উজানের ঢেউ পর্ব-১৩

0
354

#উজানের_ঢেউ ( ১৩)
কলমে✍️ #রেহানা_পুতুল
শুনে মা তৎক্ষনাৎ ক্ষিপ্র গতিতে গর্জন করে উঠলো তাদের উদ্দেশ্যে। আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। আর যাইহোক। মাহমুদ ভাইকে বিয়ে করা যাবে না কিছুতেই। নয়তো মানুষের ধারণা ও বাস্তব মিশে একাকার হয়ে যাবে জল ও নুনের মতো। মানুষ চারদিকে রিউমার ছড়িয়ে দিবে। একলাই রবো আজীবন।

আমি রুমের ভিতর থেকে তাদেরকে বলা মায়ের তেজস্বী বাক্যগুলো শুনছি।
মা তাদের বলছে,

” আপন জেঠাতো ভাইয়ের সঙ্গে রিকশায় চড়া কোন দোষ হতে পারে না। সারা বাড়ির কেউই এই নিয়ে কিছুই বলল না। তোমরা কেন বলছ, বুঝি না মনে করছ? আর আমার মেয়েকে তার স্বামী স্ব-ইচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছে। কারণ সে তার খালাতো বোনকে বিয়ে করেছে রিলেশন করেই। রত্নার সাথে মাহমুদের কোন রিলেশন আগে ছিল না। এখনো নেই। মাহমুদ রত্নাকে পছন্দ করে রত্না স্কুলে পড়ার সময় থেকেই। মাহমুদ রত্নাকে আগেও বিয়ে করতে চেয়েছে। এখনো চাচ্ছে। এবং তাদের দুজনের বিয়ে ঠিকও হয়েছে আমাদের দুই পরিবারের সম্মতিতেই।”

মা কথাগুলো বলে থামলো। এ ঘর ও ঘর হতে কয়েকজন মানুষ আমাদের উঠানে এগিয়ে এলো। তবে কেউই মুখে রা টুকু করছে না। নিরব দর্শক ও শ্রোতা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। সেই দুজনের একজন রুষ্ট কন্ঠে বলে উঠলো,

” ওহ! তাইলে এই কাহিনী। নাহ? তলে তলে গজার মাছ? মাহমুদের বাপ নাই। মা সিধাসাধা। সে শহরে ব্যবসা করে। ভালো আয় রোজগার করে। এই সুযোগে মাইয়ারে লেলাই দিলা মাহমুদের পিছনে?”

উনার কথা শেষ না হতেই মাহমুদ ভাইয়ের বজ্রকন্ঠ আমার কর্ণগোচর হলো। আমি জানালার ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে উঠানে তাকালাম। দেখলাম মাহমুদ ভাই তাদের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। তার সারামুখে ভয়ার্ত রূপ। চোখদুটো নে* শা*গ্রস্তের মতো লাল হয়ে আছে। ঘাড়ের র’গগুলো ফুলে টানটান হয়ে আছে।

তারা মাহমুদ ভাইকে দেখে ভূত দেখার মতো ঘাবড়ে গেলো। মাহমুদ ভাই বাড়িতে আছে এটা জানলে তারা কস্মিনকালেও আমাদের দুয়ারে পা রাখত না। উচ্চস্বরে কথা বলার সাহসও দেখাতো না।

মাহমুদ ভাই শক্ত চোয়ালে দাঁত কিড়মিড়িয়ে রাশভারী কন্ঠে তাদের দিকে চেয়ে বলছে,

” আপনারা দুজন মহিলা মানুষ। আমার মায়ের বয়েসী। সম্পর্কে চাচী হোন আমার। কাকাদের সাথে আপনাদের দুই পরিবারের বিরোধ চলছে ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে। আমাদের সাথে আত্মীয়তা করতে চেয়েছেন। হয়নি। তাই অহেতুক গুজব ছড়াচ্ছেন রত্না ও আমাকে নিয়ে। সম্মান হারাতে না চাইলে এক্ষুনি এখান থেকে চলে যান বলছি। আর ভালো করে শুনে যান। দ্বিতীয়বার যদি আমার কানে রত্না সম্পর্কে নেগেটিভ কিছু আসে। আমি তাদের সবার জিহবা টেনে ছিঁড়ে ফেলব। কেউই ছাড় পাবে না আমার হাত থেকে। আমাদের বিয়ের দাওয়াত খেয়ে যাবেন। ”

