Friday, August 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 462



প্রেম প্রার্থনা পর্ব-১২

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[১২]

-‘ আমি নাকি রাজনীতি? ‘

-‘রাজনীতি।’

রুদ্রর কথা শুনে স্পর্শী মুচকি হাসল। কষ্টমাখা মলিন হাসি। ছলছল চোখ। পুনরায় প্রত্যাখান! তাও একবার নয় পরপর কয়েকবার। অথচ রুদ্র মন রক্ষার্থেও বলতে পারতো, ‘ আমি শুধু তোকেই চাই স্পর্শী, শুধু তোকে।’
কিন্তু না, রুদ্র সেটা না করে পাষানের মতো বারবার ফিরিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে তার কোনো মূল্যই নেই। সে থাকলেও যা না থাকলেও তা। রাজনীতিই তার কাছে সব। নিজে বেহা/য়া হয়ে সবার মন রক্ষার্থে তাকে নিয়ে সংসার শুরু করার কথা ভেবেছে। নিজের ইচ্ছে, আকাঙ্খা, স্বপ্নকে, জলাজ্ঞলী দিয়ে
রুদ্রকে নিয়ে ভাবার ইচ্ছে পোষণ করেছে। অথচ যার জন্য এত আয়োজন সে তার পাশেও নেই, কাছেও নেই। তার করা সমস্ত আয়োজনই যেন বৃর্থা, নিরর্থক। তাছাড়া বাসার সবাই বলে ‘মেনে নে, ‘ কিন্তু কাকে মেনে নিবে, যে তার নয়, তাকে? সে তো চেষ্টা করছে কিন্তু রুদ্র! সে চাইলেও একপা এগোচ্ছে না, ভাবছে না, নতুন করে শুরু করার কথা। মূখ্য কথা কে বা চায় বিধবা হতে? এমিলির মতো পরিস্থিতিতে পড়তে চাচ্ছে না বলেই রুদ্রকে বার বার বলছে রাজনীতি ছেড়ে দিতে। কী দরকার রাজনীতি করার? রাজনীতি ছাড়া মানুষ বাঁচে না?
তাছাড়া রুদ্র তো এখন একা নয়। পরিস্থিতি মোতাবের সেও জড়িয়ে গেছে রুদ্রর সঙ্গে। এখন নিজের কথা ভাবতে গেলে
রুদ্রর নামও জড়িয়ে যাচ্ছে। আজ অথবা কাল রুদ্রকে সে স্বামী হিসেবে মানতে বাধ্য। এজন্য চাচ্ছিল রুদ্র এসব ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক। আর পাঁচজনের মতো ওরা
সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে বেঁচে থাকুক। কিন্তু সেটাও বোধহয় সম্ভব নয়।
কারণ রুদ্র দিনকে দিন যেভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে তাতে আশা ভরসা নেই। কখন কী ঘটে তাও বলা যায় না। যাকে নিয়ে বাঁচার কথা ভাববে সেইই যদি গলা অবধি জলে ডুবে থাকে তাহলে কীভাবে হবে? ভেবেছিল তার এমন পাগলামি দেখে রুদ্রর মনটা গলবে, কিঞ্চিৎ আলোর দেখাও মিলবে, কিন্তু ফলাফল শূন্য..! পুনরায় প্রত্যাখান হয়ে স্পর্শী একটা বাড়তি কথাও বলল না। দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেত্রজোড়া বন্ধ করে রইল। সঙ্গে সঙ্গেই তার চোখের কার্ণিশ বেয়ে ঝরে গেল অশ্রুফোঁটা। ওকে কাঁদতে দেখে রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে। কেবিনের সামনেই নার্সরা বসে গালগল্পে
মগ্ন। সামনের কেবিন থেকে একটা বাচ্চার কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। সম্ভবত তার হাতে ক্যানোলা করা হচ্ছে। কেবিনের দরজার কাছে এক মহিলা মুখে আঁচল গুঁজে অসহায় ভাবে কাঁদছে, হয়তোবা উনিই সেই বাচ্চাটার মা। কলিজার টুকরো বাচ্চার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।মাঝে
মাঝে উঁকি মেরে দেখছে হয়েছে নাকি। তখন দু’জন নার্সকে কেবিন থেকে বের হতে দেখা গেল। তারা বের হয়ে বাচ্চাটার মাকে বলল,

-‘ কাঁদতে কাঁদতে বাচ্চার দম আঁটকে গেছে, যান বুকে নিয়ে বুকে, পিঠে, থাবা দেন। আমরা একটু পরে এসে ক্যানোলা করে যাবো।’

একথা বলে ওরা বিরক্ত মুখে রুদ্রর পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
দম আঁটকানোর কথা শুনে সেই মা দৌড়ে গেলেন বাচ্চাটার কাছে। মুহূর্তেই বুকের ধনকে বুকে নিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। তবুও নার্সরা কেউ এগিয়ে গেলেন না। রুদ্র নার্সদের দিকে একবার তাকিয়ে নিজে গেল বাচ্চাটার কাছে। দরজা
পেরিয়ে ঢুকতেই দেখা গেল এক বছরের ফুটফুটে ছেলেকে। কাঁদতে কাঁদতেই দম আঁটকে গেছে তবুও ক্যানোলা করা হয় নি। বাচ্চাটা শ্বাস নিতেও পারছে না, কাঁদতেও পারছে না, হা করে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছে। বাচ্চাটার মা বর্তমানে একা হসপিটালে আছেন। উনার হাজবেন্ড ওষুধ আনতে গেছেন।
কিছুক্ষণ আগে তিনবার ক্যানোলার সূচ ফুঁটিয়েও বাচ্চাটার রগ পাওয়া যায় নি। ফলে মাসুম বাচ্চাটা ভয়, ব্যথায়, মায়ের দিকে হাত বাড়াতেই নার্স ধমকে ওঠে ভদ্রমহিলাকে। যা নয় তাই বলে বেরিয়ে যেতে বলে কেবিন থেকে। সেই অসহায় মা বাচ্চার ভালোর জন্যই কেবিনের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকে। আর নার্স চেপে ধরে ক্যানোলা করায় বাচ্চা ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে দম আঁটকে যায়। এ অবস্থা দেখে তারা চেষ্টা চালাতে থাকে। যখন দেখে দম আসছেই না তখন
বাচ্চাটাকে কোলে না তুলে নার্স ভদ্রমহিলাকে বুকে, পিঠে, থাবা দিতে বলে চলে যায়। বাচ্চার অবস্থা দেখে বাচ্চার মা দিশা না পেয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। তাও নার্সগুলো শুনেও এগিয়ে আসে না বরং চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে একে অন্যকে জিজ্ঞাসা করে আজ দুপুরের লাঞ্চে কে কী এনেছে।
রুদ্র কেবিনে প্রবেশ করে আগে বাচ্চাকে বুকে তুলে নিলো।
তারপর বাচ্চাটার মাথা কিছুটা নিচু করে উপুড় করে শুইয়ে পিঠে বেশ কয়েকবার চাপড় মারল। এতে বাচ্চার শ্বাসপ্রশ্বাস ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এলো। অনেক সময় ট্র্যাকিয়া বা শ্বাসনালীতে খাবার আটকে গেলে শিশুরা কাঁদতে বা কথা বলতে পারে না। তখনই এই পন্হা অবলম্বন করতে হয়। দম ফেরার পর বাচ্চার তার মায়ের বুকের সঙ্গে লেপ্টে আছে। থেমে থেমে হিঁচকি তুলে কাঁদছে। রুদ্র ওই মহিলাকে কেবিনে থাকতে বলে সে বাইরে গেল। নার্সরা খাতাতে কীসব লিখতে ব্যস্ত তবে তাদের গল্প থেমে নেই। যে নার্স দু’টো বাচ্চার হাতে ক্যানোলা করেছিল রুদ্র তাদের একজন গিয়ে বলল,

-‘ম্যম, আপনার নামটা জানতে পারি?’

-‘আমার নাম আপনাকে বলতে যাবো কেন, আশ্চর্য!’

-‘প্রয়োজন না থাকলে জানতে চাইতাম না নিশ্চয়ই।’

-‘আমার নাম দিয়ে আপনার কি প্রয়োজন সেটা বলেন?’

-আপনাকে খুব পছন্দ হয়েছে বিয়ে করব তাই নাম ঠিকানা জেনে নিচ্ছি।’

-‘আপনি কি মজা করছেন?’

-‘আপনি কি আমার শালী লাগেন?’

-‘বলবেন নাকি অন্য উপায়ে জেনে নিবো?’

-‘আমার নাম রুবাইদা বলে রুবি ডাকে।’

-‘ধন্যবাদ। ‘

একথা বলে রুদ্র সেখানে দাঁড়িয়েই কাউকে কল করল। দুই বারের বেলায় রিসিভ করল ফোনেন অপর পাশের ব্যক্তিটি।
রুবি তখনো রুদ্রকে আড়চোখে দেখতে ব্যস্ত। অন্য নার্সরাও নিজেদের মধ্যে গুজুরগুজুর করছিল। অদুরে দাঁড়িয়ে রুদ্র
কাউকে বলে উঠল,

-‘হ্যাঁ আতিক, রুদ্র বলছি। শোন, বর্তমানে তোর হসপিটালেই আছি। তিনতলার ৩০৩ নং কেবিনের সামনে যে রিসিপশন আছে সেখানকার একজন নার্স রুবাইদা, সবাই নাকি রুবি নামে চিনে। উনাকে এই মুহূর্তে যদি সাসপেন্স না করিস তোর আর ইশিতার পিক ভাইরাল করে দিবো। কোন পিক মনে আছে তো? আর তুই তো জানিস আমি অকারণে মজা করি না। তাই মজা ভেবে বসে থাকিস না। সময় মাত্র ৫ মিনিট, রাখছি।’

একথা বলে রুদ্র কল কেটে দিলো। রুবিসহ বাকি নার্সরাও হতভম্ব তাকিয়ে আছে। মুহূর্তের মধ্যেই রুবির সাসপেন্সের আদেশ চলে এলো। আতিক খাতিয়ে দেখার আগেই রুবির বিদায়ের ঘন্টা বাজিয়ে দিলো। তারপর রিসিপশনের সিসি ক্যামেরা থেকে পুরো ঘটনা দেখে উপস্থিত দুইজন নার্সকে সাপপেন্স করা হলো। যাদের কাজ সেবা করা তাদের এমন
হেলা আতিকেরও সহ্য হলো না। বিশেষ করে কোনো বাচ্চার কষ্ট দেখতে পারে না সে। কারণ তার প্রথম বাচ্চা মারা গেছে চিকিৎসার অভাবে। মূলত ডাক্তার ও নার্সদের অবহেলাতে।
সেদিনের পর জেদ ধরেই এই হসপিটালের সৃষ্টি। বারংবার বলাও আছে এখানে কোনো বাচ্চাকে অবহেলা করা যাবে না, কোনো পরিস্থিতিতেই না। অথচ রুবি..!মুহূর্তেই এই খবর হসপিটালে ছড়িয়ে গেল। সকলে ধিক্কার জানাল তাদের। এই সুযোগে ভুক্তভোগীরা কথা শুনাতে ছাড়ল না। পরিশেষে সব
হিসাব নিকাশ বুঝিয়ে দুইনার্সকে তখনই বিদায় করা হলো।
আর ওই বাচ্চার চিকিৎসার দায়ভার আতিক নিজে নিলো।

তখন রুদ্র স্পর্শীর কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে ওই ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলছিল। একটুপরে কাফি আর রুমা এলো। তারা
স্পর্শীর খোঁজখবর নিলো। তারপর দু’টো ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বলল,রুদ্রর জন্য ড্রেস আর খাবার নিয়ে এসেছে। স্যালাইন শেষ না হলে স্পর্শী খেতেও পারবে না। কখন স্যালাইন শেষ হবে ঠিক নেই। তাই তারা রুদ্রকে খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করলো। গতরাত থেকে রুদ্র খাওয়া তো দূর পরনের টি-শার্ট অবধি বদলায় নি। কালো টি-শার্টের কারণে রক্তের দাগটাও বোঝা যাচ্ছে না। কাফি আর রুমাজোরাজুরি করেও রুদ্রকে খাওয়াতে পারলো না। শুধু ড্রেস নিয়ে কেবিনের ওয়াশরুমে গিয়ে ড্রেস বদলে নিলো। তারপর নার্সদের বলে দিলো রুমা আর স্পর্শীর সমস্যা হলে দেখতে। তার বলার ধরণে নার্সরা বিরক্ত হলেও মুখে হাসি ফুটিয়ে আশ্বস্ত করল। এখানে রুদ্র বাদে অন্যকেউ হলে খ্যাঁক করে বলে ফেলতো, ‘এতই যখন দরদ তাহলে বউকে কাঁধে করে নিয়ে গেলেই তো পারেন।’
কিন্তু মুখে ফুটে বলার সাহস হলো কারোই৷ তাছাড়া আজকে যা ঘটল ভুলেও একাজ করার কথা ভাবাও যাবে না। নয়তো তাদের অবস্থাও রুবির মতো হবে। তখন রুদ্রের ফোনে কল।এলো। তাকে এখনই বের হতে হবে হাতে বেশি সময়ও নেই।
রুমাকে সাবধানে থাকতে বলে রুদ্ররা দু’জন বেরিয়ে গেল।
তাদের যেতে দেখে রুমা স্পর্শীর কেবিনে প্রবেশ করল। ওর হাতের ব্যাগ রেখে আস্তে করে বসল স্পর্শীর শিয়রে। স্পর্শী ঘুমে কাদা। ওষুধের প্রভাবে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তাই বাইরের চেঁচামেচিতেও ঘুম ভাঙ্গে নি তার। নয়তো রুবির কান্নাকাটি শুনে ছুটে বেরিয়ে আসত। মেয়েটা বড্ড বেশি চঞ্চল। আর চঞ্চল মেয়েটিকে আদুরের ছানা মতো আগলে রাখে তাদের বাসার মানুষ। কি সৌভাগ্য! রুমা স্পর্শীর ব্যান্ডেজ করা হাত দেখে হাসল। রুদ্র সারারাত এই হাতটা ধরেই বসে ছিল। কত চুমু খেয়েছে কে জানে। এসব ভেবে রুমা স্পর্শীর ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,

-‘ভাইয়া ঠিকই বলে বড্ড অবুজ তুমি স্পর্শী। নয়তো অনেক আগে ভাইয়ার চোখের ভাষায় মন পড়তে সক্ষম হতে। বুঝে ফেলতে কঠিন হৃদয়ের পুরুষটার শুধু মন নয় পুরো অস্বিত্বে মিশে আছো তুমি।’

একথা বলে রুমা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। স্পর্শীর ঘুমটা যাতে না ভাঙ্গে তাই সে কেবিনের বাইরে এসে দাঁড়াল। নতুন পেশেন্টরা এসে কেবিন দখল করছে। তাদের আত্মীয়স্বজন
ছোটাছুটি করছে পেশেন্ট নিয়ে। রুদ্র যাওয়ার আগে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে পাশের কেবিনের এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে। সে গিয়ে সেই ভদ্রমহিলার কাছে এগিয়ে গেল। তারপর কী যেন ভেবে পুনরায় কেবিনে ফিরে এলো। রুদ্রর আমানত স্পর্শী। তাকে আমানতের খেয়াল রাখতে এখানে রেখে গেছে। তার উচিত হবে না স্পর্শীকে একা রেখে যাওয়া কারণ রুদ্র আর কাফির শুত্রুর শেষ নেই। কখন কীভাবে স্পর্শীর ক্ষতি করে ফেলে তখন রুদ্রকেই বা কি জবাব দিবে? তাছাড়া কাফিও বারবার বলে গেছে নিজেদের খেয়াল রাখতে। ওদের কিছু হলে গেলে নাকি তারাও বাঁচবে না, একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাবে। একথা ভেবে সে কেবিনে ঢুকে দরজা ভালোভাবে লক করল। তারপর পাশের বেডে শুয়ে উপন্যাসের পিডিএফ নামিয়ে পড়াতে মন দিলো। এর কিছুক্ষণ পর তার ফোনে টুং করে মেসেজ এলো, ‘রুমা বোন আমার! স্পর্শীর হাতের দিকে নজর রেখো। স্যালাইন শেষ হয়ে রক্ত উঠে না যায়, কেমন?’

উক্ত মেসেজ পড়ে রুমা হেসে স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘তোমার বরটা আসলেই বউপাগল, হা হা। ‘

____-______-______-______-_________-_______-_____-

এমিলি সাদা শাড়ি পড়ে সাংবাদিকদের সামনে বসে কাঁদছে।
কিছুক্ষণ আগে তার প্রাণের স্বামীর দাফন কাজ সম্পূর্ণ করা হয়েছে। রাজনীতিবিদরা দলে দলে এসে তাকে স্বান্ত্বণা দিয়ে যাচ্ছে। এই সুযোগে সাংবাদিকরাও ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে প্রশ্ন করে যাচ্ছে। চতুরতার সঙ্গে কখনো সে সেসব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে, কখনো বা এড়িয়ে যাচ্ছে। লাইভ দেখাচ্ছে সেই দৃশ্য। ভিডিও টা দেখে কাফি ড্রাইভ করতে করতে বলল,

-‘কে মেরেছে, কেন মেরেছে জেনেও এমিলির অভিনয় দেখে অবাক না হয়ে পারছি না।’

রুদ্র একথার জবাব দিলো না। সে একমণে বাইরের দিকে তাকিয়ে ভাবছে। রুদ্রর থেকে জবাব না পেয়ে কাফি গলা পরিষ্কার করে পুনরায় বলল,

-‘অভিনয় করে কাঁদলেও চোখের পানি সত্যিই মনে হচ্ছে। কান্না করার জন্য চোখে কিছু দিয়েছে নাকি?’

-‘(রুদ্র এবারও নিশ্চুপ)’

-‘তবে বিধবা সাজে কিন্তু ভালোই দেখাচ্ছে এমিলিকে, তাই না স্যার?’

একথা শুনে রুদ্র সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ অবস্থা বলল,

-‘ রুমাকে কি বলতে হবে আজকাল বাইরের মেয়ের দিকে নজর দিচ্ছো।’

-‘সরি, স্যার এই ভুল আর কখনো হবে না।’

একথা বলে কাফি সেই যে মুখ বন্ধ করলো অকারণে আর একটাও বাড়তি কথা বলল না। গাড়ি চলছে নিজ গতিতে।
হঠাৎ রুদ্র গাড়ি থামাতে বলে চট করে গাড়ি থেকে নামল।তারপর কাফিকেও নামিয়ে হসপিটালে যেতে বলে সে নিজে
বসল ড্রাইভিং সিটে। কাফি হতবাক হয়ে কিছু বলার আগেই রুদ্র গাড়ি নিয়ে ছুঁটলো ঢাকার উদ্দেশ্যে। আজকাল রুদ্রর মতিগতি কিছুই বুঝে না কাফি। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে চলল হসপিটালের পথে। আধাঘন্টা পর হসপিটালে পৌঁছেই পড়ল আরেক বিপাকে। স্পর্শী ঘুম থেকে উঠেই জেদ ধরেছে এই মুহূর্তেই বাসায় ফিরবে। তাকে তারা কোনোভাবে বুঝিয়ে রাখতে পারছে না। এদিকে রুদ্রর ফোন বন্ধ। স্পর্শীর কান্নার গতি বেড়েই চলেছে। পরে বাধ্য হয়ে কাফি ছুটল ডাক্তারের কাছে। অনেক রিকুয়েষ্ট করে ডাক্তারের পরামর্শে স্পর্শীকে নিয়ে বাসায় ফিরল। বাসায় ফিরেই স্পর্শী রুমার সাহায্যে গোসল সেরে ভদ্রমেয়ের মতো খাবার খেলো। তারপর ওষুধ খেয়ে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখায় মন দিলো। তখন বাজে বেলা তিনটা। তারপর বাকি সময়টুকু টিভি দেখে, রুমার সঙ্গে গল্প করে, বই পড়ে তার বাকি সময়টুকু কাটল। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমে এলো। কাফি আর রুমার সঙ্গে রাতে খেয়ে পুনরায় রুদ্রর রুমে ফিরে এলো। এই সময়টুকুতে সে ভুলেও রুদ্রর কথা জিজ্ঞাসা করে নি তবে রুমা জানিয়েছে সে নাকি জুরুরি কাছে কোথাও গেছে। স্পর্শী রুমের লাইট বন্ধ করে অনেক সময় জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, তারপর শরীর যখন আর কুলাচ্ছিলই না তখন গিয়ে শুয়ে পড়ল। অন্ধকার রুমে শুয়ে থাকতে থাকতে সে ঘুমে তলিয়ে গেল। একটুপরে রুমা এসে তাকে দেখে মেসেজ করে রুদ্রকে জানিয়ে দিলো।
তারপর রুমাও সব ঠিকঠাক করে পাশের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল। এভাবে সময় কাটতে থাকল রাত গভীর হতে লাগল।
মাঝরাতে স্পর্শীর যখন শুনতে পেল কারো বিরবির করা কথা। ঘুমের ঘোরে তেমন পাত্তা দিলো না। একটুপরে কারো নিঃশ্বাস এসে বারি খেল তার চোখে মুখে এবং শুনতে পেল কেউ বলছে,

-‘জানতাম রুমা একা সামলাতে পারবে না। এমনি কাফিকে পাঠিয়েছে আমি। সারাদিন টেনশনে কেটেছে আমার অথচ এনাকে দেখো নাক ঘুমে আরামসে ঘুমাচ্ছে। সারাদিন কি করলাম, কি খেলাম খোঁজ নেওয়া তো দূর একটা কল করার প্রয়োজন মনে করে না।’

তার বলা কথা শেষ হতেই স্পর্শী হাত রাখল সেই মানুষটার ঘাড়ে। আচমকা হামলে পড়ল সেই মানুষটার ঠোঁটের উপর।
সারাদিনের রাগ তুলতে রাগে জিদে স্বজোরে কামড়ে ধরল রুদ্রর ঠোঁট। তখনই রুদ্র টের পেল নোনতা স্বাদ।অর্থাৎ ঠোঁট কেটে গেছে। সেই সঙ্গে স্পর্শী খামছে ধরেছে তার শার্ট এবং পিঠে বসিয়ে দিচ্ছে ধারালো নখ।

To be continue……..!!

প্রেম প্রার্থনা পর্ব-১১

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[১১]

-‘এই মুহূর্তে তুই আমাকে বেছে নিবি নয়তো তোর রাজনীতি। যদি আমাকে নিস তাহলে আমি তোর মনমতো হয়ে উঠবো। আর যদি রাজনীতি নিস তবে বিচ্ছেদ কেউ ঠেকাতে পারবে না। বিচ্ছেদ মানে বুঝেছিস, ডিভোর্স! সত্যি বলছি, তোকে আমি ডিভোর্স দিবোই দিবো।’

-‘স্পৃর্ধা একটু বেশি দেখিয়ে ফেললি না?’

-‘বেশ করেছি।’

-‘কলার ছাড়।’

-‘আমার কথার জবাব চাই।’

-‘আমি রাজনীতি বেঁছে নিলাম। এবার যা পারিস করে নে।’

-‘ আমার যখন মূল্যই নেই তাহলে বিয়ে করেছিস কেন? ওহ মজা নিতে? ফূর্তি করতে?’

