ডাকপিয়নের ছুটি নেই পর্ব-০৭

0
344

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব____০৭

ঘরভর্তি সাঝের গহনা,শাড়ী,জুতো,ফুল,মালা,মেকআপ আরও অনেক জিনিস ছড়িয়ে আছে তিতিরের। লোকজন ঘরে ঢুকছে, বের হচ্ছে কোনো ধ্যান নেই যেন তার। সত্যি বলতে নিজেকে বড্ড হালকা লাগছে নিজের কাছে! মনে হচ্ছে সে এই দুনিয়াতেই আর বেঁচে নেই। ম*রে গেছে! অনেক পূর্বেই ম*রে গেছে। এতো বছরের ভয়টাই তবে সত্যি হলো! সে বিনা অপরাধেও ফেঁসে গেল। আচ্ছা, সবাই সবটা জানলে কি তাকেই ভুল বুঝবে? আর এই বিয়েটা? সেটাও কি ভেঙে দিবে! সর্বপরি তার স্বামী, সেও কি ছেড়ে দিবে তাকে?

আর যেন ভাবতে পারছেনা তিতির। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। বুঝি, এটাই তার জীবনের পরে থাকা অবশিষ্ট সময়। আচ্ছা, এই শেষ মুহুর্তে সে কাকে ডাকবে? কে বুঝবে তাকে? কে বলবে, তিতির তুই নির্দোষ আর সেটা আমি বিশ্বাস করি। তুই একদম চিন্তা করিসনা।

“আপা? কি হয়েছে তোর!;

সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইশা। তার কপালের মাঝে চিন্তার অগণিত ছাপ। মুখ কুঁচকে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। হয়তো, তিতিরের এই বিধ্বস্ত অবস্থা নিয়ে ইশার মাথা ব্যাথা হবে! তিতিরের হঠাৎ মনে পড়লো, ইশাই সেই মানুষ, যে তার মাথায় হাত রেখে বলবে, সে তাকে বিশ্বাস করে। সে জানে তার আপা কখনোও এমন কাজ করবেনা।

“ইশা..;

হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো তিতির। ইশা হকচকিয়ে গেলো তিতিরের এহেম কান্না দেখে। বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠলো যেন। তিতির ওর কোমর জড়িয়ে আরও জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো। তিতিরের এমন কান্না দেখে ভীত হয়ে গেলো ইশা। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো,

“এই আপা? ক্ কাঁদছিস কেন? বল আমাকে?;

“আ..আমার সব শেষ হয়ে গে..লো রে বোন! আমার সব শেষ হয়ে গেলো।;

কাঁদতে কাঁদতে বলল তিতির। ইশার হৃৎস্পন্দন খুব দ্রুত কাঁপতে লাগলো। কি হলো তিতরের? তিতির ভীষণ নরম স্বভাবের মেয়ে। অল্পতেই কেঁদে ভাসিয়ে দেওয়া কিংবা, তার মন ভাঙা খুব সহজ। তবে তার আজকের কান্নায় একটু ভিন্নতা আছে যেন।

“বল আমাকে? কি হয়েছে! ক্ কেউ কি কিছু বলেছে? শাকিল ভাইয়া? শাকিল ভাইয়া কি…;

“ন্ না! না, কেউ কিচ্ছু বলেনি!;

“তাহলে এমন করে কাঁদছিস কেন? বলনা আমাকে? তোর কান্না দেখতে আমার ভালো লাগছেনা। আমারও কান্না পাচ্ছে আপা! বল না, প্লিজ?;

“ইশা রে! আ্ আমার ম..মনে হয় ম*রে যাওয়া উচিৎ!;

ভঙ্গ হৃদয়ে কথাটা বলে আবারও হুহু করে কেঁদে উঠলো তিতির। ইশা আহত নয়নে তাকালো বোনের পানে! কিঞ্চিৎ রাগ মিশ্রিত গলায় বলল,

“আপা! কি বলছিস যা-তা? কি হয়েছে বল আমাকে? এভাবে কাঁদলেই কি সবটা ঠিক হয়ে যাবে?;

“না রে! আমি ম*রে গেলেই সবটা ঠিক হয়ে যাবে। আমি এভাবে বেঁচে থাকতে পারবোনা!;

