Friday, August 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 461



প্রেম প্রার্থনা পর্ব-২২

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[২২]

___’যার যেখানে শান্তি মেলে তার সেখানেই মিলুক ঠাঁই।’___

ব্যস্ততায় ডুবে উক্ত মেসেজেটি দেখে রুদ্র নিজের কাজে মন দিলো। প্রিয়সীর মেসেজ দেখে পাল্টা মেসেজ করার সময়ও তার নেই। তবে মনের মধ্যে দোল খেলে গেল টুকরো টুকরো প্রশান্তির ভেলা। আর প্রশান্তির কারণ অতি প্রিয় মানুষটার মুখশ্রী, আইসক্রিম লেগে থাকা গোলাপি ঠোঁটের মিষ্টি হাসি।
মনে মনে খুশি হলেও সে থমথমে মুখে ভ্রুঁজোড়া কুঁচকে বসে রইল। তার মেজাজ বিগড়ে আছে সকাল থেকেই। নির্ধারিত সংখ্যায় ব্যলোট পেপার ছাপানোর কথা অথচ সেই অনুযায়ী কাজ হয় নি। বরং তার কাজ স্থগিত রেখে বিপক্ষদলের এক ছেলে সেখানে হাঙ্গামা বাঁধিয়ে একজনের হাত-পা ভেঙেছে।
আর প্রচার করেছে সব দোষ রুদ্রর ছেলেদের ;তারাই নাকি এসব করেছে। অথচ রুদ্রর ছেলেরা কয়েকদিন ধরে তাদের
যে যার কাজে ব্যস্ত আর বেশিরভাগ প্রচারের কাজে বাইরে বাইরে ঘুরছে, দম ফেলানোর জো নেই তাদের। রুদ্র নিজের মিটিং শেষ করে বের হতেই এ খবর তার কানেও পৌঁছেছে। এমনকি এটাও শুনেছে দুটো ছেলে তার বাসার গলির কাছে
অনেকক্ষণ ধরে নজর রাখছে।রুদ্র ছেলে দুটোর উপর তীক্ষ্ণ
দৃষ্টি রাখতে বলে ফোনটা পকেটে পুরে রাস্তা পার হয়ে চায়ের দোকানে এসে বসলো, গলা ছেড়ে বলল কড়া করে চা দিতে, মুন্সি কাকা গালভর্তি হেসে মাথা নাড়ালেন অর্থাৎ এইটুকুন
দাঁড়াও বাপজান এই এক্ষুণি দিচ্ছি। মুন্সি কাকা বোবা অথচ হাসিটা ভুবন ভোলানো, শ্যামবর্ণ গাত্রের মানুষটা খুবই সরল গোছের। জন্ম থেকেই বোবা বিধায় বিয়ে-থা করে নি। উনার বিধবা মাকে আর ছোট ভাইকে নিয়ে উনার সংসার।বর্তমানে
কোনো কর্মই ভাগ্যে জুটি নি বিধায় সামান্য পুঁজি দিয়ে এই
চায়ের দোকান খুলে বসেছেন, বেচা বিক্রি ভালোই হয়, এতে
খাওয়া পরার খরচা দোকান থেকেই মিটাতে পারেন। সমস্যা হলে রুদ্র আছে, আজ অবধি অনেকবার রুদ্র তাকে সাহায্য করেছে কখনো সরাসরি কখনো বা আড়ালে থেকে। এজন্য ছেলের বয়সী রুদ্রকে উনি খুবই ভালোওবাসেন। পরিবারের
হাল চাল জানতে চেয়ে রুদ্র সামনে পেতে থাকা বেঞ্চে বসতে না বসতেই কাফি গাড়ি নিয়ে হাজির হলো। রুদ্রকে সালাম দিয়ে ডাক্তার কী বলেছে না বলেছে সব একে একে জানাল। স্পর্শীদের বাসায় রেখে সে এখানে এসেছে চিন্তা কারণ নেই বাসার সবাই নিরাপদে আছে। রুদ্র চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে
কাফির কথায় শুনছিল। হঠাৎ খেয়াল করে কাফি মিটিমিটি হাসছে তা দেখে রুদ্র ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালে কাফি পকেট থেকে চারটা হজমি বের করে রুদ্রর হাতে দিলো। এটা তার ভীষণ অপছন্দের জিনিস। তবে রুদ্রর বুঝতে বাকি রইল কে তার জন্য পাঠিয়েছে। বাসার বাইরে তাও না খোঁচালে শান্তি পায় না মেয়েটা, বিচ্ছু একটা। সব সময় দুষ্টু বুদ্ধি তার মাথায় ঘুর পাক খেতেই থাকে। চা শেষ করে উঠে দাঁড়াতেই রুদ্রর ছেলে পেলে এসে হাজির হাঙ্গামা করা ছেলেটাকেও ধরে এনেছে।
রুদ্র ছেলেটার আগাগোড়া দেখে নিয়ে শান্ত স্বরেই বলল,

-‘ লাস্ট আরেকটা সুযোগ দিচ্ছি আমাকে খোঁচাতে আসিস না, আই রিপিট, আমাকে খোঁচাতে আসিস না। নয়তো আমার ছেলেরা তোকে গরম ডিম থিরাপিতে দিতে একটুও কার্পণ্যবোধ করবে না।’

-‘আমার ভাইও তোকে …! ”

উক্ত কথাটা বলার আগেই কাফি ছেলেটার বুক বরাবর এক লাথি বসিয়েছে। লাথির ভর সইতে না পেরে ছেলেটা মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। রুদ্র আঙুল দিয়ে কান ঘুচিয়ে কাফির দিকে তাকাতেই কাফি রুদ্রর মাকে ভিডিও কল দিলো। ছেলেটাকে ভিডিও কলে দেখিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিলো এই ছেলেই কী না।
যখন নিশ্চিত হয়ে নিলো তখন রুদ্রকে বলল,

-‘ মাস তিনেক আগে বড় মায়ের হ্যান্ড ব্যাগ চুরি করে ছুরি দিয়ে আঘাত করে পালিয়েছিল এই ছেলেটাই। এজন্যই বলি শালাকে এত চেনা চেনা লাগে কেন!সেদিন ভিড়ের মধ্যে এত খুঁজেও পাই নি। আজ হাতে পেয়েছি একে তো জন্মের শিক্ষা দিতেই হয়।’

-‘তুমি সিওর?’

-‘জি স্যার।’

-‘এক কাজ করো এর খাতির দারি পরে কোরো এখন চলো কাজ আছে।’

-‘ওকে স্যার।’

তারপর ছেলেটাকে শাল্টুর কাছে রেখে ওরা বেরিয়ে গেল।
জরুরি কাজগুলো সেরে নাহয় ছেলেটার আদর যত্ন করবে।
স্পেশাল আদরে তাড়াহুড়ো করতে নেই এতে আদর যত্নের ত্রুটি থেকে যায়। ওদিকে আরেকটা গরম খবরে তোলপাড় মিডিয়া জগৎ। রুদাশার বাবার নামেও কেস ফাইল হয়েছে,
পালক পিতা মাতাকে খুনের অপরাধে। রুদ্রনী শেখ নিজেই উপযুক্ত প্রমাণ নিয়ে নিজের বাবা- মায়ের খুনের অপরাধীর শাস্তি পেতে পুলিশের দ্বারে হাজির হয়েছে। উপযুক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে এ্যারেন্ট ওয়েন্ট নিয়ে পুলিশ গ্রেফতার করতে গিয়ে দেখে উনি পলাতক। রুদ্রাণীর বাবা মায়ের বিয়ের বিশ বছর পরেও কোনো সন্তান হয় নি। পরে তিন বছর পর পর তিনটে সন্তান দত্তক নিয়েছিলেন। সবার বড় রুদাশার বাবা, তারপর রুদ্রর ছোটো মামা, এবং সর্বশেষ রুদ্রের মা। কিন্তু রুদাশার বাবা বাকি ভাই বোনদের কখনোই দেখতে পারতেন না। কেন জানি সর্বদা খারাপ ব্যবহার করে এসেছে। ধীরে ধীরে সবাই যখন বড় হলেন বুঝতে শিখলেন তখন নিজের বাবাকেদেখে
তিন ভাইবোন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
বুঝিয়েও কাজ হলো না। রুদ্রাণীও জেদ ধরে ওর পড়াশোনা শেষ করে তুখড় রাজনীতিবিদ হয়ে গেল।সময়ের পালাক্রমে
তিনভাই ভিন্ন ভিন্ন দলের হওয়াতে তিক্ততা বাড়তেই থাকল,
কথা কাটাকাটি, ফ্যাসাদ, পরিবারের সবার সঙ্গে সবার দুরত্ব বৃদ্ধি হলো। এভাবেই দিনের অতিবাহিত হতে হতে একদিন
বাসায় এসে দেখা গেল, তাদের বাবা মাকে কে বা কারা যেন
মেরে ফেলেছে। গলা, হাত ও পায়ের শিরা কাটার পরেও খুব কষ্ট দিয়ে শ্বাসরোধ করে মেরেছে। এই কাজটা কে বা কারা করেছে এতদিন ধরা সম্ভব হয় নি। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বিগত পরশু এক পার্সেল এসেছিল রুদ্রাণীর কাছে, সেখানে ছিল খুনের বিরবণ এবং উপযুক্ত প্রমাণ।
________________________________________________

বন্ধ রুমের এককোণে গুঁটিশুঁটি হয়ে বসে আছে রুদাশা। ওর চোখের কোণা অশ্রুতে ভেজা। দুই হাঁটুতে মুখ গুঁজে এখনো কেঁদে যাচ্ছে সে। ছাব্বিশ বছর বয়সে কখনো খাওয়ার জন্য কাঁদে নি চাওয়ার আগে খাবার সামনে চলে এসেছে। এতেও ভীষণ বিরক্ত হতো, বিরক্তের চোটে কতবার খাবার ছুঁড়েছে তার ইয়াত্তা নেই।অথচ এখন প্রতি বেলায় পেটপুরে খাওয়ার জন্য কাঁদতে হয়। কাবার্ড ভর্তি অসংখ্য জামা কাপড় থাকা সত্ত্বেও এতদিন ধরে এক কাপড়ে আছে।নিজের ঘামের গন্ধে নিজের কাছে অস্বত্তি লাগছে। শখের চুলে চিরুনি লাগায় নি কয়েকদিন যাবত। নরম তুলতুলে বিছানা ছাড়া ঘুম আসে না অথচ এখন ঘুমাচ্ছে মেঝেতে শক্ত মাদুর পেতে। এভাবে কি বাঁচা যায়? রোজ একবার হলেও শিহাব খাবার দিতে আসে কিন্তু আজ আসে নি।আর না এ রুমে আছে শুকনো খাবার!
আজ সারাদিন ধরে শিহাবের অপেক্ষা করছে, কারণ শিহাব এলেই সে পেটপুরে খেতে পারবে। এমন দিনও দেখার বাকি ছিল অথচ ওই মানুষটাকে প্রচন্ড রকমের ঘৃণা করে, প্রচন্ড ঘৃণা! ভাগ্যের পরিহাস আর পরিস্থিতি মোতাবের এখন ওই ঘৃণিত মানুষটার জন্যই অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এর জন্য ওই রুদ্র দায়ী! কতদিন এভাবে আঁটকে রাখবে তাকে? কতদিন?
একদিন তাকে মুক্তি দিতে হবে, তখন কি করবে রুদ্র? তখন পারবে তো তার বাচ্চা বউকে সামলাতে, সর্বদা চোখে চোখে
রাখতে ? মোদ্দাকথা, তার হাত থেকে বাঁচাতে? এসব নানান কথা ভেবে রুদাশা যখন কাঁদতে মগ্ন তখন কেউ দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। মাথা তুলে দেখে শিহাব দাঁড়িয়ে আছে
তবে নিত্যদিনের মতো মুখে হাসি নেই। রুগ্ন মুখ, পরনে সাদা কালো মিশেলের টিশার্ট আর জিন্স। শিহাব ঘাড় ঘুরিয়ে এক বার রুদাশার দিকে তাকিয়ে প্যাকেটগুলো মেঝেতে রাখল।
তারপর আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজে বলল,

-‘মাছ ভাত এনেছি খেয়ে নিন। আর আগামীকাল আসতে না পারলে শুকনো খাবার এনেছি ওগুলো খেয়ে নিয়েন।এখানে দু’টো ড্রেস আছে চাইলে পরতে পারেন।’

-‘পৃথিবীর নিকৃষ্টতম পাপীকেও বোধহয় সারাদিনে একবেলা খেতে দেওয়া হয়, পরনের পোশাক দেওয়া হয়, আপনারা কী করছেন হ্যাঁ? এ কেমন ধারার সাজা?’

-‘বাড়তি কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। শুধু এইটুকুই জেনে রাখুন যতদিন বেঁচে থাকবেন এভাবেই রুমবন্দী হয়ে থাকতে হবে আপনাকে।’

-‘সামান্য একটা অপরাধে এত কঠিন সাজা? আমি মানি না এই শাস্তি। আমার বাবাকে খবর দিন আমি আবার আপিল করাবো। আপনারা যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন না, পাওয়ার আমাদের হাতেও আছে।’

-‘গতরাত থেকে আপনার বাবাও পলাতক। উনার বিরুদ্ধে কেস ফাইল করা হয়েছে, পুলিশ উনাকে হন্ন হয়ে খুঁজছে।’

-‘ কেস ফাইল? কে করেছে? কার এত বুকের পাঁটা?’

-‘রুদ্রাণী শেখ উরুপে রুদ্রের মা, আপনার আপন ফুপি।’

-‘কেন? কি করেছে আমার বাবা?’

-‘উনি উনার বাবা-মাকে পরিকল্পনা মাফিক মেরেছে। রুদ্রাণী শেখের জাহির করা প্রমাণের ভিত্তিতে এ্যারেন্ট ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছে। পুলিশ হন্ন হয়ে খুঁজছে উনাকে। সোশ্যাল মিডিয়াসহ তোড়পাড় এই একটা নিউজেই। রাজনীতির পদ থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছে আপনার শ্রদ্বীয় পিতৃদেবকে।’

এ কথা শুনে রুদাশা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। কি হচ্ছে কী এসব! রুদ্র আর তার মা হঠাৎ ওদের পেছনে লাগল কেন? কোন স্বার্থে? সম্পত্তির নয়তো? ওদের এত সম্পত্তিতে হচ্ছে না? রুদাশাকে ভাবনায় বিভোর দেখে শিহাব পূর্বের মতোই রুমে তালাবন্ধ করে স্থান ত্যাগ করলো। চৈতন্য ফিরে রুদাশা গলা ফাটিয়ে ডাকলেও ডাক শুনল না। শুনবে কেন?যতটুকু
বলার বলে দিয়েছে এ নিয়ে আর একটা বাড়তি কথা বলতে পারবে না সে। বাপ বেপি শয়তানের শয়তান এদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া দরকার।
________________________________________________

রাত্রি দশটা! বাসার প্রতিটা সদস্য টিভির সামনে বসে আছে।
টিভিতে চলছে দশটার সংবাদ। রুদাশার বাবার সন্ধান মিলে নি তবে হন্ন হয়ে খোঁজ চলছে।বড়রা গম্ভীর মুখে বসে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে।স্পর্শী এখানে ভালো লাগছে না বিধায় হাঁটতে হাঁটতে রান্নাঘরে এসেছে।এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু পেলো না দেখে একমুঠো কিসমিশ নিয়ে মুখে পুরে চিবাচ্ছে।
হঠাৎ কিছু ভেবে দুই গ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে ফ্রিজে রেখে হালকা নাস্তা সাজিয়ে নিলো। মিনিট পাঁচেক আগে বড় বাবা রুদ্রকে ফোন করেছিল তখন জানা গেছে তার ফিরতে আর দশ মিনিট সময় লাগবে। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীরে বাসায় ফিরে ঠান্ডা ঠান্ডা শরবত পেলে নিশ্চয়ই খুশি হবে। তাছাড়া রুদ্রকে খুশি করার টোটকাও দাদীমা কানে কানে বলে দিয়েছে। ইশ! এই বুড়ির মুখে কিচ্ছু আঁটকায় না। স্পর্শী যখন এসব ভেবে মিটিমিটি হাসছিল তখন গাড়ির হর্ণের শব্দ পাওয়া গেল।ওই
তো এতক্ষণে মহারাজের আসার সময় হয়েছে। সেই সকালে বেরিয়ে কেবল ফিরছে। সারাদিনের কাজের ভিড়ে হয়তোবা ভুলে বসেছে সে বর্তমানে বিবাহিত, তার একটা বউ আছে।
রুদ্রকে বকতে বকতে স্পর্শী রান্নাঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে মোটা থামের পেছনে লুকালো। একবার মাথা বের করে উঁকি দিয়ে দেখে নিলো কাফি পেছনে আর রুদ্র সামনে দু’জনেই কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে। তাদের পদধ্বনি নিকটে আসতেই সে উচ্চশব্দে চেঁচিয়ে ভাউউউ! করে উঠল। ওদের দু’জনের কেউ চমকানো তো বহুদূর একটু ভড়কালোও না।
এত সুন্দর একটা পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে দেখে ঠোঁট উল্টো কিছু বলার আগে কাফি বলল,

-‘আরে রে রে আপু কাঁদছো নাকি তুমি হ্যাঁ? আমি তো মনে মনে ভয় পেয়েছি? রাতের বেলা এভাবে কেউ ভয় দেখায়? আর একটু হলেই আমি পটল তুলতাম।’

-‘মনে মনে ভয় পেয়েছেন? মনে মনে কেমনে ভয় পায়?’

-‘মনের ভয়ই বড় ভয় তাই মনে মনে ভয় পেয়েছি এই আর কি।’

-‘ওহ আচ্ছা।’

একথা বলে কাফি ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে চলে গেল। রুদ্র স্পর্শীর মাথা থেকে পা অবধি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করে নাক মুখ কুঁচকালো। তারপর একগ্লাস ঠান্ডা পানি রুমে দিতে বলে সে স্থান ত্যাগ করলো।রুদ্রর কথামতো স্পর্শী হেলেদুলে তার বানানো একগ্লাস শরবত কাফিকে দিয়ে আরেক গ্লাস নিয়ে গেল রুদ্রর রুমে। রুদ্র রুমে আসে নি ড্রয়িংরুমে সবার সঙ্গে কথা বলছে। স্পর্শী গ্লাস রেখে ঘুরতেই কারো পুরুষালি শক্ত বুকের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে কারো বাহুডোরে আঁটকা পড়ল। সে দৃষ্টি তুলে কিছু বলার আগেই রুদ্র বলল,

-‘আপনি নাকি ছোট্ট একটা রুদ্র চান? ঘটনা কি সত্য? ‘

-‘ক কে কে বলেছে? ‘

-‘আমার মন।’

-‘আপনার মনের খেয়ে কাজ নেই ভুলভাল কথা বলে।’

-‘মন নাহয় ভুলভাল কথা বলে কিন্তু নিজের চোখে যা দেখেছি সেটা কীভাবে ভুল হতে পারে?’

-‘কি দেখেছেন?’

রুদ্র আর জবাব দিলো না স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল। ওর হাসি দেখে স্পর্শীর গাল দুটো লাল হয়ে উঠল। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে উঠল। নিজের বেয়ারা অনুভূতিকে লুকিয়ে রাখতে নিজেকে মুক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টাও করতে থাকল। তার লজ্জামাখা রাঙা মুখ দেখে রুদ্র উচ্চশব্দে হেসে উঠল। অনেকদিন পর রুদ্রকে এভাবে হাসতে দেখে স্পর্শীর ঠোঁটে হাসি ফুটলো। তখন রুদ্র তার হাতের বাঁধন শক্ত করে স্পর্শীর কানে কানে বলল,

-‘আমার রুমের দরজা খোলা থাকবে। রাতের খাবার খেয়ে
ভদ্রমেয়ের মতো সোজা এই রুমে চলে আসবেন। লজ্জায় পড়ি মরি করে যেন অন্য রুমে যাওয়া নাহয়।’

To be continue………..!!

প্রেম প্রার্থনা পর্ব-২১

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[২১]

পরেরদিন সকালবেলা_____

এখন ঘড়িতে দশটা বিশ। বাসায় পুরুষ সদস্য বলতে কাফি ছাড়া অন্য কেউ নেই। সকালের নাস্তা সেরেই যে যার কর্মে বেরিয়ে গেছেন। কাফিকে একটা কাজের দায়িত্ব দিয়ে রুদ্র গেছে জনসভায়, সেখান থেকে বেরিয়ে যাবে কমিশনারের কাছে, তারপর পার্টির ছেলেদের সঙ্গে বৈঠক আছে। তাদের খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিতে হবে প্রচারণার ব্যাপারে। আজ সারাদিন দৌড় ঝাপের উপরে থাকবে বাসায় ফিরতে পারবে বলে মনে হয় না। কাফি নিজের দায়িত্ব পালনের জন্য রেডি হয়ে ড্রয়িংরুমে বসে আছে। অলস ভঙ্গিতে উল্টাচ্ছে নিউজ পেপারের এক একটা পৃষ্ঠা। যত্তসব অহেতুক নিউজে ঠাঁসা পেপারের পৃষ্ঠা। হঠাৎ একটা পাতায় তার নজর আঁটকালো,
‘একাধিকবার প্রতারণা করায় স্বামীর হাতে নিজের স্ত্রী খুন।’
নিউজটা দেখামাত্রই কাফি মনে মনে বলল, ‘বেশ করেছে, নিজের হাতে পাপীকে শেষ করেছে। প্রতারণা শাস্তি এমনই হওয়া উচিত। আর প্রতারণা শুধু একটা শব্দই নয়। এরমধ্যে
লুকিয়ে থাকে শতশত ব্যথা, যন্ত্রণা। এরা বেঁচে থাকা মানেই পুনরায় পাপের সৃষ্টি। কাফি নিজেকে সামলে নিয়ে পেপারটা রেখে দিলো। ততক্ষণে মরিয়ম বেগম দাদীমা, স্পর্শী,ঝটপট তৈরি হয়ে এসেছে। উনাদের দেখে কাফি আসতে বলে গাড়ি বের করে ড্রাইভিং সিটি বসে অপেক্ষা করতে থাকল। সবাই এসে বসতেই সে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল মূল ফটক দিয়ে।
স্পর্শী বসেছে কাফির পাশের সিটটায়, পেছন মরিয়ম বেগম এবং দাদীমা। স্পর্শী বার দু’য়ের কাফিকে আড়চোখে দেখে ফিসফিস করে বলল,

-‘ভাইয়া, রুদ্র ভাইয়া কি হসপিটালে আসবে?’

-‘জি না।’

-‘সে এখন কোথায়, সেটা জানেন?’

-‘সম্ভবত মিটিংয়ে আছে।’

-‘চলেন, আমরা সেখানে গিয়ে তাকে চমকে দেই।’

-‘না! না! একাজ করার কথা মাথাতেও আনা যাবে না। স্যার ভীষণণ রেগে যাবে। তখন আমাদের দু’জনকেই পানিশমেন্ট দিবে।’

-‘কি আর পানিশমেন্ট দিবে? এক পা তুলে দু’কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখবে। আমরা দু’ভাইবোন কান ধরে দাঁড়িয়ে নাহয় সুখ দুঃখের আলাপ করবো। তাছাড়া,আপনার স্যার কোন সময় রাগে বুঝান আমারে?তার রাগ অলটাইম তার নাকের ডগায় নাচতেই থাকে। খারুশ একটা।’

স্পর্শীর কথা শুনে কাফি হাসছে। এরা দু’জন দু’জনকে এত ভালোবাসে অথচ কেউই ভুলেও মুখে স্বীকার করে না। অথচ একে অন্যেকে না দেখলেই, চোখে হারায়, ব্যাকুল হয়ে যায়।
মনে হয় এক জনের অনুপস্থিতিতে আরেকজন পাগল প্রায়,
উন্মাদ। তখন তাদের ছটফটানিতে স্পষ্টভাবে ধরা দেয় তারা একে অন্যের জালে ফেঁসে গেছে, এ জাল হতে মুক্তির উপায় নেই, কারণ এ জাল মায়া দিয়ে তৈরি বিশ্বাসের গাঁথুনি দিয়ে গাঁথা ভালোবাসার জাল। একে অপরকে এতটা ভালোবাসে
তবুও এদের অভিযোগের মাত্রা কমে না বরং বাড়তে থাকে। তাও যেন তেন অভিযোগ নয় অহেতুক অবান্তর অভিযোগ।
এটাও বোধহয় তাদের ভালোবাসার একাংশ। স্পর্শী তখনো ননস্টপ বকেই চলেছে তার অভিযোগের ঝুলি রুদ্রকে নিয়ে।
এই মুহূর্তে স্পর্শীর অভিযোগ হসপিটালে যাওয়া নিয়ে অথচ রুদ্রর কড়া আদেশ যেতেই হবে। সকালবেলা নাস্তার টেবিলে
রুদ্র জানিয়েছে দাদীমা আর স্পর্শীকে পুনরায় ডাক্তার দিয়ে আনতে, সে নিজে সিরিয়াল দিয়েও রেখেছে। যার যা সমস্যা হচ্ছে ডাক্তারকে খুলে বলতে, বিশেষ করে স্পর্শীকে। দাদীমা আর স্পর্শীকে মরিয়ম বেগম নিয়ে যাব, সঙ্গে কাফি থাকবে।একথা শুনে স্পর্শী কিছু বলতে গেলে রুদ্র তাকে পাত্তাই দেয় নি বরং মরিয়ম বেগমকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছে কাকে কোন ডাক্তার দেখাতে হবে। ধুরর! বিয়ের পর থেকে ডাক্তার আর হসপিটালের চিপায় পড়ে জীবনটাই কয়লা হয়ে গেল।
অন্যরা বিয়ে পর হানিমুনে যায়, রোমান্সের মজে থাকে আর তার জীবনে ঝামেলায় শেষ হয় না আর রোমান্স। তারপর হসপিটালে পৌঁছে সিরিয়াল অনুযায়ী নাম ডাকার অপেক্ষা করছে। পেশেন্টে গিজগিজ করছে চারিপাশ। হঠাৎই একটা মেয়েকে দেখে স্পর্শী ঘাড় ঘুরিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার মাথার মধ্যে খেলে গেল অন্য ভাবনা। তার থেকে খানিকদূরেই আট কী নয় মাসের এক গর্ভবতী মহিলার পেট ধরে হাঁটছে আর কাঁদছে। তাকে বাহুডোরে আগলে রেখেছে একজন পুরুষমানুষ। সম্ভবত উনিই ওই মহিলার হাজবেন্ড।
হয়তো লেবার পেইনের জন্য এভাবে হাঁটানো হচ্ছে। মেয়েটা
কাঁদছে দেখে পাশের মানুষ বারবার চোখ মুছে দিচ্ছে কীসব বলে বোঝাচ্ছে। মনে হচ্ছে বউয়ের সঙ্গে সঙ্গে উনিও এক্ষুণি কেঁদে ফেলবে। কী সুন্দর সেই দৃশ্য! একেই বলে দায়িত্ববান পুরুষ মানুষ। আচ্ছা ওই মেয়েটার জায়গায় সে আর পুরুষ টার জায়গায় রুদ্র থাকলে কেমন হতো? তাকেও কী এমন করে আগলে রাখতো? তাদের জীবনেও এমন একটা দিন
অবশ্যই আসবে, সেও মা হবে আর রুদ্র হবে বাবা। বাবা-মা হওয়ার অনুভূতিটা কেমন হবে? এখনকার মতো তখনো কী
রুদ্র কাজের বেড়াজালেই বন্দী থাকবে নাকি তাদেরও সময় দিবে, আগলে রাখবে? হসপিটালের দেখা এই দৃশ্যটুকু কেন জানি তার মনে গেঁথে গেল। মাথাতে কিলবিল করতে থাকল নিজের পরিকল্পনা।

এদিকে মরিয়ম বেগমের চিন্তার শেষ নেই। দাদীমার সমস্যা নাহলেও সবার চিন্তা স্পর্শীকে ঘিরেই। কারণ তার তলপেটে চিনচিনে ব্যথা কমছেই না জোরে হাঁটতে গেলেই ব্যথা বেড়ে যাচ্ছে। আর একটা মেয়ের শরীরে সেনসেটিভ জায়গা তার তলপেট। যেখানে পিরিয়ড হলেই বলা হয় ভারী জিনিসপত্র না তুলতে, কারণ এই সময়ে পেটে আঘাত পেলে ভবিষ্যতেও
এর প্রভাব পড়ে। আর স্পর্শী তো এত এত আঘাত পেয়েছে,
আল্লাহ না করুক ভালো মন্দ কিছু একটা হয়ে গেছে কী হবে মেয়েটার? মায়ের মন, মেয়েকে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই।কাফি
উনাদেরকে ডাক্তারের চেম্বারের কাছে বসিয়ে রিসিপশনের পাশে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। রুদ্র কল করেছে তাকেই বোধহয় কিছু বলছে। এর কিছুক্ষণের মধ্যে স্পর্শীকে ডাকা হলো। মরিয়ম বেগম মেয়েকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন।
মহিলা ডাক্তার স্পর্শীর মুখে হিস্ট্রি শুনে চেকআপ করে দুটো
টেস্ট করতে বলে রিপোর্ট দেখাতে বললেন। রিপোর্টটা দেখে তারপর মেডিসিন সাজেস্ট করবেন। তারপর স্পর্শীর টেস্ট করিয়ে দাদীমাকে ডাক্তার দেখানো হলো। রিপোর্ট দিবে কাল সকাল দশটায়। তারপর কাজ সেরে তারা বাসার পথে রওনা হলো। মাঝপথে এসে কাফিকে গাড়ি থামাতে হলো সামনেই বড় মিছিল একটা আসছে। শতশত পুরুষের মুখে জয়ধ্বনি হচ্ছে রুদ্রের নাম। মিছিলের সামনে এসে সাংবাদিকরা ছবি তুলছে, লাইভ দেখাচ্ছে। শতশত পুলিশ দেখা যাচ্ছে রাস্তার এপাশে-ওপাশে। তবে রুদ্র উপস্থিত নেই ভোটের প্রচার শুরু হয়ে গেছে আজকে থেকেই। স্পর্শী জানালা খুলে মাথা বের করে মিছিল দেখতে চাইলে কাফি নিষেধ করলো। কোথায় কে ঘাপটি মেরে আছে বলা যায় না। বিরোধীপক্ষ কেউ চিনে ফেলে পেট্রোল বোমা জানালা বরাবর ছুঁড়তেও পারে নতুবা টিয়ারসেল গ্যাস। জেনে শুনে এমন বোকামি করা যাবে না।
আজ থেকে পুরোদমে ভোটের প্রচার শুরু সেই সাথে বাড়তি সর্তকতাও। তাছাড়া রুদ্র বারংবার বলেও দিয়েছে মাঝপথে যেন গাড়ি না থামায়,এমনকি কেউ যেন জানালাও না খুলে।
রুদ্রর কথায় সে অক্ষর অক্ষরে পালন করছে। কিন্তু তাতে স্পর্শী বিরক্ত হয়ে উঠল ভোঁতা মুখে বসে রইল, জানালা বন্ধ থাকায় দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। ওদিকে মরিয়ম বেগমের
কোনো হেলদোল নেই উনি নিজের ভাবনায় মশগুল। পাশের সিটে বসে দাদীমা মনের সুখের পান চিবিয়ে যাচ্ছেন।উনাকে
পান খেতে দেখে ডাক্তার অনেক উপদেশও দিয়েছেন। জর্দ্দা টর্দ্দা খাওয়া নিয়ে দুটো হাদীস শুনিয়েছেন। ডাক্তারের বলা কথাগুলো উনি মনযোগ দিয়ে শুনে মাথা নাড়িয়েছেন। যার অর্থ সবকথা সুস্পষ্টভাবে বুঝছেন। তারপর ডাক্তার দেখিয়ে
বাইরে এসে আঁচলে বাঁধা পান মুখে পুরে তখন থেকে আপন মনে চিবিয়েই যাচ্ছেন। মুখে সুখী সুখী ভাব। এত সুন্দর করে বোঝানোর পরেও উনাকে পান খেতে দেখে মরিয়ম বেগম কিছু বলার আগে দাদীমাই জবাব দিলেন,

-”শুনো মেজো বউ শ্যাষ বয়সে এই পানই জান, পানই মান, পানিবিহীন টিকে না পরাণ। উঠতে, বসতে, খাইতে, শুঁইতে এই পানই আমাগো সঙ্গী। তাছাড়া ওই ডাক্তরডা বেশি বুঝে, অতিরিক্ত কথা কওনের ডাক্তর (ডাক্তার) পছন্দ না আমার।
আমার রোগ শোক না পাইয়া হুদাই বকা শুরু করছে।’

-‘ মানবেনই না যখন তখন ডাক্তারের কথা শুনে বিজ্ঞদের মতো মাথা নাড়াচ্ছিলেন কেন?’

-‘খাইয়া আমার কাম নাই হের আজাইরা বকবক শুনতে যাব। তহন আমি পানি চিবুচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম এতো তাড়াহুড়া কইরা পান বানানোর পরেও সুপারি, জর্দ্দা, খইর, চুন, দারুণচিনি সব ঠিকঠাকই দিসি। এর লাইগা পান এত সুধাদের (স্বাদ) হইছে।’

-‘ডাক্তার কিন্তু ঠিকই বলেছে আম্মা জর্দ্দা খাওয়া ঠিক না।’

-‘ওই পাগল ডাক্তরের কথা বাদ দাও। যারা ডাক্তরের কথা শুইন্না চলে তারাই কিন্তু আগে মরে। ডাক্তারের কওনে কথা কইছে আমার শুননের কথা এক কান দিয়া শুনছি আরেক কান দিয়া বাইর কইরা দিসি। ব্যস,হিসাব ঢিশমিশ। ওই কফি কুদ্দুসের দুকানের সামনে গাড়ি থামাবি আমি হাকিম জর্দ্দার কিনুম। ‘

দাদীমার কথা শুনে কাফি আর স্পর্শী মিটিমিটি হাসছে। এই
জর্দ্দা খাওয়া নিয়ে রুদ্রর সঙ্গেও উনার ঝগড়া লাগে। তখন তাদের ঝগড়া দেখে পেট ফেটে হাসি আসলেও কেউ হাসতে পারে না। তাছাড়া দাদীমা শুরু থেকেই কাফিকে কফি ডাকে তাই সেও কিছু মনে করে না, বরং ভালোবেসে মাঝেমধ্যেই রুদ্রর চোখ ফাঁকি দিয়ে পান, সুপারি, জর্দ্দা এনে দেয়। উনি আবার যা তা জর্দ্দা খান না, উনার হাকিম জর্দ্দায় চাই, প্রতি পিচ মাত্র পনেরো টাকা, এটা খেলে নাকি দেহ ঠান্ডা। কাফি সত্যি সত্যি কুদ্দুসের দোকান থেকে জর্দ্দা আর স্পর্শীর জন্য তিনটে আইসক্রিম কিনে আনলো। মরিয়ম বেগম খাবে না তাই স্পর্শী গাড়িতে বসেই মনের সুখে আইসক্রিম খাওয়া অবস্থায় ডজন খানিক সেলফি তুলল। তারপর কিছু ভেবে
রুদ্রর হটস্ এ্যাপে পাঠিয়ে দিলো। সেই সঙ্গে একটা মেসেজ করলো, ‘যার যেখানে শান্তি মেলে তার সেখানে মিলুক ঠাঁই।’

(বি:দ্র:- গল্প না পেয়ে যারা অভিশাপ দিচ্ছেন তাদের বলছি,
আমিও কারো সন্তান, আপনার মতো আমিও খুব আদরের।
তাছাড়া আমি সুস্থ নেই, বিগত তিনদিন ধরে বিছানা থেকে উঠতে পারি নি, চোখ আর মাথা ব্যথায় কাহিল আমি। ৪০ মিনিটের বেশি ফোনের দিকে তাকানো নিষেধ আমার।অথচ একটা পার্ট লিখতে চার থেকে পাঁচ ঘন্টা লেগে যায়। এজন্য ভেবেছি আমিই লেখালেখি ছেড়ে দিবো, তবে চিন্তা নেই এই গল্প শেষ করে তবেই ছাড়বো। শুধু এইটুকু বলবো ততক্ষণ অবধি অভিশাপ দিবেন না প্লিজ, সেসব দেখে কষ্ট লাগে।)

To be continue………!!

প্রেম প্রার্থনা পর্ব-২০

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[২০]

কিছুক্ষণ আগে স্পর্শীরা বাসায় ফিরেছে৷ বাসায় ফিরে তার মুখে ফুটে উঠেছে প্রাণোচ্ছল হাসি। বিশাল অট্টোলিকা হোক অথবা কুঁড়েঘর যার যেখানে মন টিকে সেটাই তার প্রশান্তির আবাস। এখন যেমন নিজের বাসায় পা রাখতে না রাখতেই তার মন মেজাজ ফুরফুরে রুপ ধারণ করেছে। অসুস্থবোধ অনেকটাই কমে গেছর। বুকচাপা দীর্ঘশ্বাস বিদায় নিয়েছে।
তবে মনে হচ্ছে বহুবছর পর নিজ আলয়ে পা রেখেছে। তার ছোটো থেকে বড় হওয়া এই বাসাতে। হঠাৎ তার অনুপস্থিতে বাসাটাও বুঝি তার বিরহে কেঁদেছে। মুখ মলিন করে তাকে খুঁজেছে। কিন্তু এই যে সুপরিচিত আপন আপন সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে বাসার আনাচে কানাচে। অস্বস্তিবোধ নেই সংকোচ নেই এখন অবাধ পাখির মতো চলতে পারবে, ঘুরতে পারবে। স্বাধীনতা আসলেই শান্তির আরেক রুপ। বন্দী জীবন সত্যিই ভীষণ কষ্টের, এ’কদিনে হারে হারে টের পেয়েছে।

স্পর্শীকে ফ্রেশ হতে বলে মরিয়ম বেগম পোশাক পরিবর্তন করে ছুটলেন রান্নাঘরে। ঝটপট নাস্তাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
মেয়েটাকে ওষুধ খাওয়াতে হবে খালি পেটে ওষুধ খাওয়ানো যাবে না। এদিকে স্পর্শী তার বাবার সঙ্গে দেখা করে মনপ্রাণ জুড়িয়ে কত কথা বলছে। পুনরায় তার প্রাণোচ্ছল চঞ্চলতা উপচে পড়ছে সর্বাঙ্গ জুড়ে। বাচালরাণীর মুখে পুনরায় কথা
ফুটেছে। মুচকি মুচকি হাসি ঠিকরে পড়ছে চিকন ওষ্ঠকোণে।
স্পর্শীর মুখপানে স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তার বাবা। মেয়ের আদুরে মুখটা অনেক শুকিয়ে গেছে, কপালে, হাতে, ব্যন্ডেজ। চট্টগ্রামে যাওয়ার পর থেকে মেয়েটা শান্তি পাই নি।
একটার উপর একটা ঝামেলা পাঁকিয়েই চলছে। বাবাকে সব কথা উগড়ে দিয়ে স্পর্শী আশেপাশে তাকাল। দাদীমা এসেই পানের বাটা নিয়ে বসে পড়েছেন। গালভর্তি পান নিয়ে ফোনে কারো সঙ্গে কথা বলছেন। স্পর্শী বাবাকে বসতে বলে মায়ের বারণ অমান্য করে গুঁটি গুঁটি পায়ে পুরো বাসা ঘুরে দেখছে।
পেট ব্যথা নেই বিধায় হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে না তবে জোরে ধাপ ফেললে চিনচিন করে উঠল। সেই ব্যথাকে অগ্রাহ্য করে সে
হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে আপনখেয়ালে। এমন কোনো জায়গা বাদ পড়ল না যেখানে তার আগমন ঘটলো না। বাসা ঘুরতে ঘুরতে তার খুশি আরো দ্বিগুন হলো যখন দেখল রজনীগন্ধা
ফুলের কলি এসেছে। তার পাশেই গোলাপের টপ। সেই গাছে তিনটে হলুদ গোলাপ ফুটেছে। কি যে সুন্দর লাগছে দেখতে!
যদিও গোলাপের চারাটা তার স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বাসা থেকে চুরি করে আনা। তখনো জানতো না হলুদ গোলাপের চারা এটা। মোদ্দাকথা, সে চুরিটাই করেছিল এক্সপেরিমেন্ট করতে। এক বর্ষণের দিনে ক্লাস টিচার আসতে পেরেছিলেন না, সেদিন তাদের প্রধান শিক্ষক ক্লাসটা নিয়েছিলেন। ক্লাস বলতে গল্পের ক্লাস। বৃষ্টি নিয়ে মজার মজার সব গল্প। একে একে স্টুডেন্টরা গল্প বলছে বাকিটা মনোযোগ দিয়ে শুনছে।
কারো কারো গল্প শুনে হাসিতে ফেটে পড়ছে পুরো ক্লাসরুম।
গল্পের এক পর্যায়ে চুরি করার কথা উঠেছিল। রবিউল স্যার নিজেও মুখভর্তি হাসি নিয়ে গর্ব করে বলেছিলেন উনি নাকি বহুবার চুরি করেছেন। যুবক বয়সে কারো গাছে ডাব, আম, পেয়ারা, এমনকি মুরগি চুরি করে পিকনিক করেছেন। আর উনি এবং উনার বন্ধুরা এসব কাজ প্রায়ই করতেন। সেগুলো সোনালি দিন ছিল। আগ্রহী শ্রোতা হয়ে উনার কথা শুনছিল
প্রত্যেকটা স্টুডেন্টে। পুরনো কথা স্মৃতিচারণ করতে করতে উনার মুখে ঝলমল করছিল অনাবিল সুখে। গল্প শেষ করে
উনি গালভর্তি হেসে একটা কথা বলেছিলেন,’চুরি বিদ্যা মহা বিদ্যা যদি না পড়ো ধরা।’ উক্ত প্রবাদটা তার ভীষণণ ভালো
লেগেছিল তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রবিউল স্যারের বাসা থেকেই কিছু চুরি করবে। তারপর যেই ভাবা সেই কাজ স্কুলে যাওয়ার পথে স্যারা বাসা পড়ে। একদিন সে স্কুলে যাওয়ার পথেই বড় গেট দিয়ে উঁকি মেরে দেখে অনেক ফুলের চারা। মনে মনে পরিকল্পনা এঁটে স্কুলথেকে ফেরার পথে আশেপাশে কাউকে না দেখে পটাপট কয়েকটা চারা তুলে ভদ্রভাবে হাঁটা ধরল। এমন ভাব করলো যেন নিজের টাকায় কিনে বাসায় নিয়ে যাচ্ছে। লোকশূন্য রাস্তায় কেউ দেখলও না তাই ধরাও খেলো না। সেদিন চারটা চারা এনেছিল একটা ছিল হলুদ গোলাপের, একটা স্ট্রোবেরির, একটা জবাফুল, আরেকটা
জলপাই। চুরি করা গাছগুলো এখনো জীবিত আছে সজীব ও সতেজ হয়ে ফুল/ফলের ধরার উপযুক্ত হয়ে উঠছে। ইশ! আর কয়েকটা আনলে ভালো হতো।পূর্বের কথা ভেবে স্পর্শী খিলখিল করে হেসে উঠল। আগামীকাল থেকে স্কুলে যাওয়া শুরু করবে। স্কুলে গিয়ে কী করবে পরিকল্পনাও করে নিলো।
তারপর সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠে রুদ্রর রুমের কাছটায় এগিয়ে গেল। কি যেন ভেবে রুমের দরজাটা খুলে জানালার পর্দা সরিয়ে অবাধ আলো প্রবেশের ব্যবস্থা করে দিলো। মুখ
বের করে বাইরে দৃষ্টি ছুঁড়ে একগাল হাসল। পূর্বালী বাতায়ণ তার শরীর ছুঁয়ে গেল। এই বাসার সবচেয়ে সুন্দর রুম এইটা, কারণ এটা এই বাসার একমাত্র রাজপুত্রের রুম। এই নিয়েও তার খুব হিংসে হতো। রুদ্র কেন এইেরুমে থাকবে? তাকেই কেন সেরা জিনিসটা দিতে হবে? সে কি এই বাসার কেউ না?
রুদ্র যেমন ছেলে সেও এই বাসার মেয়ে আর ছেলেমেয়েদের সমান অধিকার। কেউ একচুল বেশিও না কমও না। তাছাড়া বড়দের উচিত সবচেয়ে ছোটো সদস্য হিসেবে তাকেই সেরা জিনিসটা দেওয়া। অথচ উনারা করেছে উল্টো, বিগতবছরে যখন পুরো বাসা রং করানো হলো তখন যে যার পছন্দমতো নিজেদের রুম সাজিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু সে স্কুল থেকে ফিরে নিজের রুম দেখে হতভম্ব। রুমের অবস্থা দেখে রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ে সে দাদীমাকে বলেছিল,

-‘দাদীমা রুদ্রভাইয়াকে বলো উনার রুমটা আমাকে দিয়ে দিতে। আর আমার রুমটা উনাকে নিতে।’

-‘এডি কেমুন কথা? ক্যান তর রুমে কিতা হইছে?’

-‘সব রুম রং করার পরে ভাইয়ার রুম বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে।
অনেক বড় খোলামেলা সুন্দর ওই রুমটা। তাই ওটাই আমার চাই।’

-‘দাদুভাইয়ের রুম রং করনোর লাইগা দাদুভাই নিজেই রং বাইচ্ছা দিসে। রংমিস্ত্রিরে কইয়া দিসে কেমনে কেমনে করতে হইবো। মিস্ত্রি তার কথা শুইনা সেইরকমই কইরা দিসে। তুইও তুই পছন্দের কথা কইতি তাইলেই হইতো।’

-‘তোমার স্বার্থপর বেআক্কেল দাদুভাই সবসময় নিজের কথা ভাবে কেন? আমার রুমটা যদি সে নিজ দায়িত্বে রং কইরা দিতো খুব কী ক্ষতি হতো? নাকি ভাব কমে যেতো? সে ইচ্ছে করেই এমন করেছে? এই রুম নিবো না আমি। তুমি তাকে বলে আমাকে সুন্দর রুম এনে দাও।’

ওর পুরো কথা শুনে তখন কেউ পেছন থেকে বলে উঠলো,

-‘নিজের পছন্দের কাজ অন্যরা করে দিবে কেন? যে নিজের পছন্দের কথা বলতে পারে না তার এত চোটপাট কিসের? তাছাড়া তোর কমলা রং পছন্দ এজন্য মেজো মা এই রংটাই করিয়েছে।’

-‘মোটেও কমলা পছন্দ নয় আমার।’

-‘ তবে মেজো মাকে বলেছিস কেন কমলা রং তোর পছন্দ?
নিজে দোষ করে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানো অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে, ফাজিল কোথাকার।’

-‘বলেছি কি আর সাধে নাকি? সেদিন শপিং করতে গিয়ে কমলা রংয়ের একটা ড্রেস পছন্দ করেছিলাম। আম্মু নিয়ে দিচ্ছিল না তাই বলে়ছিলাম কমলা রং খুবই পছন্দ আমার।
একথা শুনে আম্মু যত বার শপিং করতে যায় কমলা রংয়ের ড্রেসই কিনে আনে। না পারি কিছু বলতে আর না পারি তার
কমলা ড্রেসেন অত্যাচার সইতে। তাছাড়া কমলা রং টা ড্রেস অবধি সীমাবদ্ধ ছিল তাই বলে রুমের রংটাও ওই ক্যাটকেটে কালার করতে হবে? এ কেমন অবিচার?’

-‘কিচ্ছু করার নেই এখন তোকে ওই রুমেই থাকতে হবে।’

-‘না! আমি তোমার রুমটা নিবো।’

-‘কেন, আমার রুম কেন?’

-‘কারণ ওই রুমটা খোলামেলা অনেক সুন্দর। ‘

-‘ওই রুমের মালিককে চেয়ে নে ফ্রিতে রুম পেয়ে যাবি।’

-‘কি বললে, জোরে বলো?

-‘কিছু না। তোকে আমার রুমের আশেপাশেও যেন না দেখি।’

একথা বলে রুদ্র প্রস্থান করেছিল। সেদিন বিরবির করে বলা রুদ্রর কথা না বুঝলেও আজ সে বুঝে, একটু একটু উপলব্ধি করতে পারে। এই রুমটা আগে থেকেই ভীষণ পছন্দের ছিল বর্তমানে রুমের মালিক আর রুম দু’টোই তার, একান্ত তার।
_____________________________________________

স্যাঁতসেঁতে বন্ধ রুমের মেঝেতে বসে কাঁদছে রুদাশা। ক্ষুধা
তৃষ্ণায় কাহিল অবস্থা। প্রায় সাতাশ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে তাও কেউ একটু পানি অবধি দেয় নি তাকে। চোখ বাঁধা অবস্থায় কোথায় এনেছে তাও জানে না। বাবাকে খবর দিতে পারলে হতো চেষ্টাও করেছিল কিন্তু শিহাবের জন্য তা সম্ভব হয় নি। বরং তার চাটুকারিতা বুঝে তাকে কয়েকটা থাপ্পড় মেরেছে। ওই কাপুরষ শিহাব এখন কোথায়? আগে তো বউ বউ করে মুখে ফ্যাঁপরা তুলে দিতো, এখন পুলিশের দায়িত্ব দেখাচ্ছে?
ওর দায়িত্ব আরো ভালো করে বুঝাবে একবার ছাড়া পাক।
সব ক’টা বেইমানকে উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে। কিন্তু এখন তার একটু পানির ভীষণ প্রয়োজন। গলা শুকিয়ে কাঠ। মনে হচ্ছে চৈত্রের খরা দেখা দিয়েছে তার পিপাসিত গলায়। ক্ষুধা জ্বালা এত যন্ত্রণাদায়ক কল্পনা করে নি সে । বাবার একমাত্র অতি আদরের মেয়ে বিধায় খাবার নিয়ে খুব জ্বালিয়েছে ওর মাকে। এটা খাবো না ওটা খাবো করে বায়নার শেষ ছিল না তার। কিন্তু ছয় মাসে আগে যখন মা মারা গেলে তখন থেকে এখন অবধি তার সেসব ফরমায়েশ খাঁটে কাজের লোকেরা। প্রতিবেলায় খাবার নষ্ট করা তার নিত্যদিনের কাজ। কিন্তু এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে পৃথিবীর জঘন্যতম খাবারটাও সে গোগ্রামে গিলতে পারবে। মোদ্দাকথা, যে কারো এঁটো খাবারের তার ঘৃণা লাগবে না। পেট কারণ, বারণ, শরম, বুঝে না সেটা যেন
এই পরিস্থিতি নতুন করে চেনালো। অন্ধকার রুমে মশার উপদ্রব বেড়ে চলেছে। চিঁ চিঁ শব্দ তুলে ছুটাছুটি করছে ইঁদুর ছানা। দুটো তেলাপোকা ঘাপটি মেরে বসে আছে রুমের এক কোণে। কি শলাপরামর্শ করছে কে জানে! রুমে একটা ফ্যান নেই, জানালা নেই, শুধু টিমটিম করে একটা লাইট জ্বলছে।
ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাঁদতে কাঁদতে রুদাশা মাটিতেই শুয়ে পড়লো।
একটুপরেই ক্যাঁচক্যাচঁ শব্দ তুলে কেউ রুমের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। শিহাব গালভর্তি হেসে হাতের খাবার পাশে রেখে হাঁটু গেড়ে বসল। তাকে দেখে রুদাশা রাগে দুঃখে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকাল। এই পুরুষটাকে কেন জানি সহ্যই হয় না। এত পরিমাণ ঘৃণা করে কখনো কাছে ঘেষারও সুযোগ দেয় নি। তাকে মুখ ফেরাতে দেখে শিহাব তাকে টেনে তুলে পাশের রুমে নিয়ে গেল। ওয়াশরুম দেখিয়ে বলল দ্রুত
ফ্রেশ হয়ে নিতে। সাদামাটা নরমাল ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বসতেই তাকে খাবার দেওয়া হলো, ভাত আর পানি মতো পাতলা ডাল তাও পরিমাণে খুবই সীমিত। রুদাশা তাই খাওয়া শুরু করলো। শিহাব দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে
দেখছে অহংকারী এক মানবীকে। বিয়ের পরেরদিন তাদের
বিশাল বড় ডায়নিং টেবিলে খেতে বসেছিল বিধায় সকলের সামনে তাকে ছোটলোক বলে অপমান করেছিল। খাবারের প্লেট ছুঁড়ে মেরেছিল মেঝেতে। নামীদামী খাবার নাকি চোখে দেখে নি তাই উপহাশ করতেও ছাড়ে নি। অথচ আজ সেই অহংকারী মেয়েটাই মোটা চালের ভাত আর পাতলা ডাল
গোগ্রাসে গিলছে। ওইটুকু ভাতে রুদাশার পেট ভরে নি তাই সে বলল,

-‘আরো খাবার চাই আমার।’

-‘আর একফোঁটা পানিও দেওয়া হবে না। আপনি শাস্তিপাপ্য আসামী, আমার বিয়ে করা বউ নন যে প্লেটভর্তি বিরিয়ানি এনে কোলে বসিয়ে জান খাও! জান খাও! বলে গান্ডে পিন্ডে গিলাবো।’

-‘তোর খুব বাড় বেড়েছে শুধু একবার বের হতে পারি।”

-‘ততক্ষণে রুদাশার অস্বস্ত্বিই বদলে দিবো, প্রমিস।’

-‘ফাঁকা চেক দিবো ইচ্ছে মতো এমাউন্ট বসিয়ে নিও শুধু বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দাও।’

-‘সরি ম্যম! আজকে থেকে আপনার বন্দি জীবন শুরু। দিনে একবার এসে খাবার দিয়ে যাবো আমি। চেঁচামেচি হাকডাক করলেও আশেপাশের কেউ শুনতে পারবে না, জনমানবহীন এলাকায় এটা। বাইরের আলো, বাতাস, রোদ, বৃষ্টি আপনার জন্য নিষিদ্ধ। আজ আসি।’

একথা বলে শিহাব গটগট করে বেরিয়ে দরজা আঁটকে চলে গেল। রুদাশা এঁটো হাতে চোখের জল ফেলতে লাগল। রুমে
দৃষ্টি বুলিয়ে তার কান্না আরো বেড়ে গেল। রুমে বিছানা নেই, মাদুর নেই, আর না আছে কোনো আসবাবপত্র। এসব নাহয় বাদ কিন্তু পেটুপুরে খাবারটুকু দিক। পূর্বের রুমের মতো এই রুমটা খুব ছোটো, দয়া করে ওয়াশরুমের ব্যবস্থা করে দিলো এই যা।জানালা তো দূর রুমে কোনো ফুঁটো আছে নাকি তাও চোখে পড়ছে না। এভাবে বাঁচা যায়! এসবকিছুর জন্য রুদ্র দায়ী। রুদ্রকে সে ছাড়বে না, কিছুতেই না। ওর বউয়ের গায়ে হাত দিয়েছে বলে এসব শাস্তি দিচ্ছে তো। আজ অথবা কাল ছাড়া তো সে পাবেই তখন নাহয় হিসাব বরাবর করে নিবে।
________________________________________________

পরশুদিন আসার কথা থাকলেও চারদিন পর রুদ্র বাসায় ফিরলো। চট্টগ্রামের সবকিছু গোছগাছ করে ফিরেছে যাতে আর যেতে নাহয়। এদিকে ভোটের দিন ঘনিয়ে আসছে। যত দিন যাবে ব্যস্ততাও তত বাড়বে। মিছিল, সমাবেশ, প্রচারের কাজে ব্যস্ত থাকবে সর্বক্ষণ। তবেএই চারদিনে বাসায় থেকে অসংখ্যবার কল এলেও কাঙ্ক্ষিত মানুষটার থেকে একটাও কল বা মেসেজ পায় নি। আর না তার কল রিসিভ করেছে।
এখন মাঝরাত! কাউকে বলে আসে নি বিধায় কেউ জেগে নেই। কাফি আর রুদ্র বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। স্পর্শীকে কল করেই যাচ্ছে রিসিভ হচ্ছে না,কুম্ভকর্ণ অলসটা বোধহয় পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। বাবা-মাকে এত রাতে বিরক্ত করতে চাচ্ছিল না কিন্তু এখন না ডেকে উপায় নেই। ওদিকে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ান রুদ্রকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যা বোঝার বুঝে নিলেন। ক্লান্ত শরীর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা পছন্দ হলো না উনার।তাই না ভেবে ফট করে কল দিয়ে বসলেন মরিয়ম বেগমকে।সন্ধ্যার দিকে মরিয়ম বেগম নুডলস এনে দেওয়ার জন্য কল দিয়েছিলেন, নাম্বারটা সামনে থাকায় সেই নাম্বারে কল দিলেন। প্রথমবারেই রিসিভ করে মরিয়ম বেগম পাশে থাকা গভীর ঘুমে মগ্ন মেয়ের দিকে তাকিয়ে পুরো কথা শুনে কল কেটে দিলেন। তারপর গিয়ে দরজা খুলে তাদের ভেতরে আসতে বলে রান্নাঘরের দিকে যেতেই রুদ্র বলে তারা খেয়ে এসেছে। তারপর কাফিকে গেস্টরুমে যেতে বলে রুদ্রও তার রুমের দিকে পা বাড়াতেই মরিয়ম বেগম পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বললেন,

-‘স্পর্শী রুমে একা আছে। তাকে একা রাখা ঠিক হবে না। একটুপর পর পেট ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে মেয়েটা।’

একথা বলে উনি উনার রুমের দিকে চলে গেলেন। আর রুদ্র দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল নিজের রুমের দিকে। হাতের ব্যাগটা রেখে পোশাক নিয়ে চলে গেল ওয়াশরুমে। জলদি ফ্রেশ হয়ে
বালিশ ঠিকঠাক করে গেল স্পর্শীর রুমে। গুঁটিশুঁটি হয়ে শুয়ে মেয়েটা। মুখে ব্যথার ছাপ। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে
গিয়ে আস্তে করে কোলে তুলে নিলো স্পর্শীকে। কপালে গাঢ় চুমু এঁকে ফিরে এলো নিজের রুমে। খুব সাবধানে স্পর্শীকে শুঁইয়ে দিয়ে দরজা আঁটকে ফাস্ট এইডের বক্স নিয়ে বসলো বিছানায়। হাত আর কপালের ব্যান্ডেজ খুলে সন্তপর্ণে ড্রেসিং করে পুনরায় ব্যান্ডেজ করে দিলো। তারপর ড্রিম লাইট অন করে বুকে টেনে নিলো অতি প্রিয় মানুষটাকে। চারদিন পর,
স্পর্শীকে দেখতে পেয়ে, ছুঁতে পেরে, অবাধ্য মনটা এতক্ষণে শান্ত হয়েছে। স্পর্শী আদুরে বিড়ালছানার মতো লেপ্টে গেছে বুকের সাথে। তখন রুদ্র হাতের বাঁধন আর একটু শক্ত করে
চোখজোড়া বন্ধ করে বলল,

-‘অনেক রাত হয়েছে এখন অভিনয় ছেড়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।’

একথা শুনে চোখ বন্ধ অবস্থায় জিহ্বাতে কামড় দিলো। এত নিঁখুত অভিনয় করেও ধরা পড়ে গেল, ইশ! কি লজ্জা, কি লজ্জা!

To be continue…..!!

প্রেম প্রার্থনা পর্ব-১৯

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[১৯]

-‘হুম অবশ্যই। তবে তুমি যদি ত্যাড়া শাশুড়ী হও তবে আমিও ছ্যাচড়া জামাইয়ের রোল প্লো করতে বাধ্য হবো।’

একথায় জবাব দিলেন না মরিয়ম বেগম থমথমে মুখে বসে রইলেন। আর রুদ্র কাফির খোঁজ নিয়ে সামান্য কিছু খেয়ে উঠে পড়লো। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করা হলো মরিয়ম
বেগম রাতে স্পর্শীকে কাছে থাকবেন আর বড় মা থাকবেন দাদীমার কাছে। রুদ্র ওর বাবাকে ফ্ল্যাটে যেতে বললে উনি গেলেন না বরং পাশের আরেকটা কেবিন এক রাতের জন্য নিয়ে নিলেন। কারণ রুদ্রর কখন জরুরি কল আসে আর সে
কখন হুটহাট করে বেরিয়ে যায় তার ঠিক নেই। তখন চারটা মেয়ে একা একা কী করবে যদি কোনো প্রয়োজন হয় তখন?
আশিক সারাদিন এখানে থেকেছে অনেক কিছু করেছে ওই ছেলেটারও বিশ্রামের প্রয়োজন। সে নিজের ইচ্ছায় যতটুকু করেছে ওইটুকুই ঢের। তাছাড়া বাসার মেয়েদের হসপিটালে রেখে উনি ফ্ল্যাটে ঘুমাতে পারবে না বরং চিন্তায় অস্থির হয়ে
প্রেশার বাড়িয়ে ফেলবেন। তারপর কোনোমতে খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে যে যার বরাদ্দকৃত কেবিনে ঢুকে গেল। রুদ্র দাঁড়াতেই
স্পর্শীর সঙ্গে চোখাচোখি হলেও দু’জনেই নিশ্চুপ। নিজেদের অস্থিরতা নিজেরাই বুঝতে পারছে বোধহয় তাই মুখে কিছুই বলছে না। বিনিময়ে রুদ্র স্পর্শীকে একটুকরো হাসি উপহার দিয়ে কেবিনের সামনের চেয়ারে বসলো। সে যেতেই স্পর্শীর চোখ দিয়ে অঝরে অশ্রু ঝরে গেল। আজকাল তার মনটাও বে/ইমানী করছে।অপ্রিয় মানুষটাকে নিয়ে কেন এত ভাবে , কেন চিন্তা করে? তার অনুপস্থিতি কেন এত পীড়া দিচ্ছে সে বুঝে না। তার অনুপস্থিতি, মলিন মুখ, মলিন হাসি দেখে ওর মনে কেউ তার হৃদপিন্ডে হাজারটা সুঁচ ফুটিয়ে দেয়। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে র/ক্তাক্ত করে দেয় বক্ষপাশ। ভোঁতা অনুভূতি ঘুরঘুর করতে থাকে মনের আনাচে কানাচে। যেমন এই মুহূর্তে তার
মনে হচ্ছে, রুদ্র তার সঙ্গে থাকুক, বকুক, বকতে বকতে তার ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি এঁটে চোখে চোখে কথা বলুক। যতদিন যাচ্ছে সে অনুভব করছে, ছেলেটা তার অজান্তে তার মনের মধ্যে ঢুকে বসে আছে। এত গালি, এত রাগ-অভিমান করেও মনগহীনে তার প্রবেশ আঁটকানো সম্ভব হয় নি।এটা বৈধতার
জোর নাকি কে জানে! কিন্তু রুদ্রর চলে যাওয়া নিজেই সহ্য করতে পারছে না। মন চাচ্ছে চেঁচিয়ে বলতে, ‘ এই রুদ্র এই তুমি এখানেই থাকো। তোমার অনুপস্থিতি আমার অস্বস্তির কারণ । ‘

কিন্তু মুখে ফুটে বলা হলো না। রুদ্রকে চেয়ারে বসতে দেখে
তার বাবা কেবিনে ডাকলেও গেল না। সেখানে বসেই নিজের ভাবনায় মশগুল হয়ে রইল। একটুপরেই ফোন ভাইব্রেট হতে দেখে কল রিসিভ করে কানে ধরল। ফোনের অপর পাশের ব্যক্তি এমন বলল সে শুনে কথা বলা অবস্থাতেই হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গেল। এতক্ষণ মরিয়ম বেগম অপর পাশের বেডে বসে অস্বত্বিতে ভুগছিলেন। মুখে যত যাই বলুন মেয়ে জামাইকে বাইরে রেখে ঘুমাতে পারবেন না তিনি। দৃষ্টিকটুও লাগছে। তাছাড়া রুদ্রকে উনি ভীষণ ভালোবাসে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এজন্যেই তো তখন রুদ্র আর তার উনার বাকবির্তকতায় কেউ কথা বাড়ায় নি। এসব ভেবে উনি বেশ
অস্বস্থি নিয়ে দরজা খুলতেই দেখেন রুদ্র ফোনে কথা বলতে বলতে দ্রুততার সাথে বেরিয়ে যাচ্ছে। স্পশীর কাছে থাকতে চেয়ে ভুল কিছু করেন নি।এ ঘটনায় উনার রাগ আরো প্রকট হলো। আজ যদি উনি উপস্থিত না থাকতেন হয়তো স্পর্শীকে একা রেখেই বেরিয়ে যেতো। আজ সকালে যখন হসপিটালে পৌঁছেছিলেন তখনো রুদ্র ছিল না। কাফি আর আশিক বসে ছিল। তারা কেন থাকবে? স্পর্শী কি তাদের বউ নাকি তাদের দাদীমা? তারা থাকতে পারলে রুদ্র কেন থাকতে পারল না?
কিসের কাজ,কীসের রাজনীতি, যে কাজের বাহানায় আপদ বিপদে পাশে পাওয়া যায় না সেই কাজ করার কি দরকার?
আজ যদি স্পর্শী মারাও যেতো তখনো কী রুদ্র কাজে ডুবে থাকত? এর আগে রুদ্র কখনো তার দায়িত্ব পালনে অনিহা দেখায় নি বরং তাকে বলার আগেই প্রয়োজনী /অপ্রয়োজন
বুঝে ফেলতো। সেই প্রয়োজর অনুযায়ী তার দায়িত্ব পালন করতো। অথচ সেই রুদ্রই বিয়ের পরপর দায়িত্বহীনের মতো কাজ করছে। যেটা মোটেও সুখকর কিছু বয়ে আনবে না।
তারপর মরিয়ম বেগম পুনরায় দরজা আঁটকে মেয়ের শিয়র ঘেষে বসলেন। রুদ্র চলে যাওয়ার পরে স্পর্শীর কান্না উনিও দেখেছেন। স্পর্শী চোখের পানি লুকাতে চোখের উপর হাত রেখে কম্পিত সুরে বলেছে, ‘আম্মু, চোখে খুব আলো লাগছে লাইটটা বন্ধ করে দাও।’ অথচ মেয়েটা অন্ধকার ভয় পায়, লাইট ছাড়া ঘুমাতে পারে না। নিজের ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে
মরিয়ম বেগম মেয়ের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে, মাথা হাত বুলিয়ে
আস্তে করে পাশের বেডে শুয়ে পড়লেন। কিন্তু চোখ কেবল
বুজে এসেছে তখনই শুনতে পেলেন স্পর্শীর করুণ স্বর। চট করে উঠে দেখেন পেটের ব্যথায় ছটফট করছে স্পর্শী আর মা! মা! বলে পেট ধরে আর্তনাদ করছে।মেয়ের অবস্থা দেখে
মরিয়ম বেগম দৌড়ে গিয়ে নার্সকে ডেকে আনলেন। ডাক্তার
রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে ইনজেকশন পুশ করলেন, দু’মিনিটের মাথায় স্পর্শী ঘুমে তলিয়ে গেল। ডাক্তার তাকে চোখে চোখে রাখতে বলে বেরিয়ে গেলেন আর মরিয়ম শিয়রে বসে আছে সারারাত পার করলেন। ফজরের আজান দিয়েছে কিছুক্ষণ হলো। ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটেছে। নামহীন পাখিদের আনাগোনা বেড়েছে। কর্মব্যস্ত জনমানব নেমে পড়েছে নিজ নিজ কর্মে। মরিয়ম বেগম নামাজ পড়ে দক্ষিণা জানালার পাশে এসে দাঁড়ালেন। কল দিলেন স্পর্শীর বাবার নাম্বারে।
স্পর্শীর বাবা সারারাতে কতবার যে মেয়ের খোঁজ নিয়েছেন তার ইয়াত্তা নেই। উনি যখন নামাজ পড়ছিলেন তখনও কল এসেছিল একবার। মেয়ে যা অবস্থা খোঁজ না পেলে দুঃচিন্তা করবে। কারণ স্পর্শী উনাদের দু’জনের কলিজা, প্রানপাখি।
বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন উনাদের মেয়ে। অথচ এই মেয়েকেই রুদ্র হেলা করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। হসপিটালে যার তার ভরসায় রেখে চলে যাচ্ছে। এ ঘটনা নিজের চোখে
না দেখলে বিশ্বাসই করতে না রুদ্র এমন কান্ডজ্ঞানহীন, তার দ্বারা এমন কিছু ঘটতে পারো। এই কাজের জন্য উনি ফিরে গিয়েই একটা ব্যবস্থা করবেন,করবেনই করবেন।

অনেকক্ষণ ধরে এমন নানান চিন্তায় মশগুল মরিয়ম বেগম। একটুপরেই মেয়েকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবেন। হয়তো রুদ্রর সঙ্গে দেখাও হবে না। তার কাছে কাজ আগে, কাজেই মজে থাকুক সে।উনি যখন নিজের ভাবনায় মশগুল তখন কেউ একজন দরজা নক করল।মেয়ের দিকে একবার তাকিয়ে উনি দ্রুত দরজা খুলতে এগিয়ে গেলেন। নতুবা নক করার শব্দ মেয়েটার ঘুম ভেঙে যেতে পারে। উনিদরজা খুলে দেখেন একজন মাঝ বয়সী মহিলা ঝাঁড়ু হাতে দাঁড়িয়ে আছে
, মূলত কেবিন ঝাঁড়ু দিতে এসেছে। ঘড়িতে তখন সাতটা দুই। মরিয়ম বেগম উনাকে নিঃশব্দে কাজ সারতে বলে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন। রুদ্র নেই, তারমানে সারারাত বাইরে কাটিয়েছি। এবার উনার ভেতর থেকে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে সত্যিই চিন্তা হচ্ছে। একটু বেশি তাড়াহুড়ো করে ফেলেছেন বিয়ের সিদ্ধান্তটা নিতে আরেকটু
সময় নিলে ভালো হতো। এতদিন ভেবেছিলেন রুদ্রর কাছে
সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্পর্শীর স্থান। আর যায় করুক স্পর্শীকে নিয়ে উনাদের আর চিন্তা করতে হবে না। এখন রুদ্র আছে, রুদ্রই সব সামলে নিবে। কিন্তু কে জানত রুদ্রই হবে উনাদের ভাবনা চিন্তার আরেকটা কারণ। যার কাছে সম্পর্কের চেয়ে রাজনীতি বড়। প্রিয় মানুষগুলো ম/রে পঁচে গলে যাক তবুও তার কাজ আগে। কেবিন ঝাঁড়ু দেওয়া হয়ে গেছে। মরিয়ম বেগম নার্সের সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন বড় মাও দাদীমার কেবিন থেকে বেরিয়ে এলেন। স্পর্শীর হালচাল জিজ্ঞাসা করলেন। ততক্ষণে রুদ্রর বাবাও সকালের জন্য নাস্তা এনে
খাওয়ার তাগাদা দিলেন। দাদীমাকে সঙ্গে নিয়ে হালকা নাস্তা সারতেই নার্স এসে ওষুধ দিয়ে গেল। স্পর্শী ঘুম থেকে উঠলে উনারা বেরিয়ে পড়বে ঢাকার উদ্দেশ্যে। গতরাতে রুদ্র নিজে উনাদের এয়ার টিকিট কনফার্ম করে রেখেছে। উনারা খেয়ে
টুকটাক জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখলেন। সকাল আটটা বিশে
স্পর্শীর ঘুম ভাঙল। এদিক ওদিক তাকিয়ে একা একা উঠে মুখ ভার করে বসে রইল। মরিয়ম বেগম তাকে ফ্রেশ করিয়ে
নাস্তা খাইয়ে মেডিসিন খাইয়ে দিলেন। তারপর ড্রেস বদলে নতুন একসেট থ্রি-পিস পরিয়ে দিলেন। থ্রি-পিস কোথা থেকে
এলো উনিও জানেন না তবে বেডের উপরেই ছিলো। হয়তো
স্পর্শীর বড় মা রেখে গেছে। এই মুহূর্তে অবান্তর চিন্তাভাবনা না করে উনি যত্ন করে মেয়ের চুল আঁচড়ে বেঁধে দিলেন। এর পর মেয়েকে নিয়ে কেবিন থেকে বের হলেন। ততক্ষণে রুদ্রর
বাবা হসপিটালের বিল পরিশোধ করে চলে এসেছেন। স্পর্শী
ঘুরে ঘুরে বড়দের মুখে মুখে তাকাচ্ছে কেউ বলছে না কেন রুদ্র কোথায়? সে কি আসবে না? যাওয়ার আগেও দেখতে পাবে না অপ্রিয় মানুষের মুখখানা? ছলছল চোখে সে মাকে আঁকড়ে ধরে লিফটের দিকে পা বাড়াল। বহুকষ্টে তার কান্না আঁটকে রেখে নিচে নামতেই দেখে রুদ্র গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে ব্ল্যাক সানগ্লাস। পরনে গতরাতের শার্ট প্যান্ট। সে একমণে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ মুখ তুলে তাকাল ওদের দিকে। সানগ্লাস থাকায় বোঝা গেল না ঠিক কার মুখপানে তাকিয়ে আছে সে। তারা ধীরে ধীরে পা ফেলে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। রুদ্র গাড়ির দরজা খুলে
দিতেই সকলে একে একে উঠে বসলো। দাদীমা আপনমনে একা একা বকে চলেছে। গাড়ি চলছে এয়ারপোর্টের দিকে।
স্পর্শী তার মায়ের কাঁধে মাথা রেখে অপলক লুকিং গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আছে। সারারাতের তৃষ্ণা মিটাচ্ছে এভাবেই তাকিয়ে থেকে।

তারপর যথাসময়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছে গাড়ি থেকে নামতেই
স্বজোরে গাড়ির দরজায় বারি খেলো স্পর্শী। ব্যথার চোটে চোখে পানি এসে গেছে। মরিয়ম বেগম মেয়ের ছটফটানি দেখে রেগে কিছু বলতেই রুদ্র বলল,

-‘তোমরা এগোও আমি ওকে নিয়ে আসছি।’

মরিয়ম বেগম কিছু বলার আগেই বড় মা উনাকে নিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। বড় বাবাও গেলেন উনাদের পিছু পিছু। রুদ্র গাড়ি লক করে স্পর্শীর দিকে কয়েকপল তাকিয়ে মন কেমন করা স্বরে বলল,

-‘পেট ব্যথা কমেছে?’

-‘কবে ফিরবে তুমি?’

-‘আর ফিরবো বলে মনে হয় না।’

-‘কেন?’

-‘কারণ ফেরার ইচ্ছে নেই।’

-‘ইচ্ছে না থাকলেও তুমি ফিরবে, ফিরতেই হবো।’

-‘কি করতে ফিরবো? তোদের মা মেয়ের রাগ ভাঙাতে? আর কাজ নেই আমার? আগে তুই ছিলি আমার বিপক্ষে এখন তোর মা যুক্ত হয়েছে। এতদিন তুই ঘ্যানর ঘ্যানর করে অন্তর আত্মা কয়লা করে দিয়েছিস এখন তোর মা বসে বসে সেই কয়লাতে বাতাস দিচ্ছে, যাতে ভস করে আগুন জ্বলে উঠে আমাকে ভ্যনিশ করতে পারে। রাগ, ক্ষোভ, মান-অভিমান শুধু তোদেরই আছে, আমার নেই? আমি মানুষ না? কষ্ট হয় না আমার?’

-‘আসলে…!’

-‘আসলে নকলের কৌফিয়ত চাই নি তোর থেকে। বাসায় গিয়ে নিজের খেয়াল রেখো তাহলেই হবে। আর যদি পারো, মাকে বুঝিয়ো উনার জামাতা দায়িত্ব জ্ঞানহীন নয়। দায়িত্ব এড়াতে না চাইলেও পরিস্থিতি সব সময় হাতে থাকে না। সব পরিস্থিতিতে নিজেকে জাহির করাও যায় না। আর গতরাতে
যতক্ষণ না কেবিনের দরজা বন্ধ হচ্ছিল ততক্ষণ সিঁড়ির দোর গোড়াতেই দাঁড়িয়ে ছিল উনার জামাতা। ইচ্ছে করেই আড়ালে ছিল, কারণ উনার জামাতা জানত উনি কি বলতে পারেন। তোর পেট ব্যথার খবর পেয়ে ছুটে এসেছিল তারপর রাত তিনটা থেকে ভোর পাঁচটা অবধি কেবিনের সামনে বসে ছিলো তোর মায়ের জামাতা। একটুও চোখের আড়াল করে নি তোদের, দায়িত্ব ভুলে কাজে ডুবে থাকে নি, চিন্তায় অস্থির নির্ঘুম থেকেছি সারারাত। সবসময় মনমতো যুক্তি না বানিয়ে অপর পক্ষকেও কিছু বলার সুযোগ করে দিতে হয়।’

-‘সত্যিই ফিরবে না তুমি? তাহলে আমিও থেকে যাই?’

-‘তুই কেন থাকবি?’

-‘আমার অপ্রিয় কিছু থেকে যাচ্ছে তাই।’

একথা শুনে রুদ্র নির্লিপ্তভাবে তার দিকে তাকিয়ে রইল। ওর তাকানো দেখে স্পর্শী গলার সঙ্গে থুতনী লাগিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। ইশ! বেখেয়ালে মনের কথা মুখ ফঁসকে বলে ফেলেছে। বসেই যখন ফেলেছে কথা ফেরানোর মানেই হয় না।তাই অধির আগ্রহে রুদ্রর জবাব অপেক্ষায় রইল সে। কিন্তু সেকেন্ডের কাঁটা মিনিটের ঘরে পৌঁছালেও রুদ্রর থেকে জবাব না পেয়ে ছলছল করে উঠল তার নেত্রজোড়া। অজস্র অভিমানে ভরে উঠল অবুজ মন।জবাব পাবে না ভেবে যখন
পা বাড়াতে যাবে তখন রুদ্র বলে উঠল,

-‘স্পর্শী!’

-‘হুম।’

-‘পরশুরাতে ফিরবো। ‘

একথা শুনে স্পর্শীর ঠোঁটে হাসি ফুটলেও সে পেছনে ফিরে তাকালো না। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল এয়ারপোর্টের ভেতরে।
রুদ্র দ্রুত এগিয়ে এসে পাশাপাশি হাঁটতে থাকল দু’জন। তবে
কারো মুখে কথা নেই শুধু মনে আছে একটুকরো স্বস্থি। আর একখন্ড বেনামি সুক্ষ অনুভূতি। তারপর স্পর্শীদের বিদায় করে রুদ্র গেল বড় মামাদের নিজস্ব কবরস্থানে। এখানে ওর
মায়ের নিকট আত্নীয়দের দাফন করা হয়। যদিও বড় মামা প্রথমে রুমাকে এখানে দাফন দেওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন না। রাগে ফেটে পড়ে রুদ্রকে যাচ্ছে তাই বলেছেন। বিনিময়ে রুদ্র তার ফোনটা বের করে কাউকে কল করে বলেছে, ‘চা নাস্তার খরচ বাড়িয়ে দিবো ভিক্টমের যত্ন আত্তি বাড়িয়ে দিন।
এমন অবস্থা করবেন যাতে মা শব্দ উচ্চারণ করার শক্তি না থাকে।’
বড় মামার বুঝতে বাকি নেই ভিক্টম উনার আদরের মেয়েটা।
গতকাল মেয়েকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছেন।চোখ, মুখ, ফুলে আছে, গালে থাপ্পড়ের দাগ, নোংরা জায়গা, কেউ
নাকি একটু পানিও দেয় নি।উড়ো খবরে জেনেছে রুদাশাকে
রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ এসেছে। আর এ খবর শুনে খোঁজ
নিয়ে দেখে রুদাশা পূর্বের স্থানে নেই, তাকে কোথাও পাঠানো হয়েছে, এত সন্ধান করেও রুদাশার হদিস মিলছে না। রুদ্রর কাছে এত অনুরোধ করেও ছেলেটা মুখ খুলছে না। মেয়ের অবস্থার কথা ভেবে পরে বাধ্য হয়েই উনি অনুমতি দিলেন।
তারপর রুমার জানাযা এবং দাফন কার্য সম্পূর্ণ করা হলো।
দলে দলে মানুষরাও চলে গেল। কাফি দুই হাঁটু মুড়ে কবরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ভাবছে তার রুমার সুখপূর্ণ খুনশুঁটির কথা। কথা ছিল ওরা কেউ কাউকে ছেড়ে যাবে না
অথচ রুমার করা পাপ রুমাকে ধ্বংস করে দিলো। কাফির কেন জানি খুবই জানতে করছে, ‘রুমা কি তাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল নাকি সেটাও তার নিঁখুত অভিনয় ছিল?’

কাফিকে এভাবে বসে থাকতে দেখে রুদ্র উঠালোও না কিছু বললোও না। এই পরিস্থিতিতে কারো কোনো বাণীতেই তার হৃদয় শান্ত হবে না, অন্তর জ্বলন কমবে না, যাকে দিয়ে হৃদয় শান্ত হবে, অন্তরের জ্বলাপোড়া কমবে তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এরচেয়ে সে কিছুক্ষণ এভাবেই থাকুক, নিজেকে বুঝ দিতে সময় নিক তারপর সামলে উঠুক। অদূরে দাঁড়িয়ে কাফির দিকে তাকিয়ে যখন রুদ্র এসব ভাবছিল। তখন রামু
সেখানে উপস্থিত হলো। কাফির দিকে মায়া মায়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল,

-‘ভাবির জানাযা শ্যাষ হওয়ার সাতে সাতেই মাশুমরে কড়া ডোজের ইনজেকশন মাইরা দিসি। গাড়িতে কাত হইয়া পইড়া আছে। হেরে এখন কি করুম স্যার?’

-‘তুমি ওরে নিয়ে সোজা ওখানে চলে যাও। ঢাকায় ফিরে ওর ব্যবস্থা করা হবে।’

-‘তয় শালারে এইহানে আনলেন ক্যান স্যার? হেই তো পাক্কা
নেশাখোর। ছালা এত মার খাওয়ার পরেও কই, আমারে একটু হিরোইন দে ভাই, তোর পাও ধরি, মরার আগে একটু হিরোইন দে।’ হের নেশার প্যারা উঠছে মার তার গায়ে লাগে না, তার হিরোইন লাগবে।’

-‘মার গায়ে লাগে কী না আমার মুখোমুখি হলেই বুঝবে সে।
এখন তুমিও বেরিয়ে পড়ো আর পৌঁছে জানিও।’

-‘স্যার? অভয় দিলে আরেকখান কথা কইবার চাই।’

-‘বলো।’

-‘আপনার বড় মামা আপনার নানা নানীকে মাইরা ফেলাইছে ম্যাডামরে (রুদ্রর মাকে) কইতাছেন না ক্যান? হেই তো সত্য জানবার লাইগা পাগল হইয়া উঠছে। মারে আন্ধারে রাইখা
কতদিন সত্য লুকাইবেন স্যার? এডা কি ঠিক হইতাছে?আর
ম্যাডাম যেভাবে অপরাধীরে গরু খুঁজা খুঁইজা বেড়ায় সত্য কত্তদিন বা আড়াল করণ যাইবো?’

-‘জায়গা নিরাপদ নয় রামু।’

-‘জ্বে স্যার বুঝছি।’

তারপর রামু প্রস্থান করল। কাফি ততক্ষণে উঠে এসে রুদ্রর পাশে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ কি মনে কাফি বলল,

-‘এমিলি আপনার আর স্পর্শীর পিক ইডিট করে হাজিবাজি ভিডিও বানিয়েছে। আর বলেছে তার লোকদের না ছাড়লে ওইসব ভিডিও ভাইরাল করে দিবে। সামনে ভোট এইকাজ করলে…!”

-‘পৃথিবীতে দুই নারীর জাত ভীষন ভয়ংকর। এক মায়াবতী, দুই ছলনাময়ী। এদের কাজই হচ্ছে পুরুষদের ঘায়েল করা।
তবে এদের পার্থক্যও রয়েছে। জানো কি সেই পার্থক্য? এরা কেউ পুরুষদের হৃদয়ে ঢালে ইস্ক কেউবা ঢালে বিষ।’

To be continue………..!!

প্রেম প্রার্থনা পর্ব-১৮

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[১৮]

যে পুরুষ নারীর মন বুঝে না, কষ্ট বুঝে না, আবেগ বুঝে না, অভিমানে ঠাসা দৃষ্টির মানে বুঝে না, সে আর যায় হোক ভালো স্বামী হতে পারে না। কারণ ভালো স্বামীরা নিজদায়িত্ব বুঝে, অভিমান বুঝে, সেই সঙ্গে চেষ্টা করে প্রিয় মানুষটির মন জুগিয়ে চলার। এ ক্ষেত্রে রুদ্র অনেক পিছিয়ে, অনেক।
মনে মনে মনগড়া কথা ভেবে স্পর্শী ধীরে ধীরে চোখজোড়া
বুজে নিলো। কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না শরীরও আর সায় দিচ্ছে না। তবে রুদ্রর অনুপস্থিততে চিন্তা হচ্ছিল। কারণ এই অবধি রুদ্রকে যতটুকু চিনেছে তার বর্তমান অবস্থা জেনেও বসে থাকার মানুষ সে নয়। তাহলে সারাদিন পেরিয়ে যাচ্ছিল তার দেখা নেই কেন, সে ঠিক আছে তো? বেহায়া মনে এসব ঘুরপাক খাচ্ছিল সর্বক্ষণ। কিন্তু মুখ ফুটে কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারে নি। আর এই পারাটাই তাকে আরো কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। স্পর্শীকে চোখ বুজতে দেখে রুদ্র মলিন হেসে ওকে
আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। ওষ্ঠ ছোঁয়ালো ওর অভিমানে ঠাসা চোখের পাতায়। মাথাটা চেপে ধরে রাখল উত্তপ্ত বুকে।
যেখানে অসহ্য চিনচিনে ব্যথারা মিছিল করছে, অদৃশ্য হয়ে
চিৎকার করে বলছে, ভালোবাসি রে পাগলি, তোকে ভীষণ ভালোবাসি।’

সারাদিন রুদ্রর বুকজুড়ে যে দূশ্যহীন ব্য/থা প্রকট হয়ে দহন ছড়াচ্ছিল, স্পর্শীর ছোঁয়া পেয়ে সেই বুক নিমিষে প্রশান্তিতে ভরে গেল। উপলব্ধি করতে পারলো এখানে শান্তির আবাস।
রুদ্রকে কাছে পেয়ে স্পর্শীও নিজেকে আঁটকাতে পারলো না রুদ্র গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ লুকালো। সারাদিনের বোবা কান্নাগুলো বাঁধ ভেঙে আছড়ে পড়তে লাগল রুদ্রর বুকে।
যার নামে শতশত অভিযোগ অথচ কান্না করতে তার বুকই বেঁছে নিলো বোকা মেয়েটা। অভিমানের ঠুনকো স্তুপ ভেঙে ফেললো অপ্রিয় মানুষটার আলতো স্পর্শে।একেই বুঝি বলে মেয়ে মানুষ। যাদের মুখে অভিমানে ভাসা মনে থাকে প্রণয়ে বাসা। স্পর্শী কাঁদতে কাঁদতে রুদ্রর বুকের শার্ট আঁকড়ে ধরে অস্পষ্টভাবে কিছু বলছে কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না। অপ্রিয় এই মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লজ্জাও লাগছে না, অথচ ভীষণভাবে লজ্জা লাগার দরকার ছিল। এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পরে রুদ্র স্পর্শীকে নিজে থেকে ছাড়াতে গেলে স্পর্শী মাথা নাড়িয়ে না বোঝাল অর্থাৎ ছাড়বে না, এভাবেই আরো কাঁদবে, আরো। তবুও রুদ্র নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে স্পর্শীকে
ধরে উঠে বসালো। হাতের ক্যানোলা সাধধানে বালিশে উপর রেখে নিজে দেওয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে স্পর্শীকে নিজের
কাছে টেনে বুকে মাথা ঠেকাল। ওভাবে থাকায় ক্যানোলাতে র/ক্ত উঠে যাচ্ছিল। এখন ঠিক আছে আর সমস্যা হবে না।
স্পর্শী রুদ্রর বুকে মাথা ঠেকিয়ে হেঁচকি তুলে কাঁদছে। তবে রুদ্রর কিছু বলছে না ধীরে ধীরে স্পর্শীর মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে।বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কাঁটল। একটুপর দরজায় নক পড়াতে স্পর্শীকে বালিশে হেলান দিয়ে বসিয়ে দরজাটা খুলে দিলো রুদ্র। রুদ্রর মা কেবিনে প্রবেশ করে একটা শপিংব্যাগ
রুদ্রকে দিয়ে বললেন,

-‘তোমার বাবা তোমার জন্য ড্রেস কিনে আনলেন যাও ফ্রেশ হয়ে এসো।’

-‘বাবা শুধু শুধু কষ্ট করতে গেল কেন?’

-‘দরকার আছে তাই, এখন যাও।’

রুদ্র কথা না বাড়িয়ে ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। তখন বড় মা ওয়াশরুমের দরজার দিকে একবার তাকিয়ে স্পর্শীর মুখ দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মেয়েটা কেঁদে কেঁটে মুখের কী অবস্থা করেছে! কিয়াৎকাল চুপ থেকে উনি স্বাভাবিকভাবে বললেন,

-‘ আর যাই করিস ভুলেও কখনো রুদ্রকে রাজনীতি ছাড়ার কথা বলবি না। সে রাজনীতি ছাড়তে পারবে না কারণ এটা তার মায়ের আদেশ আছে। তাকে অনেকদূর পৌঁছাতে হবে,
তুই তাকে সাপোর্ট দিতে না পারলেও কথা দিয়ে দূর্বল করিস না, তোর কান্নাকাটি দেখে ওর যাতে মনে না হয় রাজনীতিতে প্রবেশ করে ভুল করেছে। রাজনীতি তার আপনজনদের কষ্ট দিচ্ছে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়া উত্তম। তাহলে বলি শোন, কে কী চাচ্ছে জানি না তবে আমি চাই আমার ছেলে রাজনীতি করুক।’

-‘রাজনীতিতে মারামারি দাঙ্গা এসব কমন একটা ইস্যু। এটা আমার থেকে তুমি ভালো করেই জানো। বিরোধীদল যখন তোমার ছেলের উপর হা/মলা করবে, তার শরীরটা কুঁ/পিয়ে
র/ক্তাক্ত করবে, অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করবে, তখন তাকে দেখে তোমার কষ্ট লাগবে না? তুমি তো মা, ছেলে হারানোর য/ন্ত্রণা সইতে পারবে তুমি?’

-‘আমার হাতের উপর আমার বাবা-মা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।নিজের চোখে দেখেছি মৃত্যুর যন্ত্রণায় তারা কীভাবে ছটফট করেছে। তবুও একটুও কাঁদি নি, ভেঙেও পড়ি নি।
বাবা মায়েরটা যখন সহ্য করতে পেরেছি ছেলেরটাও পারব।’

একথা শুনে স্পশী ব্যাকুল হয়ে কেঁদে উঠলো। দৌড়ে উঠতে গিয়ে হাতে টান পড়লেও গুরুত্ব দিলো না। ক্যানোলাটা ছিঁড়ে ফুঁড়ে মেঝেতে ছিটকে পড়লো। হাত থেকে টপটপ করে র/ক্ত
ঝরে পড়তে থাকল টাইলস্ করা মেঝেতে। স্পর্শী সোজা বড় পায়ের পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।তার জল থৈ থৈ অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছে মেদুর গাল। সে কাঁদতে কাঁদতে
বলল,

-‘তুমি ছেলের শোক সইতে পারলেও আমি স্বামীর মৃত্যুশোক সহ্য করতে পারব না। এতটা নিষ্ঠুর হইয়ো না বড় মা।রুদ্রকে প্লিজ বলো এসব ছেড়ে দিতে। রাজনীতির রেষানলে আমরা
ধ্বংস হয়ে যাবো, একটু একটু করে হারিয়ে ফেলব কাঙ্ক্ষিত
মানুষগুলোকে। তোমার পায়ে পড়ি বড় মা ওকে বলো এসব ছেড়ে দিতে।’

স্পর্শীকে এভাবে কাঁদতে দেখে বড় মা ওকে দাঁড় করালেন।
তীক্ষ্ণ চোখে স্পর্শীকে পরখ করে সন্দিহান স্বরে বললেন,

-‘ভালোবেসে ফেলেছিস আমার ছেলেটাকে?’

-‘না! ভালো না বাসলেও আমি চাই সে সুস্থ থাকুক, ভালো থাকুক। কিন্তু দিনকে দিন যেভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে মনে হয় না খুব বেশিদিন ভালো লাগবে। টাকা-পয়সা, ক্ষমতা, বাড়ি গাড়ি কী হবে যদি আপনমানুষগুলোই ভালো না থাকে? তোমরা জোর করে বিয়ে দিয়েছো আমাদের, সব মেনে নিয়েছি কিন্তু এখন জোর করে বিধবা তকমা লাগিয়ো না আমার শরীরে। আমি এই কষ্ট সইতে পারব না।’

-‘বোকা মেয়ে কাঁদিস না। মন দিয়ে শোন, কাঁচের জিনিস আর রাজনীতি প্রায় একই জিনিস। কাঁচের গ্লাস হাত থেকে পড়ার পর জোড়া লাগালে যেমন জোরালো দাগ থেকে যায়, রাজনীতিতেও তাই। এই পথে একবার জড়িয়ে গেলে সহজে মুক্তি মেলে না।’

-‘তুমি রাজনীতি ছেড়ে স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করছো, তাহলে রুদ্র কেন পারবে না? কেন জেনে বুঝে বিপদ ডেকে আনছে? ওকে বুঝাও বড় মা, তুমি বললে সে ঠিক শুনবে।’

-‘কে বলেছে আমি স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পারছি? আমার তো মনে হয় না। শ্বাস প্রশ্বাস চলাকেই কী বেঁচে থাকা বলে?
তাহলে বলবো ভুল জানিস। আমি হচ্ছি জীবন্ত লাশ! মানুষ কখন জীবন্ত লাশ হয় জানা আছে তোর? যখন বেঁচে থেকে মরার মতো মৃত্যু যন্ত্রণা সইতে হয়। বর্তমানে আমিও তাইই।
এজন্যই বলছি রুদ্রকে সাপোর্ট করতে না পারলেও ইমোশন কাজে লাগিয়ে হারতে দিস না। আমি একুটু একটু করে ওকে এই অবধি দাঁড় করিয়েছি, সে আমার সাহসী ছেলে। আমার ছেলে! আমার রুদ্র! সাহসী বলেই আমি মা হয়েও ওর জান বাজি ধরে লড়ছি। তুই এখনো অবুজ। নিষ্ঠুর পৃথিবীর ম্যার প্যাঁচ বোঝার বোধ এখনো হয় নি তোর। এখন কান্না থামা,
রুদ্র শুনে ফেললে লঙ্কাকান্ড বাঁধাবে।পরে নাহয় এসব নিয়ে কথা বলা যাবে।’

-‘কিন্তু বড় মা..।’

-‘চুপ! আমার কাছে ঠুনকো আবেগের দাম নেই।’

একথা বলে বড় মা নার্স ডেকে স্পর্শীর হাত ব্যান্ডেজ করিয়ে নিলেন। এখন স্যালাইন দিবে না আর তাই নার্স কাজ শেষে বেরিয়ে গেল। স্পর্শী বালিশে হেলান দিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। নানান ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে মস্তিস্ক জুড়ে।
বড় মায়ের মতো কঠিন হৃদয়ের মানুষ পৃথিবীতে আর আছে নাকি জানা নেই তার। স্পর্শীকে ভাবনায় মশগুল দেখে বড় কথা না বাড়িয়ে তার চুল আঁচড়ে বেণি করে দিলেন। রুমাল ভিজিয়ে চোখ মুখ মুছে দিলেন। তখন মরিয়ম বেগম দরজা ঠেলেদাদীমাকে এই কেবিনে প্রবেশ করলেন। দাদীমা জ্ঞান ফেরার পর থেকেই স্পর্শীকে দেখার জন্য বড্ড উতলা হয়ে গেছেন। দাদীমাকে দেখে স্পর্শীর দু’চোখ ফেটে জল গড়িয়ে গেল। দাদীমার মুখটা শুকিয়ে গেছে কপালে সাদা ব্যান্ডেজ।
বৃদ্ধ শরীরে এমন ধকল, না জানি কত কষ্ট পেয়েছে দাদীমা।
তাকে কাঁদতে দেখে দাদীমা বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে ফেললেন, চারদিকে এত মন খারাপ কান্নাকাটি ভালো লাগছে না আর।
ক’দিন ধরে সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে বাসায় ফিরে দোয়া ও মহ্ফিলের আয়োজন করতে হবে। বিপদের উপর বিপদ। এ বিপদ থেকে রক্ষা পেতে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে কেঁদে বিপদমুক্তির পথ খুঁজবেন। ছেলে মেয়ে দুটো বিয়ে হওয়ার পর থেকে তাদের জীবনে কিছু না কিছু ঘটেই চলেছে। তারা
না পারছে নিজেরা ভালো থাকতে আর না পারছে কাউকে ভালো রাখতে। অথচ নিজেরা নিজেদের মতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এবার এমনকিছু করতে হবে যাতে ছেলে মেয়ে দু’,টো ভালো থাকে।

তখন ওয়াশরুম থেকে চুল মুছতে মুছতে রুদ্র বেরিয়ে এলো,
কেবিনে উপস্থিত সবার মুখের দিকে তাকিয়ে তোয়ালে মেলে দিলো বেডের স্ট্যান্ডে। হঠাৎ রুদ্রর সঙ্গে স্পর্শীর চোখাচোখি হলো, রুদ্রর চোখজোড়া লাল হয়ে আছে। গোসলে যাওয়ার আগে তো এমন ছিল না। আচ্ছা রুদ্র কি তাদের কথা শুনে ফেলেছে? কিন্তু তারা যখন কখা বলছিল তখন ওয়াশরুম থেকে পানি পড়ার শব্দ হচ্ছিল। পানি পড়ার শব্দ ছাপিয়েও কী ওদের কথা শুনেছে রুদ্র? নাকি তার কান্না দেখে কাঁদতে না পেরে ওয়াশরুমে গিয়ে কেঁদেছে?তার জন্য নাকি কাঁদবে, তাও রুদ্র রাজ! ধুর, কীসব অহেতুক ভাবনা।

তখন একজন ডাক্তার এসে চেকাব করে জানালো স্পর্শীকে হালকা খাবার দিতে। রুদ্রর বাবা সবার জন্য খাবার আনতে গিয়েছিলেন মাঝপথে আশিকের সঙ্গে দেখা। সে সবার জন্য তার বাসায় থেকে খাবার এনেছে। শুধু শুধু এত কষ্ট করার জন্য রুদ্রর থেকে ঝাঁড়ি খেয়েও হাসল ছেলেটা। তারপর সবাইকে খেয়ে নিতে বলে বেরিয়ে গেল।সবাই যখন স্পর্শীর কেবিনে খেতে বসেছে তখন রুদ্র মুখে খাবার তুলতে গিয়ে হাত নামিয়ে ফেললো। কাফির কান্নারত মুখটা ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। কাফিকে ছোট ভাইয়ের মতো নিজের
সঙ্গে সঙ্গে রাখে। রাগের বশে অকারণে হুমকি ধামকি দিলে একটু পরে এসে ঠিকই বলে, স্যার, কিছু লাগবে? কোথাও বের হবেন, গাড়ি বের করবো?’ সে নিজেও খেয়াল করেছে কাফি খুব নরম মনের। যখন কাউকে মারতে দেখে তখন তার চোখ মুখে কষ্টের ছাপ ভেসে ওঠে। হয়তো মায়ের কথা
মনে পড়ে যায় তার। বারো বছর বয়সী কাফি নিজের চোখে দেখেছে তার মাতাল বাবা তার মাকে মারতে মারতে মেরেই ফেলেছে। মার দেখে ভয়ে পালিয়েও এসেছিল বাসা থেকে, ঠাঁই পেয়েছিল বস্তির টোকাইয়ের সঙ্গে তারপর সেখানে বড় হয়ে কোনো এক ঘটনাচক্রে তার সঙ্গে দেখা। ধীরে ধীরে ওর বিশ্বাস অর্জন করে বর্তমানে তার সহকারী। পৃথিবীতে সবার জীবনে একটা অতীত থাকে। অতীতকে তালাবন্ধ করে বেঁচে থাকার নামই জীবন। কাফির কথা মনে পড়তেই রুদ্র খাবার
রেখে দিলো, ছেলেটা রুমার লাশ দেখে কী করছে কে জানে,
বড্ড মায়া হচ্ছে ছেলেটার জন্য।

এদিকে বড় মা তীক্ষ্ণ নজরেছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মন
মন পড়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। হয়তো আন্দাজও করে ফেললেন রুদ্রকে খাবার রেখে কাউকে ফোন করতে দেখে। তখন তিনি বললেন,

‘আশিক এখান থেকে সোজা কাফির কাছে গেছে, ওর সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। তাছাড়া দলের আরো অনেকেই আছে সেখানে। আগামীকাল সকালে ওর বউয়ের দাফনের কাজ সম্পূর্ণ করা হবে, সব ব্যবস্থাও হয়ে গেছে। সারাদিন না খেয়ে আছো এখন কিছু মুখে দাও।’

একথা শুনে স্পর্শী স্যুপ খাওয়া থামিয়ে হতবাক হয়ে তাকাল রুদ্রর দিকে। রুদ্রর দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। সবার সামনে কিছু
জিজ্ঞাসা করা ঠিক হবে কী না ভেবে পেল না স্পর্শী। তখন দাদীমা বিষ্ময় নিয়ে বললেন,

-‘কাফির বউডা ম/ইরা গেছে? আহারে বেচারি! আমরা তাও ভাগ্যের জোরে বাঁইচ্ছা গেছি। বউডা ভালোই আছিল রে।’

রুদ্র সেকথার উত্তর না দিলেও মরিয়ম বেগম মুখ খুললেন,

-‘ নিজের বউয়ের নিরাপত্তা অনিশ্চিত রেখে অন্যের বউয়ের মৃত্যুতে শোক পালন করা হাস্যকর হয়ে গেল না? যাই হোক, বড় ভাবী আমি আগামীকাল সকালে স্পর্শীকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে যাচ্ছি। তোমরা কাজ সেরে আস্তে ধীরে ফিরো।’

-‘মেজো মা আমার কথাটা..!’

-‘বলা আর শোনার পরিস্থিতি নেই। তোমার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছি মানে এই নয় আমার মেয়ের জীবন তোমার হাতে তুলে দিয়েছি। আজকে পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না যদি না স্পর্শীকে এখানে আনার কথা বলতে। যা হওয়ার হয়ে গেছে কিন্তু এখন থেকে যদি আমার মেয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করো তাহলে এবার আমাকে অন্য কিছু ভাবতে হবে।’

মরিয়ম বেগম কথা শেষ করতেই দাদীমা ধমকে উঠলেন। রাগে গমগম করছে উনার মুখ। রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

-‘থামো মেজো বউ, ফারদার এসব ফাও কথা কইবা না। কী পাইছো কী তুমরা হ্যাঁ? এসব কথা আগে ভাবো নাই ক্যান ?
জোর কইরা ওগো বিয়া দিয়া, মাইনা নে, মাইনা নে, কইরা
মুখে ফ্যাপরা তুইল্লা দিলা। এখন যখন দু’জনে একটু একটু কইরা সহজ হইতাছে এখন তুমি মশকরা শুরু করছো। বলি নিজেদের ভাবো কী তুমরা, হ্যাঁ?’

-‘বে/য়াদবি মাফ করবেন মা। কিন্তু আমি কিছুতেই আমার মেয়ের অনিশ্চিত জীবন আর মেনে নিতে পারব না। পরপর দুই দুইবার আমর মেয়েটা মরতে মরতে বেঁচে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে আমার মেয়েটাকে হারিয়ে ফেলবো আমি। ও আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন মা। এতদিন অন্যের ভরসায় থাকলেও আর পারছি না। অন্য কারো মতো এতটা পাষাণ হতে পারব না আমি যে নিজের সন্তানের জীবন নিয়ে বাজি ধরবো। অনিশ্চিত জীবন জেনেও সন্তানকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিবো।’

মরিয়ম বেগমের কথা শুনে স্পর্শী চকিতে তাকালো বড় মায়ের দিকে। বড় নিশ্চুপ হয়ে প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে।
মরিয়ম বেগমের খোঁচা মারা কথার মর্ম বুঝতে বাকি নেই কারো। কেবিন জুড়ে চলছে সুনশান নীরাবতা। স্পর্শীর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো অদূরে বসে থাকা রুদ্রর মলিন মুখপানে।
সেই নীরাবতার রাশ টেনে রুদ্রই মুখ খুলল,

-‘মোজো মা স্পর্শীই তোমার সন্তান আমি তোমার কেউ না?’

-‘ছিলে , কিন্তু কিছুক্ষণ আগে সেই সম্পর্কের ছেদ ঘটেছে। কেন ঘটেছে জানো? কারণ তোমার মা নিজের মুখে স্বীকার করেছে উনি স্পর্শীকে বিধবা রুপে দেখতে পারবে। ছেলের মৃ/ত্যুশোক সামলে নিতে পারবেন। যে মা নিজের মুখে এসব বলতে পারে তার সন্তান নিজের সন্তানের মতো দেখাটাও,
‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি’ ব্যাপারটার মতো হয়ে যাবে না?’

-‘তাহলে এখন কি করতে চাচ্ছো তুমি?’

-‘আমার মেয়েকে তোমার থেকে দূরে সরিয়ে নিতে চাচ্ছি।’

-‘কতটা দূরে?

-‘যতটা দূরে সরালে কোনো অধিকার দেখানোর পস্থা খুঁজে পাবে না তুমি।’

-‘পারবো না, চেষ্টা করে দেখতে পারো।’

-‘দেখা যাক পারি কী না।’

-‘হুম অবশ্যই। তবে তুমি যদি ত্যাড়া শাশুড়ী হও তবে আমিও ছ্যাচড়া জামাইয়ের রোল প্লো করতে বাধ্য হবো।’

To be continue…………!!

প্রেম প্রার্থনা পর্ব-১৭

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[১৭]

-‘পুরুষদের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা বোঝার ক্ষমতা যদি প্রতিটা নারীর মাঝে থাকতো তবে পৃথিবীর বুকে বিচ্ছেদ বলে কোনো শব্দ থাকত না।’

অভিমানপূর্ণ কথাটা বলে থেমে গেল রুদ্র। সেও তো হৃদয় নিংড়ে সব ভালোবাসাটুকু স্পর্শীকে উগড়ে দিয়েছে। গোপনে
এতদিন ভালোবেসেছিল ভেবেছিল বিয়ে পর সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না, যখনই তাদের সম্পর্ক সরল রেখায় ধাবিত হতে শুরু করে তখনই বিশ্রী এক ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়,
ফলে সম্পর্কের দূরত্ব তিরতির করে বাড়তে থাকে, অভিমান, রাগ, জেদের পাল্লা অনায়াসে ভারি হয়ে যায়। তখন তাকেই এক বুক কষ্ট চেপে নিষ্ঠুর পরিস্থিতি সামাল হতে হয়। অথচ
অপর পক্ষ বোঝা তো দূর অনুভব করার বৃর্থা চেষ্টাটুকু করে না। যেন সব দায় শুধু ছেলেদের। কাফির মতো সেও একই পথের পথিক, এজন্য বোধহয় তার কষ্টটা অনুধাবন করতে পারছে। বুঝতে পারছে প্রতারিত হওয়ার পরেও কাফি কেন
ডুকরে ডুকরে কাঁদছে? হৃদয়ের জ্বালাপোড়া কতটা কষ্টকর সেটা প্রতারিত মানুষটাই বোঝে। এমন তো নয় কাফি সুদর্শন না সে আর মেয়ে পাবে না। কাফি শান্ত স্বভাবের শ্যামবর্ণের পুরুষ। তার জন্যও মেয়ের অভাব হবে না। কিন্তু ওই যে এক বুক ভালোবাসা, মায়া, বিশ্বাস, এখানেই আঁটকে গেছে সে।
যারা ভালোবাসে তারাই জানে এই মায়া কতটা জোরালো।
সেই সঙ্গে কোনো মেয়ে যদি উপলব্ধি করতো পুরুষের চোখে এমনি এমনি পানি আসে না। যখন হৃদয় পুড়ে ছারখার হয়ে যায় কোনোভাবেই সামাল দেওয়া যায় না তখন হৃদয়পোড়া ঝাঁঝ অশ্রু হয়ে ঝরে যায়। তখন সেটাকে হৃদয় পোড়া নেত্র বারি নামে অখ্যায়িত করলেও ভুল হয় না।

রুদ্র কেন জানি কাফিকে কাঁদতে নিষেধ করছে না স্বান্ত্বনার বাণীও দিচ্ছে না। মনভরে কাঁদতে দিচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর
কাফি নিজেকে সামলে নিলো। অশ্রু ঝরা লাল টকটকে নেত্র মুছে রুদ্রর সঙ্গে গাড়িতে উঠে বসল। রুদ্র ড্রাইভিং সিটে বসে কাফির দিকে মাম পানির বোতল এগিয়ে দিলো। কাফি সেটা নিয়ে পানি পান করে কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,

-‘স্যার, সত্যিই কি রুমা আর নেই?’

-‘আমি অকারণে মিথ্যা বলি না কাফি। নিজেকে সামলাও।’

-‘রুদাশা কি আদৌও শাস্তি পাবে?’

-‘ওর পাকাপোক্ত ব্যবস্থার করতেই যাচ্ছি আমরা।’

তারপর তারা গেল এসপি খন্দকারের কাছে। এসপির বয়স
পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে। যদিও তার আরেকটা গোপন নাম বিটকেল খন্দকার। রসকষহীন কাঠখোট্টা বিধায় তেমন কেউ পছন্দ করে না। সামনাসামনি তার প্রশংসা করলেও আড়ালে তাকে গালি দিতে দু’বার ভাবে না। তবে দায়িত্ব পালনে অটল উনি।
যে কেসের দায়িত্ব নেন সেটার শেষ দেখেই ছাড়েন। তবে হ্যাঁ
উনি ঘুষ খান না, তবে চা, মিষ্টি, খাওয়ার জন্য লাখ দু’য়েক টাকা চোখের পলকেই হাতিয়ে নেন। তার মতে ঘুষ আলাদা জিনিস আর চা মিষ্টির জন্য টাকা নেওয়া আলাদা জিনিস।
রুদ্রকে দেখে উনি উঠে হ্যান্ডশেক করে মুখভর্তি হেসে কুলশ বিনিময় করলো। রুদ্র অহেতুক কথা কথার ইতি টেনে রপ্ত করা প্রমাণ পেশ করলো। তারপর বেশ ঝাল মশলা মিশিয়ে দারুণভাবে রুশাদার বিরুদ্ধে একটা কেস সাজালো৷ একে তো মেয়ে তার উপরে মামাতো বোন। যতই হোক এর চেয়ে ভালো সাজা তাকে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ রুদাশার বাবার রাজনৈতিক পাওয়ার আছে। কিন্তু এখন যেভাবে সে কেসটা সাজালো মুক্তি পেতে কালঘাম ছুটে যাবে। এখন বাবা মেয়ে তার বাপ দাদার পাওয়ার খাটিয়ে মুক্তির চেষ্টা করতে থাক।
রুদ্র কেস সাজিয়ে এসপির একাউন্টে মোটা অংকের টাকা ট্রান্সফার করে ফিচেল হাসল। টাকার দেওয়ার বিরুদ্ধে সে নিজেও কিন্তু খন্দকারকে এখন হাতে রাখতে হবে। এতে ওর লাভ বৈ ক্ষতি হবেনা। পরে খন্দকারের থেকে সুদে আসলে টাকা ফেরত নেওয়ার ছকও করে ফেলেছে সে। রুদ্রর টাকা হজম করা এত সোজা নয়। প্রয়োজনে গলার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে টাকা উগলিয়েই ছাড়বে।

অতঃপর তারা কাজ সেরে বেরিয়ে এলো। রুদ্র কিছু একটা ভেবে কাফিকে আস্তানায় পাঠিয়ে সে গেল রুদাশার সঙ্গে দেখা করতে। র্দুগন্ধযুক্ত জায়গায় তাকে রাখা হয়েছে। শক্ত কাঠের ছোট্ট চৌকিতে বসে আছে বাবার অতি আদুরে মেয়ে রুদাশা শারমিন। একঘন্টাতে চোখ মুখের কী হাল করেছে!
রুদাশাকে এখানে রাখার পূর্বে দুই মাতালকে রাখা হয়েছিল।
তারা দু’জন মিলে পুরো জায়গা জুড়ে প্রসাব করেছে। ঠিক ছোটো বাচ্চাদের মতো।বড় মানুষের প্রসাবের গন্ধে রুদাশার গা গুলিতে যাচ্ছে। কয়েকবার ইয়াক! ইয়াক! করো বমিও করেছে। এতক্ষণে হঠাৎ রুদ্রকে দেখে রুদাশা হন্ত হয়ে উঠে এসে এক হাত বাড়িয়ে ব্যাকুল হয়ে বলল এখান থেকে নিয়ে যেতে। প্রসাবের গন্ধে এখানে টিকাও দায়। সে হাউমাউ করে কেঁদে অনুরোধ করল নিজের দোষ স্বীকার করে নিবে। তাও যেন এই ঘিনঘিনে নোংরা জায়গা থেকে নিয়ে যায়। রুদ্র ওর কথা শুনে পকেটে হাত গুঁজে এক ভ্রুঁ উঁচু করে বলল,

-‘তোমার বাবাকে বলো তোমার জন্য এখানে একটা প্রাসাদ করে দিক। তখন সেই প্রাসাদে শুয়ে বসে শাস্তি ভোগ করতে পারবে।’

-‘ এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। প্লিজ!আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা কর। আমি তোকে খুব ভালোবাসি। ভালোবাসি বলেই রাগে জেদে এমন ভুল করে ফেলেছি। আর এমন হবে না, সত্যি বলছি। তাছাড়া তুইই বল, বয়সে বড় হয়েও তোর জন্য কোন পাগলামিটা করি নি? এজন্য কত মার খেয়েছি, কটু কথা শুনেছি, তবুও তোর কথা ভুলতে পারি না আমি। আমি শুধু তোর বউ হতে চাই। আর স্পর্শীকে সতীন হিসেবে মেনে নিতে আমার সমস্যা নেই তবুও আমাকে তোর করে নে ।’

-‘ওয়াও! দারুণ! ভালোই লাগছে শুনতে, তারপর বলো….’

-‘তোকে পেলে আমি ভালো হয়ে যাবো।’

-‘নিজের রাগ সামলে এখনো তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছি, এটা কি যথেষ্ট নয়?’

-‘সত্যি বলছি, মন প্রাণ দিয়ে আমি শুধু তোকে ভালোবাসি।’

-‘জানি তো, তুমি মনপ্রাণ দিয়েছো আমাকে আর শরীর বিলাও নিজ স্বার্থে। কিন্তু আমি তো তোমার মতো সস্তা নই যে, যার তার সাথে শুয়ে পড়বো আর প্রয়োজন মিটলে ছুঁড়ে ফেলবো। তুমি হচ্ছো বাজারের খোলা খাবারের মতো, মাছি ভনভন করা, নোংরা, অস্বাস্থ্যকর জিনিস, তোমাকে দিয়ে আমার পোষাবে না। তাছাড়া আজকে যা করেছো এর শাস্তি পেতেই হবে ছাড় নেই তোমার।’

-‘তাহলে ভুল হয়ে গেছে স্পর্শীকে মেরে ফেলাই উচিত ছিল আমার। আমি এমনিতেও তোকে পাবো না ওমনিতেও পাবো না, তবে স্পর্শী কেন পাবে? এখান থেকে বের হয়ে সত্যি সত্যিই স্পর্শীকে শেষ করে ফেলবো।’

রুদাশার কথা শেষ হাতেই সেখানে এক পুলিশের আগমন ঘটলো। লম্বা চড়া সুদর্শন পুলিশ। পুলিশের পোশাকে দারুণ
হ্যান্ডসাম লাগছে মানুষটাকে। উনি রুদ্রকে সালাম দিয়ে চট করে জেলের তালা খুললো। তারপর রুদাশাকে হেঁচকা টানে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দু’গালে স্বজোরে পরপর চারটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। রুদাশা গালে হাত দিয়ে কিছু বলার আগেই উনি স্বাভাবিকভাবে বলল,

-‘উপর মহল থেকে হুকুম এসেছে দুই ঘন্টা পরপর আপনাকে ভিটামিন দিতে। এখন চারটা দিয়ে গেলাম ঠিক দুই ঘন্টা পর আবার আসব, ধন্যবাদ।’

একথা বলে উনি তালা মেরে গটগট শব্দ করে চলে গেলেন। রুদাশা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে।তার চোখের কোণে অশ্রু জমে আছে।থাপ্পড় মারা মানুষটা আর কেউ নয় তার প্রাক্তণ
স্বামী শিহাব যার সঙ্গে তার বাবা জোর করে বিয়ে দিয়েছিল।
সংসার করে নি সে। এই মানুষটাকে সহ্য করতে পারতো না, এখনো পারে না। ডিভোর্সের এ্যাপ্লাই করা আছে তিনমাসের মধ্যে তাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে। তাকে সহ্য করতে না পারার মুখ্য কারণ, একে তো সাদামাটা পুলিশের চাকরি করে তাও আবার ছা পোষা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। যাদের জীবন বেশির ভাগ ডাল ভাতেই সীমাবদ্ধ। এরা বোঝে না শৌখিনতা আর না বোঝে আমোদ প্রোমোদের নির্দিষ্টতা। শিহাবকে তার পছন্দ নয় জেনেও তার বাবা শুধু ছোটো চাচার কারণে তার বিয়ে দিয়েছিল, ছেলে ভালো, সৎ, ব্লা ব্লা এসবের ভিত্তিতে।
সেই থেকে ছোট চাচাতে সহ্য হতো না তার, যখন সে সংসার করবে না বলে জেদ করলো, ছোট চাচা সবার সামনে তাকে থাপ্পড় মেরেছিল। থাপ্পড়ের দাগটা মুছে গেলেও রাগ মিটাতে পারে নি সে। সেই রাগ তুলতে কিছুদিন আগে লোক লাগিয়ে
ছোটো চাচাকে উতমা ক্যালানি দিয়ে হসপিটালে পাঠিয়েছে।খুশির খবর হচ্ছে তার অবস্থা নাকি তেমন ভালো না৷ বাঁচলে ভালো না বাঁচলে তো আরো ভালো এতে কিছু যায় আসে না তার। চাচার প্রতি জমে থাকা রাগ হালকা হয়েছে এইই ঢের।
কিন্তু সে এখন রুদ্রর হাত থেকে বাঁচবে কীভাবে? রুদ্র বুদ্ধি খাঁটিয়ে আঁটঘাট বেঁধে নেমেছে শিহাবের উপস্থিতিতে স্পষ্ট। এখন শিহাব সুযোগ বুঝে তাকে নাকানিচুবানি খাওয়াবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
একথা ভেবে রুদাশা নিজেই নিজের চুল খামছে ধরে রাগে
হিসহিস করতে লাগল। আর রুদ্র রুদাশার এ অবস্থা দেখে
তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে সেখান থেকে প্রস্থান করল।

তখন সে গাড়ি নিয়ে কাফিকে আস্তানায় যেতে পাঠিয়েছিল।
কারন রুমার লাশ সেখানে রাখা আছে। লাশ দেখে ছেলেটা কি করছে কে জানে। যদিও সেখানে কয়েকজন ছেলেপুলে আছে। তারা ঠিক কাফিকে সামলে নিতে পারবে। মনে মনে এসব ভেবে দৃষ্টি তুলে মেঘে ভরা আকাশ দেখে সিএনজিতে উঠে বসল। আজ সারাটাদিন স্পর্শীকে না দেখে মনটা বড্ড উতলা হয়ে উঠেছে। শরীরের এনার্জি ফুরিয়ে এসেছে। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীরটা যেন আর চলছে না। লাথির চোটে স্পর্শীর ব্য/থায় কুঁকড়ে যাওয়ার দৃশ্য চোখের সামনে ভাসছে। কানে বাজছে করুণ সুরে করা আর্তনাদ। এরিমধ্যেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। পথচারীরা ছুটাছুটি করে ছাওনির দিকে যাচ্ছে। বড় বড় বৃষ্টি ফোঁটাগুলো পিচচালা রাস্তায় আছড়ে পড়ছে। ধীরে ধীরে বৃষ্টিও গতি বাড়ছে। ঝড়ো হাওয়াতে হেলে যাচ্ছে পথের ধারের গাছ-পালা।প্রায় দেড় ঘন্টা পর সিএনজি এসে থামল হসপিটালের সামনে। তখনো বৃষ্টি ঝরছিল। সে ভাড়া মিটিয়ে আধভেজা হয়ে হসপিটালে প্রবেশ করলো। দো’তলার সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠে স্পর্শীর কেবিনে ঢুকতেই মুখোমুখি হলো মরিয়ম বেগমের। মরিয়ম বেগমের দৃষ্টি দেখে সে মাথা নত করে নিলো। তখনই রুদ্রর বাবা-মা দাদীমার রুম থেকে বেরিয়ে আসলেন। রুদ্রর মাথা নত দেখে সামনে দন্ড়ায়মান সকলের দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ছোট থেকেই এটা ওর বদ অভ্যাস, কোনো অপরাধ করলে অথবা তার কারণে কেউ কষ্ট পায় তাহলে সে ভয়ে পালিয়েও যায় না, লুকিয়েও থাকে না, বরং দোষ স্বীকার করে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে।
তার এই মাথা নত করা মানেই সে অনুতপ্ত। এতে কেউ আর কিছু বলতে পারেন না। আজও সে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে, চোখে, মুখে ক্লান্তির ছাপ। মরিয়ম বেগম একটা কথা বললেন না কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন। তখন রুদ্রর বাবা বললেন,

-‘চিন্তার কিছু নেই দু’জনেই এখন বিপদমুক্ত। সারাদিন কিছু খেয়েছো?’

রুদ্র জবাব দিলো না। খাওয়ার কথা ভুলেই গেছে সে। তাকে নিশ্চুপ দেখে বুঝে গেলেন যা বোঝার। তারপর বড়রা একে একে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন, স্পর্শী তখনো ঘুমাচ্ছে।
রুদ্র ভেজানো দরজাটা আস্তে করে লক করে দিয়ে স্পর্শীর কাছে এগিয়ে গেল। অপলক তাকিয়ে রইল স্পর্শীর মুখের দিকে। তারপর নিচু হয়ে আলতো করে স্পর্শীর কপালে ঠোঁট ছোঁয়াতেই স্পর্শী নিভু নিভু চোখ মেলে তাকাল।রুদ্রকে দেখে
অনেক কষ্টে চোখ খুলে রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। শক্ত মনের নিষ্ঠুর পুরুষটা অবশেষে এসেছে। তার এই অবস্থার জেনেও সারাদিন পেরিয়ে এখন আসার সময় হয়েছে। সময় করে এসেছে এই ঢের। দলের নেতা বলে কথা। নেতার নাকি হাজারটা কাজ। সেই হাজারটা কাজ সামলে আসতে দেরি তো হবেই। দয়া করে এসেছে এই সৌভাগ্য। এসব ভেবে সে দৃষ্টি সরিয়ে অন্য দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে চোখের কার্ণিশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে গেল। তাকে কাঁদতে দেখে রুদ্র তার পুরো মুখে আদর এঁকে বলল,

-‘ আমাকে মার, কা/ট, ইচ্ছে মতো কষ্ট দে, তাও চুপ থাকিস না, কিছু বল।’

স্পর্শীর ছলছল চোখে শুধু তাকিয়ে রইল রুদ্রর মুখের দিকে তবে কিছু বলল না। কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। যে পুরুষ নারীর মন বুঝে না, কষ্ট বুঝে না, আবেগ বুঝে না, অভিমানে ঠাসা দৃষ্টির মানে বুঝে না, সে আর যায় হোক ভালো স্বামী হতে পারে না।

To be continue…..!!

প্রেম প্রার্থনা পর্ব-১৬

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[১৬]

-‘চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে যদি অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে না পারি, তবে আমি রুদ্র রাজনীতি ছেড়ে দিবো, ওয়াদা করলাম।’

একথা বলে রুদ্র সেখান থেকে বেরিয়ে কাউকে কল করল।
মুখভঙ্গি থমথমে। রাগে ফুলে আছে নাকের পাটা। টেনশনে
কপাল বেয়ে ঝরছে সরু ঘাম। সে পায়চারি করা অবস্থাতেই কলে আলোচনা সারলো, আদেশ করলো, আদেশকৃত কাজ দ্রুত সম্পূর্ণ করার। এখন এক সেকেন্ডের গুরত্ব অপরিসীম তাই প্রতিটা সেকেন্ডকে কাজে লাগাতে হবে। কার এত স্পৃহা সেও দেখতে চায়। কোন অপরাধে তার প্রিয় মানুষের সঙ্গে এরুপ হামলা করা হলো তার জবাব চাই-ই চাই। তারপর সে
কল কেটে কাফিকে কল করে তার ফ্ল্যাটে চলে যেতে বলল।
কাফির মনের অবস্থা বুঝে রুদ্র কথা বাড়ালো না শুধু গম্ভীর স্বরে দরজার নিউ পিন আর ফ্ল্যাটের কোথায় কোথায় কোন
ক্যামেরা আছে বলে দিলো। যাতে সেসব ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে এই মুহূর্তে ইমেইল করতে পারে। কাফি মনযোগ সহকারে রুদ্রর কথা শুনে একবার লালনের দিকে তাকালো, লালন তার বলা কাজে মগ্ন। কাফি হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এসেছে লালনের কাছে। লালন তাদের ট্রিমেরই সদস্য। তার কাজ লোকেশন ট্র্যাক্ট করা। সে এখন রুমার ফোনের লাস্ট লোকেশন খোঁজার চেষ্টা করছে। তখন কিছু একটা পেয়ে কাফির দিকে তাকালো। রুমার ফোনের লাস্ট লোকেশন শো করছে এক নির্জন জঙ্গলে। হয়তো সেও বুঝে গিয়েছিল তার ফোন ট্র্যাক হতে পারে এজন্য আগেই ব্যবস্থা করে ফেলেছে।
একথা শুনে কাফি দু’জনকে পাঠালো ফোন খুঁজে বের করে আনার জন্য। তারপর সে রুদ্রর কথামতো ফ্ল্যাটে চলে গেল, একে একে খুঁজে বের করলো গোপন ক্যামেরাগুলো। ওদের
ফ্ল্যাটের মেইন দরজা থেকে দশহাত দূরের পেইটিংয়ের সঙ্গে হিডেন ক্যামেরা লাগানো আছে, ড্রয়িংরুমের শোভাবর্ধনের
জন্য লাগানো ঝাড়বাতির ঠিক মাঝখানে আরেকটা হিডেন ক্যামেরা, রুদ্রর রুমের বাম দেওয়াল ঘেষে ল্যাম্প স্টানের
বিপরীতে থাকা ফুলদানীর ফুলের মধ্যে আরেকটা ক্যামেরা,
কাফি খুঁজে খুঁজে ক্যামেরাগুলো বের করে ওর লেপটপ অন করে ফুটেজগুলো চেক করতে বসলো। একে একে ফুটেজ দেখে তার মুখের ভাষা হারিয়ে গেল। হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল স্কিণে ভাসা মানুষগুলোকে। মৃদুভাবে কাঁপতে থাকল তার পুরো শরীর। স্পর্শীকে র্নিমমভাবে লাথি মা/রার দৃশ্যটা দেখে ওর পুরো পৃথিবীটাই যেন নড়ে উঠল। স্পর্শীর ওহ মা! মাগো! বলে করুণ আর্তনাদ যে কারোর হৃদয় নাড়িয়ে দিবে।
ইশ! অসহ্য ব্যথায় কীভাবে কাতরাচ্ছে মেয়েটা। এমন করুণ অবস্থা দেখে রুদ্র মাশুমের কী যে করবে ভাবতে পারছে না সে। তাছাড় রুমা সব জেনেও কেন এই বোকামি’টা করলো?
সে তো রুদ্রর রাগ সম্পর্কে জানে, এমনকি নিজের চোখেও দেখছে অনেককিছু। তারপরেও এসব করার সাহস করলো কীভাবে? ওর কী বুক কাঁপে নি? রুদ্রর কথা নাহয় বাদ ওর কথা ভাবে নি? বিয়ের পর একটা মেয়ের কাছে কাছে তার স্বামীই নাকি সব। একথা তো রুমা নিজের মুখেই বলেছিল,
অথচ সে অপরাধ করে স্বামীকেই অপরাধীর তকমা লাগিয়ে
পালিয়ে গেল। ভালোবাসা, আস্থা, বিশ্বাস একনিমিয়েই সব মিথ্যা করে দিলো অথচ তার ভালোবাসায় কোনো খাত ছিল না, ছলনা ছিল না। এতিম জেনে কখনো হেলা করো নি বরং
অসীম ভালোবাসায় মুড়িয়ে রেখেছিল রুমাকে, কখনো উঁচু স্বরে কথা বলেও নি আর না তার না কোনো আবদার অপূ্র্ণ রেখেছে। তবুও বেলাশেষে এমন নিষ্ঠুর প্রাপ্তি! এমন ছলনা না করলেও পারতো। সে আর ভাবতে পারলো না দুইহাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠল। রুমার ছলনা মানতে পারছে না সে। মনে হচ্ছে কষ্টে বুকপাঁজর ভেঙে আসছে। পরিস্থিতি এমন ঘোলাটে সে সে চাইলেও রুমাকে বাঁচাতে পারবে না এতে রুদ্রর সঙ্গে বে/ইমানি করা হবে। বেঁচে থাকতে রুদ্রর সঙ্গে বে/ইমানি করার কথাও ভাবতেপারে না সে। এরচেয়ে মৃত্যুবরণ অনেক সহজ। এসব ভেবে অনেক কষ্টে নিজেকে
নিজেকে সামলে কাঁপা কাঁপা হাতে ফুটেজ পাঠিয়ে দিলো রুদ্রর ইমেইলে। রুদ্র সঙ্গে সঙ্গেই সেটা সিন করে আশিকের দিকে তাকালো, চোখে চোখে দু’জনের কথা হলো তারপর রুদ্র বেরিয়ে গেল নিজের উদ্দেশ্যে হাসিলের লক্ষ্যে। রুদ্র যাওয়ার আধা ঘন্টা পর কাফিও হসপিটালে উপস্থিত হলো। আশিক আর কাফি স্পর্শীদের নিরাপত্তার জন্য হসপিটালেই থেকে গেল।

ঘড়ির কাঁটা নিজ গতিতে ঘুরে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে অতিবাহিত হচ্ছে সময়ের চাকা। চার ঘন্টা পেরিয়ে গেছে রুদ্র ফিরে নি।
আর না কারো ফোন রিসিভ করেছে। নিভু নিভু সন্ধ্যা ঘনিয়ে
রাত নেমে এসেছে৷ কর্মব্যস্ত মানুষফিরে যাচ্ছে আপন নীড়ে।
হসপিটালে বেড়েছে রোগীর সংখ্যা। যার যার পেশেন্ট নিয়ে ব্যস্ত আপন জনরা। অনেকক্ষণ আগে স্পর্শীদের পাশাপাশি কেবিনে রাখা হয়েছে। ওরা এখন বিপদমুক্ত। জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ হলো। তবে জ্ঞান ফেরার পর থেকে স্পর্শী টু শব্দ করে নি। শুধু নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে, কেউ কিছু বললে নির্বাক হয়ে শুনেছে। কিছুক্ষণ আগে আশিক এসে স্পর্শীর সঙ্গে কথা বলেছে, দুষ্টু মিষ্টি কথায় হাসানোর চেষ্টাও করেছে
কিন্তু স্পর্শী নিজের ভাবনায় মগ্ন। এত মগ্ন হয়ে কী ভাবছে, কে জানে! পরিশেষে আশিক ব্যর্থ হয়ে বেরিয়ে গেছে তখনই হন্তদন্ত হয়ে কেবিনে প্রবেশ করে মরিয়ম বেগম। কলিজার
টুকরো মেয়ের অবস্থা দেখে ডুকরে কেঁদে উঠেন। মেয়েটা ব্যথা পাবে বলে আলতো করে জড়িয়ে ধরেন বুকে। উনাকে কাঁদতে দেখে স্পর্শী কথাও বললো না, বিচলিতও হলো না।
পূর্বের মতো অপলক সিলিংয়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখল।মেয়ের নীরাবতা সহ্য করতে পারছেন না মরিয়ম বেগম, ওর গায়ে, মাথায় হাত বুলি ডুঁকরে কেঁদে যাচ্ছেন। সেইভ থাকার জন্য স্পর্শীকে এতদূরে পাঠিয়েছিলেন তিনি, অথচ আজ..!
দুপুরের দিকে রুদ্রর বাবা মাকে হন্তদন্ত হয়ে বের হতে দেখে
উনার সন্দেহ হচ্ছিল। যদিও প্রথমে জানাতে চান নি তারাও, পরে মন কু ডাকছিল বিধায় চেপে ধরায় উনারা বলতে বাধ্য হোন।

মেয়ের ভালোর জন্য এতদিন বুকে পাথর চেপে ছিলেন। দিন নেই, রাত নেই, মেয়ের অনুপস্থিতে নীরবে কেঁদেছেন, একা একা তড়পাচ্ছিলেন। মেয়েটা অভিমান করে কথাও বলতো না, রাগ করে ফোনই রিসিভ করতো না। তবুও হাল ছাড়েন নি প্রতিনিয়ত রুদ্রর থেকে খোঁজ খবর নিয়েছে। রুদ্র উনার মন রক্ষার্থে গুঁটিকয়েক মিথ্যা বলতো সব বুঝেও হাসি মুখে মেনে নিতেন। কিঞ্চিৎ আশা ছিল সব ঠিক হয়ে যাবে, আজ যা হলো তারপর সেই আশাটুকুও নিভে গেল। যত যাই হোক
এভাবে চলতে দেওয়া যাবে না এবার কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। দুই দু’বার মেয়েটা ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেল, বারবার ভাগ্য প্রসন্ন থাকবে তা তো নয়। রুদ্রর সঙ্গে এবার সরাসরি
কথা বলতে হবে।মাকে কাঁদতে স্পর্শী চাইলেও টু শব্দ করতে পারছে না। মনে হচ্ছে গলা থেকে পেট অবধি কুঁপিয়ে ফালা ফালা করে দিয়েছে। অসহ্য ব্যথায় জর্জরিত পুরো শরীর। মাথা ব্যথায় চোখজোড়া আপনাআপনি বুজে আসছে। তবে মায়ের উপস্থিতিতে খুশি হয়েছে। এজন্য ঠোঁটে ফুটে উঠেছে মলিন হাসি। ছলছল চোখ। সেই সঙ্গে আরেকটা শব্দ কানে বারবার প্রতিধ্বণি হচ্ছে ‘ রুদ্র ভালো ছেলে, মুখ বুজে সব মেনে নাও।’
মেনে নিয়েছে বলেই এই দশা। রুদ্র যতদিন এসব থেকে সরে না আসবে এসব চলতেই থাকবে। আর মায়ের বলা আদেশ অনুযায়ী তাকেও সব মেনে নিতে হবে।

রুদ্রর বাবা-মা আসার পরপর কাফিও বেরিয়ে গেছে। রুদ্র কোথায় আছে, কী করছে, জানা দরকার। বেশ কয়েকবার কল করার পর রুদ্র কল কেটে একটা ঠিকানা মেসেজ করে দিলো। কাফি লোকেশন জেনে অবিলম্বে ছুট দিলো সেখানে।
লোকেশন হচ্ছে রুদ্রর বড় মামার বাসা, এখানে থেকে আধা ঘন্টার পথ। কাফি সেখানে পৌঁছে দেখে রুদ্র বসে আছে তার বড় মামার সামনে।লেপটপে চলছে স্পর্শীকে মারার ফুটেজ।
কাফি ভয়ে ভয়ে একবার রুদ্রর দিকে তাকালো তবে রুদ্রকে আজকে খুব শান্ত দেখাচ্ছে। এত শান্ত থাকার কারণ বুঝতে পারছে না সে। এটা বোধহয় ঝড় আসার আগের পূর্বাভাস।
পুরো ফুটেজ শেষ হতেই রুদ্র শান্ত কন্ঠে বড় মামাকে বলল,

-‘ আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি, কারণ আপনি আমার মায়ের আর্দশ। সেই শ্রদ্ধা বজায় রেখে এখনো বিনয়ীভাবে জানতে চাচ্ছি, রুদাশা কোথায় মামা? আপনি কি তার খোঁজ দিতে পারবেন নাকি আমি খুঁজে নিবো? যদি আমাকে খুঁজে নিতে হয় তাহলে ভুলে যাবো সে আমার মামাতো বোন।’

-‘সে তোমাকে ভালোবাসে তা তো তুমি জানোই বাবা। ছোট থেকে তোমার জন্য কত পাগলামি করে।শুধু তোমার মায়ের কথা রাখতে জোর করে বিয়েও দিলাম যাতে তোমাকে ভুলে যায় কিন্তু মেয়েটা সংসার করলো না। তাকে মেরে ধরে জোর করেও শশুড়বাড়ি পাঠাতে পারি নি। এমনকি মন্ত্রীর পুত্রবধূ
এমিলির তোমাকে পছন্দ করে জেনে এমিলিকেও অপদস্ত করার কম চেষ্টা করে নি। সে তোমার ভাগ কাউকে দিতে চায় না তাই এসব পাগলামি করে।’

-‘এটা আমার প্রশ্নের উত্তর নয়। কে কাকে ভালোবাসে এর হিসাব পরে করবো। এখন যা জানতে চাচ্ছি আপনি শুধু এইটুকু বলুন।’

-‘এবারের মতো মাফ করা যায় না বাবা? সে মানসিকভাবে
অসুস্থ তার চিকিৎসাও চলছে এসবও তোমার অজানা নয়।
তাছাড়া সকালে বেরিয়ে সে এখনো বাসাতেই ফিরে নি।’

-‘কোন অপরাধটা মাফ করার কথা বলছেন? ছোটো মামা ওকে থাপ্পড় মেরেছিল বিধায় লোক লাগিয়ে ছোটো মামার এই অবস্থা করার অপরাধটা? নাকি স্পর্শীর উপরে হামলা করার ব্যাপারটা? তাও কিন্তু একবার নয় পরপর দুই দু’বার।
ওকে এই দুটোও নাহয় বাদ, স্পাই হিসেবে রুমা নামের সেই
মেয়েটা, যাকে টাকার বিনিময়ে আমার সহকারীর পেছনে লাগিয়েছিল। বিশ্বাস অর্জন করে কাফির বউ বানিয়ে শেষে নিজের উদ্দেশ্যে হাসিল করতে চেয়েছিল। রুমা তার কথায় এসব করেছে। কিন্তু আজ আপনার মেয়ে ব্যবহারিত টিস্যুর ন্যায় কাজ শেষে মেয়েটাকে ছুঁড়ে ফেলেছে। মেয়েটার নিথর দেহ পাওয়া গেছে জঙ্গলের রাস্তার পাশে। ফোন ট্র্যাক করে ফোন উদ্ধার করতে গিয়ে লা/শ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো বলবেন তাকে মাফ করতে? হ্যাঁ, বলতেও পারেন কারণ যা দেখছি আপনার বিবেক লোপ পেয়েছে। আপনি আজকাল সত্য মিথ্যা পরখ করার ক্ষমতা হারিয়েছেন।’

-‘রুদ্র!’

-‘উসস! আস্তে মামা এখনি এত হাইপার হলে চলবে? ছোটো মামার এই অবস্থা কে করেছে তার সব প্রমাণ আমার কাছে আছে। দিবো নাকি এসপির কাছে পাঠিয়ে?’

-‘আমি যখন জেনেছি এসবের পেছনে রুদাশা আছে তখন আমার কিছু করার ছিল না। আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা করো। এদিকে সন্মান অন্যদিকে একমাত্র মেয়ের ভবিষ্যৎ।’

-‘সেসব কেচ্ছা শুনে আমার লাভ নেই। এখন বলুন রুদাশা কোথায়? এটাই কিন্তু লাস্ট বার জিজ্ঞাসা করছি। ‘

বড় মামা চিন্তিত মুখে রুদ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।
কি বলবে বুঝতেও পারছেন না তিনি। তখন কাফির ফোন বেজে উঠল। ফোন পিক করছে না দেখে রুদ্রর ঘাড় ঘুরিয়ে কাফির দিকে তাকালো। ছেলেটা দেওয়ালে দেলান দিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। হৃদয় পোড়া অশ্রু
অঝরে ঝরে যাচ্ছে। রুদ্র দীর্ঘশ্বাস উঠে কিছু বলার আগেই রুদ্রর ফোনে রিংটোন বেজে উঠল। সে কল রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে একজন বলে উঠলো,

-‘স্যার রুদাশারে পাওয়া গেছে। এয়ারপোর্টে আইসা বইয়া রইছে। আর একটু হইলে হাত ফসকে বিদ্যাশ চইলা যাইতো। এরে এহন কী করুম?’

-‘গুড জব রামু! তোমার কাজে আমি খুশি হয়েছি, বলো কি চাও?’

রুদ্রর কথায় রামু লাজুক হেসে লজ্জিত স্বরে জানাল তার বউয়ের একটা টাচ্ ফোনের খুব শখ। রুদ্র যদি কমা দামের একটা টার্চ ফোন কিনে দিতো অনেক খুশি হতো। রুদ্র সঙ্গে সঙ্গে রামুর একাউন্টে ত্রিশ হাজার টাকা পাঠিয়ে কিনে নিতে বললো। আর সে এসপিকে মেসেজ করে রুদাশার আদরযত্ন
করার সু-ব্যবস্থা করতে বলল। তার মামাতো বোন বলে যেন
ছাড় দেওয়া নাহয়। তার প্রতিটা অপকর্মের প্রমাণ একটুপর
পাঠিয়ে দিবে। তারপর সে কাফির কাঁধ জড়িয়ে ধরে বেরিয়ে এলো। বড় মামা এত করে ডাকলেও সাড়া দিলো না। রুমার ব্যবস্থা হলো, রুদাশার আপাতত ব্যবস্থা হলো এবার সোহাগ চাঁদ মাশুমের পালা।রুদ্র ফোনে সময় দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আশিক প্রতিনিয়ত তাকে স্পর্শীর খবর জানাচ্ছে। দাদীমাও এখন ঠিক আছে, ছেলে ছেলের বউদের সঙ্গে গল্প করছেন।
তবে মরিয়ম বেগম থম মেরে আছে। বাইরের ঝামেলা শেষ করে নতুন ঝামেলার মুখোমুখি হতে হবে বুঝতে বাকি নেই তার। সকালে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে রুমাকে খুঁজতে বের হয়েছিল। কারণ যে গাড়িতে করে বের হয়েছিল তারা, সেটা ভাড়া করা ছিল। সেখান থেকে কে কখন ভাড়া করেছিল তা খুঁজে বের করেছিল। এরমধ্যে জানতে পারে রুমার ফোনটা খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেছে রুমার নিথর দেহ। একথা তখন কাফিকে জানাতে নিষেধ করো। রুমার লাশ তাদের গোপন আস্তানায় পাঠাতে বলে সে রুদাশাকে খুঁজতে থাকে। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে অনেক জায়গায় খুঁজে না পেয়ে বুঝেছিল
এখানে বড় মামার হাত আছে।তারপর প্ল্যান করে বড় মামার বাসায় গিয়েছিল। বড় মামার ফোনে কল আসে উনি চোরা চোখে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বললেন,

-‘সমস্যা নেই, চলে যাও, বাকিটা আমি সামলে নিবো।’

একথা শুনে সে সিওর হয়ে যায়। ততক্ষণে লালন পেয়ে যায় রুদাশার খবর। ব্যস! প্ল্যানও সাকসেস হয়ে যায়। মনে মনে এসব ভেবে রুদ্র গাড়ির কাছে এগিয়ে যায়। কিন্তু গাড়িতে না
উঠে আচমকা কাফিকে জড়িয়ে ধরে। ছেলেটা গুঁমড়ে যাচ্ছে একা একা। কাঁদতে পারছিল না। কিন্তু রুদ্রর জড়িয়ে ধরাতে
কাফি আর নিজেকে সামলাতে পারলো না স্থান কাল ভুলে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। ওর কান্না দেখে রুদ্রর চোখও ছলছল করে উঠল। রুমাকে বোনের নজরে দেখতে সে। খুব স্নেহ করতো। স্পর্শীর জন্য কিছু কিনলে রুমার জন্যও কিছু না কিছু কিনতো। কাফি মুখে না না করলেও মনে মনে ভীষণ খুশি হতো। আর সেই খুশি ভেসে উঠতো তার চোখজোড়ায়।
কাফিকে এভাবে কাঁদতে দেখে রুদ্র তার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

-‘পুরুষদের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা বোঝার ক্ষমতা যদি প্রতিটা নারীর মাঝে থাকতো তবে পৃথিবীর বুকে বিচ্ছেদ বলে কোনো শব্দ থাকত না।’

To be continue………..!!

প্রেম প্রার্থনা পর্ব-১৫

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[১৫]

রুমা গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে রান্নাঘরে মাংস কষতে ব্যস্ত। আজকে সে হরিণের মাংস রান্না করছে। সুন্দরবনের চিত্রা হরিণ। চিত্রা হরিণের দেখতে যেমন নজরকাড়া মাংসও তেমন সুস্বাদু। সে মাস খানিক আগে খেলেও স্বাদ যেন মুখে লেগে আছে। আজ বিশেষ অতিথি এসেছে সে নিজের হাতে হরিণের মাংস রান্না করে তাদের খাওয়াবে। এসব ভেবে তার মুখে হাসি ফুটল। রান্নার ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। মনে হচ্ছে রান্নাটা দারুণ টেস্টি হবে! যদিও তার রান্না খেয়ে কেউ খুঁত বের করতে পারে না, পাক্কা শেফ কি না তাই! সে মাঝারি আঁচে মাংস কষিয়ে পরিমাণমতো পানি দিয়ে ঢেকে মাংস সেদ্ধ করতে দিলো। তারপর অন্য চুলায় চায়ের পানি বসিয়ে ড্রয়িংরুমে উঁকি মেরে এলো।

ড্রয়িংরুমের অবস্থা দেখে মিটিমিটি হেসে দুইকাপ চা বানিয়ে সেদিকে পা বাড়াল। মুখভর্তি হাসি তার। শ্যামবর্ণের মুখশ্রী খুশিতে ঝলমল করছে। আসন্ন সুখবরে ষোড়শী কিশোরীর ন্যায় চঞ্চল তার মনপ্রাণ। ড্রয়িংরুমে গিয়ে সেন্টার টেবিলের উপর চায়ের কাপটা রাখল। মুখে তৃপ্তির হাসি। কতদিন পর ছোটো ভাইকে দেখছে। বোনকে দেখে মাশুম একগাল হেসে কুশল বিনিময় করে জড়িয়ে ধরল। ইচ্ছে থাকলেও সে এসে বোনকে দেখে যেতে পারে না। কারণ এই না পারার পিছনে মস্ত বড় হেতু রয়েছে। নিজ নিজ স্বার্থ লুকায়িত। আর স্বার্থ
হচ্ছে মোটা অংকের টাকা।তারা দুই ভাইবোন মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে পরিকল্পনামাফিক এখানে এসেছে। যদিও একথা কেউ জানে না। আটমাস আগে টাকার বিনিময়ে এক
একটা দায়িত্ব অর্পণ করা হয় তাদের উপর। মাশুমের দায়িত্ব রুদ্রর প্রতি নজর রাখা আর রুমার দায়িত্ব কাফিকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে বিয়ে করা। রুমা সেই কাজ দায়িত্বের সাথেই সম্পূর্ণ করেছে।নিজেকে এতিমের পরিচয় দিয়ে সত্য গোপন
কাফির বিশ্বাস অর্জন করেছে। রুদ্রর কাছে ভালো মানুষের মুখোশ পরে এই অবধি এসেছে। কিন্তু মাশুম রুদ্রর উপরে নজর রাখতে গিয়ে খোঁজ পায় স্পর্শীর। ঠিক পুতুলের মতো দেখতে মেয়েটার বাঁকানো শরীরটা প্রবলভাবে তাকে আকৃষ্ট করে। কাম স্পৃহা জেগে ওঠে। মরিয়া হয়ে যায় পুতুলটাকে
একবার হলেও ছুঁয়ে দেখার। দিনে দিনে তার মনোবাসনা দৃঢ় হতে থাকে। কিন্তু ছুঁতে গেলে রুদ্রর মুখোমুখি হতে হবে আর রুদ্রর নজরে পড়া মানে তার পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়া। তার পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়া মানেই প্রাণ খোয়ানো। তাই মিথ্যা কথায় রস ঢেলে কৌশলে সে স্পর্শীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছিল।
উদেশ্যে হাসিলের অনেকখানি পথ এগিয়েওছিল কিন্তু রুদ্র এসে সব বানচাল করে দিলো। সেদিন যদি আর কিছুক্ষণ পর রুদ্রের আগমন ঘটতো তাহলে সে উদ্দেশ্যে সফল করে ফেলতো। আর পরিকল্পনামাফিক পরদিন সকালে জনপ্রিয় পত্রিকার পাতায় বড় করে ছাপা হতো, ‘তুখর রাজনীতি বিদ রুদ্র রাজের বোন ধর্ষণ।’ কিন্তু আফসোস সেসব কিছুই হলো না। পূর্বের কথা ভেবে মাশুম চায়ের কাপ নিয়ে আশেপাশে তাকাল। বিলাশ বহুল ফ্ল্যাটটা বেশ বড়, নজরকাড়াও বটে।
ফ্ল্যাটের ডেকোরেশন দেখে মনে হচ্ছে নামীদামী লোক থাকে এখানে। হঠাৎই তার মনে হলো ড্রয়িংরুমে আরেকজন নেই।
অপরুপ সৌন্দর্যের রমনী অনুপস্থিত এখানে। মাশুম সামনে এগিয়ে দেখে সেই রমণী রুদ্রর বেডরুমে কীসব খুঁজাখুঁজি করেছে। কিন্তু যেটাতে হাত দিচ্ছে শব্দ করে সাইরেন বেজে উঠছে নতুবা পার্স চাচ্ছে। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে বিরক্ত হয়ে, বাংলা ইংলিশ মিলে গালি ছুঁড়ছে সেই রমণী। এত কষ্ট করে এসে যদি কাজের কাজ না’ই হয় তাহলে কেমন লাগে!
রুদ্র ভীষণ চতুর বলে এই ব্যবস্থা করেছে যাতে প্রয়োজনীয় ডকোমেন্ট হাতবদল হতে না পারে। একথা ভেবে উনি ছোট্র ড্রয়ারে হাত রাখতেই পুনরায় সাইরেন বেজে উঠল। এভাবে সাইরেন বাজতে দেখে মাশুম রুমে প্রবেশ বলল,

-‘ম্যম, সাইরেন বেজে উঠছে যেহেতু আর টাচ্ করিয়েন না।’

-‘কেন?’

-‘আশেপাশের কেউ শুনে ফেললে বিপদে পড়ে যাবো।’

মাশুমের কথা শুনে সেই রমনীর মেজাজটা বিগড়ে গেল। সে বি/শ্রী গালি দিয়ে বসলো মাশুমকে। এই অর্কমাটাকে রুদ্রর রুমের রুমের সব পার্স জানতে বলেছিল অথচ দু’জন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একজন রান্নাঘরে পড়ে আছে আর আরেকজন স্পর্শীর শরীর হাতাতে ব্যস্ত।যেন ওদেরকে এসব করতে মোটা অংকের টাকা দেওয়া হয়। নিজের রাগ সামলাতে না পেরে উনি হাতের কাছে থাকা ফুলদানিটা ছুঁড়ে মারলেন। সেটা গিয়ে লাগল রুমার কপালে। সে আহ! শব্দ করে কপাল চেপে ধরে সেখানেই বসে পড়ল। মাশুম জলদি
ফাস্ট এইডের বক্স খুঁজে এনে বোনের কপালে ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দিলো। তবে মাশুম মনে মনে এর প্রতিশোধ নেওয়ার ওয়াদা করে ফেলেছে। এই মহিলা মানুষ মনে করে না তাদের। যখন তখন জঘন্য ভাষায় দূর্ব্যবহার করে। ম্যম রেগে আছে দেখে রুমা ভয়ে ভয়েই জিজ্ঞাসা করল,

-‘স্পর্শীরা কি ড্রয়িংরুমেই পড়ে থাকবে ম্যম? কেউ আসলে সন্দেহ করতে পারে।’

-‘এক কাজ করো বুড়িকে কেঁ/টে টুকরো করে ফ্রিজে ঢুকিয়ে দাও। আর মাশুম স্পর্শীকে রেপ করে ছাদে নিয়ে গিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দাও। এদের বাঁচিয়ে রাখা মানেই ঘোর বিপদ।
তাছাড়া কোথায় যেন শুনেছিলাম শত্রুর শেষ রাখতে নেই।’

-‘ওদের যা অবস্থা কয়েকঘন্টা এভাবে পড়ে থাকলে এমনিই মা/রা যাবে।’

-‘উহুম! মেয়ে মানুষের জান কৈ মাছের প্রাণ, তোমার মতো গাধীর কথা শুনে বিপদে ডাকতে পারব না আমি। আর এত কথা না বলে যা বললাম করো। তোমার আজাইরা বকবক
শোনার জন্য মাসে মাসে এত টাকা দেওয়া হয় না।’

উনি উক্ত কথার রাশ টানতেই উনার ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। সেইভ নাম্বারের নাম দেখে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে রইল।
মেয়েটা চরম বেয়াদব; দলের খাতিরে সম্ভবত দুইবার কথা হয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে কল দেখে ব্যাপারটা ভাবাচ্ছে খুব।
উনি ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে বিরক্তির সাথে কল রিসিভ করল,
তখন কারো অট্টহাসি গানে এসে বিঁধল। তার বিরক্তির ক্ষীণ
মাত্রা তড়তড় করে বেড়ে গেল। সে কলটা কেটে দিতে উদ্যত হতেই অপর পাশ থেকে সে বলে উঠল,

-‘এমিলিয়া খান উরফে এমিলি বলছি মামী সাহেবা। আহারে
এবারেও আপনার প্ল্যানে ধাপ্পা, হা হা হা।’

-‘কিছু বলার থাকলে বলো নয়তো ফোন রাখো।’

-‘আপনার যমদূত দোর গোড়ায় পৌঁছে গেছে। প্রাণে বাঁচতে চাইলে পালিয়ে যান।’

-‘মানে?’

-‘রুদ্র গাড়ি ঘুরিয়ে বাসার দিকেই আসছে বাঁচতে চাইলে গাঁ ঢাকা দেন। নয়তো কী হবে আশা করি বলে দিতে হবে না, হা হা হা।’

একথা বলে এমিলি কল কেটে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।
এমন কাঁচা কাজ এই মহিলার দ্বারাই সম্ভব। এমিলি মিথ্যা বলছে বলে মনে হলো না তাই সেই রমণী মাশুমকে কথাটা জানাতেই তারা বেড়িয়ে পড়তে উদ্যত হলো। রুমার কপালে ব্যান্ডেজ দেখে রুদ্র সন্দেহ করতে পারে তাই রুমাকেও সঙ্গে যেতে বললো। রুমা মেয়েটা যা ভীতু রুদ্রর ভয়ে সব গড়বর করে দেওয়া সম্ভবনা আছে। মোদ্দাকথা, রুদ্রর সন্দেহ হলে পেট কথা বের করেই ক্ষান্ত হবে, সেটা যে কোনো উপায়েই।
আপাতত রুদ্র থেকে বাঁচতে রুমাকে সঙ্গে নেওয়া শ্রেয়। ওরা বের হয়ে লিফট উপরে উঠছে দেখে না দাঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়েই নিচে নেমে গেল। তারপর মুখ লুকিয়ে বের হয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। রুমাকে দেখে দারোয়ানও খুব একটা গুরুত্ব দিলো না আরামসে বসে ডাল পরোটা খেতে মগ্ন হয়ে গেলেন। নিচ তলার ভাবির যা রান্না করে না, পুরাই অমৃত! মাশুমের গাড়ি বেরিয়ে যেতেই রুদ্রর গাড়ি এসে থামল গেটের কাছে। রুদ্রর গাড়ি দেখে দারোয়ান দৌড়ে বেরিয়েও এসেছেন। কিন্তু কিছু বলার আগেই রুদ্র আর কাফি গাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড়ে লিফটে প্রবেশ করেছে। লিফট’ও তরতর করে উপরে উঠতে শুরু করেছে। দারোয়ান বিরক্ত হয়ে পুনরায় খেতে বসলেন।
এদের জ্বালায় খেতে বসেও শান্তি নেই রাজনীতি লোক বলে ভয় কিছু বলাও যায় না। যদি শুনে এসব বলেছে তবে সুন্দর করে পেছনের ছাল ছাড়িয়ে উল্টো ঝুলিয়ে শুকনো মরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে দিবে। কি দরকার শুধু শুধু নিজের বিপদকে নিমন্ত্রণ জানানো। এমনিতেই একমাত্র বউ বন্ধুর সঙ্গে ভেগে যাওয়াতে দুঃখের শেষ নেই। যতটুকু সম্বল ছিল বউটা সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। একথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকাশ পানে তাকিয়ে রইলেন। তারপর গলা পাকানো কান্না গিলে ফেলে
আফসোসের সুরে বলল,, হায়রে জীবন! হায়রে বন্ধু! শালা
আর মেয়ে পেলি না, আমার বউটাকে নিয়েই ভাগতে হলো তোর!’

ওদিকে রুদ্র আর কাফি লিফট থেকে বেরিয়ে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে থমকে গেল। ফ্ল্যাটের দরজা খোলা।স্পর্শী আর দাদীমা মেঝেতে পড়ে আছে। এখানে স্পর্শী আর দাদীমা, রুমা কই?
দেড়ঘন্টা আগে তাদের তিনজনকেই রেখে গিয়েছিল। কাফি রুমাকে না দেখে দুরুদুরু বুকে নাম ধরে ডেকে খুঁজতে শুরু করলো। কিন্তু পুরো ফ্ল্যাট তন্নতন্ন করে খুঁজেও রুমাকে পেল না। বাসার অবস্থা যাচ্ছে তাইই। এখানে অপরিচিত কারোর আগমন ঘটেছ তাতে সন্দেহ নেই। কারণ ড্রয়িরুমের সোফায় সিগারেট-সহ লাইটার পড়ে আছে। সেন্টার টেবিলের উপরে পুরুষদের প্যান্টের বেল্ট রাখা। বেল্টের মাঝ বরাবর স্টার।
এমন বেল্ট রুদ্র অথবা কাফি কেউ ব্যবহার করে না। এসব সচারচর বখাটেরা ব্যবহার করে। কোমরের অনেকটা নিচে প্যান্ট পরে স্টার আকৃতির ডিজাইনের জায়গায় টি-শার্টটা কিঞ্চিৎ গুঁজে রাখে। এর দ্বারা প্রমাণিত এখানে এক পুরুষ এসেছিল। রুদ্র তার হিসাব মিলাতে মিলাতে স্পর্শীর কোলে তুলে নিয়েছে। ওর দেখাদেখি দেখি কাফি দাদীমাকে কোলে নিয়ে সোজা হাঁটা ধরেছে। রুদ্র স্পর্শীকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে দরজায় নতুন লক সেট করলো। তারপর তারা দু’জনে নিচে নেমে গাড়িতে উঠতেই দারোয়ান দ্রুতই এগিয়ে এলো।
বিশেষ করে তাদের কোলের দিকে খেয়াল করে। উনি এসে
আতংকে গড়গড় করে বলে ফেললেন তাদের আসার দু’তিন মিনিট আগে রুমা বেরিয়ে গেছে তার সঙ্গে আরো দুইজন ছিল। একজন মহিলা আর একজন পুরুষ। মুখে মাক্স ছিল বিধায় চেহারাটা দেখা যায় নি। তবে রুমার কপালে ব্যান্ডেজ করা ছিল। একথা শুনে কাফির মুখটা রক্তশূন্য হয়ে গেল।
অজানা ভয়ে কলিজাখানা মোচড় দিয়ে উঠল। থরথর করে কাঁপছে তার পুরো শরীর। নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেল যেন।
তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রুদ্র ধমকে দ্রুত গাড়িতে উঠতে বলে। ধমক খেয়ে সে দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে ড্রাইভ করে পুরো পথ পাড়ি দিয়ে হসপিটালে পৌঁছালো। রুদ্রকে দেখেই নার্সরা সেবার প্রদানে তৎপর হয়ে গেল এবং রুদ্রর আগমনের কথা আশিককে জানিয়ে সুচিকিৎসার ব্যবস্থাও করে ফেললো।
রুদ্র কিংবা কাফি কাউকেই আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে হলো না। তারপর ওটিতে দাদীমা আর স্পর্শীকে একসঙ্গে ঢুকিয়ে চিকিৎসা শুরু করা হলো।

রুদ্র পকেট থেকে ফোন বের করে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ফোনের স্কিণের দিকে। পরপর অনেকগুলো নোটিফিকেশন এসেছে তার ফোনে। এই নোটিফিকেশনগুলো আসা মানেই কেউ তার রুমে প্রবেশ করে জরুরি ডকোমেন্ট খোঁজার চেষ্টা চালিয়েছে। যদি স্পর্শী ভুলেও সেসবস্থানে হাত দিতোও তাও নোটিফিকেশন আসতো না। কারণ স্পর্শীর টাচ্ সেইভ করা আছে। তারমানে এখানে অপরিচিত কারোর হাত লেগেছে, কে সে? কার এত স্পৃহা?এসব ভেবে রুদ্র দৃষ্টি তুলে কাফির দিকে তাকালো। বেচারার মুখ শুকিয়ে এইকটুন হয়ে গেছে। রুদ্র কিছু বলছে না দেখে কাফি এবার নিজেই বলল,

-‘তদন্ত করে এই ঘটনার পেছনে আমার নামটা উঠে আসলে নিজেই নিজেকে শুট করবো আমি। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না, স্যার।’

একথা বলে সে মাথা নত করে কিছু কথা ভাবলো। তারপর কিয়ৎক্ষণ থম মেরে কম্পিত কন্ঠে পুনরায় বলল,

-‘ যদি রুমাও এসবের সঙ্গে জড়িত থাকে তাও নিজের হাতে শাস্তি দিবো। প্রিয় মানুষটাকে আপনার হাতে ম/রতে দেখলে আমার খুব কষ্ট হবে স্যার। এরচেয়ে আমিই নাহয়…….!’

কাফির কথা শুনে রুদ্র কোনো জবাব দিলো না। তার বিশ্বস্ত আঠারোজন ছেলেকে চারদিকে ছড়িয়ে দিলো। তার বাসার রাস্তায় থাকা সিসি টিভি ফুটেজটা কালেক্ট করে সেই গাড়ির নাম্বার সংগ্রহ করতে বলল। আর নাম্বার পেয়ে গেলে গাড়ির মালিক কে টেনে হিঁড়টে তার সামনে হাজির করতে বলল।
ছেলেগুলো আদেশ পেয়ে আদেশকৃত কাজে লেগে পড়লো।
কাফিকে আলাদা করে কিছু বলতে হলো সেও বেরিয়ে গেল
অন্য কাজে। সবাই চলে গেলে রুদ্র ওটির সামনে দাঁড়ালো।
ভেতরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে, সে দরজায় হাত দিয়ে নিজের বাহুতে মুখ লুকাতেই কাঁধে কারো স্পর্শ পেল। ঘুরে দেখে আশিক দৌড়ে আসায় বড় বড় শ্বাস ফেলে হাঁপাচ্ছে। আশিক ওটির দরজা নক করতেই একজন নার্স দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। আশিক আদেশ করলো সে যেন রুদ্রকে এক্ষুণি ওটির ভেতরে নিয়ে যায়। আশিকের এই আদেশ পাওয়া মাত্রই নার্স রুদ্রকে ওটিতে ঢুকিয়ে দরজাটা আঁটকে দিলো। দাদীমার কপালে ব্যান্ডেজ করা হয়ে গেছে।
ওটির মধ্যে দুটো দল রয়েছে, একদল দাদীমার পেট থেকে বিষ তুলছে আরেকদল স্পর্শীর। ইশ! কী করুণ সেই দৃশ্য! রুদ্র আর দেখতে পারলো না দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো। হাতের মুঠো শক্ত করে চেপে আছে। বুকটা অসহ্য ব্যথায় জর্জরিত হয়ে আছে। স্পর্শীর মুখের দিকে তাকালেই সেই ব্যথা তরতর করে বেড়ে যাচ্ছে।
সে ছলছল চোখে একবার দাদীমার দিকে তো একবার স্পর্শীর দিকে তাকাল। তারপর বিরবির করে বলল,

-‘চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে যদি অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে না পারি, তবে আমি রুদ্র রাজনীতি ছেড়ে দিবো, ওয়াদা করলাম।’

To be continue……!!

প্রেম প্রার্থনা পর্ব-১৪

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[১৪]

-‘জানো এখানে আমার একটুও ভালো লাগে না। তুমি এসে খুব ভালো করেছো। যাওয়ার সময় আমাকেও নিয়ে যাবে।’

-‘তোর সুয়ামী গিয়া আনছে আমারে। দাদুভাইয়ের নাকি কী জুরুরী কাজ আছে, দশদিনের লাইগা কুনহানে যাবে।’

-‘কোথায় যাবে? ‘

-‘তা তো কয় নাই মুরে। তয় হুনছি দাদুভাই ভোটে দাঁড়াইবো।’

একথা শুনে স্পর্শী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এত পাগলামি করে কী হলো! না সে কিছু বুঝাতে পারল আর না শুধরাতে পারল।
সবই তো বৃর্থা গেল। যাবেই তো কারণ রুদ্র তো হচ্ছে লাগাম
ছাড়া ঘোড়ার ন্যায়। তাকে এত সহজে বশে আনাও যাবে না।
এজন্যই তাকে দূর্বল করতে হবে পোষ মানাতে হবে। সম্পর্ক গভীর করতে হবে, ভালোবাসা জাগাতে হবে নতুবা এই শক্ত হৃদয়ের মানবকে বশে আনা সম্ভব নয়। এভাবে যেহেতু কাজ হচ্ছে না সেও আর বৃর্থা করবে না। তবে অন্য পন্থা অবলম্বন
করবে, সঙ্গে ওদের সম্পর্ক সহজ করা আপ্রাণ চেষ্টা করবে।
সত্যি সত্যিই তো এভাবে চলতে পারে না। এর সমাপ্তি টানা প্রয়োজন। হয়তো এর আগে এভাবে ভাবে নি, কিন্তু এখন ভাবছে, চিন্তা করছে। মুখ্য কথা, মানুষটা যখন একান্ত তার তার তখন ভাবনাগুলোও তার নিজের। এবার থেকে যা হবে
হাসি মুখে মেনে নিবে৷ জীবনটা আসলেই ছোট। আগামীর কথা ভেবে বর্তমানকে তিক্ত করে ফেলছে সে। যেটা বোকামি ছাড়া কিছু নয়। অথচ এর আগে তার মস্তিষ্কে এটা খেলে নি আজকে দিনটার কাজই ভবিষ্যতের বার্তা বহন করবে। গত
দু’দিন আরো একটা কথা অনেকই কথা ভেবেছে। আর রুদ্র
ঠিকই বলেছে, মৃত্যু সৃষ্টিকর্তার হাতের খেলা। এখানে কারো হাত থাকে না। যার যেভাবেই মৃত্যু লেখা আছে সে সেভাবেই
মৃত্যু বরণ করবে৷ রুদ্র ছাড়াও পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ আছে যারা রাজনীতিতে পাকাপোক্তভাবে যুক্ত। তাদের প্রিয় মানুষ আছে, আপনজনও আছে। মৃত্যুর ভয়ে তারা পিছিয়ে যাচ্ছে না, নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে, তবে সে কেন নিবে? কোন যুক্তিতে নিবে? আর রইল ভালোবাসার কথা। যে পাশে থাকা সে সব পরিস্থিতিতে পাশে থাকবে। যার হৃদয়ে নিগূঢ় প্রেমের প্রণয়কুঠুরি থাকে সে রাজনীতির ভয়ে ভালবাসতে ভয় করে না, অজুহাতে দায়ের করে না। এসব কথা ভেবে সে একটাই উত্তর পেয়েছে, নিজে স্বাভাবিক হও বাকিটা আল্লাহ ভরসা।
স্পর্শীকে অন্যমস্ক হতে দেখে দাদীমা কিছু বলার আগেই সে বলল,

-‘দাদীমা আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিবা?’

-‘কুন প্রশ্নোর উত্তর, কইয়া ফালা।’

-‘রুদ্র কি সারাজীবন চট্টগ্রামেই থাকার প্ল্যান করেছে?’

-‘ক্যান, দাদুভাই আজবীন এইহানে থাকবো ক্যান? হের কী বাড়িঘর নাইক্কা?’

-‘তাহলে ভোটে দাঁড়াচ্ছে যে? ঢাকা থেকে এসে দাপুটের সঙ্গে স্থানীয়দের সঙ্গে মিলেমিশে দলনেতা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে
বাইরের হয়ে মিটিং মিছিল করছে। মারামারি করে। আদেশ করে এর হাত ভেঙে দে, ওর পা ভেঙে দে। মূখ্য কথা, এখানে স্থায়ী দলনেতা নেই? ওর নেতাগিরি এখানকার সবাই মেনেই বা নিচ্ছে কেন?’

-‘ এডা তো জানোস হের নানা বাড়ি এইহানেই। দাদুভাইয়ের নানা- মামারা হক্কলেই রাজনীতির মানুষ। বড় বড় পদে তারা যুক্ত আছে। পাওয়ার তাদের পকেটে। ক’দিন আগে তর ছুডু মামার শশুড়ের উপ্রে হামলা হইছে। বেচারা বোধহয় বাঁচবো না। কেরা জানি মাইরা আধমরা কইরালাইছে। দিন দিন হের অবস্থা খারাপ হইয়া যাইতাছে। ঢাকাতে চিকিৎসা চলতাছে।
বড় বউমা সারাদিন হসপিটালে ভাইয়ের কাছে পইড়া থাকে,
কান্নাকাটি করে। কাইলক্কা দাদুভাই মামারে দেখতে গিয়াই মুরে নিয়া আইছে। হেই কয়েকদিন বাইত থাকবার পারবে না কী কাম আছে। আর কইলি এইহানে থাকবার কথা, তুইই ক কুন সুখের লাইগ্গা হেই এখানে থাকবো? হের মামার অবস্থা দেইখা কেরা কেরা এই আকাম করছে তারে খুঁজনের লাইগা হেই এইখানে আইছে। কাজ শেষ হইলেই ফিইরা যাইবো গা।
তাত্তাড়ি ফিরনোর লাইগাই দিন রাইত পানি কইরা তাগোরে গোরু খুঁজার লাগান খুঁইজ্যা বেড়াইতাছে। দাদুভাইয়ের বড়
মামার লোকজন দাদুভাইয়ের সঙ্গে যুক্ত আছে। তয় এখনো কুনো খবর পাওন যাইনাই। হুনলাম খুব তাড়াতাড়িই পাওয়া যাইব, দেখা যাক কি অয়। আর দাদুভাই এখানে পড়ালেখা করছে মেলাদিন, চিনা পরিচিতি আছে, এইহানে হেই মামার বাড়ি, নানার বাড়ি, তারে তো হক্কলেই চিনবোই। এর লাইগা এখানে আইসাও নেতাগিরি করে, বুঝলি?আর কেডা কইছে হেই এইহানে ভোটে দাঁড়াইব?’

-‘তুমিই কইলা হেই নাকি ভোঁটে দাঁড়াইবো।’

-‘আমি কখন কইছি হেই কথা? বেশি বুঝোনের লাইগ্গাই তর শরীর স্বাস্থ্য বাড়ে না, মাথামুড়া কুনহানকার।’

-‘ওই বুড়ি ফালতু কথা কইবা না কইলাম। আগে সোজাভাবে কইলেই হইতো। নিজে নিজে ত্যানা প্যাঁচাইয়া আমাকে কয় মাথামুডা।’

-‘এই ছেড়ি জন্মের শয়তান।এবার আসিস কিছু কইতে তখন তোরে জাঁতি দিয়া ছেঁইচ্ছা দিমু, বেদ্দপ কুনহারকার।’

একথা বলে দাদীমা রেগে চলে গেলেন। স্পর্শীও মুখ ভেংচি দিয়ে রুমের দিকে হাঁটা ধরলো। রুদ্র নেই। ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। হয়তো মহারাজ ফ্রেশ হয়ে নাস্তা
সেরে রাজ্য ভ্রমনে বের হবেন। এছাড়া তো আর কাজ নেই মহারাজের। তবে রুদ্র যেখানেই যাক এই মুহূর্তে তার নাচতে ইচ্ছে করছে। ভীষণ খুশি খুশি লাগছে। কারণ দাদীমার সঙ্গে কথা বলে বুঝলো রুদ্র এখানে থাকবে না বেশিদিন। হয়তো দশদিনের কাজ সেরেই ঢাকায় ফিরে যাবে। সেখানেই ভোট দাঁড়াবে। আর রুদ্রর সঙ্গে সেও ঢাকায় ফিরে যাবে। পুনরায় আগের মতো চলতে পারবে, ফিরবে পারবে। ওর চেনা বাসা,
চেনা রুম, চেনা মানুষজন। আবারো স্কুলে যেতে পারবে।ইশ! কবে এই দশ দিন শেষ হবে? এই বন্দি জীবন মোটেও ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করছে মনের সুখে নেচে গেয়ে প্রজাপ্রতির ন্যায় উড়ে, ঘুরে, বেড়াতে। এক আকাশ সমান অভিমার পুষে রেখে আম্মুর সঙ্গেও তেমন কথায় বলে না। বাবার তো কথা বলতে গেলেই কেঁদে ফেলেন। ধুর! তারও বোঝা উচিত ছিল
বাবা-মা খারাপ চান না। এতদিন বেস্ট জিনিসগুলোই তার জন্য আনা হয়, কেনা হয়। জীবনসঙ্গী হিসেবে বেস্ট কাউকে
খুঁজে দিবেন উনারা। মানুষ হিসেবে নিঃসন্দেহে রুদ্র বেস্ট তা বলার অপেক্ষাও রাখে না। তবুও কিছু কিছু মানুষকে যেমন অকারণে ভালো লেগে যায় তেমনি অকারণে খারাপ লাগে, বিরক্ত লাগে। তাদের উপস্থিতি চরম বিরক্তের কারণ হয়েও দাঁড়ায়। আর এই খারাপ লাগাটা কিসের লক্ষণ তারও জানা নেই। নিজের রাগ-অভিমানের বশে বাবা-মাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। এর কষ্টের সমাপ্তি টানা সময় এসেছে। রুদ্র
আগে কি ছিল, কেন ছিল, সেই চ্যাপ্টার কোল্জ। এখন যা হবে ঘটবে, রটবে এটাই মূখ্য বিষয়। এসব ভাবতে ভাবতেই সে বিছানা গুছিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে রুমটাও গুঁছিয়ে ফেললো। রুদ্রর ময়লা জামা-কাপড় ওয়াশিংমেশিনে ধুঁয়ে পানি ঝরাতে দিলো। তারপর কাবার্ড ঘেঁটে মেরুন রঙা শার্ট আর কালো জিন্স বের করে বিছানার উপরে রাখল। শার্টটা দারুণ দেখতে পরলে দারুণ লাগবে। তখন ড্রয়িংরুম থেকে রুমা চেঁচিয়ে নাস্তা করতে ডাকল। সে আসছি বলে রুম ঝাড়ু দিতে উদ্ধত হতেই রুদ্র ওয়াশরুম থেকে বের হলো। সে হাত দিয়ে ভেজা চুল ঝাড়ছে। পরনে শুভ্র রঙা তোয়ালে। ওর এই অবস্থা দেখে স্পর্শী মুখ ভেংচি দিয়ে কাজে মন দিলো। এমন না যে রুদ্রকে এই প্রথম এ অবস্থা দেখছে। কতবার দেখেছে
তার ইয়াত্তা নেই। এক বাসায় থেকেছে, আপন ভাই- বোনের মতো বড় হয়েছে, দেখাটাই স্বাভাবিক। তাকে রুম ঝাড়ু দিতে
দেখে রুদ্র তার সামনে গিয়ে চুল ঝাড়ল। ভেজা চুলের পানি গিয়ে পড়ল স্পর্শীর চোখে মুখে। তবুও কিছু বলল না দেখে রুদ্র পুনরায় একই কাজ করল।তখন স্পর্শী বিরক্তিকর শব্দ করে বলল,

-‘ফারদার এমন করলে সবাইকে বলে দিবো তোমার ডায়েরি হয়েছে।’

-‘আমার ডায়েরিয়া হয়েছে আমি তো জানি না, তুই জানলি কিভাবে?’

-‘ওয়াশরুম ভ্রমন করে।’

-‘আজ তো ওয়াশরুম ভ্রুমন করিস নি, তবে?’

-‘সেটা তো তুমি আর আমি জানি বাকিরা তো জানে না।’

একথা শুনে রুদ্র ওর নাকটা টেনে সামনে থেকে সরে গেল।
সকালবেলা মান সন্মানের দফা রফা করার ইচ্ছে তার নেই।
স্পর্শী নাকে হাত বুলিয়ে কাজ শেষ করে ঝাঁড়ু রেখে এলো।
এসে দেখে রুদ্র কাবার্ড ঘেটে পোশাক বের করছে। মেজাজ খারাপ হলেও স্বাভাবিকভাবে স্পর্শী ওর পছন্দ করা শার্টটা রুদ্রর মুখের সামনে ধরল। রুদ্র শার্টের দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে শার্ট পরে বোতাম না লাগিয়ে প্যান্ট পরে নিলো। মুখ ভঙ্গি স্বাভাবিক দেখে স্পর্শী বেলকনিতে চলে গেল। সেখানে কয়েকটা গাছ আছে যদিও নাম জানে না গাছগুলোর। তবে বিদেশী কোনো ফুলের গাছই হবে। স্পর্শী সেসব গাছে পানি দিয়ে রুমে পা রাখতেই রুদ্র খোঁচা মেরে বলল,

-‘ হাজবেন্ডের শার্ট বের করে দিলেই ভালো বউ হওয়া যায় না। শার্ট বোতামগুলোই লাগিয়ে দিতে হয়।’

স্পর্শী হাতটা মুছে এগিয়ে এসে শার্টের সব বোতাম লাগিয়ে দিয়ে পিছু ঘুরতেই রুদ্র বলল,

-‘শার্টের বোতাম লাগিয়ে দিলেই হয় না হাজবেন্ডের প্যান্টের চেইন লাগানো কী না, বেল্ট পরেছে কি না, তাও চেক করতে হয়।’

-‘একটু তো লজ্জা করো।’

-‘লজ্জা! সেটা আবার কি? আর লজ্জা করবে কেন? আমি কি মাঝরাস্তায় গিয়ে কোনো মেয়েকে বলেছি, ‘এক্সকিউজ মি আপু, আমার প্যান্টের চেইনটা লাগানো কী না চেক করে দিন প্লিজ!’ শোন যেহেতু বলি নি তাহলে লজ্জা লাগার প্রশ্নই উঠে না। আর যাকে বলেছি সে আমারই বউ, একমাত্র বউ, তাও যেন তেনো বউ না জোর করা কবুল বলিয়ে বিয়ে করা বউ। আর বউকে এসব বলাই যায়।’

এমন কথা শুনে স্পর্শী বিরক্তমুখে দাঁড়িয়ে রইল। রুদ্র সেটা খেয়াল করে এই টপিক চেঞ্জ করতে বডি স্প্রে হাতে নিয়ে পুনরায় বলল,

-‘ ভালো বউ হতে গেলে হাজবেন্ডের শার্টের বোতাম লাগিয়ে কপালে আদর দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে হয়। এতে কী হয় জানিস? হাজবেন্ডের শরীরে ফুল চার্জ হয়। বউকে রেখে
সারাদিন বাইরে থাকলে প্রচুর এনার্জি লস হয়। চিন্তরা ঘিরে ধরে তাই এই চার্জ অত্যান্ত জরুরি।’

একথা শুনে স্পর্শী ধীরে গতিতে রুদ্রর কাছে এগিয়ে এলো ।
তাকে আসতে দেখে রুদ্র নিজেও ঘুরে দাঁড়াল। চোখে চোখে রাখল দু’জন। দূরত্বও কমে গেল। তখন স্পর্শী নিজেই রুদ্রর ঠোঁটের দিকে নিজের ঠোঁট এগিয়ে নিলো। তার এমন কান্ডে
রুদ্র অনড় হয়ে অপলক তাকিয়েই রইল। ওষ্ঠে কোণে দুষ্টু হাসি। তাকে এভাবে তাকাতে দেখে স্পর্শী লাজুক হেসে এক হাত রাখল রুদ্রর চোখের উপর। তারপর রুদ্রর কানে কানে আদুরে কন্ঠে বলল,

-‘তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে। আমি না বলা অবধি চোখ খুলবে না, প্লিজ!’

-‘তা আজ কোন দিকে সূর্য উঠেছে?’

-‘রোজ যেদিন ওঠে, সেদিকেই।’

-‘ কাহিনী কি, হুম? তোর মতি গতি লাগছে না।’

-‘এজন্যই ভাল্লাগেনা। আমি স্বাভাবিক হতে চাচ্ছি অথচ….!’

-‘ওকে, ওকে, সরি।’

-‘ চোখ খুলবেনা, আমি এক্ষুণি আসছি, দাঁড়াও।’

একথা শুনে রুদ্র সেভাবেই চোখ বন্ধ দাঁড়িয়ে রইল। একটু পরে স্পর্শী বলল হাতটা বাড়াও। রুদ্র হাতটা বাড়িয়ে দিতেই হাতে কিছু একটা পেলো। রুদ্র চোখ খুলে দেখে হাতে চুনের কৌটা আর তার সামনেই ভ্রুঁজোড়া কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছেন দাদীমা। ওদিকে রুদ্রর মুখের অবস্থা দেখে স্পর্শী দরজায় দাঁড়িয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসির চোটে মেঝেতেই বসে পড়েছে সে। দাদীমা কিছু বুঝতে না পেরে একবার রুদ্র তো আরেকবার স্পর্শীর দিকে তাকাচ্ছে। রুদ্র নাকি চুন কী করবে একথা বলে দাদীমাকে ধরে এনে এনেছে স্পর্শী। সেই সঙ্গে সাবধান করে দিয়েছে কথা না বলতে, শব্দ না করতে।
স্পর্শীর কথা শুনে উনি নিঃশব্দে এসে রুদ্রর বাড়িয়ে রাখা হাতের উপরে চুনের কৌটা দিয়েছে। কিন্তু স্পর্শীর হাসি আর রুদ্রর মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে চরম ভুলই করে ফেলেছেন।
এখানকার কাহিনী অন্য কিছু সেটাও আন্দাজ করে নিলেন।
এসব খুনশুঁটির চ্যাপ্টার উনিও পার করে এসেছেন। নিজের চরম ভুল ধরতে পেরে উনি কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন। কী বা বলবেন বলার মতো কিছু খুঁজে পেলেন না। বলতে গেলে এটাই প্রমাণিত হবে স্পর্শী দাদী নাতিকেই বোকা বানিয়েছে।
এরচেয়ে চুপ থেকে কেটে পড়া বুদ্ধিমানের কাজ। দাদীমাকে যেতে দেখে স্পর্শী দাদীমার আঁচল ধরে পালাল। তখনো সে মিটিমিটি হাসছিল। ওর হাসি দেখে রুদ্র রেগে গজগজ করে নাস্তা করতে গেল। ফাজিলটার মনে এই ছিল। অথচ সরল মনে ভেবেছিল বউটা বুঝি লাইনে এসেছে। কপালটা বুঝেছি
প্রসন্ন হয়েছে।তারপর নাস্তা সেরে যখন বের হতে যাবে তখন স্পর্শীর সঙ্গে চোখাচোখি হলো। ক্ষণিকের জন্য মনে হলো
স্পর্শীর তাকে কিছু বলতে চাচ্ছে। ততক্ষণে স্পর্শী এঁটো হাত ধুয়ে রুমের দিকে হাঁটা ধরেছে। রুদ্র দরজা অবধি এগিয়েও
থমকে গিয়ে কাফিকে বলল নিচে গিয়ে দাঁড়াতে সে ওয়ালেট নিয়ে আসছে। কাফি বাধ্য সহকারীর মতো নিচে যেতেই রুদ্র রুমের গিয়ে নিঃশব্দে দরজা ভিজিয়ে দিলো। জানালায় দৃষ্টি ফেলে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে স্পর্শী। রুদ্র তার কাছে গিয়ে আচমকা পেছনে থেকে ধরলো। তাতে স্পর্শী নড়লোও না চমকালোও না যেন জানত এমন কিছুই হবে। নীরবে করা আহ্বান রুদ্র ঠিকই বুঝে নিবে। স্পর্শীকে নিশ্চুপ দেখে রুদ্র হাতের বাঁধন আরেকটু শক্ত করে কাঁধে থুতনী রেখে আমুদে স্বরে বলল,

-‘আমাকে বোকা বানানোর শাস্তি পাওনা রইল। ফিরে এসে দিবো। ততক্ষণ সাবধানে থাকা হয় যেন।’

একথা শুনে স্পর্শী রুদ্রর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে মুখোমুখি
দাঁড়াল। রুদ্রর শার্টের কলারটা ঠিকঠাক করে মুচকি হাসল।
তারপর রুদ্রর বুকের বাঁ পাশে ঠোঁট ছুঁইয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,

-‘তুমি শুধু দলনেতা নও আরো অনেকের অনেককিছু। তাই যা করবে ধীরে সুস্থে। সাবধানে যেও, আর আমার প্রাপ্য
শাস্তির বদৌলতে সহি সালামতে ফিরে এসো।’

-‘হুম।’

স্পর্শীর এমন অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে ভীষণ অবাক হলেও রুদ্র প্রকাশ করলো না। বরং একরাশ ভালো লাগায় ছুঁইয়ে গেল বক্ষপাশ। সুখের দোলা লাগল সারা গা’য়। অতঃপর সে একটা ফোন স্পর্শীর হাতে তুলে দিয়ে স্পর্শীর কপালে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে বিদায় নিলো। রুদ্র যাওয়ার আধাঘন্টা পরেই স্পর্শী আর দাদীমার একসঙ্গে শরীর খারাপ হতে শুরু করল। তারা দু’জনেই বমি করে ফ্লোর ভাসিয়ে দিলো। ধীরে ধীরে তাদের পুরো শরীর অবশ হয়ে এলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই দাদীমাও অবচেতন হয়ে লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে। কপালে ফেটে র/ক্ত গড়াতে লাগল ধবধবে সাদা টাইলের মেঝেতে।তখন স্পর্শীর চোখজোড়াও বন্ধ হয়ে আসছিল। তখন সামনে এসে দাঁড়াল অতীবও এক সুন্দরী রমনী।চোখ ধাঁধানোর তাহার রুপ এবং
ঐশ্বর্যমার্জিত পোশাক। সেই রুপবতীর ক্রোধপূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। যেন চোখ দিয়েই ভষ্ম করে দিবে।কে
সেই রুপবতী? এখানে কেন? তবে অপরুপ রুপের সেই মায়া নন্দিনী চোখের চাহনি বড্ডই রোষানলপূর্ণ, ভয়ংকর। তাকে
চেনার আপ্রাণ চেষ্টা করলো স্পর্শী। কিন্তু মস্তিষ্ক সায় দিলো না। স্পর্শী চেতনা ধরে রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। তখন কেউ তার পেটে স্বজোরে এক লাথি বসাল। পরপর তিনবার
লাথির চোটে সে পেট চেপে ধরে মা! মা! করে চেঁচিয়ে উঠল।
করুণ সুরের সেই মমতাময়ী ডাক ধাক্কা খেলো ড্রয়িংরুমের
আনাচে কানাচে। অসহ্য ব্যথায় চিৎকার করতে থাকল সে।
তখন পুরুষালী শক্ত হাতের বিশ্রী স্পর্শে তার শরীর গুলিয়ে উঠলো। গলগল করে বমি করে ফেললো কারো ডান হাতের
উপর। তখন সেই অচেনা পুরুষ স্বজোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিলো তার গালে। মনের রাগ মিটাতে শক্ত হাতে গলা চেপে ধরে শ্বাসরোধ করল। শ্বাস নিতে না পেরে সে কাঁ/টা মুরগির মতো ছটফট করতে লাগল। হাত পা দাঁপিয়েও কাজ হলো না। তার অবস্থা দেখে কেউ বিশ্রী গালি দিচ্ছিল, লা/থি মা/রছিল তলপেটের উপর। স্পর্শী আর সহ্য করতে পারলো না তার ডাগর ডাগর নেত্র জোড়া আপনাআপনিই বুজে এলো।
তবে আপ্রাণ চেষ্টা করেও মুখে উচ্চারণ করতে না পারলেও
সে মনে মনে একটি কথা একাধিক বার উচ্চারণ করে ফেললো,

-‘রু রু রু..দ্র , বাঁ বাঁ.চাও।’

To be continue…………!!

প্রেম প্রার্থনা পর্ব-১৩

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[১৩]

সারাদিনের রাগ তুলতে রাগে জিদে স্বজোরে কামড়ে ধরল রুদ্রর ঠোঁট। তখনই রুদ্র টের পেল নোনতা স্বাদ।অর্থাৎ ঠোঁট কেটে গেছে। সেই সঙ্গে স্পর্শী খামছে ধরেছে তার শার্ট এবং পিঠে বসিয়ে দিচ্ছে ধারালো নখ। আকষ্মিক আক্রমণে রুদ্র
নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলেও পরক্ষণে কিছু ভেবে হাল ছেড়ে দিলো। সমস্ত ব্যথা সহ্য করে স্পর্শীকে রাগ মেটানোর সুযোগ করে দিলো। তখনো স্পর্শী রুদ্রর ঠোঁট কামড়ে ধরে আছে। তারপর যখন সে দেখল রুদ্র বাঁধা দিচ্ছে না তখন সে
ছেড়ে দিলো। ছাড়া পেয়ে রুদ্র সরলো না বরং স্পর্শী দুইহাত
শক্ত করে চেপে ধরে শুষে নিতে থাকল স্পর্শীর ঠোঁট। স্পর্শী তাকে যত জোরে কামড় দিয়েছে রুদ্র তাকে তত সফট্ভাবে
কিস করছে। বেশ কয়েক মিনিট এমন অত্যাচার করার পর রুদ্র তাকে ছেড়ে পাশে শুয়ে পড়ল। স্পর্শী হাঁপাচ্ছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে।আচমকা একটা কথা মনে হতেই স্পর্শীর গা গুলিয়ে উঠল। ঘৃণায় চোখ মুখ কুঁচকে নিলো। পাশ ফিরে
বিরক্তের নজরে তাকার রুদ্রর দিকে। রুদ্রর ঠোঁটে রক্ত ছিল
সেই রক্ত কোথায় গেল? বোধহয় ওর পেটেই গেছে। একথা ভেবে ছিঃ! ছিঃ! করে উঠার আগেই রুদ্র হ্যাচকা টানে তাকে বুকের উপর ফেলল। অতঃপর বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে আলতো করে মুছে দিলো স্পর্শীর আধভেজা ঠোঁট।তখনো তার ওষ্ঠ কোণে দুষ্টু হাসি। মনে দুষ্টু ভাবনা। ঠোঁটে রুদ্রর ছোঁয়া পেয়ে স্পর্শী ভীষণ বিরক্ত হলো। ঝাটকা মেরে হাতটা সরিয়ে দিয়ে উঠতে চেষ্টা করলো। তখন রুদ্র তার কোমর জাপটে ধরে বলল,

-‘কামড়া-কামড়ি না করে ডিপলি কিস চাস বললেই হতো। না করতাম নাকি? তুইই বল, একমাত্র বউয়ের আবদার অপূর্ণ রাখতে পারি?’

-‘তুমি আসলেই অসভ্য, ছাড়ো! ছাড়ো বলছি।’

-‘অসভ্যের দেখেছিস কি? এই পথের যাত্রা কেবল শুরু।’

-‘উফ! অতিরিক্ত কথা বলো তুমি।’

-‘রাগের মাত্রা হাই ভোল্টেজে কেন বলবি তো নাকি।’

-‘রাগ করবো কেন? খেয়ে আর কাজ নেই আমার।’

-‘তাহলে চল আমার শখটা পূরণ করেই ফেলি?’

-‘কোন শখ?’

-‘ আমার শখ আমার বেডরুমভর্তি বউ আর ড্রয়িংরুমভর্তি ছানাপোনা থাকবে। তাদের নিয়ে একসঙ্গে ঘুরতে বের হবো, সুখে দিন কাটাব, কত মজা হবে।’

-‘তারপর এতগুলো বাচ্চা পয়দা করার পর তোমার শত্রুরা
তোমাকে মেরে রাস্তায় ফেলে যাবে। তোমার অবর্তমানে তারা
গাছতলায় গিয়ে আশ্রয় নিবে। ক্ষুধার তাড়নায় কাঁদবে।আর
বউগুলো নিজস্বার্থে জীবনসঙ্গী খুঁজে ভেগে যাবে। পরিশেষে তোমার ছানাগুলো রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে খাবে, টোকাই উপাধি পাবে, দারুণ হবে না?’

-‘ধুর! দিলি তো আমার শখের বারোটা বাজিয়ে। ‘

-‘যা সত্যি তাইই তো বললাম।’

-‘ধন্য করলি। তা হাতের কি অবস্থা এখন, ব্যথা আছে?’

-‘জেনে লাভ নেই, বাদ দাও।’

-‘ আচ্ছা, কখনো তোর মন বলে না আমার সঙ্গে মৃদু স্বরে কথা বলতে? সারাদিন পর বাসায় ফিরে যদি বউ খ্যাঁচখ্যাচ করে তাহলে কার ভালো লাগে?’

-‘যে আমার নয় তার সঙ্গে কী ভালো কথা থাকতে পারে ?’

-‘আমি তোর নাতো কার?’

-‘কবুল বললেই কেউ হওয়া যায় না।’

-‘এই ‘কেউ’ বলতে আসলে কি বুঝাচ্ছিস স্পষ্ট করে বল।’

-‘আপন মানুষ, একান্ত নিজের মানুষ।’

-‘মন চাইলে শুধু আপন নয় প্রাণপ্রিয়’ও হওয়া যায়। এজন্য নিজেদের আগ্রহ থাকা লাগে। যেটা তোর নেই। হবে কী তাও সন্দেহ। আচ্ছা আমাকে এটা বল, আমরা কি ঝগড়াই করে যাব আজীবন? এভাবে আর কত দিন? আমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক করা যায় না? আসলেই কী যায় না? এমন চলতে থাকলে আমাদের সম্পর্কের আরো অবনতি হবে৷ আমাদের বাসার মানুষগুলো হতাশ হবে, কষ্ট পাবে। একটু স্বাভাবিক হয়ে ওঠ না স্পর্শী, প্লিজ। প্রতিদিন মেজো মা কল করে আর আমাকে সাজিয়ে গুছিয়ে এমনভাবে মিথ্যাকথা বলতে যেন আমরা কত্ত সুখী। মেজো মাকে মিথ্যা বলতে আমার ভীষণ খারাপ লাগে।রুমাকেই দেখ, কাফিকে ছাড়া কিছু বোঝে না। মেয়েটা পাগলের মতো ভালোবাসতে জানে, ভালো রাখতে জানে। কাফি কোথাও গেলে প্রতিনিয়ত ফোন করে খোঁজ নিবে, কী করছে, কি খাচ্ছে, আরো কত কী, কতই সুন্দর তাদের সম্পর্কটা। যদি কোনো কারণে কাফি কল রিসিভ না করে তখন আমাকে মেসেজ করে, ‘ভাইয়া, প্লিজ, দয়া করে
এইটুকু বলুন সে সুস্থ আছে, ভালো আছে।’ তাহলে ভাব ঠিক কতটা ভালোবাসলে এমন উতলা হওয়া যায়,? ভালোবাসা তখনই সুন্দর, যখন সঠিক মানুষটা পাশে থাকে। আর সুন্দর জিনিসটা নিজের মতো করে সুন্দর করে নিতে হয়। স্বযত্নের প্রলোপ লাগিয়ে আগলে রাখতে হয় নিজ যতনে। তাকে সব সময় বুঝার চেষ্টা করতে হয়, ভালোওবাসতে হয়। তবেই না সম্পর্ক মধুর হয়। অথচ আমার বউটাকে’ই দেখ সে আমার খোঁজ নেওয়া দূর আমাকে নিয়ে সুস্থ চিন্তাও করতে পারে না। শুধু রাজনীতি করার অপরাধে কাঠগড়াতে দাঁড় করিয়ে নানান রকমের অভিযোগ দায়ের করে। আমার বাঁচা ম/রা নিয়ে পড়ে থাকে। তাকে আমি কীভাবে বোঝায় যার যেভাবে মৃত্যু লেখা আছে সে সেভাবেই মৃত্যুবরণ করবে। মৃত্যুরখেলা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার হাতে। এখানে কারোর হাত নেই। কিন্তু সেই পাগলিটা তো আমার কথা বোঝেই না। আর বুঝাতে গেলেও আমাকেই ভুল বুঝে। এমনকি এসব ভেবে আমাদের বর্তমান সময়টুকুও নষ্ট করে ফেলছে, আদৌ কি এটা ঠিক হচ্ছে?’

-‘তোমার কাছে রাজনীতিই সব শুধু শুধু আমার ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছো কেন?’

-‘বোকার মতো রাজনীতির সঙ্গে নিজের তুলনা করিস কেন?
রাজনীতি রাজনীতির জায়গায় তুই তোর জায়গায়। এখানে তুলনা আসছে কোথা থেকে? রাজনীতি হচ্ছে আমার পেশা আর তুই হচ্ছিস আমার নেশা। আমার কাছে নেশা ও পেশা দু’টোই ভিন্ন স্থানের বাসিন্দা। তাছাড়া আমারই যখন সমস্যা হচ্ছে না তোরও তো হওয়ার কথা নয়। মোদ্দাকথা, গতরাতে যে অঘটন ঘটালি এ কাজটা কোন যুক্তিতে করলি? আমার পুরো কথাটা শুনে নাহয় সিদ্ধান্ত নিতি,এখন কে কষ্ট পাচ্ছে?
রাগের বশে নেওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত সুফল ডেকে আনে না।’

-‘জানি। এজন্য একথাটা এখনো বাসার কাউকে জানায় নি। ‘

-‘ভেরি গুড! বুদ্ধি তো ভালোই আছে শুধু কাজে লাগাস না।’
আর একটা কথা, আমার সঙ্গে থাকলে হলে আমার ভালো খারাপ সব মেনেই থাকতে হবে। নয়তো বাপের বাড়ির রাস্তা মাপ।’

-‘আমার বাপ তোমার কে?’

-‘শশুড়।’

-‘তো শশুড়কে নিয়ে এভাবে কথা বলতে লজ্জা লাগছে না?’

-‘আশ্চর্য! আমি কি উনাকে চুমু খেতে চেয়েছি নাকি জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে চেয়েছি যে লজ্জা লাগবে?’

-‘তুমি আসলেই যা তা।’

একথা বলে স্পর্শী জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে বসল।
এই বে/হায়া পুরুষের মুখে কিচ্ছু আঁটকায় না নয়তো এমন কথা বলতে পারে।তার কাছে ভদ্র কথা আশা করা বোকামি।
এখন রাত দুইটা বেজে তিন মিনিট। স্পর্শীর হালচাল দেখে
রুদ্র উঠে রান্নাঘরে গেল।ওভেনে খাবার গরম করে প্লেটভর্তি
খাবার এনে স্পর্শীকে টেনে তুলে বিছানায় বসাল। তারপর সে যত্ন করে স্পর্শীর মুখে খাবার তুলে দিয়ে নিজেও খেতে লাগল। আজও আসার সময় বিরিয়ানির এনেছে এমনকি এখন খাইয়েও দিচ্ছে নিজের হাতে। স্পর্শী টু শব্দ করছে না ভদ্রমেয়ের মতো খাচ্ছে চুপটি করে। খেতে খেতে গতরাতের কথা ভেবে আপনমনে ওর অশ্রু ঝরতে লাগল। আফসোস করতে থাকল মনে মনে। প্রিয়/ অপ্রিয় যেইই হোক কারো মুখের খাবার ছুঁড়ে ফেলা উচিত নয়। অথচ সে রাগের বশে গতরাতে তাইই করেছে। তখন রুদ্র চাইলে তাকে লাগাতার থাপ্পড় মেরে থামাতে পারতো। কিন্তু এখন অবধি ছাড় দিয়েই যাচ্ছে রুদ্র। তবে খাবার ছুঁড়ে ফেলার অন্যা/য় আর কখনো করবে না সে, কখনো না। তাকে কাঁদতে দেখে রুদ্র লোকমা দিতে গিয়েও থেমে গেল। তারপর স্বাভাবিকভাবে জিজ্ঞাসা করল,

-‘ খেতে ইচ্ছে করছে না বললেই হয়, বোকার মতো কাঁদছিস কেন?’

একথা জবাব দিলো না স্পর্শী। অনেক কষ্টে খাবার গিলে
উচ্চারণ করল,

-‘সরি।’

-‘সরি কেন?’

-‘গতরাতে খাবার নষ্ট করেছি এটা করা উচিত হয় নি। আর এমন করবো না, প্রমিস।’

-‘এভাবে যদি আমাকেও একটু বুঝতি তাহলে…। ‘

-‘আমি চাওয়াটা কি খুব বেশি? আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চাই বলেই তোমার সুরক্ষার জীবন চাই। তুমি কেন বুঝছো না, রাজনীতিবিদদের জীবন কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। আজ রাতে তুমি তোমার অধিকার বুঝে নাও আর রাজনীতি টাজনীতি
এসব ছেড়ে দাও। ‘

-‘লাভ নেই। একবার দলে নাম উঠে গেলে সেখান থেকে ফেরা মুশকিল। আর এসব চিন্তা করতে কে বলেছে তোকে? তোর দায়িত্ব আমাকে ভালোবাসা। তুই তোর দায়িত্বে অটল থাক বাকিটা আমি বুঝে নিবো।’

একথা বলে রুদ্র খাওয়া শেষ করে প্লেট রেখে ফিরে এলো।
তারপর কেউ আর কোনো কথা বাড়ালো না দু’জন দু’পাশে ফিরে শুয়ে পড়ল। সময় গড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের চোখেও ঘুম নেমে এলো। পরেরদিন সকালে স্পর্শী ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হলো। রুমা বোধহয় আগেই ঘুম থেকে উঠে গেছে। সে ড্রয়িংরুম পেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা দিতেই দাদীমাকে দেখে চমকে উঠল। দাদীমা চা খেতে খেতে রুমার সঙ্গে কথা বলছে। দাদীমাকে দেখে স্পর্শী দৌড়ে গিয়ে দাদীমাকে জড়িয়ে ধরলো। খুশিতে দাদীমার গালে কয়েকটা চুমু দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। দাদীমা নাতনির হাতে থাবা মেরে মুখ ঝাপটা মেরে বলতেন,

-‘সারা রইত সুয়ামীর আদর খাইয়া এহন আইছো পিরিত দেখাইতে, সর, সর কইতাছি।’

-‘বুড়ি যেই সুয়ামী দিছো হেই আদর করে না খালি ধমকের উপ্রেই রাহে। একফুঁডাও ভালোবাসে না আমারে। এই সুয়ামী লাগবো না তুমি এইডারে হাঁটে বেইচ্চা নতুন সুয়ামী আইনা দাও।’

একথা বলেই স্পর্শী পুনরায় খিলখিল করে হাসতে লাগল। নাতনির কথা শুনে দাদীমার হেসে উঠে নাতনিকে জড়িয়ে ধরলেন। রুমা রান্নার দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে স্পর্শীর হাসি মুখের দিকে। এই বাসা এসে স্পর্শী হেসে বলে মনে হয় না।
অথচ দাদীমাকে পেয়ে কত্ত খুশি সে। তার এই হাসি ফিরিয়ে
আনতে রুদ্র তার কাজ সেরে ঢাকা গিয়ে দাদীমাকে এনেছে।
তবুও এই মেয়ের কত্ত অভিযোগ রুদ্রের প্রতি। দাদী নাতনির গল্পের শেষ নেই। তারা সোফায় বসে গল্প করেইযাচ্ছে, স্পর্শী
কাশেম বয়রা থেকে শুরু করে চেনা পরিচিত সকলের খোঁজ নিচ্ছে। একপর্যায়ে কথায় কথায় স্পর্শী দাদীমাকে জড়িয়ে ধরে অভিমানী সুরে বলল,

-‘জানো এখানে আমার একটুও ভালো লাগে না। তুমি এসে খুব ভালো করেছো। যাওয়ার সময় আমাকেও নিয়ে যাবে।’

-‘তোর সুয়ামী গিয়া আনছে আমারে। দাদুভাইয়ের নাকি কী জুরুরী কাজ আছে, দশদিনের লাইগা কুনহানে যাবে।’

-‘কোথায় যাবে? ‘

-‘তা তো কই নাই মুরে। তয় হুনছি দাদুভাই ভোটে দাঁড়াইবো।’

(বিঃদ্রঃ- মাথা ব্য/থায় কাতর আমি এজন্য রোজ গল্প দিতে পারি না।)

To be continue……..!!