরে না, দাদা। আমার বউও এমন জানেন? সে প্রচণ্ড রাগী। তাই ভাবলাম আপনার আর আমার অবস্থা একই রকম।”
শেহজাদ হেসে জবাব দেয়,
“আমার ওয়াইফ রাগী না। ওর মাথাব্যাথা শুরু হলে ও শান্ত পরিবেশ চায়। মাথাব্যাথাটা ওর খুব বাজে ভাবে এফেক্ট করে তো।”
“ও আচ্ছা। তাহলে আমরাও আর কথা না বলি। পরে দেখব আপনার স্ত্রী আবার আমার উপর রেগে গেছে!”
বলেই লোকটা প্রাণখোলা হাসলো। শেহজাদ দেখলো কা*লো-মো*টা লোকটার মনের সৌন্দর্য তার ব্যাবহারে। শেহজাদও বিনিময়ে হেসে মীরা ও ফ্রিশা দুজনের মাথায়ই সামান্য হাত বুলিয়ে দিলো।
_________
প্রায় ঘণ্টা দেড়েকের ট্রেন জার্নি শেষে ওরা দার্জিলিং এসে পৌঁছে। রাতের নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই পাহাড়ি শহরটা যেন মায়ার ডাকে বারংবার ডাকছে। শেহজাদরা আগের থেকে বুকিং করা হোটেলে গিয়ে ওঠে। হোটেল রুমে এসেই কড়া চা অর্ডার করা হলো মীরার জন্য। শেহজাদ ও ফ্রিশা ফ্রেশ হয়ে বেরোনোর পর মীরা একেবারে গোসল সেড়ে বের হয়, মাথাব্যাথার জন্য। অনেকটাই কমে গেছে। চা খেতে খেতে মীরা বলে,
“রাতের খাবার খেয়ে একটু রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করব।”
“মাথব্যাথা কমেছে?”
“হুম অনেকটাই।”
“ওকে। তাহলে চা খেয়ে তৈরি হয়ে নাও।”
ফ্রিশা বলে,
“আমিও চা খাব।”
জবাবে মীরা বলে,
“ডিনারের পর। রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাব। দার্জিলিংয়ে এসে তো চা টাই খাবে। এখন যাও। তৈরি হয়ে নাও।”
ফ্রিশা খুশি হয়ে নিজের বার্বি সুটকেস খুলে জিন্স-টপস বের করে ওয়াশরুমে চলে যায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৭
আঁধারে আচ্ছন্ন খোলা আকাশের নিচে দার্জিলিংয়ের রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা পানের বিষয়টা হয়তো খুব সাধারণ। কিন্তু যখন পাশে দাঁড়ানো, আকাশপানে বিভোর হয়ে চা পানে ব্যাস্ত নিজ স্ত্রীর উন্মুক্ত চুলে শীতল হাওয়া দোল খেয়ে যায়! এবং তার নয়নজোড়া অজান্তেই পলক ঝাপটায়! মূহুর্তটা একজন স্বামীর নজরবন্দীতে মুগ্ধতার অপার সীমায় কি না থেকে পারে? উঁহু। একদমই না। মুগ্ধচিত্তে নিজ রমণীর নৈশরূপে মনের ভিতর উঠা প্র*লয়কারী ঝ*ড়কে ভীষণ শা*স*নে রুখে রেখেছে শেহজাদ। ফ্রিশা বেঞ্চে বসে আকাশের চ্যাপ্টাকৃতির চন্দ্রমাকে দেখছে আর বিস্কিট ভিজিয়ে চা খাচ্ছে। শেহজাদ মেয়ের পাশেই দাঁড়ানো। তারই খুব কাছে দাঁড়ানো মীরা। শেহজাদ এক পা পাশ এগিয়ে মীরার পেছনে দাঁড়িয়ে চাঁদের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে,
“ওই চাঁদকে এতো কেন দেখছো?”
মীরা নজর না ফিরিয়েই মুগ্ধ হেসে উত্তর করে,
“মানুষ বলে, চাঁদেরও কলঙ্ক আছে। কিন্তু আমার কাছে তো এই কলঙ্কই মোহ-মায়া। কলঙ্ক বয়েও যে সে উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে।”
আরও ঘনি*ষ্ঠ হলো শেহজাদ। মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে মীরার একদম কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“মেঘে মেঘে চাঁদ যে তোমার চাহনিতে মুখ লুকাচ্ছে তা দেখছো না? ”
ঘোর ভাঙে মীরার। শীতল সমীরণ ও প্রিয় মানুষটার শীতলতম কণ্ঠস্বর। হৃদমাঝারে কম্পন ধরানোর জন্য যথেষ্ট। ইতস্তত হয়ে একটু পাশ সরে আমতা আমতা করে মাথা নিচু করে বলে,
“হোটেলে ফিরে চলুন। শীত শীত করছে।”
শেহজাদ মাথা সোজা করে খানিক ঠোঁট বাকিয়ে নিরব হাসে। এই হাসি মীরা দেখলো না। তমসাবৃত অম্বরে কোনো মনু*ষ্য-কূলেরও নজরে এলো না। সে প্রত্যুত্তরে শুধু বলে,
“চলো!”
মীরা ফ্রিশার কাছে এসে বলে,
“ফ্রিশামনি, তোমার চা খাওয়া হয়নি?”
ফ্রিশা আদুরে স্বরে বলে,
“আমার কুকিজই তো আমার চা খেয়ে নিয়েছে, ফেইরিমাম্মা! তাই দাদুটা আরেকটু চা দিয়েছে।”
“জলদি ফিনিশ করো। আমরা হোটেলে ফিরব। ঠান্ডা পড়ছে ভীষণ।”
ফ্রিশা ইতোমধ্যে প্রায় ঠান্ডা হয়ে যাওয়া অবশিষ্ট চা টুকু খেয়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর মীরা ও শেহজাদের হাত ধরে চলতে থাকে।
________
পরদিন খুব ভোরে দার্জিলিংয়ের মনোরোম সূর্যদোয় দেখতে ওরা টাইগার হিলে হাজির হয়েছে। এখানে প্রায় অনেক পর্যটক ভীড় জমিয়েছে তুষারশৃঙ্গের সাথে সূর্যদোয় দেখতে। দূরে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শুভ্র পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টও দৃশ্যমান। হিমালয় পর্বতমালাকে দূর থেকে কতোই না চোখ জুড়ানো লাগছে কিন্তু কাছ থেকে এর উচ্চতা দেখলে রুহু কেঁপে উঠতে বাধ্য। খাড়া খাঁই কোনো দুর্বল হৃদয়ের মানুষের জন্য ভয়ংকর অনুভূতি তো বটেই।
ফ্রিশা সচরাচর দেরি করে ঘুম থেকে উঠে কিন্তু আজ এতো জলদি উঠতে হয়েছে বলে মনটা তার খারাপই ছিল। কিন্তু প্রকৃতির এই অপরূপ চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে সে এখন হাসছে, ছবি তুলছে। উৎফুল্ল সে। শেহজাদ, মীরা ও ফ্রিশার সিঙ্গেল, ডাবল সবরকমের ছবি তুলে দিয়ে এখন তিনজনের একসাথে একটা সেলফিই তুলে নিলো। এখানে কাকেই বা বিরক্ত করবে! মীরাও ওদের বাবা-মেয়ের একটা ছবি তুলে দেয়। ফ্রিশা এবার ফোন নিয়ে তার বাবা-মাকে একসাথে দাঁড়াতে বলতে বলতেই হঠাৎই আচমকা ধাক্কায় মীরা একদম রেলিংয়ের উপর আছড়ে পড়ে! শরীরের ভারসাম্য অধিকাংশই রেলিংয়ের বাহিরে যেতে নিলেই শেহজাদ খপ করে মীরার হাতটা ধরে টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসে। আকস্মিক কাণ্ডে মীরা ভয়ে হতবাক হয়ে শেহজাদের বু*কের সাথে একদম মিশে আছে। ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী ফ্রিশার ভয়ার্ত আর্তচিৎকারে আশেপাশের মানুষজন থেমে কৌতুহল দৃষ্টি ওদের দিকেই নিক্ষেপ করে রেখেছে। শেহজাদ সবাইকে হাতের ইশারায় ‘সব ঠিক আছে’ বুঝিয়ে মৃদু স্বরে মীরাকে বলে,
“কাম ডাউন, মীরা। ইউ আর ফাইন। ইউ আর সেইফ।”
মীরার হৃৎস্পন্দন নিজ স্বাভাবিক গতিতে নেই। সময় নিয়ে ধীরে ধীরে তা স্বাভাবিক হয়। ফ্রিশা মীরার ওড়না ধরে গাঁ ঘেঁষে আছে। খানিক স্বাভাবিক হলে শেহজাদ শুধায়,
“তুমি এতো কর্ণারে কীভাবে গেলে?”
মীরা মাথা নাড়ছে। ফ্রিশা জবাবে বলে,
“না, বাবা। ফেইরিমাম্মাম এতোটাও কর্ণারে ছিলো না। সামওয়ান পুসড ফেইরিমাম্মাম।”
শেহজাদ চিন্তিত হয়। কেউ কেন মীরাকে ধা*ক্কা দিবে? হয়তো অনিচ্ছাকৃত লেগে গেছে ভেবে শেহজাদ ওদেরকে নিয়ে সেখান থেকে চলে আসে।
এদিকে আড়াল থেকে একজন রে*গে জোড়ে ভূমিতে আ*ঘা*ত করে আর বলে,
“একটুর জন্য! ওই বাচ্চাটা চিৎকার না করলেই কেউ আজ মীরাকে বাঁচাতে পারতো না। পুচকে মেয়েটাই সব শেষ করে দিলো! ছোটো ম*রিচের ঝা*ল আসলেই বেশি!”