-‘স্পর্শী, ভাষা সংযত কর আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিস না।’

-‘তুই করতে পারলে আমি বলতে পারব না? তোরা সবাই আমাকে পেয়েছিসটা কি? আমি তোদের খেলার পুতুল? মন মর্জি কিছুই থাকতে পারে না আমার? বাসা থেকে বলে মেনে নে, মেনে নে, আর তুই মূল্যই দিস না। আমি কুকুর?বারবার দূরছাঁই করবি আর তোর পদতলে পড়ে থাকব?ওই এমিলির মতো আমাকে বিধবা দেখার জন্য রাজনীতি ছাড়বি না তাই না? এমিলির বরের মতো রাস্তাঘাটে পড়ে ম/রার এত শখ?’

-‘এবার বুঝলাম এত রাগের কারণ। বস, মাথাটা ঠান্ডা কর, আগে আমার পুরো কথাটা শুন।’

-‘কিচ্ছু শোনার বাকি নেই আমার। থাক তুই তোর রাজনীতি নিয়ে। আজকের পর ভুলেও আমার সামনে আসবি না। যদি আসিস আগে তোকে খু/ন করব তারপর আমি বি/ষ খাবো।’

একথা বলে স্পর্শী রেগে রুম থেকে বেরিয়ে গেল রুদ্রও বাঁধা দিলো না। এত রাগের কারণ এতক্ষণ বুঝলো রুদ্র। বিয়েটা নাকি মানেও না আবার ওকে নিয়ে ভয়ও পায়। একেই বলে মেয়েমানুষ, মুখ এক মনে আরেক। একথা ভেবে রুদ্র মুচকি হেসে গালে হাত বুলালো। চিঙ্গিসখানের নাতনির হাতে এত জোর! গালটা এখনো জ্বলে যাচ্ছে। নতুন নতুন বিয়ে করে
বরদের নাতি আদর সোহাগের কমতি থাকে না। অথচ সে..!
এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেঝের দিকে দৃষ্টি গেল। পুরো রুমে বিরিয়ানির ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এভাবে খাবার নষ্ট করার অপরাধে শাস্তি দিতেই হবে তাহলে পরবর্তীতে এমন করার আগে দশবার ভাববে। বলার আগেই মুখের সামনে হাজার রকমের খাবার পেয়ে যায় এজন্য বোঝে না ক্ষুধার জ্বালা, খাবারের মর্ম। মনে মনে এসব আওড়িয়ে ঝাড়ু এনে সবপরিষ্কার করে মুছল। আড়চোখে দেখে এলো গেস্টরুম বন্ধ থাকায় স্পর্শী ড্রয়িংরুমে বসে ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদছে।
রাগ কমলে ঠিকই আসবে ভেবে রুমে এসে বিছানার উপর বসল। ল্যাপটপ নিয়ে জুরুরি ইমেইল চেক করল। পরবর্তী ইমেইল ওপেন করতেই স্পর্শী দরজা আঁটকে দিলো বাইরে থেকে। দরজা বন্ধ দেখে রুদ্র চট করে উঠে স্পর্শীর নাম ধরে ডাকতে লাগল। কিন্তু স্পর্শীর সাড়াশব্দ পেল না। একটু পরে মেইন দরজা খোলার শব্দ শোনা গেল। স্পর্শী বাইরে যাচ্ছে না তো? তাছাড়া মেইন দরজা খুলবেই বা কেন?যদি এমনই হয় তবে থাপ্পড় একটাও মাটিতে পড়বে না। থাপ্পড়ে মাথার ভূত ছুটিয়ে দিবে। বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি করছে সে।এতক্ষণ নিজের রাগ কনট্রোল করলেও এবার অসহ্য লাগছে। রুদ্র পুনরায় ডেকে সাড়া না পেয়ে বাইরে যেতে নিষেধ করল। ওর আদেশ অমান্য করে যদি যায়ও তবে ভ/য়ংকর শাস্তি দিবে।
চিৎকার করে একথা বলার পরেও স্পর্শীর সাড়া পেল না।
এখন ঘড়ির কাঁটা বারোর ঘরে। এতরাতে বের হওয়াও রিস্ক তাছাড়া এমিলির লোকসহ অন্য শত্রুরাও উৎ পেতে আছে।
সবসময় তাদের উপর নজর রাখছে। তারা যদি কোনোভাবে জানতে পারে স্পর্শী বাইরে তাও একা তবে তাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খাবে। না, যেভাবেই হোক আঁটকাতে হবে। তারপর রুদ্র চট করে ফোন তুলে গেটের দারোয়ানকে কল করল। দারোয়ান চেয়ারে হেলান দিয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিল।ফোনে কল পেয়ে হুড়মুড় করে উঠে পরপর দুইবার সালাম নিলো। তখন রুদ্র সালামের জবাব নিয়ে জানিয়ে দিলো স্পর্শীকে যেন বাইরে যেতে না দেয়। জোরাজারি, কান্নাকাটি, এমনকি সে মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি খেলেও না। ওর কথা শুনে দারোয়ান থতমত খেয়ে কিছু বলার আগেই কল কেটে ফোন রাখতেই বাইরের
দরজা আঁটকানোর শব্দ পাওয়া গেল। তারমানে স্পর্শী যায় নি, ফিরে এসেছে। এই মেয়ে শান্তি দিলো না। অতঃপর রাগে গজগজ করতে করতে সে এসির পাওয়ার বাড়িয়ে বিছানায় বসল। তোয়ালে নিয়ে মুখ, কপাল, ঘাড়, মুছে ছুঁড়ল কোণায় রাখা বিন ব্যাগের উপরে। মানুষ চারটা বিয়ে করে চারটা বউ সামলায় কীভাবে? তার এক বউ’ই কাল ঘাম ছুটিয়ে দিচ্ছে। চার টা বউ হলে চারদিকে থেকে প্যারা।একজনই বিয়ের শখ
আহ্লাদ মিটিয়ে দিচ্ছে আর লাগবে না। তখন দরজার কাছে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে রুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-‘তাড়াতাড়ি দরজা খোল নয়তো আজ তোর খবর আছে।’

-( সাড়াশব্দ নেই)’

-‘কথা কী কানে ঢুকছে না? আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিস না স্পর্শী এর ফল ভালো হবে না।’

তখন দরজার ওপাশ থেকে স্পর্শীও সমান তালে বলে উঠল,

-‘লাস্টবার বলছি, আমি নাকি রাজনীতি?’

-‘দরজাটা আগে খোল তারপর বলছি আমি।’

-‘না।’

ওর মুখে ‘না’ শুনে রুদ্র রাগে দুঃখে আর একটা শব্দও ব্যয় করল না। চোখে মুখ শক্ত করে বসে রইল। কাফিকে একটা কল করতে গিয়েও ফোনটা রেখে দিলো। বেচারা এখন বউ নিয়ে ঘুমাচ্ছে বোধহয়। ওর মতো তো আর বিচ্ছু বউ কপালে
জুটে নি, ঘুমাবেই তো। ওদিকে স্পর্শীও আর কিছু জিজ্ঞাসা করলো না। দরজার ওপাশে দেওয়ালে হেলান দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে যেন সব কথা ফুরিয়ে গেছে। স্পর্শী বাসায় আছে জেনে রুদ্র একগ্লাস পানি খেয়ে চুপ করে শুয়ে দরজা খোলার অপেক্ষা করতে লাগল। তার এই অপেক্ষার পালা চলতেই থাকল ঘড়ির কাঁটাও এগোতে থাকল। শুয়ে থাকতে থাকতে একটা সময় রুদ্রর চোখজোড়ায় ঘুম নেমে এলো।
ঠিক আধঘন্টা পরেই হঠাৎ’ই তার ঘুম ছুটে গেল। তড়িঘড়ি
উঠে দরজা খোলা নাকি পরখ করল। না, এখনো খোলে নি দেখে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াল।
তারপর চোখে, মুখে, পানি ঝাপটা দিয়ে রুমে এসে দাঁড়াতেই থমকে গেল। চোখে মুখে বিষ্ময়। কম্পিত পায়ে এগিয়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো দরজার কাছে। দরজার নিচ দিয়ে গড়িয়ে আসা লাল তরল হাতে নিয়ে পরখ করল। পরখ করে বুঝল এটা র/ক্ত। এখানে র/ক্ত এলো কোথা থেকে? স্পর্শী! স্পর্শী ঠিক আছে তো? সে উঠে দরজায় জোরে জোরে বারি মেরে উচ্চস্বরে স্পর্শীকে ডাকতে থাকল কিন্তু এবারো সাড়াশব্দ পেল না। তাই বাধ্য হয়েই কাফিকে কল দিয়ে বাসায় আসার কথা জানাল। রুদ্রর কন্ঠস্বর শুনেই মনে হচ্ছে খারাপ কিছু ঘটেছে। তাই সে রুমাকে নিয়ে রুদ্রর বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। দশ মিনিটে তারা ফ্ল্যাটের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। কাফি সময় অপচয় না করে পিন কোড বসিয়ে দরজা আনলক করল। এই পিন সে আর রুদ্র ছাড়া কেউ জানে না। তারপর তারা ভেতরে প্রবেশ করে রুদ্রর রুমের দিকে যেতেই স্পর্শীকে দেখে থমকে গেল। রুমা ‘ইয়া আল্লাহ’ বলে আর্তনাদ করে স্পর্শীর কাছে দৌড়ে গেল।
স্পর্শীর মাথাটা নিজের কোলে তুলে ডাকতে লাগল। কাফি দ্রুত পানি এনে মুখে ছিঁটা দিয়েও কাজ হলো না। তখন রুদ্র জোরে দরজায় থাবা দিয়ে দরজাটা খুলতে বলল কাফিকে।
কাফি দরজা খুলতেই রুদ্র বেরিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ দরজার সামনে স্পর্শী অবচেতন হয়ে পড়ে আছে। ওর পাশে ধারালো ছু/রি আর স্পর্শীর কাঁ/টা হাত থেকে গড়িয়ে পড়ছে র/ক্ত। এইটুকু দেখেই সে স্পর্শীকে কোলে তুলে হাঁটা ধরলো।
কাফি আর রুমা ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে ফোনে কল করতে করতে ছুঁটলো রুদ্রর পিছু পিছু। তারপর তারা গাড়িতে উঠে দ্রুত’ই পৌঁছাল চেনাজানা কাছের হসপিটালে। পেশেন্টের অবস্থা দেখে ডাক্তারও তাৎক্ষণিক চিকিৎসা শুরু করলেন।
ওটির দরজা বন্ধ হতেই রুদ্র ওটির সামনে থাকা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল, শরীরে যেন বিন্দুও শক্তি নেই। এই সামান্য কারণে এমন কিছু ঘটবে ভাবতেও পারে নি সে। যে মেয়েটা ছোটো থেকে র/ক্ত দেখতে পারে না সেই মেয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে! আচ্ছা, এটা কী ঘৃণার বশে নাকি অভিমান? পূর্বেও তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে কথা কাটাকাটি হয়েছে এমনতো
হয় নি, তবে আজ কেন? সে তো বোঝাতে চেয়েছে, বলতেও চেয়েছে, রাজনীতি কেন বেছে নিয়েছে তবুও..! এমন নানান প্রশ্নে বিদ্ধ হয়ে চেয়ারের হাতলে মাথা ঠেকিয়ে সে চোখ বন্ধ
করে নিলো। এত অবধি কত মানুষ মেরেছে তার ঠিক নেই,
কারো হাত ভেঙেছে, পা ভেঙেছে, কারো মাথাও ফাটিয়েছে, এমনকি মা/রতে মা/রতে মেরেও ফেলছে ক’জনকে। তাদের রক্ত দেখে তো এমন হয় নি। তবে আজকে কেন স্পর্শীর রক্ত দেখে শরীর অবশ হয়ে আসছে? এর আগে কখনো মনে হয়
র/ক্ত ভয় পাওয়ার জিনিস। তবে এ মুহূর্তে শরীরে লেপ্টানো র/ক্ত দেখে ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে তার বুকেই কেউ ছুরি চালিয়েছে। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার হৃদপিন্ডটাকে দ্বিখন্ডিত করে ফেলছে। গাড়িতে উঠেই তার রুমাল দিয়ে স্পর্শীর হাত বেঁধে দিয়েছিল কিন্তু র/ক্ত পড়া থামে নি। বরং রুমাল ভিজে তার টি-শার্টে র/ক্ত লেপ্টে গেছে। এই রক্তের দাগ যেন তার বুক কামড়ে ধরছে। অসহ্য ব্যথায় তোড়পাড় করে দিচ্ছে তার বক্ষপাশ।

তখন এক নার্স এসে জানাল রক্তের প্রয়োজন। পেশেন্টের শরীর থেকে অনেক রক্ত বেরিয়ে শরীর ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ইমিডিয়েট রক্তের প্রয়োজন। একথা শুনে রুদ্র ফোনটা বের করার আগেই কাফি জানতে চাইল স্পর্শীর রক্তের গ্রুপ কী।
পূর্বের ঘটনায় জানা গেছে স্পর্শীর রক্তের গ্রুপ সম্পর্কে। সে বলতেই কাফি জানাল তারও এ পজেটিভ রক্ত। তখন নার্স কাফিকে সঙ্গে যেতে বললে কাফিও হাঁটা ধরল। আর রুদ্র
ওদের যাওয়ার দিকে নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে রইল। এভাবে অনেক সমস্যা গড়ালো, রাত কেটে ভোরে আলোও ফুটলো।
রক্ত দেওয়ার পরপর রুদ্র কাফিকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে।
তার বিশ্রামের প্রয়োজন। কাফি রক্ত দিয়ে বের হওয়ার পরে সে খেয়াল করেছে রুমার ( কাফির বউ) ছটফটানি। মেয়েটা বড্ড বেশি ভালোবাসে কাফিকে। তার সামনে কিছু বলতে না পারলেও দেখেছে রুমার চোখে মুখে দুঃচিন্তার ছাপ। হয়তো ভেবেছিল র/ক্ত দিলে কাফি অসুস্থ হয়ে যাবে। তাদের কথা ভেবে রুদ্র সামনে থাকা স্পর্শীর দিকে তাকাল। তার চোখের ঘুম কেড়ে নিয়ে মেয়েটা কি সুন্দর নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। স্বার্থপর গুলো এমনই হয়। একজনের ঘুম কেড়ে নিয়ে তারা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে, হাসতে পারে, বাঁচতে পারে। একবারও ভাবেও না অপরপাশের মানুষটা কেমন আছে, কেমন থাকবে, তারা আদৌও বাঁচতে পারবে তো? পৃথিবীর বুকে সবাই নিজস্বার্থে উন্মাদ। সামনে থাকা মেয়েটাও সেই দলের অর্ন্তভুক্ত। যদিও এখন বিপদমুক্ত সে। কেবিনে দেওয়া হয়েছে। পরনে হালকা পেস্ট রংয়ের হসপিটালের পোশাক। দুই হাতে ক্যানেলা করে স্যালাইন আর রক্ত যাচ্ছে। মুখ ফ্যাকাশে। কাঁ/টা স্থানে আট
থেকে দশটার মতো সেলাই পড়েছে। রুদ্র সেই হাতটার দিকে তাকিয়ে আছে। স্পর্শী এখনো অবচেতন। তবে বিজ্ঞ ডাক্তার জানিয়েছে দু’এক ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরবে। রুদ্র বসে বসে তার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা করছে। পরনে গতকাল রক্তমাখা টি-শার্ট। চোখজোড়া লাল টকটকে। মুখভঙ্গি পূর্বের মতোই স্বাভাবিক। তার অপেক্ষার পালা ঘন্টা তিনেক পরে। স্পর্শী
টিপটিপ করে চোখ খুলে রুদ্রকে দেখে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।
ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালেও তার চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে অজস্র নোনাজল। তখন রুদ্র তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

-‘খু্ব ব্যথা করছে? কাঁদিস না ঠিক হয়ে যাবে।’

জবাবে স্পর্শী হ্যাঁ না কিছুই বলল না শুধু কাঁদতেই থাকল।
একটুপরে ডাক্তার এসে ইনজেকশন পুঁশ করতে গেলেই তার কান্নার গতি বেড়ে গেল। রুদ্র ধরতে গেলে নিঁখুতভাবে তাকে
সরিয়ে অন্যদিন মুখ ফিরিয়ে ডুঁকরে কেঁদে উঠলো। রুদ্র শুধু চুপ থেকে দেখে যাচ্ছে তার কান্ড। তারপর ডাক্তার মেডিসিন লিখে দিয়ে সাবধানে থাকতে বলে চলে গেলেন। রুদ্র হাতের প্রেসক্রিবশনটা নিয়ে দরজার কাছে যেতেই স্পর্শী বাঁধভাঙা কান্না আঁটকে বলল,

-‘ আমি নাকি রাজনীতি? ‘

একথা শুনে রুদ্র থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তবে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে তাকাল না স্পর্শীর দিকে। কয়েক সেকেন্ড পর সেভাবে দাঁড়িয়েই জবাব দিলো,

-‘রাজনীতি।’

To be continue………..!

প্রেম প্রার্থনা পর্ব-১০

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[১০]

ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে দশটা। স্পর্শী কানে ফোন ধরে চুপ বসে আছে। রুদ্র ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে খেলা দেখছে। সঙ্গে আছে তার বাধ্য সহকারী কাফি। দু’জনের হাতে কফির মগ। টিভি দেখার ফাঁকে ফাঁকে চলছে তাদের আলোচনা। স্পর্শী ফোনে কথা বলছে দেখে রুদ্র ইচ্ছে করেই দরজা বন্ধ করে এসেছে। যাতে তার কথা ড্রয়িংরুম অবধি না পৌঁছায়।
স্পর্শী মাথা নিচু করে থাকায় তার অশ্রু গড়িয়ে যাচ্ছে মেদুর গাল বেয়ে। এই প্রথম ওর ভীষণ আফসোস হচ্ছে মেয়ে হয়ে জন্মেছে বলে। মেয়ে না হলে আজ এমন বি/শ্রী পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। আর না অসহায় হয়ে মনের বিরুদ্ধে কবুল বলতে হতো।ওদিকে ফোন কলে মরিয়ম বেগম যা বলছে সে নিশ্চুপ থেকে শুনেই যাচ্ছে। জবাবে হ্যাঁ না কিছুই বলছে না।যেন শুনে যাওয়া তার কাম্য। মেয়ের মনের গতিবিধি বুঝেও
মরিয়ম বেগম কান্না আঁটকে মেয়েকে যথাসাধ্য বোঝানোর চেষ্টা করছেন। ইঙ্গিতে করে বলছেন রুদ্র এখন তার স্বামী,
সে যেন রুদ্রর কথা মতো চলে, পেছনের স্মৃতি ভুলে রুদ্রকে স্বামী হিসেবে গ্রহন করে, হাসিমুখে মেনে নেয়। মেনে নেওয়া মানে কী ইঙ্গিত করছে সে তাও বুঝছে। তারপর দাদীমা, বড় মা’সহ বাসার সকলে তার সঙ্গে কথা বলল। তবে সবার মুখে একটাই কথা, ‘মেনে নাও।’ অথচ সে কান্না সামলে মুখ ফুটে
কাউকে বলতে পারল না,’ প্লিজ! আমাকে একটু সময় দাও। নিজেকে একটু সামলে নিতে দাও। যাকে এতদিন ভাই বলে জেনেছি তাকে স্বামী রুপে গ্রহন করা সহজ হচ্ছে না আমার পক্ষে, পারছিও না। তার পাশে শুলে অস্বস্ত্বির কাঁ/টা শরীরে ফুটছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। স্বামী নাকি অর্ধাঙ্গ(শরীরের অর্ধেক অংশ)। সে তার স্ত্রীর দেহ ও মনের দাবীদার। অথচ এসব জেনে বুঝেও স্বাভাবিক হতে পারছি না। মোদ্দাকথা,
বিয়ের মাত্র কয়েকটা দিন হয়েছে কিসের তাড়াহুড়ো? আমি তো তো পালিয়ে যাচ্ছি না।’

উনাদের শুনে কিছু বলার ইচ্ছেটা ম/রে গেছে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। মাত্র কয়েকদিনে কাছের মানুষরাও বদলে গেছে।
সবাইকে কেমন অচেনা মনে হচ্ছে। মনের কথা মনে চেপে,
স্পর্শী সবার সঙ্গে কথা বলে কল কেটে জানালা পাশে গিয়ে দাঁড়াল। অভিমান নিয়ে তাকিয়ে রইল দুর আকাশের পূর্ণিমা চাঁদের দিকে। কি সুন্দর তার রুপ! সৃষ্টিকর্তা নিজে বানিয়েছে চাঁদকে আর দু’হাত ভরে ঢেলে দিয়েছেন এমন দৃষ্টিজুড়ানো সৌন্দর্য। আকাশের চিরসঙ্গী হিসেবে আছে তারা এবং চাঁদ। কিন্তু আকাশের কাছে কে বেশি আপন, চাঁদ নাকি তারা? সে কাকে ভাবে আপন ভাবে? চাঁদের দিকে তাকিয়ে যখন সে নিজের ভাবনায় মগ্ন তখন রুদ্র রুমে প্রবেশ করল। কাফি কাজ সেরে চলে গেছে। রুমে ঢুকে রুম অন্ধকার দেখেও সে লাইট জ্বালালো না বরং হেঁটে স্পর্শীর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু স্পর্শী তাকিয়ে দেখল না বাক্য বিনিময়ও করলো না।
তখন রুদ্র আকষ্মিক পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে থুতনি ঠেকালো। আচানক ঠোঁট ছোঁয়ালো গ্রীবাদেশে তাও
স্পর্শী অনড়, র্নিবাক। তার দৃষ্টি চাঁদের দিকেই নিবদ্ধ। চোখ অশ্রুবিদ্ধ। ওর এমন স্থিরতা সহ্য হলো না রুদ্রর। সে স্পর্শীর কোমর জড়িয়ে ধরে আরো কাছে টেনে নরম স্বরে বলল,

-‘মন খারাপ? বকেছে মেজো মা?’

-‘না।’

-‘তাহলে চুপ কেন?’

-‘এমনি।’

-‘ক্ষুধা লাগে নি, খাবি চল।’

-‘ইচ্ছে করছে না।’

স্পর্শীর কম্পিত কন্ঠস্বর শুনে রুদ্রর হাতের বাঁধন আলগা হলো। স্পর্শীর ছেড়ে দিয়ে অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল স্পর্শীর মুখপানে। বোঝার চেষ্টা করলো তার মনের কথা
এবং আন্দাজও করলো কিছুটা। সেই সঙ্গে প্রয়োজন বোধ করলো আজ খোলাখুলি ভাবেই কিছু কথা বলার। নিত্যদিন এই কাহিনী ভালো লাগবে না। মনে মনে কিছু কথা গুছিয়ে বলল,

-‘ স্পষ্টভাবে আজ কিছু কথা বলি মন দিয়ে শুন। যা বলবো আগে শুনবি, বুঝবি, ভাববি তারপর জবাব দিবি।’

-‘হুম।’

-‘পূর্বের সম্পর্কের রেশ ধরে আমাকে বিচার করিস না। যদি করিসও তাহলে ফলাফল ভালো হবে না। তুই এখন আমার বউ। একজন স্বামী তার বউকে যেভাবে কাছে চায় বা পায় আমিও তোকে সেভাবেই চাই। রাইট, সেভাবেই চায় তোকে।
একচুল ছাড় নেই, পাবিও না, পাওয়ার আশাও করিস না। এর কারণ দিনের পর দিন পাশে বউ থাকা সত্ত্বেও ব্যাচেলর জীবন কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমিও পূর্ণতা চাই, সাধারণভাবে বাঁচতে চাই। বিয়ে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই তোকে না। কারণ আমি পূর্বের সম্পর্কের কাঁ/টা/কু/টি কবুল বলার সঙ্গে সঙ্গে করে ফেলেছি। এখন অবধি স্মরণও হয় নি তুই বোন ছিলি। বর্তমানে তোকে বোন ভাবাও হারাম। কারণ আমরা এখন বৈধভাবে হাজবেন্ড-ওয়াইফ। হাজবেন্ড
হিসেবে তোর কাছে গেলে এটা ভাবিসও না ভাইয়া এসেছে।
তাহলে পাপের ভাগিদার তুইও হবি সঙ্গে আমিও। সম্পর্কটা সহজভাবে ভাব দেখবি মেনে নেওয়া সহজ হবে। তোর কাছে মনে হচ্ছে এই সম্পর্কটা বোঝা কারণ তুই এখনো ভাইয়ার আসনেই রেখেছিস আমাকে। যেটা উচিত হচ্ছে না তোর।
বিয়ে যখন হয়েছেই, আমি তোর কাছে আসবোই, সেটা তুই চাইলেও আর না চাইলেও। আর যখনই কাছে আসব তখন পূর্বের কথা মাথায় আনিস না। তাহলে কোনোদিন সম্পর্কটা
সহজভাবে নিতে পারবি না। এখনকার মতোই বোঝা মনে হবে আজীবন। যেটা মঙ্গলজনক হবে না আমাদের কারোর জন্যই। তুই আমাকে নিয়ে ভাব, একবার নয় হাজারবার ভাব, তবে হাজবেন্ড হিসেবে অন্য সম্পর্কের রেশ ধরে নয়।’

রুদ্রর কথা শেষ হতেই স্পর্শী ডুকরে কেঁদে উঠলো। কান্নার দমকে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। আগ বাড়িয়ে রুদ্রও
কিছু বলল না বরং তাকে স্বাভাবিক হওয়ার সময় দিলো। কিয়ৎক্ষণ পর, সত্যি সত্যিই নিজেকে সামলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই সে বলল,

-‘ যদি তোমার সঙ্গে আগে থেকেই প্রেমের সম্পর্ক থাকতো তাহলে মেনে নেওয়া অনেকটা সহজ হতো। যদি তুমি বিয়ের আগে থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরতে, কিস করতে, তাহলেও তোমার কাছে আসা নিয়ে সমস্যা থাকতো না। কাজিন লাভ নিয়ে কত গল্প হয়, নাটক হয়। নায়ককরা যেমন যেমন করে তুমি তো কখনো তেমন করো নি। সর্বদা নিজের ভাইয়ার মত
আগলে রেখেছো। আর আমিও তোমাকে নিয়ে সেসব কিছু ভাবি নি। যখন মাশুমের সঙ্গে কথা বলতাম তখন আমার ফ্রেন্ডরা বলতো, ‘রুদ্র ভাইয়ার মতো প্রিন্স থাকতে নর্দমায় কেন ডুবছিস? যেখানে রুদ্র ভাইয়ার রাজ্যেই তোর বসবাস সেখানে মাশুমের মতো ছেলেকে নিয়ে ভাবিস কেন রুচিতে?’
ওদের কথা শুনে মনে মনে তাওবা করতাম। ভুলেও ভাবতাম না এসব নিয়ে। কারণ তোমাকে আপন ভাইয়ার মতো ভাবি।
তাহলে এখন তুমিই বলো মাত্র দু’দিনের ব্যবধানে সেই আমি বস্ত্রহীনভাবে কীভাবে তোমাকে কাছে আসার আহ্বাণ করি?
আমিও তো মানুষ! আমারও মন আছে, ভালো লাগা, মন্দ
লাগার ব্যাপার আছে। আমার কথাটাও তো ভাবা উচিত।’

একথা শুনে রুদ্র তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কপালের মাঝ বরাবর ঠোঁট ছোঁয়াল। তারপর স্পর্শীর দুই গালে হাত রেখে মিটিমিটি হেসে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। স্পর্শী তার চোখে চোখ মিলাতে পারল না দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিলে। তখনো তার চোখ দিয়ে অঝরে অশ্রু ঝরছে।রুদ্র স্পর্শীর জল থৈথৈ করা চোখের অশ্রু মুছে বলল,

-‘আগে জড়িয়ে ধরি নি, কিস করি নি, কাজিন লাভে যা যা হয় সেসব কিছুই করিনি। কারণ তখন তুই আমার ছিলি না। একটা কথা মনে রাখবি, যে সম্পর্কে নোংরামির স্থান রয়েছে
সেই সম্পর্কের স্থায়ীত্বকাল ক্ষণকালের জন্য। পবিত্র জিনিস সবসময়ই মঙ্গলজনক। তাছাড়া আমরা জয়েন ফ্যামিলিতে বড় হয়েছি। পরিবারে সদস্য সংখ্যাও কম নয়। যদি ভুলভাল কিছু করতামও তাহলে কী তাদের নজরে পড়তো না? আর পড়লে কী সবার সঙ্গে সবার সম্পর্ক ঠিক থাকতো? নিজেকে সামলেছি বলেই তোর বাবা আমার সঙ্গে তোর বিয়ের কথা ভেবেছে। খারাপ চরিত্রের হলে এমনটা ভাবতেন তিনি?’

-‘তবুও আমার…! ‘

-‘কোনো তবুও টবুও শোনা হবে না তোমার। পূর্বের কথা ভুলে সংসারে মন দাও। নিয়ম করে আমাকে জড়িয়ে ধরবা, কিস করবা, আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাবা। এইটুকু করলেই হবে বাকিটা নাহয় আমিই বুঝে নিবো। এখন চল, দুপুরে আমি খাইয়ে দিয়েছিলাম তোকে এখন তুই আমাকে খাইয়ে শোধ করবি।’

একথা বলে রুদ্র ওর হাত ধরে টানতে টানতে রান্নাঘরে নিয়ে গেল। বড় একটা প্লেটে দু’জনের খাবার বেড়ে বেডরুমে এসে বসল। রাতের খাবার রেস্টুরেন্ট থেকে এনেছে। কারণ স্পর্শী বিরিয়ানি পছন্দ করে তিনবেলায় বিরিয়ানি দিলে খুব খুশি। মন খারাপের মুহূর্তে পছন্দের খাবারে যদি মনটা ভালো হয় এই আশায় আনিয়েছে। আগামীকাল শেফ আসবে। আগে যিনি ছিলেন তিনি রুদ্রর খবরাখবর এমিলির কাছে পৌঁছে দিতো। বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা দিতো এমিলি। এজন্য উনাকে আসতে নিষেধ করা হয়েছে সঙ্গে বেইমানি করার শাস্তিও দিয়েছে। আগামীকাল থেকে যে আসবে সে কাফির বউ। চেনা জানা কাছের মানুষ। বিয়ের আগে একটা ছোটো খাটো রেস্টুরেন্টে কাজ করতো। এখন নিজের ইচ্ছায় করে না, কাফি বললেও না। এখানে আসলে স্পর্শীকে সময় দিতে পারবে, সারাদিন এখানে থাকবে, সন্ধ্যার পরপর চলে যাবে।
তাতে স্পর্শীকে সঙ্গ দেওয়াও হবে নিজের অবসর সময়টুকু কাটবে। এমন নানান দিকে ভেবে সে আর কাফি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামীকাল থেকে কাজ বাড়বে, ব্যস্ততাও বাড়বে,
বাসায় সময় দিতে পারবে না কেউই। এরচেয়ে দু’জন মেয়ে
সঙ্গে থাকলে সেইভ থাকবে আর এফ্ল্যাটে যথেষ্ট সিকিউরিটি আছে।
রুদ্র স্পর্শীর হাতে খাবারের প্লেট ধরিয়ে বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে, দিলো এক ধমক। বলছে খাইয়ে দিতে তবুও থম মেরে বসে আছে। ধমক শুনে স্পর্শী গোমড়া মুখে হাতটা ধুয়ে এসে বিনাবাক্যে তাকে খাইয়ে দিতে থাকল। রুদ্র খাচ্ছে আর ফোনের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। মনোযোগ কী
দেখছে কে জানে। তবে সেটা দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছে।
স্পর্শী রুদ্রর মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে দেখল সে ভিডিও দেখছে। ভিডিওতে একটা মেয়ে খুব কাঁদছে। উনার সামনে সাদা কাফনে আবৃত করা কারো লাশ রাখা। ওকে তাকাতে দেখে রুদ্র নিজেই ফোন এগিয়ে দিলো ভালো করে দেখতে।
মেয়েটাকে সে চিনে, নাম এমিলি। বর্তমান মন্ত্রীর পুত্রবধূ সে।
এছাড়াও আরেকটা পরিচয় রুদ্রর গফ। ভালো করে ভিডিও
দেখে বুঝলো এমিলির হাজবেন্ড মারা গেছে। সামনে রাখা লাশটাই তার বরের। এইটুকু বোধগম্য হতেই সে বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। রুদ্রর মুখের হাসি তার বিষ্ময়ের আরেকটা কারণ। একটা মানুষ মারা গেছে আর সে হাসছে। গফের বর মারা গেছে বলেই এত খুশি হয়ে নাকি কে জানে।
কেন জানি রুদ্রর হাসিটা সহ্য হলো না তার, তাই বিরিয়ানির
এলাচ লোকমার মধ্যে ঢুকিয়ে রুদ্রর মুখে দিতে গেল। কিন্তু রুদ্র ওর হাত আঁটকে দিয়ে সেই লোকমা স্পর্শীর মুখে পুরে দিয়ে বলল,

-‘আমার সঙ্গে এক প্লেটেই খা। মুখের খাবার ফেলার চেষ্টাও
করবি না। খাবার নষ্ট করা পছন্দ করি না আমি।’

স্পর্শী মুখে এলাচসমেত বিরিয়ানি নিয়ে বসে রইল। চিবুতে গেলেই ক্যাচ করে দাঁতে এলাচ পড়ে মেজাজ বিগড়ে যাবে।কার জন্য গর্ত খুঁড়লো আর কে পড়লো। একেই বলে লোহা বাঁধানো কপাল। তাকে খেতে না দেখে রুদ্র ফোনের দিকেই চোখ রেখে বলল,

-‘অতি চালাকের গলায় দড়ি। তুই চালাকি করতে গিয়ে ধরা খেয়েছিস তাই তুই একটা গরু। মুখের খাবারটুকু শেষ কর জলদি।’

-‘না প্লিজ।’

-‘ছাড় দিতে পারি তবে শর্ত আছে, শর্ত মানবি? ‘

-‘হুম।’

-‘তুই নিজে থেকে আমাকে লিপ কিস করবি, জলদি আয়।’

একথা শুনে স্পর্শী এলাচসমেত বিরিয়ানিরটুকু ক্যাচ ক্যাচ করে চিবিয়ে গিলে খেয়ে রুদ্রর মুখে খাবার তুলে দিলো। ওর কান্ড দেখে রুদ্র বলল,

-‘এভাবে ইগনোর করলি তো, একদিন এমন দিন আসবে তুই নিজে থেকে আমার কাছে আসবি আর কিস করবি স্বেচ্ছায়।’

-‘এখনই করবো যদি আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দাও।’

-‘বল শুনি।’

-‘আমি নাকি রাজনীতি?’

-‘রাজনীতি আ..। ‘

একথা বলতে দেরি কিন্তু রুদ্রর গালে থাপ্পড় দিতে দেরি হয় নি। যেন প্রস্তুতই ছিল সে। থাপ্পড় মেরে হাতে প্লেটটাও ছুঁড়ে মারল মেঝেতে। অবশিষ্ট বিরিয়ানিটুকু ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল চারদিকে। তারপরেই হিংস্র বাঘিনী ন্যায় রুদ্রর কলার চেপে ধরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল,

-‘কিছুক্ষণ আগের ভাষণ ভুলে গেছিস? আমাকে সব মেনে নিতে হবে, জোর করে হলেও সংসার করতে হবে। আর তুই রাজনীতি রাজনীতি করে ছুঁটে বেড়াবি। দিন শেষে রাস্তাঘাটে লা/শ হয়ে পড়ে থাকবি,তখন আমার কী হবে? বিধবা তকমা নিয়ে ঘুরবো আমি? রাজনীতিই যদি নিবি আমার বিয়ে কেন করেছিস? প্রতিবাদ কেন করিস নি?মেনে নে, মেনে নে, করে সব পাগল হয়ে গেছে। কেউ জিজ্ঞাসা করেছিস কেন তোকে মানছি পারছি না। তোকে মানতে না পারার আরেকটা কারণ তোর রাজনীতি। আই রিপিট, তোকে সহ্য করতে না পারার আরেকটা কারণ রাজনীতি। এই মুহূর্তেই তুই আমাকে বেছে নিবি নয়তো তোর রাজনীতি। যদি আমাকে নিস আমি তোর মনমতো হয়ে উঠবো। আর যদি রাজনীতি নিস তবে বিচ্ছেদ কেউ ঠেকাতে পারবে না। বিচ্ছেদ মানে বুঝেছিস, ডিভোর্স!
সত্যি বলছি তোকে আর ডিভোর্স দিবোই দিবো।’

To be continue…….!!

প্রেম প্রার্থনা পর্ব-০৯

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[০৯]

-‘তোমার জন্য উপহার রেখে গেলাম। ধন্যবাদ দিতে হবে না। এই রুদ্র সস্তা কারো ধন্যবাদ গ্রহন করে না।’

রুদ্রর করা মেসেজ দেখে এমিলি হাসছে। কিছুক্ষণ আগেই রুদ্রর দেওয়া উপহার এসে পৌঁছেছে তার নিকট। নিজের স্বামীর নিথর দেহ দেখে তার কষ্টও হচ্ছে না, কান্নাও পাচ্ছে না। কেন জানি নিজেকে হালকা হালকা মনে হচ্ছে। এতদিন এই সম্পর্কের বোঝা টানতে টানতে ক্লান্ত সে। রাজনীতিতে
যুক্ত হওয়ার শর্তে ইলিয়াসকে বিয়ে করতে একপ্রকার বাধ্য হয়েছিল। আর এই শর্ত দিয়েছিল ইলিয়াসের বাবা ইসমাইল হোসেন। তখন উনি মন্ত্রী, হাতে পাওয়ার ছিল, অর্থের কমতি ছিল না। তখন দুবাই ফেরত এমিলি বাংলাদেশে এসেই প্রেম পড়েছে এক দাপুটে ছেলের। তার চলতে বলনে ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়েছে সে। কিন্তু ইলিয়াস তাকে পছন্দ করে জানায় তার বাবাকে। ইসমাইল হোসেন সরাসরি প্রস্তাব দেন তাকে।
ততদিনে ওই দাপুটে নেতার খোঁজ মিলছিল না কোনোভাবে।
পরে মরিয়া হয়ে নেতার সন্ধান পেতে সেও রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ইলিয়াসকে বিয়ে করে। বাবা মা ও জন্মভূমি ছেড়ে বাংলাদেশে স্থায়ী হয়। ইসমাইল হোসেনের পুত্র বধূর পরিচয় বহন করে রাজনীতিতে ঢুকে। তারপর দিন যায়,মাস যায়, খুঁজেও পায় তার মনপুরুষটাকে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারে তার নাম ‘রুদ্র।’ নামের মতো তার মধ্যে দাপুটে ভাব আছে, কথা ও কাজের তেজ আছে। মোদ্দাকথা রুদ্রও নেতা। যদিও তখনো কেউ জানতো না এমিলির মনের কথা।
তারপর দলের এক লোক সবটা জানিয়ে দেয় ইলিয়াসকে।
আর ইলিয়াম জিজ্ঞাসা করায় অকপটে সেও স্বীকার করে।
এভাবে দিন চলতে থাকে আর ইলিয়াসের অত্যাচার বাড়তে থাকে। একথাও সত্য সে ইলিয়াসকে স্বামী হিসেবে মানতেই পারেনি। সবসময় মনে হয়েছে ইলিয়াস তার বোঝা। রুদ্র না মা/রলে হয়তো সেই মে/রে দিতো। এমিলি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে এসব ভাবছিল।তখন কল এলো তার ফোনে। কল রিসিভ করতেই কেউ একজন বলল রুদ্র বিয়ে করেছি তাও আবার চাচাতো বোনকে। ওরা দু’জন চট্টগ্রামেই আছে। একথা শুনে এমিলি তার কার্ল করা চুল কানের পাশে গুঁজে সদ্য পরা শুভ্র শাড়ির আঁচল ঠিকঠাক করে হাসিহাসি মুখে জবাব দিলো,

-‘নজর রাখো। তবে আমি না বলা অবধি কিছু করতে যেও না। নয়তো রুদ্রের হাতেই মা/রা পড়বে। সে কেমন তা বলতে হবে না নিশ্চয়ই। রুদ্রকেও হিংস্র করবো সুযোগ বুঝে, এখন নয়।’

_______/\____________/\_____________/\___________

-‘ইয়া আল্লাহ! এই অসভ্য পুরুষের মুখে লাগাম দাও আমি ফকিরের হাতে কড়কড়া বিশ টাকা দিবো।’

একথা বলে স্পর্শী দৌড়ে এসে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসল। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে রুদ্রকে দু’টো গালিও দিলো। তারপর মনে মনে আফসোস করতে থাকল ওই বে/হায়া পুরুষটাকে নিয়ে। যার কথায় সামান্য রাখ ঢাক নেই মুখে যা আসে বলে দেয়। অপরজন কে কী ভাবলো সেই ধারও ধাঁরে না। এভাবে
বলে লজ্জা দিয়ে কী মজা পায় কে জানে।তবে ছোটো থেকে দেখে আসছে রুদ্র এমন ঠোঁটকাটা স্বভাবের। একবার রুদ্রর মামাতো বোন রুদ্রর খাৎনা ছবি দেখে খুব হাসছিল। হাসতে হাসতে রুদ্রকে রাগাতে বলেছিলেন, ‘ ছিঃ! ছিঃ! রুদ্রর ইয়ে কাঁটা রে রে।’
একথা শুনে রুমভর্তি মানুষের সামনেই সে জবাব দিয়েছিল, -‘দুলাভাই কেঁটেছিল বলেই তো তুমি তাকে বিয়ে করেছিলে। এখন আমার বেলায় ‘কাঁটা রে রে’ বলে হাসছো কেন তাই তো বুঝছি না।’
ওর এমন কাঁট কাঁট জবাবে উনার কথা এবং হাসি বন্ধ হয়ে যায়। লজ্জায় নতজানু হয়ে বেচারি কোনোমতে পালিয়ে বাঁচে। তারপর থেকে উনি আর এই বাসাতে আসে নি। রুদ্রর এমন জবাব শুনে অনেকে ভয়ে কিছু বলে না। সন্মানের ভয় তো সবারই আছে। বর্তমানে এর আরো করুণ অবস্থা। যত দিন যাচ্ছে বয়স বাড়ছে ততই যেন তার কথাবার্তার লাগাম খুলে যাচ্ছে। এইতো মাস ছয়েক আগের ঘটনা। শুক্রবারের দিন। বাসায় সবাই উপস্থিত থাকায় পিঠা বানানো হয়েছিল।
বিকালবেলা পিঠা খেতে খেতে ড্রয়িংরুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে সবাই। রুদ্রও সোফায় বসে ফোন টিপছিল। কথায় কথায়
দাদীমার ভাইয়ের কথা উঠল। দাদীমার দুই ভাই। হেলাল ও বেলাল। হেলাল ছোট থাকতে পানি ডুবে মারা গেছে।বেলাল
বেঁচে আছেন, পেশায় উনি গরুর ব্যবসায়ী। একমাত্র ছেলে
বিধায় দাদীমার মা বলতেন ‘আমার একা পুতের চার বিয়া দিমু আমি। চার বউয়ের মোট ছালপাল হইব আটাশখান। হক্কলের ঘরে ছাল পাল থাকব আটটা কইরা।’

এইটুকু শুনেই রুদ্র ফোন থেকে চোখ না সরিয়ে বলেছিল,

-‘দাদীমা তোমার আম্মা সাতের ঘরের নামতা চুজ না করে সরাসরি দশের ঘরের নামতা চুজ করলেই পারত। চার সাতে আটাশ না করে সরাসরি চার দশে চল্লিশ করলেই তো রেকর্ড করতে পারত তোমার ভাইজান। আমি সেইসময় থাকলে এই বুদ্ধি দিতাম। ইস! দেরিতে পৃথিবীতে এসে মস্ত বড় ভুল গেছে আমার।’

ওর ত্যাঁড়া কথা শুনে বাকিরা হেসে উঠলেও দাদীমা মুখ বাঁকিয়ে পুনরায় বলতে থাকলেন। তারপর বেলাল মায়ের কথা রাখতে সত্যি সত্যিই চারটা বিয়ে করেছিল। তবে তার
ছেলে মেয়ের সংখ্যা মোট বিশ জন। সকলের ঘরে পাঁচটা করে ছেলে মেয়ে। একথা শুনে রুদ্র আবার ফোঁড়ন কাটল,

-‘সেই সময় কী কোনো কাজ করতো তোমার ভাই?’

-‘তখন কুনো কামই করতো না। আমার বাপের মেলা জমি আছিল। হেই খালি জমি বেঁচতো আর খাইতো।’

-‘বাহ্! এজন্যই বউয়ের পেছনে ঘুরঘুর করতে পারতো আর প্রতিবছর ট্রেনের বগির মতো বাচ্চা আমদানি করতো। তবে
কাজকাম করলে পারত না উনার শ্রাদ্বীয় আম্মাজানের কথা রাখতে। যেমন আমার বাবা- চাচারা পারে না। একটা বউ সামলেই উনাদের কাল ঘাম ছুঁটে যায়।’

রুদ্রর কথা শুনে তখন স্পর্শীর বাবা ফিসফিস করে বললেন,

-‘ওদিকের বাঁশ ওদিকেই মানাচ্ছিল। শুধু শুধু এদিকে ঘুরানোর কি দরকার ছিল বাপ?’

ছেলের কথা শুনে বড় বাবাও মুখ কাচুমাচু করছিলেন। এটা রুদ্র নিজেও খেয়াল করে বাবাকে সিরিয়াসভাবে বলেছিল,

-‘আমি আরো তিন চারটা ভাই বোনের প্রয়োজন অনুভব করছি। এত বড় বাসা, এত টাকা পয়সা, জায়গাজমি,এসব ধ্বংস করা আমার একার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি সেই দায়িত্ব পালনে গাফিলতি করে মোটেও ঠিক করো নি। তোমার টাকা পয়সা ধ্বংস করার জন্য হলেও আমি খুব তাড়াতারি বিয়ে করবো, সাত বাচ্চার বাবা হবো।ডানে, বামে, সামনে, পিছনে, এদিকে, ওদিকে, যেদিকেই তাকাবো ছানারা ডেকে উঠবে বাবা! বাবা! বাবা! তবেই না মনে হবে আমি যোগ্য পুরুষ, যোগ্য বাবা।’

একথা বলে স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে বলেছিল,

-‘এটাও তো ক’দিন পর চলে যাবে। তখন যা থাকবে সব তো আমারই। তোমরা সবাই বুড়ো বুড়ি হয়ে যাবে। বাঁতের ব্যথায় কাতরাবে, ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি করবে। তখন আমি কথা বলার জন্য লোক ভাড়া করতে যাবো নাকি? তখন এই বাসা হাসি খুশি থাকবে না মলিন হয়ে যাবে বাসার পরিবেশ।
এসব কথা চিন্তা করা উচিত ছিল তোমার। তুমি চরম ভুল করেছো বাবা, চরম ভুল।’

সেদিন মান সন্মানের ভয়ে বড় বাবাও কিছু বলতে নি। করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন সহধর্মিণীর দিকে। আর বড় মা যেন চোখের ভাষায় বোঝাচ্ছিলেন, একে শুধরানোর তার কাম্য নয়।’

পূর্বের কথা স্মৃতিচারণ করে স্পর্শী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তখন হঠাৎ তার দৃষ্টি গেল গেস্ট রুমের দিকে। দুপুরের দিকে গেস্ট রুমের দরজা খোলা থাকলেও এখন তালা মারা। কাজ টা কার বুঝতে বাকি রইল না। অথচ সে ভেবেছিল রুদ্র বের হলেই তলপি তলপা গুছিয়েই গেস্ট রুমে চলে যাবে। অন্তত রাতের ঘুমটা যেন শান্তিপূর্ণ হয় এই আশায়। কারণ রুদ্রর পাশে শুতে খুব অস্বত্বি হয়। ঘুমাতে পারে না মনে হয় রুদ্রর গায়ের উপর তুলে দিবে। আর রুদ্র ফুটবলের মতো তাকে শট মারবে। কিন্তু তার এ পরিকল্পনায় রুদ্র ছাঁই ঢেলে দিলো।

চারদিকে মাগরিবের আজান হচ্ছে। রুদ্র এখনো বের হয় নি রুম থেকে। সে রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে মন দিয়ে আজান শুনলো। আজান শেষ হতেই রান্নাঘরের দিকে হাঁটা ধরল। চোখ বুলিয়ে খাবারের সন্ধানও করলো।
কিন্তু তেমন কিছুই নজরে পড়লো না। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। দুপুরে ভাত আর চা চা পান করেছিল তারপর কিচ্ছু খাওয়া হয় নি। অথচ বাসায় থাকলে ঘুরে ফিরে কতকিছুই না খায়। না খেলে আম্মু জোর করে খাওয়ায়। আম্মুও তাকে ভুলে গেল। কল করে না, কথাও বলে না। সবাই মিলে যুক্তি করে পর করে দিচ্ছে। এসব ভাবতে ভাবতেই ফ্রিজের কাছে এগিয়ে গেল। মস্ত বড় দানব আকৃতির ফ্রিজে হাতি ঘোড়া রেখেছে নাকি দেখা দরকার। দুই পাল্লায় ফ্রিজ খুলে পুরো ফ্রিজে চোখ বুলিয়ে হাসল। বিভিন্ন ধরনের সন্দেশ, মিষ্টি, কেক, পানীয়সহ নানান রকমের জিনিসে ঠাঁসা। সবগুলোই ওর পছন্দের। রুদ্র মিষ্টি পছন্দ করে না। ওর ঝাল জিনিস পছন্দ। যাক গে, এসব ভেবে মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগের দরকার নেই। তারপর সে প্রতি প্যাকেট থেকে একটা করে মিষ্টি খেয়ে
ডাইনিং টেবিল থেকে ফল কাটার ছুরি নিয়ে সোফায় গিয়ে বসল। রেড ভেলভেট কেক। তখন সে খেয়াল করল কেকের উপর বড় বড় করে লেখা, ‘ Welcome to my life.’

কেকের উপরে লেখাটা দেখে ভাবারও সময় পেল না সে। এর আগেই রুদ্র রুম থেকে চেঁচিয়ে বলল,

-‘এখানে আমার কালো শর্ট রেখেছিলাম। ওই শর্টের কোমরে নীল রং দিয়ে ইংলিশে লেখা ছিল, ‘PERFECT BOSS.’ ওটা দেখেছিস? কই পাচ্ছি না আমি এসে খুঁজে দিয়ে যা।’

জবাবে স্পর্শী কিছুই বললো না। তবে শক্ত করে ছুরি ধরে কেকের দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষ কেক কাটে সুখ মুহূর্তের কথা স্মরণীয় করে রাখতে। কেক কাটার সময় অনেকে ভিন্ন ধরনের উয়িশ করে। আর স্পর্শী দাঁতে দাঁত চেপে মৃদু স্বরে
বলতে বলতে কেক কাটল,

-‘শর্ট তোর, পরিস তুই, আর খুঁজে দিবো আমি? তোর কোন শর্টে কী লেখা তাও মুখস্ত করে রাখতে হবে আমাকে? রুদ্র রে রুদ্র, এই যে আমি কাটছি এই কেকটা কেক না রে, কেক না, এটা তোর গলা।’

To be continue……..!!

প্রেম প্রার্থনা পর্ব-০৮

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[০৮]

-‘এত ধারে শুলে পড়ে যাবি। সরতে সরতে ওইদিকে যাচ্ছিস কেন? তাছাড়া আমি তোর পাশে শুয়েছি কাছে তো যায় নি। নাকি এভাবেই নিমন্ত্রিত জানাচ্ছিস কাছে যাওয়ার?’

-‘খোঁচা না মারলে শান্তি পান না, তাই না?’

-‘কোথায় যেন শুনেছিলাম মেয়েদের মুখ থাকে এক কথা আর এক মনে থাকে আরেক কথা। অর্থাৎ মুখে বলবে ভাত খাবো না। আর মনে প্রত্যাশা রাখবে খাইয়ে দিলেই খেতাম।
অথচ তারা সোজাসাপ্টাভাবে মনের ভাব কখনোই প্রকাশ করবে না। আর তুই তো উল্টো পথে চলা উল্টোমালি।তোর
দ্বারা এসব করা অসম্ভব কিছু নয়। এজন্য ভেবেছি হয়তোবা
সরে টরে গিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে কাছে যাওয়ার নিমন্ত্রণ জানাচ্ছিস।’

-‘এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে..! ‘

উক্ত কথাটি শুনে রুদ্র স্পর্শীকে নিজের কাছে এনে জাপটে ধরলো। পুরুষালি শক্ত হাতের বাঁধনে বন্দি স্পর্শী।আকষ্মিক কান্ডে হতবাক, হতভম্ব সে। রুদ্রর নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে তার চোখে মুখে। তার মন কেমন করা মাদকাসক্ত চাহনিতে
নাড়িয়ে দিলো অন্তঃপুর। তবে মাদকপূর্ণ চোখে দৃষ্টি আঁটকে রাখার সাহস হলো না। দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে দু’চোখ বুজে নিলো নিজের অজান্তেই। অতঃপর নিজেকে ছাড়ানোর বৃর্থা চেষ্টা করতেই রুদ্র ওর হাতের বাঁধন শক্ত করলো। তাদের দূরত্ব ঘুচিয়ে দিলো নিমিষেই। স্পর্শীর হাত তখনো রুদ্রর বুকের বাঁ পাশে। ধুকধুক ধুকপুক দামামা বাজিয়ে দ্রুত গতিতে চলছে রুদ্রর হৃদক্রিয়া। তাকে চোখ বুঝতে দেখে রুদ্র মৃদু হাসল।
তারপর আদুরে স্পর্শে স্পর্শীর একগুচ্ছ চুল কানের পাশে গুঁজে দিতে দিতে বলল,

-‘বাড়াবাড়ি তখনই হতো যদি তোকে ঠিক এভাবে টান দিয়ে আমার বুকের উপর ফেলতাম। তোর কপালের বে/পরোয়া চুলগুলো এভাবে সরিয়ে দিতাম। তোর কপালে মাঝখানে
এমন করে ঠোঁট ছোঁয়াতাম। তোর ওই কম্পিত ওষ্ঠজোড়ায়
ঠিক এভাবে বেতাল হতে পারতাম। আমি কী এমন করেছি? করি নি তো! এমন করলে ঠিক ওমন হতো আমি শুধু এটাই বোঝালাম।’

মুখে মিটিমিটি হাসি এঁটে উক্ত জবাব দিতে দিতে সেসব কর্ম
সম্পূর্ণ করেছে রুদ্র। তখনো স্পর্শী অনড় হয়ে চোখ বড় বড় তাকিয়ে আছে। বিষ্ময়তায় তার মস্তিষ্ক এখনো উক্ত ঘটনার সংকেত পাঠাতে ব্যর্থ। রুদ্রর ছোঁয়ায় যেন জমে গেছে। তার ঠোঁটে এখনো ভেজা ভেজা ভাব। এই মুহূর্তে কী বলা উচিত কী করা উচিত কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তার। অসীম বিষ্ময়
নিয়ে অনড় হয়ে আছে। তখন রুদ্র তাকে বালিশে শুঁইয়ে মুখ গম্ভীর করে বলে উঠল,

-‘আগ বাড়িয়ে এসব করেছি আমি, বল?’

স্পর্শী বোকার মতো না সূচক মাথা নাড়ালো। আর রুদ্র হাসি আঁটকাতে জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে স্পর্শীর ওড়নার এক প্রান্তে নিজের হাতে বেঁধে অপর প্রান্ত বাঁধল স্পর্শীর হাতে। যাতে সে ঘুমালে স্পর্শী উঠে কোথাও যেতে না পারে। মেয়েটা যা চঞ্চল একে বিশ্বাস নেই। তারপর হাত বাঁধার কাজ সমাপ্ত করে রুদ্র পূর্বের মতোই ঠাঁট বজায় রেখে বলল,

-‘যেহেতু এসব করিই- নি তাই অহেতুক বদনাম দেওয়া থেকে
বিরত থাক। নয়তো সত্যি সত্যিই ঘটনা ঘটিয়ে ফেললে তখন দোষ দিস না। আর বিনাঅপরাধে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে রাজি নই আমি। আশা করি বুঝেছিস আমার কথাগুলো।খুব ক্লান্ত আমি ঘুমালাম। ভুলেও নড়াচড়া করবি না। তোর নড়াচড়ার কারণে যদি ঘুম ভাঙ্গে তাহলে খবর আছে। আরেকটা কথা, এবার থেকে চায়ে কম চিনি খাবি নয়তো ডায়বেটিস বেড়ে যাবে, তোর না আমার। সেই সঙ্গে এটাও জেনে রাখ, কবুল বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি তোর ভাইয়ের চরিত্র থেকে রিজাইন করেছি। বর্তমানে আছি স্বামী চরিত্রে। আর এখন থেকে এই চরিত্রই বহাল থাকবে।’

নিজের কথা শেষ করে রুদ্র পাশ ফিরে শুয়ে চোখজোড়া বন্ধ করে নিলো। অথচ তার ঠোঁটের কোণে মিটিমিটি হাসি।
স্পর্শী নিজেকে সামলে জবাবে কিছু বলবে কিন্ত তাকে সে
ভাবার অবকাশও দিলো না। নিজের কথা আর কাজ সমাপ্ত করে তাকে এড়িয়ে গেল। বিষ্ময়ভাব এখনো কাটে নি তার। রুদ্রর করা কাজে হতভম্ব হয়ে কথার খৈই হারিয়ে ফেলেছে।
যেসব কল্পনাও করে নি আচমকা তেমন কিছু’ই ঘটে গেছে।
তাও কী না অপছন্দের মানুষটির থেকে। স্পর্শীর ঠোঁটে হাত রেখে আড়চোখে তাকালো রুদ্রর পানে। পুরো শরীর অবশ অবশ লাগছে তার। নিঃশ্বাস নিতেও যেন ভুলে গেছে। এমন অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত নয় সে। কোনোদিন এমন ছোঁয়াও
পায় নি ষোড়শী শরীরে। কোনো পুরুষ এতটা কাছে আসে নি ভুলক্রমে। এজন্যই বুঝি রেশ কাটিয়ে উঠতে পারছে না সে। তারপর সে আর কিছু ভাবলো না রুদ্র যেভাবে তাকে শুঁইয়ে দিয়েছে ঠিক সেভাবে শুয়েই চোখজোড়া বন্ধ করে নিলো।
চোখ বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে গেল কয়েকফোঁটা নোনাজল। ভীষণ অভিমান হলো নিজের বাবা- মায়ের প্রতি। বুক ভেঙে কাঁদতে চাইলেও পারলো না।
জানালার বন্ধ করে পর্দা টানা বিধায় আলো বাতাস আসছে না রুমের মধ্যে। এসির কারনে রুদ্র সব বন্ধ করে দিয়েছে।
স্পর্শী উঠতে গেলে হাতে বাঁধা ওড়নায় টান লাগল। বাড়তি কথা বাড়ানোর ইচ্ছে হলো না তাই শুয়ে পড়লো পাশ ফিরে।
আর স্মৃতিচরণ করতে লাগল কিছু সুখ মুহূর্তের কথা।ওদের
‘ছন্দনীড়’ নামের বাড়িতে ছন্দের শেষ নেই। নিত্যদিন নানান
ছন্দে অতিবাহিত হয় তাদের বাড়ির প্রত্যেক সদস্যের। কতই না মধুর সেই দিনগুলো।মেয়ে বলে কখনো আঁটকে রাখা হয়
নি তাকে। সর্বদায় স্বাধীনভাবে চলছে তার মর্জিমতো।বাসার
ছোট সদস্য হিসেবে প্রত্যেকেই ভীষন ভালোবাসেও তাকে।সকলের কাছে তার আবদারের ঝুলি খোলা শুধু রুদ্র বাদে।
বুঝ হওয়া থেকেই রুদ্রকে অপছন্দের লিস্টে যুক্ত করেছে।
তার রুদ্রই একমাত্র ব্যক্তি যে তাকে শাসন করে, সব কাজে বাঁধা সৃষ্টি করে। এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না, একা কোথাও যাওয়া যাবে না, সর্বদা এমন ধরনের ফরমান জারি করতো। তাই তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতো। কিছু দিলে সে নিতে চাইত না আর নিলেও কখনো ব্যবহার করতো না।
যেহেতু সে অপছন্দের ব্যক্তি সে কিছু দিলেও আপনাআপনি সেই জিনিস অপছন্দের লিস্টে যুক্ত হতো। এভাবে দিনকাল
চলতে থাকলো নিজ নিয়ম। কিন্তু বিগত বছর দুয়েক আগে থেকে রুদ্রকে ভীষণ ভয় পাওয়া শুরু করলো। সে আর ওর মা গিয়েছিল ইদের শপিং করতে। রোজার মাস! তখন বেলা সাড়ে এগারোটা হবে। কেনাকাটা সেড়ে ক্লান্ত হয়ে ফিরছিল তখন একদল লোক তাদের গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। সে ঊঁকিঝুঁকি মেরে দেখতে থাকে মুখোশ পরা লোকগুলোকে।
কিন্তু তার মা ভয়ে মেয়েকে জাপটে ধরে কল করতে থাকে রুদ্রকে আর ড্রাইভারকে বলে কথা বলে কোনোভাবে তাদের আঁটকে রাখতে। কিন্তু ড্রাইভার কিছু বলার আগেই লোহার কিছু দিয়ে তারা গাড়ির কাঁচ ভেঙে ফেলে। সেই কাঁচ ছিঁটকে এসে গেঁথে যায় তার কপালে আর হাতে। সঙ্গে সঙ্গে মরিয়ম বেগম আর্তনাদ করে কেঁদে উঠেন। ততক্ষণে লাল রক্ত ঝরে পছন্দের সাদা বারবি ড্রেসে ফোঁটা ফোঁটা রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেছে। সে তখনো বিষ্ময় নিয়ে দেখছিল লোকগুলোকে।ঠিক তখনি এক লোক গাড়ির দরজা খুলে তাকে বের করে আনে আর ঠাটিয়ে থাপ্পড় বসিয়ে দেয় তার দুই গালে। সে নিজেকে সামলাতে পারে না ছিঁটকে পড়ে মাটিতে। চোখজোড়া ঝপসা হতে থাকে আপনাআপনি। চারদিকে ঘোর অন্ধকার। কানে এসে বিঁধছে মায়ের করা আহাজারি। তবে চোখজোড়া বন্ধ হওয়ার আগে স্বাক্ষী হয় আরেকটা বিভৎ/স কাহিনির। সে চোখ বন্ধ করা আগে তার কাছে ছিঁটকে আসে কারো কা/টা হাত। সম্ভবত যে তাকে থাপ্পড় মেরেছে তার। কারণ সে ব্যক্তি
তার থেকে দুই হাত দুরে মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। এমন দৃশ্য সহ্য করতে পারল না সে। গা গুলিতে ওঠে। মাথা ঘুরতে থাকে। তবে চোখ বন্ধ হওয়ার আগেই ঝাপসা চোখে দেখতে পায় রা/মদা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা অচেনা রুদ্রকে। যার চোখে মুখে র/ক্তের ছিঁটা। ভয়ংকর মুখের আদল। সে কচু কা/টার মতো কুপাতে থাকে এগিয়ে আসা মুখোশধারীদের। এরপরে
কী হয়েছিল মনে পড়ে না কারণ ততক্ষণে সে অবচেতন হয়ে পড়েছিল। যখন সেন্স ফিরে শুনে রুদ্র নাকি জেলে। কবে সে
ছাড়া পাবে ঠিক নেই। কিন্তু এই ঘটনার আট ঘন্টার পর রুদ্র বাসায় ফিরেছিল। আর বরাবরের মতো তাকে খোঁচা মেরে বলেছিল,

-‘আজকে থেকে এর বাইরে যাওয়া বন্ধ। যে সামান্য ঘটনার সম্মুখীন হতে পারে না তাকে বাইরে যাওয়া মানায় না, ননীর পুতুল একট। মেজো মা নতুন আরেকটা বারবি ড্রেস এনেছি ওকে পরিয়ে আলমারিতে তুলে রাখো।’

সেদিন রুদ্রর কথায় কড়া জবাব দিতে গিয়েও থেমে গেছে।
বিশেষ করে মরিয়ম বেগমের ইশারায় নিজেকে সামলেছে।
এই ঘটনার পরপর বাসার সবাই আরো সাবধান হয়ে গেল।
রুদ্রর কড়া আদেশে তারও একা একা বাইরে যাওয়াও বন্ধ হয়ে গেল। স্কুলে গেলে রুদ্র রেখে আসত আর মরিয়ম বেগম নিয়ে আসতেন। স্কুল টিচারের কাছে টিউশনি করতো সেটাও অফ। আর তাকে পড়ার দায়িত্ব নিলো রুদ্র আর বড় বাবা।
এভাবেই দিন কাটতে লাগল। আর যত দিন অতিবাহিত হতে থাকল রুদ্রের উপরে সেও বিরক্ত হতে থাকল। বন্দী জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। এটাকে বেঁচে থাকা বলে? যে রাজনীতি আপনজনের বিপদ ডেকে আনে সেই রাজনীতি করার কী দরকার? রাজনীতি করতেই হবে এর কোনো মানে আছে?
যারা করে না তারা কী বাঁচে না নাকি পৃথিবীতে ঠাঁই পায় না।কিন্তু এসব কথা বলার সাহস হতো না। বললেই আস্ত গিলে খাবে রুদ্র। কী দরকার ষাঁড়কে খোঁচা মেরে গুঁতো খাওয়ার।

তবে এ ঘটনার তেইশ দিনের মাথায় রাতের বেলা বড় বাবার উপর হামলা হয়। উনার রক্তাক্ত দেহখানা ফেলে রেখে যায়
বাসার মূল ফটকে। সেদিন দাদীমা ছেলের অবস্থা দেখে বড় মাকে অনেক কথা শুনিয়েছিলেন। বাদ যায় নি রাগী রুদ্রও।
তারপর রুদ্র সিদ্ধান্ত নেয় চট্টগ্রামে আসার আর আসেও সে সপ্তাহ খানিক পরেই। তারপর থেকেই সে এখানে একা থাকে
এত বড় ফ্ল্যাটে। তবে রাজনীতি ছাড়ে নি। বরং এখানে এসে দ্বিগুন চ্যালা চামুন্ডা জুটিয়ে রাজনীতির পদ পূর্বের চেয়েও
শক্তপোক্ত করেছে। নেতা হয়েছে নেতা। আর বর্তমানে এই নিষ্ঠুর নেতার সঙ্গেই তার জীবন জড়িয়ে গেছে। এসব ভেবে সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পাশ ফিরতেই রুদ্রর চোখে চোখ পড়ে। হয়তো জেগেই ছিল এতক্ষণ। রুদ্রকে তাকাতে দেখে স্পর্শী এবার নিজেই মুখ খুললো,

-‘একটা কথা বলি?’

-‘শুনতে ইচ্ছে করছে না পরে বলিস।’

-‘এখন বলতে না পারলে পরেও বলবো না।’

-‘আচ্ছা বল।’

-‘তুমি কী আমাকে ভালোবাসো?’

-‘বউ ভালোবাসার জিনিস না ঠেঙানোর জিনিস। যতক্ষণ এদের ঠেঙানো যাবে এরা ততক্ষণই ভালো থাকবে। এতক্ষণ
পাশ ফিরে কল্পনা জল্পনা করে এখন আমাকেই কথার প্যাঁচে ফেলার ফন্দি এঁটেছিস। ভেবেছিস কিছুই বুঝবো না আমি?
ভালোই ভালোই বলছি ভুল ভাল চিন্তা ঝেড়ে ফেল। নয়তো
উল্টো করে ঝুলিয়ে মাথার ভূত ছাড়িয়ে দিবো। আর কী কী বললি তোকে ভালোবাসি না কি যেন? তুইই এটা বল তোকে ভালোবাসতে যাবো কোন দুঃখে? দেশে কী মেয়ের অভাব পড়েছে?’

রুদ্রুর অপমানজনক কথা শুনে স্পর্শী উঠে বসল। এক হাতে চোখ মুখে কান্নারত কন্ঠে জবাব দিলো,

-‘তাই তো! কখনো মিথিলা, কখনো রুমানা আবার কখনো এমিলি। তোমার জীবন মেয়ের অভাব আছে নাকি? থাকবে কেন তুমি তো সাধু পুরুষ। কে প্রেম করলো, কে কার সঙ্গে বেড়াতে গেল, কে উপুড় হয়ে নিচ থেকে জিনিস তুললো, কে ওড়না ছাড়া তোমার সামনে এলো সব খবরই থাকে তোমার কাছে। তুমি তো জ্ঞানী, জ্ঞানীর জ্ঞানী মহাজ্ঞানী।’

-‘আশ্চর্য, গফের সঙ্গে নাহয় প্রেম করেছি ঠিক আছে। কিন্তু গফের মায়ের সঙ্গে কবে প্রেম করলাম ?’

