ডাকপিয়নের ছুটি নেই পর্ব-৩০+৩১+৩২

0
327

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই ♥️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_______৩০.

বিয়ের বাকি আর মাত্র দু’দিন। চারপাশ জুড়ে বিয়ের এলাহী আয়োজন হলেও যথারীতি গুরুত্ব পাচ্ছেনা বিয়ের কনে। সে যার কাছেই যাচ্ছে সেই কাজের বাহানা করে চলে যাচ্ছে। আরে বাবা, বিয়েটা তো তার নাকি? তারই বিয়েতে, তাকেই পাত্তা দিচ্ছেনা! এতো অন্যায় রীতিমতো। এর নালিশ কার দরবারে ঠুকবে সে? আছে কেউ?

“থাকবেনা কেন? তোর হবু বর আছে। তার কাছে যা?;

ইশার চুল আঁচড়ে বেঁধে দিচ্ছে তিতির। দুুপুর বারোটা বাজে। খানিক বাদেই কনের হাতে মেহেদী পড়ানোর জন্য পার্লার থেকে দুটো মেয়ে আসবে। নীচে ড্রয়িং রুমে ছোট খাটো একটা মেহেন্দির অনুষ্ঠান করবে। তার আয়োজনও হয়ে গেছে। এখন শুধু ইশাকে সাজিয়ে নীচে নিয়ে যাওয়া বাকি।

ইশা লজ্জা পেলো তিতিরের কথায়। শ্রাবণ তো সবার একধাপ উপরে। সুযোগ পেলেই হয় চুমু খেয়ে বসবে, নয়তো কান লাল হওয়ার মতো লজ্জাজনক কথা বলে ওকে লজ্জায় ফেলে দিবে। তাই তার থেকে আরও বাঁচার জন্য এরওর কাছে যায়।

“ভাইয়া আরও তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছে এখানে ওখানে!;

তিতিরের কথার পিঠে বলল নামিরা। ইশা আরেকটু মাথা নীচু করে দু’জনের অগোচরে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিঃশ্বাস ছাড়লো।

“ভাইয়া বলছিলো, তোকে কাল রাত থেকে নাকি খুঁজে পাচ্ছেনা। কি রে, আমার ভাইটাকে জ্বালাচ্ছিস কেন এভাবে?;

পূণরায় বলল তিতির। ইশা জবাব খুঁজে পাচ্ছেনা। কি জবাব দিবে এর পিঠে?

“বিয়ের আগে যত পারিস বরকে জ্বালিয়ে রাখ, বিয়ের পর কিন্তু আর রক্ষে নেই।;

তিতিরের ছোড়া লজ্জার বানটি তীরের মতো বিঁধল ইশার বুকে। ধুক করে উঠলো ভেতরটা। মুহুর্তেই কান ও গাল গরম হয়ে উঠলো তার। নিঃশ্বাস আঁটকে গেলো কয়েক মুহুর্তের জন্য।

ইশার যে কোনো জবাব আসবে না, সে কথা বোঝা হয়ে গেছে ওদের দু’জনের। তাই দু’জনে মুখ টিপে হাসতে হাসতে ইশাকে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে গেলো।

জলপাই কালারের একটা লেহেঙ্গা পড়িয়েছে ইশাকে। সাথে ম্যাচিং কানের দুল এবং গলার নেকলেস।যৎসামান্যই সাজগোজ। হালকা গোলাপি লিপস্টিক আর চুলগুলোয় লুজ খোঁপা বেঁধে কাঁচা ফুল গুঁজে দিয়েছে তিতির। অতঃপর ওকে দাঁড় করিয়ে দিলো আয়নার সামনে। বলল,

“দেখতো, সাজ পছন্দ হয়েছে কিনা?;

“দাঁড়াও আপু, আমি বরং শ্রাবণ ভাইয়াকে ডেকে নিয়ে আসি। ভাইয়া বলতে পারবে ভালো লাগছে কিনা?;

তিতিরের কথার পিঠে বলতে বলতে তড়িঘড়ি করে দাঁড়িয়ে গেলো নামিরা। ফের যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে পেছন থেকে হাত টেনে ধরলো ইশা। চোখেমুখে আতংক তার। অসহায় গলায় বলল,

“কি শুরু করেছিস তোরা!;

ফিক করে হেসে দিলো তিতির। নামিরার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

“আর লজ্জা দিওনা গো। মেয়েটা এখন দম নিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছেনা।;

সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাসলো নামিরাও। ইশা অসহায় মুখে দু’জনের দিকে তাকিয়ে রইলো স্রেফ।

__________

স্পিকারে গান চলছে ‘কাজরা মোহাব্বত ওয়ালা’। গানের তালে তালে নাচছে তানি,তুতুন আর হৃদিমা। কনের সাথে ম্যাচিং তাদের ড্রেস। ড্রয়িংরুমে এক গাদা মানুষের ভীড়। সবার মাঝে বসে আছে ইশা। আর তার দু’পাশে দু’জন মেহেদী ডিজাইনার, মেহেদী পড়াচ্ছে তাকে। নামিরা আর তিতির তার পাশেই, খানিক পেছনের দিকে বসে সবাইকে শরবত দিচ্ছে। কেউ কেউ পানি কেউ কেউ কোক নিচ্ছে। আরব, আশফি এবং শ্রাবণের বন্ধুরা তারাও ঘুরে ঘুরে খাতিরদারি করছে মেহমানদের। এই সবার মাঝে স্রেফ দুটো মানুষের কোনো খোঁজ নেই। এক শ্রাবণ আর দুই হিমাদ্র। কিন্তু ইশার চোখ যে সেই তখন থেকে শ্রাবণকে খুঁজে যাচ্ছে। কোথায় সে মহারাজ? কি রাজকার্য করছে একা একা?