অতঃপর সে স্থান ত্যাগ করে।
_______
নিজেদের স্বাভাবিক করে শেহজাদ, মীরা ও ফ্রিশা একটা খাবারের ধাবা থেকে সকালের নাস্তা খেয়ে নেয়। অতঃপর ওরা দার্জিলিং মিউজিয়াম দেখতে বেরোয়। নেপালি জাতীর স্বাক্ষর বহন করে এই মিউজিয়ামটি। মিউজিয়াম ঘুরে-ফিরে দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি রাস্তায় হেঁটে হেঁটে ওরা ফিরেছে। এই ভাবনা এসেছে মীরার মা*থায়! তার এখন হাঁটতে ইচ্ছে করছে! শেহজাদও আর কী করবে? সাথে চলতে থাকে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। দুপুরের খাবার শেষে হোটেলে রেস্ট করে এখন ওরা এসেছে ‘হ্যাপি ভ্যালি টি স্টেটে’। এটি দার্জিলিংয়ের দ্বিতীয় প্রাচীন চা বাগান। এই চা বাগান থেকে পুরো দার্জিলিং শহরের প্যানোরোমিক সৌন্দর্য দেখা যায়। এখানে বসে বিখ্যাত ব্লাক টি এর সাথে পুরো শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করা যেন মনের জন্য এক কার্যকরি পথ্য হিসেবে কাজ করে। এই সুযোগ তো মিস করা যায় না। শেহজাদ, মীরারাও করলো না। তবে তার আগে পুরো চা বাগানটা ঘুরে তো দেখতে হবে। তারপর সূর্যাস্তের সময়কালে আয়েশ করে চা খাওয়া যাবে। গাইড ঠিক করে ওরা চা বাগান ঘুরছে। চা বাগানের বিষয়ে তথ্যও পেয়েছে। সময়টা ওদের বেশ সুন্দর ও উপভোগ্যই কে*টেছে।
সুবিশাল অম্বরের পশ্চিমাংশে এখন গাড়ো গোধূলি। গোধূলির ঈষৎ লালিমা পুরো আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। সূর্য ধীরে ধীরে নিজেকে আড়ালে ব্যাস্ত। এখন যে তার ঘুমের সময়! তাইতো পৃথিবীকে আঁধারে নিমজ্জিত করে নিদ্রায় আচ্ছন্ন হতে পাড়ি জমিয়েছে। এই সুন্দরতম দৃশ্য উপভোগ করাটা যদি হয় চা বাগানের মাঝে বসে চায়ের সাথে তাহলে তো কথাই নেই। মীরা ঘোরলাগা স্বরে বলে,
“যদি এই চা বাগানের মাঝে আমার একটা ছোট্টো বাড়ি থাকতো! এই সৌন্দর্য তবে শুধু স্মৃতিপটে না, আজীবনের জন্য জীবন্ত রাখতাম।”
হালকা হাসে শেহজাদ। ফ্রিশা উৎসাহী কণ্ঠে বলে ওঠে,
“চলো একটা বাড়ি বানিয়ে ফেলি।”
ফ্রিশার কথা শুনে শেহজাদ ও মীরক যেন হেসেই খু-*ন! ফ্রিশা কিয়ৎক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পিটপিট করে এই হাসির কারণ উৎঘাটন করার প্রচেষ্টায় থেকে ব্যার্থ হয়ে নিজেও হাসির রোলে সামিল হয়ে যায়।
______
পরদিন আরও কিছু জায়গা ঘোরাফেরা করে ওরা দার্জিলিং টু জলপাইগুড়ি আসে বাষ্প ইঞ্জিন চালিত ট্রেন ‘টয়ট্রেন’ দিয়ে। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে চলা এই টয়ট্রেনই কিন্তু পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ! ছবির মতো ছুটে চলা প্রকৃতি। এরপর জলপাইগুড়ি থেকে শিলিগুড়ি তারপর বাই এয়ার কোলকাতা এসে একরাত থেকে আবার পরদিন বাই এয়ার বাংলাদেশে চলো আসে। এদিকে কোলকাতার হুগলি নদীর উপর বিখ্যাত হাওড়া ব্রিজ যখন ওরা ঘুরতে গিয়েছিল তখনও আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। কেউ একজন খুব জোড়ে মীরাকে ধা*ক্কা দিয়ে যায়। ভাগ্যক্রমে এবারও মীরা বেঁচে যায়। সেই থেকে শেহজাদ কিছুটা চিন্তিত। একই ঘটনা দুইবার একইভাবে কীভাবে ঘটে? সব কি কোইন্সিডেন্স নাকি অন্যকিছু?