একথা শুনে শুনে স্পর্শী রেগে দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিলো,

-‘গফের মায়ের সঙ্গে প্রেম করেছো একথা কখন বললাম আমি।’

-‘এমিলির মায়ের নামই তো রুমানা। তুইই তো বললি কখনো মিথিলার সঙ্গে প্রেম করি, কখনো রুমানা আবার কখনো
এমিলি, একথার মানে তো তাইই দাঁড়ায়।’

এই টপিক বাদ দিয়ে স্পর্শী উঠে চুল আঁচড়ে নিলো। রাগের চোটে তার নাকের পাটা ফুলে আছে। কোনোমতে চুলের জট খুলে চুলের কাঁটা দিয়ে চুল উঁচু করে বেঁধে নিলো। এসি অফ করে একটানে জানালার আকাশি পর্দা সরিয়ে দিলো।বাইরে তখন গোধূলির আলোমাখা আকাশপট। সূর্য্যিমামা বিদায় নেওয়ার পায়তারা করেছে। দলে দলে পাখিরা ফিরে যাচ্ছে আপন নীড়ে। একটা কাক জামগাছের ডালে বসে রক্ষ কন্ঠে কা কা করেই যাচ্ছে। সঙ্গী হারিয়ে ফেলেছে নাকি কে জানে।
একটা প্লেন উড়ে যাচ্ছে দূর আকাশপথে। সাদা সাদা ধোঁয়া উড়িয়ে যেন উপস্থিতি জানান দিয়ে যাচ্ছে। সামনেই একটা বিশাল বড় মাঠ। একদল যুবক সেখানে ফুটবল খেলছে। পথচারীরা হেঁটে যাচ্ছে যার যার কর্মে। বাইরের আবহাওয়া দেখে স্পর্শী উদাস কন্ঠে বলল,

-‘তুমি কি এখন বাইরে যাবে?’

-‘হুম।’

-‘আমিও তোমার সঙ্গে যাব। এবার থেকে তুমি যেখানে যাবে আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবে। আমি একা একা বাসায় থাকব না। বিয়ে যখন করে়ছো প্রয়োজনে বুকপকেটে নিয়ে ঘুরবা, তবুও সঙ্গেই রাখবা।’

-‘আচ্ছা তবে আয় কোলে আয়।’

-‘না, না, কোলে উঠাতে হবে না।’

-‘উহুম তা বললে তো হবে না। আমাদের একসঙ্গে পথচলা এই মুহূর্ত থেকেই শুরু হবে। এখন তোকে আমি কোলে নিয়ে ওয়াশরুমে যাব। চল আয় আয় এত সময় দেওয়া যাবে না, প্যান্ট ভিজে যাওয়ার সম্ভবনা আছে। তখন কিন্তু তোকেই দিয়েই প্যান্ট ধোঁয়াবো বলে দিলাম। এসো বউপাখি কোলে এসো আমার, চলো যায়, একসঙ্গে ওয়াশরুম ভ্রুমন করে আসি।’

একথা বলে রুদ্র চট করে উঠে আড়মোড়া ভাঙল। তারপর ঠোঁটে ফিচেল হাসি এঁটে এগিয়ে গেল স্পর্শীর দিকে। তার এগোনো দেখে স্পর্শী দৌড়ে পালালো। তাকে পালাতে দেখে রুদ্র বলল,

-‘ তোমার সঙ্গে ওয়াশরুম ভ্রমনের বাসনা এভাবে অপূর্ণ রেখে যেও না বউ। স্বামীর আদেশ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে হয়। এসো এসো জলদি এসো।’

রুদ্রর কথা শুনে স্পর্শী দৌড়ানো অবস্থায় চেঁচিয়ে বলল,

-‘ইয়া আল্লাহ! এই অসভ্য পুরুষের মুখে লাগাম দাও আমি ফকিরের হাতে কড়কড়া বিশ টাকা দিবো।’

To be continue……..!!

প্রেম প্রার্থনা পর্ব-০৭

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[০৭]

-‘জানি। আর এই খারাপ মানুষটার সঙ্গেই তোকে থাকতে হবে, ভালোবাসতে হবে। বাকিটা পথ এই খারাপ মানুষটার সঙ্গেই পাড়ি দিতে হবে।’

একথার প্রত্যুত্তর করলো না স্পর্শী। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আঁটকানোর বৃর্থা চেষ্টা করলো। তবে শেষ রক্ষা হলো না তার নেত্র বেয়ে গড়িয়েই দু’ফোঁটা অশ্রুকণা।।চাপা কান্না আঁটকানোর দমকে সে হেঁচকি তোলার মতো ফুঁপিয়ে উঠল। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরায় ঠোঁটে দাঁতের দাগটাও ফুঁটে উঠেছে। ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরে স্পর্শীর কান্না দেখে রুদ্র রাগ নিয়ন্ত্রণ করে নিলো। এই মুহূর্তে কড়া কথা বলবে না সিদ্ধান্ত নিলো। তবে কিছু কথা না বলেও থাকতে পারবে না তাই স্পর্শীর কান্নারত মুখপানে দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘আজ কয়েকটা কথা বলি মন দিয়ে শোন। যে কথাগুলোয় একটা শব্দও মিথ্যা নয়। বরং আমার দিক থেকে সদাসত্য।
বিয়ের আগে ভুলেও কখনো তোর দিকে কু- নজরে তাকায় নি, কখনো না। এমনকি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তোকে ওড়না ছাড়া দেখলেও দৃষ্টি সংযত করে নিয়েছি। এমন ভাব করেছি তোকে দেখিই না। এমনও হয়েছে আমি বসে আছি তোর হাত থেকে কিছু পড়ে গেল। তুই সাবধানতা অবলম্বন করা দূর উপুড় হয়ে সেটা তুলে নিয়ে নিজের কাজে মন দিতি।কে
সামনে আছে, কার নজর কেমন কখনো পরখও করিস নি।
উপুড় হয়ে জিনিস তোলার ফলে ফলস্বরূপ কী ঘটতো আশা করি বলা লাগবে না। তবে প্রথম যেদিন এই ঘটনার সম্মুখীন
হয়েছিলাম সেদিন নিজেকে ছোট লাগছিল। অথচ এখানেও আমার দোষ ছিল না। তারপর থেকে যখন’ই বুঝতাম এমন
ঘটনা ঘটবে/ঘটতে পারে তখন’ই তোকে ধমকে থামিয়েছে নয়তো নিজেই সরে গেছি। অথচ তুই এই ধমাকানোর কারণ
হিসেবে দাঁড় করেছিস তোকে অকারণে বকাবকি করি। সহ্য করতে পারি না তোকে। আর এসব কেন করতাম জানিস?
কারণ তখনো আমাদের সম্পর্ক ছিল চাচাতো ভাই-বোনের।
আর ভাই-বোনের সম্পর্ক হচ্ছে পবিত্র একটা সম্পর্ক। হোক সেটা চাচাতো ভাই-বোনের। এসব ভেবেই ভুলেও নোং/রা চিন্তার ঠাঁই দেই নি। কিন্তু বর্তমানে আমাদের সম্পর্কের বদল ঘটেছে। এক সম্পর্কের রেশ ধরে আরেকটা মজবুত সম্পর্কে পর্দাপণ করেছি।বর্তমান সম্পর্কের জোরে তুই আমার, মানে
পুরোটাই আমার। তোকে বৈধভাবে আমার নামে দলিল করা হয়েছে।এখন তোর উপরে পরিপূর্ণ অধিকার আছে আমার।
এখন আমার সামনে ওড়না না পোশাকহীনভাবে থাকলেও সেটা হালাল। তাই বলছি সম্পর্কের মানে বোঝার চেষ্টা কর। সন্মান দিতে শিখ। মস্তিষ্কে এটা গেঁথে নে আমিই তোর সব।
পেছনে ফেলে আসা ঘটনাগুলো এখন অতীতমাত্র। অতীত ভেবে বর্তমান নষ্ট করিস না। সেই সঙ্গে এটাও মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে নে, প্রতিটা ঘটনার পেছনে একটা হেতু থাকে। তবে সর্বদা যে সেই হেতু নেগেটিভ কিছু’ই হবে এটা ভাবা মূর্খতা।
এতদিন আমাকে চাচাতো ভাই রুপে জেনেছিস এবার স্বামী রুপে রুপান্তরিত হতে দে। সম্পর্ক তো কোনো দ্রুতগামী ট্রেন নয় যে, বুলেট গতিতে শরীক না হলে মিস হয়ে যাবে।’

-‘আগের সম্পর্কটাই ভালো ছিল। এই সম্পর্কের বোঝা টানা খুব কষ্টকর। তাছাড়া তুমি চাচাতো ভাই হিসেবে বেস্ট হলেও স্বামী হিসেবে খুব’ই খারাপ। মোদ্দাকথা, স্বামী চরিত্র তোমার জন্য বড্ড বেমানান।’

-‘স্বামী হিসেবে এমন কোনো আদেশ করেছি তোকে? নাকি তুই স্বামী হিসেবে সেই সন্মানটুকু দিয়েছিস?আমি তো বলছি না মনের বিরুদ্ধে জোর করে বউয়ের অধিকার পালন কর। এটাও বলছি না আমার অধিকার আমাকে বুঝিয়ে দে। তবে এত হাইপার হচ্ছিস কেন তাই তো বুঝছি না।’

-‘সত্যিই বুঝছো না নাকি না বোঝার ভাণ করছো?’

-‘যা বলবি ঝেড়ে কাশ।’

-‘কিছু না। আমাকে বাসায় পাঠানোর ব্যবস্থা করো। আমি থাকবো না এখানে।’

-‘আর কিছু? ‘

-‘না।’

-‘এই অনুরোধ গ্রহনযোগ্য নহে, ধন্যবাদ। ‘

একথা বলে রুদ্র এঁটো থালা নিয়ে বেরিয়ে গেল। আর স্পর্শী
নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে দেখল। কী বলবে, কী করবে, বোধগম্য হচ্ছে না তার। যাকে কখনোই তেমন নজরে দেখেই নি তাকে নাকি স্বামী হিসেবে গ্রহন করতে হবে? তার সঙ্গে এক রুমে এক বিছানায় থাকতে হবে। অপরিচিত কেউ হলে ব্যাপারটা এত কঠিন লাগতো না। রুদ্রকে দেখলেই অস্বস্ত্বিতে আকঁড়ে ধরছে। রাগে শরীর পিলপিল করছে। না চাইলেও মুখ দিয়ে যাচ্ছে তাই বেরিয়ে যাচ্ছে। পরে নিজের কাছে নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। তখন ওর ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে রুদ্র রুমে ফিরে এলো। পরনে শার্ট খুলে বিন ব্যাগের উপর রেখে গালি গায়ে ঘুরে ফিরে কীসব নিলো। তারপর শুভ্র তোয়ালে গলায়
জড়িয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াল। এখানেই আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করার মতো, এখানে রুদ্রর জায়গা অচেনা কেউ হলে তার সামনে চট করে শার্ট খুলে সে লজ্জা পেতো। মুখে রক্তিম আভা দেখা দিতো। কিন্তু এতবার রুদ্রকে খালি গায়ে দেখছে যে ফিরে তাঁকাতেও ইচ্ছে করে না। লাজলজ্জা
তো দূরের কথা। যেখানে নতুন অনুভূতি নিয়ে সংসার জীবন শুরু করার কথা। সেখানে বিরক্তির ছাড়া কোনো কিছুই তার নজরে পড়ছে না। এসব নানান ভাবনায় নিজেকে ডুবিয়ে সে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর চিন্তা ভাবনা করেই ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়াল।।অতিরিক্ত কান্না ফলে চোখ, মাথা, ব্যথায় টনটন করছে। এক কাপ চা পেলে মন্দ হয় না। একথা ভেবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রান্নাঘরে প্রবেশ করলো।দৃষ্টি বুলিয়ে দেখে
নিলো রুদ্রর ঝকঝক তকতকে রান্নাঘর। তারপর প্রিয় গান গুনগুন করতে করতে চা বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করলো।
রুদ্র গোসল সেরে রুমে চোখ বুলিয়ে দেখে স্পর্শী রুমে নেই। বেলকনিতে উঁকি মেরেও দেখে নেই। চায়ের স্মেল আসছে। সম্ভবত তারই রান্নাঘর থেকে। সে ধীর পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে দেখে স্পর্শী চা বানাচ্ছে।ওকে দেখে রুদ্র ডাইনিংয়ের চেয়ার টেনে খেতে বসলো। হটপটে খাবার রাখা। রুদ্র নিজে রান্না করার সময় পায় না তাই একজন রাধুনি আসে। রাধুনি মাঝবয়সী এক পুরুষ। রান্নার হাত চমৎকার। আজকে মেনু
সর্ষে ইলিশ, আলু ভাজা, ঘন ডাল আর ভাত। সঙ্গে আছে
একফালি লেবু। ওকে তৃপ্তি নিয়ে খেতে দেখে স্পর্শী মুখ ভেংচিয়ে কাপে চা ঢালছে। পানি বেশি দেওয়াতে এক চা বেশি হয়েছে। সেটা দেখে স্পর্শী গমগমে সুরে বলল,

-‘এক কাপ চা রেখে গেলাম। কেউ চায়লে খেতে পারে।’

-‘ভাতের প্লেটেই ঢেলে দে। ভাতের সঙ্গেই মেখে খায়। ‘

-‘এজন্যই কথা বলতে ইচ্ছে করে না।’

-‘কে বলতে বলেছে?’

-‘তুমি আসলেই যাচ্ছে তাই।’

একথা বলে স্পর্শী চায়ের কাপ নিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে গেল। টিভি অন করে বসে তার পছন্দের সিরিয়াল দেখতে থাকল।
কিন্তু মন বসলো না। একের পর এক চ্যানেল পাল্টে দেখার মতো কিছুই পেলো না। বিরক্ত নিয়ে উঠে যেতেই নজর গেল রুদ্রর ফোনের দিকে। চট করে মনে পড়ে গেল আম্মুর সঙ্গে কথা বলে নি। তাছাড়া কেঁদে কেঁটে আম্মুকে ম্যানেজ করতে পারলেই কাজ হয়ে যাবে। মনে মনে এসব ভেবে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল,

-‘আম্মুর সঙ্গে কথা বলবো ফোনের লক খুলে দাও।’

-‘ছাগলের মতো ভ্যাঁ ভ্যাঁ না করে ফোনটা এদিকে নিয়ে আয়।’

-‘তুমি পিন বলো আমি খুলতে পারবো।

-‘বলা যাবে না।’

উক্ত কথা বলে দৃষ্টি তুলতেই দেখে স্পর্শী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। চোখে মুখের বিরক্তের ছাপ। তাকে দেখে ফোন নিতে হাত বাড়াতে গেলে স্পর্শী খোঁচা মেরে বলল,

-‘তুমি ভদ্র পুরুষ কোনো মেয়ে তোমার সামনে উপুড় হয়ে কিছু তুললেও তুমি তাকাও না। তাহলে ফোনের মধ্যে কী আকডুম বাকডুম রেখেছো যে পিন বলতে ভয় পাচ্ছো?’

-‘বেশি বুঝতে গেলে এমন থাপ্পড় দিবো সারাজীবনের জন্য তোতলা হয়ে যাবি। আর ফোনে পিন নয় পাসওয়ার্ড দেওয়া।আমি বললেও তোর গোবরভর্তি মাথায় মনে রাখতে পারবি না। তাই অহেতুক কষ্ট না করে ফোনটা আমাকে দে।’

-‘না, তুমি বলো আমি লক খুলবো।’

-‘ W O B.’

এমন বেখাপ্পা পাসওয়ার্ড দেখে স্পর্শী বিরক্তমুখে তাকিয়ে বেডরুমে চলে গেল। তারপর একে একে ফোনের মেসেজ , স্টোর, মেসেঞ্জার, ইন্সট্রাগ্রাম, WhatsApp থেকে শুরু করে যত এ্যাপ আছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। কিন্তু তেমন কিছুই পেল না। তারপর হতাশ হয়ে ধৈর্য্যসহকারে আরো কিছুক্ষণ ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করে ওর আম্মুকে কল দিলো। কিন্তু মরিয়ম বেগম কল ধরলেন না। বেশ কয়েকবার কল দিয়েও কাজ
হলো না দেখে মন খারাপ করে ইউটিউবে নাটক দেখায় মন দিলো। ওদিকে, রুদ্র খেয়ে প্লেট ধুতে রান্নাঘরে ঢুকতেই চোখ চড়কগাছ। মেঝেতে চিনি ও পানি ফেলে একাকার অবস্থা।
রান্নাঘরের অবস্থা দেখে মুহূর্তে তার মেজাজ বিগড়ে গেল।
এসব স্যাঁতেস্যাতে কাজকারবার মোটেও পছন্দ নয় তার।ফ্ল্যাটে একা একা থাকলেও কখনোই নোংরা করে রাখে না ঘরদোর, রান্নাঘর। অথচ এই মেয়ে দুই মিনিট বৃন্দাবন করে গেছে। তবে এটা যে স্পর্শীর ইচ্ছাকৃত কাজ বুঝতেও বাকি রইল না তার। কারণ চিনি পানি ফেলে হলুদ গুড়ো ছিঁটানো।
চায়ে হলুদের গুঁড়ো দেওয়ার প্রয়োজন নেই নিশ্চয়ই! তাহলে হলুদের কৌটা খুললো কে আর ছিঁটালো কে? কান্নাকাটির পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে মেয়েটার শয়/তানি বুদ্ধি উদয় হয়েছে।এ মেয়ে যে তাকে জ্বালিয়ে, খাঁটিয়ে, মা/রবে সেটাও অবগত সে। এভাবেই তাকে জ্বালিয়ে অতিষ্ঠ করে তোলার প্রচেষ্টায় থাকবে যাতে সে বিরক্ত হয়ে তাকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। এ বলে এই মেয়ের বুদ্ধি নেই? ষোলোআনা বুদ্ধি আছে শুধু দুষ্ট বুদ্ধি সংখ্যা একটু বেশি এই আর কী। তারপর নিজেই সব টা পরিষ্কার করে রুমে গিয়ে দেখে ফোনে নাটক দেখছে। ওকে দেখে স্পর্শী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে পুনরায় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো।
আর রুদ্র সিলিং ফ্যান বন্ধ করে এসি অন করে পাশেই শুয়ে বলল,

-‘যখন যা খেতে ইচ্ছে করবে আমাকে বলবি। আগ বাড়িয়ে রান্নাঘরে যাবি না। মনে থাকবে?’

-‘হুম।’

-‘ফোনের কাজ শেষ করে চার্জে দিবি। আমি ঘুমালাম।’

একথা বলে রুদ্র চোখজোড়া বন্ধ করে নিলো। কিন্তু কেন জানি ওর মনে হচ্ছে স্পর্শী তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সে কিছু বলবে? নাকি অন্য কোনো সমস্যা? একথা ভেবে চোখ খুলে দেখে সত্যি সত্যিই স্পর্শী দৃষ্টি তার দিকে নিবদ্ধ। ওকে তাকাতে দেখে স্পর্শী ফোনটা এগিয়ে দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। নাটক দেখবে না। ভালো লাগছে না কিছু। এ প্রথম রুদ্রের পাশে শুয়েছে। অস্বস্তিতে শরীর কাঁটা দিচ্ছে। তখন রুদ্র চোখজোড়া না খুলেই বলল,

-‘এত ধারে শুলে পড়ে যাবি। সরতে সরতে ওইদিকে যাচ্ছিস কেন? তাছাড়া আমি তোর পাশে শুয়েছি কাছে তো যায় নি। নাকি এভাবেই নিমন্ত্রিত জানাচ্ছিস কাছে যাওয়ার?’

To be continue…….!!

প্রেম প্রার্থনা পর্ব-০৬

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[০৬]

কিন্তু বিপত্তি বাঁধল পরেরদিন সকাল আটটায়। যখন ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে জানতে পারল বড় বাবা তাকে রেখে ফিরে গেছেন। এখন থেকে তাকে রুদ্রর সঙ্গেই থাকতে হবে। রুদ্র যেদিন বাসায় ফিরবে তাকে সেদিনই ফিরতে হবে।
এর আগে কেউ আসবে না তাকে নিতে। এদিকে রুদ্রও নাকি জানে না কবে নাগাদ ফিরবে। তার জুরুরি কাজ আছে। এত সময় হাতে নেই। তাই এখন থেকে তাকে এখানে থাকতে হবে
, থাকতে নাকি বাধ্য। একথা শুনে স্পর্শী রাগে দুঃখে কাঁদতে শুরু করলো। তার কান্না দেখে মনে হচ্ছে কেউ খুব মেরেছে। নিজের ফোন থাকলে আম্মুকে কল করে জানাতে পারতো।
এছাড়া সেও জানতে চায় বড় বাবা কেন এমন করলো?ঠিক কোন অপরাধের শাস্তি দিলেন? সেদিনের ঘটনার রেশ ধরে নাকি অন্য কোনো কারণে? এটা করার আদৌ দরকার ছিল কী? এসব ভাবলে তার কান্নার গতি বেড়েই যাচ্ছে। ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে একনাগাড়ে। তার ফোলা ফোলা নেত্র গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুফোঁটা। নাক ধারণ করেছে রক্তিম আভা। তারই
সামনের সোফায় বসে রুদ্র ভ্রুঁজোড়া কুঁচকে তাকিয়ে আছে।
বিরক্তমুখে তাকিয়ে আছে ছিঁচকাদুনী স্পর্শীর দিকে।সামান্য
কারণে এত কান্নাকাটির হেতু খুঁজে পাচ্ছে না সে। এতক্ষণে নিশ্চুপ হয়ে থাকলেও এবার, ইয়াক ছিঃ! বলে দাঁড়িয়ে গেল।
এতক্ষণ কান্নার চোটে স্পর্শীর সর্দি ঠোঁট ছুয়ে যাচ্ছিল। আর সে ওড়না দিয়ে মুছছিল। জর্জেট ওড়নায় নাক মোছার ফলে
নাকটা লাল হয়ে গেছে। কিন্তু এবার সে সর্দি না মুছে বা হাত দিয়ে নাক টিপে সর্দি এমনভাবে ছুঁড়েছে সেটা এসে ওর ডান পায়ের পাতায় এসে পড়েছে। স্পর্শীর এমন কাজে রুদ্র মনে মনে ‘বেযাদব’ উপাধি দিয়ে মুখে বলে উঠল,

-‘সমস্যা কি তোর? আজাইরা কান্নাকাটি করছিস কেন?’

-‘আমি থাকব না এখানে। আমাকে বাসায় দিয়ে এসো।’

-‘ কেন থাকবি না? এটা কি বাসা না?’

-‘আমি আমার বাসায় যেতে চাই। তুমি এক্ষুণি বড় বাবাকে ফোন করে আমাকে নিয়ে যেতে বলো।’

-‘আমি কি তোর বেতনভুক্ত কর্মচারী যে, যখন যা বলবি আমাকে তাই শুনতে হবে?’

-‘তুমি বড় বাবাকে কল করবে কী না?’

-‘করবো না। এই নিয়ে আর একটাও বাড়তি কথা বলবি না। রান্নাঘরে খাবার ঢাকা আছে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নে, যা।’

-‘তোমার মতো বনমানুষের জিনিস খাবোও না আর তোমার সঙ্গে থাকবোও না।’

একথা বলে সে উঠে গেস্ট রুমে গিয়ে দরজা আঁটকে বসে রইল। দুই হাঁটুর উপর থুতনী রেখে অঝরে কাঁদতে লাগল।
এত বড় বাসায় একা থাকবে কীভাবে? রুদ্র তো সব সময় বাসায় থাকবে না। তখন সময় কাটবে কীভাবে?এসব নানান
কথা ভাবতে ভাবতে সে বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকল। আর ওকে যেতে দেখে রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইল। এদিকে তার ফোনে একের পর কল আসতেই আছে। ওর বের হতে হবে। একে বাসায় একা
রেখে বাইরে গিয়ে শান্তি পাবে বলেও মনে হয় না। কিন্তু কী আর করার এছাড়া উপায়ও নেই। এসব ভেবে রুদ্র স্পর্শীকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,

-‘ ফ্রিজে কারো পছন্দের খাবার রাখা আছে। সময় পেলে সে যেন খেয়ে নেয়। আমি জরুরি কাজে যাচ্ছি। ঘন্টা দু’য়েক পরেই ফিরবো। আর ভয়ের কিছু নেই বাসাতে ভূত- পেতনী কিচ্ছু নেই। আর থাকলেও তারা রাতে বের হয়, দিনে না।’

একথা বলে সে বাইরে থেকে দরজা আটঁকে বেরিয়ে গেল।
সিঁড়ি বেয়ে নামতেই দেখা গেল কাফি দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বেচারাকে ছুটি দিয়েছিল সে। অথচ জুরুরি কাজের জন্য ছেলেটার ছুটি ক্যান্সেল করতে হয়েছে। তবুও এই ছেলের মুখে মন খারাপের ছাপ নেই৷ সে
বরাবরের হাসি মুখে এঁটে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ সে। রুদ্রকে দেখে কাফি দ্রুত
এগিয়ে এসে ফোনে কিছু একটা দেখালো। তা দেখতেই রুদ্র
দাঁতে দাঁত চেপে গাড়িতে উঠে বসল। আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে সে। আজ লিমিট ক্রস করে ফেলেছে এমিলি।
মানুষ যে এতটাও বেহায়া হতে পারে এই মেয়েকে না দেখলে জানতো না সে। মন চাই তার মুখ বরাবর থুথু ছুঁড়তে। রুদ্রুর রাগান্বিত ফেস দেখে কাফি কথা না বাড়িয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে নিজে ড্রাইভ করতে লাগল। তখন রুদ্র কাউকে ফোন করতে বি/শ্রী গালি দিলে বলল,

-‘বা**কে উল্টো ঝুলিয়ে রাখ আমি আসছি। উহুম, না! না! কেউ ভুলেও ওর গায়ে একটা টোকাও দিবি না। আমি নিজে ওর শরীরের হাড্ডিগুলো যত্ন করে গুঁড়ো গুঁড়ো করবো। কী যেন বলেছিল আমার স্পর্শীকে এক রাতের জন্য ওর কাছে পাঠাতে?খুব দম তাই ন? আজ ওর দম কতখানি তাই পরখ করব আমি।’

একথা বলে কল কেটে চোখ বন্ধ করে সিটে শরীর এলিয়ে দিলো। রাগে তার মস্তিষ্ক দপদপ করছে। যেসব কথা জানার কথা না সেসব কথায় পাঁচকান হয়ে গেছে।কিন্তু কার মাধ্যমে হলো আন্দাজ করা যাচ্ছে না। মুখ্য কথা, আয়োজন ছাড়াই ওর আর স্পর্শীর বিয়ে সম্পূর্ণ করা হয়েছিল। যেখানে নিকট আত্মীয়দের আনাগোনা ছিল না। শুধুমাত্র বাসার সদস্যদের উপস্থিত ছিল। বাসার কেউই এসব কথা ছড়াবে না, তাহলে?
হঠাৎ করে তার স্মরণ হলো বাইরের একজন সেখানে ছিল; কাজি সাহেব। যিনি তাদের বিয়ে পড়িয়েছেন। উনার থেকেই হয়তো কেউ কথা বের করে নিয়েছে। মোদ্দাকথা, ওর শুত্রুর নজর থেকে পরিবারকে নিরাপদ রাখতে সে বাসায় বেশিদিন থাকে না। বাড়ির প্রতিটা সদস্যকে সেভ করার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এমনকি স্পর্শীর স্কুলের পাশে প্রতিবন্ধী যে লোকটা বসে ভিক্ষা করে সে একজন গুপ্তচর। সন্দেহভাজন কাউকে দেখলেই লোকটা তাকে জানিয়ে দেয়। এছাড়া স্পর্শী কখন কী করে সব খবরই তার কানে এসে পৌঁছায়। এজন্যই মাত্র দু’দিনের মাথায় মাশুমের ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল। আর
সুযোগ বুঝে সাতদিনের দিন সেটা কোল্জ করতে পেরেছে।
এছাড়াও আরেকটা ঘটনা ঘটেছিল সে বাসায় থাকাকালীন।
তাদের পাশের বাসায় একটা ব্যাচেলর ছেলে ভাড়া থাকত। ছেলেটা দেখতে, শুনতে, ভদ্র দেখতে হলেও অমানুষ জাত।
সে মাঝেমধ্যেই ওই ছাদ টপকে এই ছাদেও আসতো নাকি।
আর এসে এমন এক কাজ করতো তা বলতে রুচিতে বাঁধে তার। সেদিন দুপুরে কবুতরকে খাবার দিতে ছাদে উঠেছিল সে। কড়া রোদ থাকায় আশেপাশের ছাদেও কেউ ছিল না।
কিন্তু সেই মুহূর্তে ওই ছেলেকে এই ছাদে দেখে সন্দেহও হয় তার। ছেলেটা কী করে সেটা দেখতে কৌতুহলবশত আড়ালে দাঁড়ায় সে। তারপর যা দেখে শরীরের রক্ত টগবগ করে করে ফুটতে থাকে। ছেলেটা রোদে শুকাতে দেওয়া স্পর্শীর ভেজা অন্তবার্স পকেটে ঢুকিয়ে নেয়। তারপর স্পর্শীর ওড়না গোল করে মুড়িয়ে নাকের কাছে নিয়ে জোরে শ্বাস নেয়, মুখ মুছে।
এরপর আশেপাশে তাকিয়ে ছাদ টপকে ওই ছাদে চলে যায়।
ছেলেটার কান্ড দেখে সেই মুহূর্তে কাউকে কিছু বলে নি পরে ছেলেটাকে কোথাও দেখাও যায় নি। সেদিন থেকে সে ছাদে জামা কাপড় শুকাতে দিতে নিষেধ করে দেয় তাও দাদীমার মাধ্যমে। দাদীমাকেও সে তেমন কিছু বলে নি শুধু বলেছিল,
‘আশেপাশে ব্যাচেলর ছেলেরা আছে। বাসায় জানিয়ে দাও ছাদে যেন কেউ কাপড় শুকাতে না দেয়।’
দাদীমা বুদ্ধিমতী বিচক্ষণ মানুষ কিছু আন্দাজ করেছিলেন।
তারপর বাসার কোনো মেয়ে বউ ছাদে কাপড় শুকাতে দেয় না। এসব ঘটনা সমাপ্তি হলেও আরেকটা ঝামেলার আগমন ঘটেছে। কাফি জানিয়েছে স্পর্শীর বাবা বাজার করতে গিয়ে এক্সিডেন্টের হাত থেকে বেঁচে ফিরেছে। এইতো গতদিনের ঘটনা। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এটা পরিকল্পিত। এসব ঘটনা দ্বারা স্পষ্ট কেউ তার পরিবারের উপর নজর রাখছে। ক্ষতি করার জন্য মুখিয়ে আছে।এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার স্মরণ হলো ইলিয়াসের কথা। ওদের বিয়ের পরেরদিনই ইলিয়াস মেসেজ করেছিল,

-‘ রুদ্র রাজ এতটা কাপুরুষ জানা ছিল না। নতুন বউ রেখে পালিয়ে না গেলে জানতে আরো দেরি হয়ে যেতো? কীহ্ বা করা!অক্ষম পুরুষ হইলে যা হয়। এক কাজ কর একরাতের জন্য তোর বউকে আমার কাছে পাঠিয়ে দে। আমিই নাহয় তোর বউয়ের যৌবনের সুধা পান করি।’

মেসেজের কথা স্মরণ হতেই সে ধমকে উঠল কাফিকে। দ্রুত পৌঁছাতে গাড়ির স্পিড বাড়ানোর আদেশ ছুঁড়লো। ঝাঁঝালো
ধমক খেয়ে কাফি সত্যি সত্যি গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিলো।
তারপর তারা পৌঁছে ভেতরে ঢুকে দেখে এক লোককে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা। তার নামই ইলিয়াস। বয়স একচল্লিশের
কাছাকাছি। মাথায় আধপাঁকা চুল। ভুরি দেখে মনে হয় পাঁচ কী ছয় মাসের গর্ভবতী। কারো উপস্থিত টের পেয়ে ইলিয়াস দু’চোখ খুলে তাকায়। উল্টো করে ঝুলার ফলে মাথা ঘুরছিল তার, এখনো ঘুরছে। কিন্তু চোখ খুলে তাদের দেখে ইলিয়াস
গালির বর্ষণ ছুঁড়লো। কিন্তু যখনই মা তুলে গালি দিতে গেল
তখনই রুদ্র তার গলা বরাবর ছুঁরি গেঁথে দিলো।ইলিয়াস গোঁ গোঁ শব্দ করে অসহ্য ব্যথায় কাঁতরাতে লাগল। তার গলার রক্ত গড়িয়ে চুল দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা করে পড়তে পড়তে মাটি স্পর্শ করল। অদূরে দাঁড়িয়ে রুদ্র চোখ বুলিয়ে দেখছে আর হাসছে। ইলিয়াসের চ্যালারা অবচেতন অবস্থায় পড়ে আছে।
কিছুক্ষণ আগে এক নাচতে ওয়ালী এসেছিল এখানে। সেই
নাচনেওয়ালির নাচ দেখে তারা শরীর ছুঁতে গিয়েছিল। পরে জ্ঞান হারিয়েছে।। সম্ভবত সেই নাচনেওয়ালির কাছে এমন কিছু ছিল যার দ্বারা অবচেতন করে দিয়েছে। করারই কথা, সেই মিতালিকে আদেশ করেছিল এমন কিছু করতে। কারণ
ইলিয়াসকে শায়েস্তা করা। এদের তো দোষ নেই এরা টাকায় পাগল। এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে এটা ইলিয়াসের ডেরা।প্রথমবার আসলো সে। এখন এখানে ইলিয়াসকে মেরে লাশ ফেলে যাবে। আর এটা হবে এমিলিকে দেওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ এক উপহার। মেয়েটা বড্ড বাড় বেড়েছে। মেয়ে বলেএতদিন ছাড় পেয়েছিল তবে ধৈর্য্যসীমা অতিক্রম করেছে এবার। এজন্য
বাড়াবাড়ির ফল বুঝিয়ে দেওয়ারও সময় এসে গেছে। অন্তত তাকে বুঝতে হবে কার পেছনে পড়েছে সে। এসব ভেবে রুদ্র কাফির দিকে তাকাতেই কাফি হকিস্টিক এগিয়ে দিলো তার দিকে। রুদ্র মেরুন রঙা শার্টের হাতা ফোল্ড করে হকিস্টিক তুলে হাসল। তার হাসি দেখে ইলিয়াসের চোখজোড়া ভীত দেখালো। অনবরত মাথা নাড়িয়ে না বোঝাল। দুইহাত জোড় করে কিছু বলার আগে রুদ্র বলল,

-‘যে মাকে তুলে তুই গালি দিতে যাচ্ছিলি। আমার সেই মা’ ই বছরের পর বছর রাজনীতিতে রাজ করেছে। রাজনীতি তার রক্তে। আর সেই মায়ের ছেলের কলিজায় হাত বাড়িয়েছিস।
তোকে তো এই সাহসের মূল্য চুকাতে হবে, বুঝতে হবে, কার জিনিসের দিকে লালসার দৃষ্টি ছুঁড়েছিস।’

একথা বলে ইলিয়াসের হাত পায়ের গিরায় গিরায় হকিস্টিক দিয়ে মারতে লাগল রুদ্র। একটুদূরেই কাফি দাঁড়িয়ে আছে।
প্রথম প্রথম ভয় পেলেও এখন আর ভয় পায় না সে। বুঝে গেছে রাজনীতিতে টিকতে গেলে লড়তে হবে। আর লড়তে গেলে মরতেও হতে পারে। তবে রুদ্রর জন্য তার খুব খারাপ লাগে। রুদ্র রাজনীতিতে যুক্ত হতে ইচ্ছুক ছিল না। কিন্তু তার মায়ের আদেশে রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছে। নিজের জীবনের পরোয়া না করে মাতৃআঙ্গাকেই গুরুত্ব দিয়েছে। রুদ্র এখনো ইলিয়াসকে মারতে ব্যস্ত। ইলিয়াসের হাত পা অকেজো হয়ে গেলে তখন মাথায় আঘাদ করল। মারের চোটে ইলিয়াসের কানমুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত গড়াতে লাগল। একপর্যায়ে
ইলিয়াস শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। তাকে মারতে মারতে রুদ্রও হাঁপিয়ে গেছে। যখন দেখল ইলিয়াস শেষ তখন সে হকিস্টিক ছুঁড়ে মেনে এমিলকে মেসেজ করলো,

-‘তোমার জন্য উপহার রেখে গেলাম। ধন্যবাদ দিতে হবে না। এই রুদ্র সস্তা কারো ধন্যবাদ গ্রহন করে না।’

__________/\______________/\__________

অতিরিক্ত কান্নার ফলে স্পর্শীর চোখ মুখের বেহাল দশা। সে
কিছুক্ষণ আগে গোসল সেরে বেরিয়েছে। এখনো কিছু খায় নি। মুখটা শুকিয়ে এইটুকুন হয়ে গেছে। ঘন্টা দু’য়েকের কথা বলে রুদ্র তখন বেরিয়েছে এখনো ফিরে নি। অথচ যাওয়ার চার ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। হয়তো ভুলে গিলে খেয়েছে তাকে বাসায় আঁটকে রেখে গেছে। তখন খট করে শব্দ করে কেউ রুমে প্রবেশ করলো। দৃষ্টি তুলে রুদ্রকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলো সে। রুদ্র প্লেটভর্তি খাবার এনে সামনে বসে লোকমা তুলে মুখের সামনে ধরল। স্পর্শী খাচ্ছে না দেখে সে বলল,

-‘বিপরীত পক্ষকে ঘায়েল করতে হলে নিজেকে সুস্থ রাখা প্রয়োজন। অন্যের উপর রাগ করে নিজেকে কষ্ট দেওয়া বোকামি ছাড়া কিছু নয়। হা কর, খেয়ে নে, শরীরে শক্তি করে, যত পারিস রাগ করিস।’

-‘তুমি খুব খারাপ একটা মানুষ।’

-‘জানি। আর এই খারাপ মানুষটার সঙ্গেই তোকে থাকতে হবে, ভালোবাসতে হবে। বাকিটা পথ এই খারাপ মানুষটার সঙ্গে পাড়ি দিতে হবে।’

To be continue……….!!

প্রেম প্রার্থনা পর্ব-০৫

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[০৫]

আজ রবিবার। রৌদ্রোজ্জ্বল সুন্দর একটা দিন। জানালার দোড় গোড়ায় তেজী রোদের মেলা। ঘড়ির কাঁটা তখন নয়ের ঘরে। স্পর্শী স্কুল ড্রেস পরে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে।একজোড়া জুতোও খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ গতদিনেও জুতো গুলো এখানে রেখেছিল। এদিকে স্কুলেরও দেরি হয়ে যাচ্ছে। দেরি করে স্কুলে গেলে পেছনে বসতে হয়। স্যাররাও চালাকের চালাক পেছনে বসলে ঘুরে তাকেই পড়া
ধরে। পড়া না পারলে অপমান করে। ছেলেদের রুম আলাদা বিধায় সেই অপমান তেমন গাঁয়ে লাগে না। সত্যি বলতে গাঁ সওয়া হয়ে গেছে।মোদ্দাকথা ইংলিশ স্যার বাদে কারো কাছে
অপমানিতও হয় না। তার যত সমস্যা ইংলিশেই। এসব ভেবে
আর দাঁড়িয়ে না থেকে চেঁচিয়ে ওর মাকে ডেকে উঠল। তখন
মরিয়ম বেগম চুলা মুছতে মুছতে জবাব দিলেন,

-‘ ম্যাঁ ম্যাঁ না করে খুঁজে দেখ।’

-‘ পাচ্ছি না আমি। তুমি এসে খুঁজে দিয়ে যাও ।’

-‘কতদিন বলি নিজের জিনিস ঠিকঠাকভাবে গুছিয়ে রাখ, গুছিয়ে রাখ। শুনিস আমার কথা? আমিও পারব না খুঁজে যেতে।’

-‘তাহলে আমিও স্কুলে যাবো না।’

-‘পিঠে মার পড়ার আগে স্কুলের দিকে হাঁটা ধর।’

একথা শুনে স্পর্শী কথা না বাড়িয়ে রুমের দিকে চলে গেল। এর মিনিট দুয়েক পরপরই দৌড়ে ড্রয়িংরুম পেরিয়ে বেরিয়ে গেল। তারপর আর কোনো কথাবার্তা সাড়া শব্দ শোনা গেল না। সকালে নাস্তা করেছে, টিফিনের টাকাও নিয়েছে, তাহলে স্কুলেই গেল ভেবে মরিয়ম বেগম নিজের কাজে মন দিলেন।
রান্নাঘরের মেঝেতে বসেই বড় মা পটলের খোসা ছাড়াচ্ছেন।
পাশে দুই আঁটিলাল শাক আর একটা লাউ রাখা। দু’কেজি
আলু গড়াগড়ি খাচ্ছে মেঝের এককোণে। অন্য এক পাতিলে তাজা কৈ মাছগুলো খলবল করে লাফাচ্ছে। কৈ মাছ ভাজা ভীষণ পছন্দ স্পর্শীর। মেয়ের পছন্দ জানেন বলেই বাজারে দেখামাত্রই কিনেছেন। তবে শুধু মেয়ের জন্যই নয় এনেছেন সবার জন্যই। বড় মা একমনে দুপুরে যা রান্না হবে সেগুলোই কেটে কুটে রাখছেন। যাতে রান্নার সময় তাড়াহুড়ো না লাগে।রান্নাঘরে দু’জা যে যার কাজে ব্যস্ত। এমনিতেই উনি খুব কম কথা বলেন। এককথায় স্বল্পভাষী! উনি স্বল্পভাষী বলে প্রথম সাক্ষাতে অনেকেই অহংকারী মনে করেন। অথচ কাছ থেকে দেখলে, মিশলে, বোঝা যায় উনি কতটা স্বচ্ছ মনের। এছাড়া
উনি বিশেষ এক গুনে গুণান্বিতও বটে। বিশেষে গুনটি হচ্ছে
উনি অতি খুশিতে ডগমগ হোন না আবার অতিশোকে ভেঙে পড়েন না। সব সময় স্বাভাবিক, নিশ্চল। সকল পরিস্থিতিতে
মাথা ঠান্ডা রাখার ক্ষমতা উনার আছে৷ যেমন দিনের ঘটনা।
সেদিন উনি চাইলে রুদ্র আর স্পর্শী বিয়েতে আপত্তি করতে পারতেন, রুদ্রকে এতিম বলায় স্পর্শীকে এক থাপ্পড় মারতে পারতেন।কিন্তু এর কোনোটাই উনি করেন নি বরং পরেরদিন রুদ্রকে বলেছিলেন,
‘সে ছোট, রাগের বশে এসব বলে ফেলেছে কিন্তু তুমি ছোট নও। এসব কথার রেশ ধরে রাগ পুষে রেখো না। রাগ কখনো ভালো কিছু বয়ে আনে না বরং ধ্বংস করে।’
উনার কথা শুনে আপনাআপনি উনার প্রতি সন্মানটা আরো বেড়ে গেছে। আর সন্মান এমন জিনিস না চেয়ে নেওয়া যায় আর না কেড়ে নেওয়া যায়। নিজ গুনেই সন্মানের যোগ্য হয়। সেদিনের কথা স্মৃতিচারণ করে মরিয়ম বেগম জায়ের দিকে একবার তাকিয়ে গলা পরিষ্কার করে বললেন,

-‘স্পর্শীর কথায় কষ্ট পেও না ভাবি। জানোই তো ভেবেচিন্তে কথা বলে না সে। রুদ্রকে কথাগুলো রাগের বশেই বলেছে।’

-‘হঠাৎ একথা কেন?’

-‘তোমার মুখটা খুব শুকনো লাগছে আজ। ‘

-‘কোমরের ব্যথাটা বেড়েছে তাই হয়তো। আর শুন কয়েকটা কথা বলার ছিল। স্পর্শী তোর মেয়ে হলেও সে এখন আমার ছেলের বউ। আমারও অধিকার আছে তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। তাই আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

-‘কি সিদ্ধান্ত?’

-‘তোর ভাইয়া (রুদ্রর বাবা) একটুপরেই চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে বের হবে। আমি চাচ্ছি স্পর্শীও সঙ্গে যাক। তুই স্পর্শীর ব্যাগ গুছিয়ে দে, দু’তিন থাকার মতো জামাকাপড় দিস।’

-‘কিন্তু স্পর্শী তো স্কুলে চলে গেছে।’

-‘না যায় নি। জুতো খুঁজে না পেয়ে ড্রেস বদলে ছাদে গেছে। হয়তো কবুতরকে খাবার দিতে। আমি দেখেও বলি নি কারণ আমি চায় স্পর্শী যাক, ওরা যত দূরে দূরে থাকবে তত দুরত্ব বাড়বে।’

-‘কিন্তু স্পর্শী যে বলল রুদ্র নাকি জিনিসপত্র কার গাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছে। সেও নাকি কোথাও যাচ্ছে।’

-‘আমি নিষেধ করেছি রুদ্রকে।

-‘ওহ আচ্ছা।’

-‘শোন মরিয়ম, ছোটরা যখন ভুল করে তখন তাদের সুন্দর করে বোঝানোর দায়িত্ব বড়দের ঘাড়েই পরে। আমি জানি রুদ্র এই ব্যাপারে মুখ ফুটে কিছু বলবে না তাও তোর জন্য। কারণ তুই মেয়েকে ছাড়া থাকতে পারিস না। কিন্তু পরিস্থিতি এখন উল্টো কথা বলছে এটা তোকেও বুঝতে হবে। স্পর্শী
ছেলেমানুষী করবেই। তার বয়সটাই এমন। কিছুদিন আগেও একটা ভুল করতে যাচ্ছিল আবার করবে না এর গ্যারান্টি কী?আর এখন রুদ্রর বাসায় ফেরা মানে নিজের ক্ষতি করা তাও করবে সে। তবুও নিজের সুবিধার কথা কাউকেই বলবে না। তাই আমি ভেবেছি রুদ্রর কাছে থাকুক স্পর্শী। এতে যদি
দূরত্বটা ঘুচে। দু’একসঙ্গে থাকলে, একে অপরকে সময় দিলে তাদের সম্পর্কটা একটু হলেও সহজ হবে। যেটা এই বাড়িতে সম্ভব নয়। কেন সম্ভব নয় জানিস? কারণ তারা এই বাসারই ছেলে মেয়ে। একটু কিছু হলে স্পর্শী আমাদের নালিশ করবে
কান্নাকাটি করবে, রাগের বশে রুমও আলাদা করে ফেলবে।
যেটা হবে সংসার ভাঙার অন্যতম কারণ। যদি পূর্বে তাদের সম্পর্ক থাকতো তাহলে চিন্তা থাকতো না কিন্তু হঠাৎ’ই বিয়ে হওয়াতে ওরাও অস্বত্বিতে পড়বে /পড়েছে। যেখানে চাচাতো ভাই বোন ছিল তারা।সব মানিয়ে নিতে একটু সময় দরকার।
এখন তাদের সম্পর্ক জোড়া লাগাতে আমাদের উচিত ওদের কাছাকাছি থাকার সুযোগ করে দেওয়া। আমি কি বলছি তা বুঝতে পারছিস? আর চট্টগ্রামে যত যায়ই করুক একসঙ্গে, একরুমে ,থাকতে বাধ্য তারা।’

-‘তা ঠিক। কিন্তু রুদ্র কী রাজি হয়েছে?’

-‘না, সে এখনো জানে না স্পর্শীরা যাচ্ছে ওর কাছে।’

-‘ভাইয়া যাচ্ছে তাও জানে না? ভাইয়া কোনো কাজে যাচ্ছে নাকি এমনি ঘুরতে?’

-না, ‘স্পর্শীকে রাখতে।’

তারপর দুই জা আলোচনা করে অন্য সদস্যদের জানালেন। দাদীমা এবং স্পর্শীর বাবাও মত দিলেন। আর বড় বাবা তো জানতেন এই ব্যাপারে। উনার সঙ্গে আলোচনা করেই বড় মা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। উনাদের আলোচনা শেষ হতেই স্পর্শী প্রবেশ করল। মুখভর্তি হাসি নিয়ে কিছু বলার আগেই ওর মা অবাক হয়ে বলল,

-‘কি রে তুই স্কুলে যাস নি?’

-‘না আমার একজোড়াও জুতো নাই কি পরে যাবো?’

-‘কিহ্! তাহলে গত সপ্তাহে কেনা জুতো জোড়া কই?’

-‘আরে কী যে বলো না আম্মু? ওগুলো বের করলে পুরনো হয়ে যাবে তাই বের করি নি। তাছাড়া একদিন স্কুলে না গেলে কিছু হবে না।’

একথা বলে দাঁত বের করে খিলখিল করে হাসল। তার হাসি দেখে বাকিরাও হাসলেন। তখন বড় বাবা স্পর্শীকে জানাল উনি বেড়াতে যাচ্ছেন, সে যাবে নাকি? বেড়ানোর কথা শুনে স্পর্শী আনন্দে লাফ মেরে উঠে রাজি হয়ে গেল। ওর মুখশ্রী জুড়ে ছড়িয়ে গেল উৎফুল্লতা। বাসায় শুয়ে বসে বোরিং না হয়ে বেড়াতে যাওয়ার আনন্দে সে জানার প্রয়োজনবোধও করলো না কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে। আর কেউ বললোও না আগা বাড়িয়ে। তারপর স্পর্শী মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে চলল মহা আনন্দে। ভুলেও আন্দাজ করতে পারল না তার
এত আনন্দের ভাটা পড়বে অপ্রিয় এক মানুষের মুখ দেখে।
যার উপস্থিতিই তার বিরক্তের কারণ।
_________________________

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা না করে বেরিয়েছিল রুদ্র। ফিরলো কিছুক্ষণ নাগাদ। ততক্ষণে দিন পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। মাগরিবের আজানও হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। রুদ্রর ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীরটা বিছানা পেতে চাইছে। এই মুহূর্তে ফ্রেশ হওয়ার এনার্জিটুকুও যেন নেই তার শরীরে। সে ঘামে ভেজা শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে রুমের চারিদিকে দৃষ্টি বুলালো। কেউ নেই থাকার কথাও না। কারণ এত বড় ফ্ল্যাটে সে একাই থাকে। ইদানিং ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরে শূন্য রুমে ভালো লাগে না। কেমন শূন্যতা বিরাজ করে চারদিকে। কাউকে বোধহয় খুব দরকার এত বড় ফ্ল্যাটে। এই
দেওয়াল গুলোও যেন কথা বলার তৃষ্ণায় কাতরাচ্ছে। কেন এমন মনে হয় কে জানে?নাকি প্রেম তৃষ্ণার তার বুক তৃষ্ণার্ত বলে দেওয়ালের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে? হবে হয়তো। তাদের
বাসায় যেমন এক চঞ্চল প্রজাপ্রতি রযেছে। ঠিক তেমন এক
প্রজাপ্রতি এখানে থাকলে মন্দ হয় না। সারাক্ষণ এ-রুম হতে ও-রুম ছুঁটে বেড়াতে। যার উপস্থিতিতে ঠোঁটর কোণে ফুটতো রাগমিশ্রিত মুচকি হাসি। এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে গোসল সারতে গেল। যা হবে তা ভেবেও লাভ নেই। এরচেয়ে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নেওয়া উত্তম। সে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতেই কলিংবেল বেজে উঠল। অসময়ে কারো উপস্থিতিতে প্রচন্ড বিরক্ত ফুটে উঠল তার ক্লান্ত মুখশ্রীজুড়ে। তবে কে দেখার দরকার ভেবে আইহোল দিয়ে দেখে অবাক না হয়ে পারল না। ততক্ষণে পুনরায় কলিংবেল বেজে উঠল।
সে খালি গায়েই দরজা খুলে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। আর তাকে দেখে স্পর্শী বেজার মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো।
আগে যদি জানতো বড় বাবা রুদ্রর এখানে আসবে তাহলে জীবনেও আসতো না। স্বেচ্চায় এই ষাঁড়ের কাছে এসে গুঁতো খাওয়ার কোনো ইচ্ছেই তার ছিল না। এই লোকটা না পারে দুটো ভালো কথা বলতে আর না পারে দিল খুলে হাসতে।এর কাছে ভালো কিছু আশা করায় বৃথা।

ওদেরকে দেখে রুদ্র বাবাকে সালাম দিয়ে দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। ওর বাবা ভেতরে প্রবেশ সোফায় বসেছে। কিন্তু স্পর্শী অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। ওর কান্ড দেখে এবার রুদ্রই মুখ খুললো,

-‘ভেতর আসার ইচ্ছে নেই বুঝি? ওকে থাক তাহলে। আশা করি মশার সঙ্গে ভালোই রাতটা কাটবে, শুভ রাত্রি।’

একথা বলে দরজা আঁটকাতে গেলে স্পর্শী রাগে গজগজ করে ভেতরে প্রবেশ করলো। রাগে দুঃখে বড় বাবার দিকেও ফিরে তাকাল না। গটগট করে হেঁটে যে রুমের দরজা খোলা সেই রুমে ঢুকে উল্টো ঘুরে বসে রইল। রুদ্র বাবার সঙ্গে কথা বলে গেস্টরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে বলল। ছেলের কথা শুনে উনি গেস্টরুমে চলে গেলেন। আর রুদ্র খাবার অর্ডার করে রুমের গিয়ে দেখল ফুলোরাণী মুখ ফুলিয়ে বসে আছে।
মুখ দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুণি কেঁদে দিবে। তাই সেও আপাতত
কোনো কথা না বলে মিটিমিটি হেসে ওয়াশরুমে চলে গেল।
শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে সে খেয়াল করল তার সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে। মনটা খুব ফুরফুরে। মেজাজও বেশ চাঙ্গা।
এসব ভেবে হেসে জলদি’ই গোসল সেড়ে বের হলো। স্পর্শী আড়চোখে তাকে দেখে নজর ফিরিয়ে নিলো। রুদ্র আকাশি রংয়ের টি-শার্ট আর কালো টাওজার পরে রুম থেকে বের হলো। তখনই অর্ডারকৃত খাবার চলে এলো। সে খাবার সার্ভ করতে করতে তার বাবা এসে পাশে বসলেন। বাবা ও ছেলে
স্পর্শীর অনুপস্থিতিতে একটা ব্যাপারে আলোচনাও সেরে নিলেন। তবুও স্পর্শীর সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না আর ফ্রেশ হয়ে এখানেও এলে না। তাই বাধ্য হয়ে উনারা খেয়ে নিলেন।
ঘড়ির কাটা তখন দশের ঘরে। অনেক জার্নি হয়েছে বিধায় রুদ্রর বাবা বিশ্রাম নিতে রুমে চলে গেলেন। আর রুদ্র সব পরিষ্কার করে স্পর্শীর খাবার নিয়ে রুমে গিয়ে দেখে ফ্রেশ না হয়ে বালিশববিহীন উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে স্পর্শী।
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাবার ঢেকে এগিয়ে গেল স্পর্শীর দিকে। তাকে সুন্দর করে শুইয়ে দিয়ে ড্রিম লাইট অন করে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। সেদিন রাতে স্পর্শী জাগল না খেলোও না।
তার পছন্দের বিরিয়ানি সেভাবেই ঢাকা অবস্থায় পড়ে রইল।

কিন্তু বিপত্তি বাঁধল পরেরদিন সকাল আটটায়। যখন ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে জানতে পারল বড় বাবা তাকে রেখে ফিরে গেছেন। এখন থেকে তাকে রুদ্রর সঙ্গেই থাকবে হবে।

To be continue………..!!

প্রেম প্রার্থনা পর্ব-০৪

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[০৪]

-‘আমিই তোর মা আর তুই আমার কলিজা। রুদ্র আমাকে ওয়াদা করেছে,কেউ নাকি তোকে আমার থেকে কেড়ে নিতে পারবে না, কেউ না, কখনো না। রুদ্র আছে না রুদ্র, সে আর আমি কাউকে কাড়তেই দিবো না। আমরা আছি না, আমরা তোকে খুব ভালোবাসবো, এভাবে শক্ত করে বুকের মধ্যে আগলে রাখব।’

একথা বলতে বলতে উনার শ্বাসরোধ হয়ে আসতে লাগল। জোরে জোরে নিঃশব্দ নেওয়ার কারনে স্পর্শীর ঘুমটা ভেঙে সজাগ হলো। মাকে জোরে শ্বাস নিতে দেখে ব্যাকুল হয়ে মা!মা! করে ডেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে গেল মায়ের রুমে।
তারপর ড্রেসিংটেবিলের ছোট ড্রয়ার থেকে ইনহোলার নিয়ে সেটা পুরো দিলো মায়ের মুখে। দুই থেকে তিনবার ইনহোলার পুশ করতেই ধীরে ধীরে মরিয়ম বেগমের নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হতে লাগল। অতঃপর স্পর্শী নিজে না কোনো কথা বলল আর না মাকে বলতে দিলো। শুধু শক্ত করে মাকে জড়িয়ে বিরবির করে ‘তুমি আছো বলেই আমার পৃথিবী এত সুন্দর।’

একথা বলে নীরবে অশ্রু ঝরাতে ঝরাতে ঘুমে তলিয়ে গেল। স্পর্শীর নিঃশ্বাস ভারী হতে দেখে মরিয়ম বেগম ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালেন। আর ভাবতে লাগল স্পর্শীর ছোটো
বেলার একটা ঘটনার কথা। তখন শীতকাল। প্রচন্ড শীতও পড়েছিল সেবার। শীতের দিনে স্পর্শীকে রোদে বসিয়ে উনি রুমে এসেছিলেন ফিডার নিতে। গোসলেন পরপর খাবার না দিলে কেঁদে কেঁটে একাকার করে মেয়েটা। একথায় ছোটো থেকেই তার পেট ভরা থাকলেই তার পৃথিবী রঙিন। সামান্য ক্ষুধাও সহ্য করতে পারে না সে। একহাতে ফিডার আর অন্য হাতে একটা আপেল নিয়ে আসার পথে শুনতে পান স্পর্শীর কান্নার আওয়াজ। কান্না শুনে উনি দৌড়ে গিয়ে দেখেন পড়ে গিয়ে মুখ কেঁটে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে মেয়েটার। তার কান্না শুনে ততক্ষণে সবাই ছুটে এসেছে। উনি মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু মুখ থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হচ্ছে না। বড় মা আর উপায় না পেয়ে স্পর্শীর মুখে সরিষার তেল ঘষে দিলেন। রক্ত পড়া কমে গেল। কিন্তু ক্ষত স্থানে সরিষার তেল দেওয়াতে জ্বলতে শুরু করলো। ছোট্টো স্পর্শী ছটপট করে কাঁদতে থাকল অনেক সময়। কেউ ওকে কোলে নিতে চাইলোও গেলো না। মায়ের কাঁধে’ই মাথা রেখে ফুঁপাতে ফুঁপাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। যেন মা থাকলেই হবে। তারপর ঘুমের ঘোরে ওর মুখে ফিডার দিলে টান দিয়ে গিয়ে কেঁদে উঠল মেয়েটা। ঠোঁটের অনেকখানি ফুলে গেছে।
মুখের ব্যথায় দুইদিন খেতেই পারে নি মেয়েটা, শুধু কাঁদতো। আর মেয়ের কান্না দেখে উনিও কেঁদে ফেলতেন।আর উনারা মা ও মেয়ে যখন কাঁদতো রুদ্র তাকিয়ে দেখতো। এমনিতেই রুদ্রু স্পর্শীর দশ বছরের বড়। আর রুদ্র তখন অনেক কিছু বুঝতো। ছোট্টো স্পর্শী তার বই খাতা টেনে ছিঁড়ে ফেললেও মারা তো দূর ধমকাতোও না। শুধু রাগী রাগী দৃষ্টি তাকালেই স্পর্শী ঠোঁট উল্টো কেঁদে রাগ করে উল্টো ঘুরে বসতো। ফলে
তারই রাগ ভাঙাতে দোকানে নিয়ে গিয়ে চকলেট আর চিপস কিনে দিতে হতো। একবার হয়েছি কী, স্পর্শী তার দাদীমার পানের বাটা থেকে জর্দ্দা নিয়ে খেয়ে বমি টমি করে একাকার অবস্থা। যেমন চঞ্চল মেয়ে তেমনি শাস্তির শেষ নেই। সেদিন রুদ্র রেগে দাদীমার পান খাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষনা করে পানের বাটা লুকিয়ে রেখেছিল। এছাড়া খেলতে খেলতে স্পর্শী ওর বড় মায়ের শখের ফুলদানী ভেঙে খাটের নিচে লুকিয়েছিল। পরে তাকে খুঁজে খুঁজে খাট নিচে থেকে বের করে আনা হয়। বড় মা তার কান্ডে মন খারাপ তো দূর চোখ পাকিয়ে তাকান নি পর্যন্ত। কারণ চঞ্চল মেয়েটা এই বাড়ির প্রাণ। আর উনিও খুব বেশি ভালোবাসেন স্পর্শীকে। তাছাড়া স্পর্শী কোনো না কোনো কান্ড ঘটাবেই ঘটাবে। একবার প্রচন্ড জ্বরে এসেছিল
তার কোনোভাবে জ্বর ছাড়ছিল না। পরে ডাক্তারের পরামর্শে হসপিটালের ভর্তি করা হয়েছিল। হসপিটালে থাকবে না বলে সে কী কান্নার স্পর্শীর। হাতের কেনোলা যে কতবার খুলেছে তার ইয়াত্তা নেই। আবার যখন কেনোলা লাগাতো তখন খুব কাঁদতো। মেয়ের সঙ্গে উনিও কেঁদে বুক ভাসাতেন। তারপর তিনদিন হসপিটালে থেকে বাসায় ফিরলেন উনারা। ধীরে ধীরে স্পর্শী সুস্থ হতে লাগল সঙ্গে তার দুষ্টুমিও ফিরে এলো। বাসাটাও মেতে উঠল তার দূরন্তপণায়।

স্পর্শীর তখন চার বছর বয়স। একদিন দাদীমার বড় বোন বেড়াতে এলেন। উনি কয়েকদিন থেকে স্পর্শীর দুরন্তপনা দেখে খাওয়ার টেবিলে বললেন,

-‘ও মরিয়ম তুমি দেহি মাইয়া নিয়াই পইড়া থাকো সারাক্ষণ। আগে চাকরি করতা মাইয়া আসার পর নাকি চাকরি ছাইড়া দিছো? এত মাইয়া, মাইয়া, করলে চলবো নি বাঁছা? নিজের ভবিষ্যত নিয়াও তো ভাবতে হইবো। মাইয়া বড় হইবো তারও বিয়া দিতে হইবো। তখন তো মাইয়া তোমার কাছে থাকবার পারবো না। তখন কী করবা? বয়স হইলে শরীরের ক্ষয় হয়, চোখের জ্যোতি কমে। তহনের চিন্তা ভাবনা কইরা আখের গুছাইয়া না রাখলে হইবো? শূন্যহাতে থাকলে শ্যাষ বয়সেও কাছে বসার মানুষ পাইবা না।’

একথা শুনে মরিয়ম বেগম থম মেরে বসে রইলেন। আসলেই তো স্পর্শী বড় হচ্ছে তারও বিয়ে দিতে হবে। পরের ঘরে চলে যাবে মেয়েটা। তখন চাইলেও মেয়েকে কাছে রাখতে পারবে না। সেই মুহূর্ত থেকে উনি এসব একথায় ভাবতে লাগলেন।
সবসময় এসব চিন্তায় উনার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খেতে থাকল।
উনি এসব ভাবতেন আর মনমরা হয়ে কেঁদে কেটে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলতেন। কয়েকদিন ব্যাপারটা লক্ষ করে একদিন রুদ্র সকলের সামনে জিজ্ঞাসা করল,

-‘মেজো মা কিছু হয়েছে তোমার? কয়েকদিন ধরেই দেখছিস তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছো। স্পর্শী তো সুস্থ আছে তাহলে কাঁদছো কেন?’

রুদ্রর মুখে এই কথা উনি অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। এ ব্যাপারটা বাকিরাও খেয়াল করেছে তাই সমস্যা খুলে বলতে জেঁকে ধরলেন। উনি বাধ্য হয়ে কেঁদে কেঁদেই বললেন উনার মনের ভাবনা। ভবিষ্যতে কথা ভেবে কাঁদতে দেখে সকলে হাসলেন, সাধ্যমতো বুঝালেন মেয়েদের জন্মই অন্যের ঘর আলোকিত করার জন্য। আজ অথবা কাল স্পর্শীও অন্যের ঘরের বাতি হবে। তার নিজের একটা সংসার হবে। ব্যস্ততা বাড়বে। তখন চাইলেও যখন তখন আসতে পারবে না। যদিও আসে তাও ক্ষণিকের অতিথি হয়ে আসবে। আসলে মেয়েদের জীবনই এমন। বড় মা, দাদীমা এমন নানান কথা বলে বোঝাচ্ছিলেন উনাকে। উনাদের উক্ত কথাগুলো কেন জানি রুদ্রর পছন্দ হলো না। বিয়ের পর ছোট্টো স্পর্শী ক্ষণিকের অতিথি হবে? সে নাকি চাইলে যখন তখন এই বাসায় আসতে পারবে না।
কথাটা কেন জানি সে মানতে পারল না। তাই বিরক্তি সুরে বলল,

-‘না, আমাদের বাড়ির একমাত্র মেয়ে শুধু আমাদের ঘরই আলোকিত করবে। স্পর্শীকে অন্যের ঘর পাঠাবো না আমি।’

ছেলের কথা শুনে বড় মা হেসে উঠে জিজ্ঞাসা করলেন,

-‘তা কী করে আঁটকাবি শুনি?’

-‘আমিই বড় হয়ে স্পর্শীকে বিয়ে করবো। তারপর আমাদের এই বাসায় থেকে যাবে ও। তখন ওকে অতিথিও হতে হবে না আবার সবসময় আমাদের সঙ্গে থাকতে পারবে। আর স্পর্শী চলে যাবে ভেবে মেজো মাও আর কাঁদবে না।’

রুদ্রর কথা শুনে সবাই খুব হেসেছিল। কিন্তু রুদ্র সিরিয়াস ভাবেই ব্যাপারটা মনের মধ্যে পুষে রেখেছিল। তারপর তারা দু’জন বড় হতে লাগল। সময় অতিবাহিত হলো সুখে দুঃখের টানাপোড়ানে। সেদিনের পর থেকে রুদ্র স্পর্শীর অভিভাবক হয়ে উঠল। ছোট ছোট ব্যাপারগুলো রুদ্র মত দিতো। সঠিক আর ভুলের পার্থক্য বুঝাতো। কিন্তু দুষ্টু স্পর্শী সেসব বুঝতে
চাইতো না বরং তাকে যখন যা নিষেধ করা হতো ঘুরে ফিরে সে ওই কাজটাই করতো। এজন্য বিভিন্ন ধরনের শাস্তি ভোগ করতে হতো, এখনো হয়। দুটোতে শরীরে বড় হলেও এখনো ছোটদের মতো ঝগড়া করে। অথচ গতমাসের শেষের দিকে রুদ্রর বয়স সাতাশ হলো আর স্পর্শীর ষোলো।

আর স্পর্শীর মাঝে এই পরিবর্তন এসেছে রুদ্রের জন্মদিনের দিন। সেদিন বাসা মেহমানে ভর্তি ছিল। সকলের হইহট্টগোল
মেতে ছিল চারিপাশে। তখন নিকট আত্মীয়দের একজন আলোচনা করছিল, ‘ওকে হসপিটাল থেকে কিনে এনেছিল। খুব কষ্টে মানুষ করেছে ওর পালিত মা।আজ দেখো কত বড় হয়েছে। একেই তো বলে রাজকপাল। দেখ, ভাগ্য গুনে রাস্তা থেকে একবারে রাজপ্রাসাদে ঢুকে গেছে।’
একথা শুনে স্পর্শী ছুটে যায় দাদীমার কাছে। কিন্তু মেহমান থাকায় জিজ্ঞাসা করে না কোনোকথা। তারপর রাতে যখন
মেহমানরা চলে গেল তখন সকলের সামনেই কথাটা উঠালো সে। তখন রুদ্র সেখানে উপস্থিত ছিল না। তখন দাদীমা সত্য লুকিয়ে মিথ্যাের আশ্রয় নিয়ে থমথমে মুখে বলেন রুদ্র দত্তক নেওয়া সন্তান। তাকে নাকি হসপিটাল থেকে আনা হয়েছে। তবে দত্তক নেওয়া বাচ্চাটি এতিম ছিল না তার সবাই ছিল।
কিন্তু কিছু কারণে তাকে তার পরিবার হসপিটালে ফেলে গিয়েছিল। তারপর তাকে এই বাসায় এনে বড় করা হয়। এই কথা শুনে সে বিশ্বাস করে নেয়। আর রুদ্র বাসায় ফিরলে তাকে আলাদা করে ডেকে জানানো হয় পুরো ঘটনা। সেকথা শুনে রুদ্র জানায়, ‘সে নয় স্পর্শীই পালিত সন্তান।’ একথাটা যেন স্পর্শীর কানে কোনোভাবে না যায়৷ সে এই কঠিন সত্য সহ্য করতে পারবে না মেয়েটা। স্পর্শীর সত্য লুকাতেই রুদ্র নিজের গায়ে লাগিয়েছে পালিত সন্তানের তকমা। তবে বড় মা ব্যাপারটা মানতে চাচ্ছিলেন না পরে বড় বাবা আর রুদ্র বোঝানোর পর মেনে নিয়েছে। পুরনো কথা স্মৃতিচারণ করে উনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। উনার শূন্য কোল পরিপূর্ণ হয়েছে।
আল্লাহর রহমতে অমুল্য সম্পদ পেয়েছে উনি এজন্য মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কখনো শুকরিয়া করতে কার্পণ্য করে না।

___ ‘এক সপ্তাহ পরের ঘটনা’___

বিকালবেলা স্পর্শী ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছে। টিভিতে চলছে হিন্দি মুভি। ড্রয়িংরুমে আপাতত সে ছাড়া কেউ নেই।
তখন পাশে থাকা ফোনের রিং বেজে উঠল। মুখভর্তি বার্গার নিয়ে পাশ ফিরে তাকাল সে। ফোনের স্কিণে বড় বড় অক্ষরে
রুদ্র আর ফোনটা তার বড় মায়ের। কল দেওয়া ব্যক্তির নাম দেখে মুখে বিরক্তি ভাব এনে টিভিতে মনোনিবেশ করলো। কিন্তু পরপর ফোনটা বাজতে দেখে বিরক্তির মাত্রা বেড়েই গেল। একপর্যায়ে কলটা রিসিভ করে বাজখাঁই গলায় বলে উঠল,

-‘কল রিসিভ হচ্ছে না মানে বুঝতে হবে ফোনের আশেপাশে কেউ নাই। এই কমন সেন্সটুকুও নেই দেখছি। যায় হোক কে বলছেন, কাকে চান?’

-‘ এই যে কমনসেন্সের ঠেলাগাড়ি কল রিসিভ করে ভদ্রতা সূচক সালাম দিতে হয় এটা জানেন না? আর ‘কে বলছেন, কাকে চান।’ এ আবার কেমন কথাবার্তা?মানে আগে যতটুকু ভদ্রতা জ্ঞান ছিল সবটুকুও গুলিয়ে খেয়ে ফেলেছিস?’

-‘আর কিছু বলবেন?’

-‘হুম, আম্মুকে বল নাবিলের গাড়িতে আমার সব জিনিসপত্র
পাঠিয়ে দিয়েছি। সব যেন দেখে শুনে নামিয়ে নেয়। আর হ্যাঁ
আজ রাতের বাসে সিলেট যাচ্ছি পরশুদিন বাড়ি ফিরবো।’

-‘জিনিসপত্র পাঠিয়ে দিচ্ছেন কেন সেটাই তো বুঝলাম না।’

-‘তোকে এত বুঝতে হবে না। যতটুকু বলেছিল ততটুকু গিয়ে বল আম্মুকে, রাখছি এখন।’

একথা বলেই রুদ্র কল কেটে দিলো। আর স্পর্শী মুখ ভেঁচি দিয়ে ছুঁটলো বড় মায়ের রুমে। যেতে যেতে মনে মনে ফন্দি এঁটে নিলো। রুদ্রর কথাগুলো বলতে বলতে সুযোগ বুঝে বড় মায়ের হাতের বানানো আচরের বয়ামটা হাপিস করে দিবে।
কিন্তু সে হয়তো জানতো না বড় মাও তার জন্য কত বড় এক চমকের ব্যবস্থা করে রেখেছে। যে চমকের কারণে তার হাসি মুখ মলিনতায় ছেঁয়ে যাবে।

To be continue……!

প্রেম প্রার্থনা পর্ব-০৩

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[০৩]

”শোনো না নীল নয়না! ছড়ালে এই জোৎসা! তোমাতে বিভোর থাকি! তুমি তা কেন বোঝো না। হুম…হুম…হুম..।”

ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে চুলে বিনুনি করছে স্পর্শী। তার মনটা বেশ ফুরফুরে। যদিও এর বিশেষ কোনো হেতু নেই তবে হঠাৎ খুব খুশি খুশি লাগছে। এজন্য ওষ্ঠজুড়ে লেপ্টে আছে মিষ্টি হাসি। চোখে গাঢ় কাজল। কপালে ছোট্ট কালো টিপ। পরনে লাল কালো মিশেলের থ্রি-পিচ। ষোড়শীর ফর্সা দেহে লাল রঙা থ্রি-পিচে বেশ মানিয়েছে। তারপর সে চুলে বিনুনি গেঁথে একটা রাবার আটঁকে পেছনে ঘুরতেই দেখে দাদীমা বসে আছে। দাদীমার উপস্থিতি টের পায় নি সে। দাদীমাও এসে কিছু বলে নি। চুপ করে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। দাদীমাকে দেখে একগাল হেসে কিছু বলার আগেই দাদীমা বললেন,

-‘আমার দাদুভাই চইলা গেছে হেইডা তুই জানোস?’

-‘হুম।’

-‘তো এত সাজছোস কার লাইগ্গা? কারে তোর রুপ দেহনের
লাইগা মনে রং লাগাইতাছোস? তর সুয়ামি নাই, মুনে (মনে) চোট পাইয়া চইলা গেছে। তাও তোর মুখে হাসি ক্যান?সর! সর আমার চক্ষুর সামনে থেইক্কা। তরে আমার সহ্য হইতাছে না।’

-‘ওই বুড়ি! তয় আইছো ক্যান আমার দ্বারে। তোমার নাতির
কোলে উইঠা বইসা থাহো যাও। আমার এত ঠ্যাকা পড়ে নাই তার বিরহে বিরহিণী সাজার। সে গ্যাছে ক্যান? আমি যাইতে কইছি তারে? পৃথিবীর কোন ভদ্র পুরুষটা বিয়ার পরাদিনই বউকে না বইলা চইলা গ্যাছে দেখাও আমারে। একথা আগে
হুনছো কুনোদিন? কিন্তু তোমার নাতি গ্যাছে। ক্যান গ্যাছে? কারণ সবাই যাতে আমারে ভুল বুঝে, বকে, মারধর করে।’

-‘তোর দিলে কী মায়া মহব্বত নাই? আমার দাদুভাই গ্যাছে আজ চারদিন হইয়া গেছে। তুই একবারো ফুন দিছোস? কী খাইতাছে না খাইতাছে জিজ্ঞাস করছোস? হেই তর সুয়ামী লাগে। তার ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব তোর না?’

-‘হেই কী ফোন দিয়েছে? জিজ্ঞাসা করছে বাইচ্চা আছি না মইরা গেছি? জোর কইরা কবুল বলাইলো। তারপর মারধর কইরা কাপুরুষের মতো না বইলা চইলা গেল। হেরও উচিত আছিল না একবার ফোন দেওয়ার? এখন শুধু শুধু আমারে দুষতাছো বুড়ি। তোমার নাতি খুব ভালো তারে নিয়াই থাহো তুমি।’

-‘এত গোস্সা করলে হইবো? আয় আমার কাছে আয় আর কল দে দেখি তর সুয়ামিকে।’

-‘পারব না।’

-‘আইজ বুজবি না বুজবি কাইল চালুন আনো দুধ দুয়াই।’

-‘বুড়ি পুরান প্রবাদ ছাইড়া যা কওয়ার সোজাসুজি কও।’

-‘বইনরে সংসার ধর্ম এত সুজা না। আর সংসারধর্ম তখনই সাজাইতে পারবি যখন তুই তোর সুয়ামিরে বাইন্ধা রাখতে পারবি৷’

-‘ক্যান সুয়ামিরা কী চার পা বিশিষ্ট গরু-ছাগল যে বাইন্ধা রাখা লাগবো?’

-‘ গরু ছাগল না হইলেও তাদের বান্ধা লাগে। কী দিয়া বান্ধা লাগে জানোস? ভালোবাসা, বিশ্বাস, আর বুদ্ধি দিয়া। আর পুরুষদের মুনে রাগ, জেদ, দম্ভ, বেশি হইবোই। যদি না হয় তয়লে কেমন পুরুষ তারা? আরেকটা সত্যি কথা জানোস?পুরুষের মানুষের যতই রাগ, জেদ, দম্ভ, থাকুক তা চূর্ণ করে এক মাইয়া। বেলাশেষে কুনো না কুনো মাইয়ার কাছেই তারা বান্ধা পড়ে।তাই কইতাছি সংসার করতে হইলে একজন যদি আগুন হয় অন্যজনরে হইতে হইবো ঠান্ডা পানি। নাইলে তরা দু’জনই যদি আগুন হোস তগোর সংসার’ডা পুইড়া ছারখার হইয়া যাইবো। আবার দু’জনই যদি পানি হোস তয় স্রোতে গা ভাসাইয়া ডুইবা মরবি। তাই কইতাছি এহন সুমায় আছে তরা বুঝবার চেষ্টা কর।’

-‘এহন তুমি কইতাছে হের পায়ে তলায় পইড়া মইরা থাকতে? হেই আমারে মা/রধর করবো আর আমি ঠান্ডা পানি হইয়া বইয়া থাকুম। আর মুনে মুনে জব করুম হেই আমার স্বামী। হেই যখন যা করবে তাই সঠিক, হেডাই মাইনা নিতে বাধ্য।’

-‘সন্মান দিলে সন্মান পাওন যায় এডা জানোস? আইজকা তুই যদি মান ভুইলা তার দিকে আগাইয়া যাস। কাইল হেও তর কথা ভাববো, সন্মান দিবো। আর বুকে হাত দিয়ে ক তো দাদুভাই তরে বিনা দুষে মারছে? তুই ক্যান হক্কলের সামনে তারে এতিম কইছোস? হেই কী এতিম যে এতিম কইছিস?
দুনিয়া ভর্তি আত্মীয় স্বজন থাকতে তারে এতিস কস কোন হুশে? একথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেি তরে আছাড় মারা উচিত আছিল। কিন্তু আমার দাদুভাই তা করে নি কারণ হেই তোর মতো মাডা মোটা না। আর কুনো ফকিরকে যদি তার সামনে গিয়া কস ফকির আইসে, ভিক্ষা দাও। সেই ফকির কিন্তু মুন খারাপ করব কারণ তার দিলেও ব্যথা লাগে। কেউ কী সাধে চায় ফরিক হইতে? হক্কলেই চায় রাজা হইতে, কিন্তু আসলে কী হয়? হয় না। কারণ রাজা হওয়া তার নসীবে নাই। তেমনি
ধর, আমার দাদুভাইও তাই। ‘

-‘এহন যতই মন ভোলার কথা কও বুড়ি সব দোষ তোমার নাতীর’ই।’

-‘হ তর কুনো দোষ নাই। তুই সাধু। তয় আমার সামনে ফুন দিয়া খোঁজ ল দেহি।’ ‘

-‘পারব না। হের লাইগা তোমার পরাণ পুড়তাছে তাই তুমিই দাও।’

একথা শুনে দাদীমা রেগে আর একটা কথাও বললেন না। হাতে থাকা বাটন ফোনটা চোখের সামনে নিয়ে নাম্বার বের করে কাউকে কল করে কানে ধরলেন। প্রথম বারের বেলায় কেউ কল ধরল না তবে দ্বিতীয়বার কল করার আগেই কল এলো। বুড়ি পানে লাল করা ঠোঁটে মুখভর্তি হেসে বললেন,

-‘বাসর রাইতের পরদিনই পলাইয়া গেলা দাদু ভাই? আহারে!
তয় তুমার সমস্যাখান চুপি চুপি আমারে কইতে পারতা? মুই তোমার এমন একখান বাটনা খাওয়াইতাম একদিনেই চাঙা হইয়া যাইতা।’

-‘আমি একদম ঠিক আছি ডালিং। তুমি তোমার বুইড়ারে গিয়া বাটনা খাওয়াও। আমার ওসব বাটনা টাটনা লাগবো না আমার। আল্লাহ দিলে এমনিই বহুত চাঙ্গা আছি।’

-‘কেমন চাঙ্গা বুঝবার পারছি দাদুভকই। তয় তোমার বউই কইইতাছে তুমি কাপুরুষের মতো না বইলা পলায় গ্যাছো।’

একথা শুনে স্পর্শী শব্দ করে হাসতে লাগল। কাপুরুষ বলায় রুদ্রর মুখখানা কেমন পাংশুটে হয়েছে তা বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে তার। বীরপুরুষের মতো শিনা উঁচু করে বেড়ানো সেই রুদ্রকে বলেছে কাপুরুষ। কথাটা রুদ্রর হজম করা কথা না।
দেখা যাক জবাবে কি বলে?ফোনের ওপার থেকেই রুদ্রের কানে পৌঁছেছে কারো প্রাণখোলা হাসির শব্দ। কে হাসছ? চিনতে কষ্ট হয় নি তার। তবে স্পর্শী দাদীমার পাশেই আছে জেনে ত্যাড়াভাবে জবাব দিলো,

-‘তোমার নাতনি রাণী এলিজাবেথের ন্যায়। আমার বংশের সবচেয়ে যোগ্যতাসম্পূর্ণ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত মেয়ে সে। যার রুপ, গুনের, জুরি মেলাও ভার। এমন যোগ্যতাসম্পূর্ণ এক মেয়েকে ধরা ছোঁয়ার সাধ্য কী আর এই এতিমের আছে? তাছাড়া কাউকে না ধরে, না ছুঁলে, কাপুরুষ বলা সুস্থ কোনো মানবীর কাজ নয়, তাই না?’

রুদ্রর এমন অপমানেজনক কথা শুনে স্পর্শী এবার চেঁচিয়ে উত্তর দিলো,

-‘দাদীমা তোমার নাতিকে বলে দাও তার জন্য এই স্পর্শী মরে যাচ্ছে না। তার ছোঁয়া না পেয়ে কেঁদে কেঁদে জীবন শেষ দিচ্ছে না। মোদ্দাকথা, সে আমার কাছে এতটাও গুরুত্বপূর্ণ কেউ নয়।’

-‘আজ নাহয় কেউ আমার বিরহে কেঁদে ম/রছে না কাল যে এমনি থাকবে এর গ্যারান্টি কি?’

-‘ এর গ্যারান্টি আমি নিজে। সে আজ অথবা কাল যা ইচ্ছে করছে করুক তাতে আমার যায় আসে না।’

-‘আমার বুকে অন্য নারী থাকলেও না।’

আচমকা এমন কথা শুনে স্পর্শী কেন জানি থমকে গেল।
স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল দাদীমার দিকে। তারপর কিয়াৎকাল নিশ্চুপ থেকে জোর গলায় জবাব দিলো,

-‘যে থাকার সে এমনিই থেকে যাবে।’

-‘পৃথিবীর সবচেয়ে থার্ডক্লাস মার্কা যুক্তি এটা। বিপরীতে থাকা মানুষটাকে প্রাপ্ত সন্মানটুকুও দিবে না। মানুষ বলেই গ্রাহ্য করবে না। আর তোমার তুচ্ছ তাচ্ছিল্য সহ্য করতে অপর ব্যক্তি থেকে যাবে। এত সোজা?তবে তোর দিক থেকে লেইম যুক্তিটাই সঠিক। কারণ তুই বখাটে নেশাখোর জুটাতে পারিস, নেশাখোরের হাতখরচও দিতে পারিস। আর এসব নেশাখোররা আত্মসন্মান খুঁইয়ে হাতখরচ পেতে তোর জন্য থেকে যেতে পারে। তাই আমার মতো একটা রুদ্রকে হারালে তোর কিচ্ছু আসবে যাবে না কারণ তার কাছে তো হাজারটা মাশুম আছে, থাকবে।’

একথা বলে রুদ্র কল কেটে দিলো। আর তার গা জ্বলানো কথাগুলো শুনে স্পর্শী রাগে দুঃখে কেঁদে দিলো। মাশুম যে এত খারাপ সে কীভাবে জানবে? আর তাদের পরিচয় মাত্র সাতদিনের। এই সাতদিনে কীভাবে বুঝবে সে। আর এখানে আরেকটা ভুল বুঝেছে সকলে। সে মাশুমের সঙ্গে পালিয়ে যাচ্ছিল না। বরং মাশুমের জোড়াজুড়িতে স্কুলে ফাঁকি দিয়ে ঘুরতে গিয়েছিল। প্রেম করলে নাকি মাঝে মাঝে স্কুল ফাঁকি দিতে হয়, লুকোচুরি প্রেমে নাকি অনেক মজা। এসবকিছুর সঙ্গে নতুনভাবে পরিচিত হচ্ছে সে। তাছাড়া মানুষ ঠকেই তো শিখে। অথচ তাকে ভুল শুধরানোর সুযোগই দিচ্ছে না কেউ। মাশুমের সঙ্গে ব্রেকআপ হওয়ার ঘন্টা খানিক পরেই রুদ্রর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলো। একবারও কেউ বুঝার চেষ্টা করল না তার মনের উপর দিয়ে কী যাচ্ছে। যতই সাতদিনের প্রেম হোক মায়া বলে তো কিছু আছে নাকী! আর এসবের চাপে রাগের বশেই রুদ্রকে ছোট বড় অনেক কথা বলে ফেলেছে।
যেসব বলা মোটেও উচিত হয় নি তার। বলার পরে উপলব্ধি করেছে সে ভুল করেছে। মুলত রুদ্র বিয়ের না করার হেতু হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছিল ওই ব্যাপারটা। কিন্তু কাজের কাজ কিছু তো হলেই না বরং বড় বাবা আর বড় মাকে কষ্ট দিলো। এখন তাদের সামনে যেতেও লজ্জা লাগছে। আর না
মাফ চায় মুখ আছে তার। এখন সেদিনের রেশ ধরেই রুদ্র তাকে অপমান করছে, গা জ্বালানো কথা বলছে। এখন এটা করা কী উচিত হচ্ছে? এসব তিক্ত কথা শুনে তার কী খারাপ লাগছে না, সে কী কষ্ট পাচ্ছে না? পাচ্ছে তো, খুব কষ্ট পাচ্ছে সে। সেদিনের পর বাবা মাও তেমনভাবে কথা বলে না। যেঁচে কিছু জিজ্ঞাসা করলে বলে নয়তো চুপ করে তার মুখপানে তাকিয়ে থাকে। এতকিছু হবে জানলে মাশুমের সঙ্গে দেখা তো দূর কখনো কথাও বলতো না। এখন ওর নিজের কাছে নিজের ছোট লাগছে। মনে মনে অপরাধবোধ কাজ করছে।
একা একা এসব ভেবে সে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগল । আর তাদের দু’জনের কথোপকথন শুনে দাদীমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে রইল। দু’জনেই জেদি। এদের নিয়ে কী যে করবেন ভেবে পাচ্ছেন না তিনি।

________________________

আজ বৃহস্পতিবার! ঘড়িতে রাত নয়টা বেজে সাত মিনিট।
হসপিটালের ওটির সামনে সদ্য এক ফুটফুটে বাচ্চা কোলে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে এক দম্পত্তি। বাচ্চাটাও ভূমিষ্ট হওয়ার পর থেকেে কান্না করেই যাচ্ছে একাধারে। ধীরে ধীরে তার কান্না গতি কমার পরিবর্তে বেড়েই যাচ্ছে। কান্নার চোটে মুখটা লাল টকটক করছে। যেন স্পর্শ করলেই রক্ত ঝরবে।
বাচ্চাটার এমন কান্না দেখে ওই দম্পত্তি দিশেহারা হয়ে গেল।কোনোভাবেই বাচ্চার কান্না থামছে না দেখে তারা শরণাপন্ন হলো ডাক্তারের চেম্বারে। ডাক্তার চেকাপ করে তেমন সমস্যা পেল না। তবে একটা দুধের নাম লিখে দিলেন। সঙ্গে বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে খাওয়াবে। তারপর হসপিটালে থাকাকালীন দুধ কিনে বাচ্চাটাকে খাইয়েও দেওয়া হলো। পেটের ক্ষুধা মিটতেই ঘুমে তলিয়ে গেল বাচ্চাটি। নয়তো এতক্ষণ চেঁচিয়ে তাদের অন্তর আত্মা শুকিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এখন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে দেখে বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে ছলছল চোখে তাকিয়ে হেসে ফেললো সেই দম্পত্তি। এবং বাচ্চাটির ছোটো ছোটো হাত স্পর্শ করে কপালে চুমু এঁকে নাম ঠিক করলেন ‘স্পর্শী।’
কিন্তু তখনই কে বা কারা যেন এসে স্পর্শীকে টানা হেঁচড়া
করতে লাগল। উনাদের কোল থেকে কেঁড়ে স্পর্শীকে নিয়ে দৌড়ে চলে গেল বিপরীত পথে। সে পথের শুধু আঁধার আর আঁধার। আঁধারের ভিড়ে কাউকে দেখা গেল না। আর না পেলেন স্পর্শীর কান্নার আওয়াজ।

স্বপ্নে এইটুকু দেখে মরিয়ম বেগমের ঘুম ভেঙে গেল। হাঁতড়ে খুঁজে বেড়ালেন ছোট্ট স্পর্শীকে। কিন্তু স্পর্শী কই? বিছানায় স্পর্শীকে না দেখে উনি চট করে উঠে ছুঁটলেন পাশের রুমে।
উন্মাদের মতো দৌড়ানোর কারণে শাড়ির আঁচলটা লুটিয়ে
পড়লো টাইলসের মেঝেতে। চোখ দিয়ে ঝরছে অশ্রুধারা।
কান্নার চোটে উনার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তবুও উনার হুশ নেই।
উনার মাথায় শুধু একটা কথায় ঘুরছে কে বা কারা স্পর্শীকে নিতে এসেছে। স্পর্শী উনার দিকে হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে কেঁদে বলছে, ‘আমি শুধু তোমার মেয়ে মা। আমাকে তোমার সঙ্গেই রাখো মা, আমাকে যেতে দিও না, বাঁচাও আমাকে।’

স্পর্শীর রুমের দরজা সর্বদা হালকা করে ভেজানোই থাকে।
কারণ স্পর্শী রাতে একা থাকতে ভয় করে। মাঝে মাঝে মা! মা! করে ডাকতে ডাকতে ঘুমের ঘোরেই হাঁটা ধরে। চারদিন হলো মেয়েটার সঙ্গে কথা বলে নি উনি। কথা না বলার মুখ্য কারণ রুদ্রকে সকলের সামনে অপমান করা। রুদ্রকেও খুব
ভালোবাসেন তিনি। এর বিশেষ এক কারণ আছে বটে। সেই কারণবশত রুদ্রও উনার কলিজার টুকরো। সে কলিজাকে স্পর্শী কষ্ট দিয়েছে, অন্যায়ভাবে কটু কথা বলেছে। এটা উনি মানতে পারে নি এজন্য রাগের বশেই স্পর্শীকে খাইয়ে দেন নি, চুল বেঁধে দেয় নি। মেয়েটা কতবার যে পেছনে ঘুরে মা! মা! করে ডেকেছে তাও সাড়া দেন নি। এসব কথা ভেবে উনি ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগল। তারপর ধীর পায়ে স্পর্শীর খুব কাছে গিয়ে মেয়েটাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিলেন। আর বিরবির করতে বলতে লাগলেন,

-‘আমিই তোর মা আর তুই আমার কলিজা। রুদ্র আমাকে ওয়াদা করেছে,কেউ নাকি তোকে আমার থেকে কেড়ে নিতে পারবে না, কেউ না, কখনো না। রুদ্র আছে না রুদ্র, সে আর আমি কাউকে কাড়তেই দিবো না। আমরা আছি না, আমরা তোকে খুব ভালোবাসবো, এভাবে শক্ত করে ধরে বুকের মধ্যে আগলে রাখব।’

To be continue…..!!!