Friday, August 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 464



প্রিয়তার প্রহর পর্ব-১৪

0

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা (১৪ )
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

নিয়াজ শেখ নিজেকে আবারো আয়নায় দেখে নিলেন। আধঘন্টা ধরে আয়নায় নিজেকে দেখে যাচ্ছেন তিনি। নিজেকে আজকাল কেমন তরুণ যুবক মনে হচ্ছে উনার। হৃদয়ে ঢেউ খেলছে। যদিও বয়স উনার একচল্লিশ ছুঁই ছুই। চুলগুলোকে চিরুনি দ্বারা আচরে নিয়ে চাপ দাড়িতে হাত বুলালেন নিয়াজ। তানিয়া ঘড়ি পড়তে পড়তে ঘরে এসে বাবার দিকে তাকাল এক নজর। মুচকি হাসল সে। নিয়াজ সবুজ রঙের পাঞ্জাবি পড়েছেন। পারফিউমের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। তানিয়া এগিয়ে এলো আয়নার সামনে। বাবার সম্মুখে এসে বললো,

” বাব্বাহ্! ভালোই তো রেডি হয়েছো। ইউ আর লুকিং সো হ্যান্ডসাম বাবা।

নিয়াজ বিব্রত হলেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন,

” কি যে বলো না তুমি তানি। এখন কি আর সেই সৌন্দর্যের বয়স আছে?

” কেন থাকবে না? তুমি এখনো কিন্তু সুন্দর। সৌন্দর্যের আবার বয়স কিসের?

” আচ্ছা এসব না করলে হতো না? এই বয়সে এসে?

তানিয়া রেগে গেল। বাবার বাহু ধরে টেনে বাইরে এনে ফ্ল্যাট লক করে দিল। আজ নিয়াজ শেখ তাসলিমা খাতুনের সাথে দেখা করতে যাবেন। নির্দিষ্ট একটা রেস্টুরেন্টে বসে আলাপ আলোচনা করবেন দুজন। তানিয়ার খুশি খুশি লাগছে। পিতার জীবনে নতুন মানুষের আগমনে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে তানিয়ার মন। তানিয়া জানে নিয়াজ খুব নার্ভাস। সেজন্য বাবার সাথে নিজেও যাচ্ছে পাত্রী দেখছে। এই বিষয়টা কেমন নতুন নতুন লাগছে। এরকমটা আগে বুঝি হয়েছে কখনো?

____________

একটা ছোটখাটো রেস্টুরেন্টের মাঝের চেয়ারে বসেছেন নিয়াজ আর তাসলিমা। তাসলিমা খাতুনের পরণে মসলিন শাড়ি। চুলগুলো হাত খোঁপা করা। ঠোঁটে মেরিলের চিহ্ন। তাসলিমা খাতুনের হাবভাবে জড়তা নেই। স্বাভাবিক ভাবেই পুরো রেস্টুরেন্টটা পর্যবেক্ষণ করছেন তিনি। তানিয়া ওয়াশরুমের কথা বলে বেরিয়ে গিয়েছে। তাসলিমার বুঝতে বাকি নেই তানিয়া তাদের দুজনকে আলাদা কথা বলার সময় দিচ্ছে।

তসলিমা খাতুন দু কাপ চা অর্ডার করলেন। নিয়াজ বোকা হাসলেন। সেদিকে তাকিয়ে হাসলেন তাসলিমা খাতুন নিজেও। বললেন,

” আপনি বোধহয় অসস্তি বোধ করছেন।

নিয়াজ ভড়কালেন। এই বয়সে এসে পাত্রী দেখা আবার বিয়ে করা সবটাই যেন কাল্পনিক মনে হচ্ছে। সাধারণত এইসব টিভি সিরিয়ালেই দেখা যায়। বাস্তবেও যে এমনটা ঘটে সে ঘটনা দূর্লভ। নিয়াজের মনে হচ্ছে তিনি পাত্র দেখতে আসেননি। তাকেই পাত্রী দেখতে এসেছে। একটু হেসে তিনি বললেন,

” বুঝতেই পারছেন এই বয়সে এসে বিয়ে বিষয়টা বেমানান। আমার মেয়েটার বয়স বাড়লেও কি হবে? বাচ্চামিতে সবসময় এগিয়ে। কি পাগলামী করে বেড়াচ্ছে।

” আপনার মেয়েকে কিন্তু আমার ভালো লেগেছে। চা য়ে চুমুক দিয়ে কথাটা বললেন তাসলিমা। পুনরায় বললেন,

” আপনি বিয়ে করেননি তানিয়ার জন্যই। তাইনা?

” তা বলতে পারেন। সৎ মা ওর সাথে কেমন আচরণ করবে এই ভেবে আর এগোতে পারিনি।

” এখন কেন মনে হলো বিয়ে করা দরকার?

” কারণ আমি উপযুক্ত পাত্রী পেয়েছি। যিনি আমার মেয়েকে নিজের মেয়েই ভাববেন।

” এত কনফিডেন্ট?

” আমার মেয়ে কিন্তু পুলিশে কর্মরত। ও কিন্তু আপনার সম্পর্কে সবকিছু জেনেই আমাকে জানিয়েছে। আপনার ব্যক্তিত্বে আমার মেয়েটা মুগ্ধ হয়েছে। আমি বুঝতে পেরেছি আপনাকে নিয়ে আমার মেয়ের কখনো কোনো অভিযোগ করতে ইচ্ছে হবে না। আপনি কি চান বলুন। আপনি রাজি না হলে এখনই উঠবো আমি। আমার মেয়েটা আপনাকে ভালোমতো চিনে বলে ভদ্রতাসূচক এখানে বাধ্য হয়ে বসে থাকবেন এমনটা কিন্তু করা যাবে না। সোজাসুজি বলবেন।

তাসলিমা হাসলেন। আরো এক কাপ চা অর্ডার করলেন। মুচকি হেসে বললেন,

“বসুন।

____________

সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষণ। টিউশন থেকে ফিরে চুলায় ভাত আর ডাল বসিয়েছে প্রিয়তা। শীত ভালোই ঝেঁকে বসেছে। জ্বরের কারণে আরো বেশি শীত লাগছে প্রিয়তার। হু হু করে কাঁপছে কায়া। হুট করে ঊদিত হওয়া শীতল বাতাসে হু হু করে শিহরণ জাগাচ্ছে দেহে। হাতে হাতে ঘর্ষণ দিয়ে হাত গরম করার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে প্রিয়তা। মাঝে মাঝে আগুনের কাছে হাত রেখে সেই হাত গালে চেপে ধরছে।

ডাল আর ভাত হলে প্রিয়তা ঘরে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল। একটু আগেই আরহাম ঘরে ছিল। এখন কোথায় গেল? মাথায় ওড়না চেপে শালটাকে আরো গভীর ভাবে জড়িয়ে নিল প্রিয়যা। নভেম্বরের এই শীতের মাসে সন্ধ্যে হবার পরে আরহাম কোথায় যাবে? চিন্তা হলো প্রিয়তার। বেলকনিতে গিয়ে আশপাশে চোখ বুলাতেই মাঠে আলোর ঝলকানি দেখল প্রিয়তা। মাঠের ঠিক মাঝে অনেকগুলো শক্তপোক্ত পুরুষের দেখতে পেল। লম্বাটে, ফর্সা কয়েকজন মেয়েকেও দেখল প্রিয়তা। মাঠের মাঝে দু দিকে দুটো বাঁশ পুঁতে রাখা হয়েছে। বাঁশের উপরের শেষ অংশে কতকগুলি বাল্প লাগানো হয়েছে। পুরো মাঠটা সেই বাল্পের আলোতে আলোকিত হয়ে আছে। ব্যাডমিন্টন খেলছে সকলে। হাতে খেলার সামগ্রী। আরহাম পাশেই তানিয়ার কোলে বসে আছে। তানিয়া ব্যাডমিন্টন হাতে নিয়ে আরহামকে এটা ওটা দেখাচ্ছে। কারো গায়েই শীতের বস্ত্র নেই। মোটা শাল আর সোয়েটার ঘাসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। শব্দ শোনা যাচ্ছে সবার কথার।

প্রিয়তা নিচে নেমে এলো। রান্না হয়েছে, আরহামের খাওয়া প্রয়োজন এখন। সন্ধ্যের সময় বাইরে না থাকাই উচিত বলে মনে করে প্রিয়তা। প্রিয়তা ধীরে ধীরে নিচে নেমে এসে ডাকল আরহামকে। এত মানুষ এখানে উপস্থিত বলে উচ্চস্বরে ডাকল না। আর প্রিয়তার এমন শান্ত কণ্ঠ কানে পৌঁছাল না আরহামের। বাধ্য হয়ে মাঠে এসে দাঁড়াল প্রিয়তা। ইহান আর প্রহর তখনো খেলছে। একের পর এক ধাক্কা দিচ্ছে কক টাকে। নেটের উপর দিয়ে বারংবার উড়ছে কক টা।

প্রিয়তা তানিয়ার কাছে এসে তানিয়াকে জিজ্ঞেস করলো,

” কেমন আছেন আপু?

তানিয়া হাসল প্রিয়তাকে দেখে। ব্যাডমিন্টন হাত থেকে নামিয়ে বলল,

” ভালো আছি। তোমার কি খবর?

” এই তো চলছে।

প্রিয়তা আরহামের হাত ধরে তানিয়ার কোল থেকে উঠাল। বললো,

” ঘরে চলো। এখানে সবাই বড় বড় মানুষ। তুমি এখানে কি করছো?

আরহাম সবার দিকে তাকাল। অতঃপর হাসিহাসি কণ্ঠে বললো,

” প্রহর ভাইয়া আমাকে এনেছে। জানো আমি খেলতে পারি এখন। ইহান ভাইয়া আর প্রহর ভাইয়া আমাকে শিখিয়েছে।

” রান্না করেছি। খেয়ে আবার আসবে। এখন চলো।

প্রহর খেলা থামাল। প্রিয়তার পানে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। বললো,

” এখানে খাবার দাবারের আয়োজন করা হয়েছে। আপনি আসুন না আমাদের সাথে, ভালো লাগবে।

” আপনাদের কাজটাজ নেই? এই ভরসন্ধ্যায় খেলছেন? শীত কেমন পড়েছে দেখেছেন? সর্দি, জ্বরে ভুগবেন।

এতক্ষণ ধরে প্রিয়তার অঙ্গভঙ্গি, কথা বলার ধরণ সবটাই পর্যবেক্ষণ করেছে পুলিশ ফোর্সের অন্যতম সদস্য সোহেল। প্রিয়তাকে ওর ভালো লাগতো প্রথম থেকেই। কখনো শত্রুপক্ষের লোক বলে মনে হয়নি। তবে প্রহর স্যারের কথামতো মেয়েটার খোঁজ খবর সবটাই বের করেছে সোহেল। মুচকি হেসে জ্যাকেট গায়ে দিয়ে ছেলেটা এগিয়ে এলো সামনে। বললো,

” পুলিশ বলে কি আমরা মানুষ নই প্রিয়তা? বিনোদন তো আমাদের ও দরকার নাকি?

প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকাল। সামনের মানুষটা যথেষ্ট সুন্দর এবং সাবলীল। প্রিয়তা প্রশ্ন করলো। বললো,

” আপনি আমার নাম জানেন?

” জানবো না? এক সময় আপনাকে ভিলেইন ভেবেছি। সমস্ত খবরাখবর কালেক্ট করেছি। আপনাকে না চিনলে হবে?

হাসল প্রিয়তা। বিষয়টা সত্যিই মজার। একটা সময় তার পিছনে অনেক পুলিশ লেগে ছিল। অথচ প্রিয়তা সেসব ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। মুচকি হেসে সে বললো,

” এখনো ভিলেইন মনে হয়?

বাঁকা হাসল সোহেল। ভ্রু চুলকে মাথার পিছনের অংশ চুলকে দিল মুচকি হেসে। প্রিয়তা চলে এলো সেখান থেকে। আরহাম আর বাকিদের জন্য চিকেন ফ্রাই, নুডলস, স্যান্ডুইচ আনা হয়েছে। আরহাম প্রিয়তার সাথে খেতে চাইলেও প্রহর আরহামকে কোনোমতেই ছাড়বে না বলে দিল। পুলিশ ফোর্সের সকলে প্রিয়তাকে অনুরোধ করেছিল তাদের সাথে থাকার জন্য। প্রিয়তা থাকেনি,চলে এসেছে। রাতে আবার মাঠে উপস্থিত থাকায় ওখানকার অনেকগুলো মেয়ের সাথে আলাপ হয়েছে প্রিয়তার। সকলের সাথে আড্ডা হয়েছে কিছুক্ষণ। প্রিয়তার শান্তি শান্তি লাগছে আরহামকে এমন খুশি থাকতে দেখে। ভাইকে ফিরে পেয়ে জ্বর হুট করেই নেমে গেছে প্রিয়তার। একটু সুস্থ বোধ করছে।

__________

ভোরে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙেছে প্রিয়তার। অদ্ভুত বলা যায় না তবে সেই স্বপ্ন মানানসই ও নয়। আরহামকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছিল প্রিয়তা। দুদিন পর ভাইকে পেয়ে খুশিতে রাতে কেঁদেও ছিল আরহামের আড়ালে। ভোরে প্রিয়তার চোখে ভেসে উঠেছে এক বেমানান কল্পনা। প্রিয়তা স্বপ্নে দেখেছে পুলিশম্যান তাকে বাহুডোরে আটকে রেখেছে। প্রিয়তার কানে ফিসফিস করে কিছু বলছে। ওই কথাটুকু প্রিয়তার মনে পড়ছে না। এই হয়েছে প্রিয়তার এক জ্বালা। স্বপ্নে দেখা ঘটনা গুলোর পুরোটা মনে রাখতে পারে না প্রিয়তা, ভুলে যায়। বারংবার মনে করার চেষ্টা করলেও মনে করতে পারছে না পুলিশম্যান তাকে কি বলেছিল। সব হাবিজাবি এবড়োথেবড়ো ভাবে মনে পরল। এ স্বপ্নের কথা যদি প্রহর জানে? লজ্জায় মরে যাবে প্রিয়তা। বিব্রত হবে প্রহর। বন্ধুত্বের সম্পর্ক কোনোভাবেই প্রণয়ে পরিণত হতে পারে না। হতে দিবে না তারা।

প্রিয়তা এখনকার টিউশন বিকেলে। টিউশনির জীবনে দেখতে দেখতে এস মাস পেরিয়ে গেল প্রিয়তার। কখনো কি ভেবেছিল বেঁচে থাকার জন্য টিউশনি করতে হবে? আরিফ হোসাইন সবসময় প্রিয়তাকে বলতো ” আমার ছেলে মেয়ে হীরের মতো যত্নে থাকবে। কোনো কাজ করতে হবে না ওদের। প্রয়োজন পরলে প্রিয়তার বিয়ের সময় মেয়ের সাথে কাজের লোক পাঠিয়ে দিবো আমি। আমার মেয়ের কি কম আছে”?

প্রিয়তা ফিক করে হেসে দিল। প্রিয়তার কি আছে এখন? কিচ্ছু নেই। একজন আগলে রাখার মানুষ অবধি নেই, নিজস্ব ছাদ নেই। উপযুক্ত কর্মের ব্যবস্থা নেই। আছে শুধু তিনটে টিউশন। তা টিকবে কি না এ নিয়ে ভয়ে থাকে প্রিয়তা। কোচিংয়ের সবাই তার কথা বুঝতে পারে কি না, পড়া বুঝতে পারে কি না, এ নিয়ে বেশ চিন্তায় থাকে প্রিয়তা। অনিশ্চিত এই জীবনে নিশ্চয়তার আশায় বেঁচে থাকতে হচ্ছে তাকে।

আরহাম ঘুম থেকে উঠল সকাল নটায়। প্রিয়তার তখন শাক রান্না শেষ। ভাত বসিয়েছে মাত্র। আরহামকে উঠতে দেখে ব্রাশ করিয়ে দিয়ে হাত-মুখ ধুইয়ে দিল ছেলেটার। শার্ট -প্যান্ট পড়িয়ে, চুল আঁচড়ে ছোট একটি বল সহ মাঠে পাঠিয়ে দিল। দু মিনিট পর দরজার খটখট আওয়াজে অবাক হলো প্রিয়তা। আরহাম বেরিয়েছে মাত্র। এখনই ফিরে আসার ছেলে তো সে নয়। কিছু হলো নাকি? চিন্তিত ভঙ্গিতে দরজা খুললো প্রিয়তা। দরজার ওপাশে থাকা লোকটাকে দেখে ভীতিগ্রস্থ হলো সে। চোখ বড় বড় হয়ে এলো। জাফর আলী তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে হাস্যজ্জল মুখে। লোকটার কোলেই আরহাম। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে জাফর আলী হাসল। বললো,
” ঘরে ঢুকতে দিবে না? এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবো? ভয় পেও না। আমি কিন্তু তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী।

প্রিয়তা ভড়কাল। দ্রুত আরহামকে টেনে নিজের কোলে নিল। আশপাশে তাকিয়ে লোক খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। কপালে ভাঁজ পড়ল প্রিয়তার। অজানা ভয়ে কেঁপে উঠল হৃদয়। ঢোক গিলে জিভ দ্বারা ওষ্ঠদ্বয় ভিজিয়ে নিল। খানিক বড় বড় শ্বাস ফেলে রুদ্ধশ্বাসে বললো,

” আপনি? আপনি এখানে কেন?

” সব কথা এখানেই বলবো? ঘরে ঢুকতে দাও।

” এখানেই বলুন। আমি কিন্তু মানুষ ডাকবো।

” আশ্চর্য মিস প্রিয়তা, তুমি আমাকে ভয় পাচ্ছো কেন? লোক ডাকলে তোমার-ই ক্ষতি। আমার পায়ে কিন্তু গান আছে। যেকোনো মুহুর্তে তোমার ভাইকে শ্যুট করে দিতে পারি। তাই যা করবে ভেবেচিন্তে করো।

প্রিয়তা আঁকড়ে ধরলো আরহামকে। ভয়ে অস্বাভাবিক ভাবে বুক কাঁপল প্রিয়তার। ভাইকে হারানোর ভয় ফুটে উঠল চোখে মুখে। বারংবার শ্বাস ফেলল প্রিয়তা। বললো,

” আমরা আপনার কি ক্ষতি করেছি?

” ক্ষতি করোনি বলেই এখনো বেঁচে আছো। ক্ষতি করলে কি বেঁচে থাকতে? আমি তোমাদের ক্ষতি করতে আসিনি। সো কুল।

প্রিয়তা ঘামতে লাগল। দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। শার্টের উপরের কোর্ট ঠিকঠাক করে হাসিমুখে ঘরে ঢুকল। ঘরটার আশপাশে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো কিছুক্ষণ। আরহামকে কোলে নিয়ে ঘরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে রইল প্রিয়তা। জাফর বললো,
” তোমার একটা সাহায্য দরকার আমার। যত টাকা চাইবে আমি দিতে পারবো।

” কি সাহায্য? কি বলছেন?

” পুলিশ অফিসার আজওয়াদ ইশতিয়াকের সাথে তোমার সম্পর্ক কেমন? সত্যি করে বলবে। আমি যদি বুঝতে পারি তুমি মিথ্যে বলছো দ্যান ইউর ব্রাদার উইল বি ফিনিশ।

” উনি আমার বন্ধু। দ্যাটস ইট। এছাড়া আমাদের মাঝে আর কোনো সম্পর্ক নেই। আপনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন।

” আসল কথায় আসি। ওই পুলিশ অফিসারের মান সম্মান একদম ধুলোয় মিশিয়ে দিতে হবে। প্রেমের ফাঁদে ফেলতে হবে। এরপর অপবাদ দিয়ে পুলিশের পদবি কেড়ে নিতে হবে। ব্যস এটুকুই কাজ।

অবাক হলো প্রিয়তা। ওষ্ঠদ্বয় কেঁপে উঠল। ভয়ে থিতিয়ে গেল প্রিয়তা। এমন নোংরা কাজ করার কথা তো কল্পনায় ও ভাবতে পারে না প্রিয়তা। পুলিশম্যান অনেক ভাবে সাহায্য করেছে তাকে। সাহায্যের মর্যাদা এভাবে দিবে সে?

প্রিয়তা ভাইয়ের দিকে তাকাল। আরহাম ভয় পেয়েছে ভিষণ। বারংবার চোখের ঘন পাপড়ি এক করছে ছেলেটা। প্রিয়তা কি করবে ভেবে পেল না। এই মুহুর্তে জান বাঁচাতে হবে এটুকু মাথায় সেট করে নিল। বললো,

” উনার সাথে এমনটা করতে চাইছেন কেন? আর সেদিন আব্বুর বন্ধু সেজে আমার সাথে দেখা করলেন কেন? কথা বললেন কেন?

” আমার টার্গেট যে তুমি ছিলে। কথা বলে বুঝতে হবে না তোমার দ্বারা কাজটা হবে কি না?

” প্রহর স্যার ভেবেছিল আমি আপনার সাথে কোনোভাবে যুক্ত। যদিও সেই ভুল উনার ভেঙেছে। আপনার জন্য প্রথমে আমাকে অপরাধী ভাবা হয়েছিল।

” ওই পুলিশ অফিসারকে সাসপেন্ড করতে না পারলে আমার নাম জাফর না। আমার পেছনে লেগেছে না? ওর কোনো ধারণা আছে আমার সম্পর্কে? যেকোনো মুহুর্তে আমার লোক ওকে মেরে গুম করে দিতে পারে। কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে। জনগন জানে প্রহরের আমার প্রতি রাগ আছে। আমার সব অজানা তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করছে ওই পুলিশ। ও মরলে সন্দেহ আমার দিকে আসবে। সব কটা পুলিশ ওর আন্ডারে রয়েছে। আঙ্গুল আমার দিকে দেবে সবাই। সব পুলিশকে মারা সম্ভব নাকি?

প্রিয়তা চুপ করে রইল। চোখ বেয়ে অঝরে অশ্রু ঝরল। বিষাদে ছেয়ে গেল হৃদয়। কণ্ঠ আটকে আসল। জড়তা ভর করলো কণ্ঠে। জাফর পুনরায় বললো,

” তুমি যদি কাজ টা না করো তোমার ভাই আর তোমাকে শেষ করতে দু সেকেন্ড সময় ও লাগবে না আমার। আর এই কথা ওই পুলিশের কানে গেলেও কিন্তু তোমার ভাই শেষ। ভাইকে ভালোবাসো তো? আহ্ কি মিষ্টি বাচ্চা।

প্রিয়তা ভয় পেল। মোলায়েম হাত দ্বারা আরহামকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিল। প্রিয়তার বক্ষপিঞ্জরে ঠেসে ধরলো আরহামকে। বললো,
” আমার ভাইয়ের কিছু করবেন না প্লিজ। ও নিষ্পাপ একটা ছেলে।

” তাহলে আমার কথা মেনে নাও।

প্রিয়তা মাথা নত করলো। এইভাবে এই কেসে সে ফেঁসে যাবে কখনো ভাবেনি সে। এত সহজ সরল একটা জীবনে এত জটিলতা কেন সৃষ্টি হলো? কেন এত ফাঁদে পড়তে হলো তাদের? প্রিয়তা তো এসব চায়নি। স্বাধীনভাবে বাঁচতে চেয়েছে সে। কোনরুপ ঝামেলায় কখনো জড়াতে চায়নি। কিন্তু এ বাড়িতে আসার পর একেক সময় একেক ঝামেলার মুখোমুখি হচ্ছে সে। এসব থেকে বের হবার উপায় কি? কি করলে মুক্তি মিলবে?

__________________

ডেস্কের তিন পাশের তিনটি চেয়ারে বসে আছে ইহান, প্রহর আর তানিয়া। তিনজনের পরণে ব্লু রঙের পুলিশের পোশাক। গোল্ডেন নেইমপ্লেটে মাঝারি অক্ষরে সকলের নাম লেখা। ডেস্কের মাঝে রয়েছে গোটাকয়েক ফাইল,কলমের ঝুড়ি, ক্যাপ আর কফির খালি কাপ। ফাইল ঘাটতে ঘাটতে ইহান প্রহরের উদ্দেশ্যে বললো,

” নিয়াজ আঙ্কেলের বিয়েতে যাবি না প্রহর? ছুটি নিতে হবে একসাথে। স্যার কি দিবে ছুটি?

” আঙ্কেলের বিয়ে কনফার্ম? জিজ্ঞাসু কণ্ঠে প্রশ্ন করলো প্রহর। তাকাল তানিয়ার দিকে।

তানিয়া ঠোঁট চেপে হাসল। বললো,

” মনে তো হচ্ছে তাই। গতকাল বাবার সাথে আন্টির দেখা হয়েছে। কথাও হয়েছে। বাবাকে দেখে মনে হয়নি আন্টি নাকচ করেছেন।

” ছুটি নিলে একসাথেই নিতে হবে। তানিয়ার বাবার বিয়ে বলে কথা। বলে উঠল প্রহর।

ইহান বলে উঠলো,

” ছুটি তো আরো একবার নিতে হবে। সামনেই তো আবার তানিয়ার বিয়ে।

মুখ কুঁচকে ফেলল তানিয়া। বললো,
” এটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে স্যার। বাবার বিয়ে ভাবছি শুধু। এটা নিয়ে আমি সত্যিই খুব এক্সাইটেড।

তিনজন গল্প করলো একটু। একজন এসিসট্যান্ট এসে সালাম জানাল তিনজনকে। বিনীত ভঙ্গিতে বললো,
” একজন বয়স্ক লোক এসেছে থানায়। আপনাদের সাথে দেখা করতে এসেছে। আসতে বলবো?

তানিয়া বললো,
” আসতে দাও এখানে।

এসিসট্যান্ট চলে গেল সালাম গিয়ে। তিনজন অপেক্ষায় রইল লোকটার জন্য। দু মিনিট বাদে একজন বয়স্ক লোক কেবিনে এলো। সালাম জানাল স্বাভাবিক ভাবেই। ইহান নিজের চেয়ার ছেড়ে দিয়ে বসতে দিল লোকটাকে। প্রহর মার্জিত ভঙ্গিতে বললো,

” আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি বলুন।

লোকটার চোখ চিকচিক করে উঠল। বললো,

” স্যার আমার পোলা হারাই গেছে। জিডি করতে আইছি স্যার।

ইহান জিজ্ঞেস করলো,
“কবে হারিয়ে গেছে?

” দুইদিন হইছে স্যার।

তানিয়া ভ্রু কুঁচকাল। চশমা ঠেলে বললো,
“ছেলে হারিয়েছে দুদিন। আপনি আজকে পুলিশের কাছে এসেছেন?

” কি করমু স্যার কন? পুলিশের কাছে আইলেই ট্যাকা দরকার। এদিক ওইদিক ছোটাছুটি করতে হয়। আমি আগে সবজায়গায় খুঁজছি পোলারে। তারপর আপনাগো কাছে আইছি।

প্রহর গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
” জিডি করতে টাকা লাগে না। আপনি আপনার ছেলের সমস্ত ডিটেইলস বলে যান। আমরা আপনার ছেলেকে খুঁজে বের করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো কথা দিচ্ছি।

লোকটা তার ছেলের সমস্ত তথ্য দিল। তা দ্রুত খাতায় তুলে নিল তানিয়া। ছেলেটার নাম সাকিব। বয়স এগারো। স্কুল থেকে আর বাসায় ফিরেনি ছেলেটি। ছেলেটির বাবা-মা দুদিন ধরে খুঁজেছে ছেলেটাকে। নতুন কেস পেয়ে ভালো লাগলেও ঝামেলা ঝামেলা লাগল। না জানি কেসটাতে কত পরিশ্রম দিতে হবে,কত সময় লাগবে কে জানে?

________________

জামাকাপড় তুলতে গিয়ে প্রহরের সাথে দেখা হলো প্রিয়তার। মনে পরে গেল জাফর আলীর সব কথা। প্রিয়তা কথা বলতে চাইল না প্রহরের সাথে। দ্বিধায় পুড়ছে সে। কোনদিকে যাবে ভেবে পাচ্ছে না। বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে। নির্দিষ্ট একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছে না প্রিয়তা। এ যে ভিষণ যন্ত্রণার।

প্রিয়তাকে আলাপ শুরু করতে হলো না। প্রহর নিজেই জিজ্ঞেস করলো,

” কেমন আছেন প্রিয়তা।

” এইতো চলছে। আপনি কেমন আছেন?

” ভালো আছি। আজ নতুন কেস এসেছে থানায়। ওটা নিয়েই একটু চিন্তায় আছি।

” আপনারা তিনজন মিলে অবশ্যই কেসটা সলভড করতে পারবেন।

” আমার ও তাই বিশ্বাস। আচ্ছা আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?

” হ্যাঁ করুন না।

” আপনার দাদা-দাদি, নানা-নানি এরা কোথায়? তাদের কাছে যান নি কেন আপনারা?

প্রিয়তা হাসল। মনটা বিষিয়ে উঠল নিমিষে। সামনে থাকা মানুষটা প্রিয়তাকে নিয়ে ভেবে যাচ্ছে সর্বক্ষণ। আর এই লোকটার জীবনেই বিপদ আনতে যাচ্ছে প্রিয়তা। কি বিশ্রী ব্যাপারস্যাপার। মলিন মুখে প্রিয়তা বললো,

” আমার দাদা-দাদি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। ঊনিশশো একাত্তরের যুদ্ধতে উনারা মারা গিয়েছেন। আব্বু তখন খুবই ছোট ছিল। আব্বু মানুষ হয়েছে আব্বুর চাচার কাছে। আব্বু যখন চাকরিতে জয়েন করে নিজের পায়ে দাঁড়ায়, তখন আব্বুর সেই চাচা ইউ এস এ চলে যান। উনার সাথে আব্বুর যোগাযোগ হয় ফোন কলে। আর আম্মুর বাবা-মা অর্থাৎ আমার নানা-নানি থাকেন গ্রামে। আমার মামা একজন অসৎ মানুষ। প্রচন্ড লোভী লোকটা। আমার নানা-নানির সব সম্পত্তি নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছে মামা। আমার নানা নানি নিজেরাই মামার অধীনে বাঁচেন। মামা-মামী খেতে দিলে খায় না দিলে নাই এমন। আম্মু মাস শেষে কিছু টাকা পাঠাতো নানুকে। আগে এখানে এনেও রাখতো মাসের পর মাস। কিন্তু আম্মুর পরকিয়ার কথা জানতে পেরে নানা-নানু আম্মুর মুখ দেখেন তিন বছর ধরে। আম্মুও অত দায় নেয় না এখন। মাস শেষে খুবই কম টাকা পাঠায় নানুকে। সেই টাকা দিয়ে গরু পালে নানু। নানার ঔষধপত্র কিনেন। নানুর কাছে গিয়ে আমি আর তাদের দায়িত্ব বাড়াতে চাই না। মামা ও এটা পছন্দ করবে না। তাই এখানেই আছি। সত্যি বলতে আমাদের আপন বলতে কেউ নেই যার কাছে আমরা আশ্রয় খুঁজতে পারি। সবশেষে বলতে চাই এখানেই ভালো আছি। কারো নিয়ন্ত্রণে চলতে হচ্ছে না। কেউ আমাদের দেখে মুখ কালো করছে না।

” ওওও সো স্যাড।

” জি।

” আরহাম কোথায়?

‘ রেডি হচ্ছে।

” কোথাও যাচ্ছেন?

” হ্যাঁ শিশু পার্কে যাচ্ছি। আরহামের প্রিয় জায়গা। যাবেন আপনি?

” আপনারা যান আজ। আমি অন্যদিন যাবো। আমাকে একটু বের হতে হবে। টহল দিতে হবে।

প্রিয়তা নিচে নামল। বুক ভার হলো তার। প্রহরের সামনে বড় বিপদ। কিভাবে প্রিয়তা দুইদিক সামলাবে?

________________

চলবে?

প্রিয়তার প্রহর পর্ব-১৩

0

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা (১৩)
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

বৃষ্টি কেটে গেছে। কিছুটা উজ্জলতার ভাব দেখা দিয়েছে আকাশে। পাখিদের গুঞ্জনে আচ্ছাদিত হয়েছে শহর। নিকষ কালো আঁধার কেটে গিয়ে দিনের উজ্জলতা ফুটে উঠেছে নিবিড়ভাবে। হু হু করে শীতল বাতাসে শিরশির করছে প্রিয়তার মোলায়েম দেহ। ছোট ছোট চুলগুলো বি রক্ত করছে বারংবার। খরস্রোতা নদীর মতো বয়ে যাচ্ছে শিহরণ। হলদে আভায় মুখের পাশ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে।

প্রিয়তা আরো নিবিড়ভাবে শালটা জড়িয়ে নিল। চুলগুলোকে কানের পেছনে গুঁজে নিল। জ্বরের কারণে ঠান্ডা একটু বেশিই লাগছে প্রিয়তার। উষ্ণতায় ছেয়ে আছে দেহ। অথচ প্রিয়তার মনে হচ্ছে তার শরীর বরফের ন্যায় জমে যাচ্ছে। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে মাঠের দিকে তাকাল প্রিয়তা। এখন এই বিকেলটাতে আরহাম থাকলে মাঠে গিয়ে খেলতো। গায়ে বড়সড় শার্ট পরে, মিষ্টি হেসে আরহামকে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে কেমন লাগতো? কল্পনা করল প্রিয়তা। চোখ বুজে আরহামকে অনুভব করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাল। হঠাৎ এক মৃদু শব্দে চোখ মেলল প্রিয়তা। শব্দের উৎস খুঁজতে উপরে তাকাল। প্রহরকে দেখে খানিক ভড়কাল সে। প্রিয়তা সেইভাবে বেলকনিতে আসে না। সে জানতো না এই বেলকনির উপরেই প্রহরের বেলকনি। উপরের ভবনেও বেলকনি আছে এটাও খেয়াল করেনি। আশ্চর্যভাবে প্রহরের চোখে চোখ পরল প্রিয়তার। ছেলেটার হাতে একটি কাপ। বোধহয় কফি বা চা খাচ্ছে প্রহর। প্রিয়তাকে দেখে মোটেও অবাক হলো না প্রহর। স্লান হেসে শান্ত কণ্ঠে বললো,

” কেমন আছেন প্রিয়তা? ঔষধ খেয়েছিলেন তো?

” খেয়েছি।

” নিজের যত্ন নিবেন।

” হুহ।

” প্রিয়তা।

” হুহ্।

” এদিকে তাকান।

প্রিয়তা খানিক অপ্রস্তুত হলো। তাকাবে কি তাকাবে না ভাবতে লাগল। চুলগুলোকে শুধু শুধু কানে গুঁজে নিল। মাথা উঁচু করে উপরে তাকাল একটু সময় নিয়ে। বললো,

” বলুন শুনছি।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রহর বলতে আরম্ভ করলো,

” প্রিয়তা আপনাকে শক্ত হতে হবে। আপনি যেদিন আপনার বাড়ি থেকে চলে এলেন বাবা-মাকে ছেড়ে, সেদিনের মতো শক্ত হতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না আপনি ছাড়া আরহামের আর কেউ নেই। আরহাম বাচ্চা ছেলে। একটু আদর পেয়েই বাবার কাছে চলে গিয়েছে। তাই বলে আপনি কান্নাকাটি করে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পরবেন? এতে কি কোন সমস্যার সমাধান হবে? আপনাকে শক্ত হতে হবে। নিজেকে নিয়ে ভাবতে হবে। তবেই আপনি আপনার ভাইকে নিয়ে ভালো থাকবেন।

প্রিয়তার চোখে পানি জমল। ওষ্ঠদ্বয় দ্বারা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল প্রিয়তা। বেলকনির রেলিং ধরে নিজেকে দমানোর চেষ্টা করল প্রিয়তা। সমস্ত ভর প্রয়োগ করলো রেলিংয়ে। প্রহরের ললাটে ভাঁজ পরল। প্রিয়তার অস্বাভাবিক আচরণে চিন্তিত হলো। চিন্তিত কণ্ঠে ততক্ষণাৎ জিজ্ঞেস করলো,

” আপনি ঠিক আছেন?

: উঁহু ।

” কষ্ট হচ্ছে?

” খুব।

” আমি আসবো প্রিয়তা? প্রয়োজন হবে?

প্রিয়তা অশ্রুসজল চোখে তাকাল প্রহরের দিকে। কথাটুকু বলে প্রহর বিব্রত হলো। ভড়কাল খানিক। নিজের কথার মানে বুঝতে পেরে নিজেই জিভ কাটল। আশপাশে তাকিয়ে কথা কাটাতে চাইল। প্রিয়তা অপলক চেয়ে রইল প্রহরের পানে। ঢোক গিলল সে। বিভ্রান্তিতে চোখ মুখ নত হলো। প্রহর হাসল নিঃশব্দে। মাথা চুলকে প্রস্থান করল। প্রিয়তার নত মুখের মায়ায় আটকে গেল বোধহয়।

__________________

সোফায় বসে ফোনে গেইম খেলছে আরহাম। রাত আটটা বেজে ঊনপঞ্চাশ মিনিট। আরিফ হোসাইন অফিস থেকে ফিরেনি। দীপা আর আরহাম ছাড়া বর্তমানে বাড়িতে কেউ নেই। গতকাল এখানে এসেছে আরহাম। এতক্ষণ অবধি সবকিছু ঠিকঠাক লাগছে তার কাছে। তবে প্রিয়তার নম্বর খুঁজে পাচ্ছে না আরিফ কিংবা দীপার ফোনে। এ বিষয়টা নিয়ে বেজায় রেগে আছে আরহাম। প্রিয়তার জন্য চিন্তা হচ্ছে আরহামের। কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে বোনের সাথে। কিন্তু প্রিয়তার নম্বর মুখস্থ নেই তার। কি করে কথা বলবে বোনের সাথে?

আরহাম ড্রয়িংরুমে এলো। গায়ে ছেলেটার ঢিলেঢালা গেঞ্জি। পরণে হাফ প্যান্ট। ঠান্ডায় নাকটুকু লাল হয়ে আছে আরহামের। আরহামের বড় বড় গোলাকার চোখ দুটোতে নিদারুন মায়া রয়েছে। ছোট ছোট পা ফেলে দীপার পাশের চেয়ারটায় বসল আরহাম। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। অতঃপর আরিফের রেখে যাওয়া ফোনটা বাড়িয়ে দিল দীপার দিকে। দীপা ভ্রু কুঁচকে তাকাল ফোনটার দিকে। জিজ্ঞেস করলো,

” কি করবো ?

” আপুর নম্বর কই? খুঁজে দাও তো।

“তোমার বোনের নম্বর এ ফোনে নেই। বিরক্তির সাথে বেল উঠল দীপা।

” থাকবে না কেন? আপুর সাথে তো আব্বুর আগে কথা হতো। আব্বুর ফোনে মেয়ের নম্বর থাকবে না?

আরহামের পাকা পাকা কথায় বিরক্ত হলো দীপা। প্রিয়তার কান্নারত মুখ দেখার জন্যই ছেলেটাকে এখানে আনতে রাজি হয়েছে সে। আরিফের ছেলে সন্তানের প্রতি একটু আধটু মায়া আছে। প্রিয়তাকে বিয়ে দিয়ে অন্তত আরহামকে নিজের কাছে রাখতে চাইতো আরিফ। দীপা কখনোই স্বামীর সাথে সন্তানদের চাইতো না। পরের ছেলে-মেয়েকে পেলে বড় করার মতো ঝামেলা নিতে চায়নি দীপা। দীপার প্রেমে অন্ধ হয়ে আরিফ ও ছেলেমেয়েকে হারাতে দ্বিধা বোধ করেনি। একটু রেগেই দীপা বললো,

” তোর বোনের প্রতি এতই যদি মায়া থাকে তাহলে আসলি কেন এখানে? তোর বোনকে কোনোদিন এখানে আনা হবে না। কথাও হবে না।

” কি বলছো? এমন ভাবে কথা বলছো কেন?

দীপা আরো রাগল। এইভাবে গোটা দুদিন ধরে অভিনয় করছে আরিফের জন্য। ছেলেটা যথেষ্ট সুন্দর আর শান্ত। তবে পরের ছেলের জন্য তেমন টান নেই দীপার। সতীনের ছেলেকে দেখলেই গা জ্বলে উঠে আচমকা। একটু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল আরহামকে। বললো,

” যা ঘরে যা। যত্তসব ন্যাকামি। বোনের জন্য দরদ উতলে পরছে। চলে যা না রে বাপ।

আরহামের ওষ্ঠদ্বয় ফুলে উঠল। কেঁদে উঠল ছেলেটা। দৃঢ় কণ্ঠে বললো,
” আব্বু এলে আমি সব বলে দিবো তুমি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছো।

” যা বলিস গিয়ে।

আরহাম চলে এলো। দীপা টিভি দেখায় ব্যস্ত হলো। আরিফের সম্পত্তির অভাব নেই। এই দুটো ভাইবোন থাকলে দীপার ভবিষ্যতে জন্ম নেওয়া সন্তানরা সম্পতির ভাগ কম পাবে। দুজন ভাগ বসাবে আরিফের সম্পত্তিতে। আরহাম ছোট ছেলে। টাকা পয়সা কিংবা সম্পত্তি সম্পর্কে ধারণা নেই। কিন্তু প্রিয়তা মেয়েটা চালাক। যখন তখন বাবার সম্পত্তি দাবি করতে পারে। এটা কি হতে দেওয়া যায়। নিজের ছেলেমেয়ের ভবিষ্যত তো ভাবতে হবে দীপাকে। নইলে অবিবাহিত হয়েও বিবাহিত, সেকেন্ড হ্যান্ড দামড়া লোককে বিয়ে করতো?

___

আরিফ বাড়ি ফিরল রাত দশটার পরে। আরহাম না ঘুমিয়ে বসে ছিল। আরিফ বাসায় আসার সাথে সাথে এগিয়ে গেল আরহাম। মলিন মুখে বিচার দিল। বললো,

” আব্বু আন্টি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। জানো আমাকে ধাক্কা দিয়েছে আন্টিটা। আমি ব্যথা পেয়েছি।

আরিফ হোসাইন প্রস্তুত ছিল এসবের জন্য। অনেক তোষামোদ করে দীপাকে রাজি করিয়ে আরহামকে এখানে এনেছে সে। আরিফ জানে দীপা কোনমতেই ছেলের মতো ট্রিট করবে না আরহামকে। তবুও রক্তের টানের কারণে ছেলেটাকে কাছে রাখতে চেয়েছে আরিফ।

অফিস ব্যাগটি পাশের টেবিলে রেখে টাই খুলতে খুলতে আরিফ বললো,

” তুমি হয়তো কোনো দুষ্টুমি করেছো। তাই তো বকেছে। বড় রা ওইভাবে বকেই।

” আমি কোন দুষ্টুমি করিনি আব্বু। আপুর নম্বরটা খুঁজে দিতে বলেছি শুধু। আপুকেও তো কত জ্বালাই আমি। কই আপু তো আমাকে বকে না।

আরিফ হোসাইন ভড়কে গেল। নিজের যুক্তিটাকে উপযুক্ত হয়নি বুঝে দমে গেল। বলল,

” আমি আন্টিকে বকে দিবো।

খাবার গরম করছিল দীপা। আরহামের বিচার দেওয়া দেখে চোখ গরম করে তাকাল। রাগী কণ্ঠে বললো,

” এই ছেলেটাকে সরাও সামনে থেকে। সারাদিন জ্বালায় আমায়। এটা ওটা ভেঙে ফেলে। আমি কিন্তু ওকে সামলাতে পারবো না বলে দিলাম।

আরহাম দৃঢ় কণ্ঠে প্রতিবাদ করলো। বললো,
” আমি কখন কি ভাঙলাম? মিথ্যে বলছো কেন?

দীপা রাগল। বল প্রয়োগ করে কষিয়ে চড় মারল আরহামের ফর্সা, নরম ডান গালে। আরহাম হতবাক হলো। ব্যথায় জ্বলে উঠল মশ্রীন গাল। কেঁদে উঠল ততক্ষণাৎ। ফুঁপিয়ে উঠল। পানিতে টইটম্বুর চোখ আর ভেজা গলায় আরিফের পা জড়িয়ে বললো,

” আব্বু। আমাকে মারল আন্টি। খুব পচা ও।

আরিফ হোসাইন চোখ গরম করে তাকাল দীপার দিকে। দীপা তা দেখেও না দেখার ভান করে নিজেও রেগে বললো,

” ছেলের হয়ে এত মায়া দেখাতে আসবে না খবরদার। একে তুমি দিয়ে আসবে। নইলে আমি রাগারাগি করলে, মারলে কিছু বলতে আসবে না।

আরিফ হোসাইন ছেলেকে কোলে নিল। গাল দুটো মুছে দিল। একটু মোলায়েম, শান্ত কণ্ঠে বললো,

” সবসময় শান্ত থাকবে তাহলে আর কিছু বলবে না আন্টি। দুষ্টুমি করবে না। বড়রা ভালোর জন্য বকে। আর আন্টি নয়, ও তোমার নতুন আম্মু। মনে থাকবে?

আরহাম অপলক চেয়ে রইল আরিফের দিকে। কান্না থেমে গেল তার। অবাক হয়ে বিড়বিড় করে অস্ফুট কণ্ঠে বললো,

” এটা আম্মু?

_________________

সকাল সকাল প্রিয়তার ঘুম ভাঙল ফোনের রিংটোনে। ভোরের দিকে চোখটা লেগে এসেছিল তার। জ্বর, ঠান্ডা আর মাথা ব্যথায় সারারাত হাঁসফাঁস করেছে সে। ঘুমোতে ইচ্ছে হলেও ঘুমোতে পারেনি। ফোনের কর্কশ রিংটোনে ধীরে ধীরে চোখ মেলল প্রিয়তা। গতকাল পুলিশম্যান তাকে জোর করে ফার্মেসিতে নিয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার চেক করে দেখেছে প্রিয়তার জ্বর একশত তিন ডিগ্রি। শরীর দুর্বল। রক্তশূন্যতা জাপটে আছে প্রিয়তার শিরা উপশিরায়। ভিটামিন আর কিছু ঔষধ খেতে দিয়েছে ডাক্তার। সব কিছুর বিল মিটিয়েছে প্রহর। বাড়ি ফিরিয়ে এনেছে। আসার সময় একটা হোটেল খেতে কাচ্চি কিনে দিয়েছে। প্রিয়তা নিতে চায়নি। জোর করে ধমকে ধামকে প্রিয়তাকে গাড়িতেই খাইয়েছে খাবারটুকু। অতঃপর ঔষধ খাইয়ে ঘরে পৌঁছে দিয়েছে।

প্রিয়তা ফোন তুললো কানে। ওপাশ থেকে বাচ্চা কণ্ঠের ডাক শুনলো,

“আপু। ও আপু।

প্রিয়তা হকচকিয়ে গেল। উঠে দাঁড়াল বিছানা থেকে। শীতল স্রোত বয়ে গেল প্রিয়তার শরীরে। কান্না পেল খুব। দু দিন পর ভাইয়ের এমন আদুরে ডাকে বাকরুদ্ধ হলো প্রিয়তা। ঢুকরে কেঁদে উঠল। কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে উত্তর নিল,

‘ আরহাম। কেমন আছো ভাই?

আরহাম চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। প্রিয়তার চিন্তা বাড়ল। পুনরায় জিজ্ঞেস করায় আরহাম বললো,

” আমি এখানে থাকবো না আপু। আমাকে নিয়ে যাও। নতুন আম্মু ভালো না। আব্বু নতুন আম্মুকে বকে না।

” চুপ একদম চুপ। তোমার মা নেই। কাকে মা বলছো? ওই মহিলা তোমার মা না। আমি এক্ষুণি আসছি তোমাকে নিতে। রেগে বললো প্রিয়তা।

কল কাটল আরহাম। আরিফ হোসাইন অফিসে যাবে তখনই আরহামের আগমন ঘটে তার ঘরে। আবদার করে প্রিয়তার সাথে কথা বলার জন্য। প্রথমে আরিফ রাজি না হলেও বারবার আবদার করায় ফোন দিয়েছে প্রিয়তাকে। চলে যাওয়ার কথা বলায় আরিফ ধমক দিল একটু। বললো,

” যাবে কেন আরহাম? প্রিয়তাকে এসব বললে কেন? এখন তো তোমাকে নিয়ে যাবে ও।

” আপু আমার জন্য কষ্ট পায় আব্বু। আমাকে ছাড়া আপু ভালো নেই। আমি চলে যাবো। নতুন আম্মু তোমার সাথে আছে। আপুর তো কেউ নাই।

___

প্রিয়তা ঝটপট ব্রাশ করে প্রহরকে কল দিল।আরহামের বলা কথাগুলো বললো। দুজনে ও বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল। প্রহর ভালো একটি শার্ট জড়িয়ে নিল গায়ে। শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে হাঁক ছাড়ল। মিসেস নাবিলাকে ডেকে বললো,

” আমি একটু বের হবো মা।

মিসেস নাবিলা রান্না করছিলেন। প্রহরের থানায় যেতে হয় দশটায়। এখন বাজে মাত্র আটটা। এখন বের হওয়ার কারণ খুঁজলেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন,

” এত সকালে কেন? তোর না দশটায় যাওয়ার কথা? আমার রান্নাবান্না তো শেষই হয়নি।

প্রহর সবটা খুলে বললো মা কে। মিসেস নাবিলা সবটা শুনে একটু দুঃখ পেলেন। মেয়েটার এতসব স্যাক্রিফাইজের কথা ভেবে মায়া হলো উনার। প্রহর বের হবার পথে মিসেস নাবিলা প্রহরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। গম্ভীর মুখে বললেন,

” প্রিয়তা মেয়েটাকে আমার ভালোই লাগে। মেয়েটার দুঃখ- কষ্ট অনেক। অনেক সংগ্রাম করে যাচ্ছে প্রিয়তা। মেয়েটার জন্য আমার খুব মায়া হয়। আমি সবসময় চাই প্রিয়তা আর ওর ভাই ভালো থাকুক। তবে কি জানিস? তোর কাণ্ড কারখানা আমার কাছে স্বাভাবিক ঠেকছে না প্রহর। আজকাল প্রিয়তার সাথে তুই একটু বেশিই যোগাযোগ রাখছিস। ওর সাথে তোর কোনো রকম সম্পর্ক হোক আমি চাই না। তুই বলতে পারিস প্রিয়তা তোর বন্ধু। কিন্তু বন্ধুত্ব থেকেই প্রেম-ভালোবাসা জন্মে। ভালোবাসা কখন কার জন্য জাগ্রত হয় তা কেউ বলতে পারে না। মনে রাখিস আমি এই সম্পর্ক কোনোদিন মানবো না। তোর বাবাও বাবা-মা ছাড়া এতিম একটা মেয়েকে ছেলের বউ হিসেবে মানবে না। তাই বলবো ভেবেচিন্তে করিস সবকিছু। ও পথে পা বাড়াস না।

প্রহর কিছু বলতে চাইল। হাত দিয়ে আটকে দিলেন মিসেস নাবিলা। বললেন,

“যা আরহামকে নিয়ে আয়।

__

সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরহাম। প্রিয়তার আসার অপেক্ষা করছে। এখানে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। আরিফ অনেক বদলে গেছে। নতুন আম্মুও ভালো নয়। প্রিয়তা আগেই বলেছিল এ বাড়িতে আসার কথা না ভাবতে। কিন্তু এতদিন পর আব্বুকে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে গিয়েছিল আরহাম। কোনো কিছু না ভেবেই চলে এসেছিল এখানে।

প্রহরের গাড়ি এসে থামল প্রিয়তার বাড়ির সামনে। আরহাম দুর থেকে অবলোকন করল। অবয়ব খানিক স্পষ্ট হতেই দরজা ঠেলে ছুটে এলো প্রিয়তার সামনে। প্রিয়তা আরহামকে দেখে জড়িয়ে ধরলো। দু হাতের ভড় দিয়ে ছেলেটাকে কোলে তুলে নিল। ভাইয়ের গালে অজস্র চুমু খেল প্রিয়তা। এ দুটো দিন প্রিয়তার কাছে দু বছরের মতো মনে হয়েছে। ভাইকে ছাড়া ঘরটা ফাঁকা ফাকা লেগেছে। ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে প্রিয়তা বললো,

” তুমি চলে এসেছিলে কেন ভাই? আমার কথা একবার ও ভাবোনি কেন?

” আব্বু আমাকে ভালো বাসে না আপু। আমার ভুল হয়েছে।

” এখানে আর থাকতে হবে না তোমাকে। চলো আমার সাথে।

ভাই বোনের এমন মুহুর্ত দেখে মুচকি হাসছিল প্রহর। প্রিয়তার এখান থেকে চলে যাওয়ার কথাটা শুনে গম্ভীর হলো সে।বললো,

” কিছু না বলেই চলে যাবেন? চলুন বাড়িতে ঢোকা যাক।

প্রিয়তা যেতে চাইল না। প্রহর খানিক জোর করেই প্রিয়তাকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকল। দীপা খন্দকার অবাক হলো প্রিয়তাকে এ বাড়িতে দেখে। বললো,

” তুমি এখানে কি করতে এসেছো? তুমি নাকি বলেছিলে এ বাড়িতে আর ফিরবে না। তাচ্ছিল্যের স্বর প্রকাশ পেল।

প্রিয়তা রেগে গেল। উচ্চস্বরে বললো,
” আমি এ বাড়িতে এসেছি আমার ভাইকে নিতে। আরহামকে আপনি মেরেছেন তাইনা? কতটা পাষণ্ড আপনি বুঝতে পারছেন? একটা ছোট্ট বাচ্চার গায়ে হাত তুলতে আপনার বিবেকে বাঁধল না? আমার ভাইয়ের গায়ে হাত তোলার সাহস কি করে হলো আপনার?

প্রহর বলে উঠল,
” আন্টি, আমি কিন্তু পুলিশ। চাইলেই আপনাকে একটা বড়সড় কেসে ফাঁসিয়ে দিতে পারি। কিন্তু আমি তা করবো না। আপনার কর্মের শাস্তি প্রকৃতিই আপনাকে দিবে। আজ এই নিষ্পাপ মানুষদের আপনি যেভাবে কষ্ট দিচ্ছেন ঠিক একইভাবে আপনিও কষ্ট পাবেন। উঁহু এটা আমাদের অভিশাপ নয়। এটা প্রকৃতির নিয়ম।

চলবে?

প্রিয়তার প্রহর পর্ব-১২

0

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা ( ১২ )
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

ছাদের এক কোণে জড়সড় হয়ে বসে আছে প্রিয়তা। গালে গড়িয়ে পরা পানির ফোঁটা শুকিয়ে গিয়েছে। চোখ এখন শুষ্ক। বৃষ্টির ঝিরঝির ফোঁটায় ভালো লাগছে প্রিয়তার। একটু আগেই ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করার মতো জঘন্য পরিকল্পনা করেছিল প্রিয়তা। রেলিংয়ে উঠে নিচে তাকিয়ে জল্পনাকল্পনা করছিল। কিন্তু এখন তার মনে মৃত্যুর ভাবনা নেই। এত সহজে সবাইকে ছেড়ে কেন যাবে প্রিয়তা? আরহামের কি হবে? আত্মহত্যা কি সব সমস্যার সমাধান? প্রিয়তা সুইসাইড করলে কি আরহাম ভালো থাকবে? সব ভেবে প্রিয়তা নেমে এসেছে রেলিং থেকে। আকাশের দিকে অনিমেষ তাকিয়ে রয়েছে। মনটা ভিষণ খারাপ তার। আরহামের অবয়ব ভেসে উঠছে চোখে। দীপার ভয়ানক মুখশ্রী স্মরণ হচ্ছে বারংবার। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে প্রিয়তার। একা একা লাগছে। জগতের কোথাও, কেউ তার জন্য নেই। কারো মনে প্রিয়তার প্রতি ভালোবাসা নেই।

জুতোর খচখচ আওয়াজ শোনা গেল। ছাদে কেউ প্রবেশ করছে। প্রিয়তা নড়ল না। উঠে দাঁড়াল ও না। যেভাবে হাঁটু গেড়ে বসে ছিল সেভাবেই জড়সড় হয়ে বসে রইল। কে আসছে তা দেখার প্রয়োজন বোধ করলো না।

প্রহর ছাদে এসেছে। আজই তাদের মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করার জন্য মিশনে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোনোভাবে ব্যবসায়ীরা জেনে গিয়েছে প্রহর আর তার টিম ওদের আক্রমণ করবে। তাইতো আগে আগেই কেটে পড়েছে ওখান থেকে। এখন প্রহরের দায়ীত্ব এদের নতুন বাসস্থান কোথায় তা খুঁজতে হবে। প্রহর ফোন থেকে মুখ তুলে আশপাশে তাকাল। ছাদের এক কোণে প্রিয়তাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে মোটামুটি বিমূঢ় হলো সে। প্রিয়তার অঙ্গভঙ্গি স্বাভাবিক ঠেকল না। একটু এগিয়ে এলো প্রহর। ওষ্ঠদ্বয় জিভ দ্বারা লেপন করলো। বললো,

” আপনি? এভাবে?

প্রিয়তা মাথা উঁচু করে চাইল। প্রহরকে এই মুহুর্তে এখানে দেখে মোটেই ভালো লাগল না তার। প্রশ্নের উত্তর দিতেও ইচ্ছে করলো না। চুপচাপ একই ভঙ্গিতে বসে রইল সে। প্রিয়তার চাহনি অস্বাভাবিক। চোখের কার্ণিশ ফুলে উঠেছে। নাক লাল হয়ে গেছে। গালে শুষ্ক অশ্রুর কণা সাদা হয়ে রয়েছে। সাদামাটা মেয়েটাকে অতিরিক্ত মলিন লাগছে। প্রহর বুঝল প্রিয়তা কেঁদেছে। কোনো কারণে কষ্ট জমেছে কিশোরীর হৃদয়ে। দ্বিধা ছাড়াই প্রহর বলে উঠলো,

” আপনি কাঁদছেন?

” কাঁদছি।

দ্বিধাহীন, নিঃসংকোচ উত্তর প্রিয়তার। জড়তা নেই কণ্ঠে। একরোখা তেজী জবাব। কাঠ কাঠ কণ্ঠ মেয়েটার। প্রহরের আগমন যে ভালোভাবে নেয়নি তা বুঝল প্রহর। পাশের রেলিংয়ে বসে সময় নিয়ে বললো,

” কাঁদছেন কেন?

” ইচ্ছে হয়েছে তাই।

” ইচ্ছে হলেই সব করতে হবে? আমার যে বড্ড ইচ্ছে হয় আরহামকে নিজের কাছে রাখি। সেটা কি পারছি?

প্রিয়তা মাথা আরেকটু উঁচু করলো। কথাটা পুরোপুরি বোধগম্য হলো না তার। প্রহর যে আরহামকে খুব ভালোবাসে এটুকু বুঝতে অসুবিধে হলো না তার। চোখে অশ্রু জমতেই তা ক্লান্ত ভঙ্গিতে মুছে নিয়ে প্রিয়তা মুচকি হাসল। আশপাশে তাকিয়ে মোলায়েম স্বরে বলে উঠল,

” আরহাম আমার কাছেই থাকতে চায় না পুলিশম্যান। আপনার কাছে কি করে থাকবে?

” মানে? কোথায় এখন আরহাম? বলেছিল মার্কেটে যাবে, ব্যাডমিন্টন কিনবে। আমাকে খেলতে হবে ওর সাথে।

” আব্বুর কাছে ফিরে গিয়েছে। আর আসবে না বোধহয়।

বিস্ময়ে বিমূঢ় হলো প্রহর। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। প্রিয়তার সামনে এসে এক হাঁটু গেড়ে বসে পরল। আরহামকে খুব দ্রুত ভালোবেসে ফেলেছে প্রহর। ছেলেটার চোখে মুখে এক ধরনের মায়া আছে। দেখলেই গালদুটো টেনে আদর করে দিতে ইচ্ছে হয়। ছেলেটা চলে গিয়েছে তার বাবার কাছে? কিন্তু কেন? আরিফ হোসাইনের সম্পর্কে যতদূর জানে উনি ভালু লোক নন। আরহামকে কেন নিজের কাছে নিয়ে গেল লোকটা? প্রহরের চোখেমুখে অবাকের রেশ বহমান রইল। বললো,

” কি বলছেন? আরহাম এ বাড়ি নেই?

” না।

” ওকে নিয়ে গেল আর আপনি আটকালেন না? কিভাবে কি হলো প্রিয়তা?

” বিশ্বাস করুন আমি আটকানোর অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু আরহাম সেচ্ছায় যেতে চেয়েছে। কিভাবে ধরে রাখবো বলুন? পারিনি আমি।

প্রহর থমকাল। প্রিয়তার মনের অবস্থা এইবার পুরোপুরি বুঝতে সক্ষম হলো। আরহাম ছাড়া মেয়েটার আপন বলতে কেউ নেই। আরহাম চলে যাওয়ায় প্রিয়তা ভেঙে গিয়েছে, কষ্ট পেয়েছে। প্রহর ফোস করে শ্বাস নিল। বললো,
” এখন কি করতে চাইছেন?

প্রিয়তার হুঁশ ফিরল। এভাবে হাত পা গুটিয়ে সে বসে আছে কেন? আরহামকে ভালো রাখার দায়িত্ব এখন প্রিয়তার। সে কেন ওইসময় আরহামকে যেতে দিল? জোর করে আটকে রাখা উচিত ছিল প্রিয়তার।
হুট করে প্রিয়তা রেগে গেল। দ্রুত উঠে দাঁড়াল। গায়ের ওড়না ভালোমতো জড়িয়ে নিল অঙ্গে। রাগে কায়া কেঁপে উঠল প্রিয়তার। বললো,

” কি আর চাইবো? আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম। করি নি। কিন্তু এখন আরহামকে নিয়ে আসবো। ওখানে আরহাম থাকতে পারবে নাকি? ওরা আরহামকে বাঁচতেই দিবে না। আব্বুর আরহামের প্রতি একটু আধটু দুর্বলতা ছিল বলে ওই মহিলা আরহামকে মানতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু মহিলা তো আরহামকে ভালো বাসেই না। কেন ছেলেটাকে ওখানে রাখবো আমি? রাখবো না। এক্ষুনি যাবো।

প্রিয়তা হন্তদন্ত পায়ে চলে যেতে উদ্যত হলো। প্রহর ডেকে উঠল। এই মুহুর্তে এত জলদি কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। সবটা ভেবেচিন্তে করতে হবে।
প্রহর পুনরায় নিষেধ করল। প্রিয়তা পাত্তা দিল না। প্রহর উপায় খুঁজে না পেয়ে প্রিয়তার বাহু ধরে আটকে দিল। অতঃপর কাছে টানতে আলতো করে ধরল প্রিয়তার কব্জি। ভড়কাল প্রিয়তা। প্রহরের এরুপ স্পর্শে কেঁপে উঠল । তাজ্জব বনে গেল। বিবৃত হলো প্রহর নিজেও। বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলো। থতমত খেল সেও। চটপট ছেড়ে দিল প্রিয়তাকে। বললো,

” আপনাকে ধরার জন্য দুঃখিত। আপনি যা করতে চাইছেন তা উচিত হবে না। আরহামকে এভাবে আনা যাবে না প্রিয়তা।

প্রিয়তা থেমে গেল। করুণ কণ্ঠে বললো,
“কি করবো আমি পুলিশম্যান? আমায় একটু সাজেশন দিন কিভাবে আরহামকে নিজের কাছে রাখবো?

প্রহর মুচকি হেসে প্রিয়তাকে বসতে বললো রেলিংয়ে। পাশে নিজেও বসে রইল। একটু সময় নিয়ে বললো,

” পুলিশ হিসেবে সাজেশন দিবো নাকি বন্ধু হিসেবে?

” দু ভাবেই।

” পুলিশ হিসেবে বলবো একটা গুরুতর কেসে ফাঁসিয়ে ওদের গ্রেফতার করার ব্যবস্থা করুন। অন্যায় ভাবে সন্তানদের সম্পত্তি থেকে আলাদা করার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করুন। আর বন্ধু হিসেবে সাজেস্ট করবো আরহামকে এখনই আনতে যাবেন না। ওকে ওখানেই থাকতে দিন।

” মানে? কি বলছেন?

” আরহাম বাচ্চা ছেলে। বাচ্চারা ভালোবাসার কাঙাল। যেখানেই ভালোবাসা পায় সেখানেই আটকে যায়। জগতের অন্যায়-অবিচার সম্পর্কে বাচ্চারা ধারণা রাখে না। আরহামের সাথে এত ভালো ব্যবহার করা হয়েছে যে ওর সবাইকে ভালো মনে হয়েছে। তাই তো আপনাকে ছেড়ে চলে যেতে খারাপ লাগেনি ওর। এখন যদি আপনি ওকে আনতে যান ওর মনে হবে আপনি ওকে ভালোবাসেন না বলে ওর সুখটাকে কেড়ে নিচ্ছেন। ওর বাবা থেকে ওকে দূরে রাখছেন শুধু শুধু। ওকে আরাম-আয়েশে থাকতে দিচ্ছেন না। আমি বলি কি, আরহাম দুটো দিন ওখানে থাকুক। দীপা আন্টির মনোভাব একটু বুঝুক। দু দিন পর যখন ওদের ভালো মানুষের মুখোশ বেরিয়ে আসবে, দেখবেন আরহাম নিজেই ফিরতে চাইবে আপনার কাছে। তখন ওর কাছে আপনি খারাপ হবেন না। আপনাকে ছেড়ে যেতেই চাইবে না আরহাম।

প্রিয়তার মুখটা মলিন হলো। মিইয়ে নিল নিজেকে। সবটা বুঝে নিল মনে মনে। দু ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিল সাথে সাথেই। ভারী কণ্ঠে বলে উঠল,

” আরহামকে ছাড়া আমি থা..থাকবো কিভাবে? ও ছাড়া আমার আর কেউ নেই।

” ভয় পাবেন না প্রিয়তা। সব ঠিক হয়ে যাবে। এও ভাববেন না।

আসস্ত করলো প্রহর। প্রিয়তা তাকিয়ে রইল প্রহরের দিকে। প্রহর মানুষটা সুন্দর। সবচেয়ে বেশি সুন্দর মানুষটার ব্যক্তিত্ব। প্রিয়তার মনে আছে সেদিনের কথা। প্রিয়তাকে ধরে নিয়ে আটকে রেখেছিল প্রহর। প্রিয়তা রেগে আক্রমন করেছিল প্রহরকে। রাগে দিক্বিদিক হারিয়ে প্রহরকে আঘাত করেছিল নখ দ্বারা। ইহান প্রিয়তাকে ছাড়াতে চাইলে প্রহর নিষেধ করেছিল। প্রিয়তাকে ধরতে না করে তানিয়াকে দিয়ে প্রিয়তাকে সরিয়ে দিল। নারীদেরকে প্রহর যে ভিষণ সম্মান করে এটা প্রিয়তা সেদিনই বুঝেছিল। আজ বন্ধুর ন্যায় এমন উপদেশ দেওয়ায় প্রহরের জন্য প্রিয়তার মনে খানিক ভালো লাগা গেঁথে গেল। নিজেকে একটু শক্ত রাখতে ইচ্ছে করলো।

_________

সবে গোসল সেরে বেরিয়েছে তানিয়া। সিলেট থেকে হবিগঞ্জে যাতায়াত করায় বড্ড ক্লান্ত হয়েই বাড়ি ফিরেছে সে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বিছানার উপর থেকে ফোনটা হাতে নিল তানিয়া। চুলগুলো ভিজে চুপসে আছে তার। চশমাটা চোখের দিকে ঠেলে দিল তানিয়া। কল লিস্টে একুশ বার আবিরের মিসড কল দেখল। আবিরের এতবার কল দেওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পেল না তানিয়া। বা ভ্রু কুঁচকে ফেলল সে। আবার ও কল এলো ফোনে। একটু সময় নিয়ে বিরক্তির সাথে কলটা ধরলো তানিয়া। তানিয়া কিছু বলার পূর্বেই আবির বলে উঠল,

” এতবার কল দিচ্ছি ধরো না কেন?

” ওয়াশরুমে ছিলাম। এতবার কল করেছেন কেন? ধরছি না যখন তখন বুঝে নিবেন ফোন আমার কাছে নেই কিংবা আমি ব্যস্ত।

” সেসব পরে হবে। আগে বলো আমি এসব কী শুনছি?

” মানে? কি শুনেছেন?

” আঙ্কেলের আবার বিয়ে দিতে চাইছো তুমি? তানিয়া তুমি পাগল হয়ে গিয়েছো? দুদিন পর আমাদের বিয়ে। এখন তোমার বাবা বিয়ে করবে? লোকে কি বলবে?

” আমি বুঝলাম না। বাবার বিয়েতে সমস্যা কোথায়?

” তানিয়া আমাকে রাগিও না। আমি জানি তুমি সবই বুঝছো। ন্যাকামি করছো কেন?

” বাবাকে বিয়ে দিতে চাইছি বলে আপনি এত রাগছেন কেন? বাবার একজন লাইফ পার্টনার প্রয়োজন আবির। তাই আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

” তাই বলে এই বয়সে? এতদিন কি করেছে আঙ্কেল? নাতি নাতনি হওয়ার বয়সে নিজে বিয়ে করছেন। দুদিন পর উনার ঘরেও ছেলেপুলে আসবে। মা আর মেয়ের একই সময়ে একসাথে বাচ্চা হবে। মানে বুঝতে পারছো? তোমার এমন কাজ আমি মানতে পারছি না। কি করে এই সিদ্ধান্ত নিলে তুমি?

” আমি কোনো ভুল করিনি। কাঠ কাঠ উত্তর তানিয়ার।

” ভুল করোনি? তানিয়া, সমাজের লোকে কি বলবে একবার ভেবেছো? এই বয়সে এসে বিয়ে? কদিন পরেই আমাদের বিয়ে। ছিঃ ছিঃ!

” শাট আপ আবির। বয়স হয়েছে তো? চাহিদা কি কমে গিয়েছে? বাবার কি এই বয়সে একজন পার্টনারের প্রয়োজন নেই বলুন? কেয়ার করার মানুষের প্রয়োজন নেই? আমি চলে গেলে বাবার আর কে থাকবে বলুন?

আবির রেগে কল কেটে দিল। তানিয়া যেন সস্তি পেল। খানিক রাগ ও হলো। আবির চাইলে আজ তানিয়ার পাশে থাকতে পারতো। কিন্তু তা না করে লোকটা ছিঃ ছিঃ করছে? কোন মানুষের পাল্লায় পড়ল তানিয়া। দুজনের ভাবনা চিন্তায় এত ফারাক কেন? একসাথে থাকা কালীন এসব মনোভাব তাদের বিবাহিত জীবনে প্রভাব ফেলবে না তো? ভয় বাড়ল তানিয়ার। বসে রইল একদৃষ্টে। কি ভেবে বাবার রুমে পা বাড়াল। বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে ভালোমতো কথা বলা দরকার বাবার সাথে।

_______

আরহামের চিন্তায় প্রিয়তার সারারাত ঘুম হয়নি। সারা রাত এপাশ ওপাশ করেছে প্রিয়তা। দু ঘন্টা ধরে শাওয়ারের নিচে বসে ছিল রাতে। ফলস্বরূপ রাত থেকেই গা গরম হচ্ছে প্রিয়তার।

সকালে রান্না করল না প্রিয়তা। খেতে ইচ্ছে করলো না। জ্বর নিয়েই টিউশনিতে গেল। ঠান্ডায় মাঝে মাঝে কেঁপে উঠল প্রিয়তা। ওড়নার উপরে আষ্টেপৃষ্টে শাল জড়িয়ে নিল। কুসুম আর কোয়েলকে পড়াতে গিয়ে বারবার তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত হলো প্রিয়তা। কোনো রকমে দুজনকে পড়িয়ে দিল একটু কম সময় নিয়ে। আজ কোচিং নেই। সপ্তাহে চার দিন পড়াতে যেতে হবে কোচিংয়ে। আজ পড়াতে হবে না শুনে সস্তি পেল প্রিয়তা। মন খারাপের রেশ কাটল না তখনো। ফেরার পথে আকাশের মেঘলা ভাবটা লক্ষ্য করল প্রিয়তা। হুট করেই তুমুল বেগে ভারী বর্ষণ শুরু হলো। প্রিয়তা চটজলদি দোকানের ছাউনির নিচে গিয়ে আশ্রয় নিল। আধঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখল। অতঃপর খুব বিরক্ত হয়ে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বাড়ি ফিরতে উদ্যত হলো। বৃষ্টির তেজটুকু ভালো লাগল। আনন্দে নেচে উঠল প্রিয়তার প্রাণ। বিরবির করে মুচকি হেসে বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে বললো,

“ইটস নভেম্বর রেইন।

হাঁটতে হাঁটতে ভিজে জুবুথুবু হলো প্রিয়তা। রাস্তা পানিতে ডুবে গিয়েছে। হাঁটু অবধি পানি জমে গেছে অনেক জায়গায়। কাঁদায় রাস্তার অবস্থা খারাপ। হাঁটতে গিয়ে বেজায় বিরক্ত হলো প্রিয়তা। জুতো বারবার আটকে যাচ্ছে কাঁদায়। জ্বরের ঘোরে রাস্তাও ঘোলাটে লাগছে। জ্বরের প্রকোপ যে বাড়ছে বুঝল প্রিয়তা। তবুও নিজের মনে ক্ষোভ নিয়ে ভিজল সময় নিয়ে। উত্তপ্ত করল গা।

প্রহর গাড়ি করে বাড়ি ফিরছিল থানা থেকে। মাঝরাস্তায় এমন হুটহাট বৃষ্টি পরার কারণে বিরক্ত হলো সে। গাড়ি থামিয়ে কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা খুজল। গাড়ির ঘোলা কাচ সামনে রেখে প্রহর গাড়ি চালায় না। এতে বিপদের ঝুঁকি থাকে। কোথাও আশ্রয়ের জন্য আশপাশে তাকাতেই অদূরে প্রিয়তাকে দেখতে পেল প্রহর। প্রিয়তার চুলগুলো নিচু করে ঝুঁটি বাঁধা। গায়ে মোটা শাল। ছোট ছোট চুলগুলো ভ্রু তে জাপটে রয়েছে। বৃষ্টির কণাগুলো প্রিয়তার ললাট বেয়ে নাকের সরু স্থান দিয়ে গড়াচ্ছে। মুক্তোর ন্যায় চিকচিক করছে পানির কণাগুলো। নিষ্পাপ স্নিগ্ধ লাগছে প্রিয়তাকে।

প্রহর নেমে এলো গাড়ি থেকে। প্রিয়তার পিছনে এসে দাঁড়াল। খানিক ভিজে গেল প্রহর। চুল চুইয়ে পানি গড়াল। মাথা থেকে পানি ঝারতে ঝারতে প্রিয়তাকে রুক্ষ কণ্ঠে ডাকলো পিছু থেকে,

” প্রিয়তা।

প্রিয়তা পিছু ফিরে তাকাল। ঘোলাটে চোখে প্রহরকে চিনতে অসুবিধে হলো না মোটেও। খানিক হেসে বললো,

” আপনি?

” ভিজছেন কেন আপনি? আবহাওয়া ভালো নয়। অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা-জ্বর আসবে। বাড়ি চলুন। কি সব কাণ্ড করেন আপনি।

” আমি অলরেডি জ্বরে পুড়ছি পুলিশম্যান। আমাকে জ্বলতে দিন। জ্বলতে জ্বলতে ক্ষয় হতে দিন, ছাই হতে দিন। আমাকে আটকাবেন না।

প্রহর তাজ্জব বনে গেল। ততক্ষণাৎ আরেকটু কাছে এসে প্রিয়তার ললাটে হাত রাখল। বৃষ্টির পানিতে ভেজা সত্বেও প্রিয়তার ললাট অতিরিক্ত উষ্ণ দেখে রেগে গেল প্রহর। খারাপ লাগল খুব। টানতে টানতে প্রিয়তাকে গাড়ির ফ্রন্ট সিটে বসাল। চুলগুলো ঝেরে নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

” আপনার গা পুড়ে যাচ্ছে আর আপনি বৃষ্টিতে ভিজছেন? কেন নিজের ক্ষতি করছেন? আপনি খুব বোকা প্রিয়তা। খুবই বোকা। আপনার এই বোকামি আমি সহ্য করতে পারছি না।

প্রিয়তা খিলখিল করে হেসে উঠল। চোখ মেলে তাকাতে পারল না সে। বাচ্চাদের মতো হাসি হাসি মুখে বললো,

” এজন্যই বোধহয় আমার কেউ নেই। এজন্যেই সবাই হারিয়ে গিয়েছে। আরহাম ও চলে গিয়েছে।

চলবে?

প্রিয়তার প্রহর পর্ব-১১

0

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা (১১)
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

প্রত্যেকটা মানুষের মনে এক সুপ্ত বাসনা থাকে। যা চাইলেও মানুষ হেলাফেলা করতে পারে না, অবজ্ঞা করতে পারে না। দৈহিক চাহিদার পাশাপাশি প্রত্যেকটা মানুষের মানসিক চাহিদা রয়েছে। একবার ভেবে দেখুন, আপনি অত্যন্ত সুন্দর মেয়েকে বিয়ে করলেন। মেয়েটি যেন এক সৌন্দর্যের উজ্জল দৃষ্টান্ত। এত সুন্দর মেয়ে জগতে খুব কমই আছে। আপনি মেয়েটিকে জীবন সঙ্গী করতে পেরে নিজেকে খুব ভাগ্যবান বলে মনে করেন। শারীরিক দিক থেকে আপনি তার প্রতি সন্তুষ্ট। তার এই সৌন্দর্যে বারংবার মুগ্ধ হন আপনি। এমন সুন্দর স্ত্রীকে পেয়ে আপনি ধন্য। তার রুপে মাতাল হন প্রতিনিয়ত, গর্ব করেন। কিন্তু সে আপনার মন খারাপ বুঝে না, আপনার গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাকে গুরুত্ব দেয় না, খারাপ সময়ে পাশে এসে সান্ত্বনা মূলক বাণী ছুঁড়ে দেয় না কিংবা সহানুভূতি দেখায় না, আপনার পছন্দের জিনিসগুলোর প্রতি সচেতন না। তখন আপনার কেমন লাগবে? শারীরিক ভাবে সন্তুষ্টি পেলেও ওইযে মানসিক সন্তুষ্টি, ওটা থেকে আপনি বিরত রইবেন। একান্ত বাধ্যগত সঙ্গীর অভাব রোজ আপনাকে তাড়া করবে। তখন আপনি বুঝতে পারবেন একজন সুখ দুঃখের সঙ্গী কতটা প্রয়োজন, একজন কেয়ারিং পার্টনার পাওয়া কতটা ভাগ্যের।

এখন সকাল আটটা বেজে দশ মিনিট। অপরিচিত এক এলাকায় এসেছে ইহান আর তানিয়া। জায়গাটার নাম হবিগঞ্জ। মৌলভীবাজার থেকে অনেকটাই দূরে। প্রহরকেও এখানে আসার জন্য জোর করেছিল তানিয়া। কিন্তু প্রহরের কিছু কাজ পড়ে যাওয়ায় আসতে পারেনি সে। অগত্যা ইহানকে নিয়েই এতদূর এসেছে তানিয়া। এখানে এর আগে তানিয়া একবারই এসেছিল খুনের কেস সামলাতে। তদন্ত করতে গিয়ে এক মহিলার সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ইহানের। মহিলাটির নাম তাসলিমা খাতুন। খুনের সময় তিনি ঘটনাস্থলেই ছিলেন। তিনি খুনিকে ভালো মতো দেখেও ছিলেন। মুখ খুললে বিপদ হবে জেনেও তাসলিমা খাতুন জবান খুলেছিলেন। আদালতে কাঠগড়ায় সত্য কথা বলেছিলেন। অতঃপর খুনি খুব সহজেই ধরা পরেছিল প্রহরের টিমের হাতে। তাসলিমা খাতুনের সাথে প্রহর আর তানিয়ার ও সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। তবে ইহানের সাথে সম্পর্ক একটু বেশিই ভালো ছিল। কেননা ইহান প্রায় সময় এটা ওটা জিজ্ঞেস করতে এখানে তাসলিমা খাতুনের সাথে দেখা করতে আসতো।

এতক্ষণ খুব সাহসের সাথে পুরোটা পথ এসে তাসলিমা খাতুনের বাড়ির দরজার সামনে এসে সব সাহস নিভে গেল তানিয়ার। এই প্রথম হয়তো কোন চব্বিশ বছর বয়সী পরিপক্ক, প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে তার বাবার জন্য মেয়ে দেখতে এসেছে। বিষয়টা খুবই অদ্ভুত। এমন ঘটনা খুব কমই ঘটে। তাসলিমা খাতুন ডিভোর্সি। সন্তান জন্মদানে অক্ষম বলে বিয়ের সাত বছরের মাথায় উনার স্বামী উনাকে ডিভোর্স দিয়েছিল। এরপর উনি প্রতিজ্ঞা করেন প্রতিষ্ঠিত হবেন, নিজের পায়ে দাঁড়াবেন। তার পর বিয়েসাদির কথা ভাববেন। এ সবই ইহানের মুখে শুনেছে তানিয়া। তাইতো বাবার জীবন সঙ্গী হিসেবে তাসলিমা খাতুনকে নির্বাচিত করেছে। তাসলিমা খাতুন বিজনেস করেন। মিষ্টির বিজনেস। এ সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই তানিয়ার। তবে শুনেছে তাসলিমা খাতুন বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু মিষ্টি তৈরী করেন। বড়সড় একটা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার তৈরী করেছেন তিনি। উনার দোকানের বেশ নামডাক রয়েছে এলাকায়।

ইহান দরজায় মৃদু টোকা দিল তিনবার। তাসলিমা খাতুন শৌখিন মানুষ। বাড়ির দু পাশে বিভিন্ন ফুলের টপ বসিয়েছেন তিনি। আশপাশ ঝকঝকে পরিষ্কার,পরিচ্ছন্ন। তিনবার টোকা দেওয়ার পর তিনি দরজা খুললেন। তাসলিমা খাতুনের পরণে ঢিলেঢালা কামিজ। মাথায় পরিপাটি করে ওড়না নেওয়া। দরজা খুলে ইহানকে দেখে হাসলেন তিনি। তানিয়া আর ইহান সালাম দিল। সালামের উত্তর নিয়ে ঘরে আসতে বললেন দুজনকে। তার তৈরী মিষ্টি দিলেন খেতে। তানিয়া আসল কথাটা বলতে অসস্তি বোধ করছে। কিভাবে কি বলবে ঠাহর করতে পারছে না। ইহান বুঝল তানিয়ার ভাবাবেগ। একটু হেসে তাসলিমা খাতুনকে জিজ্ঞেস করলো,

” ভালো আছেন আন্টি?

তাসলিমা খাতুন নিজেও সামনের সোফাতে বসলেন। হাসি মুখ করে বললেন,

” ভালো আছি। তোমাদের কি খবর? সবকিছু কেমন চলছে? শুনলাম বড় একটা কেস ডিশমিশ করেছো

” এইতো চলছে। ঠিকই শুনেছেন

” অনেকদিন পর এলে। কিছু হয়েছে?

ইহান তানিয়ার দিকে তাকাল। চোখ দিয়ে আসস্ত করলো। তানিয়া বুঝতে পারল তার নাক ঘামছে। মহিলার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক মনোভাব জেগে উঠছে। হাসিখুশি থাকলেও তাসলিমা খাতুন তার কথা শুনে কেমন রিয়্যাক্ট করবে ভেবেই ভয় হচ্ছে। তানিয়া সামনে থাকা পানির গ্লাস থেকে পানি পান করল। শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে নিল জিভ দ্বারা। নার্ভাসে হাত পা থরথর করছে তানিয়ার। তবুও নিজের ভয়কে দমিয়ে তানিয়া বলে উঠল,

” আমরা এসেছি আমার বাবার পক্ষ থেকে আপনার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। শুনেছি আপনার বাবা-মা থাকেন গ্রামে। আপনি এখানে একাই থাকেন। যেহেতু আপনি পরিপক্ক, বুঝদার মানুষ এবং আপনার ইচ্ছেকেই আপনি সবচেয়ে বেশি প্রায়োরিটি দেন তাই এই প্রস্তাব নিয়ে আপনার কাছেই এলাম।

তাসলিমা খাতুন অবাক হলেন কি না তা বোঝা গেল না। মিষ্টি গুলো খাওয়ার জন্য দুজনকে তাড়া দিলেন তিনি। দুজন মিষ্টি থলে নিল মুখে। মিষ্টিগলো খেতে সত্যিই মজাদার। তাসলিমা খাতুন স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,

” আমার সমস্যা নিশ্চয় জেনেই এসেছো। আমার স্বামী রায়হানের সাথে আমার প্রেমের বিয়ে ছিল। বিয়ের সাত বছরেও আমি তাকে সন্তানের মুখ দেখাতে পারিনি। যেজন্য সাত বছরের মাথায় আমাদের ডিভোর্স হয়। আমি তখন গৃহিণী ছিলাম। আব্বা-আম্মার সহায়তায় আমি বিচ্ছেদের যন্ত্রণা সামলিয়ে উঠেছিলাম এবং স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি অনেক কষ্ট করে। সবারই জীবন সঙ্গী খুঁজে নেওয়ার অধিকার আছে। একবার ডিভোর্স হয়েছে বলে সারাটা জিবন একা থাকবো এমন সিদ্ধান্ত আমি নিইনি। আমি চেয়েছি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তবেই জীবন সঙ্গী বেছে নিবো। কিন্তু দোকান দাড় করানোর পর আমি আমার মনের মতো কাউকে খুঁজে পাইনি। হয় লোকটা আমার দোকানকে ভালোবেসেছে, নয়তো প্রস্তাব দেওয়া ব্যক্তি নিজের স্ত্রী কে কোনো কারণে ডিভোর্স দিয়েছে, নয়তো দেখা গেছে প্রস্তাবকারীর কোন বড়সড় দোষ আমার সামনে এসেছে, যা আমি মানতে পারিনি। এসব দেখতে দেখতে বয়স অনেকটাই চলে গিয়েছে। কতন স্বচ্ছ, পরিষ্কার ভালো মানুষ আমার জন্য প্রস্তাব নিয়ে আসেনি কারণ আমার সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা নেই। এখন সবটা বেমানান। এখন আর..

তানিয়া শুনল। ঝটপট বলে উঠল,

” শেষ বয়সে এসে একটা সুন্দর সংসার আপনি চান না? অবশ্যই চান তবে সেটা প্রকাশ করেন না। আমরা নারীরা ভালোবাসার কাঙ্গাল। এইযে আপনি! আপনার বয়স হয়েছে মানছি। কিন্তু অবশ্যই আপনি চান এমন একটা পুরুষ, যে আপনাকে একজন যুবতীর নজরে দেখবে, কম বয়সী পুরুষদের মতো আপনার সাথে দুষ্টুমি করবে, পাগলামো করবে, আপনার জন্য ভাববে, অনেক আগের সময়ে আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, একটা শান্তির জীবন প্রদান করবে এবং আপনার গল্প শোনাল সঙ্গী হবে। কি তাইতো? দেখুন আমি আমার বাবার বিয়ে দিতে চাই। বিষয়টা হাস্যকর হলেও সত্য। আমার আম্মু মারা গিয়েছেন জ্বরের ঘোরে। আমার তখন দশ বছর বয়স। আমার বাবা আমার আম্মুর সাথে সংসার করেছে এগারো-বারো বছর। আম্মু মারা যাওয়ার পর বাবা আর বিয়ে করেনি আমার কথা ভেবে। আমিও আর ঘাটাইনি। কিন্তু এই বয়সটাতে বাবাকে খুব একা লাগে। আমার মনে হয় এখন বাবার কাউকে প্রয়োজন। আমার বাবা একজন বিচক্ষণ, দক্ষ উকিল। বর্তমানে সে কলেজে পড়ায়। বাবার অবসর সময় কাটে বই পড়ে। এইযে আমাকে দেখছেন, আমার বয়স চব্বিশ। বাবা এখন ও অবধি আমাকে বিয়ে করার জন্য জোর করেননি। কারণ বাবা নারীদের সম্মান করেন। যে সকল নারী স্বপ্ন দেখে বাবা তাদের একটু বেশিই সম্মান করে। কারণ স্বপ্ন সবাই দেখতে পারে না। আমি আমার বাবার হয়ে এখানে এসেছি। অবশ্যই বাবার সাথে আপনি দেখা করবেন, খোঁজ খবর নিবেন এরপর সিদ্ধান্ত নিবেন। আমি আমার আম্মুর জায়গা কাউকে দিতে পারবো না। কিন্তু আব্বুর লাইফ পার্টনার হিসেবে আমি আপনাকে অবশ্যই মানবো এবং ভালোওবাসবো। আপনার স্থান বাবার পরেই সর্বদা থাকবে। এখন আপনি ভেবে বলুন।

পুনরায় তানিয়া বললো,
” ইহান স্যার আমাকে জানিয়েছে আপনি বিয়ে করতে চান। ডিভোর্সি বলে নিজেকে সারাজীবন একা রাখবেন এমন মনোভাব আপনার নেই। তাই আপনার কাছে এসেছি।

তাসলিমা খাতুন হেসে উঠলেন। তানিয়াকে তার ভিষণ পছন্দ হয়েছে। মেয়েটা সুন্দর, যথেষ্ট সুন্দর। চশমা পরা চোখে এক আলাদা মায়া আছে। দেখলেই মেয়েটাকে আদর করতে ইচ্ছে হয়। তানিয়ার মতো মনোভাব সবার হয় না। মিষ্টি স্বরে তিনি বললেন,

” আমি ভেবে জানাবো। তোমার আব্বুকে বলো আমি উনার সাথে দেখা করতে চাই।

__________________

বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িটির দিকে ফিরল ইহান আর তানিয়া। তানিয়ার খুব ভালো লাগছে নতুন মা খুঁজতে আরম্ভ করেছে বলে। তানিয়া হাসিখুশি মুখে ফ্রন্ট সিটে বসল। ইহান বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে কপাল স্লাইড করতে করতে বললো,

” আজ তুমি ড্রাইভ করো তানিয়া।

তানিয়া বিস্মিত হলো। ইহান বা প্রহর দুজনের কেউই তানিয়াকে ড্রাইভ করতে দেয় না। সবসময় নিজেরাই ড্রাইভ করে। আজ ইহানের এমন কথায় তানিয়া কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলো। বা চোখের উপরে থাকা ভ্রু উঁচু করে বললো,

” আমি? আপনি ড্রাইভ করবেন না?

” মাথা ব্যথা করছে। এতটা পথ আমি বোধহয় ড্রাইভ করতে পারবো না। হ্যাঁ পারতাম, যদি তানিয়া শেখ নামক দক্ষ পুলিশ অফিসার আমার সাথে না থাকতো। সে তো ড্রাইভ করতে পারে। কেন এত ঝামেলা নিবো?

ইহানের মুখে নিজেকে দক্ষ বলে দাবি করায় চোখ মুখ উজ্জল হলো তানিয়ার। প্রশংসা শুনে গাল দুটো লাল হলো তার। ইহান আর প্রহরের মুখে প্রশংসা শোনা ছোটখাটো বিষয় না। যে কেউ এই প্রশংসা শুনতে পায় না। তানিয়া শুনতে পেরেছে এটা তার পারদর্শীতার জন্য।
তানিয়া বললো,

” এখান থেকে সদর অনেক দূর স্যার। এতক্ষণ মাথা ব্যথা নিয়ে থাকা উচিত নয়। সামনেই তো একটা ক্যাফে আছে। চলুন ওখানে গিয়ে কফি খাবেন। একটু ভালো লাগবে।

হাসল ইহান। চমৎকার বাঁকা হাসি। দুষ্টুমির স্বরে বললো,

” অফার করছো?

খিলখিল করে হেসে উঠল তানিয়া। নজরা কাড়া হাসির ঝংকারে ইহান তাকিয়ে রইল কয়েক পল। নিদারুণ এক ব্যথায় চিন চিন করে উঠল ইহানের বক্ষস্থল। তানিয়া ঠোঁট নেড়ে বললো,

” ভুলে যাবেন না আপনি সর্ব প্রথম আমার বন্ধু ছিলেন। আমরা ট্রেনিং এ থাকাকালীন বন্ধুদের ন্যায় আচরণ করেছি। এরপর এক বছর পর আমি আপনার কলিগ হয়েছি। এখন কিন্তু আমরা নিজেদের প্রফেশনে নেই। আমাদের গায়ে পুলিশের ইউনাফর্ম নেই। তাই ক্যাফেতে বসাই যায়।

” তোমার উড বি মাইন্ড করবে না? জানলে জেলাস হবে না?

” উনি আপনার কথা জানে। জানে আপনি আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলেন এবং আছেন। আমি তো কোন ভুল করিনি। আর আমি এমন কিছুও করছি না যাতে উনার খারাপ লাগে। তাই ভয় পাচ্ছি না।

তানিয়া ড্রাইভিং সিটে বসল। পাশে বসল ইহান। ইহান খুব করে চাইল সময়টা ওই ক্যাফেতে থমকে থাকুক। কাউকে খুব নিবিড় ভাবে দেখার তৃষ্ণা মিটুক। কিন্তু তা কি সম্ভব? সময় কারো জন্য থেমে থাকে? উহু! সময় তার নিজের মতোই চলে। কারো জন্য সময় আটকে থাকে না। এই পৃথীবীতে সবচেয়ে স্বার্থপর হলো সময়। এর মাঝে কোনো দয়া-মায়া নেই। যদি থাকতো তাহলে প্রত্যেকটা মানুষ একটা বিশেষ সময়ে অনেকক্ষণ আটকে থাকতে চাইতো। আর সময় তাকে সেই সুযোগটা দিতো।

আধঘন্টা বাদেই ক্যাফেতে প্রবেশ করলো ইহান আর তানিয়া। ক্যাফের বাইরেটা ফুলে সজ্জিত। নজরকাড়া ডেকোরেশন। তানিয়া আর ইহান মাঝের টেবিলটাতে বসল। তানিয়া আর ইহান দুজনেই ব্ল্যাক কফি নিল। খুব দ্রুতই কফি চেলে এলো টেবিলে। ইহান কফিতে চুমুক দিতে দিতে আশপাশে নজর বুলাল।

তানিয়া বললো,

” কেমন কফিটা?

” দারুন। তবে এর চেয়ে আমি বেশি ভালো কফি বানাই।

” তা ঠিক।

” তানিয়া, আমার মনে হয় তাসলিমা আন্টি তোমাকে ভিষণ পছন্দ করেছেন। উনি তোমার কথাবার্তা মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন। আমি নজর দিয়েছি বিষয়টাতে। হয়তো তোমার জন্য হলেও এই বিয়েতে রাজি হবেন। উনার ভাবনা আর তোমার ভাবনা অনেকটাই মিলে।

” হতে পারে। আমার ও উনার কথাবার্তা আগেই থেকেই ভালো লাগে। আগে এইভাবে ভাবিনি বলে উনাকে ওইভাবে দেখিনি,বুঝিনি।

এই ক্যাফেটা চমৎকার। নানা ধরনের পেইন্টিং করা দেয়ালে। হরেক রকমের লাইটিং। ফুল দিয়ে টেবিলটা সাজানো হয়েছে। ক্যাফের মাঝখানে একটা মেয়ে গিটার হাতে গান গাইছে। এটা মূলত করা হয় কাস্টমারদের আকর্ষণ করার জন্য। অনেকে গান শুনতেও এখানে আসে বোধহয়। গান গাওয়া মেয়েটার পোশাকআসাক মার্জিত হলেও বুকের অর্ধাংশ খোলামেলা। ওড়না ঠিক স্থানে নেই। ছোট ছোট কাঁধ অবধি কালার করা চুল। মেয়েটা হিন্দি গান গাইছে। ইহান নজর ফেরাল মেয়েটার পোশাক দেখে। বা দিকে তাকিয়ে দেখল কিছু লোক তাদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আছে। তানিয়া আর তাকে দেখে কেমন ভাবে যেন দেখছে। কানাকানিও করছে বোধহয়। ইহান উচ্চস্বরে হেসে উঠল হঠাৎই। সবাই তাকাল ওর দিকে। শব্দ করে কফিটা টেবিলে রাখল ইহান। ভ্রু কুঁচকাল তানিয়া। এভাবে হাসছে কেন লোকটা? কি হলো? তানিয়া অপ্রস্তুত হয়ে বললো,

” হাসছেন কেন স্যার?

ইহান থামল। তীক্ষ্ম দৃষ্টি ফেলল তানিয়ার দিকে। বললো,

” তুমি মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন-এর “কেউ কেউ কথা রাখে” বইটি পড়েছো?

” না তো। হঠাৎ এই কথা কেন?

” উনি এই বইটাতে লিখেছেন,- “আপনি যদি দেখেন কোনো সুন্দরির সাথে বসে আপনি আড্ডা দিচ্ছেন আর লোকজন আপনার দিকে ঈর্ষার চোখে তাকাচ্ছে তখন ভালো না লেগে উপায় নেই। চারপাশে ঈর্ষণীয় চোখের চেয়ে সুখের বস্তু আর কী আছে”? দেখো আমাদের আশপাশের মানুষ আমাদের কেমন আড়চোখে দেখছে।

তানিয়া অবাক হলো ভিষণ। অপ্রস্তুত হয়ে নড়েচড়ে বসল। বললো,

” আপনি কী আমাকে ইনডিরেক্টলি সুন্দরী বলছেন?

” ডিরেক্টলিই বলছি, তুমি সুন্দর। এটা তো সবাই জানে। এটাতে লুকোচুরি করার মানে নেই।

” আপনার কাছ থেকে শুনতে বেশি ভালো লাগল কেন জানেন? আপনি সহজে কারো প্রশংসা করেন না। হয়তো করেন তবে মনে মনে। আপনি নিজের মনের কথা প্রকাশ করেন না। আই মিন কারো প্রশংসা করেন না, হম্বিতম্বি করেন। আপনি যার প্রশংসা আপনি সরাসরি/ সামনাসামনি করেন সে খুব লাকি। এই যেমন আমি।

______________

যে শহরে দুর্নীতির বাস সে শহরে আর যাই হোক উন্নতি সম্ভব নয়। আজকাল প্রকাশ্যে দুর্নীতি চলছে। সাধারণ মানুষজনের এ নিয়ে কথা বলার অধিকার নেই। বলতে গেলেই প্রাণ নিয়ে দ্বন্দ্বে ভুগতে হবে। ন্যায় বিচার চেয়ে পুলিশের কাছে গেলে প্রথমেই টাকা ছুঁড়তে হয়। এজন্য অনেক মানুষই থানায় আসার সাহস পায় না, জিডি করার সাহস হয় না সবার। ন্যায় বিচার কথাটা ভাবলে প্রথমেই বলতে শোনা যায় ” পুলিশের পিছনে দৌড়াতে হবে, অনেক টাকা ঘুষ দেওয়া লাগবে, অনেক সময় লাগবে বিচার পেতে, ঘুরঘুর করতে হবে এদিক সেদিক। অথচ এরকম কথা কোনোকালেই ছিল না। কথা ছিল পুলিশ জনগনকে নিরাপত্তা দিবে। দেশের সকল অন্ধকার সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দেশকে উন্নতির শিখড়ে পৌছে দিবে।

এগারোটার দিকে প্রহর ও তার টিমকে সম্মাননা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কিসের সম্মাননা পাবে ওরা? জাফর আলীকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে আজ সকালেই। জেল থেকে বেরিয়ে বুক ফুলিয়ে হাঁটছে লোকটা। কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে প্রহরকে বলা হয়েছে “উপর মহল জাফরকে ছেড়ে দিতে আদেশ দিয়েছে”। প্রহর উপর মহলের লোকেদের কল করলে তারা ভণিতা ছাড়াই বলে দিল ” লোকটার অনেক ক্ষমতা। নেতা, মন্ত্রীর সাথে হাত আছে, ওদেয সাথেই ওঠাবসা করে। কোনোভাবেই লোকটাকে জেলে আটকে রাখা যাবে না। পুরো পুলিশ টিমকে ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে এই জাফর”। প্রহর এ উত্তর শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। শেষমেশ অপরাধীর ভয়ে পুলিশদের ঘরে বসে থাকতে হবে? তাহলে তারা কোন বা* এর পুলিশ?অপরাধী বুক ফুলিয়ে, মাথা উঁচু করে হাঁটবে আর পুলিশ সেই অপরাধীর আক্রমনের ভয় চুপচাপ অন্যায় সহ্য করে যাবে? সমাজের মানুষ তবে দৃঢ় বিশ্বাস করে নিবে পুলিশ বলতে আসলে কোনো সৎ পেশা নেই।

জাফর তার কোম্পানির বিভিন্ন পন্যে ক্ষতিকর দ্রবণ ব্যবহার করে। এসকল খাবার গ্রহনের মাধ্যমে কতশত মানুষ ধীরে ধীরে প্রাণ হারিয়েছে কে জানে? অথচ সব প্রমাণ থাকা সত্বেও জাফরকে ছেড়ে দেওয়া হলো। প্রহরদের বলা হলো একদম গোপনে সম্মাননা প্রদান করা হবে ওদের। এটা আদৌ সম্মানের? আসামীকে শাস্তি দিতে পারেনি এটা কি খুব গর্বের? কেন সম্মাননা নেবে তারা? সাধারণ মানুষের প্রতি এত বড় অবিচারের জন্য অপরাধীকে যদি ভুগতেই না হয় তবে এই সম্মাননা গ্রহণ করবে কিভাবে? এ তো একটা অপমান। আসামীকে শাস্তি যদি দিতেই না পারে তাহলে সম্মাননা কেন নিবে তারা? এটার যোগ্য তো তারা নয়। তাদের আসামীর ভয়ে বসে থাকতে হচ্ছে হাত গুটিয়ে।

থানার বাইরে তানিয়া, ইহান আর প্রহর দাঁড়িয়ে আছে। সকলের মন মেজাজ খারাপ। এত দ্রুত জাফর ছাড় পেয়ে যাবে ভাবেনি ওরা। সবটা কেমন ঘোলাটে লাগছে। এত এত কষ্ট বৃথা গেল তাদের। ইতিশা ম্যামের সন্তানের খোঁজ পাওয়া গেল না এখনো। জাফরকে যে ধোলাই দিয়ে কথা বের করবে এমন সুযোগ ও পায়নি তারা। তার আগেই সবটা এলোমেলো হয়ে গেল। সব প্রমান হুট করেই গায়েব হয়ে গেল। এতে তো পুলিশেরই দোষ। আদালত কিভাবে রায় দিল। কিভাবে কি হলো সবটা গুলিয়ে যাচ্ছে প্রহরের। নিজেদের প্রতি প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে সবার। ক্ষোভ নিয়ে প্রহর বললো,

” কিসের সম্মননা দিতে চাচ্ছে হ্যাঁ? অপরাধী ছাড় পেয়েছে বলে? মনে হচ্ছে আমরাই অপরাধী, আর জাফর পুলিশ। পুলিশের চেয়েও বেশি ক্ষমতা নিয়ে ঘুরছে ব্যাডা। কি আজব ব্যাপার। এমনটা হবে কখনো ভেবেছি? ক্ষমতাই কি সব কিছু? খুলে ফেলবো এই ইউনিফর্ম?

তানিয়ার কান্না পাচ্ছে কেন যেন। জাফরের কোনো শাস্তি হলো না। এত এত কষ্ট বৃথা গেল। কোনোকিছু করেই লাভ হলো না। তারা এমন একটা পর্যায়ে চলে এসেছে যে নিজেদের বড্ড ছোট মনে হচ্ছে। কত্ত মানষ তাদের উপর ভরসা করে রয়েছে। ইতিশা ম্যাম আশায় বুক বেঁধে আছে। সবার কাছে কি জবাব দিবে তারা। চশমা ঠেলে নাক টানল তানিয়া। টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে নিল সন্তর্পণে। বললো,

” আমরা কিছুই করতে পারলাম না। ইতিশা ম্যাম এত ভরসা করেছিলেন আমাদের। আমরা এসবের যোগ্য নই। কিছুই হলো না।

ইহান তানিয়ার ইমোশনাল হয়ে যাওয়ায় বিরক্ত হলো খানিক। বললো,

” কাঁদবে না তানিয়া। এত সহজে হাল ছেড়ে দিতে পারি না আমরা। নতুন ভাবে সবটা শুরু করতে হবে। ওকে এমন ফাঁদে ফেলবো, এমন কেসে ফাঁসাবো যে ওর বাপ এসেও ওকে ছাড়াতে পারবে না। আর যদি ছাড়া পায় ও, জনগন ক্ষেপে ইট ছুড়ে মারবে ওকে। সমাজে মুখ দেখিয়ে চলতে পারবে না।

প্রহর বললো,

” কি করতে চাইছিস? আমার কাছে প্ল্যান আছে। ওর অবস্থা যদি খারাপ করতে না পারি আমার নাম ও প্রহর না। ওকে ধরতে না পারলে আমি এই চাকরি ছেড়ে দিবো।

ইহান বললো,
” তুই যেটা ভাবছিস আমিও সেটাই ভাবছি। তুই তোর পরিকল্পনা আমাদের সাথে শেয়ার কর। আমরা তিনজন মিলে কিছু একটা করবোই। হাত গুটিয়ে বসে থাকবো না।

প্রহর বললো,

” আই থিংক প্রিয়তা কোনো না কোনো ভাবে এই মামলায় জড়িয়ে পরবে। ওকে সেভ করতে হবে। মেয়েটা তো একদম নির্দোষ। প্রিয়তার কিছু হলে আরহাম ভেঙে পরবে। আমি মেয়েটার কিছু হতে দিতে পারি না। জাফরের নজর থেকে ওকে বাঁচাতে হবে। উফফফ কি যে হচ্ছে আল্লাহ্। হেল্প আস।

_______________

শুক্রবার দেরি করেই ঘুম থেকে ওঠে প্রিয়তা। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। প্রিয়তা উঠল দেরি করে। ফোনের পাওয়ার বাটন অন করে সময়টা দেখল প্রিয়তা। এগারোটার বেশি বাজে। আরহাম ঘরে নেই। হয়তো মাঠে গিয়ে খেলছে, নয়তো ছাদে বসে আছে।

প্রিয়তা ঘুম থেকে উঠে বিছানা ঠিক করলো। ঘরের মেঝেটা ঝাড়ু দিল। চুলায় ভাত বসিয়ে দিয়ে গোসল করে নিল। চুলে গামছা বেঁধে রান্না করার সিদ্ধান্ত নিল। ঘরে পটল আর আলু আছে। প্রিয়তা আলু ভাজি করতে চাইল। বিপত্তি বাঁধল আলু চিকন চিকন করে কাটতে গিয়ে। কোনোভাবেই চিকন করে কাটতে পারছে না। মোটা মোটা হয়ে যাচ্ছে। প্রিয়তা তবুও কেটেই গেল। মোটা মোটা হওয়া আলুর টুকরোগুলো পুনরায় চিকন চিকন করে কাটল। আলু কাটতে প্রায় এক ঘন্টা সময় নিল প্রিয়তা। পটল ভাজা আর আলু ভাজি করলো। আরহামকে ডাকার আগে নাকের নতুন নোস পিন পরে নিল প্রিয়তা। গায়ে তার অ্যাশ রঙের কামিজ। চোখে কাজল নিয়ে একটু পরিপাটি হলো সে। মাথা থেকে গামছা খুলে ছাদে ছড়িয়ে দেবে ভাবল।

আরহামকে ডাকতে ছাদে উঠল প্রিয়তা। ওদিনের পর ও ঘরের কারো সাথেই কথা বারণ ছিল আরহামের। তবে নিধি আর প্রহরের সাথে প্রিয়তা নিজেও এখন একটু আধটু কথা বলে। তাকে সন্দেহ করে ধরে নেওয়ার পর প্রহরের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক হয়েছে প্রিয়তার। প্রিয়তা ছাদের এক পাশে আরহাম আর প্রহরকে দেখল। সেদিনের মতো একটা চেয়ারে দুজন বসে ফোনে গেম খেলছে ওরা। সেদিন আরহামের গায়ে শার্ট বা গেঞ্জি ছিল না। আর আজ প্রহরের গায়ে কাপড় নেই। ছেলেটার পরণে শুধু হাফ প্যান্ট। প্রহরের লোমশ বুকটা উন্মুক্ত। প্রিয়তা খানিক অপ্রস্তুত হলো। নিধির কাছে গতকাল শুনেছে জাফরকে ধরার জন্য প্রহরকে এওয়ার্ড টাইপ কিছু দেওয়া হবে। এওয়ার্ড দেওয়ার সময় তো এখনই বলেছিল নিধি। তাহলে প্রহর বাড়িতে কেন? প্রশ্ন এলো প্রিয়তার মনে। এগিয়ে এলো সে। আরহামের সম্মুখে গিয়ে চুল থেকে গামছা খুলে নিল। গামছা দিয়ে চুলগুলো ঝেড়ে গামছা ছড়িয়ে দিল দড়িতে।

আরহামের উদ্দেশ্যে বললো,
” চলো আরহাম। সকাল থেকে খাওনি। রান্না করেছি। চলো খাবে।

আরহাম ঘাড় ঘুরিয়ে প্রহরকে দেখল। একটু ভয়ে ভয়ে বললো,

” আমি খেয়েছি আপু। প্রহর ভাইয়া আমাকে বিরিয়ানি খাইয়ে দিয়েছে।

প্রিয়তা কেমন করে যেন তাকাল। একটু রাগ হলো আরহামের প্রতি। রুক্ষ স্বরে প্রহরের দিকে চেয়ে বললো,

” আজ শুক্রবার। নাবিলা আন্টিই রান্না করেছে তাইনা? তাই খেতে দিয়েছেন ওকে? আমাদের কি এতটাই গরীব মনে হয়?

প্রহরের চুলগুলো বড় বড়। কপালের খানিক অংশ চুলে ঢেকে থাকে। ফর্সা মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গজিয়েছে। নাকের নিচেও হালকা গোঁফের অস্তিত্ব দেখা দিচ্ছে। প্রিয়তার চুল ঝেড়ে গামছা দড়িতে রাখা অবধি সবটাই পর্যবেক্ষণ করছিল সে। প্রিয়তার সদ্য গোসল করা স্নিগ্ধ মুখের দিকে চেয়ে থাকতে ভালো লাগছিল প্রহরের। হঠাৎ এমন রুক্ষ স্বরে এমন কথা বলতে শুনে কিছুটা রাগ হলো প্রহরের। শান্ত স্বাভাবিক কণ্ঠে প্রিয়তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,

” তানিয়া আমি আর ইহান রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম। আরহামকে আমি ভালোবাসি প্রিয়তা। ভাবলাম ওর জন্য এক প্যাকেট নিয়ে যাই। এখানে ধনী গরীবের কি হলো? মায়ের রান্না করা খাবার আমি আরহামকে দিবো ভাবলেন কি করে?

” কিন্তু আমি যে দুজনের জন্য রান্না করে ফেলেছি। ওগুলো খাবে কে? আপনি আমাকে আগে বলবেন না?

আরহাম ছোট ছোট চোখ করে চাইল। প্রিয়তার চুলের আগা দিয়ে পানি ঝরছে। নাকের ডগায় পানি চিকচিক করছে মুক্তোর মতো। পানি ঝরে জায়গাটা একটু ভিজেই গেছে। প্রহর আনমনে বলে উঠল,

” বিরিয়ানি খেয়ে জিভটা কেমন হয়ে গেছে। ভাত খেতে ইচ্ছে করছে। আরহামের খাবারটা না হয় আমাকেই দিন। কি রেঁধেছেন?

” পটল ভাজা আর আলু ভাজি। অপ্রস্তুত হয়ে মাথা নিচু করে বললো প্রিয়তা।

” আমার জন্য নিয়ে আসুন।

প্রিয়তা ভারী অবাক হলো। তার হাতের রান্না পুলিশম্যান মুখে তুলতে পারবে? এমন আবদার করার কোনো মানে আছে? প্রিয়তা চলে যেতে উদ্যত হলো। প্রহর পিছু থেকে বললো,

” মা কে সবটা বলে দিয়েছেন? দু মাস পর নাকি চলে যাচ্ছেন।

থমকাল প্রিয়তা। পিছু ঘুরে বললো,
” যেতে তো হবেই। আন্টি আমাকে রাখবে না। ব্যাচেলর মেয়ে ভাড়া দেন না উনি।

” আমি মা কে বুঝাবো।

” তার প্রয়োজন নেই। আপনার আজ সম্মাননা পাওয়ার কথা না?

“হ্যাঁ নেইনি।

” কেন?

” কারণ এর যোগ্য আমি নই। জাফর ছাড়া পেয়ে গেছে ক্ষমতার কারণে।

প্রিয়তা অবাক হলো। খারাপ লাগল বেশ। আর কিছু বলে প্রহরের মন খারাপ করার ইচ্ছে হলো না। চলে এলো সেখান থেকে।

_______________

মার্কেটে এসেছে আরহাম আর প্রিয়তা। শুক্রবার বলে আজ অনেক ভিড়। প্রিয়তার মনে হচ্ছে দুদিন আগেই শুক্রবার গেল। দুদিন আগেই এত টাকা খরচ করে মাংস ভাত খেল দু ভাইবোন। এর মাঝে আরো ছয়টা দিন কেটেছে একদমই স্বাভাবিক ভাবে। মার্কেটের পুরো জায়গা জুড়ে মানুষের ছড়াছড়ি। প্রিয়তা প্রথমেই বাচ্চাদের খেলনার দোকানে গেল। সব ধরনের ব্যাট মিন্টন রয়েছে দোকানটাতে। আরহাম ছোট বিধায় আর সেভাবে খেলতে পারে না বলে খুব কম দামি ড়্যাকেট কিনল প্রিয়তা। আরহামের হাতে একটি চিপস ধরিয়ে দিয়ে মার্কেট থেকে চলে আসতে চাইল। চিপসের দাম দিতে গিয়ে ব্যাগ হাতরে টাকা দিয়ে পাশে তাকিয়ে আরহামকে পেল না প্রিয়তা। আতঙ্ক সৃষ্টি হলো প্রিয়তার মনে। আশপাশে চোখ বুলিয়ে ডেকে উঠল ততক্ষণাৎ। অদূরে তাকিয়ে প্রিয়তার বক্ষপিঞ্জর কেঁপে উঠল। পা থরথর করে কাঁপল প্রিয়তার। বুকে বিষাদ তৈরী হলো। অজানা এক ভয়ে নির্বাক হলো প্রিয়তা। পা টলমল করে উঠল। অদূরে পোশাকের দোকানে দাঁড়িয়ে আছে আরিফ আর তার নব স্ত্রী দীপা। দুজনের মাঝখানে আরিফের হাত ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরহাম। মুখে ছেলেটার বিশ্ব জয় করা হাসি। আরহাম প্রিয়তাকে হাতের ইশারায় ডাকল। দ্রুত হন্তদন্ত পায়ে ছুটে আরহামের কাছে এলো প্রিয়তা। বুকটা ধরধর করছে তার। হারানোর ব্যথা প্রকাশ পাচ্ছে। আরহাম ওদের এত কাছে কেন? আরিফ আরহামকে কোলে নিয়ে বললো,

” কেমন আছিস প্রিয়তা?

প্রিয়তা কথা বলতে পারল না। চরম বিস্ময়ে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা সৃষ্টি হলো। কম্পন ধরলো শিরা উপশিরায়। নজর ঘোলা হলো। বুকের ভিতর হাহাকাল প্রতীয়মান হলো। দুর্বল কণ্ঠে কষ্ট করে বললো,

” ভালো আছি। আরহামকে দাও।

‘ আরহাম আমাদের সাথে যাবে। খানিক হেসে বললো দীপা।

দীপার হাসি অসহ্যকর ঠেকল প্রিয়তার কাছে। এই মুহুর্তে ভেঙে পরলে চলবে না। শক্ত হতে হবে। আরহামকে আটকে রাখতে হবে। ওদের সরিয়ে দিতে হবে আরহামের জীবন থেকে। চলামে আসার সময় দয়া দেখায়নি। এখন কিসের দয়া দেখাচ্ছে এরা? কি চাইছে?

প্রিয়তার চোখ লাল হলো। নাকের পাটা কাঁপতে লাগল। রাগে গলার রগ ফুলে উঠল। শান্ত, ধীর কণ্ঠে বলে উঠল,

‘ আরহাম কোথাও যাবে না। এতদিন একবার ও ফোন করেননি। আজ যখন ওকে দেখলেন অমনিই মায়া বেড়ে গেল? আপনাদের নাটক বন্ধ করুন।

আরিফ মুখটা মলিন করল। বললো,

” তুই নিজের জীবন গুছিয়ে নে। আরহাম আমার কাছে থাকুক। ওকে তো আমরা মেনেছি।

” কাউকে মানা লাগবে না। দিন আরহামকে।

রাগে উন্মাদের তো চিৎকার করলো প্রিয়তা। খাবলে আরিফের কোল থেকে আরহামকে নিতে চাইল। উচ্চস্বরে কয়েকবার রাগ দেখাল। ফোস করে ঘনঘপ শ্বাস ছাড়ল। এমন কাণ্ডে আরহাম হতভম্ব হলো। মুখ ছোট করে বললো,

” আমি আব্বুর কাছে যেতে চাই আপু। কয়েকদিন থেকে না হয় চলে আসবো। এই আন্টিটা তো ভালো।

আরহামের কণ্ঠ কানে পৌঁছানো মাত্র প্রিয়তা থেমে গেল। স্থির হলো মেয়েটার আঁখি। অশ্রু গড়িয়ে পরল টুপ করে। বিস্ময়ে বিমূঢ় হলো প্রিয়তা। উন্মাদনা কমে এলো। বাড়িয়ে রাখা হাত নিজের কাছে আনলো। পানিতে টইটম্বুর চোখ আর ভেজা গলায় প্রিয়তা বললো,

” কি বলছো ভাই? আ..আমি আপু হই। আমাকে ছে..ছেড়ে…

আর বলার শক্তি পেল না প্রিয়তা। মুখে হাত দিয়ে ঢুকরে কেঁদে উঠল সে। বক্ষ স্থলে ব্যথা টের পেল। ক্ষত বিক্ষত হলো প্রিয়তার হৃদয়। দীপা হাসল নিঃশব্দে। আরহাম বললো,

” আমি তো আবার আসবো। এখন শুধু যাবো। কেঁদো না আপু।

আরিফ পিছু হাঁটল আরহামকে কোলে নিয়ে। আরহাম বোনকে হাত নাড়িয়ে টা টা দিল হাসিমুখে। প্রিয়তা প্রতিক্রিয়া জানাতে ভুলে গেল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। ওরা গাড়িতে চড়ে চলে যেতেই প্রিয়তার হুশ ফিরল। মার্কেট থেকে বেরিয়ে অটো ধরে বাড়ির সামনে এলো। এতক্ষণ পর কান্না করার মতো ঠিকঠাক জায়গা পেল প্রিয়তা। চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। হাউমাউ করে কাঁদল নিজের মতো। ঘাসের উপর বসে পরলো নির্দ্বিধায়। গাল পানিতে পুকুর হয়ে গেল। কান্নার শব্দে বোধহয় মাটিও কেঁপে উঠল। প্রিয়তা উন্মাদের মতো ঘাস ছিড়তে লাগল। আকাশের দিতে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বললো,

” আমার সুখ কেন দেখতে পারে না কেউ?কি করেছি আমি? আমার দোষ কোথায়? আরহামকে ছাড়া আমি কিভাবে বাঁচবো?

আমি তো বাঁচব না। প্রিয়তা গাল মুছে উঠল। ছাদের দিকে পা বাড়াল। আজ প্রিয়তার জীবন এখানেই শেষ হবে। এত কষ্ট সইতে পারবে না সে।

চলবে?

প্রিয়তার প্রহর পর্ব-১০ + বোনাস পর্ব

0

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা ( ১০ )
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

ভয়াবহ এক ঘটনা ঘটছে বিগত কয়েক বছর ধরে। “ফুড অ্যান্ড কোল্ড” নামক বিখ্যাত কোম্পানি কেক, বিস্কিট এ কৃত্রিম ক্ষতিকর রং এবং রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে কেক ও বিস্কিটকে আকর্ষণীয় ও সুস্বাদু করে তুলছে। যা গ্রহণের মাধ্যমে মানুষ ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অসুস্থ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সম্প্রতি সিলেটের বিখ্যাত লেখিকা ইতিশা নায়েমার বইয়ে প্রকাশ পেয়েছে “ফুড অ্যান্ড কোল্ড” কোম্পানির ওউনার জাফর আলীর ভালো মুখোশের আড়ালে থাকা অযাচিত মুখ। এছাড়াও বইটিতে আরো কিছু অসৎ ব্যবসায়ীর মুখোশ উন্মোচন করা হয়েছে। জানা গিয়েছে ইতিশা নায়েমার পুত্র ইব্রাহিম নিখোঁজের পেছনে জাফর আলীর হাত রয়েছে। এ সম্পর্কে সিলেট সদর উপজেলার পুলিশ অফিসার আজওয়াদ ইশতিয়াক আমাদের জানাবেন। তার মুখেই আমরা এ তথ্যটির সত্যতা জানবো।

টিভিতে পরিপাটি করে শাড়ি পড়ে মার্জিত ভঙ্গিতে বসে থাকা মহিলাটি এতক্ষণ কথা বলছিলেন। তার কথা শেষ হতেই টিভির স্ক্রিনে ভেসে উঠল প্রহরের গম্ভীর মুখ। পাশেই ইহান আর তানিয়া দাঁড়িয়ে আছে হাস্যজ্জল ভঙ্গিতে। সাংবাদিকরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে ইন্টারভিউ নেয়ার জন্য। শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে প্রহরের সামনে। সব পুলিশদের পরণে ব্লু রঙের শার্ট। কোমরে বন্দুক গুঁজে রাখা। পরিপাটি করে রাখা চুলগুলোর উপরে স্থান পেয়েছে পুলিশের ক্যাপ। সংবাদকর্মীর কথা শেষ হতেই প্রহর বলে উঠল,

” জাফর আলীর কেসটা নিয়ে অনেকদিন ধরে পুলিশ অফিসাররা ছুটছিল। এই কেসের কুল কিনারা পেয়েও যেন পাচ্ছিলাম না। ইতিশা ম্যামের সন্তান নিখোঁজের পর থেকে এ কেসটা আরো ভালোভাবে ঘাঁটতে আরম্ভ করি। অতঃপর সবটা মিলিয়ে গুছিয়ে বুঝতে পারি জাফর আলী এতে যুক্ত। রাসায়নিক পদার্থ লাইক হাইড্রোস ব্যবহার করে জনগনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে জাফর আলীর কোম্পানি। এ সম্পর্কে সব প্রমাণ আমরা উপরমহলের নিকট পেশ করেছি। আমাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছেন ইতিশা ম্যাম নিজেই। ছেলেকে বাঁচানোর জন্য তিনি অন্যায়ের সাথে মাথা নত করেননি। বরং সন্তানের চেয়ে দেশকে , দেশের মানুষকে ভালোবেসেছেন তিনি। দেশ ও দেশের মানুষকে বড়সড় ক্ষতির হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। ইতিশা ম্যামের “দুর্নীতি” বইটা পড়লে আপনারা আরো অনেক কিছুই জানতে পারবেন। এই কেসটায় আমরা তিনজন ছিলাম। ইতিমধ্যে টিমের একজনকে এট্যাক করা হয়েছে। জাফর আলীর মুখে ইব্রাহিমের পরিস্থিতি খুব শীঘ্রই জানতে পারবো আমরা। ধন্যবাদ আমাদেয পাশে থাকার জন্য।

প্রহর ইহান আর তানিয়া ভিড় ঠেলে জিপের কাছে গেল। জিপের এক কোণে বসে আছে জাফর আলী। তাকে বের করে আনল প্রহর। হেসে বললো,

” আপনার এত এত প্ল্যান নষ্ট করার জন্য আমরা সত্যিই দুঃখিত। অন্যায়কারীকে সব সময় হেরে যেতে হয়।

জাফর আলী মোটেও দুঃখিত হলো না। হেসে ফেলল লোকটা। ধীর কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

“এক মাঘে শীত যায় না অফিসার। কতদিন আমাকে আটকে রাখবে। পুলিশ মানেই ঘুষ,জানো তো?

টেনে নিয়ে যাওয়া হলো জাফরকে। তানিয়া ভিত চোখে ইহানের দিকে তাকাল। বললো,
” উনি হয়তো বড় কোন পরিকল্পনায় নেমেছে স্যার। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

ইহান ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। থানার দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক পল। তানিয়ার কথা কুহরে পৌঁছানো মাত্র বললো,

” ও যদি প্ল্যান করে থাকে আমরাও তো বসে নেই। দেখা যাক কি হয়।

টিভিতে প্রহর ও তার টিমের জয়জয়কার চলছে। আনন্দে মেতে উঠেছে থানা। বড়সড় একটা কেস এত সহজে ডিশমিশ হবে কেউই ভাবতে পারেনি। মিসেস নাবিলা আনন্দে কেঁদে ফেলছেন। সাবিনা বেগম এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখছিলেন। তিয়াশ ও তার বউসহ একটু পরেই গ্রামে ফিরে যাবেন তারা। যাওয়ার আগে ভাইয়ের ছেলের এমন সুন্দর মুহুর্ত দেখে খুশি হলেন তিনি। এনগেইজমেন্টের দিন থেকে নিধি ও প্রহর তার সাথে কথা বলে না। দেখা হলেও খানিক এড়িয়ে যায়। এ বিষয়টা বারবার আহত করছে তাকে। যাওয়ার আগে প্রিয়তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে প্রহর। কিন্তু এটা করলে যে মানসম্মান কমে যাবে তার। নিচু হবে পুচকে একটা মেয়ের সামনে। শেষ বয়সে এসে এমন এক অপমান? কি এমন বলেছে সে? আর মেয়েটার জন্য সবার দরদ উতলে পড়ছেই বা কেন?
_______________

শীত শীত ভাব এসেছে পৃথিবীতে। খুব ভোরে কুয়াশায় ঢেকে যায় দূরের স্থান। গা শিরশির করে ওঠে। সেইভাবে এখনো শীত পড়েনি। পাখা বন্ধ করলে গরম আর মশার জ্বালায় টেকা দায়। অপরদিকে পাখা ছাড়লেই শীতে জুবুথুবু অবস্থা। শীতের শাক-সবজি সেইভাবে উঠেনি বাজারে। তবুও শীত শীত আমেজটা উন্মুক্ত হচ্ছে। নতুন এক প্রকৃতির সাথে পরিচিত হচ্ছে মানুষ। গরমের উষ্ণতা কমিয়ে শীতকাল তেন মানুষের প্রাণে এক অজানা আনন্দের জোয়ার বইয়ে দেয়।

প্রিয়তা সকালে উঠে নাস্তা বানিয়েছে ডিম ভাজা আর পরোটা। আরহাম খেয়ে পড়তে বসেছে। গতকাল রাতে পড়তে না বসায় সকাল হতেই ছেলেটার সামনে খাতা কলম রেখে দিয়েছে প্রিয়তা। পরোটা বানানো শেষ হতেই প্রিয়তা ঘরে এলো। আরহামের মুখে তুলে দিল পরোটার ছোট ছোট টুকরা। খেতে খেতে আরহাম বলে উঠল,

” আপু।

” বলো।

” আমি ব্যাট মিনটন খেলবো। বাইরে কত্ত জায়গা।

” তুমি তো পারো না ভাই। কেন আবদার করছো?

“তুমি তো পারো । আমাকে শিখিয়ে দিবে। তুমি কি বলো মনে নেই? পানিতে না নামলে সাঁতার শেখা যায় না, হোঁচট না খেলে হাঁটতে শেখা যায় না। কি বলো না?

হাসল প্রিয়তা। বাচ্চাটার মেধা এই বয়সে অনেকটাই ভালো। পড়ালেখা করার সম্পূর্ণ ইচ্ছে আছে আরহামের। প্রিয়তা কোনকিছু বললে ছেলেটা মনে রাখে। পালন করার চেষ্টা করে। সর্বক্ষণ এটা ওটা জিজ্ঞেস করতেই থাকে। জানার কৌতুহল আরহামের অনেক আগে থেকেই। ভাইয়ের এহেন কথায় গাল টিপে দিল প্রিয়তা। আরেকটা পরোটার টুকরো মুখে গুঁজে দিয়ে বললো,

” শীত ভালো মতো পড়ুক। কিনে দিবো। ও বাড়ি থেকে তো কিছুই আনা হয়নি।

” না আপু। আমি আজই খেলবো। তুমি এনে দাও না। নইলে আমাকে নিয়ে যেও ও বাড়িতে। আমি নিয়ে আসবো।

প্রিয়তার আত্মা কেঁপে উঠল। ও বাড়ি যাওয়ার কথা ভুলেও আরহামের মাথায় ঢোকানো যাবে না। গেলে হয়তো আর আসতেই চাইবে না ছেলেটা বাবাকে ছেড়ে। আর প্রিয়তা তো আরহাম ছাড়া থাকতেই পারবে না। খানিক নিচু স্বরে থমথমে মুখে আরহামকে মিথ্যে সান্ত্বনা দিল প্রিয়তা। বললো,

“টিউশন থেকে আসার পথে কিনে আনবো।

আরহাম খুশি হলো। পড়তে বসল আবার। খেয়াল করলে ছেলেটা বুঝতে পারতো প্রিয়তার মলিন মনোভাব। টাকা পয়সা হাতে নেই বললেই চলে। ছোট খাটো কম দামি ড়্যাকেট কিনতে গেলেও দুশো-তিনশো টাকা লাগবেই। এত এত খরচ হজম হচ্ছে না প্রিয়তার। বাজার সদাইয়ে হাত দেওয়া যায় না। আলুর কেজি আজ সত্তর টাকার নিচে নেই। পেয়াজ রসুনের দাম তরতর করে বাড়ছে। মাছের কথা তো ভুলেই গিয়েছে প্রিয়তা। কালকের গরুর মাংস পুরোটাই আরহামকে খেতে গিয়েছে। দই আজ বিকেলে ফ্রিজ থেকে বের করে আরহামকে দেবে। নিজে না খেয়ে কোনোভাবে ছেলেটার চাহিদা পূরণ করছে প্রিয়তা। শীত ঝেঁকে বসলেই শীতের পোশাক চাইবে আরহাম। সেগুলো কিনতেও কত খরচ। কিভাবে কি সামলাবে প্রিয়তা? কোন দিকে যাবে?
প্রিয়তা থালা-বাসন ধুয়ে ভাবতে বসল। হিসেব কষল সবকিছুর। মাথায় চিন্তা নিতে নিতে প্রিয়তা দূর্বল হয়ে পড়েছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। আগের থেকে রোগা দেখায় তাকে। তবুও যেন চিন্তা কমে না।

প্রিয়তা ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য তৈরী হলো। ফোনটা রাখল আরহামের কাছে। ভাইকে কিছু উপদেশ দিয়ে বের হওয়ার পূর্বেই দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। প্রিয়তা দরজা খুলল একটু সময় নিয়ে। দরজার ওপাশে সাবিনা বেগমকে দেখে কিছুটা অবাক হলো প্রিয়তা। সাবিনা বেগমের মুখটাও থমথমে। প্রিয়তা ঘরে আসতে বলবে কি না ভেবে পেল না। আতিথেয়তা করতে চেয়েও কেন যেন মন তাতে সায় দিল না। প্রিয়তা জিজ্ঞেস করলো,

” আপনি এখানে? কিছু বলবেন?

সাবিনা বেগম বাধ্য হয়ে এসেছেন এখানে। প্রহরকে তিনি নিজের ছেলের চাইতে বেশিই ভালোবাসেন। সেই ছেলে তার সাথে কথা বলে না। সকালে থানায় যাওয়ার আগে সাবিনাকে অনুরোধ করেছিল প্রিয়তার কাছে আসার জন্য, ক্ষমা চাওয়ার জন্য। তাইতো ক্ষোভ আর রাগ থাকা সত্বেও এখানে এসেছেন তিনি। প্রিয়তার কথার প্রতিত্যুরে তিনি বললেন,

” দেখো মাইয়া, তুমি আমার অনেক ছোট। আমি সেদিন যা কইছি কইছি। মনে রাইখো না। গায়ে মাইখো না। আংটি হারানোর শোকে কি থিকা কি কইছি নিজেও জানি না।

প্রিয়তা হাসল। এটুকু বলাতেই কি সব অপমান ফিরিয়ে নেওয়া যায়? কলঙ্ক মুছে দেওয়া যায়? প্রিয়তা ক্ষমা করতো, যদি ঘটনাটা শুধু তার সাথেই ঘটতো। এ ঘটনার সাথে আরহাম ও জড়িত। কি করে এত সহজে ভুলবে সে? কাঁধে ব্যাগটা ভালো করে চেপে প্রিয়তা বললো,

” আমি যদি এখন হেসে বলি আমি কিছু মনে করিনি, ভুলে গিয়েছি, মনে রাখিনি, তবে তা হবে আমার জীবনে বলা সবচেয়ে বড় মিথ্যে। আমি মিধ্যে বলি না আন্টি। আপনাকে মিথ্যে সান্ত্বনা দিতে পারছি না। আমি চাইলেও কোনকিছু ভুলতে পারবো না। না চাইতেও বারবার ওই ঘটনা আমার চোখে ভেসে ওঠে। তাই ভুলে যাবো, গায়ে মাখবো না এ কথা দিতে পারছি না। তবে আমি চেষ্টা করবো আপনাকে মন থেকে ক্ষমা করার। আজ আসি। আসসালামু ওয়ালাইকুম ।

প্রিয়তা জুতোর খটখট শব্দ করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। সাবিনা বেগম থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এইটুকু মেয়ের এত চ্যাটাং চ্যাটাং কথা? সাবিনা বিরক্ত হলেন বেশ। রাগে গা শিরশির করে উঠলো তার। কি এমন করেছে সে? দু কথা বললে কি হয়? বয়সে তো মেয়েটা ছোট। অথচ কথাবার্তা কি পাকা পাকা। এজন্যেই বাবার বাড়িতে টিকতে পারেনি। নিশ্চয় বাবা-মা এই আচরণের জন্যে মেয়েটাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

_______________

তানিয়া বাড়িতে বসেই জাফর আলীর বিরুদ্ধের কেসটা ক্লোজ করার কিছু তথ্য একত্রে করছে। নিয়াজ একটু আগেও দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য ডেকে গেছেন তানিয়াকে। কাজে লেগে পরলে আর উঠতে মন চায় না তানিয়ার। কেননা উঠলে আর কাজে হাত লাগাতে ইচ্ছে করে না। অলসতা লাগে। আজকাল এই অলসতা যেন বেড়েছে। জাফরের কেসটা নেমে যেতেই নিজেকে স্বাধীন মনে হচ্ছে তানিয়ার। বাবার ডাকে এইবার বিরক্ত হয়েই খাবার টেবিলে বসল তানিয়া। নিয়াজ আজ কাতলা মাছ রেঁধেছে। প্রতিদিন রান্না করে তানিয়াকে তিনি একটা কথাই জিজ্ঞেস করেন “রান্না কেমন হয়েছে, ভালো না”?

কিন্তু আজ এই ধরণের প্রশ্ন করলেন না নিয়াজ। বিষয়টাতে খুব অবাক হলো তানিয়া। এই প্রশ্ন রোজ একবার না শুনলে মনে হয় কিছু একটা সমস্যা রয়েছে। রোজ এক প্রশ্ন করতে করতে নিয়াজের যেমন অভ্যেস হয়ে গেছে, তেমনি একই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে তানিয়া। নিয়াজের এইরুপ পরিবর্তনে একটু ঘাবড়ে গেল সে। পুলিশে জয়েন করার পর নিয়াজের সাথে তার দুরত্ব বেড়েছে। আগের মতো বাবার সাথে আড্ডা দেওয়া হয় না তানিয়ার। এত এত কাজ করে রাতে আর ইচ্ছে হয় না বাবার সাথে গল্প করার। যদিও নিয়াজের সব কথাই শোনে তানিয়া। এই যেমন বিয়ের বিষয়টা। এই বিয়েটা তানিয়া পুরোপুরি মানতে চায়নি। হয়তো চাইলেই মানতে পারতো। কিন্তু কেন যেন মন, মস্তিষ্ক সম্পর্কটাকে জোড়ালো করতে পারেনি। তানিয়া খেতে খেতে নিয়াজের উদ্দেশ্যে বললো,

” জিজ্ঞেস করলে না রান্নার কথা?

নিয়াজ হাসলেন। বললেন,
” রোজ এক প্রশ্ন করি। তুমি তো রোজই বলো ভালো হয়েছে।

“ভালো হলে বলবো না? আমাকে তো রান্না করতেই দাও না।

“সারাদিন যে পরিশ্রম করো তার পর আর রান্নার ঝামেলা নিতে পারবে? বাবা হয়ে এটুকু কষ্ট যদি বুঝতে না পারি তাহলে কেমন বাবা হলাম?

তানিয়া নড়েচড়ে বসল। বললো,

” এত ভালোবাসো কেন বাবা? কতদিন
করবে এইভাবে?

” যতদিন বেঁচে থাকি ততদিনই করবো।

” একটা কথা বলতে চাই তোমায়। বলবো?

নিয়াজ মেয়ের দিকে তাকালেন। খেতে খেতে বললেন,
” অনুমতি চাইতে হবে না। নির্দ্বিধায় বলো।

” তুমি বিয়ে করো বাবা।

তানিয়ার এহেন বাক্যে বিদ্যুতের ঝটকা খেলেন নিয়াজ। খাবার মুখেই কেশে উঠলেন। তানিয়া দ্রুত হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাস এগিয়ে দিল নিয়াজের সম্মুখে। কথাটা শুনে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছেন নিয়াজ। মেয়ের মুখে এমন কথা কোন বাবাই বোধহয় সহজ ভাবে নিতে পারে না। নেওয়ার কথাও নয়। কাশি কমলে তিনি ভালো করে দম নিলেন। বুকটায় একটা ব্যথা শুরু হলো এভাবে কেশে ওঠার কারণে। সময় নিয়ে তিনি বললেন,

“মজা করছো বাবার সাথে?

” মোটেই না।
শান্ত, গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল তানিয়া। পুনরায় বললো,

” তুমি লজ্জা পাচ্ছো বাবা। কিন্তু কথাটা বলতে আমার মোটেও লজ্জা লাগেনি। আম্মু মারা গিয়েছে প্রায় চৌদ্দ বছর হয়েছে। আমি তখন ছোট। দশ বছর বয়স মাত্র । তোমার সাথে আম্মুর যখন বিয়ে হয়েছিল তখন তোমার বয়স ছিল পনেরো, আম্মুর বারো। খুব কম বয়সে তোমাকে সংসারে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আম্মুর সাথে তুমি খুব সুখেই ছিলে। সংসার জীবন তোমার সুন্দর ছিল। হুট করে জ্বরের ঘোরে মারা গেল আম্মু। আমি একা হয়ে গেলাম। আম্মুর সাথে তোমার সংসার জীবন ছিল এগারো-বারো বছরের। আম্মু মারা যাওয়ায় শুধু আমিই আম্মুর অভাববোধ করিনি। আমি দেখেছি তুমি নিজেও আম্মুর মৃত্যুতে একা হয়ে গিয়েছিলে। কষ্টে পেয়েছিলে ভিষণ। প্রায় রাতেই চোখের পানি ফেলতে। বিয়ে মানে শুধু দৈহিক চাহিদা নয় বাবা। বিয়ে মানে মনের শান্তিও। আমাদের প্রত্যেকের কিছু মৌলিক চাহিদা থাকে। এর মাঝে সুখের জন্য কাউকে কাছে রাখা এক ধরনের চাহিদা। একজন সবসময় পাশে থাকবে, সব কথা শুনবে, কেয়ার করবে, অসুস্থ হলেও দোয়া করবে এ কথা ভাবতেই তো ভালো লাগে তাইনা? স্ত্রী মানে যে শুধু সন্তানের জন্মদান তা কিন্তু নয়। স্ত্রী মানে জীবন সঙ্গি, যার সাথে জীবনের প্রত্যেকটি মুহুর্ত ভাগাভাগি করা যায়। আমি অফিসে থাকি,সময় হয় না। তুমি সারাদিন একা একা ঘরে বসে বইপত্র পড়। এই সময় তোমার একজন মানুষ প্রয়োজন যে তোমার খেয়াল রাখবে, যে তোমাকে সঠিকভাবে গাইড করবে, তোমার সুখ-দুঃখের কথা শুনবে মনোযোগ দিয়ে। তোমায় মানসিক শান্তি দেবে এমন কজন দরকার।

“কি বলছো তুমি? পাগল হয়েছো? উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন নিয়াজ। এমনটা তিনি ভেবেছেন আগে। কিন্তু এখন বিষয়টা অন্যরকম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বয়সে এসব মানায়?

” আমি জানি সৎ মা আমাকে ভালবাসবে না ভেবে তুমি বিয়ের কথা কখনো চিন্তা করোনি। নতুন মা আমাকে কিভাবে ট্রিট করবে এ চিন্তা মাথায় রেখে নিজের চাহিদা পূরণের কথা ভাবোনি। কিন্তু এখন দেখো, আমি স্বাবলম্বী হয়েছি। আর ছোট নেই আমি। দুদিন পর আমার বিয়ে হয়ে যাবে। আমি বেশিদিন এ বাড়িতে থাকবোও না। তুমি তো তখন পুরোপুরি একা হয়ে যাবে আব্বু। আমি আমার আম্মুর জায়গা কাউকে দিতে পারবো না, দিবোও না। কিন্তু তুমি চাইলেই সেই জায়গাটা অন্যকে দিতে পারবে। আমি চাই অন্তত শেষ বয়সে এসে তুমি ভালো থাকো। নিজের করে একটা মানুষ পাও, বাকিদের কথা না ভেবে নিজের কথা ভাবো। এই কথাটা আমি আগে বহুবার তোমায় বলতে চেয়েছি। কিন্তু আমি জানতাম আমার কথা ভেবে তুমি বিয়ে করতে চাইবে না। তাইতো থানায় নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করার পর এ কথাটা তোমাকে বলতে এসেছি। আমি জানি কোন বয়সটায় কি প্রয়োজন। শুধুমাত্র শারীরিক সন্তুষ্টির জন্য মানুষ বিয়ে করে এমনটা নয়। মানসিক সন্তুষ্টি বলেও একটা বিষয় আছে।

নিয়াজ চুপ করে রইলেন। তার ও ইচ্ছে হয়েছে একটা মানুষকে নিজের করে রাখতে। স্ত্রীকে তিনি অনেক ভালোবাসলেও মনের চাহিদা সবসময়ই তাড়া করেছে। সুখ-দুঃখের কথা বলার জন্য একটা মানুষের প্রয়োজন বোধ করেছেন। কিন্তু মেয়ের ভবিষ্যত ভেবে এতদিন সে পথে পা বাড়াননি তিনি। আজ মেয়ের এমন কথা শুনে যুবকের ন্যায় টগবগ করে ফুটল নিয়াজের ব্যক্তিসত্ত্বা। চুপচাপ টেবিল থেকে উঠে গেলেন তিনি। যাওয়ার আগে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তানিয়া সম্মতি পেল যেন। মুচকি হেসে বাবার হাতে হাত রাখল। নিয়াজ চলে যেতেই ফোনটা হাতে নিয়ে Ehan Sir এর নাম্বারে ডায়াল করল তানিয়া। ইহান কল ধরতেই তানিয়া উত্তেজিত, উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো,

” স্যার আমি পেরেছি। আব্বুকে আমি বুঝিয়েছি। আমার মন বলছে আব্বু রাজি।

” বাহ্। অভিনন্দন।

” আপনি যা যা বলেছিলেন আমি সবই বলেছি। অ্যান্ড আব্বুর মুখ দেখে মনে হচ্ছে আব্বু নিজেও এটা চাইতো মনে মনে। কখনও প্রকাশ করার সুযোগ পাননি।

” হয়তো। আঙ্কেলের জন্য এখন মেয়ে দেখো তাহলে। দায়িত্ব বাড়ল তোমার।

” হ্যাঁ তাই তো। এখন মিশন হলো নতুন মা। আপনি আমাকে হেল্প করবেন তো? এই বিষয়ে?

” একা একাই চেষ্টা করো তানিয়া। তুমি পারবে।

” কিন্তু কেন স্যার? আপনি থাকবেন না? মন খারাপ হলো তানিয়ার।

” আমি তো সবসময় থাকবো না তানিয়া। নিজেকে এমন ভাবে গড় যেন আর কাউকে প্রয়োজন বোধ না হয় জীবনে।

তানিয়া হাসল। বললো,

” একা একা বাঁচা যায় না স্যার। এই প্রথম আপনার কথায় একমত হতে পারছি না। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে কারো না কারো সাহায্য প্রয়োজন পড়েই। কোন মানুষই সব গুনের অধিকারি হতে পারে না। তাকে অন্যের কাছে যেতেই হয়। একা একা কোন কিছুতেই জয়ী হওয়া যায় না।

_____________________

বাড়ি ফেরার পথে তন্ময়ের সাথে হাঁটতে লাগল প্রিয়তা। ছেলেটার সাথে অনেকদিন ভালো মতো আড্ডা দেওয়া হয় না, কথা বলা হয় না। তন্ময় মুখিয়ে থাকে প্রিয়তার সাথে কথা বলার জন্য। তন্ময়ের দু কাঁধে ব্যাগ। শার্ট প্যান্টের সাথে ইন করা। চুল পরিপাটি করে গোছানো। তন্ময় ছেলেটা সুদর্শন। কিন্তু মাঝে মাঝে ছেলেটাকে হাবাগোবা মনে হয় তার স্টাইলের কারণে । হাউয়াই মিঠাই মুখে দিয়ে প্রিয়তা বললো,

” তোর কি খবর দোস্ত? মাঝরাতে ফোন বিজি দেখায় কেন?

তন্ময় থতমত খেল। প্রিয়তাকে এ নিয়ে সে কিছু বলতে চায় বুঝতে পারলো প্রিয়তা। উদগ্রীব চাহনি নিক্ষেপ করলো ছেলেটার দিকে। তন্ময় বললো,

” আমার হয়ে একটা টিউশনি করবি প্রিয়তা?

প্রিয়তার কপালে ভাঁজ পরল। এই ছেলেটা বলে কি? নিজেই কয়েকটা টিউশনি করে হাত খরচ চালাতে পারে না। আবার একটা টিউশনি প্রিয়তাকে দিয়ে দিতে চাচ্ছে? প্রিয়তা বলে উঠল,

” আমার একটা ব্যাচ আর দুটো টিউশনি আছে। তোকে আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তুই তোর টিউশনি আমায় কেন দিবি?

তন্ময়ের মুখটা ছোট হয়ে গেল। ছেলেটা কিছু ভাবছে অনবরত। আগের মতো উৎফুল্ল ভাবটা নেই। কেমন মিইয়ে গেছে। প্রিয়তার কথার উত্তরে বললো,

” আমি টিউশনিটা ছেড়ে দিবো। তাই তোকে বলছি। না নিলে আর কি করার?

” কিন্তু ছাড়বি কেন? ততক্ষণাৎ প্রশ্ন করলো প্রিয়তা।

” আমি যেই মেয়েটাকে পড়াই সেই মেয়েটা মুসলিম। মেয়েটা নাকি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। এইটা কোন কথা হলো বল? ও মুসলিম আর আমি হিন্দু। এইসব তো কোনদিন সম্ভব না। রোজ রাতে কল দেয় মেয়েটা। পাগলামি করে। আমি ওকে বোঝাতে পারি না।

অবাক হলো প্রিয়তা। বললো,

” কি বলছিস?

” হ্যাঁ রে। মেয়েটা আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। ওর নাম রিয়া। ইন্টারে পড়াশোনা করে। ধনী পরিবারের মেয়ে। পড়াশোনা একদমই করতে চায় না। ওর বাবা আমাকে টিউটর হিসেবে নিযুক্ত করেছে। কয়েক মাস যেতেই আমি বুঝতে পারি রিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি আমার প্রতি স্বাভাবিক নয়। রিয়া ভুল পথে পা বাড়িয়েছে। আমার এখন ওর কাছ থেকে সরে আসা উচিত। আমি এটা কোনমতেই সম্ভব হতে দিতে পারি না। বারবার বুঝিয়েছি ওকে। কোন লাভ হয়নি।

প্রিয়তা ভড়কাল। কি বলবে এখন ও? হিন্দু মুসলিমের প্রেম বা বিয়ে সম্পর্কে ওর ধারণা নেই। তাছাড়া এই বিষয়টিও দৃষ্টিকটু। মুসলিম হয়ে অন্য ধর্মের ছেলেকে ভালোবাসবে, বিয়ে করবে এটা মানানসই নয়। কেউই কারো ধর্ম ত্যাগ করতে পারবে না। তন্ময় ভালো ছেলে। হিন্দু হলেও কখনো প্রিয়তার সামনে ভগবানের নাম নেয়নি। বলতে গেলে ভগবান আর আল্লাহ্- দুটোকেই মোটামুটি মানে ছেলেটা। যখন প্রিয়তার সাথে থাকে তখন আল্লাহ্কে নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। প্রিয়তার আড়ালে কি করে তা প্রিয়তার জানা নেই।

ভাবতে ভাবতে দুজন হাঁটতে লাগল। পরিস্থিতি ভিন্ন হলো। একটু আগে দুজন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। আর এখন নিশ্চুপ। প্রত্যেকটি মানুষের কোন না কোন জটিল সমস্যা থাকেই। সমস্যা ছাড়া কোন মানুষই নেই পৃথিবীতে। তন্ময় সবসময় ফ্রি আর রিল্যাক্স থাকতে চাইতো, অথচ ছেলেটাকে এখন কি সব চিন্তা মাথায় রাখতে হচ্ছে। প্রিয়তা রাস্তা ক্রস করার জন্য ডায়ে বামে তাকাল। একটা মাইক্রো আসতে দেখলো ডান পাশ থেকে। কি মনে করে প্রিয়তা বায়ে তাকিয়ে আবার গাড়িটির দিকে চাইল। গাড়িতে থাকা মানুষগুলোকে দেখে প্রিয়তার মন আরো বিষিয়ে গেল। ছুপসে গেল মুখমণ্ডল। গাড়ির আয়নায় দেখতে পেল প্রীতিলতার হাস্যজ্জল মুখ। স্বামীর সাথে বোধহয় ঘুরতে বেরিয়েছে। প্রিয়তা নিজেকে আড়াল করলো কোনরকমে। মন চাইল ছুটে গিয়ে মায়ের সাথে গল্প করতে। কিন্তু মনকে প্রশ্রয় দেওয়ার কথা মাথায় আনল না প্রিয়তা। আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখল। মায়ের সুখ দেখে ভালোই লাগল তার। একটা অপূর্ণ সম্পর্ক ধরে রাখছিল দুজন। আজ তারা মুক্ত, দুজন দুদিকে পা বাড়িয়েছে দ্বিধা ছাড়াই। প্রিয়তা হেসে বিড়বিড় করে বললো,

” নারীরাই নারীদের সবচেয়ে বড় শত্রু। নারী যেমন একটি সংসারকে পরিপূর্ণ করে, তেমনি এক নিমিষে একটি সংসারকে তছনছ করে দিতে পারে।

পুনরায় বললো,

” তুমি সুখে থাকো মা। এত এত সুখ তোমার সহ্য হোক।

___________________

চলবে?

#প্রিয়তার_প্রহর
বোনাস পর্ব
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

প্রিয়তা এক অন্যরকম নারীতে রূপান্তরিত হয়েছে। আগে তার দিনের অগ্রভাগ কাটতো ফোন টিপে,ভাইয়ের সাথে আড্ডা দিয়ে আর নয়তো টিভি দেখে। এখন সেসবের কিছুই হচ্ছে না। বরং বাইরে বাইরেই কেঁটে যাচ্ছে সময়। আরহামকে সময় দেওয়া হচ্ছে না। নিজেকে নিয়েও ভাবতে ভালো লাগে না প্রিয়তার। বিকেলে আজ ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরল প্রিয়তা। সদর দরজার সামনেই আরহামকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। ছেলেটার গা উন্মুক্ত। নীল রঙের একটি ঢিলঢালা প্যান্ট পরেছে। প্রিয়তাকে দেখে এক দৌড়ে ছুটে আসল আরহাম। হেসে বোনের কোলে উঠতে চাইল। ক্লান্ত থাকা সত্বেও আরহামের নরম শরীরটা বুকে আগলে নিল প্রিয়তা। ছেলেটাকে দেখলে বোঝাই যায় না ওর পাঁচ বছর। যে কেউ দেখে বলবে বড়জোর চার বছর। রোগা পাতলা বলে আরো ছোট লাগে। উদাম শরীরে আরহামকে আরো মোহনীয় দেখায়। সমস্ত সৌন্দর্য ভর করে ছেলেটাতে। ভাইকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আরাম অনুভব করলো প্রিয়তা। ক্লান্তি দূর হয়ে গেল যেন। প্রশান্তিতে চোখ বুজে নিল। আরহামের নাকে চুমু খেয়ে বললো,

” গোসল করো নি? বিকেল হয়ে গিয়েছে।

আরহাম প্রিয়তার মতো ভ্রু কুঁচকে তাকাল। পিটপিট করে চোখের ঘন পাপড়ি একত্রে করল। আগ্রহী কণ্ঠে বললো,

” তুমি কি করে জানলে আমি গোসল করিনি?

” আমি বুঝি। গা খালি কেন তোমার?

” গুসল করতে ভালো লাগে না। শীত লাগে।

“গরম পানি করে দেই? গোসল না করলে মন ও শরীর দুটোই খারাপ লাগে বুঝলে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হয় সবসময়। তাহলে সবাই বাচ্চাদের ভালোবাসে।

হাঁটতে হাঁটতে ঘরে এলো প্রিয়তা। গ্যাসের চুলায় পানি বসাল পাতিলে। হালকা গরম হলেই নামিয়ে নিল পাতিল। ঠান্ডা পানির সাথে গরম পানির মিশ্রণে আরহামের গায়ে ঢালল। খিলখিল করে হেসে উঠল আরহাম। এখন কোন অভিযোগ নেই তার। গায়ে পানি ঢালতে আরাম বোধ হচ্ছে। গরম পানির পরিমাণ একদমই হালকা দিয়েছে প্রিয়তা। ঠান্ডা এখনো সেইভাবে পড়েনি।

গা মুছে দিতে দিতে প্রিয়তা আজকের সব কথা জানতে চাইল। সারাদিন আরহাম কি কি করেছে সেসবের কৈফিয়ত চাইল। আরহাম কথার মাঝে একসময় ডেকে উঠল। বললো,

“আপু।

প্রিয়তা আরহামের শরীরে লৌশন দিতে দিতে বললো,

” বলো।

” না কিছু না। অন্যরকম ভঙ্গি করলো আরহাম।

” কি বলো?

” আমার র‌্যাকেট কই? তুমি না আনবে বলেছিলে?

প্রিয়তা অপ্রস্তুত হলো। আজকে ভার্সিটির মাসিক ফি দিয়ে এসেছে। তবুও কম দামি র‌্যাকেট কিনে দিতে চেয়েছিল আরহামকে। কিন্তু আসার পথে সে কথা ভুলেই গিয়েছে সে। মনে নেই বললেই আরহাম মন খারাপ করবে। প্রিয়তা বোকা হেসে বললো,

” দোকানে ভালো র‌্যাকেট পেলাম না ভাই। কাল মার্কেটে তোমায় নিয়ে গিয়ে কিনে দিবো। কাল তো ফ্রাইডে। আমি তো আছিই। একসাথে খেলবো।

আরহাম মাথা নাড়ল। প্রিয়তার শরীর ভালো লাগছে না। মাথা ব্যথা করছে। একটু বিশ্রাম নিয়ে গোসল করবে ভাবল প্রিয়তা।

_______________

ছাদে বাতাস নেই। তিন তলা থেকে চারপাশটা ভিষণ সুন্দর লাগছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়েছে চারপাশ। প্রিয়তার চা খাবার অভ্যেস নেই। তবে আজ চা নিয়ে ছাদে এসেছে সে। আকাশে পাখিগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে। বাড়ি ফেরার তাড়া বুঝি সকলেরই আছে। প্রিয়তার মায়ের কথা মনে পরল। কি সুন্দর তার মা অন্য একটা পুরুষের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রীতিলতার নেই কোন পিছুটান, নেই কোন মাতৃত্বের টান। চায়ে চুমুক দিয়ে প্রিয়তা আকাশের কয়েকটি ছবি তুলল। কয়েকটা ছবি তুলল নিজের ও। প্রিয়তার চুলগুলো ছেড়ে রাখা। ঢিলেঢালা সুতির কামিজ পড়েছে সে। মিসেস নাবিলা প্রিয়তার ছাদে থাকাকালীন সময়ে ছাদে এলেন। প্রিয়তাকে দেখে এগিয়ে এলেন সামনে। পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,

“আরহাম কোথায়? আর আমাদের বাড়ি আসে না কেন।

প্রিয়তা পাশ ফিরে তাকাল। কয়েকদিনের মাঝেই এই মহিলা খুব আপন হয়ে উঠেছে প্রিয়তার। মাঝখানে যেই ঘটনা ঘটল তাতে কারো প্রতি বিশ্বাস সেইভাবে নেই বললেই চলে। তবুও পরিচিত মানুষ হিসেবে ধরা যায়। প্রিয়তা মিথ্যে বলে এ বাড়িতে উঠেছে। মিসেস নাবিলা জানেন না প্রিয়তার পরিবারের ঘটনা, জানেন না প্রিয়তা ব্রোকেং ফ্যামিলি থেকে এসেছে। চায়ে আবার চুমুক দিয়ে প্রিয়তা বললো,

” আমি যেতে নিষেধ করেছি আন্টি।

” যা হয়েছে তা ভুল হয়েছে। কিন্তু আমরা তো কিছু করেনি। কেন ভুল বুঝছো?

” এটাই তো আন্টি। আপনি কিছু করেননি বলেই আমি লজ্জিত হয়েছি। আপনি যদি জোর দেখিয়ে বলতেন আমি বা আরহাম এসব করতে পারি না, তাহলে বোধহয় এতটা অপমানিত হতাম না আমরা। অবশ্য আমরা নতুন ভাড়াটিয়া। এতটা বিশ্বাস করবেন-ই বা কি করে? দোষ আমারই

” সাবিনা তো ক্ষমা চেয়েছে। ক্ষমা করে দাও।

” হ্যাঁ চেয়েছে। কিন্তু উনার কণ্ঠে অনুতপ্ততা ছিল না, ছিল না লজ্জিত বোধ।

” বুঝেছি। তুমি শুনবে না আমার কথা। যা ভালো বুঝো করো।ভালো থাকো। নিজের খেয়াল রেখো।

” আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে আন্টি। আমার মনে হয় আজ তা বলা প্রয়োজন। মিসেস নাবিলা চলে যেতে নিলে কথাটি বললো প্রিয়তা। দৃঢ় কণ্ঠ তার। কাঠিন্যতা বজায় চোখেমুখে।

” কি বলবে? কৌতুহলী চাহনি মিসেস নাবিলার।

” আমার বাবা-মা বিদেশে নন। উনারা বাংলাদেশেই আছেন। আমি আপনাকে মিথ্যে বলেছি।

মিসেস নাবিলা অবাক হলেন। বললেন,

” তাহলে কোথায় তারা? মিথ্যে বলেছো কেন?

প্রিয়তা বুঝতে পারল তার চোখ আর নাক চুলকাচ্ছে। যেকোন সময় টুপ করে নোনা পানি ঝরবে। প্রিয়তার এটা বদ অভ্যাস। কাউকে কোন দুঃখের কথা বলতে গেলে বেশি দুঃখ লাগে। যাকে বলা হচ্ছে তার প্রতি যদি বেশি এসপেক্টটেশন থাকে তাহলে আরো বেশি কান্না পায়। প্রিয়তা আবেগঘন মুহুর্ত কাটানোর চেষ্টা করল। বললো,

“আমার আব্বু আম্মু আমার ষোল বছর বয়স থাকতেই পরকিয়ায় লিপ্ত হয়েছিলেন। আম্মু আব্বুকে রেখে অন্য এক পুরুষের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। আব্বু জেনে গিয়েছিলেন আম্মুর এই অবৈধ সম্পর্কের কথা। আম্মুকে বারবার বুঝিয়ে বলেছিলেন আব্বু। কিন্তু অন্ধ প্রেমে আটকে আম্মু আব্বুকে কোন রকম সুযোগ দেননি। তাই তো চাহিদা পূরণের জন্য অন্য এক নারীর সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন আব্বু। তখন এই সম্পর্কে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম আমি আর আরহাম। কারণ তাদের দুজনের নতুন সঙ্গী আমাদের মানতে চায়নি। আব্বুর প্রেমিকা শুধু আব্বুকেই চেয়েছিল। আব্বুর সাথে বাড়তি সন্তানকে মানবে না বলে জানিয়েছিল। অপর দিকে আম্মুর প্রেমিকও স্ত্রীর সাথে এত বড় একটা মেয়েকে সংসারে তুলবে না বলে জানিয়েছিল। তাই এই সম্পর্ক এভাবেই অবৈধ ভাবে চলছিল। এতগুলো দিন শেষে আমি বুঝতে পারলাম এভাবে আর চলতে পারে না। আমাকে কিছু করতে হবে। আব্বু আমার বিয়ের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। আরহামকে আব্বুর প্রেমিকা মেনে নিয়েছে খুব তোষামোদ করে। দুজনেই ভালো সুযোগ পেলেন। আমাকে তাড়িয়ে নতুন জীবনে পা রাখার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু আমি জানি আরহামকে তার সৎ মা ভালো বাসবে না, ভালো রাখবে না। আর আমিও ততক্ষণাৎ বিয়ে করে নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিতে পারবো না। তাই বাবার বাড়ি থেকে আমি চলে এসেছি। একেবারের জন্য চলে এসেছি। আর আমরা চলে আসার কয়েকদিনের মধ্যেই আব্বু আম্মু দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। তারা সুখে আছেন। এদিকে আমরা..

মিসেস নাবিলার চেহারা পাল্টে গেল মুহুর্তেই। প্রিয়তা এত বড় মিথ্যে বলবে তা বোধহয় ভাবেননি তিনি। তিনি ভাড়া দিয়েছিলেন এমন একটি মেয়েকে যার কিনা বাবা-মা বিদেশে থাকে। কিন্তু তা তো নয়।

মিসেস নাবিলা গম্ভীর স্বরে বললেন,

” এসব কথা আমাকে আগে বলোনি কেন?

” আমি যখনই কোন বাড়িওয়ালাকে বলেছি আমরা ব্যাচেলর থাকবো, তখনই তারা ফিরিয়ে দিয়েছে। তাই মিথ্যে বলতে বাধ্য হয়েছি।

” এটা ঠিক করোনি প্রিয়তা।

” আপনার কি মতামত আন্টি? আপনি যদি না চান তো আমরা এই বাড়িতে থাকবো না।

“গেলে দু মাস আগে থেকে বলে দিতে হয়। এটা রুলস। তোমার ইচ্ছে।

মিসেস নাবিলা হনহন করে চলে গেলেন। প্রিয়তা মুচকি হেসে অন্যদিকে চাইল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ভালো লাগল না। একদম ঠান্ডা, মিষ্টি হয়ে গিয়েছে চা। প্রিয়তা বেরিয়ে আসার আগমুহুর্তে প্রহর হেডফোন গুঁজে ছাদে প্রবেশ করলো। প্রিয়তার দিকে এক ঝলক চেয়ে কথা বলায় মনোযোগ দিল। প্রিয়তা তাকিয়ে রইল অহর্নিশ। প্রহরের ফোনে কথা শেষ হতেই প্রিয়তা জিজ্ঞেস করলো,

” উনি ধরা পড়েছে? কি যেন নাম?

” জাফর আলী।

” এর সাথে আমি কিভাবে যুক্ত হলাম? মানে উনি কেন আমার সাথে দেখা করতে এলেন জানতে পেরেছেন?

” নাহ্। জানার চেষ্টা করছি।

‘ ওও।

“প্রিয়তা। প্রহরের নরম কণ্ঠ।

” জি?

” আরহাম মন খারাপ করে বসে আছে সিড়িতে। কেন?

আরহাম মন খারাপ করে সিঁড়িতে বসে আছে? মনে প্রশ্ন জাগল প্রিয়তার। দ্রুত পায়ে দু তলার সিঁড়িতে নেমে এলো। দেখতে পেল সিঁড়ির মাঝে দু গালে হাত দিয়ে বসে আছে আরহাম। ছেলেটার মুখটা শুকনো। প্রিয়তা আরহামের পাশে এসে বসল। কি বলবে ভেবে নিল। নিচু কণ্ঠে বললো,

“মন খারাপ কেন আমার ভাইটার?

আরহাম তাকাল প্রিয়তার দিকে। ছেলেটার চোখের মণি ঘোলা। মুখটা মলিন। বোনের গা ঘেঁষে বসে আরহাম বললো,

” আব্বুর কাছে যাবো আপু। ভালো লাগছে না।

প্রিয়তা জড়িয়ে নিল আরহামকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বললো,

” আমি তো আছি। আব্বু কয়েকদিন পর এসে আমাদের নিয়ে যাবে। মন খারাপ করো না।

__________________

জাফর আলীর সম্পর্কে শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, অন্যান্য দেশের মানুষ ও জেনে গিয়েছে ইতিমধ্যে। ইন্টারনেটে ঢুকলেই জাফর আলীর ছবি দেখা যাচ্ছে। পুরো দেশের মানুষ হতবাক। এত বড় একটা ব্যবসায়ের লুকিয়ে রাখা সত্য এত জঘণ্য?

থানায় ঢুকে একটা লোক জাফরের সাথে দেখা করে এসেছে। পুলিশ লোকটাকে চেক করে দেখা করতে দিল জাফরের সাথে। জাফর হাজতে বসে আছে। কিছু একটা ভাবছে বোঝা যাচ্ছে। লোকটা জাফরকে দেখেই মাথা নিচু করল। বললো,

” আপনি ঠিক আছেন স্যার?

জাফর রেগে গেল। এই মুহুর্তে এ ধরনের কথা শুধু বলদ রাই বলবে। এই সব লোক নিয়ে কিভাবে সে কাজ করে? এখন এ প্রশ্ন করার সমৎ? রাগান্বিত কণ্ঠে জাফর বললো,

” আমাকে দেখে কি তোমার ঠিক মনে হচ্ছে? এই রকম প্রশ্ন করো কিভাবে?

” আপনি ওই মেয়েটাকে রিজেক্ট করে দিলেন কেন স্যার? ওই পুলিশ অফিসারের জন্য মেয়েটা যথেষ্ট ছিল। এমন ফাঁদে ফেলতো যে অফিসার পুলিশ গিরি ছেড়ে দিত। নারীর ফাঁদ বড় জটিল ফাঁদ স্যার।

জাফর হাসল। বললো,
” ওই অফিসারের জন্য আমি আরেকটা মেয়েকে সিলেক্ট করেছি। গতকাল যেই মেয়েটার সাথে দেখা করলাম, প্রিয়তা। প্রিয়তা মেয়েটাকে টোপ হিসেবে ধরবো বুঝলে? অফিসারের সাথে মেয়েটার খুব ভাব। শুনেছি পাঁচ বছরের এক ভাই ছাড়া মেয়েটার আর কেউ নেই। খুবই গরীব জীবনযাপন করছে। মেয়েটাকে কাজে লাগাতে হবে।

” মেয়েটা মানবে স্যার? যদি বলে দেয় অফিসারকে? সব ঘেটে যাবে না?

” আগে আমাকে বের করো এখান থেকে। আমি দেখে নিবো। তোমরা রিল্যাক্সড থাকো।

” আপনি বললে এখনই বের করতে পারি আপনাকে স্যার। সবই ঘুষের মামলা। উপরমহলে একটু বেশিই টাকা ঢালতে হবে। ওই অফিসার আপনার কিচ্ছু করতে পারবে না।

” কাল এখান থেকে আমি বের হবো। অফিসার বুঝবে আমাকে থানায় আনার শাস্তি কতটা ভয়াবহ। আমাকে আটকে রাখা কি এত সহজ? পুরো বাংলাদেশের সাতটা জেলায় আমার ব্যবসা। বড় বড় মন্ত্রী, ব্যারিস্টারের ডান হাত আমি। এত সহজে আমাকে হারাবে এই নাদান পুলিশ অফিসার? ফু দিলেই তো উড়ে যাবে।

হাসল দুজনে। প্রতিশোধের নেশা চাপল জাফরের মনে। এতদিনের সুনাম একদিনে বদলে গেল, এত টাকার লস হলো। এমনি এমনি ছেড়ে দেবে পুলিশকে?

_________________

অফিসে একটা নতুন কেস এসেছে। মাদকের ব্যবসা চলছে পুলিশের অগোচরে। পুরো টিমটাকে ধরতে হবে। কেসটা নেয়ার আগে প্রহর আর তার টিমকে সম্মানিত করা হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। আগামীকাল সকালে সম্মাননা দেওয়া হবে আর বিকেলে হবে অভিযান। থানার সকলেই এ নিয়ে খুব খুশি। তানিয়া এত বড় একটা জয়ে অংশ নিতে পেরে ভিষণ খুশি। তাই তো ট্রিট দিতে এসেছে কফিশপে। কফিশপে স্যারদের সাথে চা খেতে খেতে তানিয়া বললো,

” ইতিশা ম্যাম ও সম্মান পাওয়ার যোগ্য তাইনৃ। উনি আমাদের তথ্য না দিলে আরো অনেক দিন লাগতো কেসটা হ্যান্ডেল করতে।

প্রহর সায় জানাল। বললো,

” ইতিশা ম্যাম সম্মাননা অবশ্যই পাবেন। সেসব পরে ভাবো। নতুন কেসটা নিয়ে কিছু ভেবেছো? অভিযানে যেতে হবে। ব্যবসার আসল জায়গাটা খুঁজে পেতে হবে। হাতেনাতে ধরতেই হবে।

তানিয়া বললো,

” কিন্তু রিস্ক আছে এই কেসটায়। পুরো টিমকে কিভাবে যে ধরবো। এত ঝামেলার কেস কেন আমাদেরই দেওয়া হয়?

ইহান বলে উঠল,

” এর চেয়ে বড় বড় কেস পেয়েছি তানিয়া। তোমার ভয় হলে তুমি যেও না। আমরা তোমাকে নিতেও চাইছি না। কখন কোন বিপদ হয়।

” আমি মোটেই ভিতু নই স্যার। আমি আপনাদের সাথে যাবো। পুলিশের পোশাক পড়ার পর আমি আর আপনাদের বন্ধু থাকি না। তাই এত সহানুভূতি দেখাতে হবে না। গর্বের সাথে বললো তানিয়া।

প্রহর গা এলিয়ে চেয়ারে বসল।বললো,

” অভিযান থেকে আমরা নাও ফিরতে পারি তানিয়া। ভেবে দেখো। ব্যবসাটা অনেক বড়। লোকসংখ্যা প্রচুর। আমাদের বাংলাদেশের পুলিশ গুলো শুধু নামেই পুলিশ। প্রকৃত পুলিশ সংখ্যা যেমন কম, তেমনি সাহস, পরিশ্রম ও কম। ওখানে কোথা থেকে কে এসে এট্যাক করবে আমরা ধারণাও করতে পারছি না। কালকের দিনটা আমাদের জন্য যেমন খুশির, তেমনি ভয়ঙ্কর। নিজেকে তৈরী রাখো।

চলবে?

(বিঃদ্রঃ প্রিয়তার জন্য ভয় পাবেন না। অনেক কিছুই বাকি আছে মেয়েটার জীবনে।)

প্রিয়তার প্রহর পর্ব-০৯

0

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা ( ৯ )
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপরিচিত লোকটার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না প্রিয়তার। লোকটাকে আগে কখনো আরিফের সাথে দেখেনি সে। প্রিয়তা উনার ব্যাপারে কখনো শোনেইনি, অথচ লোকটা তাকে রাস্তায় দেখেই চিনে ফেলল? ভ্রু কুঁচকে ফেলল প্রিয়তা। লোকটার পোশাকআসাকে আভিজাত্য ফুটে উঠেছে। বয়স্ক লোকটা যুবকের ন্যায় পরিপাটি হয়ে চলে এটা বুঝতে বাকি রাখে না। প্রিয়তার এহেন আচরণে হেসে ফেললো লোকটা। বললো,

” তোমার বাবা আর আমি একই অফিসে ছিলাম। ট্রান্সফার হয়ে এখন অন্য অফিসে চলে গিয়েছি। তোমাকে আমি চিনি।

প্রিয়তা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
” ও আচ্ছা।

” তোমার বাবা কেমন আছে?

” আমি আব্বু আম্মুর সাথে থাকি না। তাই তাদের অবস্থা বলতে পারবো না। আপনি আব্বুকে কল করে খোঁজ খবর নিতে পারেন।

” সে কি? কেন থাকো না?

” বাবা-মায়ের বখে যাওয়া মেয়ে বলে। কাঠ কাঠ কণ্ঠে বলে উঠল প্রিয়তা। মনে পরল ও বাড়ি থেকে চলে আসার সময়কার কথা। আরিফ একটা বার ও ডাকেনি তাকে। বলেনি থেকে যা। কোনরুপ দরদ দেখাননি। অথচ তাদের স্মৃতি এখনও বহন করে প্রিয়তা। পরিবারের কথা মনে পরলে এখনো হাহাকার করে উঠে প্রিয়তার বক্ষস্থল।

জাফর আলী কাজ আছে বলে চলে গেল। যাওয়ার আগে সময়টা দেখে নিল। ত্যাছড়া হেসে স্থান ত্যাগ করলো। প্রিয়তা যেন বেঁচে গেল। অচেনা মানুষ হুট করে চেনা হলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। লোকটার সাথে যত কথা বলবে তত পরিবারের কথা মনে পরবে প্রিয়তার। অতিত ঘেটে ব্যথা শুধু বাড়তেই থাকবে। আরহাম ও ফিরে যেতে চাইবে। প্রিয়তা তো চায় না সেটা।

শিশু পার্কের একটি বেঞ্চে বসে আছে আরহাম আর প্রিয়তা। প্রিয়তা বাদামের খোসা ছাড়িয়ে ফু দিয়ে অনেকগুলো বাদাম একত্রে করে আরহামকে দিচ্ছে। আরহাম হাতের তালু মুখে ঠেকিয়ে বাদাম খাচ্ছে আরামে। পার্কটা অতটা বড় নয়। তবে বাচ্চাদের পছন্দসই। পুরো পার্কটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। পার্কের কোণায় কোণায় ঝুড়ি রাখা হয়েছে। কতৃপক্ষ সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলতে আদেশ করেছেন। চারদিকে বড় বড় গাছ দেখতে পেল প্রিয়তা। কৃষ্ণচূড়া গাছটি লাল বর্ণ ধারণ করেছে। নিচে থেকে দেখতে অসাধারণ লাগছে। চারপাশে বাচ্চাদের আনাগোনো। সকলের সাথেই তাদের মা-বাবা আছে। কেউ বা দোল খাচ্ছে, কেউ স্লিপারে স্লিপ খাচ্ছে, কেউ দৌড়াচ্ছে, অনেকে আবার দোকানে ভিড় করেছে।

প্রিয়তা আরহামকে একটি বড় বেলুন কিনে দিল। বেলুন নিয়ে পুরো মাঠ জুড়ে দৌড়াতে লাগল আরহাম। ভাইয়ের এই আনন্দে মন প্রাণ ভড়ে গেল প্রিয়তার। নিজেদেরকে সুখী মনে হলো খুব। কৃষ্ণচূড়া ফুলের দিকে চেয়ে রইল প্রিয়তা। আচমকা পায়ে কারো হাতের অস্তিত্ব পেল প্রিয়তা। ধরফর করে উঠল সে। ভয়ে কেঁপে উঠল হৃদয়। নিচে তাকিয়ে একটি ছয়-সাত বছরের মেয়েকে দেখতে পেল প্রিয়তা। বুকে থু থু দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। মেয়েটার দেহের গড়ন রোগা-পাতলা। পরণে ছেড়াফাটা পুরোনো কামিজ। শ্যামলা ললাটে ছোট্ট টিপ। মেয়েটার মুখে দুঃখের আভাস। প্রিয়তা তড়িঘড়ি করে মেয়েটার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে ব্যস্ত হলো। মেয়েটা হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে প্রিয়তার পা। কোনমতেই ছাড়ছে না। সবার সামনে এমন বাজে পরিস্থিতিতে পরবে ভাবেনি প্রিয়তা। কিছুটা বিভ্রান্ত হলো সে। চটপট করে মেয়েটাকে টেনে তুললো সময় নিয়ে। বললো,

“আরেহ্! তুমি আমার পা ধরছো কেন? ওঠো।

মেয়েটা উঠল না। আরো চেপে বসে রইল। মুখ তুলে বললো,

” আফা আমি দুইদিন ধইরা কিছু খাই নাই। আমারে কয়ডা ট্যাকা দেন না আফা।

” তুমি আগে আমাকে ছাড়ো। বলে উঠল প্রিয়তা।

মেয়েটা উঠল। পুনরায় বললো,
” দেন না আফা।

প্রিয়তার অসস্তি হলো। তার কাছেই টাকা নেই তেমন। যা আছে তা লাগবে মাস চলতে। আরহামের জন্য কিছু কিনবে ভেবে যে টাকা রেখেছিল তা দিয়ে কি কিছু কিনে দিবে মেয়েটাকে? ভাবনা এলো প্রিয়তার মনে। মেয়েটাকে দেখে মায়া হলো খুব। নমনীয় স্বরে মেয়েটির চিবুক ধরে বললো,

” তোমার নাম কি?

মেয়েটি হেসে বললো,
” জামিলা।

” তুমি দু দিন খাওনি কেন? তোমার মা বাবা কোথায়? তুমি এখানে কেন?

” আমার মা মইরা গেছে। আব্বায় অসুখ হইয়া বিছনায় পরছে। এইজন্যে আমি ভিক্ষা করি। দেন না আফা কয়ডা ট্যাকা।

প্রিয়তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। খোঁজ করলে দেখা যাবে আমাদের দেশে এমন লাখ লাখ মানুষ আছে যারা এক বেলা খেতে পায় না। অনাহারে, অভুক্ত থেকে কাটিয়ে দেয় কয়েকদিন। অথচ আমরা কত খাবার নষ্ট করি। এই খাবারের কিঞ্চিৎ পরিমাণ খাবার এসকল মানুষের জন্যে বরাদ্দ থাকে না। রাস্তায় বের হলেই শিশু থেকে বৃদ্ধদের দেখা যায় জনে জনে সবার কাছে হাত পাততে। বাসে উঠলেই দেখা যায় অন্ধ, বাকপ্রতিবন্ধী, পঙ্গু ব্যক্তিদের। যাদের কাজ করার মতো পরিস্থিতি নেই। প্রকৃতপক্ষে ভিক্ষা করা সবচেয়ে অসম্মানজনক কাজ। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষরা এই কাজকে তখনই সমর্থন করি যখন দেখি ভিক্ষা করা ব্যক্তি কাজ করতে অক্ষম। প্রিয়তার কাছে আসা মেয়েটির এখন ঘুরে বেড়ানোর সময়, পড়ালেখা করার সময়, জীবনকে উপভোগ করার সময়। কিন্তু মেয়েটা রোদে পুড়ে,বৃষ্টিতে ভিজে ভিক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছে।

প্রিয়তার কান্না পেল মেয়েটাকে দেখে। আরহামকে নিজের কাছে ডাকল প্রিয়তা। দুজনকে দু পাশে ধরে মেয়েটার উদ্দেশ্যে প্রিয়তা বললো,

” চলো তোমাকে একটা ভাতের হোটেলে নিয়ে যাই। যে তরকারি দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে হয় তাইই খাবে।

জামিলা থতমত খেল। নিজেকে ছাড়িয়ে নিল প্রিয়তার থেকে। মনটা খারাপ হলো মেয়েটার। ততক্ষণাৎ বলে উঠলো,

” আমারে খাওন দিয়া লাগবো না ট্যাকা দিলেই হইবো। আমার একজনের বাড়িতে দাওয়াত আছে। আপনের মতোই একজন দাওয়াত দিছে। ওইহানেই খামু

প্রিয়তা বললো,
” তাহলে চলো কেক কিনে দেই। খেতে খেতে বাড়ি যাও।

মেয়েটা মানল না। বারবার টাকাই চাইল। অতঃপর প্রিয়তা ব্যাগে হাত দিল। ব্যাগ হাতরিয়ে খুচরো টাকা পেল না। ব্যাগে শুধু পাঁচশো টাকার দুটো নোট দেখল প্রিয়তা। ভাঙতি টাকা এখন সে পাবে কোথায়? দোকানদার কিছু না কিনলে ভাঙতি দেবে না।

প্রিয়তা বোঝাল জামিলাকে। ভাঙতি নেই বলে জানাল। জোর করে টেনে নিয়ে গেল দোকানে। দোকান থেকে কেক, রুটি , বিস্কিট কিনে দিল। মেয়েটা খাবার গুলো নিয়ে চলে গেল সেখান থেকে। কোনরকম প্রতিক্রিয়া দেখাল না। প্রিয়তা অবাক হলেও গায়ে মাখল না। মেয়েটাকে কিছু কিনে দিতে পেরে মনে মনে খুশিই হলো বেশ। বাড়ি ফিরতে উদ্যত হলো আরহামকে নিয়ে। কয়েক মিনিট হাঁটতেই আরহামের মনে পরল তার বেলুনের কথা। প্রিয়তাকে বললো বেলুন এনে দিতে। পিছু হাঁটলে ছয়-সাত মিনিটেই পার্কে পৌঁছাতে পারবে তারা। কিন্তু কিছুটা হেঁটে আবার ফিরে যেতে প্রিয়তার ইচ্ছে করলো না। আবার আরহাম শুনল না সেসব কথা। বেলুনটা তার লাগবেই লাগবে।
আরহাম প্রিয়তাকে ফেলে নিজেই পিছু চললো। অগত্যা বাধ্য হয়ে প্রিয়তাও পার্কের পথটা ধরল। সৌভাগ্যবশত বেলুনটা ওখানেই বাঁধা দেখল আরহাম। ছুটে বেলুনটা নিল নিজের হাতে। এইবার বাড়ি ফেরার পথে ওভারব্রিজে উঠল প্রিয়তা। নিচে তাকাতেই একটা অন্যরকম ঘটনা ঘটতে দেখল সে। বিস্ময়ে বিমূঢ় হলো মুহুর্তেই। একটু আগে যে মেয়েটাকে প্রিয়তা খাবার কিনে দিল, সেই মেয়েটা ওভারব্রিজের কোণে একটা মহিলার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলছে বোঝা যাচ্ছে। প্রথমে কারোর কথাই শুনতে পেল না প্রিয়তা। হঠাৎই দেখল মহিলা জামিলার হাত থেকে প্রিয়তার কিনে দেওয়া খাবারগুলো এক টানে ফেলে দিচ্ছে রাস্তায়। রাগী কণ্ঠে চিৎকার করে উঠছে। জোরে কথা বলায় শুনতে পেল প্রিয়তা। মহিলা জামিলাকে রাগী কণ্ঠে বলছে,

” তোরে না কইছি ট্যাকা নিয়া আইবি?কি নিয়া আইছোস তুই? এডি দিয়া আমি কি করমু? খা গা যা। আরেক ছেমড়ি কি নিয়া আসে দেহি। তুই এইহান থে সর। এই খাওন দিয়া আমার কি হইবো? তোর প্যাট ভরবো শুদু।

প্রিয়তা একটু কাছে এলো। ওরা প্রিয়তাকে দেখতে পেল না। জামিলা শান্ত কণ্ঠে বললো,

” আমি কইছি ট্যাকা দিতে। হ্যায় না দিলে কি করমু? এই খাওনডি আমি মারে দিমুনি। পরে ট্যাকা পাইলে তুমি নিওও। এত কষ্ট করি তাও তোমার মন পাই না।

প্রিয়তার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। যতটা না অবাক হয়েছে তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছে। একটু আগে জামিলা নামের মেয়েটির জন্য কতই না দুঃখ করছিল প্রিয়তা। মেয়েটার জন্য আলাদা একটা অনুভূতি, আলাদা এক ভালোবাসা ভেসে জেগে উঠেছিল হৃদয়ে। মেয়েটার জন্য প্রিয়তার কষ্টে বুক ভার হয়ে আসছিল। কিন্তু এ ভালোবাসার কোন মূল্যই নেই জামিলার কাছে। সে মিথ্যা বলেছে প্রিয়তাকে। জামিলার মা বেঁচেই আছে। আর সেও এত দুঃখে নেই। সবই টাকা উপার্জন করার পদ্ধতি।
প্রিয়তার মস্তিষ্ক বুঝে গেল এরা একটা গ্যাং। এখানে যারাই আসে তাদেরকে এভাবে নাস্তানাবুদ করে টাকা নেয় এরা। এই ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর পেছনেও বড় মানুষের হাত আছে। তাদের জন্যই বাচ্চাগুলো কাজ করে। অথচ প্রিয়তা কি বোকা। সে ভেবেছে জামিলার সব কথা সত্যি। খুব দ্রুত বিশ্বাস করে ফেলেছিল মেয়েটাকে। মেয়েটার জন্য প্রিয়তা কাঁদতে চেয়েছিল। আফসোস করছিল পুরোটা সময়। আচ্ছা প্রিয়তার কি উচিত এদের পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেওয়া? আজকাল প্রিয়তা নিজের মাঝে এক অন্য সত্তার বিচরণ অনুভব করে। আগের প্রিয়তা আর এখনকার প্রিয়তার মাঝের তফাৎ টা একটু বেশিই নজর কাড়ে নিজের কাছে। আগে প্রিয়তার জীবন একটা নির্দিষ্ট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিল। পারিবারিক ঝামেলা, পড়ালেখা, আরহামকে আগলে রাখা এসব ব্যতিত আর কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তার সাথে ঘটেনি। তবে আজকাল সব অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে প্রিয়তার সাথে। যা মনে রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ। যা প্রিয়তাকে নতুন ভাবে গড়ে তুলছে, শিক্ষা দিচ্ছে। এখনকার প্রিয়তার মাঝে কৌতুহল, দ্বিধা, আগ্রহ ভরপুর। এই প্রিয়তা সবকিছু সম্পর্কে জানতে চায়, জানাতে চায়।

আচ্ছা প্রিয়তা এত বোকা কেন? কেন সে সবার কথা বিশ্বাস করে ফেলে? কেন সব কথা সত্য বলে ধরে নেয়? এই মেয়েটা তো তার অনুভূতি নিয়ে খেলেছে। তাকে ঠকিয়েছে, মিথ্যে বলেছে। কাউকে ঠকানো তো মারাত্মক অপরাধ। কাউকে ঠকানোর জন্য,প্রতারণা করার জন্য উক্ত ব্যক্তির ভয়াবহ শাস্তি পাওয়া উচিত। আচ্ছা ঠকানোর কি কোন শাস্তি নেই? প্রশ্ন এলো প্রিয়তার মনে। চোখে পানি জমল। ঠকে যাওয়ার যন্ত্রণায় ছটফট করলো প্রিয়তার হৃদপিণ্ড। আরহামকে নিয়ে চলে এলো সেখান থেকে। হাসিখুশি মনটা নিমেষেই বিষিয়ে গেল। মন খারাপ করে পুরোটা পথ চলে এলো।

_________________

বাড়িতে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলো ধরনীতে। মন খারাপ করে বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলো প্রিয়তা। চারদিকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন। প্রতিদিন এই সময় এই স্থানে দুটো বাল্প জ্বলে। আজ বাল্পগুলো নেই। পুরোটা জায়গা জুড়ে নিরবতা বিদ্যমান। প্রিয়তার একটু ভয় করলো। আরহামকে আগলে নিল ততক্ষণাৎ। অন্ধকারে এগিয়ে এলো। সামনে একজন মানুষের অবয়ব দেখতে পেল প্রিয়তা। ছায়াটি যখন দৃঢ় ভাবে দেখা গেল তখন প্রিয়তা বুঝতে পারল এটা প্রহর। প্রহরকে প্রিয়তা চিনে। কিভাবে এত ভালো করে চিনে তা তার জানা নেই। তবে সামনের ছায়াটি যে প্রহরের তা বুঝতে সময় লাগল না প্রিয়তার। প্রিয়তা কিছু বলার পূর্বেই একটা ঘ্রাণ ভেসে আসল তার নাকে। কেউ যেন কিছু একটা স্প্রে করলো প্রিয়তার মুখে। মাথা ঝিমঝিম করে উঠল প্রিয়তার। সবকিছু কেমন ঝাপসা লাগল। মাথা ঘুরতে লাগল। ধপাস করে কিছু পরে যাওয়ার শব্দ হলো। প্রিয়তার দেহ লুটিয়ে পরল মেঝেতে। এরপর আর কিছুই মনে নেই প্রিয়তার। কিচ্ছু না।

প্রিয়তার যখন জ্ঞান ফিরল তখনো নিজেকে আবিষ্কার করলো মেঝেতে। চোখ মেলতে ভিষণ ক্লান্তি বোধ করল প্রিয়তা। মাথাটা আবারো ঝিমঝিম করে উঠল। শরীরে খানিক ব্যথা অনুভব করলো । মনে হলো অনেকটা পথ হেঁটেছে সে। প্রিয়তা নড়াচড়া করল। চোখের পাতার সাথে যুদ্ধ করে সময় নিয়ে চোখ খুলল। চারপাশ অন্ধকার লাগল আগের মতো। প্রিয়তার মনে পরল অজ্ঞান হবার পূর্বের কথা। সে বাড়িতে ঢুকেছিল, প্রহরের ছায়া দেখেছিল দেয়ালে। হঠাৎই একটা ঘ্রাণ ভেসে এসেছিল নাকে। মাথা ঝিমঝিম করে উঠেছিল তার। ঝাপসা দেখছিল সবকিছু। লুটিয়ে পরেছিল মেঝেতে। একটা শব্দ হয়েছিল জোরে। আরহামের কণ্ঠ ভেসে এসেছিল কানে। তারপর? তারপর আর কিচ্ছুটি মনে নেই প্রিয়তার।

প্রিয়তা কষ্ট করে উঠে দাঁড়াল। ঘরে আলো নেই কোনো। তবে থাই গ্লাসের বিপরীতে থাকা চাঁদের আলোতে পুরো ঘর আলোকিত হয়ে রয়েছে। সেই আলোতে ঘরটা বোঝা যাচ্ছে একটু একটু। প্রিয়তার ভয় করল। বুঝতে পারলো কোনকিছু ঠিক নেই। ততক্ষণাৎ চিৎকার করে বললো,

” আরহাম, আরহাম। কোথায় তুমি? আমি এখানে কেন? কে আমাকে এনেছে এখানে?

খট করে দরজা খোলার আওয়াজ হলো। ভয়ে নেতিয়ে গেল প্রিয়তা। কেউ সুইচ টিপে বাল্প জ্বালিয়ে দিল। আলোর ঝলকানি চোখে পড়তেই চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল প্রিয়তা। আপনা আপনি হাতটা চোখে মেলে ধরল। আলোর ঝলকানি চোখে লাগল প্রিয়তার। সময় নিয়ে চোখ থেকে হাত সরাতেই প্রহরকে দেখতে পেল। প্রিয়তা বুঝতে পারল কোনকিছু স্বাভাবিক নয়, আর এসবের পেছনেও প্রহর রয়েছে।

প্রিয়তা প্রহরকে জিজ্ঞেস করলো,

” আরহাম কোথায়? আমি এখানে কেন? আপনিই বা এখানে কেন? কি হচ্ছে আমার সাথে?

প্রহর জবাব দিল না। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শুধু। গম্ভীর চাহনিতে ভষ্ম করতে চাইল প্রিয়তাকে। আবার ও দরজায় শব্দ হলো। ইহান আর তানিয়া ঘরটিতে প্রবেশ করলো। প্রিয়তা চোখ বুলিয়ে ঘরটাকে পর্যবেক্ষণ করলো। ঘরটার মাঝখানে একটা বড়সড় টেবিল রাখা। টেবিলে রয়েছে গুটিকয়েক ফাইল আর কাগজপত্র। টেবিলের তিন কোণায় তিনটে চেয়ার রাখা। প্রিয়তার মনে হলো এরা তাকে কিডন্যাপ করেছে। ওকে আটকে রাখার চেষ্টা করছে। মস্তিষ্কও এই কথায় সায় জানাল। প্রিয়তা রেগে গেল। ওর আশেপাশে যারা আছে এরাও ভালো নয়? এরাও প্রিয়তার ক্ষতি চায়? কিন্তু কেন? প্রিয়তা রেগে গেল ভিষণ। আর কোমল থাকবে না সে। নিজেকে বাঁচাতে হবে।

প্রিয়তা দ্রুত গতিতে প্রহরের কাছে এলো। প্রহরের শার্টের কলার মুঠোয় পুরে নিল। ঝাঁঝাল কণ্ঠে বলে ওঠল,

” আপনি কি চাইছেন হ্যাঁ? আপনার পেটে পেটে এতকিছু ছিল? আগে তো বুঝিনি? আমাকে কেন এনেছেন এখানে? কিডন্যাপ করেছেন আমাকে? আরহাম কোথায়? বলুন।

প্রিয়তা উত্তর পেল না বিধায় আরো রেগে গেল। নাকের পাটা লাল হলো তার। চোখের কার্নিশ রক্তিম হলো। প্রহরের শার্টের কলারের নিচে থাকা ফর্সা, নগ্ন গলায় নখ গেঁথে দিল প্রিয়তা। ব্যথা পেল প্রহর। ছেলে বলে প্রিয়তাকে ধরে সরাতে পারলো না। আবার ও প্রিয়তা নখ দিয়ে আচরে দিল প্রহরের কানের নিচ। কেটেছুড়ে দিতে চাইল সব। উন্মাদের মতো আচরণ শুরু করলো। ইহান এগিয়ে এলো প্রিয়তাকে সরিয়ে নিতে। প্রহরের নজরে পরল বিষয়টা। প্রিয়তাকে ধরার আগেই প্রহর বলে উঠল,

“স্টপ ইহান। ওকে ধরিস না।

পুনরায় প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে তানিয়ার উদ্দেশ্যে বললো,

” তানিয়া, প্রিয়তাকে সামলাও।

তানিয়া এগিয়ে এলো। বহু কষ্টে প্রিয়তাকে প্রহরের থেকে ছাড়িয়ে নিতে সক্ষম হলো। প্রিয়তাকে ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল তানিয়া। প্রিয়তাকে কখনোই ক্রিমিনাল মনে হয়নি তার। প্রিয়তার মায়াময় গোলাকার মুখ বরাবরই তানিয়াকে দ্বন্দ্বে ফেলে। একটু নরম কণ্ঠে তানিয়া বললো,

” আরহাম ঠিক আছে প্রিয়তা। এমন করো না। পুলিশের গায়ে হাত তোলা অপরাধ।

প্রিয়তা দমে গেল। ভারী শ্বাস ফেলল। চোখ পানিতে চিকচিক করে উঠল প্রিয়তার। ব্যথাতুর নয়নে তাকাল সবার দিকে। ক্লান্ত কণ্ঠে বললো,

” আমাকে কেন এনেছেন? আমি বাড়ি যাবো।

প্রহর এগিয়ে এলো। প্রিয়তার সামনে চেয়ার টেনে তাতে বসল। কলার ঠিক করে নিল। বললো,

” ইউ, মিস প্রিয়তা। বাবার নাম আরিফ হোসাইন, মায়ের নাম প্রীতিলতা আহমেদ, ছোট ভাই আরহাম হোসাইন। রিসেন্টলি আপনার বাবা-মা দুজন দুজনকে ডিভোর্স দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। আরিফ হোসাইন বিয়ে করেছে কলকাতায় বসবাসরত দীপা খন্দকারকে। প্রীতিলতা আহমেদ বিয়ে করেছে আজিজ মোর্শেদকে। বেশ কয়েকবছর যাবত আপনার বাবা-মা পরকিয়ায় লিপ্ত ছিল। দম্পতি তাদের নতুন জীবনে পা রাখতে পারছিল না আপনারর আর আপনার ভাইয়ের কারণে। আপনারা আপনাদের বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে চলে এসেছেন কারণ কয়েকদিন পরেই আপনাদের ওই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হতো, আপনাদের যন্ত্রণা দিয়ে নিস্তেজ করা হতো। আপনার বাবা-মায়ের নতুন জীবনসঙ্গী আপনাদের মেনে নেননি এজন্য। কি তাইতো?

প্রিয়তা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল। এত সব কথা পুলিশম্যান জানল কিভাবে? আর কেনই বা জানতে চেয়েছেন? এখন এসব বলার মানে কি? এতদিন বলার প্রয়োজন মনে করেননি কেন? হাজারটা প্রশ্ন মাথায় এলো প্রিয়তার। নিজেকে পাগল পাগল লাগল। প্রশ্ন গুলো জটলা পাকিয়ে গেল। বললো,

” আপ..আপনি কি করে? মানে কিভাবে জানলেন??

প্রহর হাসল। শব্দ করে হেসে ফেলল। প্রিয়তা তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ প্রহরের দিকে। নিঃসন্দেহে পুলিশম্যানের হাসি সুন্দর, অনবদ্য। এ হাসিতে কতশত নারী ঘায়েল হতে পারে। নজর কাড়ার মতো সৌন্দর্য বহন করে এই পুলিশম্যান। অন্যান্য সময় হলে এ হাসিতে প্রিয়তার নতুন অনুভূতি জেগে উঠতো, মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করতো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভয়ানক।
প্রহর হাসি থামিয়ে বাঁকা হেসে বললো,

” এই প্রশ্ন আপনাকে মানায় না প্রিয়। আপনি তো খুব স্মার্ট।

” কি বলতে চান সরাসরি বলুন। এমন পেঁচিয়ে কথা বলছেন কেন? কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠল প্রিয়তা।

প্রহর আসল কথায় ফিরল। বললো,

” জাফর আলী কত টাকা দিয়েছে আপনাকে? মানছি বাড়িঘর ছেড়ে আপনি নিঃস্ব হয়েছেন। তাই বলে পুলিশ অফিসারের জন্য ফাঁদ পাতবেন?

” কি যা তা বলছেন? কে জাফর আলী? কার কথা বলছেন? এসবের সাথে আমার সম্পর্ক কি?

“মিথ্যে বলবেন না প্রিয়। আপনি জাফর আলীকে চিনেন। নইলে আজ আলাদা করে দেখা করতে যেতেন না।

” কার কাছে দেখা করেছি আমি? কখন? কোথায়? কি বলছেন?

“পার্কের রাস্তার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে যার সাথে কথা বলেছেন সে আপনার পরিচিত নয় বলছেন?

” ওই লোকটা তো আব্বুর বন্ধু। আমাকে এসে আব্বুর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছিলেন। এখানে টাকা পয়সা, ফাঁদ এলো কোথা থেকে? উনাকে আমি আগে চিনতাম না।

ইহান এগিয়ে এলো এবার। বললো,

” আরিফ হোসাইনের সাথে জাফর আলীর কোন সম্পর্ক নেই মিস। আমরা খোঁজ নিয়েছি। সত্যটা বলুন।

প্রিয়তা বললো,

” উনি এসে আব্বুর সম্পর্কে জানতে চাইলেন। বললেন আব্বুর বন্ধু। উনি আমাকে মিথ্যে বললেন কেন? আমি কীসের ফাঁদ পেতেছি?

” জাফর আলীর কথায় আপনি আমাকে ফাঁদে ফেলে নিঃস্ব করতে চাননি? মিথ্যে বলছেন কেন? জাফর আলী আমার শত্রু। আমাকে এট্যাক করার জন্য মুখিয়ে আছে লোকটা। আজ সেই লোকের সাথে আপনি দেখা করেছেন।

” আমি কিচ্ছু জানি না বিশ্বাস করুন। উনাকে আজই আমি প্রথম দেখেছি। উনার কথায় আমি আপনার আশেপাশে আসিনি।

তানিয়া বলতে শুরু করলো পুরো ঘটনা। বললো,
“সিক্রেট এজেন্সির অফিসার আমাদের জানিয়েছে একটা মেয়েকে পাঠাবে জাফর আলী। প্রহর স্যারকে ফাঁদে পেলে কাবু করতে চেয়েছেন লোকটা। কথাটা জানার পরদিনই তুমি এসেছো স্যারের বাড়ি। তোমার ফোনে স্যারের ছবি পাওয়া গেছে। এতদিন একটুআধটু সন্দেহ ছিল তোমার প্রতি। কিন্তু আজ যখন তুমি সরাসরি জাফরর সাথে কথা বললে, দেখা করলে তখন আমরা নিশ্চিত হয়েছি তুমি ওরই লোক।

প্রিয়তার মাথা ঘুরছে। এতদিন তার পিছনে প্রহর গোয়েন্দা লাগিয়েছে। তাকে নিয়ে তদন্ত করেছে। অথচ সব ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি সে। তার আড়ালে তারই সাথে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা। প্রহরের কথায় ইহান এজেন্সির অফিসার আসিফকে কল করলো। ইহান আসিফকে বললো,

” তোমাকে আর ঘুরতে হবে না। জাফরের পাঠানো মেয়েটাকে আমরা পেয়েছি। আজ ওরা দেখা করেছিল। দ্যান আমরা জিম্মি করেছি মেয়েটাকে। তোমার কাজ শেষ।

আসিফ অবাক হলো ওপাশ থেকে। কণ্ঠ নামিয়ে বললো,
” আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে স্যার। জাফর মেয়েটাকে ট্রেনিং দিচ্ছে এখনো। একটু আগেই মেয়েটার সাথে একটা শপে দেখা করেছে জাফর। মেয়েটা আর জাফর দুজনেই আমার সামনে বসে আছে স্যার। আমি ফ্রুট সেলার সেজে দাঁড়িয়ে আছি। মেয়েটাকে কোনো কারণে জাফর আজ রিজেক্ট করেছে। পাঠাবে না বলেছে। কি প্ল্যান করছে বুঝতে পারছি না। আপনারা যাকে ধরেছেন সে ওই মেয়েটি হতে পারে না।

লাউড স্পিকারে থাকায় সবটা শুনল প্রহর। প্রিয়তার দিকে তাকাল। সবটা ওলটপালট হয়ে গেল হুট করে। প্রিয়তা যদি এসবে না থাকে তবে কেন জাফর ওর সাথে দেখা করলো? তাও আবার মিথ্যে পরিচয়ে? কেনই বা সিলেক্ট করা মেয়েটাকে রিজেক্ট করলো?এসবের মধ্যে প্রিয়তা কিভাবে এলো? প্রিয়তা ঘটনা বুঝতে পারল কিছুটা। আন্দাজ করে নিল অনেক কিছু। এখন তার রেগে যাওয়ার কথা। কিন্তু প্রিয়তা রাগল না। কারণ তাকে সন্দেহ করা কিংবা দোষারোপ করার নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। যে যে কারণে প্রিয়তাকে এখানে এনেছে সেগুলো ভাবা যৌক্তিক। এখানে দোষ আসলে পুলিশদের না। আবার প্রিয়তার ও নয়। কিন্তু জাফর কেন প্রিয়তার সামনে এলো? প্রিয়তার তো এ সম্পর্কে ধারণাও ছিল না। কোনভাবে এই কেসে কি জড়িয়ে পরছে সে?

________________________

রাত দশটা বেজে এগারো মিনিট। তিন তলা ভবনের ছাদের রেলিংয়ে বসে পা দোলাচ্ছে প্রিয়তা। একটু এদিক সেদিক হলেই তিনতলা ভবন থেকে পরে যাবে সে। প্রিয়তার মনটা ভালো নেই। আজব ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। সব কিছুর দোষ তার উপর পরছে। এতে পুলিশের দোষ নেই বলে প্রিয়তা কোনকিছু বলেনি কাউকে। প্রহরের জায়গায় অন্য কেউ হলে তাকেই দোষী ভাবতো। এজেন্সির খবর পাওয়ার পরদিনই আগমন ঘটে প্রিয়তার। এসে পরে প্রহরের বাড়ি। প্রহরের ঘরে যাতায়াত হয়। সবটাই সন্দেহ করার মতো কারণ।

প্রিয়তা নিজের বসার স্থানটা দেখল। এখান থেকে যদি প্রিয়তা পড়ে যায়, নিশ্চিত মরে যাবে। আচ্ছা প্রিয়তা মারা গেলে কেউ কাঁদবে? কেউ কষ্ট পাবে? কারো কোন যায় আসবে? আরহাম ছাড়া আর তো কেউ আপন নেই প্রিয়তার। এই ছেলেটাই শুধু কাঁদবে, কষ্ট পাবে। আর কে আছে প্রিয়তার? বাবা-মায়ের কাছে তো সে মৃত।

প্রিয়তা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পেছন থেকে পুরুষালি কণ্ঠে “প্রিয়তা” শব্দ শুনে আঁতকে উঠল রীতিমতো। পড়ে যেতে নিলে নিজেকে সামলে নিল প্রিয়তা। চোখের কোণে পানি জমল। হাহাকার করে উঠল বক্ষস্থল। কণ্ঠটা প্রিয়তার চেনা। প্রহর ডাকছে তাকে। এখানে কি করছে লোকটা?

প্রিয়তা পিছু ফিরে তাকাল। প্রহরের পরণে কালো শার্ট আর প্যান্ট। চুলগুলো কেমন অগোছালো। দু হাত পকেটে গুঁজে রেখছে লোকটা। সুদর্শন লাগছে তাকে। প্রহর খেয়াল করলো প্রিয়তার পানিতে টইটম্বুর করা চোখ। অন্ধকারেও প্রিয়তার সরু নাকে গেঁথে রাখা সাদা নোস পিন জ্বল জ্বল করছে। প্রিয়তা জড়তা নিয়ে ডাকের উত্তর নিল। বললো,

” হুহ?

” মন খারাপ? জিজ্ঞেস করলো প্রহর। এগিয়ে এলো সম্মুখে।

” না। মন খারাপ নেই।

” আজ যা হলো ভুলে যান। আমরা দুঃখিত।

” এ নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই। বরং আপনাদের দায়িত্বশীলতা আমাকে মুগ্ধ করেছে।

“তাহলে কাঁদছেন কেন?

” অনেক কারণ আছে। আমার জীবনটা আর পাঁচটা সাধারন মানুষের মতো নয় কি না।

” জীবন এক ধরনের জটিল চক্রাকার। এই চক্রে যেমন ভালো কিছু ঘটে, তেমনি খারাপ অনেক কিছুই ঘটে। আমাদের সেসব মানিয়ে নিয়ে চলতে হয়।

প্রিয়তা শুনল। একটু চুপ রইল। অতঃপর রেলিং ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। প্রহরের নিকটে এসে দাঁড়াল। প্রহরের চোখে চোখ রেখে বললো,

” আমি যদি কখনো হারিয়ে যাই, কিংবা মারা যাই, আমার ভাইটাকে প্লিজ দেখে রাখবেন। আমি ছাড়া ওর আপন বলতে কেউ নেই। ছেলেটা বড্ড একা, বড্ড অসহায়।

চলবে?

প্রিয়তার প্রহর পর্ব-০৮

0

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা (৮)

রাত ঘনিয়ে এসেছে। ঝি ঝি পোকারা ডাকছে বারবার। আকাশে মেঘ করেছে। তারাদের দেখা যাচ্ছে না। ইহানের মনে পরল ছোট বেলার কথা। আগে রাতে মেঘ উঠলে বুঝতে পারতো না ইহান। সহজ পদ্ধতিতে ইহানের মা রেহানা বলেছিলেন “রাতে যদি চাঁদ দেখতে না পাস, তাহলে বুঝবি মেঘ করেছে”। ইহান এটা মনে রাখে।

ইহান বা পাশে তাকিয়ে তানিয়াকে দেখল। ফার্মসির দোকানে বসে আছে তারা। ছোট একটি বিছানায় শুয়ে আছে তানিয়া। চোখ বন্ধ করে রেখেছে। ডাক্তার কিছু ঔষধ আর মলম জাতীয় পদার্থ দিয়েছেন। দুটো ইনজেকশন দিয়েছে তানিয়াকে। প্রথমে ইনজেকশন নিতে চায়নি তানিয়া। ইহান ডাক্তারের সামনেই ভয়াবহ ধমক দিয়েছে তানিয়াকে। এরপর কোনকিছুতে না করেনি তানিয়া। একদম চুপচাপ শুয়ে ছিল। ইহান ডাকল তানিয়াকে। বললো,

” উঠবে না? এখানেই শুয়ে থাকবে? রাত হয়েছে।

তানিয়া চোখ মেলল। হাত ব্যথায় টনটন করছে। ভাগ্যিস গুলিটা গা ঘেঁষে চলে গিয়েছে। যদি হাতে লাগত? তাহলে এখন হাসপাতালে থাকতে হতো। আগামীকাল প্রহর স্যারের বাসায় দাওয়াত আছে ওদের। প্রিয়তার বিষয়ের কেসটা নিয়েও খানিক ঘাঁটাঘাঁটি করতে হবে। এ মুহূর্তে বিছানায় পরলে কাজগুলো কঠিন হতো।

তানিয়া উঠে বসল। ব্যাগটা হাতে নিয়ে কল লিস্ট চেক করল। ইহানের দিকে তাকিয়ে বললো,
” প্রহর স্যার এখান থেকে বের হতে না করেছেন। উনি আসবেন বলেছেন। যাওয়াটা কি ঠিক হবে?

ইহান কথাটা শুনে বেরিয়ে এলো বাইরে। রাস্তার সাথেই ঔষধের দোকান। ডাক্তার নিজেও বেশ আন্তরিক। এতক্ষণ তানিয়ার পাশের চেয়ারে ছোট্ট ঘরে যান্ত্রিক পাখা ব্যতিত বসে থাকতে ভালো লাগছিল না ইহানের। এখন বাইরে এসে নিজেকে মুক্ত মনে হচ্ছে। প্রকৃতির মোলায়েম বাতাসে গা শিনশিন করে উঠছে। গুলিটা আরেকটু হলেই একদম ইহানের বুক বরাবর লাগত। ঠিক সময়ে হাসপাতালে না পৌছালে কিংবা গুলিটা ঠিক জায়গায় বসলে এখন ইহানের অস্তিত্ব থাকতো না। লাশ হিসেবে সকলের মুখে মুখে শোনা যেত ইহানের নাম। বিষয়টা মন্দ হতো না। কিছু মানুষ ভাবে মরণ সব সমস্যার সমাধান। ইহানের এই ভাবনা নেই। ইহানের মনে হয় সব সমস্যা মৃত্যুতেই শেষ হয়ে যায় না। কিছু সমস্যা মৃত্যুতেও তৈরী হয়।

পনেরো মিনিট বাদেই প্রহর বাইক নিয়ে ফার্মেসির সামনে এলো। ইহানকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মোটামুটি অবাক হলো প্রহর। বাড়িতে তিয়াশের গায়ে হলুদের পর্ব শেষ হয়েছে একটু আগেই। আগামীকাল বিয়ের জন্য জোগাড়যন্ত্র চলছে। ইহান মেসেজ করেছিল অনেকক্ষণ আগে। শুধু বলছিল “জাফরের চ্যালারা আক্রমণ করেছে ওদের। তানিয়া আহত হয়েছে”। এরপর দ্বিতীয় মেসেজে ঠিকানা বলে দিয়েছিল। প্রহর বাইক থেকে দ্রুত নেমে ইহানের কাছে এলো। বললো,
” তুই এখানে? তানিয়া ঠিক আছে?

ইহানের চোখে মুখে কোন চিন্তার রেশ দেখতে পেল না প্রহর। ইহান স্বাভাবিক ভাবে বললো,

” সিরিয়াস কিছু হয়নি। গুলি হাত ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে।

প্রহর আর ইহান ফার্মেসিতে ঢুকল। তানিয়া নিয়াজকে ফোন করে ফিরতে দেরি হবে বলে জানিয়েছে। ফোনটা রাখতেই প্রহরকে আসতে দেখল ভিতরে। অভ্যেসবশত উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল। প্রহর সামনাসামনি দাঁড়িয়ে বললো,
” আর ইউ ওকে তানিয়া? কিভাবে কি হলো?

ইহান বাঁকা হাসল। বললো,
” আমাকে বাঁচাতে গিয়ে আহত হয়েছে। এটা করার কোন মানে ছিল? ওরা আমাকে এট্যাক করতে চেয়েছে। সেখানে ও নিজে এগিয়ে এলো কেন? দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসার কখনো এমনটা করে?

” দায়ীত্বশীল সদস্য স্যারকে বাঁচাতে এটুকু করেই। খুব নরম কণ্ঠে খোঁচা দিয়ে কথাটা বললো তানিয়া।

প্রহর জিজ্ঞেস করল,
“ওদের ভালোমতো দেখেছো তোমরা?

ইহান বললো,
” কয়েক সেকেন্ডের জন্য দেখতে পেয়েছি। মুখগুলো মনে পরছে না। ওদের দেখবো নাকি এই মেয়েটাকে সামলাবো? এটুকু বিষয়ে হাইপার হতে হয়? অজ্ঞান হতে হয়? এমন হলে বড় বড় অপরাধীদের কিভাবে ধরবে?

তানিয়ার রাগ হলো ভিষণ। রোজ রোজ এইভাবে অপমান করার কোন মানে আছে? সে ভুল কি করেছে? একজনকে গুলি করা হচ্ছে দেখেও সে চুপ থাকবে? স্যারকে এইভাবে আহত হতে দেখবে? এটা সম্ভব?

তানিয়া উঠল বিছানা থেকে। ফোনটা ব্যাগে ভরে নিল। কাঠ কাঠ কণ্ঠে বলে উঠল,
” আমি ভুল করেছি তাইতো? আপনাকে আহত হতে দেখলে বেশি ভালো হতো তাইতো? চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলে বেশি খুশি হতেন? আমি এতটা নিষ্ঠুর নই স্যার। আপনি সবসময় অপমান করেন। আমি মেনে নিই। আর কত? আমি কোনকিছুই পারি না, কোনকিছুই বুঝি না, কোন কাজেই পটু হই। হয়েছে? আমি লেডি পুলিশ অফিসার হওয়ার যোগ্য নই। এটাই তো? বেশ মানছি আমি। আমাকে বাদ দেওয়া হোক।

তানিয়া কথাটুকু বলেই বেরিয়ে এলো। নির্বাক হলো প্রহর আর ইহান। আড়চোখে ইহানের দিকে তাকাল প্রহর। তানিয়ার পিছনে গিয়েও লাভ হলো না। একটা অটো ধরে উঠে পরল তানিয়া। পিছু ফিরে দেখল ইহান স্যারের মুখ। দেখতে পেল ভিতরের ক্ষত?

_________________

সকালে প্রিয়তার ঘুম ভাঙল গানের শব্দে। বিষয়টাতে বিরক্ত হলো প্রিয়তা। বিয়ে বাড়িতে এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু কালকের ঘটনার জন্য ও বাড়ির সবার প্রতি একটা আলাদা রাগ রয়ে গেছে প্রিয়তার। তারা যাই করুক তাতেই রাগ হচ্ছে। প্রিয়তা যতই বলুক মনে রাখিনি, ভুলে গিয়েছি, ভাবতে চাই না। আসলে প্রিয়তা কোনকিছুই ভুলেনি। আর না ভুলতে চায়।

প্রিয়তা সকালে উঠে রান্না বান্না করল না। ঘরে বাজার নেই। দুপুরে টিউশনি করে ফিরে আসার সময় বাজার করে আনবে। আরহামকে কথা দিয়েছে আজ ভালো ভালো রান্না হবে ঘরে। কথা তো রাখতেই হবে। দোকান থেকে কিনে আনা পাউরুটি আর কলা দিয়ে সকালের নাস্তা করলো প্রিয়তা আর আরহাম। খেয়েদেয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে ভাইয়ের উদ্দেশ্যে প্রিয়তা বললো,

” কাল যা হয়েছে তা তোমার জানা উচিত আরহাম। ও বাড়িতে একটা দামী আংটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওরা বলেছে তুমি কিংবা আমিই আংটিটা নিয়েছি অর্থাৎ আমরা চুরি করেছি। চুরি করা কত বড় অন্যায় তা তো তুমি জানোই। এত বড় অপবাদ বহন করার পর তুমি যদি ও বাড়ি যাও তাহলে তোমার ব্যক্তিত্ব নষ্ট হবে, আত্মমর্যাদা ভেঙে খান খান হবে। ব্যক্তিত্ব বা আত্মমর্যাদা সম্পর্কে তোমার জ্ঞান লাভ করার বয়স হয়নি। তবে এটুকু মনে রেখো আমি তোমার ভালোই চাই। তোমার খারাপ হোক, তুমি কষ্ট পাও এমন কিছু আমি কোনদিনই চাইবো না। তাই আমি চাই তুমি উপরের ফ্ল্যাটে না যাও। এখন বাকিটা তোমার ইচ্ছে।

আরহাম পুরোটা শুনল। আদুরে ভঙ্গিতে আরহাম জড়িয়ে ধরল প্রিয়তার কাঁধ। চুমু খেল প্রিয়তার গালে। একটু হেসে দাঁত বের করে বললো,

” আমি ওখানে যাবো না। ওরা আমাদের কষ্ট দিয়েছে। তুমি তো আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে। আমি কেন ওখানে যাবো।

প্রিয়তা হাসল। অজস্র চুমু খেল আরহামের নরম গালে। ফোনটা রেখে গেল আরহামের কাছে। ভালো না লাগলে কার্টুন দেখবে ছেলেটা। প্রিয়তা বের হলো বাড়ি থেকে। গতকাল রাতেও একটা কল এসেছিল টিউশনির জন্যে। ছাত্র ক্লাস ফাইভে পড়ে। প্রত্যেকটা সাবজেক্ট কম-বেশী পড়াতে হবে। মাসিক বেতন ধরা হয়েছে তিন হাজার। প্রিয়তা হিসেব করলো মাস শেষে এগারো হাজার টাকা ইনকাম করবে সে। তা থেকে সাড়ে তিন হাজার ঘর ভাড়া, বিদ্যুত বিল,
ময়লা ফেলার বিলে চলে যাবে। বাকি সাড়ে সাত হাজার টাকা দিয়ে বাজারসদাই করতে হবে। সাথে আরহামের জন্য কিছু টাকা সঞ্চয় করতে হবে।

ব্যাচ আর কুসুম,কোয়েলকে পড়াতে পড়াতে দুপুর বারোটা বেজে গেল অনায়াসে। কুসুমদের বাড়ি থেকে রোজ হেঁটেই বাজার পার করে বাড়ি ফিরে প্রিয়তা। আজও আধ ঘন্টা হেঁটে বাজারে এলো সে। বাজারের চারদিকে মানুষে ভরপুর। পোল্ট্রি মুরগির জঘণ্য গন্ধ ভাসছে চারদিকে। নানা রকমের মাছের বিস্রি গন্ধে বমি পাচ্ছে প্রিয়তার। শনিবার হাটের দিন। শনিবারে বাজারে বেশি মানুষ আসে। সব রকমের তরি-তরকারি পাওয়া যায় বাজারটাতে। শনিবারে মানুষের সংখ্যা যেমন বাড়ে, তেমনি বাড়ে কথোপকথনের আওয়াজ। পুরো বাজার জুড়ে এখন দর কষাকষির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। দাঁড়ানোর জায়গা নেই একদম। বিক্রেতারা ডেকে চলেছে ক্রেতাদের। বাজার বসার জায়গাটা ভালো নয়। উঁচু নিচু জায়গাগুলোয় বৃষ্টি পরলে পা রাখা যায় না।

প্রিয়তা প্রথমেই মাংসের দোকানে গেল। প্রথমে ভাবল মুরগির মাংস নিবে। কিন্তু মনে হলো আরহাম গরুর মাংস বেশি পছন্দ করবে। বিয়ে বাড়িতে গরুই চলে। যদি ভাইটা তার জিজ্ঞেস করে গরুর মাংস কই? তখন কি বলবে প্রিয়তা?বাজারের জিনিসপত্রের দাম সম্পর্কে ধারণা নেই প্রিয়তার। মাংসের দোকানে ভিড় দেখে পাশেই দাঁড়াল কিছুক্ষণ। টাটকা মাংস কিনা বোঝা যাচ্ছে না। পুরুষদের জন্য জায়গাই হচ্ছে না। সবাই কেমন এড়িয়ে যাচ্ছে তাকে। প্রিয়তা সময় নিয়ে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল,

” মাংস কত টাকা কেজি আঙ্কেল?

দোকানদার হেসে বললো,
” মাত্র সাতশো টাকা কেজি আপা। নিয়া যান।

প্রিয়তার মুখটা চুপসে গেল। এত টাকা দাম? ঘরে কোন মশলাপাতি ও নেই। মশলা কিনতেও খরচ হবে অনেক। মশলা ছাড়া তো মাংস ভালোই লাগবে না। আরহামের মুখটা মনে পরল প্রিয়তার। ছেলেটা অপেক্ষা করছে তার জন্য। গিয়ে রেঁধে, খেয়ে আবার বের হতে হবে । দোকানদার তাড়া দিল। প্রিয়তা এক কেজি মাংস নিল। এক হাজার টাকা দিল দোকানীকে। দোকানদার তিনশো টাকা ফেরত দিল। প্রিয়তা চটপট ছুটল মুদির দোকানে। লবঙ্গ, দাড়চিনি, রসুন সহ কিছু মশলা কিনল। সবকিছুর দাম আকাশ ছোঁয়া। আলুর কেজি ষাট টাকা। পেয়াজের দাম ও অনেক। সবকিছুর দাম শুনে মাথা ঘুরাচ্ছে প্রিয়তার। একশো টাকার নিচে বাজারই নেই তেমন। যে সবজি প্রিয়তা ছুঁয়েও দেখতো না সেসবের দাম এখন ব্যাপক। সেগুলো কিনে খাওয়ার মতো বিলাসিতা নেই এখন। টাকা ফুরিয়ে যাওয়ার অভাবে বুকের ভেতর মোচর দিল প্রিয়তার। বুঝতে পারল জগত সংসারে টিকে থাকতে হলে অর্থ জিনিসটা খুব জরুরি, অনেক প্রয়োজন। আয়ের চেয়ে ব্যয় হচ্ছে প্রতিনিয়ত। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতেই বেহাল দশা হচ্ছে। এভাবে চললে কিভাবে বাঁচবে জনগন? দরিদ্র মানুষ খাবে কি? কতশত মানুষ বাজারে এসে দাম শুনেই ফিরে যায়। এদের দুঃখ কবে ঘুচবে? যা যা দরকার তাই তাই কিনল প্রিয়তা।
ফিরে আসার পথে প্রিয়তার মিষ্টি জাতীয় কিছু নেওয়ার কথা মনে পরল। বিয়ে বাড়িতে খাওয়ার পর দই খাবারটা খুব চলে। প্রিয়তা ততক্ষণাৎ মিষ্টির দোকানে ঢুকল। দইয়ের ছোট খুঁটি কিনলো তিনশো টাকা দিয়ে। অতঃপর হাসিমুখে বেরিয়ে পরল বাজার থেকে। আরহাম আজ খুব খুশি হবে।

_____________

বাড়িতে ফিরে তাড়াহুড়ো করে ভাত বসিয়ে দিল প্রিয়তা। আলু কেটে নিল। মশলা গুলো বেঁটে নিল সময় নিয়ে। ব্যাগ থেকে মাংসের পলিথিন বের করল প্রিয়তা। বাটিতে ঢালল মাংসটুকু। মাংস টুকু বের করতেই প্রিয়তার উজ্জল মুখ ফ্যাকাশে হলো। দোকানদার মাংসের চেয়ে তেল আর হাড় দিয়েছে বেশি। প্রিয়তা গুনে দেখল এখানে ছোট ছোট একুশ টুকরো মাংস আছে। এর মধ্যে হাড় আর তেল বাদ দিলে ভালো মাংস পাওয়া যাবে মাত্র বারো-তেরো টুকরা। এই মাংস আরহামের একারই লাগবে।
প্রিয়তা আর ভাবার অবকাশ পেল না। আরহামের খিদে পেয়েছে। প্রিয়তা মাংস বসিয়ে দিল। মাংস কষাতে কষাতে আরহাম রান্নাঘরে এলো। বললো,

” খুব ঘ্রাণ বেরিয়েছে আপু। খেতে টেস্টি হবে অনেক। দেখেই আমার লোভ লাগছে।

প্রিয়তা হাসল। নেড়ে দিল মাংস। বললো,
” কষানো মাংস খাবে আরহাম?

আরহাম যেন এ কথাই শুনতে চাইছিল। মুখে হাসি ফুটল ছেলেটার। দৌড়ে ঘর থেকে ছোট একটা বাটি নিয়ে ফিরে এলো রান্নাঘরে। প্রিয়তা দু টুকরো মাংস তুলে দিল বাটিতে। গ্যাসের চুলার পাশের উঁচু জায়গায় বসে আরহাম ফু দিয়ে দিয়ে মাংসটুকু দাঁত দিয়ে ছিড়ে খেল। খাওয়া শেষে একটু ঝোল চেটে খেয়ে বললো,

” খুব মজা হয়েছে আপু। এত মজা আগে তো লাগেনি। তুমি অনেক ভালো রান্না করো।

প্রিয়তা হাসল। আরো এক টুকরা মাংস তুলে দিল আরহামের বাটিতে। আগে ও বাড়িতে কেজি কেজি মাংস আনতো আরিফ। তখন অত খেতে ইচ্ছে করতো না। আসলে কোনকিছু বেশি থাকলে আমরা তাতে আগ্রহী হই না। এক জিনিস খেতে খেতে রুচি চলে যায়, ইচ্ছে চলে যায়। এত ছিল বলেই তখন এত মজা লাগেনি। আজ এই কয়েকটা মাংস দেখেই বোধহয় বেশি ভালো লাগছে খেতে। প্রিয়তা অভিমান করে বললো,

” প্রথমে তো তুমি আমার রান্না খেতেই পারতে না আরহাম। আজ এত ভালো লাগছে?

” সত্যিই আপু। আজ বেশিই মজা লাগছে। সবকিছু পারফেক্ট দিয়েছো। একটু ঝাল ঝাল হয়েছে। তোমার রান্না সেইইই।

প্রিয়তা হাসল। আজ সে একদম মন দিয়ে রান্না করেছে। নিজের সর্বস্ব ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছে রান্নায়। তাই বোধহয় আজ আরহাম এত পছন্দ করছে তার রান্না। প্রিয়তা ভেবে নিল সব কটা টুকরোই আরহামকে আজ আর কাল সকালে খাওয়াবে। দই টুকু কারো ফ্রিজে রেখে দু দিন খাওয়াবে ছেলেটাকে। কোনমতেই ছেলেটার যেন মনে না হয় তারা অভাবে আছে।

_________________

বিছানায় শুয়ে আছে তানিয়া। মাথা ব্যথার পাশাপাশি হাত ব্যথা করছে। গতকাল ইহান স্যারকে কয়েকটা কথা শুনিয়ে এখন খারাপ লাগছে তানিয়ার। সিনিয়ররা এমন করেই জুনিয়রদের নিয়ন্ত্রণ করেন, বকাঝকা করেন। এতে এতটা হাইপার হলে নিজেরই ক্ষতি। এছাড়া ইহান তার কথা আদৌ গায়ে মেখেছে কি না এতে সন্দেহ আছে তানিয়ার। শুধু শুধূ বলে দিল কথাগুলো। না জানি দুজন কি ভাবছে তাকে নিয়ে?

আবিরকে কিচ্ছুটি জানায়নি তানিয়া। রাতে ছেলেটা নাকি এ বাড়িতে খেতে আসবে। তখনই না হয় নিজের চোখে দেখবে। এখন ফোন দিয়ে এসব বললে হাজারটা প্রশ্ন করবে আবির। যা হয়েছে তা তো হয়েছেই। এখন লোকগুলোকে ধরতে পারলেই শান্তি পাওয়া যাবে।
তানিয়ার ফ্ল্যাটের কলিং বেল বেজে উঠল। নিয়াজ ঘুমোচ্ছে এই সময়। দুপুরে না ঘুমোলে শান্তি লাগে না বয়স্ক লোকটার। তানিয়ার দুপুরে ঘুম আসে না। রাতে আসলেও ঘুমোতে পারে না মন মতো।

তানিয়া উঠল বিছানা ছেড়ে। চশমা পড়ে নিল। ওড়না জড়িয়ে দরজা খুলে চমকাল ভিষণ। ইহান আর প্রহর দাঁড়িয়ে আছে তানিয়ার সামনে। এতদিনের পরিচয়ে কখনো বাড়িতে আসেনি ইহান বা প্রহর। তানিয়া বলে কয়েও নিয়ে আসতে পারেনি ওদের। আজ যে ওরা আসবে তা ভাবতেও পারেনি তানিয়া। কয়েক পল চেয়ে তানিয়া সালাম দিল। ভেতরে আসতে বললো দুজনকে। দরজা লাগিয়ে দিয়ে ড্রয়িংরুমে বসতে দিল। তানিয়া জিজ্ঞেস করলো,

” স্যার, আপনারা চা খাবেন নাকি কফি?

প্রহর হাসল। বললো,
” ব্যস্ত হয়ো না। আমরা তোমাকে দেখতে এসেছি। কেমন আছো তুমি? হাতের কন্ডিশন ভালো?

” ঠিক আছি স্যার। সামান্য লেগেছে। কি খাবেন বলুন। নিয়ে আসছি।

ইহানের দিকে তাকাল তানিয়া। উহু, বিন্দুমাত্র বদলায়নি ইহান। একইরকম গম্ভীর ভাবে বসে আছে। তানিয়াকে দেখে নিল ইহান। স্পষ্ট স্বরে বললো,

” এখানে বসো। কোথাও যেতে হবে না।

তানিয়া শুনল। দুরত্ব বজায় রেখে চেয়ার টেনে বসলো ইহান আর প্রহরের সামনে। প্রহর বললো,

“ইহানের কথায় কিছু মনে করো না। ইউ নো যে ও এমনই। একটু গম্ভীর আর রাগী প্রকৃতির। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে…

‘ কাজের ক্ষেত্রে উনি কখনো ভুল করেন না। কখনো পিছ পা হন না। দায়িত্ব পালন করতে উনার কখনো দ্বিধা বোধ হয়নি, ভয় হয়নি। তাইতো স্যার? হাসি মুখে কথাটা বললো তানিয়া।

প্রহর হাসল। বললো,
” আমার চেয়ে তুমি এটা ভালো জানো।

ইহান গম্ভীর স্বরে বললো,
” তুমি আমাদের দলের সদস্য। তোমাকে সেভ করা আমাদের দায়িত্ব। সেসময় প্রহর ছিল না। আমি তোমাকে নিজ দায়িত্বে ওখানে নিয়ে গিয়েছি। কিন্তু কি হলো বলো তো? আমার জন্য তোমাকে আঘাত পেতে হলো। এ বিষয়টা আমাকে সেনসিটিভ করে তুলেছে। আমি চাই না আমার জন্য কারো কোন ক্ষতি হোক। আমি চাই না আমার জন্য কারো কষ্ট হোক।
মনে আছে তানিয়া আমাদের আলাপের কথা? কনকনে শীতের মাঝে পাহাড়ি অঞ্চলে ট্রেনিং চলছিল আমাদের। আমার আর প্রহরের মতো তুমিও ট্রেনিং নিতে এসেছিলে। দৌড় প্রতিযোগীতা চলছিল। প্রহর প্রথমে ছিল, আমি দ্বিতীয়তে। হুট করে একটা ছেলে আমার দিকে পা বাড়িয়ে আমাকে ফেলে দিল। ছেলেটা আমাদের মতোই পুলিশ হবার ইচ্ছে নিয়েই এসেছিল ট্রেনিংয়ে। অসংখ্য প্রতিযোগীতা,পরিক্ষা দেওয়ার পর পুলিশ হিসেবে সিলেক্ট হয় খুব কম সংখ্যক মানুষ। আমি হোঁচট খেয়ে পরে গেলাম। প্রহর চলে গিয়েছিল অনেকটা দূরে। পিছু ফিরে আসতে চেয়েছিল। আমি চিৎকার করে বলেছিলাম “আসতে হবে না তোকে। তুই এগিয়ে যা”।

আমার বাক্য শেষ হতেই তুমি কোথা থেকে এলে। তোমার সাথে ছিল ফাস্ট এইড বক্স। আমার হোঁচট খেয়ে ছিলে যাওয়া পায়ে স্যাভলন দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলে তুমি। আমাকে টেনে তুলে বেঞ্চে বসালে। টুকটাক পরিচয় হলো আমাদের। একসাথে ট্রেনিং নিলাম আমরা। দৌড়, লাফানো, টার্গেট অনুযায়ী শুট, সাঁতার, সাইকেল রেসিং সবকিছুতেই আমরা তিনজন একসাথে অতিক্রম করলাম। কিন্তু বিপত্তি বাঁধল ফাইনাল ট্রেনিংয়ে। অসংখ্য মানুষের মাঝে দুর্ভাগ্যের কারণে তুমি জাম্প এক্সামে পাশ করতে পারলে না। সে কি কান্না তোমার। সব ছেড়েছুড়ে চলে আসতে চেয়েছিলে, পুলিশ হওয়ার ইচ্ছে মুছে ফেলেছিলে মন থেকে। আমি আর প্রহর তোমাকে সান্ত্বনা দিলাম। অনেক বুঝিয়ে বললাম। তুমি মনকে নিয়ন্ত্রণ করলে। পরের বছর আবার ট্রেনিং এ আসবে বলে শপথ করলে। আমি আর প্রহর সব পরিক্ষায় পাশ করে সিলেট সদর থানায় জয়েন করলাম। তোমার সাথে আমাদের দুরত্ব বাড়ল। আমরা তোমার সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখলাম। আমি এই একবছর খুব করে চেয়েছি তুমি পুলিশ হও। পরের বছরে তোমাকে পুলিশ হিসেবে দেখতে চেয়েছি আমরা। এক বছর পর তুমি সত্যিই এলে এই থানায়। অবাক হয়েছিলাম আমি। সাথে খুব খুশিও হয়েছিলাম। যা যা সাহায্যের দরকার ছিল তোমার সবকিছুই বুঝিয়ে দিলাম। সব রকমের পরিচালনা করার পর তুমি আমাদের টিমে এসেই পরলে। তোমার স্বপ্ন তুমি অন্যায় মুছে ফেলবে দেশ থেকে। তুমি চাইতে পুলিশ হয়ে সবার সাথে থাকতে। তুমি বলতে পুলিশকে যেন বারবার ফোন করতে না হয় এজন্য তুমি সবসময় এগিয়ে থাকবে। তোমার ইচ্ছে, উদ্দেশ্যে, সাহস তোমাকে এখানে এনেছে।

এটুকু বলে থামল ইহান। পুনরায় বললো,
” আজ যদি তোমার কিছু হতো তো আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না। আমি রাগারাগি করি যেন তুমি তোমার উদ্দেশ্যে থেকে বেরিয়ে আসতে না পারো। আমি রাগারাগি করি যেন তুমি তোমার কাজে আরো বেশি একটিভ হও, পথদ্রষ্ট না হও। গতকাল যা হলো তাতে আমি প্রচণ্ড রেগে গিয়েছি। আজ কেন এসেছি বলি? তোমার দুঃখ এইবার ঘুচবে। আর বকবো না আমি তোমায়। আমাকে আর তোমার ভয় পেতে হবে না। সামনে মাসে আমি অন্য থানায় ট্রান্সফার হচ্ছি। আমার বদলে অন্য কেউ আসবে তোমাদের টিমে। তাই ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে এলাম। আমার উপর রেগে থেকো না।

তানিয়া এতক্ষণ সবটা শুনল। শেষের কথাগুলো শুনে আঘাত পেল ভিষণ। গতকালকের কথাগুলো তবে ইহান স্যারের গায়ে লেগেছে। তানিয়ার হুট করে এমন আচরণ ইহানকে অন্যরকম করে তুলেছে। তবে কি তার উপর রাগ করেই চলে যাচ্ছে ইহান? মনে সংশয় দেখা দিল।

তানিয়া প্রশ্ন করলো,
” আপনি কি আমার উপর রাগ করে চলে যাচ্ছেন?

তানিয়া মাথা নিচু করে আবারো বললো,
আমি সত্যি ওভাবে বলতে চাইনি। আমি একটু বেশিই রেগে গিয়েছিলাম। সরি স্যার।

প্রহর জানাল,
” ইহানের ট্রান্সফার সার্কিফিকেট অনেকদিন আগেই এসেছিল। কিন্তু ও অতটা আমলে নেয়নি। এখন জরুরী কারনে ওকে প্রয়োজন। ইতিশা ম্যামের কেসটা ডিশমিশ হলে আরো একটা কেসে ইনভল্ভ্ড্ হতে হবে। এরপর ওকে চলে যেতে হবে।

তানিয়ার খারাপ লাগল। কান্না পেল একটু। এভাবে বলা ওর উচিত হয়নি। একটু রাগ কমালে হয়তো এতটা খারাপ লাগতো না তানিয়ার। ইহান স্যার চলে গেলে তানিয়াকে গাইড করবে কে?

_____________________

পুরো ফ্ল্যাটের চারদিকে লাল-নীল রঙের লাইট লাগিয়েছে। বক্সে সুন্দর গান বাজছে। ইতিমধ্যে নিধি একবার এসে আরহাম আর প্রিয়তাকে ডেকে গিয়েছে। দুজনের কেউই যায়নি সেখানে। মনক্ষুণ্ণ হয়ে বারবার ফিরে গিয়েছে নিধি।

প্রিয়তা গোসল করে সাদা আর আকাশি রঙের মিশেলে গোল ফ্রক পড়েছে। চোখের পাতায় নিয়েছে আইলাইনার। ম্যাচিং করে ওড়না পরে চুল ছেড়ে দিয়েছে। প্রিয়তার প্রিয় কার্টুন হলো ডোরেমন। ডোরেমন কার্টুনের সিজুকা চরিত্রটি প্রিয়তার খুব পছন্দের। সিজুকার সামনের চুল কাটা দেখে প্রিয়তা নিজেও পার্লারে গিয়ে ওইভাবে চুল কেটেছে। সিল্ক আর পাতলা বলে এই হেয়ার স্টাইলে পুতুলের মতো লাগে প্রিয়তাকে।

আরহামকে প্রিয়তার সাথে ম্যাচিং করে সাদা শার্ট আর আকাশি প্যান্ট পরানো হয়েছে। দুজনকে একসাথে চমৎকার লাগছে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে প্রিয়তা দইয়ের খুঁটি নিচের ফ্ল্যাটের আন্টিদের ফ্রিজে রেখে এসেছে। প্রিয়তা শুধু আলু আর ঝোল দিয়ে ভাত খেয়েছে। বের হবার পূর্বে প্রিয়তা ব্যাগ আর ফোন চেক করল। সিঁড়ি দিয়ে নেমে মেইন গেটে পেরিয়ে বাইরে বের হলো তারা। আরহামকে নিয়ে শিশু পার্কে যাবে প্রিয়তা। একটা অটো ধরে সেখানেই যেতে লাগল তারা। পথে খুনশুটি হলো অনেক। বেশ কয়েকবার প্রিয়তার মনে হলো কেউ তাকে অনুসরণ করছে। কথাটা ভুল প্রমাণিত হলো কারণ আশপাশে সন্দেহ করার মতো কোন ব্যক্তি নেই। অটো থেকে নামতেই একজন লোক এসে দাঁড়াল প্রিয়তার সামনে। থতমত খেল প্রিয়তা। লোকটার পরণে ব্লেজার। বয়স পঞ্চাশের অধিক। আধপাকা দাড়ি গুলো স্টাইল করে কাঁটা। প্রিয়তাকে দেখে লোকটা বললো,

” তুমি প্রিয়তা না?

প্রিয়তা উত্তর দিল।
” জি আমিই, আপনি কে?

” আমি তোমার বাবার বন্ধু। লোকটা হেসে বলে উঠল।

“ও আচ্ছা। আমাকে ডাকলেন কেন?

” চলো হাঁটতে হাঁটতে বলি। এভাবে দাঁড়িয়ে কথা বলা যায়?

” না। যা বলার এখানেই বলুন। ভয় বাড়ল প্রিয়তার।

দূর থেকে অনুসরণ করা ব্যক্তি পুলিশে কর্মরত। প্রিয়তার দিকে নজর রাখে সে। লোকটাকে দেখে ফোন দিল পুলিশ ইমন। বললো,

” প্রিয়তা মেয়েটা জাফর আলীর সাথেই আছে স্যার। আপনার সন্দেহ সত্য। ওরা কথা বলছে।

“কি বলছে শুনতে পাচ্ছো? বললো প্রহর।

” কিছুই শুনতে পাচ্ছি না স্যার। তানিয়া ম্যাম যে কিছু শুনতে পারবে তার ব্যবস্থা নেই। প্রিয়তা আজ ঘড়িটা পরেনি স্যার। কি করবো?

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

প্রিয়তার প্রহর পর্ব-০৭

0

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা (৭ )

দুপুরের কড়া রোদ চারপাশে। ঘর জুড়ে ফুলের সুবাস। আনন্দে গমগম করা পরিবেশে নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরেছে। প্রিয়তা আর আরহাম বসে আছে সোফায়। একটু পর পর নাক টানছে প্রিয়তা। ওড়না দিছে সর্দি মুছে যাচ্ছে। এসির নিচে বসেও ঘামছে মেয়েটা। নিদারুণ এক যন্ত্রণায় বুকটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে তার। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে আসছে। কারো কাছে পানি চাইবে এমন পরিস্থিতি নেই। বরং ভয়ে ভয়ে তাকাতে হচ্ছে সকলের দিকে। এই বুঝি কটুবাক্য ছুঁড়ে দিল কেউ।

প্রিয়তা ঢোক গিলল। গাল মুছে নিল অগোচরে। মিসেস নাবিলার দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক পল। মিসেস নাবিলার চোখে মুখে দুঃখের আভাস। স্বামীর বোনের বিরুদ্ধে যে কথা বলবে ,এত সাহস হয়ে উঠছে না উনার। অপেক্ষা করছেন প্রহররে জন্য। প্রহর যথেষ্ট বুঝদার আর বুদ্ধিমান ছেলে। এই ধরনের ঝামেলা মেটানোর জন্য ওর চেয়ে ভালো কাউকে পাওয়া যাবে না।

প্রিয়তা আরহামের দিকে চাইল। ছেলেটা মন খারাপ করে বসে আছে। একটু পর পর সকলের দিকে তাকাচ্ছে। প্রিয়তা বুঝল ছেলেটার ভাবাবেগ। বললো,

” আমাদের ঘরে যেতে দিন আন্টি। কেন এভাবে আটকে রেখেছেন? আমি তো বলছি আংটিটা আমার ভাই বা আমি কেউই নেইনি।

সাবিনা বেগম এতক্ষণ চুপ ছিলেন। প্রিয়তার কথায় ঝাঁঝ মিশিয়ে বললেন,
” আংটি না দেওয়া পর্যন্ত কোথ্থাও যাইতো দিমু না।

প্রিয়তা চুপ করে গেল। নিজেকে আর প্রমাণ করতে ইচ্ছে করছে না তার। দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করছে। সমাজের মানুষ গুলো আসলেই অদ্ভুত। এরা হুট করেই একজনকে ভালোবেসে মনে জায়গা দিতে পারে। আবার হুট করেই জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে। প্রিয়তা আর তার ভাই খেলনা? বাবা-মা নেই বলে কি তারা অসহায়? বসে বসে অপমান শুনবে তারা? প্রিয়তা এত বোকা কেন? যেখানে বাবা-মা ই তাদের দূরে সরিয়ে দিয়েছে, সেখানে বাইরের মানুষদের ভালোবাসা খাঁটি বলে মনে করলো? এত বোকা প্রিয়তা? এত নির্লজ্জ?

তিয়াশ আর প্রহর ফিরল কিছুক্ষণ পর। যেই বাড়িতে এটু পর পর জোরে গান বাজছিল সেই বাড়িতে নিরবতা দেখে কৌতুহল হলো তাদের। প্রহরের প্রথমেই চোখ পরল প্রিয়তার দিকে। সবাই মেয়েটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়তা মাথা নিচু করে কাঁদছে। প্রহর অবাক হলো। কি হয়েছে এখানে?

মিসেস নাবিলা তিয়াশ আর প্রহর কে দেখে এগিয়ে এলেন। কণ্ঠে তার ভয়। চোখেমুখে কষ্টের ছাপ। প্রহরের কাঁধে হাত রেখে তিনি বললেন,

” আঁখির জন্য কেনা আংটি টা পাওয়া যাচ্ছে না প্রহর। তোর ফুপু বলছে আংটি টা প্রিয়তা বা আরহাম নিয়েছে। মেয়েটাকে কত গালমন্দ করছে। তুই কিছু একটা কর না।

প্রহর বিস্মিত হলো ভিষণ। এটুকু সময়ের মধ্যে এতকিছু হয়ে গেছে? আরহাম কেঁদে চোখ মুখ লাল করে ফেলেছে। প্রিয়তার চোখে পানি। সকলেই ঘিরে রেখেছে দুজনকে। সাবিনা বেগমের রাগী চেহারা। সবটা দেখে প্রহর অসস্তিতে পরলো। পাশে থাকা তিয়াশের দিকে চেয়ে ইনোসেন্ট লুক দিল। তিয়াশ তা দেখে বোকা হাসল। করুণ চোখে তাকিয়ে রইল প্রহরের দিকে। প্রহর সময়টা দেখে নিল। সাবিনা বেগমের উদ্দেশে বললো,

” ফুপি, উনাকে এইভাবে ঘিরে রেখেছো কেন?

সাবিনা বেগম খুব ভালোবাসেন প্রহরকে। প্রহরকে ছোটবেলায় কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন তিনি। প্রহরের প্রতি আলাদা একটা টান অনুভব করেন সাবিনা বেগম। প্রহরকে দেখেই মেকি সুরে কাঁদতে লাগলেন তিনি। শাড়ির আঁচল দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে বললেন,

” তিয়াশের বউয়ের জন্যে এত দামী একটা আংটি কিনলাম। আংটিটা চুরি হইয়া গেছে বাপজান। দ্যাখ মাইয়াডার মুখ কত ছোড হইয়া গেছে।

আঁখির দিকে তাকিয়ে কথাটা বললেন সাবিনা। পাশেই আঁখির বাবা-মা বসে আছে। বিভ্রান্ত হচ্ছে তারা। প্রহর মুখ গোল করে শ্বাস ছাড়ল। দু আঙ্গুল দিয়ে কপালে স্লাইড করল। বললো,

” তুমি প্রমাণ ছাড়া ওদের ব্লেইম করছো কেন? হোয়াই? আংটিটা আমার কাছে আছে। কেউ চুরি করেনি ওটা।

সাবিনা বেগম চুপসে গেলেন ততক্ষণাৎ। প্রিয়তার মাথা নিচু ছিল। চেনা কণ্ঠ শুনে মুখ উপরে তুললো। আংটির কথাটা বারবার বাজতে লাগল কানে। কথাটার প্রকৃত অর্থ বোধগম্য হতেই উঠে দাঁড়াল সোফা থেকে। কষ্টে জর্জরিত হওয়া তরুণীর ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল। উজ্জল হলো মলিন মুখ। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো প্রহরের দিকে। তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না প্রিয়তার। শব্দ বের করলেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলবে মনে হচ্ছে, কণ্ঠ আটকে আসবে মনে হচ্ছে। কিন্তু জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন। আংটিটা কি পুলিশম্যানের কাছে আছে?

প্রিয়তা স্থির রইল। সবাই-ই স্থির রইল। প্রিয়তা উচ্চস্বরে বললো,
” আপনার কাছে আছে আংটি টা? দিয়ে দিন না উনাকে। আমার আরহাম চুরি করেনি। আমিও করি নি। দিয়ে দিন না আংটি টা। আমরা চলে যাবো এখান থেকে।

কথাটুকু বলেই মুখে হাত চেপে ঝরঝর করে কেঁদে উঠল প্রিয়তা। প্রহরের খারাপ লাগল বিষয়টা। প্রিয়তার চোখেমুখে আকুতি। করুণ শোনাচ্ছে কণ্ঠস্বর। বুকের ভেতর পাথর চেপে রাখা মেয়েটার মুখটা কেমন শুষ্ক দেখাচ্ছে। পৃথিবীর সমস্ত দুঃখ ভর করেছে মনে হচ্ছে। প্রহর পর্যবেক্ষণ করলো পরিস্থিতি। একটা বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। তিয়াশ লুকিয়ে আছে আড়ালে। এসবের ভিতরে সে থাকবে না বোঝা যাচ্ছে। প্রহর পকেট থেকে আংটির বক্স বের করলো। বক্স থেকে বের করলো চকচকে গোলাপী রঙের হীরের আংটি। সাবিনা বেগমের কপালে ভাঁজ পরল। বললো,

” বাপজান, এইডা তো ওই আংটি না। ওই আংটি সবুজ রঙের ছিল।

প্রহর সোফায় গিয়ে বসল আরহামের পাশে। আদরের সাথে গাল চেপে ধরল ছেলেটার। বুকের সাথে জড়িয়ে নিল। বললো,

” ওই আংটি পরিবর্তন করে এই আংটিটা এনেছি আমরা। সবুজ আংটিটা আঁখি ভাবির পছন্দ হয়নি।

সকলেই আঁখির দিকে তাকাল। আঁখির বাবা-মা চোখ গরম করে তাকাল আঁখির দিকে। আঁখি মাথা নিচু করে ফেলল। প্রহরের ইশারায় নিধি আঁখি আর আঁখির বাবা-মাকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে শরবত আর ফলমূল খেতে দিল। এদিকে প্রহর বললো,

” তোমরা যেই আংটিটা কিনেছো সেই আংটি ভাবির পছন্দ হয়েছে কিনা জানবে না? গতকাল তিয়াশ ভাইয়ার রুমে গিয়ে দেখি ভাইয়ার মন খারাপ। জিজ্ঞেস করায় বললো আংটিটার ছবি পাঠিয়েছে ভাবিকে। কিন্তু ভাবির এই সবুজ রঙ পছন্দ নয়। পাল্টে আনতে বলেছে। কিন্তু তিয়াশ ভাই আংটিটা পাল্টাতে পারবে না বলায় দুজনের মাঝে একটা মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়েছে। ভাবির তো নিজের একটা পছন্দ আছে নাকি।

মিসেস নাবিলা কিছুটা বিরক্ত হলেন প্রহরের উপর। এতকিছু হবার পর এখন ছেলেটা এসব বলতে এসেছে? বললেন,
” আংটিটা নিয়ে গেছিস আমাদের বলিস নি কেন? বলে গেলে আমরা চিন্তা করতাম না। প্রিয়তাকেও এত বড় অপবাদ বহন করতে হতো না। মেয়েটা ভেঙে পরেছে একদম। কত কথা শুনতে হলো মেয়েটাকে।

প্রহর তাকাল প্রিয়তার দিকে। মাথা নিচু করে প্রিয়তা কেঁদেই যাচ্ছে। হেচকি তুলছে অনবরত। আগে যেই কষ্টের ছাপ ছিল এখন সেটা পুরোপুরি নেই। প্রহর বললো,
” ফুপিকে তুমি জানো মা। আগেকার যুগের মানুষদের মতোন আচার-আচরণ ফুপির। তিয়াশ ভাইয়ার সাথে ভাবির সম্পর্ক আছে শোনার পর প্রচুর সিনক্রিয়েট করেছিল। অনেক বোঝানোর পর ফুপি রাজি হয়েছে বিয়েতে। এখন যদি শোনে তিয়াশ ভাইয়ার বউ তার পছন্দ মানে না, তার পছন্দকে প্রায়োরিটি দেয় না, তাহলে কি পরিমান বাজে পরিস্থিতি তৈরী করবে ভেবেছো? বলবে মেয়ের ভদ্রতা নেই, মেয়ে এখনই তার মতের বিরুদ্ধে যাচ্ছে ব্লা ব্লা ব্লা। এজন্য আমি আর ভাইয়া লুকিয়ে আংটিটা চেঞ্জ করে এনেছি। অমি তো বলেওছিলাম আমরা না আসা পর্যন্ত প্রোগ্রাম শুরু না করতে।

” তুই আমাকে বলতে পারতি। মিসেস নাবিলা করুণ কণ্ঠে বলে উঠলেন।

” তোমাকে বললে তুমি ফুপিকে বলে দিতে। কোনো না কোনো ভাবে ফুপি জেনেই যেত। আঁখি ভাবিকে নিয়ে আলোচনা করতো। আমার আসতে তো আধঘন্টাও লাগেনি। তোমরাই আমাকে ফোন করতে পারতে কাউকে ব্লেইম করার আগে। আমি নিজেই তো পুলিশ নাকি? ঘরে পুলিশ থাকতে তোমরা নিজেরা তদন্ত করে চোর বের করে ফেলছো? বাহ্!

প্রিয়তা মুচকি হাসল। আরহামের কাছে গিয়ে ছেলেটাকে কোলে নিল আদুরে ভঙ্গিতে। আরহামের মাথা নিচু হলো প্রিয়তার ঘাড়ে। মুখ গুঁজে পরে রইল ছেলেটি। প্রিয়তা বললো,

” চোর তাহলে ধরা পরল। এবার আমরা যাই?

মিসেস নাবিলা এগিয়ে এলেন। আরহামের গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন,
” যা হয়েছে ভুলে যাও প্রিয়তা। এত বড় একটা ঘটনা ঘটবে অমরা বুঝিই নাই। এখনই চলে যেও না। খাওয়াদাওয়া করে..

” আপনি যে আমাদের জন্য ভেবেছেন এটাই অনেক আন্টি। যেটুকু পেয়েছি সেটুকুই হজম করতে পারছি না।

বেরিয়ে আসার আগে প্রিয়তা সাবিনা বেগমের দিকে তাকাল। মুচকি হেসে এগিয়ে এলো সাবিনার সামনে। হাসি বিস্তৃত করে বললো,

” অনুতপ্ততা গ্রাস করেছে আন্টি? আমি কিন্তু আপনাকে ক্ষমা করবো না। আমার ভাইকে যে কষ্ট দিয়ে কাঁদায় তাকে আমি ক্ষমা করতে পারি না। বাইরের মানুষ বাইরের মানুষ বলে হেদিয়ে ফেলছিলেন। জেনে রাখুন কিছু কিছু সময় বাইরের মানুষরাই আপন হয়। আজ এই মুহূর্তে আমি বলছি, আমার ভাইকে যে অপবাদ দিয়েছে তার প্রতি বিন্দু মাত্র ভালোবাসা জন্মাবে না আমার। বিন্দুমাত্র ও না।

প্রিয়তা বেরিয়ে এলো। সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে কষ্ট হলো তার। বুকে এক শীতল প্রবাহ বয়ে গেল। কথাগুলো বলে শান্তি লাগল প্রিয়তার। আর কত চুপ থাকবে? আর কত মেনে নিবে? তারা কি এতটাই অসহায় যে যার ইচ্ছে হবে কাছে টেনে নিবে? আবার যখন ইচ্ছে হবে ছুড়ে ফেলে দেবে?

ঘরে ফিরে প্রিয়তা দরজা বন্ধ করে দিল ভিতর থেকে। আরহামকে নামিয়ে দিল কোল থেকে। দু ভাইবোন হাত মুখ ধুয়ে নিল একসাথে। প্রিয়তা গরম করে রাখা ডাল দিয়ে ভাত মাখাল। ছোট ছোট লোকমা তুলে খাইয়ে দিল আরহামকে। শান্ত শীতল কণ্ঠে বললো,

” আর কখনো ও বাড়ি যাবে না তুমি। মনে থাকবে?

আরহাম পিটপিট করে চোখের পাতা এক করলো। বললো,
” বিয়েটা হয়ে গেলে আর যাবো না।

প্রিয়তা রেগে গেল। ধমকে উঠল। ভাতের বাটি শব্দ করে নিচে রাখল। বললো,
” আজ এই মুহূর্ত থেকে ওই ঘরে যাওয়ার কথা ভুলে যাবে একেবারে। যদি ও বাড়ি যাও আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না বলে রাখলাম।

” কিন্তু রাতে যে আনন্দ হবে ছাদে। আমি ঘরে বসে থাকতে পারবো না আপু। মাথা নিচু করে কথাটা বলে উঠল আরহাম।

” শোনো, আজ থেকে আমি ছাড়া তোমার আপন বলতে কেউ নেই। আজ এই মুহুর্ত থেকে আমার আপন বলতে শুধু তুমিই আছো। আমরা বাঁচবো আমাদের নিজের জন্য। তুমি শুধু কাঁদবে আমার জন্য, আমি কান্না করবো তোমার জন্য। অন্য কোনো বাইরের মানুষের জন্য আমরা আমাদের মূল্যবান অশ্রু ফেলবো না। তোমার আমি ছাড়া আর কেউ নেই বুঝেছো? কেউ নেই। জীবনের প্রত্যেকটা পদক্ষেপে আমি তোমার পাশে থাকবো। আর তুমি মিশে থাকবে আমাতে। আমরা একে পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হবো, দরকার হলে কঠিন ও হবো। কোন তৃতীয় ব্যক্তি আমাদেরকে কষ্ট দিতে পারবে না। আমরা কষ্ট দিতে দিবোই না।

সবটা শুনল আরহাম। কিছু কথা হয়তো বোঝেনি ছেলেটা। প্রিয়তা হাতে ভাত তুলে আরো কয়েক লোকমা আরহামের মুখে তুলে দিল। পুনরায় বললো,

” কাল আমরা শপিং করতে যাবো। তোমার জন্য শার্ট কিনবো। ও বাড়িতে যা রান্না হবে তার অল্পবিস্তর হলেও আমি রান্না করে খাওয়াবো তোমাকে। সারাদিন আমরা ঘুরবো, খাবো, আনন্দ করবো। অন্য কারো সাথে আনন্দ করার প্রয়োজন নেই তোমার। ওরা কেউ না তোমার। ক্ষণিকের জন্য এসেছিল, চলে গেছে।

আরহাম একটু খুশি হলো। তারা সারাদিন এই এলাকা ঘুরবে, নতুন জামা কিনবে, ভালো ভালো রান্না হবে। এতকিছু হলে আর কি চাই? ওই বাড়ির মানুষের দেওয়া অপবাদ খুব ভালো করেই বুঝেছে আরহাম। বোনের দুঃখের কারণ কিছুটা হলেও অনুমান করেছে। ওরা পচা লোক। আরহাম মিশবে না ওদের সাথে।

_________________

বিকেলে আরহাম আর প্রিয়তা গভীর ঘুম দিল। ঘুম থেকে উঠে জানালা খুলতেই অন্ধকার দেখল চারপাশ। বুঝতে পারল সন্ধ্যে হয়ে গেছে। প্রিয়তা চটপট উঠে ভাত চরিয়ে দিল চুলায়। ঘরে শুধু আলু আছে। অন্য কোন সবজি না থাকায় প্রিয়তা ভাতের মধ্যে আলু দিল ভর্তা করবে বলে। আরহামকে ডেকে তুলল। ট্রলি ব্যাগে থাকা বর্ণমালার বই রাখল আরহামের সামনে। প্রিয়তার মনে পরল হলুদ রঙের শার্টটার কথা। ছাদে ছড়িয়ে দিয়ে এসেছিল। সন্ধ্যে হয়েছে শার্টটা আনতে হবে। বুকে গামছা জড়িয়ে দরজা খুলতেই প্রহরকে দেখতে পেল প্রিয়তা। অবাক হলো খুব। ইসস্ত ভঙ্গিতে ছাদে উঠতে গেলে পিছন থেকে প্রহর ডেকে উঠল। দাঁড়াবে কি দাঁড়াবে না বুঝতে পারল না প্রিয়তা। তবুও ভদ্রতাসূচক থামল সে। বললো,

” আপনি?

” মা আপনাকে আর আরহামকে যেতে বলেছে। তিয়াশ ভাইয়াকে হলুদ দেওয়া হবে।

প্রিয়তা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। এত কিছুর পর ও এইভাবে তাদের নিমন্ত্রণ করার বিষয়টা বড্ড বেমানান লাগল প্রিয়তার কাছে। নরম হৃদয় কঠিন হলো প্রিয়তার। রূঢ় কণ্ঠে বললো,

” আন্টিকে বলবেন আমরা যেতে ইচ্ছুক নই।

প্রহর আশপাশে তাকাল। এইভাবে কথা এখানে বলার কোনো মানে আছে? কেউ দেখলে কি ভাববে? শান্ত কণ্ঠে প্রহর বলে উঠল,

‘ যা হয়েছে তাতে মায়ের কোন দোষ নেই। ফুপি দু দিন পর চলে যাবে। মা আপনাকে ভালোবাসে। আপনি না গেলে দুঃখ পাবে। সম্পর্কটা নষ্ট হবে।

” আমিও খুব কষ্ট পেয়েছিলাম, যখন আমাকে চোর বলে সম্বোধন করা হয়েছিল। কাঠ কাঠ কণ্ঠে বলে উঠল প্রিয়তা। চোখ সরাল প্রহরের থেকে।

” আরহামকে যেতে দিন।

” আরহাম যদি যেতে চায় তো নিয়ে যান।

প্রহর ডাকল আরহামকে। আরহাম বইটা বন্ধ করে বাইরে এলো। বললো,

” ডেকেছো আমায়?

প্রহর বসে পরল আরহামের সামনে। প্রিয়তার প্রতি সন্দেহ আছে তার। তেমনভাবে ভাবেও না প্রিয়তাকে নিয়ে। কিন্তু আরহাম ছেলেটাকে ভালো লাগে প্রহরের। নিষ্পাপ ছেলেটার প্রতি আলাদা মায়া রয়েছে প্রহরের। আরহামের গালে হাত বুলিয়ে সে বললো,

” তিয়াশ ভাইয়াকে ছাদে হলুদ মাখানো হচ্ছে। যাবে না? আমি নিতে এসেছি তোমায়।

প্রিয়তা বুকে দু হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রথম সিঁড়িতে। প্রহরের কথা শুনে কোন দিকেই তাকাল না আরহাম। মুখ গম্ভীর করে বললো,

” আমি যাবো না।

” প্রিয়তা না করেছে?

” না। ওরা আপুকে বকেছে। আপুকে যারা বকে তাদের সাথে আমার কথা নেই। একদম আড়িইই। তোমার সাথেও কথা নেই যাও।

প্রিয়তা গর্বের হাসি হাসল। সে জানতো আরহাম যেতে চাইবে না। প্রিয়তাকে আরহাম ও খুব ভালোবাসে। প্রিয়তার বিশ্বাস ছিল ভাই তার বিরুদ্ধে যাবে না, সব কথা শুনবে। আরহামের কথা শুনে প্রশান্তি অনুভব করল প্রিয়তা। অনুভব করল আজ থেকে আবার একা হয়ে গেছে তারা। সম্পূর্ণ একা

__________________
কাজের চাপে আবিরের সাথে কথা হচ্ছে না তানিয়ার। যদিও কথা বলার ইচ্ছে নেই, তবে বারবার ফোন করলে ধরা উচিত বলে মনে করে তানিয়া। যার সাথে সারাজীবন থাকতে হবে তার সাথে সুন্দর সম্পর্ক তৈরী করা প্রয়োজন। তানিয়া শুভ্র রঙের কামিজ পড়েছে। গলায় ওড়না পেঁচিয়ে নিয়েছে। চুলগুলোকে ঝুঁটি করে নিয়েছে। অফিস থেকে বের হবে বিধায় পরিপাটি হয়েছে ভালোমতো। নতুন চশমাটাতে গুলুমুলু লাগছে তানিয়াকে। মেয়েদের সৌন্দর্য আসলেই খুব জটিল।

তানিয়া আর ইহান অফিস থেকে বেরিয়ে এলো বাইরে। এখন বাজে সন্ধ্যে সাতটা বেজে নয় মিনিট। ট্যাক্সি ডেকে ইহান আর তানিয়া বসল একসাথে। পুলিশদের জন্য বরাদ্দকৃত জিপেই আসতে পারতো তারা। কিন্তু ইতিশা ম্যামের ব্যাপারটা গোপন রাখতে চাইছে ইহান। পুলিশের সাথে ম্যামের দেখা হচ্ছে এটা গোপন রাখাই ভালো। তানিয়া বসেই ম্যাসেঞ্জারে ঢুকল ততক্ষণাৎ। আবিরের আইডিটা প্রথমেই দেখতে পেল। বেশ কয়েকবার মেসেজ দিয়েছে ছেলেটা। তানিয়া লিখল,

” অফিসের বাইরে আছি। বাড়ি ফিরে আপনাকে ফোন দিচ্ছি।

আবির টেক্সট-টা দেখল। দ্রুত লিখে পাঠাল,
” বাড়ি ফিরে ফোন দাও না তুমি। এক্ষুণি ফোন ধরো।

তানিয়া পুনরায় লিখল,
” আমি একটু ব্যস্ত। আমি দিব ফোন।

এটুকু লিখেই ফোন রেখে দিল তানিয়া। ইহান পাশেই বসে আছে। সাই সাই করে চলছে ট্যাক্সি। তারা এখন যাচ্ছে ইতিশা ম্যামের বাড়িতে। ইতিশা ম্যামের সাথে আজ সামনাসামনি কথা বলবে ইহান। তথ্যগুলোকে জনগনের সামনে আনতে ইতিশা ম্যামের সাথে পুলিশ ফোর্স থাকবে এ বিষয়ে অবগত করতে হবে ম্যামকে, বোঝাতে হবে। তানিয়ার টাইপিং দেখে ইহান স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,

” তোমার বিয়ে কবে তানিয়া?

তানিয়া ভড়কাল। ইহান কখনোই তাকে ব্যক্তিগত কোন প্রশ্ন করে না। কাজের কথা ছাড়া অন্য কোনো কথাই বলে না তানিয়ার সাথে। তানিয়ার মনে হয় তানিয়ার পরিবারে কে কে আছে তাও জানে না ইহান। আজ হুট করে বিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করায় ভিষণ অবাক হলো তানিয়া। ওড়না ঠিক করে বললো,

” সামনের মাসের শেষের দিকে।

ইহান হাসল খানিক। দুরত্ব বজায় রাখল দুজনের মাঝে। বললো,
” বিয়ের পর ও চাকরি করবে?

” এই পেশা আমার ভিষণ শখের। আমি সবসময় চাইতাম পুলিশ হতে। অনেক কষ্ট করে আমি এ জায়গায় এসেছি। আমি এ পেশাটাকে প্রচণ্ড সম্মান করি। এ পেশাটা ছাড়তে পারবো না। ছাড়তে চাই ও না।

ইহান আর কিছু বললো না। আশপাশে নজর বুলাল। নির্দিষ্ট স্থানে এসে চোখের ইশারায় তানিয়াকে নামতে বললো। ভাড়া মিটিয়ে দারোয়ানকে পরিচয় দিয়ে ভিতরে ঢুকল। দু তলায় ওঠে পড়ল দুজন। ইতিশা ম্যামের ঘর চিনে ইহান। বেলকনির পাইপ বেয়ে উঠেছিল একবার। দরজায় কয়েকবার টোকা দিতেই ইতিশা নায়েমা দরজা খুললেন। চিনতে পারলেন না তানিয়া আর ইহানকে। জিজ্ঞেস করলেন,

” আপনারা?

ইহান আশেপাশে তাকাল । নিম্ন স্বরে বললো,
” ম্যাম আমরা পুলিশ ফোর্সে আছি। অফিসার ইহান তালুকদার বলছি। আপনার সাথে আমাদের কিছু কথা আছে।

ইতিশা নায়েমা ঘরে ঢুকতে দিলেন ওদেরকে। বসতে দিলেন চেয়ারে। আকাশি রঙের শাড়ি পরিহিতা ইতিশা নায়েমার ছবি ইহান বইয়ের শেষ পাতার প্রচ্ছদে দেখেছে। আজ এত কাছ থেকে লেখিকাকে দেখে ভিষণ ভালো লাগল ইহানের। বললো,

” ম্যাম আমরা আপনার সম্পর্কে জানি। জাফর আলীর সম্পর্কেও জানি। আমরা এটাও জানি আপনি উনার বিরুদ্ধে লিখতে চান, উনার ষড়যন্ত্র ফাঁস করতে চান। আমরাও এই কেসে ইনভল্ভ্ড্। আমাদের আপনার সাহায্য প্রয়োজন।

ইতিশা নায়েমা অবাক হলেন। এ কথা তিনি গোপন রেখেছেন এতদিন। এর কারণ পুরোপুরি লেখা সম্পন্ন হয়নি উনার। এখনও কয়েক পৃষ্ঠা লেখা বাকি আছে। ছেলে হারানোর শোকে আজকাল লিখতেই ইচ্ছা করে না ইতিশার। সাদা খাতায় ভেসে উঠে ইব্রাহিমের মুখ। অগোছালো লাগে নিজেকে। হাহাকার নেমে আসে হৃদয়ে। বই পুরোটা লেখা শেষ হয়নি বিধায় এখনো কাউকে এ বিষয়ে জানান নি তিনি। এরা কিভাবে জানল এটাই প্রশ্ন। জিজ্ঞেস করলেন,

” তোমরা কিভাবে?

তানিয়া চশমা ঠেলে দিল পেছনে। বললো,

” আমরা সবই জানি ম্যাম। কেন আপনার ছেলেকে কিডন্যাপড করা হয়েছে তা আমরা জানি। জাফর আলীর সম্পর্কে আমরাও জনগনকে জানাতে চাই।

ইতিশা নায়েমা চোখ মুছলেন। বললেন,

” জাফর আলী এক নিম্ন মানসিকতার লোক। ও নিজের স্বার্থে, নিজের ব্যবসায় বড় করার জন্য ভেজাল পণ্য বিক্রয় করে সাধারণ মানুষকে অসুস্থ করে ফেলছে। আমি এ সম্পর্কে সবটা জেনে গিয়েছি, প্রমাণ যোগার করেছি। কিন্তু পুরো বই লেখার আগেই আমার ছেলেকে কিডন্যাপ করা হলো। আমাকে ব্ল্যাকমেইল করা হলো। আমি আর লেখার মনোবল পাচ্ছি না।

তানিয়া বললো,
” কিন্তু ওরা আপনার ক্ষতি না করে ইব্রাহিমকে টার্গেট করলো কেন? আপনার কাছে ওর বিরুদ্ধে সব প্রমাণ আছে। ওরা আপনাকেই তো মেরে ফেলতে পারতো।

ইতিশা নায়েমা হাসলেন। বললেন,
” তুমি কি ভেবেছো ওরা এটা করার চেষ্টা করেনি? আমাকে ফোন দিয়েছিল জাফর আলী। ওর বিরুদ্ধে লেখা থেকে বিরত থাকতে বলেছে। হুমকিও দিয়েছে। ওরা আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করেছিল একবার। আল্লাহ্-এর রহমতে বেঁচে গিয়েছি সেদিন। বুদ্ধি করে ওকে বলেছি “তোমার সব কুকীর্তির প্রমাণ শুধু আমার কাছেই সীমাবদ্ধ নয়। আরো অনেকের কাছেই আমি তোমার মুখোশ তুলে ধরেছি। আমাকে মেরে ফেললে ওরা বুঝে যাবে আমার খুনের জন্য তুমিই দায়ী। এরপর তোমার সব তথ্য ফাঁস করে দিবে ওরা। তাই আমাকে মারলে তোমারই ক্ষতি”। কথাটা বলার পর আর আক্রমণ করা হয়নি আমাকে।

” আসলেই কি আপনি তথ্য অন্যত্র রেখেছেন? বললো ইহান।

” রাখি নি। নিজেকে বাঁচাতে মিথ্যে বলেছি। ওরা ভেবেছে নিজের মৃত্যু নিয়ে যেহেতু ভয় নেই সেহেতু ইব্রাহিমকে ধরে হুমকি দিলে আমি মাথা নত করবো। ছেলে হারানোর শোকে ওদেয সব কথা মানবো। কিন্তু ওদের ভাবনা আমি ভুল প্রমাণিত করেছি। হয়তো আমার ছেলেটাকে মেরে ফেলবে ওরা। কিন্তু তাতেও আমি পিছ পা হবো না। অবশ্য ইব্রাহিমকে মারলে আরেক ক্ষতি হবে ওদের। মিডিয়ার ধাক্কা সামলাতে হবে।

” আপনি আমাদের প্রমাণ গুলো দিতে পারবেন? অবশ্যই আপনার বই প্রকাশ হবার পরে।

” তোমাদের আমি বিশ্বাস করবো কেন? তোমরা যে অনেস্ট, আমি বুঝবো কিভাবে?

” আপনি বোধহয় আমাদের চিনতে পারেননি। আমরা প্রহরের টিমে আছি। আজওয়াদ ইশতিয়াক প্রহর, ইহান তালুকদার অ্যান্ড তানিয়া শেখ একই টিমের মেম্বার। আপনি আমাদের সম্পর্কে রিসার্চ করতে পারেন। বলে উঠল ইহান।

” ইতিশা নায়েমা উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,
” আমি এর আগে অনেক পুলিশের কাছে গিয়েছি। তারা সবাই জাফরের পা চাটা গোলাম ছিল। এজন্য পুলিশের নিকট আর যাইনি আমি। আজওয়াদ আর তোমাদের নাম আমি শুনেছি বহুবার। কাল আমি থাকবো কি না জানি না। এসেছো যখন প্রমাণগুলো পেয়ে যাবে।

তানিয়া খুশি হলো। উঠে ইতিশা নায়েমার হাত মুঠোয় পুরে নিল। বললো,
” আপনাকে দেখে অনেকেই সততা সম্পর্কে জানবে ম্যাম। ছেলের জীবনের কথা না ভেবে আপনি যেইভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ছেন, সত্যিই হ্যাটস অফ ইউ।

_____________________

তানিয়ার হোয়াটসঅ্যাপে কিছু ছবি আর তথ্য এলো। তা দেখে মুচকি হাসল তানিয়া। ইতিশা ম্যাম বই বের করলেই এই তথ্য জনগনের সামনে আনা হবে। অনেকেই বই পড়ে না। সেক্ষেত্রে যারা বই পড়ে না তারা টিভিতেই জাফরের কুকর্ম সম্পর্কে জানতে পারবে। ইতিশা ম্যাম যেহেতু সবটা সংগ্রহ করেছেন সেহেতু তার লেখাই আগে প্রকাশ পাবে।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রশান্তির শ্বাস ফেলল ইহান। এত সহজে ইতিশা ম্যাম তাদের বিশ্বাস করবে ভাবেনি ইহান। যদিও তাদের পরিচিতিই তাদের কাজটা এত সহজ করে দিয়েছে।

ইহান রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফোনে চেক করলো সবটা রিকশা খুঁজতে লাগল। কোন বাহন না দেখে হাঁটতে উদ্যত হলো। ভাবতে লাগল পরবর্তী কার্যক্রম। কেসটা ডিশমিশ করতে পারলে উপরমহল খুব খুশি হবে। ভেবে ভেবে ইহান হাঁটতে লাগল সামনে। তানিয়া চেক করতে করতে পিছু পিছু হাঁটল। হুট করেই তানিয়ার মনে হলো পিছনে কেউ আসছে। পিছু ফিরে জায়গাটা দেখে নিল তানিয়া। কাউকে না দেখে মনের ভুল ভেবে আবার সামনে তাকাল। হুট করেই দুজন ছেলে ইহানের অনেকটা সামনে গিয়ে নিজেদের বাইক পার্ক করলো। একটা রিকশা দেখতে পেল ইহান। রিকশাওয়ালার সাথে কথা বলতে লাগল ভাড়া নিয়ে। কি মনে করে তানিয়া আশপাশে তাকিয়ে ওই দুটো লোকের দিকে তাকাল। লোক দুটোর হাতে পিস্তল দেখে চমকে উঠল তানিয়া। শিরা উপশিরায় ভয় ঝেঁকে বসল। বরফের ন্যায় জমে যাওয়ার উপক্রম। লোকগুলো বন্দুক তাক করলো ইহানের দিকে। তানিয়া অপ্রস্তুত হলো। মাথা কাজ করা বন্ধ হলো তানিয়ার। কি করবে ভেবে পেল না সেই মুহুর্তে। মুখ দি শব্দ বের হলো না তার। বন্দুক থেকে একটা বিকট আওয়াজ বের হলো। গুলির শব্দ শুনে ইহান ওপাশে তাকাতেই তানিয়া ধাক্কা মেরে ইহানকে ফুটপাতে ফেলে দিল। নিজেও সরে যেতে চাইল। কিন্তু গুলিটা লাগল তানিয়ার বাহুতে, সরে আসতে পারল না। কোনরকমে গুলিটা বাহু ঘেঁষে বেরিয়ে গিয়েছে। রক্ত ঝরছে অনবরত। তানিয়া বসে পরল রাস্তায়। ব্যথায় কুকিয়ে উঠল। চিকচিক করে উঠল তানিয়ার চোখের কার্ণিশ। ইহান দ্রুত উঠে তানিয়াকে ধরল। বাইকে থাকা লোকগুলোর দিকে তাকাল ইহান। এ মুহূর্তে তানিয়াকে দেখা বেশি প্রয়োজন বলে মনে হলো ইহানের। তানিয়াকে গিয়ে ধরে বসল সেখানেই। তানিয়ার হাত ধরে বললো,

” এটা কি করলে? আমাকে সরিয়ে নিজে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পরলে? এত মহৎ হতে কে বলেছে তোমায়? কতটা ব্লিডিং হচ্ছে।

তানিয়া চোখ মেলে তাকাতে পারল না। যন্ত্রণায় হাঁসফাঁস করতে লাগল। ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল দু মিনিট পরেই। ইহান বিরক্ত হলো খানিক। বললো,

” তোমাকে পুলিশে জয়েন হতে কে বলেছে স্টুপিড? আমাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেই পটল তুলছো দেখছি। মাথামোটা কোথাকার। এতটুকুতেই অজ্ঞান হতে হয়? চোখ খুলো তানিয়া। স্পিক আপ।

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

প্রিয়তার প্রহর পর্ব-০৬

0

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা ( ৬ )

উপরের ফ্ল্যাটের পুরোটা জুড়ে প্রহরদের বসবাস। তিন তলায় উৎসবের আমেজ, সাজ সাজ রব। বক্সে অনবরত হিন্দি গান বেজে চলেছে। নাচ, গানের আয়োজন ও চলছে নির্দিষ্ট কক্ষে। হৈ হুল্লোরের আওয়াজ নিচ তলাসহ আশপাশের ভবনগুলোতেও পৌছাচ্ছে। প্রিয়তার এসবে আগ্রহ নেই তেমন। যদিও নিধি পই পই করে বলে দিয়েছে সব অনুষ্ঠানে থাকতে হবে তাকে। মিসেস নাবিলাও বলে গিয়েছেন তার আশেপাশে থাকতে। তবুও এত মানুষের সামনে যেতে কেমন উদ্ভট লাগছে প্রিয়তার। আরহামের খুশির শেষ নেই। খুশিতে হয়তো সারারাত ঘুম হয়নি ছেলেটার। ভোর হতেই ছুটে বেরিয়ে গেছে উপরে। সবার মাঝে বসে গল্পের আসর বসিয়েছে। এনগেইজমেন্ট-এর কার্যক্রম হচ্ছে নিতান্তই শখের বশে। চাইলেই মেয়ের বাড়িতে গিয়ে আঙটি পরিয়ে এনগেইজমেন্টের ঝামেলা ক্লোজ করতে পারতো। কিন্তু তা না করে আয়োজন করে প্রোগ্রাম করা হচ্ছে। পিয়াস করিম বলেছেন কোন ত্রুটি থাকা যাবে না তার ভাগ্নের বিয়েতে। ছোট খাটো অনুষ্ঠান গুলোও করতে হবে, সে যতই ঘরোয়া ভাবে হোক। গায়ে হলুদ আর বিয়ের আয়োজন হবে ছাদে। ঘরে এত মানুষের জায়গা হলেও ঘেঁষাঘেষি হবে। দাঁড়ানোর জায়গা হবে না। মেয়ে বাড়ি থেকেও তো লোকজন আসবে হলুদ নিয়ে। ঘরের মাঝে এমন আয়োজন দেখতে ভালো লাগবে না।

প্রিয়তা সকালে উঠেছে আজ। কোচিং আর টিউশন সকালে রেখেছে। বিকেলে উপরের ফ্ল্যাটে থাকতে হবে। পড়ানোর সময় পাবে না। আরহামের এই খুশিটা কোনোভাবেই ভাঙতে চায় না প্রিয়তা। সে গেলে আরহামকে দেখে রাখতে পারবে। কখন কোন দুষ্টুমি করে বলা যায় না।
আজ তরকারি রান্নার ঝামেলা নিল না প্রিয়তা। চাল, ডাল একত্রে মেখে পানি দিয়ে বসিয়ে দিল চুলায়। সাথে ডিম পোজ করে দিবে আরহামকে। যদিও ও বাড়িতে খাবার দেওয়ার মানুষ আছে আরহামের।

টিউশনিতে গিয়ে আজ মনটা খারাপ হলো প্রিয়তার। কুসুমের মা কিছুটা অসুস্থ। আজ গার্মেন্টস-এ যায়নি তিনি। মহিলা ভিষণ ধুর্ত প্রকৃতির। অসুস্থ হলেও বারবার পড়ার জায়গায় এসে খোঁজ নিয়েছেন। সময়ের এক মিনিট আগেও প্রিয়তাকে ছাড়তে চাননি তিনি। প্রিয়তা কুসুমকে ফিন্যান্সের একটি অঙ্ক বুঝিয়ে করতে দিয়েছে। কোয়েল এসে পাশে বসল তখন। জিজ্ঞেস করলো আরহামের কথা। আরহামের কথা বলতে বলতেই বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পর্কে বলে ফেলল প্রিয়তা। আরহাম কেন আজ এত খুশি? কি করছে? এসব বলতে গিয়ে অনুষ্ঠানের বিবরণ দিয়ে দিয়েছে। ও ঘর থেকে সব শুনেছে কুসুমের মা। ততক্ষণাৎ তিনি এসে হাজির হলেন পড়ার ঘরে। কোয়েলকে বকা দিয়ে ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরে গিয়ে মেয়েকে উচ্চস্বরে বললেন,

” মাসে মাসে দুই হাজার টাকা দিমু কি এমনি এমনি নাকি? কিসের এত গল্প? পড়া বাদ দিয়া এমনে প্রত্যেকদিন গল্প করস ম্যাডামের লগে? ম্যাডামেরও দেখি কাণ্ডজ্ঞান নাই। পড়ানো বাদ দিয়া কি আলাপ শুরু করছে। ট্যাকা তো ঠিকই গুইনা নিবো। গল্প করার লাইগা দুই ট্যাকা কম তো নিবো না।

প্রিয়তা ঘরের বাইরে থেকে সবটাই স্পষ্ট শুনেছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রিয়তার কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। নরম সত্তা নিমিষেই দুমড়ে মুচড়ে উঠছে তার। কথাগুলো বারবার ভেসে উঠছে মস্তিষ্কে। বিষণ্ণতায় ছেয়ে যাচ্ছে কোমল হৃদয়। চিকচিক করে উঠছে চোখের কার্ণিশ। নিজের কর্মে নিজে লজ্জিত হলো প্রিয়তা। এভাবে স্টুডেন্টকে বসিয়ে রেখে আসলেই তার গল্প করা উচিত হয়নি। পড়ানোর বিনিময়ে টাকা নিবে সে। এইভাবে গল্প করলে তো মেয়েটার পড়ায় সমস্যা হবে। অপরদিকে মন এসব মানতে নারাজ। বারবার বলে উঠছে “তুই অপমানিত হচ্ছিস, তোকে হেয় করা হচ্ছে। তুই কোন ভুল না করেও দোষী হচ্ছিস। কি এমন হয়েছে মেয়েটার সাথে কথা বলায়? পড়ানো বাদ দিয়ে তো কিছু করিসনি”।

প্রিয়তা বুঝল কুসুম লজ্জা পাচ্ছে। প্রচন্ড পরিমানে লজ্জা পাচ্ছে মেয়েটা। মাথা নিচু করে রয়েছে তার সামনে। মায়ের এমন কথাবার্তায় মেয়েটা কাঁচুমাচু হয়ে আছে। প্রিয়তার সামনে মায়ের মুখে এমন কথা বোধহয় আশা করেনি মেয়েটা। প্রিয়তা কুসুমকে স্বাভাবিক করতে হাসল। পড়াতে ব্যস্ত হয়ে গেল। এমন ভাব ধরলো যেন সে কিছু শোনেইনি। কিন্তু হৃদয়ে যে তোলপাড় শুরু হয়েছে তা কি কেউ জানল? বুঝল সে ব্যথা?

এরপর এক মিনিট ও পড়ার বাইরের কোন কথা বলেনি প্রিয়তা। নির্দিষ্ট সময়ের কয়েক মিনিট বেশিই পড়িয়ে দিল। বেরিয়ে আসার আগে কুসুমের মা প্রিয়তার পাশে এসে বসলেন। একটু হেসে বললেন,

” আপনে তো কুসুম রে পড়ান। আমার ছোট মাইয়ারে একটু দেইখেন তো। ও সবই পারে। অঙ্ক আর ইংরেজি পারে না। যোগ বিয়োগে ভুল করে। ইংরেজি লেখতে পারে না। কুসুমরে পড়া দেখাইয়া বইসা না থাইকা ওরেও কিছু বুঝাইয়া দিয়েন। এক লগে দুই জনেরই পড়া হইয়া যাইবো।

প্রিয়তা হেসে সম্মতি জানাল ভদ্রতার সাথে। পড়ানোর কথা ছিল শুধু কুসুমকে। কোয়েলকে পড়ানোর কথা আগে বলা হয়নি। কোয়েলকে পড়ালে কি বেতন বাড়িয়ে দিবে? প্রশ্ন জমলো প্রিয়তার মনে। প্রত্যেকটা মানুষই সুযোগ সন্ধানী। সুযোগ পেলে সেই সুযোগের সৎ ব্যবহার করতে চায় সবাই। প্রিয়তাও তার ব্যতিক্রম নয়। তার মন বলে উঠল বেতন বাড়িয়ে দেওয়া হবে কিনা জানতে। কিন্তু স্বভাব বশত মুখ ফুটে উচ্চারণ করতে পারল না বেতনের কথা। ব্যাগ গুছিয়ে চলে এলো বাইরে। দুদিন ধরে ভার্সিটিতে যাচ্ছে না। তন্ময়ের সাথে দেখা হচ্ছে কোচিং শেষে। ছেলেটা সবসময় প্রিয়তার জন্য চিন্তা করে। হাত খরচের টাকা দিতে চায়। প্রিয়তা নেয় না। ছেলেটা নিজেই মেসে থাকে। বাবা-মায়ের দেওয়া টাকায় চলতে হিমশিম খায়।

মাথার ব্যথাটা ক্ষণে ক্ষণে বেড়ে যায় প্রিয়তার। জ্বলে ওঠে শিরা উপশিরা। অস্থির অস্থির লাগে। হুট করেই রাগ কেমন বেড়ে যায়। ক্লান্তিতে চোখ বুজে যায়। আবার হুট করেই কান্না দলা পাকিয়ে যায় গলায়। এমন কেন হচ্ছে জানা নেই প্রিয়তার। নতুন নতুন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে অনেক। কোন গার্ডিয়ানের কাছ থেকে এমন কথা শুনতে হবে কখনো ভাবেনি সে। এটা ছিল প্রিয়তার টিউশনির এক নতুন অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা হয়তো প্রায় টিউশনি করা মানুষরাই পেয়ে থাকে। তাদের কাছে এইসব স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রিয়তা একটু ভালবাসা চায়, যত্ন চায়, ভরসা করার মানুষ চায়। চায় পাশে থাকার মানুষ।

আজ প্রিয়তা ঘরে ফিরল দুপুরের পর পর। কোচিংয়ে আজ কম শিক্ষার্থী এসেছিল। এ দুদিন সকাল সকাল পড়িয়ে দিবে বলে জানিয়েছে সবাইকে।

প্রিয়তা ঘরে প্রবেশ করে হাত ঘড়িটা রাখল তোষকের উপরে। আরহামকে এসে বাড়িতেই পেল। কিছু একটা খুঁজছে আরহাম। প্রিয়তা গা থেকে ওড়না সরিয়ে যান্ত্রিক পাখার নিচে বসল কিছুক্ষণ। ফ্যানটা কেনার সময় দরদাম করেছে তন্ময়। এগুলো কিনতে গিয়েই প্রিয়তার টাকা শেষ। কিছু কিনবো না কিনবো না করেও বাজারে গেলে নৈমিত্তিক অনেক কিছুই কিনতে হয়। দেখা যায় দৈনন্দিন জীবনে অনেক কিছুর প্রয়োজন হয় আমাদের। না কিনলেও গরমে বাঁচা যাচ্ছে না। কয়েকদিন পরেই শীতকাল। তখন বিদ্যুত বিল আসবে না, ফ্যানের প্রয়োজন হবে না। কিন্তু গরমের সময়ে এই যান্ত্রিক পাখা একমাত্র ভরসা

” কি খুঁজছো আরহাম? শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো প্রিয়তা।

আরহাম আড়চোখে চাইল প্রিয়তার দিকে। ছেলেটা যে দৌড়াদৌড়ি করেছে বুঝতে পারল প্রিয়তা। ফোলা গালগুলো কেমন লাল হয়ে আছে। ললাটে দেখা যাচ্ছে ঘামের চিহ্ন। প্রিয়তাকে দেখে হাসল আরহাম। বললো,

“কোন শার্ট পড়বো আপু? আমাকে ভালো লাগবে কোনটায়?

হাসল প্রিয়তা। কাছে টেন নিল ছোট্ট শরীরটাকে। গালে গাল ঘষে দিল। চুলে হাত বুলিয়ে দিল যত্ন নিয়ে। ছেলেটাকে এত সুন্দর লাগে প্রিয়তার। মন চায় সর্বক্ষণ জড়িয়ে ধরে বসে থাকতে। আরহামের গাল আলতো করে ছুঁয়ে প্রিয়তা বললো,

” তোমাকে সবকিছুতেই মানায় ভাই। যেটা ইচ্ছে পড়ে নাও।

” বিয়েতে কি পড়বো? তুমি কিন্তু নতুন শার্ট কিনে দিবে বলেছো।

” দিবো তো।

” রাতে তিয়াশ ভাইয়াকে হলুদ মাখাবে। সবাই হলুদ জামা পড়বে। আমার তো হলুদ শার্ট নাই। একটা ছিল, ওটায় তো ময়লা লেগেছে।

” আমি ধুয়ে দিবো। ওটাই পরবে। তন্ময় ভাইয়া তোমার জন্মদিনে বাদামি রঙের যে শার্টটা দিয়েছিল ওটা পরে নাও এখন।

আরহাম খুশি হলো। রশি থেকে টেনে বাদামি রঙের শার্টটা হাতে নিল। প্রিয়তার কাছে নিয়ে এলো শার্টটা। প্রিয়তা আগে পড়তে বসলেই আরহামকে এটা ওটা পড়াতো। এই বয়সেই ছেলেটা অনেকগুলো ছড়া শিখে ফেলেছে, যোগ বিয়োগ করতে পারে, এক থেকে বিশ অবধি কথায় লিখতে পারে। রঙ সম্পর্কে ও ধারণা আছে আরহামের। কথাবার্তা বলে স্পষ্ট। সামনে মাসেই আরহামকে ভর্তি করতে হবে স্কুলে। টিউটর হিসেবে প্রিয়তা তো আছেই।

কয়েকমাস আগে আরহামের জন্মদিনে তন্ময়ের দেওয়া বাদামি রঙের শার্টটা পড়িয়ে দিল প্রিয়তা। বোতাম ঠিকঠাক ভাবে লাগিয়ে বললো,

” ওখানে গিয়ে একদম দুষ্টুমি করবে না বুঝলে? তিয়াশ ভাইয়ার বউ আসলে আমাকে জানাবে।

আরহাম শুনল সব। প্রিয়তা আরহামের চুল আচরে দিল। নতুন জুতো বের করে দিল। হাতে লাইট জ্বলে ওঠা ছোটদের ঘড়ি পরিয়ে দিল। আরহাম চলে যেতেই হলুদ শার্টটা ধুয়ে দিলো প্রিয়তা।

____
টকটকে লাল রঙের একটা থ্রিপিস পড়েছে প্রিয়তা। হাতে ঝলমলে লাল রঙের রেশমি চুরি। চোখের পাতায় চিকন আইলাইনার নিল। ললাটে জায়গা করে নেওয়া ভ্রূ অবধি চুলগুলো আঁচড়ে নিল প্রিয়তা। লাল রঙে ফর্সা মুখ আরো উজ্জল লাগছে। ঠোঁটে লিপবাম নিয়ে বাড়ির জুতোই পড়ল প্রিয়তা। ধীর পায়ে তিন তলায় গেল। ঘরে ঢুকে নিধির পাশে গিয়ে বসল। আশপাশে তাকিয়ে প্রহরকে দেখতে পেল না প্রিয়তা। তবে সামনের মানুষটাকে দেখে শ্বাসরুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরী হলো। সাহিল ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। গতকাল ওই কথা বলার পর এক দৌড়ে এখান থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। না জানি লোকটা কত রেগে আছে।

সাহিল প্রিয়তার পাশের চেয়ারে এসে বসল। পাঞ্জাবীর হাতা গুটিয়ে বাঁকা হাসল। বললো,

” কাল তুমি আমায় কি বলছিলে? আমি যেন কী?

প্রিয়তা বিরক্ত হলো কিছুটা। কালকে কি বলেছে সেটাও মনে রাখতে হবে? এমন উদ্ভট কথা বললে যে কেউ পাগল বলবে একে। প্রিয়তা তো ভুল কিছু বলে নি। শুধু শুধু লোকটা ঝগড়া করতে এসেছে। প্রিয়তার বিরক্তি প্রকাশ পেল না তার অঙ্গভঙ্গিতে। একটু হেসে সে বললো,

” আমি? আপনাকে? কখন, কোথায়? কবে,কাকে, কিভাবে? আমি আপনাকে চিনি নাকি?

প্রিয়তার অভিব্যক্তিতে ভ্যাবাচ্যাকা খেল সাহিল। মনে মনে হাসল প্রিয়তা। লোকটা রসিকতা করে বেশি। হাসিখুশি থাকতে ভালোবাসে বোধহয়। প্রিয়তার এমন কথায় সাহিল যে হতভম্ব হয়েছে তা তার অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছে। প্রিয়তা নজর সরিয়ে আশপাশে তাকাল। পালিয়ে যাওয়ার কৌশল খুঁজল। চোখ বড় বড় করে সাহিল বললো,

” তুমি দেখছি বেশ পাঁজি আছো। এমন ভাব করছো যেন আমাকে চিনোই না।

” চিনি বুঝি?

” আমি একজন আর্টিস্ট। অত হেলাফেলা করো না।

খুব গর্বের সাথে পাঞ্জাবী হাতা গুটিয়ে কথাটা বললো সাহিল। ভেংচি কেটে চুল ঠিক করল। প্রিয়তা থমকাল। একজন আর্টিস্টের হাবভাব এমন হয়? সেধে সেধে ঝগড়া করতে আসে? প্রিয়তার ভালো লাগে এই পেশাটা। জিজ্ঞেস করলো,

” কি আর্ট করেন আপনি?

” পোর্ট্রেট।

” আমার একটা ছবি এঁকে দিবেন?

” দিবো। যদি তুমি আমাকে হ্যান্ডসাম বলে সম্বোধন করো।

” দুঃখিত ভাইয়া। আমি মিথ্যে বলতে পারি না।

কথাটুকু বলে বাক্য ব্যয় করলো না প্রিয়তা। নিধিকে ডেকে তার সাথেই চলে গেল ভিতরে। যাওয়ার সময় বলে উঠল ” মানুষের সৌন্দর্য তার ব্যক্তিত্বে লুকিয়ে থাকে। আপনার মতো ঝগড়াইট্টা মানুষের হওয়া উচিত পাগলাগারদের হেড অফিসার”। সাহিল করুণ চোখে থাকিয়ে রইল। ভার্সিটিতে কত মেয়ে তাকে প্রপোজ করে। আর এই মেয়ে বলে কি না সে সুদর্শন নয়? এত বড় মিথ্যে বলে বলছে মিথ্যা বলে না?

তিয়াশকে প্রথম খেয়ালে আসল প্রিয়তার। প্রহরের বংশের ছেলেরা অধিক সুন্দর। সকলের মাঝেই মাধুর্যতা আছে। তিয়াশ ভাইয়া সবার চেয়ে চিকন হলেও অতিরিক্ত ফর্সা। তিয়াশ ভাইয়ার হবু বউ আঁখি মেয়েটাও সুন্দর। গোলাপী রঙের লেহেঙ্গা পড়েছে মেয়েটা। সুন্দর ভাবে সেজেছে। তিয়াশ ভাইয়া আর আঁখি কে মানিয়েছে একসাথে। আরহাম ফোন নিয়ে ওদের গেছে ছবি তোলার জন্য। প্রিয়তা বসে রইল দিশা আর নিধির সাথে। টুকটাক কথাবার্তা বলতে লাগল। সকলেই প্রিয়তার সৌন্দর্যের প্রশংসা করল। প্রহর আর তিয়াশ ভাইয়া কোথায় যেন গিয়েছে। সে এলেই আংটি পড়ানো হবে। ততক্ষণে সবাই ছবি তুলছে অনবরত। গায়ে হলুদের প্ল্যান করতে লাগল। নিধির ঘরে তখন একটা মেয়ে আসলো। মেয়েটা আঁখির বড় বোন মিথিলা। এসেই টুকটাক খোশগল্প করলো সবার সাথে। অতঃপর নিধির পাশে এসে বসল মেয়েটা। হাসিখুশি মুখে বললো,

” আংটি পড়াতে তো এখনো দেরি আছে। আমায় একটু দেখাও না আংটিটা। আন্টিকে বলে এসেছি চিন্তা নেই।

নিধি উঠে দাঁড়াল প্রিয়তার পাশ থেকে। পড়ার টেবিলে থাকা ঝুরি থেকে ওয়ারড্রবের চাবি বের করল। ওয়াড্রবের লকার খুলে আংটিটা বের করতে গিয়ে ভীতিগ্রস্থ হলো নিধি। চোখমুখে থাকা হাসি গায়েব হয়ে গেল মুহুর্তেই। এদিক ওদিক খুঁজতে লাগল আংটির বক্স। কোথাও আংটি নেই। গতকাল রাতেও আংটি বের করে সবাইকে দেখিয়েছে সে। এখানেই রেখেছিল দেখানোর পর। কোথায় যাবে আংটিটা? নিধির স্পষ্ট মনে আছে আংটিটা এখানে রেখেছিল।

নিধি জামাকাপড় সরিয়ে ওয়ারড্রবের তাক গুলো খুঁজল। কোথাও হীরের আংটির অস্তিত্ব নেই। নিধির দুশ্চিন্তা বাড়ল। দ্রুত মিসেস নাবিলার কাছে ছুটল। খানিকক্ষণ বাদে মিসেস নাবিলাও হন্তদন্ত হয়ে নিধির ঘরে এলেন। তোষক সরিয়ে, সুকেস ঘেঁটে আংটি খুঁজতে লাগলেন। আঁখির বোন আঁখির চেয়ে অনেকটাই বড়। অধিক স্বাস্থ্যের অধিকারি বলে আঁখির মায়ের বয়সী লাগে মেয়েটাকে। পান খেয়ে দাঁত কেমন লাল করে ফেলেছে মেয়েটা। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আংটি পাওয়া গেল না। তিয়াশের মা সাবিনা বেগম ঘরে এলেন। হা হুতাশ শুরু করে দিলেন। সেইসময় আঁখির বোন মুখ খুললো। বললো,

” আর পাইবেন না মাওয়ই। চুরি হইছে। বাড়ি ভরা মানুষ। একটু ভালো কইরা রাখবেন না?

মিসেস নাবিলা ঘামতে লাগলেন। পিয়াস করিম জানলে খুব রাগারাগি করবেন। আংটিটা অনেক দামী। একটু পরেই আংটি পড়ানো হবে ছেলেমেয়েকে। এখন যদি জানা যায় মেয়ের জন্য কেনা আংটি হারিয়ে গেছে, তাহলে নির্ঘাত আলোচনার মুখোমুখি হতে হবে।

মিসেস নাবিলা বললেন,

” হারাবে কেন? ঘরেই আছে। কে চুরি করবে?

” সবাই বাড়ির মানুষ তো? দেখেন ভাড়াটিয়া, প্রতিবেশী আসছে নাকি।

নিধির কাজিন তানিশা মেয়েটা ঘরে ঢুকল আরহামের সাথে। বললো,

” ভাড়াটিয়া বলতে শুধু প্রিয়তা আপু আর আরহামই এসেছে। ওরা চুরি করার মানুষ নয়। আন্টি তো না জেনেশুনে দাওয়াত দেয়নি। ঘরেই আছে। ভালো করে দেখো।

প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে ফেলল মিথিলার কথা শুনে। এ ধরনের কথা বলার মানে কি? ঘরের মানুষ চুরি করবে না, তার মানে বাইরের মানুষ চুরি করেছে? এ বাড়িতে ওরা ছাড়া আর কেউই বাইরের নয়। কোনভাবে দোষ চাপাতে চাইছে ওদের উপর? প্রিয়তা আরহামকে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। সাবিনা বেগম মেকি সুরে কাঁদতে লাগলেন। বললেন,

” তোমারে কইছিলাম ভাবি। কইছিলাম সব অনুষ্ঠান ছাদেই করো। ঘরের ভিতর অনুষ্ঠান করলে চোর বাইড়া যায়। আমার মামাতো বইনের বিয়ার দিন ঘর থিকা ফোন হারাইছিল। বাটি চালান দেওয়নের পর দেখছে পাশের বাড়ির এক মহিলা চুরি করছে। এহন এই বাড়িতে আমরা আত্মীয়রা ছাড়া বাইরের মানুষ কইতে গেলে এরাই আছে। চাপ দেও ভাবি কইয়া দিবো। নাইলে আমি বাটি চালান দিমু।

প্রিয়তা বাকশক্তি হারাল। এতক্ষণ সরাসরি তাদেরকে চোর বলা হয়নি বলে চুপ ছিল প্রিয়তা। কিন্তু এখন সরাসরি চোর অপবাদ দেওয়ায় মুর্ছা গেল সে। হাস্যজ্জল মুখ অন্ধকারে ঢেকে গেল। প্রিয়তার নিজেকে নির্জীব বলে মনে হলো। যেন কোন কষ্ট নেই, কোন আনন্দ নেই। এক মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল প্রিয়তা। টপ করে চোখের পানি মেঝেতে পরল। বললো,

” আমি বা আমার ভাই আংটি নেইনি। আমরা আংটিটা দেখিওনি। প্রমাণ ছাড়া এইভাবে বলবেন না আন্টি।

সাবিনা বেগম ক্ষেপে গেলেন। বললেন,
” মুখ দেইখাই কইয়া দিতে পারি কে কেমন। তোমার বাপ-মা নাকি বিদেশে। এই কাজ কইরা বেড়ায় দেইখাই বাপ-মা থুইয়া গেছে। নাইলে বাপ-মায় থাকে বিদেশ। ছোড ভাই নিয়া এইখানে থাকবো ক্যান?

মিসেস নাবিলা থামতে বললেন সাবিনা বেগমকে। কোনভাবেএ থামলেন না তিনি। পাত্তা দিলেন না কারো কথায়। বললেন,
” এই পোলাডা সারাদিন এই ঘর ওই ঘর করছে। দেইখো এই-ই নিছে।

প্রিয়তার মাথায় আকাশ ভাঙল। এত বড় অপবাদ কি করে কেউ প্রমাণ ছাড়া দিতে পারে? আরহাম এইসব চুরিটুরি করার ছেলেই নয়। সবার সামনে এইভাবে ছেলেটাকে মিথ্যা কিভাবে অপবাদ দিচ্ছে এরা? প্রিয়তা কেঁদে দিল নিঃশব্দে। সবসময় তার সাথেই এমন হচ্ছে। একের পর এক এমন সব ঘটনা ঘটছে যে বারবার ভেঙে যাচ্ছে প্রিয়তার হৃদয়। ভাইয়ের হাসি মুখটা দেখার জন্যেই এই অনুষ্ঠানে এসেছিল প্রিয়তা। সবকিছুতেই ব্যর্থ হচ্ছে প্রিয়তা, হেরে যাচ্ছে বারবার। সমাজের মানুষ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে তাদের বাবা-মা নেই। জীবনের আনন্দ গুলো এত ক্ষণিকের জন্য আসে কেন? আসার সাথে সাথেই আবার চলে যায় কেন? প্রিয়তা তো ভাইকে একটু সুখী দেখতে চেয়েছে, একটু ভালো থাকতে দেখতে চেয়েছে। তার ইচ্ছে গুলো এভাবে অপূর্ণ রয়ে যাচ্ছে কেন? বাইরের মানুষ বলে এইভাবে ওদের অপমান করবে কখনো ভাবেনি প্রিয়তা। হৃদয়ে এক অদ্ভুত ব্যথা অনুভব করলো সে। হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। নিজের জীবনকে নিয়ে আফসোস হচ্ছে। আরহাম ইতিমধ্যে কেঁদে ফেলেছে। প্রিয়তার ওড়নার এক অংশ ধরে ছেলেটা বললো,

” আমি কিচ্ছু ধরিনি আপু। তুমি বলেছিলে কিছু না ধরতে। আমি কিচ্ছু ধরি নি। আমি আংটি দেখিও নাই আপু।

প্রিয়তা ঠোঁট চেপে ধরে কান্না আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো। আরহামের হাত শক্ত করে ধরে বললো,

” আমার ভাই সোনা কোনটা আর সিটিগোল্ড কোনটা জানে না। হীরে আর পাথরের পার্থক্য বোঝে না। ও কেন আংটি নিবে। আরহাম এমন ছেলে নয়।

সাবিনা বেগম বললেন,

” ও না নিলে তুমি নিছো। চুরি করার মতো আর তো কেউ নাই এই বাড়ি। ভালোয় ভালোয় আংটি দাও। একটু পরেই আংটি বদল হইবো। আমার ভাইয়ের পোলায় কিন্তু পুলিশ।

প্রিয়তা বসে পরল মেঝেতে। আরহামকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। গাল বেয়ে তপ্ত নোনা পানি গড়াল অনবরত। চুপচুপে ভিজে গেল দুজনের গাল। প্রিয়তার নাকের পাটা লাল হলো। চোখ লাল হয়ে উঠল। মিসেস নাবিলার উদ্দেশ্যে জড়তা নিয়ে বললো,
” আমরা চোর নই আন্টি। এত বড় মিথ্যা অপবাদ দিবেন না। আমার ভাই এসব করতেই পারে না। নিষ্পাপ ছেলেটাকে নিয়ে এমন অপবাদ রটাবেন না প্লিজ। আমাকে কি আপনার এতটা খারাপ মনে হয় আন্টি? আমরা এমন নই।

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

প্রিয়তার প্রহর পর্ব-০৫

0

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা (৫)

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আরহাম। আতঙ্কিত হয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে। হুট করে এতকিছু হয়ে যাবে কেউই ভাবেনি। প্রিয়তার এমন অবস্থা আরহামকে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলেছে।

প্রিয়তাকে ঘরে শুইয়ে দিয়ে ডাক্তারকে ডেকেছে প্রহর। কপাল কেটে রক্ত বেরিয়েছে কিছুটা। পা মনে হয় মচকে গেছে। গড়িয়ে পরে যাওয়ার কারণে ব্যথা কম পায়নি তা
বুঝেছে প্রহর। নিধি আর মিসেস নাবিলাকে ডেকে এনেছে প্রিয়তার ঘরে। দুজন দুশ্চিন্তায় হাঁসফাঁস করছে। কয়েকদিন হলো এসেছে। এর মধ্যে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে। এভাবে চললে ছোট্ট আরহামের কি হবে?

ডাক্তার আসল আধঘন্টা পরে। তুলোতে ঔষধ দিয়ে কপালের আশপাশ পরিষ্কার করে দিল। ক্ষত বেশি হলে ব্যান্ডেজ করতে হতো, কিন্তু ক্ষত অত বড় নয় বলে ওয়ানটাইম লাগিয়ে দিল। সাথে দিল চার রকমের বড় বড় ঔষধ। ঔষধের মূল্য পরিশোধ করলো প্রহর। আরহামের কথায় প্রিয়তার কষ্ট পাওয়ার ব্যাপারটা নজর এড়ায়নি তার। সামান্য এই কথায় এত কষ্ট পাওয়ার কি আছে? নাকি সবই ভনিতা? অসহায়ত্বের প্রমান?

প্রিয়তার জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ হলো। চোখ এমনিতেই বন্ধ করে রেখেছিল সে। কেন যেন চোখ খুলতেও প্রচণ্ড অলসতা অনুভব করছিল। চোখ খুলে ঘর ভরতি মানুষ দেখে অবাক হলো প্রিয়তা। পাশের রুমের বয়স্ক আঙ্কেল আন্টি, নিচের ফ্ল্যাটের ভাই-ভাবি, মিসেস নাবিলা সহ অনেকেই উপস্থিত প্রিয়তার ঘরে। সকলের চোখে মুখে চিন্তার রেশ। সকলের সাথে তেমন পরিচয় নেই প্রিয়তার, কথাও হয়নি অনেকের সাথেই। তবুও সবার আগমনে মুচকি হেসে ফেলল প্রিয়তা। মিসেস নাবিলা এগিয়ে এলেন প্রিয়তার কাছে। খাট নেই বিধায় প্রিয়তার পাশে তোষকের উপরেই বসে পড়লেন। প্রিয়তাকে একটু ভালো দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

” এখন ঠিক আছো? কিভাবে পড়লে বলো তো?

এতটুকু মায়া মিশ্রিত কন্ঠে কেঁপে উঠল প্রিয়তা। আহ্লাদে গলে যেতে ইচ্ছে হলো। না বলা কথা বলতে ইচ্ছে হলো। প্রিয়তার ঠোঁট ভেঙে কান্না পেল তখনই। আজকাল তার যেন কি হয়েছে। কথায় কথায় ভ্যা ভ্যাঁ করে কান্না করতে ইচ্ছে করে। কেউ বকলে কাঁদতে ইচ্ছে করে আবার কেউ ভালোবাসলেও কাঁদতে ইচ্ছে করে। এত চোখের পানি কবে থেকে হলো প্রিয়তার? কই আগে তো এত দুর্বল ছিল না সে? কেন এত কষ্টের প্রভাব তার হৃদয়ের অলিগলিতে মিশে গেল। এইযে নাবিলা আন্টি এগিয়ে এলো, এইযে একটু দরদ আর সহানুভূতি দেখাল, এতেই প্রিয়তার কান্না পাচ্ছে। সমস্ত ভালোবাসা উগরে দিতে মন চাইছে। এই বেহায়া মনকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে প্রিয়তা।

” ঠিক আছি আন্টি।

” দেখেশুনে চলবে না? কত বড় বিপদ হতে পারতো জানো? প্রহর যদি ঠিক সময়ে না দেখতো কি হতো?

” প্রহর?

” হ্যাঁ প্রহর-ই তো আমাদের ডেকে এনেছে। ডাক্তার নিয়ে এসেছে।

” প্রহর কে আন্টি?

” আমার ছেলে প্রহর। পরিচিত হওনি ওর সাথে? একসাথে এলে নামটাও জানলে না?

” আপনার ছেলে তো আজওয়াদ। আজওয়াদ ভাইয়া। আপনার আরো ছেলে আছে?

” হায়রে! আমার একটাই ছেলে। আজওয়াদ আমার ছেলের ভালো নাম। ডাক নাম প্রহর। কর্মক্ষেত্রে সবাই আজওয়াদ বলে ডাকে। আর চেনা সবাই প্রহর বলে।

” ওওউ

” আজকে আর রান্নাবান্না করতে হবে না তোমাকে। আরহাম আর তুমি আমার ঘরেই খাবে।

প্রিয়তা হাসল। সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে প্রহর। ছেলেটার মুখে গম্ভীরতা বিদ্যমান। অন্যদিকে তাকিয়ে আছে সে। আরো সকলেই প্রিয়তার সাথে টুকটাক গল্প করতে ব্যস্ত হলো। সকলের সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগল প্রিয়তার। সবাইকে খুব আপন বলে মনে হলো। সাথে দীর্ঘশ্বাস ও ফেলল প্রিয়তা। জীবনটা কেমন অন্যরকম। এই আনন্দ, এই কান্না।

___________________

ল্যাপটপে কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে দেয়া হয়েছে তানিয়াকে। বিছানায় পা তুলে বসে সেইসব সংগ্রহ করতে ব্যস্ত হয়ে আছে সে। টাইপিং এর খটখট শব্দই শোনা যাচ্ছে অবিরত। সাথে ঝিনঝিন করে বেজে উঠছে তানিয়ার হলদে রেশমি চুড়ি। তানিয়ার সামনেই আধ শোয়া অবস্থায় বসে আছে ইহান। সেও তানিয়াকে তথ্য পেতে সহায়তা করছে। তানিয়া একটু পর পর ঠোঁট নারাচ্ছে, গালে হাত দিয়ে ভাবছে, ঠোঁট কামড়ে চিন্তার অবসান ঘটাচ্ছে। ইহান সবটাই পর্যবেক্ষণ করলো। ঘড়িতে সময় দেখে নিল। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর নিঃশব্দে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল ইহান। তানিয়া চোখ তুলে দেখেও কিছু বললো না। ইহান ঘরে ফিরলো পাক্কা বিশ মিনিট পর। তার হাতে লাল রঙের ছোট বাটি। তানিয়ার সামনে বাটিটা রাখল ইহান। বাটির মধ্যে কাঁটা চামচ রয়েছে। তানিয়া তাকিয়ে দেখল না সেসব। কাজে মশগুল হয়ে আছে বিধায় ইহানকেও খেয়াল করলো না। ইহান আবার আগের জায়গায় বসল। বললো,

” খেয়ে নাও। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার আমার বাসায় এলে।

” প্রথম বার তো নয় স্যার। মুচকি হেসে ল্যাপটপে খটখট আওয়াজ করতে করতে কথাটা বললো তানিয়া।

ইহান চোখ ছোট ছোট করে ফেলল। তানিয়া এইবার ঠিকমতো তাকাল ইহানের দিকে। লোকটাকে আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। মাঝে মাঝে তানিয়ার মনে হয় ইহান মানুষটা পৃথিবীর অন্যতম সৌন্দর্যের প্রতীক। হাফ হাতার জলপাই রঙের গেঞ্জিটাতে অমায়িক লাগছে তাকে। নরম, শান্ত মনে হচ্ছে। অথচ এই লোকটা কতটা গম্ভীর, কতটা বদমেজাজি তা তার সাথে না মিশলে বোঝাই যাবে না। তানিয়ার এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। ইহানকে কেমন অপরিচিত বলে মনে হচ্ছে। অসস্তি নিয়ে সে বলে উঠল,

” খাবো না স্যার। আমি খেয়েই এসেছি।

” আমি নিজে বানিয়ে এনেছি। টেস্ট করে দেখো।

এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে কি অজুহাত দেওয়া উচিত তা বুঝতে পারল না তানিয়া। বাটি থেকে চামচ তুলে চামচের সাথে নুডুলস পেঁচিয়ে মুখে তুলে নিল। নিঃসন্দেহে ইহান স্যারের রান্নার হাত ভালো। বরাবর নিজের রান্না নিজেই করে ইহান। ঘরবাড়ি গুছিয়ে রাখার কাজটাও নিজেই করে। চাইলেই বাড়িতে কাজের লোক রাখতে পারতো ইহান। কিন্তু ভিন্ন চিন্তাভাবনার কারণে এসবে আগ্রহী নয় সে। নিজের সব কাজ নিজেই করতে পছন্দ করে লোকটা।

তানিয়া খেতে আরম্ভ করলো। কিছুটা নুডুলস খাওয়ার পর ইহান বলে উঠলো,

” পুরোটা খেয়ো না। আমার জন্যেও রেখো।

লজ্জা অসস্তি সব দলা পাকিয়ে গেল তানিয়ার। এতটা লজ্জার মুখে পরতে হবে কখনো ভাবেনি মেয়েটা। ভদ্রতা দেখিয়ে সে নিজেই অনেকটা নুডুলস রেখে দিতো। এই ভাবে বলার কি দরকার স্যারের? সে কি সবসময় খাই খাই করে? নাকি সে খেতে চেয়েছে নিজে খেতে? নিজেই বানিয়ে আনলো, আবার কথাও নিজেই শোনাচ্ছে? লজ্জায় জুবুথুবু হয়ে বসে রইল তানিয়া। ঘন কালো চুলের উপর বিরক্তি দেখিয়ে হাত খোপা করে নিল। দ্রুত অফিশিয়াল কাজগুলো করতে লাগল। সম্পূর্ণ কাজ শেষ হতেই বলে উঠলো,

” আমি বাড়ি যাবো।

” আটকে রেখেছি আমি? যাও

তানিয়া চশমা ঠিক করলো। ব্যাগে কাগজপত্র নিয়ে নিল। বেরিয়ে যেতে উদ্যত হতেই দেখল ইহান ও তার সাথেই বের হচ্ছে। ইহান এগিয়ে এলো তানিয়ার পিছু পিছু। সদর দরজার সামনে এলে তানিয়াকে দাঁড় করিয়ে স্ট্যান্ড এ গেল। ওখান থেকে অটো এনে ভাড়া মিটিয়ে তানিয়াকে উঠিয়ে দিল খুব দায়িত্বের সাথে। সবটাই ইহান করলো গাম্ভীর্য বজায় রেখে। তানিয়ার সাথে বাকি আর কথা হলো না। তানিয়া অটোতে উঠে ভদ্রতাসূচক বললো,

” যাই স্যার।

ইহান গাঢ় চোখে তাকিয়ে রইল। দু হাত পকেটে রেখে একধ্যানে তাকিয়ে রইল কয়েকপল। অতঃপর একটু হেসে বললো,

” যাই না, বলো আসি।

তানিয়া চলে গেল। কিছুদূর যেতেই মাথা বের করে পিছু ফিরে ইহানকে দেখল। ইহান যতক্ষণ অটোটাকে দেখা যায় ততক্ষণ দেখেই গেল। আচানক বক্ষপিঞ্জরে কেমন তিক্ততা তৈরী হলো। অনেক কথা বলতে ইচ্ছে হলো। অনেক ভাবনা ভাবতে ইচ্ছে হলো। দ্বিধার এই শহরে দ্বিধাহীন হতে ইচ্ছে করলো। আকাশের পানে চাইল ইহান। মুচকি হেসে গুনগুনিয়ে শান্ত;সুরেলা স্বরে গাইল,

_কোনো যে তোকে পাহারা , পাহারা দিল মন
কেন যে এত সাহারা , সাহারা সারাদিন !
কেন যে তোকে পাইনা পাইনা মনে হয় — সারাটা দিন।

______________________

ফার্স্ট ডে এট টিউশন প্রিয়তার বেশ ভালোই কাটল। কুসুম নামের মেয়েটা এই বয়সেই বেশ পরিপক্ক হয়ে উঠেছে। প্রিয়তা যাওয়ার সাথে সাথেই বেশ আয়োজন করে আতিথেয়তা করেছে। অতঃপর নিজেই বই খুলে যা যা পড়তে পারে না বা বোঝেনি তাই তাই প্রিয়তার সম্মুখে এগিয়ে দিয়েছে। কুসুমের একটা ছোট বোন ও আছে। মেয়েটার নাম কোয়েল। ভারী মিষ্টি ওই ছোট মেয়েটা। যতটা সময় ছিল ততটা সময়ই প্রিয়তার সাথে গল্পে মশগুল হয়ে ছিল। কুসুমের মা গার্মেন্টসে কাজ করে। কুসুমের বাবা ছোটখাটো একটা চাকরি করে। বাড়িতে এই দু বোনই থাকে। সকালে নাকি কুসুমের মা রান্না করে রেখে যায়। দুবোন একসাথে খায় আর পড়াশোনা করে। বিকেলে মাঠে বন্ধুবান্ধবদের সাথে খেলাধুলা করে, ঘুরে বেড়ায়। এসবই তাদের নিত্যদিনের রুটিং।

প্রিয়তার শরীর ভালো নেই। ব্যথায় রাতে সামান্য জ্বর এসেছিল। মুখে রুচি নেই। মাথায় ক্ষত স্থানের ব্যথাটা এখনো রয়েছেই। পা এক বিশেষ পদ্ধতিতে ঠিক করে নিয়েছে প্রিয়তা। একবার ওর বান্ধবী নয়নার এভাবে পা মচকে গিয়েছিল। সেসময় নয়নার স্বামী নয়নার পা ধরে বাঁকিয়ে দিয়েছিল। সাথে সাথেই নয়নার পা ঠিক হয়ে গিয়েছিল। প্রিয়তা অতটা ধৈর্যশীল কিংবা সহ্য ক্ষমতাবান নয় তবে নিজের খেয়াল তাকে নিজেকেই রাখতে হচ্ছে। ব্যথা নিয়েও পা সোজা করেছে সে। যে দিকটি মচকেছে তার বিপরীত দিকে জোরে চাপ প্রয়োগ করে সোজা করেছে পা। গুগোল থেকে ধারণা নিয়েছে এ বিষয়ে। এরপর ব্যথার কারণে কেঁদেছে অনেকটা সময় ধরে। পায়ে তেল মালিশ করে দিয়েছে আরহাম। নরম,কচি হাতে বোনের সেবা করেছে ছেলেটা।

প্রিয়তা যখন কুসুমদের বাড়ি থেকে বের হলো তখন বিকেল হয়ে আসছে। আকাশ অতিরিক্ত মেঘলা। বৃষ্টি পরবে বোঝা যাচ্ছে। প্রিয়তা কুসুমদের বাড়ি ছেড়ে ব্যাচ পড়ানোর উদ্দেশ্যে কোচিং সেন্টারে গেল। রায়হান স্যার ওখানে যেতে বলেছে প্রিয়তাকে। কোচিং সেন্টারে একটা ব্যাচ পড়াতে হবে প্রিয়তার। মাস গেলে ছয় হাজার টাকা পাবে। শরীর ক্লান্ত, অবসন্ন থাকলেও প্রিয়তা সঠিক সময়ে কোচিং সেন্টারে পৌঁছাল। প্রথম দিনই দেরি করা যাবে না। আরহামকে নিধির সাথে রেখে এসেছে সে। নিধিকে বলে এসেছে আরহামকে একটু পর পর ঘরে এসে দেখে গেলেই হবে। কিন্তু প্রিয়তা জানে নিধি তা করবে না। আরহামকে মেয়েটা নিজের কাছেই রাখবে সর্বক্ষণ। নাবিলা আন্টি বারবার টিউশনিতে আসতে না করেছিলেন প্রিয়তাকে। কিন্তু কথা দিয়ে কথা না রাখতে পারলে বড্ড খারাপ লাগতো প্রিয়তার। প্রথম দিনই এভাবে অজুহাত দিয়ে ঘরে বসে থাকা উচিত নয়। প্রিয়তার জন্যে এই অজুহাত দেওয়া আরো নিষেধ। তার নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি ঘর ভাড়া, খাওয়া-পরার খরচ মেটাতে হবে। কয়েকদিন পর আরহামকে ভর্তি করতে হবে স্কুলে। তখন খরচ আরো বাড়বে। এই কয় টাকায় কি হবে ভেবেই দুশ্চিন্তায় মাথা ভার লাগল প্রিয়তার। আঘাতের স্থানগুলোতে কেমন চিনচিন শীতল ব্যথা বয়ে গেল।

ব্যাচ পড়িয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যে নেমেছে। ক্ষুধায় পেটের ভিতের থেকে উদ্ভট শব্দ বের হচ্ছে। পথে ভেবেছিল কিছু একটা কিনে খাবে। কিন্তু নিজের জন্য কিছু কেনার টাকা দিয়ে আরহামকে মজা কিনে দেওয়া যাবে ভেবে পানি খেয়েই পেট ভরিয়েছে প্রিয়তা। ও বাড়িতে কুসুম তাকে বিস্কিট খেতে দিয়েছিল। কিন্তু কোয়েল পাশে বসে থাকায় কিছুটা নিজে খেয়ে বাকিটা কোয়েলকে খাইয়ে দিয়েছে।

বাড়ি ফিরে আরহামকে পেল না ঘরে। প্রিয়তা আশাও করেছিল আরহামকে ঘরে পাবে না। আন্দাজ ঠিক হয়েছে। আরহাম বোধহয় বাড়িওয়ালী আন্টির ঘরেই আছে।
প্রিয়তা বাইরের জামাকাপড় রেখে সুতির ফ্রক পড়ল। বেঁধে রাখা ভেজা চুলগুলো আঁচড়ে নিল। সকালে ডাল রান্না করেছিল। আরহাম ডাল দিয়ে চটকে ভাত মেখে দিলে ভালোই খায়। ফ্রিজ নেই বলে ডাল টক হবার ভয় থাকে। প্রিয়তা চটপট ডাল গরম করে নিল। পাতিলে থাকা নিচের অংশের ভাত কিছুটা পানি পানি হয়ে গেছে। ডাল দিয়ে খেলে আর খারাপ লাগবে না। প্রিয়তা একটু জীবন নিয়ে ভাবল। আরহামকে স্কুলে ভর্তি করাতে টাকা লাগবে। সবচেয়ে বড় কথা আরহামের চাহিদাগুলো কিভাবে মেটাবে? আগামীকাল বাড়িওয়ালীর ননদের ছেলের এনগেইজমেন্ট। কাল জামা কেনার বায়না না করলেও পরেরদিন বিয়েতে পরার জন্য এটা ওটা আবদার করে বসবে। মুখের উপর না করার সাধ্য নেই প্রিয়তার। অপর দিকে জমানো টাকা দিয়ে পুরো একমাস চলতে হবে।

ডাল গরম করে প্রিয়তা মিসেস নাবিলার ফ্ল্যাটে যেতে উদ্যত হলো। দরজা খোলা ছিল বলে আর অনুমতি নিল না। তবে ভিতরে ঢুকে বুঝতে পারল ভুল সময়ে এসেছে এখানে। বাড়ি ভরতি মানুষের সমাগম। প্লাস্টিকের ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে ড্রয়িংরুম। একজন ব্যক্তি মই-য়ে উঠে দেওয়াল রং করছে। আরেকজন লোক অপর পাশের দেওয়ালে সুন্দর করে ফুল আঁকছেন। সবটা দেখিয়ে দিচ্ছে দু-তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে। প্রিয়তা ড্রয়িংরুম পেরিয়ে নিধির ঘরে গেল। দরজা খানিক ভিড়িয়ে রাখা। প্রিয়তা হাতের উল্টোপিট দিয়ে দরজায় টোকা দিল। ভেতর থেকে নিধি বললো,

” কে? ভিতরে আসো।

প্রিয়তা ওড়না ঠিক করে নিল। মাথা নিচু করে রইল। অসস্তিতে মরিমরি অবস্থা মেয়েটার। প্রিয়তার একটা নিজস্ব জগত ছিল। সেই জগতে আরহাম, তন্ময় আর দু একজন মানুষের বসবাস ছিল। এই মানুষ জন ব্যতিত অন্য কারো সাথে সেইভাবে মেলামেশা করা হয়নি প্রিয়তার। কলেজেও তেমন বন্ধু ছিল না তার। যারা ছিল তারা শুধু কলেজে গেলেই কুশল বিনিময় করতো,ব্যস। প্রিয়তা রেগে গেলে যার তার সাথে কথা বলতে ইসস্ত বোধ করে না কখনো। নরম স্বভাবের মেয়েরা সহজে রাগে না। আবার রেগে গেলে সেই রাগ ঝেরে ফেলা মুশকিল হয়ে পরে। নরম মেয়েরা কঠিন ভাবে রাগে, আর সেই রাগ কমাতে ঝক্কি পোহাতে হয়। প্রিয়তাও তেমন ধরনের মেয়ে। সহজে রাগে না কিন্তু রেগে গেলে আর হুশ থাকে না। এখন নিধির ঘরে কয়েকটি কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা এ নিয়ে দ্বিধা কাজ করছে প্রিয়তার। দরজা মেলল প্রিয়তা। একটা অপরিচিত মেয়ের কোলে বসে আছে আরহাম। মুচকি হাসল সে। নিধির উদ্দেশে বললো,

” আরহামকে দাও, নিয়ে যাই।

আরহাম প্রিয়তাকে দেখে হাসল। আরহামের পাশে একটা কাঁচের প্লেটে ফলমূল রাখা। সেখান থেকে একটা আপেলের টুকরো টুপ করে মুখে দিল আরহাম। বললো,

” আপু দেখো বিয়েতে কত্ত মজা হয়। সবাই কত্ত ভালো। তুমিও আসো না।

প্রিয়তা ভালো করে ঘরে চোখ বুলাল। নিধির আর প্রিয়তার বয়সী চারটা মেয়ে বিছানায় বসে আছে ফোন নিয়ে। সকলের গায়ে সুন্দর, আকর্ষণীয় পোশাক,। সাজসাজ ব্যাপার রয়েছে সকলের মাঝে। নিধি প্রিয়তাকে দেখে খুশি হলো। বিছানা থেকে উঠে প্রিয়তাকে ঘরে টেনে আনল। সকলের উদ্দেশে বললো,

” এই যে, এর কথাই বলছিলাম। এটাই প্রিয়া আপু। আরহামের বড় বোন।

প্রিয়তা সালাম দিল। নিধি পরিচয় করিয়ে দিল সবার সাথে। এরা নিধির কাজিন। নাবিলা আন্টির বড় বোনের মেয়ে দিশা আর পায়েল। ছোট বোনের এক ছেলে আর এক মেয়ে। দুজনের নাম রায়ান আর মেঘনা। মিসেস নাবিলা ভাই বোনদের মধ্যে মেজো। অপরদিকে নিধির বাবারা এক ভাই দুই বোন। পিয়াস করিম সবার বড়। তার মেজো বোনের ছেলে-মেয়ে তানিশা, সাহিল। আর প্রহরের ছোট ফুপির একমাত্র ছেলে তিয়াশ। ড্রয়িংরুমে বাড়ির ছেলেরা সাহিল, তিয়াশ, রায়ান টুকটাক কাজ করছে। সবাইকে কাজকর্মদেখিয়ে দিচ্ছে। নিধির সাথে বসে আছে নিধির খালাতো, ফুপাতো বোন। সবাই একসাথে হয়ে আড্ডা জমিয়েছে দুপুর থেকে। এদের মধ্যে দিশা মেয়েটা বোনদের মধ্যে বড়। প্রিয়তাকে দেখে মিষ্টি হাসল সে। ফোনটা বিছানায় রেখে এগিয়ে আসল প্রিয়তার দিকে। বিস্ময় দৃষ্টি মেলে বললো,

” ও মাই গড! তুমি তো একদম পুতুলের মতো দেখতে। আরহামের মতোই কিউট। মনে হচ্ছে জীবন্ত পুতুল দেখছি।

প্রিয়তা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলো। রক্তিম হলো গাল। ওষ্ঠদ্বয় জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিল। মুচকি হেসে বললো,

” আপনারাও ভিষণ সুন্দর।

দিশার এমন কণ্ঠে ভ্রু কুচকে ফেলল মেঘনা। হেসে বললো,

” ও কি আমাদের মতো অলস নাকি? নিশ্চয় ক্রিমটিম মাখে, ফেসিয়াল করে। সুন্দর হবে না?

প্রিয়তা কি বলবে এখন? বলবে সে এসব কিছুই মাখে না? সৌন্দর্য নিয়ে কখনো ভাবেইনি সে? কথাটা বলা কি ঠিক হবে? সকলে ভাববে প্রিয়তা গর্ব করে বলছে এসব। কিংবা বিশ্বাস না ও করতে পারে। বিষয়টা অন্যরকম হবে। অনেকের মনে অনেক ভাবনা আসবে। প্রিয়তার এ নিয়ে আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করল না। যে যা ভাবে ভাবুক। সৌন্দর্যকে কেন্দ্র করে তর্ক করা এক ধরনের অন্যায়। তার গায়ের রং ফর্সা। অনেকে ভাবতেই পারে এই সৌন্দর্য প্রসাধনীর কামাল। তাতে কি যায় আসে?

প্রিয়তা চুপ করে রইল। আরহামকে বললো,

” সন্ধ্যে হয়েছে অনেকক্ষণ। ঘরে আসোনি কেন? চলো যাই। ভাত খাবে।

আরহামের মুখ মলিন হয়ে এলো। এত মানুষের সাথে সে আগে কখনো মেশেনি। সবার এমন সুন্দর ব্যবহার দেখে ছেলেটা যে ব্যাপক খুশি হয়েছে তা ছেলেটার চঞ্চলতাই বুঝিয়ে দিচ্ছে। প্রিয়তা আরহামকে বোঝালো সকালেই আঙটি বদল হবে। আর তখন দু ভাইবোনই আসবে। এখন বাড়িতে যারা রয়েছে তারা সকলে বাড়িরই লোক। বিয়ে আর গায়ে হলুদে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে সব ভারাটিয়াদের। আপাতত তারা মেহমান নয়। আরহাম আর প্রিয়তাকে বিশেষ ভাবে এনগেইজমেন্টেও দাওয়াত দিয়েছে নাবিলা আন্টি। কিন্তু এখনই ঘনঘন সে বসে থাকা নেহাতই অভদ্রতা।

প্রিয়তা ঘর থেকে বের হতেই মিসেস নাবিলার সাথে দেখা হলো তার। মিসেস নাবিলা দুজনকে দেখে হাসলেন। বললেন,

” টিউশন করিয়ে ফিরতে সন্ধ্যে হলো? এত ঝামেলা নিচ্ছো কেন? তোমার বাবা-মা টাকা পাঠাবে না?

এই প্রশ্নটা আগে কেন মাথায় আসেনি প্রিয়তার? সত্যিই তো! বাবা-মা যদি বিদেশ থাকে তাহলে যতই মেয়ে অবাধ্য হোক টাকা পাঠাবেই। ছেলে-মেয়েকে নিয়ে অবশ্যই পিতামাতার চিন্তা থাকবে। ওরা কি খাবে, কি পরবে এ নিয়ে ভাবনা থাকবে। প্রিয়তা এত কষ্ট করছে কেন এ নিয়ে প্রশ্ন তো সবাই তুলবেই। এত মিতব্যয়ী কেন তাতো জানতে চাইবে।

প্রিয়তা ভাবল সবটা আন্টিকে বলে দিতে। আরহামের সামনে এসব বলা উচিত হবে না। আরহামকে তাই ততক্ষণাৎ ঘরে পাঠিয়ে দিল প্রিয়তা। শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে নিল জিভ দ্বারা। খুব ভেবে কিছু বলতে উদ্যত হতেই নাবিলা আন্টির ডাক পরলো। তড়িঘড়ি করে মিসেস নাবিলা রান্নাঘরে চলে গেলেন। প্রিয়তা সস্থির নিঃশ্বাস ফেলল। বুক থেকে ভারী বোঝা নেমে গেল মনে হলো। বুকের ভেতর কেমন ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে প্রিয়তার। বুকে হাত দিয়ে শান্তিতে চোখ বুজল সে। আরেকটু হলেই আন্টি সব জেনে যেতেন। কেমন রিয়্যাক্ট করতেন তিনি? বাড়ি থেকে বের করে দিতেন? আরহামকে ঘরে পাঠিয়েছে মনে হলে বাড়ি ছাড়তে চাইল প্রিয়তা। কিন্তু বের হওয়া আর হলো না তার। পেছন থেকে পুরুষালি কণ্ঠে ” এই মেয়ে” বলে ডেকে উঠল কেউ। প্রিয়তা থমকাল। পেছন ফিরে লোকটাকে দেখল। অপরিচিত ছেলের ডাক শুনে কপালে ভাঁজ পড়ল প্রিয়তার। দ্বিধা নিয়ে বললো,

” আমায় ডাকছেন?

” হ্যাঁ তোমাকেই। আগে পরিচিত হই দাঁড়াও।
ছেলেটি এগিয়ে এলো প্রিয়টার নিকট। পুনরায় বলে উঠলো,

” আমি সাহিল। ছেলেপক্ষের লোক। ছেলে আমার কাজিন হয়। তুমি বুঝি নাবিলা আন্টির বোনের মেয়ে? তাই-ই হবে। এছাড়া তো আর কাউকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি।

প্রিয়তা থতমত খেল। কিছু বলার আগেই সাহিল সোফায় গিয়ে বসল। হেসে বলে উঠল,

” তোমার নাম পরে শুনবো। এখানে এসে বসো তো। এই বাড়ির সবগুলো মেয়ে অলস। কাজ করার ভয়ে ঘরে ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে। পরশু বিয়ে, অথচ কনে-কে লাগেজ ভরে কি কি পাঠাতে হবে এ নিয়ে কারো কোন চিন্তাই নেই। প্রহর ভাই তো চোর বাটপারদের ধরা ছাড়া আর কিছুতেই নেই। মেয়েদের সাজগোজে কি কি লাগে আমি কি করে বুঝবো? তুমি তো মেয়েই। সাজগোজের কি লাগবে আমায় বলো তো। আমি লিখে নেই ঝটপট।

প্রিয়তা অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেল। লোকটা না জেনে না শুনে একজনকে আদেশ করছে এভাবে? প্রিয়তা উচ্চবিত্ত পরিবারের হলেও সাজগোজে কখনো মন বসেনি তার। সবসময় শুনে এসেছে না সাজলেই প্রিয়তাকে বেশি সুন্দর লাগে। সাজলে প্রিয়তাকে মানায় না, বরং দেখতে অদ্ভুত লাগে। যেজন্য সাজগোজ থেকে দূরে থাকে প্রিয়তা। বলতে গেলে খুব একটা প্রয়োজন না পরলে সাজে না সে। ব্যাসিক ধারণা থাকলেও বিয়েতে সাজগোজের কি কি দিতে হয় এ নিয়ে ধারণা নেই প্রিয়তার। বিয়ের কনেকে পায়ের নখ সাজানোর জিনিস থেকে শুরু করে চুলের ফিতা অবধি কিনে পাঠিয়ে দিতে হয়। সবকিছুর নাম জানা নেই প্রিয়তার। কি একটা ফ্যাসাদে পরে গেল সে।

প্রিয়তা বোকা হাসল দাঁত কেলিয়ে। চোখের পলক ফেলল কয়েকবার। বললো,

” আমার এ বিষয়ে ধারণা নেই ভাইয়া। অন্য কাউকে খুঁজুন প্লিজ।

সাহিল ঠোঁট বাঁকিয়ে ত্যাছড়া হাসল। মিনমিন স্বরে বললো,

” ভয় পাচ্ছো? তোমার রুপের রহস্য জেনে যাবো ভাবছো? আমি জানি মেয়েরা রূপের রহস্য মরে গেলেও বলতে চায় না। ধারণা নেই বলে তুমি বোঝাতে চাইছো তুমি মেকআপ-টেকআপ ইউস করো না। রাইট? বুঝে গেছি। আরেহ বলে ফেলো। ফাউন্ডেশন আর কি কি যেন লাগে?

প্রিয়তা হা হয়ে থাকিয়ে রইল । লোকটার মাথা নষ্ট নাকি? কি সব আবোল তাবোল বলছে? রূপের রহস্য আবার কি? আল্লাহ্ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন নিজের পছন্দে। এখানে রহস্য এলো কোথা থেকে? সব মেয়েই কি মেকআপ করে নাকি? আশ্চর্য। কতজনকে এমন দেখেছে লোকটা?

প্রিয়তা একটু রেগে গেল। বললো,

” পাবনার পাগলাগারদ থেকে পালিয়ে এসেছেন তাইনা? চিল! আমি নিজ খরচে আপনাকে পাঠিয়ে দিবো।

চলবে?
লেখনীতে:#বৃষ্টি_শেখ