#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৪
সময়ের পাতা খুব দ্রুত উলটে যায়। ঋতু পরিবর্তন হয়ে শরৎ, হেমন্ত। তারপর এখন শীত ঋতু। পর্ণমোচী উদ্ভিদেরা নিজেদের রিক্ত করে প্রকৃতিতে কাঙালের রূপ নিচ্ছে। কনকনে শীতের ভোর সকালে মীরা ফজরের নামাজ পড়ে পুকুর পাড়ে শাল জড়িয়ে এসে বসেছে। গতকাল রাতেই তাঁরা কলকাতায় পৌঁছেছে। রাইমার বিয়ে যে আজ। একটু পরেই বাড়ির মহিলা সদস্যরা জল সইতে চলে আসবে। রাইমার দধিমঙ্গলের অনুষ্ঠান চলছে, আসার পথে মীরা রাইমার দুয়েকটা ছবি তুলে নিজেও ও-কে এক লোকমা খাইয়ে চলে এসেছে (এই বিষয় আমার তেমন জ্ঞান নেই)। শেহজাদ নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়েছে। আর ফ্রিশা এখনও জাগেনি। পুকুর পাড়ে বসে বসে গতরাতের কথা ভাবছে মীরা। রাইমা তাকে হাসি-ঠাট্টার মাঝেই হুট করে জিজ্ঞাসা করে বসে,
“তুই ভালোবাসিস জিজুকে? জিজু তোকে ভালোবাসে তো?”
এর বিপরীতে এক কথায় কোনো উত্তর দিতে পারেনি মীরা। সারারাত তার ঘুমও ঠিকমতো হয়নি এসব ভাবতে ভাবতে। আজ সতেজ, শীতল পরিবেশে চোখ বন্ধ করে নিজের মন থেকে উত্তর খুঁজছে। দুজনের কারোর জীবনেই তো কেউ প্রথম ভালোবাসা না। দ্বিতীয়বার কি ভালোবাসতে পেরেছে আদৌও? এই প্রশ্ন জর্জরিত মীরার মন মোহনা। বিগত ছয় মাসের স্মৃতি রোমন্থন করে মনের অভ্যন্তর থেকে খুব আকুল ভাবে সাড়া পেলো, সে দ্বিতীয় বার ভালোবাসতে পেরেছে। সত্যি পেরেছে। মুদিত আঁখি যুগল মেলে স্থির জলরাশির দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকালো। এই শুষ্কতম ঋতুতেও তার মনে ফাগুনের হাওয়া বয়ে যায়। ও*ষ্ঠকোণে ফুটে উঠে লাজরাঙা হাসি। খানিক সময় পেরোতেই রাইমার বাড়ির মহিলা সদস্যদের এদিকে আসারা পদধ্বনি শুনে মীরা উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর তাদের জন্য স্থান ফাঁকা করে সেখান থেকে চলে আসে। যদিও রাইমার কাকিমা, মীরাকে থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু মীরার এখন ফ্রিশাকে তুলতে হবে। তারপর রাইমার সাথে থাকতে হবে, তাই রাইমাদের বাড়ির পথে হাঁটা দেয়।
________
কুঞ্জদের বাড়ি থেকে কুঞ্জর গায়ে ছোঁয়ানো হলুদ এসেছে। এখন রাইমাকে উঠোনে আনা হয়েছে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য। মীরা ও রাইমার দুয়েকজন ভাবী ও কাজিন বোনেরা বরপক্ষ থেকে আসা মানুষদের আপ্যায়নে গিয়েছে। বরপক্ষ থেকে আসা এক সুদর্শন যুবক ছেলে তো মীরাকে দেখে সেখানেই হাঁ হয়ে বসে আছে। ফ্রিশা ওদিকে বাড়ির বাচ্চাদের সাথে খেলছে। মীরা ফাঁকা ট্রে হাতে সেখান থেকে চলেই আসছিল তখন সেই যুবকটি মীরাকে ডাকে। সে মীরার নামটা শুনতে পেয়েছে রাইমার ভাবি ও কাজিনদের মুখ থেকে ডাক শুনে। অচেনা কোনো পুরুষ কণ্ঠে নিজের নাম শুনে ভ্রু কুঁচকে পিছু ফেরে মীরা। ছেলেটি মীরার সামনে এসে কিছুটা এটিটিউটের সাথে হাত বাড়িয়ে বাঁকা হেসে বলে,
“হ্যালো। আমি রাহুল।”
মীরার মুখভঙ্গির বিন্দু মাত্র পরিবর্তন হয়নি। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে যখন যুবকটি মীরার থেকে কোনো প্রত্যুত্তর পেলো না তখন সে আবার বলে,
“আমি কুঞ্জের মাসতুতো ভাই। আপনি নিশ্চয়ই রাই বৌদির বোন হোন?”
মীরা মুখে জোরপূর্বক হাসির রেখার টেনে বলে,
“ওহ আচ্ছা। আমি রাইয়ের বোন না কিন্তু বোনের মতো বান্ধবী।”
“পরিচিত হতে পারি?”
মীরা তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সামনে দাঁড়ানো লোকটির কথা বলার ধরণ বুঝতে চাইলো তখন সবটা তার মস্তিষ্কে ধরা দেয়। লোকটা তার সাথে ভবিষ্যতে ফ্লার্টিং করার ধা*ন্দা করছে। মীরা মুচকি হেসে সেই আশায় জল ঢালতে বলল,
“কেন পারবেন না? আপনি তো আমার নাম জানেনই। সাথে এটাও জানলেন যে আমি রাইয়ের ফ্রেন্ড। এখন আমি আমার বাকি পরিচয়টাও দিচ্ছি। ওই যে দেখছেন (আঙুল তা*ক করে) একটা লোক পিলারে সাথে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে এদিকেই তাকিয়ে আছে? সেই লোকটা আমার স্বামী! আর একটু পরপর যে বাচ্চারা এদিকে দৌড়াদৌড়ি করছে না? তার মধ্যে যেই বাচ্চাটার রেড-ব্রাউন চুলের রং, সেই বাচ্চাটা আমার মেয়ে! আর কিছু জানতে চান?”
যুবকটি থতমত খেয়ে হা হয়ে একবার শেহজাদের দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার মীরার দিকে তাকাচ্ছে। মীরার মনে মনে ভীষণ হাসি পেলেও সে যত্র হাসলো না। ঘুরে চলে যেতে নিলে পেছন থেকে যুবকটি প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“কিন্তু আপনার সিঁথি তো ফাঁকা! আজকালকার মেয়েরক বিয়ের পরও সিঁথি ফাঁকা রেখে অবিবাহিত ছেলেদের গুমরাহ করে। কী যে মজা পায়! গ*ড নওজ!”
মীরা আবার পিছু ঘুরে মুচকি হেসে জবাবে বলে,
“আমি মুসলিম তাই বিয়ের পরও আমার সিঁথি ফাঁকা। আর কিছু জানার বাকি? বাকি থাকলে বাড়ি গিয়ে কুঞ্জদার থেকে জেনে নিবেন। ধন্যবাদ।”
মীরা আর দাঁড়ালো না। সেখান থেকে চলে আসলো। পিছনে ছেলেটা নিজের কপাল চাঁপড়ে নিজেদের লোকদের কাছে চলে গেল। মেহমান ঘর থেকে বেরোতেই শেহজাদ এসে মীরার পথ রোধ করে দাঁড়ালো। মীরা হুট করে শেহজাদকে গম্ভীর মুখে দেখে শুধালো,
“কী হলো? সামনে এসে দাঁড়ালেন কেন?”
শেহজাদ জবাব দেয় না। মীরা কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে বলে,
“কী বলবেন বলুন নয়তো আমি রান্নাঘরে এটা (ট্রে টা দেখিয়ে) রেখে আসি।”
শেহজাদ হুট করে মীরার হাত থেকে ট্রে টা এক প্রকার ছিনিয়ে নিয়ে বিয়ে বাড়ির মানুষজনদের মধ্যে কাউকে ডেকে ট্রে টা দিয়ে রান্নাঘরে রেখে আসতে বলে। তারপর মীরার হাত ধরে বাড়ির একটা ফাঁকা কোনায় নিয়ে যায়। মীরাকে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়া করিয়ে সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শুধায়,
“আরেহ! ওই ছেলেই তো আমাকে ডাকলো! আমি কি সেধে সেধে গিয়েছিলাম কথা বলতে? আপনি তো সেখানে দাঁড়িয়ে দেখলেনই।”
“কী কথা হচ্ছিলো তোমাদের?”
মীরা এবার দেয়ার থেকে সরে আসতে চাইলে শেহজাদ নিজের হাতের দ্বারা দেয়াল ধরে মীরার পথ রোধ করে। মীরা শেহজাদের চোখের দিকে তাকালে খানিক ঘাবড়ে যায়। শেহজাদের চোখে কেমন একটা রাগের আভাস! মীরা ভীতু স্বরে বলে,
“আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? তেমন কোন কথা হয়নি। আমি ওই ছেলেকে দেখাচ্ছিলাম যে আপনি আমার স্বামী, আর ফ্রিশামনি আমার মেয়ে। এটাই।”
“ওই ছেলে তোমাকে ডিস্ট্রাব করছিল?”
মীরা ভাবলো শেহজাদকে শান্ত করতে হবে। বলা যায় না, যদি কোনো ঝামেলা করে বসে? বরপক্ষের লোক ওরা। মীরা হুট করে শেহজাদের গলা জড়িয়ে বলল,
“ব্যাপার কী হুম? এতো পজেসিভ? ভয় হচ্ছে? যদি আপনার সুন্দরী বউকে কেউ নিয়ে নিতে চায়? ভালোবেসে ফেললেন বুঝি?”
আচমকা মীরার স্বর পালটে যাওয়াতে হতভম্ব হয়ে গেল শেহজাদ। সে মীরার কথা পাত্তা না দিয়ে বলে,
“সবসময় একটু বেশি বুঝো তুমি। আমি তো তোমার সেফটির জন্য বলছিলাম। বিয়ে বাড়িতে কিছু ছেলেরা মেয়েদের সাথে অস*ভ্য*তামি করার চেষ্টা করে। একটা অচেনা ছেলে তোমাকে ডাকলো, তুমি কথা বললে। তোমার সাথে কোনো অস*ভ্যতা*মি করেছে কী-না? যাইহোক বাদ দাও। অস*ভ্যতা*মি না করলে তো ভালোই। তুমি তোমার কাজে যাও।”
এই বলে শেহজাদ সেখান থেকে সরে যাচ্ছিল, তখনি মীরা শেহজাদের বাম হাতের কব্জি ধরে আটকায়। ফের শুধায়,
“ভালোবাসেন আমাকে?”
চলবে ইনশাআল্লাহ,
#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৫
শেহজাদ একদৃষ্টে মীরার মুখপানে দৃষ্টি স্থির রেখেছে। মীরার অনুভূতি মিশ্রিত প্রশ্নে তার মন হঠাৎই অশান্ত হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগের রাগ যেন কর্পূরের ন্যায় হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। প্রায় মিনিট খানিক পেরোনোর পর বিয়ে বাড়ির মানুষজনের হুড়োহুড়িতে চলাফেরার মধ্যে একজন হুট করে শেহজাদকে সামান্য ধা*ক্কা দিলে সে বাস্তবে ফিরে। মীরার উদগ্রীব নয়ন যুগলে তাকিয়ে থাকা যেন ভীষণ ভয়ের হয়ে দাঁড়িয়েছে তার জন্য। পরন্তু শেহজাদ নজর নামিয়ে মীরার হাত ছাড়িয়ে যেতে চাইলে মীরা ফের হাত আঁকড়ে ধরে আবার করুণ স্বরে বলে ওঠে,
“ভালোবাসেন না। তাই না? এটা মুখে বললেও আমি তেমন কিছু মনে করতাম না। বলে দিলে অন্তত মিথ্যে আশায় থাকতাম না।”
শেহজাদ এবারেও চুপ করে আছে। তাই জন্য মীরা নিজেই শেহজাদের হাত ছেড়ে দিয়ে ঠোঁটের কোণে বিস্তর কৃতিম হাসি টেনে এগিয়ে এসে বলে,
“আপনি তো পরশু সন্ধ্যার ফ্লাইটে ফিরে যাবেন। আমি যাচ্ছি না।”
শেহজাদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়েও যখন দেখলো মীরা উত্তর দিচ্ছে না। তখন প্রশ্ন করেই বসে,
“কেন যাবে না?”
“এখন আমার ফ্রি সময়। খাতাও দেখে শেষ করে এসেছি। তাই সময়টা একটু নিজের মতো থাকতে চাই। ফ্রিশাও আমার সাথে থাকবে।”
“তুমি সাডেনলি এসব কেন বলছো?”
“ইচ্ছে হলো তাই। আমার ইচ্ছে হতে পারে না? নাকি শুধু আপনারই ইচ্ছে হতে পারে? ফ্রি সময়ে বাড়ি ফিরে কী করব? আপনাকে দেখব? কেন দেখব? তার থেকে ভালো আমি প্রকৃতি দেখি। অন্তত মাইন্ড ফ্রেশ হবে।”
মীরা এবার শেহজাদকে ফেলে চলে যাচ্ছে। পেছন থেকে শেহজাদ বলে ওঠে,
“তুমিও আমার সাথে ফিরবে, মীরা।”
“না!”
“প্লিজ, মীরা। সবসময় জেদ করলে চলে না।”
“আশ্চর্য! আমার লাইফ, আমি জেদ করব। আমি তো জেদ নিজের সাথে করছি। এতে আপনার কোনো ক্ষতি তো হচ্ছে না।”
“মীরা!”
মীরা উত্তর না করে পেছন না ঘুরেই চলে যাচ্ছে। শেহজাদ হুট করে বলে ওঠে,
“নিজেরটাই দেখছো। আমি কীভাবে থাকব?”
থামে মীরা। পেছনে ঘুরে ফিরে এসে কড়া কণ্ঠে শুধায়,
“কেন? আমার এখানে থাকার সাথে আপনার কী সম্পর্ক? আপনার মেয়ের জন্য? ওকে। ফ্রিশাকে সাথে করে নিয়ে যান।”
“এখানে ফ্রিশার কথা আসছে না। আমি তোমার কথা বলছি।”
“আমার কথা কেন? আমি থাকলেও কী আর না থাকলেও কী? ইউ ডোন্ট লাভ মি রাইট? অভ্যাস হয়ে গেছি তাই? অভ্যাস বদলাতে শিখতে হয়। ইন ফিউচার, আমি না থাকলে তখন এই অভ্যাসটা আপনার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে।”
শেহজাদ আবার রেগে গিয়ে মীরা ডান হাতের কব্জি শক্ত করে ধরে টেনে কোথাও একটা নিয়ে যাচ্ছে। মীরা হতবাক হয়ে শেহজাদকে দেখছে। শেহজাদের চোখে যেন রোশা*গ্নির স্ফু*লিঙ্গ জ্ব*লছে। মীরা কয়েকবার হাত ছাড়তে বলেছে, নিজেও ছাড়াতে চেয়েছে। কিন্তু পারেনি!
শেহজাদ মীরাকে নিয়ে রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে এবার বলে,
“হঠাৎ কী হয়েছে তোমার? এমন করছো কেন?”
মীরা ছাড়া পেয়ে আবার আগের মুডে গিয়ে শান্ত হয়ে বসে। তারপর নিজের হাতের অবস্থা দেখতে দেখতে বলে,
“কী করলাম? কিছুই তো করিনি।”
“কিছু করোনি?”
“না তো। আপনিই বরং বেশি রিয়াক্ট করছেন। এখন আমার উচিত রাইয়ের কাছে থাকা! আর আপনি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন!”
শেহজাদ মীরার কাছে এগিয়ে ওর হাঁটুর সামনে বসে চোখের দিকে চেয়ে বলে,
“আমি যদি বলি ভালোবাসি, তবে তুমি খুশি হয়ে যাবে?”
মীরা কয়েক মূহুর্ত নিশ্চুপ থেকে বলে,
“মন থেকে বলতে হবে।”
“তাহলে মন থেকে বুঝতেও হবে। মুখে বললেই ভালোবাসা হয় আর না বললে হয় না? মুখে তো অন্যের খুশির জন্য কতোকিছুই বলা যায়। ভালোবাসা এক্টিভিটিতে বুঝতে হয়, মিসেস মীরা। সো এখন থেকে তাই করুন।”
অতঃপর মুচকি হেসে শেহজাদ উঠে দরজা খুলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। মীরা সেখানেই ঠায় বসে রয়। আপন মনে ভাবতে থাকে, ‘আমি কি একটু বেশিই ফোর্স করে ফেললাম? উনি কি রাগ করলেন? ধ্যাত শুধু শুধু। তবে পরশুদিন আমি সত্যি ফিরব না। দেখি উনি কী করে?”
এসব ভাবার মধ্যেই মীরার ফোন বেজে উঠলো। রাইমা কল করছে। মীরা ফোন রিসিভ না করেই দ্রুত ওর কাছে যেতে রুম থেকে বের হয়।
________
প্রায় সন্ধ্যার দিকে রাইমাকে নিয়ে পার্লার থেকে ফিরেছে মেয়েরা। রাইমাকে এতটা সুন্দর দেখাচ্ছে যে তা নিয়ে মেয়ে-বউদের মাঝে হাসির অন্ত নেই। লতানো ডিজাইনের লাল কাতান বেনারসি। পাড়ে পাতি-পুতির কাজে শাড়ির মাহাত্ম্য আরও বাড়িয়েছে। ভারী ফুল নেক জড়োয়া হার ও পাতলা চেইনের মতো একটা সিতা হার। টিকলি ও হালকা টানা দিয়ে ছোটো সোনার মুকুটের সাথে শুভ্র শঙ্খ মুকুট তো আছেই। কপালের কলকাটা ছোটোর মধ্যে অসাধারণ। দুই হাতেও একটা করে মোটা বালার সাথে শাখা-পলা। মীরা, রাইমাকে বসিয়ে রুমে এসে রাইমার জন্য গিফটটা নিয়ে আবার যায়। তারপর রাইমার হাত ধরে হাতে ডায়মন্ড গোল্ডের দুটো চুড়ি পড়িয়ে দেয়। রাইমা নিজের হাতে ব্রেসলেটটা দেখে বলে,
“পছন্দ হওয়া নিয়ে না। এতো গহনা এসব কি আমার খুব একটা পড়া হবে বল তো?”
“চুপ! তোদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়। পূজো এসব। পড়া হবে ঠিকই। এখন শান্ত হয়ে বস। একটু পড়েই পিঁড়ি নিয়ে আসবে। আমি একটু দেখি ফ্রিশা কই।”
এই বলে মীরা ফ্রিশাকে খুঁজতে বেরোয়। পথে শেহজাদকে দেখে যত্র থেমে যায়। সিলভার রঙের পাঞ্জাবি-পাজামাতে শেহজাদকে ভীষণ সুদর্শন দেখাচ্ছে। মীরা মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে এবার নিজের দিকে তাকায়। সিলভার রঙের বেনারসি শাড়ির সাথে সে মুক্তো ও স্বর্ণের, নেক পিস ও সিতা হার পড়েছে। চুলগুলো রিং করে খোলা রেখে অর্ধেকটা এক পাশ করে এনে রেখেছে। সাথে সাদা ডেইজি তো আছেই। তাকেও নিশ্চয়ই কম সুন্দর লাগছে না! এগিয়ে গিয়ে শেহজাদের পাশে দাঁড়িয়ে হালকা কেঁশে শুধায়,
“এখানে একা দাঁড়িয়ে কী দেখছেন? বিয়ে বাড়িতে আবার চোখের মতিভ্রম হলো না-কি?”
শেহজাদ এক পলক চেয়ে মুচকি হেসে প্রত্যুত্তরে বলে,
“পাশে যদি এমন একজন থাকে তবে নজর কোনো হুরপরীর দিকেও যাবে না।”
শেহজাদ সেখান থেকে নিরবে সরে যায়। মীরা ফ্রিশাকে সামনে খুঁজতে খুঁজতে পাশে তাকিয়ে দেখে শেহজাদ নেই! তদ্রুপ সে কোমড়ে হাত গুঁজে চোখ ছোটো ছোটো করে বলে,
“এই লোক আমাকে ফাঁকি দিলো! অভ*দ্র লোক!”
এরপর মুখ ভার করে ফ্রিশাকে খুঁজতে ছুটলো।
_______
পিঁড়িতে বসিয়ে মুখ পানপাতা দিয়ে ঢেকে রাখা রাইমাকে ছাদনাতলায় আনা হয়েছে। এবার ও-কে কুঞ্জের চারিপাশে পদক্ষিণ করানো হচ্ছে। অতঃপর শুভদৃষ্টি। শুভদৃষ্টিতে রাইমার থেকে কুঞ্জকেই বেশি লাজুক দেখাচ্ছিল। ফ্রিশা তার বাবার কোলে চড়ে বিয়ে দেখছে আর ফুল ছিটাচ্ছে। ফ্রিশা বলে,
“বাবা? রাই আন্টিকে নামাবে না? আন্টি যদি পড়ে যায়?”
“নামাবে সোনা। আরেকটু পরেই নামাবে।”
“ফেইরিমাম্মাম, তোমার বন্ধুকে বলো না? ভালো করে ধরে বসতে। পড়ে যাবে তো।”
মীরা হেসে জবাব দেয়,
“পড়বে না, বাচ্চা। আর তোমার রাই আন্টি যদি পড়েও যায় তোমার কুঞ্জ আঙ্কেল আছে তো। সারাজীবন সামলানোর জন্য।”
ফ্রিশা কী বুঝলো নিজেও জানে না। মিষ্টি হেসে বিয়ে দেখছে।
মালাবদল শেষে রাইমাকে নামানো হয় তারপর বিয়ের রীতিনীতি শুরু হয়। অতঃপর সাতপাক, সিঁদুর দানের মাধ্যমে রাইমা বাঁধা পড়ে কুঞ্জের সাথে। বিয়ের সব রীতি শেষে যেখানে বাসর জাগবে সেখানে রাইমা ও কুঞ্জকে নেওয়া হয়। সবাই নাচ-গানের মাধ্যমে আসর জমিয়ে রেখেছে। রাইমা এবার মীরাকে খুব করে ধরলো গান গাইতেই হবে। অতঃপর মীরাও গান ধরলো,
“আমার পরানো যাহা চায়।
তুমি তাই, তুমি তাই গো,
আমার পরানো যাহা চায়।
তোমা ছাড়া আর এ জগতে মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো
আমার পরানো যাহা চায়।
তুমি তাই, তুমি তাই গো
আমার পরানো যাহা চায়।
তুমি সুখ যদি নাহি পাও, যাও সুখের সন্ধানে যাও। (২)
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে, আর কিছু নাহি চাই গো।
আমার পরানো যাহা চায়।”
~রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(গানটা আমার ভীষণ পছন্দের। বাকিটুকু নিজ দায়িত্বে শুনে নিবেন।)
গানটা শেষ করে মীরা শেহজাদের দিকে তাকায়। দুজনের অপলক শুভদৃষ্টিতে রাইমা তুড়ি বাজিয়ে ভাঙিয়ে বলে,
“এই যে? বাসরটা আমার। আর তোমরা এখানে শুভদৃষ্টিতে মেতে আছো? নট ডান জিজু।”
শেহজাদ খানিক লজ্জা পেয়ে যায়। মীরা তো কপট রা*গ দেখিয়ে রাইমাকে দুয়েকটা লাগিয়েও দিয়েছে। এরপর হাসি-আড্ডায় রাত দেড়টার মতো বেজে গেলে শেহজাদ ঘুমন্ত ফ্রিশাকে নিয়ে সেখান থেকে উঠে যায়। মীরাকে তো রাইমা উঠতেই দিবে না। তাদের কথাই আছে রাইমার বাসর জাগাতে মীরাকে সাথে থাকতে হবে।
পরদিন সব রিচুয়ালের পর কনে বিদায় হয়। যাওয়ার সময় রাইমার ও তার পরিবারের কান্নাতে মহল বেশ ভার। মীরা ও শেহজাদরা রাইমাদের বাড়ি থেকে একটা হোটেলে ওঠলো। যদিও রাইমার মা-কাকিরা নিষেধ করছিলো কিন্তু ফ্রিশার বিয়ে বাড়ির ভিড়ে শরীর খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। দুই রুমে হোটেলে উঠেই ফ্রিশা কোলাহোল মুক্ত পরিবেশ পেয়ে ঘুমিয়ে গেছে।
_______
রাইমার বৌভাতের অনুষ্ঠানও খুব সুন্দর ভাবে মিটে গেছে। গাড়ো নীল শাড়িতে রাইমাকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছিলো। বৌভাতের অনুষ্ঠানে শেহজাদ মীরার হাতে তিনটি এয়ার টিকেট ধরিয়ে দিয়ে বলে,
“আমরা দার্জিলিং যাচ্ছি।”