Wednesday, July 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 391



ডাকপিয়নের ছুটি নেই পর্ব-১৭+১৮

0

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব____১৭

মনে আষাঢ় নিয়ে ব্যালকনিতে পা ছড়িয়ে বসে আছে ইশা। প্রকৃতি সব ভালো কেন একসাথে সহ্য করতে পারেনা? এটা ওর প্রশ্ন। সবার সাথে কতটা হাসিমজায় কাটলো দুটো দিন। কিন্তু এই আবার দুঃখ বেদনার সূচনা ঘটলো। তুর্জর সাথে বড্ড কঠিন ব্যাবহার করেছে শ্রাবণ। থেকে থেকে ঐ সময় টুকুতেই ডুবে যাচ্ছে ও। ওকে ফিরে পাওয়ার আকুতি মিনতি এখনও কানে ভাসছে ওর।

তুর্জ ইশার প্রতি বড্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ কথা বোঝে ইশা। কিন্তু, তুর্জ এতোটাও ভালো মানুষ নয়, যতটা হওয়া উচিৎ। সে দেখায় এক, করে এক, বলে এক। কে জানে, কি লুকিয়ে রাখে অন্তরে অন্তরে। বড্ড রহস্য ময় চরিত্র লোকটার।

ভাবতে ভাবতেই ভানার ঘোর কাটে ফোনের শব্দে। ফোন বাজছে, কথাটা মস্তিষ্ক বুঝতেই অন্তরটা কেঁপে উঠলো ইশার। আবারও তুর্জ নয়তো? আতংক মনে ফোনটা তুললো। তবে বেশ সময় লাগিয়ে। তবে না, তুর্জ না।

নামিরার কল এসেছে। ইশা হাফ ছেড়ে বাঁচল একরকম। ফোনটা চটজলদি রিসিভ করে কানে তুলতেই ওপাশ থেকে মন খারাপের ভারি গলায় কথা বলে নামিরা।

“ভুলে টুলে গেলি নাকি আমাকে?;

ইশা মুখ বাঁকালো। নামিরাকে ও গোনায় ধরলো না যেন, এমন ভাব দেখিয়ে বলল,

“তোকে ভুলতে গিয়ে আবার মনে করার সময় আছে নাকি?;

” সেই তো, এখন তো আমি পর হয়ে গেছি!;

“গেছিসই তো। যাক বাবা, নিজে যে বুঝেছিস সেই তো ঢের। নয়তো তোর ঐ গবেট মাথাকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে কাম সারা হয়ে যেতো আমার।;

ওপাশ থেকে নিশ্চুপ হয়ে গেলো নামিরা। দিগুণ মন খারাপ করে বলল,

“আমাকে বাসা থেকে বড্ড প্রেশার দিচ্ছে বিয়ে করার জন্য! প্লিজ, আমাকে উদ্ধার কর।;

“কেন? ঘরের চালডাল কি একটু বেশি খরচ হয়ে যাচ্ছে নাকিরে? বুঝতে পারছিনা তো!;

“জানিনা।;

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ইশা। ভাবতে লাগলো সাতপাঁচ। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি আসাতে একটু উদগ্রীব হয়ে উঠলো। চটপটে গলায় বলল,

“একটা বুদ্ধি পেয়েছি। কয়টা দিন পালিয়ে যা কোথাও। আন্টি আর মামার মাথা থেকে এই বিয়ের ভূত যতদিন না নামে।;

নামিরা হতাশ গলায় জবাব দিলো,

“ধুর! আমার এমন কেউ আছে নাকি? কার সাথে পালাবো?;

ইশা দাঁত কেলিয়ে হাসলো। নামিরার কথাটাকে পাত্তা না দিয়ে বলল,

“আমি আছিনা? আমার সাথে পালাবি!;

নামিরা আরও হতাশ হলো। বলল,

“তুই তোর পাগলামির কথা রেখে সিরিয়াস কথা বল। আমি এখন কি করবো?;

“যা বললাম তাই। সব ব্যাগপত্র গুছিয়ে নে। আজ রাতেই পালাবি তুই। মিশন আমার বাসা।

“তোর বাসা?; একটু দমে গেলো নামিরা।

” ইয়েস, ম্যাডাম। জাস্ট কয়টা দিন তোর মায়ের থেকে দূরে থাকলেই দেখবি, বিয়ের ভূত অটোমেটিক তাদের মাথা থেকে নেমে গেছে।;

“তুই সিওর জান?;

“হান্ড্রেড পারসেন্ট সিওর। কখন বের হতে পারবি বল আমি তোর বাসার নীচে অপেক্ষা করবো।;

“না, তোকে আসতে হবেনা। আমি একাই পারবো।;

“ঠিকাছে। জলদি এসে পড়।;

“হু।;

ফোন কাটলো নামিরা। ইশার মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো। কিছু কিছু সম্পর্ক বড্ড অদ্ভুত হয় তাইনা? এই যেমন মা-বাবা,ভাই-বোন আর বেস্ট ফ্রেন্ড। ইশা ভাবে, বেস্ট ফ্রেন্ড সম্পর্ক গুলি পৃথিবীতে আছেই শুধু মন ভালো করার খাতিরে। একটু মন খারাপ হলেই যেটা মা কিংবা ঘরের লোককে বলা যায়না, সেটা বেস্ট ফ্রেন্ডকে অনায়াসে বলে ফেলা যায়। আর ওমনি ওই সিরিয়াস কথা কিংবা মন খারাপের ব্যাপারটা কনভার্ট হয়ে মজার কথায় রূপান্তরিত হয়। আবার বড় বড় জটিল সমস্যা গুলো এক নিমিষে সমাধান হয়ে যায়। উদাহরণ স্বরূপ নামিরার সমস্যাটাই ধরা যায়।

___________

খান বাড়িতে গমগম পরিবেশ। খান সাহেব গম্ভীর মুখে বসে আছেন ড্রয়িং রুমে। পাশে তার বিবি। আর তাদের দু’পাশ থেকে বসেছে বাসার বাকি সদস্যরা। এক গম্ভীর আলোচনা চলছে আধঘন্টা যাবত। খান সাহেব সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না কোনটা ঠিক হবে আর কোনটা ভুল। তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। তুর্জর মা-বাবা, এবং তুর্জ নিজেও একাধিক বার কল করে তাদের কাছে মাফ চেয়েছে। তাদের বক্তব্য তারা ইশাকে চায়, তাদের আর কোনো চাওয়া নেই। তুর্জ রাগের মাথায় একটা অন্যায় করে ফেলেছে, যেটা আসলেই ক্ষমার অযোগ্য! তবে, এটাও সত্যি সে ইশাকে ছাড়া কিছুতেই থাকতে পারবেনা। ইশাকে সে মন দিয়ে ফেলেছে। প্রতিটা দিন গুমরে গুমরে ম*র*ছে ইশাকে হারানোর য*ন্ত্র*ণায়। কান্নাকাটিও করছে তুর্জ। সবটাই একটু একটু করে বুঝিয়ে বললেন তুর্জর মা রূপা বেগম।

ইশাকে ডেকে পাঠালেন খান সাহেব। তিনি ইশার মুখ থেকেই শুনতে চান ইশার কি মত? যদি ইশা তুর্জকে মাফ করতে পারে তবে তিনি তুর্জকে আরেকটা সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবছেন। যদি ইশা না করে তবে, না-ই।

“ইশানি, তুর্জকে কি তুমি ক্ষমা করতে চাও? তোমার মন কি বলে?;

নানাজানের প্রশ্নে ইশা ভাবনায় তলিয়ে গেলো। এমন নয় যে তুর্জ শুধু খান সাহেবের কাছেই ওর জন্য আকুতি মিনতি করেছে, কিংবা কেঁদেছে! তুর্জ ওর কাছেই একই ভাবে কেঁদে কেটে ভাসিয়েছে। তার শুধু একটাই কথা, সে ক্ষমা চায়।

সবার দৃষ্টি ইশার উপর। তিতির এসে ইশার হাত ধরে দাঁড়ালো। মনে সাহস দিয়ে বলল,

“ভয় পাস না। তোর মন যা বলে সেটাই কর।;

ইশা মায়ের দিকে তাকালো। মরিয়ম বিবি মেয়েকে চোখের ইশারা আস্বস্ত করলেন। এরপর ইশা বড় মামির দিকে তাকালেন। আফিয়া বেগম অসহায় চোখে তাকিয়ে আছেন ইশার দিকে। যেন সে চায়না, তুর্জর মতো ছেলেরা মাফ পাক। এটাই তাদের সারাজীবনের শাস্তি হোক। ইশা বেশিক্ষণ দেখতে পারলোনা বড় মামির পানে। খান সাহেবও চান তুর্জকে ক্ষমা করতে। বেশ বুঝতে পারছে ইশা। ইশা এবার শ্রাবণের পানে তাকালো। গম্ভীর রাগি মুখটা নীচু করে রেখেছে শ্রাবণ। মুখটা ঠিক করে দেখতেও পারছেনা ইশা। বুক ভরে দীর্ঘশ্বাস এলো ওর। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নানাজানের পানে তাকালো। বলল,

“এতো করে যখন বলছে, তবে ক্ষমা করে দাও নানাজান। ভুল তো মানুষেরই হয়।;

বুকের ভেতরটায় যেন কেউ পা*ষাণের মতো ছুরি বসিয়ে দিলো শ্রাবণের। র*ক্তক্ষরণ শুরু হলো তৎক্ষনাৎ। আচমকা দাঁড়িয়ে গেলো শ্রাবণ। ইশা চকিতে শ্রাবণের পানে তাকাতেই সামনে থেকে বলে উঠলেন খান সাহেব,

“যাক। আমার নাতনি যখন ক্ষমা করতে রাজি তখন আমাদেরও আর কোনো আপত্তি নেই। বিয়ের কথা আগাতে পারি তাহলে,কি বলো সকলে?;

ইশার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো নানাজানের শেষোক্ত উক্তিতে। সে তো কেবল ক্ষমা করার কথা বলেছে, বিয়ে তো সে করতে চায়না।

শ্রাবণ তাচ্ছিল্য মিশ্রিত হাসলো। যা দেখে ভেতরটা ফেটে চৌচির হয়ে গেলো ইশার। হাহাকার আরম্ভ হলো অন্তরের অন্তস্তলে। তীব্র চিৎকারে বাড়ি মাথা তুলে জানাতে ইচ্ছে করলো, সে এই বিয়ে করতে চায়না।

সবার কথার মাঝে প্রস্থান করলো শ্রাবণ। শ্রাবণের যাওয়ার পানে আহত নয়নে তাকিয়ে আছে ইশা। শ্রাবণ বড্ড কষ্ট পেয়েছে তার এই জবাবে। আবারও কষ্ট দিলো মানুষটাকে।

হাতের কাছে যে কয়টা শার্ট পেলো সব একসাথে করে ব্যাগের মধ্যে ভরছে শ্রাবণ। মাথার মধ্যে টগবগিয়ে র*ক্ত ঝড়ছে। আর এক মুহুর্তে এই বাড়িতে থাকলে হয়তো প্রলয়ঙ্কারী কান্ড ঘটিয়ে বসবে। সে নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারছেনা এই রাগের সামনে। সে কেন বারবার ভুলে যায়, ইশা তাকে চায়না ওর জীবনে! কেন ভুলে যায়?

“ক্ কোথায় যাচ্ছো তুমি? এগুলো কেন গোছাচ্ছো? কি হলো জবাব দাও। কোথায় যাচ্ছো তুমি?;

দৌড়ে এসে শ্রাবণের ঘরে ঢুকলো ইশা। শ্রাবণ এদিক সেদিক থেকে তার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো তুলে নিয়ে ব্যাগে ভরছে। ইশাও ঘুরছে তার পায়ে পায়ে। গলার স্বরে মনে হচ্ছে কাঁদছে সে।

“শ্রাবণ ভাই একটু দাঁড়াও। একদন্ড দাঁড়িয়ে আমার কথাটা একটু শোনো প্লিজ?;

শ্রাবণ আপন মনে আছে। তার রুমে সে ছাড়া আদৌও কেউ আছে কিনা, তার হাবভাবে একদম বোঝার উপায় নেই।

“প্লিজ শ্রাবণ ভাই, আমার কথাটা একটু শোনো? আমি জানতাম না নানাজান তুর্জকে আগেই ক্ষমা করে দিয়েছে! নানাজান তুর্জর সাথেই যে আমাকে বিয়ে দিতে চায় কিংবা সে যে আমার ক্ষমা করার অপেক্ষায় ছিলো আমি কিভাবে বুঝবো? বলো আমাকে? আমি কিভাবে বুঝবো? আমি তো শুধু তুর্জকে ক্ষমা..;

হাত উঠিয়ে দিলো ইশাকে থামিয়ে দিলো শ্রাবণ। র*ক্তিম চোখে ইশার দিকে তাকিয়ে রা*গি গলায় বলল,

“তুর্জ তোকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। সো? ইনজয় ইওর লাইফ।;

ইশা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। শ্রাবণের হাত দুটো ধরে অসহায় গলায় বলল,

“আমার চাইনা এই ভালোবাসা। আমি ওকে বিয়ে করতে…;

“চাস। তুই ওকেই বিয়ে করতে চাস। আর তাইতো, এতকিছুর পরেও মানবদরদীর মতো এক কথাও ওকে ক্ষমা করে দিলি।;

“তুমি আমাকে ভুল…;

“জাস্ট শাটআপ ইশা! আর একটা কথা বললে কিন্তু আমার হাত উঠে যাবে। আর আমি চাইনা, তুর্জর মতো এভাবে নিজের পুরুষত্ব জাহির করতে।;

বলেই আবার নিজের ব্যাগ গোছাতে শুরু করলো শ্রাবণ। ইশা আবারও ছুটে গেলো শ্রাবণের কাছে। পেছন থেকে শ্রাবণের হাত টেনে ধরে কান্না জড়ানো গলায় বলল,

“তোমার যা খুশি তুমি করো! আ্ আমি কিছু বলবনা।;

“হাত ছাড়!;

শান্ত গলায় বলল শ্রাবণ। ইশা কাঁদতে কাঁদতে বলল,

“না আমি ছাড়বোনা। তুমি আগে বলো, তুমি কোথায় চললে এতো রাতে? ব্যাগ গুছিয়ে কোথায় যাবে?;

শ্রাবণ জবাব দিলো না। এক ঝাটকায় ইশার হাত থেকে নিজের বাহু ছাড়িয়ে নিয়ে ব্যাগের চেইন লাগিয়ে কাঁধে তুললো ব্যাগটা। ইশা ধাক্কা খেয়ে দু’কদম পিছিয়ে গেলো। শ্রাবণ হাঁটা ধরেও আবার দাঁড়িয়ে পড়লো। ইশার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে তাচ্ছিল্য করে বলল,

“বারবার বোকার মতো তোর কাছে ছুটে আসি বলে, এই না যে আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারবোনা। আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারবো! আলবাত পারবো। আর এই পারাটাকেই আমার সারাজীবন ধরে রাখতে চাই! আমি আর তোর মুখ দেখতে চাইনা।;

ইশা এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলো! ছুটে এসে শক্ত করে ধরলো শ্রাবণকে। কাঁদতে কাঁদতে আকুতি জানিয়ে বলল,

“আমি সইতে পারবোনা এই পীড়া! তুমি এতোটা পা*ষাণ হয়োনা শ্রাবণ ভাই। আমি যে ম*রে যাবো তোমার বিরহে!;

তাচ্ছিল্য করে হেসে উঠলো শ্রাবণ। ইশাকে দূরে সরিয়ে দিলো নিজের থেকে। দু’কদম পিছিয়ে তাচ্ছিল্যের গলাতেই বলল,

“নারী বড় রহস্যময়ী!;

কাঁদছে ইশা। কি করে আটকাবে সে মানুষটাকে। তার বলা কথাগুলো যদি সত্যি হয়, তাহলে যে সে সত্যি সত্যি ম*রে যাবে!

“তুর্জ তোকে অনেক সুখে রাখবে!;

“চাইনা আমার এই সুখ।;

“তুই ডিসিশন নিয়ে নিয়েছিস ইশা। আমাকেও আমার ডিসিশন নিতে দে।;

ইশা আকস্মিক পা জড়িয়ে ধরলো শ্রাবণের। শ্রাবণ হকচকিয়ে গেলো। ইশা তার পা’দুটো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলল,

“তুমি এটা করতে পারোনা শ্রাবণ ভাই!;

“পা ছাড়!;

“আমি ছাড়বোনা। তুমি আমাকে এই বিরহ য*ন্ত্র*ণায় এমন করে একা ফেলে যেতে পারোনা! আমি তোমাকে যেতে দিবোনা।;

“ইশা পা ছাড়, আমি আর এক মুহুর্ত এখানে থাকবোনা। পা ছাড়!;

শ্রাবণ বজ্র কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো। ইশা আঁতকে উঠে পা ছেড়ে দিলো শ্রাবণের। শ্রাবণ আর এক দন্ডও দাঁড়ালো না। হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেলো।

#চলবে
#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব____১৮.

অক্টোবরের শেষ। শীতের বাতাস এখনই নাকে ঠেকে। নরম রোদের মৃদু আলো আর শীলত হাওয়া। সবটাই মন ভালো করে দেওয়ার আস্ত কিছু উপকরণ। কিন্তু এতেও মন ভালো হয়না কারোর কারোর। মনে করিয়ে দেয় ব্যর্থতার কথা। মনে করিয়ে দেয় কি পেতে গিয়েও যেন হারাতে হয়েছে নিজের বোকামির জন্য। ইশাও ঠিক তাই। নিজের বোকামির ফলে আবারও কতটা দূরত্ব হয়ে গেছে শ্রাবণের থেকে। শ্রাবণ কুমিল্লা চলে গিয়েছে আজ তিনদিন। তিনদিনে না কারোর সাথে যোগাযোগ করেছে আর না যোগাযোগ করার কোনো মাধ্যম রেখেছে। তার ফোন বন্ধ সেদিন থেকেই। রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা ফোন হাতে নিয়ে শুধু শ্রাবণের নাম্বারে ডায়াল করে গেছে ইশা। তবে ওপাশ থেকে শুধু একটাই জবাব, ‘আপনার কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটি এই মুহুর্তে বন্ধ আছে অনুগ্রহ করে আবার চেষ্টা করুন, ধন্যবাদ। অতিষ্ঠ হয়ে ফোনটাকে অসংখ্য বার ছুঁড়ে ফেলেছে ইশা। শ্রাবণের কন্ঠ শোনার জায়গায় অসংখ্য বার এই মহিলার গলা শোনাতে সে ধৈর্য্য হারা হয়ে পড়েছে। তারপরও যোগাযোগ করার কোনো সুযোগ হয়ে ওঠেনি।

আজ ভোর ভোর ক্লাস পড়াতে ৫দিনের বন্ধ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটেছে নামিরাকে নিয়ে। নামিরাও এসে ওর কাছে উঠেছে আজ তিনদিন। শ্রাবণ আর ইশার ব্যাপারে সবটাই সে জানে। তবে এই জানার কোনো মূল্য নেই। কারন, এই সমস্যা থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য বিশেষ সমাধান দিতে পারছেনা ইশাকে।

“কিরে, কোন দুনিয়ায় ডুবে আছিস?;

কলম দিয়ে খোঁচা মে/রে ইশাকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনলো নামিরা। ইশা চমকে ওঠে আশেপাশে তাকিয়ে সশব্দে বলে উঠলো,

“ইয়েস প্রেজেন্ট স্যার!;

ইকোনমিকস ক্লাস চলছে। ইকোনোমিকসের টিচার পারভেজ সাহেব মোটা চশমার উপর থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন ইশার পানে। নামিরা কপাল চেপে ধরলো। আশেপাশের স্টুডেন্টরা কেউ কেউ মুখ টিপে হেসে দিলো। পারভেজ সাহেব ইশার প্রতি ক্ষীপ্র হয়ে বললেন,

“কিসের প্রেজেন্ট?;

ইশা বোকার ন্যায় কতক্ষন তাকিয়ে থেকে মাথা চুলকে নামিরার পানে তাকালো। তবে এতেই যেন তার কাছে সব ক্লিয়ার হলো। সঙ্গে সঙ্গে জিভ কেটে পূণরায় মাথা চুলকাতে চুলকাতে স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল,

“স সরি স্যার।;

পারভেজ সাহেব আর মনোযোগ দিলেননা এদিকে। তিনি পূণরায় পড়ানো শুরু করলেন। ইশা নামিরার দিকে পূণরায় ফিরে ওর পিঠে ধুম করে এক কিল বসিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,

“কেস খাওয়ালি কেন?;

নামিরার পিঠ বেঁকে গেলো। চোখমুখ কুঁচকে অসহায় গলায় বলল,

“স্যার ম্যাথ করাচ্ছে, ইক্যুয়েশন জিজ্ঞেস করছে সবার কাছে!;

নামিরার অসহায়ত্বের ছাপ এবার ইশার চোখে মুখে ফুটে উঠলো। পূণরায় স্যারের দিকে তাকিয়ে দেখলো পারভেজ সাহেব এক এক করে ওদের সারিতেই এগিয়ে আসছেন। শুঁকনো গলায় ঢোক গিললো ইশা। নামিরাকে খোঁচাতে খোঁচাতে বলল,

“আ্ আমি আজ বাঁচব না রে নামু! এই ইকোনমিকস এর ইক্যুয়েশন পড়তে পড়তে কোনদিন দেখবি শহীদ হয়ে গেছি!;

“আরে এতো প্যারা নিসনা। এটা দেখ। এটাই মনে হয়।;

বলতে বলতে খাতাটা এগিয়ে দিলো নামিরা। ইশা ঢোক গিলে বলল,

“তোর মনে হওয়া দিয়ে আমি বেঁচে থাকতে পারবোনা! থাক তুই, আমি গেলাম।;

বলেই উঠে পেছনের দরজা দিয়ে স্যারের চোখের আড়ালে পালিয়ে গেলো ইশা। নামিরা ইশার কান্ড দেখে আতংকে একাকার হয়ে গেলো। পারভেজ স্যারের চোখ বড় পাকা। তার চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যাওয়া চারটি খানি কথা নয়। কিন্তু ইশা বেরিয়ে গিয়েছে। ভ*য়ে বুকে পাথর চাপা পড়লো নামিরার। ইশাকে ঠিক মতো বেরিয়ে যেতে দেখে একটু হলেও স্বস্তি পেলো বেচারি।

ইশা এক দৌড়ে এসে ক্যান্টিনে থামলো। হাঁপাতে হাঁপাতে একটা চেয়ার টেনে বসে গলা উঁচিয়ে পানি চাইলো রাসেলের কাছে। রাসেল এই ক্যান্টিনে কাজ করে প্রায় ১০বছর। স্বল্প বেতনের, অধিক খাটুনি হলেও এই ক্যান্টিনের জব সে কিছুতেই ছাড়তে পারেনা। আলাদা এক মায়া জন্মে গেছে তার গোটা ক্যাম্পাসটা জুড়ে। প্রতিটা স্টুডেন্টের সাথে তার আলাদাই এক সখ্যতা। যদিও দেয়ালে বড়বড় করে লেখা রয়েছে, ‘সেল্ফ সার্ভিস’ তারপরও সে সবার জন্য নিজের হাতে খাবার নিয়ে আসে। নিজের হাতে সার্ভ করে। মুলত এটাই তার ভালোবাসা প্রকাশের আসল মাধ্যম। একদম পেছনের মাথা থেকে একটা পরিচিত গলা পেয়ে এক বোতল পানি নিয়ে চলে যায় রাসেল। ইশা টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে রাখে। রাসেল গিয়ে ওর সামনো দাঁড়িয়ে পানিটা এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ইশানি আপা, পানি লন।;

ইশা মুখ তুলে তাকায়। রাসেলকে দেখে মৃদু হেসে পানির বোতলটা নিয়ে বলল,

“বড্ড গলা শুঁকিয়ে গেছে রাসেল ভাই।;

“দৌড় দিয়া আইলেন মনে হইলো!;

ইশা পানি খেতে খেতে চোখ বড়বড় করে তাকালো রাসেলের পানে। অতঃপর এক নিঃশ্বাসে অর্ধেক পানি সাবাড় করে বলল,

“উফফ, আর বলোনা! পারভেজ স্যারের ইকোনমিকস ইক্যুয়েশন একদিন আমার দফারফা করে ছাড়বে।;

“ওমা কি কন! শ্রাবণ ভাই কিন্তু পারভেজ স্যারের পছন্দের ছাত্র আছিলো। হেয় তো সারাদিন পারভেজ স্যারের এই সব ইক্ ইক.. কি জানি কয়! যাই হোউক, হেইয়া নিয়াই থাকতো। পারভেজ স্যারেও অনেক খুশি হয়া যাইতো হের উপর।;

শ্রাবণের কথা শুনে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলো ইশার। তবে সেটা নিয়ে বিশেষ না ভেবে রাসেলের উদ্দেশ্যে বলল,

“শ্রাবণ ভাই তো শ্রাবন ভাই-ই। তাকে নিয়ে বিশেষ কিছুই বলার নেই।;

” হ তা ঠিকই। তা আপনে কিছু খাইবেন? সিঙারা দিমু?;

“না গো। নামুকে একা ফেলে এসেছি বাঘের গুহায়। আর এখন যদি ওকে ছাড়া সিঙারাও খেয়ে ফেলি, তবে আমার গর্দান নেবে ও।;

ইশার কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে হো হো করে হেসে উঠলো রাসেল। মাথা দুলিয়ে বলল,

“আইচ্ছা, তাইলে নামিরা আপা আসুক।;

“হ্যাঁ, আসুক।;

চলে গেলো রাসেল। ইশা দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে ফোনটা বের করে হাতে নিলো। একহাতে বাকি পানি টুুকু খেতে খেতে অন্যহাতে শ্রাবণের নাম্বারটা ডায়াল করলো। কিছু না ভেবে কল লাগিয়ে দিলো। কয়েক সেকেন্ড পার হতেই সেই ভদ্র মহিলা বলে উঠলো,

“The number you dialled is currently unreachable!; ফোনটা কান থেকে নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ইশা।

ক্যান্টিন এখন পুরোই খালি। ক্লাস টাইমে হাতে গোনা কয়েক জন ছাড়া ক্যান্টিনে তেমন লোক সমাগম দেখা যায়না। এরকম একটা সময়েরই সুযোগ খুঁজছিলো তুর্জ। আশেপাশে ভালো করে পরখ করে তবেই ঢুকলো ক্যান্টিনে। ইশার সাথে সামনাসামনি কথা বলবে বলে সেই সকাল থেকে ক্যাম্পাসের মাঠে অপেক্ষা করছে সে। আর এখন প্রায় দুপুর। এতক্ষণ ওয়েট করেও ইশার সাথে দেখা হওয়ার আশাটা একদম শূন্য ছিলো। তবে ভাগ্য তার সহায় হলো। হঠাৎই দূর থেকে দেখতে পেলো ইশাকে। ক্লাস থেকে বের হয়ে দৌড়ে যাচ্ছে ক্যান্টিনের দিকে। সে আর দেরী করলোনা। ইশার সাথে জনমানবহীন জায়গায় কথা বলতে চায় সে। তাই ক্যান্টিনের বাইরেও অপেক্ষা করলো খানিকটা সময়। অবশেষে অপেক্ষার পালা মিটলো। ক্যান্টিন পুরো ফাঁকা হয়ে যেতেই ক্যান্টিনে প্রবেশ করলো সে।

“ভাই, সিগারেট দিমু?;

টংয়ের দোকানে একটা বেঞ্চে অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে শ্রাবণ। ব্যাচে জুনিয়র চারটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে তার দু’পাশে। তার মধ্যে একটা ছেলে বলল কথাটা। শ্রাবণ গম্ভীর গলায় বলল,

“ল একটা।;

ছেলেটা উৎসাহিত হয়ে দোকানীর থেকে ভালো দামের একটা সিগারেট নিলো। সিগারেটটা শ্রাবণের মুখে তুলে দিয়ে ম্যাচের কাঠি তুলে আগুনও ধরিয়ে দিলো। শ্রাবণ কপালে ভাজ ফেলে দু-তিন টান দিয়ে সিগারেটটা নামিয়ে নিলো। ভেতরের কষ্ট গুলোকে ধোঁয়ার সাহায্যে উড়িয়ে দিতে দিতে বলল,

“ইশার ক্লাস কখন শেষ হবে? আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারবোনা। বিকেলে একটা মিটিং আছে। ওকে এক পলক দেখেই বাসে উঠবো।;

“ভাই, সেই কুমিল্লা থেইক্কা চার-পাঁচ ঘন্টা জার্নি কইরা আহেন আবার যান! তাও বাড়িত যাননা। এমনে হইলে কি হইবো কন?;

“ওকে না দেখে থাকতে পারিনা। কি করবো বল?;

ব্যাথাতুর কন্ঠস্বর শ্রাবণের। কাউকে বুঝতে দিবেনা সেই বাহানায় কথাটা বলেই আবার সিগারেটে টান দেয়। ওরা চারজনে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। তন্ময় নামের ছেলেটা একটু ক্ষেপাটে ধরনের। রেগেমেগে বলে উঠলো,

“ভাই রাহেন তো এই ফ্যামিলি পারাম্পারা। ভাবিরে লইয়া চইলা যান। তারপর বিয়া কইরা লন। তাইলেই তো হয়। ঝামেলা মিটমাট।;

তন্ময়ের কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো শ্রাবণ। পরপর দু’বার সিগারেটে টান দিয়ে বলল,

“সেই তো চায়না আমার সাথে থাকতে। অন্যকে কি বলি?;

“না ভাই, এডা হইতে পারেনা। ভাবি আপনারে অনেক চায়। আপনে তো জানেন, মেয়েদের মন বোঝা এতো সোজা না।;

“হু, আসলেই! মেয়েদের মন বোঝা আসলেই সোজা না।;

বড্ড বিধ্বস্ত লাগছে শ্রাবণকে। শুঁকিয়ে যাওয়া মুখ, সিগারেটে পোড়া ঠোঁট আর এলোমেলো চুল। পড়নের সাদা শার্টটার এক হাত ঝুলে আছে তো অন্যহাত সুন্দর করে ফোল্ড করা। গলার টাইটা এখনও ঝুলছে। রাতের মিটিংটা শেষ করে বাসে উঠে যায়। পাগলের মতো হন্নে হয়ে ছুটে আসে ঢাকা। সেই ভোর থেকে এখনও অব্দি ইশার ভার্সিটির বাইরে টংয়ের দোকানে বসে আছে। তাকে এক পলক দেখবে বলে।

“ভাই, ভাবি আইতাছে! ওমা ঐডা আবার কেডা?;

রফিক নামের ছেলেটা প্রথম বাক্যটা বড় উৎসাহের সাথে বললেও পরের বাক্যটা আওড়াতে আওড়াতে বিস্ময়ে ঢাকা পড়লো তার গলার স্বর। শ্রাবণ চটজলদি তার হাতের সিগারেটটা ফেলে দাঁড়িয়ে গেলো। তবে পূণরায় তাকে বসে পড়তে হলো ইশা আর তুর্জকে হাত ধরাধরি করে আসতে দেখে। ভেতরটা যেন ঝ*লসে যেতে লাগলো শ্রাবণের। মন ভা*ঙার শব্দ নেই, তবে পীড়া তো আছে! মন ভে*ঙে যাচ্ছে তার। বড় করুণ ভাবে মন ভে*ঙে যাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখার জন্য তো বারবার ছুটে আসেনা সে।

তুর্জ একটা রিক্সা ডাকলো। ইশা এলোমেলো পায়ে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে তুর্জর দেখানো রিক্সায় উঠে গেলো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তুর্জও উঠে বসলো ইশার পাশে। তুর্জ কিছু বলছে ইশাকে। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ইশার মাথাটা তার কাঁধে রাখলো। ইশা কোনো বাঁধা দিচ্ছেনা। তুর্জ ইশার কোমর জড়িয়ে ধরলো আপত্তিকর ভাবে। ইশার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলোনা। তুর্জ রিকসাওয়ালাকে বলে রিক্সার হুড লাগিয়ে দিলো। অতঃপর রিক্সা চলতে শুরু করলো।

এই পুরো দৃশ্যটা শ্রাবণের চোখের সামনেই ঘটলো। কিন্তু সে নির্বিকার। তন্ময়, রফিক, শাফিন আর হৃদয় রাগে ফোঁস ফোঁস শব্দ করছে। শ্রাবণকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে যেমন অবাক হচ্ছে, ওদিকে ঐ বাইরের ছেলেটাকে ইশার সঙ্গে এতো ক্লোজ হতে দেখে সহ্য করতে পারছেনা একদম।

“ভাই, আপনে চুপ থাকবেন? কিছু কইতাছেন না কেন?;

তেড়ে যেতে লাগলো ওরা চারজন। শ্রাবণ বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গম্ভীর গলায় বলল,

“দাঁড়া! যেতে দে ওদের।;

“কিন্তু ভাই..;

“বললাম তো যেতে দে।;

রাগান্বিত গলায় চেঁচিয়ে উঠল শ্রাবণ। ওরা চারজন শ্রাবণের রাগ দেখে চুপসে গেলো। রিক্সা ততক্ষণে ওদের দৃষ্টির অগোচরে বিলুপ্ত হয়েছে। শ্রাবণ আবারও দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ওদের উপর ক্ষিপ্র হয়ে লাভ নেই। তাই পূণরায় শান্ত গলায় বলল,

“ও ইশার হবু স্বামী। ওর সম্পুর্ন অধিকার আছে ইশার উপর। আর ইশাও রাজি এই বিয়েতে।;

“ভাই, কি বলতাছেন?;

আহত হলো ওদের মন। কথাটা বলে উঠলো হৃদয়। শ্রাবণ মাথা নাড়ে। একটা ঢোক গিলে কিছুক্ষন চুপ থেকে পূণরায় বলে,

“আমার জন্য বাসের টিকিট কিনে নিয়ে আয় যা। ওকে দেখতে এসেছিলাম, দেখা শেষ। এবার ফিরতে হবে।;

শ্রাবণের মনের কঠিন অবস্থা বোঝার সাধ্য হয়তো কারোর নেই, তবে কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে ওরা। এতেই যেন ওদের ভেতরটা জ্ব*লছে। না জানি শ্রাবণের ঠিক কেমন অনুভূতি হচ্ছে।

শাফিন আর তন্ময় প্রস্তুত হলো টিকিট আনতে যাওয়ার। রফিক আর হৃদয়কে শ্রাবণকে দেখতে বলে তারা বের হতেই আবার দাঁড়িয়ে পড়লো নামিরাকে দেখে। নামিরা দৌড়ে এসে দাঁড়ালো মাঝরাস্তায়। আশেপাশে চাতক পাখির মতো দৃষ্টি ঘুরিয়ে খুঁজতে লাগলো কিছু। শাফিন আর তন্ময় সন্দিহান নয়নে তাকালো। শ্রাবণকে ডেকে বলে উঠলো,

“ভাই, ঐডা তো ভাবির বান্ধবী না?;

শ্রাবণ মুখ উঁচিয়ে তাকালো। নামিরাকে দেখে হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বলল,

“হু।;

“দেইখা মনে হইতাছে কাউরে খুঁজতাছে। ডাক দিমু?;

“দরকার নেই। তোরা যে কাজে যাচ্ছিলিস, যা।;

শ্রাবণের বারন শুনে ওরা আর কথা বাড়ায় না। চলে যেতে উদ্যোত হয়। ঠিক তখনই ওদিক থেকে ডাক পড়ে নামিরার।

“শাফিন, তন্ময়?;

নামিরার ডাক শুনে এবার শ্রাবণও একটু বিচলিত হয়। শাফিন আর তন্ময় পূণরায় শ্রাবণের উদ্দেশ্যে বলে,

“ভাই, আমগোই তো ডাকতাছে।;

“কোনো বিপদ হইলো না তো?;

শ্রাবণও সেটাই ভাবছে। বলল,

“যা তো। দেখে আয়।;

শাফিন আর তন্ময় দৌড়ে যায় নামিরার কাছে। নামিরা ওদের পেয়ে অসহায় গলায় বলে,

“তোমরা ইশাকে চিনো তো?;

তন্ময় বড় আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে উঠলো,

“হ ভাবিরে আবার চিনমুনা… থুরি, ইশা আপুরে তো চিনি।;

কথাটা মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেলেও সামাল দিলো পরক্ষণেই। নামিরা প্রায় কেঁদে ফেলার উপক্রম। কান্না জড়ানো গলায় বলল,

“ত্ তোমরা ইশাকে এক্ষনি কারোর সাথে যেতে দেখেছো?;

কথাটা শুনে দু’জনের মাঝে বো/মা ফাটলো যেন। একে-অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে একটু রাগান্বিত হয়ে বলল,

“হ দেখছি! শ্রাবণ ভাই বলল, ওটা নাকি ইশা আপুর হবু স্বামী।;

নামিরার চোখের এক রাজ্যের বিস্ময় নেমে এলো।

“শ্রাবণ ভাই? শ্রাবন ভাইকে কোথায় পেলে তোমরা?;

অবিশ্বাস্য গলায় প্রশ্ন করলো নামিরা। শাফিন টংয়ের দোকানের দিকে ইশারা করে বলল,

“ঐ যে, ঐদিকে ভাই।;

নামিরা আর এক সেকেন্ড দেরী করলোনা। পা*গলের মতো ছুটলো সেদিকে। নামিরার চোখমুখে আতংক। শ্রাবণকে দূর থেকেই দেখতে পেয়ে কেঁদে দিলো। এক দৌড়ে শ্রাবণের সামনে এসে দাঁড়িয়ে কান্না জড়ানো গলায় বলে উঠলো,

“ভাইয়া, ইশার বড় বি*পদ! ইশাকে বাঁচান!;

নামিরার কথায় শ্রাবণের কপাল চওড়া হয়ে গেলো।

“বিপদ মানে? কি হয়েছে!;

“তুর্জ ইশাকে কোথায় যেন নিয়ে গেছে!;

শ্রাবণের চওড়া কপাল কুঁচকে গেলো। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে অভিমানি গলায় বলল,

“হ্যাঁ দেখলাম তো, দু’জনে হাত ধরাধরি করে বের হলো। রিক্সায় উঠেও তুর্জ কাঁধে ঢলে পড়েছে ইশা। সবটাই দেখেছি।;

“ভাইয়া সেদিন আপনি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর ইশা নানাজানের সাথে কথা বলে। নানাজানকে ইশা বুঝিয়ে বলে সে তুর্জকে বিয়ে করতে চায়না। নানাজান ওর কথায় আর আপত্তি করেনা। সেদিন থেকেই তুর্জদের সাথে ওর সব সর্ম্পক চুকে যায়। সেখানে আজ.. আজ ইশা হঠাৎ তুর্জর সাথে এভাবে কোথায় যাবে আপনিই বলুন? আমার তো কিছু ঠিক মনে হচ্ছে না।;

শ্রাবণের মাথায় যেন আকাশ ভে*ঙে পড়ে। বি*স্ফো*রিত নয়নে নামিরার পানে তাকিয়ে বলে,

“মানে?;

“হ্যাঁ ভাইয়া। আমার মনে হচ্ছে, আমাদের সবার চোখের আড়ালে কোনো অ*ঘটন ঘটতে চলেছে। প্লিজ আপনি কিছু একটা করুন। প্লিজ!;

“তন্ময়, গাড়ি বের কর!;

নামিরার কথার জবাব না দিয়ে শ্রাবণ বজ্র কন্ঠে চেঁচিয়ে বলল কথাটা। ওরা সবাই বাইক বের করলো যার যার। শ্রাবণ বাইক নিয়ে নামিরাকে উঠতে বলল তার সাথে। আরও দুটো বাইকে রফিক-তন্ময়, শাফিন আর হৃদয় উঠে পড়লো। শ্রাবণ বাইক স্টার্ট দিলো, যেদিকে ইশাদের রিক্সাটা গেলো।

#চলবে

ডাকপিয়নের ছুটি নেই পর্ব-১৪+১৫+১৬

0

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই ♥️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_____১৪

মেঘাচ্ছন্ন আকাশে হঠাৎই বজ্রপাতের আহাজারি শুরু হলো। গুড়ুম গুড়ুম শব্দে মেঘের প্রতিটি খন্ড দিগুণারে খন্ডিত হচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ বিকট শব্দ। আঁতকে উঠে শ্রাবণের শার্টের হাতা খামচে ধরলো ইশা। শ্রাবণ পাশ ফিরে বাইরে তাকালো। ঝড় হাওয়া শুরু হয়েছে। আকাশ পাতাল এক করে তীব্র বাতাসে লেগুনা চালক গাড়ি থামিয়ে দিলো। যাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলল,

“বইন্যা শুরু হইছে! গাড়ি দশ মিনিট পর চালাইতে হইবো।;

একটা দোকানের সামন গাড়ি থামালো লেগুনা চালক। এক এক করে সবাই গাড়ি থেকে নেমে গেলো। ইশা তখনও স্থবির হয়ে বসে আছে। দু’হাতে শ্রাবণের শার্ট খামচে ধরা। শ্রাবণ ইশার মতিগতি পর্যবেক্ষণ করলো। ভয় পেয়ে আছে ইশা। যা বুঝে শ্রাবণ ইশার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

“এখানে বসে থাকা রিস্কি। বাইরে চল। দেখি, কোথাও থাকার ব্যবস্থা করা যায় কিনা।;

ইশা ভ/য় জড়ানো গলায় বলল,

“আমরা যদি বন্যার কবলে পড়ে ম/রে যাই শ্রাবণ ভাই?;

“ম/র/ন এলে ম/র/বো। অসুবিধা তো নেই!;

“আমি এতো করুণ ভাবে ম/র/তে চাইনা!;(কাঁদো কাঁদো গলায়) যেখানে ম/রা/র সময় একটু টক বা ঝালও খেতে পারবোনা!;

শ্রাবণ বোকা চোখে তাকিয়ে রইলো ইশার পানে। তেমন গলাতেই প্রশ্ন করলো,

“এই ম/রা/র সময় টক আর ঝাল খেয়ে কে ম/রে?;

“ওমা, এখন আমি ম/রে যাচ্ছি, তো ম/রা/র আগে একটু আমার পছন্দ খাবার খেতে চাইবোনা?;

“কোন দেশের পাগলরে তুই?;

শ্রাবণ অতিষ্ঠ কন্ঠে শুধালো ইশাকে। ইশা দাঁত বের করে হাসলো। শ্রাবণ দিলো এক রামধমক। ইশা পূণরায় জড়োসড়ো হয়ে গেলো। তবে এবার বজ্রপাতের শব্দে নয়, বরং শ্রাবণের ধমকে।

মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। আশেপাশের প্যাসেঞ্জাররা সবাই যে যেখানে পারলো দাঁড়িয়ে গেল। শ্রাবণ ইশাকে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালো একটা ভাঙা বাড়ির সামনে। উপরে ছাউনি থাকায় বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা। তবুও দৌড়ে আসতে আসতে অর্ধেক ভিজতে হলো দু’জনকেই। ইশার শাড়ির অবস্থাটা বেশি নাজেহাল হলো। সামান্য জলে যেখানে শাড়ির এপিঠ ওপিঠ স্পষ্ট হয়ে আসে, সেখানে এতোখানি জলে বাদ রাখেনি কিছুই।

“আরব ভাইদের সাথে চলে গেলেই ভালো হতো!;

“সব সময় সব ভালো করতে নেই। দাদাজানকে চিনিস না তুই?;

“আমিও একই কথা বললাম আরব ভাইকে।;

“দাদাজানকে এতো কৈফিয়ত কে দিবে?;

“তুমি।;

“পারবোনা। চুপচাপ দাঁড়া।;

ইশা আর কথা বাড়ালোনা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। ক্যালেন্ডারে অক্টোবর পড়েছে। অক্টোবরে না গরম না ঠান্ডা’ মৌসুম হওয়ার কথা। সেখানে রোজকারের এই বৃষ্টি বন্যায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে শ্রাবণ। বৃষ্টি তার ভালো লাগেনা। সামান্য বৃষ্টিতেই কাদা পানিতে গা গোলায়। বরং ফকফকা রোদ্দুর বরাবর পছন্দ তার। তার সাথে মৃদুমন্দ বাতাস। কিন্তু ইশা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। বৃষ্টির মৌসুম ইশার সবচেয়ে পছন্দ মাস। কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমানো, ছাদে উঠে বৃষ্টিতে ভেজা, খিচুড়ি খাওয়া এ যেন রোজকারের অভ্যাস। খীচুড়ির কথা মনে পড়তেই পেটে ডাক দিলো যেন ওর। মাঝরাতে ক্ষিধে পাওয়াটা আজকাল খুবই কমন একটা রোগ ওর।

ইশাকে পেট চেপে ধরে কাচুমাচু করতে দেখে শ্রাবণ এক পলক তাকালো ওর মুখের দিকে। মুখটা শুঁকনো লাগছে। হয়তো ক্ষিদের জ্বালায়।

“কি হয়েছে, পেট চেপে ধরোছিস কেন?;

ইশা সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ইচ্ছে করলোনা জবাব দিতে। তবুও না দিয়েও উপায় কি?

“এমনিই।;

“ক্ষিদে পেয়েছে?;

ক্ষিদের সময় ক্ষিদের কথা জিজ্ঞেস করাটাও ক্ষিদে বাড়ানোর তারিকা যেন। পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো ইশার। অতিকষ্টে পূণরায় বলল,

“হ্যাঁ, খুব।;

শ্রাবণের কপালে চিন্তার ভাজ দেখা গেলো। সে কপাল কুঁচকে আশেপাশে নজর ঘুরালো। বিশেষ কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে আশেপাশে। আশেপাশে দেখতে দেখতেই পূণরায় শ্রাবণ বলে উঠলো,

“তানির থেকে দুটো সমুচা খেলিনা কেন?;

এই প্রশ্নতো ইশার নিজেরও। কেন খেলোনা?

“ওর খুব ক্ষিদে পেয়েছিলো তো। আমি সেখান থেকে কিভাবে খেতাম?;

“ওর ক্ষিদে পেয়েছে বলে ও একাই খাবে, বাকিরা সব হা করে থাকবে? ওখানে মোট ৮টা সমুচা ছিলো। তুই দুটো খেলে কম পড়তো না ওর।;

ইশা আর কথা খুঁজে পেলোনা। আবারও নিরবতা বিরাজ করলো চারপাশে। বৃষ্টি থামার যেন নামই নিচ্ছেনা। বাতাসের তোড়ে বৃষ্টির ঝাপটা এসে বারবার ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ওদের। শ্রাবণ ইশার হাত ধরে কাছে এনে দাঁড় করিয়ে দিলো। যেন বজ্রপাতের শব্দে পূণরায় ভ*য় না পায়।

হঠাৎ পেছন থেকে যেন দরজা খোলার শব্দ পেলো ওরা দু’জনে। দু’জনেই একসাথে পেছন মুড়ে তাকালো। এক বৃদ্ধ হারিকেন হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার উপর বহুকাল পুরোনো একটা ছাতা। ইশা আর শ্রাবণকে এক পলক দেখে ধীর গলায় বলে উঠলো,

“বৃষ্টিতে আঁটকা পড়েছো বাবা?;

শ্রাবণ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। দূরে দেখিয়ে বলে,

“ওখানেই নেমেছি। তবে, দাঁড়ানোর জায়গা ছিলোনা বলে..;

“আমার বাসা খালিই আছে। তোমরা চাইলে আমার বাসায় উঠতে পারো।;

শ্রাবণ লোকটাকে ডিঙিয়ে পেছনের দিকে দৃষ্টিপাত করলো। ঘরের বাইরেটা টুকিটাকি ভাঙাচোরা হলেও ভেতরটা এতোটাও খারাপ লাগছেনা। দেখে ঠিকঠাকই মনে হচ্ছে।

“ওভাবে দেখছো কি? ভাঙাচোরা ঘর?;

“না না! এমন কিছু নয়। এতো রাতে আপনাকে শুধু শুধু কষ্ট দেওয়ার কোনো মানেই হয়না। তাই ভাবছিলাম..;

“ওতো ভাবাভাবি রাখো দেখি। আমি প্রতিদিন রাতে একবার করে বের হই। ভাবি আমার ছেলে আর বউমা বুঝি এলো। দেখো আজ সত্যি সত্যি আল্লাহ আমার ছেলে আর বউমার মতোই কাউকে পাঠিয়ে দিলো। এসো এসো, ভেতরে এসো।;

শ্রাবণ আর বাঁধ সাধলো না। ইশাকে নিয়ে বৃদ্ধর পেছন পেছন চলে গেলো। ঘরে ঢুকতেই বৃদ্ধ হইহই করে গলা ছাড়লো,

“ও বুড়ি, বুড়ি? দেখো কারা এসেছে?;

ভেতরে থেকে রাগ পায়ে হেঁটে এলো এক বৃদ্ধা। লাল পাড়ের সাদা কাপড় পড়নে। এ যেন কোনো শুভ্রপরী। ইশার চোখ আঁটকে গেলো বৃদ্ধার প্রশংসনীয় রূপে। চোখ আটকালো শ্রাবণেরও। এ যেন ইশাই। ইশা বুঝি বৃদ্ধকালে এমনই হবে দেখতে?

“কে এলো গো? খোকা এলো? বউমাও এলো বুঝি?;

“দেখোনা কে এলো।;

বৃদ্ধর মুখে তৃপ্তির হাসি। বৃদ্ধার মুখে দিগুণ উৎসাহ। তবে সেই উৎসাহ ঘেরা মুখটায় নিমিষেই পর্দা পড়লো ইশা আর শ্রাবণকে দেখে। মুষড়ে পড়লো নয়ন জোড়া। বৃদ্ধর উদ্দেশ্যে আহত স্বরে শুধালো,

“এরা কারা?;

“বৃষ্টিতে আঁটকে পড়েছে। বাড়ির বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলো।;

বৃদ্ধার মুখে পূণরায় হাসি ফুটলো। ইশা আর শ্রাবণের পানে এগিয়ে এসে বলল,

“সে ভালো করেছো। আহারে, একদম ভিজে গেছো দেখছি। জামাকাপড় ছাড়বে মা?;

কি মোহাচ্ছন্ন ব্যবহার তাদের। মোহিত হয়ে গেলো ইশা। স্মিত হেসে বলল,

“আপনি ভীষণ সুন্দর। একদম উপন্যাসের মতো।;

বৃদ্ধা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। পরক্ষণেই আবার ফ্যাকাসে রঙ ধারণ করলো তার মুখ। চোখ টলমল করতে লাগলো। ইশা ভড়কে গেলো এমন অবস্থায়। ইশা শ্রাবণের পানে তাকালো ভয়ার্ত চোখে। তাকালো শ্রাবণও। ইশা এগিয়ে এসে বৃদ্ধার হাত ধরলো। অপরাধী গলায় বলল,

“আপনি কি আমার কথায় কষ্ট পেয়েছেন? আমি সরি। আসলে আমি এতো ভেবে..;

“না মা। ও কষ্ট পায়নি। আসলে ওর সমস্যাটা হলো অল্পতেই বড্ড চোখের জল ছাড়ে। সেই বাচ্চাকালের স্বভাব। এখনও রয়ে গেছে।;

ইশা একটু স্বস্তি পেলো যেন। বৃদ্ধার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,

“কাঁদবেন না প্লিজ, আপনাকে কাঁদলে কিন্তু মোটেও ভালো লাগেনা।;

বৃদ্ধা হেসে উঠলো খিলখিলিয়ে। যেন কোনো বাচ্চাকে মজার কাহিনী শুনিয়েছে কেউ। হাসলো ইশাও।

বৃদ্ধ পূণরায় বলল,

“ছেলে-মেয়ে দুটোকে এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখবে? বসতে দাও। আমি ওদের জন্য তোয়ালে আনছি।;

বলেই চলে গেলেন বৃদ্ধ। বৃদ্ধা ইশা আর শ্রাবণকে বসতে দিলো। বুড়ো কি করছে দেখে আসি বলে, সেও চলে গেলেন ভেতরে। বৃদ্ধাও প্রস্থান করলে বড়ো কৌতুহল নিয়ে ঘুরে বসলো ইশা। শ্রাবণের পানে তাকিয়ে বলল,

“উনাদের একটু অদ্ভুত লাগছেনা তোমার কাছে?;

শ্রাবণের কৌতুহলও কিছু কম নয় যেন। সেও একই কৌতুহলে জবাব দিলো,

“অদ্ভুত তো লাগছেই।;

“আমাদের এখানে আসাটা একদম উচিৎ হয়নি বলো?;

“অনুচিতও হয়নি। তুই যেমনটা ভাবছিস, ওরকম কিছু না। আজকাল বৃদ্ধ বাবা-মাকে একা করে কত সন্তান শুধু বউকে নিয়ে দেশান্তর হচ্ছে জানিস? এরাও তেমনই এক অসহায় বাবা-মা। যাদের সন্তান উনাদের একলা ফেলে চলে গেছে।;

ইশার মনটা বিষাদে ঘিরে ধরলো হঠাৎ। মানুষ কত নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। কত পা/ষা/ণ!

“আহারে! এমন মানুষও হয়?;

“হয়।;

বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা তোয়ালে আর কিছু শুঁকনো খাবার নিয়ে হাজির হলো। খাবার পেয়ে যেন চাঁদ হাতে পাওয়ার আনন্দ হলো ইশার।

“তোমরা চাইলে আজকের রাতটা এখানে কাটাতে পারো বাবা। যে হারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, তাতে আমার মনে হয়না এই বৃষ্টি সহজে থামবে বলে।;

“গোটা রাতটা থাকা তো সম্ভব নয়। বাড়ির লোক চিন্তা করবে।;

বলল শ্রাবণ। যার জবাবে এবার বৃদ্ধা বলল,

“চিন্তা করাটা তো স্বাভাবিকই বাবা। কিন্তু তুমি যদি একবার টেলিফোন করে দাও, তাহলে তো আর চিন্তা করবেনা।;

“এদিকে নেটওয়ার্ক একদম ডাউন। এক লাঠিও নেটওয়ার্ক তোলা যাচ্ছে না।;

বির*ক্তির সুরে বলল শ্রাবণ। বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। জবাবে আর কিছু বলতে পারলোনা।

“তোমরা একটু বিশ্রাম নাও বাবা। তারপর বৃষ্টি কমলে না হয়..;

“ঠিকাছে।;

বৃদ্ধা এবং বৃদ্ধ পূণরায় মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। শ্রাবণ হয়তো তাদের মনের ভাবটা ধরতে পেরেছে। তারা চায়না আজ রাতেই শ্রাবণ আর ইশা তাদের এখান থেকে চলে যাক।

______

বন্ধ ঘরটায় হারিকেনের আলো নিভু নিভু করে জ্বলছে। ইশা লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো শক্ত বিছানায়। মাথার নীচেও একটা শক্ত বালিশ। কতক্ষণ এপাশ ওপাশ করে সামনে তাকালো। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো শ্রাবণ। শ্রাবণ ভেতরে ঢুকতেই চোখে চোখ পড়লো দু’জনের। ইশা ভীত মনে চোখ সরিয়ে নিলো। বাইরে এখনও মুষলধারে বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে। শ্রাবণ নেটওয়ার্ক তোলার চিন্তায় তিক্ত হয়ে উঠেছে এবার। কে জানে, বাড়ির সবাই কতটা চিন্তা করছে তাদের।

শ্রাবণ ধীরপায়ে হেঁটে এসে বসলো বিছানার একপাশে। ইশা আঁড়চোখে দেখছে গম্ভীর মানুষটাকে। হারিকেনের হলদে আলোতে অন্যরকম লাগছে শ্রাবণকে। শীতল পরিবেশে শ্রাবণের এমন বিমোহিত রূপ উষ্ণতা ছড়াচ্ছে রমনীর হৃদয়ে। বুক কাঁপছে দুরুদুরু। যেটাকে কোনো ভাবেই পাত্তা দিতে চাইলোনা ইশা। তাই পাশ ফিরে শ্রাবণের থেকে মুখ ফিরিয়ে শুলো। শ্রাবণ গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে ইশার পানে তাকালো কিছু বলবার উদ্দেশ্যে। তবে তাকে থমকাতে হলো। থমকাতে হলো ইশার ভেজা পিঠে লেপ্টে থাকা চুলগুলো দেখে। থমকাতে হলো ইশার ফর্সা ঘাড়ে কালো তিলটা দেখে।

শ্রাবণের কি হলো জানেনা সে। শুঁকনো গলায় ঢোক গিলে উঠে গেলো ওখান থেকে। এখানে বসবে না সে।ইশা আর শুয়ে থাকতে পারলোনা। উঠে বসলো। এতো শক্ত বালিশে মাথা রাখার অভ্যাস নেই একদম। ইশাকে উঠে বসতে দেখে শ্রাবণ গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“কি হয়েছে? উঠে বসলি কেন?;

“ভালো লাগছেনা।;

“বৃষ্টির পানিতে ভিজে একাকার হয়েছিস। চেঞ্জ করলেই পারতিস।;

“তুমিই তো যাওয়ার তাড়ায় আছো। তাই আর কষ্ট করে চেঞ্জ করিনি। এখন ঠান্ডা লাগছে।;

” জ্বর আসেনি তো?;

ব্যস্ত গলায় কথাটা বলেই এগিয়ে আসলো শ্রাবণ। তার বরফ শীতল হাতটা ইশার কপালে ঠেকাতেই শিউরে উঠলো ইশা। ইশার গা বেশ গরম। বুঝতে পারলো সে। কপালের হাত গালে ঠেকিয়ে অতঃপর গলায় ঠেকিয়ে বলল,

“গা তো গরম।;

ইশার বুক কাঁপল। কেমন অস্থির লাগছে ওর। হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে উঠলো ধরনী। মাথার উপরেই যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। ভয়ে আতংকে বিটক চিৎকার করেই শ্রাবণকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ইশা। শ্রাবণ হতভম্ব হয়ে গেলো এমন ঘটনায়। ইশা কাঁপছে যেন। শ্রাবণ পূণরায় ঢোক গিললো। এবার যেন ইশার শরীরের উষ্ণ ভাব জ্বা*লিয়ে দিলো তার ভেতরে। নিঃশ্বাস ভারি হতে লাগলো ক্রমশই। বুক ধড়ফড় করতে লাগলো ঠিক ইশার ন্যায়।

“ভ*য় পেলি?;

শীতল গলায় প্রশ্ন করলো শ্রাবণ। শ্রাবণের ঘনঘন দম নেওয়া ইশা টের পেলো। তার গরম নিঃশ্বাস ক্রমশ আঁচড়ে পড়ছে ইশার মুখের উপর। শ্রাবণ হাত তুলে আরেকটু জড়িয়ে নিলো ইশাকে। নিজের সাথে আরেকটু শক্ত করে রাখতে ইচ্ছে করলো যেন। এই ভালোলাগার কোনো নাম নেই। কোনো ব্যাখ্যা নেই।

“আমার ভ*য় করছে শ্রাবণ ভাই!;

“তুই তো সত্যি বড্ড পাগল! আমি থাকতেও তোর এতো ভ*য়?;

ইশার বড্ড বলতে ইচ্ছে করলো, ” তুমি থাকলে যে আরও ভ*য়, তোমাকে হারানোর ভ*য়।;

#চলবে

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব______১৫

“সোজা হ, এখন আর বজ্রপাত হচ্ছে না।;

প্রশান্তির দফারফা করে লজ্জারা ঢাকঢোল পেটাতে লাগলো ইশার মনে। শ্রাবণের এই ধরনের কথা সে মোটেও আশা করেনি, সেটাও এই মুহুর্তে। ইশা শ্রাবণকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। কাচুমাচু করতে করতে পিছিয়ে যেতেই মনে হলো তাকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে এলো কেউ। সোজা এসে শ্রাবণের বুকে। শ্রাবণ চকিতে তাকালো ইশার পানে। ইশা অসহায় নেত্রে শ্রাবণের পানে তাকালো। অসহায় গলায় মাথায় হাত চেপে বলল,

“আমার চুল!;

শ্রাবণ ইশার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো। ইশা এক হাতে নিজের মাথা চেপে ধরেছে, আর অন্যহাতে শ্রাবনের বুক। ইশার চুল আঁটকে পরেছে শ্রাবণের পাঞ্জাবির বোতামে।

“আহ্ এতো নড়ছিস কেন?;

ধমকের সহিত বলল শ্রাবণ। ধমক খেয়ে স্থীর হয়ে গেলো ইশা। মনেমনে দু-চারটে গাল পেড়ে বলল, এখানে সমস্যাটা ওর হয়েছে, আর ওকেই কিনা ধমক খেতে হচ্ছে।

“আমি ছাড়িয়ে দিচ্ছি, চুপ করে দাঁড়া।;

“ব্যাথা হলে বলবোনা?;

“চুপ থাকবি। হজম করবি।;

কপাল কুঁচকে তাকালো ইশা। এ কথার কোনো আগামাথা নেই যেন। শ্রাবণ ওর পাঞ্জাবির বোতাম থেকে একটা একটা করে চুল ছাড়িয়ে দিতে লাগলো ইশার। ইশা কতক্ষণ কপাল কুঁচকে থেকে পাত্তা না পেয়ে মুখ উঁচিয়ে তাকালো শ্রাবণের পানে। গৌরবর্ণ মুখে কালো ঘণ দাঁড়িতে শ্রাবণের রূপ বরাবরই বিমোহিত লাগে। ইশা তার থুঁতনিতে পলকহীন চেয়ে রইলো। সেই সাথে শ্রাবণের শরীর থেকে সকালের সেই পারফিউমের তীব্র ঘ্রানটা পূণরায় নাকে ভাসতে লাগলো ওর। কি প্রখর এখনও সেই ঘ্রাণটা।

“তোর মতিগতি আজকাল অন্যরকম লাগছে কিন্তু।;

চুল ছাড়িয়ে ইশাকে নিজের থেকে সরিয়ে পাশে সরে এলো শ্রাবণ। ইশা বোকাকান্ত দৃষ্টিতে তাকালো শ্রাবণের পানে। এ কথার মানে না বুঝে বোকাকান্ত গলাতেই শুধালো,

“আমি কি করলাম?;

“কিছু করিসনি। বস এখানে, আমি উনাদের থেকে তোর জন্য কোনো ড্রেস পাই কিনা দেখি!;

বলেই প্রস্থান করলো শ্রাবণ। ইশা তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে আওড়ালো,

“যা বাবা, আমি আবার কি করলাম?;

ড্রেস না মিললেও পেয়ে গেলো একটা সুতির শাড়ি। আর তার নিজের জন্য পেলো বুড়োর পড়া একটা সাদা ফতুয়া। সেটা নিয়েই ফিরে এলো শ্রাবণ। শাড়িটা ইশাকে ধরিয়ে দিয়ে সে চলে গেলো নিজে চেঞ্জ করার জন্য। শাড়ি ইশার সহজে হজম হয়না। এই শাড়ি এতক্ষণ ধরে সামলে রাখতে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে যে যু*দ্ধের স্বীকার হতে হয়েছে, সে কথা তে এতো সহজে ভোলা যাবেনা।

শাড়িটা উল্টে পাল্টে দেখা কিংবা, এর ভেতরে বাহিরে সুন্দর নকশিকাঁথার কাজ দেখা ছাড়া ইশার আর কিছু করণীয় নেই। শ্রাবণ পাঞ্জাবি পাল্টে বুড়োর দেয়া ফতুয়া পড়ে ফিরে এলো। শ্রাবণের পেটা শরীরে সুন্দর লাগছে ফতুয়াটা। ইশা শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে আর চোখ ফেরাতে পারলোনা। শ্রাবণ ইশার তাকিয়ে থাকা দেখে ভ্রু নাচালো। ইশা মৃদু হেসে না সূচক মাথা নেড়ে একই ভাবে তাকিয়ে দেখতে লাগলো শ্রাবণকে। ওর হাতে ধরে রাখা শাড়ির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো শ্রাবণ। ভারী গলায় বলল,

“তোকে চেঞ্জ করার জন্য কি আলাদা ভাবে ইনভাইটেশন দিতে হবে?;

“অ্যা?;

শ্রাবণ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। খানিকটা এগিয়ে এসে ইশার মাথায় চাটি মে/রে বলল,

“জলদি যা।;

মাথায় মা/র পড়তে জ্ঞান ফেরে ইশার। তবে পূর্ণ ভাবে নয়। আশেপাশের পরিস্থিতি সম্মন্ধে সে জ্ঞাত নয়। এমন ভাবেই বলল,

“কোথায়?;

“চেঞ্জ করতে।;(দাঁতে দাঁত চেপে)

এবার মনে পড়লো ইশার। পরক্ষণেই আবার মনে পড়লো সে, শাড়ী পড়তে জানেনা। এবার? এবার কি হবে? ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে লাগলো ইশা। বোকাকান্ত দৃষ্টিতে তাকালো শ্রাবণ। চিন্তান্বিত এবং ব্যস্ত গলায় বলল,

“কি হলো, কাঁদছিস কেন?;

“আমি তো শাড়ি পড়তে পারিনা!(কাঁদতে কাঁদতে)

“তাহলে এটা কি পড়ে আছিস?;

ইশা নিজের দিকে তাকালো। নিজের পরনের শাড়িটা পূণরায় দেখে আরও জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো।

“এটা তো বড় মামি পরিয়ে দিয়েছে!;

“এবার তোর বড় মামিকে, মানে মাকে কোথায় পাবো?;

“বড় মামিকে পেলে তো আর আমরা এখানে আঁটকে যেতাম না।;

“ওয়েট, নেট থেকে ডাউনলোড করে দেখি।;

“ধ্যাৎ, এখানে নেট আছে নাকি?;

“ড্যাম!;

“এখন আমি কি করবো?;

“আরে দাঁড়া, দেখছি কি করা যায়!;

“তুমি শাড়ি পড়াতে পারো?;

“না, পারিনা। বাট ট্রাই করা যেতে পারে। কাম টু মি।;

ইশা যেন আঁতকে উঠলো। লজ্জায় গাল লাল হয়ে ওঠার দশা। শ্রাবণ ওকে শাড়ি পড়িয়ে দিবে, এটা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়।

“তাকিয়ে আছিস কেন? আসবি তো!;

ইশা এখনও স্তব্ধতার গন্ডি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলতে পারছেনা।

“ওকে ফাইন!;

শ্রাবণ ওর কাছে এগিয়ে আসতে নিলেই চেঁচিয়ে উঠে দু’কদম পিছিয়ে গেলো ইশা। আমতাআমতা করতে করতে বলল,

“ক্ কোনো দরকার নেই! আমি যেভাবে পারবো, করে নিবো, আই মিন পরে নিবো!;

শ্রাবণ বুঝলোনা ইশার কথা। এই যে কান্না জুড়ল শাড়ি পড়তে পারেনা বলে, এই আবার আতংকে কাচুমাচু হয়ে যাচ্ছে।

“ঠিকাছে, পড়ে নে। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। শেষ হলে ডেকে নিস।;

“হ্ হ্যাঁ, ডাকবো।;

শ্রাবণ পূণরায় প্রস্থান করলো। ইশা অস্থিরতা নিয়ে ধপ করে বসে পড়লো বিছানায়। এভাবে হয় নাকি? ধ্যাৎ!

“শ্রাবণ ভাই, ভেতরে এসো?;

দরজার ওপাশ থেকে ইশার ডাক পরতে উঠে দাঁড়ালো শ্রাবণ। একবার দরজার পানে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলো। অতঃপর দু’হাতে প্যান্ট ঝেড়ে চলে গেলো ডাকের উৎস বরাবর। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে আর আশেপাশে তাকালো না সে। দরজাটা ভেতর থেকে ছিটকিনি দিয়ে এগিয়ে গেলো বিছানার পানে। এবার যে তাকেও একটু রেস্ট নিতে হবে।

ভাবতে ভাবতে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। নেটওয়ার্ক বিজি প্রত্যেক জায়গাতে। কাউকেই কোনো খবর দেওয়া হয়নি। কে জানে, কতটা দুশ্চিন্তা করছে সবাই।

“মা গো!;

বিকট শব্দ। পায়ে শাড়ি পেঁচিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো ইশা। তবে যে সে জায়গায় নয়, সোজা গিয়ে শ্রাবণের বুকে। আঁতকে উঠল শ্রাবণ। এ যেন ভাবনায় তলিয়ে থাকার ছোট খাটো শা*স্তি। ইশা তার বুকের উপর ধপাস করে পড়তেই দম বেরিয়ে আসার পালা। খানিক মতিগতি তৈরী হলো, এক্ষনি ইশাকে একটা রাম ধমক দিবে বলে তবে মুহুর্তেই যেন সব ওলট-পালট হয়ে গেলো। হারিকেনের হলদে আলো এবার উপচে এসে পড়লো এই মনোহারিণীর মুখবিবরে। জ্বলজ্বল করে জ্বলছে তার গভীর নেত্রদ্বয়। নরম গালে খেলা চলছে অবাধ্য চুলগুলোর। একফালি স্নিগ্ধ আলো এসে জড়িয়ে ধরলো তার ঠোঁট, গলা এবং তার যতসামান্যই নীচে। শাড়ির আঁচল সরে গেছে কিঞ্চিৎ। যেটা টেনশনে আর খেয়াল হলো না ইশার। সে গভীর আতংকে তার শাড়ি নিয়ে।

“স্ সরি, সরি! আমার পা স্লিপ হয়ে গেছে!;

অসহায় গলায় নিজের দোষ স্বীকার করলো ইশা। ফের শ্রাবণ বুকে ভর দিয়েই উঠে বসতে নিলো সে। কিন্তু পারলোনা। শ্রাবণ এক টানে তাকে পূনরায় নিজের বুকের উপর এনে ফেললো। ইশা হকচকিয়ে তাকালো। কিছু বলবে, তবে তার পূর্বেই থেমে গেলো। ঢিপঢিপ করে বাজছে অন্তরের অন্তস্তল। অস্থির লাগছে ক্রমশ।

শ্রাবণ কিছু না বলেই ইশাকে তার নীচে নিয়ে, সে ইশার উপর উঠে গেলো। অদলবদলের জার্নিতে পূণরায় ইশা চকমালো। চোখ জোড়া আলুর সেপের আকার নিয়েছে তার। অবাকের শীর্ষে পৌঁছে বলে উঠলো,

“ক্ কি হলো এটা?;

“আমি আবারও ফল করেছি ইশুপাখি।;

বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে পুড়ে গেলো ইশার। শ্রাবণের কন্ঠে ঘোর, নয়নে নেশা। ঢোক গিললো ইশা। নিঃশ্বাস নিতে পারছেনা ও এই দম বন্ধকর মুহুর্তে। শ্রাবণ ওর হাতটা নামিয়ে আনলো ইশার কোমরে। উষ্ণ দেহে শ্রাবণের শীতল স্পর্শ কাঁপিয়ে তুললো ইশাকে। ফট করে চোখ বন্ধ করে পূনরায় দম আঁটকে নিলো। শ্রাবণ মাতাল হাসে ইশার প্রতিক্রিয়ায়। ইচ্ছে করেই ইশার উন্মুক্ত জঠরে হাত চেপে ধরলো সে। ইশার দেহ আবারও শিহরণে কেঁপে উঠলো। বন্ধ নেত্র জুগল আরও কুঁচকে গেলো। বুক ভারী হয়ে ঘণ নিঃশ্বাসের মাত্রা তেজ হতে লাগলো।

পূণরায় মাতাল হাসে শ্রাবণ। কাছে এগিয়ে ইশার কপালে কপাল ঠেকিয়ে ধীর স্বরে ঠোঁট নেড়ে আওড়ায়,

“আই এম সরি!;

বলেই মুখ ডুবিয়ে দেয় ইশার গলায়। ইশা স্তব্ধ হয়ে পড়ে শ্রাবণের এই পাগলামি তে। এক হাতে বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরে অন্যহাতে শ্রাবণের কাঁধের কাছটা খামচে ধরে। শ্রাবণ টের পায়। টের পায় ইশার তীব্র অনুভূতি গুলোকে। টের পায় ইশার বর্তমান মনের অবস্থাকে। তবুও সে অপারগ। ইশাকে সে ভালোবাসে। গভীর অনুভূতিতে ভালোবাসে।

শ্রাবণের হাত বিচরণ করতে থাকে ইশার কোমরে, জঠরে এবং গলায়। ইশা কাঁপছে। থরথর করে কেঁপে উঠছে প্রতি মুহুর্তে। শ্রাবণের স্পর্শ গুলো ক্রমশ গভীর হচ্ছে। উষ্ণ হচ্ছে দুটো দেহই। একজনেরটা তীব্র অনুভূতিতে, আরেকজনেরটা তীব্র ভ*য়ে।

ইশা পারছেনা নিজের অনুভূতিদের সাথে যু*দ্ধ করে কুল পেতে। যার ফলে সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো শ্রাবণকে। জড়িয়ে ধরলো শ্রাবণও। নিজের সাথে একদম মিশিয়ে নিতে চাইলো তার প্রাণনাশিনীকে। কিছুতেই আর দূরে রাখতে চায়না সে।

হঠাৎ তীব্র বেগে কেঁপে উঠলো শ্রাবণের ফোনটা। সেই সাথে অসহ্য কর একটা রিংটোন। ঘোর কেটে গেলো শ্রাবণের। ছিটকে উঠলো সে ইশাকে ছেড়ে। বালিশের পাশ থেকে ফোনটা তুলতেই দেখলো দাদাজানের কল। আর কিছু ভাবার সময় নিলোনা শ্রাবণ। দ্রুত ফোনটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

_______

সকাল ১১টা। বাসায় ফিরেছে ইশা আর শ্রাবণ। তবে এই আসার মাঝের দীর্ঘ সময়টা আর কেউই কারোর সাথে প্রয়োজন ব্যতীত কথা বলতে পারেনি। ইশা ভ*য় আর জড়তা নিয়ে পুরোটা সময় পার করেছে। শ্রাবণ অপরাধ বোধে আর মুখ নাড়তে পারেনি। বাড়িতে ফিরে আর কাউকে তেমন কৈফিয়ত দিতে হয়নি। কারন রাতেই শ্রাবণ সবাইকে জানাতে পেরেছিলো তাদের বর্তমান অবস্থা। আসার সময় সেই বুড়ো এবং বুড়িকে কথা দিয়ে এসেছে, তারা মাঝে মাঝে এসে তাদের সাথে দেখা করে যাবে। বুড়ি আনন্দে তখনও কেঁদেছে। শ্রাবণ এক ধ্যানে চেয়ে দেখেছে বুড়ির কান্না। ইশা আর তার মাঝে বয়সের পার্থক্যটি ছাড়া আর কোনো ব্যবধান দেখতে পায়নি সে।

ড্রয়িং রুমে আসর জমালো ছেলেমেয়েরা। গুরুজনরাও অবস্থানরত। ডাক পড়লো ইশা আর শ্রাবণের। এসে থেকে আর কেউই নীচে নামেনি এখনও অব্দি।

তিতির বলল,

“কই রে ইশুরানি? আর কি দেখা পাবো তার?;

আফিয়া বেগম আর নুপুর বেগম ডাইনিং টেবিলে নতুন জামাইয়ের জন্য নাস্তার পরে কফি সাজাচ্ছিলো। তিতিরের গলা পেয়ে আফিয়া বেগম বললেন,

“ওকে ডাকিস না তো এখন! ক’টা দিন তোর বিয়ে বিয়ে করে খুব খেটেছে মেয়েটা। আর কাল রাতের কথা তো বাদই দিলাম।;

সিঁড়ি ধরে নামছিলো শ্রাবণ। মায়ের কথাটা কানে ভাসতে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। কাল রাতের ঘটনা মনে পড়ছে তার। কি থেকে কি করেছে সে নিজেও জানেনা! একবার সরি বলা দরকার ছিলো ইশাকে!

“হ্যাঁ রে তিতির। তোরা আড্ডা দে মা।;

বললেন নুপুর বেগমও। তখনই এসে হাজির হন মরিয়ম বিবি। দুই ভাবির আলোচনার মুল উৎস নিজের মেয়ে, এই ভেবে মৃদু হাসলেন তিনি। দুই ভাবিকেই উদ্দেশ্য করে বললেন,

“তোমরা আমার মেয়েটাকে একটু বেশিই আশকারা দিচ্ছো ভাবি।;

“তুমি থামোতো, ও তোমার একার মেয়ে নাকি?;

বকার সুরে বললেন আফিয়া বেগম। হাসলেন নুপুর বেগম। বললেন,

“এই কথা আপাকে বুঝাতে বুঝাতে আমি একদিন পাগল হয়ে যাবো দেখো তোমরা!;

নুপুর বেগমের কথায় শব্দ করে হেসে উঠলেন আফিয়া বেগম আর মরিয়ম বিবি। মরিয়ম বিবি হাসি থামিয়ে বললেন,

“ঠিকাছে বাপু, আর বলবোনা। এবার যাই একটু মেয়েটার কাছে। দেখি, কি করছে?;

“হ্যাঁ আপা যাও।;

মরিয়ম বিবি হাঁটা ধরলেন মেয়ের রুমের উদ্দেশ্যে। সিঁড়িতে শ্রাবণকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনিও।

“শ্রাবণ? ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস? যা নীচে যা, সবাই মিলে আড্ডার আসর জমিয়েছে তোকে ছাড়াই। যা যা।;

এই বলে তিনি উপরে উঠতে লাগলে শ্রাবণ নড়েচড়ে ডেকে ওঠে তাকে।

“মনি?;

“হ্যাঁ রে, বল?;

“ইশা কি ঘুমচ্ছে?;

“জানিনা তো। গিয়ে দেখছি কি করছে সে মহারাণী।;

“ওর জ্বর-টর এলো কিনা দেখো একটু। রাতে বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছে তো।;

শ্রাবণের চিন্তান্বিত গলায় দিগুণ উদ্বিগ্ন হয়ে গেলেন মরিয়ম বিবি। আতংকের সহিত বলে উঠলেন,

“তাই তো! আমি তো এ কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।;

আর এক মিনিটও দাঁড়ালেন না তিনি। দ্রুত পায়ে চলে গেলেন মেয়ের ঘরে। কম্বলের নীচে গুটিশুটি হয়ে ঘুমাচ্ছে ইশা। মরিয়ম বিবি একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে এসে বসলেন ওর পাশে। গলা উঁচিয়ে মেয়ের মুখ খানা দেখতে বৃথা চেষ্টা করলেন। উপায় না পেয়ে আস্তেধীরে ডাকতে লাগলেন ওকে।

“ইশা, ও মা? জেগে আছিস?;

বেঘোরের ঘুম খানিক পাতলা হয়ে এলো মায়ের ডাকে। তবে নড়েচড়ে স্বভাব বসত পূণরায় ঘুমে ডুব দিলো ইশা। মরিয়ম বিবি ওর মুখ থেকে কম্বলটা নামিয়ে কপালে হাত রাখলেন। খুব গরম না হলেও স্বাভাবিকের তুলনায় যেন একটু বেশিই গরম। তিনি হাত নামিয়ে গালে আর গলায় ঠেকাতেই ঘুমের ঘোরে লাফিয়ে উঠে বসলো ইশা। সেই সাথে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো এক অপ্রত্যাশিত কথা,’শ্রাবণ ভাই’!

মরিয়ম বিবি হকচকিয়ে গেলেন। অবাক স্বরে বললেন,

“শ্রাবণ?;

মায়ের গলায় আতংকে পড়ে গেলো ইশা। পাশ ফিরে মাকে দেখে আরেকদফা চমকে উঠলো। বোবা গলায় বলল,

” মা?;

“হ্যাঁ। কি স্বপ্ন দেখছিলিস?;

“হ্ হ্যাঁ মা। স্ স্বপ্ন দেখছিলাম।;

কপাল ডললো ইশা। সেই সাথে পুরো মুখ একবার মালিশ করলো। পরক্ষণে আবারও বলল,

“তুমি এখানে? কিছু বলতে এসেছো?;

“ঘুমচ্ছিস না জেগে আছিস,দেখতে এসেছিলাম। আর শ্রাবণ বলল…;

“বলল? ক্ কি বলল?;

ঘাবড়ানো গলায় বলল ইশা। মরিয়ম বিবি মেয়ের রিয়াকশন দেখে কপাল কুঁচকালেন। বলল,

“বলল রাতে বৃষ্টি ভিজতে হয়েছে নাকি তোদের? তাই আবার জ্বর এলো কিনা!;

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ইশা। মরিয়ম বিবি এখনও কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। সন্দিহান গলায় বললেন,

“কি ব্যাপার রে? কিছু হয়েছে?;

কট খেয়ে গেলো যেন। চোখ জোড়া বড়বড় করে নিলো ইশা। পরমুহূর্তেই মাকে ভুলানোর জন্য শব্দ করে হাসতে লাগলো। হসতে হাসতে বলল,

“কি আবার হবে? কিছুই না, কিছুইনা। আ্ আমি এখন ঘুমাবো মা। ত্ তুমি এখন যাও তো।;

বলেই ধপাস করে শুয়ে পড়লো উল্টো দিকে ফিরে। মরিয়ম বিবি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকালেন। মেয়ের এই উদ্ভট আচরণ সে যে ধরতে পারছেনা।

#চলবে

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব______১৬

“মনি, ইশা আসেনি?;

নাস্তা সামনে নিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে বসে ছিলো শ্রাবণ। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ইশার কথা। অশান্তি লাগছে ওকে দেখতে না পেয়ে। তাই হঠাৎ মরিয়ম বিবিকে পেয়ে যেন খানিক স্বস্তি পেলো। কিঞ্চিৎ তাড়াহুড়োতেই ইশার কথা জিজ্ঞেস করে বসলো মনিকে। মরিয়ম বিবি এসে বসলেন চেয়ার টেনে। গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে শ্রাবণের প্রশ্নের জবাবে না সূচক মাথা নাড়লেন। অতঃপর বললেন,

“না। ঘুমাবে বলল। তাই আর উঠাইনি।;

“কেন, শরীর কি বেশি খারাপ? জ্বর এসেছে?;

শ্রাবণের অস্থির ভাব ভঙ্গিমা মরিয়ম বিবির মনে সন্দেহের বীজ রোপন করলো যেন। তিনি কয়েক ঢোক পানি খেয়ে সন্দিহান নয়নে তাকালেন শ্রাবণের পানে। তবে সন্দেহ প্রকাশ না করেই বললেন,

“না শরীর তো ঠিকই আছে। তবে আচরণ একটু অন্যরকম ছিলো!;

শ্রাবণ আরও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। শুধালো,

“কেন, কি করেছে ও?;

“হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে বসলো তোর নাম নিয়ে, তারপর হঠাৎ আবার ধপাস করে শুয়ে পড়লো উল্টো ঘুরে।;

শ্রাবণ বিষম খেলো মনির এহেম কথা শুনে। কাশতে কাশতে মুখে হাত চাপতেই দাঁড়িয়ে গেলেন মরিয়ম বিবি। চটজলদি পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে খেতে বললেন। ওদিকে রান্নাঘর থেকে দৌড়ে আসলেন আফিয়া বেগম।

“কি হলো বাবা?;

চিন্তান্বিত হয়ে প্রশ্ন করার মাঝে পানি খেয়ে শান্ত হলো শ্রাবণ।

“ক্ কিছুনা মা। আমার আর ক্ষিদে নেই। আমি ঘরে গেলাম।;

বলেই উঠে চলে গেলো।

“ক্ষিদে নেই মানে? সকাল থেকে তো কিছু খেলিনা!;

কোনো জবাব এলো না ছেলের থেকে। মরিয়ম বিবি শ্রাবণের যাওয়ার পানে তাকিয়ে সন্দিহান সুরে বলে উঠলেন,

“আমার কিছু ভালো ঠেকছেনা ভাবি।;

“কি? কি ভালো ঠেকছেনা!;

“শ্রাবণ কেমন অদ্ভুত আচরণ করলো বলে মনে হলোনা তোমার?;

“হ্যাঁ গো, ঠিকই বলেছো।;

“ইশাও জানো ঠিক এমনই আচরণ করলো। অদ্ভুত!;

“সন্দেহ জনক কিছু মনে হচ্ছে তোমার?;

“মনে তো হচ্ছেই। তবে কিছু না জেনে কিছু বলা যায়না।;
,
“ঠিক।;

“চলো রান্না ঘরে যাই।;

রান্না ঘরে চলে গেলো ননদ ভাবি। শুধু খাবার টেবিলে পড়ে রইলো শ্রাবণের ফেলে যাওয়া আধখাওয়া রুটি আর ডালভাজি।

ইশার রুমের দরজাটা ভেজিয়ে রেখে গেছে মরিয়ম বিবি। প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। ভেতরে যাবে কি যাবেনা, এই ভাবনাতেই পুরো পাঁচ মিনিট ব্যয় হয়ে গেলো। অবশেষে মনের সাথে যুদ্ধ করে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো সে। কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে আছে ইশা। শ্রাবণ হাসফাস করছে ভেতরে ভেতরে। সে এখানে কেন এসেছে এর উত্তর তার কাছে নেই। কেন দাঁড়িয়ে আছে, কেন ইশার কাছে যাচ্ছে জানেনা সে। তবে এটুকু জানে, এই মুহুর্তে একবার ইশাকে দেখতে না পেলে এক্ষনি যেন দমটা বেরিয়ে আসবে।

এতক্ষণ ওপাশ ফিরে ঘুমালেও, ঘুমের মাঝেই এপাশ ফিরে শুলো ইশা। এতে যেন শ্রাবণর বেশ ফায়দা হলো। সে পা গুণেগুণে এগিয়ে গিয়ে ঠিক ইশার সামনে বসলো। কম্বলের নীচে কেবল চোখ ব্যতীত বাকি সবই ঢেকে আছে ওর। সেই চোখ জোড়াও লজ্জায় মুখ লুকিয়েছে একঝাঁক চুলের আড়ালে। শ্রাবণ হাত বাড়িয়ে ইশার মুখ থেকে কম্বলটা নামাতেই বুকের ভেতরটা তার দারুণ ভাবে কেঁপে ওঠে। ঘুমন্ত ইশুপাখিকে মায়াবনো বিহারিণীর উপাধি দিতে ভুললো শ্রাবণ। মনোজ্ঞ হাসলো সে। হাত বাড়িয়ে ইশার চোখগুলো উন্মুক্ত করলো চুলগুলোর জোরপূর্বক ভালোবাসা থেকে। অতঃপর ক্রমে হাতটা নামিয়ে রাখলো ওর নরম গালে। ঠোঁট জোড়া গাঢ় লালে ছেয়ে আছে। লিপস্টিক পরেনি, তবুও! শ্রাবণের অবাধ্য মন যেন বারবার তাকে ঠেলে দিচ্ছে ইশার লাল ঠোঁটের দিকে। মন তাকে উস্কাচ্ছে এই বলে, ছুঁয়ে দে, ছুঁয়ে দে। এই কথা ভেবে শ্রাবণ আপন মনেই হাসলো। মানুষের মন কতই না অবুঝ হয়। ঠিক যেন নবজাতকের শিশু।

ঘুমের মাঝে বড়বড় নিঃশ্বাস টানছে ইশা। স্বপ্নে দেখছে শ্রাবণকে। শ্রাবণ তার খুব কাছে, এতোটাই কাছে যে দু’জনের মাঝে এক ইঞ্চিরও তফাৎ নেই। ইশার ঘুমন্ত চোখ জোড়া বারবার কুঁচকে যাচ্ছে। এলোমেলো হাত নাড়ার চেষ্টা করছে। শ্রাবণ ইশার এমন অবস্থা দেখে শঙ্কিত মনে তাকালো। হালকা গলায় কাশি দিয়ে ইশাকে ডাকতে লাগলো।

“ইশা, কি হয়েছে তোর? ইশা! ইশা?;

“ন্ ননন না! না!;

ঘুমের ঘোরেই হাত নাড়ছে ইশা। শ্রাবণ ইশার হাত চেপে ধরলো। অনন্তর, আবারও ডাকতে লাগলো। শ্রাবণের ডাক ইশার মগজ ছুঁতে পারছেনা কিনা জানা নেই। তবে আচমকাই ‘না’ বলে এক চিৎকারে উঠে বসলো ও। হাঁপাতে হাঁপাতে গলায় গালে হাত বুলালো। শ্রাবণ চকিতে তাকিয়ে আছে ইশার পানে। ওর ডান হাতটা এখনও তার হাতের ভাজে।

“কি হলো? দুঃস্বপ্ন দেখেছিস?;

“প্ পানি!;

একহাতে মুখে চেপে ধরলো ইশা। পরক্ষণেই পানির আকুতি জানালো। শ্রাবণ ওকে পানি দিলো। পানি পেয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো।

“এবার বল?;

“হু?;

“এবার বল কি দেখেছিস?;

ইশার এবার হুঁশ ফিরলো। শ্রাবণের গলা পেয়ে দম আঁটকে এলো মুহুর্তেই। চোখ জোড়া বড়বড় করে পাশ ফিরে তাকাতেই এক রকম ছিটকে সরে পড়লো দূরে। শ্রাবণ দৃঢ় চাহনিতে এখনও তাকিয়েই আছে।

ইশা ভয় মিশ্রিত গলায় বলে উঠলো,

“ত্ তুমি?;

“হ্যাঁ আমি! কাকে এক্সপেক্ট করছিলিস?;

ইশা ডান হাতটা মুখে চাপলো। লজ্জা,ভয়, সংকোচ তিন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে ওর ভেতরে। চোখ খুললেও শ্রাবণকে দেখছে আবার চোখ বন্ধ করলেও শ্রাবণকেই দেখছে। কি মহাবিপদে পড়লো বেচারি!

“বল?;

অনন্তর ধমকের জোরে শোনা গেলো শ্রাবণের গলা। ইশা ভীত হয়ে নখ কাটতে লাগলো। যা হচ্ছে ওর সাথে সে কথা চাইলেও কাউকে বলা সম্ভব নহে।

” ত্ তুমি আমার ঘরে কেন এসেছো?;

এই প্রশ্নটা ভারি হলো শ্রাবণের ধমকের আগে। শ্রাবণ এবার আমতাআমতা করতে লাগলো। কেন এসেছে সে এখানে? উত্তর থাকলেও কিভাবে বলবে সে?

“এ্ এসেছি আমার দরকারে! তোকে এতো কৈফিয়ত দিতে পারবোনা।;

“কেন? আমার ঘরে দরকারে এসেছো আর আমাকেই বলতে পারবেনা?;

জোর গলায় বলে উঠলো ইশা। বলে মনে হলো সে ভুল করেছে। শ্রাবণের মুখে মুখে তর্ক করাটা একদমই ঠিক হয়নি ওর। মনেমনে জিভ কাটলো। শ্রাবণ ত্যাড়া চোখে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে চোখের মাঝে বন্দু*ক বসানো থাকলে তার সুবিধাই হতো! চোখ দিয়েই গু*লির বর্ষণ করে ফেলতো।

” ঘুমা চুপচাপ।;

এই বলেই গটগট পায়ে উঠে চলে গেলো শ্রাবণ। ইশা ফিক করে হেসে ফেললো শ্রাবণের পালিয়ে যাওয়া দেখে। মনে মনে খুব করে বকে বলল, আগে তো মুখে শুধু কথার খৈ ফুটতো। আর এখন? বড্ড ইগো হয়েছে জনাবের!

__________

পড়ন্ত বিকেলে শিশিরে ভেজা ঘাসের উপর পা ফেলতেই শরীর শিউরে উঠলো ইশার। পায়ের তলায় কেউ ইচ্ছে করে সুড়সুড়ি দিচ্ছে যেন। সঙ্গে সঙ্গে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। ওর হাসি দেখে হাসলো তিতির, তানি এবং তুতুন। দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো তিনবোন। একই ছন্দে সবাই একত্রে খিলখিল করে হাসতে লাগলো। দূর থেকে এই বিরল দৃশ্য নজর বন্দী করছে শাকিল আর শ্রাবণ। ইশাকে দিয়ে বলে কয়ে সব কাজ করানো গেলেও খালি পায়ে ওকে কোথাও দাঁড় করানো যাবেনা। কারন ছোট বেলা থেকেই ওর পায়ের তলাতে বড্ড সুড়সুড়ি। আজ তিতিরের জোড়াজোড়িতে একরকম বাধ্য হয়েই নরম ঘাসে পা রাখার সিদ্ধান্ত নিলো। তবে সেই সিন্ধান্ত যেন কাল হলো ওর জন্য। পায়ে সুড়সুড়ি লাগাতে হাসতে হাসতে দম বেরিয়ে যাওয়ার দশা হচ্ছে।

“আমি আর পারছিনা রে আপা! আমাকে যেতে দে প্লিজ।;

হাসতে হাসতে কোনো রকমে বলল ইশা। তিতির ওর হাসিতে তাল মিলিয়ে বলল,

“একদম না। অভ্যাস কর।;

“ধুর, এই বেহুদা অভ্যাস আমি করতে পারবোনা! মাফ কর।;

“কোনো মাফ হবেনা। এই তানি, ধরে রাখতো ওকে? আমি আসছি।;

হুকুম পেয়ে ইশাকে ঝাপটে ধরে রাখলো তানি। ইশা এখনও হাসতে হাসতে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। এর পরের প্লান তারা ফুচকা খেতে যাবে। সেই সাথে যত ফাস্ট ফুড আছে, আজ সব ট্রাই করবে। নতুন দুলাভাই এসেছে বলে কথা।

ইশা আর হেসে কুলাতে পারছেনা। পেট চেপে ধরে নরম ঘাসের উপর বসে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গেই ওর পাশ ঘেঁষে বসে পড়লো তুতুন আর তানি। ইশা ক্ষেপে যাওয়ার ভান করে তানির পিঠে দু’চার ঘা বসালো। বকে বলল,

“আমার সঙ্গে আজ যা করলি মনে রাখিস কিন্তু। একদম সুদেআসলে উসুল করবো।;

“এহ্, আমার এমন কোনো সমস্যাই নেই, তুমি হয়তো ভুলে গেছো।;

” ও তাই না? সারাক্ষণ মিষ্টি মুখে পুড়ে রাখে কে রে? শাকিল ভাইয়া হাঁড়ি হাঁড়ি মিষ্টি এনেছে। যদি একটাও তোর কপালে জুটেছে, দেখে নিস?;

কারোর থেকে কিডনি চাইলেও বোধহয় এতোটা কষ্ট হবেনা, যতটা কষ্ট ওকে মিষ্টি দিবেনা বলে হচ্ছে ওর। চোখেমুখে নিমিষেই আষাঢ় মাস নেমে এলো তানির। এক্ষনি কেঁদে ভাসাবে যেন।

“আপা আমার সাথে এই না-ইনসাফি টা করিসনা, প্লিজ! মিষ্টি না খেয়ে আমি কিভাবে থাকবো। মাও এখনও অব্দি একটাও খেতে দিলোনা।;

শব্দ করে হেসে উঠলো ইশা। সঙ্গে যুক্ত হলো তুতুন। ইশার দিকে তাকিয়ে তুতুন বলে উঠলো,

“আল্লাহ আমি কোনোদিন এমন মিষ্টি পাগলা দেখিনাই গো আপা।;

“আমিও না রে। আচ্ছা কাঁদিস না! শাস্তিস্বরূপ তুই হাফ হাফ ভাগে পাবি, যা।;

মুহুর্তেই আনন্দে চোখমুখ চকচক করতে লাগলো তানির। হেসে উৎসাহিত গলায় বলল,

“সত্যি?;

“হু সত্যি। এবার যা আমার জুতোটা এখানে নিয়ে আয়। আমি খালি পায়ে আর মোটেই যেতে পারবোনা এখান থেকে।;

জুতো আনার কথা শুনে একটু শয়তানি হাসলো তানি। তবে ইশা আবারও ওকে ওর মিষ্টির কথা মনে করিয়ে দিতে উঠেপড়ে দৌড়ে গেলো। চটজলদি জুতোটা এনে পড়িয়েও দিলো ইশার পায়ে। ইশা জুতো পড়ে দাঁড়াতেই সামনে এসে দাঁড়ালো তিতির। কোমরে হাত চেপে ইশার পায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

“আবার জুতো পরলি?;

“আপা আর না প্লিজ! এই কষ্ট আর সহ্য করতে পারবোনা!;

“ঠিকাছে চল। আর কষ্ট পেতে হবেনা।;

“আমার লক্ষী আপা। এবার কি ফুচকা খেতে যাবো?;

“হু, ঐ যে শ্রাবণ ভাই আর শাকিল একজন ফুচকাওয়ালাকে ধরে এনেছে।;

“ইয়ে!(খুশিতে আত্মচিৎকার করে)

“আস্তে মা। চল, তুতুন তানি জলদি আয়।;

সবার আগে এসে হাজির হলো ইশা। জিভে জল চলে এসেছে ওর। কোনোমতে ঢোক গিলেই ফুচকাওয়ালাকে বলল,

“মামা এক প্লেট ঝাল দিয়ে!;

“হ মামা দিতাছি।;

দক্ষ হাতে ফুচকা মাখাতে আরম্ভ করলেন ফুচকাওয়ালা। তবে ইশার যেন দেরী সয়না। পারলে নিজেই হাতে মেখে খাওয়া শুরু করে।

“জলদি জলদি!;

তাড়া দিয়ে পূনরায় বলল ইশা। ফুচকাওয়ালা ওর দিকে চেয়ে হেসে উঠলো। মাথা ঝুলিয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর জানালো।

“এতো কিসের তাড়া! আপনি আস্তেধীরে বানান।;

একখানা গম্ভীর স্বর ভেসে এলো পেছন থেকে। শ্রাবণ এসেছে। সঙ্গে শাকিলও আছে। শ্রাবণের কথায় বিশেষ পাত্তা দিলো না ইশা। ও ওর মতো চেয়ে রইলো ফুচকা মাখানোর দিকে। তার জবাবে শাকিল স্মিত হেসে বলল,

“শুনেছি আমার বড় শালিকা ফুচকা বলতে অজ্ঞান। তাই একটু কসরত করে ফুচকা মামাকে একরকম তুলে নিয়ে এসেছি।;

শাকিলের কথা শুনে ইশা মুগ্ধ গলায় বলল,

“ও দুলাভাই ইউ আর দ্য বেস্ট। জানো, সেই ভোর থেকে আমার মনটা শুধু ফুচকা ফুচকা করছিলো।(শ্রাবণ তাকাতেই) ন্ না মানে, দুপুর! দুপুর থেকে;

কি ঢব দিচ্ছেরে বাবা। শ্রাবণের এমন তাকানো যেন কাজে দিয়েছে। ওদিকে শাকিল শব্দ করে হেসে উঠলো। বলল,

“হ্যাঁ জানি তো শালিকা সাহেবা। আজকে বের হওয়ার সময় তোমার আপা বলেই দিয়েছে, ইশানির জন্য ফুচকা মাস্ট।;

“এমন আপা যেন প্রতি ঘরে ঘরে পাওয়া যায় দুলাভাই। দোয়া করো।;

“নো নো নো! আমার তিতির শুধু আমার কাছেই ঠিকাছে। অন্য কোনো ঘরে দ্বিতীয়টি থাকারও দরকার নেই।;

আরও ভালো মন্দ টুকিটাকি কথা বলতে বলতে ইশার ফুচকা রেডি হয়ে গেলো। লাল টকটকে রঙ হয়েছে ফুচকা গুলোর। কি ভয়ানক ঝাল নিয়েছে দেখে মাথা ঘুরতে লাগলো সকলের। তিতির ওকে এতো ঝালের ফুচকা কিছুতেই খেতে দিবেনা। কিন্তু ওকে তো এটাই খেতে হবে। তাই হাজার বারন স্বত্বেও ভোজন রসিকের ন্যায় দুই প্লেট ফুচকা সাবাড় করেছে। এখন যে ঝালের তোড়ে মাথা ঘুরছে ওর।

এরপর খাওয়া হয়েছে চিজ বার্গার, আইসক্রিম, চকলেট। একটার পর একটা খেতে কারোরই কোনো ক্লান্তি ছিলো না আজ। তবে এই যদি ঘরের খাবার হতো, তবে কেউ মুখেও তুলতো কিনা বড্ড সন্দেহ ছিলো সকলের।

সারা বিকেল,সন্ধ্যা খাওয়া দাওয়া আর ঘোরাঘুরিতেই কাটলো ওদের। এখন বাসায় যাওয়ার সময় হয়েছে। বাড়ি থেকে ইতিমধ্যে কল চলে এসেছে।

“সো, আজকের দিনটা কে কেমন ইনজয় করলে?;

রসানো গলায় প্রশ্ন করলো শাকিল। তিতির শাকিলের পানে তাকিয়ে লজ্জা মিশ্রিত হাসলো। তানি, তুতুন আর ইশা এক সাথে বলে উঠলো, ‘বেস্ট’। ওদের চেঁচানো গলায় রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া গুটি কতেক লোক অবাক বিস্ময়ে চেয়ে ছিলো। যা দেখে আবার চার বোন চুপিচুপি হেসেছে। হাসতে হাসতে আবার হাঁটতে লাগলো সকলে। তবে হঠাৎ আনন্দের মেলায় যেন মেঘের হাট দেখা গেলো। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে একটা কল এলো ইশার ফোনে। বোনদের সাথে হাসি মজায় অন্যমনস্ক হয়েই কলটা রিসিভ করলো ইশা। কানে তুলে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো এক পরিচিত গলা,

“বউ, আমার বউ! আমাকে ছাড়া তুমি কিভাবে আছো বলো তো? একটাবারও কি মনে পড়ছেনা আমার কথা? মন কেমন করছেনা আমার জন্য?;

ইশার পদতল থমকে গেলো। এতো তুর্জর গলা। কিন্তু তুর্জ কি করে কল করবে? ও তো ব্লক করে দিয়েছিলো তুর্জর নাম্বার।

“ক্ কেন ফোন করেছেন?;

এক দলা অস্বস্তি নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো ইশা।

ঠিক তখনই সম্মুখে এসে দাঁড়ালো শ্রাবণ। গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো,

“কে কল করেছে?;

#চলবে

ডাকপিয়নের ছুটি নেই পর্ব-১২+১৩

0

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🍁🍂
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব____১২

একই সীটে পাশাপাশি গা ঘেঁসে বসে আছে শ্রাবণ আর ইশা। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে এক মনে। বাচ্চারা সব একত্র হয়ে হল্লা করছে পেছনে। বারেবারে শ্রাবণের ধমকে দু’চার মিনিটের জন্য চুপ হলেও পূনরায় তাদের আনন্দ উল্লাস জমজমাট হয়ে ওঠে।

এদিকে ইশা কাচুমাচু হয়ে বসে আছে শ্রাবণের ভয়ে। শ্রাবণ ওর এমন ভাব দেখে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

“বসতে অসুবিধা হলেও একটু এডজাস্ট করে নে!;

ইশা পাশ ফিরে তাকালো শ্রাবণের পানে। সে উসখুস করছে, বসতে না পারার দায়ে না। অন্য কারনে। সেটা কি করে বলবে শ্রাবণকে। ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে শ্রাবণ ভ্রু নাচালো। ইশা না সূচক মাথা নাড়িয়ে সম্মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। শ্রাবণের এতোটা কাছে বসতে ভেতরে ভেতরে কেমন হচ্ছে ইশার। পেটের ভেতর গুড়গুড় করছে যেন।

“বেশি অসুবিধা হচ্ছে?;

“না। তেমন অসুবিধা হচ্ছে না।;

“আরেকটু এগিয়ে আয় এদিকে।;

“আর এগোলে তো..;

আর এগোলে শ্রাবণের বুকের সাথে লেগে যাবে ইশার পিঠ। ইশা লজ্জা পাচ্ছে এই বিষয়টার জন্য। শ্রাবণের এতোকিছু মাথায় নেই। তার দুশ্চিন্তা ইশার অসুবিধা হওয়া নিয়ে।

“আরে এগিয়ে আসতে প্রবলেম?;

বলেই ইশার কোমর ধরে নিজের কাছে টেনে আনলো শ্রাবণ। শ্রাবণের হাত ইশার কোমর ছুঁতেই হকচকিয়ে তাকালো ইশা। চোখ জোড়া রসগোল্লা করে তাকাতেই শ্রাবণ ওকে তার নিজের কাছে টেনে নিলো। পরক্ষণেই চোখে চোখ পড়লো দু’জনের। ইশার বুকের ভেতর ঢোল পেটাচ্ছে কেউ। চোখ মুখ কেমন হয়ে উঠল তার। খানিক লজ্জা, খানিক ভয়!

“বস চুপটি করে।;

মানুষটাকে সত্যিই বোঝেনা ইশা। এমন একশোটা রূপ একেক মুহুর্তে। কোনটা আসল ভাববে সে?

শ্রাবণের শরীর থেকে এক মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আসছে বারবার। ইশা না চাইতেও বারবার সেই মাতাল ঘ্রাণ উপভোগ করতে শ্রাবণের প্রতি ঝুঁকে যাচ্ছে। শ্রাবণ হয়তো বুঝতে পারছেনা ইশার মতলব খানা। সে স্বাভাবিক ভেবেই ইশাকে ধরে রেখেছে আগের মতো। ইশা সেই সুযোগে শ্রাবণের আরও সন্নিকটে পৌঁছে গেলো। খানিক বাদে শ্রাবণের মনে হলো ইশা তার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। কি অদ্ভুত ব্যাপার! এই তো এক্ষনি ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছিলো শ্রাবণের পানে। আবার এক্ষনি ঘুম!

শ্রাবণ মনেমনে হাসলো। হেসেই ইশার কোমর ছেড়ে কাঁধ আগলে নিলো। ইশাকে আগলাতে আগলাতেই পূণরায় পেছন থেকে হৈ-হুল্লোড়ের শব্দে রাগী চোখে তাকালো শ্রাবণ। শ্রাবণের রাগী দৃষ্টিজোড়া ভড়কে দিলো বাচ্চাগুলোকে। তারা নিজ নিজ দায়িত্বে চুপ হয়ে গেলো।

“ভাইয়া, গাড়ির এসিটা বন্ধ করে গাড়ির জানালা খুলে দেইনা?;

বলল তুতুন। ওর চোখ মুখ বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। যা দেখে বুঝতে অসুবিধা হলোনা, এসিটা ঠিক হজম করতে পারছেনা তুতুন। তানি বলল,

“কেন, এসির বাতাসই ঠিক আছে।;

“আমার বমি পাচ্ছে এসির গন্ধে!;

তানি আবারও বলল,

“এসির আবার গন্ধ আছে নাকি? অদ্ভুত কথা বলিস তো!;

কথাটা বলে থামলে পারলোনা তানি। এর মধ্যে বমির বেগ চাপলো তুতুনের। হা করতেই মৃদু গলায় চেঁচিয়ে উঠলো তানি। আরব পাশ থেকে তুতুনকে ধরে বলল

“আস্তে আস্তে! এখানেই বমি করিসনা, ড্রাইভার সাহেব? গাড়িটা সাইট করেন।;

ড্রাইভার গাড়ি থামালো চটজলদি। তুতুন লাফিয়ে পড়লো গাড়ির বাইরে। সঙ্গে সঙ্গে বমি! তানি ঘৃণার জন্য যেতে পারছেনা বোনের কাছে। আরব কি করবে যেন বুঝে উঠতে পারছেনা। এদিকে সোরগোল শুনে উঠে পড়লো ইশা। আশেপাশে তাকিয়ে কতক্ষণ বোঝার চেষ্টা চালালো কার কি হলো! অতঃপর যখন দেখলে তুতুন বমি করছে, একরকম দৌড়ে গেলো তুতুনের কাছে। দু’হাতে ওর মাথাটা চেপে ধরে গলা উঁচিয়ে পানি চাইলো। পানি নিয়ে গেলো শ্রাবণ। তুতুন দুই বার লাগাতার বমি করে শান্ত হলো। ইশা ওকে পানি খাওয়ালো। অতঃপর, চোখে মুখে খানিক পানির ছিটা দিয়ে কাছে টেনে জড়িয়ে রাখলো নিজের সাথে। স্নেহভরা গলায় জিজ্ঞেস করলো,

“বেশি খারাপ লাগছে?;

তুতুন কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতে কোনো রকমে জবাব দিলো,

“আ্ আমি বাসায় যাবো আপা!;

ওর কথা শুনে ইশা শ্রাবণের পানে তাকালো। শ্রাবণ এগিয়ে এসে তুতুনের মাথায় হাত রাখলো। আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল,

“একা বাসায় গিয়ে কি করে থাকবি? গাড়িতে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নে। দেখবি আস্তে আস্তে ভালো লাগবে।;

তুতুন কান্না করতে লাগলো। যা দেখে ইশা ওকে আগলে ধরে বলল,

“কাঁদছিস কেন সোনা? আমি আছি তো। তোর মেজ আপা থাকতে এতো চিন্তা করতে হয়?;

“আমার অনেক খারাপ লাগছে আপা! আমি আর ঐ গাড়িতে উঠবোনা।;

“শোনো মেয়ের কথা! আমরা এই গাড়িতে না উঠলে কি করে যাবো বড় আপার কাছে? বড় আপা যে আমাদের পথ চেয়ে বসে আছে।;

“বড় আপাকে চলে আসতে বলোনা প্লিজ!;

“চলে আসতে বললেই কি চলে আসা যায়? বড় আপা এখন শশুর বাড়িতে। ওখান থেকে ওকে আসতে হলে সবার অনুমতি লাগবে।;

বলল শ্রাবণ। তুতুন বুঝতে চাইলোনা যেন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ইশা ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নিয়ে গেলো গাড়ির কাছে। সাত-পাঁচ বুঝিয়ে আবারও উঠিয়ে দিলো গাড়িতে। তবে এবার সেও উঠলো তুতুনের সাথে। পেছন থেকে কয়েকজন সামনের সীটে পাঠিয়ে দিলো শ্রাবণের কাছে। বাচ্চাদের তুলে দিয়ে শ্রাবণ উঠতে নিলে ডেকে উঠলো তুতুন। বলল,

“তুমিও বসোনা আমার কাছে ভাইয়স! নয়তো আমার আরও খারাপ লাগবে!;

তুতুনের কথা ফেলতে পারলোনা শ্রাবণ। আরবকে বাচ্চাদের সাথে সামনে দিয়ে সে এসে বসলো তুতুনের আরেকপাশে। তুতুনকে আদর করে মাথায় বুলিয়ে দিয়ে বলল,

“ইশার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়।;

তুতুন তাই করলো। ইশার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লে ইশা আস্তে আস্তে ওর মাথায় হাত বুলাতে লাগলো।

“তোরও তো গাড়িতে বমি করার স্বভাব আছে। বমি পেলে এক্ষনি করে আয়।;

রুক্ষ গলায় কথাটা ইশার উদ্দেশ্যে বলল শ্রাবণ। ইশা মুখ কুঁচকে তাকালো। নাক সিটকে বলল,

“ছিলো! এখন নেই। এখন আমার সব গাড়িতে চলার অভ্যাস হয়েছে।;

এ কথাটার পিঠে ইশাকে ক্ষেপানোর মতো আর কথা খুঁজে পেলোনা শ্রাবণ। ড্রাইভারকে বললে আবারও গাড়ি স্টার্ট দেয় সে। তুতুন ইশার কোলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ে।

মোট চার ঘণ্টা পেছনে ফেলে অবশেষে এসে পৌঁছালো সবাই। তিতিরের শশুর বাড়ির লোক আগে থেকেই গেটে দাঁড়িয়ে ছিলো তাদের অপেক্ষাতে। এক এক করে সবাই গাড়ি থেকে নেমে এলে সবাইকেই মিষ্টি মুখ করিয়ে ভেতরে নিয়ে যায়। শাকিল এসে গুরুজনদের সালাম জানিয়ে শ্রাবণ এবং আরবের সাথে কোলাকুলি করলো। তিতির যেন তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় ছিলো তার বাবা-মা, ভাই বোন,এবং দাদা-দাদীকে দেখার জন্য। ইশাকে পেয়ে প্রায় দশ মিনিট জড়িয়ে রেখেছে নিজের সাথে। কতশত কথা জমে গেছে মাত্র একদিনের ব্যবধানে। সব এক এক করে উগরে দিচ্ছে বোনের কাছে। তিতিরের এহেম পাগলামি দেখে এক কোনে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে তার প্রাণপ্রিয় স্বামী। মাঝেমাঝে চোখাচোখি হলেই চোখ টিপে দিচ্ছে শাকিল। তিতির তখন লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। সকাল থেকে দু’জনের মাঝে এরূপ খুনসুটি চলে আসছে।

তিতিরকে ভীষণ খুশি দেখাচ্ছে। বাবা-মা, দাদা-দাদি তিতিরের এই হাসিপূর্ণ মুখখানা দেখেই যেন শান্তি পেলেন। প্রত্যেক বাবা-মায়েরই আক্ষেপ থাকে, তাদের মেয়ের জীবনের আনন্দ কিংবা খুশি নিয়ে। তাদের দুশ্চিন্তা থাকে, তাদের মেয়ে কি স্বামীর বাড়িতেও যথেষ্ট আনন্দে থাকবে, যতটা তাদের কাছে ছিলো? এইদিক থেকে বাবা-মায়ের মন স্বার্থক হলো মেয়ের হাস্যজ্বল মুখখানা দেখে। স্বার্থক যেন ইশাও। ওমন একটা ঘটনাকে মনে রেখে যে তার আপা তার সুন্দর ভবিষ্যতটা কুৎসিত করে ফেলেনি, এটাই যে যথেষ্ট ওর জন্য।

“আসতে কোনো অসুবিধা হয়নিতো?;

জিজ্ঞেস করলো তিতির। তুতুন কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,

“অসুবিধা হয়নি আবার? জানো আমি কত অসুস্থ হয়ে পড়েছি!;

তুতুনের কাঁদো কাঁদো মুখখানা দেখে বড্ড মায়া হলো ইশা এবং তিতিরের। দু’জনেই একসাথে কাছে এনে আদর করতে লাগলো তুতুনকে। তিতির বলল,

“ইশশ, আমার ছোট্ট পাখিটা কতো কষ্ট পেলো আমার জন্য।;

তুতুন বুঝদার মেয়ে। আপার মন খারাপ হলে তার আরও খারাপ লাগবে। তাই নিজেকে শক্ত দেখিয়ে বলল,

“আরে ধুর ঐ কষ্ট তো কিছুই না আপা। তোমাকে দেখার জন্য আমি তো এমন হাজার কষ্ট মুখ বুজে সহ্য করবো।;

শুনে হেসে উঠলো ইশা এবং তিতির। তিতির হাসিমুখেই তুতুনের কপালে চুমু খেয়ে বলল,

“কত ভালোবাসে আমার পাখিটা আমাকে। দেখেছিস ইশু?;

“হ্যাঁ, তাই তো দেখছি।;

“কি ব্যাপার শালিকা, তুমি নাকি গাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েছো?;

উপস্থিত হলো শাকিল, আরব এবং শ্রাবণ। তুতুন মুখ তুলে তাকালো শাকিলের পানে। এখন তার লজ্জা লাগছে। সবাই কেন তার অসুস্থতা নিয়ে পড়ে রইলো।

শাকিলের প্রশ্নের পিঠে আরব বলে উঠলো,

“শুধু কি তাই? সে অসুস্থ হয়ে সাথে সাথে ঘোষণা দিলো সে বাসায় যাবে। এবং তার আপাকে যেন নিয়ে আসা হয়।;

বলেই হাসতে লাগলো তারা। তুতুন লজ্জা পেয়ে আবারও তার আপাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো।

“এই যে বেয়ান, একা একাই মিষ্টি খেয়ে সাবাড় করবেন নাকি? আমাদেরও একটু সাধেন? আমরাও একটু খাই!;

বলেই শব্দ করে হেসে উঠলো একঝাঁক ছেলে। শাকিলের বন্ধুরা এবং কাজিনরা। তানি সবেই একটা মিষ্টি তুললো মুখে দিবে বলে। তার মাঝেই এহেম বানী ভেসে আসতে চোখ বড়বড় করে তাকালো সম্মুখে। বড্ড মিষ্টি পাগল সে। মিষ্টি দেখলেই অস্থির হয়ে যায়।

“এতো মিষ্টি খাচ্ছেন যে, পরে বর তো হিমশিম খাবে আপনাকে তুলতে!;

পূণরায় ভেসে এলো কথাটা। তানি লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। মিষ্টি এখন আর তার গলা দিয়ে নামবেনা। এরা কি শুরু করলো!

লজ্জায় পড়ে মিষ্টির বাটিটা রেখে একটা মিষ্টি হাতে নিয়েই দৌড়ে পালালো ওখান থেকে। পেছন থেকে হোহো করে হাসির শব্দে ভেসে আসছে ক্রমশ।

“মা গো!;

ঝড়ের গতিতে কিছুটা একটা তেড়ে আসতেই হুমড়ি খেয়ে নীচে পড়ে গেলো ইশা। সেই সঙ্গে আসমানী রঙের সুন্দর শাড়িটাতে বেশ খানিকটা মিষ্টির ঝোল মেখে গেলো। হা করে তাকালো সে সম্মুখ পানে। মুখে হাত চেপে মৃদুস্বরে চিৎকার করে উঠলো তানি। ইশার পড়ে যাওয়াতে নয়, বরং তার খেতে না পারা মিষ্টিটা মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়ার কষ্টে। ঝাঁপিয়ে পড়লো নীচে। ইশা প্রথমে খুশি হয়ে গিয়েছিলো এটা ভেবে যে, তানি হয়তো তাকে তুলবে। কিন্তু না! ইশাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমান করে দিলো ক্ষনেই। তানি মিষ্টিটা উঠিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,

“তুই একটু দেখে আসবিনা আপা! দেখ আমার মিষ্টিটার কি হাল হয়েছে? এখনও অব্দি একটা কামড়ও বসাতে পারিনি!;

তানির আক্ষেপ করা দেখে একহাত পানিতে ডুবে ম*র*তে ইচ্ছে করলো ইশার। নিজের অবস্থা দেখে এবার যে হাসবে না কাঁদবে তাই বুঝে কুলোতে পারছেনা।

“শিট! আপনি পড়ে গেলেন কিভাবে?;

একজোড়া হাত টেনে তুললো ইশাকে। ইশা বারন করার আগেই সে নিজেকে দাঁড়ানো অবস্থায় আবিষ্কার করলো। সামনে দাঁড়িয়ে আছে কেউ! ইশা ভ্রু কুঁচকে তার পানে তাকাতেই প্রদর্শিত হলো এক যুকবের মুখশ্রী। ইশা ভ্রু কুঁচকে তাকাতে সে ভ্রু কপালে তুলে নিলো। যেটা দেখে ইশা স্বাভাবিক ভাবে তাকালো লোকটার পানে। এবার লোকটাও তাই। ইশা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

“ধন্যবাদ।;

এই বলে শাড়ির আঁচলটা ঝাড়তে ঝাড়তে চলে যেতে নিলেই লোকটা পিছু ডাকে তার।

“আপনি ইশানি, তাইনা?;

“কেন? আমার নাম দিয়ে আপনার কাম কি?;

গলার স্বর রুক্ষ করে বলল ইশা। লোকটা আমতাআমতা করে বলল,

“না মানে, আপনাকে শাকিলের বউয়ের ছবি দেখার টাইমে দেখেছিলাম। তখনই নামটা জেনেছি।;

“আপার ছবি আপনি কি করে দেখলেন?;

“ও সরি, পরিচয় দিতে ভুলে গিয়েছি.. আমি আলভি। শাকিলের বেস্ট ফ্রেন্ড।;

পূণরায় ভ্রু কুঁচকালো ইশা।

“আপনাকে তো বিয়েতে দেখিনি!;

“জি জি। আমি ইম্পরট্যান্ট কাজের জন্য আঁটকে পড়েছিলাম। বাই দ্য ওয়ে, আমি থাকলে কিন্তু বাকিদের এতো নাকানিচুবানি খাওয়াতে পারতেন না।;

ইশা হেসে উঠলো। ভাব নিয়ে বলল,

“ইশাকে মাত দেওয়া এতো সহজ নয় মশাই। আপনি কেন, আপনার মতো আরও দশ আপনি এলেও বরপক্ষের হারা তো লেখাই ছিলো।;

এই বলেই ভাবটা বজায় রেখে চলে গেলো ইশা। আলভি ইশার যাওয়ার পানে বাঁকা নজরে তাকিয়ে রইলো। মনেমনে হেসে বলল,

“ফাইনালি পাখি খাঁচার দিকে অগ্রসর হলো। লেটস্ সি।;

#চলবে

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই ♥️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব____১৩

“আন্টি, আপনাদের ওয়াশরুমটা কোন দিকে?;

শাকিলের মায়ের সঙ্গে দেখা হলো ইশার। শাড়িতে মিষ্টির ঝোলটা ভালো ভাবেই মেখেছে। এখনই না ধুতে পারলে আঠাল হয়ে থাকবে।

“ডানদিকে গিয়ে একটা রুম পাবে মা। ওখানেই আছে।;

“জি, ঠিকাছে।;

ভদ্রমহিলার দেখানো রাস্তাতেই চলে গেলো ইশা। তিনি যেভাবে বললেন, সেভাবেই দেখা মিললো ওয়াশরুমের। রুমটা ফাঁকাই আছে। ফ্রেশ হয়ে খানিকক্ষণ রেস্ট নেওয়া যাবে। এই শাড়ি পড়ে হাঁটাচলা করা মোটেও মুখের কথা নয়। ও ছাড়া এই কষ্ট আর কেউ বুঝবেনা।

“তুতুন, ইশা কোথায়?;

তুতুন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সবদিকে। এখন শরীরটা ঝরঝরে লাগাতে ওকে আর পায় কে। ওর সমবয়সী মেয়েও মিলে গেলো বেশ কয়েকজন। যার দরুন সারাক্ষণ খেলার মধ্যে দিয়েই যাচ্ছে সে।

“মেজআপা এখানেই ছিলো ভাইয়া!;

শ্রাবণ আশেপাশে একবার নজর দিলো। এখানে কোথাও নেই ইশা। অনেকক্ষণ যাবত চোখের আড়াল হয়েছে সে।

“এখানে কোথাও নেই। একটু বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখবি?;

“আমি এখন খেলছি ভাইয়া।;

বৌভাতের অনুষ্ঠান করা হয়েছে বাড়ির সামনে বিশাল জায়গা জুড়ে। সেই সুবাদে বাড়ির ভেতরে মহিলাগন ব্যতীত আর কাউকে পাওয়া মুশকিল। এতো মহিলাদের মাঝে সে ইশাকে খুঁজতে যাবে ব্যাপারটা ভালো দেখায় না।

তুতুন দৌড়ে চলে গেলো তার সখীদের সাথে। শ্রাবণ একা একা দাঁড়িয়ে রইলো। আর কাউকে দেখছেওনা যে জিজ্ঞেস করবে।

“শাকিল?;

দেখা মিললো শাকিলের। শ্রাবণের ডাক পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো শাকিল। এগিয়ে এসে বলল,

“শ্রাবণ, কিছু লাগবে?;

“আব.. একটু প্রবলেম ছিলো!;

“হ্যাঁ হ্যাঁ, প্লিজ বলো কি প্রবলেম?;

“ইশাকে কোথাও দেখছিনা। হয়তো বাসার ভেতরে গিয়েছে।;

“হতে পারে। আমি কাউকে দিয়ে ডাকিয়ে দিচ্ছি?;

“না, তার দরকার নেই। আমিই যাচ্ছি যদি আমার যাওয়াতে কোনো প্রবলেম না থাকে!;

“আরে কোনো প্রবলেম নেই। নিজের বাসাই ভাবোনা প্লিজ।;

“আহ্ থ্যাংক্স।;

মৃদু হেসে,

“এনিটাইম ব্রো।;

ওয়াশরুমের দরজাটা খুলতেই খট করে একটা শব্দ হলো। ইশা শাড়ির আঁচলে কাঁধে তুলে ঝুলে থাকা অংশটা হাতে পেঁচিয়ে বের হলো। একটু ধুতে গিয়ে অনেকটা ভিজে গিয়েছে। এখন না শুঁকিয়ে তো বের হওয়া সম্ভব নয়। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আশেপাশে তাকাতে তাকাতে কাঁধ থেকে শাড়ির আঁচলটা নামিয়ে নিলো। কখন কে কোথা থেকে এসে পড়বে বলা যায়না।

উপরে তাকিয়ে দেখলো ফ্যান আছে। তাই চটজলদি সুইচ টিপে ফ্যানের নীচে এসে দাঁড়ালো। শাড়ির আঁচলটা ঝাড়তে ঝাড়তে সময় ব্যায়ের খাতিরে পাশে তাকাতেই চমকে উঠলো অপ্রত্যাশিত কাউকে দেখে। আলভি দরজার সাথে হেলান দিয়ে এক মনে তাকিয়ে আছে ইশার পানে। ইশা চটজলদি নিজের শাড়ি ঠিক করে নিয়ে বির*ক্ত স্বরে বলল,

“একি আপনি! আপনি এখানে কি করছেন?;

ইশার বির*ক্তিভাবে আলভির তেমন হেলদোল দেখা গেলোনা। সে একই ভাবে তাকিয়ে রইলো ইশার দিকে। তার দৃষ্টি বিচরণ করছে ইশার দেহে। ইশা অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। শাড়ি এপাশ-ওপাশ টেনেটুনে ঠিক করে পূণরায় বলে উঠলো আলভির উদ্দেশ্যে। তবে এবার একটু রা*গী গলায়।

“কি সমস্যা? এখানে কি চাই?;

এবার আলভির হুঁশ ফিরে। নড়েচড়ে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঘোর লাগা নয়নে তাকালো ইশার পানে। ফের বলল,

“আপনি এতো সুন্দর কেন? আমার চোখ ফেরানো দায় হয়ে যাচ্ছে ম্যাডাম!;

চেতে গেলো ইশা। কারোর পারমিশন ছাড়া এভাবে কারোর ঘরের সামনে এসে অসভ্যের মতো তাকিয়ে থাকা মোটেও ভদ্রতার লক্ষণ নয়। সে আরও বির*ক্তি নিয়ে বলল,

“কোনো দরকার?;

“জি অনেক দরকার।;

এই বলে রুমের ভেতর ঢুকে এলো আলভি। ইশা ভড়কে গেলো। রাগ বির*ক্তি এক করে বলল,

“ক্ কি সমস্যা? ভেতর আসছেন কেন?;

“আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।;

“আমি কোনো কথা শুনতে চাইনা।;

এই বলে ইশা আলভির পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে আলভি পূণরায় বলে ওঠে,

“শুধু আপনাকে না, আমি আপনার ফ্যামিলির সাথেও কথা বলব, যদি দরকার হয়!;

ইশা দাঁড়িয়ে পড়লো। মহা বির*ক্তি নিয়ে বলল,

“মানে?;

“আপনি ভীষণ সুন্দর। একদম আমার মনের মতো। গায়ের রঙ থেকে শুরু করে, পায়ের নখ অব্দি। কোনো কমতি নেই আপনার।;

“আমার হাতের ঘুষিও খুব সুন্দর। একটা খেলেই তিনদিনের বেড রেস্ট।;

দাঁতে দাঁত চেপে বলল ইশা। আলভি হেসে উঠলো। ইশা নির্ঘাত মজা করছে।

“আপনি রা*গলেও কিন্তু আপনাকে ভীষণ সুন্দর লাগে।;

“আর কিছু?;

“আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই!;

ফট করে বলে বসলো আলভি। ইশা ভ্রু কুঁচকে তাকালো আলভির পানে। তেতে ওঠা গলায় বলল,

“আমি আপনাকে কেন বিয়ে করতে যাবো?;

“কারন আমিও অনেক সুন্দর। শ খানিক মেয়ে আমার জন্য পাগল। শ খানিক মেয়ে বিয়ে করতে চায় আমাকে। আমি হ্যান্ডসাম। ভালো জব আছে। মোটা অংকের মাইনে..;

“প্লিজ থামুন! আগে এই যে গোবর ঠাসা মাথাটা পরিষ্কার করুন। ভালো লুক, ভালো জব আর কি? শ খানিক মেয়ে আপনার পেছনে ঘুরঘুর করে! ব্যস? আর কিছু না? আপনি কেমন মানুষ, ভালো নাকি খারাপ এগুলোর তো কোনো প্রয়োজনই পড়েনা তাইনা? ভালো লুক, ভালো জব আর মোটা অংকের মাইনে পেলেই যেকোনো মেয়ে হাতের তুড়ি বাজাতেই আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাবে! এটাই ভাবেন তো? আগে দেখান আপনি মানুষটা কেমন। শো অফ না করে আগে ভালো মানুষ হতে হবে। কি বললাম? ভালো মানুষ! বুঝলেন?;

“আপনার দেখি ভালো দেমাগ? কি রূপের অহংকার নাকি?;

“আপনার মতো গাধারা বুঝবেনা। বাদ দিন।;

আলভির মুখের রঙ পাল্টে গেলো ইশার কথাটা শুনে। তেতে উঠে ক্ষপ করে ইশার হাতটা চেপে ধরে রাগান্বিত কন্ঠে বলল,

“আমাকে গাধা বললেন?;

ইশা দিগুণ তেতে উঠলো। নিজের হাতটা এক ঝাটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে ক্ষোভ মিশ্রিত গলায় বলে উঠলো,

“কি সাহস আপনার!;

আলভি এক পা এগোলো ইশার পানে। ভাবলো ইশা হয়তো টলবে তার জায়গা থেকে। কিন্তু না। ইশা এক ইঞ্চিও নড়লোনা। আলভি তা দেখে গলা মোটা করে বলে উঠলো,

“সাহসের দেখলেন কি? মেয়ে মানুষ বলে ভালো ভাবে কথা বলছিলাম আপনার সাথে। আর কিন্তু তা হবেনা।;

ফিক করে হেসে দিলো ইশা। আলভি রাগি চোখে তাকালো ইশার পানে। আরেকপা এগিয়ে আসলো। পরক্ষণেই দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,

“খুব ভাব তাইনা? আপনার ভাব..;

ঠাসস করে এক বিকট শব্দ হতেই দু’পা পিছিয়ে পড়লো আলভি। গালে হাত চেপে হাদার মতো তাকিয়ে রইলো সম্মুখে। ইশাও চকিত পাশ ফিরে তাকালো। চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। ইশা চোখ নামিয়ে নিয়ে আঁড়চোখে তাকালো আলভির পানে। ওর কান থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে বলে মনে হলো ইশার। হাসিটা যেন আরও দিগুণ চেপে বসলো।

শ্রাবণ লাল চোখ জোড়া নিয়েই তেড়ে গেলো আলভির পানে। আলভি “ওমা গো” বলে চেঁচাতে চেঁচাতে পিছিয়ে পড়লো দু-পা। ওর চেঁচানো দেখে আর এগোতে পারলোনা শ্রাবণ। ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়লো সে। আলভির মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে উঠলো। কুকিয়ে বলো উঠলো,

“আমাকে মা*রবেন না প্লিজ!;

শ্রাবণ এবার রাগী নয়, প্রশ্ন বিদ্ধ মুখ করে তাকালো আলভির পানে। ভ্রু কুঁচকে বলল,

“কেন?;

আলভি আমতাআমতা করছে। চোখে জল যেন চিকচিক করছে। ফের বলল,

“না ভাই, প্লিজ মাইরেন না!;

“কেন?;

পূণরায় কুঞ্চিত ভ্রু করে শুধালো শ্রাবণ। আলভি এবার ফুঁপিয়ে উঠলো। বলল,

“মা সবসময় কথা বলার আগে মে*রে নেয় ভাই!;

“একশবার মা*রা উচিৎ, এরকম কুলাঙ্গারকে মা*রবে না তো কাকে মা*রবে? এবার আমার হাতেও মা*র আছে তোর জন্য! এদিকে আয়!;

“না ভাই, আমি আসবোনা। আপনি মুখে বলেন। আমি শুনবো।;

শ্রাবণ গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো। পেছন মুড়ে একবার ইশার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,

“তুই এখানে কি করছিস? বন্ধু পাতাচ্ছিস নাকি এই বলদের সাথে?;

ইশা এপাশ ওপাশ করে তুমুল গতিতে মাথা নাড়লো। অতঃপর বলল,

“আমি এখানে (শাড়ির আঁচল ধরে) শাড়ি ঠিক করার জন্য এসেছিলাম। আর এই বলদ তখনই এসে হাজির হয়!;

“কি বলছিলো তোকে?;

“আমাকে বিয়ে করতে চায়!;

“ও ওয়াও। বেস্ট জোড়ি ইন দ্য ওয়াল্ড! কি ভাই, পছন্দ হয়েছে পাত্রী?;

আলভি বোকা হাসি দিলো। মাথা চুলকে বলল,

“হ্যাঁ ভাই।;

ইশা জ্বলে উঠলো ওদের কথপোকথনে। রাগান্বিত গলায় বলে উঠলো,

“মানে কি শ্রাবণ ভাই? তুমি মজা করছো আমার সাথে।;

শ্রাবণ ইনোসেন্ট চোখে তাকালো। যেন সে কিছুই বুঝতে পারছেনা।

” মজা আর আমি? আমাকে দেখে কি মনে হয় তোর? আমি মজার মুডে থাকি?;

“ভাই, আপনি কি হন পাত্রীর? ভাই?;

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো শ্রাবণ। ইশা ফিক করে হেসে দিলো। শ্রাবণ রাগী চোখে তাকাতেই ইশার হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। সামনে থেকে আলভি পূণরায় বলে উঠলো,

“ভাই না? তাহলে কি দুলাভাই?;

শ্রাবণ ফোঁস করে উঠলো। তেতে উঠে তেঁড়ে গেলো আলভির পানে। দাঁতে দাঁত চেপে আলভির কলার চেপে ধরে বলে উঠলো,

“দুলাভাই তোর বাপ শালা!;

হকচকিয়ে গেলো আলভি। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে হাত জোর করে মাফ চাইতে লাগলো শ্রাবণের পানে। ইশা আর নিজেকে সামলে রাখতে পারছেনা। জোরে জোরে হেসে উঠলো পরমুহূর্তেই।

_________

বৌ ভাতের অনুষ্ঠান শেষ করে তিতির এবং শাকিলকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হলো সবাই। আসার সময় গাদাগাদি করে এলেও যাওয়ার পথে মানুষ আরও বাড়াতে গাড়িতে জায়গা কম পড়লো। যার দরুণ গাড়ি থেকে নেমে যেতে হলো শ্রাবণ, আরব, ইশা আর তানিকে। শ্রাবণ দাদাজানকে জানালো, তারা ক্যাব বুক করে চলে আসবে। ওদের সঙ্গে তুতুন আসার জন্য জোরাজোরি করলে, শ্রাবণের এক ধমকে চুপচাপ চলে গেছে।

রাত সাড়ে এগারোটা। অর্ধেক পথ এসে দুর্ভাগ্যক্রমে বুক করা ক্যাবটাও খারাপ হয়ে গেলো তাদের। তাই অর্ধেক ভাড়া দিয়ে এখন গাড়ির খোঁজে চারজনেই হাঁটতে লাগলো মাঝরাস্তায়। এদিকে নেটওয়ার্কের অবস্থাও খুব বাজে। পূণরায় ক্যাব বুক করার জন্য যথেষ্ট নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না।

” ভাইয়া, আমার ক্ষুধা লেগেছে। সেই দুপুরে একটু খেয়েছি।;

পেট চেপে ধরে বসে পড়লো তানি। কথাটা বলে বড় একটা দম নিয়ে তাকালো শ্রাবণের পানে। ওর বসে পড়াতে বাকিদেরও দাঁড়াতে হলো। শ্রাবণ হাতের ঘড়িতে সময় দেখে বলল,

“হ্যাঁ, রাত তো কম হলোনা। দাঁড়া, দেখছি কিছু পাওয়া যায় কিনা!;

“জলদি কিছু করো।;

শ্রাবণ হোটেল খুঁজতে চলে গেলো। এর মাঝে আরব বলে উঠলো,

“এদিকে আমার একটা ফ্রেন্ডের বাসা আছে! ওকে একটা কল দিয়ে দেখি দাঁড়া।;

“দেখ দেখ। আমার আর বাসায় যেতে মোটেও ইচ্ছে করছেনা।;

আরবের কথার পিঠে অধৈর্য্য গলায় বলল তানি। ইশা তানির হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে বকার সুরে বলল,

“মাঝরাস্তায় এমন করে বসে পড়লি কেন? লোকে দেখছে যে।;

“আমি আর পারছিনা রে আপা!;

“ওদিকে দেখ, বেঞ্চ দেখা যাচ্ছে একটা। চল গিয়ে বসি।;

ইশার বলতে দেরী হলেও তানির দৌড়ে গিয়ে বসে পড়তে দেরী হলোনা। ইশা ওর দৌড়ে যাওয়ার পানে তাকিয়ে আরবের উদ্দেশ্যে বলল,

“বাসায় না ফিরতে পারলে নানাজান রাগবেন ভাইয়া। তুই কি ভুলে গেলি?;

“ভুলিনি, কিন্তু আমার যে আর পা চলছেনা। জানিস, এখনও কতখানি পথ? গাড়ি পেলেও জ্যাম ঠেলে মিনিমাম তিন ঘন্টা। আমিও আর নিতে পারছিনারে!;

“কষ্ট হলেও ফিরতে হবে, প্লিজ!;

“কোনো প্লিজ মানতে পারছিনা। আমি আর তানি আমার ফ্রেন্ডের বাসায় উঠে যাই। তুই আর ভাইয়া চলে যা।;

“মানে? আমরা দু’জনে গেলে নানাজান তোদের কথা জিজ্ঞেস করবেনা? তখন কি জবাব দিবো?;

“কাকে কিসের জবাব দিতে হবে?;

হাতে সমুচা নিয়ে হাজির হলো শ্রাবণ। ইশার কথার পিঠে প্রশ্ন করতে আরব আর ইশা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো একে অপরের। ইশা আর জবাব না দিয়ে শ্রাবণের হাত থেকে সমুচার প্যাকেটটা নিয়ে গিয়ে চলে গেলো তানির কাছে। খাবার পেয়ে রাজ্য জয়ের হাসি দিলো তানি। অনন্তর, বিনা বাক্য খরচে খেতে শুরু করলো।

এখন বাজে ঠিক রাত বারোটা। একটা লেগুনায় উঠলো ইশা আর শ্রাবণ। আরব আর তানি চলে গেলো আরবের বন্ধুর বাসায়। একা চলল ইশা আর শ্রাবণ। আকাশের অবস্থা মোটেও ভালো নয়। লেগুনা ভাঙা রাস্তায় ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে চলছে। ইশার একপাশে শ্রাবণ আর অন্যপাশে একজন বয়স্ক লোক। ভাঙা রাস্তার বদৌলতে বেচারি একবার এপাশে ছিটকে পড়ছে তো একবার ওপাশে। যা দেখে বয়স্ক লোকটি শ্রাবণের উদ্দেশ্যে বলল,

“তোমার বউরে ধইরা বহো মিয়া! রাস্তার অবস্থা দ্যাখছো? পইরা যাইবো তো।;

লোকটার কথা শুনে চোখ বড়বড় হয়ে গেলো ইশার। শ্রাবণ মুচকি হেসে লোকটার কথা মোতাবেক ইশার কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে নিলো। ফের লোকটার উদ্দেশ্যে বলল,

“আসলে চাচা নতুন বিয়ে করেছি তো! মাঝেমাঝে তো মনেই থাকেনা আমার একটা বউ আছে।;

শ্রাবণের কথাটা শোনা মাত্র আশেপাশের আরও অনেক আরোহীরা হো হো করে হেসে উঠলো। ইশা শক্ত করে হয়ে বসে রইলো। শ্রাবণের উষ্ণ হাতটা বিচরণ করছে ইশার কোমরে। ইশা শুঁকনো গলায় ঢোক গিলে পাশ ফিরে তাকালো শ্রাবণের পানে। তাকালো শ্রাবণও। দু’জনের চোখাচোখি হয়ে গেলো কয়েক লহমার জন্য। ইশা তার কম্পিত দৃষ্টি খানা নামিয়ে আনলো মাটিতে। ঠিক তখনই শ্রাবণ ইশার কাছে এসে ধীর কন্ঠে বলে উঠলো,

“ভয় নেই। পড়বিনা।;

ইশার বুকের ভেতরটা বেজে উঠলো। লজ্জা লাগছে তার। মাথা নীচু করে নিতে একঝাঁক চুল এসে ঢেকে দিলো তার মুখখানা। অমনি যেন স্বস্তি মিললো তার।

#চলবে

ডাকপিয়নের ছুটি নেই পর্ব-১০+১১

0

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব____১০

“শ্রাবণ ভাই..;

আতংকিত গলায় চেঁচিয়ে ওঠে ইশা। তুর্যকে টেনে তুলে আরেকটা ঘুষি মা*র*তে গিয়ে থেমে যায় শ্রাবণ। ইশা দৌড়ে এসে দাঁড়ায় তুর্যকে আড়াল করে। ইশার চোখের কোনে জল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে,

“ত্ তুমি এখানে কি করছো? কেন এসেছো!;

“ছি ইশা! এখানেও সেই ছেলে? যার জন্য তুমি আমার হাতে চরটা খেলে, এখানেও সেই..;

তুর্য কথাটা শেষ করার পূর্বেই ইশাকে সামনে থেকে সরিয়ে পূণরায় তাকে চেপে ধরলো শ্রাবণ। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“এতো বড় স্পর্ধা? হু! ইশার গায়ে হাত তুলে আবার বড় গলায় কথা বলছিস জা*নোয়ার?;

শেষোক্ত কথাটা বলতে বলতে গর্জে উঠলো শ্রাবণের কন্ঠস্বর। কথাটা এতোটাই জোরে শোনালো যে ইশা ভ*য়ে চমকে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে এক কদম পিছিয়ে পড়ে মুখে হাত চাপলো! তুর্যও চমকে উঠলো শ্রাবণের এরূপ হুংকারে। ভড়কে যাওয়া দৃষ্টি মেলে শ্রাবণের দিকে তাকাতেই শ্রাবণ আবারও বলে উঠলো,

“কোন সাহসে হাত তুলেছিস? কে দিয়েছে এতো সাহস তোকে? বল?;(গর্জে ওঠে)

তুর্য পূণরায় কেঁপে উঠলো ভ*য়ে। তার চোখের পাতা কাঁপছে। গলা শুঁকিয়ে এসেছে। শুঁকনো গলায় ঢোক গিলে কিছু বলবে তার পূর্বেই ইশা পূণরায় এসে হাত ধরলো শ্রাবণের। আকুতিপূর্ণ গলায় বলল,

“ছেড়ে দাও শ্রাবণ ভাই। বাড়ি ভর্তি আত্মীয়স্বজন। প্লিজ! একটা বাজে পরিস্থিতি হয়ে যাবে। নানা নানু..;

“আমাকে একদম বোঝাতে আসিস না ইশা!;

গম্ভীর গলায় কথাটা বলেই অগ্নি দৃষ্টিতে পূণরায় তুর্যর পানে তাকালো শ্রাবণ। তুর্য হাসফাস করছে। সে যে ভুল করেছে সেটা যেন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। কিন্তু দমলে তো চলবেনা। সে ভুল করলে, শ্রাবণ অন্যায় করেছে। এবং এখনও অব্দি করে যাচ্ছে।

“এসব কথা আমাকে না বলে নিজের ঘরের মেয়েকে বলো শ্রাবণ। তোমাদের কি চোখে পড়ছেনা সেই সকাল থেকে ওর ফষ্টিনষ্টি? কতক্ষণ এই ছেলের সাথে কতক্ষণ ঐ ছেলের সাথে! আমি ওর হবু হাসবেন্ড! আমার কি এসব দেখতে ভালো লাগবে? ও তোমার বউ হলে, তুমি সহ্য করতে পারতে ওর এসব নোংরামি?;

তুর্যর চিন্তাধারা দেখে অবাক বনে গেলো শ্রাবণ। কয়েক মুহুর্ত কিছুই বলে উঠতে পারলোনা সে।

“সকাল থেকে এসে থেকে দেখছি ওর এসব কান্ড! আমি এসব একদম সহ্য করবোনা এই বলে দিলাম। আমার সাথে থাকতে হলে ওকে এসব নোংরামি ছাড়তে হবে। নয়তো আমি ওকে বিয়ে করবোনা!;

“করোনা।;

“কি?;

“ইয়েস! এই বিয়ে ক্যানসেল। এন্ড আমি শ্রাবণ, দেখে ছাড়বো তোমার মতো লোকের সাথে আমার ঘরের মেয়ের বিয়ে কি করে হয়?;

“মানে? তুমি.. আমার কথাটা বুঝতে পেরেছো তো?;

“ইশা, নীচে চল। আমি এক্ষনি সবাইকে বলতে চাই, আমি তোর আর তুর্যর বিয়েটা ক্যানসেল করেছি।;

ইশার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। তুর্য বোকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্রাবণের পানে। শ্রাবণ তুর্যর শার্টের কলার ছেড়ে দিয়ে ইশার হাত ধরে রওনা হলো নীচে। তুর্য দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়ালো ওদের। বোকা গলায় কতক্ষণ আমতাআমতা করে ইশার পানে তাকালো। অপরাধবোধে হাঁপিয়ে উঠে বলল,

“ইশা, শ্রাবণ এসব কি বলছে? ওকে বোঝাও! আ্ আমি তো তোমার হাসবেন্ড। তোমার উপর কি আমার কোনো অধিকার নেই? আমি কি তোমাকে…;

“জাস্ট শাটআপ তুর্য!(র-ক্ত চোখে চেয়ে) ইশার সঙ্গে আর জাস্ট একটা কথা বলার দুঃসাহস দেখালে আমি তোমার জিভ টেনে আলাদা করে ফেলবো! তুমি চিনোনা আমাকে, প্রয়োজনে আমি আমি কতটা ভ*য়ানক হতে পারি, কোনো আইডিয়া নেই তোমার!;

শ্রাবণের শান্ত স্বরের হুমকি ভেতরটা নাড়িয়ে দিলো তুর্যর। নিজের ভালো ভেবই সরে গেলো সে। শ্রাবণ আর এক মুহুর্তও দাঁড়িয়ে রইলোনা। হুড়মুড় করে চলে গেলো ইশাকে নিয়ে। তুর্য ওদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রা*গে ফুঁসতে লাগলো। ইশাকে সে কিছুতেই হাতছাড়া করতে পারবেনা! এতো কাঠখড় পুড়িয়ে শেষ অব্দি এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারবেনা সে।

“মানে? কি বলছো কি এসব!;

বাড়ি ভরা লোকের সামনে খান সাহেবের উচ্চস্বর প্রতিধ্বনি হতেই সকল কোলাহল, সোরগোল থেমে গেলো। শ্রাবণ দাঁত চিবিয়ে নিজের রা*গটা সংবরণ করার চেষ্টা করছে। ইশা অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক কোনে। শমসের সাহেব, সাজ্জাদ সাহেব একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। মেয়ে বিদায়ের সময় আবার কোন আপদ হলো? মনে মনে ঠিক এটাই ভাবছেন। আফিয়া বেগম, নুপুর বেগম এবং মরিয়ম বিবি হাতের কাজ ফেলে দৌড়ে এলেন উপস্থিত মহলে। বিয়েটা তো সিষ্ঠু ভাবেই এগোচ্ছিলো, হঠাৎ কি গণ্ডগোল বাঁধলো?

“হ্যাঁ দাদাজান, তুর্য এবং ইশার বিয়েটা আমি ভেঙে দিচ্ছি। ইশা তুর্যকে বিয়ে করবেনা।;

“ও দাদুভাই, তুই এসব কি বলছিস রে?;

দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলেন আনোয়ারা বেগম। শ্রাবণের পিঠে কাঁধে হাত বুলিয়ে কথাটা বলেই থামলেন না। পূণরায় বললেন,

“মাথা ঠান্ডা কর ভাই। এতো রে*গে আছিস কেন? কি হয়েছে?;

“দাদু, আমার মাথা একদম ঠান্ডাই আছে। আমি মাথা গরম করে, কিংবা রা*গের মাথায় কিছু বলছিনা। যা বলছি একদম ভেবেচিন্তে বলছি।;

তুর্যর বাবা এবং মাও উপস্থিত রয়েছেন এখানে। শ্রাবণের এহেম বানীতে তারা অবাক হলেও খানিক ক্ষিপ্র হয়ে উঠলেন। তুর্যর মা রূপা বেগম ক্ষিপ্র গলাতেই বলে উঠলেন,

“বিয়ে ভাঙছো মানে? বিয়ে ভাঙার তুমি কে হ্যাঁ? তুমি কি গুরুজন!;

তুর্যর মায়ের কথায় তাচ্ছিল্য মিশ্রিত হাসলো শ্রাবণ। ভ্রু চুলকে একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে এগিয়ে গেলো খান সাহেবের দিকে। খান সাহেবের হাত দুটো ধরে পূর্বের সেই গম্ভীর ভাবটা ফিরিয়ে এনে শান্ত স্বরে বলল,

“আমার প্রতি ভরসা আছে তো তোমার?;

“শ্রাবণ, এখানে ভরসা আর বিশ্বাসের কথা নয় দাদাজান। এখানে আমাদের খান বংশের সম্মান জড়িয়ে। ইশার সাথে তুর্যর আংটিবদল হয়েছে। বিয়ে ঠিক। হঠাৎ বিয়ে ভাঙলে.. লোকে ওকে হাজার কথা শোনাবে! আমাদের দিকে আঙ্গুল তোলার সাহস করবে!;

“লোকের কথায় তুমি কারোর জীবন নিয়ে এমন উদাসীনতা দেখাতে পারোনা। তুমি জানোনা, তুর্য কতটা অযোগ্য এই সম্পর্কের জন্য। এবং অবশ্যই একজন মানুষের তালিকাতেও ওর কোনো স্থান হতে পারেনা।;

“কি বলছোটা কি তুমি?;

অধৈর্য্য হয়ে উঠলেন খান সাহেব। বির*ক্ত হয়ে শ্রাবণের থেকে হাত ছাড়িয়ে অন্যপাশে সরে গেলেন। তিতির, তুতুন, আফিয়া বেগম এবং নুপুর বেগম গিয়ে দাঁড়ালো ইশার পাশে। তিতির ইশাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে আস্তে করে জানতে চাইলো,

“কি হয়েছে রে? ভাইয়া ওমন ক্ষে*পে আছে কেন? তুর্য ভাই কি কিছু করেছে?;

ইশা কিছু বলতে পারলোনা। আফিয়া বেগম ইশাকে বুকে টেনে নিলেন। খানিকটা সময় পেরিয়ে গেলো নিরবতায়। নুপুর বেগম বললেন,

“কিছু না হলে শ্রাবণ ওমন ক্ষে*পতো নাকি? তাই না বলো ভাবি?;

“হ্যাঁ রে। ছেলেটা ওমন করে রেগে গেছে মানে তুর্য কিছু তো একটা করেছে।;

“এই ইশা বলনা মা? কি হয়েছে!;

ইশা নিজের মাঝে নেই যেন। ছাদে যা ঘটলো। তারপর এখানে পূণরায় যা ঘটছে!

“এই বিষয়ে আমরা পরে কথা বলি? এখন এই ঘরভর্তি লোকের সামনে এসব সিনক্রিয়েট করার কোনো মানে হয়না।;

ছেলের হাত ধরে পাশে টেনে আনলেন শমসের সাহেব। গলার স্বর খাদে নামিয়ে কিঞ্চিৎ রাগী গলায় বললেন শেষোক্ত কথাটা।

শ্রাবণ বাবার থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পূণরায় খান সাহেবের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। এবার সে গম্ভীর নয়, বরং তীব্র ক্ষো*ভে ফেটে পড়ছে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে বলে উঠলো,

“তুর্য তোমার বাড়ির সম্মানকে দুই পয়সারও দাম দেয়না খান সাহেব! তুমি কি জানো সেটা? সে তোমার বাড়ির সম্মানকে এক মুহুর্তের ব্যবধানে পায়ের কাছে এনে ফেলেছে, তুমি কি জানো সেটা? তুর্য কোনো কারন ছাড়া ইশার গায়ে হাত তুলেছে! ওকে তুলনা করেছে একজন ন.. থাক! আশাকরি, যতটুকু তোমাকে বোঝানোর তা বোঝাতে পেরেছি!;

একটা চাপা গুঞ্জন শুরু হলো মহলে। বাড়ির সবাই একই সাথে আর্তনাদ করে উঠলো শ্রাবণের কথা গুলো শুনে। আফিয়া বেগম, নুপুর বেগম ইশাকে দেখতে লাগলেন রা*গী দৃষ্টিতে। ছুটে গেলেন মরিয়ম বিবিও।

“কি! এতো বড় স্পর্ধা? এতো বড় স্পর্ধা কারোর হয় কি করে, খানের নাতনির গায়ে হাত তোলে? কোথায় তু্র্য! ডাকো তাকে?;

গর্জে উঠলেন খান সাহেব। আতংকে কেঁপে উঠলো সবাই।

“না না, এটা অসম্ভব খান সাহেব! আমাদের ছেলে এমন কোনো কাজ করতেই পারেনা। ও মেয়েদের কতটা সম্মান করে, আপনি কি দেখেননি আগে? সেখানে ও, ওর হবু বউকে.. ছি ছি ছি! এটা আমি মানতে পারবোনা!;

বলে উঠলো তুর্যর মা। মহিলা বড় ধড়িবাজ। দেখলেই বেশ বোঝা যায়। কিন্তু, তাকে ধরা যে এতো সোজা নয়।

“এই বিয়ে আজ এখানেই ভেঙে দিলাম আমি। ইশা, এদিকে এসো। খোলো ওই কুলাঙ্গারের আঙটি। আর ছুঁড়ে ফেলো বাইরে।;

নানাজানের হুকুম অমান্য করলোনা ইশা। ছুটে এসে দাঁড়ালো নানাজানের সামনে। চটজলদি হাতের রিংটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিতেই সেটা গিয়ে পড়লো তুর্যর কপালে।

_____________

তিতিরকে তুলে দেওয়া হলো বরের গাড়িতে। মেয়ের বিদায়ে হাউমাউ করে কেঁদে ভাসালেন সবাই। বাবা-মা, ভাই বোন, দাদা-দাদী এমনকি বাড়ির কাজের লোকটাও। তিতিরকে ভালোবাসেনা, এমন মানুষ বড় কমই মিলবে। যেমন শান্ত, তেমন ভদ্র। বড়দের সম্মান করা, ছোটদের স্নেহ করা কোনো গুনেরই কমতি ছিলোনা তিতিরের মাঝে। বড্ড সহজ-সরলও বটে মেয়েটা। কে জানে, শশুর বাড়িতে গিয়ে মানিয়ে গুছিয়ে নিতে পারবে কিনা!

আফিয়া বেগম কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। নুপুর বেগম আর মরিয়ম বিবি তাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে ঘরে দিয়ে গেলেন। সারাদিনের এতো ধকলের পরে এমন করে কাঁদা যে মোটেই উচিৎ হয়নি। আরও কতরকম বুঝ বুঝিয়ে গেলেন তারা। কিন্তু, মায়ের মন বলে কথা! মেয়ে বিদায়ে মা কাঁদবে না, মায়ের বুক খালি হবেনা এও কি সম্ভব।

সবারই মন খারাপ। এই মন খারাপের ভীড়ে ইশার মনটা যেন একটু বেশিই খারাপ। নিজের উপর বড্ড রাগ হয় মাঝেমাঝে। যে ওকে নিজের সবটা উজাড় করে ভালোবেসেছিল, তাকে বোকার মতো পায়ে ঠেলে দিয়েছিলো কেবল বাড়ির সম্মানের কথা ভেবে। আর আজ? আজ যা হলো, তাতে সত্যিই কি আর বেঁচে রইলো এ বাড়ির সম্মান। যার সাথে ও গোটা জীবনটা কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, সেই মানুষটাই তো ওকে এক ধাক্কায় ওর নিজের নজরেই নীচু করে দিলো।

“ইশু ইশু, ইশুপাখি ইশুপাখি!;

চমকে উঠলো ইশা। চটজলদি পেছন মুড়ে তাকাতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো ছোট্ট একটা ডাকপিয়ন বাক্স। যার উপর আসন জুড়ে বসে আছে কথা বলা একটা টিয়া পাখি। টিয়া পাখিটির পায়ের কাছে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, ” ডাকপিয়নের ছুটি নেই”। ইশা ছুটে গেলো ডাকপিয়নের বাক্সটার কাছে। যেটা হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। ইশা ছুটে এসে একরকম কেঁড়ে নিলো ডাকপিয়নের বাক্সটা। নিজের আনন্দ, খুশি যেন কিছুতেই দমিয়ে রাখতে পারছেনা সে। মৃদু চিৎকার করে হাসতে হাসতে বলে উঠলো,

“ডাকপিয়ন। আমার ডাকপিয়ন?;

“হ্যাঁ। তোর ডাকপিয়ন।;

মুগ্ধ হেসে বলল শ্রাবণ। সেই মুগ্ধ হাসিতে বসন্ত ফুটলো ইশার হৃদয়ে। পূণরায় মৃদু স্বরে চেঁচিয়ে বলল,

“আমার নামে চিঠি এসেছে শ্রাবণ ভাই?;

শ্রাবণ হেসে উঠলো শব্দ করে। ইশার গাল টেনে আহ্লাদ করে বলল,

“এসেছে পাগলি।;

ডাকপিয়নের এই ছোট্ট বক্সটি অনেক ছোট বেলায় একটা মেলা থেকে ইশাকে কিনে দিয়েছিলো শ্রাবণ। এবং তারপরের দিনই ডাকপিয়নে চিঠি জমার খবর দিতে কিনে আনলো এক কথা বলা টিয়াপাখি। যার নাম ছিলো মিঠু। রোজ যখন ইশা ঘুম থেকে উঠতো, ঠিক তখনই মিঠু মিষ্টি করে ডাকতো ইশু, ইশু! চিঠি, চিঠি। রোজ ইশার নামে চিঠি পড়তো এই ডাকপিয়নে। আর যেটাই ইশার অভ্যাসে পরিণত হতে লাগলো প্রতিনিয়ত। রোজ ঘুম থেকে উঠেই মিঠুর ডাক এবং ছোট্ট একখানা চিঠি। হঠাৎ একদিন মিঠুর বড্ড অসুখ করলো। কাউকে কোনো সুযোগ না দিয়েই মিঠু চলে গেলো না ফেরার দেশে। মিঠুর চলে যাওয়ার শোক ছোট্ট ইশা কিছুতেই কাটাতে পারলোনা। না খাওয়া, না ঘুম! সারাক্ষণ ডাকপিয়নের সামনে বসে থাকতো মিঠুর কথা বলার আশায়। কখন মিঠু ইশু বলবে, আর কখন চিঠি বলবে। রোজ একের পর এক চিঠি দিয়ে ভরে যেতে লাগলো ডাকপিয়ন। কিন্তু, ইশার তার প্রতি কোনো আগ্রহ বাড়াতে পারলোনা। এদিকে চিঠিদাতা যেন অস্থির হয়ে উঠলো। একদিন ইশার ঘরে খবর নিতে গেলো তার সমস্যা কি? কেন সে এমন উদাসীন হয়ে পড়লো, কেন সে কোনো চিঠি তুলছেনা?

ইশার ঘরে গিয়ে চিঠিদাতা দেখতে গেলো ডাকপিয়নের বক্সে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, “ডাকপিয়নের ছুটি নেই”। অবাক হলো চিঠি দাতা। এই সমস্যার সমাধান কি? পূণরায় সে চিঠি লিখতে আরম্ভ করলো। কিন্তু, রোজ চিঠি লিখেও যে কোনো লাভ হচ্ছে না! ইশা কিছুতেই স্বাভাবিক হচ্ছে না। তাই সে সিদ্ধান্ত নিলো ইশার জন্য পূণরায় টিয়াপাখি আনা হবে। তবে এমন পাখি আনতে হবে যার কোনো ভাবেই মৃ*ত্যু হবেনা। যেই ভাবা সেই কাজ। চিঠিদাতা বাজার থেকে পূণরায় একটা কথা বলা টিয়া পাখি কিনে আনলো। তবে সে এমন পাখি, যে সারাক্ষণ রেকর্ডারের মতো ইশুপাখি, ইশুপাখি বলতে ডাকতে থাকে। কোনো কিছুতেই সে থামতো না। পূর্বের মিঠুর চেয়ে এই মিঠু হাজারগুন বেশি স্পিডে ও হাজারটা বেশি কথা বলতো। ইশা স্বাভাবিক হয়ে গেলো। পূণরায় তার রোজকারের নিয়ম মেনে ঘুম ভাঙতে লাগলো। এবং রোজ, ‘ইশু পাখি চিঠি এসেছে’ বলে তার ঘুম ভাঙাতে লাগলো।

“ইশুপাখি, চিঠি এসেছে। ইশুপাখি!;

ক্যাচক্যাচ করে কথাটা বলে শান্ত হয়ে গেলো মিঠু। ইশা খিলখিল করে হাসতে লাগলো। এতো আনন্দ সে কোথায় রাখবে? শ্রাবণ যে পূণরায় তার হাসির কারন তাকে ফিরিয়ে দিলো। এতো কৃতজ্ঞতা বোধ সে কি করে প্রকাশ করবে।

#চলবে

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব______১১

অভিমানের তীব্র পাহাড় জমে হঠাৎ একদিন ডাকপিয়নের বাক্সটি নিয়ে চলে যায় শ্রাবণ। সেদিন ছিলো এক কালবৈশাখী রাত। যে রাতের পর, ঝড় হাওয়া দেখলেই বুক ফেটে কান্না আসতো ইশার। ইশা অনেক অনুনয়-বিনয় করেছিলো ডাকপিয়নের জন্য, কিন্তু শ্রাবণের মন গলেনি আর। গত তিনবছরে ইশা আর একেবারের জন্যও দেখেনি এই ডাকপিয়নকে।

“আশাকরি আর মন খারাপ করবিনা। দেখ, আমাদের জীবনে সব মানুষ যে ভালো হবে এবং সবকিছু যে ভালো ঘটবে, ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়। আমাদের জীবনে খারাপটা তখনই আসে, যখন আমরা ভালোর ব্যবহার ভুলে যাই, ভালোর কদর করতে পারিনা।;

“আমি তোমার সাথে বড্ড অ*ন্যায় করেছি। তারই শা*স্তি বুঝি..;

“তুই হয়তো তোর পাশ থেকে ঠিক ভেবেছিলি। আর আমি আমার পাশ থেকে ঠিক। তাই আমরা কেউই খারাপ হলাম না।;

“তুমি আমাকে কখনোও মাফ করতে পারবে শ্রাবণ ভাই?;

“কিসের মাফ? অ*ন্যায় করেছিস নাকি তুই?;

“তুমি আমার উপর রেগেও নেই?;

উচ্ছ্বসিত গলায় বলে উঠলো ইশা। শ্রাবণ মৃদু হেসে বলল,

“না রেগে নেই। যা এবার ঘরে যা। রেস্ট নে। সারাদিন অনেক ধকল সামলেছিস।;

“এটা নিয়ে যাই?;

শ্রাবণ পূণরায় হাসলো। বলল,

“তোর জিনিস, তোর ইচ্ছে। যা খুশি কর।;

খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো ইশা। ওর ইচ্ছে করলো শ্রাবণকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেতে। পরক্ষণেই নিজের আবেগ সামলে আসতাগফিরুল্লাহ বলতে বলতে ডাকপিয়নের বাক্স নিয়ে চলে গেলো। শ্রাবণ ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে চোখমুখ শক্ত করে নিলো হঠাৎ। তার বারবার মনে পড়ছে তুর্যর কথা। তুর্যর ব্যাপারটা মোটেও স্বাভাবিক ভাবে হজম করতে পারছেনা সে। এতো অপমানের পরেও সে বারবার ইশাকে বিয়ে করার জন্য পায়ে পড়েছে খান সাহেবের! এই দু’মুখী আচরণের কারন কি? ইশার প্রতি ওর চিন্তা-ভাবনা, কার্যকপাল কিছুই যেন একে অপরের সাথে মিলছেনা। ওর উদ্দেশ্য কি শুধুই ইশাকে ভালোবাসা, নাকি এখানে অন্য কোনো ব্যাপার আছে। খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।

__________

শ্রাবণের হাতে জোর আছে বেশ! এক ঘুষিতেই গাল কেটে র*ক্ত জমাট বেঁধেছে তুর্যর মুখে। চোখের কোনটাও কালশিটে হয়ে উঠেছে। হাতে বরফ নিয়ে ছেলের রুমে ঢুকলেন রূপা বেগম। তুর্য আধশোয়া হয়ে বসে আছে বিছানায়। ডান হাতের কোলে ল্যাম্পশেডটা বারবার অনঅফ করছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ ক্ষি*প্ত সে। রুপা বেগম রুমে ঢুকতে তার পানে ক্ষো*ভ নিয়ে তাকালো সে। পাত্তা দিলেন না রূপা বেগম। উল্টে রা*গ ঝেড়ে বললেন,

“তর সইছিলোনা এতো ভালো সম্মন্ধটা হাত ছাড়া করার তাইনা? এবার খুশি তো?;

আরও ক্ষে*পে গেলো তুর্য। কেমন হিং*স্র চাহনি নিক্ষেপ করে বলল,

“কাটা ঘায়ে নুনেরছিটে দিতে এসেছো?;

“ভুল যখন করেছিস, শুনতে তো হবেই তাই না?;

“ভুল করেছি কি আর সাধে? ওকে পায়ের নীচে রাখতে হলে একটুআধটু কড়া হতেই হতো! কিন্তু ঐ শ্রাবণটা এসেই তো..;

“হয়েছে হয়েছে, খুব করে দেখিয়েছো। এবার এটা লাগাও। ইশশ, মে*রে কি অবস্থা করেছে।;

আফসোস করে শেষোক্ত কথাটা বলে বরফের বাটিটা এগিয়ে দিলো রূপা বেগম। তুর্য উঠে বসলো। মায়ের থেকে বরফের বাটিটা নিতে নিতে বলল,

“সব শোধ তুলবো মা। তুমি এ নিয়ে চিন্তা করোনা।;

“কিভাবে তুলবি?;

“আছে, ও তুমি বুঝবেনা।;

“ও আমি বুঝতেও চাইনা। যা করবি, তাড়াতাড়ি করবি। ওরা কিন্তু তোর জন্য তাদের মেয়েকে নিয়ে বসে থাকবেনা। সুযোগ পেলেই ভালো ছেলের হাতে তুলে দিবে।;

“না মা। তুমি আসল ব্যাপারটাই মিস করে যাচ্ছো।;

“আসল ব্যাপার, মানে?;

“তুমি শ্রাবণকে লক্ষ্য করেছো কখনও? ও সবার চেয়ে ইশার প্রতিই একটু অন্যরকম। এখানে অন্য ব্যাপার আছে মা।;

“কি বলছিস তুই, সবই তো আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।;

“ধুর ছাড়ো তো। যাও এখন তুমি। আমাকে আমার প্ল্যান সাজাতে দাও।;

“তোর কথা ছাতারমাথা কিছুই বুঝিনা আমি। বরফ গুলো লাগিয়ে নে। একটু পর আমি ঔষধ দিয়ে যাবো।;

“হু।;

ভাবুক মনে বসে রইলো তুর্য। শ্রাবণ কি ইশাকে ভালোবাসে? কিন্তু সেটা কি করে হবে? সে তো প্রায়ই ইশার সম্মন্ধে খোঁজ নিয়েছে। এরকম কিছু হলে একটুআধটু তো খবর পেতোই! আবারও খোঁজ নিতে হবে, ভালো করে খোঁজ নিতে হবে।

___________

চোয়াল শক্ত করে ইশার পানে তাকিয়ে আছে শ্রাবণ। যেন চোখ দিয়েই ভ*স্ম করে দিবে ওকে। ইশা গুটিশুটি হয়ে বসে আছে। চেহারার এমন ভাব করেছে যেন বিশ্বের সেরা অসহায় ব্যক্তি সে। বাড়ির প্রায় অর্ধেক লোকই ঘুমে কাদা। ঘুমোয়নি হাতে গোনা কয়েক জোড়া কপোত-কপোতী। তাদের মধ্যে ইশা এবং শ্রাবণ অন্যতম। যদিও বা তারা কপোত-কপোতী নয়।

ইশার গালের বা পাশে পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ পড়ে আছে। ফর্সা মুখে দাগ গুলো খুব বি*ভৎ*স লাগছে ইশার। তুর্যর দেওয়া চড়টা এতো সহজ ছিলোনা। দাগ গুলো যতবার শ্রাবণের চোখে ভাসছে ততবারই ভেতর থেকে হিং**স্র হয়ে উঠছে সে। ইচ্ছে করছে এক্ষনি চলে যায় তুর্যর কাছে, এবং যতক্ষণ না ইশার মুখ থেকে এই দাগগুলো সরছে ততক্ষণ তাকে লাগাতার মা*রে। চাইলেও পারছেনা দাদাজানের জন্য। যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে, সে আর এই নিয়ে কথা টানতে চাননা।

“ওমন করে তাকিয়ে থাকলে আমার ব্যাথা ভালো হবেনা। তুমি বুঝতে পারছোনা, এতে উল্টো আমার ব্যাথা বাড়ছে!;

“ইচ্ছে করছে এই ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলি নীচে!;

“তুমি আমাকে মা*র্ডা*র করতে চাইছো নাকি?;

“উচিৎ তো সেটাই। যত সমস্যার মুলে তুই। কেন নাচতে নাচতে বিয়েতে হ্যাঁ করলি? আমাকে না করেও শান্তি হয়নি তাইনা? ডিরেক্ট বিয়ে করতে চলে এসেছে। আজ তোর জন্যই একটা বাইরের ছেলে তোর ঘরে ঢোকার সাহস পেয়েছে, আর তোর জন্যই একটা বাইরের ছেলে তোর গায়ে তা তোলার দুঃসাহস করেছে!;

“হু! জানি, এখন সব দোষ আমারই হবে!;

“এটাকে দোষ দেয়া বলেনা, এটাকে বলে গাধামি। বুঝেছিস?;

“গাধামি আবার কি?;

“এই তো সঠিক প্রশ্ন করেছিস। গাধামি কি?;

“ধ্যাৎ, এখন মোটেও মজা করার মুডে নেই আমি।;

“তোর কি মনে হয় আমি তোর সাথে মজা করার জন্য বসে থাকি? বড্ড সাহস বেড়েছে তোর!;

ইশা চুপসে গেলো। মনে পড়লো এই গুরুগম্ভীর লোকটার সাথে একটু বেশিই কথা বলে ফেলছে সে। কখন যে পরের চড়টা এর হাত থেকে পড়বে কে জানে!

শ্রাবণ একটা টুল টেনে বসলো ইশার সামনে। ইশা আশেপাশে দেখতে লাগলো। বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ। কিছুক্ষণ আগেই খুব বৃষ্টি হয়েছে। তারই রেশ রয়ে গেছে বাতাসে, গাছের ডালে, রাস্তায় এবং বাড়ির ছাদে। ইশা টেনে নিঃশ্বাস নিয়ে শ্রাবণের পানে তাকাতেই শ্রাবণ ওর হাতে ধরে রাখা মলমটা নিয়ে নিলো।

“তুমি এটা দিয়ে কি করবে?;

প্রশ্ন করলো ইশা। শ্রাবণ বিনা জবাবে মলমটা খুলে নিজের হাতে খানিক নিয়ে নিলো। ইশা পূণরায় কিছু বলবে তার পূর্বেই শ্রাবণ তার হাতটা ইশার গালে চেপে ধরলো। ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলো ইশা। আতংক নিয়ে শ্রাবণের পানে তাকাতেই শ্রাবণ গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,

“রিলিফ পাবি, এতো ঢং করার কিছু হয়নি।;

“ঢং? আ্ আমি ঢং করছি? ব্যাথা হলে বল..;

“চুপ!;

ইশার মুখে হাত চাপলো শ্রাবণ। ইশা চোখ বড়বড় তাকালো। শ্রাবণ চোখ দিয়েই শাসাল যেন। চোখ নামিয়ে নিলো ইশা। শ্রাবণও খানিক বাদে হাত নামিয়ে নিলো ওর মুখ থেকে। অতঃপর গালে ধীরে সুস্থে মলম মালিশ করে দিলো। ইশা আর কোনো কথা বলল না এরমাঝে। চুপচাপ সেবা নিতে লাগলো তার শ্রাবণ ভাইয়ের। আজকের শ্রাবণের মাঝে সেই তিন বছর আগের শ্রাবণের বড্ড মিল খুঁজে পাচ্ছে ইশা। ঠিক এরকমই তো ছিলো মানুষটা একটু রাগী, একটু কেয়ারিং।

“চুপ থাকতে বলেছি, এভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে বলিনি!;

কথাটা শুনে লজ্জায় পড়ে গেলো ইশা। লজ্জা পেয়ে চোখ উল্টেপাল্টে নামিয়ে নিলো। মাটিতে বিদ্ধ করে আঁড়চোখে একবার তাকালো শ্রাবণের পানে। শ্রাবণ তখনও এক ভাবেই তাকিয়ে ছিলো ওর পানে। এবার যেন দু’জনের চোখাচোখি হয়ে গেলো। ইশা পূণরায় চোখ নামিয়ে নিলে শ্রাবণ হেসে উঠলো মনেমনে। মনেমনেই আওড়ালো, ‘পাগলি’

“আব.. তোকে একটা জিনিস দেওয়ার ছিলো?;

আমতাআমতা করে বলল শ্রাবণ। ইশা মুখ উঁচিয়ে তাকালো শ্রাবণের পানে। বিস্মিত কন্ঠে শুধালো,

“কি জিনিস?;

“বস এখানে।;

বলেই উঠে চলে গেলো সে। ইশা তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। শ্রাবণ গেলো আর আসলো। পূনরায় ইশার সামনে এসে বসলো সে। হাতে পলিথিনে মোড়ানো কিছু একটা ধরে রেখেছে। ইশার কৌতুহল তড়তড় করে বেড়ে গেলো। চোখমুখ ছোট ছোট করে দেখতে লাগলো শ্রাবণের হাতের ব্যগটা।

“কি আছে এতে?;

প্রশ্ন করলো ইশা। ইশার প্রশ্নে শ্রাবণ একবার তাকালো ইশার পানে। তবে ইশার প্রত্যাশা অনুযায়ী জবাব দিলোনা। মৃদু হেসে পলিথিনটা খুলে ভেতর থেকে বের করলো কিছু। যা দেখতেই ইশার চোখ চড়ক গাছ। চোখ জোড়া বড়বড় করে মৃদু স্বরে চেঁচিয়ে উঠে বলল,

“বেলী ফুলের মালা?;

“দেখি হাতটা দে?;

“অ্যা?;

শ্রাবণ জবাব দিলোনা। সে নিজেই ইশার হাতটা টেনে নিজের হাতে নিলো। অতঃপর পরম যত্নে বেলীফুলের মালাটা পড়িয়ে দিলো ইশার হাতে। ছাদের হলদে আলোতে গোটা মুহুর্তটি বড্ড নেশালো লাগছে ইশার কাছে। ঘোর লাগছে এতো সুন্দর মুহুর্তটির প্রতি।

“সেই সকাল থেকে এভাবে রেখে দিয়েছি! কতবার যে চেক করেছি নেতিয়ে যাওয়ার ভ*য়ে। ফাইনালি, আ’ইম সাকসেস।;

ইশা নিজের হাতটা চোখের সামনে উঁচিয়ে ধরলো। হাতের উপর একফালি হলদে আলো পড়ল। ইশা মাতাল হেসে বলল,

“তুমি আমার জন্য এতো ভাবো শ্রাবণ ভাই?;

“একদম না। এখানে ভাবার কি আছে? আর আমাদের মাঝে মোটেও সব আগের মতো নর্মাল নয়। ভুলে যাসনা।;

গম্ভীর হয়ে গেলো শ্রাবণ। ইশা অবাক বনে যাওয়া চেহারায় শ্রাবণের পানে তাকাতেই গম্ভীর ভাবটা বজায় রেখেই উঠে চলে গেলো সে। ইশা হতভম্ব হয়ে বলে উঠলো,

“মানে কি?;

মানে কি, কে জানে? এই ছেলেটাকে, বোঝার সাধ্য কারো নেই। ইশার তো আরও নয়।

_______

আজ তিতিরের বৌভাত। সকাল থেকে বাড়িতে তোড়জোড় শুরু হলো তিতিরের শশুর বাড়ি যাওয়ার। মোট চারটে গাড়ি ভাড়া করা হলো সবাই মিলে যাওয়ার জন্য। দুর্গম পথ। যেতে অনেকটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। সেই চিন্তাতেই বাড়ির প্রায় প্রত্যেকটা মানুষ ভ*য়ানক সাজলেও মুখে বাড়তি একটা প্রসাধনীও ছোঁয়ালো না ইশা। বড় মামি আজও শখ করে শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছে ইশাকে। ইশা শাড়ি না পড়ার জন্য অনেক জোরাজোরি করলেও সেদিনের মতোই পার পেলোনা। আসমানী এবং সাদার কম্বিনেশনে একটা সিল্ক শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছে। সঙ্গে পড়ালো স্বল্প অলংকার। চুলগুলো আগের দিনের মতোই ছেড়ে রাখলো। কানের পাশে একটা সাদা গোলাপ। কপালে পাথরের একটা টিপ আর হালকা লাল লিপস্টিক। এতেই বিরক্ত লাগছে ইশার। এতোখানি পথ, সেজেগুজে বসে থাকা তো দূর, এই শাড়ি সামলানোই তো তৃতীয় বিশ্বযু*দ্ধের বরাবর। তবে বাকিদের কথা না বলাই শ্রেয় যেন। একেকজন সেজেছে ভূতের মতো।

একটা গাড়িতে ১০দশ করে গাদাগাদি করে বসেছে। একটা গাড়িতে আট জন, এবং ইশাদের গাড়ি মোট তেরোজন। ইশাদের গাড়িটা দেওয়াই হলো মুলত সমবয়সীরা একসাথে মজা করে যাওয়ার জন্য। যেখানে বসলো তুতুন, তানি, ইশা, আরব, শ্রাবণ, শ্রাবণের তুই মামাতো বোন, আরবের তিনজন খালালো এবং মামাতো বোন আরও বেশ কয়েকজন। তবে বাকিদের গাড়ির তুলনায় এই গাড়িটাই বেশি ফুল হয়ে গেলো। শ্রাবণ ড্রাইভারের পাশের সীটে বসে বাকিদের সবগুলোকে পেছনে বসিয়ে দিলো। কিন্তু তারপরও বিপত্তি বাঁধলো। এখানে বেশিরভাগই ছোট হওয়াতে মা*রামা*রি চলছে কতক্ষণ পরপর। এ একে একটা কিল দিলে, ও ওকে একটা ঘুষি মা*র*ছে। আবার টানাটানি চলছে ইশার শাড়ির আঁচল নিয়ে। ইশার শরীর শুকনা পাতাল গড়নের। এক কোনে বসে সারাদিন পার করে দিতে পারে। তবে এদের সাথে বসাটাই অসম্ভব হয়ে উঠছে ক্রমশ। এরপর আরও একটা সমস্যা দেখা গেলো! ইশার চুল গুলো বড় হওয়ায় অনেকটা মাটি ছুঁই ছুঁই অবস্থা। যা দেখে বাচ্চাগুলো যেন নতুন খেলনা পেলো। কতক্ষণ পরপর ইশার চুল ধরে ঝুলে পড়ছে। বেচারী রেগে গেলেও বেশি কিছু বলতে পারছেনা। আর এর সবটাই সামনে থেকে দেখছে শ্রাবণ। তাই হঠাৎ পেছন এসে গাড়ির দরজা খুলে ইশার হাত ধরে নামিয়ে নিয়ে চলে গেলো সামনের সীটে। আগে নিজে উঠে পরে ইশাকে উঠিয়ে বসিয়ে দিলো তার পাশে। ইশা অবাক স্বরে বলে উঠলো,

“এটা কি হলো?;

শ্রাবণ গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,

“চুপ করে বস। একটুও নড়াচড়া করলে বাইরে ফেলে দিবো!;

“শুরু হয়ে গেলো হুমকিধামকি!(বিরবির করে);

“কি বললি?;

“কি বলবো? তুমি নিজেই তো বললে চুপ থাকতে। এখন আবার নিজেই জিজ্ঞেস করছে!;

ভাব নিয়ে বলল ইশা। শ্রাবণ চোখ পাকিয়ে তাকালে আবার চুপসে গেলো সে।

#চলবে

ডাকপিয়নের ছুটি নেই পর্ব-৮+৯

0

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব____০৮

বড় মামীর দেওয়া মিষ্টি রঙের লেহেঙ্গাটা পড়ে ঘরময় পায়চারি করছে ইশানি। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেলো! এখনও শ্রাবণকে কিছু জানিয়ে উঠতে পারলোনা! ওদিকে সাজিদ আর ওর সাঙ্গপাঙ্গরা মিলে তিতিরের বিয়ে ভাঙার মতলব আঁটছে। বারবার ম্যাসেজ করে যাচ্ছে তিতিরের নাম্বারে। এবার ইশার নিজেরও যেন ভ*য় হতে লাগলো। এখনই যদি ঐ বদমাইশটাকে আঁটকানো না যায়, তবে অনেক গুলো জীবন একসাথে ন*ষ্ট হয়ে যাবে। নানাভাইয়ের সম্মান, মামাদের সম্মান! কিছুই যে আর থাকবেনা! আর ভাবতে পারছেনা ইশা। এবার কিছু একটা করতেই হবে।

“তুতুন, এই তুতুন?;

“আরে বাবা, সাজার সময় এতো ডিস্টার্ব করছিস কেন?;

“সাজবি পরে। আগে যা, শ্রাবণ ভাইকে খুঁজে নিয়ে আয়!;

“ও বাবাগো! সে আমি পারবোনা। ডাকলেই কেমন খেঁকখেঁক করে!;

“আজ করবেনা।;

“কেন, আজ কি?;

“আজ যাই হোক, আজ করবেনা! তুই যা ডেকে নিয়ে আয়!;

“তুই আমাকে বাঘের গুহায় পাঠাচ্ছিস কিন্তু!;

“উফফ ড্রামা কুইনরে, পরে ড্রামা করিস বোন! আগে যা বললাম তা কর।;

সাজ অর্ধেক কমপ্লিট করেই চলে গেলো তুতুন। বিয়ে বাড়ির এতো ভীড়ে কোথায় খুঁজবে এই যমরাজকে! তবে খুঁজতে, আর খুঁজে পেতে বেশি কাঠখড় পোড়াতে হলোনা তুতুনকে। নীচতলাতেই নিজের বন্ধুদের সাথে পেয়ে গেলো শ্রাবণকে।

“তোমাকে মেজ আপা ডাকছে!;

আগে পরে কোনো কথা না বলে, এহেম কথা বলাতে শ্রাবণ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তুতুনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,

“কে ডাকছে?;

“মেজ আপা!;

“কেন?;

“জানিনা। জরুরি কাজ আছে। জলদি চলো।;

বলেই আবার দৌড়ে চলো গেলো তুতুন। শ্রাবণ ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে দেখলো কোথায় গেলো ও! বন্ধুদের বলে সেও চলে গেলো তুতুনের পেছন পেছন। অফহোয়াইট একটা পাঞ্জাবি পড়েছে শ্রাবণ। গৌর দেহে রঙটা ঝাঁকিয়েছে বেশ। গাল ভর্তি চাপদাড়ি গুলো, আরও সৌন্দর্য্য বাড়িয়েছে এই পুরুষের। তবে এই রূপই এই মুহুর্তে বাঁধা হলো ইশার কাছে পৌঁছাতে। সিঁড়ি ধরে উপরে উঠতেই একগাদা মেয়ে এসে জড়োসড়ো হলো তার সামনে। সে এপাশ থেকেও যেতে পারছেনা, আবার ওপাশ থেকেও যেতে পারছেনা। তাই একপাশ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লে মেয়েগুলোও দাঁড়িয়ে পড়লো। যা দেখে শ্রাবণ বিরক্ত গলায় বলল,

“আপনারা আগে নামুন।;

মেয়ে গুলো গলা বেঁধে হেসে উঠলো। শ্রাবণ বুঝলো এরা তাকে ডিস্টার্ব করার জন্যই এমন করছে। ভাবতেই মেজাজটা বিগড়ে গেলো তার। মুখ তুলে ওদের পানে তাকাতেই সবগুলো মাথা ঝুকিয়ে ফেললো। যেন, লজ্জা পেয়েছে। শ্রাবণ নিজেকে যথেষ্ট কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে আবারও বলল,

“কিছু বলতে চান?;

একটা মেয়ে বড় কৌতুহলের সঙ্গে প্রশ্ন করলো,

“আপনি শ্রাবণ, তাইনা?;

“জি। আমিই শ্রাবণ।;

সঙ্গে সঙ্গেই কানাঘুঁষা শুরু হলো। ‘বলেছিলাম না ইনিই তিনি!’ ‘হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যান্ডসাম আছে’ ‘তোর সাথে মানাবে’। কানাঘুঁষা করতে হয়, অন্যের থেকে লুকিয়ে। কিন্তু মেয়েগুলো তা করছেনা। ফিসফিসিয়ে কথাগুলো বলছে স্বাভাবিকের তুলনায় জোরে। শ্রাবণ গলা খাঁকারি দিয়ে উপরে উঠে যেতে নিলে তাকে আবারও আঁটকায় মেয়েগুলো!

“আপনার নাম্বারটা কি দেওয়া যাবে?;

“কেন?;,

ভ্রু কুঁচকে ফট করে প্রশ্ন করলো শ্রাবণ। মেয়েগুলো খানিক ভড়কে গেলো। আমতাআমতা করে বলল,

“এমনি।;

শ্রাবণ আর কিছু বলল না। আবারও উঠতে নিলে আবারও পিছুডাক পড়ে। এবার সে রেগে যায় ভেতরে ভেতরে! তবে এবারও নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করে। মুখে জোরপূর্বক হাসির রেখা টেনে পেছন মুড়ে তাকিয়ে বলল,

“আবার কি হলো?;

“আপনি কি সিঙ্গেল আছেন? নাকি…;

“না, সে মোটেই সিঙ্গেল নেই! সে বিবাহিত, আর সে তার বউকে ভীষণ ভালোওবাসে। তাদের বাচ্চাও আছে। তিনটা! (আঙুল দেখিয়ে)। আর একটা অন দ্য ওয়ে!;

ঝাসিকি রানি যেন উপর থেকে টপকে পড়লো! ঝাঁঝালো গলায় কথাগুলো বলেই শ্রাবণের হাতটা ধরে টেনে নিয়ে গেলো ইশা। রুমে ঢুকে শ্রাবণের হাতটা ছেড়ে দিয়ে রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে দরজাটা লক করে দিলো! ইশার এই রণচণ্ডী রূপে মোটেই পরিচিত নয় শ্রাবণ। হাতে গোনা কয়েকবার ইশাকে রাগতে দেখলেও, এভাবে কখনও রণচণ্ডী হতে দেখেনি।

“কি হয়েছে? এভাবে ওখান থেকে টেনে নিয়ে এলি কেন?;

“চুপ! একদম চুপ..;

শ্রাবণ প্রশ্ন করতেই তেড়ে গেলো ইশা। শ্রাবণ ভড়কে গিয়ে দু’কদম পিছিয়ে গেলো। আমতাআমতা করে বলল,

“স্ট্রেঞ্জ!;

“খুব খেজুরে আলাপ হচ্ছিলো তাইনা? আর এদিকে আমি? আমি সেই সকাল থেকে তার পিছু পিছু ঘুরে ম*র*ছি তার বেলায় সে ব্যস্ত! তার সময় নেই! তার কাজ আছে! আর এখন? সব কাজ শেষ?;

“খেজুরে আলাপ হচ্ছিলো না আঙ্গুরের হচ্ছিলো সেটা তোকে বলতে হবে?;

“হ্যাঁ বলতে হবে! কারন, আমি তোমার সাথে মজা করছিনা। আর না ছোট বেলার মতো আমার খেলার ঘর ভেঙেছে বলে তোমাকে খুঁজে ম*র*ছি! এদিকে সত্যি সত্যি সবটা শেষ হতে বসলো, আর তুমি..;

ইশার শেষোক্ত কথাটা মাথায় বাজলো শ্রাবণের। সঙ্গে সঙ্গে তার গম্ভীর রাগী মুখটা ভেসে উঠলো। গম্ভীর গলাতেই বলল,

“মানে?;

“একটা সর্বনাশ হয়ে গেছে শ্রাবণ ভাই!;

“কি হয়েছে?;

“আপাকে একটা ছেলে ব্ল্যাকমেইল করছে। তুমি তাকে চিনবে! তমাল ভাইয়ের কাজিন সে!;

তার বোনকে ব্ল্যাকমেইল করছে, কথাটা শুনতেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো শ্রাবণের! অগ্নি দৃষ্টিতে ইশার তাকিয়ে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,

“সাজিদ!;

“হ্যাঁ হ্যাঁ! সাজিদ! ও আপার বিয়ে ভেঙে দেয়ার হু*মকি দিচ্ছে.. এ্ এই যে দেখো (তিতিরের ফোনে সাজিদের পাঠানো ম্যাসেজ গুলো দেখিয়ে) আমাদের কিছু একটা করতে হবে।;

ইশার হাত থেকে ফোনটা একরকম কেঁড়ে নিলো শ্রাবণ। সাজিদের পাঠানো ম্যাসেজ গুলো দেখে তার মস্তিষ্ক যেন জ্বলে উঠলো। রাগে ফুঁসে উঠে বলল,

“ওর এতো বড় বুকের পাটা!

“তুমি জানোনা, ও আপার সাথে কি করেছে!;

“চল আমার সাথে!;

ইশার হাত ধরে নিজের সঙ্গে নিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে বেরিয়ে গেলো শ্রাবণ। সে জানে এই মুহুর্তে সাজিদকে কোথায় পাওয়া যাবে! শ্রাবণ ইশাকে বাইকের পেছনে তুলে সেদিকেই রওনা হলো। সাজিদ শ্রাবণের কলেজের জুনিয়র ছিলো। তমালের কাজিন হিসেবে সাজিদের সাথে তার একটা পরিচিতি থাকলেও অন্য সব দিক থেকে তাদের সম্পর্ক ছিলো সাপেনেউলে। সাজিদ বরাবরই বড় উচ্ছৃঙ্খল ধরণের ছেলে। ছোট বেলা থেকে রাজার হালে বড় হওয়ার এই একটাই অসুবিধা ছিলো! ও ভাবতো, ওর বাবার টাকা দিয়ে হয়তো সব কিছু ও কিনে ফেলতে পারে। আর সেটা যে সম্ভব না, তারই প্রমাণ দিতো শ্রাবণ। যার ফলে, দু’জনের মাঝে একটা প্রতিশোধ নেওয়ার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। হয়তো, সেই ক্ষোভ থেকেও সাজিদ তিতিরের সাথে এই মিসবিহেইভটা করতে পারে।

কালো গাড়িটার উপর আয়েস করে বসলো সাজিদ। হাতে ধোঁয়া উড়ানো গরম চা। চায়ে একটা ফু দিয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করে চোখ বুলালো। তিতিরের সাথে এই ব্ল্যাকমেইলের খেলাটা খেলতে ভীষণ ভালো লাগছে তার। এটা তার একধরনের নেশা। মেয়েদের সম্মান নিয়ে খেলতে কার না ভালো লাগে! মানুষ অযথাই ভালো মানুষ হওয়ার মুখোশ পড়ে থাকে! আসল মানুষ, আসল পুরুষ তো সাজিদ, কেননা সে কখনোও আড়ালে কিছু করেনা। যা করে একদম প্রকাশ্যে। কথাটা ভাবতে ভাবতে বাঁকা হাসলো সাজিদ। গুণগুণ করতে করতে একহাতেই সে পূণরায় টাইপ করলো তিতিরের নাম্বারে,

“হেই তিতিরপাখি, কামঅন বেইব! একটা তো রিপ্লাই দাও। এভাবে চুপ করে থাকলে কি করে হবে বলোতো? আজ না তোমার বিয়ে। এখনই যদি চুপ হয়ে যাও, তবে বিয়ে ভাঙার পর কি করবে? বোবা হয়ে যাবে তো!;

ম্যাসেজটা সেন্ট করে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠলো। ফোনটা অফ করে পূণরায় রেখে দিলো আগের জায়গায়। ক্লাবের বাইরে তার গাড়ি রাখা। ভেতরে জমিয়ে পার্টি হচ্ছে। আপাতত তার সেসবে মন নেই! আজ সে একটা মেয়ের গোটা ভবিষ্যৎ ন*ষ্ট করতে যাচ্ছে, এখন পার্টি-ফার্টিতে মন দিলে চলবেনা। এখন এই দিকে ফোকাস হতে হবে। ভাবতে ভাবতে চায়ের কাপে চুমুক বসাতেই হাওয়ার বেগে ছিটকে পড়লো সাজিদ। মনে হলো তার পা ধরে কেউ টেনে হিঁচড়ে ছুঁড়ে ফেলেছে। ঘটনার আকস্মিকতাশ ভ*য়ে চিৎকার করে উঠলো সে। নীচে পড়ে আশেপাশে তাকাতে তাকাতে হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ালো শ্রাবণ। হাতে একটা হকিস্টিক। সাজিদের হঠাৎ মনে পড়লো, এটা সেই কলেজের হকিস্টিকটা। যেটা দিয়েই শ্রাবণ তাকে একবার মে*রেছিলো। খানিক ভড়কে গেলো সাজিদ। তবে দমলোনা। নিজের ভেতরের পুরুষকে জাগিয়ে গর্জে উঠে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ালো। পড়নের সাদা লেদারের দামী জ্যাকেটটাতে ময়লা লেগেছে। সেটাই ঝাড়তে ঝাড়তে শ্রাবণের দিকে জ্ব/ল/ন্ত দৃষ্টিতে তাকাতে শ্রাবণ তেড়ে গিয়েই বসালো এক বারি। বারিটা পড়লো সাজিদের ডান হাতের বাহুতে। খানিক ঝুঁকে পড়লো সাজিদ। আবারও সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে। আপাতত তার খেলা নয়, আগে শ্রাবণ খেলুক, তারপর সে নিজের খেলা দেখাবে। এখন শ্রাবণের হাতে মা*র খেয়ে নিজের জেদটা আরও গাঢ় করবে সে।

শ্রাবণের চোখ জোড়া হিং*স্র হয়ে আছে। র*ক্তবর্ণের এই চোখ জোড়াই এককালে ফোবিয়া ছিলো সাজিদের। তবে এখন আর সেটা ফোবিয়াতে নেই। ভ*য়কে জয় করে সেটাকে এখন জেদে পরিণত করেছে সাজিদ! আরও বেশ কয়েকটা মা*র খেলো হকিস্টিকের। এবার শ্রাবণ মা*র*তে নিলে সাজিদ ধরে ফেলে হকিস্টিকটা। কিন্তু ধরেও যে কায়দা করতে পারেনা! সাজিদের হাঁটু বরাবর শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে লাথি দেয় শ্রাবণ। সাজিদ হাঁটু ভেঙে হুমড়ি খেয়ে পড়ে নীচে। শ্রাবণ এবার নিজেই টেনে তোলে ওকে! টেনে দাঁড় করিয়ে শার্টের কলার চেপে ধরে গর্জে উঠে বলে,

“আমার বোনকে টার্গেট করিস তুই? তোর এতো বড় কলিজা!;

শ্রাবণের হাতে বন্দি হলেও সাজিদের বড়াই কমেনা এক ফালিও। ফিক করে হেসে দেয় শ্রাবণের কথা শুনে। যেন শ্রাবণ তাকে কোনো মজার বাক্য শুনিয়েছে।

“নিজের বোনকে তো সামলে রাখতে পারিসনি! এখন আমাকে মে*রে কি হবে বন্ধু? পারলে নিজের বোনের বিয়ে ঠেকা! তোর বোনের সম্মান লোডিং হচ্ছে ব্রো। খানিক বাদেই বুমমম!;

বলেই আবারও উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো সাজিদ। শ্রাবণ রা*গে থরথর করে কেঁপে উঠলো। ভেতরটা জ্ব*লে যাচ্ছে তার। কি করেছে এই জা*নো*য়ারটা তার বোনের সাথে!

ঠাসস ঠাসস করে বারকয়েক বিকট শব্দ হওয়াতে কেঁপে উঠলো চারিপাশ। সাজিদ গালে হাত দিয়ে সামনে তাকাতেই আবারও একটা চড় পড়ার শব্দ হলো। এবং সাজিদের হাত তার অন্যগালে গিয়ে ঠেকলো! পরক্ষণেই তার চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে অন্য পাশে নিয়ে গেলো ইশা! ফের পূণরায় শুরু হলো সাজিদের উপর তার এট্যা*ক! এমন ভাবে কুংফু ক্যারাটি চালাচ্ছে, সাজিদ যেটা ধরতেই হিমশিম খাচ্ছে। অতঃপর এক পর্যায়ের সাজিদের কলার চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো ইশা,

“আমার আপাকে অসম্মান করা? আমার আপাকে! জানিস, তোর জন্য কতটা কাঁদতে হয়েছে আমার আপাকে? তোর মতো একটা জা*নো*য়ার না জানি কত গুলো দিন ধরে আমার আপাকে ক*ষ্ট দিয়ে যাচ্ছিস। শ*য়*তানের বাচ্চা!;

বলতে বলতে পেট বরাবর ঘুষি মা*র*লো সাজিদের। ঘুষি খেয়ে ভাজ হয়ে গেলো সাজিদ! কাশতে কাশতে পেটে হাত চাপতেই পা তুলে পূনরায় সাজিদের পেট বরাবর লাথি মা*র*লো ইশা! সাজিদ ছিটকে পড়লো রাস্তায়!

#চলবে

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব____০৯

ইশা তেড়ে গিয়ে সাজিদের উপর চড়াও হয়ে এলোপাতাড়ি কিল ঘুষি মা*র*তে মা*র*তে বলতে লাগলো,

“আর কত মেয়ের জীবন এভাবে ন/ষ্ট করেছিস তুই? কত মেয়ের সাথে এমন মিথ্যে অভিনয় করে তাদের ক্ষতি করেছিস? বল! বল বলছি?;

সাজিদ কাশতে কাশতে র*ক্ত বমি করছে! যা দেখে একটু ভ*য় পেলো শ্রাবণ। দ্রুত গিয়ে ইশার হাত চেপে ধরলো। ওকে সাজিদের উপর থেকে সরিয়ে আনতে চাইলেও ওর সাথে যেন পেরে উঠছে না। রা*গে, ক্ষোভে ইশা আউট অফ মাইন্ড হয়ে গেছে যেন। কলেজে ইশা ক্যারাটে শিখেছিলো। ভ*য়ানক রকমের মা*রের কৌশল তখনই রপ্ত করে এই মহারানী! ক্ষণকালের জন্য তো ভুলেই গিয়েছিলো শ্রাবণ।

“ইশা, ছাড় ওকে! এভাবে মা*র*লে কোনো সমাধান হবেনা!;

“আজ ওকে আমি মে/রেই ফেলবো! আমার আপাকে ব্ল্যাকমেইল করার সাহস কি করে হয় ওর? বোকা ভেবেছে আমার আপাকে তাইনা? ভেবেছে, আমার আপাকে বাঁচানোর কেউ নেই?;

বলতে বলতে আবারও দিলো দু-তিন ঘা! শ্রাবণ টেনে তুলে আনলো ইশাকে। ওর হাতদুটো শক্ত করে চেপে ধরে নিজের দিকে ফেরাতে চেষ্টা করলে, সফল হলোনা কোনোমতেই। ইশা এখনও বারবার তেড়ে যেতে লাগলো সাজিদের পানে।

“ওর যা মা*র খাওয়ার খেয়েছে ও! এবার ওকে পুলিশে দিতে হবে, উইথ প্রুফ।;

” হ্যাঁ, ঠিক বলেছো তুমি। এই কুলাঙ্গারকে অবশ্যই অবশ্যই পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া উচিৎ।;

কিঞ্চিৎ শান্ত হতে পারলো ইশা। শ্রাবণ ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইশার মাথায় হাত রাখলো। অতঃপর মৃদুস্বরে বলল,

“শান্ত হ। ওর বাকি শাস্তি আমরা না, পুলিশ দিবে।;

শ্রাবণের হাতটা ইশার কপাল ছুঁতেই অদ্ভুত ভাবে ইশার সমস্ত রাগ গলে জল হয়ে গেলো। এবং সেই সাথে সে ভেবে অবাক হলো, রেগে গিয়ে সে কোনোদিন কাউকে এমন রাম ধোলাই করেনি। আজ কি হলো হঠাৎ করে?

“আ্ আমি কি একটু বেশি বেশি করে ফেললাম শ্রাবণ ভাই?;

ইশার হঠাৎ করা এই বোকা প্রশ্নটায় নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলোনা শ্রাবণ। ফিক করে হেসে দিলো সে। তার হাসিতে প্রকৃতি বাকরূদ্ধ হয়ে গেলো! স্তব্ধ হয়ে গেলো ইশার হৃৎস্পন্দন। এই তো, এই তো সেই হাস্যমুখ, প্রাণোচ্ছল মানুষটা। এই তো সে!

“তোকে এভাবে রা*গতে আমি কোনোদিনও দেখিনি। তবে, যা হয়েছে ভালোর জন্যই হয়েছে কিন্তু!;

ইশা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিলো! শ্রাবণ ওর হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে এখনও। ইশা তার হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো। এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শ্রাবণ পুলিশে কল করলো। অবশেষে সব মুশকিলের আসান হলো। পুলিশের মাধ্যমে সাজিদের কাছে মেয়েদের ব্ল্যাকমেইল করার সমস্ত ডকুমেন্ট ফাইল ডিলিট করিয়েছে শ্রাবণ। এমনকি, সাজিদের মুখ থেকেও বয়ান নিয়েছে, তিতিরের সাথে যা হয়েছে, সবটাই সে জোর করে করেছে। তিতিরকে শরবতের বদলে সে বিদেশি এলকোহল খাইয়ে নিজের বসে এনে অসভ্যতা করতে চেয়েছে, একই সাথে তার ছবি ধারণ করেছে, এবং আজ এতোবছর বাদে সেই ছবি ব্যবহার করে তিতিরের বিয়ে ভা*ঙার হু*মকি দিয়েছে! সবকিছুর শা*স্তি হিসেবে তিন বছরের জন্য কারাবন্দী করা হলো সাজিদ।

সব কাজ মিটিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো দু’জনে। মাথার উপর সূর্য মামার নাচনকোঁদন শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। গরমে আধাসিদ্ধ হয়ে মাঝপথেই গাড়ি থামালো শ্রাবণ। ইশাকে পেছন থেকে নামতে বলে সেও নামলো। ইশা আশেপাশে তাকাতে তাকাতে বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,

“এটা কোথায় থামালে! বাসায় যাবেনা?;

“গরমে মাথা গরম হয়ে গেছে। পানি নিতে হবে!;

এই বলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে সামনের একটা দোকানের দিকে এগিয়ে গেলো শ্রাবণ। ওদের ঠিক সামনেই একটা মুদি দোকান। শ্রাবণ সেখানে গিয়ে একটা পানি নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো খানিক। অতঃপর যখন ইশার কথা মনে পড়লো, পেছন ফিরে ওর দিকে পানির বোতল ধরে ভ্রু নাচালো। অর্থাৎ, তারও পানির প্রয়োজন আছে কিনা, জিজ্ঞেস করলো!

ইশা এপাশওপাশ মাথা নাড়লো। অর্থাৎ, তার দরকার নেই। শ্রাবণ পানির টাকা দিয়ে ইশার জন্য একটা কিটক্যাট নিয়ে চলে গেলো ওর কাছে। চকলেটটা ওর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে আবারও উঠে বসলো বাইকে। ইশা এহেম ঘটনায় হতবাক হয়ে ওর হাতে থাকা চকলেটটার পানে চেয়ে রইলো! বছর তিনেক আগেও শ্রাবণ এই কাজটা রোজ করতো। ভেসে উঠলো যেন চোখের তারায়।

“দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি বাইকে উঠবি?;

“অ্যা?;

মনের ভেতর সুখ সুখ অনুভূতি হলো ইশার। তাই শ্রাবণের কথাটা ঠিক শুনতে পায়নি সে। শ্রাবণ কপাল কুঁচকে তাকালো ইশার পানে। চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল,

“আছিস পৃথিবীতে?;

ইশার ঘোর কাটে সেই শব্দে। তবে তখনও ব্যাপারটা ধরতে পারছিলো না। তাই শ্রাবণ ধমকে উঠে বলল,

“গাড়িতে ওঠ জলদি!;

চমকে উঠে পৃথিবীর বুকে অবতরণ করলো ইশা। চটজলদি শ্রাবণের পেছনে উঠে বসতে শ্রাবণ পূণরায় গাড়ি স্টার্ট দেয়। ইশা লেহেঙ্গা সামলে শ্রাবণকে ধরে বসতেই গাড়ি টান দিলো শ্রাবণ। আধঘন্টার মাঝেই ফিরে পৌছে গেলো বাসায়।

বাসায় ফিরতেই ইশা সোজা চলে গেলো তিতিরের কাছে। যা ঘটেছে, সবটা যতক্ষণ বলতে না পারবে, ততক্ষণ যেন শান্তি নেই। তিতিরকে কনে সাজানো হচ্ছিলো। এতো ভালো ব্রাইডাল লুক সে কাঁদতে কাঁদতেই বিসর্জন দিয়ে দিচ্ছে। তবে ইশা যখন পৌঁছালো তার কাছে, তখনই যেন তার কান্নার ইতি ঘটলো। বোনকে সবটা খুলে বলে, সারাজীবন সুখে শান্তিতে থাকার পরামর্শও দিলো ইশা। তিতির ইশাকে জড়িয়ে ধরে আরও কতক্ষণ কেঁদে কেটে পুরোপুরি শান্ত হতে পারলো। তারপর আরকি, পূণরায় জমজমাট হয়ে উঠলো বিয়ে বাড়ি।

ইশা নিজের রুমে এলো। খানিক ফ্রেশ হয়ে বসে পড়লো আয়নার সামনে। গত ২/৩ ঘন্টায় চেহারার তেরোটা বাজিয়ে ফেলেছে। একটু ঠিক না করলেই যে নয়। আর তাছাড়া, বোনের বিয়ে উপলক্ষেও তো খানিক সাজগোজ প্রয়োজন। একদম সাদামাটা মোটেও মানায়না। তাই প্রয়োজন মাফিক যতটুক লাগলো ততটুকুই করলো। মুখে যতসামান্য পাউডার, দিয়ে চোখে কাজল পড়লো, অতঃপর ঠোঁটে গোলাপি রঙের লিপস্টিক পড়ে চুলগুলো ছেড়ে রাখলো। কপালে পাথরের একটা টিপ পড়তে পড়তে লেহেঙ্গার সাথে ম্যাচিং করা প্লাস্টিকের ফুলগুলো কানের একপাশ থেকে আঁটকে দিলো ক্লিপ দিয়ে। অতঃপর দু’হাত ভর্তি কাচের চুড়ি গুলো পড়ে তাকালো আয়নায় মাঝে। এই সামান্য সাজেই ভীষণ ফুটে উঠেছে গোলাপফুলটা। কথাটা ভেবে আপন মনেই হেসে উঠলো ইশা। লেহেঙ্গার ওড়নাটা একপাশে ফেলে লম্বা চুলগুলো সব একপাশে নিয়ে এলো। ভীষণ সুন্দর লাগছে তাকে দেখতে। নিজেকে একবার ঘুরে ফিরে দেখে সব কিছু ওকে আছে ভেবে দরজার দিকে হেঁটে আসতেই থমকে দাঁড়ালো। সামনে শ্রাবণ দাঁড়িয়ে আছে। হাতে কাঁচা ফুলের মালা। এগুলো দেখে ইশার চিনতে অসুবিধা হয়নি এগুলো তিতরকে মেহেদী পড়ানোর সময় দেওয়া হয়েছিলো। তখন তাজা থাকলেও সময় গড়াতে এখন সব গুলোই নেতিয়ে পড়েছে।

“এগুলো নিয়ে কোথায় চললে?;

ভাবুক মনে প্রশ্ন করলো ইশা। শ্রাবণ জবাব দিতো পারলোনা। কেননা, তার চোখ জোড়া অনেক পূর্বেই আঁটকে গেছে মনোহারিণীর প্রতি। যখন সে আনমনে ভীষণ যত্নে নিজেকে সজ্জিত করছিলো কাজল পড়ে? যখন তার ওষ্ঠদ্বয় নড়েচড়ে হঠাৎ প্রশান্ত হয়েছে লিপস্টিকের মেটে গন্ধে। যখন কারোর থেকে নজর কাড়বে বলে আহ্লাদ করে ঐ টিপটা স্থান পেলো তার কপালের শীর্ষে। যখন ভীতমনে এক এক করে হাতজোড়া ভরে উঠছিলো কাঁচের চুড়িগুলোতে। তখনই, ঠিক তখনই সে আঁটকে গেলো মায়াবতীর প্রতি! ভীষণ ভাবে আঁটকে গেলো।

“ওভাবে তাকিয়ে কি দেখছো? আ্ আমাকে দেখতে ভালো লাগছেনা!;

ইশা ডানহাতটা তুলে নিজের মুখে হাত বুলালো। হাতটা তুলতে ঝুড়ির ঝনঝন আওয়াজে ধ্যান ভেঙে গেলো শ্রাবণ। নিজের অবস্থান বুঝে গলা খাঁকারি দিয়ে নেতিয়ে পড়া ফুল গুলো ধরিয়ে দিলো ইশার হাতে। ইশা অবাক হয়ে গেলো শ্রাবণের কান্ড দেখে।

“কি হলো, এগুলো আমাকে.. মানে এগুলো কি করবো আমি?;

শ্রাবণ তাড়াহুড়ো করে কোনো কথা না বলেই চলে গেলো! ইশা অবাকের উপর অবাক হয়ে শ্রাবণের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল! এটা কি হলো?

বর যাত্রী চলে এসেছে। সবাই গেইটের কাছে আসতেই তাদের আটকানো হলো। ইশা, তুতুন, তানি, এবং তাদের কাজিনরা মিলে প্রায় ২০জন মিলে গেইট ধরলো। হৈচৈ হল্লাহল্লি করতে করতে বরের কাছে মোট ৫০হাজার টাকা ডিমান্ড করা হলো! যা শুনতেই হাঁপিয়ে উঠলো বরপক্ষের লোক। শাকিলের কাজিনরা এবং বন্ধুরা মিলে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া শুরু করলো ইশাদের সাথে। কিছুতেই ৫০হাজার টাকা দিবেনা তারা। কেউ একজন বলে উঠলো,

“৫০টাকা দেখছেননি জীবনে? আসছে, ৫০হাজার ডিমান্ড করতে!;

মেয়ে পক্ষের একজন বলে উঠলো,

“বাইরের রাস্তা চিনেন মশাই? বিয়ে করার চিন্তা বাদ দিয়ে বাড়ি গিয়ে নাকে তেল মেখে ঘুমোন। কাজে আসবে!;

কথাটা বলতেই হাসির রোল পড়লো মেয়েদের পাশে। বরপক্ষের মুখ আঁটকে গেলো যেন! পরক্ষণেই আবার আরেকজনের জবাব এলো,

“সেকি, টাকার লোভে এখন মেয়েও দিবেন না নাকি? আপনারা দেখি যৌতুক দাবী করছেন! টাকার বিনিময়ে বিয়ে হবে!;

“যৌতুক আবার কি? এটা আমাদের প্রাপ্য! আর প্রাপ্য কখনোও হাতছাড়া করতে নেই, হ্যাঁ!;

তর্কে বিতর্কে কেটে গেলো বেশ কিছুটা সময়। নিয়ম অনুযায়ী বরপক্ষই হারলো কনেপক্ষের সাথে। যুক্তি মিলাতে না পেরে জোরাজোরি করে ৫০থেকে ৩০এ আসলো। অতঃপর ত্রিশ হাজার দিয়েই গেইট পার করতে হলো তাদের। ভেতরে এসে বরকে বসানো হলো তার আসনে। কনের ডাক পড়তে কনেকেও নিয়ে আসা হলো বরের কাছে। দু’জনকে পাশাপাশি বসিয়ে বড়দের কিছু নিয়ম পালন করে কাজীকে ডেকে বিয়ে পড়ানো শুরু করা হলো। আলহামদুলিল্লাহর সহিত তিনবার কবুল পড়ে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হতেই আবারও শুরু হলো মেয়েদের দুষ্টামি। বরের জুতা চুরি করা হলো। জুতা চুরির পেছনে প্রধান হলো ইশা। অনেক্ষন যাবত বরের জুতা নিখোঁজ হওয়ার খবর মাত্রই রটালো। শাকিলের কাজিনরা এবং বন্ধুরা কপাল ডলতে লাগলো। কখন গায়েব হলো বরের জুতা? তারাও যে ওত পেতে ছিলো!

ইশা চিলেকোঠার ঘরে এসে শাকিলের জুতা লুকিয়ে আবারও নীচে নেমে গেলো। ইশাকে নীচে দেখতেই শাকিলের বন্ধুরা এসে ধরলো।

“বেয়ান, এটা কিন্তু ঠিক নয়! এভাবে না বলে কারোর জুতা চুরি করা একদম ভালো কাজ নয়!;

“জুতা লাগবে?;

ইশার এহেম প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো তারা। জুতা লাগবে মানে কি? তারা আমতাআমতা করে একে-অপরের দিকে তাকালো। ইশা ভাব নিয়ে বলল,

“জুতা লাগলে বলবেন, ভালো জুতা আছে।;

বলেই মুখ টিপে হাসতে হাসতে চলে গেলো। এভাবে জুতা চাওয়া মানে নিজেই নিজের ইজ্জতের ফালুদা বানানো। তারচেয়ে বরং তারাই খুঁজবে। মাথা চুলকে চলে গেলো তারা। দূর হতে তাদের গোটা কান্ড দেখে হাসলো শ্রাবণ। ইশাকে সে চিনে। এতো সহজে হারবার পাত্রী সে নয়।

“আপা, তুর্য ভাই ডেকে পাঠিয়েছে তোকে!;

তুতুনের লেহেঙ্গার রঙটা গাঢ় লাল। লাল টুকটুকে বউয়ের মতো লাগছে ওকে। একটু আগেই ওর চুল খুলে যাওয়ায় ইশা সুন্দর করে আঁটকে দিলো পূণরায়। তখন তুতুনের ভীষণ রাগ জমেছিলো পার্লারের মেয়েগুলোর প্রতি! এতোগুলো টাকা নিলো, অথচ ঠিক করে চুলটাও বাঁধতে পারলোনা। তবে এখন মনটা বেশ ফুরফুরে। তাই তুর্যর এক বাক্যে এসে হাজির হয়েছে ইশার কাছে। ইশা তখন তার নানীকে শাড়ির কুঁচি ঠিক করে দিতে ব্যস্ত। তাই তুর্যর ডাকটাকে উপেক্ষা করে তুতুনকে বলল,

“বল কাজ করছি। শেষ হলে আসবো।;

বেশি সময় লাগলোনা নানীর শাড়ির কুঁচি ঠিক করে দিতে। তবে, এরপরের কাজটা ততক্ষণে বেমালুম ভুলে গেলো ইশা। ওদিকে তুর্যর বাবা-মা অনেকক্ষণ ধরেই অপেক্ষা করছেন তাদের হবু বউকে দেখার জন্য। কিন্তু ইশার যেন সেকথা মাথাতেও এলোনা।

জুতা চুরির বিষয়টা এবার বড়দের মাঝেও ছড়াছড়ি হয়ে গেলো। এবার আর বরের মুখ লুকানোর জায়গা নেই। টানা ২ঘন্টা ধরেও কেউ বরের জুতা খুঁজে বের করতে পারেনি। তার জুতা ফেরত পেতেও বরের পকেট খসিয়ে ১০হাজার হাতিয়ে নিলো কনে পক্ষ। অতঃপর এলো, কনের মুখ দেখার পালা। কবুল বলার পর কনের মুখ দেখানো হলোনা শাকিলকে। একটা আয়না এনে তাকে বলা হলো, এটায় তার বউয়ের মুখ দেখতে হবে। এবং খুব সুন্দর একটা ডায়লগ বলতে হবে তার প্রিয় মানুষটিকে। তবে তার আগে একটা শর্ত আছে। মুখ দেখতে হলে আগে ১০হাজার ছাড়তে হবে। তারপর এই মহৎ কাজ সম্পন্ন হবে। প্রথমে রাজি হলোনা বরপক্ষ। হৈচৈ পড়ে গেলো এই বলে, অলরেডি চল্লিশ হাজার নেওয়া হয়েছে। আর দিতে হলে, গরীব হয়ে যাবে বর। কিন্তু তাতেও লাভ হলোনা। বাধ্য হয়ে পূণরায় দশ হাজার ভাঙতে হলো।

রাত ৮টা বাজে। বরপক্ষের, কনে পক্ষের সবারই খাওয়াদাওয়া শেষ করিয়ে, কনে বিদায়ের সময় হয়ে গেলো। সবাই যেন মহা ব্যস্ত। তবে এর মাঝেও ইশাকে বার কয়েক ডেকে পাঠালো তুর্য। ইশা নানান বাহানায় প্রতিবারই তার ডাক উপেক্ষা করে গেলো! তবে কাজটা যে ইশা মোটেও ভালো করলোনা, তা যে এবার হাড়েহাড়ে টের পেতে হবে তাকে। সবার চোখের আড়ালেই ইশার হাত ধরে ছাদে নিয়ে গেলো তুর্য। রাগে কেমন ফোঁস ফোঁস করছে সে। ইশা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। বিস্ময় নিয়েই প্রশ্ন করলো,

“কি হয়েছে তুর্য? আপনি ঠিকাছেন! আপনাকে এরকম…;

ইশা কথাটা শেষ করার পূর্বেই ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলো তুর্য। রাগে গর্জে উঠে ইশার গাল চেপে ধরতেই ঝড়ের বেগে ছিটকে পড়লো অনেকটা দূরে! ইশা ঘটনার আকস্মিকতায় এতটাই চমকালো যে, সে আসলে কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভড়কাবে সেটাই ভুলে গেলো! গালে হাত চেপে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সম্মুখে তাকালো ইশা! ততক্ষণে শ্রাবণ তেড়ে গিয়ে তুর্যর শার্টের কলার ধরে টেনে তুললো।

#চলবে

ডাকপিয়নের ছুটি নেই পর্ব-০৭

0

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব____০৭

ঘরভর্তি সাঝের গহনা,শাড়ী,জুতো,ফুল,মালা,মেকআপ আরও অনেক জিনিস ছড়িয়ে আছে তিতিরের। লোকজন ঘরে ঢুকছে, বের হচ্ছে কোনো ধ্যান নেই যেন তার। সত্যি বলতে নিজেকে বড্ড হালকা লাগছে নিজের কাছে! মনে হচ্ছে সে এই দুনিয়াতেই আর বেঁচে নেই। ম*রে গেছে! অনেক পূর্বেই ম*রে গেছে। এতো বছরের ভয়টাই তবে সত্যি হলো! সে বিনা অপরাধেও ফেঁসে গেল। আচ্ছা, সবাই সবটা জানলে কি তাকেই ভুল বুঝবে? আর এই বিয়েটা? সেটাও কি ভেঙে দিবে! সর্বপরি তার স্বামী, সেও কি ছেড়ে দিবে তাকে?

আর যেন ভাবতে পারছেনা তিতির। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। বুঝি, এটাই তার জীবনের পরে থাকা অবশিষ্ট সময়। আচ্ছা, এই শেষ মুহুর্তে সে কাকে ডাকবে? কে বুঝবে তাকে? কে বলবে, তিতির তুই নির্দোষ আর সেটা আমি বিশ্বাস করি। তুই একদম চিন্তা করিসনা।

“আপা? কি হয়েছে তোর!;

সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইশা। তার কপালের মাঝে চিন্তার অগণিত ছাপ। মুখ কুঁচকে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। হয়তো, তিতিরের এই বিধ্বস্ত অবস্থা নিয়ে ইশার মাথা ব্যাথা হবে! তিতিরের হঠাৎ মনে পড়লো, ইশাই সেই মানুষ, যে তার মাথায় হাত রেখে বলবে, সে তাকে বিশ্বাস করে। সে জানে তার আপা কখনোও এমন কাজ করবেনা।

“ইশা..;

হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো তিতির। ইশা হকচকিয়ে গেলো তিতিরের এহেম কান্না দেখে। বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠলো যেন। তিতির ওর কোমর জড়িয়ে আরও জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো। তিতিরের এমন কান্না দেখে ভীত হয়ে গেলো ইশা। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো,

“এই আপা? ক্ কাঁদছিস কেন? বল আমাকে?;

“আ..আমার সব শেষ হয়ে গে..লো রে বোন! আমার সব শেষ হয়ে গেলো।;

কাঁদতে কাঁদতে বলল তিতির। ইশার হৃৎস্পন্দন খুব দ্রুত কাঁপতে লাগলো। কি হলো তিতরের? তিতির ভীষণ নরম স্বভাবের মেয়ে। অল্পতেই কেঁদে ভাসিয়ে দেওয়া কিংবা, তার মন ভাঙা খুব সহজ। তবে তার আজকের কান্নায় একটু ভিন্নতা আছে যেন।

“বল আমাকে? কি হয়েছে! ক্ কেউ কি কিছু বলেছে? শাকিল ভাইয়া? শাকিল ভাইয়া কি…;

“ন্ না! না, কেউ কিচ্ছু বলেনি!;

“তাহলে এমন করে কাঁদছিস কেন? বলনা আমাকে? তোর কান্না দেখতে আমার ভালো লাগছেনা। আমারও কান্না পাচ্ছে আপা! বল না, প্লিজ?;

“ইশা রে! আ্ আমার ম..মনে হয় ম*রে যাওয়া উচিৎ!;

ভঙ্গ হৃদয়ে কথাটা বলে আবারও হুহু করে কেঁদে উঠলো তিতির। ইশা আহত নয়নে তাকালো বোনের পানে! কিঞ্চিৎ রাগ মিশ্রিত গলায় বলল,

“আপা! কি বলছিস যা-তা? কি হয়েছে বল আমাকে? এভাবে কাঁদলেই কি সবটা ঠিক হয়ে যাবে?;

“না রে! আমি ম*রে গেলেই সবটা ঠিক হয়ে যাবে। আমি এভাবে বেঁচে থাকতে পারবোনা!;

“আবার! আবার ঐ একই কথা? তুই কি পাগল হলি আপা? শ্রাবণ ভাইকে ডাকবো? তুই কি শ্রাবণ ভাইকে বলবি?;

ভাইয়ের নামটা শুনতেই আতংকে কেঁপে উঠলো তিতির। ইশার হাতটা খামচে ধরে আতংকিত গলায় বলল,

“ন্ না না! ভাইকে ডাকবিনা প্লিজ। ভাই জানলে আমাকে ও নিজেই মে/রে ফেলবে!;

“কি যা-তা বলছিস তুই? আচ্ছা তোর ফোনটা দে। আমি শাকিল ভাইকে একটা কল দেই। তুই তার সাথে কথা বল। দেখবি ভালো লাগবে।;

“ন্ নারে! কেউ আমাকে বুঝবেনা, কেউনা!;

“কি হয়েছে প্লিজ আমাকে খুলে বল? এভাবে কান্নাকাটি করা মোটেও কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারেনা। এই কথা কিন্তু তুই-ই আমাকে বলতিস। মনে আছে?;

তিতির যেন খানিক ভরসা পেলো। নিজেকে ধাতস্থ করতে চেষ্টা করে চোখের জল মুছে তাকালো ইশার পানে। ইশা প্রশ্ন বিদ্ধ নয়নে চেয়ে আছে তার দিকে। তিতির ইশার হাতটা ধরে কম্পিত কণ্ঠে শুধালো,

“তুই আমাকে বিশ্বাস করিস ইশা? তোর কি মনে হয় আমি কখনোও কোনো নোংরা কাজ করতে পারি?;

ইশা বিস্মিত হলো তিতিরের প্রশ্নে। তবুও, অটুট বিশ্বাসের সঙ্গে বলল,

“তোকে অবিশ্বাস করার কোনো প্রশ্নই আসেনা আপা। তুই হলি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বোন। আমি সবসময় উপরওয়ালার কাছে কি প্রার্থনা করি জানিস? তোর মতো একটা বড় বোন যেন সব ঘরে জন্মায়। ইউ আর দ্য বেস্ট আপা!;

তিতিরের কথায় আবারও কান্নার বেগ চেপে বসলো। সে যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা, ইশা তাকে এতোটা বিশ্বাস করে, এতোটা ভালোবাসে।

“এবার বলবি, কি হয়েছে?;

তিতির নিজেকে আরেকটু শান্ত করার চেষ্টা করে। তখনও তার চোখের কোন গড়িয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। এবার ইশা সেটা নিজের হাতে মুছিয়ে দিয়ে তিতিরের কপালে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে বলল,

“ভাই ভাইকে অবিশ্বাস করতে পারলেও, একজন বোন কখনোও তার বোনকে অবিশ্বাস করতে পারেনা। জানিস না বুঝি তুই?;

তিতির চোখের জল মুছে উপরনীচ করে মাথা নাড়ে। অতঃপর প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে ইশাকে টেনে তার পাশে বসায়। পাশে পড়ে থাকা ফোনটা তুলে ইশার হাতে দেয়। ফের কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,

“স্ সাজিদ কে মনে আছে তোর? আমার ভার্সিটির সিনিয়র ছিলো! যার প্রতি আমার অনেক ক্রাশ ছিলো?;

ইশা তিতিরের ফোনটা হাতে নিতে নিতে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে।

“মনে আছে। কিন্তু হঠাৎ সাজিদের কথা কেন বলছিস?;

“ওর মতো নোংরা মানুষ পৃথিবীতে আর দুটো নেই রে বোন! ও আমাকে ব্ ব্ল্যাক মেইল করছে!;

“মানে! ওর সাথে কি তোর প্রেম হয়েছিলো নাকি?;

তিতির না সূচক মাথা নাড়ে। বলে,

“না! আমি ওকে পছন্দ করি এটা জেনেই ও আমার সাথে মজা নিচ্ছিলো। আ্ আর আমি বোকার হদ্দ কখনোও বুঝছেই পারিনি!;

“ও জানতো তুইওকে পছন্দ করতিস?;

“হু।;

“তারপর?;

“তখন আমি ফ্রেশার্স ছিলাম। একদম নিউ স্টুডেন্ট। কিছু বোঝার আগেই যেন শেষ হয়ে যাচ্ছিলো সব। কারোর সাথে তেমন একটা ভাবও হয়নি। তাই সিনিয়ররা অর্থাৎ, সাজিদ আর ওর ফ্রেন্ডসরা মিলে একটা গেট টুগেদার পার্টি অ্যারেঞ্জ করে। যেহেতু পার্টিটা আমাদের জন্য, সেহেতু আমাকে স্পেশালি ইনভাইট করে। সাজিদের একটা ফ্রেন্ড আমাকে বলেছিলো, এই পার্টি অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে। এই পার্টির মূখ্য উদ্দেশ্যই হচ্ছে, নিউ স্টুডেন্টদের মাঝে একটা ভালো বন্ডিং ক্রিয়েট করা। আমি শুনে ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, এই সুযোগে আমার হয়তো নিউ ফ্রেন্ড হবে। বাসায় মিথ্যে বলে আমি যাই ঐ পার্টিতে। এমনকি ভাইকেও কোনো ভাবে জানতে দেইনি। আমি জানতাম, ভাইকে জানালে ভাই কখনোও আমাকে যেতে দিবেনা। দরকার পড়ে, ঐ পার্টি আমাদের ঘরে হবে।;

“তারপর?;

“তারপর আমি বিকালের দিকে চলে যাই সাজিদের বাসায়। আমাকে আগে থেকেই ঠিকানা দেওয়া হয়েছিলো ওখানের। ওখানে গিয়ে দেখি সব এলাহি কান্ড। রাজপ্রাসাদের মতো একটা বাড়ি। আমি রিক্সা থেকে নামতেই দারোয়ান গেট খুলে আমাকে সোজা বাসায় চলে যেতে বলে। আমি তার কথা মতো সোজা গিয়ে ঢুকলাম বাসার ভেতরে। জানিস, ভেতরে ঢুকে বোঝারই উপায় ছিলোনা এখন রাত না দিন। লাল-নীল বাতি জ্বলছে। ডিজে বাজছে। আর তার মাঝে এক গাদা ছেলে মেয়ে পাগলের মতো নাচানাচি করছে। প্রথমে আমার খুব অকোয়ার্ড লাগলেও যখন সাজিদকে দেখলাম, বিশ্বাস কর কিশোরী মনের সব খারাপ লাগা উবে গেলো। সাজিদ আমাকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলো। আমাদের ক্লাসের অনেকেই ছিলো ওখানে! সবার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো। পরিচয় হয়ে আমারও খুব ভালো লাগছিলো। ক্ কিন্তু এরপর যা হলো…;

আতংকে পূণরায় কেঁপে উঠলো তিতির। ইশা তার হাতটা শক্ত করে ধরলো। মাথায় হাত রেখে বলল,

“আমি তোকে বিশ্বাস করি আপা। আমি জানি তুই কিছু করতে পারিসনা।;

“ব্ বোন, আমি জানিনা সাজিদ শরবতের নাম করে আমাকে কি দিয়েছিলো! আমি কোনো গন্ধও পায়নি। আমার মনে হয়েছিলো, এটা কোনো দামী কিংবা বিদেশি শরবত। আমি বিনা বাক্যব্যয়ে ওটা খেয়ে নেই! ত্ তারপর, হঠাৎ হঠাৎ কেমন মাথা ঘোরাতে আরম্ভ করলো। আ্ আমি যখন সাজিদকে বললাম, সাজিদ আমাকে ওর রুমে নিয়ে গেলো! আমার স্পষ্ট মনে আছে, ও আমাকে রেস্ট নেয়ার কথা বলে রুম থেকে ব্ বেরিয়ে যায়। ত্ তারপর হঠাৎ…;

থেমে গেলো তিতির। কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার। আবারও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। বাকিটা বুঝে নিলো ইশা। আর কিছু না ভেবে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তিতিরকে। তিতিরকে জড়িয়ে রেখেই তার ফোনটা ওপেন করলো ইশা। তবে যা দেখলো, সেটা দেখার জন্য যেন মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা। কিন্তু ছবি পাঠানো হয়েছে। ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, তিতিরকে একটা ছেলেকে কিস করছে! তবে ছেলেটা ক্যামেরা থেকে উল্টো থাকায় তার মুখটা একদমই বোঝার উপায় নেই। কেবল তিতিরকেই দেখা যাচ্ছে এখানে। ছবির নীচে একটা ম্যাসেজও আছে!

“সেই থাপ্পড়টা কিন্তু আমি আজও ভুলিনি তিতিরপাখি! সো? লেটস্ টেইক আ রিভেঞ্জ!;

ইশার কাছে এবার যেন সবটা পরিষ্কার হয়ে গেলো। সে তিতিরকে নিজের থেকে টেনে তুলে বলল,

“ও তোর সাথে জোর করে খারাপ কিছু করতে চেয়েছিলো? তাইনা!;

“হ্ হ্যাঁ! শুধু আমার সাথে নয়, ও সব মেয়েদের সাথেই এমন করে। হয়তো ভাগ্যক্রমে আমার সর্বনাশ ও করতে পারেনি! আর এসব নোংরামি করার জন্য আমি ওকে থাপ্পড়ও দিয়েছিলাম। আর আজ ও সেটাই রিভেঞ্জ নিতে..;

“বুঝে গেছি। আপা, তুই একদম চিন্তা করিসনা। তোর বোন থাকতে কারোর বাপের সাধ্য নেই তোকে সবার চোখে ছোট করবে! মে/রে একদম পুঁতে দিবো মাটিতে। আমি তোর ফোনটা নিয়ে গেলাম।;

“ক্ কোথায় যাচ্ছিস?;

“এই সমস্যার সমাধান করতে। তুই নিশ্চিন্তে কনে সাজতে শুরু কর আপা, তোর বোন এসে তোকে তুলে দিবে। প্রমিজ। আমি তোর গায়ে কলঙ্কের দাগ কেন, একটা ফুলের টোকাও পড়তে দিবোনা!;

“ক্ কিন্তু বোন!;

“কোনো কিন্তু ফিন্তু নেই। যা বললাম, কর। আমি আসছি!;

তিতিরের ফোনটা নিয়ে বেরিয়ে এলো ইশা। আশেপাশে একবার তাকিয়ে এক দৌড়ে চলে গেলো শ্রাবণের ঘরে। শ্রাবণ তার বড় খালুকে নিয়ে সবেই ফিরলো বাসায়। ক্লান্ত আর বির*ক্ত ভাবটা মিলেমিশে জগা খিচুড়ি পাকিয়ে আছে। ঘামে ভেজা শার্টটা চেঞ্জ করার খাতিরে আলমারি থেকে একটা নতুন শার্ট বের করতে করতে তার দুই বন্ধু আকাশ এবং তমাল এসে হাজির হলো। শ্রাবণ ওদের দু’জনকে বসতে বলে ওয়াশরুমে ঢুকবে ঠিক তখনই ঝড়ের গতিতে এসে হাজির হলো ইশা। ইশাকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে কপালে বির*ক্তির ছাপ ফেলে তাকালো শ্রাবণ। ইশা তার সামনে এসে দাঁড়াতে বন্ধুরা যেন শুনতে না পায়, ঠিক তেমন করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“এতো বড় হয়েছিস, এখনও কমন সেন্স বলতে কিছু হয়নি?;

“তোমার সাথে আমার জরুরি কিছু কথা আছে!;

যেন শ্রাবণের গম্ভীর গলাটা উপেক্ষা করলো ইশা। ঘনঘন দম ফেলে কথাটা বলে তবেই ক্ষান্ত হলো।

“সময় নেই। পরে।;

“অনেক বেশি ইম্পরট্যান্ট শ্রাবণ ভাই!;

“তোর ইমপরট্যান্ট তোর কাছে রাখ! আমার সময় নেই।;

এই বলে শ্রাবণ ওয়াশরুমে চলে যেতে নিলে ইশা তার হাত টেনে ধরে। জেদ ধরা গলায় বলে,

“আমার কথাটা না শুনলে অনেক বড় বিপদ হয়ে যাবে। প্লিজ?;

“ধের!;

রেগে গেলো শ্রাবণ। ইশার থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে তার শার্টটা ধরিয়ে দিলো ইশার হাতে। অতঃপর বন্ধুদের নিয়ে চলে গেলো ঘর থেকে! শ্রাবণ চলে গেলে হতাশ দৃষ্টিতে তাকায় ইশা! এবার কি করবে ও? কি করে এই ফাঁদ থেকে তিতিরকে বাঁচাবে!

#চলবে

ডাকপিয়নের ছুটি নেই পর্ব-০৬

0

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_____০৬

রাতে বৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে রাস্তাঘাট একদম স্যাঁতস্যাঁতে আর কর্দমাক্ত হয়ে আছে। শ্রাবণের বাইক নিয়ে মেইন রোডে উঠতে বেশ বেগ পেতে হলো। ইশা আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিলো মেইন রোডে। শ্রাবণের হুকুমে আগেই সে এসে পড়েছে এখানে। শ্রাবণ বাইক নিয়ে মেইন রোডে উঠলেও ইশা এখনও খাম্বার ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। হয়তো সে, পূণরায় শ্রাবণের হুকুমের অপেক্ষায় আছে।

“ল্যাম্পপোস্টের মতো নিজের জায়গা বুঝে দাঁড়িয়ে থাকবি, নাকি বাইকে উঠবি?;

শ্রাবণের এহেম বাণী কর্ণকুহরে প্রবেশ করলে, ইশা খানিকক্ষণ বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অতঃপর কিঞ্চিৎ বির*ক্ত পেশ করে এগিয়ে আসে বাইকের দিকে। মহা টেনশনে মাথার ভেতর দপদপ করতে লাগলো ওর! বাইকে ওঠা ওর জন্য ছোট খাটো একটা সুনামি। আগের দিন হলে, শ্রাবণ সযত্নে হাত ধরে তুলে দিতো বাইকের পেছনে, তবে আগের দিন আর নেই! এখন এই বিশ্বযু*দ্ধ ওর একারই করতে হবে।

“ব্ বলছিলাম যে, বাইকটা না নিলে হতোনা?;

“বাজার অব্দি হেঁটে যেতে পারলে যা! আমি তো বাইক নিয়েই যাবো!;

এই বলেই বাইক স্টার্ট দিলো শ্রাবণ। ইশার আকাশ-পাতাল এক করে রা*গ হচ্ছে। কোনো মানবিকতা নেই লোকটার মাঝে! ও কি আর সাধে বলবে বাইক না নেওয়ার কথা?

“দ্ দাঁড়াও! আমাকে ফেলে যেওনা। বাজার কি এখানে নাকি?;

শ্রাবণ হেলমেট পড়তে পড়তে বলল,

“এতো নাটক না করে উঠে বস! আমার হাতে মোটেও সময় নেই।;

“আবার কোথায় যেতে চাও!;

“বড় খালুকে আনতে যেতে হবে।;

“উনি আসলেন না কেন?;

বির*ক্ত হলো শ্রাবণ! ইশার পানে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে বলল,

“তোর সাথে এখন খেজুরে আলাপ করতে বসতে হবে নাকি!;

তব্দা খেলো ইশা। সে তো কেবল নিজের ভ*য়টা লুকাতে চাচ্ছিলো কথার মারপেঁচে। এই মানুষটা আর কি বুঝবে!

“উঠছি!;

নিজের ভ*য় কে জয় করতে হবে ইশা, এই বলে নিজের মনকে স্বান্তনা দিলো বেচারি। অতঃপর কাঁপা কাঁপা পা জোড়া এগিয়ে নিয়ে কোনো মতে উঠে বসলো শ্রাবণের পেছনে। বাইকের লুকিং গ্লাসে ইশার কার্যকলাপ দেখছিলো শ্রাবণ। ভ*য়ে মুখটা একদম কাচুমাচু হয়ে গেলো তার! বাইকে ওঠা নিয়ে এতো কিসের ভ*য় তার, কে জানে? গোটা একটা বছর শ্রাবণ তাকে বাইকেই তো ঘুরিয়েছে। এমনকি বাইক চালানোটাও ট্রেনিং দিয়েছিলো। ভীতুর ডিমটায় সব গুলে খেয়ে ফেলেছে।

“ধরে বস! পড়ে গেলো তো সবাইকে আবার আমাকেই কৈফিয়ত দিতে হবে! আর তুই খুব ভালো করে জানিস যে…;

“হ্ হ্যাঁ, জানি জানি! তুমি কাউকে কৈফিয়ত দিতে পছন্দ ক্ করো না! ত্ তাই বলে, আমাকে মে*রে ফেলার প্লান করোনা প্লিজ।;

ভ*য়ে জড়োসড়ো হয়ে গেলো ইশা। কোনো মতে পেছন থেকে শ্রাবণের কাঁধটা খামচে ধরে বসলো। কাঁপছে তার হস্তদ্বয়। টের পেলো শ্রাবণ। মনে মনে ভীষণ হাসছে সে। কিন্তু এভাবে বাইক চালানো সম্ভব নয়। তাই না চাইতেও ইশার হাতটা নিয়ে নিজের কোমর পেঁচিয়ে দিলো। ভীষণ অবাক হলো ইশা। বিস্ময়ের চোটে চোখ মুখ সব যেন অন্যরকম দেখালো। শ্রাবণ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

“ধরে বস! পরে গেলে এর দায় আমার কাঁধে তুলতে পারবোনা।;

ইশা কিছুই বলতে পারলোনা জবাবে। চুপচাপ কোনঠাসা হয়ে বসে রইলো পেছনে। শ্রাবণ ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাইক স্টার্ট দিলো।

বৃষ্টির কারনে বাজারের অবস্থা আরও ভ*য়াবহ। রাস্তাঘাটের অবস্থা যেমন তেমন হলেও বাজার যেন কর্দমাক্ত নদীতে পরিনত হলো। বাইক টেনে একদম ফুলের দোকানের সামনে থামালো শ্রাবণ। বাইক থামতেই নিজের জীবন নিয়ে নেমে পড়লো ইশা। বড়বড় দম ফেলে একবার ভ্রু কুঁচকে বাইকটার দিকে তাকিয়ে মনেমনে কয়েকখানা বকা ঝাড়লো। শ্রাবণ ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলো। ওর মুখের রিয়াকশন দেখে অন্যদিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো শ্রাবণ। অতঃপর বাইকটা পাশে নিয়ে সেও নেমে পড়লো। ফুলের দোকানীর থেকে ভোরের সচ্ছ ফুলগুলো ঝুড়ি ভরে কিনে নিলো। হাজার দুয়েক টাকার ফুল কিনলো সব মিলিয়ে। যখন টাকা দিতে যাবে, ঠিক তখনই হাতে একটা বেলি ফুলের মালা পেঁচিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো ইশা। শ্রাবণের সামনে হাত নাচিয়ে আহ্লাদী গলায় বলল,

“সুন্দর না?;

শ্রাবণ গম্ভীর গলায় বলল,

“না। আর কোনো কাজ খুঁজে পাসনা? এগুলো নিয়ে বাসায় যাবি। রিক্সা করে দিচ্ছি।;

ইশার হাস্যজ্বল মুখখানা নিভে গেলো শ্রাবণের জবাবে। সে বিনাবাক্যে বেলি ফুলের মালাটা খুলে রেখে দিলো। শ্রাবণ কথাটা ওকে এভাবে বলতে চায়নি। অন্যমনস্ক থাকায়, বুঝতে পারেনি। তবে যেই মাত্র ইশা ফুলের মালাটা খুলে দিলো, ঠিক তখনই ভেতরে কেমন যেন হতে লাগলো তার। ইশার মন খারাপের আচ সে দূর থেকেও পাচ্ছে।

দোকানীকে টাকা শোধ করার সময় বারবার করে ইশার পানে দেখতে লাগলো শ্রাবণ। ইশা বিনাবাক্য ব্যয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। যা দেখতে বড্ড খারাপ লাগছে শ্রাবণের। আজ প্রথমবার তার নিজের উপরই ক্ষোভ বাড়তে লাগলো! কথাটা এভাবে না বললেও তো হতো!

রিক্সা ডেকে, ইশাকে রিক্সায় তুলে দিলো শ্রাবণ। যাওয়ার আগে একবার জিজ্ঞেস করতে চাইলো, ফুলের মালাটা ইশা নিবে কিনা! কিন্তু চেয়েও জিজ্ঞেস করতে পারলোনা । রিক্সা চলতে লাগলো। শ্রাবণ পেছন থেকে পলকহীন চেয়ে রইলো রিক্সা যতক্ষণ চোখের অলক্ষ্যে সরে না গেলো। রিক্সাটি আর দেখা গেলোনা খানিক বাদেই। বহুদূর চলে গেলো মাত্র কয়েক লহমার মধ্যে।

ইশা বাসায় পৌঁছে ফুল গুলো বড়মামাকে বুঝিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। এখন বাজে সকাল ৮টা। তিতির সবে ঘুম থেকে উঠলো। তুতুন আর তানিও উঠলো খানিক বাদে। ইশা ফ্রেশ হয়ে ধপাস করে শুয়ে পড়লো নিজের বিছানায়। আহা কি শান্তি। মনে হচ্ছে যেন অনন্ত কাল নিজের আরাম দায়ক বিছানা থেকে বঞ্চিত ছিলো সে। আজ আবারও ফিরে পেয়ছে তাকে! একটু জমিয়ে আরাম না নিলে যেন চলবেইনা।

জানালার কাচ ভেদ করে ফুুরফরে করে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে ঘরের ভেতর। চোখ বন্ধ করে লম্বা নিঃশ্বাস টানলো ইশা। অনুভব করলো প্রকৃতির শান্ত স্পর্শ। যে স্পর্শ পেতেই হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে সোনালী অতীতে। ছোট বেলার কথা বড্ড মনে পরে, সেই সাথে মনে পরে হাসিখুশি সেই মানুষটাকে। যার মূখ্য কাজই ছিলো ইশার পেছনে লাগা, আর পুরো বাড়িটাকে মাতিয়ে রাখা। কিন্তু আজ সে নিজেই চুপ। গম্ভীর এক মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে তারই করা কিছু ভুলের কারনে। সব তো ঠিকই ছিলো! তাহলে কেন করতে গেলো সে ওমন? কেন বুঝলোনা মানুষটাকে!

“আসবো?;

“কে?;

তুর্জ দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে! তুর্জকে দেখতে ক্ষণেই ভেতরটায় এক বির*ক্তির রেশ ছড়িয়ে গেলো। দোতলায় তার আসার কোনো দরকার খুঁজে পায়না ইশা! কাউকে দিয়ে ডাকিয়ে নিলেই তো সে চলে যায়।

চটজলদি শোয়া থেকে উঠে বসলো ইশা। তুর্জ অনুমতি পাওয়ার আর অপেক্ষা করলোনা। নির্দ্বিধায় ঢুকে পড়লো।

“কখন এলেন?;

প্রশ্ন করলো ইশা। তুর্জ ইশাকে একবার চোখ ভরে দেখে মৃদু হেসে জবাব দিলো,

“মাত্রই। সারারাত ঘুমাওনি নাকি? চোখমুখ ফুলে আছে।;

তুর্জর এহেম প্রশ্নে ইশা চোখমুখ একবার মালিশ করে বলল,

“না। সেভাবে ঘুম হয়নি।;

“দেখেই বুঝেছি। এখন না হয় একটু ঘুমিয়ে নিতে। ঘুমের ঘাটতি থাকা কিন্তু শরীরের জন্য ক্ষতিকর।;

ইশা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো তুর্জর পানে। আজকে তুর্জর আচরণ যেন একটু অন্যরকম লাগছে। নিজের কাছেই ভিন্ন ঠেকলো তুর্জকে। ইশাকে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে এক ভ্রু নাচিয়ে শুধালো তুর্জ,

“এভাবে কি দেখছো? ভুল বললাম নাকি!;

“ন্ না। তেমন কিছু নয়। আঙ্কেল আন্টি এসেছেন?;

“না বাবা-মা দুপুরের দিকে আসবে। এখন আসতে না পারায় তোমার কাছে দুঃখ ভরে পাঠিয়েছে।;

স্মিত হাসলো ইশা। চোখ ঝাপটে বলল,

“দুঃখিত হতে হবেনা। ইট’স ওকে।;

স্মিত হাসলো ইশাও। তুর্জ হাতে একটা শপিং ব্যাগ ধরে রেখেছে। মাত্রই সেটা চোখে পড়লো ইশার। তবে ইশা প্রশ্ন করার আগেই তুর্জ সেটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

“এটা তোমার জন্য। মা পাঠিয়েছে। মা বলেছে, তার ছেলের হবু বউকে আজ এই ড্রেসটাতে দেখতে চায়।;

ইশার হাসি হাসি মুখখানা ধপ করে নিভে গেলো। সে বুঝতে পারলো তুর্জর হঠাৎ এই ভালো হওয়ার কারনটা। যখন তাদের এনগেজমেন্ট হয়, তখন তুর্জ ইশাকে একটা ড্রেস গিফ্ট করেছিলো। ইশা হাসি মুখেই সেই উপহার গ্রহণ করে, তবে কখনও খুলে দেখেনি। যেভাবে তুর্জর থেকে নিয়েছিলো, ঠিক সেভাবেই আলমারিতে তুলে রাখে সে। একদিন কথায় কথায় তুর্জ ভীষণ জেদ ধরে তার দেওয়া ড্রেসটা ইশাকে এখনই পড়তে হবে। মাঝরাত ছিলো। ইশা স্বাভাবিক ভাবেই তুর্জকে না করে দেয়, সাথে এও জানায় কখনও কোথাও বাইরে গেলে সে তার দেওয়া ড্রেসটা পড়বে। তবে, তুর্জ মানেনা। সে আরও জেদী হয়ে ওঠে। অবশেষে ইশা বাধ্য হয়েই রাজি হয়। তুর্জর মন রাখতে, সে তার গিফট করা ড্রেসটা পড়ে৷ কিন্তু পড়তে গিয়ে তার মনে হয়, তুর্জ তাকে সাধারণ বাঙালি মেয়েদের কোনো ড্রেস গিফ্ট করেনি। ড্রেসটা লম্বায় তার হাঁটুর সামান্য নীচে অব্দি, এবং সেই সাথে স্লিভলেস! পেছন থেকে, সামনে থেকেও কোথাও থেকে, কোনোভাবেই শালীন পোশাকের নাম দিতে পারলোনা এই ড্রেসটাকে। সবটা বুঝে ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে যায় ইশা! সঙ্গে সঙ্গেই কল দেয় তুর্জকে। তুর্জকে এক বুক আশা নিয়ে ইশার কলটা রিসিভ করতেই একগাদা কথা শুনিয়ে কলটা কেটে দেয় ইশা! তুর্জর সব আশায় এক বালতি জল পড়ায় সেও ভীষণ ক্ষিপ্র হয়, তবে ইশা তার হবু বউ হওয়াতে এক্ষনি এতো বাড়াবাড়ি করার সাহস পেলোনা। তারপর থেকে তুর্জর কোনো উপহারই আর নিতোনা ইশা। আজকেও যে নিবে, সেটাও নির্ভর করছে।

“কি হলো? ড্রেসটা তুমি নিবেনা?;

“না। আপনাকে আমি আগেও বলেছি, বিয়ের আগে আমাকে এসব উপহার দেওয়া বন্ধ করুন। ভালো লাগেনা আমার এসব!;

তুর্জর মুখটা কাচুমাচু হয়ে গেলো। হাত বাড়িয়ে ইশার হাতের উপর হাতটা রাখতেই হাতটা সরিয়ে নেয় ইশা। পূণরায় কিছু বলতে নিলে তুর্জ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,

“বাবা-মা পাঠিয়েছে। তুমি না পড়লে তারা খুব কষ্ট পাবে।;

“আপনার তাদেরকে বলা উচিৎ ছিলো!;

কাঠ কাঠ গলায় বলল ইশা। ওর দৃষ্টি অন্যকোথাও। সেই সুযোগে বির*ক্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো তুর্জ। নিজের রা*গটাকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণের রাখার চেষ্টা করে বলল,

“বাবা-মা অনেক হার্ট হবে ইশা, প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। আগে তোমার-আমার মাঝে ছোট্ট একটা ভুল বোঝাবুঝি ছিলো, সেটাতো আমি তাদেরকে এভাবে বলতে পারিনা। তাই না?;

ইশা যেন কথা বাড়াতে চাইলোনা তুর্জর সাথে। তুর্জর হাত থেকে শপিং ব্যাগটা নিয়ে বলল,

“আপনি হয়তো ব্রেকফাস্ট করে আসেননি। আসুন, ব্রেকফাস্ট করবেন।;

“তুমি পড়বে তো ড্রেসটা?;

ইশা শপিং ব্যাগটা আলমারিতে তুলে রাখতে রাখতে বলল,

“পড়বো। চলুন।;

“দ্যাটস লাইক আ গুড গার্ল।

ইশা জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে চলে গেলো। তুর্জও গেলো তার পিছু পিছু।

#চলবে

ডাকপিয়নের ছুটি নেই পর্ব-০৫

0

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_০৫

চোখে আর ঘুম ধরা দিলোনা কারোরই। বেশ অনেকক্ষণ হলো, বিছানা ছেড়ে উঠে গেছে শ্রাবণ। ইশা উঠে বসেছে তার পরক্ষণেই। বাকিরা সবাই ঘুমে কাদা। তানির পিঠের নীচ থেকে ওড়নাটা বের করে গায়ে জড়িয়ে উঠে গেলো একরাশ অস্থিরতা নিয়ে। ছাদে পা রাখতেই শীতল বাতাসটা এসে জড়িয়ে গেলো সর্বাঙ্গে। বুকের ভেতরটায় এক অন্যরকম অনুভূতির মেলা বসলো ঠিক তখনই। দুরুদুরু কাঁপছে অন্তরের অন্তস্তল। দূর থেকেই দেখতে পেলো উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। চন্দ্রমা মেঘের আড়ালে লুকিয়েছে। আকাশে কেবল সহিষ্ণু কালো মেঘ। ইশা পা গুনে হাঁটতে লাগলো। শ্রাবণ সিগারেট জ্বা*লালো। বাতাসে তীব্র গন্ধ ছড়িয়েছে ক্ষণেই। ইশা নাক কুঁচকালো। কাছাকাছি আসতেই সিগারেটের গন্ধে পেটে মোচড় দিলো ওর। সেই সাথে কাশি শুরু হলো। ইশার কাশির শব্দ আঘাত হানলো শ্রাবণের বক্ষঃপিঞ্জরে। সঙ্গে সঙ্গে জ*লন্ত সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো অদৃশ্যে। সম্মুখে উড়তে থাকা ধোঁয়া টুকুন চটজলদি হাতের সাহায্যে উড়িয়ে দিয়ে মুখ মুছে পেছন মুড়ে তাকালো। ততক্ষণে ইশা এসে দাঁড়িয়ে তার সামনে। এই সেই ইশা, যার এক কথায় শ্রাবণ তার সব বদঅভ্যাস গুলোর বলি দিতো। তারপর, একদিন সময় বদলে গেলো। এই সেই ইশা, যার হাজার বারনেও আর শ্রাবণের কোনো মাথা ব্যাথা হলোনা!

কিন্তু আজ, আজ যেন একটু ভিন্ন হতে চাইলে তার অবাধ্য হৃদয়। নিজেকে বোঝাতে চাইলো, ইশাকে ক*ষ্ট দিলে সে নিজেও ভালো থাকবেনা! মোটেও ভালো থাকবেনা।

“সিগারেট খাচ্ছিলে?;

“তুই এখানে কি করছিস?;

“ঘুম আসছেনা!;

“তো আমি কি করতে পারি? আমাকে দেখে নিশ্চয়ই ঘুমের ঔষধ ডেলিভারি দেওয়া ডেলিভারি বয় লাগছেনা!;

শ্রাবণের ত্যাড়া ত্যাড়া জবাবে উত্তর খুঁজে পেলোনা ইশা। নিশ্চুপ হয়ে রইলো কিছুক্ষন। অতঃপর ধীর গলায় পূণরায় কথা পাড়লো,

“তুমি ঘুমালে না কেন?;

“আমার কাউকে কৈফিয়ত দিতে ভালো লাগেনা। খুব ভালো করে জানিস তুই!;

“কৈফিয়ত চাইছি না। শুধু জিজ্ঞেস..;

“ভেতরে যা। এতো রাতে কেউ দেখলে বদনাম রটাবে। আর তুই তো বদনামে খুব ভ*য় পাস।;

“শ্রাবণ ভাই! আমরা কি আর আগের মতো কথা বলতে পারিনা?;

“তখনও তোকে বলেছি, আর এখনও বলছি! অতীত নিয়ে পড়ে থাকিসনা।;

“তার মানে, তুমি সত্যি বদলে গেলে?;

শ্রাবণ নিজের জবাবটাকে স্থগিত রাখলো। যেন, ইশার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলোনা। কতক্ষণ নীরব থেকে পূণরায় বলল,

“দাঁড়িয়ে আছিস কেন! ভেতরে যেতে বললাম তো?;

ধমকে উঠলো শ্রাবণ। ইশা চমকে উঠলো। নিস্তব্ধ রাত বড্ড জোরে বাজালো শ্রাবণের উচ্চস্বর। ইশা ভীত চোখে তাকালো শ্রাবণের পানে। শ্রাবণ চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। যেন আরও বেশ কয়েকটা ধমক বাকি আছে ইশার কপালে।

“য্ যাবোনা! কি করবে?;

অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো শ্রাবণ। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“দেখ, রাত-দুপুরে এসব নাটক কিন্তু ভালো লাগছেনা!;

“আমি নাটক করছি?;

“হ্যাঁ করছিস! আরও কতকি করছিস, তুই নিজেও জানিসনা!;

“কি করেছি আমি? তুমি সব সময় আমার সাথেই কেন এমন করো? কি এমন করি আমি!;

জেদী গলায় প্রশ্ন ছুড়লো ইশা। শ্রাবণ রাগি চোখেই দেখছে ইশার জেদী মুখশ্রী!

“তুই কাজই এমন করিস যে, আমাকে না চাইতেও তোর সাথে খারাপ আচরণ করতে হয়!;

“আমি ভুল করলে আমাকে বলো শ্রাবণ ভাই, কিন্তু তারপরও আমার সাথে এমন করোনা, তোমার এই কঠোর ভাবমূর্তি একদিন আমাকে শেষ করে ফেলবে!;

বড্ড করুন শোনালো ইশার বলা শেষোক্ত কথাটা। শ্রাবণ ওর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অদূরে নিক্ষেপ করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। তবে তার সব চেষ্টার একটাও যদি কখনও সফল হতো! তাহলে তো সে ধন্য হয়ে যেতো!

“ভেজা শরীরটাকে তোর ঐ হবু বরকে দেখিয়ে বড্ড আনন্দিত হয়েছিস তো? আর কি চাই!;

স্তব্ধ হয়ে গেলো ইশা। কন্ঠনালীতে ক্ষনিকেই কোনো চাপ পড়লোনা কথা খরচ করার জন্য। এখানে দোষটা ওর। ও স্বীকার করছে নিজের কাছেই! কিন্তু, শ্রাবণের কানে সেই খবর কি করে এলো?

“তোর বিয়েটা এই মুহুর্তেই হয়ে যাওয়া উচিৎ। তুর্জ আমাকে নিজে এসে বলেছে তোদের বিয়েটা আরেকটু এগিয়ে আনার কথা! কারন, তোকে ছোঁয়ার জন্য তার যে তর সইছেনা।;

ইশার ভেতরটা মুচড়ে যেতে লাগলো। কি বলছে শ্রাবণ! তুর্জ কি সত্যিই এমনটা ভাবে ওকে নিয়ে? কথাটা ভেবে নিজেরই হাসি পেলো নিজের উপরে। আরও একবার প্রমাণ হলো,মেয়েদের সৌন্দর্য্য তাদের জন্য অভিশাপ!

“চলে যা ইশা, অনেক দূরে চলে যা! নয়তো একে একে অনেক গুলো জীবন ন*ষ্ট হয়ে যাবে। যা বোঝার ক্ষমতা তোর কোনোদিনই হবেনা!;

বড্ড কান্না পেলো ইশার। তুচ্ছ মনে হলো ওর নিজেকে! কেউই যে ওকে বোঝার চেষ্টা করছেনা! সবাই যে যার মত, অভিমান, অভিযোগ চাপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ওর উপর! কেউ বুঝছেনা ওকে!

“তুর্জ তোকে ভালোবাসেনা, বাসে তোর শরীরটাকে। এ’কথা বুঝিস তুই?;

আবারও বলে উঠলো শ্রাবণ। ইশার চোখের কোন গড়িয়ে জল পড়লো। কিছু বলতে চাইলেও কান্নার বেগ চেপে কিছুই বলতে পারলোনা। শ্রাবণ নিঃশব্দে উপলব্ধি করলো মায়াবতীর কান্না! বড্ড করুন হলেও, বড্ড নেশালো মনে হলো শ্রাবণের। সে চায়না এই কান্না থামুক। সে চায়, অনন্তকাল ব্যাপী মায়াবতীর কান্না বজায় থাকুক। তাহলেই সে শান্তি পাবে। এত বছরের তিল তিল করে গড়ে তোলা অনুভূতি গুলোকে এক লহমায় ধূলিসাৎ করে দেওয়ার শা/স্তি এই কান্নাগুলো। চলুক, যতদিন না সে তার ব্যর্থ হৃদয়কে পূণরায় প্রশান্ত করতে পারবে।

“আমার সামনে এসব ন্যাকামি চলবেনা। হয় তুই চলে যা, না হয় আমি চলে যাচ্ছি!;

এই বলে হাঁটা ধরতেই পেছন থেকে তার হাত টেনে ধরলো ইশা। কান্না ভেজা গলায় বলল,

“চলে যাবো আমি! একদিন অনেক দূরে চলে যাবো। তবুও, তুমি কোথাও যেওনা শ্রাবণ ভাই!;

“রুমে যা!; শান্ত স্বরে বলল শ্রাবণ।

ইশা শ্রাবণের হাত ছেড়ে চোখের জল মুছে চলে গেলো ভেতরে। শ্রাবণ ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়লো।

ভোরের আলো ফুটতেই হৈচৈ শুরু হলো বিয়ে বাড়িতে। বাচ্চাদের কান্নার আওয়াজ, বড়দের চিৎকার চেঁচামেচি! ৫টার দিকে চোখটা লেগে এলেও ছয়টার মধ্যে উঠে পড়তে হলো ইশাকে। পাশে বড় মামী নেই। নেই শ্রাবণও। হয়তো সারা রাত আর আসেনি সে। আরব ঘুমচ্ছে বেঘোরে। তুতুন এবং তানি জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে আছে। ইশা উঠতে উঠতে ওদের দু’বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দু’জনকেই চুমু খেয়ে উঠে গেলো। নিজের রুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নীচে নামতেই দেখা হলো আনোয়ারা বেগমের সাথে। আনোয়ারা বেগম খাবার টেবিলে বসে পান সাজাচ্ছেন। ইশাকে দেখতেই ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন,

“দিদি ভাই, ঘুম কেমন হলো?;

“আর ঘুম!;

“সেকি রে, জায়গা মেলেনি?;

“জায়গা মিলেছে। তবে ঘুম মিলেনি জানপাখি! তোমার মতো একজন বুড়ো পেলে তো সারা রাত তার বুকে মাথা রেখেই পার করে দিতাম।;

নানীর গাল টেনে কথাটা বলে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। আনোয়ারা বেগম হাত উল্টে একটা মা*র দিলেন ইশাকে। লজ্জা পাওয়া গলায় বললেন,

“পাজি মেয়ে একটা!;

ইশা ফিক করে হেসে দিলো। অতঃপর নানীকে ছেড়ে তার পাশের চেয়ারটায় বসতে বসতে আশেপাশে নজর বুলালো। মা-কে খুঁজছে। বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে। ক্ষিদেয় যেন পেটের ভেতর ইঁদুর দৌড়াচ্ছে।

“মা কি রান্না ঘরে নানু?;

“হ্যাঁ। তোর জন্য নাস্তা তুলে রাখতে বললাম। রাতে তো কিছু না খেয়েই চলে গেলি!;

গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো ইশা। মাথা চুলকে বলল,

“না গিয়ে উপায় ছিলো? মা বলল, এতো মেহমানকে খাবার দিতে দিতে খাবারই শেষ! আমি আর ভাগে পেলাম না!;

“কি বিশ্রী কান্ড! যা এখন জলদি গিয়ে নাস্তাটা সেরে নে। গরম গরম খেতে ভালো লাগবে।;

“তুমি খেয়েছো বুড়ি?;

“হ্যাঁ, তোর বুড়োর সাথে মাত্রই নাস্তা খেয়ে উঠলাম।;

“বাহ্, এটা কিন্তু মন্দ করোনি।;

গলা উঁচিয়ে কথাটা বলতে বলতে রান্না ঘরে ঢুকলো ইশা। মা,বড় মামি এবং ছোট মামি ছাড়াও আরও বেশ কয়েকজন অপরিচিত কাজের লোককে দেখা গেলো। এদেরকে ইশা না চিনলেও মুচকি হেসে কথা বলল সবার সাথে। মেয়েকে দেখে মরিয়ম বিবি নাস্তার প্লেটটা তুলে দিলো ঝটপট। আগে ক্ষমা চেয়ে বলল,

“রাতের জন্য মায়ের উপর রেগে থাকিসনা মা! বুঝিসই তো, এতো মানুষজন! কেউ কেউ তো ২বারও খেলো।;

শেষোক্ত কথাটা গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন মরিয়ম বিবি। আফিয়া বেগম এবং নুপুর বেগম কথাটা শুনে মুখ টিপে হাসলেন। অতঃপর আফিয়া বেগম বললেন,

“রাক্ষস বাপু! এদিকে আমাদের ছেলেমেয়েরা খেতে পায়না, আর ওদিকে তারা দু’বার করে খায়। কোনো বিবেক নাই।;

নুপুর বেগম মুখে আঁচল চেপে আস্তে করে বললেন,

“থাক আপা, বাদ দাও। মা ওখানে বসে আছে। শুনতে পাবে।;

আরও অনেক কথা হলো তিন ননদ-ভাবীর মধ্যে। ইশা শুনেও শুনলোনা। নিজের খাবার নিয়ে চট জলদি খেতে বসলো। খাওয়া যখন মাঝামাঝি হয়ে এলো, ঠিক তখনই দেখতে পেলো শ্রাবণকে। এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করতে করতে এদিকেই হেঁটে আসছে। পরনের লাল টি-শার্টটা বেকায়দায় কুঁচকে আছে। সেটাও টেনেটুনে ঠিক করলো। ইশাকে সে দূর থেকেই দেখতে পেয়েছে। তবে ভাবখানা এমন যে, সে ইশাকে কেন, সামনের দেয়ালটাকেও দেখেনি!

“মা, নাস্তা দাও জলদি! খেয়ে বের হতে হবে।; (গলা উঁচিয়ে ডাকলো মাকে)

“কই যাবি এতো ভোরে?;

সুপারি কাটতে কাটতে শুধালেন আনোয়ারা বেগম। শ্রাবণ চেয়ার টেনে বসলো। গ্লাসে পানি ঢেলে আগে খেয়ে অতঃপর দাদীর প্রশ্নের জবাব দিলো।

“ফুল কম পড়েছে। বাবা বলল।;

“সেটা এখন মনে পড়লো?;

“রাতেই বলেছে। কিন্তু মাঝরাতে ফুল কোথা থেকে জোগাড় করতাম বলো?;

“সেও তো কথা। একা যাবি?;

“হ্যাঁ, বাইক নিয়ে চলে যাবো। দেখি, আর কাউকে পাই কিনা!;

“ইশাকে নিয়ে যা।;

নিজের নামটা উঠতেই হঠাৎ বিষম খেলো ইশা। কাশি উঠতেই চমকে গেলেন আনোয়ারা বেগম। শ্রাবণের আধখাওয়া পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে চিন্তান্বিত গলায় বলে উঠলেন,

“কি হলো, দেখে খা বাপু!;

নানীর থেকে পানিটা নিয়ে ঢকঢক করে গিলে খেলো ইশা। এক পর্যায়ে বিষম থেকে রেহাই পেয়ে আবারও খাবারে মনোযোগী হলো। দাদীর কথার পিঠে হ্যাঁ না কোনো কিছুই বললনা শ্রাবণ।

“মা? খাবার কি পাবো আজ?;

পূণরায় গলা উঁচিয়ে মাকে ডাকলো শ্রাবণ। কিন্তু এবারেও কারোর সাড়া নেই। তাই সে বির*ক্ত হয়ে উঠে যেতে নিলে আঁটকালো দাদী। ইশাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“ও ইশা, শ্রাবণের খাবারটা এনে দে না! ছেলেটার তো ক্ষিদে পেয়েছে। রান্না ঘরে সবাই ব্যস্ত। যা তুই গিয়ে নিয়ে আয়!;

ইশা অসহায় নেত্রে তাকালো নানীর পানে। বোকা গলায় প্রশ্ন করলো,

“আমি?;

“হ্যাঁ, যা জলদি।;

ইচ্ছে না থাকলেই নানীর কথা ফেলতে পারলোনা ইশা। চুপচাপ উঠে গেলো শ্রাবণের জন্য খাবার আনতে। মিনিট দুয়েক বাদে খাবার নিয়ে আবারও ফেরত এলো। শ্রাবণের সামনে দিয়ে, নানীর কথা মতো গ্লাস ভর্তি করে পানিও ঢেলে দিলো। অতঃপর পূণরায় বসে পড়লো নিজের বাকি খাবারটুকু শেষ করতে।

#চলবে

ডাকপিয়নের ছুটি নেই পর্ব-০৪

0

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব____০৪.

ইশার মনেমনে অনেক কথা জমলো! কিন্তু এই মানুষটাকে কিছু বলার বোকামি সে করবেনা। তাই কোনো কথা না বলে চলে যেতে নিলেই খেতে হলো আরেক ধমক!

কেননা, সে কফির মগ গুলো নিয়ে পূনরায় নীচের দিকে রওনা হচ্ছিলো। শ্রাবণ ধমক দিয়ে বলল,

“উপরে যখন উঠেই গিয়েছিস, এগুলা দিয়ে বাকি গুলো ফ্লাক্সে করে নিয়ে আয়।;

ইশা ঢোক গিলে, হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে ধীর গতিতে উঠে যায় ছাদে। পেছন পেছন গুটি গুটি পায়ে এগোয় লতিফাও। শ্রাবণ ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে নীচে নেমে যায়। ফোনটা হয়তো ভে*ঙে গেছে! ভাবতে ভাবতে ফোনটা মেঝে থেকে কুড়িয়ে তুলতে দেখলো স্ক্রিনে দাগ পড়ে গেছে। আফসোস করে, কপাল ডলতে ডলতে চলে গেলো বাইরে। ইশা সবাইকে কফি দিয়ে এক প্রকার দৌড়ে এলো সিঁড়িতে। ভেবেছিলো শ্রাবণ হয়তো থাকবে, কিন্তু সে নেই। যা দেখে, মনের কোনে কালো মেঘেদের ভীড় জমলো। তবে শ্রাবণ যেমন হুকুম করে গেলো, তেমন ভাবেই সব তামিল করলো। পরের কফিগুলো দুটো ফ্লাক্সে ভরে নিয়ে এলো। এক এক করে সবাইকে কফি দিয়ে নিজের জন্যও নিলো। তুতুনের পাশে আসন করে বসতে বসতে আবারও এসে পড়লো আরেক গুরু দায়িত্ব। তাই বসেও আর বসা হলোনা। কফি নিয়েই উঠে যেতে হলো। পূণরায় এই গুরুদায়িত্ব শেষ করে বসতে ইচ্ছে করলেও বসলোনা আর। ফোন আর কফির মগটা নিয়ে চলে গেলো ছাঁদের একপাশে।

আকাশে মস্ত বড় একখানা চাঁদ উঠেছে। চাঁদের পাশে লক্ষাধিক তারার মেলা। চারপাশে মৃদু বাতাস। বাতাসে বৃষ্টির আভাস। মস্ত বড় চাঁদটাকে ঘিরে বারবার মেঘেদের হাট বসলেও পরক্ষণেই কেটে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে তা। আবারও, পূণরায় থেকে থেকে মেঘ জমে ঢেকে যাচ্ছে চাঁদটা। ইশা তার স্থীর দৃষ্টি জোড়া নিক্ষেপ করে রেখেছে চাঁদের পানে। কফির মগে এক বার চুমুক দিয়ে হারিয়ে গেলো প্রকৃতির এই সৌন্দর্য্যের মাঝে। প্রকৃতির এই অসামান্য রূপে সৃষ্টিকর্তার নিকট কৃতজ্ঞতা পেশ করলো মনেমনে। ঠিক তখনই মনটাকে বিষন্ন করে দিয়ে ফোনটা বেজে উঠলো ওর। ফোনটা সামনে ধরতেই দেখা মিললো তুর্জর নাম্বারটা। যা দেখতেই বিষন্ন মনে আরেকটু বি*ষ পড়লো যেন।

“বউ, কি করছো?;

ইশা মনেমনে বড্ড বির*ক্ত হলো। সরাসরি বলল,

“বিয়েটা না হওয়া অব্দি আমাকে এই ভাবে ডাকবেন না প্লিজ।;

“কেন? বউ কি রাগ করে?;

“প্লিজ তুর্জ!;

“ওকে, ফাইন। তুমি যা বলবে, সেটাই হবে। কি করছিলে?;

“কফি আড্ডা হচ্ছে।;

“তুমি তো আড্ডায় নেই, আরব বলল।;

” হু, সবাইকে কফি দিয়ে আমি চাঁদ বিলাস করতে এলাম।;

“একা কেন? আমাকে সঙ্গে নিতে অসুবিধা ছিলো?;

“মাঝেমাঝে কেবল একা, স্রেফ নিজেকে নিয়েই কিছু করতে হয়। আপনাকে নিয়ে চন্দ্র বিলাস করার অজস্র সুযোগ হবে। কিন্তু, নিজেকে নিয়ে হয়তো আর তেমন সময় হবেনা কখনোও।;

“আমার কাছে থাকলে, কোনো কাজই তোমাকে একা করতে দিবোনা। বাবার বাড়িও আসা চলবেনা। সার্বক্ষনিক, আমাকে সময় দিতে হবে।;

ইশা থমকালো কিঞ্চিৎ। মজা করছে কি তুর্জ?

“বিয়ের পর বাবার বাড়ি আসবোনা আমি?;

“না।;

“কেন? মা, বড় মামি, ছোট মামি তাদের দেখতে ইচ্ছে করলে?;

“ওসব জানিনা। আমি আমার বউকে একদমই ছাড়তে পারবোনা কোথাও।;

“ওহ। এই তবে আপনার প্লান।;

“তা নয়তো কি? আমি আমার বউকে ছাড়া একদমই থাকতে চাইনা। ব্যস।;

ইশার মন খারাপ হয়ে গেলো। মাকে ছাড়া কোনোদিনও এক মুহুর্তের জন্য থাকেনি সে। বড় মামি, ছোট মামি, মামারা কাউকেই একদিনের বেশি না দেখে থাকতে পারেনা ও। সেখানে, তুর্জর এমন আবদার! যেন অন্যায় আবদার ঠেকলো ইশার মনে।

“চুপ হয়ে গেলে কেন? কি ভাবছো?;

“কিছু ভাবছিনা। আপনি বলুন?;

“একটা কথা বলবো বউ?;

“বিয়ে না হওয়া অব্দি আমাকে ইশা বলেই সম্মোধন করুন, প্লিজ!; (কাঠ কাঠ গলায়)

ওপাশ থেকে বির/ক্ত গলা শোনা গেলো তুর্জর,

“আশ্চর্য, তুমি এতো রিয়াক্ট করছো কেন? বউই তো ডেকেছি! বউ বলে আদর সোহাগ তো করছিনা!;

ইশার অসহ্য লাগছে তুর্জর এমন আচরণ! বলছে তো এই ডাক তার ভালো লাগছেনা, তারপরও কেন ডাকতে হবে তাকে?

“কথায় কথায় তোমার ওভার রিয়াক্ট পছন্দ নয় আমার। প্লিজ বিয়ের আগেই যথাসম্ভব এই ব্যাড হ্যাবিট চেঞ্জ করো। বিয়ের পর এসব সহ্য করবোনা আমি!;

হুকুমের সুরেই বলল তুর্জ। বির*ক্তিতে কপালের ভাজ তীক্ষ্ণ হলো ইশার।

“মানে? আমার একটা কথা পছন্দ না হলে আমি বলতে পারবোনা? বললেই আপনার কাছে ওভার রিয়াক্ট বলে গণ্য হবে? কেন!;

“আমার হবু বউকে আমি বউ বলে ডাকলে কি অসুবিধা, আমি তো সেটাই বুঝতে পারছিনা!;

“তুর্জ প্লিজ, এতো প্রশ্ন করবেন না! আমি কেবল এই শব্দটা এখন ব্যবহার করতে না করছি। বিয়ের পর যা খুশি করুন, আমি বারন করিনি!;

“ঝগড়া করার হলে, নিজের রুমে যা! এখানে দশজনের সামনে নিজেদের পার্সোনাল প্রবলেম তুলে নাই ধরলি!;

বাতাসের তাল কেটে একখানা পরিচিত গলা কানের পর্দায় বারি খেতেই থেমে গেলো ইশা। ওপাশ থেকে ধেড়ে গলায় চেচাচ্ছে তুর্জ। ইশা পাশ ফিরে তাকালে শ্রাবণকে দেখতে পেলো। তাই তুর্জকে আর বিশেষ কিছু না বলে, ফোনটা কান থেকে নামিয়ে কেটে দিলো। শ্রাবণ আর দাঁড়িয়ে রইলোনা। কথাটা বলেই চলে গেলো ছাদের অন্য প্রান্তে। ইশা খেয়াল করলো শ্রাবণের হাত খালি। লতিফাকে বলেছিলো, শ্রাবণ এলে তাকেও যেন এক মগ কফি দেয়। নির্ঘাত ভুলে গিয়েছে! ইশা নিজের কফি রেখে দিয়ে, শ্রাবণের জন্য এক মগ নিয়ে গেলো। শ্রাবণ ছাদের রেলিঙের হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শীতল চাহনি তার চন্দ্রমাতে নিবদ্ধ। পেছনে কারোর অস্তিত্ব প্রগাঢ় ভাবে উপলব্ধি হলেও মুখে কোনো কথার স্থান দিলোনা শ্রাবণ। এক বুক য*ন্ত্র*ণা নিয়ে, বরাবরের ন্যায় নিজেকে খোলসের মধ্যে বন্দী রাখলো।

ইশা দুই মিনিট নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো তার পেছনে। অতঃপর নিজেই আগ বাড়িয়ে ডাকলো শ্রাবণকে,

“বড় মামি স্পেশালি কফিটা তোমাকে দিতে বলেছে। সন্ধ্যায় নাকি বলেছিলে, মাথা ধরেছে। কাজের চাপে তখন দিতে পারেনি। তারজন্য সরি!;

ইশার কোমল স্নিগ্ধ গলার স্বর বরাবরই তাকে খোলস ছেড়ে আসতে বাধ্য করে। তবুও সে, শক্ত হয়ে নিজের খোলস ধরে রাখে। এবারও তার ব্যাতিক্রম নয়। ইশার কোমল স্নিগ্ধ গলার স্বরকে তুচ্ছ করে কঠোর গলায় জবাব দিলো,

“মাথা ব্যাথা সেরে গেছে। এখন এসবের দরকার নেই!;

“শুধু কি মাথা ব্যাথা? ক্ কফি তো আরও অনেক প্রবলেম সল্ভ করতে পারে। এই যেমন মন?;

ভয় জড়ানো কন্ঠ বলল ইশা। শ্রাবণ ওর কথায় তাচ্ছিল্য মিশ্রিত হাসলো। তবে মুখ উল্টো দিকে থাকায় সেই হাসি দেখার ভাগ্য হলোনা ইশার। শ্রাবণ ঘুড়ে দাঁড়ালো ইশার পানে। ইশাকে একবার আপাদমস্তক দেখে বলল,

“তুর্জকে পছন্দ না হলে, বিয়ে কেন করছিস?;

শ্রাবণের থেকে এহেম প্রশ্ন পাওয়া অষ্টম আশ্চর্যের ব্যাপার। হতবিহ্বল নয়নে তাকালো ইশা। অবাকের শীর্ষে পৌঁছে বলল,

“ক্ কি বললে?;

“কিছুনা!;

বলেই কফিটা নিয়ে নিলো ইশার থেকে। পূণরায় উল্টো দিকে ঘুড়ে দাঁড়ালো। ফের, একবার, দু’বার অতঃপর লাগাতার কয়েক বার চুমুক দিলো কফিতে। ইশা পলকহীন চেয়ে রইলো শ্রাবণের পানে। সে কিছু বলতে চায় শ্রাবণকে। কিন্তু, কিভাবে বলবে জানেনা। মনেমনে আওড়াতে লাগলো কথাটা। অতঃপর, একপর্যায়ে বলতে পারলো,

“তুর্জ আমাকে বউ বলে ডাকতে চায়! তাই, এতো ঝগড়া।;

কথাটা যেন বি/স্ফো/র/ক ঘটালো শ্রাবণের ভেতরে। তার কফিতে চুমুক দেওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। ঝলসানো হৃদয়ে সে এবার যেন চেয়েও হাসতে পারলোনা। আহত গলায় বলল,

“ওহ, ভালোতো।;

“আমার ভালো লাগছেনা ওর থেকে এই ডাকটা শুনতে! এটা তো তুমি আমায়…;

“তুই ওর হবু বউ! কিছুদিন বাদে তোদের বিয়ে হবে। দ্যেন তুই ওর পার্মানেন্ট বউ হয়ে যাবি। তাহলে, বউ বলে ডাকলে তোর অসুবিধা হওয়ার কিছু তো দেখছিনা।;

“জ্ জানিনা!;

“এখন আর না জেনে উপায় নেই! অতীতের কথা ভুলে যা। অতীত ভেবে বর্তমান ন/ষ্ট করার কোনো মানে হয়না।;

“আ্ আমাকে তুমি আর কখনোও মাফ করবেনা, তাইনা?;

হেসে উঠলো শ্রাবণ। একবুক য/ন্ত্র/ণা ভেতরে চেপে রেখেই হেসে উঠলো সে। সম্মুখে ঘুরে, ইশাকে আবারও দেখতে লাগলো আপাদমস্তক। দেখা শেষে বলল,

“তুই সত্যিই বড্ড বোকারে ইশা! বড্ড বোকা।;

শ্রাবণের চোখ জোড়া ভাসছে নোনাজলে। যা দেখে ভেতরটায় ভাঙন ধরলো ইশার। কেন সে কষ্ট দিচ্ছে এই মানুষটাকে, আর কেন সে কষ্ট পাচ্ছে নিজেও! কেন?

“তিতিরের বিয়েটা হলেই তোরও বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে! বি প্রিপেয়ার্ড ইশুপাখি!;

কথাটা বলতে বলতে কফির মগটা ঠেসে দিলো ইশার হাতে। গরম কফিটা হাতে ঠেসে যেতে ছ্যাঁত করে পুড়ে গেলো, মন পোড়ার ন্যায়। তবে, তার চেয়েও বেশি আতংক ধরে গেলো শ্রাবণের কথাটায়! ওর বিয়েটা এক্ষনি হবে মানে কি? ও যে এক্ষনি বিয়ে করতে চায়না!

“ম্ মানে! ক্ কি বলছো এসব? আমি এখন বিয়ে করবোনা! শ্রাবণ ভাই, দাঁড়াও! দাঁড়াও প্লিজ…;

দাঁড়ালো না আর শ্রাবণ। গটগট পায়ে চলে গেলো নীচে।

দোতলা ভবনটিতে যথেষ্ট ঘর থাকলেও সবাইকে শুতে দিতে গিয়ে মনে হলো, আরও বেশ কয়েকটা ঘর হলে মন্দ হতোনা। প্রত্যেক ঘরেই গাদাগাদি করে শুতে হলো সবাইকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য ক্রমে বাড়ির মানুষ গাদাগাদি করেও জায়গা পেলোনা। আবার কেউ কেউ পেলেও অস্বস্তি নিয়ে শুতে পারলোনা। তুতুন আর তানি জেদ ধরলো তারা কেউ ইশাকে ছাড়া ঘুমাবেনা। ইশা জেদ ধরলো সেও তার বড় মামির কাছে ঘুমাবে। কিন্তু সব ঠিক হলেও জায়গা মিললো না কোথাও। অবশেষে জায়গা খুঁজে বের করলো শ্রাবণ। চিলেকোঠার ছোট্ট ঘরটিই এখন একমাত্র ভরসা। যেখানে আলোবাতাসের ছিটেফোঁটা অব্দি নেই। শ্রাবণ এবং আরব মিলে এক এক করে সব কিছুর ব্যবস্থা করলো। একটা স্ট্যান্ড ফ্যান বসিয়ে মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে দিলো। তার উপর তোশক দিয়ে চাদর বিছিয়ে দিলো ইশা। বালিশ নিয়ে এলো তুতুন আর তানি। বালিশ ঠিক করে বিছানা পেতে দিলো আরব। মোট ছ’খানা বালিশ দিলো বিছানায়। আরব, শ্রাবণ, আফিয়া বেগম, ইশা, তানি এবং তুতুন শুয়ে পড়লো পাশাপাশি। প্রত্যেকেই সটান হয়ে শুয়ে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়লো। সারাদিন খুব ধকল গেলো সবার। ছোট বড় কাজ সবাইকেই করতে হয়েছে। কাল আবারও একই ধকল, একই খাটুনি যাবে সবার উপর থেকে। এখন এই টুকু সময়ও যদি রেস্ট নিতে না পারতো, তবে আর কাউকে দেখতে হতোনা!

“আচ্ছা বড়মা, বড় আপার বিয়ে হয়ে গেলে কি মেজ আপারও কি বিয়ে হয়ে যাবে?;

প্রশ্নটা তানির। স্বল্প বুঝে ঘটে যেটুকু ধারন করতে পারলো সেটুকু দিয়েই প্রশ্ন করলো সে। তবে এই প্রশ্নটাই কারোর কারোর মনে ঝড় তুলে দিলো। শ্রাবণ অনুভূতি শূন্য দৃষ্টিতে একবার পাশ ফিরে দেখলো ইশাকে। ইশাও দেখলো, তবে ওর দৃষ্টিতে ছিলো একরাশ অসহায়ত্বতা।

আফিয়া বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইশার মাথায় হাত রাখলেন। কতক্ষন কি যেন ভাবলেন আপন মনে। অতঃপর বললেন,

“ইশা যদি চায়, তাহলে কালই ওর বিয়ে হবে। কি রে, করবি নাকি দু’বোন একসাথে বিয়ে?;

ইশা অসহায় নেত্রে তাকালো বড় মামির দিকে। বলল,

“প্লিজ না! আমি এতো জলদি মোটেও বিয়ে করতে চাইনা।;

কথাটা একটু জোরেই বলল ইশা। যেন কাউকে শোনাতে চাইলো ওর অটুট সিদ্ধান্তের কথা।

“করে ফেল ইশু! পরে কিন্তু বুড়ি হয়ে বিয়ে করতে হবে!;

কথার তাল ধরলো আরব। মজার ছলে কথাটা বলে হেসে উঠলো সে। ইশাও হাসলো, তবে তাচ্ছিল্য করে আপন মনে। তুতুন বলল,

“মেজ আপার জন্য তুর্জ ভাইয়া একদম পার্ফেক্ট, তাইনা বলো বড় মা?;

“মানানসই বলছিস?; শুধালেন আফিয়া বেগম।

“হ্যাঁ গো।;

মন সায় দিলোনা আফিয়া বেগমের। বললেন,

“জানিনা রে মা। তবে আশা করবো তেমনটাই হবে।;

সবাই আবারও নিশ্চুপ। ধীরে ধীরে ক্লান্ত শরীরটা বিশ্রাম নেওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো প্রত্যেকেরই। কেবল, চাতক পাখির মতো জেগে রইলো একজোড়া পাখি! তারা না পারছিলো ঘুমাতে, আর না পারছিলা কোনো কথা জোগাতে। কেবল দীর্ঘশ্বাসের পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পার করতে লাগলো নির্ঘুম রাত।

#চলবে

ডায়পিয়নের ছুটি নেই পর্ব-০৩

0

#ডায়পিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব______০৩

ইশার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো শ্রাবণ। ভ/য়ে গলা শুঁকিয়ে কাঠে পরিণত হলো ইশার। চাইলো কি, ঘটলো কি, আর হলো কি! শ্রাবণ ওর হাতটা ধরেই হেঁচকা টানতে টানতে নিয়ে গেলো দোতলায়। পেছন থেকে ভ/য়াতুর নয়নে তাদের দেখে দৌড়ে পালালো তানি। শ্রাবণ ইশাকে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো। হাতটা ধরে রেখেই এক লাথি দিয়ে দরজাটা সজোরে আঁটকালো। শব্দটা এতোটাই জোরে হলো যে আরেকদফা নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করতে হলো ইশাকে।

ইশাকে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে রা/গে ফুঁসছে শ্রাবণ। ভ/য়ে নেত্রদ্বয় মাটিতেই বিঁধে রইলো ইশার। ভেতরে ভেতরে কাঁপছে ও। শ্রাবণ এবার নির্ঘাত চড় বসাবে ওর গালে! হলুদ পড়লো তো পড়লো, কার উপর? তা না এই ব/দমেজাজী লোকটার উপরই পড়তে হলো।

“বিয়ে বাড়িটাকে নিজের বেডরুম ভাবলে তো চলবেনা! যেখানে হাজার জন বাইরের মানুষ থাকে, সেখানে ধিঙ্গি মেয়ে হয়ে এভাবে হলুদ নিয়ে ছোটাছুটি করছিস?;

দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলেই ক্ষান্ত হলোনা শ্রাবণ। কথাটা বলতে বলতে বলিষ্ঠ হাতে চেপে ধরলো ইশার বাহুদ্বয়। চোখ থেকে উপচে পড়ছে রা*গ। যেন গোটা খান বাড়িটাকে ভ/স্ম করবে, এই আ*গুন লাল চোখ দিয়েই।

শ্রাবণের রা*গি চোখ জোড়া বরাবরই মৃ*ত্যু ভ*য় দেয় ইশাকে। আজও তাই। ভ*য়ে তো আগে থেকেই যায় যায় প্রাণ। এখন যেন, দিশেহারা মনে হলো নিজেকে। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

“ত্ তানি আর আমি…”

“জাস্ট শাটআপ!;

ধমকের তোড়ে চুপসে গেলো ইশা। মাথা নীচু করে কাঁদতে লাগলো এবার! মানুষটা এমন কেন? অবশ্য এর জবাব ইশা ছাড়া আর কারোর কাছে মিলবেও না!

“আমার সামনে একদম এসব ন্যাকামি করবিনা! যত ন্যাকামি করার ইচ্ছা তোর প্রিয় হবু বরের সামনে গিয়ে করবি! আমার সামনে নয়। এখন যেভাবে পারবি এই পাঞ্জাবি ক্লিন করে দিবি।;

বলেই ইশাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো নিজের কাছ থেকে। ধাক্কা খেয়ে নিজেকে সামলাতে বেশ বেগ পেতে হলো ইশার। অতিকষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে অসহায় চোখে তাকালো শ্রাবণের পানে। শ্রাবণ গটগট পায়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। ইশা এখনও দাঁড়িয়ে আছে খাম্বা হয়ে। শ্রাবণ চলে গিয়ে আবারও ফেরত আসলো। পূণরায় ইশার হাত ধরে ওকে নিজের রুম থেকে বের করে দিয়ে ঠাস করে ওর মুখের সামনে দরজা লাগিয়ে দিলো। ইশা হতভম্ব হয়ে কতক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেও পারলোনা। শ্রাবণ বলল ওর পাঞ্জাবিটা ক্লিন করে দিতে। এই মুহুর্তে সেটা না করলেও আরেক বি*পদ। তাই স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শ্রাবণের রুমের বাইরে। শ্রাবণ হয়তো আশা করেনি, ইশা তার পাঞ্জাবি নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে। দরজা খুলতেই ইশাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবারও চলে গেলো। ইশা তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানার উপর পড়ে থাকা পাঞ্জাবিটা নিয়ে চলে গেলো নিজের রুমে।

তুর্জ এসেছে ঘন্টা খানিক হলো। তবে ইশার দেখা নেই। তানি এসে বলল, ইশা নাকি নিজের ঘরেই আছে। কাজ করছে। কিন্তু কি এমন কাজ আছে, যে একঘন্টা ধরেও শেষ হচ্ছে না।

“ছোট মামি, আসবো?;

“আরে তুর্জ বাবা যে। এসো এসো।;

নুপুর বেগম রান্না ঘরে কাজ করছিলেন। তুর্জ রান্না ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তুর্জকে দেখতে হাতের কাজ রেখে এগিয়ে এলেন তিনি। ভেতরে আসতে বলে জায়গা করে দিতে তুর্জ বাঁধ সাধলো। হাত কচলে কাচুমাচু করা গলায় বলল,

“না ভেতরে আসবোনা। ইশাকে দেখতে পাচ্ছি না অনেক্ষণ। তানি বলল রুমে আছে নাকি!;

“সেকি! ইশা এখনও নামেনি নীচে? এই মেয়েটারও বলি হারি যাই! এই তুতুন, তুতুন?;

“মামি কাউকে ডাকতে হবেনা। আপনি যদি অনুমতি দেন, তবে আমি গিয়ে ডেকে আনি ওকে?;

“ওমা অনুমতি দেওয়ার কি আছে বাবা? যাও তুমি। গিয়ে দেখো কি এমন রাজকার্য উদ্ধার করছে তোমার বউ!;

লজ্জা মিশ্রিত হাসলো তুর্জ। শার্টের কলার একপাশ থেকে টেনেটুনে ঠিক করতে করতে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। নুপুর বেগম সিঁড়ি অব্দি এগিয়ে দিলো তুর্জকে। তুর্জ মৃদু হেসে চলে গেলো উপরে। তুর্জ যেতেই নুপুর বেগমের সামনে এসে হাজির হয় শ্রাবণ। তুর্জকে উপরে যেতে দেখে শ্রাবণ চিন্তান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করে নুপুর বেগমকে,

“তু্র্জ কোথায় যাচ্ছে?;

“ইশার ঘরে।;

সাবলীল গলায় জবাব দিয়ে নিজের কাজে চলে গেলেন নুপুর বেগম। তবে এই সাবলীল জবাবটাই কাটার মতো বিঁধে গেলো শ্রাবণের গলায়। উপরে কেউ নেই, একমাত্র ইশা ছাড়া! কথাটা ভাবালো তাকে। তু্র্জর উপরে যাওয়ার প্রয়োজনটা কি? অবশ্য, প্রয়োজনের কাজ ক’টাই বা করে তুর্জ!

দরজায় দু’বার টোকা পড়লো ইশার। তবে ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেলোনা। তুর্জ আশেপাশে একবার তাকালো। পুরো দোতলা খালি। তাই আর আগেপাছে কিছু না ভেবে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। অবশ্য ভেতরেও ফাঁকা। ইশাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। পুরো ঘর ছানমান করতেই ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ হলো। শব্দের উৎস ধরে পেছন মুড়ে তাকাতেই থমকে গেলো তুর্জ। আধভেজা শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমের দরজা খুলে বের হলো ইশা। হাতে ধরে রাখা সাদা একটা পাঞ্জাবি। মূলত সেদিকে তার ভ্রূক্ষেপ নেই বললেই চলে। তার ভ্রুক্ষেপ কেবল এই তীব্র বাসনার মেয়েটিকে নিয়ে। ভেজা শাড়ি খানিকটা শরীরের সাথে লেপ্টে গেছে ইশার। চোখের ক্ষুধা মিটিয়ে দেখছে তু্র্জ। এদিকে ইশার মাথাতেও আসেনি, তার ঘরে অনাকাঙ্ক্ষিত কারোর আগমন ঘটেছে।

ব্যালকনিতে শ্রাবণের পাঞ্জাবিটা শুকাতে দিয়ে নিজের ভাবনাতেই আবার ফিরে এলো ঘরে। ভেজা শাড়িটার পানি ঝাড়তে ঝাড়তে ওয়ারড্রবের কাছে এগিয়ে আসতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো ইশা। আঁতকে উঠে দু’পা পিছিয়ে পড়ে বির*ক্ত গলায় শুধালো,

“আ্ আপনি! আপনি এখানে কেন? কি করছেন?;

ইশার গলায় ধ্যান ভাঙে তুর্জর। ফট করে নিজের চোখ নামিয়ে নেয় ইশার থেকে। নীচের দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকে বলে,

“আমি অনেক্ষণ যাবত তোমার অপেক্ষা করছিলাম। তুমি নামছো না ভেবে চলে এলাম খোঁজ করতে।;

ইশা ভেতরে ভেতরে রা/গে ফেটে পড়লো। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো দরজাটা খোলা। দরজা তো সে লক করে দিয়েছিলো! খুললো কেমন করে? মনেমনে রা/গান্বিত হয়ে সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করলো তুর্জকে,

“আপনি ভেতরে এলেন কি করে? দরজা তো লক করা ছিলো!;

ইশার প্রশ্নে পেছন মুড়ে দরজার দিকে একবার তাকালো তুর্জ। নিজেকে নির্দোষ প্রমানে বলল,

“নো নো নো, দরজা লক ছিলোনা ট্রাস্ট মি! লক থাকলে আমি কেমন করে আসবো?;

গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো ইশা। বলল,

“ঠিকাছে, আপনি নীচে যান। আমি চ্ চেঞ্জ করে আসছি।;

কথাটা বলতেও মুখে বাঁধলো ইশার। তাকে এই অবস্থায় দেখেও লোকটা দাঁড়িয়ে ছিলো এতক্ষণ। কমন সেন্সও নেই নাকি!

তু্র্জ মুচকি হেসে মাথা দুলিয়ে প্রস্থান করলো। তুর্জ যেতেই বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়লো ইশা। কেমন লোকরে বাবা। সামান্য কমন সেন্স বলতে কিছু নেই।

হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হলো সবে। হলুদের সরঞ্জাম লোক দিয়ে সরিয়ে কালকের বিয়ের আয়োজন শুরু হলো পূণরায়। সন্ধ্যা থেকে রাত ৮টা অব্দি সবার সাথে আড্ডা দিয়ে ফিরে গেছে তুর্জ। যাওয়ার আগে জানিয়ে গিয়েছে কাল সকাল সকাল চলে আসবে বাবা-মাকে সাথে নিয়ে। যাওয়ার আগে ইশাকে এক মুহুর্তের জন্য একা চাইলেও, সম্ভব হলোনা। তাই মনে একরাশ আক্ষেপ নিয়েই যেতে হলো তাকে। তবে মনেমনে আজকের ঘটনাটি এখনও খোদাই হয়ে আছে যেন। ইশার আকর্ষণীয়ে দেহটি সে কোনো ভাবেই ভুলতে পারছেনা। কবে, এই মেয়েটাকে নিজের বউ করে পাবে! কি করে নিজেকে সামলে রাখবে একটা বছর!

রাত ১১টা। ছাদে উঠলো এক গাদা মানুষ। সঙ্গে উঠেছে বিয়ের কনে, ইশা, তুতুন, তানি, আরব এবং শ্রাবণ। এখন জমিয়ে কফির আড্ডা হবে। যে যার জীবনের এক একটা স্মরণীয় হাসির গল্প বলে শোনাবে। যদি সেই হাসির গল্পে একাধিক লোক হাসে, তবে তার জন্য গিফ্ট থাকবে। খেলাটি ভীষণ মজার। কিন্তু ইশার অংশগ্রহণ করা হলোনা। সবার জন্য কফি বানানো, নিয়ে আসা, সার্ভ করা সবটাই তার ঘাড়ে এসে পড়লো। আড্ডায় যোগ হলো তিতিরের মামাতো এবং খালাতো ভাই বোনরা। শ্রাবণের বন্ধুরা। আরবেরও গুটি কয়েক বন্ধু এলো আজ। এখন তারাও আছে এই আড্ডায়। আরও আছে তুতুনের দু’জন বান্ধবী, তানির তিনজন বান্ধবী। তবে একলা বাদ পড়লো ইশার একমাত্র বান্ধবী নামিরা। নামিরার না আসার কারনটা একটু ব্যক্তিগত। যা তার বেস্ট ফ্রেন্ডকেও সে জানায়নি।

ট্রেতে প্রায় ৭টা কফির কাপ নিয়ে সিঁড়ি গুনে গুনে উঠছে ইশা। পেছনে আছে লতিফা, ওর হাতেও আরেকটা ট্রে যেটাতে বিস্কুট, চানাচুর,আর মুড়ি রাখা। দু’জনেই ধীরেধীরে উঠছে উপরে। নীচে আরও কয়েকটা কাপ সাজিয়ে রেখে এসেছে। একটা দিয়ে আবার যাবে আরেকটা আনতে। দু’জনেই আতংকে কাঁপছে যদি কোনো ভাবে পড়ে যায়, সেই ভ*য়ে! এক সিঁড়ি উঠছে তো এক সিঁড়ি থামছে।

“ইয়েস বস। ইয়া ইয়া, আজ রাতেই সাবমিট করে দিচ্ছি। ইয়াহ্।;

গলার স্বরটা ভীষণ কাছ থেকেই ভেসে আসছিলো। হঠাৎ বাতাসের গতীতে ইশাকে পাশ কাটিয়ে গেলো কেউ। তবে মানুষটা এতোটাই দ্রুত নেমে গেলো যে, থরথর করে কাঁপতে থাকা কফির কাপ গুলো মুহুর্তেই উল্টোপাল্টে গেলো। কিন্তু গেলোনা, একজোড়া হাত এসে শক্ত করে ধরে ফেললো ট্রেটা। ইশা আতংকে বিমুঢ় হয়ে গেলো ক্ষণেই। চোখ জোড়া বড়বড় করে ট্রেটার দিকে তাকাতেই দেখলো কাপ গুলো হেলতে দুলতে আবার স্থীর হয়ে গেলো। ইশা দম আঁটকে সম্মুখে তাকাতেই দেখলো রা*গি চোখে তাকিয়ে আছে শ্রাবণ। পাশ থেকে লতিফা খানিক ফ্যাকাসে গলায় বলে উঠলো,

“ভাইজান আপনের মুবাই!;

শ্রাবণ লতিফার কথায় কোনো ভ্রুক্ষেপ করলোনা। তার রা*গি চোখ এখনও ইশার উপরই এঁটে আছে। ইশা পাশ ফিরে লতিফার দৃষ্টি অনুসরণ করে নীচে তাকাতেই আরেকদফা আঁতকে উঠলো। ফের পূনরায় ভ*য়াতুর নয়নে শ্রাবণের পানে তাকাতেই শ্রাবণ ধমকে বলে উঠলো,

“তোর কি কোনোদিন আক্কেল হবেনা? এতো বড় মেয়ে, হাঁটুতে বুদ্ধি নিয়ে ঘুরিস!;

ধমক খেয়ে আঁতকে উঠলো ইশা। খিঁচে চোখ জোড়া বন্ধ করে কুঁজো হয়ে পড়লো কিঞ্চিৎ। রা*গে শ্রাবণের মাথা ফেটে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে একটা চড় বসাতে, এই বোকা মেয়েটাকে।

ইশা কান্না জড়ানো কম্পিত স্বরে বলল,

“আ্ আমি কি করেছি! আমাকে কেন বকছো?;

“তোকে কফি আনতে কে বলেছে?;

“ছাদে স্ সবাই কফি খাবে বলল!;

“তো, তাই বলে সব গুরু দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিবি? মা, ছোট মা নেই? তোর মতো বলদকে দিয়ে কেন এসব কাজ করাতে যায়?;

“আমি.. আমি বলদ! তুমি কিন্তু..;

“আর একটা কথা বললে থাপড়ায় দাঁত ফেলে দিবো।;

চুপসে গেলো ইশা! ওর মুখে আর কথা আসলোনা। শ্রাবণ পূণরায় দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“এতো গুলো মানুষ কফি খাবে আর উনি নাচতে নাচতে কাপে করে কফি নিয়ে চললেন! ইচ্ছে করছে মাথায় তুলে আছাড় মা*রি! বাসায় ফ্লাক্সের অভাব? ফ্লাক্সে করে নিয়ে গিয়ে সবাইকে দিতে পারলিনা! এই তোর ঘটে কি আসলেই বুদ্ধি নেই? এতো হাঁদা তুই?;

ইশার মনেমনে অনেক কথা জমলো! কিন্তু এই মানুষটাকে কিছু বলার বোকামি সে করবেনা। তাই কোনো কথা না বলে চলে যেতে নিলেই খেতে হলো আরেক ধমক!

#চলবে