“এই নে, শরবত খা। মেহেদী পরতে পরতে নিশ্চিয়ই হাঁপিয়ে উঠেছিস?;

ইশার মুখের সামনে এক গ্লাস শরবত ধরে বসে পড়লো আরব। ইশা মুখ বাঁকিয়ে তাকালো।

“এক ঢিলে দুই পাখি কিভাবে মা*র*তে হয়, তোমার থেকে প্রশিক্ষণ নিতে হবে ভাইয়া।;

শরবতটা ইশার সামনে ধরলেও আরবের সম্পূর্ণ দৃষ্টি নামিরার পানে। আর সেটা কেউ খেয়াল না করলেও ইশার চোখ এড়ায়নি। নামিরা একটা জলপাই রঙের শাড়ি পড়েছে তিতিরের সাথে ম্যাচিং করে। ভীষণ মিষ্টি লাগছে ওকে এই রঙটায়। ফর্সা শরীরে, না মানানোর কিছু নেই। চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁটে সামান্য লিপস্টিক।

ইশার কথায় খুকখুক করে কেশে উঠলো আরব। দ্রুত নামিরার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ইশার পানে তাকালো। ইশা মিটমিটিয়ে হাসছে। ভ্রু নাচিয়ে পূণরায় বলে উঠলো,

“কি ব্যাপার হ্যাঁ, কি বলতে চাও?;

“ক্ কি বলবো। তোর জন্য ভালোবেসে শরবত নিয়ে এলাম, আর তুই কিনা আমাকে ভুল বুঝছিস?;

“হু হু, সব বুঝতে পারছি। আমার বিয়েটা একটু হতে দাও। তারপর তোমার কান টানা শুরু করবো।;

আবারও কেশে উঠলো আরব। ইশা ওর কাশি দেখে শব্দ করে হেসে উঠলো। আর থাকা যাবেনা এখানে, এই ভঙ্গিমাতেই উঠে পালালো আরব। হাসতে হাসতে ইশার চোখ গেলো সিঁড়িতে। সিঁড়ির মাঝামাঝিতে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। পরনে জলপাই সবুজ পাঞ্জাবি। মাথার চুল গুলো জেলের সাহায্যে সেট করা। গৌরবর্ণ মুখশ্রীতে হালকা খোঁচা দাঁড়ি। খুব সন্তর্পণে চোখাচোখি হলো দুই হবু নবদম্পতির। মুহূর্তেই এক প্রশান্তির লেনদেন হলো দু’জনের মাঝে। চোখের পলক পড়ছেনা কারোরই। তবে এই প্রশান্তির ক্ষণ বেশি সময়ের জন্য স্থায়িত্ব হলোনা। ইশার বাহুতে টান পড়াতে ওর ভ্রম কাটলো। চকিতে সম্মুখে তাকাতেই তানি আর হৃদিমা ওকে টানতে লাগলো। ইশা আর বসে থাকতে পারলোনা ওদের জোড়াজুড়িতে। ইশাকে একদম সামনে নিয়ে গেলো ওরা। এদিকে গান বাজছে। তানি বলল,

“নাচো আপা।;

ইশা স্মিত হেসে ওদের সাথে নাচের তাল ধরলো। শ্রাবণ সিঁড়িতে হেলান দিয়ে স্থীর দৃষ্টিতে কেবল চেয়েই রইলো ইশার পানে। চোখ থেকে তার মুগ্ধতা ঝড়ছে। সবার মাঝে নজর কাড়া মুখখানা দেখে ভেতরটা ভরে উঠছে ক্রমশ।

“ভাইয়া,আসো না?; হৃদিমা হাত উঁচিয়ে ডাকে শ্রাবণকে।

শ্রাবণকে না সূচক মাথা নেড়ে হাত ইশারায় বলে, “তোমরা ইনজয় করো।” কিন্তু কেউ শুনলোনা তার কথা। বলতে বলতে হৃদিমা চলে গেলো শ্রাবণের কাছে। একরকম জোর করে নিয়ে এলো তাকেও। তারপর আর কি, সেও মৃদু হেসে মত্ত হলো নাচে। বর-কনে একসাথে কাপল ডান্স করছে, আর সেটা ক্যামেরা বন্দী না করলে হয় নাকি? নামিরা ফোনটা করে ঝটপট ক্যামেরা অন করলো। তবে কারোর হেঁচকা টানে সেই ভিডিওটি তিন সেকেন্ডের বেশি অতিক্রম করলোনা। আরব ওকে টেনে নিয়ে গেলো সবার মাঝে। শুরু হলো তাদেরও কাপল ডান্স।

উঠতে যেয়ে হঠাৎ ধপ করে বসে পড়লো তিতির। শাকিল এসেছে তাকে ডাকতে একসাথে নাচবে বলে, তবে তার পক্ষে উঠে দাঁড়ানো এই মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ বলে মনে হলো। শাকিল লক্ষ্য করলো তিতিরের এভাবে বসে পড়াটা। সে বিচলিত হয়ে ধরে ফেললো তিতিরকে।

“কি হয়েছে তিতির?;

তিতির জবাব দিতে পারলোনা। অসম্ভব রকমের মাথা ঘুরছে তার। কেমন গা গোলাচ্ছে, অস্থির লাগছে, বমি পাচ্ছে। ক’টা বলবে?