“আবার! আবার ঐ একই কথা? তুই কি পাগল হলি আপা? শ্রাবণ ভাইকে ডাকবো? তুই কি শ্রাবণ ভাইকে বলবি?;

ভাইয়ের নামটা শুনতেই আতংকে কেঁপে উঠলো তিতির। ইশার হাতটা খামচে ধরে আতংকিত গলায় বলল,

“ন্ না না! ভাইকে ডাকবিনা প্লিজ। ভাই জানলে আমাকে ও নিজেই মে/রে ফেলবে!;

“কি যা-তা বলছিস তুই? আচ্ছা তোর ফোনটা দে। আমি শাকিল ভাইকে একটা কল দেই। তুই তার সাথে কথা বল। দেখবি ভালো লাগবে।;

“ন্ নারে! কেউ আমাকে বুঝবেনা, কেউনা!;

“কি হয়েছে প্লিজ আমাকে খুলে বল? এভাবে কান্নাকাটি করা মোটেও কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারেনা। এই কথা কিন্তু তুই-ই আমাকে বলতিস। মনে আছে?;

তিতির যেন খানিক ভরসা পেলো। নিজেকে ধাতস্থ করতে চেষ্টা করে চোখের জল মুছে তাকালো ইশার পানে। ইশা প্রশ্ন বিদ্ধ নয়নে চেয়ে আছে তার দিকে। তিতির ইশার হাতটা ধরে কম্পিত কণ্ঠে শুধালো,

“তুই আমাকে বিশ্বাস করিস ইশা? তোর কি মনে হয় আমি কখনোও কোনো নোংরা কাজ করতে পারি?;

ইশা বিস্মিত হলো তিতিরের প্রশ্নে। তবুও, অটুট বিশ্বাসের সঙ্গে বলল,

“তোকে অবিশ্বাস করার কোনো প্রশ্নই আসেনা আপা। তুই হলি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বোন। আমি সবসময় উপরওয়ালার কাছে কি প্রার্থনা করি জানিস? তোর মতো একটা বড় বোন যেন সব ঘরে জন্মায়। ইউ আর দ্য বেস্ট আপা!;

তিতিরের কথায় আবারও কান্নার বেগ চেপে বসলো। সে যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা, ইশা তাকে এতোটা বিশ্বাস করে, এতোটা ভালোবাসে।

“এবার বলবি, কি হয়েছে?;

তিতির নিজেকে আরেকটু শান্ত করার চেষ্টা করে। তখনও তার চোখের কোন গড়িয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। এবার ইশা সেটা নিজের হাতে মুছিয়ে দিয়ে তিতিরের কপালে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে বলল,

“ভাই ভাইকে অবিশ্বাস করতে পারলেও, একজন বোন কখনোও তার বোনকে অবিশ্বাস করতে পারেনা। জানিস না বুঝি তুই?;

তিতির চোখের জল মুছে উপরনীচ করে মাথা নাড়ে। অতঃপর প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে ইশাকে টেনে তার পাশে বসায়। পাশে পড়ে থাকা ফোনটা তুলে ইশার হাতে দেয়। ফের কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,

“স্ সাজিদ কে মনে আছে তোর? আমার ভার্সিটির সিনিয়র ছিলো! যার প্রতি আমার অনেক ক্রাশ ছিলো?;

ইশা তিতিরের ফোনটা হাতে নিতে নিতে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে।

“মনে আছে। কিন্তু হঠাৎ সাজিদের কথা কেন বলছিস?;

“ওর মতো নোংরা মানুষ পৃথিবীতে আর দুটো নেই রে বোন! ও আমাকে ব্ ব্ল্যাক মেইল করছে!;

“মানে! ওর সাথে কি তোর প্রেম হয়েছিলো নাকি?;

তিতির না সূচক মাথা নাড়ে। বলে,

“না! আমি ওকে পছন্দ করি এটা জেনেই ও আমার সাথে মজা নিচ্ছিলো। আ্ আর আমি বোকার হদ্দ কখনোও বুঝছেই পারিনি!;

“ও জানতো তুইওকে পছন্দ করতিস?;

“হু।;

“তারপর?;

