বেড়াজাল পর্ব-২১+২২

0
360

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #২১

মাঝে কেটে গেছে চারটে দিন। সময়ের সাথে কিছু কিছু সম্পর্কেও খনিক হলেও বদল এসেছে।
.
.
সকলের সূর্যের কিরণটা হয় বেশ অন্যরকম ভালোলাগার জিনিস তখন না থাকে সূর্যের এতো তেজ না থাকে প্রখর উত্তাপ। সেই কিরণই সকাল সকাল চন্দ্রার ঘরের জানলার পর্দা ভেদ করে এসে পড়লো তার মুখে। কিছুক্ষন চোখ পিটপিট করে চোখ খুললো চন্দ্রা। প্রথমেই নজর দিলো দেওয়াল ঘড়িটার দিকে, ঘড়ি দেখে তো চন্দ্রার চক্ষু চড়কগাছ। ঘড়িতে পরিষ্কার সময় দেখাচ্ছে ৯:১৫।
চন্দ্রার কপালে হাত কোনোদিন তো তার এতো লেট হয়না উঠতে। যদিও কয়েকদিন তার অক্লান্ত পরিশ্রম গেছে, তাও সে অ্যালার্মের প্রথম রিংয়েই উঠে যায়। তাহলে আজ ঘড়ির দিক থেকে চোখ সরিয়ে চন্দ্রা বালিশের পাশ থেকে মোবাইল তুলে দেখলো নাহ্ অ্যালার্ম তো বেজেছে দেখাচ্ছে। তাহলে কি সে শুনতে পায়নি..?
এসব ভাবতে ভাবতেই যেই বিছানা ছেড়ে উঠতে যাবে ওমনি পেটের কাছে রাখা শক্তপোক্ত হাতটা জানো একটু জোরেই টেনে মিশিয়ে নিলো তার সাথে। হালকা করে নাক ঘষে দিল ঘাড়ে। চন্দ্রা শিউরে উঠলো যদিও এইরকম প্রায়শই করেই থাকে সিয়াম। তাও তার প্রত্যেকটা স্পর্শ চন্দ্রার কাছে প্রথম স্পর্শের মতই অনুভুতি দেয়।
চন্দ্রা এবার হালকা করে নিজেকে এদিক ওদিক মুচড়ে নিজেকে সিয়ামের বাহুবন্ধন থেকে ছাড়াতে চাইল।
সিয়াম মুখ দিয়ে একটা বিরক্তি সূচক আওয়াজ করে বললো “কি সমস্যা এরকম ছটপট করছো কেনো শান্তি মত ঘুমোতে দাও তো একটু।” বলেই চন্দ্রাকে কোমর ধরে টেনে আরেকটু কাছে এনে পেটের উপর হাত রেখে ঘাড়ে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লো। চন্দ্রার এবার কাঁপাকাঁপির উপক্রম। চন্দ্রা মোটেই বোঝে না রোজ রাতে এক ধারে শোওয়ার পরেও সকালে কি করে সে সিয়ামের বাহুডোরে বন্দী থাকে। চন্দ্রা আরেকবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সিয়ামের মাথাটা হাত দিয়ে একটু পিছনে থেকে বললো “দেখছেন কটা বাজে..? অফিস নেই আপনার..? ছাড়ুন আমায় উঠতে দিন।” সিয়াম আগের মতই মুখ গুঁজে বললো “আজ না তোমার ছুটি..?”
চন্দ্রা এবার নিশ্বাস ছেড়ে বললো “আর তাই জন্যেই আপনি ফোনের অ্যালার্ম বন্ধ করে দিয়েছেন..?”
সিয়াম এবার মুখটা সোজা করে চোখ বন্ধ করেই ঠোঁট এঁটো করে হেসে বললো ” কি করবো ম্যাডাম আপনার এতদিন পর এতো শান্তির ঘুম দেখে ভাঙ্গতে ইচ্ছে হলো না। আজ আমারও অফিসে দেরি করে গেলে হবে তাই আর ওঠালাম না।”
চন্দ্রা এবার হালকা হেসে বললো “হয়েছে এবার তো উঠতে দিন। আরো কাজ আছে আমার।”
সিয়াম শুনলনা চন্দ্রার ঘাড়ে নাক ঘষতে ঘষতে বাচ্ছাসুলোভ গলায় বললো “আরেকটু থাকো, প্লিজ চন্দ্রাবতী”
কি নেশা মেশানো ছিলো এই বাক্যে চন্দ্রা ধরতে পারলো না কিন্তু নিজ জায়গা থেকে নড়তেও পারলো না। অগত্যা কিছুসময় সিয়ামের কাছেই থাকতে হলো তাকে।