“এই তিতির! একি, তুমি তো ঘামছো! ক্ কি হয়েছে জান?;

“আ্ আমার শরীরটা ঠিক লাগছেনা। ব্ বমি পাচ্ছে।;

গলার স্বর ক্ষণিকেই ধরে গেলো তিতিরের। শাকিল ঘাবড়ানো চোখে চারপাশে তাকালো। এতো জোরে স্পিকার বাজছে, হয়তো একারণেই শরীর খারাপ হচ্ছে তিতিরের।

“রুমে যাবে? রুমে নিয়ে যাবো?;

“হ্ হ্যাঁ!;

তিতিরকে ধরে রুমে নিয়ে এলো শাকিল। শুয়ে দিতে চইলো তবে সেই সময়টুকু তিতির শাকিলকে দিলোনা। আকস্মিক উঠে দৌড়ে গেলো ওয়াশরুমে। আর সঙ্গে সঙ্গে বমি শুরু হলো। শাকিল আরও ঘাবড়ে যেতে লাগলো তিতিরের অবস্থা দেখে। সেও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা। ছুটে গেলো ওয়াশরুমের দিকে।
_______

নাচতে নাচতে হঠাৎ পা স্লিপ হয়ে গেলো তানির। পা মচকে পেছনের দিকে পড়ে যেতে নিলেই বড় সাবধানতার সহিত ধরে ফেললো কেউ। তানি ‘মা’ বলে মৃদু চিৎকার দিয়ে খামচে ধরলো তার শক্তপোক্ত পেশিবহুল হাত খানা। এমন ভাবে ধরলো, বেচারা ব্যাথায় মৃদু আওয়াজ করলো। তবে তানির সেদিকে ধ্যান নেই। সে বেঁচে গেছে, এই যেন যথেষ্ট।

“আপনি?(মৃদু চিৎকার করে)

তানিকে সোজা করে দাঁড় করাতেই মানুষটার কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম। তৎক্ষণাৎ দু’হাতে কান চেপে ধরে রাগান্বিত গলায় বলল,

“গাধা নাকি, চেঁচাচ্ছো কেন এভাবে?;

আরাফ দাঁড়িয়ে তানির সামনে। পেছনে নিলাশাকেও দেখা যাচ্ছে। নিলাশাকে দেখে তানির তেমন ভয় না হলেও আরাফকে দেখে ওর ভেতরটা লন্ডভন্ড হতে লাগলো। এই ছেলে এখানে কেন এসেছে? বাড়ি বয়ে এসে চড় মা*রা*র নালিশ করবে নাকি? দাদাজান জানলে তো মে*রে ফেলবে ওকে!

“ক্ কি? কেন এসেছেন এখানে হ্যাঁ? চলে যান বলছি।;

“অলওয়েজ কি ঝগড়ার মুডেই থাকো?;

“হ্যাঁ থাকি! তো? আপনি যাবেন নাকি আমি…;

“হেই আরাফ। নিলাশা। প্লিজ কাম, প্লিজ কাম!;

পেছন থেকে শ্রাবণের গলা ভেসে আসতেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো তানির। ও তো ভুলেই গিয়েছিলো দাদা জানের আগেও কেউ আছে যে ওর পিণ্ডিচকটে দিতে পারবে। আর সে হলো শ্রাবণ।

তানি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা। লেহেঙ্গা ধরে দিলো ভোঁ দৌড়। আরাফ ওর দৌড়ে পালানোর দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই মুচকি হাসলো। পরক্ষণেই খানিক বিচলিত হয়ে ভাবলো, পায়ে না ব্যাথা পেলো?

চলবে

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_____৩১.

বমির বেগ থামলো ঔষধ খেয়ে। তিতিরের মাথার কাছে বসে আছে আফিয়া বেগম। পাশে নুপুর বেগম এবং আনোয়ারা বেগম। শাকিল, শ্রাবণ, আরব, আশফি সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে আছে তিতিরের পায়ের কাছে। ইশা আর নামিরা বসে আছে তাদের সামনেই, অর্থাৎ তিতিরের পায়ের কাছে। দু’জন তিতিরের দুপা মালিশ করছে। একটু আগে পুরো শরীর জমে উঠছিলো তিতিরের। এখন একটু স্বাভাবিক। ডাক্তার দেখছে তিতিরকে।

মেহেন্দির অনুষ্ঠানের মাঝে হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে শাকিল। কাকে খুঁজবে, কাকে কি বলবে সাময়িক সময়ের জন্য সে বোবা হয়ে গিয়েছিলো। তার অস্বাভাবিক আরচণ চোখে পড়েছিলো শ্রাবণের। ইশাকে থামিয়ে দিয়ে, অপেক্ষা করতে বলে ছুটে যায় সে শাকিলের কাছে। কি হয়েছে জানতে চাইলে শাকিল ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘তিতির কেমন যেন করছে, বারবার বমিও করছে’ ব্যস, মুহুর্তেই অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলো। মেহমানদের নীচে রেখেই ঘরের লোক সবাই উপরে ছুটলো তিতিরের কাছে।

“গুড নিউজ!;

ডাক্তারের গম্ভীর মুখের পরিবর্তন ঘটে মুহুর্তেই আনন্দ মুখর হয়ে বললেন কথাটা। সবার চোখে মুখে উদ্বিগ্ন ভাব। তিতিরের এমন বেগতিক খারাপ অবস্থায় ডাক্তার আবার কিসের সুখবর দিতে চলেছেন? তবে এই উদ্বেগ ছিলো মাত্র ক্ষণকালের জন্য। সবার মুখও ঠিক আনন্দমুখর হয়ে উঠলো ডাক্তারের বলা দ্বিতীয় বাক্যটিতে।

“তিতির প্রেগন্যান্ট।;

বো*মা বি*স্ফো*র*কের চেয়েও দিগুণ জোরে ফাটলো এই আনন্দ সংসাদ। সবার প্রথমে আরবের উৎফুল্ল গলায় ঢোল বাজলো। পরক্ষণেই হৈচৈ পড়ে গেলো ছোট্ট রুমটিতে।

তিতিরের ক্লান্ত শরীরে আর কিছু অবশিষ্ট নেই অত্যাধিক বার উদগীরণের পরে। তবুও এমন সুসংবাদ যেন নিমিষেই ওর সমস্ত ক্লান্তি শুষে নিলো। সর্বাঙ্গ জুড়ে এক শিহরণ বয়ে গেলো গাঢ় অনুভূতিতে। মা হবে সে, মা হবে! চোখের কোন ভরে উঠলো ক্ষণেই। ফুপিয়ে উঠলো সবার অলক্ষ্যে।

শাকিল মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। ডাক্তার যা বলেছে, সে শুনেছে। তবে শোনার পর তার প্রতিক্রিয়া লোড হচ্ছে না। যেন নেটওয়ার্ক বিজি অন্তরীক্ষের। চেয়েও হাসতে পারছেনা, বা চেয়েও কাঁদতে পারছেনা। এমন শূন্য অনুভূতি কখন হয় জানেন, মানুষ যখন অতিরিক্ত আশ্চর্যান্বিত হয়ে যায়। তার ধ্যান ফেরাবার কারবার অবশ্য করতে চলেছে আরব। শাকিলের সামনে দাঁড়িয়ে ভীষণ জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

“কংগ্রাচুলেশনস দুলাভাই।;

শাকিল চমকে উঠলো। চোখজোড়া তার কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে আসবে ভাব। সে এখন টের পাচ্ছে সব। সে টের পাচ্ছে তার তীব্র অনুভূতি। সে বাবা হবে। বাবা হবে।

আরব জড়িয়ে ধরলো শাকিলকে। শাকিল হাসলো। আবার দু-ফোটা জল বিসর্জন দিয়ে কাঁদল। সে কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা যেন। হাসবে, নাকি কাঁদবে?

দশ মিনিটের মাঝে পুরো ঘর খালি করে দেওয়া হলো। তিতিরের এখন ভরপুর রেস্ট নিতে হবে। এবং এই রেস্টের মাঝে শাকিলকেও প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে উপস্থিত থাকতে হবে। তিতিরকে এক মুহুর্তের জন্যও একা রেখে যেতে পারবেনা সে। বড় ভাই হিসেবে শ্রাবণের আদেশ।

অনুষ্ঠানে কম বেশি মিষ্টি পরিবেশন হলেও পূণরায় সবাইকে মিষ্টি মুখ করানো এই খুশির সংবাদে। দ্বিতীয়বার মিষ্টি খেতে অনেকেই হিমশিম খেলেও তানি যে মহাখুশি। মিষ্টি খেতে হলেও ওর ইচ্ছে প্রতিদিন একটা না একটা অনুষ্ঠান হোক বাড়িতে। তাতে আর কিছু না হোক, মিষ্টির বর্ষণ হবে, আর তাতে ও মন প্রাণ ডুবিয়ে ভিজতে পারবে, অর্থাৎ খেতে পারবে।

“লাইক সিরিয়াসলি, এতো মিষ্টি কিভাবে খাও?;

ইদানীং একটা সমস্যা শুরু হয়েছে তানির জীবনে। উটকো সমস্যা যাকে বলে। আর তার নাম আরাফ। মাত্রই মিষ্টিটা তুললো মুখে পুড়বে তাই, অমনি উটকো ঝামেলা এসে হাজির।

“হাত দিয়ে তুলি, মুখ দিয়ে খাই। আর কোনো প্রশ্ন?;

ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো আরাফ। এই মেয়ে কি সোজা করে কথা বলতে জানেনা?

“তুমি প্রচুর বেয়াদব। জানো সেটা?;

“জানি।;

“জ্ জানো মানে? সিনিয়রদের সাথে কথা বলার মিনিমাম ম্যানার্স নেই তোমার মাঝে।;

“হ্যাঁ নেই। তো কি হয়েছে?;

“ড্যাম! আর ইউ সিরিয়াস?;

“আপনার প্রবলেম কি বলবেন?;

“কিছুনা।;

বিরক্ত হয়ে প্রস্থান করলো আরাফ। তানি গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে পূণরায় মিষ্টিতে ধ্যান দিলো। তবে পূণরায় এসে হাজির হলো আরাফ। তবে এবার কিছু বলতে নয়, করতে। চোখের পলক ঝাপটে তানির হাতে ধরে রাখা মিষ্টিটা ছোবল মে*রে কেঁড়ে নিয়ে মুখে পুড়ে নিলো। যা দর্শনে তানির পুরো দুনিয়া এফোড় ওফোড় হয়ে গেলো। মুহুর্তেই আরাফের হা সমান ওর মুখটাও হা হয়ে গেলো। আরাফ যখন মিষ্টিটা গিলে নিলো, তখন যেন র*ক্ত*ক্ষ*রণ শুরু হয়েছে। এই নি*পী*ড়ন, এই অ*ত্যা*চার তানি কখনোই সহ্য করবেনা।

