উজানের ঢেউ পর্ব-১০

0
364

#উজানের_ঢেউ ( ১০)
কলমে✍️ #রেহানা_পুতুল
আমি সাইন কোথায় করবো? পেপারস দেন।”
সে অসহায় মুখে মায়া মায়া কন্ঠে আমাকে বলল,

” নাহ! রত্না প্লিজ! আমার কিছু কথা শোনো সাইন করার আগে।”

“এটা কোন দয়া দাক্ষিণ্য করার স্থান নয়। মানুষের দয়া হবে মানুষের জন্য। কোনো অমানুষের জন্য নয়। কোন কাপুরুষের কথা শোনাও আমাদের সবার অন্যায় হবে।”

আমার অসহিষ্ণু কন্ঠের বলিষ্ঠ কথাগুলো শুনেই, উকিল পেপারস এগিয়ে, দেখিয়ে দিলো কোথায় কোথায় সাইন করতে হবে।

সে আমাদের কারো কাছেই এতটুকু আশ্রয় পেলনা। কূল হারা মাঝির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। আমি সাইন করে দিলাম। সেও সাইন করে দিলো নিরুপায় হয়ে। রাজনের উপরে তার কোন দাবী নেই। সেটাও লিখিতভাবে জানিয়ে দিলো।

আসার সময় দেখলাম, সে আমাকে ঘাড় ঘুরিয়ে পলকহীন চোখে দেখছে। তার সারামুখে ছিলো অনুশোচনার গাঢ় আবরণ। সম্পূর্ণ কাজ শেষ করে আমরা বাড়ি ফিরলাম শেষ বিকেলে। বাবা আমাদের সবাইকে বাইরে লাঞ্চ করালো। আমি খেতে না চাইলেও বাবার আদেশ অমান্য করার মতো সাহস ছিলনা। তাই বাবার অনুগত ও বাধ্য কন্যা হয়ে খেতে হলো।

ঘরে ঢুকেই রাবু বলল,

” আপা তোর আগের মতো রূপ দেখেই তার মাথা নষ্ট হয়ে গেলো। তাই তোকে আবার ফিরে পেতে চাইছে। বুঝতে পেরেছিস? ”

” না বোঝার কিছুই নেই। আমরা সবাই এটা বুঝতে পেরেছি।”

রাবু বলল,

” যে পুরুষদের কাছে মনের চেয়ে রূপের কদর বেশী। রূপের পসরা দেখলেই যাদের যৌবন খলবলাইয়া উঠে। এমন কুরুচিপূর্ণ পুরুষদের সকাল বিকাল আসতে যেতে গু’য়ের স্যান্ডেল দিয়া তাদের চাবকানো উচিত।”

ধুম করে আমার মুখ দিয়ে হাসি বেরিয়ে গেলো রাবুর কথা শুনে। বললাম,

” ভালো বলছিস। লাইক কমেন্ট সবই দিলাম তোকে। যা।”

রাবু আমাদের সবার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তাক করলো। বলল,

” আচ্ছা, এই বেয়াদবটা কোন শাস্তি পাবেনা?”

মা রাবুকে বলল,
” তুই কি শাস্তি দিতে চাস?”

রাবু বলল,

” আমি কেন শাস্তি দিব? দিবে তো আপা।”

বাবা পাশ থেকে বলল,
” শাস্তি আমরা দিতে হবে না তাকে। আর কি লাভ হবে দিয়ে। মনে রাখবি, কাউকে দৌড়াতে গেলে একই সমান পথ তোরও দৌড়াতে হবে। হয়রানি আছে। সবর করে আল্লাহর উপর ছেড়ে দিতে হয়। তিনিই সবচেয়ে শক্তিশালী বিচারক। তিনি ছাড় দেন,কিন্তু ছেড়ে দেন না।”

আমি বাবার কথায় মত প্রকাশ করলাম,

” ‘রিভেঞ্জ অব নেচার’ বলে একটা কথা আছে। যা অলরেডি সে পেয়েছে। এবং হয়তো আরো পাবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। নিজের জন্মদেওয়া সন্তান বড় হলে চোখের সামনে এখানে ওখানে দেখবে। কিন্তু তার মুখে বাবা ডাক শুনবে না। তাকে বুকে জড়িয়ে নিতে পারবে না। এটার উপরে আর কোন শাস্তি বরাদ্দ থাকতে পারে না একজন পিতার জন্য। আর যে জন্মভিটা থেকে চিরদিনের জন্য অধিকার হারালো। উচ্ছেদ হলো। মৃত পিতার মুখ দেখতে পেলনা। ত্যাজ্যপুত্র তকমা এঁটে গেলো তার জীবনে। এসব কি কম মনে করছিস। তার চেহারা সুরতের হাল দেখেছিস? আমাকে একদিন বলেছে ভাঙ্গাচোরা বেড়ার ঘরের মতো লাগে দেখতে। তাকে কেমন লাগে? তাকে তো বহু পুরোনো ঘূণে ধরা বাঁশের মতো লাগল দেখতে।”

রাবু টেবিল চাপড়ে বলল,

” আপা ঠিক বলছিস। তোকে লাইক কমেন্ট দিলাম। শোধবোধ। ”

তারপর সপ্তাহ খানেক কেটে গেলো,
মাহমুদ ভাই কোনভাবেই আর যোগাযোগ করছে না। এটা আমাকে অল্পস্বল্প হলেও ভাবিয়ে তুলল। কোন অসুখ বিসুখ হলো নাকি উনার। ফোন দিব দিব করেও সংকোচে আর দেয়া হয়নি।

আমি ও আঞ্জুমান মিলে পার্লারের জন্য বড় একটি রুম পেয়ে গেলাম। ওয়াশরুম তো আছেই। ততটা যুতসই মনে হলোনা। তবে প্রাইমারি লেভেলের জন্য মন্দ নয়। টাকা বাবার কাছেই গচ্ছিত আছে। আমাকে দিতে চেয়েছে। আমিই নেইনি। যখন যা লাগে বাবার থেকে নিয়ে নিয়ে পার্লারের যাবতীয় জিনিসপত্র কিনে নিচ্ছি। বাবা দায়িত্ব নিয়ে রঙ মিস্ত্রি দিয়ে অফ হোয়াইট কালার রঙ করিয়ে দিলো। পার্টিশন দিয়ে একপাশে সরু লম্বা রুম বের করা হলো। ফেসিয়াল ও বিভিন্ন রূপ চর্চার জন্য একটা সিট ফেলতে হবে তাই। পুরো রুম নতুনের মতো চকচক করছে। এভাবে একমাস লেগে গেলো রুমটাকে পুরোপুরি লেডিস বিউটি পার্লারের উপযোগী করে তুলতে। নেইমপ্লেট রেডি। আকর্ষণীয় নাম দিলাম। ‘অঙ্গসাজ’।

তবে যত যাই করছি। বিয়ের বিষয় টা ভুলিনি। এ নিয়ে বাবা ও মায়ের উপরে আমার ক্ষোভ ও অনুযোগ রয়েছে। এটা মা ধরতে পেরেছে। যেহেতু আমি শুনেই গিয়েছি।

এক সকালে মা আমাকে ডেকে নিলো নয়নকে দিয়ে। বাবাও রয়েছে পাশে।
মা বাবার উপস্থিতিতেই বলল,

” মা শোন,তোর বয়স অল্প। যতই স্বাবলম্বী হোস না কেনো,দিনশেষে একজন সঙ্গীর প্রয়োজন রয়েছে জীবনে। কে কতদিন বাঁঁচবে তা আগে থেকে কেউই বলতে পারবেনা। পাশে দুটো ভরসার হাত থাকা দরকার। মাথার উপরে বটবৃক্ষের মতো একজনের নিরবিচ্ছিন্ন ছায়ার দরকার। তোর আব্বা তোর বিয়ে ঠিক করেছে। তবে ফাইনাল হয়নি। তোর মতামত নিয়েই কথা দিবে তাদের। আর অবশ্যই বিয়ে হবে ইদ্দতের চারমাস দশদিন সম্পন্ন হওয়ার পরেই। তোকে আরো পরেই জানাতাম। কিন্তু রাবু বলে ফেলছে। তাই আমরাও জানালাম তোকে। ”

” পাত্র কে বাবা? আর যেই হোক। আমি আগে নিজে শক্তভাবে দাঁড়াই। তারপরে দেখা যাবে। ”