________________________

সকাল ১১:৩০

সিয়াম কিছুসময় আগেই অফিস বেরিয়েছে মাত্র। চন্দ্রা তাই রান্নাঘরটা হালকা গুছিয়ে রাখছিলো। হটাৎ খেয়াল পড়লো পাশে একটি টিফিন বক্সের দিকে। চন্দ্রা হাতে নিয়ে দেখলো সেটা সিয়ামের। চন্দ্রা হাঁফ ছেড়ে নিজে নিজেই বললো “দেখেছো কাণ্ড এতো বলে বলে দিয়েও সেই কিনা টিফিন বক্সটাই ফেলে রেখে চলে গেলো। এখন দুপুরে খাবে কি..?”
চন্দ্রার এসব ভাবতে ভাবতেই কিছুদিন আগের কথা মনে পড়লো। সেইদিনও সিয়াম টিফিন বক্স ভুলে চলে গিয়েছিল ঘরে। চন্দ্রা দেখেও কিছু বলেনি সে ভেবেছিল অফিস ক্যান্টিন থেকে কিছু খেয়ে নেবে হয়তো সিয়াম।
কিন্তু সবচেয়ে বেশি অবাক চন্দ্রা তখন হয়েছিল যখন রাতে সিয়াম এসে জানিয়েছিল সে কিছু খায়নি ক্যান্টিন থেকে কিনে। চন্দ্রা কারণ জিজ্ঞেস করতে সিয়াম শুধু মিষ্টি হেসে বলেছিলো “অভ্যাসটা আমার একদম খারাপ করে দিয়েছো বুঝলে চন্দ্র। এখন তোমার হাতের রান্না ছেড়ে বাইরের খাবার খেতে ইচ্ছে করে না।”
আসলেই চন্দ্রার যতই কাজ থাকুক সিয়ামের টিফিনটা সে প্রতিদিন নিজের হাতেই বানায়। চন্দ্রা এবার টিফিন বক্সটা হাতে নিয়ে ভাবলো লাঞ্চ টাইমের আগে গিয়েই সিয়ামের অফিসে টিফিন বক্সটা দিয়ে আসবে। তার চেনাও হয়ে যাবে জায়গাটা। এই ভেবে টিফিন বক্সটা টেবিলে রাখতেই কলিং বেল বেজে উঠলো।
চন্দ্রা গিয়ে দরজা খুলে দেখলো হাসি মুখে অপূর্ব দাঁড়িয়ে। চন্দ্রাকে দেখে সালাম দিলো। চন্দ্রাও হেঁসে সালামের উত্তর দিয়ে বললো “সিয়াম তো এখন বাড়ি নেই ভাইয়া একটু আগেই বেড়িয়ে গেছে।”
অপূর্ব একটা মনভোলানো হাসি দিয়ে বললো “আজ আমি সিয়ামের সাথে না সিয়ার সাথে দেখা করতে এসেছি ভাবী।”
চন্দ্রা একটু অবাক হয়ে বললো “সিয়া..? কিন্তু সিয়া কোনো.?”
অপূর্ব মুখে হাসি বজায় রেখে বললো “আসলে একটু দরকার ছিল। আর আমরা তো এখন ভালো বন্ধু হয়ে গেছি।”
চন্দ্রার বিষয়টা বেশ খটকা লাগলেও অপূর্বের মুখের উপর না করতে পারলো না। সিয়ার রুমটা দেখিয়ে দিয়ে নিজের কাজে গেলো।
অপূর্ব কিছু কথা ঠিকই বলেছে যে সে বন্ধু হয়েছে সিয়ার কিন্তু নেহাতই জোর করে। আর এখন না তার কোনো দরকারি কাজ আছে সিয়ার সাথে। তবে হ্যাঁ কিছু কাজ তো আছে।
অপূর্ব সিয়ার ঘরের দরজায় একটু জোরে টোকা মারতেই দরজাটা আসতে করে কিছুটা খুলে গেলো। অপূর্ব দরজায় মাথায় তাকিয়ে দেখলো ছিটকিনিটা বোধহয় দেওয়া হয়েছিল অসাবধানতা বশত সেটা লাগেনি। অপূর্ব দরজার সামান্য ফাঁক দিয়ে মুখ গলিয়ে সিয়াকে ডাকতে যেতেই তার চোখ পড়লো সিয়ার ব্যালকনিতে। সিয়াকে পুরোটা না দেখা গেলেও যতটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে বোঝা যাচ্ছে সিয়া একটা ফল কাটার ছুঁড়ি নিয়ে এক হাতে আরেক হাতের উপর রেখে দাঁড়িয়ে আছে। হাত দিয়ে বিন্দু বিন্দু রক্ত পড়াও শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে।
এই দৃশ্য দেখে অপূর্বের বুক কেঁপে উঠলো যেনো। তাড়াতাড়ি করে ব্যালকনিতে ছুটে গিয়ে সিয়ার হাত থেকে এক টানে ছুঁড়িটা নিয়ে নীচে ফেলে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো “পাগল হয়ে গেছো সিয়া..? কি করতে যাচ্ছিলে এটা..?”
সিয়া হতভম্ব সে ভাবেওনি এইরাম সময় কেউ চলে আসবে সে তো দরজায় ছিটকিনি আটকে রেখেছিল তাহলে…?
সিয়ার এবার সব যন্ত্রণা কষ্ট রাগে পরিণত হলো। সামনের মানুষটির উপরই চেঁচিয়ে উঠলো “কি মনে করেন আপনি নিজেকে হ্যাঁ..? আমার জীবন আমি যা খুশি করি মরি বাঁচি যা খুশি আপনার কি..? কে অধিকার দিয়েছে বলুন আমার রুমে ঢোকার..?”
অপূর্ব রেগে উত্তর দিতে গিয়েও দিলো না চুপচাপ হজম করে গেলো অপমানটা। সিয়া নিজের মতো বলেই গেলো, যেনো সব দোষ অপূর্বের। অপূর্ব তাও কিছু বললো না।
অবশেষে সিয়া কাঁদতে কাঁদতে ব্যালকনির একটা কোণে বসে পড়লো হাঁটুতে মুখ গুঁজে।
অপূর্ব তা দেখে রুম থেকে এক গ্লাস জল নিয়ে এসে সিয়ার পাশে বসলো। সিয়ার পাশে বসতেই সিয়ার কান্নার স্বরে বলা কিছু কিছু টুকরো কথা অপূর্বের কানে এসে ঠেকলো।
সিয়া একনাগাড়ে বলেই চলেছে “কি অপরাধ করেছিলাম আমি..? প্রত্যেকবার আমিই কেনো..? আমার সাথেই কেনো..?কেনো আমাকে কেউ ভালোবাসে না..? না বাবার ভালোবাসা পেলাম না মায়ের তাও তো মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু এর পর আর পারছিনা আমি, আমার সহ্য ক্ষমতা যে ক্ষীণ হয়ে আসছে আসতে আসতে। হে উপরওয়ালা তাড়াতাড়ি আমায় নিজের কাছে ডেকে নাও প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”