আরাফ আর দাঁড়িয়ে থাকলোনা। যে কাজ সে করেছে, এর পর যে কোনো বি*স্ফো*র*ণ ঘটবেনা, তার গ্যারান্টি স্বয়ং জমরাজও দিতে পারবেনা।

_________

“জুস।;

নরম গদিতে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে ইশা। মনটা খানিক আনন্দে নেচে উঠছে আবার খানিক বিষন্নতায় ঘিরে ধরছে। এই দু’মুখো অনুভূতির সঠিক কোনো কারন বের করতে পারছেনা সে। হঠাৎ কানের পাশে কারোর উচ্ছ্বসিত গলা পেতে পাশ ফিরে তাকালো। ততক্ষণে আগন্তুক ঘুরে এসে ওর পাশে আয়েস করে বসলো। এলোমেলো চুল, ক্লান্ত মুখশ্রী আর ভীষণ মায়াবী একখানা হাসি জুড়ে রয়েছে ঠোঁটের কোনে। ইশার মনের সমস্ত বিষণ্ণ ভাব দূর হয়ে গেলো এক লহমায়। শ্রাবণ জুসের গ্লাসটা ধরিয়ে দিলো ইশার হাতে। অতঃপর সোফায় পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বুজলো। ইশা এখনও একই ভাবে, একই চাহনিতে দেখছে শ্রাবণকে। শ্রাবণের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে বার্তা দিতেই সে বন্ধ চোখেই কথা পাড়লো,

“আমার বউয়ের হক এভাবে নষ্ট না করে জুসটা খা।;

ভ্রুকুটি হয়ে এলো ইশার। উনার বউয়ের হক কে কষ্ট করছে? তারই হবু বউ! কি একটা অবস্থা। চোখ সরিয়ে নিলো ইশা। আর ভুলেও তাকালো না শ্রাবণের পানে। বউয়ের হক নষ্ট করছে তাই তো, ঠিকাছে, আর দেখবেইনা।

বিনা বাক্যে পুরো গ্লাস খালি করে দিলো ইশা। অতঃপর উঠে দাঁড়ালে হাতে টান পড়ে। শ্রাবণ ওর দিকে তাকিয়ে আছে প্রশ্ন বিদ্ধ নয়নে। ভ্রু নাচিয়ে বলল,

“কোথায় চললি?;

“আমার বর খুঁজতে।;

ইশার অকপটে জবাব। তৎক্ষনাৎ গম্ভীর হয়ে উঠলো শ্রাবণের মুখ।

“মানে?;

“তোমার বউয়ের হক নষ্ট করেছি, তাই আমার বরটাকে খুঁজতে চললাম, যেন তোমার ক্ষতিপূরণ চুকাতে পারি।;

“চুপচাপ বস এখানে। অনেকদিন হয়েছে ধমকটমক পড়ছেনা। তাই দিব্যি মাথায় চড়ছিস।;

“ছাড়ো। বসবোনা আমি। অন্যের বর হয়ে পরনারীর হাত ধরছো! লজ্জা করছেনা? ছাড়ো, ছাড়ো।;

শ্রাবণ হেঁচকা টান মে*রে বসিয়ে দিলো তার অভদ্র বউটাকে। তার অভদ্র বউ ওরফে ইশারানি ধপ করে বসে পড়লো পূর্বের স্থানে। এবং ঘটনার আকস্মিকতায় ভড়কে গিয়ে চারচোখ করে তাকালো শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ বকার সুরে বলল,

“কপালে খুব দুঃখ নাচছে কিন্তু। কাল থেকে ইগনোর করে যাচ্ছিস আমাকে। সব হিসেব রেখেছি আমি।;

বুকের ভেতর যেন কেউ হাতুড়ির বারি মা*র*লো ইশার। সেরা অহসায়ের খেতাব নিয়ে চেয়ে রইলো শ্রাবণের পানে। শ্রাবণ বাঁকা হাসে, আবার রাগান্বিত হয়। সত্যিই ইশার কপালে সত্যিই দুঃখ আছে।

“ক্ কি করেছি আমি?;

“বলবো, হাতে আর দুটো দিন সময় আছে। যত পারিস করে নে। এরপর তো আমার পালা।;

শয়তানি হেসে তাকায় শ্রাবণ। ইশার দুনিয়া এলোমেলো হতে শুরু করে। ঠিক এজন্যই পালাচ্ছে সে শ্রাবণের থেকে।

_______

“গায়ে হলুদ”
“শ্রাবণ & ইশা”

স্টেজের মাঝে ছোট্ট ব্যানার ঝুলছে। তার মাথা জুড়ে গাঁদাফুলের অসম্ভব সুন্দর ডেকোরেশন। স্টেজে দুটো পিঁড়ি রাখলো ডেকোরেশনের ছেলেগুলো। সামনে আমপাতা, জল ভরা কলসি। নামিরা এসে জলভরা কলসিতে আমপাতা গুলো রেখে সেটা আবার জায়গা মতো রেখে দিলো। আরব এলো ঢালা ভর্তি ফুল নিয়ে। আশফি, তানি, তুতুন, হৃদিমা সবাই কিছু না কিছু করছে। সবাই হাতে হাতে কাজ করাতে অতি জলদি সম্পন্ন হচ্ছে সবকিছু।

“ভাইয়া আর আপুকে কখন আনবে?;

তুতুনের অবুঝ মনের প্রশ্ন। নামিরা মুচকি হেসে বলল,

“আপু আর ভাইয়া তো রেডি হচ্ছে। তুমি গিয়ে দেখে আসতে পারো তাদের আর কতটুকু হলো সাঝ।;

তুতুন খুশি হয়ে ছুটলো দোতলায়। সঙ্গী করলো তার সমবয়সী কয়েকজনকে। প্রথমে শ্রাবণের ঘরে উঁকি দিলো।

শ্রাবণের বন্ধুরা রেডি করে দিচ্ছে শ্রাবণকে। সাথে দু’চারটে মশকরা তো ফ্রীতে চলছে এখানে। হলুদ পাঞ্জাবিতে ভাইয়াকে ভীষণ সুন্দর লাগছে তুতুনের মতে।

“ভাইয়া?;

“তুতুন,ভেতরে আয়।;

ভাইয়ার পারমিশন পেয়ে উৎফুল্ল মনে রুমে প্রবেশ করলো তুতুন।

“তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। একদম নতুন বর মনে হচ্ছে।;

শ্রাবণ মুচকি হাসলো। তুতুনের হাত ধরে ওকে কাছে এনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

“তোকে তো আরও বেশি সুন্দর লাগছে। আমার মনে হচ্ছে, আজ সবাই আমার হবু বউকে রেখে তুতুনকেই ঘুরে ঘুরে দেখবে।;

তুতুন লজ্জা পেলো। লজ্জা মিশ্রিত হেসে বলল,

“ইশ না, আমাকে কেন দেখবে!;

“কারন তোমাকে আস্ত একটা পুতুল লাগছে।;

পাশ থেকে বলল শ্রাবণের বন্ধু। তুতুনের লজ্জা এবার আকাশ ছুলো। সে ছুট্টে চলে গেলো রুম থেকে। এদিকে প্রায় শব্দ করেই হেসে উঠলো শ্রাবণ আর তার বন্ধুরা।

#চলবে

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব______৩২

গাঢ় হলুদ রঙের একটা জামদানী শাড়ি পড়ানো হয়েছে ইশাকে। আফিয়া বেগমের ভীষণ পছন্দের। শমসের সাহেবের সাথে ঝগড়া করে শাড়িটা কিনেছেন সেদিন। শাড়িটা যখন হাতে তুলেছিলেন, কেন যেন ইশার মুখটাই ভেসে উঠেছিলো সবার আগে। অবশ্য এর আগেই ইশার হলুদের জন্য সুতির শাড়ি নেওয়া হয়েছিলো। এই শাড়িটা দেখার পরমুহুর্তেই ঐ শাড়িটা বাদের তালিকায় চলে যায়।

শাড়িটা যখন পড়ছিলো ইশা, বড়মামা আর বড় মামির ঝগড়ার সিনটা খুব করে মনে পড়ছিলো। বড় মামি পারেও। তুলনা হয়না মানুষটার। এরপর এলো গহনার পালা। শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে আর্টিফিশিয়াল গহনা নেওয়া হয়েছিলো। তবে সেটা আবার পছন্দ হলোনা স্বয়ং বরের। চলবেনা, ইশাকে হলুদে সব তাজা কাচাফুলের গহনাই পড়তে হবে। এসব প্লাস্টিক চলবেনা। ইশা কপাল চাপড়ে বলল,

” ঠিকাছে, কোনো প্লাস্টিক চলবেনা।;

তাই আজ ভোর ভোর ফুলের বাজার থেকে ঝুড়ি ভরে বিভিন্ন ফুল এসেছে খান বাড়িতে। লোক ডেকে সেই ফুল দিয়ে আবার হলুদের জন্য গহনা বানানো হয়েছে। এই কথা ভেবেও একদফা হাসলো ইশা। মনেমনে।

“গহনার সেট গুলো খুব সুন্দর হয়েছে আপু। কোথা থেকে নিয়েছেন?;

যে মেয়েটা ইশাকে সাজাচ্ছে, সে শুরু থেকেই বারবার তাকাচ্ছিলো গহনা গুলোর দিকে। মেয়েটার হঠাৎ করা প্রশ্নে ইশা হতাশ জনক গলায় বলল,

“আমার বরের হুকুমে ঘরেই বানানো হয়েছে আপু।;

“তাই তো বলি, পাঁচ বছর হলো এই প্রফেশনে আছি। আর এই পাঁচ বছরে রোজ কম করে হলেও শ’খানেক ব্রাইড সাজিয়ে দেই। কারোর কাছে কখনও এমন অসাধারণ কাজের গহনা দেখিনি।;

ইশা মুচকি হাসলো। তার পাগল বরের পাগল পাগল কান্ড। কিন্তু, সবার থেকে যখন এভাবে প্রশংসা পায়, তখন নিজেকে ভীষণ স্পেশাল মনে হয় তার। এর কারনটাও একমাত্র তার বর। মানুষটা এমনই। একটু রাগী হলেও, রোজ কোনো না কোনো ভাবে ঠিক এভাবেই ওকে নিজের কাছে নিজেকে স্পেশাল বানিয়ে তুলে।

“ইশশ, এতো মিষ্টি লাগছে আপনাকে।;

সাজগোজ সম্পূর্ণ হলো। মেয়েটার মুখে পূণরায় নিজের প্রশংসা পেয়ে সংকীর্ণ মনে ইশা আয়নার দিকে তাকায়। কাচা ফুলের গহনা গুলো ওর সৌন্দর্য আরও হাজারগুণ করে বাড়িয়ে দিয়েছে। সত্যিই ভীষণ মিষ্টি লাগছে ওকে দেখতে।

হঠাৎ কেউ দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরলো ইশাকে। ইশা চমকে গেলো এহেম আকস্মিক ঘটনায়। তবে ক্ষণকালেই হৃদপিণ্ডের লাফালাফি কমে এলো তুতুনের উচ্ছ্বসিত গলা পেয়ে,

“আপাআআ, তোমাকে এত্তোওও সুন্দর লাগছে।;

এই বলেই ইশার গালে গাল ঘষতে লাগলো তুতুন। ইশা হেসে উঠলো। ওর গলা জড়িয়ে রাখা তুতুনের হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বলল,

“তুতুনপাখিকে আরও বেশি সুন্দর লাগছে।;

“উমমম!;

বিড়ালের মতো করছে তুতুন। পাশে বসা মেয়েটা বলল,

“তোমার আপার সাজ পছন্দ হয়েছে?;

“খুবববব!; জবাব দিলো তুতুন।

ফের ইশার সাথে কথার ঝুড়ি খুলে বসলো তুতুন। এটা, ওটা আরও কত কথা। ইশা মুচকি হেসে তুতুনের সব কথারই জবাব দিতে লাগলো। এরমাঝেই রুমে আগমন ঘটলো এক ঝাক মেয়েদের। ইশাকে হলুদের জন্য নীচে নিতে। শ্রাবণকে ইতিমধ্যে নিয়ে বসানো হয়েছে।

পাশাপাশি পিড়ি দু’টোতে বসানো হয়েছে ইশা আর শ্রাবণকে। খান সাহেবকে একটা ছোট মোড়া দেওয়া হলো তাদের সামনে বসতে। তিনি বসলেন ধীরেসুস্থে। ফের হলুদের বাটি থেকে খানিক হলুদ তুলে মুচকি হেসে আগে মাখালেন শ্রাবণকে। অতঃপর মাখালেন ইশাকে।

তার পাশে বসলেন আনোয়ারা বেগম। তিনিও খানিক হলুদ তুলে আগে শ্রাবণকে মাখিয়ে অতঃপর ইশাকে মাখালেন। মাখাতে মাখাতে এক অজানা কারনে তার চোখের তারা ভরে উঠলো নোনাজলে। তার চোখে জল দেখে ছেলে-মেয়েরা, নাতি-নাতনিরা সবাই বড়ো বিচলিত হলো।

“ও বুড়ি, কি হলো তোমার? কাঁদছো কেন?;

ইশা আনোয়ারা বেগমের হাত দু’টো আগলে ধরে জিজ্ঞেস করলো। আনোয়ারা বেগম মাথা নীচু করে চোখের জল মুছে না সূচক মাথা নাড়লো। বলল,

“কিছু না রে। পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে। আমার শমসেরটার জন্য। ছেলেটা আমার…;

“থাকনা, তুমি আবার ওসব নিয়ে কেন পড়লে?;

আনোয়ারা বেগমকে থামিয়ে দিলেন খান সাহেব। তিনি জানেন ভুলটা তারই ছিলো। এবং এই ভুলের জন্য সে ভীষণ ভাবে অনুতপ্ত। তবে আফিয়া বেগমেরও যে কোনো দোষ ছিলোনা। তাহলে আজ এতো গুলো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর এই মানুষটাকে কেন কষ্ট পেতে হবে? যা হয় তা যে আর বদলানো যায়না। বর্তমানকে মেনে নিয়ে ভালো থাকতে হয়। শমসের সাহেবকেও থাকতে হবে, এবং আফিয়া বেগমকে ভালো রাখতে হবে।

চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালেন আনোয়ারা বেগম। খান সাহেবকে উঠতে সাহায্য করলো আরব আর সাদ্দাত সাহেব। খান সাহেব অতীত ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আনোয়ারা বেগমের দিকে তাকালেন। তার মাথায় হাত রেখে মৃদু হেসে তার হাতটা ধরলেন। আনোয়ারা বেগম মুখ তুলে তাকালেন তার পানে। পরক্ষণেই খান সাহেব বললেন,

“মানলাম যা হয়েছে বড্ড খারাপ হয়েছে, কিন্তু তুমি বলো, বড় বউমাকে এই বাড়িতে না আনলে তোমার সাজানো-গোছানো সংসার কি আজও এমনই থাকতো? সংসারটা এমন শক্ত হাতে ক’জন সামলাতে পারে বলো তো?;

আনোয়ারা বেগম ভাবুক হলেন। ভাবুক মনে ভাবলেন, ঠিকই তো। তার বড় বউমার মতো এমন লক্ষীমন্ত মানুষ আর কোথায় মিলতো?

খান সাহেব এবং আনোয়ারা বেগমের পালা শেষ হলে এরপর পালা এলো শমসের সাহেব এবং আফিয়া বেগমের। দু’জনে একসাথে স্টেজে উঠে হলুদ মাখালেন দু’জনকে। ফের এলেন মরিয়ম বিবি। তিনিও মায়ের মতো একই কান্ড করলেন। মেয়েকে হলুদ মাখাতে নিয়ে প্রানপ্রিয় মানুষটার কথা ভেবে অঝোরে কাঁদলেন। আজ মানুষটা বেঁচে থাকলে, সারা বাড়ি জুড়ে বাচ্চাদের মতো হল্লা করে বেড়াতেন।

এরপর এলেন হামজা সাহেব এবং শাহনাজ বেগম। তারপর সাদ্দাত সাহেব এবং নুপুর বেগম। হলুদ মাখাতে গিয়ে নুপুর বেগম ইশার পানে এগিয়ে এসে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন,

“মনটা বড্ড আনচান আনচান করছে, তাই না রে?;

ইশা ভয়াবহ লজ্জা পেয়ে গেলো। নুপুর বেগম সর্বদাই একটু বাচ্চা সুলভ স্বভাবের। এই নিয়ে তাকে বকাও খেতে হয় সাদ্দাত সাহেবের কাছে।

তারা নেমে গেলে এরপর আসে শাকিল এবং তিতির। অতঃপর ক্রমে ক্রমে বাড়ির বাকি ছোট বড় সকল সদস্যরা একএক করে হলুদ মাখিয়ে গেলো ওদের দু’জনকে। হলুদ মাখানো শেষ হলে জলভরা কলসির পানি দিয়ে প্রথমে শ্রাবণকে ফের ইশাকে গোসল করালো। যদিও এতে আধা গোসলই হয়েছে। বাকি গোসল যার যার রুমে হবে। দেখতে দেখতে দিনের অর্ধেক বেলা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানেই শেষ হলো।

_______

“আসবো?;

খোরশেদ সাহেবের নাতনীর সাথে শ্রাবণের বিয়েটা না হওয়াতে খোরশেদ সাহেব এখনও ভীষণ ক্ষেপে আছেন তার বন্ধু খান সাহেবের উপর। নিজের নাতনির বিয়ে ভেঙেছে এতো বড় অপমানটা সে কিছুতেই ভুলতে পারবেনা। এই বদনামের রেশ ধরে বেশ কয়েক দিন বাসা থেকেও বের হননি তিনি। তবে এতো কিছু হওয়ার পরও খান সাহেবের কোনো অনুতাপ নেই। সে তো দিব্যি নিজের নাতি-নাতনির বিয়ে দিতে মজেছে। প্রায় প্রতিদিনই এই বিষয়ে বেশ খানিকটা সময় গম্ভীর হয়ে ভাবেন তিনি। আজও তাই। আর হঠাৎ এই ভাবনার মাঝেই কারোর কন্ঠস্বর ভেসে আসে দরজার ওপার থেকে। তিনি মাথা তুলে তাকান সেদিকে। একখানা পরিচিত মুখ দেখতে পেলেন যেন। হ্যাঁ, ঠিকই দেখেছেন। আর এই পরিচিত মুখখানা আর কারোর নয়, সব সমস্যার মুলে যে ছিলো সেই মানুষটারই। অর্থাৎ শ্রাবণের।

“একি তুমি?;

ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন শমসের সাহেব। শ্রাবণ মৃদু হাসে। কোমল স্বরে বলে,

“জি আমি।;

“তোমাকে ঢুকতে দিয়েছে কে এ বাড়িতে?;

“কেন, আমার এ বাড়িতে আসা নিষেধ বুঝি?;

“একশবার নিষেধ। যে বা যারা এই খোরশেদ আলমকে দশজন মানুষের সামনে ছোট করে, অপমান করে তাদের মুখ আমি কোনোদিন দেখিনা। আর আমার বাড়িতে তো তাদের কোনো স্থানই নেই।;

বিনা অনুমতিতেই তার রুমে প্রবেশ করে শ্রাবণ। খোরশেদ সাহেব রাগে মুখ ঘুরিয়ে নেন। শ্রাবণ সব ভুলে বলে,

“সেদিন আমার কাউকে ছোট করার কোনো উদ্দেশ্য ছিলোনা দাদু। আমি তো কেবল আমার ভালোবাসার মানুষকে হারানোর ভয়ে যা করার করেছি। ভীষণ ভালোবাসি ওকে আমি। তাহলে আপনিই বলুন, একজনকে মনে রেখে আরেকজনকে বিয়ে করাটা কি অন্যায় হতোনা? আপনার নাতনীকে ঠকানো হতোনা?;

“এসব ছেলে ভোলানো কথা তোমার দাদাজানকে বলো, আমাকে নয়।;

“মাফ করবেন দাদু, ভেবেছিলাম হয়তো আপনি আমার ব্যাপারটা বুঝবেন। দাদাজানের কাছে শুনেছিলাম আপনিও নাকি দাদীকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। খুব যু*দ্ধ করতে হয়েছিলো ভালোবাসার মানুষটিকে আপন করে পেতে। এমনকি পরিবারের বিরুদ্ধেও গিয়েছিলেন। আমিও কিন্তু সেটাই করেছি দাদু। তাহলে আমার অন্যায়টা কোথায়?;

দমে গেলেন খোরশেদ সাহেব। মাত্র এক মিনিট আগেও ছেলেটার প্রতি ভয়াবহ রাগ আর ক্ষোভ থাকলেও এখন যেন নিজের অতীত দেখতে পাচ্ছেন চোখের তারায়। না না, তিনি ভুল করছেন, অন্যায় করছেন। শ্রাবণ ভুল নয়। সে তো কেবল নিজের ভালোবাসা বাঁচাতে, ভালোবাসার মানুষটাকে হারানোর ভয়ে এমনটা করেছে। তিনিও করেছিলেন নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে আপন করে পেতে। ঠিকই তো, এতো জলদি কি করে ভুলে গেলো সে?

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে