Friday, August 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 465



প্রিয়তার_প্রহর পর্ব-০৪

0

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা ( ৪ )

অফিসের কিছু ফাইল গোছাতে গোছাতে সন্ধ্যে হয়ে গেছে। প্রহর ছুটি নিলেও ইহান আর তানিয়াকে কাজ করে যেতে হচ্ছে। ফাইল কারেক্ট করতে গিয়েই মাথা ঝিমঝিম করছে তানিয়ার। পাশেই ল্যাপটপে মনোযোগী হয়ে বসে আছে ইহান। তীক্ষ্ম চোখ দুটির উপরে থাকা ললাট ভাঁজ হয়ে আছে। তানিয়া উঠে দাঁড়াল। পায়চারি করতে করতে ফাইলের লেখা গুলো দেখতে লাগল। জুতোর খচখচ আওয়াজ কানে বাজল ইহানের। সেদিকে দিকে না তাকিয়েই বললো,

” শব্দ হচ্ছে তানিয়া। বসে কাজ করো। এভাবে পায়চারি করছো কেন?

তানিয়া বিরক্ত হলো। এত নিয়মকানুন ভালো লাগছে না তার। সব কাজ বসে বসে করার কি মানে? এক ধ্যানে বসে থাকতে থাকতে মেরুদণ্ডে ব্যথা হচ্ছে। এসব সে কি করে বোঝাবে? হাতের ব্যথাটাও আছে। ফোস্কা পরে গেছে। কখন বাড়ি ফিরবে কে জানে?

তানিয়া বিনুনি থেকে বেরিয়ে আসা দুষ্টু চুলগুলোকে কানে গুঁজে নিল। চশমা ঠেলে আবার ও আগের জায়গায় ধপ করে বসে পড়ল। অতঃপর ল্যাপটপ খুলে হেডফোন কানে লাগিয়ে নিল। প্রিয়তার সাথে থাকা ট্র্যাকিং ডিভাইসটার সাথে তানিয়ার হেডফোনের কানেকশন আছে। সিক্রেট এজেন্সির একজন কল করে বলেছিল প্রহরকে কিংবা ইহানকে কাবু করার জন্য শত্রুর দল একটা মেয়েকে পাঠাবে। নারীর ভালোবাসা দিয়ে কাবু করবে। বিচ্ছেদ ঘটিয়ে একদম নিস্তেজ করে দিবে প্রহর বা ইহানকে। সেই কথা অনুযায়ী হুট করেই প্রিয়তার আগমন ঘটল। প্রিয়তা মেয়েটা প্রহরের কাছে সাহায্য চাইল, বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করল। সবকিছুই কেমন মিলে গেল। তাই তো প্রিয়তাকে সন্দেহজনক লাগছে সবার।

হেডফোন কানে নিয়ে তানিয়া বুঝল প্রিয়তা কাঁদছে। ফোপানোর শব্দ স্পষ্ট বুঝতে পারছে। মাঝে মাঝে বিলাপ করছে। নাক টানছে অনবরত। খানিক পর পর মৃদু স্বরে বলছে,

” আম্মু বিয়ে করে নিল। আব্বুও বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের কেউ রইল না। তোকে নিয়ে আমি কোথায় যাবো? কি করবো?

তানিয়া কিছুক্ষণ হেডফোন কানে রাখল। কিছু ভাবতে লাগল মনোযোগ দিয়ে। এরপর হেডফোনটা কান থেকে নামিয়ে নিল। চোখ বন্ধ করে কথাগুলোর উপর ভিত্তি করে একটা চিত্র এঁকে ফেলল কল্পনায়। প্রিয়তা আর আরহাম কাঁদছে, দুজনেই মিশে আছে একে অপরের সাথে। কি সুন্দর একটা দৃশ্য, কি মোহনীয়। চোখ মেলে ইহানের দিকে তাকিয়ে অসস্তি নিয়ে তানিয়া বললো,

” প্রিয়তা কোন ক্রাইমের সাথে এড থাকতে পারে না স্যার। মেয়েটা এত মিষ্টি আর মজার যে সন্দেহ-ই হয় না। আমার মনে হয় আমরা ভুল বুঝছি মেয়েটাকে।

ইহান হাসল। পাশে থাকা পানির বোতল থেকে পানি খেয়ে নিল। বললো,
” কে ভালো আর কে নয় তা জানি না। সবাইকেই সন্দেহের খাতায় রাখতে হবে। কে কিভাবে পুলিশ ফোর্সের ক্ষতি করার চেষ্টা করবে তা বোঝা দায়।

তানিয়া একটু চুপ রইল। আজ একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে। শরীরটা ভালো লাগছে না মোটেই। বাড়িতে গিয়ে রান্নাবান্না করতে হবে। তানিয়ার মা তিশা মারা গেছে বছর কয়েক হয়েছে। একমাত্র বাবাকে নিয়েই তানিয়ার পরিবার। রোজ রাত করে বাড়ি ফিরলে তানিয়ার বাবা নিয়াজ শেখ রাগারাগি করেন। মেয়ের এই পেশা তার পছন্দ হলেও তিনি চাননি তানিয়া পুলিশে জয়েন করুক। মেয়ে ছোটখাটো একটা চাকরি করবে, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে, টেনশন কম নিবে এসবই চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তানিয়ার রোজ কি পরিমানে ধকল যায় তা তিনি বোঝেন। তানিয়া ফোনটা ব্যাগে রাখল। গালে হাত দিয়ে উদাসীন কণ্ঠে বললো,

” বাড়ি কখন ফিরবো স্যার?

” তাড়া আছে তোমার?

” জি, একটু।

” চলো পৌছে দেই।

‘ লাগবে না স্যার। আমি একাই যেতে পারবো।

” বেশি কথা বলা আমার পছন্দ নয়। যা বলেছি তাই করো।

তানিয়া ব্যাগে ফাইল ভরে উঠে দাঁড়াল। ওয়াশরুমে গিয়ে হাতে মুখে পানি দিয়ে বাইরে এলো। ইহান ফোন টিপতে ব্যস্ত। লম্বাটে দেহের গড়ন, শ্যাম বর্ণের মুখশ্রী, সব মিলিয়ে ইহান একটু বেশিই সুন্দর। ফর্মাল ড্রেস-আপে আকর্ষণীয় লাগে ইহানকে। এই লোকটা যদি হেসে ওঠে তাহলে ভালো লাগবে না। তানিয়া সবসময় ইহান স্যারকে গম্ভীর দেখেছে। হুট করে ইহান যদি তার সামনে হেসে ফেলে তো ইহানকে একদম মানাবে না। বড্ড বেমানান লাগবে, কেমন অদ্ভুত লাগবে।

ইহান তাড়া দিল। গাড়িতে গিয়ে উঠল তানিয়া। সিট বেল্ট বেঁধে নিল। ইহান পাশে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। কিছুদূর যেতেই গাড়িটি থামিয়ে দিল ইহান। তানিয়া অবাক হলো। কৌতুহলী কণ্ঠে বললো,

” থামলেন কেন?

” একটু থাকো। আসছি।

ইহান বেরিয়ে গেল। কোথায় গেল তা বলার প্রয়োজন বোধ করলো না। কিছু সময় কাটতেই আবার ফিরে এলো। ছোট্ট একটা প্যাকেট তানিয়ার হাতে ধরিয়ে দিল। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল তানিয়া। কি আছে এতে? প্যাকেটটা খুলেই বিস্মিত হলো। ঔষধের পাতা আর মলম জাতীয় ঔষধ রাখা। তানিয়ার এমন বিস্ময় দেখে ইহান স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,

” হাতে ফোসকা পরে গেছে। বাড়ি গিয়ে মনে করে মেডিসিন নেবে।

” আপনি এসব করতে গেলেন কেন?

” আজ হাত পুড়েছে, কাল পা পুড়বে। এরপর দেখা যাবে অসুস্থতার বাহানায় থানায় আসা বন্ধ করে দিবে। এইসব অজুহাত তো চলবে না। কাজে ফাঁকি দেওয়া আমার পছন্দ নয়। এছাড়া টিমের মেম্বারদের দেখে রাখার দায়িত্ব ও তো আছে।

তানিয়ার মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল। তানিয়া কাজে ফাঁকি দেয় না। তবুও ইহান এমন করে বলে যে মনে হয় তানিয়া সবসময় অজুহাত দিয়ে কাজে আসে না। একটু ভালো করে বললেই হতো। এভাবে বলার কি খুব দরকার ছিল? কেন নিবে তার কেনা ঔষধ? তানিয়া গাড়ির গ্লাসের সামনে প্যাকেটটা রেখে দিল। মুচকি হেসে বললো,
” আমার ঘরে মেডিসিন আছে স্যার। এটা অফিসে রেখে দিবেন। অন্যদের কাজে লাগবে।

” নিতে বলেছি।

” ধন্যবাদ।

ইহান আর বাক্য ব্যয় করলো না। সোজা তানিয়াদের ফ্ল্যাটের সামনে এসে গাড়ি থামাল। এর মধ্যে একটা কথোপকথন ও হয়নি তাদের মাঝে। গাড়ি থেকে নেমে তানিয়া ইহানকে ধন্যবাদ দিয়ে পা বাড়াল। ইহান নেমে এলো গাড়ি থেকে। তানিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। অতঃপর ঠান্ডা, নরম কণ্ঠে ডাকল।

‘তানিয়া।

এমন নরম কণ্ঠ তানিয়ার পরিচিত নয়। ডাক শুনেই ভড়কে গেল সে। দুদণ্ড সময় নিয়ে পিছু ফিরল। ইহানের চোখ তখন শীতল। গাম্ভীর্য নেই মুখে। পকেটে দু হাত রেখে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে। তানিয়া উত্তর নিল।

” জি?

কোন কথা বললো না ইহান। তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। ঘড়িতে সময়টা দেখে নিল। অতঃপর কি যেন হলো ইহানের। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,

” কিছু না।

” তাহলে ডাকলেন কেন?

” এমনি। বাড়ি যাও।

তানিয়ার রাগ হলো। কিছু বলবে বলে না বললে মেজাজ খারাপ হয় তার। উৎসুক হয়ে ওঠে কথাটা শোনার জন্য। কিন্তু ইহান যখন বলে দিয়েছে কিছু না, তখন বোমা হামলা চালালেও এই কথার পরিবর্তন হবে না। তানিয়া পা বাড়িয়ে চলে গেল। এই মানুষটার মতিগতি বোঝা আসলেই কষ্টকর। কেনই বা ডাকলো? কেনই বা এমন শান্ত হলো?

___________________

জীবন একটা যুদ্ধক্ষেত্র। এ যুদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়, বিভিন্ন চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরতে হয়। কাল কি হবে এই ভেবে কতশত মানুষ দুশ্চিন্তায় ভুগে। অথচ কাল আমরা না ও বেঁচে থাকতে পারি, সূর্যের আলো কাল আমাদের চোখে না-ও পৌঁছাতে পারে। অন্যায়,দুর্নীতির এই বাজারে সাধারণ মানুষের টিকে থাকা দুষ্কর।

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেয়ালের তারকাটায় লাগিয়ে রাখা ছোট্ট আয়নায় নিজের মুখ দেখল প্রিয়তা। সারা রাত ঘুম হয়নি প্রিয়তার। চোখ ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। নাকের পাটা লাল রং ধারণ করেছে। মাথা ব্যথায় চোখ মেলে তাকাতে পারছে না। আরহাম গতরাতে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। প্রিয়তা ঘুমোতে পারেনি। সারা রাত নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছে। মাঝরাতে একবার চোখ লেগে এসেছিল। কিন্তু স্বপ্নে মায়ের বিয়ে দেখে ঘুম ভেঙে গেছে। এই নিষ্ঠুর এক স্বপ্ন দেখে ভয়াবহ ভাবে কেঁদেছে প্রিয়তা। এখন আর চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে না।

প্রিয়তা গোসল করে নিল দু ঘন্টা ধরে। বড় দেখে ফ্রক পড়ে নিল। গামছা দিয়ে চুল পেঁচিয়ে বেরিয়ে এসে চুলায় ডাল বসিয়ে দিল। আরহামকে উঠিয়ে দিয়ে দাঁত ব্রাশ করিয়ে ছাদে পাঠাল। রান্না হলেই বাচ্চাটাকে খেতে দেবে। নিধির সাথে খুব ভাব হয়েছে আরহামের। নাবিলা আন্টির সাথেও সময় কাটায় আরহাম। আন্টি আন্টি বলে কান ঝালাপালা করে দেয়। ছোট বাচ্চাটার প্রতি মিসেস নাবিলার কোন ক্ষোভ নেই। আরহামকে দেখলেই এটা ওটা খেতে বলেন। আরহাম সেসব খায় না। প্রিয়তাকে এসে প্রথমে জানায়।

পাতিলে রসুনের উপর ডাল ঢালতে গিয়ে ছিটকে গরম ডাল হাতে এসে পড়ল প্রিয়তার। ব্যথায় মুখ দিয়ে আহ্ শব্দটি উচ্চারণ করলো। তড়িঘড়ি ট্যাপ ছেড়ে পানির নিচে হাতটা ধরে রাখল। এই ব্যথায় প্রিয়তা কাঁদল না। এত কাঁদলে চলবে না। আরহাম এভাবে তাকে কাঁদতে দেখলে নিজেও কাঁদবে। প্রিয়তা আরেক চুলায় ভাত বসিয়ে চুল আঁচড়ে নিয়ে ফোন টিপতে লাগল। গতকাল প্রিয়তা রায়হান স্যারকে মেসেজ করেছিল। রায়হান মন্ডল প্রিয়তাদের ভার্সিটির একজন পুরোনো শিক্ষক। প্রিয়তাকে ভিষণ ভালোবাসেন তিনি। প্রিয়তার রেজাল্ট দেখেও খুব খুশি হন। প্রিয়তা স্যারকে বলে রেখেছিল কয়েকটা টিউশনির ব্যবস্থা করে দিতে। স্যার কিছু লিখেছে কিনা তা দেখার জন্য অনলাইনে ঢুকতেই একটা কল এলো অচেনা নাম্বার থেকে। ধরবে না ধরবে না করেও কলটা ধরলো প্রিয়তা। সালাম জানাল মৃদু স্বরে। ওপাশে মধ্যবয়স্ক পুরুষ কণ্ঠে একজন সালামের উত্তর নিল। জিজ্ঞেস করল,

” আপনি কি প্রিয়তা হোসাইন বলছেন?

” জি আমি প্রিয়তা বলছি।

” টিউশনির বিজ্ঞাপন দেখে আমি কল করেছি।

প্রিয়তার চোখ মুখে খুশির ঝিলিক ফুটে উঠল। আনন্দের জোয়ার বইলো হৃদয়ে। খুশিতে নেচে উঠল প্রিয়তার প্রাণ। ততক্ষণাৎ উত্তর দিল।

‘ জি আঙ্কেল বলুন। কাকে, কখন, কোথায় পড়াতে যেতে হবে?

” আপনার রেজাল্ট দেখেই আমি আপনাকে আমার মেয়ের টিচার হিসেবে নিতে চাইছি। আমার মেয়ে কুসুম নাইনে পড়ে। ওকে কমার্সের গ্রুপিং সাবজেক্ট গুলো বুঝিয়ে দিতে হবে।

” সমস্যা নেই আঙ্কেল। আমি পড়াতে পারবো।

” বেতনটা আগে বলে নেই। আপনার না পোষালে এসে তো লাভ হবে না। আমি দু হাজার দিতে পারবো। আপনি পড়াবেন?

দু হাজার টাকা অন্যদের কাছে কোন ব্যাপার-ই না। কিন্তু প্রিয়তার কাছে এই দু হাজার টাকাই বর্তমানে অনেক। কথায় আছে “নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো”। এ দু হাজার টাকা দিয়ে ঘর ভাড়াই শোধ করা যাবে না। কিন্তু আরহামের কিছু কিছু চাহিদা এতে পূরণ হবে। যদিও স্টুডেন্টটার বাসা এখান থেকে অনেক দূর। হেঁটে গেলে বিশ-পঁচিশ মিনিট সময় লাগবে। নইলে অটো ভাড়া লাগবে যেতে আসতে ত্রিশ টাকা। রোজ ত্রিশ টাকা ভাঙা সম্ভব নয়।

প্রিয়তা রাজি হলো। বললো,
” কাল থেকেই আমি পড়াতে যাবো।

কল কাটলো ওপাশের ভদ্রলোক। প্রিয়তা মেসেঞ্জারে গিয়ে স্যারের মেসেজ দেখল। একটা ব্যাচ আপাতত প্রিয়তাকে দিতে পারবেন তিনি। সময়ের স্বল্পতার কারণে রায়হান মন্ডল অনেক স্টুডেন্টদের ফিরিয়ে দেন। প্রিয়তাকে এক ব্যাচ ম্যানেজ করে দিতে অসুবিধা নেই উনার। লেখাটুকু পড়ে প্রিয়তার চোখ মুখের উজ্জলতা বাড়ল। আর দু একটা টিউশনি পেলে আরামে চলে যাবে তার। সুখের মুখ দেখার বড্ড তৃষ্ণা প্রিয়তার।

_____________________

আরহামকে খুঁজে পাচ্ছে না প্রিয়তা। ছেলেটার চুলগুলো আজ কেঁটে দিতে হবে। আরহামের চুলগুলো সুন্দর হলেও ভিষন পাতলা। বাচ্চাদের চুল যত কাটা হয় তত ভালো চুল গজায়। এইসব কাজ সাধারণত বাবা-মা করে থাকে। কিন্তু আরহামের মা-বাবা থেকেও নেই। তাই কাজগুলো এখন প্রিয়তাকেই করতে হবে। প্রিয়তা যখনই বলেছে “তোমার চুল কেটে দিবো”, তখন থেকেই আরহাম উধাও। কাল থেকে আর সময় পাবে না প্রিয়তা। সকালে ভার্সিটি যেতে হবে, দুপুরে দুটো টিউশনিতে যেতে হবে। এসে রান্নাবান্না করে নিজের পড়ালেখা কমপ্লিট করতে হবে। আজকের থেকে ভালো সময় আর পাওয়া যাবে না।

প্রিয়তা গোসল করার মগে পানি নিল। সাবান আর লেজার একসাথে রাখল। ভেজা চুলগুলোকে হালকা খোপা করে নিল প্রিয়তা। দুই ভ্র অবধি কাঁটা চুলগুলো আঁচড়ে নিল ভালো করে। হাতে ফোন নিয়ে অতঃপর আরহামকে ডাকতে বের হলো ঘর থেকে। আরহাম প্রায় সময় নিধির সাথে খেলা করে। ওখানে থাকবে ভেবে প্রিয়তা নাবিলা আন্টির ফ্ল্যাটে এলো। মিসেস নাবিলা তখন রান্নাবান্না করছিল। দরজা খোলা বলে প্রিয়তা ফ্ল্যাটে প্রবেশ করলো। রান্নাঘর থেকে আওয়াজ পেয়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়াল। মিসেস নাবিলা প্রিয়তাকে দেখে হাসলেন। প্রিয়তা বললো,
” আরহামকে দেখেছেন আন্টি?

মিসেস নাবিলা প্রিয়তার দিকে তাকালেন। প্রথম যখন প্রিয়তার সাথে দেখা হয় তখন প্রিয়তাকে তার ভালো লাগেনি। কারণ প্রিয়তা মা-বাবা ছাড়া ঘর ভাড়া নিতে এসেছিল। এ শহরে ব্যাচেলর থাকতে আসা মেয়েগুলোকে একটা ভিন্ন নজরে দেখা হয়। অনেকে ভাবে মেয়েটা বাবা-মায়ের সাথে থাকতে আগ্রহী নয়, নিশ্চয়ই কোন কুকর্ম করে এসেছে, তাই বাড়িতে জায়গা হয়নি। অনেকে ব্যাচেলর মেয়েরা নেশাপানি করে, খারাপ বন্ধুদের সাথে মিশে। সে অনুযায়ী প্রথমে প্রিয়তাকে অত ভালো লাগেনি মিসেস নাবিলার। তবে প্রিয়তার নরম কণ্ঠ, ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা, হাসিহাসি মুখ দেখে অতটা খারাপ বলে মনে হয়নি মেয়েটাকে। নিধির মুখে শুনেছে প্রিয়তা খুব মেধাবী ছাত্রী। টিউশনি করাতে চায়। সেক্ষেত্রে বলা যায় মেয়েটা শিক্ষিকা। তাই তো এখন আর গোমড়া মুখে কথা বলে না।

প্রিয়তার কথা শুনে তিনি বললেন,

” তোমার ভাই তো এসেছিল। চলে গেল একটু আগে। তোমার কাছে যায়নি?

” না। ভেবেছি আজ ওর চুল কেটে দিবো। সেজন্য এখন লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে।

” দেখো গিয়ে ছাদে খেলছে হয়তো। ওখানেই পাবে। কোথায় যাবে আর?

প্রিয়তা রান্নাঘর ছেড়ে পা বাড়াতে উদ্যত হলো। কি মনে করে পিছু ফিরে তাকাল মিসেস নাবিলার দিকে। এই মহিলার গা দিয়ে কেমন মা মা ঘ্রাণ বেরিয়ে আসে। কি সুন্দর কাজের লোক থাকতেও নিজের হাতে রান্না করে সন্তানদের মুখে তুলে দেয়। অথচ প্রিয়তার নিজের ভাগ্য দেখো, কোথায় গিয়ে ঠেকে গিয়েছে সে। নড়বার শক্তি নেই, এগুবার শক্তি নেই। কেমন একা, অসহায়। প্রিয়তা মিসেস নাবিলার উদ্দেশ্যে বললো,

” ধন্যবাদ আন্টি।
মিসেস নাবিলা একটু হাসলেন। কৌতুহলী চোখ নিক্ষেপ করলেন। বললেন, “ধন্যবাদ? কেন? কিসের জন্য”?

” আরহামকে দেখে রাখার জন্য।

কথাটুকু শেষ করে উত্তরের অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে এলো প্রিয়তা। সিঁড়ি বেয়ে তৃতীয় ভবনের ছাদের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। আশপাশে তাকাতেই আজওয়াদকে দেখে অপ্রস্তুত হলো প্রিয়তা। আরহামকে ডাকতে দ্বিধা হলো। মন চাইল চলে যেতে। কি করবে ভেবে পেল না প্রিয়তা। মন র মস্তিষ্কের লড়াই চললো কিছুক্ষণ। পরিশেষে মস্তিষ্কের কথায় সায় জানিয়ে ছাদে পা রাখল প্রিয়তা। ছাদে রোদ নেই। মৃদু বাতাস বইছে ক্ষণে ক্ষণে। আজওয়াদ একটা চেয়ারে বসে আছে। তার কোলেই বসে আছে আরহাম। বাতাসে আজওয়াদের চুল এলোমেলো হচ্ছে। চুলগুলোকে বারবার পিছু ঠেলে দিচ্ছে সে। আজওয়াদের গায়ে অফ হোয়াইট শার্ট। ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে পুলিশটা নিঃসন্দেহে অতিরিক্ত সুন্দর। আরহামের গায়ে কাপড় নেই। ঢিলেঢালা হাফ প্যান্ট পড়েছে। ফিনফিনে রোগা উদাম শরীরে কাতূকুতু দিচ্ছে আজওয়াদ। খিল খিল করে হেসে উঠছে আরহাম। এত সুন্দর একটা দৃশ্য মুঠোফোনে নজরবন্দি করলো প্রিয়তা। অতঃপর ছাদে পা বাড়িয়ে ডাকল আরহামকে।

” আরহাম। ঘরে চলো।

দুজনের নজর আবদ্ধ হলো প্রিয়তাতে। আজওয়াদ দৃষ্টি সরিয়ে নিল ততক্ষণাৎ। আরহাম কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে কোমল কণ্ঠে বললো,

” একটু পরে যাই আপু।

” একটু পরে না। এক্ষুণি। চুল কেটে দিবো বলেছিলাম না?

” আমি গেম খেলছি। একটু পর যাবো।

” তাহলে আমি সবকিছু এখানে নিয়ে আসি? বসে থাকো চুল কেটে দিবো।

” আমি চুল কাটবো না। আমাকে পচা দেখাবে।

” বড় হলে যেটুকু চুল আছে সেটুকুও ঝরে যাবে। তখন একদম টাক হয়ে যাবে। দেখতে আরো পচা লাগবে। যা বলছি শুনবে। দিন দিন অবাধ্য হচ্ছো আরহাম।

আরহাম ঠোঁট উল্টে পিছু তাকিয়ে আজওয়াদের দিকে দৃষ্টি দিল। চোখের ভাষায় বলতে চাইল প্রিয়তাকে তার হয়ে বোঝাতে। আজওয়াদ থতমত খেল বিষয়টা বুঝতে পেরে। হাত চালিয়ে চুলগুলো পিছু ঠেলে দিল। বললো,
” কেন জোর করছেন? অনুমতি ছাড়া ছেলেটার চুল কাটতে পারেন না আপনি।

” আমার ভাই, আমি কি করবো আর কি না করবো তা আপনার কথা শুনে করবো? ওর হয়ে সাফাই গাইতে আসবেন না।

আজওয়াদের রাগারাগি করার মুড নেই। ক্রোধটুকু গিলে ফেললো সে। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো। আরহামের কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা হলো। ঠোঁট উল্টে কান্না করার ভঙ্গি করলো। অতঃপর একটা শক্ত কথা বলে উঠল। বললো,

” আব্বু ভালোবাসে না, আম্মু ভালোবাসে না। এখন আপুউ ভালোবাসে না। থাকবো না আমি। চলে যাবো।

মাত্র দু বাক্যের কথা। না বুঝেই বলেছে আরহাম। কথাটার গভীরতাও জানে না সে। কিন্তু এই কথাটিই বুকে গিয়ে লাগল প্রিয়তার। হু হু করে কেঁপে উঠল কিশোরীর কায়া। রাগান্বিত অবয়ব মুহুর্তেই পাল্টে গিয়ে চুপসে গেল। কষ্টে বুক ভার হলো। প্রিয়তা অনুধাবন করলো তার কান্না পাচ্ছে। খুব বাজে ভাবে কান্না পাচ্ছে। চোখের কার্নিশ পানিতে টইটম্বুর হয়ে গিয়েছে। যেকোন সময় চোখ বেয়ে নেমে আসবে। প্রিয়তা অসস্তিতে পরলো। আজওয়াদ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখ মুছলেও দেখে ফেলবে। ছোট ভাইয়ের এই অভিমানী কথায় এত বড় মেয়ের কেঁদে ফেলার বিষয়টা আজওয়াদের কাছে নিশ্চয় হাস্যকর লাগবে? হেসে ফেলবে সে। লজ্জায় ফেলবে প্রিয়তাকে। না, কেঁদে দেওয়া যাবে না। স্থান ত্যাগ করতে হবে। প্রিয়তা পিছু ফিরে সরে আসতে চাইল। ঝাপসা চোখে পা ফেলতে গিয়ে ভুল জায়গায় পা ফেলল। আচমকা পা মচকে পড়ে গেল প্রিয়তা। গড়িয়ে গড়িয়ে দু সিঁড়িতে গিয়ে হাতের সাহায্য থেমে গেল। শরীরের ব্যথায় মা বলে চিৎকাল করলো প্রিয়তা। মাথায় আঘাত পেল। রক্ত বেয়ে পরল চোখের পাশ দিয়ে। পায়ের যন্ত্রণায় কেঁদে ফেললো মেয়েটা। সর্বস্ব শক্তি হারিয়ে ফেলল। নিদারুণ কষ্টে প্রিয়তার সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল। তার সাথেই কেন বারবার এমন হচ্ছে? কেন এত এত ব্যথার সম্মুখীন হচ্ছে সে? তার কি দোষ? এত সহ্যক্ষমতা তো তার নেই। তবে কি এখানেই সবটা শেষ? আরহামকে কি সুস্থ জীবন দিতে পারবে না প্রিয়তা? ভাবতে পারল না প্রিয়তা। ঢুকড়ে কেঁদে উঠল।

ধপ করে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে আরহাম আর আজওয়াদ এগিয়ে এলো। প্রিয়তাকে এভাবে পড়ে গিয়ে কাঁদতে দেখে হতভম্ব হলো আজওয়াদ। আরহামকে নিয়ে ততক্ষণাৎ এগিয়ে এলো। প্রিয়তা নড়ছে না, শব্দ করছে না। নিস্তেজ দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। প্রহর প্রিয়তার ডান হাতে চাপ প্রয়োগ করে ডাকল,

” প্রিয়! প্রিয়তা।

ওষ্ঠদ্বয় জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিল প্রহর।প্রিয়তা জ্ঞান হারিয়েছে। আরহাম কেঁদে দিল শব্দ করে। ততক্ষণাৎ প্রিয়তাকে কোলে তুলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামল আজওয়াদ। শত্রুকে রক্ষা করার মতো পরিস্থিতিতে ফেঁসে গেল নিমিষেই। এই মেয়েটাকে তো শুট করা উচিত। তা না করে বাঁচানোর জন্য মরিয়া হচ্ছে প্রহর? ছিঃ! পুলিশ হয়ে শেষে কিনা অপরাধীকে সাহায্য করছে? উপরমহল জানলে আজওয়াদকে ফায়ার করে দিবে নিশ্চিত। যদিও মাত্র তিনজন ব্যতিত প্রিয়তার গোপনীয়তা কেউ জানে না। একটু আগেই প্রিয়তার উপর রেগে ছিল সে, ডাকতে দ্বিধা হচ্ছিল। এখন কিনা মেয়েটাকে কোলে করে ঘুরতে হচ্ছে? ইন্টারেস্টিং গেইম ইজ অন

_______________________
ঘুমের রেশ এখনত কাটেনি তানিয়ার। চোখ কচলে সামনে তাকাতেই থতমত খেল সে। আবির এখানে কি করছে এত সকালে? যতদূর মনে পরে কাল রাতে তানিয়া কল বা মেসেজ কোনটাই করেনি। হুট করে বাড়ি এসে পরল ছেলেটা?

বাধ্য হয়ে হাসল তানিয়া। এ কাজ নিয়াজের-ই হবে। আজ একটু ছুটি নিয়েছে তানিয়া। এই সুযোগে ছেলেটাকে তানিয়ার দ্বারে পাঠিয়েছে নিয়াজ। প্রচণ্ড রাগ হলেও কিছু বললো না তানিয়া। হেসে বললো,
” আপনি? এত সকালে?

” আশা করোনি?

ছেলেটার ভয়ঙ্কর দৃষ্টি বুঝতে পারল তানিয়া। গতকাল ফাইল চেক করতে গিয়ে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। আবির কল করলেও তা ধরতে পারেনি সে। ফোনটা বাধ্য হয়ে সাইলেন্ট করে রেখেছিল। নিয়াজ শেখ তার বন্ধুর ছেলে আবিরের সাথে তানিয়ার বিয়ে ঠিক করে রেখেছেন। তানিয়া এখনই বিয়ের জন্য প্রস্তুত নয় জানানোতে আবির সময় দিয়েছে তানিয়াকে। এ সম্পর্কের খাতিরে প্রায় সময় আবির এ বাড়িতে আসে। নিয়াজের সাথে গল্প করে। নিয়াজ চোখ বুজে বিশ্বাস কলে আবিরকে। আবিরের সাথে তানিয়ার বিয়ে দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে আছেন তিনি। দুজন যেন দুজনকে ভালোমতো চিনে নিতে পারে এজন্য দুজনকে মাঝে মাঝেই বাড়ি থেকে বের হতে বলেন তিনি। বিয়ের আগে নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ জানার অধিকার দুজনের আছে বলে মানেন নিয়াজ। কোন সমস্যা না থাকলে আগামী দু মাসের মধ্যেই দুজনের চার হাত এক করতে চান নিয়াজ। আবির দেখতে যেমন ভালো, তেমনই ভালো তার ব্যবহার। অন্যদিকে আবির একটা প্রাইভেট কোম্পানিরও ম্যানেজার। তানিয়াকে সবদিক দিয়েই সুখী রাখবে ছেলেটা। কিন্তু তানিয়ার পছন্দ নয় আবিরকে। কেন জানি খুব ছ্যাছড়া মনে হয় ছেলেটাকে। দুজন-দুজনার বিপরীত। তবুও তানিয়া বাবার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে অকপটে। বাবা নিশ্চয় সবদিক বিবেচনা করেই সিদ্ধান্তটা নিয়েছে।

তানিয়া চশমা পড়ে বিছানা ছাড়ল। চুলগুলোকে হাত খোপা করে নিল। বালিশ ঠিক করতে করতে বললো,

” আশা করবো না কেন? মাঝে মাঝেই তো আসেন।

” কাল রাতে আমার কল ধরো নি কেন?

” কাজ ছিল।

কাজের বাহানায় তানিয়া সবসময় আবিরের থেকে দূরে থাকে। এ বিষয়টা নিয়ে আবির বিরক্ত। চাকরি নিয়ে প্রায়ই কথা কাটাকাটি হয় একে অপরের সাথে। তানিয়ার এতে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। সে নিজের মতো চলতে ব্যস্ত। কাল রাতে কল না ধরায় আবির রেগে আছে। এখন আবারও “কাজ” শব্দটি শুনে রেগে গেল সে।

” কি এমন কাজ ছিল যে কল ধরার সময় পাওনি?

” ফাইল চেক করছিলাম। ভুল ত্রুটি শুধরে দিচ্ছিলাম। অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল বলে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।

” সবসময় কাজ নিয়ে পরে থাকলে আমাকে সময় দেবে কখন? তুমি বুঝতে পারছো না আমার সময় দরকার?

” নিজেকেই তো সময় দিতে পারি না। খানিক আফসোসের সুর তানিয়ার।

” তুমি কিন্তু দিন দিন অবাধ্য হয়ে যাচ্ছো তানিয়া। এমন করলে আমি তোমাকে চাকরি করতে এলাউ করবো না।

” মানে?

” মানে আমার কথা না শুনলে চাকরি করতে দেবো না। এই বা* – এর চাকরি করার কি দরকার? আমি কি কামাই করি না?

” মুখ সামলে কথা বলুন আবির। আমার পেশা নিয়ে আমি একটা বাজে কথাও শুনতে চাই না। ভাষা সংযত করুন।

আবির বুঝতে পারল বিষয়টা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। দুজনই সমান তালে রেগে যাচ্ছে। হয়তো বা বড়সড় ঝগড়া ও লাগতে পারে। দুজনের একজনকে শান্ত হতে হবে। তানিয়াকে ভালোবাসে সে। ঝগড়া করে সময় নষ্ট করতে চায় না। এছাড়া তানিয়া জেদি স্বভাবের মেয়ে। দুরত্ব বাড়লেও কোন যায় আসবে না মেয়েটার। তাই ঝগড়া করলে নিজেরই ক্ষতি। নিজেকেই কষ্ট পেতে হবে।

আবির ফোস করে জোরে শ্বাস টানল। বললো,
” ওকে ওকে, রিল্যাক্স। আ’ম সরি। আর বলবো না। রেগো না প্লিজ।

” হুহ। এত সকালে আসলেন। কোনো দরকার ছিল? শান্ত কণ্ঠেই বললো তানিয়া।

” হুহ দরকার তো আছেই। রেডি হয়ে নাও জলদি। বের হবো আমরা।

“মানে? কোথায় যাবো? বিস্ফোরিত কণ্ঠ তানিয়ার ।

” ভয় নেই। আঙ্কেলের কাছ থেকে পারমিশন নিয়েছি। আজ সিলেটের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াবো। তোমায় মন ভরে দেখবো। লাঞ্চ করবো একসাথে। অ্যান্ড দেন বাড়িতে ড্রপ করে দিয়ে যাবো। আই মিন স্পেশাল টাইম স্পেন্ড করবো।

” এখনই?

” হ্যাঁ এখনই। তুমি রেডি হও। আমি বাইরে ওয়েট করছি।

আবির বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বিরক্তিতে কাঁদতে ইচ্ছে হলো তানিয়ার। এতদিন পর ছুটি পেয়েছে। সারাদিন টিভি দেখবে, ফানি ভিডিও দেখবে, খাবে, ঘুমাবে চিল করবে তা নয়। সব আশা ভেঙে দিল আবির। এখন কিনা ঘুরে বেড়াতে হবে ওর সাথে? তার যে যেতে ইচ্ছে করছে না। আবার না গেলেও বাবার বকা শুনতে হবে। ধুরররর!

তানিয়া হলদে রঙের থ্রি পিস পড়ে নিল। হাত ভর্তি হলদে চুড়ি। চোখে গাঢ় করে কাজল নিল। গলায় চিকন চেইন পরল। যেতেই যখন হবে তখন সাজগোজ করলে ক্ষতি কি? ওড়না মাথায় নিয়ে ব্যাগ হাতে নিতেই ফোন বেজে উঠল তানিয়ার। ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠল ‘Ehan Sir” নামটা। তানিয়ার গলা শুকিয়ে গেল। ছুটির দিনে স্যার দিচ্ছে কেন? কিছু হলো না তো? তানিয়া ফোন ধরল।

” আসসালামু ওয়ালাইকুম স্যার।

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কাল যে ফাইল রি-চেইক করতে দিয়েছিলাম, করেছিলে?

” জি। করেছি।

” ওগুলো নিয়ে আমার বাসায় আসো।

” এখনই?

” ইটস ইমার্জেন্সি। লেইট করো না।

” আমি বের হচ্ছিলাম একটু। পরে যাই?

” খুব প্রয়োজন না হলে আমি তোমায় বলবো কেন? স্টুপিড।

” আঙ্কেল আন্টি গ্রাম থেকে ফিরে এসেছে?

” না তো। কেন?

থতমত খেল তানিয়া। এর মানে স্যার ব্যতিত বাড়িতে এখন কেউ নেই। কিভাবে যাবে সে? অসস্তি হচ্ছে যে।

” বাসায় যেতে হবে?

” আমি যেতে পারলে আর তোমায় বলতাম না। কাজের প্রতি সিরিয়াস হও।

” আসছি স্যার।

ইহান কল কাটল। এতক্ষণ নিঃশ্বাস আটকে গিয়েছিল তানিয়ার। এখন ভালো করে শ্বাস নিল। ইহানের আসতে পারবে না কথার মানে তানিয়া বোঝেনি। হয়তো স্যার বাসায় বিজি আছে। তানিয়া কোনদিকে যাবে এটা ভেবে দিশেহারা হলো। বাইরে আবির আর নিয়াজ অপেক্ষা করছে। ওদিকে ইহান তাড়া দিচ্ছে। আবিরের সাথে না গেলে বাবা বকবে, আর স্যারের কথা না শুনলে ইহান স্যার নিজেই বকবে।

তানিয়া বুদ্ধি আটল। মনে পড়ল প্রহর স্যারের গতকাল বলা কথা। ইতিশা ম্যামের বাড়িতে বেলকনির পাইপ বেয়ে ঘরে ঢুকেছিল ইহান স্যার আর প্রহর স্যার। তানিয়াও সেইভাবেই নিচে নামবে। পুলিশের ট্রেনিং নেওয়ার সময় অনেকবার অনেক স্থানে উঠতে-নামতে হয়েছে। এ পদ্ধতি কাজে লাগানো তানিয়ার কাছে কোন ব্যাপারই না। নিজের বুদ্ধি দেখে নিজেই গর্বিত হলো তানিয়া। আবিরের সাথে যাওয়ার কোন ইচ্ছেই নেই তার। কাজে গেলে নিজেরই ভালো লাগবে। বাড়ি ফিরে না হয় বাবাকে বোঝানো যাবে ।

ওড়না বেঁধে সিনেমাটিক স্টাইলে সাবধানে নিচে নামল তানিয়া। সাবধানে নামতে গিয়েও দেয়ালে বেড়ে ওঠা ফুল গাছের কাঁটায় হাত ছিলে গেল। জামায় শ্যাওলা লেগে গেল। হাতের চুড়ি গুলোও মটমট করে ভাঙল কয়েকটা। কোমর অবধি খুলে রাখা ঘন কেশ অগোছালো হয়ে গেল। চশমাতেও ধুলো লাগল কিছুটা। তবুও তানিয়া কোনরকম আওয়াজ না করে রাস্তা থেকে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। মনে হচ্ছে পালিয়ে যাচ্ছে বাড়ি ছেড়ে। আজ বাড়ি ফিরলে ঝড় বয়ে যাবে তার উপর।

____________

ইহানের বাড়ি ভবনবিশিষ্ট নয়। একদম খোলামেলা বাড়ি। চারপাশে গাছগাছালি। বিশাল বড় বারান্দা। অফ হোয়াইট রঙের দেয়ালগুলোতে চমৎকার অঙ্কন করা হয়েছে।

তানিয়া বিশাল গেট পাড় হয়ে বাড়ির গেটের সামনে এসে দাঁড়াল। এ বাড়ির কলিং বেল নষ্ট। কোন এক আড্ডায় ইহান কথাটা বলেছিল। তানিয়া হাত দিয়ে দরজায় কয়েকবার টোকা দিল। দরজা ভিড়িয়ে রাখা। ভেতর থেকে আটকানো নেই বিধায় ঢুকে পরল বাড়িতে। ড্রয়িংরুমে মাঝারি আকারের টিভি। এখান থেকেই রান্নাঘর দেখা যাচ্ছে। ইহানের ব্যবহৃত পারফিউম এর ঘ্রাণ পুরো বাড়ি জুড়ে। ইহানের বাবা-মা থাকে শহরে। ইহানের ডিউটি এখানে বলে একাই থাকতে হয় তাকে। মাঝে মাঝে উনারা আসেন এখানে ছেলেকে দেখতে। শহরে দুজনের কর্মক্ষেত্র আছে বিধায় ছেলের সাথে থাকতে পারেন না উনারা। তানিয়া ইহানের ঘরটা এর আগে দেখেছিল একবার। অনেকদিন আগের বাড়িটি এমন ছিল না। সেসময় প্রহর তানিয়ার সাথে ছিল।

তানিয়া নির্দিষ্ট কক্ষে ঢুকতে দোনামনা করছিল। দরজা খোলা থাকায় তানিয়াকে দেখল ইহান। গম্ভীর স্বরে বললো,

” এসো।

তানিয়া চশমা ঠিক করলো। নিজের অবস্থা দেখে অসস্তি হলো নিজেরই। এমন সেজেগুজে কখনো স্যারদের সামনে আসেনি সে। জামাকাপড়ের বেহাল দশা। মনে মনে ইহান কি ভাববে কে জানে? খানিক লজ্জা নিয়েই ভিতরে ঢুকল তানিয়া। ইহানের হাতে ব্যান্ডেজ দেখতে পেল। বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় রয়েছে ইহান। তানিয়াকে দেখে উঠে বসে ভদ্রতা দেখাল না। সকালে একটা কেসের জন্য এলাকার বাইরে যেতে হয়েছিল। সেখানে একটা চোর ধরা পড়েছে। ইহান ফোর্স নিয়ে সেখানে গিয়ে চোরকে ধরতেই লোকটা তড়িঘড়ি করে নিজেকে বাঁচাতে ইহানের বাহুতে ছুরি দিয়ে আঘাত করে। এরপর পালিয়ে যেতে নিতেই অন্যান্য পুলিশ ধরে ফেলে লোকটাকে। আর এখন জেলে বসে আছে লোকটা।

তানিয়া বিছানায় বসল। ব্যাগ থেকে নিঃশব্দে ফাইলগুলো বের করল। ইহানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

” কিভাবে কেটে গেল স্যার?

” চোর ধরতে গিয়ে। বাদ দাও। কিছু খাবে?

” জি না।

” খাইয়ে দিবে?

” কি?

” কিছু না।

তানিয়া স্পষ্ট শুনেছে ইহানের কথা। তবুও মনে হচ্ছে তার শোনায় ভুল। এটা কেন বলবে স্যার? তানিয়া লজ্জা পেল। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে মাথা নিচু করলো। গালে লাল আভা উৎপন্ন হলো। ঢিপঢিপ আওয়াজ হলো বুকে। কেঁপে উঠল সে। শীতল প্রবাহ হৃদয় জুড়ে দুলে উঠল।

চলবে?
লেখনীতে: #বৃষ্টি_শেখ

প্রিয়তার প্রহর পর্ব-০৩

0

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা (৩)

আরহাম বাড়ি যাবে বলে কান্না করছে। বিষয়টা স্বাভাবিক হলেও প্রিয়তার মেজাজ খারাপ হবার উপক্রম। ও বাড়ি থেকে চলে আসার পর কেউ একটা কল দিয়ে জিজ্ঞেস করেনি তারা কেমন আছে, কি খাচ্ছে? অথচ বাবা-মায়ের জন্য কান্না করতে করতে হেচকি উঠে গেছে আরহামের। এতই যখন ওদের জন্য মায়া তখন প্রিয়তার সাথে এলো কেন?

প্রিয়তা বিছানা গুছিয়ে, ঘর ঝাড়ু দিয়ে গ্যাসে ভাত বসাল। ঠান্ডা ভাত খাওয়ার অভ্যেস নেই আরহামের। তাই সকালে অল্প রান্না করছিল। প্রিয়তার কিছু বানাতে আলসেমি লাগছে। ও বাড়িতে কাজের লোক ছিল। কোন কাজই নিজে থেকে করতে হয়নি। বাবা-মা বাড়ি ফিরে যে যার মতো ঘরে চলে যেতো বলে মন খারাপ করে দু ভাইবোন ঘরেই বসে থাকতো। এখন বাইরে বেরিয়ে টিউশনি খুঁজতে হচ্ছে, রান্না করতে হচ্ছে,কতশত চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে। জীবনের বাঁক এভাবে ঘুরে যাবে কখনো ভাবেনি প্রিয়তা। পরিস্থিতি বিবেচনা করে মুহুর্তেই রাগ গলে গেল তার। মন খারাপের বার্তা এলো। গাল বেয়ে অঝরে পানি গড়াল। আরহাম তার মায়ের ভালোবাসা পাচ্ছে না। বাবার করুণার পাত্র হয়ে রয়েছে। এই ছেলেটার তো এমন জীবন পাওয়ার কথা ছিল না। আদরে আদরে বেড়ে ওঠার কথা ছিল ছেলেটার।

প্রিয়তা হাঁটু গেড়ে বসে রইল রান্নাঘরে। সময় চলে যাচ্ছে তরতর করে। এভাবে মুখ গুঁজে বসে থাকলে চলবে না। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে গাল মুছে হাসিমুখে আরহামের কাছে এলো প্রিয়তা। কোলে নিল ছেলেটাকে। চুমু খেয়ে ভরিয়ে দিল ভাইয়ের ললাট। বললো,

” আম্মু তো ফোন দেয়নি ভাই। ওখানে গেলে তোমাকে ভালোভাবে থাকতে দেবে না। আমি তো আছি তোমার কাছে। ভয় পেয়ো না।

আরহাম পিটপিট করে চোখের পাতা কয়েকবার এক করলো। নাক টেনে চোখ মুছল। বললো,
” তুমি থাকো না। আমার ভাল্লাগে না একা। কোনো মানুষ নেই এখানে।

” আমি টিউশনি পেলে তোমাকে সাথে করে নিয়ে যাবো। ওখানে মানুষ থাকতে পারে। তুমি আমার সাথে থাকবে, যতটা সময় আমি বাইরে থাকি।

” আমার এখন নুডুলস খেতে ইচ্ছে করছে আপু। ভাত খাবো না। তরকারি মজা লাগে না

চিন্তায় পরল প্রিয়তা। ভার্সিটি থেকে তাড়াতাড়ি ফিরেছে সে। পেয়াজ মরিচ ছাড়া ডিম ভেজেছিল তাতে লবন হয়নি ভালোমতো। এক জায়গায় লবন বেশি হয়েছে আরেক জায়গায় লবণ হয়-ইনি। এখন তো ঘরে নুডুলস নেই। দোকানে গিয়ে আনতে হবে। এরপর আবার রান্না করার ও ধকল আছে। তবুও ভাইয়ের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিল প্রিয়তা। মাথায় ওড়না চেপে বেরিয়ে আসল বাইরে। দোকান থেকে নুডুলস কিনল ভাইয়ের জন্য। অতঃপর আধঘন্টা ধরে রান্না করে নুডুলসের বাটি আরহামের সামনে দিল। খেতে গিয়ে কতশত গল্প করলো তারা। ফোনে কার্টুন দেখে বাকি সময়টুকু কাটাল। টিউশনির একটা ব্যবস্থা না করতে পারলে হচ্ছে না। আরহামের শখ, আহ্লাদ পূরণ করতে হবে। এমনকি আরহামকে পড়ানোর দায়িত্ব এখন প্রিয়তার। বাজারে কোনকিছুতে হাত দেওয়াই যায় না। সব সবজির ব্যাপক দাম। জমানো টাকা দিয়ে কতদিন চলবে?

____________________
সকলের মনে অনেক প্রশ্ন। প্রহর স্যার কেন এখন ডেকে এনেছেন? জানতে আগ্রহী সবাই। তানিয়ার নত মুখে অভিমান। কফির ফোঁটায় হাত জ্বলছে। লালচে একটা ভাব দেখা দিচ্ছে হাতে। এক্ষুণি মেডিসিন না নিলেই নয়। কিন্তু এমন গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছেড়ে উঠে যাওয়া যায় না। আবার বসে থাকতেও অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। কি করবে ভেবে না পেয়ে একজনকে ডেকে বরফ আনতে বললো। এ অফিসের বাইরেই একটা দোকান আছে। বরফ থাকবে হয়তো।

প্রহরের সব কাজ শেষ হলো। আর তখনই পিছনের চৌষট্টি ইঞ্চির এলইডি টিভি অন হলো। সব পুলিশ অফিসার নড়েচড়ে বসল। সব মনোযোগ ঢেলে দিল প্রহরের কথায়। প্রহর রিমোট চেপে একটি ছবি বের করল। হাস্যজ্জল চেহারার এক মহিলার ছবি ভেসে উঠলো টিভিতে। সকলে আগ্রহী চোখে চেয়ে রইল। প্রহর বলতে শুরু করল,

আসসালামু ওয়ালাইকুম। আমার কথা মেনে এত সকালে এখানে উপস্থিত হওয়ার জন্য তোমাদের অনেক ধন্যবাদ। আমি কিছু কথা বলবো, সকলেই মন দিয়ে শুনবে। মাথায় সেট করে নিবে সব। দ্বিতীয় বার যেন কথা রিপিট করতে না হয়।
পেছনে টিভির স্ক্রিনে যিনি আছেন তিনি ইতিশা নায়েমা। শি ইজ আ বিগ রাইটার ইন সিলেট। মেইবি উই অল নো হার। একসময় ইতিশা ম্যাম সাংবাদিক ছিলেন। “সিলেট দৈনিক সংবাদ”- এর একসময় পরিচিত মুখ ছিলেন। লেখালিখিটাকে পেশা হিসেবে নেবেন বলে তিনি সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়েছিলেন। সাংবাদিকতা এখন আর উনার পেশা নয়। ইতিশা নায়েমার একমাত্র ছেলে ইব্রাহিমের নিখোঁজের ঘটনা ইতিমধ্যেই শহরে ছড়িয়ে গিয়েছে। আমরা সকলেই এ কেসটা সম্পর্কে জানি। তিনি তার জীবনের তিক্ত ঘটনা বইয়ের পাতায় ছাপানোর সময় একটি পৃষ্ঠায় লিখেছিলেন – ‘তার ছেলে ইব্রাহিম বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু। ছেলেটা মানসিক ভারসাম্যহীন”। আর এখন সেই ছেলেটাকেই এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এক সপ্তাহ ধরে। প্রহর রিমোট চেপে ছবি বদলে ফেলল। একটা ছেলের ছবি ভেসে উঠল স্ক্রিনে। আবার বলতে শুরু করলো,

এখন তোমরা টিভিতে যেই ছেলেটিকে দেখছো এই সেই ইব্রাহিম। গত কয়েকদিন ধরে সে নিখোঁজ। যেহেতু ছেলেটা সুস্থ নয় তাই সকলের মতামত ইব্রাহিম হারিয়ে গেছে। এর পেছনে কারো কোন কোন ষড়যন্ত্র নেই। ইতিশা ম্যাম নিজে ঘটনাটি ঘটার পরদিন সাক্ষাতকারে বলেছিলেন ইব্রাহিমের হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টা অসম্ভব। দশ বছরের ছেলেটা নিজ হাতে খেতে পারে না, হাত পা প্রায় অকেজো। একা কোথাও যেতে পারে না ইব্রাহিম। মায়ের সব কথাই শোনে। হারাবার মতো ছেলে ইব্রাহিম নয়। উক্ত কথার পরিপ্রেক্ষিতে সকলেই নিশ্চিত হয়েছিল ইব্রাহীমের নিখোঁজ হবার পেছনে কোন হাত আছে।
ইব্রাহিমের নিখোঁজের পর পু’লিশ ফোর্স বিষয়টা নিয়ে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। এই নিখোঁজ সংবাদের দু দিন পর আরেকটা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু নিখোঁজ। এর পরের দিন আরো একটি, এর পরের দিন আরো একটি। এভাবে গুনে গুনে ছয়জন বাচ্চা নিখোঁজ হয়েছে গত এক সপ্তায়। আর এরা প্রত্যেকেই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু। কিছু মানুষের ধারণা এটা ছেলে’ধরা কেস। এই ধরনের বাচ্চাদের কিড’ন্যাপ করে কিডন্যা’পার-রা বাচ্চাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করে ব্যবসা করছে। এ কথা জানার পর ইতিশা ম্যাম বলেছেন ইব্রাহিমের সাথে হয়তো এমন কিছুই হয়েছে। কিন্তু তোমরা জানো কি এটা সম্পূর্ণ মিথ্যে? এর পেছনেও জঘ’ণ্যতম সত্য রয়েছে।
গতকাল ইতিশা ম্যাম যখন বাড়ির বাইরে ছিলেন তখন আমি আর ইহান বেলকনির পাইপ বেয়ে লুকিয়ে ম্যামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ম্যামের বাড়ি আমরা সার্চ করেছি। সন্দেহজনক কিছু না পেয়ে ফিরে আসার পথে একটা ডায়েরি নজরে আসে ইহানের। ডায়েরি ঘেটে আমরা কিছু তথ্য পেয়েছি। ডায়েরির মাঝ পৃষ্ঠায় শহরের নামকরা “ফুড অ্যান্ড কোল্ড” কোম্পানির ওউনার জাফর আলীর ছবি পেয়েছি। আর ছবিটিতে লাল সাইন পেন দিয়ে ক্রস চিহ্ন দেওয়া ছিল। ছবিটির নিচে গোটা অক্ষরে লেখা ছিল ” মুখোশ উন্মোচন”। কিন্তু এটুকু তথ্যে আমরা কিছুই বুঝিনি। কোন কিছুই জানতে পারিনি। তাই “ফুড অ্যান্ড কোল্ড” কোম্পানির এক কর্মচারীকে আমরা আটক করি। কয়েক ঘা দেওয়ার পর মুখ খুলেছে ছেলেটা। জাফর আলী নিজের কোম্পানিকে আরো উঁচু স্থানে নিতে, কাস্টমার বাড়াতে খাদ্যে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করেন। কেক, বিস্কিট-এ হাইড্রোস নামক ক্যামিকাল ব্যবহার করে খাবারকে আকর্ষণীয় ও সুস্বাদু করেন। খাদ্যে অধিক পরিমানে হাইড্রোস ব্যবহার মানুষকে মৃত্যুর দিতে ঠেলে দিতে পারে এ কথা জেনেও এমন কাজ করেন। এই বিষয়ে কোনোভাবে অবগত হন ইতিশা ম্যাম। কোম্পানির সব দুর্নীতির তথ্য নিয়ে নিজের বই লিখতে চেয়েছিলেন ম্যাম। তাই এর শাস্তিস্বরূপ ম্যামের ছেলেকে কিডন্যাপ করা হয়েছে।

থমথমে পরিবেশ বিরাজমান হলো। সকলের চোখেমুখে পুরো ঘটনা জানার আগ্রহ। এতকিছু প্রহর বের করেছে কোন পুলিশকে না জানিয়েই। একজন জিজ্ঞেস করলো,

” স্যার, যদি ম্যামকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ইব্রাহিমকে কিডন্যাপ করা হয়, তাহলে বাকি বাচ্চারা কেন নিখোঁজ হচ্ছে?

” ইতিশা ম্যাম ফেইমাস রাইটার। তার ছেলে নিখোঁজ এটা সবার কাছে একটি বিশেষ ঘটনা। এ নিয়ে তদন্ত করার জন্য উপরমহল থেকে চাপ দেওয়া হয়। জাফর আলী বুঝে গিয়েছে কেসটা নিয়ে অফিসাররা অনেক দুর যাবে। তাই নিজে যেন কোনোভাবে ধরা না পরে সেজন্য একটা পরিকল্পনা সাজিয়েছে। ইব্রাহিমের সাথে সাথে আরো বাচ্চাদের আটকে রেখেছে। যেন কেসটা অন্য দিকে ঘুরে যায়। সবাইকে বোঝানো হচ্ছে এই কাজটা করছে কোন এক দল। আমি শিওর ম্যামকে ব্ল্যাকমেইল করে লেখা বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। কিন্তু এক সপ্তাহ পরেও যখন ইব্রাহিমের খোঁজ পাওয়া যায়নি তখন বুঝে নিতে হবে ম্যাম অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি। আর লেখালিখিও বন্ধ করেননি।
উপযুক্ত প্রমান জনগনের সামনে আনাই এখন আমাদের মূল লক্ষ্য। আমি জানি তোমরা আমাকে বিশ্বাস করবে এবং পাশে থাকবে।

কথাগুলো সকলেই শুনল। নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করল। প্রহর হাসল। কঠিন এক কেস পেয়েছে কয়েকদিন আগে। দুদিন আগেও কেসটা কঠিন ছিল। কিন্তু এখন এই কেসের রহস্য তার কাছে খুব সহজ। শত্রুপক্ষের চাল ধরে ফেলতে সক্ষম হয়েছে প্রহর। খুঁজে পেয়েছে বিখ্যাত লেখিকা ইতিশা নায়েমার ছেলের সন্ধান। আজ রাতে পুরো পুলিশ ফোর্সের শান্তির নিদ্রা আসবে চোখে।

_____________
প্রহরের কাজিনের বিয়ে কয়েকদিন বাদে। প্রহরের সবচেয়ে প্রিয় ফুপির ছেলের বিয়ে। বিয়েটা অনুষ্ঠিত হবে প্রহরদের বাসায়। প্রহরের বাবা পিয়াস করিমের দুটো বোন। ছোট বোনের ছেলে তিয়াশের বিয়ে। বাড়ির ভাড়াটিয়াদের সকলকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। আত্মীয়-স্বজন এসে পরবে দু একদিনের মধ্যেই। প্রহরের ব্যস্ততা কমলেই এনগেইজমেন্ট করে রাখবে বলে ভেবেছিলেন মিসেস নাবিলা। এখন প্রহরের ব্যস্ততা কম, তাই দেরি করার অবকাশ নেই। নতুন ভাড়াটিয়া প্রিয়তা আর আরহামকে শুধু জানানো বাকি। মিসেস নাবিলা সকালে একবার গিয়েছিলেন প্রিয়তার ঘরে। তখন ঘরে শুধু আরহাম ছিল। প্রিয়তা ঘরে ছিল না। আরহামকে বলে এসেছিল প্রিয়তাকে নিয়ে একবার যেন তাদের ঘরে আসে।

প্রিয়তা ভার্সিটি থেকে ফিরে আবারও বেরিয়েছিল বাইরে। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বিজ্ঞাপন বিলিয়ে এসেছে। দেয়ালে দেয়ালে টিউশনির সন্ধানে বিজ্ঞাপনের কাগজ লাগিয়ে এসেছে। এই বুদ্ধিটা প্রিয়তাকে শান্তশিষ্ট, ভদ্র ছেলে তন্ময় দিয়েছে। প্রিয়তার পাশে থেকে লেখা ফটোকপি করাসহ ঘুরে ঘুরে দেয়ালে আটকে দিয়েছে। বাড়িতে ফেরার পর প্রিয়তা ফোন ঘেটে ভাত আর শাক ভাজি রান্না করেছে। ফেসবুক নামক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে আজকাল অন্যদের থেকে রেসিপি জানা যায় ছোট্ট একটি পোস্ট করার মাধ্যমে। রান্নার পরে যখন আরহামের মুখে বাড়িওয়ালা আন্টির তাদের বাড়ি যেতে বলার কথাটা শুনল তখন চিন্তা বেড়ে গেল প্রিয়তার। আন্টি কেন ডাকবে তাকে? প্রিয়তা কি কোন ভুল করেছে ?

দরজা আটকে আরহামকে নিয়ে ঘর থেকে বের হলো প্রিয়তা। সুতির কামিজ টা ঠিক করে নিল সে। আগে সবসময় দামি জামাকাপড় পড়তো প্রিয়তা। সুখী পরিবার না পেলেও আভিজাত্যে অভ্যস্থ ছিল প্রিয়তা। সুখ, সম্পদ পেলে কেউ আবার তা দূরে সরিয়ে রাখে? কিন্তু এখন অভ্যেস পরিবর্তনের সময় এসেছে। সাধারণ জীবনযাপনে নিজেদের মানিয়ে নিতে হবে ভেবেই ভারী শ্বাস ফেলল প্রিয়তা। আরহামের এক আঙ্গুল ধরে হাসিমুখে প্রহরদের দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল। কলিং বেল চাপলেই গৃহকর্মী দরজা খুললো। ভিতরে ঢুকে সোফায় গিয়ে বসল দুজন। কলিং বেলের শব্দে ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো নিধি। মেয়েটার বয়স প্রিয়তার চেয়ে একটু কমই হবে। নিধির মুখ প্রিয়তার খানিক পরিচিত। গতকাল সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার সময় নিধির সাথে দেখা। প্রিয়তা জানতো না নিধি বাড়িওয়ালার মেয়ে। চলে যেতে লাগলে পেছন থেকে ডেকে নিজের পরিচয় দেয় নিধি। নিধি যে খুব চঞ্চল তা তার অঙ্গভঙ্গি-ই বলে দেয়। প্রিয়তাকে নিজেদের ঘরে দেখে খুশি হলো নিধি। দৌড়ে এসে পাশে বসল। জিজ্ঞেস করলো,

” কেমন আছো প্রিয়তা আপু?

” আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো। তুমি কেমন আছো?

” আমি ফার্স্ট ক্লাস আছি। জানো এ বাড়িতে তোমাদের মতো আই মিন আমার সমবয়সী কেউ নেই। তুমি এসেছো বলে আমি কিন্তু খুব খুশি হয়েছি। তোমার সাথে জমিয়ে আড্ডা দিবো এখন থেকে।

এতকিছুর মধ্যে একটা ভালো দিক খুঁজে পেল প্রিয়তা। আরহামকে দেখে রাখতে পারবে নিধি। সময়ে অসময়ে আড্ডা দিয়ে মনটাও ভালো হয়ে যাবে ভেবেই প্রিয়তার চোখ হাসল। জানতে পারলো মিসেস নাবিলা একটু বাজারে গেছেন। একটু পরেই চলে আসবেন। নিধির চঞ্চলতায় মুগ্ধ হলো প্রিয়তা। এটা ওটা নিয়ে আলোচনা করে লাগল। পাশ থেকে আরহাম উঠে গেছে তা খেয়ালে রইল না প্রিয়তার। ঘরগুলো ঘুরে দেখবে ভেবে নিধি মেয়েটাও অত পাত্তা দিল না।

প্রহর ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। গোসল করে বেরিয়েছে মাত্র। ভাইয়ের বিয়ের সব দায়িত্ব নিয়েছে প্রহর। বাড়িতেই কিছুদিন থাকবে ভেবেছে। গোসল করে বের হতেই নিজের ঘরে ছোট্ট একটা ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু বাঁকা করল। ছেলেটা ভিষণ সুন্দর আর ছিমছাম দেহের অধিকারি। গাল দুটো ফোলা ফোলা বলে ছেলেটাকে দেখতেও আকর্ষণীয় লাগে। কিন্তু এ ঘরে ছেলেটার কি কাজ? কি চাইছে বাচ্চাটা? আরহামের পিছনে গিয়ে দু হাত বুকে ভাঁজ করে দাঁড়াল প্রহর। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। আরহাম তখন ঘরের শো পিস দেখতে ব্যস্ত। এ ঘরটার দরজা খোলা বলে ভিতরে ঢুকেছে সে। ভেবেছিল ঘরটা একনজর দেখেই চলে যাবে। কিন্তু ঘরে সুন্দর একটা খেলনা বাইক দেখে দাঁড়িয়ে গেল। ঘরটির টেবিলে একটা সুন্দর চকচকে বাইক রাখা। বাইকটা আকারে অতি ক্ষুদ্র হলেও হুবহু সত্যিকারের বাইকের মতো। ঘর সাজিয়ে রাখার একটা আসবাবপত্র মাত্র। ও বাড়ি থেকে এ বাড়িতে আসার সময় আরহামের খেলনা গুলো আনা হয়নি। এই খেলনা বাইকটা আরহামের খুব পছন্দ হয়েছে।
আরহাম বাইকটা নেড়েচেড়ে দেখল। মেঝেতে বসে হাত দিয়ে চালিয়েও দেখল। অতঃপর কি ভেবে খেলনাটি টেবিলে রাখতে গিয়ে পেছন থেকে পুরুষালি কণ্ঠ শুনে আঁতকে উঠল আরহাম। ছোট বাইকটা হাত থেকে ফসকে মেঝেতে পরল। ঝনঝন শব্দ হলো কিছুটা। বাইকের উপরিভাগ ভেঙে গেল নিমিষেই। ভয়ে হাত পা গুটিয়ে নিল আরহাম। কেঁপে উঠল ছেলেটার কায়া। করুণ চোখে তাকাল সুঠাম দেহের পুলিশের দিকে। আরহামের লোমকূপ দাঁড়িয়ে উঠল অজানা এক ভয়ে। আতঙ্কিত হয়ে মাথা নিচু করলো। মিনমিনিয়ে বললো,
” আমি ইচ্ছে করে করিনি। পড়ে গেল, ভেঙে গেল। আমি বুঝিনি।

গম্ভীর প্রহর আরহামের অভিব্যক্তির পরিবর্তন খুব সুক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করলো। ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছে অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছে। অনুতপ্ততায় দগ্ধ হয়ে আছে ছেলেটা। মনে হচ্ছে ভয়ে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে আসবে। ছেলেটার নাম যেন কি শুনেছিল? মনে পরছে না। প্রিয়তা নামের মেয়েটির ভাই এই ছেলেটা, তা প্রহর জানে। গতকাল প্রিয়তার কোলে দেখেছিল।
প্রহর তার গাম্ভীর্য খানিক ত্যাগ করলো। বিছানা থেকে শার্ট নিয়ে কোনভাবে গায়ে জড়িয়ে নিল। বোতাম গুলো আটকে নিতে নিতে বললো,

” এখানে কি করছো তুমি?

আরহাম তার মায়াময় মুখটা উঁচু করলো। ঠোঁট উল্টে কান্না করার ভঙ্গি করল। চিকচিক করে উঠল ছেলেটার চোখ। নাক কেমন লাল হয়ে গেল নিমিষেই। জড়তার কারণে কথা বলতেও দ্বিধায় পরল ছেলেটা। বললো,

” আমি ঘুরতে এসেছি। আন্টি বলেছিল আসতে। ওটা আমি ভাঙতে চাইনি।

” কিন্তু ভেঙে তো ফেললে ।

” তুমি না ডাকলে ভাঙতো না । পেছন থেকে ভূতের মতো ডাকলে কেন? দোষ তো আমার না।

প্রহর বিস্মিত হলো। একটু আগেই ছেলেটা কেমন ঘাবড়ে গিয়েছিল। কেঁদে দেওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। অথচ এখন কি কায়দা করে কথা বলছে। কি সুন্দর প্রহরের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে। ভাই বোন কি একই রকম নাকি? কেউ তো কারো চেয়ে কম নয়। এটুকু ছেলের কি সুন্দর সম্বোধন। প্রথম দেখায় এভাবে কেউ বলে?

” এই শো পিস টা কত দামী জানো? বললো প্রহর।

” জানবো না কেন? জানি তো। আমি আরেকটু বড় হলেই তোমাকে এমন বাইক কিনে দিবো। আর ঝামেলা করো না। আপু যদি জানে আমায় বকেছো তাহলে…

“কি করবে তোমার আপু?

এতক্ষণ যে সাহসী মনোভাব ছিল তা বদলে গেল। প্রহরকে হাতের ইশারায় নিচু হতে বললো। প্রহর শুনলো। একটু নিচু হতেই আরহাম কানে কানে বললো,

” আমার আপু কিন্তু ভূত। তোমাকে কামড়ে দেবে। আমায় বকলে ঘাড় মটকে দেবে।

কথাটুকু বলেই দৌঁড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল আরহাম। প্রহর কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কোন ভাই তার বোনকে ভূত বলে? পাগল কি এরা দুজন? নাকি প্রহর নিজে?

_______________

বিয়ের দাওয়াত পেয়ে খুশিতে আত্মহারা আরহাম। বিয়ে বাড়িতে হৈ হুল্লোর হবে ভাবতেই ছেলেটা হেসে উঠছে। প্রিয়তার এসবে মন নেই। প্রীতিলতা কিংবা আরিফ যতই খারাপ হোক, তারা তো প্রিয়তার আপনজন। রক্তের একটা টান আছে। এইভাবে থাকতে তার মোটেও ভালো লাগছে না। সবকিছুতেই মন খারাপ হচ্ছে প্রিয়তার। বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল তাই। মমতাময়ী মায়ের মুখ ভেসে উঠছে কল্পনায়। আগে কত সুন্দর একটা পরিবার ছিল প্রিয়তার। হাসিখুশি থাকতো সবাই। প্রীতিলতা স্বাধীনচেতা মানুষ। সংসারের পাশাপাশি চাকরি করতে চাইতো। আরিফ কখনোই কোনকিছুতে বাঁধা দেয়নি। আর এ সুযোগ নিয়েই প্রীতিলতা কলিগের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। পাশাপাশি বসে গল্প করা, ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট, কাজের জন্য এখানে ওখানে একসাথে যাওয়া আসা করা সবটাই নিত্যদিনের রুটিং ছিল প্রীতিলতার। আরহামের জন্মের দু বছরের মাথায় ধরা পরে গেল প্রীতির অবৈধ সম্পর্ক। ঝগড়া বেড়ে গেল, দুরত্ব বেড়ে গেল, সম্পর্ক নষ্ট হলো। তারপর? তারপর আর ভাবতে ইচ্ছে হলো না। কষ্টের কথা স্মরণ করলে কষ্ট বাড়ে, চোখের কার্নিশ বেয়ে পানি গড়ায়, বুকের ভেতরে হাহাকার করে ওঠে। এসব আর ভাববে না প্রিয়তা। একবার ও না।

নিধির সাথে খেলাধুলা করে ঘরে ফিরল আরহাম। প্রিয়তা চলে এলেও আরহাম নিধির কথায় এতক্ষণ ও ঘরে ছিল। হাসিহাসি মুখে সে বোনের পাশে এসে দাঁড়াল। বললো,

” বিয়েতে আমি কি পরবো আপু? আমি কিন্তু খুব আনন্দ করবো।

প্রিয়তা মলিন হাসল। ভাইয়ের গাল আলতো চেপে বললো,
” তোমার তো জামাকাপড়ের অভাব নেই। যেকোন একটা পড়ে যেও।

” উহু, তুমি আমাকে নতুন শার্ট কিনে দিবে। ওগুলো আমি পরবো না। প্রমিস করো, কিনে দিবে।

নিদারুণ যন্ত্রণায় বুকটা কেঁপে উঠল প্রিয়তা। হাতে তেমন টাকা নেই। ঘরের টুকটাক জিনিসপত্র কিনে অনেক টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। বাকি যে টাকা আছে তা দিয়ে এখনো এক মাস চলতে হবে। আরহামকে জামাকাপড় কিনে দিলে সে টাকাটুকুও থাকবে না। ভাইকে কিভাবে বোঝাবে দুর্দশার কথা? বুঝবে আদৌ? কেন যেন মুখের উপর না বলতে পারল না প্রিয়তা। বললো,
” কিনে দিবো।

বিকেলে খেতে বসতেই একটা কল এলো আননোং নাম্বার থেকে। প্রথমে কলটা কেটে দিল প্রিয়তা। পরপর তিনবার কল দেয়ার পর ফোনটা ধরলো। নম্র স্বরে সালাম জানাল প্রিয়তা। ওপাশের নারী কণ্ঠে এক মহিলা বলে উঠল,

” হেই প্রিয়তা। হাউ আর ইউ? আমায় চিনেছো?

নিঃশ্বাস আটকে গেল প্রিয়তার। এই কণ্ঠ তার চেনা। আরিফ আগে এই মেয়েটার সাথে কথা বলতো। জিজ্ঞেস করলে বলতো বান্ধবী। প্রিয়তা এই কণ্ঠ বহুবার শুনেছে। এই মহিলাটির প্রেমেই মজে আছে আরিফ। মহিলার নাম দীপা। তিনি ইন্ডিয়ান। কলকাতায় বসবাস করেন। হুট করে প্রিয়তাকে ফোন দিল কেন? নাম্বার-ই বা পেল কোথায়? কি চাইছে উনি? যা চেয়েছিলেন তা তো পেয়েছেন। প্রিয়তা আর আরহাম তো সরে এসেছে তাদের জীবন থেকে। এখন ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করার কি প্রয়োজন? রাগে মুখ বিকৃত করলো প্রিয়তা। জ্বলে উঠল সর্বাঙ্গ। যথেষ্ট মার্জিত থাকতে চেষ্টা করলো। কণ্ঠ নামিয়ে বললো,

” আমায় কেন কল করেছেন? আপনার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি।

” রেগো না বেটা। শান্ত হও। ভুলে যাচ্ছো আমি তোমার হবু সৎ মা।

” সৎ মা মাই ফুট। আপনার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। সো প্লিজ আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেন না।

” আচ্ছা করবো না। একটু শুনে নাও আমার কথা।তোমার আম্মু যে বিয়ে করেছে তা কি তুমি জানো?

” কি বলছেন? বাজে বকবেন না।

” তোমার আম্মু আব্বুর ডিভোর্স হয়ে গেছে। আর গতকাল তোমার আম্মু বিয়েও করে ফেলেছে। মায়ের বিয়েতে থাকতে পারোনি। কষ্ট হচ্ছে? বাবার বিয়েতে নিশ্চয়ই থাকবে? তোমায় নিমন্ত্রণ জানাতেই তো কল করলাম।

প্রিয়তা কিংকর্তব্য বিমূঢ় হলো। হাত পা অবশ হয়ে এলো তার। কখন যে টুপ করে চোখ থেকে তপ্ত নোনা পানি চিবুক বেয়ে গড়াল তা অনুমান করতে পারল না প্রিয়তা। সর্বাঙ্গে শীতল শিহরণ বয়ে গেল। বক্ষদেশ কেঁপে উঠল। বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথায় মুখ দিয়ে শ্বাস নিল প্রিয়তা। শব্দহীন কান্নার দাপটে নাক লাল হয়ে গেল। খট করে কল কেটে দিল প্রিয়তা। পাওয়ার বাটন চেপে ফোন অফ করে দিল। বুকের ভেতর ভয়ঙ্কর তোলপাড় শুরু হলো প্রিয়তার। নাম না জানা ব্যথায় হাপিয়ে উঠল। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি টুকু পেল না। এক স্থানে বসে রইল।এত যন্ত্রণা হচ্ছে কেন? বুকটা ভার হয়ে আসছে কেন?এটা তো হওয়ারই ছিল। তাহলে কেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে হৃদয়?
বোনের এমন অভিব্যক্তি দেখে আরহাম কাছে এসে বসল। পায়ে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

” কি হলো আপু? কাঁদো কেন? আম্মু কল দিয়েছিল? যেতে বলেছে তাইনা? খুশিতে কাঁদছো?

প্রিয়তা ভেজা চোখে ভাইয়ের দিকে কয়েক পল তাকিয়ে রইল। আলতো হাতে ছুঁয়ে দিল আরহামের নরম গাল। জড়িয়ে ধরলো বুকের মাঝখানটায়। কিছুক্ষণ ভাইকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। অতঃপর হুট করে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল প্রিয়তা। চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। আরহামকে জড়িয়ে নিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল। খানিক উচ্চ স্বরে বললো,
” ভাই রে, আমরা এতিম হয়ে গেছি ভাই। আমাদের আর কেউ নেই। আম্মু চলে গেছে। তোর কথা ভাবেনি, আমার কথাও ভাবেনি। আমরা অনাথ হয়ে গেছি ভাই। আমাদের কেউ রইল না। আমরা কিভাবে থাকবো ভাই? কিভাবে বাঁচবো? আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। আমি মরে যাবো ভাই। আমার কষ্ট হচ্ছে।

প্রিয়তার এমন কান্নায় আরহাম ও কেঁদে দিল। প্রিয়তাকে এভাবে কখনো কাঁদতে দেখেনি আরহাম। বোনের এমন উন্মাদের মতো অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেল সে। নিজের কান্না থামিয়ে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। বললো,

” তুমি কাঁদলে আমার কান্না পায় আপু। কেঁদো না। তোমাকে আইসক্রিম খাওয়াবো। আমার সাথে হাসো।

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

প্রিয়তার প্রহর পর্ব-০২

0

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা (২)

প্রিয়তা যখন নতুন বাড়িতে উঠল তখন সন্ধ্যে সাতটা বেজে আঠারো মিনিট। বৃষ্টি নেই বললেই চলে। তবে গাঢ়, ঠান্ডা বাতাসে শীতল হয়েছে ধরনী। বাড়িটির রং হালকা গোলাপী রঙের। তিন ভবন বিশিষ্ট বাড়িটাকে বোধহয় আরো বড় করতে চায় বাড়ির মালিক। আজওয়াদ বিশাল বড় গেটটা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো। সিঁড়ি ভেঙে তৃতীয় ভবনে উঠল তারা। আজওয়াদ নির্দিষ্ট কক্ষে গিয়ে কলিং বেল চাপ। পর পর দু-বার বেল বাজাতেই এক অর্ধ বয়স্কা ভদ্রমহিলা দরজা খুললেন। আজওয়াদ নামক ছেলেটাকে দেখে মৃদু হাসলেন। আজওয়াদের ঠোঁটের কোণেও হাসির রেখা দেখা দিল। জুতো খুলে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে আজওয়াদ মহিলার উদ্দেশ্যে বললো,
” তুমি বলতে না ভাড়াটিয়া খুঁজতে? এই নাও ভাড়াটিয়া। যা প্রশ্ন আছে করে নাও।

প্রিয়তা এগিয়ে এল। মিসেস নাবিলা প্রিয়তাকে দেখে ব্যতিব্যস্ত হলেন । দরজার কাছ থেকে সরে প্রিয়তাকে ভেতরে ঢুকতে বললেন। সোফায় বসতে দিয়ে বাড়িতে কর্মরত মহিলাকে শরবত আনতে বললেন। প্রিয়তার বিষয়টা ভালো লাগল। বুঝতে পারল আজওয়াদ নামক পুলিশের মা হন এই মহিলা। আজওয়াদ লাগেজ রেখেই একটি ঘরে ঢুকেছে। প্রিয়তা সরাসরি বলে উঠল ” বাইরে ঘর ভাড়া দেওয়ার পোস্টার দেওয়া দেখে এসেছি। মাসিক ভাড়াটা যদি বলে দিতেন।

মহিলার পোশাক মার্জিত। খয়েরী রঙের তাঁতের শাড়ি পড়ে বসে আছে সামনে। চুলগুলো শক্ত করে খোঁপা করে রেখেছেন। প্রিয়তার প্রশ্নে মহিলা হাসলেন। বললেন, “এত বড় বাড়িতে থাকার মানুষের অভাব। এক তলা আর দু তলায় ভাড়াটিয়ারা থাকে। আমাদের কোন কিছুর অভাব নেই। তাই ভাড়া অত বেশি নেই না আমি। কিন্তু মাসের দশ তারিখের মধ্যে ভাড়া দিয়ে দিতে হবে। এই ব্যাপারে কোন ছাড় নেই”।

” আমি শুধু আমার ভাইকে নিয়ে এখানে থাকবো। আশা করি এতে আপত্তি থাকবে না আপনার? অস্বস্তি নিয়ে কথাটা বলে উঠল প্রিয়তা।

মিসেস নাবিলা সহসা বিস্মিত হলেন। খানিক গম্ভীর হলেন মুহুর্তেই। বোঝা গেল একা একটা মেয়েকে ঘর ভাড়া দিতে নারাজ তিনি। চোখমুখ কুঁচকে মিসেস নাবিলা বলে উঠলেন ” তোমার মা-বাবা নেই? এখানে তো ব্যাচেলর ভাড়া দেওয়া হয় না।

” আমার ভাইটাই আমার পরিবার আন্টি। আমার আব্বু-আম্মু প্রবাসী। আমি ওদেশে যেতে চাই না বলেই এখানে রয়েছি। আম্মু চলে আসবে কয়েকমাস বাদেই।

প্রিয়তা মিথ্যে বলতে বাধ্য হলো। আরহামের দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক পল। পরিচয় পত্র দেখে প্রিয়তাকে একটি ঘর দেখিয়ে দিলেন মিসেস নাবিলা। নাবিলার স্বামী নিজেও প্রবাসী। এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে এ বাড়িতে থাকেন তিনি। ছেলে আজওয়াদ আর মেয়ে নিধি তার প্রাণ। প্রিয়তাকে তেমন পছন্দ না হলেও ছেলে সাথে করে নিয়ে এসেছে বিধায় পরিবার ছাড়াও ঘর ভাড়া দিতে রাজি হয়েছেন তিনি। বেগড়বাই করলে না হয় অন্য ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

আরহাম গভীর ঘুমে। প্রিয়তা নতুন ঘরে প্রবেশ করেই আরহামকে মেঝেতে কাঁথা বিছিয়ে শুইয়ে দিল। প্রীতিলতা আর আরিফ দুজনেই ভালো আয় করতো বিধায় ভিষণ সচ্ছল জীবনযাপন করতো প্রিয়তা আর আরহাম। তুলোর ন্যায় নরম বিছানায় শুতে অভ্যস্থ হলেও সেই অভ্যেস পরিবর্তন করার প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে এখন। আরহামকে শুইয়ে দিয়ে প্রথমেই প্রিয়তা ব্যাগ থেকে তারকাটা বের করে মিসেস নাবিলার থেকে হাতুরি এনে দেওয়ালের দু জায়গায় তারকাটা বিধিয়ে দিল। অতঃপর একটা মোটা দড়ি দু তারকাটায় শক্ত করে বেঁধে নিল। লাগেজে থাকা জামাকাপড় সবগুলো গুছিয়ে দড়ির উপর রাখল, ঘরের আশপাশ ঝাড়ু দিল, পানি আর কাপড় দিয়ে ঘর ঝেড়ে মুছে নিল। এতটুকু কাজ করেতেই হাঁপিয়ে উঠল প্রিয়তা। পিঠে চিনচিন ব্যথা অনুভব করলো। মেরুদণ্ড ভেঙে আসছে মনে হলো। ঢকঢক করে বোতলের পানি পান করল প্রিয়তা। আরহামের মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে ঢুকড়ে কেঁদে উঠল। এই ছেলেটা কিভাবে এত কষ্টে থাকবে? প্রিয়তা যদি টিউশনি না পায়? কিভাবে চলবে? কি খাবে? স্মরণ হতেই দুশ্চিন্তা ঝেঁকে বসল মস্তিষ্কে। মা-বাবা ছাড়া কেমন লাগবে তাদের? কেন এত কষ্ট পেতে হচ্ছে?

মুঠোফোন চট জলদি হাতে তুলল প্রিয়তা। তন্ময়কে মেসেজ দিল। ইতিমধ্যে ছেলেটা পঞ্চাশেরও বেশী বার কল করেছে। ফোন সাইলেন্ট করে রাখার কারণে শুনতে পায়নি রিংটোন। প্রিয়তার মনটা আরো খারাপ হলো যখন দেখল প্রীতিলতা কিংবা আরিফের কোন কল আসেনি। ফোনের পাওয়ার বাটন চেপে বালিশের নিচে ফোনটা রেখে দিল সে। অসময়ে ঘুম পেল খুব। পেটে ক্ষুধা থাকতেও অলসতার জন্য রান্না বান্না করলো না প্রিয়তা। সকালে আবার টিউশনি খুঁজতে হবে ভেবেই ভারী শ্বাস ফেলল। জানালা দিয়ে শীতল বাতাস এসে গা ছুঁয়ে দিল। আরহাম কেঁপে উঠল। ছেলেটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো প্রিয়তা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ঘুমে আচ্ছন্ন হলো নিজেও।

______________
সকালে শোরগোলে ঘুম ভাঙল প্রিয়তার। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে ছিল বলে তাড়াতাড়িই ঘুম থেকে উঠে পরল। আরহাম ঘুমোচ্ছে এখনো। রাতে উঠে একটু কান্না করেছিল ছেলেটা। দু ভাই বোন অনেকক্ষণ জেগে ছিল রাতে। তাই আরহামকে ঘুমোতে দেখে ডাকল না প্রিয়তা। এ এলাকাটা একটু ভ্রমণ করা দরকার। যে এলাকার সদস্য হয়ে থাকতে হবে সে এলাকা চিনে রাখা প্রয়োজন। পূর্বের রুটিং মাফিক প্রিয়তার মর্নিংওয়াক করতে ইচ্ছে হলো। চুলে শক্ত করে ঝুঁটি বেঁধে জুতো পরে নিল। হাতে তন্ময়ের দেওয়া ঘড়িটাও পরে নিল। আরহামের গালে চুমু খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। সতেজ সকালে উৎফুল্ল হলো প্রিয়তার মন। বাড়ির আশপাশে থাকা বিশাল মাঠটা নজর কাড়ার মতো। ফুলের ঘ্রাণে জায়গাটা সতেজ লাগছে। আরহাম উঠে যাবে ভেবে পা চালাল প্রিয়তা। এসে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সহসা গোলাকার এক বস্তু পায়ে লাগায় হুট করে মাঠে হাঁটু ভেঙে বসে পরল প্রিয়তা। ব্যথায় মুখ কুঁচকে ফেলল। মৃদু আর্তনাদ করে উঠল মুখ দিয়ে। ঝিমঝিম করে উঠলো হাঁটুর খানিক নিচ অংশ। চোখ চিকচিক করে উঠল ব্যথার কারণে। প্রিয়তা পা চেপে অদূরে থাকা অনেকগুলো প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের দেখতে পেল। একজন মেয়ে আর দুজন ছেলেকে এগিয়ে আসতে দেখল তার দিকে। পাশে পরে থাকা গোলাকার বস্তুটি ক্রিকেট বল। ব্যথা পাওয়ার উৎস এই বলটাই। দূর থেকে যারা আসছে তারাই যে এই ঘটনা ঘটিয়েছে তা বুঝতে সমস্যা হলো না প্রিয়তার। রাগে নাকের পাশ ফুলে উঠল তার। বলটা হাতে নিয়ে শক্ত করে ধরে রাখল। লোকগুলোর আসার অপেক্ষা করল খানিক্ষণ। ওদের এগিয়ে আসতে দেখে প্রিয়তা দাঁড়িয়ে পরল। ভিষণ আশ্চর্য হলো যখন বাড়ির মালিকের ছেলে অর্থাৎ আজওয়াদ নামক ছেলেটির হাতে ব্যাট দেখতে পেল। চেঁচিয়ে উঠল প্রিয়তা। রাগ বেড়ে গেল। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চেয়ে বলে উঠল,
” আপনার কি খেয়ে আর কাজ নেই? আমার সাথে কি শত্রুতা? এভাবে আমায় আঘাত করলেন কেন? ইচ্ছে করে করছেন তাইনা?

সামনে আজওয়াদের ডান পাশে থাকা মেয়েটির চোখে গোলাকার চশমা। পরনে দামি কুর্তি। লম্বা বেনুনী বাতাসে দুলছে। মেয়েটির বা পাশেই শ্যামবর্ণের আরেকটি ছেলে। নাম না জানা ছেলেটার পাশে আজওয়াদ ব্যাট মাটিতে ঠুকে রেখে দাঁড়িয়ে আছে। গরমে ঘাম ঝরছে সবার। গায়ের কাপড় ঘামে ভেজা । আজওয়াদ শর্ট হাতার টি শার্ট পরেছে। টাউজারের নিচের অংশ গুটিয়ে নিয়েছে। সুঠাম দেহের ছেলেটির মাঝে অনুতপ্ততার রেশ নেই। নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। কারো মুখে কথা না দেখে সামনের মেয়েটি চিন্তিত কণ্ঠে প্রিয়তার বাহুতে আর হাতে হাত রাখল। কোমল কণ্ঠে বললো,
‘ তোমার লাগেনি তো আপু? আমরা বুঝতে পারিনি। বেশি ব্যথা পেয়েছো?

প্রিয়তা উপলব্ধি করলো মেয়েটার কণ্ঠ মিষ্টি আর সুন্দর। আরো মনে হলো মেয়েটি ভিষণ ভালো। কিন্তু রাগ থাকায় শান্ত হতে পারল না প্রিয়তা। ঝাঁঝালো গলায় বললো,
” লেগেছে। খুব লেগেছে। মনে হচ্ছে পা ভেঙে গেছে। কিন্তু যে মেরেছে তার কোন ভ্রূক্ষেপ আছে? ইনি পুলিশ কিভাবে হলো বলুন তো?

আজওয়াদ বোধহয় বিরক্ত হলো কথাটা শুনে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে স্থির করলো। ব্যাট মাটি থেকে উঠিয়ে কাঁধে নিয়ে বললো,
” আমি ইচ্ছে করে আপনাকে উদ্দেশ্যে করে বলটা মারিনি। এটা নিছকই দুর্ঘটনা।

” চোখের মাথা খেয়েছেন নাকি? আমি যাচ্ছি দেখেও বলটা মারলেন কেন? আপনি যদি এমন করেন বাকি সাধারণ জনগন কি করবে ? আমার পায়ে যে আমি ব্যথা পেলাম এর দায় কে নিবে? প্রচন্ড রাগান্বিত ভঙ্গিতে বললো প্রিয়তা।

” লিসেইন মিস, কেউ সহজে ইচ্ছে করে এভাবে ব্যাট দিয়ে বল গায়ে লাগাতে পারে না। বলটা যেইভাবে ছোঁড়া হয়েছিল আমি সেই ভাবেই পিটিয়েছি। এতদূরে বলটা যাবে কে জানতো?

প্রিয়তার রাগে ওষ্ঠাদ্বয় দাঁত দিয়ে চেপে ধরল। হাতে থাকা বলটায় চাপ প্রয়োগ করল। বললো,
” বেশ, আসুন আপনাকে মেরে দেখাই। দেখুন বল লাগানো যায় নাকি। চলুন ওখানে। কিভাবে বল পেটাতে হয় দেখাচ্ছি।

আত্মবিশ্বাসের সাথে কথাটি বলে উঠল প্রিয়তা। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বল নিয়ে এগিয়ে গেল খেলার জায়গাটিতে। আজওয়াদের পাশে থাকা নাম না জানা ছেলেটি মুখ খুলল এবার। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
‘ ইট ওয়াজ আ এক্সিডেন্ট। কেউ ইচ্ছে করে করেনি। উই আর রিয়েলি ভেইরি সরি।

প্রিয়তা থামল না। তিনটে লম্বা লাঠি তথা ক্রিকেট স্ট্যাম্প গুলোর সামনে গিয়ে আজওয়াদের কাছ থেকে ব্যাট নিয়ে খেলার জন্য দাঁড়াল। একটু ঝুঁকে ব্যাটটা মাটিতে ঠুকল। আজওয়াদ এর দিকে তাকিয়ে বললো,

” আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম ওখানে গিয়ে দাঁড়ান। আর কেউ একজন বলিং করুক।

” আমি আপনার কথা শুনবো কেন? আমি তো বলেছি অনিচ্ছাকৃত ভাবে ঘটেছে সব। অবাক হয়ে বলে উঠল আজওয়াদ।

” শুনবেন না কেন? এমনিতেই বল ছুঁড়ে পা জখম করে ফেলছেন, আবার মুখ ফুটে সরি ও বলেননি। এখন আবার বলছেন আমার কথা কেন শুনবেন? এক্ষুণি ওখানে গিয়ে না দাঁড়ালে আপনার থানায় গিয়ে আপনারই নামে মামলা করে আসবো।

চশমা চোখের মেয়েটি ফিক করে হেসে ফেলল। হাত দিয়ে আড়াল করলো ঠোঁট। সকলের দৃষ্টি মেয়েটিতে নিবদ্ধ হলো। চশমা ঠেলে মেয়েটি প্রিয়তার দিকে চেয়ে বললো,
” তুমি তো দেখছি ভারী বুদ্ধিমতী। একদম ঠিক জায়গায় হাত দিয়েছো।

অপর ছেলেটি গলা নামিয়ে আজওয়াদের উদ্দেশ্যে বললো,
” প্রহর, সরি বলে দে ভাই। কত মানুষ এখানে দেখেছিস?নিউজ পেপারে ছাপিয়ে দিবে এসব। ভুল তো তোরই তাইনা? শুধু শুধু মেয়েটাকে রাগিয়ে বলের বারি খাস না।

রাগাশ্রিত চোখে তাকাল আজওয়াদ। কপালের রগ ফুলে উঠল রাগে আর বিরক্তিতে। ভ্রু কুঁচকে ফেলল সে। আঙ্গুল দিয়ে কপালে স্লাইড করলো। বললো,

” এই মেয়ে বল ছুঁড়ে আমাকে কাবু করতে পারবে ভেবেছিস? বলের আঘাত আমার কাছে পিপড়ের কামড়ের মতো লাগবে। ফোট!

আবার প্রিয়তার দিকে চেয়ে বললো,
” আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি মিস। তাই সরি আমি বলবো না। যা ইচ্ছা করুন।

প্রিয়তার রাগে কান্না পেল। লোকটা এত পাষণ্ড কেন? এইভাবে তার ক্ষতি করেও অনুতপ্ত হচ্ছে না। প্রিয়তা জমে গেল। আশপাশে যারা আছে তারা সকলেই আজওয়াদের সমবয়সী। আরো কয়েকটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে পিছনে। সকলের চোখে বিস্ময় উপচে পড়ছে। সকলের এরূপ দৃষ্টিতে অসস্তি হলো প্রিয়তার। কিন্তু ততক্ষণাৎ পিছন থেকে বাচ্চা কণ্ঠের ডাক শুনে রাগ মাটি হলো প্রিয়তার। আরহাম ছোট ছোট পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমেছে। ঘুমের রেশ নেই চোখেমুখে। ফর্সা শরীরে কালো শার্ট মানিয়েছে। বাচ্চাকে আনন্দিত দেখাচ্ছে ভিষণ। মিষ্টি আদুরে কণ্ঠে পুনরায় প্রিয়তাকে ডাকল ছেলেটা,

” আপু, তুমি এখানে কেন?

প্রিয়তা ব্যাটটা ফেলে আরহামের কাছে এসে থামল। ফিসফিস করে আরহামের কানে কানে বললো,
” ঘরে যাও ভাই। আমি এক্ষুণি আসছি। এসেই সবটা বলবো।

আরহাম বিনা বাক্যে স্থান ত্যাগ করলো। প্রিয়তা ফিরে এলো সবার মাঝে। সবার সাথে ভাব জমাতে চাইল সে। প্রথমেই চশমা পরা মেয়েটিকে বললো,
” আপনার নাম কি আপু? আপনি বেশ কিউট। আমার ভালো লেগেছে।

মেয়েটা মুচকি হাসল। বললো,
” আমি তানিয়া, তানিয়া শেখ। তুমি?
” প্রিয়তা,শুধু প্রিয়তা।
আজওয়াদ এর পাশের ছেলেটার উদ্দেশ্যে বললো,
” আর আপনি?
” আমি ইহান। ইহান তালুকদার।

প্রিয়তা ব্যাটটা হাতে নিল। মুচকি হেসে আজওয়াদের সামনে এসে বললো,
” আর আপনার নাম?
‘ আমার নাম আপনার জানা। বিরক্ত হয়েই কথাটুকু বললো আজওয়াদ। পুনরায় বললো ‘ এখান থেকে গেলে খুশি হতাম। আপনি আমার ভ্যালুএবল টাইম ওয়েস্ট করছেন।

প্রিয়তা হাসল একটু। কাল দুপুর থেকে খায়নি বলে শরীরে শক্তি নেই। তবুও ব্যাট উঠিয়ে শরীরের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে আজওয়াদের পেশিবহুল বাহুতে প্রহার করলো। বিকট শব্দ হলো। মুহুর্তেই নিস্তব্ধ হলো পুরো জায়গা জুড়ে। বিস্ময়ে মস্তিষ্ক যেন অপ্রস্তুত হলো। এক দু সেকেন্ড করে আরো কয়েক মুহুর্ত কেটে গেল। সকলের অবাক দৃষ্টিতে তটস্থ হলো প্রিয়তা। কালবিলম্ব না করে ব্যাট ফেলে পিছু ফিরে ছুট লাগাল। প্রিয়তার স্থান ত্যাগ করা দেখে সকলের হুঁশ ফিরল। পেছনে থাকা সকলেই ছুটে এলো আজওয়াদের কাছে। কতকজন প্রিয়তাকে ধরার জন্য উদ্যত হতেই তানিয়া ওদের থামিয়ে দিল। হাতের ইশারায় সকলকে শান্ত হতে বললো। প্রিয়তার হাসি পেল। ছুটতে ছুটতে খুব গর্বের সাথে হাসি মুখে বললো,

” আমার সাথে লাগতে আসবেন না পুলিশম্যান। আমাকে আঘাত করলে আক্রমণকারীকেও আঘাত পেতে হবে।

হুট করে এমন এক ঘটনা ঘটবে ভাবেনি কেউই। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল আজওয়াদ। ওষ্ঠাধর কিঞ্চিত ফাঁক করে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। বাহুতে হাত দিয়ে বললো,
” আশ্চর্য মেয়ে মানুষ। মনে হচ্ছে মশা কামড়েছে। মেয়েটা নিশ্চিত বোকা। প্রহার করার জন্য শক্তি, বুদ্ধি, দুটোই থাকতে হয়। পালিয়ে গিয়ে যুদ্ধ জয় করা কিংবা বিজয়ী হওয়া যায় না।

ইহান ভ্রু কুঁচকে প্রিয়তার অঙ্গভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করেছে এতক্ষণ। মেয়েটাকে স্বাভাবিক লাগছে না মোটেই। পুলিশ জেনেও প্রহরকে আঘাত করার সাহস কিভাবে পেল ভেবেই গা শিরশির করছে তার। আজওয়াদ ইশতিয়াক প্রহরকে কোনো মেয়ে এভাবে প্রহার করতে পারে?এতো অবিশ্বাস্য। মেয়েটার ভয় নেই? কি হতে পারে জানা নেই? প্রহরকে বিস্ময় নিয়ে সে বললো,
” মেয়েটা অদ্ভুত। আমার সন্দেহ হচ্ছে। গতকাল যার কথা বলেছিলি এটা তো সেই মেয়ে।

এগিয়ে এলো তানিয়া। চুলগুলোকে পিছনে ঠেলে একটু হেসে বললো, ” ডোন্ট ওয়ারি স্যার। মেয়েটা এখন থেকে আমাদের নজরবন্দি। ওর ঘড়িতে আমি জিপিএস ট্র্যাকিং ডিভাইস সেট করে দিয়েছি। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আমরা ওর গতিবিধি, কথোপকথন শুনতে পারবো। মেয়েটা কোন ক্রাইমের সাথে এড থাকলে আমাদের ধরতে খুব একটা অসুবিধা হবে না”।

উক্ত কথার পরিপ্রেক্ষিতে শুধু মুচকি হাসল প্রহর। আজ ছুটির দিনে সব বন্ধুবান্ধবদের সাথে সময় কাটানোর জন্য ক্রিকেট খেলাটাকে বেছে নিয়েছিল। প্রিয়তা নামের মেয়েটা সব গোলমাল করে দিল। সন্দেহ তার ও হয়েছিল প্রথমবার প্রিয়তাকে দেখে। এখন তানিয়ার পদক্ষেপটা ভালো লেগেছে কিছুটা । ইহান এর- ও ভালো লেগেছে বিষয়টা। পুলিশে কর্মরত তানিয়া মেয়েটা কাজের প্রতি ভিষণ দায়িত্বশীল। দিনের প্রায় ষোল ঘন্টাই প্রহর আর ইহানের মতো নিজেকে কাজে ব্যস্ত রাখে। ইহান নিজেও তানিয়ার কাজে খুশি হলো। কিন্তু তা প্রকাশ না করে ভিন্ন ভঙ্গিতে রাগান্বিত স্বরে বললো,

” তানিয়া, ইউ আর ঠু মাচ। রিস্ক নিয়ে এটা করতে গেলে কেন? মেয়েটা যদি বুঝে যেত? ব্লান্ডার হতো জানো না? না বলে কেন কিছু করতে যাও ?

খানিক কেঁপে উঠল তানিয়া। চশমা ঠেলে ঠিক করে নিল নিজেকে। প্রহর স্যার আর ইহান স্যার দুজনকেই প্রচণ্ড সম্মান করে তানিয়া। দুজনেই তার উপরের পদে রয়েছে। প্রহরের চেয়ে ইহানকে বেশি ভয় হয় তার। প্রহর তবুও হাসে, ইহান তো সর্বক্ষণ বকতে থাকে। গম্ভীর প্রকৃতির দুটো মানুষ তানিয়ার চিন্তাভাবনার সম্পূর্ণ বিপরীত বলেই বোধহয় এত সংকোচ। ইহানের কথা শুনে আঘাত পেল তানিয়া। প্রশংসা করতে এত কিপ্টামি করার প্রয়োজন কি? সমস্যা কোথায় লোকটার?

__________

খোলা বিশাল তৃণভূমি। গাছের পাতায় রোদ খেলা করছে। গাছ থেকে ফুল ঝড়ে মাটিতে অবস্থান করছে। কোলাহল বাড়ছে ক্রমশ। পাখির কিচিরমিচির শব্দে পরিবেশটা আরো বেশি সুন্দর লাগছে। আশেপাশে তরুন তরুণীর মেলা বসেছে যেন। প্রায় মানুষের পিঠে কলেজ ব্যাগ। ক্যান্টিনের আশপাশে ভাজা পোড়ার গন্ধ বিদ্যমান। সেখানেও ভিড় করেছে শিক্ষার্থীরা। প্রিয়তার দিকে অজস্র প্রশ্ন ছুঁড়ে উত্তরের আশায় অপলক চোখে তাকিয়ে আছে তন্ময়। ছেলেটার শার্টের হাতা দিয়ে কবজি অবধি ঢাকা। সাদা রঙের শার্টটার সব বোতাম পরিপাটি করে লাগানো। একাত্তরের যুদ্ধ শুরু হলেও এই পরিচ্ছন্নতা কেউ বদলাতে পারবে না বলে মনে হয় প্রিয়তার। প্রিয়তার একদিনের এডভেনচার সম্পর্কে জানতে আগ্রহী তন্ময়। প্রিয়তাকে আজ ভার্সিটিতে দেখে সস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে সে। তন্ময় শতাধিক প্রশ্ন করেছে প্রিয়তাকে। সব প্রশ্ন শুনে খানিক দম ফেলে হাস্যজ্জল মুখে প্রিয়তা বলে,

” ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি চব্বিশ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। এখনও আব্বু কিংবা আম্মু কল করেনি। বুঝতে পারছিস তন্ময়? উনারা কত রিল্যাক্সড?

তন্ময় মাথা নিচু করে ফেলল। জগতের নিয়মনীতি তার অদ্ভুত লাগে। প্রিয়তার বিষয়টা আরো অদ্ভুত। প্রিয়তার মা প্রীতিলতা স্বামী থাকতেও একজনকে ভালোবাসে। এই পরকিয়া ধরে ফেলার পর আরিফ হোসাইন নিজেও বিদেশী একটা মহিলার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। প্রিয়তার বাবা-মা দুজনেই সরকারি কর্মকর্তা। শিক্ষিত মানুষের এমন মুর্খের মতো আচরণ মানা যায়? কাকে বেশি দোষ দেওয়া উচিত এ নিয়েও প্রিয়তা মেয়েটা দ্বিধায় আছে। আরহামের একটা পরিবার দরকার ছিল। কিন্তু তা কি ছেলেটা পেয়েছে? শুধুমাত্র বাবার করুণা টুকুই ভাগ্যে জুটেছে ছেলেটার। গতকাল বিকেলে এখানকার এক বাজারে গিয়েছিল তন্ময় আর প্রিয়তা। টুকটাক জিনিসপত্র কিনেছে রান্নাবান্নার জন্য। তন্ময়ের মেসে একটা ছেলে থাকে। পড়াশোনার পাশাপাশি ছেলেটা রেস্টুরেন্টে পার্ট টাইম জব করে। ছেলেটার দেওয়া লিস্ট অনুযায়ী বাজার করে এনেছে। সকালে আরহামের জন্য পরোটা আর ডিম ভেজে এসেছে প্রিয়তা । ছেলেটা একা একা কি করছে কে জানে? তন্ময় ব্যাগ থেকে কিটক্যাট বের করে প্রিয়তার হাতে দিল। বললো,” আরহামকে রেখে এলি। থাকতে পারবে একা একা? কোন বাড়িতে উঠেছিস বললিও না। বললাম নিয়ে যেতে ও বাড়িতে, তাও গেলি না।

“নিবো না কেন? সময় হলে ঠিকই নিবো। ধৈর্য ধর। আগে সবটা গুছিয়ে নিই।

তন্ময় বলে উঠল,
” আমি তোর আর আরহামের সুন্দর একটা ভবিষ্যত দেখতে চাই। তোর সুখ আমার সাথে ভাগাভাগি করবি তো?
_______________________

কম্পিউটারের কিবোর্ডের খটখট আওয়াজে কান দুটো ঝাঁঝিয়ে যেচ্ছে তানিয়ার। সামনে থাকা বড় ডেস্কের চেয়ারে বসে আছে প্রহর। ফোনে কাউকে কিছু বলে যাচ্ছে অনবরত। তার পাশেই ইহান ল্যাপটপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে কিছু খুঁজছে। তানিয়ার আশেপাশে আবার ত্রিশের অধিক পুলিশ ফোর্স বসে আছে। সকলেই মনোযোগী চোখে তাকিয়ে আছে সামনে। এ নিয়ে তিনবার বড়সড় হাই তুললো তানিয়া। ঘড়ির কাটা টিকটিক করে ঘুরছে, অথচ সময় যেন যাচ্ছেই না। দু ঘন্টা ধরে একই জায়গায় বসে থাকতে থাকতে বোর হচ্ছে সকলে। কেবল ইহান আর প্রহর নির্বিকার। একজন ল্যাপটপে তথ্য বের করছে, আরেকজন নিজের মাথায় ঘুরে বেড়ানো রহস্যগুলোকে সকলের সামনে উপস্থাপন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভোরের আলো কেবল কেটেছে। পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ আসছে। থাই গ্লাসের দিকে তাকিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য অনুধাবন করা যায়। কিন্তু সেসবে মন দিতে পারছে না তানিয়া। পুলিশ হওয়ার দরুন কল্পনাগুলোকে কল্পনায় আটকে রাখতে হচ্ছে। প্রহর আর ইহানের টিমে আছে বলে ঘুমটুম বাদ দিয়েছে অনেক আগেই। এত দায়িত্ববান পুলিশ অফিসারদের পাওয়া যায় না শহরে। এই দায়িত্বের কষাঘাতে কত বসন্ত পেরিয়ে গেল তানিয়ার। এ আফসোস কি যাবে কখনো?

আবার মুখে হাত দিয়ে হাই তুললো তানিয়া। ঘুম কাটাতে বাকি সবার মতো কফিতে চুমুক দেওয়ার সময় ইহানের দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পরলো দুজনের। ইহান তানিয়ার দিকেই তাকিয়ে ছিল। সামনে তাকাতেই ইহানের চোখে চোখ আটকে গেল তানিয়ার। মুহুর্তেই অপ্রস্তুত হয়ে চোখ নামাল তানিয়া। গা শিরশির করে উঠল। কিবোর্ড হাত দিয়ে চেপে অসস্তি কমাতে চাইল, এদিক ওদিক থাকিয়ে নিজের চঞ্চলতা কমাতে চাইল। ইহানের তীক্ষ্ম দৃষ্টি তখনো তানিয়াতে নিবদ্ধ। তানিয়ার এহেন হাই তোলায় বিরক্ত হলো বোধহয়। কণ্ঠে দৃঢ়তা এনে ডাকল,

“তানিয়া!

তানিয়া চমকে তাকাল। আচানক এমন ডাকে ধরফরিয়ে উঠে দাঁড়াল। কম্পিত হাতে টেবিলে কফিটা রাখতে গিয়ে গরম কফির ফোঁটা ছিটকে হাতে এসে পড়ল। জ্বলে উঠলো হাতের মুঠো। দাঁতে দাত চেপে ব্যথা লুকানোর চেষ্টা করল। বক্ষজুড়ে অজানা ভয়ে ছেয়ে গেল। কণ্ঠে জড়তা নিয়ে বললো,
” জি.. জি স্যার। ব..বলুন।

” এটা ঘুমোনোর জায়গা নয়। ঘুম পেলে বাড়ি যাও। কাজের হেরফের হওয়া আমার পছন্দ নয়।

ইহানের এহেন বাক্যে তানিয়ার মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল। নম্র কণ্ঠ অগোছালো হয়ে আসল। শুকিয়ে এলো বক্ষদেশ। অপমানিত হলো খানিক। সকলের সামনে এমন উক্তি শুনে চোখ ফেটে পানি বের হতে চাইল। তানিয়া মোটেই দুর্বল নয়। বড়সড় খুনিদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে বিনা দ্বিধায়। মৃ’ত্যুভয় কখনোই কাবু করতে পারেনি তাকে। এতসব তানিয়া শিখেছে প্রহর আর ইহানের থেকে। বলতে জড়তা নেই প্রহর আর ইহান দুজনেই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, তীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তার অধিকারি। তারা কতশত মামলা ডিশমিশ করেছে তা জানা নেই তানিয়ার। ইহানের কথা শেষে আগের ন্যায় বসে পরল চেয়ারে। অভিমান কেটে গেল একটু পরই। ইহান বা প্রহর কেউই কাজে গাফিলতি পছন্দ করে না। এমন বকা অহরহ খেতে হয় তাকে। তবুও নারীর নরম সত্তা মাঝেমাঝে অভিমানে বুঁদ হয়ে থাকে। কেউ বোঝে না সেই অভিমান, জানতেও চায় না।

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

প্রিয়তার প্রহর পর্ব-০১

0

#প্রিয়তার_প্রহর
সূচনা পর্ব (১)
লেখনীতেঃ বৃষ্টি শেখ

আমার আব্বু আম্মুর মাঝে যখন বিবাহ বিচ্ছেদের সূচনা ঘটে তখন আমার বয়স ষোল, আর আমার ছোট্ট ভাইটার বয়স দুই। এত বড় একটা মেয়ে আর ছোট্ট, মিষ্টি একটা ছেলে থাকতেও আমার আম্মু পরকিয়ায় জড়িয়েছিল তারই অফিসের এক কলিগের সাথে। আব্বু বুঝে গিয়েছিল আম্মু আর তার নেই। প্রথম দিকে আব্বু আম্মুকে খুব বোঝানোর চেষ্টা করতো। কিন্তু ততদিনে আম্মু ভালোবেসে ফেলেছিল ওই লোককে। কোনোমতেই এ অবৈধ সম্পর্ক থেকে ফিরে আসতে চায়নি আম্মু। এজন্য আব্বু-আম্মুর মাঝে বনিবনা হচ্ছিল না কোনভাবেই। একসাথে থেকেও দুরত্ব ক্রমশ বাড়ছিল। তাই তো আব্বুও নিজের পথ বেছে নিয়ে অন্য নারীতে বিমোহিত হলো। দুজন যখন দু পথে পা বাড়ানোর ইচ্ছা প্রকাশ করলো, তখন আমি আর আমার ভাই তাদের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ালাম। তারা না পারল আমাদের ছাড়তে, না পারল আগলে নিতে। এছাড়া সমাজের মানুষ, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন কি বলবে তা ভেবে এই দম্পতি তাদের নতুন জীবনে পা রাখতে পারছিল না। তাইতো এখনো তারা এক সাথে বসবাস করছে, দুজনেই পরকিয়াতে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছে। তাদের দুজনের ইচ্ছা খুব শীঘ্রই আমার বিয়ে হোক, আমার ভাইটাকে আব্বু তার নতুন স্ত্রীর কোলে দিক। হয়তো বা একসময় এ দম্পতি আলাদা হবে এবং দু দিকে ঘুরেও যাবে। কিন্তু আমার আর আমার ভাইয়ের কি হবে? সৎ মায়ের অত্যাচার মানতে পারবে ছেলেটা? ওর বয়স এখন পাঁচ আর আমার ঊনিশ। এতগুলো দিন ধরে একই ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। তিক্ততা বেড়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। শীঘ্রই বোধহয় আমরা আমাদের জীবনের বাঁকে হারিয়ে যাবো। উত্থান পতন ঘটবে নিশ্চয়ই।

২৬-০৮-২০২৩
(প্রিয়তা)

উক্ত কথাটুকু ডায়েরিতে লিখে সেই পৃষ্ঠায় বুকমার্ক রেখে ডায়েরিটি বন্ধ করলো প্রিয়তা। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। বাতাসের বেগের কারণে বৃষ্টির ছোট ছোট ফোঁটা জানালায় শব্দ করছে। জানালায় লেগে পানির কণা ছিটকে ঘরে এসে পড়ছে। প্রিয়তা মুগ্ধ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলো প্রকৃতি। হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করলো মাদকতাময় পৃথিবীতে। প্রিয়তা মনে করে একবার যে পৃথিবীর সুখ অনুভব করে সে আর পৃথিবী ছাড়তে চায় না। প্রিয়তার জীবনে সুখ নেই বছর দু-তিন হয়েছে। তবুও সে বাঁচতে চায় তার ভাইটার কারণে। বাড়িতে একা একা থাকে ছেলেটা। আব্বু আম্মু দুজনই যায় অফিসে, সে যায় ভার্সিটিতে। আগে বাড়ির কাজের মহিলার কাছে থাকতো আরহাম। তবে দুষ্টুমি করার কারনে বাচ্চাটার গায়ে কয়েকবার হাত তুলেছে বাড়িতে কর্মরত মহিলা। জানার পর থেকে থেকে প্রিয়তা আর আরহামকে কারো কাছে ছেড়ে দেয় না। মূলত সাহস পায় না।

ভাবনার জগতে হারিয়ে থাকা রমণীর ধ্যান ভাঙল। দুজন মানব-মানবীর কর্কশ আওয়াজে কান ভো ভো করলো প্রিয়তার। বিরক্তিতে মুখ থেকে শব্দ বের হলো। ছুটে আরহামের কাছে গেল সে। বাচ্চাটা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। বাতাসে পাতলা চুলগুলো উড়ছে বারবার। প্রিয়তার রাগ হলো খানিক। এত আওয়াজে তো ছেলেটার ঘুম ভেঙে যাবে। কোন কান্ডজ্ঞান নেই কারো?

প্রিয়তা নিজের ঘর ছেড়ে পা বাড়াল। পাশের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবনা চিন্তা করে দরজায় টোকা দিল। মুহুর্তেই ঘরের ভেতরে থাকা পুরুষ ও মহিলার কণ্ঠের আওয়াজ থেমে গেল। নিশ্চুপ হলো দুজনের কণ্ঠস্বর। প্রিয়তা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ঘরের ভিতরে ঢুকল। তির্যক চোখে নম্র কণ্ঠে বললো,

” বাচ্চাটা ঘুমোচ্ছে, রোজ রোজ একই কাহিনী করছো। ছেলেটা এমনিতেই খুব অশান্তিতে থাকে? তোমাদের মায়া হয় না ছেলেটার উপর? কেন এত শব্দ করছো?

প্রীতিলতা ক্ষেপে উঠল মেয়ের কথায়। ভ্রু কুঁচকে ফেলল। প্রিয়তার আগমনে যে সে বেজায় বিরক্ত হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলে উঠল,

” ভালো না লাগলে বেরিয়ে যাও বাড়ি থেকে। থাকতে বলেছি এখানে? বয়স তো আঠারো পেরিয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক হয়েও বাবা-মায়ের ইনকামে চলছো। লজ্জা করে না তোমার? আবার বড় বড় কথা বলো।

প্রিয়তা হাসল। ভিষণ মজা পেল কথাটায়। কোনো মা তার মেয়েকে প্রাপ্তবয়স্ক হবার জন্য বাড়ি থেকে চলে যেতে বলে? জানা নেই প্রিয়তার। এমন ঘটনা শোনেওনি কখনো। একটু হেসে সে বললো,

” তোমার লজ্জা করল না এত বড় একটা মেয়ে থাকতেও অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হতে? যেখানে তুমি জানোই আরহাম বা আমাকে তোমার প্রেমিক কখনোই মেনে নিবে না, আমাদের সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দিবে না।

প্রীতিলতা আরো ক্ষেপে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে ধরল। দ্রুত এগিয়ে এসে চুলের মুঠি ধরে ফেলল প্রিয়তার। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল প্রিয়তা। আপনা আপনি চুলে হাত গেল তার। ব্যথায় ঝিমঝিম করে উঠলো মাথাটা। মস্তিষ্ক অচল হয়ে এলো। তবুও কাঁদল না সে, অভিব্যক্তি দেখাল না। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ করল না। চোখ বড় করে তাকিয়ে রইল পাষণ্ড মায়ের দিকে। প্রীতিলতা উচ্চস্বরে বলল,

” পার্সোনাল লাইফে এন্টাফেয়ার করার সাহস তোমাকে কে দিয়েছে? ঠিকমতো খেতে দিচ্ছি, শুতে দিচ্ছি। এমনকি পড়াশোনার খরচ ও বহন করছি। আর কত চাই? বেরিয়ে যাও বাড়ি থেকে। তোমাদের জন্যই আমাদের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে। তোমরা না থাকলে এতদিনে আমাদের মাঝে কোন সম্পর্ক থাকতো না। আর সম্পর্ক না থাকলে ঝগড়াও হতো না।

” আমি যা চাই তা তুমি আমায় কখনোই দিতে পারবে না। ঠিকই চলে যাবো আমি। তখন চাইলেও ফেরাতে পারবে না।

প্রীতিলতা ছেড়ে দিল মেয়েকে। পাশের সোফায় বসে পড়ল। আরিফ হোসাইন সবটা দেখেও চুপ রইল। তার প্রেমিকা কখনোই প্রিয়তাকে মানবে না। যদিও মহিলা(আরিফের প্রেমিকা) অনেক বিচার বিশ্লেষণের পর আরহামকে মেনে নিয়েছে। কিন্তু প্রিয়তার একটা ব্যবস্থা না হলে কোনকিছুই ঠিক হবে না। প্রীতিলতা আহমেদ আর আরিফ হোসাইনের বয়স অনেক হলেও শারীরিক গঠন নিয়ন্ত্রণ করে চলে দুজনেই। দুজনকেই খুব কম বয়সী লাগে। হুট করে দেখে কেউ বলতে পারবে না দুজনের এত বড় একটা মেয়ে আর ছেলে আছে। এত সৌন্দর্যের কারণেই হয়তো এ বয়সে দুজনের নতুন প্রেমে পড়ার আনন্দ উপভোগ করতে ইচ্ছে হয়েছে।।

প্রিয়তা নিজের ঘরে ফিরল। আলগোছে সবার আড়ালে চোখ মুছে নিল সে। ঘরের বিছানার দিকে তাকিয়ে অবাক হলো খানিক। আরহাম ইতিমধ্যেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। বিছানার ঠিক মাঝখানে আড়াআড়ি পা ভাঁজ করে বসে আছে সে। আপুকে দেখেই মুখে হাসি ফুটল আরহামের। প্রিয়তা এগিয়ে এসে আরহামের গালে হাত রাখল। আরহাম ভূমিষ্ঠ হয়েছিল সঠিক সময়ের আগেই। দশমাসের বদলে সাত মাস আঠারো দিন রাতে জন্ম হয়েছিল ছেলেটার। দীর্ঘদিন হাসপাতালে ছিল ছেলেটা। এরপর একটু পুষ্ট হবার পর বাড়িতে আনা হয়েছিল। এজন্য পাঁচ বছর হলেও আরহামকে দেখে মনে হয় বয়স চার বছরের অধিক হবে না। আরহামের মায়া মায়া মুখ, চিকন নাক, বড় বড় গোলাকৃতির চোখ, ফোলা ফোলা গাল দেখে যে কেউ বাচ্চাটাকে ভালোবেসে ফেলবে। অথচ আরহামের সবচেয়ে আপন তার পিতামাতাই তাকে সহ্য করতে পারে না। আরিফ হোসাইনের ভবিষ্যত স্ত্রী চায় প্রিয়তাকে বিয়ে দিয়ে দিতে। আরহামকে প্রথমে মেনে নিতে চাইতো না মহিলা। আরিফকে বলেছিল ছেলেটাকে অন্য কাউকে দিয়ে দিয়ে। কিন্তু সন্তানের মায়া একটু হলেও ছিল বলে আরিফ অনুরোধ করে আরহামকে নিজের কাছে রাখার। সব শেষে রাজি হয় সেই মহিলা। এখন বিয়ের প্রস্তুতি মনে মনে নিচ্ছে এরা। এ ঘটনায় প্রিয়তার বিয়ে নিয়ে বেশ দৌড়াদৌড়ি করছে আরিফ। প্রিয়তা যাবে কোথায়? প্রীতিলতা কস্মিনকালেও তাকে নিজের নতুন সংসারে জড়াবে না। এ মুহুর্তে ভাইকে রেখে বিয়েও করবে না প্রিয়তা।

প্রিয়তা অতসব ভাবল না। আলতো করে গাল টানল ভাইয়ের। মিষ্টি হেসে কাঁথা ভাঁজ করতে করতে বললো,
“একটু আগেই ঘুমোলে। এখনই উঠে গেলে?

আরহাম পিটপিট করে তাকাল। বললো,
” শব্দ লাগে। ঘুম হয় না।

প্রিয়তা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনটা খারাপ হলো তার। রোজ রোজ এক অশান্তি আর ভালো লাগে না। আরহাম ব্যতিত আর কারো প্রতিই এখন টান অনুভব করে না প্রিয়তা। বাবা মায়ের প্রতি প্রচন্ড রাগ হয়। দুজনের সংসারের প্রতি হেয়ালিপনা না থাকলে আজ তাদের সুখী একটা পরিবার হতো। একটা সুস্থ পরিবার পেত আরহাম।

প্রিয়তা মন খারাপের দিকটা ধরতে দিল না আরহামকে। বিছানায় বসে হাত বাড়িয়ে ছেলেটাকে কোলে নিল। শব্দ করে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বললো,

” আম্মু খুব রেগে আছে। যাও তাকে আদর দিয়ে আসো।

আরহাম নড়ল না। বিড়াল ছানার মতো গুটিয়ে রইল ফোনের বাহুডোরে। আরো বোধহয় আঁকড়ে ধরলো প্রিয়তার বাহু। বুকে মুখ গুঁজে বসে রইল। আরহামকে উঠতে না দেখে আবার ও একই কথা বললো প্রিয়তা। আরহাম আতঙ্কিত কণ্ঠে মিনমিনিয়ে বললো,

” আম্মু বকে। যাবো না। এখানেই থাকি।

প্রিয়তার কপালে ভাঁজ পড়ল। আরহাম ও আজ বুঝতে পারছে তার মা তাকে ভালোবাসছে না। আরিফ হাসান যত দ্রত সম্ভব প্রিয়তাকে বিয়ে দিয়ে তাড়িয়ে দিবে। প্রীতিলতা তার প্রেমিকার সাথে ঘর বাঁধবে। আরহাম নতুন মায়ের সাথে থাকতেই পারবে না। পড়ালেখায় প্রিয়তা যথেষ্ট মেধাবি। এইচ এস সি তে একটুর জন্য গোল্ডেন মিস করেছে। জীবন নিয়ে অনেক ভাবনা তার। এখন আকস্মিক বিয়ে মানে স্বপ্নের বিসর্জন, ভাইয়ের প্রতি অত্যাচার।
প্রিয়তা বুঝল এই বাড়ি ছাড়ার সময় এসেছে। বাবা মায়ের নতুন জীবনে সে কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ও সরে গেলেই সকলের শান্তি।
প্রিয়তা স্থির কণ্ঠে গাম্ভীর্য এনে আরহামের দিকে তাকিয়ে বললো,
“চল ভাই, আমরা দুরে কোথাও হারিয়ে যাই। যেখানে গেলে বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদের যন্ত্রণা আমাদের ছুঁতে পারবে না”।

ভাইকে জড়িয়ে ধরল প্রিয়তা। স্বভাবগত ভাবে আরহাম ছেলেটা ভারী চঞ্চল। ছোট্ট, ফর্সা মুখটা গরমে লাল হয়ে গিয়েছে আরহামের। নরম নরম হাতে বোনের গলা জড়িয়ে ধরল সে। প্রিয়তার কথা শুনে বাচ্চাটা কি বুঝলো কে জানে? ঘাড় কাত করে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ল। প্রিয়তা ছোট ভাইয়ের এই না বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভঙ্গি দেখে নরম হয়ে উঠল। তপ্ত নোনা পানি গাল বেয়ে গড়াল। জীবনের এই জটিলতা বাচ্চাটা কিভাবে সামলাবে? ভাবতেই কম্পিত হলো প্রিয়তার হৃদয়। ছোট্ট বাচ্চাটার গালে গাল রাখল সে। ভাইয়ের গালে শব্দ করে চুমু খেল। ছেলেটা আদুরে ভঙ্গিতে পানি মুছে দিয়ে বললো,

” কাঁদে না আপু। আমাদের একদিন সবাই ভালোবাসবে।

প্রিয়তা হাসল। আরহামকে বিছানায় বসিয়ে ততক্ষণাৎ বালিশের নিচে রাখা ফোনটা তুলে নিল হাতে। চোখের পানি মুছে ফেলল। নির্দিষ্ট একটা নাম্বারে ফোন করল। প্রথমে ওপাশের লোকটা ফোন ধরল না ফোন। আবার ও কল করায় কেটে দিল জলদি। সাথে সাথেই কল ব্যাক করল। তা দেখে হাসল প্রিয়তা। ছেলেটা এমনই। কখনো কল ধরবে না। নিজে কল দিবে।
” কিরে, ফোন ধরিস না কেন? কটা বাজে জানিস? এখনো ঘুমোচ্ছিস? বললো প্রিয়তা।

ওপাশে থাকা ছেলেটির নাম তন্ময়। সাদামাটা এই ছেলেটা হিন্দু ধর্মের। কলেজের দ্বিতীয় দিন থেকে তন্ময়ের সাথে বন্ধুত্ব প্রিয়তার। সরল আর সাধাসিধা এই ছেলেটি সবসময় প্রিয়তার পাশে থাকে। ছেলেটা বোধহয় ঘুমিয়েছিল। হাই তুলে ঘুম ঘুম কণ্ঠে তন্ময় বলে উঠল, “সারা রাত গেম খেলেছি। এখন সেই ঘুম পাচ্ছে। কি হয়েছে? এত সকালে কল করলি”?

প্রিয়তা উপলব্ধি করল তন্ময়কে সবটা বলতে উদ্যোত হতে একটুও সংকোচ বোধ হচ্ছে না। বরং পুরো ঘটনা বিশ্লেষণ করতে ইচ্ছে করছে। আলতো হেসে সাবলিল নারী কণ্ঠে প্রিয়তা বললো,
” তুই যে বাড়ি থাকিস ওই বাড়িতে ঘর খালি আছে রে?

তন্ময় বিস্মিত হলো। ঘুম ঘুম ভাব কেটে গেল মুহুর্তেই। বললো, “কেন রে? ঘর খালি দিয়ে তুই কি করবি? তোর বাপের তো বিরাট বড় বাড়ি”।

” বড় বাড়ি দিয়ে কি করবো? বাড়িতে তো সুখ নেই, ভালোবাসা নেই। নম্র কণ্ঠে বললো প্রিয়তা।

আবার ও শ্বাস ফেলে বললো,
“তুই সবটাই জানিস তন্ময়। আমাকে এবার নিজের পথ নিজেকে খুঁজতে হবে। আমি এ বাড়িতে আরহামকে আর রাখবো না। বাবা-মায়ের এমন বিচ্ছেদ ছেলেটার ব্যক্তিজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। আমি আর ছোট নই। নিজের ব্যবস্থা নিজে করতে পারবো। কিন্তু আরহামের একটা সুস্থ পরিবেশ দরকার। স্বাধীনভাবে বাঁচার জন্য,শেখার জন্য পরিবেশ বিষয়য়টা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই অসুস্থ পরিবেশ ওকে নিঃস্ব করে দিবে।

তন্ময় মনোযোগ দিয়ে অবলোকন করলো প্রিয়তার কথাগুলো। মেয়েটার মানসিকভাবে ভেঙে পরা স্বাভাবিক। আরহামকে প্রিয়তা বড্ড বেশি ভালোবাসে। সে না হয় বিয়ে করে চলে যাবে, কিন্তু আরহামের কি হবে? তন্ময় ও দুশ্চিন্তায় পরলো। বললো, ” কি করতে চাইছিস”?

” আমার জমানো কিছু টাকা আছে। সেসব নিয়ে আপাতত বাড়ি ছাড়তে চাইছি। বাকিটা পরে দেখা যাবে। বললো প্রিয়তা।

” আমি যে বাসায় থাকি এখানকার অনেক নিয়ম কানুন আছে। চিৎকার-চেঁচামেচি করা যাবে না, রান্না করা যাবে না, ময়লা ফেলার জন্য আলাদা বিল, লাইট বেশিক্ষণ জ্বালিয়ে রাখা যাবে না, আরো কত কি। আরহামকে নিয়ে তো তুই এসব মানতে পারবি না। এছাড়া ব্যাচেলর বাড়িতে আরহামকে নিয়ে থাকা যাবে না। ব্যাচমেটদের সাথে একা থাকতে হবে।

” তাহলে অন্য বাসা খুঁজতে হবে। তবুও এই বাড়িতে থাকবো না আর।

” আমি তোর পাশে আছি প্রিয়তা। তবে বাড়ি খোঁজার সময় আমি তোর সাথে যাবো না। একেকজন একেক কথা বলবে। তাতে আমার যায় না আসলেও তোর জন্য ব্যাপারটা ক্ষতিকর। এত বড় পৃথিবীতে একা কিভাবে থাকবি তুই? একটা মেয়ের সাথে তার বন্ধু ঘর খুঁজতে গেলে সবার চোখে তা দৃষ্টিকটু দেখাবে। তাই যাওয়া উচিত হবে না। কিন্তু তোর যদি এতে কোন সমস্যা না হয় তাহলে আমি যাবো।

” না না, তোকে আমি নিবো না। বাড়ি থেকে বের হচ্ছি। তোকে জানালাম। তুই ছাড়া আর বলার মতো কে আছে আমার?

“শোন, কোন সমস্যায় পরলে ততক্ষণাৎ আমাকে জানাবি। আর্থিক কোন সাহায্য দরকার হলে বলবি।

হাসল প্রিয়তা। কল কাটল। লাগেজ টা গুছিয়ে নিল। পরিপাটি বড় একটা সুটকেস খুলে সেখান থেকে কিছু টাকা বের করল। আরহামকে একটা ঢিলেঢালা শার্ট আর হাঁটু অবধি প্যান্ট পরিয়ে দিল। নিজেও একটা সুতির ফ্রক গায়ে জড়িয়ে নিল। পায়ে ম্যাচিং করে পার্পেল রঙের কেস পরে নিল। পিঠে ষোল ইঞ্চির একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে রাখল। আরহাম শুধু পিটপিট করে তাকিয়ে রইল আপুর দিকে। তা দেখে মুচকি হাসল প্রিয়তা। শেষবারের মত জিজ্ঞেস করলো, “তুমি আমার সাথে যাবে? নাকি বাবা-মায়ের সাথে এখানে থাকবে”?

আরহাম কিছু ভাবল না। আলতো হাতে জড়িয়ে ধরলো প্রিয়তার কাঁধ। বললো, ” তোমার সাথে যাবো”।

লাগেজ নিয়ে ঘর থেকে বের হতেই প্রীতিলতা আড়চোখে দেখল মেয়েকে। তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল সে। বোঝাতে চাইল তারা ছাড়া প্রিয়তার আর কোন গতি নেই। ঘুরেফিরে এখানেই আসতে হবে প্রিয়তাকে। কিন্তু প্রিয়তা এই ভঙ্গি দেখে মোটেই দুঃখ পেল না। আরহামের দিকে চেয়ে হাসিমুখে বের হলো ঘর থেকে। যাওয়ার আগে আরিফ হোসাইনের দিকে চেয়ে বললো, ” “আমাদের জীবনটা একটা যুদ্ধক্ষেত্র আব্বু। এ যুদ্ধক্ষেত্রে সবসময় সংগ্রাম করে যেতে হয়। তুমি এই যুদ্ধে হেরে গিয়েছো। আশা করি তোমার পরবর্তী জীবন তোমাকে সুখী করবে”।

হেরে যাওয়ার কথাটা বুঝল না আরিফ। চলে যেতেও নিষেধ করলো না প্রিয়তাকে। হয়তো সেও ভাবে প্রিয়তা ঠিকই ফিরে আসবে। এত বড় ভূপৃষ্ঠের আনাচে-কানাচে কোথাও টিকে থাকতে পারবে না প্রিয়তা। এতই কি সহজ জীবন?

________________
আকাশ আজ মেঘলা। মৃদু বাতাস বইছে। ক্ষণে ক্ষণে বাতাসের ঝাপটায় কেঁপে উঠছে আরহাম। নতুন এক লক্ষ্যে এগোনোর জন্য প্রতি পদে পদে সংগ্রাম করার মানসিকতা থাকতে হয়। প্রিয়তার তা থাকার কথা নয়। তবুও এক নতুন জীবনের প্রতি আগ্রহ জন্মেছে প্রিয়তার।
প্রিয়তা এমন একটা বাড়ি খুঁজছে যেখানে ভাড়াটিয়ারা তাদের পরিবার নিয়ে থাকে। তবে দেখা গেল কোনো বাড়িতে ঘর ভাড়া বেশি, কোনোটায় একা একটা মেয়েকে ঘর ভাড়া দিবে না, কোনো বাড়ির পরিবেশ আবার ভালো না। প্রিয়তা সবাইকে বলেছে আরহামই তার পরিবার। কিন্তু সবাই প্রিয়তার দিকটা বুঝতে নারাজ। পরিবার অর্থাৎ মা-বাবাকে নিয়ে আসতে হবে। নইলে ঘর ভাড়া দেওয়া হবে না।

প্রিয়তা আরহামকে কোলে নিল। সিঁথি কেটে নেওয়া চুলের আগা গোলাপি রঙ করা। সামনের চুলগুলোও ভ্রু অবধি কেটেছে প্রিয়তা। ফ্রক হাঁটু অবধি নেমে এসেছে। পিঠের ব্যাগটা ভালোমতো ধরে প্রিয়তা ফুটপাতের একটি দোকানে এসে দাঁড়াল। দোকানের সামনে ঝুলিয়ে রাখা রুটি আর কলা কিনে আরহামের হাতে দিয়ে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে রইল। ছোট হাতে রুটি ছিঁড়ে কলা দিয়ে রুটিটুকু খেয়ে ফেলল আরহাম। লাগেজে থাকা পানির বোতল বের করে খেয়ে তৃপ্তি পেল খানিক। অতঃপর কোল থেকে নেমে প্রিয়তার হাত ধরে হাঁটতে লাগল। দু ভাইবোনের হাঁটার অভ্যেস নেই। বাস থেকে সিলেটের মৌলভিবাজারে নেমে আধঘন্টা হাঁটতেই ক্লান্ত হয়ে গেছে দুজন। আগে মায়ের গাড়ি চড়ে অতদুরে ভার্সিটিতে যেত প্রিয়তা। এখন ভার্সিটি আরো কাছে হলো ভেবে ভালো লাগলো প্রিয়তার। দু তিন বাড়ি ঘুরেও ঘরের ব্যবস্থা হয়নি। সন্ধ্যে নেমে এসেছে। প্রিয়তা ঠিক করল ঘর ভাড়া বেশি চাইলেও শীঘ্রই এক বাড়িতে উঠবে তারা। কিন্তু মেঘলা আকাশ তাতে সায় জানাল না। ঝুমঝুমিয়ে বড় বড় ফোঁটায় রাস্তা ভিজিয়ে দিল মুহুর্তেই। তাড়াহুড়ো করে আরহামকে নিয়ে এক রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়াল প্রিয়তা। প্রকৃতির প্রতি ভিষণ রাগ হলো তার। এখন ভিজে ভিজে বাড়ি খুঁজতে হবে নাকি? নিজের বোকামিতে নিজেই বিরক্ত হলো প্রিয়তা। আগে থেকেই ঘর ঠিক করে রাখা উচিত ছিল। হুট করে মন মতো বাড়ি পাওয়া বেশ কঠিন এটা বোঝা উচিত ছিল।

সন্ধ্যা বেলার উত্তাল বাতাস, বৃষ্টির কণার তুমুল ঝংকারে মুগ্ধ হলো প্রিয়তা। ভাইকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বসে পরল বাইরের বেঞ্চে। প্রকৃতি উপভোগ করতে লাগল দু জন। আরহাম চোখের পলক ফেলল বারবার। একটু ঠান্ডা লাগতেই আটশাট হয়ে বোনের কোলে বসে রইল। কয়েক মুহুর্ত কাটতেই হুড়মুড় করে একটি বাইক এসে থামল রেস্টুরেন্টের সামনে। বাইকের মালিক বাইকটাকে কোনরকমে রাস্তার পাশে রেখে রেস্টুরেন্টের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। গায়ে তার পুলিশের ইউনিফর্ম। নেমপ্লেটে মোটা আর বাংলা মাঝারি অক্ষরে লেখা আজওয়াদ ইশতিয়াক। লম্বা আর পেটানো শরীরের পুলিশের মুখের গড়ন অমায়িক। চিকন, সরু নাকে পানির কণা বিদ্যমান। প্রিয়তা দৃঢ় তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে নামটা আওড়াল মনে মনে। লোকটা ফোনটাকে শুকোনোর জন্য ব্যস্ত হয়ে হুট বসে পড়ল প্রিয়তার পাশে। প্যান্টের পকেটে থাকা রুমাল দিয়ে ফোন মুছল। অনাকাঙিক্ষত বৃষ্টিতে লোকটা হুশজ্ঞান হারিয়েছে বলে মনে হলো প্রিয়তার।
পুলিশ হয়ে অনুমতি ব্যতিত একটা মেয়ের পাশে বসে পড়ল? এটা কেমন স্বভাব?প্রিয়তা আরহামের দিকে একবার তাকিয়ে পাশে বসা সুদর্শন পুলিশের দিকে তাকাল। বললো,
” হেই, পুলিশ ম্যান। পাশে বসার জন্য অনুমতি চাইতে হয়। জানেন না?

নারী কণ্ঠ আলাদা রকমের সুন্দর হয়। চিকন নম্র সুরে উক্ত বাক্যটি বলা মেয়েটার কথা কুহরে পৌঁছাল আজওয়াদের। ঘাড় কাত করে মেয়েটির দিকে তাকাল আজওয়াদ। ব্যক্তিগত ভাবে পুলিশে কর্মরত সকলেই আজওয়াদের সাথে তেমন ভাবে কথা বলে না। আসলে হাজার কথার পরিপ্রেক্ষিতে একটা উত্তর সবার জন্য বিরক্তিকর বলেই এমনটা করে সকলে। এই মেয়ে এত অচেনা হয়েও প্রথম সাক্ষাতে পুলিশ অফিসারকে এভাবে কথা শোনাবে এ যেন এক বিস্ময়। কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরে আরো অবাক হলো আজওয়াদ। চুলের পানি কপাল বেয়ে গড়াল তার। খানিক গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠে আজওয়াদ বললো, ” আমি আপনার গা ঘেঁষে বসিনি। অনেকটা ডিসট্যান্স আছে। এখানে আপনি যেমন আশ্রয়ের জন্য এসেছেন, আমিও তেমনি আশ্রয়ের জন্যই এসেছি। বারান্দার এই বেঞ্চ সবার জন্য উন্মুক্ত। তাই অনুমতি দরকার হবে বলে মনে হয়নি।

থতমত খেল প্রিয়তা। লোকটার গম্ভীরতা দেখে চুপসে গেল। ঠিকই তো! এই বেঞ্চটা সবার জন্য উন্মুক্ত। এছাড়া আজওয়াদ দুরত্ব রেখেই বসেছে। পুলিশের সাথে অনেক ভেবে চিন্তে কথা বলা উচিত। নইলে বিনা অপরাধে কখন যে থানায় টেনে নিয়ে যাবে তার কোন টাইম টেবিল নেই। প্রিয়তা ওষ্ঠজোড়া চেপে ধরল। জিভ দিয়ে ওষ্ঠদ্বয় ভিজিয়ে নিল। আরহামের পাতলা চুলে বিলি কেটে অস্বস্তি নিয়ে পুলিশের উদ্দেশ্যে বললো ” আমি ভেবেছিলাম আপনি অনুমতি নেবেন। পুলিশ হিসেবে…

কথাটুকু বলতে দিল না আজওয়াদ। বললো,” পুলিশের নিয়মনীতির মাঝে এটা নেইই। চেক করতে পারেন”।

প্রিয়তার মনে হলো লোকটার সাথে তর্কে না গিয়ে সাহায্য করার কথা বলা উচিত। সন্ধ্যে নেমেছে অনেকক্ষণ। অন্ধকার হয়ে আছে আশপাশ। বারান্দার বাল্পটি আলো দিচ্ছে রাস্তায়। বৃষ্টির বেগ কমেছে। কোলাহল বাড়তে শুরু করেছে। রাস্তার লোকজন আড়চোখে দেখছে প্রিয়তাকে। এলাকায় নতুন মানুষ দেখলে সবাই এভাবে তাকিয়ে থাকে বোধহয়। কোথাও উঠতে না পারলে লোকজন বাজে ভাববে তাকে। এ মুহূর্তে পুলিশ লোকটাকে ভরসা করাই উত্তম বলে মনে হলো প্রিয়তার। সহসা বোকা হেসে সে বললো, ” আসলে আমি এ এলাকায় নতুন। আশেপাশে কোন ভালো বাড়ি বা হোস্টেল আছে? আমি ভালো ঘর খুঁজে পাচ্ছি না। আপনি কি আমায় সাহায্য করবেন?

আজওয়াদ ঘাড় কাত করে প্রিয়তাকে দেখল। আশপাশে নজর বুলিয়ে প্রিয়তাকে পর্যবেক্ষণ করলো। খানিক বিরক্তির সহিত বললো,
” যে এলাকায় এসেছেন সেই এলাকা সম্পর্কে আগে থেকে জেনে নেওয়া প্রয়োজন ছিল আপনার। আশেপাশে হোস্টেল নেই। তবে ভালো বাড়ি পাওয়া যেতে পারে।

পিনপিন নীরবতা চললো কিছুক্ষণ। পুরোপুরি বৃষ্টির ফোঁটা উধাও হলে আজওয়াদ উঠলো বেঞ্চ থেকে। বাইকের চাবি আঙ্গুলে নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে হেঁটে গেল সামনে। প্রিয়তার দিকে না তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো ” আমার সাথে আসুন।

প্রিয়তা লাগেজ আর আরহামকে নিয়ে উঠতে পারল না। আরহাম ঘুমিয়ে গেছে। ভারী না হওয়ার পরেও হাত পা ছেড়ে দেওয়ায় ছেলেটাকে সামলাতে কষ্ট হলো প্রিয়তার। তার উপর লাগেজ টানতেই হাতে চিনচিন ব্যথা অনুভব করল। পেটে মোচড় দিয়ে উঠল। অনেকক্ষণ বসে থাকায় উঠতে গিয়ে চোখে সব অন্ধকার দেখতে পেল। মাথা কেমন ঝিমঝিম করে উঠল। আরহামকে ভালোভাবে বুকে জড়িয়ে নিল প্রিয়তা। আজওয়াদ বাইক রেখেই হেঁটে যাচ্ছে। প্রিয়তা পেছনে আসছে কিনা তা দেখার প্রয়োজন বোধ করছে না লোকটা। প্রিয়তা ডাক দিল,
” শুনুন।

আজওয়াদ থেমে পেছনে তাকাল। কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে রইল প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা কোনরুপ অস্বস্তি ছাড়াই বললো, “একটু লাগেজ টা নিয়ে যান না। বাচ্চাটাকে নিয়ে লাগেজ টানতে হিমশিম খাচ্ছি”।

আজওয়াদ পিছু ফিরে প্রিয়তার সামনে এসে লাগেজ হাতে নিল। মৃদু হাওয়ায় প্রিয়তার কপালে থাকা চুলগুলো উড়ছে। শর্ট ফ্রক হওয়ায় পা উন্মুক্ত হয়ে আছে। যে কেউ দেখলে বুঝে যাবে প্রিয়তা ধনী পরিবারের মেয়ে। পোশাকআসাক পর্যবেক্ষণ করলেই জানা যাবে প্রিয়তার আর্থিক অবস্থা ভালো, কোন উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে এসেছে। কিন্তু নতুন এলাকায় চার-পাঁচ বছরের ছেলে নিয়ে ঘর খুঁজতে এসেছে কেন? সন্দেহ হলো আজওয়াদ-এর। পরক্ষণেই বোধ হলো মানুষের জীবনে অনেক ধরনের প্রতিবন্ধকতা আসে। বিত্তশালী লোকদের কখনো কখনো হুট করে রাস্তায় নামতে হয়। এই মেয়েটার জীবনেও বোধহয় কোন জটিলতা রয়েছে।

______________________

চলবে?

বেড়াজাল পর্ব-৩৯ এবং শেষ পর্ব

0

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #৩৯ (সমাপ্তির প্রথম খন্ড)

কেটে গেছে দুই মাস। সময়ের সাথে সাথে মানুষ গুলোর ভিতরও পরিবর্তন এসেছে।

আজ শুক্রবার। সবাই বাড়িতে থাকার দরুণ চন্দ্রা সিয়া অপূর্বকে ডেকেছে এই বাড়ি আসার জন্য। তাই চন্দ্রা এখন রান্নাঘরে। সিনথিয়াও ওর হাতে হাতে সাহায্য করছিলো কিন্তু হটাৎই ফোনে কল আসায় তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেছে। চন্দ্রা জিজ্ঞেস করলে শুধু বলেছে দরকারি কাজ আছে তাড়াতাড়ি চলে আসবে সে।

চন্দ্রা তাই আর মাথা না ঘামিয়ে রান্নাঘরে একাই সব করতে লাগলো। এরই মধ্যে সিয়াম এসে উপস্থিত হলো রান্নাঘরে। কড়াইতে সদ্য সবজি ছাড়ার কারণে চন্দ্রা টের পেলো না তেমন।
সিয়াম এসে ফট করে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই চন্দ্রা চমকে উঠলো। তা দেখে সিয়াম হেসে বললো “এখনও বুঝতে পারো না কে এমন ভাবে তোমায় পিছন থেকে জড়িয়ে ধরতে পারে..?”

চন্দ্রা মুচকি হেসে বলল “হ্যাঁ বুঝি সবই বুঝি তা কি মনে করে আজ রান্নাঘরে হুম হুম..?” বলেই চন্দ্রা দুই ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো।

সিয়াম ওভাবেই জড়িয়ে বললো “তুমি দেখি দিন দিন সুন্দর হয়ে যাচ্ছ বউ ব্যাপার কি বলতো..? সাড়া সপ্তাহটা তো ঠিক ভাবে দেখতেই পাই না তোমায় তাই আজ চলে এলাম মন ভরে তোমায় দেখতে।”

চন্দ্রা মিটিমিটি হেসে বললো “থাক আর তেল লাগাতে হবে না আমি রান্নায় এমনিই তেল বেশি দি।”

সিয়াম হাত আলগা করে বললো ” এইরকম তুমি বলতে পারলে আমায় চন্দ্র..? আমি কি না তোমায় বাটার লাগাই..? যাও আর করলাম না আদর।” বলেই সিয়াম পিছন ফিরে বাসন পত্র নিয়ে টুকটাক নাড়তে লাগলো।

চন্দ্রা তা দেখে করুন মুখ করে সিয়ামের সামনে গিয়ে বললো “আমি তো মজা করছিলাম সিয়াম। আচ্ছা সরি……সরি বলছি তো” সিয়ামের তাও কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে চন্দ্রা এবার নিজেই সিয়ামকে জোর করে তার দিকে ঘুরিয়ে নিজের পা হালকা উঁচু করে সিয়ামের এক গালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। এর পর আরেক গালে ঠোঁট ছুঁয়াতে গেলেই সিয়াম টেনে চন্দ্রার ঠোঁট দুটো আঁকড়ে ধরলো।

_________________________________

সিয়া সকালের ব্রেকফাস্ট করে উপরের ঘরে এলো। আজ তার সিয়ামদের বাড়ি যাওয়ার কথা কিন্তু সকাল থেকেই কেমন গা গুলাচ্ছে তার। কয়েক দিন ধরেই হচ্ছে তার এইসব একজন মেয়ে হয়ে সে ভালোই বুঝেছে এই সব কিসের ইঙ্গিত। কয়েকদিন থেকে কাজের চাপে সে অতটা গুরুত্ব দেয়নি আর না অপূর্বকে কিছু জানিয়েছে। বমিও করেছে সে তার অফিসে দুই বার শরীরটা দূর্বল হয়ে আছে কিছুটা তাই। কিন্তু আজ তার শরীরটা একটু বেশিই খারাপ লাগছে তার। কাল বাড়ি ফেরার পথে একটা প্রেগনেন্সি টেস্ট কিট নিয়ে এসেছিল। সিয়া সেটা নিয়েই ওয়াসরুমে চলে গেলো।

কয়েক মিনিট বাদ সিয়া ওয়াসরুম থেকে বেরিয়ে প্রেগনেন্সি কিট তার দিকে দেখলো। জ্বল জ্বল করছে সেখানে দুটো লাল দাগ। সিয়া বুঝতে পারলো না তার খুশি হওয়া দরকার কিনা..?মনের মধ্যে যেনো অনেক কিছুর জোট পাকিয়ে আসছে তার। এসব ভাবতে ভাবতেই সিয়া সামনে এগিয়ে কিট টা টেবিলের উপর রাখলো। তখনই অপূর্ব আসলো ঘরে সিয়াকে এইরকম অন্যমনস্ক দেখে অপূর্ব কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো ” সিয়া..? কি ভাবছো..?”

সিয়া আচমকা আওয়াজ পেয়ে দুই পা পেছোতেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো তার পরে যেতে নিলেই অপূর্ব ধরে ফেললো। ধরে বিছানায় বসিয়ে অপূর্ব চিন্তিত মুখে বললো ” কি হয়েছে কি তোমার সিয়া..? কয়েক দিন ধরেই দেখছি ঠিক মতো খাচ্ছো না, ঘুমোচ্ছো না এইটুকু সিঁড়ি উঠতেই কেমন হাঁপিয়ে যাচ্ছ। না না আজকেই তোমায় ক্লিনিকে নিয়ে যাবো কোনো কথা শুনতে চাই না এই নিয়ে আমি। আমি এক্ষুনি ডক্টরকে কল করছি। আজ আর ওইবাড়ি যেতে হবে না তোমায়।”

সিয়া অপূর্বকে এইভাবে উত্তেজিত হতে দেখে বললো “আরে আরে আমার কথা তো শোনো আগে..? আমার কিছু হয়নি।”
অপূর্ব ফোন নিয়ে বললো “না সিয়া অনেকদিন থেকেই দেখছি আর না। চুপ থাকো তুমি আমি যা বলবো তাই করবে।”

সিয়া শুনলো না অপূর্বের কথা তাকে হাত টেনে বেডে বসালো। অপূর্ব বেডে বসেই সিয়ার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সিয়া পাশের টেবিল থেকে প্রেগনেন্সি কিটটা নিয়ে মুখ কাচুমাচু করে অপূর্বের হাতে দিলো। অপূর্ব কৌতূহল বশত তাড়াতাড়ি নিয়ে দেখতেই চোখ ছানা বড়া হয়ে গেলো তার। একবার সিয়ার মুখের দিকে তাকালো একবার কিট তার দিকে সিয়া করুন মুখ নিয়ে তাকিয়ে রইলো অপূর্বের দিকে। অপূর্ব কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করেই সিয়াকে জাপটে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুঁজে থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ বলতে লাগলো। তারপর মুখ তুলেই সিয়ার মুখে আদুরে স্পর্শ গুলো দিয়ে আবার জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজলো। এইসব এত তাড়াতাড়ি হলো সিয়ার বুঝতে একটু সময় লাগলো সবটা। সিয়া এবার অপূর্বের পিঠে হাত রেখে বলল “তুমি খুশি হয়েছ..?”

অপূর্ব মুখ সিয়ার হাত দুটো ধরে বললো “খুশি মানে..?আমি প্রকাশ করতে পারবনা আমি কতোটা খুশি হয়েছি। অনেক অনেক ধন্যবাদ সিয়া আমায় লাইফে আসার জন্য আমায় পরিপূর্ণ করার জন্য। একমিনিট তুমি খুশি হওনি এতে…?”
সিয়া হকচকিয়ে গেল। তা দেখে অপূর্বের মুখটা আঁধারে ছেয়ে গেল। সিয়া তা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পরল “তুমি যেমনটা ভাবছো তেমনটা নয় অপূর্ব। আমি দ্বিধা দ্বন্দে ছিলাম একটু কারণ আমাদের কোনো বেবী প্ল্যান ছিল না আর এতো তাড়াতাড়ি তোমার যদি অসুবিধা হয়..? তাই ভেবে আর কি.. কিন্তু তোমায় দেখে এখন আর আমার মনে ছিটে ফটো দ্বিধাদ্বন্দ নেই বিশ্বাস করো।”

অপূর্ব হালকা হেসে বললো ” বাচ্চা উপরওয়ালার দান সিয়া। তার আসারই ছিলো তাই সে এসেছে। আর ধরলাম আমার কথা তোমার সাথে যুক্ত কোনোকিছুই আমার প্ল্যানের বাইরে নয়।”

সিয়া এই প্রথম এগিয়ে গিয়ে শক্ত করে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলো অপূর্বকে। দুফোঁটা চোখের জল ফেলে শুধু আওরালো “থ্যাঙ্ক ইউ অপূর্ব থ্যাংক ইউ ফর এভ্রিথিং”
.
.
.
সিয়ার খবর সায়মা বেগম অলীক সাহেব আর অপা জানতেই বাড়িতে যেনো খুশির ধুম পড়ে গেছে তাদের। অলীক সাহেব একগাদা খেলনা নিয়ে এসেছেন সাথে মিষ্টি। সায়মা বেগম এখন থেকেই বসে গেছেন বাচ্চার কাঁথা সেলাই করতে। অপা সব বাচ্চার স্টিকার কিনে এনে সারাবাড়ি ময় লাগিয়েছে। সিয়ার এইসব দেখে ভীষণ রকম আনন্দ হচ্ছে সবার এইরকম মাতামাতি দেখে সে হেসেই যাচ্ছে। হেসে হেসে তার গালটা এবার ব্যাথা করছে কিন্তু তাও সে হাসছে। হটাৎই তার মনে হলো এতো খুশি সে এই প্রথমবার হলো জীবনে। চোখটা মুহূর্তেই ছলছল করে উঠলো।
.
.
সিয়াকে জোর করে আজ ক্লিনিকে নিয়ে এসেছে অপূর্ব। ডক্টর অপূর্বের সাথে আলাদা কথা বলতে চায় বলে সিয়া বাইরের চেয়ারটায় এসে বসেছে। হঠাৎই তার চোখ গেলো সামনে থেকে আসা মা ও ছেলের দিকে। সিয়ার চিনতে ভুল হলো না ওটা আতিফ ও তার মা। সিয়া কথা বলতে চাইলো না তাই মুখ ঘুড়িয়ে না দেখার ভান করে বসে রইল।

“সিয়া..?” এতদিন পর ওই মুখে নিজের নাম শুনে সিয়া চমকে উঠলো। না এখন আর তার আগের মতো ভালো লাগা কাজ করছে না কাজ করছে রাগ।

আতিফযে সিয়াকে দেখে বেশ অবাক সাথে খুশিও হয়েছে সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সিয়া বিনিময়ে মুচকি হাসলো।
আতিফ নিজে থেকেই এবার বললো ” কেমন আছিস সিয়া..? বাড়িতে সবাই কেমন আছে..?”
সিয়া ভদ্রতার খাতিরে একটা হাসি দিয়ে বললো ” ভালো। সবাই ভালো। তা তুই কেমন আছিস..? আর তোর বউ..?”

আতিফ আর তার মা এতোক্ষণ হাসি মুখ করে থাকলেও এবার তাদের মুখটা অপরাধবোধ ছেয়ে গেল। আতিফের মা এবার সামনে এগিয়ে এসে সিয়ার হাত ধরে অনুতপ্ত গলায় বললো “আমায় ক্ষমা করো মা। আজ আমার জন্যই আমার ছেলের জীবনটা তছনছ হয়ে গেলো। একটু বেশি সুখে সাচ্ছন্দের আশায় আমি তার সুখটাই কেরে নিলাম।”

সিয়া বিস্ময় নিয়ে বললো ” মানে..? বুঝলাম না ঠিক।”

আতিফের মা ফির বললেন “আসলেই পাপ বাপকেও ছাড়ে না মা। যার সাথে ছেলেটার বিয়ে দিলাম একটু উঁচু পদ দেখে পরে জানতে পারলাম মেয়েটা আগে থেকেই অনেক ছেলের সাথে সম্পর্ক করেছে। সংসারে নিত্য নতুন এই নিয়ে অশান্তি লেগেই থাকত। আমাকেও ঠিকঠাক মত খেতে দিতো না। এই দেখে আমার বড়ো ছেলে ছেলের বউও আলাদা হয়ে গেলো আমার সংসার থেকে। তারপরই মেয়েটা নিজেই ডিভোর্স দিয়ে দিলো। সে নাকি পরিবারের চেপে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল। আমি এখন নিঃস্ব মা। অপরাধ বোধ রোজ আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। তুমি পারলে আমাদের এই মা ছেলেকে ক্ষমা করো মা।”

সিয়া এবার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে একপলক আতিফকে দেখলো মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে সে। তারপর সিয়া বললো “আপনাদের অপরাধের শাস্তি আপনাদের পাওয়ারই ছিলো একদিন। একজনের চোখের জলের দাম এতটাও সস্তা নয়। তবু দোয়া করবো ভালো থাকবেন, আমি অতোটাও স্বার্থপর নই যে কারোর খারাপ দোয়া করবো। একটাই কথা বলতে চাই যা হয় তা হয়তো ভালোর জন্যই হয়, এটা আমি এখন উপলদ্ধি করতে পারছি ভালো ভাবে। আর আতিফ ভালো কোনো মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিস।”

আতিফ এবার করুন স্বরে বলল ” সিয়া একটা বার কি আমায় সুযোগ দেওয়া….”

আতিফের কথা শেষ হওয়ার আগেই পিছন থেকে অপূর্বের আওয়াজ আসলো ” সিয়া..”
সিয়া তাকাতেই অপূর্ব এসে তার কোমর জড়িয়ে বললো “শরীর খারাপ লাগছে..? এখানে…” বলতে বলতেই তার চোখ গেলো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ দুটির উপর। তারা চোখ ভরা কৌতুহল নিয়ে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। অপূর্ব সিয়ার কোমর না ছেড়েই বললো “তুমিই আতিফ রাইট..? আমি ড. অপূর্ব এহসান সিয়ার হাসবেন্ড। সত্যি বলতে তোমার উপর আগে রাগ থাকলেও তোমায় একটা ধন্যবাদ দেওয়ার ছিলো তুমি না ছাড়লে হয়তো এই মেয়েটাকে আমি পেতাম না জীবনে।”

কোমরে অপূর্বের হাতটা না সরানো দেখে সিয়া মুচকি হাসলো। তার এই ধরে রাখাই প্রমাণ দিচ্ছে তার প্রতি মানুষটার অধিকার বোধ, সে শুধু এখন এই মানুষটার এটার প্রমাণ। সিয়া এবার আতিফের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো “আম অলসো থ্যাংকফুল টু ইউ। এই মানুষটা হারিয়ে ফেললে হয়তো আমি জীবনের অনেক কিছুই হারাতাম।”

আতিফ আর তার মা মুখ কালো করে বললো ” বিয়ে করেছিস..? বাহ্ সুখে সংসার কর এই দোয়া করি আর পারলে ক্ষমা করিস এর বেশি কিছুই বলার মুখ নেই আমার। ভালো থাকিস আসি রে।” এই বলে সে আর তার মা বেড়িয়ে গেলো সেখান থেকে।

এরপর অপূর্ব আর সিয়াও গাড়িতে উঠে রওনা দিলো সিয়ামের বাড়ির উদ্দেশ্যে। কেউ কোনো কথা বললো না গাড়িতে তা দেখে সিয়া এবার নিজেই জিজ্ঞেস করলো ” ডক্টর কি বললেন তোমায় আমার ব্যাপারে..?” এতোক্ষণ অপূর্বের মুখ স্বাভাবিক থাকলেও এবার মুখটা মলিন হয়ে এলো। কিন্তু সিয়া তা বোঝার আগেই হালকা হেসে বললো “কই তেমন কিছু না। তোমার শরীরটা একটু দুর্বল তাই একটু বেশি খেয়াল রাখতে বলেছে তোমার। আমি বলছি কি এখন জবটা না করলে হয় না..? পরে তোমার ইচ্ছে হলে আমি বাঁধা দেবো না কিন্তু এখন…”

অপূর্ব ভেবেছিল সিয়া জবের জন্য জেদ করবে কিন্তু তার সব ধারণা ভুল প্রমাণ করে সিয়া অপূর্বের হাতের উপর হাত রেখে হেসে বলল ” ওকে ”

অপূর্বের মুখেও হাসি ফুটে উঠলো। মিথ্যে বলতে পারবে না মনকে সে, তবে সে আজ সত্যিই সিয়াকে হারাবার ভয় পেয়েছিলো একটু। তবে সিয়ার আনসার শুনে সেই ভয়টা এখন আর তার নেই।

“এই এই গাড়ি থামাও” সিয়ার উত্তেজিত গলা শুনে অপূর্ব গাড়ির ব্রেক কষে বললো “কি হয়েছে..? কি হয়েছে..?”

সিয়া অবাক হয়ে গাড়ির জানলা দিয়ে কিছু একটা দেখালো অপূর্বও তা দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।

___________________________

কিছুক্ষণের মধ্যেই সিয়া আর অপূর্ব সিয়ামদের বাড়িতে এসেই সিয়া ভাইয়া ভাবী বলে জোরে জোরে চেঁচাচ্ছে।

ওদের ডাক শুনে সিয়াম আর চন্দ্রা দৌড়ে রান্নাঘরের বাইরে এসে ওদের দেখে অবাক। ততক্ষণে সিরাজও নেমে এসেছে উপর থেকে তাদের চিল্লা চিল্লি শুনে।

সিয়া সিনথিয়ার কান ধরে বলে বললো ” ভাবী দেখেছো দুটো চোরকে ধরে এনেছি রাস্তা থেকে। রাস্তা নয় পার্ক থেকে দুজনে বসে বসে প্রেম করছিল।”

অপূর্বও পিয়াসের কান মুলে বললো “দেখ সিয়াম তলায় তলায় মহাশয় এই টেম্পু চালাচ্ছিল।”

চন্দ্রা সিয়াম দুজন দুজনের দিকে একবার দেখলো। তারপর অপূর্ব আর সিয়াকে চোখের ইশারায় অন্যদিকে আসতে বলল।
অপূর্ব সিয়া তা বুঝে চলে গেলো ভিতরে। কিছুক্ষণ পর সবাই গম্ভীর মুখ করে বেরিয়ে এলো।

পিয়াস ভয় পেলো কি বোঝা গেলো না, কিন্তু সিনথিয়া বেশ ভয় পেলো। যদি কেউ মেনে না নেয় তাদের সম্পর্কটা..? এই মানুষটাকে ছাড়া সে কিছুই ভাবতে পারে না। কদিনেই বড্ড আপন হয়ে গেছে মানুষটা।

সবাই গম্ভীর মুখ করেই এবার বারিয়ে এলো সবাই। সিনথিয়া আরো ভয় পেলো, পিয়াসের কাছ ঘেঁষে তার হাতের উপরের অংশটা চেপে ধরলো। পিয়াস চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করলো তাকে। সিনথিয়ার ভয় তাও কমলো না।

সিয়াম গম্ভীর মুখ করে বললো “ভুল যখন করেছিস শাস্তি তো পেতেই হবে দুজনকে।”

সিনথিয়া আর পারলো না কেঁদে দিলো হুহু করে। ওকে দেখে সবাই হকচকিয়ে গেল। চন্দ্রা বিচলিত হয়ে বললো “আগে শুনে তো নে শাস্তি টা তারপর ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদবি।”

পিয়াস চুপ করাতে ব্যস্ত সিনথিয়াকে। সিয়াম এবার দেরি না করে বললো “ভেবেছিলাম কদিন পর বলবো কিন্তু এরা তো দেখছি রোমিও জুলিয়েটকেও হার মানিয়ে দেবে। এই অপূর্ব তাড়াতাড়ি খবর দে আজই দুজনের রেজিষ্ট্রি করিয়ে দেবো শাস্তি স্বরূপ। পরে ওদের ইচ্ছে মতো বিয়ের তারিখ ঠিক করা যাবে।”

সিনথিয়া এবার কান্না থামিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো সবার দিকে। তা দেখে সবাই হু হা করে হেসে দিল। পিয়াসও ফিক করে হেসে দিল। সে মজাটা হালকা বুঝতে পেরেছিল আগেই তবে বলেনি সিনথিয়াকে।

তারপর সবাই আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এই আনন্দের খবরের মধ্যে সিয়ার প্রেগনেন্ট হওয়ার খবরটা যেনো আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিলো সবার আনন্দ।

অবশেষে সিনথিয়া পিয়াসের রেজিষ্ট্রি শেষ করে রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই বেশ খানিকক্ষণ আড্ডা দিয়ে শুতে চলে গেলো যে যার রুমে।

______________________________

সিয়াম ঘরে ঢুকে চন্দ্রাকে দেখতে না পেয়ে ব্যালকনির দিকে গেলো। এখন তারা সিয়ামের উপরের ঘরটাতেই থাকে। সিয়াম জানে চন্দ্রার মন খারাপ থাকলে সে ব্যালকনিতে গিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।

সিয়াম ধীরে ধীরে গিয়ে চন্দ্রার পাশে রেলিংয়ে দুই হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো ” আমার চাঁদের কি আজ মন খারাপ..?”

চন্দ্রা সিয়ামের দিকে ঘুরল। সিয়াম চন্দ্রার চোখে জল দেখে বিচলিত হয়ে বললো “একি চন্দ্র কি হয়েছে..? সিরাজকে দেখে কষ্ট পেয়েছ..? তাই তো..? আমি তোমার তাকানো দেখেই বুঝেছি তখন।”

চন্দ্রা এবার কান্নারত অবস্থায় বললো ” আমি খুব খারাপ তাই না সিয়াম..? কীভাবে দিভাইকে দূরে পাঠিয়ে দিলাম সিরাজের থেকে। সিরাজকে চোখের সামনে দিন দিন কেমন হয়ে যেতে দেখছি। সারাদিন বাড়িতে থাকে না আগের মত হাসি মজা করে না। কেউ ফোন করলে পায় না। সারাদিন অফিসে পরে থাকে। আমার নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয় সিয়াম। আমার এতো রাগ কেনো কেনো।” বলেই চন্দ্রা নিজের দুই হাত ঠুকতে লাগলো রেলিংয়ে।

সিয়ামের বুকটা কেঁপে উঠলো। চন্দ্রাকে টেনে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরে বললো “শান্ত হও চন্দ্র, কে বলেছে সব দোষ তোমার..? সিরাজ যা করেছে সেটা ওর প্রাপ্য ছিলো। তোমার সাথে আরো বাকি মেয়েদের সাথে এটা না হলে ও অন্য কোনো না কোনো দিক দিয়ে শাস্তি ঠিক পেতই। তুমি তোমার জায়গা থেকে ঠিক ছিলে চন্দ্র। কেউই চাইবে না তার আপনজন এমন একটা মানুষের সংস্পর্শে থাকুক। তাই নিজেকে অপরাধী ভেবো না। আর এই সিদ্ধান্ত টা তো ইন্দ্রা সিরাজ দুজনের জন্যই সঠিক। এতে তারাও বুঝতে পারবে তাদের ভালোবাসা কি সত্যি নাকি শুধুই কয়েকদিনের মোহ।
আর রইলো রাগের কথা হ্যাঁ ওইটা তোমায় একটু কন্ট্রোল করতে হবে। আমরা জীবনে কেউই পারফেক্ট নই চন্দ্র। সবারই কিছু না কিছু দোষ গুন আছে। তাই এইসবকে বড়ো করে দেখো না ওইসব জীবনের অংশ। কিন্তু হ্যাঁ এরপরের বার থেকে কোনো কিছু নিয়ে রাগ হলে কিছুক্ষণ চুপ করে যাবে দেখবে রাগ কমে যাবে আর সব কিছুর সমাধানও সহজে করতে পারবে। বুঝলে পাগলি..?”

চন্দ্রা সিয়ামের বুকের মধ্যে থেকেই মাথা নাড়ালো। সিয়াম পাশে রাখা দোলনায় চন্দ্রাকে কলে নিতে বসে বললো “অনেক হয়েছে কান্নাকাটি এবার একটু হাসো তো দেখি। বেশ কয়েকদিন থেকে দেখছি আমায় আর আগের মতো আদর কোরো না।”

চন্দ্রা চেতে বললো “ওমনি তাহলে সকালে কে আগে…”

সিয়াম বাঁকা হেসে বললো “থামলে কেন বলো সকালে তুমি আগে কি করেছ এমন..?”

চন্দ্রা আবার আগের মতো সিয়ামের বুকে গুটিসুটি মেরে বললো “জানি না যাও। আবার তুমি আমার পিছনে লাগবে।”

সিয়াম গলায় শব্দ করে হাসলো। চন্দ্রা তা দেখে আসতে করে ডাকলো ” সিয়াম..”

সিয়াম একটু অবাক হলেও শুধু বললো “হুম”

চন্দ্রা এবার ইতস্তত করে বললো “সিয়া আপুর বাবু হবে কদিন বাদ অথচ তাদের বিয়ে আমাদের কতগুলো মাস পর হলো। আমারও বাবু চাই একটা। যে আমায় মা তোমায় বাবা বলে ডাকবে। আমাদের সংসারটা পরিপূর্ণ করবে।”

সিয়াম এবার চন্দ্রার চোখে চোখ রেখে মুচকি হেসে বলল “আমার চন্দ্রাবতীর হুকুম বলে কথা, আমার সাধ্য কি তার হুকুম অগ্রাহ্য করি।”

চন্দ্রা লাজুক হেসে সিয়ামের বুকে মুখ লুকলো। সিয়াম হেসে চন্দ্রাকে কলে তুলে চললো ঘরের দিকে।

#চলবে..?

( অনেক অনেক দুঃখিত। আমি চেয়েও পারছি না তাড়াতাড়ি দিতে তাই একটু বেশি করে দিয়ে পুষিয়ে দিচ্ছি আজও প্রায় 2300+ ওয়ার্ড আছে। আর একটা পর্ব হবে আমি তাড়াতাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করবো)

বেড়াজাল পর্ব-৩৮

0

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #৩৮

সকাল বেলা সূর্যের কিরণে চন্দ্রার ঘুম হালকা হয়ে আসতেই ব্লঙ্কেট টার ভিতর আরেকটু নিজের শরীরটাকে ঢুকিয়ে নিলো। শুধু মুখটা বের করে আয়নার দিকে তাকাতেই দেখলো সিয়াম সদ্য স্নান সেরে এসে চুল ব্রাশ করছে। পড়নে শুধু একটা ট্রাউজার। উন্মুক্ত লোমহীন রেগুলার জিম করা পারফেক্ট শেপ বডিতে কয়েকটা বিন্দু বিন্দু জলকণা লেপ্টে আছে।
চন্দ্রা নিজের অজান্তেই হাঁ করে চেয়ে রইল সেইদিকে। সিয়াম মিররে তা দেখে হেসে বেডের কাছে এগিয়ে এলো।

চন্দ্রা তা বুঝতে পেরে ব্ল্যাঙ্কেটটা দুই হাত দিয়ে টেনে মুখ ঢাকলো। এখন দেখা যাচ্ছে শুধু তার ওই মায়াবী চোখ জোড়া। সিয়াম বেডে বসে চন্দ্রার দিকে একটু ঝুঁকে চুলগুলো আরেকটু এলোমেলো করে বললো “ম্যাডামের কি আজ আর ওঠার ইচ্ছে নেই..?”

এতোটা কাছে আসায় শিয়ামের গা থেকে আসা শাম্পু জেলে মিশিয়ে একটা চরা পুরুষালী সুবাস চন্দ্রার নাকে ঠেকতেই সে হুট করে দুই হাত ব্ল্যাঙ্কেট থেকে বের করে সিয়ামের গলার পিছনে দুই হাত আটকে বললো ” নাহ..! চলো আজ তুমিও অফিসে ছুটি নিয়ে নাও, আমিও ক্লাসে যাবো না।”
সিয়াম এবার গলায় শব্দ করে হেসে চন্দ্রার নাকে নাক ঘষে বললো “আমার সাথে থাকতে থাকতে ম্যাডামের দেখছি আমার হাওয়া লেগেছে। কিন্তু সরি বউ আজ এই আবদারটা রাখতে পারবো না অফিসে জরুরী মিটিং আছে একটুপরে, তাই যেতেই হবে।”

এর পর চন্দ্রা দুই হাত সরিয়ে মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বললো “ব্রেকফাস্ট করে যেও।”

সিয়াম চন্দ্রার এই রকম মুখ ফোলানো দেখে মুখটা তার কানের নিয়ে গিয়ে নাকটা আরেকটু ঘষে বললো ” এগেইন সরি চন্দ্রাবতী। সত্যি বলছি আজ সময় থাকলে ব্রেকফাস্ট টাও বেডেই সেরে যেতাম।”

এই কথার পিঠে কি কিছু বলা যায়..? চন্দ্রা ভেবে পেলো না, নিজের লাল টুসটুসে গাল তাকে নিয়ে এলোমেলো দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকালো। সিয়াম তা দেখে মুচকি হেসে চন্দ্রার জামাকাপড় বের করে দিয়ে নিজে রেডি হতে লাগলো।

____________________________________________

সিরাজ বসে আছে একটা গোলাকৃতি সোফায়। তার হাত পা অনবরত কেঁপছে। এই প্রথম বার বোধহয় তার এতো চিন্তা হচ্ছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামই তার প্রমাণ দিচ্ছে।
এরই মধ্যে ইন্দ্রা একটা ট্রে তে করে কফি আর স্নাক্স নিয়ে এসে টেবিলের উপর রাখলো।

কফিটা ইন্দ্রা সিরাজের দিকে এগিয়ে দিতেই সিরাজ ছোট্ট করে ” থ্যাংকস ” বলে গরম কফিটা এক ঢোকে অর্ধেকটা খেয়ে নিল। তা দেখে ইন্দ্রা চাপা স্বরে চেঁচিয়ে উঠল “আরে কি করছেন টা কি..? ওটা অনেক গরম।”

ইন্দ্রা কথা শেষ হওয়ার আগেই সিরাজ অর্ধেক কফি খেয়ে ডান হাতের দুটো আঙুলের উল্টো পিঠ ঠোঁটে তাকিয়ে মুখ বিকৃত করে বসে রইলো কয়েক সেকেন্ড। তারপর চিন্তিত মুখে ইন্দ্রাকে বললো ” আমার খুব টেনশন হচ্ছে ইন্দ্রা। তোমার আব্বু যদি আমার কাছে তোমায় না দেন..?”

ইন্দ্রা হালকা হেসে বললো “আপনি অযথা উল্টোপাল্টা চিন্তা করে টেনশন করছেন। শুভ শুভ ভাবুন দেখবেন সব ভালোই হবে।”

সিরাজের তাও টেনশন তো কমলই না উল্টে বেড়ে গেলো কয়েকগুন। সামনে বসা মেয়েটাকে হারিয়ে ফেলার ভয় চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরলো তাকে।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই চয়ন সাহেব গম্ভীর মুখ করে এসে বসলেন সিরাজের সামনের সোফায়। সিরাজকে কয়েক পলক দেখে গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞেস করলেন ” তা কতদিন ধরে চলছে এইসব..?”

সিরাজ একটু ভরকে বললো ” জ্বি..? না মানে ওই ” সিরাজের গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে এলো।

চয়ন সাহেব এবার বললেন ” দেখো আমি সোজাসাপ্টা কথা বলতে ভালোবাসি তাই সরাসরি বলছি আমার মেয়েকে পছন্দ করার আগে নিশ্চই তার পাস্ট জেনেছ..?”

সিরাজ ঘাড় হেলায় অর্থাৎ হ্যাঁ। চয়ন সাহেব ফের বললেন “সব জেনে বুঝেই যদি তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চাও তবে আমার কোনো আপত্তি নেই। মেয়েদের খুশিতেই আমার খুশি। কিন্তু তোমার মা..”

সিরাজ এবার শান্ত গলায় বললো “ওইসব নিয়ে আপনি ভাববেন না আংকেল। তিনি তার পাপের সাজা ভোগ করছেন। উনি ফিরে এলেও ওই বাড়িতে তার আর জায়গা হবে না.. আপনার মেয়ের ব্যাপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।”

চয়ন সাহেব এবার মাথাটা হালকা নাড়িয়ে বললেন ” তবে তাই। পরের দিন সিয়াম চন্দ্রার সাথে আমি কথা বলে সব ঠিক করি।”

সিরাজ এবার হালকা একটা হাসি দিয়ে হ্যাঁ বোধক ঘাড় হেলালো আলতো করে। চয়ন সাহেব দুজনকে কথা বলতে দিয়ে চলে গেলেন উপরে।

চয়ন সাহেব যেতেই ইন্দ্রা একগাল হেসে সিরাজের পাশে বসে বললো “দেখলেন খামোখা টেনশন করছিলেন আপনি।”

সিরাজ এবার ইন্দ্রার বাম হাতের উল্টো পিঠে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে বললো “তোমার জন্যে টেনশন কখনই আমার কাছে খামোখা নয়।”

_______________________________________

সিনথিয়া রেডি হয়ে গাড়ি আসার অপেক্ষা করছে। আজ সিয়া আপূর্ব আর অলীক সাহেব সবাই কাজে বেড়িয়ে যাবেন। সায়মা বেগম আর অপা সকাল হতেই অপূর্বের নানীর বাড়ি গেছেন। ওনার শরীরটা নাকি হুট করেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাই সিনথিয়া নিজেই জেদ করেছে ওই বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য। ওই বাড়িতে থাকা কালীন নিজের রুম থেকে খুব একটা বের হয়নি সে। এখন তার ওতো বড়ো বাড়িটা ঘুরে দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছে। তার জেদের কাছে হার মেনেই সিয়া সিয়ামকে ফোন করে বলেছে সিনথিয়ার জন্য গাড়ি পাঠাতে।
তার যে নিজের একটা বড়ো ভাই আছে তা যেনো তার বিশ্বাসই হয় না। আর শুধু একটা কেনো তার দুটো ভাই ভাবী একটা বড়ো আপু সবাই আছে, তারা সবাই সিনথিয়ার নিজেরই তো।
তার মম তাকে ছোট থেকেই বলেছিলো তার আগে পরে কোনো ভাই বোন বা রিলেটিভ নেই। তাই বন্ধুদের ভাই বোন দেখলে আর ভীতর থেকে একটা চাপা কষ্ট বেরোতো। যদিও সে সেটা কখনোই তার মমকে বুঝতে দেয়নি।

এইসব ভাবনার মাঝেই গাড়ি এসে গেটের মুখের কাছে থামতেই সিনথিয়া এগিয়ে গিয়ে গাড়ির ভিতরের মানুষটিকে দেখে চমকে উঠলো। এই মানুষটাকে সে দিনে কতোবার লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতো তার হিসেব নেই। অথচ সিনথিয়া যতবার কোননা না কোনো কারণে কথা বলতে গেছে পিয়াস ততবারই এড়িয়ে গেছে তাকে। সিনথিয়া এতে কষ্ট পেয়ে তার সামনে যাওয়া কমিয়েছিল তবে তাকে লুকিয়ে দেখা না। কিন্তু তাকে এইসময় এখানে দেখাটা সিনথিয়ার ডেস্টিনি বলে মনে হলো।

গাড়ির ভিতর থেকে পিয়াস দরজা খুলে দিলো। সিনথিয়া এবার চুপচাপ গাড়িতে বসলো।
পিয়াস এবার বললো ” সিটবেল্টটা লাগিয়ে নিন।”

সিনথিয়া হটাৎ পুরুষালী কণ্ঠ শুনে চমকে গিয়ে বললো ” জ্বী..?”
পিয়াস পুনরায় স্বাভাবিক গলায় বললো ” সিটবেল্টটা লাগিয়ে নিন।”
সিনথিয়া এবার হকচকিয়ে বললো ” ও হ্যাঁ- হ্যাঁ ” বলে সিটবেল্ট লাগিয়ে নিলো।

আধ ঘণ্টা পর গাড়ি সিয়ামদের বাড়ির সামনে থামতেই সিনথিয়া গাড়ি থেকে নেমে শুধু থ্যাংকস বলে সামনের দিকে এগোতে নিলেই পিয়াস পিছন থেকে ডাকলো “শুনুন”

সিনথিয়া থেমে পিছনে ঘুরে বললো ” হ্যাঁ বলুন..? ”

পিয়াস এবার স্বাভাবিক মুখ করে বললো ” পরের বার থেকে প্রায়ই সামনা সামনি দেখা হবে আমাদের। তাই আর গাছের পিছনে লুকিয়ে বা গাড়ির মিররে লুকিয়ে দেখার দরকার পড়বে না।” বলেই একটা তেছরা হাসি দিয়ে সানগ্লাস পরে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল ওখান থেকে।

স্ট্যাচু হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল সিনথিয়া। মানে লোকটা সব বোঝে..? ইস কি লজ্জা। কি লজ্জা। এক্ষুনি যদি কোনো যাদু হয়ে মাটিটা ফাঁক করা যেত তাহলে সিনথিয়া এক সেকেন্ডও সময় না ব্যয় করে টুপ করে ঢুকে যেত সেখানে। কিন্তু আফসোস সেসব কিছুই হবে না।

পিয়াস কিছুটা দূরে গিয়ে গাড়ি থামিয়ে সানগ্লাসটা খুলে হেসে ফেললো। মেয়েটা তার থেকে অনেকটাই ছোটো, মেয়েটা একবার তাকে গাড়িতে অ্যাক্সিডেন্ট হওয়া থেকে বাঁচিয়ে ছিলো। তারপরে পরপর দুদিন তার সাথে ভালো ভাবেই কথা হয়েছিল। কিন্তু তারপরই সিয়াম মেয়েটার আসল পরিচয় জানিয়ে তার সাথে কথা বেশি কথা বলতে বারণ করেছিল। যদিও কারণটা সুইটি বেগম ছিলো। কিন্তু এখন তো সুইটি বেগম নেই তাই তার কোনো বাঁধাও নেই কথা বলায়। মেয়েটার তার প্রতি পাগলামি দেখে তার খুব ভালো লাগে। তার কলেজে একটা সো কোল্ড রিলেশনশিপে ব্রেকআপ হওয়ার পর সে আর কোনো সম্পর্কে জড়ায়নি। তাই এই প্রেম হওয়ার আগের অনুভুতিটা তার কাছে একদম নতুন, নিজেকে এখন যেনো উনিশ কুড়ির যুবক মনে হলো পিয়াসের।

________________________________

আজ অপূর্বদের বাড়িতে সায়মা বেগম আর অপা থাকবেনা বলে অপূর্ব আর সিয়া ঠিক করেছিলো তারা সন্ধ্যে ছয়টার পরপরই ফিরে যাবে বাসায়। কারন অলীক সাহেবকে খেতে দেওয়া চা দেওয়ার ভার সায়মা বেগম সিয়ার উপরে দিয়ে গেছে। সিয়াও সেই কাজ সানন্দে করছে। এই ছোটো ছোট কাজ গুলোই তাকে এই বাড়ির অংশ হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।

সিয়া এবার অলীক সাহেবকে সন্ধ্যেতে চা দিয়ে নিজের ঘরে এসে বিছনায় বসলো। একবার ঘড়ির দিকে তাকালো সন্ধ্যে সাতটা বাজতে যায়। অপূর্ব এখনো ফিরলো না। সিয়া এবার নিজের ফোনে ফেসবুক ওপেন করে স্ক্রল করতে লাগলো।
মিনিট কয়েকের মধ্যেই কারোর পায়ের আওয়াজ পেয়ে উপরে তাকাতেই অপূর্ব এসে দুম করে সিয়ার কোলের মধ্যে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লো।
সিয়া বিচলিত হলো না। সেদিন তার এই সম্পর্কের প্রতি এক ধাপ বাড়ানোর পর অপূর্ব নিজে থেকেই এখন এই সম্পর্কে অনেক সরল হয়ে এসেছে। বন্ধুত্বের দিক থেকে একটু একটু করে সম্পর্কটা স্বামী স্ত্রীর দিকে এগোচ্ছে। এতে দুজনেই সমান এফোর্ট আছে, এবং তারা নিজেরাও ভীষন খুশি।

সিয়া অপূর্বের মাথায় বিলি কেটতে কাটতে বললো “ফ্রেশ হবে না..? আর আজ এতো দেরি হলো যে…?”

অপূর্ব ক্লান্ত গলায় বললো “উম একটু পরে। আর আজ অনেক পেসেন্ট ছিলো। তাও তো অনেক পেসেন্টকে কালকের ডেট দেওয়া হয়েছে।”

সিয়া অপূর্বের ক্লান্ত গলা শুনে বললো ” চা বা কফি কিছু খাবে..?”

অপূর্ব মৃদু গলায় বললো ” হম কফি।”

সিয়া সেটা শুনে উঠতে গেলে অপূর্ব ধরে বলে ” আরেকটু বিলি কেটে দাও।”

সিয়া মুচকি হেসে বসে আবার বিলি কেটে দিতে থাকে। প্রায় আধ ঘণ্টার কাছাকাছি হয়ে এলে সিয়া অপূর্বকে আলতো স্বরে ডাক দেয়। অপূর্বের ঘন ঘন শ্বাস দেখে সিয়া বুঝে নেয় সে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু তার তো এখানে বসে থাকলে চলবে না রাতের রান্না করতে হবে। সে যেচে সায়মা বেগমের থেকে রাতের রান্নার দায়িত্ব নিয়েছে।

সিয়া এবার অপূর্বের মাথাটা আসতে করে বালিশে রাখতে গেলেই অপূর্ব জেগে যায়। সিয়া তা দেখে অপরাধী গলায় বলে ” ইস জাগিয়ে দিলাম..? সরি সরি আমি বুঝিনি.. আসলে রাতের রান্না বাকি ছিল তাই…”

অপূর্ব সিয়াকে মাঝেই থামিয়ে দিয়ে বললো ” রিলাক্স সিয়া, ভালো করেছো উঠিয়ে আমি ফ্রেশ হতেও ভুলে গিয়েছিলাম দেখো। যাও তুমি নীচে যাও আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

সিয়া নীচে কিচেনে গিয়ে রান্না চাপলো রাতের। অল্প অল্প সব সবজি পাতি কাটলো। এরই মধ্যে অপূর্বও এলো কিচেনে। সিয়াকে দেখে মুচকি একটা হাসি দিতেই সিয়াও বিনিময়ে একটা মুচকি হাসি ফিরিয়ে দিল।

অপূর্ব এবার নিজেই কফির কাপ বের করে জল গরম বসলো। তা দেখে সিয়া হকচকিয়ে বললো ” একি একি তুমি কেনো করছো..? ইস দেখেছো তোমার কফির কথা একদম ভুলে গেছি তুমি সর আমি করে দিচ্ছি।”

অপূর্ব হেসে গরম জলটা নামতে নামতে বললো ” তাতে কি হয়েছে সিয়া..? সংসার যখন দুজনের তখন দুজনকেই তো সমান ভাবে হাত লাগাতে হবে। শুধু কি আমি একাই কাজ করে এসেছি নাকি..? তুমি যে ঘন্টার পর ঘন্টা অফিসে কাজ করে এসেছো তার বেলা..? আর আমি এতটাও অকৃতজ্ঞ নই যে নিজের কাজটা শুধু বড়ো করে দেখে ঘরে ফিরে তোমায় কাজ করতে দেখে পায়ের উপর পা তুলে বসে কফি খাবো আর তুমি ওই ক্লান্ত শরীর নিয়ে সব কাজ করবে। আজ থেকে যখনই এইভাবে তোমার হাতে সংসারের দায়িত্ত্ব আসবে তুমি সবসময় আমায় এইভাবেই পাশে পাবে।”

সিয়া একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মানুষটার দিকে। সে আসলেই এতটা ভাগ্যবতী..? মনের ভিতর থেকে উত্তর এলো অবশ্যই নইলে কি আর এইরকম একটা স্বামী শশুর শাশুড়ী আর বোনের মত ননদ পায় সে.? সিয়ার কেমন আলাদা সুখ সুখ অনুভূতি হলো প্রায় “অনেক অনেক” দিন বাদ।

_____________________________________

আজ সাড়ে সাতটা বেজে যাওয়ায় পরও চন্দ্রা বাড়ি ফিরতে পারেনি ক্লাস থেকে। আগামীকাল তাদের একটা শো আছে তাই নিয়েই আজ বেশিক্ষণ প্র্যাকটিস হয়েছে অন্যান্য সব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সে আগেই সিয়ামকে জানিয়ে দিয়েছিল তার ফিরতে দেরী হবে সে ফ্রী হলে মেসেজ দেবে। আর কল না তুললে যেনো টেনশন না নেয় তার ফোন সাইলেন্ট থাকবে।

চন্দ্রা এবার ফোনটা হতে তুলতেই দেখলো তার বাবা চয়ন সাহেব তিন বার কল করেছেন। চন্দ্রা সিয়ামকে তাড়াতাড়ি মেসেজ করে দিয়েই চয়ন সাহেবকে ফোন লাগালো।
চয়ন সাহেব ফোন রিসিভ করে হাসি মুখে ইন্দ্রার বিষয়টা বললেন।

চন্দ্রা সব শুনে স্তব্ধ হয়ে রইলো সে তো এইসবের চাপে তার দিভাইয়ের ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছিলো। না না আর দেরী করা যাবে না অঘটন ঘটার আগেই তাকে আটকাতে হবে। ওইরকম একটা ছেলের হাতে চন্দ্রা কিছুতেই নিজের দিদিকে আর তুলে দিতে পারবেনা। আপাতত নিজেকে সামলে বললো ” কই দিভাই আমায় কিছু জানালো না তো..? আর দাঁড়ায় আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই বাড়িতে আসছি।”
চয়ন সাহেব সেটা শুনে বললেন ” ও হয়তো লজ্জায় বলতে পারেনি। কেনো তুই খুশি হোসনি..? আমি তো ভাবলাম তুই সবথেকে বেশি খুশি হবি একই বাড়িতে নিজের দিদিকে পেয়ে।”

চন্দ্রা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলল ” তেমন কিছু না বাবা। আমি একটু দিভাইয়ের সাথে কথা বলতে চাই, আসছি আমি।”

বলেই চন্দ্রা ফোন রেখে দ্রুত বেরোলো ওইবাড়ির উদ্দেশ্যে।
চন্দ্রা বাড়িতে ঢুকেই হরবড়িয়ে ইন্দ্রার রুমে ঢুকলো। ইন্দ্রা চমকে গিয়ে কান থেকে ফোনটা নামিয়ে বললো ” ও তুই..? আয় আয় এভাবে আচমকা কেউ আসে..? ভয় পাবো না..?”

চন্দ্রা ইন্দ্রার হাতের ফোনের দিকে একপলক তাকিয়ে বললো “কিছু ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে তোর সাথে আমার।”

ইন্দ্রা অবাক হলো কিছুটা তারপর ফোনটা কানে তুলে বললো ” পরে ফোন করছি চন্দ্রা এসেছে, হুম ।” বলেই ফোনটা রেখে দিতেই চন্দ্রা এসে ওর উপর একপ্রকার ঝাঁপিয়ে পড়েই জিজ্ঞেস করলো ” হ্যাঁরে সিরাজের ব্যাপারে তুই সব জেনে এই সম্পর্কটাতে রাজি হয়েছিস তো…?”

ইন্দ্রা অবাক হয়ে বললো “সব জেনে মানে…? কিছু হয়েছে কি যা আমি জানি না..?”

চন্দ্রা এবার দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে ইন্দ্রাকে সবটা খুলে বললো। চন্দ্রার সাথে প্রথম দেখা, প্রেমে পড়া, তারপর বিশ্বাসঘাতকতা, জ্বেলে যাওয়া সবটা।

ইন্দ্রা কিছুটা জানতো সে সিরাজ আগে কেমন ছিল কিন্তু পুরোপুরি না। চন্দ্রার মুখ থেকে সব শুনে ইন্দ্রা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল “ও তো এখন ভালো হয়ে গেছে তাই না..? পাস্ট তো আমারও আছে..”

চন্দ্রা চেঁচিয়ে উঠলো “পাস্ট..? তুই জানিস সিয়ার বিয়ের দিন বিদায়ের পর সিরাজ অজানা অচেনা একটা মেয়েকে নিয়ে গিয়ে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। আবার দেখলাম অনেকগুলো টাকাও দিয়েছে তাকে। সর মানে বুঝতে পারছিস তুই..?”

ইন্দ্রাকে সিরাজ এই ব্যাপারে কিছুটা বলেছিলো যে মেয়েটার সাথে নাকি ওর আগে রিলেশন ছিলো তাই সেদিন তাকে কিছু ছবি দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা নিয়েছিল। ইন্দ্রা সেটাই বললো চন্দ্রাকে।

চন্দ্রা একটু চুপ হলেও দমলো না আবার বললো “দেখেছিস তো ওর পাপ ওকে বর্তমানেও শান্তি দিচ্ছে না। তুই এইরকমই একজনের কাছ থেকে বেরিয়ে এসেছিস দিভাই আবার একই ভুল করিস না।”

ইন্দ্রা কাঁদতে কাঁদতে বললো ” কিন্তু…”
কথা শেষ করার আগেই চয়ন সাহেব দরজার বাইরে থেকে ভিতরে আসতে আসতে বললো “কোনো কিন্তু না ইন্দ্রা।”

বাবার গলা শুনে দুই মেয়েই বেশ চমকে তাকালো। তারমানে চয়ন সাহেব সব শুনেছেন..?

ইন্দ্রা বাবার কাছে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো ” আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি বাবা। আর ও তো ভালো হয়ে গেছে বলো।”

চয়ন সাহেব এবার বললেন “আমি তোমার খুশির জন্যই এই সম্পর্কে রাজী হয়ে ছিলাম ইন্দ্রা। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তুমি আবার ভুল মানুষকে বেছে নিচ্ছ আর আমি বাবা হয়ে সেটা কখনোই চাইবো না। আমি চাই তোমার যখন ভিসা এসে গেছে তুমি ইউ এস এ গিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করো। যাতে পরবর্তীতে পূর্বের ঘটনার সম্মুখীন হতে না হয়। ততোদিন সিরাজ যদি পারে অপেক্ষা করুক আর যদি অপেক্ষা না করতে পারে তাহলে ভাববে সে তোমার ছিলোই না কোনোদিন। আগের মতো একই ভুল আবার করো না ইন্দ্রা। আমি কাল পরশুরই ফ্লাইটের টিকিট ম্যানেজ করছি তুমি রেডি থেকো। ”

ইন্দ্রা কান্নারত অবস্থায় বলে ” ঠিক আছে বাবা তুমি যা বলবে আমি তাই করবো। কিন্তু যাওযার আগে কি একটিবার আমি সিরাজের সাথে কথা বলতে পারি..?”

চয়ন সাহেব বললেন “এটা শুধু সিরাজের না তোমারও ধৈর্য্যের পরীক্ষা মা। আজ এখন থেকেই তোমার ওর সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ। যা বলার ওকে আমি বলে দেবো। তুমি ফিরে এসো ততদিনও যদি তোমাদের দুজনের সিদ্ধান্ত একই থাকে তাহলে আমরা কেউই আপত্তি করবো না।”

ইন্দ্রা আবার মুখ চেপে কেঁদে ঘাড় হেলালো।

#চলবে..?

বেড়াজাল পর্ব-৩৬+৩৭

0

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #৩৬

সিয়ামের ফোন করার একঘন্টার ভিতর ভিতরই সব পৌঁছে গেলো সেই ঠিকানায়। সিরাজ বাড়িটির সামনে পৌঁছাতেই গার্ড গেট খুলে দেয়। সিরাজদের গাড়ি ভিতরে প্রবেশ করার পর সিরাজ সিয়ামকে ফোন দেয়। সিয়াম বলে বাড়ির ভিতরে চলে আসতে।

সিরাজ, ইন্দ্রা, সিয়া আর অপূর্ব সবাই বেশ কৌতুহলী হয়েই ভিতরে প্রবেশ করলো। তারা তখনও বুঝতে পরেনি ভিতরে তাদের জন্য কি চমক অপেক্ষা করছে।

চারজনেই ভিতরে ঢুকে দেখলো সিয়াম সোফায় পায়ের উপর পা তুলে কীসব পেপার্স দেখছে। আর উল্টোদিকেই সুইটি বেগম একটি মেয়েকে কিসব বোঝাচ্ছেন। তাদের মাথার কাছেই দুটো গার্ড দাঁড়িয়ে।

সিরাজ অবাক হয়ে ডাকলো ” ভাইয়া ”
সিয়াম পেপার্স গুলো রেখে উঠে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত গুঁজে বললো ” আয়..এদিকে সবাই।”

সিয়ামকে এই দাঁড়ানো অবস্হায় দেখে সিরাজ, অপূর্ব আর ইন্দ্রা তেমন চমকালো বলে মনে হলো না। কিন্তু সিয়া বেশ চমকালো। কৌতূহল না চাপতে পেরে জিজ্ঞেস করে বসলো ” ভাইয়া তুমি ঠিক কবে হলে…? আগে বলনি তো..?

সিয়াম গম্ভীর মুখ করে বললো ” সবটা বলবো একটু ওয়েট কর।”
সিয়া সুইটি বেগমকে দেখে আবার বলে উঠলো ” আর মা এখানে এখানে কি করছে সাথের মেয়েটা কে..?”

সিয়াম পকেটে হাত গুঁজেই সুইটি বেগমের কাছে গিয়ে বলল ” তা আমার সুইট মনি.. তুমি বলবে নাকি আমি বলবো পাশের মেয়েটা কে হয় তোমার..? থাক তোমায় আর কষ্ট করে বলতে হবে না। সিনথিয়া তোমার পাশে বসে থাকা মহিলাটি তোমার কে হন..?”

সিনথিয়া এতোক্ষণ অবাক হয়ে সবাইকে দেখছিলো। সিয়ামের কোথায় হুঁশ ফিরলে অস্ফুট স্বরে বলে ” মম ”

এই কথা শুনে সামনের দাঁড়িয়ে থাকা চারজনই চমকে উঠলো।
সিরাজ সম্পত্তির ব্যপারে সবটা জানতো, আর জানতো সুইটি বেগম সিয়ামের বাবা মাকে মেরে ফেলার প্ল্যান করছে। তারপর থেকেই সিরাজ কম কথা বলতো সুইটি বেগমের সাথে। কিন্তু তারা মরে যাওযার পর সুইটি বেগম সিরাজকে ডেকে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন তিনি কিছুই করেননি এইসব যা হয়েছে সব অ্যাক্সিডেন্টে হয়েছে। সিরাজ সরল মনে সবটাই বিশ্বাস করেছিল। ব্যাস এইটুকুই সে জানে। তার মম এর যে আরো একটা মেয়ে আছে সেটা তো সুইটি বেগম তাকে বলেনি।

সিরাজ অবাক হয়ে বললো ” কি বলছিস ভাইয়া..? মম এর মেয়ে মানে আমাদের আপন বোন হয় এই মেয়েটা..? কই আমরা কেউ তো কিছু জানি না।”

সিয়াম এবার বাঁকা হেসে সুইটি বেগমের দিকে তাকালো। তিনি দরদর করে ঘামছেন। এই জন্য নয় যে তার সম্মতি হাতছাড়া হবে, এই জন্য যে তার আদরের ছেলে আর প্রাণের টুকরো মেয়েটা সব জেনে তাকে ঘৃণা করবে। এতো বছর পর আজ হঠাৎ তার এমন অনুভুতি হচ্ছে কেনো তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি কাজ গুলো করার সময় তো ছেলেমেয়েগুলোর কথা ভাবেনি। তাহলে এখন কেনো ভাবছে…?

সিয়াম এবার সবার দিকে একবার তাকালো। তারপর সিনথিয়ার কাছে গিয়ে বলল ” তুমি আমার জায়গাটায় বসো। আর এখন আমি যা যা বলবো ওদের সাথে তুমিও মন দিয়ে পুরোটা শুনবে। মাঝে একটাও কথা বলবে না।”
কথা শেষ করতেই সিনথিয়া ধীরে ধীরে উঠে সিয়াম যে সোফায় বসে ছিলো সেই সোফায় বসলো।

সিয়াম এবার বলা শুরু করলো সব। ঘটনার সূত্রপাত করলো তার মা আর সুইটি বেগমের বিয়ের আগে থেকেই। তারপর তার আর তার মা বাবার জীবন ঘটিত যা জড়িয়ে ছিলো সব কিছুর খোলসা করলো। এমনকি সুইটি বেগমের সাংসারিক সব কুকীর্তির প্রমাণ দেখলো সবাইকে, বিশেষ করে সিনথিয়াকে। সিনথিয়া সমেত সবাই অবাক নয়নে শুধু সিয়ামের কথা শুনেই গেলো কারোর মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোলো না।

সেখানে উপস্থিত সবাই জানে সুইটি বেগম লোভী ও অহংকারী মানুষ। কিন্তু এই লোভের জন্য যে সে দুটো মানুষকে পর্যন্ত খুন করতে পারে তাও যারা তাকে অসময়ে ঠাঁই দিয়েছিল এইসব সবার ধারণার বাইরে ছিল।

সিয়াম ধীরে ধীরে এটাও বললো সিয়া আগের পক্ষের আর সিরাজ সিনথিয়া এই পক্ষের সন্তান। সিয়ামের আবার সম্মত্তি ফেরানোর প্রচেষ্টা এতো বছর অভিনয় করে থাকা সবটাই বললো সে।

একের পর এক চমক যেনো সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। সিনথিয়া অবাক চোখে সুইটি বেগমের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো ” মম তুমি কি এগুলো সত্যিই করেছ..?”

সুইটি বেগম আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। রাগে ক্ষোভে চেঁচিয়ে উঠলেন ” হ্যাঁ হ্যাঁ আমি করেছি সব আমি করেছি। আমিই আমার আপন বোন আর দুলাভাইকে মেরেছি। আমি আমার স্বামীকে ঠকিয়ে আরেকটা বিয়ে করেছি। আমিই সম্পত্তির লোভে চন্দ্রাকে মারতে চেয়েছি। তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছি সিয়ামের থেকে। ভেবেছিলাম লুকিয়ে বিয়ে দিলে মেয়েটা পরের দিনই ঝামেলা করে বাড়ি চলে যাবে। কিন্তু গেলো না দিন দিন আমার বিরূদ্ধে চলে গেলো। তাই আমি তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে….. ”

” ব্যা-স-স ” সিয়াম গর্জে উঠলো। সবাই মোটামুটি সিয়ামের গর্জন শুনে থতমত খেলো। কারন সিয়ামকে কোনোদিনই তারা এই প্রকার রেগে যেতে দেখেনি। সিয়াম তাদের কাছে বরাবরই একটা শান্ত, কম কথা বলা, মিষ্টভাষী মানুষ তার এই রূপ দেখলে যে কারোর অবাক হওয়ারই কথা।

সিয়াম ওই রাগী ভারী কণ্ঠেই বললো ” প্লিজ থামো মনি। এতটা নীচে নামতে তোমার বুক কাঁপলো না..? ওই নিষ্পাপ ফুলের মতো মেয়েটা কি দোষ করেছিল তোমার..? তোমার আমার সাথে শত্রুতা ছিলো তো আমার ক্ষতি করতে এইসবে ওকে জড়ানোর কি দরকার ছিলো..? এইসবের শাস্তি তুমি পাবে মনি সবের। ইরফান কল দ্যা পুলিশ ”

সুইটি বেগম এবার সবার দিকে তাকিয়ে চোখের কোনের পানি মুছে বললেন ” দাঁড়াও সিয়াম। খেলা এখনও শেষ হয়নি। চন্দ্রা কিন্তু এখনও আমার কাছে আছে।”

এবার সিনথিয়া এগিয়ে এসে সুইটি বেগমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কান্নারত অবস্থায় বলল ” তুমি এতটা খারাপ মম..? এতটা..? আর আমি কিনা তোমায় ওয়ার্ল্ড বেস্ট মম ভাবতাম। ভাবতাম আর যে যাই করুক আমার মম কোনোদিন খারাপ কাজ করতে পরে না। আর তুমিই সেই এতটা জঘন্য কাজটা করলে..? আমার কাছে তো পুরো পৃথিবীটাই মিথ্যে হয়ে গেলো মম আমার আর এই পৃথিবীতে কেউ রইলো না। ” বলেই সিনথিয়া মুখ চেপে কেঁদে দিলো।

সিরাজও এবার শক্ত গলায় বললো ” ছিঃ মম ছিঃ! তুমি এতটা জঘন্য কাজ করতে পারলে..? আমি জানতাম তুমি লোভী কিন্তু এখন খুনিও..? আমি আর নিতে পারছি না ভাইয়া তুমি এই মহিলাকে চোখের সামনে দিয়ে সরাও নইলে আমিই রেগে কিছু করে ফেলবো।”

সুইটি বেগম এবার মুখ খুললেন ” বাহ্ ! যাদের জন্য করি চুরি তারাই বলে চোর..? এতো ছলনা নিজেকে অপরাধী করা কার জন্যে..? তোদের জন্যই তো..? নইলে এতো সম্পত্তি আমি কি করবো বল..?”

সিয়া পাশ থেকে ক্ষিপ্ত মেজাজে বললো ” প্লিজ মম। নিজের পাপের ভাগীদার সবাইকে কোরো না। আর যাদের জন্য করলে মানে কি..? কেউ কি তোমায় কসম দিয়েছিল এইসব করার জন্য..?”

সিরাজ আবার বলে ” কারোর জন্য নয় মম। তুমি শুধু নিজের কথা ভাবো আর নিজের জন্যে এইসব করেছো। প্রতিশোধের আগুনে তুমি দুটো প্রাণ কেড়ে নিলে। কীকরে পারলে..? একবারও ভাবলে না তোমার এই পাপের আঁচ আমাদের গায়েও লাগবে..?”

সুইটি বেগম হতাশ হয়ে চেয়ে থাকলেন ছেলে মেয়ের দিকে। তিনি সত্যিই কি ভাবেননি ছেলে মেয়েদের কথা..? শুধু নিজের কথাই ভেবেছেন সারাক্ষণ..? নাহ্ এখন এইসব ভাবলে চলবে না। নিজেকে নিয়ে যখন সে ভাবেই তখন সবার কথা শুনে কাজ নেই। আগে নিজে বাঁচুক তারপর ছেলেমেয়েদের বোঝানো যাবে।

সুইটি বেগম এবার হেসে বললেন ” বেশ মানলাম আমি সার্থপর। আমিই খারাপ, তাহলে আরেকটু খারাপ হই কি বলো সব..? আচ্ছা সিয়াম তোমার চন্দ্রা কোথায়..?”

সিয়াম আসেপাশে সবাইকে একবার দেখে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়ালো।

সিনথিয়া চেঁচিয়ে উঠলো ” মম আর কতো নীচে নামবে তুমি..? চন্দ্রা আপু কই..? তুমি কোনো ক্ষতি করনি তো তার..?”

সিরাজ সিয়া দুজনেই উত্তেজিত হয়ে বললো ” সত্যি তো ভাবী কই..? আশা থেকে তো দেখলাম না। মম সত্যি বল ভাবী কোথায়..?”

ইন্দ্রা এতক্ষণে কাঁদা শুরু করে দিয়েছে চন্দ্রাকে না দেখতে পেয়ে।

সুইটি বেগম কারোর কথায় পাত্তা না দিয়ে এবার সিয়ামের সামনে গিয়ে বললেন ” তা সিয়াম তোমার প্রাণপ্রিয় বউকে চাই নাকি এই পুরো সম্মতির মালিকানা..? ভেবে বলবে আমার একটা কলে কিন্তু তার প্রাণ নিয়ে টানাটানি পরে যাবে। এতগুলো পাপ করেই ফেলেছি যখন আরেকটা নয় করেই জেলে গেলাম।”

সবাই এবার বেশ ভয় পেল। শুধু ভাবভঙ্গি পাল্টানো না সিয়ামের মুখের সে আগের মতই স্বাভাবিক থেকেই বললো ” চন্দ্রর সামনে এই সম্পত্তি এক কানাও মূল্য আমার কাছে নেই সেটা এখানে উপস্থিত প্রায় সবাই জানে। তবে হ্যাঁ আমার বাবা মায়ের এতো কষ্টের অর্জন করা জিনিস আমি তোমার মতো একজন খুনির হাতে নীরবে তুলে দিলে তারা আমায় কোনোদিনও ক্ষমা করতেন না। আর রইল চন্দ্রার কথা..? এই পিয়াস ভিতরে আয়।”

পিয়াস ভিতরে আসতেই সুইটি বেগমের মাথায় যেনো এবার বাজ পড়লো। তার শেষ দান তাও যে এভাবে মাঠে মারা যাবে তা তিনি কল্পনাও করেননি।

পিয়াস চন্দ্রার একহাত ধরে ভিতরে নিয়ে আসছে। চন্দ্রার মাথায় হাতে ব্যান্ডেজ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে সে সামনের দিকে আসছে। চন্দ্রাকে এভাবে দেখে ইন্দ্রা আর সিয়া দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরলো।

সিয়াম বাঁকা হেসে সুইটি বেগমকে বললো ” আরেহ মনি..? চমকে গেলে নাকি..? এতোটা আশা করনি তাইনা..? তোমারও বোঝা উচিত ছিল আমি আর সেই ছোটো সিয়াম নেই যে কিনা তার মনির অন্ধ ভক্ত ছিলো, যার এককথায় সিয়াম নিজের প্রাণ দিতেও প্রস্তুত ছিলো। তোমায় মায়ের আসনে বসিয়েছিলাম মনি তবে আমি ভুলে গিয়েছিলাম কাক ময়ূরের পালক লাগলেও ময়ূর হতে পরে না।”

সুইটি বেগম আবার চেঁচিয়ে উঠলেন ” সিয়াম..!! কথা সংযত করো।”
পিয়াস সুইটি বেগমকে এভাবে চেঁচাতে দেখে গার্ড দের ইশারা করতেই তারা মিনিট কয়েক মধ্যেই পুলিশ নিয়ে এলো।

সুইটি বেগম এতক্ষণে বোধহয় উপলব্ধি করলেন সব পাওয়ার আশায় তার কাছে আর কিচ্ছু নেই। সে নিঃস্ব, না আছে তার কাছে পয়সা এর না আপনজন। তিনি সেখানেই দাঁড়িয়ে হুহু করে কেঁদে দিলেন।
সিয়ামের ইশারায় পুলিশ সব পেপার্স দেখে সুইটি বেগমকে অ্যারেস্ট করলেন।

সিনথিয়া এই দৃশ্য সহ্য না করতে পেরে জ্ঞান হারালো। পিয়াস সামনে থাকায় সিনথিয়াকে ধরে ফেললো। সবাই জল নিয়ে এসে সিনথিয়ার মুখে ছিটাতে লাগলো। সবার মনের মধ্যেই এখন যেনো এক নীরব ঝড় চলছে কিন্তু কেউই তা প্রকাশ করতে রাজি নয়। সবাই স্বাভাবিক যেনো কিছুই হয়নি একটু আগে।

#চলবে..?

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #৩৭

সেই ঘটনার দুই দিন পেরিয়ে গেছে। যে যার মতো কর্মস্থলে ফিরে গেছে আগের মতোই। সিয়া সিরাজ কষ্ট পেলেও সামলে নিয়েছে নিজেদের। শুধু ব্যতিক্রম সিনথিয়ার, সে মানসিক ভাবে ভীষণ ভেঙে পড়েছে। সেই দিনের পর তাকে সিয়াম নিজের বাড়িতে এনেই রেখেছে আর সিরাজ সিয়ার আর নিজের বোন বলে পরিচয় দিয়েছে সিনথিয়াকে।
সিয়া সিরাজও বেশ সুন্দর ভাবেই আপন করে নিয়েছে সিনথিয়াকে। সিয়া দুইদিন এই বাড়িতেই থেকে গেছে সিনথিয়ার জন্য, ইন্দ্রা বাড়ি ফিরে গেছে তার।

ফোনটা দুই মিনিটে তিন বারের উপর বাজায় বিরক্ত হয়ে সিয়া ফোনটা আবার সাইলেন্ট করে দিলো।

সে সিনথিয়ার সাথে কথা বলছিলো আর তাকে সব মজার মজার জিনিস বলছিলো যাতে মেয়েটার মন ভালো হয়। কিন্তু সিয়া এই বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকে অপূর্ব যে মুখ বেজার করে ওই বাড়িতে গেলো। যাওযার পর থেকেই মিনিটে মিনিটে ফোন মেসেজ করে জিজ্ঞেস করছে কখন সে ফিরবে..? পারলে সিনথিয়াকে নিয়েই যেনো তার বাড়ি চলে আসে। এক এক করে তার বোন মা সবাইকে দিয়েই ফোন করিয়ে এক কথা বলেছে সে।

সিয়া এবার ফোনটা রেখে সিনথিয়াকে আবার গল্প বলার জন্য রেডি হতেই, সিনথিয়া মুচকি হেসে বলল “অপূর্ব ভাইয়া তোমাকে খুব ভালবাসে তাইনা আপুই..?”

সিনথিয়ার এমন প্রশ্নে সিয়া কিছুটা থমকাল। তারপর হেসে কথাটা ঘুরিয়ে বললো ” আর বলিসনা পাগল লোক একটা। সারাদিন যে কতবার ফোন করলো এই নিয়ে তার হিসাব নেই, প্রত্যেকবার এক একটা বাহানা। সিয়া এই খুঁজে পাচ্ছি না, সিয়া ওইটা কই রেখেছ..? অথচ সব ঘুছিয়ে রেখে এসেছি আমি।”

সিনথিয়া হাসলো, সিয়া তা দেখে খুশি হলো, যাক মেয়েটাকে সে সরল করতে পেরেছে কিছুটা।

হটাৎই সিনথিয়া আচমকা সিয়াকে জিজ্ঞেস করলো “আচ্ছা ওই যে ছেলেটা সিয়াম ভাইয়ার সাথে ছিলো সেটা কে..?”

সিয়া একটু অবাক হলেও তার রেশ চেপে বললো “ওহ ওইটা তো সিয়াম ভাইয়ার বন্ধু পিয়াস ভাইয়া, বিজনেস পার্টনারও বলতে পারো। আমি সিরাজ, সিয়াম ভাইয়া, পিয়াস ভাইয়া সব একসাথেই বড়ো হয়েছি। পিয়াস ভাইয়া খুব ভালো সিয়াম ভাইয়া যখন বাইরে কোথাও যায় পিয়াস ভাইয়াই আমাদের দেখভাল করে সব দরকারি জিনিসপত্র থেকে শুরু করে ছোটো ছোটো জিনিসও পিয়াস ভাইয়া আমাদের এনে দেয়।”

সিনথিয়া সব শুনে শুধু বললো ” ও ”
সিয়া এবার একবার সিনথিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো “বসো তুমি আমি তোমার রাতের খাবারটা নিয়ে আসি।” বলে সিয়া রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

_______________________________

এই দুইদিন সব ঠিকঠাক থাকলেও চন্দ্রার জীবনে যেনো বেশ বড়সড় ঝড় চলছে। সেই দিন সেই ঘটনার পর থেকে সিয়াম তার সাথে কথা বলা পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে। যদিও নীরবে চন্দ্রার সব খেয়ালই রাখছে। চন্দ্রা অনেক চেষ্টা করেও সিয়ামের সাথে কথা বলতে পারেনি। এই কারণে সে বেশ কষ্টে আছে।
এই মানুষটা তার সবচেয়ে বড় বেস্ট ফ্রেন্ড যার সাথে কোনো কথা শেয়ার না করলে চন্দ্রার রাতে ঠিকঠাক ঘুম হয় না। অথচ দুইদিন ধরে এক বিছনায় শুয়েও সিয়াম ওর থেকে দূরে দূরে থেকেছে।
চন্দ্রা এর কারণটা পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও কিছুটা পেরেছে। সেই দিন তার সত্যিই নিজেকে মারপিটের ঝামেলায় জড়ানো উচিৎ হয়নি, সত্যিই সেদিন যা খুশি হতে পারত।

এসব ভাবনার মাঝেই চন্দ্রা ডোর বেলের আওয়াজ শুনতে পেলো। খুশি হয়ে নিজের শাড়িটা ঠিক করে দৌড় দিল দরজার দিকে। সে আজ একটা সুন্দর সাদার উপর শাড়ি পড়েছে, শাড়িটা বেশ পাতলা অনলাইন থেকে নেওয়া তার আজই এটা। ন্যাচারাল মেকআপে বোঝার উপায় নেই সে মেকআপ করেছে কিনা।

চন্দ্রা হাসি মুখে দরজা খুলতেই সিয়ামকে সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলো। এখন সে আর হুইলচেয়ার ব্যাবহার করে না।
সিয়াম চন্দ্রাকে এভাবে দেখে মাথা থেকে পা পর্যবেক্ষণ করে ভ্রু কুঁচকে চন্দ্রার পাশ দিয়ে ঘরের ভিতর চলে গেলো।

চন্দ্রা বেশ হতাশ হলো। সে ভেবেছিল সিয়ামের রাগটা একটু হয়তো পড়বে তাকে এভাবে দেখে কিছুতো অন্তত মন্তব্য করবে কিন্তু সিয়াম তার একটাও করলো না।

অগত্যা চন্দ্রা চুপচাপ দরজাটা বন্ধ করে গুটি গুটি পায়ে সিয়ামের রুমে ঢুকে দেখলো সিয়াম ফ্রেশ হতে ঢুকছে। চন্দ্রা তা দেখে ঝটপট বললো ” আমি তোমার খাওয়ারটা ঘরে নিয়ে আসছি।”
সিয়াম ভারী কণ্ঠেই বললো ” দরকার নেই, আমি ডাইনিং টেবিলেই খাবো।”
চন্দ্রা এবার কিছু না বলেই চলে গেল খাবার বাড়তে। সিয়ামের এভাবে তার সাথে কথা বলাটা সে নিতে পড়ছে না মোটেই। সিয়াম কোনোদিনই তার সাথে এভাবে ভারী কণ্ঠে কথা বলেনি। কিন্তু এই তিনদিন ধরে বলছে আর এটা ভেবেই চন্দ্রার বুক ভার হয়ে আসছে।

চন্দ্রা খাবার সাজিয়ে দিতেই সিয়াম এসে বসলো টেবিলে। চন্দ্রা এবার আড়চোখে তাকালো লোকটাকে তার একটু বেশি সুন্দর লাগে সবার থেকে। এই সে এলোমেলো চুল খানিকটা কপালে পরে, ঘরের সাধারণ পেলো টিশার্ট আর ট্রাউজার এতেই যেনো তাকে কি সুদর্শন ঠেকছে চন্দ্রার চোখে। কিন্তু তার থেকেও আরও বেশি সুদর্শন পুরুষ আছে এই পৃথিবীতে কিন্তু চন্দ্রার শুধু তাকেই কেনো এতো ভালো লাগে..? ভালোবসে বলেই কি..?

চন্দ্রা এবার সিয়ামের সামনের চেয়ারটাতে বসলো। সিয়াম একটা খাবারের প্লেটে খাবার তুলে চন্দ্রার সামনে রাখলো। চন্দ্রা খাওয়া শুরু করলো। ঘটনার দিন সে সিয়ামকে খাইয়ে দিতে বলায় প্রথম বার সিয়ামের থেকে খাওয়া নিয়ে ধমক শুনেছিল সেইদিন, তাই এই দুই দিন খাওয়া নিয়ে আর জেদ করেনি সে।

খেতে খেতে চন্দ্রা সিয়ামের দিকে তাকাতেই তার চোখা চোখি হয়ে গেলো, চন্দ্রা দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো। তার বুঝতে বাকি নেই সিয়াম তাকে হাত দিয়ে না স্পর্শ করলেও চোখ দিয়ে তার প্রতিটা অঙ্গ স্পর্শ করে যাচ্ছে। চন্দ্রার এটা অনুভব করেই গা শিরশিরিয়ে উঠলো। সে শাড়ির আঁচলটা বুকের কাছে আরএকটু টেনে নিল। কিন্তু পাতলা শাড়ি আর ডিপ নেক ব্লাউজে তেমন কিছু লাভ হলনা।

চন্দ্রার এইরকম শাড়ি পরার অভ্যাস নেই। আজ বাড়িতে কেউ নেই, সিরাজ অফিসিয়ালি কাজে বাইরে আর সিয়া অপূর্বের জোড়াজুড়িতে তাড়াতাড়ি ডিনার সেরেই সিনথিয়াকে নিয়ে বেড়িয়ে গেছে তার শশুর বাড়ি।সিয়ামকে রাগ ভাঙ্গানোর ভালো সুযোগ ভেবেই সে এই শাড়িটা পড়ে সুন্দর করে সেজেছে। কিন্তু এইরকম অসস্তিতে পড়বে জানলে সে অন্য কিছু পড়তো।
এতো জড়তা তার থাকতো না যদি সিয়াম তার সাথে কথায় সহজ হতো। কিন্তু এই এড়িয়ে চলা ব্যাপারটাই তার মধ্যেই আলাদা কষ্ট তৈরি করছে।

সিয়াম খেয়ে দেয়ে কিছু না বলে নিজের রুমে চলে গেল। চন্দ্রাও খেয়ে সব গুছিয়ে ঘরে গিয়ে দেখলো সিয়াম দাঁড়িয়ে একটা বই নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। চন্দ্রা এবার সব জড়তা কাটিয়ে সিধে গিয়ে সিয়ামকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।

সিয়াম বুঝতে পেরে চন্দ্রার হাত দুটো ছাড়িয়ে বইটা রেখে অন্যদিকে গিয়ে ঘরের সাথে অ্যাটাচ সোফায় বসে ল্যাপটপ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলো ।
চন্দ্রা এবার গিয়ে টেনে ল্যাপটপটা সরিয়ে টেবিলে সিয়ামের মুখোমুখি বসলো।

সিয়াম এবার বিরক্তি নিয়ে বললো “কি হচ্ছে কি চন্দ্র সামনে থেকে সর কাজ করতে দাও।”
চন্দ্রা এবার করুন মুখ করে বললো “কেন এইরকম করছো সিয়াম..? আমার যে আর ভালো লাগছে না এই এড়িয়ে যাওয়া। একই ছাদের নীচে থেকেও আমরা দুজন অপরিচিতদের মত থাকছি। কেন সিয়াম কেন এমন করছো..?”

সিয়াম এবার চোখ মুখ কঠিন করে চন্দ্রার চোখে চোখ রাখল। চন্দ্রা ভরকালো, এই দৃষ্টি তার অচেনা কারণ সে সিয়ামকে খুব একটা রেগে যেতে দেখেনি কখনও।

সিয়াম ওভাবেই চোখ মুখ শক্ত করে বললো “তুমি সত্যিই জানো না চন্দ্র আমি ঠিক কি জন্যে রেগে আছি..?”

চন্দ্রার দৃষ্টি এলোমেলো দেখে সিয়াম নিজেই পুনরায় বললো “সেই দিন তোমার সাথে কি কি হতে পারতো তুমি কল্পনা করতে পারছ চন্দ্র..? আমি যদি সেদিন ঠিক সময় ওখানে না পৌঁছাতাম তা-হ-লে…….আমার তো ভাবলেই বুকটা কেঁপে ওঠে এখনো। ওখানে গিয়ে তোমায় ওই অবস্থা দেখে সেদিন আমার কি অবস্থা হয়েছিল তুমি ধারণাতেও আনতে পারবে না চন্দ্র। তুমি ছাড়া যে আমি নিঃস্ব তুমি তা ভালো ভাবেই জানো তাই বারবার আমার বারণ করার সত্বেও নিজেকে এভাবে বিপদে জড়াও তাই না…? খুব ভালো লাগে আমায় এভাবে তরপাতে দেখে..?”

চন্দ্রা এতক্ষণ মুখ নীচু করে বসে ছিল এবার ছলছল চোখ নিয়ে মুখ তুলে সিয়ামের চোখের দিকে তাকালো। তারপর হাত বাড়িয়ে সিয়ামের হাতটা ধরতে যেতেই সিয়াম হাতটা সড়িয়ে নিলো।
চন্দ্রা তা দেখে ফুঁপিয়ে উঠে বললো “সরি সিয়াম আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যদি তুমি পেপার্স গুলো না পাও যদিও আমি তোমায় বলেছিলাম কোন কোন জায়গায় লুকোতে পারি, তাও আমার ভয় হচ্ছিল যদি তুমি সেগুলো পাওয়ার আগেই মনির হাতে পরে যায়। তাহলে তো আমাদের এতদিনের প্ল্যান তোমার এতদিনের কষ্ট সব ব্যর্থ যেত তাই আমি রিস্ক টা নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। আর তুমি তো সকালে আমার ব্রসলেটে ট্র্যাকিং ডিভাইস লাগিয়ে দিয়েছিলে তাই আরও…”

সিয়াম আগের মতোই রেগে বললো ” তাই আরও কি চন্দ্র..? তুমি নিজের লাইফ রিস্ক নিয়ে অতগুলো লোকের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গেলে..? একবারও আমার কথা ভাবলে না..? আমার উপর তোমার একটুও ভরসা নেই তাইনা..? হাহ্ জিজ্ঞেস করছি কি থাকলে আমার জন্য ওয়েট করতে সেখানে একা একা লড়াই করতে যেতে না। আমি ভীষণ হতাশ হয়েছি চন্দ্র তোমার এই কাজ দেখে। আমি আগেও বলেছিলাম তোমার থেকে গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে কোনো কিছুই না। কাজ না হলে না হতো, আমি ঠিক কোনো না কোনো ভাবে সামলে নিতাম পরে। আমার শত্রুর অভাব নেই চন্দ্র। এখন তো মনে হচ্ছে তোমায় আমার লাইফের সাথে জড়িয়ে সত্যিই ভুল করেছি।”

চন্দ্রা কান্নারত অবস্থায় বলল ” এরকম করে বলো না সিয়াম। তুমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তির মধ্যে একটা। তুমি যেমন তোমায় আমায় ছাড়া নিজেকে কল্পনা করতে পারো না তেমনি আমিও পারি না তোমায় ছাড়া নিজেকে কল্পনা করতে। আমার তখন মাথা কাজ করছিলো না তাই হুটহাট যা করার করে ফেলেছি। আমি সত্যিই বুঝিনি এইরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হবো। আমায় এইবারের মতো মাফ করো প্লিজ।” চন্দ্রা শেষ কথাটা সিয়ামের এক হাত নিজের দুই হাতের মধ্যে নিয়ে বললো।

সিয়াম হাতটা এবার আলতো করে ছাড়িয়ে বললো ” ইটস ওকে। ডিনারের পর যে ওষুধটা আছে ওইটা খেয়ে নাও। আমি শুতে গেলাম ঘুম পাচ্ছে আমার।” বলেই সিয়াম উঠে গিয়ে বেডের একপাশে শুয়ে পড়ল।

চন্দ্রা কিছুক্ষণ সিয়ামের দিকে তাকিয়ে চোখের জল মুছে ওষুধ না খেয়েই লাইট নিভিয়ে বেডের অন্য পাশে শুয়ে পড়লো। চোখের জল ঠোঁট কামড়ে চাপতে চাইলেও পরলো না বেশিক্ষণ মুখ চেপে হু হু করে কেঁদে দিল। এই একটা মানুষের এড়িয়ে চলা তার বুকে অদৃশ্য রক্তক্ষরণ ঘটায়।

প্রায় এক ঘণ্টার বেশি চন্দ্রাকে একইভাবে কাঁদতে দেখে সিয়াম দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লো। বেশি বলে ফেললো নাকি মেয়েটাকে..? এতদিন যে সে নিজেও ভীষণ কষ্টে ছিলো তার চন্দ্রের সাথে কথা না বলে। কিন্তু এই পাগল মেয়েকে সেই তার ভিতরের এই কষ্ট কি করে বোঝাবে..? সেই দিন চন্দ্রাকে ওই অবস্থায় দেখে যে তার কি অবস্থা হয়েছিল সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না।

অনেকক্ষণ কাঁদার দরুন চন্দ্রার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছিল। সিয়াম এবার আস্তে করে একটু এগিয়ে গিয়ে চন্দ্রার শাড়ির ফাঁক গলিয়ে তার উন্মুক্ত উদর টেনে তাকে নিজের দিকে নিয়ে আসলো। তারপর হাত দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে বললো “এইভাবে আর আমায় না বলে কোনো কাজ করবেনা চন্দ্র। আমি ভীষণ কষ্ট পাই।”
চন্দ্রা হিচকি তুলে বললো ” সত্যি ক্ষমা করেছো তো..? আর রাগ করে থাকবেনা বলো..?”
সিয়াম চন্দ্রার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো ” আমি রাগ করিনি চন্দ্র। আমি শুধু উপলব্ধি করতে চেয়েছিলাম তোমায় তোমার ভুল টা।”

সিয়াম এবার চন্দ্রার মাথায় ঠোঁট ছুঁয়ে বললো “শুয়ে পরো অনেক রাত হয়েছে। ”

চন্দ্রা এবার নিজেই একটু এগিয়ে এসে সিয়ামের ঘাড়ে মুখ গুঁজল। পিছনে টি-শার্ট খামচে ধরলো ওর। সিয়াম এবার হাঁস ফাঁস করতে লাগলো। চন্দ্রাকে পিছনে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললো ” এমন করো না চন্দ্র, এরপর আমি আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবো না, তোমার শরীর এখনো পুরোপুরি সুস্থ নয়। এমনিই যা মোহনীয় রূপ নিয়ে আমার সামনে এসেছো আমার পক্ষে খুব কষ্টকর নিজেকে আটকানো।”

চন্দ্রা সিয়ামের ঘাড়ে নাক ঘষতে ঘষতে ভাঙা গলায় বললো “কিচ্ছু হবে না, আমি একদম ঠিক আছি।”

এই আকুল আবেদন কি ফিরিয়ে দেওয়া যায়..? নাহ্ সিয়ামও পারলো না। জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে। নিজের মধ্যে শুষে নিতে লাগলো নিজের প্রিয় নারীটির শরীরের সেই মনমাতানো চিরচেনা ঘ্রাণ। চন্দ্রাও নিজেকে পুরোপুরি সিয়ামের হাতে ছেড়ে দিলো। দুই দিনের অপেক্ষা, মনোমালিন্য সব ধুয়ে মুছে গেলো প্রতিটি স্পর্শে।

#চলবে..?

বেড়াজাল পর্ব-৩৫

0

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #৩৫

চন্দ্রা পিট পিট করে চোখ খুললো। বুঝতে একটু দেরী হল তার বর্তমান অবস্থান। হাত পা নড়াতে না পেরে তড়াক করে উঠলো। তার পুরোপুরি হুঁশ আসতেই আসতে আসতে মনে পড়লো আগের কথা। তারমানে সুইটি বেগম সব বুঝে গেছেন…? যতদূর মনে হচ্ছে তিনিই তাকে কারণবশত এখানে নিয়ে আসতে পারেন এইভাবে। চন্দ্রার পেপার্স গুলো নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। সেগুলো ওই সোফার কভারের নীচেই রয়েছে এখনো। চন্দ্রা মনে মনে উপরওয়ালাকে ডাকলো যাতে ওই পেপার্স গুলো সুইটি বেগমের হাতে না পড়ে। কিন্তু তাকে আপাতত এখান থেকে বেরোনোর উপায় বের করতে হবে।

মুখও বাঁধা তার। চন্দ্রা চারিদিক খেয়াল করলো জায়গাটা কোনো একটা স্টোর রুমের ভিতর। তার মাথা এবার খালি খালি লাগছে। বেরোবে কি করে এখান থেকে সে এখন যদিও জানে সিয়াম তাকে খুঁজে নেবে তাও বেশি দেরী করা যাবে না তার নিজেকেই কিছু করতে হবে।

অনেক কষ্টে সে উঠে বসে পাশের দেওয়ালের কাছে গেলো ঘসরে ঘসরে, ঘরটা যে নতুন তৈরি তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে বিধায় রং প্লাস্টার কিছুই হয়নি। চন্দ্রা এবার কি মনে করে সেই দেওয়ালের বের হয়ে থাকা কোনের দিকে নিজেকে পিছন করে দড়িটা ঘষতে লাগলো দেওয়ালে। সময় লাগলো, হাতও বেশ খানিকটা ছিলে গেলো তবে দড়িটা কেটে গেলো। চন্দ্রা ঝটপট মুখ খুলে পায়ের দড়ি খুললো।
চারিদিক দেখলো সবই তো হলো এবার বেরোবে কীকরে এখান থেকে..? দরজা তো বাইরে থেকে বন্ধ।

চন্দ্রা এবার চোখ বুঝে আবার খুললো। এবারের যে কাজটা করতে যাচ্ছে বেশ রিস্কি তার জন্য। সে আসতে আসতে ঘরের ভিতর থাকা কিছু জিনিস ফেলতে লাগলো বেশ শব্দ করে যাতে সেই আওয়াজ বাইরে অবধি যায়। তারপর গিয়ে বন্ধ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো।

মিনিট দুয়েক বাদ একটা লোক দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো। এদিক ওদিক তাকানোর আগেই চন্দ্রা তার ঘাড়ে সপাটে মারলো। লোকটা ঘাড় ধরে কিছুসময়ের মধ্যেই অজ্ঞান হলো। চন্দ্রা হাঁপ ছাড়লো। তার এতো দিনের ক্যারাটে শেখার আসল পরিক্ষা আজ বোধহয় দিতে হবে তাকে।
চন্দ্রা ধীরে ধীরে বেরোলো দরজা দিয়ে, কিন্তু সামনে যাওয়ার তিনটে রাস্তা দেখে কনফিউজ হলো সে। হাতে বেশি সময় নেই দেখে প্রথম দিকের গলি মতো রাস্তায় ঢুকলো। কিছুটা যেতেই দুটো লোককে বসে মদ্যপান করতে দেখলো। চন্দ্রা প্রস্তুত ছিলো এইরকম কিছুর জন্য কিন্তু সামনের দুটি লোককে দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ অবাক হয়েছে তারা।
তারা কিছু একটা বুঝতে পারে এগিয়ে এলো চন্দ্রার কাছে তাকে ধরার জন্য। হাত বাড়িয়ে তাকে ধরতে গেলেই চন্দ্রা হাতটা ধরে ফেললো, আরেকটা হাত দিয়ে সপাটে মেরে দুই পায়ের মাঝ বরাবর মারলো। লোকটা সঙ্গে সঙ্গে নীচে পরে গেলো। তাকে এভাবে দেখে আরেকজন এগিয়ে এলো চন্দ্রা তার ফাইটিং স্কিল অনুযায়ী মরলেও শাড়িতে জড়িয়ে নীচে পরে কপালে বেশ আঘাত পেল। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো তার। এমনিই অজ্ঞান থাকার জন্য মাথায় বেশ প্রেশার পড়েছে তার।

ওভাবে মাথা চেপেই উঠে ওই রাস্তা থেকে বেড়িয়ে অন্য রাস্তা ধরলো। কিছুটা দূর এগোতেই আরও চারজনকে দেখতে পেলো।
চন্দ্রা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের মতো লড়তে লাগলো। শাড়ি পরে থাকায় বেশ অসুবিধা হলো তার পা চালাতে। নিজে পড়লও মুখ থুবড়ে। শরীর এবার তার দিচ্ছে না। লড়ার মতো আর শক্তি নেই তার। হাতের কিছু দূরে কোনের দিকে পরে থাকা লাঠিটা কৌশলে নিয়ে ওকে ধরতে আসা লোকদুটোর মাথায় বেশ জোরেই মারলো। আর দুজনের আগেই পা ভেঙে মাথা ফাটিয়েছে সে।
আজ জীবনে প্রথম বার সে এতো সাহস দেখলো। কিন্তু নিজের উপর গর্ব করার সময় এখন তার নেই, পালাতে হবে তাকে। শাড়ি টা আঁচলের দিকে বেশ খানিকটা ছিঁড়ে গেছে ওই নিয়েই আবার দৌড় দিল সে। কিছুটা দূরে যেতেই আরও দুটো লোক এলো। চন্দ্রা মাথা চেপে ধরে চোখ বুঝলো তার শরীরে একটুও জোর নেই। লোকদুটো এসে চন্দ্রাকে ধরতেই সামনে দিয়ে আরো লোক আসার আওয়াজ পেলো সে।
চোখের কোন দিয়ে তার দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তেই সে বিড়বিড় করে বললো “সিয়াম কোথায় তুমি..?তোমার চন্দ্রাবতী যে আর পারছে না লড়তে।” বলেই জ্ঞান হারালো সেখানে।
.
.
.
সুইটি বেগম তন্ন তন্ন করে সারা বাড়ি খুঁজে ফেলেছেন। অথচ ফাইলস গুলো কোথাও নেই। সিসিটিভিতেও তেমন কিছু ধরা পরেনি। তিনি চন্দ্রাকে ধরে নিয়ে যাওয়ায় সময় মহিলা সার্ভেন্টকে দিয়ে চেক করিয়েছেন তার কাছেও তো নেই। আর না সে বাড়ি থেকে কোথাও বেরিয়েছে তাহলে গেলো কোথায় ফাইলস গুলো..? তিনি আবার নিজের আলমারির সব ঢেলে খুঁজতে লাগলো।

” কি মনি ফাইলস খুঁজছো..? দেখোতো এইগুলো কিনা..?”
সুইটি বেগম চমকে তাকালেন দরজার দিকে।

সিয়াম পা ক্রিস ক্রস করে এক হাত পকেটে গুঁজে আর এক হাতে পেপার্স গুলো নিয়ে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মুখে লেগে বাঁকা হাসি।

সুইটি বেগমকে দেখে মনে হলো না সিয়ামের দাঁড়ানো দেখে তিনি যতটা চমকেছেন, তার থেকে বেশি না তার হাতে পেপার্স গুলো দেখে চমকেছেন। তার এতো কিছুর পরও কি তাহলে শেষ রক্ষা হলো না..?
তিনি এবার নিজেকে ধাতস্থ করে উঠে গিয়ে সিয়ামের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন “বাহ্..! মায়ের মতো হয়েছ দেখছি। আমার কোনো জিনিসই সহ্য হয়না সব ছিনিয়ে নেওয়া স্বভাব তোমার আর তোমার মায়ের তাইনা..?”

সিয়াম এবার রক্তলাল চোখ করে চগর্জে উঠলো “শাট আপ মনি, জাস্ট শাট আপ.! তোমার ঐ পাপী মুখে আমার মায়ের কথা উচ্চারণও করবে না তুমি…! আর কি বললে তুমি তোমার কাছ থেকে তোমার জিনিস ছিনিয়ে নিয়েছি আমি আর মা..? হাহ্। বলেই সিয়াম ঠোঁট বেকিয়ে একটু হেসে আবার বললো “নিজেদের জিনিস ছিনিয়ে নেওয়ার দরকার পড়ে না। ভাগ্যে থাকলে সেটা নিজের থেকেই এসে যায়। কিন্তু তোমরা এসব বুঝবে না বুঝলে তোমার মতো অসৎ, লোভী, অহংকারী, খুনি মানুষদের পক্ষে এইসব কথা হজম করা কঠিন। কুকুরের পেটে কি আর ঘি সহ্য হয়..?” শেষের টুকু বেশ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো সিয়াম।
সুইটি বেগম চেঁচিয়ে উঠলেন “সিয়াম লিমিট ক্রস কোরো না। আর ফাইলস গুলো দাও আমার কাছে, দাও বলছি।”

বলেই তেড়ে নিতে গেলে সিয়াম সরে দাঁড়ালো। সুইটি বেগম দরজায় ধাক্কা খেলেন। তারপর মাথা ধরে ঘুরে দৌড়ে নীচে নেমে জোরে জোরে সিকিউরিটি গার্ডদের ডাকতে লাগলেন। সিকিউরিটি গার্ডরা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে দেখে সুইটি বেগম চেঁচাতে লাগলেন “তোমরা থাকতে এই ছেলেটা ভিতরে আসে কিভাবে হ্যাঁ..? এখন দাঁড়িয়ে মুখ কি দেখছো যাও ওই রাস্কেলটাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করো এক্ষুনি।”

সিয়াম সুইটি বেগামের এইরকম চেঁচামেচি দেখে সামনের সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে বললো “ওদের উপড় চেঁচিয়ে লাভ নেই মনি, ওরা এখন তোমার না আমার গার্ড। এক্ষুনি আমার এক কোথায় ওরা তোমায় এখন থেকে ধাক্কা দিয়ে বেড় করে দেবে।”

সুইটি বেগম অবাক চোখে তাকালেন সবার দিকে। বড্ড অসাবধান হয়ে গিয়েছিলেন এই কদিন টাকা আর অহংকারের লোভে। কিন্তু তার শেষ ঘুটি তার কাছেই আছে ভেবে পিছন ফিরে সিয়ামের উদ্দেশ্যে বললেন “কি চাও তুমি..? শুধু সম্পত্তি..? দিয়ে দেবো তোমায় এই বাড়িতে সিনক্রিয়েট করো না।” শেষ কথাটা আড়চোখে উপরের দিকে তাকিয়ে বললেন।
সিয়াম সেই বরাবর তাকিয়ে উপরে তাকিয়ে দেখলো সিনথিয়া আর তার বন্ধুরা দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চই সুইটি বেগমের চেঁচামেচি শুনেই এখানে এসেছে তারা।

সিয়াম একটা গার্ডকে চেঁচিয়ে বলল “সিনথিয়ার সব বান্ধবীকে দায়িত্ব সহকারে গাড়ি করে তাদের বাড়ি পৌঁছে দাও।”

গার্ডও সেই অনুসারে তাদেরকে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো। সিনথিয়া নীচে নেমে এসে সিয়ামকে রুক্ষ স্বরে বললো “আপনি কে..? আমার মমের সাথে এভাবে কথা বলছেন কেনো..?”

সিয়াম একবার সুইটি বেগমের দিকে তাকিয়ে সিনথিয়ার মাথার একপাশে হাত রেখে হালকা হেসে বললো ” আমি তোমার দূর সম্পর্কের বড়ো ভাইয়া। তুমি হয়তো আমায় চেনো না, সমস্যা নেই কিছুক্ষণ পরই চিনে যাবে।” বলে আবার মুচকি হাসলো সিয়াম।

ওমনি সুইটি বেগম তাড়াতাড়ি এসে সিনথিয়াকে সিয়ামের কাছ থেকে নিয়ে বললো “ওকে এসবের মধ্যে জড়িও না। বলছি তো সম্পত্তি যা চাই সব দিয়ে দেবো।”

সিনথিয়া অবাক হয়ে বললো ” তুমি সব সম্পত্তি এমনি এমনি কেনো দিয়ে দেবে মম..? আর এই ভাইয়াটাই বা কে..? তুমি তো আগে কোনোদিন বলোনি আমার ভাইয়া আছে..?”

সুইটি বেগম এই প্রথম মেয়েকে ধমক দিয়ে বললেন ” চুপ করো সিনথিয়া। আমাদের কথার মাঝে কথা বলবেনা। যাও উপরে রুমে যাও আমি না ডাকা অবধি আসবে না নীচে।”

সিনথিয়া ধমকে একবার সিয়ামের দিকে তাকিয়ে উপরে যাওযার জন্য পা বাড়ালো। সিয়াম এবার গম্ভীর স্বরে বললো ” দাঁড়াও সিনথিয়া, তোমার মম নিজের স্বার্থের জন্য কতগুলো ছেলেমেয়ের জীবন নষ্ট করেছে তার কাহিনী শুনবে না..?”

সিনথিয়া দাঁড়িয়ে পিছন ঘুরে অবাক হয়ে বললো “মানেহ..?”

সুইটি বেগম রেগে চেঁচিয়ে বললেন “সিয়াম..! বলছি না ওকে এসবের থেকে দূরে রাখতে ও এসবের কিছুই জানে না।”

সিয়াম এবার হালকা হেসে সুইটি বেগমের দিকে এগিয়ে এসে বললো ” হ্যাঁ জানে না। তবে ওর ও তো সবটা জানার অধিকার আছে তাই না মনি..? যে ওর ওয়ার্ড বেস্ট মম কতজনের মা বাবাকে কেড়ে নিয়েছে তাদের কাছ থেকে..?”

___________________________________

সন্ধ্যে ৭ টা

সিরাজ অফিসের ঝামেলা মিটিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। আজ সে একটু বেশিই ক্লান্ত। সেই কোন সকাল আটটায় গিয়েছে অফিসে, সেই যে একটা স্যান্ডুইচ আর এক কাপ কফি খেয়েছিল তারপর আর কিছু খেতেই পারেনি। আর না ইন্দ্রাকে কল মেসেজ দিতে পেরেছে। কে জানে মেয়েটা কি ভাবছে।

সিরাজ আর কিছু না ভেবে ইন্দ্রার ফোন কল লাগালো।
.
.
ফোনের রিং বাজতেই একপ্রকার খপাৎ করেই ধরলো ইন্দ্রা। আজ সারাদিন এই মানুষটার জ্বালানো খুব মিস করেছে সে, মুখে যতই না না করুক এই মানুষটার প্রতি যে তার আসলেই টান কাজ করে, আর এই জিনিসটা আজ বেশ ভালো করেই উপলব্ধি করতে পেরেছে সে। বেশ অভিমানও হয়েছে তার সেই সকাল সাড়ে আটটার শুধু একটা মেসেজ “আজ ব্যাস্ত থাকবো, নিজের খেয়াল রেখো।”
এইটুকু ছাড়া আর একটাও মেসেজ বা কল আসেনি তার ফোনে সারাদিন যে সে চাতক পাখির মতো ফোনের দিকে চেয়ে বসে ছিল সেটা কোনোভাবেই সিরাজকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। তাই বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর সে ফোনটা রিসিভ করলো।

সিরাজ ওপাশ থেকে ক্লান্ত গলায় বললো ” ইন্দ্রা..? কই ছিলে ফোন রিসিভ করতে এতোক্ষণ লাগলো যে..?”

ইন্দ্রা বেশ ধীর গলায় বললো ” আপনার কি আমি যেখানেই থাকি যা খুশি করি আপনাকে বলবো কেনো..?”

সিরাজ ইন্দ্রার এইরকম অভিমানী গলা শুনে হেসে বললো ” সাধে কি আর বাচ্চা বলি তোমায় ইন্দ্রা..? এই দেখো এখন কেমন বাচ্চাদের মতো অভিমান করে মুখ ফুলিয়ে বসে আছো..!”

ইন্দ্রা ফুঁসে উঠে বললো ” তাহলে এই বাচ্চাকে বার বার ফোন দেন কেন..? আমি রাখছি ফোন, আজকের মতো আর ফোন দেবেন না আমায় হূহ।”

বলেই ফোন রাখতে গেলে সিরাজ এবার চমকে উঠে বলে ” আরে ইন্দ্রা… শোনো তো..”

ইন্দ্রা আবার ফোন কানে নিয়ে বিরক্ত গলায় বললো “কি..?”

সিরাজ এবার নরম গলায় বললো ” আজ সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত ছিলাম ইন্দ্রা। অফিসে একটু ঝামেলা হয়েছিল। দাদাভাইও ছিলো না তাই সবটা আমাকেই দেখতে হয়েছে। এখনও বাড়ি ফিরিনি আমি।”

ইন্দ্রা এবার একটু নরম হলো বোধহয় বললো “আচ্ছা বুঝলাম। তাহলে এখন রাখি..? আপনি বাড়ি গিয়ে রেস্ট নিন তবে।”

– ইন্দ্রা..
– হুমম
– তোমার বাড়ির গেটের কাছে আসতে পারবে এখন..?

ইন্দ্রা বিস্ফারিত নয়নে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো “এখন…? আপনি কি এখন আমার বাড়ির গেটের সামনে আছেন..?”

সিরাজ বললো না তবে আসছি। আর শোনো পারলে কিছু খাবার এনো সাথে। সেই সকাল থেকে কিছু খাইনি কাজের চাপে। আজ ভাবী বাড়িতে নেই আর সার্ভেন্টের হাতের রান্না খেতে ভালো লাগে না।”

ইন্দ্রা প্রথমে না বলবে ভাবলেও এবার তার ভীষণ মায়া হলো। তাই আর কিছু না ভেবে শুধু বললো “এসে ফোন করুন।”
সিরাজ মুচকি হেসে গাড়ি ঘোরালো।

সিরাজ এসে ফোন করার কয়েক মিনিট পরেই ইন্দ্রা একপ্রকার দৌড়েই এলো। সিরাজ গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে আসতে বললো। চন্দ্রা ড্রাইভিং সিটের পাশে বসে টিফিন বক্সটা এগিয়ে দিল সিরাজের দিকে।

সিরাজ ভ্রূ কুচকে তাকিয়ে বললো “আমাকে দিচ্ছ কেন খাইয়ে দাও।”

ইন্দ্রা বড় বড় করে তাকিয়ে বললো ” আমি..? না না আমি পারবোনা আপনার খেতে হলে খান নয়তো ঘরে নিয়ে চলে যান। নিন ধরুন..”

সিরাজ তা দেখে আফসোসের সুরে বলল “আজ আর খাওয়া হবে না তোর বুঝলি সিরাজ। নইলে এই কাটা হাত নিয়ে কীকরে তুই একা একা খাবি..? কি আর করার পৃথিবীর সবাই নিষ্ঠুর।” বলেই ব্যান্ডেজ করা ডান হাতটা বুকে রাখলো।

ইন্দ্রা এবার ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো ” কি হয়েছে আপনার ডানহাতে..?”

সিরাজ এবার একটু কঠিন স্বরে বলল ” তোমার না জানলেও চলবে দাও টিফিন বক্সটা দাও। দিয়ে চলে যাও বাড়ি।”

ইন্দ্রা এবার মিনমিন করে বললো ” আরেহ সরি সরি। আমি বুঝতে পারিনি আপনি রাগ করবেন না, আমি কি জানতাম বলুন যে আপনার হাত কাটা আছে। দাড়ান খাইয়ে দিচ্ছি।”
বলে ইন্দ্রা টিফিন বক্স খুলে ভাত মাংসের ঝোল দিয়ে মেখে সিরাজকে খাইয়ে দিতে লাগলো।

খাওয়ার মাঝখানে সিরাজ বললো ” উমম, ইন্দ্রা তোমার হাতের রান্না তো আমি আগেও খেয়েছি কই এতো টেস্ট লাগেনি তো আগে..?”

ইন্দ্রা তার লাল টুকটুকে হওয়া গাল টাকে নিয়ে চুপ করে বসে রইল। সে জানে সিরাজ এইরকম তাকে রাগাবার জন্য বলছে। এই যে প্রতিবার এক লোকমা ভাত মুখে দেওয়ার সময় সিরাজের ঠোঁট ইচ্ছাকৃত বার বার তার আঙুল স্পর্শ করছে এর জন্যই সিরাজ এইধরনের কথা বলছে। ইন্দ্রা জানে সে এখন কিছু বললে আবার সেটাকে তার দিকেই ঘুরিয়ে দিয়ে তাকেই লজ্জায় ফেলে দেবে। তাই এখন চুপ চাপ থাকাটাই শ্রেয় তার জন্য।

এরই মাঝে সিয়ামের কল দেখে সিরাজ তুলে বললো ” হ্যাঁ ভাইয়া বল।”

সিয়াম ওপাশ থেকে কি বললো ইন্দ্রা শুনতে পেলো না। তবে ফোন রাখতেই ইন্দ্রা জিজ্ঞেস করলো তাকে।
সিরাজ চিন্তিত মুখ করে বললো ” ভাইয়া আমায় তোমায় অপূর্ব আর সিয়াকে নিয়ে এই ঠিকানায় যেতে বললো।” বলে ফোনের ঠিকানাটা ইন্দ্রাকে দেখলো।

সিরাজ বললো “তুমি ঘরে তালা দিয়ে এসো আমি সিয়া আর অপূর্বকে ফোন করি।”

ইন্দ্রা ঘাড় নাড়িয়ে চলে গেলো তার বাড়িতে।

__________________________________

সিরাজ কিছুক্ষণের মধ্যেই ইন্দ্রাকে নিয়ে সিয়ার শশুর বাড়ির সামনে চলে গেলো। গিয়ে দেখলো তারা দাঁড়িয়ে আছে আগে থেকেই বাইরে। সিরাজ যেতেই দুজনে গাড়ির পিছনে উঠে বসলো।
উঠতেই দুজনে প্রশ্নের বান শুরু করলো “কেনো ডেকেছে তাদের..? কোন জায়গা এটা..?”

সিরাজ বিরক্ত হয়ে বলল “এই বস তো তোরা দুজন চুপ করে। আমি কি নিজেও জানি নাকি কেনো ভাইয়া ডেকেছে..? তোরা যতটুকু জানিস আমিও ততটুকুই জানি।”

সিয়া এবার মুখ দিয়ে ” চিহ ” বলে বিরক্তিকর শব্দ করলো। তারপর হটাৎই সিরাজের হাতের দিকে তাকিয়ে বললো “এই ভাইয়া তোর হাতে কি হয়েছে..?”

সিরাজ ইতস্তত করে বললো ” আরে এমনি কিছু না।”

সিয়া চিন্তিত হয়ে বললো ” মিথ্যে বলিস না ভাইয়া তুই বরাবরই নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি উদাসীন। কিছু হলে বলতে চাস না মোটে।”

সিয়ার কোথায় তাল মিলিয়ে অপূর্বও বললো “হ্যাঁ ঠিকই তো সিরাজ। পরে ইনফেকশন হলে..? এখন যাওযার পথে ফার্মেসিতে দেখিয়ে কিছু মেডিসিন কিনে নি চো। কিছু না নিলেও একটা টিটেনাস নিয়ে নিবি।”

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি সিরাজ ইনজেকশনকে ভীষণ ভয় পায়। কিন্তু সিয়া অপূর্ব যা ধরেছে আজ তাকে ইনজেকশন নিয়িয়েই ছাড়বে।

সিরাজ এবার মহাবিরক্ত হয়ে বলল “আরে কিছু হয়নি আমার বলছি তো..!”

সিয়া বললো “কিছু হয়নি বললেই হলো..?এতো খানি ব্যান্ডেজ কি এমনি এমনি করেছিস নাকি..?”

সিরাজ এবার অসহায় মুখ করে ব্যান্ডেজ খুলে বললো “দেখ এবার বিশ্বাস হলো কিছু হয়নি আমার…!”

ইন্দ্রা এতোক্ষণ সব চুপচাপ শুনলেও এবার একটা এত্তবড় হাঁ করে সিরাজের হাতের আর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।মানে এতক্ষণ তাকে বোকা বানিয়েছে এই লোকটা..?

সিয়া বললো ” উফ ভাইয়া কিছু হয়নি তো এইরকম হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে কেনো রেখেছিস..?আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম কত্ত।”

সিরাজ ইন্দ্রার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললো “মাঝে মাঝে ফ্রি ট্রিটমেন্ট পাওয়ায় জন্য কত কি করতে হয় রে বোন তুই বুঝবি না ওসব।”

ইন্দ্রা জানলার দিকে মুখ ঘুড়িয়ে বসে রইলো সাড়া রাস্তা। মনের ভিতর কোথাও ভালো লাগা জন্ম নিলেও প্রশ্রয় দিল না সে সেটাকে, বরং নিজের মনকেই ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে রাখলো।

#চলবে..?

বেড়াজাল পর্ব-৩৪

0

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #৩৪

চন্দ্রা ভয়ে ভয়ে গিয়ে সিনথিয়ার বাড়ির বড়ো দরজাটা খুললো। ওমনি ফট ফট করে কিছু একটার আওয়াজ এলো, অনেকগুলো মেয়েলী কণ্ঠস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো ” হ্যাপি বার্থডে ” শুনতে পেয়ে চন্দ্রা চোখ পিট পিট করে খুলে কানে চেপে থাকা দুই হাত নীচে নামলো। সামনে কতগুলো তাকে দেখে অবাক হওয়া মেয়েকে দেখে মনে কোথাও একটা স্বস্তি ফেললো। হটাৎই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলো সে।

সামনের মেয়েগুলি একেওপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। তারা যে সিনথিয়া ভেবে ওই বেলুন ফাটিয়েছে এটা ভালোই বোঝা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে থেকে একজন চন্দ্রাকে জিজ্ঞেস করলো “আচ্ছা আপনি কে..? সিনথিয়ার কোনো রিলেটিভ..? কিন্তু আমরা যতদূর জানি ওর আগে পরে মা ছাড়া কেউ নেই।”

চন্দ্রা অস্বস্তি সরিয়ে হালকা হেসে বললো ” আমি ওর দূর সম্পর্কের এক আপু। বাইরে দাঁড়িয়ে কেনো আসো সবাই ভিতরে এসো। সিনথিয়া উপরেই আছে।”

সবাই হাসি মুখে চন্দ্রার সাথে পরিচিত হয়ে ঘরের ভিতর ঢুকলো। সিনথিয়ার রুমে গেলো সবাই ধীরে ধীরে। সিনথিয়াকে এইভাবে শুয়ে থাকতে দেখে চার জন বান্ধবীকেই বেশ সিরিয়াস দেখালো। ওর চারপাশে বসে ওর শরীরের অবস্থা কখন কি হয়েছে সব জানতে চাইলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।

চন্দ্রা পুরোটা সময় দাঁড়িয়ে দেখলো। এমন বুঝি বন্ধুও হয়…? কই তার তো কোনোদিন ছিলো না এমন বন্ধু। সে সরল ছিলো বলে সবাই তাকে শুধু সাহায্যের সময় ব্যাবহার করতো, তারপর যেনো কেউ চিনতেই পারতোনা তাকে। সেখান থেকেই বন্ধুত্বের প্রতি যে তার এক আকাশ পরিমাণ দুরত্ব জন্মালো তারপর থেকে সে বন্ধু বানানই ছেড়ে দিল। সেও সবার সাথে দরকারেই কথা বলতো। তবে এখন সিয়া তার ভীষণ ভালো বন্ধু। এইসব কথা ভেবেই চন্দ্রা মুচকি হাসলো। তারপর হটাৎ মনে পড়লো তার এসব ভাবলে চলবে না এখন কীকরে এখন থেকে কাগজ গুলো নিয়ে বেরনো যায় সেটা ভাবতে হবে তাকে।

এই মধ্যেই সিনথিয়া বলে উঠলো ” আপু তুমি একটু কিচেন থেকে ওদের জন্য স্নাক্সের ট্রে গুলো এনে দেবে। আমি সব সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছি।”
সিনথিয়ার দুজন বন্ধুও গেলো জোর করে চন্দ্রার সাথে। অন্যসময় চন্দ্রা সঙ্গ পেলে খুশি হলেও এখন হতে পড়লো না। মাথায় তার অন্য চিন্তা ঘুরছে।
.
.
.
সুইটি বেগম সিনথিয়ার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলেও ঘরে এলেন কিছু কাগজ নিতে।
সিড়ি দিয়ে উঠতে যাবেন এমন সময় তিনি দেখলেন সিরাজ শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে কানে থাকা ব্লুটুথে কাকে কি বলতে বলতে নেমে আসছে।
সিরাজ সুইটি বেগমকে না দেখার ভান করে পাশ কাটাতে গেলে সুইটি বেগম ধীর কিন্তু কঠিন গলায় বললেন “দাঁড়াও।”
সিরাজ একটা ভ্রু উঁচু করে সুইটি বেগমের দিকে ঘুরে বললো “কিছু বলবে মম..? তাড়াতাড়ি বলো অফিসে সমস্যা হয়েছে ভাইয়া ডাকছে আর্জেন্ট।”

সুইটি বেগম এবার শিরদাঁড়া সোজা করে করে এক পা এক পা করে এগিয়ে এসে সিজারের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। তার চালচলনে সে আধিপত্যের ছোঁয়া আছে তা দেখলেই যে কেউ ধরে নেবে। তিনি এবার সিরাজের চোখে চোখ রেখে বললেন ” ব্যাবসায় তো আমার কথা মতো কাজ করলে না। করলে আজ সব সাম্রাজ্য তোমার হতো।”

সিরাজ বিরক্ত হলো তাও মুখ নীচু করে বললো ” তুমিও জানো মম ভাইয়া কতটা করে বা করেছে আমার আর সিয়ার জন্য তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার সাহস আমার নেই। আর যাই হোক গায়ে যাদের রক্ত বইছে তাদের মতো হয়ে আর পাপ বাড়াতে চাই না।”

সুইটি বেগম সশব্দে গর্জে উঠলেন ” সিরাজ ” বলে।
সিরাজ একহাত ঘাড়ের পেছনে বুলিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে বললো। “চেঁচিয় না মম। সত্যি কথা তো তাই গায়ে একটু লাগলো। ”

সুইটি বেগম রাগে হতভম্ব হয়ে রইলেন। তার ছেলে এতোটা অধঃপতনে গেছে..? অদেও কি অধঃপতনে গেছে নাকি শুধু তার কথার অমান্য করায় তার এমন লাগছে। চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করলেন তিনি। তারপর ভালো ভাবে বললেন ” যা করার করে নাও একদিন। কিছুদিন পর আমার বন্ধুর এক মেয়ের সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করেছি। সে তোমার সাথে মিলে ব্যাবসা আরো উঁচুতে তুলে দেবে, তুমি শুধু চুপচাপ বিয়েটা সেরে নেবে। আর আর ওই যে মেয়েটা কি নাম একটা..? হ্যাঁ ইন্দ্রা…! ওই মেয়েটাকে যত তাড়াতাড়ি পারো জীবন থেকে সরাও। আমি তো ভেবেই অবাক তুমি কবে থেকে এতদিন ধরে একই গার্লফ্রেন্ডের সাথে আছো..? তারপর মেয়েটার আগে কেচ্ছা আছে। তারপরও…”

” ব্যা-স-স ”

আর বলতে পারলেন না তিনি সিরাজের ধমকে চুপ করে গেলেন।
সিরাজ রক্তলাল চোখ করে বললো ” ব্যাস মম আর একটাও কথা শুনতে চাইনা আমি ওর ব্যাপারে। ও আমার, তাই তাকে জড়িয়ে কথা গুলো আমায় শত কাঁটা ফোঁটা সমান বেদনা দেয়। ওকে নিয়ে আমার সামনে সমালোচনা করার অধিকার আমি কাউকে দিইনি কাউকে মানে কাউকেই না। সো আমার লাইফে ইন্টারফেয়ার করার কথা মাথাতেও এনো না। ” বলেই কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আবার পিছনে ফিরে এলো সে আবার সেই রুদ্রতাপ কঠিন মুখমণ্ডল নিয়েই বললো ” আফটার আ ফিউ ডেইস আই উইল মেক হার লিগ্যালি মাইন। আর তুমি এর মধ্যে নাক না গলালেই খুশি হব।” বলেই আগের মত তথাকথিত অ্যাটিটিউড নিয়ে বেরিয়ে গেলো দরজা দিয়ে।

সুইটি বেগম সেই দিকে তাকিয়ে রাগে থর থর করতে করতে বিড়বিড় করলেন ” এর ফল তুমি পাবে সিরাজ। ওদের তো সবকটাকে জেলের হাওয়া খাওয়াবই। তুমি কথার অবাধ্য হলে তোমার কপালেও শনি নাচবে এবার। খুব ভাইয়া ভক্ত হয়েছ না..?” বলেই কাউকে ফোন দিলেন। ফোন রিসিভ হতেই বললেন ” কিছু খবর পেলি..?”
ওপাশ থেকে কি বললো শোনা গেলো না। সুইটি বেগম আবার বললেন “কথা মত কাজ শুরু কর। আর হ্যাঁ খুব সাবধানে।” বলেই ফোন রেখে নিজের রুমের দিকে এগোলেন।
.
.
.
এইদিকে সিনথিয়ার বন্ধুরও বেশ ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছে চন্দ্রা। কিছু মিনিটের জন্য হলেও সে চিন্তামুক্ত হয়ে হাসি মজা করছিলো কিচেনে দাঁড়িয়ে। হটাৎ এক মহিলা সার্ভেন্ট এসে বললো চন্দ্রার সাথে নাকি কেউ দেখা করতে এসেছে। চন্দ্রা অবাক হলো এখানে কে দেখা করতে আসবে..? সার্ভেন্ট তাড়া লাগলো। চন্দ্রা তাই সব রেখে তাড়াহুড়ো করে দেখতে গেলো কে এসেছে। চলতে চলতে বুঝতে পারলো সে সিনথিয়ার বাড়ির একদম পিছনের দিকে এসে পড়েছে। কিন্তু কাউকে তো দেখতে পাচ্ছে না এখানে তাহলে..? ফেরার জন্য পিছনে ঘুরতেই একজোড়া হাত পিছন থেকে এসে তার নাকে রুমাল চেপে ধরলো। চন্দ্রা ছটপট করার আগেই নিস্তেজ হয়ে পড়লো।
.
.
সিনথিয়া চন্দ্রাকে না দেখতে পেয়ে তার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলো তার কথা। তার বন্ধু বললো ” সার্ভেন্ট বলেছে নাকি তার আর্জেন্ট কল এসেছে তাই যেতে হয়েছে তাকে ঘরে আর বলল তোকে জানো বলে দি।”
সিনথিয়া কিছু বললো না। সে তো আজ কোনো সার্ভেন্টকে আসতে বলেনি । হয়তো মা ধমকাধমকি দিয়ে অনিয়েছে। সিনথিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লো তার মা তাকে নিয়ে একটু বেশীই পসেসিভ।

____________________________________

অপূর্ব আজ আর অফিস থেকে এসে অফিস যায়নি। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর এসে বিছনায় একটু শুয়েছিল। হটাৎ করেই মাথাটা তার ভীষণ যন্ত্রণা করছে। সে বুঝতে পারলো না তার মাথায় এতো যন্ত্রণা কেনো হচ্ছে। সিয়াকেও আসতে দেখছে না। লাঞ্চের পর থেকে সে একবারও রুমে আসেনি। তাই ফোন দিয়েকে রুমে আসার মেসেজ দিয়ে চোখের উপর হাত দিয়ে শুয়ে রইলো সে।

সিয়া মেসেজ পেতেই ফোন হাতে তুলে দেখলো, তারপর আবার একই ভাবে ফোন রেখে সায়মা বেগমের হাতের সেলাইয়ের কাজ দেখতে লাগলো।
সায়মা বেগম হাসতে হাসতে অনেক গল্প করলেন। সিয়া যেনো সব কথা শুনেও শুনছেনা কোথায় যেনো হারিয়ে যাচ্ছে। অপূর্বের ফুল রেখে চলে যাওয়া প্রথমে স্বাভাবিক ঠেকলেও পরে সেটা মোটেই স্বাভাবিক লাগেনি সিয়ার। অপূর্ব এমন কোনোদিন করে না সে কিছু যখন আনে সিয়া নিতে না চাইলেও জোর করে তার হাতে ধরিয়ে দেয়।

সায়মা বেগম সিয়াকে এমন অন্যমনস্ক দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন “অপূর্বের কথা ভাবছো..?”
সিয়া হটাৎ করে এমন প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে বললো ” কই না তো। ও তো ঘরেই আছে।”
সায়মা বেগম হালকা হেসে বললেন ” কখনও কখনও আমরা একই বিছানায় পাশাপাশি শুলেও মানুষটির সাথে আমাদের মনের দূরত্ব আকাশ সমান হয়, আবার কখনও কখনও মানুষটি আকাশ সমান দূরে থাকলেও তার সাথে আমাদের মনের কিঞ্চিৎ পরিমাণ দূরত্ব থাকে না। সবটাই নির্ভর করে সম্পর্কের সমীকরনের উপর”

সিয়া অবাক হয়ে শুনলো। সায়মা বেগম আবার বললেন “আমার ছেলেটা বড্ড নরম মনের আম্মু, কিন্তু সে ভিতরে গুমরে গুমরে মরলেও তোর কাছে কোনোদিন নিজের ভালোবাসার দাবী রাখবে না যতদিন না তুমি চাও। তবে আমি তো তার আম্মু হই আমি দেখেছি জানো সেই রাত গুলো, যেখানে ছিলো তোমায় পাওয়ার আকুলতা, না পাওয়ার ব্যার্থতা। জানো তোমার রিলেশনের কথা সে যেদিন প্রথম জানতে পারলো সেইদিন ছোটবেলার পর থেকে সেই প্রথমবার আমার কাছে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছিলো। শুধু একটাই কথা বার বার বলছিলো যে “আমি হেরে গেছি আম্মু পারিনি তাকে আমার করে নিতে।”
তোমার মনে আছে সিয়া তোমার বাসর রাতের দিন অপূর্বের তোমার রুমে যেতে দেরি হয়েছিল, কেনো জানো..? সেদিনও ও রুমে যাওযার আগে সেই আগের দিনটার মতো কেঁদে আমার হাত ধরে বলেছিল “আমি জিতেছি আম্মু। সে এখন আমার, সম্পূর্ণ আমার।”
বিশ্বাস করবে না সেইদিন আমার থেকে খুশি বোধহয় আর কেউ ছিল না।
ছোটোথেকেই আমি ওর সবথেকে বড়ো বেস্টফ্রেন্ড হওয়ার তোমার কথা আমি অনেক বছর আগে থেকেই জানতাম। জানো ওকে বিদেশে পড়াতে পাঠানোর আমাদের কোনো প্ল্যান ছিলো না। কিন্তু দিন দিন ছেলেটাকে চোখের সামনে বিষণ্ণতায় ডুবে যেতে দেখে পাঠাতে বাধ্য হলাম। হলোও তাই ওখানে গিয়ে ও বেশ হাসিখুশি ছিলো, আমরা ভেবেছিলাম হয়তো তোমায় ভুলে গেছে। কিন্তু এখন মনে হয় ও একটা পলকের জন্যও তোমায় ভুলতে পারেনি সেখানে গিয়েও। এইসব কথা তোমার বড়ো ভাইয়া সিয়ামও জানে সে বলতে চেয়েছিলো তোমায় অপূর্বের কথা কিন্তু অপূর্ব বলতে দেয়নি। সে চায়নি তুমি তোমার ভালোবাসার মানুষটার থেকে আলাদা হয়ে তার মতো কষ্ট পাও।
দেখো আম্মু এসব আমার আর অপূর্বের পার্সোনাল কথা। তবে আমার মনে হলো তোমায় জানানো দরকার, তাই জানালাম।”

সিয়া স্থির হয়ে বসে রইলো। নড়চড় করার ক্ষমতা নেই তার মধ্যে এখন। তাকে এতটাও কেউ এইভাবে ভালোবাসতে পারে তার ধারণার বাইরে ছিলো। তাকে পাওয়ার জন্য যে মানুষটা রাতে কান্না করছে সে কিনা সেই মানুষটাকে দিনের পর দিন নিজের থেকে দূরে সরিয়ে কষ্ট দিচ্ছে..? তাও আবার কার জন্য যে ওকে শুধু ব্যাবহার করেছে প্রতিটা পদক্ষেপে।

সিয়া কোনরকমে বসা থেকে উঠে সায়মা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলল ” ধন্যবাদ আম্মু সত্যিই এগুলো জানা আমার জন্যে খুব দরকার ছিল। আমি একটু আসছি।” বলেই দৌড়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো।

রুমে এসে সিয়া দেখলো অপূর্ব বিছানায় শুয়ে আছে। সিয়া করুন চোখে তাকালো মানুষটার দিকে। ওই চোখে ঠিক কি আছে সিয়া নিজেও জানেনা। শুধু তার মনে হচ্ছে সামনের মানুষটি তার একান্ত আপন।
সিয়া এবার খেয়াল করলো অপূর্ব মাঝে মাঝে হাত মুষ্টি বদ্ধ করে মাথায় মারছে আবার কখনো চুল টানছে জোরে। সিয়া বুঝতে পারলো অপূর্বের মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে। সে আসতে আসতে গিয়ে তার পাশে বসে মাথা থেকে তার হাতটা সরিয়ে নিজে মাথা ম্যাসাজ করে দিতে লাগলো।
অপূর্বের মুখে আলতো হাসি ফুটলো। সেই দেখে সিয়া জড়তা কাটিয়ে অপূর্বের কপালে নিজের ঠোঁট দুটো চেপে ধরলো সেকেন্ড চারের জন্য।

অপূর্ব চোখ খুলে বিস্ফোরিত হয়ে তাকালো সিয়ার দিকে। সিয়া তা দেখে হেসে ফেললো।

আচ্ছা ওই বাচ্চা প্রেমিক প্রেমিকা গুলো কি ঠিক বলে যে প্রেমিকার চুমু খেলেই তার সব অসুখ ঠিক হয়ে যায়..? তাহলে অপূর্ব নিজেকে সেই খাতায় ফেললো বলে এবার।

# চলবে..?

বেড়াজাল পর্ব-৩৩

0

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #৩৩

সিনথিয়া বার বার বাথরুম টু রুম আর রুম টু বাথরুম করছে। চন্দ্রা দুবার ওয়ারেস জল দিয়েছে তাও তেমন কাজ হচ্ছে না। চন্দ্রা জানে লিমিটেশন তাই অল্পই দিয়েছে একদম।

চন্দ্রা এদিক ওদিক তাকালো। সিসিটিভি লাগানো আছে রুমের ভিতর না হলেও ডাইনিং বড়োগেট সবজায়গায়। চন্দ্রা ওতো ভাবলোনা ধরা সে এমনিই পড়বে পরে, কিছু না কিছু ভাবে। সিসিটিভি ফুটেজ বন্ধ সে এখন কোনোভাবেই করতে পারবে না। কিন্তু সিয়াম বার বার ঘরের ভিতরের সিসিটিভি থেকে সাবধানে থাকতে বলেছে তাকে।

চন্দ্রা সিনথিয়াকে বললো “আমি দেখছি যদি রুমে কোনো ওষুধ থাকে।” যদিও কথাটা ভিত্তিহীন সে মোটেই এই একদিনে এসে কারোর রুম থেকে ওষুধ খুঁজে পাবে না।
সিনথিয়া কিছু বললো না। কারন সে বলার অবস্থায় নেই পেত চেপে পা মুড়ে সোফায় বসে আছে। সে বুঝতে পারছে না আজ সকাল অবধিই তো সে ঠিক ছিলো, হটাৎ কি এমন খেলো সে যাতে তার পেট এতো মুচড়াচ্ছে। আজ সব খাবার বাইরে থেকে অর্ডার দেওয়া হবে তাই সে সব সার্ভেন্ট দের ছুটি দিয়েছে। তার সাথে থাকা আয়াকেও আজ বেরেপাকামি করে সে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে। সিনথিয়া এসব ভাবতে ভাবতেই মাথা সোফার পিছনের দিকে হেলিয়ে দিলো। কিন্তু বেশিক্ষণ রইলো না সে স্বস্তি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আবার তাকে বাথরুমের শরণাপন্ন হতে হলো।

সিয়া আগেই জেনে নিয়েছিল সুইটি বেগমের রুম। তাই একবার দরজার দিকে তাকিয়ে আলমারি খোঁজা শুরু করলো। কোথাও না পেয়ে লকার খোলার কথা ভাবলো। সিয়াম ওকে চাবি ছাড়া লকার খোলার জন্য আরও একটা উপায় বলেছে। চন্দ্রা ব্যাগ থেকে একটা নেইল কাটার বের করলো সেখান থেকে নেইল ফাইলটা খুলে লকার খোলার চেষ্টা করলো। সময় লাগলো তবে খুলে গেলো। চন্দ্রা একটা বিশ্বজয়ের হাসি দিল। কিন্তু সে হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না ফাইল তো সে পেলো, কিন্তু সেখানে মোট পাঁচটা মোটা মোটা ফাইল রাখা। চন্দ্রা বুঝবে কীকরে এবার..? পড়ে দেখার মতো তার হাতে সময় নেই।
চন্দ্রা ভেবে না পেয়ে সিয়ামকে কল করলো। দুই বার কল হয়ে কেটে গেল। চন্দ্রা এবার উপায় না পেয়ে চিন্তিত হয়ে ফাইল গুলো দেখতে লাগলো। না প্রচুর পেপার্স, চন্দ্রা এটাই বুঝতে পারছে না এতো দরকারি কাগজ কিসের..?
বাইরে থেকে কারোর আসার আওয়াজ পেয়ে তাড়াতাড়ি করে আলমারি টে আবার ফাইল গুলো রেখে দরজা বন্ধ করে দিলো চন্দ্রা।
সেইসময় সিনথিয়া ঘরে ঢুকলো। মেয়েটা একেবারে নেতিয়ে গেছে কিছুক্ষনেই। হাঁটতেও যেনো কষ্ট হচ্ছে। চন্দ্রা সিনথিয়াকে দেখে এগিয়ে গিয়ে ধরলো। নিজের হয়ে সাফাই দিতে গিয়ে নিজের কথাতেই কথা জড়িয়ে ফেললো ” আমম সিনথিয়া আমি আসলে এখানে ওষুধ মানে ওই আলমারির কাছে ওই দিকে ভাবলাম আমি।” চন্দ্রা কি বলছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না। সিনথিয়া কি তাকে দেখেছে..?

সিনথিয়া চন্দ্রার হাতের উপর হাত রেখে বললো “রিলাক্স আপু, বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এখন এই ঘর থেকে চলো মম পছন্দ করেননা ঠিক তার ঘরে কেউ ঢুকুক।”

চন্দ্রা মাথা নাড়িয়ে সিনথিয়া নিয়ে বেরিয়ে ওর রুমে গেলো। সিনথিয়া কে বললো ” ওহহ, দেখেছো আমি আমার ব্যাগ টা আনিনি। দাড়াও ওইটা নিয়ে আসি আর তোমার জন্য এক গ্লাস ওয়ারেসের জলও আনি।”
সিনথিয়া মাথা নাড়ালো। চন্দ্রা রুমের বাইরে বেরিয়ে এদিক ওদিক দেখে আবার সুইটি বেগমের রুমে ঢুকলো। তাড়াতাড়ি করে আবার আলমারি খুলে ফাইল দেখতে লাগলো। শেষে একটা নীল রঙের ফাইল পেলো সেটা খুলতেই আকাঙ্ক্ষিত জিনিসটা চন্দ্রার সামনে পড়তেই চন্দ্রার চোখ চিকচিক করে উঠলো।

চন্দ্রা তাড়াতাড়ি করে ফাইল থেকে কাগজ গুলো বের করে নিল। কি মনে করে অন্য ফাইল থেকেও কটা কাগজ নিলো যদি কোনো কাজে লেগে থাকে ভবিষ্যতে। ফাইল নইলে সমস্যা হবে এই ভেবে শাড়ির ভাঁজে আসতে করে নিয়ে আঁচল দিয়ে নিজেকে পুরো ঢেকে নিলো। তারপর আসতে আসতে নীচে গিয়ে কাগজ গুলো ব্যাগে ঢোকাবে এমন সময় ডোরবেল বেজে উঠলো, থামাথামির নাম নেই বাজছে তো বাজছেই। চন্দ্রা তাড়াহুড়োতে ব্যাগে না রেখে সোফার সিটের নীচে রেখে দরজা খুলতে গেলো।
.
.
” পিয়াস এই পিয়াস..!” বিরক্তি নিয়ে ডাকতে ডাকতে নিজের অফিসের রেস্ট ঢুকে টাইয়ের নট ঢিলে করে গা এলিয়ে দিল নিজের চেয়ারে। একমাত্র তার এই রুমেই সিসিটিভি নেই। চন্দ্রার জন্য চিন্তা হচ্ছে তার। সকাল থেকে কল দিতে পারেনি মেয়েটাকে, কতদূর কি এগোলো কি হলো সে কিছুই বুঝতে পারছে না। বিরোধি পক্ষ আগের দিন সকাল থেকেই ঝামেলা শুরু করেছে , কাল পরিবেশ শান্ত থাকলেও আজ সকাল থেকেই চারিদিকে হাজার রকম নিউজ বেরোচ্ছে। প্রেস কনফারেন্স এই সব দিক দেখতে গিয়ে ফোন পর্যন্ত ধরতে পারেনি সে। চন্দ্রা নিজেও সকালে উঠে খবরের কাগজে এইসব নিউজ পড়ে গেছে। সিয়াম তাকে চিন্তা করতে বারণ করেছে আশ্বাস দিয়েছে সে এইদিকটা সে সামলাবে।
.
.
.
পিয়াস হন্তদন্ত হয়ে সিয়ামের রেস্ট রুমে ঢুকেই চিন্তিত মুখ নিয়ে বলে উঠলো ” সর্বনাশ হয়ে গেছে রে সিয়াম..! রাসেল ব্লস্টার্ড টা পিঠে ছুঁড়ি মেরেছে। সুইটি বেগমকে আটকানোর জায়গায় সব বলে দিয়েছে।” বলে চোখ নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো সে।

আশানুরূপ কোনো উত্তর না পেয়ে পিয়াস আবার চোখ তুলে তাকালো সিয়ামের দিকে। সিয়ামকে চোখ বুঝে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখে পিয়াস কি প্রতিক্রিয়া করবে বুঝতে পারলো না। নিভে যাওয়া গলায় বললো “। শুনলি সিয়াম..? কিছু তো বল..? রাসেল কি করে এমন করতে পড়লো..? সবচেয়ে বেশি ভরসা করেছিলাম আমরা ওকে।”

সিয়াম এবার হালকা চোখ খুলে বললো ” উম হুম ! কি জানিস তো পিয়াস আমরা যাকে সবচেয়ে বিশ্বস্ত ভাবি দিন শেষে তারাই পিঠে ছুঁড়ি মারে। ওর যে আমার উপর রাগ ছিলো আমি বুঝেছিলাম তবে এতটা করবে বুঝিনি। যাক ছাড় ওসব ও নিজের শাস্তি নিজে পাবে যখন এই কোম্পানি থেকে বেরিয়ে অন্য কোম্পানিতে অ্যাপ্লাই করবে। মিলিয়ে নিস তুই ঠিক এক মাস পরই ও এখানে আমার সামনে থাকবে। আর সত্যি তো একদিন জানারই ছিলো আজ না হোক কাল। কিন্তু এখন আমার চন্দ্রার জন্য বেশি চিন্তা হচ্ছে। এসব ছাড় এখান থেকে বেরোতে হবে এখন চন্দ্রার কাছে যাওয়া বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। গার্ড দের ইনফর্ম কর। ”

পিয়াস মাথা নাড়িয়ে বেরোতে গেলেই সেই রুমে আওয়াজ হলো দরজায়। সিয়াম ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তার এই রুমে পিয়াস ব্যতীত অতি দরকার ছাড়া কেউ আসে না। তাহলে..?”

পিয়াস সিয়ামকে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে বাইরে গেলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার সে রুমে ঢুকলো এবার তাকে আগের থেকে বেশি চিন্তিত লাগছে। সিয়াম হাঁপ ছাড়ল। আজ সকালটা বোধহয় না হলেই ভালো হতো।
পিয়াস এবার এসে বললো ” বেরোনো যাবে না সিয়াম এখন বাইরে প্রচুর ভির প্রেস মিডিয়া সমান তালে ভিড় বেড়েই চলেছে। সবার তোকে চাই নইলে ঝামেলা করবে।”

সিয়াম এবার সত্যিই চিন্তায় পড়লো ভীষন। এইদিক সে সামলে নেবে কিন্তু ওই দিক চন্দ্রা একা কীভাবে সামলাবে..? সে চেয়েও এখন এখন থেকে বেরোতে পারবে না।

শেষমেশ পিয়াসকে কিছু বলে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।

____________________________________

অপূর্ব সিয়ার জন্য দুই ব্যাগ চকলেট নিয়ে এসেছে। আর সেই সব পেয়ে সিয়া খাবার দাবার ছেড়ে সেইগুলো নিয়ে বসেছে।
সায়মা বেগম সেই নিয়ে ছেলেকে বকেই যাচ্ছে তখন থেকে। কেনো সে এই খাবার সময় এতগুলো চকলেট এনেছে।
অপূর্ব কপাল চাপরালো। তার তো এখন নিজেকে এই বাড়িতে থাকা ভারাটে লাগছে। যাই হোক আসেপাশে সব দোষ তার হয়ে যাচ্ছে।
এই তো আগের দিন রাতেই পকোড়া গুলোয় একটু নুন হয়ে গিয়েছিল। সিয়া সেই শুনে মুখ ফুলিয়ে সায়মা বেগমের কাছে নালিশ ঠুকেছে, আর সেই নিয়েই কি ঝামেলা, সায়মা বেগম, অলীক সাহেব সবাই বেশ ভালো করেই বকেছে তাকে। লজিক দিয়ে বুঝিয়েছে মাঝে মাঝে তরকারিতে নুন বেশি খেতে হয়। এইসব লজিক শুনে অপূর্বের অর্ধেক রাত অবধি ঘুম আসেনি।

সব মেনে নিলেও সিয়ার ওই মুখ ফোলানো তার সহ্য হয়নি। তাই ডিউটি থেকে আর্জেন্ট ছুটি করিয়ে গোলাপ আর চকলেট নিয়ে হাজির হয়েছে। গোলাপ গুলো সিয়াকে যদিও দেওয়া হয়নি এখনও।
.
.
সিয়া দুই হাতে দুটো চকলেট খেতে খেতে রুমে ঢুকলো। অপূর্ব তাকে কিছুক্ষন দেখে হেসে এগিয়ে গিয়ে টিস্যু দিয়ে মুখ নাক গাল মুছিয়ে দিল। সিয়া স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ” বুকটা তার ধক ধক করছে হটাৎ।”
অপূর্ব সেইরকম হাসি মুখ করেই বলল “বাচ্চাদের মতো নিজেও খেয়েছো নাক গালকেও খাইয়েছ দেখছি।”

সিয়া মুখ ফুলিয়ে বিছনায় পা তুলে বসলো। চকলেট এনে দিয়েছে বলে আর ঝগড়া করলো না। হটাৎই তার মনে পড়লো কতদিন সে চকলেট খায় না। একসময় ভীষণ পছন্দের ছিলো তার চকলেট। টাকা থাকলেই সিয়া এদিক ওদিক থেকে চকলেট কিনে খেতো। কিন্তু আতিফের পড়াশোনা শেষে চাকরির জন্য অ্যাপ্লাই করার সময় থেকেই সে এসব ছোটো ছোটো জিনিসে পয়সা খরচ করা ছেড়ে দিয়েছিল। খালি মনে হতো ওই টাকা বাঁচিয়ে আতিফকে কিছু একটা কিনে দেবে। সিয়ার আর গলা দিয়ে নামলনা চকলেট মনটা বিষয়ে গেছে তার।

অপূর্বের শান্ত ধীর গলায় তার নাম শুনে তার দিকে ফিরলো সে।
অপূর্ব কিছুটা হাঁপ ছেড়ে বললো ” আজ আতিফকে দেখলাম হসপিটালে। বউয়ের সাথে এসেছিল। আমায় না চিনলেও আমি ঠিকই চিনেছি। কিন্তু তার মুখ দেখে আমার কেমন যেনো লাগলো ঠিক ভালো না। একবার মনে হয়েছিল গিয়ে কথা বলি মেরে ওখানেই মুখটা ভেঙে দি। কিন্তু করিনি তোমার অপমান আমার সহ্য হতো না আর ওখানেই খুন করে দিতাম আমি রাস্কেল টাকে।”

সিয়া তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো “ভালোই আছে। ভালো থাকার জন্যই তো ছেড়ে গেছে। আর প্লিজ অপূর্ব ওর কথা আর তুলবে না কখনো।” বলে আবার চকলেটে কামড় বসালো।
অপূর্ব সিয়ার দিকে তাকালো। কষ্ট দিয়ে ফেললো কি মেয়েটাকে..? কবে সে মানসিক শারীরিক দিক থেকে নিজের করে পাবে মেয়েটাকে..? কবে তার হয়ে যাবে পুরোপুরি..? আদেও হবে তো.?

অপূর্ব আনা গোলাপ ফুল গুলো বিছানায় একপাশে রেখেই চলে গেলো রুমের বাইরে। সিয়া কিছুক্ষন পর লক্ষ্য করলো ফুলগুলোকে। সেগুলো হাতে নিয়ে মুচকি হাসলো রুমের দরজায় দিকে তাকিয়ে।

______________________________

সিরাজের জোড়াজুড়িতে ফোনটা অন করতেই হয়েছে ইন্দ্রাকে। নয়তো সে হুমকি ধমকি দিয়ে গেছে পরে এমন ফোনে না পেলে বাড়ি থেকে এসে তুলে নিয়ে যাবে। ইন্দ্রা বেশ ভয় পায় এই বেখেয়ালি ছেলেটাকে কখন যে করে বসে। তাই ইন্দ্রা আর রিস্ক না নিয়ে সিরাজের কথা মত ফোন খুলে রেখেছে। কিন্তু তার এখন মনে হচ্ছে কেনো খুললো সে ফোন টা..?

সিরাজ অলরেডি চার ঘণ্টায় দশবার ফোন করে ফেলেছে।
প্রত্যেক বারই ইন্দ্রা কারণ জিজ্ঞেস করলে বলেছে সে চেক করছে ইন্দ্রা ফোন আবার বন্ধ করলো কিনা।

লাস্ট ফোন আসার কয়েক মিনিট পর আবার ফোন আসতেই ইন্দ্রা এবার ফোন তুলে রেগে বললো “কি হয়েছে টা কি বলবেন..? এতবার ফোন করার কোনো মানে হয়..? আমি একটা কাজ করতে পারছি না ঠিক ভাবে।”

সিরাজ ওপাশ থেকে বললো “আমার সন্দেহ হচ্ছে তোমার উপর যদি আবার ফোন বন্ধ করে দাও। তুমি এই কলে থেকেই বাকি কাজ করো।”

ইন্দ্রা হাঁপ ছাড়ল। হ্যাঁ তার কাছে আপাতত এটাই বেটার বার বার ফোন ধরার চেয়ে।

ফোনের ওপাসে সিরাজ মুচকি হাসলো। মেয়েটাকে সারাক্ষণ জ্বালাতে তার মাঝে যে খুশি হয় সে সেই খুশি আর কিছুতে পায় না।

# চলবে..?