সেই দুজন মহিলা টু শব্দটিও করল না আর। নিচু মাথায় ভেজা বিড়ালের মতো মাহমুদ ভাইয়ের পাশ কেটে চলে গেলো। আমি ওড়না দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরলাম। মিটমিটিয়ে হেসে মনে মনে বললাম, ওরে আমার বীরপুরুষ রে। তোমার গলায় আমি মালা দিবো বলছি?

দেখলাম মাহমুদ ভাই আমাদের ঘরের ভিতর ঢুকলো লম্বা লম্বা পা ফেলে। জানালা থেকে সরে গেলাম দ্রুত। মাহমুদ ভাই নয়ন নে বলছে,

” নয়ন, রত্না পার্লারে গিয়েছে?”

” নাহ ভাইয়া। আপু ঘরেই আছে।”

” উহু শিট! ” বলে উঠলেন মাহমুদ ভাই। হয়তো এই ভেবে, আমি কথাগুলো শুনে কষ্ট পেলাম।

নয়ন আমার রুমে আসল। সুখ সুখ কন্ঠে বলল,

” আপু, মাহমুদ ভাইয়া আসছে আমাদের ঘরে।”

” তো? আমি কি নাচবো ধেই ধেই করে? এই নয়ন, মাহমুদ ভাই কিভাবে জানল এদের কথা?”

” আপুনি, আমি চুপিচুপি মাহমুদ ভাইয়ার জানালায় গিয়ে বলছি এটা?”

” কি বলছিস?”

” বলছি ভাইয়া, উত্তর ঘরের জেঠিমারা আম্মুর সাথে ঝগড়া লাগছে তোমাকে ও আপুকে নিয়ে।”

” তারপর?”

” তারপর মাহমুদ ভাইয়া গেঞ্জি গায়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো।”

” তোকে কে পাঠালো তাকে খবর দিতে?”

” বারে? কে পাঠাবে আবার। রাবুপু তো কলেজেই। আমিই গেলাম বুদ্ধি করে।তোমাদের না বিয়ে হবে? ”

” কি বুদ্ধিমান ভাইরে আমার। যা ভাগ বলছি। ফাজিল কোথাকার। আচ্ছা শোন,মাহমুদ ভাই মার সাথে কি কথা বলছে? ”

” তোমার বিয়ে নিয়ে।”

নয়ন চলে গেলে আমি তার পিছন দিয়ে উঠে গেলাম। মাহমুদ ভাই কথার প্রসঙ্গ চেঞ্জ করলেন। আমার দিকে চেয়ে আদেশের সুরে,

” কিরে পার্লারে গেলিনা কেনো? ”

” আমার ইচ্ছে।”

” আমি কি বলছি আমার ইচ্ছে? ত্যাড়া আনসার দিচ্ছিস কেনো? কি হয়েছে? মুখ অমাবস্যা হয়ে আছে কেনো? ”

আমি মুখ নামিয়ে রাখছি মাটির দিকে। পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে উঠানের মাটি উঠাচ্ছি।

মাহমুদ ভাই সেটা লক্ষ্য করলেন। বললেন,

” উঠানে তোকে কূয়ো বানাতে কে বলছে?”

আমি পা থামিয়ে নিলাম। একটু পরেই মা,নয়ন, মাহমুদকে ভাইকে শুনিয়ে মিনমিনিয়ে বললাম,

” আমি জেঠিদের সব কথা শুনেছি। আমার লাইফে কাউকে দরকার নেই। সারাজীবন আশেপাশের মানুষ বাঁকা চোখে দেখবে। নিন্দা করে কথা শুনাবে। এত অপমান নিয়ে ভালো থাকা যায় না। ”

বলেই দ্রুতপদে তাদের সম্মুখ ত্যাগ করলাম। মাহমুদ ভাই মাকে বলছে,

” চাচী ও এটা কি বলল? এই রত্না শুন বলছি ”
বলে আমার পিছু নিলো। আমি দরজা ভিড়িয়ে দিতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম উনার বাহুশক্তির কাছে। উনি রুমের ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমার মাথায় রাগ চড়ে গেলো তখন। মাহমুদ ভাইয়ের দিকে রোষপূর্ণ দৃষ্টি ফেললাম।

” কাল রিকসায় চড়লাম। তাতেই এত কিছু। আর এখন দিনে দুপুরে আপনি আমার রুমে। কেউ দেখলে কি ভাববে? ছিহঃ! বেরিয়ে যান বলছি। আমি ড্রেস চেঞ্জ করবো। বের হবো। ”

” আমার সামনেই চেঞ্জ করবি তুই। কারন আমি তোর ফিয়ন্সে এখন।”

উদ্যত স্বরে বলল মাহমুদ ভাই।

তখন আমি নিজের উপর কন্ট্রোল রাখতে পারি নি। মাহমুদ ভাইয়ের দিকে একটা কাঁচের গ্লাস ছুঁড়ে মারি টেবিলের উপর থেকে নিয়ে। উনি ক্যাচ ধরার মতো গ্লাসটি ধরে ফেলল। হেসে দিয়ে আমাকে মানানোর ভঙ্গিমায় বলল,

” আরেহ! আরেহ! করে কি, করে কি? এই তোর মাথায় গোবর নাকি? তুই কিসের নারী উদ্যোক্তা হবি। আর অন্য কেউ বলছে এসব? তারা কেন বলছে এসব? তা তুই যেমন জানিস। আমিও জানি। পুরো বাড়ির সবাই জানে। থার্ড পারসনের কথা ধরে বসে থাকলে লাইফে কিছুই করতে পারবিনা। যেই লাউ সেই কদুই রয়ে যাবি।”

” হ্যাঁ। হইছে। আমার মাথায় সব গোবর। আমি কদু বনাম লাউ। এবার রক্ষা করেন আমাকে। যান তো প্লিজ। লেট হয়ে যাচ্ছে। ”

” গোবরকে সারে রূপান্তরিত করতে হবে আমার কাছে নিয়ে। নয়তো তোর ভবিষ্যৎ অন্ধকার।”

” তাতে আপনার কি?”
হেয়ালী করে বললাম।

” আমার কি মানে? আমারই তো সব। গ্লাস এটা যে মারলি। যদি আমার কপালে পড়তো? দস্যি মেয়ে কোথাকার। ”

এই বলে উনি আমার খুব কাছে চলে এলেন। ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়ালেন গা ঘেঁষে। আমার কপালে উড়ে আসা বেপরোয়া চুলগুলোকে হাত দিয়ে কানের পিছনে গুঁজে দিলেন। হাতের চার আঙ্গুলের উল্টো পিঠ দিয়ে আদূরে স্পর্শ দিলেন গালের এক পাশে। গালের উপর হতে আঙ্গুলগুলো বুলিয়ে নিলেন চিবুক পর্যন্ত। আমি আবেশিত হয়ে চোখে বন্ধ করে ফেললাম। বুক ধড়পড় করছে আমার বিদ্যুৎ গতিতে। হার্টবিট বেড়ে গেলো।

মাহমুদ ভাই আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসিফিসিয়ে বললেন,

” পানকৌড়ি। তুমি যে আমাকে লাইক করো,লাভ করো,মিস করো,ফিল করো। তা এই মুহূর্তে প্রমাণ হয়ে গেলো। ধরা পড়ে গেলে। পালিয়ে বাঁচতে পারবেনা পাখি। খাঁচায় বন্ধী হতেই হবে। সো বাহানা দিয়ে লাভ নেই। তুমি আরেকটু আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠো। তারপরেই বিয়ে হবে। বিকেলে ঢাকা চলে যাবো। মেসেজ দিও। কথা হবে। টেইক কেয়ার।”

এরপর মাহমুদ ভাই চলে গেলো রুম থেকে। আমি আবার দরজা বন্ধ করে দিলাম। কেমন উদাস উদাস লাগছে। ভাবছি সত্যিই তো। আমিও তো মাহমুদ ভাইকে এখন পছন্দ করি। অযথাই ছেলেমানুষী করি। অকারণেই হেয়ালী করি। মনে মনে নিজের উপর বিরক্ত হলাম। তবে আগে পার্লারটা একটা অবস্থায় যাক তারপর।

রাজন এলোমেলো পায়ে আমার কাছে এলো। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলাম। মা এসে জিজ্ঞেস করলো মাহমুদ ভাইয়ের সাথে কি কথা হলো। মাকে আস্বস্ত করলাম সব ঠিক আছে বলে। মা মনে মনে শুকরিয়া আদায় করলেন। মায়ের অভিব্যক্তি তাই জানান দিচ্ছে।

সেদিন আর বের হলাম না। এত উচাটন মন নিয়ে পার্লারে যাওয়া সম্ভব হয়নি। সাংমাকে ফোন দিয়ে বলে দিলাম,যাবনা।

না চাইলেও আশরাফুল ও তাদের পরিবারের কথা মনে পড়ে গেলো । শিরিনের কথা মনে পড়লো। মনে আমাদের সবাইকেই পড়ে। শক্রকেও মনে পড়ে। তবে আসল বিষয় হলো কাকে কিভাবে মনে পড়ছে। সেটাই। সব মানুষকে একই পরিপ্রেক্ষিতে মনে পড়েনা।

কাউকে মনে পড়ে শ্রদ্ধ্যায়, কাউকে ঘৃণায়,কাউকে ভালোবাসায়, কাউকে বিরক্তির সাথে, কাউকে নিদারুণ উপেক্ষায়, কাউকে করুণায়,কাউকে পরম মমতায়,কাউকে অতি যতনে অতি সংগোপনে।

গোধূলীঝরা পড়ন্ত বিকেল। চারপাশ মুখরিত ছোট বড় সবার কলরবে। যে যার মতো বিকেলকে উপভোগ করছে। রাবু এখনো কলেজ থেকে ফেরেনি। ক্রমশ আমাদের উদ্বিগ্নতা বেড়ে চলছে হুহু করে। বাবাকে ফোনে জানানো হলো। বাবা বাড়ি চলে এলো। রাবুর কাছে মোবাইল নেই। কলেজে মোবাইল নিয়ে যাওয়া নিষেধ। আমি নয়নকে নিয়ে রাবুর কলেজে গেলাম রাজনকে মায়ের কাছে রেখে। কলেজ বন্ধ। গেটের দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করেও রাবুর কোন সন্ধান মেলেনি। অবসাদগ্রস্ত মনে দুই ভাইবোন বাড়ি ফিরে এলাম। সম্ভাব্য সব স্থানে রাবুর খোঁজ নিলাম। কোন খোঁজ মিলল না।

মা বুক চাপড়ে গগন কাঁপিয়ে আর্তনাদ করছে। আমরা সবাই অশ্রুবিলাপে ভেসে যাচ্ছি আমাদের চঞ্চল চড়ুয়ের মতো নিখোঁজ রাবুটার জন্য।

চলবে.. ১৩

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে