Friday, August 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 463



প্রেম প্রার্থনা পর্ব-০২

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[০২]

স্পর্শী কাঁদতে কাঁদতে তার রুমের দিকে গেলেও রুমে প্রবেশ করল না। আশেপাশে উঁকি মেরে রুদ্রের রুমে প্রবেশ করল।
বরাবরের মতোই পরিপাটি করে সাজানো রুমটা। মহারাজ বোধহয় গোসল সেরে একেবারে রেডি হয়েই বের হয়েছেন।
আজ থাকবে নাকি চলে যাবে কে জানে! জিজ্ঞাসা করলেও তো বলবে না। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। একখন্ড অভিমানী মেঘ এসে বসল মনের উঠান জুড়ে। মিষ্টি হাসি মলিন রুপে ধরা দিলো। চোখ দুটো কেন জানি ছলছল করে উঠল। সেই সঙ্গে সমস্ত মন খারাপ এসে ভর করলো স্নিগ্ধ সরল বদনখানায়। গতকাল রাতে এ রুমে এসে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই তাকে স্বজোরে থাপ্পড় মে/রেছিল রুদ্র। সেই মুহূর্তে অবাক হলেও পরবর্তীতে কারণ বুঝে চুপ হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া থাপ্পড়টা সে অকারণেই খাই নি বরং বিশেষ কিছু কারণ জড়িত ছিল। মোদ্দাকথা সেই মুহূর্তে তার মাথা কাজ করছিলো না। ভীষণভাবে দিশেহারা লাগছিল।।
তাই রাগের বশে রুদ্রকে কী বলেছে না বলেছে খেয়াল নেই।
তবে রুদ্র হুটহাট রেগে যাওয়ার ছেলে নয়। যখন সে রাগকে কনট্রোলে আনতেই পারে না ঠিক তখনই কিছু একটা করে।
যেমন,গতরাতে এক থাপ্পড়ে তার মুখের বুলির লাগামে এনে দিয়েছে। মুখ্য কথা, সকলের উচিত কাউকে কিছু বলতে খুব ভেবে চিন্তে বলা। যাতে বিপরীত ব্যক্তির উপর এর প্রভাব না পড়ে। কিন্তু অতিরিক্ত রাগের বশে আমরা এটাই ভুলে যায়।
তাছাড়া উপস্থিতিও তার অনুকূলে ছিল না তাই না চাইতেও
ভুলটা করে ফেলেছে। এসব ভাবতে ভাবতে সে উঠে দাঁড়াল
কয়েক পা এগিয়ে যেতেই সেন্টার টেবিলের সঙ্গে ধাক্কা লেগে তার উপরে রাখা পিংপং বল গড়িয়ে খাটের নিচে চলে গেল। এই যা! এবার কী হবে? এই রুমের একটা জিনিসও এদিক ওদিক হলে রুদ্র তাকে আস্ত রাখবে না। একথা ভেবে দৌড়ে গিয়ে বলটা ধরার আগেই বলটা খাটের নিচে ঢুকে গেল। সে হুমড়ি খেয়ে পড়েও কাজ হলো না। কিন্তু বলটা বের করতেই হবে আর সঠিক স্থানে রাখতেই হবে। এমনিতেই তার উপরে ভীষণ রেগে আছে ক্ষ্যাপা মহারাজ। গতকাল থেকে রাগের চোটে খুব একটা কথাও বলে নি। এখন যদি রুমে এসে তার জিনিস এলোমেলো দেখে তাহলেই শুরু করে দিবে।এরচেয়ে
বলটা ঠিকঠাক জায়গায় রেখে কেটে পড়া উত্তম। মনে মনে
একথা ভেবে খাটের নিচে ঢুকতে চেষ্টা করলো। দেহের জোর খাঁটিয়ে সামান্য একটু ঢুকে আর নড়তে পারল না। নড়তে না পেরে বের হওয়ার চেষ্টা করেও আঁটকে গেল। ডানে বানে এ দিক করেও কাজের কাজ কিছু হলো না। তখন হিমুর কন্ঠ শোনা গেল। ইংলিশ গান গাইতে গাইতে এদিক দিয়ে যাচ্ছে।
হিমু তার ছোট ফুপুর ছেলে। ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র। তার
কাজ বই নিয়ে বসে থাকা। পড়াশোনা চাপ কম তাই বেড়াতে এসেছে কিছুদিন হলো। তার সঙ্গে খুব একটা কথা বলে না সে। কারণ হিমু বাংলার চেয়ে ইংলিশে কথা বলে বেশি। এত দ্রুত ইংলিশে কথা বলে কিছুই বোঝে না। শুধু বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। তবে এটা বুঝতে দেয় না কিছু বোঝে নি সে। বরং এমন ভাব করে যেন সব জানে, বুঝে। তাছাড়া গণিতে পাঁকা হলেও ইংলিশে বড্ড কাঁচা সে । ইংলিশ জিনিস মাথায় ঢুকতেই চায় না। অথচ মানুষ ইংলিশ টুকটাক বুঝলেও ভয় করে গণিতকে। কিন্তু তার বেলায় উল্টো কাহিনি। লজ্জার কথা ইংলিশে মাত্র তেত্রিশ মার্ক তুলতেই তার কাল ঘাম ছুটে যায়। কিছু আগে অর্ধ বার্ষিকী পরীক্ষা হয়েছে। সে জানে সে ফেল করবে। এটা ঠিক ভবিষ্যতে বাণী না, তবে যা হালচাল তাতেই স্পষ্ট। এছাড়া ‘ফেল করব’ একথা গর্ব করে বলাটাও একটা আর্ট। যা ফেলটু স্টুডেন্টদের পরিষ্কার মনের সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। এসব ভাবনা সাইডে রেখে স্পর্শী হিমুকে গলা উঁচিয়ে ডাকল।হিমু আশেপাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে পা বাড়াতেই পুনরায় তার নাম শুনতে পেল। দু’পা এগিয়ে গিয়ে কৌতুহলবশত রুদ্রর রুমে উঁকি মেরে দেখে স্পর্শী উবু হয়ে মেঝেতে শুয়ে আছে। তার মাথা খাটের নিচে আটঁকে গেছে। তা দেখে সে দৌড়ে গিয়ে বলল,

-‘আরে রে রে তুই আটকালে কীভাবে?’

-‘আগে আমাকে টেনে বের কর। তারপর নতুনভাবে আঁটকা পড়ে তোমাকে প্রথম থেকে দেখাচ্ছি।’

-‘আরে রেগে যাচ্ছিস কেন আমি এমনিই জানতে চাইলাম।’

-‘ভাইয়া কিছু একটা করো প্লিজ। দম বন্ধ লাগছে তাড়াতাড়ি কর। এভাবে আর দু’মিনিট থাকলে আমি চ্যাপা হয়ে যাবো।’

– চ্যাপা না সঠিক শব্দটা হবে চ্যাপ্টা।’

-‘আমি খাঁটের নিচে আটঁকা পড়ে মা/রা যাচ্ছি, আর তুমি কী না আমার কথার ভুল ধরছো? হে সুন্দর পৃথিবী বিদায়! বিদায়।’

একথা শুনে হিমু দ্রুত পেছনে গিয়ে স্পর্শীর পা ধরে টানতে লাগল। তবুও কিছুতেই কিছু হলো না। এত নিচু খাট! এখন
কীভাবে বের হবে? হিমু পা ধরে টানাটানি করেও কাজ হলো না দেখে সে চেঁচিয়ে বাসার সবাইকে ডাকল। তার ডাক শুনে
স্পর্শীর বাবা আর বড় আব্বু ছুঁটে এলেন। উনাদের পেছনে দৌঁড়ে এলেন বাকি মহিলা সদস্যরা। রুদ্র বাসায় নেই। খেয়ে তখনই বেরিয়ে গেছে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। স্পর্শীর বাবা খুব চেষ্টা করেও মেয়েকে বের করতে পারলেন না। পরে দুইভাই খাট তুলে ধরে স্পর্শীকে উদ্ধার করলেন। উদ্ধার হয়ে স্পর্শী হাঁটা ধরল নিজের রুমের দিকে। নতুবা প্রতিটা সদস্যই এক এক করে ভাষণ দিতে শুরু করতো। যেটা হজম করাও কষ্ট।
মেয়েকে যেতে দেখে স্পর্শীর বাবা-মা একে অপরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বড় মাও আর কথা বাড়ালেন না নীরবে স্থান ত্যাগ করলেন।

বাসের সিটে চোখ বন্ধ করে বসে আছে রুদ্র। মেজাজ তুঙ্গে।
গতরাতে একটু ঘুম হয় নি বিধায় প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে।
চোখ দু’টো জ্বলছে। বাস ছাড়ে নি। হয়তোবা লেট হবে। কেন জানি প্রচুর ঘামছে সে। ঘামে টি-শার্ট টা ভিজে শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। একটুপরে বাস ছাড়ল। জানালা দিয়ে বাতাস
এসে শরীর জুড়িয়ে ঘাম শুকিয়ো দিলো। কিন্তু মন জুড়াতে
ব্যর্থ হলো। অশান্ত মন হয়তো শান্ত হবে কিছুতেই। কিছুদিন বড্ড জ্বালাবে তাকে। চোখ বন্ধ করে থাকতে থাকতে হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠল কারো মায়াবী বদনমাখা। অথচ এমন হওয়ার কথা নয়। সে নিজেই বিরক্ত হলো তার অযথা ভাবনার প্রতি। দিনকে দিন শান্তি নামক জিনিস তার জীবন থেকেই উঠে যাচ্ছে। শুন্য জায়গাটা দখল করছে অশান্তিরা।
এইতো গতরাতে তোড়জোড় করে বিয়ে করার কারণই ছিল না। কিন্তু করতে হলো। বাবা-চাচার কথা ফেললে পারল না।
তাছাড়া গাধীটা প্রেম করা শিখেছে মাত্র সাতদিনের পরিচয়ে বখাটের সঙ্গে পালিয়েও যাচ্ছিল। বখাটে বেকার। তবে তার
রসে টইটম্বুর মার্কা প্রেমবাক্যে স্পর্শী গলে গদগদ। সে ভাবে সেই বখাটে তাকে খুব ভালোবাসে। ভালোবাসার প্রেম তরঙ্গ শুধু বখাটের নিকটে। আর সেই বখাটে ওর ব্রেণ ওয়াশ করে এটা বুঝিয়েছে, ‘ ভালোবাসা থাকলে গাছ তলায় গিয়ে থাকা যায়।’ ব্যস তারপর দু’জনে গাছতলায় থাকতে রাজি। অথচ স্পর্শী সেই বখাটের বাবার নাম তো দূর তার বাসার ঠিকানা অবধি জানে না। এমনকি কোন জেলার ছেলে তাও জানে না। শুধু জানে তাকে ভালোবাসে। সুন্দরী মেয়েদের বুদ্ধি যে হাঁটুর নিচে এটা তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। তারপর তারই এক ফ্রেন্ডের ছোট ভাই স্পর্শীকে স্কুলের উল্টো পথে যেতে দেখে সন্দেহ করে। আর সন্দেহের কারণ পাশে থাকা ছেলেটা। যে স্পর্শীর শরীর বার বার ছুঁইয়ে দিচ্ছিল। আর স্পর্শীর ঠোঁটে ছিল বিরক্তমাখা হাসি। ছেলেটা বুদ্ধি করে রুদ্রকে কল করে
ভিডিও করে দেখায়। পরশুদিন বাসায় এসেছে বিধায় ছোট বাজারের কাছে ছিল সে। পুরো ঘটনাটা দেখে যায় ছেলেটার বলা স্থানে। আর উপস্থিত হয়ে রেগে দু’জনকে দেখে দুথাপ্পড় লাগিয়ে দেয় ছেলেটার দুই গালে। নাক বরাবর একটা ঘুষি দিতেও ভুলে না। একপর্যায়ে রুদ্রর সঙ্গে ছেলেটার হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়। তখন সেখানে রুদ্রর বন্ধুরা উপস্থিত হয় আর
উত্তম মাধ্যমে দেয় ছেলেটাকে। রুদ্র তখনো স্পর্শীকে কিছু বলে নি। বরং কল করে ব্যাপারটা স্পর্শীর বাবাকে জানায়।
একথা শুনে অফিস থেকে উনারা চলে আসে এখানে। আর ছেলেটা মার খেয়ে জানায়, নেশার টাকা যোগাড় করতে না পারায় স্পর্শীকে আঁটকে রেখে টাকা হাতানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছিল। এতদিন স্পর্শীই তাকে হাতখরচ দিতো। সেই টাকা দিয়ে সে নেশা করতো। একথা শুনে স্পর্শী কাঁদো কাঁদো হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

-‘তুমি আমাকে ভালোবাসো না মাশুম? তোমাকে ভালোবেসে বিশ্বাস করে গাছ তলায় থাকতেও চলে এসেছি।’

-‘আমাদের প্রেম পূর্ণতা পাবে না স্পর্শী। আমাকে ভুলে গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করো। আর শেষ বিদায় দিতে হাসি মুখে আজকের হাত খরচটা দিয়ে দাও জান। আমার নেশা উঠেছে, দেখো হাত পা কাঁপছে, মাথা ঘুরছে, চোখে ঝাপসা দেখছি।’

-‘কুতাবাসা! গাঁজাখোর! আমার টাকায় নেশা করবি? দাঁড়া তোর নেশা করা ছুটাচ্ছি।’

একথা বলে স্পর্শী মাশুমের উপর হামলে পড়ল। মাশুমের চুল টেনে, খামচি, কিল, ঘুষি, দিতে থাকল একের পর এক। আর মাসুম বলতে থাকল,

-‘আমাকে শুধু গাঁজাখোর বললে ভুল করবে প্রিয়শী। আমি দু’টাকার গাঁজাখোর নয়। আমি চার টাকার ইয়াবা খোরও বটে। নিজের স্বপ্নে পূরণ করতে দু’একবার হিরোইনের টানে
নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছি। তুমি আমাকে ভুল বুঝো না জান। নেশাখোররাও মানুষ, তাদের জানে মনেও প্রেম আছে। আর এই নেশাযুক্ত মন নিয়ে বলছি ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

মাশুমের কথা শুনে রুদ্রু ভ্রু কুঁচকে স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে আছে। তাচ্ছিল্যপূর্ণ দৃষ্টি। যার অর্থ পৃথিবীতে ছেলে পেলি না? শেষে কী না এই নেশাখোর! ঠিক তখন মাশুম দুই হাতে তালি বাজিয়ে পেট ধরে হাসতে হাসতে রুদ্রকে বললো,

-‘এসব বললে খুশি হতেন নিশ্চয়ই? এই স্পর্শী, তোমার এই চাচাতো ভাই বহুত চালাক। জানো গতরাতে আমাকে হুমকি
দিতে আমার মেসে গিয়েছিল। উপরোক্ত কথাগুলো বলতে শিখিয়ে দিয়েছে। সঙ্গে তোমার সঙ্গে ব্রেকআপ করার জন্য
টাকা অফারও করেছে। অথচ এখন দেখো হিরো সেজে দাঁড়িয়ে আছে যেন কিচ্ছু জানে না।’

একথা বলতে দেরি কিন্তু রুদ্র তাকে লাথি মারতে দেরি করে নি। স্পর্শীর বাবা চাচারাও রেগে গেছেন। উনারা কিছু বলার আগেই মাশুম বলল,

-‘আঙ্কেল আমি স্পর্শীকে বিয়ে করতে চাই। তবে বর্তমানে আমার কিছু না থাকলেও ভবিষ্যতে হতে পারে। আপনারা চাইলে আমি ঘরজামাই থাকতেও রাজি। এতে আপনাদের মেয়ে আপনাদের কাছেই রইল। শশুড়বাড়ি কেমন থাকবে না থাকবে ভাবার অবকাশ রইল না।’

একথার উত্তরে স্পর্শীর বাবা বললেন,

-‘আমি কপালপোড়া নই বলেই খারাপ কিছু ঘটার আগেই
ব্যাপারটা জানতে পেরেছি। আর ঠিক বলেছো তুমি, সত্যি সত্যিই আমার মেয়েটাকে ছাড়া থাকতে খুবই কষ্টকর হবে আমার। যদিও এর সলিউশনও পাকাপোক্ত করা রেখেছি।
তুমি জানো না এজন্যই বলছি, ‘রুদ্র হচ্ছে স্পর্শীর উডবি হাজবেন্ড।’ স্পর্শীর আঠারো বছর হলেই বিয়ে সম্পূর্ণ করা হবে।

একথা শুনে স্পর্শী ডুকরে কাঁদতে লাগল। সে কিছুতেই এই বিয়ে করবে না। কোনোভাবেই পছন্দ না রুদ্রকে। বেপরোয়া একটা ছেলেকে স্বামী হিসেবে কল্পনাও করে নি। রুদ্রের সঙ্গে কিছুতেই মানাতে পারবে না নিজেকে। কিন্তু স্পর্ষীর কথাতে স্পর্শীর বাবা গুরুত্ব দিলো না। বরং মাশুমকে হুমকি দিয়ে মেয়েকে টানতে টানতে বাসায় নিয়ে এলেন। ঝোঁকের বশে বলা কথাটা অনেক ভেবে চিন্তে বড় ভাইকে সরাসরি প্রস্তাব দিলেন। বাড়ির প্রতিটা সদস্য একমত হলেন। তবে রুদ্র কিছু বললো না শুধু তাকিয়ে রইল স্পর্শীর কান্নারত মুখের দিকে। যাতে স্পর্শী এমন ভুল আর না করে এজন্য কাজিকে ডেকে আনলেন। আজ কলেমা পড়ে বিয়ে সম্পূর্ণ হোক। স্পর্শীর আঠারো বছর পূর্ণ হলে রেজ্রিট্রি সমেত অনুষ্ঠান করা হবে।
কাজি ততক্ষণে লেখালেখির কাজ শুরু করেও দিয়েছেন। তখন স্পর্শী চেঁচিয়ে বলল,

-‘আমি রুদ্রকে বিয়ে করবোই না। সে তো আমার বড় বাবার ছেলে নয়। তাকে দত্তক নেওয়া হয়েছে। বাবা- মা নেই এমন কাউকে বিয়ে করবো না আমি, এতিম একটা।’

স্পর্শীর এমন কথা শুনে সকলে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল।
তবে রুদ্রর মধ্যে কোনো প্রকারের প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।
সুন্দর করে উঠে স্পর্শীর হাত ধরে পাশের একটা রুমে নিয়ে গেল। দরজা আস্তে আঁটকে শার্টের হাতা গুটিয়ে পরপর দুটো থাপ্পড় মেরে বলল,

-‘বিয়ে যদি করতে হয় আমাকেই করবি তুই। সাহস থাকলে বিয়ে আঁটকে দেখা। আর কী বললি তুই আমি এতিম? ওকে হলাম এতিম। মেনে নিলাম আমি এই বাসার দত্তক নেওয়া সন্তান। তো? তো কি হয়েছে সেটা বল?’

-‘কোন অধিকারে আমার গায়ে হাত তুললে, সেটা বলো!’

-‘ হাহা হা অধিকার!’

-‘হ্যাঁ অধিকার। আর তুমি শুনতে পাচ্ছো না আমি তোমাকে
বিয়ে করবো না, করবো না, করবো না।’

-‘ছাড় পাবি না, করতেই হবে। তবে আমি নই, বিয়েতে বাধ্য করবে তোর বাবা-মা।’

একথা বলে ড্রয়িংরুমে গিয়ে বাবা মায়ের কথায় একপ্রকার বাধ্য হয়ে কবুল বলে সে। তারপর রাতে যখন তাকে রুদ্রর রুমে যেতে বলা হয়, সে যায় না। বরং বিশ্রী গালি দিয়ে মনে যা আসে চেঁচিয়ে বলতে থাকে। রুদ্র রুমে বসেই শুনতে পায়
তার বলা কটুবাক্যগুলো। রাগে তার শরীর কাঁপতে থাকে।
তারপর স্পর্শী যখন রুমে আসে রাগ সামলাতে না পেরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয় স্পর্শীর গালে।

To be continue……..!

প্রেম প্রার্থনা পর্ব-০১

0

‘প্রেম প্রার্থনা’
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার আলো
[০১]

নববধূর সাজে সদ্য বাসরঘরের চৌকাঠে পা দিয়েছে স্পর্শী।
চোখে রঙিন স্বপ্ন। হঠাৎ হেঁচকা টানে সামনে ঘুরিয়ে স্বজোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিলো রুদ্র রাজ। পুরুষালি শক্ত হাতের থাপ্পড়ে তাল সামলাতে না পেরে সে লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে।
আচমকা এমন করায় গালে হাত দিয়ে অবাক নেত্রে তাকিয়ে রইল ষোড়শী নববধূ। টলমলে চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে রুদ্র এগিয়ে গেল একদফা দিতে। ভয়ে কিঞ্চিৎ পিছিয়ে ঠোঁট উল্টো ডুকরে কেঁদে উঠল স্পর্শী। তার পুরো মুখে স্পষ্ট হলো ভয়ের আভাস। একটু পিছিয়ে না সূচক মাথা নাড়ালো বেশ কয়েকবার। রুদ্রের দৃষ্টি তার অন্তর আত্মা কাঁপিয়ে দিচ্ছে।
ভয়ে তার কাজল কালো নেত্রে ঝরছে বেপরোয়া নোনাজল। কান্নার ফলে পুরো মুখ লালবর্ণ ধারণ করেছে। বিয়ে করবে না বলায় কিছুক্ষণ আগেও খুব মেরেছে রুদ্র। পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দিয়েছে ফর্সা আদুরে দু’গালে। মা/র খেয়ে বিয়ে করেছে তারপরেও মারছে। সামান্য ভুলই তো করেছে, আর কত বার মাফ চাইবে? তাকে কাঁদতে তখন রুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-‘দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে নয়তো এমন শট দিবো
এখানেই পটল তুলবি। কী কথা কানে যাচ্ছে না? আরেকটা দিবো?’

-‘দা দী জা ন আ।’

স্পর্শীকে তোতলাতে দেখে রুদ্র আশেপাশে তাকিয়ে লাঠি খুঁজল। কিন্তু হাতের কাছে চিরুণী ছাড়া কিছু পেলো না। সে চিরুণী দিয়েই স্পর্শীর মাথায় জোরে আরেকটা বারি দিলো।
এবার ব্য/থায় হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। তার কান্নার শব্দ শুনে দরজায় নক পড়ল। বাসার অন্য সদস্যরা ছুটে এসেছে
তাকে উদ্ধার করতে। সবাই রুদ্রের নাম ধরে ডাকছে, দরজা খুলতে বলছে। রুদ্রর বাবাও রুদ্রকে বের হতে বলছে। শুধু শুধু অকারণে মা/র/বে কেন মেয়েটাকে জানতে চান তিনি।
যা হওয়ার হয়ে গেছে এখন মারলে লাভের লাভ কিছু হবে?
হবে না! বরং মেয়েটা আরো ভয় পাবে। এরচেয়ে মেয়েটাকে বুঝাতে হবে যাতে এমন ভুল আর না করে। এছাড়া কিছুক্ষণ আগে তাদের সম্পর্কের বদল ঘটেছে। পূর্বে স্পর্শী ছিল তার চাচাতো বোন আর এখন বউ। বৈধ সম্পর্কে আবদ্ধ তারা। এ কথা স্মরণ রাখতে হবে দু’জনকেই। আর এ বাসার পুরুষরা বউদের গায়ে হাত তুলে না। এমন হীন- মানসিকতার মানুষ উনারা কেউ নন। বাবার মুখে এত কথা শুনেও রুদ্র দরজা তো খুললোই না বরং রাগে গজগজ করতে করতে স্পর্শীর গাল চেপে ধরলো। সঙ্গে ইশারায় বোঝালো আর একটা টু শব্দ করলে এক্ষুণি মে/রে ফেলবে। তারপর কে/টে টুকরো করে মাগুর মাছের পুকুরে ফেলে আসবে। রুদ্র বা স্পর্শীর আর কোনো শব্দ না পেয়ে দাদীমা সবাইকে যেতে বললেন।
আদেশ পেয়ে সবাই চলে গেলে দাদীমা খিলখিল হেসে বললেন,

-‘সুয়ামি, আমার নাতনি ডা এখুনো মেলা ছুুডু বাসর রাইতের কিচ্ছু বুজে না। তুমি একটু সামলাইয়া লইয়ো। আইজক্কার রাইতে হের উপ্রে গোস্সা কইরো না। পরথম রাইতে গোস্সা কইতে নাই দাদুভাই তয়লে আল্লাহ পাক অসুনতুষ হয়। দিন যাক দেখবা হেতিও আস্তে ধীরে সব শিইখা যাইবো। ততদিন একটু সবুর করো দাদুভাই।’

-‘দাদীমা রুমে যাও। ভুলেও যদি দরজায় আর একটা টোকা দাও, তোমার নাতনীর এমন অবস্থা করবো তুমি তা কল্পনাও করতে পারবে না।’

-‘দাদু ভাই আমার কথাডা শুনো।’

-‘যেতে বলেছি আমি।’

একথা শুনে দরজায় ওপাশ থেকে আর কোনো শব্দ পাওয়া গেল না। তখন স্পর্শী নাক টেনে ভয়ে দাদীমা! দাদীমা! বলে চেঁচিয়ে উঠতেই তার হাতে আরেকটা বারি পড়ল। মার খেয়ে
কান্না আঁটকানোর চেষ্টা করলেও অঝরে অশ্রু ঝরে যাচ্ছে। চোখের পানির সঙ্গে নাকের সর্দি মিলেমিশে একাকার। যখন সর্দিমিশ্রিত চোখের পানি ঠোঁট ছুইয়ে যাচ্ছে তখন সে সড়াৎ করে সেটা টেনে নিচ্ছে। স্পর্শীর এহেন কাজে রুদ্র নাক, মুখ কুঁচকে হাতের ইশারায় উঠে দাঁড়াতে বলল। ইশারা বুঝে সে উঠতে গেলে পায়ে বেনারসি পেঁচিয়ে পড়ল ধপাস করে। শক্ত মেঝেতে ব্যথাও পেয়েছে। ব্যথাতুর শব্দ করে নিতম্বের দিকে হাত বাড়িয়েও হাত গুটিয়ে নিলো। আড়চোখে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, রুদ্র কিছু বুঝেছে না কী। কিন্তু কী বুঝল কে জানে পুনরায় সড়াৎ করে সর্দি টেনে পা থেকে শাড়ি ছুটিয়ে উঠে দাঁড়াল। এরপর আর কিছু বলতে হলো না রুদ্রকে। বরং নিজে নিজেই কান ধরে উঠবস করতে লাগল আপনমনে। তাকে উঠবস করতে দেখে রুদ্র বিছানায় গিয়ে আধশোয়া হয়ে বই নিয়ে বসল। বিরবির করে পড়ছে বইতে দৃষ্টি রেখে। আর তার দিকে দৃষ্টি রেখে স্পর্শী মনে মনে তাকে গালি দিয়ে ধুঁয়ে দিচ্ছে। এমন গালি যা রুদ্র কখনো শুনে নি। শুনবেই বা কী করে এগুলো তো ইন্টেক করা গালি। বাজারে
নতুন এসেছে। এসব ভাবতে ভাবতে তার কান থেকে হাতটা ছুঁটে গেল। রুদ্রকে তাকাতে দেখে জোরপূর্বক হেসে নিজের কাজে মন দিলো। ধূর বাবা, ভাল্লাগে না! বাসরঘরে বউয়ের সঙ্গে কেউ এমন করে? এই রুমে আসার পূর্বে বুড়ি (দাদীমা) কত কিছুই না শিখিয়ে দিলো। রুদ্রকে ভাই না ডাকতে, রুমে ঢুকার সঙ্গে সঙ্গে তাকে সালাম করতে, মিষ্টি খাইয়ে দুধের গ্লাসটা এগিয়ে দিতে। রুদ্র যা যা বলবে তাতে সম্মতি দিতে।
কিন্তু এসব করা তো দূর এই রুমে পা দিতে না দিতেই এমন থাপ্পড় জুটলো যে, থাপ্পড়ের প্রভাবে সব গুলিয়ে ফেললো।
কোথায় সালাম আর কোথায় দুধের গ্লাস চোখে তো পড়লো না। বরং থাপ্পড়ের চোটে দু’চোখে সর্ষে ফুল দেখতে লাগল।
ইস! গালটা এখনো লাল হয়ে ব্যথায় টনটন করছে। ভাগ্যিস কানে মারে নি নয়তো বয়রা হয়ে যেতো। ওই কাশেম বয়রার মতো। লোকটার নাম কাশেম আলী। অথচ কানে কম শুনে এজন্য সবাই তাকে কাশেম বয়রা বলে ডাকে। অচেনা কেউ যদি এসে জিজ্ঞাসা করে, ‘কাশেম আলীর বাসা কোনদিকে?’
পাড়ার কেউ চিনতে পারে না বরং জিজ্ঞাসা করে, এ পাড়াতে
কাশেম আলী বলে কেউ নাই তবে কাশেম বয়রা আছে।আর
কাশেম বয়রার কথা কী বলবো? সে পান কে শুনে কান আর কান কে শুনে যান।পরে ভুলভাল শুনে নিজেই চেঁচিয়ে লোক
জড়ো করে। সবাই যখন বুঝিয়ে বলে দোষটা তার তখন সে কাজের বাহানায় কেটে পড়ে। এইতো গতপরশু দিনের কথা,
স্কুল থেকে ফেরার পথে তার জুতো ছিঁড়ে গিয়েছিল। খুঁড়িয়ে হেঁটে আসার সময় কাশেমের সঙ্গে তার দেখা। কাশেম তাকে দেখলে মুখভর্তি হেসে আগে জিজ্ঞাসা করে, ‘আম্মা, আপনে কিরাম আছেন? শরীর স্বাস্থ্য ভালা তো?’
জবাবে সে যদি বলে ‘ জি, ভালা আছি।’
তখন কাশেম মুখটা এতিমের মতো করে উত্তর দিবে, ‘ কালা আছেন? কালা আবার কেমনে থাকে আম্মা? আমনে বহুত ফর্সা তয় কালা থাকবেন কিল্লায়?’
একথা শুনে তাকে কিছু না বলতে না দেখে কাশেমই বলল,
-‘আম্মা আপনে খুঁড়াইয়া হাটতাছেন ক্যান? পাও (পা) ব্যথা করতাছে?’
-‘আর বলবেন না, জুতোটা ম/রার আর জায়গা পেল না।’
-‘কুত্তা মরছে? কোন কুত্তাডা? আয় হায় আপনে কী 000 তে কল করছেন আম্মা?’
-‘কি আশ্চর্য! কুত্তা মরলে 000 তে কল করতে যাবো কেন?’
-‘যাতে কুরিয়ার সার্ভিসের লোক আইসা কুত্তাডা লইয়া যায়।’
-‘বলেন কী! মরা কুত্তা নিয়া কুরিয়ারের লোকরা কী করবে?’
-‘থুক্কু ওইডা কুরিয়ার সার্ভিসের লোক না কথাডা বলে কুকুর কোম্পানির লোক।’
-‘এ্যাঁ! কুত্তার আবার কোম্পানি কোথায় পেলেন আপনি?’
-‘আম্রপালি? আম্রপালি আম তো গাছে নাই আম্মা তয় পানি আইনা দিমু?’

তারপর সে আর কোনো জবাবই দেয় ন। কারণ কথায় কথা বাড়ে। শুধু বোবার মতো হেসে স্থান ত্যাগ করেছে। সেদিনের কথাগুলো মনে হতেই সে মিটিমিটি হাসতে লাগল। তারপর কী মনে করে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে দেখে রুদ্র ঘুমিয়ে গেছে।
এটাই মোক্ষম সুযোগ ভেবে সে পা টিপে হেঁটে দরজায় খুলে ভৌ দৌড়। সেকেন্ডের মধ্যেই আবার ফিরে এসে দরজা বন্ধ পুনরায় দৌড়। স্পর্শী যাওয়ার পরপর রুদ্র উঠে বইটা রেখে ভালোভাবে শুয়ে পড়লো। রাত অনেক হয়েছে আগামীকাল খুব ভোরে উঠতে হবে। ওইদিকে, স্পর্শী নিজের রুমে গিয়ে শাড়ি একটানে খুলে বিছানায় ছুঁড়ে মারলো। তারপর বিরক্ত মুখে তাকিয়ে রইল পেটিকোটের নাড়ের দিকে। নাড়ে গিট্টু বেঁধে বসে আছে। ইস, জরুরি প্রয়োজনে ওয়াশরুমে যাওয়া প্রয়োজন! এখন কি হবে? এজন্য বুঝি বলে বিপদের উপরে বিপদ না এলে বিপদ মানায় না। সে আর দাঁড়িয়ে না থেকে জ্যামিতি বক্স খুজতে লাগল। কিন্তু এখানে ওখানে খুঁজেও
জ্যামিতি বক্সের সন্ধান পেল না। তাই হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে
পিছনে ঘুরতেই নজর গেল ড্রেসিংটেবিলের চিপায়। দ্রুত উবু হয়ে জ্যামিতি বক্স খুলে দেখে কাঁটা কম্প্যাস নেই। পরিশেষে রাগে দুঃখে কাঁচি দিয়ে পেটিকোটের নাড় কেটে উদ্ধার হলো।
তারপর ফ্রেশ হয়ে এসে চার পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে পড়ল আপন শয্যায়। পরেরদিন সকালে মায়ের ঝাঁকুনিতে স্পর্শীর ঘুম ভাঙল। তাকে এই রুমে দেখে মায়ের প্রশ্নের শেষ নেই।
এত প্রশ্নে ভিড়ে খুব বিরক্ত হয়ে উঠে বসলো সে। তখন তার মা পুনরায় জানতে চাইলেন,

-‘কি হলো উত্তর দিচ্ছিস না কেন? এই রুমে কেন তুই?”

-‘রুদ্র ভাই বাড়াবাড়ি করছি তাই বাধ্য হয়ে পালিয়ে এসেছি।’

-‘রুদ্র এখন তোর স্বামী। বাবা মায়ের পরে স্বামী হচ্ছে একটা মেয়ের সবচেয়ে আপনজন। আর বাড়াবাড়ি করেছে মানে কী? সে যদি.. তুই তার বউ তার অধিকার আছে তোর কাছে যাওয়ার।’

-‘কি আশ্চর্য! তুমি কি পাগল টাগল হয়ে গেলে নাকি আম্মু?
স্বামী, বাড়াবাড়ি,, কাছাকাছি এসব কোথা থেকে এলো? কী বলছো এসব?’

মেয়ের কথা শুনে এবার স্পর্শীর আম্মু নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। উনি অন্যভাবে কথাটা ধরেছেন। তারপর কথা কাটাতে দ্রুত ফ্রেশ হতে বলে উনি প্রস্থান করলেন। স্পর্শী
আর একটু শুয়ে এপাশ ওপাশ করে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে গেল। নিচে গিয়ে দেখে সবাই খেতে বসেছে সেও তার চেয়ার টেনে খেতে বসল। একটুপরে রুদ্র এসে বসল তারা সামনের চেয়ারে। সেই জমিদার আবার সকালে বেশি কিছু খায় না। তাই তাকে শুনানোর জন্য সে বড় মা বলল,

-‘বড় মা আমাকে আরো দু’টো সিদ্ধ ডিম দাও। গতরাতে খুব ধকল গেছে আমার। অনেক ক্যালরিও লস হয়েছে। তোমার ছেলে স্বামী হিসেবে খুব খারাপ। খারাপেরও খারাপ। বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি করেছে গতরাতে।’

একথা বলতে দেরি কিন্তু ওর পিঠে কিল পড়তে দেরি হয় নি।
এক কিল খেয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে আম্মুর দিকে তাকিয়ে আছে স্পর্শী। কারণ মেরেছে তার আম্মুই। কিল মেরে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মরিয়ম বেগম। যেন তৈরি হয়ে আছে আরেকটা কিল বসানোর। কিল খেয়ে স্পর্শী কাঁদতে লাগল।আজকাল দুঃখের কথা বললেও মার খেয়ে হয়। গতরাতে রুদ্র যা করেছে তাই তো বললো দোষের কিছু তো বলে নি।
কাঁদতে কাঁদতে সে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে খেয়াল করল রুদ্র হাসছে। তার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা লুকোচুরি করছে।
সেই সঙ্গে তাকে তাচ্ছিল্য করে বলছে, ‘বেশ হয়েছে।’ তার হাসি দেখে স্পর্শী চোখ মুছে রুমের দিকে পা বাড়াল। আর মনে মনে বলল,

-‘মার খেতে দেখে হাসলে তো? ওকে, এবার তুমিও তোমার
পছন্দের শার্টগুলো আমার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না।’

চলবে।

সখি পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0

#সখি
#পর্ব- ২য় ও শেষ পর্ব
লেখা- নাসরিন সুলতানা

সন্ধ্যার পর সাবের বাড়ি ফিরলো।
বাড়িতে পা দিয়েই মনে হলো আজকে বাড়িটা কেমন চুপচাপ হয়ে আছে।
এমনিতেও ওদের বাড়িটা চুপচাপই থাকে আরও বেশি মনে হচ্ছে।
বসার রুমে নেলি বসেছিল।
সাবেরকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
যেন সে কোন অদ্ভুত বস্তু।
সাবের বলল – কি ব্যাপার এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
নেলি মৃদু কন্ঠে বলল – কোন ব্যাপার না এমনিই তাকালাম। তোমার দিকে তাকালে কোন সমস্যা আছে? সমস্যা হলে বল আর তাকাবনা।

সাবের অবাক হল! কি হলো নেলির?একেবারে সাবেরের মতো করে কথা বলছে। সকালেও তো বেশ ভালোই ছিল।
– যতো ইচ্ছে তাকাও সমস্যা নেই, তাকানো শেষ হলে আনুর মাকে বল কড়া করে চা দিতে। সাথে যেন কিছু দেয় ক্ষিধে লেগেছে। আমি গোসলে যাচ্ছি।
নেলি বলতে চাইল- আনুর মা নেই, মা-বাবাও নেই। বুবুকে নিয়ে হসপিটালে গেছে।
একজন ক্ষুধার্ত মানুষকে এসব বলা ঠিক না।
তাই সে বলল – তুমি ফ্রেস হও আমি নাস্তা দিচ্ছি।
চা খেতে খেতে সাবের হঠাৎ প্রশ্ন করল – বাসায় কি কিছু হয়েছে?
নেলি সে কথায় উত্তর না দিয়ে বলল – তোমরা বাসায় এতোজন সুস্থ মানুষ সবাই মিলে বুবুর মতো একজনকে ভালোবাসা দিয়ে ভালো রাখতে পারোনা?
সাবের চুপ করে রইল।
নেলি ভেজা গলায় বলল – বুবুকে হসপিটালে নেয়া হয়েছে, দুপুরে খায়নি বলে সেন্সলেস হয়ে গেছে বুবু। আমি সত্যিই বুঝিনা কারা অসুস্থ তোমরা না কি বুবু?
নেলি ঠিক জায়গায় আঘাত করেছে। সত্যিই কতদিন বুবুকে সে ঠিক করে খেয়াল করেনা, কথা বলা তো দূরে থাক।
বুবুর অসুখ ধরা পড়ার পর ডাক্তার বার বার করে বলেছিলেন সিজোফ্রেনিয়ার পেশেন্টকে আদর, ভালোবাসায় রাখতে হয়।
এই বুবুকে নিয়ে প্রশ্ন তোলায় সে তার প্রথম প্রেম, ক্যারিয়ার সব ছুড়ে ফেলেছিল ।

সাবের প্যান্ট পরে আবার বেরিয়ে পড়ল হাসপাতালে যাওয়ার জন্য।
বের হওয়ার মুখেই দেখে বাবা, মা ফিরে এসেছেন বুবুকে নিয়ে।
– কি হয়েছে বুবুর? সাবের উদ্বেগের সাথে বলল।
– যা হয় আর কি, আমার মেয়ে তো ভড়ং করে। সেলিনা শান্ত কিন্তু অভিমানের সুরে বললেন।
– চুপ করো তো সেলিনা, আগে ঘরে গিয়ে বস। কামাল সাহেব বলে উঠলেন।
ঘরে যেয়ে বসলেন সেলিনা। ক্লান্ত গলায় বললেন- প্রেসার, সুগার দুটোই কমে গিয়েছিল, তেমন সিরিয়াস কিছুনা। তোমরা ব্যস্ত হয়োনা।
মেহেরজান সাবেরকে দেখে বলল – তুই আজ এতো তাড়াতাড়ি ফিরে এলি ভাই? মুখটা কি শুকনো লাগছে। ও সখি ভাইকে খেতে দে তো।
মেহেরজানের মনেই নেই বিকেলের কথা।
সাবের একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবল – আহারে, আমার বোনটা কি মায়াবতী!
সাবের থেকে মাত্র দেড় বছরের বড় বুবু। দু’জন একসাথেই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলো। বুবু এক ক্লাস উপরে । প্রাইমারি স্কুল, একগাদা স্টুডেন্ট। ভীতু সাবেরের ভরসা ছিলো বুবু। তার ক্লাসে এনে সাবেরকে বসিয়ে রাখতো বুবু। মাত্র দেড় বছরের বড় তবুও কিভাবে সাবেরকে তখন থেকেই আগলে রাখত। বুবু যখন ক্লাস নাইনে তখন থেকেই কেমন অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে দিল।
প্রথম দিকে মা বিরক্ত হয়ে মার লাগাতো। আস্তে আস্তে বুঝা গেলো এটা একটা মানষিক রোগ।
কতো কবিরাজ, ডাক্তার দেখানো হলো! শেষে মেন্টাল থেরাপি ইলেক্ট্রিক শকও দেয়া হলো। কাজের কাজ কিছুই হলোনা। বুবু আর আগের বুবু হয়ে উঠলোনা। কি কষ্ট আর মন খারাপ করা দিন যে গেছে! কেউ বললো বিয়ে দিলে ঠিক হবে। মা রাজি হলেন না। এমন অসুস্থ মেয়েকে বিয়ে দিলে সেটা আরও খারাপ হতে পারে ভেবে।
আস্তে আস্তে সাবেরদের হাসিখুশি বাড়িটা কেমন মরে গেল। মা চুপচাপ হয়ে গেলেন। বাবাও কেমন দূরে সরে গেলেন। ভাইয়া বিয়ে করলো ঠিকই কিন্তু মিথি ভাবি এসে বাড়িটাকে জাগিয়ে তুলতে পারলোনা। সারাক্ষণ বিরক্ত হয়ে থাকে মিথি ভাবি। বুবু একটু উলটা পালটা কিছু করলেই কপাল কুঁচকে ফেলেন। বহুদিন পর নেলি এসে বাড়িটাকে আস্তে আস্তে জাগিয়ে তুলছে। বুবু ঠিক নাম দিয়েছে নেলির। কি মিষ্টি নাম সখি! বুবুর সখি তবে সাবেরের কেন নয়? প্রথম থেকেই ওকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল সাবের। কিন্তু ও কিভাবে যেন মনের এতো কাছে চলে এসেছে সাবের নিজেই জানেনা।
সাবেরর বুকটা কেমন ভারী হয়ে আছে। অনেক দিন পর সেই ছোট বেলার মতো বুবুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
**********

রাতের খাওয়ার পর কামাল সাহেব সবাইকে নিয়ে বসলেন।
কোন ভনিতা না করে ছেলেদের বললেন- দেখ তোমাদের যার যার সংসার হয়েছে এখন তোমাদের মা-বাবাকে প্রয়োজন নেই। তোমার মা আর আমি ঠিক করেছি মেহেরকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যাব।
সাবের বিষন্ন গলায় বলল- বাবা, এটা ঠিক না। মা-বাবা তো সন্তানের আত্মার সাথে মিশে থাকে।
– তোমার কথা শুনে খুশি হতাম সাবের, যদি তুমি নিজের দিকে তাকাতে আগে। আত্মার সাথে মিশে থাকার কথা বললে? বলতে পারবে আমি রাতে কখন খাই, কখন ঘুমাই?
– বাবা, তুমি তো জান আমি রাতে দেরি করে বাসায় আসি। এসে দেখি তোমরা ঘুমিয়ে গেছ।
– কেন দেরি করে আস? কি কাজ কর তুমি? ইচ্ছে করেই তুমি এমন কর। এসব করে নিজের জীবনকে কোথায় দাড় করিয়েছো সেই খেয়াল আছে?
সাবের চুপ করে রইলো।
তিনি আরও বললেন – সব তোমার দায়িত্ব এড়ানোর অজুহাত।
আবেদ বলল- বাবা, আমাদের ভুল হয়ে গেছে। আসলে নানান ব্যস্ততায় তোমাদের দিকে খেয়াল করা হয়না কিন্তু তোমাদের দু’জনকে ছাড়া এই বাড়ি অচল।
কামাল সাহেব ম্লান হাসলেন।
বললেন – দেখলে তো কাছে থেকেও সম্পর্ক কতো দূরের হয়ে যায়।
– বাবা মেহের সব সময় ডাক্তারের ট্রিটমেন্টে আছে ওকে নিয়ে গ্রামে চলে যাবে এটা কেমন কথা?
-কিন্তু মেহের এমন অবস্থায় আছে ওকে ফেলে রেখে মরতেও আমার ভয় লাগবে, আল্লাহ মাফ করুন এমন কথা আমাকে বলতে হচ্ছে।
আবেদ কিছু বলতে যাচ্ছিলো।
তিনি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন – আমার যা বলার তা বলা হয়ে গেছে এর আর অন্যথা হবেনা।
আমি উঠছি ঘুমানোর সময় হলো আমার।
কামাল সাহেব উঠে পড়লেন, সেলিনাও সাথে গেলেন।

ঘরের সবাই চুপ করে রইলো।
মিথি ভাবলো কি এমন হয়েছে যে বাড়ি ছাড়তে হচ্ছে। মেহেরকে এসাইলামে দিলেই হয়। আজাইরা দরদ পাগলের জন্য। আজ প্রায় ওকে মেরেই ফেলছিলো।
মিথি বললো – তোমরা সবাই মনে হয় আমাকেই দায়ী করছো আজকের ঘটনার জন্য।
সাবের বলে উঠলো – মনে হয় আবার কি তুমি তো বুবুকে দেখতেই পারোনা।

– সাবের তুমি কিন্তু সব সময়ই সীমা ছাড়িয়ে কথা বলো।
– আর তুমি সীমা ছাড়িয়ে অকাজ করো, পাষন্ড মহিলা। আজ যদি বুবুকে চলে যেতে হয় তার জন্য তুমিই দায়ী।
মিথি এবার আবেদের দিকে তাঁকিয়ে বললো – দেখলে তোমার ভাইয়ের ব্যবহার? এ বাড়ির কোন মানুষটা সুস্থ বলো তুমি? কারোর যেতে হবেনা আমিই চলে যাব এখান থেকে।

আবেদ বললো – তোরা থামবি এবার? কি বাজে ঝগড়া শুরু করলি? বাবা-মায়ের রাগটা আগে ভাঙা।

নেলি চুপ করে সব কথা শুনছিলো সে বললো – মা-বাবারা সন্তানের উপর রাগ করলেও সেটা ধরে রাখেন না। ভাইয়া, জানি বুবুকে সবাই ভালোবাসেন, তবে আর একটু সহনশীল হতে হবে বুবুর প্রতি।

আবেদ বললো- মেহের এমন আচরণ করে মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে।

– ভাইয়া, বুবু আমাদের জন্য আল্লাহপাকের তরফ থেকে একটা পরীক্ষা, আমাদের জন্য অনেক বড় নিয়ামতও।
– তা ঠিক।
– বুবু ইচ্ছে করে এমন করেনা, এটাই তার অসুখ। আমাদের বুঝতে হবে সেটা।

মিথি ব্যাঙ্গ করে বললো। – আচ্ছা তুমি মেহেরজানের সব ঢং সহ্য করে আল্লাহপাকের সব নিয়ামত নিয়ে নাও, আমরাও চেষ্টা করবো ওর ঢংয়ের সাথে মানিয়ে নিতে। মেহেরজান তো আবার তোমার সাথে সখি পাতিয়েছে।

নেলি অসহায়ভাবে সাবেরের দিকে তাকালো।
সাবেরের চোখে একইসাথে বিষ্ময়, মুগ্ধতা আর কৃতজ্ঞতার ছোঁয়া।

আবেদ বললো – আমি নেলির সাথে একমত।
আমার বোন এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে তার মনে আরও বিরূপ প্রভাব পড়বে। ও আরও অসুস্থ হয়ে যাবে।
– বাবাকে বুঝাতে হবে, যা একরোখা মানুষ। সাবের বললো।
নেলি বললো – ভাইয়া, মা-বাবার সবচেয়ে দুর্বল জায়গা হচ্ছে বুবু। বুবুকে সবাই যদি একটু যত্ন, একটু আদর করেন, দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।
আবেদ ধরা গলায় বললো – আমরা নিজেদের নিয়ে এতো ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম সত্যিই শেষ কবে মেহেরের সাথে গল্প করেছি মনে নেই। অথচ আমাদের মনোযোগ ওর বেশি দরকার।
মিথির ঘুম পাচ্ছিলো। সে বললো – আমি উঠছি, ঘুম পাচ্ছে। আবেদকে রেখেই সে উঠে পড়লো।
সাবের একবার ভাবলো ভাবিকে দু’টো কড়া কথা শুনিয়ে দেয়। কি ভেবে সেটা আর করলোনা।
কিছু কিছু ঘটনা অনভিপ্রেত হলেও ঘুমন্ত অনুভূতিতে টোকা দেয়। আজকের ঘটনাটি সেই রকমই। সাবেরের ঘুমন্ত অনুভূতি জেগে উঠেছে।
জীবনের সুখগুলো বারবার ধরা দেয়না।
ধরা দেয়া সুখকে পায়ে মাড়ানোর মত বোকামি সে আর করবেনা। আগামীকাল সকালে মা-বাবার পা ধরে বসে থাকবে সে। যেভাবেই হোক বাবার রাগ ভাঙাতে হবে।
আবেদ বললো – আমি একটু মেহের কে দেখে আসি
আবেদের আজ মন কেমন কেমন লাগছে কতো দিন ছোট বোনটার সাথে ভালো করে কথা হয়না।
মেহেরের ঘরে যেয়ে দেখলো মেহের শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছে। আবেদ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলো। তার বুকের ভেতর চিনচিন করতে লাগলো।
তার সুস্থ বোনটা কিভাবে হুট করে অসুস্থ হয়ে গেলো। মানুষের ব্রেন কি জটিল একটা জিনিস!
একটু এদিক সেদিক হলেই সর্বনাশ হয়ে যায়।
মেহের আবেদকে দেখে উঠে বসলো।
একদম সুস্থ মানুষের মতো বললো – ভাইয়া, ইউটিউবে পুরানো মুভি দেখছি দেখবে নাকি?
– কি মুভি রে?
– সান ফ্লাওয়ার, সুফিয়া লোরেনের। কি অসাধারণ মুভি। শেষ সিনটা আমি সহ্য করতে পারিনা। চোখে পানি চলে আসে।
– কষ্টের মুভি আমি দেখিনা, হাসির মুভি হলে দেখতে পারি।
– আচ্ছা, তাহলে মিস্টার বিন দেই?
– এখন মুভি দেখবোনা।
– তাহলে আমাকে কি বলতে এসেছো বলে চলে যাও। তোমার বউ আবার কথা শুনাবে।

আবেদ হেসে ফেললো। মেহেরজানের এই স্বাভাবিক আচরণ দেখে মিথি ভাবে ওর অসুখটা হয়তো ঢং।

– বলতে এসেছি, বাসায় কোন আনন্দ নাই, কেমন মেন্দা মারা আবহাওয়া। একটা কিছু কর যেন সবাই মিলে একটু আনন্দ করতে পারি।
– হ্যাঁ, আসলেই তো অনেক দিন আনন্দ করা হয়না।এর জন্য সাবের দায়ী। আমার সখিকে সে খুব কষ্ট দেয়। কেন দেয় জানো?
– জানিনা তো।
– ভালোবাসে বলেই কষ্ট দেয়।
– কি বইয়ের ভাষায় কথা বলিস!
– আমি জানি, জানি। বলেই মেহের মিটিমিটি হাসতে লাগলো।
আবেদ আর ওকে ঘাটালোনা। বোনের মাথায় হাত রেখে বললো – তোর অনেক বুদ্ধি। কতো কিছু বুঝে ফেলিস যা হয়তো সাবের নিজেই বুঝেনা।
– তুমি ঘুমাতে যাও ভাইয়া, আমি ভেবে বের করি আনন্দের জন্য কি করা যায়।

**************
আজ প্রিয়ংবদা বাড়িটায় বেশ উৎসব উৎসব ভাব।
প্রথমে কথা ছিলো সাবের সবাইকে বাইরে খাওয়াবে।
মেহেরজান ভেবে বের করেছে ছাদে বারবিকিউ পার্টি হবে। আজকাল সবাই কতো রকম পার্টি করে। তাদের বাড়িতেই কিছু হয়না।
আজ রান্না থেকে মাকে ছুটি দেয়া হবে।
সবাই মিলে রান্না করবে।
মেনু হল চিকেন বারবিকিউ এর সাথে পোলাও, মাছের কাবাব, খাসির মাংস। ডেজার্টে থাকবে ঘরে পাতা টক মিষ্টি দই।
মিথি বললো – বারবিকিউ এর সাথে নান খায় মানুষ পোলাও খায়না।
আবেদ বললো – মানুষ যা খুশি খাক, আমরা পোলাও খাবো।
অনেক বছর পর সেলিনার আজ খুব ভালো লাগছে। মেহেরজানের জন্য তার যে ভাবনা ছিলো নেলি তার অনেকটাই দূর করেছে।
তিনি দূর থেকে রান্নার তদারকি করছিলেন।

কামাল সাহেব বললেন – ছেলেমেয়েরা কি রাঁধতে কি রাঁধবে শেষে অখাদ্য হবে। যাওনা তুমি একটু দেখ।

– একদিন অখাদ্যই খাওনা। আজ আমার ছুটি। সেলিনা রেগে বললেন।

কামাল সাহেব আর কথা বাড়ালেন না।
তার বড় ভালো লাগছে। বাড়িটা যেন বিষন্নতা কাটিয়ে ঝলমল করছে। হয়তো এটা সাময়িক আনন্দ। তবুও হোক না কিছু আনন্দ।
জীবনে হতাশা, গ্লানি, কষ্ট, ক্লেদ যেমন আছে তেমনি সুখ, আনন্দও আছে।
মেঘের আড়ালে সূর্য হাসি মুখে লুকিয়ে থাকে।
সূর্যের হাসি মুখ দেখার জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়।
কামাল সাহেবও অপেক্ষা করবেন।

সাবের আজ বাসা থেকে বের হয়নি। মেহেরজানের কড়া হুকুম। সাবেরের ঘাড়ে দায়িত্ব পড়েছে মাছের কাঁটা বেছে কাবাবের জন্য রেডি করা। এটা যে এতো কঠিন কাজ, তার জানা ছিলোনা। তার খুব মেজাজ খারাপ হচ্ছে। নেলিও আশেপাশে নেই, তাহলে ওর উপর ঝামেলা দিয়ে সে কেটে পড়তে পারতো। নেলি আনুর মায়ের সাথে মুরগী কাটছে।
মিঠু তার পাশে ঘুরঘুর করছিলো।
সাবের বললো – যা তো বাবা, হাত ধুয়ে এসে মাছের কাঁটা বেছে দেখ খুবই মজার কাজ।
মিঠু গম্ভীর হয়ে বললো – আমি কাঁটা বাছতে পারিনা।
সাবেরের আর কিছু করার নেই সে বিরক্ত হয়ে মাছ থেকে কাঁটা আলাদা করতে লাগলো।

*********
রাত গভীর হওয়ার পর সবাই ঘুমুতে চলে গেছে।
শুধু মেহেরজান তার অভ্যাস মতো জেগে রইলো।
নেলির কেনো যেনো ঘুম চটে গেছে।
সে বারান্দায় বসে রইলো।
সাবের হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে।
আজ রাতে মনে হয় ঘুম আসবেনা।
নেলির মন কেমন হাহাকার করে উঠলো।
খুব মায়ের কথা মনে হচ্ছে।
বেলিটার বিয়ের বয়স হয়ে গেছে।
মা না জানি কত চিন্তা করে বেলিকে নিয়ে।
বেলিরও একদিন সংসার হবে। অচেনা, অজানা মানুষদের সাথে থাকতে হবে। সেখানে যদি ঘরের মানুষটাই পরের মতো ব্যবহার করে তখন কি যে কষ্ট হয়। নেলির মন খারাপ ভাবটা আরও ভারী হলো।
রাত বাড়ার সাথে সাথে কেমন রহস্যময় আঁধার ঘিরে আছে চারপাশটাকে।
সেই আঁধারে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নেলির মনে হলো তার এইটুকু জীবনে মানিয়ে চলতে চলতে ক্লান্তি এসে গেছে। বুবুই ভালো আছে। নিজের এক জগতে নিজেই রানী।
নেলির পাশে এসে সাবের দাঁড়ালো। নেলিকে তার কিছু কথা বলার ছিলো। তার মনে হলো আজকে যদি কথাগুলো বলা না হয় তাহলে হয়তো আর বলা হবেনা। কিছু কিছু কথা বলার জন্য পরিবেশ তৈরি করতে হয়। আজ যেন সেই পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
সাবেরের কিছুটা দ্বিধা লাগছে। বিয়ের পর থেকে নেলি তার খারাপ মেজাজই দেখেছে।
সে কিভাবে শুরু করবে ভাবছিল।
নেলি সাবেরকে দেখে অবাক হলোনা।
বললো – জেগে আছো এখনো?
সাবের বললো – পাশের একজন যদি জেগে থাকে তাহলে কি ঘুম আসে?
– আমি তো প্রায়ই রাত জাগি, অন্ধকার কেটে কিভাবে দিনের আলো ফুটে সেটা দেখি।
– একদিন আমাকে নিয়েও তো দেখতে পারতে। সাবের কেমন উদাসী গলায় বললো।
– ও বাবা, তোমাকে নিয়ে দেখার উপায় আছে।
তুমি বলতে অন্ধকার কেটে কিভাবে দিনের আলো ফুটে সেটা দেখার কিছু নেই। ফালতু জিনিস।
সাবের হেসে ফেললো।
নেলি অবাক হলো। এ কোন সাবের! হীরে কি কখনো গলে!
– তুমি তো হীরের টুকরো ছেলে, হীরের মতই কঠিন।
– কে বলেছে তোমাকে এসব ফালতু কথা?
নেলি আর বললনা বড় মামী বলেছে। সেটা বললে খুব হাস্যকর শুনাবে।
সে আমতা আমতা করে বললো – আমার মনে হয়েছে।
– তোমার আর কী মনে হয়েছে?
– মনে হয়েছে তুমি আমাকে দেখতে পারনা।
সাবের আবার হাসলো।
– তোমার সম্পর্কে আমার কি মনে হয়েছে শুনবে?
নেলির খুব শুনতে ইচ্ছে করছিলো তবুও সে চুপ করে রইলো।
সাবের বললো- আমার মনে হয়েছে এই মেয়েটা বুবুর সখি, কিন্তু আমার সখি কেন হচ্ছেনা।
নেলি কেঁপে উঠল আবেগে। সাবের হালকা করে নেলির চিবুক ধরে বললো – আজ আমরা দু’জন একসাথে ভোর হওয়া দেখবো। তুমি একটু বস, আমি দু’ কাপ কফি বানিয়ে আনি।

নেলি বসে আছে। সাবের গেছে কফি বানাতে। তার যদিও খুব ইচ্ছে করছে সাবেরের পাশে যেয়ে কফি বানানো দেখতে। আবার অপেক্ষা করতেও ভালো লাগছে। একই সাথে দু’রকম ইচ্ছে কেবল মানুষেরই হয়। রাতের অন্ধকার আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে।
সাবের আসছে, তার পায়ের শব্দ আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
নেলি বসে আছে, ভালোবাসার অপেক্ষায়। যে ভালোবাসার জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা করা যায়।

সমাপ্ত।

সখি পর্ব-০১

0

#সখি
পর্ব- ১
লেখা- নাসরিন সুলতানা লেখা- নাসরিন সুলতানা

নেলির বিয়ে হয়েছে মাত্র ঊনিশ দিন।
এই ক’দিনেই নেলি বুঝে গেছে ওর বর সাবের বেশ বদমেজাজী টাইপের।
নেলির শ্বশুর বাড়িটার বেশ একটা বাহারি নাম আছে। বউ হয়ে আসার ক’দিন পর নেলি বেশ কৌতুহল নিয়ে সাবেরকে জিজ্ঞেস করেছিল – আচ্ছা, বাড়ির নাম প্রিয়ংবদা কে রেখেছে?
সাবের বিছানায় শুয়ে বই পড়ছিল, বেশ খটমটে টাইপের জটিল বই।
সে বই থেকে মুখ তুলে ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলল – এতো বাজে প্রশ্ন করো কেন ? বাড়ির নাম কে রেখেছে সেটা জেনে তুমি কি করবে?
নেলির বড্ড লজ্জা লাগল।
এটা যে বাজে প্রশ্ন সে বুঝতে পারেনি।
নেলি আরও অনেক কিছু বুঝেনা।
এই যেমন তার বরের মেজাজের উঠানামা।
এতো মেজাজি! নেলির কথা বলতেই ভয় লাগে।

অথচ বিয়ে ঠিক হবার পর ওর বড় মামী খুশিতে গদগদ হয়ে নেলির মাকে বললেন – তোমার মেয়ের রাজকপাল বুবু। হীরের টুকরো ছেলে পাইসো নেলির জন্য। কি বড় খান্দান! শ্বশুর ডাক্তার ভাবা যায়!

নেলির মা রাহেলা আমতা আমতা করে
বললেন – রওশন আমার বড় ভয় করছে। আমার খান্দানের দরকার নাই ওরা আমার নেলিকে ভালোবাসবে তো?
বড় মামী রওশন বিয়ের ঘটকালি করেছেন।
তিনি হাত ঝাড়া দিয়ে বললেন – রাখো তোমার ভালোবাসা, বিয়েই তো হচ্ছিলোনা। বাবা নেই, পরের বাড়িতে আশ্রিত এমন মেয়েকে বিয়ে দেয়া কি কঠিন!

রাহেলা আর কথা বাড়ালেন না।
আসলেই নেলির বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি নিজেদের বাড়িটা ভাড়া দিয়েছেন।
দুই মেয়ে নেলি আর বেলিকে নিয়ে ভাইয়ের বাড়িতে উঠেছেন শুধুমাত্র মেয়েদের নিরাপত্তার কথা ভেবে।
ভাইয়ের বউ কথায় কথায় সেই খোঁটা দিতে ছাড়েনা।
অথচ তাদের তিনজনের খরচের টাকা মাসের প্রথমেই তিনি রওশনের হাতে তুলে দেন।
আল্লাহর উপর ভরসা করে রাহেলা ভয়ে ভয়েই বিয়েতে রাজী হয়েছিলেন।
বিয়ের আগের রাতে নেলিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন -একটু মানিয়ে চলিস মা।
নেলি অবশ্য এমনিতেই মানিয়েই চলতো।
মানিয়ে চলার ভালো একটা গুন নেলির আছে।
********

প্রিয়ংবদা নামের বাড়িটিতে প্রচুর জায়গা।
বাড়িটা তেমন আহামরি না যদিও, তবুও
প্রথম দিনই নেলির বাড়িটার প্রতি মায়া পড়ে গেলো। কেমন যেন শান্তি শান্তি ভাব আছে।
বড় মামী খান্দান আর হীরের টুকরো ছেলে বলে যে বয়ান দিচ্ছিলেন দেখা গেলো সেটাও অনেকটা বাড়িয়ে বলা।
নেলির শ্বশুর কামালউদ্দিন ডাক্তার, কিন্তু রিটায়ার্ড করেছেন।
এখন আর তিনি প্র‍্যাকটিস করেন না।
তার কাজ বাজার করা, আর পাড়ার মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে মসজিদেই অনেকটা সময় কাটানো। বেশ সরল মানুষ, কিন্তু চট করে রেগে যান। শুধু একটাই সমস্যা করেন প্রতি বেলায় টাটকা এবং গরম খাবার ছাড়া খেতে পারেন না।
সেই রান্নাটা আবার নেলির শাশুড়ি সেলিনাকেই করতে হয়। অন্য কারোর হাতের রান্না তিনি খেতে চাননা।
সেলিনার বেশিরভাগ সময় রান্না ঘরেই কাটে।
অবসর পেলে ঘুমিয়ে না হয় বই পড়েন তিনি।
এ বাড়িতে সাবেরের বড় ভাই আবেদ বউ বাচ্চা নিয়ে থাকে।
আবেদ একটা কলেজের প্রভাষক ।
আবেদের বউ মিথিও একটা স্কুলে আছে।
দুইটা বাচ্চা তাদের, বড়টা ছেলে মিঠু।
ছোটটা দেড় বছরের মেয়ে নাম আনা ।
সাবেরের বড় বোন মেহেরজানও থাকে বাড়িটায়। মেহেরজানের এই বাড়িতে থাকার কথা নয়, এই বয়সে সাধারণত মেয়েদের বিয়ে হয়ে স্বামী সংসার হয় কিন্তু মেহেরজান জটিল মানসিক রোগ সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। তাই আর বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়নি ওকে। বত্রিশ বছর বয়সী মেহেরজানকে দেখে নেলি অবাক! মানুষ এতো সুন্দর হয়!
নেলির বর সাবেরকে হীরের টুকরো ছেলে বলা যেতে পারে কারণ সাবের খুব ভালো ছাত্র ছিল।
হীরের দ্যুতির মতই উজ্জ্বল রেজাল্ট করার পর বুয়েটের আর্কিটেক্ট এ ভর্তি হয় সে। কিন্তু দু’বছর পড়ার পর সে পড়াশোনা ছেড়ে দিল। ছ’মাস ঘরে বসে থাকার পর হিস্ট্রিতে অনার্স ভর্তি হয়ে এক বছর পর সেটাও বন্ধ করে দিল। এরপর বাবার পিড়াপীড়িতে বিএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফার্স্ট ক্লাস থার্ড হয়ে আবার তার হীরক দ্যুতির পরিচয় দেয়। মাস্টার্স শেষ করে একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি নেয়। কিন্তু তার বিখ্যাত মেজাজের জন্য বেশিদিন চাকরি করতে পারেনি।
এখন চেষ্টা করছে গ্রামের বাড়িতে একটা ফার্ম দিতে, এই ফার্ম নিয়েই সে ইদানীং খুব ব্যস্ত।
হীরে খুব কঠিন রত্ন। এর ব্যবহারও বিচিত্র ধরনের।
কখনো অলংকার হিসাবে আবার কখনো কাঁচ কাটার জন্য হীরে ব্যবহার করা হয়। হীরা কাটতে হলেও হীরা লাগে।
নেলি অসহায় হয়ে ভাবে হীরে বাইরে থেকে দেখতেই দ্যুতিময়, কিন্তু ভেতরটা শক্ত পাষাণ।
নেলির জীবন কাটতে লাগলো পাষাণ হীরের সাথে!

********

দিনে দিনে নেলি এই বাড়ির সাথে তার জীবনকে জড়িয়ে ফেলল।
এ বাড়ির শ্যাওলা জড়ানো উঠান, ঝাঁকড়া আম গাছ আর অযত্নে বেড়ে উঠা মাধবীলতার ঝাঁড় যেন নেলির কতো চেনা!
অথচ নেলি এই বাড়িতে এসেছে মাত্র নয় মাস সতেরো দিন। একদম নির্ভুল হিসাব। নেলি প্রতি রাতে শুয়ে শুয়ে হিসাব করে।
মাঝে মাঝে নেলির মনটা বড্ড উচাটন হয়ে উঠে।
তখন মন চায় বাসা থেকে বেড়িয়ে কোন অজানায় চলে যেতে। সেটা সম্ভব নয় বলে সে নানান কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে।
আজ নেলির দিনটাই শুরু হলো উলট পালট কষ্টের ভেতর দিয়ে। সাবের ভোর বেলা বের হয়ে যাওয়ার সময় কিছু খায়না। সাধলেও লাভ নেই তাই নেলি সাধেওনা।
আজ বের হবার সময় সাবের খুব স্বাভাবিক গলায় বললো- নেলি, ঝটপট কিছু খেতে দাও।
নেলি ফ্রিজ খুলে খাওয়ার মতো কিছু পেলোনা।
তাড়াতাড়ি আটা গুলে রুটি বানাতে গেলো।
সাবের সেটা দেখে বলল – থাক কিছু লাগবেনা, আমি বাইরে খেয়ে নেব।
নেলি বললো – একটু বস আমার দু’মিনিট লাগবে।
সাবের হেসে বললো- দু’মিনিটে তো হবেনা, তাও শুধু শুধু সময় বেঁধে দিলে! মানুষ কেন যে অকারণে সময় বেঁধে দেয়।
পাষাণ লোকটা নেলির মন খারাপ করিয়ে দিয়ে আনমনে বের হয়ে গেল।
নেলি নিজেকে ব্যস্ত রাখতে শাশুড়ীর সুতির শাড়িগুলো বের করে হালকা মাড় দিয়ে দিলো। কেমন ম্যাড়মেড়ে শাড়ি পরেন মা!
উঠানের তারে কাপড় মেলতে মেলতে দেখে মিঠু ফিচফিচ করে কাঁদছে।
এই ছেলেটা এতো ছিঁচকাঁদুনে যে আর বলার না!
একবার তাকিয়ে আবার শাড়ি মেলায় মন দিলো নেলি। মাড় দেয়া শাড়ি টান টান করে মেলে শুকাতে না দিলে পরে ভাঁজ করার সময় ভারি মুশকিল হয়ে যায়।
বেশ তাঁতানো রোদ উঠেছে।
নেলি অকারণেই সূর্যের দিকে তাকালো।
ইশ কি রোদ রে বাবা!
সূর্য থেকে চোখ সরানোর পর চোখে লাল, কমলা আলোর ঝিকমিক খেলে গেলো।
নেলি কাপড়ের বালতিটা বারান্দার এককোনায় রেখে মিঠুর কাছে গেলো।
– কি রে মিঠু, কাঁদছিস কেন?
– কাঁদছি কই?
– আমি যে কান্নার শব্দ পেলাম, তোর হাতে কি রে বেলের শরবত নাকি?
– হুম।
– খাচ্ছিস না কেন হাতে নিয়ে বসে আছিস সেই তখন থেকে দেখছি।
– খেতে ভীষণ পঁচা, মুখ কেমন শিরশির করছে।
– দে তো চেখে দেখি।
এ বাড়িতে চৈত্র মাসের গরমে প্রতিদিন বেলের শরবত বানায় নেলির শ্বশুর ।
উঠানের একপাশে মস্ত বেল গাছ।
প্রতি বছর নাকি ঝেঁকে বেল আসে। এবারও গাছ ভরা বেল। দুপুরের আগ দিয়ে কামাল উদ্দিন বড় ঘরের খাটে বসে বেলের শরবত বানান, সেই শরবত এক গ্লাস করে বাড়ির সবাইকে খেতে হয়।
তা শরবত খেতে হোক এ নিয়ে নেলির কোন মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু এই শরবত এতো অখাদ্য করে বানান যা আর বলার না।
ভালো করে ছাঁকেন না। আঁশ, একটা, দুটো বিঁচি থেকেই যায় গ্লাসের তলানিতে।
কেউ কিছু না বলে খেয়ে নেয়।
শুধু মিঠুই কাঁদে।

সাবেরকে দিলে বেসিনে ঢেলে দিয়ে বলে- এসব ফালতু খাবার আমাকে দিবেনা।
– বাবা মন খারাপ করবেন, না খেলে। নেলি মৃদু কন্ঠে বলে।
– আশ্চর্য! মানুষের মন ভালো করার দায়িত্ব তোমাকে কে দিল? সাবের বিরক্ত হয়ে বলে।
নেলি এখন আর সাবেরের কথায় রাগ করেনা, ভয়ও পায়না।
শুধু মাঝে মাঝে উদাস হয়ে যায়।
মনে মনে বলে- এই হীরাকে একদিন আমি ভেঙে ফেলব।
*************

মিঠুর হাত থেকে গ্লাসটা নিল নেলি।
– এতো সামান্য বিষয় নিয়ে কাঁদতে হয় না বাবা।
কান্নার জন্য অনেক বড় বড় বিষয় আছে।
– কি বিষয় আছে চাচী?
-সেটা বড় হলে নিজেই বুঝতে পারবি রে। বলে গ্লাসটা মিঠুর হাতে ফিরিয়ে দিল।
মিঠু দু’হাতে গ্লাস ধরে চুমুক দিয়ে বললো – মেহের ফুপু কি জন্য কাঁদে?
নেলি এই প্রশ্নের উত্তর জানেনা।
তাই প্রসংগ পাল্টে বলল -আজ স্কুল নেই?
– না।
– একটু জিরিয়ে গোসল করতে যা।

নেলির হাতে আপাতত কোন কাজ নেই।
রান্নার দায়িত্ব পুরোটাই শাশুড়ির।
সাহায্যকারী আছে আনুর মা।
শ্বশুর সাহেব খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে এতো খুঁতখুঁতে! কারো হাতের রান্নাই তার মুখে লাগেনা।
কতো রকমের যে বাতিক মানুষের!
শুধু শুধুই বুড়ো মানুষটাকে রান্না ঘরের আগুনে আটকে রাখা।
***********
মেহেরজান ঘুম থেকে উঠে বারোটার পর। সারারাত কখনো পায়চারী করে, কখনো গান গায় আবার কখনো কাঁদে। ভোরের দিকে ঘুমাতে যায়। অষুধের প্রভাবে গভীর ঘুম হয়।
তার নাস্তা খাওয়ার সময় সাথে থাকে নেলি।
ভীষণ আশ্চর্য লাগে মেহেরজানকে তার।
দিব্যি সুস্থ মানুষ, কিন্তু আবার সুস্থ না! কি অদ্ভুত রোগ! স্বাভাবিক কথা বলছে, আবার সেই সাথে অস্বাভাবিক কথা বলছে।
মেহেরজানের নাস্তা হলো পাতলা রুটি, পেঁপে ভাজি, সাথে কুসুম ছাড়া ডিম সিদ্ধ ।
শেষে মগ ভর্তি লাল চা, তাও চিনি ছাড়া।
মেহেরজানের ডায়বেটিস, হাইপ্রেশার, হাই কলেস্টেরল কি নেই!
নেলি খুব চেষ্টা করে মেহেরজানের জন্য মুখরোচক কিছু বানাতে।
রোজ দিন পারেনা অবশ্য।
মেহেরজান অনেক কিছু হজম করতে পারেনা।
এদিক সেদিক কিছু হলে শ্বশুর সাহেব আস্ত রাখবেন না। মেয়ের ব্যাপারে খুব কড়া নিয়ম তাঁর।
সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় মেহেরজান আর নেলি টুকটাক গল্প করে। তাদের বেশির ভাগ গল্পই খাওয়া দাওয়া নিয়ে।
– বুবু ডিমটা পেঁপে ভাজির সাথে মিশিয়ে নাও তাহলে মজা লাগবে।
– দেখি, রুটিটা রোল করতো, আচ্ছা দাও আমি করে দিচ্ছি।
নেলি ডিমটা চটকিয়ে পেঁপে ভাজির সাথে মিশিয়ে পুর বানিয়ে রুটির ভেতর রেখে রোল বানিয়ে দিলো।
– নাও এখন খাও মজা লাগবে।
মেহেরজান কোন মজা পায়না। বিরস মুখে একটু একটু করে খায়।
-কোন মজা নাই রে সখি।
মেহেরজান নেলিকে সখি ডাকে।
নেলির বড় ভালো লাগে এই ডাকটা।
আরও ভালো লাগবে সাবের যদি কখনো ডাকে এ নামে। কি অদ্ভুত ভাবনা, নেলির কেমন লজ্জা লাগল!
সে তো সাবেরের সখি হতেই চায়, কিন্তু সেটা পাষাণ হীরে বুঝলে তো হতোই!

মেহেরজান খেতে খেতে বলে – জানিস সখি অর্ণব আমার মেহেরজান নামটা একটুও পছন্দ করেনা।

নেলি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে – অর্ণব কে বুবু?

মেহেরজান লাজুক গলায় বলে – আমার বর অর্ণবকে চিনিস না? বাবা কেন যে আমার নাম রেখেছেন মেহেরজান!

– সুন্দর নাম বুবু।

– আমার দাদীর নাম ছিলো মেহেরজান ।

– তোমাকে বাবা অনেক ভালোবাসেন।

– তা বাসে। কিন্তু অর্ণব বলে এটা নাকি পঁচা নাম।
সে আমাকে শুধু জান ডাকে।

বলেই হাসিতে ভেঙে পড়লো মেহেরজান। সে হাসি আর থামেইনা। কি অস্বাভাবিক লাগছে বুবুকে!
নেলি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
বহু কষ্টে হাসি থামালো মেহেরজান।
হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল – সখি দুটো শুকনো মরিচ পুড়িয়ে পেঁয়াজ, সরষের তেল দিয়ে মেখে দিবি? রুটি দিয়ে খাবো।

– মরিচ ভর্তা খেলে তোমার পেট জ্বলবে বুবু।
দুপুরে তোমার জন্য মাখা মাখা ঝোলের পাবদা মাছ রেঁধে দিব।

মেহেরজান খুশি হয় শুনে, একটু একটু করে খায়।
নেলির বড় কষ্ট হয় মেহেরজানের জন্য। আহা! কি কষ্টের জীবন!
কি মায়া লাগে!

***********

নেলি রান্নাঘরে ঢুকল।
গরমে তেঁতে পুড়ে ওর শাশুড়ি সেলিনা রান্না করছেন।
কড়াইয়ে বড় বড় রুই মাছের পেটি ভাজা হচ্ছে। সেলিনা সাবধানে মাছ উল্টে দিলেন। ।
শাশুড়ির সারা মুখে ঘাম লেগে আছে।
– মা, আপনি তো ঘেমে একেবারে শেষ, দেন আমি মাছগুলো ভাজি।
সেলিনা ক্লান্ত গলায় বললেন – পারবে তুমি, দেখ সাবধানে ভাজ। মাছ বেশি কড়কড়ে হয়ে গেলে তোমার শ্বশুর খাবেনা। চুলার আঁচ কমিয়ে দাও।

– আমি আঁচ কমিয়ে দিচ্ছি, আপনি ফ্যানের নীচে বসেন।
নেলি শাশুড়ির হাতে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিয়ে চুলার পাশে দাঁড়ালো।
সেলিনা পানি হাতে নিয়ে গ্লাসের দিকে তাকালেন।
গ্লাসে একটুকরো বরফ ভাসছে।
নেলি জানে তিনি ঠান্ডা পানি ছাড়া খেতে পারেন না।
রান্না ঘরে আসার আগে পানি নিয়েই এসেছে সে। অল্প ক’দিনেই সবাইকে কি আপন করে নিয়েছে মেয়েটা।
আল্লাহপাক কিছু কিছু মানুষকে এতো ভালো মানুষ করে দুনিয়ায় পাঠান!
এরা যেন শুধু দিতেই আসে। অথচ তার ছেলে এমন ভালো মেয়েটার কোন মুল্যেই বুঝলনা!

– মা দেখেন ভাজা মনে হয় হয়ে গেছে।
সেলিনার কেনো যেন আগ্রহ হলোনা দেখার।

-আরও কিছু রান্না করবেন মা?
– না রে মা, আর কিছু না।
রান্না শেষ শুধু মাছ ভাজাই বাকি ছিলো।
-একটা কথা বলি মা?
– কি কথা নেলি?
– ঘরে তো পাবদা মাছ আছে, বুবুর জন্য হালকা মসলা দিয়ে রেঁধে দেই?
– আজকে না, নেলি আর একদিন করো।
নেলির মনটা দমে গেলো।
আহারে, বুবু অপেক্ষায় থাকবেন।
সেলিনা সেটা বুঝতে পেরে আবার বললেন- তোমার বুবুকে আজ মাছ ভাজা দিও।
উচ্ছল মুখে নেলি বললো – আচ্ছা মা।

*********

মেহেরজান দুপুরের খাবার খায় বিকেলের আগে আগে। সেলিনা খাওয়ার সময় আজ পাশে বসে ছিলেন । মেহেরজান চুপচাপ খাচ্ছিল।
ওর চেহারায় আনমনা এক হাসির খেলা।
সেলিনা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
কি মিষ্টি একটা মায়াভরা মুখ। দেখে কে বলবে অসুস্থ! মনে হচ্ছে কোন ঘরের দুষ্টু একটা বউ।
যে সারাক্ষণ স্বামী, সন্তান নিয়ে খুঁনসুটিতে মেতে থাকে। আহ! কি অপূর্ণ একটা জীবন তার মেয়ের! তিনি মরে গেলে এই মেয়েকে কে দেখবে? হে মাবুদ
ওকে সুস্থ করে দাও তুমি!
– মা, আরেক পিস মাছ ভাজা দাওনা।
– মুরগীর ঝোলটা খাও মা, ভাজাভুজি খাওয়া ভালো না।
– সব সময় এতো না না করো কেনো তুমি? ভালো লাগেনা আমার।
– তোমার যে ভাজা খাবার সহ্য হয়না।
– আচ্ছা খাবোনা যাও।
মেহের প্লেট ভরে ভাত নিল। বাটি ভর্তি মুরগীর ঝোল সবটাই ঢেলে নিল।
সেলিনা তাঁকিয়ে রইলেন। খেতে পারুক আর নাই পারুক মেহের পাত ভরে খাবার নিবে। কিছু বলেও লাভ নাই।
– মা, ভাজা মাছ খুব মজা হয়েছে অর্ণবের জন্য দুই পিস রেখে দাও।
– অর্ণব কে মা?
মেহের ভাত খাওয়া থামিয়ে থমথমে গলায় বলল- অর্ণবকে চিননা ? কেন চিননা? নিজের মেয়ের বরকে এতো অবহেলা কেন তোমার? এই জন্যেই তো অর্ণব এখানে আসেনা।

মেহেরের এই এক সমস্যা। কাল্পনিক এক জগতে বাস করে।
– ঠিক আছে আমি অর্ণবের জন্য দু’পিস রেখে দিচ্ছি।
ঠিক এই সময় স্কুল থেকে মিথি এলো।
– মেহের, তুমি প্লেট ভরে খাবার নিয়ে নষ্ট করো খাবার…
সেলিনা চোখের ইশারায় মিথিকে বারণ করলেন কিছু না বলতে।
মিথি আরও রেগে গেল।
– আপনারাই ওকে অসুস্থ বানিয়ে রেখেছেন।
নিজের সবটাই বুঝে, তবুও পুতুপুতু করে অসুখ অসুখ করেন।
– মিথি তুমি চুপ করবে?
– এভাবে খেলে যে কেউ অসুস্থ হবে।
দু’দিন পর পর পেট নেমে যায় ছিঃ।
– চুপ করো মিথি, পায়ে পা বেঁধে ঝগড়া না করলে তোমার চলেনা?
মেহেরজান ভাত খাওয়া রেখে এঁটো হাতে মিথির চুলে ধরে টানতে টানতে বললো- এই, তুই আমার মায়ের সাথে ঝগড়া করিস কেন?
মিথি ভয়ে চিৎকার করতে লাগলো।
চিৎকার শুনে আবেদ ছুটে এলো, কামাল সাহেব এলেন।
আবেদ মিথিকে ছাড়িয়ে নিতে গেলো, সেলিনা এসে মেহেরজানকে ইচ্ছেমতো চড় দিলেন।
নেলি দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছিলো। ভয়ে তার কাঁপুনি এসে গেলো।
আনুর মা এসে মেহেরজানকে সরিয়ে নিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। মুহূর্তের মাঝে একটা বাজে পরিস্থিতি হয়ে গেলো।
সেলিনা এসে মেহেরজানের কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন – মরে যা তুই, মর তুই, এই যন্ত্রণা আর সহ্য হয়না ।
মিথির কিছু ছেড়া চুল মেহেরজানের হাতে।

মেহেরজান ফুঁপাতে ফুঁপাতে বললো – আমার মায়ের সাথে আবার ঝগড়া করলে আমি ওকে গলা টিপে মারব।
মেহেরজানের গালে চড়ের লাল দাগ।
সেলিনা ক্লান্ত গলায় স্বামীকে বললেন – আমি আর পারিনা, ওকে মেন্টাল ক্লিনিকে ভর্তি করে দাও।
কামাল সাহেব ভাঙা গলায় বললেন – আমার মেয়ের জন্য কারোর যদি এ বাড়িতে থাকতে অসুবিধা হয় সে স্বছন্দে চলে যেতে পারে। কিন্তু আমার মাকে আমি মেন্টাল হসপিটালে পাঠাবো না।

***************
অনেক দিন পর আজ সাবেরের মনটা বেশ ভালো।
এবার তার আমের বাগানে ভালো ফলন হয়েছে।
বাগানের মালি জসিম চাচা হাসতে হাসতে বললেন- তোমার বউয়ের ভাগ্যে এমন ফলন হইসে গো বাপ।
সাবের তার সব কর্মচারীদের সাথে খুব সহজ আচরণ করে।
কিন্তু জসিম চাচার কথায় তার বিরক্তি লাগলো।
– চাচা ফলন দেয়ার মালিক আল্লাহপাক, আমার বউয়ের এখানে কোন হাত নাই।
– তাও একটা কথা আছে বাপ, বউয়ের হাত দিয়া সৌভাগ্য আহে।
সাবের আর তর্কে গেলোনা।
তর্কে গেলে তার মুডটাই নষ্ট হবে।
যার হাত দিয়েই আসুক সৌভাগ্য এলেই হলো।
ইদানিং নেলির মুখটা বারবার উঁকি দিয়ে যায়।
সে কি আবার প্রেমে পড়লো!
স্ত্রীর প্রেমে পড়াটাই তো স্বাভাবিক, কিন্তু সাবের পণ করেছে জীবনে আর কাউকে ভালোবাসবে না। এতে অবশ্য মেয়েটার প্রতি চরম অবিচার করা হবে।
সাবের নিরূপায়, তার মনটা তো কবেই মরে গেছে!
সেই যে স্নিগ্ধা যখন ওকে প্রশ্ন করলো – তোমার বোন মেহের আপার কি সমস্যা সাবের?
– সমস্যা শুনে তুমি কি করবে? সাবের ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।
– শুনেছি মেহের আপা নাকি পাগল?
– বুবু পাগল না, তার জটিল মানসিক সমস্যা সিজোফ্রেনিয়া।
– ও, বুঝেছি। স্নিগ্ধা চুপ হয়ে গেলো।
ওর মিষ্টি চেহারায় কালো মেঘের ছায়া।
সাবের বললো – আমার বুবুর মতো ভালো মেয়ে পৃথিবীতে খুব কম আছে। বুবুর সমস্যা হলো সে নিজের একটা কাল্পনিক জগতে থাকে।

সেই প্রথম তারুণ্যে স্নিগ্ধা আর সাবেরের উথাল-পাথাল যে ভালোবাসাটা ছিলো সেই ভালোবাসার জাল কেটে সাবেরই দূরে সরে গেলো।
বুবুর মানসিক রোগটাকে স্নিগ্ধার বাবা জেনেটিক সমস্যা বলেছিলেন। বংশ পরম্পরায় এই রোগের বীজ নাকি সুপ্ত থাকে।
সাবের এতো ডিপ্রেশনে চলে গেলো তার আর বুয়েটেই পড়া হলোনা।
ইদানিং সে ভাবে তার আর স্নিগ্ধার ভালোবাসাটা একটা মোহ ছিলো।
সাবের ছিলো দুর্দান্ত ভালো ছাত্র, আরও অনেক প্রতিভা ছিলো তার। স্নিগ্ধা সেসব দেখেই সাবেরকে ভালোবেসে ছিলো। মোহ থেকে যে সম্পর্ক হয় সেখানে গভীরতা থাকেনা।
সাবের ভাবে আজকাল বেশিরভাগ মানুষই স্বার্থপর, অসুস্থ রুচির। সেই তুলনায় তার বুবু যেন মিষ্টি কোন ফুলের সুবাসের মতো। এমন বুবুকে নিয়ে যারা কথা তোলে তাদের সাথে সাবের কেন সম্পর্ক রাখবে! এই পৃথিবীতে আসলে কে যে সুস্থ এটা বুঝাই দায়। সাবের নিজেই কি সুস্থ!
সাবের শুনেছে স্নিগ্ধা বিয়ে করে এখন অস্ট্রেলিয়ায় সেটেল্ড। এই খবর শুনে সাবেরের কি বুকের মধ্যে চিনচিন করে ব্যাথা করেনি?
মাঝে মাঝে মনে হয় সে নিজেও মানসিক রোগী।
নাহলে নেলির মতো মিষ্টি স্বভাবের মেয়ের সাথে সে অযথাই রাগারাগি করে। শুধু নেলি কেন তার মেজাজ যাচ্ছেতাই রকমের খারাপ।
সাবের কি চেষ্টা করতে পারেনা আর একটু সহনীয় আচরণ করতে?
নেলি তো তার বন্ধুও হতে পারে, যাহ কি ভাবছে এসব! ওর মতো মানুষের আবার বন্ধু!
নেলিও নির্ঘাত বিপদে পরেই ওকে বিয়ে করেছে।
বাবা নেই, মামার বাড়ি আশ্রিত। না হলে সাবেরদের মতো পাগল পরিবারে কেউ মেয়ে বিয়ে দেয়।
মিথি ভাবিও বুবুকে পছন্দ করেনা।
মিঠুকে তো বুবুর ধার ঘেঁষতে দেয়না।
আর আনাকে ভাবী কোলেও নিতে দেয়না।
একদিন বলছিল সাবেরও নাকি আধা পাগল।
ভাইয়াকেও কথা শোনায় পাগল পরিবার বলে। শান্ত চুপচাপ ভাইয়া চুপ করে থাকে বলে রক্ষা।
সাবেরকে এমন কথা নেলি বললে তো উপায় ছিলোনা।
নেলিও যে ওদের পাগল ভাবেনা তা কে বলবে!
আচ্ছা, সেই কখন থেকে সাবের কি সব ভাবছে!
আজকে কি ওকে ভূতে পেলো নাকি?
তবে এটা ঠিক অনেক দিন পর মনের দরজা খুলে সে ভাবলো। মনের দরজায় আজকাল বারবার নেলির মুখটাই উঁকি দিচ্ছে।
সাবের অনেক দিন পর গুন-গুন করে ” যার চোখ তাকে আর মনে পড়েনা”।
ফিরে ফিরে শুধু নেলির মুখটাই চোখে ভাসছে।
ভালো মুসিবত হলো দেখছি!

***********

প্রিয়তার প্রহর পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

1

#প্রিয়তার_প্রহর
সমাপ্তি পর্ব (২০)
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

শীতল পবন ছড়িয়ে রয়েছে বসুন্ধরায়। ঘাসের বুকে শিশির বিন্দু জমে আছে। প্রিয়তা ক্ষণসময় ধরে বিমূঢ়, নিস্তব্ধ। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে প্রিয়তার কায়া। অস্থির অস্থির লাগছে। পুরুষের প্রথম আদর মাখা স্পর্শে নেতিয়ে গিয়েছে সে। নেত্রপল্লব ভিজে একাকার প্রিয়তার। পছন্দের মানুষের এই মিষ্টতা সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছে। ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে প্রিয়তা। ওষ্ঠদ্বয় আর কণ্ঠ শুষ্ক হয়ে আসছে। প্রহর বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে স্লাইড করে দিল প্রিয়তার গালে। অবাকের শেষ সীমানায় এসে প্রিয়তা নড়েচড়ে উঠল। বা হাত দ্বারা খামচে ধরল প্রহরের পিঠের শার্টের অংশ। চোখ বুজে ফেলল। প্রহর হাসল নিঃশব্দে। মুখ গোল করে ফু দিয়ে প্রিয়তার ক্ষুদ্র চুলগুলো উড়িয়ে দিল ললাট থেকে। প্রিয়তা চোখ মেলল। চেয়ে রইলো খানিকক্ষণ। প্রহরের চোখের দিকে তাকিয়ে অস্থির ঠেকল। ছেড়ে দিল শার্টের অংশ। থতমত খেল সে। নিজের এহেন কাজে লজ্জা পেল ভিষণ। অপমানিত হলো মনে মনে। নিজেকে নির্লজ্জ, বেহায়া উপাধিতে ভূষিত করে দিল। মাথা নুইয়ে প্রিয়তার দ্বন্দ কাটল। প্রহর এখনো নেশালো চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। প্রিয়তা সেই চোখের দিকে তাকিয়ে ঘোর ভাঙল। হুট করেই ভিষণ রাগ হলো তার। প্রহরের প্রতি রাগে দিক্বিদিক হারিয়ে প্রিয়তা চোখ গরম করে তাকাল। কঠিন চাহনি নিক্ষেপ করে বলে উঠল,

” আপনার সহানুভূতির আমার প্রয়োজন নেই। আমাকে ছুঁয়েছেন কেন? পুলিশ হয়েও এমন ব্যবহার?

” পুলিশ বলে কি আমাদের অনুভূতি নেই প্রিয়?

” আমাকে প্রিয়তা বলে ডাকবেন।

” যদি না ডাকি?

” আপনি কি করতে চাইছেন হ্যাঁ? লিরা আপু এসব দেখলে কি ভাববে? ছিঃ! চলে যান।

‘ লিরা কি ভাববে?

” জানি না। আপনি আমার আশপাশে ঘেঁষবেন না। আরহামের থেকেও দূরে থাকবেন। আপনাকে আমার সহ্য হচ্ছে না।

” আমি যদি তোমার থেকে দূরে থাকি তুমি খুশি হবে?

” হবো।

” কিন্তু আমি হবো না।

” আপনার কথার মানে বুঝতে পারছি না।

” কারণ তুমি বোকা।

” হ্যাঁ। চালাক হবার দরকার নেই। বোকা হওয়াই ভালো। আপনার মতো চালাক নই বলেই স্বস্তিতে আছি।

” এমন বোকা মেয়েই আমার পছন্দ। সত্যিই।

প্রিয়তা হতভম্ব। সামনে থাকা মানুষটার এমন অভিব্যক্তি কখনো দেখেনি সে। যখন দেখল তখন দুরত্ব বেড়ে গিয়েছে মাইল মাইল। চাইলেও সেই দুরত্ব মিটিয়ে কাছে আসার উপায় নেই, ভালোবাসার উপায় নেই। সবটা ভেবে প্রিয়তার ভারী রাগ হলো। চক্ষুদ্বয় শীতল হলো। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে খানিক উচ্চস্বরে বললো,

” পুলিশম্যান, আপনি আপনার লিমিট ক্রস করছেন। হ্যাভ ইউ লস্ট ইউর মাইন্ড? দুদিন বাদে আমরা এখান চলে যাবো। এরপর আপনার সাথে আমাদের দেখা সাক্ষাৎ হবে কি না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আবার দুদিন বাদে আপনার বিয়ে। আপনি কোন সাহসে আমাকে ছুঁয়েছেন? কোন মুখে পছন্দ কথাটা উচ্চারণ করছেন?

” কার বিয়ে? আশ্চর্যিত হয়ে গেল প্রহরের অভিব্যক্তি।

‘ ঢং করবেন না। আপনি জানেন না?

” আমি জানি না। বলো প্রিয়তা।

” লিরা আপুর সাথে আপনার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। সে কারণেই আপু এখানে এসেছে। সত্যিই জানেন না এসব?

” এখন জানলাম। এসব কথা তুমি কিভাবে জানলে?

” তা আপনার না জানলেও চলবে

প্রিয়তা পা বাড়িয়ে ঘরে ঢুকল। প্রহর তাকিয়ে রইল কয়েক পল। চোখের ভাষা বোঝার উপায় নেই। সেই চোখ প্রত্যেকবারে মতোই স্থির, দৃঢ়, তীক্ষ্ম, বাব দিতে বললো,

” এজন্যই এত দূর দূর করছো। বেশ, দূরেই যাচ্ছি। তুমি সইতে পারবে তো প্রিয়? কষ্ট হবে না?

_________

প্রীতিলতার সুখের সংসার। শ্বশুর আর স্বামী যথেষ্ট ভালো। শাশুড়ি বয়স্ক মানুষ। সারাক্ষণ খিটখিটে মেজাজে থাকে। ছোট ছোট কারণেও চিল্লাপাল্লা করার স্বভাব মহিলার। মাঝে মাঝে প্রীতিলতার তর্ক হয় শাশুড়ির সাথে। যুদ্ধ বেধে যায়। পরিস্থিতি জটিল হয়ে আসে। তবুও স্বামী ভালো বলে প্রীতিলতার যায় আসে না। আজিজ মোর্শেদ উচ্চবিত্ত পরিবারের বড় সন্তান। সুখ শান্তি সবটাই দেওয়ার চেষ্টা করে সে।

প্রীতিলতা ঘুমিয়ে আছে। বেশ কয়েকদিন ধরে ঘুমটা বেড়েছে। আজ রবিবার বলে অফিস নেই। দুপুর অবধি ঘুমানোর ইচ্ছে নিয়ে রাতে ঘুমিয়েছিল সে। কিন্তু সেই সাধের ঘুম তার হলো না। শাশুড়ি সকাল আটটা বাজতেই কড়া নাড়ল প্রীতিলতার ঘরে। অসম্ভব তেজী মহিলা খাইরুন নাহার। তার ছেলে আজিজের কয়েক বছর আগে বিয়ে হয়েছিল অসম্ভব রূপবতী এক মেয়ের সাথে। মেয়ের যেমন রুপ, তেমনই গূণ। হাতে কর্মে নিপুণ মেয়েটার কি যে এক রোগ হলো? বিয়ের ছ মাসের মাথায় মারা গেল মেয়েটা। এরপর থেকে খাইরুন নাহার আরো বেশি খিটখিটে হয়ে গিয়েছেন। পছন্দের বউমার এহেন মৃত্যুতে শোকাহত তিনি। পরবর্তীতে তিনি ভেবেছিলেন ছেলের জন্য সংসারী, কম বয়সী মেয়ে নিয়ে আসবেন। কিন্তু সেগুড়ে বালি, ছেলে পছন্দ করলো এমন একটি মহিলাকে যার দু দুটো ছেলেমেয়ে আছে। ছেলের বয়স ব্যাপার না। “সোনার আংটি বাঁকাও ভালো” এই কথাটা খুব মানে খাইরুন। ঠিক সময়ে প্রিয়তা নামের মেয়েটার বিয়ে দিলে এখন নাতি-নাতনি নিয়ে খেলতে পারতো প্রীতিলতা। যদিও প্রীতিলতা দেখতে আহামরি সুন্দর, রুপ সৌন্দর্যে ভরপুর তার নারীদেহ। শরীরে এক ফোঁটা মেদ নেই। দেখে মনে হয় না বয়স এত বেশি। তবুও মন মানে না খাইরুনের। ছেলের এহেন পছন্দে নিরাশ তিনি।

বারবার দরজা ধাক্কানোর ফলে রেগে বেরিয়ে আসল প্রীতিলতা। বড়সড় হাই তুলে তেজী কণ্ঠে তাকাল। দাঁত চিবিয়ে বললো,

” এত সকালে ডাকছেন কেন মা? আজ ছুটির দিন। আপনাকে বলেছিলাম অনেকক্ষণ ঘুমাবো। শুনতে পাননি?

শাড়ির আঁচল টেনে ভেংচি কাটলেন খাইরুন। তিনিও রাগী কণ্ঠেই বললেন,

” ঘুমাইলে রান্দাবান্দায় কেডায় করবো? না খাইয়া থাকুম নাকি সবাই?

” আমি তো কাজের লোক রেখেই দিয়েছি। আপনার মাথা খারাপ হয়েছে? আমাকে রান্না করতে ডাকছেন কেন?

” ওই কাজের ছেড়িরে আমি ছুটি দিছি। প্রত্যেকদিন যদি ওর রান্দা খাইতে হয় তাইলে পোলারে বিয়া করাইছি কিসের লাইগা?

” আমি তো বসে বসে খাই না। চাকরি করি। মাস শেষে মোটা অঙ্কের টাকা সংসারে দেই। আমাকে কিভাবে কাজ করতে বলেন? আশ্চর্য।

” ব্যবহার ভালো করো। শাশুড়ির লগে ক্যামনে কথা কইতে হয় জানো না। চিবাইয়া কথা কউ ক্যান? আগের ঘরের তো শাশুড়ি ছিল না। বুঝবা ক্যামনে শাশুড়ি কি জিনিস।

” আপনার সাথে কথা বলে মেজাজ নষ্ট হচ্ছে। কাজের লোককে ছুটি দিয়েছেন যখন তখন রান্না করুন। আমি এসবে নেই। আমাকে ঘুমোতে দেন।

আজিজ ঘুম থেকে উঠে মা আর স্ত্রীর এমন তর্কাতর্কি দেখে ভ্রু কুঁচকাল। মায়ের প্রতি অবাধ ভালোবাসা আজিজের। আজিজের একটি মাত্র বোন আছে। বোনটা চায় মাকে নিজেদের কাছে রাখতে। কিন্তু আজিজ তাতে রাজি নয়। মাকে ছাড়া দুদণ্ড থাকতে পারে না সে। এক কথায় আজিজকে সবাই ঠাট্টা করে বলে “মাম্মাস বয়”।

আজিজ উঠে শার্ট গায়ে জড়াল। ঘুম ঘুম চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

” কি হইছে মা?

‘ দ্যাখ তোর বউরে কইছি একটু রানতে। তোর বউ কতডি কথা শুনায় দিল। কি হ্যার ব্যবহার দ্যাখ।

প্রীতিলতা চেতে গেল। ভয়ঙ্কর চাহনী নিক্ষেপ করে বলে উঠল,

” মিথ্যা বলবেন না। আপনিই সকাল সকাল ঝগড়া করতে এসেছেন। সপ্তাহে দুটো দিন বাড়ি থাকি। এই দুদিনে জীবনটাকে দুর্বিসহ বানিয়ে দেন। সমস্যা কি আপনার?

আজিজ মোর্শেদ রেগে গেল ভিষণ। মায়ের সাথে এমন করে কেউ কথা বললে তার রাগ হয়। আজিজের বাবা ছিলেন সুদখোর। টাকা পয়সার কারবার করতে গিয়ে ধরা খেয়ে তিন বছর জেলে ছিল। এই তিন বছর খাইরুন-ই সংসারের হাল টেনে নিয়ে গিয়েছেন। তখন আজিজ খুব ছোট ছিল বলে তখন উপার্জন করতে পারেনি। সে কথা আজও স্মরণ করে আজিজ। মায়ের সাথে প্রীতিলতার এমন ব্যবহার দেখে চোখ পাকাল আজিজ। ক্ষুদ্ধ হয়ে বললো,

” তোমার সাহস বাড়ছে প্রীতি। মায়ের সাথে এমন ব্যবহার করছো কেন? আমি বিয়ের আগে বলিনি আমার মায়ের সব কথা শুনতে হবে?

” তোমার মা ও তো বিয়ের আগে ভালো ছিল। বিয়ের পর রঙ পালটেছে কেন?

খাইরুন নাহার বলে উঠল,

‘ কি করুম? বিয়া করার লাইগা ছটফট করতাছিলা। বাধ্য হইয়া বিয়াতে রাজি হইছি। এখন বুঝতে পারতাছি তোমার ব্যবহার কেমন।

প্রীতিলতা আজিজের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

” এমন মহিলাকে কিভাবে তুমি সহ্য করো? এমন ব্যবহার করলে আমি কিন্তু থাকবো না।

” এমন মহিলা মানে?

” ডাইনি।

ঠাসস করে প্রীতির গালে থাপ্পড় মারল আজিজ। রাগে মগজ টগবগ করে ফুটছে তার। লাল রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। চোখ পাকিয়ে ভয়ঙ্কর ভাবে তাকাল আজিজ। তেতে উঠল ততক্ষণাৎ। ক্রোধে ফেটে পরল। প্রীতির চুলের মুঠি ধরে সে বলে উঠল,

” যাবেই তো। ফুটফুটে একটা ছেলে আর অত ভালো একটা মেয়েকে যখন এক মিনিটে ছেড়ে আসতে পেরেছো তখন আমি আর এমন কী? তোমার কাছে নিজের স্বার্থই তো সব।

প্রীতিলতা গালে হাত দিয়ে হা করে তাকিয়ে রইল স্বামীর সম্মুখে। চোখ গোলাকার হলো। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আজিজের এমন আচরণ মানতে কষ্ট হলো প্রীতিলতার। যার জন্য ফুটফুটে একটা বাচ্চাকে ছেড়ে দিল, সুখের সংসার ছেড়ে দিল, নিজের মেয়েকে দিনের পর দিন মানসিক অত্যাচার করল, সেই লোকটাই প্রীতির গায়ে হাত তুলল? এত কিছু ছেড়ে কি পেল সে? মা ভক্ত ছেলেকে বিয়ে করে জীবনকে দুর্বিসহ করে তুললো? জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতে আজিজ তার পাশে থাকবে এই ভেবেছিল প্রীতিলতা। পরকিয়ার সময়ে আরিফের মতো ভালো স্বামীকে তখন ভালো মনে হয়নি। ভালোবেসেছিল আজিজ কে। প্রেমে অন্ধ হয়ে অনেক মানুষকে ছেড়ে এসেছিল। সেই আজিজের এমন পরিবর্তন কেন হলো?

__________

তানিয়ার আজকাল ভারী সুখ সুখ লাগে। নতুন মানুষের আগমনে নিয়াজ শেখ উৎফুল্ল হয়ে উঠেছেন। সারাক্ষণ এটা ওটা নিয়ে তাসলিমা খাতুনের সাথে মান অভিমানের পর্ব চলছে তাদের মাঝে। এইতো সকালেই, সকালে তানিয়া ভাবল আজ রান্না করবে। তাসলিমা খাতুনকে এত দ্রুত সবটা ধরিয়ে দেবে না বলে ভেবেছিল। কিন্তু তানিয়া উঠে দেখে সে ওঠার আগেই তাসলিমা খাতুন উঠে গিয়েছেন। তানিয়া রান্না ঘরে গিয়ে দেখে তাসলিমা চা বানাচ্ছে। তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরে ঢুকল সে। জিজ্ঞেস করল,

” আপনি এত সকালে উঠেছেন কেন আন্টি? রান্নাঘরেই বা এসেছেন কেন? আমিই তো আসছিলাম চা বানাতে।

তাসলিমা খাতুনের সৌন্দর্য দ্বিগুন হয়েছে নাকের ফুল পরায়। অন্য রকম লাগছে। মুচকি হেসে তিনি বললেন,

” নিজের সংসার নিজেকে গুছিয়ে নিতে হবে না? ভাবলাম আজ থেকেই স্টার্ট করি। তোমার বাবা আমাকে আসতেই দিবে না রান্নাঘরে। নিজেই নাকি রান্না করবে। তুমি নাকি খেয়ে তারপর থানায় যাবে। তাইতো আমি উনাকে বসিয়ে নিজেই নাস্তা আর চা বানাতে এলাম।

” বাবা উঠেছে?

” হ্যাঁ।

” আমি কোনো সাহায্য করবো আন্টি?

” আমাকে আন্টি বলেই ডাকবে? আড়চোখে কাপে চা ঢালতে ঢালতে মিষ্টি হেসে বলে উঠলেন তাসলিমা।

” আপনাকে আমি পছন্দ করি আন্টি। ভালোও বাসি। আমি আপনাকে আমার মায়ের জায়গা কখনো দিতে পারবো না। তাই বলে এমনটা নয় আপনার স্থান আমার হৃদয়ে নেই, আপনাকে ভালোবাসি না। আমার জীবনে আপনাদের দুজনের অবস্থান রয়েছে দু স্থানে। আপনি যেমন আমার মায়ের মতো হতে পারবেন না তেমনি। আমার মা ও আপনার মতো হতে পারবে না। দুজন দু দিক থেকে সেরা। কেউ কারো জায়গা দখল করতে পারবে না। আপনি আমার আন্টি হয়েই থাকুন। দেখবেন অমর্যাদা করবো না।

তাসলিমা খাতুন হাসলেন। রান্না করতে করতে তানিয়ার সাথে গল্প আরম্ভ করলেন। মাঝে মাঝে খিলখিল করে হাসলেন। রান্না টেস্ট করালেন তানিয়াকে দিয়ে। একসাথে খেতে বসে তানিয়া আজ পুরো পরিবার সামনাসামনি খেতে পেল বহু বছর পর। এই সুখ এতদিন দেখা যায়নি। ধরা ছোঁয়া যায়নি। পলকহীন ভাবে কেটে গিয়েছে বিধ্বস্ত সময়। রঙ বেরঙের মিছিল ঘুরে বেরিয়েছে সমতলে।

খেতে বসে নিয়াজ শেখ বললেন,

” আপনাকে বলেছিলাম রান্না বান্না করবেন না। সেই রান্না ঘরে ঢুকলেন-ই।

” স্বামী সন্তানের খেয়াল রাখতে হবে না? এর আগেও তো স্বামীর ঘর করেছি। এটা নতুন তো নয়।

নিয়াজ শেখ গম্ভীর হলেন। বিয়ের পরেরদিন বোধহয় প্রথম বিয়ের আলাপ শুনতে খারাপ লেগেছে উনার। অল্প ভাত খেয়েই উঠে পরলেন তিনি। বললেন,

” নতুনত্ব অনুভব করুন, দেখবেন ভালো লাগবে।

তানিয়া আপাতত বসে আছে কফিশপে।গতকাল আবিরকে বিয়েতে নিমন্ত্রণ করা হলেও আবির আসেনি। আবিরের বাবা-মা তখন ব্যবসায়ের কাজে শহরের বাইরে। হুট করেই কাজ পরায় চলে যেতে হয়েছে তাদের। তানিয়া ভেবেছিল আবির আসবে বিয়েতে। কিন্তু তানিয়ার ভাবনা ভুল প্রমাণিত করে গতকাল আবিরের পা তানিয়াদের বাড়িতে পরেনি। গতকাল একবার ও কথা হয়নি আবিরের সাথে।আজ থানায় পৌঁছানোর পূর্বে আবিরের কল এসেছে। তানিয়া কলটা ধরেছে ইচ্ছে না থাকলেও। তখন আবির এ কফিশপে আসতে বলেছে। খুব জরুরী কথা আছে বোধহয়। তানিয়াকে অপেক্ষায় রেখে দেরি করছে আবির। তানিয়া আর পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করবে ভাবল। আর তার ঠিক দু মিনিট মাথায় আবির প্রবেশ করল কফিশপে। তানিয়া নড়েচড়ে বসল। মন বলছে একটি ঝামেলা হবে তাদের মাঝে। আবির কোনো সুখবর দিতে আসছে না। আসলে গত কয়েকদিন ধরে আবিরের ব্যবহার মার্জিত ঠেকছে না তানিয়ার কাছে। এজন্য সবকিছুতেই নেগেটিভ চিন্তাভাবনার উদয় হচ্ছে।

আবির কফিশপে ঢুকল। পরণে তার জন্য সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট। চোখে ব্যান্ডের সানগ্লাস। চুলগুলো বেশ গোছালো। তানিয়াকে দেখে আবির সানগ্লাস খুলে শার্টের পকেটে রাখল। ক্রূর হাসল ছেলেটা। হাবভাব নিয়ে বসল তানিয়ার সম্মুখের চেয়ারে। টেবিলে দু হাত রেখে আবির খানিক গম্ভীর হয়ে বলে উঠল,

” আঙ্কেলের বিয়ে তবে দিয়েই দিলে।

তানিয়ার ললাটে ভাজ প্রতীয়মান হল। সম্মুখে অবস্থান করা যুবকের প্রতি বিতৃষ্ণা জেগে উঠল। এই বিষয়টা নিয়ে আবির কথা বলবে বুঝতে পারলে তানিয়া এখানে মোটেই আসতো না। গতকাল নিয়াজের বিয়েতে যায়নি বলে এমনিতেই তানিয়া রেগে আছে আবিরের উপর। তার পর এখানে ডেকে এ ধরনের কথা শুনে তিক্ততায় ছেয়ে গেল তার হৃদয়। আবিরের চোখে চোখ রাখল সে। নাকের পাটা ফুলিয়ে বলে উঠল,

” হ্যাঁ দিলাম।

” তুমি পুলিশ অফিসার বলে আমি খুব প্রাউড ফিল করতাম। কিন্তু তুমি যা করলে তার পর তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার গভীরতা কমছে। তা কি তুমি বুঝতে পারছো না?

” ভালোবাসা কি নিতান্তই তুচ্ছ জিনিস আবির? যে একটু কিছু হলেই ভালোবাসা কমে যাবে? গভীরতা মিলিয়ে যাবে? ভালোবাসা ঠুনকো নয় আবির। আপনি অযথাই মোহ কে ভালোবাসা বলে আখ্যায়িত করছেন।

” ইনস্টাতে তুমি আঙ্কেল আর আন্টির ছবি পোস্ট করেছো। আমার কলিগরা সেই পোস্ট দেখেছে। আমাকে নিয়ে হাসছে রীতিমত। এটা আমার জন্য কতটকু অসম্মানের তা তুমি জানো না? কেন আমার অবাধ্য হলে?

” বাবার খুশির দিনটা সবার সাথে ভাগ করেছি। এতে অন্যায় কিছু দেখছি না। শুনে রাখুন আজ যারা এই বিষয়টা নিয়ে হাসছে তারা নোংরা মস্তিষ্কের মানুষ। এদের কাছে ভালোবাসা মানে শুধু যৌবনের তারনা।

” তানিয়া। রেগে চিৎকার করে নামটা বলে উঠল আবির।

” চিৎকার করবেন না। এটা আপনার বাড়ি নয়। ম্যানার্স জানেন না?

” ওয়েল আমার ম্যানার্স নেই। শোনো, আমি তোমাকে বিয়ে করছি না। আঙ্কেলকে আমি গতকাল রাতে কল করে বলে দিয়েছি। আঙ্কেলকে বোঝাবে কেমন?

” বাবাকে এইসব বলেছেন কেন? বাবা কি ভাববে? বাবা ভাববে তার বিয়ের কারণেই আমার বিয়ে ভেঙেছে। বাবা খুব কষ্ট পাবে। কেন সবটা বলেছেন?

” কারণ তুমি আমায় বাধ্য করেছো। আমি বি রক্ত তোমার কাজকর্মে।

” আর বিরক্ত হতে হবে না। আজ এখানেই সম্পর্কের ইতি টানছি আমরা। আল্লাহ্ হাফেজ।

তানিয়া ফোস করে শ্বাস টানল। জটিলতা আর ভালো লাগছে না। ভাগ্যিস এ সময় বাবার বিয়ে দিয়েছিল সে। নয়তো আবিরের এমন মন মানসিকতার সাথে পরিচিত হতে সময় লাগতো। হয়তো ততদিনে একটা বৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়ে কষ্ট পেত সে। তানিয়া পার্স হাতে নিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো। আর কাউকে আটকাবে না সে। জীবন যেদিকে নিয়ে যাবে সে দিকেই এগোবে। অনেক মানুষের মুখোশ দেখবে জীবনে। তবেই কিছু অর্জন করতে পারবে।

________

প্রিয়তা প্রস্তুত হচ্ছে। নিজের বাসায় আবার ও পা রাখবে প্রিয়তা। আগের বার প্রহর সাথে ছিল বলে প্রিয়তার কোনোরূপ ভয় হয়নি। কোনো খারাপ লাগা কাজ করেনি। আজ খুব নার্ভাস লাগছে প্রিয়তার। আবারো কতদিন পর আরিফের মুখোমুখি হবে সে। সম্পত্তি ভাগ বাঁটোয়ারা করার জন্য দাবি জানাবে। আচ্ছা আরিফ হোসাইন কি ভাববে? প্রিয়তাকে খুব লোভী ভাববে উনি? ভাববে প্রিয়তা তার দয়া ছাড়া সমাজে টিকে থাকতে পারছে না?

প্রিয়তা বিবেকের কথা শুনল। এখন আবেগাপ্লুত হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। আরহামের একটা ভবিষ্যত আছে। কেন ছেলেটা বাবার সম্পত্তি ছেড়ে এমন অসহায় জীবনযাপন করবে? আজ দাবি না জানালে সেই সম্পত্তি ভোগ করবে অন্য মানুষজন। আরহাম এমন দুর্বল ভাবে থাকবে এমনটা ভাবতে চায়না প্রিয়তা। আরহামর জীবন টা তাকেই গুছিয়ে দিতে হবে। সবার সাথে লড়তে হবে। নিজের আর আরহামের জায়গা পাকাপোক্ত করতে হবে।

আরহাম প্রিয়তার সাথে অভিমান করেছে। প্রহরদের বাড়ির সামনের রাস্তার বা পাশের ফুতপাতে একটা মুদি দোকান তৈরী হয়েছে। সেখান থেকে প্রিয়তা আরহামের জন্য কেক, বিস্কিট কিনে আনে। আরহাম বায়না ধরেছে দোকানে গিয়ে কেক খাবে। প্রিয়তা আপত্তি জানিয়েছে। ভাংটি যে টাকা আছে তা গাড়ি ভাড়াতে লাগবে। তারা এখন নিজেদের বাড়িতে ফিরবে। একটু আগেই ভাত খেয়েছে আরহাম। এখন কিসের কেক খাওয়া? প্রিয়তা সাফসাফ জানিয়েছে দোকানে যাবে না সে। ও বাড়িতে যাবে। কথাটা শুনেই আরহাম অভিমান করে ছাদে চলে গিয়েছে। প্রিয়তা পুরোপুরি তৈরী হয়ে ছাদে উঠল। ছাদে আরহাম নেই। প্রিয়তা নিচের ফ্ল্যাটে সব জায়গায় খুঁজল আরহাম কোথাও নেই। কি ভেবে প্রিয়তা প্রহরদের বাড়ির কলিং বেল চাপল। ফোন টিপতে টিপতে বেরিয়ে এলো একজন অর্ধবয়স্ক লোক। প্রিয়তা বুঝতে পারলো লোকটা প্রহরের বাবা। প্রিয়তা সালাম দিল। জিজ্ঞেস করল,

” আমার ভাই এসেছে আঙ্কেল?

লোকটা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। বললো,

” ঘরে তো আমাদের পরিবারের লোক ব্যতিত কেউ নেই। দেখো ঘরে গিয়ে। পাও কি না।

” আচ্ছা, থাক।

মলিন মুখে চলে আসতে উদ্যত হতেই পিছন থেকে প্রহর ডেকে উঠল প্রিয়তাকে। প্রহরের গা উন্মুক্ত। পুরুষালি অঙ্গ স্পষ্ট। সুঠাম দেহের ভাঁজে ভাঁজে মাধুর্য মিশে আছে। প্রহরের চাহনি অন্যরকম। মাদকতা মেশানো কণ্ঠ। প্রিয়তার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। দু দিন পর প্রহরকে সামনাসামনি দেখতে পেল সে। ভিষণ অগোছালো লাগছে নিজেকে। প্রহরের হাতে ফোন। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে প্রহর বলে উঠল,

” তুমি এখানে? কি মনে করে?

” আরহামকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। চিন্তিত স্বর প্রিয়তার।

প্রহরের মুখ ফ্যাকাশে হলো। চিন্তা হলো তার ও। আরেকটু এগিয়ে এসে বললো,

” কোথায় আর যাবে? বাড়িতেই আছে। ভালো করে খুঁজে দেখো।

“সব জায়গায় তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। আরহাম কোথাও নেই।

” একটু অপেক্ষা করো। আসছি।

প্রহর ঘরে ঢুকে দিল। জলপাই রঙের শার্ট হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে শার্ট গায়ে জড়াল। দু দিকে দুজন গেল আরহামকে খুঁজতে। পুরো বাড়ির প্রত্যেকটা রুমে আরহামকে খুঁজল ওরা। মাঠে গিয়েও চক্কর কেটে আসল। কোথাও আরহামের অস্তিত্ব নেই। হঠাৎই প্রিয়তার ভয় লাগল। অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠল বুক। আরহাম তাকে না বলে কোথাও যায় না। এই সময় কোথায় যাবে? প্রিয়তা দোকানে গেল খুঁজতে। শেষমেশ হতাশ হয়ে ফিরে এলো। প্রহরের চোখমুখ গম্ভীর হলো। ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে চেহারা। সব জায়গায় খুঁজেছে আরহামকে। কোথাও পায়নি। একটা সময় প্রহরের মনেও ভয় ঢুকে গেল। প্রিয়তার অবস্থা নাজেহাল। মাঠের মাঝখানে বসে পরেছে সে। কান্না করে যাচ্ছে অনবরত। চোখের পানি গাল থেকে গড়িয়ে মাঠের ঘাসে পরছে। প্রহর তার টিমকে কল করল। বাড়ির আশপাশের সব জায়গায় লোক লাগিয়ে দিল। প্রিয়তার ফোনে কল এলো। আননোং নাম্বার দেখে প্রিয়তা প্রথমে কেটে দিল। পুনরায় একই নম্বর থেকে কল আসলে চোখ মুছে প্রিয়তা কল ধরল। হেচকি উঠছে তার। কান্না দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। বুক কাঁপছে বারংবার। চিন্তা চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে স্বাভাবিক করে প্রিয়তা বললো,

” হ্যালো, কে বলছেন?

” তুমি প্রিয়তা?

” জি।

‘ ভাইকে খুঁজছো?

” হ্যাঁ। আপনি কে বলছেন?

” আমাকে চিনবে না। আরহাম এখন নর্দমায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। রক্ত গড়াচ্ছে শরীর বেয়ে। পারলে বাঁচিয়ে নাও। সময় নেই হাতে।

প্রিয়তার বুকটা ধক করে উঠল। মুচরে উঠল শরীর। বাকরুদ্ধ হয়ে পরল। প্রাণপ্রিয় ভাই সম্পর্কে এমন কথা শুনে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। বিধ্বস্ত আর রুগ্ন দেখাল প্রিয়তাকে। উঠে দাঁড়াল সে। প্রহরের সাথে এসে দাঁড়াল। ফোনের ভলিউম বাড়িয়ে রেকর্ড করলো কথোপকথন। ওপাশের ব্যক্তি হাসল উচ্চস্বরে। প্রিয়তা বলে উঠল,

” আমার ভাইকে কি করেছেন আপনি? কি আবোল তাবোল বলছেন? আমার ভাইকে ফিরিয়ে দিন প্লিজ। আমি মরে যাবো। ও বাচ্চা। ও কোথায়? আপনি কে?

” তোমার ভাইয়ের এই ক্ষতির জন্য তুমি দায়ী নও। দায়ী তোমার ওই পুলিশ অফিসার। ওর জন্যেই নিষ্পাপ এক বাচ্চার প্রাণ নিতে হলো। পুলিশ এবার বুঝুক কাছের মানুষ হারালে কেমন লাগে।

” কি সব বলছেন? আপনি মিথ্যে বলছেন। আমার ভাই ঠিক আছে। আরহাম কোথায়? বলুন এক্ষুণি। আমি আপনাকে ছাড়বো না।

” তোমাদের বাড়ির আশপাশের নর্দমায় খুঁজে দেখো। পেয়ে যাবে। এতক্ষণে হয়তো কুকুর খুবলে খেয়েও নিয়েছে।

প্রহর ফোনটা নিজের হাতে নিল। রেগে উঠল সে। কপালের রগ ফুলে ফেপে উঠল। প্রিয়তার মাথা ভনভন করছে। অস্থিরতায় শরীর থরথর করে কাঁপছে। বেঁচে থাকার ইচ্ছে মরে যাচ্ছে। আরহামের এমন অবস্থা কি করে দেখবে সে? ছেলেটাকে বড্ড ভালোবাসে প্রহর। রেগে গিয়ে প্রহর বললো,

” তোকে আমি ছাড়বো না জানোয়ার। সাহস থাকলে আমার সামনে এসে আমার সাথে লড়াই কর। ওই ছোট্ট ছেলেটার সাথে এমন করছিস কেন?

লোকটা হেসে কল কেটে দিল। প্রিয়তা বিমূঢ়। হাত-পা অবশ হয়ে আসছে তার। লোকটার কথা বারবার ভেসে আসছে কানে। অসহায় লাগছে প্রিয়তার। এত দুঃখ আর সইছে না।

__________

শহরের বড় একটি হাসপাতালের করিডোরে বসে আছে প্রহর আর প্রিয়তা। প্রিয়তার কান্না আহছে না এখন। দুঃখে চোখ এখন বেইমানি করছে তার সাথে। অবশ লাগছে নিজেকে। রোবট বলে মনে হচ্ছে। কষ্টে জর্জরিত হচ্ছে হৃদয়, হাহাকার করে উঠছে। প্রহর প্রিয়তার পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে পুড়ছে প্রহর। বাইরের কাউকে বোঝাতে পারছে না। আরহামের জন্য কষ্ট হচ্ছে ভিষণ। কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু প্রহর তা করছে না। প্রিয়তাকে সাহস যোগাচ্ছে পাশে থেকে। আরহামকে বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে একটা ডাস্টবিনে পরে থাকতে দেখতে পেয়েছে তারা। আরহামের মাথায় বড়সড় আঘাত লেগেছে। হাতে-পায়ে গভীর ক্ষত। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল ছেলেটার শরীর। এতটাই আঘাত পেয়েছে যে মারা গিয়েছে বলে সবাই ভুল করছে। আরহামের শরীর নড়ছিল না। নিস্তেজ ছিল শরীর। প্রিয়তা আরহামকে এমন অবস্থায় দেখেই লুটিয়ে পরেছিল। এখন সে ঠিক আছে। তবে ডাক্তার রা আরহামের ব্যাপারে নিশ্চিত নয়। চেষ্টা করে দেখছে শুধু। বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা তেমন নেই বললেই চলে। আশা দিতে পারছে না কোনোমতেই।

প্রহর প্রিয়তাকে রেখে থানায় ছুটল। আরহামের যে এমন ক্ষতি করেছে তাকে খুঁজে বের করতে হবে। শাস্তি দিতে হবে। প্রহরের খারাপ লাগছে খুব। তার কারণেই আরহাম এত কষ্ট পাচ্ছে, মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। নিষ্পাপ ছেলেটার কতই না কষ্ট হয়েছে সেসময়। কেদেছে অনেক। প্রহরের বুক ভার হলো। চোখের কার্ণিশে অশ্রু জমল। বারবার আরহামের রক্ত মাখা শরীর স্মরণ হলো। প্রহরের চিৎকার করতে ইচ্ছে হলো। এ কয়েকদিনে আরহামের প্রতি আলাদা টান সৃষ্টি হয়েছে প্রহরের। বাচ্চাটার দিকে তাকালে কেমন মায়া মায়া লাগে। জাপটে ধরে রাখতে ইচ্ছে হয়। ছেলেটা বাঁচবে তো?প্রহরের ভয় হচ্ছে। ভিষণ ভয়। এত ভয় প্রহরের আগে হয়নি কখনো।

প্রহর পুনরায় ডাস্টবিনে গেল তদন্ত করতে। আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করলো এই ঘটনা নিয়ে। কেউই কিছু বলতে পারল না। প্রহর স্তব্ধ হলো। দাঁড়িয়ে রইল তদন্তের স্থানে। হঠাৎ প্রহরের মনে হলো কেউ তার কোমরে হাত রেখেছে। পদক্ষেপ নেওয়ার পূর্বেই নারীর কোমল হাত প্রহরের কোমরে থাকা রিভলবার টেনে নিজের হাতে নিল। প্রহর দু হাত উঁচু করে ধীরে ধীরে পিছু ফিরল। অবাক হলো ভিষণ। সামনে প্রিয়তা দাঁড়িয়ে। দু হাতে রিভলবার ধরে রেখেছে। প্রহরের বুকে তাক করে ধরে রেখেছে রিভলবার। প্রহর বিস্ময় নিয়ে হাত নামাল। প্রিয়তা উচ্চস্বরে হাসল। এলোমেলো লাগছে তাকে, ভয়ঙ্কর লাগছে। দৃষ্টিতে প্রতিশোধের নেশা জেগে উঠেছে। উন্মাদের মতো আচরণ করল প্রিয়তা। বললো,

” আপনার জন্যই। শুধুমাত্র আপনার জন্য আমার ভাই আজ মৃত্যুর মুখে। আমি জানি, আরহাম বাঁচবে না। যার জন্য আরহাম এত কষ্ট পেল তাকে আমি কি করে ছেড়ে দেই? আপনিও বাঁচবেন না। আপনাকে আমি খুন করবো প্রহর। যন্ত্রণা দিয়ে খুন করবো। আপনার মৃত্যু হবে আমার হাতে। আমরা কি চেয়েছিলাম বলুন? আমি আর আরহাম একটা সহজ-সরল জীবন চেয়েছিলাম। সুখে-শান্তিতে বাঁচতে চেয়েছিলাম সৎ ভাবে। আপনি আমাদের এই অন্ধকার দুনিয়ায় নিয়ে এলেন। আমাকে জায়গা দিলেন আপনাদের বাসায়। আপনার শত্রুরা আমার শত্রুতে পরিণত হলো। আমার ভাইকে হারাতে চলেছি আমি। এত সহজে আপনাকে ছাড়বো? আমার যে কষ্ট হচ্ছে। বুক পুড়ছে খুব। আরহাম ছাড়া আমার কেউ নেই। এই এত বড় পৃথিবীকে আমি আর আরহাম বড্ড একা। ছেলেটাকে আমাকে একা রেখে চলে যাচ্ছে। আমি মানতে পারবো না। আপনাকে শেষ করতে এসেছি।

প্রহর এমন এক মুহুর্তেও হাসল। তার অঙ্গভঙ্গিতে ভয়ের রেশ দেখা গেল না। আত্মবিশ্বাসের সাথে প্রহর বললো,

” প্রিয়, আমার প্রিয়। তোমার চোখে আমি আমার প্রতি ভালোবাসা দেখেছি। তুমি আমাকে শেষ করতে পারো না। তুমি আমায় ভালোবাসো। বড্ড বেশিই ভালোবাসো। আরহাম হারাবে না। আমি আরহামকে ভালোবাসি। ওর ক্ষতি যারা করেছে তাদের আমি শেষ করবো। আমাকে সময় দাও।

” উঁহু। সময় নেই। আরহাম কষ্ট পাচ্ছে। আপনিও পাবেন। ইউ আর ফিনিশড মিস্টার আজওয়াদ ইশতিয়াক প্রহর।

প্রিয়তা গুলি ছুড়ল। শব্দ বের হলো না গুলি থেকে। রিভলবারে সাইলেন্সার লাগানো। বন্দুকের নল থেকে গরম ধোঁয়া বের হলো। প্রিয়তা হাসল গাঢ় চোখে। সামনে থাকা বলিষ্ঠ দেহের সুদর্শন পুরুষ লুটিয়ে পরল মাটিতে। ধপ করে শব্দ হলো। চোখ থেকে টপ করে অশ্রু ঝরল। চিনচিন ব্যথা হলো বুকে। চোখ বুজে ফেলল সে। শান্ত গলায় প্রহর বললো,

” প্রিয়, আমার প্রিয়। তোমার এমন রুপ আমি চাইনি। আমার সত্যিই কষ্ট হচ্ছে না, আমি সুখ পাচ্ছি। আমার প্রিয় মানুষের থেকে পাওয়া বিষাক্ত এ ভালোবাসা আমি স্মরণে রাখবো।

প্রথম পরিচ্ছেদের সমাপ্তি।

( আসসালামু ওয়ালাইকুম। এতদিন যারা সাইলেন্ট রিডার ছিলেন তারাও মন্তব্য করবেন। তবেই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ দ্রুত আসবে। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে প্রিয়তা হবে একদম ভিন্ন রকম। তখন শুধু প্রিয়তার জীবনে নতুন নতুন ঘটনা দেখবেন। তানিয়া-ইহান ও থাকবে সেখানে। সবাইকে তুলে ধরবো ইন শা আল্লাহ্। এটা আমি লিখবো অফলাইনে। পুরোটা শেষ করে পোস্ট করবো একে একে। যাতে আপনাদের ধৈর্য ধরতে না হয়।)

প্রিয়তার প্রহর পর্ব-১৯

0

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা (১৯)
লেখনীতেঃ#বৃষ্টি_শেখ

তানিয়াদের বাড়ি থেকে প্রিয়তারা ফিরল দুপুরের পর পর। তখন ঝুম বৃষ্টি। ঘোলাটে শহর। শির শির করে উঠেছিল মেরুদণ্ড। শীত আর বৃষ্টি দুটো একসাথে ভালো লাগে না কারোই। দুই প্রকৃতিকে দুই ভাবে দেখতেই ভালো লাগে। এছাড়া প্রিয়তার ঠান্ডা লেগেছে আগেই। ও বাড়ি থেকে অনেকগুলো কেকের টুকরো আর খাবার প্যাক করে দিয়েছে তানিয়া। রাতে রান্না করতে হবে না বলে প্রিয়তা খুশি। কিছু তরকারিও বেঁচে যাবে।

আরহাম পড়তে বসেছে। গায়ে পাতলা চাদর। পড়তে পড়তে পাশে থাকা ছোট বাটি থেকে কেকের টুকরো মুখে দিচ্ছে। আড়চোখে তাকাচ্ছে প্রিয়তার দিকে। বেলকনিতে বসে পড়ছে প্রিয়তা। গরম চায়ের কাপ বেলকনিতে টুল পেতে তার উপরেই রেখেছে। চায়ের গরম ধোঁয়া উড়ছে। প্রিয়তা সেদিক থেকে নজর সরিয়ে বাড়ির নিচের রাস্তায় চোখ বুলাল। একজন ব্যক্তি সাইকেলে চড়ে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। লোকটার হাতে অনেক গুলো কাগজ। এ বাড়িটির ভিতরে প্রবেশ করল ছেলেটা। প্রিয়তা সবটাই দেখল সূক্ষ্মচোখে। এর দু মিনিট পরেই দরজায় খটখট শব্দ হলো। এখন কে আসবে? মনে প্রশ্ন নিয়ে দরজা খুললো প্রিয়তা। দরজার ওপ্রান্তে সাইকেলে চড়ে বাড়িটিতে প্রবেশ করা লোকটাকেই দেখল প্রিয়তা। লোকটার বয়স আনুমানিক পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে। রোগা ফিনফিনে চেহারা। গায়ে মোটা জ্যাকেট। প্রিয়তাকে দেখে ছেলেটা ভদ্রতাসূচক হাসল। বললো,

” আপনার নামে চিঠি আছে ম্যাম।

প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। কে তাকে আবার চিঠি দেবে এত ঘটা করে? কি সব হচ্ছে আজকাল? দ্বিধা নিয়ে প্রিয়তা নড়চড়ে দাঁড়াল। গম্ভীর হয়ে বললো,

” আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমাকে চিঠি দেওয়ার মতো কেউ নেই। চিঠির তো প্রশ্নই অসে না।

” আপনার নাম প্রিয়তা না? আপনার ঠিকানা তো এটাই দেওয়া।

প্রিয়তা খাম নিতে হাত বাড়াল। খামের উপরে প্রিয়তার নাম আর ঠিকানা দেখতে পেল। অতঃপর নিজের চিঠি বুঝতে পেরে খাতায় সাইন করে দিল। ছেলেটা চলে যেতে উদ্যত হতেই প্রিয়তা পিছু ডাকল। জিজ্ঞেস করলো,

” এখন তত চিঠির যুগ নেই। ডাকপিয়ন এখন দেখাই যায় না। আপনি সত্যিই চিঠি বিলি করেন?

হাসল ছেলেটা। কাগজ গুলো ভালো মতো আঁকড়ে ধরল। থুতনিতে থাকা কয়েকটা দাড়িতে হাত বুলাল। বললো,

” আমি সেই যুগটা এই সময়ে আনতে চাইছি ম্যাম। আমাদের অনলাইনে একটা পেজ আছে। সেখানে সবাই সবাইকে চিঠি লিখে পেজের ইনবক্সে দেয়। এবং আমরা সেই চিঠি পোস্ট করে প্রাপককে মেনশন দেই। এমনটা করতে করতে আমরা বুঝতে পারলাম শুধু অনলাইনে নয়, অফলাইনেও আমরা চিঠি আদান প্রদান করে মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ সুমধুর করতে পারি।

” আমাকে এই চিঠিটা কে দিয়েছে? আপনি নিশ্চয়ই তার সম্পর্কে জানেন। খামে প্রেরকের নাম, ঠিকানা কিচ্ছু নেই।

” স্যরি ম্যাম। যারা গোপনীয়তা বজায় রেখে চিঠি পাঠাতে চায় আমরা তাদের নাম বলতে পারি না।

প্রিয়তা কথা বাড়াল না। এদের নিয়ম সম্পর্কে বুঝে গেছে সে। হাত পা বেঁধে রেখে দিলেও ছেলেটা প্রেরকের নাম বলবে না। তাই আর কথা না বলে বিদায় দিয়ে দরজা বন্ধ করল প্রিয়তা। খামটি হাত দিয়েই ছিঁড়ে ফেলল প্রিয়তা। স্থির হয়ে বেলকনিতে গিয়ে বসল। চোখ বন্ধ করে শ্বাস টানল। একটা সময় চিঠি নামক যোগাযোগ পদ্ধতিটাকে ভিষণ পছন্দ করতো প্রিয়তা। চিঠি পেতে ইচ্ছে করতো খুব। আবেগ মিশ্রিত চিঠি দেখলে মন ভরে যেত প্রিয়তার। কল্পনা করতো তার একজন একান্ত মানুষ হবে। নিজের সমস্ত ভালোবাসা মিশিয়ে চিঠি লিখবে। প্রিয়তা ঠোঁট ছোয়াবে সেই চিঠিতে। বক্ষপিঞ্জরে রেখে ঘন ঘন শ্বাস ফেলবে খুশিতে।

সেসব আর কোথায়? জীবন কোথায় এনে ফেলল তাকে। জীবনের রঙ গুলো ছিনিয়ে নিল যত্ন নিয়ে। বাস্তবতা বুঝতে শিখিয়ে দিল। আপন মানুষ পর হলো। মৃত্যুর ভয় তাড়া করল। আর কত? আর কত সইবে প্রিয়তা? সবকিছুরই নাকি শেষ আছে। এই অশান্তির সমাপ্তি আদৌ ঘটবে? মাঝে মাঝে ভয় হয় প্রিয়তার। নিজের কল্পনাকে বড্ড বেমানান লাগে। নিজেকে কেমন তুচ্ছ মনে হয়। কেউ কোথাও তার জন্য অপেক্ষা করে নেই। প্রিয়তা কাগজের ভাঁজ খুলল। নিজের নামটা দেখে অবাক হলো না। এইবারে প্রিয়তার নামের পাশে হবু অর্ধাঙ্গিনী লেখা। প্রিয়তা হসে ফেলল লেখাটুকু পড়ে।

হবু অর্ধাঙ্গিনী( প্রিয়তা )

তুমি বিশেষ কেউ নউ, নক্ষত্রের মতো অসম্ভব কিছু নউ। তোমার মাদকতা মেশানো চোখে আমার প্রতি ভালোবাসা নেই। তবুও ভালোবাসার যে প্রতিজ্ঞা করেছি তা রাখার জন্য আমি সর্বদা প্রস্তুত। তোমাকে প্রায়ই দেখি, প্রায়ই শুনি। অবাক হই আমি। আমার ভালোবাসার মানুষটা এত সুন্দর কেন? এত উজ্জল কেন? ঘোর লেগে যায় কেন আমার? উত্তর কি আছে তোমার কাছে? আমি নিজস্ব অনুভূতি বিশ্লেষণ করতে পারি না। কখনো করিওনি। বাট নাউ, আই হ্যাভ টু সে ইউ, আই লাভ ইউ।

প্রিয়তা গভীর চোখে মুগ্ধ হয়ে লেখাটুকু পড়ল।বিস্ময়ে বিমূঢ় হলো প্রিয়তা। এইভাবে কে লিখল? কেন লিখল? প্রিয়তা কি লোকটাকে চিনে?

—-

প্রিয়তার ঘরের গ্যাস সিলিন্ডার শেষ। ভোর ছাড়া গ্যাস আসে না। এক মাসেই সিলিন্ডার শেষ হয়ে গিয়েছে। আজ রাতে রান্না না করলেও চলবে। কিন্তু সকালে? সকালে কি করবে? গ্যাস পেতে হলে ভোরে উঠে রান্না করে কলেজে যেতে হবে, এরপর আবার রয়েছে টিউশনি। প্রিয়তার মাথা ঘুরতে লাগল। এত এত খরচ কিভাবে সামলাবে মস্তিষ্ক বুঝতে পারছে না।

বিকেলে প্রিয়তা পড়তে বসেছে। পরিক্ষার আগে পুরো দমে পড়াশোনা করতে চাইছে। হঠাৎ জাস্টিন বিবারের “লেট মি লাভ ইউ” গানটা শুনতে পেল সে। উচ্চ স্বরে বাজতে থাকা গান শুনে বিরক্ত হলো প্রিয়তা। ছাদ থেকে গানের শব্দ আসছে। এ সময় কে বক্স বাজাবে? প্রিয়তা আরহামকে পড়া দেখিয়ে উঠে দাঁড়াল। গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ছাদের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। আরহাম ও প্রিয়তার পিছু পিছু বের হলো। দরজা পেরিয়ে ছাদে প্রবেশ করতেই কান ঝাঁঝিয়ে এলো প্রিয়তার। অত শব্দ না হলেও প্রিয়তার মাথা ব্যথার কারণে শব্দটা বেশিই মনে হচ্ছে। ছাদের রেলিংয়ের পাশে প্রহর আর একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির পরণে কালো ফতুয়া আর জিন্স। প্রহর দুরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে কিছু বলছে। প্রিয়তা পা বাড়াবে কিনা দ্বিধায় পড়ে গেল। অতঃপর একটু এগিয়ে এসে উচ্চস্বরে বললো,

” মিউজিকের ভলিউম টা কমান প্লিজ। আমাদের ডিস্টার্ব হচ্ছে।

প্রহর কথা থামিয়ে প্রিয়তার দিকে তাকাল। মেয়েটাও প্রিয়তার পানে তাকিয়ে প্রিয়তাকে পর্যবেক্ষণ করলো। প্রহর তা দেখে মুচকি হাসল। বক্সের ভলিউম কমিয়ে দিল। সামনের চুলগুলোকে পেছনে ঠেলে দিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো,

” পরিচিত হও। ও প্রিয়তা। তোমাকে ওর কথাই বলেছিলাম। কেসটা সলভড করতে প্রিয়তা আমাদের খুব হেল্প করেছে।

লিরা মিষ্টি হাসল। মেয়েটার মাঝে বিদেশী বিদেশি ভাব আছে। গায়ের রঙ তার অতিরিক্ত ফর্সা। সাদা চামড়া মানেই বিদেশী এমনটা কখনো মনে হয়নি প্রিয়তার। বাংলাদেশেও অনেক সাদা চামড়ার, সুন্দর মানুষ আছে। তবুও মেয়েটাকে দেখে বিদেশি বিদেশিই লাগল। পোশাঈ পরিচ্ছদ মার্জিত লাগল। লিরা হাত বাড়াল প্রিয়তার দিকে। নম্র স্বরে বললো,

” হাই, আ’ম লিরা। ফ্রম ইংল্যান্ড।

” হ্যালো, আমি প্রিয়তা।

” আমি তোমার কথা শুনেছি প্রহরের মুখে। প্রহর ওয়াজ রাইট। হি সেইড, ইউ লুক লাইক আ বার্বি ডল। নাউ আই সি দ্যাট।

প্রহর থতমত খেল। প্রিয়তা সেদিকে না তাকিয়ে বললো,

” আপনি বাংলা জানেন?

” ইয়েস, আই নো দিস ল্যাঙ্গুয়েজ। বিকজ লং ডেইস এগো আই ওয়াজ লিভ ইন দি বাংলাদেশ। মাই প্যারেন্টস্ ওয়াজ বর্ন(Born) ইন বাংলাদেশ। দ্যাটস হোয়াই আই হ্যাভ টু লার্ন বাংলা।

” আচ্ছা। আমি আসলে আমার ভাইকে পড়াচ্ছিলাম। আপনাদের মিউজিকের কারণে পড়তে সমস্যা হচ্ছিল।

এইবার লিরা আরহামের দিকে তাকাল। আরহাম এতক্ষণ চুপচাপ বোনের পাশে দাঁড়িয়ে কথোপকথন শুনছিল। সে বুঝেছে লিরা মেয়েটা মিশুক। ব্যবহার যথেষ্ট মার্জিত। লিরা নিচু হয়ে আরহামের থুতনিতে হাত রাখল। বললো,

” হেই বেবি। তোমার নাম কি?

” মাই নেইম ইজ আরহাম।

” উইল ইউ বি মাই ফ্রেন্ড?

আরহাম প্রিয়তার দিকে তাকাল। প্রিয়তা মুচকি হাসল। অতঃপর আরহাম হাত মেলাল। হাসল একটু। প্রিয়তা ছাদ থেকে নেমে আসল। প্রহর প্রিয়তার পিছু পিছু এলো। পিছন থেকে পায়ের শব্দ শুনে প্রিয়তা থমকাল। পিছু ফিরে প্রহরকে দেখে অবাক হলো প্রিয়তা। কণ্ঠ নামিয়ে কিছু বলার পূর্বেই প্রহর সিঁড়ির হাতল ধরে পথ আটকে দাঁড়াল। সম্মোহনী চোখে চেয়ে বললো,

” তুমি আমার এওয়ার্ড ফানশনে যাও নি কেন প্রিয়তা? আমি ভেবেছিলাম তুমি আসবে।

” কাজ ছিল। তানিয়া আপুর বাসা থেকে এসে আমি টায়ার্ড ছিলাম।

” কি হয়েছে?

” কি হবে?

” তোমার কণ্ঠ, আচরণ, অঙ্গভঙ্গি আমার অন্যরকম লাগছে।

” আপনার বাবা এসেছে আমাকে তো বলেননি।

” তুমি আমার সাথে রুড বিহেইভ করছো। বলার সময় পাইনি।

” বিয়ে কবে হচ্ছে?

” কিসের বিয়ে?

” কিছু না।

” কি বলতে চাও। বলো প্লিজ।

” কিছু বলতে চাই না। সামনের মাসে আমি আর আরহাম এখান থেকে চলে যাচ্ছি। আমি চাই না আমাদের বন্ধুত্ব গাঢ় হোক। তাই আপনি আমার থেকে দুরত্ব বজায় রাখবেন প্লিজ।

প্রহরকে বাক্য ব্যয় করতে দিল না প্রিয়তা। দ্রুত পায়ে সিড়ি ভেঙে নেমে গেল। সব কথাই প্রহরের মাথার উপর দিয়ে গেল। কি হচ্ছে কেন হচ্ছে বোধগম্য হলো না। প্রিয়তার করুণ মুখ স্পষ্ট বুঝতে পারল প্রহর। শুধু বুঝতে পারল না মেয়েটার ভিতরকার পরিস্থিতি।

__________

প্রিয়তাদের নিচের ফ্ল্যাটে একটি নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। তারা এসেছে মাসের প্রথমেই। কিন্তু প্রিয়তার সাথে পরিচয় হয়নি সেই নতুন ভাড়াটিয়ার। প্রিয়তা গুঁড়ো মাছ কিনেছে। কাটাকুটি করার পর ধুয়ে মাছ ফ্রিজে রাখতে গিয়েছিল নিচে। নিচের ফ্ল্যাটের এক বৃদ্ধার ফ্রিজে সবসময় মাছ, মাংস রাখে প্রিয়তা। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে গিয়ে নতুন ভাড়াটিয়ার সাথে দেখা। সেই পরিবারে সদস্য সংখ্যা মাত্র তিনজন। স্বামী, স্ত্রী, আর সন্তান। পরিবারের কর্তা রায়হান সাহেবের স্ত্রীর সাথে প্রিয়তার আলাপ হয়েছে অনেকক্ষণ। আপুটার সাত বছরের একটি ছেলে আছে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে আপুটা খুব অনুরোধ করল আরহামকে নিয়ে তাদের ফ্ল্যাটে যাওয়ার জন্য। প্রিয়তা জোরাজুরি করার পর মেনে নিল। কারণ বেঁচে থাকলে হলে আশপাশের মানুষগুলোর সাথে মানিয়ে চলতে হয়। সবাইকে আপন ভেবে কাছাকাছি রাখতে হয়। কখন কোন বিপদে, কাকে কাজে লাগে তা তো বলা যায় না।

সকালে আরহাম আর প্রিয়তা এলো রায়হান সাহেবের ঘরে। রায়হান সাহেব তখন অফিসে। বাড়িতে ছিল তার স্ত্রী হালিমা আর ছেলে রাকিব। প্রিয়তারা ফ্ল্যাটে আসতেই রান্নাবান্না শুরু করে দিল হালিমা। বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা আর খাওয়া দাওয়ার পর প্রিয়তা ঘরে ফিরতে উদ্যত হলো। আরহাম তখন খেলায় ব্যস্ত। আরহাম ফিরতে চাইল না প্রিয়তার সাথে। রাকিবের সাথে খেলনা দিয়ে খেলছিল সে। কিছুতেই ফিরতে চাইল না ঘরে। প্রিয়তা রেগে গেল কিছুটা। বললো,

” চলো আরহাম। পরে আবার আসবে। অনেকক্ষণ হলো আমরা এসেছি।

আরহাম অনুনয় করে করে বলে উঠল,

” পরে যাবো আপু। একটু খেলা করেই চলে যাবো।

হালিমা আপু আরহামকে রেখে যেতে বললো। অগত্যা বাধ্য হয়ে একাই ঘরে ফিরল প্রিয়তা। পড়তে বসল আবার। দুপুরে টিউশনিতে গিয়ে স্টুডেন্টদের পরিক্ষা নিবে সে। এম সি কিউ এর পরিক্ষা। সেসব প্রস্তুত করল অনেক সময় নিয়ে। প্রিয়তার ফাঁকা ফাঁকা লাগল। আরহাম আসেনি তখনো। উঠবে উঠবে করে লিখতে লিখতে উঠা হলো না প্রিয়তার। কিছুক্ষণ পর কান্নার শব্দ এলো বাইরে থেকে। প্রিয়তা কান খাঁড়া করল। আরহামের কান্নার স্বর শুনে বুকটা ধক করে উঠল প্রিয়তার। তড়িঘড়ি করে বই খাতা রেখে উঠে দাঁড়াল সে। দরজার পাশে আরহামকে কান্না করতে দেখে জড়িয়ে ধরল ছেলেটাকে। প্রিয়তার বক্ষপিঞ্জর কেঁপে উঠল। অজানা আশঙ্কায় মলিন হলো চেহারা। ভাইয়ের এমন কান্নায় প্রিয়তার চোখ চিকচিক করে উঠল। চোখের কার্ণিশে অশ্রর চিহ্ন দেখা দিল। প্রিয়তার কান্না পাচ্ছে ভিষণ। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। জড়ার কারণে কথা আটকে আসছে বারবার। নাক টানল প্রিয়তা। আরহামের মাথার দু পাশে হাত রেখে বলে উঠল,

” কাঁদছো কেন আরহাম? কি হয়েছে?

আরহামের ফর্সা,নরম গাল পানিতে টইটম্বুর। একবার গাল মুছে দিলে আবার পানির দেখা মিলছে। নাক মুখ লাল হয়ে গিয়েছে আরহামের। ডান কান রক্তিম হয়েছে। আরহামের হেচকি তোলার শব্দ কানে বিঁধছে প্রিয়তার। আরহাম কেঁদে যাচ্ছে অনবরত। প্রিয়তা পুনরায় জিজ্ঞেস করল। আরহাভ কেঁদেই চললো। এইবার প্রিয়তার কণ্ঠ স্বাভাবিক। গাম্ভীর্যপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সে। আরহাম ভয় পেল। দুর্বল কণ্ঠে বললো,

” আপু রাকিব আমাকে মেরেছে।

” কেন মেরেছে তোমায়?

” ওর খেলনা ধরেছি বলে আমার কান মুচড়ে দিয়েছে। দেখো না খুব ব্যথা করছে আপু।

প্রিয়তা কানে হাত দিল। গরম হয়ে আছে ডান পাশের কান। রক্তিম হয়ে আছে। মুচড়ে দেওয়া জায়গাটায় হাত বুলাল প্রিয়তা। আরহামের এমন করুণ কণ্ঠে দুর্বল হলো সে। তবুও সেইসব বুঝতে না দিয়ে প্রিয়তা রয়েসয়ে দাঁড়াল। বললো,

” তোমাকে আমার সাথে আসতে বললাম। আসো নি। বড়দের কথা না শুনলে এমনই হয়। রাকিব তোমাকে মারল হালিমা আপু কিছু বললো না?

” আন্টি দোকানে। আমি রিমোর্ট কন্ট্রোল গাড়িটা ধরেছি বলে আমার হাতে থাপ্পড় মেরে আমাকে কান ধরে এখানে এনে দিয়েছে। পেটে ঘুষি মেরেছে। আমি আর কিচ্ছু করিনি আপু।

” ঘরে চলো। আমি রাকিবকে বকে দিবো।

” তুমি আমাকে গাড়ি কিনে দিবে? আমি আর কক্ষনো ওই ঘরে যাবো না।

” গাড়িটার দাম কত?

” সাড়ে সাতশো। তুমি কিনে দিবে আপু?

” না। অত টাকা আমার কাছে নেই। এত খেলতে হবে না।

আরহাম ঠোঁট উল্টাল। নরম চোখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। বাচ্চাটার রাগ হলো বোধহয়। এমন জীবন যাপনে অভ্যস্থ নয় বলে আরহামের একটু বেশিই কষ্ট হচ্ছে মানিয়ে চলতে। রাগান্বিত হয়ে আরহাম বলে উঠল,

” আমাকে ওটা কিনে না দিলে আমি ভাত খাবো না। তুমি ভালো নও। আমাকে শুধু বকো। আমাকে খেলনা দাও না। আমি কিচ্ছু খাবো না

” বেতন পেলে দিবোনি।

” তুমি দিবে না জানি। আমায় প্রমিস করো দিবে।

প্রিয়তা রেগে গেল। যদিও এ মুহুর্তে রাগ করা বোকামো। তবুও প্রিয়তা রেগে গেল। এত এত যন্ত্রণা তার সহ্য হচ্ছে না। আগের মাসের ভার্সিটির মাসিক ফি দেওয়া হয়নি। স্যার বলেছে টাকাটা দিলেই পরিক্ষা দিতে দিবে। এ নিয়ে টেনশনে আছে প্রিয়তা। দু দিন পর ঘর খুঁজতে হবে। এ নিয়েও ভাবনার শেষ নেই তার। অপরদিকে মিসেস নাবিলার কথা শুনে প্রিয়তা জোর হারিয়েছে। সব দিক থেকে নিজেকে অসহায়, অবলা লাগছে। এ সমাজে আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না এমনিতেই। তার উপর আরহামের এমন বায়না অসহ্যকর ঠেকল প্রিয়তার কাছে। কষে চড় মারল আরহামের গালে। মুহুর্তেই আরহাম হতবিহ্বল হলো। পলকহীন ভাবে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল। ফর্সা গালে চার আঙ্গুলের দাগ পরে গেল আলহামের। আরহাম কাঁদতে ভুলে গেল। হা করে তাকিয়ে রইল বোনের দিকে। প্রিয়তা আরো দুটো কিল বসাল আরহামের পিঠে। ভয়ানক এক শব্দ হলো। আরহাম শুয়ে পরল মেঝেতে। গায়ে ময়লা লেগে গেল। ব্যথায় চিৎকার করে উঠল এবার। প্রিয়তার এই চিৎকার ও বিরক্তিকর ঠেকল। আরহামের গাল চেপে ধরে বললো,

” সবসময় শুধু আবদার আর আবদার। তোমাকে কি কি দিলে তুমি সুখী হবে? তুমি বুঝো না কিছু? আমার কাছে টাকা নেই বুঝো না? এত বড়লোকি স্বভাব কেন তোমার? আব্বু আম্মু তো রাখেনি তোমায়। আমার ঘাড়ে এসে পরতে হয়েছে। আমার কাঁধে দায়িত্ব পরেছে। পরিস্থিতি বুঝো না? তোমার জ্বালা আমার সহ্য হচ্ছে না আরহাম।

আরহাম কাঁদতে লাগল শব্দ করে। কষ্ট পেল ভিষণ। দৌড়ে ছাদে উঠে গেল সে। প্রিয়তা বসে রইল দরজার বাইরেই। কান্না পেল খুব। কিয়দংশ সময় পর লিরা আর প্রহর এলো প্রিয়তার সামনে। প্রহরের কোলে আরহাম মুখ গুঁজে আছে। প্রহর আরহামকে দাঁড় করাল। হাত বাড়িয়ে প্রিয়তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করতে চাইল। প্রিয়তা অগ্রাহ্য করলো সেই সহানুভূতির জন্য বাড়িয়ে দেওয়া হাত। একটা কঠিন কাজ করে ফেলল প্রহর। এই প্রথম বার প্রিয়তাকে ছুঁয়ে দিল সে। প্রিয়তার বাহু ধরে ফেলল ছেলেটা। দু বাহু ধরে উঠে দাঁড় করাল প্রিয়তাকে। অবাকের শেষ সীমানায় গিয়ে প্রিয়তা পুতুলের ন্যায় উঠে দাঁড়াল। প্রহর গাম্ভীর্যপূর্ণ দৃষ্টি মেলে বললো,

” আরহামকে মেরেছো কেন?

” আমার ভাই, আমার ইচ্ছে হয়েছে আমি মেরেছি। আপনাকে কৈফিয়ত দিবো কেন? অকপটে বলে উঠল প্রিয়তা। কঠিন চাহনি তার।

লিরা এগিয়ে আসল। মেয়েটা আসলেই চমৎকার । আরহামের কান্নায় ব্যথিত সে। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে লিরা বলে উঠল,

” হোয়াট হ্যাপেন্ড প্রিয়তা? ওকে মেরেছো কেন? আহ্, বাচ্চা। ব্যথা পেয়েছে। তোমাকে অন্যরকম লাগছে।

প্রহর বলে উঠল,

” আমি তোমার থেকে একটা আশা করিনি প্রিয়তা। আরহামের বাবা-মা থেকেও নেই। তুমিই ওর একমাত্র আপন জন। কিভাবে পাষণ্ডের মতো মেরেছো দেখো। দাগ হয়ে গিয়েছে। এখন কান্না করছে ছেলেটা।

প্রিয়তা উন্মাদের মতো আচরণ শুরু করলো। আরহামকে টেনে কাছে টানল সে। রাগান্বিত হয়ে বলে উঠল,

” তুমি সবাইকে গিয়ে বিচার দিচ্ছো? যাও ওদের কাছেই। ফারদার আমার কাছে আসবে না।

প্রহর রেগে গেল। অতি নিকটে এসে দাঁড়াল প্রিয়তার। কঠিন স্বরে বললো,

” সমস্যা কি তোমার? কাল থেকে এমন রুড বিহেইভ করছো কেন সবার কাছে?

” হ্যাঁ আমি রুড। তো? আপনার কি? আমার যা ইচ্ছে আমি করবো। আমার পার্সোনাল লাইফে এন্টারফেয়ার করবেন কেন? যে পারছে সে এসে আমাকে আর আমার ভাইকে অপমান করছে, অসম্মান করছে। ছেলেটাকে ভোলাভালা পেয়ে মেরে দিচ্ছে ইচ্ছে মতো। আমি কিছুই করতে পারছি না। বড়লোক ঘরের ছেলে বলে এত আবদার করতে হবে তার কোনো মানে আছে? বলে কিনা রিমোর্ট কন্ট্রোল গাড়ি না পেলে ভাত খাবে না। এখন আমি কি করবো? পুরো মাসের বাজারের টাকা দিয়ে ওর জন্য গাড়ি কিনবো? আমার কি দুর্দশা চলছে আমিই বুঝতে পারছি। এক পা চলতে গিয়ে দু পা পিছিয়ে যাচ্ছি। একের পর এক আঘাত পেয়ে যাচ্ছি। সবাই তো শুধু সহানুভূতি দেখাতে পারে। প্রকৃতভাবে আমার পরিস্থিতি বোঝার মতো কেউ নেই। আমি সম্পূর্ণ একা। আরহাম বোঝে না আমাকে। অভাবের কথাও বোঝে না। কেন বুঝবে না? বুঝতে হবে।

প্রহর কথা থামিয়ে দিল। লিরাকে বললো আরহামকে নিয়ে যেতে। লিরা চলে গেল অসহায় ভঙ্গিতে। প্রহর দুরত্ব আরো কমাল। কাঁপা হাতে দু হাত দিয়ে প্রিয়তার গালে হাত রাখল। চোখের দিকে চেয়ে থেকে বললো,

” তুমি পারবে প্রিয়তা। সবটা সামলাতে পারবে। কোনো না কোনো ব্যবস্থা হবেই। ধৈর্যহারা হইয়ো না। আমি তোমার পাশে আছি।

চলবে?

প্রিয়তার প্রহর পর্ব-১৮

0

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা (১৮)
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

প্রিয়তা আর মিসেস নাবিলা দুজন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে। কারো মুখেই কোনো কথা নেই। প্রিয়তার আগ্রহ প্রকাশ পাচ্ছে। সে জানতে চায় মিসেস নাবিলা তাকে কী বলতে চান? কেন কথাটা এত জরুরী?

মিসেস নাবিলা আমতা আমতা করছেন। বলবে বলবে করেও বলছেন না। প্রিয়তা ভারী শ্বাস ফেলল। শান্ত স্বরে বললো,

” আপনি আমাকে কি বলে চান বলে ফেলুন। আমার সামনে আপনি এমন অসস্তি বোধ করবেন না, এমন আমতা আমতা করবেন না। আমি এসবে লজ্জা পাই। আমার মনে হয় আমি আপনাকে কম্ফোর্ট দিতে পারছি না। সেজন্য আপনি দ্বিধা বোধ করছেন।

মিসেস নাবিলা প্রিয়তার কথা শুনলেন মনোযোগ দিয়ে। বললেন,

” আগামীকাল প্রহরের বাবা আসবে। ছেলে এত বড় একটা কেস সলভড করেছে ভেবে মানুষটা খুব আনন্দিত। আগামীকাল প্রহর আর ওর টিমকে সম্মাননা প্রদান করা হবে। সেখানে প্রহরের বাবা থাকতে চায় বলেই আসছে। আমার ছেলেকে আমি ভালোমতোই চিনি প্রিয়তা। ছেলেটা কখনো কোনো মেয়ের সাথে মেশে নি । আঠাশ বছরের জীবনে তুমি আর তানিয়া ছাড়া আর কারো সাথেই এত পরিচিত হয়নি প্রহর। তানিয়াকে নিয়ে আমার ভাবনা নেই। প্রহর মেয়েটাকে শুধু বন্ধুই ভাবে। কিন্তু তোমার প্রতি ওর ভাবনাচিন্তা ভিন্ন হতে পারে।

প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকাল। এইসব কি বলছেন আন্টি? কি বোঝাতে চাইছেন? প্রহরের সাথে তার পরিচয়টা অন্যভাবেই হয়েছিল। এত এত ঘটনা ঘটার পর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হওয়া স্বাভাবিক। হ্যাঁ মাঝে মাঝে প্রহরকে নিয়ে অন্য রকম চিন্তা আসে প্রিয়তার মাথায়। তাই বলে এতটা তো নিজেও কখনো ভাবেনি সে। প্রহরের আচার-আচরণেও কখনো সেরকম কিছু খুঁজে পায়নি প্রিয়তা। তাহলে কিসের ভিত্তিতে নাবিলা আন্টি এসব বলতে এসেছেন? ভাবতে বসলো প্রিয়তা। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,

” কি বলতে চাইছেন আন্টি?

” প্রহরের বাবা প্রহরের জন্য একটি মেয়েকে ঠিক করে রেখেছে। ওর বিজনেস পার্টনারের মেয়ের সাথে। ইংল্যান্ডে একসাথে বিজনেস করে প্রহরের বাবা আর লিরার বাবা। এবার দেশে আসার সময় মেয়েটাকে নিয়ে আসবে ও। বিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেই আসছে। আমার ভয় হয়। প্রহরের যদি তোমার প্রতি কোনো অনুভূতি থাকে..

” আপনি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছেন আন্টি। তেমন কিছুই নেই আমাদের মাঝে। আপনার চিন্তা করা বৃথা।

” কিন্তু হতে কতক্ষণ বলো? তোমাদের মাঝে সম্পর্ক হলেও আমার সমস্যা ছিল না। পিয়াস মানে প্রহরের বাবা কখনো এই সম্পর্ক মানবে না। আমার কেন যেন ভয় করছে। প্রহরের হাবভাব আমার ঠিক ঠেকছে না।

” আমি এখন কি করতে পারি? আমায় এসব বলার নিশ্চয় কারণ রয়েছে। কি সেই কারণ?

” সামনের মাসেই চলে যেও এ বাড়ি থেকে। আমি ভালো একটা বাসা ঠিক করে দিবো। আরহামকে আর তোমাকে আমি ভালোবাসি। কিন্তু আমার কিছুই করার নেই। ভবিষ্যতে যদি তোমাদের কোনরুপ সম্পর্ক হয়? তোমার কষ্ট পাও তা আমি চাই না।

” ঘর আমি নিজেই খুঁজে নিবো আন্টি। আপনি ভাববেন না। সামনের মাসেই আমরা চলে যাবো। এ কটা দিন থাকতে দিন আমাদেয। কেননা এই সময় তো কেউ ঘর ভাড়া দেয় না।

_________

আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠল প্রিয়তা। ভাত বসিয়ে চিংড়ি দিয়ে লাউয়ের তরকারি রান্না করল। আরহাম এই তরকারিটা খেতে পছন্দ করে। বেতন পেয়ে ছোট ছোট চিংড়ি মাছ এনেছিল সে। তন্ময়ের রুমমেট এই রান্নাটা প্রিয়তাকে বলে দিয়েছিল। বাইরে প্রচণ্ড কুয়াশা পরেছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছে। শীত এখন অতটা নেই। আকাশে রোদের ছিটেফোঁটাও নেই। অন্ধকার অন্ধকার লাগছে পৃথিবীকে। প্রিয়তা রান্না করে পড়তে বসলো। সামনে বার্ষিক পরিক্ষা। টিচাররা প্রত্যেকবারের মতো এবারও প্রিয়তার ভালো রেজাল্ট আশা করছে। তারা তো জানে না প্রিয়তার পরিস্থিতি।

প্রিয়তা হেঁটে হেঁটে পড়তে লাগল। আরহামের ঘুম কাটল প্রিয়তার কণ্ঠ শুনে। গুনগুন করে পড়ছে প্রিয়তা। মাঝে মাঝে খাতায় লিখছে। আরহাম ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করে খেতে বসল। প্রিয়তা খাবারটুকু বেড়ে দিয়ে আবার ও পড়তে লাগল। ফোনের রিংটোন বেজে উঠল প্রিয়তার। আননোং নাম্বারটা দেখে প্রিয়তা ফোনটা ধরল। সালাম দিল প্রথমেই বললো,

” কে বলছেন?

ওপাশের নারী কণ্ঠে মিষ্টি হেসে তানিয়া বলে উঠলো,

” আমি তানিয়া বলছি। চিনেছো?

” আপনি? কেমন আছেন? আমাকে ফোন দিলেন হঠাৎ? কিছু হয়েছে আপু?

তানিয়ার হাসির শব্দ শোনা গেল। শান্ত হয়ে তানিয়া বললো,

” আমি খুউউব ভালো আছি। তুমি আমাদের বাসায় আসবে প্রিয়তা? আরহামকে নিয়ে আসবে একটু?

অবাক হলো প্রিয়তা। তানিয়া ডাকছে কেন তাকে? বিস্ময়ে বিমূঢ় হলো সে। সাবলীল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠল,

” আমি আপনাদের বাসায়? কেন আপু?

” আমার বাবার আজ বিয়ে। আমি চাইছি বাড়িটাকে সাজাতে। একটু খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করতে। ইহান আর প্রহর স্যার ও আসবে। আমি চাই তুমিও আসো। আরহাম খুব খুশি হবে। এসো না প্লিজ।

” না আপু, আপনারা আনন্দ করুন। আমার সামনে পরিক্ষা। বাসায় বসে প্রিপারেশন নিচ্ছি। আঙ্কেলের জন্য আমার শুভ কামনা থাকবে।

” শোনো, তুমি যদি না আসো আর কখনো তোমার সাথে কথা বলবো না। আমি তোমার বড় হই। বড়দের কথা শোনো। এক্ষুণি চলে আসবে আরহামকে নিয়ে। নইলে আমি রাগ করবো প্রিয়তা। আমার এমন একটা সুখের দিনে তোমাকে রাখতে চাইছি। আসবে প্লিজ। কিচ্ছু শুনতে চাই না।

কল কেটে দিল তানিয়া। দ্বিধায় নড়েচড়ে বসল প্রিয়তা। তানিয়ার সাথে তার সম্পর্ক অত মজবুত নয়। দেখা হলে কুশল বিনিময় ব্যতিত তেমন কোনো কথাও হয়নি। প্রহরের মুখে তানিয়ার বাবার বিয়ের সম্পর্কে একটু-আধটু শুনেছে প্রিয়তা। সেই বিয়েতে প্রিয়তাকে নিমন্ত্রণ জানানো হবে কখনো ভাবেনি সে। প্রিয়তা বসে পরল মেঝেতে বিছিয়ে রাখা বিছানায়। আরহাম ভাত মাখাতে মাখাতে বোনের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। ছেলেটার গালে ঝোল লেগে আছে। তানিয়ার সাথে প্রিয়তার কথোপকথন শুনেছে আরহাম। ভাতের লোকমাটুকু মুখে নিয়ে ছেলেটা বলে উঠল,

” তানিয়া আপু আমাদের যেতে বলেছে আপু? চলো না যাই। আমাকে তোমার আগে দাওয়াত দিয়েছে। আমি বলেছি তোমাকে জানাতে। তোমার সাথে যাবো বলেছি।

প্রিয়তা কিছু বললো না। আরো কিছুক্ষণ পড়ে বইখাতা সব গুছিয়ে রাখল। তানিয়া ই-মেইলে ঠিকানা দিয়ে দিয়েছে। মেসেজ করে পুনরায় অনুরোধ করেছে। প্রিয়তা শান্ত ভঙ্গিতে আরহামের কাছে আসল। ভাইকে জড়িয়ে ধরলো বক্ষপিঞ্জরে। চুমু খেল অনবরত। আগলে নিলো বাহুডোরে। বললো,

” তুমি যাবে?

আরহাম খুশি হলো। উৎফুল্ল দেখাল তাকে। সন্দেহ নিয়ে বললো,

” তুমি যাবে?

আরহামের প্রশ্নে খিলখিল করে হেসে উঠল প্রিয়তা। আরহামের নরম, মশ্রীন গাল টেনে দিল। লাগেজ থেকে পার্পল কালারের একটি শার্ট বের করল। ফুল প্যান্ট পড়িয়ে শার্টের সাথে ইন করে দিল। নিজেও ম্যাচিং করে পার্পল রঙের ফ্রক পরল প্রিয়তা। হাতে চুরি পরল শখ করে। চোখে গাঢ় করে কাজল পরল। লিপবামের কারণে চিকচিক করে উঠল প্রিয়তার ওষ্ঠদ্বয়। সাদা পাথরের একটি নোজ পিন পরে নিল সে। মাথার সামনের কয়েকটি চুল নিয়ে ঢিলাঢালা ছোট্ট খোঁপা বেঁধে নিল। পেছনের চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে নিজেদের আয়নায় দেখল প্রিয়তা। আজ কতগুলো দিন পর এইভাবে সাজল প্রিয়তা। হুট করেই জীবনের রঙ গুলো কেমন গায়েব হয়ে গেল প্রিয়তার। সমাজের শত শত বাঁধার মধ্যে আটকে গেল মুহুর্তেই। আর নিজেকে রাঙাতে ইচ্ছে হলো না তার। আর নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় পেল না প্রিয়তা। এখন এই সাজগোজ কেমন বিলাসীতা লাগে। ঘরে চাল কিনতে গিয়ে যে অবস্থা হয় তারপরে সাজগোজ করলে মানুষ তাকে কি বলবে?

প্রিয়তা ফোনটা নিয়ে আরহামকে সাথে করে বের হলো। বাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় ওঠার সময় প্রহরের মুখোমুখি হলো প্রিয়তা। প্রিয়তাকে দেখে দাঁড়াল প্রহর। সে এখন তানিয়ার বাড়িতেই যাচ্ছে। প্রিয়তাকে দেখে প্রহর থামল। মেয়েটাকে আজ অমায়িক লাগছে। অগোছালো থেকে বেরিয়ে এসে আজ প্রিয়তাকে অন্যরকম লাগছে। দু ভাইবোনকে পার্পল রঙে বেশ মানাচ্ছে। প্রহর আড়চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। চোখ বারবার মেয়েটাতে নিবদ্ধ হলো। ক্ষণিকের জন্য পৃথিবীর সমস্ত অলিগলি ভুলে যেতে চাইল। প্রহরের ধ্যান ভাঙল। হাসল সে। এগিয়ে এলো প্রিয়তার দিকে। বললো,

” আপনি তানিয়ার বাসায় যাচ্ছেন?

প্রিয়তার গতকাল রাতে মিসেস নাবিলার বলা কথা মনে পরল। বিষাদে ছেয়ে গেল প্রিয়তার হৃদয়। কান্না পেল খুব। সামনের মানুষটার প্রতি ভিষণ রাগ হলো প্রিয়তার। তার জন্যই তো এতকিছু। কেন এখানে তাকে এনেছিল পুলিশম্যান? কোনো কথা না বলে শক্ত হয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে অটত স্যান্ডের দিকে পা বাড়াল প্রিয়তা। প্রিয়তার এহেন আচরণে অবাক হলো প্রহর। ডাকল পেছন থেকে। জিজ্ঞেস করলো,

” উত্তর দিলেন না।

প্রিয়তা দাঁড়াল না। হেঁটে যেতে যেতে গম্ভীর কণ্ঠেই উত্তর দিল,

” ওখানেই যাচ্ছি। আপনাকে বলতে যাবো কেন কোথায় যাচ্ছি না যাচ্ছি? আপনি জিজ্ঞেস করছেন কেন?

প্রহরের বিস্ময় ধরতে পারল প্রিয়তা। তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। প্রহর বলে উঠল,

” এভাবে কথা বলছেন কেন প্রিয়তা?

প্রিয়তা এবার থামল। পিছু ফিরে প্রহরকে পরখ করলো। দম ফেলল ভালো করে। স্বাভাবিক হয়ে বললো,

” কিভাবে কথা বলছি?

” ইগনোর কেন করতে চাইছেন?

” আমি আপনাকে ইগনোর করবো কেন? আর করলেও সমস্যা কোথায়?

” এই মুহর্তে আপনি বা আরহাম সেইভ না। বাড়িতে থাকলে ভালো হতো। তখন কি হয় বলা যায় না। আপনি চলুন আমার সাথে, আমিও তো তানিয়ার বাসায় যাচ্ছি। একসাথেই চলুন।

প্রিয়তার রাগ হলো। দ্রুত পায়ে প্রহরের নিকট এলো সে। চোখ দিয়ে ভষ্ম করে দিতে চাইল প্রহরকে। ওষ্ঠদ্বয় কামড়ে ধরল দাঁত দিয়ে। জিভ দ্বারা ওষ্ঠদ্বয় ভিজিয়ে নিল। প্রহরের চোখে চোখ রেখে তেজী স্বরে বললো,

” আর কত করুণা করবেন আমাদের? এভাবে আর কতদিন নিরাপত্তা দেবেন? এইবার এই করুণা করা বন্ধ করুন।

” আমি আপনাকে করুণা করছি? প্রিয়তার এহেন আচরণ স্বাভাবিক ঠেকছে না প্রহরের। প্রিয়তাকে কেমন অচেনা লাগছে তার। প্রচণ্ড উন্মাদনা নিয়ে প্রহর জিজ্ঞেস করল,

” করছেন না বলছেন? দৃঢ় জবাব প্রিয়তার।

” আমি আপনাদের ভালোবাসি প্রিয়তা। এজন্যে এত বার সাবধান করছি। পুলিশ হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব। এখানে করুণা কোথা থেকে এলো?

” ভালোবাসেন? হাহ! আমরা আপনার জন্য দায়। শুধু আর শুধু মাত্র দায়। আর কিচ্ছু না। ঠিকই।

” এমন করছেন কেন প্রিয়তা? কি হয়েছে? আপনি ঠিক আছেন? হঠাৎ কি হলো আপনার?

প্রিয়তা ভড়কাল, থতমত খেল। দিক দিশা বুঝে উঠল। সত্যিই তো! সে এমন টিনেজারদের মতো আচরণ করছে কেন? কেন এভাবে অনর্থক যা তা বলে যাচ্ছে? কেন নিজের চাহিদা প্রকাশ করছে? এগুলো কতন ধরনের পাগলামী? কি ভাববে এই পুলিশ? আর প্রিয়তার কেন মানতে কষ্ট হচ্ছে প্রহর যা করছে সবটাই দায়ের কারণে? কেন এত যন্ত্রণা হচ্ছে? কেন শুনতে ইচ্ছে করছে প্রিয়তা করুণার পাত্রী নয়? তবে কি প্রহরের প্রতি অন্যরকম অনুভূতি সজাগ হচ্ছে প্রিয়তার? দুর্বল হচ্ছে এই সৎ পুলিশ অফিসারের ব্যক্তিত্বে? আটকে যাচ্ছে মোহতে?

প্রিয়তা দুরত্ব বাড়াল। নিজেকে স্বাভাবিক করলো ততক্ষণাৎ। বললো,

” সরি সরি, আমার মাথা আসলে ঠিক নেই। জানি না কি বলেছি। সরি!

প্রিয়তা দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে চাইল। এলোমেলো লাগছে নিজেকে। হারিয়ে যাচ্ছে অতল গভীরে। প্রহরকে খুব কাছের ভাবতে ইচ্ছে করছে। এটা তো সম্ভব নয়। সমাজ মেনে নিবে না। প্রহরের বাবা মানবে না। এটা তো হতে পারে না। তবুও কেন প্রহরের পাশাপাশি থাকতে ইচ্ছে করছে প্রিয়তার? মন অন্য কিছু ভাবতে চাইছে কেন? প্রিয়তা আড়াল করতে চাইল নিজেকে। পা চালাল হন্তদন্ত হয়ে। পেছন থেকে প্রহর বলে উঠল,

“তুমি কি চাও দায় এড়িয়ে তোমাকে নিজের কর্তব্য বলে মনে করি? প্রিয়তা, তুমি কি আমার থেকে কিছু চাও? কিছু লুকাচ্ছো?

প্রিয়তার এ মুহুর্তে জ্ঞান হারিয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়তে ইচ্ছে হলো। প্রহর কি সবটা আঁচ করতে পেরেছে? বুঝতে পেরেছে প্রিয়তার দ্বন্দ্ব? প্রিয়তা চোখ বুজল। লজ্জায় মরি মরি অবস্থা তার। নিজেকে খুব নির্লজ্জ মনে হলো এ মুহুর্তে। গতকাল নাবিলা আন্টির এত কথা শুনেও কেন যে প্রহরের সাথে কথা বলতে গেল সে? এ নিয়ে ভিষণ আফসোস হলো প্রিয়তার। দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। আরহাম পিট পিট করে চেয়ে রইল শুধু। অটোতে উঠে বোনের উদ্দেশ্যে বললো,

“প্রহর ভাইয়া তোমাকে তুমি করে ডাকল না?

____________

পুরো ঘর-বাড়ি গুছিয়েছে তানিয়া। একজন দায়িত্বশীল লেডি অফিসারের কাজ ব্যতিত বাড়ির কোনো কাজেই হাত লাগায় না তানিয়া। সব কাজ নিয়াজ একাই করেন। পুরো বাড়ির মেঝে চকচক করছে। বেলুন আর ফুল দিয়ে সাজিয়েছে ড্রইংরুম। ইহান কাজীকে কল করে ড্রইংরুমে এসেছে। নিয়াজ লজ্জায় ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। তার এহেন লজ্জাকে পাত্তা দিচ্ছে না তানিয়া। নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছে সকাল থেকে। বিকালে সম্মাননার জন্য থানায় যেতে হবে। তাই সকাল সকাল বাবার বিয়ে দিতে চাইছে তানিয়া। একটা কেক ও অর্ডার করেছে সে। আজকের দিনটা মনে রাখার এক জমজমাট আয়োজন করেছে মেয়েটা।

ইহান বেলুন ফুলাচ্ছে। অদ্ভুত একটা কাজ হলেও খুব মন দিয়ে কাজটা করছে ইহান। তানিয়া ইহানকে এই কাজের দায়িত্ব দিয়েছে। ইহানের কথা অনুযায়ী বেলুন দিয়ে বাড়ি সাজানো বাচ্চাদের কাজ, তাদের মাথায় এই আইডিয়া প্রথমে আসঃ। তাদের বয়সী ছেলেমেয়েদের ঘর সাজানো উচিত ইউনিক ফার্নিচার, ফ্লাওয়ার্স, লাইট দিয়ে।

প্রিয়তা সেসময় তানিয়ার বাড়িতে এলো। প্রহর একটু আগেই এসে সোফায় বসেছে। ক্লান্ত হয়ে বসেছে বোধহয়। তানিয়ার পরণে তখন সুতির ঢিলেঢালা কামিজ। গায়ে বড়সড় গামছা। চুল গুলো কাঠি দিয়ে বেঁধে রাখা। প্রিয়তার অসস্তি হলো। এত সেজেগুজে দাওয়াত খেতে এলো সে। অথচ বাড়ির মানুষ জনই সাজেনি। অবশ্য তানিয়া তা ভাবলো না মোটেও। প্রিয়তাকে এভাবে সুন্দর করে সেজে আসতে দেখে খুশিই হলো সে। কাছে এসে প্রিয়তার গাল ছুঁয়ে তানিয়া বললো,

” তোমাকে খুব মিষ্টি লাগছে প্রিয়তা। অপূর্ব লাগছে। চোখ ফেরাতেই পারছি না। তোমাকে দেখে কি যে খুশি হয়েছি। বলে বোঝাতে পারবো না।

প্রিয়তা বিনিময়ে হাসল। আরহাভের দিকে তাকিয়ে বললো,

” আপনার ভালোবাসার টানে আরহাম এসেছে। আর আরহামের বোন হিসেবে আমি এসেছি। এত ভালো একটা দিনে আমাদের কাছে টেনেছেন এর জন্য কৃতঞ্জতা।

তানিয়া হাসল। হাসল আরহাম ও। সবকিছু প্রায় প্রস্তুত। তাই তানিয়া ড্রেস চেঞ্জ করতে গেল। প্রিয়তা পুরো বাড়িটাতে নজর বুলাল। প্রিয়তাকে দেখে আরহাম হাসল। পাশে বসল প্রিয়তার। আরহামকে কোলে নিল। বললো,

” তুমি এলে তাহলে। তোমার উপর দিয়ে কি কি গেছে সবই বুঝি। ধৈর্য হারিও না। সব ঠিক হয়ে যাবে।

” আপনারা থাকতে আমাদের আর কি হবে? আপনাদের সবার নিজের দায়িত্বের প্রতি এতটা গুরত্ব দেখে অমি সত্যিই অবাক হয়েছি। বর্তমানের পুলিশরা তো এমন নয়।

” এই শহরটাকে আমরা একটা সুস্থ পরিবেশ দিতে চেয়েছি। অপরাধ করলে অপরাধীর যেন বুক কেঁপে উঠে সে ব্যবস্থা করতে চেয়েছি। জানি না কতটুকু সফল হয়েছি। তবে চেষ্টা করে যাচ্ছি।

” পুলিশম্যানের মুখে শুনলাম আপনি নাকি চলে যাচ্ছেন?

” ঠিক শুনেছো।

” কেন যাচ্ছেন?

তানিয়া বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। তানিয়ার পরণে আকাশি রঙের জর্জেটের শাড়ি। শরীরের ভাজ অস্পষ্ট। চুলগুলো এখন খোলা। হাতে মুখে প্রসাধনীর চিহ্ন নেই। অঙ্গসমূহ তার ভেজা। গোসল করে সবে বেরিয়েছে সে। তানিয়ার এমন বেশভূষায় হা করে তাকিয়ে রইল ইহান। তৃষ্ণা পেল খুব। গলা শুকিয়ে কাঠ হলো। অন্তরে খচখচানি শুরু হলো। অপর পাশে চেয়ে রইল মাথা নত করে। আরহাম বেলুন দিয়ে খেলতে শুরু করল। প্রিয়তা বসেই রইল সোফায়। তানিয়া এসে গল্প জুড়লে তখনই কথা বলে প্রিয়তা।

বেশ কিছু সময় পর তাসলিমা খাতুন এলেন। সাথে উনার মা-বাবা। শাড়ি পরিহিত তাসলিমাকে দেখে যুবতি লাগল।নিয়াজ ও বেরিয়ে এলেন লজ্জা ভেঙে। সকলের সাথে কুশল বিনিময় হবার পর কাজী আসলেন ঘরে। বিনা দ্বিধায় বিয়ে পড়ালেন। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে বাড়িতে আরো হৈ হুল্লোর শুরু হলো। পুলিশ ফোর্সের আরো কয়েকজন এসেছে। বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই নাচ, গান আরম্ভ করলো তারা। প্রিয়তা ছিল সেখানকার নিরব দর্শন। নিয়াজ আঙ্কেলের বিয়ে হওয়ায় প্রিয়তা খুশি হয়েছে। তানিয়ার মনোভাব ও পছন্দ হয়েছে। এত এত নোংরা মানুষের মাঝে কয়েকজন ভালো মানুষটাকে দেখে প্রিয়তার ভালো লাগল। আবার ঘাবড়েও গেল অনেকটা। এত ভালো তার সহ্য হবে তো? এত সুখ সইবে?

___________

চলবে?

প্রিয়তার প্রহর পর্ব-১৭

0

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা (১৭)
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

রাতের আঁধারে নিস্তব্ধ শনশন বাতাস। মৃদ্যু কেঁপে উঠছে প্রিয়তার কায়া। দুলছে গলায় পেঁচিয়ে রাখা কালো ওড়না। ছোট ছোট চুলগুলো কপালে লেপ্টে আছে অযত্নে। এই সমাজের অযাচিত কিছু ঘটনার রোষানলে পিষে গিয়েছে প্রিয়তা। কোনোভাবেই বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। আর না সম্ভব একেবারে এসবে ঢুকে পরা। প্রিয়তা একটা সাদামাটা, সহজসরল জীবন চেয়েছিল। যেজন্য পরিবার ছেড়ে চলে এসেছিল এই অনিশ্চয়তার জীবনে। কিন্তু এই জীবনটা এখন অত সহজ নয়। ক্ষণে ক্ষণে মৃত্যুর ভয় তাড়া করছে প্রিয়তাকে। ভাইকে নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে। ঘর থেকে বের হবার আগে বারবার ভাবতে হচ্ছে। ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কিছ নোংরা মুখ সামনে চলে আসায় অপরাধীরা হিংস্র হয়ে উঠেছে। মৃত্যুর তাণ্ডব করতে চাইছে। আর এই অপরাধীরা কোনো সাধারণ ছোটখাটো ব্যক্তিবর্গ নয়। এদেরকে দেশের মানুষ সম্মান করে, বিশ্বাস করে। এদের কথায় চলে এলাকা। শত শত চ্যালা এদের হাতের নাগালে চলে। জনগন কি করবে? পুলিশের এত দায় কিসের? প্রাণ হারানোর ভয় তো সবার আছে।

খলিল নামের লোকটি একজন ডাক্তার। শহরে তার একটা মাঝারি আকারের ফার্মেসি আছে। সকলে লোকটাকে খুব ভালো বলেই জানে। বিশ্বস্ত ডাক্তার হিসেবে মানে। কিন্তু এই খলিল তার ডাক্তারি পেশার অগোচরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের তুলে এনে ভিক্ষে করিয়ে টাকা ইনকাম করে। যেসকল বাচ্চাদের খুঁত নেই, সেসব বাচ্চাদের বিভিন্ন ঔষধ দিয়ে অসুস্থ বানিয়ে রিপোর্ট ধরিয়ে দেয়। ভিক্ষা করার কৌশল বের করে দেয়, হাত-পা কেটে প্রতিবন্ধী বানিয়ে দেয়। খলিলের কথামতো সবাইকে রোজ নির্দিষ্ট একটা টাকা এনে ধরিয়ে দিতে হয় খলিলকে। নইলে পেতে হয় শাস্তি।

প্রিয়তা ছুটে চলেছে নিস্তব্ধ, কোলাহলমুক্ত পাকা রাস্তায়। বাতাসে গা কাঁপছে। ভয়ঙ্কর লাগছে সবকিছু। আরহামের ঘুম ছাড়ছে না। বোনের ঘাড়ে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে আছে ছেলেটা। প্রিয়তা প্রহরের কল পাওয়ার সাথে সাথে ঘুম থেকে উঠে আরহামকে টেনে তুলেছে। আরহামের গায়ে কোনোরকমে জ্যাকেট পরিয়ে বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়। জ্যাকেটের চেইন লাগানোর মতো সময় নেয়নি প্রিয়তা। নিজেও শাল কিংবা জ্যাকেট পরে আসেনি। নিজের কথা ভাবে না প্রিয়তা। ভাইক নিয়েই সকল ভয় তার। আরহামের কিছু হলে প্রিয়তা নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। সবচেয়ে বড় কথা আরহামকে প্রিয়তা ভালোবাসে। ওকে ছাড়া এক মুহুর্ত ও থাকতে পারবে না সে। নিষ্পাপ এই ছেলেটার তো কোনো দোষই নেই। তবে কেন আরহামকে ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে? আঘাত পাওয়ার আশঙ্কায় থাকতে হবে? প্রিয়তার ভয় বাড়ছে। মনে হচ্ছে এক্ষুণি কেউ একজন পিছন থেকে আক্রমণ করে বসবে। রাস্তায় একটা অটো ও নেই। রাত একটা বাজে কেই বা যানবাহন নিয়ে বসে থাকবে? এতটা পথ কি করে যাবে প্রিয়তা? আরহামকে নিয়ে যেতে পারবে তো? নাকি তার আগেই মৃত্যুর মুখে ঢলে পরতে হবে।

_______

গোলাগুলির এক মুহূর্তে থেমে গেল শত্রুপক্ষ। শান্ত হলো পরিবেশ। আরো এক জিপ ভরে পুলিশ এসেছে। খলিলের লোকজনের চেয়ে এখন পুলিশের লোক সংখ্যা বেশি। শুধু গুলিতেই নয় একের পর এক থাপ্পড়,ঘুষি দিয়ে যাচ্ছে প্রহর আর ইহান। একটা লোককেউ ছাছে না। রক্তাক্ত হচ্ছে স্থানটা। শব্দে ভরে উঠেছে আবার। দুই পক্ষই আক্রমণের শিকার।

প্রহর চোখের ইশারায় ইহানকে ডাকল। দুজন মিলে সাবধানতার সাথে বন্দুক নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকল। বাড়িতে আগে থেকেই কিছু পুলিশ অফিসার রয়েছে। অতর্কিত হামলায় অপ্রস্তুত হয়েছে খলিলের লোকজন। অস্ত্র হাতে নেওয়ার সময় পায়নি। যারা বুঝে গিয়ে অস্ত্র উঠিয়েছিল তাদের কৌশলে ধরা হয়েছে। গুলি ছুঁড়েছে পুলিশরাও। বাড়িতে ঢুকে কোথাও কাউকে পেল না প্রহর বা ইহান। খুঁজল আরেকটু। ছাদে এসে রেলিংয়ের কাছে এসে একজনকে দেখল তারা। খলিল পালানোর চেষ্টা করছে। পেছনের গেট পেরিয়ে বাইরে এসেছে মাত্র মাত্র। প্রহর উচ্চ স্বরে নিচের সবাইকে ডাকল। বললো,

” খলিল পালাচ্ছে। ওকে ধরো। পালাতে যেন না পারে।

তানিয়া বাড়ির নিচের বারান্দার দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। বাড়ির সদর দরজা আটকানো। কেউ যেন পালাতে না পারে এজন্য আগেই এটায় লক করে রেখেছে প্রহর। খলিল লোকটা লাফিয়ে গেটের পাশের দেয়াল পার হতে চাইল। এক পা উঠিয়ে পার হতে গেলেই। তানিয়া দৌড়ে খলিলের কাছে গেল। ডান হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল খলিলের শার্টের কলারের অংশ। নামিয়ে নিল দেয়াল থেকে। কষে থাপ্পড় মারল খলিলের গালে। হাতাহাতি হলো খলিলের সাথে। তানিয়াকে সরাতে চাইল খলিল। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে তানিয়াকে ধাক্কা মারল খলিল। তানিয়া পরে গেল নিচে। অতঃপর উচ্চস্বরে ডাকলো সবাইকে। প্রহর তখন বাড়িটির ভিতরের এক ঘরে থাকা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বের করছে। ইহান ছাদ থেকে ছুটে এলো দ্রুত গতিতে। ততক্ষণে খলিল দেয়াল পেরিয়েছে। বাইরে থাকা কয়েকজন পুলিশকে ফোন দিল ইহান। কানে থাকা হেডফোনে চাপ লাগাল আঙ্গুল দ্বারা। অপর প্রান্তের পুলিশকে বললো,

” খলিল মাত্র বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। ওর পেছনে যাও। আজ ওকে ধরতেই হবে। প্ল্যান ডিশমিশ হতে দেওয়া যাবে না।

তানিয়ার হাতে কাঁচের টুকরো ঢুকে গেছে। বাড়িটির আশেপাশে অসংখ্য কাঁচের টুকরো। মদের বোতলের একটা ভোটকা গন্ধ ভেসে আছে। ব্র্যান্ডের বোতল গুলোকে ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে রেখেছে আশপাশে। বোঝা গেল এই খলিল নামক ডাক্তার মদ্যপান করে প্রচুর। চ্যালাদের নিয়ে বাইরে বসে আড্ডা দেয়। ইহান তানিয়ার পরিস্থিতি দেখে এগিয়ে গেল তানিয়ার কাছে। চিন্তিত হলো সে। হাত থেকে ধীরেসুস্থে কাচ বের করছে তানিয়া। মাঝে মাঝে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলছে। রক্ত গড়াচ্ছে হাতে। হাতের তালু মাখামাখি হয়েছে রক্তে। বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট না থাকলে অগণিত গুলি বিধতো বুকে। কাচ বিঁধে যাওয়ার উপর দিয়ে সবটা গিয়েছে ভেবে মনে মনে খুশিই হলো তানিয়া। উঠে দাঁড়াল কষ্ট করে। হাঁটু বোধহয় ছিলে গিয়েছে। একটু ব্যথা করছে সেখানে। জ্বলছে খানিক।

ইহান পর্যবেক্ষণ করলো। তানিয়াকে ধরে উঠাল। তানিয়ার হাত মুঠোয় ধরে দায়িত্ব নিয়ে কাচের টুকরো বের করল খুব যত্ন নিয়ে। চোখে পানি জমল তানিয়ার। মুখ দ্বারা শব্দ করলো না কোনো। তাকিয়ে রইল রক্তাক্ত হাতের দিকে। জ্বলে যাওয়া স্থানে ফু দিল। ইহান পকেটে থাকা নিজের রুমাল পেঁচিয়ে দিল তানিয়ার হাতে। বললো,

” মিশন তো কমপ্লিট। ফার্মেসিতে চলো। ব্যান্ডেজ করতে হবে। আল্লাহ্ জানে তুমি এত আহত হও কিভাবে।

” আমি নিজেও জানি না। সব হামলা আমার সাথেই হয়। আচ্ছা প্রহর স্যার কোথায়? ড. খলিল ধরা পরেছে?

” প্রহর ভিতরের ছেলেমেয়ে গুলোকে বের করছে। ধরা পরেছে খলিল। বেশিদূর যেতে পারেনি। জানতাম পালানোর চেষ্টা করবে। রাস্তার এদিক ওদিক, অলিতে গলিতে পুলিশ ফোর্স রাখা হয়েছে আগে থেকেই। চিন্তা নেই। এইবার জাফরকেউ ধরতে পারবো।

তানিয়া হাসল। মিষ্টি হাসি। জ্যাকেট টা খুলে ফেলল। এতক্ষণের হানাহানিতে ভিষণ গরম লাগছে। বন্দুক থেকে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। বন্দুকটা ইহানের হাতে দিয়ে সে বললো,

” আমাকে তো নিয়ে আসতে চাইলেন না। দেখেছেন এসে কত ভালো হলো? কতকিছু দেখতে পারলাম। গুলি করার সুযোগ পেলাম। এত রিস্কি একটা মিশন আমার সামনে হলো। ইটস ইন্টারেস্টিং।

” হাতটা তো কেটেছিঁড়ে ফেললে। ক্ষতি হয়নি কে বললো? এর থেকে বেশি কিছুও হতে পারতো।

হাসল তানিয়া। মনোমুগ্ধকর হাসি তার। গোল চশমার আড়ালে থাকা চোখগুলোও হাসল। ইহান সহ্য করতে পারল না তানিয়ার হাসি। দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিল সে। অপর পাশে ফিরে বড় বড় দম নিল। ওষ্ঠদ্বয় দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল। নিস্তব্ধ এই শহরে প্রিয় নারীর অমায়িক হাসি তোলপাড় শুরু করে দিল ইহানের হৃদয়ে। বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ইহান। বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভূত হলো। শ্বাস নিতেও কষ্ট হলো খানিক। এই হাসিটা আর কিছুদিনই দেখতে পাবে সে। এরপর সব সৌন্দর্য ফিকে পরে যাবে। দেখতে পাবে না শখের নারীকে। বিড়বিড় করে ইহান বলে উঠল,

” এ শহরের সকল সৌন্দর্য তোমাতে নিবদ্ধ তানু। তুমি আমার পছন্দের চাঁদ । তোমাকে দেখা যায়, অনুভব করা যায়। শুধু ছোয়া যায় না, একান্ত নিজের বলে দাবি করা যায় না।

_______

রাত দুটো বেজে আঠারো মিনিট। প্রায় শতাধিক ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে এ বাড়ি থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ টিম। প্রায় সব বাচ্চাদের হাত-পা অচল, কয়েকজন কথা বলতে পারে না। মাত্র কিছুজন সুস্থ সবল ছেলেমেয়ে পাওয়া গেল। প্রহরের নির্দেশ অনুযায়ী পুলিশের জিপ এলো চারটা। সেখানে গাদাগাদি করে রাখা হলো বাচ্চাদের। এতক্ষণে প্রিয়তার কথা মনে পড়ল প্রহরের। জিপে থাকা ল্যাপটপে প্রিয়তার লোকেশন ট্র্যাক করল। প্রিয়তার লোকেশন ভেসে উঠল ল্যাপটপের স্ক্রিনে। ম্যাপের মতো আঁকাবাঁকা দাগ ভেসে উঠল। প্রহর হাসল। প্রিয়তা মোটেও অত বোকা নয়। মনে করে ঘড়িটা হাতে পরে বেরিয়েছে মেয়েটা। বিপদ হলে প্রহর যেন প্রিয়তাকে খুঁজতে পারে সেজন্য ঘড়িটা সাথে সাথে রেখেছে প্রিয়তা। প্রহর জায়গাটা চিনে নিল। অতঃপর কল করল প্রিয়তাকে। রিং হবার সাথে সাথেই ফোন তুলল প্রিয়তা। কণ্ঠে মেয়েটার ভয়, উৎকণ্ঠা। যন্ত্রণার পাহাড়। প্রহর কিছু বলার আগেই প্রিয়তা বলে উঠল,

” আপনি কোথায়? আমি থানায় পৌঁছাতে পারিনি। রাস্তায় একটা গাড়িও নেই। আরো আধঘন্টার পথ বাকি। আমার ভয় করছে। আরহামের কিছু হবে না তো? হঠাৎ আমাদের বের হতে বলেছেন কেন? কোনো বিপদ হবে না তো?

প্রহর বললো,

‘ রিল্যাক্স প্রিয়তা। আমরা খলিলকে অ্যাটাক করছি। সব বাচ্চাদের উদ্ধার করেছি। এট্যাকের সময় খলিল জাফরকে ফোন করতে পারে, এই ভয়টা ছিল আমার। জাফর আপনাদের ক্ষতি করে আমাদের মিশন ক্যানসেল করে দিতে পারে বলে মনে হয়েছে। ইনফ্যাক্ট এখনো আমি ডাউট করছি আপনাদের ক্ষতি করতে পারে। বাকিটা আমি পরে বলবো। আপনার লোকেশন দেখতে পাচ্ছি। আমরা আসছি। আপনি ততক্ষণ নিজেদের সেইভ রাখুন।

আরহামের ঘুমন্ত শরীরের ভর এলিয়ে দিয়েছে প্রিয়তার শরীরে। এতক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে প্রিয়তার পা ব্যথা হয়ে গিয়েছে। ঠান্ডায় রীতিমতো কাঁপছে প্রিয়তা। শ্বাস আটকে আসছে। প্রিয়তা জানে আরহাম কোনোমতেই এখন হাঁটতে পারবে না। এতক্ষণ ছেলেটাকে কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দুর্বল লাগছে প্রিয়তার। পানি পিপাসা পেয়েছে। হুট করে ঘুম ভাঙায় মাথা ব্যথাও করছে। ঘুম পাচ্ছে প্রচুর। এই প্রথম এত রাতে বাড়ি থেকে বের হয়েছে প্রিয়তা। আশেপাশে কেউ নেই তার। মনে হচ্ছে এই বুঝি সাদা পোশাকে বেরিয়ে এলো কোনো আত্মা। আঁকড়ে ধরল প্রিয়তার কাঁধ। কিংবা চতুষ্পদ জন্তু আক্রমন করে বসল। ভয়ে গা গুলিয়ে আসছে প্রিয়তার। আঁধারে ভয়ঙ্কর লাগছে পুরো শহর। এক হাতে ফোনের আলো জ্বেলে আরেক হাতে আরহামকে জড়িয়ে রেখেছে সে। হাতেও ব্যথা হচ্ছে ভালো মতো। প্রিয়তা হুট করে কেঁদে দিল যন্ত্রণায়। আর সইতে পারছে না সে। মস্তিষ্ক কাজ করছে না। নিদারুণ ব্যথায় কুকিয়ে উঠছে বারবার। নিজেকে নিজেই আঘাত করে মেরে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। বসে পরতে ইচ্ছে করছে মাঝরাস্তায়। এই ব্যথা কে বুঝবে? কে জানতে চাইবে? তাদের বিপদ হবে না তো?

খলিলকে একটা জিপে উঠানো হলো ফোর্স সহ। জিপের ড্রাইভিং সিটে বসল প্রহর। প্রিয়তার জন্য পাশে জায়গা রাখল। মাঝরাস্তায় মেয়েটাকে তুলে নিবে জিপে। ইহান আর তানিয়া যখন জিপে উঠতে গেল তখন জিপে কোনো জায়গা নেই। এত রাতে অন্য গাড়ি পাওয়া সম্ভব না। ইহান একজন পুলিশকে ফোন দিয়ে তার বাইক আনতে বললো। আধঘন্টার মাঝেই বাইক আসল। প্রহর জিপ স্টার্ট দিল। ইহান আর তানিয়া বসল বাইকে। ছুটে চলল নিজের মতো। জিপ শীঘ্রই পৌছাল প্রিয়তার লোকেশনে। জিপের আলো ঘুটঘুটে অন্ধকারে চোখে পরল প্রিয়তার। হাত দিয়ে চোখ মুছে নিল সন্তর্পণে। জিপের কাছে এসে দাঁড়াল। প্রহর উঠতে বললো গাড়িতে। বসতে দিল তার পাশে। প্রিয়তা সাবধানে আরহামকে নিয়ে উঠে বসল। সিটে গা এলিয়ে দিল সে। মনে জমা এত এত প্রশ্ন আর করা হলো না প্রিয়তার। সমস্ত দুঃখ-কষ্ট ভর করল। ঘুমে চোখ বুজে আসল। ঘুমু ঘুমু চোখে এক পলক প্লহরের দিকে তাকিয়ে ঘুমিয়ে গেল প্রিয়তা। মেয়েটার ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শোনো গেল শুধু। প্রহর প্রশান্তিতে শ্বাস ফেলল। এতক্ষণ প্রিয়তাকে নিয়ে ভয়ে ছিল সে। কোনোভাবে জলিল যদি প্রহরের এই অ্যাটাকের কথা জাফরকে জানাতো, তাহলে প্রিয়তা বা আরহামের ক্ষতি করার ভয় দেখিয়ে সবটা ডিশমিশ করে দিত জাফর। এতকিছু হয়নি ভেবে চিন্তা কমল প্রহরের। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল সে। আরহামের গাল টেনে দিয়ে পাতলা চুলে হাত বুলিয়ে দিল। প্রিয়তার এলোমেলো চুল গুছিয়ে দিল।

___________

প্রিয়তার যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘড়ির কাটায় নয়টা বেজে ঊনত্রিশ মিনিট। চারদিকে আলো ছড়িয়ে পড়েছে। গরম গরম ভাব আসছে। নিজের অবস্থান দেখে নিল প্রিয়তা। প্রহরের ডেস্কের চেয়ারে ঘুমিয়ে আছে সে। গায়ে একটা মোটাসোটা শাল। আরহাম কোলে নেই। চারপাশে শোরগোলের আওয়াজ। প্রিয়তার ঘুম ঘুম ভাব কাটল। একটু এপাশ ওপাশ করে উঠে পরল নিঃশব্দে। চারপাশে ভালোমত চোখ বুলাল। সেসময় ঘরটায় প্রবেশ করল প্রহর। গায়ে সাদা রঙের শার্ট। চুল গুলো ভেজা। ফর্মাল ড্রেসআপে আকর্ষণীয় লাগছে ছেলেটাকে। প্রিয়তাকে উঠতে দেখে মুচকি হাসল প্রহর। ডেস্ক থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে বললো,

“গুড মর্নিং প্রিয়তা। ঘুম ভালো হয়নি তাইনা?এখানে তো বিছানা নেই।

প্রিয়তা হাই তুলল। হাত দিয়ে চুলগুলোকে আঁচড়ে নিল। অলস ভঙ্গিতে বললো,

” গুড বলে আমার জীবনে কিছু নেই। আজকের সকালটা কোনোভাবেই গুড নয়। এতটা রাস্তা হাঁটতে হাঁটতে আমার শরীর ব্যথা হয়ে গিয়েছে।

” এটুকু না করলে আরহাম বা আপনার ক্ষতি হতে পারতো। এত বড় রিস্ক নিতে আমি পারতাম না।

” আপনি শুধু আমায় নিয়ে ভাবছেন কেন? আপনার মা আর বোনকেও তো জাফর এট্যাক করতে পারে।

” মা ফুপির বাসায় গিয়েছে গতকাল মাঝরাতে। নিধি এখন হোস্টেলে। ওদের আমি আগেই সরিয়ে ফেলেছি। হঠাৎ আক্রমণ করেছি বলে সবাইকে সরিয়ে নেওয়াটা নজরে রাখেনি জাফর। ওর তো অন্য প্ল্যান ছিল। আপনাকে তো কোথাও পাঠাতে পারি না। পাঠালেও আপনি যাবেন না। তাই আমার কাছেই রাখছি।

” কতদিন রাখবেন এভাবে? আমাকে নিয়ে আমি ভয় পাই না। আরহামকে নিয়েই সব চিন্তা আমার। আচ্ছা আরহাম কোথায়?

” তানিয়ার ডেস্কে। খেলছে বোধহয়। আমি বাড়ি থেকে গোসল করে খেয়ে এলাম। আপনার আর আরহামের খাবারটা তানিয়ার ডেস্কে রেখে এসেছি। আরহাম আর আপনি খেয়ে নিবেন এখন। আর ব্যথার ট্যাবলেট ও রেখেছি।

” আপনি কি আমাকে সারাজীবন আপনিই বলবেন?

” কেন? আপনি সারাজীবন থাকবেন নাকি?

” না মানে আপনি আমাকে আপনি সম্বোধন করলে আমার নিজেকে আপনার চেয়ে বড় বলে মনে হয়। তাই আর কি।

” আচ্ছা এটা পরে ভেবে দেখবো। আপনি এখন খেয়ে নিন। আজকে আপনাকে থানায় থাকতে হবে। জাফরকে ধরতে পারলেই মা আর নিধি ফিরবে। আপনিও বাড়ি যাবেন।

” আচ্ছা।

______________

থানায় আটকে রাখা হয়েছে খলিলকে। সব বাচ্চাদের বয়ান নেয়া হয়েছে। কিছু বাচ্চার বাবা-মায়ের সাক্ষী নেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে থানার সামনে প্রেসের লোক জড়ো হয়েছে। সকলের মনে অনেক প্রশ্ন। সবকিছুর উত্তর দিচ্ছে ইহান। তথ্যসমূহ তুলে ধরছে মিডিয়ার কাছে। প্রহর জেলের ভিতরে ঢুকল শান্ত ভঙ্গিতে। প্রহরের মুখে হাসি। জেলে থাকা চেয়ারটা টেনে বসল সে। লাঠি দিয়ে আঘাত করলো মেঝেতে। ভয়ে কেঁপে উঠল খলিল। ধরে আনার পর ইহান নামক পুলিশ কয়েক ঘা দিয়েছে তাকে। হাতে পায়ে দাগ পরে গিয়েছে। ব্যথা হচ্ছে অনেক। প্রহর শান্ত ভঙ্গিতে বললো,

” জাফর তো আপনার বন্ধু? শুনেছি খারাপ মানুষরা নাকি ভালো বন্ধু হতে পারে না। জাফরের অনেক তথ্য আপনার কাছে আছে। আবার জাফরের কাছে আপনার সব তথ্য আছে। সব তথ্য আমাকে দিবেন নাকি আরো কয়েক ঘা খাবেন?

” আমি কিছু বলবো না। একটু পরেই ছেড়ে দিবি আমাকে।

“আমি ছারলেও মিডিয়া ছাড়বে না। সব ছেলেমেয়েদের বয়ান মিডিয়ায় দেওয়া হয়েছে। টেলিভিশন, রেডিও, ইন্টারনেটের সর্বত্র স্থানে আপনার কুকর্ম ফাঁস হয়ে গিয়েছে। এখান থেকে বের হলেই জনগন আপনাকে ইট ছুড়ে মারবে। আর বাকি রইল ক্ষমতার কথা? এইবার সব গুছিয়ে রেখেছি আমি। উপরমহলে আপনাদের বিরুদ্ধে ফাইট করেছি। দাবি জানিয়েছি নিজের।এইবার আপনি যদি জাফরের তথ্য আমাদের দেন তো আপনার শাস্তি কম হবে। তবুও যদি না বলেন আপনার মেয়ের হাত-পা কেটে ভিক্ষে করাবো। যেমনটা আপনি অন্যের সন্তানদের দিয়ে করাতেন। কি ভালো লাগবে?

রেগে গেল ডক্টর খলিল। ক্ষেপে উঠল। বললো,

” আমার মেয়ের ক্ষতি করলে তোকে মেরে পুঁতে রাখবো।

” অন্যের ছেলেমেয়েকে দিয়ে যখন ভিক্ষে করাতেন তখন তাদের বাবা-মায়ের ও এমন রাগ হতো। নিজের মেয়ে বলে খুব মায়া তাইনা? আপনি একটা নোংরা মানুষ। রেগে বললো প্রহর নিজেও।

দমে গেল খলিল। “নিজে বাঁচলে বাপের নাম” কথাটি উচ্চারণ করল। সময় নিয়ে সব তথ্য তুলে ধরল মিডিয়ার সামনে। বেরিয়ে এলো জাফরের কুকর্ম। মিডিয়ায় ছড়িয়ে গেল মুহুর্তেই। ভাইরাল হলো কথাগুলো। জনগন থানায় এসে হামলা চালাল। প্রেসের লোক জনগনের সামনে মাইক্রোফন রাখলেই সকলে তাদের মনের ক্ষোভ ঝেরে প্রকাশ করল মিডিয়ায়। পুলিশকে আদেশ করা হলো জাফরকে ধরে আনার জন্য। প্রহর, ইহান আর তানিয়া হাসল। আনন্দে আত্মহারা হলো সকলে। প্রিয়তাও খুশি হলো। বেরিয়ে এলো থানা থেকে। এবার বাড়ি ফেরা দরকার।

_________

ছাদের কার্ণিশে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা। রাতের আবহাওয়া ভালো লাগছে তার। হাতে প্রিয়তার দুধ চা। এই ঠান্ডায় চা খেতে ভিষণ ভালো লাগছে প্রিয়তার। চুমুকে চুমুকে বিষাদ কেটে যাচ্ছে। প্রকৃতিকে আজ খুব সুন্দর লাগছে প্রিয়তার। চাঁদ টাকে আকর্ষণীয় লাগছে। নিজেকে কেমন স্বাধীন মনে হচ্ছে আজ। আগামীকাল নিজের বাড়িতে যাবে প্রিয়তা। তার জীবন যেমনই কাটুক না কেন, আরহামের জীবনটা সুন্দর, উৎফুল্ল করে তোলা প্রয়োজন। বাবার সম্পত্তির অংশ পাওয়া আরহামের অধিকার। সেই অধিকার থেকে ছেলেটা বঞ্চিত হবে কেন? সামনে আরহামের অনিশ্চিত ভবিষ্যত। টাকা-পয়সা, সম্পত্তি না থাকলে এ দুনিয়ায় কারো দাম নেই। আরহাম বেরঙের জীবন যাপন করুক তা প্রিয়তা চায় না। দমে গেলে তো তার চলবে না। লড়তে হবে আরহামের জন্য।

প্রিয়তা চায়ে চুমুক দিল। ছাদে প্রবেশ করলেন মিসেস নাবিলা। একটু আগেই ফিরেছেন তিনি। একদিনের অভিযানে তেমন মন ভরেনি উনার। ছেলের এমন সুন্দর মুহুর্তে মা না থাকলে কি চলে? তাইতো চলে এসেছেন। প্রিয়তাকে এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলেন তিনি। প্রিয়তা নাবিলার উপস্থিতি বুঝল। একটু হাসল সে। মিসেস নাবিলা জিজ্ঞেস করলেন,

” কেমন আছো প্রিয়তা? আরহাম কেমন আছে?

” আলহামদুলিল্লাহ্ আন্টি। আমরা ভালো আছি। আপনি ফিরলেন কখন?

” এইতো একটু আগেই। জানো কাল প্রহরের বাবা আসবে ইনল্যান্ড থেকে। প্রহর খুব খুশি।

” ও আচ্ছা।

” তোমাকে একটা কথা বলতে চাই প্রিয়তা। খুব জরুরী কথা। এখন এই কথাটা না বললেই নয়।

প্রিয়তা শুনতে মনোযোগী হলো। আগ্রহ প্রকাশ করলো। মিসেস নাবিলা দমে গেলেন। মুখ মলিন হলো উনার। চুপ করে গেলেন। প্রিয়তা স্থির হয়ে রইল। কি এমন বলতে চায় উনি? এমন মলিন কেন কেন আন্টির মুখ? কথাটা শুনে প্রিয়তা কষ্ট পাবে না তো? ভয় হলো প্রিয়তার।

চলবে?

প্রিয়তার প্রহর পর্ব-১৬

0

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা (১৬)
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

প্রিয়তা,

তোমার নামের মতোই তুমি মিষ্টি। তোমায় তাই তো খুব প্রিয় প্রিয় লাগে। হুট করেই প্রেমে পড়েছি তোমার। মারাত্মক ভাবে আটকে গিয়েছি। ছোটাছুটি করেও লাভ হচ্ছে না, বরং ফেসে যাচ্ছি তোমার মায়ায়। তুমি আমায় চিনবে না। আমি তোমার নাড়ি-নক্ষত্র বলে দিতে পারবো। লেখা গুলো হয়তো অগোছালো। কিন্তু আমি এই লেখাটায় নিজের সমস্ত ভালোবাসা উজার করে দিয়েছি। উইল বি ইউ আর মাইন প্রিয়তা?

সকালে ঝড় ঝাড়ু দিয়ে কিছু চিপসের প্যাকেট ফেলতে গিয়ে দরজার বাইরের ফ্লোরে একটি কাগজ দেখতে পেল প্রিয়তা। আশপাশে চোখ বুলিয়ে কাগজটির মালিককে খুঁজতে চেষ্টা করলো সে। কাউকে না দেখে কাগজটা হাতে তুলে নিল প্রিয়তা। আজকাল সব কিছুতেই সন্দেহ আর ভয় হয় প্রিয়তার। এই কাগজটা খুলতেও ভয় হচ্ছিল খুব। তবে কাগজের কোণায় “প্রিয়তা” অর্থাৎ নিজের নাম দেখে অবাক হলো প্রিয়তা। কাগজে লেখা বাক্য গুলো আওড়াল। চট করে হাসি পেল প্রিয়তার। ঘটনাটাকে প্র্যাঙ্ক বলে মনে হলো। কাগজের মালিককে খোঁজার চেষ্টা অবধি করলো না। যে ভালোবাসে সে সামনাসামনি বললো না কেন? প্রিয়তাকে অবাক করতে চাইছে লোকটা? প্রিয়তা যেন লোকটার জন্য চিন্তা করে এটাই চাইছে? প্রিয়তা ভাবল কিছুক্ষণ। যার প্রিয়তাকে দরকার সে প্রিয়তার এমন গা ছাড়া স্বভাবে ব্যথিত হবে। লোকটা আবার ও চিঠি লিখবে হয়তো। একসময় নিজেই এসে ধরা দেবে। প্রিয়তা খুঁজবে না তাকে।

গতকাল রাতেই ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়েছে প্রিয়তা। বাজার সদাই ও করেছে কিছু কিছু। পরিক্ষার ফি দিতে গিয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছে প্রিয়তার। সে খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছে পরিশ্রমী ব্যক্তিরা কেন এত সহজে টাকা ভাঙতে চায় না। প্রিয়তার পুরো এক মাসের পরিশ্রমের টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। অল্প কয়েক টাকাই অবশিষ্ট আছে তার কাছে।

আরহামকে সব বুঝিয়ে সুঝিয়ে ভার্সিটির জন্য বের হলো প্রিয়তা। শীতের কারণে শাল জড়িয়েছে গায়ে। সকাল আটটা বেজে এখন বারো মিনিট। কুয়াশা দেখা যাচ্ছে অদূরে। কাছে গেলেই হারিয়ে যায় সেই কুয়াশা। শিশির ভেজা গাছগুলোতে জীবন্ত লাগে।

প্রিয়তা অটো স্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়াল। বার্ষিক পরিক্ষা অতি নিকটে। গোটা এক মাসে পড়াশোনাতে তেমন মন দেয়নি প্রিয়তা। কুসুমের পেছনে আর কোচিংয়ে থাকা স্টুডেন্টদের পিছনে অনেক সময় দিয়েছে সে। এখনের সব ক্লাসগুলোতে মনোযোগী হতে হবে। প্রিয়তা ঘড়ি দেখে নিল আবার ও। মনে পরল ট্র্যাকিং ডিভাইসের কথা। রিকশা নেই বাইরে। ঠান্ডায় কারোই বোধহয় বের হতে ইচ্ছে করবে না এখন। আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে প্রিয়তার সর্দি লেগেছে। ব্যাগে টিস্যূ রাখতে হচ্ছে সর্বক্ষণ।

আশপাশে তাকিয়ে প্রিয়তা অটো খুঁজল। রিকশায় গেলে ভাড়া বেশি নেয়। এখানে অটো নেই। প্রিয়তা ভাবল সামনেরটুকু হেঁটে যাবে। কিন্তু তাতে বিঘ্ন ঘটল প্রহরের আগমনে। প্রহরের পরণে আয়রণ করা পুলিশের পরিচ্ছন্ন পোশাক। মাথায় বাইকের হেলমেট। হাতে চকচকে কালো ঘড়ি। কোমড়ে ছোটখাটো বন্দুক গুঁজে রাখা। মুখে অমায়িক হাসি। প্রিয়তা থমকাল। প্রহর বাইক থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘ কোথায় যাচ্ছেন প্রিয়তা।

প্রিয়তা হাসল। পুলিশম্যানকে দেখলেই মনটা ভালো হয়ে যায় তার। লোকটার মাঝে হয়তো জাদু আছে। লোকটার নজরকাড়া হাসিতে প্রিয়তা সবসময় বেকায়দায় পরে। নজর বুলিয়ে প্রিয়তা বললো,

” ভার্সিটিতে যাচ্ছি। ইমপরট্যান্ট ক্লাস আছে। অটোই খুঁজে পাচ্ছি না। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

” এলাকা টহল দিতে।

” ও আচ্ছা।

প্রহর আশপাশে নজর বুলিয়ে বাইকের আয়নায় মুখ দেখল। চাপ দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললো,

” চলুন আপনাকে পৌঁছে দিই।

প্রিয়তা নিজেও আশপাশে তাকাল। জাফরের

লোকটাকে দেখে প্রিয়তা উঠে পড়ল বাইকে। দুরত্ব মেপে বসল। হেলমেট পরে নিল। আনইজি ফিল করলো প্রিয়তা। ব্যাগটা কোলে রাখল। বাইকর আয়নায় প্রিয়তার এমন দুরত্বে বসার বিষয়টা খেয়াল করলো প্রহর। হাসল একটু। বললো,

” আমার গায়ে তো গন্ধ না। দুরত্ব কমিয়ে বসুন। পরে যাবেন প্রিয়তা।

প্রিয়তা থতমত খেল। বললো,

” আমি ঠিক আছি চলুন।

” আমি কিন্তু দ্রুত গতিতে বাইক চালাই। পড়ে গেলে আমাকে দোষ দিবেন না

“আপনি না পুলিশ? পুলিশ হয়ে জোরে বাইক চালান?

” জনগন করলে দোষের। পুলিশদের দোষ নেই বুঝলেন। ধরে বসুন প্রিয়তা। ওয়ার্ন করছি।

প্রিয়তা দুরত্ব কমাল। হাত রাখল প্রহরের কাঁধে।প্রহর বাইক স্টার্ট দিল। জাফরের লোকটা পিছনে আসছে না। হয়তো প্রহরের চোখে ধরা পরার ভয়েই আসছে না। প্রিয়তা নেমে যেতে চাইল। কি মনে করে যেন থেকে গেল। পুরোটা পথ চুপ রইল দুজন।

______________

কিবোর্ডের খটখট টাইপিংয়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। দশ জন পুলিশ একত্রে সার্চ করছে জাফরের তথ্যগুলো। কোনোকিছুই সার্চ করে আয়ত্বে আনা যাচ্ছে না। গতকাল তানিয়া বা ইহান এমন কাউকে পায়নি যে খলিলের আসল মুখোশ সম্পর্কে জানে। শেষমেশ হতাশ হয়ে ফিরে এসেছে ইহান আর তানিয়া।

একটি কাগজে ইহান এঁকে চলেছে কিছু একটা। মাঝে মাঝে ভাবছে কিছু কথা। অনবরত ঠোঁট নারাচ্ছে সে। দাগ টানছে খাতার এপাশে ওপাশে। প্রহর স্যার নেই থানায়। ফিরতে উনার একটু লেট হবে। সব দায়িত্ব ইহানকে পালন করতে হচ্ছে। তানিয়াকে সর্বক্ষণ ল্যাপটপে নজর রাখতে হচ্ছে, সার্চ করতে হচ্ছে।

মেইন করিডোরে একজন অর্ধবয়স্ক কনস্টেবল এলো। সবাইকে একত্রে কাজ করতে দেখল লোকটা। তানিয়ার উদ্দেশে বললো,

” তানিয়া ম্যাম।

তানিয়া চোখ সরাল ল্যাপটপ থেকে। ইহান ও কাজে বিরতি নিলো। আড়চোখে তাকাল কনস্টেবলের দিকে। তানিয়াকে কি বলছে তা শুনতে চাইল বোধহয়। তানিয়া বললো,

” বলুন। কিছু হয়েছে?

” আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে। আমি বলেছি আপনি বিজি। কিন্তু উনার নাকি অনেক জরুরী কথা আছে আপনার সাথে। বললো উনি আপনার ফিয়ন্সি।

তানিয়া ভড়কাল। আবির কখনো এখানে আসে না। বলতে গেলে আবিরের থানায় আসা পছন্দ করে না তানিয়া। যেজন্য বিয়ে ঠিক হবার পর পরই তানিয়া এ ব্যাপারে আবিরকে সচেতন করেছে। হঠাৎ আবিরের এখানে আসার কারণ বুঝতে পারল না তানিয়া। ইহানের দিকে চাইল একটু। ইহান তানিয়ার ভাষা বুঝল। অনুমতি দিল যেতে। তানিয়া শার্টের কলার ঠিক করে দ্রুত পা চালাল।

আবির দাঁড়িয়ে আছে থানার বাইরে। আবিরের উচ্চতা তানিয়ার চেয়ে অধিক। ফর্সা গায়ের রং। গায়ে সাদা শার্ট। হাত ঘড়িতে সময় দেখছে ছেলেটা।

তানিয়া এগিয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলো,

“আপনি এখানে?

” তোমাকে কখন ডেকেছি? এতক্ষণ লাগে?

” আমি আপনাকে থানায় আসতে নিষেধ করেছিলাম আবির। কেন এসেছেন?

” আমার সাথে এখন যাবে তুমি। কথা আছে।

” গুরুত্বপূর্ণ একটা কেস হাতে পেয়েছি। আপনার কথায় এখান থেকে গেলে চাকরি থাকবে? প্রহর স্যারও আজ থানায় নেই।

“যাবে তুমি?

” না।

” সত্যিই আঙ্কেলের বিয়ে দিচ্ছো?

” হ্যাঁ দিচ্ছি।

” আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি তানিয়া। শ্বশুরের বিয়ে হবে ভাবতেই আমার লজ্জা লাগছে। তোমার এটা কি শুরু করেছো? আমার কলিগরা জানলে..

” আমার লজ্জা লাগছে না। বাবার ভালো চাইবো আমি।

” তুমি যদি এমন অবাধ্যই থাকো সরি টু সে আমি বিয়ে করবো না তোমায়।

” আপনাকে বিয়ে করার জন্য কি আমি লাফাচ্ছি? নাকি আপনি আমাকে বিয়ে না করলে আমি মরে যাবো? বাবার বিয়েটা ফাইনাল। পাত্র-পাত্রী দুজনেই রাজি। আপনি কেন এসবে এসে নিজেকে ছোট করছেন?

” ওউ, আচ্ছা। তাহলে আমাদের বিয়ে ক্যানসেল? শোনো তানিয়া একেঅপরের প্রতি সম্মান না থাকলে সম্পর্ক টিকে না। তুমি আমার মতামতে গুরুত্ব না দিয়ে আমাকে অসম্মান করছো। বিয়ে না হলে তোমারই ক্ষতি হবে। লোকে বলবে তোমার বিয়ে ভেঙেছে। তোমার বাবা তো সবাইকে জানিয়েছে আমার সাথে তোমার বিয়ের কথা।

তানিয়া রেগে গেল ভিষণ। দ্রুত থানায় ঢুকে পরল। কাজে মনোযোগ দিল আবার ও। আজকে রাতে খলিলের বাড়িতে আক্রমণ করবে পুলিশরা। সেই প্রস্তুতি চলছে থানায়। এই ঘটনায় কত জন আহত আর কতজন নিহত হবে কেউ জানে না? এদিকে আবিরের এমন কথা শুনে মেজাজ খারাপ হলো তানিয়ার। সবটায় কিভাবে নিজেকে সামলাবে বুঝতে পারছে না তানিয়া।

——

রাত বারোটা বেজে দশ মিনিট। চারদিকে কুয়াশা। গা শিরশির করছে তানিয়ার। খড়ি দিয়ে জ্বালিয়ে রাখা আগুনের মাধ্যমে হাতে তাপ দিচ্ছে তানিয়া। মৃদ্যু কেঁপে উঠছে তানিয়ার ঠোঁট। নাক লাল হয়ে আছে ঠান্ডায়। মাঝে মাঝে হাঁচি ও দিচ্ছে। আবহাওয়ার এইরুপ পরিবর্তনের কারণে অনেকের ঠান্ডা লেগেছে। তানিয়ার ঠান্ডার ধাঁচ নেই। এত রাতে বাইরে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকার কারণেই এমন হচ্ছে। তারা সবাই এখন আছে জঙ্গলে। চারপাশে কেবল গাছপালা। ত্রিশ জন পুলিশ একত্রে এসেছে এখানে। বাকিরা আসার সাহস করেনি। তানিয়ার গায়ে শাল বা জ্যাকেট নেই। যেই ব্যাগে শাল ছিল সেই ব্যাগ থানাতেই ভুলে রেখে এসেছে সে। যার ফল স্বরুপ ঠান্ডায় কাঁপতে হচ্ছে এখন। গা বরফের ন্যায় জমে যাচ্ছে।

প্রহর আর ইহানের গায়ে জ্যাকেট। সকলেই বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পড়েছে। জাফর আর খলিলের লোকজন খুব ধুর্ত আর ভয়ঙ্কর পুলিশের গায়ে গুলি ছুঁড়তে সময় নিবে না তারা। ইহান প্রহরের সাথে কথা বলতে বলতে তানিয়ার দিকে চাইল। চেয়েই রইল। প্রহর তা দেখে হাসল একটু। ইহানের কাঁধে হাত দিয়ে বললো,

” না গেলে হয় না ইহান? আমাদের রেখে অন্য এলাকায় যাবি? ভালো লাগবে তোর?

ইহান হাসল। মনোমুগ্ধকর হাসি ছেলেটার। ব্যথা সমূহ বুঝলো প্রহর। ঘাঁটিয়ে দেখল না শুধু। ইহান চুলে হাত বুলিয়ে বললো,

” দুরত্ব বেড়ে গেলে কি ভালোবাসা কমে? একই শহরে তো আছি নাকি? মাঝে মাঝে আসবো। দেখা হবে।

” তানিয়াকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হবে না তোর? কেন যাচ্ছিস তাহলে? ভালোবাসিস বলে দে।

ইহান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলো। বিস্ময়ে বিমূঢ় চোখে তাকিয়ে রইল। আশপাশে তাকিয়ে অন্যের উপস্থিতি আছে কিনা দেখল ইহান। প্রহরের কলার টেনে কাছে এনে বললো,

‘ তুই জানিস?

” জানবো না? হেসে বললো প্রহর।

” কিভাবে জানিস?

” সিক্সথ সেন্স।

ইহান আর প্রহর দুজনেই হাসল। ফোঁস করে শ্বাস টানল। কিছু বললো না। এগিয়ে এলো তানিয়ার সামনে। আগুনের পাশে বসে পড়ল। তানিয়ার দিকে তাকিয়ে রাগী কণ্ঠে বললো,

” জ্যাকেট কই তোমার? বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটে কি শীত মানবে? কোনো আক্কেলজ্ঞান নেই তোমার?

তানিয়ার মুখ নত হলো। নম্র কণ্ঠে বললো,

” থানায় জ্যাকেটটা ফেলে এসেছি স্যার। তখন তো বুঝিনি এত লেট হবে মিশনে যেতে।

” তুমি মিশনে যাবে না তানিয়া। বাড়ি যাও।

” মানে কি?

‘ মানে তুমি যাবে না।

” কিন্তু কেন? আমি কি করেছি?

” রিস্ক আছে তানিয়া। বুঝো একটু। বাড়ি যাও। যেও না যা আমাদের সাথে। বিপদ হলে?

” আপনি বন্ধু হিসেবে আমাকে ট্রিট করছেন স্যার। আপনাকে অনুরোধ করছি, আমাকে আপনার জুনিয়র কলিগ ভাবুন আর সঠিক শিক্ষাই দিন। ভয় পেয়ে দূরে সরতে চাই না আমি। আপনি তো কখনো কাউকে এমন বলেন না।

ইহান হার মানল। বললো,

” বেশ। আমার পেছন পেছন থাকবে সবসময়। বুঝলে?

মাথা নাড়ল তানিয়া। ইহান নিজের জ্যাকেট খুলে তানিয়ার হাতে দিল। বুঝে নিল তানিয়া।পড়ে নিল মস্ত বড় জ্যাকেটটা।

___________

বিরাট বড় বাড়ি। চারপাশে গাছপালাতে ঢেকে আছে যেন। মটমট করে গাছের পাতা ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে পায়ের চাপে। সবার মনোযোগ বাড়িটির দিকে। আক্রমন করলেই প্রতিপক্ষদের থেকেও আক্রমণের মুখোমুখি পরতে হবে। জায়গাটা খুবই নির্জন। পেঁচা ডাকছে বারবার। ঝিঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। নির্জনতায় ভয়ঙ্কর একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। রাত একটার সময় এমন আক্রমণ কোনো পুলিশ করে? দেশের শত্রুরাই এমন ভাবে আক্রমণ করে। তবে খলিল র জাফরের যে ক্ষমতা তার বিন্দুমাত্র ক্ষমতা পুলিশের নেই। তাই লুকিয়ে পেছন থেকে আক্রমণ করছে হচ্ছে।

প্রথমে প্রহর দাঁড়িয়ে আছে। এরপরেই ইহান আর ইহানের পেছনে বন্দুক দু হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে তানিয়া। বুক কাঁপছে তার। এই ঠান্ডায় রুহ্ কেঁপে উঠছে। পা ফেলতেও ভয় হচ্ছে খুব।ইহান পেছনে তাকিয়ে তানিয়াকে লক্ষ্য করলো। মেয়েটা ভয় পাচ্ছে বোধহয়। ভয় ইহান আর প্রহরের ত হচ্ছে। কিন্তু তারা ভয় বুঝতে গেলে বাকি সবাই পিছিয়ে পড়বে।

ইহান বাড়ির পেছনে গেল। প্রহর সামনে এসে দরজার সামনে কান পাতল। চারদিক দিয়ে বাড়িটি ঘিরে ফেলল পুলিশ টিম। কয়েকজন পাইপ বেয়ে ছাদে উঠল। ভেতরে ধীরে ধীরে প্রবেশ করে আক্রমণ করবে ভেবেছে প্রহর আর ইহান। পদক্ষেপ নিতে হবে কৌশল খাটিয়ে। একটা শব্দ হলো বাড়ির পাশে। তানিয়া ভয় পেল। পেছন থেকে ইহানের শার্ট খামচে ধরলো সে। ভয়ে থিতিয়ে গেল। এত বড় একটা মিশনে সে কখনো আসেনি। প্রথম বলে এত ভয় লাগছে তানিয়ার। ইহান চোখ দ্বারা আসস্ত করল তানিয়াকে। তানিয়া থামল। ভয় দূর করার চেষ্টা করলো। বাড়ির ভিতর থেকে গুলির বিকট শব্দ ভেসে উঠল। তানিয়া দ্রুত স্থান ত্যাগ করে দেয়ালের আড়ালে লুকাল। ইহান এগিয়ে গেল তানিয়াকে রেখে। একেক করে গুলি ছুড়ল দু পক্ষই। গাছগাছালি কেঁপে উঠল বোধহয়। বোমা ছুড়ল পুলিশের দিকে। সবাই নিজেদের জায়গা ঠিক করে নিল। দেয়ালের আড়ালে একজনকে দেখতে পেয়ি তানিয়া লোকটার পায়ে গুলি করলো। চেঁচিয়ে উঠল লোকটা। প্রহর একের পর এক গুলি ছুড়ল গাছের আড়াল থেকে। দুজন পুলিশ অফিসার আহত হলো। প্রহর হুট করে চেঁচিয়ে উঠল দ্রুত ফোন বের করলো পকেট থেকে। প্রিয়তাকে কল করলো। তিনবার রিংয়ের পর ঘুমুঘুমু কণ্ঠে প্রিয়তা কল ধরল। হ্যালো বলার সময়টুকু দিল না প্রহর। বললো,

” আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন থানায় আসুন। ও বাড়িতে বিপদ হতে পারে প্রিয়তা। আমি রিস্ক নিতে চাইছি না। আরহামকে নিয়ে সরে যান আল্লাহর দোহাই লাগে।

চলবে?

প্রিয়তার প্রহর পর্ব-১৫

0

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা (১৫)
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

দুপুরের আগেই পার্কে যেতে চেয়েছিল প্রিয়তা। কিন্তু আজ যেহেতু বেতন পাবে তাই বেতন নিয়ে তবেই ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যানিং করেছে সে। কুসুমের মা লাঞ্চে খেতে আসবেন বাসায়। প্রিয়তা ভেবেচিন্তে দুপুরে কুসুমের বাসায় এসেছে পড়াতে। প্রিয়তার পরণে কালো হিজাব আর কালো থ্রিপিস। কালো সালোয়ার দিয়ে পায়ের সর্বত্র ঢেকে নিয়েছে সে। কুসুমের পাশাপাশি কোয়েলকে পড়াতে গিয়ে বিরাট ঝামেলা লাগে প্রিয়তার। প্রায়সই নির্দিষ্ট সময়ের অধিক সময় পড়াতে হয়। কুসুম আর কোয়েল দুজনেই প্রিয়তার কাছে পড়তে ভালোবাসে। সামনে কোয়েলের পরিক্ষা বলে বিশেষভাবে নজর দিচ্ছে প্রিয়তা। এক একটি টপিক বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছে বিরক্তি ছাড়াই।

দুপুর একটা বাজে কুসুমের মা খেতে আসলেন। প্রিয়তাকে দেখে সালাম দিলেন তিনি। পাশের রুমে চলে গেলেন খাওয়ার জন্য। প্রিয়তা দুজনকে ভালো মতো পড়াতে লাগল। আসার সাথে সাথেই বেতনের কথা বলার মতো বোকা প্রিয়তা নয়। তাই কুসুমের মা পার্স নিয়ে ও ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তখন প্রিয়তা বেতনের কথা তুলল। বললো,

” আন্টি আজকে বেতন দেওয়ার কথা ছিল।

কুসুমের মা হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন। প্রিয়তার কথায় তার বেতনের কথা মনে পড়েছে এমন ভাব ধরলেন তিনি। বললেন,

“আর বইলা না গো বেতন পাইয়া ঘর ভাড়া, দোকানের বিল, কিস্তি দিয়া হাতে দুই হাজার টাকা হাতে। পুরা মাস চলতে হইবো বুঝোই তো। আমি তোমারে দুই মাসের বেতন এক সাথে দিয়া দিমুনি। চিন্তা কইরো না।

প্রিয়তা ভড়কাল। মাথা নত হলো। টাকাটা তার দরকার। মাস শেষ হয়েছে কয়েকদিন আগে। কুসুমের মা বেতন পেয়েছে এটাও জানে প্রিয়তা। তাই তো ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গল তার। খানিক দৃঢ় কণ্ঠে প্রিয়তা বললো,

” আমাকে শুধু কুসুমকে পড়ানোর কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পড়াতে এসে একই এমাউন্টে দুজনকে পড়ানোর দায়িত্ব দিয়েছেন। আমি মেনে নিয়েছি এটা। কিন্তু মাস শেষ হবার পর ও টিউটরের বেতন না দেওয়া কি ঠিক আন্টি? অনেক হয়েছে। আর পড়াতে আসবো না। আজ আমার বেতনটা দিলেই আমি চলে যাবো।

” সামনে মাইয়ার পরিক্ষা। এহন চইলা যাইতে চাইলে হইবো নাকি?

” আমি অনেক ধৈর্য ধরেছি আন্টি। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে বোধহয় দুজনকে এভাবে পড়াতে চাইতো না। আঙ্কেলকে আমি টাকা দেওয়ার কথা বলে দিবো। আজকে আমি আমার বিকাশে টাকা দেখতে চাই। আমি আর আসবো না

পুনরায় বললো,
– এমন ব্যবহারের জন্য দুঃখিত।

প্রিয়তা বেরিয়ে এলো। কিচ্ছু ভালো লাগছে না তার। কুসুমের মা ঘর ভাড়া, বিদ্যুত বিল, দোকান খরচ সবই দিতে পেরেছে। শুধু আটকে আছে প্রিয়তার বেতন। কোচিংয়ে গিয়ে প্রিয়তা ছয় হাজারের জায়গায় ছ হাজার আটশো টাকা পেল। প্রিয়তা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল কোচিংয়ের হেড স্যারেরদিকে। প্রিয়তার পড়ানোর ধরন, ব্যবহার, স্টুডেন্টদের নাকি ভালো লেগেছে। তাই বাকি আটশো টাকা প্রিয়তাকে বোনাস দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে আরো বাড়াতে পারেন তারা।

প্রিয়তা টাকা গুলো নিয়ে আপনমনে হাঁটতে লাগল। এই টাকাগুলো প্রিয়তার প্রথম উপার্জন। পরিশ্রম করে প্রিয়তা এই টাকাটা পেয়েছে। আনন্দে প্রিয়তা কেঁদে ফেলল রাস্তায়। খুশিতে মুচকি হেসে উঠল সে। হিসাব কষতে লাগল সবকিছুর। কিছুক্ষণ বাদেই বিকাশে টাকা পাওয়ার মেসেজ দেখতে পেল প্রিয়তা। আরো খুশি হলো প্রিয়তার হৃদয়। আরহামের জন্য রাস্তা থেকে একটা খেলনা গাড়ি কিনল। টাকাটা নিয়ে বাড়ি ফিরল সে। পরিশ্রম যেন আজ স্বার্থক হলো।

____________

বাড়িতে ফিরে খাবার গরম করে রেখে প্রিয়তা বেলকনিতে বসল। হিন্দি গান শুনতে শুনতে প্রিয়তা নিচে তাকাল। খানিকক্ষণ বাদে প্রিয়তার মনে হলো একজন লোক এ বাড়ির সদর দরজার আশপাশে ঘুরাঘুরি করছে। প্রিয়তা দৃষ্টি দৃঢ় করল। অনেকটা সময় নিয়ে লোকটাকে পর্যবেক্ষণ করল। অতঃপর বুঝতে অসুবিধে হলো না এই লোকটা জাফরের লোক। জাফরের লোক ছাড়া প্রিয়তাকে নছরে রাখার মানুষ এখন নেই।

বিরক্তিতে মুখ দিয়ে বিরক্তিসূচক শব্দ বের করল প্রিয়তা। সামনের ছোট চুল গুলো বিরক্তি সহকারে কানে গুঁজে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করল। প্রিয়তার মন খারাপ হলো আবার। কি করবে এই ভেবে চিন্তিত হলো সে। দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগে প্রিয়তা সিদ্ধান্ত নিল প্রহরকে সবটা জানাবে। এরপর যা হবে তা দেখে নিবে। এমন সৎ একজন পুলিশ অফিসারের অগোচরে তার জন্য ফাঁদ পাতবে প্রিয়তা? এটা তো অন্যায়। এর পরিণতি অবশ্যইভয়াবহ হবে। প্রহর যদি কোনোভাবে জানতে পারে? তাহলে তো প্রিয়তাকে ভুল বুঝবে। সমাজের চোখেও খারাপ হবে প্রিয়তা। জিতে যাবে দেশের শত্রুরা। অন্যায়ের সংখ্যা বাড়বে। একজন সৎ পুলিশ অফিসার হারিয়ে যাবে সিলেট থেকে। জাফরের ক্ষমতা জিতে যাবে।

প্রিয়তা কল লিস্টে প্রহরের নাম্বার খুঁজল। নির্দিষ্ট নম্বরটা পেয়ে ডায়াল করার আগ মুহুর্তে বুড়ো আঙ্গুল ফোন থেকে তুলে নিল প্রিয়তা। পুনরায় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দিকে তাকাল। বিড়বিড় করে আওড়াল,

” জাফর লোকটা খুব ধুরন্ধর প্রিয়তা। হি ক্যান ডু এনিথিং। হয়তো বা তোর ফোন-কল অ্যাপটাও নিয়ন্ত্রণ করে লোকটা। ধরা পড়তে পারিস তুই। ট্র্যাক জিনিসটাকে তুচ্ছ মনে করিস না।

প্রিয়তা উঠে দাঁড়াল। ঘরে এসে ওড়না ভালোমতো পেঁচিয়ে প্রহরের ফ্ল্যাটে যেতে চাইল। ততক্ষণাৎ মনে পড়ল ওদিনের অপমানের কথা। প্রিয়তা ও বাড়িতে ঢুকতে পারে না। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে ওই বাড়িতে আর কখনো পা রাখবে না। সেই প্রতিজ্ঞা কি করে ভাঙবে? আর না ভাঙলে প্রহরকে আলাদা ভাবে জানাবে কিভাবে? কল করলে জাফর জেনে যাবে। ছাদে কথা বললেও বুঝে যেতে পারে।

প্রিয়তা চিন্তায় পড়ল। পায়চারি করল গরে। দাঁত দ্বারা নখ কাটল। নজর বুলিয়ে পাশে আরহামের খাতা, কলম দেখে হাসল প্রিয়তা। বুদ্ধি বের হলো। দ্রুত নিজের ব্যাগ থেকে খাতা, কলম বের করে চিঠি লিখল। সেই চিঠিতে খোঁজ খবর নেওয়ার কোনো বাক্য ছিল না। চিঠির নিয়মকানুন ও ছিল না। এটাকে চিঠি হিসেবে ধরল না প্রিয়তা। জরুরী কথাগুলোই কেবল লিখে গেল।

পুলিশম্যান,

আপনাকে একটা বিষয় জানাতে চাইছি। আজ জাফর আলী এ বাড়িতে এসেছিলেন। আমার ঘরেও এসেছিলেন। আপনাকে ফাঁদে ফেলতে এখন আমাকে ব্যবহার করতে চান জাফর। আমাকে বড়সড় হুমকি দিয়েছেন উনি। আরহামকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়েছেন। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। আমি আপনার ক্ষতি চাই না, আর না ওই লোকটাকে সমর্থন করি। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। আমি ওদের নজরবন্দি। আপনাকে ফোন করে সবটা বলে দিলে ধরা পড়তে পারি বিধায় কাগজে লিখছি। আমার আপনার সাহায্যের প্রয়োজন। আপনাকে আমার দ্বারা শেষ করার পরিকল্পনা আমরা সফল হতে দিতে পারি না। কিছু একটা ভাবুন।

প্রিয়তা বলছি,

ঘর থেকে বেরিয়ে এলো প্রিয়তা। আরহাম সিঁড়িতে খেলছিল। প্রিয়তা খুব সাবধানে আরহামের কাছে এলো। ভাইকে কোলে বসিয়ে কন্ঠ নরম করে ফিসফিসিয়ে বললো,

” তোমাকে একটা কাগজ দিবো আরহাম। কাগজটা তুমি পুলিশম্যানকে দিয়ে আসবে। কেউ যেন কাগজটা না দেখে। একদম লুকিয়ে, সবার আড়ালে দিবে। শুধুমাত্র পুলিশম্যানকেই দিবে। অন্য কারো হাতে যেন না পরে। মনে থাকবে? এই নাও।

প্রিয়তা কাগজটা আরহামের পকেটে রেখে দিল। আরহামকে মিসেস নাবিলা এখনো ভালোবাসেন। এই সময়ে আর কোনো উপায় নেই। একজনকে যেভাবেই হোক প্রহরের কাছে যেতে হবে। বাধ্য হয়ে আরহামকে পাঠাতে হলো ও ঘরে। মনে মনে লজ্জিত হলো প্রিয়তা। আরহাম খুশি মনেই উপরে উঠল। ফ্ল্যাটে গেল। প্রিয়তা বসে রইল সিঁড়িতে। আরহামের ফিরে আসার অপেক্ষা করল। মনে মনে ভয় হলো প্রিয়তার। মিসেস নাবিলা জেনে গেলে বিষয়টা খারাপ হবে। যদিও প্রিয়তা এমন কিছু লিখেনি যাতে কারো অসম্মান হয়। যাতে কেউ তাকে খারাপ ভাবে। বরং প্রত্যক্ষ ভাবে প্রহরকে সাহায্য করছে প্রিয়তা।

দীর্ঘ দশ-বারো মিনিট পর আরহাম ফিরল। দীর্ঘ বলার কারণ প্রিয়তার কাছে এটুকু সময় অনেক আশঙ্কায় কেটেছে, অনেকটা সময় মনে হয়েছে। প্রহর কি বলবে? আরহাম কাজটা ঠিকমতো করতে পারবে কি না এ নিয়ে খুব চিন্তায় ছিল প্রিয়তা। আরহাম ফেরার সাথে সাথে প্রিয়তা জিজ্ঞেস করলো,

” উনি কিছু বলেছে তোমায়?

আরহাম শার্টের পকেট থেকে আরেকটি কাগজ বের করল। কাগজটা হলদে রঙের। কালার পেপার মনে হলো প্রিয়তার। তবে কাগজটা ভালোই মোটা। প্রিয়তা কাগজটা নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা আটকে গেল। নিঃশ্বাসের গতি বেড়ে গেল প্রিয়তার। কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজের ভাঁজ খুললো সে। সেথায় লেখা।

প্রিয়তা,

আপনি যা লিখেছেন সে সবই আমি জানি। আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আরহামের সুরক্ষা আমি দিবো। ভাবছেন এসব কিভাবে জানলাম আমি? তন্ময়ের দেওয়া ঘড়িটা আপনি সবসময় পরে থাকেন। আর না পরলে ঘড়িটা ঘরের ভিতরেই থাকে। আপনার ঘড়িতে জিপিএস ট্র্যাকিং ডিভাইস সেট করা প্রিয়তা। তানিয়া ওটা আপনার ঘড়িতে সেট করে দিয়েছে। আপনার ঘরে কে এলো আর কে গেল, কে কি বললো সবটা আমি জানতে পারি। আমরা জানতাম আপনি এসবে জড়িয়ে পড়তে পারেন। তাই তানিয়া আপনাকে এখনো নজরে রাখে। তানিয়া এই খবরটা আমাকে সকালেই জানিয়েছে। আপনি ভয় পাবেন না প্লিজ। আমি প্রহর আপনাকে নিরাপত্তা দিবো কথা দিচ্ছি। কেউ আপনাদের ক্ষতি করতে পারবে না। আপনি শুধু জাফরের কথায় হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলাবেন ব্যস। বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি। আবার ও বলছি ভয়ের কিছু নেই। আমি আছি।

পুলিশম্যান।

প্রিয়তার আনন্দে কান্না পেল। সাথে কৌতুহলী হলো সে। তোষকের পাশে পরে থাকা ঘড়িটাতে হাত বুলাল প্রিয়তা। ঘড়িটা অনেকদিন আগে তন্ময় তাকে দিয়েছিল। অনেক দামি না হলেও কম টাকার নয় ঘড়িটা। প্রিয়তা সবসময় ঘড়িটা হাতে রাখার চেষ্টা করে।

ট্র্যাক সম্পর্কে ধারণা নেই প্রিয়তার। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘড়িটা দেখতে লাগল। ঘড়ির শেষ প্রান্তের এক কোনায় একটা মেডিসিনের মতো লম্বা আর গোলাকার কালো বস্তু দেখতে পেল। বুঝতে পারল এটাই সেই উদ্ভট বস্তু, যার দ্বারা প্রিয়তা পুলিশম্যানের নজরবন্দি হয়ে রয়েছে। মনে মনে খুব খুশি হলো প্রিয়তা। বিরাট বড় একটা বোঝা বুক থেকে নেমে গেল মনে হচ্ছে তার। নিজেকে দায়মুক্ত মনে হচ্ছে। প্রহরের ভরসার বাণী বারংবার ফুটে উঠছে চোখের পাতায়।

______________

বিকেলে বেশ ভালো মুডেই আরহামকে নিয়ে পার্কে এসেছে প্রিয়তা। পার্কের আশপাশটাও ঘুরে দেখল আজ। পেছন পেছন যে জাফরের লোক তাকে অনুসরণ করছে এটা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারল প্রিয়তা। মাঝে মাঝে মুচকি হাসল সে। আজ পার্কটাতে প্রচুর ভিড়। একজন গায়িকা এসেছে এখানে। সকলেই সেদিকে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়তা আরহামকে আইসক্রিম, ললিপপ কিনে দিল। একসাথে কানামাছি খেলল চোখ বেঁধে। মাঠের কোণে থাকা স্টেজে জনতার ভিড়। শব্দে কান ঝাঁঝিয়ে উঠছে প্রিয়তার। প্রিয়তাকে অনুসরণ করা লোকটাকে এতক্ষণে ভালমতোই চিনেছে প্রিয়তা। একবার ও প্রিয়তাদের থেকে দূরে সরছে না লোকটা। জাফরের ভক্ত বলে মনে হচ্ছে লোকটাকে।

ওদিক থেকে বাংলা গানের সুর ভেসে আসছে। তোমায় “হৃদ মাঝারে রাখবো” এই গানটি প্রিয়তা প্রায়ই শুনে। গানের সাথে সাথে ঠোঁট নাড়াল প্রিয়তা। লোকজনের হৈ হুল্লোরে পুরো মাঠটা অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। প্রিয়তার মনে হলো এই পার্কটা যেহেতু বাচ্চাদের জন্য তাই গায়িকার উচিত ছিল ছোটদের ছড়া, কবিতা কিংবা গান গেয়ে শোনানো। এই গানটা বোধহয় বড়দের জন্য।

প্রিয়তা খেয়াল করল তাকে অনুসরণ করা ব্যক্তিটি ফোন কানে চেপে ধরে আছে। এত আওয়াজে লোকটা ফোনের অপর প্রান্তে থাকা মানুষটির কথা বুঝতে পারছে না। যেজন্য লোকটা পার্ক থেকে বেরিয়ে আসল। প্রিয়তা স্থান ত্যাগ করল। অনুষ্ঠানের বিপরীত দিকে চলে এলো। এখানে অত আওয়াজ নেই। গানের হালকা শব্দ ভেসে আসছে। সেদিনের মতো আজ ও একই ঘটনা ঘটল। একটা ছেলে এলো প্রিয়তার কাছে। ছেলের পড়ণে স্যান্ডু গেঞ্জি। গায়ের রং ফর্সা। হাতে একটি থালা। সেখানে খুচরো দু-পাঁচ টাকার নোট আর কয়েন। প্রিয়তা মুখ ফিরিয়ে নিল। ছেলেটা ডাকল। বললো,

” আপু আমাকে কিছু টাকা দিন না।

প্রিয়তা আড়চোখে তাকাল। ছেলেটার করুণ মুখ। মায়া মায়া গোলাকার চোখ। কণ্ঠ অমায়িক। দাঁত গুলো চিকচিক করছে ছেলেটার। মুখটা কেমন শুকনো শুকনো লাগছৈ। প্রিয়তা এড়িয়ে যেতে পারল না। জিজ্ঞেস করল,

“- তোমার আম্মু কোথায়? সে তোমাকে ভিক্ষা করতে পাঠিয়েছে?

ছেলেটা অবাক হয়ে তাকাল। অপমানিত হলো বোধহয়। মাথা নত করে বললো,

” আম্মু অসুস্থ। তার ঔষধ কিনতেই ভিক্ষা করি।

প্রিয়তা বিশ্বাস করল না। বললো,

” আমার কাছে টাকা নেই। সরি।

ছেলেটা মাথা নত করে মলিন মুখে চলে যেতে উদ্যত হলো। কি মনে করে আবার সামনে ফিরে প্রিয়তাকে দেখল। বললো,

” আপনাকে তো আমি চিনি।

” আমাকে চিনো? কিভাবে?

” আপনার ছবি দেখছি আমার বসের বন্ধুর হাতে।

” আমার ছবি?কণ্ঠে বিস্ময় প্রিয়তার।

” হ্যাঁ আপনার ছবিই দেখেছি।

” তোমার বস কে? বসের বন্ধুই বা কে?

‘বসের বন্ধুকে তো চিনি না। আমার বসের নাম খলিল। বসের বন্ধু বসকে আপনার ছবি দেখিয়ে বলেছিল ” এই হলো সেই মেয়ে। এই মেয়েটাই হবে আমাদের টোপ। পুলিশের সাথে ওঠাবসা ওর”।

” কি বলছো?

” আপনাকে একটা কথা বলি। বস আর বসের বন্ধুর থেকে দূরে থাকবেন। নইলে আপনাকেও আমাদের মতো ভিক্ষা করাবে। আপনি তো বড়। কেউ ভিক্ষা দিবে না। আপনার হাত-পা কেঁটে ফেলবে ওরা। দূরে থাকুন ওদের থেকে।

প্রিয়তা থতমত খেল। ভয় হলো ভিষণ। জিজ্ঞেস করলো,

” তোমার বসের বন্ধু কি খুব লম্বা? বড় গোঁফ আছে লোকটার? দাঁড়ি আছে? শ্যামলা মতন?

ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোধক বুঝাল। প্রিয়তা আশপাশে তাকাল আবার। প্রিয়তা এতক্ষণ যা বর্ণনা দিয়েছে তা জাফরের অবয়বের। তবে কি জাফর এসবেও যুক্ত? ছোট ছোট বাচ্চাদের দিয়ে ভিক্ষা করাচ্ছে লোকটা? প্রিয়তা বললো,

” এসব কথা আর কাউকে বলোনি? পুলিশের কাছে যাওনি?

আমার আব্বু মারা গেছে। আম্মুর পেটে বাবু। আমি ভিক্ষা না করলে আম্মুকে মেরে ফেলবে ওরা। পুলিশকে জানালে আমাকেও মেরে ফেলবে। আপনাকে বলেছি কারণ আমার মনে হলো আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন। আপনার তো পুলিশের সাথে খুব খাতির।

প্রিয়তা সবটা বুঝল। বিশ টাকার নোট দিয়ে ছেলেটিকে দ্রুত বিদায় দিল সে। জাফরের লোক যেন কোনোভাবে ছেলেটার সাথে প্রিয়তার যোগাযোগ জানতে না পারে এজন্য। পার্ক থেকে বেরিয়ে এলো সে। রিকশায় বসে কিছু জল্পনাকল্পনা করল। ফোন বের করে জাফরকে কল দিল। বললো,

” আপনার কথায় রাজি হয়েছি। অফিসারের থানায় যাচ্ছি আমি। বলবো এখান দিয়েই যাচ্ছিলাম তাই দেখা করতে এসেছি। থানা থেকেই মিশন শুরু করতে চাইছি।

” বেশ। আমার সাথে কোনো চালাকি করলে কিন্তু,

” আমি আমার ভাইকে ভালোবাসি। আমি চিটিং করবো না। আপনার লোককে বলবেন ভালো মতো ফলো করতে। উনাকে নিয়ে বেরও হতে পারি। যদি ধরে ফেলে আপনার লোককে? সব শেষ কিন্তু।

” সমস্যা হবে না

” টাকা দিবেন তো স্যার? মুচকি হেসে বলল প্রিয়তা।

” পাবে পাবে। আগে কাজ টা হোক।

প্রিয়তা কল কাটল। জাফরকে বিশ্বাস করাতে হবে প্রিয়তা লোভী। প্রহরের বিরুদ্ধে সে সব করবে। জাফরের হয়ে কাজ করতে প্রিয়তার কোনো দ্বিধা নেই।

প্রিয়তা প্রথমে বাড়ি ফিরল। এখন প্রহর বাসায় থাকবে না প্রিয়তা তা জানে। আরহামকে ঘরে রেখে প্রিয়তা আবার ও বের হলো। রিকশা ডেকে থানার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। পিছনে একটা বাইক ও চললো। প্রিয়তা থানায় পৌছে কনেস্টবল কে প্রহরের কথা বলল। প্রহরের কেবিনে পৌঁছে প্রিয়তা সালাম দিল। ডেস্কের তিন কোণায় তিনটি টেবিলে ইহান, প্রহর আর তানিয়া বসে আছে। প্রিয়তা আশপাশে নজর বুলাল। প্রিয়তাকে দেখে মিষ্টি হাসল তানিয়া। বললো,

“তুমি এখানে? কেমন আছো প্রিয়তা?

” আলহামদুলিল্লাহ্ আপু। আপনি কেমন আছেন?

” আলহামদুলিল্লাহ্। বসো।

একটা চেয়ার আনা হলো। প্রিয়তা বসল সেখানে। ইহানের উদ্দেশ্যে বললো,

” আজ কালের মধ্যে থানায় নতুন কেউ জয়েন করেছে?

ইহান ভাবল। বললো,

” হ্যাঁ আজই তো।

” উনি আশেপাশে আছে?

” না।

প্রিয়তা সবটা প্রহরকে জানাল। সবটা জেনে ভিষণ অবাক হলো তিনজন। প্রহর কিছু একটা ভাবল সময় নিয়ে। ইহানের উদ্দেশ্যে বললো,

” সাকিব ছেলেটার স্কুল ওই পার্কের থেকে পনেরো মাইল দূরে তাই না ইহান? কোনোভাবে কি সাকিব ও ওখানেই আছে?

পুনরায় প্রহর বললো,

” আমি প্রিয়তার সাথে বের হচ্ছি। ওকে অনুসরণ করা লোককে বিশ্বাস করাতে হবে প্রিয়তা তাদের কথামতো চলছে। তানিয়া আর তুই এক্ষুণি পার্কে যাবি। সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করবি। কোনো ক্লু পেলে কালেক্ট করবি। এট্যাক করবো সময় বুঝে।

______________

“স্যার চলুন বাদাম ভাঁজা খাই।

ইহান ভ্রু কুঁচকে তাকাল তানিয়ার দিকে। কাজ করতে এসে খাওয়া, বসার বিষয়টা ভালো লাগে না ইহানের। এমনিতেই ঘুরে ঘুরে কোথাও কোনো প্রমাণ পায়নি। কেউ কিছুই বলতে পারছে না। সাক্ষী হিসেবেও তো বাইরের কয়েকজনকে লাগতো। কোনো কিছু না পেয়েই তানিয়া খাওয়াদাওয়ার কথাটা তুলেছে। ইহান চুলগুলোকে ঠিক করে বললো,

” কাজের সময় কিসের খাওয়াদাওয়া? ওঠো। আরো সবাইকে জিজ্ঞেস করে দেখি।

তানিয়া নড়ল না। পার্কের বাইরের ছোট টুলে বসে রইল। ইহান দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। এই মেয়েটার দ্বারা কিচ্ছু হবে না বুঝে নিল। বললো,

” তুমি এখানে থাকো। আমি দেখছি।

তানিয়া মাথা নাড়ল। ইহান সামনে এগিয়ে আরো কিছু মানুষকে জিজ্ঞেস করলো বাচ্চাদের সম্পর্কে। অতঃপর বাদাম ভাজা আর পানির বোতল নিয়ে বসল তানিয়ার পাশে। তানিয়ার হাতে সেসব গুঁজে দিয়ে বললো,

” তুমি বাড়ি যাও। তোমার থেকে তো কোনো লাভ হচ্ছে না।

” আশ্চর্য স্যার। আমি কিছুই করছি না? এখানে বসে আমি নজর রাখছি কেউ আমাদের অনুসরণ করছে কি না। এটা কি কাজ নয়?

” আমি বসে বসে দেখি তুমি যাও মেয়েদের জিজ্ঞেস করে এসো।

” বাদামটা খেয়ে নিই। যাচ্ছি।

চলবে?