#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই ♥️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব____৪৩ এবং সমাপ্ত পর্ব
চোখের তারায় মনোহারিণীর ঘুমন্ত মুখশ্রী হৃদয় হরণ করলো শ্রাবণের গম্ভীর মনোভাবের। মায়ের বলার পর শ্রাবণ এদিক সেদিক না তাকিয়ে সোজা চলে এলো নিজের ঘরে। ইশার কাছে মাফ চাওয়ার তাগিদে। কিন্তু রুমে এসে দেখলো, তার ইশুপাখি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে বিছানার মাঝামাঝি হয়ে। শ্রাবণ দীর্ঘসময় তার পানে স্থীর ও স্বস্তির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে রইলো। বুঝি সে নতুন করে প্রেমে পড়লো চেনা মুখটির। আলগোছে ইশার পাশ ঘেঁষে বসতে বসতে আওড়ালো কথাটি। হাতের নিশপিশ করা ভাবটাকে দমন করতে না পেরে আলগোছে স্পর্শ করলো তার নরম শীর্ণ গালে। ইশা ঘুমের ঘরেই কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো। কাঁচা ঘুম। হয়তো মিনিট পাঁচেকও হয়নি এই ঘুমের।
“উপরওয়ালা আমাকে ক্ষমা করবেন না বউপাখি! তোমার সাথে আমি অন্যায় করেছি, অন্তত তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও!;
সন্তর্পণে হৃৎস্পন্দন তড়িৎ হারে বেড়ে গেলো শ্রাবণের। কথাগুলো বলতে বলতে ইশার নেতিয়ে থাকা হাতটা তুলে নিজের মুঠোবন্দি করে নিলো। বুক চিঁড়ে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে ইশার বন্দী হাতটায় নিজের কপাল চেপে ধরলো। সেকেন্ড গড়ালো না, পরক্ষণেই শ্রবণবিবর হলো অনাকাঙ্ক্ষিত একখানা স্বর,
“ক্ কি হয়েছে তোমার? কি হয়েছে!;
কন্ঠে একরাশ আকুলতা ও তীব্র ভীতি। নিজের হাতটা শ্রাবণের কপালের সাথে আরেকটু চেপে ধরে খানিক এগিয়ে গেলো ইশা। শ্রাবণ ফট করে ইশার হাতটা নামিয়ে দেয় নিজের কপালের শীর্ষ বিন্দু হতে। পরক্ষণেই ক্ষুধার্ত ভিখারির ন্যায় বুকের মাঝে মিশিয়ে নেয় ইশাকে। ঘুম কাতুরে ইশার সবটা বুঝতে বেশ কিছুটা সময় লেগে গেলো। শ্রাবণের হৃৎস্পন্দনের ন্যায় পাল্লা দিয়ে কাঁপছে তার দেহ। মাথায় একরাশ দুশ্চিন্তারা এসে ভীড় জমালো। একবার মনে হলো, সব কিছু ঠিক আছে তো?
“তুমি এমন করছো কেন, কি হয়েছে? আমাকে বলোনা?;
ইশার আকুল কন্ঠ পুনরায় শ্রবণবিবর হয় শ্রাবণের। সে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ইশাকে। মনের আশ মেটেনা তখনও। নিজের অপরাধ বোধ, একই আছে বুকের ভেতরটায়।
“কি গো, বলোনা? আমার যে এবার ভয় করছে।;
ইশার মুখে ভয়ের কথা শুনে শ্রাবণ ওকে আলগা করলো নিজের থেকে। সোজা করে বসালো তার থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরত্বে। ফের ব্যস্ত গলাতে বলল,
“বসো, আমি আসছি!;
কোথায় চললে?’ প্রশ্ন করতে চেয়েও সময়ের কাছে হার মেনে গেলো ইশা। শ্রাবণ অতি দ্রুত প্রস্থান করলো। ঠিক দু’মিনিটের মাথায় আবার ফিরেও এলো। ইশা ঠিক ওখানেই, তৃষ্ণার্ত কাকের ন্যায় প্রহর গুনছিলো।
শ্রাবণের হাতে একখানা নীল রঙা খাম দেখে ইশা প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে তাকালো তার পানে। শ্রাবণ চমৎকার হেসে খামটা নিয়ে এগিয়ে গেলো ডাকবাক্সটির কাছে। ইশা নেত্রে অবিশ্বাস্য ভাব জমিয়ে দেখে যাচ্ছে শ্রাবণের কান্ড। শ্রাবণ খামটা ডাকবাক্সে ফেললো। ক্ষণেই হা রে রে করতে করতে টিয়াপাখিটি গলা বাজিয়ে ডেকে উঠলো, ‘ইশুপাখি চিঠি এসেছে, ইশুপাখি চিঠি এসেছে’। ইশা চমকে উঠলো। পরক্ষণেই একঝাক আনন্দ আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়েও নিলো ওর সর্বাঙ্গ। মনটা আনন্দে নাচনকোঁদন করে উঠতেই ইশা চটজলদি বিছানা ছেড়ে নেমে পড়লো। বহুদিন হয়ে গেছে, কোনো চিঠি মেলেনি।
ইশা তাড়াহুড়োয় বের করলো চিঠিটা। মনটা তার আকুপাকু করছে চিঠি খোলার আকাঙ্ক্ষায়। নাচতে ইচ্ছে করছে উৎফুল্লতায়।
“থ্যাঙ্কিউ আমার ডাকপিয়ন, থ্যাঙ্কিউ সো মাচ। বহুদিন যাবত বড্ড মিস করছিলাম, আমার চিঠি গুলোকে।;
“আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি, মস্ত বড় অন্যায়। প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও।;
শ্রাবণের এমন বাক্যে চিঠি খোলার কথা ভুলে গেলো ইশা। চকিত পেছন মুড়ে তাকাতেই চোখের তারায় ভেসে ওঠে শ্রাবণের ক্লিষ্ট, মলিন মুখখানা। বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো ইশার। চোখের গলি ভরাট হলো বুকের ভেতরের চাপা আর্তনাদ গুলো মনে পড়াতে। উপরওয়ালা ওর মোনাজাত কবুল করেছেন তবে। শ্রাবণকে পুনরায় ওর পানে ফিরিয়ে দিলেন তিনি।
“না, এখানে তোমার কোনো ভুল নেই, আমিই তো তোমাকে না জানিয়ে এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার ভুল, আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।;
বলতে বলতে ইশা হাত জোর করলে শ্রাবণ ওর হাত টেনে জড়িয়ে ধরলো পুরনায়। শক্ত করে আঁকড়ে ধরে জড়ানো কন্ঠে বলল,
“না একদম না। তুমি একদম ক্ষমা চাইবেনা। তুমি ঠিক ছিলে, আমি ভুল ছিলাম।;
ইশার আর কোনো বাক্যব্যয় করতে হলোনা। পরম স্নেহে বাকি রাত টুকু মানুষটার বুকের সাথে লেপ্টে থেকেই পার হলো।
_________
দুপুর বারোটা। গা পোড়া গরমে রাস্তার পাশের ছাওনিতে মোড়ানো ছোট্ট ফুচকার দোকানটায় বসে আছে আরাফ আর তানি। দু’জনের হাতে দুটো ফুচকার প্লেট। তানি ওর সম্পূর্ণ মনোযোগ ফুচকায় নিবন্ধ করে খেয়ে চলেছে। কিন্তু আরাফ সেটা পারছেনা। সে তানির সাথে তাদের প্রেমের সম্ভাব্য বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চায়। কিন্তু কোনো মতেই পারছেনা। উসখুস করছে ভেতরে ভেতরে।
আরাফের উৎফুল্ল হৃদয়ে ভাটা পড়লো। মুখটা লটকে গেলো ক্ষণেই। শার্টের কলার্টটা টেনে ঠিক করতে করতে মাথা নীচু করে বলল,
“ভালো নাকি খারাপ!;
“ভদ্র।;
ছোট্ট কাঠখোট্টা জবাবে এবারও আরাফের মুখের প্রফুল্লতা ফেরত এলোনা। মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে চিরুনি করে বলল,
“ব্যস?;
তানি ফের ফুচকা খেতে নিয়ে থামে। এবার সে আরও বিরক্ত হলো। সমস্যা কি লোকটার? খেতে চেয়েছে চকলেট, মিষ্টি, হাতে ধরিয়ে দিলো ফুচকা! যাক সমস্যা নয়, ফুচকাটা তার এতোটাও অপ্রিয় নয়। মোটামুটি এডজাস্ট করতে পারে। কিন্তু হঠাৎ এসব ব্যাঙের ছাতামাথা প্রশ্ন করে খামোখাই বিরক্তির সাগরে ফেলে দিচ্ছে তাকে।
“কি শুনতে চান সরাসরি বলুন? অযথা আজাইরা প্যাঁচাল পাড়ার কোনো ইচ্ছে নেই।;
সাত মাস পড়েছে ইশার অনাগত সন্তানের। ডাক্তার বলছেন, তারা চাইলেই আলট্রাসনো করিয়ে বেবির জেন্ডার জানতে পারবে। কেননা, এর পুর্বে বারকয়েক আলট্রাসনো করালেও শ্রাবণের বারনে কেউ জানতে চায়নি ইশার পেটে যে আছে সে তাদের প্রিন্স নাকি প্রিন্সেস। শ্রাবণ এবারও কাঠকাঠ হয়ে জবাব দিলো, তারা জানতে চায়না।
ডাক্তার ফাজলে করীম অবাক হয়ে শুধালেন,
“কেন? আধুনিক বিশ্বের এটাই তো সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং পার্ট।;
শ্রাবণ মলিন হেসে জবাব দেয়,
“এখানেই আমার অসুবিধা!;
ডাক্তার সাহেব শ্রাবণের কথাটা ঠিক বুঝলেন না। ফাইলে কলম চালাতে গিয়েও থামলেন। প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে তাকালে, শ্রাবণ ঠোঁটের কোনে এক চাঞ্চল্য হাসি এঁটে, এগিয়ে গিয়ে টেবিলের উপর হাত দুটো রাখলো। একে অপরকে জুড়ে কয়েক মুহুর্তে ভাবনায় বিজড়িত হয়ে বলে উঠলো,
“ছোট বেলায় স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর হঠাৎ যখন বাবার হাতে নতুন কোনো পেন্সিল বক্স দেখতে পেতাম, তখন যে আনন্দ টা হতো আমি আমার সন্তানের ক্ষেত্রেও একই আনন্দ পেতে চাই। ইংলিশ এক্সাম, বুকটা বিরামহীন কাঁপছে, হঠাৎ দাদীজান এসে কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে এক টুকরো স্নেহ দিয়ে মায়ের চোখের আড়ালে হাতে দশটাকা গুঁজে দিয়ে বলতো, পরীক্ষা শেষ হইলে তোমার পছন্দের কিছু কিনে খাবা’ এই যে কিছু কিনে খাবার অপ্রত্যাশিত আনন্দ, আমি আমার সন্তানের ক্ষেত্রেও ঐ একই আনন্দটা পেতে চাই। আমি চাই ও আমার অপ্রত্যাশিত সুখের কুন্ডলী হোক। আমার অনাকাঙ্ক্ষিত অনাবিল খুশির একমাত্র ভাগীদার হোক। যদি আগেই জেনে ফেলি, তবে প্রত্যাশিত আনন্দ পাবো, যেটায় হয়তো আমার আনন্দ আরেকটু বেশি হবার কথা ছিলো, কিন্তু কম হবে! আমি চাইনা প্রত্যাশিত আনন্দে আমার সন্তানের প্রতি সবার ভালোবাসার বিন্দু পরিমান কমতি হোক। সে কে, এই চাওয়াটাই আমাদের একমাত্র চাওয়া নয়, সে কি, আমাদের কতটা জুড়ে রয়েছে সেটাই আমাদের একমাত্র চাওয়া। আমরা চাই সে সুস্থ ও স্বাভাবিক ভাবে দুনিয়ার আলো দেখুক। আপনি শুধু আমাদের এতটুকু ইনসিওর করবেন, সে কি সুস্থ আছে? স্বাভাবিক আছে?;
মুগ্ধতা ঝড়ছে নয়নে তার। অর্থাৎ ইশার। এতো সুন্দর এক্সপ্লেনেশন যে ও নিজেকেও দিতে পারবে না, অন্যকে তো দূর। আজ মানুষটার প্রতি আরও এক আকাশ সম ভালোবাসা বেড়ে গেলো ওর।
ফাজলে করীম ভরাট হাসলেন। তার সাদা দাঁত গুলো ঝলমল করছে। বোঝাই যাচ্ছে, ভীষণ খুশি হয়ে গেছেন তিনি। লোকটার বয়স পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। জরুরী নয়, সব ডাক্তারদের চোখেই ভারি পাওয়ারি মোটা চশমা থাকবে। উনারও নেই। জুয়ান তাগড়া ছেলেদের ন্যায় তার চোখের জ্যোতি। আধুনিকতার ছোঁয়া পেতে পেতে মানুষ আজ দিশেহারা। স্বাভাবিক ভাবেই এই দম্পতিকেও তিনি ব্যতিক্রম ভাবতে পারেননি। প্রথমে একটু অবাক হলেও ভেবেছিলেন শেষ অব্দি কেউই ধৈর্য্য ধরতে পারেনা। কিন্তু সে ভুল ছিলো। নিজের ভুল সে ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছে। ছেলেটাকে একটা স্যালুট দিতে ইচ্ছে করছে তার।
“ইউ আর সো লাকি ডিয়ার। বেশি ঔষধ দিবোনা। সামান্য ক’টা ঔষধ দিলাম। টাইমলি খাবে, এন্ড অবশ্যই অবশ্যই নিজের খেয়াল রাখবে। দৌড়ঝাপ, ভারী কাজ একদম নয়। সোজা ‘না’ বলে দিবে। ওকে?;
ইশার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে গেলো ডাক্তার সাহেব। ইশা লক্ষ্মী মেয়ের মতো সবটা শুনে কেবল মাথা নেড়ে সমর্থন করলো।
________
ছোট্ট একটা ঘরোয়া আয়োজন করা হয়েছে ইশার জন্য। বহুদিন বাদে খান বাড়িতে পুনরায় কোনো খুশির আয়োজনে মেতে উঠেছে সকলে। নামিরা ছোটাছুটি করছে এটা সেটা নিয়ে। আরব আর শ্রাবণ ঘর সাজানোর দায়িত্বে রয়েছে। তিতির, তানি আর তুতুন রয়েছে ভাইদের এসিস্ট্যান্ট হয়ে। ওদিকে তিতিরের ৩মাসের ছেলে বাবার কোলে থেকে অতিষ্ঠ হয়ে এবার কান্না জুড়লো চিৎকার করে। ছেলের কান্নায় তিতিরকে এসিস্ট্যান্ট পদ থেকে বাদ দিয়ে দিলো শ্রাবণ। আগে তাদের একমাত্র ভাগ্নেকে সামলাতে হবে, পরে সব কাজ। তিতির মুখ লটকে ছুটলো ছেলের কাছে। আফিয়া বেগম, নুপুর বেগম, এবং মরিয়ম বিবি রান্না করছেন এলাহি আয়োজনে। আজকে ইশার পছন্দের সমস্ত খাবার রান্না হচ্ছে, দরজার ওপাশে। ইশা সবার হৈচৈ করা কান্ড দেখছে নানীর সাথে বসে বসে। নানীজান ওর লম্বা কেশ গুলোকে আঁচড়ে বেঁধে দিচ্ছেন। খোঁপা করবেন, সাথে একটা বেলি ফুলের মালা ধরিয়ে দিয়ে গেছে শ্রাবণ। আদেশ করে গেছে তার গিন্নির খোঁপায় যেন এই ফুলটা পড়ানো থাকে। আনোয়ারা বেগম রসিকতা করে বললেন,
“ও আমি পারবোনা, যার গিন্নি সেই যেন এসে পড়িয়ে দেয় ওটা।;
শ্রাবণ হাসতে হাসতে চলে গেলো। সাথে জানিয়ে খেলো, ‘তাকে একবার ডাকলেই সে উড়ে চলে আসবে।’
সমস্ত আয়োজনের অন্তমিলে ইশাকে এনে বসানো হলো খাবার টেবিলে। ওর সামনে শ’ত রকমের খাবার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বড় বড় পাঁচ মাছ৷ মাছের মুড়ো, আস্ত মুরগী, দশ-বারো পদের ভর্তা, তরকারী! সব দেখে ইশার জিভে জল আসার উপক্রম। সবাই উৎসুক দৃষ্টি তাকিয়ে আছে, ইশা প্রথমে কোনটা তুলবে। ইশা সবার মনের ডাক শুনে বড় মাছের মুড়োটাই তুলে নিলো। আফিয়া বেগম, নুপুর বেগম এবং মরিয়ম বিবি মুখ চাওয়াচাওয়ি করে মৃদু হাসলেন। আনোয়ারা বেগমও হাসলেন মুখ টিপে। ইশা এদিকসেদিক না দেখে খেতে আরম্ভ করলো। যা দেখে শ্রাবণ খোঁচা মে*রে বলে উঠলো,
“বর কে না সেধে খেয়ে নিলে? হায়হায়, মা এ তুমি কেমন মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দিলে? দেখো, দেখো চেয়ে?;
শ্রাবণ পুনরায় গম্ভীর রূপ ধারণ করলো। অন্য ভাবনায় ততক্ষণে ডুবে গেলো তার বিবশ মনন।
শ্রাবণকে অন্যমনস্ক হয়ে পড়তে দেখে আর কিছু বলতে যেয়েও পারলোনা ইশা। এক সমুদ্র মন খারাপ নিয়ে নিঃশব্দে প্রস্থান করলো।
ইশা নামাজ পড়লো। নামাজের পর প্রায় অনেকটা সময় জায়নামাজে পড়ে রইলো। কতক্ষণ কান্না করলো, আবার কতক্ষণ আল্লাহ পাকের নিকট আশ্রয় চাইলো। বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে। শ্রাবণকে না জানিয়ে কাজটা করে ও ভুল করেছে। সেটা এখন হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে। কি এমন হতো? শ্রাবণ নিষেধাজ্ঞা জারি করতো? তাতে কি? ও কি পারতোনা মানুষটা বোঝাতে? তবে সময় এখনও ওর অনুকূলেই আছে। এখনও ততটা দেরী হয়ে যায়নি।
দরজায় করাঘাত পড়লো। ইশা মোনাজাত শেষ করে জায়নামাজ গুছিয়ে ওঠা কালীন বাইরে থেকে দরজায় করাঘাতের শব্দ পেয়ে ও সেদিকে তাকায়। দরজা ভেজানোই আছে। ইশা দোয়া শেষ করে গলা ঝাড়লো,
“কে, ভেতরে এসো?;
অনুমতি পেয়ে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে এলো নামিরা, তুতুন আর তানি। ওদের তিনজনকে দেখে ঠোঁটের কোনো লম্বা একটুকরো হাসির রেখা ফুটে উঠলো ওর।
“কি ব্যাপার, সবার একসাথে আসা হলো যে?;
ইশা আগ্রহী জানতে। প্রশ্নটা করে বিছানায় বসতে বসতে তিনজনকে বসতে ইশারা করলো। নামিরা ওকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বলে উঠলো,
কথাটা বলতে দেরী হলেও শব্দ করে হেসে ফেলতে দেরী করলো না ইশার। সঙ্গে জুটলো তানি আর ওর ডেভিল মার্কা হাসি। তুতুন অবুঝ বাচ্চা, বোনদের সাথে তাল মিলিয়ে সেও হাসতে লাগলো। বিপাকে পড়ে গেলো বেচারা নামিরা। তার রায়বাঘিনী ননদীনি যে এরূপ ঠাট্টা করে বসবে, তা যে কস্মিনকালেও ভাবেনি সে।
“কথাটা ও মন্দ বলেনি মাই ডিয়ার ভাবি। কিউ না আপ ভি…;
ইশার পুরো কথাটা শেষ করতে দিলোনা। তার পূর্বেই নামিরা তেড়ে গিয়ে ইশার মুখ চেপে ধরলো। কুটিল চাহনিতে বলে উঠলো,
“নো প্লিজ।;
“কেন হ্যাঁ, তুই তো বলতি সবসময়, আমরা দু’জন বেস্ট ফ্রেন্ড একই সাথে একই সময়ে বিয়ে করবো। আর আমাদের বেবিও হবে একসাথে। বিয়েটা তো হলোনা, এটলিস্ট বেবিটা তো নিতেই পারি।;
থামাতে পারলোনা ইশাকে। এমনকি তানিও থেমে রইলোনা। দু’বোন মিলে ইচ্ছে মতো লজ্জায় ফেললো নামিরাকে। নামিরা পারলে সেন্সলেস হয়ে যেতো ওখানে। বড্ড পাজি এই তানিটা। আর তার সাথে যুক্ত হলো ইশাটাও।
সন্ধ্যার একটা জমজমাট নাস্তা হলো ইশার ঘরে। বাকিরাও পেয়েছে, তবে ওদের তিনজনের আড্ডাটা নিরলস ভঙ্গিতে অব্যাহত রয়েছে ইশার ঘরে। তানির সব দম ফাটা হাসির গল্প, এবং তুতুনের কিছু না বোঝার মুখস্থ চর্চা চর্চিত হয়ে গেলো। কিন্তু এতো সময়ের মাঝেও একবারও শ্রাবণের মুখ দর্শন হয়নি ইশার। শ্রাবণ আসেনি ঘরে, মনে পড়তেই লুকানো ক্লেশ গুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো ইশার মনে। যার দরুণ হাসি মজায় মেতে থাকা ওর উৎসুক মুখের ভঙ্গিমা ক্ষণকালেই বিলুপ্ত হয়ে গেলো। ব্যাপারটা দৃষ্টিগোচর হয়নি নামিরার। তাই সে সবার অলক্ষ্যে মৃদু স্বরে প্রশ্ন করেই ফেললো,
“তুই ঠিকাছিস ইশা? তোর চোখমুখ কিন্তু অন্য কথা বলছে! কি হয়েছে তোর সোনা? মুখটা ওমন হয়ে আছে কেন! কি নিয়ে এতো দুশ্চিন্তা তোর?
কতটুকু দুশ্চিন্তার কথা আর খোলাসা করবে নামিরার কাছে। ইশার বুকটা ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে নীরব যন্ত্রণায়। কোথায় শ্রাবণ, কোথায় সে?
অনেক্ষণ যাবত ছেলেকে লক্ষ করছেন আফিয়া বেগম। কিভাবে কথা শুরু করবেন ভাবতে ভাবতে এক কাপ কফি নিয়ে গেলো ছেলের কাছে। না হয় কফির বাহানাতেই ছেলের সাথে কথা জুড়বেন। তিনি মা হয়ে বোঝেন ছেলের মনের অশান্তি। কিন্তু সন্তানদের সব অশান্তিতে মায়েদের নাক না গলানোটাই উত্তম। তবে, এই মুহুর্তের অশান্তিতে মা হয়ে ছেলের সাথে তার কথা বলা আবশ্যক।
“এতো অস্থির হয়ে আছিস কেন? বাবা হওয়ার বিষয়টা হজম হচ্ছেনা?;
খানিক ঠাট্টা করার ভঙ্গিমায় কথা পাড়লেন আফিয়া বেগম। শ্রাবণ মাথা নীচু রেখেই কফিটা নিলো মায়ের থেকে। সমস্ত ক্লান্তি, দুশ্চিন্তার অবসান এক কাপ কফি। একটা চুমুক দিয়ে কথা পাল্টানোর প্রসঙ্গে বলল,
“কফিটা ভালো হয়েছে মা।;
আফিয়া বেগম ভ্রু কুঞ্চিত করলেন। পন্ডিতি একটা ভাব নিয়ে বললেন,
“কথা ঘোরাচ্ছিস কেন বলতো? সব ঠিকঠাক আছে তো বাবা?;
কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিলে ভ*য়ানক জ্ব*লে। ঠিক তেমন ভাবেই জ্ব*লছে শ্রাবণের বুকের ভেতরটা। মাকে সবটা বলবে কিনা ভাবছে সে। কিন্তু বললে কি হবে? এখন আর কোনোকিছুই ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সে পারবেনা একটা নিষ্পাপ প্রাণকে নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিতে। যেটা ইসলামও সম্পূর্ণ হা*রাম বলে ঘোষণা দিয়েছে।
“এতো কি ভাবছিস? এই শ্রাবণ..;
“হ্যাঁ?;
“কি ভাবছিস? কি হয়েছে তোর! সকাল থেকে দেখছি অন্য চিন্তায় বারবার মসগুল হয়ে পড়ছিস?;
“কি হবে মা। কিছুইনা।;
বলতে বলতে ক্লেশ ছেড়ে পুনরায় কফির কাপে চুমুক দেয়। আফিয়া বেগম হাল ছাড়লেন না। সরাসরি প্রশ্ন করে বসলেন,
“তুই কি এই সুসংবাদে অখুশি? ইশার প্রেগন্যান্সি তোকে চিন্তার অতল গহ্বরে ফেলে দিলো যেন!;
বুকটা পুনরায় জ্বলে যায় শ্রাবণের। কফিটা পুনঃবার খেতে নিয়েও রেখে দেয়। আফিয়া বেগম ছেলের পরিবর্তন লক্ষ করে হেসেই ফেললেন। মমতাময়ীর মায়াবী হাসি। ঠোঁটের কোনে হাসি বজায় রেখে বললেন,
“প্রথম প্রথম প্রেগন্যান্সিতে মেয়েদের কত রকম পাগল পাগল চিন্তা থাকে জানিস? এক মাস, দু’মাস পেরোতেই ওরা সারাক্ষণ এই ভাবনায় মসগুল হয়ে যায় বাচ্চা কেমন হবে, কার মতো হবে, ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে? একশ রকম চিন্তা। ঠিক বাচ্চাদের মতো। আবার যখন, ছ’মাস পেরিয়ে যায়, তখন তো তাদের মহা দুশ্চিন্তা গুলো আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে যায়। বাচ্চার জন্য ড্রেস কেনা থেকে শুরু করে তার জন্য একটা আলাদা ঘর বানিয়ে ফেলে। আর সেই ঘরটা রোজ তার একেকটা স্বপ্ন ভেঙে সাজিয়ে তোলে নির্নিমেষ। আবার যখন ন’মাসে পা দেয়, তখন সারাক্ষণ একটা মেয়ের দুশ্চিন্তা থাকে আর যাই হোক তার সন্তানটা যেন সুস্থ, স্বাভাবিক ভাবে পৃথিবীর আলো দেখতে পারে। সে চলে যাক, কিন্তু তার বাচ্চাটা রয়ে যাক। একজন মেয়ে, একজন মা কতটা স্যাক্রিফাইস করে ফেলে তার সন্তানকে দুনিয়াতে আনার জন্য! ভাবতেও পারবিনা বাবা।;
শ্রাবণের বুকটা চৌচির হয়ে ধরা দেয় মায়ের নিকট। শ্রাবণ নেমে পড়ে মায়ের পায়ের কাছে। পায়ের পা জোড়া আগলে ধরে মাথা রাখে মায়ের কোলে। তার কষ্ট হচ্ছে। ভবিষ্যত ভেবে তার বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে যে।
আফিয়া বেগম শ্রাবণের মাথায় হাত রাখলেন। হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
” জানিস, একজন মেয়ের, একজন মায়ের সবচেয়ে বড় শক্তি কি? তার জীবনসঙ্গী। এই একটা মানুষকে সে চোখ বন্ধ করে ভরসা করে যায়। আর প্রেগন্যান্সির সময় একজন স্বামীর ভূমিকা থাকে অতুলনীয়। স্বামীর ভরসাতে, স্বামীর দেওয়া মনোবলেই মেয়েরা ম*র*ণের চেয়েও কঠিন য*ন্ত্র*ণা পার করে আসতে পারে। প্রসব বেদনা তখন আর ঘায়েল করতে পারেনা একজন নারীকে।;
“মা আমি কি করবো? আমার যে সবটা বড্ড এলোমেলো লাগছে। আমার নিজেকে এলোমেলো লাগছেনা মা। আমি বুঝি নিজেকে হারিয়ে ফেলছি!;
“না রে বোকা। তোর মতো এই অনুভূতি প্রত্যেকটা ছেলেরই হয়। তারা বুঝে উঠতে পারেনা এই সময়টা তাদের ঠিক কতটা স্থীর ও শক্ত থাকতে হয়। তারা যদি একটাবার ভাবে, তাদের মুখের এক চিলতে হাসিই তাদের স্ত্রীদের মনোবল, তাদের স্থীর ভাবে দাঁড় করিয়ে রাখে, কোনো ভাবেই তাদের মাঝে ভেঙে পড়ার ন্যায় তিক্ত অনুভূতি আসতে দেয়না, তখন তারা নিশ্চয়ই নিজেদেরকে সামলে রাখতো। তোর বাবাও ঠিক তোরই মতো, তোর আসার সংবাদে কথার খেই হারিয়ে ফেলেছিলো। তখন বাবা ছিলেন সবার মাথার উপরের একমাত্র পরিচালক। আমাদের একমাত্র পথপ্রদর্শক। তিনি তোর বাবাকে ঠিক এভাবেই বুঝিয়ে ছিলেন, ‘ওর হাতটা শক্ত করে ধরো, ভালোমন্দের বিচার করবেন আল্লাহপাক, আমাদের এতো দুশ্চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই’ এই কথা শুনে মানুষটা এক নিমিষে বদলে গেলো। কি ভয় কি ডর, সব ভুলে সে আমার হাতটা এমন ভাবে আঁকড়ে ধরলো যে আমিও সমস্ত ভ*য়কে জয় করে তোকে সুস্থ ভাবে দুনিয়ার আলো দেখাতে সক্ষম হলাম। বাবারে, ইশাকে এই মুহুর্তে একা ছাড়িস না। ওর পাশে থাক। ওকে আগলে রাখ। না জানি, মেয়েটার মনেও কতটা ভয় জমে আছে। এগুলো আর কেউ নয়, একমাত্র তুই পারবি দূর করতে।;
“মা, আমি যদি ইশাকে হারিয়ে ফেলি? আ্ আমার ইশা যদি আমার থেকে চিরতরে হারিয়ে যায়!;
শঙ্কায় বুক কাঁপছে শ্রাবণের। ছেলের মনের অবস্থা পুণরায় অনুধাবন করতে আফিয়া বেগমের বিন্দুমাত্র সময় অপচয় হলোনা। তিনি মৃদু হাসলেন। শ্রাবণের মাথায় হাত বুলিয়েই যাচ্ছেন। খানিক সময় বয়ে গেলো। হয়তো তিনি ছেলেকে পুনরায় বোঝাতে যেয়ে কিছুটা সময় নিলেন। অতঃপর পুনরায় বললেন,
“মানুষ মনের অসুখে ম/রে বেশি! মানুষ যখন সুখে থাকে তখন উপরওয়ালা তার আয়ুতে আরও দুটো দিন যুক্ত করেন। তাই তো বলছি, ইশাকে সুখে রাখার জন্য সব কর। যতদূর যেতে হয় যাবি। ওর সুখের জন্য তোর মনের ঘরে কোনো না’ এর জায়গা যেন না হয়।;
“ও কিছু করেনি, সবটাই আমার না’ এর জন্য। আমি ওকে না’ করেছিলাম মা।;
“ইশাকে কখনোও ভুল বুঝিসনা বাবা। ইশা এমন একটা মেয়ে যে কিনা সবার সুখের কথা চিন্তা করে নিজে বি*ষপান করে নিতে পারে। দেখ, ওর জীবনে যে কয়টা ভুল সবই ছিলো আমাদের বোকামির ফল। ও কোনোদিন মুখ ফুটে নিজের চাহিদা, নিজের ভালো লাগার কথা ব্যক্ত করেনি। সব সময় আমরা কি চেয়েছি, আমাদের কিসে ভালো লাগবে সেই ভেবেই ও সবকিছু করে গেছে।;
শ্রাবণের অক্ষিকোন থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লে আফিয়া বেগম শ্রাবণকে তুলে বসালেন। পরম যত্নে ছেলের অশ্রুসিক্ত নয়ন জোড়া দু’হাতে মুছিয়ে দিয়ে বললেন,
কার্ফিউ জারি করেছে ইশা। যতদিন শ্রাবণ বাচ্চার জন্য রাজি না হয়, ততদিন সে কোনোমতেই অন্ন মুখে তুলবেনা। এমনকি জলও স্পর্শ নয়।
তিতিরের প্রেগন্যান্সির সাত মাস পূর্ণ হলো আজ। ঘরে ছোটখাটো একটা আয়োজন করা হয়েছে তিতিরকে বড়দের দোয়া ও ভালোবাসা করায়ত্ত করার জন্য। দিনের শুরু হতেই সবাই এই ছোট্ট আয়োজন টুকু হাতে হাতে শেষ করেছে তিতিরের দুই ভাই। বোনরাও এখন পিছিয়ে নেই কোনোকিছুতে।
কাজ করতে করতে আপাতত ক্লান্ত শ্রাবণ। ঘরে ঢুকে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই রেকর্ডিং এর ন্যায় বেজে উঠলো ইশা। ফুল চার্জড হয়েই মন খারাপের সুরে বলল কথাটা।
“হ্যাঁ, বাচ্চা। আবারও শুনতে চাও? আমার বাচ্চা লাগবে। নয়তো, নয়তো আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।;
মুখ ভার করে অন্যদিকে ফিরে বসলো ইশা। শ্রাবণ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এখন বাচ্চা? ইশার পড়াশোনার মাঝামাঝি শ্রাবণ কিছুতেই বাচ্চা নিতে রাজি নয়। এটলিস্ট অনার্স কমপ্লিট হলে ভেবে দেখবে সে।
“ও গড! এই মেয়েকে নিয়ে আমি কই যাবো?;
“তোমাকে কোথাও যেতে হবেনা। হবেনা যেতে। আমিই চলে যাবো, অনেকদূর, বহুদূর!;
“এদিকে এসো!;
বুকের উপর হাত চেপে ইশাকে ডাকলো শ্রাবণ। ইশা একবার চেয়ে পূণরায় ফিরে গেলো অন্যদিকে। অর্থাৎ সে আসবেনা। তাই শ্রাবণ ইশার হাত টেনে নিয়ে এলো বুকের উপর। ইশার মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে রাখলো কিছুক্ষণ। ইশা তবুও শান্ত হলোনা। অশান্ত মনে হাসফাস করতে লাগলো। শ্রাবণ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে অনুদ্ধত গলায় বলল,
“বাচ্চা লাগবে?;
“হু।;
“এখনই?;
“হু।;
“আর পড়াশোনা?;
“পড়াশোনা লাগবেনা। চাইনা!;
“তাহলে শুরুতেই বন্ধ করে দিতে, অযথা এতো টাকা খরচ করে পড়া কেন?;
কিন্তু পারলোনা। তার আগেই শ্রাবণ ওর ভুল ভেঙে বলে উঠলো,
“আমাদের জীবনের কোনোকিছুকেই তুচ্ছ করে দেখা উচিৎ নয়। একটা আগে শেষ করো, পরেরটা আপনাআপনি চলে আসবে।;
ইশা মানতে পারলোনা শ্রাবণের কথাটা। তবে এটাও বুঝে গেলো, ও না খেয়ে ম/রে গেলেও শ্রাবণ বাচ্চার জন্য রাজি নয়।
“সকাল থেকে কিচ্ছু খাওনি, সবই কিন্তু চোখে পরে আমার। এসব অনিয়ম আমার কাছে চলবেনা।;
এবারের কথাটা একটু গম্ভীর হয়ে বলল শ্রাবণ। ইশা দমে গেলো। রাগ বা অভিমান কোনোটাই আর প্রকাশ করতে পারলোনা। তার আবদার, অভিমান, কিংবা বাচ্চামো সবটাই শ্রাবণের গম্ভীরতার আগে। শ্রাবণ দুম করে রেগে গেলে, তার কপালে যে শনি আছে সেটা ইশার অজানা নয়।
“চলো, খাবে কিছু।;
শ্রাবণ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। কথাটা বলতে বলতে ওয়াশরুমে ঢুকে চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়ে এসে ইশাকে নিয়ে নীচে গেলো।
নীচে আসতেই খান সাহেবের মুখোমুখি হলো দু’জন। ইশা পাশ কাটিয়ে চলে গেলো রান্নাঘরে। শ্রাবণ বসলো খান সাহেবের সাথে। খান সাহেব চিন্তান্বিত হয়ে কথা পাড়লেন,
“আজ নিলাশার বিয়ে। কার্ড পাঠিয়েছে খোরশেদ।;
“আচ্ছা, তাই নাকি? এতো বেশ ভালো কথা।;
“হ্যাঁ, যাবে তোমরা?;
“আমরা বলতে, তুমি যাবেনা?;
“আমার শরীরটা ক’দিন ধরে বেশ খারাপ যাচ্ছে। আমি যেতে পারবোনা।;
খান সাহেবের শরীর খারাপ, অথচ শ্রাবণ জানেনা। শ্রাবণ উত্তেজিত হলো খানিক। অস্থির গলাতে জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার শরীর খারাপ, অথচ আমাকে কেউ জানালো না!;
“ব্যস্ত হয়োনা দাদুভাই। এ বয়সে এসব একটু আধটু হয়েই থাকে।;
“না দাদাজান, শারীরিক অসুস্থতা কোনো হেলফেলা করার জিনিস নয়। তুমি চলো, আমি এখনই তোমায় ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবো।;
শ্রাবণ খান সাহেবের হাতটা ধরে উঠাতে চাইলে তিনি বারবার না করতে থাকেন। শেষ অব্দি শ্রাবণ পারেনা তার সাথে। হার মেনে বলে,
“ঠিকাছে, আজ না হোক কাল বা পরশু আমি তোমাকে নিয়ে যাবো। অমিতকে চিনো তো? আমার বন্ধু?;
“রুপার ছেলে?;
“হ্যাঁ হ্যাঁ, ও এখন বড় ডাক্তার। ক’দিন আগেই ডিগ্রি পাশ করেছে। অনেক দিন ধরে বলছে দেখা করতে। কাল তোমাকে নিয়ে যাবো। না করবেনা একদম।;
“তুমি অযথাই ব্যস্ত হচ্ছো।;
“আমি কোনো কথা শুনবোনা।;
______
দু’হাতে দুটো শাড়ি ইশার। একটা ফুল ব্লাক আর অন্যটা ফুল রেড। গাঢ় লাল রঙে ইশাকে বরাবরই নতুন বউ মনে হয়। তাই সে খুব ভালো করেই জানে শ্রাবণ তার জন্য কোন রঙটা বাছাই করবে।
“রেড।; একবার দেখেই বলল শ্রাবণ।
ইশা মুচকি হেসে কালো শাড়িটা আলমারিতে তুলে রেখে বলল,
“জানতাম। তোমার পছন্দ মুখস্থ হয়ে গেছে আমার।;
“তাই নাকি? তাহলে সারাক্ষণ বাচ্চা বাচ্চা না করে, আমার মনের কথাটা মেনে নিলেই তো পারো।;
“হু।;
“এই যে, কথা বন্ধ হয়ে গেলো। আচ্ছা, আমি কি তোমার খারাপ চাই বলেই বলি? তুমি কি বুঝোনা?;
“বুঝি।;
“তাহলে মুখ ভার হয়ে গেলো কেন?;
“এমনি।;
“তিতিরের হাইয়েস্ট আর টু মান্থ। নতুন সদস্য অলরেডি আসছে আমাদের বাড়িতে। ওকে নিয়েই আমরা সবাই মেতে থাকবো। ও কি আমাদের পর বলো?;
“না।;
যত যাই বলা হোক, এই বিষয়ে ইশার মন পাবেনা শ্রাবণ। এ কথা সে খুব ভালো করেই জানে। তাই মন ভুলাতে এগিয়ে যায় ইশার সন্নিকটে। কাছে টেনে বারংবার তাকে ছুঁয়ে দেয় ভালোবাসার গভীর স্পর্শে। ইশা ক্ষণকালের জন্য ভুলে যায় ওসব কথা।
শাড়ি পরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালো ইশা। শ্রাবণও রেডি। সাদা শার্টের উপর ডার্ক রেড ব্লেজার জড়িয়ে নিলো। চুল গুলো ঠিক করতে করতে আঁড়চোখে তাকালো ইশার পানে। ইশা তার লম্বা কেশগুলো খোঁপা বেঁধে নিলো। গলায় পড়লো বড় পাথরের কাজ করা একটা নেকলেস। কানে তারই টপ দুল। মুখে সামান্য পাউডার ঘসে ঠোঁটে হালকা লাল রঙের লিপস্টিক দিয়ে পাশে তাকাতেই চোখে চোখ পরলো শ্রাবণের। ইশা ভ্রু কুঁচকায়।
“তাকিয়ে আছো কেন? কিছু কি কম হয়েছে?;
শ্রাবণ কিছু বলেনা। সে চোখের তৃষ্ণা মেটাতে চেয়েই থাকে। ততক্ষণে ইশা আরেকবার দেখে নেয় নিজেকে। কিছু কম হলো কিনা। পরক্ষণেই ভ্যাবাচেকা খাওয়া গলায় বলল,
“কিছু বেশি হলো না তো? লিপস্টিক! লিপস্টিক বেশি হয়েছে?;
পূণরায় আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করে ইশা। শ্রাবণ ওর অস্থিরতা দেখে মুচকি হাসে। নিজেদের মাঝে সামান্য দূরত্ব টুকু ঘুচিয়ে নিয়ে এক ইঞ্চি ব্যবধানে দাঁড়ায়। ইশার সম্পূর্ণ মুখবিবর নিজের দু’হাতে নিয়ে সামান্য উঁচিয়ে ধরে তার মুখোমুখি। ইশা ভড়কে যায়। চোখ জোড়া গোলগাল করে তাকায় তার দিকে।
ইশার বক্ষঃস্থল শিহরণে মুষড়ে গেলো। লজ্জায় কঠিন আকারে লাল বর্ণ ধারণ করলো তার গাল।
“উফফ, ছাড়ো তো। ওদিকে দেরী হয়ে..;
“ছাড়তে পারছিনা তো।;
“আমি ছাড়িয়ে দিচ্ছি।;
“না, আগে চুমু তারপর বাকি সব।;
“না, এখন কিচ্ছু নয়। চলো চলো, দেরী হয়ে যাচ্ছে।;
জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো শ্রাবণের থেকে। শ্রাবণ চোখ দিয়ে শাসিয়ে বোঝালো,
“যখন ধরবো, তখন কেঁদেও কুল পাবেনা;
ইশা ওসবে একদমই পাত্তা দিলোনা। সে নিজের কাজে মনোনিবেশ করলো। নিজের শাড়ি, সাজ সব ঠিকঠাক করে শ্রাবণের ব্লেজার ঠিক করে বের হলো একসাথে।
নিলাশার বিয়েতে গুরুজনরা বাদে সবাই এলো। শ্রাবণ, ইশা, আরব,তানি,তুতুন এমনকি তিতিরও। তিতিরের সারাক্ষণ কেবল শুয়ে না হয় বসেই কাটাতে হয়। সেই কথা ভেবেই শ্রাবণ বোনকেও নিয়ে এলো। মা অবশ্য বারন করেছিলো এতো হৈচৈ এর মাঝে অসুবিধা হতে পারে তিতিরের। কিন্তু কেউ শোনেনি বারন। কখনোও কখনোও মায়েদের দুশ্চিন্তাতেই যেন সন্তানের আনন্দ লুকিয়ে থাকে। এ বেলাতেও সেটাই হলো।
নিলাশা এমনিতেই ভয়ানক রূপবতী। আর আজ যেন সৃষ্টিকর্তা দিগুণ রূপে ফুটিয়ে তুলেছেন তার সৃষ্টিকে। নিলাশাকে উপরের ঘরে দেখতে এলো ইশা আর বাকিরা। ইশা তিতিরকে ধরে ধরে সিঁড়ি পার করালে ইতিমধ্যে সব সিঁড়ি পেরিয়ে নিলাশার রুমের সামনে চলে যায় তানি। নিলাশার রুমের সামনে পৌঁছালেও রুমে ঢুকলোনা সে। আপাদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। তবে সেই অপেক্ষা কেউ একজন দীর্ঘায়িত করতে দিলোনা। হাতে হেঁচকা টান খেয়ে ওখান থেকে উধাও হয়ে গেলো তানি। ইশারা উপরে উঠতে উঠতে তানিকে আর খুঁজে পেলোনা। তাই আর অপেক্ষা না করে ঢুকে পড়লো নিলাশার রুমে।
তানির পেছনে বড় একটা আলমারি। আর সেই আলমারির সাথেই লেপ্টে আছে তানি। শ্বাস প্রচন্ড গতিতে ওঠানামা করছে। চোখ জোড়া বন্ধ কোনো অজানা ভয়ের সূত্রপাতে। হাতজোড়া মুষ্টিবদ্ধ, তবে কারোর সুঠাম বাহুর নিকট অবরুদ্ধ।
খুব কাছ থেকে একটা পরিচিত গন্ধ নাকের ডগায় বারি খেলো তানির। সঙ্গে সঙ্গে তার পরিচিত কন্ঠস্বর এক অদ্ভুত শিহরণ সৃষ্টি করলো তার সর্বাঙ্গে। বুকের ভেতরটা ডাক চিৎকার পাড়ছে অনবরত। না চাইতেও চোখ জোড়া মেলে সামনে তাকাতেই আরেকটু বড়সড় ধাক্কা খেলো। রাগতে চাইলো রণচণ্ডীর ন্যায়। কিন্তু পারলোনা। আরাফের কঠিন অধিকারবোধ তার রাগকে শুষে নিলো।
তানির হাত জোড়া পেছনে মুচড়ে রেখেছে আরাফ। কারনটা খুবই সহজ। এই মেয়ের মুখের চেয়ে হাতটা বেশি চলে। আরাফ তানির হাতটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরলে তানি ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলো। আরাফ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো,
“যে প্রশ্ন করা হয়েছে, শুধু তারই উত্তর দিবে।;
“হাত ছাড়ুন। আর আপনার সাহস দেখে আমি অবাক না হয়ে পারছিনা। ভাইয়াকে বলে দিবো একদম।;
ভাই বলতে তানি শ্রাবণকেই বুঝিয়েছে। জানে আরাফ। শ্রাবণকে সেও তো ভয় পায়। তবে কথায় আছেনা, ‘পেয়ার কিয়া তো ডারনা কেয়া’। হ্যাঁ ভালোইতো বাসে সে তানিকে। এই রাগী আর মিষ্টি পাগলি মেয়েটা সে ভালোবেসে ফেলেছে। আর এই কথাটাই বলেছিলো সে তানিকে। আর তারপর থেকেই আজ সতেরো দিন যাবত তানি তাকে সমানে ইগনোর করে যাচ্ছে। কি পাষাণ মেয়েটা।
“ছ্ ছাড়বো, তার আগে তোমাকে বলতে হবে আমাকে কেন ইগনোর করা হচ্ছে?;
“কারন, আপনাকে দেখলেই আমার রাগ হয়। মন চায় এক ঘুষি মে/রে আপনার নাক ফাটিয়ে দেই।;
হকচকিয়ে গেলো আরাফ,
“ত তুমি মেয়ে না ডাকাত?;
“আমি ডাকাত।;
কি সহজ স্বীকারোক্তি তানির। আরাফ কপাল কুঁচকে ফেললো। এবার সে তানির হাত ছেড়ে কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে ধরে বলল,
“ওকে, তাহলে আমি প্রুফ করে দিচ্ছি তুমি ডাকাত নাকি মেয়ে?;
আরাফের স্পর্শে কেঁপে উঠলো তানি। তার চোখ ছানাবড়া। আরাফ একহাতে তানির কোমর জড়িয়ে ধরে অন্যহাত তুলে আনলো তানির লম্বাটে মুখ বিবরে। তানি পূণরায় কেঁপে উঠলো। তার গলা শুঁকিয়ে কাঠকাঠ হয়ে গেলো। নিজের অজান্তেই পূর্বের ন্যায় তার চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে গেলো। আরাফ মুচকি হাসলো। তানির চোখমুখের অস্থিরতা মেপে আরেকটু কাছে এগিয়ে এলো। তানির নিঃশ্বাস ক্রমশই ভারী হতে লাগলো। ঘণ হতে থাকলো। আরাফ সবটটাই পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে সন্তর্পণে। আর মুচকি হেসে যাচ্ছে।
“আমি তোমার অনুভূতি হতে চাই তানি, আমি তোমার অনুভূতিতে মিশে যেতে চাই। আমি তোমার হৃৎস্পন্দন হতে চাই, আমি তোমার হৃদযন্ত্রের মালিক হতে চাই। আমাকে একটা সুযোগ দাও। আমি একটা সুযোগ চাই। আমি তোমাকে আমার ভালোবাসায় রাঙিয়ে তুলতে চাই। আমি চাই তুমি আমার হও, আমার হও।;
ছিটকে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো তানি। ঘণ নিঃশ্বাস বিসর্জন দিতে দিতে চোখ তুলে তাকালো আরাফের পানে। আরাফ অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে ওরই পানে। কি করুণ তার চাহনি, যেন এই ভালোবাসার অভাবেই তার মৃ**ত্যু হবে।
“তুমি কি কিছুই বলতে চাওনা?;
“না!;
“কিন্তু কেন?;
“কারন আমি আপনাকে ভালোবাসিনা!;
আরাফ থমকে গেলো। তানি তাকে ভালোবাসেনা! সত্যিই কি বাসেনা? নাকি বাসতে চায়না। তার কোনো কমতি কি তানিকে বাঁধা দিচ্ছে ভালোবাসতে?
“আমাকে ভালো না বাসার কারন?;
“জানিনা।;
“তোমার কি অন্য কাউকে ভালোলাগে?;
“জানিনা;
“কিছুতো একটা জানতে হবে তোমাকে। সব কিছু জানিনা বলে এড়িয়ে গেলে তো হবেনা তানি। আমি তোমাকে ভালোবাসি।;
“উফফ, আমার বি*র*ক্ত লাগে এসব ভালোবাসা-ফালোবাসায়। অসহ্য লাগে।;
আরাফ স্তব্ধ হয়ে গেলো। এরকম হয় নাকি? ভালোবাসা আবার বি*র*ক্তির বস্তু হয়? কি আজব!
ভোর ৬টায় এলার্মের বিপরীতে যদি কাকের ঐ বিশ্রী গলার কা কা আওয়াজ শুনতে হয়, তবে যে কারোরই মেজাজ তুঙ্গে চড়ে যাবে। ইশারও তাই হলো। বিরক্তির স্পষ্ট ছাপ কপালের শীর্ষে নিয়ে উঠে বসলো। শীতের দিন। দিবস যতটা ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটে যায়, রজনী ততটাই ধীর গতিতে কদম ফেলে। তাই সকাল ৬টা, শীতের দিনে ভোর রাত। উষ্ণ বিছানা ছেড়ে উঠতে বড্ড আলসেমি লাগছে ইশার। তবুও ছাড়তে হলো। চোখ ডলতে ডলতে উঠলো সে। অলস পায়ে হেঁটে গেলো ব্যালকনিতে। গার্ডেনে পাহাড় সমান একটা আমগাছ। কাকটা ওখানেই বাসা বেঁধেছে। বাসা বেঁধেছিস ভালো কথা, এমন কা কা করে ঘন্টা বাজিয়ে লোকের ঘুম হারাম করাটা কি খুব জুরুরি?
“হুঁশ, হুঁশ।;
পানি ছুঁড়ে মা*র*লো ইশা। কাকটা সরার নামই নিচ্ছেনা। কেমন পাষাণের মতো ডেকেই যাচ্ছে। মেজাজ খারাপ হলো ইশার। এ কেমন বিচার সাতসকালে।
“ক্ষিদে পেয়েছে তোর? খাবার খাবি? ডাকিসনা মা। অসহ্য হচ্ছে খুব।;
পাগলের ন্যায় একা একা প্রলাপ বকে যাচ্ছে কাকের সহিত। কতক্ষণ পর পুনরায় নতুন করে বি*র*ক্ত হয়ে রুমে চলে এলো। ভাবছে আবারও শুবে, কিন্তু শুলো না। বিছানা হাতড়ে ওড়না আর ফোনটা নিয়ে চলে গেলো নীচে। চা বানাবে। চা খেতে খেতে শ্রাবণকে কল দিবে। দু’দিন আগে মানুষটার সাথে শেষ কথা হয়েছে। আজ দু’দিন ধরে কাজের চাপে একদমই লাপাত্তা।
শীত শীত লাগছে ইশার। ওড়না না এনে চাদরটা আনলে বেশি উপকার হতো। কিন্তু পুনরায় পা চালিয়ে রুমে যেতে ইচ্ছে করছেনা। তাই ওসব ভাবনা ছেড়ে নীচে চলে এলো। আজকের দিনের শুরুটাই কেমন এলোমেলো লাগছে। কেমন অদ্ভূত। যেন ডিসেম্বর বিদায়ের তীব্র বেদনা ছড়িয়ে পড়ছে সারা ঘরময়।
শেষ সিঁড়িটা পার করতে কেমন হোঁচট খেয়ে পড়তে নিলো ইশা। পড়লোনা। সাহায্যের জন্য হাতের কাছে পেয়ে গেলো কিছু একটা। বুকে হাত চেপে বড় করে দম দিলো ইশা। ওরই বা দোষ কি, এই সাতসকালেও ঘরটা কেমন আমাবস্যার ন্যায় হয়ে আছে। আরেকটু হলেই যেতো পরে।
“কে, কে ওখানে?;
বুকের ভেতরটা ধড়াক করে কেঁপে উঠলো ইশার। ফাঁকা ঘরে যেকোনো কিছুরই শব্দ বড্ড জোরে হয়। আর সেটা যদি হয় কারোর কথা। ঝনঝন করে বেজে উঠলো। ইশা চোখ বড়বড় করে সম্মুখে তাকালো। সিঙ্গেল সোফাটায় অন্ধকারে বসে আছে কেউ। ইশা নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো। এমন কাকভোরে নানাজান ব্যতীত কেউ নয়। ও প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে গলা ঝাড়লো,
“আমি নানাজান। আমি।;
ইশা জবাবের আশায় রইলো। কিন্তু এরপর আর কোনো জবাব এলোনা সামনের দিক থেকে। ইশা ভাবলো নানাজান নামাজের পর অনেক দোয়াদরুদ পড়েন, হয়তো তাই পড়ছেন। তাই আর ওসবে নিজেকে বেশি ঘাটালোনা। খুব সাবধানে চলে গেলো রান্নাঘরে। গ্যস অন করে পানি বসালো। ফের কেবিনেটের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ফোনটা হাতে নিলো। এবার সে শ্রাবণকে কল করবে। দু’টো দিন খুব সহ্য করেছে, আর করবেনা। কাজে গেলে বাড়িতে বউয়ের কথা একদম ভুলেই যায়। অদ্ভুত পুরুষ মানুষ।
ইশা ডায়াল করবে শ্রাবণের নাম্বারে। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো কেউ। ইশা দ্বিতীয়বারের মতো ভয়ে চমকে উঠলো।
“ব্ বড় মামি!;
আফিয়া বেগম ঢুকলেন রান্নাঘরে। তিনি পেছন থেকে ইশার গলা পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। হাতে পানির খালি গ্লাস। ইশা সেদিকে একবার দেখে প্রশ্নবিদ্ধ মুখ করে আফিয়া বেগমের দিকে তাকালে আরও ভীত হলো। চোখমুখ কেমন শুঁকিয়ে আছে আফিয়া বেগমের। যেন তিন রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে মানুষটা।
“কি হয়েছে, তোমার চোখমুখ এমন লাগছে কেন? পানি, পানি লাগবে?;
শেষ প্রশ্নটি ইশা আফিয়া বেগমের খালি গ্লাসটিকে নির্দেশ করে জিজ্ঞেস করলো। আফিয়া বেগম নিরুৎসাহিত ইশার উৎকন্ঠায়। সে সেসবে কান না দিয়ে ইশার হাতটা চেপে ধরে সামনের দিকে খানিকটা টেনে নিয়ে বিপন্ন গলায় বললেন,
“শ্রাবণকে একবার কল দে তো মা। কল তুললে যত দ্রুত সম্ভব বাড়িতে আসতে বলবি। বাবার শরীরটা বাড়াবাড়ি হচ্ছে।;
বলেই খালি গ্লাস নিয়েই ছুটলেন। ইশা বিস্মিত হলো। বলে উঠলো,
“নানাজানের কি হয়েছে, আমি যে এক্ষনি দেখলাম ওখানে বসে দোয়া দরূদ পড়…;
বলে শেষ করতে পারলোনা ইশা। আফিয়া বেগমের ছায়াখানাও নেই দূর দূরান্তে। চলে গেছেন তিনি। ঠিক সেই মুহুর্তেই গ্যাস পোড়ার গন্ধ ঠেকলো ইশার নাকে। ইশা এমন অদ্ভুত গন্ধ পেয়ে নাক কুঁচকালো। তখনও ওর মাথায় এলোনা, এটা গ্যাস পোড়ার গন্ধ। তবে মনে পড়তে বেশি সময়ের প্রয়োজন হলোনা ওর। হঠাৎ মস্তিষ্ক সিগনাল দিতেই ছুটে গেলো সেদিকে। কি বোকার মতো কান্ড করলো, চুলায় পানি দিলো অথচ চুলা জ্বালালোনা। অন্যমনস্ক হয়ে শুধু গ্যাস অন রেখেছে। এক্ষনি যে একটা অঘটন ঘটে যেতো।
হঠাৎ হাতের ফোন বিকট শব্দে বেজে উঠলো। ইশা পুনরায় চমকালো। ভয়ে এবার হাত থেকে ফোনটা মেঝেতে পড়ে গেলো। বিস্ময়ের মহাসাগরে পড়ে বারবার শুধু ফোনটার দিকে তাকাতে লাগলো ইশা।
ঠিক তখনই পাষাণের ন্যায় কেউ গলা ছেড়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। এবার বুঝি ইশা পাগল হয়ে যাবে। আজ হচ্ছে কি খান বাড়িতে। সব কিছু এমন অস্বাভাবিক কেন লাগছে। কান্নার শব্দ বরাবর পাগলের মতো ছুটে গেলো ইশা। কান্নার শব্দটা খান সাহেবের ঘর থেকে ভেসে আসছে। ইশার পদতল থমকে গেলো ঘরের দরজায় এসে। আফিয়া বেগমের বলে যাওয়া কথাটা বারবার মনে পড়তে লাগলো। বারবার কানে বাজতে লাগলো, ” বাবার শরীরটা বাড়াবাড়ি হচ্ছে” ইশার মস্তিষ্ক ওখানেই বিকলাঙ্গ বলে ঘোষিত হলো। নানাজান কি তবে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছেন? বুকটা ফাঁকা হয়ে গেলো ইশার। শ্বাসনালি আঁটকে এলো তীব্র যাতনায়। এটা কেন হলো? কেন হলো এটা! কেন? একই প্রশ্ন বারবার করে যাচ্ছে মন! এটা কেন হলো, কেন হলো, কেন হলো? এমনটা তো হওয়ার নয়, এমনটা কেন হলো?
_________
“কে,কে ওখানে?;
হঠাৎ দুঃস্বপ্নের ন্যায় ঘুম ভেঙে গেলো ইশার। নানা জানের গলাটা কাঁচের ন্যায় বারবার ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হচ্ছে কানের পর্দায়। পরক্ষণেই চিৎকার করে ঘুম ভেঙে যায় ওর। শ্রাবণ পাশে থাকে, শক্ত করে আঁকড়ে ধরে, তবুও শান্ত হতে পারেনা ও। পাগলের মতো কান্না করতে থাকে, আর শুধু মনে পরে একজোড়া স্নেহের হাত। যে শাসনের মুখোশ পড়ে স্নেহের সহিত বড় করেছে ছোট্ট ইশাকে। খুব মনে পড়ে নানাজানের কথা। আজ তার মৃ*ত্যুু*র তিনমাস।
“দুঃস্বপ্ন দেখেছো?;
দরদর করে ঘামছে ইশা। শ্রাবণ ওর হাতটা মুঠোয় শক্ত করে ধরে রাখলো। জোর দিয়ে শুধাল ফের।
ইশা অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছে কিছু, সঙ্গে হাপাচ্ছে বেশ। হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলো। শ্রাবণ ভড়কে গেলো। চটজলদি ইশার মাথাটা নিজের বুকের চেপে ধরে কোমল স্বরে বলে উঠলো,
“কাঁদছো কেন পাখি? কি হয়েছে, বলবে তো আমাকে?;
“নানাজান আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো, কেন চলে গেলো, কেন চলে গেলো?;
“এ কেমন প্রশ্ন বলোতো? মানুষ কি চিরকাল থাকে? থাকেনা তো। সবাইকেই একদিন না একদিন চলে যেতে হবে। দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করতে হবে। তোমাকেও, আমাকেও;
“নানাজানকে আমার ভীষণ মনে পড়ে, বুকের ভেতরটা খা খা করে ওঠে মানুষটাকে এক পলক দেখার জন্য। তোমার মনে পড়ে যখন আমার বাবা আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো? নানাজানও ঠিক সেটাই করলো! সবাই ফাঁকি দিয়ে চলে যায়, সবাই পাষাণ!; (কাঁদতে কাঁদতে)
ইশার বাবার মৃ*ত্যু*র পর নানাজানই ছিলো ইশার একমাত্র ভরসার মানুষ, যিনি ওকে কথা দিয়েছিলো, একদিন সবাই ওকে ছেড়ে চলে গেলেও স্রেফ ঐ মানুষটাই যাবেনা। থাকবে ওর সাথে, চিরটাকাল। বাচ্চা মেয়েটার মন ভুলাতে খান সাহেবের শ্রুতিমধুর মিথ্যে বাক্যটা আজও কানে বাজে ইশার। যা ওকে আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে আহত করে।
“না পাখি, পৃথিবীর নিয়ম মানুষকে পা*ষাণ করে, মানুষ পা*ষাণ নয়। কার না ইচ্ছে করে তার প্রিয়জনদের সাথে অনন্ত কাল পার করতে, কারই না ইচ্ছে করে প্রিয়জনদের নিয়ে এক সাথে অজস্র বছর বাঁচতে। কেউ কি চায় প্রিয়জনদের ছেড়ে চলে যেতে? একদম চায়না। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম মেনে, সৃষ্টিকর্তার আদেশে আমাদের সবারই একদিন মৃ*ত্যু*র স্বাদ গ্রহন করতে হবে। হবেই হবে। দাদাজানের হাতে হয়তো এতটুকুই নির্দিষ্ট সময় ছিলো। কেউ যে তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যরেখা ভেদ করে সামনে আাগাতে পারেনা। দাদাজানও পারেনি।;
“আমাকে নানাজানের কাছে নিয়ে যাবে একবার, যাবে?;
“আজ নয়। তোমার শরীরটা একদমই ঠিক নেই। এই শরীর নিয়ে..;
“না করোনা প্লিজ, আমি যেতে চাই। আমাকে নিয়ে চলো!;
ইশার কান্নারত মুখ দেখে শ্রাবণ চেয়েও না করতে পারেনা আর। শ্রাবণ ভাবে কিছুটা সময়। কি করে ইশাকে বুঝিয়ে রাখা যায়। কিন্তু ইশা তার ভাবনার মাঝেও আরও অসংখ্য বার অনুরোধ করতে থাকে যাওয়ার জন্য। যার দরুণ সে ইশাকে শান্ত করার জন্য আশ্বাস দেয়, তাকে নিয়ে যাবে।
তিনমাসে খান সাহেবের কবরের মাটি অনেকটাই শক্ত হয়েছে। প্রথম দিকে কাঁচা মাটির এক অদ্ভুত গন্ধ পাওয়া যেতো। এখন আর সেই গন্ধ অনুভব হয়না ঘাণেন্দ্রিয়তে।
শ্রাবণ আর ইশা দাঁড়িয়ে আছে কবরস্থানের পাশে। হাতজোড়া একত্র করে একমনে কবর জিয়ারত করছে দু’জনে। শ্রাবণ উপরে উপরে শান্ত স্থীর থাকলেও, ভেতরে ভেতরে তার খুব কষ্ট হয় দাদাজানের জন্য। খান সাহেবের প্রথম নাতি শ্রাবণ। আর প্রথম নাতির জন্য তার টান টা বাঙালিকে আলাদা করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই হয়তো। শ্রাবণের প্রথম কথা শেখা খান সাহেবের কাছে। তার মা সবসময় বলতো, শ্রাবণ নাকি সবার আগে দাদাজান বলে ডেকেছিলো। যার দরুণ তার পরের প্রত্যেক নাতি-নাতনিই তাদের ডাকার সাথে ‘জান’ শব্দটা যুক্ত করে।
শ্রাবণের অক্ষিগোলক ভরাট হয়ে ওঠে নিমিষেই। কিছু মধুর স্মৃতি আজ বড্ড দাগ কেটে যাচ্ছে বক্ষঃস্থলে। ইশা কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। জিয়ারত শেষ করে শ্রাবণ স্নেহের হাতজোড়া বাড়িয়ে দিলো ইশার পানে। ইশা কাঁদতে কাঁদতেই মাথা রাখে তার কাঁধে। শ্রাবণ ওর বাহুদ্বয় আগলে রেখে বোঝানোর উদ্দেশ্যে বলল,
“কাঁদলে দাদাজান কষ্ট পান। কেঁদোনা প্লিজ।;
ইশার কান্না থেমে গেলো এক নিমিষে। তবে শ্রাবণের কথা শুনে নয়, তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিলো বলে। ইশার দুর্বল দেহটা ঢলে পড়লো শ্রাবণের বাহুডোরে। শ্রাবণ চমকিত দৃষ্টিতে তাকালো ইশার দিকে। বুকটা কেঁপে উঠলো তার। গলা ছেড়ে বিকট শব্দে ধ্বনিত হলো ইশার নামটা।
সাতদিনের নতুন বউ নামিরা। সাতদিন পূর্বেই ঘরোয়া ভাবে আরব আর ওর বিয়েটা হয়ে গেছে সবার উপস্থিতিতে। সেখানে ছিলোনা বাড়তে কোনো আনুষ্ঠানিকতা। কেবল কাজি ডেকে, কবুল পড়ে নামিরাকে ঘরে তুলেছে আরব। খান সাহেবের চলে যাওয়ার শোক খান বাড়ি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাইতো, বিয়ের আনন্দের চেয়েও মৃ**ত্যুশোকটা এখনও একধাপ এগিয়ে।
“মা, ইশাকে কি একটু স্যুপ করে দিবো?;
রান্নাঘরে কাজ করছে নামিরা। কাজ করতে করতে হঠাৎ ওর ইশার কথা মাথায় এলো। ক’দিন ধরে ওর শরীরটা খুব খারাপ যাচ্ছে। খাওয়া-দাওয়া একদম কিচ্ছু করছেনা মেয়েটা।
নুপুর বেগম তরকারি কাটছিলো। নামিরার প্রশ্নে তিনি মুখ তুলে তাকালেন।
“হ্যাঁ, বানাও। তবে নিজের নাস্তাটা আগে সেরে নাও তো বাপু। সেই কাক ভোরে উঠে রান্নাঘরে ঢুকেছো।;
“আগে সবার নাস্তা হোক, মা। আমি না হয় আপনাদের সাথেই বসবো।;
নামিরা ভীষণ ঘরোয়া মেয়ে। যেদিন থেকে বিয়ে হয়ে এসেছে এ বাড়ি, নুপুর বেগম একদম হিসেব করে বলতে পারবে, মেয়েটা ঠিক কতটুকু সময় নিজের কথা ভেবে রেস্ট নিয়েছে। আরবের ভাগ্যটা সোনায় বাঁধানো। নয়তো এমন মেয়ে কি এতো সহজে মেলে?
নুপুর বেগম তরকারি কাটতে নিয়েও কয়েক মুহুর্তে মনোমুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো নামিরার দিকে। আফিয়া বেগম আর মরিয়ম বিবিও ওখানেই আছেন। তারা অন্য কাজ করছিলেন। তবে তাদেরও কাজে কিঞ্চিৎ বিরতি এলো নামিরার কথা শুনে। আফিয়া বেগম মৃদু হেসে নামিরাকে বললেন,
“শোন মেয়ে, তোকে আমাদের সাথে মোটেও বসতে হবেনা। তুই ওদের সাথে বসে যাবি। তোকে কিন্তু আমরা মোটেও এতো কাজ করতে দিবোনা এই বলে দিলাম। দু’টো দিন সখে সখে করছো ভালো কথা, কলেজ শুরু হলো পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে হবে, বুঝেছিস?;
শাসনের আড়ালে বুকভরা ভালোবাসা শুধু আফিয়া বেগমই দিতে পারেন। এ কথা আর নতুন নয় নামিরার জন্যে। নামিরা সর্বদাই দেখেছে, কত গভীর ভালোবাসা আফিয়া বেগমের। নামিরা তার কথার জবাব দিলোনা। মনেমনে হাসলো খুব।
আফিয়া বেগম আর মরিয়ম বিবিও এসে বসে পড়লেন ইশার কাছে। তুতুন পানি নিয়ে এলো। শ্রাবণ চটজলদি সামান্য পানি নিয়ে ইশার চোখেমুখে ছিটিয়ে দিলো ভালো করে। কিন্তু তাতে কাজ হলোনা।
“তোরা কোথায় গিয়েছিলি?;
প্রশ্ন করলেন আফিয়া বেগম। কন্ঠে তার বেজায় উদ্বেগ। শ্রাবণ পকেট হাতড়ে ফোনটা বের করতে করতে অপরাধী গলায় বলল,
“বড্ড জেদ করছিলো মা, দাদাজানের কাছে যাবো যাবো করে! কান্না জুড়লো। এরপর আর কি করে না যেয়ে পারি বলো? তাই…;
রেগে গেলেন আফিয়া বেগম। ধমকের সুরে বলে উঠলেন,
“পাগল হোসনি তো তুই? মেয়েটার শরীরের কথা একবার চিন্তা করবিনা? গত তিনমাস যাবত ম*রা*র মতো হয়ে আছে! তোদের কি বলবো, আমার ভাষা নেই আর।;
শ্রাবণ নতশিরে দাঁড়িয়ে রইলো। শমসের সাহেব বললেন,
“এখন কি চেঁচামেচি করার সময় ? আরব, ডাক্তারকে একটা কল করতো।;
“হ্যাঁ বাবাই, করছি।;
“এখন চেঁচামেচি করোনা। ডাক্তার আসুক, তাকে দেখতে দাও।; শমসের সাহেব আফিয়া বেগমের উদ্দেশ্যে পুনরায় বললেন।
তানি এসে শ্রাবণের হাত ধরে একটা সোফায় বসিয়ে দিলো। ফের গেলো পানি আনতে। এক গ্লাস পানি এনে, শ্রাবণের হাতে দিয়ে বলল,
“পানিটা খাও।;
শ্রাবণ মলিন হেসে পানিটা নিলো তানির থেকে। কয়েক ঢোকে পুরোটা শেষ করে খালি গ্লাসটা এগিয়ে দিলো তানির দিকে। তানি সেটা হাতে নিতে নিতে উসখুস করতে লাগলো। শ্রাবণ প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে তাকালো তানির পানে। শুধালো,
শ্রাবণ ভ্রু কুঁচকালো। তানি ছোট্ট একটা ঢোক গিলে আশেপাশে তাকালো। ফের শ্রাবণের হাত ধরে ভয়ার্ত গলায় বলল,
“আপা প্রেগন্যান্ট!;
চকিতে তাকালো শ্রাবণ। ক্ষণেই তানির হাত থেকে নিজের হাতটা এক ঝাটকায় ছাড়িয়ে নিলো। অদূরে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকা ইশার পানে পুনরায় তাকালো। তখন তানি আবারও বলল,
“দু’মাস চলছে। আপা কাউকে জানতে দেয়নি। অবশ্য জানাতে চায়নি। ভেবেছিলো তিনমাস অতিক্রম করলে সবাইকে জানাবে। আর কেন জানিনা আপা খুব ভয় পাচ্ছিলো। বারবার বলছিলো, তুমি জানলে খুব রাগবে। বকবে আপাকে!;
শ্রাবণ অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে ফিরে তাকালো তানির দিকে। জানতে চাইলো,
“তুই কি করে জানলি?;
“আপা এই ক’দিন যাবত অনেক বেশিই অসুস্থ। কিন্তু তুমি বাসায় থাকলে আপা বেশিরভাগ সময় আমার ঘরেই কাটায়। কারন, ও খুব ঘন ঘন বমি করতো। পাছে তুমি টের না পাও, তাই আমার ঘরে এসে বসে থাকতো। একদিন ওর অবস্থা অনেক বেশি খারাপ হয়ে যায়। আমি তোমাদের সবাইকে ডাকতে গেলে আপা আমাকে আঁটকায়। বলে, তোকে আমার কসম কাউকে ডাকবিনা। তাই আমি আর..;
যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে শ্রাবণের। মেয়েটা এবার নিজেকে শেষ করেই ছাড়বে। তুর্জর সাথে ঐ এক্সিডেন্টের পর থেকে ইশা কম বেশি প্রায়শই অসুস্থ থাকতো। শ্রাবণ ডাক্তারের সাথে রেগুলার কথা বলতে থাকে ইশাকে সুস্থ রাখার জন্য। তখন ডাক্তার একদিন শ্রাবণকে এলার্ট করে ইশার প্রেগন্যান্সির ব্যাপারে। জানায়, বাচ্চা নেওয়ার জন্য যেন তারা বেশি তাড়াহুড়ো না করে। ইশার পাকস্থলীতে বিষের পরিমাণ একটু বাড়াবাড়ি হওয়াতে সবকিছুই খানিক প্যাঁচে পড়ে যায়। যা বাচ্চা নিতে গেলে তারা ফেইস করবে। তাই, ইশার সুস্থ হওয়ার পরেও কিছুটা গ্যাব রেখেই যেন তারা বাচ্চা নেয়। তবে, ইশার যে বড্ড বেশি তাড়া। সেদিন এই বিষয়ে কথা উঠলে এই কারনেই শ্রাবণ হাবিজাবি বুঝায় ইশাকে। এখন সে নিজেকেই বকছে মনেমনে। ইশাকে সবটা সহজ ভাবে বুঝিয়ে দিলে ইশা নিশ্চয়ই বুঝতো।
________
সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে। অন্তরীক্ষের লাল হলদে আবরণ পশ্চিমের রূপ বদল ঘটিয়েছে নিদারুণ আকারে। মনোমুগ্ধকর। শ্রাবণের ললাটে গুনে গুনে ঠিক তিনটে ভাজ পড়েছে। সে চিন্তিত। মহা চিন্তায় জমে যাচ্ছে। এমন আনন্দিত, প্রীত আর সন্তোষজনক সংবাদ কোনো দীর্ঘ আঘাত, কোনো দীর্ঘ ঘা দিয়ে যাবে না তো তাদের জীবনে? কেন করলে তুমি এমন ইশুপাখি, কেন করলে? নিজের জেদকে জিতিয়ে কি এমন পেলে?
“একি কি করছো!;
একখানা আতংগ্রস্থ কন্ঠ কর্নপাত হতেই চমকে উঠলো শ্রাবণ। ঘুরে পেছনে তাকাতে তাকাতে কন্ঠের মালিক সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। শ্রাবণ তাকে দেখতে পেলোনা সুষ্ঠু ভাবে। তার পূর্বেই সে সজোরে আঘাত করলো শ্রাবণের হাতে। অমনি শ্রাবণের হাত ফস্কে পড়ে গেলো জলন্ত সিগারেটের শেষাংশ। সিগারেটটা নীচে পড়তে হুঁশ ফিরলো শ্রাবণের। চটজলদি ইশাকে নিয়েই দুকদম সরে গেলো পেছনে। আরেকটু হলেই হাত জ্বলে যেতো ছোট্ট অগ্নিকুণ্ডটায়। শ্রাবণ নিজের বোকামিতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কপাল ডলতে লাগলো।
“সিগারেট খাচ্ছো?; ইশার কঠিন স্বর শোনা গেলো।
শ্রাবণের সেসবে কোনো হেলদোল নেই। তার কিছু একটা মনে পড়তেই ইশার হাতটা ছেড়ে সরে গেলো খানিক দূরে। ইশা অবাক হলো। অভিমানে ভারি হলো অন্তস্থল।
“কিছু বলবে?;
“কি হয়েছে তোমার? মুখটা ওমন শুঁকনো লাগছে কেন?;
মেয়েটার মাঝে এতো মায়া কেন? এই যে সামান্য এক প্রশ্ন করলো সে, তাতেও যেন একঝাক মায়া ছড়িয়ে দিলো চারপাশে। আতরের খুশবুর ন্যায় ছড়িয়ে পড়লো সেই মায়া। শ্রাবণ পারবেনা ওর সাথে রেগে না অভিমান করে থাকতে। বড্ড দুর্বল সে এই জায়গাটায়।
“যা বলতে এসেছো বলে চলে যাও। আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই।;
শ্রাবণ বড্ড পাষাণ, আর বরাবরই এই পাষাণ মনোভাব সে আঁকড়ে বসে থাকতে পারে। এতে ইশার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এমনিতেই অপরাধবোধে কারোর দিকে তাকাতে পারছেনা ও। তারউপর শ্রাবণের এই তীব্র অভিমান কি করে ভাঙাবে ও?
“তুমি কি খুব রেগে আছো?;
“রেগে থাকবো কেন? কি এমন করেছো যে আমাকে রেগে থাকতে হবে?;
ইশা থমকায়। শ্রাবণ হয়তো ওর মুখে শুনতে চাচ্ছে ওর করা ভুলের কথা। ইশা বলতে রাজি, কিন্তু এরপরের যে ঝড় ওর জন্য অপেক্ষা করছে, সেটা কি করে সামলাবে?
“আমাকে প্লিজ মাফ করে দাও, আমি হয়তো একটু বেশিই করে ফেলেছি! আমার অবশ্যই ধৈর্য্য ধরা উচিৎ ছিলো। আ্ আমি অনেক ডেস্পারেট হয়ে পড়েছিলাম। আ.. আমাকে ক্ষমা করে দাও…;
কান্নায় সিক্ত হলো তার মায়াবী নেত্রদ্বয়। শ্রাবণ তবুও শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সে গলবে না, একবিন্দুও নয়।
সামনের সীটের দরজাটা খুলে ইশা বসতে নিলেই আকস্মাৎ বসে পড়লো মায়া। ইশা চকিতে তাকালো। প্রথমে বোঝার চেষ্টা চালালো কি হলো! যখন ব্যাপারটা উপলব্ধি হলো তখন স্বাভাবিক ভাবেই ভীষণ বিরক্ত হলো। মায়া ওর এই বিরক্তি প্রকাশের অপেক্ষা করছে হয়তো। তবে আশানুরূপ ইশা কিছুই বললোনা। তাই সে নিজেই আগ বাড়িয়ে বলল,
“পেছনের সীটে বসতে আমার একটু অসুবিধা হয়। আশাকরি তুমি কিছু মনে করোনি।;
ইশা স্বাভাবিক গলায় বলল,
“না আপু। কিছু মনে করিনি।;
বলেই দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে পেছনের সীটে গিয়ে বসলো। মায়ার অদ্ভুতুড়ে হাসি আর চোখে পরলো না ইশার। পেছনের সীটে আগে থেকেই তন্ময় বসে ছিলো। ইশাকে বসতে দেখে শুঁকনো হেঁসে বলল,
“বাই দ্য ওয়ে আমি অনেক ভালো ড্রাইভ করি। আসার টাইমে কিন্তু আমিই ড্রাইভ করে নিয়ে এসেছি।;
ইশা ভাবান্তর দৃষ্টিতে তাকালো তন্ময়ের পানে। তন্ময় কিছু একটা ইঙ্গিত করেছে। তবে সেটা বুঝতে ইশার বেশি বেগ পেতে হয়নি। আসার সময়ে তন্ময় গাড়ি চালিয়েছে, শ্রাবণ নয়। অর্থাৎ প্রত্যাশিত হলেও শ্রাবণের পাশের সীট মায়ার জন্য বরাদ্দ ছিলোনা।
গাড়ির দরজার কাচে টোকা পড়লো। তন্ময় পেছন মুড়ে তাকালে তার সাথে সাথে ইশাও তাকায়। শ্রাবণ বাইরে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে। তন্ময় তড়িঘড়ি গাড়ির দরজা খুলে দিলো। প্রশ্নবিদ্ধ মুখে শ্রাবণের পানে তাকালো।
“আরেকটা রাইড হয়ে যাক?;
তন্ময় প্রফুল্ল হয়ে উঠলো। চোখ ঝাপটে বলল,
“সেকেন্ড চান্সটা মিস করতে চাইনা!;
বলেই বেরিয়ে গেলো। তন্ময় বের হতেই শ্রাবণ বসে পড়লো ইশার পাশ ঘেঁষে। ঠিক তখনই সামনে থেকে মায়ার গলাটা ভেসে এলো,
“আবার তন্ময়! নো ওয়ে;
“কেন আপু, ভাইয়া কি ভালো ড্রাইভার নয়?;
“ওর সাথে রিস্ক মনে হয়।;
ইশা বিরক্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। শ্রাবণ বিষয়টা লক্ষ্য করে মায়ার উদ্দেশ্যে বলল,
“দু’টো দিন বউকে ছাড়া থেকেছি! আর পারছিনা, সরি মায়া।;
চোখ বন্ধ করতেই ইশার চোখের তাঁরায় ধরা দেয় একটা ছোট্ট ঘটনা। ওদের রিসেপশনের দিনেও গুণে গুণে তিনখানা চিঠি এসেছিলো শ্রাবণের নামে। কুরিয়ার বয় দরজার সামনে এসে দাঁড়াতে আরবের সাথে দেখা হলো। আরব লোকটাকে দেখে ‘কাউকে খুঁজছেন?; প্রশ্ন করলে জবাব দেয় লোকটা,” শ্রাবণ খান আছেন? উনার নামে চিঠি আছে” আরব ভাবুক গলায় জবাব দিলো, “আছে, আজকে তার বউভাত, আমি তার ভাই! আপনি এগুলো আমাকে দিন”
লোকটার থেকে চিঠি নিয়ে আরব চলে যায় ভেতরে। বরাবরের মতোই আজও চিঠি দিতে শ্রাবণকে পেলোনা আরব। যার দরুণ বরাবরের মতোই সোজা চলে যায় শ্রাবণের ঘরে। আলমারিটা খুলে চিঠি দু’টো রেখে দেয় আগের জায়গায়। চিঠি রেখে যাওয়ার সময় ঘরের সামনে থেকেই দেখা হয়ে যায় ইশার সাথে।
“কাউকে খুঁজছো ভাইয়া?;
“ভাইয়ার নামে চিঠি এসেছে। ওকে না পেয়ে আজও আমিই রেখে গেলাম!;
“হ্যাঁ, আগেও তো অনেক চিঠি পেয়েছি! তবে ভাইয়াকে পাইনি। তাই ভাইয়াকে না জানিয়েই রেখে যেতে হলো।;
এই বলে আরব চলে যেতে নিলে পিছু ডাকে ইশা। কৌতুহল নিয়ে জানতে চায়,
“শ্রাবণ ভাই কখনোও দেখেছে এই চিঠিগুলো?;
আরব ভাবুক গলায় বলল,
“মনে তো হয়না!;
“তুমি বলোনি দেখতে?;
“একবার বলেছিলাম, ভাইয়া বলল জমিয়ে রাখ, একদিন সব একসাথে পোড়াবো!;
চলে যায় আরব! ইশাও চলে আসে রুমের ভেতরে। শ্রাবণকে জানায়না। নিজেই আলমারি খুলে বের করে আনে একগাদা চিঠি। আর কিছু না ভেবে সবগুলো চিঠিই পুড়িয়ে ফেলে নিজের হাতে।
“ভাই, এমারজেন্সি বিয়ে করতে চাচ্ছি।;
ইশার ধ্যান ভাঙে। সামনে থেকে ভেসে আসে তন্ময়ের গলা। শ্রাবণ সন্দিহান গলাতে বলল,
“বিয়ে আর তুই! আমি কি ঠিক শুনেছি।;
“ঠিকই শুনেছিস, তোদের এমন সফ্টি সফ্টি প্রেম দেখে নিজেকে বড়ই এতিম ফিল হচ্ছে। টিকে থাকতে পারছিনা।;
“শালা, তোর তো নজর ভালোনা।;
“পারছিনা ভাই। না চাইতেও নজর চলে যাচ্ছে।;
আরও টুকটাক কথা চললো বেশ খানিকটা সময়। ততক্ষণে একবারের জন্যেও শ্রাবণের বুক থেকে মাথা তোলেনি ইশা। সামনের লুকিং গ্লাস থেকে পেছনের সবটাই দেখা যায়। মায়া প্রতিটি সেকেন্ড কেবল ওদেরই পর্যবেক্ষণ করে গেছে। না কথা বলেছে, না চোখ সরিয়েছে।
তন্ময় আর মায়াকে বাসায় নিয়ে আসলো শ্রাবণ। তন্ময় আসতে চাচ্ছিলোনা একদমই। আর এর কারনটা অবশ্যই মায়া। তন্ময় শ্রাবণের খুব কাছের ফ্রেন্ড হলেও মায়ার সাথে তার বন্ধুত্ব বেশ জোরালোই ছিলো। তবে যেদিন থেকে তন্ময় জানতে পারে মায়া শ্রাবণকে পছন্দ করে, সেদিন থেকেই তন্ময় সাবধান হয়ে যায় মায়ার ব্যাপারে। মায়ার জন্য শ্রাবণের জীবনে কোনো বিপত্তি এলে সে মানতে পারবেনা। কারন, শ্রাবণ বরাবরই ভালোবাসার ব্যাপারে ভীষণ সেনসিটিভ। সে ইশাকে ছোট বেলা থেকেই ভালোবাসে। আর সে কখনো চাইবেনা কেউ এসে তাদের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তির নাম কুড়িয়ে নিক। তাই আজ যখন বন্ধু মহলে শ্রাবণের নাম উঠলে, তখন তন্ময় বারবার করে শ্রাবণের বিষয়টা পাল্টে অন্য বিষয়ে কথা বলতে আগ্রহ দেখিয়েছে। কারন সে জানে, মায়া আজও শ্রাবণকে আগের মতোই চায়।
তানিকে নিয়েও সবে সবে বাসায় ফিরলো আরব। শ্রাবণ ইশাকে নিয়ে এলে আরব একাই চলে যায় তানিকে আনতে। তানি বাসায় ফিরে শ্রাবণকে দেখতে আমোদে আটখানা হয়ে গেলো। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো অনেক্ষণ। ফের নাক টেনে টেনে বাচ্চাসূলভ গলায় কত যে গল্প। মায়াকে দেখে চোখ কুঁচকে তাকালো তানি। মুখ বেঁকিয়ে মায়াকে ঘুরেফিরে দেখতে লাগলো। মায়াও দেখছে তানিকে। মায়া কিছু জিজ্ঞেস করবে তার পূর্বেই তানি ইশার গা ঘেঁষে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
“এই মেয়েটা কে রে আপা। কেমন করে তাকিয়ে থাকে ভাইয়ার দিকে?;
“তোর ভাইয়ার বন্ধু;
তানির কুঁচকানো মুখটা আরও কুঁচকে গেলো। এই জবাবে ও সন্তুষ্ট নয়। ভাইয়ার বন্ধুকে পছন্দ হয়নি তানির। নীচে সবার গলা পেয়ে উড়তে উড়তে এলো তুতুন। তিতিরও এলো। এবার বেশ কিছু দিন যাবতই এ বাড়িতে রয়েছে তিতির।
সবাইকে দেখে ক্রমশ কৌতুহল বাড়ছে মায়ার। ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো শ্রাবণের পাশে। সবাইকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলো,
“এরা সবাই তোর বোন নাকি?;
মায়ার প্রশ্নে ইশা সহ সবাই তাকায় মায়ার পানে। এমনকি তন্ময়ও। যেন অস্বাভাবিক কোনো প্রশ্ন করেছে সে। শ্রাবণ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। অতঃপর বলে,
“হ্যাঁ, পরিচয় করিয়ে দেই। ও হচ্ছে তিতির, ও হচ্ছে তানি আর ইনি হচ্ছেন আমাদের সবার প্রিয় তুতুনপাখি।;
মায়া মৃদু হাসে। শ্রাবণ এবার বোনদের উদ্দেশ্যে বলে,
“আর ও হচ্ছে মায়া, আমার ক্যাম্পাসের সবচেয়ে গুড ফ্রেন্ড।;
মায়ার মুখটা নিভে গেলো এমন করে পরিচিতি পেয়ে। গুড ফ্রেন্ড? জাস্ট?
“হ্যালো মায়া আপু।;
“হাই;
তিতির আর তুতুন হাই জানালো মায়াকে। মায়া জোরপূর্বক হেসে হাত নাড়লো।
“তুমি জানো, শ্রাবণের কাছে আমার দুই হাজার একশ আট খানা চিঠি আছে!;
মায়ার চতুরতা দেখে মৃদু হাসলো ইশা। শ্রাবণ দু’দিন পর বাড়ি ফেরাতে বাড়ির পরিবেশটা ঈদের চেয়ে কিছু কম নয়। ভাই বোনদের হুল্লোড়, বড়দের আনন্দ। সব মিলিয়ে ত্রিশটা রোজার পরে ঈদের আনন্দটাই উপলব্ধি হচ্ছে ইশার। তাই সেই আনন্দ আরও একটু প্রগাঢ় করতে ইশা আজ প্রথমবারের মতো রান্না ঘরে ঢুকেছে। অবশ্য বিয়ের পর এই প্রথম। বিয়ের আগে টুকটাক অনেক রান্নাবান্নাই করেছে ইশা। সন্ধ্যার নাস্তা বানাবে ও। মায়া অনেক ভালো রাঁধতে পারে এই বলে সেও এলো ইশাকে হেল্প করতে। তবে ইশা প্রথমেই বুঝেছিলো, মায়া ওকে হেল্প করার জন্য আসছেনা। মনেমনে অবশ্যই অন্য বদ চিন্তা আছে মায়ার।
“তোমার খারাপ লাগলোনা শুনে?;
ইশার হাসি মায়াকে আশাহত করলো। মায়ার উদ্দেশ্য সফল হলোনা বুঝতেই অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলো কথাটা। ইশা ময়দা মাখাচ্ছে। হাতটা মাখোমাখো হয়ে আছে পানি যুক্ত ময়দায়। সেই হাতটা তুলে মায়ার সামনে ধরতেই ভয় পেয়ে সরে গেলো মায়া। ইশা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে পূর্বের হাসি ঠোঁটের কোনে এঁটে রেখেই বলল,
“না গো, যদিনা তোমার পাঠানো চিঠি গুলো আমি রোজ নিয়ম করে এই হাতে আ*গুনে না পো*ড়াতাম।;
চমকে উঠলো মায়া। ক্ষোভ মিশ্রিত নয়নে তাকালো ইশার পানে। যেন ইশা মস্ত বড় পাপ করেছে। আর এই পাপের কোনো ক্ষমা নেই।
“আমার পাঠানো চিঠিগুলো তুমি প্ পুড়িয়ে ফেলেছো?;
“হ্যাঁ, কেন? তুমি কি ভেবেছিলে তোমার পাঠানো চিঠিগুলো পড়ে আমি শ্রাবণকে ভুল বুঝে দূরে সরে যাবো? ওহ মায়া আপু, সব কিছু এতো ইজি ভাবলে চলে নাকি? তুমি শ্রাবণকে চিনোনা? জানোতো, সে কেমন! যেখানে তুমি চার-চারটা বছর ধরে সামনে থেকেও মানুষটাকে এক ইঞ্চি পরিমান পরিবর্তন করতে পারোনি, সেখানে কিনা এই সামান্য ক’টা চিঠি শ্রাবণকে পাল্টে ফেলবে! হাসালে। আর যদি আমার কথা বলি, তাহলে বলবো আমি বড্ড বোকা। আগেপরে কিছু না ভেবেই মানুষটাকে হারানোর ভয়ে কেঁদেছি।;
ইশার গলা অত্যন্ত স্বাভাবিক। আর এতোটাই স্বাভাবিক যে মায়া এতেই দম ছাড়ছে বারবার। এক সুক্ষ্ম ব্যাথা ভেতরটা ক্রমাগত ছিদ্র করে যাচ্ছে মায়ার। ইশা কেন শ্রাবণকে এতোদিনেও ভুল বুঝতে পারলোনা? তবে কি তার ভালোবাসায় কোনো খামতি বা কমতি ছিলো? ছিলো বৈ কি! অবশ্যই ছিলো। নয়তো ইশা এতোটা কনফিডেন্স নিয়ে ওর পাঠানো চিঠিগুলো ন/ষ্ট করতোনা।
“তুমি কখনোও পড়োনি চিঠিগুলো?;
“পড়ার মতো আমার অঢেল বই ছিলো, অঢেল মানুষও ছিলো অবসর সময়টাকে মন মতো কাটানোর। তাই সত্যি বলতে তোমার চিঠিগুলো আমি কখনোও আগ্রহ বাড়িয়েও দেখিনি।;
রান্নাঘরের দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো ইশা আর মায়া। তিতির, তানি আর তুতুন দাঁড়িয়ে আছে। ওরা তাকাতেই তিতির ভ্রুকুটি করে বলল,
“খুব গম্ভীর আলোচনা চলছে মনে হচ্ছে। কি ব্যাপার আমার ভাইয়ের বউ? সব ওকে তো?;
মায়ার বড্ড কষ্ট হচ্ছে, হিংসে হচ্ছে ইশাকে দেখে। সবাই ওকে কেন এতোটা ভালোবাসে। আর এই যে প্রতিটা মুহুর্তে তারা কোনোনা কোনো ভাবে ইশাকে শ্রাবণের নামের সাথে জুড়ে রাখে! এটা একদম সহ্য করতে পারছেনা মায়া।
ইশা চোখ জোড়া ছোট করে তাকায় তিতিরের পানে। গাল ফুলিয়ে বলে,
“এখনই পর করে দিলে তো, মনে থাকবে আমার!;
বলেই আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়। তুতুন সবার আগে ছুটে এসে ইশাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর কাজ দেখতে থাকে। অতঃপর তানি আর তিতির ঢুকে ভেতরে। ইশার কথায় তিতির মুচকি হেসে মায়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আমার ভাইকে বিয়ে করে নিলো, আর তাকে নাকি আমার ভাইয়ের বউ বলে ডাকা যাবেনা! তুমি বলো মায়া আপু, এখানে দোষটা কোথায়?;
মায়া অন্যমনস্ক থাকায় ঠিক ভাবে খেয়াল করেনা তিতিরের কথাটা। তিতির উত্তরের আশায় হাসি মুখেই চেয়ে থাকে মায়ার দিকে। তানি ভ্রু কুঁচকে প্রথম থেকেই চেয়েছিলো মায়ার পানে। ওকে এরূপ অন্যমনস্ক দেখে তানি শয়তানি হেসে এগিয়ে যায় মায়ার পানে। মায়ার পেছনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ বিকট চিৎকার করে বলে ওঠে,
“মায়া আপু তোমার মাথার উপর দুটো তেলাপোকা বেলি ডান্স করছে!;
মায়ার ধ্যান ভাঙে তানির চিৎকারে। অতঃপর যে বাক্যটি সর্বপ্রথম তার মনে আতংক সৃষ্টি করে সেটা হলো মাথার উপর দু’টো তেলাপোকা! ভয়ে আতংকে মায়ার অবস্থা খারাপ হয়ে গেলো মাত্র কয়েক সেকেন্ডে। চিৎকার করতে করতে হঠাৎই লাফাতে শুরু করলো মায়া। মায়ার চিৎকারে আতংকগ্রস্থ গোটা খান বাড়ি। রান্নাঘর থেকে এমন বিকট গলার চিৎকার শুনে ছুটে এলো সবাই! মায়া রীতিমতো ব্যাঙের মতো লাফাচ্ছে। শ্রাবণ, তন্ময়, আরব এমনকি বাড়ির মহিলা সদস্যরাও ছুটে এলেন। ইশাকে চুলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সবার প্রথমে ইশাকে নিয়েই আতংক বাড়লো। শ্রাবণ দৌড়ে এসে ইশাকে টেনে নিয়ে গেলো অন্যপাশে। উদগ্রীব গলায় জিজ্ঞেস করতে লাগলো,
শ্রাবণ ইশার হাত ছেড়ে মায়ার দিকে আসতে নিলে তানি শ্রাবণকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“কিছুই হয়নি ভাইয়া। মায়া আপু অযথাই ভয় পাচ্ছে।;
“ক্ কেন, তুমিই তো বললে আমার মাথার উপর দু’টো তেলাপোকা!;
মায়ার মুখে ‘তেলাপোকা’ শুনে সবাই একসাথেই বলে উঠলো,
“তেলাপোকা”
“হ্ হ্যাঁ! ত্ তেলাপোকা!;
তানি আর পারলোনা নিজেকে সামলাতে। ইশাও তাই। সঙ্গে তিতির আর তুতুনও যোগ হলো। সশব্দে হাসতে লাগলো চারবোন। বাকিরা ভড়কানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তাদের পানে। মায়া ভ্যাবাচেকা খেয়ে আছে। হাসছে কেন ওরা? ভাবতে গেলে তার একটি কথা মনে পড়ে। আর সেটা হলো,
“মায়া আপু তোমার মাথার উপর দুটো তেলাপোকা বেলি ডান্স করছে!;
মায়ার রাগান্বিত হলো নিজের বোকামোর কথা ভেবে! কথাটা সে ভালো করে না শুনেই রিয়াক্ট করে ফেললো। পরক্ষণে রা*গ হলো তানির উপর। ও আসছে থেকে এই মেয়েটা একটার পর একটা কান্ড করেই যাচ্ছে। এই যে একটু আগেই তো, কফি দেওয়ার নাম করে একমগ গরম কফি ওর ওড়নায় ঢেলে দিয়েছি। আবার সেই ওড়নায় ইচ্ছে করে দুটো পিঁপড়া ছেড়ে দিয়েছে। সবটাই ইচ্ছে করে করেছে তানি। খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে মায়া। কিন্তু শ্রাবণের বোন বলেই কিছু বলতে পারছেনা।
“তানি কি শুরু করেছিস তুই? বাড়িতে কাউকে শান্তিতে থাকতে দিবিনা নাকি?;
নুপুর বেগম শাসানী কন্ঠে বলে উঠলো। তানি ইনোসেন্ট মুখ করে হাসি থামায়। ইনোসেন্ট গলাতেই ফের বাক্য আওড়ায়,
“মা আমি কি করলাম? বাড়িতে সবাই তো কমবেশি আমার এসব কথায় অভ্যস্ত, তাই কেউ আমাকে সিরিয়াসলি নাওনা। আজ একজনকে পেয়েছি যে আমাকে সিরিয়াসলি নিয়েছে। এই সুযোগ আমি কেন হাতছাড়া করবো?;
মেয়ের এহেম কথাতে রাগী চোখে তাকালো নুপুর বেগম। দ্বিতীয়বার বকে উঠবে তবে তার পূর্বেই থামিয়ে দিলো শ্রাবণ। ইশাও থামালো বলেকয়ে,
“থাকনা ছোট মামি, ছোট মানুষ একটু দুষ্টুমিই না হয় করেছে!;
মায়ার শরীর জ্বলে যাচ্ছে রাগে। ছোট মানুষের এই নমুনা? ওর চেয়ে তো ওর ছোট বোনটা বেশি ম্যাচিউরড।
“দুষ্টুমি করে মানুষের হার্ট এট্যাক করানোর জোগাড়, তাইতো!;
নুপুর বেগমের রাগ কমলোনা মেয়ের উপর থেকে। পরের বাক্যটি আওড়াতে আওড়াতে অনেকের থেকে বাধাপ্রাপ্ত হলো। তানির ন্যাচার সম্মন্ধে সবারই ধারণা রয়েছে। এটা তো কিছুই না। এমনও হয়েছে অনেককে ও সত্যি সত্যি তেলাপোকা এনে ভ*য় দেখিয়েছে।
“আমাদের তানিটা খুবই দুষ্ট। আমাদের তো হাড়মাংস জ্বালিয়ে খায় একদম। তুমি কিছু মনে করোনি তো ?;
বললেন আফিয়া বেগম। মায়া জোরপূর্বক হেসে জোরপূর্বক মাথা নাড়ে। সে অনেক কিছু মনে করেছে! তবে মুখে কিছুই বলার নেই।
এক এক করে সবাই চলে গেলো রান্নাঘর থেকে। শুধু দাঁড়িয়ে রইলো তারা চারবোন। মায়া যেতে যেতে তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে তানির প্রতি। তবে তানির তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তার বোনদের সাথে তাল মিলিয়ে হাসতে ব্যস্ত।
রাত আটটা। তন্ময় এবং মায়া চলে গেছে মিনিট দুয়েক হবে। শ্রাবণ আর আরব ওদের গাড়ি অব্দি ছেড়ে এলো। শ্রাবণ বাসায় ঢুকতেই মায়ের প্রশ্নের সম্মুখীন হলো,
“মেয়েটা তোকে ভালোবাসে, তাই না?;
মায়ের করা আচানক প্রশ্নে শ্রাবণ একটু থমকায়। মায়াকে সে এখানে আনতে নারাজ ছিলো মনেমনে। তবে বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে মায়া তাকে একরকম জোর করেই এসেছে এখানে।
শ্রাবণ কয়েক মুহুর্ত ভাবতে সময় নেয়। ভেবে জবাব দেয়,
“হ্যাঁ মা। তুমি ঠিকই ধরেছো!;
আফিয়া বেগমের মুখে আঁধার নেমে এলো। বলল,
“আশ্চর্য, তাহলে তুমি ওকে এ বাড়িতে কি করে নিয়ে এলে? একবারও আমাদের কথা ভাবলেনা? আমাদের ছাড়ো একবার ইশার কথা ভাবতে! ওর কাছে ব্যাপারটা কতটা সহনীয় ছিলো ভেবে দেখেছো?;
শ্রাবণ মায়ের মুখ চেয়ে অসহায় গলায় বলল,
“সরি মা! আমি সরাসরি না করতে পারিনি। তন্ময়…;
“সরাসরি না বলতে পারতে হবে তোমাকে। এটা কোনো মজার বিষয় নয় শ্রাবণ। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ইশাকে তুমি বিয়ে করেছো। এতো মজবুত সম্পর্কটাকে কোনো উটকো ঝামেলার জন্য ন-ষ্ট হতে দিওনা। মনে রেখো তুমি ইশাকে ভালোবাসেছো, সারাজীবন সুখে রাখবে বলে কথা দিয়েছো। সেটাকে কারোর জন্য তাসের ঘর করে ফেলোনা!;
“আমি ভুল করেছি মা, এই ভুল আর দ্বিতীয়বার কখনোও হবেনা।;
“ঠিকাছে। এখন ঘরে যাও। একটু ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নাও।;
শ্রাবণ মাথা নেড়ে চলে যায় নিজের ঘরে। ইশা ঘরেই ছিলো। শ্রাবণের লাগেজ থেকে তার জামাকাপড় বের করছে। শ্রাবণকে রুমে ঢুকতে দেখে ইশা একখানা মিষ্টি হাসি উপহার দেয়। শ্রাবণও একই ভাবে হাসে। সে কিছু বলতে চায় ইশাকে। মায়ার ব্যাপারে। তবে কোথা থেকে শুরু করবে বুঝতে পারছেনা।
“ফ্রেশ হবে? টি-শার্ট আর ট্রাউজার দিবো?;
কাজে মনোযোগ রেখেই গিন্নিদের মতো প্রশ্ন করে ইশা। শ্রাবণ আর পারেনা টিকে থাকতে। মায়ের কথাগুলো মনে গেঁথে গেছে একদম। ইশা অলরেডি মায়াকে নিয়ে ভীষণ আপসেট ছিলো! তাকে বারবার একটা কথাই বলছিলো যে ও ভয় পাচ্ছে! ভয় পাচ্ছে মায়াকে নিয়ে। যদি কোনোভাবে তাকে কেঁড়ে নেয় মায়া?
ইশার ভাবনাগুলো অবান্তর হলেও কষ্টটা অবান্তর ছিলোনা একদমই। বোঝে সে। শ্রাবণ ছুটে আসে একরকম। ইশার প্রশ্নের কোনোরূপ জবাব না দিয়ে পেছন থেকে আঁকড়ে ধরে ইশাকে। ইশা হকচকিয়ে যায় শ্রাবণের কান্ডে। ভড়কে যাওয়া গলায় কিছু জিজ্ঞেস করবে ভাবলো তবে তার পূর্বেই শ্রাবণ ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে ওর ঠোঁটজোড়া প্রগাঢ় ছোঁয়ায় আলিঙ্গন করলো। ইশা মুষড়ে গেলো শ্রাবণের গভীর স্পর্শে। অনুভূতিদের তীব্র যাতনায় ভেতর থেকে যেন ভাজ হয়ে গেলো ইশা। এসব অনুভূতিদের সাথে পাল্লা দিতে দিতেই শ্রাবণ পেছন থেকে দরজাটা আঁটকে দিলো। ফের ইশাকে নিজের বাহুডোরে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে পূনরায় ওর ওষ্ঠদ্বয়কে স্পৃষ্ট করলো নিজের অধর দ্বারা। দু’জন দু’জনাতে আষ্টেপৃষ্টে থাকাবস্থাতেই শ্রাবণ ইশাকে নিয়ে গেলো বিছানায়। আর সময় নিলোনা অপ্রয়োজনীয় কোনো ভাবনাতে। ইশাকে নিয়ে শুয়ে পড়লো। এবার ওর ঠোঁট ছেড়ে নেমে এলো গলায়। উন্মাদ হয়ে যায় ক্ষণেই। কি করেছে সে জানেনা। তবে এই মুহুর্তে ইশাকে কাছে না পেলে আর সে টিকে থাকতে পারবেনা এই ধরণীতে। এমতাবস্থায় ইশার কাতর গলায় ছোট্ট একটি শব্দ ভেসে এলো,
শৈত্যপ্রবাহ প্রবাহ শুরু হয়েছে। শীতের মৌসুমেও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে সিক্ত হচ্ছে ধরণী। আলোহীন আবদ্ধ ঘরটায় কেবল ঊর্ধ্বশ্বাসের ওঠানামা। ইশার করা প্রশ্নটিতে শ্রাবণ হুঁশের দেশে ফিরে আসে। তড়াক করে ইশাকে ছেড়ে উঠে বসে সে। ঘন দীর্ঘশ্বাসের ওঠানামা খানিকটা স্থগিত হলে করুণ গলাতে বলে,
“ফ্রেশ হয়ে আসছি, মাকে রাতের খাবার দিতে বলো!;
বলে শ্রাবণ উঠে যেতে নিলে আচমকা টান অনুভব করে বাঁ হাতের তর্জণী আঙ্গুলে। শ্রাবণ ঘাড় ফিরিয়ে পেছন তাকালে দৃষ্টি যায় মনোহারিণীর আকুল অক্ষিপটে। কিছু বলছে তার অক্ষিপট। কোনো বার্তা দিচ্ছে হয়তো। শ্রাবণ আপন মনে বোঝার চেষ্টা চালালো। তবে কতটুক বুঝলো জানা নেই। সে চেষ্টা চালাতে চালাতেই পূণরায় বসলো আগের জায়গায়। ইশা শুয়ে আছে পূর্বের স্থানে। শ্রাবণ ব্যাকুল নয়নে দৃষ্টি বুলালো ইশার মুখবিবরে। বলল,
“খারাপ লাগছে? সরি!;
ইশা না সূচক মাথা নাড়ে। ঠিক শ্রাবণের ন্যায় ব্যাকুল হয়ে বলে,
শ্রাবণের ভেতরটা র*ক্ত শীতল হয়ে উঠলো। ঠোঁটের কোনো জমে গেলো তুষ্ট হাসি। ইশার মুখ বিবরে স্থীর দৃষ্টি রেখে বলল,
“বেশি ভদ্র হয়ে গেলাম কি?;
ইশা অভিমানি গলায় বলল,
“তা নয়তো কি?;
“তবে, বেহায়া হয়ে যাই? কি বলো?;
ইশার কথা আঁটকে যায় গলায়। শ্রাবণ কথাতে বেশ ওস্তাদ। কথা দিয়েই মানুষ পটিয়ে ফেলতে পারে। এই যে এখন? এহেম কথাতে যে ইশার হৃদস্পন্দন লক করে দিলো? সে খবর আছে কি তার?;
ইশার হাতের মাঝে শ্রাবণের হাতটা আঁটকে যেতেই শ্রাবণ পুরোটা ডুবে গেলো ইশার মাঝে। কেবল রয়ে গেলো দু’জনের ঊর্ধ্বশ্বাসের উর্ধ্বগতি। বুক ভারী হয়ে চোখের কোন থেকে ক্রমেই জল গড়িয়ে গেলো অজানা সুখে। বারেবারে সেই সুখের বহিঃপ্রকাশে শ্রাবণের উদাম দেহে স্পষ্টাকারে বেশ অনেকটা নখের আচর বসে গেলো। শ্রাবণ হাসলো আর সুযোগ দিলো তার মনোহারিণীকে। ভীষণ সুখে ভরিয়ে তুললো উপযুক্ত সময়টাকে।
শ্রাবণ জবাব দিলোনা। সে দৃষ্টি বুলাচ্ছে এলোমেলো ইশাতে। ঘরে ড্রিম লাইট জ্বলছে। সেই আলোতেই আধো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ইশাকে। কানের লতি টকটকে লাল হয়ে আছে ইশার। তার হঠাৎ মনে পড়লো সে ইচ্ছে করেই কামড় দিয়েছিলো। এরজন্য ইশা দু’টো মা*রও লাগিয়েছিলো তাকে। মুচকি হেসে সন্তর্পণে হাত বুলালে ওখানে। ইশা স্বল্প শিহরণে কেঁপে উঠলো। অনুভূতিতের মেলা বসতে অজ্ঞাতসারে নেত্রদ্বয় বন্ধ করে ফেললো। শ্রাবণের এবার চোখ পড়লো ইশার গলায়। কম করে হলেও পরপর তিন চারটে দাগ কড়া চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। বুকের ভেতরটা মোচড় দিলো শ্রাবণের। ইশাকে নিয়েই লাফিয়ে উঠে বসলো সে। এটা সে কখন করেছে! মনে পড়ছে না তো।
“আহ্।;
গলায় হাত রাখতেই কাতর কন্ঠে ব্যাথা জানান দিলো ইশা।
“বেশি ব্যাথা?;
“হু!;
“কখন করলাম, মনে পড়ছেনা একদমই।;
“থাকনা। ক্ষিদে পেয়েছে। খেতে চলো!;
“না, বসো এখানে। কিছু একটা লাগিয়ে দেই।;
শ্রাবণ উঠতে নিলে ইশা তার হাত ধরে থামিয়ে দেয়। বাঁধ সাধা গলায় বলে,
“কিচ্ছু লাগবেনা। এই সুখের ব্যাথা আমি এতো সহজে ভুলতে চাইনা। সময় নিক সারতে। যতদিন এসব থাকবে, ততদিন তোমাকে খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করতে পারবো। তোমাকে তো আবারও যেতে হবে চট্টগ্রাম! (মন খারাপের সুরে) তখন এগুলোই হবে আমার সুখের স্মৃতি।;
ইশার মন খারাপ ধরতে শ্রাবণের বেশি বেগ পেতে হয়নি। ইশার মলিন চাহনি আহত করলো তার বক্ষপিঞ্জর। কাছে টেনে ইশার মাথাটা বুকের মাঝে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখে বলল,
“তোমাকেও নিয়ে যাবো এবার। আর একা ছেড়ে থাকতে পারবোনা।;
“কি করে যাবো, ফাইনাল এক্সাম চলছে তো!;
শ্রাবণের মাথায় ছিলোনা ব্যাপারটা। সে নিজের কথায় নিজেকেই বকলো মনে মনে। ইশা পরীক্ষা রেখে কি করে যাবে? কথাটা ভেবে বললে তো আর আলাদা করে ওর মনের কষ্টটা বাড়তো না।
ইশার মন ভুলাতে শ্রাবণ ওকে টেনে তুলে কপালে ছোট্ট একটা ভালোবাসার ছোঁয়া এঁকে বলল,
ইশার লজ্জা রাঙা মুখশ্রী আচানক শ্রাবণের বুকে তোলপাড় শুরু করলো। এতক্ষণ সে খেয়াল না করলেও হঠাৎ বুকটা চিনচিন করছে তার। ইশার এই রূপটা একদমই নতুন তার কাছে। এর আগে কখনোও দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার।
শ্রাবণের উষ্ণ হস্তদ্বয় এসে ঠেকলো ইশার লাল টুকটুকে গালে। শ্রাবণ এগিয়ে আসছে ঘোর লাগা নয়নে। ইশা হাসফাস করে উঠলো হঠাৎ। লজ্জায় আবারও ম*রিম*রি দশা ওর। বুকের ভেতর ঢোল পেটাচ্ছে কেউ। হাতপা নিশপিশ করছে, শরীর জমে যাচ্ছে। দু’জনের মাঝে তখন দেড় ইঞ্চি তফাৎ। ইশা চোখ বন্ধ করে সায় জানালো শ্রাবণকে। শ্রাবণ যখনই ইশার কম্পিত ওষ্ঠজুগল আলিঙ্গন করবে, ঠিক তখনই দরজায় ঠকঠক করে কড়া নাড়ে কেউ। চমকে ওঠে দু’জনেই। ক্ষণেই বর্তমানে ধরা দিয়ে একে অপরকে দেখে লজ্জা মিশ্রিত নয়নে। শ্রাবণ মাথা নীচু করে কপাল চুলকায়। ইশা কোনো রকম বিছানা হাতড়ে ওড়নাটা নিয়ে দৌড়ে যায় ওয়াশরুমে। শ্রাবণও শার্ট উঠিয়ে জড়িয়ে নেয় শরীরে-। বোতাম গুলো সম্পূর্ণ লাগিয়ে এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করতে করতে চলে যায় দরজা খুলতে। দরজার অপর পাশে ভঙ্গ হৃদয়ে দাঁড়িয়ে আরব। চোখমুখ একদমই শুকনো। শ্রাবণের কপালে চিন্তার সুক্ষ্ম ভাজ পড়ে। চিন্তান্বিত গলাতে জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে?;
_____________
ছাদের এক কোনে দোলনায় বসে আছে আরব আর শ্রাবণ। হাতে ধোঁয়া উড়ানো কফির মগ। ইশা মাত্রই দিয়ে গেলো দু’জনকে। শ্রাবণ মগ দু’টো রেখে ইশাকে রুমে যেতে বলল। আরবের মুখ শুঁকনো দেখে ইশা জানতে চেয়েছিলো কি হয়েছে?’ শ্রাবণ বলল, ‘পরে বলছি’ ইশা আর কোনোরূপ প্রশ্ন না করে চলে যায় রুমে। ছাদে আজ বেশ ঠান্ডা। তারউপর খনেখনে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। এমন ঠান্ডায় বাইরে যত কম থাকা যায়।
“কফিটা খা। ভালো লাগবে।;
“না ভাইয়া, ভালো লাগছেনা।;
“কি সমস্যা খুলে বল?;
শ্রাবণের সোজাসাপ্টা প্রশ্ন আরবকে স্বাভাবিক রাখলেও সে যা বলতে চলেছে, সেটা স্বাভাবিক ভাবে বলতে পারছেনা। মনে হচ্ছে ভেতর থেকে বারবার কেউ আটকাচ্ছে তাকে। বাঁধা দিচ্ছে বলতে।
“ভাইয়া আমি বিয়ে করতে চাই।;
শ্রাবণ কফির মগে চুমুক দিয়ে খানিক কফি মুখের ভেতরে নিতে নিতে আরবের এহেম বাক্য প্রলাপে আর গিলতে পারলো না কফিটা। বিষম খেলো সে। কাশতে কাশতে মাথায় হাত চেপে বিস্ময় নিয়ে বলে উঠলো,
“বিয়ে! কাকে?;
আরব মাথা নুইয়ে রইলো। কিছুক্ষণ আগে নামিরার কল এসেছিলো। প্রতিদিনকার মতো সে ভালো মনেই কলটা রিসিভ করে, তবে নামিরা যে খবর দিলো,তাতে সে আর ভালো মন দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বসে থাকতে পারেনি। অস্বাভাবিক ভাবে সাহায্যের জন্য দৌড়ে এসেছে ভাইয়ের কাছে।
“নামিরার বিয়ে ঠিক হয়েছে!;
অশান্ত মনে বলল আরব। শ্রাবণ তখন নিজের হাত পরিষ্কার করছে কফি পরাতে। নামিরার বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে সে পূণরায় বিস্মিত হয়ে তাকায় আরবের পানে। অবাক কন্ঠে জানতে চায়,
“নামিরা? ওহ দ্যাটস আ গুড নিউজ। তো এই নিউজের সাথে তোর বিয়ে করার কি সম্পর্ক?;
ভাবুক গলাতে জিজ্ঞেস করলো শ্রাবণ। আরব অতিষ্ট হয়ে ওঠে। হাতের কফিটা নীচে নামিয়ে রেখে ভাইয়ের দিকে ঘুরে বসে বলে ওঠে,
“সম্পর্ক আছে! তুই বুঝতে পারছিস না?;
শ্রাবণ কাঁধ নাচিয়ে না সূচক মাথা নেড়ে বলল,
“নো। ক্যান ইউ এক্সপ্লেইন?;
আরব দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। হতাশ গলায় বলে,
“আ্ আমি নামিরাকে ভালোবাসি। আমাদের বেশ কিছুদিনের রিলেশন!;
“হোয়াট! আর ইউ সিরিয়াস?;
“ইয়াহ্। ভাইয়া প্লিজ কিছু একটা কর। ওর হিটলার মা আর মামু এবার ওকে বিয়ে দিয়েই ছাড়বে।;
“আমি কি করবো? ভালো তুই বাসিস। ফাইটও তোকেই করতে হবে আরব। এখানে আমার কি করার আছে?;
“আমি বেকার একটা ছেলে। আমি কি করে এই মুহুর্তে নামিরার মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াবো। তাছাড়া মাস্টার্স শেষ করে চাকরির জন্য, বা বিজনেসের জন্য ট্রাই করতেও এনাফ টাইম প্রয়োজন।;
“সিম্পল সলিউশন, আমাদের ফ্যামিলি বিজনেসে ঢুকে পর।;
“না, এটা সম্ভব নয়। আমি নিজে কিছু করতে চাই ভাইয়া।;
“হ্যাঁ আমি তো বলছিনা তুই কিছু করবিনা। দেখ, আফটার গ্রাজুয়েশন তোকে নিজের থেকে কিছু করতে হলেও এনাফ মুলধনের প্রয়োজন। তখন তোকে হয় বাবাইয়ের কাছে না হয় দাদাজানের কাছে হাত পাততে হবে! তো কেন তুই এই মুলধনটা নিজের পরিশ্রমে বানিয়ে পূণরায় নিজে কিছু করবিনা। ইট’স আ গ্রেট এচিভমেন্ট ছোটু। ডোন্ট মিস ইট।;
আনন্দে চোখ জোড়া উৎফুল্ল হয়ে উঠলো আরবের। হ্যাঁ শ্রাবণের বুদ্ধিটা মন্দ নয়। সে এটাই করবে। কিন্তু নামিরা? নামিরার বিয়েটা আপাতত কি করে আটকাবে?
“কিন্তু ভাইয়া নামিরার বিয়েটা কি করে আঁটকাবো?;
“আঁটকাতে হবে কেন? নামিরার বিয়েটা হবে। তবে অন্যকারোর সাথে নয়, তোর সাথে।;
“কি করে?; উদগ্রীব কন্ঠে।
“সেটার ব্যবস্থা আমি করবো। এখন কফিটা খা তো চুপচাপ।;
আরবের মন ফুরফুরে হয়ে গেলো। ওর ইচ্ছে করছে ভাইকে জড়িয়ে ধরতে। এতো ভালো পরামর্শ শ্রাবণ ছাড়া আর কেউই দিতে পারবেনা। শ্রাবণের মতো এমন একজন ভাই পেলে সত্যি জীবন স্বার্থক।
পরের দিন বেলা থাকতে থাকতেই খান সাহেব এবং শ্রাবণ গিয়ে হাজির হলো নামিরার বাসায়। নামিরার মামুও বাসায় ছিলেন এ বেলায়। নামিরার বিয়ে নিয়ে তাদের টুকটাক প্রস্তুতি চলছে। ছেলে পছন্দ হয়েছে। কাল তারা নামিরাকে দেখতে আসবেন বলে জানিয়েছেন। তবে মাঝপথে নামিরার জন্য ঠিক করা এই পাত্রকে বাদ দিতে হলো খান সাহেবের কথা শুনে। তিনি তাদের পানে আতিথেয়তার হাত বাড়িয়ে দিলেন। জানালেন নামিরাকে তাদের আরবের জন্য নিতে চান তিনি। আরব ভালো ছেলে। নম্র-ভদ্র। এমনকি ভবিষ্যতে ভালো কিছু করার সামর্থ্যও ওর মাঝে আছে। কেবল খান সাহেবের নাতির পরিচয় নয়, সে একসময় নিজের পরিচয়েই চলতে পারবে।
আরবের বেকারত্ব নিয়ে নামিরার মামু প্রশ্ন করলে, শ্রাবণ জানায়, আরব পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের পারিবারিক ব্যাবসা সামলাচ্ছে। সেই হিসেবে আরব বেকার নয়। সব শুনে নামিরার মামুরও আর আপত্তি করার কোনো জায়গা রইলোনা। নামিরার মাও খুশি, মামুও খুশি। খান সাহেব জানালেন সবার এক্সামের পাট চুকে গেলেই আরব এবং নামিরার এনগেজমেন্ট হবে। আপাতত ওরা শান্ত মনে পরীক্ষার ঝামেলা শেষ করুক।
দুপুর ২টা। সাতসকালের পাখির কিচিরমিচিরের চেয়েও দিগুণ হারে চেঁচামেচি গোটা খান বাড়ি জুড়ে। আজ শ্রাবণ-ইশার বিয়ে। জনেজনে আত্মীয় স্বজন ঢুকছে খান বাড়িতে। গার্ডেনে বিশাল প্যান্ডেল করা হয়েছে বিয়ের। পাঁচ’শ জন মানুষ অনায়াসে বসতে পেরেছে। তবে পাঁচ’শ জন মানুষের একসাথে নিঃশ্বাস ফেলাটা বো*মা বি*স্ফো*র*ণের মতো শব্দধ্বনি তৈরি করছে।
খানিক্ষণ আগেই প্রায় দশজনকে রঙবেরঙের জুস দিয়ে গেছে আরব আর আশফি। এখন আবার ডাক পড়লো, নতুন করে। আরও বিশ জনকে দিতে বলা হয়েছে। আরব,আশফি, শ্রাবণের বন্ধুরা, আরবের বন্ধুরা, এমনকি আরাফও রয়েছে মেহমানদারিতে। এরা হলো বাড়ির এক একটা পিলার যেন। গোটা বিয়েটার যেকোনো কাজে, যেকোনো সময় এদের একদম হাতের কাছে পাওয়া গেছে। যেমন আরব! সবচেয়ে ঘোড়ার মতো দৌড়ঝাঁপ সেই বেশি করেছে। আজও এর ব্যতিক্রম নয় যেন। জুসের অর্ডার আসতেই এক ছুট্টে চলে গেলো বাড়ির ভেতর। মহিলা মহলের কাজ বাড়ির ভেতরে। মা-চাচিরা আজকের জন্য স্রেফ পাহারায় রয়েছেন।
“বড় মা, আরও জুস চাই। বিশজনের মোটামুটি। দিতে পারবে?;
“তুই একটু জিরিয়ে নে বাবা! আর কত খাটবি।;
চিন্তান্বিত হয়ে বললেন আফিয়া বেগম। বলতে বলতে আবার রান্না ঘরে উঁকি দিয়ে জুসের কথা বলে দিলেন। বড়মা অলওয়েজ বেস্ট। বলতেই হবে। তার সবদিকেই যেন নজর। আরব মুচকি হেসে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো বড় মায়ের দিকে। তা দেখে আফিয়া বেগম ভ্রু নাচালেন।
দ্রুত পায়ে মা-ছেলের মাঝে উপস্থিত হয় নামিরা। আরবকে প্রথমে খেয়াল করেনি। কথাটা বলতে বলতে পাশে চোখ পরে তার। ওমনি বীরপুরুষের পরিচয় দিয়ে চোখ টিপে দেয় আরব। নামিরা আঁতকে ওঠে মনেমনে। আফিয়া বেগম দেখে ফেললো কেমন বাজে হয়ে যাবে ব্যাপারটা। তবে আফিয়া বেগম দেখেননি। তিনি উদ্বিগ্ন হলেন তিতিরের নামটা শুনে।
“হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি এক্ষনি দিচ্ছি।; বলেই রান্না ঘরে চলে গেলেন তিনি।
রাস্তা ক্লিয়ার হয়ে যেতেই আরব এসে দাঁড়ায় নামিরার সামনে। ঠোঁটের কোনে দুষ্টমিভরা হাসি। নামিরা চোখ তুলে তাকায় আরবের দিকে। আরব ফ্লায়িং কিস দিয়ে পূণরায় চোখ টিপে। এবার নামিরার চোখ জোড়া বড়বড় হয়ে যায়। চোখ পাকিয়ে তাকায় সে। আবর উল্টে মুখ টিপে হাসে। এরই মাঝে ফের এসে পরেন আফিয়া বেগম। হাতে লেবুর শরবত। নামিরা আরবকে পাশ কাটিয়ে আফিয়ার বেগমের কাছে গিয়ে লেবুর শরবতটা নিয়ে চলে যায়। নামিরা চলে যেতেই আফিয়া বেগম বলেন,
“মেয়েটা কি ভীষণ লক্ষি, তাই-নারে?;
“ভীষণণণ!; আরবের চোখ তখন নামিরার চলে যাওয়ার পানে স্থীর। ধ্যানও যে বিশেষ তার আমলে নেই, গলার স্বর শুনেই বেশ বোঝা গেলো।
আফিয়া বেগম আরবের পানেই চেয়েছিলেন। মূলত তিনি বাজিয়ে দেখছেন আরবকে। তাই হাসি চেপে পূণরায় বলেন,
“তা বিয়ের ডেইট টা কি ফাইনাল করবো বাবা?;
“হ্যাঁ… অ্যা?(আঁতকে উঠে) ক্ কার বিয়ে বড় মা?;
“কেন তোর আর নামিরার?;
দ্বিতীয়বারের মতো আঁতকে উঠলো আরব। থতমত খেয়ে কপাল, গাল, গলা ডলতে লাগলো। ধরা পরে গেছে তো সে! এবার কি হবে?
“কার বিয়ের কথা হচ্ছে ভাবি?;
পেছন থেকে ভেসে এলো নুপুর বেগমের গলা। আরব হকচকিয়ে গেলো মাকে দেখে। এবার তার আত্মা শুকাতে লাগলো ক্রমশ। আর যাই হোক, মায়ের কাছে এভাবে ধরা পরতে চায়না সে।
বলেই পালাই পালাই করে পালালো আরব। আফয়িা বেগম শব্দ করে হেসে উঠলেন। নুপুর বেগম আহাম্মক হয়ে চেয়ে রইলেন দু’জনের দিকে। কিছু যে পূনরায় জিজ্ঞেস করবেন, তা ভুলে গেলেন আফিয়া বেগমের হাসির শব্দে।
_________
“এতো কড়া লিপস্টিক দিতে হবে?;
অসহায় গলায় শুধালো ইশা। তিতির চোখ পাকালো। হাতে ধরা লেবুর শরবতটা খেতে নিয়েও খেলোনা। ওকে চোখ পাকিয়ে বলল,
“ম্যান্ডেটরি। বাঙালি বিয়ের কনে, কড়া লিপস্টিক না হলে চলবে কি করে?;
হাল ছেড়ে দিলো ইশা। নাহ্, আজ এদের কবল থেকে কোনোমতেই ছাড় পাবেনা। লাল বেনারসির সাথে ভারী সাঝগহনা। সবই ঠিকঠাক ভাবে করলেও কড়া লিপস্টিকের বেলায় তার বড্ড অনীহা। তবে বুঝলোনা কেউই। পার্লারের মেয়েটা তিতিরের কথা মতোই কড়া লাল লিপস্টিক লাগিয়ে দিলো। অবশেষে কনের সাজ পরিপূর্ণ।
“দেখি দেখি, মাশা-আল্লাহ। ভীষণ সুন্দর লাগছে।;
গাল ফুলিয়ে তাকালো ইশা। তিতির ওর গাল টেনে বলল,
“একদম এভাবে তাকাবিনা। তাকিয়ে দেখ, কতটা মানিয়েছে।;
তিতিরের কথার অবাধ্য হলোনা ইশা। মুচকি হেসে সম্মুখে তাকালো বড় আয়নাটার দিকে। লাল টুকটুকে বউ একটা। দু’হাত ভরে আছে মেহেদির গাঢ় রঙে। তারউপর হাত ভর্তি লাল চুড়ি।
“শ্রাবণ ভাইয়া তো জিতেছে আপু।;
পাশ থেকে বলে উঠলো নামিরা। সঙ্গে সঙ্গে তিতির ধমক দিয়ে বলল,
“চুপ, ওটা আমার ভাই!;
বলতেই হাসির রোল পড়লো ওখানে। এদিকে ইশা লজ্জায় না পারছে হাসতে, না পারছে মুখ লুকাতে।
_______
গোল্ডেন কালারের শেরওয়ানিতে শ্রাবণের সুঠাম দেহখানা নজর কাড়লো সবারই। পাশে তার লাল টুকটুকে বউ। পাশাপাশি রাজকীয় চেয়ার দু’টোতে বসানো হলো দু’জনকে। বর-কনের থেকে কারোরই দৃষ্টি সরছে না যে।
“ভয় করছে?;
সবার সামনেই আলতো করে ইশার হাতটা নিজের হাতে তুলে নিলো শ্রাবণ। ইশা কাঁপছিলো। ভয়ে নাকি ভয়ানক অনুভূতিতে কে জানে? তবে আজকের মতো এমন মিশ্র অনুভূতি ওর গোটা জীবনে হয়নি। সব কিছু বড্ড অদ্ভুত লাগছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। লজ্জা লাগছে। আরও কতকি। ক্ষণে ক্ষণে ধড়ফড় করছে বুকের ভেতরটা। আর এই সব মিশ্র অনুভূতির খেলা তখনই বন্ধ হলো, যখন শ্রাবণ দায়িত্ব নিয়ে ওর হাতটা আলতো করে স্পর্শ করলো।
“জ্ জানিনা।;
“সত্যি করে বল!;
“এ্ একটু!;
“তাহলে বিয়েটা ক্যান্সেল করে দেই।;
আঁতকে উঠলো ইশা। শ্রাবণের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই বেশরমরে মতো চোখ টিপ দিলো সে। সাথে দম আঁটকে দেওয়ার মতো মধুর হাসি এঁটে দিলো ঠোঁটের কোনে।
“সবাই দেখছে!;
লজ্জায় মরিমরি করছে ইশা। কথাটা বলতে বলতে পূণরায় মাথাটা নীচু করে নিলো। শ্রাবণ মুচকি হাসলো। ফের সম্মুখে তাকালো। কাজী সাহেবকে নিয়ে এলেন সাদ্দাত সাহেব। এখন বিয়ে পড়ানো শুরু হবে। খান সাহেব কোথায়?
“দাদাজান কোথায়?; প্রশ্ন শ্রাবণের।
সাদ্দাত সাহেব বললেন,
“বাবা অপরাধবোধের জন্য আসতে পারছেন না এখানে।;
ভ্রু জুগল কুঁচকে গেলো শ্রাবণের।
“কিসের অপরাধবোধ?;
“খোরশেদ আঙ্কেলের নাতনীর কথা ভেবে বাবা খুব কষ্ট পাচ্ছেন। ভাবছেন, এক নাতনীর বিয়ে ভেঙে তিনি আরেক নাতনীর বিয়ে দিচ্ছেন।;
শ্রাবণ আর কিছু বলতে পারলোনা। তবে ভেতরে ভেতরে জমে রইলো অনেক কথা। গতকাল খোরশেদ সাহেবকে সে সবটা বুঝিয়ে এসেছে। এমনকি এও বলেছে, সে যেন তার বিয়ের সময় এখানে উপস্থিত থাকে। খোরশেদ সাহেব তাকে কথাও দিয়েছিলো। কিন্তু কোথায় তিনি? তাকে তো কোথায় দেখতে পাচ্ছেনা।
“কোথায়, খান কোথায়? এদিকে নাতির বিয়ে শুরু হয়ে গেছে, কোথায় গিয়ে লুকিয়ে আছে বেটা?;
খোরশেদ সাহেবের গলা সামনে থেকেই ভেসে উঠলো। চকিতে তাকালো বাড়ির লোক। এমনকি শ্রাবণও। মানতেই হবে, এক সেকেন্ডের জন্য হলেও শ্রাবণ ভেবেছিলো, খোরশেদ সাহেব আসবেন না। তার কথা রাখবেন না।
খান সাহেব এবং খোরশেদ সাহেবের ভুল বোঝাবুঝির অন্ত হলো। এবার যে বিয়েটা হওয়ার পালা। ছেলে-মেয়ের নামধাম লিখে শ্রাবণকে কবুল বলতে বললে শ্রাবণ বিনা দ্বিধায়, বিনা দ্বিমতে শান্ত স্বরে মৃদু হেসে জানিয়ে দেয় তিন কবুল। এবার ইশার পালা। ইশাকেও কবুল বলতে বলা হলে ইশার যেন গলা দিয়ে শব্দ উচ্চারিত হচ্ছে না। সামান্য তিনটে শব্দ, তাতেও কত পরিশ্রম হচ্ছে। ইশার নিশ্চুপ আচরণ ভাবালো সবাইকে। তবে শ্রাবণ নির্বিকার। সে ইশার হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরলে ইশা তাকে দেখে। গোটা মানুষটাকে একটু একটু করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। না, এযে তারই শ্রাবণ। তার ভালোবাসার মানুষ। তার আপন মানুষ।
“আলহামদুলিল্লাহ্, কবুল, কবুল, কবুল।;
ইশার মুখ থেকে উচ্চারিত ধ্বনিমালা দীর্ঘ কোলাহল বাঁধিয়ে দেয় উপস্থিত মহলে। সবাই একই সাথে জাগর দিয়ে জানান দেয়, ” আলহামদুলিল্লাহ”
বাসর রাতে ঝগড়া! খানিক রসহ্য নয় কি? না না, কেবল খানিক রহস্য নয়, বিশাল রহস্য লুকিয়ে আছে এখানে। রাত আনুমানিক ২টা। এখনও বিয়ের সাজপোশাকে বসে আছে ইশা। গাল দুটো ফুলিয়ে, চোখের কোনে জল নিয়ে। কি হলো, কি হচ্ছে শ্রাবণের বুঝতে অনেকটা সময় লেগেছিলো বটে। তবে সে যখন ঘটনার মুল অনুমান করতে সক্ষম হয়েছে, তখন ইশার শ্রাবণের ঘর ছেড়ে নিজের ঘরে যাওয়ার পালা। অনেক কষ্টে তাকে আঁটকানো গেলেও, এখনও মানানো যায়নি। কান্না করে ঠোঁট ফুলিয়ে আপাতত ব্যালকনিতে অবস্থান করছে সে।
শ্রাবণও এখনোও চেঞ্জ করতে পারেনি। আরব আর নামিরাকে বলে ইশার জন্য খাবার আনিয়েছে। সবেই তারা দরজার ওপাশ থেকে এক প্লেট ভাত আর বিভিন্ন আইটেমের ভর্তা মাখানো দিয়ে গেলো। সবই ইশার পছন্দের। দেখা যাক এতে তার মনোহারিণীর রাগ কমে কিনা?
ব্যালকনির থাইয়ের উপর টোকা দিলো শ্রাবণ। ওপাশ থেকে ইশার কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেলোনা। শ্রাবণ আরেকবার টোকা দিতে নিয়েও দিলোনা। থাই খুলে ব্যালকনিতে পা রাখলো। মুহুর্তেই এক দমক ঠান্ডা বাতাস এসে বারি খেলো তার শরীরে। রাতের শহরে শীত নামের বস্তুটির আবির্ভাব ঘটেছে বেশ কিছুদিন পূর্বেই। তবে একে উপলব্ধি করতে হলে অবশ্যই রাতবিরেতে এরকম অভিমানে মন নিয়ে ঝিমোতে হবে ব্যালকনিতে।
“ইশা!;
ইশা অন্যমনস্ক, নিশ্চুপ ভঙ্গিতে পা তুলে, হাঁটু জড়িয়ে বসে আছে ছোট্ট মোড়াটায়। তার সামনে আরেকটি মোড়া, সাথে ছোট্ট একটা টি-টেবিল। শ্রাবণের হাতে ধরে রাখা প্লেটটা সে ছোট্ট টেবিলটাতে রাখলো। পরক্ষণেই একপলক তাকালো ইশার পানে। ইশা এখনও আগের মতোই বসে আছে। ওকে দেখে মনেই হচ্ছে না, বাস্তব জগতে তার কোনো অস্তিত্ব আছে কিনা। কেননা, সে ভাবনার জগতেই বিভোর।
“সারাদিনে এতো ধকল গেলো, তিতির বলছিলো, একদমই কিছু খেতে পারিসনি।;
বসতে বসতে কোমল গলায় কথা পাড়লো শ্রাবণ। ইশা এখনও নিশ্চুপ। মুখে রা’ কাটছে না একদম।
“এতক্ষণে তো অনেক ক্ষুধা লাগার কথা!;
নাক টানলো ইশা। এবারেও জবাব না পেয়ে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়লো শ্রাবণ। ইশা যে কথাই বলছেনা। আর না কোনো প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। এভাবে হলে কিভাবে হবে? কিন্তু শ্রাবণ হাল ছাড়লোনা। ইশার চুপ থাকাটাকেই সে সম্মতি ধরে নিয়ে ইশার পাশাপাশি বসলো। প্লেটটা তুলে নিরব থেকে ভাত মাখালো। অতঃপর এক লোকমা তুলে ধরলো ইশার সামনে। ইশা মুখে কিছু না বললেও শ্রাবণকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করালোনা। চুপচাপ খেয়ে নিলো। ইশা যখন খাচ্ছিলো তখন মনে মনে নিজেকে শাবাশি দিলো শ্রাবণ। এটলিস্ট একটু হলেও ইশার মনের কথা সে বুঝতে পেরেছে।
“কম হয়ে গেলো, তাইনা?;
খালি প্লেটটা নির্দেশ করে শুধালো শ্রাবণ। ইশা জবাব দিলোনা। শ্রাবণ আর এই নিয়ে ঘাটলোনা ইশাকে। আসল টপিক তো এখনও পরেই আছে।
“ঐ চিঠিগুলো আমার নামে এলেও, আমি জানিনা কে পাঠিয়েছে। ইভেন কখনোও জানার চেষ্টাও করিনি। বিশ্বাস কর, কখনও পড়া তো দূর হাত দিয়ে ছুঁয়েও দেখিনি!;
‘চিঠি’ হ্যাঁ চিঠি নিয়েই এই মন কষাকষির সূত্রপাত। শ্রাবণের আলমারিতে শ্রাবণের নাম করেই বেশ ক’খানা চিঠি পেয়েছে ইশা। যা দেখেই হৃদয় ভাঙে ইশার। যে মানুষটা ছোট থেকেই ওকে ভালোবেসে এসেছে, আজ তার আলমারি জুড়ে এ কার বসবাস? কে এই রমনী? কে তার শ্রাবণকে এতো যত্ন করে চিঠি লিখে আলমারি ভর্তি করেছে। আজকেও একখানা চিঠি এসেছে। শ্রাবণের বিয়ের দিনটাও পার পেলোনা!
“আমাকে বিশ্বাস কর, আমি এসব বিষয়ে জানিনা কিছুই। মনোহারিণীর অশ্রুসিক্ত নয়ন আমাকে দ্বি-খণ্ডিত করছে ইশুপাখি! তীব্র ভাবে আঘাত করছে অন্তস্থলে!;
‘বউপাখি’ ডাকটা ইশার অপরিচিত নয়। ছোট বেলায় অনেকবার, হাজারবার শুনেছে এই মানুষটার মুখে। তবে ‘তুমি’ বলে সম্মোধন, এক তীব্র অনুভূতি নাড়া দিয়ে উঠলো ভেতরে। সে পাশ ফিরে দেখলো শ্রাবণকে। তার আকুলতা মিশ্রিত নেত্রজুগল কোনোদিন মিথ্যে বলেনি। আজও বলছেনা। তবুও ইশার রাগ অভিমান কমলোনা এক ইঞ্চিও। অবশ্য এর পেছনেও যথাযথ কারণ রয়েছে।
“আমি কি একদমই ক্ষমার অযোগ্য?;
“কেন তুমি ঐ চিঠিগুলো কখনোও খুলে দেখোনি? কেন জানতে চাওনি এর পেছনে কে আছে? আছে কোনো যুক্তিযুক্ত জবাব?;
এতক্ষণে কথা ফুটলো ইশার মুখে। শ্রাবণ ভাবনায় পড়ে গেলো ইশার কথায়। রেগে হলেও যথাযথ কথাই বলেছে ইশা।
“জানিনা, তবে একজনকে সন্দেহ হয়েছিলো কয়েক বছর পূর্বে।;
“বাহ বেশ তো, তবে কেন তার খোঁজ নাওনি?;
“প্রয়োজন মনে করিনি। কারন আমি সর্বদাই আমার ইশুপাখিকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছি। অন্যকেউ কে আমার জন্য ম/র/লো, বা কে আমার জন্য বাঁচল , আমার সত্যিই কোনো মাথা ব্যাথা ছিলোনা। আজও নেই, আগেও ছিলোনা।;
ইশা নিষ্পলক চেয়ে রইলো শ্রাবণের পানে। এমন নয় যে সে অবিশ্বাস করছে তার ভালোবাসার মানুষটিকে, কেননা ইশা চেয়েও কোনোদিন অবিশ্বাস করতে পারবেনা তাকে। সেই দুঃসাহসও নেই ওর। তবে এটাও সত্যি প্রায় শ’খানেক চিঠি দেখে ওর বুকটা কেঁপে উঠেছিলো অজানা ভ*য়ে। আজই ওদের জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচণা ঘটলো, আর আজই এমন এক বি*ষাদিত অনুভূতির স্বীকার হতে হলো? কেন আজই এসব ঘটতে হলো?
“কে সে? যে আমার একমাত্র ডাকপিয়নকে আমার থেকে কেঁড়ে নেওয়ার ফন্দি নিয়ে বসে আছে?;
“ওর নাম মায়া।;
ইশার বুকটা আরও একবার কেঁপে উঠলো। মায়া? এই মায়া আবার কে?;
“আমার সাথেই পড়তো। ফার্স্ট ইয়ার থেকেই আমার উপর ওর ভীষণ ক্রাশ ছিলো। বারবার প্রপোজ করা থেকে শুরু করে অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলো! তবে শুরু থেকেই ও জানতো তোমার কথা। কেবল ও নয়, আমার বন্ধুমহল থেকে শুরু করে এমন কেউ ছিলোনা যে তোমার কথা শোনেনি আমার মুখে। কিন্তু ঐ যে পাগলামি, সেটা কখনোই ছাড়তে পারলোনা! বড়লোক বাপের একমাত্র মেয়ে। চলাফেরা ছিলো অত্যাধুনিক। কিন্তু যেদিন থেকে বুঝতে পারলো আমি এসব পছন্দ করিনা কিংবা চিঠির সাথে আমার অদ্ভুত একটা টান রয়েছে সেদিন থেকেই মায়া একদম পাল্টে গেলো। ওয়েস্টার্ন ছেড়ে চলে এলো শাড়িতে। স্মার্টফোন ছেড়ে চলে এলো চিঠিতে।;
“এতোকিছু করেও তোমার মন পেলোনা কেন?;
“কারন আমার মনটা সর্বদাই এই মনটার সাথে জুড়ে ছিলো!;
বলতে বলতে ইশার গালে হাত রাখলো শ্রাবণ। ইশা মনোযোগী হয়ে শুনছিলো শ্রাবণের কথা গুলো। হঠাৎ শ্রাবণের গাঢ় ছোঁয়া পেয়ে শিউরে উঠলো। খানিক কাঁপলো। চোখ বুঁজে অনুভব করলো এই পবিত্র ছোঁয়া। এই মানুষটা ওকে ঠিক কতটা ভালোবাসে, সেটা কখনোও মুখে বলে বা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
“ভালোবাসি,খুব ভালোবাসি।;
“আমি ভয় পেয়ে গিয়ছিলাম।; (ফুঁপিয়ে উঠলো)
“কিসের ভয়?;
“মনে হচ্ছিলো আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলবো!;
বলতে দেরী হলেও কাঁদতে ইশার একদন্ড সময় লাগলোনা। কান্নায় ভেঙে পড়তে শ্রাবণ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ইশাকে। একদম বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। ফের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“মৃ//ত্যু ছাড়া আমাকে কেউ কোনোদিন তোমার থেকে আলাদা করতে পারবেনা, বউপাখি;
“কিসের ভয়? এগুলো তো নর্মাল। এখানে ভয় পাওয়ার কি আছে?;
ইশা সত্যিই ভীষণ ভয় পাচ্ছে। তবে শ্রাবণের মনেমনে যে অন্যকিছু।
“আমাকে একটু সময় দাও, প্লিজ। আমি নিজেকে প্রিপেয়ার করতে চাই।;
“কোনো সময় হবেনা। তোমার কি একটুও খারাপ লাগছেনা? আমার কিন্তু বিরক্ত লাগছে এবার। আর কতক্ষণ;
শ্রাবণের অস্থিরতা দেখে ইশা মনে মনে নিজেকেই বকছে। সত্যিই তো, শ্রাবণ তার অনুভূতি গুলোকে আর কতভাবে দমিয়ে রাখবে। তার না হয় ভয় হচ্ছে। কিন্তু শ্রাবণের বেলায় তো সম্পূর্ণ ভিন্ন।
“ঠ্ ঠিকাছে! আ্ আমি রেডি;
বলতে বলতে চোখ জোড়া বুঁজে নিলো ইশা। বক্ষঃস্থল ওঠানামা করছে ঊর্ধ্বশ্বাসে। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে মৃদু আকারে। শ্রাবণ ওর এহেম প্রতিক্রিয়ায় বেশ মজা পাচ্ছে। ছোট্ট শব্দ আওড়ালো,
“হু।; বলেই ইশার মাথায় হাত দিলো।
চুলের ক্লিপ খুলছে ধৈর্য্য সহকারে। প্রায় অনেক্ষণ যাবত শ্রাবণের হাত জোড়া ইশার চুলের ক্লিপে এঁটে থাকলে একটু একটু করে চোখ মেলে তাকায় ইশা। শ্রাবণ ওর চুল খুলতে সাহায্য করছে। ইশা এক ধ্যানে চেয়ে থেকে কিছু বলবে তার পূর্বেই শ্রাবণ কোমল স্বরে বলে উঠলো,
“সবে সবে সূচণা ঘটলো আমাদের জীবনের এই নতুন অধ্যায়টির। হাতে অঢেল সময় রয়েছে। তুমি সেই অঢেল সময় থেকে যতটা খুশি সময় নিতে পারো। আমি অপেক্ষা করবো। প্রয়োজন পড়লে সারাজীবনের অপেক্ষা। কোনো তাড়া নেই।;
“মানে?;
“চুল গুলো ভীষণ জট পাকাতো। এখন আর জট পাকাবেনা। সাবধানে একটা একটা করে ক্লিপ খুলেছি। এবার শাড়িটা পাল্টে একটা কমফোর্ট ড্রেস পড়ে লম্বা একটা ঘুম দাও। আমি ততক্ষণে একটু কফি করে আনি।;
ইশার গলা ওখানেই আঁটকে গেলো। কোনো জবাব তৈরী হলোনা মনের ভেতরে। তবে অনেক কৃতজ্ঞতা বোধ জন্মালে মানুষটার প্রতি। সে তো আর এমনি এমনি বলেনা, সবচেয়ে আলাদা এই মানুষটা। সবচেয়ে।
আজ তানির এইচএসসি এক্সাম শুরু হয়েছে। শ্রাবণ-আর ইশার বিয়ের আনন্দের দিনগুলো কোনো মতে পার করে উঠতে উঠতে বেচারির কষ্টের দিন শুরু। দুই সপ্তাহ মোটামুটি ভাবে কাটিয়েছে। তবে আজ থেকে ওর হতাশার দিন শুরু হলো। তানি সর্বকালের অলস মেয়ে। তবে আজকের এই বিশেষ দিনে সে সবার আগে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসেছে ভালো মেয়ের মতো। নুপুর বেগম মেয়ের অবস্থা দেখে রীতিমতো আতংকে পরে গেছেন। ছুটে এসে তার কপালে মাথায় হাত ঠেকিয়ে বিস্মিত হয়ে শুধালেন,
“ওমা তোর শরীর ঠিকাছে তো?;
তানি জানে তার মা তাকে বিদ্রুপ করছে, তবে ইচ্ছাকৃত নয়। তাই আর পাত্তা দিলোনা। আনোয়ারা বেগম ওর পেছনে পায়েস নিয়ে ছোটাছুটি করেছেন কতক্ষণ, আজ সে এতোই সিরিয়াস যে মিষ্টির কোনো খাবারই মুখে তুলতে দেখা যায়নি। তিতির,ইশা,আরব এবং তুতুন বেজায় দুশ্চিন্তায় পরে গেলো এই বিষয়ে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এক্সামের চাপে মিষ্টি পাগলি মিষ্টি খেতে ভুলে গিয়েছে।
ইশার সেমিস্টার ফাইনাল শুরু হয়েছে দু’দিন আগে। ওদিকে আরবেরও মাস্টার্স ফাইনাল চলছে। সময়টাই যেন পরীক্ষা ময়। তাই আজ তানির প্রথম এক্সাম হলেও ভাই বোনরা কেউই তাকে সঙ্গ দিতে পারলোনা। বেচারি তানি এক বুক হাহাকার নিয়ে একাই ছুটলো এক্সাম দিতে। অবশ্য ইশা আর আরব কথা দিয়েছে, ওদের এক্সাম শেষ হলেই তানির হলের সামনে পৌঁছে যাবে। তারপর তিনজন মিলে মজা করতে করতে একসাথে ফিরবে।
“তুমি আরবের বোন না?;
রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে তানি। ওর বান্ধবী নিলার আসার কথা। কথা হয়েছে দু’জন একসাথেই যাবে এক্সাম দিতে। তবে নিলা না এলেও কিছু অবাঞ্ছিত অপ্রয়োজনীয় লোকের দেখা পেলো তানি। ওর সামনে হ্যাংলাপাতলা গড়নের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। নাম বাদশা। দেখলেই মনে হয়, এক পেগ মদ গিলে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক ওভাবেই ঢুলতে থাকে। আজও এর ব্যতিক্রম নয়। তানি বাদশাকে চেনে। গলির মোড়ে প্রায়শই দেখা যায় ছেলেটাকে। বাইকের উপর বসে সিগারেট খেতে খেতে বখাটেদের মতো আড্ডা দেয়, সঙ্গে মেয়েদের টিজ করতে ছাড়েনা।
“হ্যাঁ।;
তানি ছোট্ট করে জবাব দেয়। বাদশা অদ্ভুত চাহনিতে দেখতে থাকে তানিকে। তানির শামলা গায়ের রঙ। তবে মুখভর্তি মায়া। বাদশা চোখ বুলিয়ে বলে,
হঠাৎ পেছন থেকে কারোর দম ফাটা হাসির শব্দ পাওয়া গেলো। হাসির উৎস বরাবর তানি এবং বাদশা দু’জনেই তাকালো। কিঞ্চিৎ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে একজন হ্যান্ডসাম ছেলে। মুখে মিষ্টি হাসি। চোখে মুখে দিগুণ বিদ্রুপতার ছাপ। তানির কথাটা বাদশা হজম করতে না পারলেও, সে ভীষণ মজা পেয়েছে।
“আরাফ, তুই এখানে?;
বাদশার মুখে আরাফের নামটা শুনে বির*ক্ত লাগলো তানির। ওর কাছে দু’জনের আলাদা কোনো বর্ণনা নেই। দু’জনকেই এক লাগে। দু’টোই বখাটে। মনেমনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তানি। আরাফ হেঁটে এসে দাঁড়ায় তানির বাহু ঘেঁষে। তানির চোখমুখ শক্ত হয়ে ওঠে অনাকাঙ্ক্ষিত ছোঁয়ায়। সে পেছন ফিরে তাকায় গরম চাহনিতে, কিন্তু আরাফের মুখের বা চোখের কোনো পরিবর্তন নেই। সে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।
“টিজ করার জন্য আজ বোধহয় পর্যাপ্ত রমনী মেলেনি, তাই না?;
ভদ্র ভাষায় অত্যন্ত অভদ্র একটি প্রশ্ন করলো আরাফ। তানির রাগ হচ্ছে এসব মুহুর্তের সাক্ষী হতে। সে চলে যেতে চাচ্ছে কিন্তু কোনো অদৃশ্য বাঁধা তাকে যেতে দিচ্ছেনা।
“মানে?; (দাঁতে দাঁত চেপে)
“মানে ফানে এক্সপ্লেইন করার সময় নেই। শ্রাবণ ভাইকে চিনিস তো?;
বাদশা মনেমনে বড্ড ক্ষেপছিলো আরাফের উপর। তবে শ্রাবণের নাম শুনতে ওর রুহু কেঁপে উঠলো। একবার শ্রাবণের হাতে পরেছিলো এই বখাটে। অবশ্যই কোনো মেয়েকে উত্ত্যক্ত করাকালীন। যা মা*রটা খেয়েছিলো সেদিন। আজও ভুলেনি।
“ক্ কেন! চিনলে চিনি না চিনলে নাই! তোর সমস্যা কি?;
“ও কে জানিস তো?; তানিকে ইশারা করে।
ভয় হলেও বুকে সাহস জমিয়ে রেখেছিলো বাদশা। কিন্তু আরাফের কথার ধরণে সে সাহস টুকু ধরে রাখতে পারছেনা। মনে হচ্ছে দুর্ভোগ জাতীয় কিছু আছে কপালে।
“তুই কি বলতে চাস ক্লিয়ার করে বল! এতো পেঁচাবি না।;
“ওকে, সো লেট মি টেল ইউ ব্রো, ও শ্রাবণ ভাইয়ের বোন। আরব, তানি, তিতির, তুতুন সবাই শ্রাবণ ভাইয়ের ভাই বোন। জানতিস না নিশ্চয়ই। কি বল, কত বড় উপকারটা করলাম তোর?;
বলে দাঁত কেলিয়ে ভ্রু নাচালো আরাফ। বাদশার মাথার উপর বড়সড় একটা বজ্রপাত ঘটে গেলো। সত্যি বলতে আরাফ ওর উপকারই করেছে। নয়তো আজ স্বয়ং যমরাজও ওকে উদ্ধার করতে পারতোনা ঐ যমদূত থেকে।
“নিজের এটুকু ক্ষমতা ছিলোনা ওকে ভাগানোর? আমার ভাইয়ের নামটাই কেন নিতে হলো?;
“সেকি, তোমার জন্য এখন আমি এসব বখাটেদের সাথে মা/রা/মা/রি করবো নাকি?;
“দরকার হলে করবেন। আরেকজনের নাম ভাঙিয়ে কেন খাবেন?;
“ইওর সেফটি ফার্স্ট। আমি চাইলেই ওকে মে*রে ভাগাতে পারতাম। কিন্তু এরপরে এই মা*রে*র ক্ষোভ প্রকাশে ও একটা না একটা সিনক্রিয়েট ঠিকই করতো। তবে এখন ব্যাপারটা কেমন হলো? শ্রাবণ ভাইয়ের ভয়ে হলেও ও তোমার দিকে দ্বিতীয়বার চোখ তুলে দেখার দুঃসাহস করবেনা।;
এতো লম্বা বর্ণনার পর তানির আর কোনোরূপ জবাব দিতে ইচ্ছে করলোনা। সে চুপচাপ অন্যদিকে তাকিয়ে নিলার অপেক্ষা করতে লাগলো। আরাফ হাত ঘড়িতে দৃষ্টি বুলালো। সাড়ে নয়টা বাজে। ফের তানির পানে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
“এক্সাম দিতে যাচ্ছো?;
“হু।;
“বাড়ির গাড়ি নিয়ে যেতে।;
“কেন?;
“আজকে প্রথম দিন। আর আজই এমন একটা সিনক্রিয়েট হলো। বাড়ির গাড়িতে রিলাক্সে চলে যেতে, হোপফুলি এমন কোনো প্রবলেম আসতোনা।;
“আপনাকে এতো ভাবতে হবেনা। আমি আমার ইচ্ছে মতো যাবো!;
“হ্যাঁ থাকে। আপনি এবার আসুন। আমি কষ্ট করে যা পড়েছি আপনার সাথে কথা বলতে যেয়ে সব ভুলে যাচ্ছি।;
আরাফ দমে গেলো। না, আজ সে মনেমনে ঠিক করেই এসেছে তানির সাথে কোনোরূপ ঝগড়া সে করবেনা। কিন্তু মনেমনে ঠিক করলেও কি, এই মেয়ের মুখ যে হারে ছুটে, বাঁচতে হলেও জবাব দেওয়া আবশ্যক হয়ে পরে।
“উহুম.. ওকে আই এম স্যরি। কখন যাবে? লেট হচ্ছে না।;
তানির মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখা গেলো। হাত ঘড়িতে নজর বুলালো। আজকে তো ফোনটাও সাথে আনেনি। নিলা কখন আসবে, কতদূর আছে কে জানে?
“কারোর জন্য অপেক্ষা করছো?;
“হ্যাঁ, আমার ফ্রেন্ড আসবে।;
“ছেলে না মেয়ে?;
ফট করে প্রশ্ন করে বসলো আরাফ। তানি স্বাভাবিক ভাবে জবাব দিতে চাইলেও আরাফের আগ্রহতে কপালের ভাজ তীক্ষ্ণ করে তাকালো।
“সেটা দিয়ে আপনার কি কাজ?;
থতমত খেয়ে গেলো আরাফ। আমতাআমতা করে বলল,
“ন্ না মানে ছ্ ছেলে হলে তো এতক্ষণে এসে যাওয়ার কথা, মেয়ে বলেই বোধহয় লেইট হচ্ছে!;
“হাহা সো ফানি!;
আরাফের চালাকিটা তানি ধরতে না পারলেও ব্যঙ্গ করলো তার ভাবনাকে। অতঃপর নিজেই আবার বিরবির করে বলল,
“বেহুদা কথা হলেও একদম সত্যি কথাই বলেছে লোকটা।;
“কিছু বললে?;
“না।;
“তুমি চাইলে আমি তোমাকে লিফ্ট দিতে পারি।;
তানি মনেপ্রাণে চাইলো আরাফকে না করতে, তবে সময়ের চিন্তা করে আর না করলোনা। বলল,
“ঠিকাছে।;
আরাফ মনেমনে বেজায় খুশি হয়ে গেলো। তবে মুখে একদমই প্রকাশ পেলোনা।
__________
এক্সাম শেষ করে বের হলো নামিরা আর ইশা। ক্যান্টিনে যাবে বলে সেদিকেই রওনা হলো। তবে যেতে যেতে মাঝপথে দেখা হয়ে গেলো আরবের সাথে। আরবেরও এক্সাম শেষ হয়েছে। আবরকে পেতে ইশা প্রথমেই ব্যস্ততা দেখালো তানিকে আনতে যাওয়ার। আরব তাড়া খেয়ে বলল,
“আমি গেইটের বাইরে অপেক্ষা করছি, তুই আয়।;
বলে চলে গেলো আরব। ইশা আর নামিরা কিছু খাওয়ার জন্য চলে গেলো ক্যান্টিনে। কোনোরকমে দু’টো সিঙ্গারা খেয়ে তাড়াহুড়ো করে বের হলো তারাও।
শ্রাবণ আজ দু’দিন ধরে ঢাকায় নেই। চট্টগ্রামে গেছে। কাজের সূত্রে। ক্যাডারের পদেই নাম করা জব হয়েছে তার। সেই খাতিরেই এদিকে সেদিকে ছোটাছুটি। আজ ফেরার কথা ছিলো। তবে গেটের বাইরে শ্রাবণের গাড়িটা দেখতে মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা ইশা। হ্যাঁ, শ্রাবণ ফিরেছে। আর ফিরতেই সোজা তার কাছে চলে এসেছে। তবে, এখানেও একটা কিন্তুর আবির্ভাব ঘটলো। কালো ব্লেজার পরিহিত তার শ্রাবণ গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে কথা বলছে একটা মেয়ের সাথে। সাথে অবশ্য আরেকটা ছেলেও আছে। দেখে মনে হচ্ছে সমবয়সী তারা। ইশার চোখে আলাদা কিছু না পরলেও মেয়েটার মায়ামিশ্রিত মুখ খানা সুচের মতো ফুটলো। কে এই মেয়ে? মায়া নয়তো?;
“ইশু, জলদি আয়।;
আরবের ডাকে ইশার ঘোর কাটে। ইশা সম্ভ্রম ফিরে পেয়ে এগিয়ে যায় ওদের দিকে। ইশার নাম কানে বাজতে শ্রাবণ আর ঐ মেয়েটা একসাথেই ফিরে তাকায়। শ্রাবণের চোখে পরিশুদ্ধ ভালোবাসা আর মেয়েটার চোখে অদ্ভুত অসহায়ত্বতা। ইশা ধীরপায়ে এগিয়ে যায় ওদের দিকে। তাদের সাথে থাকা দ্বিতীয় ছেলেটি সবার আগে উৎসুক হয়ে শুধালো,
“ভাবি নাকি?;
“হ্যাঁ। আমার বউপাখি।;
ইশার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তখনও মেয়েটার প্রতিই। শ্রাবণের মুখে ‘বউপাখি’ সম্মোধনে মেয়েটার যেন বুকে ব্যাথা হলো। হঠাৎ হোঁচট খেলে মানুষ যেমন পড়ে যেতে নেয়, মেয়েটাও যেন পরে যেতে চাইলো। তবে নিতান্তই নিজের মাঝে, নিজের মনে।
ইশা কাছে আসতে আসত শ্রাবণ এগিয়ে এসে ওকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে। একদম বেপরোয়া ভাবে। যেন কাউকে দেখাতেই এমনটা করলো।
“মিসড ইউ সো মাচ!;
ইশার দু’গালে হাত রেখে মৃদু স্বরে বলল শ্রাবণ। ইশা মুচকি হাসলো। শ্রাবণ ওর কাঁধ জড়িয়ে নিয়ে দাঁড়ালো ছেলেটা আর মেয়েটার সামনে। পরিচয় করাতে বলল,
“ও হলো তন্ময়। আমার স্কুল, কলেজ এবং ভার্সিটি সবসয়মের ক্রাইম পার্টনার। অনার্স শেষ করে পগারপার হয়ে যায় লন্ডনে। আজই দেশে ফিরেছে।;
“২০ বছরের দুঃস্বপ্নকে আজ বাস্তবে রূপ পেতে দেখে কি করে ভালো না থেকে পারি বলেন তো!;
ইশা বুঝতে পারে তন্ময় ওকে কোন দুঃস্বপ্নের কথা বলেছে। তাই মুচকি হেসে মাথা দুলায়। শ্রাবণও হাসে মুচকি মুচকি। ফের মেয়েটার দিকে ইশারা করে স্বাভাবিক গলাতেই বলে,
“ও মায়া। আমার ভার্সিটি ফ্রেন্ড।;
বুকের ভেতরটা কেমন করে কেঁপে উঠলো ইশার। সমস্ত সুখ, সমস্ত আনন্দ এক মুহুর্তেই বিষাদময় হয়ে উঠলো। তবুও স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে বলল,
“ভালো আছি। আমি কিন্তু তোমাকে ভাবি ডাকতে পারবোনা। ইশাই ডাকবো।;
সুমধুর কন্ঠ মায়ার। তবে তার প্রতিটি কথার ছন্দমালা ইশার হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দিচ্ছে কোনো অজানা ভয়ে। ইশার মলিন হাসিও বিলুপ্ত হলো। পাশ থেকে শ্রাবণ তার হয়ে জবাব দিলো,
সবাই আর চেয়েও স্বাভাবিক হলোনা। তন্ময় পরিস্থিতি সামলাতো বলল,
“খুবই অদ্ভুত মজা।;
মায়া সশব্দে হাসতে লাগলো তন্ময়ের কথায়। যদিও এখানে হাসির মতো বিশেষ কিছুই ঘটেনি।
________
দুপুর দুইটা। এক্সাম শেষ করে বের হয়ে তানি সবার প্রথমেই খুঁজতে লাগলো তার বাড়ির লোককে। তবে বিশেষ কাউকেই নজরে পড়লোনা একজনকে বাদে। আর সে হলো আরাফ। আরাফকে দেখতেই তানি চলে যায় তার কাছে। উদগ্রীব গলায় জিজ্ঞেস করে,
“আপনি এখনও যাননি?;
তানিকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে আরাফ। তানির প্রশ্নের জবাব না দিয়েই বলে,
“ও গড। জানো কতটা ভ*য় পেয়ে গিয়েছিলাম।;
তানি ভ্রু কুঁচকায়,
“কেন?;
“কেন আবার! সেই কখন এক্সাম শেষ হলো। সবাই চলেও যাচ্ছে। একা তোমারই পাত্তা নেই।;
“অপেক্ষা করছিলেন বুঝি?;
“হ্যাঁ তা নয় তো…;
বলতে যেয়েও থেমে গেলো আরাফ। চোরা নজরে তাকালো তানির পানে। আমতাআমতা করে কথা ঘুরিয়ে বলল,
“ন্ না মানে, এখান থেকেই ফিরছিলাম তো, তাই ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করে যাই। এক্সাম কেমন হলো জানার জন্য!;
তানি জানে আরাফ ঢব মা*র*ছে। তবে ধরা দিলোনা তাকে। হঠাৎ কেউ পেছন থেকে ডেকে ওঠে আরাফকে,
“পেয়েছো তোমার বউকে?;
মধ্যবয়স্ক এক লোক। আরাফকে ডেকে এহেম কথা বলতেই তানির চোখ চড়কগাছ। আরাফ যেন আকাশ ভেঙে নীচে পড়লো। দু’জনের চোখই ডিম্বাকৃতির আকার নিলো। দু’জন দু’জনের দিকে তাকাতেই লোকটা ওদের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। সামনেই আরাফের বয়সের একটা ছেলের সাথে কথা বলে। তাতে ওদের আর বুঝতে অসুবিধা হয়না লোকটা আরাফকে নয়, ঐ ছেলেটাকে বলেছে কথাটা। পরক্ষণেই দু’জনে শব্দ করে হেসে ওঠে। আরেকটু হলেই যে তানি আরাফের মাথা ফাটাতো।
বিয়ের বাকি আর মাত্র দু’দিন। চারপাশ জুড়ে বিয়ের এলাহী আয়োজন হলেও যথারীতি গুরুত্ব পাচ্ছেনা বিয়ের কনে। সে যার কাছেই যাচ্ছে সেই কাজের বাহানা করে চলে যাচ্ছে। আরে বাবা, বিয়েটা তো তার নাকি? তারই বিয়েতে, তাকেই পাত্তা দিচ্ছেনা! এতো অন্যায় রীতিমতো। এর নালিশ কার দরবারে ঠুকবে সে? আছে কেউ?
“থাকবেনা কেন? তোর হবু বর আছে। তার কাছে যা?;
ইশার চুল আঁচড়ে বেঁধে দিচ্ছে তিতির। দুুপুর বারোটা বাজে। খানিক বাদেই কনের হাতে মেহেদী পড়ানোর জন্য পার্লার থেকে দুটো মেয়ে আসবে। নীচে ড্রয়িং রুমে ছোট খাটো একটা মেহেন্দির অনুষ্ঠান করবে। তার আয়োজনও হয়ে গেছে। এখন শুধু ইশাকে সাজিয়ে নীচে নিয়ে যাওয়া বাকি।
ইশা লজ্জা পেলো তিতিরের কথায়। শ্রাবণ তো সবার একধাপ উপরে। সুযোগ পেলেই হয় চুমু খেয়ে বসবে, নয়তো কান লাল হওয়ার মতো লজ্জাজনক কথা বলে ওকে লজ্জায় ফেলে দিবে। তাই তার থেকে আরও বাঁচার জন্য এরওর কাছে যায়।
“ভাইয়া আরও তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছে এখানে ওখানে!;
তিতিরের কথার পিঠে বলল নামিরা। ইশা আরেকটু মাথা নীচু করে দু’জনের অগোচরে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিঃশ্বাস ছাড়লো।
“ভাইয়া বলছিলো, তোকে কাল রাত থেকে নাকি খুঁজে পাচ্ছেনা। কি রে, আমার ভাইটাকে জ্বালাচ্ছিস কেন এভাবে?;
পূণরায় বলল তিতির। ইশা জবাব খুঁজে পাচ্ছেনা। কি জবাব দিবে এর পিঠে?
“বিয়ের আগে যত পারিস বরকে জ্বালিয়ে রাখ, বিয়ের পর কিন্তু আর রক্ষে নেই।;
তিতিরের ছোড়া লজ্জার বানটি তীরের মতো বিঁধল ইশার বুকে। ধুক করে উঠলো ভেতরটা। মুহুর্তেই কান ও গাল গরম হয়ে উঠলো তার। নিঃশ্বাস আঁটকে গেলো কয়েক মুহুর্তের জন্য।
ইশার যে কোনো জবাব আসবে না, সে কথা বোঝা হয়ে গেছে ওদের দু’জনের। তাই দু’জনে মুখ টিপে হাসতে হাসতে ইশাকে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে গেলো।
জলপাই কালারের একটা লেহেঙ্গা পড়িয়েছে ইশাকে। সাথে ম্যাচিং কানের দুল এবং গলার নেকলেস।যৎসামান্যই সাজগোজ। হালকা গোলাপি লিপস্টিক আর চুলগুলোয় লুজ খোঁপা বেঁধে কাঁচা ফুল গুঁজে দিয়েছে তিতির। অতঃপর ওকে দাঁড় করিয়ে দিলো আয়নার সামনে। বলল,
“দেখতো, সাজ পছন্দ হয়েছে কিনা?;
“দাঁড়াও আপু, আমি বরং শ্রাবণ ভাইয়াকে ডেকে নিয়ে আসি। ভাইয়া বলতে পারবে ভালো লাগছে কিনা?;
তিতিরের কথার পিঠে বলতে বলতে তড়িঘড়ি করে দাঁড়িয়ে গেলো নামিরা। ফের যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে পেছন থেকে হাত টেনে ধরলো ইশা। চোখেমুখে আতংক তার। অসহায় গলায় বলল,
“কি শুরু করেছিস তোরা!;
ফিক করে হেসে দিলো তিতির। নামিরার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাসলো নামিরাও। ইশা অসহায় মুখে দু’জনের দিকে তাকিয়ে রইলো স্রেফ।
__________
স্পিকারে গান চলছে ‘কাজরা মোহাব্বত ওয়ালা’। গানের তালে তালে নাচছে তানি,তুতুন আর হৃদিমা। কনের সাথে ম্যাচিং তাদের ড্রেস। ড্রয়িংরুমে এক গাদা মানুষের ভীড়। সবার মাঝে বসে আছে ইশা। আর তার দু’পাশে দু’জন মেহেদী ডিজাইনার, মেহেদী পড়াচ্ছে তাকে। নামিরা আর তিতির তার পাশেই, খানিক পেছনের দিকে বসে সবাইকে শরবত দিচ্ছে। কেউ কেউ পানি কেউ কেউ কোক নিচ্ছে। আরব, আশফি এবং শ্রাবণের বন্ধুরা তারাও ঘুরে ঘুরে খাতিরদারি করছে মেহমানদের। এই সবার মাঝে স্রেফ দুটো মানুষের কোনো খোঁজ নেই। এক শ্রাবণ আর দুই হিমাদ্র। কিন্তু ইশার চোখ যে সেই তখন থেকে শ্রাবণকে খুঁজে যাচ্ছে। কোথায় সে মহারাজ? কি রাজকার্য করছে একা একা?
ইশার মুখের সামনে এক গ্লাস শরবত ধরে বসে পড়লো আরব। ইশা মুখ বাঁকিয়ে তাকালো।
“এক ঢিলে দুই পাখি কিভাবে মা*র*তে হয়, তোমার থেকে প্রশিক্ষণ নিতে হবে ভাইয়া।;
শরবতটা ইশার সামনে ধরলেও আরবের সম্পূর্ণ দৃষ্টি নামিরার পানে। আর সেটা কেউ খেয়াল না করলেও ইশার চোখ এড়ায়নি। নামিরা একটা জলপাই রঙের শাড়ি পড়েছে তিতিরের সাথে ম্যাচিং করে। ভীষণ মিষ্টি লাগছে ওকে এই রঙটায়। ফর্সা শরীরে, না মানানোর কিছু নেই। চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁটে সামান্য লিপস্টিক।
ইশার কথায় খুকখুক করে কেশে উঠলো আরব। দ্রুত নামিরার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ইশার পানে তাকালো। ইশা মিটমিটিয়ে হাসছে। ভ্রু নাচিয়ে পূণরায় বলে উঠলো,
“কি ব্যাপার হ্যাঁ, কি বলতে চাও?;
“ক্ কি বলবো। তোর জন্য ভালোবেসে শরবত নিয়ে এলাম, আর তুই কিনা আমাকে ভুল বুঝছিস?;
“হু হু, সব বুঝতে পারছি। আমার বিয়েটা একটু হতে দাও। তারপর তোমার কান টানা শুরু করবো।;
আবারও কেশে উঠলো আরব। ইশা ওর কাশি দেখে শব্দ করে হেসে উঠলো। আর থাকা যাবেনা এখানে, এই ভঙ্গিমাতেই উঠে পালালো আরব। হাসতে হাসতে ইশার চোখ গেলো সিঁড়িতে। সিঁড়ির মাঝামাঝিতে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। পরনে জলপাই সবুজ পাঞ্জাবি। মাথার চুল গুলো জেলের সাহায্যে সেট করা। গৌরবর্ণ মুখশ্রীতে হালকা খোঁচা দাঁড়ি। খুব সন্তর্পণে চোখাচোখি হলো দুই হবু নবদম্পতির। মুহূর্তেই এক প্রশান্তির লেনদেন হলো দু’জনের মাঝে। চোখের পলক পড়ছেনা কারোরই। তবে এই প্রশান্তির ক্ষণ বেশি সময়ের জন্য স্থায়িত্ব হলোনা। ইশার বাহুতে টান পড়াতে ওর ভ্রম কাটলো। চকিতে সম্মুখে তাকাতেই তানি আর হৃদিমা ওকে টানতে লাগলো। ইশা আর বসে থাকতে পারলোনা ওদের জোড়াজুড়িতে। ইশাকে একদম সামনে নিয়ে গেলো ওরা। এদিকে গান বাজছে। তানি বলল,
“নাচো আপা।;
ইশা স্মিত হেসে ওদের সাথে নাচের তাল ধরলো। শ্রাবণ সিঁড়িতে হেলান দিয়ে স্থীর দৃষ্টিতে কেবল চেয়েই রইলো ইশার পানে। চোখ থেকে তার মুগ্ধতা ঝড়ছে। সবার মাঝে নজর কাড়া মুখখানা দেখে ভেতরটা ভরে উঠছে ক্রমশ।
“ভাইয়া,আসো না?; হৃদিমা হাত উঁচিয়ে ডাকে শ্রাবণকে।
শ্রাবণকে না সূচক মাথা নেড়ে হাত ইশারায় বলে, “তোমরা ইনজয় করো।” কিন্তু কেউ শুনলোনা তার কথা। বলতে বলতে হৃদিমা চলে গেলো শ্রাবণের কাছে। একরকম জোর করে নিয়ে এলো তাকেও। তারপর আর কি, সেও মৃদু হেসে মত্ত হলো নাচে। বর-কনে একসাথে কাপল ডান্স করছে, আর সেটা ক্যামেরা বন্দী না করলে হয় নাকি? নামিরা ফোনটা করে ঝটপট ক্যামেরা অন করলো। তবে কারোর হেঁচকা টানে সেই ভিডিওটি তিন সেকেন্ডের বেশি অতিক্রম করলোনা। আরব ওকে টেনে নিয়ে গেলো সবার মাঝে। শুরু হলো তাদেরও কাপল ডান্স।
উঠতে যেয়ে হঠাৎ ধপ করে বসে পড়লো তিতির। শাকিল এসেছে তাকে ডাকতে একসাথে নাচবে বলে, তবে তার পক্ষে উঠে দাঁড়ানো এই মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ বলে মনে হলো। শাকিল লক্ষ্য করলো তিতিরের এভাবে বসে পড়াটা। সে বিচলিত হয়ে ধরে ফেললো তিতিরকে।
তিতিরকে ধরে রুমে নিয়ে এলো শাকিল। শুয়ে দিতে চইলো তবে সেই সময়টুকু তিতির শাকিলকে দিলোনা। আকস্মিক উঠে দৌড়ে গেলো ওয়াশরুমে। আর সঙ্গে সঙ্গে বমি শুরু হলো। শাকিল আরও ঘাবড়ে যেতে লাগলো তিতিরের অবস্থা দেখে। সেও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা। ছুটে গেলো ওয়াশরুমের দিকে।
_______
নাচতে নাচতে হঠাৎ পা স্লিপ হয়ে গেলো তানির। পা মচকে পেছনের দিকে পড়ে যেতে নিলেই বড় সাবধানতার সহিত ধরে ফেললো কেউ। তানি ‘মা’ বলে মৃদু চিৎকার দিয়ে খামচে ধরলো তার শক্তপোক্ত পেশিবহুল হাত খানা। এমন ভাবে ধরলো, বেচারা ব্যাথায় মৃদু আওয়াজ করলো। তবে তানির সেদিকে ধ্যান নেই। সে বেঁচে গেছে, এই যেন যথেষ্ট।
“আপনি?(মৃদু চিৎকার করে)
তানিকে সোজা করে দাঁড় করাতেই মানুষটার কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম। তৎক্ষণাৎ দু’হাতে কান চেপে ধরে রাগান্বিত গলায় বলল,
“গাধা নাকি, চেঁচাচ্ছো কেন এভাবে?;
আরাফ দাঁড়িয়ে তানির সামনে। পেছনে নিলাশাকেও দেখা যাচ্ছে। নিলাশাকে দেখে তানির তেমন ভয় না হলেও আরাফকে দেখে ওর ভেতরটা লন্ডভন্ড হতে লাগলো। এই ছেলে এখানে কেন এসেছে? বাড়ি বয়ে এসে চড় মা*রা*র নালিশ করবে নাকি? দাদাজান জানলে তো মে*রে ফেলবে ওকে!
“ক্ কি? কেন এসেছেন এখানে হ্যাঁ? চলে যান বলছি।;
“অলওয়েজ কি ঝগড়ার মুডেই থাকো?;
“হ্যাঁ থাকি! তো? আপনি যাবেন নাকি আমি…;
“হেই আরাফ। নিলাশা। প্লিজ কাম, প্লিজ কাম!;
পেছন থেকে শ্রাবণের গলা ভেসে আসতেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো তানির। ও তো ভুলেই গিয়েছিলো দাদা জানের আগেও কেউ আছে যে ওর পিণ্ডিচকটে দিতে পারবে। আর সে হলো শ্রাবণ।
তানি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা। লেহেঙ্গা ধরে দিলো ভোঁ দৌড়। আরাফ ওর দৌড়ে পালানোর দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই মুচকি হাসলো। পরক্ষণেই খানিক বিচলিত হয়ে ভাবলো, পায়ে না ব্যাথা পেলো?
বমির বেগ থামলো ঔষধ খেয়ে। তিতিরের মাথার কাছে বসে আছে আফিয়া বেগম। পাশে নুপুর বেগম এবং আনোয়ারা বেগম। শাকিল, শ্রাবণ, আরব, আশফি সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে আছে তিতিরের পায়ের কাছে। ইশা আর নামিরা বসে আছে তাদের সামনেই, অর্থাৎ তিতিরের পায়ের কাছে। দু’জন তিতিরের দুপা মালিশ করছে। একটু আগে পুরো শরীর জমে উঠছিলো তিতিরের। এখন একটু স্বাভাবিক। ডাক্তার দেখছে তিতিরকে।
মেহেন্দির অনুষ্ঠানের মাঝে হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে শাকিল। কাকে খুঁজবে, কাকে কি বলবে সাময়িক সময়ের জন্য সে বোবা হয়ে গিয়েছিলো। তার অস্বাভাবিক আরচণ চোখে পড়েছিলো শ্রাবণের। ইশাকে থামিয়ে দিয়ে, অপেক্ষা করতে বলে ছুটে যায় সে শাকিলের কাছে। কি হয়েছে জানতে চাইলে শাকিল ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘তিতির কেমন যেন করছে, বারবার বমিও করছে’ ব্যস, মুহুর্তেই অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলো। মেহমানদের নীচে রেখেই ঘরের লোক সবাই উপরে ছুটলো তিতিরের কাছে।
“গুড নিউজ!;
ডাক্তারের গম্ভীর মুখের পরিবর্তন ঘটে মুহুর্তেই আনন্দ মুখর হয়ে বললেন কথাটা। সবার চোখে মুখে উদ্বিগ্ন ভাব। তিতিরের এমন বেগতিক খারাপ অবস্থায় ডাক্তার আবার কিসের সুখবর দিতে চলেছেন? তবে এই উদ্বেগ ছিলো মাত্র ক্ষণকালের জন্য। সবার মুখও ঠিক আনন্দমুখর হয়ে উঠলো ডাক্তারের বলা দ্বিতীয় বাক্যটিতে।
তিতিরের ক্লান্ত শরীরে আর কিছু অবশিষ্ট নেই অত্যাধিক বার উদগীরণের পরে। তবুও এমন সুসংবাদ যেন নিমিষেই ওর সমস্ত ক্লান্তি শুষে নিলো। সর্বাঙ্গ জুড়ে এক শিহরণ বয়ে গেলো গাঢ় অনুভূতিতে। মা হবে সে, মা হবে! চোখের কোন ভরে উঠলো ক্ষণেই। ফুপিয়ে উঠলো সবার অলক্ষ্যে।
শাকিল মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। ডাক্তার যা বলেছে, সে শুনেছে। তবে শোনার পর তার প্রতিক্রিয়া লোড হচ্ছে না। যেন নেটওয়ার্ক বিজি অন্তরীক্ষের। চেয়েও হাসতে পারছেনা, বা চেয়েও কাঁদতে পারছেনা। এমন শূন্য অনুভূতি কখন হয় জানেন, মানুষ যখন অতিরিক্ত আশ্চর্যান্বিত হয়ে যায়। তার ধ্যান ফেরাবার কারবার অবশ্য করতে চলেছে আরব। শাকিলের সামনে দাঁড়িয়ে ভীষণ জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“কংগ্রাচুলেশনস দুলাভাই।;
শাকিল চমকে উঠলো। চোখজোড়া তার কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে আসবে ভাব। সে এখন টের পাচ্ছে সব। সে টের পাচ্ছে তার তীব্র অনুভূতি। সে বাবা হবে। বাবা হবে।
আরব জড়িয়ে ধরলো শাকিলকে। শাকিল হাসলো। আবার দু-ফোটা জল বিসর্জন দিয়ে কাঁদল। সে কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা যেন। হাসবে, নাকি কাঁদবে?
দশ মিনিটের মাঝে পুরো ঘর খালি করে দেওয়া হলো। তিতিরের এখন ভরপুর রেস্ট নিতে হবে। এবং এই রেস্টের মাঝে শাকিলকেও প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে উপস্থিত থাকতে হবে। তিতিরকে এক মুহুর্তের জন্যও একা রেখে যেতে পারবেনা সে। বড় ভাই হিসেবে শ্রাবণের আদেশ।
অনুষ্ঠানে কম বেশি মিষ্টি পরিবেশন হলেও পূণরায় সবাইকে মিষ্টি মুখ করানো এই খুশির সংবাদে। দ্বিতীয়বার মিষ্টি খেতে অনেকেই হিমশিম খেলেও তানি যে মহাখুশি। মিষ্টি খেতে হলেও ওর ইচ্ছে প্রতিদিন একটা না একটা অনুষ্ঠান হোক বাড়িতে। তাতে আর কিছু না হোক, মিষ্টির বর্ষণ হবে, আর তাতে ও মন প্রাণ ডুবিয়ে ভিজতে পারবে, অর্থাৎ খেতে পারবে।
“লাইক সিরিয়াসলি, এতো মিষ্টি কিভাবে খাও?;
ইদানীং একটা সমস্যা শুরু হয়েছে তানির জীবনে। উটকো সমস্যা যাকে বলে। আর তার নাম আরাফ। মাত্রই মিষ্টিটা তুললো মুখে পুড়বে তাই, অমনি উটকো ঝামেলা এসে হাজির।
“হাত দিয়ে তুলি, মুখ দিয়ে খাই। আর কোনো প্রশ্ন?;
ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো আরাফ। এই মেয়ে কি সোজা করে কথা বলতে জানেনা?
“তুমি প্রচুর বেয়াদব। জানো সেটা?;
“জানি।;
“জ্ জানো মানে? সিনিয়রদের সাথে কথা বলার মিনিমাম ম্যানার্স নেই তোমার মাঝে।;
“হ্যাঁ নেই। তো কি হয়েছে?;
“ড্যাম! আর ইউ সিরিয়াস?;
“আপনার প্রবলেম কি বলবেন?;
“কিছুনা।;
বিরক্ত হয়ে প্রস্থান করলো আরাফ। তানি গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে পূণরায় মিষ্টিতে ধ্যান দিলো। তবে পূণরায় এসে হাজির হলো আরাফ। তবে এবার কিছু বলতে নয়, করতে। চোখের পলক ঝাপটে তানির হাতে ধরে রাখা মিষ্টিটা ছোবল মে*রে কেঁড়ে নিয়ে মুখে পুড়ে নিলো। যা দর্শনে তানির পুরো দুনিয়া এফোড় ওফোড় হয়ে গেলো। মুহুর্তেই আরাফের হা সমান ওর মুখটাও হা হয়ে গেলো। আরাফ যখন মিষ্টিটা গিলে নিলো, তখন যেন র*ক্ত*ক্ষ*রণ শুরু হয়েছে। এই নি*পী*ড়ন, এই অ*ত্যা*চার তানি কখনোই সহ্য করবেনা।
আরাফ আর দাঁড়িয়ে থাকলোনা। যে কাজ সে করেছে, এর পর যে কোনো বি*স্ফো*র*ণ ঘটবেনা, তার গ্যারান্টি স্বয়ং জমরাজও দিতে পারবেনা।
_________
“জুস।;
নরম গদিতে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে ইশা। মনটা খানিক আনন্দে নেচে উঠছে আবার খানিক বিষন্নতায় ঘিরে ধরছে। এই দু’মুখো অনুভূতির সঠিক কোনো কারন বের করতে পারছেনা সে। হঠাৎ কানের পাশে কারোর উচ্ছ্বসিত গলা পেতে পাশ ফিরে তাকালো। ততক্ষণে আগন্তুক ঘুরে এসে ওর পাশে আয়েস করে বসলো। এলোমেলো চুল, ক্লান্ত মুখশ্রী আর ভীষণ মায়াবী একখানা হাসি জুড়ে রয়েছে ঠোঁটের কোনে। ইশার মনের সমস্ত বিষণ্ণ ভাব দূর হয়ে গেলো এক লহমায়। শ্রাবণ জুসের গ্লাসটা ধরিয়ে দিলো ইশার হাতে। অতঃপর সোফায় পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বুজলো। ইশা এখনও একই ভাবে, একই চাহনিতে দেখছে শ্রাবণকে। শ্রাবণের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে বার্তা দিতেই সে বন্ধ চোখেই কথা পাড়লো,
“আমার বউয়ের হক এভাবে নষ্ট না করে জুসটা খা।;
ভ্রুকুটি হয়ে এলো ইশার। উনার বউয়ের হক কে কষ্ট করছে? তারই হবু বউ! কি একটা অবস্থা। চোখ সরিয়ে নিলো ইশা। আর ভুলেও তাকালো না শ্রাবণের পানে। বউয়ের হক নষ্ট করছে তাই তো, ঠিকাছে, আর দেখবেইনা।
বিনা বাক্যে পুরো গ্লাস খালি করে দিলো ইশা। অতঃপর উঠে দাঁড়ালে হাতে টান পড়ে। শ্রাবণ ওর দিকে তাকিয়ে আছে প্রশ্ন বিদ্ধ নয়নে। ভ্রু নাচিয়ে বলল,
শ্রাবণ হেঁচকা টান মে*রে বসিয়ে দিলো তার অভদ্র বউটাকে। তার অভদ্র বউ ওরফে ইশারানি ধপ করে বসে পড়লো পূর্বের স্থানে। এবং ঘটনার আকস্মিকতায় ভড়কে গিয়ে চারচোখ করে তাকালো শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ বকার সুরে বলল,
“কপালে খুব দুঃখ নাচছে কিন্তু। কাল থেকে ইগনোর করে যাচ্ছিস আমাকে। সব হিসেব রেখেছি আমি।;
বুকের ভেতর যেন কেউ হাতুড়ির বারি মা*র*লো ইশার। সেরা অহসায়ের খেতাব নিয়ে চেয়ে রইলো শ্রাবণের পানে। শ্রাবণ বাঁকা হাসে, আবার রাগান্বিত হয়। সত্যিই ইশার কপালে সত্যিই দুঃখ আছে।
“ক্ কি করেছি আমি?;
“বলবো, হাতে আর দুটো দিন সময় আছে। যত পারিস করে নে। এরপর তো আমার পালা।;
শয়তানি হেসে তাকায় শ্রাবণ। ইশার দুনিয়া এলোমেলো হতে শুরু করে। ঠিক এজন্যই পালাচ্ছে সে শ্রাবণের থেকে।
_______
“গায়ে হলুদ”
“শ্রাবণ & ইশা”
স্টেজের মাঝে ছোট্ট ব্যানার ঝুলছে। তার মাথা জুড়ে গাঁদাফুলের অসম্ভব সুন্দর ডেকোরেশন। স্টেজে দুটো পিঁড়ি রাখলো ডেকোরেশনের ছেলেগুলো। সামনে আমপাতা, জল ভরা কলসি। নামিরা এসে জলভরা কলসিতে আমপাতা গুলো রেখে সেটা আবার জায়গা মতো রেখে দিলো। আরব এলো ঢালা ভর্তি ফুল নিয়ে। আশফি, তানি, তুতুন, হৃদিমা সবাই কিছু না কিছু করছে। সবাই হাতে হাতে কাজ করাতে অতি জলদি সম্পন্ন হচ্ছে সবকিছু।
“ভাইয়া আর আপুকে কখন আনবে?;
তুতুনের অবুঝ মনের প্রশ্ন। নামিরা মুচকি হেসে বলল,
“আপু আর ভাইয়া তো রেডি হচ্ছে। তুমি গিয়ে দেখে আসতে পারো তাদের আর কতটুকু হলো সাঝ।;
তুতুন খুশি হয়ে ছুটলো দোতলায়। সঙ্গী করলো তার সমবয়সী কয়েকজনকে। প্রথমে শ্রাবণের ঘরে উঁকি দিলো।
গাঢ় হলুদ রঙের একটা জামদানী শাড়ি পড়ানো হয়েছে ইশাকে। আফিয়া বেগমের ভীষণ পছন্দের। শমসের সাহেবের সাথে ঝগড়া করে শাড়িটা কিনেছেন সেদিন। শাড়িটা যখন হাতে তুলেছিলেন, কেন যেন ইশার মুখটাই ভেসে উঠেছিলো সবার আগে। অবশ্য এর আগেই ইশার হলুদের জন্য সুতির শাড়ি নেওয়া হয়েছিলো। এই শাড়িটা দেখার পরমুহুর্তেই ঐ শাড়িটা বাদের তালিকায় চলে যায়।
শাড়িটা যখন পড়ছিলো ইশা, বড়মামা আর বড় মামির ঝগড়ার সিনটা খুব করে মনে পড়ছিলো। বড় মামি পারেও। তুলনা হয়না মানুষটার। এরপর এলো গহনার পালা। শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে আর্টিফিশিয়াল গহনা নেওয়া হয়েছিলো। তবে সেটা আবার পছন্দ হলোনা স্বয়ং বরের। চলবেনা, ইশাকে হলুদে সব তাজা কাচাফুলের গহনাই পড়তে হবে। এসব প্লাস্টিক চলবেনা। ইশা কপাল চাপড়ে বলল,
” ঠিকাছে, কোনো প্লাস্টিক চলবেনা।;
তাই আজ ভোর ভোর ফুলের বাজার থেকে ঝুড়ি ভরে বিভিন্ন ফুল এসেছে খান বাড়িতে। লোক ডেকে সেই ফুল দিয়ে আবার হলুদের জন্য গহনা বানানো হয়েছে। এই কথা ভেবেও একদফা হাসলো ইশা। মনেমনে।
“গহনার সেট গুলো খুব সুন্দর হয়েছে আপু। কোথা থেকে নিয়েছেন?;
যে মেয়েটা ইশাকে সাজাচ্ছে, সে শুরু থেকেই বারবার তাকাচ্ছিলো গহনা গুলোর দিকে। মেয়েটার হঠাৎ করা প্রশ্নে ইশা হতাশ জনক গলায় বলল,
“আমার বরের হুকুমে ঘরেই বানানো হয়েছে আপু।;
“তাই তো বলি, পাঁচ বছর হলো এই প্রফেশনে আছি। আর এই পাঁচ বছরে রোজ কম করে হলেও শ’খানেক ব্রাইড সাজিয়ে দেই। কারোর কাছে কখনও এমন অসাধারণ কাজের গহনা দেখিনি।;
ইশা মুচকি হাসলো। তার পাগল বরের পাগল পাগল কান্ড। কিন্তু, সবার থেকে যখন এভাবে প্রশংসা পায়, তখন নিজেকে ভীষণ স্পেশাল মনে হয় তার। এর কারনটাও একমাত্র তার বর। মানুষটা এমনই। একটু রাগী হলেও, রোজ কোনো না কোনো ভাবে ঠিক এভাবেই ওকে নিজের কাছে নিজেকে স্পেশাল বানিয়ে তুলে।
“ইশশ, এতো মিষ্টি লাগছে আপনাকে।;
সাজগোজ সম্পূর্ণ হলো। মেয়েটার মুখে পূণরায় নিজের প্রশংসা পেয়ে সংকীর্ণ মনে ইশা আয়নার দিকে তাকায়। কাচা ফুলের গহনা গুলো ওর সৌন্দর্য আরও হাজারগুণ করে বাড়িয়ে দিয়েছে। সত্যিই ভীষণ মিষ্টি লাগছে ওকে দেখতে।
হঠাৎ কেউ দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরলো ইশাকে। ইশা চমকে গেলো এহেম আকস্মিক ঘটনায়। তবে ক্ষণকালেই হৃদপিণ্ডের লাফালাফি কমে এলো তুতুনের উচ্ছ্বসিত গলা পেয়ে,
“আপাআআ, তোমাকে এত্তোওও সুন্দর লাগছে।;
এই বলেই ইশার গালে গাল ঘষতে লাগলো তুতুন। ইশা হেসে উঠলো। ওর গলা জড়িয়ে রাখা তুতুনের হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুতুনপাখিকে আরও বেশি সুন্দর লাগছে।;
“উমমম!;
বিড়ালের মতো করছে তুতুন। পাশে বসা মেয়েটা বলল,
“তোমার আপার সাজ পছন্দ হয়েছে?;
“খুবববব!; জবাব দিলো তুতুন।
ফের ইশার সাথে কথার ঝুড়ি খুলে বসলো তুতুন। এটা, ওটা আরও কত কথা। ইশা মুচকি হেসে তুতুনের সব কথারই জবাব দিতে লাগলো। এরমাঝেই রুমে আগমন ঘটলো এক ঝাক মেয়েদের। ইশাকে হলুদের জন্য নীচে নিতে। শ্রাবণকে ইতিমধ্যে নিয়ে বসানো হয়েছে।
পাশাপাশি পিড়ি দু’টোতে বসানো হয়েছে ইশা আর শ্রাবণকে। খান সাহেবকে একটা ছোট মোড়া দেওয়া হলো তাদের সামনে বসতে। তিনি বসলেন ধীরেসুস্থে। ফের হলুদের বাটি থেকে খানিক হলুদ তুলে মুচকি হেসে আগে মাখালেন শ্রাবণকে। অতঃপর মাখালেন ইশাকে।
তার পাশে বসলেন আনোয়ারা বেগম। তিনিও খানিক হলুদ তুলে আগে শ্রাবণকে মাখিয়ে অতঃপর ইশাকে মাখালেন। মাখাতে মাখাতে এক অজানা কারনে তার চোখের তারা ভরে উঠলো নোনাজলে। তার চোখে জল দেখে ছেলে-মেয়েরা, নাতি-নাতনিরা সবাই বড়ো বিচলিত হলো।
“ও বুড়ি, কি হলো তোমার? কাঁদছো কেন?;
ইশা আনোয়ারা বেগমের হাত দু’টো আগলে ধরে জিজ্ঞেস করলো। আনোয়ারা বেগম মাথা নীচু করে চোখের জল মুছে না সূচক মাথা নাড়লো। বলল,
“কিছু না রে। পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে। আমার শমসেরটার জন্য। ছেলেটা আমার…;
“থাকনা, তুমি আবার ওসব নিয়ে কেন পড়লে?;
আনোয়ারা বেগমকে থামিয়ে দিলেন খান সাহেব। তিনি জানেন ভুলটা তারই ছিলো। এবং এই ভুলের জন্য সে ভীষণ ভাবে অনুতপ্ত। তবে আফিয়া বেগমেরও যে কোনো দোষ ছিলোনা। তাহলে আজ এতো গুলো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর এই মানুষটাকে কেন কষ্ট পেতে হবে? যা হয় তা যে আর বদলানো যায়না। বর্তমানকে মেনে নিয়ে ভালো থাকতে হয়। শমসের সাহেবকেও থাকতে হবে, এবং আফিয়া বেগমকে ভালো রাখতে হবে।
চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালেন আনোয়ারা বেগম। খান সাহেবকে উঠতে সাহায্য করলো আরব আর সাদ্দাত সাহেব। খান সাহেব অতীত ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আনোয়ারা বেগমের দিকে তাকালেন। তার মাথায় হাত রেখে মৃদু হেসে তার হাতটা ধরলেন। আনোয়ারা বেগম মুখ তুলে তাকালেন তার পানে। পরক্ষণেই খান সাহেব বললেন,
“মানলাম যা হয়েছে বড্ড খারাপ হয়েছে, কিন্তু তুমি বলো, বড় বউমাকে এই বাড়িতে না আনলে তোমার সাজানো-গোছানো সংসার কি আজও এমনই থাকতো? সংসারটা এমন শক্ত হাতে ক’জন সামলাতে পারে বলো তো?;
আনোয়ারা বেগম ভাবুক হলেন। ভাবুক মনে ভাবলেন, ঠিকই তো। তার বড় বউমার মতো এমন লক্ষীমন্ত মানুষ আর কোথায় মিলতো?
খান সাহেব এবং আনোয়ারা বেগমের পালা শেষ হলে এরপর পালা এলো শমসের সাহেব এবং আফিয়া বেগমের। দু’জনে একসাথে স্টেজে উঠে হলুদ মাখালেন দু’জনকে। ফের এলেন মরিয়ম বিবি। তিনিও মায়ের মতো একই কান্ড করলেন। মেয়েকে হলুদ মাখাতে নিয়ে প্রানপ্রিয় মানুষটার কথা ভেবে অঝোরে কাঁদলেন। আজ মানুষটা বেঁচে থাকলে, সারা বাড়ি জুড়ে বাচ্চাদের মতো হল্লা করে বেড়াতেন।
এরপর এলেন হামজা সাহেব এবং শাহনাজ বেগম। তারপর সাদ্দাত সাহেব এবং নুপুর বেগম। হলুদ মাখাতে গিয়ে নুপুর বেগম ইশার পানে এগিয়ে এসে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন,
তারা নেমে গেলে এরপর আসে শাকিল এবং তিতির। অতঃপর ক্রমে ক্রমে বাড়ির বাকি ছোট বড় সকল সদস্যরা একএক করে হলুদ মাখিয়ে গেলো ওদের দু’জনকে। হলুদ মাখানো শেষ হলে জলভরা কলসির পানি দিয়ে প্রথমে শ্রাবণকে ফের ইশাকে গোসল করালো। যদিও এতে আধা গোসলই হয়েছে। বাকি গোসল যার যার রুমে হবে। দেখতে দেখতে দিনের অর্ধেক বেলা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানেই শেষ হলো।
_______
“আসবো?;
খোরশেদ সাহেবের নাতনীর সাথে শ্রাবণের বিয়েটা না হওয়াতে খোরশেদ সাহেব এখনও ভীষণ ক্ষেপে আছেন তার বন্ধু খান সাহেবের উপর। নিজের নাতনির বিয়ে ভেঙেছে এতো বড় অপমানটা সে কিছুতেই ভুলতে পারবেনা। এই বদনামের রেশ ধরে বেশ কয়েক দিন বাসা থেকেও বের হননি তিনি। তবে এতো কিছু হওয়ার পরও খান সাহেবের কোনো অনুতাপ নেই। সে তো দিব্যি নিজের নাতি-নাতনির বিয়ে দিতে মজেছে। প্রায় প্রতিদিনই এই বিষয়ে বেশ খানিকটা সময় গম্ভীর হয়ে ভাবেন তিনি। আজও তাই। আর হঠাৎ এই ভাবনার মাঝেই কারোর কন্ঠস্বর ভেসে আসে দরজার ওপার থেকে। তিনি মাথা তুলে তাকান সেদিকে। একখানা পরিচিত মুখ দেখতে পেলেন যেন। হ্যাঁ, ঠিকই দেখেছেন। আর এই পরিচিত মুখখানা আর কারোর নয়, সব সমস্যার মুলে যে ছিলো সেই মানুষটারই। অর্থাৎ শ্রাবণের।
“একশবার নিষেধ। যে বা যারা এই খোরশেদ আলমকে দশজন মানুষের সামনে ছোট করে, অপমান করে তাদের মুখ আমি কোনোদিন দেখিনা। আর আমার বাড়িতে তো তাদের কোনো স্থানই নেই।;
বিনা অনুমতিতেই তার রুমে প্রবেশ করে শ্রাবণ। খোরশেদ সাহেব রাগে মুখ ঘুরিয়ে নেন। শ্রাবণ সব ভুলে বলে,
“সেদিন আমার কাউকে ছোট করার কোনো উদ্দেশ্য ছিলোনা দাদু। আমি তো কেবল আমার ভালোবাসার মানুষকে হারানোর ভয়ে যা করার করেছি। ভীষণ ভালোবাসি ওকে আমি। তাহলে আপনিই বলুন, একজনকে মনে রেখে আরেকজনকে বিয়ে করাটা কি অন্যায় হতোনা? আপনার নাতনীকে ঠকানো হতোনা?;
“এসব ছেলে ভোলানো কথা তোমার দাদাজানকে বলো, আমাকে নয়।;
“মাফ করবেন দাদু, ভেবেছিলাম হয়তো আপনি আমার ব্যাপারটা বুঝবেন। দাদাজানের কাছে শুনেছিলাম আপনিও নাকি দাদীকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। খুব যু*দ্ধ করতে হয়েছিলো ভালোবাসার মানুষটিকে আপন করে পেতে। এমনকি পরিবারের বিরুদ্ধেও গিয়েছিলেন। আমিও কিন্তু সেটাই করেছি দাদু। তাহলে আমার অন্যায়টা কোথায়?;
দমে গেলেন খোরশেদ সাহেব। মাত্র এক মিনিট আগেও ছেলেটার প্রতি ভয়াবহ রাগ আর ক্ষোভ থাকলেও এখন যেন নিজের অতীত দেখতে পাচ্ছেন চোখের তারায়। না না, তিনি ভুল করছেন, অন্যায় করছেন। শ্রাবণ ভুল নয়। সে তো কেবল নিজের ভালোবাসা বাঁচাতে, ভালোবাসার মানুষটাকে হারানোর ভয়ে এমনটা করেছে। তিনিও করেছিলেন নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে আপন করে পেতে। ঠিকই তো, এতো জলদি কি করে ভুলে গেলো সে?
টেবিলে চারটা কফি রেখে গেলো ওয়েটার। ইশা ভ্রু কুঁচকে কফিগুলোর দিকে তাকালে, পাশ থেকে শ্রাবণ ওয়েটারকে ডেকে বলে উঠলো,
“এক্সকিউজ মি, আমরা তিনজন।;
“না, আরেকজন আছে। আমিই চারটা দিতে বলেছি।;
সামনে থেকে নিলাশা বলে উঠলো। ইশা এবার কফি রেখে নিলাশার দিকে সন্দিহানি দৃষ্টিতে তাকালো। এই মেয়ের মতিগতি ঠিক ধরতে পারছেনা ও। একটু আগে নিজেই ওদের কফি খাওয়ার জন্য রিকোয়েস্ট করেছে। আর এখন কফি খেতে এসে একটা বেশি কফি অর্ডার দিলো। করতে চাচ্ছে কি মেয়েটা?
“ও, ওকে আপনি যান।;
শ্রাবণ ওয়েটারকে পূণরায় যেতে বলে ইশার কফিটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজের কফিটা নিয়ে নিলো। নিলাশা আঁড়চোখে তাদের দু’জনকে নজরবন্দি করছে। আশেপাশে বেশ কোলাহল। নিলাশা ইশা আর শ্রাবণের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আশেপাশে তাকালো বারকয়েক। শ্রাবণ ওসবে আগ্রহ না দেখিয়ে নিজের কথা বলতে উদ্যোত হলো,
“সরি নিলাশা। আমার বাবার করা একটা ছোট্ট বোকামির জন্য আপনার লাইফে এতো বাজে একটা ইমপ্যাক্ট এলো। ভাবলে আমার সত্যিই ভীষণ খারাপ লাগছে।;
শ্রাবণ অত্যন্ত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একজন মানুষ। নিলাশা সেদিনই বুঝেছিলো। এবং সেই সাথে তার এই বিশ্বাসটুকুও হয়ে গিয়েছিলো যে, ইশানিকে শ্রাবণ ভ*য়ানক রকমের ভালোবাসে। ঠিক তার ইয়াসিরের মতো। তার ভাবতেই ভালো লাগে এই পৃথিবীতে শ্রাবণ এবং ইয়াসিররে মতো পাগল প্রেমিকগুলো আছে বলেই ভালোবাসার জিকির হয়। নয়তো কবেই বিলুপ্তি হয়ে যেতো ভালোবাসা নামের ফ্যান্টাসির।
“না, আপনি ভুল ভাবছেন শ্রাবণ। আপনার সাথে আমার বিয়েটা ভেঙে আপনি আমার কোনো ক্ষতি করেননি। বরং উপকার করেছেন!;
শ্রাবণ কফিতে চুমুক বসাতে গিয়েও থেমে গেলো নিলাশার কথা শুনে। ভ্রু জোড়া তার আপনাআপনিই কুঁচকে এলো।
“মানে?;
“আমি একজনকে ভালোবাসি।;
থেমকালো ইশা আর শ্রাবণ। দুজনে একসাথেই তাকালো নিলাশার পানে। পরক্ষণেই আবার দু’জন দু’জনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে মুচকি হাসলো। ইশার ভারী হৃদয় মুহুর্তেই শীতল হয়ে গেলো। আর শ্রাবণের মাথায় অপরাধবোধের যে বোঝাটা ছিলো, সবটাই ক্রমশ হালকা হলো।
“এক্সকিউজ মি, ম্যে আই সিটেড?;
নিলাশার পেছন থেকে সচ্ছ গলায় ভেসে এলো কারোর ডাক। নিলাশা ফট করে পেছন মুড়ে তাকাতেই দৃশ্যমান হলো নজরকাড়া সৌন্দর্যের এক যুবককে। পরনের ফর্মাল ড্রেসআপ দেখে বোঝাই যাচ্ছে অফিসের জন্যই রেডি হয়ে বেরিয়েছে। মাঝপথে প্রেয়সীর ডাক পেয়ে হাজির হতে হলো।
নিলাশার হাস্যজ্বল মুখশ্রী দেখতে তাদের আর বুঝতে অসুবিধা হলোনা ইনিই তার কথিত প্রেমিক পুরুষ। ইয়াসির লম্বা করে হাসলো। নিলাশার পাশের চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে সেই হাসি আরও দীর্ঘ করে সম্মুখে তাকালো। ইশা আর শ্রাবণকে একনজর দেখে হাত বাড়ালো শ্রাবণের দিকে।
“ইয়াসির;
“শ্রাবণ;
“হাই, ইউ মাস্ট বি ইশানি রাইট?;
ইয়াসিরের প্রশ্নে স্মিত হেসে মাথা নাড়লো।
“জি, ইশানি।;
“ইউ গাইজ লুকিং লাইক আ পার্ফেক্ট কাপল আই সয়্যার। বস আমি তো রীতিমতো অবাক বনে গিয়েছিলাম, আমার সুন্দরী প্রেয়সীকে এই ফার্স্ট টাইম কেউ রিজেক্ট করলো উইথআউট এনি হেজিটেশন অর সামথিং লাইক দ্যাট। ক্যান ইউ ইমাজিন, এই মেয়েকে আমি রোজ কম করে হলেও পঞ্চাশ জনের কুনজর, ইভটিজিং থেকে সেইভ করে রাখি। সেখানে আপনি বস.. ইউ হ্যাভ টু এপ্রেশিয়েট ইওর লাক ইশানি।;
গড়গড় করে বলেই যাচ্ছে ইয়াসির। নিলাশা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ইশা লজ্জা মিশ্রিত হাসলো। জবাবে শ্রাবণ বলল,
“এতো সহজে হাত ছাড়বো বলে ভালোবাসিনি। সত্যি বলতে, যখন এই মেয়েটা চোখের সামনে থাকে, তখন যেন বাকি দুনিয়া ভুলে যাই আমি। ও আমার উপনেত্র। যতক্ষণ ও চোখের সামনে থাকে ততক্ষণই আমি শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারি, চারপাশ জুড়ে এক সচ্ছতা বিরাজ করতে থাকে। আর যেই না মাত্র ও চোখের আড়াল হয়, অমনি যেন দুনিয়া ঝাপ্সা লাগে।;
বলে থামলো শ্রাবণ। ইশার অক্ষিপট স্থীর হয়ে গেলো শ্রাবণের মন্ত্রমুগ্ধ বিশ্লেষণে। পাশ ফিরে মানুষটাকে এক পলক দেখার জন্য হৃদয়খানা আকুল হয়ে উঠলো যেন। ক্ষণেই পাশ ফিরে তাকালো শ্রাবণের পানে। এক মুহুর্ত বিলম্ব সইলোনা অন্তরের অন্তস্তলে। শ্রাবণ বিমুগ্ধ নয়নে পূর্বেই চেয়েছিলো ইশার স্নিগ্ধ মুখে। ইশা তাকাতে চোখের পলক ঝাপটালো সে।
গাড়িতে গাল ফুলিয়ে বসে আছে নামিরা। আরব ড্রাইভ করতে করতে বারবার পেছনের সীটে তাকাচ্ছে আঁড়চোখে। বাসা থেকে অনেক কাহিনি করে নামিরাকে বের করতে পারলেও আফিয়া বেগমের বাবার বাড়ি এসে মামলা ডিসমিস অর্থাৎ উল্টেপাল্টে গেলো। শ্রাবণের মামাতো ভাই আশফি এবং মামাতো বোন হৃদিমা। ওদের দু’জনকে নিয়ে বের হতে গিয়ে বিপত্তিটা বাঁধে। হৃদিমা এবার তানির সাথে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। আশফি আরবের বয়সি। একই ক্লাস। হৃদিমা ছোট থেকেই আরবের উপর ভীষণ ক্রাশ। সেকথা ওর ফুপি অর্থাৎ আফিয়া বেগমও জানেন। জেনে কিছু বলেননি অবশ্য। বলেছিলেন, বড় হ, তারপর দেখা যাবে।’ এখন তো সে অনেক বড় হয়েছে। সুতরাং এখনতো ফুপি ঠিকই দেখবে।
হৃদিমা আর আশফিকে পেছনের সীটে বসতে বললে, হৃদিমা জেদ ধরা গলায় জানায়, ‘ও সামনের সীটে বসবে।’ এ কথা শুনে অবশ্য নামিরার মুড এতোটাও বিগড়ে যায়নি যতটা বিগড়েছে এর পরের কান্ডটিতে। সামনের সীটে বসেও বাংলা সিনেমার নায়িকার মতো সীট বেল্ট না বেঁধে বারবার পরে যাচ্ছে। যা দেখে রীতিমতো বির-ক্ত হয়ে উঠলো নামিরা। অবশ্য আরব সেটা একদমই খেয়াল করেনি। একপর্যায়ে আরবের চোখে পড়লো বিষয়টা। সে তৎক্ষনাৎ বলে উঠলো,
“কি ব্যাপার হৃদিমা, সীট বেল্ট বাঁধছো না কেন?;
“ওও আরব ভাইয়া, আমি তো একদম ভুলেই গিয়েছিলাম। আহ্ এটা কি হলো!;
আরব গাড়ি থামালো। সাদা মনে হৃদিমার সীট বেল্টটা বেঁধে দিয়ে নিজের জায়গায় এসে বসতেই টেনে ধরলো হৃদিমা। ধন্যবাদ জানাতে ঝাঁপিয়ে পড়লো আরবের উপর। আহ্লাদে গদগদ হয়ে জড়িয়ে ধরলো আরবকে। ঘটনার আকস্মিকতায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো আরব। ওদিকে নামিরা রাগে এটম বোমে পরিনত হলো। যেকোনো সময় ঠুস করে ফেটে যেতে পারে।
গাড়ি থামালো শমসের সাহেবের সবথেকে কাছের বন্ধ ইকবাল সাহেবের বাসার সামনে। আরব গাড়ির সীট বেল্ট খুলে বের হতে নিলেই পাশ থেকে পূণরায় হাত টেনে ধরলো হৃদিমা। অসহায় তার চাহনি,
“সীট বেল্টটা খুলে দাও প্লিজ।;
“সীট বেল্ট খুলতেও পারোনা তুমি?;
“না।;
নামিরার মাথা গরম হয়ে উঠলো পূণরায়। সে আরবের পানে তীব্র ক্ষোভ নিয়ে তাকাতেই মুখ ঘুরিয়ে উপরে তাকালো আরব। অর্থাৎ আজকের জন্য বেঁচে যাওয়ার আর্জি করলো উপরওয়ালার কাছে।
আরব হৃদিমার থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে কোনো রকমের পগারপার হলো। নামিরা এপাশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরব এসে দাঁড়ালো ওর পেছনে। কথা বলার দুঃসাহস করতে পারছেনা। কে জানে কোন রিয়াকশন দুঃখ অপেক্ষা করছে তার কপালে।
“রেগে আছো?;
“যান না, যান? আপনার লুতুপুতু পুতুপুতু হৃদিমার গায়ে গিয়ে ঢলে পড়েন। আমার কাছে কি হ্যাঁ?;
বলেই হনহনিয়ে চলে গেলো নামিরা। আরব ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে হা করে দম ছাড়লো। পরক্ষণেই আওড়ালো,
“এতো পুরোই এটম বোম হয়ে আছে।;
_______
আজকেই ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের টেস্ট এক্সামের ফিস জমা দেওয়ার লাস্ট ডেট ছিলো তানির। বাসা থেকে তাড়াহুড়ো করে এসে কোনোমতে শেষ মুহুর্তে কাজটা সম্পূর্ণ করতে পারলো। তবে সেই কাজও শেষ হলো ঘন্টাখানেক হবে। আজকে আরবের সাথে ওরও আত্মীয় স্বজনদের বাসায় যাওয়ার কথা ছিলো বিয়ের কার্ড দিতে। তবে এই কাজের জন্যই যেতে পারেনি। এখন মনে হচ্ছে এদিকে না এসে ওদিকে গেলে অনেক বেশি শান্তি লাগতো। একেতো মাথার উপর চড়া রোদ আর দ্বিতীয় এই দুপুর বেলা একটা রিক্সাও ওর চোখে পড়ছেনা। মনে হচ্ছে আজ সমস্ত রিকসাওয়ালারা এক হয়ে অবরোধ করছে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির সামনে। বিরক্তিতে আবোলতাবোল চিন্তায় মাথা ভরে উঠছে ওর। কাকে ফোন করবে এখন? বাবা-বাবাই কাজে ব্যস্ত। আরব, শ্রাবণ দুই ভাই-ই বাইরে আছে নিজেদের কাজ নিয়ে। কেউ নেই যে, ওকে এসে নিয়ে যাবে এখান থেকে।
একটা কালো গাড়ি তানিকে পাশ কাটিয়ে যেতে তানি জোরে জোরে হাত নাড়াতে লাগলো। সঙ্গে সাহায্যের জন্য বারবার ডাকছেও। গাড়ির ড্রাইভার তানিকে লক্ষ করে পেছনের সীটে বসা মালিককে বলল,
“মেয়েটা গাড়ি থামাতে বলছে ছোট সাহেব। মনে হচ্ছে বিপদে পড়েছে কোনো!;
গাড়ির মালিক সচ্ছ কাচ থেকে বাইরে দৃষ্টিপাত করলো। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখে অকারণেই তার সমান্তরাল ভ্রু জুগল বক্ররেখায় কুঁচকে গেলো।
“আঙ্কেল আমাকে একটু হেল্প করুন না প্লিজ। দেড়ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি রিক্সার জন্য। কোনো রিক্সা পাচ্ছিনা। মাঝেমাঝে দুই একটা প্রাইভেট কার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু হেল্পের জন্য কেউই দাঁড়াচ্ছে না।;
তানি আপন মনে গুনগুন করতে করতে ব্যাগ থেকে ফোন বের করলো। শূন্যে দৃষ্টি ভাসিয়ে এয়ারপডের হদিস চালালো আন্দাজে। গান শুনতে শুনতে বাড়ি যাবে। ঠিক তখন পাশ থেকে একটা ক্ষোভ মিশ্রিত গলা শুনতে পেলো তানি। তড়িঘড়ি পাশ ফিরে তাকাতেই আঁতকে উঠলো লোকটাকে দেখে। ভয় জড়ানো গলায় বলল,
“আ্ আপনি এখানে কেন?;
________
বাড়ি ফিরে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ইশা। শরীরের অবস্থা আজ একটু বেশিই খারাপ বলে মনে হচ্ছে। নিজের রুমে যেতেও বেশ বেগ পেতে হলো ওকে। কোনোমতে নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ফোনটা বেজে উঠলো। শ্রাবণের কল। উফফ, এক ঘরে থেকে কেউ কল দেয়?
“হ্যাঁ বলো?;
“আমার রুমে আয়।;
“এখন আবার?; (ক্লান্ত স্বরে)
“কি হয়েছে, গলাটা এমন লাগছে কেন?;
“জানিনা। মনে হচ্ছে নাড়িভুড়ি সব জ্বলে যাচ্ছে।;
শ্রাবণের কলটা কেটে গেলো। ইশা আর তাকাতে পারলোনা ফোনের স্ক্রিনে। ফোনটা হাত থেকে ফেলে দু’হাতে পেট চেপে ধরলো। অবস্থা বেগতিক। ক্রমেই পেটে ভ*য়ানক ব্যাথার উপক্রম বাড়ছে।
“ইশা!;
দৌড়ে এলো শ্রাবণ। ইশা তখন তাকানোর অবস্থায় নেই। পেট চেপে ভাজ হয়ে রইলো।
“কি হলো হঠাৎ?;
“আ্ আমার পেট!;
তীব্র ব্যাথায় যেন নড়তে পারছেনা ইশা। গোঙাতে লাগলো। শ্রাবণ আতংকিত হয়ে বারবার তাকাতে লাগলো ওর পানে। হঠাৎ এমন হওয়ার তো কথা নয়। ডাক্তার তো বলেছিলেন অবস্থার উন্নতি ঘটবে আস্তে আস্তে। তবে এখনও কেন এমন ব্যাথা বা জ্বলা ভাব আসবে? কিছুই বুঝতে পারছেনা শ্রাবণ। ইশা গোঙাতে গোঙাতে হঠাৎ চিৎকার করতে লাগলো। ব্যাথা আর জ্বলা ভাবটা মাত্রাতিরিক্ত হচ্ছে। চিৎকার করতে করতে খামচে ধরছে পেট।
নীচ থেকে একগাদা মানুষ দোতলায় ছুটে এলো ইশার চিৎকার শুনে। আফিয়া বেগম, মরিয়ম বিবি, নুপুর বেগম সব হন্নে হ’য়ে ছুটে এলেন ইশার ঘরে। ইশাকে এভাবে ছটফট করতে দেখে সবার মাঝেই বিরাজ করলো আতংক। শ্রাবণ আর কোনো রিস্ক নিতে চাইলোনা। পাজা কোলে তুলে নিলো ইশাকে। অতঃপর দ্রুত ছুটলো হসপিটালে।
তানির আতংকে ঘেরা নেত্রদ্বয় মুহুর্তেই কুঞ্চিত হলো। ওর মনে পড়ছে সেদিনের ঘটনাটি। মিষ্টি পাগলি তানি খোরশেদ সাহেবদের বাড়ি গিয়েও মিষ্টি খেতে ছাড়েনি। এদিকে যে তার ভাই বিয়ে ভেঙে চলে গেছে সে খবর আর তার ছিলোনা।
প্রায় চারটা মিষ্টি একসাথে মুখে পুড়লো তানি। এখন না পারছে গিলতে না পারছে কথা বলতে। ঠিক তখনই এক অপরিচিত ছেলে পথ আঁটকে দাঁড়ায় তানির।
“হোয়াট দ্যা.. এক্সকিউজ মি? কে আপনি?;
তানি গোলগাল চোখ পাকিয়ে তাকায়। ওর দেখাদেখি ছেলেটাও চোখ জোড়া ডিম্বাকৃতির ন্যায় করে ফেলে। এটাকে বলে সঙ্গ দোষ। তানি মুখে কিছু বলতে পারেনা, তাই চোখ আর হাতের বোঝাতে চেষ্টা করে।
“আপনি কে?; (চোখের ইশারায়)
ছেলেটা আর কেউনা, নিলাশার ভাই আরাফ। নিলাশাকে সবার মাঝে বসিয়ে দিয়ে নিজের রুমে যাচ্ছিলো একটা কাজে। আর যাওয়ার পথেই দেখা হয় এই মেয়েটার সাথে। এভাবে পাগলের মতো করে মিষ্টি কে খায়?
আরাফ চোখ জোড়া কুঁচকে তাকায়। তানির প্রশ্ন সে বোঝেনি। তাই প্রশ্নবিদ্ধ মুখ করে এখনও চেয়ে আছে ওর পানে।
“কি এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? চোখ দিয়ে গিলে খাবেন নাকি?; (চোখ আর হাতের ইশারায়)
পূণরায় তানির চোখ আর হাতের ইশারায় করা প্রশ্ন আরাফের শান্ত স্বভাব গুরুগম্ভীর করে দিলো। আরাফ রাগান্বিত হয়ে তানির হাত চেপে ধরে বলল,
“এসো আমার সাথে!;
তানি ভড়কে গেলো আরাফের কান্ডে। সাথে ভীষণ রেগেও গেলো এই অপরিচিত ছেলেটা ওর হাত ধরে টানার জন্য। আরাফ ওকে টেনে নিয়ে বেসিনের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল,
“মুখে যা আছে ফেলে দাও। জলদি!;
তানির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। আরাফকে এই মুহুর্তে ওর মানুষ বলেই মনে হচ্ছে না। এমন অমানুষ হয় কেউ?
তানির এভাবে তাকানো দেখে আরাফ বির-ক্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। অতঃপর আশেপাশে একবার তাকিয়ে যা ভাবলো সেটাই করলো। হঠাৎ তানির গাল চেপে ধরে মাথাটা নুইয়ে দিলো বেসিনের সামনে। আর এতোই জোরে ধরলো যে তানি মিষ্টি গুলো না পারছে গিলতে, আর না পারছে ফেলতে। তবে গেলার চেয়ে ফেলে দেওয়াটাই বেশি সহজ ছিলো। তাই বাধ্য হয়ে ফেলে দিলো মিষ্টি গুলো। তানি মিষ্টি গুলো ফেলতেই আরাফ ওকে ছেড়ে দেয়। রাগে তানির শ্যামবর্ণ চেহারা কালচে ভাব এনে দেয় ওর মুখে। আরাফকে এই মুহূর্তে গিলে খেয়ে নিলেও ওর এই রাগ পরবেনা। কিছুতেই না। মিষ্টি নিয়ে এতো অন্যায় তো ওর মাও ওর সাথে করেনা। কিন্তু এই অসভ্য ছেলেটা.. এরচেয়ে ভালো ওর অর্ধেক কলিজা দাবী করতো ছেলেটা। ও খুশি হয়ে সেটাও দিয়ে দিতো।
“পুরো কথা শুনতে না পারলে আমার এনজাইটি লেভেল তরতর করে বাড়তে থাকে! সরি ফর ডুয়িং দিস!;
তানি ফোঁস ফোঁস করছে রাগে। আরাফের ওসবে কোনো লেনদেন নেই। সে পূণরায় শান্ত প্রতিমায় রূপান্তরিত হয়ে নরম গলায় শুধালো,
“তুমি শ্রাবণ ভাইয়ের কাজিন?;
মাথার তারটা আর আস্ত নেই তানির। কথা নেই, বার্তা নেই ঠাসস করে একটা চড় মে*রে বসলো আরাফকে। এতোবড় ছেলের গায়ে সে হাত তুলবে, এটা পাঁচ মিনিট আগেও কল্পনা করেনি। চড় খেয়ে আরাফ স্তব্ধ হয়ে গেলো। কি বলবে বা কি করবে, কোনোটাই আর মাথায় ধরলোনা তার।
তানি হনহনিয়ে চলে গেলো। আরাফ স্রেফ গালে হাত চেপে শূন্য অনভূতি নিয়ে ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। ক্ষণেই তানি আবার ফিরে এলো। তানিকে রাগান্বিত অবস্থায় রণচণ্ডীর চেয়ে কম কিছু লাগছেনা। আরাফ ভড়কে গেলো ওর ফিরে আসা দেখে। তানি এসে তার সামনে দাঁড়াতেই এক পা পিছিয়ে গেলো সে। তানি বেসিনের দিকে তাকালো ফোঁস ফোঁস করে। ইচ্ছে করছে এই লোকটাকে মে/রে ফেলতে। কিন্তু যাদের বাসায় এসে মিষ্টি খেলো, তাদের বাসার কাউকে মে/রে ফেললে ব্যাপারটা জঘন্য হয়ে যাবে। কাল নিউজে হেডলাইন হবে, ‘আত্মীয়কে মিষ্টি খেতে না দেওয়ার অপরাধে খু*ন হলো এক যুবক!’ ছ্যা, বোকা বোকা হেডলাইন।
“তোদের মিষ্টি তোরা খা!;
কথাটা বলেই মুখ ঝামটি দিয়ে আবার চলে গেলো তানি। আরাফ চকিতে তাকিয়ে ফের এক পা পিছিয়ে গেলো। কেননা, সে এখনও বাকরূদ্ধ। এখনও স্তব্ধ, আতংকিত।
“আপনি আমাকে মিষ্টি খেতে দেননি তাই, আমি রাগ সামলাতে পারিনি। এতে আমার তো কোনো দোষ আমি দেখছিনা।;
প্রথমে ভয় পেলেও পুরো ঘটনাটি একবার ঝালাই করতে যেয়ে মনে হলো এখানে ওর ভয় পাওয়ার কোনো কারনই নেই।
আরাফ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে তানির অগোচরে গালে হাত ডললো। অর্থাৎ সেও ঘটনাটি পুনরায় ভাবতে গিয়ে চড় খাওয়ার একই অনুভূতি অনুভব করলো।
“অভদ্র মেয়ে!;
দাঁতে দাঁত চেপে আস্তে করে বলল আরাফ। তানি মুখ ভেঙচি দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো।
__________
“কোনো সিরিয়াস ইস্যুজ তো নয় ডক্টর?;
ইশার পালসরেট চেক করছেন ডক্টর। শ্রাবণ অস্থির গলায় ইশার অবস্থা জিজ্ঞেস করলে ডাক্তার গম্ভীর মুখে তাকান। কিছু না বলে শ্রাবণকে তার চেম্বারে আসতে বলে চলে যান। শ্রাবণ সময় ব্যায় না করে তার পিছুপিছু গিয়ে চেম্বারে ঢোকে। ডাক্তার সাহেব চেয়ার টেনে বসে খানিক বিরক্তি নিয়ে বলেন,
“ইশানি এখনও পুরোপুরি সুস্থ হয়নি শ্রাবণ। তোমরা একথা এতো জলদি কি করে ভুলে গেলে?;
শ্রাবণ অবাক হওয়ার প্রচেষ্টা চালালো। বাড়ির মানুষ গুলো ইশার অসুস্থতাকে অবজ্ঞা তো দূরে থাক এক মুহুর্তের জন্যও ভোলেনি। তাহলে ডাক্তারের এমন উক্তির মানে কি?
“ম্ মানে!;
“আমি তোমাকে স্পেশালি ডেকে নিয়ে বলেছিলাম ওর খাবারের রুটিনটা। ৬মাস প্রয়োজন নেই, এটলিস্ট ১মাস রুটিন ফলো করো। কিন্তু সেটাও তোমরা পারলেনা। হোয়াটএভার, ওর পেটে ঘা জাতীয় কিছু দেখা গিয়েছে। আমি ঔষধ দিচ্ছি। ঔষধ গুলো নিয়মিত করবে, সাথে পাতলা লিকুইড খাবার দিতে থাকবে।;
শ্রাবণের মাথায় ধরছেনা। যেখানে ওকে প্রতিদিনই স্যুপ বা এ জাতীয় লিকুইড খাবার দেয়া হচ্ছে সেখানে ডক্টরের এ কথার মানে কি! আজ সকালেও তো মা ওকে স্যুপ দিয়ে.. ভাবতে গিয়েও থামতে হলো শ্রাবণকে। মা আর ইশার কানে কানে কথা বলার দৃশ্যটা মনে আছে তার। আচ্ছা, তখন কি কোনোভাবে উল্টাপাল্টা খেয়েছে ও? হ্যাঁ! সে ঠিকই ভাবছে। সকালে তার সন্দিহান দৃষ্টি মোটেই ভুল ছিলোনা। সে ঠিকই সন্দেন করেছিলো।
ইশাকে ইনজেকশন দিয়ে ওর পেটের ব্যাথা কমাতে হয়েছিলো ডাক্তারকে। এখন ও মোটামুটি সুস্থ বোধ করছে। এতক্ষণ যাবত মা আর মামির সাথে কেবিনেই রয়েছে। শ্রাবণ ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গিয়েছে। কথা শেষ করে ফিরে এলেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হবে তারা।
দরজা ঠেলে কেবিনে ঢুকলো শ্রাবণ। বিছানায় অর্ধমৃ/ত চেহারা নিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে ইশা। পাশে মা আর মনি। ভেতরে ভেতরে তীব্র রাগ চেপে রেখেছে সে। আজকের সকালে ইশার খাবারটাই ওর জন্য পূণরায় ম*র*ন ব্যাধি তৈরি করেছে। এই মেয়েটা কি কখনও নিজের ভালো বুঝবেনা?
এই বলে আবারও বেরিয়ে গেলো শ্রাবণ। ইশা তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলো। শ্রাবণ একটা বারও ওর দিকে দেখলো না! কেন? আর তার মুখটাও কেমন অস্বাভাবিক লাগছে যেন। কি হয়েছে শ্রাবণের?
ইশাকে নিয়ে গাড়িতে বসালো আফিয়া বেগম। ওকে মাঝে বসিয়ে দুই মা দু’পাশে বসবেন। মরিয়ম বসার পূর্বেই আফিয়া বেগম উঠে এলেন। শ্রাবণকে দেখা গেলো সামনের ফার্মেসীতে। ঔষধ কিনছে। মরিয়ম বিবি আর না উঠে শ্রাবণের কাছে চলে গেলেন। ইশা সেদিকে স্থীর দৃষ্টি রেখে মামির উদ্দেশ্যে বলল,
“মামি, তোমার কি সবকিছু স্বাভাবিক লাগছে?;
“কেন রে?;
“শ্রাবণের ভাইয়ের মুখটা একটু অন্যরকম লাগছেনা?;
ইশার দৃষ্টি অনুসরণ করে আফিয়া বেগমও তাকালো ছেলের পানে। কিছু একটা ভেবে উনি মুচকি হাসলেন। ইশার দিকে তাকিয়ে ওর মাথায় হাত রেখে বললেন,
“মানুষ যখন ভালোবাসার কাছে অসহায় হয়ে পড়ে, তখন এমনই হয় জানিস তো! তুই তো দেখিসনি, তুই অসুস্থ হয়ে পড়ার সাথে সাথে কেমন পাগলের মতো করেছে আমার ছেলেটা। শুধু আজই নয়! সেদিন যখন তোকে মৃ*তপ্রায় অবস্থায় হসপিটালে নিয়ে এলো, পাগলের মতো চিৎকার করেছে হসপিটালের করিডোরে। আশেপাশের মানুষ গুলো কেমন ফ্যালফ্যাল করে দেখছিলো ওকে।;
ইশার মন অন্যদিকে ঘুরে গেলো মামির কথাগুলোয়। ওর নিজেকে ভীষণ লাকি মনে হয়। এই যে, শ্রাবণের মতো এমন একজন মানুষ পেয়েছে ওকে পাগলের মতো ভালোবাসার জন্য।
ঔষধের সাথে ইশার জন্য আলাদা করে কয়েকটা জুস কিনে আনলো শ্রাবণ। ক্লান্ত শরীরে এনার্জি দিবে একটু হলেও।
“মা, এগুলো ওকে দাও।;
মায়ের পাশেই ইশা বসে আছে। অথচ ইশার দিকে না তাকিয়েই মায়ের হাতে জুস গুলো ধরিয়ে দিয়ে ড্রাইভিং সীটে গিয়ে বসলো শ্রাবণ। ইশার পূণরায় কেমন সন্দেহ জাগলো শ্রাবণের আচরণে। না, মামির ধারনা ভুল। কেবল ওর অসুস্থতার জন্যই শ্রাবণের চোখমুখ এমন হয়নি। নিশ্চয়ই সবার অগোচরে কিছু ঘটেছে যেটা শ্রাবণ জানলেও আর কেউ জানেনা।
বাসায় পৌঁছাতে সন্ধ্যা হলো তাদের। বাসায় ফিরতেই সামনাসামনি পড়লেন হামজা সাহেব এবং তার বউ শাহনাজ বেগমের। অর্থাৎ ইশার বড় চাচা এবং বড় চাচী। সকাল থেকে বাইরে থাকার ক্লান্তি আবার বাসায় ফিরতেই ঘন্টা তিনিকের জন্য হসপিটালে এডমিট সব মিলিয়ে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে ইশাকে। চোখ জোড়া গর্ত খুঁড়ে ঢুকে পড়েছে তার ভেতরে। শুকনো শরীরটা কোনো কঙ্কালের চেয়ে কম লাগছেনা।
“ইশানি?;
শাহনাজ বেগমের গলা পেতেই চোখ জোড়া বড়বড় করে সম্মুখে তাকালো ইশা। চকিতে দেখছে শাহনাজ বেগমকে। আনন্দে নিজের অবস্থার কথা ভুলে দৌড়ে যেতে নিলে তিনি হাত উঠিয়ে ওকে থামতে বলেন। তারপর নিজেই একরকম ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেন।
ইশা ধীর পায়ে চলে গেলো হামজা সাহেবের দিকে। মায়ের কাছে শুনেছে বড্ড কড়া ধাঁচের মানুষ ছিলেন হামজা সাহেব। কিন্তু জাফর সাহেব অর্থাৎ ইশার বাবার মৃ/ত্যু/র পর একদমই ভেঙে পড়েন হামজা সাহেব। ভাইয়ের অকাল মৃ/ত্যু একদম ভেঙে দিয়েছিলেন মানুষটাকে। হামজা সাহেবকে প্রায় অনেকটাই জাফর সাহেবের মতো দেখতে। কোমল চাহনিতে মৃদু হাস্য মুখে খান সাহেবের সঙ্গে কথা বলছেন। ইশাকে লক্ষ করেননি একদম।
“চাচ্চু?;
পেছন থেকে কাঁপা কাঁপা গলায় ভেসে এলো কারোর ডাক। হামজা সাহেব কথা থামিয়ে দিয়ে পেছনে তাকালেন। ইশা চমকে উঠলো। এই তো সেই চোখ, সেই মুখ, সেই নাক। একদম বাবার মতো!
হামজা সাহেব দাঁড়িয়ে গেলেন। ইশার শরীর ভেঙে আসতে চাইলো। কোনো মতে সোফা ধরে দাঁড়াতে দৌড়ে এলো শ্রাবণ। পাশ থেকে আরও দুই জোড়া হাত ইশাকে ধরে ফেললো। এক হামজা সাহেব, দুই হিমাদ্র। হামজা সাহেবের ছেলে। শ্রাবণ আর নাগাল পেলোনা ইশার। তারাই ইশাকে ধরে বসালো সোফায়। হিমাদ্র ইশাকে পানি এগিয়ে দিলে ইশা এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ে। অর্থাৎ খাবেনা সে। হামজা সাহেব ইশার পাশে বসলে ইশা কিছু না বলে জড়িয়ে ধরে তাকে। ডুকরে কেঁদে উঠে সবার বুক কাঁপিয়ে অবুঝ মনেই হামজা সাহেবকে বাবা বলে ডেকে ওঠে।
সবাই স্তব্ধ হয়ে যায় ইশার ডাকে। ইশা কাঁদতে শুরু করেছে। ওর এই শারীরিক অবস্থায় এভাবে কাঁদাটা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। শ্রাবণ ওকে কিছু বলতে নিলে হঠাৎ শোনা গেলো হিমাদ্রর বিষন্ন গলার স্বর,
“ইশুপাখি!;
থমকে গেলো শ্রাবণ। বুকের ভেতরটায় কেউ কুৎসিত ভাবে খামচে ধরলো যেন। দম ফুরিয়ে এলো তার। র*ক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে হিমাদ্রর এই ডাকে।
“কাঁদছিস কেন? আমরা সবাই তো আছি!;
পূণরায় যেন কেউ অ/স্ত্র চালালো শ্রাবণের বক্ষঃস্থলে। সে সহ্য করতে পারছেনা হিমাদ্রর কথাগুলো। এগুলো তো তার কথা, হিমাদ্র কেন বলছে?
“বাবাকে মনে পড়ছে?;
হিমাদ্রর একের পর এক বানীতে ইশার কান্না থামলোনা। হামজা সাহেবের বুকে পড়ে একই ভাবে চোখের জল বিসর্জন দিয়ে গেলো। হামজা সাহেব খুব করে বুঝালেন ইশাকে। কিন্তু তারপরও, বাবার স্মৃতি আজ বড্ড পীড়া দিচ্ছে ওকে। আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতো? শুধু এই একটা আক্ষেপেই বুকটা ফেটে যাচ্ছে ওর।
“কাঁদিস না। এই শ্রাবণ আছে তো তার ইশুপাখির জন্য? হু?;
গালে শ্রাবণের স্পর্শ পেতে কান্নার দমক কমে এলো ইশার। বাচ্চাদের ন্যায় ঠোঁট ফুলিয়ে চেয়ে আছে শ্রাবণের পানে। শ্রাবণ ওর পায়ের কাছে হাঁটু ভাজ করে বসলো। ফের দু’গাল উঁচিয়ে ধরে কোমল গলায় কথাটা বলতেই ইশা শান্ত হয়ে গেলো। সবাই দেখলো, আর হাসলোও মনে মনে। ভালোবাসার টান, ভালোবাসার জোর হয়তো একেই বলে।
“আরও কান্না পাচ্ছে? আরও কাঁদতে হবে?;
ইশা এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ে। শ্রাবণ মুচকি হাসে। ইশার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলে,
“কাঁদিস না প্লিজ, তুই কাঁদলে আমার বক্ষঃস্থলে তীব্র হাহাকার জমে যায়। তখন কিন্তু আমারও কান্না পায়।;
শ্রাবণের কথায় সবাই শব্দ করে হেসে উঠলো। তবে ইশা লজ্জায় অস্থির হয়ে উঠলো। একঘর লোকের সামনে ওর কান্না থামাতে মানুষটার এভাবে লজ্জা দিয়ে কথা বলতে হলো?
শ্রাবণ এসে ইশার কান্না থামাতে নিলে হিমাদ্রর ভেতরটা কেমন জ্ব*লেপুড়ে উঠলো। আজ যদি সব ঠিক থাকতো, তবে ইশা শ্রাবণের নয়, তার ঘরের বউ হতো।
সন্ধ্যা সাতটা। আজকের মতো কার্ড বিলি করা এখানেই শেষ। আরব গাড়ি ঘোরালো নামিরার বাড়ির পথে। একদমই ইচ্ছে করছেনা ওকে ছাড়তে, কিন্তু ওর মায়ের কথা ভেবে আবার সাহস করে বলতেও পারছেনা আজকে ওদের সাথেই যেতে।
“নামিরা আপু, তুমি ইশা আপুর বেস্ট ফ্রেন্ড তাইনা?;
হৃদিমাকে এবার পেছনের সীটে বসিয়েছে আরব। বাহানা দিয়েছে ওর সীটবেল্ট বাঁধতে না পারার ব্যাপারটা। ওটা হৃদিমা ইচ্ছেকৃত ভাবে করেছে যেন সাহায্যের খাতিরে আরবকে বারবার কাছ থেকে দেখতে পারে। নামিরা ঠিকই বুঝেছিলো। কিন্তু আরব প্রথমে এতো গভীরে ভাবতে পারেনি। হৃদিমাকে নিতান্তই সে তানির মতো ভাবে। সেখানে হৃদিমা এতোটা গভীরে ভেবে বসে আছে সেকথা আরবের ঘটে ঢুকতে বেশ সময় নিয়েছে।
“হ্যাঁ।; জবাব দিলো নামিরা।
“তোমার বয়ফ্রেন্ড নেই?;
হৃদিমার কৌতুহলী গলায় নামিরার রাগ আরও তরতর করে বাড়ছে। একবার ইচ্ছে করছে বলে দিতে, আমার বয়ফ্রেন্ড আমার পাশেই বসে আছে। কিন্তু বলতে পারছেনা। হৃদিমা শ্রাবণ ভাইয়ের মামাতো বোন। কোনোভাবে এই মুহুর্তে আরব আর ওর ব্যাপারটা সবার সামনে না আসাটাই ভালো। আনতে চায়না এমনটা নয়, কিন্তু কোনোভাবে এই মেয়েটার মাধ্যমে কেউ না জানুক সেটাই চায় নামিরা। তাই মনের কথাটা মনে রেখেই প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়লো। নামিরার ভাবা ও দীর্ঘশ্বাসের মাঝের সময়টুকুও সবুর করলো না হৃদিমা। আরও একবার একই কথা জিজ্ঞেস করলো। যার ফলে নামিরা জোরপূর্বক হেসে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“না, নেই!;
আরব শকড হয়ে গেলো নামিরার এমন জবাবে। নাই মানে? তার নামটা না বলুক, কিন্তু বয়ফ্রেন্ড যে একেবারেই নেই সে কথা কেন বললো?
হৃদিমার মুখের ভঙ্গিমা সামনে থেকে ঠিক বুঝতে পারা গেলোনা। আবর নামিরার দিকে করুন চোখে তাকিয়ে আছে। নামিরা সেদিকে তাকাচ্ছেও না। যেন, আরবের শকিং ফেস নিয়ে ওর কোনো মাথা ব্যাথাই নেই।
নামিরার মেজাজ প্রথম থেকেই খারাপ। আর তার কারনটাও এই মেয়েটাই। আবার গরম মেজাজের উপর এই মেয়েটাই ঘি ঢালছে, এবার একটা চামাট মার্কা জবাব না দিলে একদমই চলবেনা।
“তোমার মতো বয়সে সময়টা পড়ালেখার পেছনে ব্যায় না করে যদি রূপচর্চায় দিতাম, তাহলে আজ নিশ্চয়ই আমার একটা বয়ফ্রেন্ড থাকতো। কি আরব ভাইয়া? ঠিক বলেছি না?;
হৃদিমার মুখটা বুঝি ফাটা বেলুনের ন্যায় চুপসে গেলো। আরব খুকখুক করে কেশে উঠলো। বিষম লেগেছে নির্ঘাত। পেছন থেকে হৃদিমা আঁতকে উঠলো।
“কি হলো, কি হলো? আরে আরব ভাইয়াকে পানি দাও! নামিরা আপু, কোথায় চেয়ে আছো। ডেস্ক থেকে পানিটা বের করে দাও!;
নামিরার শরীর জ্বলে উঠলো। হঠাৎ রাগান্বিত গলায় বেশ জোরেশোরেই বলে উঠলো নামিরা,
“গাড়ি থামান।;
আরব চমকে উঠে গাড়ি থামালো। আতংকিত গলায় শুধালো,
“ক্ কি হলো?;
“আমার বাসা এসে গেছে!;
আর কিছু বললো না নামিরা। গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। আরব পড়েছে মহাবিপদে। কিছু বলতেও পারছেনা, কিছু করতেও পারছেনা। নামিরা দ্রুত হেঁটে চলে যাচ্ছে বাসার দিকে।
“তোমরা ওয়েট করো, আমি আসছি।;
এই বলে আবরও বের হয়ে গেলো। নামিরা আর পেছন মুড়ে দেখলো না একবারও। আবর বলেছিলো কালও কার্ড দিতে যেতে হবে। যদি এই মেয়ে কালও ওদের সাথে যায়, তবে ম/রে গেলেও বের হবেনা।
“নামিরা, দাঁড়াও। প্লিজ দাঁড়াও।;
পেছন থেকে আরবের গলা পেলে নামিরা আরও জোরে জোরে হাঁটা ধরে। আরব হেঁটে পারেনা ওর সাথে। তাই পিছু আসতে আসতে নামিরার বাসায় পৌঁছে যায়।
আরবের মুখের উপর দরজাটা লাগাতে আরব বাইরে থেকে ঠেলে ধরে। নামিরা রাগ মিশ্রিত গলায় বলে,
“কি সমস্যা?;
“আমাকে একবার বায় না বলেই চলে এলে!;
“বায়। হয়েছে? এবার যান!;
“আ্ আমার কথাটা তো শোনো জান!;
“জাস্ট শাটআপ! ডোন্ট কল মি জান।;
“পাখি? প্ পাখি তো ডাকতে পারি?;
“কেন, আমি কি জঙ্গলে থাকি?;
তেতে উঠলো নামিরা। আরব অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো। আর কি বলবে? নামিরা যে সব কথাতেই রেগে যাচ্ছে।
“জান, প্লিজ..;
“নো! যান না আপনার ঐ ন্যাকা ষষ্ঠীর কাছে। আরব ভাইয়া, সীটবেল্টটা বেঁধে দাওনা, আরব ভাইয়া সীটবেল্টটা খুলে দাওনা!;(ব্যাঙ্গ করে)
আরব কপাল চাপড়ালো। সত্যিই ভীষণ রেগে গেছে নামিরা। যদিও রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে এসব ভেবে লাভ নেই। এখন এই রাগ কিভাবে পরবে, সেটা ভাবতে হবে। তাই সাহস করে দরজার ফাঁক থেকে হাত বাড়িয়ে নামিরার হাতটা ধরলো আরব। নামিরা বি-স্ফো*রিত দৃষ্টিতে তাকালো। এই চোখ দিয়েই ভ-স্ম করে দিবে আরবকে।
“কে এলো?;
ঘরের ভেতর থেকে নামিরার মায়ের গলা ভেসে উঠলো। যা শুনতে ভয়ে আপনাআপনিই আরবের হাত আলগা হয়ে এলো। কিন্তু তারপরও ছাড়লোনা। শক্ত করে ধরে রাখলো। ভেতর থেকে আবারও নামিরার মায়ের গলা,
“নামু এলি?;
গলাটা এবার কাছ থেকেই শোনা গেলো। অর্থাৎ তিনি এদিকেই আসছেন। নামিরার রাগ এবার আড়াল হলো। বরং ভয়টাই বেশি হানা দিচ্ছে মনের মাঝে। আরব এভাবে হাত ধরে আর তার মা এদিকেই আসছে!
“কি হচ্ছেটা কি? হাত ছাড়ুন। মা আসছে কিন্তু!;
“তোমার সাথে আমার কথা শেষ হয়নি। আমাকে ভেতরে আসতে দাও।;
“একদমই না। হাত ছাড়ুন!;( বিরক্তির গলায়)
“আরব নাকি রে?;
পূণরায় নামিরার মায়ের গলা ভেসে এলো। তবে এবার একদম কানের পাশ থেকে। নামিরা চমকে উঠলো। আরবও চমকালো, তবে নাছোড়বান্দার মতো এখনও শক্ত করে নামিরার হাতটা ধরে রইলো।
“হ্ হ্যাঁ মা! আ্ আরব! ম্ মানে আরব ভাইয়া। ভাইয়া ভেতরে আসুন না। কতবার করে বললাম।;
আরব নামিরার হাত ছেড়ে দিলো। যাক একটা ডোজে তো কাজ হলো। নামিরা পাশে সরে যেতে আরব ভেতরে ঢুকলো। নমিরার মা বেজায় খুশি হলেন আরবকে দেখে। নামিরাকে যেভাবে নিয়ে গেলো আবার সেভাবেই বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেলো। এমন ছেলে কোথায় মিলবে।
“আহারে, এক বেলাতেই চোখমুখ একদম শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। বসো বাবা বসো। আমি তোমার জন্য একটু কিছু খাবার নিয়ে আসি।;
“না মা, উনি বাইরে থেকে খেয়েছেন। এখন বাসায় যাবেন। তাড়া আছে নাকি! তাইনা?;(আরবের পানে তাকিয়ে)
“না না আন্টি। বিশেষ তাড়া নেই। আপনি আমাকে একটু পানি দিতে পারেন। গলাটা একদমই শুকিয়ে গেছে।; বলল আরব।
নামিরার মা পানি আনতে চলে গেলেন। নামিরা রাগি চোখে তাকালো আরবের পানে। আরব দাঁত কেলিয়ে হেসে এগিয়ে এলো নামিরার কাছে। নামিরা পেছনে সরে যেতে নিলে আরব ওর কোমর পেঁচিয়ে নিয়ে আসে কাছে। পরক্ষনেই একহাতে কান ধরে অসহায় গলায় বলে,
“আ’ইম রিয়েলি সরি।;
“ক্ কি করছেন, মা এসে পড়বে।;
“প্লিজ মাফ করে দাও?;
“হ্ হ্যাঁ মাফ করে দিয়েছি। ছাড়ুন এবার।;
আবর নামিরাকে ছাড়বে বলেও ছাড়লোনা। নামিরার মাথার পেছনে হাত দিয়ে তাকে আরও কাছে টেনে এনে গভীর স্পর্শ করলো নামিরার ওষ্ঠদ্বয়ে। নামিরা কেঁপে উঠলো শিহরণে। ওর রাগ, অভিমান এক নিমিষেই গলে জল হয়ে গেলো। আরব আরেকটু গভীর হতো যদিনা নামিরার মায়ের আসার শব্দ পেতো। সঙ্গে সঙ্গে নামিরাকে ছেড়ে দিয়ে ভদ্র শান্ত ছেলের মতো চুপটি করে সোফার উপর বসলো।
____________
হামজা সাহেবের সাথে রাত ১টা অব্দি আড্ডা দিয়েছে ইশা। কত মজার মজার গল্প করেছে তার সাথে। হামজা সাহেবও কম যাননা। ক্ষণে ক্ষণে ইশাকে হাসাতে হাসাতে অস্থির করে তুলেছেন। বাচ্চাদের ন্যায় খিলখিলিয়ে হেসেছে ইশা। কত আনন্দ এবং উপভোগ্যকর মুহুর্ত ছিলো। মাত্রই রুমে এলো মায়ের সঙ্গে। মরিয়ম বিবি ওকে শুয়ে দিয়ে ঘরের আলো নিভিয়ে চলে গেলেন। মাথার কাছে জ্বলছে লাল রঙের একটা ড্রিম লাইট। লালচে আলোতে বারবার কেবল ইশার চোখ পড়ছে বিছানার পাশে ছোট্ট টি-টেবিলটার উপর। ওর ডাকবাক্সটি বারবার জ্বলে উঠছে যেন। ইশার মন লাফিয়ে উঠলো এই ভেবে যে, চিঠি এলো নাকি? ভাবতে দেরী হলেও হাত বাড়িয়ে ডাকবাক্সটি এনে কোলে চড়াতে দেরী নেই। ঠিক তখনই চেঁচাল টিয়াপাখিটা।
“ইশুপাখি চিঠি এসেছে, ইশুপাখি চিঠি এসেছে।;
ইশা আনন্দে হেসে উঠলো। চটজলদি ডাকবাক্সের তালা খুলেতেই একটা খাম বেরিয়ে এলো। বাবাহ, চিঠি পাঠানোর কি ঘটা। ভেবে লজ্জা মিশ্রিত হাসলো ইশা। ফের চিঠিটা তুলে ডাকবাক্সটি পুনরায় টি-টেবিলে রেখে চিঠিটা খুললো। ভেতরে ছোট্ট একটা চিরকুট। এতো বড় খাম অথচ এক রত্তি চিঠি। এটা ভারী অন্যায় হলো।
❝তুমি দেখনি আমার শুন্যতায় ডুবে থাকা হাহাকার❞
চিরকুটটা মেলে ধরতেই একলাইনের লেখাটি ভেসে উঠলো অক্ষিপটে। ইশার ভ্রু জুগল কুঁচকে গেলো। ভাবুক হয়ে চিরকুটটা উল্টে ধরতেই আরও এক লাইন লেখা চোখে পড়লো,
❝আজ যা হলো,তা যেন আর কখনও রিপিট না হয়, ইশুপাখি! নয়তো আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবেনা❞
ইশার বুকটা ধক করে উঠলো। শ্রাবণ এ কিসের কথা বলছে? কি হয়েছে আজ, কিসের ইঙ্গিত দিলো?
টুং করে বেজে ওঠে ফোনটা। বাসায় ফেরার পর থেকেই আর ইশাকে একা পায়নি শ্রাবণ। কতক্ষণ হামজা সাহেব, কতক্ষণ শাহনাজ বেগম তাদের কাছেই ঘুরেফিরে থেকেছে ও। তাই লজ্জার মাথা খেয়ে সেও আগ বাড়িয়ে ডেকে আনতে পারেনি। যার দরুণ ডাকবাক্সে চিঠি দিয়ে গেছে।
“ঘুমিয়েছিস?;
শ্রাবণের ম্যাসেজ, জ্বলজ্বল করছে ফোনের স্ক্রিনে। ইশা ফোনটা হাতে তুলে একটা ঢোক গিললো। এতক্ষণ আনন্দে নাচলেও এখন যে ভয়ে কথাও বলতে পারছেনা।
“না।;
টানা তিন মিনিট ভেবে তারপর রিপ্লাই করলো ইশা। ঠিক তখনই দরজায় টোকা পড়লো। চমকে উঠলো ইশা। ভয়াতুর দৃষ্টিতে সেদিকে তাকাতেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো শ্রাবণ। ইশার এবার মাথা ঘুরতে লাগলো। কি যে শনিটা নাচছে ওর কপালে, কে জানে।
শ্রাবণের হাতে একটা বাটি দেখা যাচ্ছে। ইশা সেদিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবার শ্রাবণের মুখ চেয়ে তাকালো। শ্রাবণের মুখভঙ্গিমা একদমই শান্ত। যেন কিছু হয়নি। ইশা অযথাই ঘাবড়ে যাচ্ছে।
“ক্ কি হয়েছে, কিছু বলবে?;
“তানিকে রসগোল্লা বানিয়ে দিয়েছি। ভাবলাম তোর জন্য নিয়ে আসি।;
“আহ্, মেয়েটা পারেও।;
নিজের অজান্তেই মৃদু হাসলো ইশা। শ্রাবণকে ভয় পাওয়ার কথা থাকলেও শ্রাবণের কেয়ারিংয়ের ব্যাপারটা দেখে এই মুহুর্তে ভুলে গেলো সব। শ্রাবণ হাতে ধরে রাখা বাটিটা এনে বিছানার উপর রাখলো। ইশা আস্তে আস্তে উঠে বসতে নিলে এগিয়ে এসে ধরে বসতে সাহায্য করলো শ্রাবণ। অতঃপর বাটিটা ইশার হাতে তুলে দিয়ে বলল,
“টেস্ট ইট।;
“(মুখে দিয়ে) তুমি এতো ভালো মিষ্টি বানাতে পারো?;
ইশা অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলে উঠলো কথাটা। শ্রাবণ মুচকি হাসলো। মাথা নেড়ে বলল,
“আরও অনেক কিছু পারি।;
“তাই?(আগ্রহী গলায়)
“হ্যাঁ।;
“আমাকে কবে টেস্ট করাচ্ছো তোমার হাতের রান্না?;
“বিয়ের পর। যখন তুই কনসিভ করবি!;
“অ্যা!;
“হু। কনসিভ করার আগ অব্দি আমি আমার বউয়ের হাতের রান্না খেতে চাই।;(ইশার নাক টেনে)
ইশার বিষম লাগলো শ্রাবণের কথায়। খুকখুক করে কেশে উঠলো হঠাৎ। কাশতে কাশতে আবার পরক্ষণেই হাত চাপলো মুখে। শ্রাবণ ওর কাশি দেখে শব্দ করে হেসে উঠলো। ফের মাথায় আর পিঠে হাত চাপড়াতে লাগলো।
“ব্ বিয়েই হতে পারলোনা, আর তুমি বাচ্চায় চলে গেলে।;
“কেন? আমার তো খুব ইচ্ছে বিয়ের পরপরই বেবি নেওয়ার। তোর ইচ্ছে নেই?;
“উফফ!(লজ্জা পেয়ে) আ্ আমরা তো অন্য টপিকেও কথা বলতে পারি নাকি?;
“না পারিনা। আমার এই টপিকেই কথা বলতে হবে।;
“নো প্লিজ!;
“কেন, লজ্জা পাচ্ছিস?;
“তুমি থামবে?;
“আচ্ছা আচ্ছা থামছি। তাহলে বেবি না, বেবির নাম নিয়ে কথা বলি?;
“শ্রাবণ ভাই!;
“দেখেছিস কি অবস্থা? আমাদের বিয়ের বাকি আর মাত্র চারদিন। আর তুই এখনও আমাকে ভাই ভাই লাগিয়ে রেখেছিস। সাপোজ, বিয়ের পরও তুই আমাকে ভাই ভাই করবি। আর এই ভাই ভাই করার মাঝেই আমাদের বাচ্চা হয়ে যাবে। দ্যেন? আমার বাচ্চা আমার বউয়ের এই ভাইকে মামু মামু বলে সারা ঘুরে বেড়াবে! ওহ গড। আমার তো ভেবেই সব উল্টেপাল্টে যাচ্ছে।;
কথাটা বলে দু’জন দু’জনের দিক বেশ কিছুক্ষণ চেয়েই কাটালো। ফের খানিক সময় যেতে দু’জনে একসাথেই ফিক করে হেসে দিলো। হাসতে হাসতে ইশা ঢলে পড়লো শ্রাবণের বুকে। শ্রাবণ দু’হাতে ঝাপটে ধরলো ইশাকে। দু’জনের হাসির শব্দ দরজা ডিঙিয়ে ঠকঠক করে কড়া নাড়ছে পাশের রুমে হিমাদ্রর বক্ষঃপিঞ্জরে। এতো সুন্দর মোহময়ী এক নব দম্পতির হাসির শব্দ অসহ্য লাগছে তার। ইচ্ছে করছে সব কিছু ভেঙে চুরমার করে দিতে। কতটা অসহায় সে ভালোবাসার কাছে। না পারছে কাছে নিতে না পারছে দূরে ঠেলে দিতে।
সবাইকে হল রুমে বসালেন আতাউল সাহেব। ভেতরে আসতে আরও অনেক জনের সাথে পরিচয় হলো সবার। নিশালার দুই খালা-খালু, দুই ফুপা-ফুপি, বড় ভাই, মা এবং দুই মামি। আরও দেখা গেলো অনেককে। যাদের সাথে স্বল্প পরিচয় হলো। হল রুমে বড় বড় তিন খানা সোফা ধরেছে। খান পরিবারকে সেখানেই বসালো। বসানোর সঙ্গে সঙ্গে জুস এবং সঙ্গে হালকা কিছু মিষ্টি খাবার নিয়ে হাজির তিন চারজন কাজের লোক। খাবার গুলো রেখে যেতেই সবাইকে হাতে হাতে তুলে দিলো তারা।
“কত বছর পর আমার বন্ধু আমার বাড়িতে পা রেখেছে। আদর আপ্যায়নের যেন কোনো কমতি না হয়, দেখো তোমরা।;
খোরশেদ সাহেবের বানী শিরোধার্য করলো সকলে। আতাউল সাহেব, রফিস সাহেব, সফিক সাহেব, দুই ফুপা লোকমান সাহেব এবং ফারুক সাহেব, দুই খালু রবিউল সাহেব এবং আসিফ সাহেব সবাই একসাথেই মস্তিষ্ক নীচু করে বুঝালো তা। খোরশেদ সাহেব স্মিত হাসি হেসে মাথা নাড়লো। অতঃপর খান সাহেবের পানে চেয়ে বলল,
“নাতি-নাতনিদের সাথে পরিচয় করাবি না?;
খান সাহেব মাথা ঝাঁকান। প্রথমে বসে ছিলো আরব আর তুতুন। তাই তিনি ওদের দিকে আঙ্গুল ইশারা করে বললেন,
“আমার ছোট ছেলের এক ছেলে আরব আর দুই মেয়ে তুতুন আর তানি। আর এই যে আমার বড় ছেলের একমাত্র লাটসাহেব, আমাদের রাজপুত্র শ্রাবণ। ওর পরে এক মেয়ে, তিতির। বিয়ে দিলাম কিছু দিন আগেই। আপাতত শশুর বাড়িতে। আর এটা আমাদের সবচেয়ে আদরের দুলালি আমাদের ইশানি, মরিয়মের একমাত্র মেয়ে।;
সবার পরিচয় করানোর সাথে সাথে খোরশেদ সাহেবের দিকে চেয়ে ছোট্ট একটা হাসি উপহার দিয়েছে। কিন্তু শ্রাবণ পারেনি। তার এসব কান্ডই উদ্ভট লাগছে। হাসি তো দূর সে একবারও তাকায়নি খোরশেদ সাহেবের দিকে। চরম বির*ক্ত হচ্ছে সে। খোরশেদ সাহেব খান সাহেবের ভালো বন্ধু ছিলেন শুনেছে সে। তবে এতেটাও ভালো বন্ধু ছিলেন না যে, এক বেলা এসে চেটেপুটে খেয়ে যাবে।
“শ্রাবণ দাদুভাই, তুমি তো একদমই কিছু মুখে তুললেনা!;
শ্রাবণের হুঁশ ফিরলো কারোর ডাকে। ডাকের উৎস বরাবর তাকাতে খোরশেদ সাহেবের হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা দেখতে পেলো সে। না চাইতেও জোর পূর্বে হাসতে হলো। হেসেই জবাব দিলো,
“জি খাচ্ছি।;
ফর্মালিটি করে বললেও কিছুই মুখে তুললো না শ্রাবণ। খোরশেদ সাহেব আর এই নিয়ে পিছু পড়লোনা শ্রাবণের। নিলাশার ভাইকে আরাফকে ডেকে পাঠালো। আরাফ নিলাশার বড় ভাই। অনার্স শেষ বর্ষে পড়াশোনা করছে।
“হ্যাঁ দাদু, বলো?;
“এসো দাদুভাই। তোমার সঙ্গে তো কারোর পরিচয়ই হলোনা।;
আরাফ নিতান্তই শান্ত স্বভাবের একজন ভদ্র ছেলে। দাদুর কথা মোতাবেক সে স্মিত হেসে তার পাশে বসলো। খোরশেদ সাহেব শ্রাবণকে দেখিয়ে তার উদ্দেশ্যে ক্ষীণ কন্ঠে শুধালো,
“মানাবে বোনের সাথে?;
আরাফ মুচকি হাসলো। সম্মুখে বসে থাকা এই হিরো মাফিক ছেলেটাকে তার বোনের পাশে সবচেয়ে বেশি মানাবে। আরাফের মুখের হাসিই জবাব হলো খোরশেদ সাহেবের প্রশ্নে।
আরাফ মাথা নেড়ে চলে গেলো। বাচ্চারা বোরিং হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যেই। এতো গুরুজনদের মাঝে ঠিক মিলমিশ ঘটাতে পারছেনা। তাই এখান থেকে পালানোর রাস্তা খুঁজছে। তানি এবং তুতুন সুযোগ পেতেই উঠে চলে গেলো। যেতে পারলোনা ইশা। কারন সে এখন ততটাও বাচ্চা নয়।
নীল শাড়িতে নীলাঞ্জনা। এক নীলাম্বরী হাজির হলো উপস্থিত মহলে। নীল শাড়ি পরহিতা মেয়েটিকে দেখে এক অদ্ভুত অনুভূতিতে বুক জ্বালা করতে লাগলো ইশার। ওর বোরিং,বির*ক্তির মুখখানা শুকিয়ে গেলো। মেয়েটা ভয়ানক সুন্দরী। যাকে এক কথায় কোনো অপ্সরার সাথে তুলনা করা যায়। গায়ের রঙখানা চমক দিচ্ছে। হাতে সোনার বালা জোড়া এতো সুন্দর ফুটে উঠেছে যে চোখ ধরে আসে। ইশার মাথায় অদ্ভুত এক খেয়াল এলো। বার কয়েক চোখের পলক ঝাপটে পাশ ফিরে তাকালো। সবার ধাঁধানো চোখ নিলাশার প্রতি। শ্রাবণও কি তাই? তড়াক করে মাথা ঘুরিয়ে ইশা বিপরীত পাশে তাকালো। শ্রাবণ ফোন ঘাঁটছে। কপাল খানায় বির*ক্তির স্পষ্ট রেখা দৃশ্যমান। জ্বলে থাকা স্ক্রিনের আলো আঁচড়ে পরেছে তার গৌরবর্ণ মুখশ্রীতে।
খোরশেদ সাহেবের বলাতে নিলাশা কোমল স্বরে সালাম দিলো সবাইকে। খান পরিবারের প্রত্যেক সদস্য সাদরে সালামের জবাব দিলো। নুপুর বেগম বেশ আনন্দিত। শ্রাবণের সাথে কতটা ভালো মানাবে নিলাশাকে ভাবতেই আনন্দে গদগদ করছেন তিনি। পরীর মতো দেখতে মেয়েটা ক’দিন বাদে তাদের সারা বাড়িময় পায়চারি করে বেড়াবে।
মরিয়ম বিবি মলিন হেসে তাকিয়ে আছেন নিলাশার পানে। ইশা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে প্রতি মুহুর্তে তার কেন যেন মনে হতো ইশা আর শ্রাবণ দু’জন দু’জনকে ভালোবাসে। বিশেষ করে শ্রাবণ, পাগলের মতো করেছে প্রতিটা মুহুর্তে। আফিয়া বেগমের হাত ধরে ছোট্ট বাচ্চাদের মতো কেঁদেছে শব্দ করে! এসব কি শুধু র*ক্তের সম্পর্কের দায়ে? জানেন না তিনি!
“দেখো গিন্নি, মাশা-আল্লাহ। একটা নীলপরি বসে আছে আমাদের সামনে।;
আফিয়া বেগম কেঁপে উঠলেন। হয়তো হাতে আর মাত্র কয়েক সেকেন্ডই বেঁচে আছে। তার পাগল ছেলে এই যে চিৎকার করে উঠলো বলে।
ইশা আর শ্রাবণ অবাক নয়নে তাকালো খোরশেদ সাহেবের দিকে। একটু আগে তার বলা কথাটা ঠিক কিভাবে নিবে ওরা, বুঝতে পারছেনা যেন। তিনি এক অবিশ্বাস্য বানী শুনিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে ইশা আর শ্রাবণের।
“আমি কিন্তু আজই শ্রাবণ আর নিলাশার এনগেজমেন্টটা সেরে ফেলতে চাই ‘খান। তোর কোনো আপত্তি নেই তো? পছন্দ হয়েছে তো আমার নাতনিকে?;
-“হোয়াট?;
শ্রাবণের শান্ত স্বরে করা প্রশ্নটি একটা গম্ভীর পরিস্থিতি তৈরি করে দিলো মহলে। এনগেজমেন্টের কথা শুনে নিলাশার মা সহ সকল মহিলাগন এসে উপস্থিত হলো এখানে। শ্রাবণের কথায় তারাও কিঞ্চিৎ বিস্মিত। তবে এই বিস্ময় অন্য ভাবনাতে। এমনটা নয় যে, তারা জানেনা শ্রাবণ আগে থেকেই সবটা জানেনা।
খোরশেদ সাহেব মৃদু হেসে বললেন,
-“কেন দাদুভাই, তুমি কি চাওনা আজই তোমাদের এনগেজমেন্টটা হোক? আমরা কিন্তু সবাই চাই। তোমার দাদাজানকে দেখো? কেমন হা করে দেখছে তোমার হবু বউকে!;
মস্তিষ্ক ধপ করে জ্বলে উঠলো শ্রাবণের। তার নরম মুখের আদল মুহুর্তেই শক্ত হয়ে গেলো। খান সাহেবের দিকে তাকাতে তাকাতে তার দৃষ্টিতে বি*স্ফোরক অনুভূতি নেমে এলো।
“চাইবে না কেন আঙ্কেল? অবশ্যই চাইবে।;
বলতে বলতে অপ্রস্তুত মূলক হাসলেন শমসের সাহেব। ব্লান্ডারটা তো তিনি করেছেন ছেলেকে কিছু না জানিয়ে। এখন শ্রাবণের এই অদ্ভুত দৃষ্টি খানা কি করে স্বাভাবিক করবেন তিনি?
আফিয়া বেগমের বুক কাঁপছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। কি হবে? কাকে আঁটকাবেন তিনি? ছেলেকে নাকি স্বামীকে!
এক বিশ্রী অনুভূতি হতে লাগলো ইশার! তবে কি এই পরীর মতো দেখতে মেয়েটা ওর শ্রাবণ ভাইয়ের বউ হবে? এটা ও নিজের চোখে কিভাবে দেখবে? কিভাবে সহ্য করবে?
“তাহল, শুরু করা যাক?;
আনন্দে উপচে পরছে আতাউল সাহেবের গলা দিয়ে। তিনি তার বউয়ের পানে তাকিয়ে মুচকি হেসে ইশারা করলেন কিছু। নিলাশার মা যেতে যেতে সঙ্গে তার এক বোন এবং নিলাশার ছোট ফুপিকে নিয়ে গেলো।
শমসের সাহেব এবং সাদ্দাত সাহেব একত্রে মাথা দুলিয়ে বলল,
“হ্যাঁ আঙ্কেল। শুরু করা…;
“এক মিনিট বাবা!;
থেমে গেলেন শমসের সাহেব এবং সাদ্দাত সাহেব। শ্রাবণ বাবার দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। অবিশ্বাস্য স্বরেই শুধালো,
“হোয়াটস গোয়িং অন বাবা?;
“শ্রাবণ, কি হচ্ছে? এসব কথা বলার সময় পরে অনেক পাবে। এখন থামো।;
গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন খান সাহেব। তিনি অবাক হয়ে যাচ্ছেন নাতির আচরণ দেখে। জেনেশুনে কি বোকার মতো আচরণ করে যাচ্ছে তখন থেকে!
“না দাদা, তুমি ভুল ভাবছো। এসব কথা বলার সময় পরে কেন কখনোই হওয়া ফেয়ার ছিলোনা! আমরা এখানে কেন এসেছি? টেল মি দ্য ট্রুথ!;
খান সাহেবের কপালের মাঝে ভাজ দেখা গেলো। অবাক বিস্ময়ে তিনি শুধু একটা শব্দই উচ্চারণ করতে পারলেন,
“মানে?;
“শ্রাবণ, নিলাশাকে আমরা তোমার জন্য পছন্দ করেছি বাবা। আজ ওকে দেখতেই এখানে এসেছি আমরা। আমরা সবাই চাই, তুমিও ওকে পছন্দ করো। আর দেখো ওকে পছন্দ না হওয়ার কোনো কারন নেই। এতো সুন্দর একটা মেয়ে, আর ওর আচার-আচরণও ভীষণ…;
“তোমরা আমাকে না জানিয়ে আমার বিয়ে পাকা করে ফেলেছো। দ্যাটস আ নাইস থিংস দাদাজান। বাট আই এম সরি টু স্যে, আমি তোমার বড় ছেলে নই!;
“শ্রাবণ!;
গর্জে উঠলেন শমসের সাহেব। সাদ্দাত সাহেব অবাক নয়নে তাকালেন স্রেফ। তার মুখ থেকে কোনো কথা এলোনা।
“নো বাবা। এই কথাটা তুমিও ভালো করে জেনে রাখো!;
“কি হচ্ছেটা কি এখানে?;
অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন খান সাহেব। নিজের বাল্যকালের বন্ধুর সামনে নিজের সম্মান সচক্ষে ভেসে যেতে দেখছেন তিনি।
“সাদ্দাত ওকে বসতে বল প্লিজ। বাইরে আমাদের একটা সম্মান আছে, ও কি ভুলে যাচ্ছে সেটা!;
সাদ্দাত সাহেব শ্রাবণকে কিছু বললেন না। তিনি ভাইকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পরলেন।
“তুমি তোমার ছেলেকে কিছু বলোনি শমসের?;
রাগে ভেতরে ভেতরে ফুঁসছেন খান সাহেব। দাঁতে দাঁত চেপে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন। বাবার রাগান্বিত গলা শমসের সাহেবের কাছে মৃ/ত্যু সমতূল্য। তিনি ভড়কে গেলেন। কাঁপা গলায় বললেন,
“না বাবা! সময় মেলেনি!;
“সময় মেলেনি ফাজলামো করছো? একঘর বাইরের লোকের সামনে তোমার ছেলের এই অপমানসূচক কথা গুলো শুনতে সময় মিলছে তো?;
ভয়নাক রকমের রেগে গেলেন খান সাহেব। খান পরিবার এক নিমিষে মুষড়ে পড়লো আতংকে। খান সাহেবকে এতোটা রাগতে বোধহয় ত্রিশ বছর পূর্বেই একবার দেখেছিলো সবাই।
“খান, শান্ত হ। কি করছিস?;
খোরশেদ সাহেবের কথায় রা*গের আগুনে আরও ঘি পরলো যেন। তিনি শান্ত হতে পারলেন না। উল্টে আরও রাগলেন। কিন্তু মুখে কিছু বলার পূর্বে খোরশেদ সাহেব শ্রাবণের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো,
“দাদুভাই, তোমার কি আমার নাতনিকে পছন্দ হয়নি?সমস্যাটা আমাকে খুলে বলো। আমি তোমাকে সমাধান দিচ্ছি।;
শ্রাবণ অসহায় চোখে তাকালো দাদাজানের দিকে। মানুষটা অসুস্থ হয়ে পরবেন হয়তো তার এই জবাবে। কিন্তু, এ ছাড়া আর কোনো উপায় এই মুহুর্তে তার জানা নেই।
“আমি আপনার নাতনি কেন, কাউকেই পছন্দ করতে পারবোনা। কারন আমি.. আমি ইশাকে ভালোবাসি। যেদিন থেকে বুঝতে শিখেছি, ঠিক সেদিন থেকেই। জানিনা ঠিক কত বছর, কত মাস, কত সপ্তাহ কিংবা কত দিন! হিসাব করে রাখলে হয়তো এই দাবীতে বিশেষ প্রাইজ জিতে নিতে পারতাম। বিশ্বাস করুন, এক মুহুর্তের জন্যও ওকে ছাড়া দ্বিতীয় কারোর কথা ভাবতে পারিনি আমি। কারোর কথা না।;
স্তব্ধ হয়ে গেলো গমগম পরিবেশ। মুখে হাত চাপলেন আফিয়া বেগম। মরিয়ম বিবি রিয়াকশন দিতে ভুলে গেলেন। নুপুর বেগম বড় বড় চোখে তাকালো শ্রাবণের দিকে। শমসের সাহেব, সাদ্দাত সাহেব, খান সাহেব এমনকি আরবও! সবার কানের পাশ থেকে ভো শব্দ করে যেন কিছু উড়ে গেলো। সর্বশেষ ইশা! ওর মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেলো ক্ষণেই। এতক্ষণ ঝৈঝামেলা এক মুখী হয়ে দেখলেও ক্রমশ সবার দৃষ্টি তার উপর নিবদ্ধ হতে মস্তিষ্ক আরও ভোঁতা হতে লাগলো।
খোরশেদ সাহেবের পরিবারের মাঝে গুঞ্জন শুরু হলো। তাদের হাসি হাসি মুখে মুহুর্তেই চটলা পরে গেলো শ্রাবণের কথায়। অনেকের বাঁকা দৃষ্টি এসে পরলো ইশার প্রতি। শ্রাবণ কারোর তোয়াক্কা না করে ইশাকে হেঁচকা টান দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলো। মিশ্র এক অনুভূতি ঝড় তুলেছে দু’জনের ভেতেরই। ইশার চোখ ভিজে উঠেছে প্রায়। যা দেখে শ্রাবণ ধমক দিয়ে বলে উঠলো,
“কান্না ছাড়া আর কিছু পারিস না?;
ইশা ফুঁপিয়ে উঠলো। শ্রাবণ আবারও বলল,
“আজই আমাকে বিয়ে করতে হবে! পারবি?;
ইশার কান্না থেমে গেলো। কিছু বলবে তার পূর্ব পূণরায় শ্রাবণ বলে,
“দুমনা হয়ে কোনো জবাব দিবিনা। যদি এই সমাজ আর পরিবারের বাইরে ভাবতে পারিস তবেই জবাব দিবি। চেয়ে দেখ, এখানে পঞ্চাশজন মানুষের প্রত্যেকেই আমাদের বিরূদ্ধে। এখন তোর জবাব কি ‘না’ হবে?;
ইশা এবারও জবাব দিতে পারলোনা। শমসের সাহেব তেড়েমেরে উঠলেন। তেড়ে এসে শ্রাবণের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললেন,
“অনেক হয়েছে! বাকি কথা বাসায় গিয়ে হবে।;
শ্রাবণ শান্ত ভঙ্গিতে নিজের হাত থেকে বাবার হাতটা ছাড়িয়ে দিলো। পকেট হাতড়ে একটা বক্স বের করলো। লাল রঙের ছোট্ট একটা বক্স। শমসের সাহেব আঁতকে উঠলেন,
” এতে কি? কি আছে এতে?;
জবাব দিলো না শ্রাবণ। বক্সটা খুলতেই একটা সোনার আংটি জলজল করে উঠলো। দূর হতে আফিয়া বেগম কান্নাভেজা চোখে মৃদু হাসলেন।
শ্রাবণ ইশার হাতটা টেনে নিয়ে আংটিটা পরিয়ে দিয়ে খালি বক্সটা বাবার হাতে ধরিয়ে দিলো। শমসের সাহেব এবার নির্ঘাত হার্ট এট্যাক করবেন। একি অসভ্যতা শুরু করেছে তার ছেলে?
পরক্ষণেই, ইশার হাত ধরে ধীরপায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো শ্রাবণ। একঘর লোক স্রেফ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলো ওদের যাওয়ার পানে।
“এসব প্রেম ভালোবাসা এই খান পরিবারে আগেও হয়নি, এখনও হবেনা।;
খান সাহেবের কাঠকাঠ গলা। বয়স বেড়ে চামড়ায় ভাজ পরলেও সবসময়কার মতো ভারী কন্ঠখানা তার একটুও নরম হয়নি। পূর্বের সেই তেজ, সেই ঔদ্ধত্য এই টুকুও যায়নি। তারউপর খোরশেদ সাহেবের নাতনির সাথে শ্রাবণের বিয়ে ভাঙাতে ক্ষোভ প্রকাশ করতে ছাড়েননি খোরশেদ সাহেব। ছোট বড় অনেক অপমান মুখ বুজে সহ্য করে ফেরত আসতে হয়েছে তাদের।
“এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে আমার তেমন কোনো অসুবিধা হবেনা দাদাজান। ইশাকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমি ভালো ভাবেই পালন করতে পারবো। এটা ভেবোনা, আমি এই খান পরিবার ছাড়া অচল!;
কন্ঠে দৃঢ়তা এখনও একই শ্রাবণের। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকালেন শমসের সাহেব। দাদাজানের সাথে কথা বলার ভদ্রতা টুকুও ভুলে গেছে তার ছেলে। ইচ্ছে করছে লাঠি পেটা করতে।
“শোনো তোমার ছেলের কথা! এতকাল ধরে এই শিক্ষায় বড় করেছো একে!;
হাসফাস করছেন খান সাহেব। শ্রাবণ প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়ল। কিছু একটা ভেবে এগিয়ে এসে দাদাজানের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। খান সাহেব তাকে সরিয়ে দিতে চাইলে শ্রাবণ জোর করে তার হাত ধরে রাখে। ঠোঁটের কোনে এঁটে দেয় মৃদু হাসির রেখা। অতঃপর লম্বা নিঃশ্বাস টেনে বলতে শুরু করে,
“আমি আমার বাবার শিক্ষায় বড় হয়নি দাদাজান। আমি তোমার শিক্ষায় বড় হয়েছি। এই যে ভালোবাসার প্রতি জেদটা দেখছো, এটাও তোমার থেকেই শিখেছি। তুমি বলতেনা, একসাথে দশটা কাজ হয়না। তেমন একসাথে দশজনকেও রাখা যায়না। ভালোবাসো একজনকেই, এবং সঙ্গে রাখো সেই একজনকে। দুনিয়া এফোড় ওফোড় হয়ে যাক নিজের অধিকারে কখনও আরেকজনের কুদৃষ্টি সহ্য করবেনা। যে জিনিস তোমার সেটা কেবলই তোমার থাকুক। আমি আর কারোর মতো হতে পারিনি দাদাজান। আমি শুধু তোমার প্রতিরূপ। শুধু পার্থক্য আমাদের ভাবনাটুকু। তুমি ভালোবাসার মতো এতো সুন্দর গীতিটাকে জঞ্জাল ভাবছো। তুমি সুন্দর পবিত্র প্রণয়কে শ্রীহীন দূষিত ভাবছো! তোমার ভাবনাটা ভুল দাদাজান৷ ভালোবাসা অপবিত্র নয়, ভালোবাসা শ্রীহীন দূষিত নয়। ভালোবাসা পবিত্র দাদাজান।;
একরাশ নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে গেলো সারা ঘরময় জুড়ে। খান সাহেব অবাক হয়ে শুনছিলেন শ্রাবণের কথাগুলো। শ্রাবণ থামতে তার প্রসন্ন মুখে ভাটা পরলো। থামলো কেন শ্রাবণ? আরও কি কিছু বিশ্লেষণ করা যায়না?
খান সাহেবের মন নরম হওয়ার আচ বুঝি শ্রাবণ পেয়ে গেছে। পলকহীন চেয়ে রইলো দাদাজানের অবনত দৃষ্টির পানে। খান সাহেবের ন্যায় শমসের সাহেব এবং সাদ্দাত সাহেবও চুপ হয়ে গেলেন। নুপুর বেগম আফিয়া বেগম একজন আরেকজনের হাত ধরাধরি করলেন। সাদ্দাত সাহেব শমসের সাহেবের কাঁধে হাত চেপে বললেন,
“বেটার ভালোবাসার দম আছে ভাইজান।;
শমসের সাহেব আর রেগে থাকতে পারছেন না ছেলের প্রতি। ভালোবাসলে বুঝি এমনই আগলে রাখতে জানতে হয়। তিনিও যদি একটু চেষ্টা করতেন, তাহলে হয়তো আজ তার প্রথম প্রেম থেকে যেতো।
মরিয়ম বিবি দূরে দাঁড়িয়ে মলিন হাসলেন। তিনি ভুল ছিলেন না। শ্রাবণ তার পাগলী মেয়েটাকে সত্যিই ভীষণ ভালোবাসে। আর এই ভালোবাসার ভীষণ জোর। তার কাঠখোট্টা বাবাকেও নরম করে ফেললো ছেলেটা। সাধুবাদ জানাতে হয়।
“ইশানিকে ডাকো।;
বাসায় ফেরার পর থেকে আর ইশার মুখ দেখেনি কেউ। দাদাজানের ক্রোধান্বিত মুখশ্রী দেখার মনোবল ওর নেই। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে রেখেছে সে।
শ্রাবণের বুঝানোতে ঠিক কতটুকু বুঝলো খান সাহেব? ধরা গেলোনা। নুপুর বেগম দোতলায় গেলেন ইশাকে ডাকতে। খানিক বাদে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিয়েও এলেন ওকে। ভয়ে কদম ফেলতে পারছেনা ইশা। এখন কি সবাই মিলে ওকে বকবে? পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষ যে ওদের বিরুদ্ধে! কি হবে ওদের ভাগ্যে?
“দ্ দাদাজান!;
বিচলিত গলায় ডাকলো ইশা। খান সাহেব গম্ভীর মুখে বসে আছেন। শ্রাবণ তার পাশেই বসে আছে নত মস্তিষ্কে। সবার মুখই কম বেশি গম্ভীর। সবার এমন ভাবমূর্তি ইশার আত্মা অব্দি কাঁপিয়ে তুললো। কি হতে চলেছে? কি হবে? মাথা ঘুরছে ওর। ভাবতে পারছেনা কিছু।
“এদিকে এসো।;
কেঁপে উঠলো ইশা। শ্রাবণ আঁড়চোখে দেখছিলো ইশাকে। ভীষণ ভ/য় পাচ্ছে বেচারি। ইচ্ছে করছে উঠে গিয়ে হাত ধরে নিয়ে আসতে।
ইশা কম্পিত মনে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। খান সাহেব সামনের খালি সোফাটায় ইশারা করে বসতে বললেন। বসলো ইশা। বারবার ঢোক গিলছে শুঁকনো গলায়। কারোর মুখের দিকে তাকানোর দুঃসাহস করতে পারছেনা। ঠিক তখনই কঠোর গলায় বলে উঠলেন খান সাহেব,
“যা জিজ্ঞেস করবো একদম সোজাসাপ্টা জবাব দিবে!;
“জ্ জি নানাজান।; (ভয়ার্ত গলায়)
“এই পাগলকে কবে থেকে পছন্দ করো?;
ইশার বুকের ভেতরটায় শব্দ করে ঢোল পিটিয়ে উঠলো কেউ। জ্বলে যাচ্ছে ভেতরটা। মুহুর্তেই ঢোক গিললো পূণরায়। গলা ধরে আসছে ওর।
“আগেই বলেছি একদম সোজাসাপ্টা উত্তর চাই!;
“ক্ কবে থেকে আমি জানিনা নানাজান। হয়তো যেদিন থেকে দুনিয়ার ভালোমন্দ বুঝতে শিখেছি। সেদিন থেকেই মনে হয়েছে শ্রাবণ ভাইকে আমি ভ্ ভালোবাসি।;
শ্রাবণের শিরদাঁড়া সোজা হয়ে গেলো ইশার জবাবে। ঠিক মেরুদণ্ড হয়ে ফুড়ুৎ করে দৌড়ে নেমে গেলো শীতল র*ক্তস্রোতের ধারা। তৃপ্তি দ্বায়ক হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটের কোন জুড়ে।
হতাশার নিঃশ্বাস ছাড়লেন খান সাহেব। রাগতে চাইলেন ভীষণ। কিন্তু এই মায়াভরা মুখ দুটো তার ভেতরটা ক্রমশই উদ্বেগরহিত করে দিয়ে যাচ্ছে। চেয়েও পারছেন না ওদের বিরোধিতা করতে। মন বলছে চুলোয় যাক খোরশেদ আর ওর অপমানজনক কথা। সে তার পরিবারে সুখ সচক্ষে দেখতে চায়। তার একটু একটু করে যত্নে তৈরি করা সুখের সংসার। তিনি কোনো মূল্যেই হারাতে চান না। আজ বড় অপরাধবোধ হচ্ছে তার বড় ছেলের কথা ভেবে। নিজের জেদের জন্য ছেলেটাকে কতটা কষ্ট দিয়েছিলেন তিনি। ধিক্কার জানান তিনি নিজেকে। আর যাই হোক, কোনোদিন ছেলের চোখে আর বেস্ট বাবা হতে পারবেন না তিনি। কোনোদিন না।
“আগামী শুক্রবার খান বাড়ির এ যাবত কালের সবচেয়ে বড় এবং এলাহি আয়োজনে আমি তোমাদের চারহাত এক করে দিতে চাই। আমি তোমাদের সুখ চাই, আর কিছু না।;
নিঃশব্দে একটা বি*স্ফো*র*ণ ঘটলো খান সাহেবের সিদ্ধান্তে। সবাই মুখে কিছু বলতে না পারলেও ভেতরে ভেতরে যেন চিৎকার করে উঠলেন আনন্দে। ইশা স্তব্ধ হয়ে গেছে। শ্রাবণও তাই। দাদাজান এতো সহজে ব্যাপারটা মেনে নেবেন, আদৌও ভাবেনি কেউ।
খান সাহেব লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আনোয়ারা বেগম স্বামীর উঠে দাঁড়ানো দেখে সেও উঠে পরলো। খান সাহেব ধীর পায়ে হাঁটা ধরলেন রুমের দিকে। আনোয়ারা বেগম তার পিছু পিছু। সবাই তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। যেইনা দু’জন রুমের ভেতরে চলে গেলো অমনি আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলো আরব। সাদ্দাত সাহেব এক লাফে ষোল বছরের কিশোরে পরিনত হলো। হৈ হৈ করতে করতে শিষ বাজালেন। শমসের সাহেব দূর থেকেই মুচকি হাসলেন। নুপুর বেগম নাচছেন রীতিমতো। আফিয়া বেগম মরিয়ম বিবির কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেন শক্ত করে। সবার নাচনকোঁদন দেখে হেসে উঠলো শ্রাবণ। ইশা লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো সবার নাচানাচি দেখে। ওর পক্ষে এই মুহুর্তে আর এখানে বসে থাকা সম্ভব নয়। তাই সবার চোখের আড়াল হয়ে চলে গেলো নিজের ঘরে।
“হ্যাঁ রে। আমার এখনও নিজেকে পাগল পাগল লাগছে জানিস।;
“আর পাগল পাগল লেগে লাভ নেই মেরি জান। এবার প্রাকটিক্যালি পাগল হওয়ার জন্য রেডি হও।;
আঁতকে উঠলো ইশা। ধমকের সহিত বলল,
“নির্লজ্জ মেয়ে, মুখে কিছু আঁটকায় না?;
“আঁটকাবে কেন? জাস্ট ইমাজিন ইশুপাখি, আর সাতদিন বাদে তুই শ্রাবণ ভাইয়ের বউ হয়ে যাবি। তারপর থেকে রোজ তার বুকে মাথা রেখে ঘুমাবি। কথায় কথায় লজ্জায় আঁচড়ে পরবি তার বুকে। আর শ্রাবণ ভাইকে আমি যতটা চিনেছি সোনা, সে তোমাকে একটা দিনও শান্তিতে থাকতে দিবেনা!;
কান জোড়া যেন ধ্বসে পরলো ইশার। বুকের ভেতরটায় কেউ ধুম ধুম করে ইট ভাঙছে বলে মনে হচ্ছে। এই অসভ্য মেয়েটা দিনকে দিন বড্ড পাঁজি হয়ে যাচ্ছে। কোনো কথায় যদি লাগাম থাকতো।
কিছু না বলেই ফোনটা কেটে দিলো ইশা। বড়বড় নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো। যা ও ভাবতেও পারছেনা, সেটাই নামিরা অক্ষরে অক্ষরে বিশ্লেষণ করে দিচ্ছে।
ফোনটা বিছানার উপর ফেলে গলা থেকে ওড়নাটা খুলে বিছানায় ফেলতেই কেঁপে উঠলো কারোর গভীর স্পর্শে। শ্রাবণ এসেছে। ইশা কেঁপে উঠে পেছন ফিরতেই শ্রাবণ নাক ডুবিয়ে দিলো ইশার খোলা চুলে। দু’হাতের মাঝে বন্দি করলো তার মনোহারিণীকে।
একটু আগে নামিরার কথাগুলো শুনে যেভাবে লজ্জা পেয়ে হেসেছিস। ঠিক ওভাবে হাসবি।;
ইশার চোখ জোড়া বড়বড় হয়ে গেলো।
“ত্ তুমি সব শুনেছো?;
শ্রাবণ বাঁকা হাসলো। যা দেখে ইশা অসহায় গলায় বলল,
“এটা কিন্তু একদম ঠিক হয় শ্রাবণ ভাই! তুমি আমাদের কনভারসেশন কেন শুনবে?;
শ্রাবণ শব্দ করে হেসে উঠলো। ইশা লজ্জায় আবারও লাল হতে শুরু করেছে। ইশা যত লজ্জা পাচ্ছে, শ্রাবণের হাসির শব্দ ততই গাঢ় হচ্ছে। এক পর্যায়ে ইশা পালাতে চাইলো শ্রাবণের সামনে থেকে। কিন্তু পারলোনা। শ্রাবণ ওর হাত ধরে আঁটকে দিলো। পরক্ষনেই হেঁচকা টান দিয়ে মিশিয়ে নিলো নিজের সাথে।
বলতে বলতে পূর্বের ন্যায় ইশার পেছনে চলে এলো শ্রাবণ। পেছন থেকে ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে কাঁধে থুঁতনি রেখে সামনের দিকে হাত ইশারা করলো। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় ফুটে উঠেছে একজোড়া প্রতিবিম্ব।
ইশার নিশ্বাস ভারী হলো ক্রমাগত। ওর কানে বাজতে লাগলো শ্রাবণের বলা কথাটা। “জানিস, লজ্জা পেলে কতটা অভিলাষী লাগে তোকে?” দম বন্ধ হয়ে আসছে যেন।
শ্রাবণ ঘোর লাগা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সম্মুখে। শুঁকনো গলায় ঢোক গিললো পরমুহূর্তেই। ফের সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাসফাস করা গলায় বলল,
“সাতদিনই তো, কোনো ব্যাপারনা। আমি নিজেকে সামলাতে পারি।;
ইশা বিস্মিত হলো।
“কি হয়েছে?; কোমল স্বরে শুধালো।
শ্রাবণ মাথা চুলকে বলল,
“কিছুনা।;
বলেই চলে গেলো ইশাকে কিছু বলতে না দিয়ে। ইশা তাকে ডাকতে নিয়েও ডাকতে পারলোনা। শ্রাবণ বেরিয়ে যেতেই একরাশ দুশ্চিন্তা চেপে ধরলো ইশার কপাল। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বিছানার দিকে চোখ যেতেই আঁতকে উঠলো ইশা। একবার নিজের দিকে তো একবার বিছানার দিকে তাকাতে লাগলো। ওড়নাটা তো সেই কখন খুলে রেখেছিলো। নিজের এই বোকামির জন্য এখন সেন্টি খেয়ে বেহুঁশ হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে ওর।
আজ রবিবার। ইশার ঘুমের তেরোটা বাজিয়ে সকাল সকাল ওকে উঠিয়ে বসিয়ে রেখেছে বাড়ির লোক। ওদের বিয়ের প্ল্যানিং চলছে, অথচ ওদেরই কোনো মাথা ব্যাথা নেই। কথায় বলে, যার বিয়ে তার খবর নেই, পাড়া পড়শির ঘুম নেই। খান বাড়ির বর্তমান অবস্থা। খান সাহেব অব্দি এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছেন, আত্নীয় স্বজনদের দাওয়াত দিতে দিতে অস্থির হয়ে উঠছেন। অথচ তার নাতি নাতনির এই নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথাই দেখছেননা। এটা নিয়েই তার অস্থিরতা আরও দিগুণ করে বাড়ছে। তাই আজ আদেশ এসেছে, দু’জনকে যেন ভোর ভোর তুলে দেওয়া হয়। বাড়িতে ডেকোরেশন থেকে শুরু করে সব কিছুতে তে তাদের দু’জনের পছন্দ অপছন্দ জানতে হবে। না জানলে কি করে হবে?
ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে বিছানা ছাড়লো ইশা। ব্যস্ত পায়ে রুমে ঢুকলেন আফিয়া বেগম আর মরিয়ম বিবি। ইশার ব্লাউজের মাপ নিবেন তারা। ইশার অবস্থা এমন নাজুক দেখে তারা কপাল চাপড়ে আবার বেরিয়ে গেলেন। যেতে যেতে বলে গেলেন মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে শ্রাবণের ঘরে যেতে। দু’জনের জুতার মাপটা নিতে হবে।
ইশা তাদের কথা ঠিক কতটুকু বুঝলো বোঝা গেলোনা। কেবল ঘুম ঘুম চোখে হু হু করে মাথা নেড়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। ওদিকে শ্রাবণকে এক ডাকেই পেয়ে গেলো আফিয়া বেগম আর মরিয়ম বিবি। হন্তদন্ত পায়ে ঢুকলেন শ্রাবণের ঘরে। শ্রাবণ ফ্রেশ হয়ে আধশোয়া হয়ে বসলো।
“উঠেছিস? ব্রেকফাস্ট করবি?;
“ঘুম পূরণ হয়নি মা। যা কাজ আছে জলদি বলো, শেষ করে আরেকটু ঘুমাবো!;
“এখন আর ঘুম পূরণ করার সময় নেই রে। হাতে মাত্র চারদিন বেঁচে আছে। কত কাজ বাকি বলতো?;
“ব্রেকফাস্ট করে ইশাকে নিয়ে আলতাফ মামার দোকানে যাবি। বিয়ের যত গহনা মামার থেকেই নিবো। বাবা বলে দিয়েছেন।;
শ্রাবণ মনে করার চেষ্টা করলো মায়ের আফতাফ মামার কথা। হ্যাঁ মনে পরেছে। সম্পর্কে তার নানা হন তিনি। বড় একটা শপিং মলে আজ ১০ বছর যাবত বিশাল জায়গা জুড়ে দোকান তার।
“ঠিকাছে। আর কিছু?;
“না আজকের জন্য শুধু বিয়ের গয়না কেনা হবে। বাকি কাজ কাল থেকে।;
“ঠিকাছে।;
আরও টুকটাক কথা বলার মাঝে এসে হাজির হলো ইশা। ঘুম এখনও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে ওর নেত্রদ্বয়। শ্রাবণ এক পলক দেখলো ওকে। পরক্ষণে চোখ নামিয়ে মায়ের কথায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো।
জুতার মাপ নিয়ে সেই সাথে ইশার ব্লাউজের মাপ নিয়ে তারা চলে গেলেন। এবং সেই সাথে বলে গেলেন নীচে ব্রেকফাস্ট দেওয়া হবে, খেতে আসতে।
মা আর মনি চলে গেলে এবার সরাসরি ইশার পানে তাকালো শ্রাবণ। ইশা মাথা কাত করে ঘুমোচ্ছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। ইশার অবস্থা দেখে হেসে উঠলো শ্রাবণ। দেয়ালের বুকে লক্ষ্য স্থীর করতে দেখলো সবে ৬টা। এতো সকালে ইশার ঘুম ভাঙানো খুব মুশকিল। তাও তো পেরেছে আজ।
“ঘুম কি বেশি আসছে?;
শ্রাবণ জিজ্ঞেস করলো। ইশার কোনো হেলদোল নেই। হয়তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই গভীর ঘুমে চলে গেছে। শ্রাবণ মুখ টিপে হাসলো। এই সুযোগ আর কখনও আসবেনা। তাই ফট করে একটা ছবি তুলে নিলো। ছবি তুলে ফোনটা বিছানায় রেখে এগিয়ে গেলো ইশার কাছে। কতক্ষণ এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে দু’হাতে ইশার কোমর আলিঙ্গন করে টেনে আনলো নিজের বুকে। হঠাৎ চমকে উঠলো ইশা। ধর থেকে মাথা আলাদা হওয়ার মতো অনুভূতি হলো ওর। চমকিত দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকাতেই খানিক উষ্ণ স্পর্শে কেঁপে উঠলো ভেতরে থেকে। চোখ জোড়া তখন কোটর থেকে লাফিয়ে পড়ার উপক্রম। ডিম্বাকৃতির ন্যায় দৃষ্টি সম্মুখে ছিটকে যেতেই শ্রাবণ গভীর ভাবে সমাহিত হলো ইশার ওষ্ঠদ্বয়ে। ইশার নিঃশ্বাস তখন অস্বাভাবিক গতিতে ওঠানামা করছে। পারছেনা চেঁচিয়ে উঠতে। শ্রাবণ ওকে ছাড়ার নাম নিচ্ছেনা। এমন অপ্রত্যাশিত ছোঁয়া যাতনা দিলেও অদৃশ্য সুখের প্রতিবিম্ব ছুঁতে পারছে।
এক পর্যায়ে এসে ইশাকে ছেড়ে দিলো শ্রাবণ। এই সুযোগ, এখন পালাতে না পারলে ও নির্ঘাত অজ্ঞান হয়ে পরে থাকবে মেঝেতে।
“ভালোবাসার কোমল পরশ সব ক্লান্তি দূর করে দেয়, জানিস?;
শ্রাবণের গাঢ় কন্ঠস্বর প্রতিধ্বনি তুলে ইশার কর্ণকুহরে। নিঃশ্বাসের চঞ্চলতা এখনও স্থায়ীত্ব ইশার বক্ষঃপিঞ্জরে। শ্রাবণের হাত জোড়া যে এখনও তার কোমর জড়িয়ে আছে। বিচরণ করছে এদিক সেদিক।
শ্রাবণ হেসে উঠলো। শ্রাবণ ভীষণ গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। একথা কারোরই অজানা নয়। তবে অজানার বিষয়টি হলো শ্রাবণের হাসিখানা হৃদয়ে ছিদ্র করার মতো যথেষ্ট। এবং সেই সাথে আশ্চর্যের বিষয় হলো সেদিনের পর থেকে অতি ক্ষুদ্র বিষয় গুলোতে খুব হাসে মানুষটা। প্রশান্তিতে মন ভরে যায় ইশার। ইচ্ছে করে দেখতেই থাকি, দেখতেই থাকি।
“ঘুম তো কেটে গেছে, তাইনা?;
হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো শ্রাবণ। এই মুহুর্তে শ্রাবণের হাসির কারন ইশা না জানলেও কোনো অজানা কারনে ভীষণ লজ্জা লাগছে ওর।
“হ্ হ্যাঁ!;
ইশার হ্যাঁ সূচক জবাব পেয়ে শ্রাবণ আরও সশব্দে হাসতে লাগলো। অতএব সে সফল হয়েছে। এই গভীর ছোঁয়া ইশাকে উপহার দেওয়ার মুখ্য উদ্দেশ্যই ছিলো ইশার ঘুম গায়েব করা।
ব্রেকফাস্ট টেবিলে কাউকেই প্রত্যাশা না করলেও সবাইকেই দেখা গেলো। দাদাজান,দাদীজান, বাবা, বাবাই এবং আরব। সবাই খাওয়া অলরেডি শুরু করে দিয়েছেন। আরবকে এতো সকাল সকাল উঠানোর কারন হলো আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ইশা আর শ্রাবণের বিয়ের কার্ড পৌঁছানো। সঙ্গে আফিয়া বেগমের বাবার বাড়ি থেকে তার ভাইয়ের এক ছেলে আর এক মেয়েও থাকবে। তাদের বাড়ি থেকেই ওদের দু’জনকে নিয়ে যাবে আরব।
বিকেলের দিকে আফিয়া বেগমের ভাই ভাবী, নুপুর বেগমের দুই ভাই-ভাবী সবাই এক এক করে আসবেন। মরিয়ম বিবির শশুর বাড়ি থেকে তেমন কেউই নেই, একমাত্র ইশার চাচা বাদে। ইশার বাবার বড় ভাই হামজা সাহেব। হামজা সাহেবকে আজই আসার জন্য অনুরোধ করেছেন খান সাহেব। হয়তো সন্ধ্যা হতে হতে চলে আসবেন তার বউ এবং একমাত্র ছেলে তাসরিফ কে নিয়ে। বাকি আত্নীয় স্বজনরা কার্ড পেলে তবেই আসবে।
ঘুম কেটে গেলেও শরীরের ম্যাজমেজে ভাবটা কাটেনি ইশার। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। ক্লান্ত হাতে একটা চেয়ার টেনে বসতে নিলেই ধপ করে বসে পড়ে শ্রাবণ। ইশা চকিতে পাশ ফিরে তাকালো। ইশা তাকাতেই সবার দৃষ্টির অগোচরে শ্রাবণ চোখ টিপে দিলো। ইশা লজ্জা পেয়ে হাসফাস করে উঠলো। লজ্জার কোনো বালাই নেই শ্রাবনের। টেবিলে এতো গুলো মানুষের সামনে কি করছে এগুলো? কেউ দেখলে কি ভাববে?
“কি নানুভাই? দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি?;
খান সাহেবের হাস্যমুখর স্বর শোনা গেলো। ইশা সম্মুখে তাকালো। খান সাহেব স্মিত হেসে চেয়ে আছেন ওর পানে। নানাজানের ন্যায় ইশাও ঠোঁটের কোনে হাসি ফোঁটালো। তবে নিতান্তই জোর পূর্বক। ওর জায়গায় বসার জন্য শ্রাবণকে মনে মনে দুচারটে বকা দিয়ে শ্রাবণের সামনের ফাঁকা চেয়ারটায় বসলো। বসতেই লতা এলো পাঁউরুটি, জেলি আর ডিম নিয়ে। যা দেখে ইশার খানিক অরুচি ধরলো। দু’দিন ধরে ওর সব কিছুতেই ভীষণ অরুচি লাগছে। যেন কিছু খেয়েই শান্তি পাচ্ছেনা, হজম হচ্ছে না।
ইশার খাবারের প্রতি অনীহা কেউ খেয়াল না করলেও আফিয়া বেগম ঠিকই খেয়াল করলেন। তাই সবার জন্য এক খাবার আনলেও ইশার জন্য তিনি কিছু ব্যতিক্রম খাবার নিয়ে হাজির হলেন।
ইশার সামনে একটা স্যুপের বাটি রাখলেন আফিয়া বেগম। স্যুপ দেখলে ইশার এখন রীতিমতো বমি পায়। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে বাড়ির লোক যে পরিমান স্বাদহীন স্যুপ ওকে গিলিয়েছে। তাতে বমি পাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
“আমি এটা খাবোনা, দয়াকরো আমার উপর!;
অসহায় নেত্রে আফিয়া বেগমের শাড়ির আঁচল টেনে ধরলো ইশা। আফিয়া বেগম যেতে নিয়েও দাঁড়িয়ে পড়লেন। ইশাকে স্যুপ দিতে দেখে শ্রাবণ মনেমনে মায়ের প্রতি বেজায় খুশি হলো। এখনও নিয়ম করে ইশাকে এমন পাতলা খাবারও দেওয়া উচিৎ। কিন্তু মহারানীর অসহায় মার্কা মুখ দেখে সেও আর কিছু বলতে পারেনা।
আফিয়া বেগম সবার পানে চোরা চোখে তাকালেন। অতঃপর ইশার কাছে এসে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন,
আফিয়া বেগমের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই ইশার হাসি হাসি মুখ এমনিতেই গায়েব হয়ে গেলো। কষ্ট করে আর গায়েব করতে হলোনা। পূণরায় ইশার অসহায় ঘেরা মুখটা দেখে সে আর কিছু না ভেবে নিজের খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।
________
নামিরার ফোন বাজছে বেশ খানিকটা সময় নিয়ে। আরব ওর বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আধঘন্টা যাবত কল করে যাচ্ছে ওকে। কিন্তু কোনো খবরই নেই। দিন-রাত এক করে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে মেয়েটা। আরব বির*ক্ত হয়ে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হঠাৎ তার মাথায় এক বুদ্ধি এলো। সে তৎক্ষণাৎ ইশাকে কল দিলো।
“ভাইয়া, বলো?;
“আমি নামিরার বাসার সামনে।;
“সে কি? কেন?; (অবাক গলায়)
“কেন টেন পরে। তোর আমাকে একটা হেল্প করতে হবে।;
“হ্যাঁ বলো কি হেল্প।;
“আমি এখন নামিরার বাসায় যাবো।;
“মানে?;(আঁতকে উঠে) কেন ভাইয়া? তুমি ওকে কল করে বাইরে ডেকে নাও না। ওর মা আর মামু খুব ডেঞ্জারাস! একবার যদি কিছু টের পায়, তবে আমার নামুর কপালে দুঃখ আছে।;
“আহা কিচ্ছু হবেনা। তুই শোন..;
“বলো?;
“তুই নামিরার মাকে কল করবি। কল করে বলবি, আমি নামিরাকে নিতে আসবো। যদি কারন জিজ্ঞেস করে, তাহলে বলবি তোর আর শ্রাবণ ভাইয়ের বিয়ের কার্ড দিতে যেতে হবে আমাদের আত্মীয়দের বাসায়। আরব ভাইয়া একা পারবেনা, তাই ওকেও সঙ্গে যেতে বলেছে মনি। বুঝেছিস?;
“আমার মাথা ঘোারাচ্ছে ভাইয়া। তুমি কি রিস্ক নিতে চাচ্ছো বলো তো?;
“প্লিজ বইন, কোনো প্রশ্ন করিসনা। অনেক ভেবে চিন্তে বাঘের গুহায় রওনা হচ্ছি। বুক কাঁপছে আমার।;
“ভাইয়া তুমিও ম*র*বে আর আমাকেও মা*র*বে।;
“দোয়া আর দয়া দুটোই একসাথে কর। যা।;
কল কেটে ফেনটা পকেটে রেখে দিলো আরব। বুক ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বারবার কয়েক ফু দিলো বুকে। কে জানে, আজ আদৌও এই গুহা থেকে বেঁচে ফিরতে পারবে কিনা।
পাঁচমিশালি কাজ করা অসম্ভব সুন্দর দেখতে একটা নেকলেস ইশার সামনে রাখলেন আলতাফ সাহেব। এক দেখাতেই চোখে ধরলো তাদের। এতক্ষণ যাবত এতো এতো কালেকশন দেখালেও কোনোটাই ঠিক পছন্দ করে উঠতে পারেনি ইশা। এবার হয়তো পছন্দ হবে।
ইশাও মুচকি হাসলো। হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে নেকলেসটা হাতে তুলে দেখতে নিলে আলতাফ সাহেব পূণরায় বলে উঠলেন,
“চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতা। মানুষ দেখলেই বুঝতে পারি কার কি পছন্দ হবে।;
তার কথায় সায় জানিয়ে শ্রাবণ বলল,
“তা যা বলেছেন নানা।;
“নানাভাই, আপনি আপনার বউকে একটু পরিয়ে দেন ওটা? ট্রায়েল দিয়ে নেন। আমার জহরির চোখ বুঝলেন। আমি হলফ করে বলতে পারি আপনার বউ এই গয়না পরলে কারোর চোখ আর বউয়ের থেকে সরবে না।;
বলতে বলতে হাসলেন তিনি। শ্রাবণ মৃদু হেসে মাথা দুলালো। তাদের সামনেই বড় আয়নাটার সামনে গেলো দু’জনে। ইশার হাত থেকে নেকলেসটা নিয়ে ধীরস্থির হয়ে পরিয়ে দিলো ইশার গলায়। চোখে চমক দিলো শ্রাবণের। আলতাফ সাহেব ঠিকই বলেছেন। এই গয়না ইশা একবার পরলে আর কারোর চোখ সরবে না ওর উপর থেকে।
শ্রাবণের বলতে দেরী হলেও কারোর কুদৃষ্টি পড়তে সময় নিলোনা তাদের একান্ত সময়টাতে। পেছন থেকে একটা মেয়েলি গলা পেতে দু’জনেরই ভ্রম কাটে। ডাকের উৎস খুঁজতে দু’জনে একত্রেই আয়নার ভেতর তাকায়। তাদের পেছনে অত্যন্ত সুন্দরী একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে ল্যাভেন্ডার কালারের একটা কামিজ। চুল গুলো খোলা, আর ওড়নাটা এক পাশে ফালানো। হাতে একটা শপিং ব্যাগ। কালারটা ওর উপর খুব মানিয়েছে। যেন এই রঙটা কেবল ওর জন্যই আবির্ভূত হয়েছে এই পৃথিবীতে।
মেয়েটাকে চিনতে ইশার তেমন বেগ পেতে হয়নি। তবে শ্রাবণের চিনতে মোটামুটি অসুবিধাই হলো। আয়না থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ইশাকে নিয়েই পেছন মুড়ে তাকালো শ্রাবণ। স্বাভাবিক গলায় মেয়েটার উদ্দেশ্যে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
“ইয়েস?;
“চিনতে পেরেছেন?;
কি স্নিগ্ধ গলার স্বর মেয়েটির। বুক জ্বলতে লাগলো ইশার। সেই সাথে এক অপরাধবোধ। শ্রাবণ আর ওর ভালোবাসার মাঝে মেয়েটা অকারণেই ভিলেন হলো। এবং সেই সাথে মেয়েটাই হলো ভিকটিম। যার সাথে অ*ন্যায় করেছে ও। কিছু বা করেও ভ*য়াবহ অন্যায় করলো মেয়েটার সাথে। ওর কারনেই মেয়েটার বিয়েটা ভেঙে গেলো।
“সরি! কে আপনি?;
নিলাশার কোমল স্নিগ্ধ দৃষ্টি খানায় কেমন অবিশ্বাস্য অভিপ্রায় ধরা দিলো। যেন শ্রাবণের করা প্রশ্নটা অযৌক্তিক, হাস্যকর।
“আমি.. নিলাশা!;
নিলাশা স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দিলো। তবে ইশা উপলব্ধি করলো নিলাশার কন্ঠের তাচ্ছিল্যতা। তাকে না চেনার তাচ্ছিল্যতা।
শ্রাবণ মনে করার চেষ্টা করলো। মস্তিষ্কে খানিক চাপ দিতে মনেও পরে গেলো নিলাশার কথা। যার সাথে দু’দিন আগে তার বিয়ে ঠিক করার কথা হয়েছিলো।
আজ সোমবার। হসপিটালে আজ ইশার তৃতীয় দিন। সকাল আটটা বাজতেই বাড়ি থেকে সকালের নাস্তা নিয়ে হাজির হলো আরব আর নামিরা। হসপিটালে ইশার থাকে থাকছে শ্রাবণ আর মরিয়ম বিবি। গতকাল ছিলেন আফিয়া বেগম আর শ্রাবণ। ইশার বন্ধ কেবিনে বিনা শব্দে প্রবেশ করলো শ্রাবণ। ঘুমচ্ছে ইশা। ডাক্তার বলেছিলেন সকালের নাস্তা আটটায় করালে ভালো হয়। সেই নিয়ম অনু্যায়ী শ্রাবণের হাতে সকালের নাস্তা। সে ভেতরে ঢুকে টিফিনবক্স গুলো টেবিলের উপর রাখলো। ইশাকে ডেকে উঠাতে হবে। হাতের স্যালাইনের দিকে একবার তাকালো সে। শেষের পথে।
“সুপ্রভাত ইশুপাখি।;
ইশার পানে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে দূর হতেই মনেমনে আওড়ালো শ্রাবণ। স্মিত হেসে এগিয়ে গেলো জানালার দিকে। হাত উঁচিয়ে দু’টো পর্দা সরাতেই একফালি রোদ উপচে পড়লো মেঝেতে। কতক্ষণ গড়াগড়ি খেয়ে ছড়িয়ে যেতে লাগলো সারা ঘরময়। ইশাকেও ছাড়লোনা। অতি দ্রুত গতিতে আলিঙ্গন করলো ইশার কপাল,নাক, ঠোঁট এবং সারা শরীর। চোখের উপর ফকফকা আলো পড়তেই ইশার ঘুমের রেশ পাতলা হতে লাগলো। শ্রাবণ এগিয়ে এলো ইশার দিকে। মাথায় হাত রেখে ডাকতে লাগলো কোমল স্বরে,
বলতে বলতে ইশাকে উঠে বসতে সাহায্য করলো শ্রাবণ। ওয়াশরুম থেকে পানি আর ব্রাশ এনে রাখলো ইশার সামনে। ইশা একহাতে মুখ ধুয়ে আস্তে ধীরে ব্রাশ করে নিলো। ততক্ষণে শ্রাবণ বক্স খুলে খাবারগুলো এক এক করে বের করে সাজিয়ে রাখলো। ইশার মুখ ধোঁয়া হলে সেগুলো পূণরায় রেখে এলো ওয়াশরুমে। সেই সাথে নিজেও ফ্রেশ হলো। চোখেমুখে পানি দিয়ে এসে খাবার গুলো ইশার সামনে রাখলো।
খাবার দেখে ইশার মুখ খানা চুপসে গেলো। এখানে সব পাতলা আর ঝোল ঝোল খাবার। দু’তিন পদের স্যুপ আছে তবে সেটাও ঝালনুন হীন! এই খাবার কি মানুষ খায়?
ইশাকে নাকমুখ কোঁচকাতে দেখে শ্রাবণ বলে উঠলো,
“কোনো লাভ নেই। ডক্টর বলেছেন টানা একমাস এভাবেই রুটিন মেনে খাবার খেতে হবে। কোনটা থেকে শুরু করবি বল?;
” আমি খাবোনা।;
“না খেলে কবরে পাঠাবো। কোনটা আগে ঝটপট চুজ কর!;
শ্রাবণের শান্ত স্বরের খাটাস মার্কা হু*মকিতে ইশার মুখ কাচুমাচু হয়ে গেলো। এই টুকু অপরাধের জন্য সে কবরে যেতে চায়না। তাই ভালোয় ভালোয় আঙুল তাক করলো প্রথম বক্সটার পানে। স্যুপ রয়েছে তাতে। শ্রাবণ নীরব চাহনিতে বক্সটা তুলে চামচ নিয়ে ইশার মুখের সামনে ধরলো। ইশার ভেতর থেকে বমি আসছে এসব খাবার দেখে। কোথায় ওর পছন্দের ঝাল ঝাল খাবার আর কোথায় এই নিরামিষ খাবার। এসব মুখে রোচে নাকি?
” হা কর।;
ইশা হা করলো। শ্রাবণ গম্ভীর থেকে খাওয়াতে শুরু করলো ওকে।
মরিয়ম বিবির খাবার সবে শেষ হলো। দুটো পরোটা খেয়েই হাত ধুয়ে উঠে গেলেন তিনি। মেয়ের কেবিনে যাবেন। তাড়াহুড়ো করে নাকেমুখে খেয়েছেন। তিনি কেবিন থেকে বের হতেই আঁড়চোখে আরবের দিকে তাকালো নামিরা। আরব যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলো। মনি বের হতেই তেড়েমেড়ে গেলো নামিরার পানে। নামিরা তৈরি হচ্ছে উঠে দৌড়ে পালাবে। তবে সেই সুযোগ আর হলোনা। আরবের বাহুডোরে বন্দী পরতে হলো তাকে।
“এটা কিন্তু মোটেই ভালো হচ্ছে না আরব। আমি কিন্তু চিৎকার করবো!;
আরব ঠোঁটের কোনে দুষ্টু হাসি এঁটে বলল,
“মনির জন্য এতক্ষণ রেহাই পেলেও এখন কোথায় পালাবে?;
“কেউ এসে পড়বে! আন্টি এসে পড়লে কিন্তু খুব খারাপ হবে। আমি লজ্জায় কাউকে মুখ দেখাতে পারবোনা!;
“দরকার নাই। শুধু আমাকে মুখ দেখালেই চলবে।;
“আপনি কিন্তু বড্ড নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছেন।;
“আচ্ছা? তাই নাকি! তা একটু নির্লজ্জপনা দেখাবো নাকি হু?;
নামিরা আঁতকে উঠলো। অস্থির হয়ে উঠলো আরবের থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য। সুযোগে দুটো বসালো আরবের কাঁধে। আরব তাতেও টললো না। শব্দ করে হেসে উঠলো।
“ছাড়ুন না!;
“তখন কি বলেছিলাম?;
“কি?;
“ভালোবাসি বলো!;
“বলবোনা।;
“এরজন্যই শা*স্তি।;
“উফফ!;
“এই আরব? আমার ফোনটা কি তোর কাছে?;
দরজার কাছ থেকে ভেসে এলো মরিয়ম বিবির গলা। ভ*য়ে আতংকে দু’জন ছিটকে পড়লো দু’দিকে। মরিয়ম বিবি হন্তদন্ত ভেতরে ঢুকলেন। বেডে, সোফায় একবার নজর বুলিয়ে আরবের দিকে তাকালেন। আরব রীতিমতো স্ট্যাচু হয়ে আছে। যা দেখে মরিয়ম বিবি ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।
” কি হয়েছে তোর?;
আরবকে করা প্রশ্নে নামিরারও হুঁশ ফিরলো। নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে ওর ব্যাগের পাশ থেকে মরিয়ম বিবির ফোনটা হাতড়ে উঠালো। মরিয়ম বিবির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার ফোন আমার কাছে ছিলো আন্টি।;
আরবের থেকে মনোযোগ সরে গেলো মরিয়ম বিবির। নামিরার কাছে নিজের ফোনের সন্ধান পেয়ে খুশি মনে আবার চলে গেলেন। আরব যথা স্থানে দাঁড়িয়ে কোমর বেঁকিয়ে মরিয়ম বিবির যাওয়া দেখলো। সামনের কেবিনে ঢুকে পড়েছে সে। এবার সে সোজা হলো। নামিরার দিকে তাকিয়ে বুকে হাত চেপে বড় করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলল,
“বাঁচলাম।;
“জি না। বলুন, বাঁচালাম।;
আরব মশা তাড়ানোর ভাব করে বসে পড়লো বেডে। চোরা চাহনিতে নামিরার পানে তাকিয়ে বলল,
“ভালোবাসি কিন্তু বললেনা।;
নামিরা ক্ষেপা চোখে তাকালো। আরব শব্দ করে হেসে উঠলো নামিরার এই চাহনি দেখে।
গুনে গুনে তিনচামচও খেতে পারলোনা ইশা। মুহুর্তেই নাকমুখ কুঁচকে বমি করতে লাগলো। মরিয়ম বিবি হন্যে হয়ে ছুটে গেলেন বালতি আনতে। ততক্ষণে ফ্লোর ভিজে উঠলো। শ্রাবণ অসহায় নেত্রে ইশার কপাল চেপে ধরলো। ইশা কাঁপা কাঁপা হাতটা ঠেকালো শ্রাবণের হাতে। নাড়িভুড়ি সব বের হয়ে এসেছে বলে মনে হচ্ছে ইশার। কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। এই সমস্যাটা দু’দিন ধরেই চলে আসছে। কিছু পেটে পড়লেই মুখ উল্টে বমি। এর কারন অবশ্য বলেছেন ডক্টররা। পেটে বি-ষ দ্রব্য পরার কারনে হচ্ছে এমনটা।
শ্রাবণকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসে ইশা। লেবুটা নিয়ে মায়ের কথা মতো গন্ধ শুঁকে। শ্রাবণ খাবার গুলোর দিকে অসহায় দৃষ্টি মেলে দেখে একবার। একটা খাবারও খেতে পারলোনা। ভাবতেই কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার। তুর্জকে মে/রে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কেন যে মা*র*লো না তখনই!
তুর্জকে পুলিশ দিয়ে এরেস্ট করিয়েছেন খান সাহেব। বড় দাপটি লোক হওয়ায় ভালো মতো সাজা লিখিয়েছেন পুলিশ স্টেশনে। খান সাহেবের হুকুমে তুর্জ এখন জেলে। কাল তার কেস কোর্টে তোলা হবে। কম করে হলেও দশ বছরের সাজা তো নিশ্চিত।
শ্রাবণ ডক্টরের সাথে কথা বলবে বলে চলে গেলো। আবরও গেলো তার সাথে। নামিরা আসলো ইশার কাছে। পাশে বসে স্নেহ করে একটু আধটু খাওয়ানোর চেষ্টা করলো মরিয়ম বিবির সাথে।
_______
আফিয়া বেগম হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন। শমসের সাহেব ডেকেছেন গলা চড়িয়ে। অফিস যাবে অথচ ফাইল খুঁজে পাচ্ছে না। ইম্পরট্যান্ট ফাইল। কাল রাতে আগেভাগেই বের করে রেখেছিলেন। আফিয়া বেগম গুছিয়ে আবার কোথায় তুলে রেখেছেন কে জানে?
বিরক্ত গলায় শুধালেন শমসের সাহেব। আফিয়া বেগম মনে করার চেষ্টা করলেন তার স্বামী ঠিক কোন ফাইলেন কথা বলছেন। হ্যাঁ মনে পড়েছে। কপালে হাত চেপে বললেন,
“ওটা তো আলমারিতে তুলে রাখলাম সকালে তোমার সামনে। তখন তো জানতেও চাইলাম, ফাইলটা কি তুলে রাখবো কিনা? তুমি যে ‘হু’ বললে?;
আশ্চর্যান্বিত শমসের সাহেব। তিনি কখন কোন ফাইল তুলে রাখার জন্য ‘হু’ বলেছিলেন? মনে পড়লোনা। আফিয়া বেগম আলমারি খুলে ফাইলটা বের করে স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে বললেন,
“আজকাল বড্ড অন্যমনস্ক থাকো। কি ব্যাপার? অফিসে কাজের চাপ কি একটু বেশি?;
ফাইলটা পেয়ে আবার অন্যমনস্ক হয়ে যান শমসের সাহেব। বিবির কথা ঢুকলো না মাথায়। আফিয়া বেগম চেয়ে রইললেন। জবাব না পেয়ে তিনিও আর এই প্রসঙ্গে কিছু বললেন না। কথা ঘোরালেন। মনের মধ্যে দু’দিন ধরে একটা কথা ঘুরছে। স্বামীর সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করতে চান। কিন্তু পারছেন না।
“শ্রাবণের জন্য একটা ভালো মেয়ের খোঁজ পেয়েছি। নাম নিলাশা। বাবার বন্ধুর নাতনি। দেখতে শুনতে মন্দ নয়। লক্ষিমন্ত মেয়ে। প্রানবন্ত, হাসিখুশি। ঘরের সব কাজ জানে। মানুষের সাথে বেশ অমায়িক। আমাদের শ্রাবণ যেমন ওর জন্য একদম পার্ফেক্ট হবে বলেই মনে হচ্ছে। দাঁড়াও তোমাকে ছবি দেখাচ্ছি।;
বলতে বলতে পকেট হাতড়ে ফোন বের করলেন শমসের সাহেব। এতক্ষণ বলতে না পারা কথা গুলো বলার উৎসাহটুকু নিমিষেই বিলীন হয়ে গেলো আফিয়া বেগমের। স্বামীর কথায় স্তব্ধ তিনি। শ্রাবণের জন্য পাত্রী ঠিক করলো নাকি? কিন্তু তার ছেলে যে…
আফিয়া বেগমের ভাবনাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিলেন শমসের সাহেব। চোখের সামনে তুলে ধরলেন ফুটফুটে হাস্যজ্বল একটি মেয়ের ছবি। সাধারণ মেয়ে বললে ভুল হবে। এতো যেন কোনো অপ্সরা। কিছু বলতে পারলেন না আফিয়া বেগম। শমসের সাহেব উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্ত্রীর মুখপানে। যেন তার মুখ থেকে মেয়েটার প্রশংসা না শুনে তিনি যাবেন না।
মুচকি হেসে ফাইল নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন শমসের সাহেব। আফিয়া বেগম আর কিছু বলার দুঃসাহস করলেন না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলেন।
_______
ইশা বাড়ি যেতে চায়। তার এই আবদ্ধ পরিবেশে দম বন্ধ লাগে। বাড়ি গেলে সবাইকে চোখের সামনে দেখলেও যেন শান্তি। তাই পরদিনই রিলিজ নিয়ে বাড়ি ফিরলো ইশা। ডক্টর একটা রুটিন চার্ট দিলেন। সেই অনুযায়ী ইশাকে দেখভাল করতে হবে। চার্টটা হাতে নিয়ে সবাই এক এক করে মুখস্থ করলো। একজন যদি ভুলে যায় তবে অন্যজন যেন সময় মতো সবটা করতে পারে। এই নিয়ে একচোট গবেষণাও হলো। বাড়ির সবাই খুব খুশি ইশাকে পেয়ে। তুতুনের আনন্দ সবার উর্ধ্বে। তার মেজআপাকে পেয়ে বাড়ি মাথায় তুলে নাচছে সে। ইশাকে বাড়ি আনতে তিতিরও চলে এলো শশুর বাড়ি থেকে। শাকিল ওকে দিয়ে চলে গেছে অফিসে। বলেছে রাতে ফিরবে।
ভাইবোনরা সবাই মিলে ইশার ঘরে আড্ডায় বসলো। আজকে সকলের স্কুল-কলেজ-ক্যাম্পাস থাকলেও ইশাকে ছেড়ে এক পাও নড়েনি কেউ। আজকের দিনটা শুধু ইশার জন্য। স্কুল কলেজ আবার কাল থেকে।
“চল লুডু খেলি।; বলল তিতির।
আরব নাকচ করে বলল,
“মেয়েদের খেলা। আমি একা ছেলে মানুষ কি করবো?;
“তুই চেয়ে দেখ ভাইয়া।; বলে মুখ টিপে হাসলো তানি।
তুতুন খিলখিল করে হেসে উঠে বলল,
“ভাইয়া তুমি আর আমি পুতুল খেলি চলো। তুমি হবে আমার পুতুল বউয়ের শাশুড়ী। জল্লাদ শাশুড়ী।;
তুতুনের কথায় আরবের ইজ্জতের দফারফা। নামিরা মুখ টিপে হাসছে ওদের কথা শুনে। আরব নামিরাকে আঁড়চোখে দেখে নিজের ইজ্জত ধরে রাখার তাগিদে বলল,
“তোর পুতুল বউয়ের জল্লাদ শাশুড়ী কেন হতে যাবো! আমাকে দেখে কি তোর মেয়ে বলে মনে হয়? তাও নাকি জল্লাদ!;
রসালো গলায় শ্রাবণকে ডাকলো নামিরা। ইশা আঁতকে উঠে নামিরার হাত চেপে ধরলো। করুন তার চাহনি। যেন এক্ষনি নামিরার পায়ে পরে যাবে ওকে চুপ করানোর দায়ে। নামিরা বাঁকা হাসলো। লতার থেকের ওর কফিটা নিতে অগ্রসর হয়ে একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখালো ইশাকে। পরক্ষণেই আবারও বলে উঠলো,
“স্পেশাল নাকি?;
শ্রাবণ ফ্লাক্স থেকে কফি ঢালছিলো। সবার জন্য নয়, কেবল ইশার জন্য। নামিরার কথাটা শুনে মুচকি হাসলো। মাথা দুলিয়ে ধীর গলায় বলল,
“ইয়েস, ফর স্পেশাল পারসন।;
নামিরা দুষ্ট হাসে। শ্রাবণের কথাটা অবশ্য নামিরা বাদে কেউ শোনেনি। ইশা অসহায় চোখে দু’জনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। এরা এতো আস্তে করে কি বলছে? ইশার সব গোপন তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছে না তো বেয়াদবটা।
“হাউ লাকি শী ইজ।;
শ্রাবণের ন্যায় বলল নামিরা। শ্রাবণ পূর্বের ন্যায় ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসির রেখা টেনে রাখলো। ফের হাতে কফির মগটা তুলে এগিয়ে গেলো ইশার কাছে। ইশা তটস্থ হয়ে রইলো। কোনো নড়াচড়া নেই তার। যেন নড়লেও শ্রাবণ ধরে ফেলবে তার করা পাগলামি গুলো। নিজেকে এখন চোর চোর অনুভূতি হচ্ছে ইশার।
“এমন উশখুশ করছিস কেন? কি হয়েছে?;
কফিটা এগিয়ে দিলো ইশার পানে। ইশা অন্যমনস্ক হয়ে উশখুশ করছে। যেটা চোখে পড়তেই বলে উঠলো শ্রাবণ। ইশা চকিতে তাকালো শ্রাবণের পানে। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলে উঠলো,
“কই, কিছুনা তো!;
এই বলে কফিটা নিতে গেলেই কফিটা সরিয়ে নিলো শ্রাবণ। সন্দিহান দৃষ্টিতে চেয়ে থেকেই বলল,
“কি? কি লুকাচ্ছিস?;
ইশা পড়লো ফান্দে। কি বলবে এখন? কি লুকাচ্ছে ও?
“ক্ কফি খাবো।;
শ্রাবণ বেশি ঘাটালো না ইশাকে। কফিটা দিয়ে এপাশে এসে বসলো। ইশার একবার ইচ্ছে করলো নামিরার মাথায় বারি দিয়ে ওকে অজ্ঞান করে দিতে। ফাজিলটার জন্য মসিবতে পরতে পরতে বেঁচে গেলো।
কফি আর ভুট্টা ভাজা খেতে খেতে আড্ডা জমলো জমজমাট। আড্ডার মাঝেই চোখাচোখি হচ্ছিলো চারজন প্রেমিক জুগলের। চোরা নজর, আর লজ্জা মিশ্রিত হাসি সর্বক্ষণই লুকিয়ে যাচ্ছে ইশা আর নামিরা। ওদিকে তিতিরও রয়েছে ওদের মাঝে। যদিও তার জুগল তার কাছে নেই, তবে দূরেও নেই। অফিসে বসে সারাক্ষণই চ্যাটিং চলছে দু’জনের। এতে তিতির যতক্ষণ বাড়িতে থাকে, তার মোটেও নিজেকে একা বলে মনে হয়না। মনে হয় এই তো মানুষটা সঙ্গে রয়েছে।
______
রাতে বেশ দেরী করে বাসায় ফিরলেন শমসের সাহেব এবং সাদ্দাত সাহেব। আজকে নিলাশাকে দেখতে গিয়েছিলেন অফিস শেষে। সাদ্দাত সাহেবকেও সঙ্গে নিয়ে গেছেন শমসের সাহেব। মেয়েটা নিতান্তই ভদ্র-সভ্য ও শান্ত। তাদের পরিবার যেমন ঠিক তেমনই নিলাশাদের পরিবারও। চাঁদের টুকরো পছন্দ করেছেন তিনি ছেলের জন্য। ছেলেটা খুব সুখে থাকবে।
ঘরে ঢুকতেই রোজকারের মতো চেঞ্জ করার জন্য তার জামাকাপড় বের করে রাখলেন আফিয়া বেগম। শমসের সাহেব তাড়া দিয়ে ওয়াশরুমে যেতে যেতে বললেন,
“বাবা কি ঘুমিয়েছেন?;
জবাব দিলেন আফিয়া বেগম,
“না। ব্যবসায়িক আলোচনা জুড়েছে নাতিদের সাথে। ঘুমোবে বলল।;
“বেশ বেশ। তুমি বরং সবার জন্য কফি করো। নিলাশার ব্যাপারে তোমার পুত্রকে এখনি জানিয়ে রাখি। পরে ওর জন্য যেন সবটা ইজি হয়।;
ওয়াশরুমের দরজা লক করার শব্দ হলো। বিরক্তি এবং টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছি আফিয়া বেগমের। তিনি খুব ভালো করেই জানেন, তার ছেলে অন্য কোনো মেয়ের নাম শুনলেই অদ্ভুত ভাবে রিয়াক্ট করবে। কারন ও তো ইশাকে ভালোবাসে।
বাবার ঘরে উপস্থিত হলেন শমসের সাহেব। ততক্ষণে অফিসের কল পেয়ে চলে গেছে শ্রাবণ। চলে গেছে আরবও। খান সাহেব টিভি ছেড়েছেন। দেশের খবরটা দেখে ঘুমোতে যাওয়ার ইচ্ছে। আনোয়ারা বেগম স্বামীর সঙ্গে টুকটাক কথা বলার মাঝে পান চিবোচ্ছেন।
“বাবা আসবো?;
“এসো এসো। কি ব্যাপার এতো রাতে? কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?;
শমসের সাহেব ভেতরে আসলেন। খান সাহেব বসতে ইশারা করলেন। শমসের সাহেব বসে মাকে একবার দেখলেন। অতঃপর আশেপাশে দেখে বললেন,
“আপনার নাতিরা চলে গেছে?;
“হ্যাঁ চলে গেলো তো। শ্রাবণের কল এলো আর আরবের পড়া বাকি। এই বলে সবাই গেলো।;
“যাক। বাবা বলছিলাম যে আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।;
“হ্যাঁ হ্যাঁ বলো।;
ঠিক তখনই আফিয়া বেগম কফি নিয়ে প্রবেশ করলেন রুমে। স্বামীকে আর শশুরকে কফি দিয়ে তিনি চলে যেতে চাইলে শমসের সাহেব তাকে আটকান। ছেলের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলবেন সেখানে ছেলের মা না থাকলে কি হয়?
“তুমিও বসোনা।;
আফিয়া বেগম কোনোরূপ দ্বিমত না করে বসে পরলেন। কফিতে চুমুক বসালেন শমসের সাহেব। কয়েক লহমা বিলম্ব করে অতঃপর শুরু করলেন কথা,
“বাবা আজ নিলাশাকে দেখে এলাম একদম বাসায় গিয়ে। খুবই লক্ষিমন্ত আর আদুরে একটা মেয়ে। তার আচার-আচরণ এতো সুন্দর যে বলে প্রকাশ করতে পারবোনা। সাদ্দাতকে সঙ্গে নিয়েছিলাম। ওরও ভীষণ পছন্দ হয়েছে ওকে। আঙ্কেলের সাথেও কথা বললাম। আঙ্কেল মানে আপনার বন্ধু খোরশেদ সাহেব। তিনি বললেন একদিন সবাই মিলে তার নাতনিকে দেখতে যেতে। সবাই বসে আলোচনা করতে। ছেলে-মেয়েদের একে অপরকে পছন্দ হলে তিনি অতি জলদি নাতনিকে তুলে দিবেন।;
“বেশ বেশ। তাহলে সবাই মিলে পাত্রী দেখতে কবে যাবে দিনক্ষণ ঠিক করো।;
“হ্যাঁ বাবা। এই ব্যাপারেই কথা বলতে এলাম। এই শুক্রবার হলে কেমন হয়?;
অস্থির চিত্তে বিছানা ছেড়ে উঠে গেলো নামিরা। ইশার পড়ার টেবিল থেকে একটা খাতা আর কলম নিয়ে এলো।
“ধর, এখানে সুন্দর করে লিখে দে, এই রাত ২টা বাজে তুই ছাদে যাওয়ার জন্য জেদ ধরেছিস। আর এর জন্য শ্রাবণ ভাই যদি কাউকে মা*র্ডা*র করে এর সব দায় কেবল তোর। নে নে, ধর।;
ইশা প্রথমে উৎসাহিত থাকলেও শ্রাবণের নাম শুনতে তার হাসি হাসি মুখের বিলুপ্ত ঘটলো। শ্রাবণ যদি ভুল ক্রমেও তাকে এতো রাতে ছাদে উঠতে দেখে, নিশ্চয়ই বকবে। মা/রতেও পারে।
“তোমার হিরো যে পরিমাণ তারকাটা, আমি জানিনা সে এর শা/স্তি হিসেবে আমাদের মে*রেও ফেলতে পারে।;
নামিরার কথায় যুক্তি একশভাগ প্রমানিত। ঐ গম্ভীর মানুষটা সব করতে পারে।
“প্লিজ এমন করিসনা আমার সাথে! আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে যাবো আর লুকিয়ে লুকিয়ে চলে আসবো।;
“ইশুরে, তুই কিন্তু আমাকে তোর বাসাতেও থাকতে দিবিনা বলে দিলাম।;
“প্লিজ নামু। প্লিজ?;
ইশা ভং ধরলো বাচ্চাদের মতো করে। চোখ দুটো ছোট ছোট করে অসহায় মুখে বলল কথাটা। নামিরার বড্ড মায়া হলো ওর এই মুখ দেখে। কিন্তু মাঝেমাঝে সব মায়ার বাটন কাজ করতে নেই। সে কথা ভুলে গেলো নামিরা। মায়া করে ইশাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো। তারপর সবার চোখের আড়ালে চোরের মতো ছাদে নিয়ে এলো ইশাকে। ছাদে উঠতেই হাড় কাঁপিয়ে উঠলো ঠান্ডা বাতাসে। ইশা নামিরার হাত খামচে ধরে অসহায় গলায় বলল,
“এতো ঠান্ডা কেন রে?;
ইশার পরনে কেবল একটা টি-শার্ট আর প্লাজু। সব দিক থেকেই ঠান্ডা লাগছে শরীরে। ওড়নাটা নিয়ে এলে জড়িয়ে থাকা যেত। এখন যে সেই উপায়ও নেই।
“একদম ঠিক হয়েছে। আগেই বলেছিলাম।;
নামিরার কথার প্রতিত্তোরে ভাব নিলো ইশা। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
দাঁতে দাঁত চেপে চাপা ক্ষো*ভে ফেটে পরলো শ্রাবণ। ইশা আঁতকে উঠে পূণরায় চোখ জোড়া খিঁচে বন্ধ করে নিলো। কি বলবে এখন এর প্রতিত্তোরে? কোনো জবাব যে নেই ওর কাছে।
“কি হলো, এখন মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না কেন?;
ধমকে উঠলো শ্রাবণ। ইশা চমকে উঠে দু’হাতে শক্ত করে চেপে ধরলো রেলিঙ। এতক্ষণ কিছু মনে না হলেও শ্রাবণের ভ-য়ে এখন মাথা ঘেরাচ্ছে ওর। ভনভন করে ঘুরছে।
ইশার কোনরূপ জবাব না পেয়ে আরও ক্ষেপে গেলো শ্রাবণ। এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে ইশার হাত চেপে ধরলো শক্ত করে। ইশার পরনের টি-শার্টের হাতা কাঁধ থেকে সামান্যই নীচে। যার দরুণ বাকি খোলা হাত টুকু ঠান্ডা বাতাসে বরফ হয়ে উঠেছে পূর্বেই। শ্রাবণ গলার স্বর মুহুর্তেই পাল্টে গেলো। উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
“ঠান্ডায় তো পুরো জমে গেছিস আহাম্মক! হুঁশ জ্ঞান নেই নাকি?;
শ্রাবণের উষ্ণ হাত ইশার বাহু স্পর্শ করতেই কেঁপে উঠলো ইশা। শ্রাবণ কিছু না ভেবেই ইশাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো। ধমক দেওয়ার তীব্র ইচ্ছে জাগলেও ইশার নাজুক মুখ খানা তাকে নরম হতে বাধ্য করলো। গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে ঠান্ডা গলায় বলল,
“ওড়না কই তোর?;
ইশা বোবা চোখে তাকালো শ্রাবণের পানে। পরক্ষণেই নিজের দিকে একবার তাকিয়ে আড়াল হতে চাইলো। কিন্তু শ্রাবণ তাকে শক্ত করে ধরে রাখে। ফলে আর উল্টো ফিরতে পারেনা ইশা। লজ্জায় ভেতরে ভেতরে ম/রে যাচ্ছে সে।
“এটলিস্ট গরম কাপড় তো নিয়ে আসবি! ইডিয়ট একটা।;
চাপা স্বরে ধমক খেলো ইশা। ভয়, লজ্জা, সংকোচে গলায় জড়তা পেঁচিয়ে গেছে তার। শ্রাবণের কোনো কথাতেই কোনো জবাব নেই মুখে।
“ভাইয়া, আপনি!;
পেছন থেকে নামিরার গলায় ভেসে এলো। নামিরার গলা পেয়ে ইশা আর শ্রাবণ দু’জনে একসাথেই পেছন মুড়ে তাকালো। নামিরা শুঁকনো গলায় ঢোক গিললো। কথায় আছেনা, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়?
“জি আমি। এসে আপনাদের অসুবিধায় ফেলে দিয়েছি মনে হচ্ছে!;
নামিরা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,
“আ্ আমি কিছু করিনি ভাইয়া। আপনার ইশুপাখি.. ন্ না মানে ইশা জ্ জোর করলো!;
শ্রাবণ দানবীয় চাহনি দিলো ইশার পানে। অর্থাৎ আজকে ওর জীবন শেষ। একদম ফিনিশড। নামিরার হাতে চাদর দেখে শ্রাবণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“যাক কারোর তো এটলিস্ট কমন সেন্স আছে। (নামিরার দিকে তাকিয়ে) চাদরটা কি এই মহারানীর জন্য?;
“হ্ হ্যাঁ ভাইয়া।;
চাদরটা শ্রাবণের হাতে কোনোরকম তুলে দিয়ে এক দৌড়ে পালালো নামিরা। ইশা ওর দৌড়ে পালানোর দিকে এতিমের মতো চেয়ে আছে। ওর এই মহুর্তে দাঁড়িয়ে একটা গান গাইতে বড্ড ইচ্ছে করছে, ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে!;
দৌড়ে সিঁড়ি থেকে নামতেই এক জোড়া হাত বাহুডোরে পেঁচিয়ে নিলো নামিরাকে। ছাদ,সিঁড়ি এবং ইশার রুম এই পুরো এরিয়াটা অন্ধকার এবং নিস্তব্ধতায় নিমজ্জিত হয়ে আছে। অবশ্য এই আহাম্মক মার্কা বুদ্ধিটা তার মগজ থেকেই নিসৃত হয়েছিলো। যার ফল এখন সে ভোগ করবে বলে মনে হচ্ছে।
ঘটনার আকস্মিকতায় নামিরার মনে ভয়াবহ আতংক সৃষ্টি হলো। যার দরুণ হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে নামিরা গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠতে নিলো সাহায্যের আশায়। এতো রাতে, এভাবে করে কোনো মানুষ তাকে ধরতে পারেনা! এ নিশ্চিয়ই কোনো অতৃপ্ত আত্মার কাজ, যে কিনা তার অতৃপ্ত বাসনাকে তৃপ্ত করতে এসেছে।
“শশশ, ডোন্ট শাউট!;
নামিরার মুখে কেউ শক্ত করে হাত চেপে রেখেছে। নামিরা নিঃশ্বাস নিতে পারছেনা। বড়বড় চোখে সামনে থাকা ব্যক্তিটির পানে তাকালো। না এ কোনো অতৃপ্ত বাসনা বহনকারী আত্মা নয়! এ স্বয়ং তার প্রেমিক পুরুষ।
নিঃশ্বাস নিতে না পারলেও মুখে বলতে পারলোনা নামিরা। হাতপা ছোড়াছুড়ি করে মুখ থেকে আরবের হাতটা সরিয়ে তেতে উঠে বলল,
“আপনি কি মানুষ?;
“চিৎকার করলে এখনই ম/রে ভূত হয়ে যেতাম। সরি!;
বলতে বলতে কানে হাত নিলো আরব। নামিরা বড় বড় দম ফেলতে ফেলতে বলল,
“হয়েছে হয়েছে। আপনি এখানে কি করছেন? এতো রাত হলো এখনও ঘুমোচ্ছেন না কেন?;
“তোমাকে এক পলক না দেখে ম*রেও শান্তি পাচ্ছিলাম না। তাই এপাশ-ওপাশ করে উঠে এলাম।;
বলতে বলতে আলতো স্পর্শে নমািরার কোমরে হাত রাখলো আরব। নামিরা কেঁপে উঠে আরবের বুকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,
“কেউ দেখে ফেলবে!;
ধাক্কা খেলেও আরবকে নড়াতে পারলোনা নামিরা। আরব বাঁকা হেসে আরও শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরলো নামিরাকে। আরেকটু কাছে এলো সে নামিরার। এতোটা কাছে যে দু’জনের নিঃশ্বাস দু’জনের উপরই ভারী হতে লাগলো।
“মিস করছিলাম!;
নামিরা এতক্ষণ ছোটাছুটি করতে চাইলেও আরবের গভীর ছোঁয়া তাকে নাজুক করে তুললো। চেয়েও ধমকের সহিত কিংবা রাগী গলায় কিছু বলতে পারলোনা।
“না পরতে পারার কি আছে? আমার অসুবিধা হচ্ছে না। তাই এভাবে নিলাম।;
“অনুভূতি শক্তিও আছে নাকি তোর? গ্রেট!;
বলেই জোরপূর্বক চাদরটা দিয়ে ইশার পুরো শরীর জড়িয়ে দিলো। ইশা কতক্ষণ হতভম্বের ন্যায় চেয়ে থেকে আনমনে হাসলো। কিন্তু শ্রাবণ এখনও বেশ সিরিয়াস হয়ে আছে। গম্ভীর মুখশ্রী ইশাকে বারবার ঠেলছে তার পানে। গাল টেনে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, ‘বাবু,এতো ক্ষেপে আছো কেন?’
পরক্ষণেই নিজের দুঃসাহসের বলি চড়িয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। মিনিট পাঁচেক এভাবেই ব্যয় হয়ে গেলো। কারোর মুখে কোনো কথা নেই। ইশা উশখুশ করছে। শ্রাবণ ওর গা ঘেঁসে রেলিঙে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শ্রাবণের কাঁধ এসে ঠেকেছে ইশার কপাল বরাবর।
ঠান্ডা বাতাসে চোখ জ্বলছে ইশার। ফলে চোখের কোনে জল জমেছে। কিন্তু তারপরও এই মেয়ের কোনো হেলদোল নেই। ইচ্ছে করছে রাম ধমক দিতে। তবে নেহাতই ওর অসুস্থতার জন্য পার পেয়ে যাচ্ছে।
“দেখোনা ছুঁয়ে।;
আবদার করা গলা ইশার। শ্রাবণ বিনা বাক্যে ইশার হাত দু’টো ধরে ক্ষীণ স্বরে বলল,
“হ্যাঁ, একদম ঠান্ডা নয়। তারপরও, এখানে আর থাকা চলবেনা।;
“প্লিজ আর পাঁচ মিনিট।;
“নো মোর ওয়ান সেকেন্ড। গট ইট?;
ইশা চুপ হয়ে গেলো। তর্ক করলে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারবেনা। উল্টে মা*র খেয়ে চ্যাপ্টা হতে হবে। সুতরাং এই প্ল্যান বাদ।
শ্রাবণ কিছুটা শান্ত হলো। ইশার হাত ছেড়ে পাশে এসে ওর কাঁধ জড়িয়ে নিলো নিজের বাহুডোরে। ইশা একদম মিইয়ে রয়েছে। একটা টু শব্দ তার মুখ থেকে আসছেনা। শ্রাবণ পা বাড়ায় সামনে। ইশাও পায়ে পা ফেলে শ্রাবণের। গুণেগুণে হাঁটছে তারা। শ্রাবণ বারবার ইশার পায়ের দিকে লক্ষ করছে। ইশা ঠিকঠাক ভাবে হাঁটতে পারেনা এখনও।
“সাবধানে!;
নিজের হাতে শক্ত করে আগলে রেখেও ভরসা পাচ্ছেনা শ্রাবণ। ইশা মনেমনে হাসলো শ্রাবণের অসন্তোষ মনের কথাতে। ইশাকে হাসতে দেখে গলা খাঁকারি দেয় শ্রাবণ। খানিক গম্ভীর স্বরে বলে,
“হাসার মতো কিছু বলিনি!;
“সেকি, এখন হাসতেও পারবোনা নাকি?;
“না, পারবিনা।;
“এ কিন্তু ভারী অন্যায় শ্রাবণ ভাই!;
কথাটা বলেই শ্রাবণের হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিলো ইশা। শ্রাবণ দাঁড়িয়ে পরলো। অপ্রসন্ন গলায় শুধালো,
“কি সমস্যা তোর? রাতটা কি এখানেই পার করবি!;
” না। আগে আমার কথা শোনো।;
“কি কথা?;
“ভালোবাসো আমায়?;
মাথার উপরে একটা তারা জ্বলে উঠলো। সেই সাথে শ্রাবণের ভেতরটায়ও ছ্যাঁত করে পুড়ে গেলো। তার গম্ভীর মুখশ্রী এখন অবাকের সর্বোচ্চ সীমায় গিয়ে ঠেকেছে। বড় নেত্রজুগলে এক অবিশ্বাস্য চাহনি। সবটাই ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে ইশা পূণরায় বলে উঠলো,
“বাসোনা?;
“না বাসিনা!;
ইশা প্রশ্ন করে ফিরতে পারলোনা, সঙ্গে সঙ্গে শ্রাবণের জবাব। ইশার দুষ্টুমি ভরা হাসিটা উধাও হয়ে গেলো। শ্রাবণ অবাক হলেও সে হলো আহত। আহত নেত্রজুগল জ্বলে উঠলো।
“ম্ মানে?;
“মানে পরিষ্কার। শুনিস নি?;
“ন্ না..;
“ও শুনিস নি? তাহলে আবার শোন?;
ইশা হোঁচট খেলো। ওর বুকের ভেতর কেউ ক্রমাগত ছুরিঘা-ত করে গেলো মাত্র এক সেকেন্ডের ব্যবধানে।
“ভালোবাসি না! এবার চল রুমে? অনেক কাহিনী করেছিস!;
এই বলে শ্রাবণ ইশার পানে এগিয়ে আসতে নিলেই তাকে হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দেয় ইশা। নত মস্তিষ্ক ওর। কাঁদছে কি? শ্রাবণের বুকের ভেতর খামচে ধরলো কেউ। প্রশ্নটা নিজের মনে উৎপত্তি ঘটতেই চমকে গেলো সে। ইশা কাঁদবে কেন?
“ইশা, কাঁদছিস?;
ইশা দেখাবেনা ওর চোখের জল। মুখ লুকাতে হাতের সাহায্য নিজের মুখ আড়াল করে কোনো রকমে বলল,
“আমি রুমে যাচ্ছি!;
এই বলে অস্থির চিত্তে হাঁটা ধরতেই পা জোড়া ঘোষণা করলো অবস বলে। অমনি কেঁপে উঠলো পায়ের তলা। পরে যেতে লাগলো নীচের দিকে। শ্রাবণ ছুটে এসে ধরলো ওকে। ধমকের সুরে চেঁচিয়ে উঠল,
চারদিন পর। এই চারিদন সবচেয়ে ব্যস্ত সময় কাটলো শ্রাবণের। বিসিএস এর পরীক্ষা ছিলো গতকাল। যেটার দীর্ঘ প্রতীক্ষা ছিলো শ্রাবণের। অবশেষে ক্যাডার হওয়ার স্বপ্নটা পূরণ হওয়ার সময় এসে গেছে তার।
আজ শুক্রবার। নীলাশাকে দেখতে যাওয়ার কথা আজ। বাবার সাথে কথা বলে পাঁচদিন আগেই খোরশেদ সাহেবকে তার নাতনিকে দেখতে যাওয়ার কথা পাকাপাকি করেছিলেন শমসের সাহেব। সকাল থেকেই তিনি ভীষণ প্রফুল্ল মনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সবাইকে তৈরি হতে তাড়া দিচ্ছেন। কাউকে কাউকে কাজে সাহায্য করছেন। যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সব কাজ শেষ করে সবাই মিলে ছেলের হবু বউকে দেখতে যেতে পারে।
শ্রাবণ বাড়িতে নেই। কাল রাতে একটা ইমারজেন্সি কল পেয়ে তাকে ধানমন্ডি যেতে হয়েছে। বাসায় কখন ফিরবে সে কথা কাউকেই জানায়নি। তাই কারোর ভরসা না করে শমসের সাহেব নিজেই কল দিলেন শ্রাবনকে।
“বাসায় কখন ফিরবে?;
“এখনই ফিরতে চেয়েছিলাম। তবে পারবোনা বলে মনে হচ্ছে।;
ওপাশ থেকে গাড়ির শব্দ পাচ্ছেন শমসের সাহেব। এক কান চেপে ছেলের শোনার সুবিধার্থে উচ্চস্বরে বললেন,
“১১টার মধ্যে বাসায় আসতে হবে। এমারজেন্সি আমাদের এক জায়গায় যেতে হবে।;
“বাবা আমার বন্ধু আলিফকে চিনো না? ওর বাবা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পরেছেন। রাত থেকে উনাকে নিয়ে হসপিটালে ছোটাছুটি করছে সবাই! অবস্থা ক্রিটিকাল। এমন সিচুয়েশনে ওকে একা রেখে আমি কিভাবে আসি?;
“ওখানে তুমি ছাড়াও অনেক মানুষ থাকবে বাবা। তোমাকে এতো ভাবতে হবেনা। ১১টার মধ্যে তোমাকে বাসায় দেখতে চাই।;
কল কেটে দিলেন শমসের সাহেব। কারন তিনি জানেন এরপর শ্রাবণ একটা কথা বলবে, সে একটা বলবে! দরকার নেই এতো কথা বাড়ানোর। শুভ কাজে যাওয়ার আগে ছেলের মুডটা খারাপ করবেন না তিনি।
“কি গো, শুনছো?;
গলা উঁচিয়ে আফিয়া বেগমকে ডেকে উঠলেন শমসের সাহেব।
“সবাইকে জলদি জলদি তৈরি হতে বলো।;
বলতে বলতে নিজের রুমে চলে গেলেন শমসের সাহেব। আফিয়া বেগমের হাত থেকে কাঁচের গ্লাসটা পরে কয়েক টুকরো হলো। ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন নুপুর বেগম।
“আপা, কি হলো তোমার?;
শ্রাবণের ব্যস্ততার জন্য তিনি এই বিষয়ে কোনো কথাই বলতে পারেননি ওকে! বড্ড অপরাধ বোধে ভুগছেন তিনি। যেটা ঘটতে চলেছে সেটা হলে কারোরই ভালো হবেনা। বরং তিন তিনটে জীবন নষ্ট হয়ে যাবে।
“মা, ও মা?;
ইশা সুস্থ হয়ে গেছে মোটামুটি। হাঁটতে চলতে এখন আর তোমন অসুবিধা হয়না ওর। শুধু খাওয়াদাওয়াতেই একটু অসুবিধা রয়ে গেছে।আলমারি থেকে শাড়ি বের করছিলেন মরিয়ম বিবি। মেয়ের প্রশ্নে আলমারির দরজা ধরে বাইরে মুখ বের করে বললেন,
“কি হয়েছে?;
“আজকে সবাই মিলে কোথায় যাবো, বলোনা?;
“বলবো। আগে ড্রেস পরে তৈরি হয়ে নে। তারপর বলবো।;
“পরবো, তার আগে তোমাকে বলতে হবে আমরা আজ কোথায় যাচ্ছি?;
“গেলেই জানতে পারবি। রেডি হতে যা এবার।;
“আমাকে এখনই জানতে হবে মা। প্লিজ বলো;
“উফফ, বিরক্ত করিসনা।;
চলে গেলেন মরিয়ম বিবি। ইশা মায়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে শব্দ করে নিঃশ্বাস ছাড়ে। ক’দিন ধরে বাসায় কারোর মতিগতি বোঝা মুসকিল হয়ে যাচ্ছে। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। মাথার কাছ থেকে ফোনটা কুড়িয়ে সময়ে নজর বুলালো। ৯টা বাজে। বড় মামা বলেছে সবাইকে নিয়ে এগারোটার মধ্য বের হবে। মাঝে মাঝে খান বাড়িতে এরকম হুটহাট বেরোনোর ছোটখাটো প্ল্যান হয়েই থাকে। তবে প্রত্যেকবার ইশার মনটা বেশ প্রফুল্ল থাকলেও এবার কোনো অনুভূতিই হচ্ছে না ওর। এর কারণ অবশ্যই শ্রাবণ। কাল তার সমস্ত ব্যস্ততার অন্ত হয়েছে। কিন্তু কোথায় কি, এতোদিন মহারাজকে দেখতে পেলেও কাল রাত থেকে একদমই লাপাত্তা সে।
ইশা বিছানারা উপর থেকে ড্রেসটা নিয়ে চলে গেলো ওয়াশরুমে। গোল্ডেন রঙের উপর পাথরের কাজ করা একটা জামা। সঙ্গে অফ হোয়াইট প্লাজু এবং গোল্ডেন রঙের ওড়না। ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে বের হলো ইশা। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে চুল গুলো আঁচড়ে খোলাই রাখলো। মুখে সামান্য পাউডার আর লিপবাম দিয়ে, গলায় একটা লকেট পরে নিলো। জামার হাতা কব্জি অব্দি। চুরি পরলে উদ্ভট লাগবে ভেবে আর পরলোনা। কানে লকেটের সঙ্গে থাকা দুলটা পরে নিলো।
সবাই রেডি। বাবার আদেশ অমান্য করতে পারেনি শ্রাবণ। তাই ১১টার মধ্যে সেও এসে হাজির হলো। ১২টা বাজতেই খোরশেদ সাহেবদের বাসার উদ্দেশ্যে বের হলো সবাই। এখান থেকে পাঁচ মিনিটের রাস্তা। তাই আর গাড়ি নিলোনা। রিক্সা ডেকে দু’জন দু’জন করে উঠে পড়লো। রিক্সা গিয়ে থামলো খোরশেদ সাহেবের বড় বাড়িটার সামনে। খোরশেদ সাহেব, নিলাশার বাবা আতাউল সাহেব এবং তার মামারা রফিক, সফিক সাহেব আগে থেকে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে তাদের অপেক্ষায়।
খান সাহেব রিক্সা থেকে নামতেই জড়িয়ে ধরলেন খোরশেদ সাহেবকে। আতাউল সাহেব খান সাহেবের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলেন। রফিক এবং সফিক সাহেবও তাই করলেন। ততক্ষণে পেছনে এসে সবাই এক এক করে দাঁড়ালো। খান সাহেব এক এক করে সবার পরিচয় করাতে নিলে স্বভাব সুলভ খোরশেদ সাহেব বকে উঠলেন খান সাহেবকে। সব কথা কি বাইরেই বলবে নাকি?
পুরো ত্রিশ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করে এলেও ইশাদের রিক্সাটা খুঁজে পেলোনা তারা। শ্রাবণের অবস্থা করুন থেকে করুনতম হচ্ছে। তখন যদি রা*গ করে হলেও ইশাকে আঁটকে দিতো, তাহলে এই অপ্রকৃতিস্থ মুহুর্ত কখনোই তৈরি হতোনা। শ্রাবণের এটা ভেবে ভেবে মাথা খারাপ হচ্ছে, তুর্জ ইশাকে নিজের সাথে নিয়ে গেলো অথচ ইশা বাঁধা দিলোনা? পরক্ষণেই তার মনে পড়লো, ইশার হাঁটাচলা কেমন অস্বাভাবিক ছিলো। মনে হচ্ছিলো বারবার ঢলে পড়ছে ও। সেই সুযোকেই কি তুর্জ ওকে ওভাবে করে জড়িয়ে রেখেছিলো? আর ভাবতে পারছেনা শ্রাবণ। তার পায়ের র*ক্ত ছিটকে মাথায় উঠে যাচ্ছে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে কেবল তুর্জকে জানেপ্রানে শেষ করে দেওয়ার ক্ষোভ ভেসে উঠছে। তুর্জ এখনও আন্দাজও করতে পারেনি, কার উপর ওর শকুনের নজর দিয়েছে ও!
“ভাই, ঐ রিক্সাটাই তো ছিলো!;
তন্ময়ের বাইকটা হঠাৎ ব্রেক কসলো। সামনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠলো কথাটা। কথাটা কানে প্রবেশ করা মাত্র বিকট আওয়াজে শ্রাবণও বাইক থামিয়ে দিলো। তার র*ক্ত চক্ষু জোড়া গিয়ে বিঁধে গেলো সেই রিক্সাটার উপর। হিং*স্র গলায় বাকিদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
শ্রাবণের আ*ক্র*ম*না*ত্মক আচরণের ভড়কে গেলো রিক্সাওয়ালা। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেলো ক্ষণেই। কাঁপা কাঁপা হাতে হাত জোর করে বলতে লাগলো,
“স্যার, আ্ আমি কিছু করিনাই! আমারে মা*ইরেননা!;
শ্রাবণ যে নিজের হুঁশে নেই, তা তাকে দেখলেই বোঝা যায়। নামিরা ছুটে এসে দাঁড়ায় ওদের সামনে। শ্রাবণকে শান্ত হতে বলে ওদের চারজনকেও একটু ধৈর্য্য ধরতে বললো। এভাবে কথা বললে, রিক্সাওয়ালা এমনিতেও ওদের কথা বুঝবেনা। নামিরার কথায় সবাই একটু ধীরস্থির হতে চেষ্টা করলো। ওদের আর কথা বলতে না দিয়ে নামিরা ইশার একটা ছবি বের করে রিক্সাওয়ালা দেখিয়ে বলল,
“এক্ষনি কি এই মেয়েটাকে আপনি নিয়ে এসেছেন রিক্সায় করে?;
রিক্সা ওয়ালা ইশার ছবিটা ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো। প্রথম দফায় চিনতে পারলোনা। তবে আন্দাজ করে বলল,
“হ আপা। লগে একটা পোলাও আছিলো!;
সবটা এবার জলের মতো পরিস্কার হয়ে গেলো ওদের কাছে। শ্রাবণ ধৈর্য্য হারা হয়ে উঠলো পূণরায়। রিক্সাওয়ালাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে নিলে রিক্সা ওয়ালা ঘাবড়ে গিয়ে পিছিয়ে পড়ে দু’পা। তা দেখে নামিরা আবারও শ্রাবকে শান্ত থাকার জন্য বলে, পূণরায় রিক্সাওয়ালার কাছে ইশার কথা জানতে চায়।
“আপনি কি বলতে পারবেন, ওরা এখান থেকে ঠিক কোনদিকে গেছে?;
রিক্সা ওয়ালা কাঁপা কাঁপা হাতটা নির্দেশ করে কোথাও। সবাই সেই নির্দেশিত হাতের পানে তাকাতেই যেন চমকে ওঠে আপাদমস্তক। সামনেই একটা কাজী অফিস। তুর্জ ইশাকে নিয়ে কাজী অফিসে কেন গেলো?
তারা আর এক মুহুর্তও দাঁড়ালো না। হন্নে হ’য়ে ছুটে গেলো সেদিক পানে।
কাজীর মাথায় ব*ন্দু*ক ঠেকিয়ে ধরেছে একটা ছেলে। পাশে আরেকটা ছেলে তাকে শক্ত করে চেপে ধরে আছে। তুর্জ আর ইশা ঠিক তার সামনের চেয়ার দু’টোতে বসা। তাদের পেছনে আরও চার জন দাঁড়িয়ে আছে। দু’জনের হাতে বর কনের মালা, দু’জনের হাতে মিষ্টির প্যাকেট। তুর্জ ঠোঁটের কোনে একটা পৈ*শাচিক হাসি একে ইশার পানে তাকালো। ইশা ঢুলছে ঘুমে। বারবার হাত পা নেড়ে কিছু বলার প্রয়াস করছে। তবে বরাবরের মতোই ফলাফল শূন্য। সে না নিজের হুঁশে ফিরতে পারছে, আর না পুরোপুরি ঘুমের রাজ্যে যেতে পারছে। তার সাথে ঘটতে থাকা প্রতিটা মুহুর্ত সে উপলব্ধি করতে পারলেও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা কিংবা প্রতিক্রিয়া করা কোনোটাই সম্ভব হচ্ছে না তার জন্য।
“বউ, ও বউ? শুনতে পাচ্ছো?;
নাকি সুরে বউ বলে ইশাকে ডেকে এক বিশ্রী হাসি হাসলো তুর্জ। ইশা বারবার ঘোলাটে দৃষ্টিতে দেখছে তাকে। ইশা কিছু বলতে পারছেনা দেখে, তুর্জ আরও আনন্দ পাচ্ছে। খেলার আসল মজা তো এখানেই, দেখতে,শুনবে কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া করতে পারবেনা।
“ফাইনালি আমাদের স্বপ্নটা পূরণ হতে চলেছে বউ। দেখো তাকিয়ে, আমরা আমাদের স্বপ্নের খুব কাছাকাছি। দেখোনা বউ।;
ইশার মুখ চেপে ধরে নিজের কাছে টেনে আনলো তুর্জ। ইশা ব্যা*থায় অস্ফুট স্বরে আওয়াজ করলো। তাতে তুর্জর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে নিজের আমোদে আরও মত্ত হয়ে ইশার হাতটা চেপে ধরে খাতার দিকে এগিয়ে নিলো সই করবে বলে। ইশা ভেতরে থেকে তীব্র প্রতিবাদ জানালেও বাইরে থেকে কিছুই করতে পারছেনা। তুর্জ সেই বিশ্রী হাসি হেসে নিজের এক ভ*য়ানক অতীত ফাঁস করলো ইশার কাছে।
ইশার হাতটা খাতার উপর চেপে ধরে ইশার শরীরে একটা বিদঘুটে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আস্তে করে বলে উঠলো,
“কংগ্রাচুলেশনস টু বি মাই সেকেন্ড ওয়াইফ মাই ড্রিম কুইন। ট্রাস্ট মি, তোমাকে দেখার পর আমি আর একদিনও আমার বউয়ের শরীর ছুঁয়ে দেখিনি। তোমাকে ছোঁয়ার তীব্র বাসনা নিয়ে প্রতিটা রাত কতটা কাতরে ম*রে*ছি তোমার কোনো ধারণাই নেই। আজ সেই সব বাসনা পূরণ হতে চলেছে। কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তোমাকে পেতে, তুমি তো জানোনা। এই বউ, বউ? আমাকে কংগ্রাচুলেট করবেনা হু? আহ্ থাক, একবারে বাসর রাতেই করো। ওকে?;
বলেই খিটখিটিয়ে হাসতে লাগলো তুর্জ। ইশার চোখ টলমল করছে। ক্লান্ত চাহনিতে একবার তাকায় তুর্জর পানে। পরক্ষণেই আবার নেতিয়ে পড়ে ক্লান্তির কাছে। তু্র্জ ওর হাতটা আবারও এগিয়ে নিয়ে যায় খাতার কাছে। একটা সই হলেই বিয়ে ফাইনাল। তখন আর কেউ চাইলেও ইশাকে ওর থেকে আলাদা করতে পারবেনা।
“সাইন করো বউ। এই এখানটায়।;
ইশার হাত চলেনা। ওকে হাই পাওয়ারের ঘুমের ঔষধ খাওয়ানো হয়েছে। যার দরুণ নিজের শরীরের ভার নিজের কাছেই অসহনীয় হয়ে উঠেছে।
“আমিও একটা সাইন করে দেই?;
টেবিলের উপর দু’হাতে ভর দিয়ে দাঁড়ালো কেউ। কন্ঠটি বেশ পরিচিত। তুর্জ সন্দিহান চোখে পাশ ফিরে তাকাতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। নিজের জমকে চোখের সামনে দেখে কেউ এতোটা ভয় পায়না, যতটা ভয় তুর্জর শ্রাবণকে দেখে হলো। তবে এই ভয় স্রেফ কয়েক ক্ষণের জন্যই ছিলো তার চোখে। পরক্ষণেই হিং-স্র দৃষ্টিতে তাকাতেই শ্রাবণ গর্জে উঠে এক লাথি দিলো তুর্জর চেয়ারে। লাথি খেয়ে ঝড়ের বেগে চেয়ার ভেঙে পড়ে গেলো তুর্জ। সঙ্গে সঙ্গে তুর্জর লোকগুলো তেড়ে এসে চেপে ধরলো শ্রাবণকে। কিন্তু তাকে আঁটকে রাখা এতো সহজ হলোনা। শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে গা ঝাড়া দিতেই সবগুলো ছিটকে পড়লো খানিক দূরে। ততক্ষণে তুর্জ উঠে দাঁড়িয়েছে। ওর চোখে মুখে এক হিং*স্র*তার ছাপ। এতদিনের লুকিয়ে রাখা হিং*স্র দানবটা যেন এখন মুক্তি পেলো।
“গায়ে ভালো জোর আছে! না না, আজ বুঝিনি। সেদিনই বুঝেছিলাম। আজ সুযোগ পেয়ে কমপ্লিমেন্ট দিলাম।;
তুর্জর গা জ্বলানো কথা শুনে চোয়াল শক্ত করে তাকালো শ্রাবণ। নামিরা ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো ইশাকে। নামিরার সাথে সাথে হৃদয়, রফিক, শাফিন আর তন্ময় এসে জড়ো হয়ে দাঁড়ালো শ্রাবণের পেছনে।
“ইশা, এই ইশা? তুই ঠিকাছিস? ইশার কি হয়েছে? আপনি কি করেছেন ওর সাথে?;
“তোমার বান্ধবী যা ত্যাড়া! অল্প কথায় কাজ হলে তো হতোই!;
বলে সামনের দিকে তাকাতেই এলোপাতাড়ি কয়েকটা ঘুষি পড়লো তুর্জর মুখে। তুর্জকে মা*র*তেই ওর সাঙ্গপাঙ্গরা আবারও উদ্যোত হলো শ্রাবণের কাছে তেড়ে আসতে। তবে এবার আর সফল হলোনা ওদের চারজনের জন্য। যে ছেলেটার হাতে পি*স্ত*ল ছিলো, ওরা চালাকি করে আগে সেটা বাজেয়াপ্ত করলো ওদের থেকে। এবং সফলও হলো। পি*স্ত*ল ওদের কাছে ট্রান্সফার হতে ছেলেগুলো দমে গেলো ভ-য়ে। তন্ময় বাঁকা হেসে বলল,
“তোর প্রথম ভুল ছিলো ইশার জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া, তোর দ্বিতীয় ভুল ছিলো ভালোবাসার নাম করে দিনের পর দিন এই নোংরা চোখ দিয়ে প্রতি মুহুর্তে নোংরা চিন্তাভাবনা করা, আর তোর তৃতীয় ভুল ছিলো ম্যারেড হওয়া স্বত্বেও তোর তীব্র লালসার কাছে হার মেনে ইশাকে বিয়ে করতে চাওয়া! এখানেই শেষ নয়, তবে এখান থেকেই তোর ভুলের শুরু। ইশাকে প্রতিনিয়ত মেন্টাল টর্চার করা, ওকে নিয়ে নোংরা চিন্তা রাখা, ওর গায়ে হাত তোলা আর আজ? আজ তো তোর ভুলের মাত্রাই রইলোনা! তোর সাহস আছে বলতে হবে.. কিন্তু সাহস টা সাহস অব্দি থাকলেই তো ভালো হতো। দুঃসাহস করতে কেন গেলি?;
তুর্জর নাক মুখ ফেটে র*ক্ত পড়ছে জোয়াল দিয়ে। শ্রাবণ ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দৃষ্টিতে একবার তাকায় প্রায় অচেতন হয়ে থাকার ইশার মুখবিবরে। ইশার এই অবস্থা শুধু মাত্র তুর্জর জন্য। কথাটা ভাবতেই আবারও এক হিং**স্র দানব ভর করে শ্রাবণের শরীরে। শুরু হয় আবারও এলোপাতাড়ি মা*র। এতো মা*র সহ্য হলোনা তুর্জর। হা করে র*ক্ত বমি করতে করতে বেহুঁশ হয়ে গেলো। তখন গিয়ে শ্রাবণ ছেড়ে দিলো তুর্জকে।
এদিকে ইশার অবস্থাও করুন। হঠাৎ জ্ঞান হারালো সে। নামিরা চেঁচিয়ে উঠে শ্রাবণকে ডেকে উঠতেই, দৌড়ে যায় শ্রাবণ। দু’হাতে ইশাকে আগলে ধরতে গিয়ে উপলব্ধি করে, ইশার শরীরে র*ক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে সারা শরীর বরফের ন্যায় জমে গেছে। এক্ষনি হসপিটালে না নিলে ভয়ানক কিছু ঘটে যেতে পারে।
হসপিটালের করিডোরে জয়েন ফ্যামিলির এক গাদা মানুষ ভীড় জমিয়েছে। দুপুর পেরিয়ে বিকেল হলো। সূর্য মামা পশ্চিমাকাশে ডুবুডুবু হয়ে আছে। প্রকৃতি শীতের আমেজ ছড়িয়ে দিচ্ছে ক্রমশ। দূরে একটা অতিথি পাখি সুন্দর সুর তুলে ডাকছে। পাশাপাশি তিন সিটের একটা চেয়ারে ওরা তিনবোন মন খারাপ করে বসে আছে। ওদের থেকে একটু দূরে মরিয়ম বিবি আধা অচেতন হয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন। তার যে ঐ একটা মাত্র মেয়ে। আজ কিছু হয়ে গেলে ম*রা*র পর তার স্বামীকে কি জবাব দেবে সে? কিভাবে তার মেয়েটাকে লালনপালন করেছে সে যে আজ এই দশা হলো? এর জবাব তখন কি দিয়ে দিবে সে? আনোয়ারা বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। ভেজা গলায় বললেন,
“ধৈর্য্য ধর মা, আমার ইশার কিছু হবেনা। ধৈর্য্য ধর।;
বার্ধক্যে পৌঁছেও মানুষ চিনতে পারলেননা খান সাহেব। এই অপরাধবোধটাই কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে তাকে। তার যে চামড়ার ভাজে ভাজে দক্ষতা। এতো দক্ষ হয়েও কি লাভ হলো? আজ তার নাতনির এই করুন অবস্থার জন্য যদি কেউ দায়ী হয় তাহলে সেটা একমাত্র সে। আর কেউ না।
সবার থেকে বেশ খানিক দূরত্বে বসে আছেন আফিয়া বেগম। তার পাশেই তার ছেলে। শ্রাবণ অন্যমনস্ক হয়ে দেয়ালে পিঠে ঠেকিয়ে বসে আছে। আফিয়া বেগম ছেলের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রেখে আছেন। আজ তিনি সম্পূর্ণ নিশ্চিত হলেন, তার ইশাকে তার পাগল ছেলেটা কতটা ভালোবাসে। মাকে জড়িয়ে ধরে ইশার জন্য একটা ছোট্ট বাচ্চার মতো কেঁদেছে শ্রাবণ। শ্রাবণের কান্না সবাই দেখেছে! ছেলের কান্নার শব্দ, ছেলের আকুতি সবটা এখনও কানে ভাসছে তার।
ইশাকে কম পাওয়ারি বা অল্প স্বল্প ঘুমের ঔষধ দেয়নি তুর্জ। হাইডোজের বেশ কিছু ঘুমের ঔষধ দিয়েছে ওকে। মুলত একটা জুসের সাথেই তুর্জ তাকে এই ঔষধ গুলো গুলিয়ে দিয়েছিলো। যার ফলে যেকোনো মুহুর্তে ইশার মৃ-ত্যু-র রিস্ক অনেক বেশি বলে জানান ডাক্তাররা। কেউ সু-ই-সা-ইড এ-টে-ম্প করলেও এমন হাই পাওয়ারের ঔষধ খায়না। এই মুহুর্তে ওয়াশ করে সবটা বের না করলে ইশার মৃ*ত্যুু*ও নিশ্চিত হয়ে যাবে।
হসপিটালের একটা ওয়াশরুম থেকে চোখেমুখে পানি দিয়ে বের হলো নামিরা। ইশার অবস্থায় সেও ভেঙে পড়েছে সবার মতো। তবে সবাইকে সামলানোর লোক থাকলেও নামিরাকে সামলানোর কেউ নেই এখানে। ছোট বেলার কথা আজ বড্ড বেশি মনে পরছে নামিরার। বরাবরই বড্ড নরম স্বভাবের মেয়ে ছিলো নামিরা। স্কুল-কলেজে বরাবরই অন্যের হুকুমে ওঠাবসা ছিলো ওর। যে যা বলতো ভীত মনে সবার কাজ করে দিতো। কখনো প্রতিবাদ করার সাহস টুকু অব্দি ছিলোনা। ওর কোনো বন্ধুও ছিলোনা। সবাই ওকে ছোট বড় করে কথা বলতো। ওর বাবা-মায়ের ছিলো ভাঙাচোরা সংসার ছিল। আজ দু’জন একসাথে আছেন তো, কাল কেউ কারো মুখ দেখছেনা৷ পরিবারের কলহ, বাইরের লোকের নিন্দে, ক্লাসমেইটদের হাতে র্যাগিং সব মিলিয়ে একরকম একাকিত্বে পড়ে গিয়েছিলো ও। নামিরার মনে পড়ে সেই দিনটির কথা, একটা মেয়ে ওর টিফিন নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করে। ও প্রথমে দিতে চায়না। তাই মেয়েটা ওর গালে দু’টো চড় মে*রে ওর টিফিনটা ছিনিয়ে নেয়। নামিরা কাঁদতে কাঁদতে মুখ ঢাকে বেঞ্চে। কারন সে জানে, সে প্রতিবাদ করতে পারবেনা। আর সেদিন ওর সারাদিনের খাবার কেবল ঐ টিফিনটাই ছিলো। সব মিলিয়ে বিষন্ন মনে কাঁদতে বসে সে। তবে হঠাৎ ওর কান্না বন্ধ হয়ে যায় এক অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হয়ে। একটা মেয়ে ওর টিফিন কেঁড়ে নেওয়া মেয়েটাকে সজোরে কয়েকটা থাপ্পড় মা*রে এক গাদা স্টুডেন্টদের সামনে। সেই সাথে কড়া গলায় বেশ কয়েকটা হু*মকিও দেয়। ফের নামিরার টিফিনটা ওর থেকে কেঁড়ে নিয়ে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে টিফিনটা নামিরার হাতে দিয়ে চলে যায়।
ঐ মেয়েটাকে বলা কথা গুলো শোনেনি নামিরা। তবে একটু ঠিকই বুঝতে পারে, তার এই ছোট্ট জীবনে এর চেয়ে ভালো ঘটনা আর কিছুই হতে পারেনা। কেউ তার জন্য আরেকজনের সাথে লড়াই করবে এ কথা নামিরা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেতো না।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কান্নারা পূণরায় দলা পাকিয়ে আসে নামিরার কন্ঠনালীতে। না পারছে গিলতে না পারছে ওগরাতে। সেই থেকে প্রতিটা বিপদে নামিরা সবসময় একটা মুখই দেখতো। যদিও এতো কিছুর পরও নামিরা ইশার বেস্ট ফ্রেন্ড হতে পারেনি। ইশার বেস্ট হতে নামিরাকে আরও অনেক কঠিন কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছিলো। আর সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ ছিলো সবাইকে কড়া গলায় না’ বলা। মানুষের সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো, তারা সহজে না বলতে পারেনা। দেখবেন, আপনি যদি খুব সহজেই লোককে না’ বলতে পারেন, তবে আপনার অর্ধেক সমস্যাই জল হয়ে ভেসে যাবে। আমরা ভাবি, তাকে কিভাবে না বলি? ওকে কিভাবে না বলি? না বলা কি এতোই সহজ? দুনিয়াতে কঠিন কিছুই নয়। আর সবচেয়ে সহজই হলো না বলতে পারা। একবার বলে দেখুন, দেখবেন সেই লোকটি আপনাকে আর দ্বিতীয়বারের মতো কিছু বলতে সাহস পাবেনা।
ইশার এই ট্রিকস কাজে লাগে নামিরার জীবনে। সে যেদিন থেকে সবাইকে না বলতে শিখেছে, সেদিন থেকেই ওরা বেস্ট ফ্রেন্ড।
“এখানে একা একা বসে আর কতক্ষণ কাঁদবে?;
একখানা অপ্রত্যাশিত গলা নামিরার কানে বারি খেতেই ওর কান্নায় ভাটা পড়লো। মাথা তুলে সম্মুখে তাকাতেই আরবকে দেখে ভেতরটা কেমন করে উঠলো! চটজলদি চোখ মুছে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে পূণরায় আরবের করুন গলাটি পায়,
আরব অসহায় ভঙ্গিতে হাসলো। নামিরার কথাটা মনে মনে একবার আওড়ে দোষ চালানো গলায় বলল,
“দায়িত্ব এড়াতে তো তুমি ভালোই জানো। সে কথা কি তারা জানে?;
নামিরা চমকে ওঠে। পেছন মুড়ে দাঁড়ায়। কিঞ্চিৎ রাগি গলাতেই বলে,
“আমি মোটেই দায়িত্ব এড়ায়নি। যা হওয়ার নয় আপনি কেন সে কথা নিয়ে পড়ে আছেন?;
“তোমাকে চাওয়াটা কি আমার অপরাধ ছিলো?;
“আপনার আগে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আর ইশা এসব জানলে কি ভাববে বলুন তো? ওর কি মনে হবেনা, আমি ওর পিঠ পিছে এসব করে বেড়াচ্ছি?;
“এসব মানে কিসব? তুমি কিন্তু আমার ভালোবাসাকে অপমান করছো নামিরা।;
“চাইনা অপমান করতে। তাই তো আমি আপনাকে না করে দিয়েছি।;
কন্ঠ রাশভারি হলেও দমে গেলো আরব। বুকের ক্ষ*ততে আবারও কেউ আ*ঘাত করলো যেন। গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“ইশা আমার বোন, ও আমাদের ব্যাপারে কখনোই এসব ভাববেনা।;
“ভাবার কোনো পর্যায়ও তৈরি করতে চাইনা আমি।;
এখানেই কথা শেষ করে আবারও উল্টো ঘুরে গেলো নামিরা। চলে যাবে। তবে এবারও যেতে পারলোনা। পেছন থেকে হাতে টান অনুভব করতেই তার সারা শরীর শিউরে উঠলো। আরব ওর হাত টেনে ধরেছে।
“আমার ভালোবাসার কি কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে।;
নামিরার বড্ড কষ্ট হয় এই মানুষটার জন্য। ভালোবেসে এই মানুষটা যতটা অবহেলা পেয়েছে ওর থেকে, সেটা হাজার ভালোবাসা দিয়েও কখনোও পরিশোধ করতে পারবেনা ও।
“আছে। আর আছে বলেই আমি আপনার কাছে যেতে চাইনা। আপনার ভালোবাসাকে আমি সম্মান করি।;
“আমাকে রেখে পালিয়ে যাওয়ার এই সম্মান আমার চাইনা নামিরা। আমি তোমাকে চাই। তোমার ভালোবাসা, তোমার ছোঁয়া, তোমার অনুভূতি.. আমি গোটা তুমিটাকে চাই। কিভাবে বোঝাই তোমায়?;
“ইউ ডিজার্ভ বেটার আরব। আমার থেকেও…;
বেশ জোরেশোরে শব্দ হলো। আরব তীব্র রা*গে নামিরাকে দেয়ালে ঠেসে ধরলো। দু’পাশ থেকে ওর কাঁধ চেপে ধরে রা*গান্বিত গলায় বলে উঠলো,
“এতো বেটার দিয়ে কি হবে যদি ভালোবাসাটাই না আসে?;
নামিরার দুই কাঁধ আরব চেপে ধরেছে এ কথা ভুল। সত্যিটা হলো খামচে ধরেছে। নামিরা ব্যাথায় চোখ জোড়া খিঁচে বন্ধ করে নিলো। কাতর স্বরে বলল,
“আমার ব্যাথা লাগছে।;
এই কথায় আরবের মনের ঘা যেন আরও বাড়লো। সে অসহায় গলায় বলল,
“আমার মনের ব্যাথা কি তোমার চোখে পড়েনা? এতো স্বার্থপর তুমি!;
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো নামিরা। আর কতভাবে এই মানুষটাকে ও দূরে সরিয়ে রাখবে। আর যে পারছেনা। কোনো ভাবেই পারছেনা।
নামিরার কান্নার বেগ বাড়ে। ও সত্যি সত্যিই শব্দ করে কাঁদতে লাগে। আরব আর পারছেনা ওকে এভাবে দেখতে। তাই এক টানে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো তার ভালোবাসার মানুষটিকে। শক্ত করে আগলে রাখলো, চেপে রাখলো বুকের সাথে। তার শূন্য হৃদয়টা ভরাট হচ্ছে। ক্রমশ ভরাট হচ্ছে পূর্ণতায়।
________
ইশার গলা দিয়ে নল ঢুকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা লাগিয়ে ভেতরের পয়জন গুলো ওয়াশ করেন ডাক্তাররা। মেয়েটা এমনিতেই অর্ধমৃ*ত হয়ে আছে, কিন্তু এই প্রসেসিং এ ওকে যেন বাকিটাও মে-রে ফেললো। মৃ-তের মতো বেডে পরে আছে ইশা। সেন্স নেই ওর। ওয়াশ করার সময় বারবার সেন্স হারিয়েছে। শেষবার যখন জ্ঞান হারালো তখন ডাক্তার নিজেই স্যালাইনের সাথে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে দিলেন। সাথে এও জানিয়ে গেলেন ঘন্টা খানিক পেরোলেই জ্ঞান ফিরবে। ওকে কেবিনে শিফ্ট করা হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। সবাই ওর সাথে দেখা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠতে ডাক্তার মাত্র কয়েকজনকে এলাউ করলো। মরিয়ম বিবি, খান সাহেব এবং শ্রাবণ গেলো কেবিনের ভেতর।
ইশার ফর্সা মুখটা র*ক্তশূণ্য ফ্যাকাসে হয়ে আছে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক, বা হাতে স্যালাইন,এলোমেলো চুল, উষ্ক-শুষ্ক ঠোঁট সব মিলিয়ে যাচ্ছেতাই দশা বলা যায়। মেয়েকে এই অবস্থায় মেনে নিতে পারছেন না মরিয়ম বিবি। দেয়ালে মাথা ঠোকাতে ইচ্ছে করছে তার। মেয়েটা কতটা কষ্ট পাচ্ছে, আর সে মা হয়েও কিছু করতে পারছেনা। এমন মা হয়ে কি লাভ?
খান সাহেব নাতনির করুন দশা দেখে ভেতর থেকে মড়মড় করে ভে*ঙে পড়ছেন। দাঁড়িয়ে থাকাটাও তার জন্য বড্ড কঠিন মনে হচ্ছে। হাতে ধরে রাখা লাঠিটা নড়বড় করছে। যেকোনো মুহুর্তে তিনি পড়ে যেতে পারেন। তার অবস্থা বুঝলো শ্রাবণ। দ্রুত এসে দাদাজানের কাঁধ ধরে ফেললো দু’হাতে। চিন্তান্বিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
“দাদাজান, ঠিকাছো তুমি? শরীর খারাপ করছে?;
খান সাহেব বাচ্চাদের ন্যায় ফুঁপিয়ে উঠলেন। কাঁপা কাঁপা হাতটা তুলে শ্রাবণের কাঁধের উপর নিজের ভর দিলেন। অপরাধী গলায় বারবার কিছু আওড়াতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারছেন না। ভেতরের অপরাধ বোধটা এতোটাই তীব্র হলো যে, তিনি কথাও বলতে পারছেন না। শ্রাবণ তার মনের অবস্থা ঠিক আন্দাজ করতে পারছে। বয়স্ক মানুষটা ভেতর থেকে একটুও ঠিক নেই। উনার কান্না দেখে শ্রাবণের চোখের কোন চিকচিক করে উঠলো নোনাজলে। মরিয়ম বিবি বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। খান সাহেব মেয়ের আলিঙ্গন পেয়ে কেবল ফোঁপাচ্ছেন। শ্রাবণ তাকে শক্ত করে ধরে রেখে বড়দের মতো করে বলল,
“সব ঠিক হয়ে যাবে। এই ঘটনার জন্য তুমি একদম নিজেকে দোষারোপ করবেনা দাদা। যা হওয়ার হয়ে গেছে। হয়তো এটাই আমাদের ভাগ্যে ছিলো।;
“আ্ আমার নাতনিটা, আ..মার ইশা..;
“ও ঠিক হয়ে যাবে দাদা। তুমি এভাবে ভেঙে পড়োনা প্লিজ। তুমি আমাদের সবার মাথার উপরের বটগাছ। তোমাকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখলে, আমরা কিভাবে ঠিক থাকবো? তখন যে সবাই একএক করে ভাঙতে শুরু করবে।;
খান সাহেব নিজেকে সামলে নিলেন। অসহায় চোখে কতক্ষণ ইশার দিকে চেয়ে রইলেন। মনেমনে ওয়াদা করলেন, তিনি তার ইশার সাথে আর কোনো অন্যায় হতে দিবেন না। একদম দিবেন না।
মরিয়ম বিবি বাবাকে নিয়ে বাইরে চলে গেলেন। অসহায় একা দাঁড়িয়ে রইলো শ্রাবণ। অপরাধী চোখ জোড়ায় জলপ্রপাতের ধারা শুরু হয়েছে। ধীর পায়ে এগোতে এগোতে দু’হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে বেডের কাছের ছোট্ট টুলটা টেনে বসলো। ভেরতটায় র*ক্ত ক্ষরণ চলছে। একটু আগে তিতির বলছিলো, গত তিন দিনে ইশা তাকে ১০হাজারের উপর কল করেছে। এমনকি আজ সকালেও! শ্রাবণ সময়ের আন্দাজ করে মেপে দেখলো তুর্জর সাথে ইশার দেখা হওয়ার আগ মুহুর্তেও ইশা তাকেই কল করেছে। আর সে? ওকে ভুল বুঝে যা-তা কান্ড করে ফোন বন্ধ করে রেখেছিলো। এ কথা ভাবতে নিজেকে খু*ন করতে ইচ্ছে করছে শ্রাবণের। আজকে ইশার এই অবস্থার জন্য সে নিজেও কি দায়ী নয়?
বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে তার। না, ভালোবাসার মানুষটাকে মৃ*ত্যুর সাথে লড়তে দেখে নয়, তার নিজের ভুলের জন্য আজ তার ভালোবাসা ম*রতে বসেছে!
শ্রাবণের হাতটা কাঁপছে। সেই কাঁপা হাতেই ইশার ঘুমন্ত হাতটা জড়িয়ে ধরলো। র*ক্ত শীতল হয়ে ইশার শরীর এখনও বেশ ঠান্ডা। ব্যাপারটা বোধগম্য হতে শ্রাবণ চটজলদি ওর হাত ডলতে লাগলো। কতক্ষণ গালে কতক্ষণ বুকে ইশার হাতটা ঠেকাতে লাগলো। পুরুষ মানুষ কত সহজে কাঁদতে পারে? এর ব্যাখ্যা কার কাছে আছে? নাকি এই প্রশ্নটাই ভুল?
“এই ইশা ওঠনা? আর কতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকবি? আর কত জ্বা*লাবি এমন করে? সেই ছোট থেকেই জ্বা*লিয়ে আসছিস! তোকে ভালোবেসে দেখি মহা ফ্যাসাদে পড়ে গেলাম! সুযোগ পেয়ে পেয়ে মাথায় চড়ে গেছিস। মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে খুব শাসন করি, জানিস না বানরকে মাথায় চড়াতে নেই! তুই তো বানরই। (হেসে) কিন্তু পারিনা শাসন করতে। শাসন করতে গেলেই তোর অশ্রুসিক্ত নয়ন জোড়া দেখে আমার ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে পরে। শ্বাসপ্রশ্বাস আঁটকে যায়! কত কষ্ট করে দম নিতে হয় আমাকে। তোর একের পর এক বোকামিতে প্রায় অনেকটা সময় নষ্ট করেছি আমরা। তুইও তো আমাকে খুব ভালোবাসতিস? তাহলে কেন পিছিয়ে পড়লি? ফ্যামিলি মানবেনা বলে? আচ্ছা আমার প্রতি কি তোর একটুও ভরসা ছিলোনা? আমি কি পারতাম না আমাদের ফ্যামিলিকে মানাতে? সব একা একাই ভেবে নিলি। আমাকে কখনোও বুঝতেও দিলিনা এতে তুই নিজেও কতটা গুমরে ম*রেছিস। তুই সত্যিই বড্ড বোকা রে ইশুপাখি, বড্ড বোকা।;
প্রায় ৩০বছর আগের কথা, শ্রাবনের বাবার শমসের সাহেবের একটা প্রেম ছিলো। বাল্যকালের প্রেম। মেয়েটা তাদের পাড়াতেই থাকতো। একসাথে স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয় এবং চাকরীর শুরুটাও দু’জনের একসাথেই হয়েছিলো। প্রায় ১৫বছরের প্রেমের সম্পর্ককে একটা পরিনতি দিতে চাইলেই শুরু হলো বাঁধা। তখন পাড়া,মহল্লা এবং শহর জুড়ে ছিলো খান সাহেবের দাপট। প্রেম জিনিসটা বরাবরই তার অপছন্দের ছিলো। তার দাপটে প্রতিবাদ করার মানুষ ছিলোনা বললেই চলে। মেয়ের বাবা বিয়ের প্রস্তাব দিতে এসে ছেলে-মেয়েদের প্রেমের কথা উল্লেখ করাতে চরম অপমানের স্বীকার হয়ে ফিরে যেতে হয়েছিলো তাকে! সে আর যাই করুক প্রেমের সম্পর্ক মেনে নিবেনা। বাবার এই সিদ্ধান্ত ভেঙে পড়েন শমসের সাহেব! একদিকে প্রেমিকা একদিকে বাবা, কাকে ছেড়ে কার কাছে যাবেন তিনি? তবুও তিনি সিদ্ধান্ত নেন প্রেমিকাকেই বেছে নিবেন। কিন্তু পারেন না, সব কিছু ছেড়েছুড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তার বাবার প্রথম হার্ট এট্যাক আসে। বাবাকে নিয়ে হন্নে হয়ে ছোটেন হসপিটালে। টানা তিনরাত পার করেন সেখানে, এদিকে তার প্রেমিকার বাবা অভিমানে ক-ষ্টে জোর করে মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেন। এই ঘটনা কারোরই অজানা নয়। শ্রাবণ, তিতির, ইশা, আরব ওরা সবাই জানে এই ঘটনা। এমনকি শ্রাবণের মাও জানেন। এরপর থেকে খান বাড়িতে কেউ আর কখনোও ভালোবেসে বিয়ে করার দুঃসাহস করেনি।
তাই ইশাও চাইতোনা তার বড় মামুর মতো তার শ্রাবণ ভাইও একই ক*ষ্ট বুকে চেপে সারাজীবন পার করুক। তাই তো নিজের ভালোবাসাকে মাটি দিয়ে একজন পরপুরুষকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলো। এমনকি তার সাথে এনগেজমেন্ট করে নিয়েছিলো।