Friday, August 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 460



কোন_সুতোয়_বাঁধবো_ঘর পর্ব-০৪

0

#কোন_সুতোয়_বাঁধবো_ঘর
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৪

নাদিম বাসায়, ফিরে আসতেই, ফরিদা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, কিরে আমার মেয়েটা কেমন আছে? ও সুস্থ আছে তো?
নাদিম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দেয়, আমরা মনে হয় ইরহাকে বিয়েটা বেশ তাড়াহুড়ো করে দিয়ে ফেলেছি?
‘কেন কি হয়েছে?
‘রবিনের মা’ আন্টি ব্যাবার প্রচন্ড রুড। আমাদের সাথে এমন বিহেভিয়ার করলে, না জানি ইরহার সাথে কেমন ব্যাবহার করে৷
‘ভাবছি বেয়াইনের সাথে কথা বলে, ইরহাকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসবো।শেষ কয়েকটা দিন এখানে থাকবে৷ বাচ্চা মেয়েটা একা একা সব সামলাতে পারবে না
‘তোমার মেয়ে আসতে চাইবে তো! যদি রাজি হয় তাহলে নিয়ে এসো।

নিশাত দাঁড়িয়ে সবটা শুনলো। নাদিম নিজের ঘরে ঠুকতেই নিশাত দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলা শুরু করে, তোমার বোনকে বাসায় নিয়ে আসবা মানে! আমাকে কি চাকর মনে হয়? সরাদিন এতো খাটি আরো খাটানোর ধান্দা। তুমি তোমার মাকে বলে দাও
ইরহাকে এখানে আনার দরকার নেই৷

‘তুমি ব্যাগপত্র গুঁছিয়ে রাখো, ইরহা আসলে তোমাকে রেখে আসবো, তোমাদের বাসায়।ইরহা যে ক’মাস এ বাড়িতে থাকবে, তুমি ও বাড়িতে থাকবে।
‘ঠিক আছে, আমি আজই চলে যাবো। করবো না তোমার সংসার৷ সব সময় নিজের মা,আর বেনদের কথা ভাবো। কখন আমার কথা ভাবো না। একটা প্রেগন্যান্ট মানুষ বাসায় থাকলে কত কাজ বেড়ে যাবে।তারপর তার পিছেনে খরচ হবে কত টাকা। আমি কিছু বললেই দোষ। সব ঠিক কথা তোমার মা, বোন বলে।
‘তোমার বাজে কথা বন্ধ করো। থাকতে ইচ্ছে না হলে চলে যাও। আর কাজ তুমি একা করো না। একজন হেল্প হ্যান্ড আছে৷ আর আমার বোনদের আমি ছাড়া কেউ নেই। আমার সামর্থ্য অনুযায়ী যথাসাধ্য চেষ্টা করবো ওদের ভালো রাখার। বাড়ি, ব্যাবসা সব আমার একার নাকি! এগুলো বাবার রেখে যাওয়া,ওদেরও অধিকার আছে। যদি এসব মেনে ভালো ব্যাবহার করে থাকতে পারো, তাহলে থাকো। নয়তো আজই চলে যাবে৷
নিশাত চুপ হয়ে গেলো। নাদিম নিশাতের পাশে বসে বলে,দেখো নিশাত আমি আমা মা, বোন, আর তোমাকে ভালোবাসি।বর্তমানে আমার পৃথিবী জুড়ে তোমরা তিনজন। তাই তোমাদের ভালো খারাপ সবটা দেখার দ্বায়িত্ব আমার৷ আমি কারো জন্য কাউকে কষ্ট দিতে পারবো না৷ লবুর বয়স যখন আটমাস তখন বাবা আমাদের ছেড়ে যায়। মা একা হাতে আমাদের সামলেছে। তাই মায়ের কথার অবাধ্য হওয়ার প্রশ্নই উঠে না৷ আর আমার বোনরা কেমন আমি জানি৷ তাই তুমি একটু মানিয়ে নাও।তোমার জায়গা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমন ভাবে তাদের জায়গাও। একটু ভেবে দেখো তোমার সাথে তোমার ভাবি এমন করলে, কেমন লাগবে তোমার?
নিশাত কিছু না বলে,নাদিমকে জড়িয়ে ধরলো। নিম্ন স্বরে বলল,সরি।
নাদিম আলতো করে কপালে চুমু দিয়ে বলে, এইতো লক্ষী বউ আমার৷


রবিন সুস্থ হলো,ভালোই কাটছিলো দিন। তবে দিনগুলোর সাথে সাথে সন্দেহ বাড়তে থাকে। ইরহার ডেলিভারি ডেট খুব কাছাকাছি চলে এসেছে।
ফরিদা বেগম,শত বলেও মেয়েকে রাজী করাতে পারেনি। ও বাসায় যাওয়ার জন্য। তাই লাবিবার পরিক্ষা শেষ হতেই লাবিবাকে পাঠিয়ে দিয়েছে।
লাবিবা প্রায় খেয়াল করে ইরহার উদাসীনতা। বার কয়েক জিজ্ঞেস ও করেছে, কিরে আপি তোর কি হয়েছে৷ সেরকম কোন উত্তর পায়নি৷

✨কাজী অফিসে বসে আছে রবিন আর লামা। ওইদিকে ইরহাকে হসপিটালের এডমিট করা হয়েছে। রবিন অনেকবার বলেছে,লামা বিয়েটা অন্যদিন করি, আজ আমাকে দরকার ইরহার৷
‘লামা কিছুতেই মানবে না।তার৷ একি কথা তোমার সন্তান পৃথিবীতে আসার আগে আমাকে বিয়ে করতে হবে। অবশেষে তাই করতে হচ্ছে। কাজী অফিসে লামাকে বিয়ে করে। সাথে সাথে হসপিটালের উদ্দেশ্য বের হয়ে যায়।রবিনের কোন ইচ্ছে ছিলো না লামাকে বিয়ে করার৷ হুট করে সে লামার ফাঁদে আটকে যায়। আস্তে আস্তে রবিন লামাকে অপছন্দ করা শুরু করেছিল। কিন্তু আজকে লামা ব্ল্যাকমেইল করে, বিয়েটা সম্পন্ন করলো। লামা নিজের মুঠোফোনে নিজের আর লামার অন্তরঙ্গ মূহুর্তের বেশ কিছু ভিডিও ক্লিপ রেখে দিয়েছে। যার ফলে নিরুপায় হয়ে বিয়েটা করতে হলো রবিনের।
রবিন হসপিটালে পৌঁছে শুনতে পায় তার মেয়ে হয়েছে। রবিন খুশি হয়ে ছুটে আসে, শেফালী বেগমের কোল থেকে নিজের কোলে তুলে নেয় বাচ্চাটাকে। সাথে সাথে ওর চোখ থেকে কয়েক ফোটা নোনা জল গড়িয়ে পরে। বুকের বা পাশে হুট করে কেমন ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। মেয়াটার কপালে আলতো করে চুমু খায়। রবিনের চোখের জল গড়িয়ে ছোট রুবাবার গাল পরে। মেয়েকে মায়ের কাছে দিয়ে ইরহার খোঁজ নেয়। শেফালী বেগম বলেন তুই এখনি দেখা করতে পারবি না আরো আধঘন্টা পর দেখা করিস৷ যাহহহ এখন মিষ্টি কিনে নিয়ে আয়৷
লাবু, নাদিম, ফরিদা বেগম সবাই হসপিটালে উপস্থিত। বাবুর নরমাল ডেলিভারি হয়েছে। ইরহা সুস্থ আছে কিন্তু বেশ দূর্বল।

এভাবে হাসি আনন্দে কাটছিলো দিনগুলো। রবিন আবার আগের মত হয়ে গেছে। তা দেখে ইরহাও নিচের ভেতর থেকে সব সন্দেহ সরিয়ে ফেলেছিল।
আর রবিনের রুবাবার প্রতি ভালোবাসা দেখে, ইরহার বুঝতে বাকি নেই। রবিন ভালো বাবা হবে।
রুবাবার বয়স যখন চারমাস। তখন থেকে আবার রবিন পাল্টে যেতে শুরু করে, আবার আগের মত লেট করে বাড়ি ফেরা৷ প্রায় প্রায় বাহিরে রাত কাটানো শুরু করে।
প্রায় দু’দিন পর রবিন বাড়ি ফিরে আসলো। ইরহা রুবাবাকে বেডে শুয়ে দিয়,রবিনের সামনে এসে বলে, সমস্যা কি তোমার?
রবিন সিঙ্গেল সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বলে,কিসের সমস্যা?
‘কোথায় থাকো ইদানীং। মেয়েটাকেও সময় দাওনা আজকাল৷
‘দয়া করে এখন শুরু হয়ে যেও না। একদম মুড নেই তোমার সাথে তর্ক করার। পারলে খাবার দাও নয়তো চুপ থাকো।

ইরহা কিচেন থেকে খাবার এনে রুমে দিলো। খাবার দিয়ে বলে,শোন আমি কখনো তোমার কথার অবাধ্য হইনি, কারণ ছাড়া তর্ক করিনি, তোমার কাছে বিশেষ কোন আবদারও করিনি। তবে আজ মাস খানেক ধরে,তোমাকে নিজের হ্যাসবেন্ড না। অন্য মানুষ মনে হচ্ছে।
রবিন খাবার মুখে তোলার আগে বলে,তাহলে তাই মনে করো। তবুও প্যারা দিও না৷
‘একটা প্রবাদ আছে, দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দিতে হয়। যখন দাঁত থাকবে না শত আফসোস করেও ফিরে পাবে না। আমাকে খুব সহজ পেয়েছো। তাই এমন অবহেলা করো।
‘অবহেলা কখন করলাম?
‘আচ্ছা বলো তো,লাস্ট কবে আমরা একসাথে বসে নিজেদের মধ্যে একটু প্রেম ভালোবাসার কথা বলেছি? শেষ কবে তুমি আমাকে ঘুরতে নিয়ে গেছো বা আমাকে কিছু গিফট করেছো?শেষবার কবে জিজ্ঞেস করেছ, ইরহা তোমার কিছু লাগবে?
‘দোখো তোমার এসব ন্যাকামি ছাড়াও আমার বাহিরে হাজারটা কাজ থাকে। তোমার কাছে এটিএম কার্ড আছে, বিকাশ আছে যা লাগবে নিজের ইচ্ছে মত খরচ করবে। আমি তো বাঁধা দেইনি।
‘তাইতো টাকাকে বিয়ে করেছি, রাতে টাকার সাথে বাসর করবো, টাকার সাথে প্রেম আলাপ করবো।মেয়েকে বলবো,টাকাই তোর বাবা।
‘তোমার সমস্যাটা কি ইরহা? আগে তো কখনো এমন বিহেভ করোনি! আজ হঠাৎ এমন উদ্ভট আচরণ?
‘কিছু না খেয়ে নাও। সময় আর মানুষ দু’টোই পাল্টে যায়। সময় পাল্টাতে তাও সেকেন্ডের কা’টা লাগে।তবে মানুষ পাল্টাতে কিছুই লাগে না।
‘তুমি বলতে কি চাইছো?
‘যে বুঝদার তাকে কোন ভাবে বোঝানো যায় না৷ তবে অবহেলা বাড়তে থাকলে সম্পর্ক শেষ হতে থাকে। সম্পর্ক যেটাই হোক গুরুত্ব থাকা প্রয়োজন। গুরুত্ব হীন সম্পর্ক লবণহীন তরকারির মত।

#চলবে

কোন_সুতোয়_বাঁধবো_ঘর পর্ব-০৩

0

#কোন_সুতোয়_বাঁধবো_ঘর
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব-৩
রান্নার সব গুছিয়ে দিয়ে শেফালী বেগমকে ডাকতে গেলে৷ শেফালী বেগম বলে, যাও যাও আরাম করো পাইছো এক ছুতা। আমরা তো আর মা হইনাই। পোলাপান বাতাসে উইড়া আসছে৷ যত কুয়ারা আর ঢং৷
নাদিম সবে মাত্র ঢুকেছে। বোনের সাথে বোনের শ্বাশুড়ির আচরণ দেখে হতবাক।
‘ভাইয়া তুমি কখন আসলা!
‘তা বাবা আসছো একটু কাশি বা টোকা দিয়া তো আসবা। মানুষের বাসায় এভাবে দুম করে কেউ ঢুকে পরে!
‘দরজা খোলা ছিলো আন্টি তাই নক করিনি।
‘হইছে বুঝচ্ছি আসো বসো। ইরহা তোমার ভাইয়ের হাত থেকে ব্যাগগুলো নাও। আর শরবত করে এনে দাও। তা বাবা এতো কি নিয়া আসলা।
‘খাবার নিয়ে আসছি আন্টি। আজকে বাসায় অনেক কিছু রান্না হলো তাই পাঠিয়ে দিলো মা।
‘ও আমরা কি না খেয়ে থাকি!
‘না না তা কেন হবে! মায়ের মন তো। এরজন্য।
‘আমারও মেয়ে আছে কই আমার মনতো এসব কয় না। থাক বাদ দাও। আইছো যখন খেয়ে যেও।
‘না আন্টি বাসায় মেহমান আমাকে যেতে হবে। অন্য এক সময় আসবে।
‘দেহো তোমার যেইডা ভালো মনে হয় করো। এহন কার পেলাপান মুরব্বিদের কথা শুনে নাকি।
ইরহার শরবত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ভাইয়া শরবতটা খাও। খেয়ে উনার সাথে দেখা করবা চলো৷
‘হ্যা-রে রবিনের সাথে দেখা করেই চলে যাবো৷ আয় তুই বস আমার পাশে।
নাদিম রবিনের রুমে এসে রবিনের খোঁজ খবর নিয়ে, আবার বেশি দেরি করলো না। বের হওয়ার আগে ইরহাকে উদ্দেশ্য করে বলে গেলো, ভালো থাকিস বোন।

নাদিম চলে যেতেই শেফালী বেগম তেড়ে এসে বলে,দেখলি তোর বউয়ের কান্ড!বাপের বাসায় ফোন করে খাবার আনাইছে। কে আমরা কি ফকির না খেয়ে থাকি!
‘আম্মা আপনি ভুল ভাবছেন, আমি বলিনি এসব পাঠাতে। মা নিজে থেকে পাঠালো৷
‘আর শাক দিয়া মাছ ঢাকতে হবে না।তোমারে কইছিলাম রান্না গোছাও। ভাবছো তোমারই বুঝি রান্না করা লাগবো। তাই খাবার আনাইছো। আমার চুল কি বাতাসে পাঁকছে বয়স-কি এমনি বাড়ছে? কিছু বুঝিনা ভাবছোে।নিম নিমা সয়তান তুমি।
‘থামো তো মা কি শুরু করলা।খাবারই তো দিয়ে গেছে৷ তাতে কি হইছে।
‘এই তোর কারণে লাই পাইছে। কিছু না বলতে বলতে মাথায় উঠিয়েছিস।এখন আর মায়ের কথা ভালো লাগে না। বউ যা করে তাই ঠিক। হ্যা-রে এই দিন দেখার জন্য তোরে এতো বড় করছি!
রবিন ইরহাকে উদ্দেশ্য করে বলে,তোমাকেও বলি, কিছু হলেই বাপের বাসায় জানাতে হবে কেন! রান্না করতে তোমার এখন সমস্যা হয়। রান্না তো মা-ই করে। তুমি শুধু একটু গুছিয়ে দাও এরজন্য বাপের বাড়ি ফোন দিয়ে খাবার পাঠাতে বলবা!
ইরহা কিছু না বলে কিচেনে চলে গেলো।খাবার গরম করে টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিয়ে, রবিনের জন্য নিয়ে গেলো রুমে।
‘খাবার দেখেই রবিন বলে, গেস্টকে খাবার দিয়েছো?

সবার জন্য আমি টেবিলে খাবার দিয়ে তোমার জন্য নিয়ে আসলাম। আচ্ছা আর কেউ তোমাকে দেখতে আসলো না৷ এই মেয়েটা কেন আসলো!
‘ইরহা তুমি এখনো সন্দেহ করছো?
‘দেখো আমি নিজেকে ভুল বোঝাতেই পারি, কিন্তু নিজের চোখকে অবিশ্বাস করবো কিভাবে! জানো চোখ হলো সবচেয়ে নিখুঁত ক্যামেরা। মোবাইলে তোলা ফটো এডিট করে এদিক সেদিক করা যায়। কিন্তু চোখের ক্যামেরা যা বন্দী করে, তা কিন্তু বিন্দু মাত্র নড়চড় হয় না। আবার সেই ছবি সেভ হয় মস্তিষ্ক নামক ম্যামোরিতে। যা চাইলেই ডিলিট করা যায় না৷
‘সম্পর্কে বিশ্বাস থাকা জরুরি, তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না!তাহলে কেমন ভালোবাসো?
‘বিশ্বাস আর ভালোবাসা দু’টোই খুব নাজুক বিষয়। ভালোবাসা সহজ হলেও বিশ্বাস করা সহজ নয়। বিশ্বাস অর্জন করা কঠিন তবে তা ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া সহজ৷ আর রইলো একে অপরকে বিশ্বাস করার কথা? তুমিও তো আমাকে বিশ্বাস করো না। বললাম আমি বলিনি খাবার পাঠতে, মা নিজেই পাঠিয়েছে। তুমি কি বিশ্বাস করেছিলে?
‘আচ্ছা আমার বউটার অভিমান জমেছে আমার উপর! ছারো তো সব আসো আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দাও।
‘তোমার ওই অফিসের কলিগ যাবে কখন!
‘আমি বলে দিচ্ছি ও খেয়েই চলে যাবে।
‘ও মানে?
‘ইরহা কি শুরু করলে !সব কিছুতে দোষ ধরছো? ভুলে বের হয়ে গেছে মুখ থেকে। তোমাকে একদম এমন মানায় না বউ। তুমি তো আমার সুইট বউ। এবার তাড়াতাড়ি খাইয়ে দাও খুব খিদে পেয়েছে৷


লামা আর শেফালী বেগম একসাথে খেতে বসেছে। দু’জনের মদ্যে ভাব জমে গেছে। খাওয়ার চেয়ে হাসাহাসি বেশি করছে। কথার ফাঁকে লামা হুট করে শেফালী বেগমকে জিজ্ঞেস করে বসে, আন্টি আপনি
রবিন স্যারের জন্য এমন একটা মেয়েকে কিভাবে বউ করে আনলেন!
‘আর বইলো না মা। সব রুপের মায়া৷ দেখোনা দেখতে কত সুন্দর চকচক করে চেহারা। কথা বলে কত ছোট ছোট করে, কি মায়া ভরা মুখ। এসব দেখেই এনেছিলাম। কে জানতো আসলে নিমনিমা সয়তান। তারচেয়ে তোমার মত কেউ বউ হয়ে আসলে, ভালোই হতো।
‘এখনো কিন্তু সময় আছে আন্টি। স্যারকে যে কেউ মেয়ে দেবে।
‘তোমার স্যার করলে তো! তার তো বউ অন্ত প্রাণ। যতসব আদিখ্যেতা
‘তা যা বলেছেন আন্টি কি ঢং এসব সহ্য করার মত না।
‘বাদ দাও তুমি খাও। এসবই আছে আমার কপালে।
ইরহা টেবিল থেকে আরো খাবার নিচ্ছে। এমন সময় লামা বলে, ম্যাম আমি যে খাবারটা এনেছি, সেগুলো দেখছি না যে!
‘সরি, সরি আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম, এক্ষুনি নিয়ে আসছি৷
‘তাতো ভুলে যাবেই। সারাদিন মন যদি বাপের বাড়ি পরে থাকে তাহলে মনে থাকবে কি করে। কঠিন কন্ঠেই কথাগুলো বললেন, শেফালী বেগম।
‘আম্মা সত্যি মনে ছিলো না৷ আমি এখন নিয়ে আসছি।
লামা ন্যাকা স্বরে বলে, আন্টি আমি কত কষ্ট করে রবিন স্যারের জন্য তার পছন্দের, দম বিরিয়ানি, পাবদা মাছের ঝোল,ইলিশ পাতুরি। রান্না করে নিয়ে এসেছিলাম।
‘থাক মন খারাপ করে না। রাতে আমি নিজে রবিনকে তোমার রান্না করে আনা খাবার খাওয়াবো।
‘ধন্যবাদ আন্টি। আপনি অনেক সুইট।

ইরহা কিচেন থেকে লামার খাবার গুলো এনে টেবিলে রেখে রুমে চলে গেলো।
রুমে এসে নিজের মত খাবার খাচ্ছে। আর গভীর ভাবে কিছু ভাবছে।
রবিন বলল,কি ভাবছো এতো মনযোগ দিয়ে?
‘আসলে মস্তিষ্ক আর মনের মধ্যে যদি দ্বিধা তৈরি হয়।তখন নিজের মধ্যে কঠিন যুদ্ধ চলে, আসলে কোনটা সঠিক মনে করবো? যা মস্তিষ্ক বলছে, নাকি যা মন বলছে?
‘তুমি এখনো সকালের ঘটনায় পরে আছো! তুমি এমন কবে হলে?আমি বললাম তো যাস্ট ভুলবোঝাবুঝি। আর কিছু না। ছিহহহহ আমার ভাবতেও ঘৃণা লাগছে। তুমি আমাকে এতো নিচু ভাবছো। তোমার মত বউ থাকতে আমি অন্য কারো সাথে এসব করা তো দূর। ভাবতেও পারিনা।
‘ইরহা কিছু না বলে খাবার শেষ করে কিচেনে সব রেখে এসে,রবিনের পাশে শুয়ে পরলো।

রবিন আলতো করে ইরহার কপালে চুমু খেয়ে বলে,আমার ইরহা থাকতে আমার আর কাউকে দরকার নেই। আর একটুও মন খারাপ করে থাকবে না।
‘ইরহা শান্ত স্বরে বলল,মেয়ে মানুষের মন মমের মত। আর পুরুষ মানুষ দেশলাইকাঠি। তোমরা প্রথমে আগুন জ্বালাও। তারপর আবার ফু দিয়ে নিজেরাই নেভাও।আমরা তো জ্বলে শেষ হই আবার আদরে গলে যাই। তাই খুব সহজ আমাদের বোকা বানানো।

#চলবে

কোন_সুতোয়_বাঁধবো_ঘর পর্ব-০২

0

#কোন_সুতোয়_বাঁধবো_ঘর
#নুসাইবা_ইভানা
পর্ব-২

ইরহার মাথায় কথাটা আসতেই দ্রুত নিজের রুমের দিকে আসে। দরজার সামনে দাঁড়াতেই পা থমকে যায়। নিজের চোখে দেখছে রবিনের ঠোঁটের সাথে সেই মেয়েটার ঠোঁটের আলিঙ্গন। হাতে থাকা চায়ের ট্রেটা নিচে পরে যেতেই। সামনের মানুষ দু’টো নিজের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব বাড়িয়ে নেয়।

রবিন ইরহার দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি যা ভাবছো তা ঠিক না৷ আসলে একটা ভুলবোঝাবুঝি ক্রিয়েট হচ্ছে ।

ইরহা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,কি এমন ভুলবোঝাবুঝি! যার কারণে চার ঠোঁটের মিলন ঘটাতে হয়?
‘লামার হাতে একটা ফাইল, রবিন ফাইল দেখিয়ে বলে,এই ফাইলের জন্য যতসব হয়েছে। এটা চেক করাতে চেয়ে মিস লামা আমার উপর বেশি ঝুঁকে পরেছে। আর দূর থেকে দেখে তুমি ভুল ভাবছো।
‘তুমি বলতে চাইছো আমার চোখের দেখা ভুল!
‘হুম ভুল। ইরহু তোমার কি হয়েছে!তুমি আমাকে বাহিরের মানুষের সামনে ছোট করছো? কি ভাববে মিস লামা! যে তুমি আমাকে বিশ্বাস কর না? সরি মিস লামা, আমার ওয়াইফের বুঝতে ভুল হয়েছে।
‘ইট’স ওকে স্যার। তবে এভাবে সত্যিটা না জেনে ভুল বোঝাটা ম্যামের ঠিক হয়নি। আমি তো কারেকশনের জন্য আপনাকে ফাইলের মেইন পয়েন্টগুলো দেখাচ্ছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারিনি ম্যাম এতো নিচু মানসিকতার। সরি ম্যাম আমারই ভুল হয়েছে। আপনাদের বাসায় আর আসবো না। আসি স্যার সুস্থ হয়ে দ্রুত অফিসে আসুন। সবাই আপনার অপেক্ষায়।
ইরহা পুরোপুরি বোকা বনে গেলে! কি হলো এটা? চোখের সামনের দৃশ্যটা মূহুর্তে মিথ্যে হয়ে গেলো! আসলেই কি আমার চোখের দেখা ভুল ছিলো?
‘কি ভাবছো ইরহা। আমাকে তো ছোট করেছোই, আর কি চাও?
ইরহা কোন কথার উত্তর না দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে আসলো। ডাইনিং রুমের একটা চেয়ারে থম মেরে বসে পরলো। বারবার মনে মনে দৃশ্যটা রিপিট করছে। নাহহহ এতো বড় ভুল তো হতে পারে না। তাহলে কি আমি যা ভাবছি তাই সঠিক? হাত বাড়িয়ে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে কয়েক চুমুক পান করলো। নিজের সাথে এখন যুদ্ধ চলছে। আসলে সত্যিটা কি? যেটা চোখের দেখা নাকি যেটা রবিন বলছে! মানুষ তো বলে, চোখের দেখাও ভুল হয়।

ইরহা রুম থেকে বের হতেই রবিন নিম্ন কন্ঠে রাগী স্বরে বলে, মানা করেছিলাম আমার বাসায় আসতে! কেন এসেছো?
‘আই নিড ইউ রবিন। আমি আর তোমাকে না দেখে থাকতে পারছিলাম না। আর তোমাকে এভাবে এতোদিন পর দেখার পর কন্ট্রোল করতে পারিনি। তোমাকে একটু আদুরে চুম্বন করার থেকে নিজেকে আটকাতে পারিনি। সরি রবিন তোমাকে ভালোবাসতে যেয়ে বিপদে ফেলার জন্য!
‘যাস্ট পাঁচ দিন হয়েছে আমাদের দেখা হয় না।কিন্তু কথা তো বন্ধ নেই টেক্সট চলছে। কথা হচ্ছে, তারপরেও এতো ডেস্পারেট হওয়ার কি আছে!
‘বুঝেছি বউয়ের আঁচলের তলে পাঁচদিন থেকে আমার ভালোবাসা ভুলে গেছো। তাই এভাবে কথা শোনাচ্ছ। আমার ভালোবাসা আর আবেগের কোন মূল্য নেই!
‘লামা তোমার সাথে আমি পরে কথা বলবো এখন তুমি প্লিজ চলে যাও।
‘চলে যাবো! এই রবিন তুমি সত্যি আমাকে ভুলে যাচ্ছো! আর তোমার ওয়াইফ আজ জানুক কাল জানুক জানতে পারবেই। এটা নিয়ে এতো ভাবার৷ কি আছে?
‘এখন ইরহার যা কন্ডিশন, এই অবস্থায় ওর সামনে এসব আসলে বিষয়টা আরো ঘোলা হবে। প্লিজ তুমি চলে যাও আর দু’চার দিনের মধ্যে আমি তো আসছি।
‘যাকে ছেড়ে দিয়ে আমাকে বিয়ে করতে চাইছো। তারজন্য এখনো এতো দরদ!আর আমার ভালোবাসার দু’পয়সার দাম নেই,তোমার কাছে?
‘তুমি ভুলে যাচ্ছো লামা আমাদের মধ্যে কি কথা হয়েছিল, আই লাভ ইউ। এটাই সত্য। তবে ইরহা আমার প্রথম স্ত্রী প্রথম দ্বায়িত্ব সেটা আমি অস্বীকার করতে পারিনা৷ তাই প্লিজ পাগলামো করো না। এখন যাও।

লামা আর কিছু না বলে বের হয়ে আসবে এমন সময় ভাঙ্গা কাপের টু’ক’রোতে পা কে’টে যায় বেশ খানিকটা। সাথে সাথে চিৎকার করে লামা।
লামার চিৎকারের আওয়াজ শুনে, শেফালি বেগম ছুটে আসে, ইরহাও উঠে আসে,

শেফালী বেগম লামাকে ধরে বেডের উপর বসায়। বেশ খানিকটা কেটে গেছে, রক্ত দেখে রবিনও হাইপার হয়ে যায়।

শেফালী বেগম বলেন, কি ইরহা তোমার বোধ বুদ্ধি কি দিনদিন লোপ পাচ্ছে! হাতে থেকে না হয় পরে গেছে কাউকে বলে পরিস্কার করাবে তো। তুমি না পারলে আমাকে বলতে।

ইরহা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, রবিন ধমকের সুরে বলে, দাঁড়িয়ে না থেকে ফাস্টএইড বক্স নিয়ে এসো। দেখছোই তো কত খানি কেটে গেছে।

ইরহা ভায়োডিন দিয়ে পরিস্কারর করে একটু মলম লাগিয়ে,বেন্ডেজ করে দিলো। সরি আপু আমার খেয়াল ছিলো না৷ আমার জন্য আপনি এতোটা আঘাত পেলেন৷
‘এখন সরি বলে কি হবে!আমার যন্ত্রণা আর ঝড়া রক্ত ফিরে আসবে? স্বামীকে সন্দেহ করার কাজ ছাড়া আর কোন কাজ পারেন আপনি?
‘ইরহা ইটের জবাবে পাটকেল দিতে পারে, কিন্তু নিজের হ্যাসবেন্ডের জন্য চুপ রইলো।
‘রবিন বলল, মিস লামা এবার বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে। বেখেয়ালি ভাবে হয়ে গেছে। এতো প্যানিক করার কি আছে! ইট’স ওকে। ইরহা তুমি এক কাজ করো, মিস লামা কে গেস্ট রুমে নিয়ে যাও।
লামা কটমট চোখ করে রবিনের দিকে তাকালো। রবিন চোখ দিয়ে কিছু ইশারা করছে।
‘এই দৃশ্যটুকু ইরহার দৃষ্টিগোচর হয়নি। কথায় আছে না। অনেক সময় দেখেও চুপ থাকতে হয়। ইরহা ভদ্রতার খাতিরে চুপ করে রইলো। নম্র স্বরে বলল, আপু চলুন আমার সাথে।

শেফালী বেগম কাঁচ পরিস্কার করতে করতে বলে, আর কত রঙ দেখবো।প্রথম মহিলা মনে হয় যে মা হচ্ছে। যত্ত রঙ ঢং আমার কপালে জুটলো।আর তুমি কই যাও। তোমার নিতে হবে না। এইটুকু পরিস্কার৷ করে আমি নিয়ে যাচ্ছি। নবাব নন্দিনী তুমি যে দুপুরের রান্না বসাও। ফ্রিজ থেকে মাছ, মাংস বের কর, সব গুছিয়ে নাও।
ইরহা কিচেনে এসে সব গুছিয়ে নিচ্ছে এমন সময় ইরহার ফোনটা বেজে উঠলো। ফোন কানে তুলতেই ফরিদা বেগম ( ইরহার মা) বললেন, কিরে মা কেমন আছিস?

‘এতোক্ষণের চেপে রাখা কষ্ট যেনো মূহুর্তে জেগে উঠলো। নিজের অজান্তেই চোখ দুটো ভরে উঠলো, গলা আটকে আসছে, মনে হচ্ছে গলায় কিছু বিঁধে আছে। যার দরুন কথা বের হতে চাইছে না৷
‘কিরে মা চুপ করে আছিস কেন? শরীর ভালো নেই?
‘ইরহা ফোনটা কানের পাশ থেকে একটু দূরে সরিয়ে।নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে বলে, এই তো মা ভালো আছি।
‘কিরে মা তোর কি হয়েছে বল তো!তোর গলা এমন শোনাচ্ছে কেন?
‘ঘুমিয়ে ছিলাম তো তাই৷ মা, তোমাকে বললাম লাবিবাকে পাঠাতে কবে পাঠাবে?
‘লাবুর তো পরিক্ষা। তবে আজ নাদিম কে পাঠিয়েছি তোদের বাসায়। আজ তোর মেজো ফুপি এসেছিল।কত কি রান্না করলাম। অসুস্থ মেয়েটাকে রেখে কি ভাবে মুখে তুলি! তাই পাঠিয়ে দিলাম।
‘এসবের কি দরকার৷ ছিলো। ভাইয়ার অফিস নেই।
‘নারে আজ যায়নি।নিশাত বলল আজ ছুটি নিয়েছে।
‘আচ্ছা মা পরে কথা বলবো। এখন রাখি। বলে কল কেটে দিয়ে কেঁদে ফেললো। ইরহা চিন্তা করছে, ইশশ মেয়ে হওয়া কত কঠিন৷ ঠোঁটের কোণে আসা কথাটাও গিলে ফেলতে হয়। চোখের জলকে আটকে দিতে হয়।বলতে চেয়েও থেমে যেতে হয়। সংসার বুঝি এতোই কঠিন৷ মা’গো তুমি জেনে কেন এই কঠিন পথে পাঠালে! এরচেয়ে একা থাকাই তো ঢের ভালো। একহাতে ওড়নার আঁচল মুখে চেপে রেখে কেঁদে যাচ্ছে ইরহা।

#চলবে

কোন সুতোয় বাঁধবো ঘর পর্ব-০১

0

সূচনা পর্ব
#কোন_সুতোয়_বাঁধবো_ঘর
#নুসাইবা_ইভানা

ছয় মাসের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ডিভোর্স পেপারে সাইন করছে ইরহা। সাইন করার আগে একবার রবিনের দিকে দৃষ্টি দিলো।
সেই স্বামী নামক মানুষটা অন্য আরেকজনের হাত শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
শেষ বারের মত কিছু বলতে চেয়েও আটকে গেলো ইরহা। চোখের কার্ণিশ বেয়ে জলটুকু গড়িয়ে পরার আগেই সাইন করে দিলো৷ বাচ্চাটাকে আকড়ে ধরে কোর্ট থেকে বের হবে। তার আগে রবিন এসে বলে,দেখো ইরহা জোড় করে সব হলেও ভালোবাসা হয় না।তবে তুমি চাইলে ডিভোর্স না দিয়ে আমাদের বাসায় থাকতে পারতে। আমার মেয়েটা অনন্ত পিতৃহারা হতো না।তবে যাইহোক আমি আমার মেয়েকে নিজের পরিচয় দেবো। ওর যা লাগে সব খরচ আমিই বহন করবো। রবিনের কথা শেষ হওয়ার আগেই ঠাসসসসস করে একটা শব্দ হলো। সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো ইরহার দিকে।যে মেয়ে কখনো কারো মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেনি, সে কিনা গায়ে হাত তুলল!
রবিন নিজেও হতবুদ্ধি হয়ে গেলো।ইরহা বড্ড শান্ত মেজাজের মেয়ে। কখন উঁচু আওয়াজে কথাও বলেনি। কিন্তু আজ তার গায়ে হাত তুলল!
‘ লামা এসে বলে সাহস তো কম না আমার হ্যাসবেন্ডের গায়ে হাত তুলিস! ভুলে যাস না ওর সাথে তোর আর কোন সম্পর্ক নেই!
‘আমি ভুলে যাইনি। সম্পর্ক থাকলে সম্মান করতাম। কারণ স্বামীকে সম্মান করতে হয়। আজ সম্পর্ক শেষ তাই ছোট একটু প্রতিবাদ করে বুঝিয়ে দিলাম। চুপ করে ছিলাম বলে, আমি নিরীহ অবলা নারী নই। প্রতিবাদ আমিও করতে পারি।
‘এসব লেকচার রাখ আর বিদায় হ।
‘আপনার মত কাউকেই ও ডিজার্ভ করে। যে আরেকজনের স্বামী সংসার কেড়ে নিয়েও বুক ফুলিয়ে বাজে বিহেভিয়ার করতে পারে। আর হ্যা আরেকটা কথা,
‘আপনার হ্যাসবেন্ডকে সামলে রাখবেন৷ আমি তো সামলাতে পারলাম না। ছাড়া গরু ঘাস পেলেই মুখ দিবে। তাই মুখটা বেঁধে রাখার চেষ্টা করুন। আর হ্যা যাওয়ার সময় এতোটুকু তার প্রাপ্য ছিলো।

‘শেফালী বেগম বলে,কি মেয়ে দেখলি, সব সময় ভান ধরতো কিছু বুঝে না। ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে পারেনা৷ দেখলি আসল রুপ কালনাগিনী বিদায় হয়েছে ভালো হয়েছে।

‘ইরহা আর পিছু ফিরলো না। সোজ এসে রিকশায় উঠলো৷ নিজের বাচ্চা মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে চোখের জলটুকু মুছে নিচ্ছে বারবার। এই তো সেদিেনের কথা তিন বছর আগেই কত স্বপ্ন নিয়ে রবিনের সাথে ঘর বেঁধেছিলো। সবাই কত আনন্দিত ছিলো৷ দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়েটা হয়েছিল।
একটা মেয়ে বুঝ হওয়ার পর থেকে নিজের একটা সংসারের স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্নের ডানায় ভর করে কতশত রঙিন স্বপ্ন আরো বুনে। ছোট বেলায় পুতুল খেলা বা হাড়ি পাতিল নিয়ে বাচ্চামো সেই সাংসারিক খেলা।তারপর বুঝ হওয়ার পর থেকে একটু একটু করে মনের মধ্যে পুষে রাখা স্বপ্নগুলো ডানা ছড়াতে থাকে। কখন ভাবেনি সেই কল্প ডানাগুলো এতো,তাড়াতাড়ি ভেঙ্গে যাবে! জীবনের কঠিন এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে তার কি করা উচিৎ ছিলো?
ইরহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, জীবনটা এমন না হলেও পারতো!
বিয়ের পর কখন মনে হয়নি রবিন নামের মানুষটা খারাপ। এ্যারেন্জম্যারেজ। দু’জনে দু’জনকে বুঝতে বুঝতে বছর খানিক পার হয়ে যায়। ইরহার বিয়েতে প্রথম দিকে মত না থাকলেও ধীরে ধীরে রবিনের ব্যাক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে যায়। খুনসুটি ভালোবাসা পূর্ণ একটি সংসার। কত ভালোবাসা জড়ানো সংসারটা মূহুর্তে পাল্টে গেলো সেদিন সন্ধ্যায়। যখন প্রথমবার রবিনের ওয়ালেটে একটা মেয়ের ছবি দেখতে পায়৷ বেশ কিছু সময় ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকে৷ রবিনকে কিছু না বলে ছবিটা নিজের কাছে রেখে দেয়। তখন ইরহা চারমাসের অন্তঃসত্ত্বা। তারপর কেটে যায় বেশ কিছুদিন। এরপর একদিন রাত বারোটায় রবিন কল করে বলে,ইরহা জান আমার কি করো?
‘এইতো তোমার অফিস থেকে ফেরার অপেক্ষা করছি৷
‘জান আজকে তো ফিরতে পারবো না। ফরেনারদের সাথে ডিল৷ মিড নাইট প্রেজেন্টেশন।
‘তারমানে আসবে না সত্যি।
‘কাজ করতে হবে তো জান! যে আসছে অন্তত তার জন্য এক্সট্রা কাজ করতে হবে। যাতে সুন্দর একটা জীবন উপহার দিতে পারি। তুমি খেয়েছো তো ইরহু!
‘হুম খেয়েছি৷ তুমিও খেয়ে নিও।
‘আচ্ছা জান সাবধানে ঘুমিয়ো৷ হাত পা সাবধানে নড়াচড়া করবে।
‘মিস করবো তোমাকে অনেক।
‘জান আমার চেয়ে কম মিস করবা। এবার ঘুমিয়ে পরো রাখি৷
এরপর থেকে প্রায় রাতে অফিসের মিটিংয়ের নাম করে বাহিরে রাত কাটাতো।

ইরহার যখন আটমাস চলে,তখন চেক-আপের জন্য ক্লিনিকে গেলে সেখানে রবিনের কলিগের বউ রাবেয়ার সাথে দেখা হয়। কথায় কথায় ইরহা রাতের মিটিংয়ের কথা তুললে, রাবেয়া বলে, নাতো আপা এমন কোন মিটিংয়ে তো আপনার ভাই জয়েন করেনি৷ এমন কোন মিটিং হলে তো জানতাম।
ইরহা নিস্তব্ধ হয়ে গেলো, বিষয়টা নিয়ে আর ঘাটাঘাটি করলো না৷ ক্লিনিক থেকে ফিরে আর এক মূহুর্তের জন্য স্থীর হতে পারলো না। সারাক্ষণ নিজের সাথে যুদ্ধ করে গেলো। রাত এগারোটায় রবিন বাসায় ফিরে আসলো। ইরহা রববিনকে বললো,তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো আমি খাবার দিচ্ছি।
‘তোমাকে কষ্ট করতে হবে না।আজকে আমি ডিনার বাহিরে সেরে এসেছি। তুমি শুয়ে পর আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। আর হ্যা মশারী আমি টাঙাবো। তোমার কষ্ট করতে হবে না। রবিন ওয়াশরুমে চলে যেতেই। ইরহা দ্রুত রবিনের ফোন হাতে নিলো। লক পাল্টে ফেলেছে। অনেক চেষ্টা করে লক খুলতে ব্যার্থ হয়ে ফোনটা জায়গা মত রেখে দিলো।
দু’জনেই পাশাপাশি শুয়ে আছে। কিন্তু কি অদ্ভুত মনে হচ্ছে শত জনমের দূরত্ব। রাত গভীর হচ্ছে একজান নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে আর একজনের চোখে ঘুম নেই। ঘন্টা দু’য়েক এপাশ ওপাশ করে উঠে বসলো ইরহা খুব সর্তক ভাবে মোবাইলটা আমার নিয়ে রবিনের ফিঙ্গার লক খুলল। মোবাইল ঘেটে তেমন কিছুই পেলো না৷ হতাশ হয়ে মোবাইল রেখে দিলো। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে ভাবছে,আমি কি মিছিমিছি সন্দেহ করছি? আসলে যেটা ভাবছি সেটা তো নাও হতে পারে! এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পরেছে খেয়াল নেই ইরহার।
সকাল বেলা যখন ঘুম থেকে উঠে তখন বেলা ন’টা বাজে। রবিন ততক্ষণে অফিসে চলে গেছে। ইরহা ফ্রেশ হয়ে বাহিরে আসতেই।
শেফালী বেগম কর্কশ কন্ঠে বলে, আমরাও তো মা হয়েছি।তুমি একা তো মা হচ্ছ না। আমরা ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে ঘরের সব কাজ একলা হাতে করেছি। আমরা তোমাদের মতো এতো অজুহাত আর ঢং দেখাইনি। মনে হচ্ছে তুমি একাই পৃথিবীতে মা হচ্ছো।
‘আর এমন হবে না আম্মা।সারাদিনটা ভালোই কটলো।সন্ধ্যার দিকে রবিনকে অফিসের তিনজন স্টাফ এসে দিয়ে গেলো। হাত পায়ে ব্যান্ডেজ করা। জানা গেলো একটা ছোট এক্সিডেন্ট করেছে। কয়েকদিন রেস্ট নিলে সুস্থ হয়ে যাবে।
ইরহা খেয়াল করলো রবিন বেশিরভাগ সময় ফোনেই লেগে থাকে আবার ফিসফিস করে কথা বলে।কিন্তু ইরহা সামনে আসলেই চুপ হয়ে যায়। এভাবেই চলছিলো। ইরহার মনে সন্দেহ বাড়তে থাকে। এরমধ্যেই একদিন একজন মেয়ে আসে কিছু খাবার নিয়ে রবিনের সাথে দেখা করতে।

ইরহা প্রথমে বিষয়টি আমলে নেয়নি। আসতেই পারে অফিসে একসাথে কাজ করে। কিন্তু মেয়েটির চেহারা ভালো করে খেয়াল করার পর ইরহার বুকটা ধক করে উঠলো। সেইদিনের ছবির মেয়েটা আর এই মেয়েটা তো একজনই। হুট করে অজনা ভয় জেঁকে ধরলো ইরহাকে। সব হারানোর ভয়।

#চলবে

প্রেম প্রার্থনা পর্ব-২৮ এবং শেষ পর্ব

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[২৮] (অন্তিম পার্ট)

সুসজ্জিত এক আবাসিক হোটেলের রুমের ঠিক মধ্যেখানে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে স্পর্শী। পুরো রুমে লাল ও সাদা বেলুন, সুগন্ধি মোম এবং ফুল দিয়ে সাজানো। বিশাল বড় রুমটার
জানালা থেকে শুরু করে বিছানার চাদরটাও ফকফকে সাদা
রঙের। দামী কার্পেটে মোড়া টাইলস্ করা মেঝে। এককথায় রুমের ডেকোরেশন অসম্ভব সুন্দর। রুদ্র আস্তে করে দরজা আঁটকে স্পর্শীর পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। মেয়েটা অবাক নেত্রে
তাকিয়ে দেখছে চারিপাশ, তার চোখে জল, বিষ্ময়, ও খুশির ছাড়াছড়ি। রুদ্র মুচকি মুচকি হাসছে বোকা মেয়েটার কান্ড দেখে। খুব পছন্দ হয়েছে মুখে বললেই হয় কান্নাকাটি করতে হবে কেন, আশ্চর্য কারবার! অতঃপর দুপা এগিয়ে আচমকা
স্পর্শীকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রাখল। কিয়ৎকাল পার করে ঘাড় কিঞ্চিৎ বাঁকা করে আদুরেভাবে জিজ্ঞাসা করল,

–‘খুশি তো?’

-‘খুবব! এটাও আশা করি নি তাও তোমার থেকে।’

-কেন, কেন?’

-‘আমাকে খুশি করার সময় আছে নাকি তোমার?’

-‘এখন থেকে থাকবে আর কখনো অজুহাত দায়ের করব না, বোঝা গেল?’

-‘কেন, এখন থেকে কি এমন হবে যে আমার জন্য তোমার অহরহ সময় থাকবে? না মানে রাজনীতিবিদ বলে কথা।’

একথা শুনে রুদ্র ঠোঁট কামড়ে হেসে তার গলায় মিষ্টি আদর এঁকে তাকে সামনে ঘুরিয়ে চোখে চোখ রেখে পুনরায় হাসল। কেন জানি ওর ভীষণ হাসি পাচ্ছে। গাড়িতে আলোচনার পর
স্পর্শী নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চালাচ্ছে। পাহাড়
সমান অভিমান লুকিয়ে রেখে যথেষ্ট স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ তার ভাব-ভঙ্গিসহ সর্বাঙ্গে অস্বাভাবিকতার ছাপ, হাত কাঁপছে, শরীর দুলছে। হাজবেন্ডের ভালোর জন্য স্পর্শীদের মতো ওয়াইফদের এমন চাওয়াটা স্বাভাবিক, সেই হাজবেন্ড যদি সেকথা বোঝা তো দূর উল্টে রং যুক্তি গছিয়ে একের পর একটা অহেতুক যুক্তি দায়ের করে তখনই কী বা বলার থাকে। তবে স্পশী এত সহজেই মেনে নিবে এটা আশা করে নি। কারণ বিয়ের পর থেকে প্রতিটা মুহূর্ত সে রাজনীতি বিরুদ্ধে। কত কান্ড না করে চলেছে রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। অথচ আজ রাজনীতি ছাড়ার শর্ত জুড়ে দিলে প্লে বয়ের ব্যাপারটা। এই প্রস্তাবে রাখার পরপরই একটা চড় খাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু না, এবারো স্পর্শী হতবাক করে দিয়ে মেনে নিলো। তবে মেয়েটার মনের উপর ঝড় বয়ে
যাচ্ছে তখন থেকে সেটা ভালোভাবেই অবগত সে। মনে মনে এসব ভেবে রুদ্র তাদের দূরত্ব ঘুচিয়ে নিলো। দু’হাতে স্পর্শীর
দুই গাল ধরে দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলাল। অদ্ভুত সেই দৃষ্টি! রুদ্রকে মন কেমন করা চাহনিতে তাকাতে দেখে স্পর্শী নিজে চোখে চোখ রাখল তার চোখে। না বলা কথা ছুঁড়ে দিলো ব্যক্তিগত
পুরুষটার দিকে। চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দিলো মনের বার্তা।
তবে ঠোঁট হাসি নেই। লজ্জার ছিঁটেফোঁটাও নেই তার চোখে মুখে। অথচ এই মুহূর্তে লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠার কথা, রাঙা বধূর মতো মুখ লুকানো কথা তার প্রশ্বস্ত বুকে। তাছাড়া এই রুমের ডেকোরেশন দিচ্ছে অন্যকিছুর ইঙ্গিত। যা এতক্ষণে বুঝেও গেছে স্পর্শী। তার এই নিশ্চুপতার কারণটা বোধগম্য
হচ্ছে না রুদ্রর। সে জহুরি চোখে তাকিয়ে মন পড়ার প্রয়াস চালাচ্ছে। তখন স্পর্শী হঠাৎ রুদ্রর চোখের উপর হাত রেখে চোখ বন্ধ করে দিলো। রুদ্রর গলা জড়িয়ে ধরে গালে একটা চুমু খেলো, রুদ্র চোখ খুলতে গেলে চোখের উপর হাত রেখে কানে কানে বলল না বলা অবধি চোখ না খুলতে। রুদ্র চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে অনুভব করতে লাগল স্পর্শীর ছোঁয়া। সে একটু একটু করে ছুঁয়ে দিচ্ছে রুদ্রর কপাল, গাল, চিবুকসহ, প্রশ্বস্ত বুক। রুদ্র মিটিমিটি হাসছে। ওকে হাসতে দেখে স্পর্শী
রুদ্রর বুকের বাঁ পাশে এক হাত রেখে সেখানেও ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,

-‘আমি এখন যা বলব মন দিয়ে শুনে একটা কল্পরাজ্য তৈরি করবে। তারপর আমার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে উপলব্ধি করবে আমি অবস্থান, ওকে?’

-‘ওকে।’

স্পর্শী তার গলা পরিষ্কার করে নিজেকে সামলে বলতে শুরু করল। ধরো, একদিন অনেক রাত করে বাসায় ফিরলে তুমি, ড্রয়িংরুমে বসে আমাদের পরিবারের সবার সঙ্গে কথা বলে রুমের দিকে পা বাড়ালে। রুম বন্ধ। আমি আছি সেইই রুমে।
দরজার নিচে গাঢ় আঁধার থাকায় বুঝলে রুমটা অন্ধকারের ডোবা। নাম ধরে ডাকলে আমি দরজা খুললাম না। বারবার দরজা নক করলেও না। তোমার ডাকাডাকিতে উপস্থিত হয়ে গেল বাকি সদস্যরাও, সকলে আমাকে দরজা খোলার তাড়া দিতে থাকল। না, না পুরো কথা শোনো আগে চোখ খুলিও না আমি গলায় ফাঁ/স দেওয়ার কথা বলব না। এত সহজে ছাড় পাবে না তুমি। যতদিন বেঁচে আছি তোমাকে বিনা দরখাস্তে জ্বা/লিয়ে পুঁ/ড়িয়ে খাঁক করে দিবো। ধুর, পরেরটুকু শোনোই
না রে বাবা রোমান্টিক কাহিনি বলছি আমি, চুপ করে শোনো শুধু। তারপর যখন আমি দরজা খুললামই না তখন তোমরা সবাই মিলে ভাবলে আমি সুই/সাইড করেছি, মনে মনে ভয় পেলে, ঠিক করলে দরজা ভাঙবে, ভাঙলেও তাই। কিন্তু চট
করে দরজা খুলে লাইট জ্বালিয়ে দেখলে নগ্ন অবস্থায় আমি অন্য পুরুষের বুকে।কারো উন্মুক্ত বুকে লেপ্টে আছে তোমার স্পর্শী, তোমার ভালোবাসা, তোমার প্রাণ। তার সর্বাঙ্গে অন্য পুরুষের স্পর্শ। অচেনা পুরুষের দেওয়া লাভ বাইট সুস্পষ্ট ভাবে ভেসে উঠেছে তোমার স্পর্শীর নগ্ন শরীরে। তুমি……।

এইটুকু বলে স্পর্শী আর একটা শব্দও ব্যয় করতে পারল না, স্বজোরে এক থাপ্পড়ে ছিঁটকে পড়ল বেডের উপরে। হ্যাঁচকা টানে তাকে উঠে বসিয়ে রুদ্র আরেকটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো তার বাম গালে। ছিঁটকে খাটের কোণায় বারি খাওয়ার আগে তাকে ধরে রুদ্র বিছানার ফেলে গলা চেপে ধরল। এতই শক্ত করে ধরেছে স্পর্শীর অবস্থা বেগতিক। তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে যাচ্ছে। ওকে অঝরে কাঁদতে দেখে রুদ্র আরো রেগে গেল। রাগে জ্ঞাণশূন্য হয়ে বাজখাঁই গলায় বলে উঠল,

-‘এতদিন এই হাতে এই বুকে আগলে রেখেছি আজ এহাতে তোকে মেরে এই হাতে দিয়েই তোর কবরে মাটি দিবো। অন্য পুরুষের ছোঁয়া পাওয়ার শখ চিরতরে মিটিয়ে দিবো। অন্য পুরুষের বুকে লেপ্টে থাকার পরিকল্পনা করিস, এত স্পর্ধা!
আর কী কী যেন বললি?অন্য পুরুষের বাইট তোর শরীরে..!
এই মুহূর্তে আগে আমাকে সামলা এরপর নাহয় যাস অন্য পুরুষের সংস্পর্শে।’

একথা বলে হাতের বাঁধন ঢিলে করে কাছে আসতেই স্পর্শী তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে কাশতে থাকল। দৌড়ে গিয়ে একটু পানি খেয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে হাসতে হাসতে বলল,

-‘অন্যকে জ্বলাতে খুব ভালো লাগে?এসব শুনে এখন কেমন লাগছে? কষ্ট হচ্ছে, খুব কষ্ট বুঝি? আহারে। যখন আমাকে প্লে বয় হওয়ার কথাটা বললে ঠিক এভাবেই আমার বুকটাও কেঁপে উঠেছিল। ভীষণ, ভীষণ, জ্বালা পোড়া হচ্ছিল আমার অন্তদেশে তাইই এভাবেই শোধ নিলাম। সেই সঙ্গে আরেকটা কথা শুনে নাও তুমি যদি প্লে বয় হও। আমি এরচেয়ে আরো তিনগুণ খারাপ হবো, হবোই হবো। আমাকে যদি একভাগে পো/ড়াতে চাও আমিও তোমাকে কোনো না ভাগে পু/ড়ি/য়ে
ছারখার করে দিবো। তুমি যদি দশটা মেয়ের সঙ্গে শুতে চাও
আই মিন পুনরায় মুখে উচ্চারণ করো তবে আমি সত্যি সত্যি
বিশটা ছেলের সঙ্গে..!

-‘ তোকে তো আজ…।’

-‘খবরদার কাছে আসবে না। তোমার ভংচং মার্কা কাহিনীতে আমি অতিষ্ঠ। একটুও ভয় পাই না তোমাকে। গাড়িতে বয়াণ শুনে এতক্ষণ ভাবছিলাম কী করা যায়। ভেবে দেখলাম তুমি সর্বদা নিজের স্বার্থে অনড় থাকো তাই আমাকে আমার স্বার্থ দেখতে হচ্ছে।’

-‘ এসব বা*লের কাহিনি করে মুহূর্তটাকে নষ্ট না করলেই কী নয়? তোর এই কাহিনি দেখতে এখানে এনেছি? তাছাড়া খুব তো বলিস আমি কাছে আসি না, এই করি না, সেই করি না, হ্যান ত্যান কত কি! এখন যখন সুন্দর মুহূর্তে কাটানোর চেষ্টা করলাম ওমনি তোর কাহিনি শুরু হয় গেল। আজাইরা কথা এখনই বলতে হবে।’

-‘কেন বলবো না? তুমি রাজনীতিও ছাড়বে না, বেবি নিতেও দিবে না, প্লে বয় হবা, অন্য মেয়ের সঙ্গে শুতেও যাবে। আমি
সতী সাবিত্রী হয়ে তোমার শর্ত মেনে নিবো? আমাকে পাগলা কুত্তায় কামড়েছে, হ্যাঁ? আমাকে মুক্তি দিয়ে তুমি যখন যেটা ইচ্ছে তাইই করো। কেউ বলার নেই কওয়ার নেই। তবে হ্যাঁ, এটা ফাইনাল আমি আর তোমার সঙ্গে থাকব না।’

-‘তোর থাকা- থাকির মায়েরে বাপ। আজকে তো তুই শেষ।’

একথা বলে রুদ্র ধীরে ধীরে তার দিকে এগোতে থাকল। ওর এগোনো দেখে স্পর্শী ছুটে পালানোর আগে আঁটকে পড়লো শক্ত হাতের কবলে। মুহূর্তেই নিজেকে আবিষ্কার করল রুদ্রর কোলে, উন্মাদিত রুদ্র আজ আর না কোনো দূরত্ব রাখল না,
বাড়তি কোনো কথায়ও ভাবল না, মন এবং শরীরের কথাকে সায় দিলো। স্পর্শীর অভিযোগের দুয়ারে তালা ঝুলিয়ে রাখ ঢাখ উন্মুক্ত করে তাকে আপন করে নিলো। তবে বিশেষ সেই মুহূর্তে স্পর্শীকে আদরে ডুবিয়ে জানিয়ে দিলো অজানা কিছু কথা।যা শুনে স্পর্শীর ঠোঁটে হাসি ফুটল বিজয়ের হাসি,অশ্রু ভরা চোখে ভাসতে থাকল ঝমমকে খুশি। পরেরদিন সকালে আর্বিভাব হলো নতুন এক সকালের, আগের রুটিনে খানিক
পরিবর্তন আসল তাদের। মান-অভিমান ভুলে আনন্দে কেটে গেল বেশ কয়েকটা দিন। এই কয়েকদিনে রুদ্র সত্যি সত্যিই রাজনীতি থেকে নিজেকে সরানোর পদক্ষেপ নিলো। স্পর্শীর এতদিনের চাওয়াকেই প্রধান্য দিলো। সাংবাদিকের মাধ্যমেই
ছড়িয়ে সে নির্বাচন অংশগ্রহণ করবে না নিজের পদ থেকে সরে দাঁড়াবে। হঠাৎ সিদ্ধান্তের পেছনে কোনো কারণ, বারণ, কিচ্ছু নেই এটা তার মর্জি। এই নিয়েও কম জলঘোলা হলো না। নানান যুক্তি, কটুক্তি, অপবাদ, মিথ্যাচার, ভেসে বেড়াতে লাগল আকাশে বাতাসে, এটা হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ এই
রাজনীতি হচ্ছে সুপার গ্লু আঠার মতো লাগলে সহজে মুক্তি তো মিলেই না বরং জোরাজোরি, টানাটানি, করলে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। এভাবে কিছু দিন পেরিয়ে নির্বাচনের দিন চলে এলো, দলের বড় বড় নেতারাও রুদ্রকে বুঝিয়ে কোনো সুরাহা করতে পারল না। ফাস্ট এ্যান্ড লাস্ট রুদ্রর একটাই কথা রাজনীতি চ্যাপ্টার এখানেই ক্লোজ। পরে বিপক্ষীয় দল নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা হাতে নিলো। আর রুদ্র এসব থেকে একেবারেই নিজেকে সরিয়ে বাবার অফিসের হাল ধরলো।
এভাবেই দিন যেতে যেতে মাসে পরিণত হলো। মাস কাটতে না কাটতে বছরে গড়াতে লাগল। বাসার কারো মনেই এখন
রাজনীতির রোশানলে পড়ে মৃত্যুর ডঙ্কা বাজে না, মনে মনে
কেউ রুদ্রর জন্য আফসোসও করে না, এখন সবাইই খুশি।
তাছাড়া বাসার পরিবেশটাও বদলে গেছে কাফি এখন সেই বাসারই সদস্য। সে বর্তমানেও রুদ্রর এ্যাসিসটেন্ট হিসেবেই রয়েছে। তবে তাকে পুনরায় ভালো একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করানো হয়েছে আর বিয়েটা দিয়েছে দাদীমা নিজে। মেয়ের নাম তানিয়া, একটা স্কুলের শিক্ষিকা। বেশ মিশুক স্বভাবের মেয়ে সে। এতিম মেয়েটি কাফির সঙ্গে খুব সহজে নিজেকে মানিয়েও নিয়েছে। তবে রুদ্রর রাজনীতি ছাড়া নিয়ে এখন অবধি কেউ কোনো কথায় তুলে নি। সে যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সবাই তাতে ই সম্মতি দিয়েছে। এমনকি বড় মাও হাসিমুখেই
ছেলের সিদ্ধান্তে মেনে নিয়েছেন। অনেক হলো রাজনীতির খেলা এবার নাহয় একটু সুস্থভাবে বাঁচা যাক, সুখ-দুঃখের পালা এই বহমান জীবনে চলতেই থাকবে তবুও স্বস্তিভরে নিঃশ্বাসটুকু নেওয়া যাক। এই ছোট্টো জীবনে সব চাওয়ার
পাওয়ার চাহিদার মিলবে এমন তো নয়। জীবন মানে ত্যাগ, ত্যাগ মানেই অদৃশ্য তৃপ্তি। সব ত্যাগেই বিরহ থাকে এমনটাও নয়। সময়ের স্রোতধারায় স্পর্শীও পুরোপুরিই বদলে গেছে এখন সে বরপাগল একটা মেয়ে। যতটুকু সময় রুদ্র বাসায় থাকবে তার পেছনেই আঠার মতো লেগে থাকবে। কিছুদিন হলো সে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে পদার্পন করেছে। ওর এখন একমাত্র লক্ষ্যই অকারণে রুদ্রকে রাগিয়ে মিটমিটিয়ে হাসা। সে ভালোমতোই জানে বাচ্চা কনসিভের কথা বললেই রুদ্র রেগে বোম হয়ে যায়। মাঝে মাঝে দুকান ধরে দাঁড়িয়েও থাকে। তবুও ঘুরে ফিরে টেপ রেকর্ডার মতো ওই কথায় ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকে। এইতো কিছুক্ষণ আগে কফির মগ হাতে হন্তদন্ত হয়ে রুমে এসেছিল। রুদ্রকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জুরুরি মিটিং স্কিপ করতে বাধ্য করে কাঁদো কাঁদো মুখে বলেছিল,’ ‘ ‘তানিয়া আপু প্রেগনেন্ট, আসার সময় দাদীমাকে বলছে শুনলাম, এটা নাকি এ/ক্সি/ডেন্টলি হয়েছে। বলি,পৃথিবীতে এত এত মানুষের এক্সিডেন্ট আমাদের হয় না কেন? এক্সি/ডেন্ট করা ড্রাইভারদের এক নৈতিক অধিকার৷। বছর বছর গাড়ি চালিয়ে যদি এ/ক্সি/ডেন্ট নাই’ই করে তবে সে ড্রাইভার নামের কল/ঙ্ক।’
এই কথার জবাবে রুদ্র কটমট করে তাকিয়ে ছিল। আসলে সে কী বলবে নিজেও বুঝতে পারছিল না। এই ছাতার কথা বলার জন্য তার মিটিং স্কিপ করালো; এর কোনো মানে হয়!
এই গাধীটার মাথায় আর বুদ্ধি শুদ্ধি হবে বলেও মনে হয় না।
তারপর রোজকার মতো তাকে এক পা তুলে দু’কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রুদ্র হনহন করে ওয়াশরুমে চলে গেল। তাকে যেতে দেখে স্পর্শী কান ছেড়ে আয়নাতে নিজেকে ঘুরে ফিরে দেখে গুনগুন করে গান গাইতে লাগল। অতঃপর আয়নাতে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তার শাহাদৎ আঙুল তুলে বলল, ‘নিজের ব্যক্তিগত পুরুষটাকে কারণে অকারণে বিরক্ত করে, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাঁক করতে না পারলে তুমিও মেয়ে নামে
কল/ঙ্ক। স্বামীকে জ্বা/লানো স্ত্রীর ভালোবাসাগত অধিকার।
জাগো মেয়েরা জাগো স্বামীকে জ্বা/লিয়ে মা/রো।’ একথা বলে সে ডাকাতিয়া হাসি হাসতে লাগল। তারপর হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়াতে ভাবতে লাগল কিছুদিন আগের কথা।

সেদিন ছিল বুধবার! কলেজ থেকে ফিরে সোফায় বসে টিভি দেখছিল। দুপুরবেলা বাসার মহিলাগণ দুপুরে খেয়ে ভাতঘুম দিচ্ছে। তার ঘুম আসছিল না বিধায় সে রুদ্রের সঙ্গে ফোনে কথা বলে আপনমনে টিভি দেখছিল। তখন কাফি ড্রয়িংরুম থেকে তার নাম ধরে ডেকে উঠল। অলস ভঙ্গিতে কোনোমতে উঠে হেলেদুলে ড্রয়িংরুমে যেতেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল। খুব চেনা লাগলেও স্মরণ হচ্ছিল না কোথায় দেখেছে। তখন বড় এসে দাঁড়াতেই ভদ্রমহিলা বিনয়ের সঙ্গে সালাম দিলো, হাসি মুখে কুশল বিনিময় করল। তখনই তার স্মরণ হলো উনাকে সে চিনে, খুব ভালো করে চিনে, কারণ মহিলা আর কেউ নয় স্বয়ং রুদাশা। কিন্তু রুদাশার এক কোন রুপ! তার সর্বশরীর বোরকা হাত মোজাতে আবৃত করা শুধু চোখ দু’টো বেরিয়ে আছে। তাকে দেখে রুদাশা এগিয়ে এসে পূর্বের ঘটনার জন্য বার মাফ চাইল। বিষ্ময়ে যখন সে কথা বলতেই ভুলতে গেছে ততক্ষণে রুদাশা তার পা ধরে কাঁদতেও শুরু করেছে। স্পর্শী তাৎক্ষণিক রুদাশাক ধরে দাঁড় করিয়ে জড়িয়ে ধরল। এমন কিছু আশা করে নি সে। রুদাশার চোখে পানিতে মনটা গলে গেলেও কিছু বলল না সে। তাকে চুপ থাকতে দেখে রুদাশার কান্না বেড়ে গেল। যে কান্নার শব্দ নেই, গন্ধ নেই, বর্ণও নেই।
আছে শুধু অনুতাপের নিগূঢ় ছাপ। স্পর্শীকে নিশ্চুপ দেখে
রুদাশা এবার হাত জোড় করে কাফিকে কিছু বলতে গেলে কাফি শুধু এইটুকুই বলল,
‘ আমি র/ক্তে মাংসে গড়া সাধারণ মানুষ। কারো দোষ গুন ধরার যোগ্যতা আমার নেই। তবে পূর্বে যা ঘটে গেছে সেটা অতীতমাত্র। অতীত ঘটলে কষ্ট ছড়া কিছুই পাওয়া যায় না, যাবে না। যাকে হারিয়েছি তাকে তো ফিরে পাওয়া সম্ভব নয় তাই পূর্বের কথা আজ থাক। তাছাড়া আপনাকে মাফ করে দিয়েছি যেদিন জেনেছি আপনি নিজেকে বদলে ফেলেছেন, রুমাকে মা/রার আফসোসে পুড়ে ম/রছেন, আফসোস হচ্ছে নিরব ঘাতক। এর দহন ভীষণ যন্ত্রণার। না আপনাকে স্বস্ত্বি দিবে আর না শান্তি। তাছাড়া পাপ ও পূর্ন্যের বিচার করার ক্ষমতা আমানর নেই তাই এই দায় আমি নিলাম না। মাথার উপরে একজন তো আছেই। তবে আমি দোয়া করি শিহাব ভাইয়ের সঙ্গে বাকিটা জীবন ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।’

একথা বলে কাফি স্বভাবসুলভ হেসে প্রস্থান করল। তানিয়া গেল তার পিছু পিছু। শরীর খারাপ শুনে রুদ্রই তাকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছিল একটুপরে তানিয়ে নিয়ে হসপিটালেযাবে।
তানিয়াকে একবার চেকআপ করে নেওয়া জরুরি। এদিকে
স্পর্শীর মাথায় ঘুরছে অন্যকথা। তার মুখে হতভম্বের ছাপ। সে এখনো বিষ্ময় নিয়ে রুদাশার দিকে তাকিয়ে আছে, কিছু
বুঝতে পারছে না সে। যদিও শুনেছিল রুদাশা বদলে গেছে
তবুও বিশ্বাস করেছিল না। কিন্তু এখন চোখে দেখছে সেটা অবিশ্বাস করার জো নেই। কিন্তু এই পরিবর্তনের কারণ কি?
এসব অদৌও সত্যি নাকি কোনো ছলচাতুরী?না সে মনমতো
কোনো জবাবই খুঁজে পেল না। মোদ্দাকথা, কোথায় বা গেল তার স্টাইলিশ পোশাক-আশাক, কোথায় গেল বাহারি সাজ, কোথায় বা তার আকাশচুম্বী অহংকার? যে অহংকার ছিল তার একসময়ের অলংকার। কাফি যাওয়ার পর রুদাশা ওর
নিকাব সরিয়ে মুখ বের করল। দু’হাতে দু’চোখ মুছে পুনরায় অঝরে কাঁদতে লাগল। পরনে ঢোলাঢালা সাধারণ বোরকা, সাজগোছের ছিঁটে ফোঁটাও নেই। বড় মা রুদাশার জন্য নাস্তা আনতে গেলে দ্রুত বাঁধা দিলো, কিছু খাবে না, শিহাব নাকি
রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে এখনই চলে যাবে সে। রুদ্র এই সময় বাসায় থাকে না জেনেই এসেছে স্পর্শীর কাছে মাফ চাইতে। অতঃপর স্পর্শীর থেকে মাফ পেয়ে হাসি মুখে চোখজোড়া মুছতে মুছতে চলে গিয়েছিল। সে চলে যাওয়ার পর রুদ্রকে ফোন করে জোর করেই রুদাশার পরিবর্তনের কারণ জেনে তবেই ক্ষান্ত হয়েছিল। রুমবন্দি থাকাকালীন শিহাব তাকে খাবার, পোশাকসহ, নিত্য চাহিদার অভাব বুঝিয়েছিল। রং
এর দুনিয়ায় আরাম আয়েশ থেকে দুরে রেখেছিল। দু’মুঠো
ভাতের মর্ম বুঝিয়েছিল। বিলাসিতা করা তো দূর অতিরিক্ত কিছুই দেওয়া হতো না তাকে। একদিন শিহাব বেশ কয়েকটি ইসলামিক বই রুমে রেখে এসেছিল। একাকিত্ব ঘুচাতে এবং
সময় কাটানোর জন্য রুদাশা নাড়াচাড়া করে একসময় পড়া শুরু করে এবং বিভিন্ন ধরনের বিষয় আশয় জানতে পারে।
ফোন, লেপটপ, সোশ্যাল কোনো কিছুর সঙ্গে যোগাযোগ না থাকায় সে বইতেই বুদ হয়ে যায়। যত পড়ে কেন জানি তার জানার আগ্রহ ততই বেড়ে যায়। তার এ আগ্রহ দেখে শিহাব সুযোগটাকে কাজ লাগায়, আরো কিছু বই এনে দেয়,রুদাশা বন্দিরুমে বসে সেসব বই পড়তে থাকে আর জানতে থাকে অজানাকে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এভাবে কেটে
যায় তার। নতুন বই ছুঁইয়ে দেখা আর পড়া আনন্দকে আয়ত্ত করে সে। আরো কিছু বই এনে দেওয়ার আবদার করে এবং
বইতে যা যা পড়ে নিজে নিজে আমল করার চেষ্টা করে। জং ধরা মস্তিষ্কে পাপ ও পূন্যের তফাৎ বুঝে। এবং ধীরে ধীরে সে বদলাতে থাকে, অহংকারী রুদাশা পরিণত হয় ধার্মিক রুপে।
এতে শিহাবও তাকে সহযোগিতা করে। স্বামীর হক ও সন্মান নিয়ে একটা বই পড়ে সে নিজের ভুল বুঝে সেদিন শিহাবের
সামনে কেঁদে কেঁদে মাফ চাই। পূর্বের করা সব অপরাধ মাফ করে আরেকটা সুযোগ দেওয়ার অনুরোধ করে। শিহাবও তাকে সুযোগ দেয় রুদাশাও পারফেক্ট সহধর্মিণী হয়ে ওঠে।
আর এই সবকিছুর পেছনে কলকাঠি নেড়ে এসব ঘটিয়েছে রুদ্র। অনেক আগেই রুদাশার নামের কেস তুলে আরেকটা সুযোগ দিতে চেয়েছিল। সেই সুযোগই রুদাশার জীবন চেঞ্জ করে দিয়েছে। রুদাশার বাবাও আর বেঁচে নেই। দেশ ত্যাগের উদ্দেশ্যে যে ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর যাচ্ছিলেন সেই ফ্লাইট কীভাবে যেন ব্লাস্ট হয়, উনিসহ মা/রা যায় অসংখ্য মানুষ। মানুষের জীবন আসলেই বহমান। আর বহমান বলেই সুখ দুঃখ মিলে অতিবাহিত হয় অবিরাম।

প্রায় তিন বছর পর,

আজ সোমবার। সরকারি ছুটির দিন বিধায় রুদ্রসহ বাসার সকল সদস্যই উপস্থিত আছে। আজ কাফির মেয়ে তিন্নির জন্মদিন। বাসায় সেসবেরই আয়োজন চলছে। মেহমানদের
নিয়ে অনুষ্ঠানের ঝামেলা করা হয়নি। স্পর্শীর আর রুদ্রের কথামতো এতিমের বাচ্চাদের খাবার ও পোশাক বিতরণের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠান,মেহমানদের গেদারিং কেন
জানি পছন্দ হয় না রুদ্রর। সে সর্বদা অনুষ্ঠান এড়িয়ে বিকল্প কিছু করার চেষ্টা করে। তার কাছে এ অনুষ্ঠান মানেই লোক দেখানো ব্যাপার স্যাপার। এমনকি সব ঠিকঠাক হওয়া পরে যখন সবাই যখন চাচ্ছিল তার আর স্পর্শীর বিয়ে অনুষ্ঠান সারতে তখনও সে বাঁধ সেধেছে। কিছুতেই অনুষ্ঠানের জন্য রাজি করানো যায় নি। আজকের সমস্ত কাজ সেরে কেবল বাসায় ফিরেছে রুদ্র। ঘামে ভিজে একাকার অবস্থা, ঘড়িতে তখন বিকাল পাঁচটা। গোধুলিয়া মেরুপ্রভা। রুদ্র চটজলদি
ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখল স্পর্শী জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। গভীর চিন্তায় মশগুল। মন খারাপের ছাপ চোখে মুখে। পরনে হালকা গোলাপি রঙের ঢোলাঢালা ম্যাক্সি। উঁচু ফোলা পেট। কাঁধে পড়ে আছে যত্ন করে বাঁধা হাতখোপা। খোঁপার মাঝখানে আঁটকানো রুপার তৈরি স্টার আকৃতির কাঁটা। নিশ্চয়ই এটা তার মায়ে কাজ। কারণ উনি স্পর্শীর আরাম আয়েশের দায়িত্বে নিযুক্ত, মরিয়ম বেগম দেখেন খাবার-দাবার, বড় বাবা এবং স্পর্শীর বাবার দায়িত্ব রুদ্রর চোখ এড়িয়ে এটা ওটা এনে দেওয়া, দাদীমা দেন তার
মহামূল্যবান পরামর্শ, কাফি আর তানিয়ার কাজ হাসানো, আর রুদ্রর কাজ তাকে ধমকানো। স্পর্শীর এখন আটমাস সতেরো দিন চলে। বিয়ের পর থেকে বাচ্চা বাচ্চা করে তার কানমাথা ঝালা পালা করে দেওয়া মেয়েটার কোলে সত্যিই
বাচ্চা আসতে চলেছে। মরিয়ম বেগমে ভয় দূর হয়েছে। নতুন সদস্যকে বরণ করতে মুখিয়ে আছে বাসার প্রত্যেক সদস্য।
বাচ্চার পজিশন জানার জন্য গতমাসে আল্ট্রোসোনোগ্রাফি করে জানা গেছে টুইন ছেলে বেবি হবে। কে বাচ্চা সেটা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। যা হবে তাতেই সবাই খুশি। কিন্তু বড় পেট নিয়ে স্পর্শীর একটু বেশি কষ্ট হয়ে যায়। হাঁটতে পারে না, শুতে পারে না, শুলে আর একা একা উঁঠতে পারে না, পা ফুলে অনেকটা পানি জমেছে, শারীরিক গঠনেও পরিবর্তন এসেছে। তবে গোলমলু স্পর্শীকে দেখতে বেশ লাগে। চঞ্চল স্পর্শী এখন গটগট করে হাঁটতে পারে না, লাফাতে পারে না, এখন সে পেট ধরে আস্তে ধীরে হাঁটাচলা করে, সেই দৃশ্যটুকু রুদ্র মনভরে, চোখভরে, আত্মাভরে দেখে আর হাসে। স্পর্শী পূর্বের মতো একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে জানালার পাশে, তবে হাতে আছে একবাটি কয়েক রকমের ফল। হয়তো মরিয়ম বেগম হয়তো ধমকে টমকে খেতে দিয়ে গেছেন। এই মেয়েটা আগে ছিল পড়াচোর প্রেগনেন্ট হওয়া পর হয়েছে খাওয়া চোর। খাওয়াতে তার বড্ড অনীহা। ধমক খেয়ে এখন মুখটা গোমড়া করে খাচ্ছে। রুদ্র মিটিমিটি হেসে হাতের টাওয়াল বেলকনিতে মেলে রুমে এলো। তার উপস্থিতি টের পাওয়াতে মাথা ঝাঁকাল। ভেজা চুলে পানি ছিঁটকে পড়ল স্পর্শীর চোখে মুখে। ঠান্ডা পানির ছিঁটে গায়ে পড়তেই স্পর্শী বিরক্ত নিয়ে তাকিয়ে পুনরায় বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। রুদ্র ধীরে ধীরে
কাছে গিয়ে আলতো করে পেছনে থেকে জড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, মন খারাপ কেন? স্পর্শী কোনো জবাব দিতে পারল না, কারণ আজকাল এতবেশি মুড সুয়িং হচ্ছে সে নিজেও জানে না হঠাৎ হঠাৎ মন খারাপ কেন হচ্ছে। হঠাৎ স্পর্শী
বলে উঠল,

-‘বাবুর বাবা একটা সত্যি কথা বলো তো আমায়।’

-‘হুম।’

রুদ্র ঠোঁট কামড়ে নিজের হাসি আঁটকালো। এখন কিছুতেই
হাসা যাবে না নয়তো খবর আছে। আর স্পর্শী বর্তমানে এই সম্বোধনেই ডাকে। খারাপ লাগা দূর মনটা কেন জানি খুশিতে ডগমগ করে ওঠে। স্পর্শী রুদ্রর পারমিশ পেয়ে আমতা আমতা করে এমিলির কথা জানতে চাইল। রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার পর রুদ্র রাজনীতির কোনো বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে না। সুখে-দুঃখে দিব্যি আছে সে। তবে অসংখ্যবার নানা কারণে অকারণে বিপদে পড়তে হয়ছে। সেসব দিন পেরিয়ে
গেছে অনেক আগেই তবে আজক স্পর্শীর জানতে চাওয়ার কারণ রুদ্র কাছে স্পষ্ট। হয়তো টিভিতে সংবাদ দেখেছে যে এমলি গণধর্ষণের শিকার হয়ে সু/ইসাইড করেছে। প্রবাদে আছে ‘অতি বার বেড়ো না ঝড়ে পড়ে যাবে।’ এই প্রবাদটা এমিলির জন্য যথার্থ।এমিলি তার শশুরের ক্ষমতাকে কাজ লাগিয়ে অতিরিক্ত বাড়া শুরু করেছিল, ভুলে গিয়েছিল সে একটা মেয়ে, তার চলাফেলাতে মার্জিত ভাব থাকা দরকার। কিন্তু না, সে উগ্র স্বভাবের, চলাফেরা ক্ষমতাবান লোকদের সঙ্গে ফলস্বরূপ যা হওয়ার তাইই হয়েছে। এসব শুনে স্পর্শী ঘুরে দাঁড়িয়ে রুদ্রর গলা জড়িয়ে ধরতে গেলে বড় পেট বাঁধ সাধলো। বিরক্ত হয়ে কিছু বলার আগেই রুদ্র হেসে নিচু হয়ে স্পর্শীর গলা জড়িয়ে ধরে ভ্রুঁ নাচালো। এবার স্পর্শীও হেসে রুদ্রর কপালে পড়ে থাকা ভেজা চুল এলোমেলো করে দিতে দিতে বলল,
-‘দত্তক নেওয়া আমিটাকে এত ভালোবাসে কেন তুমি?’
-‘ইচ্ছে করে তাই।’
-‘কেন ইচ্ছে করে?’
-‘মনে বলে তাই।’
-‘কেন মন বলে?’
-‘আপনি আমার মনোহারিণী তাই।’
-‘কেন আমি আপনার মনোহারিণী?’
-‘কপালে আর কোনো মেয়ে জুটে নি তাই।’
-‘কেন মেয়ে জুটেনি।’
-‘তুই নজর দিয়েছিস তাই।’
-‘কেন নজর দিয়েছি।’
-‘আমার মতো ভালোবাসায় আঁটকে গেছিস তাই।’

পরবর্তী কিছু বলতে গেলে রুদ্র সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে স্পর্শীর ঠোঁটে আদর এঁকে দিলো। থামিয়ে দিল প্রশ্নের গাড়ি। স্পর্শী লাজুক হেসে মুখ লুকাল তার ব্যক্তিগত পুরুষের বুকে। যে
বুকে শান্তির আবাস। কে বলে প্রেম প্রার্থনা বিচ্ছেদের শব্দ।
তার প্রেম প্রার্থনা তো ব্যর্থ যায় নি। অনেক সাধনার পর সে রুদ্রকে ফিরে ফিরেছে নিজের মত করে। বোঝাতে পেরেছে
তার ভালোবাসা, তার চাওয়া-পাওয়ার গভীরতা। এভাবেই
থাকতে চাই আজীবন ভালবাসতে চাই প্রিয় মানুষটার সঙ্গে সারাজীবন। সে সুখী, ভীষণ খুশি, কারন বেলাশেষে পূর্নতা পেয়েছে প্রেম-প্রার্থনা

~সমাপ্ত~

প্রেম প্রার্থনা পর্ব-২৭

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[২৭]

-‘ পৃথিবীতে স্বামীরা খারাপ হলেও প্রকৃত বাবারা কখনো তার সন্তানের অনিশ্চিত জীবন চাই না। আর আমি নিশ্চিত, ভবিষ্যতে তুমিও প্রকৃত বাবাদের একজনই হবে।’

একথা শুনে রুদ্র কিয়ৎকাল নিশ্চুপ রইল। স্পর্শীকে পূর্বের মতো বুকের সঙ্গে চেপে ধরে একহাতে ড্রাইভ করছে। কারো মুখে রা শব্দটুকুও নেই অথচ দু’জনের ভেতরটাই এই মুহূর্তে অশান্ত, অদমনীয়। স্পর্শী তার নিজের অজান্তেই সম্পর্কের দোহায় দিয়ে অনেক বড় অংক কষে ফেলেছে। এর পরিণতি হয়তো ভেবেই দেখে নি। তার এমন করার কারণটাও এখন সুস্পষ্ট। স্পর্শী আদুরে বিড়াল ছানার মতো রুদ্রর বুকে মুখ লুকিয়ে শার্টের বোতাম খুঁটরে যাচ্ছে। মুখটা চুপসানো। মনে মনে প্রস্তুত’ও একটা রাম ধমক হজম করার। ওর চুপসানো মুখ দেখে রুদ্র মনে মনে কিছু কথা গুছিয়ে স্পর্শীর কপালে আদর এঁকে শান্তভাবে বলল,

-”খুব ভালোবাসিস আমাকে?’

-‘ভীষণ।’

-‘আজীবন থাকতে চাস আমার সঙ্গে?’

-‘খুব করে চাই। জানো, আমার না বাঁচতে ইচ্ছে করে সুস্থ ভাবে বাঁচা যাকে বলে। তুমি-আমি আমরা মিলে সাজানো একটা সংসার হবে আমাদের। আমি একদিন খুব ভালো বউ
হবো তোমার, নিজের হাতে রান্না করব, সংসার সামলাবো, আমাদের একটা পুচকু হবে, তার যত্ন নিবো, একজন ভালো মা হবো।’

-‘আর?’

-‘আর? উমমম না আর কিছু না। আমার এইটুকুই চাওয়া।’

-‘তারমানে তোর কথা অনুযায়ী সুস্থভাবে বাঁচতে গেল এখন আমাকে রাজনীতি ছাড়তে হবে, তাই তো?’

-‘হুম।’

-‘তাহলে বলব এসব চিন্তা মাথা থেকে ছেড়ে ফেল। যতদিন না আমি নিজে চাইব ততদিন বাচ্চার চিন্তা স্মরণেও আনতে পারবি না। যদি ভেবে থাকিস, আমাদের একটা বাচ্চা হলেই আমার পায়ে শেকল পড়ে যাবে আর রাজনীতি ছেড়ে দিবো তাহলে তুই ভুল ভাবছিস। যেমন আছিস তেমনই থাক তোর প্রতি আমার ভালোবাসা কখনোই কমবে না। তবে বার বার রাজনীতি ছাড়ো, রাজনীতি ছাড়ো, করে এসব কাহিনি সৃষ্টি করিস না। প্রতিটা মানুষের ভালো লাগা মন্দ লাগা বলে কিছু ব্যাপার থাকে। আমার কাছে রাজনীতি ভালো লাগার একটা দিক, আমি রাজনীতে যুক্ত ছিলাম আছি আর তাইই থাকব।
তাছাড়া আমি যেমন তোর সমস্ত ভালো-মন্দ মিলিয়ে হৃদয়ে
ঠাঁই দিয়েছি তবে তুই কেন পারছিস না? কেন অহেতুক চিন্তা করে আমাকে দমিয়ে রাখতে চাস? মোদ্দাকথা, এ নিয়ে পূর্বে আমাদের কথা হয়ে গেছে তাই কথা না বাড়ানোই প্রয়োজন দেখছি না। ‘

-‘থাকবা আমার সঙ্গে আর বাচ্চার সিদ্ধান্ত তুমি একা নিবে?’

-‘ ঠিক তাই।’

-‘তাহলে তুমি নিজে নিজেই প্রেগনেন্ট হয়ে নিজের বাচ্চা নিজে পয়দা করিও।’

-‘বেহুদা কথাবার্তা যত বলবি কম বলবি তত মাথা ঠান্ডা থাকবে। আর যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। আর হ্যাঁ
আরেকটা কথা, প্রয়োজনের তুলনায় লেবু যত চটকাবি তত তিতা লাগবে। বেস্বাদে মুখটা বিষিয়ে যাবে, গা গুলাবে। তাই আগে প্রয়োজন অনুযায়ী মাপ বুঝে নেওয়া জুরুরি।’

-‘এসব যখন বলো তখন নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয়, আমার ম/রে যেতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা আমার চাওয়ার কোনো দাম নেই তোমার কাছে?’

-‘আছে বলেই সমস্ত কাজ ফেলে ঘুরতে বের হয়েছি।’

-‘কাজ, কাজ আর কাজ, এত কিসের কাজ তোমার? কাকে এত ব্যস্ততা দেখাও তুমি? চোখের সামনে আছি বলে গুরুত্ব দিচ্ছো না, যখন সত্যি সত্যি থাকব না, তখন বুঝবা ঠিক কি ছিলাম। এখন আমি যেমন তোমার প্রতিটা কথায় দগ্ধ হচ্ছি, একদিন তুমিও আমাকে না পেয়ে আফসোসে ডুবে হাজার আকুতি করলেও তোমার প্রেম প্রার্থনা শোনার মানুষ থাকবে না। আজ যেমন আমার কথা শুনছ না তখন আমিও শুনবো না তোমার কথা।’

-‘বরাবরই আমার ইমোশন অকেজো তাই তোর ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলে কাজ হচ্ছে না, সরি। রাজনীতি ছাড়া বাদে অন্য
অপশন থাকলে বল।’

-‘আমি কনসিভ করতে চাই। তারপর আমার বাচ্চাকে নিয়ে তোমার থেকে অনেক দূরে চলে যেতে চাই।’

-‘তোর বয়স অনুযায়ী চিন্তা ভাবনা খাপে খাপ। তবে আমার রাজনীতি নিয়ে যখন এতই সমস্যা তখন আমি রাজনীতিই ছেড়ে দিবো, তবে শর্তসাপেক্ষে। যদি তুই সেই শর্ত মেনে নিস তবে তোর কথামতো সব হবে, প্রমিস।’

-‘কী শর্ত? ঝটপট বলো আমি সব শর্তে রাজি।’

-‘আজ অবধি কোনো পরিস্থিতিতেই মেয়েলি কোনো কেসে নিজেকে জড়ায় নি। তবে রাজনীতি ছেড়ে দিলে আমি পাক্কা
মেয়েবাজ হবো, মেয়েবাজ বুঝিস? প্লে বয়। উঠতে, বসতে, খেতে, শুতে, নিত্যনতুন মেয়ের সঙ্গে লিপ্ত হবো। আর কোন মেয়ের শরীর কীভাবে হাতাবো প্রমাণসহ দেখবি তুই। আই মিন সাক্ষী থাকবি সেই সঙ্গে…! ”

রুদ্রর কথা শুনে স্পর্শী শক্ত হাতে খামচে ধরল রুদ্রের শার্ট।
পরক্ষণেই ডুকরে কেঁদে উঠল নিষ্ঠুর পুরুষটার বুকে মুখ লুকিয়ে। এই কোন আজাব নেমে এলো তার জীবনে? এক বিপদ থেকে উদ্ধার হতে চাইলে আরেকটা বিপদের দ্বারে পড়তে হচ্ছে। রুদ্র কীভাবে বলতে পারছে এসব কথা? তার কি বুক কাঁপছে না বিবেকে বাঁধছে না? রুদ্র নির্লিপ্তভাবে ড্রাইভ করছে। তার মুখভঙ্গি অত্যন্ত গম্ভীর। তাকে এভাবে কাঁদতে দেখেও রুদ্র বিচলিত হওয়া দূর টু শব্দ অবধি করল না। তখন স্পর্শীই বলল,

-না, না, থামো, থামো প্লিজ! আচ্ছা ঠিক আছে রাজনীতিই করো তবুও আমার হয়ে থেকো। তোমার বুকে অন্য নারীকে সহ্য করতে পারব না আমি। আজ প্রমিস করছি জীবনেও রাজনীতি ছাড়ার কথা বলবো না তোমাকে। তোমার যখন যা মন চাই তাই করিও তবুও অন্য নারীতে আসক্তি হইয়ো না, প্লিজ।’

-‘যদি শর্তের হেরফের হয় তখন?’

-‘হবে না, প্রমিস, প্রমিস, প্রমিস।’

-‘চোখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে বস। এই আলোচনার রেশ ধরে সুন্দর মুহূর্তটুকু নষ্ট করিস না। সেই সঙ্গে মস্তিষ্কে গেঁথে নে স্বার্থের এই পৃথিবীতে ক্ষমতা আর টাকা ছাড়া সব তুচ্ছ। এই দুটো ছাড়া মানুষকে মানুষ বলেই গণ্য করা হয় না। যার পকেটে টাকা আছে তার সন্মান আছে। বনের রাজারও কিন্তু ক্ষমতা বুঝে রাজত্ব করে পুরো বনে। ক্ষমতার জোরে থাবা বসায় অসহায় প্রাণীর উপরে, সেখানে আমি তো আমিই। আর হ্যাঁ বেবি কনসিভের ব্যাপারটা ভুলে যা নয়তো তোকে ছুঁয়ে দেখা তো দূর বাসায় আসাও বন্ধ করে দিবো।’

স্পর্শী একটা কথাও বলল না, কাঁদলোও না, শুধু নিশ্চুপ হয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল। রুদ্র গাড়ি থামাল এক পাঁচ তারকা রেস্টুরেন্টের সামনে। পাকিং লটে গাড়িটা পার্ক করে স্পর্শীকে নিয়ে গেল বিল্ডিংয়ের আট নং ফ্লোরে। স্পর্শী স্বাভাবিকভাবে হেঁটে যাচ্ছে রুদ্র পিছু পিছু। যেন কিছুই হয় নি তাদের মধ্যে সব স্বাভাবিক। রুদ্রও এখন হেসে হেসে কথা বলছে, এটা-ওটা দেখাচ্ছে। পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হলে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। রুদ্র হঠাৎ’ই তার হাঁটার গতি কমিয়ে তার হাতের আঙুলের ভাঁজে আঙ্গুল গুঁজে পাশাপাশি হাঁটতে থাকল। স্পর্শী খুব অবাক হলেও রুদ্র তাকানোর প্রয়োজন মনে করলো না। আট নং ফ্লোরে এসে স্পর্শী দৃষ্টি বুলিয়ে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখছে। খুব সুন্দর করে সাজানো ভেতরটা।
কিন্তু ভেতরে একটা মানুষেরও আনাগোনা নেই সব টেবিল ফাঁকা। এই নিয়ে তেমন কিছু ভাবল না সে কারণ রুদ্র তাকে
আউল ফাউল কোনো জায়গায় আনবে না। তার উপরে এই টুকু বিশ্বাস আছে। অতঃপর রুদ্রর ইশারায় কর্ণারে একটা টেবিলে মুখোমুখি বসতেই এক ওয়েটার ওয়েলকাম ড্রিংকস দিয়ে এসে অর্ডার নিয়ে নিল। সব স্পর্শীর পছন্দের খাবার। সেটা দেখে স্পর্শী মনে মনে হাসল। মনের ঘরে আঘাত হেনে তার পছন্দের খাবার এনে মলম লাগানো হচ্ছে।একটুপরেই আরেকজন এসে অনেকগুলো লাল টকটকে গোলাপ আর চকলেট দিয়ে গেল।পূর্বের জন যেতে না যেতেই এক মেয়ে ওয়েটার উপস্থিত হলো। মুখভর্তি তেলতেলে হাসি সমেত এক ডালা কোণ আইসক্রিম হাতে তুলে দিলো। স্পর্শী কথা না বলে মুখে হাসি এঁটে সেগুলো নিয়ে টেবিলে রেখেছে। সে বুঝে গেছে এসব রুদ্রেরই কাজ। সে রুদ্রর মুখোমুখি বসে ঘাড় ঘুরিয়ে কাঁচ ভেদ করে রাস্তায় চলা গাড়ি দেখছে।জ্যামে কতশত গাড়ি আঁটকে আছে। তারা যখন গাড়ি করে এলো এত জ্যাম ছিল না। সে যখন একমনে এসব ভাবছিল তখন
রুদ্র ওর বাম হাতটা টেনে নিয়ে অনামিকা আঙুলে স্বর্ণের রিং পরিয়ে হাতের উল্টো পিঠে চুমু এঁকে বলল,

-‘রাগ করেছিস?’

-‘নাতো।’

-‘রাজনীতি আর কনসিভের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।’

-‘বিনিময় কি পাবো?’

-‘সম্পূর্ণ আমিটাকে।’

-‘আচ্ছা।’

তারপর রুদ্র তার কথা দ্বারা স্পর্শীকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে থাকল। মজার মজার সব গল্প শুনাতে থাকল।খাবার এলে নিজেই স্পর্শীকে সার্ভ করে দিলো। এক পর্যায়ে রুদ্রর
একটা কথা শুনে স্পর্শীও খিলখিল করে হেসে উঠল। তার মায়াবী মুখে খুশি ঝিকমিকিয়ে উঠল। অভিমান সরে গিয়ে
চোখে ফুটল একরাশ লজ্জা। কারণ রুদ্র এসব সব কথা বলছিল না চাইলেও লজ্জারা তাকে ঘিরে ধরছিল। মানুষটা যে চরম লেভেলের বেহায়া তা পুনরায় প্রমাণ পেল।অতঃপর
খাবার পর্বে শেষ করে তারা গাড়ি নিয়ে অনেক জায়গা ঘুরে মজা করল, দু’জন টুকটাক কেনাকাটা করল, যা আবদার করল রুদ্র কিনে দিলো, এই প্রথম রুদ্র তাকে এভাবে সময়
দিচ্ছে, সবটা যেন স্বপ্নের মতোই। রাত যখন সাড়ে বারোটার কাছাকাছি তখন রুদ্র জানাল তারা আজ বাসাতেই ফিরবে না। হতবাক স্পর্শী কিছু বলার আগেই রুদ্রর ফোনে একটা কল এলো। হুম, হ্যাঁ, তে কথা সেরে কল কেটে পুনরায় তাকে নিয়ে গেল আরেক জায়গায়। আর সেখানে গিয়ে ই স্পর্শীর সব কথা ফুরিয়ে গেল, বিষ্ময়ে অবশ হয়ে এলো তার মস্তিক,
অনেক চেষ্টা করেও যখন কোনো কথা গুছাতে পারলো না
তখন শুধু ছলছল চোখে তাকিয়ে রইল রুদ্রর মুখের দিকে।

To be continue………….!!

প্রেম প্রার্থনা পর্ব-২৬

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[২৬]

-‘কে রে বা*?’

-‘বা* না, তোর মায়ের একমাত্র জামাতা।’

-‘আমি এখন ঘুমাব কেউ যেন না ডাকে।’

-‘অসময়ে ঘুমনো বের করছি তাড়াতাড়ি দরজা খুল।’

-‘খবরদার বলছি কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করবা না। যেখানে গিয়েছিলে তুমি সেখানে যাও। কাজ না পেলে তোমার এমলি আছে না? তাকে কোলে নিয়ে বসে থাকো তবুও আমাকে ডাকবে না। আমি তোমার কেউ ছিলাম না, এখনও নেই।’

-‘নিজের স্বামীকে অন্য মেয়ের কাছে যেতে বলছিস। এবার ইতিহাসের পাতায় তোর নামটাই আগে থাকবে। শোন, কথা বেশি হয়ে যাচ্ছে, ঝটপট রেডি হয়ে নিচে আয় আমি ওয়েট করছি। ঠিক পনেরো মিনিট দিলাম এর মধ্যে যদি রেডি হতে না দেখি তখনই বুঝবি আমি কী জিনিস।’

-‘তুমি কি জিনিস নতুন করে জানার দরকার নাই। যতটুকু জেনেছি ততটুকুই যথেষ্ট।

-‘ঠিক পনেরো মিনিট।’

-‘বলছি তো, আমি এখন কোথাও যাব না, মানে যাব না।’

অপর পাশ থেকে রুদ্রর কোনো শব্দ পাওয়া গেল না। স্পর্শী ভালো করে কান পেতে বোঝার চেষ্টা করলো আসলেই রুদ্র আছে নাকি চলে গেছে। যখন বুঝল সত্যিই নেই তখন রাগ ঝাড়তে চেঁচিয়ে বলল,

-‘তখন নিয়ে গেল না এখন আসছে ভালোবাসা দেখাতে। তোর ওই ভালোবাসায় পিঁপড়া ধরবে বে/য়াদব পুরুষ মানুষ।
কোথাও ঘুরতে নিয়ে যায় না, একটু ভালোবাসেও না, সুন্দর করে কথা বলা তো আরো দূর, এখন আবার আসছে থ্রেট দিতে। তোর মতো থ্রেট ওয়ালাকে আমি বলে বিয়ে করেছি নয়তো জীবনেও বিয়ে হতো তোর।’

রাগে গজগজ করতে করতে স্পর্শী উঠে রুমের লাইট অন করল। কান্না করে চোখ মুখ ফুলিয়ে একাকার অবস্থা। এই অবস্থায় বাইরে গেলে লোকে কি বলবে, ধুর ভাল্লাগেনা,নিয়ে তো যাচ্ছিসই কান্নার আগে নিয়ে গেলে কি হতো? ভিলেনের মতো শুধু থ্রেট দিতে পারে, ভিলেন একটা। অতঃপর নিজের মনমতো রুদ্রকে ঝেড়ে গালে হাতে কিছুক্ষণ ভেবে দেখল রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। না আজকের রাগ আপাতত
এইটুকুই থাক বেশি হয়ে গেলে তখন আবার তাকেই সাফার করতে হবে। পূর্বের রাগ ভুলে সে নাক টেনে চোখ টোখ মুছে
আস্তে করে রুমের দরজা খুলল। দরজা খুলতেই দেখে রুদ্র দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ফোন স্কল করছে। দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা যেন বলিউডের কোনো হিরো। তাকে দরজা খুলতে দেখে রুদ্র ঠোঁটে ভিলেনী হাসি এঁটে ভ্রুঁজোড়া নাচাচ্ছে। যার মানে দাঁড়ায়, ‘যাবি না তো দরজা খুললি যে, এই রাগ!’ ওকে দেখে স্পর্শী চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। তারমানে সে এখানে ঘাপটি মেরে তার কথা শুনছিল?যাহ্ এখন কি হবে?
পূর্বের মতো কান ধরিয়ে না রাখলেই হয় তার আগে পালাতে হবে। একথা ভেবে দরজা আঁটকানোর আগেই রুদ্র চট করে রুমের ঢুকে নিজে দরজা আঁটকে দিলো। ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে স্পর্শীর দিকে এগিয়ে শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বলল,

-‘ আমি বে/য়াদব পুরুষ? কি বে/য়াদবি করেছি? না করেই যখন অপবাধ দিলি এবার নাহয় করেই দেখায়? তুইও বুঝ, বে/য়াদব পুরুষ আসলে কাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি।’

-‘বে বে বেড়াতে যাব না? যাই রেডি হ হ হয়ে আসি।’

-‘আমার আর যেতে ইচ্ছে করছে না। তোকে বেয়াদবির মাত্রা বুঝাতে ইচ্ছে করছে তাই যাওয়া-যাওয়ি ক্যান্সেল।’

-‘ওহ! তাহলে তুমি যাও আমি এখন ঘুমাব।’

-‘আমি থাকলে সমস্যা কি? চল, আমিও তোর সঙ্গে ঘুমাব। এতে আমার কাজটাও সহজ হবে।’

-‘আমার সঙ্গে ঘুমাতে হবে না এমলির কাছে যাও। তোমাকে
আদরে সোহাগে ডুবিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিবে। সত্যি সত্যি আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, মাথা ব্যথা করছে, এখন যাও আর নিজের কাজ করো গিয়ে। আর তুমি না গেলে আমিই নাহয় চলে যাচ্ছি।’

একথা বলে যেতেই রুদ্র হেঁচকা টানে বুকে ফেলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। স্পর্শী ছাড়াতে চাইলে রুদ্র আরো শক্ত করে ধরে বলল,

-‘এত রাগ করলে চলবে?’

-‘আমি কারো উপরে রেগে নেই।’

-‘তাহলে কেঁদে কেটে চোখ মুখ কি করেছিস?’

-‘আমার স্বামী আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে না অথচ অন্য মেয়ের সঙ্গে বসে রসের আলাপ সারবে। আর আমি এসব শুনে দাঁত বের করে হাসব? ছাড়ো আমাকে, ধরবে না তুমি, যার কাছে গিয়েছিল তার কাছেই যাও।’

-‘এমলি বর্তমানে দেশে নেই। তোকে রাগানোর জন্যই তখন এমলির কথা বলেছি।’

-‘কেন বললে? আমাকে রাগাতে কষ্ট দিতে খুব ভালো লাগে? শান্তি পেয়েছো তো এবার?একটু বেড়াতে যেতে চেয়েছি তাই কত বাহানা। সব কাজ ঠিকই করো শুধু আমার বেলাতেই তোমার কাজ আর কাজ।’

-‘নির্বাচনের সময় দম ফেলারও সময় নেই, বিকাল বেলা মন টিকছিল না বলেই কাজ ফেলে তোকে আনতে গিয়েছিলাম। রোজ তো যেতে পারি না, পারবোও না। তাছাড়া এই সময়ে সবাইকে নিরাপদ রাখতে বাসাতেই থাকতে বলছি। কে কখন ক্ষতি করে ফেলে বলা যায়? আর এসব যদি তুইই না ভাবিস তাহলে কিভাবে হবে, এত অবুজ হলে চলবে?’

-‘এতকিছু জানি না আমি, আমার ঘুরতে ইচ্ছে করছে নিয়ে চলো, ব্যস। আর যাব নাই বা কেন আমার জলজ্যান্ত একটা তুমি আছো, তোমার আমি আছি, বাসাতে গাড়ি আছে, তাই কোনো অজুহাত চলবে না।’

-‘আপনার কাছে জলজ্যান্ত একটা আমি আছি তা বুঝলাম।
কিন্তু এই আমিটার যত্ন নেন, একটু বোঝার চেষ্টা করেন? শুধু শুধু অহেতুক রাগ করে কান্না করি উল্টে আমাকেই কষ্ট দিতে পারেন।’

-‘রাগ দেখালাম বলেই তো কাজ ফেলে ছুটে এলে নাহলে কী আসতে? আসতে না তো।’

-‘তোর ঘটে কি কখনোই সুবুদ্ধি হবে না? আমি চলে আসাতে বেচারা কাফির উপর দিয়ে কত চাপ যাচ্ছে, জানিস? তাকে এখন সবকিছু একা হাতে সামাল দিতে হবে।’

-‘বোনের খুশির জন্য ভাই একটু কষ্ট করুক। তাছাড়া ভাইয়া যদি জানে তুমি আমাকে নিয়ে বের হয়েছো তাই খুশিই হবে। এখন আমি যাই, ঝটপট রেডি হয়ে আছি।’

একথা বলে স্পর্শী সাইড কেটে দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।
ওর যাওয়া দেখে রুদ্র মিটিমিটি হেসে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
এক্ষুণিই বলল যাব না, হ্যান-ত্যান, আরো কত কি, মুহূর্তেই সব রাগ গলে জল। একটুপরে স্পর্শী দরজা খুলে উঁকি মেরে দেখে রুদ্র রুমে নেই।সে হাফ ছেড়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে
কালো রঙের একটা থ্রিপিচ পড়ে তৈরি হতে ড্রেসিংটেবিলের সামনের টুলে বসে পড়ল। স্কুল থেকে ফিরে সে রোজ গোসল সারে আজকে কান্নাকাটির জন্য দেরি হয়ে গেল। অবেলায় গোসল করতে দেখলে মরিয়ম বেগম বকবে থাকবে। মায়ের বকুনি থেকে বাঁচতে সে হেয়ার ড্রয়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে কাঁটা দিয়ে চুল বেঁধে নিলো। তারপর কপালে ছোটো একটা কালো টিপ পরে চোখে টানল কাজলের রেখা।ঠোঁটে লাগল স্টবেরী ফ্লেবারের লিপবাম। একহাতে স্বর্ণের ব্রেসলেট আগে থেকেই পরা আছে। এখন অন্যহাতে ড্রেসের সঙ্গে মিলিয়ে একগোছা কালো চুড়ি পরল। কানে কালো পাথরের টপ। গলাতে স্বর্ণের চেইনের সঙ্গে কালো পাথরের চমৎকার লকেট। এই সেট টা দাদীমা কিনে দিয়েছিল তাকে। সে টুল থেকে উঠে একটুদুরে গিয়ে দাঁড় নিজেকে পরখ করে মিষ্টি করে হাসল। যার মানে সাজটা একেবারেই মনমতো হয়েছে খুব খারাপ লাগছে না দেখতে। তারপর ওড়না দুই কাঁধে ফেলে ছড়িয়ে নিতেই কেউ বলে উঠল,

-‘ ম্যম,দয়া করে যদি একটু তাড়াতাড়ি করতেন খুব উপকার হতো। রাত বাজে সাড়ে ন টা, ফিরে আসতে হবে তাই না?’

-‘হুম, হুম, কেন নয়? হয়ে গেছে আমার, চলো চলো।’

একথা বলে স্পর্শী আগে আগে গটগট করে বেরিয়ে গেল।
রুদ্র হাফ ছেড়ে তার পিছু পিছু গেল। তারপর দু’জন বিদায় নিয়ে বাইরে এসে বাইকের জায়গায় গাড়ি দেখে স্পর্শী ঠোঁট উল্টো রুদ্রর দিকে তাকাল। বাইকে যেতে চেয়েছিল সে। রুদ্র তার দিকে না তাকিয়ে চুপ করে গাড়িতে উঠে ড্রাইভিং সিটে বসল। এর মানে গেলে গাড়িতেই যেতে হবে নতুবা ক্যান্সেল।
স্পর্শী রাগে গজগজ করে উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়েই উঠল।
গাড়ির জানালা খোলা। বাতাসের ঝাপটা এসে লাগছে তার খুশির ঝলক মাখা চোখে মুখে। বেহায়া ওড়না উড়ছে বড্ড অবাধ্যভাবে। না গাড়িতে করে যেতেও খারাপ লাগছে না বরং এতদিন পর রাতে এভাবে ঘুরতে পেরে খুশি লাগছে। সেই খুশি উপড়ে পড়ছে তার স্নিগ্ধ বদনে। রুদ্র আপনমনে ড্রাইভ করছে। স্পর্শী সিটে হেলান দিয়ে বসে তাকিয়ে আছে নক্ষত্রভরা ওই দূর আকাশের দিকে। নির্লজ্জ চাঁদটাও যাচ্ছে তাদের সঙ্গে। স্পর্শী চাঁদটার দিকে তাকিয়ে গভীরভাবে কিছু ভেবে বলে উঠল,

-‘রুদাশার কি খবর? সেও কি দেশের বাইরে?’

-‘না, সে আপাতত রুমবন্দি জীবন কাটাচ্ছে। সে কোথায় তা অজানায় থাক। আর শিহাব ভাই মানে রুদাশার হাজবেন্ডের রিকুয়েষ্টে ওর নামের সব কেস উয়িথ ড্রো করেছি। এইকথা
সে নিজেও জানে না। তবে শিহাব ভাই যেমন মানুষ তাকে মানুষ না বানিয়ে রুম থেকে বের করবে বলেও মনে হয় না।’

-‘বন্দি রেখে কাউকে পরিবর্তন করা আদৌও সম্ভব?

-‘সম্ভব, তবে সঠিক টেকনিক খাটাতে হবে। আমার বিশ্বাস এ কাজটা শিহাব ভাই খুব ভালো করে পারবে।’

নিজের কথা শেষ করে রুদ্র চট করে স্পর্শীর চুলের কাঁটা খুলে পেছনের সিটে ছুঁড়ে মারল। স্পর্শীর শ্যাম্পু করা চুল অবাধ্য হয়ে উঠতে লাগল জোরালো বাতাসে। তখন রুদ্র সামনে দৃষ্টি রেখেই স্পর্শীকে আদেশ করল তার দিকে সরে এসে কাঁধে মাথা রাখতে। এত সুন্দর মুহূর্তে স্পর্শী কেন জানি অবাধ্য হতে পারল না। সে রুদ্রর কথামতো সরে এসে আস্তে করে রুদ্রর কাঁধে মাথা রাখল। তখন রুদ্র একহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

-‘পেট কাপড় বেঁধে প্রেগনেন্ট সাজার কাহিনি কি? আসলে তোর মনে কি চলছে খোলাসা কর বল। আমি কোনো মজা করছি না তাই আশা করবো তুইও মজা করার কথা মাথায় আনবি না। তাছাড়া আমাকে এই মুহূর্তে ছুঁয়ে আছিস। আর আমাকে ছুঁয়ে যদি মিথ্যা বলিস তাহলে আমি মারা গেলেও যেতে পারি। এখন তুই ভাব সত্যি বলবি নাকি মিথ্যা বলবি।’

-‘ পৃথিবীতে স্বামীরা খারাপ হলেও প্রকৃত বাবারা কখনো তার সন্তানের অনিশ্চিত জীবন চাই না। আর আমি নিশ্চিত, ভবিষ্যতে তুমিও প্রকৃত বাবাদের একজনই হবে। ‘

To be continue………!!

প্রেম প্রার্থনা পর্ব-২৫

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[২৫]

-‘ আমার বাচ্চা বউটাকে আগে পেলে পুষে বড় করি তারপর যদি বেঁচে থাকি তখন আমার ছানাপোনার কথা ভাবা যাবে। কিন্তু না, আমি বাদে সবাই এখন থেকেই আমার ছানাপোনা নিয়েই চিন্তিত। তাদের কি করে বলি ছানাপোনার আগমনের কার্যক্রম সম্পূর্ণ হতে ঢের বাকি। ‘

অতঃপর রুদ্র মনের কথা মনে চেপে মরিয়ম বেগমের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। মরিয়ম বেগম একে একে জানালেন বর্তমানে রুদ্রই উনার একমাত্র জামাতা, হ্যান ত্যান আরো কত কি! এ কথা শুনে সামনে দন্ডায়মান মাঝ বয়সী ভদ্র মহিলা রুদ্রকে ভালো করে পরখ করলেন। মুখে তেলতেলে হাসি এঁটে এটা ওটা জিজ্ঞাসা করলেন। যত কম কথায় জবাব দেওয়া যায় রুদ্র তাই দিলো। তারপর সময় দেখে যাওয়ার কথা বলতেই
ভদ্র মহিলার অন্য কথার টাল টানলেন, ফিরে গেলেন কবে কার বাগানের বরই চুরি করতে গিয়ে ধরা খেয়েছিলেন সেই গল্পে। মরিয়ম বেগমও উনার কথায় রেশ ধরে সেই গালগল্পে
মজে গেলেন। ধীরে ধীরে টেনে আনলেন গ্রামের কোন চাচা কবে মারা গেছে, কোন বান্ধবী কার সঙ্গে ভেগেছিল, কে কে বাইরের দেশে স্যাটেল হয়েছে, পুরনো কলেজটা এখন আর নেই, সেখানে নাকি এখন ইটের ভাঁটা হয়েছে, কোন বান্ধবীর সঙ্গে যোগাযোগ হয় আর কোনটার সঙ্গে হয় না তার লিস্টও
দিলেন। কোন বান্ধবীর স্বামী নেশাখোর আর কারটা লুচ্চার ঘরে লুচ্চা, কে হুজুর বিয়ে করে হুজুরনী সেজেছে তাও বেশ গুছিয়ে গাছিয়ে উল্লেখ করলেন। নিজের বর্তমান অবস্থাসহ ছেলে মেয়েদের কথাও ইনিয়ে বিনিযে জাহির করতে ভুলল না। এতসব কথার ফাঁকে ফাঁকে ভদ্র মহিলা বার বার রুদ্রর মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। তীক্ষ্ণভাবে পরখ করছে হাবভঙ্গি।
বেচারা রুদ্র বার বার সময় দেখছে এখান থেকে গিয়ে তাকে প্রেস কনফারেন্সে উপস্থিত হতে হবে। প্রচারণার জন্য আজ নিজে বের হবে, এতদিন ছেলেপেলে প্রচার চালালেও আজ নিজেই রাস্তায় নামার কথা। দুপুরের লাঞ্চের একটা মিটিংও রেখেছে সেখানে উপস্থিত থাকাও জুরুরি। ওদিকে স্পর্শীরও
খোঁজ নিতে পারে নি এখনো, মেয়েটার পেট ব্যথা বাড়ল না কমলো কে জানে। এতদিন পর স্কুলে গিয়ে বান্ধবীকে পেয়ে
শান্তভাবে বসে থাকবে না নিশ্চয়ই,সে উড়ন্ত এক প্রজাপ্রতি। তার কাজই হলো তিড়িংবিড়িং করে লাফিয়ে লাফিয়ে চলা।
কিন্তু এতসব কাজ সারতে গেলে তাকে এখন যেতে কিন্তু এই
দুই মহিলার গল্পের তোড়ে সে চিপকে গেছে। উনারা না নিজে যাচ্ছে আর না তাকে যেতে দিচ্ছে, কী যে জ্বালা! উনাদের এ
রসের গল্পভঙ্গ করতে রুদ্র দুইবার বলল, ‘ঠিক আছে আন্টি আজ আসি তাহলে, ভালো থাকবেন।’
ওমা! রুদ্রর কথা দন্ড়ায়মান দুই ভদ্র মহিলার কেউ পাত্তা না তো দিলেনই না বরং উল্টে ভদ্র মহিলা বললেন,’ তা জামাই
কী দেশেই থাকবা নাকি বাইরের দেশে সেটেল হবা? এদেশে সুস্থ ভাবে বাঁচা যায়?”
উনার এই কথার প্রেক্ষিতে কিছু বলার আগে মরিয়ম বেগম জিজ্ঞাসা করলেন উনার কয়ছেলে মেয়ে, তারা কে কি করে। বাঁচাল মহিলা উনার পরিবারবর্গের কথা বলে চেহারায় এক
দাপুটে ভাব এনে গর্বে বুক ফুলিয়ে এটাও জানালেন, উনার জামাতা পাশের হসপিটালের ডাক্তার, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ।
টাকা পয়সার কোনো অভাব নেই, মাসে দু’বার বিদেশ যায়।
জামাতা পেয়েছেন লাখে একটা। আম্মা! আম্মা করে ডেকে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলে।
রুদ্র বিরস মুখে এদিক ওদিকে তাকাচ্ছে কাফি বারবার কল দিচ্ছে তাকে যেতে হবে। কিন্তু মরিয়ম বেগমকে একা রেখেও যেতে পারছে না, চারিদিকে মিছিল, প্রচারণার জন্য বিরোধী দলে ঝামেলা লেগেই আছে, এমতাবস্থায় একা ছাড়ার কথা প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু দুই বাঁচালের গল্পই সমাপ্ত হচ্ছে না যাবে কীভাবে! অনবরত একটার পর একটা চলতে আছে তাদের জীবনের গল্প কথা বিদায় জানিয়েও লাভ হলো না, গুরুত্বই দিলো না কেউ। তার এমুহূর্তে মনে হচ্ছে দুই মহিলার গল্পভঙ্গ করার মতো কঠিন কাজ পৃথিবীতে আর একটিও নেই। ঠিক সেই সময় ভদ্র মহিলার ডাক পড়ল। উনার কোমরে সমস্যা, ঠিকভাবে হাঁটতে পারে না, কোনো কাজ করতে পারে না তাই ডাক্তার দেখাতে এসেছে। তারপর গল্পের সমাপ্তি ঘটিয়ে কত
আফসোস করে উনাকে বিদায় নিয়ে যেতে হলো। উনার মুখ দেখে মনে হলো বিদায়পর্বে কষ্টে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছেন। খুব কষ্ট পাচ্ছেন এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আরো ঘন্টাখানিক গল্প করতে না পেরে। মহিলার মতিগতি এমন উনি যদি পারতেন ডাক্তারকেও বলতেন, ‘ডাক্তার সাহেব আপনি আর একঘন্টা অপেক্ষা করুন আমি গল্প শেষ করে আসছি।’যাক অবশেষে বিপদ হতে মুক্তি পেয়ে রুদ্র মরিয়ম বেগমকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। কিছুদূর গিয়ে মরিয়ম বেগমকে গাড়িতে বসিয়ে ডাক্তারের প্রেসক্রিবশন অনুযায়ী ওষুধগুলোও নিয়ে এলো। তখন মরিয়ম বেগম বললেন,

-‘যার সঙ্গে এতক্ষণ কথা বললাম একটা সময় সে আমার হেটার্স ছিল, কথা বলে বুঝলাম এখনো আছে। আমরা এক সঙ্গে পড়াশোনা করেছি। ওর নাম জেরিন খান। কিন্তু জেরিন নাম তার পছন্দ নয় এজন্য কেটে কুটে নাম রেখেছে জেরি।
আর বলল না ওর মেয়ে জামাই ডাক্তার, ডাক্তার না ছাই, সে
আজীবন মিথ্যা কথার হাঁড়ি। এক গলা পানিতে নেমেও যদি কেউ বলে ওর জামাতা এমবিবিএস জামাই থুরি ডাক্তার ; তাও এ কথা বিশ্বাস করবো না আমি। যদি তাই হতো তাহলে আমার জামাতার দিকে বার বার ঘুরে ঘুরে তাকাত না, ওকে আমি ভালো করে চিনি। ‘

মরিয়ম বেগমের কথা শুনে রুদ্র মিটিমিটি হাসছে। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে রসিয়ে রসিয়ে গল্প করে, হেসে, কত কথার আদান- প্রদান ঘটিয়ে এখন বলছে সেই মহিলা নাকি হেটার্স। অথচ গল্প চলাকালীন সময়ে দেখে মনে হচ্ছিল ঘনিষ্ঠ ফ্রেন্ডশীপ দু’জনের। অনেকদিন পর দেখা হওয়াতে মনপ্রাণ জুড়িয়ে
গল্প জুড়ে দিয়েছেন। অথচ আড়ালে আসতেই না আসতেই শুরু হয়ে গেল বদনাম, এরা পারেও বটে। তারপর রুদ্র সহি সালামতে মরিয়ম বাসায় পৌঁছে নিজের কাজে চলে গেল।
আজ এত কাজ কখন ফিরবে কে জানে! একটুপরেই বড় মাও ফিরে এলেন জানালেন কোনো সমস্যা হয় নি। তারপর দুই জা মিলে হাতে কাজ করে দুপুরের রান্নাও শেষ করলেন। বাসায় দাদীমা আর উনারা দুই জা কেউ নেই। তাই তিনজনে দুপুরের খেয়ে যে যার রুমে বিশ্রাম নিতে চলে গেলেন। স্কুল ছুটির পর স্পর্শী রিকাশার জন্য বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। সব স্টুডেন্টরা হুড়োহুড়ি করে বেরিয়ে যাচ্ছে স্কুলের গেট দিয়ে। রিকশার জন্য এদিক ওদিকে তাকাতেই দেখে অদূরে বাইকে হেলান রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে। পরনে হালকা বেগুনি টি-শার্ট ব্ল্যাক জিন্স আর চোখে সানগ্লাস। দাঁড়ানোর ভঙ্গি বলিউডের হিরোদের মতোই। সানগ্লাস থাকায় বোঝা যাচ্ছে না সে কোন দিকে তাকিয়ে আছে। তবে ধারণা করা যাচ্ছে তার চোখাদৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ। এই মুহূর্তে সে এখানে রুদ্রকে আশা করে নি তবে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে যখন পেয়েই দেখে তখন সহজে ছাড়বে না। রুদ্রকে দেখামাত্রই মনে পরিকল্পনা এঁটে নিয়েছে
ততক্ষণে। সে গুঁটিগুঁটি পায়ে সেদিকে হাঁটা ধরল। হেলেদুলে হেঁটে রুদ্রর সামনে গিয়ে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইল। না নিজে কোনো কথা বলল আর না মাথা তুলে তাকাল। হঠাৎ তার এমন মলিন মুখ দেখে রুদ্র ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল,

-‘কি হয়েছে, কেউ কিছু বলেছে?’

স্পর্শী না সূচক মাথা নাড়াল অর্থাৎ কেউ কিছু বলে নি।অথচ তার মুখটা শুকিয়ে আমচুর হয়ে আছে। রুদ্র আরো কিছু কথা জিজ্ঞাসা করলেও স্পর্শী ঠিকঠাক উত্তর দিলো না। স্পর্শী নিজে থেকে কিছু বলছে না দেখে রুদ্র আশেপাশে তাকিয়ে বাইকে বসতে বলতেই স্পর্শী বলল,

-‘তুমি যাও আমি এখন বাসায় যাব না।’

-‘যাবি না মানে? রাস্তার মধ্যে থাপ্পড় খেতে না চাইলে ঝটপট উঠে বস।’

-“বললাম তো আমি বাসায় যাব না।’

-”স্পর্শী এবার বেশি বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। এমনিতেই মেজাজ চড়ে আছে নখরা করলে একটা মাইরও মাটিতে পড়বে না।’

একথা শুনে স্পর্শী উল্টো ঘুরে একটা রিকশা ডাকতেই রুদ্র তার হাত ধরে টেনে বাইকে বসিয়ে বাইক স্টার্ট দিলো। স্পর্শী কিছু বলতে গেলে ধমকে তাকে থামিয়ে দিলো। বাইক চলছে
নিজ গতিতে। স্পর্শী মুখ গোমড়া করে রুদ্রকে ধরেও বসে নি বললেও ধরছে না। কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করলেও মুখ খুলছে না। বাসায় গিয়ে একে সাইজ করতে হবে। দিনকে দিন চরম বেয়াদব হচ্ছে মেয়েটা। আগে যা একটু আধটু ভয় পেতো এখন তাও পায় না। রুদ্রর গম্ভীর মুখ দেখে তখন স্পর্শী আমতা আমতা করে বলল,

-‘বাসায় যাব না আমি, কোথাও বেড়াতে নিয়ে চলো।’

-‘কাজ আছে আমার, অন্যদিন যাব।’

-‘না, আজই যাব, এখনই যাব মানে, এখনই যাব।’

-‘বলছি তো কাজ আছে আমার।’

-‘ তোমার কাজ তো সব সময়ই থাকে। আজ অবধি কখনো তো বলো নি তোমার কাজ নেই, বেড়াতে নিয়ে যাবে, অথবা বাইরে কোথায় খেতে নিয়ে যাবে। একগাধা সব খাবার এনে হাতে ধরিয়ে দাও যেন আমি দিনের পর দিন না খেয়ে থাকি।
নামী দামী রেস্টুরেন্টের খাবার এনে দিয়েই সব দায়িত্ব শেষ।
বউকে নিয়ে ঘুরাঘুরি করলে বউয়ের মন ভালো থাকে জানো না তুমি? আর আজকে খাবার টাবার কিচ্ছু লাগবে না আমি বাইকে করে তোমার সঙ্গে ঘুরব, লং ড্রাইভে যাব! এই মুহূর্তে পাখির মতো উড়তে ইচ্ছে করছে, তুমি আমাকে সঙ্গে দাও
ব্যস! আজ আমি কোনো কারণ বারণ অজুহাত শুনবই না। আমার এখন বেড়াতে ইচ্ছে করছে, তাই তুমি বেড়াতে নিয়ে যাবে, আর কোনো কথা না।’

-‘আমি তোর বাপের চাকর?’

-‘না, আমার।’

-‘ আবার বল হর্ণের শব্দে শুনি নি।’

-‘বললাম, তুমি স্বামী মানুষ চাকর হতে যাবে কেন? এসব তো মনে আনাও পাপ।’

-‘অথচ রাতে স্বামী মানুষের বুকের উপর পা তুলে বেঘোরে ঘুমাস। কখনো কখনো কিল ঘুষিও মারিস তখন মনে পাপ বোধ হয় না?’

-‘আ..সলে ইচ্ছে করে করি নি তো হয়ে যায়।’

-‘আজ সকালে বলেছিলাম আমার শার্ট আয়রণ করে দিতে
দিয়েছিলি?’

-‘এবার থেকে তোমার সব কথা শুনবো তাও নিয়ে চলো না প্লিজ! প্লিজ! প্লিইইজজ!”

রুদ্র কথা বাড়াল না বাসার পথের রাস্তায় মোড় নিলো। সেটা দেখে স্পর্শী চেঁচিয়ে অনেক রিকুয়েষ্ট করেও কাজ হলো না।
রুদ্র নিজের কথা ঠাঁট বজায় রাখতে মোড় পেরিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। তারপর হঠাৎই খেয়াল করল একটা হাত তার কোমরে আঁকিবুঁকি করছে। তার আবার ভীষণ কুতুকুতু। এই একটা জিনিসেই সে কাবু। রুদ্র নিষেধ করলেও স্পর্শী শুনল না বরং কতুকুতু দিতেই থাকল। কাতুকুতু এমন জিনিস নড়ে
উঠতেই হয়। ফলস্বরূপ রুদ্র মোড়ামুড়ি করতেই হাত কেঁপে উঠল সে জলদি ব্রেক কষে বাইক থামাতেই স্পর্শী খিলখিল করে হেসে উঠল। রুদ্র চোখ মুখ শক্ত করে স্বজোরে ধমকে উঠে পুনরায় বাইক স্টার্ট করতেই স্পর্শী শেষ চেষ্টা চালাতে
তার পিঠে মাথা রেখে আহ্লাদী সুরে গেয়ে উঠল,

“চলো না ঘুরে আসি অজানাতে
যেখানে নদী এসে থেমে গেছে।’

তবুও রুদ্র নিজের সিদ্ধান্তেই অটল। ততক্ষণে বাইকের গতি বাড়িয়ে দিয়েছে ফলে দশ মিনিটে তারা বাসার পৌঁছে গেল।
স্পর্শী বাইক থেকে নেমে করুণ দৃষ্টিতে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে মুখ গোমড়া করে বাসায় ঢুকে গেল। এতবার করে রিকুয়েষ্ট করেও রুদ্র তাকে নিয়ে গেল না। রুদ্র তার পেছনেই আসছে ফোনে কারো সঙ্গে কথা বলতে বলতে।তবে তার একটা কথা স্পর্শীর কানে গেঁথে গেল, ‘এমিলিকে বসতে বলো, আসছি।’ একথা শুনে সে রাগে দুঃখে কেঁদেই ফেলল। কাঁধের ব্যাগটা ড্রয়িংরুমের সোফায় ছুঁড়ে ফেলে চোখ মুছতে মুছতে নিজের রুমের চলে গেল। দাদীমা ডাকলেও জবাব দিলো না। স্পর্শী
নিজের রুমে গিয়ে পোশাক না বদলে সেভাবেই শুয়ে কাঁদতে লাগল। আর রুদ্রর বিরুদ্ধে অহরহ অভিযোগ দায়ের করল।
বিয়ের আগে রুদ্র তাকে বেড়াতে যেতো না। মূলত সে রুদ্রর সঙ্গে কোথাও যেতে চাইত না কারণ রুদ্রকে তখন সহ্য হতো না। কিন্তু বিয়ের পরও রুদ্র তাকে কোথাও নিযে যায় না, মুখ ফুটে বলেও না কোথাও যাওয়ার কথা। কেন এমন করে সে
ভেবে পায় না? পূর্বের কথা নাহয় বাদ দিলাম আজ এতবার বলার পরেও কি রুদ্র পারত না তাকে নিয়ে কোথাও যেতে?
অন্তত নদীর পাড় থেকে ঘুরে আসতে বা ক্যাম্পাসে একপাক চক্কর দিয়ে আসতে, বাইকে গেলে কতটুকুই বা সময় লাগত?
আচ্ছা বেড়াতে নাহয় না নিয়ে গেল এক প্লেট ফুচকা খাইয়ে মন ভোলানোর চেষ্টা করতে পারতো। নতুবা ফুটপাত থেকেই একটা গোলাপ দিতে পারতো। কিন্তু এসবের কোনোটা করা দূর মুখের উপর বলে দিলো তার কাজ আছে। ওর কাজ তো সবসময় থাকে। এতই যখন কাজ আছে তাকে আনতে গেল কেন? কে পা ধরেছিল যেতে? সে তো বলে নি, তাহলে? আর যখন গেলোই তখন একটু ঘুরতে নিয়ে গেলে কি হতো? ওর বেলায় যত রাজ্যের কাজ আছে অথচ এমিলির জন্য সময় ঠিকই আছে। ওয়েট, ওয়েট, আচ্ছা এতদিন পর ওই এমিলি এলো কোথা থেকে? তারমানে এমিলির জন্যই তাকে নিয়ে গেল না। এমন নানান কথা ভেবে সে রাগে অভিমানে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে একটা সময় ঘুমিয়ে গেল। মরিয়ম বেগম এসে ঠেলে, ধাক্কিয়ে, গুঁতিয়ে উঠাতেও পারলেন না। ডাকাডাকিতে বিরক্ত হয়ে মরিয়ম বেগমকে যেতে বলে তার রুমের দরজা আঁটকে আবার শুয়ে পড়লো। রুমের লাইট অবদি জ্বালাল না। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যার আজান দিচ্ছে তবুও সে উঠল না, সেভাবেই গোো ধরে শুয়ে রইল। এর ঘন্টা খানিক পরে কেউ দরজা নক করাতে খুব বিরক্ত হলেও সাড়া দিলো না, উঠে দরজাও খুলল না। অপর পাশের ব্যক্তিও যেন নাছোড়বান্দা একনাগাড়ে নক করেই যাচ্ছে। আর সহ্য করতে না পেরে সে চেঁচিয়ে বলল,

-‘কে রে বা*!’

-‘বা* না তোর মায়ের একমাত্র জামাতা।’

To be continue……!!!!

প্রেম প্রার্থনা পর্ব-২৪

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[২৪]

‘পরিস্থিতির যাতাকলে পড়ে সময় নাকি কথা বলে’ একথার সত্যতা স্পর্শী হারে হারে টের পাচ্ছে। সত্যি সত্যিই বর্তমান পরিস্থিতি সত্যতা দেখিয়ে দিচ্ছে, নিজ সুরে কথাও বলছে।
যত দিন যাচ্ছে সম্পর্কের গভীরতা বাড়ছে নিষ্ঠুর মানুষটার প্রতি মায়া জন্মাচ্ছে। যাকে সহ্য হতো না তার অনুপস্থিতিতে বক্ষপাশ অশান্ত করে তুলছে। ক্ষণে ক্ষনে মনে হচ্ছে একান্ত ব্যক্তিগত পুরুষটা ছাড়া নিঃশ্বাস ফেলাও কষ্টসাধ্য।আহা! কী
নির্বোধ ক্ষোভ! পরক্ষণে তার উপস্থিতিতে ওষ্ঠকোণে ফুটছে প্রানবন্ত উৎফুল্লের হাসি। যেন এই পৃথিবীর সমস্ত সুখ প্রিয় মানুষটার উপস্থিতিতেই বরাদ্দ। তার কথা বলা, মিটিমিটিয়ে হাসা, আড়চোখে তাকানো, রাগানোর ধরণ, প্রশ্রয়মিশ্রিত
ধমক, তার এসবকিছুতেই নিঁখাদ ভালোবাসা লেগে থাকে।
তার ব্যবহারেই সুস্পষ্ট হয় অব্যক্ত প্রেমানুভূতির কাব্যকথা।
সেই সঙ্গে চারদিকে ছড়ানো প্রেমময় বেহায়া বাতায়ন এসে ফিসফিসিয়ে জানিয়ে যায়, ‘সে তোমাকে ভালোবাসে।’এসব বুঝি বৈধ সম্পর্কের জোর, বিয়ে নামক বৈধতার কারিশমা!

এতক্ষণ মনে মনে এসব ভেবে স্পর্শী মাথা তুলে ঘুমন্ত রুদ্রর মুখপানে তাকাল। নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে মানুষটা।তার বুকে মাথা পেতে সে চুপটি করে রাত জাগছে। ঘুমকাতুরে মেয়েটার সব
ঘুম ছিনিয়ে নিয়েছে ঘুমন্ত পুরুষটা। তার ধ্যান জ্ঞান করতেই
আজ চোখের পাতায় ঘুম ধরা দিচ্ছে না, কীসব চিন্তারা এসে ভর করে অলস মস্তিষ্কে।সে পাশ ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা করবে তারও উপায় নেই। রুদ্র তাকে বাহুডোরে জাপটে ধরে আছে যেন ছাড়লেই চলে যাবে নতুবা হারিয়ে যাবে। যেহেতু চোখে ঘুম নেই, কথা বলার মানুষও নেই, তাই সে নিজস্ব ভাবনার অলিখিত এক গ্রন্থ খুলে বসেছে। যে গ্রন্থের আদি হতে অন্ত রুদ্রের অধিষ্ঠান। স্পর্শী সেই তখন থেকে ভেবে চলছে তার আর রুদ্রর বর্তমান আর ভবিষ্যতের কথা। আগামীতে তার কী হবে সেসব অবান্তর কথা। সময়ের অগ্রভাগে পরিস্থিতি আজ উল্টো ভ্রমে মজেছে। এই তো কিছুদিন আগেও সে চাচাতো ভাইকে বিয়ে করবে না, সংসার করবে না, বলে কত ঝামেলার সৃষ্টি করেছে। মনের ঝাল মিটাতে যখন যা ইচ্ছে তাইই বলে অপমান করেছে রুদ্রকে। কখনো ভাবে নি যাকে যা বলছি তা আদৌও ঠিক কী না। এসব শুনে মানুষটার কষ্ট হচ্ছে কী না। এসব ভাবার অবস্থাতেই ছিল না রাগে জেদে তার মন মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এমনকি সেই সময় বাবা-মাকে অনেক কথাও শুনিয়েছে রাগে ও অভিমানে মুখ ফিরিয়েও নিয়েছে। তখন যেই রুদ্রর পক্ষে কথা বলতো কেন জানি তাকেই শত্রু বলে মনে হতো। সেদিন যখন ওদের বিয়ে
আঁটকানো গেল না তখন রুদ্রর রাজনীতিটা তার কাছে বাঁধা মনে হলো। একাধারে মনে হতো রাজনীতির কারণে রুদ্রকে তার পছন্দ না, স্বামী হিসেবে মানতে পারে না।তাই রাজনীতি
থেকে রুদ্রকে সরানোর পরিকল্পনাও এঁটেছিল।কিন্তু রুদ্রকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে পরে আবেগী হয়ে নিজের ক্ষতি করতেও দ্বিধা করে নি। তবুও রুদ্র তার সিদ্ধান্তেই অনড়। সেই ঘটনার পরে রুদাশার কর্মেও রুদ্রকে থামানো গেল না কুটিল বুদ্ধি দ্বারা রুদাশাসহ তার বাবাকেও জব্দ করার ব্যবস্থা করলো।
বর্তমানে রুদ্রর সঙ্গে তার নানার বাড়ির সবার সম্পর্ক কেমন নড়বড়ে, দূর্বল। ছোটো মামা কিছুটা সুস্থ হয়ে চট্টগ্রামে ফিরে গেছে। রুদাশাকে কোন জেলে রাখা হয়েছে এই খবর কেউই জানে না, অনেকে ধারণা করছে রুদাশা বেঁচে নেই। রুদাশার বাবা মেয়ের সন্ধান পেতে কম চেষ্টা করে নি কিন্তু বারংবারই ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে উঠে পড়ে লেগেও মেয়েকে ছাড়াতে পারে নি রুদাশার বাবা। সেই বেচারা এখন নিজেও পলাতক। পুলিশ উনার বাড়ি ঘেরাও করে উনার সব ব্যাংক একাউন্ট লক করে দিয়েছে। ওই বেচারা বেশিদিন গা ঢাকা দিয়েও থাকতে পারবে না, কারণ রুদ্র নিজেও গোপনে
উনার খোঁজ চালাচ্ছে। তার গায়ে হাত তোলার কারণে আজ রুদ্র উনাদের বাবা মেয়েকে নাকি দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছে। তবুও
সে রাজনীতি ছাড়ছে না। দিনকে দিন একের পর এক ঘটনা
তাদের জীবনে আছড়ে পড়ছে। সুক্ষভাবে পরিবারের সদস্য দের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছে। অথচ এ একরোখা পুরুষটা
রাজনীতি ছাড়া তো দূর ভোটে দাঁড়িয়ে নিজেকে পাকাপোক্ত
ভাবে রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছে। এসব ঘটনা দ্বারাই স্পষ্ট এভাবে রুদ্রকে থামানো যাবে না। যত দিন যাবে রুদ্র আরো আগ্রাসী হয়ে উঠবে এজন্য তাকেই সংগোপনে
অন্য পথ অবলম্বন করতে হবে। আর সে সেটা করার জন্যই উঠে পড়ে লেগেছেও। এই পরিকল্পনায় হয়তো তার হবে জয় নতুবা ক্ষয়। জয়ে হবে সুদিন আর ক্ষয়ের হবে নিঃশেষ।দেখা
যাক রুদ্রর তাকে কি উপহার দেয়।

তবে এসবের মধ্যে যেটা হয়েছে সেটা হচ্ছে সে দিনকে দিন রুদ্রর প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছে। আর এদূর্বলতা তার মনে ভয় সৃষ্টি করছে, ছিঁটকে পড়ছে নিজের জায়গা থেকে,পরক্ষণেই আবার ভাবছে থেমে গেলে হবে না পরিকল্পনা সফল করতে হবে। সুস্থভাবে বাঁচার জন্য হলেও পরিকল্পনা সফল করতে হবে। এজন্য আগামীকাল রিপোর্টে কি আসে জানা দরকার।
তারপরে নাহয় নিজ পরিকল্পনায় আরো একটা ধাপ এগিয়ে যাবে। এতক্ষণ নিজের পরিকল্পনার কথা ভাবতে ভাবতে সে ঘুমে তলিয়ে গেছে। নিজের অজান্তে রুদ্রর শক্ত প্রশ্বস্ত বুকে নিদ্রালু হয়ে লুটিয়ে পড়েছে। শান্তিতে ডুবে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে প্রিয় মানুষটার বুকে মাথা রেখে, সাদা টি-শার্ট আঁকড়ে ধরে।
সেই অবস্থাতেই সময় কাটল, রাত পোহাল, সকাল’ও হলো।
রোজকার মতো সবাই নাস্তা সেরে যে যার কাজকর্মে বেরিয়ে গেল। আজ পেটে ব্যথা নেই বিধায় স্পর্শী স্কুলে গেছে, সঙ্গে গেছে বড় মা। দরখাস্তবিহীন স্কুল গ্যাপের কারণে এমনিতেই বাসায় গার্ডিয়ান কল আসতো, কাউকে না কাউকে যেতেই হতো। এজন্য উনি আগে প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলতে গেছেন যেন স্পর্শীকে স্যারদের কথা শুনতে না হয়। উনাদের স্কুলের গেটে নামিয়ে রুদ্র আর মরিয়ম বেগম গেছে রিপোর্ট আনতে। একেবারে রিপোর্ট দেখিয়ে ডাক্তার সঙ্গে কথা বলে
তারপরেই ফিরবেন। রুদ্র রিসিপশন থেকে রিপোর্ট কালেক্ট করে মরিয়ম বেগমকে নিয়ে ওয়েটিং রুমে বসে আছে।একটু
পরেই তাদের ডাক পড়বে। রুদ্রকে চিন্তিত মুখে বসে থাকতে দেখে মরিয়ম বেগম বললেন,

-‘রুদ্র!”

ডাকটা রুদ্রর কর্ণকুহুরে পৌঁছালেও সে মাথা তুলে তাকালো না। স্মার্টলি সেভাবেই বসে রইল মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
মরিয়ম বেগম পুনরায় কিছু বলার আগে সে স্বাভাবিকভাবে জবাব দিলো,

-‘আমি এমনিতেই খুব টেনশনে আছি মেজো মা। প্লিজ এমন কিছু বোলো না যাতে আমার টেনশনের মাত্রা বেড়ে যায়।’

-‘তুমি কি করে বুঝলে আমি এমন কিছু বলবো?’

-‘আমার মুখের দিকে এতক্ষণ তাকিয়ে থেকে গভীরভাবে কিছু চিন্তা করে অবান্তর কথা বলবে না এটা জানা কথা।’

-‘অবান্তর কথা নয় বাস্তব কথাটাই বলছি তোমার ইচ্ছে হলে
ভেবেচিন্তে উত্তর দিও।’

-‘বলো।’

-‘পেটে আঘাত পাওয়ার কারণে যদি আমার মেয়েটা কখনো মা হতে না পারে তখন কি করবে?’

-‘কথাটা বাংলা মুভির মায়েদের মতো হয়ে গেল না? তাছাড়া স্পর্শী মা হতে পারবে না কেন এটা বুঝাও আমারে? বুঝতে পারছি কেন কথাটা বললে তারপরেও বলি সেদিনের ঘটনায় যদি তার সমস্যা হয়েও থাকে এর চিকিৎসা আছে। এইদেশে সেই চিকিৎসা না থাকলে বাইরের দেশে আছে।’

-‘উন্নত চিকিৎসা তো আমিও করিয়েছে কই আমার তো…!’

-‘মেজো মা, নেগেটিভ চিন্তাধারা সুফল বয়ে আনে এমনটাও কিন্তু নয় তাই এসব ভেবো না। হয়তো তুমি মনকে বুঝ দিতে আমার থেকে এমন কিছু শুনতে চাচ্ছো, যেটা শুনে তোমার অশান্ত মন শান্ত হয়। কিন্তু আমি তোমার মনকে শান্ত করতে মিথ্যা আশ্বাস দিবো না। যদি স্পর্শী কখনো মা হতে না পারে আমি আবার বিয়ে করবো।’

একথা শুনে মরিয়ম বেগম বিষ্ময়ে কথা বলতেই ভুলে গেল।
হতবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন রুদ্রর মুখ পানে। কিয়ৎক্ষণ সেইভাবেই তাকিয়ে থাকতে দেখে রুদ্র চট করে উনার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে হাত দুটো ধরে বলল,

-‘আরে রিল্যাক্স! রিল্যাক্স! মজা করছি আমি, আমার পুরো কথাটা শোনো। আমি তোমার মেয়েকেই বিয়ে করবো এটাই বলতে চাচ্ছিলাম।’

মরিয়ম বেগম রুদ্রর হাত থেকে হাত সরিয়ে নিতে গেলে রুদ্র উনার দু’হাতের উপর চুমু এঁকে বলল,

-‘আমার নিজের মায়ের থেকে তোমাকে কোনো অংশে কম ভালোবাসি না মেজো মা। নরমাল হও প্লিজ! এত হাইপার হলে তোমার প্রেশার বেড়ে যাবে। আমি সত্যিই মজা করেছি, সরি সরি আর করবো না।’

-” মা হতে না পারার যন্ত্রণা কতটা পীড়াদায়ক যদি বুঝতি তাহলে এমন মজা করতে পারতি না। আমি মা হতে না পারা এক ব্যর্থ নারী। আমি যে পথের পথিক আমি চাই না আমার মেয়েটাও একই পথের পথিক হোক। যেসব দিনের সম্মুখীন হয়েছি স্মরণেও আনতে পারি না আমার মেয়ে এমন দিনের সম্মুখীন হোক এজন্য খুব ভয় হয়।’

-‘তোমার কথা অনুযায়ী যদি স্পর্শী কখনো মা হতে না পারে তখন কি করবো এটাই শুনতে চাচ্ছো তো? মেজো মা, মুখে তো অনেক বড় বড় কথা বলা যায়। বড় কথা বলে কতজন
সেসব কথার রাখে, বলো তো আমায়? জীবনটা বক্ররেখা। জীবনের যাত্রা কখন কোনদিক দিয়ে শুরু হয় তা বলা যায়?
আমি জানিনা আমাদের ভাগ্যকে কি লেখা আছে তবে যদি তোমার ভয়ের কারণ সত্যিই হয় তাহলে আমিও এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবো।’

-‘সেই কঠিন সিদ্ধান্ত টা কি? পুনরায় বিয়ে?’

-‘উহুম! বাবা ডাক না শুনেও আমার মেজো বাবা যেমন যত্নে আগলে রেখেছে তোমায়। তোমার ব্যর্থতাকে নিমূল করতে একটা পুষ্পকলি এনে দিয়েছে তোমার কোলেবুকে। আমি মেজো বাবার মতো এত হৃদয়বান হতে না পারলেও আমার মতো করে স্পর্শীকে আমার কাছেই রেখে দিবো আজীবন।
মৃত্যুব্যতীত তাকে কখনো আমার থেকে দূরে যেতো দিবো না যদিও না সে চায়। আর বাচ্চা কাচ্চার ব্যাপারটা পরে ভাবা যাবে। কারণ আমি জানি আমার ভাগ্য একটা অপ্রসন্ন হবে না।’

রুদ্রর বলা কথা শুনে মরিয়ম বেগম ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
তারপর রুদ্র কোনোমতে উনাকে সামলে ডাক্তারের চেম্বারে প্রবেশ করল। ডাক্তার মনযোগ সহকারে রিপোর্ট নেড়ে চেড়ে দেখে জানালেন কোনো সমস্যা নেই, সবকিছু নরমাল। তবে একবার যখন আঘাত পেয়েছে তখন এখন থেকেই সাবধানে থাকতে হবে, ভারী জিনিসপত্র তোলা নামা থেকে সর্তক হতে হবে, বিশেষ করে পিরিয়ডের সময়। বাঙালি নারীরা এ সময় শরীরের হেলাফেলা করে নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনে।
আর অবশ্যই তাকে চোখে চোখে রাখতে হবে যেন ওই ঘটনা
পূনরাবৃত্তি না হয়। একবার বেঁচে গেল মানে এই না বারবার বেঁচে যাবে। আর মোদ্দাকথা স্পর্শী মেয়ে মানুষ আজ অথবা কাল তাকে সন্তান জন্ম দিতে হবে। সন্তান জন্ম দেওয়ার এই জার্ণিটা মোটেও সোজা কথা নয়। তখন যাতে সমস্যা না হয় এজন্য এখনই এত সর্তকতা। এসব নানান উপদেশপূর্ণ কথা বলে ডাক্তার মেডিসিন লিখে মরিয়ম বেগমকে বাইরে যেতে বললেন। ডাক্তার উনার থেকে কিছু লুকাচ্ছে ভেবে মরিয়ম বেগমের মুখটা শুকিয়ে গেল। এইেব্যাপারটা বিজ্ঞ ডাক্তার খেয়াল হেসে বললেন,

-‘মিসেস মরিয়ম আপনার মেয়ের কোনো সমস্যা নেই, ভয় পাবেন না। আসলে রুদ্র আপনার ছেলে+ বর্তমানে জামাতা।
শাশুড়ির সামনে অনেক কিছু বলা যায় না। আমরা ডাক্তার, লাজ লজ্জা নেই বললেই চলে। কিন্তু কিছু কথা মুখের উপর বলে দিলে আপনারা অস্বস্তিতে ভুগবেন এজন্য বাইরে যেতে বললাম। রুদ্র আমার চেনাজানা বলে তার জন্য এটুকু করা, নয়তো কে কার শাশুড়ী আর কে কার জামাতা এত দেখার সময় আমাদের হাতে নেই। এরপরেও যদি আপনার কোনো ডাউট থাকে তাহলে বসতে পারেন। আর রুদ্র তোমরা এখন স্বামী-স্ত্রী, একসঙ্গে এক রুমে থাকো, তুমিও শক্ত সার্মথ্যবান যুবক, তোমাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে নিশ্চয়ই। ‘

ডাক্তারের বলা সর্বশেষ কথা কানে পৌঁছাতেই মরিয়ম বেগম পড়িমরি করে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন। ছিঃ! ছিঃ! মা হয়ে এসব কথা কানে শোনা যায়? বলার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেলে ভালো হতো। জামাইয়ের সামনের কি সব কথাবার্তা।
আর ডাক্তারের লজ্জা নেই তা যেন হাতেনাতে প্রমাণও দিয়ে দিলো। ডাক্তারের সামনে রুদ্র নিরুত্তর হয়ে বসে আছে। তার দৃষ্টি ডাক্তারের টেবিলে থাকা টুইন বেবিদের ছবিটার দিকে।
মরিয়ম বেগমকে যেতে দেখে ডাক্তার খোলামেলাভাবে কথা শুরু করলেন,

-‘স্পর্শীর বয়স একেবারেই অল্প তার উপরে এ বয়সে বিয়ে!
যেটা মোটেও ঠিক হয় নি। যাই হোক ফ্যামিলি ম্যাটারে কথা না এগোয়। অপরিপক্ক বয়সে বিয়ে, শারীরিক সম্পর্ক, সন্তান জন্মদান কতটা ঝুঁকিপূর্ণ আপনাকে বলতে হবে না নিশ্চয়ই।
তবুও ডাক্তার হিসেবে শুধু এইটুকুই বলছি আপনার ওয়াইফ এখন যেন কনসিভ না করে। এতে মা ও বাচ্চা দুজন ঝুঁকিতে পড়তে পারে। আপনাদের দু’জনের বয়স অল্প, আবেগ বেশি
সঙ্গে ভুলের সংখ্যাটাও। তাই আবারও বলছি আপনি নিজে সর্তক হবেন আর খেয়াল রাখবেন আবেগের বশে ভুল যেন নাহয়।’

রুদ্রর উনার কথায় সম্মতি দিয়ে প্রেসক্রিবশন নিয়ে বেরিয়ে এলো। একটুদূরে দাঁড়িয়ে আছে মরিয়ম বেগম। চেনা কারো সঙ্গে রাজ্যের গল্পের জুড়ে দাঁত বের করে হাসছে। রুদ্র তার বিরক্তিকর মেজাজ নিয়ন্ত্রণে এনে সেদিকে পা বাড়াল। আর
যেতে যেতে ডাক্তারের কথাগুলো পুনরায় স্মরণ করে মনে মনে বলল,

-‘ আমার বাচ্চা বউটাকে আগে পেলে পুষে বড় করি তারপর যদি বেঁচে থাকি তখন আমার ছানাপোনার কথা ভাবা যাবে। কিন্তু না, আমি বাদে সবাই এখন থেকেই আমার ছানাপোনা নিয়েই চিন্তিত। তাদের কি করে বলি ছানাপোনার আগমনের কার্যক্রম সম্পূর্ণ হতে ঢের বাকি। ‘

To be continue…………!!

প্রেম প্রার্থনা পর্ব-২৩

0

#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[২৩]

-‘আমার রুমের দরজা খোলা থাকবে। রাতের খাবার খেয়ে
ভদ্রমেয়ের মতো সোজা এই রুমে চলে আসবেন। লজ্জায় পড়ি মরি করে যেন অন্য রুমে যাওয়া নাহয়।’

-‘সবার সামনে দিয়ে তোমার রুমে আসতে লজ্জা লাগে।’

-‘ কেন, লজ্জা লাগবে কেন? আমি কি পাশের বাসার অচেনা পরপুরুষ?’

-‘ তা না আসলে..! ”

-‘আসলে নকলে আপনার কাছেই রাখুন। শুধু যতটুকু বলছি ততটুকুই করে আমাকে ধন্য করুন।’

-‘দাদীমাকে বলেছিলাম আজ দাদীমার সঙ্গে ঘুমাব।’

-‘এখন গিয়ে বল আমার সঙ্গে ঘুমাবি।’

-‘ইশ! বাজে দেখায় না ব্যাপারটা?’

-‘দেখাক।’

একথা বলে রুদ্র শার্টের বোতাম খুলে বিছানার উপর বসল।
ঘামে ভিজে গেছে ওর পরনের শার্ট। কপাল, ঘাড়সহ কানের পাশ দিয়ে বেয়ে ঝরে যাচ্ছে সরু ঘাম। রুদ্রকে ঘামতে দেখে
স্পর্শী শরবতের গ্লাস রুদ্রর হাতে ধরিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল দাদীমার ঘরে। দাদীমা মনের সুখে পান বানাচ্ছেন আর গুনগুন করতে গান গাইছেন। উনার সামনে টিভিতে চলছে জলসার রোজকার সিরিয়াল। স্পর্শীকে পাশে বসতে দেখে দাদীমা একনজর তাকিয়ে টিভি দেখায় মন দিলেন। এ সময় কথা বলতে আগ্রহী নন তিনি। স্পর্শী কাজ না পেয়ে নিজেও টিভি দেখাতে মন দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। মনের মধ্যে অশান্তি নিয়ে টিভি দেখা যায়? উফ রে! বিরক্ত আর বিরক্ত।
স্পর্শীকে উশখুশ করতে দেখে দাদীমা কিছু বলার আগে সে হনহন করে বেরিয়ে এলো। বড় মা আর তার মা খাবার এনে টেবিলে রাখছে। স্পর্শীর বাবা আর বড় বাবা ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছেন আর কীসব আলোচনা করছেন। সবাই কিছু না কিছু ব্যস্ত। স্পর্শী রান্নাঘরের সামনে গিয়ে কিছু করার উদ্দেশ্যে দাঁড়াল ঠিকই কিন্তু কোনো কাজই চোখে পড়ল না।
ফলস্বরূপ নখ কামড়ে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে বড় মা আর ওর মায়ের মুখে মুখে তাকাচ্ছে। মেয়েকে মুখের দিকে বারংবার তাকাতে দেখে মরিয়ম বেগম জিজ্ঞাসা করলেন কিছু লাগবে না কি? সে পরপর মাথা নাড়িয়েছে অর্থাৎ কিছুই লাগবে না এমনিই দাঁড়িয়ে আছে। খাবার টেবিল সাজানো হয়ে গেলে
সবাই এসে যে যার চেয়ার টেনে খেতে বসেছে৷ বড়দের মধ্যে টুকটাক কথাবার্তা চললেও স্পর্শী আর রুদ্র তারা খাওয়াতে মগ্ন মাঝেমধ্যে দু’জন দু’জনের দিকে তাকাচ্ছে, চোখাচোখি হয়ে গেলে চোখ সরিয়ে নিচ্ছে।মরিয়ম বেগম স্পর্শীর মাছের কাটা বেছে দিচ্ছেন আর সে খাচ্ছে। গালগল্পের মাঝেই রুদ্র
খাওয়ার প্রায় শেষের পথে। ছেলেটা ছোটো থেকেই এত দ্রুত খায় যেন হাজারটা কাজ মাথায় নিয়ে খেতে বসে। ধীরেসুস্থে খেলে মহাভারত অসুদ্ধ হয়ে যাবে। রুদ্রর খাওয়া শেষ। এঁটো বেসিনে হাত ধুয়ে রুদ্র তার মাকে বলল,

-‘আম্মু, আমি রুমে যাচ্ছি এক মগ কফি পাঠিও তো।’

-‘আচ্ছা যাও, পাঠাচ্ছি আমি।’

একথা বলে রুদ্র স্পর্শীর দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। রুদ্র যেতেই স্পর্শীও ছাদে যাওয়ার পায়তারা আরম্ভ করলো। কিন্তু খাওয়া শেষ না করে ওষুধ না খেলে মরিয়ম বেগম উঠতে দিচ্ছে না। ততক্ষণে বড় মা খেয়ে চুলার উপরে কফির পানি বসিয়েছেন। স্পর্শী যখন দেখলো রেহাই নেই তখন বেজার মুখে খাবার শেষ করে ওষুধ খেয়ে বড় মায়ের কাছে গেল। বড় মাকে কিছু বলতে হলো না উনি মুখ দেখে সব কিছু বুঝে মুচকি হাসলেন। তারপর কফির মগ স্পর্শীর
হাতে ধরিয়ে দিয়ে সাবধানে যেতে বললেন। স্পর্শীও এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা রুদ্রর রুমে গিয়ে হাঁফ ছাড়ল। ওর হাঁফ ছাড়া দেখে রুদ্র কান থেকে ফোন সরিয়ে কফির মগটা হাতে নিয়ে আদেশ করলো রুমের দরজা আঁটকে দিতে। ওর কথামতো স্পর্শী তাই করে ঘুরতেই রুদ্র বলল রুমের লাইট অফ করে ড্রিম লাইটটা অন করে দিতে। তারপর একগ্লাস পানি দিতে, এরপর বিছানা ঝেড়ে দিতে, বেলকনির দরজাও আঁটকে দিতে, এসির পাওয়ার বাড়াতে, ফোনটা চার্জে দিতে,
এভাবে একের পর এক কাজ করিয়ে বসতেই রুদ্র পুনরায় কিছু বলার আগে স্পর্শী খ্যাঁক করে বলে উঠল,

-‘এসব করতে ডেকেছো আমায়? আমি তোমার চাকর?’

-‘তা নয় তো কি?’

-‘তুমি আমাকে চাকর বললে? আমি তোমার চাকরর! নিজে ডেকে এনে এখন এসব বলে অপমান করছো? ঠিক আছে চলে যাচ্ছি আমি আর আসবই না তোমার রুমে।’

একথা বলে চলে যাওয়ার আগেই রুদ্র উঠে তার পথরোধ করে দাঁড়াল। ভ্রুঁকুটি করে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে স্পর্শীর নাক টেনে ধরে বিছানায় বসাল। তারপর আলমারী থেকে অনেক বড় একটা বক্স বের করে স্পর্শীর সামনে রেখে পাশে শুয়ে পড়লো। এত বড় বক্স দেখে স্পর্শী আড়চোখে একবার তাকাতেই রাগ গলে জল হয়ে গেল।কৌতুহলবশত বক্স খুলে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।বক্সের মধ্যে অনেকগুলো শাড়ি গয়নাসহ মেয়েলি সাজগোছের জিনিস। স্পর্শী হাঁটমুড়ে বসে একটা করে জিনিস বের করছে নেড়ে চেড়ে দেখে একগাল হেসে পাশে রাখছে। সবকিছু বের করে দেখে এখানে আটটা শাড়িও আছে। শাড়ি গুলোর রং এক একটা একেক কালার।
শাড়ির গুলোর নাম না জানলেও শাড়িগুলো তার খুব পছন্দ হয়েছে। সবগুলো শাড়ি দেখে স্পর্শী সোনালি পাড়ের সিঁদুরে লাল শাড়িটা নিজের গায়ে ধরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছে।
শাড়ি এত সুন্দর দেখেই পরতে ইচ্ছে হচ্ছে।যদিও শাড়ি টাড়ি পরতে পারে না তবুও কেন জানি এই মুহূর্তে মন টানছে।আগ বাড়িয়ে শাড়ি পরতে লজ্জা লাগছে। কিয়াৎক্ষণ ধরে শাড়িটা
গায়ে ধরে যখন রাখতে যাবে তখন রুদ্র বলল,

-‘যা শাড়িটা পরে আয়। লিলিপুটকে শাড়িতে কেমন দেখায় দেখি।’

-‘কার কাছে যাব?’

-‘থাক, কারো কাছে যেতে হবে না এদিকে আয় আমি পরিয়ে দিচ্ছি।’

-‘তুমি শাড়ি পরাতে পারো?’

-‘না, ইউটিউব দেখে শিখে নিতে কতক্ষণ।’

-‘ কিহ!’

-‘এত চেঁচানোর কি আছে? এদিকে আসতে বলছি আয় নতুবা খবর আছে তোর।’

-‘কিন্তু ব্লাউজ নেই তো শাড়ি কেমনে পরবো?’

-‘ব্লাউজ ছাড়াই পরাবো, আয়।’

একথা শুনে স্পর্শী শাড়িটা নিয়ে একছুটে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রুদ্রর কাছে নাকি শাড়ি পরবে, কি লজ্জা! কি লজ্জা!
তাও নাকি ব্লাউজ ছাড়া। এ অসভ্য পুরুষটার মুখের লাগাম
কি দিন দিন খুলে যাচ্ছে? হোক না বিয়ে করা বর তাতে কি?
বর হলে কী সব লজ্জা খুঁইয়ে তার কাছে শাড়ি পরতে হবে?
না, না, একাজ তার দ্বারা সম্ভব নয় এরচেয়ে বড় মা অথবা তার মায়ের কাছে যাওয়া উত্তম। উনারা এতরাতে শাড়ি পরতে দেখে হয়তো হাসবেন লজ্জা দিবেন তবুও ওই বেহায়া রুদ্রর থেকে এই ঢের। শাড়ি হাতে বের হতেই সে তার মায়ের সামনে পড়ে। মরিয়ম বেগম নতুন শাড়ি হাতে দেখে জিজ্ঞাসা করেন,

-‘ঘুমাস নি এখনো আর তোর হাতে এটা কার শাড়ি?’

-‘ভাইয়া দিয়েছে।’

-‘পরতে বলেছে নাকি দেখতেই দিয়েছে?’

-‘না মানে আসলে…।’

মেয়েকে লজ্জায় নতজানু হয়ে তোতলাতে দেখে মরিয়ম বেগম ঠোঁট চেপে হাসলেন। তারপর স্পর্শীকে রুমে নিয়ে গিয়ে সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে চুলে খোঁপা করে একটা লাল ফুল গুঁজে দিলেন। তারপর কথা বাড়িয়ে মেয়েকে অহেতুক লজ্জায় না ফেলে নিজের কাজে মগ্ন হলেন। মাকে ব্যস্ত হতে দেখে স্পর্শী শাড়ি ধরে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে রুদ্রর রুমের দিকে যেতেই বড় বাবার মুখোমুখি হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। উনার পেছনে বড় মাও ছিলেন তা খেয়াল করে দৃষ্টি এদিক ওদিক ঘুরাতে লাগল আর মনে মনে দোয়া করল যেন কেউ কিছু জিজ্ঞাসা না করে। লজ্জায় তার গাল দুটো আরো লাল হয়ে উঠেছে। বড় বাবা আর বড় মা একে অন্যের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে বিনাবাক্যে তাকে যেতে সাইড দিলো। স্পর্শী থুতনী বুকের সঙ্গে ঠেঁকিয়ে নত মস্তকে কিছুদূর যেতেই শুনতে পেল উনাদের হাসির শব্দ। উনাদের হাসির শব্দে সে নিজেও হেসে ফেলল। কেন জানি বুকের মধ্যে ধুকপুক করছে। না রুদ্রকে এসব বুঝতে দেওয়া যাবে না নয়তো তাকে পঁচিয়ে খুব মজা নিবে, এসব ভেবে সে নিজেকে সামলে রুদ্রর রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি মারল। রুদ্র উপুড় হয়ে হয়ে আছে। পাশে পড়ে আছে রেখে যাওয়া শাড়িগুলো। রুদ্রর চোখজোড়া বন্ধ তার পা ঝুলছে বিছানার বাইরে। এটুকু সময়ের মধ্যে ঘুমিয়ে গেল নাকি কে জানে। সে গলা খাঁকারি দিয়ে রুদ্রর দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাশে বসেছে। রুদ্র চোখ খুলে স্পর্শীকে দেখে অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়াল। সম্মুখে বসে থাকা স্পর্শীর মাথা থেকে পা অবধি পরখ করে আলমারি থেকে আরেকটা বক্স বের করে স্পর্শীর মুখোমুখি বসল। বক্সের ভেতর আরো অনেক বক্স। সবগুলোই গয়নার বক্স। সে এক একটা করে সব বক্স খুলতেই দেখা গেল বাহারি ডিজাইনের সব গয়না। কি সুন্দর ইউনিক ডিজাইন! কৃত্রিম লাইটের ঝলকানিকে গয়নাগুলো চকচক করছে। বিয়ের কণে সাজাতে মাথা থেকে পা অবধি যেসব গয়না লাগে সব আছে এখানে। গয়নার সব বক্স খুলে
রাখায় বিছানাজুড়ে শুধু গয়না আর গয়না।এতগুলো স্বর্ণের গয়না দেখে স্পর্শী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। বিশেষ কোন উপলক্ষবিহীন এত গয়না দেওয়ার কারণ বোধগম্য হচ্ছে না তার। ততক্ষণে রুদ্র স্পর্শীকে গয়না পরানো শুরুও করেছে। স্পর্শীর পরনের শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে সিম্প্যাল কিছু গয়না পরাতেই স্পর্শী বলল,

-‘এগুলো সব আমার? কিন্তু কি উপলক্ষে দিলে? আমার জন্মদিন আসতে তো অনেক দেরি।’

-‘বউকে গয়না দিতে উপলক্ষ লাগবে?’

-‘না, তা না কিন্তু হঠাৎ এত গয়না তাই বলছি আর কি।’

-‘মন চাইল তাই। তাছাড়া সাদামাটাভাবে বিয়ে হয়েছে মনে মনে হয়তো এই নিয়ে আফসোস করিস এজন্য..।’

-‘আফসোস থেকে যদি এতসব কিছু পাওয়া যায় তবে আমি সারাজীবন আফসোসে ডুবে মরতে চাই। আর তুমি আমাকে আফসোস করতে দেখে এতএত শাড়ি গয়না দিবে, ওকে?’

-‘শখ কতো মেয়ের, খেয়ে আর কাজ নেই আমার।’

-‘তুমিই তো বললে।’

-‘মোহরানার টাকা পরিশোধ না করে বউকে নাকি স্পর্শ করা ঠিক না। তোর মোহরানার টাকা আলমারিতে আছে তাছাড়া বিয়েতে বউকে যেসব হাজিবাজি দিতে হয় সবকিছু দিলাম। এবার বউ আমার, স্পর্শও আমার।’

-‘কিহ্! তারমানে তুমি আমাকে স্পর্শ করতে এসব দিলে?’

-‘ তোর পেটে ব্যথার কি অবস্থা?’

-‘জোরে হাঁটলে চিনচিন করে উঠছে।’

-‘এছাড়া আর কোনো সমস্যা? ‘

-‘না, রিপোর্টে যে কি আসবে চিন্তা হচ্ছে খুব।’

-‘রিপোর্টে যা আসে আসে ওসব নিয়ে তোকে ভাবা লাগবে না। তোর কাজ, খাবি, দাবি, ঘুরবি, ফিরবি আর মন দিয়ে পড়াশোনা করবি, ব্যস এইটুকু করলেই আমি ধন্য।’

-‘হুম, আচ্ছা শোনো আরেকটা কথা। তুমি এতকিছু থাকতে বাজপাখি মার্কায় ভোটে দাঁড়ালে কেন আর কিছু পেলে না?’

-‘ বাজপাখি খারাপের কি হলো?’

-‘এটা না নিয়ে একেবারে বদনা মার্কা নিতে। মিছিলে তোমার ছেলেপেলেরাও গর্ব করে বলতে পারত, তোমার ভাই আমার ভাই, রুদ্র ভাই! রুদ্র ভাই! রুদ্র ভাইয়ের মার্কা কি? বদনা ছাড়া আবার কি।’

একথা বলে স্পর্শী খিলখিল করে হাসতে লাগল। ওর হাসি দেখে রুদ্র তাকে কাছে টেনে শুয়ে পড়ে গলায় মুখ ডুবাতেই স্পর্শীর হাসি থেমে গেল। চোখ মুখ খিঁচে শ্বাস আঁটকে অনড় হয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর রুদ্র তার গলায় একটা বাইট দিয়ে ফিসফিস করে বলল,

-‘পেট ব্যথার কারণে আজও ছাড়া পেয়ে গেলি। নয়তো ঠিক এ মুহূর্তে উন্মাদের মতো আদরের আলপনা আঁকতাম তোর সর্বাঙ্গে। একটু একটু করে বুঝাতাম ব্যাকুলতার মাত্রা। তবে এই ছাড় আর বেশিদিন পাবি না; যথাশীঘ্রই ধরা দিতে হবে আমাকে কাছে, এখন থেকেই নাহয় প্রস্তুত হ।’

To be continue…….!!