“তখন আমি ফ্রেশার্স ছিলাম। একদম নিউ স্টুডেন্ট। কিছু বোঝার আগেই যেন শেষ হয়ে যাচ্ছিলো সব। কারোর সাথে তেমন একটা ভাবও হয়নি। তাই সিনিয়ররা অর্থাৎ, সাজিদ আর ওর ফ্রেন্ডসরা মিলে একটা গেট টুগেদার পার্টি অ্যারেঞ্জ করে। যেহেতু পার্টিটা আমাদের জন্য, সেহেতু আমাকে স্পেশালি ইনভাইট করে। সাজিদের একটা ফ্রেন্ড আমাকে বলেছিলো, এই পার্টি অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে। এই পার্টির মূখ্য উদ্দেশ্যই হচ্ছে, নিউ স্টুডেন্টদের মাঝে একটা ভালো বন্ডিং ক্রিয়েট করা। আমি শুনে ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, এই সুযোগে আমার হয়তো নিউ ফ্রেন্ড হবে। বাসায় মিথ্যে বলে আমি যাই ঐ পার্টিতে। এমনকি ভাইকেও কোনো ভাবে জানতে দেইনি। আমি জানতাম, ভাইকে জানালে ভাই কখনোও আমাকে যেতে দিবেনা। দরকার পড়ে, ঐ পার্টি আমাদের ঘরে হবে।;

“তারপর?;

“তারপর আমি বিকালের দিকে চলে যাই সাজিদের বাসায়। আমাকে আগে থেকেই ঠিকানা দেওয়া হয়েছিলো ওখানের। ওখানে গিয়ে দেখি সব এলাহি কান্ড। রাজপ্রাসাদের মতো একটা বাড়ি। আমি রিক্সা থেকে নামতেই দারোয়ান গেট খুলে আমাকে সোজা বাসায় চলে যেতে বলে। আমি তার কথা মতো সোজা গিয়ে ঢুকলাম বাসার ভেতরে। জানিস, ভেতরে ঢুকে বোঝারই উপায় ছিলোনা এখন রাত না দিন। লাল-নীল বাতি জ্বলছে। ডিজে বাজছে। আর তার মাঝে এক গাদা ছেলে মেয়ে পাগলের মতো নাচানাচি করছে। প্রথমে আমার খুব অকোয়ার্ড লাগলেও যখন সাজিদকে দেখলাম, বিশ্বাস কর কিশোরী মনের সব খারাপ লাগা উবে গেলো। সাজিদ আমাকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলো। আমাদের ক্লাসের অনেকেই ছিলো ওখানে! সবার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো। পরিচয় হয়ে আমারও খুব ভালো লাগছিলো। ক্ কিন্তু এরপর যা হলো…;

আতংকে পূণরায় কেঁপে উঠলো তিতির। ইশা তার হাতটা শক্ত করে ধরলো। মাথায় হাত রেখে বলল,

“আমি তোকে বিশ্বাস করি আপা। আমি জানি তুই কিছু করতে পারিসনা।;

“ব্ বোন, আমি জানিনা সাজিদ শরবতের নাম করে আমাকে কি দিয়েছিলো! আমি কোনো গন্ধও পায়নি। আমার মনে হয়েছিলো, এটা কোনো দামী কিংবা বিদেশি শরবত। আমি বিনা বাক্যব্যয়ে ওটা খেয়ে নেই! ত্ তারপর, হঠাৎ হঠাৎ কেমন মাথা ঘোরাতে আরম্ভ করলো। আ্ আমি যখন সাজিদকে বললাম, সাজিদ আমাকে ওর রুমে নিয়ে গেলো! আমার স্পষ্ট মনে আছে, ও আমাকে রেস্ট নেয়ার কথা বলে রুম থেকে ব্ বেরিয়ে যায়। ত্ তারপর হঠাৎ…;

থেমে গেলো তিতির। কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার। আবারও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। বাকিটা বুঝে নিলো ইশা। আর কিছু না ভেবে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তিতিরকে। তিতিরকে জড়িয়ে রেখেই তার ফোনটা ওপেন করলো ইশা। তবে যা দেখলো, সেটা দেখার জন্য যেন মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা। কিন্তু ছবি পাঠানো হয়েছে। ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, তিতিরকে একটা ছেলেকে কিস করছে! তবে ছেলেটা ক্যামেরা থেকে উল্টো থাকায় তার মুখটা একদমই বোঝার উপায় নেই। কেবল তিতিরকেই দেখা যাচ্ছে এখানে। ছবির নীচে একটা ম্যাসেজও আছে!

“সেই থাপ্পড়টা কিন্তু আমি আজও ভুলিনি তিতিরপাখি! সো? লেটস্ টেইক আ রিভেঞ্জ!;

ইশার কাছে এবার যেন সবটা পরিষ্কার হয়ে গেলো। সে তিতিরকে নিজের থেকে টেনে তুলে বলল,

“ও তোর সাথে জোর করে খারাপ কিছু করতে চেয়েছিলো? তাইনা!;

“হ্ হ্যাঁ! শুধু আমার সাথে নয়, ও সব মেয়েদের সাথেই এমন করে। হয়তো ভাগ্যক্রমে আমার সর্বনাশ ও করতে পারেনি! আর এসব নোংরামি করার জন্য আমি ওকে থাপ্পড়ও দিয়েছিলাম। আর আজ ও সেটাই রিভেঞ্জ নিতে..;

“বুঝে গেছি। আপা, তুই একদম চিন্তা করিসনা। তোর বোন থাকতে কারোর বাপের সাধ্য নেই তোকে সবার চোখে ছোট করবে! মে/রে একদম পুঁতে দিবো মাটিতে। আমি তোর ফোনটা নিয়ে গেলাম।;

“ক্ কোথায় যাচ্ছিস?;

“এই সমস্যার সমাধান করতে। তুই নিশ্চিন্তে কনে সাজতে শুরু কর আপা, তোর বোন এসে তোকে তুলে দিবে। প্রমিজ। আমি তোর গায়ে কলঙ্কের দাগ কেন, একটা ফুলের টোকাও পড়তে দিবোনা!;

“ক্ কিন্তু বোন!;

“কোনো কিন্তু ফিন্তু নেই। যা বললাম, কর। আমি আসছি!;

তিতিরের ফোনটা নিয়ে বেরিয়ে এলো ইশা। আশেপাশে একবার তাকিয়ে এক দৌড়ে চলে গেলো শ্রাবণের ঘরে। শ্রাবণ তার বড় খালুকে নিয়ে সবেই ফিরলো বাসায়। ক্লান্ত আর বির*ক্ত ভাবটা মিলেমিশে জগা খিচুড়ি পাকিয়ে আছে। ঘামে ভেজা শার্টটা চেঞ্জ করার খাতিরে আলমারি থেকে একটা নতুন শার্ট বের করতে করতে তার দুই বন্ধু আকাশ এবং তমাল এসে হাজির হলো। শ্রাবণ ওদের দু’জনকে বসতে বলে ওয়াশরুমে ঢুকবে ঠিক তখনই ঝড়ের গতিতে এসে হাজির হলো ইশা। ইশাকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে কপালে বির*ক্তির ছাপ ফেলে তাকালো শ্রাবণ। ইশা তার সামনে এসে দাঁড়াতে বন্ধুরা যেন শুনতে না পায়, ঠিক তেমন করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“এতো বড় হয়েছিস, এখনও কমন সেন্স বলতে কিছু হয়নি?;

“তোমার সাথে আমার জরুরি কিছু কথা আছে!;

যেন শ্রাবণের গম্ভীর গলাটা উপেক্ষা করলো ইশা। ঘনঘন দম ফেলে কথাটা বলে তবেই ক্ষান্ত হলো।

“সময় নেই। পরে।;

“অনেক বেশি ইম্পরট্যান্ট শ্রাবণ ভাই!;

“তোর ইমপরট্যান্ট তোর কাছে রাখ! আমার সময় নেই।;

এই বলে শ্রাবণ ওয়াশরুমে চলে যেতে নিলে ইশা তার হাত টেনে ধরে। জেদ ধরা গলায় বলে,

“আমার কথাটা না শুনলে অনেক বড় বিপদ হয়ে যাবে। প্লিজ?;

“ধের!;

রেগে গেলো শ্রাবণ। ইশার থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে তার শার্টটা ধরিয়ে দিলো ইশার হাতে। অতঃপর বন্ধুদের নিয়ে চলে গেলো ঘর থেকে! শ্রাবণ চলে গেলে হতাশ দৃষ্টিতে তাকায় ইশা! এবার কি করবে ও? কি করে এই ফাঁদ থেকে তিতিরকে বাঁচাবে!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে