Saturday, August 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 467



বেড়াজাল পর্ব-১৭+১৮

0

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #১৭

চন্দ্রা কফি হাউসেবসে বসে তার দিদির ব্যাপারটা ভাবছিল। খেয়াল করেনি যে আতিফ তার সামনে দাঁড়িয়ে।
আতিফ চন্দ্রাকে আগেই দেখেছিল ফটোতে আগে। তাকে সিয়াই দেখিয়েছিল চন্দ্রা আর সিয়ামের একসাথে ফোটো বিধায় তার চিনতে অসুবিধা হয়নি। আতিফ এবার কিছুটা গলা ঝারার ভান করলো। সেই আওয়াজ শুনে চন্দ্রা ভাবনার জগৎ থেকে বেড়িয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলো একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে সিয়া যেমন আতিফের বর্ণনা দিয়েছিল তেমনি ঠিক। চন্দ্রা উঠে দাঁড়িয়ে বললো ” আতিফ..? ” আতিফ বললো “হ্যাঁ আমিই আতিফ” চন্দ্রা চেয়ার দেখিয়ে বললো “প্লিজ সিট”
আতিফ চেয়ার টেনে বসল চন্দ্রার মুখোমুখি।
চন্দ্রা এবার প্রশ্ন করলো “তা আতিফ তোমায় এখানে কেন ডেকেছি তা নিশ্চই বুঝতে পারছো..?”
আতিফ হ্যাঁ সূচক ঘাড় নাড়িয়ে বললো “হ্যাঁ সেই একই বিষয় নিয়ে আমরও কিছু বলার আছে।”
চন্দ্রা দুটো কফি অর্ডার দিয়ে বললো “আমিই তাহলে বলি আগে..?” আতিফ সম্মতি দিল। চন্দ্রা বলতে শুরু করলো “তা আতিফ আমি যা সিয়ার কাছ থেকে শুনলাম তোমাদের রিলেশন অনেককটা বছরের। তা হটাৎ এমন কি হলো যে তুমি সিয়াকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছো..?”
আতিফ এবার মাথা হালকা নীচু করে বললো “কারণটা হচ্ছে আমার মা তিনি মেনে নিতে পারছেন না সিয়াকে। তিনি আগে থেকেই আমার জন্যে মেয়ে দেখে রেখেছিলেন কিন্তু আমায় জানাননি। এখন জোর করছেন আমায় তাকেই বিয়ে করতে হবে।”
চন্দ্রা পুরো কথাটা শুনে বললো “তা এই মায়ের ব্যাপারটা তোমার এতদিন রিলেশন চালিয়ে যাওয়ার সময় মনে পড়েনি..?” আতিফ বললো “না মা সিয়াকে আমার বান্ধবী হিসেবে বেশ পছন্দ করেন তবে বউ হিসেবে তিনি মানতে পারবেন না জানিয়েছেন।”
চন্দ্রা এবার মুখটা খানিকটা শক্ত করে বললো ” তা তুমি কেনো ভালো করে বোঝাচ্ছেনা মাকে..?তুমি যদি বলো তাহলে আমরা কথা বলতে পারি তোমার মায়ের সাথে।”
আতিফ আঁতকে উঠে বললো “না না আমি মাকে বুঝিয়েছি কিন্তু মায়ের উপর কথা বলার সাহস আমার নেই। আমি মাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করি আর ভালবাসি তার কথার খেলাপ আমি করতে পারবো না।”
চন্দ্রা এবার খানিকটা রেগে বললো “আর সিয়ার এতবছরের ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে..? মেয়েটা এতবছর ধরে নিঃস্বার্থ ভাবে যে তোমার প্রতি ভালোবাসো উজাড় করে দিল..? তার কি..?”
আতিফ উত্তর দিলো না। বলা যায় ভাষা খুঁজে পেলো না। কিছুক্ষন পর সে বললো “আমি এসব কথা শুনতে চাইনা ভাবী। আমি সম্পর্ক তাকে আর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবনা এই শেষ কথা। মায়ের বিরুদ্ধে যাওযার ক্ষমতা আমার নেই।” এই বলে ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে চন্দ্রার হাতে দিয়ে বলল “আগামী মাসের পঁচিশ তারিখ আমার বিয়ে আপনারা আসবেন না জানি তাও আমন্ত্রণ রইলো।”
চন্দ্রা কার্ডটা নিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। সে এবার বুঝলো যে মানুষ নিজে থেকে বলদাতে চায় তাকে শত চেষ্টা করেও ফিরিয়ে আনা যায় না। চন্দ্রা আর কথা না বাড়িয়ে শুধু বললো “আর কিছু বলার নেই আমার। শুধু এইটুকুই বলার যা তুমি করবে তাই তুমি ফিরে পাবে অন্যরূপে অন্যভাবে প্রস্তুত থেকো।” এই বলে কার্ডটা চন্দ্রা ব্যাগে রেখে কফি হাউস থেকে বেরিয়ে পড়লো।

____________________________________

চন্দ্রা বাড়ি ফিরে এসে সিয়ার রুমে গেলো। সিয়া তখনও একই ভাবে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে ছিল। চন্দ্রা গিয়ে আস্তে করে সিয়াকে ডাক দিতেই সিয়া একপ্রকার দৌড়েই এলো চন্দ্রার সামনে। চন্দ্রাকে কিছু বলতে না দিয়ে সিয়া বললো “কি হলো ভাবী..? আতিফ কি বললো..?তুমি মানতে পেরেছ তাকে..?বলো না ভাবী বলো না চুপ করে আছো কেনো..?” চন্দ্রা কি বলে সান্তনা দেবে বুঝতে পারছিলো না। সে ভেবেছিল বাড়ি এসে কিছু করে বুঝিয়ে দেবে সিয়াকে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে ভুল ছিল। সে এখন এই পাগল মেয়েটাকে বোঝাবে হয়ে সে এতদিন অপাত্রে ভালোবাসা ঢেলেছিল। চন্দ্রা সিয়াকে বাচ্চাদের মত করে বুঝিয়ে শান্ত করলো। আতিফের সব কথাই খুলে বললো। শুধু বিয়ের ব্যাপারটা চেপে গেলো, এখন বিয়ের ব্যাপারটা তুললে সিয়া না জানি কি করে ফেলবে।

দিভায়ের চিন্তা সিয়ার ব্যাপারটা নিয়ে চন্দ্রা ভীষণ ঘেঁটে ঘেঁটে ছিলো। তারপর সিয়ামের হাতে নিজের পার্সোনাল ডায়েরি হাতে দেখে চন্দ্রা হঠাৎই মেজাজ বিগড়ে যায়।
এক দৌড়ে গিয়ে সিয়ামের হাত থেকে নিজের ডায়েরি টা একপ্রকার ছিনিয়েই নিলো চন্দ্রা। সিয়াম চন্দ্রাকে দেখে হালকা হেসে কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু চন্দ্রা সেসব না শুনেই মেজাজ দেখিয়ে বললো ” আপনাকে কে অধিকার দিয়েছে আমার পার্সোনাল ডায়েরি ধরার..?ভুলে যাবেন না আপনাকে আমি স্বামীর অধিকার এখনও দিইনি যে সেই অধিকারে আপনি আমার পার্সোনাল জিনিস হাত দেবেন।”
এই বলে চন্দ্রা ডায়েরিটা নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। এইদিকে যে তার কথায় একজনের হৃদয়ের শত ভাগ হলো সেই দিকে তার নজর গেলো না।

রুম থেকে বেরোনোর কিছুক্ষন পর চন্দ্রা বুঝতে পারলো সে বোধহয় মাথা গরমে একটু বেশিই বলে ফেলেছে। সে পুনরায় সিয়ামের রুমে সিয়ামকে খুঁজতে গিয়ে দেখে সিয়াম নেই। সারা বাড়ি খোঁজ করলে দারোয়ান চাচা জানায় সিয়াম কিছুক্ষন আগেই অফিসের জন্য বেরিয়ে গেছে। চন্দ্রার এবার ভীষন অপরাধ বোধ হলো নিজের উপর। কি দরকার ছিল মানুষতাকে ওভাবে বলার।
এসব ভাবতে ভাবতেই চন্দ্রার ফোন বেজে উঠলো। চন্দ্রা তাকিয়ে দেখলো ইন্দ্রা ফোন করেছে। চন্দ্রা ফোন তুলতেই ইন্দ্রা বললো ” হ্যালো চন্দ্রা। বলছি একটু তাড়াতাড়ি আয়না এই বাড়ি বাবার শরীরটা খারাপ করেছে। আমি একা পারছি না।” চন্দ্রা এবার বিচলিত হয়ে বললো “কি বলিস দিভাই আবার কি হলো..? দাঁড়া আমি দশ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়েই বেরোচ্ছি।” এই বলে চন্দ্রা ফোন রেখে রেডি হতে চলে গেলো।
রেডি হয়ে এসে এক সার্ভেন্টকে সব বুঝিয়ে দিলো যে সিয়ামের অফিস থেকে আসার পর কি কি লাগে। আর তার কাছেকাছে থাকতে যাতে তার অসুবিধা না হয়।
এই সব বুঝিয়ে চন্দ্রা বেরিয়ে গেলো ওই বাড়ির উদ্দেশ্যে।
.
.
.
সিয়াম বাড়ি এলো সন্ধ্যার দিকে এসেই চন্দ্রাকে না দেখতে পেয়ে চন্দ্রার নাম ধরে ডাকল দুই একবার। তখনই সার্ভেন্ট এসে বললো “স্যার বৌমনি তো বাড়িতে নেই বাপের বাড়ি গেছে কি দরকারে আপনার ফোন বন্ধ তাই বললো আপনাকে যেনো জানিয়ে দিই।” সিয়াম এবার ফোন হতে নিয়ে দেখলো সেটা সুইচ অফ হয়ে পড়ে আছে।
সিয়ামের এবার ফোন টাকে তুলে আছার মারতে ইচ্ছে হলো, কিন্তু অদতেই দোষ তার ভেবে নিজেকে শান্ত করলো। সকালে জরুরী ডাক পড়ায় তাকে একটু তাড়াতাড়িই অফিস যেতে হয়েছিল। চন্দ্রাকে বলারও সময় পায়নি। সিয়ামের এবার মনে হলো চন্দ্রা তার উপর হয়তো রেগে আছে। চন্দ্রার ফোন ফোন লাগিয়ে দেখলো সে কল রিসিভ করছে না। সিয়াম তা দেখে চিন্তায় ইন্দ্রাকে ফোন করলো।
ইন্দ্রা জানালো চিন্তার কিছু নেই। তার বাবা এখন ঠিক আছেন চন্দ্রা একটু ফাঁকা হলেই তাকে ফোন করে নেবে।
সিয়াম শুধু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে সেটা শুনে।
_____________________________

চন্দ্রা রাত ৯ টার পর একটু ফ্রি হয়ে বসলো নিজের রুমে। আজ সারাদিন তার অক্লান্ত পরিশ্রম গেছে। ফোন দেখারও সুযোগ পায়নি সে। সিয়ামের কথা মাথায় আসতেই দেখলো সিয়ামের 15+ মিসড কল হয়ে রয়েছে। চন্দ্রা কল ব্যাক করলো কিন্তু ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হলো না। চন্দ্রার এবার ভীষণ খারাপ লাগা শুরু হলো।
কিছুক্ষন পর দরজায় কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে চন্দ্রা নীচে গিয়ে দেখলো তার নামে একটা পার্সেল এসেছে। চন্দ্রা সেটা নিয়ে দেখলো সিয়ামই পাঠিয়েছে তাকে।
চন্দ্রার এবার মুখে হালকা হাসি ফুটলো। নিজের রুমে এসে পার্সেলটা খুলতেই প্রথমে তার চোখে পড়লো একটা চিরকুট। তাতে লেখা….

প্রিয় চন্দ্রাবতী❤️

আমার বলে সম্মোধন করলাম না কারণ সেই অধিকার আমি পাইনি। নিজের দিক দিয়ে যতটা হয় আমি আমাদের সম্পর্কটায় দেওয়ার চেষ্টা করেছি জানিনা কতটুকু কি পেরেছি। কাল আমাদের বিয়ের ছয় মাস পূর্ণ হবে তাই তোমার জন্য স্পেশাল কিছু অরেঞ্জ করেছি। এই পার্সেলে কিছু উপহার রইলো তোমার জন্য। পছন্দ হলে কাল একবার তোমায় আমার দেওয়া এই উপহার গুলোতে সজ্জিত দেখতে চাই। ইচ্ছে হলে পরো আমি জোর করবো না। তবে কাল অবশ্যই এই ঠিকানায় পৌঁছে জেও বিকেল ৬ টায়। অনেক বড়ো সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য। আমি অপেক্ষায় থাকবো।

ইতি
সিয়াম

চন্দ্রা চিরকুটটা নিয়ে একটা বড়ো হাসি দিল। কালকের কথাটা তার মাথা থেকেই বেড়িয়ে গিয়েছিলো। সে নিজেও তো কত কিছু প্ল্যান করে রেখেছিল এই দিনটার জন্য। তার এতদিনের একটু একটু করে সঞ্চয় করা অনুভুতি সিয়ামকে ব্যাক্ত করবে বলে এই দিনটাই বেছে রেখেছিল চন্দ্রা।
চন্দ্রা ঠিক করলো কালই সে তার সব অনুভুতি মনের এতো ব্যাকুলতা সব প্রকাশ করবে। সে ভালোই বুঝেছে এই মানুষ টাকে ছাড়া তার কখনই ভালো থাকা হবে না। জীবনে প্রাণ খুলে বাঁচতে গেলে তার এই মানুষটাকেই চাই।
তাই আর ফোন না করে পার্সেল টা পাশে রেখে চিরকুটটা বুকে জড়িয়ে শুয়ে পড়লো চন্দ্রা।

#চলবে..?

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #১৮

আজ শুক্রবার। পরিষ্কার আকাশ রোদ ঝলমল করছে চারিদিকে, চন্দ্রার খুশিতে যেনো রোদও সামিল হয়ে নিজের কিরণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সকাল থেকেই চন্দ্রা বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে। কখনো গুনগুন করছে তো কখনো বাড়ির এদিক সেদিক লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। আর মাঝে মাঝে গিয়েই সিয়ামের দেওয়া শাড়ীটা নিজের গায়ে ফেলে আয়নায় দেখছে।

ইন্দ্রা বেশ অনেক্ষণ ধরেই চন্দ্রার কার্যকলাপ লক্ষ্য করছিলো। শেষে আর নিজেকে ধরে না রাখতে পেরে চন্দ্রাকে জিজ্ঞেস করেই ফেললো..
–এই চন্দ্রা কি হয়েছে বলতো আজ তোর..? এতো খুশি কিসের..?আজ কিছু আছে..?সকাল থেকে দেখছি কেমন খরগোশের মতো এদিক সেদিক লাফিয়ে বেরাচ্ছিস। কি এমন হলো আমায়ও একটু বল..?

ইন্দ্রার শেষের কথাটায় ছিলো দুষ্টুমির আভাস। চন্দ্রা তা ভালই ধরতে পারলো। এবার তার নিজের মনের মধ্যেই প্রশ্ন জাগলো আসলেই কি সে একটু বেশি লাফাচ্ছে খুশির ঠেলায়..? তারপর নিজেকে সামলে বললো ” ক-ক-ক-ই, আমাকে আবার কই লাফাতে ঝাপাতে দেখলি..? হ্যাঁ মেজাজটা হালকা ফুরফুরে ব্যাস এই টুকুই। তোর এই আমার ওপর নজরদারি করাটা আর গেলো না।”
ইন্দ্রা এবার মুখটা বেজার করে বললো “যা বাব্বা নরজদারি কই করলাম..?উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছেস তাই জিজ্ঞেস করলাম কারণটা কি..?”
চন্দ্রা এবার তাড়া লাগিয়ে বললো “এই যা তো তুই তোর কাজে যা আমার পিছনে লাগা ছেড়ে।”
ইন্দ্রা চন্দ্রার দিকে মুখ বেঁকিয়ে চলে গেল। চন্দ্রা আবার ব্যাস্ত হয়ে পড়লো নিজের শাড়ি গয়নাগাটি নিয়ে।

___________________________________

বিকেল পাঁচটা।

চন্দ্রার এবার হার্টবিট ফাস্ট হতে শুরু করেছে। এতো ভেবে ভেবেও এখনও সে রেডি হয়ে উঠতেই পারেনি। সে ভেবেছিল দিভাই কে সব কথা এসে বলবে। কিন্তু এখন তো দেখছে তাকে দিভাইয়ের হেল্প নিতেই হবে। অগত্যা চন্দ্রা শাড়ি রেখে ইন্দ্রাকে টেনে টেনে নিয়ে এলো নিজের রুমে।ইন্দ্রা এবার নিজের হাতটা চন্দ্রার হাত থেকে ছাড়িয়ে বললো “কি হয়েছে কি বল তো..? এতো তাড়া কিসের তোর..? আর এই শাড়ি গয়না..এই তুই সত্যি করে বল তো কই যাবি তুই..?”
চন্দ্রা এবার আমতা আমতা করে সিয়ামের কাছে যাওয়ার কথাটা বললো।
ইন্দ্রার মুখে এবার দুষ্টুমির হাসি দেখা দিলো। ইন্দ্রার এই হাসি দেখে চন্দ্রা চোখ বড়ো বড়ো করে বললো “এই জন্যে ঠিক এই জন্যেই আমি তোকে আগে জানতে চাইনি। জানতাম আমি তুই আবার পিছনে লাগবি।”
ইন্দ্রা শাড়িটা হাতে নিতে নিতে বলল “কই আর পিছনে লাগতে দিস বল তুই..?আমি কি একবারও জিজ্ঞেস করেছি বল যে তুই আজ রাত বাড়ি ফিরবি কিনা..?”

চন্দ্রা বোধহয় বুঝলো কথার ইঙ্গিতটা। চমকে উঠে বললো ” দিভাই তুই আবার শুরু করেছিস..?যা তো তুই আমি একাই তৈরি হয়ে নেবো।”
ইন্দ্রা শব্দ করে হেসে বললো “আমি তো, আজ ওই বাড়ি যাবি কিনা সেটার কথা বলছিলাম।”
চন্দ্রা লাজুক মুখটা লুকোবার জন্য বাইরের দিকে তাকিয়ে বললো “থাক তোকে আর এক্সপ্লেনেশন দিতে হবে না।”

ইন্দ্রা হেসে চন্দ্রাকে তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। পাক্কা দেড় ঘন্টা সময় নিয়ে চন্দ্রাকে রেডি করে আয়নার সামনে দাঁড় করালো।
চন্দ্রা নিজেকে দেখে যেনো নিজেই চিনতে পড়লো না। পড়নে সাদা ডিজাইন করা শাড়ি, হাতে চুড়ি, কানে ঝুমকো, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক আর হালকা মেকাপ। চন্দ্রা নিজেকেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত ছিল আয়নায়।

ইন্দ্রা তা দেখে হালকা গলা ঝেড়ে বললো “বলছি কি অ্যাম্বুলেন্স কি এখন থেকে ফোন করে রাখবো..?”
চন্দ্রা ভ্রূ কুচকে বললো “মানে..? অ্যাম্বুলেন্স কেনো..?”
ইন্দ্রা এবার চন্দ্রার দুই কাঁধে হাত দিয়ে পিছন থেকে বললো “না মানে যদি তোর বর আজ তোকে দেখে অজ্ঞান হয়ে যায়..? আচ্ছা ধর বাইচান্স চিন্তেই পারলো না তুই ওর বউ তাহলে..?”
চন্দ্রা এবার ইন্দ্রাকে হালকা মেরে লাজুক হেসে বললো “যা তো তুই এবার।” ইন্দ্রা হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

__________________________

চন্দ্রা ঠিকানা হাতে নিয়ে একটা ফার্মহাউসের সামনে দাঁড়িয়ে। রিকশাওয়ালা তো এই বাড়িটাই বলে নামিয়ে দিল তাকে। বাড়িটি বেশ সুন্দর দেখতে। সামনে সিয়ামদের বাড়ির সামনের মতো বড়ো গার্ডেন ফুল দিয়ে সাজানো।
চন্দ্রা ধীরে ধীরে প্রবেশ করলো বাড়িটির ভিতর। সামনেই সর্ভেন্ট দাঁড়িয়ে ছিল। তারা চন্দ্রাকে দেখেই সামনে এগিয়ে এসে বললো..
–ম্যাম আসুন। আমি আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি স্যারের কাছে।
চন্দ্রা এবার যেনো একটু মনে সাহস পেলো। সার্ভেন্টটা চন্দ্রাকে একটা রুমের সামনে নিয়ে গিয়ে বললো…
–আপনি ভিতরে যান ম্যাম স্যার আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। এই বলে সে চলে গেলো।

চন্দ্রা আসতে আসতে ভিতরে ঢুকলো রুমের বেশ অন্ধকার দেখে ভয়ে যেই দরজা দিয়ে পুনরায় বেরোতে যাবে ওমনি আলো জ্বলে উঠলো রুমের। সাথে কিছু গোলাপ ফুলের পাপড়ি এসে চন্দ্রার মাথায় পড়লো। চন্দ্রা চমকে পিছনে তাকাতেই দেখলো সিয়াম হাসি মুখে হুইচেয়ারে বসে আছে।
সিয়ামকে আজ পুরো অন্যরকম লাগছে। তার সাদা শাড়ির সাথে মিলিয়ে সেও আজ সাদা শার্ট পড়েছে। চন্দ্রা কি আরেকবার ক্রাশ খেলো..?
ওপর দিকের মানুষটার যে তার থেকে খারাপ অবস্থা চন্দ্রা বুঝতেই পারলো না।

সিয়ামের হার্টবিট ভীষণ ফাস্ট চলছে। না চন্দ্রাকে তো সে এইভাবে সেজেগুজে প্রথম বার দেখছে না, তাহলে কেনো প্রত্যেকবার তার একই অনুভুতি কাজ করে চন্দ্রাকে দেখলে.? কেনো প্রত্যেকবার সে মুগ্ধ হয় এই রমণীর প্রতি..?বারবার তোলপাড় করে তার সমস্ত অনুভূতি।
চন্দ্রার সমস্ত রূপই সিয়ামের খুব পছন্দের। এই যো এখন সে অবাক দৃষ্টিতে চোখ গোল গোল করে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে আছে এই রূপও সিয়ামকে ভিতর থেকে ভীষণ আকর্ষন করছে।
সিয়াম এবার নিজেকে সামলে চন্দ্রার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো “ওয়েলকাম ওয়াইফি। চারিপাশটা কেমন লাগছে বললে না তো..?” চন্দ্রা এবার হুঁশে ফিরে চারিপাশ টা দেখলো। বেশ সুন্দর ফুল বলুন দিয়ে ডেকোরেশন করা চারিদিক। চন্দ্রার মুখে এবার আপনাআপনিই হাসি ফুটে উঠলো। সিয়াম এবার চন্দ্রাকে নিয়ে গিয়ে একটা টেবিলের সামনে বসলো। টেবিল টাও বেশ সুন্দর করে ডেকোরেট করা। চন্দ্রার মনটা আরো খুশি হয়ে গেলো।

কিছু সময় পেরোনোর পরও চন্দ্রা দেখলো সিয়াম একদৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে তার দিকে। চন্দ্রা এবার লজ্জা পেয়ে ইতস্তত করে সিয়ামের উদ্দেশ্যে বললো “কি দেখছেন ওমন করে..?”
সিয়াম হালকা হেসে উত্তর দিলো “দেখছি না ভাবছি, ভাবছি তোমার নামটা এক্কেবারে মিলে গেছে তোমার সাথে। আজ সত্যি সত্যি মনে হচ্ছে চাঁদ নিজে হেঁটে আমার ঘরে এসেছে।”

চন্দ্রা এবার ভীষণ লজ্জা পেলো। নিজের এতো প্রশংসা শুনতে সে অভ্যস্ত নয়। সিয়াম এবার হেসে বললো “চন্দ্র তুমি কি জানো লজ্জা পেলে তোমায় লাল টমেটোর মত লাগে। দেখো গাল গুলো কেমন লাল লাল হয়ে গেছে বলেই পাশ থেকে একটা ছোট্ট আয়না ধরলো চন্দ্রার মুখের সামনে। চন্দ্রা আয়নায় নিজেকে দেখে ফিক করে হেসে ফেললো।
সিয়াম সেই হাসি দেখে শুকনো চোখে তাকিয়ে বললো “এভাবেই হাসতে থেকো চন্দ্র। হাসলে তোমায় ভীষণ মিষ্টি লাগে। কক্ষনও যেনো তোমার চোখে জল না আসে এমনকি আমি না থাকার পরও।”

চন্দ্রা এবার বিস্মিত হলো মনের আকুলতা না চাপতে পেরে জিজ্ঞেস করলো “এমন করে কেনো বলছেন..? কোথায় যাবেন আপনি..?আপনাকে না বারণ করেছি এইসব কথা বলতে। আর কি সারপ্রাইজ এর কথা বলেছিলেন আপনি কই সেই সারপ্রাইজ..?”
সিয়াম এবার আলতো হেসে বললো ” বলা যায় না চন্দ্র কার জীবনে কি মোড় আসে সময়ের স্রোতে কে কোথায় ভেসে যায়।”
চন্দ্রার এবার ভালো লাগছে না মানুষটা এসব কি কথা বলছে আজকের দিনটাতে। চন্দ্রা কিছু বলতে যাওয়ার আগেই সিয়াম একটা খাম বাড়িয়ে চন্দ্রার টেবিলের কাছে রাখলো। চন্দ্রা তাতে হাত না দিয়ে বললো “কি আছে এতে..?”
সিয়াম সোজাসাপ্টা জবাব দিল “ডিভোর্স পেপার”

চন্দ্রার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। সে ভাবেইনি এরকম কিছু হতে পারে। কাঁপা কাঁপা হাতে খামটা হাতে নিল কিন্তু খুললো না।

কিছুক্ষন পিনপিনে নীরবতা কাজ করলো দুজনের মাঝেই।
তারপর সিয়ামই আগে মুখ খুললো। হালকা গলা ঝেড়ে বললো ” চন্দ্র ”
চন্দ্রা এবার চেঁচিয়ে উঠলো “একদম ডাকবেন না আমায় এই নামে। আপনি এই সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য আমায় এখানে ডেকেছেন..? আগে একটুও টের পেলে আমি মোটেই আসতাম না এখানে। ” বলে মাথা নীচু করে ফেললো টপ টপ করে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরলো।

সিয়াম এবার চন্দ্রাকে কাঁদতে দেখে চন্দ্রার দিকে এগিয়ে এসে বসলো। চন্দ্রার মুখের কাছ থেকে চুল সরিয়ে কিছু বলতে যেতেই চন্দ্রা সিয়ামের হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বললো “স্পর্শ করবেন না আমায় একদম। খারাপ লোক একটা। এতদিন যে নিজের মায়ায় আটকালেন তার প্রতিদিন কে দেবে..?নিজেকে আমার অভ্যাসে পরিণত করলেন তার দায় ভার কে নেবে..? বলুন.?” বলে আবার চন্দ্রা কান্নায় ভেঙে পড়ল।
সিয়াম স্বাভাবিক ভাবে বললো “মায়া একসময় কেটে যাবে চন্দ্র । অভ্যাসও বদলে যাবে। সময় সব বদলে দেয় চন্দ্র, দেখই না কয়েক মাস আগেও তুমি আমার থেকে ডিভোর্স চাইতে মুক্তি চাইতে আমার কাছ থেকে। আর আজ..?আমি কারোর জীবনের বোঝা হতে চাই না চন্দ্র। আমি চাই তুমি পাখির মত আকাশে উড়ে বেড়াও নিজের স্বপ্ন পূরণ করো। আমার থেকে অনেক ভালো একজনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে ডিজার্ভ করো তুমি চন্দ্র। তাই তো দেখো না আজ পর্যন্ত স্বামীর অধিকার টুকুও দিতে পারেনি আমায়। বন্ধুত্ত্ব আলাদা জিনিস চন্দ্র আর ভালোবাসা আলাদা। আমরা সারাজীবন বন্ধু হয়ে থাকতেই পারি কিন্তু তাতে কি সংসার হবে..? উল্টে তোমার জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে অকালে। তাই যা ডিসিশন নেবে মাথা ঠাণ্ডা করে।”

চন্দ্রা এবার কাঁদতে কাঁদতে হাপাতে শুরু করেছে। সিয়াম তা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে বললো “শান্ত হও চন্দ্রা। কষ্ট হচ্ছে তো”
আদতেই কষ্টটা এই সময় চন্দ্রার চোখের জল দেখে কার বেশি হচ্ছে সেটা ঠিক ধরতে পারলো না সিয়াম।
চন্দ্রা কান্না থামালো না। ওইভাবেই বললো “কে বলেছে আমি আপনাকে শুধু বন্ধু ভাবি..? কে বলেছে আপনি আমার উপর বোঝা..?কে বলছে আমি আপনার সাথে সংসার করতে পারবোনা..? বলুন কে বলেছে..?
আপনাকে ছাড়া আমার চারপাশ অন্ধকার সিয়াম। আপনি কেনো বোঝেন না..?”
“আপনি না আমার চোখ পড়তে পারেন তাহলে এইটুকু কেনো বুঝলেন না যে এই পাগল, উড়নচণ্ডী, বেখেয়ালি মেয়েটা আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছে বলুন কেনো বুঝলেন না..?” বলে চন্দ্রা সিয়ামের জামার কলার ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সিয়ামের বুকে মাথা রাখলো। আজ আর সিয়াম চন্দ্রাকে আগলে নিলো না। চন্দ্রার এবার আরো বেশি করে অনুভব হলো সে সিয়ামকে ছাড়া সে কতোটা একা।
চন্দ্রা সিয়ামের বুকে মাথা রেখেই কাঁদতে কাঁদতে বললো সিয়ামকে বললো “আপনিই আমার স্বাধীনতা, আপনিই আমার শান্তির যায়গা। আপনি বোঝা নন আমার আপনি শক্তি আমার। এইজীবনে আপনাকে ছাড়া আমি দ্বিতীয় কাউকে চাই না বিশ্বাস করুন। আমি বুঝেছি আপনাকে ছাড়া আমার কোনোদিনই ভালো থাকা হবে না। আপনি আমার এতো কাছে এসে সারাজীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে কিছুতেই সেগুলো কেড়ে নিতে পারেন না সিয়াম কিছুতেই না।” চন্দ্রার কান্নার বেগ বাড়লো সাথে হাপনিও।
সিয়াম এবার চন্দ্রাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করলো। চন্দ্রা যেনো তবুও শান্ত হচ্ছে না নিজের মনে সিয়ামকে বলেই যাচ্ছে তার মনের কথা।
সিয়াম আর উপায় না পেয়ে চন্দ্রার মুখ দুই হাত দিয়ে উঁচু করে নিজের ঠোঁট চেপে ধরলো চন্দ্রার ঠোঁটে।
কয়েক সেকেন্ড পর চন্দ্রা শান্ত হলো। বর্তমান অনুভুতিটা তার মাথায় আসতে সময় লাগলো। চন্দ্রার মাথায় কথাটা পৌঁছাতেই চন্দ্রাও তাল মেলালো সিয়ামের সাথে। সিয়ামও চন্দ্রার সম্মতি পেয়ে চন্দ্রাকে আরেকটু নিজের কাছে টেনে নিল। শান্ত হলো দুটি মন, শান্ত হলো চারপাশে পরিবেশ।

#চলবে..?

বেড়াজাল পর্ব-১৫+১৬

0

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #১৫

মাঝে কেটে গেছে অনেককটা মাস। মাস পেরোনোর সাথে সাথে বদলেছে সব সম্পর্কের সমীকরণ গুলোও। চন্দ্রা আর সিয়ামের সম্পর্কের ছয় মাস পূর্ণ হতেও আর হাতে মাত্র কয়েকটা দিন বাকি। যদিও এই নিয়ে দুজনের কারোরই কোনো মাথা ব্যাথা দেখা যায়নি। চন্দ্রার ধারনা সিয়ামের ডিভোর্সের কথাটা মনে নেই আর তাই সেও নিজেও ব্যাপারটা চেপে গেছে। কি দরকার যেমন চলছে চলুক না।

এখন সিয়ামের সান্নিধ্য চন্দ্রার সবচেয়ে প্রিয়। তাদের সম্পর্কটা “জাস্ট ফ্রেন্ড” থেকে “বেস্ট ফ্রেন্ড” এ এসে নেমেছে। চন্দ্রার ছোটো থেকেই খুব একটা বন্ধু বান্ধব ছিল না সে খুব একটা সবার সাথে মিশতে পারতো না বলে। স্কুল লাইফের বন্ধু গুলো কলেজে উঠে হারিয়ে গেছে আর যে কটা কলেজের হাতে গোনা কটা বন্ধু ছিল তারও কলেজের পর হারিয়ে গেছে। চন্দ্রার বেস্ট ফ্রেন্ড বলতে ছিলো শুধু তার দিভাই ইন্দ্রা। কিন্তু ইন্দ্রারও বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকে চন্দ্রা ভীষণ একা হয়ে পড়েছিল। না তার সাথে কথা বলার তেমন কেউ ছিলো আর না কথা শোনার। সিয়ামের সাথে বন্ধুত্ব হওয়ার পর চন্দ্রার প্রথমে ইতস্তত লাগলেও পরে সে সহজ হতে শুরু করলো। এই ভাবে চলতে চলতে আজ তারা বেস্ট ফ্রেন্ড। এখন চন্দ্রার সারাদিনের পর সবচেয়ে পছন্দের কাজ রাতে দুই মগ কফি নিয়ে সিয়ামের সাথে গল্পের ঝুড়ি খুলে বসা। সারাদিন কেমন কাটলো কোথায় কি হলো এমনকি অদরকারি অনেক কথাই সব এক নিশ্বাসে চন্দ্রা বলে চলে সিয়ামকে। সিয়ামও একমনে সব কথা শোনে তার। তার কাছে এই মুহূর্তটা একটু বেশিই স্পেশাল এই সময়টাই তাকে উপলব্ধি করায় সে চন্দ্রাকে একটু একটু করে নিজের ভালোবাসার বেড়াজালে জড়িয়ে ফেলতে সক্ষম হচ্ছে।
এই সময় যতোই সিয়ামের ইম্পর্ট্যান্ট কাজ থাকুক না কেনো সে সব কাজ সাইডে রেখে দেয়। চন্দ্রা ঘুমিয়ে গেলে সে আবার নিজের কাজ নিয়ে বসে।

সারাদিন তাদের দুজনেরই সময় হয়না বলতে গেলে। সিয়াম থাকে অফিসে আর চন্দ্রা তার ক্যারাটে ক্লাসে। দুজনের দেখা হয় সেই রাতে। চন্দ্রার যেনো এখন ভালো লাগে না। সবসময় যেনো সিয়ামের আসেপাশে থাকতে ইচ্ছে করে। সিয়ামেরও একই পরিস্থিতি হয়, সে চেয়েও পরে না চন্দ্রাকে খুব একটা সময় দিতে তাও ছুটির দিন গুলো চেষ্টা করে চন্দ্রার সাথে কাটানোর কিন্তু সেখানেও প্রবলে, ছুটির দিন গুলোয় সিয়ার ক্যারাটে স্কুল থেকে এদিক সেদিক কম্পিটিশনে নিয়ে যাওয়া হয় বিধায় চন্দ্রা বেশিরভাগটাই বাড়িতে থাকতে পারে না। তাতেও দুজনের মনের দুরত্ব কমতে গিয়ে বেড়েছে যেনো। দুজনের মুখোমুখি দেখা না হলেও সারাক্ষণ একে ওপরকে মেসেজ, কল, ভিডিও কল এইসব চলতেই থাকে। তাদের মাঝে মাঝেই মনে হয় যেনো তারা কোনো লং ডিসটেন্স রিলেশনশিপে আছে।

সন্ধ্যে ৬ টা
চন্দ্রা আজ কিছুটা তাড়াতাড়িই ফিরেছে বিশেষ কারণে নইলে তার ফিরতে ফিরতে ৮ টা বেজে যায়। তার বিশেষ কারণটা হচ্ছে সে আজ প্রথম নিজের হাতে সিয়ামের জন্য কিছু রান্না করবে ঠিক করেছে। এই কয়েকদিনে সে ইন্দ্রার থেকে টুকটাক অনেক রান্নাই শিখেছে যেমন কফি, ভাজাভুজি, নানা রকমের ভর্তা ইত্যাদি। কিন্তু আজ সে বানাতে চলেছে বিরিয়ানি। এইকয়দিনে সে ভালোই বুঝেছে সিয়ামেরও ওর মতো বিরিয়ানি ভীষণ পছন্দের। তাই সাত তাড়াতাড়ি বাজার করে ফিরে কোমর বেঁধে সে আজ রান্নায় নেমেছে।
অপরিপক্ব হাতে রান্না করায় বেশ ভোগান্তি হলো চন্দ্রার। ডান হাতে বেশ কিছুটা গরম তেলও পড়লো। চন্দ্রা একটু বরফ লাগিয়ে আবার কাজে মন দিল। প্রায় আড়াই ঘন্টা পর রান্না কমপ্লিট করে ফ্রেশ হয়ে আবার রান্না ঘরে আসলো সব সাজাতে। সব ঠিকঠাক করে ঘড়ি দেখতে লাগলো। আধা ঘন্টার মতো পেরিয়ে যাওযার পরও যখন সিয়াম এলো না তখন চন্দ্রার চিন্তা হতে লাগলো। সিয়াম তো ৮:৩০ বাজার পর পরই চলে আসে। আজ ৯ টা বেজে গেলো। এসব ভাবনাতেই ডোর বেল বেজে উঠলো। চন্দ্রা খুশি হয়ে তাড়াতাড়ি করে গিয়ে দরজা খুলে দিল। দরজা খুলে দিতেই চন্দ্রার হাসি মুখটা মিলন হয়ে গেলো। কারণ সামনে সিয়ামের যায়গায় সিরাজ দাড়িয়ে। সিরাজ একপলক চন্দ্রাকে দেখে উপরে চলে গেলো। চন্দ্রা সিরাজের যাওযার দিকে তাকালো। কেনো জানো তার মনে হয় সিরাজের মধ্যে বেশ পরিবর্তন এসেছে। সেই চন্দ্রার বাড়ি থেকে ফেরার পরই সে আর চন্দ্রাকে উত্যক্ত করে না, এখন তো বেশি রাত অবধি বাড়ির বাইরেও থাকে না, সিয়ামের বলতে কোম্পানির বেশ কিছু কাজও করে সে, বেশির ভাগ তাকে ফুরফুরে মেজাজেই দেখা যায়।

এইতো সেদিন এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটলো। চন্দ্রা রাতের ডিনার সাজাচ্ছিল সবার জন্য। তখন টেবিলে শুধু সিয়া ছিলো। সিরাজ উপর থেকে তাড়াতাড়ি নেমে টেবিলে বসে চন্দ্রাকে বললো “ভাবী তাড়াতাড়ি খেতে দাও। কাল সকালে তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে অফিসে।” বলে ফোন টিপতে লাগলো। এইশুনে চন্দ্রা কিছুক্ষন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিল সিরাজের দিকে। ওই প্রথম বোধহয় সিরাজ চন্দ্রাকে ভাবী বলে ডেকেছিল।

এসব ভাবতে ভাবতে আবার ডোর বেলের আওয়াজ পেলো চন্দ্রা। চন্দ্রা এবার খুশি হয়ে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললো। এবার সেই আকাঙ্খিত মানুষটির মুখ দেখতে পেলো চন্দ্রা। দারোয়ান চাচা দরজার কাছে দিয়ে চলে গেলো বাইরে। চন্দ্রার এইরকম হাসি মুখ দেখে সিয়াম হেসে জিজ্ঞেস করলো “ব্যাপার কি…? মহারানী আজ এত খুশি যে..?” চন্দ্রা সিয়ামের হুইচেয়ার ধরে ঘরে নিয়ে যেতে যেতে বলল “সারপ্রাইজ আছে। আগে আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন তারপর দেবো।” সিয়াম বললো “তাই..? সারপ্রাইজ তাও আমার জন্য..?আমার তো এক্ষুনি দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।”
চন্দ্রা হেসে বললো “না মশাই এখন না, আগে যান ফ্রেশ হয়ে আসুন তারপর দেখবো।”

সিয়াম ফ্রেশ হতে গেলো। চন্দ্রা রান্না ঘরে গিয়ে একটা প্লেটে সুন্দর করে সব সাজিয়ে ঢাকা দিয়ে সিয়ামের ঘরে নিয়ে এল। সিয়াম ফ্রেশ হয়ে আসতেই দেখলো বিরিয়ানির গন্ধে সারাঘর মো মো করছে। সিয়াম একটা লম্বা শ্বাস টানল তারপর বললো “ওহহো এই হচ্ছে তাহলে তোমার সেই সারপ্রাইজ।”
চন্দ্রা প্লেট টা খুলে সিয়ামের সামনে রাখতে রাখতে বললো “হম এই সেই সারপ্রাইজ কিন্তু এটার মধ্যে স্পেশাল কি বলুন তো..?” সিয়াম কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল ” বিরিয়ানি তো এমনিতেই স্পেশাল, এর উপরও কিছু স্পেশাল আছে নাকি..?” চন্দ্রা এবার মুখ ফুলিয়ে বললো “পারলেন না তো, এই বিরিয়ানিটা আমি নিজের হাতে করেছি।” সিয়ামের যেনো এবার অবাকের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেলো। তার বউ রান্না করেছে তার জন্যে..? যে মেয়ে কিনা কদিন আগেও চা বানাতে পারতো না সে তার জন্য বিরিয়ানি বানিয়েছে..?
চন্দ্রা তাড়া দিয়ে বললো “কি হলো..? টেস্ট করে দেখুন না। আমি কিন্তু এখনও খেয়ে দেখিনি। আর সিনেমার হিরোদের মতো নুন ঝাল বেশি হলে মুখ বুজে খেয়ে নেবেন না, ভালো হোক খারাপ হোক মূখের উপরই বলবেন আমায় বুঝলেন।” সিয়াম হেসে ঘাড় নাড়িয়ে বললো “আচ্ছা বাবা তাই। তবে এরম ভাবে খেলে বোধহয় টেস্ট পাবো না তেমন। না মানে যে বানিয়েছে সে যদি খাইয়ে দিতো তাহলে টেস্টটা বোধহয় আরো দ্বিগুণ হতো।”

সহজ সরল এক আবদার। চন্দ্রা চেয়েও চেয়েও পারলো না সিয়ামকে। লাজুক হেসে এক চামচ বিরিয়ানি তুলে সিয়ামের মুখের সামনে ধরতেই সিয়াম তা মুখে নিল।
চন্দ্রা অধীর আগ্রহে চেয়ে রইলো সিয়ামের মুখপানে তার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য।
বিরিয়ানি মুখে নেওয়ার পরই সিয়ামের মুখ গম্ভীর হলো। মুখের পুরোটা শেষ করে কিছুটা জল খেয়ে সিয়াম বললো “চন্দ্র তুমি সত্যি কথা যখন বলতে বলেছ তখন আমি মিথ্যে বলবো না তোমায়।” চন্দ্রার মুখটা এবার ভয়ে মিলন হয়ে গেল।
সিয়াম গম্ভীর মুখ করেই বললো “তোমার প্রথম রান্না বুঝলাম তবে তোমার নিজেও টেস্ট করে দেখো উচিত ছিল তাহলে বুঝতে বিরিয়ানিতে ঝাল বেশি, নুন কম হয়েছে আলুও ঠিকঠাক সিদ্ধ হয়নি মসলাও ঠিকঠাক মেশেনি।
চন্দ্রার হৃদয় এবার আহত হলো। সে আগে ওইসব কথা বললেও কোথাও না কোথাও তার মন শুধু সিয়ামের প্রশংসাটাই শুনতে চাইতো। চোখ ছলছল করে উঠলো চন্দ্রার। সে মুখটা নামিয়ে চামচটা প্লেটে রেখে বললো “সরি আসলে প্রথম বার তো তাই বুঝতে পারিনি। পরের বার খেয়াল রাখবো। আপনি দাড়ান আপনার জন্য আমি অন্যকিছু আনছি এটা আর খেতে হবে না আপনাকে।” বলেই চন্দ্রা খাবারের প্লেটটা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পিছন ঘুরতে সিয়াম ডাকল ” চন্দ্র ”
চন্দ্রা দাঁড়িয়ে পড়লো। সিয়াম বললো “এদিকে এসে বসো একবার।” চন্দ্রা কথা বাড়ালো না কারণ কথা বদলে তার গলার কাছে চাপা কান্না সে আটকাতে পারবে না। চুপ করে আবার একই যায়গায় বসলো সে সিয়ামের সামনে কিন্তু এবার মুখ নীচু করে রাখলো।
সিয়াম এবার এক চামচ বিরিয়ানি তুলে চন্দ্রার মুখের সামনে ধরে বললো ” শুধু আমাকে খাইয়ে রিভিউ নিলেই হবে..? নিজে রান্না করেছি যখন নিজে খেয়ে রিভিউ দাও দেখি।” বলে চন্দ্রার মুখে পুরে দিলো খাবারটা। চন্দ্রা না চাইতেও খেলো।
সিয়াম এবার প্রশ্ন করলো “এবার বলো দেখি কোথায় কি কম হয়েছে..?” চন্দ্রা এবার চোখ এদিক সেদিক করে বললো ” কই সব তো ঠিকই আছে নুন, ঝাল সবই এমনকি মসলাটাও ঠিকঠাকমতো মিশেছে।”
সিয়াম এবার সেই মনভোলানো হাসি টা দিলো। চন্দ্রা অবাক হয়ে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে বললো “তাহলে আপনি মিথ্যে বললেন কেনো..?”
সিয়াম গা ছাড়া ভাব দেখিয়ে বললো ” ওইটা তো আমি এমনি মজা করছিলাম।”
চন্দ্রার এবার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগলো। সিয়াম এতক্ষণ গা ছাড়া ভাব দেখলেও এবার তার ভীষণ খারাপ লাগলো।
সিয়াম চন্দ্রার চিবুকটা হালকা তুলে বললো “হেই বউ! আমি শুধুই মজা করছিলাম বিশ্বাস করো তোমাকে হার্ট করার মতো কোনো ইনটেনশন আমার ছিলো না।”
চন্দ্রা এক ঝটকায় সিয়ামের হাত সরিয়ে বললো “স্পর্শ করবেন না আমাকে একদম। বাজে লোক একটা, আপনি জানেন আমার মনের মধ্যে কি ঝড় চলছিলো..?” এই বলে কাঁদতে কাঁদতে চন্দ্রা সোফার বালিশে মুখ গুঁজলো।

সিয়াম চন্দ্রার নাম ধরে ডাকল কয়েকবার। কিন্তু চন্দ্রা কোনো সাড়া দিলো না সে নিজের মতো কেঁদেই যাচ্ছে। সিয়াম আর না পেরে চন্দ্রার কিছুটা কাছে গেলো।
সেই ঘোর মেশানো কণ্ঠে ডাকলো ” চন্দ্রাবতী… ”

চন্দ্রার মুখ বালিশে গোঁজা বিধায় শুধু পিছন দিকটাই দৃশ্যমান তার। চন্দ্রাকে না কাঁপতে দেখে সিয়াম বুঝলো চন্দ্রা কান্না থামিয়েছে কিন্তু চোখ দিয়ে এখনও অশ্রু পড়ছে।
সিয়াম আবার একইভাবে বললো “চন্দ্রাবতী, এদিকে ফেরও দেখি।” বলে নিজেই চন্দ্রাকে ধরে নিজের দিকে ঘোরালো। চন্দ্রা ফর্সা হওয়ায় একটু কাঁদতেই তার মুখ চোখ টমেটোর মতো লাল হয়ে ফুলে গেছে।
সিয়াম এবার তার দুই হাত গলার পাশ দিয়ে নিয়ে গিয়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে চন্দ্রার চোখের জল মুছে দিলো।

তারপর চন্দ্রার মাথাটা নিজের বুকের সাথে ঠেকিয়ে চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বললো “চন্দ্রাবতী কিছু কথা বলি মন দিয়ে শোনো, তুমি যখন বললে আমি যেনো সিনেমার হিরোদের মত খেয়ে মিথ্যে না বলি যা হবে সত্যি সত্যি তোমায় মুখের উপর বলে দি যাতে তুমি পরে আরো ভালো করতে পারো। কিন্তু আসলে কি তাই..? যখন আমাদের জন্য ভালোবেসে কেউ কিছু বানায় তখন সেই খাবারের টেস্টের থেকেও আমাদের কাছে ইম্পর্ট্যান্ট হয়ে ওঠে সেই মানুষটির মুখের হাসি। আমরা যতই বলি খারাপ হলে জানো সে বলে কিন্তু আদতেই কি তারা খারাপ বললে বা কোনো খুঁত ধরলে আমাদের ভালো লাগে..? বরং মন খারাপ হয় পরের বার আর সেই জিনিসটা সেই মানুষটার জন্য বানাতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় সেই তো খেয়ে খুঁত ধরবে তার জন্যে করে কি লাভ। এর পিছনের শ্রমটা আর ভালোবাসাটা অনেক কম মানুষই বোঝেন। তাইতো আমরা প্রিয় মানুষটার হাতের খাবার নুনপোড়া হোক কিংবা ঝাল বেশি হোক সেটা আমরা তৃপ্তি করে খেতে পারি। হ্যাঁ রোজকার ব্যাপারটা আলাদা।
অনেক সংসারেও এমন হয় জানতো অনেক বছর সংসার করার পরও একদিন খাবারে নুন কিংবা ঝাল বেশি হলে তারা চিৎকার চেঁচামেচি করতে দুইবার ভাবে না। তারা একবারও ভাবে না ওপর পাশের মানুষটিও কতটা পরিশ্রম করে সেইটুকু বানিয়েছে, বা সেও যে নানান টেনশনে থাকতে পারে। এইসব কথা কাউকে মুখ ফুটে বলাও যায়না। সব সহ্য করে নিতে হয়। তাই আমি চাই তুমি পরের বার থেকে যেনো এইরকম কথা আর না বলো।
আর আজ তোমার খাবার যদি ঝাল বেশি নুনপোড়াও হতো তাও আমি বিনা কষ্টে পুরো খাবারটাই খেতাম কেনো জানো কারণ সেটা তুমি শুধু মশলা মিশিয়েই বানাওনি তাতে নিজের ভালোবাসা, শ্রম, অনুভুতি সব মিশিয়ে বানিয়েছো। বুঝলেএএএ পাখি” বলে চন্দ্রার নাকটা হালকা করে টেনে দিল।
চন্দ্রা এবার নিজের ভুল বুঝতে পেরে সিয়ামের বুকের মধ্যে গুটিসুটি মেরে বললো “সরি আর এমনটা হবে না”
সিয়াম চন্দ্রাকে আরেকটু জড়িয়ে নিয়ে বললো “ইটস ওকে চন্দ্রাবতী আমি আছি না। যতদিন আমি আছি তোমার সব ভুলত্রুটি ধরিয়ে ঠিক করে দেওয়ার দায়িত্ব আমি নিলাম। আমি যখন থাকবো না তখন অন্যবিষয়।”
চন্দ্রার প্রথম কথাটা শুনে মনটা শীতল হলেও শেষের কথাটা শুনে বুকটা কেঁপে উঠলো সে ফট করে সিয়ামের মুখ চেপে ধরে বললো “বালাই ষাট এরম কথা মুখেও আনবেন না আর। কোথায় যাবেন আপনি..?”
সিয়াম মুখ থেকে চন্দ্রার হাত টা নিজের হাতে নিয়ে হাতের উল্টপিঠে ঠোঁট ছুঁয়ে বললো “বলা তো যায়না কখন কি হয়ে যায়।”
চন্দ্রা এবার কোনো কথা বললো না। তার মনে এক ভীষণ রকম ভয় জন্মেছে এই মুহূর্তে। সেই ভয়টি হলো সিয়ামকে হারিয়ে ফেলার। সে প্রকাশও করতে পড়ছে না এই অনুভূতিটা। সিয়াম চন্দ্রার এরম বিরস মুখ দেখে চন্দ্রার চিবুক তুলে বললো “আমি যেখানেই থাকি আমার চন্দ্রাবতী একবার মনে মনে স্মরণ করলেই আমি সেখানে উপস্থিত হবো।” চন্দ্রার এবার হালকা হাসি ফুটে উঠলো মুখে।
সিয়াম এবার চন্দ্রকে নিজের কাছে আরেকটু টেনে এনে নিজের অধর ছোঁয়ালো চন্দ্রার চোখের পাতায় তার পর গালে চন্দ্রা কেঁপে উঠলো হালকা। অবশেষে চন্দ্রার অধরে অধর মেলাতেই চন্দ্রার পুরো শরীর কেঁপে উঠলো সে সিয়ামের কলারটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরলো, আজ যেনো কোন অদৃশ্য শক্তির জন্যে সিয়ামকে বাঁধা দিতে পারলো না সে। সিয়াম কিছুক্ষন পর সরে আসতেই চন্দ্রা লজ্জায় সিয়ামকে ছেড়ে বেরিয়ে গেলো রুমের বাইরে।

সিয়াম তর্জনী আঙুলের পিঠটা ঠেকলো ঠোঁটে। তারপর আনমনেই হেসে উঠলো সে। বহুবছরের প্রতীক্ষার আজ অবসান হয়েছে তার। আজ তার থেকে খুশি মানুষ বোধহয় এই পৃথিবীতে নেই।

_______________________________________

চন্দ্রা লজ্জায় রান্না ঘরের সামনে এসে চেয়ার ধরে হাঁপাতে লাগলো। ইস কি করে ফেললো সে আজ..? এবার সে সিয়ামের সামনে যাবে কি করে..? এইসব ভাবতে ভাবতেই দেখলো সামনে দিয়ে সিয়া আসছে। চন্দ্রা ঠিকঠাক হয়ে সিয়াকে ডাক দিয়ে বললো “এই সিয়া, আজ আমি নিজের হাতে বিরিয়ানি বানিয়েছি তুমি টেস্ট করবে না..?”
সিয়া মিলন হেসে বললো “না ভাবী আজ আর ভালো লাগছে না তুমি ফ্রিজে রেখে দাও আমি কাল খাবো।” বলে উপরে চলে গেল সে।
চন্দ্রার এবার কেমন যেনো ঠেকলো সিয়াকে তাকে দেখে মনে হলো অনেকে রাত ঘুমোয় না কেঁদে কেঁদে চোখ লাল করে ফেলেছে যেনো। চন্দ্রা ভাবলো কিচ্ছুক্ষণ পর একবার গিয়ে জিজ্ঞেস করবে তাকে আতিফের সাথে কোনো ঝামেলা হয়েছে নাকি।

#চলবে..?