অপূর্বের বুকে যেনো কেউ ছুঁড়ি চালাচ্ছে। সিয়ার প্রতিটা কথার ধারে তার বক্ষস্থল যেনো ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটার খুশির জন্যই তো সে এতদিন তার সামনে ভালবাসার দাবী নিয়ে আসেনি। দূর থেকেই চোখের দেখা দেখে তৃষ্ণা মিটিয়েছে। এখন কি অবস্থা করেছে মেয়েটা নিজের। আজ সে সঠিক সময়ে না এলে কি হতো..? আর ভাবতে পারলো না অপূর্ব সিয়ার পাশেই ব্যালকনিতে হেলান দিয়ে বসে পড়লো সে।
সিয়ার মাথায় ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। সিয়া প্রতিক্রিয়া দেখালো না কোনো।
তার ইচ্ছে করছে না। ছোটো থেকেই সে মা – বাবার ঝামেলা দেখছে, এখনও মায়ের সাথে তার ঝামেলা লেগেই থাকে সে চায় না ঝামেলা, একটুকরো শান্তির খোঁজ চায় সে। কিন্তু কোথায় পাবে..? এজীবনে কি সে আর পাবে শান্তি।
অপূর্ব একটু দম নিয়ে সিয়াকে আলতো স্বরে ডাকলো। প্রথম দুবার সেই ডাকটা এড়িয়ে গেলেও তৃতীয় বারে সিয়া মুখ তুলে তাকালো কিন্তু কোনো জবাব দিলো না।
অপূর্ব জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিল। সিয়ার হাত অনবরত কেঁপে যাচ্ছে। সিয়া গ্লাসটা ধরতেও অপূর্ব গ্লাসটা ছাড়লো না ধরেই থাকলো সিয়ার জল খাওয়া অবধি।
অপূর্ব এবার একটু চোয়াল শক্ত করে বললো ” কিসের জন্যে নিজেকে এইরকম শাস্তি দিচ্ছ সিয়া..?ভুল মানুষকে ভালবাসার জন্য…? আদতেই কি সব দোষ তোমার সিয়া..?”
সিয়ার কাছে উত্তর নেই। সিয়ার মাথায় হটাৎ একটা কথাই ধাক্কা মারলো আসলেই কি সব দোষ তার..?

অপূর্ব আবার বলতে শুরু করলো ” আসেপাশে তাকিয়ে দেখো সিয়া তুমি শুধু একা নও এই পরিস্থিতির শিকার আরো অনেকেই আছে তোমার মতো। কেউ নিজেকে বদলে ফেলেছে অথবা কেউ কষ্টের ভার সহ্য না করতে পেরে এই পৃথিবী ছেড়েছে। কিন্তু তাতে অপরদিকের মানুষটির উপর কোনো প্রভাবই পরেনি সে তার মতো দিব্যি আছে। সুখে সংসার করছে হেসে খেলে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আদতেই কি এটা হওয়ার ছিলো..? এই বিশ্বাসঘাতক মানুষগুলোর কি এতো সুখ পাওয়ার কথা ছিল..?
তারা পেলে তুমি কেনো পারবে না সিয়া সুখী হতে..?
আমি জানি অনেকটা সময় লাগবে হয়তো পারবেও না এই ট্রমা থেকে বের হতে। কিন্তু একবার চেষ্টা করতে কি ক্ষতি..? সিয়া অপরদিকের মানুষটা যদি তোমায় ছেড়ে সুখী হতে পারে তাহলে তুমি কেন না..? তুমিও দেখিয়ে দাও তুমিও পরো তাদের ছাড়া সুখী হতে যারা তোমায় ছাড়া সুখী আছে। মানছি তুমি ছোটথেকেই তেমন ভালোবাসা পাওনি। কিন্তু যতটুকু আপনজনেদের কাছ থেকে পেয়েছো অতটুকুতে কোনো ভেজাল ছিলো..?
সিয়াম, সিরাজ তোমায় প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে সিয়া তাদের ভালবাসার মূল্য অন্তত শোধ করো। আর আমিও তো….”
গলার স্বরটা একপ্রকার আটকেই গেলো অপূর্বের। এখনও সে সিয়ার সামনে ভালবাসার দাবী রাখতে চায় না। আপাতত তাকে ট্রমা থেকে বের করাই তার মূল উদ্দেশ্য।

সিয়ার মনে আপাতত ঝড় চলছে। কি করবে কি করবেনা সে নিজেই বুঝতে পারছে না। কিন্তু অপূর্বের কথা শুনে আজ প্রথমবার তাকে ভীষণ কাছের লেগেছে।
সিয়াকে আরো কিছু কথা বলে হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে অপূর্ব ফিরে গেলো। সিয়া মাথায় এখন শুধু অপূর্বের যাওয়ার সময় শেষ কথায়টাই ঘুরছে।
অপূর্ব সিয়ার রুম থেকে বের হওয়ার সময় পিছন ঘুরে সিয়ার উদ্দেশ্যে বলেছিলো “তুমি কি চাও সেটা সম্পূর্ণ তোমার হাতে সিয়া। জীবন একটা যুদ্ধক্ষেত্র। এখানে সর্বক্ষণ নিজেকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয় প্রত্যেকটা মানুষকেই। সুতরাং হার জিত বিশ্বাসঘাতকতা সবই এর অংশ। কিন্তু ডিসিশান এখন তোমার হাতে তুমি এর থেকে পালিয়ে বাঁচবে নাকি আর পাঁচটা যোদ্ধার মতো নিজের বেঁচে থাকার অধিকার ছিনিয়ে নেবে।”

সিয়া আলমারির কোন থেকে একটা ঘুমের ওষুধের পাতা বের করলো। অনেকক্ষণ সেই ওষুধের পাতার তাকিয়ে থেকে শেষে একটা ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লো। এখন তার লম্বা একটা ঘুম দরকার। আর ভাবতে ইচ্ছে করছে না তার কিছু।

________________________________

ইন্দ্রাকে বাড়ি ফিরে যেতে হয়েছে বিশেষ কারণে। তার বাবার রিপোর্ট গুলো আনতে হবে। তাই সকাল সকালই সে বেরিয়ে পড়েছে বাড়ির উদ্দেশ্যে।
সিরাজেরও এবার আর ঘরে মন বসছে না। ইন্দ্রা থাকলে সে মাঝে মাঝেই এটা সেটার বাহানা করে ইন্দ্রার আসেপাশে বাচ্চাদের মতো ঘুরঘুর করতো সেটা সেটা জিজ্ঞেস করার বাহানায় নানা কথা বলতো। এটা বেশ তার পছন্দের কাজ ছিলো।
সিরাজ আরকিছু না ভেবে গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো। এখন একটু বাইরে গেলে যদি তার অস্তিরতা কমে।
.
.
সিগন্যালে গাড়ি থামতেই সিরাজের চোখ পড়লো পাশের কফি শপে। সামনেটা কাঁচ থাকায় কফিশপের প্রায় অর্ধেকটাই দৃশ্যমান। সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ইন্দ্রা একটি ছেলের সাথে বেশ হেসে হেসে কথা বলছে। যেনো অনেকদিনের চেনা পরিচিত।
সিরাজের এবার মাথায় দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। হাতের পেশি শক্ত হলো।
নাহ্ আর দেরি করা যাবে না তার এবার তার প্রাণপাখি উড়ে অন্য কোথাও যাওযার আগেই তার খাঁচায় বন্দি করতে হবে তাকে। পিছন থেকে অন্য গাড়ির হর্ণের আওয়াজ পেতেই সিরাজ দৃষ্টি ফিরিয়ে সামনের দিকে আনলো। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চললো নিজের সবচেয়ে দরকারি কাজটা সারতে।

___________________________

দুপুর ১ টা

চন্দ্রা সব গোছগাছ করে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লো সিয়ামের অফিসের উদ্দেশ্যে। সিয়ামের লাঞ্চ টাইম ১:৩০- এ চন্দ্রা একপ্রকার তাড়াহুড়ো করেই পৌঁছালো সিয়ামের অফিসে। অফিসের রিসেপশনে গিয়ে জানতে পারলো সিয়াম আছে ৭থ ফ্লোরে। সিয়াও সেই বুঝে লিফটে উঠে ৭থ ফ্লোরে গেলো। সিয়ামের কেবিনে নক করে ঢুকে দেখলো সেটা ফাঁকা। তাই কেবিন থেকে বেড়িয়ে আসতেই একজন এমপ্লয়ই তাকে তার নাম পরিচয় জিজ্ঞেস করলো। চন্দ্রা নিজের পরিচয় দিলো সিয়ামের স্ত্রী বলে।
তখন সে জানালো সিয়ামের কেবিনের ভিতর অ্যাটাচ একটা রেস্ট রুম আছে। সিয়াম মাঝে মাঝে সেখানেই থাকে। যদিও সেখানে সিয়ামের অ্যাসিস্ট্যান্ট ছাড়া কারোর ঢোকার নিয়ম নেই। কিন্তু চন্দ্রা স্ত্রী বলে তাকে যেতে দিলো।

চন্দ্রা সেই কথা অনুযায়ী সিয়ামের কেবিনের ভিতর রেস্ট রুমটায় নক করলো আস্তে দুইবার। কিন্তু ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না। চন্দ্রা এবার দরজার লকটা ধরে ঘোরাতেই সেটা খুলে গেলো।
চন্দ্রা ভিতরে নজর দিতেই চন্দ্রার চোখ স্থির হয়ে গেলো। হাতে ধরে রাখা টিফিনবক্সের ব্যাগটা আপনাআপনিই পড়ে গেলো। এটা কি দেখছে সে..? নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেন সে।
তাকে দেখে অপরদিকে মানুষদুটিও সে সমান ভাবে চমকে উঠেছে এটা তাদের মুখে স্পষ্ট।

#চলবে..?

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #২২

চন্দ্রা সেই কথা অনুযায়ী সিয়ামের কেবিনের ভিতর রেস্ট রুমটায় নক করলো আস্তে দুইবার। কিন্তু ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না। চন্দ্রা এবার দরজার লকটা ধরে ঘোরাতেই সেটা খুলে গেলো।
চন্দ্রা ভিতরে নজর দিতেই চন্দ্রার চোখ স্থির হয়ে গেলো। হাতে ধরে রাখা টিফিনবক্সের ব্যাগটা আপনাআপনিই পড়ে গেলো। এটা কি দেখছে সে..? নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেন সে।
তাকে দেখে অপরদিকে মানুষদুটিও সে সমান ভাবে চমকে উঠেছে এটা তাদের মুখে স্পষ্ট।

চন্দ্রা হতবাক সে বিশ্বাস করতে পারছে না চোখকে নিজের। সিয়াম দাঁড়িয়ে আছে সামনের ডেস্কে হেলান দিয়ে হাত দুটো আড়াআড়ি করে বুকের কাছে গোঁজা। সিয়ামের মুখেও অবাকের ছাপ। সেও বোধহয় এই সময় চন্দ্রাকে এখানে আশা করেনি।

চন্দ্রা ঠিক কি রিয়াকশন দেবে বুঝে উঠতে পারলো না। সিয়ামের পাশের জনকে একবার দেখলো। চিনতে পারলো না লোকটিকে দেখে তবে সিয়ামের বয়সই লাগলো।

চন্দ্রা ধীর পায়ে সিয়ামের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। তার অবাকের রেশ যেনো কাটতেই চাইছে না। মাথায় শতাধিক প্রশ্ন ঘুরপাক করছে। কোনটা আগে জিজ্ঞেস করবে আর কোনটা পরে এইসব ভেবে ভেবেই চন্দ্রা প্রথম প্রশ্নটা সিয়ামকে করলো “আপনার পা একদম ঠিক আছে সিয়াম..?”
সিয়াম তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার অ্যাসিস্ট্যান্ট কম বন্ধুর পিয়াসের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করতেই সে মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে গেলো সেই রুম থেকে।
চন্দ্রা আবার একটু জোরেই প্রশ্ন করলো ” সিয়াম আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করলাম উত্তর দিন আমার প্রশ্নের। আপনার পা কি পুরোপুরি ঠিক..?”

সিয়াম কিছুক্ষন চুপ থেকে চন্দ্রার চোখের দিকে তাকিয়ে শুধু ছোট্ট করে বললো ” হুম ”
ব্যাস এইটুকুই বাক্যেই চন্দ্রার এতো দিনের সঞ্চয় করা বিশ্বাসের খুঁটিটা যেনো নড়ে উঠলো। হাত পা যেনো অবশ হয়ে এলো তার। হালকা পা টা পিছনে রাখতে পড়ে যেতে নিলেই সে চোখ বন্ধ করে দিল। পড়ে যাওযার আগেই একটা শক্তপোক্ত হাত তাকে আগলে নিলো।
চন্দ্রার চোখ বুজেও বুঝতে ভুল হলো না মানুষটা কে। তীব্র পুরুষালী পারফিউমের গন্ধটা ভেসে আসছে তার নাকে।
জাস্ট কয়েকটা সেকেন্ড। চন্দ্রা ঝাড়া মেরে সিয়ামের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কিছু দূর গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল “স্পর্শ করবেন না আপনি আমায়। আপনার মত বিশ্বাসঘাতকের সাথে এতদিন সংসার করেছি ভেবেই তো আমার গা শিরশিরিয়ে উঠছে। ”
সিয়াম এতক্ষণ শান্ত থাকলেও এবার অধৈর্য হলো। চন্দ্রাকে উদ্দেশ্য করে বললো “শান্ত হও চন্দ্র। আমাকে একটা সুযোগ তো দাও নিজের দিকটা বলার..! আমি বুঝিয়ে বলছি সবটা তোমায়।”

চন্দ্রা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলো ” কি বোঝাবেন আপনি আমায়..?কিভাবে এতদিন আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন সেটা বোঝাবেন..? নাকি কিভাবে ঠকিয়ে বিয়ে করেছেন সেটা..?আপনার লজ্জা হলো না সিয়াম আমার অনুভুতি নিয়ে এইভাবে খেলতে..? বলুন সিয়াম বলুন।” বলতে বলতে চন্দ্রা কান্নায় ভেঙে পড়লো।

সিয়াম কিছু বলার আগেই চন্দ্রা ওই কান্নারত অবস্থায় বলে উঠলো “আর এক্সপ্লেনেশন দিতে হবে না আমায় সিয়াম। ডিভোর্স পেপারস্ আমিই পাঠিয়ে দেবো আপনাকে।” বলেই সিয়ামকে কিছু বলতে না দিয়েই চন্দ্রা দৌড়ে বেড়িয়ে গেলো সেখান থেকে।
সিয়াম কয়েকবার চন্দ্রার নাম ধরে ডাকলো কিন্তু চন্দ্রা নিজের মতোই কাঁদতে কাঁদতে অফিস থেকে বেড়িয়ে পড়লো। সিয়াম চিন্তিত মুখ নিয়ে কাউকে ফোন করলো। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হতে সিয়াম ভারী গলায় বললো “আজকের সবকটা মিটিং ক্যান্সেল করে দাও।”
ওপাশ থেকে কি উত্তর এলো বোঝা গেলো না। কিন্তু উত্তরটা যে সিয়ামের মনমতো হলো না তা সিয়ামের রাগান্বিত লাল মুখটাই বলে দিলো। সিয়াম ফোন টা পাশের সোফায় ছুঁড়ে ফেলে মাথার চুল টেনে ধরলো।
পিয়াস দৌড়ে এসে সিয়ামকে এই অবস্থায় দেখেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। সে জানে এক্ষুনি সিয়ামকে সে কিছু বললেই সিয়াম রেগে যাবে। পিয়াস বন্ধু হলেও বেশ ভয় পায় সিয়ামের রাগকে। সিয়াম চোট করে রাগে না, কিন্তু একবার রাগলে তাকে শান্ত করা যায় না।

অগত্যা সিয়াম বেরোতে পারলো না অফিস থেকে আজ গুরুত্বপূর্ণ ক্লায়েন্ট আসবে তার বিদেশ থেকে সে আজ চলে গেলে কয়েক কোটি টাকার লস হবে তার কোম্পানিতে।
সিয়ামের ধারণা অনুযায়ী চন্দ্রা তার বাপের বাড়ীতেই যাওযার কথা তাই সে মিটিংয়ে ঢোকার আগেই ইন্দ্রাকে বলেছে চন্দ্রা সেখানে গেলে তার খেয়াল রাখতে।
ইন্দ্রা কারণ জিজ্ঞেস করতে সিয়াম শুধু বলেছে সে পরে সব খুলে বলবে। ইন্দ্রাও তাই আর প্রশ্ন করেনি।

সিয়ামের মিটিং শেষ হলো সন্ধ্যে সাত টায়। আজকে মিটিং-এ তার সময়টা অনেকটা বেশিই লেগেছে। কারন ক্লায়েন্টরা আজকের মধ্যেই সব মিটিয়ে কাল সকলের ফ্লাইটের মধ্যেই বেড়িয়ে যাবেন। অফিসে তাই রাতেই ছোটখাটো একটা পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। অফিসের সবাইকে সেখানে উপস্থিত দেখলেও পিয়াস চারিদিক খুঁজেও সিয়ামকে কোথাও দেখতে পেলো না।

___________________________

সিয়াম অফিসের এক কোনায় এসে দাঁড়িয়েছে। এতো হইহুল্লোড় তার ভালো লাগছে না। তার মাথায় শুধু এখন চন্দ্রার চিন্তাই ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাগের মাথায় কোথায় গেলো কি করছে সে কিছুই জানে না সে। এসব ভাবতে ভাবতেই সিয়াম পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখলো একটা আননোন নাম্বার থেকে বেশ কয়েকটা মিসডকল। তারপর নিচে দেখে ইন্দ্রার দুইবার মিসডকল শো করছে। সিয়াম আগে ইন্দ্রার নম্বরেই কল দিল।
ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই সিয়াম উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠলো “চন্দ্রা কোথায় ইন্দ্রা..?”
ইন্দ্রা বললো ” কই চন্দ্রা ভাইয়া..? সে তো আসেনি এখানে। আমিও কয়েকবার কল করলাম সুইচঅফ বলছে ফোন।”
সিয়ামের এবার পাগল হওয়ার জোগাড় ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো ঘড়িতে বাজে ৯:২৩ । মেয়েটা গেলো কই এতো রাতে। সিয়াম মনে মনে নিজেকে কষে দুটো লাথি দিলো। তার জন্যেই হয়েছে এসব। সে আসলেই তো সবটা লুকিয়ে গেছে চন্দ্রার কাছ থেকে। সে ভেবেছিল একটা সঠিক সময় দেখে শান্ত ভাবে বোঝাবে চন্দ্রাকে। কিন্তু কথা থেকে যে কি হয়ে গেলো সিয়াম টেরই পেলো না।
এসব ভাবতে ভাবতেই সেই আননোন নাম্বারটায় কল ব্যাক করল সিয়াম। কয়েকবার রিং বাজার পর ওপাশ থেকে রিসিভ হলো ফোনটা।
ফোনের ওপাশ থেকে একজন রাশভারী কণ্ঠে বলে উঠলো “আপনিই সিয়াম..?”
সিয়াম একটু চোয়াল শক্ত করেই জিজ্ঞেস করলো “হ্যাঁ কি দরকার তাড়াতাড়ি বলুন।”
ওপাশ থেকে একই ভাবে উত্তর এলো “চন্দ্রা নামের মেয়েটি আপনার কে হয়..?”
সিয়ামের গলা এবার এটটু নরম হলো। সে কৌতুহলী কণ্ঠে বললো ” সি ইজ মাই ওয়াইফ, বাট আপনি এসব কেনো জিজ্ঞেস করছেন..?”
ওপাশ থেকে উত্তর এলো “আপনার ওয়াইফ •••হসপিটালে ভর্তি আছে আপনি যত দ্রুত সম্ভব এখানে আশার চেষ্টা করুন।” আরো কিছু কথা বললো লোকটা।
সিয়ামের মাথার এবার আকাশ ভেঙে পড়লো। সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। পরিষ্কার করে আরো বার দুয়েক জিজ্ঞেস করলো। ওপাশ থেকে একই উত্তর এলো।
সিয়াম দিকবেদিক ভুলে দৌড় লাগলো হসপিটালের দিকে। লিফটে ওঠার আগের মুহূর্তেই পিছন থেকে পিয়াস চেঁচিয়ে উঠলো। সিয়াম সেদিকে তাকাতেই দেখলো পিয়াস তার হুইচেয়ার টা নিয়ে দৌড়ে এসেছে।
পিয়াস এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো “কি যে করিস না তুই। এই ভাবে বাইরে গেলে কি কেলেঙ্কারি হবে বলতো। এতে বস তাড়াতাড়ি তারপর চল কোথায় যাবি আমি নিয়ে যাচ্ছি।”
সিয়াম আর কথা না বাড়িয়ে তাতে বসেই লিফটে উঠলো। আসলেই তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। বারবার মনে হচ্ছে সব দোষ তারই। তার ভুলেরই শিকার ওই মেয়েটা।
আজ পিয়াস না থাকলে যে তার কি হতো। মনে মনে কয়েকবার ধন্যবাদ দেয় সে পিয়াসকে। এমনি এমনি সে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে না পিয়াসকে যথেষ্ট কারণ আছে তার পিছনে। পিয়াস তার শুধু অ্যাসিস্ট্যান্ট কম বন্ধুই নয়। তাকে সিয়াম নিজের ভাইয়ের চোখে দেখে।

সিয়াম হসপিটালে যেতে যেতে ইন্দ্রা সিরাজ দুজনকেই খবর পাঠালো। দুজনেই শুনে বেশ চমকে গিয়েছিলো ইন্দ্রা তো কেঁদেই দিয়েছিল। সিয়াম তাই সিরাজকে বললো ইন্দ্রাকে তার বাড়ি থেকে নিয়ে একসাথে আসতে।

সিয়াম হসপিটালে পৌঁছেই চন্দ্রার খোঁজ নিয়ে চন্দ্রার কেবিনের সামনে গিয়ে দেখলো। একজন চল্লিশের ঊর্ধ্বে ভদ্রলোক কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। স্যুট বুট পড়ে থাকায় নেহাতই বয়স অনেকটাই কম লাগছে।
সিয়াম গিয়েই তার কলার চেপে ধরলো। রক্তলাল চোখ করে বললো ” সাহস কি হয় আপনার আমার বউয়ের এই অবস্থা করার..? এখন কি এখানে সাধু সাজার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন..? আই সোয়ার আমার আমার বউয়ের যদি কিছু হয় না আপনাকে দেশের কোনো আইন বাঁচাতে পারবে না আমার হাত থেকে।”
পিয়াস দৌড়ে এসে সিয়ামের হাত থেকে ভদ্রলোকের কলার ছাড়ালো। সে অবগত সিয়ামের রাগ সম্পর্কে এখানেই যে খুনোখুনি করেনি এটাই তার সৌভাগ্য।

পিয়াস টেনে সিয়ামকে দূরে নিয়ে এসে বললো “সিয়াম এটা হসপিটাল সিনক্রিয়েট করিস না এখানে, শান্ত হ। ওই লোককে আমরা পরে দেখবো আগে গিয়ে ভাবীকে দেখ।”

অন্যসময় হলে সিয়াম পিয়াসকে ধমকে দিতো কিন্তু এখন আর পারলো না পিয়াসের কথা শুনে তীক্ষ্ণ চোখে সেই লোকটার দিকে তাকিয়ে চন্দ্রার কেবিনে প্রবেশ করলো সিয়াম।
.
.
চন্দ্রার কেবিনে ঢুকে সিয়াম দেখলো হাত পা মাথা গলার খানিকটা অংশ ব্যান্ডেজ করা চন্দ্রার। পাশেই ডাক্তার নার্সকে কিছু বলছিলেন। সিয়ামকে দেখে ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন ” আপনি কি ওনার হাসবেন্ড হন.?”
সিয়ামের উত্তর দেওয়ার মতো ভাষা নেই। আসলেই কি সে হাসবেন্ড যে নিজের বউয়ের খেয়াল রাখতে পারে না। যার জন্য তার বউ আজ এইভাবে শয্যাশায়ী। উত্তর এলোনা ভিতর থেকে। সিয়াম চন্দ্রার দিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শুধু হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালো।

ডাক্তার এবার বললেন “ওনার হাত পা মাথায় বেশ চোট লেগেছে যদিও ব্যান্ডেজ করে দিয়েছি তাও বেশ কিছুদিন পুরোই বেডরেস্টে থাকতে হবে। আর আরেকটা জিনিস….”
বলেই ডাক্তার একটু থামলেন।

সিয়াম এবার দৃষ্টি ঘুড়িয়ে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললো “কি হলো আপনি এইরকম চুপ করে গেলেন কেনো..? সিরিয়াস কিছু না তো..? বলুন ডক্টর বলুন চুপ করে থাকবেন না।”
শেষের কথাটিতে কি এমন তেজ ছিলো জানা গেলো না কিন্তু পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নার্সটা হালকা কেঁপে উঠলো সেই আওয়াজ শুনে।
ডাক্তার স্বাভাবিক গলায় বললেন ” এটা হসপিটাল আপনি একটু ধীরে কথা বলুন। আর তেমন সিরিয়াস কিছু না ওনার গলায় চোট লেগেছে তাই কিছুদিন উনি কথা বলতে পারবেন না আর পারলেও অসুবিধা হবে। যদিও কিছু দিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে সমস্যাটা। তাও আপনাদের দায়িত্ব ওকে কথা না বলতে দেওয়া। রাতে একজনকে থাকতে হবে আজ ওনার কাছে। কাল কিছু চেকাপ করিয়ে সব ঠিকঠাক দেখলে বিকেলের মধ্যেই ছেড়ে দেওয়া হবে ওনাকে। তবে আজ হাই পাওয়ারের ওষুধ পড়ায় রাতে ঘুম ভাঙ্গবে না আর আপনারাও ভাঙার চেষ্টা করবেন না। ” বলেই ডাক্তার আর নার্স দুজনেই বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে।
সিয়াম এগিয়ে এলো চন্দ্রার কাছে। আসতে করে চন্দ্রার বাম হাতটা ধরলো। ডানহাতে ব্যান্ডেজ তার। বাম হাতেও চারিদিকে কটাছড়া দেখে সিয়ামের বুক কেঁপে উঠলো। এ কি অবস্থা করেছে মেয়েটা নিজের। তার ভুলের শাস্তি তাকে যা দিতো সে মাথা পেতে নিত। কিন্তু চন্দ্রা নিজেকে এতোখানি আঘাত দিতে পরে সিয়াম ভাবতেও পারেনি।
সিয়াম চন্দ্রার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। চন্দ্রার মুখটা বেশ ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। চারদিকে কাটাছড়া।
সিয়াম আর পারলো না সেই দৃশ্য দেখতে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো তার চোখ দিয়ে। মুখটা আলতো করে চন্দ্রার ঘাড়ের কাছে রাখলো। না আজ আর সেই চেনা পরিচিত পারফিউমের সুবাস পাচ্ছে না সিয়াম। আজ সব ছাপিয়ে শুধু মেডিসিনের গন্ধই এসে ঠেকছে তার নাকে।
এই বিষয়টা ভাবতেই যেনো সিয়ামের আরো ভিতর থেকে নাড়া দিলো। তাও কিছুক্ষন পড়ে থাকলো ওইভাবেই।
কিছুক্ষন বাদ মুখ তুলে চন্দ্রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।

কানের কাছে ঠোঁট ছুঁয়ে বললো ” তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও চ্ন্দ্রাবতী, সকল অমাবস্যা দূর করে আবার আমার জীবনটা তোমার আলোয় আলোকিত করে দাও।”

_______________________

ইন্দ্রা নিজের বাড়ির রোডের সামনে দাঁড়িয়ে একবার চোখ মুছছে একবার গাড়ি দেখছে। সিরাজ এখনও এসে পৌঁছায়নি। ইন্দ্রা জানে সিরাজের তার বাড়ি থেকে এখানে আসতে কিছুটা সময় লাগবে। তাও আজ তার মন মানছে না। এক সেকেন্ড তার কাছে এক একটি বছর সমান মনে হচ্ছে। চন্দ্রাকে সে মেয়ের মত ভালবাসে। চন্দ্রার কিছু হলে ইন্দ্রার মন আগে থেকেই খচখচ করে। আজ সকাল থেকেও করছিলো। সে বিশেষ পাত্তা দেয়নি সে বিষয়ে।এখন দেখছে মহাভুল করেছে সে মনের কথা না শুনে।

গাড়ির হর্ণ শুনে ইন্দ্রা গাড়িটির দিকে তাকিয়ে দেখলো সিরাজ গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে আছে। ইন্দ্রা আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি গিয়ে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে গিয়ে বসলো।

হসপিটাল পৌঁছাতে তাদের এখনও আধা ঘন্টা লাগবে। এইদিকে ইন্দ্রা কেঁদে কেঁদে হেঁচকি তুলে ফেলছে দেখে সিরাজ সামনে রাখা একদম ছোট্ট ছোট্ট দুটো জলের বোতল থেকে একটা বোতল বাড়িয়ে দিলো ইন্দ্রার দিকে।
ইন্দ্রা তা দেখে ঘাড় নাড়ালো অর্থাৎ তার লাগবে না।

সিরাজ দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললো ” এইরকম কাঁদতে থাকলে শেষে বোনকে দেখতে গিয়ে নিজেই ভর্তি হয়ে যাবে।”
ইন্দ্রা এবার রাগ রাগ চোখে তাকিয়ে এক ঝটকায় জলের বোতলটা খুলে বোতলে মুখ দিয়েই ঢকঢক করে খেয়ে বোতলটা সামনে রেখে দিল।

সিরাজ তা দেখে মুচকি হাসলো। ইন্দ্রার অগোচরেই সিরাজ সেই একই বোতল থেকে মুখ লাগিয়ে বাকি জল টুকু শেষ করলো। যদিও জল নামমাত্রই ছিলো তাতে। তাতে কোনো যায় আসে না সিরাজের কারণ তার আসল উদ্দেশ্য পাশের মানুষটার একটু ছোঁয়া পাওয়া।

#চলবে..?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে