Friday, August 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 466



বেড়াজাল পর্ব-৩২

0

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #৩২

অপূর্ব রেডি হচ্ছে। আজ তাকে ডিউটিতে যেতেই হবে। বিয়ে উপলক্ষ্যে দুই দিন অলরেডি ছুটি নিয়েছে সে। সিয়া ঘরে অপূর্বের রুমাল, জলের বোতল নিয়ে এসে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখলো। আড়চোখে অপূর্বকে দেখলো একবার। সে দাঁড়িয়ে শার্টের হাতা ফোল্ড করছে।
সিয়া কি করবে ভেবে না পেয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে গেলে অপূর্ব ডেকে উঠলো তার নাম ধরে।

সিয়া পিছনে ঘুরে বললো “হুম বলুন। কিছু লাগবে আপনার আর..?”
অপূর্ব কিঞ্চিৎ হেসে বললো “তোমাকে ”
সিয়া ভরকে গেল। ইতস্তত করে বললো ” মা-মা-নে..?”
অপূর্ব কথাটা এড়িয়ে হাতঘড়িটা পড়তে পড়তে বলল ” শাড়ি সামলাতে না পারলে পড়ার দরকার নেই। এই বাড়িতে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই পোশাকের উপর। শালীনতা বজায় রেখে তোমার মনের মতো পোষাক পরতে পারো। এমন জড়িয়ে পেঁচিয়ে হাঁটার চেয়ে ওইটা বেটার।” অপূর্বের এই শেষ বাক্যটাই কি মজার আভাস লুকিয়ে আছে..? ধরতে পারলো না সিয়া। তার মনে চলছে তাহলে মানুষটা খেয়াল করেছে তার শাড়ি পড়ে হাঁটা চলা করতে অসুবিধা হচ্ছে..?

সিয়াকে এভাবে ভাবতে দেখে অপূর্ব কিছুটা সিয়ার কাছে এগিয়ে গেল। সিয়ার স্তভিত ফিরে সামনে তাকিয়ে অপূর্বকে এতো কাছে দেখে চমকে গেলো। কয়েক পা পিছিয়ে যেতে চাইলো কিন্তু পারলো কি..?
“আজ কোমরটা ভাঙল বোধহয়..!” এই মনে মনে বলে চোখ বুঝতেই একটা হাত এসে ওকে জড়িয়ে নিলো। টেনে নিল আরো কাছে।
সিয়া চোখ খুললো পিটপিট করে। মাথা তুলে অপূর্বকে এতো কাছে দেখে দ্রুত সরে গিয়ে বললো ” সরি সরি আমি আসলে ঐ। মানে আপনি…!”

অপূর্ব এবার কিছুটা রাগ মিশ্রিত গলায় বললো ” ইটস ওকে। তবে এক্ষুনি শাড়ি ছেড়ে অন্য কোনো জামা পরো। আর সিয়া আগে যেমন বন্ধু হিসেবে তুমি করে বলতে তেমনই ডেকো। আপনি ডাকটা দূরের লাগে বড্ড।” শেষ কথাটা বেশ নরম কণ্ঠে বললো অপূর্ব।
সিয়া শুধু মাথা নাড়লো।

অপূর্ব তাকে সাবধানে থাকতে বলে বেড়িয়ে গেলো।
সিয়া বিছনায় বসে পড়লো। সে যথা সাধ্য মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে জীবনের এই নতুন পরিবর্তনের সঙ্গে। কিন্তু অদেও কি সে আর পাঁচটা বউয়ের মতো লক্ষ্মী বউ হয়ে উঠতে পারছে..? সে জানে পারছে না, কিছু করতে গেলেই পুরোনো দিনের কিছু জমানো স্মৃতি বারে বারে ধাক্কা দেয় তার মস্তিষ্ককে। অপূর্ব নিশ্চই এইরকম বউ ডিজার্ভ করে না। আচ্ছা তার উপর সে করুনা করেনি তো অসুস্থ বলে..? সিয়া মাথা চেপে ধরলো। বার বার কেনো সেই একই প্রশ্নে এসে থামে তার চিন্তা..?

সিয়া আর পারলো না বসে থাকতে। উঠে নীচে গেলো। একদিক থেকে সে ভীষণ ভাগ্যবতী মনে করে নিজেকে সে, এতো সুন্দর শশুর বাড়ি পাওয়ার জন্য। অপূর্বের মা-বাবা সিয়ামকে সত্যি বলেছিলো বিয়ের সময়, তারা সত্যি সিয়াকে বিয়ের পর তাদের মেয়ে বানিয়েই রেখেছে।

দুইদিনেই সিয়াকে তারা অনুভব করিয়েছে যে তারও বাবা মা আছে। যাদের যখন খুশি জড়িয়ে ধরা যায়, যাদের উপর অভিমান করা যায়, আবদার করা যায়। সময়টা কম হলেও সিয়ার ভালোবাসার পরিমাণটা শুধু বেড়েই গেছে।

সিয়া নীচে নেমে রান্নাঘরে সায়মা বেগমের কাছে গিয়ে কাধেঁর একপাশে মুখ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। সায়মা বেগম তাকে দেখে হেসে দিয়ে বললেন ” কি ব্যাপার আম্মু মন খারপ..?”
সিয়া অবাক হয়ে বললো “তুমি কি করে বুঝলে..?”

সায়মা বেগম এবার মিষ্টি হেসে তরকারি নাড়তে নাড়তে বললো ” মায়েদের এসব বোঝাতে হয় না তারা ছেলেমেয়েদের চোখ দেখেই বুঝতে পারে। অপু আর অপা এতো বড়ো হওয়ার পরও মন খারাপ হলে আমার আসেপাশে এসে ঘুরঘুর করে। কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে এমনই ঘুরছে। কিছুক্ষণ আমি কথা বলে সহজ করলে তারপর মন খারাপের কারণ খুলে বলে।”

সিয়া হালকা হাসলো। কেনো যেন এখন তার মনটা আগের থেকে ভালো লাগছে। একটা বাটি নিতে নিতে বললো “আমি কিছু সাহায্য করি আম্মু..?”

সায়মা বেগম অবাক হয়ে বললেন ” সেকি কথা আজ অফিস নেই তোমার..? সবাই তো বেড়িয়েই গেলো কাজে।”
সিয়া বাটিতে থাকা সবজি গুলো নাড়তে চাড়তে বললো “তিন দিনের ছুটি নেওয়াই ছিলো আগে থেকে। তবে আজ যাওযার কথা ভেবেছিলাম কিন্তু এখন ভালো লাগছে না।”

সায়মা বেগম হেসে বললেন ” তাহলে ঠিকাছে। আজ তাহলে সারাদিন মা বেটি মিলে জমিয়ে আড্ডা দেবো কেমন..?” সিয়া বেশ খুশি হলো।
দুই মা মেয়ে মিলে একসাথে রান্না শেষ করলো। সায়মা বেগম গল্পের সাথে সাথে ধীরে ধীরে সংসারী হওয়ার কিছু নিয়মও বলে দিলেন। তার এতো দিনের সংসার জীবনের কিছু মজার কিছু দুঃখের গল্প তুলে ধরলেন। সিয়া সেসব শুনে কখনো খিলখিলিয়ে হাসলো তো কখনো অবাক হয়ে শুনলো সেসব। বিকেলের পর সেই আড্ডায় যোগ দিলেন অলীক সাহেব আর অপাও। ঝগড়া খুনসুঁটি লুডো খেলা সবটা মিলিয়ে সিয়ার দিন আজ এককথায় ” খুব খুব ” ভালো কাটলো।

রাতে অপূর্ব বাসায় ফেরার পর থেকেই সিয়াকে বেশ ফুরফুরে মেজাজে দেখলো। তখন বেশ খুশি হলেও এইমূহুর্তে ঘরে সিয়ার অপেক্ষা করতে একদমই তার ভালো লাগছে না। আচ্ছা সারাদিন তো কাটলো সবার সাথে তার জন্য কি এই রাত টুকুর কটা ঘন্টাও দেওয়া যায় না। বেজায় বিরক্ত হয়ে চোখ মুখ কুঁচকে বসলো ল্যাপটপ নিয়ে বসলো। যদিও তার তেমন কাজ নেই কোনো কিন্তু বিরক্তি তো কমাতে হবে।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই সিয়া বেশ ফুরফুরে মেজাজে একপ্রকার প্রজাপতির মতো উড়তে উড়তেই একটা প্লেট হাতে নিয়ে এসে বসলো অপূর্বের পাশে।
অপূর্ব আড়চোখে তাকালো সিয়ার দিকে আর প্লেটের দিকে। কিছু একটা পকোড়া হবে আছে।
অপূর্বের আপাতত সেই বিষয়ে ইন্টারেস্ট নেই। মুখ ল্যাপটপের দিকে করেই বলল “এখন এই অধমের কথা মনে পড়লো ম্যাডামের..?”
সিয়া এবার হাসি মুখ পালটে বললো “ওমনি বলছো কেনো..? তোমায় কি ভুলে গেছি নাকি যে মনে করতে হবে সময়ে সময়ে।”
অপূর্ব হাসলো। ল্যাপটপটা পাশে বন্ধ করে রেখে বললো ” তা এতো খুশির কারণ কি..? আজ কি কি করলে সারাদিন আমিও একটু শুনি..?”

সিয়া এবার হেসে উত্তেজিত হয়ে হিসাব দিতে লাগলো তার সারাদিনের। অপূর্ব কতটা শুনলো বোঝা গেলো না তার দৃষ্টি শুধু ওই হাসৌজ্জ্বল মুখটায়। কত্তোগুলো দিন বাদ সে সিয়াকে এইরকম হাসিখুশি দেখছে। প্রশান্তির এক হাওয়া বয়ে গেলো শরীরে তার। সে পারছে ধীরে ধীরে সিয়াকে কষ্টের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করতে।

______________________________

ডোর বেল বেজেই চলেছে।
ইন্দ্রা বিরক্ত হয়ে সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বিড়বিড় করতে লাগলো “এতো সকালে এইভাবে কে ডোরবেল বাজাচ্ছে..? উফফ আসছি আসছি।” শেষ বাক্য একটু জোরেই বললো।

গিয়ে দরজা খুলতেই চমকে গেলো ইন্দ্রা। তার সামনে স্বয়ং সিরাজ দাঁড়িয়ে। ইন্দ্রা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে বললো “আপনি এইসময়ে এইখানে..? কোনো দরকারে এসেছিলেন..?”
সিরাজ বুঝলো না সামনের মেয়েটি কি তার সাথে মজা করছে..? রাগ চাপলো মাথায় এক হাত দরজায় রেখে মাথাটা কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো “ইয়েস মিস ইন্দ্রাকে দরকার। তার অমূল্য কিছু সময় থেকে আমায় কি কিছু সময় ভিক্ষে দেওয়া যাবে তা জানা দরকার।”

ইন্দ্রা মিন মিন করে বললো ” এইরকম করে কেনো বলছেন..? আসুন ভিতরে এসে বলুন কি বলবেন।”

সিরাজ চোখ বুঝে মনকে “কন্ট্রোল কন্ট্রোল ” বলে সামলে গম্ভীর গলায় বললো “তোমার বাবা বাড়ি আছেন..?”

ইন্দ্রা ঘাড় নাড়িয়ে বললো ” না কয়েকদিনের জন্য বাইরে গিয়েছেন কাজের সূত্রে, একটা বারণ শোনেননি আমার।”

সিরাজ ইন্দ্রাকে পা থেকে মাথা অবধি দেখে বললো “তাহলে বাইরে কোথাও কফিশপে চলো। একা একটা মেয়ের বাড়িতে যাওয়াটা ঠিক দেখাবে না।”

ইন্দ্রা ইতস্তত করলেও সিরাজের গরম মেজাজ দেখে কিছু বলল না শুধু ওড়না তো পাল্টে চুল ঠিক করে লিপবাম লাগিয়ে বেড়িয়ে পড়লো ইন্দ্রা।
সিরাজের গাড়িতে উঠার সাথে সাথেই শুরু হলো তার প্রশ্নের বান “কই ছিলে ইন্দ্রা এই দুইদিন। না একটা ফোন না মেসেজ ফোনটা অবধি সুইচ অফ করে রেখেছ। জানো আমার কেমন পাগল পাগল অবস্থা হয়েছিলো..? এই সব কেনো করছো..? শুধু চন্দ্রার জন্যে..?”

ইন্দ্রা থমকালো। সিরাজ এইভাবে ব্যাপারটা ধরে ফেলবে সে ভাবেনি সে আসলেই চন্দ্রার ফোনকল থেকে বাঁচতেই এই দুইদিন ফোন অফ করে রেখেছে। সিরাজের এইরূপ প্রশ্নে শুধু মাথা উপর নীচ করলো।

সিরাজ নিশ্বাস ছাড়ল। দুইবোনের মধ্যে কিছু বলতে চায়না সে। সিরাজ এতদিনে যা দেখেছে বুঝেছে তাদের সম্পর্কটা এতোটাও ঠুনকো নয় যে এই সামান্য মনোমালিন্যে ভেঙে যাবে। আপাতত কিছু সমস্যাকে তাদের মতোই ছেড়ে দিতে হয়। তারা নিজে থেকেই যেনো কিভাবে ঠিক হয়ে যায়।

সিরাজ চুপচাপ গাড়ি ড্রাইভ করতে লাগলো। ইন্দ্রা তা দেখে জিজ্ঞেস করলো “কোথায় যাচ্ছি আমরা এখন..?”

সিরাজ নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো “দেখি আশে পাশে কোনো বাচ্চাদের নিয়ে ঘোরার যায়গা আছে কি..?”

ইন্দ্রা আবার ফুঁসে উঠলো ” আপনি আবার আমায় বাচ্চা বললেন। গাড়ি থামান, গাড়ি থামান বলছি। যাবো না আমি আপনার সাথে।” বলে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলো।

সিরাজ হেসে দিলো এই মেয়েটা নাকি তার থেকে বড়ো..?কেউ বিশ্বাস করবে..? সারাক্ষণ বাচ্চাদের মতো ছটপট করে তারপর তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে এদিক সেদিক পরে যায়। আবার কিছু বললেই বাচ্চাদের মত গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। সে যাই হোক এই ছোটো ছোটো বাচ্চামো গুলোতেই তো সে ডুবে মরেছে। এই সব জিনিস মোটেই কমের চোখে দেখবে না সে।

সিরাজ গাড়ি পার্ক করে ইন্দ্রাকে নামতে বললো। ইন্দ্রার হাতের শুধু দুটো আঙুল নিজের আঙুলে আবদ্ধ করে চোখে সানগ্লাস পরে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো। ইন্দ্রা একবার হাতের দিকে তাকিয়ে আবার মুখ ঘুরিয়ে হাঁটতে লাগলো।
যাওয়ার সময় এক ভদ্রলোক সিরাজকে কেমন একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখলো। সিরাজের চোখ এড়ালোনা। হটাৎ ইন্দ্রাকে জিজ্ঞেস করলো ” আচ্ছা আমায় লোকে এইরকম ভাবে দেখছে কেনো..? মুখে কি কিছু লেগে আছে দেখো তো একবার।”

ইন্দ্রা এবার ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো সিরাজকে। গায়ে পরা শার্টের উপরের দুটো বোতাম খোলা দেখেই বোঝা যাচ্ছে শার্টটা ভীষণ তাড়াহুড়োয় পড়া হয়েছে। সাথে তো উসকাখুশকো চুল আছেই। আচ্ছা মানুষটা কি ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে এভাবেই চলে এসেছে..?
একজন জিম করা পারফেক্ট শেপের বডি ওয়ালা সুদর্শন ছেলেকে এইরকম এলোমেলো রূপে দেখে যে কেউ দুই বার ঘুরে দেখবে। সেটা হোক কৌতূহলের দৃষ্টিতে আর হোক মুগ্ধতার। কিন্তু এখন ইন্দ্রার ভীষণ রকম হাসি পেলো সিরাজের এই রূপ দেখে। কিছু না বলে স্থান কাল বয়স ভুল খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো রাস্তার মাঝেই। আগে যাও বা একটা দুটো মানুষ দেখছিল এখন রাস্তায় যাতায়াত প্রায় সব মানুষই তাদের দিকে ফিরে ফিরে চাইছে।

ইন্দ্রার হাসি দেখে অপলক চেয়ে রইলো সিরাজ। এই প্রথম মেয়েটাকে এইরকম হাসতে দেখলো সে নয়তো ইন্দ্রাকে সবসময় সব বিষয়ে মুচকি হাসতেই দেখেছে সে।
ইন্দ্রা হাসি থামিয়ে বললো “এইরকম পাগল বেশে ঘুরলে তো সবাই চেয়ে চেয়ে দেখবেই।”
সিরাজ হকচকিয়ে বললো “মানে..?”

ইন্দ্রা এবার আসে পাশে দেখে একটা শপের বাইরের কাঁচের দরজার সামনে সিরাজকে দাঁড় করিয়ে বললো “দেখুন কি অবস্থা আপনার।”

সিরাজ দেখে চেঁচিয়ে বললো “শিট! এভাবে ছিলাম এতক্ষণ..? আগে বলনি কেন..?” বলেই গাল ফুলিয়ে চুল গুলো ঠিক করতে লাগলো। তার চুল আগাগোড়াই একটু ঝাঁকড়া টাইপের তাই জেল দিয়ে সেট করে রাখে সে কিন্তু এখন আর উপায় কি..?

ইন্দ্রা একটু এগিয়ে এসে সিরাজের শার্টের দুটো বোতাম লাগিয়ে দিল। সিরাজের সাথে চোখা চোখি হতেই অসস্তিতে সরে দাঁড়ালো আবার।

সিরাজ মুচকি হেসে একটা হোটেলের ভিতর গিয়ে দুই জনের একটা টেবিলে বসলো। খাবার অর্ডার দিয়ে দুজনে টুকটাক কথা বলতে থাকলো। খাওয়ার আসার পর সিরাজ এক চামচ তুলতেই তার পায়ের কাছে একটা বাচ্চা এসে হাসি মুখে দাঁড়ালো। বেশি না হলেও অন্তত বছর চার হবে বাচ্চাটার। সিরাজ হেসে নাম জিজ্ঞেস করলো তার। সেও হেসে বললো ” ইহাদ “। সিরাজ এবার তাকে কোলে তুলে নিয়ে বললো “তোমার বাবা মা কই ইহাদ..? এখনে একা কেনো..?” বাচ্চাটি তার মতো করে উত্তর দিলো “ওয়াসরুমে পাপা ওখানে মা ”
বেশ অনেক্ষণ ধরে সিরাজ আর ইন্দ্রা বাচ্চাটার সাথে গল্প আর আদর করলো।

কিছুক্ষন পর একটি লোক এসে বললো “এক্সকিউজ মি..?”
সিরাজ তাকিয়ে বললো ” ইয়েস..?”
লোকটি কিছু বলার আগেই বাচ্চাটা পাপা বলে এগিয়ে গেলো। লোকটি এবার হাসি মুখ করে বললো ” সরি ওর জন্য। খুব জ্বালিয়েছে না..? আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম কোথায় না কোথায় গেলো। থ্যাংক ইউ আপনাদেরকে আমার অনুপস্থিতিতে ওকে দেখার জন্য।”

সিরাজ হেসে বললো ” আরে না না অসুবিধার কি আছে ও খুব ভালো। আর আমাদেরও ভীষণ ভালো লাগলো। তবে পরবর্তীতে একটু খেয়াল রাখবেন ওর দিকে।” বলেই আবার বাচ্চাটার গালে মুখ ঘষতেই বাচ্চাটা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।

লোকটি হেসে ইহাদকে নিতে নিতে বললো ” আপনার বাচ্চা ভীষণ পছন্দের মনে হয়..?”

সিরাজ এবার আড়চোখে ইন্দ্রার দিকে তাকিয়ে বললো ” হ্যাঁ খুব বাচ্চাগুলো এতো কিউট হয় যে দেখলেই মনে হয় সারাদিন কলে নিয়ে বসিয়ে রাখি।” বলেই বড়োসড়ো এক হাসি দিল। তারপর বাচ্চাটাকে হেসে বাই বললো।

ইন্দ্রার দৃষ্টি এড়ালো না সেই কথাটা। আচ্ছা ” বাচ্চা ” কথাটা কি সিরাজ তাকে উদ্দেশ্য করে বললো তখন। ভাবতেই ইন্দ্রার রাগ হওয়ার পরিবর্তে একরাশ লজ্জা এসে ঘিরে ধরলো তাকে।

______________________________________

চন্দ্রা সময়মতো সিনথিয়া দের বাড়ি চলে এসেছে। প্রথমে আসতেই তাকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিলো না। পরে সিনথিয়াকে ফোন করে গার্ডদের বলে তাকে ঢুকতে হয়েছে। তাও তারা চন্দ্রার ব্যাগ চেক করতে ছাড়েনি। চন্দ্রা এতে খুবই বিরক্ত।

সিয়ামকে সকালে সুইটি বেগমের কথাটা বলতে সিয়াম বলেছিলো ওই দিকটা সে সামলে নেবে। তবে চন্দ্রা যাতে মাথা ঠান্ডা করে যা করার করে। চন্দ্রা আজ বুকে অনেক সাহস নিয়ে এসেছে। যা করার আজকের মধ্যেই করতে হবে তাকে।

সিনথিয়া চন্দ্রাকে দেখতে পেয়েই জড়িয়ে ধরলো। চন্দ্রা পুরো বাড়িটা চোখ বুলিয়ে বললো ” বাহ্ বেশ সুন্দর তো তোমার বাড়িটা আমায় একটু ঘুরে দেখাবে..?”
সিনথিয়া রাজি হলো। খুশি মনে চারদিক প্রত্যেকটা ঘোর ঘুরিয়ে দেখলো চন্দ্রাকে।

চন্দ্রা জিজ্ঞেস করলো ” এখনও তোমার বন্ধুরা আসেনি..?”
সিনথিয়া মুখ ভার করে বললো ” না তারা বললো আরেকটু দেরি হবে। ”
চন্দ্রা হেসে বললো চিন্তা করো না চলো। বলে দুজনে ডাইনিং টেবিলে বসলো। চন্দ্রাকে কিছু স্যানকস খেতে দিলো সিনথিয়া। চন্দ্রা সাবধান বশত কিছুটা জোলাপ বের করে একটু খানি মিশিয়ে দিলো সিয়ার জুসে। তার খারাপ লাগলো কিন্তু তার কাছে আর উপায় নেই। সিনথিয়াকে আসতে দেখেই চন্দ্রা দ্রুত জুসটা এগিয়ে রাখলো।

#চলবে..?

বেড়াজাল পর্ব-৩১ + বোনাস পর্ব

0

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #৩১

মাঝে কেটেছে একদিন। সবাই সবার কাজে বেশ ব্যস্ত। সিয়া সকালে ঘুম থেকে উঠে পাশে তাকাতেই তার চিরচেনা মুখ অপূর্বকে দেখতে পেলো। হাত সরাতে গিয়ে দেখলো আগের দিনের মতোই তার হাত অপূর্বের হাতে বদ্ধ। সিয়া অবাক হলো কিছুটা, কারণ কাল সারাদিন অপূর্বের দেখা পায়নি সে। কখনও হসপিটাল কখনো মেহমানদের নিয়ে ব্যস্ত ছিল।
সিয়া শেষ দেখেছিল তাকে গতকাল দুপুরে খাওয়ার টেবিলে। কিন্তু সবক্ষণ যেন আড়াল থেকে ওর খেয়াল রেখে গেছে। যখন যেটা মনে করেছে কেউ না কেউ এসে দিয়ে গেছে। সিয়া জিজ্ঞেস করলে বলেছে অপূর্ব ভাইয়া পাঠিয়েছে। তারপর সে রাতেও দেখেনি অপূর্বকে, সিয়া রাতে বিছানায় এসে পিঠ ঠেকাতেই যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে সে নিজেও বুঝতে পারেনি।

সিয়া হালকা করে হাতটা হাতটা সরিয়ে উঠতে গেলেই দেখলো তার অর্ধেক শাড়ি অপূর্বের হাতের নিচে। সিয়া লজ্জা পেলো এখন যদি অপূর্ব জেগে যায় তাহলে সে ভীষণ অস্বস্তিতে পড়বে। তার শাড়ি পরার অভ্যাস একদম নেই। নতুন বউ বলে কাউকে সেই কথা বলতেও পারেনি।

সে বুঝতে পারে না রোজ রাতে অপূর্ব কেনো তার হাত এভাবে ধরে ঘুমায়। আচ্ছা তার আগে কোনো প্রেমিকা ছিলো না..? সিয়ামের বোন বলেই কি শুধু তার কথায় রাজি হয়ে বিয়ে করেছে তাকে..? উফফ এসব ভাবতে গেলেই একটা ছেড়ে হাজারটা প্রশ্ন এসে তাকে ঘিরে ধরে। বার বার তার মনে হয় সে অপূর্বকে বাধ্য করেছে এই বিয়েতে।
তারপর এসব ভাবনা বাদ দিয়ে সে ফ্রেশ হয়ে নীচে নামলো। কাল মেহমানদের নিয়েই সারাক্ষণ কেটে গেছে। সিয়া কারোর সাথেই তেমন কথা বলেনি শুধু কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে তার উত্তর দিয়েছে। অথচ আজ সারা বাড়ি ফাঁকা। সব মেহমানরা কাল রাতেই বাড়ি ফিরে গেছে।

সিয়া রুম থেকে বেরোতেই অপূর্ব চোখ মেললো তার কাছ থেকে হাত সরানোর সময়ই তার ঘুম হালকা হয়ে গিয়েছিল। সিয়ার শাড়ির অবস্থা দেখে সে চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। সে তখন উঠলে সিয়া ভীষণ রকম অসস্তিতে পড়তো সে জানে।

সিয়া ডাইনিং টেবিলের কাছে আসতেই দেখলো অপূর্বের বাবা অলীক সাহেব চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। সিয়া মাঝে মাঝে ভাবে অপূর্বের মা বাবাকে দেখে মনেই হয় না যে তাদের এতো বড়ো একটা ছেলে আর মেয়ে আছে। আসল বয়সের থেকে বয়স অনেকটা কম লাগে।
সিয়া টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে লাগলো।

অলীক সাহেব এবার মুখ তুলে সিয়াকে দেখে একমুখ হাসি নিয়ে বললেন “আরে আম্মু দাঁড়িয়ে কেনো বসো বসো” বলে তিনি নিজেই চেয়ার টেনে দিলেন।

সিয়া এবার আলতো হেসে বসে বললো “অপা কি স্কুলে গেছে আঙ্কেল…?”

অলীক সাহেব হাসি মুখে বললেন “হ্যাঁ আম্মু তার প্রাইভেট স্কুল তাই সকালেই যেতে হয়। কিন্তু তোমার উপর আমি বেশ রেগে আছি আম্মু। তুমি এটা ঠিক করলেনা” শেষ কথাটায় বেশ গম্ভীর মনে হলো অলীক সাহেবকে।

সিয়া ঘাবড়ে গেলো। কিন্তু তার মনে পড়ছে না সে কথার খেলাপ করে কিছু করেছে।
অলীক সাহেব সিয়ার চিন্তিত মুখ দেখে একইরকম গম্ভীর হয়ে বললেন ” আমি তোমায় আমায় মেয়ে ভেবে আম্মু বলছি অথচ তুমি দেখো আমায় নিজের বাবা ভাবতে পারছো না।”

সিয়া এবার অপরাধী চোখে তাকালো। তার নিজেরই খেয়াল নেই সে কখন আঙ্কেল বলে দিয়েছে। এবার সে মাথা নিচু করে মিনমিন করে বললো “সরি বাবা।”

অলীক সাহেব এবার সিয়াকে দেখে জোরে হেসে বললো ” আরে আম্মু ভয় পেয় না। আমি মজা করলাম তুমিও অপু আর অপার মত আমায় আব্বু বলে ডেকো কেমন।”

সিয়া এবার একটা স্বস্থির হাসি দিয়ে ঘাড় নাড়লো। তখনই সায়মা বেগম রান্নাঘর থেকে প্লেট নিয়ে আসতে আসতে বললেন “কি কথা হচ্ছে বাপ বেটিতে…? আমায়ও একটু শোনাও।”

অলীক সাহেব বললেন “এই প্ল্যান করছিলাম ছেলের সাথে তোমার আমার আরেকবার হানিমুনটা সেরে নিলে কে কেমন হয়..?”
সায়মা বেগম এবার গরম চোখে তাকিয়ে বললেন “কিছুই আটকায় না নাকি মুখে তোমার..?এই বুড়ো বয়সে এসে আবার হানিমুন যাবে বলছো..?”

অলীক সাহেব এবার অবাক মুখ করে বললেন ” একি সায়মা তুমি আমায় বুড়ো বলতে পারলে..?এখনও অপূর্বের পাশে দাঁড়ালে লোকে আমায় তার বড়ো ভাই বলবে। এই আম্মু তুই বল আমায় দেখে কি তোর বুড়ো মনে হয়..?”
সিয়া এতক্ষণ অবাক হয়ে তাদের ঝগড়া দেখছিল। সে ভাবেনি এইরকম একটা শশুর বাড়ি তার ভাগ্যে আছে। কারন আতিফের মুখ থেকে শুনেছিল তার মা নাকি খুব গম্ভীর পান থেকে চুন খসলেই নাকি তার ভাবীর উপর চড়াও হতেন। আতিফ তাই বলেছিলো সিয়ার বেশি অসুবিধা হলে সে আলাদা ভাড়া বাড়ি নিয়ে থাকবে।

তাই সিয়ার কাছে এই পরিবেশ একদমই নতুন। অলীক সাহেবের এইরূপ প্রশ্ন শুনে সিয়া মুচকি হেসে বলল “হ্যাঁ আব্বু তোমায় জাওয়ান সিমেনার শাহরুখ খান লাগে।”

অলীক সাহেব গর্বের সাথে হেসে সায়মা বেগমের দিকে তাকালেন। সায়মা বেগম মুখ ভেংচে বললেন “ওইরম একটু আধটু মিথ্যে বলতে হয়।”

এরই মাঝে অপূর্ব নীচে নেমে এসে চেয়ার টেনে বসে বললো “গুড মর্নিং আব্বু আম্মু। তা আজ তোমাদের ঝগড়ার টপিকটা কি..?”

সায়মা বেগম উত্তর দিলেন “এইযে এলেন এলেন নবাবপূত্তুর এবার বাপ বেটা মিলে আমার পিছনে লাগবে। এই আম্মু আমি বলে দিচ্ছি তুই কিন্তু মোটেই এই বাপ বেটার দলে যোগ দিবি না।”
সিয়া হেসে বললো “না না আম্মু আমি অলওয়েজ তোমার দলে।”
সায়মা বেগম এবার হেসে সবাইকে খেতে দিলেন।
অপূর্ব সন্তুষ্ট চোখে তাকালো সিয়ার দিকে। তার বেশ ভালো লাগছে সিয়াকে এই পরিবেশে মানিয়ে নিয়ে এতটা হাসি খুশি দেখে। তার পূর্ণ ভরসা আছে তার পরিবারের উপর সিয়া এতদিন যা প্রাপ্য ভালোবাসা পায়নি তার কিছুটা হলেও সে পূরণ করতে পারবে।

____________________________________

রাত ১০ টা

চন্দ্রা একবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে আর রেগে এইদিক ওইদিক করছে। সিয়াম আজ সেই কোন সকালে বেরিয়েছে অফিসে তখন চন্দ্রা ওঠেওনি। আর এখনও বাড়ি ফেরেনি। সারাদিন চন্দ্রাকে একটা মেসেজ বা কলও দেয়নি। চন্দ্রা কল দিয়েছিল সেটাও রিসিভ করেনি আর না তার মেসেজের রিপ্লাই দিয়েছে। সিয়াম সেই কোন সকাল আটটায় একটা মেসেজ দিয়েছিল যে তার আজ একটু জরুরী কাজ আছে তাই তাড়াতাড়ি বেরোতে হয়েছে। বাড়ি সে তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করবে। তাড়াতাড়ি তো দূরে থাক রাত দশটা বাজার পরও সে বাড়িতে ঢোকেনি। চন্দ্রা এবার দশবরের মাথায় ডায়েল করলো সিয়ামের নম্বর।
ওপাশ থেকে সুইচ অফ বললো। চন্দ্রা অবাক এবার তার চিন্তা বেশি হচ্ছে সে যখন আটটায়ও লোকটাকে ফোন করেছে তখনও ফোন গেছে সিয়ামের কাছে। এরই মধ্যে সুইচ অফ..? চন্দ্রা পিয়াসকে ফোন করতে যেতেই তার ফোনে কল ঢুকলো। নাম দেখলো সিনথিয়া।

চন্দ্রা একটু অবাক হলো। রাত দশটা বাজে এখন মেয়েটা কি কারণে ফোন দিয়েছে..? চন্দ্রার সাথে তার সেইদিনই গাড়িতে তার শেষ দেখা হয়েছিল। এরপর হোয়াটসঅ্যাপে নরমাল হাই হেলো ব্যাস।
চন্দ্রা এবার ফোনটা রিসিভ করে কানে দিয়ে বললো “হ্যাঁ সিনথিয়া বলো এতো রাতে ফোন করলে..?”

সিনথিয়া ওপাশ থেকে বললো ” সরি সরি আসলে সারাদিন ব্যস্ত ছিলাম তাই ফোন করা হয়ে ওঠেনি। আসলে তোমায় কিছু বলার ছিল। তুমি ফ্রী তো এখন..?”

চন্দ্রা হেসে বললো “হ্যাঁ হ্যাঁ আমি ফ্রী। তুমি নির্দ্বিধায় বলো কি বলবে।”

সিনথিয়া এবার বললো “কাল আমার জন্মদিন আপু, তাই ঘরে ছোটখাটো একটা পার্টি রেখেছি, বেশি না আমার দুইচারটে মেয়ে ফ্রেন্ড আসবে। আসলে ছেলে বন্ধু মম পছন্দ করে না। তাই যদি তুমিও আসো তো আমার ভালো লাগবে। দেখো না করো না।”

চন্দ্রা বেশ অবাক হলো। সে ভেবেছিল সিনথিয়া তাকে বলবেই না তার জন্মদিনে। সেখানে ফোন করে বলাটা একটু অবাক লাগলেও চন্দ্রা সেটা চেপে হাসি মুখে বললো “ঠিকাছে যাবো।”
সিনথিয়াও এবার হাসি মুখে বললো “ওকে দেন! কাল সকালে দেখা হচ্ছে। তাড়াতাড়ি চলে আসবে কিন্তু তুমি এলে তারপর কেক করবো।”
চন্দ্রা হেসে বললো ” আচ্ছা আচ্ছা তাই তাড়াতাড়ি আসবো।” বলে গুড নাইট বলে ফোন রেখে দিল।

চন্দ্রার চিন্তা হচ্ছে কাল সকালে কেক কাটার সময় সেখানে সুইটি বেগমও উপত্থিত থাকবেন। তাকে দেখলেই তো সে চিনে ফেলবে। চন্দ্রা কি করবে এখন..?
এসব ভাবতে ভাবতেই সিয়াম দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকে ঘরের।
চন্দ্রা সিয়ামকে দেখে সারাদিনের কথা পুনরায় মনে পড়ে। সিয়ামের সাথে ঝগড়া করার মনোভাব থাকলেও সিয়ামের ক্লান্ত মুখ দেখে তার সিদ্ধান্ত পাল্টায়। না নিরবতায় শাস্তি দেবে সে লোকটাকে সেও বুঝুক কথা না বললে কেমন লাগে।
চন্দ্রা তাই চুপচাপ রান্নাঘর থেকে শরবতের গ্লাস আর খাবারটা এনে শব্দ করে টেবিলের উপর রাখলো। তারপর দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে সিয়ামের ফ্রেশ হওয়ার জামাকাপড়ও জোরেই বিছানায় রেখে একটা বই নিয়ে বসে পড়লো বিছানায়।
সিয়াম নিরবে তার কার্যকলাপ দেখলো। সে জানতো চন্দ্রা রেগে আছে তার উপর। সিয়াম আর কিছু না বলে ফ্রেশ হয়ে নিলো।
চন্দ্রা পুরো মনোযোগ বইতে দেওয়ার চেষ্টা করতেই এক লোকমা ভাত তার সামনে দেখে মুখ তুলে তাকালো সিয়াম তার দিকে হাতটা বাড়িয়ে আছে।
চন্দ্রার এবার আরো রাগ লাগলো সারাদিন সে খেয়েছে কিনা খোঁজখবর না নিয়ে দিন শেষে দরদ দেখাতে এসেছে। খাবে না সে।
চন্দ্রা গম্ভীর গলায় বললো “আমি খাবো না আপনি খেয়ে নিন।”
সিয়াম এবার অপরাধী গলায় বললো ” সরি চন্দ্র। আজ সারাদিন ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম। নিজে দুপুরে খাওয়ার টুকু সময় পাইনি। আমি জানি রাতে তুমি আমায় ছাড়া খাও না এখন তুমি না খেলে আমি কীকরে খাই বলো..? তার থেকে থাক আমিও খাবো না।”

চন্দ্রার এবার মনটা ভীষন খারাপ হয়ে গেলো। মানুষটা সারাদিন না খেয়ে আছে..? আর এখন সে জেদ দেখাচ্ছে। রাগ অভিমানের উপর তার মানুষটার ভালো থাকা আগে।

সিয়াম প্লেট টা রাখতে গেলে চন্দ্রা বললো “দাঁড়ান! আমি খাবো, দিন খাইয়ে।”
সিয়াম মুচকি হাসলো সে জানতো চন্দ্রা তার না খাওয়ার কথা শুনলেই আর বারণ করবে না। তাই সে চন্দ্রাকে খাইয়ে দিতে দিতে নিজেও খেয়ে নিলো।

চন্দ্রা খেয়ে চুপচাপ অন্যপাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। সিয়াম বুঝলো তার চন্দ্রাবতীর এখনও তার উপর থেকে রাগ কমেনি।
সিয়াম এবার লাইট নিভিয়ে চন্দ্রাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে তার ঘাড়ে মুখ গুঁজলো। সারাদিনের ক্লান্তির পর এটাই তার পরম শান্তির জায়গা। এই মানুষটার কাছে যেনো তার সুখের চাবিকাঠি আছে, এই মানুষটার কাছে এলেই তার দুঃখ কষ্ট রাগ সব যেনো একমুহূর্তে উড়ে যায়। তখন শুধু ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়।

চন্দ্রাও সারাদিনের পর কাছের মানুষটার সান্নিধ্য পেয়ে নিজেকে একটু গুটিয়ে নিলো। সিয়ামের শরীর থেকে ভেসে আসা তীব্র পুরুষালী গন্ধটা তাকে আকৃষ্ট করছে।

চন্দ্রা ঝট করে সিয়ামের হাত সরিয়ে বেড সাইড ল্যাম জ্বেলে উঠে গেলো বিছানা থেকে। তার এখন গলে গেলে হবে না। নইলে সিয়াম এই একই কাজ বার বার করবে। তাকে একটু বোঝানো দরকার।
সিয়াম চন্দ্রার উঠে যাওয়া দেখে দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ল। আজ একটু বেশিই অপেক্ষা করিয়েছে মেয়েটাকে। অফিসের কাজ তো ছিলোই প্লাস বিরোধী পক্ষের সাথে আজ ঝামেলা লেগেছিল। সব ঠিকঠাক থাকলেও সিয়ামের সাথে হাতাহাতিতে সিয়ামের ফোনটা ভেঙেছে। তার হাতেও একটু লেগেছে। যদিও এর শাস্তি স্বরূপ সিয়াম এক একটাকে দায়িত্ব সহকারে হসপিটালে পাঠিয়ে এসেছে। কিন্তু সেসব কথা এই পাগল মেয়েকে বলা যাবে না। এক্ষুনি উত্তেজিত হয়ে পড়বে। তার মাথাতে আগে থেকেই অনেকটা ভার দিয়ে রেখেছে সিয়াম।

সিয়াম চোখ ঘুরিয়ে চন্দ্রাকে দেখলো। চন্দ্রা সোফায় পা তুলে বসে ফোন ঘাঁটছে। সিয়াম এবার দু হতে ভর দিয়ে উঠে গিয়ে সোফায় চন্দ্রার কোলে মাথা রেখে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল।
চন্দ্রা দু-একবার সরাবার চেষ্টা করেও যখন পারলো না তখন হাল ছেড়ে নিজের ফোন দেখার কাজে মন দিল।

কিছুক্ষন পর চন্দ্রার সাড়া শরীর শিরশিরিয়ে উঠলো। ঠান্ডা বরফের মতো জমে গেলো সে। সিয়াম চন্দ্রার শাড়ি হালকা সরিয়ে তার উন্মুক্ত উদরে মুখ ঘষছে। চন্দ্রার না চাইতেও তার হাত চলে গেলো সিয়ামের চুলের ভাঁজে।
সিয়াম ওভাবেই থেকে বললো ” এখনও রাগ করে থাকবে চন্দ্রাবতী..? বলছি তো আর হবেনা। এবার অন্তত ক্ষমা করো।”
চন্দ্রা বলতে পারলো না কিছু। সিয়ামের গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে তার উন্মুক্ত উদরে। হৃদস্পন্দনের গতি বেড়েই চলেছে।
সিয়াম এবার উঠে বসলো। চন্দ্রাকে সেই ঘোর মেশানো কণ্ঠে ডাকলো ” চন্দ্রাবতী..?” চন্দ্রা নিজের অজান্তেই সাড়া দিলো ” হুঁম ”
সিয়াম পুনরায় জিজ্ঞেস করলো “এখনও রাগ কমেনি..?”
চন্দ্রা উত্তর না দেওয়ায় সিয়াম চন্দ্রার দিকে কিছুটা ঝুঁকলো। চন্দ্রার চোখের কোনে জলের অস্তিত্ব পেয়ে সিয়াম উদ্বিগ্ন হয়ে এগিয়ে গিয়ে চন্দ্রার মুখ দুই হাতে তুলে বললো ” কি হয়েছে বউ..? কেনো কাঁদছো..? আমি বলছি তো আর হবে না। আচ্ছা ফাইন কি শাস্তি দেবে বলো আমি তাতেই রাজি। প্লিজ কান্না বন্ধ করো তোমার চোখের জল আমার সহ্য হয় না।”

চন্দ্রা গড়িয়ে পড়ার আগেই শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বললো ” কিচ্ছু করতে হবে না। তবে আপনি জানেন আজ আমি সারাদিন কি চিন্তায় ছিলাম..? প্রথমে তো ফোন তুলছিলেন না পড়ে করতেই দেখি সুইচ অফ। আমি যদি এইরকম কিছু করতাম আপনার কেমন লাগতো..?”

সিয়াম এবার বোধহয় অনুভব করলো তার কেমন লাগতো। এতক্ষণ সে শুধু অপরাধ বোধ থেকেই সরি বলছিলো। আসলেই চন্দ্রার জায়গায় সে হলে পাগল পাগল অবস্থা হতো তার। সিয়াম এবার চন্দ্রার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বললো ” আইম এক্সট্রিমলি সরি চন্দ্র। আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি তুমি এতটা চিন্তা করবে। আর কক্ষনও হবে না বিশ্বাস করো। এই শেষ।”

চন্দ্রা বললো ” ঠিক আছে বিশ্বাস করলাম কিন্তু। এইরকম ভুল যেনো দ্বিতীয় বার না হয়।”

সিয়াম হেসে বললো ” যথা আজ্ঞা মহারানী। তা বলছিলাম কি..!” বলেই সিয়াম কিছুটা চন্দ্রার দিকে এগোলো বিধায় চন্দ্রা কিছুটা নিজের মাথা পিছনে করে দুই ভ্রু নাচিয়ে বলল ” কি….?”

সিয়াম আরেকটু এগিয়ে কানের কাছে গিয়ে বলল “এতোক্ষণ তো রাগ অভিমান দেখালে এবার একটু আদর দিয়ে পুষিয়ে দাও।”

চন্দ্রা এবার ফিক করে হেসে দিল। দিয়ে হালকা করে সিয়ামের বাহুতে মারতেই সিয়াম ” আহহ ” করে উঠলো।
চন্দ্রা চমকে সিয়ামের হাত নিয়ে দেখলো বেশ খানিকটা কাটা। আগে কিছু ওষুধ দেওয়ায় রক্তটা এখন আর পড়ছে না।
চন্দ্রা চিন্তিত মুখ নিয়ে বললো ” এটা কি করে হলো..? আপনি আমায় আগে বলেননি তো..? ” বলেই হাতটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো।

সিয়াম এবার বললো “তেমন কিছুই হয়নি চন্দ্র। সামান্য লেগেছে অসাবধানতায়। ডাক্তার দেখেছে ওষুধও দিয়েছে দুদিনের মধ্যে সেরে যাবে।”

চন্দ্রার তাও বিশ্বাস হলো না। মনে হলো সিয়ামের থেকে তার বেশি লাগছে একটু। ওই চিন্তিত মুখ নিয়ে বললো “কোথায় আছে ওষুধ বলুন আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।” বলেই উঠতে গেলে সিয়াম টেনে বসিয়ে বললো ” শান্ত হও তো। আমার এখন ওই মেডিসিন না ভিটামিন ইউ মেডিসিন লাগবে বুঝলে।” বলেই চন্দ্রাকে কলে তুলে নিলো।

চন্দ্রা কিছু বলতে যাচ্ছিলো সিয়াম নিজের মতো করে তার মুখ বন্ধ করে দিলো। আস্তে আস্তে বেড সাইডের ল্যামটা নিভিয়ে পারি দিলো সুখের রাজ্যে।

#চলবে..?

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #বোনাস পর্ব

রাত ৩ টে।

ব্যালকনির কাছে হালকা হওয়ায় কাঁচের তৈরি ড্রিম ক্যাচারটা নড়ছে। বাইরে থেকে তাতে হালকা আলো পড়ায় দৃশ্যটা একপ্রকার অপূর্ব ঠেকছে চন্দ্রার কাছে। সে প্রিয় মানুষটার বুকে লেপ্টে একদৃষ্টিতে সেই দৃশ্য দেখছে।

সিয়াম চন্দ্রার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মাথায় ঠোঁট স্পর্শ করে বললো “ঘুমাবেনা..?”

চন্দ্রা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো “একটা সত্যি কথা বলবে সিয়াম..?”
সিয়াম খানিকটা অবাক হলো আজ হটাৎ চন্দ্রা তার নামের সাথে তুমি সম্মধন করছে। তাও সেসব কিছু না বলে বললো “এভাবে বলো না চন্দ্রাবতী। আমায় নিজেকে অপরাধী মনে হয় তোমার।”

চন্দ্রা বললো “তুমি আমায় আগে থেকে চিনতে সিয়াম..?”
সিয়াম চমকালো। আজ হটাৎ এমন প্রশ্ন করছে মেয়েটা।

সিয়ামকে চুপ থাকতে দেখে চন্দ্রা সিয়ামের চোখের দিকে তাকিয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করল “উত্তর দাও। চিনতে..?”

সিয়াম চোখ নামিয়ে শুধু মাথা উপর নীচ করলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো ” কিন্তু তুমি কীকরে জানলে..?কে বলেছে তোমায় ইন্দ্রা..?”

চন্দ্রা চমকে বললো “দিভাইও জানতো..? শুধু আমি জানি না..?”
সিয়াম চোখ বুঝলো। আবার ভুল করে সে বেফাঁস কথা বললো।
চন্দ্রা এবার সিয়ামের কাছ থেকে সরে যেতে চাইলো। সিয়াম দিলো না শক্ত করে চেপে ধরে থাকলো নিজের সাথে।
চন্দ্রা মলিন কণ্ঠে বললো “ছাড়ো সিয়াম ভালো লাগছে না আমার।”
সিয়াম এবার করুন চোখে তাকিয়ে বললো ” শুনবে না কি করে চিনতাম..?”
চন্দ্রা একই ভাবে বললো “নাহ্ ইচ্ছে নেই। তোমার মনে হয়নি নিশ্চই বলা প্রয়োজন তাই বলোনি।”

সিয়াম নিষ্প্রভ গলায় বললো ” এভাবে বলো না চন্দ্র। তোমায় জড়িত সব কিছুই আমার কাছে প্রয়োজনীয়। তবে হ্যাঁ লুকিয়ে গিয়েছিলাম কিছু কারণবশত।”

চন্দ্রা উত্তর দিলো ” ওইতো বলছি দরকার হয়নি তাই বলোনি। এখনও দরকার নেই। ছাড়ো আমায় ঘুম পাচ্ছে আমার।”

সিয়াম তাও ছাড়লো না উল্টে নিজের সাথে আরেকটু জড়িয়ে বললো ” না চন্দ্র আজ সব বলবো আমি তোমায় সব শুনতে হবে। আমার কাছ থেকে তোমায় দূরে করে দেয় এমন কিছু আমি আর লুকোতে চাই না। তাতে যা হবে হোক।”
চন্দ্রা উত্তর দিলো না।
সিয়াম এবার বলা শুরু করলো “তোমার মনে আছে চন্দ্র তুমি একবার পাহাড়ি অঞ্চলে বেড়াতে গিয়েছিলে তোমার দিদি আর বন্ধুদের সাথে তখন তুমি বেশ ছোটো ছিলে।”

চন্দ্রা কেঁপে উঠলো থর থর করে। সে মনে করতে চায়না সেই কালো রাত। সিয়াম বুঝতে পেরে চন্দ্রার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো “কাম ডাউন চন্দ্র। আমি আছি তো..?তোমার উপর কোনো কালো ছায়া পড়ার আগে তাকে আমার সম্মুখীন হতে হবে। ”

চন্দ্রা আগের থেকে একটু স্থির হলেও ভয়ে কুঁকড়ে রইলো। সিয়াম আবার বলা শুরু করলো “আমি তখন সদ্য বাবার বিজনেসে জয়েন করেছি। বাবা আমায় অনেকটা ছোটো থেকেই ব্যাবসার কাজে তার সাথে এদিক ওদিক নিয়ে যেতেন, যাতে ভবিষ্যতে আমি আরো দক্ষ হয়ে উঠতে পারি।
সেইবারও গিয়েছিলাম বাবার সাথে একটা পাহাড়ি অঞ্চলের কাছাকাছি। বেশ কিছুদিন থাকায় সেখানকার কিছু মানুষদের সাথে সামনের পাহাড় গুলো রোজ ঘুরে দেখতাম। প্রায় পাহাড়ের কিছু অংশও আমার বেশ চেনা হয়ে গিয়েছিল। একদিন বিকেলের দিকে সেখানকার এক বন্ধুর সাথে ডেয়ার নিয়ে পাহাড়ে গিয়েছিলাম প্ল্যান মাফিক আলো পড়ার আগেই আমার বাড়ি ফিরে আসার কথা ছিলো।
সেখানে অনেক ট্যুরিস্ট পার্টি ঘুরতে আসতো তাই সন্ধ্যে অবধি সেখানে কোনো ভয় ছিলো না। বেশ পুলিশও থাকতো। আমার ফেরার কথা আলো পরার আগে থাকলেও আমার বেশ দেরী হয় ফিরতে ততক্ষণে আলো কিছুটা পড়ে এসেছে দিনের।
হটাৎ ফেরার সময় দেখলাম একটা মেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে রাস্তার এক কোণে। আমি কিছুটা ভয় পেয়েছিলাম জীবিত না মৃত ভেবে। তারপর বুকে সাহস নিয়ে এগিয়ে গিয়ে মেয়েটির কাছে বসলাম মুখের কাছ থেকে চুলগুলো সরিয়ে শ্বাসের গতি চেক করলাম দেখলাম বেঁচে আছে শুধু অজ্ঞান হয়েছে। ডাকতে গিয়ে দেখলাম বেশ ভালো জ্বর গায়ে। আমি ভেবে পেলাম না কিকরা উচিৎ। ব্যাগ থেকে বোতল বেড় করে মুখে জল ছিটালাম বেশ খানিকক্ষণ পর মেয়েটা চোখ খুললো। আমি এবার পূর্ণ দৃষ্টি দিলাম মেয়েটার দিকে গোলগাল ফরসা মুখটায় মলিনতার চাপ ফুটে রয়েছে। মেয়েটা এককথায় বেশ মিষ্টি দেখতে ছিলো।
চোখ খুলতেই আমি তার নাম, আর এইসময় এখানে কেনো তা জিজ্ঞেস করলাম। মেয়েটি অস্পষ্ট ভাষায় উত্তর দিলো চন্দ্রা। আমি স্পষ্ট ভাবে শুনতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম “চন্দ্রাবতী..?” সে ঘাড় নেড়ে আবার অস্পষ্ট ভাষায় বললো “জ জ ল”
আমার বোতলের যতটুকু জল ছিলো সেটা সবটাই তার মুখে দিতে গিয়ে শেষ হয় গিয়েছিলো। আমি উঠে একটু দূরে আসলাম ওখানকার কিছু দোকান আমার চেনা ছিলো। তাই জানতাম কিছুটা দূরে গেলে জল আমি পেলেও পেতে পারি। পেয়েও গেলাম এক দোকানে দোকান বন্ধ থাকলেও সেখানে পানীয় জলের ব্যাবস্থা থাকে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো জল নিয়ে এসে। জল নিয়ে যেতেই কিছুটা দূরে থেকে দেখলাম কতক গুলো মানুষ মেয়েটিকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আমি চেয়েও এগোতে পারিনি। কারণ সেই সময় গায়ের শক্তি কোনো কাজে আসতো না আমার বুদ্ধি কাজে লাগাতে হতো।তারা বেশ অনেকজন ছিলো। আমি কিছুটা হলেও জানতাম তাদের সম্পর্কে, তারা সেখানকার পাহাড়ি কিছু মানুষ যাদের জন্য বিশেষ করে মানুষকে যেতে দেওয়া হয়না সন্ধ্যার পর সেখানে। তারা মেয়েটাকে আমার চোখের সামনে দিয়ে তুলে নিয়ে গেলো। আমি জানতাম মেয়েটার সাথে এবার কি হতে চলেছে। আমি ভয় পেয়েছিলাম কিছুটা কারণ আমি নিজেও তখন খানিকটা ছোটো ছিলাম তাও ওই মুহূর্তে মেয়েটাকে ফেলে পালিয়ে আসতে পারিনি আমি।আমি ফোন বার করলাম কিন্তু নেটওয়ার্কের জন্য একটাও ফোন লাগলো না। আমার ভিতর হটাৎ করেই কেমন দায়িত্ত্ব বোধ কাজ করছিলো। তারপর…”

তারপরের দৃশ্য চন্দ্রার মনে পড়তেই আবার কেঁপে উঠলো সে। সে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিল সবার সাথে এসে তখন তার কাছে ফোনও ছিলো না নিজের বিধায় কাউকে ফোনও করতে পারেনি। একটা মানুষের আবছা এক মানুষের অবয়ব দেখেছিল শুধু। তারপর কতকগুল লোক এসে তাকে তুলে নিয়ে গেলো। চন্দ্রার অবচেতন মন তখন সেই কিছুক্ষণ দেখা মানুষটিকে আসা করছিলো কেনো করছিলো সে নিজেও জানে না। চোখ দিয়ে শুধু একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছিল মনে হয়েছিল সেই রাতই তার জীবনের শেষ রাত।
তারা নিয়ে গিয়ে চন্দ্রাকে বেঁধে রেখেছিল। জল খাওয়াতে চন্দ্রা কিছুটা হুঁশে এসেছিল। চন্দ্রার সামনে তাকে মারার পরিকল্পনা হলে সে ভয়ে চিৎকার করেছিল। ফলস্বরূপ তাকে তাদের হাতের কড়া কটা চড় থাপ্পড় খেতে হয়েছিল। চন্দ্রার শরীর আগে থেকেই নিস্তেজ থাকায় আরো নুইয়ে পড়েছিল মেয়েটি। তারপর তারপর তার স্পষ্ট কিছুই মনে নেই একটু মানুষের অবয়ব ছাড়া। শুধু মনে আছে সকালে সে নিজেকে হোটেলে আবিষ্কার করেছিল। সেই রাতের বিশেষ কিছুই তার মনে ছিলো না সেই ঘটনার পর থেকেই চন্দ্রার মেন্টাল শকে ছিলো বেশ কিছুদিন তাই সবাই তাকে সেই রাতের কথা মনে করতে বারণ করতো। সেই ঘটনার পর থেকেই চন্দ্রা কেমন বদমেজাজি হয়ে গেছে। ছোটো ছোটো ব্যাপারে সিনক্রিয়েট করে ফেলে। সে আগে এমন ছিলো না। এসব ভাবতেই তার এসির মধ্যেও ঘাম ছুটে গেলো।
সিয়াম চন্দ্রার অবস্থা খারাপ দেখে বললো “আর শুনতে হবে না চন্দ্র এইটুকু যথেষ্ট আজকের জন্য বাকি আবার পরে শুনো।”
চন্দ্রা শুনলো না জোরাজুরি করলো সিয়ামকে বলার জন্য। সিয়াম খানিক বিরক্ত হয়ে বললো “তুমি বড্ড জেদি চন্দ্রাবতী।”
বলেই আবার বলা শুরু করলো সিয়াম ” ওই মানুষগুলোর কাছে গিয়ে দেখলাম তারা তোমায় বেঁধে রেখেছে আর সেখানে পাহারা দেওয়া। আমি অনেক্ষন ভাবলাম আমার ব্যাগে একটা দেশলাই ছিলো। আমি বেশ কিছু পাতা জোগাড় করে তাদের তাদের আগুন লাগলাম ঠিক তুমি যেই দিকটা চাইলে তার একদম উল্টো দিকে। তাতে তারা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমি ধীরে ধীরে গিয়ে তোমায় ছাড়িয়ে বোনের ভিতর টেনে এনে আড়াল হলাম। বিশ্বাস করবেনা চন্দ্র সেইদিন একটু উনিশ বিশ হলে দুজনেই প্রাণ হারাতাম। তারা সেখানে তোমায় না পেয়ে খুঁজতে থাকলো জঙ্গলে। আমি খুব সাবধানের সাথে তোমার মুখ চেপে ধরে বসে রইলাম। কারন তুমি কাঁদতে কাঁদতে হিচকী তুলে ফেলেছিলে। যতটা না ভয় পেতাম তার দ্বিগুণ ভয় পেলাম। খুব ভাগ্যবশত তারা খুঁজে পেলনা আমাদের। পাহাড়ি ভাষায় কিছু গালাগাল করে তারা ফিরে গেলো তাদের আস্তানায়। আমি যেমন তেমন করে সেই রাতটা সেখানে কাটিয়ে সকালে তোমায় কোলে তুলে নীচে এলাম। আমার গায়েও সেইসময় বেশি শক্তি ছিল না তাই অনেকটা সময় লাগলো আমার। এসে তোমার ব্যাগ ঘাটতেই একটা ছোট্ট ডায়েরি পেলাম। সেখানে তোমার পরিবারের বিভিন্ন জনের নাম্বার লেখা ছিল। আমি প্রথম নম্বর দেখে তোমার দিদিকে কল করলাম। তোমার দিভাই বন্ধুবান্ধবরা ছুটে এলো। আমিও পিয়াসকে ফোন করায় সেও ছুটে এলো আমার কাছে। তোমার দিভাই জানালো তারা অনেক খুঁজেছে তোমায় এদিক ওদিক। আর রাত বলে পুলিশ পাহাড়ে উঠতে দেয়নি। তোমার দিভাই কাঁদতে কাঁদতে তোমায় জড়িয়ে ধরে আমার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। তোমার বাড়ির ঠিকানা বললো কথায় কথায়। আমি তোমার দিকে একবার তাকিয়ে চলে এলাম নিজের বাড়ি। বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা ওইটুকু সময়ে কি অসম্ভব মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছিলাম আমি তোমার। তুমি বেশ বাচ্চা বাচ্চা দেখতে ছিলে যদিও এখনও আছো। তারপর বাড়ি এসে বুঝলাম তোমার ঐ অল্পসময়ের সান্নিধ্য আমার মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে গেছে। তোমায় খোঁজার জন্য আমি বেড়িয়ে পড়লাম আমার সাথে পিয়াসও ছিলো। তখন আমার নিজের এতো বেশি সোর্স ছিলো না যা করার নিজেরাই করতাম দুজনে। দুই বছর খুঁজেও তোমার কোনো খোঁজ পেলাম না। অথচ তুমি আমার সামনেই ছিলে। তোমার খোঁজ পেয়ে আমি বাবাকে জানালাম তিনি আমায় তোমার বাড়ির ঠিকানা নিয়ে যেতে বললেন। আমি নিজে গেলাম তোমার বাড়ি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে তোমার বাবার কাছে তারপর তোমার বাবা ইন্দ্রার কাছ থেকে শুনে সব রাজি হলেন কিন্তু সময় চাইলেন কারণ তুমি তখন সবে কলেজে উঠেছো। আমিও সময় দিলাম ইন্দ্রাকে কিছু বলতে বারণ করলাম কারণ সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম তোমায়। তারপর তো খবর এলো তোমার দিভাই ইন্দ্রা পালিয়ে গেলো একজনের হাত ধরে। তারপর আমার বাবা মায়ের সাথে যা ঘটলো।” বলেই সিয়াম থামলো।

চন্দ্রা সিয়ামের দিকে তাকাতেই সিয়াম আবার বললো “আমি তারপর আর চাইনি তোমায় আমার সাথে জড়াতে। তাই তোমার খোঁজ খবর নেওয়া বন্ধ করলাম। শুনলাম তুমি কারোর সাথে রিলেশনে গিয়েছো। শুনে বুকটা আমার খালি হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল অবশেষে আমি তোমায়ও হারিয়ে ফেললাম। পরে এটাও আমার কানে এসেছিল তোমার ব্রেকআপ হয়েছে।তাও আমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাইনি।”

চন্দ্রা চমকে উঠলো সিয়াম যদি জানে ছেলেটা সিরাজ ছিলো তাহলে..? তাকে ভুল বুঝবে..? এতদিন তো এইভয়ে সে সিয়ামকে সত্যিটা বলেনি। সে সত্যিটা বলতে গিয়েও গলায় আটকে ফেললো। এতো এতো জিনিস সে মাথার নিতে পারছে না। মাথাটা তার আবার সেই অসহ্য যন্ত্রণায় ঘিরে ধরলো।
চন্দ্রা দুই হাত দিয়ে মাথার চুল চেপে ধরলো। সিয়াম ঘাবড়ে গেল। এই কারণেই মেয়েটাকে সে কিছু বলতে চায়নি। সে জানতো মেয়েটা আবার উত্তেজিত হয়ে যাবে। সিয়াম পাশের ওয়ারড্রয়ার থেকে একটা ওষুধ বের করে চন্দ্রাকে খাইয়ে দিল। তাও চন্দ্রা শান্ত হচ্ছে না দেখে চন্দ্রাকে বিছানার সাথে চেপে ধরলো। তার উষ্ণ স্পর্শ গুলো আবার এঁকে দিতে লাগলো চন্দ্রার শরীরের ভাঁজে। চন্দ্রা না চাইতেও সিয়ামকে আগলে নিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেলো সে।

সিয়াম দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে এসিটা একটু বাড়িয়ে চন্দ্রাকে ভালো করে ব্ল্যানকেট দিয়ে ঢেকে তাকে জড়িয়ে ধরে নিজেও তলিয়ে গেল ঘুমে।

সিয়ামের নিজেরও যেন বেশ ভার মুক্ত লাগছে চন্দ্রাকে সব বলতে পারে।

#চলবে ..?

( রিচেক হয়নি।)

বেড়াজাল পর্ব-৩০

0

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #৩০
চোখ খুলে সিয়া নিজেকে একটা ফুলসজ্জিত ঘরে পেলো। নিজের আশপাশ চোখ ঘুরিয়ে দেখলো একটা বড়ো রুম। চারিদিক ফুল দিয়ে সাজানো। ঘরটা বেশ সুন্দর। সিয়ার চোখ গেলো ঘরের একপাশের দেওয়ালে সেখানে অপূর্বের বিভিন্ন রকম অ্যাওয়ার্ড রাখা। তার উপরে সেগুলো পাওয়ার বিভিন্ন ছবি। তার পাশে জায়গাটা ফাঁকা কিছুটা।

সিয়া উঠে সেদিকে গেলো। এরই মধ্যে দরজায় আওয়াজ হতেই সিয়া পিছন ফিরে দেখলো তার শাশুড়ি সায়মা বেগম হাসি মুখে খাওয়ারের প্লেট আর একহাতে একটা ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে।
তিনি ঘরে প্রবেশ করে ব্যাগটা বিছানায় রাখলেন। সিয়াকে দেখে বললেন “উঠেছো..?এসো খাবারটা খেয়ে নেবে, ওই বাড়িতে নিশ্চই ঠিক মতো খেতে পারোনি..?”
সিয়া ইতস্তত করে বললো ” না আন্টি ইটস ওকে।”
সায়মা বেগম বললেন ” তা বললে শুনছি না আমি। শুনেছি অপূর্বের কাছে তুমি কিছুই খাওনি সেই দুপুর থেকে। আচ্ছা আগে যাও ফ্রেশ হয়ে এই কাপড়টা পড়ে এসো। হাঁসফাঁস লাগছে নিশ্চই এই কাপড়ে..?”

সিয়া হালকা হেসে ওয়াসরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে একটা শাড়ি পরে এসে বিছানায় একধারে বসলো। সিয়া বিছানায় বসতেই সায়মা বেগম আসতে করে বললেন ” আমি খাইয়ে দি..?” সিয়া অবাক হলেও শুধু ঘাড় নাড়লো।
সায়মা বেগম হেসে ভাত মাখতে মাখতে বললেন “তুমিও সবার মত আমায় আম্মু ডেকো কেমন..?আর কোনোকিছুতে কোনোরকম অসুবিধা হলে সঙ্গে সঙ্গে আমায় জানাবে বুঝলে। নিজের মায়ের মতোই আপন ভেবো এই মা কেও।”

সিয়া মুখে খাবার টা নিয়ে আবার কেঁদে দিলো। তার মা আবার আপন..? মায়ের ভালবাসা কি সে কোনোদিন বোঝেই নি। এই প্রথম তাকে সিয়াম ছাড়া কেউ এতো যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছে।

সায়মা বেগম অস্থির হয়ে পড়লেন সিয়ার কান্না দেখে জিজ্ঞেস করলেন ” আরে আরে কাঁদছো কেনো..? ওই বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে বুঝি..? খাওয়ার সময় চোখের জল ফেলতে নেই বুঝলে এতে সংসারের অমঙ্গল হয়।”

সিয়া তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে নিলো। সায়মা বেগম আবার ভাত মাখতে মাখতে বললেন “আমার ছেলেটাকে একটু আগলে রেখো দেখবে সে তোমায় মাথায় তুলে রাখবে। আর যদি বকা দেয় তুমি এসে আমায় বলে দেবে আমি রোদে একপা তুলে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখবো।” শেষের কথাটা সায়মা বেগম বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন।
সিয়া সেটা শুনে ফিক করে হেসে দিল। শায়মা বেগমও হাসলেন। সিয়াকে খাইয়ে তিনি বিশ্রাম করতে বলে চলে গেলেন।
তিনি যাওযার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই অপূর্ব ঘরে ঢুকলো। তার এখন যেনো বুক টা ঢিপ ঢিপ করছে। কই এতো দিন এমনকি বিয়ের সময়ও তো করেনি তাহলে এখন কেনো..? সিয়া এখন একান্ত তার তাই..?এই মেয়েটাকে পারলে সে নিজের চোখের পলকে বসিয়ে রাখে। সামান্যতম কষ্টও যেনো অপূর্বের সহ্য হয় না। আজ বিদায়ের পর গাড়িতে যখন সিয়াকে তোলা হলো সে কাঁদতে কাঁদতে তার বুকেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। ওই প্রথম অপূর্ণ নিজে ডক্টর হয়েও চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। মন অশান্ত হয়ে গিয়েছিল। বার বার সিয়াকে ওঠানোর চেষ্টা করছিল। ওইসময়ে তার উপর দিয়ে কি গেছে সেটার সিকি ভাগও যদি সামনের মেয়েটা টের পেত তাহলে তাকে ছাড়া দ্বিতীয় কারোর কথা ভাবত না।
অপূর্বকে দেখে সিয়া একবার চোখ তুলে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। সেই চোখে নেই কোনো ভয়, লজ্জা যেমনটা আর পাঁচটা সদ্য বিবাহিতা বউদের থাকে।

অপূর্ব জানে সিয়ার সময় প্রয়োজন। কটা দিনে এতো গুলো বছরের স্মৃতি ভুলিয়ে দেওয়া মুখের কথা নয়। সে সময় দিতে রাজি কিন্তু সবশেষে মানুষটা যেনো তার কাছেই ফিরে আসে।

অপূর্ব গিয়ে বসলো সিয়ার এক পাশে। পকেটের ভিতর একটা বক্সের ভিতর থেকে আংটি বের করে সিয়ার হাত টা ধরতে গেলো। সিয়া ঝট করে হাতটা সরিয়ে নিলো।
অপূর্ব বেশ কষ্ট পেলেও নিজেকে সামলে একটু হেসে সিয়ার হাতটা পুনরায় টেনে ধরে আংটিটা পরিয়ে দিল।

সিয়া আংটিটা নিয়ে নাড়াচাড়া করল। অপূর্ব সেদিকে দেখে ধীরে ধীরে সিয়ার দিকে এগোলো। সিয়া চোখ তুলে অপূর্বকে এতো সামনে দেখে ভয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো। তার বাঁধা দেওয়া সাজে না। অপূর্ব তার স্বামী তারও কিছু ইচ্ছে অনিচ্ছে আছে। আর বিয়েটা তো সে সিয়ার প্রস্তাবেই করেছে।

হটাৎ মাথায় সুড়সুড়ি লাগতে সিয়া চোখ খুললো। দেখলো অপূর্ব তার মাথা থেকে ফুলের পাপড়ি গুলো ঝেড়ে দিচ্ছে। সিয়া হাঁপ ছাড়লো। অপূর্ব আসতে আসতে বিছানার সব ফুল জড়ো করে একধারে করে হাসি মুখে সিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো “আর অসুবিধা হবে না এবার আরামে শুয়ে পরো।”

সিয়া ইতস্তত করে শুয়ে পড়লো বিছানায়। কিছুক্ষণ পর ডিম লাইট জেলে অপূর্বও শুয়ে পড়লো।
কিছুক্ষণ পর সিয়া নিজের হাতের উপর আরেকটা হাতের স্পর্শ পেলো। সে কেঁপে উঠলো, হাতটা হালকা মোচড়ামুচড়ি করলো। অপূর্ব সিয়াকে টেনে হালকা নিজের দিকে নিয়ে এলো। সিয়ার ধুকপুকানি যেনো অপূর্ব বাইরে থেকে শুনতে পাচ্ছে। অপূর্ব এবার হেসে বললো “টেক ইয়োর টাইম সিয়া। আমি কোনকিছুতেই তোমায় জোর করবো না। কিন্তু শুধু এই হাত টুকু ধরে রাখার অনুমতি দাও।”
সিয়া কিছু বললনা তবে হাতটা আর নাড়ালো না। অপূর্ব সম্মতি পেয়ে আনমনে হেসে চোখ বুঝলো।

এখন তার বিশ্বাস হচ্ছে তার বউ সিয়া, তার সাথে একঘরে এক বিছানায় আছে। এবার আর সে কথাও যেতে পারবে না, অপূর্ব যেতে দেবে না।

_________________________________

পাখির কিচিরমিচিরে ঘুম ভাঙলো চন্দ্রার। হালকা নড়চড় করে উঠতেই দেখলো নড়তে পারছে না। সিয়াম এখনও তাকে জাপটে ধরে আছে।
চন্দ্রা হালকা হেসে সিয়ামের থেকে নিজেকে ছাড়াতে গেলে সিয়াম বিরক্ত হয়ে আরো জড়িয়ে নিলো তাকে। চন্দ্রা পড়লো এবার মহা ঝামেলায় এই লোকটার থেকে ছাড়া পাওয়া এখন ভীষণ মুশকিল। প্রত্যেক সকালে মানুষটা এইরকম করে। সে এখন কি বলবে এটাও চন্দ্রার মুখস্থ হয়ে গেছে। একটু নড়াচড়া করলেই বলবে আজ আর তোমায় কাজে যেতে হবে না আমিও অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নি চলো। তারপর চন্দ্রা একবার উঠিয়ে দিতেই অফিস যাওযার জন্যে তাড়াহুড়ো করবে।

চন্দ্রা এবার ঘড়ির দিকে তাকালো। আজ তাকে সিনথিয়ার সাথে আবার দেখা করতে হবে। বিয়ের চক্করে সে দুইদিন দেখা করবে করবে করেও করা হয়নি। আজ যে করেই হোক তাকে সময় মতো পৌঁছতেই হবে। চন্দ্রা এবার সিয়ামকে হালকা ধাক্কা মারে বললো “এই যে শুনছেন..? কটা বাজে দেখুন। নয় নিজে উঠুন নয় আমায় ছাড়ুন।” বলেই চন্দ্রা ওঠার জন্য নড়াচড়া করতে লাগলো। এইরকম বলিষ্ঠ একজন মানুষকে সরানো নেহাতই তার পক্ষে বেশ কষ্টকর তারপর শরীরে তার ব্যাথা করছে।
সিয়াম ছারলো না ঘুমের ঘরেই চন্দ্রার ঘাড়ে নাক ঘষতে ঘষতে বললো “আজ আর তোমায় কাজে যেতে হবে না বুঝলে আমিও অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নি চলো।” চন্দ্রা শ্বাস ছাড়লো সে এই কথাটারই অপেক্ষা করছিল।

চন্দ্রা এবার জোড়াজুড়ি করতে সিয়াম বিরক্ত হয়ে বললো “সবার চিন্তা মাথায় নিয়ে মাথা গরম করে ফেলো। এর একফোঁটাও যদি আমার ভালোলাগার চিন্তা করতে এইরকম জোড়াজুড়ি করতে না।”
চন্দ্রা হাঁপ ছাড়লো সিয়াম এরম ইমোশনাল অনেক কিছুই রোজ বলে। কিন্তু তার সমস্যাটা হচ্ছে সে সব জেনেও এই কথার পিঠে কোনো কথা খুঁজে পায় না। অগত্যা চুপচাপ কিছুক্ষণ থাকতেই হয় তার কাছে।
চন্দ্রা এবার সিয়ামের চুলগুলো তার আঙুল দিয়ে আঁচড়াতে আঁচড়াতে বললো “আজ না সিয়াম, আজ সত্যিই অনেক কাজ। সিনথিয়ার কাছে সময় মতো পৌঁছোতে হবে। সামনেই ওর জন্মদিন আসছে। সেই দিনটাকেই কাজে লাগাতে হবে আমায়।”
সিয়াম এবার পুরোপুরি চোখ খুললো। চন্দ্রার কানের পাশে চুমু খেয়ে বললো “যাই করো সাবধানে। তোমার ক্ষতি করে আমি এই সম্পত্তির কানাকড়িও চাই না। তাতে সম্পত্তি হাত ছাড়া হবে হোক। তোমায় ফাইলটা আনার কথা বলা কারন সেখানে মনির আরো কুকীর্তির প্রমাণ আছে। ”

চন্দ্রা এবার বললো “আপনি চিন্তা করবেন না আমি নিজেকে সামলাতে পারি। আর বিষয় টা সম্পত্তি পাওয়ার নয়। সেটা আমার শশুর শাশুড়ীর রক্ত জল করা পরিশ্রমের ফল। আমি সেটা কিছুতেই ভুল মানুষদের হাতে তুলে দিতে পারি না। এই বাড়ির বউ হিসেবে আমারও কিছু দায়িত্ত্ব আছে।”

সিয়াম অপলক তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা মাঝে মাঝে বাচ্চামি করে বসে কিছু কিছু যায়গায়। আবার কিছু যায়গায় বড়দের থেকেও বুদ্ধিমানের কাজ করে ফেলে।
সিয়াম কিছু বললো না চন্দ্রার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ডোবালো।
.
.
ব্রেকফাস্ট টেবিলটা আজ ভোরে আছে। মেহমানরা সবাই সকালের নাস্তা করেই বেড়িয়ে যাবে। তারপর বাড়িটা আবার শূন্যতায় ডুবে যাবে। এখন তো সিয়াও থাকবেনা। চন্দ্রার এসব ভাবনার মাঝেই সিরাজ এসে বসলো টেবিলে। চন্দ্রা মুখ ফিরিয়ে সেরভেন্টের হতে খাবার ধরিয়ে দিল। সিরাজ দেখেও কিছু বললো না। সবাই টেবিল ছাড়তে সিয়াম সিরাজকে জিজ্ঞেস করলো “সিরাজ কাল কি তুই আমার চেক বুক থেকে টাকা নিয়েছিস..?”
সিরাজ এবার একটু থেমে বললো “হ্যাঁ ভাইয়া একটু দরকার ছিলো কাল। তুমি আমার স্যালারি থেকে কেটে নিও। আমি এখন রোজ অফিস যাব।”
কথা গুলো চন্দ্রার কর্নগচোর হতেই তার রাগে ঘৃণায় গা রি রি করে উঠলো।
সিয়াম হেসে বললো “তার দরকার নেই। তুই শুধু মন দিয়ে কাজ কর।”
সিরাজ শুধু ঘাড় নাড়ালো।

সিয়াম বেরোনোর সময় চন্দ্রাকে অন্যমনস্ক দেখে হাতের উপর হাত রাখলো। চন্দ্রা চমকে সে দিকে তাকালে সিয়াম বললো “রিলাক্স আমি।”
চন্দ্রা হাসি মুখ করে বললো “বেরোবেন না সময় তো হয়ে এলো।”
তারপর হাতের মাঝে কিছু অনুভব করে তুলে দেখলো একটা ওষুধের পাতা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সিয়ামের দিকে তাকালে সে চন্দ্রার এক হাত টেনে হাতের পিঠে চুমু খেয়ে বললো “পেইনকিলার খাবার শেষে খেয়ে নিও।”
চন্দ্রা হাসলো মানুষটাকি একটু বেশি খেয়াল তাখে তার..?

__________________________________

চন্দ্রা দাঁড়িয়ে আছে রোডের পাশে। আজ রোদটা একটু বেশিই তেজ দিচ্ছে।এখন বেলা গড়িয়ে দুপুরে থেকে কিছুক্ষণ পরই বিকেল হবে, কিন্তু তাপ কমার নামই নেই।

সে বারবার তার সালোয়ার কামিজের ওরনা দিয়ে ঘাম মুছছে। সে খবর পেয়েছে সিনথিয়া এই সময় কলেজ থেকে বাড়ি ফেরে এই রাস্তায়। চন্দ্রার এদিকে কোনো কাজ ছিলো না সে শুধু সিনথিয়ার জন্যই এসেছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সে দেখলো সিনথিয়া গাড়ি নিয়ে এদিকেই আসছে। আজ তার সাথে ড্রাইভার নেই। চন্দ্রা তাকে দেখে গাড়ি খোঁজার ভান করলো।
কয়েক সেকেন্ড পরই সিনথিয়া গাড়ির কাঁচ নামিয়ে চন্দ্রাকে ডাকলো ” হেই আপু..?তুমি এখানে..?”

চন্দ্রা হালকা হেসে বললো “আসলে কাজে এসেছিলাম কিন্তু দেখো না কোনো গাড়ি পাচ্ছি না বাড়ি যাওযার।” বলেই এদিক ওদিক তাকালো।

সিনথিয়া এবার খুশি হয়ে বললো “আরে আপু তুমি আমার গাড়িতে উঠে এসো আমি পৌঁছে দিচ্ছি।”

চন্দ্রা বললো “না না তোমার অসুবিধা হবে সিনথিয়া।”

সিনথিয়া এবার গাড়ির ডোর লক খুলতে খুলতে বললো “সাহায্য করতে আবার কিসের অসুবিধা। আগের দিন তুমি আমার হেল্প করলে সেই হিসেবে কি আমি তোমায় আজ হেল্প করতে পারি না..? তুমি না আগের দিন আমায় তোমার বোনের মতো বললে..?”

চন্দ্রা মিষ্টি করে হেসে বললো “আচ্ছা আচ্ছা তাই চলো।”
বলে গাড়ির ভিতর বসে পড়লো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই চন্দ্রা বেশ বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেললো সিনথিয়ার সাথে। তার নিজেরও বেশ ভালো লাগছে।
সিনথিয়া চন্দ্রাকে নামানোর সময় তার ফোন নম্বর নিল। চন্দ্রা ভেবেছিল সিনথিয়া তাকে তার বার্থডে তে ইনভাইট করবে কিন্তু সেরাম কিছুই বলেনি সে। এতে চন্দ্রা চিন্তিত এই দিন না হলে অন্যদিন বের করতে হবে তাকে।

চন্দ্রা গাড়ি থেকে নেমে সিনথিয়াকে টাটা বলে বাস স্ট্যান্ডের কাছে গেলো বাড়ি ফেরার বাস ধরতে।

#চলবে..?

বেড়াজাল পর্ব-২৯

0

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #২৯

সিরাজ নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে ছুঁড়ে মারলো সামনের মেয়েটিকে।
সামনের মেয়েটি পরে যেতে নিলেও নিজেকে সামলে ঘুরে দাঁড়ালো। মুখে তার আময়ীক হাসি। অত্যাধিক সুন্দরী না হলেও আধুনিকতায় সেটি চাপা পড়ে গেছে। পড়নে হালকা সিফন শাড়ি আর স্লীভলেস ব্লাউজ। শাড়িটা একদম বুকের মাঝ দিয়ে নিয়ে একপাশে ফেলে রাখা। মেয়েটি সেটি হাত দিয়ে একবার ঠিক করে সিরাজের দিকে এগিয়ে এলো।

সিরাজ রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। পারছে না সামনের মেয়েটিকে দুটো কষিয়ে থাপ্পড় দিতে। সিরাজ দাঁতে দাঁত চেপে বললো “কি চাস কি তুই..?আর তোকে এখানে কে ডেকেছে..?”

মেয়েটি হেলেদুলে বললো “আমি তোমার প্রাণের বোনের কলিগ সুইটহার্ট।”
সিরাজ চোখমুখ কুঁচকে বললো “মেহমানদের মতো এসেছিস দাওয়াত খাবি চলে যাবি। আর লিসেন আমি আর আমার জীবনের পুরোনো নোংড়া আবর্জনা ঘেঁটে সুন্দর জীবনটাকে দুর্গন্ধে ভোরাতে চাই না।”

মেয়েটা আলতো হাসলো। নিরসন্দেহে মেয়েটার হাসি চমৎকার। হেসে এগিয়ে এসে সিরাজের কপাল থেকে চিবুক অবধি নিজের তর্জনী আঙুল স্লাইড করে বললো “কি ব্যাপার ডার্লিং..?এক সময় তো রাতে আমার সাথেই মজে থাকতে। এখন আমাকে দেখেই নোংরা মনে হচ্ছে..? তোমরা পুরুষরা পরও বটে রং বদলাতে।” বলেই হাসতে হাসতে আরেকটু কাছে এগোলো।

সিরাজ তাকে ধাক্কা মারে সরিয়ে দিয়ে বলে “তুই নিজের ইচ্ছেতে আসতিস আমার কাছে পয়সার জন্য।”

মেয়েটি এবার একহাতের নখের দিকে তাকিয়ে আফসোসের সুরে বলে ” তা আসতাম বটে। আমার আবার পয়সার খিদেটা একটু বেশিই। তবে তোমায় কি কম ভালবাসতাম বলো তাই দেখো এখনও এসেছি তোমার কাছে।”
সিরাজ আবার বাঁজখাই গলায় বললো “কি চাস সাফসাফ বল, নয়তো এক্ষুনি সবার সামনে দিয়ে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে আমার দুই মিনিট লাগবে না।”

মেয়েটা এবার একটু সিরিয়াস হলো। স্ট্রেট চুল গুলো বাম হাত দিয়ে পিছনে ঠেলে বললো “দেখো আমি কিছু চাই না তেমন। শুধু কটা টাকা চাই। বেশি না এই পাঁচ লাখ মতো।”

সিরাজ ক্ষিপ্ত মেজাজ বললো “তোর সাথে সব লেনদেন সেইসময়ই চুকে গেছে। এখন কোন মুখ নিয়ে টাকা চাইতে এসেছিস..?আমি এক টাকাও তোকে দেবো না যা করার করে নে।”
মেয়েটা শয়তানি হেসে বললো ” যা করার করবো তো..? এটা দেখায় পর ভেবে চিন্তে বলো কিন্তু।”
বলেই ফোন ঘেঁটে কয়েকটা তার সাথে সিরাজের ঘনিষ্ট ছবি সিরাজের সামনে ধরলো।

সিরাজ রেগে ফোনটা কেরে নিতে গেলে মেয়েটা হাত সরিয়ে দিলো। এবার একটু জোরেই হেসে বললো “কাম ডাউন ডার্লিং আমার কাছে আরো কপিস্ আছে।”
তারপর আরেকটু এগিয়ে এসে সিরাজের কানের কাছে বললো “খবর পেলাম তুমি নাকি প্রেমে পড়েছ..? মেয়েটি তো দেখলাম বেশ সুন্দরী। বেশ ভালো মাল পটিয়েছ। তা তাকে পাঠাবো নাকি তোমার এইসব কুকীর্তির ছবি..? সইতে পারবে তো সে..?”

সিরাজ এবার মেয়েটার গলা চেপে ধরলো। মেয়েটি ছাড়াতে চেয়েও পারলো না চোখ উল্টে এলো তার। সিরাজ যে এতো হিংস্র হয়ে যাবে সে ভাবেনি। সিরাজ দাঁতে দাঁত চেপে বললো “খবরদার যদি এইরকম কোনো কাজ করার কথা তুই কল্পনাতেও ভাবিস জ্যান্ত পুঁতে দেবো তোকে।” বলেই ধাক্কা মেরে মেয়েটিকে সরিয়ে দিলো।

মেয়েটি দূরে গিয়ে গলায় হাত দিয়ে কাশতে লাগলো। সিরাজ বললো “তোর টাকা চাই তো..? আগে আমার সামনে এই প্রত্যেকটা ফোটো ডিলিট কর। আমি এক্ষুনি দিয়ে দিচ্ছি তোকে টাকা।”

মেয়েটি আর কথা না বাড়িয়ে ফোন থেকে আর বাকি ফোন করে তার ল্যাপটপ থেকে সব পিক ডিলিট করে দিলো।
সিরাজ আসতে করে সিয়ামের ঘরে গিয়ে চেকবুকটা নিয়ে এলো। সিয়াম সিরাজ বা সিয়ার দরকারের জন্য সে চেকবুক টা রেখেছিল সেটায় চেক লিখে মেয়েটির হাতে ধরিয়ে দিলো। তার নিজের কাছে এখন এতগুলো টাকা নেই।

মেয়েটিকে সাবধান করে দিয়ে বললো “এর পর তোর এই অভিশপ্ত মুখ যেনো আমি এই এলাকার আসে পাশে না দেখি। নয়তো আই সোয়ার সেখানে দেখবো সেখানেই পুঁতে রেখে দেবো।

মেয়েটি শুধু অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।

সিরাজ নিজের মাথার চুল টেনে বসে পড়লো তার বিছানায়।

________________________________

সিয়াম বিদায়ের শেষে খাওয়ার দাওয়ার পর আবার গেলো সেই কুঠুরিতে। এবার আর তাকে ধমকি ধামকি দিতে হলো না লোকটি নিজে থেকেই বলতে শুরু করলো “আমি কিছু জানি না স্যার সত্যি। আমাকে রাফি আর সুইটি বেগম বলেছিলেন যাতে চন্দ্রার এইরকম অ্যাক্সিডেন্ট করাই। অনেক দিন ধরেই চেষ্টায় ছিলাম কিন্তু কোনোনা কোনো ভাবে হয়ে উঠছিল না। সেই দিন সুযোগ পেয়েছিলাম তাই…” বলার শেষ হতে দিলো না সিয়াম অতিরিক্ত রাগে আঘাত করে বসলো লোকটির মাথায়।
দ্বিতীয় বার আঘাত করার আগে পিয়াস আটকালো টেনে নিয়ে এলো তাকে।

পিয়াস একধারে সিয়ামকে টেনে নিয়ে এসে বললো “ওকে মারিস না আর। ওর শাস্তি ও পেয়েছে বাকিটা পুলিশকে দেখতে দে। তুই রাঘব বোয়াল গুলোকে ধরতে নাম এবার। আর রাফি তোর হাতের এতো মার খেয়ে জেলে গিয়েও শোধরালো না ওকে আমি দেখে নেবো। তুই ওইদিকটা চিন্তা করিস না। ”

সিয়াম আর কথা বাড়ালো না। লোকটিকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে বলে বেরিয়ে এলো কুঠুরি থেকে। সিয়াম জানে পুলিশের কাছে সে মুখ খুলবে না সুইটি বেগমের নামে, আর খুললেও সুইটি বেগম টা টাকা দিয়ে চুপ করিয়ে দেবেন। সিয়াম এখন চায় না পুলিশের কিছুতে জড়াতে। সে আগে সব কটা প্রমাণ হাতে পাক তারপর লাস্ট চালটা সে চালবে।

সিয়াম আগের দিনের গার্ডেনের কাছে জায়গা টায় এলো যেখানে তারা সবাই মিলে একসাথে আড্ডা দিয়েছিল।
এখন তার মনটা ভীষণ ভার হয়ে আছে।
সিয়া শুধু তার বোন ছিল না মাও ছিলো তার। তার খুঁটিনাটি খেয়াল রাখতো চন্দ্রা আসার আগে অবধি। সিয়ার বিদায়ের সময় বুক ফেটে কান্না আসলেও সে কাঁদতে পারেনি সবার সামনে। সে সবার বড়ো তাই সে তখন কাঁদলে সবাই ভেঙে পড়তো আরও। কিন্তু এখন সে কিছুতেই চোখের জল আটকাতে পারলো না। চোখের কোন দিয়ে গড়িয়ে পড়লো জল। এই কষ্টটা শব্দে ব্যাখ্যা করতে পারবে না।

_____________________________

সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হতে সব মেহমানরা জোর করলো ইন্দ্রাকে আজকের রাতটা থেকে যেতে। তাদের সাথে এতক্ষণে বেশ সাক্ষাত গড়ে উঠেছে তার। ঐদিকে বাবা ফোন দিয়ে বলছে আজকের রাতটা চাইলে যেনো থেকে যাই। বিয়ে বাড়ীতে অনেক কাজ থাকে চন্দ্রা একা হাতে হিমশিম খাবে। ইন্দ্রা চুপ করে ঘড়ির দিকে তাকালো সে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছে সে আজ রাতে থাকবে কি না..?
চন্দ্রাকে দেখতে পেয়ে ইন্দ্রা দৌড়ে গেলো তার কাছে। চন্দ্রা যেনো অন্যমনস্ক হয়ে জলের বোতল গুলো রাখছিলো।
ইন্দ্রা গিয়ে ডাকতে তার হুশ ফিরলো। ইন্দ্রা বললো “আজ কি রাতে আমি এখানে থাকবো…? মানে তোর যদি কোনো সাহায্য লাগে তাই আর কি…”

চন্দ্রার সব রাগ এবার পড়লো ইন্দ্রার উপর সে স্থান কাল ভুলে চেঁচিয়ে উঠলো “কেনো থাকবি..? এটা কি তোর শশুরবাড়ি নাকি যে তোকে সব দায়ভার নিতে হবে..?আমি একা সব করতে পারবো। আর বাবাকে একা ছেড়ে এখানে পড়ে থাকবি বলছিস কীকরে তুই, তোর বিবেকে বাঁধছেনা..?আমার সংসার আমি ঠিক কোননা কোনোভাবে সামলে নেবো তুই কি সারাজীবন এভাবে এসে সাহায্য করবি নাকি..?”

ইন্দ্রা হতভম্ভ। চন্দ্রা আর সিয়ার শরীর খারাপের জন্যই তো সে এখানে এতকটা দিন ছিলো। তারপর তার বাবা বাইরে গেলেই চন্দ্রা ফোন করে বার বার ডাকতো এখানে এসে থাকার জন্য। আর আজ তার সেই বোন কিনা তাকে এইভাবে কথা শোনালো।

ইন্দ্রার চোখে জল এলো। আলতো স্বরে বললো “সরি আমি আসলে তোদের একটু বেশিই আপন ভেবে ফেলেছিলাম। আমার লিমিটটা বোঝা উচিত ছিলো। আ আমি এক্ষুনি ওবাড়ি ফিরে যাচ্ছি।” বলেই ইন্দ্রা রুম থেকে নিজের ব্যাগ এনে দৌড়ে বেড়িয়ে গেলো বাড়ির দরজা দিয়ে।

এতক্ষণ পিয়াস সব দাঁড়িয়ে দেখলেও কিছু বলেনি তার অধিকার নেই বলার। চন্দ্রা পিয়াসের দিকে তাকাতে পিয়াস হকচকিয়ে গেল।

চন্দ্রা গম্ভীর গলায় বললো “ভাইয়া আপনি একটু ওর পিছনে যাবেন মানে এতো রাত..”
পিয়াস তাড়াতাড়ি করে বললো “হ্যাঁ ভাবী আমি দেখছি তুমি চিন্তা কোরো না।” বলেই পিয়াসও বেরিয়ে গেলো।
.
.
সিরাজ ব্যালকনিতে একটা সিগারেট নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হিসেব মেলাচ্ছিল তার জীবনের। হঠাৎই ইন্দ্রাকে চোখ মুছতে মুছতে ব্যাগ নিয়ে বাইরের দিকে যেতে দেখে সিরাজ হকচকিয়ে গেলো। এতো রাতে কি বাড়ি ফিরে যাচ্ছে মেয়েটা..? তাও কাঁদতে কাঁদতে হটাৎ এমন কি হলো..?
সিরাজের বুকের ভিতরটা চিনচিন করে উঠলো সূক্ষ্ম ব্যাথায়। মা বোনের পর এই প্রথম বোধহয় কোনো নারীর জন্য এই অনুভুতির সৃষ্টি হলো। পিয়াস কেও যেতে দেখলো ইন্দ্রার পিছনে।
সিরাজ আর না ভেবে হাতের সিগারেট ফেলে পিয়াসকে ফোন করে কি হয়েছে জানতে চাইলো। পিয়াস শুধু বললো চন্দ্রা আর ইন্দ্রার কথা কাটাকাটি হয়েছে। সিরাজ অবাক হলেও পিয়াসকে বললো “তুমি একটু ওয়েট করো আমি ছেড়ে আসতে যাচ্ছি ওকে। আমার একটা প্রয়োজনীয় জিনিস ওর কাছে রয়েছে ।”
পিয়াস সম্মতি জানালো। সিরাজ দেরি না করে দৌড়ে গেলো।

______________________________________

চন্দ্রা ওই ঘটনার পর রুমে চলে এলো। তার এবার হাঁসফাঁস লাগছে। রাগের মাথায় একটু বেশিই বলে ফেলেছে সে। কিন্তু কি করবে সে এইরকম একটা অসুস্থ সম্পর্কে তার দিদিকে জড়াতে দিতে পারে না সে। সে ঠিক করলো কাল অথবা পরশুর মধ্যে গিয়েই তার দিভাইকে সব সত্যি খুলে বলবে। তারপর বাকি সিদ্ধান্ত দিদির।

চন্দ্রা নিজের মনকে বুঝিয়ে শান্ত করে ঘড়ির দিকে তাকালো। রাত একটা বেজে দশ। চন্দ্রা দরজার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করলো লোকটা গেলো কোথায় এতো রাত হয়ে গেলো এখনও এলো না..?
বলেই বিছানা ঝেড়ে নিলো। ভাবলো এর দশ মিনিট ওয়েট করে সিয়ামকে বাইরে খুঁজতে যাবে।
এরই মধ্যে সিয়াম প্রবেশ করলো ঘরে। চন্দ্রা তাকিয়ে দেখলো সিয়ামের চোখ নাক লাল হয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে এতোক্ষণ কাঁদছিল। চন্দ্রার খারাপ লাগলো সে জানে সিয়া সিয়ামের জন্য কি ছিল।

সিয়াম হটাৎ করে চোখ তুলে বললো “তুমি ঘুমাওনি এখনও..? এতো রাত হয়ে গেলো।” বলেই হুইচেয়ার থেকে উঠে ঘড়ি খুলে রাখলো আয়নার সামনে। তার মনটা এখনও ভার হয়ে আছে। কিন্তু এখন আর চোখের জল ফেললে চলবে না। এবার আগের মত শক্ত হতে হবে তাকে। তার উপর নির্ভর করে তার ভাই বোনের দায়িত্ব ব্যাবসা তার এতো নরম হলে চলে না।

চন্দ্রা সিয়ামের দিকে একদষ্টিতে তাকিয়ে বললো “কষ্ট হচ্ছে সিয়ার জন্য..? চিন্তা করবেন না অপূর্ব ভাইয়া আপনার মতোই সুখে রাখার চেষ্টা করবে তাকে।”

সিয়াম কিছু বললো না শুধু ঘুরে তাকালো চন্দ্রার দিকে। চন্দ্রা সিয়ামের ওই রক্তবর্ণ চোখ দেখে দুই হাত বাড়িয়ে দিল। যেমন করে মা দেয় তাদের বাচ্চাদের কলে আসার জন্য।

সিয়াম এক দৌড়ে এসে চন্দ্রকে ঝাপটে ধরলো। এতক্ষণের আটকে রাখা কান্নার বাঁধ ভাঙলো। তার চোখের জল ভিজিয়ে দিলো চন্দ্রার কাঁধ।
চন্দ্রাও নিবিড় আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে থাকলো সিয়ামকে। সিয়ামের কান্না থামলেও কিছুক্ষণ পরে রইলো ওভাবে। তারপর নিজেকে ছাড়িয়ে চন্দ্রার চোখে চোখ রেখে বললো “আজ তোমাতে মিশে বিলীন হতে হতে চাইলে কি তুমি বাঁধা দেবে..?”
চন্দ্রা উত্তর দিলো না। একটা মেয়ে হয়ে তারপক্ষে এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর মুখে দেওয়া সম্ভব নয়। তার শ্বাসের গতি বাড়লো লজ্জায়।
সিয়াম তাকিয়ে রইলো সেই মুখপানে। এই মুখটা দেখে সে জীবনের বেঁচে থাকার শক্তি পায়। মনে হয় তারও কেউ আছে তার অতিআপন সুখ দুঃখের সঙ্গী।

চন্দ্রা উত্তর দিলো না কোনো, জড়িয়ে ধরলো সিয়ামকে। সিয়াম মুচকি হাসলো। সে তার সম্মতি পেয়ে গেছে। মিলিত হলো দুটি অধর। সিয়াম আরেকটু কাছে টেনে আরো নিবিড় ভাবে মিশিয়ে নিলো চন্দ্রাকে তার সাথে। হাতের বিচরণ হলো অবাধ্য। শ্বাসের গতি বেড়ে চললো দুজনেরই। সিয়াম ধীরে বেড সাইডের লাইট অফ করে দিলো। দুজনেই আজ প্রবেশ করলো নতুন সুখের রাজ্যে।

_______________________________________

সিরাজ যতক্ষণে গাড়ি নিয়ে বেরোলো ততক্ষণে ইন্দ্রা রাস্তায় নেমে পড়েছে কাঁদতে কাঁদতে। সিরাজ গাড়ি নিয়ে তার পাশে গিয়ে বললো ” ইন্দ্রা গাড়িতে উঠে এসো। আমি পৌঁছে দিচ্ছি বাড়ি।”

ইন্দ্রা এক হাত দিয়ে চোখের জল মুছে বললো “দরকার নেই আপনাদের কোনো কিছুর আমার। আপনি সারাক্ষণ কেনো আমার পিছনে পরে থাকেন বলুন তো.??

সিরাজ আসতে করে ইন্দ্রার চোখের দিকে শীতল দৃষ্টি দিয়ে বললো “সত্যি বোঝো না কেনো পরে থাকি..?

ইন্দ্রা উত্তর দিলো না। তার মন হয়তো কোথাও জানে এর উত্তর। তাই চুপ করে থাকলো।

পাশ দিয়ে ছেলেদের একটা বাইক ক্রস করলো। সিরাজ সে দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ইন্দ্রার দিকে তাকিয়ে বললো “রাস্তাটা ভালো নয় ইন্দ্রা জেদ কোরো না উঠে এসো গাড়িতে।”

ইন্দ্রা ছাড়লো না সে তার কথায় অটল বললো “সামনেই বাস স্ট্যান্ড আমি ওখান থেকে বাস ধরে নেব। আপনি ফিরে যান।”

সিরাজের এবার রাগ উঠলো। গলার স্বর কঠিন করে বললো “তুমি নিজে উঠবে নাকি কলে করে তুলতে হবে..? আমি মরে গেলেও এই ফাঁকা রাস্তায় তোমায় একা ছাড়বো না। তাই জোর করতে বাধ্য করো না আমায়।”

ইন্দ্রা উপায় না পেয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। দাম করে গাড়ির দরজা লাগলো। তার একপ্রকার রাগের বহিঃপ্রকাশ। সিরাজ দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
ইন্দ্রার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে গাড়ির পিছনে রাখলো।

কিছুক্ষন নিরবতায় কাটার পর ইন্দ্রা মুখ খুললো “কেনো করছেন এইরকম..?আমাদের সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যত নেই।”
সিরাজ স্বাভাবিক গলায় বললো “তুমি চাইলেই এই সম্পর্কের একটা সুন্দর ভবিষ্যত তৈরি করতে পারি আমরা। অতীত আমাদের হাতে না থাকলেও ভবিষ্যত আমাদের হাতে থাকে।”

ইন্দ্রা আবার বললো “কিন্তু সমাজ..? আপনার বাড়ির লোক..? তারা কি বলবে..?”

সিরাজ গাড়ির ব্রেক কষলো আসতে করে। ইন্দ্রা শিটবেল্ট পড়ে নেই এটা তার খেয়ালে আছে।
সে ইন্দ্রার চোখে চোখ রেখে বললো “আমি সমাজের পরোয়া করি না ইন্দ্রা। তাই তারা কি বললো না বললো সে নিয়ে আমার কোনোকালেই কোনো মাথব্যথা ছিলো না। আর আমার বাড়ির লোককে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। শুধু তুমি রাজি হলেই আমি সব সামলে নেবো। বলো তুমি রাজি আমায় নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করতে..?”

ইন্দ্রা ভেবে পেলো না কি বলবে। তার পক্ষে দ্বিতীয় বার অন্য কারোর সাথে সংসার সাজানো বেশ কঠিন। মানুষকে ভরসা করাটা তার কাছে আরোও কঠিন।
সে শুধু বললো “বাবার কাছে প্রস্তাব রাখুন। সে চাইলে আমার কোনো আপত্তি নেই।”

সিরাজের মনে হাজার রঙ বেরঙের প্রজাপতি ডানা মেললেও তা মুখে প্রকাশ করলো না। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চললো তার হবু শ্বশুরবাড়ির রাস্তায়।

#চলবে..?

বেড়াজাল পর্ব-২৮ + বোনাস পর্ব

0

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #২৮

শুক্রবারের সকাল। শুক্রবারটা এমনিই সবার মেজাজ বেশ ফুরফুরে থাকে। সিয়াম সিরাজ সিয়া কেউই কাজে বেরোয় না। সবাই ঘরে থাকায় দুপুরে নয় ভালোমন্দ খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হয় আর নয়তো মাঝে মাঝে কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে সবাই মিলে খেয়ে আসা হয়।

কিন্তু আজকের শুক্রবারটা বিশেষ দিন সবার কাছে। কারন আজ বাড়ির ছোটো মেয়ে সিয়ার বিয়ে। সকাল থেকেই চন্দ্রা কাজে লেগে পড়েছে। সিয়াম সিরাজ ও ভোররাত থেকে উঠে সব দেখাশোনা আয়োজন করতে ব্যস্ত। আজ ইন্দ্রা নেই এই বাড়িতে।
কাল যখন সবাই শপিংগে যায় সিয়ার জন্য জামাকাপড় কিনতে তখন ইন্দ্রার ফোনে ফোন আসে নয়ন সাহেবের শরীরটা খারাপ করেছে আবার। ইন্দ্রা তাই সেখান থেকেই তার বাড়ি চলে গিয়েছে। চন্দ্রাও যেতে চেয়েছিল কিন্তু ইন্দ্রা যেতে দেয়নি। বাড়িতে এখন সে ছাড়া কেউ নেই সব দেখভাল করার মতো সেও যদি চলে যায় বিয়ে টা যা তা ভাবে একটা দিতে হবে। যদিও ইন্দ্রা ঘরে গিয়ে জানিয়েছে বাবার তেমন কিছু হয়নি প্রেশার বেড়ে গিয়েছিলো শুধু।
সে এও বলেছে নয়ন সাহেব আজ সুস্থ থাকলে সে সিয়ার বিয়ের আগেই চলে আসবে। কিন্তু থাকতে পারবে না। চন্দ্রা তাতেই সম্মতি জানিয়েছে। সে নিজেও ক্যারাটে স্কুল থেকে প্রায় দিন গিয়ে বাবাকে দেখে আসে।

সিয়াম সকাল সকাল পিয়াসকেও ডেকে নিয়েছে। পিয়াসও এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে সব আয়োজন করছে। বিয়েটা ঘরোয়া ভাবে হলেও সিয়ার কিছু ফ্রেন্ডস সিয়াম সিরাজ সবার ক্লোজ কিছু ফ্রেন্ড আর আসে পাশের কয়েকটা মেহমানকে বলা হয়েছে।
সিয়াম চায় বিয়েটা ঘরোয়া ভাবে হলেও একটু পরিপাটি সুন্দর বিয়েবাড়ির মতো সাজানো গোছানো থাক। এই দিনটা সবার জীবনে একবারই আসে, পরেও বিবাহবার্ষিকী বা বড়ো করে অনুষ্ঠান পালন করা হলেও আজকের দিনের মতো ভয়,জড়তা, ভালোলাগা মেশানো দিনটাআর ফিরে পাওয়া যায় না। আর সিয়ার দুই বড়ো ভাই থাকতে তারা কোনোমতেই তাদের বোনের বিয়ের এই দিনটা এইরকম সাদামাটা হতে দেবে না।

বিয়ে বেলার দিকে। তার আগেই চন্দ্রাদের সব কাজ শেষ করতে হবে। আজ তো ইন্দ্রাও নেই তাই আরো হিমশিম খাচ্ছে সে। অলরেডি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে হাত কেটে ফেলেছে সে ছুঁড়িতে। তারপর নিজেই চুপচাপ রুমে গিয়ে ফার্স্টএইড বক্স খুলে একটা ওয়ান টাইম ব্যান্ডেড লাগিয়ে আবার কাজ করা শুরু করেছে। সিয়াম এখন জানতে পড়লেই তাকে কড়া কটা কথা শোনাবে তার এই অসাবধানতার জন্য। তাই সে যতটা পারছে সিয়ামের থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করছে। লোকটার সব দিকে নজর চন্দ্রা একবার সামনে পড়লেই সিয়াম ধরে ফেলবে তাকে।

চন্দ্রা সব ঠিকঠাক করে নিজে গেলো রেডি হতে। কারন এরপর সিয়াকে রেডি করতে হবে, বাকি মেহমানরা চলে সে আর সময় পাবে না।
চন্দ্রার রুমে ঢোকার আগেই ইন্দ্রার ফোন এলো। চন্দ্রা সেখানে দাঁড়িয়েই ফোন রিসিভ করে বললো “কোথায় তুই..? কখন আসবি..? আর বাবার শরীর কেমন আছে এখন..? আর গাড়ির আওয়াজ আসছে যে তুই কি বাইরে আছিস..?”
ইন্দ্রা ওপাশ থেকে বললো “হ্যাঁ বাইরে আছি। সকালে হসপিটালে এসেছিলাম ভেবেছিলাম তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে রেডি হয়ে তোর বাড়ি যাবো। কিন্তু এখানেই কতো বেজে গেলো দেখ। আর বাবা এখন ঠিক আছে তুই চিন্তা করিস না।”
চন্দ্রা বললো “তাহলে আর বাড়ি যাস না দিভাই মালতি বুয়াকে ফোন করে দে। আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি একেবারে এখানে চলে আয়। এখন বাড়ি গিয়ে এখানে আসতে গেলে অনেকটা সময় যাবে। তুই এখানে এসে রেডি হয়ে নিস।”

এরপর ইন্দ্রা কি বললো গাড়ির আওয়াজে চন্দ্রা ঠিক তা শুনতে পেলো না। ফোন রেখে আসে পাশে দেখতে লাগলো কাউকে পাঠানোর জন্য। ড্রাইভার নেই আজ সে গেছে আরেক জায়গায় মেহমানদের নিয়ে আসতে।
তাই চন্দ্রা কাউকে না পেয়ে সিয়ামকে দেখতে পেয়ে বললো “শুনছেন দিভাই এ.আই হসপিটালের কাছে আছে আপনি কাউকে বলুননা যেনো গাড়িটা নিয়ে গিয়ে দিভাইকে নিয়ে আসে।”

সিয়াম বললো “আচ্ছা আমি বলে দিচ্ছি। কিন্তু তুমি এখনও রেডি হওনি কেনো..? যাও তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।”
চন্দ্রা যেতে যেতে বলল ” হ্যাঁ আমি যাচ্ছি। আর আপনার জামাকাপড়ও বের করে রাখছি আপনি তাড়াতাড়ি আসুন।” বলেই চন্দ্রা রেডি হতে চলে গেল।

সিয়াম পিয়াসকে ডেকে বললো একটু গিয়ে ইন্দ্রাকে নিয়ে আসতে। পিয়াস মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো।

পিয়াস গেটের কাছে আসতেই ফোনে একটা কল এলো। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশের কথা শুনে মুখটা শক্ত হয়ে এলো তার শুধু বললো “কোনের স্টোর রুমে নিয়ে যা আমি না যাওয়া অবধি মুখও বেঁধে রাখে।” বলেই ফোন রেখে দিল। সে আগে থেকেই এই বাড়ির আনাচ-কানাচ চেনে।
কিন্তু এখন সমস্যা হলো সে কোন দিকে যাবে..?

লোকটাকে ওখানে বেশিক্ষণ রাখাও যাবে না। আজ বাড়িতে মেহমান আসবে ভুল করেও যদি কেউ টের পায় তো সর্বনাশ। তাই এখন সেখানে যাওয়াটা বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। কিন্তু সিয়াম যখন বলেছে এই কাজটাও ইম্পর্ট্যান্ট। সে এবার কি করবে..? আসে পাশে তাকিয়ে দেখলো সিরাজ কিছু লাইট নিয়ে একটা লোকের সাথে কথা বলতে বলতে গেটের দিকে আসছে।
পিয়াস আর উপয় না পেয়ে সিরাজকে ডাকল।

সিরাজ লোকটাকে কি একটা বলেই পিয়াসের কাছে যেতেই পিয়াস বললো ” সিরাজ একটা আর্জেন্ট কাজ পরে গেছে এখন আমার। একজনকে আনতে যেতে বললো সিয়াম এখন আমি যেতে পারবোনা তুই কি গিয়ে একটু নিয়ে আসতে পারবি..?”

সিরাজ ভ্রু কুঁচকে এদিক ওদিক তাকিয়ে কপালের একপাশে বুড়ো আঙুল ঘষে বললো ” এখন..? এখন কীকরে হবে..?অন্যকেউ নেই..? আমি অন্যকাউকে বলে দেখছি দাঁড়াও।”

পিয়াস অস্থির হয়ে বললো ” আরে না না থাক। আসলে চন্দ্রার বড়ো আপুকে আনতে হতো তাই জন্যেই আমায় বলেছে সিয়াম। থাক অন্যকাউকে বলতে হবে না আমি দেখছি যদি ম্যানেজ করা যায়।”
ইন্দ্রার কথা শুনতেই সিরাজের কুঁচকানো ভ্রূ এবার সোজা হলো। পিয়াসকে আটকে আমতা আমতা করে বললো “আমায় দাও পিয়াস ভাই আমিই যাচ্ছি। এদিকটা অন্যকাউকে বলছি দেখতে।”

পিয়াস অবাক হলেও কিছু বললো না। এখন কিছু বললে যদি এবার যেতে না চায়। তাই কিছু না বলেই সিরাজকে ঠিকানা আর হাতে চাবি দিয়ে পিয়াস নিজের কাজে চলে যায়।
.
.
চন্দ্রা স্নান সেরে সিয়াকে দেখতে গিয়েছিলো। তাকে সাজাতে এসেছে পার্লার থেকে।
সিয়া জোর করে ধরে চন্দ্রাকেও মেকাপ করিয়েছে তাদের কাছে ইন্দ্রা এলে তাকেও সাজাবে বলে ঠিক করে রেখেছে। তার দাবী সে একা এতো সাজবে এটা তার ভালো লাগছে না। চন্দ্রাও আর নাকচ করেনি বেশি, এমনিতেই তার হাতটা কাটা তারউপর মেয়েটা আজকেই চলে যাবে, তারপরে আর কেউ এই ছোটো ছোটো আবদার গুলো করবে না তার কাছে। হুট হাট করে এসে ভাবী বলে জড়িয়েও ধরবে না কেউ। ভাবতেই চন্দ্রার মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেলো।
সে এই বাড়িতে আসার পর সিয়া তাকে খুব একটা পছন্দ করত না এটা সে জানে, কিন্তু আসতে আসতে সিয়াই হয়ে উঠেছিল তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। দুজনে অনেক সময় বেড়িয়ে পড়ত একসাথে এদিক ওদিক ঘুরতে। আজ মেয়েটা চলে যাবে ভাবতেই চন্দ্রার আর ভালো লাগলো না সিয়ার ঘরটাকে থাকতে।
সিয়াকে রেডি হতে বলে সে চলে এলো নিজের রুমে। তার এখনও শাড়ি পরা বাকি। ঘরে এসে দেখলো সিয়াম এখনও আসেনি তাই দেরি না করে ঝটপট চন্দ্রা শাড়িটা পড়ে নিতে লাগলো। সব ঠিকঠাক মতো আসতে আসতে করলেও মুশকিল হলো শাড়ির কুঁচি করার সময়। সে হাতে এবার একটুও জোর দিতে পারছে না। হাতে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ তিনটে লাগানো এক এক করে সে সযত্নে নিজের দায়িত্বে ভুলভাল কাজ করতে গিয়ে কেটেছে এগুলো। সর্বক্ষণ হাত শাড়ি দিয়ে ঢেকে সিয়ামের কাছ দিয়ে লুকিয়ে রেখেছে।

অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পরও চন্দ্রার পক্ষে যখন সম্ভব হলো না তখন বিরক্ত হয়ে চন্দ্রা ছেড়ে দিল শাড়ির কুঁচি।
ওমনি একটা হাত এসে ধরে নিলো সেটা সযত্নে। ধীরে ধীরে সাজাতে থাকলো একটার পর একটা কুঁচি।

চন্দ্রা অবাক হয়ে সিয়ামের দিকে তাকাতেই সিয়াম বললো ” হাতে কি আর জায়গা আছে কাটার মতো তাহলে বলো আমি সেখানটা কাটতে সাহায্য করছি।”

চন্দ্রার মুখটা চুপসে গেল। শেষমেশ সে ব্যার্থ হলো তার হাতটা লুকোতে, তার ভেবেই তো রাগ লাগছে নিজের উপর।
চন্দ্রার চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে সিয়াম শাড়িটা ঠিক করে চন্দ্রাকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে নিজে পিছনে দাঁড়ালো।
চন্দ্রার মুখটা হালকা করে তুলে বললো মুখটা কানের কাছে নিয়ে বললো “আজ বোধহয় আমার চন্দ্রাবতীকে দেখে চাঁদও লজ্জায় মুখ লুকোবে মেঘের আড়ালে।”

চন্দ্রার সব রাগ এবার বাষ্পের মতো উড়ে গেলো। লজ্জায় মুখটা নামিয়ে নিলো এবার সে।

সিয়াম তা দেখে আরেকটু জড়িয়ে বললো ” উফ চন্দ্র এভাবে লজ্জা পেয়ে আমার আর হৃদস্পন্দন বাড়িও না। এমনিই মন চাইছে এক্ষুণি আদর করে সব সাজ নষ্ট করে দিই। এরপর কন্ট্রোললেস হয়ে পড়লে আমায় দোষ দিতে পারবেনা কিন্তু আমি আগের থেকেই বলে রাখলাম।” বলেই নাক ঘষলো চন্দ্রার কানের কিছুটা নীচে।

চন্দ্রার এবার লজ্জায় গাল কান সব লাল হয়ে উঠলো। না আর বেশিক্ষণ থাকা যাবে না এখানে এই লোকটা যখন যা খুশি করতে পারে। তখন আর চন্দ্রা সত্যিই আটকাতে পারবে না।
চন্দ্রা এবার নিজেকে ছাড়াতে চাইলেই সিয়াম আরেকটু টেনে বললো “আরেকটু থাকো প্লিজ..?”

চন্দ্রা কোথায় কান না দিয়ে নিজেকে ছাড়তে ছাড়াতে বললো ” এখন না জনাব। মেহমান এলো বলে আপনি যান তাড়াতাড়ি রেডি হন।” বলেই মুচকি হেসে দৌড় লাগালো দরজার দিকে।
সিয়াম চোখ ছোটো ছোটো করে বললো “এর শোধ আমি রাতে তুলবো। দেখবো আজ কীকরে বাঁধা দাও।”
চন্দ্রা আর দাঁড়ালো না এই লোকটার কথায় এবার সে মাটি ফাঁক করে নীচে ঢুকে যাবে লজ্জায় গাল কান গুলো এমনিই গরম হয়ে গেছে সেটা সে টের পাচ্ছে অলরেডি।

চন্দ্রা রুম থেকে বেরোতেই সিয়াম হালকা হাসলো। এই দিনগুলোর একসময় সে স্বপ্ন দেখতো। কখনো পূরণ হবে তা সে কল্পনাও করেনি। সে ধরেই নিয়েছিল তার জীবন থেকে বাবা মায়ের মতো সে তার চন্দ্রাবতীকেও বুঝি হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু ভাগ্য তাকে এইবার খালি হাতে ফেরায়নি। এর জন্য সে উপরওয়ালার কাছে সর্বদা চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।

এসব ভাবনার তার ফোন বেজে উঠলো। সিয়াম ফোন হাতে নিয়ে দেখলো পিয়াসের ফোন। তুলে বল বলতেই, পিয়াস কিছু একটা বললো। যাতে সিয়ামের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। শুধু বললো ” রাখ আমি পাঁচ মিনিটে আসছি।”

#চলবে..?

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #বোনাস পর্ব

সিরাজ হসপিটালের সামনে এসে চারিদিক দেখলো। পিয়াস তো তাকে এই জায়গাটাই বললো তাহলে ইন্দ্রা কই গেলো..? তার দেরি হচ্ছে দেখে নিজেই চলে গেলো না তো..? সিরাজ একবার ইন্দ্রার ফোনে ফোন করলো। নাহ্ ফোন তো সুইচ অফ বলছে। সিরাজের এবার টেনশন হতে লাগলো গাড়ি ঘোরাবার আগে কি মনে করে একবার গাড়ি থেকে নেমে এদিক ওদিক দেখতে লাগলো।

দেখতে দেখতে কিছুটা আগে এগোতেই সিরাজের পা থেমে গেলো। পিছন থেকে দেখে মানুষটাকে ইন্দ্রার মতো লাগছে কিন্তু সে এইরকম রাস্তার ধারে বসে আছে কেন..? শুধু কি গাড়ি আসার অপেক্ষায়..?
সিরাজ দৌড়ে গেলো ইন্দ্রার কাছে। পিছন থেকেই ডাকলো ” ইন্দ্রা..?”
ইন্দ্রা পিছন ঘুরে সিরাজকে দেখে কেমন ইতস্তত করলো। সিরাজ ভালো ভাবে লক্ষ করলো ইন্দ্রা পায়ের আঙুলটা চেপে ধরে আছে। সিরাজ চিন্তিত মুখ নিয়ে বললো “পায়ে কি হয়েছে ইন্দ্রা..? এভাবে এখানে বসে আছো কেনো..?”

ইন্দ্রা মুখটা কাচুমাচু করলো, যেনো বলতে বলতে চাইলো না কারণটা। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে আসতে করে বললো “পায়ে পা জড়িয়ে পড়ে গেছি। পায়ের আঙুলে তাই লেগেছে একটু।”

সিরাজ চেঁচিয়ে বললো “হোয়াট..?এই শুকনো ফাঁকা রাস্তায় তুমি কিনা এমনি এমনি পায়ে পা জড়িয়ে পড়ে গেলে..? লাইক সিরিয়াসলি..? বলেই সিরাজ হাসতে শুরু করলো।
হাসি বাড়তেই থাকলো, হাসতে হাসতে সেও ইন্দ্রার পাশে বসে পড়লো রাস্তায়। তাও তার হাসি থামছে না।
ইন্দ্রা গাল ফুলিয়ে চোখ মুখ শক্ত করে সিরাজের দিকে তাকালো।
ইন্দ্রার এইরকম গাল ফোলানো দেখে সিরাজ হাসতে হাসতেই ইন্দ্রার গাল দুটো ধরে টিপে দিলো। দিয়েই সিরাজের হুশ পড়লো সে কি করেছে। ইন্দ্রারও ততক্ষণে বিস্ময়ে একহাত গালে পৌঁছেছে, চোখ সিরাজের দিকে স্থির।
সিরাজ এবার হাসি থামিয়ে আমতা আমতা করে বলল “চলো চলো এখন তাড়াতাড়ি না পৌঁছালে বিয়ে আর দেখতে পারবো না। এই বাচ্চাদের নিয়ে বাইরে বেরোনো মহা ঝামেলা শুধু এদিক ওদিক পড়ে যায়।” বলেই এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে হাত ঝাড়তে লাগলো।

ইন্দ্রা ফুঁসে ওঠে বললো ” আমি বাচ্চা..? গুণে গুণে দুই বছরের বড়ো আমি আপনার থেকে। ওকে..?”

সিরাজ গা ছাড়া ভাব দেখিয়ে বললো “বয়সে বড়ো হলেই যে বুদ্ধি বেশি হবে এমন তো কথা নেই। এই তোমাকেই দেখো না। আমিও প্রথমে ভেবেছিলাম তুমি অনেক বড়ো কিন্তু তোমার থেকে তো সাত বছরের বাচ্চাও সাবধানে চলাফেরা করে।” বলেই সিরাজ আবার হাসতে লাগলো।

ইন্দ্রা আর নিতে পারলো না। সে মানছে সে একটু বেখেয়ালি তাই বলে এভাবে বলবে তাকে..? আসে পাশে তাকিয়ে দেখলো হাতের কাছে কয়েকটা ছোটো ছোটো নুড়ি পেলো তাই তুলে মারলো সিরাজের দিকে।

সিরাজের গায়ে দুটো নুড়ি পাথর লাগতেই সিরাজ হাসি থামিয়ে বললো ” আরে আরে করছো টা কি..? বাচ্চাদের মতো নুড়ি পাথর ছুঁড়ছো কেনো..?”

ইন্দ্রা আরো দুটো নুড়ি ছুঁড়ে বললো “আগে আমায় বাচ্চা বলা বন্ধ করুণ তবে আমিও নুড়ি ছোঁড়া বন্ধ করবো।”

সিরাজ দুই হাত তুলে বললো ” আচ্ছা আচ্ছা আর বলবনা। কিন্তু এবার তো ওঠো এখানেই বসে থাকবে নাকি..?”

ইন্দ্রা উঠতে যেতেই পায়ে টান পড়লো মুচকে গাছে বোধহয়। সিরাজ এবার ধরলো না আর। ইন্দ্রা এবার রেগে তাকিয়ে বললো ” দেখতে পারছেন না আমি এখানে স্ট্রাগেল করছি..? মানবতার খাতিরেও তো মানুষ সাহায্যের হাত টা বাড়ায় নাকি..? শুধু খালি পিছনে লাগতে পারে…” এসব বিড়বিড় করে বলতে বলতে নিজে উঠে দাঁড়িয়ে এক পা এগোতে আবার পায়ে টান পড়লো ফলে পা টা হালকা বেঁকে গেলো। সিরাজ এবার হুট করেই ইন্দ্রার একটা হাত আর পিছন থেকে তাকে ধরলো। দিয়ে আসতে আসতে তাকে হাঁটিয়ে গাড়ির কাছে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল।
গাড়ি ঘুরিয়ে সিরাজ সিট বেল্ট লাগতে লাগাতে বললো “এখান থেকে ফার্মেসিতে গিয়ে আগে পায়ে ব্যান্ডেজ করবে , তারপর ঘরে যাবো। বাচ্চাদের মতো না না করবে না পায়ের অবস্থা বেশ খারাপ।”

ইন্দ্রা না বলবে ভেবেছিল কিন্তু সিরাজের কথা শুনে কথা পাল্টে বললো ” আপনি আবার আমায় বাচ্চা বললেন..? আমি যাবোনা আপনার গাড়িতে আমি নেমে যাচ্ছি।”

সিরাজ এবার ভড়কে গেলো সে ভাবেনি ইন্দ্রা এইরকম জেদ করবে। সে ইন্দ্রার দিকে তাকিয়ে বললো ” আচ্ছা আচ্ছা সরি বাবা আর বলবনা।”
ইন্দ্রা চোখ পাকিয়ে তাকাতেই সিরাজ আবার বললো “বলবনা বলছি তো তিন সত্যি। এবার তো বিশ্বাস করো।”
ইন্দ্রা এবার কিছু না বলে চুপচাপ জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকলো।
সিরাজ হাঁপ ছেড়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বিড়বিড় করতে লাগলো ” পাগলকে পাগল বললেই খেঁপে যায়।”

__________________________________

বরযাত্রী আসতে বেশ অনেকটাই বেলা হয়েছে। তাদের বাড়ি থেকেও বেশ কিছু মেহমান এসেছে। চন্দ্রা ইন্দ্রাকে সিয়ার কাছে রেখে নিজে নীচে এসে সব মেহমানদের দেখশোনা করছিলো। সুইটি বেগম ঘরের দরজা আটকে বসে আছেন প্রতিদিনের মতো। চন্দ্রা একবার ডাকতে গিয়েছিলো তাকে। তিনি বলেছেন শুধু বিয়ে পড়ানোর সময় তাকে যেনো ডাকা হয় । চন্দ্রা তাই আর তাকে ডাকেনি সব নিজের হাতেই করছে।

____________________________________

অন্ধকার কুটুরির মতো ঘরটায় দরজা খোলার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ হলো। আসতে আসতে দৃশ্যমান হলো একটি মানব গায়ে গাঢ় নীল শেরওয়ানি জড়ানো। চোখ মুখ ভীষণ কঠিন তাতে হিংস্রতা প্রকাশ পারছে। তাতেও যেনো কোথাও সৌন্দর্যতা ফুটে উঠছে।

একটা পকেটে হাত ঢুকিয়ে অন্য হাতে চাকুটা ঘোরাতে ঘোরাতে সামনে চেয়ারে বেঁধে রাখা লোকটির দিকে এগুলো চেয়ারের একপাশে হাত রেখে লোকটির দিকে একটু ঝুঁকে বললো “যা যা জিজ্ঞেস করবো সত্যি করে বলবি। নয়তো আজই শেষ রাত তোর জীবনে।” বলেই লোকটির মুখ থেকে খুলে দিলো কাপড়টা।

লোকটি হাঁপাতে লাগলো তাও থামলনা বললো ” আমি কিছু জানি না বিশ্বাস করুন। আমি সত্যিই কিছু জানি না। ওটা জাস্ট একটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিলো ব্যাস। আআআআহহহহহ” বলতে বলতেই লোকটি হাতের দিকে তাকালো ঝড় ঝড় করে রক্তের বন্যা বইছে সেখান থেকে।

ভারী কন্ঠে আবার আওয়াজ এলো ” আগেই বলেছিলাম মিথ্যে বলবি না আমার সামনে। এর পরের কোপটা গলায় পড়বে।”
লোকটা ভয় পেলেও সেই একই কথা বলতে থাকলো সে কিছু জানে না। ছুঁড়িটার ধার গলায় একটু টের পেতেই কেউ চেঁচিয়ে উঠলো ” সিয়াম দাঁড়া।”

সিয়াম পিছন ফিরে দেখলো পিয়াস দাঁড়িয়ে। সিয়াম বিরক্ত হয়ে বলল ” কি..?”
পিয়াস বললো তাড়াতাড়ি চল বরযাত্রী এসে গেছে তোকে ভাবী এক্ষুনি ডাকলো।
সিয়াম চাকুটা লোকটার গলা থেকে নামিয়ে বললো “তোকে আমি এসে দেখছি। তোর ওই হাত আগে বাদ দেবো আমি। ওই হাত বড্ডো লম্বা তোর নইলে কি আর সিয়ামের চন্দ্রাবতীর দিকে হাত বাড়াস..?” বলেই আরেক হতে চাকু দিয়ে কোপ দিলো। লোকটা আবার চিৎকার করতেই সিয়াম পিয়াসকে ইশারা করলো। পিয়াস এসে লোকটার মুখে কাপড় বেঁধে দিলো।

সিয়াম এবার বললো “একে দিয়ে দিয়ে কিছু হবে না এর মেয়েকে তুলে নিয়ে আসার ব্যাবস্থা কর পিয়াস।”

পিয়াস ঘাড় নাড়ালো। সিয়ামের এইরূপকে সে বেশ ভয় পায়। একরূপে সে যেমন নরম, মিষ্টিভাষী, ওপর রূপে তেমনি হিংস্র, কঠিন। পিয়াস জানে এই পরিবর্তন আনতে বাধ্য করেছে বাইরের মানুষ তাকে। বাবা মা মারা যাওয়ায় পর যখন সে পারিবারিক ব্যাবসায় জয়েন করলো তখন থেকেই তার উপর মাঝে মাঝেই হামলা হতো। অনেক কোট কাছারি করেও যখন কোনো লাভ হলো না। সিয়াম তখন ঘুরে প্রহার করা শিখল। শক্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়ালো প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। এখন তাকে আর কোর্টে যেতে হয় না। সে নিজেই নিজের দোষীদের সাজা দেয়। তবে বড়োকোনো অপরাধ না করলে সিয়াম কখনই কারোর প্রাণ নেয়না। আর না তাদের পরিবারের মানুষদের জোরায় তাদের কোনো বিষয়ে।

এবারে লোকটির গলায় চাকু আর তার মেয়েকে তুলে আনার কথা শুনে বেশ অবাকই হলো পিয়াস। সিয়াম তো এইরকম কোনোদিন করে না তাহলে আজ কেনো..?

পিয়াস দরজা বন্ধ করে ছুটে গেলো সিয়ামের পিছনে। সিয়াম গিয়ে হুইচেয়ারে বসতেই পিয়াস সেটা পিছন থেকে ধরে নিয়ে যেতে যেতে বললো “তুই হটাৎ লোকটাকে প্রাণে মেরে ফেলতে গেলি..?আর আর তার মেয়ে কে নিয়ে আসতে বলছিস যে..? সত্যি লোক পাঠাবো..?”

সিয়াম মুখ কঠিন করেই বললো ” না। লোকটাকে আমি শুনিয়ে বললাম শুধু কথাটা। এরপর সে কিছু লুকোতে চাইলেও পারবে না। আর মেরে আমি কখনোই ফেলতাম না তাকে ওটা শুধু জাস্ট ভয় দেখালাম।”

পিয়াস উত্তর দিলো না তবে মনে মনে খুশি হলো এটা ভেবে সে একটু হলেও এইরূপের সিয়ামকে চেনে। সে জানতো সিয়াম বড়ো কোনো ক্ষতি করবেনা লোকটার।

______________________________

অপূর্ব আর সিয়ার বিয়েটা সুসম্পন্ন হয়েছে ভালো ভাবে। বিয়ের সময় সবাই উপস্থিত ছিলো। এখন খাওয়া দাওয়ার পর্ব চলছে। অপূর্বকে সিয়ার পাশে বসানো হয়েছে।
অপূর্ব বার বার দেখছে সিয়াকে। কি সুন্দর লাগছে আজ মেয়েটাকে তার চোখ ফেরানো দায় হয়ে পড়ছে। কিন্তু এত সৌন্দর্যতা সে উপভোগ করতে পারছে না। পাকা দেখার পর থেকেই মেয়েটা তার সাথে কথা বলছেনা। অপূর্ব বুঝতে পারছে না হটাৎ করে সিয়ার কি হলো। সে সুযোগও পাচ্ছে না যে জিজ্ঞেস করবে। এতো কিছুর মাঝেই তার সবথেকে বেশি খুশি লাগছে এটা ভেবে এবার যতোই মনোমালিন্য হোক সিয়া অন্তত তার কাছে বাঁধা থাকবে।

হুট করেই সে হাতে চাঁদ পেয়ে গেছে। সে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করলো এই বিশেষ দিনে, এই চাঁদের কখনও কোনরকম হেলেফেলা সে হতে দেবেনা।

দেখতে দেখতে বিদায়ের পর্ব চলে এলো। সুইটি বেগম নতুন জীবনের শুভ কামনা করে নিজের রুমে চলে গেলেন। সিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লো, এর বেশি সে আশাও করে না।

এরপর সিয়ামের কাছে যেতেই সিয়া হাঁটু ভাঁজ করে বসে সিয়ামকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল। এই মানুষটাকে সে একটু বেশিই ভালবাসে। ছোটো থেকেই বাবা – মা দুজনেরই ভালবাসা তাকে দিয়েছে এই মানুষটা। তার সব আবদার ইচ্ছে গিয়ে শেষ হতো এই মানুষটার কাছে। হতো বলছে কি এখনও হয়।

সিয়াম সিয়ার মাথায় হাত বুলাতে বললো “নতুন জীবনে সব কিছু নিজের মনের মত সাজিয়ে নিস। সবার অতীত থাকে জীবনে কিন্তু সেই অতীতকে টেনে এনে নিজের বর্তমান ভবিষ্যত নষ্ট করিস না। আর কক্ষনও এই বাড়িতে আসার সময় নিজেকে অতিথি ভাববি না। তুই এই বাড়ির মেয়ে ছিলি আছিস আর থাকবি। এই বাড়ির দরজা তোর জন্য সর্বদা খোলা কেউ কোনো কৈফিয়ত চাইবে না এখানে তুই কেনো কি কারণে আসলি। তোর রুম তোরই থাকবে সেটায় শুধু তোর অধিকারি থাকবে। আর অপূর্ব বিষণ ভালো ছেলেরে একটা সুযোগ দিয়ে দেখিস ওকে। এই ভাইয়ার কথা শোন তুই কোনোদিন নিরাশ হবি না।”

সিয়া ঘাড় নাড়লো। কান্নার জোরে সে কিছু বলতে পারছে না। উঠে সিরাজের কাছে গেলো। সিরাজ হালকা হেসে বললো ” গাড়ি রেডি রাখছি আমি। গেলেই তো তোকে তোর শশুরবাড়ীর লোক কালকের মধ্যে বাড়ি পাঠিয়ে দেবে । তাই আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।”
সিয়া ঠোঁট চেপে কান্না আটকে সিরাজের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সিরাজ কান্না আটকালো তার দুর্বল হলে চলবেনা মেয়েটা আরো কাঁদবে। তার বুক টা যে ফেটে যাচ্ছে। মেয়েটা তার থেকে কতো দূরে চলে যাচ্ছে। চাইলেও আর যখন তখন তার পিছনে লাগতে পারবে না। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া মারপিট করতে পারবে না। হুট হাট কারোর চকলেট চুড়ি করে খেতে পারবে না। কেউ তাকে এদিক ওদিক ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার আবদারও আর করবেনা।

সিয়া সিরাজকে ছেড়ে চন্দ্রার গালে হাত দিয়ে বললো ” এই সংসারটা দেখে রেখো ভাবী। আর আমার ভাইয়াকেও এভাবেই আগলে রেখো। পরের বাড়ি যাচ্ছি ভেবে পর করে দিও না। তুমি আমার সই সই-ই থাকবে।” চন্দ্রা এবার কেঁদে সিয়াকে জড়িয়ে ধরলো।

সিয়া ইন্দ্রা আর পিয়াসের থেকেও বিদায় নিলো। তারাও সিয়ার ভীষণ আপন।

সিয়া গাড়িতে ওঠার সময় পিছন ফিরে বাড়িটাকে একবার প্রাণভরে দেখলো। এই বাড়ির আনাচে কানাচে তার কতশত স্মৃতি। তার প্রিয় রুম ছোট্ট ব্যালকনি সব ছেড়ে আজ নতুন জায়গায় গিয়ে নতুন জিনিস আপন করে নেবে সে। আচ্ছা তাদের কি কষ্ট হবে না..? আজ থেকে তারা আর সিয়াকে প্রতিদিন দেখতে পাবে না তার স্পর্শ পাবে না। তাদের কি মন কাঁদবে না সিয়ার মতো..?
.
.
.

সিয়াকে বিদায় দিয়ে সবাই ঘরের ভিতর প্রবেশ করলো। সবারই মন ভীষন ভার হয়ে আছে। আজ কিছু মেহমানরা থাকবে এখানে। চন্দ্রা আর ইন্দ্রা মিলে সবার খাওয়া দাওয়ার ব্যাবস্থা করলো। সবাইকে দেখতে পেলেও চন্দ্রা সিরাজকে দেখতে পেলো না। সবাই খেতে বসায় চন্দ্রার উপর ভর পড়লো সিরাজকে ডাকার। চন্দ্রা কথা না বাড়িয়ে সিরাজকে ডাকার উদ্দেশ্যে তার রুমের দিকে পা বাড়ালো।

সিরাজের রুমের একটু কাছে যেতেই চন্দ্রা দেখলো সিরাজ অচেনা একটা মেয়েকে টেনে তার রুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
চন্দ্রার এবার রাগে গা ঘিন ঘিন করে উঠলো। তার মানে সিরাজ এখনও পাল্টায়নি..? সবই কি তার নাটক শুধু তার দিভাইকে পটানোর জন্য..? চন্দ্রা আর ভাবতে পারলো না নীচে নেমে গেলো সিড়ি দিয়ে।

#চলবে..?

বেড়াজাল পর্ব-২৭

0

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #২৭

চোখের পলকে যেন তিনদিন কেটে গেল। এই তিনদিনে কেউ কারোর সাথে কথা বলার পর্যন্ত সময় পায়নি। সিয়ামের অফিসে চাপ বেড়েছে তাই সিরাজের ঘাড়ে ভীষণ চাপ পড়েছে। নইলে অফিসের ব্যাপারে সে বেশ খাপছাড়া স্বভাবের, খুব দরকার না পড়লে তাকে পাওয়া যায় না অফিসে।
সিয়ামকে এই বিষয়ে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেই সে বলে সিরাজ এখনও ছোটো মাথায় চাপ পড়লে সে নিজে থেকেই কাজে মন দেবে। আস্তে আস্তে যেনো তাই হচ্ছে।

ঐদিকে চন্দ্রাও সিনথিয়ার ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে চলেছে। আপাতত সে এইটুকু জানতে পেরেছে সিনথিয়া তাদের ক্যারাটে ক্লাসের থেকে কিছুটা দূরে কোচিং ক্লাসে যায়। চন্দ্রা পরের পদক্ষেপ নেওয়ার আগে সিয়ামের সাথে একবার কথা বলতে চায়। কিন্তু লোকটার সময় কোথায়..? সেই সকালে বেরোয় দুপুরে একটু বাড়ি আসে আবার অফিসে গেলে বাড়ি আসতে আসতে অনেক রাত হয়।
চন্দ্রার সাথে দেখাই হয় না। কারন চন্দ্রা বেরোয় বেলার দিকে আর বাড়ি ফেরে সন্ধ্যার দিকে। এতসবের পরেও সিয়ামের কড়া নির্দেশ সে যেনো অপেক্ষা না করে রাতে তার জন্য চুপ চাপ খেয়ে যেনো শুয়ে পড়ে। চন্দ্রাও সিয়ামের অবাধ্য হয় না।
.
.
.
কিন্তু আজ এক বিশেষ কারণে সবাই বাড়িতে। সেই বিশেষ কারণটা হল আজ অপূর্বের বাড়ি থেকে সিয়াকে দেখতে আসবে।
সকাল থেকেই তাই চন্দ্রা আর ইন্দ্রা ব্যাস্ত রান্নাঘরে। চার পাঁচটা সার্ভেন্ট থাকলেও সিয়া সিরাজ সিয়াম এখন মোটেই রান্নার বুয়াদের হাতের রান্না খেতে চায় না। তাই খুব অসুবিধা ছাড়া চন্দ্রা রান্না বন্ধ দেয় না। চন্দ্রার শরীর খারাপের সময়টা পুরোটাই ইন্দ্রা এখানে থেকে তার সাহায্য করে একা হাতে সামলেছে। ইন্দ্রা পাক্কা গিন্নি একজন, সর্বগুণে সম্পন্না বললেও ভুল হবে না। তার হাতের কাজ থেকে হাতের রান্না সবই বেশ নিখুঁত। চন্দ্রা তার থেকে বেশ কিছু জিনিস রপ্ত করেছে।
মাঝে মাঝে তার ইন্দ্রার প্রাক্তনের কথা ভেবে খুব আপসোস হয়। এতো দামী হীরে সহজে পাওয়াতে তাকে কাঁচ ভেবে কেমন ভেঙে টুকরো টুকরো করেছে মানুষগুলো।

সিয়াম সিরাজ ছুটি নিয়ে বেলা ১১ টা অবধি বাড়িতে থাকলেও জরুরী কারণে দুইজনকেই যেতে হয়েছে অফিসে। তারা জানিয়েছে মেহমান আসার আগেই তারা চলে আসবে।

_________________________________________

১২:৩০ বাজতেই চন্দ্রা ইন্দ্রাকে তাড়া লাগলো সব গুছানোর জন্য মেহমানরা আসলো বলে। ইন্দ্রা বড়ো জিনিস গুলো গুছিয়ে ছোটো ছোটো জিনিস যেমন স্যালাড, মিষ্টি জাতীয় জিনিস সার্ভেন্টকে গোছাতে বলে দুজনেই চলে হলো স্নানে।

চন্দ্রা স্নান করে একটা হালকার উপর গোলাপি শাড়ি পরে নিল। গোলাপি রঙটা তাকে একটু বেশি মানায়। তাই সিয়াম কিছু আনলেই বেশিরভাগ গোলাপি রঙের জিনিসই আনে তার জন্য।

চন্দ্রা চুল ঝাড়তে ঝাড়তে তোয়ালে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। সদ্য শাড়ি পড়ায় গায়ের শাড়ি এলোমেলো।
টের পেলো না এই দৃশ্য একজনের শ্বাস প্রক্রিয়া ভীষণ ভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে।
চন্দ্রা কোমরের কাছে উন্মুক্ত অংশে কারোর হাতের ছোঁয়া পেলো। হালকা কেঁপে উঠলেও মুচকি হাসি দিল, আয়নায় দেখার দরকার পড়লো না মানুষটা কে। মানুষটার তার ভীষণ আপন তাই তার স্পর্শটাও তার ভীষণ চেনা।

সিয়াম এবার পিছন থেকে জড়িয়ে ঠোঁট ছোঁয়ালো চন্দ্রার পিঠের সদ্য স্নান সেরে আসা সাক্ষী বিন্দু বিন্দু জলকণায়।
চন্দ্রা এবার নিজের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো নিজের পেটের কাছে সিয়ামের হাতের উপর।
চন্দ্রা বাঁধা দিচ্ছে না দেখে সিয়াম নিজেই হেসে একটু সরে গিয়ে বললো “রোম্যান্স টা পরের জন্য তুলে রাখলাম রাণী সাহেবা। হাতে এখন সময় নেই মেহমান আসলো বলে।”

চন্দ্রা এতক্ষনে চোখ খুললো। দীর্ঘ তিনদিন পর মানুষটার একটু স্পর্শ পেয়ে সে মোমের মত গলে গিয়েছিলো। আজ আর ইচ্ছে হচ্ছিল না সিয়ামকে বাঁধা দেওয়ার, সিয়াম না নিজেকে সংযত করলে আজ সত্যিই একটা অঘটন ঘটে যেত অসময়ে।
চন্দ্রা এবার লজ্জায় পালাবে বলে ঠিক করল, দরজার দিকে তাকাতেই সে দেখে দরজা ভেজানো। চন্দ্রা এবার চমকে তাকায় সিয়ামের দিকে সিয়াম দাঁড়িয়ে অফিস থেকে আসা শার্ট খুলছে, মূলত স্নানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
চন্দ্রা তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা দিতে গিয়ে দেখে হালকা একটা ছায়া সরে গেলো সেখান থেকে। চন্দ্রা তা দেখে চেঁচিয়ে বললো “কে ওখানে..? উত্তর দাও কে ওখানে..?”
সিয়াম অর্ধেক শার্ট খুলেই চন্দ্রার কাছে গিয়ে বলল “কি হয়েছে চন্দ্র এভাবে চেঁচাচ্ছ কেনো..?”
চন্দ্রা এবার তাড়াতাড়ি দরজা টায় ছিটকিনি লাগতে গিয়ে দেখলো সেটা লাগছে না। কারণ উদ্ধার করতে দরজার নিচে চোখ যেতেই চন্দ্রা দেখলো একটা ছোট্ট পাথর কিন্তু তার জন্যেই ছিটকিনি ঠিক করে লাগছে না। চন্দ্রা সেটাকে সরিয়ে রেগে সিয়ামের উদ্দেশ্যে বললো ” আপনি একটু দেখে শুনে কাজ করতে পারেন না। এক্ষুনি কেউ দেখে নইলে কি হতো বলুন তো..? বলছি কি দেখে নিল বোধহয়।”
সিয়াম চন্দ্রার চিন্তিত মুখ দেখে বললো “আরেহ চন্দ্র তুমি বেকার বেকার এতো চিন্তা করছো। আচ্ছা সরি, আমি একটু তাড়াহুড়োতে ছিটকিনিটা লাগতে গিয়েছিলাম তাই ওমন হয়েছে এর পিছনে আর কারণ নেই।”

এই বলেই সিয়াম বিছানায় রাখা পাঞ্জাবি নিয়ে স্নান করতে চলে গেলো।

চন্দ্রার মন খুঁতখুঁত করলো। সে যা সন্দেহ করে পরে গিয়ে তা ঠিক হয়। সে নিজেও চায় না ঠিক হোক কিন্তু হয়।

_____________________

সেরভেন্ট ইন্দ্রাকে এসে খবর দিলো মেহমানরা গেটের কাছে। ইন্দ্রা কোনমতে হালকা ক্রিম আর লিপবাম লাগিয়ে শাড়ি পরে তাড়াহুড়ো করে সিড়ি দিয়ে নামতে লাগলো সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে থাকা মানুষটিকে দেখতে গিয়ে, হুট করেই শাড়িতে পা আঁটকে খেই হারালো নিজের। দু তিন পা এলোমেলো পড়লো সিড়িতে তারপর নিজের শরীরের ভারে নিজের নিয়ন্ত্রণ না দেখে চোখ বুজে সামনের মানুষটির কাঁধ ঝাপটে ধরলো দুই হাতে। তার মুখটা গিয়ে ঠেকলো সেই মানুষটার গলায়।

সিরাজ হতভম্ব। সে ভাবেইনি ইন্দ্রা তাকে দেখে এভাবে টাল খেয়ে পড়ে যাবে। তার নিজেরই দুই পা দুই সিড়িতে উপর নীচ করে রাখা। হটাৎ ইন্দ্রাকে ওভাবে পড়তে দেখে সেও তার কোমর জড়িয়ে ধরেছে। কিন্তু এখন তার বুকের ধুকপুকানি যেনো বাইরে থেকে মানুষ শুনতে পাবে। কই সে কত মেয়ের কাছে গেছে এইরকম তো কোনোদিন ফিল হয়নি তবে কি এটা মনের অভ্যন্তরীণ অনুভুতি থেকে বলে..?

ইন্দ্রা এবার পিটপিট করে চোখ মেলল। তার বুক ভয়ে আগে থেকেই ধুকপুক করছে। সামনের মানুষটির দিকে চোখ তুলে চাইতেই দেখলো সিরাজ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। ইন্দ্রা লজ্জায় মাথা নীচু করে নিলো।

সিরাজ ওভাবেই ধরে বললো “একটু আস্তে চলাফেরা করলে কি হয়..? কখনও হাত পুড়িয়ে ফেলো কখনো নিজে পরে যাও। আমি না থাকলে আজ কি হতো ভেবে দেখেছো..? পারো তো খালি আমার পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতে।”
সত্যিই তাই অন্যসময় হলে ইন্দ্রা পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতো এখন কিন্তু কোনো এক কারণে পারলো না এইমুহূর্তে।
কোনরকমে জড়তা নিয়ে বললো “অনেক ধন্যবাদ আপনাকে এবার ছাড়ুন আমায়। মেহমান এলো বলে।”

সিরাজের খেয়াল ছিল না সে এতো কাছ থেকে ইন্দ্রাকে ধরে আছে ইন্দ্রা বলতেই সে ঝট করে তাকে ছেড়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো “আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।”

ইন্দ্রা একটা হাঁফ ছেড়ে দৌড়ালো সিয়ার রুমে। তাকে রেডি থাকার কথা তো বলাই হয়নি।

____________________________________

অপূর্বের ফ্যামিলি থেকে এলো সে তার বাবা মা আর অপূর্বের বোন। তাদের ছোট্ট ফ্যামিলি। সিয়াম আগে থেকেই তাদের চিনতো তাই বেশি অসুবিধাও হয়নি। তাদের সাথে বেশ অনেক্ষণ কথা বললো সবাই। বেশ আময়িক তাদের আচরণ যেনো কতদিনের চেনা পরিচিত। সবার ভীষণ পছন্দ হলো সিয়ার শশুরবাড়ি।
এরই মধ্যে সুইটি বেগম নামলেন সবার দিকে নজর বোলালেন, নাহ্ তাদের দেখে বেশ উচ্চবিত্তই মনে হলো সুইটি বেগমের। তিনি নকল হাসি মুখে রেখে সবার সাথে পরিচিত হলেন। জানতে চাইলেন ছেলের পেশার ব্যাপারে।

অপূর্বের মা বাবা একটু অবাক হলেও তার মা বললো “ওর নাম শোনেননি আগে…? ওতো এখনকার বিখ্যাত সাইকিয়াটিস্ট। এখানে কেনো বিদেশেও তার বেশ নাম ডাক।”

সুইটি বেগম আর সিয়াম ছাড়া সবাই বেশ চমকালো। সবাই এতো সুন্দর করে মেশার পরেও কিনা তার পেশা জানতো না তারা..?
সুইটি বেগমের তেমন কোনো হেলদোল দেখা গেলো না। তিনি সরাসরি সিয়াকে পছন্দ হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করলেন।

তারা সবাই জানালেন সিয়াকে তাদের ভীষন পছন্দ হয়েছে। এবং আগামী তিনদিনের ভিতর তিনি বিয়ে পরিয়ে দিতে চান ঘরোয়া ভাবে। তার ছেলে তাড়া লাগাচ্ছে। এই বলে অপূর্বের মা তার হাত থেকে দুটি বালা খুলে সিয়ার হাতে পড়িয়ে দিয়ে দোয়া করলেন। তারপর সবাই দুপুরের খাবার খেয়ে বিকেলের দিকে চলে গেলেন।

অপূর্ব খেয়াল করলো সিয়া তার পেশার কথা শোনার পর থেকেই কেমন থম মেরে রয়েছে। কারোর সাথে তেমন কথা না বলে অল্প সল্প খেয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।
সবাই থাকায় অপূর্বও আর কিছু বললো না।
.
.
সিয়া একদৃষ্টিতে জানলার পাশে বসে আকাশ দেখতে লাগলো। সে এখন বুঝতে পারছে অপূর্ব কেনো তার সাথে যেচে যেচে বন্ধুত্ব করেছিল। তাকে এতোটা ট্রমা থেকে কিভাবে বের করে এনেছিল। সব নিশ্চই সিয়াম ভাইয়ের কথাতেই করেছিল।
আর সে তাকে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড ভেবে কিনা বিয়ের প্রস্তাব রাখলো। তার কাজই তো সবার সাথে এইভাবে মিশে তাদেরকে মানসিক অবসাদ থেকে বের করা। সিয়ার আর ভাবতে পারলো না জীবনটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে আর তার ইচ্ছে হচ্ছে না। যা হবার হবে সে আর কোনকিছুতেই বাঁধা দেবে না। কারোর কাছ থেকে ভালবাসা পাওয়ার আশা সে রাখে না আর।

এসব ভেবে ড্রায়ার থেকে এক পাতা ওষুধ বের করলো।এই ওষুধ তাকে অপূর্বই দিয়েছে। তাকে বলছিলো ঘুমের ওষুধ। আসলেই এটা খেয়ে সিয়া অনেকক্ষণ ঘুমায়। সিয়া এবার বুঝলো কেনো এই ওষুধ অপূর্ব তাকে সেচ্ছায় দিয়েছিল। একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে সেটা থেকে একটা ওষুধ বের করে খেয়ে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লো সে ।
পাশে অনাদরে পরে ভাইভ্রেট হতে থাকা ফোনের স্ক্রিনে দেখালো জ্বল জ্বল করতে থাকা অপূর্বের নামটি।

____________________________

বিকেলে সব গুছিয়ে চন্দ্রা বেরোলো তার নতুন উদ্দেশ্যে। সিয়াম বলেছিলো কাল থেকে শুরু করতে কিন্তু চন্দ্রা আর দেরি করতে চায়নি।

চন্দ্রা নিজের গন্তব্য স্থলে পৌঁছে হাত ঘড়িতে সময় দেখল ৬:১০।
সিনথিয়ার ছুটি হওয়ার কথা তো ছয়টায়। ইশ তাহলে কি সে দেরি করে ফেললো..?
বিরক্তি নিয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই সামনের গেট থেকে সিনথিয়াকে বেরোতে দেখলো। আরো অনেকেই বেরোলো চন্দ্রা ভাবলো আজ আর তার কাজ হবে না।

কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে সবাই চলে যাওয়ায় পরেও সিনথিয়া কাকে যেনো ফোন করে ধমকাতে লাগলো। চন্দ্রা আরেকটু কাছে যেতেই বুঝলো সে তার ড্রাইভারকে ধমকাচ্ছে এখনও না আসার জন্য।
চন্দ্রা হাসলো আজ অদ্ভুত ভাবে ভাগ্য তার সহায়। সে সামনের একজনকে হাতের ইশারায় করতেই একজন মহিলা কিছু খাওয়ার নিয়ে যাওযার সময় সিনথিয়ার জামার উপর ফেলে দিলো।

সিনথিয়া রাগে চেঁচিয়ে উঠলো “ননসেন্স! চোখ নেই আপনার এভাবে কেউ চলা ফেরা করে..? দিলেন তো আমার পুরো ড্রেস টা খারাপ করে।”

সামনের মহিলাটি কাচুমাচু করে সরি সরি বললো।

সিনথিয়া আবার রেগে গিয়ে বললো ” আপনার সরিতে আমার জামাটা ঠিক হয়ে যাবে না ইডিয়েট। এই যান তো আপনি সামনে থেকে নইলে এবার আমি কিছু করে ফেলবো।”
মহিলাটি কাচুমাচু মুখ করে চলে গেলো। যেতে যেতে চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিল।

চন্দ্রা এবার সময় বুঝে এদিক ওদিক তাকিয়ে সিনথিয়ার দিকে এগিয়ে গেলো।

সিনথিয়া তখন রাগে বিড়বিড় করছে আর একটা টিস্যুপেপার দিয়ে জামাটা মুছছে। জামার রং হালকা হওয়ার বেশ খারাপ দেখাচ্ছে মোছার পরেও।
চন্দ্রা এবার সিনথিয়ার সামনে গিয়ে বললো ” এক্সকিউজ মি?”
সিনথিয়া বিরক্তি নিয়ে চন্দ্রার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো ” ইয়েস হোয়াট..?”
চন্দ্রা এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো “আপনার জামার অবস্থা থেকে এলাম। মুছছেন যত ততো তহ আরো ছড়িয়ে পড়ছে।”

সিনথিয়া এবার করুন মুখ করে চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে বললো ” সামনে কোনো কল আছে জানেন..? এখন তো সেন্টারও বন্ধ হয়ে গেছে।”

চন্দ্রা বললো “না তেমন কিছু তো সামনে নেই। আপনি আমার সাথে আমার বাড়ি চলুন এই পাঁচটা বাড়ি পরই গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেবেন।”

সিনথিয়া বারণ করতে গিয়েও করলো না। আশে পাশের বেশ মানুষ কৌতুহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে তার দিকে। তাই চন্দ্রার কথা মত সে তার বাড়িতেই গেলো ফ্রেশ হতে।

চন্দ্রা জামাটার অবস্থা দেখে নিজের একটা লং ফ্রক বার করে সিনথিয়াকে দিলো। এই জামা গুলো তার বিয়ের আগের। সেও কিছুটা সিনথিয়ার মতো লং ফ্রক আর মাঝে মাঝে জীন্স টপ পড়ত।

সিনথিয়া সেটা ফ্রেশ হয়ে এসে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ মুখ নিয়ে বললো ” অনেক অনেক থ্যাংকস আপনাকে। নইলে আজকাল কার মানুষ তো সাহায্য করতেই চায় না।”

চন্দ্রা শুধু একটা মিষ্টি হাসি দিল।

#চলবে..?

বেড়াজাল পর্ব-২৫+২৬

0

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #২৫

চন্দ্রা আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলো কিন্তু তার আগেই দরজায় টোকা পড়ার আওয়াজ পেলো দুজন।
চন্দ্রা সিয়ামের দিকে তাকাতেই সিয়াম উঠে গিয়ে হুইচেয়ারে বসলো। চন্দ্রা উঠে গিয়ে দরজা খুলতে উদ্যত হলো।

দরজা খুলতেই চন্দ্রা অপূর্ব আর সিরাজকে দেখতে পেলো।
চন্দ্রা বেশ অবাক হলো দুজনকে এই সময় দেখে। একনজর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ৯:১৫।
সিয়াম ভিতর থেকে বাইরে এসে প্রশ্ন করলো “আরে তোরা এতো রাতে..?কোনো দরকার..?”
অপূর্ব চন্দ্রাকে পাশ কাটিয়ে সিয়ামের কাছে গিয়ে বলল “আরে দেখনা এসেছিলাম সিয়ার সাথে দেখা করতে, তার মন ভালো নেই বলে সিরাজ এখন আমায় ছাড়ছেনা। বলছে নাকি এখন ছোট্ট করে পার্টির আয়োজন করবে বাগানে।”
সিয়াম প্রথমে বারণ করবে ভাবলো। এমনিও তার আর চন্দ্রার কারোরই এখন মন মেজাজ তেমন ভালো নেই। তারপর ভাবলো সিয়া চন্দ্রা সবারই একটু ফ্রেশ এয়ারের দরকার। তাই সেসব ভেবে সিয়াম বললো “আচ্ছা তাই বেশি কিছু না করে ছোটোখাটোর মধ্যে কিছু আয়োজন কর। আর অপূর্ব আজ রাতে আর বাড়ি ফিরবি বলে জেদ করিস না সিরাজের সাথে থেকে যা।”

অপূর্ব এবার বললো ” তা কি করে হয়। কাল সকালেই আমায় বেরোতে হবে আর্জেন্ট।”
চন্দ্রা এবার পাশ থেকে মিষ্টি হেসে বললো ” তাতে কি ভাইয়া আজ রাত থেকে কাল আমার হাতের ব্রেকফাস্ট করে নয় সবাই একসাথে কাজের জন্য বেরোবেন।”
অপূর্ব এবার গলা ঝরার নাটক করে বললো “আহেম আহেম ভাবীজানের আদেশ অমান্য করলে সিয়াম যদি আবার আমার গর্দান নেয়, না না বাবা আপনার আদেশ শিরোধার্য ভাবীজান।”
অপূর্বের কথা শুনে ওখানে থাকা সবাই হেসে দিলো।
তারপর একমুহুর্ত দেরি না করে সিরাজ অপূর্বকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল “চ আর কতো দেরি করবি..? সব আয়োজন কিন্তু আমাদেরই করতে হবে।”
চন্দ্রা সেই দেখে হেসে সিয়ামের দিকে ফিরলো। সিয়াম আগে থেকেই চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে ছিলো বিধায় চোখাচোখি হোল চন্দ্রা ইতস্তত করে চোখ সরিয়ে নিয়ে সিয়ামকে বললো “আমার আরো কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা বাকি আছে। যদি আপনি..”
সিয়াম কথা শেষ করার আগেই বললো “সব দেবো। তবে আমার তোমারও হেল্প লাগবে এই কাজে” চন্দ্রা অবাক হয়ে বললো “আমার..?”
আর করোর কিছু বলার আগেই সেখানে সিয়া আর ইন্দ্রা এসে উপস্থিত হলো। ওদের দেখে সিয়াম চন্দ্রা কেউই আর কথা বাড়ালো না।
সিয়াকে দেখেই বোঝা গেলো তার মন খারাপ। সে এসেই চন্দ্রার হাত ধরে বললো ” তুমি আগে জানাওনি কেনো ভাবী যে আতিফের বিয়ে সামনে..?”
চন্দ্রা আমতা আমতা করে সিয়ামের দিকে তাকালো। সিয়াম চন্দ্রাকে দেখে সিয়াকে নিজের কাছে ডাকলো। সিয়া চুপচাপ গিয়ে সিয়ামের কাছে বসলো।
সিয়াম সিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো ” তখন তুই সেটা শুনলে নিজের সাথে আরো খারাপ কিছু করে ফেলতি সিয়া। তোর ভাবী জেনে শুনেই তোকে বলেনি। আর তুই কথা থেকে জানলি..? এই জন্যেই কি আজ তোর মন খারাপ..?”
সিয়া হালকা হাসলো সেই হাসতে বিষণ্ণতা স্পষ্ট। সেখানে থাকা প্রত্যেকটা মানুষের তা বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না।
সিয়া ওভাবেই বললো “সব টুকু তো মেনেই নিয়েছিলাম ভাইয়া। তাও সে এমনটা কেনো করলো..? তার আর আমার কমন ফ্রেন্ডদের বলেছে আমি নাকি তাকে ছেড়ে দিয়েছি, বাজে ব্যবহার করেছি। তারা আমায় ফোন করে জানাচ্ছে এসব, কি এমন ক্ষতি করেছিলাম ভাইয়া ওর..?আমি শুধু ভালোবেসেছিলাম আর এটাই কি আমার অপরাধ..?”

” ভালোবাসা অপরাধ না তবে ভুল মানুষকে ভালবাসা জঘন্য অপরাধ ”
অপূর্ব রমরমা কণ্ঠে পিছন থেকে বলে উঠলো। সবাই ফিরে অপূর্বর দিকে তাকালো।

সিয়াম এবার বললো “সত্যি বেশিদিন চাপা থাকে না সিয়া। তুই শুধু পাপের হিসাব রাখ, তার বিচার উপরওয়ালা করবেন।”
সিয়া মাথা নাড়ালো বাকিরা তাড়া মারতে সবাই এসে পৌঁছালো সিয়মদের বাগানের একপাশে।
কমসময় হলেও অপূর্ব আর সিরাজ সুন্দর করে সাজিয়েছে চারিদিক বেশ লাইট নীচে সুন্দর করে কার্পেট বিছানো। আর সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে বাগানের মধ্যে ছোট্ট সাইজের পুল যাতে সচ্ছ নীল জল। যদিও সেখানে শুধুই মাছ থাকে। এমনি সময় ছোটো লাইট জ্বলে সেখানে, বড়ো কোনো অনুষ্ঠান হলে তবে পাশের বড়ো লাইট গুলো জ্বালানো হয়। আজ সেই লাইট জ্বালানোয় চারদিক ঝলমল করছে তারমধ্যে সিরাজ আবার একটা ব্লুটুথ স্পিকারে গান চালিয়ে দিয়েছে আসলেই একটা পার্টি পার্টি ফিলিংস আসছে সবার মধ্যে। একমাত্র সিয়াই প্রাণহীন জড়বস্তুর মতো বসে আছে।
চন্দ্রার সিরাজকে ভালো না লাগলেও আগের মত চক্ষুশূল লাগে না। সিরাজও যেমন ওকে এড়িয়ে চলে চন্দ্রাও তেমনটাই করে।
সিরাজ এবার কিছু বলতে যাবে তখনই ইন্দ্রা বললো “দাঁড়াও সবাই আমি হালকা কিছু খাওয়ার নিয়ে আসি সবার জন্য, নইলে কেমন খালি খালি লাগবে সব।” বলেই সে চলে গেল ভিতরে রান্নাঘরে।
সিরাজও এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো “আমিও তাইলে ফ্রিজ থেকে কিছু কোল্ডড্রিংকস নিয়ে আসি।”
সিয়াম মাথা নিচু করে মুচকি হাসলো। অপূর্ব জোরেই হেসে দিলো বললো ” হ্যাঁ হ্যাঁ সেতো অবশ্যই দেখিস তুই আবার জমে যাস না গিয়ে।”
সিরাজ সবার দিকে তাকিয়ে দাঁত চেপে একটা হাসি দিয়ে বললো “তোকে আমি পরে দেখছি মাথা খারাপের ডাক্তার।”
অপূর্ব এবার হাসিটা কমিয়ে সিয়ার দিকে নজর দিল। নাহ্ মেয়েটা আগের মতোই বসে আছে মানে সিরাজের কথা শোনেনি এই ভেবে একটা নিশ্বাস ফেললো।
চন্দ্রা পুরোটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলো। তারমানে তার সন্ধেহই আসতে আসতে সত্যিতে রূপ নিচ্ছে।
.
.
সিরাজ রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো ইন্দ্রা মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সিরাজ উঁকিঝুকি মেরে দেখলো প্লেটে কতকগুলো পোড়া পকোড়া শুধু।

সিরাজ এবার হেসে পিছন থেকে বললো “তোমার রূপের আগুনে এগুলোও ঝলসে গেছে দেখছি।”
ইন্দ্রা চমকে পিছনে তাকালো সিরাজকে দেখতে পেয়ে তার মেজাজ যেনো পারদের মতো চড়লো।
ইন্দ্রা পাশ থেকে একটা খুন্তি নিয়ে সিরাজের দিকে তাক করে বললো “আপনার জন্যই হয়েছে সব দায় আপনার ওইসময়ে যদি আপনি ওমন ষাঁড়ের মতো না চেঁচাতেন তাহলে এইরকম হতো না”
সিরাজ হালকা পিছনে ঝুঁকে বললো “এটা ঠিক না ইন্দ্রা রান্না পোড়ালে তুমি আর তার দায়ও কিনা আমার..?”
ইন্দ্রা চেঁচিয়ে বললো “হ্যাঁ যত খারাপ কাজ হয় সব দায় আপনার আপনিই দায়ী বুঝেছেন।”
সিরাজ এবার খুন্তিটা সরিয়ে ইন্দ্রার দিকে ঝুঁকতেই ইন্দ্রা পিছিয়ে সিংকে লেগে হালকা দেহের অগ্রভাগ পিছিয়ে গেলো।
সিরাজ যথাযথ দূরত্ব রেখে ইন্দ্রার চোখে চোখ রাখল। একহাত ইন্দ্রার পিছনে আরেক হাত ইন্দ্রার একপাশে রেখে বললো ” এতো খারাপ কাজের মাঝে মন চুরির করার দায়ও তো কখনো দিতে পারো। তার দায়ভার নয় আমিই নেবো।” এইটুকু বলে মুচকি হেসে ফ্রিজ থেকে কোল্ডড্রিংকসটা নিয়ে চলে গেল সিরাজ।

ইন্দ্রা তখনও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কি বলে গেলো লোকটা তাকে..? ইন্দ্রা এতটাই অবুঝনা যে একটা ছেলের চাহনি কথাবার্তা বুঝবে না। কিন্তু তার ভয় হয়। তাদের সম্পর্ক লোকসমাজে মেনে নেবে..? সিরাজের থেকে সে গুণে গুণে দুই বছরের বড়ো। সে জানে এসব এখনকার দিনে ম্যাটার করে না। কিন্তু সিরাজের মা..? তার বাবা আর বোন..? এরা কি মেনে নেবে..? শেষ পরিণতি কি এই সম্পর্কের..? সে নিজেও সিরাজের প্রতি কিছুটা দুর্বল হয়েছে কটা দিনে। যা সে নিজের মনের কাছেও প্রকাশ করতে চায় না। এসব ভাবতে ভাবতে পিছনে ঘুরতেই দেখলো একটা রেডিমেট ফ্রইসের প্যাকেট। তারমানে সিরাজ তখন এইটার জন্য তার পিছনদিকে হাত বাড়িয়েছিল।
ইন্দ্রা এবার মুচকি হাসি দিয়ে সেগুলো ঝটপট ভেজে নিয়ে গার্ডেনের দিকে গেলো।
.
.
আড্ডা বেশ জমে উঠেছে সবার সবাই সবার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টায় আছে। এরই মধ্যে অপূর্ব বললো সিয়াম ভাই একটা গান ধর। কলেজে আমরা কতো প্রোগ্রাম করেছি একসময়।
সিয়াম হাসলো একসময় তারা কলেজে বিখ্যাত গানের গ্রুপ ছিলো। নিজের কলেজে ছেড়েও বিভিন্ন জায়গায় প্রগ্রাম করেছে সে। কিন্তু সময়ের স্রোতে সব কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো।
সিয়াম বারণ করলো না উল্টে সিরাজকে বললো ভিতরের রুম থেকে তার গিটারটা আনতে। সিরাজ বিনাবাক্যে গিয়ে সিয়ামের গিটার টা এনে দিল।
সিয়াম এবার কিচ্ছুক্ষণ নিজের মতো টুংটাং করে গিটার হতে সেট করে নিয়ে গান ধরলো………

Chand si mehbooba ho meri
Kab aaisa maine socha tha..(2×)
.
Haan tum bilkul waisi ho
Jaisa maine socha tha…

চন্দ্রা এতোক্ষণ ইন্দ্রার সাথে টুকটাক কথা বললেও গান শুরু হতেই সিয়ামের দিকে তাকালো। সিয়াম তার দিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে গান গেয়ে চলেছে।
চন্দ্রার মনে পড়লো সেই দিন গুলোর কথা তার প্রবল ইচ্ছার সত্বেও তাকে বাবা গিটার শেখার পারমিশন দেয়নি। এইদিকে কিনা তার বরই এতো সুন্দর গিটার বজায়..? চন্দ্রা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে এসব ভাবতেই হটাৎ আবার কানে ঠেকলো সেই সুর…..

Aaisa hi roop khayalon mein tha
Jaisa maine socha tha..
.
Haan tum bilkul waisi ho
Jaisa maine socha tha…….

সিয়ানের তাকানো দেখে ইতিমধ্যে সব মিটিমিটি হাসা শুরু করে দিয়েছে এমনকি বাদ যায়নি সিয়াও। সেও এখন নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টায় আছে।
সিয়াম হেসে গান শেষ করলো চন্দ্রাও সবার দিকে তাকিয়ে লজ্জায় নিজের চিবুক নামলো। ইস লোকটা তাকে সবার সামনে লজ্জা দিতেও ছাড়ে না।

সিয়াম ভালোই বুঝলো তার লজ্জা দেওয়ার টেকনিকটা বেশ সফল হয়েছে। লজ্জায় চন্দ্রার গাল যখন লাল হয়ে যায় সিয়ামের ইচ্ছে করে টুক করে গিয়ে একটা কামড় বসাতে। এইযে এখন যেমন মন চাইছে। সিয়াম নিজের ভাবনায় নিজেই ঠোঁট এলিয়ে হাসলো।

এরপর শুরু হলো নামের লড়াই.. সিরাজ শর্ত রাখলো নামের লড়াইয়ে মানুষের নাম ছাড়া সব নামই বলা যাবে। সবাই প্রথমে এরম উদ্ভট শর্ত নিয়ে মাথা ঘামালেও ব্যাপারটা যে শুধু সিয়ার মুখে হাসি ফোটানো সেই বুঝে সবাই রাজি হলো।
অপূর্ব বললো আমি আগে বলছি “পেঙ্গুইন ” সবাই হেসে দিল।
নাও এবার সিয়া বলো ” ন ” দিয়ে। সিয়া থতমত খেলো সে ভাবেনি অপূর্বের পরেই তাকে বলবে।
অপূর্ব সিরাজ তারা লাগলো কাউন্ট করা শুরু করলো সিয়া আর কিছু না পেয়ে বললো “হ্যাঁ নেংটি ইঁদুর ”
সবাই আবার হেসে গড়াগড়ি খেলো। তা দেখে সিয়াও হেসে দিল।
নাচ গানে খেলায় এই দুইঘন্টা সবার ভীষণ আনন্দে কাটলো। সারারাত এইরকম মজা করার ইচ্ছে থাকলেই নিজেদের ইচ্ছেতে মাটি চাপা দিয়ে সবাই ঠিক করলো আবার অন্যদিন। কারন পরেরদিনই সবার অফিস চন্দ্রার ক্যারাটে স্কুল সব আছে। সিয়াও জানালো কাল থেকে সে অফিসে জয়েন করবে নিজেকে আর ঘরবন্দী করে রাখবে না। সবাই বেশ খুশি হলো, যতই হোক আজ আয়োজনটা সবাই সিয়ার এই হাসি মুখটা দেখার জন্যই করেছে।

_________________________________

রাত ১২ টা।

সবাই ডিনার শেষ করে যে যার ঘরে চলে গেছে। সিয়াম ঘরে এসে দেখলো চন্দ্রাও বিছানা ঝেড়ে শোওয়ার প্রস্তুতি করছে। সিয়াম আগের মত দরজা ভালো করে লক করে পর্দা টেনে বিছানার একসাইডে বসলো। চন্দ্রাকে তাও তার দিকে মনোযোগ দিতে না দেখে গলা ঝাড়ল।
চন্দ্রা তখনও না তাকিয়ে পাশে রাখা জলের গ্লাস বাড়িয়ে দিল সিয়ামের দিকে।
সিয়াম এবার বেশ বিরক্ত হলো। চন্দ্রার হাত থেকে জলের গ্লাসটা নিয়ে বললো “চন্দ্রা আমি জল চাইনি।”
চন্দ্রা স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিল ” তাহলে কি ওষুধ দেবো গলা ধরেছে আপনার..?”
সিয়াম এবার হতাশ হলো। কই থেকে কথা কই নিয়ে যায় এই মেয়ে।
সিয়াম এবার না পেরে চন্দ্রার হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে এসে বললো ঘোর মেশানো কণ্ঠে বললো “এখনো ক্ষমা করনি চন্দ্রাবতী..?”
চন্দ্রার মনে আর দ্বিধা দ্বন্দ নেই তাও সিয়াম যখন নিজে থেকে বলছে তখন কিছু ফায়দা নেওয়াই যায় এইরকম সুযোগ ছাড়া ঠিক না।
চন্দ্রা সিয়ামের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো “ক্ষমা করতে পারি তবে এক শর্তে।”
সিয়াম শুধু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো “তুমি যা বলবে তাই করতে রাজি চন্দ্র, শুধু ক্ষমা করে দাও আমায়। আমার প্রাণ চাইলেও..” চন্দ্রা মুখ চেপে ধরলো তার ডান হাত দিয়ে। এই প্রথম চোট লাগার পর তার ডান হাতকে সে কোনো কাজে লাগালো। তাও এই লোকটার উল্টোপাল্টা কথাবার্তা বন্ধ করার জন্যে। ভেবেই চন্দ্রার রাগ লাগলো। এভাবে বলার কি আছে..?
চন্দ্রা কথা না বাড়িয়ে গিটারটা এনে বিছানায় রাখলো তারপর দুই হাত আড়াআড়ি ভাবে বুকের কাছে ভাঁজ করে অন্য দিকে তাকিয়ে বললো “নিন শেখান তবেই ক্ষমা করব।”
সিয়াম অবাক হয়ে বললো “এতো রাতে..? কাল শিখিয়ে দেবো চন্দ্র এখন ঘুমোবে চলো।” চন্দ্রা জেদ ধরলো না তার এখনই শেখা লাগবে।
সিয়াম বেচারা আর কি করবে বউয়ের আবদার তাকে এখনই শেখাতে হবে।
সিয়ামকে রাজি হতে চন্দ্রা দেখে, গিটার নিয়ে সিয়ামের পাশে বসতে যেতেই সিয়াম একটানে চন্দ্রাকে নিজের কলার উপর বসিয়ে দিলো।
চন্দ্রা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো “এটা কি হলো..? এভাবে কিভাবে শেখাবেন আপনি..?”
সিয়াম বাঁকা হেসে বললো “সে আমার দায়িত্ব আমার কাছে শিখতে চেয়েছো যখন আমার মতন করেই শিখতে হবে।”

চন্দ্রাও আর কথা না বাড়িয়ে শেখাতে মনোযোগ দিলো।

হাতে গোনা মিনিট পাঁচক সব ঠিকঠাক মত চললেও সিয়াম এবার মুখ ডোবালো চন্দ্রার চুলে। চন্দ্রাকে কাছে টানা মাত্রই তার চুল খুলে গিয়েছিলো। আর সেখান থেকেই ভেসে আসা মাতোয়ারা গন্ধ কখন থেকে সিয়ামকে টানছিল শেষ মেশ সে থাকতে না পেরে কাজটা করেই ফেললো।
চন্দ্রা অনুভব করলো তারও গিটারে হাত থেমে গিয়েছে। হালকা মাথাটা সরিয়ে বললো “এই আপনার গিটার শেখাবার ধরণ হ্যাঁ…”
সিয়াম এবার চুল ছেড়ে চন্দ্রার কাঁধের কাছে নাক ঘষতে ঘষতে নেশালো গলায় বললো “বাকিটা আবার কাল শেখাবো চন্দ্রাবতী। চলো আজ তোমায় অন্যকিছু শেখাই।”

চন্দ্রাও আর কিছু বলতে পারলো না। ইতিমধ্যে ঘন ঘন শ্বাস ফেলা শুরু করেছে সেও। সিয়াম আসতে করে গিটার টা বেডের পাশে হেলান দিয়ে রেখে ডুব দিল চন্দ্রার মাঝে। শাড়ির আঁচল নামানোর আগেই চন্দ্রা হাত আটকে দিলো সিয়ামের। সিয়াম জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকালে। চন্দ্রা শুধু চোখ এদিক ওদিক করলো।

সিয়াম হালকা হেসে সরে গিয়ে পাশে টেনে চন্দ্রকে নিজের বুকে নিয়ে শুয়ে পড়লো। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললো “তোমার অনুমতি ব্যতীত কিছুনা, কক্ষনও না।
বাই দা ওয়ে হ্ট ব্যাগ লাগবে..? এনে দেবো..?”
চন্দ্রা সিয়ামের বুকে মুখ লুকিয়ে মাথা নাড়ালো। সিয়াম চন্দ্রার চিবুক তুলে ঠোঁটে একটা গাঢ় চুম্বন এঁকে বললো “আমার থেকে কিছু লুকবেনা চন্দ্রাবতী। এমনকি ছোটো থেকে ছোটো বিষয়ও না। আর লুকলেও আমি তোমার চোখ পড়তে জানি এমনিও বুঝতে পারবো।”
চন্দ্রা হাসলো আসলেই এই মানুষটাকে ভালো না বেশে থাকা যায়না, যেমনটা সে পারেনি।

____________________________________

সকালে উঠে সবাই হাসি মজা করেই ব্রেকফাস্ট সরলো। তারপর যে যার কাজে বেরিয়ে গেলো। পরে থাকলো শুধু সিয়া আর চন্দ্রা। ইন্দ্রাও দরকারি কাজে বের হয়েছে
সকাল সকাল।
চন্দ্রাও সিয়াকে শুভকামনা জানিয়ে বেরিয়ে পড়লো। সিয়া চেয়ার থেকে ব্যাগ নিয়ে বেরোতে যাবে সেইসময় সুইটি বেগম নামলেন নীচে। সিয়া উপেক্ষা করে বেরোতে গেলে তিনি গম্ভীর গলায় ডাকলেন “সিয়া তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। এখানে বসো একটু।”

সিয়ার মুখে লাগতে ইচ্ছে হয়না এই মহিলার। তাই চুপচাপ গিয়ে সুইটি বেগমের সামনের চেয়ারে গিয়ে বসলো।
সুইটি বেগম কতগুলো ছবি হোয়াটসঅ্যাপে সেন্ড করে বললেন “দেখো দেখে বলো কাকে পছন্দ আমি কিছুদিনের মধ্যেই তার সাথে বিয়ে ঠিক করবো। মুখে তো চুনকালি মাকিয়েই দিয়েছো আরো মাখানোর আগে বিদেয় হও।”

সিয়া বেশ আহত হলো শুনে। কিছুক্ষন ফোটো গুলো দেখে বললো “আমি এক্ষুনি বিয়ে করতে চাইছি না। আর এই ছেলেগুলোকেও পছন্দ হয়নি আমার। আমায় একটু সময় দাও।”
সুইটি বেগম গর্জে উঠলেন “সময় দিতে পারবনা। বিয়ে তোমার কিছুদিনের মধ্যেই হবে। নিজের পছন্দের কেউ থাকলে জানিও যদি ঠিকঠাক লাগে আমার তবে কথা এগোবো আর নয়তো আমার পছন্দের ছেলের সাথেই হবে।” বলেই গটগট করে তিনি উপরে চলে গেলেন।

সিয়া থম মেরে বসে রইলো। তার সাথেই কেনো হয় সবসময় এসব..? একটা ঝড় পারতে না পেরোতেই আরেকটা ঝড়। চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। সেসব দিকে সে পাত্তা দিলো না এসব এখন তার নিত্যদিনের সঙ্গী। পাশ থেকে ফোন তুলে কাঁপাকাঁপা হাতে একটা নাম্বার ডায়েল করলো।
ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই সিয়া কেঁদে বললো “এক্ষুনি একবার দেখা করতে পারবে..? প্লিজ প্লিজ।”

#চলবে..?

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #২৬

একটা নিরিবিলি কফিশপে সিয়া মাথা নীচু করে বসে আছে। সামনের মানুষটি একবার হাত ঘড়ি দেখলো তারপর আবার সিয়ার দিকে তাকালো সিয়া তাকে ডেকে আনার পর কুড়ি মিনিট অতিক্রম হতে চললো তাও সিয়া একইরকম ভাবে বসে আছে। সামনের মানুষটি সব বাদ দিয়ে মৃদু স্বরে ডাকল ” সিয়া ”

সিয়া মাথাটা তুললো তার চোখ দুটো টকটকে লাল। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বললো ” আমায় বিয়ে করবে অপূর্ব..?”

অপূর্ব আকাশ থেকে পড়লো। সে কি দিনেও এসব স্বপ্ন দেখছে..?
যাহ নাহ্ নিজের মনকে কষিয়ে ধমক দিল। দিয়ে বললো ” কি বলছো সিয়া ভেবে বলছো…? হটাৎ বিয়ে..?”

সিয়া এবার কাঠ গলায় উত্তর দিলো “এতকিছু বলতে পারবো না শুধু উত্তর দাও পারবে কি না..? নইলে আমি মায়ের পছন্দের ছেলে দেখে বিয়ে করে নেবো।”

অপূর্ব চমকালো। সিয়ার প্রস্তাবটা ঠিক তার কাছে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো, তাই তার বিশ্বাস করতে অসুবিধা হচ্ছিলো একটু। নিজেকে সামলে বললো ” কিন্তু তুমি আমার কিংবা আমার ফ্যামিলির ব্যাপারে কিছু জানো না সিয়া। আর আমাকে একটু সময় দাও। হুট করে আমি বলে দিতে পারি না।” আসলেই তার সিয়ামের সাথে কথা বলা জরুরী এই বিষয়ে। নইলে সে পারলে এক্ষুনি সিয়াকে বিয়ে করে ঘরে তুলতে পারে। তার ঘরের কেউ কোনো আপত্তি জানাবে না এই বিষয়ে। কিন্তু সে হুটপাট সিদ্ধান্ত নিতে চায় না। সসম্মনানে ঘরে তুলতে চায় তার মনের রাণীকে।

সিয়া পুনরায় বললো “আমার জানার দরকার নেই কিচ্ছু। এক সপ্তহ সময় দিলাম ভেবে বলো এর মধ্যে বিয়ে করতে পারলে ভালো নয়তো আমি মায়ের কথা মতোই বিয়ে করে নেবো অন্যকোথাও। ভেবে বলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।” বলেই দেরি না করে কাঁধে ব্যাগ উঠিয়ে চলে গেলো সেখান থেকে।

অপূর্ব বসে রইলো। খুশি হওয়ার কথা হলেও খুশি হতে পারলনা তেমন সে। সিয়া তাকে বিয়ে করবে বলছে ঠিকই তবে তাতে একফোঁটাও ভালবাসা নেই। শুধুই বন্ধুত্বের খাতিরে এইভাবে কি সংসার হবে তাদের..?

সিয়া বেরিয়ে অফিসে যাওয়ার বাস ধরার জন্য দাঁড়ালো। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো হালকা মেঘ করেছে। দৃষ্টি ফেরালো সিয়া সে আর অচেনা কোনো পুরুষকে জীবনে জড়াতে চায় না তাই এই সিদ্ধান্ত। যদিও অপূর্বকে সে পুরোপুরি চেনে না তবে সিয়ামের বন্ধু মানে অনায়াসে ভরসা করাই যায়। তারপর এখন তারা ভীষন ভালো বন্ধু..সিয়ার মনে হলো সংসার করতে হলে এখানেই সে চেষ্টা করতে পারবে। অপূর্বকে এতদিনে এইটুকু সে চিনিছে। আদেও চিনেছে..? একটা মানুষটাকে এতো বছর ধরেও চিনতে পারলো না আর আরেকজনকে এই কয়েকটা দিনেই চিনে ফেললো। ব্যাপারটা সিয়ার কাছেও বেশ হাস্যকর।

_______________________________

সিয়াম জরুরী কল করে চন্দ্রাকে ডাকিয়ে আনলো তার অফিসে। চন্দ্রা আসতেই একজন বললো সে তার রেস্ট রুমে আছে। চন্দ্রা গিয়ে সেখানে একবার নক করতে ভিতর থেকে ভরাট গলায় উত্তর এলো ” কাম ইন ” চন্দ্রা বেশ অবাক হলো সিয়াম এই গলায় কক্ষনও বাড়িতে কথা বলে না কারোর সাথে।
দরজা টা খুলতেই দেখলো সিয়াম আগের দিনের মতো সামনের দিকে ডেস্কে হেলান দিয়ে বসে কিছু ফাইল দেখছে।
চেনা পরিচিত কড়া পারফিউমের মিষ্টি গন্ধটা বাতাসে ভেসে নাকে আসতেই মাথা তুলে তাকালো সিয়াম। সামনে চন্দ্রাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। কিছুক্ষন দেখে চন্দ্রকে পরখ করে ফাইল পাশে রেখে দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে বললো “কাছে এসো”
চন্দ্রা দরজা ভেজিয়ে চমকিত নজরে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে বললো “কিহ্হহ”
সিয়াম ঠোঁট এঁটো করে হাসলো বললো ” ওতো দূর থেকেই কি কথা বলবে নাকি..?”
চন্দ্রা হাঁপ ছেড়ে বললো “তো এরম করে বলুন না।” বলেই নিজের ব্যাগটা ডেস্কে সিয়ামের পাশে রাখতেই সিয়াম হ্যাঁচকা টান মেরে নিজের কাছে নিয়ে এলো। চন্দ্রা টাল সামলাতে না পেরে সিয়ামের বুকে পড়লো এক হাত সিয়ামের পিঠে। চন্দ্রা চোটজলদি মাথা উঠিয়েই বললো “এই আপনার জরুরী কাজ..? এই জন্য আপনি আমায় ওতো দূর থেকে ডাক করলেন..?”
সিয়াম হেসে বললো “না জরুরী আরো কাজ আছে কিন্তু এটাও তার মধ্যে একটা জরুরী কাজ।”
চন্দ্রা হালকা হেসে গলা জড়িয়ে বললো ” আজকাল বড্ডো লাগাম ছাড়া হয়ে যাচ্ছেন মশাই।”
সিয়াম মুখটা আরেকটু কাছে নিয়ে গিয়ে বললো ” এতো আদুরে বউ সামনাসামনি ঘুরলে দোষ নেই, আর বর একটু আদর করলেই দোষ..?”
আমি কোথায় ঘুরলাম আপনিই তো ডাকলেন। কথাটা চন্দ্রার মুখ দিয়ে বেরোরো না ঢোঁক গেলার সাথে গিলে ফেললো।

সবে ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ হবে ওমনি দরজায় শশব্দে করাঘাত। সিয়াম চোখ বুজে দম নিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো। চোখ মুখ দেখেই তার বোঝা যাচ্ছে আজ দরজার বাইরের লোকটাকে সে খুন করবে। চন্দ্রা হাসলো তার বেশ মজা লাগছে উচিৎ শিক্ষা হয়েছে তার বরের। যদিও তার স্পর্শ চন্দ্রার বিশেষ ভালো লাগে তাই বলে সে সময় কাল না বুঝেই এসব করবে তার তো কোনো মানে হয় না।

সিয়াম এবার হালকা গলার স্বর উঁচিয়ে বললো “ভিতরে আয়।”
পিয়াস ভিতরে ঢুকলো। চন্দ্রাকে দেখে সালাম দিলো। চন্দ্রাও সালামের উত্তর দিলো। সিয়াম বললো “মিট হিম! হি ইস মাই অ্যাসিস্ট্যান্ট কাম ফ্রেন্ড পিয়াস।”
চন্দ্রা মিষ্টি হাসলো। সিয়াম এবার দুজনকে বললো ” বসো তোমাদের সাথে পার্সোনাল কিছু কথা আছে।”
দুজনেই ঘরের সাথে লাগোয়া সোফায় বসলো। হাতে একটা রিমোট নিয়ে সিয়াম ও এসে বসলো চন্দ্রার পাশে।

সিয়াম চন্দ্রাকে উদ্দেশ্য করে বললো “এখন যা দেখবো মন শক্ত করে দেখবে। আর পিয়াসের সাথে জড়তা রাখবে না ওকে নিজের বড়ো ভাইয়ের চোখে দেখো ও আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু।”
চন্দ্রা ঘাড় নাড়ালো। সিয়াম রিমোট টিপে মনিটর অন করতেই সামনে এলো একটি ষাটের ঊর্ধ্বে ভদ্রলোকের ছবি।
চন্দ্রা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সিয়ামের দিকে তাকাতেই সিয়াম বললো “ইনি হলেন আফজাল হোসেন। সুইটি সরি আমাদের প্রিয় মনির স্বামী।”
চন্দ্রা ভ্রূ কুচকে বললো “মানে যাকে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন..?”
সিয়াম বাঁকা হেসে বললো ” না যার সাথে তিনি স্বামী থাকার সত্বেও পরকীয়ায় লিপ্ত হয়েছিলেন। এমনকি সিরাজও এই আফজাল সাহেবের সন্তান।”
সিয়া ভীষন রকম চমকালো। তার কথা বলার মত ভাষা বেরোলো না মুখ দিয়ে।
হটাৎ কিছু মাথায় আসতেই জিজ্ঞেস করল ” কিন্তু সিয়া যে একবার বলেছিল সিয়া ও সিরাজ যমজ।”
সিয়াম বললো ” হ্যাঁ পরিচয় সব জায়গায় তাই দেওয়া হয়। কিন্তু সিয়া একমাত্র আগের পক্ষের মেয়ে সিরাজ নয়।”
চন্দ্রা হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো ” আগের পক্ষের মানে..?”
সিয়াম পুনরায় বললো “মনি ডিভোর্সের এক মাসের মাথায় আবার বিয়ে করে। তার পরেই সিরাজের জন্ম। সিয়া আর সিরাজ যমজ নয়। সিয়া সিরাজের দুই বছরের বড়।”

চন্দ্রা অবিশ্বাস চোখে চেয়ে থাকে পর্দায়। সিয়াম আবার রিমোট ঘোরায়। এবার আসে এক মেয়ের হাস্যোজ্জ্বল ছবি চন্দ্রা সেই মেয়েটার সাথে সুইটি বেগমের বেশ মুখের মিল পেলো।
এবার পিয়াস বললো ” এটি হলো সুইটি বেগমের পরের পক্ষের মেয়ে সিনথিয়া। সিরাজের দুই বছরের ছোট।”
সিয়া এবার নির্বিশেষে চেয়ে প্রশ্ন করে “মনি এইকারণেই সিয়াকে নিজের মেয়ে বলে মানেন না..?” সিয়াম ঘাড় নাড়ায়।
চন্দ্রার এবার ভীষণ খারাপ লাগে সিয়ার জন্য।
চন্দ্রার এসব ভাবনার মধ্যেও তারা মাথায় আসে প্রশ্ন জাগে সে সিয়ামকে বলে “আচ্ছা তাহলে মনি সিয়া সিরাজকেই শুধু কেনো নিয়ে এলো এই বাড়িতে..? আর তার স্বামীই বা এখন কোথায়..?”
সিয়াম সোফায় বসে বললো “কারণ তাদের দুজনের প্ল্যান ছিলো আমাদের বাড়ির সম্পত্তি কি করে নেওয়া যায়। তখন ওনার স্বামী তার ওই ছোট্ট মেয়ে নিয়ে অন্য বাড়ি থাকতেন। কিছু বছর পর সব প্ল্যান মতো চললেও আফজাল সাহেব বিপত্তি ঘটালেন এসব সম্পত্তি ছেড়ে তিনি আরেক কোটিপতি মহিলার হাত ধরে পারি জমালেন বিদেশ। এইদিকে মনি পড়লো অসুবিধায় তখন সিয়া সিরাজ সিনথিয়া সবারই বোঝার ক্ষমতা হয়েছে। তিনি চাইতেন না সিনথিয়াকে এসবের মধ্যে জড়াতে। কারন বাবার চলে যাওয়ায় সে এমনিই মেন্টাল শকে ছিলো ভীষণ।”

চন্দ্রা থম মেরে কিছুক্ষন বসে থাকলো। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। এতো কিছু..? আমাদের চোখের আড়ালে কতো কি ঘটে যার সাথে ঘটে সে ছাড়া হাতে গনা কজনই টের পায়। আর তারপর এইরকম কাহিনী হলে তো হলোই বিশ্বাস করেই অবিশ্বাস্য লাগে এইসব সত্য।

চন্দ্রা নিজেকে সামলে বললো ” লাস্ট দুটো প্রশ্ন ”
চন্দ্রার বাচ্চাদের মতো হাতের আঙ্গুল দেখিয়ে দুটো বলায় তা দেখে আলতো হাসলো সিয়াম, কাছে এসে চন্দ্রার গাল টিপে বললো ” দুটো কেনো আরো একশটা প্রশ্ন করো। এই বান্দা সবসময় হাজির তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে।”
চন্দ্রা হালকা ইতস্তত করে পিয়াসের দিকে তাকালো। দেখলো সে মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে।
চন্দ্রা আর কথা না বাড়িয়ে বললো “এই জন্যেই কি মনি বাড়িতে থাকে না বেশি তার মেয়ের কাছে গিয়ে থাকে বলে..?”
সিয়াম এবার একটু সিরিয়াস মুখ করে বললো “হুম সিয়া আর সিরাজ জানে মনি তার বান্ধবীর সাথে ছোট্ট একটা ব্যাবসা করে তাই সেখানেই বেশি থাকে।”

সিয়াম এবার চন্দ্রার হাত নিজের হাতে নিয়ে বললো “তোমার হেল্প লাগবে চন্দ্র।”
চন্দ্রা নির্দ্বিধায় বলে “কি হেল্প লাগবে বলুন আমি সবরকম সাহায্যের জন্য প্রস্তুত আছি।”
সিয়াম এবার বললো “আমার যে সম্পত্তির উইলটা মনির
কাছে সেটা ওই বাড়িতে আছে মানে যেখানে সিনথিয়া থাকে। আর সেখানে কড়া পাহারা থাকে সবসময় মনি আর কিছু চেনা পরিচিত মহিলা ছাড়া সেই বাড়িতে কেউ প্রবেশ করতে পরে না।”

চন্দ্রা ভ্রু কুঁচকে বললো “এখানে আমি কি সাহায্য করতে পারি..?”
সিয়াম বললো ” প্রথমে সিনথিয়াকে তোমায় বন্ধু বানাতে হবে তারপর ওর সাথে ওর রুমে গিয়ে আমায় ওই ফাইলটা এনে দিতে হবে। বলো পারবে..?”
চন্দ্রা মুচকি হেসে বললো ” কতটা পারবো জানি না তবে নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।”

সিয়াম খুশি হলো সে জানতো চন্দ্রা তাকে না করবে না, আর চন্দ্রা ছাড়া এই কাজ কেউ করতে পারবে না পারলেও সিয়াম ভরসা করতে পারবেনা তার উপর। সিয়াম চন্দ্রাকে গেট অবধি ছেড়ে আসার জন্য বাইরে পা বাড়ালো। পিয়াস কে বললো মনিটর ত যাতে অফ করে দেয়।

পিয়াস মনিটরের কাছে গিয়ে সিনথিয়ার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকলো। মেয়েটা একসময় তার প্রাণ বাঁচিয়ে ছিলো। তখন জানতো না পিয়াস মেয়েটার আসল পরিচয়। পিয়াসের বাড়ির কাছাকাছি থাকে মেয়েটি। পিয়াস প্রায়সই দেখে। কথাটা সিয়ামও জানে। কিন্তু সবসময় তাকে দূরত্ব বজায় রাখতে বলে তার থেকে সুইটি বেগমের জন্য, তিনি জানতে পারলে দুবার হাত কাঁপবেনা পিয়াসকে মারতে। মেয়েকে ভীষণ রকমের ভালোবাসেন তিনি। পিয়াসও সিয়ামকে নিজের বড়ো ভাইয়ের চোখে দেখে তাই সিয়ামের কথা সে অমন্য করে না।

#চলবে..?

বেড়াজাল পর্ব-২৩+২৪

0

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #২৩

সিরাজ ইন্দ্রা দুজনেই হসপিটালে পৌঁছে চন্দ্রার কেবিনের দরজার কাঁচ দিয়ে দেখে সিয়াম চন্দ্রার হাত মাথায় ঠেকিয়ে বসে আছে পাশে।
ইন্দ্রা ও সিরাজ একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে আর ভিতরে না ঢুকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পিয়াসের কাছে যায়।
পিয়াস ওদের দেখে উঠে দাঁড়ায়। ইন্দ্রা ব্যাকুলতা নিয়ে জিজ্ঞেস করে “আপনি জানেন ডাক্তার কি বলেছে..? কেমন আছে আমার বোন..? কিছু হবে না তো..?”

পিয়াসের কাছে ইন্দ্রা অচেনা হলেও তার ধরতে সময় লাগে না সে চন্দ্রার বোন। কারন তাদের দুই বোনকেই অনেকটা একই দেখতে।
পিয়াস আশ্বাসের সাথে বলে ওঠে “চিন্তা করবেন না। ভাবী ঠিক আছে একদম। শুধু কিছু কিছু জায়গায় চোট লেগেছে তাই ডাক্তার বলেছে কিছুদিন বেড রেস্টে থাকতে, তাহলেই ঠিক হয়ে যাবে।” ইন্দ্রা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে।
এর মধ্যেই দেখা যায় দরজা ঠেলে সিয়ামকে বাইরে আসতে। সিয়াম ওদের দুজনকে দেখে বলে “এতক্ষণ সময় লাগলো যে তোদের..?আর ইন্দ্রা তুমি দেখতে চাইলে ভিতরে গিয়ে দেখা করে আসতে পরো।”

ইন্দ্রা সে কোথায় সায় দিয়ে ভিতরে চলে গেলো চন্দ্রার কাছে।
সিরাজ সিয়ামকে উদ্দেশ্য করে বললো “আসলে ভাইয়া রাস্তায় জ্যাম ছিলো। তুমি কিছু খাবে এনে দেবো..?আর রাতে কি তুমি থাকবে..?
সিয়াম হতাশ গলায় বললো “আমার এখন খাবার গলা দিয়ে নামবেনা রে। তোরা খেয়ে নে কিছু। আর হ্যাঁ রাতে আমি এখানেই থাকবো।”

ইন্দ্রা ততক্ষণে কেবিনের বাইরে এসে সিয়ামের উদ্দেশ্যে বললো “ভাইয়া একটা রিকুয়েস্ট রাখবেন।”
সিয়াম বললো “এভাবে বলছো কেনো ইন্দ্রা আমিও তো তোমার বড়ো ভাইয়ের মতো তাই আবদার করো।”
ইন্দ্রা এবার হালকা হাসি মুখ করে বললো “আজ রাতে আমি থাকি চন্দ্রার কাছে..? এমনিতেও আজ তো ওর হুশ ফিরবে না। আপনারা বরং কাল সকাল সকাল চলে আসবেন এখন গিয়ে রেস্ট নিন।”
সিয়াম বললো “না ইন্দ্রা তা হয় না এই অবস্থায় আমি ওকে ছেড়ে কিভাবে চলে যাবো..?আর তুমিই বা একা কিভাবে সামলাবে..?”
সিরাজ এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার মুখ খুললো “হ্যাঁ ভাইয়া ইন্দ্রা ঠিক বলেছে। তুমি বাড়ি চলো কি অবস্থা দেখো নিজের পাগল পাগল লাগছে তোমায়। গিয়ে ফ্রেশ হয়ে একটু ঘুমিয়ে কাল সকালে আসবে এমনিও তো ভাবীর ঘুম কাল সকালেই ভাঙবে।”

সিয়াম বাড়ি যেতে না চাইলেও সবাই মিলে তাকে জোর করে পাঠালো বাড়ি।
বাড়ি এসে ঘরে ঢুকতেই সিয়ামের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। অন্যসময় হলে মেয়েটা হাসি মুখ করে দরজা খুলতো। তার জন্যে অপেক্ষা করে বসে থাকতো। সে কাজ করলে তার চোখের সামনে ঘুরঘুর করতো। সেসবই ভীষণ ভালো লাগতো সিয়ামের। আজ যেনো মনে হচ্ছে পুরো বাড়িতে নিস্তব্দতা নেমে এসেছে।
সিয়াম ফ্রেশ হয়ে নিলো। আজ আর কিছু তার খেতে মন চাইছে না। তাই একটু কফি নিয়ে ল্যাপটপটা নিয়ে বসলো।
কিছুক্ষণ পর সিয়াম ল্যাপটপ বন্ধ করে পাশে রেখে দিল বিরক্তিতে। তার কিছুই ভালো লাগছে না। চন্দ্রাকে দেখার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠছে। কিন্তু এখন তো আর তাকে দেখা করতে দেবেনা সকালের আগে। সিয়াম কফিটাও শেষ করতে পারলো না। ঘরের দরজা ভালোভাবে আটকে পর্দা টেনে গিয়ে দাঁড়ালো ব্যালকনিতে। তার ব্যালকনিটা বাগানের হালকা পিছন দিক হওয়ায় পরিষ্কার ব্যাতিত সেখানে কেউ যায় না। যদিও সিয়ামের সুবিধে এতে সে যাবতীয় দরকারি কাজ এখানে করতে পারে।

সিয়াম আকাশের দিকে তাকালো। চাঁদ দেখা যাচ্ছে না আকাশে। সিয়াম আনমনে হাসলো আজ তার ঘরের চাঁদ আর আকাশের চাঁদ দুজনেই তার থেকে মুখ ফিরিয়ে আছে।

সিয়াম বেশ খানিকক্ষণ একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকলো। মনে মনে কথা সাজালো কিভাবে চন্দ্রার সুস্থ হওয়ার পর তাকে সবটা গুছিয়ে বলবে। কিন্তু অবাধ্য মনটা কিছুতেই মানতে চাইছে না তার এখন তার নিজের উপরই রাগ হচ্ছে কেনো যে চন্দ্রার কাছে সে রইল না।
এসব ভাবতে ভাবতেই সিয়াম ফোন বের করে পিয়াসকে ফোন লাগালো। পিয়াস ফোন তুলতেই সিয়াম বললো ” সব ডিটেইল বের করেছিস লোকটার..?”
পিয়াস ওপাশ থেকে বললো “তোকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাচ্ছি সব। আর শোননা বলছি যে..” বলেই থামলো পিয়াস।
সিয়াম বললো “হেজিটেড করিসনা বল যা বলবি।”
পিয়াস আমতা আমতা করে বলল “বলছি দেখ তুই কিছু করতে যাস না হিতেবিপরীত হবে।”
সিয়াম বাঁকা হেসে বললো “এই সিয়াম ওতো কাঁচা কাজ করে না তা তো তোর জন্য পিয়াস। আর বাই দা ওয়ে লোকটা ড্রিংক করে গাড়ি চালাচ্ছিল।”
পিয়াস অবাক হয়ে বলে “সত্যি..? দেখে তো বেশ ভদ্র সভ্য মনে হলো। মনে হলো না তো ড্রিংক করে গাড়ি চালাচ্ছিল।”
সিয়াম চুপ থেকে বললো “ওই জন্যই আমি এতো কথা বলার পরও সে চুপ করে ছিলো। যদি আমি ধরে নি। ভাবলো কি হসপিটালে নিয়ে এসে নাম কিনে নিলেই এই সিয়াম তাকে ছেড়ে দেবে..? নেভার! জাস্ট দেখতে থাক পিয়াস তুই কি থেকে কি হয়। ” সিয়াম ফোন রেখে দেয়।
ফোনে চন্দ্রার একটা ছবি বার করে জুম করে দেখতে থাকে আর বিড়বিড় করে বলে “সিয়ামের চন্দ্রাবতীর গায়ে আঁচড় দেওয়ার ফল সবকটাকে ভুগতে হবে চন্দ্রাবতী।”
ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সিয়াম বোঝে না কখন সকাল হয়ে গেছে। শেষ রাতের দিকে তার একটু চোখ লেগেছিল বটে কিন্তু একটা দুঃস্বপ্ন এসে সিয়ামের সেই ঘুমটাও ভাঙিয়ে দিয়েছে।
সিয়াম উঠে ফ্রেশ হয়ে বাথরুম থেকে বেরোতেই অভ্যাস বশত রোজকার মতো চেঁচিয়ে উঠলো “চন্দ্রা শার্টটা কই আমা…” পুরো কথা শেষ করতে পারলো না খেয়ালে এলো চন্দ্রা নেই এখানে। বুক টা মোচড় দিয়ে উঠলো সিয়ামের। এই কদিনেই চন্দ্রা তার অভ্যাস পুরোপুরি খারাপ করে দিয়েছে। মেয়েটা একদিন নেই তাতেই তার এই অবস্থা। এই জন্যেই মেয়েটাকে সে বাপের বাড়িও যেতে দেয়না গেলেও থাকতে দেয় না। সিয়ামের মাকে ছাড়া বাড়ি যেমন প্রাণহীন লাগতো তার কাছে চন্দ্রাকে ছাড়াও সিয়ামের একই অনুভুতি হয়।
সিয়াম আর না ভেবে তাড়াতাড়ি দরজা দিয়ে বেরোতে গিয়ে দেখলো সিয়া নামছে সিড়ি দিয়ে। সিয়াও সিয়ামকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে এলো সিয়ামের কাছে এসে বললো “ভাইয়া এতো সকাল সকাল সবাই কোথায়..? ভাবী ওঠেনি..?আসলে আমি কাল স্লিপিং পিলস্ খেয়ে ঘুমিয়েছি তাই দেরি হলো উঠতে।”
সিয়াম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিয়াকে নিজের কাছে ডাকলো। সিয়াও বিড়াল ছানার মত গুটি গুটি পায়ে সিয়ামের কাছে গিয়ে বসলো। সিয়াম সিয়ার মাথায় হাত রেখে বলল “আয়নায় দেখেছিস নিজেকে..?কি থেকে কি হয়েছিস..? এসব দেখে আমাদের কষ্ট হয় না..?জীবনের সব সিদ্ধান্তই তো আগে আমায় জিজ্ঞেস করে নিতিস এখন কি খুব বড়ো হয়ে গেছিস..?”
সিয়ার এবার চোখে জল এলো। আসলেই ভীষণ খারাপ কাজ করেছে সে তার উচিৎ হয়নি একটা বিশ্বাসঘাতকের জন্য তার ভালোবাসার মানুষগুলোকে কষ্ট দেওয়া। সিয়া সিয়ামের কোলে মাথা রেখে কান্নারত অবস্থায় বললো “ক্ষমা করো ভাইয়া ক্ষমা করো আর এমন করবো না। আমি সত্যিই অনেক বড়ো ভুল করেছি। আসলে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি তোমরা যদি বকাঝকা করো। আর হবে না ভাইয়া আমি আবার আগের মত হওয়ার চেষ্টা করবো। কারোর জন্য আমি আর নিজের জীবন শেষ করবো না।

সিয়াম মনে মনে বেশ অবাক হলো সিয়ার কথা শুনে কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ করলো না। শুধু মনে মনে অপূর্বকে ধন্যবাদ দিলো। সিয়ার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো ” সিয়া তোর ভাবীর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। আমি এখন সেখানেই যাচ্ছি।”
সিয়া ভীষণ রকম চমকে বললো ” কিহহহহহ..? ভাবীর অ্যাক্সিডেন্ট! কখন কীভাবে..? আর তোমরা আমায় একটাবারও বলেনি কেনো ভাইয়া..?”
সিয়াম আস্থা দেওয়ার সুরে বললো “শান্ত হ। তোর নিজের শরীর অসুস্থ এই অবস্থায় আমিই সিরাজকে বলতে বারণ করেছি।”
সিয়ার বেশ খারাপ লাগলো। এতো বড়ো অঘটন ঘটে গেলো আর সে জানেই না।মন খারাপ করে বলল “আমিও যাবো ভাইয়া হসপিটাল।”
সিয়াম ঘড়ি দেখলো আর দু-মিনিটও তার লেট করলে চলবে না।”
সিয়াম সিয়াকে ধীর স্বরে বললো “তুই আগে ফ্রেশ হ। নাস্তা কর, আমি অপূর্বকে পাঠিয়ে দিচ্ছি সেও দেখতে যাবে বলেছিলো। আমার এখন একটু তাড়া আছে।”
সিয়া ঘাড় নেড়ে চলে গেলো নিজের রুমে।
সিয়াম সিরাজকে ফোন লাগালো। সিরাজ জানালো সে আগে থেকেই অপেক্ষা করছে তার গাড়িতে। সিয়াম আর সিরাজ এবার সোজা হসপিটালে গেলো।

সিয়াম কেবিনে ঢুকে দেখলো একজন নার্স ছাড়া কেউ নেই কেবিনে। সিয়াম একবার চন্দ্রাকে দেখে নার্সকে জিজ্ঞেস করলো “ওর এখনো ঘুম ভাঙছে না কেনো..?” নার্স বললো “ভেঙে যাওয়ার তো কথা। কিছুক্ষণ পরও না ভাঙলে আপনি ডক্টরের সাথে কথা বলবেন একটু। নিজেরা তাড়াহুড়ো করে ডাকতে যাবেন না এতে পেশেন্টের মাথায় চাপ পড়বে।”
সিয়াম ঘাড় নাড়ালো। নার্সটা বেরিয়ে গেলো। সিয়াম এবার চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে তার বাম হাতটা আগের মত দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে চন্দ্রার কানে ঠোঁট ঠেকিয়ে ঘোর মেশানো কণ্ঠে ডাকলো ” চন্দ্রাবতী.. চোখ মেলে দেখো একজন কাতর হয়ে গেছে তোমার ঐ চোখ দুটো দেখার জন্য।”
বিস্ময়কর ঘটনা নাকি ধরতে পারলো না সিয়াম। কিন্তু এই কথা শুনে চন্দ্রা হালকা নড়ে উঠলো। মিনিট দশেক বাদ পিট পিট করে চোখ খুললো।
সিয়ামকে সামনে দেখে মুখে হালকা হাসি ফুটলেও টা মুহূর্তেই মিলিয়ে গেলো মাথায় কিছু স্মৃতি ধাক্কা দিতে। চন্দ্রা কিছু বলার জন্য উত্তেজিত হয়ে পড়ল। কিন্তু কথা বলতে পারলো না গলা দিয়ে তার স্বর বেরোচ্ছে না। আচমকা উত্তেজিত হয়ে পড়ায় সিয়ামও দেখে ঘাবড়ে গেলো। কি করবে না ভেবে পেয়ে তাড়াহুড়ো করে ডক্টরকে ডেকে আনলো। ডক্টর নার্স এসে ধরে ইনজেকশন দিয়ে চন্দ্রাকে শান্ত করলেন মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দিলেন।

সিয়াম পুরো বিষয়টাই লক্ষ্য করলো। আসলেই কি সে অনেক বড়ো ভুল করেছে..? যেই কারণে সিয়ামকে এক পলক দেখেই চন্দ্রা এইরকম করছে..?
আচ্ছা এখন কি চন্দ্রা সত্যি তাকে এখন ছেড়ে দেবে..? নানা ছাড়বে বললেই কি সিয়াম ছেড়ে দেবে নাকি। তার কাছে জোর করে হলেও আটকে রাখবে। নাহলে যে সিয়ামও ভালো থাকার এক মাত্র সম্বল হারাবে।

_______________________________

অপূর্ব সিয়ার বাড়ির সামনে গাড়ি নিয়ে ওয়েট করছে। একবার হাত ঘড়ি দেখছে তো একবার সিয়া আসছে কি না তা দেখছে।
এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতেই অপূর্বের চোখ গেলো সিয়ার বাড়ির দরজার দিকে। সিয়া হেঁটে হেঁটে আসছে।
অপূর্বের রোদ থেকে বাঁচার জন্য যে সানগ্লাসটা চোখে পড়েছিল সেটা এক টান মারে ডান হাত দিয়ে খুলে ফেললো।
সিয়া একটা গোলাপি কালারের চুড়িদার পড়েছে তার গোলাপি ওড়নাটা মাথায় দেওয়া। মুখে তেমন কোনো কৃত্রিম প্রসাধনি নেই। সূর্যের কিরণে গাল গুলো চকচক করছে। ঠোঁটে শুধু একটু লিপবাম যার জন্যে ঠোঁটটাও ঝিলিক মারছে সূর্যের আলোয়।
অপূর্ব আবার সানগ্লাসটা পরে নিল। তাপে তার চোখ দুটো ঝলসে যাচ্ছে। না সূর্যের তাপ নয়, এটা অন্যরকম তাপ।
সিয়া এসে অপূর্বের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে তার পাশে ড্রাইভিং সিটে বসলো।
অপূর্ব তাকালো না। শুকনো ঢোঁক গিললো শুধু দুবার। তারপর গাড়ি চলতে শুরু করল।
বাইরের আওয়াজ ছাড়া গাড়ির ভিতরে পিনপিনে নীরবতা। অন্যসময় হলে অপূর্বই যেচে যেচে হাজারটা কথা বলে কিন্তু আজ তাকে পুরো শান্ত লাগছে। সিয়ার দিকে ভুল করেও একবার তাকায়নি সে।
সিয়া এবার জড়তা করতে নিজেই বলে উঠলো “আপনি ঠিক ছিলেন অপূর্ব। আমি সত্যিই বড্ড বোকা নইলে কি আর একজন বিশ্বাসঘাকতকের জন্য নিজের প্রাণ দিতে যাই।”
অপূর্ব শুনে হালকা হাসলো তারপর বললো ” তুমি অনেক স্ট্রং সিয়া। নইলে এতো সহজে কেউ বাস্তবতা মেনে নিতে পারে না।”
সিয়া উত্তর দিলো না জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে থাকলো। অবশ্যই বাইরে সে প্রচন্ড স্টং মেয়ে কিন্তু ভিতরে ভিতরে যে চুরমার হয়ে গেছে। কিন্তু সে কথা কাকে বলবে..?

______________________________________

বিকেল অবধি সবাই প্রায় হসপিটালই ছিলো। চন্দ্রাকে ছুটি করিয়ে সবাই মিলে তাকে সিয়ামের বাড়ি নিয়ে এলো। চন্দ্রা মানা করতে পারলো না তার ভিতর সেইটুকু শক্তি অবশিষ্ট নেই এখন। কিন্তু সবাই থাকলেও বেহায়া চোখ দুটো যাকে খুঁজছে সে কই..?
সিয়াম চন্দ্রার সামনে আর যায়নি। এই অবস্থায় চন্দ্রা আবার উত্তেজিত হলে ডাক্তার ছাড়তো না হসপিটাল থেকে। তাই সিয়াম সবাইকে সব বুঝিয়ে অফিস চলে গেছে নিজের যদিও ওখান থেকে বসে বসেই সবটা পর্যবেক্ষণ করেছে সে।

রাত ১২ টা

চন্দ্রা নিজের রুমে একটা বই খুলে কোলে নিয়ে বসে আছে। তার ভিতরটা অস্তির অস্থির লাগছে সিয়াম কোনোদিন এতো দেরি করে না। মিনিট কুড়ি আগে ইন্দ্রা চন্দ্রাকে একা রেখে নিজের রুমে গেছে। চন্দ্রা ফোন হাতে নিয়েও ফোন করেনি সিয়ামকে এক তো সে কথা বলতে পারবে না দুই তার অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা বাকি।
তখন সে একটু বেশিই অভার রিয়েক্ট করে ফেলেছে সিয়ামের সাথে।

ধীরে ধীরে তার সামনে অনেক সত্যিই আসছে। চন্দ্রা এই বিষয় ইন্দ্রাকে কিছু করে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে। ইন্দ্রা তাকে অনেক বুঝিয়েছে এই ব্যাপারে। তার ধারণা কোনো কারণ না থাকলে সিয়াম নিশ্চই এইরকম করতো না। ইন্দ্রা কথায় কথায় এটাও জানিয়েছে যে তাকে তার আগের লাইফ থেকে বের হতে যে মানুষটা সাহায্য করেছে সে সিয়ামই। তাই ইন্দ্রা সিয়ামকে আগে থেকে চেনে।
চন্দ্রার মাথায় প্রচুর প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। ইন্দ্রা পুরো বিষযটাতার কাছে ক্লিয়ার করেনি। কতক্ষণে যে তার গলা ঠিক হবে আর সিয়ামের কাছে প্রশ্নের ঝুলি নিয়ে বসতে পারবে এই ভেবে যাচ্ছে শুধু।

এই মধ্যেই দরজায় খট করে আওয়াজ হয়। সিয়াম ভিতরে আসে। চন্দ্রা শীতল দৃষ্টিতে তাকায় সিয়ামের দিকে।
সিয়াম ভাবেছিল রাত করে গেলে চন্দ্রা ঘুমিয়ে যাবে তাই সে রাত করেই এসেছে কিন্তু চন্দ্রাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে সে বেশ অবাক হয়েছে। আচ্ছা চন্দ্রা কি তার অপেক্ষা করছিল..?
সিয়াম আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে “তুমি এখনও ঘুমাওনি..? খেয়েছো রাতে..? মেডিসিন ঠিকঠাক নিয়েছ..?”
চন্দ্রা কিছু বলে না সিয়ামের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বইয়ের পাতায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
সিয়াম দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে প্রথমটা ছাড়া সবকথা প্রশ্নের উত্তরই তার জানা। সে বারে বারে সিয়া ইন্দ্রাকে ফোন করে চন্দ্রার খোঁজ নিয়েছে।
সিয়াম দরজাটা ভালো মতো আটকে সবকটা জানলার পর্দা টেনে দেয়। তারপর হুইচেয়ার থেকে নিজেই উঠে এসে চন্দ্রার পাশে বসল।
সিয়াম বসে চন্দ্রার দিকে তাকাতেই দেখলো চন্দ্রা কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

#চলবে..?

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #২৪

সিয়াম বসে চন্দ্রার দিকে তাকাতেই দেখলো চন্দ্রা কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
সিয়াম এবার নিজের ডান হাত টা বাড়িয়ে চন্দ্রার হাত ধরতে গেলেই চন্দ্রা হাতটা সরিয়ে নিলো।
সিয়ামের বেশ খারাপ লাগলো কিন্তু মুখে কিছু বললো না।
– চন্দ্র আমি জানি আমি অনেক বড়ো ভুল করেছি তোমার কাছ থেকে সবটা লুকিয়ে। কিন্তু একটাবার আমায় সুযোগ তো দাও নিজেকে এক্সপ্লেইন করার।
চন্দ্রা সেই শুনে আওয়াজ করে বইটা বন্ধ করে দিয়ে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সিয়ামর দিকে। তারপর উত্তেজিত হয়ে কিছু একটা বলতে উদ্যত হলো কিন্তু পারলো না গলার জন্য। গলায় টান পড়ায় বাম হাত দিয়ে ধরে মুখটা বিকৃত করে নিলো।
সিয়াম চমকে উঠলো সে ভাবেনি চন্দ্রা এইরকম কিছু করবে। সে পাশ থেকে জলের গ্লাসটা নিয়ে চন্দ্রার সামনে ধরলো। চন্দ্রা একপলক তা দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিল অর্থাৎ সে জল খাবে না।
সিয়ামের এবার রাগ হলো এতো কষ্ট পাচ্ছে তাও তাকে জেদ করতেই হবে, সিয়াম এবার নিজেই জোর করে চন্দ্রার এক হাত ধরে চন্দ্রাকে জলটা খাইয়ে দিলো।
গ্লাসটা রেখে সিয়াম শুধু বললো “কিচ্ছু শুনতে হবে না তোমায় শুয়ে পরো।” বলে চন্দ্রাকে ঠিকঠাক করে শুইয়ে সে নিজেও শুয়ে পড়লো।
চন্দ্রা এবার উসখুশ করছে তার শোনার ভীষণ আগ্রহ ছিল উপর উপর সে যতই রাগ দেখাক না কেনো। মুখ ফুটে তো এখন সে বলতেও পারবে না। অগত্যা নিজেকে গালাগাল করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লো সে।
সিয়াম ইচ্ছে করেই বলেনি আজ চন্দ্রাকে। সিয়াম সব বললেই আবার সে একের পিঠে এক প্রশ্ন করতে গিয়ে উত্তেজিত হতো আর নয়তো সব চাপ মাথায় দিতো। তার থেকে চন্দ্রা কথা বলতে পড়লেই সে সব খুলে বলবে বলে ঠিক করলো।

পরের দিন সকালে চন্দ্রা উঠেই দেখলো সে নিজের জায়গাতেই আছে উল্টে সিয়াম নিজের জায়গা থেকে সরে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। চন্দ্রার এবার বুঝতে অসুবিধা হলনা রোজ সকালে কেন নিজেকে সিয়ামের হাতে আবদ্ধ পেত। অসভ্য লোকটা ওকেই টেনে নিজের কাছে নিয়ে যেত, যাতে করে চন্দ্রার মনে হয় সে নিজেই ঘুমের ঘোরে সিয়ামের কাছে চলে গেছে।
চন্দ্রা চোখ ছোটো ছোটো করে সিয়ামকে দেখলো। যতই মনে মনে বকুক লোকটাকে সিয়ামের সান্নিধ্য চন্দ্রার এখনও ভীষণ প্রিয়। সিয়াম একেবারে আলতো করে ধরে শুয়ে আছে তাকে যাতে অল্প পরিমাণও চন্দ্রা ব্যাথা না পায়। চন্দ্রার কেনো যেন সরাতে ইচ্ছে হলো না, তাই সেও চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করে পরে রইল।

মিনিট দশেক বাদ সিয়ামের ঘুম ভাঙলো। চোখ পিটপিট করে খুলেই চোখের সামনে চন্দ্রাকে দেখে একটা মিষ্টি হাসি হাসলো তারপর আস্তে করে চন্দ্রার কপালের পাশে একটা গভীর চুম্বন দিয়ে উঠে পড়ল।
চন্দ্রা জেগে থাকায় পুরোটাই অনুভব করলো। মিনিট কয়েকবাদ সেও চোখ খুলল। সব ঠিক থাকলেও তার মনে কোথাও গিয়ে খচ করছে। তার সবসময় মনে হচ্ছে সিয়াম আরো অনেক কিছুই লুকিয়ে আছে এখনও। তাই সে চেয়েও সিয়ামকে সুস্থ অবস্হায় দেখে খুশি হতে পারছে না।

সিয়াম চন্দ্রাকে ওইরকম অন্যমনস্ক ভাবে বসে থাকতে দেখে তোয়ালে টা পাশে রেখে বললো “তা ম্যাডাম মনে মনে আমার গুষ্টি উদ্ধার করা হলে আপনি কি ফ্রেশ হবেন..?”
চন্দ্রা ঘোর থেকে বেড়িয়ে এসে সিয়ামের দিকে তাকালো। লোকটা ভুল বলে না সে সত্যিই তার চোখ পড়তে জানে এবার বিশ্বাস হলো চন্দ্রার।

সিয়াম বিছানার কাছে এসে বিনাবাক্যে চন্দ্রাকে কোলে তুলে নিয়ে হাসতে হাসতে বললো “এবার দেখছি হুইচেয়ারটা তার ঠিকঠাক যোগ্য মানুষ পাবে।”
চন্দ্রা চোখ গরম করে সিয়ামের দিকে তাকাতেই সিয়াম মুখটা ভীতু ভীতু করে বললো “আচ্ছা আচ্ছা বসতে হবে না হুইচেয়ারে, আমিই আপনাকে কোলে তুলেই সব জায়গায় নিয়ে যাবো হয়েছে, এবার তো এইরম কটমট করে তাকানো বন্ধ করো আমার ভয় লাগছে।” বলেই সিয়াম একটা মুচকি হাসি দিল।
চন্দ্রা চোখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকালো। সিয়াম দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে চন্দ্রাকে ফ্রেশ করিয়ে আনলো।
সে শুনেছে বউরা নাকি তার বরদের কথা বলার সুযোগই দেয় না। আর তাই বউয়েরা বেশি কথা না বলতে পারলে তারা ভীষণ খুশি হয়।
কিন্তু সিয়ামের একদম ভালো লাগছে না চন্দ্রাকে এভাবে দেখে তার ওই সবসময় কথা বলা চন্দ্রাটাকেই বেশি পছন্দ।

__________________________________

মাঝে কেটে গেছে চারদিন। বাড়ির সবাই চন্দ্রাকে এইকদিন বেশ যত্ন করেছে। এমনকি সুইটি বেগমও এসে মাঝে মাঝে চন্দ্রার খোঁজ নিয়ে গেছে যা চন্দ্রার কাছে ভীষণ আশ্চর্যজনক। কারন কোনকিছুতেই তাকে দেখা যায় না এমনকি সারাদিন বাড়িতেও খুব একটা তাকে দেখা যায় না। কিন্তু এইসব দেখার পরও সিয়াম আগের মতই চুপচাপ। তিনি কোথায় যায় সারাদিন কি করেন এই বিষয়ে কারোর কোনো মাথা ব্যাথা দেখেনি চন্দ্রা। সে নিজেও বেশি মাথা ঘামায়নি এই বিষয়ে কোনোদিন, তবে কিছুমাস ধরে তার ব্যবহারে নজরদারি করেছে চন্দ্রা তার চালচলন বেশ অদ্ভুত ধরনের তা বেশ লক্ষ্য করেছে , এই যেমন এক্ষুনি তার আচরণ দেখে মনে হবে সে এক কথায় তার প্রাণও দিতে পারেন কারোর জন্য। এবার একসময় মনে হয় তার মতো স্বার্থপর মানুষ দুনিয়ায় দুটো নেই।

এই কয়েকদিনে বেশ অভুতপূর্ণ কিছু ঘটনা ঘটেছে যা কিছুমাসেও ঘটেনি। এই যেমন অপূর্ব সক্ষম হয়েছে সিয়াকে তার বন্ধু বানাতে সিয়া পুরোপুরি ভাবে নিজেকে ট্রমা থেকে না বের করতে পারলেও অপূর্বের সাহায্যে অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে। পরিবর্তন এসেছে ইন্দ্রা
ও সিরাজের সম্পর্কেও। তারা এখন দুজনে কিছুনা কিছু নিয়ে ঝগড়া করতেই থাকে। এটা তাদের দুজনের কাছেই আশ্চর্যজনক তাও প্রথম গিয়ে সিরাজই খোঁচায় ইন্দ্রাকে কয়েকদিন ইন্দ্রা চুপচাপ মেনে নিলেও এখন বেশ ঝগড়া করে সেও পায়ে পা মিলিয়ে।
সব সম্পর্ক বদলালেও শুধু বদলায়নি চন্দ্রা আর সিয়ামের সম্পর্ক। চন্দ্রা আগের মতই সিয়ামকে ইগনোর করে চলছে, আর সিয়াম আগের মতই চন্দ্রার সব কাজ নিজের হতে হতে করে দিচ্ছে। চন্দ্রা এইকয়েক দিনে সিয়ামকে দেখে বেশ অবাক হয়েছে। যে মানুষটা নিজের শরীর খারাপ নিয়েও অফিস গেছে সে তার অসুস্থতায় অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সারাদিন ওর আসেপাশে থেকেছে। খুঁটিনাটিও খেয়াল রেখেছে ওর জল টুকু তাকে একা খেতে দেয়নি। এইসব দেখে চন্দ্রার মন একটু গোললেও বিশেষ পাত্তা দেয়নি সে সেদিকে, সে যতক্ষণ না সত্যিটা জানছে ততক্ষণ তার মন কোনকিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না।

আজ সকাল সকাল ডক্টরের কাছে চেকআপ করিয়ে এনেছে সিয়াম চন্দ্রার। ডক্টর বলেছেন এখন চন্দ্রা মোটামুটি হলেও সুস্থ কথা বলতে পারবে আর হাঁটাচলাও করতে পারবে নিজে, তবে বেশি নয় একদম কমসম।
সিয়াম ঘরে ফিরেই চন্দ্রাকে কিছু বলতে দেওয়ার আগেই অফিসের দরকারি কল পেয়ে ছুটে গেছে সেখানে।
চন্দ্রার এবার ভালো লাগছে না এখনই মানুষটাকে যেতে হলো। কতশত প্রশ্ন মনে জমেছে তার যতক্ষণ উত্তর খুঁজে পাচ্ছে তার মন শান্ত হচ্ছে না কিছুতেই।
চন্দ্রা ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে সিয়ামের পড়া বইগুলো দেখতে লাগলো খুলে খুলে। হঠাৎই বইয়ের ভিতর থেকে কিছু একটা নীচে পড়ার আওয়াজ পেলো চন্দ্রা। নীচে তাকাতেই দেখলো একটা ছোট্ট ইয়াররিং পড়ে আছে মেঝেতে, চন্দ্রা সেটা তুলে হাতে নিয়ে দেখতেই চমকে উঠলো এটা তো তারই প্রিয় একটা ইয়ারিংয়ের মধ্যে একটা, যেটা সে হারিয়ে ফেলেছিল কিছু বছর আগে ঘুরতে গিয়ে। এটা তার এতটাই প্রিয় এর এক অংশ তার কাছে এখনো রাখা আছে যত্ন করে। চন্দ্রার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিল। তার ইয়াররিং সিয়ামের বইয়ের ভিতর কীকরে এলো..? তাও এতো বছর আগের। চন্দ্রা বই বন্ধ করে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো এর মানে আরো অনেক কিছুই আগে যা চন্দ্রা এখনও জানে না। চন্দ্রা ঠিক করলো সে সিয়ামকে এই বিষয়ে এখন কিছু বলবে না আগে তার আগের বিষয় গুলো ক্লিয়ার করুক তারপর তাকে এই বিষয় জিজ্ঞেস করবে।

সিয়াম ফিরলো বিকেলের দিক করে। এসেই দেখলো চন্দ্রা ফোনে কিছু একটা করছে। তাই তাকে আর ডিস্টার্ব না করে সে দরজাটা ভালো ভাবে আটকে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই চন্দ্রা শান্ত কঠিন স্বরে বলল ” আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে যদি আপনার হাতে সময় থাকে তাহলে কিছু সময় চাইছি আপনার কাছে।”
সিয়াম বেশ চমকালো এতদিন বাদ চন্দ্রার কণ্ঠস্বর শুনে। তবে মুখে প্রকাশ করলো না। শুধু ” হুম ” বলে এসে চন্দ্রার মুখোমুখি বসলো।
চন্দ্রা এবার নিজেকে ধাতস্থ করে সিয়ামকে বললো “জিজ্ঞেস করার মতো কিছু রেখেছেন..? আপনাকে আপাদমস্তক দেখেই আমার সন্দেহ হচ্ছে। আচ্ছা আপনি আমায় আসলেই ভালোটালো বসেন নাকি সেটাও অভিনয়..?”
সিয়াম এবার চেঁচিয়ে বললো ” চন্দ্র , আমার ভালোবাসার দিকে আঙ্গুল তোলার অধিকার কারোর নেই। এমনকি তোমারও না বুঝেছ..?”
চন্দ্রা ধমক শুনে হলকা কেঁপে উঠলেও নিজেকে সামলে নিলো। সে এই প্রথম সিয়ামকে এতো রেগে যেতে দেখলো।

লাস্টের এই কটা বাক্যই যথেষ্ট ছিল সিয়ামের হৃদয়ের শত টুকরো করার জন্য। তাও নিজের রাগটা সামলে চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস টেনে বললো “ফাইন! সব জানতে চাও তো সবটা বলছি তোমায়। কিন্তু বলার আগে একটা শর্ত তোমায় আমাকে দিতে হবে। বোলো দিতে রাজি..?”
চন্দ্রা নীচের দিকে তাকিয়ে একবাক্যে বললো ” রাজি “।
সিয়াম বললো ” আমার এই পুরো ঘটনা বলার সময় তুমি আমায় একটাও প্রশ্ন করতে পারবেনা। আমার বলা শেষ হলে তুমি তোমার এক এক করে প্রশ্ন করতে পারো।”
চন্দ্রা কিছুক্ষন ভেবে বললো “আচ্ছা তাই। বলুন তবে।”
সিয়াম একটা লম্বা শ্বাস টেনে বলতে শুরু করলো তার অনাথ হওয়ার কথা, সুইটি বেগমের তাদের সাথে ছলনা করার কথা, সিয়ামের মা বাবাকে মেরে সম্পত্তির দখলের কথা তার এতো বছর অসুস্থতার অভিনয় করার কথা সবটুকু যতটা সিয়ামের বলার প্রয়োজন ছিল।
চন্দ্রা হা করে শুধু শুনেই গেলো প্রত্যেকটা কথা এখন মনে হচ্ছে তাকে শর্ত না দিলেও সে চুপ করেই শুনতো প্রত্যেকটা কথা। কারন প্রত্যেকটা কথায় ছিল চন্দ্রার জন্য চমক।
চন্দ্রা সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে সিয়ামের মা বাবার মৃত্যুর ঘটনা শুনে। যা বলার সময় সে লক্ষ্য করেছে সিয়ামেরও ঠোঁট কাঁপছিলো। হয়তো জলও এসেছিল চোখে তবে টা গড়িয়ে পড়ার আগেই সন্তপর্নে সে মুছে ফেলেছে। যদিও চন্দ্রার চোখের আড়াল হয়নি তা। চন্দ্রার ভেবেই গা শিরশির করে উঠছে , তার নিজেরই যখন এতো খারাপ লাগছে শুনে আর এই মানুষটাতো এত বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছে এসব।
চন্দ্রা এবার দুজনের নীরবতা কাটিয়ে প্রশ্ন করলো ” তা আমার থেকে আপনার অসুস্থতা লুকোবার কারণ..?”
সিয়াম জবাব দিলো ” বিশেষ কারণ কিছুই না আমি উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করছিলাম শুধু। আর এমনিতেও আমার উপর বেশ নজর রাখা হয়। তাই আমি চাইনি ভুলবশতও মনি একটুও টের পাক।”

চন্দ্রা আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলো কিন্তু তার আগেই দরজায় টোকা পড়ার আওয়াজ পেলো দুজন।
চন্দ্রা সিয়ামের দিকে তাকাতেই সিয়াম উঠে গিয়ে হুইচেয়ারে বসলো। চন্দ্রা উঠে গিয়ে দরজা খুলতে উদ্যত হলো।

#চলবে..?

বেড়াজাল পর্ব-২১+২২

0

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #২১

মাঝে কেটে গেছে চারটে দিন। সময়ের সাথে কিছু কিছু সম্পর্কেও খনিক হলেও বদল এসেছে।
.
.
সকলের সূর্যের কিরণটা হয় বেশ অন্যরকম ভালোলাগার জিনিস তখন না থাকে সূর্যের এতো তেজ না থাকে প্রখর উত্তাপ। সেই কিরণই সকাল সকাল চন্দ্রার ঘরের জানলার পর্দা ভেদ করে এসে পড়লো তার মুখে। কিছুক্ষন চোখ পিটপিট করে চোখ খুললো চন্দ্রা। প্রথমেই নজর দিলো দেওয়াল ঘড়িটার দিকে, ঘড়ি দেখে তো চন্দ্রার চক্ষু চড়কগাছ। ঘড়িতে পরিষ্কার সময় দেখাচ্ছে ৯:১৫।
চন্দ্রার কপালে হাত কোনোদিন তো তার এতো লেট হয়না উঠতে। যদিও কয়েকদিন তার অক্লান্ত পরিশ্রম গেছে, তাও সে অ্যালার্মের প্রথম রিংয়েই উঠে যায়। তাহলে আজ ঘড়ির দিক থেকে চোখ সরিয়ে চন্দ্রা বালিশের পাশ থেকে মোবাইল তুলে দেখলো নাহ্ অ্যালার্ম তো বেজেছে দেখাচ্ছে। তাহলে কি সে শুনতে পায়নি..?
এসব ভাবতে ভাবতেই যেই বিছানা ছেড়ে উঠতে যাবে ওমনি পেটের কাছে রাখা শক্তপোক্ত হাতটা জানো একটু জোরেই টেনে মিশিয়ে নিলো তার সাথে। হালকা করে নাক ঘষে দিল ঘাড়ে। চন্দ্রা শিউরে উঠলো যদিও এইরকম প্রায়শই করেই থাকে সিয়াম। তাও তার প্রত্যেকটা স্পর্শ চন্দ্রার কাছে প্রথম স্পর্শের মতই অনুভুতি দেয়।
চন্দ্রা এবার হালকা করে নিজেকে এদিক ওদিক মুচড়ে নিজেকে সিয়ামের বাহুবন্ধন থেকে ছাড়াতে চাইল।
সিয়াম মুখ দিয়ে একটা বিরক্তি সূচক আওয়াজ করে বললো “কি সমস্যা এরকম ছটপট করছো কেনো শান্তি মত ঘুমোতে দাও তো একটু।” বলেই চন্দ্রাকে কোমর ধরে টেনে আরেকটু কাছে এনে পেটের উপর হাত রেখে ঘাড়ে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লো। চন্দ্রার এবার কাঁপাকাঁপির উপক্রম। চন্দ্রা মোটেই বোঝে না রোজ রাতে এক ধারে শোওয়ার পরেও সকালে কি করে সে সিয়ামের বাহুডোরে বন্দী থাকে। চন্দ্রা আরেকবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সিয়ামের মাথাটা হাত দিয়ে একটু পিছনে থেকে বললো “দেখছেন কটা বাজে..? অফিস নেই আপনার..? ছাড়ুন আমায় উঠতে দিন।” সিয়াম আগের মতই মুখ গুঁজে বললো “আজ না তোমার ছুটি..?”
চন্দ্রা এবার নিশ্বাস ছেড়ে বললো “আর তাই জন্যেই আপনি ফোনের অ্যালার্ম বন্ধ করে দিয়েছেন..?”
সিয়াম এবার মুখটা সোজা করে চোখ বন্ধ করেই ঠোঁট এঁটো করে হেসে বললো ” কি করবো ম্যাডাম আপনার এতদিন পর এতো শান্তির ঘুম দেখে ভাঙ্গতে ইচ্ছে হলো না। আজ আমারও অফিসে দেরি করে গেলে হবে তাই আর ওঠালাম না।”
চন্দ্রা এবার হালকা হেসে বললো “হয়েছে এবার তো উঠতে দিন। আরো কাজ আছে আমার।”
সিয়াম শুনলনা চন্দ্রার ঘাড়ে নাক ঘষতে ঘষতে বাচ্ছাসুলোভ গলায় বললো “আরেকটু থাকো, প্লিজ চন্দ্রাবতী”
কি নেশা মেশানো ছিলো এই বাক্যে চন্দ্রা ধরতে পারলো না কিন্তু নিজ জায়গা থেকে নড়তেও পারলো না। অগত্যা কিছুসময় সিয়ামের কাছেই থাকতে হলো তাকে।

________________________

সকাল ১১:৩০

সিয়াম কিছুসময় আগেই অফিস বেরিয়েছে মাত্র। চন্দ্রা তাই রান্নাঘরটা হালকা গুছিয়ে রাখছিলো। হটাৎ খেয়াল পড়লো পাশে একটি টিফিন বক্সের দিকে। চন্দ্রা হাতে নিয়ে দেখলো সেটা সিয়ামের। চন্দ্রা হাঁফ ছেড়ে নিজে নিজেই বললো “দেখেছো কাণ্ড এতো বলে বলে দিয়েও সেই কিনা টিফিন বক্সটাই ফেলে রেখে চলে গেলো। এখন দুপুরে খাবে কি..?”
চন্দ্রার এসব ভাবতে ভাবতেই কিছুদিন আগের কথা মনে পড়লো। সেইদিনও সিয়াম টিফিন বক্স ভুলে চলে গিয়েছিল ঘরে। চন্দ্রা দেখেও কিছু বলেনি সে ভেবেছিল অফিস ক্যান্টিন থেকে কিছু খেয়ে নেবে হয়তো সিয়াম।
কিন্তু সবচেয়ে বেশি অবাক চন্দ্রা তখন হয়েছিল যখন রাতে সিয়াম এসে জানিয়েছিল সে কিছু খায়নি ক্যান্টিন থেকে কিনে। চন্দ্রা কারণ জিজ্ঞেস করতে সিয়াম শুধু মিষ্টি হেসে বলেছিলো “অভ্যাসটা আমার একদম খারাপ করে দিয়েছো বুঝলে চন্দ্র। এখন তোমার হাতের রান্না ছেড়ে বাইরের খাবার খেতে ইচ্ছে করে না।”
আসলেই চন্দ্রার যতই কাজ থাকুক সিয়ামের টিফিনটা সে প্রতিদিন নিজের হাতেই বানায়। চন্দ্রা এবার টিফিন বক্সটা হাতে নিয়ে ভাবলো লাঞ্চ টাইমের আগে গিয়েই সিয়ামের অফিসে টিফিন বক্সটা দিয়ে আসবে। তার চেনাও হয়ে যাবে জায়গাটা। এই ভেবে টিফিন বক্সটা টেবিলে রাখতেই কলিং বেল বেজে উঠলো।
চন্দ্রা গিয়ে দরজা খুলে দেখলো হাসি মুখে অপূর্ব দাঁড়িয়ে। চন্দ্রাকে দেখে সালাম দিলো। চন্দ্রাও হেঁসে সালামের উত্তর দিয়ে বললো “সিয়াম তো এখন বাড়ি নেই ভাইয়া একটু আগেই বেড়িয়ে গেছে।”
অপূর্ব একটা মনভোলানো হাসি দিয়ে বললো “আজ আমি সিয়ামের সাথে না সিয়ার সাথে দেখা করতে এসেছি ভাবী।”
চন্দ্রা একটু অবাক হয়ে বললো “সিয়া..? কিন্তু সিয়া কোনো.?”
অপূর্ব মুখে হাসি বজায় রেখে বললো “আসলে একটু দরকার ছিল। আর আমরা তো এখন ভালো বন্ধু হয়ে গেছি।”
চন্দ্রার বিষয়টা বেশ খটকা লাগলেও অপূর্বের মুখের উপর না করতে পারলো না। সিয়ার রুমটা দেখিয়ে দিয়ে নিজের কাজে গেলো।
অপূর্ব কিছু কথা ঠিকই বলেছে যে সে বন্ধু হয়েছে সিয়ার কিন্তু নেহাতই জোর করে। আর এখন না তার কোনো দরকারি কাজ আছে সিয়ার সাথে। তবে হ্যাঁ কিছু কাজ তো আছে।
অপূর্ব সিয়ার ঘরের দরজায় একটু জোরে টোকা মারতেই দরজাটা আসতে করে কিছুটা খুলে গেলো। অপূর্ব দরজায় মাথায় তাকিয়ে দেখলো ছিটকিনিটা বোধহয় দেওয়া হয়েছিল অসাবধানতা বশত সেটা লাগেনি। অপূর্ব দরজার সামান্য ফাঁক দিয়ে মুখ গলিয়ে সিয়াকে ডাকতে যেতেই তার চোখ পড়লো সিয়ার ব্যালকনিতে। সিয়াকে পুরোটা না দেখা গেলেও যতটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে বোঝা যাচ্ছে সিয়া একটা ফল কাটার ছুঁড়ি নিয়ে এক হাতে আরেক হাতের উপর রেখে দাঁড়িয়ে আছে। হাত দিয়ে বিন্দু বিন্দু রক্ত পড়াও শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে।
এই দৃশ্য দেখে অপূর্বের বুক কেঁপে উঠলো যেনো। তাড়াতাড়ি করে ব্যালকনিতে ছুটে গিয়ে সিয়ার হাত থেকে এক টানে ছুঁড়িটা নিয়ে নীচে ফেলে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো “পাগল হয়ে গেছো সিয়া..? কি করতে যাচ্ছিলে এটা..?”
সিয়া হতভম্ব সে ভাবেওনি এইরাম সময় কেউ চলে আসবে সে তো দরজায় ছিটকিনি আটকে রেখেছিল তাহলে…?
সিয়ার এবার সব যন্ত্রণা কষ্ট রাগে পরিণত হলো। সামনের মানুষটির উপরই চেঁচিয়ে উঠলো “কি মনে করেন আপনি নিজেকে হ্যাঁ..? আমার জীবন আমি যা খুশি করি মরি বাঁচি যা খুশি আপনার কি..? কে অধিকার দিয়েছে বলুন আমার রুমে ঢোকার..?”
অপূর্ব রেগে উত্তর দিতে গিয়েও দিলো না চুপচাপ হজম করে গেলো অপমানটা। সিয়া নিজের মতো বলেই গেলো, যেনো সব দোষ অপূর্বের। অপূর্ব তাও কিছু বললো না।
অবশেষে সিয়া কাঁদতে কাঁদতে ব্যালকনির একটা কোণে বসে পড়লো হাঁটুতে মুখ গুঁজে।
অপূর্ব তা দেখে রুম থেকে এক গ্লাস জল নিয়ে এসে সিয়ার পাশে বসলো। সিয়ার পাশে বসতেই সিয়ার কান্নার স্বরে বলা কিছু কিছু টুকরো কথা অপূর্বের কানে এসে ঠেকলো।
সিয়া একনাগাড়ে বলেই চলেছে “কি অপরাধ করেছিলাম আমি..? প্রত্যেকবার আমিই কেনো..? আমার সাথেই কেনো..?কেনো আমাকে কেউ ভালোবাসে না..? না বাবার ভালোবাসা পেলাম না মায়ের তাও তো মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু এর পর আর পারছিনা আমি, আমার সহ্য ক্ষমতা যে ক্ষীণ হয়ে আসছে আসতে আসতে। হে উপরওয়ালা তাড়াতাড়ি আমায় নিজের কাছে ডেকে নাও প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”

অপূর্বের বুকে যেনো কেউ ছুঁড়ি চালাচ্ছে। সিয়ার প্রতিটা কথার ধারে তার বক্ষস্থল যেনো ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটার খুশির জন্যই তো সে এতদিন তার সামনে ভালবাসার দাবী নিয়ে আসেনি। দূর থেকেই চোখের দেখা দেখে তৃষ্ণা মিটিয়েছে। এখন কি অবস্থা করেছে মেয়েটা নিজের। আজ সে সঠিক সময়ে না এলে কি হতো..? আর ভাবতে পারলো না অপূর্ব সিয়ার পাশেই ব্যালকনিতে হেলান দিয়ে বসে পড়লো সে।
সিয়ার মাথায় ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। সিয়া প্রতিক্রিয়া দেখালো না কোনো।
তার ইচ্ছে করছে না। ছোটো থেকেই সে মা – বাবার ঝামেলা দেখছে, এখনও মায়ের সাথে তার ঝামেলা লেগেই থাকে সে চায় না ঝামেলা, একটুকরো শান্তির খোঁজ চায় সে। কিন্তু কোথায় পাবে..? এজীবনে কি সে আর পাবে শান্তি।
অপূর্ব একটু দম নিয়ে সিয়াকে আলতো স্বরে ডাকলো। প্রথম দুবার সেই ডাকটা এড়িয়ে গেলেও তৃতীয় বারে সিয়া মুখ তুলে তাকালো কিন্তু কোনো জবাব দিলো না।
অপূর্ব জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিল। সিয়ার হাত অনবরত কেঁপে যাচ্ছে। সিয়া গ্লাসটা ধরতেও অপূর্ব গ্লাসটা ছাড়লো না ধরেই থাকলো সিয়ার জল খাওয়া অবধি।
অপূর্ব এবার একটু চোয়াল শক্ত করে বললো ” কিসের জন্যে নিজেকে এইরকম শাস্তি দিচ্ছ সিয়া..?ভুল মানুষকে ভালবাসার জন্য…? আদতেই কি সব দোষ তোমার সিয়া..?”
সিয়ার কাছে উত্তর নেই। সিয়ার মাথায় হটাৎ একটা কথাই ধাক্কা মারলো আসলেই কি সব দোষ তার..?

অপূর্ব আবার বলতে শুরু করলো ” আসেপাশে তাকিয়ে দেখো সিয়া তুমি শুধু একা নও এই পরিস্থিতির শিকার আরো অনেকেই আছে তোমার মতো। কেউ নিজেকে বদলে ফেলেছে অথবা কেউ কষ্টের ভার সহ্য না করতে পেরে এই পৃথিবী ছেড়েছে। কিন্তু তাতে অপরদিকের মানুষটির উপর কোনো প্রভাবই পরেনি সে তার মতো দিব্যি আছে। সুখে সংসার করছে হেসে খেলে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আদতেই কি এটা হওয়ার ছিলো..? এই বিশ্বাসঘাতক মানুষগুলোর কি এতো সুখ পাওয়ার কথা ছিল..?
তারা পেলে তুমি কেনো পারবে না সিয়া সুখী হতে..?
আমি জানি অনেকটা সময় লাগবে হয়তো পারবেও না এই ট্রমা থেকে বের হতে। কিন্তু একবার চেষ্টা করতে কি ক্ষতি..? সিয়া অপরদিকের মানুষটা যদি তোমায় ছেড়ে সুখী হতে পারে তাহলে তুমি কেন না..? তুমিও দেখিয়ে দাও তুমিও পরো তাদের ছাড়া সুখী হতে যারা তোমায় ছাড়া সুখী আছে। মানছি তুমি ছোটথেকেই তেমন ভালোবাসা পাওনি। কিন্তু যতটুকু আপনজনেদের কাছ থেকে পেয়েছো অতটুকুতে কোনো ভেজাল ছিলো..?
সিয়াম, সিরাজ তোমায় প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে সিয়া তাদের ভালবাসার মূল্য অন্তত শোধ করো। আর আমিও তো….”
গলার স্বরটা একপ্রকার আটকেই গেলো অপূর্বের। এখনও সে সিয়ার সামনে ভালবাসার দাবী রাখতে চায় না। আপাতত তাকে ট্রমা থেকে বের করাই তার মূল উদ্দেশ্য।

সিয়ার মনে আপাতত ঝড় চলছে। কি করবে কি করবেনা সে নিজেই বুঝতে পারছে না। কিন্তু অপূর্বের কথা শুনে আজ প্রথমবার তাকে ভীষণ কাছের লেগেছে।
সিয়াকে আরো কিছু কথা বলে হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে অপূর্ব ফিরে গেলো। সিয়া মাথায় এখন শুধু অপূর্বের যাওয়ার সময় শেষ কথায়টাই ঘুরছে।
অপূর্ব সিয়ার রুম থেকে বের হওয়ার সময় পিছন ঘুরে সিয়ার উদ্দেশ্যে বলেছিলো “তুমি কি চাও সেটা সম্পূর্ণ তোমার হাতে সিয়া। জীবন একটা যুদ্ধক্ষেত্র। এখানে সর্বক্ষণ নিজেকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয় প্রত্যেকটা মানুষকেই। সুতরাং হার জিত বিশ্বাসঘাতকতা সবই এর অংশ। কিন্তু ডিসিশান এখন তোমার হাতে তুমি এর থেকে পালিয়ে বাঁচবে নাকি আর পাঁচটা যোদ্ধার মতো নিজের বেঁচে থাকার অধিকার ছিনিয়ে নেবে।”

সিয়া আলমারির কোন থেকে একটা ঘুমের ওষুধের পাতা বের করলো। অনেকক্ষণ সেই ওষুধের পাতার তাকিয়ে থেকে শেষে একটা ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লো। এখন তার লম্বা একটা ঘুম দরকার। আর ভাবতে ইচ্ছে করছে না তার কিছু।

________________________________

ইন্দ্রাকে বাড়ি ফিরে যেতে হয়েছে বিশেষ কারণে। তার বাবার রিপোর্ট গুলো আনতে হবে। তাই সকাল সকালই সে বেরিয়ে পড়েছে বাড়ির উদ্দেশ্যে।
সিরাজেরও এবার আর ঘরে মন বসছে না। ইন্দ্রা থাকলে সে মাঝে মাঝেই এটা সেটার বাহানা করে ইন্দ্রার আসেপাশে বাচ্চাদের মতো ঘুরঘুর করতো সেটা সেটা জিজ্ঞেস করার বাহানায় নানা কথা বলতো। এটা বেশ তার পছন্দের কাজ ছিলো।
সিরাজ আরকিছু না ভেবে গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো। এখন একটু বাইরে গেলে যদি তার অস্তিরতা কমে।
.
.
সিগন্যালে গাড়ি থামতেই সিরাজের চোখ পড়লো পাশের কফি শপে। সামনেটা কাঁচ থাকায় কফিশপের প্রায় অর্ধেকটাই দৃশ্যমান। সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ইন্দ্রা একটি ছেলের সাথে বেশ হেসে হেসে কথা বলছে। যেনো অনেকদিনের চেনা পরিচিত।
সিরাজের এবার মাথায় দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। হাতের পেশি শক্ত হলো।
নাহ্ আর দেরি করা যাবে না তার এবার তার প্রাণপাখি উড়ে অন্য কোথাও যাওযার আগেই তার খাঁচায় বন্দি করতে হবে তাকে। পিছন থেকে অন্য গাড়ির হর্ণের আওয়াজ পেতেই সিরাজ দৃষ্টি ফিরিয়ে সামনের দিকে আনলো। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চললো নিজের সবচেয়ে দরকারি কাজটা সারতে।

___________________________

দুপুর ১ টা

চন্দ্রা সব গোছগাছ করে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লো সিয়ামের অফিসের উদ্দেশ্যে। সিয়ামের লাঞ্চ টাইম ১:৩০- এ চন্দ্রা একপ্রকার তাড়াহুড়ো করেই পৌঁছালো সিয়ামের অফিসে। অফিসের রিসেপশনে গিয়ে জানতে পারলো সিয়াম আছে ৭থ ফ্লোরে। সিয়াও সেই বুঝে লিফটে উঠে ৭থ ফ্লোরে গেলো। সিয়ামের কেবিনে নক করে ঢুকে দেখলো সেটা ফাঁকা। তাই কেবিন থেকে বেড়িয়ে আসতেই একজন এমপ্লয়ই তাকে তার নাম পরিচয় জিজ্ঞেস করলো। চন্দ্রা নিজের পরিচয় দিলো সিয়ামের স্ত্রী বলে।
তখন সে জানালো সিয়ামের কেবিনের ভিতর অ্যাটাচ একটা রেস্ট রুম আছে। সিয়াম মাঝে মাঝে সেখানেই থাকে। যদিও সেখানে সিয়ামের অ্যাসিস্ট্যান্ট ছাড়া কারোর ঢোকার নিয়ম নেই। কিন্তু চন্দ্রা স্ত্রী বলে তাকে যেতে দিলো।

চন্দ্রা সেই কথা অনুযায়ী সিয়ামের কেবিনের ভিতর রেস্ট রুমটায় নক করলো আস্তে দুইবার। কিন্তু ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না। চন্দ্রা এবার দরজার লকটা ধরে ঘোরাতেই সেটা খুলে গেলো।
চন্দ্রা ভিতরে নজর দিতেই চন্দ্রার চোখ স্থির হয়ে গেলো। হাতে ধরে রাখা টিফিনবক্সের ব্যাগটা আপনাআপনিই পড়ে গেলো। এটা কি দেখছে সে..? নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেন সে।
তাকে দেখে অপরদিকে মানুষদুটিও সে সমান ভাবে চমকে উঠেছে এটা তাদের মুখে স্পষ্ট।

#চলবে..?

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #২২

চন্দ্রা সেই কথা অনুযায়ী সিয়ামের কেবিনের ভিতর রেস্ট রুমটায় নক করলো আস্তে দুইবার। কিন্তু ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না। চন্দ্রা এবার দরজার লকটা ধরে ঘোরাতেই সেটা খুলে গেলো।
চন্দ্রা ভিতরে নজর দিতেই চন্দ্রার চোখ স্থির হয়ে গেলো। হাতে ধরে রাখা টিফিনবক্সের ব্যাগটা আপনাআপনিই পড়ে গেলো। এটা কি দেখছে সে..? নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেন সে।
তাকে দেখে অপরদিকে মানুষদুটিও সে সমান ভাবে চমকে উঠেছে এটা তাদের মুখে স্পষ্ট।

চন্দ্রা হতবাক সে বিশ্বাস করতে পারছে না চোখকে নিজের। সিয়াম দাঁড়িয়ে আছে সামনের ডেস্কে হেলান দিয়ে হাত দুটো আড়াআড়ি করে বুকের কাছে গোঁজা। সিয়ামের মুখেও অবাকের ছাপ। সেও বোধহয় এই সময় চন্দ্রাকে এখানে আশা করেনি।

চন্দ্রা ঠিক কি রিয়াকশন দেবে বুঝে উঠতে পারলো না। সিয়ামের পাশের জনকে একবার দেখলো। চিনতে পারলো না লোকটিকে দেখে তবে সিয়ামের বয়সই লাগলো।

চন্দ্রা ধীর পায়ে সিয়ামের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। তার অবাকের রেশ যেনো কাটতেই চাইছে না। মাথায় শতাধিক প্রশ্ন ঘুরপাক করছে। কোনটা আগে জিজ্ঞেস করবে আর কোনটা পরে এইসব ভেবে ভেবেই চন্দ্রা প্রথম প্রশ্নটা সিয়ামকে করলো “আপনার পা একদম ঠিক আছে সিয়াম..?”
সিয়াম তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার অ্যাসিস্ট্যান্ট কম বন্ধুর পিয়াসের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করতেই সে মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে গেলো সেই রুম থেকে।
চন্দ্রা আবার একটু জোরেই প্রশ্ন করলো ” সিয়াম আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করলাম উত্তর দিন আমার প্রশ্নের। আপনার পা কি পুরোপুরি ঠিক..?”

সিয়াম কিছুক্ষন চুপ থেকে চন্দ্রার চোখের দিকে তাকিয়ে শুধু ছোট্ট করে বললো ” হুম ”
ব্যাস এইটুকুই বাক্যেই চন্দ্রার এতো দিনের সঞ্চয় করা বিশ্বাসের খুঁটিটা যেনো নড়ে উঠলো। হাত পা যেনো অবশ হয়ে এলো তার। হালকা পা টা পিছনে রাখতে পড়ে যেতে নিলেই সে চোখ বন্ধ করে দিল। পড়ে যাওযার আগেই একটা শক্তপোক্ত হাত তাকে আগলে নিলো।
চন্দ্রার চোখ বুজেও বুঝতে ভুল হলো না মানুষটা কে। তীব্র পুরুষালী পারফিউমের গন্ধটা ভেসে আসছে তার নাকে।
জাস্ট কয়েকটা সেকেন্ড। চন্দ্রা ঝাড়া মেরে সিয়ামের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কিছু দূর গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল “স্পর্শ করবেন না আপনি আমায়। আপনার মত বিশ্বাসঘাতকের সাথে এতদিন সংসার করেছি ভেবেই তো আমার গা শিরশিরিয়ে উঠছে। ”
সিয়াম এতক্ষণ শান্ত থাকলেও এবার অধৈর্য হলো। চন্দ্রাকে উদ্দেশ্য করে বললো “শান্ত হও চন্দ্র। আমাকে একটা সুযোগ তো দাও নিজের দিকটা বলার..! আমি বুঝিয়ে বলছি সবটা তোমায়।”

চন্দ্রা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলো ” কি বোঝাবেন আপনি আমায়..?কিভাবে এতদিন আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন সেটা বোঝাবেন..? নাকি কিভাবে ঠকিয়ে বিয়ে করেছেন সেটা..?আপনার লজ্জা হলো না সিয়াম আমার অনুভুতি নিয়ে এইভাবে খেলতে..? বলুন সিয়াম বলুন।” বলতে বলতে চন্দ্রা কান্নায় ভেঙে পড়লো।

সিয়াম কিছু বলার আগেই চন্দ্রা ওই কান্নারত অবস্থায় বলে উঠলো “আর এক্সপ্লেনেশন দিতে হবে না আমায় সিয়াম। ডিভোর্স পেপারস্ আমিই পাঠিয়ে দেবো আপনাকে।” বলেই সিয়ামকে কিছু বলতে না দিয়েই চন্দ্রা দৌড়ে বেড়িয়ে গেলো সেখান থেকে।
সিয়াম কয়েকবার চন্দ্রার নাম ধরে ডাকলো কিন্তু চন্দ্রা নিজের মতোই কাঁদতে কাঁদতে অফিস থেকে বেড়িয়ে পড়লো। সিয়াম চিন্তিত মুখ নিয়ে কাউকে ফোন করলো। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হতে সিয়াম ভারী গলায় বললো “আজকের সবকটা মিটিং ক্যান্সেল করে দাও।”
ওপাশ থেকে কি উত্তর এলো বোঝা গেলো না। কিন্তু উত্তরটা যে সিয়ামের মনমতো হলো না তা সিয়ামের রাগান্বিত লাল মুখটাই বলে দিলো। সিয়াম ফোন টা পাশের সোফায় ছুঁড়ে ফেলে মাথার চুল টেনে ধরলো।
পিয়াস দৌড়ে এসে সিয়ামকে এই অবস্থায় দেখেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। সে জানে এক্ষুনি সিয়ামকে সে কিছু বললেই সিয়াম রেগে যাবে। পিয়াস বন্ধু হলেও বেশ ভয় পায় সিয়ামের রাগকে। সিয়াম চোট করে রাগে না, কিন্তু একবার রাগলে তাকে শান্ত করা যায় না।

অগত্যা সিয়াম বেরোতে পারলো না অফিস থেকে আজ গুরুত্বপূর্ণ ক্লায়েন্ট আসবে তার বিদেশ থেকে সে আজ চলে গেলে কয়েক কোটি টাকার লস হবে তার কোম্পানিতে।
সিয়ামের ধারণা অনুযায়ী চন্দ্রা তার বাপের বাড়ীতেই যাওযার কথা তাই সে মিটিংয়ে ঢোকার আগেই ইন্দ্রাকে বলেছে চন্দ্রা সেখানে গেলে তার খেয়াল রাখতে।
ইন্দ্রা কারণ জিজ্ঞেস করতে সিয়াম শুধু বলেছে সে পরে সব খুলে বলবে। ইন্দ্রাও তাই আর প্রশ্ন করেনি।

সিয়ামের মিটিং শেষ হলো সন্ধ্যে সাত টায়। আজকে মিটিং-এ তার সময়টা অনেকটা বেশিই লেগেছে। কারন ক্লায়েন্টরা আজকের মধ্যেই সব মিটিয়ে কাল সকলের ফ্লাইটের মধ্যেই বেড়িয়ে যাবেন। অফিসে তাই রাতেই ছোটখাটো একটা পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। অফিসের সবাইকে সেখানে উপস্থিত দেখলেও পিয়াস চারিদিক খুঁজেও সিয়ামকে কোথাও দেখতে পেলো না।

___________________________

সিয়াম অফিসের এক কোনায় এসে দাঁড়িয়েছে। এতো হইহুল্লোড় তার ভালো লাগছে না। তার মাথায় শুধু এখন চন্দ্রার চিন্তাই ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাগের মাথায় কোথায় গেলো কি করছে সে কিছুই জানে না সে। এসব ভাবতে ভাবতেই সিয়াম পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখলো একটা আননোন নাম্বার থেকে বেশ কয়েকটা মিসডকল। তারপর নিচে দেখে ইন্দ্রার দুইবার মিসডকল শো করছে। সিয়াম আগে ইন্দ্রার নম্বরেই কল দিল।
ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই সিয়াম উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠলো “চন্দ্রা কোথায় ইন্দ্রা..?”
ইন্দ্রা বললো ” কই চন্দ্রা ভাইয়া..? সে তো আসেনি এখানে। আমিও কয়েকবার কল করলাম সুইচঅফ বলছে ফোন।”
সিয়ামের এবার পাগল হওয়ার জোগাড় ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো ঘড়িতে বাজে ৯:২৩ । মেয়েটা গেলো কই এতো রাতে। সিয়াম মনে মনে নিজেকে কষে দুটো লাথি দিলো। তার জন্যেই হয়েছে এসব। সে আসলেই তো সবটা লুকিয়ে গেছে চন্দ্রার কাছ থেকে। সে ভেবেছিল একটা সঠিক সময় দেখে শান্ত ভাবে বোঝাবে চন্দ্রাকে। কিন্তু কথা থেকে যে কি হয়ে গেলো সিয়াম টেরই পেলো না।
এসব ভাবতে ভাবতেই সেই আননোন নাম্বারটায় কল ব্যাক করল সিয়াম। কয়েকবার রিং বাজার পর ওপাশ থেকে রিসিভ হলো ফোনটা।
ফোনের ওপাশ থেকে একজন রাশভারী কণ্ঠে বলে উঠলো “আপনিই সিয়াম..?”
সিয়াম একটু চোয়াল শক্ত করেই জিজ্ঞেস করলো “হ্যাঁ কি দরকার তাড়াতাড়ি বলুন।”
ওপাশ থেকে একই ভাবে উত্তর এলো “চন্দ্রা নামের মেয়েটি আপনার কে হয়..?”
সিয়ামের গলা এবার এটটু নরম হলো। সে কৌতুহলী কণ্ঠে বললো ” সি ইজ মাই ওয়াইফ, বাট আপনি এসব কেনো জিজ্ঞেস করছেন..?”
ওপাশ থেকে উত্তর এলো “আপনার ওয়াইফ •••হসপিটালে ভর্তি আছে আপনি যত দ্রুত সম্ভব এখানে আশার চেষ্টা করুন।” আরো কিছু কথা বললো লোকটা।
সিয়ামের মাথার এবার আকাশ ভেঙে পড়লো। সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। পরিষ্কার করে আরো বার দুয়েক জিজ্ঞেস করলো। ওপাশ থেকে একই উত্তর এলো।
সিয়াম দিকবেদিক ভুলে দৌড় লাগলো হসপিটালের দিকে। লিফটে ওঠার আগের মুহূর্তেই পিছন থেকে পিয়াস চেঁচিয়ে উঠলো। সিয়াম সেদিকে তাকাতেই দেখলো পিয়াস তার হুইচেয়ার টা নিয়ে দৌড়ে এসেছে।
পিয়াস এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো “কি যে করিস না তুই। এই ভাবে বাইরে গেলে কি কেলেঙ্কারি হবে বলতো। এতে বস তাড়াতাড়ি তারপর চল কোথায় যাবি আমি নিয়ে যাচ্ছি।”
সিয়াম আর কথা না বাড়িয়ে তাতে বসেই লিফটে উঠলো। আসলেই তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। বারবার মনে হচ্ছে সব দোষ তারই। তার ভুলেরই শিকার ওই মেয়েটা।
আজ পিয়াস না থাকলে যে তার কি হতো। মনে মনে কয়েকবার ধন্যবাদ দেয় সে পিয়াসকে। এমনি এমনি সে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে না পিয়াসকে যথেষ্ট কারণ আছে তার পিছনে। পিয়াস তার শুধু অ্যাসিস্ট্যান্ট কম বন্ধুই নয়। তাকে সিয়াম নিজের ভাইয়ের চোখে দেখে।

সিয়াম হসপিটালে যেতে যেতে ইন্দ্রা সিরাজ দুজনকেই খবর পাঠালো। দুজনেই শুনে বেশ চমকে গিয়েছিলো ইন্দ্রা তো কেঁদেই দিয়েছিল। সিয়াম তাই সিরাজকে বললো ইন্দ্রাকে তার বাড়ি থেকে নিয়ে একসাথে আসতে।

সিয়াম হসপিটালে পৌঁছেই চন্দ্রার খোঁজ নিয়ে চন্দ্রার কেবিনের সামনে গিয়ে দেখলো। একজন চল্লিশের ঊর্ধ্বে ভদ্রলোক কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। স্যুট বুট পড়ে থাকায় নেহাতই বয়স অনেকটাই কম লাগছে।
সিয়াম গিয়েই তার কলার চেপে ধরলো। রক্তলাল চোখ করে বললো ” সাহস কি হয় আপনার আমার বউয়ের এই অবস্থা করার..? এখন কি এখানে সাধু সাজার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন..? আই সোয়ার আমার আমার বউয়ের যদি কিছু হয় না আপনাকে দেশের কোনো আইন বাঁচাতে পারবে না আমার হাত থেকে।”
পিয়াস দৌড়ে এসে সিয়ামের হাত থেকে ভদ্রলোকের কলার ছাড়ালো। সে অবগত সিয়ামের রাগ সম্পর্কে এখানেই যে খুনোখুনি করেনি এটাই তার সৌভাগ্য।

পিয়াস টেনে সিয়ামকে দূরে নিয়ে এসে বললো “সিয়াম এটা হসপিটাল সিনক্রিয়েট করিস না এখানে, শান্ত হ। ওই লোককে আমরা পরে দেখবো আগে গিয়ে ভাবীকে দেখ।”

অন্যসময় হলে সিয়াম পিয়াসকে ধমকে দিতো কিন্তু এখন আর পারলো না পিয়াসের কথা শুনে তীক্ষ্ণ চোখে সেই লোকটার দিকে তাকিয়ে চন্দ্রার কেবিনে প্রবেশ করলো সিয়াম।
.
.
চন্দ্রার কেবিনে ঢুকে সিয়াম দেখলো হাত পা মাথা গলার খানিকটা অংশ ব্যান্ডেজ করা চন্দ্রার। পাশেই ডাক্তার নার্সকে কিছু বলছিলেন। সিয়ামকে দেখে ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন ” আপনি কি ওনার হাসবেন্ড হন.?”
সিয়ামের উত্তর দেওয়ার মতো ভাষা নেই। আসলেই কি সে হাসবেন্ড যে নিজের বউয়ের খেয়াল রাখতে পারে না। যার জন্য তার বউ আজ এইভাবে শয্যাশায়ী। উত্তর এলোনা ভিতর থেকে। সিয়াম চন্দ্রার দিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শুধু হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালো।

ডাক্তার এবার বললেন “ওনার হাত পা মাথায় বেশ চোট লেগেছে যদিও ব্যান্ডেজ করে দিয়েছি তাও বেশ কিছুদিন পুরোই বেডরেস্টে থাকতে হবে। আর আরেকটা জিনিস….”
বলেই ডাক্তার একটু থামলেন।

সিয়াম এবার দৃষ্টি ঘুড়িয়ে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললো “কি হলো আপনি এইরকম চুপ করে গেলেন কেনো..? সিরিয়াস কিছু না তো..? বলুন ডক্টর বলুন চুপ করে থাকবেন না।”
শেষের কথাটিতে কি এমন তেজ ছিলো জানা গেলো না কিন্তু পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নার্সটা হালকা কেঁপে উঠলো সেই আওয়াজ শুনে।
ডাক্তার স্বাভাবিক গলায় বললেন ” এটা হসপিটাল আপনি একটু ধীরে কথা বলুন। আর তেমন সিরিয়াস কিছু না ওনার গলায় চোট লেগেছে তাই কিছুদিন উনি কথা বলতে পারবেন না আর পারলেও অসুবিধা হবে। যদিও কিছু দিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে সমস্যাটা। তাও আপনাদের দায়িত্ব ওকে কথা না বলতে দেওয়া। রাতে একজনকে থাকতে হবে আজ ওনার কাছে। কাল কিছু চেকাপ করিয়ে সব ঠিকঠাক দেখলে বিকেলের মধ্যেই ছেড়ে দেওয়া হবে ওনাকে। তবে আজ হাই পাওয়ারের ওষুধ পড়ায় রাতে ঘুম ভাঙ্গবে না আর আপনারাও ভাঙার চেষ্টা করবেন না। ” বলেই ডাক্তার আর নার্স দুজনেই বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে।
সিয়াম এগিয়ে এলো চন্দ্রার কাছে। আসতে করে চন্দ্রার বাম হাতটা ধরলো। ডানহাতে ব্যান্ডেজ তার। বাম হাতেও চারিদিকে কটাছড়া দেখে সিয়ামের বুক কেঁপে উঠলো। এ কি অবস্থা করেছে মেয়েটা নিজের। তার ভুলের শাস্তি তাকে যা দিতো সে মাথা পেতে নিত। কিন্তু চন্দ্রা নিজেকে এতোখানি আঘাত দিতে পরে সিয়াম ভাবতেও পারেনি।
সিয়াম চন্দ্রার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। চন্দ্রার মুখটা বেশ ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। চারদিকে কাটাছড়া।
সিয়াম আর পারলো না সেই দৃশ্য দেখতে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো তার চোখ দিয়ে। মুখটা আলতো করে চন্দ্রার ঘাড়ের কাছে রাখলো। না আজ আর সেই চেনা পরিচিত পারফিউমের সুবাস পাচ্ছে না সিয়াম। আজ সব ছাপিয়ে শুধু মেডিসিনের গন্ধই এসে ঠেকছে তার নাকে।
এই বিষয়টা ভাবতেই যেনো সিয়ামের আরো ভিতর থেকে নাড়া দিলো। তাও কিছুক্ষন পড়ে থাকলো ওইভাবেই।
কিছুক্ষন বাদ মুখ তুলে চন্দ্রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।

কানের কাছে ঠোঁট ছুঁয়ে বললো ” তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও চ্ন্দ্রাবতী, সকল অমাবস্যা দূর করে আবার আমার জীবনটা তোমার আলোয় আলোকিত করে দাও।”

_______________________

ইন্দ্রা নিজের বাড়ির রোডের সামনে দাঁড়িয়ে একবার চোখ মুছছে একবার গাড়ি দেখছে। সিরাজ এখনও এসে পৌঁছায়নি। ইন্দ্রা জানে সিরাজের তার বাড়ি থেকে এখানে আসতে কিছুটা সময় লাগবে। তাও আজ তার মন মানছে না। এক সেকেন্ড তার কাছে এক একটি বছর সমান মনে হচ্ছে। চন্দ্রাকে সে মেয়ের মত ভালবাসে। চন্দ্রার কিছু হলে ইন্দ্রার মন আগে থেকেই খচখচ করে। আজ সকাল থেকেও করছিলো। সে বিশেষ পাত্তা দেয়নি সে বিষয়ে।এখন দেখছে মহাভুল করেছে সে মনের কথা না শুনে।

গাড়ির হর্ণ শুনে ইন্দ্রা গাড়িটির দিকে তাকিয়ে দেখলো সিরাজ গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে আছে। ইন্দ্রা আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি গিয়ে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে গিয়ে বসলো।

হসপিটাল পৌঁছাতে তাদের এখনও আধা ঘন্টা লাগবে। এইদিকে ইন্দ্রা কেঁদে কেঁদে হেঁচকি তুলে ফেলছে দেখে সিরাজ সামনে রাখা একদম ছোট্ট ছোট্ট দুটো জলের বোতল থেকে একটা বোতল বাড়িয়ে দিলো ইন্দ্রার দিকে।
ইন্দ্রা তা দেখে ঘাড় নাড়ালো অর্থাৎ তার লাগবে না।

সিরাজ দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললো ” এইরকম কাঁদতে থাকলে শেষে বোনকে দেখতে গিয়ে নিজেই ভর্তি হয়ে যাবে।”
ইন্দ্রা এবার রাগ রাগ চোখে তাকিয়ে এক ঝটকায় জলের বোতলটা খুলে বোতলে মুখ দিয়েই ঢকঢক করে খেয়ে বোতলটা সামনে রেখে দিল।

সিরাজ তা দেখে মুচকি হাসলো। ইন্দ্রার অগোচরেই সিরাজ সেই একই বোতল থেকে মুখ লাগিয়ে বাকি জল টুকু শেষ করলো। যদিও জল নামমাত্রই ছিলো তাতে। তাতে কোনো যায় আসে না সিরাজের কারণ তার আসল উদ্দেশ্য পাশের মানুষটার একটু ছোঁয়া পাওয়া।

#চলবে..?

বেড়াজাল পর্ব-১৯+২০

0

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #১৯

হালকা ঠান্ডার আমেজ। মৃদু বাতাস বইছে বাইরে আর তার দাপটেই নড়ছে রুমের জানালার পর্দা গুলো। এইসব কোনদিকেই খেয়াল নেই রুমের ভিতরের দুটি মানুষের তারা নিজেদের মতো মত্ত একে অপরে।
কয়েক মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পর সিয়াম চন্দ্রাকে ছেড়ে তার কপালে নিজের কপাল ঠেকালো। দুজনের শ্বাসের গতিই অস্বাভাবিক।

সিয়াম চন্দ্রার মুখটা আলতো হাতে তুলে চোখের কোনের জলটুকু মুছে বললো ” শান্ত হও চন্দ্র। এই দিনটা একদিননা একদিন আসারই ছিলো। তোমার এখন আমাকে ভালো লাগলেও কিছু বছর ঠিকই বোঝা মনে হবে…”
চন্দ্রা কথা শেষ করতে দিল না তার আগেই রিনরিনে কণ্ঠে বলে উঠলো ” আমার এটা ক্ষণিকের আবেগ বা ভালোলাগা নয় সিয়াম যে কিছুদিন পর সেটা শেষ হয়ে যাবে। আমি ভালোবাসি তোমায়। তুমি থাকলেও আমার না থাকলেও আমার। তোমার জায়গা আমি দ্বিতীয় কাউকে দিতে পারবো না সিয়াম। প্লিজ আমার থেকে দূরে সরে যেও না। তুমি আমায় ভালো থাকতে বলছো কিন্তু ভালো থাকার দায়িত্ত্ব নিতে চাইছো না এমন কেনো সিয়াম..? কি দোষ আমার বলো..? এইটুকুই যে আমি প্রথমে তোমায় মানতে চাইনি..? নাকি আমার তোমার প্রতি ভালোবাসা ধীরে ধীরে জন্মেছে..? আচ্ছা আচ্ছা তুমি কি আগের দিনের ডায়রির কথাটা নিয়ে রেগে আছো..?তুমি বিশ্বাস করো আমি ওভাবে রিয়্যাক্ট করতে চাইনি খুব টেনশনে ছিলাম তাই ওসব বলে দিয়েছি।” বলেই আবার আগের মত কাঁদতে শুরু করলো চন্দ্রা। এবার তার কান্নার সাথে শরীরও থর করে কাঁপতে লাগলো। চন্দ্রা নিজের অজান্তেই টেবিলের পাশে থাকা কাঁটা চামচ চেপে ধরলো হাত থেকে বিন্দু বিন্দু রক্ত পড়া শুরু হলো। চন্দ্রার মুখ বিকৃত হতে দেখে সিয়ামের নজর গেলো চন্দ্রার হাতের দিকে। সিয়ামের বুকটা এবার কেঁপে উঠলো। কি করছে কি মেয়েটা তার জন্য নিজেকে কষ্ট দিচ্ছে..?
সিয়াম এক ঝটকায় চন্দ্রার হাত থেকে চামচটা কেরে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো ” প্লিজ স্টপ চন্দ্র। হোয়াট আর ইউ ডুইং..?”
বলেই সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্রার মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরলো শক্ত করে। চন্দ্রাও পরম আবেশে জড়িয়ে ধরলো সিয়ামকে। কিন্তু কান্না থামালো না।”
সিয়াম কিছুক্ষন মাথায় হাত বুলানোর পরও দেখলো চন্দ্রার কান্না থামলো না উল্টে হিচকি ওঠা শুরু হয়ে গেলো।
সিয়াম আর থাকতে না পেরে চন্দ্রাকে বললো ” প্লিজ স্টপ ক্রাইং চন্দ্র। আমি কোথাও যাচ্ছি না তোমায় ছেড়ে এমনকি তুমি বললেও না। তুমি ভাবলে কীকরে যেই মানুষটা সারাজীবন তোমায় আগলে রাখার দায়িত্ব নিয়েছে সে তোমায় এতো সহজে ছেড়ে দেবে..?”
চন্দ্রার কিছুটা সময় লাগলো বুঝতে। কথাটা মাথায় পৌঁছাতেই ঝট করে সিয়ামের বুক থেকে মাথা তুলে “মানে কি বলতে চাইছো..? তাহলে ঐ ডিভোর্স পেপারের মানে..?”
সিয়াম মুখে এবার একটা তির্যক হাসি খেলে গেলো।
–খুলেই দেখেছোকি কি আছে অতে..?
চন্দ্রা এবার কথার উপর কথা না বলে পাশ থেকে ঝট করে সেই খামটা তুলে নিলো। তার চোখের জল পড়ার দরুণ খামটা কিছুটা ভিজে গেছে। তোয়াক্কা করলো না চন্দ্রা একটানে ছিঁড়ে ফেললো খামটা। ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো শুধু একটা সাদা কাগজ। চন্দ্রা হতভম্ভ কাগজটার এপিঠ ওপিঠ খুঁজেই এক বর্ণ লেখা দেখতে পেলো না সে।
এবার সিয়ামের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে আগে থেকেই চন্দ্রার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখের হাসিই বলে দিচ্ছে এই ব্যাপারটাতে খুব মজা পেয়েছে সে।
চন্দ্রা এবার খানিক রাগ দেখিয়ে বললো ” এসব কি আর ডিভোর্স পেপার কই..?”
সিয়ামের হাসিটা এবার একটু চওড়া হলো। ওভাবেই বললো “কই ডিভোর্স পেপার আমি তো কোনো ডিভোর্স পেপার দিইনি তোমায় ওইটা তো শুধু তোমার রিয়াকশন দখার জন্য মজা করেছিলাম।”
চন্দ্রা হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারলো না নিজের মনেই নিজেকে দু চারটে কথা শোনালো। কি এমন হতো তার আগে খামটা খুলে দেখলে। মানুষটা কিভাবে বকা বানিয়ে তার মনের কথা বের করে নিল।

চন্দ্রার এবার ভারী অভিমান হলো সে খামটা টেবিলে রেখে বালকানির সামনের বেতের মোড়াটায় গিয়ে বসে আকাশের দিকে চেয়ে রইল তার কথা বলার ইচ্ছে নেই এখন।
সিয়াম বুঝলো তার প্রিয়তমা এখন তার উপর অভিমান করেছে। সিয়ামও ধীরে ধীরে চন্দ্রার কাছে গিয়ে চন্দ্রার এক হাত নিজের হাতে নিতেই চন্দ্রা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো কিন্তু সিয়ামের শক্তির সাথে পারে না উঠে চেঁচিয়ে উঠলো “ছাড়ুন ছাড়ুন আমায় বাজে লোক একটা। একদম ধরবেন না আমায়। জানেন আমার আজ কেমন ফিল হচ্ছিল.? মনে হচ্ছিল দম আটকে যাবে। আর আপনি..? আমি তো আজ নিজের মনের কথা বলবো বলেই এসেছিলাম এরকমটা না করলেও হতো।” বলেই ছলছল দৃষ্টি নিয়ে চন্দ্রা আকাশের দিকে চেয়ে রইল।
সিয়াম বুঝলো ওই অভিমানী চোখের ভাষা। চন্দ্রার চিবুকত ধরে নিজের দিকে ঘোরাতেই টুপ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো চন্দ্রার চোখ দিয়ে।
সিয়াম সেটা হাত পেতে নিজের তালুতে নিলো। চন্দ্রা অবাক হয়ে সেই দিকে তাকালো।
সিয়াম জলটা নিজের মাথায় হাত বুলিয়ে মুছে নিয়ে বললো ” আর কক্ষনও এই অমূল্য সম্পদ নষ্ট করবে না। যতক্ষণ আমি পাশে থাকবো ততক্ষণ তো নাই।”
” হ্যাঁ আমি জানি তুমি আজ মনের কথা বলতে। তোমার চোখ পরে আমি টা অনেক আগেই বুঝেছি। কিন্তু সেই প্রকাশে তো এত ব্যাকুলতা থাকতো না, আর না থাকতো আমায় এতো হারিয়ে ফেলার ভয়। আমি দেখতে চেয়েছিলাম তোমার মনের ব্যাকুলতা। আর ডায়রির কথা বলছো সেটা আমি একবারও খুলে দেখিনি ব্যাগের পাশে পড়ে ছিলো তাই তুলে ব্যাগে রাখতে গিয়েছিলাম। ”

চন্দ্রার এবার বেশ খারাপ লাগলো। মাথাটা নীচু করে বললো “সরি। আমিই বুঝতে ভুল করেছিলাম।”
সিয়াম এবার মাছি তাড়ানোর মতো করে বললো “এসব শুকনো সরি টরিতে আমার পোষাবে না বুঝলে।”
চন্দ্রা অবাক হয়ে বললো “তাহলে কি চাই..?”
সিয়াম এবার বাঁকা হাসি দিয়ে নিজের মুখটা চন্দ্রার কানের কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে বললো “ক্যান আই কিস ইউ অ্যাগেন..?” চন্দ্রার এবার বলার ভাষা রইলো না লজ্জায় গাল দুটো টকটকে লাল হয়ে উঠলো। সিয়াম নিশ্চুপতা সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে নিজের হাতটা চন্দ্রার শাড়ির ফাঁকে কোমরে গলিয়ে দিয়ে নিজের দিকে টেনে নিয়ে এলো। এবার ডুব দিলো সেই অনন্ত নেশায়। হাতের বিচরণ হলো অবাধ্য। চন্দ্রা এবার থর থর করে কাঁপতে শুরু করলো। সিয়াম আরেকটু জড়িয়ে নিলো তার সাথে।
চন্দ্রার গা থেকে আসা মিষ্টি মনমাতানো সুবাসটা কখন থেকে টানছিল ওকে। তারপর আবার ওই লাল টকটকে ঠোঁট। নিজের স্ত্রীকে এই রূপে দেখে ঘায়েল হয়েছে সে কখন। এতোক্ষণ যে সে নিজেকে এই কাজ থেকে বিরত রেখেছিল এটা তার নিজের কাছেই আশ্চর্যজনক।

দুজনেই যখন দুজনাতে মত্ত ছিলো ওমনি সিয়ামের ফোন বেজে উঠলো সশব্দে বেজে উঠলো। সিয়াম বিরক্ত হয়ে হাতড়িয়ে ফোনটা সাইলেন্ট করে দিলো। কয়েক সেকেন্ড আবার বেজে উঠলো ফোনটা। সিয়াম এবার ভারী বিরক্ত চন্দ্রার বেশ মজা লাগলো সে মিটিমিটি হেসেই যাচ্ছে। সিয়াম চন্দ্রার এইরাম মিটি হাসি দেখে চোখ ছোটো করে ফোন নিতে নিতে বললো “এর শোধ আমি পরে তুলবই চন্দ্র দেখে নিও। তখন সুনামি আসলেও তোমায় আমি ছাড়বো না তারপর দেখবো এই হাসি তোমার কই থাকে।” চন্দ্রার হাসি মিনিটেই থেমে গেলো গাল গুলো আবার লাল হয়ে উঠলো।

ফোন ধরতেই সিয়ামের মুখ থমথমে হয়ে উঠলো। উত্তেজিত হয়ে হসপিটালের নাম জিজ্ঞেস করলো। এবার চন্দ্রাও চিন্তায় পড়ল। হলোটা কি মানুষটাকে এভাবে কোনোদিন আগে উত্তেজিত হতে দেখেনি চন্দ্রা।
সিয়াম ফোন রাখতেই চন্দ্রা চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো “কি হয়েছে সিয়াম..? কোনো প্রবলেম..?”
সিয়াম ফোন পকেটে রাখতে রাখতে বললো ” খুব বড়ো প্রবলেম চন্দ্র সিয়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে সুইসাইড করতে চেয়েছে। এখন হসপিটালে ভর্তি। ভাগ্যিস সিরাজ সঠিক সময়ে দেখেছিল নইলে আমার বোনটা আজ..” বলতে বলতে সিয়ামের গলার স্বর কেঁপে উঠলো।
চন্দ্রাও হতভম্ভ সে ভাবেইনি এমন কিছু। সিয়ার ব্যপারটা তার একদম মাথা থেকেই বেড়িয়ে গিয়েছিলো। আসলেই এই সময়ে মেয়েটাকে এক মুহুর্ত যেখানে একা ছাড়া উচিত না সে বেমালুম ভুলে গেলো তার কথা।
এসব ভাবতে ভাবতেই সিয়াম তারা লাগলো চন্দ্রাকে চন্দ্রা উঠে চেঞ্জ করে নিলো পাঁচ মিনিটের মধ্যে মেকআপ তুলে ফেললো। কারন ঐভাবে হসপিটালে গেলে খারাপ দেখাবে।

___________________________________

সিয়াম চন্দ্রা হাসপাতালে গিয়েই দেখলো সেখানে সিরাজ আর ইন্দ্রা আগে থেকেই বসে আছে। সিয়াম তাড়াতাড়ি গিয়ে সিরাজকে সিয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলো। সিরাজ জানালো এখন ঠিক আছে চিন্তার কিছু নেই। সিয়াম সস্তির নিশ্বাস ছাড়ল।
চন্দ্রা আগেভাগে ইন্দ্রাকে দেখে অবাক হলেও এই পরিস্থিতিতে ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলো।
সিয়াকে পরের দিন ছেড়ে দেওয়া হলো। সবাই বাড়ি নিয়ে আসলো তাকে কিন্তু কেউ জিজ্ঞেস করলো না এমনটা করার কারণ।

সিয়াকে রুমে শুইয়ে দিয়ে পাশে ইন্দ্রাকে বসিয়ে চন্দ্রা সিয়ামের রুমে এসে দেখলো সিয়াম একমনে কি ভেবে যাচ্ছে। চন্দ্রা বোধহয় সিয়ামের মনের ভিতরটা পড়তে পারলো। সিয়াম যে ভিতরে ভিতরে ভীষণ অনুতপ্ত তা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। চন্দ্রার এবার বেশি খারাপ লাগলো সে সিয়ামকে এইসব আগে জানালে হয়তো এতদূর যেত না ব্যাপারটা।

চন্দ্রা সিয়ামের কাছে গিয়ে মুখোমুখি বসলো। সিয়াম চন্দ্রাকে দেখে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে বললো “কিছু বলবে..?”
চন্দ্রা উপরনিচ মাথা নাড়লো কিন্তু কিছু বললো না।
সিয়াম এবার মুখ খুললো “আমার কাছে ইতস্তত করো না চন্দ্র মনে যা আছে খুলে বলো।”
চন্দ্রা এবার কিছুটা সময় নিয়ে সিয়ামকে সিয়ার ব্যাপারে সব খুলে বললো। সিয়াম সবটা শুনেও আগের মতই বসে রইলো কোনো রিয়াকশন দিলো না। চন্দ্রা এবার বেশ অবাক হলো সে ভেবেছিল সবটা শুনে সিয়াম হয়তো আজ প্রথমবার তাকে বকবে কিন্তু তার সব ভাবনা মিথ্যে করে দিয়ে সিয়াম শুধুই সবটা শুনলো।

কেটে গেলো নীরবতায় কুড়ি মিনিট। সিয়াম এবার বললো “তোমার দোষ নেই চন্দ্র। দোষ তো আমার আমি নিজের কাজে এতটাই ব্যাস্ত হয়ে গিয়েছিলাম কদিন খেয়াল দিতে পারিনি বোনের দিকে। আমি একটু খেয়াল করলেই আজ এই দিনটা আসতো না।”

চন্দ্রার এবার ভীষণ খারাপ লাগছে একদিকে সিয়ামের জন্য তো অন্য দিকে সিয়ার জন্য। চন্দ্রার এরম বেজার মুখ দেখে সিয়াম বললো ” চিন্তা করো না চন্দ্র। আমি ব্যবস্থা করে নিয়েছি সিয়ার, ওকে আবার নতুন করে জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। আর সেটা একজনই পারবে।”
বলেই সিয়াম ফোন তুলে কাকে যেনো কল করে কথা বলতে বলতে বেলকনির দিকে চলে গেলো। চন্দ্রা তাকিয়ে রইলো মানুষটার দিকে।

#চলবে..?

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #২০

সকাল থেকেই চারিদিক পরিবেশ যেনো থম মেরে আছে। কারোর মুখে কোনো কথা নেই বাড়িতে যে যার মতো নিজের কাজ করে যাচ্ছে নিঃশব্দে।
চন্দ্রাকে দরকারে তার কর্মক্ষেত্রে যেতে হয়েছে। সিয়ামেরও বাড়ি ফিরতে বেশ কিছু সময় আছে। বাড়িতে আছে বলতে ইন্দ্রা সিয়া ও সিরাজ। সিয়াম ইচ্ছে করেই সিরাজকে আজ যেতে বারণ করেছে। তাই সিরাজ আজ ঘরেই আছে।

ইন্দ্রা সিয়াকে তার ঘরে বসিয়ে রান্নাঘরে গেলো সিয়ার জন্য স্যুপ বানাতে। পুরো স্যুপ বানিয়ে যেই সেটা নামতে যাবে ওমনি পিছন থেকে টুংটাং আওয়াজ পেয়ে পিছনে তাকাতেই সিরাজকে দেখলো ইন্দ্রা। সিরাজও ইন্দ্রাকে দেখে একটা হাসি দিয়ে হাতের বোতলটা তুলে বললো “জল ভরতে এসেছিলাম। তোমায় ডিস্টার্ব করে থাকলে সরি।”
ইন্দ্রা হালকা হেসে বললো “না না আপনারই কিচেন সরি বলছেন কেনো। নিয়ে নিন জল ।”
সিরাজ সেই শুনে জল ভরতে লাগলো বোতলে। ইন্দ্রা একপলক সিরাজের দিকে তাকালো। একটা স্লিভলেস কলার দেওয়া ব্ল্যাক টিশার্ট পরা পরনে ট্রাউজার। যার ফলে তার মাসাল গুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ইন্দ্রা দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। কিছুদিন ধরে তার মনের অনুভুতি সে নিজেই বুঝতে ব্যার্থ। কি চলছে আসলে তার মনে..? এই মানুষটার থেকে সে যতই দূরে থাকতে চায় মায়ায় পড়বে না বলে ততই জানো ভাগ্য তাদেরকে কাছাকাছি নিয়ে চলে আসে। ইন্দ্রা চায় না তার মতো একজন অভাগী কারোর জীবনে যাক।
এসব ভাবতে ভাবতেই সিরাজের কিছু কথা কানে প্রবেশ করলো “ইন্দ্রা স্যুপটা নাবাও এবার ধরে যাবে যে তলাটা।”
ইন্দ্রার ধ্যান ফিরলো এবার। তাড়াহুড়ো করে স্যুপটা নামতে কিছুটা গিয়ে হাতে পড়লো। ইন্দ্রা এবার একটু জোরেই চেঁচিয়ে উঠলো “আহঃ” বলে।
সিরাজ পিছন ফিরে এই অবস্থা দেখতেই তাড়াতাড়ি করে ইন্দ্রার হাতটা নিয়ে বেসিনের কল খুলে জলের সামনে ধরলো। ইন্দ্রা মুখটা বিকৃত করে দাঁড়িয়ে রইল। বেশ ভালই জ্বলছে তার হাতটা। সিরাজ ইন্দ্রার। মুখ দেখে হাতে জল দিতে দিতেই বললো “একটু সাবধানে কাজ করলে কি হয়..? সবসময় এমন তাড়াহুড়ো করলে হয়..?”
ইন্দ্রা এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে সিরাজের দিকে চাইলো বেশ উদ্বিগ্ন লাগছে তাকে। যেনো স্যুপটা ইন্দ্রার না তার হাতেই পড়েছে।
ইন্দ্রার তাকিয়ে থাকা থেকে তার দৃষ্টিতে চোখ রাখলো সিরাজ। কিছুক্ষন দুজনেই অপলক তাকিয়ে রইল। কয়েক সেকেন্ড ইন্দ্রা ব্যতিব্যস্ত হয়ে সিরাজের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে স্যুপের বাটিটা অন্যহাতে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে গেলো রান্নাঘর থেকে।

সিরাজ চেয়ে রইলো ইন্দ্রার যাওযার পানে। না আর পারা যাচ্ছে না। তার মনের এই খাপছাড়া অনুভুতি ইন্দ্রাকে দেখলেই তার সীমাহীন খুশি অন্যকিছুরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সিরাজ আর বেশি না ভেবে জলের বোতলটা নিয়ে চলে গেলো নিজের রুমে।

ইন্দ্রা সিয়ার রুমে গিয়ে দেখলো সিয়া নেই। ইন্দ্রা চিন্তায় এদিক সেদিক খুঁজতে লাগলো সিয়াকে। শেষে ব্যালকানিতে গিয়ে নীচে তাকাতেই নিচের বাগানে দেখতে পেলো সিয়াকে। ইন্দ্রার মনে হলো এই সময় টুকু সিয়াকে একা ছাড়াই ঠিক হবে। তাই সেও আর ডাকলো না।

_______________________________

সিয়া আনমনে বসে ফুলগুলো দেখছিল। এখন মাথায় তার শুধুই ঘুরপাক খাচ্ছে পুরানোদিনের জমানো স্মৃতি। একসাথে ঘুরতে যাওয়া একসাথে খাওয়াদাওয়া আতিফের জন্য সিয়ার হাত পুড়িয়ে রান্না শেখার স্মৃতি আরও কত কি। আচ্ছা মানুষ এতো সহজে কিভাবে বদলে যেতে পারে..? তার কি এইসব কথা একটিবারও মনে পরছে না..?কি দিব্যি আছে সে।
সে তো জানতো সিয়ার একমাত্র প্রশান্তির জায়গা শুধুমাত্র আতিফ। তাও সে সব যেনে বুঝে কেনো এসব করলো।
সুইটি বেগম এইসব শোনার পর সিয়াকে দেখতে তো যায়নি বরং উল্টে সিয়া আসার পর গালিগালাজ করেছে তাকে। সিয়াম সিরাজের জন্য খুব বেশি কিছু বলতে পারেনি ঠিকই কিন্তু যা বলেছেন ওটাই যথেষ্ট ছিল সিয়ার জন্যে। তিনি জানিয়েছেন সিয়ার বিয়ে তিনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ততো তাড়াতাড়ি দেবেন। সিয়ারও আর উত্তর দিতে ইচ্ছে হয়নি এখন শুধুই তার মনে হচ্ছে সময় যেখানে নিয়ে যাবে সেও সেই স্রোতেই গা ভাসিয়ে দেবে।
এই সব ভাবনা ভাবতে ভাবতেই পাশে পরে থাকা জলের পাইপটা হাতে নিল সিয়া গাছে জল দেওয়ার জন্য। সিয়া গাছ গুলোতে জল দিতে দিতেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো। হটাৎ কারোর চিল্লানোর আওয়াজ পেয়ে সিয়া ভরকে তাকালো সামনের দিকে। হাতের পাইপটা তাড়াহুড়ো করে ফেলে দিয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো সামনে ভিজে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে। দেখতে বেশ সুদর্শন ফরমাল ড্রেসআপ।
সিয়া এবার অনুতপ্ত গলায় বলে উঠলো “সরি বুঝতে পারিনি অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। আপনি কি কাউকে খুঁজছেন..?”

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি এবার ভ্রু কুঁচকে সিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো “হ্যাঁ খুঁজছি তো অবশ্যই। কিন্তু আপনি আমার যা অবস্থা করলেন তাতে তার সাথে আর এই অবস্থায় দেখা করতে পারবো বলে মনে হয় না।”
সিয়ার এবার খারাপ লাগলো। সে আবার বললো “অ্যাগেন সরি। আপনি আসুন আমার সাথে আমি আপনার ফ্রেশ হওয়ার ব্যাবস্থা করছি। তবে আপনি কার সাথে দেখা করতে এসেছেন বললে ভালো হতো।”
ওপর পাশের ছেলেটি বলল “আমি সিয়ামের সাথে দেখা করতে এসেছি আমি ওর বন্ধু। আর আপনাকে এতো হাইপার হতে হবে না আমি না হয় অন্যদিন আসবো।”
সিয়া এবার তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলো ” না সেরাম কিছুই না। আপনি আসুন না ভিতরে আমি বলছি toh সমস্যা হবে না। ভাইয়ার জামা নিয়ে আপাতত চেঞ্জ করে নিন।”
অপরদিকে মানুষটা কি ভাবলো কে জানে তারপর ছোট্ট করে উত্তর দিলো “ওকে”
সিয়া তাকে নিয়ে যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করলো “আপনার নাম..?”
পাশের ছেলেটার মুখে বোধহয় মুচকি হাসি দেখা গেলো। ওভাবেই উত্তর দিলো “অপূর্ব”
সিয়া শুধু ঠোঁট গোল করে বললো “ওও”
.
.
.
সিয়া অপূর্বকে সিয়ামের ঘরের বাথরুম দেখিয়ে সামনে থেকে সিয়ামের জামা বের করে দিলো একটা।
অপূর্ব ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই সিয়া বললো “আপনি আসুন ডাইনিং রুমে কফি খান। ভাইয়া তো এখনও আসেনি কিছুক্ষনের মধ্যে চলে আসতে পারে।”
অপূর্ব টাই করলো। ডাইনিং রুমে গিয়ে বসতেই সিয়া তাকে কফি দিলো। সিয়া ওয়েট করতে বলে চলে যেতেই অপূর্ব পিছন থেকে ডেকে উঠলো “শুনুন..!” সিয়া পিছনে ঘুরে বললো কিছু বলবেন..?
অপূর্ব ইতস্তত করে বললো “আপনি যদি ফ্রি থাকেন তাহলে একটু বসবেন এখানে না মানে যতক্ষন না আপনার ভাই আসছে।” সিয়া কি ভেবে আর না করলো না চুপচাপ গিয়ে বসলো অপূর্বের উল্টো দিকের সোফায়।
অপূর্বের মুখের হাসিটা কি সামান্য বাড়লো..? কে জানে।
কিছুক্ষনের নীরবতা কাটিয়ে অপূর্বই সিয়াকে প্রশ্ন করলো এক এক করে যেমন সে কি করছে কোথায় জব করে ইত্যাদি। সিয়া খানিক বিরক্ত হলেও ভদ্রতার খাতিরে কিছু বললো না তেমন চুপচাপ পরিমাণ মতো উত্তর দিতে থাকলো।
কিছুক্ষনের মধ্যেই সিয়াম চলে এলো। সিয়ামকে দেখে অপূর্ব উঠে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো। সিয়ামও এতদিন পর বন্ধুকে দেখতে পেয়ে তাকে আলিঙ্গন করলো।
তারপর দুজনের আড্ডা বসলো। সিয়ার আর ভালো লাগলো না তাই সে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।

কিছুক্ষন পর চন্দ্রাও এসে পড়ল। সিয়াম চন্দ্রার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল অপূর্বের। চন্দ্রা সালাম করলো অপূর্ব সালামের উত্তর দিয়ে বলল “এবার বুঝেছি ভাবী আমার বন্ধুটার একসময় এতো পাগলামির কারণ। আপনি আসলেই পুতুলের মত দেখতে।” বলেই ফিক করে হেসে সিয়ামের দিকে তাকাতেই দেখলো সিয়াম চোখ গরম করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
চন্দ্রার মাথার উপর দিয়ে গেলো কথাটা। তাই সে আবার অপূর্বকে জিজ্ঞেস করলো “মনে কি বলতে চাইছেন ভাইয়া একটু পরিষ্কার করে বলবেন আমি বুঝলাম না ঠিক।”
অপূর্ব মুখ খোলার আগেই সিয়াম তারা লাগলো চন্দ্রাকে ফ্রেশ হয়ে কিছু নাস্তা নিয়ে আসার জন্যে। চন্দ্রা যেতে না চাইলেও চন্দ্রাকে জোর করে পাঠালো সিয়াম।
চন্দ্রা যেতেই সিয়াম অপূর্বের পিঠে কিল মেরে বললো “এক্ষুনি দিচ্ছিলি তো, প্রেমটা শুরু হওয়ার আগেই শেষ করে। আর খবরদার যদি আগের কোনো কথা তুলেছিস চন্দ্রার সামনে তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না দেখিস।”
অপূর্ব শব্দ করে হাসলো সিয়ামের কথা শুনে। যদিও কিছুটা আসলেই সত্যি সিয়ামের ভয়ঙ্কর রূপ দেখলে আসলেই সিয়ামের থেকে খারাপ তখন কাউকে মনে হয় না।

#চলবে..?