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #১৬

রাত ১০ টা।
চন্দ্রা মোটামুটি সব রান্নাঘরে গোছগাছ করে ঠিক করলো একবার সিয়ার কাছে যাবে। মেয়েটাকে একদমই ঠিক লাগলো না দেখে। চন্দ্রা ধীরে ধীরে উপরে সিয়ার রুমের কাছে গিয়ে দেখলো রুমের দরজা ভেজানো। চন্দ্রা হালকা করে খুলে উঁকি মেরে দেখলো সিয়া একটা ডিম লাইট জেলে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। সামনেই পরে ফোন, দেখেই বোঝা যাচ্ছে কারোর ভয়েস রেকর্ড চলছে।

চন্দ্রা এবার দরজায় নক করতেই সিয়া হাঁটু থেকে মাথা তুলে তড়িঘড়ি করে চোখ মুছে ফোন রেকর্ডার টা অফ্ করে বললো “আরে ভাবী এসো না ভিতরে।” বলেই বেডের পাশে লাইটের সুইচ দিয়ে দিলো। ঘোরের চারিদিকে আলো পড়তেই চন্দ্রা ভালো করে একবার চোখ বোলালো পুরো ঘরে। সিয়ার অর্ধেকের বেশি জিনিস ছড়ানো ছিটানো। অথচ সিয়া বেশ পরিস্কার পরিচছন্ন জায়গার জিনিস জায়গায় না রাখলেই সে রেগে যায়। তাহলে কি এমন হলো যে…?
চন্দ্রা এবার গিয়ে বসলো সিয়ার পাশে। সিয়া বললো “কিছু বলবে ভাবী..?”
চন্দ্রা কিছুক্ষন সময় নিয়ে সিয়াকে বললো “সিয়া তুমি আমায় আর ইন্দ্রা দিভাইকে নিজের বড়ো আপুর মতই ভাবো তো নাকি পর ভাবো..?” সিয়া একটু অবাক হয়ে উত্তর দিল “এমা ভাবী এইরকম বলছো কেনো তোমরা তো আমার ফ্যামিলি তোমাদের ছাড়া কাদের আপন ভাববো। ” এই বলেই সিয়া মাথা নিচু করে নিল। চন্দ্রা বুঝতে পারলো সিয়ার চোখের জল আটকাতেই এই প্রয়াস তার।
চন্দ্রা একটু এগিয়ে এসে সিয়ার হাত নিজের হাতের নিয়ে বললো “সিয়া যদি আপন ভেবেই থাকো আমাদের তাহলে কি হয়েছে তোমার খুলে বলো আমাকে। একা একা কষ্ট পাওয়ার চেয়ে এটা ভালো। অন্তত মনটা কিছুটা হালকা তো হবে।” সিয়া এবার মুখটা তুললো দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে কান্নার দরুন চোখ মুখ ফুলে আছে চোখের নীচে কালি জমেছে। সিয়া এবার নিজেকে সামলাতে না পেরে আচমকা চন্দ্রাকে জড়িয়ে ধরলো। চন্দ্রা টাল সামলাতে না পেরে হালকা পিছিয়ে গেলো তবুও ধরে নিলো সিয়কে। সিয়া চন্দ্রাকে জড়িয়ে ধরেই কাঁদতে কাঁদতে বললো “আমার অনেক বড়ো সর্বনাশ হয়ে গেছে গো ভাবী।” চন্দ্রা খুব একটা অবাক হয়নি সে ধারণা করেছিলো যে প্রেমঘটিত কিছু হবে তাই সে সিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো “কি হয়েছে সিয়া খুলে বলো আমায়। নইলে বুঝবো কি করে বলো।” সিয়া এবার আস্তে ধীরে তার আর আতিফের রিলেশনের কথাটা বললো। চন্দ্রা সব শুনে বললো “হম এতো ভালো কথা সে চাকরি পেয়েছে তোমার দাদাকে বলবো তাহলে তাদের বাড়ি কথা বলতে যেতে..?”
সিয়া চোখ মুছে বললো ” এখানেই শেষ না ভাবী আসল কাহিনী তো এর পর থেকে শুরু হয়েছে। আতিফ চাকরি পাওয়ার পর একমাস খুব ভালোই গিয়েছিলো আমাদের সে তার প্রথম স্যালারি দিয়ে আমায় এই সোনার চেনটা গিফট করেছে।” বলেই গলা থেকে চেনটা বের করে চন্দ্রাকে দেখলো। চন্দ্রা বললো “তারপর..?” সিয়া বললো “তারপর হঠাৎ করেই আতিফের ইগনোর করা শুরু হলো, দেখা করার কথা বললে নানা অজুহাত দেওয়া শুরু করলো। আমি ভাবলাম কাজের চাপ আছে তাই হয়তো সময় দিতে পারছে না। কিন্তু নতুন ইনস্টাগ্রাম একাউন্ট খুলে দেখলাম সে দিব্যি তার নতুন বন্ধু বান্ধবদের সাথে রোজ আড্ডা দিচ্ছে হাঙ্গআউট করছে। এইদিকে আমায় বলে অফিসের কাজে নাকি তার নাওয়া-খাওয়ার সময় হচ্ছে না। আজ তো দুপুরে দেখা করে বলেই দিলো তার মায়ের পক্ষে নাকি আমাকে মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমি নাকি কম মাইনের একটা চাকরি করি আর তার মা যাকে বেছেছেন সে নাকি অনেক বড়ো যায়গায় চাকরি কর। ” শেষের কথাটা বেশ তাচ্ছিল্যের শুরে বললো সিয়া।

চন্দ্রা এবার পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। সিয়াকে আশ্বস্ত করে বললো সে নিজে গিয়ে পরের দিন আতিফের সাথে কথা বলবে। যদি কিছু করা যায়। সিয়া তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল “কিছুই হবে না ভাবী। গিয়ে দেখবে তোমার হাতে বিয়ে কার্ড ধরিয়ে দিয়েছে হয়তো তার।”
চন্দ্রা কথা বাড়ালো না সে জানে এখন সে যত ভালোই কথা বলুক না কেন সিয়ার কাছে সব তিক্ত লাগবে। চন্দ্রা শুধু আশ্বস্ত করলো সিয়াকে এই বলে যে সে কাল নিজে গিয়ে কথা বলবে আতিফের সাথে। এই বলে সিয়াকে একটু কিছু খাইয়ে শুইয়ে দিয়ে চলে এলো নিজের রুমে।

চন্দ্রা বেশ অন্যমনস্ক হয়েই রুমে ঢুকলো। সিয়াম চন্দ্রাকে লক্ষ্য করে বললো “চন্দ্র..? কিছু নিয়ে টেনশনে আছো কি..?এইরকম অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে।” চন্দ্রার এবার হুশ ফিরলো হাপ ছেড়ে মনে মনে ভাবলো এই মানুষটার থেকে সে কিছু লুকোতে পারে না। তার চোখ পড়তে জানে যেনো মানুষটা। চন্দ্রা ইতস্তত করলো তারপর ভাবলো না থাক কল কি হয় একেবারে জেনেই সিয়ামকে সে জানাবে। তাই সিয়ামের উদ্দেশ্যে বললো “না তেমন কিছু না এমনিই।”
সিয়াম বিশ্বাস করলো কি বোঝা গেলো না। মুখভঙ্গি আগের মত করেই বললো “বেডে এসে বসো চন্দ্র, কিছু দেওয়ার আছে তোমায়।” চন্দ্রা এবার বাধ্য মেয়ের মতো বিছানায় গিয়ে বসলো।
সিয়াম আলমারি থেকে একটা ছোট্ট প্যাকেট বের করে বিছানায় রাখল। চন্দ্রা কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো “কি আছে এতে..?” সিয়াম মুচকি হেসে প্যাকেটটা খুলে একটু বক্স থেকে একটা সোনার ব্রেসলেট বার করলো। চন্দ্রা অবাক হয়ে বললো “বাহ্ ভারী সুন্দর দেখতে তো। কিন্তু এটা কার জন্য…?” সিয়াম চন্দ্রার ব্রেসলেটটা চন্দ্রার হাতে দিয়ে বলল “ব্রেসলেটে যার নাম লেখা তার জন্যেই। এবার বলো দেখি কার নাম লেখা..?” চন্দ্রা ব্রেসলেটটা উল্টে পাল্টে দেখলো কয়েকবার তাও কিছু চোখে পড়লো না তার। অবশেষে ব্রেসলেটির পিছনের দিকে ছোট্ট করে “চন্দ্রাবতী” লেখাটা চোখে পড়লো চন্দ্রার।
চন্দ্রা এবার বুঝলো ব্রেসলেটটা তার জন্যই আনা। চন্দ্রা এবার একটু ঘুরিয়ে বললো “তা এই ব্রেসলেটটা আমাকে কেনো দেওয়া হচ্ছে জানতে পারি..?” সিয়ামও চন্দ্রার মতো মুখ করে বললো “হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই জানতে পারো।”
চন্দ্রা তার মতো করে সিয়ামকে বলতে দেখে সিয়ামের দিকে গরম চোখে তাকালো। তা দেখে সিয়াম হেসে দিয়ে বললো ” সরি সরি আসলে তুমি এই প্রথম কিছু নিজের হাতে রান্না করেছ তাই এইটা আমার তরফ থেকে উপহার।”
চন্দ্রা এবার ব্রসলেটটা নেড়েচেড়ে বললো “আপনি শুধু আমায় উপহার দেওয়ার বায়না খোঁজেন না..?” সিয়াম এবার একটু জোরেই হাসলো, তারপর বললো “না চন্দ্রাবতী আজ যদি আমার বাবা মা বেঁচে থাকতেন তাহলে কি তারা তোমায় খালি হতে আশীর্বাদ করতেন বলো..?তারা যাতে বলতে না পারে যে আমার ছেলেটা অকর্মার ঢেঁকি হয়েছে কিচ্ছু শেখাতে পারিনি তাকে। বাড়ির বউ যে প্রথম রান্না করলে তাকে আশীর্বাদ স্বরূপ কিছু দিতে হয় তাও জানে না ছেলেটা ।” চন্দ্রা এবার হালকা হেসে ব্রেসলেটটা সিয়ামের হাতে দিয়ে বললো “পরিয়ে দিন” এইটা আগের সিয়াম হলে ভীষণ অবাক হতো বৈকি কিন্তু এখন একটুও অবাক হলো না এরম আবদার মাঝে মাঝেই চন্দ্রা করে বসে তার কাছে তাই তারও অভ্যাস হয়ে গেছে।

সিয়াম চন্দ্রার ডান হাতটা টান দিতেই চন্দ্রা জ্বালায় “আহহহহহ” করে উঠলো। সিয়াম সঙ্গে সঙ্গে হাতটা নিয়ে বললো “কি হলো চন্দ্রা..? এতোখানি ফোসকা পড়লো কিভাবে..? নিশ্চই বিরিয়ানি বানাতে গিয়ে..?” চন্দ্রা এবার খানিকটা ভরকে গেল কারণ সে নিজেও ভুলে গিয়েছিল। হালকা জ্বালাপোড়া করলেও খেয়াল করেনি সেই দিকে।
সিয়াম এবার তাড়াতাড়ি একটা অয়েন্টমেন্ট এনে চন্দ্রার হাতে লাগিয়ে দিতে দিতে চন্দ্রাকে বকতে লাগলো।
” যে কেনো সে একা একা বানাতে গেলো..? হাতে ফোসকা পড়েছে সে সিয়ামকে আগে বলেনি কোনো হেনতেন।” কিন্তু চন্দ্রার তো সেই দিকে ধ্যান নেই তার ধ্যান সিয়ামের দিকে। এই প্রথম সে সিয়ামকে এতটা উদ্বিগ্ন হতে দেখলো তার জন্য। তার মনে এখন খুশির বাতাস বইছে।

সিয়াম চন্দ্রাকে একধ্যানে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটা শয়তানি হাসি দিয়ে চন্দ্রার গালে টুপ করে একটা চুমু খেয়ে নিলো। চন্দ্রা হতভম্ভ হয়ে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে বললো “এটা কি হলো..?” সিয়াম গা ছাড়া ভাব দেখিয়ে বললো “তুমি যা ভাবে তাকিয়ে ছিলে আমি ভাবলাম চুমু টুমু চাও হয়তো তাই আর কি।” চন্দ্রা বাঁ হাত দিয়ে সিয়ামের কাঁধে হালকা মেরে বললো “দিন দিন চরম অসভ্য হচ্ছেন আপনি।” সিয়াম হেসে কাঁধে হাত বোলাতে বোলাতে বললো “এটা কিন্তু ঠিক না বউ আমি তোমায় চুমু দিলাম আর তুমি আমায় কিনা মারছো ধরে..? আমায় চুমুটা রিটার্ন দিয়ে উপহার টা শোধও তো করতে পারো..?” চন্দ্রা এবার মিথ্যে রাগ দেখিয়ে বললো “ধ্যাত কথাই নেই আপনার সাথে। খালি পিছনে লাগেন আপনি আমার।”
চন্দ্রার রাগী মুখ দেখে সিয়াম হাসতে লাগলো। সেও বুঝতে পারলো না কিছু মাসের ব্যাবধানে তার হাসিটাও একটা মানুষের কাছে মুগ্ধতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

____________________________

সিরাজ মলে গিয়েছিলো তার দরকারি কিছু জিনিসপত্র নিতে। সেখানেই ইন্দ্রাকে দেখে সিরাজ হাসি মুখ নিয়ে এগিয়ে গেল তার দিকে। ইন্দ্রা তখন কিছু দেখছিল। সিরাজ পিছন থেকে বললো “তা ম্যাডাম আজকাল তো ডুমুরের ফুল হয়ে গেছেন দেখাই মেলে না আপনার।”
ইন্দ্রা চমকে পিছনে ফিরে তাকিয়ে সিরাজকে দেখে হালকা হাসি দিয়ে বললো “আরে আপনি এখানে..?” সিরাজ আসে পাশে তাকিয়ে দেখলো অনেক মানুষ যাতায়াতের সময় তাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। তাই সিরাজ ইন্দ্রাকে বললো “চলুন গিয়ে ফুড কর্নারে বসে কথা বলি এখানে অনেক মানুষ।” ইন্দ্রা ইতস্তত করলেও সিরাজ জোর করে নিয়ে গেলো তাকে। ইন্দ্রার সান্নিধ্য তার ভালো লাগে। বেশীরভাগ তার আসে পাশে থাকার চেষ্টা করে, কিন্তু মেয়েটা তার থেকে বেশ দূরত্ব রেখেই চলে।

ইন্দ্রা একটা মেয়ে হয়ে বোঝে সিরাজের ওই চাহনি কেয়ারের মানে। তার মনেও কোথাও সফট কর্নার তৈরি হয়েছে সিরাজের জন্য। কিন্তু সে আর কোনো সম্পর্কে জড়াতে চায় না বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় তার মানুষকে। কিন্তু সিরাজকে সে মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারে না।

___________________________________

চন্দ্রা কফিশপে অপেক্ষা করছে আতিফের। আতিফকে ফোন করায় সে বলেছে কিছুক্ষনের মধ্যেই সে এসে পৌঁছাচ্ছে। চন্দ্রা তাই কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বাইরের কাঁচের দরজা দিয়ে বাইরে তাকালে দেখে সিরাজ ও ইন্দ্রাকে একসাথে হেসে কথা বলতে বলতে মল থেকে বেরোতে। চন্দ্রার বেশ খটকা লাগে কিছুদিন ধরেই তার এই জিনিসটা ভালো ঠেকছে না চোখে। না তার দেরি করলে চলবে না তাকে তার দিদির সাথে কথা বলতে হবে।

#চলবে…?

বেড়াজাল পর্ব-১৪

0

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #১৪

পার্কে ঘোরার পর্ব শেষ করে সবাই এলো রেস্টুরেন্টে। যে যার পছন্দ মত অর্ডার দিলেও সিয়া ভীষণ ভাবনায় পড়লো তার এখন চিজ পাস্তা, প্যানকেক এইসব খেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু এখানে এখন দুটোর মধ্যে কোনোটাই এভেলেবেল নেই। সিয়া মেনু কার্ডটা জোরে রেখে বললো “ধুর! ঢপের রেস্টুরেন্ট কিছুই পাওয়া যায় না।আমি খাবো না” সিরাজ শুনে বললো “আসলে কি বলতো ওরা জানতো না তোর মত মহারানী আসবে এই রেস্টুরেন্টে নইলে দেশ বিদেশ থেকে আগেই সব খাবার অর্ডার দিয়ে রাখতো।” সিয়া এবার রেগে সিরাজকে এক মেরে বললো “আবার তুই আগের মত আমার পিছনে লাগা শুরু করেছিস। আর কি এমন খেতে চেয়েছি এগুলো তো বেসিক জিনিস।” সিরাজ টোন কেটে বললো “খালি এটা সেটা খাবো এক প্লেট বিরিয়ানিও তো শেষ করতে পারিস না ঠিক করে। এতো বড়ো বড়ো কথা আসে কথা দিয়ে তোর..? যা আছে চুপচাপ খেয়ে নে। নইলে ঘরে গিয়ে একা একা আলু সিদ্ধ ভাত করে খাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।” সিয়া চেঁচিয়ে উঠলো ” ভাইয়াআআআ ” বলে। সবাই তাদের ঝগড়া দেখে মিটিমিটি হাসতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। চন্দ্রা বেশ অবাক হলো সিরাজের এই রূপ দেখে। তার সাথে রিলেশনে থাকাকালীন সিরাজ এতো মজা করে কথা বলতো সবার সাথে, এইভাবে তারও পিছনে লাগতো মাঝে মাঝে। কিন্তু তার বিয়ে হয়ে আসার পর থেকেই সে সিরাজকে অন্যরূপেই দেখেছে।
অগত্যা সিয়াকেও সবার সাথে অন্য কিছু অর্ডার দিতে হলো। সবার খাওয়া শেষ হতে ইন্দ্রা চন্দ্রাকে জিজ্ঞেস করল “চন্দ্রা আজ আমার সাথে কি বাড়ি যাবি নাকি এখান থেকে সোজা শশুরবারী যাবি..?” চন্দ্রা এবার আমতা আমতা করে বলল “আসলে দিভাই কাল সকালে ওনার অফিস আছে রে। আমি না থাকলে ভীষণ অসুবিধা হবে ওনার আমি অন্য একদিন যাবো আবার।” ইন্দ্রা বুঝলো তার বোনটা আসতে আসতে দায়িত্ব নিতে শিখছে, সংসারী হচ্ছে দিন দিন, তাই সেও আর কথা বাড়ালো না।

সিয়াম মনে মনে বেশ খুশি হলো চন্দ্রাকে তার কথা ভাবতে দেখে। সেও বুঝতে পারছে চন্দ্রা তার #বেড়াজালে একটু একটু করে জড়িয়ে পড়ছে।

সিয়াম বললো “তাহলে ইন্দ্রা তুমিও আমাদের সাথে আমাদের বাড়ি চলো। কিছুদিন কাটিয়ে আসবে চন্দ্রাও সারাদিন একাই থাকে বাড়িতে।” ইন্দ্রা প্রথমে না না করলেও চন্দ্রা ও সিয়া জোর করে নিয়ে গেলো ইন্দ্রাকে তাদের সাথে।
বাড়ি পৌঁছে যে যার রুমে চলে গেল। চন্দ্রা গিয়ে ইন্দ্রার জন্য গেষ্ট রুমটা খুলে দিল। তারপর নিজে রুমে এসে দেখলো সিয়াম কিছু কাগজপত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। চন্দ্রা আর সে দিকে না দেখে নিজে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে বসলো সিয়ামের পাশে। শুতে যাওযার প্রস্তুতি নিতেই সিয়াম ডেকে উঠলো “চন্দ্র..?” চন্দ্রা বালিশ ঠিক করতে করতে বললো “হুম বলুন”। সিয়াম চন্দ্রাকে উদ্দেশ্য করে বলল “আচ্ছা তোমারও তো কিছু স্বপ্ন আছে জীবন নিয়ে তুমি তো আমায় তেমন কিছুই বলো না। তাই আমি নিজ দায়িত্বেই খোঁজ খবর নিয়ে নিয়েছি।” চন্দ্রা অবাক হয়ে ভ্রূ কুচকে বললো “তাই.. ? তা কি খোঁজ নিলেনশুনি..?” সিয়াম বললো “আর শুনতে হবে না ম্যাডাম। কাল থেকেই তুমি ক্যারাটে স্কুলে গিয়ে সব ঠিকঠাক করে আসবে আবার আগের মত ক্লাস শুরু করবে। আর কাগজপত্র গুলো ঠিক রেখো আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি ওই স্কুলের বাচ্চাদের জন্য ডোনেশন দেবো যাতে বাচ্চাগুলোর আর তেমন আর্থিক অসুবিধা না হয়।” চন্দ্রা এবার যেনো কথা বলা ভুলে গেলো। হতভম্ব হয়ে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে বললো ” সত্যি…? আপনি সত্যিই বলছেন..? আমি আবার ক্যারাটে স্কুলে জয়েন করব..? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আপনি আমার হাতে চিমটি কেটে বলুন দেখি।” বলেই চন্দ্রা নিজের বাঁ হাতটা বাড়িয়ে দিলো। সিয়াম হেসে চিমটি দেওয়ার বদলে চন্দ্রার হাতের উল্টো পিঠে একটা চুম্বন করলো। চন্দ্রা কেঁপে উঠল এবার। ফট করে হাত সরিয়ে নিতে গেলে সিয়াম হাতটা ধরে টেনে নিজের কিছুটা কাছে নিয়ে আসলো। চন্দ্রার থেকে এইমুহুর্তে সিয়ামের দূরত্ব দুই- তিন ইঞ্চি। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় চন্দ্রারকে বেশ মোহনীয় লাগছে। দুজনের মুখেই কথা নেই অপলক তাকিয়ে আছে দুজনার দিকে। সিয়াম মুখটা আরেকটু এগিয়ে আনতেই চন্দ্রা চোখ বন্ধ করে নিলো। কিছুক্ষন বাদ কপালে কারোর ঠোঁটের স্পর্শ পেলো। সিয়াম চন্দ্রার কপালে হালকা ঠোঁট ঠেকিয়ে বললো “তিন সত্যি আমার চন্দ্রাবতী”
আমার চন্দ্রাবতী কথাটা চন্দ্রার কানে বারবার বাড়ি খেলো। এখন তার আবার আগের মত অনুভুতি হচ্ছে। তার খালি মনে হচ্ছে সিয়ামের এই কটা কটা চোখ সে আগেও কোথাও দেখেছে,কিন্তু কবে কথায় সে চেয়েও মনে করতে পারছে না। সে সিয়ামকে ছেড়ে উল্টো ফিরে শুয়ে পড়লো। সিয়াম বোধহয় কিছুটা টের পেলো তাই সেও আর কোনো কথা না বলে শুয়ে পড়লো টেবিল ল্যাম্পটা নিভিয়ে।

সকালে উঠে চন্দ্রা দেখলো সিয়াম তার অনেকটা কাছে শুয়ে। সিয়ামের একহাত তার পেটের উপর মুখটা কিছুটা চন্দ্রার ঘাড়ের কাছে, চন্দ্রা এবার ঘাড় উচিয়ে দেখলো সিয়াম সিয়ামের জায়গাতেই আছে সে নিজেই নিজের জায়গা ছেড়ে সিয়ামের জায়গায় এসে শুয়ে আছে। চন্দ্রা এবার হাজারবার দোয়া করলো যাতে সিয়ামের ঘুমটা না ভেঙ্গে যায়, সে আস্তে আস্তে সিয়ামের হাতটা পেটের উপর দিয়ে সরাতে গেলে সিয়াম কিছুটা নড়েচড়ে উঠে চন্দ্রাকে আরেকটু নিজের দিকে টেনে নিল। তার দরুণ সিয়ামের নিশ্বাস পুরোপুরি এখন চন্দ্রার ঘাড়ে পড়ছে। চন্দ্রার এবার শ্বাস আটকে এলো। বিয়ের পর বোধহয় এই প্রথম সিয়াম তার এতটা ঘনিষ্ট হলো। চন্দ্রা আবার চেষ্টা করলো নিজেকে ছাড়ানোর শেষে নিজেকে ছাড়তে পেরে এক বিজয়ের হাসি হাসলো সে। ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে সিয়ামের দিকে তাকালো সিয়াম বেঘোরে ঘুমাচ্ছে দেখে চন্দ্রা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। চন্দ্রা রুম থেকে বেরোতেই সিয়াম চোখ বুজেই মুচকি হেসে একটা বলিশ জড়িয়ে শুয়ে পড়লো।

_____________________________

চন্দ্রা রান্নাঘরে যেতেই দেখলো ইন্দ্রা সকাল সকাল উঠেই সব নাস্তা রেডি করে ফেলেছে এখন সব টেবিলে রাখবে বলে গোছাচ্ছে। চন্দ্রা অবাক হয়ে বললো “দিভাই তুই এসব কেনো করতে গেলি..? আর সাথী খালা কই এতক্ষণে তো ওনার সব রান্না কমপ্লিট হয়ে যায়।” ইন্দ্রা বললো “আমার তো জানিস সকালে একটু হাটাহাটির অভ্যাস আছে, তাই বাগানের দিকে যেতেই মালি চাচা বললো আজ নাকি খালা আসবেন না বলেছেন যেনো তোদের বলে দি। তারপর আমার হটাৎ করেই মনে পড়লো আমার বোনটা তো অকর্মার ঢেঁকি রান্নার ‘ র ‘ ও পারে না তাই আমিই করে দিলাম।”
চন্দ্রা গাল ফুলিয়ে বলে উঠলো “দিভাই ওমনি করে বলবি না। তুই নিজেই আমায় করতে দিতি না কিছু ঘরে। ”
ইন্দ্রা বলল ” আচ্ছা বাবা হয়েছে সব দোষ আমার। আর নিজের ঘরে হলে কি করতাম না বড় দিদি হয়ে যদি হেল্পই না করতে পারলাম তাহলে আর কিসের দিদি বল..?”
চন্দ্রা এবার ইন্দ্রাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো ” দিভাই এই দিভাইইইই” ইন্দ্রা ভ্রু কুঁচকে বললো হ্যাঁ কি আবদার আছে করে ফেলুন। চন্দ্রা মুচকি হাসলো সে ছোটো থেকেই কোনো আবদার করতে চাইলে দিকে এভাবেই এসে জড়িয়ে ধরে থাকতো।
চন্দ্রা ওভাবে জড়িয়ে ধরেই বললো “আমায় কিছু রান্না শিখিয়ে দিবি রে..? না মানে এইরাম যদি মাঝে মাঝে দরকার পরে তাই আর কি।”
ইন্দ্রা এবার ঘুরে চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো “কি বলিস রে তুই শিখবি রান্না..? এইসবও আমায় শুনতে হচ্ছে..?”
চন্দ্রা মুখ বেঁকিয়ে বলল “কেনো শিখতে পারি না নাকি বড়ো হয়েছি এবার একটু আধটু রান্না না জানলে হয়..?
ইন্দ্রা এবার টোন কেটে কেটে বললো “বেশ বেশ বুঝলাম। তো কারণ কি শুধু তাই..?নাকি বরমশাইকে নিজের হাতে করে কিছু খাওয়াতে পারো না বলে কষ্ট হচ্ছে..?”
চন্দ্রা এবার একটু মিথ্যে রাগ দেখিয়ে বলল “ধুর ওসব কিছুই না। তুই কি শিখাবি না শেখাবি না সেটা বল শুধু।”
ইন্দ্রা বললো ” আরে সকাল সকাল এতো মাথা গরম করছিস কেনো..? ওমা শাওয়ারও তো দেখি নিসনি ও এবার বুঝেছি সকাল সকাল কেনো মেজাজ চড়ে আছে।” চন্দ্রা এবার জোরে চেঁচিয়ে কানে হাত দিয়ে বললো ” ছি দিভাই ছি! লজ্জা করছে না তোর এসব বলতে বোন হই তোর। দিন দিন চরম অসভ্য হয়ে যাচ্ছিস তুই”
ইন্দ্রা জোরে হেসে দিয়ে বললো “বোন হস বলেই না বলছি অন্যকেউ হলে থরিই এইরকম মজা করতাম..?”
চন্দ্রা মুখ বেকিয়ে ইন্দ্রাকে সাহায্য করতে লাগলো কাজে।

_____________________________

ইন্দ্রা কফি নিয়ে সিয়াকে দেওয়ার উদ্দেশ্যে গেলো। উপরতলায় গিয়ে সে পড়লো মহামুশকিলে সে তো জানেই না কোনটা কার ঘর। শুধু শুনেছিল সুইটি বেগমের ঘরটা কোনের দিকে। তাই সেদিকে না গিয়ে হাতের সামনের দরজাটা নক করতে গিয়ে দেখলো দরজা টা নিজে থেকেই কিছুটা খুলে গেলো। ইন্দ্রা এবার ভিতরে দেখতেই দেখতে পেলো সিরাজ পুশ আপ করছে। সিরাজ দরজায় কারোর আওয়াজ পেয়ে ঘুরে দেখল ইন্দ্রা কফি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সিরাজ তাকাতেই ইন্দ্র ঘাবড়ে গিয়ে বললো “সরি সরি আমি ওই আমি মানে আমি ওই কফি..” সিরাজ ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়ে বললো ” আপনি এত ভয় পান কেনো সবেতে বলুন তো..? আমি বাঘ না ভাল্লুক যে আপনাকে খেয়ে ফেলবো..?” ইন্দ্রা ইতস্তত করে বললো “না আসলে আমি না বুঝেই এসেছি সিয়ার রুম ভেবে। কিছু মনে করবেন না। সিয়ার রুমটা কোনটা একটু বলতে পারবেন।” সিরাজ বললো ” আমার পাশের রুমটাই ওর। কিন্তু আজ তো ওকে পাবেন না অনেক সকালে বেড়িয়ে গেছে সে, বললো কিসব দরকার আছে অফিসে।” ইন্দ্রা ঘাড় নাড়িয়ে রুম থেকে বেরোতে গেলেই সিরাজ পিছন থেকে ডাকলো ” শুনুন ”
ইন্দ্রা পিছন ঘুরতেই সিরাজ এসে ইন্দ্রার হাত থেকে কফিটা নিয়ে এক চুমুক দিয়ে বললো “এনেছেন যখন ফেরত কেনো নিয়ে যাচ্ছেন..?আমাকে কি আপনার চোখে পড়ে না..?” তারপর কফিতে চুমুক দিয়ে বললো”উম কফিটা তো বেশ সুন্দর হয়েছে আপনি বানিয়েছেন..?”
ইন্দ্রা বললো ” ধন্যবাদ, হ্যাঁ আমিই বানিয়েছ। আসলে জানতাম না আপনি কফি খান নইলে আপনার জন্যও নিয়ে আসতাম।”
সিরাজ বললো “সরি বলার দরকার নেই এবার নিজের বিপদ নিজেই ডেকেছেন আপনি। আমি কিন্তু মাঝে মাঝেই আপনার কাছে এইরকম কফি খেতে চাইবো।”
ইন্দ্রা হালকা হেসে মাথা নাড়িয়ে বললো “আমার অসুবিধা নেই।”

_______________________________

দুপুর ১২ টা

সিয়া প্রত্যেকবারের মত আজও এসে দাঁড়িয়ে আছে কফি হাউসের সামনে। বার বার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে টেনশনে।তাকে একটু আগেই আতিফ ফোন দিয়ে বেশ সিরিয়াস ভাবে বলেছে খুব ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে সিয়ার সাথে কিন্তু সে দেখা করে বলতে চায়। সিয়ার ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে সেই কথা ভেবেই। কি এমন কথা যার জন্য আতিফ তাকে এতো জরুরিভাবে ডাক পাঠালো।
এসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতেই সামনে তাকিয়ে দেখলো আতিফ দৌড়ে দৌড়ে আসছে। সে এসেই সিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে হাঁপাতে লাগলো। সিয়া কিছু জিজ্ঞেস করতেই আতিফ বললো “বলছি বলছি আগে চো কফিশপের ভিতরে গিয়ে বসি।” বলে দুজন ভিতরে গিয়ে বসলো।

সিয়া এবার বিরক্ত হয়ে বললো ” এইরকম গাধার মত বসে না থেকে এবার বলবি কি হয়েছে…?পাক্কা পাঁচ মিনিট ধরে এরম চুপচাপ বসে আছিস। আমার এবার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে প্লিজ বল না।
আতিফ এবার সিয়ার হাতটা নিজের হতে নিলো। সিয়ার জানো টেনশন বেড়েই যাচ্ছে। আতিফ এবার মুখ তুলে বললো “আমি চাকরিটা পেয়ে গেছিরে সিয়া।” সিয়া এবার যেনো অবাক হতেও ভুলে গেলো। সিয়াকে এইরম অবাক হতে দেখে আতিফ সিয়ার এক গালে হাত রেখে বলল “শুনছিস তুই সিয়া চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি।” সিয়া এবার কেঁদে ফেলল। আতিফ জানে সিয়া নিজেও কতটা কষ্ট পেত তার কষ্ট দেখে। সে চেয়ারটা একটু সিয়ার কাছে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বসে সিয়াকে জড়িয়ে ধরলো বুকে তারও চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। আজ আর কেউ কাউকে কাঁদতে বারণ করলো না। কারন এটা যে খুশির অশ্রু।

#চলবে..?

বেড়াজাল পর্ব-১২+১৩

0

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #১২

ভোর ৪ টে। সিরাজের রুমের ভিতর যেনো ঝড় বয়ে গেছে। চারিদিক ভাঙা জিনিসে ছড়াছড়ি। সিরাজ মাথার চুল টেনে মাথা নীচু করে বসে ব্যালকনির ধার ঘেঁষে। এবার যেনো সব তার সহ্য সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। চন্দ্রা আর সিয়ামকে সে যতবার একসাথে দেখে ততবার তার বুকে রক্তক্ষরণ হয়। সেই কারণে সে বেশির ভাগই বাড়িতে থাকতো না কিন্তু দিনশেষে তো তাকে বাড়িতেই ফিরতে হয়।তার মনে যে চন্দ্রার জন্য সফট কর্নার ছিলো সেটা সে অস্বীকার করতে পারবে না সেই সফট কর্নারটা যে ভালোলাগা না ভালোবাসা সেটা সে নিজেও জানে না। এটা তো মানতেই হবে চন্দ্রাকে সে বাকি মেয়েদের থেকে আলাদা চোখে দেখতো। চন্দ্রার পবিত্রতায় হাত দেওয়ার কথা সে কখনো মাথাতেও আনেনি। হ্যাঁ এটা ঠিক অনেক মেয়েকেই সে নিজের শয্যাসঙ্গী করেছে তবে কাউকে জোর করে নয় সবাই তার পয়সার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তার শারীরিক চাহিদা মেটাতো। চন্দ্রা তার জীবনে আসার পর সে এইসব থেকে অনেকটা দূরে নিয়ে গিয়েছিল নিজেকে নেশাভানও প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল বলতে গেলে। কিন্তু ওই “এক মাঘে কি আর শীত যায়..?” তেমনটাই ঘটলো তার সাথেও।সেইদিন পার্টিতে বন্ধুরা জোর করে তাকে ড্রিংকস করিয়েছিলো। তাই সে হুশ-জ্ঞান হাড়িয়ে ফেলেছিল সেইরাতে। সে ঠিক কি করেছে তার মনেও নেই ঠিকভাবে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি আঘাত সিরাজের তখন লেগেছিল যখন চন্দ্রা তার সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল।তারপর ওই থানায় কেস। এতদিনে নিজেকে সারাক্ষণ নেশায় ডুবিয়ে সেইসব কথা ভুলে থাকতে চাইলেও বিয়ের দিন চন্দ্রাকে নিজের বড়ো ভাইয়ের বউ হিসেবে দেখে মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিলো তার। তার দরুণ সময় পেলেই চন্দ্রাকে সে কটু বাক্য শোনাত। সিরাজ হাতের দিকে তাকালো বেশ খানিকটা কেটে গেছে আরও কয়েক জায়গায় ভালোই চোট লেগেছে। যদিও এর চেয়ে অনেক বেশি লেগেছে তার হৃদয়ে। সে ঠিক করেছে চন্দ্রা যখন তার ভাইয়ার সাথে ভালো আছে তখন সে আর তাদের সম্পর্কে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না। সে স্বীকার করে ভুল একসময় তারই ছিলো কোনো মেয়েরই এইসব শুনে মেনে নেওয়ার কথা না চন্দ্রা তার জায়গায় ঠিকই ছিলো।
সিরাজ উঠে দাড়ালো। শাওয়ার নিয়ে এসে নিজেই এক এক করে সব গোছাতে লাগলো ঘরের। ভাঙ্গা জিনিস গুলো সার্ভেন্ট দিয়ে পরিষ্কার করলো।

_______________________________

সকাল ১০ টা

সিয়া আজও দাড়িয়ে আছে আতিফের জন্য। গতকালে ইন্দ্রার অতীত শুনে সিয়ার মনে ভীষণ ভয় হচ্ছে মনটা কেমন উসখুশ করছে। সিয়া জানে এই অস্বস্তির অবসান ঘটবে একমাত্র আতিফের সান্নিধ্য পেলে।
আতিফকে আসতে দেখেই সিয়া এক মুহূর্ত দেরি না করে আতিফকে গিয়ে জাপটে ধরল শক্ত করে।
আতিফ একটু হকচকিয়ে গেল। সিয়া সাধারণত এমনটা করে না। আতিফ কিছু জিজ্ঞেস না করেই সিয়ার পিঠে হাত রাখলো। সিয়া নিজেই কয়েক মিনিট বাদ আতিফকে ছেড়ে দাড়ালো। তারপর দুজনে বসল একসাথে কিছুক্ষন। সিয়া গতকালের সব ঘটনা খুলে বললো আতিফকে। কিন্তু আতিফ তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না।স্বাভাবিক ভাবেই নিলো ব্যাপারটা যেটা সিয়ার কাছে ভীষণ অস্বাভাবিক লাগলো।

________________________________

সিয়া বাড়ি ফিরে ঠিক করলো সে চন্দ্রার বাড়ি যাবে। কিন্তু বাড়ির ড্রাইভার আজ ছুটি নিয়েছে আর সিয়াও ড্রাইভিং পারে না ঠিকঠাক। উপায় না পেয়ে সিরাজকে জোরাজুরি করলো তাকে ড্রাইভিং করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সিরাজের যাওয়ার এক ফোঁটা ইচ্ছে না থাকলেও বোনের জেদের কাছে হার মেনে তাকে যেতেই হলো সিয়কে নিয়ে।

সিয়াম সকাল থেকে চন্দ্রার দেখা পায়নি। সেই যে একবার এসে তাকে ফ্রেশ হতে হেল্প করলো তারপর তাকে চা টুকুও ইন্দ্রা দিয়ে গেছে। সিয়াম ডাকবে না ডাকবে না করেও থাকতে না পেরে চন্দ্রার নাম ধরে ডেকেই ফেলল।
চন্দ্রা তখন রান্নাঘরে ইন্দ্রার সাথে গল্প করছিল। সিয়ামের আওয়াজ পেয়ে ইন্দ্রা দুষ্টুমি করে বললো “কি যাদু করলি বলতো এতো দেখি বউকে কিছুক্ষন না দেখতে পেয়েই চোখে হারাচ্ছে।” চন্দ্রা ইন্দ্রাকে হালকা ঠেলা মেরে বললো “খালি উল্টোপাল্টা কথা, কিছু হয়তো দরকার পড়েছে তাই ডাকছে।” ইন্দ্রা আবার দুষ্টু হাসি হেসে বললো “হ্যাঁ নতুন বউদের ওমনি একটু আধটু দরকার পড়ে বরের কাছে বুঝলি।” চন্দ্রা এবার খানিকটা লজ্জা পেলো। ইন্দ্রা বললো “থাক আর লজ্জায় লাল নীল না হয়ে যা বরের কাছে।নইলে দেখবো রান্নাঘর থেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।” বলে ইন্দ্রা হেসে দিল। চন্দ্রা” ধ্যাত দিভাই তুইও না” বলে দৌড়ে চলে গেলো সিয়ামের রুমে। ইন্দ্রার হাসি মুখটা মিলন হলো যতই যে হাসি খুশি থাকার চেষ্টা করুক বাইরে ভিতরে সে গুমড়ে গুমড়ে মরছে। কিন্তু তা দেখাতে চায় না কাউকে সে জানে তাকে কিছু মানুষ ভীষণ ভালোবাসে তার কষ্ট দেখে তারাও দ্বিগুণ কষ্ট পাবে।

চন্দ্রা নিজের ঘরে প্রবেশ করতেই দেখলো সিয়াম একমনে জানলার দিকে তাকিয়ে আছে। সিয়া এসেছে টের পেয়ে সিয়াম ঘুরে বললো “সকাল থেকে কোথায় ছিলে..?”
চন্দ্রা এবার বললো “আমি তো দিভাইয়ের কাছে কিচেনে ছিলাম। কিন্তু আপনি ডাকছিলেন কেনো..? আর এভাবে কেউ ডাকে..?দিভাই কিভাবে পিছনে লাগছিল বলুনতো..?”
সিয়াম ফট করে জিজ্ঞেস করলো “কিভাবে শুনি..?” চন্দ্রা কোনোকিছুই না ভেবে বলে উঠলো “বললো যে আপনি আমায় চোখে হারান। আমি বললাম দরকারে ডাকছেন হয়তো। সে বলে হ্যাঁ নতুন বউদের ওমন একটু দরকার পরে…” পুরো কথাটা শেষ করার আগেই চন্দ্রার খেয়াল এলো কি বলছে সে। সিয়ামের দিকে তাকিয়ে দেখলো সিয়াম ঠোঁটের কিছুটা উপর দুই আঙ্গুল চেপে মুচকি মুচকি হাসছে। চন্দ্রা লজ্জায় জিভ কাটলো সবজায়গায় দরকারের চেয়ে বেশি বলার অভ্যাসটা তার এখনো গেলো না।
সিয়াম এবার চন্দ্রাকে বললো “হ্যাঁ তোমার দিভাই তো ঠিকই বলেছে দরকার তো আছে।”
চন্দ্রা হালকা লজ্জা পেয়ে বলল “কি দরকার বলুন..?”
সিয়াম এবার চন্দ্রাকে উদ্দেশ্য করে বললো “চন্দ্র আমি চাইছি আজ আমরা একটু বাইরে যাই, ঘুরিফিরি তাতে
ইন্দ্রার মনও ভালো হবে সাথে তোমারও।”
চন্দ্রা শুনে বললো “হ্যাঁ ভালো আইডিয়া। তাহলে সিয়া আপুকেও ডেকে নিন।”
সিয়াম হেসে বললো “হ্যাঁ অবশ্যই। মহারানীর কথার খেলাপ করার সাধ্য কি আমার আছে..?” চন্দ্রা লজ্জা পেয়ে মাথা নীচু করে তাড়াতাড়ি যেতে গিয়েই হোচট খেলো কর্পেটে।
পরে যেতে নিলেই সিয়াম ধরে ফেললো চন্দ্রার হাত। চন্দ্রা টাল সামলাতে না পেরে সিয়ামের শার্টের কলার ধরে সিয়ামেই কোলেই পড়ে গেলো।
চন্দ্রা ভয়ে আসতে আসতে চোখ খুলে বুঝতে পারলো তার অবস্থান ঠিক কোথায় কিন্তু সেখান থেকে নড়ার ক্ষমতা সে পেলো না। চন্দ্রা তখন কলার ধরে টান দেওয়ায় সিয়ামের থেকে তার মুখের দূরত্ব প্রায় কয়েক ইঞ্চি সমান।
সিয়ামের চোখে চোখ পড়তেই চন্দ্রার বুক ধুকপুক করতে শুরু করলো। সে যেনো বাইরে থেকে আওয়াজ পাচ্ছে তার হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানির। অন্যদিকে সিয়ামেরও অবস্থাও নাজেহাল এই প্রথম সে চন্দ্রার এতো কাছে। কিছু নিষিদ্ধ ইচ্ছে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তার। চন্দ্রা শাড়ী পরে থাকায় তার অনুভূতি হলো সিয়ামের হাত তার কোমরের কিছু অংশ স্পর্শ করে আছে। এইকথাটা মাথায় পৌঁছাতেই চন্দ্রার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো তার তাড়াতাড়ি করতে উঠতে গিয়ে আবার পিছল খেলো সে। সিয়াম এবার চন্দ্রার কোমরটা একটু শক্ত করেই ধরে বললো “এতো তাড়াহুড়ো কিসের তোমার..?একটু সাবধানে কাজকর্ম করতে পারো না..?” এই প্রথম কোনো পুরুষের স্পর্শ পেলো সে এতো কাছ থেকে। মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোলো না চন্দ্রার, সে চুপটি করে সিয়ামের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো শুধু। ওই চোখে যেনো রাজ্যের সব মায়া জড়িয়ে চন্দ্রা চেয়েও যেনো চোখ ফেরাতে পারলো না।
তখনই আওয়াজ এলো ডোর বেলের। চন্দ্রার এবার হুশ ফিরল। সেই আওয়াজ শুনে চন্দ্রা সিয়ামকে ছেড়ে একটু দূরে চলে গেলো লজ্জায়। চন্দ্রা আর দাড়িয়ে না থাকতে পেরে দৌড়ে চলে গেলো বাইরে।
ডোর বেলের শব্দ শুনে ইন্দ্রা তাড়াহুড়ো করে দরজা খুলে দিতেই, সিয়া “আপুইইইই” বলে চেঁচিয়ে ইন্দ্রাকে জড়িয়ে ধরলো।
ইন্দ্রাও হেসে জড়িয়ে ধরলো সিয়াকে। সিয়া এবার ইন্দ্রাকে ছেড়ে বলল “দাড়াও আপু আমি ভাইয়া-ভাবীর সাথে দেখা করে আসি। এই বলে সে চন্দ্রার রুমে চলে গেলো।
ইন্দ্রা সিরাজকে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসালো। তারপর কিচেন থেকে গিয়ে চা নাস্তা এনে টেবিলে রাখলো। চা তুলে সিরাজকে দিতে গিয়েই অসাবধান বশত চায়ের খানিকটা গিয়ে পড়লো সিরাজের হাতে। সিরাজ তাড়াতাড়ি হাত ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ইন্দ্রা এবার ঘাবড়ে গেলো সামনে কিছু না পেয়ে তার ওড়না দিয়েই সিরাজের হাতটা মুছে দিতে দিতে বলল “সরি সরি ক্ষমা করবেন আমি এইরকমটা করতে চাইনি, আসলে আসলে”
সিরাজ বুঝতে পারলো ইন্দ্রা ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে তাই সে ওড়নাটা হালকা করে সরিয়ে বললো “আচ্ছা আচ্ছা আপনি আগে শান্ত হোন আমার তেমন কিছুই হয়নি। চা খুব একটা বেশি গরম ছিলো না আর আমি বুঝতে পেরেছি অসাবধানতা বশত হয়েছে এটা আমি এতো উত্তেজিত হবেন না।” ইন্দ্রা তাও শুনলো না দৌড়ে গিয়ে ফ্রিজ থেকে বাটি করে বরফ এনে সিরাজকে দিলো হাতে লাগানোর জন্য। সিরাজও বেচারা উপায় না পেয়ে বসে বসে হাতে বরফ ঘোষতে লাগলো।

#চলবে..?

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #১৩

সম্পত্তি, এই সম্পত্তি লোভ এমনই এক জিনিস যার জন্য মানুষ নিজের মানুষগুলোকেও খুন করতেও দুইবার ভাবে না। তেমনই এক মানুষ হচ্ছেন এই সুইটি বেগম। সুইটি বেগম ছিলেন দুই বোন দুই ভাই। তিনি ছিলেন বড়ো আর সুহানা মানে সিয়ামের মা ছিলেন তার দুই বছরের ছোটো তাদের ছোটো ছিলো তার দুই ভাই। সুইটি বেগম বড়ো মেয়ে হওয়ায় একটু বড়ো হতেই তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল অনেক দায়িত্ব। সেই চাপে তিনি পড়াশোনাও মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল অনেক বড়ো দেশ – বিদেশ ভ্রমন করার, বড়ো কোনো বাড়িতে বিয়ে করার। সুহানা তার দুই বছরের ছোট হলেও সে ছিলো সুইটি বেগমের থেকে বেশ সুন্দরী ও শিক্ষিতা। তাকে কোনো সময় কেউ কাজের জন্য জোর করতো না আর না করা হত তাদের দুই ভাইকে তাদের পড়াশোনার উপর বেশি জোর দেওয়া হতো। পড়াশোনার খরচের অর্ধেক দিতো সুইটি বেগম সেলাইয়ের হাতের বিভিন্ন কাজ করে। সুইটি বেগম মুখে কিছু না বললেও বেশ কষ্ট পেতো সে এই সব দেখে। তার বিয়ে ঠিক হওয়ার সময় তিনি জানান তার পছন্দ একজনকে আর তিনিই হলেন সিয়ামের বাবা আয়ান সাহেব। সবাই তার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেলে তারা ভাবেন সেই প্রস্তাব সুহানার জন্য আর তারা রাজি হয়ে যান। বিয়ের আগে তাদের দেখা করার তেমন একটা চল ছিলোনা তাদের গ্রামে। সরাসরি বিয়ের সময় সুহানার যায়গায় সুইটিকে দেখে ছেলেপক্ষ ভীষণ অবাক হন। আয়ান সাহেব জানান তিনি সুহানাকে চাড়া কাউকে বিয়ে করবেন না। সবাই পরিস্থিতির শিকার হয়ে সুয়াহার সাথেই আয়ান সাহেবের বিয়ে দেন। কিন্তু কেউ একটিবারের জন্যও সুইটি বেগমের কথা ভাবেন না। তিনি মানুষিক ভাবে ভীষণ ভেঙ্গে পড়েন, কয়েকবার সুইসাইড করারও চেষ্টা করেন, কিন্তু সফল হননা। তারপর তিনি ঠিক করেন তিনি যতদিন বেচেঁ আছেন তিনি সুহানাকেও ভালো ভাবে সংসার করতে দেবেন না। আর আয়ান সাহেবের সম্পত্তি তিনি নিয়েই ছাড়বেন যেকোনো হালে যেকোনো মূল্যে। কিছুদিন বাদ সুইটি বেগমকেও বিয়ে দেওয়া হয় শিহাব সাহেবের সাথে। তিনি ছিলেন এক প্রাইভেট ফর্মে কর্মরত। সুইটি বেগমকে তিনি মাথায় তুলে রাখলেও সুইটি বেগম তাকে কিছুতেই সহ্য করতে পারতেন না আর না তার অর্থে সন্তুষ্ট হতে পারতেন। এর কিছু বছরের মধ্যেই সিয়া ও সিরাজ জন্ম নেয়। সুইটি বেগমের সম্পত্তির লোভ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, মনে পরে প্রতিশোধের কথা। শিহাব সাহেবকে তালাক দেন তিনি, যদিও এটা খুব একটা সহজ ছিলো না কারণ সুইটি বেগম শিহাব সাহেবকে সহ্য না করতে পারলেও শিহাব সাহেব ভীষণ ভালোবাসতেন তাকে। তারপর তিনি সব দোষ শিহাব সাহেবের উপর চাপিয়ে গিয়ে ওঠেন সুহানা বেগমের বাড়ী। আয়ান সাহেব সুইটি বেগমের বানানো সব কথা বিশ্বাস করে থাকতে দেন নিজের বাড়ি। কিন্তু সেই বিশ্বাস চুরমার করে তিনি সুহানা ও আয়ানের সংসারে আগুন লাগাতে থাকেন নিত্য দিনের ঝামেলা লাগাতে থাকেন তাদের সম্পর্কে। যদিও কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন আয়ান সাহেব কিন্তু সুহানা বেগম টা মানতে মোটেই রাজি ছিলেন না।অবশেষে একদিন সব প্ল্যান করে দুজনের অ্যাক্সিডেন্ট করান। সুহানা বেগম ও আয়ান সাহেবের মৃত্যুর পর তিনি সিয়ামকে নিজের ছেলের মত যত্ন-আত্তি করতেন কারণ একটাই তার সম্পত্তি। আয়ান সাহেব সব সম্পত্তির তার ছেলে ও বউয়ের নামে করে ভাগ করে দিয়েছিলেন। সিয়ামের যেদিন সঠিক বয়স হয় তিনি সিয়ামকে দিয়ে সিয়ামের সম্পত্তির ভাগটা লিখিয়ে নেন। কিন্তু তার দ্বিতীয় দলিলের শর্ত ছিল সিয়ামের মায়ের পরবর্তীকালে যদি কিছু হয় সিয়াম তার মায়ের সম্পত্তির ভাগ নিজের নামে করতে পারবে একটি বয়সের পর।কিন্তু তাকে কিছু নিয়কানুন মানতে হবে। যেমন তাকে পুরো সুস্থ-সবল হয়ে সেই দলিলে স্বাক্ষর করতে হবে। কোনরকম শারীরিক অসুস্থ্তা বা মানসিক অসুস্থতা নিয়ে সে সাক্ষর করলে সেই সম্পত্তির পুরো ভাগটাই চলে যাবে অনাথআশ্রম বা বৃদধাশ্রমে। সুইটি বেগম ভালোই বুঝেছিলেন দ্বিতীয় উইলটা অনেক ভেবে চিন্তেই বানিয়েছেন আয়ান সাহেব। যাতে পরবর্তীকালে তাদের কিছু হলেও সিয়ামের কোনো ক্ষতি না হয়। সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার হলো সেই দলিল সুইটি বেগমের কাছে নেই আছে সিয়ামের কাছে। সিয়ামকে সুইটি বেগম যতবার এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছে সিয়াম এড়িয়ে গেছে।

একদিন সুইটি বেগম সিরাজকে সম্পত্তির ব্যাপারটা খুলে বলতে সিয়াম কিছুটা শুনতে পায়। সেই রাতে প্রচুর ড্রিংক করে সে বাড়িও ফেরে না রাতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়।
দুইদিন পর সুইটি বেগমের কাছে হসপিটাল থেকে কল আসে সিয়ামের অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার। সবাই দেখতে গেলে ডাক্তার জানান তার পা দুটি ড্যামেজ হয়ে গেছে।সে আর কোনোদিন হাঁটতে পারবে কি না ঠিক নেই। সেই কথা শুনে সুইটি বেগমের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে এতো দিন সিয়ামকে বাঁচিয়ে রাখার কারণ তার এইভাবে বৃথা যাবে সে ভাবেনি। তাও সিয়ামকে দেশের বড়ো বড়ো ডাক্তার দেখান সুইটি বেগম যাতে সিয়াম চলতে পারে। কোনো কোনো ডক্টর সিয়ামের ঠিক হওয়ার আশ্বাস দেন তো কোনো কোনো ডাক্তার সারাজীবন না হাঁটতে পারার আশ্বাস দেন। কথায় আছে না “আশাতে বাঁচে চাষা” সুইটি বেগমেরও ঠিক এই অবস্থা এখন।
কিন্তু তার চিন্তা অন্য জায়গায় এতদিন সে সিরাজকে নিজের দলে রেখে অনেক কাজই করিয়ে নিত। কিন্তু সিরাজের হটাৎ কেমন পরিবর্তন সুইটি বেগমের চোখে লাগছে। না এভাবে চলতে দিলে তো চলবে না এইযে এতো সম্পত্তি সবই তার ছেলের জন্য মেয়েকে নিয়ে তার কোনোকালে তেমন মাথাব্যাথা ছিলও না, আজও নেই সম্পত্তির ভাগ চাইলে তাকেও নয় কিছুটা দেওয়া যাবে সম্পত্তি কি আর কম নাকি তার কাছে এখন..? কিন্তু তার আর বাকিটাও চাই। তিনি ঠিক করলেন সিরাজকে ডেকে এবার তার সাথে কথা বলতে হবে। এখনও সেই দলিলের পেপার্স হাতে পাওয়া বাকি তার। এতে তাকে একমাত্র সাহায্য করতে পারে সিরাজ।
___________________________________

বিকেল ৪ টে

চন্দ্রা সবাইকে নিয়ে বেরোলো কিছু কেনাকাটির উদ্দেশ্যে। যদিও সিরাজকে নিয়ে যাওয়ার তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না। আর তার যা দেখে মনে হলো সিরাজেরও তেমন ইচ্ছে ছিলো না যাওয়ার। কিন্তু সিয়ামের আর সিয়ার জোড়াজুড়িতে তাকেও যেতেই হলো। কিন্তু তারা ঠিক করলো বেশি দুর যাবে না সামনেই কোথাও কেনাকাটা করবে ও ঘুরবে। যদিও সেটা শুধু সিয়ামের জন্যই, তার এই অবস্থায় সব জায়গায় যেতে প্রবলেম হবে তাই চন্দ্রার এইরকম সিদ্ধান্ত। চন্দ্রা ভেবেছে তার এই সিদ্ধান্ত যে শুধু সিয়ামের জন্য তা কেউ বুঝতে পারেনি। কিন্তু সবাই ঠিকই বুঝতে পেরেছে। সিয়াম মনে মনে বেশ খুশি হলেও ইন্দ্রা সিয়া ইতিমধ্যে মুচকি মুচকি হাসা শুরু করে দিয়েছে।
মোটামুটি রকম সব কেনাকাটি শেষ করে মেয়েরা ঠিক করলো তারা পাশের পার্কে যাবে। সিরাজ শুধু পর্যবেক্ষন করছিলো চারিদিক এখানে আসা অবধি সে একটা কথাও বলেনি, সিয়ামকে সাহায্য করতেই জানো এসেছে সে শুধু।

পাশের পার্কে যেতেই সিয়া ইন্দ্রা ও সিরাজকে টেনে নিয়ে গেল অন্য দিকে কিছু কথা আছে বলে। যদিও সবই বাহানা চন্দ্রা আর সিয়ামকে কিছুটা সময় একসাথে কাটাতে দেওয়ার এই বুঝে সিরাজ ও ইন্দ্রাও মানা করলো না সিয়াকে। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো অন্য জায়গায় যখন সিয়ার ফোনে আতিফের কল আসলো আর সে কিছুটা দুর চলে গেলো কথা বলতে।

ইন্দ্রা ভীষণ উসখুশ করছে। সিরাজ কিছুটা হলেও বুঝলো ব্যাপারটা তার নিজেরও কেমন একটা লাগছে। তাও সে নিজেকে সামলে ইন্দ্রাকে বললো “চলুন আমরা গিয়ে ওদিকটায় বেঞ্চে বসি। এখন চন্দ্রা ও সিয়াম এর কাছে ফিরে গেলে খারাপ দেখাবে।” ইন্দ্রা সম্মতি জানালো সিরাজের কোথায় তারপর দুজনে গিয়ে বসলো সামনের দিকের বেঞ্চে।
___________________________

এইদিকে চন্দ্রা সিয়াম ভালোই বুঝেছে তাদের স্পেস দিতেই সবাই প্ল্যান করে অন্য জায়গায় গেছে। তাও দুজনেই চুপ জানো দুজনেরই কেউ কিছুই বোঝেনি। সিয়াম এবার চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে চন্দ্রাকে বলল “চন্দ্র হাওয়াই মিঠাই খাবে..?” চন্দ্রা অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল “কেনো আমি কি বাচ্চা নাকি..?” সিয়াম হেসে বললো “কেনো হাওয়াই মিঠাই খেতে গেলে কি বাচ্চা হতে হয়..?” চন্দ্রা মুখ বেঁকিয়ে বলল “না তা নয় তবে আমি কোনো দিন হাওয়াই মিঠাই খাইনি, সবসময় বাচ্চাদেরই দেখেছি খায়।” সিয়াম এবার আকাশ থেকে পড়লো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো “সিরিয়াসলি চন্দ্র তুমি ছোটোবেলাতেও কোনোদিন খাওনি..?” চন্দ্রা উত্তর দিলো “না বাবা দিতেন না যদি আমার আর দিভাই এর শরীর খারাপ করে এইসব ভয়ে। কিন্তু দিভাই ঠিকই বন্ধুদের সাথে লুকিয়ে এটা ওটা খেতো। তবে আমার সে সুযোগ হয়নি তেমন।” সিয়াম আফসোস করে বলল “ইসস চন্দ্র শৈশবকালের দারুন একটা আনন্দ মিস করে গেলে তুমি। তুমি জানো এটাকে ছোটো বেলায় আমরা বুড়ির চুল বলতাম আর স্কুলের সামনে ভ্যানে করে এলেই বড়ো একটা হাওয়াই মিঠাই তৈরি করিয়ে সব বন্ধুরা মিলে ভাগ করে খেতাম।” চন্দ্রার শুনে বেশ মজা লাগলো তারও এবার একবার ট্রাই করার ইচ্ছে হয়েছে খুব মিষ্টি হয় শুনে সে কোনোদিন ট্রাই করার কথাও ভাবেনি। সিয়াম হেসে গিয়ে একটা হাওয়াই মিঠাই কিনে দিল। চন্দ্রা সিয়ামকে জিজ্ঞেস করলো “আপনি খাবেন না..?” সিয়াম বললো “নাহ তুমিও খেয়ে দেখ আজ কেমন লাগে” চন্দ্রা তাও শুনলো না তার থেকে কিছুটা নিয়ে সিয়ামের মুখের সামনে ধরলো। এবার কার সাধ্য সিয়ামকে হাওয়াই মিঠাই খাওয়া থেকে আটকায়..?এখন তো তার ডায়াবেটিস থাকলেও সে পুরোটা খেয়ে নেবে। সিয়াম হেসে মুখে নিলো কিছুটা। চন্দ্রা একটু খেয়ে বললো “এ তো খেতে ভীষণ মজা। বলে বাকিটা সে নিজেই খেয়ে নিল।” সিয়াম চন্দ্রার এইরকম বাচ্ছামি দেখে হেসে আরও কতগুলো হাওয়াই মিঠাই কিনে দিল। চন্দ্রার খুশি আর দেখে কে।

#চলবে..?

বেড়াজাল পর্ব-১০+১১

0

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #১০

সিয়াম ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই দেখছে চন্দ্রা কিছু নিয়ে উসখুশ করছে। যেনো কিছু বলতে চেয়েও পারছে না।
সিয়াম ঘড়ির দিকে তাকালো ঘড়িতে বাজে ৮:২৭ তার বেরোতে হবে ১০ টার আগে। তার আগে তাকে চন্দ্রার সাথে একবার কথা বলতেই হবে। হয়তো কোনো জড়তার জন্যই মেয়েটা তাকে কিছু বলতে পারছে না।
সিয়াম এবার নিজের রুম থেকেই উচ্চস্বরে চন্দ্রার নাম ধরে ডাকল। কিছুক্ষণের মধ্যেই চন্দ্রা দৌড়ে এলো সিয়ামের রুমে তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা কাজ করছিলো সে। শাড়ির আঁচলটা কোমরে গোঁজাই আছে এখনো। চন্দ্রা এবার সিয়ামকে উদ্দেশ্য করে বলল ” হ্যাঁ বলুন ডাকছিলেন..? আর আপনি ব্রেকফাস্ট করবেন না..? আজ তো অফিস আছে চলুন চলুন আগে ব্রেকফাস্ট করে নেবেন নয়তো গত পরশুর মতো পরে তাড়াহুড়ো করতে হবে।”
সিয়াম বলল ” থামো থামো পাকা গিন্নি হয়ে গেছো দেখছি তুমি। আগে আমার কথাটা শুনে নাও। আর এদিকে এসে বসো তো একটু, আমার কিছু কথা আছে তোমার সাথে। ” চন্দ্রা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল ” এখন..? ” সিয়াম চন্দ্রার ব্যস্ততা দেখে বললো ” বেশি সময় নেব না তোমার চন্দ্র, শুধু দশটা মিনিট দাও।” চন্দ্রা এবার কোমর থেকে আঁচলটা খুলে শান্ত হয়ে বসলো সোফায়।
সিয়াম চন্দ্রার সামনে গিয়ে বলা শুরু করলো ” তুমি কি কিছু বলতে চাও আমায় চন্দ্র..? বলতে চাইলে নির্দ্বিধায় বলো। সকাল থেকে কেমন উসখুশ করছো দেখছি। মনের মধ্যে যা আছে বন্ধু ভেবে বলে ফেল চন্দ্র, দেখবে মনটা হালকা হবে। ” চন্দ্রা আবারও উসখুশ করতে করতে বলল ” ওই আসলে, মানে কালকে ওই ”
সিয়াম বললো ” হ্যাঁ কাল কি..?কিছু হয়েছে কাল..?”
চন্দ্রা এবার ইতস্তত করে বললো ” না কিছু হয়নি তবে কাল পাপা ফোন করে বলল আপনাকে নিয়ে যেনো গিয়ে দুই দিন থেকে আসি। কিন্তু আপনার তো এখন রোজ অফিসে যেতে হয় তাই আর কি।” সিয়াম এবার হাফ ছাড়ল সে কিনা কি ভেবে বসেছিল তারপর চন্দ্রাকে বললো “এই কথা বলতে তুমি এতো ইতস্তত করছিলে চন্দ্র..? আমি তো নিজেই ভাবছিলাম তোমায় বলবো যাওয়ার কথা।”
চন্দ্রা এবার চমকিত স্বরে বলল “সত্যি..? কিন্তু আপনার যে রোজ অফিস থাকে..?”
সিয়াম উত্তর দিল “কাল শুক্রবার আমার অফিস নেই। তাই কালকের সারাদিন থাকতে আমার কোনো অসুবিধা নেই।আজ আমার অফিস থেকে আসার পরই রওনা দেব কেমন। তুমি রেডি থেকো।”
চন্দ্রা এবার মহা খুশি হলো। এতক্ষণে তার খেয়াল এলো সিয়াম তাকে এতোক্ষণ তুমি সম্বোধন করেই পুরো কথাটা শেষ করেছে। চন্দ্রা মনে মনে ভাবলো যাক কাউকে একজনকে তো শুরু করতেই হতো প্রথম সেটা নাহয় সিয়ামই করলো। চন্দ্রা এবার সোফা থেকে উঠে দাড়িয়ে বললো ” আসুন ব্রেকফাস্ট টা সেরে নেবেন।” সিয়ামও সম্মতি দিল চন্দ্রার কথায়।

আজ ব্রেকফাস্ট টেবিলে সবার দেখা মিললো একসাথে।নইলে তো শুধু সুইটি বেগম আর অফিস থাকলে সিয়ামকে পায় টেবিলে চন্দ্রা। আর সিরাজের তো কোনো ঠিক-ঠিকানাই পায় না চন্দ্রা কখন বাড়ি আসে কখন যায় সে কিছুই টের পায় না। বাকি রইলো সিয়া তার অফিসের জন্য তাকে আগে খেয়েই বেরিয়ে যেতে হয়।
চন্দ্রা সবাইকে যার যার প্লেট এগিয়ে দিল। শুধু সিরাজের বেলাতেই চন্দ্রা রান্নার খালাকে বললো “খালা আমার হাত যাচ্ছে না অতদূর আপনি একটু দিয়ে আসবেন..?”
সিরাজ ভালোই বুঝল চন্দ্রা তাকে এড়িয়ে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করছে। এসব দেখে তার মাথার রাগ আরো চড়ে উঠলো।
সিয়াম এবার সবার উদ্দেশ্য বললো “আজ কি তোরা ফ্রী আছিস..?” সিয়া সিরাজ দুইজনেই একসাথে প্রশ্ন করল ” কেন ভাইয়া কিছু দরকার ছিল…?” সুইটি বেগম সিয়ামকে উদ্দেশ্য করে বললেন “কোথাও যাবি বাবা..?”
সিয়াম সুইটি বেগমকে বলল “হ্যাঁ মনি, চন্দ্রর বাবা ফোন করেছিলেন আমাদের দুজনকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। তাই আমি চাইছিলাম সিয়া ও সিরাজ আমাদের সাথে চলুক।” সিয়া ব্রেড মুখে দিতে দিতে বলল “আমার তো হবে না ভাইয়া এমনিতেই অফিস থেকে এই মাসে দুটো লিভ নিয়ে নিয়েছি দরকারি কারণে। আর লিভ নেওয়া যাবে না। তবে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে ওখানে পৌঁছে যেতে পারি।” সিয়াম সিয়াকে বলল ” হ্যাঁ তাই করিস তবে। আর সিরাজ তুই যাবি তো..?তুই যে আজ ফ্রী আছিস তা কিন্তু আমি জানি।”
চন্দ্রার এবার অস্বস্তি হতে শুরু করল এই লোকটা যে কেনো সিরাজকে ধরে টানাটানি করছে চন্দ্রা তাই বুঝতে পারছে না। সিরাজ প্রথমে না বললেও অবশেষে মা আর ভাইয়ার জোরাজুরিতে হাপিয়ে বলে উঠল “ফাইন, যাবো কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না রাতের আগেই ব্যাক করবো আমি। “সিয়াম বললো “আচ্ছা তাই, তাও চল।”
সবাই একসাথে ব্রেকফাস্ট সেরে যে যার কাজে বেড়িয়ে পড়ল। সিয়াম চন্দ্রাকে সন্ধ্যে বেলায় রেডি হয়ে থাকতে বলে সেও বেরিও গেলো।
চন্দ্রা কিচেনে অল্প হাতে হাতে কাজ করে সিয়ামের দেওয়া গল্পের বই নিয়ে বসলো নিজের রুমে। সেইসময় চন্দ্রার ঘরে সুইটি বেগম প্রবেশ করলেন। চন্দ্রা সুইটি বেগমকে দেখে বই রেখে উঠে দাঁড়াল। সুইটি বেগম হেসে চন্দ্রাকে বললেন ” ইটস ওকে বেটা ওতো উত্তেজিত হতে হবে না। চন্দ্রা তাও সুইটি বেগমকে বললেন “আরে না মনি উত্তেজিত হবো কেনো..? আর তুমি দাড়িয়ে আছো কেন বসো বসো।” সুইটি বেগম হাতের ব্যাগটা নিয়ে সোফায় বসলেন। চন্দ্রাকেও বললো বসার জন্যে চন্দ্রা বসলো আরেকটি সোফায়। সুইটি বেগম চন্দ্রার উদ্দেশ্যে বললেন “আমার তো তোমার বিয়ের সময় তেমন কিছু দেওয়া হয়নি বেটা,তাই এই সোনার আংটি টুকু এনেছি।”
চন্দ্রা বলে উঠল “এসবের আবার কি দরকার ছিল মনি..? তোমার ভালবাসাই তো যথেষ্ট আমার জন্যে।”
সুইটি বেগম চন্দ্রার হাতে আংটি পড়ানোর জন্য টেনে নিয়ে বলতে লাগলেন “তা হয় নাকি আমি না তোমার শাশুড়ির মত সে থাকলে কি আর কোনো খামতি রাখতো বলো কোনো কিছুতে আমিও রাখতে চাইনা মা।” বলে আংটি টা পরিয়ে যেই চন্দ্রার হাতের দিকে ভালো করে নজর দিলেন ওমনি চমকে উঠে চন্দ্রার হাত কিছুটা তুলে বললেন “এই বালা তুমি কই পেলে চন্দ্রা..?এই বালা তো সিয়ামের মায়ের।”
সুইটি বেগম বেশ চেপেই হাতটা ধরায় চন্দ্রার হাতে কিছুটা ব্যাথা লাগলো। সে একপ্রকার নিজের হাত না সুইটি বেগমের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল “সিয়াম দিয়েছে মনি এই বালা আমায়।” সুইটি বেগম আগের মতোই চমকে জিজ্ঞেস করলেন ” কিন্তু সিয়াম যে বলেছিলো এই বালা জোড়া তার কাছে নেই..?” চন্দ্রা বললো “তা তো জানি না মনি উনি এলেই ভালো বলতে পারবেন।”
সুইটি বেগম এবার কিছুটা নরম হয়ে বললেন “খুব সুন্দর মানিয়েছে তোমায় বালাটা চন্দ্রা, কই দেখি আমি একবার ভালো করে..” বলে চন্দ্রার হাত থেকে বালাটা খুলতে গেলেই চন্দ্রা হাতটা সরিয়ে নিয়ে বললো “আসলে মনি উনি এই বালা জোড়া আমায় খুলতে বারণ করেছেন, কিছু মনে করবেন না।”
সুইটি বেগম হেসে বললেন ” আরে না না ঠিক আছে আসলে সিয়াম বলেছিলো তার কাছ থেকে এই বালা জোড়া চুড়ি হয়ে গেছে তাই আর কি দেখছিলাম ভালো করে ওইটা আসল কি নকল।” এই বলে সুইটি বেগম বেশ চিন্তিত মুখ নিয়ে রুমের বাইরে চলে গেলেন। চন্দ্রার এবার বেশ সন্দেহ হচ্ছে এই সুইটি বেগমর উপর তিনি এই রোদ তো এই বৃষ্টি তাকে বোঝার উপায় নেই।

_________________________________

বিকেল ৪ টে

সিয়াম আজ একটু তাড়াতাড়িই ফিরেছে অফিস থেকে। এই প্রথম সে শশুর বাড়ি যাচ্ছে সাথে কিছু ফল মিষ্টি নিতে হবে। তার জন্যই সিয়াম ভেবেছে তারা একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আগে সেগুলো কিনবে তারপর তার শশুরবাড়ি ঢুকবে। ঘরে ঢুকে সিয়াম আসেপাশে চন্দ্রকে দেখতে না পেয়ে বেশ মন ভার করলো। এই কয়দিনে অভ্যাস খারাপ করে দিয়েছে ওর। অফিস থেকে এসে চন্দ্রার মুখ না দেখলে তার সারাদিনের ক্লান্তি আরও যেনো বেড়ে যায়। কই সে অফিস থেকে এলে তার সামনে ঘুর ঘুর করবে তা না কই গিয়ে বসে আছে কে জানে…?
চন্দ্রাকে উচ্চস্বরে একবার ডাকতেই চন্দ্রা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠলো “আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন সিয়াম। আমি পুরো রেডি আপনার কফি নিয়ে যাচ্ছি খেয়ে তারপর বেরোবেন।” সিয়াম বেচারা আর কি করবে। বউয়ের আদেশ বলে কথা তাই অগত্যা সেও মুখ ভার করে চলে গেলো ফ্রেশ হতে।
সিয়াম ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই সামনে তাকিয়ে হুশ উড়ে গেলো তার। সে ভাবেনি এতো বড়ো চমক অপেক্ষা করছে তার জন্য। সামনে চন্দ্রা দাড়িয়ে কফি মগ হাতে নিয়ে, পরনে তার লাল জর্জেটের শাড়ি ম্যাচিং করে লাল ব্লাউজ আর ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। হাতে সিয়ামের দেওয়া দুই জোড়া বালা, কানে ছোটো ঝুমকা। চন্দ্রা দেখতে বেশ গোলগাল টাইপের কিন্তু একে মোটা বলা যায়না ঠিক আবার রোগাও বলা যায়না, তার সাস্থ্য ভালো। তারউপর ফর্সা মুখটা বেশ মিষ্টি ধরনের হওয়ার কারণে শাড়টা একটু বেশিই ফুটেছে তার শরীরে।
সিয়ামের হার্টবিট ভীষণ ফাস্ট চলতে শুরু করল, এক্ষুনি জানো তার হার্টটা লাফিয়ে বেরিয়ে আসবে বাইরে। এর আগেও সে চন্দ্রকে দেখেছে বিয়ের সাজে কিন্তু সেইরকম ভাবে দেখার সুযোগ তার হয়নি। চন্দ্রা ঘরে সবসময় শাড়ি নয়তো লং কিছু পরে আর তেমন সাজেও না তারপর হঠাতই এই রূপ দেখে সিয়ামের মনে হচ্ছে কোনো অপ্সরী দাড়িয়ে আছে তার সামনে।
চন্দ্রা এবার সিয়ামের চাহনি দেখে শুধু খানিকটা না বেশ খানিকটা লজ্জা পেল। একটা মেয়ে হয়ে সে বোঝে এই চাহনির মানে তাই আর দাড়িয়ে না থেকে সিয়ামের কাছে এসে বললো “আমায় দেখা শেষ হলে এবার কফিটা নিন।”
চন্দ্রা সামনে থাকায় তার শরীর থেকে তেড়ে আসছে এক কড়া মিষ্টি পারফিউমের সুভাস। সিয়মের মাথা ঝিমঝিম করছে, নেশা লেগে যাচ্ছে সামনের মানুষটার। নাহ এভাবে একভাবে তাকিয়ে থাকলে আজ একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে সে। যা সিয়াম চায় না এখন একদমই না। তাই চোখের দৃষ্টি নামিয়ে কফির মগটা হাতে নিয়ে বললো “তা এতো সাজগোজের কারণ জানতে পারি..?” চন্দ্রা উত্তর দিলো “কারণ আবার কি..? কতদিন বাদ বাপের বাড়ি যাচ্ছি বলুন তো। আর এতো সাজগোজ কই হালকার উপর একটু মেকআপ করেছি ব্যাস।”
সিয়াম এবার কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললো “কারণ কি শুধু এটাই..?” চন্দ্রা চোখটা একটা এপাশ-ওপাশ করে উত্তর দিলো “হ্যাঁ তা নয়তো কি..?” সিয়াম এবার কফির মগ পাশে রেখে বললো ” আচ্ছা বেশ তাই মানলাম। তুমি দাঁড়াও আমি এক্ষুনি রেডি হয়ে আসছি।” বলে সিয়াম রেডি হতে চলে গেলো।
চন্দ্রা নিজের মনকে এবার জিজ্ঞেস করলো “আচ্ছা সত্যিই কি সে শুধু বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য এতো সেজেছে..?”
ভিতর থেকে উত্তর এলো নাহ আজ সিয়ামের সাথে প্রথম কোথাও বেরোনো তার। তারউপর মানুষটার একটু দৃষ্টি আকর্ষণ.? নাহ্ নাহ্ ছি..! কিসব ভাবছে চন্দ্রা সে মনকে কষিয়ে এক ধমক দিলো।
এরই মধ্যে সিয়ামও চলে এলো ড্রেস চেঞ্জ করে। এবার অবাক হওয়ার পালা যেনো চন্দ্রার সিয়ামকে দেখে আরেকবার ক্রাশ খেলো সে। ব্ল্যাক শার্ট সাথে জীন্স চুলগুলো হালকা বড়ো হওয়ার কারণে কিছুটা কপালে পরে চোখে হোয়াইট ফ্রেমের চশমা যদিও সে চশমটা খুব দরকারেই পড়ে কিন্তু চন্দ্রার তাও মনে হলো এইটার সাথে সিয়ামকে একটু বেশি মানাচ্ছে। সিয়াম চন্দ্রাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি হেসে বলল “তা আজ কি যাওয়ার প্ল্যান আছে ম্যাডাম..?”
চন্দ্রার হুশ ফিরল এবার সে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল “হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন।” সিয়াম বললো “তুমি গিয়ে বাইরে দাড়াও আমি সিরাজকে ডেকে আনছি।” চন্দ্রার খুশি এক নিমেষে ধুলিস্যাৎ হয়ে গেলো সিয়ামের এইকথা শুনে। সে মুখ বেজার করে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো।
কিছুক্ষন বাদ চন্দ্রা দুই ভাইকে আসতে দেখলো গাড়ির সামনে। সিরাজ শুধু চন্দ্রাকে একপলক ভালো করে দেখে নিল। চোখ ঝলসে যাচ্ছে তার বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা দায় হয়ে উঠলো তার জন্যে তাই চোখ নামিয়ে সিয়ামকে গাড়িতে তুলে দিলো। তারপর নিজে গিয়ে বসলো ড্রাইভারের পাশের সিটে। সামনের আয়না দিয়ে চন্দ্রাকে ভালোভাবে দেখা গেলেও সিরাজ গোটা রাস্তায় একবারও তাকালো না চন্দ্রার দিকে ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা পৌঁছে গেলো চন্দ্রার বাড়ি। সবাই গাড়ি থেকে নেমে জিনিস পত্র নিয়ে বাড়ির বেল বাজতে একজন দরজা খুলে দিল।
সামনের মানুষটিকে দেখে চন্দ্রা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার মুখ দেখেই মনে হচ্ছে সামনের মানুষটিকে সে মোটেও আসা করেনি এই সময়ে।

#চলবে..?

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #১১

সামনের মানুষটিকে দেখে চন্দ্রা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার মুখ দেখেই মনে হচ্ছে সামনের মানুষটিকে সে মোটেও আসা করেনি এই সময়ে।
চন্দ্রার সামনে দাঁড়িয়ে চন্দ্রার দিদি ইন্দ্রা। চন্দ্রা খাকিক্ষণ সময় নিলো তার অবাকের রেশ কাটাতে তারপরই ইন্দ্রার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গলা জড়িয়ে নিলো। ইন্দ্রাও এতদিন বাদ বোনকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে।

এরমধ্যেই চয়ন সাহেব বাইরে এসে দাঁড়ালেন। দুই মেয়েকে এই অবস্থায় দেখে বললেন “কি শুরু করেছিস বলতো তোরা? দুজন জামাই এসে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আর তোরা এখন জড়াজড়ি করছিস।”
ইন্দ্রা এবার চন্দ্রা কে ছেড়ে চোখ মুছে বললো ” তাইতো আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম সর দেখি জামাইকে ঢুকতে দে ঘরে।” বলে দুইবোন দরজা ছেড়ে দাড়ালো। সিয়াম সিরাজ ঘরের ভিতর প্রবেশ করলো। চন্দ্রা গিয়ে তার পাপাকে কিছুক্ষন জড়িয়ে ধরে থাকলো।
চন্দ্রার এইসময় ইন্দ্রার ব্যাপারে জানার তীব্র ইচ্ছে থাকলেও সে নিজেকে সামলে নিলো। পরে একান্তে নয় জিজ্ঞেসা করা যাবে সবার সামনে জিজ্ঞেস করলে যদি ইন্দ্রা অস্বস্তিতে পড়ে যায় এই ভেবে চন্দ্রা আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।
চয়ন সাহেবকে সিয়াম আর সিরাজের সাথে কথা বলতে দেখে চন্দ্রা আস্তে করে উঠে তার দিদির কাছে কিচেনে চলে গেলো। ইন্দ্রা যে সিয়ামকে দেখে একটুও চমকায়নি এটা বেশ খটকা লেগেছে চন্দ্রার, কারণ মানুষের খারাপ দিকই আগে সবার চোখে পড়ে, যেমন তার পড়েছিল সিয়ামের ব্যাপারে।
চন্দ্রা রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো ইন্দ্রা অর্ধেক রান্না শেষ করে কড়াইতে সেমাই করছে। চন্দ্রা একটু দুষ্টুমি করে পা টিপে টিপে ইন্দ্রার পিছন দিয়ে কানের কাছে গিয়ে জোরে চেঁচালো “ধাপ্পাআআআআ” ইন্দ্রা চমকে উঠে পিছনে তাকাতেই দেখলো চন্দ্রা হেসেই যাচ্ছে। ইন্দ্রা এবার চন্দ্রার কান ধরে বললো “ওরে বদমাশ এখনও পল্টাসনি তুই সেই আগের মত পাজিই রয়ে গেছিস..?” চন্দ্রা হাসি থামিয়ে সিরিয়াস ভাবে বললো “কিন্তু তুই অনেক পাল্টে গেছিস দিভাই। কি হাল করেছিস নিজের দেখেছিস..? চোখ কোটরে ঢুকে গেছে, গায়ের আসল রঙ চাপা পরে গেছে। আর জিজুই বা কই..? আর আর বাবা কি করে..? মানে তোর উপর তো ভীষণ রেগে ছিলো হটাৎ কি এমন হলো..?”
ইন্দ্রা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলল “সে অনেক ঘটনা রে। আপাতত এইটুকুই জেনে রাখ ওই সংসার ছেড়ে চলে এসেছি। বলতে গেলে বাবা গিয়েই নিয়ে এসেছে। সত্যি বলতে তো সিয়ামের জন্যই…” ইন্দ্রা পুরো কথা শেষ করতে পারলো না বাইরে থেকে চয়ন সাহেব হাঁক দিলেন নাস্তা নিয়ে যাওয়ার জন্য। চন্দ্রা চেঁচিয়ে বলল “আসছি পাপা দুই মিনিটে” বলে ইন্দ্রাকে জিজ্ঞেস করলো “হ্যাঁ সিয়ামের ব্যাপারে কি বলছিলি যেনো তুই..?
ইন্দ্রা হেসে বললো ” না না তেমন কিছু না। খালি বললাম উনি খুব ভালো।” চন্দ্রা ফট করে জিজ্ঞেস করলো “তুই কীকরে জানলি..?” ইন্দ্রা এবার বললো “বাবার কাছে শুনেছি উফফ তুইও না এতো প্রশ্ন করিস কেনো বলতো..? যা নাস্তা নিয়ে যা তাড়াতাড়ি” বলে চন্দ্রাকে হাতে নাস্তার ট্রে দিয়ে ড্রয়িং রুমে পাঠিয়ে দিল।

রাত ৮ টায় সিয়াও চলে এলো। রাতের খাওয়া সবাই একসাথে সম্পূর্ণ করলো। খাওয়ার শেষে চন্দ্রা, ইন্দ্রা আর সিয়া গিয়ে এক রুমে বসলো। সিয়ার ইন্দ্রাকে বেশ মনে ধরেছে, তার মধ্যে একটা মা মা ভাব আছে। সিয়া ইন্দ্রার গাল টেনে বললো “কি মিষ্টি গো তুমি একদম পুতুলের মতো। তোমায় আর চন্দ্রা ভাবীকে অনেকটা এক দেখতে মনেই হয়না তুমি চন্দ্রা ভাবীর থেকে বড়ো মনে হয় সমবয়সী তোমরা দুজন।” ইন্দ্রা হেসে বললো “তুমিও ভারী মিষ্টি সিয়ারানী”
চন্দ্রা এতক্ষণ ব্যাগে কি একটা খুঁজছিল ওদের কথা শুনে চন্দ্রা বললো “ওর কথা আর বলনা আপু ছোটো থেকে যে কত লাভ লেটার পেয়েছে তার ঠিক নেই।
ইন্দ্রা ধমক দিয়ে বললো “আবার বেশি বলছিস চুপচাপ নিজের কাজ কর।”
সিয়া এইসব শুনে বললো ” তাই আপু তা তোমার কাউকেই পছন্দ হয়নি..?আচ্ছা আপু তোমায় চন্দ্রা আপুর বিয়ের সময় কেনো দেখিনি..?”

ইন্দ্রা এবার চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে দেখল চন্দ্রা কাজ থামিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
সিয়া দুজনকে দেখে বললো ” প্রবলেম থাকলে ইটস ওকে আপু। আমি তো এমনিই জানতে চাইছিলাম।”

ইন্দ্রা এবার বললো “না সিয়া তুমিও তো আমার বোনের মতই তোমাকে বলতে আমার প্রবলেম নেই। আর চন্দ্রা তুইও জানতে চাইছিলি না..? আয় এখানে এসে বস। আমি খুলে বলছি।” চন্দ্রা ব্যাগ ছেড়ে এসে বিছানার একধারে বসলো।

ইন্দ্রা এবার বলতে শুরু করলো। ইন্দ্রা বললো “আমি যখন সদ্য কলেজ পড়ুয়া। তখন আমি প্রেমে পড়ি আমার চেয়ে ৭ বছরের বড়ো এক ছেলের তার নাম ছিল পলাশ। সে আমার অনেক খেয়াল রাখতো। ছোটোবেলা থেকে তেমন মা-বাবা কারোর আদরিই পাইনি আমি। তাই একটু ভালোবাসা আর যত্ন পেতেই আমি মিইয়ে গিয়েছিলাম তার কাছে। তাকে ছাড়া সব কেমন ফিকে ফিকে লাগতো। আমার রিলেশন ছিলো এক বছর তিন মাসের। তাও ও আমার কোনো ভুল হলে নিজের উপর নিয়ে নিত। একদিন হঠাৎই বললো ওর বাড়ি থেকে নাকি জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে আমায় ওকে তখনই বিয়ে করতে হবে নয়তো তাকে আমি চিরদিনের জন্য হারাবো।আমি ভিষন ভয় পেয়ে গেলাম। বাবাকে ওর কথা বলার সাহস আমার ছিলো না কারণ ও তখনও ছিলো বেকার, তারউপর আমি তখন সবে সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছি। তার জোড়াজুড়িতে সেই রাতেই সাহস করে মায়ের কিছু গয়না আর মায়ের একটা বেনারসি নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম ওর সাথে। সেই রাতেই আমরা বিয়ে করি, আর সাক্ষী থাকে ওর কিছু বন্ধুরা। তারপর পলাশের ঘরে উঠি। পলাশরা ছিলো এক ভাই এক বোন। বোন তখন ছোটো সবে ক্লাস এইটে পড়ে। আর ছিলো বলতে পলাশের মা-বাবা। সকালে সেই খবর আমার বাড়িতে জানানো হতেই বাবা আমায় ত্যাজ্য করলেন। আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়েছিল চন্দ্রার জন্যে কারণ ওকে আমি ছোটো থেকে কোলে পিঠে মানুষ করেছি।
এইরকম ভাবেই কেটে গেলো পাঁচ মাস। ভালোই চলছিল সব পলাশরা বেশ উচ্চবিত্ত পরিবারের ছিলো। সমস্যা শুরু হলো চার মাসের মাথায়। ইন্দ্রার কোনো কাজই জানো তার শশুর শাশুড়ীর পছন্দ হতো না। কোনো না কোনো কিছু নিয়ে তারা অশান্তি লাগিয়েই রাখতেন এভাবে ইন্দ্রার কলেজে যাওয়াও তারা বন্ধ করে দিলেন। প্রথম প্রথম পলাশ ইন্দ্রার সাইড নিয়ে কথা বললেও কিছুদিন পর থেকেই ইন্দ্রাকে প্রচন্ড মারধর শুরু করে। শশুর শাশুড়ী দেখে তো কিছু বললেন না উল্টে বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া যাবতীয় গয়না নিয়ে নিলেন। তার কিছুদিন পর ধরা পরে পলাশের পরকীয়ার কথা। বিয়ের পরও তার বাইরে দুটো প্রেমিকা ছিলো।
আমি জানতে পারি অর্ধেক পলাশের ফোন দেখে আর অর্ধেক পলাশের এক মেয়ে বান্ধবীর কাছ থেকে যদিও নিজের পরিচয় দিইনি আমি কাউকে। সেদিন সেসব কথা আমার মুখ থেকে শোনার পর রাতে ড্রিংক করে এসে পলাশ আমায় বেল্ট দিয়ে মারে লাথিও মারে পেটে যার চোটে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। পলাশের বাড়ির লোক ভয় পেয়ে আমায় হসপিটালে নিয়ে যায়। তারপর এই খবর বাবার কানে পৌঁছায় বাবার এক চেনা পরিচিতর সূত্র ধরে। বাবা সব রাগ অভিমান ভুলে আমায় দেখতে যায় হসপিটালে আর সেখান থেকেই নিয়ে আসে আমায় এখানে ওদের পরিবারকে হুমকি দিয়ে যে আমার সাথে আর কোনো যোগাযোগ তারা করতে চাইলে বাবা পুলিশে দেবে। আর ডিভোর্স লেটার বাবা পাঠিয়ে দেবে ওদের বাড়ি। আমার সেদিন বাবার সামনে দাঁড়াবার মুখ ছিলো না, কিন্তু কিছু করারও ছিলো না আমায় বেরোতেই হতো ওই নরক থেকে কিছু করে। এই বলে ইন্দ্রা থেমে চোখের জল মুছলো। চন্দ্রা ইন্দ্রাকে জড়িয়ে ধরলো। সিয়ারও মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো।
চন্দ্রা এবার জিজ্ঞেস করলো “আচ্ছা দিভাই এখন কি খবর ওই জানোয়ারের জানিস..?” ইন্দ্রা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল “হ্যাঁ শুনলাম আমি আসার পরের দিনই এক বড়োলোকের মেয়েকে বিয়ে করেছে। সুখেই থাকে বুঝলি চন্দ্রা এরা দিনশেষে, শুধু ঠকে যাই আমাদের মত বোকা মানুষরা।”
সিয়া মন খারাপের সুরে বলল “এখন আপু…?পড়াশোনা টা শেষ করবে না..?” ইন্দ্রা উত্তর দিলো “হ্যাঁ ইচ্ছে তো আছে। নিজের পায়ে দাঁড়াবো।”
চন্দ্রা বললো ” দিভাই তুই বরং ইউ এস এ চলে যা। তোর এক বন্ধুও থাকে না ওখানে..? এখানে যত একা থাকবি তত ডিপ্রেশনে চলে যাবি। একেবারে পড়াশোনা শেষ করে ফিরিস।” ইন্দ্রা বললো “বাবাও একই কথা বলছিলেন দেখি যদি ভিসা পাই তো চলেই যাব।”
এর মধ্যেই নীচ থেকে ডাক পড়লো সবার। তিনজন নীচে গিয়ে দেখলো সিরাজ রেডি হয়ে দাড়িয়ে আছে সিয়াকে নিয়ে ব্যাক করবে বলে। চন্দ্রা ও ইন্দ্রা অনেক জোর করলো সিয়াকে আজ রাত টা থাকার জন্য। কিন্তু সিয়া জানালো সকালে তার কিছু জরুরী কাজ আছে। আজ তাকে ব্যাক করতেই হবে। তেমন হলে সে আবার কাল বেলার দিকে আসবে নয় এখানে। এই বলে দুজন রওনা দিলো তাদের বাড়ির উদ্দেশ্য।

এদিকে চন্দ্রা ইন্দ্রার কাছে জেদ ধরেছে সে আজ তার কাছে ঘুমোবে। তাও ইন্দ্রা অনেক বুঝিয়ে চন্দ্রাকে সিয়ামের রুমে পাঠালো রাত ১ টার সময়। চন্দ্রা ঘরে ঢুকে দেখলো সিয়াম তার একটা গল্পের বই নিয়ে বিছানায় বসে বসে পড়ছে। চন্দ্রা সিয়ামকে বললো “আপনি এখনো ঘুমাননি..?” সিয়াম বই থেকে মুখ তুলে চশমা টা খুলে বললো “ফাইনালি মহারানীর এই ঘরে আসার সময় হলো।আমি তো ভাবলাম আজ আসবেই না এই ঘরে। আজকের দিনটা বরং দিদির সাথেই থাকতে পারতে চন্দ্র।”
চন্দ্রা বিছানায় বসতে বসতে বললো ” আমিও তো দিভাইকে বললাম সে কথা কিন্তু দিভাই শুনলে তো। বললো রাতে যদি আপনার কোনো কষ্ট হয়..?” তাই ঠেলে ঠুলে পাঠিয়ে দিল।
সিয়াম বিড়বিড় করে বললো ” যাক কেই তো বুঝলো আমার কষ্ট।”
চন্দ্রা বললো কিছু বললেন..? সিয়াম বললো “কই নাতো তুমি শুয়ে পরো আমি টেবিল ল্যাম্প অফ করে দিচ্ছি।”

_______________________________

রাত ২ টো

সিয়াম বিছানা থেকে উঠে বসে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে আসতে করে ডাকল “চন্দ্র”
চন্দ্রা পাশ ফিরে বললো “আপনি এখনও ঘুমাননি..?”
সিয়াম বললো “পাশে একটা মানুষ শুয়ে ছটপট করলে কি পাশে শুয়ে থাকা মানুষটার ঘুম হয়…?”
চন্দ্রা এবার নিজের কর্মের জন্য দুঃখিত হলো। বললো “সরি আমি বুঝতে পারিনি আপনি ডিস্টার্ব হচ্ছেন। আমি আর নড়াচড়া করবো না আপনি ঘুমান।”
এই বলে পাশ ফিরতে গেলেই সিয়াম বললো “চন্দ্র কি হয়েছেবলোতো…? দিভাই এর জন্য মন খারাপ লাগছে..?”
চন্দ্রা এবার ছলছল চোখে সিয়ামের দিকে তাকালো। আসলেই তার এইসব শোনার পর থেকেই ভীষণ খারাপ লাগছে। দিদিকে ভীষণ ভালোবাসে সে, ছোটো থেকেই দিদিকে স্টাগেল করে বড়ো হতে দেখেছে সে। তাই সে চায়না দিভাইয়ের গায়ে কোনো আঁচ আসুক।আচ্ছা পৃথিবীতে এতো বেঈমান মানুষ থাকতে তার দিভাইয়ের সাথেই কেনো..?
সিয়াম বললো ” কষ্ট পেওনা চন্দ্র। তোমার দিভাই জীবনে একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তাকে ভুগতেই হতো আজ না হয় কাল। এই ভুল আজকাল প্রচুর ছেলে মেয়ে করে জানো। তারা বুঝতে পরে না প্রেম আর সংসার এক জিনিস নয়। প্রেমিকের সাথে ঘণ্টার পর ঘন্টা কথা বলতে ইচ্ছে করে, তার হাতের ননুপোড়া রান্নাও তখন অমৃত মনে হয়। কিন্তু একজন স্বামীর ক্ষেত্রে তা হয়না বিয়ের পর আসতে ধীরে সব বদলাতে থাকে। দুই তিন ঘন্টার কনভারসেশন নেমে আসে তুই তিন মিনিটে। তখন স্ত্রীর হাতের রান্না ভালো হলেও একঘেয়ে মনে হয়। সময়ের সাথে অনেক কিছুই পরিবর্তন আসে এইরকম। তখন একে অপরের প্রতি বিশ্বাস ভরসা না থাকলে জন্ম নেয় সন্দেহের আর সেই থেকেই ধরে সম্পর্কে ফাটল।”

চন্দ্রা মন দিয়ে শুনলো প্রত্যেকটা কথা। আসলেই তো সে নিজের চোখেও দেখেছে এইরকম কতো সম্পর্ক ভাঙ্গতে।

সিয়াম আবার বলা শুরু করলো “টাকা না থাকলে ভালোবাসা জানলা দিয়ে পালায় এই প্রবাদটা মানুষ এমনি এমনি বলে না জানো চন্দ্রা। এই যুগে দাড়িয়ে খুব কম সংখ্যক মানুষই নিঃসঙ্গতায় তার কাছের মানুষের সাথে থাকে। তেমনি হাতের পাঁচটা আঙ্গুলও এক হয়না।
তুমি যদি কাউকে ভালোবাসো তার প্রতি ভালোবাসা বাড়িয়ে দাও। দেখবে সে এমনিই তোমার থেকে দূরে চলে যাবে। কারন আসল ভালোবাসার ভার অনেক বেশি চন্দ্রা, সেটাকে সারাজীবন বহন করার মতো ক্ষমতা সবার থাকে না।vতাই তো চারিদিকে এতো বিচ্ছেদ। তোমার দিভাইয়ের লাইফে আবার কেউ আসবে দেখো যে এই সবের উর্ধ্বে গিয়ে আবার তাকে ভালোবাসতে দেখাবে। আর না আসলেও প্রবলেম নেই অন্তত কিছুটা হলেও মানুষ চিনতে শিখবে সে”

চন্দ্রা অবাক চোখে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে রইলো তাকে এতো সুন্দর করে আগে কেউ বোঝায়নি। এখন তার মনটা অনেক হালকা লাগছে। সিয়াম চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে সেই ঘোর মেশানো কণ্ঠে ডাকল ” চন্দ্রাবতী..? আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দি একটু..?দেখবে এক্ষুনি ঘুম এসে যাবে।”
চন্দ্রার বোঝে না কি আছে এই ডাকে তাকে বার বার দুর্বল করে তোলে এই ডাক। সে আর না করার সাহস পেলো না। সিয়াম নীরব সম্মতির লক্ষণ ভেবে নিয়ে আসতে আসতে করে চন্দ্রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। চন্দ্রাও এতদিন পর কারোর যত্ন পেয়ে চুপটি করে ঘুমিয়ে পড়ল।

#চলবে..?

বেড়াজাল পর্ব-০৯

0

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #৯

সিয়া ঘড়ি দেখছে আর রাস্তা দেখছে। আতিফ তাকে বলেছিলো দুপুর ১২ টায় কফি হাউসের সামনে দেখা করতে,কিন্তু এখন বাজে ১২:৩৫ । সিয়ার মধ্যে তাও সেইরকম কোনো বিরক্তি দেখা যাচ্ছে না, বরং তার চেয়ে চিন্তায় বেশি ঘামছে সে। সে জানে আতিফ একটা চাকরির জন্য সারাদিন কতো ঘোরে এদিক ওদিক। সিয়া এবার ফোনটা তুলে অতিফের নম্বর ডায়াল করতেই দেখলো সামনে থেকে আতিফ ছুটে ছুটে আসছে। আতিফ এসে সিয়ার সামনে দাড়িয়ে হাপাতে হাপাতে বলল ” সরি সরি তুই তো জানিস আমি একটু লেট লতিফ। রাগ করিস না প্লিজ। তোর জন্য অনেক গুলো চকলেট….” শেষ করতে দিল না সিয়া একটু রাগী স্বরেই বলল ” রোজ রোজ এক ডায়লগ শুনতে ভালো লাগে না আতিফ ” কতক্ষণ ধরে দাড়িয়ে বলতো আমি..? আতিফ একটু হকচকিয়ে গেল সিয়ার কথা শুনে সিয়াকে খুব কমই রাগতে দেখে সে। সিয়া ভীষণ ঠান্ডা মাথার মানুষ কিন্তু রেগে গেলে সেই রাগ আতিফও ঠান্ডা করতে পারে না সহজে। এর মধ্যেই সিয়া আবার বলে উঠলো ” অন্তত একবার ফোনটা করে বলে দিলে পারতি যে কাজে আটকে আছি তাই আসতে দেরি হবে কিছুক্ষণ। তুই জানিস না আমার চিন্তা হয় দেখ চিন্তায় কেমন ঘেমে স্নান হয়ে গেছি।” বলে নিজের ডান বাম হাতটা দেখলো আতিফকে। আতিফ এবার আফসোসের সুরে বলে উঠলো ” হয়েছে তো! আর কি করবো বল..?এই মাঝ রাস্তায় কান ধরে ওঠবস করবো..? বল করবো তাই করছি দ্বারা।”
এই বলে সিয়াকে কিছু বলতে না দিয়েই রাস্তায় কান ধরে একবার ওঠবস করতেই সিয়া আসেপাশে তাকালো অনেক মানুষই আগ্রহের সাথে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সিয়া এবার আতিফের হাত ধরে কফি হাউসের ভিতরে গিয়ে বসল। কিছুক্ষণ পর সব ঠিকঠাক হতেই সিয়া প্রশ্ন করলো আতিফকে ” সবই তো বুঝলাম কিন্তু ছিলি কই তুই এতক্ষণ..? ”
আতিফ কফির কাপে চুমুক দিতেই যাচ্ছিলো সিয়ার কথা শুনে সেটা মুখের কাছ থেকে নামিয়ে আমতা আমতা করে নীচের দিকে তাকিয়ে বলল “ওই একটা বন্ধুর শরীর খারাপ তাই তাকে নিয়ে একটু হসপিটাল গিয়েছিলাম।”
সিয়া এবার চোখ সরু করে তাকিয়ে বললো ” তা এমনি মাথা নীচু করে মিনমিন করে বলার কি আছে..?আমি কি তোকে খেয়ে ফেলতাম নাকি এটা শুনলে..?” আতিফ কিছু না বলে শুকনো হাসলো শুধু কিন্তু কিছু বললো না।

____________________________

চন্দ্রা স্নান সেরে বাগানে এসে পায়চারি করছিলো আর নানা রকমের ফুলগুলিকে আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছিলো। এই কাজ ভারী পছন্দের চন্দ্রার, হুটহাট পছন্দ হলেই সেই ফুলটি তুলে নেওয়া একদম পছন্দনা তার। চন্দ্রার নিজের বাড়িতেও এতো না হলেও বেশ অনেকগুলো ফুলের গাছ ছিল। আসে পাশের বাচ্চারা চন্দ্রার ভয়ে সেগুলিতে হাত দিতে পারতো না। চন্দ্রা যখন বাড়িতে থাকতো না তারা চুপিচুপি এসে একটা দুটো করে ফুল ছিঁড়ে নিয়ে যেত। যদিও চন্দ্রা প্রত্যেকবারই ধরে ফেলত তারপর তাদের বকুনিও দিতো তবু তারা এই কাজ করতো। চন্দ্রা এইসব মনে করতে করতে আনমনে হেসে ফেললো। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো কিছুটা দূরে সিয়াম তার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে তে।
চন্দ্রা এবার সিয়ামকে উদ্দেশ্য করে বলল ” কি দেখছেন ওমন করে..? ”
সিয়াম একই ভাবে তাকিয়ে উত্তর দিলো ” আমার ফুলকে ” সিয়া স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিল ” কিন্তু আমি তো দেখলাম আপনি তো আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ”
সিয়াম হালকা হেসে উত্তর দেয় ” আমি আমার ফুলকেই দেখছিলাম চন্দ্র মনের চোখ দিয়ে দেখলে আপনিও আমার মত দেখতে পেতেন। ”
চন্দ্রা সিয়ামের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝল না একটা ফুলের সামনে গিয়ে বলল ” এই ফুলটা দেখুন এটি বোধহয় এই বাগানের সবচেয়ে সুন্দর ফুল ”
সিয়াম আনমনে বলে উঠলো ” নাহ্ আমার চোখে আমার ফুলটিই সবচেয়ে সুন্দর শুধু পুরো বাগানে না, পুরো পৃথিবীর মধ্যেই তার মতো নিষ্পাপ পবিত্র ফুল আমি কোথাও দেখিনি।”
চন্দ্রা সিয়ামের পুরো কথা না শুনলেও কিছু কথা তার কানে এলো। এবার সে ব্যাকুল হলো সেই ফুলটিকে দেখার জন্য সিয়ামকে উদ্দেশ্য করে বলল ” আমিও দেখতে চাই আপনার সেই ফুলকে। দেখান না কোথায় আছে ” বলে এইপাশ ওইপাশ দেখতে লাগলো।
সিয়াম এবার পড়লো মহা মুশকিলে এই জন্য সে জোরে কথাটা বলতে চায়নি। তাও চন্দ্রাকে উদ্দেশ্য বলল ” চন্দ্র সেই ফুলের মালিক আমি ঠিকই…কিন্তু সেই ফুলের উপর এখনও কোনো অধিকার নেই আমার । যেদিন সেই ফুলের উপর সমস্ত অধিকার আমার থাকবে সেই দিন নিশ্চই দেখবো আপনাকে।” এখন চলুন দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। চন্দ্রা এবার কিছু না বলে খানিকটা মুখ ফুলিয়েই সিয়ামের পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। সিয়াম বুঝতে পারলো চন্দ্রার অভিমান হয়েছে। সিয়াম কিছু একটা ভেবে চলে গেলো লাঞ্চ সারতে।
খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই চন্দ্রা ঘরে এসে দেখলো সিয়াম ফোন নিয়ে কিছু করছে। তাই সেও ব্যাস্ততা দেখানোর জন্য আলমারিতে জামাকাপড় গুলো ঠিকঠাক করতে লাগলো।

চন্দ্রার অভিমান হয়েছে ঠিকই। তাকে না বন্ধু বলেছে সিয়াম অথচ একটা ফুল গাছ তাকে দেখাতে পারছে না। এ কেমন বন্ধুত্ব তার..?তারমানে নিশ্চই সে চন্দ্রাকে বন্ধু ভাবতে পারেনি এখনো। এই অভিমান না চন্দ্রা দেখাতে চাইছে আর না নিজে সইতে পারছে। তাই ঠিক করেছে সে বেশি কথা বলবেনা সিয়ামের সাথে সে যতক্ষণ না নিজে থেকে সিয়াম বোঝে যদিও বুঝবে এই আশাও নেই তার। তার মন যে কি চায় মুহুর্তে তা সে নিজেও বুঝতে অক্ষম।
সিয়াম চন্দ্রার গাল ফোলানো মুখ দেখে ফোনটা পাশে রেখে আলতো স্বরে ডাকল ” চন্দ্র ” চন্দ্রার কোনো হেলদোল দেখা গেলো না সে আগের মতই কাজ করে যাচ্ছে । সিয়াম আর এক-দুইবার ডাকল চন্দ্রার নাম ধরে তখনও যখন চন্দ্রা সারা দিলো না।
সিয়াম এবার গলার স্বর নীচে নামিয়ে একটু ঘোর মিশিয়ে ডাকলো ” চন্দ্রাবতী “।
চন্দ্রার হাতটা থেমে গেলো কাপড়ের ভাঁজেই। যতবার সে এই ডাকটা শোনে ততবারই একই অনুভূতি হয়। শরীরের শিরায় শিরায় কাঁপন ধরে, কেনো তার এইরকম অনুভূতি হয় সে নিজেও জানে না। এই ডাক জানো কাউকে মনে করিয়ে দেয়।
চন্দ্রা এবার সিয়ামের দিকে ফিরে বললো ” বারণ করেছিলাম না এই নামে ডাকবেন না আমায়। ”
সিয়াম এবার গা ছাড়া ভাব দেখিয়ে বলল ” আমি কি করতাম আপনাকে তো নাম ধরেই ডাকছিলাম আপনি তো সাড়া দেননি। তাই দায়ে পরে এই পথ টাই বাছতে হলো আমায়, আর আপনিও দেখুন কি সুন্দর সাড়া দিলেন।”
চন্দ্রা একটু রাগী চোখে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে বললো ” তা এতবার করে ডাকার কি হয়েছে শুনি একটু ”
সিয়াম হাফ ছেড়ে বললো ” বলছি আগে আপনি সোফায় এসে বসুন তো লক্ষী মেয়ের মতো” চন্দ্রা কারণ জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলো না বরং তার অভিমানী মন করতে দিলো না তাই সে চুপচাপ গিয়ে সোফায় বসল।
সিয়াম এবার আলমারি থেকে একটা ব্যাগ এনে চন্দ্রার হাতে দিলো। চন্দ্রা অবাক হয়ে সিয়ামকে জিজ্ঞেস করলো ” কি আছে এতে..? আর আমাকে কোনো দিচ্ছেন..? ”
সিয়াম বলল ” আপনার জন্যই ওইটা তাই খুলে দেখুন কি আছে।” চন্দ্রা এবার ব্যাগ থেকে জিনিসটি বের করতেই মুখে হাসি ফুটে উঠল। ব্যাগে ছিলো হুমায়ূন আহমেদের কিছু গল্প সমগ্র।
চন্দ্রার খুশি তার মুখ চোখে দেখা যাচ্ছে।
সিয়ামের ও যেনো ভীষণ ভালো লাগছে চন্দ্রার এই হাসি মুখ দেখে।সে ঠিক করলো মাঝে মাঝেই চন্দ্রাকে একটু রাগিয়ে দেবে তারপর সে এইরকম উপহার নিয়ে এসে রাগ ভাঙাবে শুধু চন্দ্রার এই নিষ্পাপ হাসি মুখটা দেখার জন্য।
চন্দ্রা উৎফুল্ল গলায় বলে উঠলো “আপনি কি করে জানলেন আমি গল্প পড়তে ভালোবাসি…?”
সিয়াম হেসে বললো ” আপনার দিনে বেশির ভাগ সময়ই গল্পের বই নিয়ে বসে থাকা দেখে।”
চন্দ্রা এবার সব রাগ ভুলে বললো ” অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমি বলে বোঝাতে পারবো না আমি কতটা পরিমাণ খুশি হয়েছি। ”
সিয়াম বলল ” ধন্যবাদ দিতে হবে না, এর বদলে একটা জিনিস চাইবো দেবেন..?”
চন্দ্রা এবার ভাবুক ভাবে বললো ” আমার কাছে তো দেওয়ার মতো কিছুই নেই। তাও বলুন আমার সাধ্যের মধ্যে থাকলে নিশ্চই দেবো।”
সিয়াম হেসেই বললো ” হ্যাঁ ম্যাডাম আপনার সাধ্যের মধ্যেই চাইছি। আচ্ছা আমরা তো একে অপরকে বন্ধু বলি তাইতো…?” চন্দ্রা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল।
সিয়াম এবার বললো ” বন্ধুরা কি কেউ আপনি আপনি করে কথা বলে একে ওপরকে তাই আমি চাই আমরা এবার দুজন দুজনকে তুমি করেই সম্বোধন করব। ব্যাস এইটুকুই চাই দিতে পারবেন..?”
চন্দ্রা এবার খানিকটা ভেবে উত্তর দিল ” আচ্ছা, কিন্তু এটা তো আর এক দিনে সম্ভব নয়, তাও আমি যথা সম্ভব চেষ্টা করবো।”
সিয়াম বললো “চেষ্টা করলেই হবে।আমি জানি অভ্যাস বদলাতে একটু সময় লাগে।”
চন্দ্রা হেসে বই গুলো নিয়ে সোফা থেকে উঠতে যেতেই সিয়াম বলে উঠলো “আরেকটা জিনিস চন্দ্র।” বলে আলমারি থেকে গিয়ে একটি বক্স বের করে চন্দ্রার সামনে আনলো। চন্দ্রা বক্সটা দেখে সিয়ামকে জিজ্ঞেস করলো ” এটায় কি আছে..?” সিয়াম বক্সটা খুলে দুই জোড়া বলা বের করে বলল “এটা আমার মায়ের বালা। এই বালা দুটো আমার ভীষণ পছন্দের ছিলো ছোটো থেকেই , তাই মা বলত যখন আমার বউ আসবে তখন জানো আমি এই বালা জোড়া তাকে দিই।” চন্দ্রা অবাক হয়ে বললো “কিন্তু আমাকে..?” সিয়াম হেসে বালা দুটো নিয়ে চন্দ্রার হাতে দিয়ে বলল “ডিভোর্স না হওয়া অবধি তো আপনিই আমার বউ। তাই আপনাকেই দিলাম, ডিভোর্স হলে নাহয় আমায় আবার ফিরত দিয়ে যাবেন। কিন্তু এ বাড়িতে যতদিন আমার কাছে আছেন ততোদিন এই বালাটা সাবধানে হতে রাখবেন।” চন্দ্রা শুধু মাথা নাড়িয়ে বালা জোড়া নিলো পড়ার জন্য। সিয়ামের মুখে ডিভোর্সের কথা শুনে একটু খারাপ লেগেছে তার।কেনো লেগেছে সে নিজেও জানে না। এসব ভাবতে ভাবতে বালা জোড়া পড়তে গিয়ে চন্দ্রা দেখলো বালাটা তার হাতে ঢুকছে না। সে সিয়ামকে উদ্দেশ্য করে বলল ” বালা জোড়া মনে হয় আমার হাতের মাপের চেয়ে ছোটো বুঝলেন, তাই হচ্ছে না।”
সিয়াম হাত বাড়িয়ে বলল ” কই দেখি আমাকে দিন আমি পরিয়ে দিচ্ছি।” চন্দ্রা বললো ” হুম চেষ্টা করে দেখুন হবে বলে মনে হয় না। ”
সিয়াম বালা জোড়া হাতে নিয়ে চন্দ্রার ডান হাতটা নিজের হাতে নিল। চন্দ্রা সিয়ামের হাতের স্পর্শে কেমন কেঁপে উঠল। এই প্রথম কোনো পুরুষ তাকে স্পর্শ করলো। আচ্ছা প্রথম বলা যায় কি সেই পাহাড়ি অঞ্চলে…” ভাবতে ভাবতেই আলতো চাপ পড়লো চন্দ্রার হাতে, চন্দ্রা তাকিয়ে দেখলো বালা জোড়া সুন্দর ভাবে ঢুকে গেছে তার দুই হাতে ।তেমন কোনো ব্যাথাও লাগেনি।” চন্দ্রা এবার লাজুক ভঙ্গিতে বালা জোড়া পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। যদিও সেসব কিছুই নয় একটা মেয়ে হয়ে সে বালা পড়তে পারলো না এটা তার কাছে ভীষণ লজ্জার ঠেকছে তাই মুখ লুকোতে এসব।
সিয়াম এবার চন্দ্রকে প্রশ্ন করলো ” আপনি চুড়ি একদম পড়েন না তাই না..? ” চন্দ্রা এবার খানিকটা মুখ তুলেই বলল ” নাহ্ আমার খুব একটা পছন্দের নয় চুড়ি। আমি জানি আপনি হয়তো ভাববেন মেয়ে হয়ে চুড়ি পছন্দ নয় এ আবার কেমন কথা। তাও আমার ঠিক পছন্দের নয় কারণ আমি হাতে বেশিক্ষণ রাখতে পারি না হাত উসখুশ করে। তবে আপনি যেহেতু এটা খুলতে বারণ করেছেন আমি খুলবো না।”
সিয়াম চন্দ্রার কথা শুনে বেশ খুশি হলো। সেও নিজের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সম্পর্কটার উপর এবার যা হবে সব উপরওয়ালার হাতে।

#চলবে..?

বেড়াজাল পর্ব-০৮

0

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #৮

শরৎকালের সকাল। আকাশ যেনো পেঁজা তুলার মতো মেঘে ছেয়ে আছে। চন্দ্রা সিয়ামের উপরের রুমের বড়ো ব্যালকনির দোলনটাতে বসে নিজের ফোনে পুরনো সব ছবি দেখছে। কতো স্বপ্ন কতো আশা অথচ সময়ের পরিবর্তনে আজ সবই স্মৃতি। চন্দ্রার বাড়ির পাশেই তার একটা ছোটো ক্যারাটে স্কুল ছিল। সেখানে চন্দ্রা ও তার চেনা পরিচিত এক ভাইয়া ক্যারাটে শেখাতো ছোট ছোট বাচ্চাদের। সেই স্কুলটাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল চন্দ্রার। এখন কি অবস্থা সেদিকের সেটা ভেবেই দীর্ঘনিশ্বাস বেড়িয়ে এলো চন্দ্রার। আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল শুধু।
ফোনের ভাইব্রেশনে ফোনের দিকে দেখতেই একটা নাম জ্বলজ্বল করে ওঠে স্ক্রিনে ” পাপা “।

চন্দ্রার অভিমানটা আরো গাঢ় হয়ে আসে। ফোন টা কেটে দেবে দেবে করেও ধরল সে কিন্তু কোনপ্রকার কথাই বললো না।ওপাশ থেকে চন্দ্রার বাবা বলে উঠেন ” এখনো রেগে আছিস মা..?”
চন্দ্রার এবার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গে সে চেঁচিয়ে বলে ওঠে “তো খুব আনন্দ হওয়ার কথা আমার..? এমন কি শত্রুতা ছিলো পাপা আমার সাথে তোমার এভাবে সত্যটা লুকিয়ে কেনো বিয়েটা দিলে..? একবারও জানতে পারলে না আমায়..?তুমি একবার আবদার করলেই আমি নিজেই হাসতে হাসতে বিয়ে করে নিতাম ওনাকে। কিন্তু এভাবে মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে..” পুরো কথা শেষ করতে পারলো না চন্দ্রা তার আগেই কান্নায় ভেংগে পড়লো।”

চন্দ্রার বাবা নরম সুরে বললেন ” আমার কথাটা একবার শোন মা। আমি সত্যি জানতাম না রে এই বিষয়ে তুই জানিস না। তুইতো জানিস বিয়ের আগের দিন অবধি আমি বাইরে ছিলাম দেশের। সব দায়িত্ত্ব ছিলো তোর মামা – মামীর ঘাড়ে। তারা আমায় বলেছিলো তোর নাকি বিয়েতে সম্পূর্ণ মত আছে, তবেই না আমি হ্যাঁ করেছিলাম এই বিয়েতে। আর তোকে যখন জিজ্ঞেস করলাম তুইও তো নিশ্চুপ ছিলি তাই আমিও ভেবে নিয়েছিলাম তুই রাজি এই বিয়েতে।”

চন্দ্রা কান্নারত অবস্থায় বলল ” হ্যাঁ আমি রাজি ছিলাম কিন্তু সেটা শুধুই তার ছবি দেখে এবং তিনি একজন বিজনেসম্যান এইটুকু জেনে। এর বাইরে তো আমাকে আর কোন ইনফরমেশনই দেয়া হয়নি। আর তুমিই বা এই বিয়েতে সম্মতি দিলে কীকরে বাবা..?”

চন্দ্রার বাবা চয়ন সাহেব এবার খানিকটা চুপ করে রইলেন তারপর বললেন ” কেমন আছিস তুই..?ওখানে অসুবিধা হচ্ছেনা তো..? হলে আমায় জানাবি। আর জামাইকে নিয়ে আয় আমাদের বাড়ি একদিন। ”
চন্দ্রার মনে হলো তার পাপা তার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলো। সেসব ছেড়ে চন্দ্রা বলল ” ভালো আছি পাপা। তুমি কেমন আছো..? আর আমি দেখছি তোমার জামাইকে বলে কবে তিনি ফাঁকা থাকেন তোমায় জানিয়ে দেবো কোনো।”
চয়ন সাহেব ওপাশ থেকে বললেন ” আমিও ভালো রে মা। আর একটা কথা বলি শোন। বিয়েটা যখন হয়েই গেছে তুই একটু মানিয়ে নিয়ে চলিস কেমন। সিয়াম ছেলেটা খুব ভালো রে।”
চন্দ্রা কিছু বলতে পারলো না ” হুম ” ছাড়া। তার মনের অবস্থা সে একাই জানে। সিয়ামকে সে মেনে নিত যদি তাকে বিয়ের আগেই এইগুলো জানানো হত। কিন্তু এখন ভীষণ জড়তা কাজ করে হয়তো প্রথম রাতের এতবড়ো শক আর তার খারাপ ব্যাবহারের জন্যই এইটা।
আরও টুকটাক কথা বলে রেখে দিল চন্দ্রা ফোন।
এই দ্বিতীয় বার চন্দ্রা তার বাবাকে এতো সুন্দর করে কথা বলতে দেখলো তার সাথে। চন্দ্রার মায়ের মৃত্যু হয় চন্দ্রার জন্মের সময়। তখন থেকেই তার দুই মেয়ে চন্দ্রা আর ইন্দ্রাকে নিজের হাতে বড়ো করেছেন চয়ন সাহেব। তিনি মেয়েদের সব ইচ্ছে পূরণ করলেও তিনি ছিলেন ভীষণ কঠিন।দুই মেয়েই তাকে বেশ ভয় পেত। ইন্দ্রা ছিলো চন্দ্রার চার বছরের বড়ো। মা মারা যাওয়ার পর সেই জানো চন্দ্রার মা হয়ে উঠেছিল। চন্দ্রার শুধু আফশোস হয় এক জায়গায় তার ওতো সুন্দর গুণসম্পন্ন দিদিটা পড়লো এক খারাপ লম্পট ছেলের প্রেমে। যার বিরুদ্ধে গিয়ে লড়াই করতে হারালো নিজের বাবাকেই। বাবা ত্যাজ্য কন্যা করলো তাকে। কিন্তু চন্দ্রা তার সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে এখনো কথা বলে সে জানে বাবা কথা না বললেও ভীষণ কষ্ট হয় তারও।
তার মনের মধ্যে এখন এটাই চলছে আজ তার যদি মা বেচেঁ থাকতো তাহলে হয়তো এগুলো হতে দিত না।
তার বিয়েটাও কেমন অদ্ভুত রকম ভাবে হয়েছিল।বিয়ের সময় বরকে দেখতে দেওয়া হয়নি এমনকি বিয়ের সময় মোটা পর্দা লাগানো হয়েছিল সামনে। জিজ্ঞেস করায় সুইটি বেগম বলেছিলেন এটা তাদের বংশগত নিয়ম। চন্দ্রা আর কথা বাড়ায়নি। এমনকি গাড়িতে ওঠার সময়ও সিয়াম আগেই বসে ছিল গাড়িতে নামার সময় সুইটি বেগম তাড়াতাড়ি করে সিয়ামের আগেই গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাকে বাসর ঘরের জন্যে। চন্দ্রা কেনো জানি কিছু মেলাতে পারছে না সব ঘটনা গুলো কেমন জানি অদ্ভুত।

________________________________

সন্ধ্যে ৬ টা

সিয়াম বাসায় ফিরে দেখলো চন্দ্রা বই বুকের উপর রেখে তার নিচের রুমের বেডের পাশে সোফায় ঘুমিয়ে আছে। সিয়ামের প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠল মুখে। এতো প্রশান্তি এই তিন বছরে বোধহয় কোনো কাজেই পায়নি। যা সে এখন ক্লান্ত হয়ে ফেরার পর চন্দ্রার এই ঘুমন্ত মুখ দেখে পাচ্ছে।
সিয়াম চন্দ্রাকে কিছুক্ষণ দেখে ফ্রেশ হয়ে কিচেন থেকে নিজেই এক কাপ কফি আনলো।
সিয়ামের বাকি কোম্পানির কাজ গুলো সারার জন্য ল্যাপটপটা খুঁজতেই দেখলো ল্যাপটপের ব্যাগটা সোফায় চন্দ্রার মাথার কোন পড়ে। সিয়াম চন্দ্রার কাছাকাছি গিয়ে আসতে আসতে ব্যাগ টা নেওয়ার চেষ্টা করছিল আর মনে মনে দোয়া করছিলো যাতে চন্দ্রার ঘুম না ভেঙ্গে যায়। সিয়াম যেই ব্যাগটা নিতে হালকা জোরে টান দিল। ওমনি চন্দ্রা সিয়ামের সব দোয়ায় জল ঢেলে চোখ খুললো।
সিয়াম তখন ঝুঁকেই ছিলো কিছুটা চন্দ্রার দিকে ফলে চোখ খুলেই সিয়ামকে একদম কাছে পেলো তার। কয়েক মিনিটের জন্য থমকে গেলো দুজনেই। সিয়াম এতো সামনে থাকায় তার শরীর থেকে এক তীব্র এক পুরুষালী গন্ধ এসে চন্দ্রার নাকে ঠেকছে তাতে ঘোর লেগে যাচ্ছে তারও। সিয়াম এবার নিজেকে সামলিয়ে কিছুটা সরে এসে গলাটা হালকা ঝরলো।
চন্দ্রা নিজেও বেশ লজ্জা পেয়ে উঠে বসে কানের পিঠে চুল গুজলো।
সিয়ামই এবার অস্বস্তি ভাবটা কাটাতে বলল ” সরি চন্দ্র আমার জন্য আপনার ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো।”
চন্দ্রা এবার ইতস্তত করে বলল ” আরে না না ইটস ওকে, আপনি এসেগেছেন আমি একটুও টের পাইনি। আপনি ডাকলেন না কেনো..? আর আপনি কফি খাবেন..?”
সিয়াম হেসে বলল ” আপনি এতো শান্তিতে ঘুমাচ্ছিলেন তাই আর ভাঙ্গতে চাইনি আর আমি নিজেই নিজেই কফি নিয়ে খেয়ে নিয়েছি , আসলে কিছু কাজ বাকি আছে ল্যাপটপে। আপনি যান ফ্রেশ হয়ে আপনার কফিটা নিয়ে আসুন আমি ততক্ষণে কাজ শেষ করে নি। তারপর একসাথে বসে আরেককাপ কফি খাবো নয় আপনার সাথে। ”
চন্দ্রা হালকা হেসে বলল ” আচ্ছা “। সে যতটা সম্ভব জড়তা কাটানোর চেষ্টা করছে সিয়ামের সাথে একজন সাধারণ বন্ধুর মতো মেশার চেষ্টা করছে।

চন্দ্রা কিচেনে কফি নিতে গিয়ে হঠাৎই খেয়াল এলো সিয়াম যখন তার ওতো কাছে ছিলো তখন চন্দ্রার কেনো যেনো মনে হচ্ছিল এই মুখ চোখ সে আগেও দেখেছে কোথাও।চন্দ্রা মাথায় জোর দিয়েও মনে করতে পারলনা কিছু নাহ এটাও মনেরই ভুল নাহলে সে তো আগেও সিয়ামকে দেখেছে এইরকম তো কিছু মনে হয়নি তার।

#চলবে..?

বেড়াজাল পর্ব-০৭

0

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #৭

চন্দ্রা হালকা মাথা ঝাঁকিয়ে মনে মনে বলল “না না কি দেখতে কি দেখেছি কে জানে সব আমার মনের ভুল ওনার পা নড়বে কীকরে তুইও না চন্দ্রা।”
মেহমানরা ভীষণ প্রশংসা করলো চায়ের। চন্দ্রা হেসে মনে মনে সিয়ামকে অনেক ধন্যবাদ দিলো। সিয়ামকে দেখেও মনে হলো সে চন্দ্রার থেকেও বেশী খুশি হয়েছে চন্দ্রার প্রশংসায় পঞ্চমুখ দেখে।

__________________________

দুপুর ২ টা

মেহমানরা সবাই দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ করে রওনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরী হলো। সুইটি বেগমও গেলেন তাদের সাথে তাদেরকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসতে।

ইতিমধ্যে সিয়াম সিয়া দুজনের খাওয়া সম্পূর্ণ হয়েছে। মেহমানরা জোর করে তাদের দুজনকে তাদের সাথেই বসিয়েছেন। সিয়াম বসতে চাইছিল না সুইটি বেগম জোর করে বসিয়েছেন। সুইটি বেগমও একসাথেই খেয়ে নিয়েছেন মেহমানদের ছাড়তে যাবেন বলে। এখন বাকি শুধু চন্দ্রা সবাই চন্দ্রকেও বলেছিল বসার জন্যে কিন্তু চন্দ্রা না করে দিয়েছে সবাই বসে পড়লে পরিবেশনের দিকে দেখবে কে..? তার উপর সে আবার নতুন বউ এখন মেহমানরা হাসি মুখে কথা বললেও পিছনে ঠিকই তার এই আগে বসে খেয়ে নেওয়া নিয়ে কথা শোনাবেন।

সবশেষে চন্দ্রা রান্নাঘরটা গোছগাছ করে যেই খাবারের টেবিলের সামনে এসে কোমড় থেকে আঁচলটা খুলে যেই বসতে যাবে সামনে থেকে কেউ একজন বলে উঠলো “ওভাবেই বেশি ভালো লাগছে জান। দিন দিন হট হয়ে যাচ্ছ বুঝলে তা রহস্য কি..? ভাই কি একটু বেশি আদর দিয়ে ফেলছে..?” শেষ কথাটা বেশ কিছুটা সুর টেনেই বলল সিরাজ।
চন্দ্রার রাগে গা জ্বলে উঠলো রক্তচক্ষু নিয়ে বলল “জানোয়ার জানোয়ারই থেকে গেলি, মেয়েদের কোনোদিন সম্মান না আগে জানতিস না এখন জানিস”

সিরাজ বাঁকা হেসে কিছু বলতে নিলেই সেখানে সিয়া উপস্থিত হয়। সিরাজ তাকে দেখে কথার টোন পাল্টে বলে “আরে ভাবী খেতে দেন। আর কতক্ষন ওয়েট করা লাগবে..?আমার কি ক্ষুদা পায়না নাকি..?”
চন্দ্রার হালকা খটকা লাগে সে পিছন ঘুরে দেখেতেই দেখে সিয়া দাড়িয়ে।চন্দ্রা এবার বুঝতে পারে সিরাজের পাল্টি খাওয়ার কারণ।

চন্দ্রা সিয়াকে জিজ্ঞাসা করে “আপু কিছু লাগবে আপনার..?”
সিয়া বলে “নাহ্ তেমন কিছুনা তুমি একা একা খাবে তাই সিয়াম ভাইয়া বলল তোমার কাছে গিয়ে যেনো বসি। ভাইয়া ইম্পর্ট্যান্ট কাজ করছে নইলে সেই আসতো।” বলে সিয়া চন্দ্রার পাশের চেয়ারে বসে ফোন টিপতে লাগলো।
চন্দ্রা মনে মনে উপরওয়ালা কে লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল ।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে চন্দ্রা ঘরে এসে দেখে সিয়াম কাজ নিয়ে ব্যাস্ত।তাই সিয়ামকে আর না ডিস্টার্ব করে চন্দ্রা চলে যায় তার মন ভালো করার জায়গায়।
বাগানে এসে চন্দ্রা বেঞ্চে বসে ভাবতে থাকে তার আর সিরাজের প্রথম আলাপের দিন গুলো…
_____________________________

চন্দ্রা তখন সবে অনার্সে ভর্তি হয়েছে। বন্ধু বান্ধবীদের সাথে সবসময় হাসি আড্ডা ঘুরতে যাওয়া এই সব নিয়েই ব্যাস্ত থাকতো সে। কিন্তু ঘটনার সূত্রপাত হয় নবীন বরণের দিন সে দিন চন্দ্রা নীল রঙের শাড়ি পরে গিয়েছিলো কলেজে। কলেজ গেটে প্রবেশ করার সাথে সাথেই এক নীল রঙের পাঞ্জাবি পরা ছেলের সাথে ধাক্কা লেগেছিল তার। আর সেই মানুষটিই ছিলো সিরাজ। ধাক্কা লাগার পরও কয়েক সেকেন্ড দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে ছিল। সিরাজ মাথা চুলকে মুচকি হাসি হেসে ” সরি ” বলে চলে গিয়েছিল।

সিরাজ ছিলো চন্দ্রার দুই ক্লাস সিনিয়র। দেখতে শুনতে কোনদিক থেকেই খারাপ ছিল না সে। চন্দ্রার সব বন্ধু-বান্ধবীদের প্রেম করা দেখে তারও কিশোরী মনে সখ জেগেছিল প্রেম করার। চন্দ্রার বন্ধুরা সেই শুনে সর্বপ্রথম সিরাজের নামই নিয়েছিল।তারা বুঝতে পেরেছিল কোথাও না কোথাও সিয়ার বেশ লাগে সিরাজকে। চন্দ্রার হয়ে তার বান্ধবীরাই সিরাজের কাছে প্রস্তাব রেখেছিল চন্দ্রার জন্য।
সিরাজ হেসে বলে বলেছিল ” যার জন্যে বলতে এসেছো তোমরা…কই তাকে তো কোথাও দেখছি না..?সে নিজে যদি আমার সামনে এসে দাঁড়ায় তবেই এই প্রপোজাল অ্যাকসেপ্ট করবো আমি”
এই কথা শুনে চন্দ্রার বান্ধবীরা চন্দ্রাকে আড়াল থেকে টেনে বের করে এনে সিরাজের সামনে দাড় করিয়েছিলো। সিরাজ এই অবস্থা দেখে হেসে চন্দ্রাকে জিজ্ঞেস করেছিল “ওরা যা বলছে তা কি সত্যি..?পছন্দ করো আমায়..?”
চন্দ্রা লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল। চন্দ্রাকে কিছু বলতে না দেখে সিরাজ নিজেই বলল ” চুপ থাকা কিন্তু সম্মতির লক্ষণ”। চন্দ্রা লাজুক হেসে মুখটা আকাশের দিকে করে নিয়েছিল। সেই দেখে সিরাজও মুখটা আকাশের দিকে করে রেলিং ধরে বলেছিলো “আমারও তোমায় ভীষণ ভালো লাগে জানো চন্দ্রা, সেই প্রথম দিন থেকে। আজ তুমি না বললেও কোন না কোনোদিন আমি নিজেই তোমায় আমার মনের কথা বলতাম।”

এভাবেই চলতে থাকলো সময় দেখতে দেখতে তিন মাস কেটে গেল তাদের প্রেমের। চন্দ্রা যখন সিরাজের বন্ধুমহলের সাথে পরিচিত হলো তখন সিরাজের ব্যাপারে বিভিন্ন কথাই তার কানে আসতো যেমন সিরাজের চরিত্রে সমস্যা আছে। সে অনেকের সাথে রাত কাটিয়েছে। এরাম অনেক কিছু তবে চন্দ্রা এসব এড়িয়ে চলত কারণ সিরাজের হাবভাবে সেইরকম কখনোই কিছু প্রকাশ পায়নি। তিন মাসের রিলেশনশিপে সিরাজ চন্দ্রার হাত টাও ধরেনি এমনকি চন্দ্রা বায়না করলেও না। তাই চন্দ্রা চেয়েও মানুষটিকে সন্দেহ করতে পারতো না।

সত্য টা চন্দ্রার সামনে তখন এলো যখন তারই এক কাছের বান্ধবী কাঁদতে কাঁদতে রাত ৮ টায় তার বাড়ি এলো। তার অবস্থা ছিল জীর্ণশীর্ণ, কাপড়ের অবস্থা খুবই খারাপ। চন্দ্রা তাড়াহুড়ো করে তাকে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে শান্ত করিয়ে যখন জিজ্ঞেস করলো তার এরকম দশার কারণ কি..? তখনই সে বললো তাদের ক্লোজ একজনের পার্টিতে গিয়েছিলো সে। সেখানে সিরাজ ও তার বন্ধুরাও উপস্থিত ছিল। সিরাজ অতিরিক্ত ড্রিংক করায় নিজের হুশ হাড়িয়ে ফেলেছিল আর সামনে তাকে পাওয়ায় তারই হাত ধরে টেনে পাশের রুমে নিয়ে গিয়ে অসভ্যতামী করার চেষ্টা করেছিল। জোরে গান বাজার দরুন কেউই কোনো টের পায়নি। সিরাজ নেশায় থাকায় তাকে জোরে ধাক্কা দিতেই সে কিছুটা দূরে গিয়ে পড়েছিল। আর সেই সুযোগে সে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে এসেছে। চন্দ্রার বাড়িটা বেশি দূর নয় সেখান থেকে তাই দৌড়ে সে এই অবস্থায় চন্দ্রার বাড়িতেই এসেছে।
চন্দ্রা প্রথম বিশ্বাস না করতে চাইলেও মেয়েটির কিছু তাদের সাথে গ্রুপ পিক আর ভিডিওর সাউন্ড শুনে বুঝে গিয়েছিল সেটা সিরাজ। যদিও ভিডিওতে কিছু দেখা যায়নি তেমন শুধু খাপছাড়া খাপছাড়া ভয়েস ছাড়া। গানের জন্য সেটিও পরিষ্কার নয়। কিন্তু যতটুকু ছিলো চন্দ্রার বিশ্বাস ভাঙার জন্য যথেষ্ট ছিল।

সেইরাতে চন্দ্রা সারারাত জেগে ছিল। সারারাত শাওয়ার নিয়ে ভিজে জামায় বসেছিল নিজের ঘরে। সকালে চন্দ্রার বাবা চন্দ্রকে ডাকতে গিয়ে তাকে জ্বরের ঘোরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখেন মেঝেতে তিনি সঙ্গে সঙ্গে ডক্টরকে ফোন করে আসতে বলেন। টানা একসপ্তাহ ভুগেছিলেন চন্দ্রা সেই ভয়ংকর জ্বরে। চন্দ্রা প্রথম তার বাবাকে তার জন্য কাঁদতে দেখেছিল তার অসুস্থতায়। চন্দ্রার নিজেরই মনের অবস্থা ভালো না থাকায় বাবার সাথে তেমন খুলে কথাও বলতে পারেনি।
সিরাজ অনেকবার ফোন দিয়েছিল এর মধ্যে কিন্তু চন্দ্রা ধরেনি। টানা এক সপ্তাহের পর কলেজে গিয়ে সিরাজকে সব প্রমাণ সহ দেখিয়ে তার সাথে ব্রেকআপ করেছিল। এতে সিরাজ ভীষণ পরিমাণে রেগে গিয়েছিলো তার দাবী সে যার সাথে যা খুশি করুক চন্দ্রার সাথে তো করেনি। তার তো হাত পর্যন্ত ধরেনি তাহলে ব্রেকআপের মানে কি..?সে বোধহয় ভুলে গিয়েছিল “এক মাঘে শীত যায় না “। চন্দ্রা আর কথা বাড়ায়নি সিরাজকে সব জায়গা থেকে ব্লক করে, সেই মেয়েটিকে থানায় কেশ করতে বলে সেই কলেজ ছেড়ে দিয়েছিল।তারপর চার বছর তার আর সিরাজের দেখা হয়নি। মাঝে শুনেছিল সে থানায়ও গেছে কিন্তু পয়সার জোরে বেচেঁ গেছে। চন্দ্রা এই সিরাজ নামক অভিশাপ টাকে জীবন থেকে ভুলতে বিয়েতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের লিখন খন্ডায় কে..? যার মুখ সে জীবনে দর্শন করতে চায়নি এখন দায়ে পরে তাকেই দিন রাত চোখের সামনে দেখতে হচ্ছে।

সিয়ামের আওয়াজ কানে আসতেই পুরোনো দিনের কল্পনা থেকে বেরিয়ে এলো চন্দ্রা। তাড়াহুড়ো করে উঠে গেলো সিয়ামের রুমে। গিয়ে দেখলো সিয়াম হাতে ফোন নিয়ে বসে আছে।
চন্দ্রা যেতেই সিয়াম বলল “ফোন টা কাছে রাখবেন না চন্দ্র..? দেখুন তো আপনার মামা কতবার কল দিয়েছে। আমি ধরতে গিয়েই কেটে গেলো।এখন একবার করবো কলব্যাক..?”
চন্দ্রা পড়িমড়ি করে সিয়ামের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বলল “না না আমি করে নেবো পরে”
সিয়ামের কেমন খটকা লাগলো চন্দ্রার ব্যাবহারে টাও কিছু বললো না সে।

_______________________________

সিয়া বসে আছে কফিহাউসে আর বার বার ঘড়ি দেখছে। এবার তার ভীষণ বিরক্তি লাগছে।সে চলে যাওয়ার জন্য উঠতে গেলেই। সামনের চেয়ারে একটা ছেলে ধপ করে এসে বসে বলতে লাগলো “সরি সরি সরি…! তুইতো জানিস বল আমি একটু লেট লতিফ।এখন রাগ করিস না প্লিজ..আমি তোকে অনেকগুলো চকলেট আইসক্রিম কিনে দেবো তারপর মাথায় কাঁচা ফুল লাগিয়ে রিকশায় করে সারা ঢাকা ঘুরাবো প্রমিস। সিয়া এই কথা প্রায় একশবার শুনে ফেলেছে টাও যতবারই শোনে ততবারই রাগ ভুলে হেসে দেয়। সিয়া ব্যাগ থেকে টিফিন বক্সটা বের করে সামনে রেখে বললো “ওইসব কিছু লাগবে না আপাতত তুই চাকরিটা জোগাড় কর আতিফ।মা ঘর থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে।আর তুইতো জানিস ঘরে আমার অবস্থা। মা বেশিদিন রাখতে চায়না আমায়। শুধু সিয়াম ভাইয়া আছে বলে রক্ষে নয়তো কবেই কার সাথে….”
আতিফ সিয়ার কথা মাঝে কেটে বললো “আহঃ সিয়া থাক নাহ এখন এসব কতদিন বাদ তোকে দেখলাম বলতো এখন এসব না বললেই নয় আর আমি তো চেষ্টা করছি বল একটা চাকরির..?”
সিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লো আতিফ আর সে বেস্টফ্রেন্ড ছিলো দশ বছরের তার মধ্যে তারা রিলেশনে আছে পাঁচ বছর হলো।এখন শুধু আতিফের একটা চাকরির অপেক্ষা তাহলেই সে ঘরে তাদের বেপারে জানতে পারবে। সিয়া নিজেও একটা প্রাইভেট ফর্মে চাকরি করে।সেখান থেকে যা পায় তার অর্ধেক ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করে রাখে আর বাকি দিয়ে আতিফের জন্য তার প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন জামা-কাপড়, টুকটাক হাত খরচা ইত্যাদিতে দেয়।
বলতে গেলে আতিফ এখন পুরোটাই সিয়ার উপর নির্ভশীল বলতে গেলে যদিও সিয়া তাকে এগুলো জোর করেই দেয়। এমনকি মেস ভাড়াও দিতে চায় কিন্তু আতিফ নেয় না সেইটুকু খরচ সে টিউশনি করে তুলে নেয়। খাওয়ার খরচও সেখান থেকে কিছুটা বাঁচে। কিন্তু সিয়া শুনলে তো রোজ সে দুপুরে আতিফের জন্য খাবার নিয়ে আসে নিজে লুকিয়ে বানিয়ে। আর সে রোজ আসতে না পারলে এক চোদ্দো-পনেরো বছরের ছেলের হাতে পয়সা দিয়ে রোজ খাবার পাঠিয়ে দেয়।
আতিফ মাঝে মাঝে গালে হাত দিয়ে সিয়াকে দেখে আর ভাবে তার এই খারাপ ভাগ্যে করে পেল সে এই রাজকন্যাটাকে..?।
সিয়া ডাকতে আতিফের ধ্যান ভাঙলো সিয়া বলল “এবার উঠি রে এখন থেকে একটু মলে যেতে হবে। বাড়িতে মা আছে আর মা থাকলে তো জানিস রাত আটটার আগে আমায় বাড়ি ঢুকতে হয়।”
আতিফ একটু মন খারাপ করে বলল “এই তো এলি এক্ষুনি চলে যাবি..? যাহ তাহলে তোকে এখন আটকে রাখার ক্ষমতা নেই আমার। কদিন যেতে দে সারাজীবনের মত আটকে রাখবো আমার কাছে।”
সিয়া লাজুক হেসে আটিফের চুল এলোমেলো করে বলল “দেখবো”
বলে দুজনেই বেরিয়ে পড়ল নিজেদের নিজেদের গন্তব্যে।

#চলবে…?

বেড়াজাল পর্ব-০৬

0

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #৬

এভাবেই কেটে গেছে মাঝে দুটো দিন। চন্দ্রা পুরো বাড়িটা ভালো ভাবে দেখে বুঝে নিয়েছে। পুরো বাড়িটা জুড়ে উপর নীচ করে আছে মোট নয় টা মতো রুম এর মধ্যে একটাতে থাকে সিয়াম আর চন্দ্রা, একটাতে সিয়া একটাতে সিরাজ আরেকটাতে থাকেন সুইটি বেগম। বাকি পাঁচটি রুমের মধ্যে সিয়ামের উপরের একটা রুম যা ফাঁকা থাকে, আরেকটি সিয়ামের বাবা মায়ের রুম যা বন্ধ থাকে, আর বাকি রুম গুলির মধ্যে একটি গেস্ট রুম ও একটি স্টোর রুম। বাকি দুটো রুম নাকি বন্ধই থাকে সবসময় তার চাবি আছে না হারিয়ে গেছে তাও কেউ খোঁজ রাখে না নাকি। এই বাড়িটা সিয়ামের বাবা মায়ে ভীষণ পছন্দ করে কিনেছিলেন তারপর নিজেদের ইচ্ছমতো সাজিয়েছিলেন।সিয়ামের বাবা মা দুজনেই ছিলেন ভীষণ শৌখিন যা চন্দ্রা সিয়ামের দুটো রুম দেখেই বুঝেছে যে তেনাদের ছেলেও সেই গুন পেয়েছে। এইসব খবর চন্দ্রা পেয়েছে বাড়ির এক অতি পুরোনো মালীর থেকে।তিনি নাকি সিয়ামের বাবা মা থাকাকালীনই এখানে কাজে লেগেছিলেন।
কিন্তু চন্দ্রার একটা জায়গায় খটকা লেগেছে যে তিনি এই পুরো বিষয়টিই কেমন ভয়ে ভয়ে বলেছেন। চন্দ্রা সিয়ামের বাবা মায়ের কথা জিজ্ঞেস করতে তিনি শুধু অ্যাক্সিডেন্ট বলে এড়িয়ে গেছেন।

সিয়াম আপাতত বাড়িতে নেই।সে গেছে তার অফিসে খুব জরুরী কাজ না থাকলে সে অফিস যায় না।তবে এই কদিন নাকি তাকে রোজই অফিস যেতে হবে। অফিসে কি নিয়ে নাকি ভীষন ঝামেলা হয়েছে এই টুকুই বুঝেছে চন্দ্রা সিয়ামের গতরাতে কারোর সাথে কল কনভারসেশনে। এই দু-দিনে সিয়ামের সাথে চন্দ্রার কথা হয়েছে বলতে স্বাভাবিক টুকটাক ধরনের যেমন খেয়েছেন, ঘুমাবেন কখন এইসব নিয়ে। চন্দ্রা সারাদিনের বেশিরভাগটাই থেকেছে নয়তো ছাদে নয়তো বাগানে। সে সিয়ামের টুকটাক হেল্প করে দিলেও মনের মধ্যে ভীষন রকম জড়তা রয়েছে তার।

এইসব ভাবতে ভাবতে চন্দ্রা এগোচ্ছিল সিয়ামের উপরের ঘরের দিকে সিয়ামের ঘরের পাশের ঘরটা সিয়ার আর তার পাশের টা সিরাজের।চন্দ্রা সিরাজকে দেখে তাড়াতাড়ি করে সিয়ামের ঘরে প্রবেশ করতে গেলো, কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।সিরাজ দৌড়ে এসে চন্দ্রার হাতের কব্জি শক্ত করে ধরে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরলো।দুইদিন নেশায় বুদ থাকায় চন্দ্রার কথা মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল তার।আজ চন্দ্রকে সামনে দেখে আগেরদিনের চড়ের কথাটা সর্বপ্রথম মাথায় এলো সিরাজের।তার রাগ টা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।

চন্দ্রা ছটপট করতে লাগলো সিরাজ টা দেখে বাঁকা হাসি হেসে মুখটা চন্দ্রার মুখের সামনে নিয়ে গিয়ে বলল “খুব রস হয়েছে না।আগে তো খুব আমার পিছনে ঘুরতি হাতটা ধরার জন্যে বায়না করতি এখন কি নতুন নাগর পেয়ে আমায় ভুলে গেলি..?আরে তুই যা চাস ভাই দিতে পারবে না কিন্তু আমি পারবো তুমি বোঝো না কেনো বলোতো পাখি।”
চন্দ্রার এবার শরীর শক্ত হয়ে এলো রাগে সিরাজের পায়ে পাড়া দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে কষিয়ে দুটো থাপ্পড় মারলো গালে। তারপর সিরাজের কলার ধরে বলল “জানি না কোন জন্মের পাপের কারণে তোকে আমি এই জন্মে নিজের জীবনে অভিশাপ হিসেবে পেয়েছি। নিশ্চই কোনো বড়োসড়ো ধরনেরই পাপ করেছিলাম নয়তো তোর মতো জানোয়ারের ঘরের বৌমা হয়ে আসি..?আর শোন আমার সাথে লাগতে আসবি না ক্যারাটেতে ব্ল্যাকবেল্ট পাওয়া মেয়ে আমি নাহলে পরের বার নিজের হাড়ের টুকরো গুনে শেষ করতে পারবি না।” বলে সিরাজের কলার ছেড়ে দিল সিরাজ কিছু করার উদ্দেশ্যে একপা বাড়াতেই পিছন থেকে সিয়া এসে বলল “কি করছিস তোরা এখানে..?”
সিরাজ নিজেকে সংযত করে হাত নামিয়ে “কিছু না” বলে সিয়ার পাশ কাটিয়ে নীচে নেমে বাড়ি দিয়ে বেড়িয়ে গেলো।
সিয়া চন্দ্রাকে উদ্দেশ্য করে বলল “নীচে চলো মা ডাকছে গ্রাম থেকে কিছু মেহমান এসেছে তারা তোমাকে আর ভাইয়াকে দেখতে চাইছেন। আমি ভাইয়াকে ফোন দিয়েছিলাম কিছুক্ষণের মধ্যে ভাইয়াও চলে আসবে।” এই বলে সিয়া নীচে যাওয়ার উদ্দেশ্য পা বাড়ালেই চন্দ্রা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে “মনি এই দুদিন কোথায় ছিলেন..?”
সিয়া পিছন ফিরে বলল “ঘরের বউ হয়ে এইটুকু খোঁজ রাখো না..?” চন্দ্রা আমতা আমতা করলো সে কাকেই বা জিজ্ঞেস করতো সিয়ামের সাথে তো ভালোভাবে কথাই বলে ন সে তার উপর এই বাড়ির সার্ভেন্ট গুলো কেমন করে তাকায় যেনো।তাই সে কাউকেই কিছু জিজ্ঞেস করেনি।
চন্দ্রকে এভাবে দেখে সিয়া নিজেই বলল “মায়ের এক বন্ধু ভীষণ অসুস্থ তাই মা তাকে দেখতে গিয়েছিল। কিছু কারণবশত আসতে পারেননি আজ সকালেই বাড়ি এসেছে।”
চন্দ্রা মাথা হালকা নাড়িয়ে সিয়ার পিছু পিছু নীচে গেলো। চন্দ্রাকে দেখতে পেয়ে সুইটি বেগাম সবার সামনে নিয়ে গেলেন। মেহমানরা চন্দ্রা দেখে বললেন…

– বাহ্ ভাবী সিয়ামের বউকে তোহ খুব মিষ্টি দেখতে
– হ্যাঁ তাইতো এতো সুন্দর পুতুলের মতো বউ কই পেলেন ভাবী…?
– এই মেয়ে তোমার কি শুধু এই রূপই আছে নাকি গুনও আছে..? এক কাপ চা করে আনোতো সবার জন্য আর আমার চায়ে চিনি কম দেবে।

চন্দ্রা এবার পড়লো মহা মুশকিলে সে রান্নার র পারে না। সুইটি বেগমও কথায় ব্যাস্ত সবার সাথে তাকে ডেকে বলারও উপায় নেই। অগত্যা চন্দ্রা মুখ বেজার করে রান্নাঘরের দিকে যেতে লাগলো। তখনই সিয়ামকে বাড়ির মেইন দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে দেখল।কয়েক সেকন্ডের জন্য চোখাচোখি হলো দুজনের।চন্দ্রা চোখ সরিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। সিয়ামও সবার সাথে কথা কথা বলল ভালোমন্দ জিজ্ঞেসা করল সবাই খুব প্রশংসা করলো চন্দ্রার। সেই দেখে সিয়াম মুচকি হেসে মনে মনে বলল “পছন্দটা কার দেখতে হবে না।”

প্রায় মিনিট পনেরো হয়ে গেলো চন্দ্রাকে যে সেই রান্নাঘরে যেতে দেখলো আর তোহ দেখাই নেই। সিয়াম এবার আসতে আসতে রান্নাঘরে গেলো। গিয়ে যা দেখলো তাতে সিয়ামের হুশ উড়ে গেলো।
চন্দ্রা এক কড়াই জলে অর্ধেকের বেশি চা পাতা দিয়েছে তার উপরে ভেসে আছে তেজ পাতা, লবঙ্গ, আর বেশ কিছুটা না ছোলা আদা।
সিয়ামের এবার পেট ফেটে হাসি এলো। কোনমতে মুখচেপে হেসে মুখ স্বাভাবিক করে ডাক দিল “চন্দ্র” চন্দ্রা চমকে পিছনে তাকালো।
সিয়াম তা দেখে বলল “আসতে আসতে আমি ভয় পাবেন না”। চন্দ্রা স্বস্থির নিশ্বাস ছেড়ে আবার নিজের কাজে মন দিলো।
সিয়াম একটু খোঁচানোর জন্য বলল “তা কি বানাচ্ছেন..? চা পাতার স্যুপ..? আচ্ছা এটা খেয়ে শরীরের কোন কোন উপকার হবে..?না মানে এতো স্বাস্থ্যকর স্যুপ তো আগে কোনদিন দেখিনি তাই আর কি।”শেষের কথাটা একটু হাসি চেপেই বলল সিয়াম।
চন্দ্রা এবার বিরস মুখে তাকিয়ে সিয়ামকে বলল”আপনিও মজা নিচ্ছেন..?
সিয়ামের এবার একটু খারাপ লাগলো চন্দ্রাকে বলল “আমি যেমন যেমন বলছি সেইভাবে করুন ঐ কড়াটা ঐ পাশে রাখুন আমি সার্ভেন্টকে দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে দেবো”।
চন্দ্রা ধীরে ধীরে সিয়ামের কথা মতো কাজ করলো। সবশেষে চন্দ্রা অপরিপক্ব হাতে কাপে চা ঢালতে গিয়ে অল্প চা সিয়ামের পায়ের আঙুলের কাছে পড়লো।চন্দ্রা “সরি সরি” বলে পায়ের দিকে তাকালো পায়ের বুড়ো আঙুলটা যেনো একটু নড়লো। সিয়াম সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল “ইটস ওকে..! প্রথম প্রথম ওরাম একটু হয়। নিন নিন আপনি তাড়াতাড়ি করুন ওখানে এবার সবাই খুঁজতে শুরু করলো বলে। চন্দ্রা তাড়াহুড়ো করে সব কাপ-প্লেট সাজিয়ে ট্রেতে নিয়ে সিয়ামের সাথে ডাইনিং রুমে গেলো। কিন্তু কোথাও একটা তার খটকা থেকেই গেলো যা শুনেছে সে সিয়ামের দুইপা-ই অবশ তাহলে হালকা চা পড়াতে পায়ের আঙুলটা নড়ে উঠলো কিকোরে..?সে হালকাই হোক না কেনো। চন্দ্রা হালকা মাথা ঝাঁকিয়ে মনে মনে বলল “না না কি দেখতে কি দেখেছি কে জানে সব আমার মনের ভুল ওনার পা নড়বে কীকরে তুইও না চন্দ্রা।”

#চলবে…?

বেড়াজাল পর্ব-০৫

0

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #৫

চন্দ্রা সিয়ামের কথা শুনে দরজার গোড়ায় দাড়িয়ে পড়লো কিছুক্ষণ সময় নিয়ে পিছনে ঘুরে শক্ত গলায় বলল “ভেবে দেখবো” বলে দরজা খুলে বেড়িয়ে গেলো।

রাত 12 টা

সিয়াম একবার ঘড়ির দিকে তাকালো আর একবার রুমের দরজার দিকে। নাহ মেয়েটা সেই যে গেলো আর তোহ এলো না। এখানের কিছুই সে তেমন চেনে না। কোনটা কার ঘর কোন ঘর খোলা হয়না মেয়েটা তোহ কিছুই জানে না। সিয়াম এবার হুইচেয়ারে করে আস্তে আস্তে রুমের বাইরে এলো নীচের তোলার চারদিকে খোঁজার পরও যখন চন্দ্রাকে পেলো না সিয়ামের মনটা ছটপট করতে লাগল।

এতো রাতে উচ্চস্বরে চন্দ্রার নাম নিয়েও সে ডাকতে পারছে না। চিন্তিত ভঙ্গিতে যেই বাগানের দিকের দরজায় যেতে যাবে ওমনি চন্দ্রাকে সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে দেখলো।
চন্দ্রা সিয়ামকে দেখে বলল “আপনি এখানে এতো রাতে..? কিছু দরকার ছিল..?”
সিয়াম একদৃষ্টিতে চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে বলল “আপনাকে”।
চন্দ্রা খানিকটা অবুঝের মতন বলল “সরি..? বুঝলাম না আমাকে দরকার মানে..?”
সিয়াম এবার গলাঝেরে বলল “না আপনি এত রাতেও রুমে আসছেন না দেখে একটু চিন্তায় পরে গিয়েছিলাম এখানের তেমন কিছুই তোহ আপনি চেনেন না।তাই আর কি”
চন্দ্রা বলল “আপনার আমাকে নিয়ে না ভাবলেও চলবে। নতুন জায়গা চিনি না তোহ কি হয়েছে ঠিক চিনে নেবো।আপনি আমার দিকে একটু কম নজর লাগলেই খুশি হবো।”
এইবলে চন্দ্রা সিয়ামের পাশ কাটিয়ে সিয়ামের রুমে চলে গেলো।
সিয়াম দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বিড়বিড় করে বলল “নারী তুমি পরও বটে এই রোদ তোহ এই বৃষ্টি”

চন্দ্রা সিয়ামের ঘরটার এদিক সেদিক দেখছে। এই ঘর টাও আগের ঘরের মতো কিছুটা কিন্তু আগেরটার থেকে কিছুটা ছোট আর ওতো বড়ো খোলা বারান্দা নেই এই ঘরে।
খুট করে দরজা খোলার শব্দে চন্দ্রা দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো সিয়াম এক প্লেট খাবার নিয়ে রুমে ঢুকছে। খাবার দেখেই চন্দ্রার পেট টা চু চু করে ডেকে উঠলো।সেই যে বিকেলে এক কাপ কফি খেয়েছে তারপর কিছু খাওয়া হয়নি তার।কিন্তু সেটা এখন মুখ ফুটে বললে খারাপ দেখাবে তাই চন্দ্রা নিজের মতো ব্যাস্ত থাকার চেষ্টা করলো।
সিয়াম খাবারের প্লেট টা টেবিলের উপর রেখে ডাকল”চন্দ্র..! খাবার টা খেয়ে নিন”
“চন্দ্রা, চন্দ্রা আমার নাম ” এক নিশ্বাসে বলল চন্দ্রা।
সিয়াম হালকা হেসে বললো “চন্দ্রাবতী বলতে বারণ করেছেন মেনে নিয়েছি কিন্তু চন্দ্র টা আমি শুনবো না আমি আপনাকে এই নামেই ডাকবো”।
চন্দ্রা প্রতিউত্তরে কিছু বলতে চেয়েও বললো না।সিয়াম এবার তারা লাগলো খেয়ে নেওয়ার জন্য।চন্দ্রা এবার অবাক হয়ে বললো “আপনি কি করে জানলেন আমি খাইনি..?”
সিয়াম বিছানায় রাখা বই গুলো ওঠাতে ওঠাতে বললো “মুখ দেখে।আপনার ওই শুকনো মুখই বলে দিচ্ছে আপনি অনেকক্ষণ যাবত না খেয়ে আছেন আর আপনার ক্ষীদেও পেয়েছে।”
চন্দ্রা আর কথা না বাড়িয়ে খেয়ে নিল। খাওয়া শেষে মনে পড়লো এতক্ষণ যাবত সে নিজেএকা একাই গাপুস-গুপুস করে খেয়ে নিয়েছে ক্ষীদের জ্বালায়। সামনের মানুষটি খেয়েছে কিনা একবারও জিজ্ঞাসা করা হয়নি।
চন্দ্রা আস্তে করে মাথা তুলে সিয়ামের দিকে তাকাতেই দেখলো সিয়াম তার দিকে তাকিয়েই মিটিমিটি হাসছে। যেনো সে ধরতে পেরেছে চন্দ্রার মনে কি চলছে।
চন্দ্রা একটু আমতা আমতা করে বলল “সরি একা একাই খেয়ে নিলাম আপনাকে একবারও জিজ্ঞেস করা হয়নি। আপনি খেয়েছেন..?”
সিয়াম অমন ভাবেই জবাব দিলো “ইটস ওকে..! ক্ষিদে পেলে চেপে রাখবেন না। এটা ভালো জিনিস নয়।অসুবিধে হলে আমায় বলবেন।”
চন্দ্রা এবার বলল “আমার শেষ প্রশ্নের উত্তর দিন।”
সিয়াম চন্দ্রার হাবভাব দেখে হেসে বলল “আজ খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।”
চন্দ্রা প্লেট হতে দাড়িয়ে বলল “এই আপনিই না এক্ষুনি খাওয়া সম্পর্কে জ্ঞান দিচ্ছিলেন। এখন নিজেই পাল্টি মারছেন..?আমি এক্ষুনি আপনার জন্য খাবার আনছি অল্প হলেও খেয়ে শোবেন।”
এই বলে সিয়ামকে কিছু না বলেই চন্দ্রা প্লেট নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো।
কয়েক মিনিট বাদ চন্দ্রা হতে খাবার নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। প্লেট টা টেবিলের উপর রেখে বলল “নিন কম করেই এনেছি।অন্য সময় হলে জোর করতাম না কিন্তু জানেন আমার দাদী বলতো রাতে খালি পেটে শুতে নেই কিছু অন্তত খেতে হয়।”
সিয়ামের কাছে হালকা হেসে হুইচেয়ার ঠেলে টেবিলের কাছে গেল। চন্দ্রার এই ছোটো ছোটো কেয়ার গুলো তার কাছে জানো বিশাল প্রাপ্তি।
খাওয়ার প্লেট সামনে নিয়ে সিয়াম ভাবছে এবার সে খাবে টা কি করে..?সকালে ডান হাতে বেশ ভালই চোট পেয়েছে।সকালে ব্রেকফাস্ট সিয়া আর দুপুরে লাঞ্চে তার মনি তাকে খাইয়ে দিয়েছিল।এখন কি করবে সে..?
আকাশ – পাতাল ভেবে বাঁ হাতেই চামচ তুলে নিল সিয়াম।
চন্দ্রা কিছু জিজ্ঞেস করার উদ্দেশ্যে সিয়ামকে ডাকতে গিয়ে দেখলো সিয়াম বাঁ চামচ দিয়ে যতবার খাবার তুলছে ততবারই খাবার টা আবার প্লেটে পরে আছে।
চন্দ্রা চুপচাপ কিছুক্ষণ এই দৃশ্য দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পরলো।
সিয়াম খাওয়ার ছেড়ে অপলক তাকিয়ে রইলো চন্দ্রার দিকে। এই বাড়ি আসার পর এই প্রথম মেয়েটাকে সে হাসতে দেখলো। খুব করে চন্দ্রার কাছে গিয়ে বলতে ইচ্ছে হলো “এই মেয়ে এরামি সবসময় হাসি খুশি থাকতে পারো না..? সারাক্ষণ ঐরম গোমড়া মুখ নিয়ে ঘুরে বেড়াও কেনো..?” কিন্তু মুখ দিয়ে শুধু বেরোলো “আপনি হাসছেন..? এদিকে আমি খাওয়ারের সাথে যুদ্ধ করে হাপিয়ে উঠছি।
চন্দ্রা কিছুকরে হাসি থামিয়ে বলল “এই জন্যেই আপনি রাতে খেতে চাইছিলেন না তাই নাহ..?”
সিয়াম শুধু হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়িয়ে এবার সেই একই কাজে মন দিলো।
চন্দ্রার এবার খারাপ লাগলো তার কিছু ভুলের জন্যই মানুষটার আজ এই অবস্থা।চন্দ্রা একবার সিয়ামকে জিজ্ঞেস করবে ভাবল যে সে কি খাইয়ে দেবে..? তারপর নিজের মনকেই বকা দিলো এসব কি ভাবছে সে এটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। তারপর কয়েক সেকেন্ড পর ভাবল কারোর হেল্প করা বাড়াবাড়ি হলে হোক বাড়াবাড়ি।

এইভাবে চন্দ্রা টেবিলের সামনে গিয়ে সিয়ামে কে ইতস্তত করে বলল “আপনার খেতে প্রবলেম হলে আমি খাইয়ে দি…?”
সিয়ামের কানে কথাটা প্রবেশ করতেই সিয়াম ভাবলো সে নিশ্চই ভুল শুনেছে তাই আরেকবার চন্দ্রাকে জিজ্ঞেস করলো “হ্যাঁ..?কিছু বললেন..?”
চন্দ্রা এবার মুখটা নীচু করে এদিক সেদিক তাকিয়ে বলল ” আমি খাইয়ে দি..?”
সিয়ামের খুশি দেখে কে..?হতে যেনো চাঁদ নিজে এসে ধরা দিয়েছে। এরাম অফার রোজ রোজ এলে তোহ সে নিজ ইচ্ছায় প্রতিদিন হাত কাটতে রাজি। তবু মুখে তার কোনো রিয়াকশন না দিয়ে বলল “আপনার প্রবলেম না থাকলে আমারও কোনও প্রবলেম নেই”।
চন্দ্রা নিজের হাত ধুয়ে এসে প্লেট টা হাতে তুলে ভাত মেখে সিয়ামের মুখের সামনে ধরলো।
সিয়াম একবার চন্দ্রার দিকে দৃষ্টি দিয়ে হাতের খাবার টুকু মুখে নিলো। এইরকম করে পুরো প্লেটের ভাত দশ মিনিটের মধ্যে শেষ করে ফেললো সিয়াম।
চন্দ্রা প্লেট টা রান্নাঘরে রেখে হাত ধুয়ে এসে দেখল সিয়াম হুইচেয়ার থেকে বিছানায় যাওয়ার চেষ্টা করছে নিজে নিজে তাকে দেখেই মনে হচ্ছে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।
চন্দ্রার এবার একটু খারাপ লাগলো তাহলে কাল রাতেও লোকটা এইভাবেই শুয়েছে,আর সে কিনা টেরই পায়নি।
চন্দ্রা সিয়ামের দিকে এগিয়ে গিয়ে সিয়ামকে উঠতে সাহায্য করলো।সিয়াম হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো চন্দ্রার দিকে এই কি সকালের তাকে সেই তিক্ত কথা শোনানো মেয়েটি..? তাহলে সকালের চন্দ্রার চরিত্রের সাথে এখনকার চরিত্রের মিল পাচ্ছে না কেনো সিয়াম..?
চন্দ্রা সিয়ামকে বিছানায় শুয়ে চাদর টেনে দিল।
চন্দ্রা সিয়ামের এতো কাছে আসায় চন্দ্রার শরীরের মিষ্টি এক সুবাস সিয়ামের নাকে ঠেকলো।সিয়ামের এবার যেনো নিজেকে কেমন মাতাল মাতাল লাগছে। সে বুঝতে পারছে সে ডুবে যাচ্ছে একজনের নেশায়।সেই অবস্থাতেই সিয়াম ঘোর লাগানো কণ্ঠে ডাকল “চন্দ্র” চন্দ্রা মুখ তুলে বলল “হুম বলেন” সিয়াম একইভাবে বলল “আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু আমি এখনও পাইনি।আমরা কি বন্ধু হতে পারি..?”
চন্দ্রা কিছুটা সময় নিলো তারপর বিছানার আরেকপাশে বসতে বসতে শুধু বলল “হুম হতেই পারি”।

#চলবে..?