Saturday, August 2, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 408



মন গহীনের শব্দ পর্ব-০৯

0

মন গহীনের শব্দ
| ৯ |
সুলেখা আন্টি নিজেকে সামলাতে পারল না আর। রাতের আলো আঁধারে রোডসাইড ল্যামপোস্টের আবছা আলোয় আমি দেখলাম, সে কাঁদছে।

আমি তাকে থামালাম না। সামনের নদীর দিকে তাকালাম। ছোট নদীটি এখন একেবারেই শান্ত। সেই শান্ত নদীটির দিকে তাকিয়ে অশান্ত হৃদয় নিয়ে আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম সুলেখা আন্টির কান্না থামার।

খুব দ্রুতই অবশ্য তিনি সামলে নিলেন নিজেকে। বললেন, “জানো সু, আমার জীবনটা প্রচুর অপূর্ণতায় পরিপূর্ণ। ছোটোবেলাতেই মাকে হারালাম। মাস পেরোতে না পেরোতেই বাবা আবার বিয়ে করল। সৎ মা প্রচন্ড দুর্ব্যবহার করতেন। তাও মুখ বুজে সব সহ্য করে ছিলাম। কিন্তু আমাকে তার সংসার থেকে তাড়ানোর জন্য শেষপর্যন্ত গয়না চুরির জঘন্য অপবাদ চাপিয়ে দিলেন মাথায়। সেদিন অমানবিক অত্যাচার করা হলো আমার উপর। নয় বছর বয়সী আমাকে মে মাসের প্রচন্ড গরমে হাত পা বেঁধে উঠোনের তপ্ত মাটিতে প্রখর সুর্যালোকে রেখে দেওয়া হলো সারাদিন। বাবা রাতে বাড়ি ফিরলে তাকে বলা হলো আমাকে বাড়িতে রাখলে সে নাকি আর থাকবে না।

পরদিন বাবা নিজেই গিয়ে আমাকে নানাবাড়ি রেখে আসলো। সাথে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিল, আমাকে আর সে ফেরত নেবে না। নানা মারা গেছে অনেক আগেই, নানি বেঁচে থাকলেও পুরোপুরি মামাদের উপর নির্ভরশীল। চাইলেও তার পক্ষে আমার জন্য কিছু করা সম্ভব ছিল না। তার নিজেরই প্রতিনিয়ত ছেলের বউদের গঞ্জনা সহ্য করতে হতো। বাবা রেখে যাওয়ার পর নানাবাড়িতে আমাকে নিয়ে একপ্রকার হট্টগোলই বেঁধে গেল। তিন মামার কেউই নিজেদের সাথে আমাকে রাখবে না। অনেক তর্কবিতর্কের পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, বড়মামা যেহেতু সবার বড় তাই তার সাথেই থাকতে হবে আমাকে। কিছুটা হলেও চিন্তামুক্ত হলাম আমি। সৎ মায়ের সংসারে ক্ষুধার কষ্ট আমি খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছিলাম। কতবেলা যে না খেয়ে কাটাতাম। এখানে নিশ্চই আমাকে কেউ না খাইয়ে রাখবে না। অন্তত পেটপুরে তিন বেলা খেতে তো পাব। সত্যিই খাওয়ার কষ্ট রইল না আমার। কিন্তু বড়মামির স্বরূপ খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করলাম কিছুদিনের মধ্যেই। মামি মায়ের মতো বেদম প্রহার করতেন না, অল্প আঘাতই এমনভাবে করতেন যার জন্য ভুগতে হতো আমাকে অনেকদিন।

যেমন ধরো একদিনের কথা বলি, তার পাঁচ বছর বয়সী ছোট ছেলেটাকে আমার কাছে দিয়ে বললেন দেখে রাখতে। অনেকক্ষন দেখে রাখার পর আমি কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম, এরমধ্যেই ছেলেটার কীভাবে যেন অল্প হাত কেটে গেল। যদিও সেটা একেবারেই সামান্য ছিল, তবু তার জন্য কঠিন শাস্তি দেওয়া হলো আমাকে। মামি রান্না করছিলেন তখন, গরম লোহার খুন্তি হাতেই এগিয়ে আসলেন আমার দিকে। ফ্রকটা তুলে তলপেটে চেপে ধরলেন সেটা। আমি আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠলাম। এরকম আরও বহু অত্যাচার চলতো আমার উপর দিনের পর দিন। তবে এতকিছুর মধ্যেও একটা দিক থেকে আমি মামার প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলাম। কিভাবে যেন মামিকে রাজি করিয়ে মামা আমাকে একটা প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল। মামির সংসারে হাড়ভাঙা খাটুনির সাথে সাথে পড়ালেখাটাও চালিয়ে যাচ্ছিলাম কোনোভাবে। এরকম করেই এসএসসি পাস করলাম।

তারপরেই বেঁকে বসলেন মামি। কিছুতেই আর পড়াবেন না। আমি মেনে নিলাম। অন্যের অনুগ্রহে যা হয়েছে তাই অনেক। কিন্তু কিছুদিন পরে আরও ভয়ংকর একটা কাজ করে ফেললেন মামি। মামার অনুপস্থিতিতে হুট করেই একদিন আমার বিয়ে দিয়ে দিলেন। আমার মতামতের তোয়াক্কা না করে একপ্রকার জোর করেই বিয়েটা দেওয়া হলো। এমনকি যার সাথে বিয়ে হবে, বিয়ের আগে তার চেহারাটুকুও দেখতে দেওয়া হলো না আমাকে। বিয়ে পড়ানোর পর তাকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। মাত্র ষোলো বছর বয়স ছিল তখন আমার। কিন্তু যার সাথে বিয়ে হয়েছে তার বয়স তখন কমপক্ষে পঞ্চাশ হবে।

ওবাড়িতে যাওয়ার কিছুদিন পর কাগজপত্র ঘেঁটে জানতে পেরেছিলাম তার বয়স ছাপ্পান্ন চলছে। মানে বুঝতে পারছ? আমার থেকে গুনে গুনে চল্লিশ বছরের বড় ছিল সে। ততদিনে আমি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে গিয়েছি একেবারে। খুব বড় স্বপ্ন আমি কখনোই দেখিনি৷ তবে খুব করে চাইতাম নিজের ছোট্ট একটা সংসার হোক। কুড়েঘর হলেও নিজের একটা ঘর হোক। একান্ত নিজের একটা মানুষ হোক। সবই ইচ্ছেই পূরণ হলো। কুড়েঘরের বদলে বিশাল রাজপ্রাসাদ পেলাম। স্বামী সংসার সবই হলো। কিন্তু সব হয়েও কিছুই হলো না আমার।

বিয়ের পর তার বয়স দেখেই আমি আন্দাজ করেছিলাম, এটা তার দ্বিতীয় বিয়ে। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পরে বুঝতে পারলাম, প্রথম স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থাতেই তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। এমনকি তার প্রথম পক্ষে চারটা মেয়েও রয়েছে। সেই মেয়েদের মধ্যে বড় মেয়েটি আমার চেয়েও বছর দুয়েকের বড়, পরের জন আমার সমবয়সী। বিয়ের রাতেই তিনি আমার কাছে সবটা খুলে বললেন। তিনি আমাকে বিয়েই করতে চাননি আসলে। শুধুমাত্র মায়ের চাপে পড়ে করতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের বিশাল সম্পত্তির পুরোটাই তার মায়ের নামে। কিন্তু ছেলের প্রয়োজন সত্ত্বেও সেই সম্পত্তি তিনি কিছুতেই ছেলেকে দেবেন না। নাতির মুখ দেখতে পারলেই কেবল সম্পত্তি দেবেন ছেলেকে। প্রথম বউয়ের পরপর চার মেয়ে। শারীরিক জটিলতার জন্য তিনি আর সন্তান নিতে পারেননি। সেজন্যই বাধ্য হয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করা। বিয়ের রাতেই তিনি জানালেন আমাকে তার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। শুধু মায়ের জেদের জন্যই কাজটা করতে বাধ্য হয়েছেন তিনি৷ প্রয়োজনীয় কথাটুকু সেরে তিনি তার প্রথম স্ত্রীর কাছে চলে গেলেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এরকম একটা অসম সম্পর্ক আমার পক্ষেও মেনে নেওয়া সহজ ছিল না। এরপর প্রত্যেকটা রাতই এভাবে কাটতে লাগল। মাকে দেখিয়ে রাতে তিনি আমার ঘরে আসলেও সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর আবার চলে যান। সংসার স্বামী সবটাই তার প্রথম স্ত্রীর আয়ত্বে ছিল। তবুও তিনি আমাকে দেখতে পারতেন না একেবারেই। এতে অবশ্য তার দোষ দেওয়া যায় না। কোনো স্ত্রীর পক্ষেই নিজের স্বামীর অন্য স্ত্রীকে মেনে নেওয়া সহজ নয়। তাছাড়া তার মনে আরও একটি ভয় কাজ করত সম্ভবত। যতই সবকিছু তার হাতের মুঠোয় থাক, আমিও তার স্বামীর বিয়ে করা স্ত্রী। পুরুষের মন বদলায় ক্ষনে ক্ষনে। যদি কখনও আমার মোহে পড়ে সে আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়, এবং যদি সত্যিই আমার গর্ভে বংশের উত্তরাধিকারি আসে, তাহলে স্বামী সংসার সবই তার হাতছাড়া হয়ে যাবে। এমনকি সম্পত্তিও তার মেয়েরা পাবে না।

এভাবেই কেটে গেল কয়েকমাস। ওবাড়ির কেউ আমার সাথে কথা পর্যন্ত বলে না। এতগুলো মানুষ থাকা সত্বেও আমি একঘরে হয়ে গেলাম ওই বাড়িতে। নিজের জীবনটা আমার কাছে শুধুই প্রহসন বলে মনে হতো তখন। প্রায় ছয় মাস পার হয়ে যাওয়ার পর একদিন আচমকা তার পরিবর্তনটা লক্ষ করলাম আমি। নানা ছুতোয় আমার কাছে ঘেসার চেষ্টা করতেন। একদিন সরাসরিই বলে ফেললেন, তিনি আমাকেও তার স্ত্রীর মর্যাদা পুরোপরিভাবে দিতে চান। তার ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হলো না আমার। ততদিনে আমার নিজের স্বপ্ন,আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা সবই মরে গেছে। যে যা বলে সেটাই মেনে নেই। নিজের ভাগ্যকে এবারও মেনে নিলাম। শুধু আমি নই, তার এই পরিবর্তন তার প্রথম স্ত্রীও ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন। সব বুঝে ফেলার পরেই মোক্ষম চালটা চাললেন তিনি।

একদিন দুপুরে খাবার খেয়ে ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে পায়ের উপর অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে ঘুম ভেঙে গেল আমার। তাকিয়ে দেখলাম সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে খাটের পাশেই। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আধশোয়া হয়ে আমাকে বিছানার সাথে চেপে ধরল লোকটা। আমি তখন আতঙ্কে চিৎকার করতেও ভুলে গেছি। কিছু একটা বলে চেঁচিয়ে উঠতে যাব, ঠিক তখনই ভেজানো কাঠের দরজাটা শব্দ করে খুলে গেল। বাড়ির সবাই প্রায় একসাথেই ঢুকল ঘরে। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হলো আমাকে সেদিন। কিছু না করেও আমি হয়ে গেলাম চরীত্রহীনা। একপর্যায়ে তার প্রথম স্ত্রীটি চুলের মুঠি ধরে ঘরের বাইরে এনে ধাক্কা মারলেন আমাকে। সবার অগোচরে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, খুব সখ হয়েছিল, এবাড়ির রানী হওয়ার, তাই না? আজ সেই সখ মিটিয়ে দিলাম।

আমি তখন কান্না ভুলে তার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম। বোঝার চেষ্টা করছিলাম সেই বিয়ে থেকে শুরু করে এই পুরো ব্যাপারটাতে আমার দোষটা আসলে কোথায়। দীর্ঘক্ষন আমার চরিত্র নিয়ে কাঁটাছেড়া করার পর বাড়ির সব সদস্যদের উপস্থিতিতেই আমাকে তালাক দিলেন তিনি। শেষমেষ সিদ্ধান্ত হলো, আমাকে আবার মামার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। আবার সেই পুরোনো জীবন।

মামার বাড়িতে ফিরে আসার কিছুদিন পরেই আমার ফিরে আসার কারন ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। দলে দলে আশেপাশের বাড়ির মেয়ে বউরা আসতো। নানান কথা শুনিয়ে যেত। মামিও তাদের সাথে সায় দিতেন। বুড়ো স্বামী দিয়ে আমার হয় না বলে পরপুরুষ এনে আমি জ্বালা মেটাই, একাধিক পুরুষের সাথে আমার সম্পর্ক আছে এরকম আরও বহু নোংরা আপবাদ যা মুখে উচ্চারণ করতেও আমার বাঁধে। মাঝে মাঝে অতি কষ্টে আমার হাসি পেয়ে যেত। তাদের মতে বহু পুরুষের সাথে আমার বিছানায় সম্পর্ক রয়েছে, অথচ আমি তখনও কুমারী। গভীরভাবে কোনো পুরুষের স্পর্শ আমার গায়ে লাগেনি অব্দি। এভাবেই কেটে গেল কয়েক বছর। লোকেরা আমার নামে নিন্দা করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে ছেড়ে দিল ওসব। তারপর একদিন এলাম শহরে খালার বাসায়। খালা অসুস্থ তাই কিছুদিন তার সংসার দেখাশোনা করতে হবে। সেখানেই তোমার দাদি আমাকে দেখে পছন্দ করলেন। খালা পুরোনো কথা লুকিয়ে বিয়ে দিতে চাইলেও আমি নিজেই সব খুলে বললাম তোমার দাদিকে। তিনি জেনেশুনেই তার পুত্রবধু করে নিলেন আমাকে। আবারও চোখে না দেখেই অজানা অচেনা একটা লোকের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল। তোমার মায়ের ব্যাপারটা তোমার দাদি বিয়ের আগেই আমাকে বলেছিলেন। বিয়ের রাতে তোমার বাবাকে দেখে আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থাকলাম। এত সুদর্শন পুরুষ আমি আমার জীবনে দ্বিতীয়টি দেখিনি কখনও। আমার বিশ্বাস হতে চাইল না, এরকম একটা মানুষকে তার স্ত্রী ছেড়ে যেতে পারে।

নিজেকে নিয়ে ভাবা অনেক আগেই আমি বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আঘাতে জর্জরিত হয়ে আমি বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম যে, কিছু কিছু মানুষ শুধু দুর্ভাগ্য নিয়েই পৃথিবীতে আসে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তারা সুখের দেখা পায় না। আমি মেনে নিয়েছিলাম, আমিও সেই দলেরই একজন। কিন্তু তোমার বাবার সাথে জড়ানোর পর আমি আবার নতুন করে স্বপ্নের আকাশে ডানা মেলে উড়তে শুরু করলাম। তারপর খুব জলদিই আবার মাটিতে মুখ থুবড়ে পরলাম। তোমার বাবা স্পষ্টই জানালেন, তার পক্ষে কখনও আমাকে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। এদিকে তোমার দাদি প্রতিনিয়তই চাপ দিতেন, যেভাবেই হোক তার এই রগচটা ছেলেকে আগের হাসিখুশি অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমিও বারবার সেই চেষ্টাই করতাম। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক স্বাভাবিক করারও সবরকম চেষ্টাই করতাম কিন্তু প্রতেকবারই প্রত্যাখ্যাত হতাম খুব কঠিনভাবে। মাঝে মাঝে রাগে বিছানা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হতো আমাকে। সেধে ঘনিষ্ঠ হতে গিয়ে অপমানিত হতে হতো প্রত্যেকবার। সেই সময়ের অনুভূতিটা আমি ভাষায় ব্যাখ্যা করতে পারব না। লজ্জায় তখন মরে যেতে ইচ্ছে হতো আমার। একসময় হাল ছেড়ে দিলাম। আরও একবার নিজের দুর্ভাগ্যকে মেনে নিলাম। তোমার দাদি প্রথমে নরম আচরণ করলেও একসময় বদলে গেলেন।

এবার আর আমি ভেঙে পড়লাম না। কারন ততদিনে আমার খারাপ থাকার অনেকগুলো কারনের মধ্যে একটা ভালো থাকার কারনও তৈরি হয়েছে। সেই কারনটা হলে তুমি। ওবাড়িতে যাওয়ার দিনই তুমি ‘মা মা’ বলে ছুটে এলে আমার কাছে। তোমার বাবা সাথে সাথেই তোমাকে বললেন, আমি তোমার মা নই। শিখিয়ে দিলেন আমাকে আন্টি বলে ডাকতে। তারপর থেকে তুমি আন্টি বলে ডাকলেও আমি আমার মেয়ের স্থানটা তোমাকেই দিয়ে দিলাম। আমার শত অপূর্ণতার মাঝেও পরিপূর্ণ হয়ে গেলাম তোমাকে পেয়ে।

এই কথাগুলো আজ পর্যন্ত আমি কারও সাথে শেয়ার করিনি। ভবিষ্যতেও হয়তো করতাম না। কিন্তু জীবনের এই অন্তিমলগ্নে এসে অন্তত একজনের সাথে হলেও সবকিছু বলতে ইচ্ছে হলো। তাহলে হয়তো নিজের কষ্টগুলো একটু হলেও হালকা হবে। তুমিতো আমার মেয়ে৷ একটা সময়ের পর মা আর মেয়েই নাকি হয়ে ওঠে একে অপরের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধু মনে করেই আজ তাই কথাগুলো তোমার সাথে অকপটে বলে ফেললাম। তবে কথা দাও, তুমি আজ যা যা জেনেছ এগুলো দ্বিতীয় কাউকে বলবে না কিংবা বুঝতে দেবে না কখনও।”

এতক্ষন যাবত চুপ করে তার বলা কথাগুলো শুনে যাচ্ছিলাম। আমি উপলব্ধি করলাম, এতগুলো বছর ধরে যে মানুষটা আমাদের পরিবারকে শুধু দিয়েই গেছে, সেই মানুষটার প্রাপ্তির ঝুলি একেবারেই শূন্য।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)

#আমাতুল্লাহ_স্বর্ণা

মন গহীনের শব্দ পর্ব-০৮

0

মন গহীনের শব্দ
| ৮ |
কিন্তু তার ব্যক্তিত্বের কাছে একশ তামিম ভাইও মূল্যহীন।আমি তার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললাম, “সুন্দর লাগছে।”
উত্তরে আবারও সেই হৃদয় কাঁপানো শব্দহীন হাসি। তিনি গাড়ি স্টার্ট দিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “আজ কি আমরা শুধু গাড়িতেই থাকব?”
“নদীর পাড়ে যাব। ওখানে কিছুক্ষন থেকে সন্ধ্যার আগেই বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসব তোমাকে।”
“এই না প্লিজ, আজ আমি বেশি রাত অব্দি বাইরে থাকব।”
“সুজাতা, বিয়েটা হয়নি এখনও। বেশিক্ষন এভাবে থাকাটা বোধহয় ঠিক হবে না। তাহলে আজ ভুল কিছু হলেও হয়ে যেতে পারে।”
“সবকিছুতেই শুধু বিয়ে, বিয়ে আর বিয়ে। তারমানে বিয়ের আগে আমি কিছুই করতে পারব না। ওকে, চলুন তাহলে আজই বিয়ে করে ফেলি।”

কথা শেষ করেই খেয়াল হলো আমার। হুট করে এসব কী বলে ফেললাম? লজ্জায় মাটি ভাগ করে ভিতরে ঢুকে যেতে ইচ্ছে হলো। চট করেই মাথাটা ঘুড়িয়ে অন্যদিকে তাকালাম। আমার লজ্জা আরো বাড়িয়ে দিতে তিনি উচ্চশব্দে হেসে উঠলেন।
“ম্যাডামের তো দেখছি বিয়ে করার খুবই তাড়া।”
আমি বললাম, “প্লিজ, চুপ করেন।”।
তিনি চুপ করলেন না। বলতেই থাকলেন, “আমারও অবশ্য ইচ্ছে আছে বিয়েটা জলদিই করার। তবে আমি ভেবেছিলাম তুমি ভার্সিটি জয়েন করার পরে ধীরেসুস্থে যা করার করব। কিন্তু এখন তোমার আগ্রহ দেখে মনে হচ্ছে, এতটা দেরি করা মনেহয় ঠিক হবে না। আমাকে দূরে সরিয়ে আজকাল তুমি দেখি থাকতেই পারছ না একদম।”
আমি কাতর স্বরে তাকে বললাম, “প্লিজ, এবার অন্তত থামেন।”

কিন্তু আমার অনুরোধ শোনার সময় কই তার। একের পর এক লজ্জা দিয়ে যেতেই থাকলেন তিনি। সন্ধায় বাসায় পৌঁছে দেওয়ার কথা থাকলেও দিলেন না তিনি। মাগরিবের ওয়াক্তে আমাকে গাড়িতে বসিয়ে রেখেই লক করে পাশের মসজিদে নামাজে গেলেন।

আজকাল অবশ্য আমিও নামাজে নিয়মিত হয়েছি। তবে এখন মাসের বিশেষ দিনগুলো চলছে বলে নামাজের তাড়া নেই।

অনেকটা সময় একসাথে কাটিয়ে আমকে যখন বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে গেলেন তখন প্রায় রাত দশটা বাজে ঘড়িতে। তখনও আমি জানতাম না যে পরের দিন এতবড় একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে আমার জন্য। এক রাতের মধ্যে তিনি কী এমন করলেন জানি না। পরেরদিন বাদ মাগরিব কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়াই তার সাথে আমার বিয়েটা হয়ে গেল। একটা লাল জামদানি পড়ে কোনোপ্রকার সাজসজ্জাহীন আমি সোফায় গিয়ে তার পাশে বসলাম। শুধু আমাদের বাসার লোক আর আলতাফ ভাইয়ের দুজন বন্ধুর উপস্থিতিতে বিয়ের পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে একে অপরের জন্য বৈধ হয়ে গেলাম আমরা। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, আপাতত ঘরোয়া ভাবে বিয়েটা পর্যন্তই স্থগিত থাকবে সব৷ বাবার নির্বাচনের পরে বড় করে আয়োজন করা হবে। আমার বিশ্বাসই হলো না প্রথমে, এই মানুষটা আজ থেকে শুধু আমার।

রাতে খাওয়ার পর আলতাফ ভাইকে আমার রুমেই পাঠানো হলো আজ। বিয়ের পর প্রথম তার সাথে একা আমি। লজ্জা আর অস্বস্তি ঘিরে ধরল আমাকে। খাটের এককোনে চুপচাপ গিয়ে বসলাম আমি। তিনি আমার পাশে বসলেন কোনোরকম দূরত্ব না রেখেই। আমার একটা হাত টেনে নিলেন তার কোলের মধ্যে। আমি নড়েচড়ে বসলাম। আজকে নিশ্চই তিনি তার অধিকার আদায় করে নেবেন। আজকে রাতটা কেমন হতে পারে, সেটা ভাবতেই প্রচন্ড রকমের লজ্জা পেয়ে গেলাম আমি। লজ্জার সাথে সাথে অস্বস্তিও বাড়ছে। না, তার কাছে নিজেকে সঁপে দিতে কোনো দ্বিধা নেই আমার। তবে আজ তো আমি প্রস্তুত নই শারীরিকভাবে। এই বিষয়টা কীভাবে বলব তাকে সেটা ভাবতেই কুকড়ে যাচ্ছিলাম আমি। তিনি একের পর এক উষ্ণ স্পর্শ একে দিলেন আমার কপালে, ঠোঁটে, গালে। তারপর একেবারে পেঁচিয়ে ধরে শুয়ে পড়লেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেই বিভিন্ন কথাবার্তা বলতে থাকলেন তিনি। প্রত্যেক মুহুর্তেই আমার মনে হলো, এই বুঝি তিনি আরেকটু গভীরভাবে ছুঁতে চাইবেন আমাকে। কিন্তু অনেকক্ষন কেটে যাওয়ার পরেও যখন তিনি সেরকম কিছু করলেন না, তখন আমি নিজেই প্রশ্ন করলাম,
“এতদিন তো বিয়ে হয়নি, সেই ছুতোয় দূরে সরিয়ে রাখতেন আমাকে। কিন্তু এখন তো আমি আপনার জন্য হালাল। তবুও কেন নিজের অধিকার আদায় করে নিচ্ছেন না?”

তিনি সাথে সাথেই উত্তর দিলেন, “কারন তুমি এখন শারিরীকভাবে প্রিপেয়ার্ড নও। খুব সম্ভবত মাসের একটি বিশেষ সময় চলছে তোমার এখন।”

আমি প্রথমে চমকে উঠলাম। তারপর লজ্জায় চুপসে গেলাম। তার বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি কীভাবে বুঝলেন?”

“এই সময়টাতে তোমার মধ্যে অনেক পরিবর্তন আসে। ফ্রেশ মুখটাতে কয়েকটা ব্রন দেখা যায়, চোখের নিচে কালি পড়ে, হাঁটার স্টাইলেও চেঞ্জ আসে কিছুটা। অন্যান্য সময় তুমি খুব চঞ্চল, ধুপধাপ বসে পড়, উঠে দাড়াও, চটপট সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাও। কিন্তু এই সময়টাতে বসতে উঠতে গেলে তুমি সময় নাও কিছুটা। গতকাল অনেকটা সময় তুমি আমার সাথে ছিলে। এই সময়টাতে কিছু ব্যাপার আরও বেশি চোখে পড়েছে আমার।”
আমি লজ্জায় আর মাথা তুললাম না। আমার ব্যাপারে এত ছোটো ছোটো বিষয়ও তিনি নোটিশ করেছেন। আর আমি বোকা এতদিন কিনা ভাবতাম, তিনি বোধহয় ভালো করে আমার দিকে তাকানও না। আলতাফ ভাই হেসে বললেন, “ও ময়না, তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো?”
আমি কৃত্রিম রাগ নিয়ে তার দিকে তাকালাম। বললাম, “আলতাফ ভাই প্লিজ, আপনি অন্তত এই নামে ডাকা শুরু করবেন না এখন।”

“হাসব না কি কাঁদব বুঝতে পারছি না। বউ দেখি এখনও আমাকে ভাই বলে ডাকে।”

আমি জিভে কামড় দিয়ে বললাম, “অনেকদিনের অভ্যাস, ঠিক হতে সময় লাগবে।”
“আচ্ছা যাও, আজ রাত পুরোটা দিলাম তোমাকে। শুধু নাম ধরে ডেকে ডেকে অভ্যাস করো। কাল থেকে ভাই টাই বাদ।”

আমি হাসলাম। পুরো রাত কাটল আমাদের গল্প আর খুঁনসুটিতে।

দেখতে দেখতে চলে গেল আরো দুই মাস। এই দুই মাসে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। আলতাফের সাথে সম্পর্ক অনেকটাই এগিয়েছে। বিয়ের আগে যে মানুষটাকে একেবারেই বেরসিক মনে হয়েছিল, এই একমাসে প্রত্যেকদিন তাকে যেন নতুন করে আবিষ্কার করছি। প্রায় প্রত্যেকদিন রাতেই কোনো না কোনো ছুতোয় বাসায় এসে হাজির হয় সে। এসে আমাকে রুমে পেলেই দরজা আটকে দেবে অথবা বাইরে থাকলে সবার সামনেই ডাক দিয়ে বলবে, “সুজাতা, একটু রুমে এসো তো।”
সবার সামনে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে তখন। দাদি আর রুনি মিটিমিটি হাসে।

আজকে বাসায় ব্যস্ততা প্রচুর। রাত পোহালেই নির্বাচন। আলতাফ, বাবা আর দলের ছেলেপেলেরা ব্যস্ত সকাল থেকেই। সুলেখা আন্টি আর দাদি চিন্তা করছে খুব৷ পরেরদিন ঝামেলাহীন ভাবেই কাটল। মধ্যরাতে বাবার দলের ছেলেপেলেরা উচুঁকন্ঠে স্লোগান দিতে দিতে বিজয়োল্লাসে মেতে উঠল। বাবার জয়লাভে সবাই খুব খুশি। ফলাফল জানার সাথে সাথেই সুলেখা আন্টি নফল নামাজ আদায় করতে গেল। পরেরদিন সকালে আত্মীয়স্বজনে ঘর ভরে গেল। সবাই বাবাকে শুভেচ্ছা জানাতে আসছে। ফুপুও মান অভিমান সব ভুলে আমাদের বাসায় এলো। তিনদিন ধরে চলল মহাভোজ। হাসি আর আনন্দে মেতে থাকলাম সবাই। কিন্তু সেই আনন্দ বেশিদিন রইল না আমাদের।

সপ্তাহখানেক পড়ে পরে হুট করেই একদিন সুলেখা আন্টির শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এলো। আমিই তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম। নরলাম কিছু চেকাপ করে টেস্ট দিলেন। রিপোর্ট পাওয়া যাবে দুই দিন পর। দুদিন পরে রিপোর্ট নিয়ে আবার ডাক্তারের সাথে দেখা করতে গেলাম। রিপোর্টগুলো দেখেই ডাক্তারের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। একই টেস্ট আবার করাতে দিলেন। দ্বিতীয়বারেও সেই একই হতাশা তার চেহারায়। তিনি সুলেখা আন্টিকে বললেন, “আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে খুব। আপনি বরং পাশের রুমে গিয়ে রেস্ট করুন। আমি ততক্ষনে আপনার মেয়ের সাথে কথা বলি।”
সুলেখা আন্টি বললেন, “ডক্টর, আমার কি সিরিয়াস কিছু হয়েছে?”
“আরে না, তেমন কিছু না।”
“দেখুন ডক্টর, আমি টিনেজার নই। আপনি যা খুশি তাই বোঝাতে পারবেন না আমাকে। নিজের বড় ধরনের কোনো অসুখের কথা শুনে ভেঙ্গে পড়ার মত দুর্বলও আমি নই। আপনি নির্দ্বিধায় আমার কাছে সত্যিটা বলতে পারেন।”

অগত্যা ডাক্তার বললেন, “আপনার রিপোর্টে লিউকোমিয়া এসেছে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে রক্তের ক্যান্সার। আর অনেকটা দেরি করে ফেলেছেন আপনারা। প্রাইমারি স্টেজে ধরা পড়লে হয়তো ট্রিটমেন্টে কাজ হতো। এখনও আমি ট্রিটমেন্ট দেব। তবে নিশ্চয়তা দিতে পারছি না কিছুতেই।”

সুলেখা আন্টি শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “ডক্টর, আমার হাতে আর কতদিন সময় আছে? বছরখানেক নাকি আরও কম?”

ডাক্তার মাথা নিচু করে ফেললেন। সুলেখা আন্টি হেসে বললেন, “তারমানে সময় আরও কম?”

ডাক্তার কিছু বলার আগেই আমি হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম ওখানে বসেই। সুলেখা আন্টি স্বাভাবিকভাবেই ডাক্তারের সাথে কথা বলে বের হয়ে এলো। পুরোটা সময় আমি তার হাত ধরে রাখলাম শক্ত করে। সুলেখা আন্টি বাইরে বের হয়ে বলল, “সু, নদীর পাড়ের পার্কটায় যাবে? রাতের এই সময়টাতে চমৎকার লাগে জায়গাটা।”
আমি চোখ মুছে বললাম, “যাব।”

নদীর পাড়ে ভালোই মানুষের ভীর৷ সুলেখা আন্টি আর আমি নিরিবিলি এককোনে টাইলস করা বেঞ্চে বসলাম। আমি তখনও নিশব্দে কেঁদে যাচ্ছি৷ সুলেখা আন্টি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “বোকা মেয়ে, কাঁদছ কেন? শক্ত করো নিজেকে।”

অবাধ্য অশ্রুর সাথে সাথে ভেতরের জমা কষ্টগুলোও বাঁধ ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসতে চাইল এবার৷ আমি কান্না চেপে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললাম, “আমার সাথেই কেন এমন হয় সবসময়? মা কী, সেটা বোঝার আগেই সে আমাকে ছেঁড়ে চলে গেল। একটু একটু করে বুঝতে শিখলাম যখন, তখন আঁকড়ে ধরলাম তোমাকে৷ তারপর থেকে তোমার কাছেই মায়ের আদর, স্নেহ, ভালোবাসা খুঁজেছি। তোমার আঁচলে অদৃশ্যভাবে বেঁধে নিয়েছি নিজেকে। মায়ের জায়গাটা পুরোপুরিই তোমাকে দিয়ে দিয়েছি আমি৷ অথচ আজ তুমিও আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছ। মায়েরা নাকি মমতায় গড়া হয়৷ তাহলে তোমরা এত নিষ্ঠুর কেন?
সুলেখা আন্টি নিজেকে সামলাতে পারল না আর। রাতের আলো আঁধারে রোডসাইড ল্যামপোস্টের আবছা আলোয় আমি দেখলাম, সে কাঁদছে।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)

#আমাতুল্লাহ_স্বর্ণা

মন গহীনের শব্দ পর্ব-০৭

0

মন গহীনের শব্দ
| ৭ |
শেষ রাতের দিকে প্রচন্ড শীতে কাঁপুনি উঠে গেল শরীরে। বুঝতে পারলাম জ্বর আসছে। পাত্তা দিলাম না তেমন। ভাবলাম হালকা পাতলা জ্বর হয়ে দুই একদিনের মধ্যেই সেরে যাবে। কিন্তু টানা পাঁচ দিন ভুগিয়ে অবশেষে জ্বর বিদায় নিল। পড়াশোনা এই কদিনে হয়নি বললেই চলে। কোচিং-এর অনেকগুলো লেকচারও মিস হয়ে গেছে। সেগুলোর ব্যাকাপ দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলাম আমি।

এরমধ্যে আলতাফ ভাইয়ের সামনে যাইনি একবারও। আজও তার সাদা গাড়িটি বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দেখলাম ব্যালকনি থেকে। দূর থেকেও আমি বুঝতে পারলাম, তিনি আমার ব্যালকনির দিকেই তাকিয়ে আছেন। আমি রুমের মধ্যে চলে এলাম।

কিছুক্ষন পরে সুলেখা আন্টি এলো কেক আর চকলেট নিয়ে। বলল, “আলতাফ এনেছে তোমার জন্য। খেয়ে নিও।”
হঠাৎই আমার রাগ লাগল খুব। সেদিন যা তা বলে অপমান করে একবার স্যরি বলার প্রয়োজনবোধ করলেন না তিনি, এমনকি জ্বরের মধ্যে একটা টেক্সট করে খোঁজ অব্দি নিলেন না। আজ হঠাৎ এই আদিখ্যেতা আমার আর সহ্য হলো না। আমি চিৎকার করে রুনিকে ডাকলাম৷ রুনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করল, “এমুন চিল্লাফাল্লা করে ডাকেন ক্যান আপা। আমি তো ডরাইয়া গেছিলাম।”
“এই কেক আর চকলেটগুলো তোর। খেয়ে নিস এগুলো। আর খাওয়া হলে তোর আলতাফ ভাইজানকে একটা ধন্যবাদ দিয়ে আসিস। এগুলো উনিই এনেছেন।”
“আইচ্ছা।”

সুলেখা আন্টি হতাশ চোখে তাকিয়ে বসে আছেন পাশে। কিছুক্ষন পড়েই ঝড়ের বেগে রুমে ঢুকলেন আলতাফ ভাই। সবসময়ের মতো আজ আর অনুমতি নেয়ার প্রয়োজনবোধ করলেন না। রুমে ঢুকেই সুলেখা আন্টিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “চাচি, আমি কি সুজাতাকে কিছুক্ষনের জন্য আমার সাথে নিয়ে যেতে পারি?”
“অবশ্যই, নিয়ে যাও। না যেতে চাইলে জোর করে নিয়ে যাও।”
“ধন্যবাদ, চাচি।”
একপ্রকার টেনে হিঁচড়েই আমাকে রুম থেকে বের করলেন তিনি। একেবারে গাড়ির সামনে এনে হাত ছাড়লেন। গাড়ির দরজা খুলে বললেন, “উঠে পড়ো।”
আমার তখন রাগে শরীর কাঁপছে। আমি বললাম, “যাবো না।”
“যেতে তো হবেই। তোমার সাথে আমার কথা আছে।”
আমি মুখ ভার করে উঠে বসলাম গাড়িতে। গাড়ি এসে থামল তার বাসার সামনে। তিনি আমার হাত ধরেই ভেতরে নিয়ে গেলেন। লিভিংয়েই বসলাম আমরা। তিনি গলা ছেড়ে ডাকলেন, “ফুপু, এদিকে এসো। দেখে যাও, কাকে নিয়ে এসেছি।”
বাবা মা মারা যাওয়ার পর থেকে এক দুঃসম্পর্কের ফুপু থাকেন তার সাথে। নিঃসন্তান এবং বিধবা বলে আর কোনো পিছুটানও নেই তার। ফুপু এসে কিছুক্ষন কুশলাদি বিনিময় করে চলে গেলেন। ফুপু চলে যাওয়ার পর আলতাফ ভাই চেয়ার টেনে একেবারে আমার মুখোমুখি বসে প্রশ্ন করলেন, “এবার বলো, তোমার জন্য নেওয়া খাবারগুলো রুনিকে কেন দিয়েছ?”
“আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই।”
“ইচ্ছে হলেই সব করতে হবে?”
” হ্যাঁ, হবে।”

“ওগুলো আমি আমার হবু বউয়ের জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম। সেগুলো সব তুমি রুনিকে দিয়ে দিয়েছ। নিজের অধিকার নিজেই ছেড়ে দিয়েছ। এবার তাহলে রুনিকেই বিয়ে করে ফেলি, কী বলো?”
“করুন। তাতে আমার কী।”
“আরেকবার বলো প্লীজ। আমি অন্য কাউকে বিয়ে করলে তোমার সত্যিই কোনো সমস্যা নেই? যা বলবে ভেবে চিন্তে বলো কিন্তু। আমি এটাকেই তোমার মনের কথা বলে ধরে নেব।”
আমি কোনোরকমে কান্না চেপে বললাম, “আপনি ইচ্ছে করে আমার সাথে এমন করছেন, তাই না?”
সে বরাবরের মতোই স্বাভাবিক, “কাঁদছ কেন? তুমি তো আগে থেকেই জানতে আমি এরকম। একেবারে ছোটোবেলা থেকেই তো দেখে এসেছ আমার স্বভাব। জেনেশুনেই আমার মতো কঠিন হৃদয়ের মানুষকে পছন্দ করেছ। চাচার কাছে যখন তোমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলাম, তখনও তো তোমার সম্মতি নেয়া হয়েছিল। তাহলে এখন কেন কাঁদছ?”
“আপনি আসলেই খুব খারাপ একটা মানুষ।”

তিনি হেসে দিলেন। আমার একটা হাত আলতো করে তার হাতের মুঠোয় নিয়ে নিচু এবং নরম গলায় বললেন, “স্যরি। সেদিন তোমার সাথে খুব রুড বিভেভ করে ফেলেছিলাম, তাই না?”

ব্যাস, তার এই একটুখানি আহ্লাদে আমার অশ্রু আর বাঁধ মানল না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম আমি। তিনি যেন কৈফিয়ত দিয়ে যাচ্ছেন,
“কী করব বলো। অন্য কেউ তোমার দিকে কামনার দৃষ্টিতে তাকিয়েছে সেটা ভাবলেই মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছিল।”
“তাই বলে আপনি যা নয় তাই বলবেন আমাকে? আমি সেজেগুজে ছেলেদের সিডিউস করি?”

“কখনও না। আমি জানি, আমার সুজাতা একটা পবিত্র ফুল। সেদিন অফিসিয়াল কিছু ঝামেলাও ছিলো। সব মিলিয়ে মন মেজাজ বিক্ষিপ্ত ছিল বলেই ওরকম করে ফেলেছি। তাছাড়া তোমাকে নিজের সামনে থেকে সরাতেও চাইছিলাম।”

আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করাল্ম, “কেন?”

“এরকম আবেদনময়ী হয়ে সামনে এলে নিজেকে সামলানো মুশকিল। যেহেতু আমি একজন পুরুষ, স্বাভাবিক জৈবিক চাহিদাগুলো আমারও আছে। তুমি আমার জন্য হালাল নও এখনও। বিয়ের আগে হারামভাবে ঘনিষ্টতাও চাইছিলাম না। এজন্যই চেয়েছিলাম, বিয়েটা করে ফেলতে। কিন্তু চাচা আর চাচি কিছুতেই তোমার ভার্সিটি জয়েন করার আগে অব্দি বিয়ের প্রেসার দিতে চান না। এদিকে আমি প্রতিনিয়ত তোমার শূন্যতায় তড়পাচ্ছি, ওদিকে তুমি বিধ্বংসী রূপে আমার সামনে আসছো। এভাবে নিজেকে সামলে রাখা যায় না।”

তার কথা শুনে আমি চট করেই নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলাম। নিচের দিকে তাকিয়ে অনুভব করলাম প্রচন্ড রকমের লজ্জা পাচ্ছি।

আলতাফ ভাই বললেন, “এরপর চকলেট দিলে যদি রুনিকে দাও, তাহলে সত্যি সত্যিই ওকেই বিয়ে করে ফেলব।”
আমি বললাম, “আমি করতে দিলে তো।”
তিনি হাসলেন। বললেন, “অবশেষে মেঘ কেটেছে। চলো, এবার তাহলে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।”
“আরেকটু থাকি প্লিজ।”
“এখন না। বিয়ের পরে যত খুশি থেকো।”
“আশ্চর্য, আমি একটু থাকতেও পারব না। তাহলে এখানে আমাকে নিয়ে এসেছেন কেন?”

“নিজের অপরাধবোধ হালকা করতে। সেদিন তোমাকে কঠিন কথাগুলো শোনানোর পর থেকে নিজেই শান্তি পাচ্ছিলাম না। তোমাদের ঘর অথবা পাবলিক প্লেস কথাগুলও বলার জন্য সুইটেবল ছিল না। সেজন্যই এখানে এনেছি। কথা বলা শেষ তাই এখন বাসায় দিয়ে আসবো।”
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, “বেরসিক কোথাকার।”
উত্তরে আবারও সেই হাসি।

এরমধ্যে কেটে গেছে আরো কয়েকমাস। আমার এইচএসসির রেজাল্ট বেরিয়েছে। জিপিএ ফাইভ পেয়েছি শুনে সবাই খুব খুশি। রিলেটিভ, বন্ধুবান্ধব সবাই শুভকামনা জানাতে কল করছে। শুধু একজন মানুষেরই কোনো খবর নেই৷ আমি জানি, সে এমনই তবু অকারণ অভিমান করে থাকলাম সারাদিন।

কাঙ্ক্ষিত মেসেজটি এলো রাত এগারটার দিকে। স্ক্রিনে শুধু একটা শব্দই ভাসছে, “কংগ্রাচুলেশনস।” এই একটা শব্দই আমার কাছে মনে হলো অনেক অনেক দামি।

এদিকে এডমিশন টেস্টের সময়ও ঘনিয়ে আসছে। আলতাফ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ একেবারে বন্ধ৷ না হয় কথা আর না কোনো টেক্সট। শুধু মাঝে মাঝে চোখের দেখা দেখি। দেখতে দেখতে দিন পার হয়ে গেল। পরপর কয়েকটা ভার্সিটির জন্য এক্সাম দিলাম। অনেকগুলোতে দিলেও এখানকার পাবলিক ভার্সিটিতেই অ্যাডমিশন নেওয়ার ইচ্ছে আছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত ওয়েটিং লিস্টে এসে আটকে গেলাম। বাকি সবগুলোতেই চান্স পেয়েছি। রেজাল্ট পেয়ে মন খারাপ হয়ে গেলা আমার।

রাতে বাসায় ফিরে বাবা ডাকলেন তার রুমে। আমি খোলা দরজায় নক করে বললাম, “ডেকেছিলে, বাবা।”।
” হ্যা, আম্মা। এদিকে এসো। তোমার আন্টির কাছে শুনলাম সব। মন খারাপ করে আছো নাকি সারাদিন। বেশি টেনশন নিও না। পাবলিকে না হলে প্রাইভেটে ভর্তি হয়ে যাবে। আর তাছাড়া, ওয়েটিং লিস্টে তো আছ, যা হবে ভালোই হবে ইনশাআল্লাহ। ”
বাবার সাথে কথা বলে মন কিছুটা হলেও হালকা হলো।

পরেরদিন সকাল সকালই এলো আলতাফ ভাই। দুপুরে আমাদের বাসাতেই খেলেন। বিকেলে একপ্রকার জোর করেই আমাকে নিয়ে বের হলেন। আমি গাড়িতে উঠে বললাম, “প্রত্যেকবার আমার হাজার অনুরোধেও একটু সময় দিতে চান না আমাকে, তাহলে আজ সেধে কেন নিয়ে যাচ্ছেন?”

“দাদি বললেন, তার নাতনির মন ভালো নেই। তাই মন ভালো করতে নিয়ে যাচ্ছি।”
উত্তর শুনেই আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তারমানে দাদি বলেছেন বলেই আজ আমাকে নিয়ে বের হয়েছেন৷ তাইতো বলি, যে মানুষ খুব দরকার ব্যতীত আমার সাথে একটা কথাও বলে না, সে কিনা নিজে সেধে আমাকে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে।

আমি বললাম, “আপনার আমাকে নিয়ে যেতে হবে না। আমি যাবো না কোথাও।”
তিনি গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বললেন, “রেগে যাচ্ছো কেন?”

“রেগে যাওয়া উচিৎ না বলছেন? আজ পর্যন্ত নিজে থেকে একদিন কোথাও আমাকে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছেন? কখনও পাশাপাশি বসে ভালো করে দুটো কথা বলেছেন আমার সাথে? আজকেও দাদি বলেছে বলে আমাকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নিজের কোনো ইচ্ছে নেই আপনার? থাকবেই বা কী করে। আমার প্রতি আপনার কোনো অনূভুতিই তো নেই। আমি একাই শুধু…।”
“একাই শুধু কী?”
“কিছু না।”

“আচ্ছা, তোমাকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে কেন নিয়ে যাবো আমি? পাশাপাশি বসে কথাই বা কেন বলব? ধর্মীয় বল কিংবা সামাজিক, কোনো দিক থেকে কি আমাদের মধ্যে কোনো বৈধ সম্পর্ক আছে?”
“মানে! আপনি কি বলতে চান? আমাদের দুজনেরই দুজনের প্রতি যে অনুভূতিগুলো রয়েছে সেগুলোর কোনো দাম নেই?”
“না, আপাতত নেই। তুমি আমার জন্য হালাল নও এখনও। আমাদের ভবিষ্যত সবসময়ই অনিশ্চিত। ধরো,আজকে তোমাকে নিয়ে আমার ফিলিংসগুলোকে বাড়তে দিলাম। কাল তো তোমার সাথে আমার বিয়ে নাও হতে পারে। যতক্ষন পর্যন্ত তোমাকে বিয়ে না করছি, ততক্ষন পর্যন্ত তথাকথিত ভালোবাসার আলাপ করা আমার পক্ষে সম্ভব না।”

“আমি আপনাকে ভালবাসি। তার কি বিন্দুমাত্র দামও নেই আপনার কাছে?”
আলতাফ ভাই হাইওয়ের পাশেই গাড়ি থামালেন। তারপর বললেন, “সুজাতা, হয়তো তুমি আমার কথায় হার্ট হচ্ছো। তবে সত্যি এটাই যে বিয়ের আগেই ভালোবাসায় আমি বিশ্বাসী নই৷”

“আপনি খুব খুব খারাপ একটা মানুষ।”
তিনি হাসলেন, “আমি জানি। কী আর করা বলো, এই খারাপ মানুষটাকেই তুমি শেষ পর্যন্ত পছন্দ করে ফেললে। এরজন্যই তো, সুদর্শন ডাক্তারটিকেও রিজেক্ট করে দিয়েছিলে একসময়। বেচারা অনেক কষ্ট পেয়েছিল।”
“আপনাকে বলেছে। তামিম ভাই কোনো কষ্ট পায়নি।”

“তুমি তার কষ্টটা দেখতে পাওনি। দেখবেই বা কি করে, তুমি তো ভালো করে তার দিকে কোনোদিন তাকাওনি অব্দি। তুমি তো আগেই একটা খারাপ মানুষকে নিজের মনের মধ্যে জায়গা দিয়ে রেখেছো।”

“হ্যা, শুধু আমিই রেখেছি। আমাকে তো কেউ তার মনে জায়গা দেয়নি এখনও।”
“একটু ভালো করে চোখ কান খুলে বোঝার চেষ্টা করো, তাহলেই বুঝতে পারবে কেউ তোমাকে মনে জায়গা দিয়েছে কী দেয়নি।”

আমি সতর্ক হয়ে গেলাম। চোখ কান খুলে কি বোঝার ইঙ্গিত দিলেন তিনি? কিছু কি মিস করে যাচ্ছি? কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তার ইঙ্গিত দেয়ার কারন বুঝতে পারলাম আমি। সাথে সাথেই ফিক করে হেসে দিলাম। তার ঠোঁটের কোনেও মুচকি হাসি লেগে আছে।

সেদিন শপিং মলে পছন্দ করে একটা শার্ট কিনেছিলাম তার জন্য। সরাসরি কখনোই গিফট আদান প্রদান যেহেতু হয় না আমাদের মধ্যে, তাই ইচ্ছে করেই শার্টের প্যাকেটটা তার গাড়িতে ফেলে এসেছিলাম। সেই শার্টটাই আজ পড়ে আছেন তিনি। মুখে কিছু না বলেও তিনি বুঝিয়ে দিলেন যে তার মনেও আমার জন্য একটা সফট কর্নার আছে। এজন্যই এই ব্যক্তিত্ববান মানুষটার প্রেমে বার বার পড়ি আমি। হতে পারে তামিম ভাইয়ের মতো তার গায়ের চামড়া ততটা সাদা নয়। কিন্তু তার ব্যক্তিত্বের কাছে একশ তামিম ভাইও মূল্যহীন।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)

#আমাতুল্লাহ_স্বর্ণা

মন গহীনের শব্দ পর্ব-০৬

0

মন গহীনের শব্দ
| ৬ |
গেট থেকে বাইরে বের হয়ে রাস্তার দিকে তাকাতেই চমকে গেলাম আমি। আলতাফ ভাইয়ের সেই গাড়িটি রাস্তার অপজিট সাইডে পার্ক করা। স্বয়ং তিনিই ড্রাইভিং সিটে বসে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। সাধারন সেই চাহনি, দৃষ্টিতে কোনো কঠোরতা নেই, না আছে চেহারায় কোনো কাঠিন্য। তবু আমার ভিতর পর্যন্ত কেঁপে উঠল তার চোখের দিকে তাকিয়ে। মাথায় প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আলতাফ ভাই কীভাবে জানলেন যে আমি এখানে আছি? কতটা জানেন তিনি? আমি ভদ্র মেয়েটির মতো চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি স্টার্ট দিয়েই তিনি প্রথম প্রশ্নটি করলেন, “মিশন সাকসেসফুল হয়েছে?”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কিসের মিশন?”
ওপাশ থেকে আর কোনো কথা নেই। আমি বুঝতে পারলাম, পরিস্থিতি যথেষ্টই উত্তপ্ত। মিনমিন করে বললাম, “স্যরি।”
“স্যরি ফর হোয়াট!”
“আপনি তো জানেনই তুলি আমার খুব কাছের বন্ধু। সেই স্কুল থেকে বন্ধুত্বটা শুরু। স্কুলে প্রায় সবাই মায়ের ব্যাপারটা নিয়ে কানাঘুষা করত। কেমন করে যেন তাকাত আমার দিকে। একমাত্র তুলিই নিঃস্বার্থভাবে মিশত আমার সাথে। সবার আগে ওই আমার দুঃখগুলোকে আমার মতো করে অনুধাবন করার চেষ্টা করেছে। ওকে বিপদ থেকে বাঁচাতে আমার এই কাজটা করতেই হলো।”

“তুমি তুলিকে হেল্প করেছ, এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমার আপত্তিটা অন্য জায়গায়। একটা নিকৃষ্ট লোককে ফাঁদে ফেলার জন্য তুমি নিজেকে আকর্ষণীয়ভাবে প্রেজেন্ট করেছ তার সামনে। তুমি জানতে সে নোংরা দৃষ্টিতে তোমার দিকে তাকাবে, তবুও তুমি…”
পুরো কথা শেষ না করেই থেমে গেলেন তিনি। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে বসে থাকলাম। এত নিস্পৃহ শীতল কন্ঠস্বর। এ যেন আগাম ঝড়ের পূর্বাভাস। তিনিই বললেন আবার, “অথচ আমাকে বললেই এর সমাধান হয়ে যেত। ওই বাজে লোকটার সামনেই তোমাকে যেতে হতো না। নাকি আমাকে আজকাল আর তোমার প্রয়োজন পড়ছে না।”
“প্লিজ, এভাবে বলবেন না। আমি আসলেই এত কিছু ভাবিনি। ভয় হচ্ছিল, যদি লোকটা তুলির চরম ক্ষতিটা করে ফেলে। তখন মাথায় যা এসেছিল তাই করেছি।”
“ওকে, আজ থেকে তুমি নিজের মর্জি মতোই থেক তাহলে।”
আমি এবার কেঁদেই ফেললাম। কাতর কন্ঠে অনুরোধ করলাম, “প্লিজ।”
আমার চোখের পানি দেখেও মন গলল না তার। বললেন, “এখন আর কেঁদে কি হবে? যা করার তা তো করেই ফেলেছ। যতবারই ভাবছি, ওই নোংরা লোকটার সামনে তুমি দিনের পর দিন গিয়েছ, ততবারই তোমাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে।”
আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই তিনি থামিয়ে দিলেন আমাকে, “তোমার বাড়ি এসে গেছে। যাও, ভেতরে যাও।”
আমি বলতে গেলাম, “আপনি একবার…”
“আমি এখন আর কিছুই শুনতে চাইছি না। তুমি বাসার ভেতরে যাও।”
আমি মলিন মুখে গাড়ি থেকে নামলাম। ইচ্ছে করল চিৎকার করে কান্না করি। নিজের করা কাজের জন্য নিজেরই অনুশোচনা হচ্ছে এখন। ঠিকই তো, সেজেগুজে দিনের পর দিন ওই নোংরা লোকটার সামনে গিয়েছি। না জানি কত কুৎসিত চিন্তা সে মনে মনে করেছে আমাকে নিয়ে। তাকে ফাঁদে ফেলতে নিজে থেকে তার হাত অব্দি ধরেছি। সেকথা মনে হতেই শুকনো ঢোক গিললাম আমি। আমি তার হাত ধরেছিলাম সেটা আলতাফ ভাই জানতে পারলে নিশ্চিত আমাকে মেরেই ফেলবেন। এতদিন নিজের প্লান সাকসেসফুল করার জন্য এতটাই মরিয়া ছিলাম যে অন্য কিছু ভাবার অবকাশই ছিল না। কিন্তু আজ আলতাফ ভাইয়ের কথাগুলো শোনার পর কেমন একটা লাগছে। মনে হচ্ছে আবিরের নোংরা দৃষ্টি এখনও গায়ে লেগে আছে। অনেকক্ষন সময় নিয়ে গোসল করলাম আমি। সেই নোংরা দৃষ্টিকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দিতে চাইলাম। সুলেখা আন্টি দুপুরের খাবার খেতে ডাকতে এলো রুমে। আমাকে দেখে বলল, “একি সু? তোমার চেহারা এমন লাগছে কেন? চোখও তো লাল। শরীর খারাপ করেছে?”
“না, আন্টি। তেমন কিছু না। একটু বেশি সময় নিয়ে শাওয়ার নিয়েছি, তাই আরকি।”
“এটা একদমই ঠিক করোনি৷ সিজন চেঞ্জের এই সময়টাতে এমনিতেই ঠান্ডা লাগার চান্সেস বেশি থাকে। তার উপর একমাস পরেই তোমার এক্সাম। এখন এমন লং টাইম শাওয়ার নিলে জ্বর হতে পারে।”
“আর এমন করব না।”
“গুড গার্ল। খেতে এসো এখন।”
সুলেখা আন্টি চলে গেল। কাল রাত থেকে পড়াশোনা হয়নি তেমন। দুপুরের খাবার খেয়েই আজ তাই পড়তে বসে গেলাম। তবে সেটা শুধু বসে থাকাই হলো। পড়া হলো না এক অক্ষরও। হবেই বা কী করে, আবিরের ব্যাপারটা সলভ হলেও মাথার মধ্যে এখন আলতাফ ভাই গেড়ে বসেছেন। আমি পড়ার টেবিল ছেড়ে বিছানায় এসে বসলাম। একটা ফ্রেশ ঘুম প্রয়োজন এখন। তাহলে যদি চিন্তাটা কিছুটা হলেও কমে। ঘুম ভাঙল শেষ বিকালের দিকে। মাথাটা ভার হয়ে আছে। সুলেখা আন্টির কাছে গিয়ে বললাম, “একমগ কফি করে দাও তো।”
“দিচ্ছি, তুমি বসো এখানে। ও, তুমি তো ঘুমিয়ে ছিলে। আলতাফ এসেছিল বিকালে। তোমার জন্য ব্লাক ফরেস্ট কেক আর তোমার প্রিয় চকলেট ফ্লেভারের আইসক্রিম এনেছে। সব ফ্রিজে রাখা আছে। খেয়ে নিও।”
“আমি প্রায় দৌড়েই ফ্রিজের কাছে এলাম। ফ্রিজ থেকে কেক বের করে রুমে চলে গেলাম সোজা। সেই দুপুর থেকে ফোনটা চেক করা হয়নি। ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম স্ক্রিনে সেই কাঙ্ক্ষিত মেসেজের কিছু অংশ ভাসছে। মেসেজ ওপেন করলাম।
“জানি, টেনশন করে খাওয়াদাওয়া পড়াশোনা সবই এখন লাটে উঠবে। কিন্তু সামনেই যে একটা ইম্পর্টেন্ট এক্সাম, সেটাও মাথায় রাখতে হবে। তোমার সাথে আমার বোঝাপড়াটা নাহয় এক্সামের পরেই হবে। এখন যদি আর কোনো উলটাপালটা চিন্তা মাথায় এনে পড়ায় গাফিলতি করা হয়, তাহলে তার ফলাফল কিন্তু ভয়ংকর হবে।”
স্পষ্টই হুমকি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাতে আমি ভয় পেলাম না মোটেও। বরং আজকের পড়াটা আরও ফুরফুরে মেজাজে হলো। দেখতে দেখতে দিনগুলো কেটে যাচ্ছে। একসময় এক্সামও শুরু হয়ে গেল। আমি দিগ্বিদিক ভুলে শুধু প্রিপারেশন নিচ্ছি আর একের পর এক এক্সাম দিচ্ছি। অবশেষে সবগুলো এক্সাম শেষ হলো। এক্সামের পর সপ্তাহখানেক রেস্ট নিয়ে এডমিশনের প্রিপারেশন নেয়া শুরু করে দিলাম। নির্বাচনের সময়ও কাছাকাছি এসে গেছে। আলতাফ ভাইয়ের যাতায়ত বেড়েছে বাড়িতে। কিন্তু বরাবরের মতই তার আচরণ নিস্পৃহ। একবার চোখ তুলে আমার দিকে ঠিকভাবে তাকিয়েও দেখেন না। তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য রোজই নতুন নতুন পন্থা অবলম্বন করছি। কিন্তু সবকিছুর ফলাফল শূন্য৷ তবে আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেভাবেই হোক আজ আলতাফ ভাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করবোই। আচ্ছা, তার প্রিয় রঙের শাড়ি পড়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে কেমন হয়? নিশ্চই চমকে যাবেন আমাকে দেখে। আমি আলমারি ঘেঁটে আমার প্রিয় সাদা শাড়িটা বের করলাম। সাদা সিল্ক কাপরের উপর সুক্ষ্ণ বুননে তৈরি করা হয়েছে শাড়িটা। খুব যত্ন করে শাড়িটা পড়লাম। সিদ্ধান্ত নিলাম আজ প্রিয় এবং অপ্রিয়র কম্বিনেশনে সাজব। আলতাফ ভাইয়ের সবচেয়ে পছন্দের রং সাদা হলেও সবচেয়ে অপছন্দের রং লাল। ব্লাড রেড কালারের লিপস্টিক দিয়ে ঠোঁট রাঙালাম। তারপর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আলতাফ ভাইয়ের গাড়ি গেটের মধ্যে ঢুকতে দেখেই দৌড়ে ড্রয়িং রুমের দিকে গেলাম আমি। তিনি ঘরে ঢুকলেন ফোন স্ক্রল করতে করতে। একবার শুধু চোখ তুলে আমার দিকে তাকালেন। তারপর আবার দৃষ্টি নামিয়ে নিলেন মোবাইলের দিকে। ঠিক যেন আমার কোনো অস্তিত্বই নেই, সেভাবে আমাকে এড়িয়ে সোফায় গিয়ে বসলেন। রাগে আমার মাথায় আগুন ধরে গেল। আমি তার মুখোমুখি গিয়ে বসলাম। তিনি মোবাইলের দিকে চোখ রেখেই জিজ্ঞাসা করলেন, “কিছু বলবে?”
“না।”
“তাহলে এখানে বসে আছো কেন?”
“কিছু না বললে এখানে বসা যাবে না?”
“না বসাটাই বোধহয় ভালো। একটু পরে চাচা আসবেন এখানে, দরকারি কথা বলতে।”
“আপনাদের সেই দরকারি কথায় আমার থাকা কি বারণ?”
“বারণ নয় ঠিক, তবে সেখানে নিজেকে মানানসই মনে হবে না তোমার। বোরিং লাগবে।”
“তবুও আমি থাকব।”
“অ্যাজ ইওর উইশ।”
আমার রাগের পারদ বেড়েই যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কথায়ও সেটা প্রকাশ পাচ্ছে স্পষ্ট৷ অথচ তিনি একেবারে নির্লিপ্ত। আমি বললাম, “কেউ সুন্দর করে সাজলে তাকে মিনিমাম কমপ্লিমেন্টটুকু দিতে হয়৷ এই ম্যানারটুকুও অন্তত দেখানো যেত।”
“এইযে তুমি সেজেছ, এটা যেমন তোমার ইচ্ছে। ঠিক তেমনি কমপ্লিমেন্ট দেব কী দেব না সেটাও আমার ইচ্ছে। আর তাছাড়া আমি তো সবসময়ই ম্যানারলেস। তুমি বরং এই রূপে তোমার আবির স্যারের কাছে চলে যাও। তিনি তোমাকে দেখে খুব সুন্দর সুন্দর কমপ্লিমেন্ট দিতে পারবেন। এর আগেও তো তুমি এরকমভাবে নিজেকে তার সামনে প্রেজেন্ট করেছিলে, তাই না? ভালো কথা, আজ হঠাৎ এতো সাজ কেন? আমাকেও কি তার মত ইমপ্রেস করতে চাইছ? এভাবে এখন পর্যন্ত কজনকে সিডিউস করেছ বলোতো?”
আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলাম তার কথা শুনে। তারমানে এখনও সেই আবির স্যারের বিষয়টা নিয়ে রেগে আছেন উনি। এত ঠান্ডা গলাতেও এরকম ভাবে কাউকে অপমান করা যায়? আমার দুচোখ ছাপিয়ে জল এলো। আজ ইনডিরেক্টলি আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুললেন তিনি। অথচ এই কঠিন মানুষটার সাথে একটু কথা বলার জন্য আমি সারাক্ষন ছটফট করি। একবার তাকে দেখার জন্য সারাক্ষন হাপিত্যেশ করে বসে থাকি। আমি একছুটে রুমে চলে গেলাম। শাড়ি, অর্নামেন্টস সব খুলে বিছানায় ছুরে মারলাম। রাগে জেদে ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে বসে থাকলাম ঘন্টার পর ঘন্টা। তার ফলও অবশ্য হাতেনাতেই পেলাম। শেষ রাতের দিকে প্রচন্ড শীতে কাঁপুনি উঠে গেল শরীরে। বুঝতে পারলাম জ্বর আসছে।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)

#আমাতুল্লাহ_স্বর্ণা

মন গহীনের শব্দ পর্ব-০৫

0

(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য। মানসিকভাবে রক্ষনশীল পাঠক এড়িয়ে চলুন।)

মন গহীনের শব্দ
| ৫ |
আমি ইচ্ছে করেই একটা শপিং ব্যাগ গাড়ির মধ্যে রেখে নেমে গেলাম। প্রথমেই গেলাম সুলেখা আন্টির রুমে। নিজের জন্য কিছু কিনলে সবার আগে তাকেই দেখাই আমি। সুলেখা আন্টি শুয়ে আছে বিছানায়। মুখ জুড়ে ক্লান্তির ছাপ। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কী ব্যাপার? এই অসময়ে শুয়ে আছ কেন?”

“তেমন কিছু না, হালকা একটু জ্বর আছে। হাতে এত ব্যাগ যে, শপিং করেছ বুঝি?”

“আগে বলো তুমি মেডিসিন নিয়েছ? ইদানিং তোমার কিছুদিন পরপরই জ্বর হচ্ছে। একজন ভালো ডাক্তারের সাথে কনসাল্ট করা উচিৎ তোমার।”

“আরে তেমন সিরিয়াস কিছু না। খুবই সামান্য জ্বর হয়। এর জন্য ডাক্তারের কাছে যাওয়া লাগবে না। বয়স হচ্ছে তো, এখন এমন একটু আধটু হয়। তুমি চিন্তা কোরো না।”

সুলেখা আন্টির সাথে কিছুক্ষন কথা বলে রুমে চলে এলাম। সারা বিকেল পড়াশোনার ব্যস্ততাতেই কাটল। বাবার রুমে ডাক পড়ল সন্ধ্যার পরে। অনেকক্ষন ওখানে কাটিয়ে রুমে এসে সাথে সাথেই আবিরকে কল করলাম। ঠিক চারবারের সময় রিসিভ হল ফোন। আমি উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললাম, “স্যার, এতক্ষন ধরে কল করছিলাম, আপনি রিসিভ করছিলেন না কেন?”

“রিল্যাক্স সুজাতা। আমি ফোন রুমে রেখে বাইরে গিয়েছিলাম। কী ব্যাপার বলোতো? তোমার কন্ঠ এমন লাগছে কেন?”
আমি বললাম, “সর্বনাশ হয়ে গেছে স্যার, বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে।”
“এসব তুমি কী বলছ সুজাতা?
“আমার কিছু ভালো লাগছে না স্যার। চলেন আমরা পালিয়ে যাই।”

“তুমি পাগল হয়েছ সুজাতা? কোথায় পালাবো? যেখানেই যাই না কেন, তোমার বাবা আমাদের ঠিক খুঁজে বের করবেন।”

“তাহলে এখন আমরা কী করব স্যার।”
“আমাদের কিছুই করার নেই সুজাতা। তুমি বিয়ে করে নাও।”
“স্যার, আমি বাবাকে আপনার কথা বলব। যেভাবে হোক তাকে রাজি করাবোই।”

“না সুজাতা, তোমার বাবা কখনোই আমাকে মেনে নেবেন না। যদিও আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, তবু বলছি, তুমি বিয়ে করে নাও। তোমার স্মৃতিটুকুই না হয় আমি যত্ন করে আমার মনের মধ্যে রেখে দেব। তোমাকে এই অল্প কয়েকদিনেই আমি প্রচন্ড রকমের ভালোবেসে ফেলেছি। হয়তো তোমাকে না পেলেও বেঁচে থাকব। কিন্তু সেটা বেঁচে থেকেও মরে যাওয়ার সমান হবে। ইচ্ছে করছে এখনই তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসি, কিন্তু আমার হাত পা যে অদৃশ্য শেকলে বাঁধা।”

“ঠিকাছে। ভুলে যাব আপনাকে। কিন্তু শেষবারের মতো আপনার কাছে কিছু চাইব, দেবেন আমাকে?”
“আমার সাধ্যের মধ্যে থাকলে অবশ্যই দেব। তুমি বলো সুজাতা।”
“আপনার একটা দিন আমাকে দেবেন? সেদিন সারাদিন আপনি আমার সাথে থাকবেন। আপনার মনে আছে স্যার, কিছুদিন আগে আপনি আমার হাতের রান্না খেতে চেয়েছিলেন। আপনাকে আমি রান্না করে নিজের হাতে খাওয়াব। একটা দিন প্লিজ, আপনার একটা দিন আমার জন্য দেবেন? দূরে কোথাও একদিন নিজেদের মতো করে কাটাব আমরা।”

“এভাবে কেন বলছ? তুমি চাইলে আমি কখনই না করতে পারি? কিন্তু কেউ জানতে পারলে তোমার আমার দুজনেরই সমস্যা হতে পারে।”
“কেউ জানতে পারবে না স্যার। আমি সব ব্যবস্থা করে রাখব। কালই না হয় চলুন। আমার একটা ফ্রেন্ডের বাসা আছে। ওর বাসায় এখন কেউ নেই। বাইরে বের হওয়াটা রিস্কি। বাবার লোক সবখানেই আছে। তারচেয়ে ওর বাসাতেই চলুন।”

“একটা কথা জিজ্ঞাসা করি?”
“বলুন।”
“আমাকে এত বিশ্বাস করো কেন তুমি? একা পেয়ে তোমার যদি কোনো ক্ষতি করে দেই?”

“আমি জানি, আপনি সেটা কখনোই করবেন না। সুজাতা মানুষ চিনতে কখনও ভুল করে না।”
“আমি নিজের মনকে কীভাবে সান্ত্বনা দেব জানি না। তোমার মতো চমৎকার একটা মেয়েকে পেয়েও হারাতে হচ্ছে আমার।”
“আমার খুব কান্না পাচ্ছে।”

মোটামুটি দীর্ঘ একটা বিরহের আলাপ চলল আমাদের। ফোন রেখে আমি পৈশাচিক হাসি দিলাম। শেষ পর্যন্ত তাহলে পটেছে ব্যাটা। মনের আনন্দে গান শুরু করলাম,
“দেখুক পাড়া পড়শিতে,
কেমন মাছ গেঁথেছি বরশিতে,
দেখুক এবার পড়শিতে।”

গান গাইতে গাইতে গেলাম সুলেখা আন্টির কাছে। বললাম, “আন্টি, তোমার সেই বিশ্ববিখ্যাত পায়েসটা কাল একটু রেঁধে দিও তো আমকে। একজনকে খাওয়াব।”
সুলেখা আন্টি ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “একজনটা কে শুনি?”
আমি হেসে বললাম, “টপ সিক্রেট। বলা যাবে না।”

সেদিন পুরো রাত উত্তেজনায় আমার ঘুম হলো না। পরেরদিন সকাল সকালই নাস্তা করে বের হলাম। নির্দিষ্ট ফ্লাটে পৌঁছে ফোন করলাম আবিরকে। তিনি ফোন রিসিভ করতেই বললাম, “আপনি কোথায় স্যার? এখনও আসছেন না কেন?”
“আমি এসে গেছি সুজাতা। চারতলার ফোর বি ফ্লাট তো। আমি দরজার সামনেই আছি।”

আমি জলদি গিয়ে দরজা খুললাম। স্যার ভিতরে ঢুকতেই আবার তড়িঘড়ি করে দরজাটা লক করে দিলাম। তিনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে কিছুক্ষন। তারপর বললেন, “এই সাদামাটা রূপেও তোমাকে ভয়ংকর সুন্দর লাগছে। একেবারে জলন্ত আগ্নেয়গিরির মত।”

আমি নিচের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসলাম। আবির স্যার বললেন, “ইচ্ছে করছে তোমাকে গভীরভাবে ছুঁয়ে দিতে।”
“কিন্তু এটা অন্যায় স্যার।”
“আমি জানি সেটা। আচ্ছা, আমার এই ইচ্ছেটাও না হয় অপূর্ণই থাক।”
“স্যার, আজকের এই সুন্দর দিনটা মিষ্টিমুখ করে শুরু করি চলুন, আমি আজ নিজের হাতে আপনার জন্য পায়েস রান্না করেছি।”
“তাই হোক তবে।”
আমি পায়েসের বাটিটা স্যারের দিকে এগিয়ে দিলাম৷ স্যার পায়েস মুখে দিয়ে বললেন, “তোমার রান্নার হাত তো দেখি চমৎকার।”

খেতে খেতে পুরো বাটির পায়েসই শেষ করে ফেললেন। আমার অধৈর্য লাগছে কিছুটা। যার থেকে মেডিসিন নিয়েছিলাম সে তো বলেছিল পাঁচ মিনিটের মধ্যেই কাজ শুরু করে দেবে। তাহলে এখনও কিছু হচ্ছে না কেন? আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম আবিরের দিকে, তখনই পরিবর্তনটা লক্ষ করলাম। আর এক সেকেন্ডও তার সাথে থাকা সেফ মনে হলো না আমার। জলদি বাইরে বের হয়ে ছিটকিনি টেনে দিলাম আমি। এরপর গিয়ে মেইন দরজাটা খুলে দিলাম। তামিম ভাই দরজার বাইরেই অপেক্ষা করছিল। তার সাথে আরও দুজন লোক নিয়ে এসেছে। আমাকে দেখেই চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল, “তুই ঠিক আছিস তো? এত দেরি হলো কেন? আমি এদিকে চিন্তায় শেষ।”
“আমি ঠিক আছি, তুমি আগে বলো, ক্যামেরাগুলো ঠিকঠাক লাগিয়েছ?”
“সব রেডি একেবারে। তবুও আমি ভিতরে গিয়ে দেখছি। তুই বাইরেই অপেক্ষা কর।”
“ওকে। ভেতরে গিয়ে ওর মোবাইলটা আমাকে আগে দিওতো। ওটাতে হয়তো কিছু থাকতেও পারে।”

তামিম ভাই তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। মোবাইলটা হাতে পেয়ে আমি আরাম করে সোফায় বসলাম। আগেই কৌশলে একদিন তার মোবাইলের পাসওয়ার্ড দেখে রেখেছিলাম, তাই আজ আর ফোন খুলতে তেমন সমস্যা হলো না। প্রথমেই গ্যালারিতে গেলাম আমি। তারপর গুগল ড্রাইভ, ফাইল ম্যানেজার সব চেক করলাম কিন্তু কোথাও কিছুই পেলাম না। শেষে কী একটা মনে করে মেসেঞ্জারে গেলাম। মেসেঞ্জারে ঢুকেই আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। পুরো ইনবক্সে শুধু মেয়েদের সাথে কথোপকথন। তবে লাস্ট কনভার্সেশন গতকাল রাতে একটা ছেলের সাথে।

আমি গতকাল রাতের কনভার্সেশন প্রথম থেকেই পড়তে শুরু করলাম। প্রথম মেসেজটা আবিরই করেছে, “মামা, নতুন মালটা তো পইটা গেছে।”
“নতুন আবার কোনটা?”
“আরে ওই আগুন সুন্দর মেয়েটার কথা বলেছিলাম। বাপ রাজনীতিবিদ, ওইটা।”
“কিন্তু তুই তো বলেছিলি ওর বাবা অনেক প্রভাবশালী। রিস্ক আছে তাই এটার জন্য নাকি কোনো টোপ ফেলবি না।”
“আমি তো কোনো টোপ ফেলিনি। মেয়ে তো সেইরকম হট। যেমন চেহারা, তেমন তার ফিগার। এপর্যন্ত যেই কটাকে বিছানায় নিয়েছি তারা কেউ এই মেয়ের ধারেকাছেও নেই। তবুও কোনো রিস্ক নিতে চাইছিলাম না। মেয়ের বাবার যা দাপট, মার্ডার করে ফেললেও কেউ কিছু করতে পারবে না। সেজন্যই তো সামলেছিলাম নিজেকে। কিন্তু মেয়ে তো নিজেই আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।”
“ভালোই তো। এটাকেও কি তবে ফাহাদ ভাইয়ের ফাঁকা ফ্লাটে নিয়ে যাবি?”
“ভেবেছিলাম এটাকে নিয়ে বেশিদূর এগোব না। হালকা পাতলা এঞ্জয় করব শুধু। কিন্তু এই মেয়ে তো নিজেই সেধে আমার সাথে ফাঁকা ফ্লাটে যেতে চাইছে।”
“মানে কি? মেয়ে নিজেই শুতে চাইছে তোর সাথে?”
“গাধার বাচ্চা, কথা না বুঝেই লাফাস কেন? আমার সাথে সুখ দুঃখের আলাপ করবে বলে একা দেখা করতে চাইছে। নিজের হাতের রান্নাও নাকি খাওয়াবে। আমিও এদিকে সব প্রিপারেশন নিয়ে রেখেছি, যৌ* উত্তেজক মেডিসিনটা আমার সাথেই আছে। কোনোরকমে একবার পানির সাথে মিশিয়ে কাল খাইয়ে দিতে পারলেই হবে। তারপর কাল সারাদিন সে আমার হাতের পুতুল হয়ে থাকবে।”
এতটুকু পড়ে আমার হাসি পেয়ে গেল। দুজনেই ফাঁদ পাতার জন্য একই ট্রিক্স অ্যাপ্লাই করেছি তাহলে। আমি আবার পরতে শুরু করলাম।
“সবই বুঝলাম। কিন্তু মেয়েটা যখন সেন্সে আসবে তখন তো সবই বুঝে যাবে। তারপর যদি ওর বাপকে বলে তোর বারোটা বাজায়?”
“বুঝতে পারলেও সমস্যা নেই। তখন একটু ড্রামা করতে হবে। বলব, ও নিজেই আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছিল। আর তাছাড়া সেন্স আসলেও মেডিসিনের প্রভাব কাটতে অনেক সময় লাগবে৷ তখন আমি যা বলব, ও সেটাই বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে।”
“ভালোই প্লান বানিয়েছিস শালা। কিন্তু যা করার সাবধানে করিস।”
এই মেসেজটা সীন হয়েছে তবে কোনো রিপ্লাই দেওয়া হয়নি।

সত্যিই, মানুষের বাহ্যিক চেহারা দেখে তার ভিতরটা কখনোই আঁচ করা যায় না। কত সুন্দর মায়াময় একটি মুখ। অথচ ভিতরটা কিনা এত কুৎসিত। এই চেহারার আর মিষ্টি কথার মায়ায় পড়েই তো তুলি তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করেছিল।

কিছুদিন আগে তুলির মা আমাকে ডেকে নিয়ে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, “কত কষ্ট করে মেয়ে দুটোকে বড় করলাম। অথচ দেখ, বাবা মায়ের মানসম্মান ডোবানোর আগে একবারও ভাবল না। এসব লোক জানাজানি হলে বিষ খাওয়া ছাড়া আমার আর কোনো পথ থাকবে না।”
সেদিন তাকে কথা দিয়েছিলাম, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব ব্যাপারটা সলভ করার। যেহেতু বাবার পলিটিক্যাল পাওয়ার আছে, তাই তিনিও আমার কথাতে ভরসা করেছিলেন৷ ভেবেছিলেন বাবার হেল্প নিয়েই হয়তো ব্যাপারটা সলভ করব আমি। কিন্তু আমি তো জানতাম, বাবাকে জানালে উপকার হওয়ার বদল ক্ষতি ও হতে পারে। বাবা জানলে হয়ত তার ছেলেপেলে দিয়ে কয়েকটা হুমকি দেওয়াবে বা মারধোর করাবে৷ তাতে যদি চটে গিয়ে আবির ভিডিওগুলো ভাইরাল করে দেয়, তাহলে তো তুলির আরও বড় ক্ষতিটা হয়ে যাবে৷ সেজন্যই বাবাকে জানিয়ে রিস্ক নেইনি। আবিরের খোঁজ বের করে তাকেই টিচার হিসেবে রাখলাম। অনেক ছক কষে আজকের শেষপর্যন্ত নিজের উদ্দেশ্য সফল হতে যাচ্ছে আমার।

তামিম ভাই রুম থেকে বের হলেন গুনে গুনে দুই ঘন্টা পর। তার পিছনেই বের হচ্ছে আবির। তবে আবিরকে দুইপাশ থেকে দুইজন ধরে রেখেছে। আবিরকে একইসাথে হতভম্ব এবং ক্লান্ত দেখাচ্ছে। কোনোরকমে তাকে সোফায় বসানো হল। মাথার ঝঁকড়া চুলগুলো এলোমেলো, শার্টের বোতামগুলোও উলটোপালটা লাগানো। তামিম ভাই হাসতে হাসতে বলল, “আজ যা দেখালেন ভাই, মনে হলো হরর সিনেমা কোনো। ভাইয়ের তো দেখি সেই পাওয়ার। একা একাই জামাকাপর খুলে যা করলেন। কত সখ ছিল বিয়ে করে নতুন বউকে নিয়ে নিজের টাকায় কেনা এই ফ্লাটে এনে তুলব। অথচ তার আগেই আপনি শুভ উদ্বোধন করে দিলেন। আমি অবশ্য লাইভ দেখার সাথে সাথে পুরোটাই ভিডিও করে রেখেছি। দেখবেন নাকি একটু?”
তামিম ভাই আবিরের সামনে ভিডিও প্লে করে ক্যামেরাটা ধরল। আবির বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইল সেদিকে। তারপর বলল, “সুজাতা, তুমি আমার সাথে এমনটা কেন করলে?”
আমি হেসে বললাম, “স্যার বোধহয় এখনও আমাকে চিনতে পারেননি। তুলির সাথে যখন কলেজের সামনে দেখা করতে যেতেন, তখন তার সাথে আরও একটা মেয়ে থাকত বোরখা পরে। যার শুধু চোখ দেখা যেত। আমার চোখের দিকে আরেকবার তাকিয়ে দেখুনতো চেনা যায় কিনা।”
আবির এবার বাকরুদ্ধ।

ততক্ষনে তুলি আর ওর মাও এসে পৌঁছেছে। তুলি এসেই পায়ের জুতো খুলে মারতে শুরু করল আবিরকে। এরপর হাউমাউ করে কেঁদে ফ্লোরেই বসে পড়ল।

আমি তামিম ভাইকে বললাম, “এসব নোংরা লোকের সাথে কথা বলা তো দূর চেহারাও দেখতে ইচ্ছে করছে না আমার। তুমিই যা বলার বলো।”
তামিম ভাই বললেন, “আর তো বলাবলির কিছু নেই। এই লেটেস্ট ভিডিওগুলো আজ আপলোড করে দেব। কাল আমাদের আবির স্যার নিশ্চিত তার ভার্সিটির হট টপিকে থাকবেন।”
আবির আর্তনাদ করে উঠল যেন, “প্লিজ,এটা করবেন না। আপনারা যা বলবেন আমি তাই শুনব।”
“ভেরি গুড। এবার তাহলে এবার আসল কথায় আসা যাক। আপনি বুদ্ধিমান লোক, নিশ্চই বুঝতে পারছেন যে কী করতে হবে।”
“বুঝতে পেরেছি। তুলির ভিডিওগুলো আমার ল্যাপটপে আছে। আমি রুমে গিয়েই ওগুলো ডিলিট দিয়ে দেব।”
“আপনার উপর তো ভরসা করতে পারছি না ভাই। তারচেয়ে বরং আমার সাথের দুজন লোক আপনার সাথে যাক। যা করার ওরাই গিয়ে নিজ দায়িত্বে করে দিয়ে আসবে।”
আবিরকে বগলদাবা করে নিয়ে গেল দুজন। সেই দৃশ্য দেখে আমার প্রচন্ড হাসি পেয়ে গেল।

তুলি এবং তুলির মা দুজনেই কাঁদছেন এখনও। তুলির মা বললেন, “তুমি খুব সাহসী মা। আজ আমাদের জন্য যা করলে, তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। তবে আমি তোমার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন সবসময় তোমাকে ভালো রাখেন।”

সবাই চলে যাওয়ার পর তামিম ভাই বললেন, “আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না এই মারাত্মক প্লানটা তুই করেছিস। তুই যে চূড়ান্ত পর্যায়ের ডেঞ্জারাস মেয়ে সেটা আজ আরেকবার প্রমাণ হয়ে গেল। ভালোই হয়েছে যে তোকে বিয়ে করতে হয়নি আমার।”
আমি বললাম, “তামিম ভাই, তুমি মনেহয় ভুলে যাচ্ছ, প্রস্তাবটা তোমরা দিয়েছিলে আর আমি রিজেক্ট করেছিলাম।”
“সেটা ভুলিনি। তবে যাই বলিস, সু। একটা ব্যাপার আমার বেশ ইউনিক লাগছে।”
“এরমধ্যে ইউনিক কী পেলে তুমি?”
“না মানে, এতদিন দেখে এসেছি ছেলেরা মেয়েদের আপত্তিকর ভিডিও বানিয়ে ব্লাকমেইল করে। কিন্তু ইতিহাসে তুই মনেহয় প্রথম মেয়ে হতে যাচ্ছিস যে ছেলেদের ন্যুড ভিডিও বানিয়ে ব্লাকমেইল করছিস।”
আমি চোখ পাকিয়ে বললাম, “তোমার এইসব বস্তাপচা সস্তা ইয়ার্কি করা শেষ হয়েছে? তাহলে আমি যাব এখন।”
“ওকে চল, তোকে পৌঁছে দিয়ে আসি।”
“কোনো দরকার নেই। তুমি তোমার বাসাতেই থাকো। আমি নিজেই চলে যেতে পারব।”

গেট থেকে বাইরে বের হয়ে রাস্তার দিকে তাকাতেই চমকে গেলাম আমি।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)

#আমাতুল্লাহ_স্বর্ণা

মন গহীনের শব্দ পর্ব-০৪

0

মন গহীনের শব্দ
| ৪ |
আমার মনে হলো, মা আসলে খুব ভাগ্যবতী। ভাগ্যবতী বলেই এরকম নিকৃষ্ট কাজ করার পরেও সবাই তাকে এত ভালোবাসে।

দাদি বলতে শুরু করলেন, “হুট করেই একদিন তোর মারে বিয়া কইরা নিয়া আসলো তোর বাপে। বিয়াটা প্রথমে মানতেই পারলাম না। আমার চান্দের মত পোলা, এমন কালো মেয়ে বিয়া কইরা আনছে এটাই মানতে পারতাম না। অভাবের সংসার ছিল তখন তোর বাপের। সখ আহ্লাদ তো দূরের কথা, তিনবেলা খাবার যোগাইতেই কষ্ট হয়ে যাইতো। তার উপর সারাক্ষন আমি তোর মায়েরে কথা শুনাইতাম, খারাপ ব্যবহার করতাম। তারপরেও তোর মা কোনোদিনও টু শব্দ করে নাই। তোর বাপে মাঝেমধ্যে মানা করত তোর মায়ের সাথে এমন করতে। কিন্তু তোর মা হেসে বলত, মায়েরা এমন একটু বলে। মায়েদের শাসনের মধ্যেও ভালোবাসা থাকে। সারাদিন খারাপ ব্যাবহার করতে করতে কখন যে তোর মা রে ভালোবেসে ফেললাম, নিজেও জানি না। একসময় আমরা শাশুড়ি বউমা হইয়া উঠলাম প্রাণের সখি। সংসারে টাকা পয়সার অভাব থাকলেও সুখ শান্তির কোনো অভাব ছিল না আমার। টাকার অভাবও বেশিদিন রইল না তোর বাপের। ধারদেনা কইরা অল্প পুঁজি নিয়া ব্যাবসা শুরু করছিল, তারপরে কয়েক বছরের মধ্যেই লাখ লাখ টাকার মালিক হইয়া গেল। বাড়ি, গাড়ী সবই হইল। নতুন বাড়িতে আসার কয়দিনের মধ্যেই তোর মায় পোয়াতি হইল। জানোস ময়না, দিনগুলা যে কী আনন্দের ছিলো। কয়েকমাস পরে তুই জন্মাইলি। তোর বাপে সারাদিন ব্যস্ত থাকতো ব্যবসা নিয়া। বাড়িতে থাকতাম আমরা তিন জন। তোর বয়স যখন দুই বছর, তখন আসলো তোর মায়ের দুঃসম্পর্কের এক এতিম বিধবা বোন। ওর নাম ছিল রাহেলা। সেও তোরে খুব ভালোবাসতো। আমার সেই সুখের দিনগুলা আর বেশিদিন রইল নারে বোন। তোর বয়স তখন চার বছর। আমার আর রাহেলার কাছে তোরে রাইখা তোর মায় বাসা থেকে বের হইল একদিন। বলল, তার কী একটা জানি দরকার আছে। সারাদিন পার হয়ে গেল, কিন্তু সে ফিরল না। তোর বাপে অফিস থেকে বাসায় ফিরে এইসব শুনে পাগলের মত হয়ে গেল। সারারাত ধরেও তোর মাকে খুঁজে পাইলো না। আমার শক্ত মনের পোলাডাও সেদিন হাউমাউ কইরা কাঁদল তোরে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে। তারপরে থাইমা গেল হঠাৎ। তোর মায়েরেও খোঁজা বন্ধ কইরা দিল। আমি আর রাহেলা অনেকবার বললাম, আরেকবার খুঁজে দেখতে কিন্তু তোর বাপে কোনো কথাই শুনল না। সেই থেকে পোলাডা আমার একেবারে অন্যরকম হইয়া গেল। একমাত্র তুই ছাড়া কারো সাথে ঠিকভাবে কথা পর্যন্ত বলত না। শুধু তোর মায়ের রুমটার মধ্যে ঢুইকা কাঁদতো সারাক্ষন। ব্যাবসা বানিজ্যও দিনদিন খারাপ হইতেছিল। এসব দেখে আত্মীয়স্বজনেরা আবার বিয়ে করানোর পরামর্শ দিল। কিন্তু কিছুতেই তোর বাপে আর রাজি হয় না। বছর পার হয়ে যাওয়ার পরেও যখন তোর মা আর ফিরল না, তখন একরকম জোর কইরাই তোর বাপেরে বিয়ে করাইলাম। সুলেখা এই বাড়িতে আসার পর ভাবলাম এইবার আমার পোলা ঠিক হবে। কিন্তু কিছুই পরিবর্তন হইল না আর। সুলেখা সবরকম চেষ্টাই করল, কিন্তু কোনোটাতেই সফল হইল না। একসময় সুলেখার উপরে বিরক্তি আইসা গেল। ওরে দোষ দেওয়া শুরু করলাম। বউ আনার পরেও কেন আমার পোলা মনমরা হইয়া থাকব? এই নিয়া কথা শোনাতে শুরু করলাম। আমি জানতাম, সুলেখার কোনো দোষ নাই। তবু কেন জানি ওরে ভালো লাগতো না আমার। সুলেখারে নিজে পছন্দ করে আনলেও তোর মায়ের জায়গায় বসাইতে পারতাম না কিছুতেই। আমি জানি, দিনের পর দিন সুলেখার প্রতি অন্যায় হয়েই যাইতেছে। কিন্তু কিছুতেই নিজেকে বদলাইতে পারি না তবুও।”

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে জড়িয়ে ধরলাম দাদিকে। মনে মনে মাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “আমাদের পুরো পরিবারটাকে তুমি এলোমেলো করে দিলে মা। অথচ তুমি চাইলেই খুব সুখী একটা পরিবার হতে পারতাম আমরা।” আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে কখন জানি ঘুমিয়ে গেলাম।

সকালের নাস্তা করে রেডি হয়ে নিলাম। আজ বাইরে তামিম ভাইয়ের সাথে দেখা করার কথা। তামিম ভাই হলো আমার একমাত্র ফুপুর ছেলে। তার অবশ্য আরো একটা পরিচয় আছে। তামিম ভাই একজন নামকরা হার্টের ডাক্তার। ডাক্তার হিসেবে এই শহরে তার যথেষ্ট নামডাক রয়েছে। তামিম ভাই অবশ্য আরো একটা কারনে বিখ্যাত, তবে সেটা শুধু সুন্দরী মেয়েদের কাছে। তার একটা মুচকি হাসিই শত রমণীর হৃদয়ে ঝড় তোলার জন্য যথেষ্ট।

ফুপুর বাসা কাছাকাছি হওয়া সত্বেও তামিম ভাইয়ের সাথে আজ রেস্টুরেন্টে দেখা করতে হচ্ছে। এর পিছনেও অবশ্য আরও একটা বিশেষ কারন রয়েছে। এক বছর আগে ফুপু তার পুত্রবধূ করার জন্য প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন বাবার কাছে। বাবা পুরো সিদ্ধান্তটাই আমার হাতে ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি রিজেক্ট করে দেওয়ায় ওখানেই ব্যাপারটা ফুলস্টপ করে দিতে হয়েছিল তাদের। আমার মতো একরত্তি মেয়ে তার ডাক্তার ছেলেকে রিজেক্ট করেছে, এটা ফুপু কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। সেই থেকে আমাদের বাড়িতে তার পা রাখা বন্ধ। আমি যদিও সেই ঘটনার পর কয়েকবার গিয়েছিলাম তার বাসায়। কিন্তু প্রত্যেকবারই তার সেই পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটার কারণে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। তামিম ভাই অবশ্য এসব বিষয়ে একেবারেই নিরুত্তাপ ছিল। আমার হ্যাঁ বা না কোনোটাতেই তার মাথাব্যাথা ছিল না। তাই ফুপুর সাথে সম্পর্কটা ঠিক না হলেও তামিম ভাইয়ের সাথে সেটা আগের মতই রয়ে গেছে।

রেস্টুরেন্টে ঢুকে প্রথমেই তামিম ভাইয়ের দিকে চোখ গেল আমার। ভ্রু কুঁচকে ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে সে। আমি এগিয়ে গিয়ে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললাম, “স্যরি, একটু লেট হয়ে গেল।”
“ফর্মালিটি ছেড়ে কাজের কথা বল। আমি অনেক ব্যস্ত আজ।”
“ব্যস্ত কেন? তুমি তো বলেছিলে, আজ তোমার অফ ডে।”
“অফ ডে গুলোতেই ব্যস্ততা আরও বেশি থাকে আমার। আম্মার ঠিক করা তেইশ নম্বর পাত্রীটির সাথে আজ দেখা করতে হবে। দেখছিস না, কেমন সেজেগুজে বের হয়েছি। আম্মার মতে আগের বাইশ জন রূপে গুনে এই মেয়ের পায়ের নখেরও যোগ্য নয়।”

আমি হতাশ হয়ে বললাম, “বুঝলাম না, ফুপু সুন্দরী বউয়ের জন্যে এত পাগল হয়ে আছে কেন?”

“কারনটা তুই নিজেই। এখনও সেই পুরোনো ইগো নিয়েই বসে আছে। যেভাবেই হোক, তোর চেয়ে সুন্দর মেয়েকেই তার ছেলের বউ করে আনতে হবে। এবারের মেয়েটা তোকে টেক্কা দেওয়ার জন্য একেবারে পার্ফেক্ট। আম্মা নিজে গিয়ে দেখে এসেছে মেয়েকে। মেয়ের চোখ দেখতে একেবারে ঐশ্বরিয়ার চোখের মত। আর হাসি দেখতে অবিকল দিপিকা পাড়ুকোনের হাসির মত। বলতে পারিস, একজনের মধ্যেই বলিউডের সব নায়িকাদের গুন বিদ্যমান।”

তামিম ভাইয়ের বর্ণনার ফিরিস্তি শুনে আমি ফিক করে হেসে দিলাম। সে চোখ রাঙিয়ে বলল, “হাসছিস কেন? আমি কি হাসির মত কিছু বললাম?”
“একদমই না। হাসির মত কিছু বলনি। এখন আমরা কাজের কথায় আসি।”
“হ্যা, বল এবার। এত জরুরি তলব কেন?”

আমি পুরো ব্যাপারটা তাকে বুঝিয়ে বললাম। পরবর্তী ঘন্টাখানেকে একটা চমৎকার প্লানও বানিয়ে ফেললাম। কাজ শেষ করে আমি বললাম, “তোমার মুল্যবান সময়টুকু আমাকে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। হবু ভাবীর সাথে মিট করার সময় ও তো হয়ে এল তোমার। আসছি তাহলে।”
“এখনই হবু ভাবি বলছিস কেন? নাও তো হতে পারে।”
“তুমি চাইলেই হবে। প্রত্যেকবারই কোনো না কোনো খুঁত ধরে রিজেক্ট করে দাও মেয়েগুলোকে। এবার অন্তত এটা করো না।”
“ধ্যাত, পছন্দ না হলে করবো টা কী? আচ্ছা সু, কখনও জানতে চাইনি এর আগে তবে আজ জিজ্ঞাসা করছি, আমাকে কেন রিজেক্ট করেছিলি তুই?”

“তোমাকে রিজেক্ট করার দুটি কারন ছিল৷ প্রথমত, তুমি সুন্দর। যেখানে যাও সেখানেই কোনো না কোনো মেয়ে তোমার সাথে ফেবিকলের মত চিপকে থাকে। তোমাকে বিয়ে করলে বিয়ের পরে আমার ইনসিকিউরিটিতে ভুগতে হবে। এই বুঝি কোনো মেয়ে আমার বরকে প্রপোজ করে ফেলল। এই টেনশন নিয়ে আমার পক্ষে চলা অসম্ভব। তারচেয়ে বরং আমি গড়পড়তা চেহারার কাউকে বিয়ে করব। যাকে নিয়ে মেয়েরা টানাহেঁচড়া করবে না। তোমাকে বিয়ে না করার দ্বিতীয় কারনটা কিছুটা হাস্যকর, তবুও বলছি। এটার মেইন পয়েন্ট ওই একই। তুমি সুন্দর। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল, সুন্দর একটা ছেলেকে রিজেক্ট করব। তোমাকে দিয়েই সেই ইচ্ছেটা পূরণ করলাম।”

তামিম ভাই কিছুক্ষন হতাশ চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, “সু রে, তোর রিজেক্ট করার কারন শুনে রাগ করব নাকি সুন্দর বলে প্রশংসা করেছিস বলে খুশি হব সেটাই বুঝতে পারছি না।”
“তুমি বসে বসে ভাবতে থাকো। আমি আসছি।”

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে রাস্তার পাশে রিকশার জন্য দাঁড়ালাম। তার প্রায় সাথে সাথেই গাড়িটা এসে একেবারে সামনে থামল। এই গাড়িটা আমার পরিচিত। গাড়ি থেকে নামল আলতাফ ভাই। আলতাফ ভাই হলো বাবার বাল্যকালের বন্ধুপুত্র। একইসাথে বাবার ডানহাত। আলতাফ ভাইয়ের বাবা-মা অনেক আগে রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। তখন সম্ভবত তার বয়স পনের-ষোল হবে। আলতাফ ভাইয়ের বাবা মারা যাওয়ার আগে তার দায়িত্ব বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সম্ভবত নিজের বিশাল প্রপার্টি এবং ছেলের দায়িত্ব নিজের কোনো আত্মীয়স্বজনের কাছে দিয়ে যেতে ভরসা পাননি। সেই থেকেই আমাদের বাসায় আলতাফ ভাইয়ের অবাধ যাতায়ত।

আলতাফ ভাই আমার দিকেই এগিয়ে আসছেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কী ব্যাপার আলতাফ ভাই, আপনি এখানে?”

“চাচা নিতে পাঠালেন তোমাকে। তুমি গাড়ি নিয়ে বের হওনি শুনেছেন, তাই খুব দুশ্চিন্তা করছেন। চলো, তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমার আবার অফিস যেতে হবে।”

আমি বললাম, “শুধু বাবা চিন্তা করছে? আর কেউ করছে না?”
তিনি নিশব্দে হাসলেন।আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। তারপর আলতাফ ভাইকে বললাম, “আগে সামনের শপিং মলটায় চলুন, আমার কিছু কেনাকাটা আছে।”
“ওকে।”

প্রায় দুই ঘন্টার মত চলে গেল শপিংয়ে। শপিং শেষে গাড়িতে উঠে আমি বললাম, “আলতাফ ভাই, পুরো শপিং মলে আপনি আমার পিছনে যেভাবে ঘুরেছেন, তাতে আপনাকে এতক্ষন আমার বডিগার্ডের মতো লাগছিল।”
আবারও হাসলেন তিনি। বাসার সামনে এসে গাড়ি থামল। আমি ইচ্ছে করেই একটা শপিং ব্যাগ গাড়ির মধ্যে রেখে নেমে গেলাম।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)

#আমাতুল্লাহ_স্বর্ণা

মন গহীনের শব্দ পর্ব-০৩

0

মন গহীনের শব্দ
| ৩ |
বাসার গলি থেকে বের হয়ে কিছুদূর এগিয়ে মেইন রোডের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। রিকশার খোঁজে চারপাশে তাকিয়ে দেখছিলাম, ঠিক তখনই আপাদমস্তক কালো কাপরে আবৃত একজন মহিলা আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন।

অনেকদিন ধরে বিভিন্ন জায়গায় এই মহিলার সাথে আমার দেখা হচ্ছে। তিনি নিজেই সম্ভবত আমাকে ফলো করছেন। প্রত্যেকবার আমার সাথে দেখা হলে সেই একই প্রশ্ন করেন তিনি, “কেমন আছ, মা?”

প্রথমে মনে হতো তিনি নিশ্চই বাবার শত্রুপক্ষের কেউ যে আমার ক্ষতি করতে চায়। কিন্তু যতবার তার চোখের দিকে তাকাতাম ততবার নিজের ভাবনাকে নিজের কাছেই ভুল মনে হতো। এমন দরদ ভরা কন্ঠ আর মায়া ভরা দৃষ্টি নিয়ে তার পক্ষে আমার ক্ষতি করা কি আদৌ সম্ভব? অন্যান্য দিনের মত আজও সেই একই প্রশ্ন। এর আগে দায়সারা জবাব দিয়ে সরে গেলেও আজ আর তা করলাম না৷ বরং হেসে বললাম, “আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”
“ভালো আছি, মা।”

আমি কিছুটা কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলাম, “আজ আমি একেবারে নতুন একটা বোরখা পড়ে আছি। শুধু চোখদুটোই দেখা যাচ্ছে আমার। তারপরেও আপনি আমাকে কীভাবে চিনলেন?”
“তোমার চোখ দেখেই তো চিনলাম। আমার তুলন মায়ের চোখ চিনতে আমার কখনও ভুল হতেই পারে না। এই চোখ যে আমার খুব পরিচিত।”

আমি চমকে উঠলাম তার কথা শুনে। দাদি বলতেন, গায়ের রং আর চেহারা বাবার মত পেলেও আমার চোখ একেবারে আমার মায়ের মতো। এমনকি আমার তুলন নামটাও মায়ের দেওয়া। মা চলে যাওয়ার পর সুলেখা আন্টি আমাকে নিজের মেয়ের মতই আগলে নিয়েছিলেন। তার উদ্যোগেই আমার তুলন নাম বাদ দিয়ে তার নামের সাথে মিলিয়ে নতুন করে রাখা হয়েছিল সুজাতা। নিজের এই বাতিল হয়ে যাওয়া নাম টা অনেকদিন পরে কারো মুখে শুনলাম। মুহুর্তেই আমার মনটা বিষিয়ে উঠল। তার মানে এই মহিলাটি মায়ের পরিচিত।

আমি কঠিন গলায় তাকে বললাম, “আপনি আর কখনও আমার সামনে আসবেন না।”
তারপর তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। পিছন থেকে তিনি কথা বলে চলেছেন, “তোমাকে একজন খুব দেখতে চায়, একদিন আমার সাথে যাবে, মা?”

আমি তার কথার কোনো জবাব না দিয়েই রিকশায় উঠে বসলাম। তুলিদের বাড়িতে পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত আমার কানে তার বলা শেষ কথাগুলো বাজতে লাগল। দাঁতে দাঁত চেপে বিরবির করে বলতে থাকলাম, “আমি কারও সাথে দেখা করতে চাই না।”

তুলিদের বাসায় পৌঁছে কলিং বেল চাপলাম। দরজা খুলে দিল তুলির বড় বোন। তুলি ওর রুমেই শুয়ে ছিল। তুলিকে দেখে আমি আবার চমকালাম। গত কয়েকদিনে তুলির ওজন কমে অর্ধেক হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে একটা মেয়ের মনের অবস্থা ঠিক কেমন হতে পারে, সেটা আমি ভালোই বুঝতে পারছিলাম। ভুল মানুষকে ভালোবেসে এবং অন্ধের মতো বিশ্বাস করে তার কাছে নিজেকে সঁপে দেয়ার মত মারাত্মক ভুলটা করেছে তুলি।

আমি তুলির মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। তুলি আমকে জাপটে ধরে শব্দ করে কাঁদল। তারপর একসময় নিস্তেজ হয়ে গেল।

আমি বললাম, “নিজেকে শক্ত কর তুলি।”

“কেন যে তোর কথা শুনলাম না। কাজিনের বার্থডে পার্টিতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল ওর সাথে। গিটারে সুর তুলে আমার দিকে পুরোটা সময় তাকিয়ে ও গাইল, ‘ভালোবাসা যত বড়, জীবন তত বড় নয়।’ জানিস সেদিন কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল। চোখে তখন রঙিন চশমা। সেদিন এই গানের প্রত্যেকটা লাইনকে মনে হলো বেদবাক্য। তাই ও প্রপোজ করার সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলাম সেদিন। বোকার মত নিজের দুর্বলতাগুলো একের পর এক প্রকাশ করতে থাকলাম ওর কাছে। তখন তো আর জানতাম না, ওটা যে একটা মানুষের মুখোশ পড়া অমানুষ। ওর সাথে যতক্ষন থাকতাম ততক্ষনই নানা অজুহাতে আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করত। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার চেহারা আর শরীরের সৌন্দর্য বর্ণনা করত। আর আমিও এমন গাধা ছিলাম, ওর ঐ কথাগুলোকে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ মনে করতাম। যখন ওর সাথে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেলাম, তখনই শুরু করল ইমোশোনাল ব্লাকমেইল। তাকে সত্যিকারের ভালোবাসি কি না সেই পরীক্ষা দিতে হলো আমাকে। বন্ধ রুমের মধ্যে আমাকে নিরাবরণ করতে করতে ও বলেছিল, -এইতো জান, আর কিছুদিন পরেই বিয়ে করব আমরা।
আমিও তখন রঙিন স্বপ্ন দেখছিলাম। টানা তিন ঘন্টা পরে যখন আমরা রুম থেকে বের হলাম, তখন বাইরের রুমে বসা ওর বন্ধুটি মিটিমিটি হাসছিল। ওই মুহুর্তে হঠাৎ করেই প্রথমবার আমার মনে হলো, আমি হয়তো ভুল করে ফেলেছি৷ তারপরে কিছুদিন পরপরই ওর ডাকে সারা দিতে হতো আমার। আস্তে আস্তে সংশয় বাড়তে লাগল আমার। একসময় বললাম বিয়ের আগে এভাবে আর সম্ভব না। সেদিনই ওর আসল রূপটা আমার সামনে এলো। নিজের স্মার্টফোন বের করে একের পর এক ভিডিও দেখিয়ে যাচ্ছিল আমাকে। ওর সাথে আমি যে কয়দিন ইন্টিমেট হয়েছি, তার সব ভিডিও রেখেছে ও। ওর কথা যতবারই তোকে বলেছি ততবারই তুই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছিস। তুই ওকে দেখে অনেকবার বলেছিলি, ওকে তোর সুবিধার মনে হচ্ছে না। আমি বিরক্ত হওয়া সত্বেও তুই বারবার বোঝাতে চাইতি আমাকে। শেষে তোর সাথেও একচোট হয়ে গেল এসব নিয়ে। আমার এখনও বিশ্বাস হয় না যে এই জঘন্য কাজগুলো আমি করেছি। সেদিন যখন বাসায় এসে ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি দিয়ে গেল, তখন আমার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। তারপর থেকে বাবা মা কেউ আমার সাথে কথা বলে না। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে সু। তুই কি আমাকে একটু বিষ এনে দিতে পারবি?”

আমি আর কোনো সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম না ওকে। এই পরিস্থিতিতে কোনো সান্ত্বনাতেই মনকে বোঝানো যায় না।

তুলির বাসা থেকে ফেরার সময় সারাটা পথ আমি ভাবতে ভাবতে এলাম। আমি নিজেও কোনো ভুল বা অন্যায় করছি নাতো? নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দিলাম, “না, আমি যা করছি ঠিকই করছি।”

এরমধ্যে চলে গেছে আরও ছয়দিন। এই ছয়দিনে আবির স্যারের সাথে আমার সম্পর্কটা অনেকটাই গভীর হয়েছে। সন্ধার পরের দেড় দুই ঘন্টা আমরা একেবারেই নিজেদের মত করে সময় কাটাই।

এই ছয় দিনে অবশ্য আরও একটা ব্যাপার ঘটেছে। দাদি এবার সিরিয়াসলি রাগ করেছে। সেই যে সাতদিন আগে নিজেকে ঘরবন্দি করেছে, তারপরে একবারের জন্যও নিজের রুম থেকে বের হয়নি। প্রত্যেক বেলার খাবার রুনি গিয়ে তার রুমে দিয়ে আসে। এমনকি রুনি ছাড়া বাকী সবার সাথে তিনি কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছেন। বাবা, আমি এবং সুলেখা আন্টি প্রত্যেকদিনই তার রুমে গিয়ে নানা কথা বলে তার রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করি। কিন্তু আমাদের সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ।

আজকের অবশ্য মনে মনে অন্য ছক কষেছি আমি। দুপুরের দিকে কথা বলার জন্য দাদির রুমে গেলাম আজ। তার প্রায় সাথে সাথেই রুনি এলো তার দুপুরের খাবার নিয়ে। দাদি কিছুক্ষন আমার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে থেকে অন্য দিকে ঘুরে বসলেন। রুনিও আয়েশ করে বসল খাটের পাশে। আমার আর দাদির কথোপকথন শোনার জন্য প্রবল আগ্রহ দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে। আমি রুনিকে ধমক দিয়ে বললাম, “খাবার দেয়া শেষ। এখনও এখানে কী করছিস তুই? বের হ এখনই।”
রুনি হতাশ হয়ে রুম ছেড়ে গেল। আমি দাদিকে বললাম, “তুমি ওদিক তাকিয়ে আছো কেন? আমার দিকে তাকাও।”

দাদি নড়েচড়ে আরো শক্ত হয়ে বসল। কিন্তু একবারও আমার দিকে তাকাল না। আম কঠিন গলায় বললাম, “তুমি যদি ভেবে থাকো যে আমি তোমার রাগ ভাঙ্গাতে এসেছি, তাহলে তুমি ভুল ভাবছ। আমি আজ শুধু আমার সিদ্ধান্ত জানাতে এসেছি, আজ যদি তুমি আমার সাথে কথা না বলো, তাহলে কাল সকালে আমার দুচোখ যেদিকে যায় আমি সেদিকেই চলে যাব। তখন আর হাজার বার ডাকলেও ফিরব না। শোনো বুড়ি, আমি কিন্তু তোমারই নাতনি। যা বলেছি তাই করব কিন্তু।”

কথাগুলো বলেই রুম থেকে বের হয়ে এলাম আমি। দাদির সাথে নরম গলায় কথা বললেই আরও পেয়ে বসে। সমানে সমানে তেজ দেখিয়েই জব্দ করতে হবে একে। রেগে থাকলেও দাদির সবচেয়ে দুর্বলতা হলাম আমি। আজ যেটুকু ডোজ দিয়েছি আশা করি সেটুকুতেই কাজ হয়ে যাবে।

দাদির রুম থেকে বের হয়ে ফুরফুরে মেজাজে খেতে বসলাম আমি। সন্ধ্যার পরে আবির স্যারের সাথে সময়টুকুও ভালো কাটল আজ। পড়াশোনার চাপে আজকাল সুলেখা আন্টির সাথে কথা হয় না তেমন। তাই স্যার চলে যাওয়ার পর আজ সুলেখা আন্টিকে সময় দিলাম ঘন্টাখানেক। তারপর রাতের খাবার খেয়ে কিছুক্ষন পড়ার পর দরজা খোলা রেখেই ঘুমাতে গেলাম। ঘুমের ভান করে কিছুক্ষন শুয়ে থাকার পরেই পাশে দাদির উপস্থিতি টের পেলাম। আমি চোখ বন্ধ করে মটকা মেরে পড়ে রইলাম। দাদি কিছুক্ষন অপেক্ষা করে প্রশ্ন করলেন, “ও ময়না, ঘুমাইছোস?”
আমি কোনো জবাব দিলাম না। দাদি আবার কথা বললেন, “আমি ভালো কইরাই জানি যে তুই ঘুমাসনাই। চুপ করে থাইকা আর ঢং করিস না।”

আমি বললাম, “তোমার সাথে আমার কথা নেই। না হয় রাগের মাথায় দুটো কথা শুনিয়েছি তোমাকে। তাই বলে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেবে তুমি?”

“রাগ করিস না বোন, মাথাটা ঠিক ছিল না সেদিন। রাতেই তোর মাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখলাম। হাসতে হাসতে বলল,- আম্মা অনেকদিন হয় আপনাকে দেখি না, তাই আসলাম। আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিন তো। আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। তারপরেই তোর কান্না করল। আমারে জিজ্ঞাসা করল, -আমারে আপনারা কীভাবে ভুলে গেলেন। তখনই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তোর মায়ের সেই দুঃখী চেহারা মনে পড়ছিল বারবার।। তারমধ্যেই ওই ন/টী বেডি পিঠা নিয়া ঢং করতে আসলো।”

“দাদি, সুলেখা আন্টিকে তুমি এত অপছন্দ কেন করো? আমি বুঝি মায়ের জন্য তোমার মনে এখনও একটা সফট কর্নার আছে। কিন্তু এটাও তো ঠিক, তোমাদের স্নেহ ভালোবাসার কোনো মূল্য না দিয়ে জঘন্য ভাবে এই বাড়ি ছেড়েছিলেন তিনি। স্বামী, শাশুড়ি তো দূর, চার বছরের অবুঝ মেয়েটির কথাও ভাবেনি সে। তারপরেও তার প্রতি তোমার এত মায়া। আর সুলেখা আন্টিকে দেখো, নিজের সব সখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে ছোট থেকে বড় করেছে আমাকে। কখনও মায়ের অভাবটুকু বুঝতে দেয়নি। তারপরেও কেন তার সাথে একটু ভালো করে কথা বলো না তুমি?”

দাদি নিশ্চুপ। আমি আরও কিছু বলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ নাক টানার আওয়াজ এল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমি বুঝতে পারলাম, দাদি কাঁদছেন। সাথে আরও বুঝলাম, এই কান্নাটা মায়ের জন্যই। আমার মনে হলো, মা আসলে খুব ভাগ্যবতী। ভাগ্যবতী বলেই এরকম নিকৃষ্ট কাজ করার পরেও সবাই তাকে এত ভালোবাসে।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)

#আমাতুল্লাহ_স্বর্ণা

মন গহীনের শব্দ পর্ব-০২

0

মন গহীনের শব্দ
| ২ |
এখনও রুনির চোখমুখ চকচক করছে। নতুন কোনো ইস্যু পেলেই রুনির চেহারা এমন হয়ে থাকে। কফির মগটা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে রুনি বলল, “এই লন আফনের কফি। রাইখা জলদিই যাইতে হইব আবার। ঘরের সব কাম তো এই রুনিরই করন লাগে। ওদিকে দাদি আবার সেই কহন থেইকা চিল্লাফাল্লা শুরু করছে। আফনের লগে নাকি মাস্টারের ইটিশ পিটিশ চল…।”

রুনির কথার গাড়ি চলতে শুরু করেছে। অতিসত্বর এই গাড়ি থামাতে হবে। আমি শান্ত অথচ কঠিন স্বরে বললাম, “রুনি, আমার টেবিলের উপরে এই যে স্টাপলারটা দেখতে পাচ্ছিস, এটাতে গতকালই পিন ভরেছি আমি। এটা কীভাবে ব্যবহার করে জানিস তো? তুই যদি এখনই তোর মুখ বন্ধ না করিস তাহলে আমি এটা দিয়ে তোর ঠোঁটদুটো আটকে দেব।”
হুমকিতে কাজ হলো৷ রুনি কফির মগ রেখে সুড়সুড় করে চলে গেল।

ও যাওয়ার পরেই এলো দাদি। রুনিকে ভয় দেখিয়ে তাড়ানো গেলেও এই জিনিস কোনোভাবেই তাড়ানো যাবে না। মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে। আগেই দরজা লক করে নেয়া উচিৎ ছিল। আমি বই পড়তে পড়তে দাদির দিকে তাকালাম। আমাকে কোনোরকম বিরক্ত না করেই সে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। আচ্ছা, বুড়ি তাহলে আজ এখানে ঘুমাতে এসেছে।

আমি বই পড়ায় মনোযোগ দিলাম। পড়া শেষ করে যখন উঠলাম তখন ঘড়িতে রাত দুইটা বেজে দশ মিনিট। আমি পা টিপে টিপে বিছানায় গেলাম। দাদি যদি কোনোভাবে জেগে যায় তাহলে এখন বিরক্ত করবে নিশ্চিত। সবে কোলবালিশটা জড়িয়ে ধরে শুয়েছি, এরমধ্যেই কথা বলে উঠল সে, “কাহিনী কী? সত্যি কইরা বল তো আমারে। তোর মতিগতি তো কিছুই বুঝতেছি না।”

“কিসের কাহিনী? দাদি প্লিজ, এই মাঝরাতে বিরক্ত করো নাতো। ঘুমাতে দাও।”
“তোরে আমি খুব ভালো কইরাই চিনি। উপর থেকে দেখতে আলাভোলা মনে হইলেও বাপের মতো মাথার মধ্যে বদবুদ্ধিতে ঠাসা। অনেক বছর ধইরা যাদের সাথে চলাফেরা, তাদেরও সহজে তুই বিশ্বাস করিস না। আর এই মাস্টার তো একমাসও হয়নাই তোরে পড়াইতে আসছে। এরমধ্যেই তোর তারে মনে ধরল কীভাবে?”

“উফ দাদি। তোমাকে তো আগেও বলেছি, ভালোবাসা হলো একটা পবিত্র ব্যাপার। নিজের অজান্তেই মানুষ কখন প্রেমে পড়ে যায় সেটা সে নিজেও জানে না। তোমার মাস্টারকে প্রথমবার দেখেই আমি তার প্রেমে পড়ে গেছি। সে আমার ট্রু লাভ। এখন তোমার অহেতুক সন্দেহ বন্ধ করো, বুড়ি। আমি এখন ঘুমাব। আমাকে আর একদম বিরক্ত করবে না।”
“তুই যতই বলস। আমি জানি, মনে মনে তুই ঠিক কোনো বদ মতলব করতেছোস।”
আমি কোনো জবাব দিলাম না এবার আর। কথা বললে বুড়ি একের পর এক প্রশ্ন করতেই থাকবে।

চোখ বন্ধ করে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছি জানি না, ঘুম ভাঙল দাদির ক্রমাগত ধাক্কায়। ঘুম হালকা হতেই শুনলাম, সে বলছে, “ওই, ঘুম থেকে ওঠ জলদি। ফজরের ওয়াক্ত চইলা যাইতাছে। নামাজ পড়বি না?”

আমি একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঘুম থেকে উঠলাম। দাদি মনে হয় আগেই নামাজ আদায় করেছে। নামাজ শেষ করে উঠে দেখলাম সে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু আমার আর ঘুম হলো না। শেষে নিজেই রান্নাঘরে গিয়ে একমগ কফি বানিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঘুম থেকে ওঠার সময় প্রচন্ড রকমের বিরক্ত লাগলেও নামাজ পড়ার পর থেকে মনের মধ্যে অন্যরকম প্রশান্তি কাজ করছে।

এখন গরমকাল চলছে। অথচ বাগানের শেষপ্রান্তের কৃষ্ণচূড়া গাছটা কেমন হালকা কুয়াশায় ঘেরা মনে হচ্ছে। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে গাছটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষন। কৃষ্ণচূড়া আমার সবচেয়ে প্রিয় ফুল বলেই বোধ হয় গাছটার প্রতি এত অবসেশন কাজ করে আমার।

কফি শেষ করে স্টাডি টেবিলের দিকে চলে গেলাম। ইদানিং খাওয়াদাওয়া আর পড়াশোনা ছাড়া তেমন কোনো কাজ নেই বললেই চলে। এইচএসসি এক্সামের মাত্র দেড় মাস বাকি। টেস্ট এক্সামের পর কলেজে যাওয়াও বন্ধ। ব্যাচের পড়াগুলো সব বাদ দিয়ে এখন শুধু রিভিশান দিচ্ছি। একমাত্র আবির স্যারই বাসায় এসে পড়িয়ে যান। এবং সেই পড়ানোর একমাত্র কারন হচ্ছে তার প্রতি আমার অতি আগ্রহ।

পড়া শেষ করে আজকেও তুলির কাছে কল দিলাম। তুলি হচ্ছে আমার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী। গত কয়েকদিন যাবত তুলির সাথে আমার যোগাযোগ বন্ধ। একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটার পর থেকেই একেবারে নীরব হয়ে গেছে মেয়েটা। তুলির কাছে একের পর এক কল করতেই থাকলাম আমি৷ কিন্তু বরাবরের মতই রিং বাজতে বাজতে কেটে গেল৷ ফোন রেখে সিদ্ধান্ত নিলাম, কালই একবার ওদের বাসায় যাব।

আজও স্যার পড়াতে এলেন সন্ধ্যার কিছুক্ষন পরে। পড়ানো শুরু করার পরপরই তিনি বললেন, “প্রত্যেকটা বইয়ের এ টু জেড তোমার নখদর্পণে। এখন কোনোরকম টিচারের হেল্প ছাড়া শুধু রিভিশান দিলেই হয়। শুধু শুধুই আমাকে প্রত্যেকদিন এখানে আসতে বাধ্য করছ তুমি।”
“কেন? এখানে আসায় আপনি কি খুব বিরক্ত?”
“সেরকম নয়, সুজাতা। এরকম না পড়িয়ে মাস শেষে বেতন নিতে আমার আত্মসম্মানে লাগে।”
“আপনার কিছু করতে হবে না স্যার, আপনি শুধু বসে থাকবেন আর আমি আপনাকে দেখব।”
“তুমি পাগল হয়ে গেছ সুজাতা। কী সব উলটাপালটা বলছ।”
“সত্যিই আমি পাগল হয়ে গিয়েছি। এজন্যই এখন আমি পাগলামি করব।”
আবির স্যার দুর্বল কন্ঠে প্রশ্ন করলেন, “মানে?”
আমি বললাম, “আজ আপনাকে আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে। আপনার মনে কি আমাকে নিয়ে বিন্দুমাত্র অনুভূতিও নেই?”

আমার কথার জবাব না দিয়ে স্যার চুপচাপ বসে রইলেন। আমি আবার বললাম, “আপনি আমাকে পড়াচ্ছেন আজ সতের দিনে চলছে। যদিও বাপারটা হাস্যকর লাগবে শুনতে, তবুও বলছি এই কয়েকদিনেই আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। এবং আমার মনেহয় যে আমার এই অনুভূতিটি একতরফা নয়৷ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে একবার বলুন তো, এই কদিনে আমার প্রতি আপনার কি একটুও দুর্বলতা জন্মায়নি?”

আবির স্যার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তুমি যখন বুঝেই ফেলেছ, তাহলে আর তোমার থেকে লুকাবো না কিছুই। সত্যি তোমার প্রতি আমার অন্যরকম একটা অনুভূতি কাজ করে। এরকম আগে কখনোই হয়নি আমার। আজকাল আমার চিন্তা ভাবনা, কল্পনা সবই তোমাকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে এই কল্পনাকে বাস্তবে পরিণত করার মত দুঃসাহস আমি কখনই দেখাতে পারব না।”

আমি আকুতি ভরা কন্ঠে প্রশ্ন করলাম, “কিন্তু কেন?”

“কারন তোমার আর আমার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড একেবারেই আলাদা। আমি মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা একটা ছেলে যাকে এই পর্যন্ত আসতে অনেকটা স্ট্রাগল করতে হয়েছে। আর তুমি উচ্চবিত্ত প্রভাবশালী বাবার একমাত্র মেয়ে। যদিও কথাগুলো সিনেমাটিক লাগছে, তবু এটাই কঠিন বাস্তবতা।”

“আমি এতকিছু বুঝতে চাই না। আমার শুধু আপনাকে লাগবে।”

“এটা অসম্ভব সুজাতা। তুমি আমি হাজারবার চাইলেও এটা সম্ভব না। তোমার পরিবার কখনও এটা মানবে না। যদিও এই কদিনে তোমাকে আমি আমার মনে এতটাই জায়গা দিয়ে ফেলেছি যে সেখানে অন্য কাউকে কখনও কল্পনা করাও সম্ভব না। কিন্তু এটাও সত্যি যে, তোমাকে আমি কখনোই নিজের করে পাব না। একসময় হয়তো তোমার বিয়ে হয়ে যাবে অন্য কোথাও। কিন্তু আমার মনের মধ্যে খুব যত্ন করে তোমাকে আমি রেখে দেব আজীবন।”

“আপনাকে পাওয়ার জন্য আমি সবকিছু করতে পারব। শুধু আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না স্যার।”

আমার কথা শেষ হওয়ার পরে আবারও পিনপতন নীরবতা৷ অনেকক্ষন এভাবে পার হয়ে যাওয়ার পর তিনি বললেন, “শেষপর্যন্ত তোমার জেদের কাছেই হার মানতে হলো। তুমি যা চাইবে তাই হবে।”
আনন্দের আতিশায্যে আমি টেবিলের উপর রাখা স্যারের হাতটা আলতো করে ধরলাম। তিনি আমার হাতের উপরে অন্য হাতটি রেখে চোখের ইশারায় ভরসা দিলেন।

স্যার চলে যাওয়ার পর আমি হাসতে হাসতে রুম থেকে বের হলাম। দাদির রুম থেকে চ্যাঁচামেচির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখি সেই একই পুরোনো কাহিনী। দাদি সুলেখা আন্টির সাথে রাগারাগি করছে। আমি দাদিকে বললাম, “তোমার সমস্যা কী বলোতো? আন্টির সাথে রাগারাগি করছ কেন?”

“ময়না, এখনই এই ন/টী বেডিরে আমার চোখের সামনে থেকে সরতে বল। আলগা দরদ দেখাতে আসছে। ওর কাছে কি আমি পিঠা খাইতে চাইছিলাম? তারপরেও আসছে ক্যান?”

আমি বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে ফেললাম। হাজারবার বারণ করা সত্বেও আমাকে ময়না নামেই ডাকতে হবে তার। অন্যান্য দিনের মতো নাম নিয়ে আমি আর তর্কে গেলাম না। আন্টিকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী হয়েছে বলোতো?”
“আসলে গতকাল মা রুনির সাথে বলছিলেন, তার খুব পাটিসাপটা পিঠা খেতে ইচ্ছে করছে। তাই আজকে তার জন্য বানিয়ে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু মায়ের মনেহয় পছন্দ হয়নি। থাক বাদ দাও।”
কথা বলতে বলতেই কান্না আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছিল আন্টি। একসময় চোখের জল লুকাতেই বুঝি বেরিয়ে গেল ঘর থেকে৷

দাদিকে আমি ভালোবাসি খুব, কিন্তু আজ আর নিজের রাগ ধরে রাখতে পারলাম না। চেঁচিয়ে বললাম, “একটা মানুষ এতটা নিষ্ঠুর হয় কী করে? মানুষটা তোমার মন পাওয়ার জন্য কতকিছু করেছে দিনের পর দিন, আর তুমি শুধু তাকে অপমানই করে গেছ। তোমার কি একটুও মায়া হয় না?”

“না। আমার কোনো মায়া নাই। সব দয়ামায়া আল্লাহ শুধু তোদেরই দিছে। আমি তো ভালা না। আজ থেকে আমি আর আমার ঘর থেইকাই বের হব না। আমার খাবার দাবারও রুনি এই ঘরে দিয়ে যাবে। আর তুই এখনও আমার মত খারাপ মানুষের ঘরে করতেছিস কী? বের হয়ে যা এইখান থেকে।”

কথা বলতে বলতে লাঠিতে ভর দিয়েমি.মি. দাদি নিজেই এলো। তারপরে আমাকে টেনে দরজার বাইরে বের করে দিয়ে মুখের উপরেই ঠাস করে দরজাটা আটকে দিল। আমি দরজার বাইরে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আজ দাদির সাথে রাগারাগি করতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, তাহলে হয়তো একটু নরম হবে সুলেখা আন্টির সাথে। কিন্তু এখন দেখছি উলটো সেই আমার সাথে রেগে আছে।

রাতে দরজা লক করে ঘুমানোর কথা থাকলেও আমি দরজা খোলাই রাখলাম আজ। রাগ পড়ে গেলে দাদি নিজেই আসবে৷ আজ আর পড়তেও বসলাম না। পড়তে না বসার পিছনে অবশ্য কিছু কারণ রয়েছে। শুয়ে থাকলে দাদি আসার পর তার সাথে একটু আলাপ জমাতে সুবিধা হবে। পড়তে বসলে হুট করেই সেটা করা যাবে না। আর তাছাড়া, আজ সকালেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এখন থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে নিয়মিত হব। বেশি রাত জাগলে ফজরে উঠতে সমস্যা হয়ে যায়। তারচেয়ে বরং রাতের পড়াটা ভোরবেলা জলদি উঠে পড়ে নেয়া যাবে। বিছানায় শুয়ে কয়েকবারই আমি দরজার দিকে তাকালাম। অনেকক্ষন পার হয়ে যাওয়ার পরেও দাদি এলো না। অপেক্ষা করে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম আমি।

পরের দিন সকালের নাস্তা সেরে রেডি হয়ে নিলাম তুলিদের বাসায় যাওয়ার জন্য। রেডি হয়ে প্রথমেই বাবার রুমে উঁকি দিলাম। বাবা বেড়িয়েছে আরো অনেক আগেই। সুলেখা আন্টি বসে বসে উপন্যাস পড়ছে।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কী করছ আন্টি?”
“আরে সু, আজ দেখি নতুন বোরখা পড়েছ।”
“হ্যাঁ। কেমন লাগছে?”
“মাশাল্লাহ। অনেক সুন্দর। তা কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”
“তুলিদের বাসায় যাব।”
“ড্রাইভার কে বলেছ?”
“গাড়ি নিয়ে যাব না আন্টি। রিকশা নেব।”
” সু, গাড়ি নিয়ে গেলে কী সমস্যা?”
“প্লিজ আন্টি জোর করো না।”

“এতটা অবুঝ হলে চলে? কেন বুঝতে চাও না, তোমাকে নিয়ে আমার আর তোমার বাবার চিন্তা হয় খুব। আর কিছুদিন পরেই নির্বাচন। তোমার বাবার চারদিকে শত্রু। যদি কোনো ক্ষতি করে ফেলে। গাড়ি নিয়ে গেলে একটু টেনশান ফ্রী থাকি আমরা।”

“আন্টি, যাতে কোনো সমস্যা না হয় সেজন্যই তো আমি বোরখা পরে বের হই। এমনকি নিকাব পড়ে মুখটাও ঢেকে রাখি। শুধু চোখের কিছু অংশ দেখে কেউ আইডেন্টিফাই করতে পারবে না আমাকে। তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পার।”

“ওকে বাবা। সাবধানে যেও। পৌঁছেই আমাকে ফোন করে জানিও।”
“ওকে।”
বাসার গলি থেকে বের হয়ে কিছুদূর এগিয়ে মেইন রোডের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। রিকশার খোঁজে চারপাশে তাকিয়ে দেখছিলাম, ঠিক তখনই আপাদমস্তক কালো কাপরে আবৃত একজন মহিলা আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)

#আমাতুল্লাহ_স্বর্ণা

মন গহীনের শব্দ পর্ব-০১

0

মন গহীনের শব্দ
| ১ |
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মেকাপের ফাইনাল টাচ দিতে দিতে আড়চোখে বিছানায় বসা দাদির দিকে তাকালাম আমি। দাদি পান খাচ্ছে। তার ঠোঁটদুটো লাল হয়ে আছে৷ সত্তর বছর বয়সী এই বৃদ্ধা যৌবনে যে ঠিক কী পরিমাণে সুন্দর ছিল, সেটা তার পান খাওয়া টকটলে লাল ঠোঁট দেখলেই বোঝা যায়৷ এই মুহূর্তে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ভ্রু কুঞ্চিত করে৷

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “দাদি, দেখ তো আমাকে কেমন লাগছে?”
“ন/টী বেডি। এত সাজছিস ক্যান? তোর কি বিয়া লাগছে আজ? নাকি দেখবার আসছে তোরে? আসবো তো মাস্টারে পড়াইতে। তার সামনে এত সাজন গোজন কিসের?”

ন/টী বেডি শব্দ দুটি দাদির মুদ্রাদোষ। শুধু সে নিজে বাদে পৃথিবীর আর সব মেয়েদেরই তার ন/টী বেডি মনে হয়।

আমি হেসে বললাম,
“তুমি বুঝবে না দাদি। তোমার মাস্টারের মনে আমাকে নিয়ে মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে৷ সেই হাওয়া যাতে কালবৈশাখী ঝড়ে পরিণত হয় সেজন্যই সেজেগুজে যাচ্ছি।”

“সর্বনাশ! হাবলা মাস্টার একটা। তোর বাপের সামনে গেলেই চোরের মত জি জি করে। আর তোর দিকে হা কইরা তাকাইয়া থাকে। শ্যাষম্যাশ তুই কিনা ওই হাভাইত্যার পেরেমে পড়লি?”

“উফ! দাদি, ভালোবাসা হলো পবিত্র একটা ব্যাপার। এত নিয়ম-কানুন মেনে কখনও প্রেমে পড়া যায় না। তুমি এসব বুঝবে না বুড়ি। তুমি বসে বসে পান খাও। আমি গেলাম।”

দাদিকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই আমি রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। পিছন থেকে সে তারস্বরে চিৎকার করে চলেছে, “রুনি, ওই রুনি, আজমলরে ডাক। ওর সাথে এখনই আমার কথা আছে। ওর মাইয়ায় তো বংশের ইজ্জত ডুবাইলো বইল্যা। যত জলদি পারা যায় এইটারে বিয়া দেওয়া লাগবো৷ আজমল গ্যালো কই?”

দাদীর অহেতুক চিৎকার যেন কানে না আসে সেজন্য স্টাডি রুমের মধ্যে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিলাম আমি। তখনই পিছন থেকে মৃদু আপত্তি জানালেন তিনি,
“একি সুজাতা, দরজা চাপালে কেন?”

আমি সামনের মায়াময় সৌম্য মুখটির দিকে তাকালাম। মহাশয়ের নাম আবির। আমার হোম টিউটর। নামকরা একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে পড়ছে। এবার ফাইনাল ইয়ার। বোকার হদ্দটা পড়াশোনা ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। আমি বললাম, “যাতে নির্বিঘ্নে পড়াশোনা করতে পারি সেজন্যই দরজা ভেজিয়ে রেখেছি৷”
“দরজাটা খুলে দাও।”
“কেন?”
“তুমি বুঝতে পারছ না। এভাবে দরজা বন্ধ করে দুজন একসাথে থাকাটা ভালো দেখায় না।”
আমি না বোঝার ভান করে জিজ্ঞাসা করলাম, “কেন ভালো দেখায় না?”
“তোমাকে কীভাবে যে বোঝাই।”
“আশ্চর্য, আপনি এমন ভাব করছেন যেন দরজা লক করে আমি আপনার শ্লীল/তাহানি করছি।”

আমার কথা শুনে আবির স্যার হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষন। তারপর বললেন, “ছি, সুজাতা। তুমি কী বলছ এসব?”
“একদম ছি ছি করবেন না। আর আপনাকে কতবার বলেছি, আমাকে শুধু ‘সু’ বলে ডাকবেন। আমার কাছের মানুষেরা আমাকে এভাবেই ডাকে।”
“আমি তোমার কাছের মানুষদের মধ্যে কেউ নই। আমি তোমার শিক্ষক।”

“কে বলেছে আপনি আমার কাছের মানুষ না? আপনি তো আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। আমার মনের মানুষ। দাদির ভাষায় বলতে গেলে আমার পিরিতের মানুষ।”

মাস্টার সাহেব আমার কথা শুনে খুকখুক করে কেশে উঠলেন। মনে হয় আমাকে কিছু বলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমি তাকে কিছু বলার সুযোগ দিলাম না। ব্যস্ত হয়ে বললাম, “অনেক হয়েছে প্রেমের আলাপ। এখন আমাদের পড়াশোনা শুরু করা উচিৎ।”

তিনি হতাশ চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে ম্যাথামেটিক্স এর বই খুললেন। দেড় ঘন্টার মত পড়ালেন আমাকে। এরমধ্যে তাকে যতরকম জ্বালাতন করা যায় সবই করলাম আমি। বেচারা আমাকে পড়াতে এসে ভালোভাবেই ফেঁসে গেছে। পড়ানো শেষ করে উঠে যাওয়ার জন্য দাঁড়াতেই আমি তার হাত ধরে ফেললাম। তিনি আঁতকে উঠে হাত সরিয়ে ফেললেন।

আমি আবারও হাত ধরে কাতর কন্ঠে বললাম, “আপনার জন্য আজ এত সুন্দর করে সেজেছি। অথচ আপনি শুধু কয়েকবার আড় চোখে দেখে আর তাকালেন না। প্লিজ, আমাকে ভালো করে দেখুন একবার।”
“এসব তুমি কি শুরু করেছ সুজাতা৷ আমার হাত ছাড়ো, কেউ এসে পড়তে পারে। প্লিজ, আই বেগ।”
আমি হাত ছেড়ে দিলাম। স্যার চলে যাওয়ার পরপরই আমার ডাক পড়ল বাবার রুমে।

আমার বাবার নাম আজমল তালুকদার। এই শহরের সবচেয়ে প্রভাবশালী মানুষগুলোর মধ্যে সে একজন। সামনের মেয়র ইলেকশনের জন্য আজকাল আটঘাট বেঁধে প্রস্তুতি নিচ্ছে বাবা।

কারণে অকারণে বিভিন্ন সময়েই আমার ডাক পড়ে বাবার রুমে। আমি রুমের সামনে গিয়ে খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে উঁকি দিয়ে বললাম, “মে আই কাম ইন স্যার?”
“আরে আম্মা। এদিকে এসো। আমার রুমে আসতে আবার তোমার পার্মিশন নেয়া লাগবে নাকি?”
“অবশ্যই নিতে হবে। ভবিষ্যতের মেয়র তুমি। কিছুদিন পর পুরো শহরই তো চালাবে তুমি।”

“কী যে বলো আম্মা। তুমি আমার মা। তোমার কোনো পার্মিশন লাগবে না। আসো তো, আমার কাছে এসে বসো এখন। তোমার সাথে কথা বলি একটু।”
“কথা কি দাদীজান সংক্রান্ত?”
“আরে না। তাকে নিয়ে আর কী বলব। প্রত্যেকদিন নতুন কোনো না কোনো নিষয় নিয়ে বাড়ি মাথায় তোলা তো তার পুরোনো অভ্যাস। গত দুইদিন কাজের ব্যস্ততায় তোমার সাথে দেখা হয়নি। সেজন্যই ডাকলাম। তোমার সাথে কথা বললে মনের মধ্যে শান্তি লাগে আম্মাজান। তুমি চেহারা পেয়েছ আমার আর তোমার দাদির মত। কিন্তু তোমার হাঁটাচলা, কথাবার্তা বলার ধরন হুবহু তোমার মায়ের। তোমার সাথে কথা বললে তাই কলিজায় শান্তি লাগে।”
“বাবা, তোমাকে অনেকবার বলেছি মায়ের কথা কখনও আমার সামনে বলবে না। যে মহিলা স্বামী সংসারের কথা চিন্তা না করে এমন বিশ্রী একটা কাজ করল, তার জন্য এখনও এত দরদ কেন তোমার?”
“এইভাবে বলে না আম্মা। সে তোমার মা হয়। তার সাথে আমার অনেক সুখ দুঃখের স্মৃতি আছে। আমার হাত ধরে এক কাপরে সে যখন বাসা থেকে বের হয়েছিল, তখন আমার কিচ্ছু ছিল না। কতদিন যে অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটিয়েছি আমরা। তারপরেও তোমার মা একটা অভিযোগ পর্যন্ত করে নাই কখনও। একসময় আমার গাড়ী বাড়ি সব হলো, অথচ তখনই তোমার মা আমাকে আর তোমাকে একা করে দিল। আমার ভুলেই আমি তাকে হারালাম। তার প্রতি ভালোবাসায় কমতি ছিল বলেই হয়তো সে চলে গিয়েছিল। তবুও তার উপরে আমি রাগ করতে পারি না। তুমিও তার উপর এত রাগ পুষে রেখ না, আম্মা।”

“আমি তোমার মতো মহান নই বাবা। কখনও যদি তাকে আমার সামনে পাই। সেদিন তার করা সব অন্যায়ের কৈফিয়ত তাকে দিতেই হবে। আমার বাবাকে একা করে চলে যাওয়ার মতো এত জঘন্য কাজ কীভাবে করল সে, তার জবাব আমি অবশ্যই চাইব তার কাছে।”

মুখে কঠিন জবাব দিলেও মনের মধ্যে একরাশ অভিমান জমা হলো আমার। থম মেরে বসে রইলাম। কিছুক্ষন পরেই রুমে এলো সুলেখা আন্টি। সুলেখা আন্টি বাবার দ্বিতীয় পক্ষ। মা চলে যাওয়ার পর আমার দেখভালের জন্যই বাবা তাকে বিয়ে করে এনেছিল।

সুলেখা আন্টি রুমে ঢুকে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কী ব্যাপার সু? এইমাত্রই তো হাসতে হাসতে এই রুমের দিকে আসতে দেখলাম তোমাকে। এখন দেখছি বাবা মেয়ে দুজনেই মুখটাকে বাংলার পাঁচ করে রেখেছ। হলোটা কী তোমাদের?”
আমি গিয়ে সুলেখা আন্টির গলা জড়িয়ে ধরে বললাম, “কিছুই না। এই বাবা মেয়ের সামান্য মতবিরোধ। হাতের ট্রেতে কী? পায়েস করেছ?”

“হ্যা, তোমাদের দুজনের জন্য এনেছি।”

আমি পায়েসের বাটি হাতে নিয়ে বললাম, “তোমার পায়েসটা বরাবরই দুর্দান্ত হয়। আমাকে যখন পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে, সেদিন তুমি এই পায়েস বানাবে। তারপর পাত্রপক্ষের সামনে গিয়ে বলবে মেয়ে নিজের হাতে এই পায়েস বানিয়েছে। ব্যাস, তোমার এই পায়েসের গুনেই আমার বিয়ে হয়ে যাবে।”

“বুঝলাম। কিন্তু এরকম মিথ্যে বলাটা কি ঠিক হবে?”

“শোনো আন্টি, আমাদের দেশে নাইনটি পার্সেন্ট লোক মেয়ে দেখানোর সময় এই মিথ্যেটা বলে। বরং এটা না বললে সেটা অস্বাভাবিক লাগবে।”

“তবুও। মিথ্যে বলতে আমার ভালো লাগে না৷ তাছাড়া আমাদের সু দেখতে এত সুন্দর মাশাল্লাহ। তাকে দেখেই ছেলেপক্ষের মাথা ঘুরে যাবে। আর কোনো গুনের কথা শোনানোর প্রয়োজনই পরবে না।”

“আমি তো দেখতে আমার বাবার মত হয়েছি। আমাকে সুন্দর বলা মানে বাবাকেও সুন্দর বলা। আচ্ছা বাবাকে প্রথমবার দেখে কি তোমার মাথা ঘুরে গিয়েছিল?”

আমার কথা শুনে বাবা কেশে উঠল। সুলেখা আন্টিও লজ্জা পেয়ে তড়িঘড়ি করে চলে গেল। কিছুক্ষন আগে মনের মধ্যে জমা হওয়া অভিমানগুলো হাওয়াই মিঠাইয়ের মত মিলিয়ে গেল। এইতো বেশ আছি। বাবা, সুলেখা আন্টি আমার পাশে আছে। আর আছে ঝগড়ুটে দাদি। দাদির ঝগড়ার আড়ালেও যে এক পৃথিবী ভালোবাসা লুকিয়ে আছে সেটা সে না বললেও আমি বুঝতে পারি। এত এত আপনজনের মধ্যে অন্য কাউকে মনে করার সময় কোথায় আমার। পায়েস খেয়ে সোজা পড়ার টেবিলে গিয়ে বসলাম আমি। দাদী সম্ভবত আরেকচোট ঝগড়ার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল, আমাকে পড়ার টেবিলে দেখে নিঃশব্দেই চলে গেল আবার।

ডিনার টাইমে ডাকতে এলো সুলেখা আন্টি। রাতের খাওয়া শেষ করে আমি তাকে বললাম, “আমাকে কড়া করে এককাপ কফি বানিয়ে দিও তো। আমি বাগানে যাচ্ছি রিফ্রেশমেন্টের জন্য। কিছুক্ষন পরে আবার পড়তে বসব।”
“ইদানীং তুমি প্রচন্ড রাত জাগছো সু। আজকে না হয় জলদিই শুয়ে পড়ো।”
“এখন ঘুমানোর সময় নেই। আর ঠিক দেড় মাস পরে এইচএসসি। তাক লাগিয়ে দেওয়া রেজাল্ট করতে হবে আমার। একবার এক্সামটা হয়ে যাক, তারপর শুধু নাকে তেল দিয়ে ঘুমাব।”
“বুঝলাম। কিন্তু এই রাতে বাগানে যাওয়ার কী দরকার। ঘরে বসেই কিছুক্ষন রেস্ট করো, তারপরে নাহয় পড়তে বোসো।”
“তুমি কি ভয় পাচ্ছ? গেটের বাইরে তো আর যাচ্ছি না। কিছুক্ষন শুধু কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে বসে থাকব।”
“এই রাতের বেলা বাগানে পোকামাকড় বা সাপ থাকতে পারে। ব্যালকনি থেকেও তো তোমার কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখা যায়।”
“আচ্ছা বাবা, তুমি যখন এত করে বলছ। তাহলে যাবো না৷”
“সু, তোমার কৃষ্ণচূরা ফুল খুব পছন্দ, তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“এই গাছটা তোমার বাবা লাগিয়েছিলেন সেই তোমার ছোটোবেলায়।”
“জানি তো।”
“কিন্তু আরেকটা ব্যাপার তুমি জানো না।”
“কি সেটা?”
“তোমার মায়েরও ভীষণ পছন্দ ছিল কৃষ্ণচূড়া ফুল। যেদিন তোমার মা নিখোঁজ হলেন, ঠিক তার পরের দিনই তোমার বাবা এই ফুল গাছটা লাগিয়েছিলেন। মাঝেমধ্যেই ব্যালকনি থেকে এই গাছটার দিকে তিনি অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকেন। আমি বুঝতে পারি, তখন নিশ্চই তোমার মায়ের কথা মনে পড়ে তার।”
“আন্টি, বাবা এখনও মায়ের কথা মনে করে বলে তুমি খুব কষ্ট পাও, তাই না?”
“একদমই না। তোমার মা তার স্ত্রী ছিলেন। তার কথা মনে করাটাই তো স্বাভাবিক।”
“কিন্তু সে বাবাকে ফেলে অন্য একজন লোকের হাত ধরে পালিয়েছিল। তবুও তাকে কেন মনে রাখতে হবে বাবার?”
“তোমার বাবা তাকে মনে রেখেছেন বলেই আমার আরো বেশি ভালো লাগে মানুষটাকে। এরকম নিঃস্বার্থ ভাবে আজকাল কজনই বা ভালোবাসতে পারে।”
“ধ্যাৎ, তোমাদের মতো এমন অতিরিক্ত ভালো মানুষ আমার দুচোখে দেখতে ইচ্ছে করে না।”

আমি ধুপধাপ পা ফেলে রুমে চলে এলাম। তার কিছুক্ষন পরেই রুনি এলো কফিমগ নিয়ে। রুনি হলো এই বাসার হেল্পিং হ্যান্ড। দুনিয়ার যাবতীয় সব বিষয়েই রুনির আগ্রহ প্রবল, একমাত্র কাজ করা ছাড়া। এখনও রুনির চোখমুখ চকচক করছে। নতুন কোনো ইস্যু পেলেই রুনির চেহারা এমন হয়ে থাকে।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)

#আমাতুল্লাহ_স্বর্ণা

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৮২

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৮২|
হসপিটালে সিমরানকে রাখা হলো তিনদিন। চব্বিশ ঘন্টা অক্সিজেন চলে। এরপর স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়। কারো সাথে কথা বলে না সে। নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকে। মাঝেমাঝে দৃষ্টিজোড়া চঞ্চল হয়ে উঠে। চারপাশে তাকিয়ে কী যেন খুঁজে। পরোক্ষণেই উতলা মন হতাশ হয়। মুখশ্রী স্থবির হয়ে যায়। তানজিম চৌধুরী আর নিধি সর্বক্ষণ পাশে আছে ওর। যখন নিধি সময় দিচ্ছে তখন তানজিম চৌধুরী বাড়ি চলে যায়। আবার যখন নিধি আসে তখন তানজিম চৌধুরী বাড়ি যাচ্ছে। দু’জনেরই সংসার আছে। বাসায় ছোটো বাচ্চা নিধির। সবমিলিয়ে যেভাবে সুবিধা হয় সেভাবেই সব সামলাচ্ছে সকলে মিলে।
সিমরানের মামা, মামিরাও এসে ঘন্টা দু’য়েক সময় দিয়ে গেছে।

সিমরান কথা বলল চতুর্থ দিন। তবু মাত্র সাত শব্দের বাক্য,

‘ নিধি আপু, আমি আমার বাড়ি যেতে চাই।’

ওর মানসিক যা অবস্থা তাতে বিরোধীতা করার প্রশ্নই উঠে না। তাই অর্পণের সঙ্গে কথা বলে ওকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। এতদিন সৌধ আইয়াজ আর নিধির থেকেই ঘনঘন সিনুর আপডেট নিচ্ছিল। আজ আইয়াজও চলে গেল। এমনিতেই ফারাহ আসতে পারেনি। তার ওপর কয়েকদিন কাছে নেই আইয়াজ। সোহান আংকেলের আকস্মিক মৃত্যুর খবর। তাকে শেষবার দেখতে না পারা। সবমিলিয়ে মন খারাপ, দুঃশ্চিন্তা থেকে ফারাহও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাই আইয়াজ আর এখানে থাকতে পারল না। ও চলে যাওয়াতে সিমরানের খোঁজ নিতে নিধির কাছেই ফোনকল করতে শুরু করে সৌধ। প্রতিদিন আম্মাকে যদি দু’বার ফোন করে নিধিকে করে দশ থেকে এগারোবার। আম্মাকে যতটা না বোঝানো যায় বন্ধুকে তারচেয়েও অনেক বেশি বোঝানো যায়। তাই তো সৌধ তার অপারগতা, আকুলতা, ভয় সবটা বোঝাতে পারল নিধিকে। আর নিধিও বুঝতে পারল। একদম স্পষ্টভাবেই বুঝতে পারল, সৌধ সিনুকে পাগলের মতো ভালোবাসে। সিনুর প্রতি সৌধর অনুভূতির গভীরতা আজ ভয়ংকর। একটি পবিত্র সম্পর্কের বন্ধন, ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়?
যে ভালোবাসা দেখে বিস্ময় জাগে। মুগ্ধতা এসে ভর করে। একরাশ স্বস্তিদায়ক নিঃশ্বাসও ফেলা যায়। আজ নিজেকে নির্ভার লাগছে নিধির৷ বহুদিনের তৃষ্ণা নিবারণ হলে যে প্রশান্তি অনুভূত হয়৷ সেই প্রশান্তি অনুভব করছে। আবেগ, অনুভূতির দাবানলে হওয়া অনুভূতিদের প্রশ্রয় না দেওয়া নিয়ে আজ আর কোনো আফসোস নেই৷ দিনশেষে সৌধর প্রতি সে কৃতজ্ঞ। ভীষণ রকম কৃতজ্ঞ। ছেলেটা তার জন্য অনেক করেছে অনেক। বিনিময়ে পেয়েছে পাহাড়সম দুঃখ, কষ্ট৷ আজ যখন সিনুকে পেয়ে সে কষ্ট, যন্ত্রণা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। তাই সৌধকে সুখী করা, সৌধর ভালোবাসার প্রিয় মানুষটার এই করুণ সময়ে সে পাশে না থেকে দূরে সরে যেতে পারেনি। অন্তত বন্ধুর টানে, বন্ধুর প্রিয়জনকে আগলে রাখার দায়িত্বটা নিজে নিজেই নিয়েছে। বন্ধুত্বের ঋণ কখনো শোধ করা যায় না। নিধিও পারবে না সৌধর ঋণ শোধ করতে৷ কিন্তু জীবনে কোনো পরিস্থিতিতে কেউ তাকে অকৃতজ্ঞ বলে আঙুল তুলতে পারবে না।

সিমরান নিজের জগত, ধ্যানে এতটাই বিভোর যে তার আশপাশে কী হয়ে যাচ্ছে কিচ্ছুটি খেয়াল করে না। ওকে স্বাভাবিক করতে নিধি বারবার কথা বলার চেষ্টা করে। সিমরান নিজের মতোই চুপটি মেরে বসে থাকে। না কাঁদে আর না হাসে৷ তার কিছু ভালো লাগে না৷ কাউকে ভালো লাগে না। এই পৃথিবী, আশপাশে থাকা প্রতিটি মুখ তার কাছে অচেনা আর অজানা।
.
.
সৌধর মুখে সোহান আংকেলের মৃত্যুর খবর শুনে বিশ্বাস করল না নামী৷ আজ তার হসপিটালে ডিউটি ছিল৷ সুহৃদকে সুহাসের কাছে রেখে সে এসেছে হসপিটালে। সৌধ ঠিক এই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়েছে। সৌধর ফ্যাকাশে মুখে, বিমর্ষ কণ্ঠে বলা কথাটি শুনে নামী রাগান্বিত হয়ে বলল,

‘ ছিঃ ছিঃ! এটা আপনাদের প্ল্যান তাই না? নিশ্চয়ই এটা সুহাসের বুদ্ধি? ও কোনোদিন বড়ো হবে না, কোনোদিন ম্যাচিওর হবে না৷ বাবাকে নিয়ে কেউ এমন বলে ছিঃ। আমি ওকে এক্ষুনি ফোন করছি। ছেলের বাবা হয়ে গেল এখনো আক্কেল জ্ঞান হলো না! ‘

ফোন করতে উদ্যত হয়ে আচমকা থেমে গেল নামী৷ হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল একটি বিষয় স্মরণ হয়ে। সুহাস যতই পাগল থাকুক। তাই বলে বাবা সম্পর্কে এমন একটি কথা বলবে? আর সৌধ ভাইয়া! সে তো এসব এলাউ করার মানুষ নয়। সৌধর পানে সুক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল নামী। আর যা বুঝল তাতে সর্বাঙ্গ শিউরে উঠল। থমথমে মুখে, অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,

‘ আপনি মিথ্যে বলছেন ভাইয়া! ‘

‘ আমার রুচিবোধ এতটা নির্বোধ নয়। আর না মস্তিষ্ক বিকৃত। আমি আমার বন্ধু এবং বউয়ের বাবা সম্পর্কে মিথ্যা বলব? অপ্রয়োজনে, খুব বিপদে না পড়লে আমি মিথ্যা বলি না নামী। এই মুহুর্তে আমি কী সিচুয়েশনে আছি তুমি জানো না৷ সিনুর পাশে আমাকে প্রয়োজন, সুহাসকে প্রয়োজন। আর সুহাস যখন জানতে পারবে আংকেল নেই। তখন ওর পাশে তোমাকে প্রয়োজন। আমি কিছু ভাবতে পারছি না নামী৷ আমাকে বাংলাদেশে ফিরতে হবে। সুহাসকে কীভাবে কনভিন্স করব বুঝতে পারছি না। ‘

হৃৎস্পন্দন থেমে গেল নামীর। বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো সৌধকে৷ পৃথিবী কখনো নিষ্ঠুর হয় না৷ নিষ্ঠুর হয় পৃথিবীর মানুষ। আর মানুষের ভাগ্য৷ সুন্দরতম এই পৃথিবীতে খুব কম মানুষই পরিপূর্ণ সুখী জীবনযাপন করতে পারে। আজ ভাগ্য ছাড়া কাউকে দোষারোপ করতে পারছে না নামী। নিরুপায় হয়ে ঠাঁই বসে আছে সৌধর মুখোমুখি। চোখ দুটো ক্রমশ লাল হয়ে উঠছে। দেহে কাঁপুনি ধরেছে খুব। অবচেতন মনটা খুব করে চাইছে সুহাসকে। এত দিশেহারা, এত মরিয়া এ জীবনে আর কখনো লাগেনি। তীব্র অপরাধ বোধ হচ্ছে একটি বিষয় ভেবেই, ‘ সুহৃদ তার নানা, নানির ভালোবাসা পায়নি
দাদা, দাদির ভালোবাসাও পেল না। সোহান আংকেল তার বংশধরকে সশরীরে দেখার সুযোগ পেল না৷ একটিবার ছুঁয়ে আদর করতে বুকে টেনে নিতে পারল না৷ ‘ আর ভাবতে পারল না কিছু। দু-হাতে মুখ ঢেকে হুহু করে কেঁদে উঠল।

নামীর ফেরার কথা দুপুরের পর৷ কিন্তু দুপুরের মধ্যেই সে ফিরে এলো৷ সুহৃদকে ঘুম পাড়িয়ে একটি রোমান্টিক উপন্যাস পড়ছিল সুহাস। হঠাৎ নামী এসে ভেজা গলায় ডাকল,

‘ সুহাস? ‘

চকিতে তাকাল সুহাস। অবাক কণ্ঠে বলল,

‘ এত তাড়াতাড়ি! ‘

কথাটা বলেই বই ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। নামীর কাছাকাছি এসে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,

‘ মুখটা এমন লাগছে কেন? এনিথিং রং? ‘

অকস্মাৎ ডুকরে উঠল নামী। অনেকক্ষণ ধরে আঁটকে রাখা কান্নাটা উপচে পড়ল। প্রচণ্ড শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সুহাসকে। কিয়ৎক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সুহাস। ধীরেধীরে হাত উঠিয়ে বুকের ভেতর আগলে নিল নামীকে। মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল,

‘ কী হয়েছে নামী? ‘

হতবিহ্বল সুহাস৷ মস্তিষ্ক পুরোপুরি ফাঁকা লাগছে৷ শক্ত খোলসে আবৃত মেয়েটার কী হলো হঠাৎ? এভাবে ভেঙে, মুচড়ে ধরা দেওয়ার মতো মানুষ তো এ মেয়ে নয়। স্তম্ভিত সুহাস নামীকে জড়িয়ে ধরে অনেকটা সময় কাটিয়ে দিল। নামীও কাঁদতে কাঁদতে বুক ভিজিয়ে ফেলল সুহাসের। এক পর্যায়ে নাক টানতে টানতে মাথা তুলে হাত বাড়িয়ে সুহাসের চোয়ালদ্বয়ে স্পর্শ করল। বলল,

‘ বাংলাদেশে ফিরতে হবে সুহাস।’

চমকে উঠল সুহাস। কপট রাগ দেখিয়ে নামীর হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,

‘ ওওহ! এমনি কথায় কাজ হচ্ছিল না। তাই ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে ফিরে যেতে বলছ? বলেছি না, তোমাকে আর সুহৃদকে না নিয়ে ফিরব না। ‘

চোখ গলে দু’ফোঁটা অশ্রু ঝড়ে পড়ল নামীর। এগিয়ে এসে ফের সুহাসের গাল দু’টো আলতো হাতে ছুঁয়ে বলল,

‘ আমাদের যতদ্রুত সম্ভব নিয়ে চলো সুহাস। ‘

নামীর চোখ দুটো দেখে বুক ধক করে উঠল সুহাসের। বিচলিত হয়ে পড়ল ভীষণ। দু-হাত বাড়িয়ে নামীর গালদুটো চেপে ধরে শুধাল,

‘ কী হয়েছে নামী? ‘

‘ কোনো প্রশ্ন নয় সুহাস। আমাকে তুমি বাংলাদেশে নিয়ে চলো। আমি সুহৃদকে নিয়ে ওর পরিবারে, ওর বাড়িতে ফিরতে চাই। ‘

কাঁদতে কাঁদতে গা কাঁপছিল নামীর৷ সুহাস ওর চোখের জল মুছে দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলল,

‘ তোমার বাড়ি তুমি ফিরবে। এত কেঁদে বলার কী আছে? বরফ গলেছে এতেই আমি খুশি এত পানি ঝড়াতে হবে না। ‘

কথাটা বলেই ফের চুমু খেল কপালে৷ এরপর তাকাল অশ্রুসিক্ত চোখ দু’টোতে। নাকে নাক ঘঁষল। ভেজা গালে গভীর চুম্বন এঁটে ঠোঁটে আলতোভাবে একবার ঠোঁট মিলিয়ে বলল,

‘ ঝুটঝামেলা শেষ। ভাব, ভাব, ভাব। আমরা মিলে গেছি ওকে? ‘

সুহাসের বাচ্চাসুলভ আচরণ দেখে কান্নার মাঝেও ঈষৎ হাসল নামী। চোখ বেয়ে ঝরল নোনাপানির ধারা। সুহাস সে নোনাপানি মুছে দিতে দিতে বলল,

‘ আহ হা৷ আর কেঁদো না নামী। এবার একটু হাসো। আরো একটু বুকে আসো। ‘

কথাটা বলতে বলতেই গভীর আলিঙ্গন করল ওরা। সুহৃদের ঘুম ভেঙেছে কিছুক্ষণ। নড়েচড়ে উঠে বসে চোখ কচলে বাবা, মায়ের দিকে তাকিয়েছে। দু’জনকে এক সঙ্গে আলিঙ্গনরত অবস্থায় দেখে ওর বাচ্চা মন এত্ত আনন্দ পেল যে খিলখিল করে হেসে উঠল। আচমকা বাচ্চার হাসিতে চমকে উঠল ওরা। বিস্মিত হয়ে একসঙ্গে তাকাল ছেলের পানে। পৃথিবীতে এরচেয়ে সুন্দর দৃশ্য কি ওরা আর দেখেছে? আছে কি এরচেয়েও অধিক সুন্দর দৃশ্য? এ যেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সুন্দর দৃশ্য। অশ্রুসিক্ত নামী ছেলের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সুহাসের পানে তাকাল। মৃদুস্বরে বলল,

‘ আমাদের বাবা। ‘

বুকের ভেতর শীতল শিহরণ বয়ে গেলে সুহাসের। একহাতে নামীর কাঁধ জড়িয়ে অপর হাতে সুহৃদকে উড়ন্ত চুমু ছুঁড়ে বলল,

‘ ইয়েস আওয়ার লিটল ফাদার, নুহাস খন্দকার সুহৃদ। ‘
.
.
কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরের সকাল। সিমরানের ঘুম ভাঙলেও বিছানা ছাড়েনি৷ সে শুয়ে আছে তার বাবা মায়ের ঘরে৷ গায়ে ব্লাঙ্কেট জড়ানো ছিল। হঠাৎ অস্থিরতা অনুভব করল খুব৷ হাসফাস চিত্তে ব্লাঙ্কেট সরিয়ে একধ্যানে তাকিয়ে রইল দেয়ালে টাঙানো ফ্যামিলি ফটোর দিকে। খোলা দরজা পেরিয়ে সৌধ ঘরে ঢুকল ঠিক সেই মুহুর্তেই। ধুকপুক ধুকপুক বুকটা নিয়ে ধীরপায়ে কয়েক পা এগুতেই স্থবির হয়ে গেল তার অর্ধাঙ্গিনীকে দেখে। মনে পড়ে গেল পনেরো,বিশদিন আগের দেখা সেই স্বপ্নটিকে৷ স্বপ্নে দেখা সেই রুগ্ন দেহের বিবর্ণ মুখের সিমরানকে। প্রিয় মানুষকে নিয়ে দেখা স্বপ্ন এভাবেও সত্যি হয়? সৌধ বিড়বিড় করল,

‘আমার স্বপ্ন, এ দৃশ্য মিথ্যে হয়ে যাক।’

নিমেষে চোখ বুজল। তৎক্ষনাৎই আবার খুলল। এগিয়ে গিয়ে বসল তার বউপাখিটার পাশে। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল মাথায়৷ পরিচিত, কাঙ্ক্ষিত ভরসা ভরা সে স্পর্শটি পেয়ে সন্তর্পণে চোখ দু’টি বুজে নিল সিমরান। কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা উষ্ণ জল।

চলবে!
® জান্নাতুল নাঈমা
আজকের পর্বটা রিচেক করিনি৷ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন৷ খাপছাড়া হলেও মানিয়ে নেবেন৷