” পাত্র আমাদের অচেনা। আমিও দেখিনি। আমার এক ব্যবসায়ীক বন্ধুর ভাইয়ের ছেলে। চট্রগ্রাম ব্যবসা করে নাকি। বিপত্নীক। স্ত্রী মারা গিয়েছে হঠাৎ করে। ছোট একটি কন্যা সন্তান রয়েছে।সব মিলিয়ে আমার কাছে ঠিকঠাক মনে হলো। সেও সন্তানের গুরুত্ব বুঝবে। তুই বুঝবি। যেহেতু দুজনেরই সন্তান রয়েছে।”

” বাবা আমি আপনার পছন্দকে সম্মান করি। আমি একবার পাত্রের সাথে দেখা করবো। তারপর জানাবো। তাও এখন নয়। কয়দিন পর। মনের দিক থেকে আমি ভালো নেই বাবা।”

” আচ্ছা সময় নে তুই মা। সমস্যা নেই। আর পার্লার কবে চালু করবি?”

” এ মাসের শেষে মিলাদ দিবো। তারপরের মাসের এক তারিখ থেকেই বিসমিল্লাহ বলে চালু করবো। একজন বিউটিশিয়ান ও রেডি। নাম সাংমা। পাহাড়ি মেয়ে। ”

” খুব ভালো। তাহলে আমি মিলাদ পড়ানোর জন্য হুজুরকে বলে রাখবো। আমাদের মসজিদের আতিক হুজুরকে বলব।”

বাবা মায়ের সামনে থেকে সরে গেলাম। তাদের সামনে স্বাভাবিক থাকলেও আমার কেমন যেন বেশ খারাপ লাগছে। মাহমুদ ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে। হঠাৎ করে উনার কি হলো বুঝে উঠতে পারছি না। কারো কাছে বলতেও পারছি না। আমার নতুন কর্ম জীবনের বিষয়টাও উনার অজানা। তার এটা জানার অধিকার আছে কাজিন হিসেবে। সে এই ভিতরে বাড়িও এলনা আর। আমি চাই মিলাদের দিন তিনি উপস্থিত থাকুক। যার জন্য আরাধনার মন্দির সাজিয়ে প্রতিক্ষার প্রহর গুনছে বসন্তের পর বসন্ত। সেই মাহমুদ ভাইয়ের প্রার্থনার হাত উঠুক তার পানকৌড়ি’টার জন্য।

অলস দুপুরে মোবাইল বেজে উঠলো। রাজনের বড় চাচী লায়লা ভাবির ফোন। সবার খোঁজ খবর নিলাম। এরপর উনি বিস্মিত স্বরে বললেন,

” শোন। ঘটনা তো রমরমা। তোর জন্য খুশীর খবর এটা।”

আমার আর তর সইলো না। ব্যস্তসমেত হয়ে জানতে চাইলাম,

” কি হয়েছে ভাবি?”

” আরেহ কি হইতে আর বাকি? সব খবর ত পাই। শিরিন এই বাড়ির ময়নারে বলে। ময়না আইসা আমাদের বলে। ময়নারে শিরিন মানা করে আমাদের না বলার জন্য। কিন্তু ময়না বাদুনি আমাদের না বলে থাকতে পারেনা। এই দুটার খাতির তো বহু আগ থেকেই।
এদিকে আম্মার শারিরীক কন্ডিশনও ভালো না। ধর যত যাই হোক। মায়ের কাছে তো সন্তান। মন পোড়েই ওই ইবলিশের জন্য।”

” আজব ভাবি। আসল কথা না বলে সাইড কথায় চলে যাচ্ছেন। ”

” বলছি। শুন, শিরিন জিন্দেগীতেও মা হইতে পারব না। এবার বুঝুক কত ধানে কত চাল। আর বারো মাসে বছর না আঠারো মাসে বছর।”

আমি চমকে উঠলাম। একজন নারী কোনদিন মা হতে পারবে না। এটা যে কতবড় শূন্যতা,কত বড় যন্ত্রণা সেই নারীর জন্য। আমি তো নারী। তাই আমি বুঝি। বললাম,

” কি বলছেন ভাবি? সত্যিই তো? কিভাবে এটা সিউর হলো তারা?”

” শিরিনের নাকি পিরিয়ড বন্ধ হইছে পাঁচ সপ্তাহ চলছে। এই ভিতরে তার তলপেট ব্যথা আরম্ভ হয়। পরে হাসপাতালে নেয়। টিউমার হইছে নাকি জরায়ুর মুখেই। তো জরায়ু নাকি কাইটা ফালায়া দিতে হইছে। জরায়ু না থাকলে বাচ্চা ক্যামনে হইবো আর?”

” হায় আল্লাহ! এদিকে সেতো লিখিতভাবে রাজনের অধিকার ছেড়ে দিয়েছে। তারমানে চিরদিন নিঃসন্তান হয়েই বাঁচতে হবে।”

” ওই তুই আফসোস করস ক্যান? আমার তো খুশী লাগতাছে। যে আমার পবিত্র চরিত্রে কলংকের দাগ লাগায়া দিলো। তার জিন্দেগীর এমন দুর্দশাই হওয়া উচিত।”

” তা ঠিক ভাবি। নাহ। আমি কেবল একজন মেয়ে হয়ে অন্য একটা মেয়ের এই বিষয়টা অনুধাবন করলাম। এইই।”

” শোন। খবর আরেক টা আছে। জালিমে নাকি বিদেশ নাকি যাইতে পারব না আর। গার্মেন্টসে নাকি অল্প বেতনের চাকরি করে। রাহিমা আপার বাসায় আছে। শিরিনও নাকি সুস্থ হইলে চাকরি করবো গার্মেন্টসে। তার পরিবারের কেউই তার সাথে যোগাযোগ করে না। আছিলো বাবার সংসারে রাজকন্যার মতন। আর এখন চলে রাহিমা আপার বাসায় চাকরানির মতন। আহ! কি দূর্গতির জিন্দেগী হ্যাগো দুইজনের।”

ভাবির থেকে কথা বলে বিদায় নিলাম। প্রলম্বিত স্বাস ফেললাম এই ভেবে,

প্রতিটি মানুষের জীবনেই কোন না কোনভাবে উজানের ঢেউ আসে। উল্টো স্রোতের মতো ভেসে যায় জীবনের উজান ঢেউয়ের তোড়ে।
সাঁতরে টিকে থাকতে পারে কয়জন আমার মতো। দুমড়ে মুচড়ে যায় আশরাফুল ও শিরিনের মতো। টিকে থাকতে পারাটাই সফলতা। হেরে যাওয়াটাই চরম ব্যর্থতা। তাদের এই জীবনের জন্য তারাই দায়ী। তাই ছারখার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার জীবনের জন্য আমি দায়ী নই। আমি নিদোর্ষ ছিলাম। নিরপরাধ ছিলাম। তাই আমি ঘুরে দাঁড়াতে পারছি।

সময়,পরিবেশ,পরিস্থিতি এখন আমার অনুকূলে। কথায় আছে,

” সময় হলো অর্থ সম্পদের মতন। আজ তোমার কাল আমার।”

কেবল সময়ের সদ্ব্যবহার করা জানতে হয়। মাকে সব জানালাম। মাও আফসোস করলো কিছুটা।

এদিকে মনস্থির করলাম পরেরদিন মাহমুদ ভাইকে সরাসরি ফোন দিবো। ফেসবুকে বোবা ভাষায় ডিটেইলস বলা সম্ভব নয়।

নিরালা দুপুরে মাহমুদ ভাইকে ফোন দিলাম। সালাম দিলাম। তিনি সালামের জবাব দিয়েই বললেন,

” অভিনন্দন পানকৌড়ি। নতুন জীবনে পদার্পণ করতে যাচ্ছিস। শুনে খুব ভালো লাগল। ”

আমি ধরে নিলাম হয়তো পার্লারের কথা মিন করেই এটা বলেছে। কারো কাছ থেকে শুনতেই পারে। এটা লুকোচুরির বিষয় নয়।আমি মুঠোফোনর এ-প্রান্তে মৃদু হেসে বললাম,

” দোয়া করবেন আমার জন্য। মাহমুদ ভাই আপনি কবে আসবেন বাড়িতে?”

তিনি অনুজ্জ্বল হাসি দিয়ে বললেন,

” দোয়া তোর একার জন্য নয় শুধু। তোদের দুজনের জন্যই। তা তোর হবু বরের নাম কিরে পানকৌড়ি? ”

মুহূর্তেই আমার হাসিহাসি মুখে ভর করলো প্রগাঢ় নৈঃশব্দ্যতা ও বেদনার স্তুপ।

চলবে.. ১০

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে