Wednesday, July 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 392



ডাকপিয়নের ছুটি নেই পর্ব-০২

0

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_২

“তুমি মরিয়মের মেয়ে না? নামটা যেন কি?;

তিতিরকে নিয়ে স্টেজে বসানো হলো। সঙ্গে আছে তুতুন এবং তানু। বোনের দু’পাশে জায়গা দখল করে বসে আছে দু’জনে । ইশানি তিতিরকে বসিয়ে দিয়ে নীচে নামার সময় কেউ একজন তার হাতটা টেনে নিয়ে হঠাৎ প্রশ্নটা করলেন। ইশানি একটু চমকালো আকস্মিক টান পড়াতে। নিজেকে ধাতস্থ করতে কয়েক মুহুর্ত সময় নিয়ে হাসি মুখে জবাব দিলো,

“জি। আমার নাম ইশানি।;

মহিলা ফকফকা দাঁতের হাসি দিলো। হলদেপাখিকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে ফের বলল,

“দেখেই চিনেছি। এই খান বাড়িতে এতো সুন্দর পরীর মতো মেয়েটা আমাদের ইশানিই হবে।;

কথাটা ঠিক পছন্দ হলোনা ইশানির। তার বাকি তিন বোনও ভীষণ সুন্দর। এককথায়, একেবারে চোখে লাগার মতো। কিন্তু বাঙালি সর্বদা গায়ের রঙ দিয়েই বিচার করতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ইশানি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে মহিলার কথার প্রতিবাদ করে বলল,

“এটা আপনি ভুল বললেন আন্টি। আমাদের বাড়ির সব মেয়েরাই কিন্তু পরী সমতুল্য। আমি তো বলি, পরির চেয়েও বেশি মায়াবতী।;

মহিলার মুখ খানা খানিক কাচুমাচু হয়ে এলো। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলল,

“একদম একদম। তা বলছিলাম যে, শাড়িতে কিন্তু তোমাকে একদম নতুন বউয়ের মতো লাগছে। বুঝতেই পারছিলাম না, কার হলুদে এসেছি!;

শাড়ি’ শব্দটা মাথায় বাজলো ইশানির। মনে পড়লো শ্রাবণের দেওয়া ডিরেক্ট হু/ম/কি/র কথা! শাড়িটা ওকে পাল্টাতে হবে, ভুলেই গিয়েছিলো কয়েক মুহুর্তের জন্য। মহিলার কথায় আর জবাব দিতে পারলো না ইশানি। তাড়াহুড়ো করে ছুটে গেলো নিজের রুমে। এবার রুম ফাঁকাই পেলো। সবার আগে রুমের দরজাটা লক করে খানিক সস্তির নিঃশ্বাস নিলো। শ্রাবণকে আর কোথাও দেখেনি। হয়তো নিজের রুমেই আছে। আরব ভাই বলছিলো, তুর্জকে আরেকবার কল করতে! কিন্তু ওর যে মোটেই ঐ মানুষটাকে কল করতে ইচ্ছে করেনা। মানুষটা যে বড্ড সুযোগ সন্ধানী। কিন্তু করবে তো করবে কি? সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কল দিয়েই দিলো তুর্জর নাম্বারে। কয়েক সেকেন্ড পেরোতে কল তোলে তুর্জ,

“আজ সূর্য কোন দিক থেকে উদয় হলো?;

তুর্জর কথা শুনে মৃদু হাসার চেষ্টা করলো ইশানি। তবে সেই হাসি এলোনা যেন ঠোঁটের কোনে।

“আজকে আসছেন তো?;

“তুমি বললে!;

“বড় মামা বারবার বলছিলো আপনার কথা। হাতে একটু সময় নিয়ে চলে আসেন।;

“জো হুকুম মহারানী।;

“হু, ছাড়ছি।;

“সেকি কথা? কল দিলেই রাখি রাখি করো কেন বলোতো? এই পাগল বরটার সাথে দু’দন্ড কথা বলা যায়না?;

“ছোট মামি বলে, বিয়ের আগে এতো কথা না বলাই ভালো। বিয়ের পর অঢেল সময় হবে কথা বলার!;

“কিন্তু মহারানী, বিয়ের আগের যে নবজাত অনুভূতি, সেটা তো বিয়ের পর হবেনা! এজ লাইক, আমাদের ফার্স্ট ডেট, ফার্স্ট হাগ, ফার্স্ট কি…;

“আমার হাতে অনেক কাজ পড়ে আছে। পরে কথা হবে।;

বলেই কলটা কেটে দিলো ইশানি। এই তো সবে শুরু। খানিক বাদে লোকটা বিছানা অব্দি চলে যাবে তার নবজাত অনুভূতি নিয়ে। ফোনটা বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলে উঠে গেলো। আলমারিটা খুলে শুরু করলো চিরুনি তল্লাশি। তবে, আশানুরূপ ভাবেই হতাশ হতে হলো। কেননা সে জানতো হলুদের জন্য তেমন বিশেষ কোনো পোশাক পাবেনা। তার মানে, শ্রাবণের আদেশ মোতাবেক হলুদ শেষ না হওয়া অব্দি তাকে নিজের ঘরেই থাকতে হবে।

হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। খান সাহেব এবং তার বউ আনোয়ারা অর্থাৎ তিতিরের দাদা-দাদী সবার প্রথমে হলুদ ছোঁয়ালেন আদরের নাতনিকে। তারপর এলেন আফিয়া বেগম, নুপুর বেগম এবং মরিয়ম বিবি। সবাই মিলে একে একে হলুদ মাখাতে লাগলেন। অতঃপর এলেন বাড়ির বাবা-চাচারা। সবার হলুদ মাখানো শেষ হতে এবার খোঁজ পড়লো ছোটদের। ছোটদের মধ্যে গন্য হলো বাড়ির ছেলে-মেয়েদের। আরব, শ্রাবণ, তুতুন, তানি এবং ইশানি। আরব তিতিরকে হলুদ মাখাতে গিয়ে ভূত করে ফেললো। সে নিয়ে শুরু হলো তোলপাড়। হাসাহাসির রোল পড়লো ক্ষণেই। আরব বকাও খেলো নিজের মায়ের কাছে। মেয়েটাকে এত সুন্দর করে সাজানো হলো, ভালো ছবি ওঠার আগেই ভূত করে ফেললো। আরব বকা খেয়ে শ্রাবণের কাছে গিয়ে দুঃখ বিলাস করতে চাইলে আরেক দফা ধমক পড়লো তার কপালে।

সবশেষে খোঁজ পড়লো ইশানির। প্রায় অনেক্ষণ কারোর চোখে পড়েনি সে। একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে আফিয়া বেগম আরবকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন,

“ইশা কই রে? অনেক্ষণ যাবত নিখোঁজ। তিতিরকে হলুদ মাখাবে না?;

আবর এবং মায়ের পেছনেই দাঁড়িয়ে ফোন টিপছিলো শ্রাবণ। মায়ের প্রশ্নে সে মুখ তুলে আড়চোখে একবার তাকালো চারপাশে। অনেক্ষণ যাবত সেও দেখেনি তাকে! তবে কি, ম*রা*র ভয়ে নিজের ঘরে ঘাপটি মে*রে*ছে, নাকি হবু বরের সঙ্গে টাইম স্পেন্ড চলছে?

“ভালো কথা বলেছো তো বড় মা! আমিও ওকে দেখছিনা অনেক্ষণ হলো।;

আশেপাশে দেখতে দেখতে বড় মায়ের ন্যায় দুশ্চিন্তাগ্রস্থ কন্ঠে বলল সে।

“এই তুতুন?;

হাত উঁচিয়ে ডাকলো তুতুনকে। ভাইয়ের ডাক পেয়ে দৌড়ে এলো তুতুন।

“হ্যাঁ ভাইয়া, বল!;

“ইশু কই?;

“মেঝআপা.. এখানেই ছিলো?;

সেও দৃষ্টি বুলালো চারপাশে। কোথাও দেখতে না পেয়ে বলল,

“মনে হয় ঘরে।;

“এই সময় ঘরে কি করছে?;

শুধালেন আফিয়া বেগম। তুতুন ভাবুক কন্ঠে বলল,

“জানিনা গো বড় মা। মনে হয় তুর্জ ভাই কল করেছে। কথা বলছে হয়তো!;

“কাজের সময় কথা বলতে হবেনা। বোনের বিয়েতে একটু মন খুলে আনন্দ করবেনা? এখন কথা বললে হবে? যা-তো, ডেকে নিয়ে আয়। বল আমি ডাকছি।;

“ওকে বড় মা।;

আবারও দৌড়ে চলে গেলো তুতুন। আফিয়া বেগমের কপালের মাঝে তীক্ষ্ণ ভাজ। তিনি জানেন না কেন, তবে তুর্জকে সে ঠিক পছন্দ করতে পারেন না। দেখেই কেমন অস্বাভাবিক মনে হয়। মনে হয় যা সে নয়, সেটাই তুলে ধরার চেষ্টা করে। জানেনা, সবাই মিলে মেয়েটার ভবিষ্যত ন*ষ্ট করছে কিনা!

দরজায় দু’বার টোকা পড়তেই দরজার পানে তাকালো ইশানি। সম্মুখ পানে বড় একটা ড্রেসিং টেবিল। বড় আয়নাটায় নিজেকে আপাদমস্তক একবার দেখে, গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“কে?;

জবাব এলোনা কোনো। নীচে সাউন্ড বক্স বাজার কারনে আরও শোনা গেলোনা। জবাব না এলেও দ্বিতীয় পূণরায় টোকা পড়লো দরজায়। ইশা এবার উঠে দাঁড়ালো। কে’ আরেকবার জিজ্ঞেস করতে করতে দরজা খুলে দিলো।

“ত্ তুমি!;

শ্রাবণ দাঁড়িয়ে আছে গম্ভীর মুখে।

“এখনও এই বেহুদা পোশাকে?;

“ত্ তো কি করবো? দেখনি সেদিন.. শপিংমলে! তিতির আপু বলছিলো সবাই সেম শাড়ি নিবে! তাই বড় মামিও আমাকে শাড়ি দিলো। এখন, এই মুহুর্তে আমি নতুন ড্রেস কোথা থেকে জোগাড় করবো?;

“জানিনা।;

“না জানলে কেন বলছো চেঞ্জ করতে?;

কথাটা বেশ বির*ক্ত নিয়েই বলল ইশানি। সঙ্গে সঙ্গেই গরম চোখে তাকালো শ্রাবণ। যা দেখতেই তুবড়ে গেলো সে। দরজা ছেড়ে সরে গেলো ভেতরে। রা/গ থাকবে সর্বদা নাকের ডগায়! এমন মানুষ গোটা জন্মে দেখেনি ইশানি। শ্রাবণ ইশানির পানে রা/গি চোখে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠলো,

“নেক্সট টাইম থেকে এসব বেহুদা পোশাক পড়তে দেখলে!(দাঁতে দাঁত চেপে) যা নীচে যা। সবাই খুঁজছে তোকে ;

প্রথম রাগ, পরক্ষণেই আবার নরম হতে দেখে চোখ জোড়া বড়বড় হয়ে গেলো ইশানির। বিহ্বল গলায় শুধালো,

“আমাকে ‘তুমি বলছো নীচে যেতে?;

এবার বির*ক্তির দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো শ্রাবণ। বলল,

“যেতে বলেছি তো!;

ইশানির আনন্দ হলেও প্রকাশ করতে পারলোনা। বেটা খারাপ, কিন্তু একটু ভালো খারাপ। খারাপ খারাপ না।

আর কোনো জবাব দিতে গেলেও ধমক খেতে হবে ইশাকে। তাই শাড়ির কুঁচি আগলে দ্রুত পায়ে ছুটলো নীচে। পেছনে বিছানার উপর পড়ে রইলো ওর ফোনটা। ওর ফোনটা দেখতেই একবার পেছন মুড়ে তাকালো শ্রাবণ। না, ইশা আর ফোন নিতে আসবেনা। তাই কিছু না ভেবেই ফোনটা হাতে তুলে নিলো। ভেবেছিলো লক করা থাকবে। তবে তাকে প্রশান্তি দিতে ফোনটা আনলক করাই ছিলো। শ্রাবণ আর সাত-পাঁচ না ভেবে কল লগে ঢুকলো। তুর্জর নাম্বারে কল গিয়েছিলো। তবে মাত্র ১৭ সেকেন্ডই কথা হয়েছে। যা দেখে শ্রাবণ মলিন হাসলো। পরক্ষণেই ফোনটা রেখে দিলো বিছানার উপর।

নীচে ভাইবোনদের হল্লা হল্লি শুরু হয়েছে। হলুদ নিয়ে একজন আরেকজনে পেছনে ছোটা, একে কতক্ষণ হলুদ মাখানো আবার ওকে কতক্ষণ হলুদ মাখানো। বাড়িটাকে মাতিয়ে তুললো মাত্র কয়েক মুহুর্তেই।

শাকিলদের পরিবার আসাতে তাদের আতিথেয়তায় অস্থির হয়ে উঠলেন গুরুজনেরা। এরই মাঝে ঘটলো এক আতংকিত ঘটনা। হলুদ নিয়ে ছোটাছুটি করার এক পর্যায়ে বাটি ভর্তি হলুদ গিয়ে পড়লো শ্রাবণের সাদা পাঞ্জাবিতে। বন্ধুদের নিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে খোশগল্পে মেতে ছিলো সে। হঠাৎ এমন আকস্মিক আ/ক্র/ম/ণে/র স্বীকার তা যেন কল্পনাতীত ছিলো। ভড়কে যাওয়া মুখশ্রীতে একবার নিজেকে দেখে সামনে তাকাতেই মেজাজটা যেন ভ*য়া*ন*ক ভাবে চড়ে গেলো। পড়লো তো পড়লো, কিন্তু কার হাত থেকে পড়লো? একদম ইশার হাত থেকে! এজন্যই হয়তো বলে, “যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয়!”

“হোয়াট দ্য…;

র*ক্তিম চাহনিতে ভ*স্ম করে দিবে ধরনী, এমনই এক লাল চক্ষু নিক্ষেপ করলো ইশার পানে। ইশা অসহায় নেত্রে মুখে হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। ভ*য়ে রীতিমতো কাঁপছে সে। সঙ্গে কাঁপছে তানিও। মূলতও তানিই ওকে ধাক্কাটা দিয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে এহেম ঘটনা।

শ্রাবণ ইশার পানে তেড়ে আসতে নিলেই নিজেকে আড়াল করে কুঁজো হয়ে পড়লো ইশা। তানি প্রথমেই নিজের প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ে পালিয়েছে।

“কি করলি এটা? এতো ফূর্তি কিসের তোদের!;

“আ্ আমি না! আমি না!; ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বলল ইশানি।

#চলবে

ডাকপিয়নের ছুটি নেই পর্ব-০১

0

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#সূচনা_পর্ব

১.

“সাদা শরীরটা দেখিয়ে পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিস নাকি?;

কথাটা কানের পর্দায় বারি খেতেই এক বি*ষা*ক্ত অনুভূতিতে কান জোড়া খসে পড়লো যেন ইব্বানির! চোখ জোড়ায় ঢেলে পড়লো একরাশ বি*ষা*দ। কপাল কুঁচকে ঠেকে গেলো একজন আরেকজনেতে। রজনীগন্ধার বড় ঝুড়িটা আর উপরের দিকে ধরে রাখতে পারলোনা। সেই শক্তিও আর অবশিষ্ট রইলোনা। সর্বাঙ্গে এক বি*ষা*ক্ত বি*ষ কিলবিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফুলের ঝুড়িটা নীচে ফেলে চটজলদি শাড়ির আঁচলের পাশ থেকে হাত দিতেই আরও একরাশ বি*ষা*ক্ত অনুভূতি আষ্টেপৃষ্টে ধরলো ওকে। ঝনঝন করে উঠলো মস্তিস্ক। মুহুর্তেই কাঁপতে আরম্ভ করলো ভেতরে ভেতরে। অবশ্য এ কথা ভুল, কাঁপছে ও! ভীষণ ভাবে কাঁপছে আর সেটা প্রকাশ্যেও ধরা পড়ছে। কাঁপা কাঁপা হাতে বেরিয়ে আসা গতর ঢেকে চোখ বুজল। আর ঠিক তখনই পূণরায় কানের পর্দায় বারি খেলো এক তীক্ষ্ণ আওয়াজ,

“শিট!;

আওয়াজটা কোথা থেকে এলো জানেনা ইব্বানি। জানতেও চায়না। অন্তত এটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে, একদল শ*কু*ন ওকে গিলে খাচ্ছিলো তাদের নোং*রা চাহনি দিয়ে। কাঁপছে ও! ভীষণ ভাবে কাঁপছে। ঠিক তখনই আবারও মঁইয়ের উপর থেকে হাক পড়ে আরবের!

“কি রে, কি করছিস? দে ফুলগুলো!;

আরবের ডাকে হুঁশ ফিরে ইব্বানির। কিন্তু ও এখনও স্বাভাবিক হতে পারছেনা। কারন, একটু আগের ছোঁড়া বি*ষ বাক্যটি আর কারোর নয়, শ্রাবণের। আর সে এখনও মূর্তিমান হয়ে ওর পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে। জানে ইব্বানি।

“ইব্বু! কি হলো? নীচে সব ঠিক আছে?;

আবারও হাঁক ছাড়ে আরব। ইব্বানি নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করে। কিন্তু পারছেনা। ও জানে, এই অসচেতনতার শা*স্তুি শ্রাবণ ওকে একটু একটু করে দিতে থাকবে! তাই হয়তো এই মুহুর্তে এখান থেকে ওর চলে যাওয়াই শ্রেয়!

কোনো শব্দ না করে বিনা বাক্যে দৌড়ে চলে গেলো ইব্বানি। পেছনে রেখে গেলো হিং*স্র*তা*য় ভরপুর একজোড়া চোখ! পেছন মুড়ে দেখলোনা সেই জ*লন্ত চাহনি। কারন ও জানে, একবার ঐ চোখে তাকালে আরও ভ*য়া*ন*ক ভাবে ঝ*ল*সা*তে হবে ওকে।

আরব বির*ক্তির রেশ টেনে উপর থেকে নীচের দিকে তাকালো। ইব্বানি কোথাও নেই! যা দেখতেই বির*ক্তিতে কপাল কুঁচকে গেলো ওর। গলা ফাটিয়ে ইব্বানির নাম নিয়ে যা পারলো বকতে লাগলো। তবে তার বলাও বন্ধ হলো, গোষ্ঠির সবচেয়ে গম্ভীর মানুষটা দেখে। অর্থাৎ শ্রাবণ।

আজ খান বাড়ির সর্বজ্যেষ্ঠ কন্যা তিতিরের গায়ে হলুদ। শহরের এক প্রান্তে দীর্ঘকাল ব্যাপী বসবাস করে আসছে এই খান বাড়ি। ভবনটি দো’তলা। আজকাল শহরে এমন কিসিমে’র দো’তলা ভবন বড় সাধনার পর পাওয়া যায়। মা-বাবা, দুই ভাই ও এক বোনের এই খান বাড়ি। বাবা-মায়ের বড় সাধের প্রিয় সন্তান তারা তিন ভাইবোন। ছোট থেকেই জীবনের সব দুঃখ, ক*ষ্ট, ঝ*ড় ঝা*পটা মিলেমিশে সামলে এসেছেন তারা। তাই আজ বিয়ের পরে, সন্তানদের নিয়েও ঠিক একই ভাবে যৌথ পরিবার নিয়ে বেঁচে আছেন। আশা করা যায় আরও কয়েক প্রজন্ম এভাবেই চালিয়ে নিতে পারবেন তারা। তারা না থাকলেও থেকে যাবে তাদের শিক্ষা, থেকে যাবে তাদের একত্বতা। থেকে যাবে তাদের একজোট হয়ে লড়ে যাওয়ার সংগ্রাম, ইতিহাস।

তিতির হলো খানে সাহেবের বড় ছেলে, শমসের খান এবং আফিয়া বেগমের একমাত্র মেয়ে। তিতির খান। শমসের খানের দুই সন্তান। তিতির এবং শ্রাবণ। বয়সে শ্রাবণই বড়। তবে কন্যা সন্তানদের তালিকায় তিতির পড়ে সবার আগে। অনার্স শেষ করেই বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়েছে তাকে। এতে অবশ্য তিতিরের কোনো দ্বিমত নেই। দাদা-দাদি, বাবা, চাচা এবং ফুপুর ভীষণ পছন্দ এই ছেলেকে। তাই তারও আপত্তি করার কোনো কারন ছিলোনা। তিতির দেখতে আহামরি সুন্দরী না হলেও ভীষণ মায়াবতী। গায়ের রঙ শ্যামা। মায়ের মতো হয়েছে। সেদিক থেকে শ্রাবণ অবশ্য আলাদা। পুরোই খান সাহেবে ন্যায় দেখতে এই সুপুরুষ। সৌন্দর্য্যে,উচ্চতায়, গম্ভীরতায়! দেখতে সুপুরুষ হলেও গম্ভীরতায় শ-পুরুষের আত্মা কাঁপিয়ে দিতে পারে। শ্রাবণ বিসিএস পড়ছে। পাশাপাশি কুমিল্লাতে একটা কোম্পানির ভালো পোস্টিং এ জব করছে। মাসের একটা নির্দিষ্ট টাইমেই দেখা মেলে তার। তবে এ মাসে বোনের বিয়ে উপলক্ষে অসময়েই এসে হাজির হয়েছে।

এরপরে হলেন সাদাত উদ্দিন খান। সাদাত সাহেবের বউ নুপুর বেগম। এবং তাদের এক ছেলে ও দুই মেয়ে। আরব, তুতুন এবং তানি। আরব মাস্টার্স দেবে। তুতুন এইচএসসি দেবে এবং তানি সবে নাইন।

এরপরে হলেন খান সাহেবের একমাত্র কন্যা মরিয়ম বিবি খান। ইব্বানি তার এবং জাফর সাহেবের একমাত্র মেয়ে। ইব্বানি এই পৃথিবীতে আসার দুই বছরের মাথায় জাফর সাহেবের মৃ**ত্যু হয়। হঠাৎ মৃ**ত্যু। যার কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছিলোনা। ইব্বানি এবার বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষে আছে।

খান বাড়ির কোনো মেয়েই আহামরি সুন্দর না হলেও ইব্বানি সবার ব্যতিক্রম। তবে খান বাড়ির প্রত্যেক পুরুষই ভ*য়া*ন*ক সুন্দর। যেমন দেখতে, তেমনই চালচলন। ইব্বানিও হয়েছে তেমন। যেমন রূপ তেমন গুন। ষোলকলায় পরিপূর্ণ একদম।

ইব্বানি দৌড়ে এসে নিজের ঘরে ঢুকতেই সামনে পড়লো ছোট মামি অর্থাৎ নুপুর বেগম। ইব্বানির ফর্সা মুখ গরমে লাল হয়ে উঠেছে। পরনের হলুদ শাড়িটা প্রায় অনেকটা এলোমেলো! ঘন্টা খানিক আগেই তার দিঘল কেশে নুপুর বেগম নিজ কাঁচা ফুলের গাজরা বেঁধে দিয়েছিলেন। সবটাই এখন ম*রোম*রো অবস্থায় পড়ে আছে ইব্বানির হাতে। সবটাই এক পলকে দেখতে পেয়েছেন নুপুর বেগম। যার দরুণ আপনাআপনিই তার কপালের মাঝে চিন্তার সুক্ষ্ম রেখা ভেসে উঠলো। বিস্মিত হয়েই শুধালেন তিনি,

“ইব্বু? কি হয়েছে তোর মা? চোখ মুখ এমন লাগছে কেন? আর চুলের গাজরা, শাড়ি.. সব এমন এলেমেলো হলো কি করে?;

বুক ফেটে কান্না এলো ইব্বানির। সে শাড়ি পড়তে পারেনা। মেজ মামিই ভালোবেসে নিজ হাতে পড়িয়ে দিয়েছে। বড় মামি ক’দিন ধরেই বলছিলো ওকে শাড়ি পড়ার কথা। সবার চাওয়া পূরণেই সে শাড়ি পড়েছে আজ। আর আজই এমন এক বি*ষ বাক্যের স্বীকার হতে হবে, কে জানতো? অবশ্য ঐ মানুষটার থেকে এরচেয়ে ভালো আর কি আশা করবে ও!

“ওমা? কথা বলছিস না কেন! কি হয়েছে আমাকে বলবিনা?;

স্নেহের স্পর্শে ইব্বানিকে কাছে টেনে নিলেন নুপুর বেগম। ইব্বানি শক্ত হয়ে আছে। সে কাঁদবে না। কাঁদলে হাজারটা প্রশ্নের ভীড়ে ভেসে যেতে হবে তাকে। তবে হয়তো ওর কপাল খারাপ! যেটা প্রমান করতেই হাজির হলেন আফিয়া বেগম। হাতে মেয়ের জন্য নিয়ে যাওয়া এক বাটি হলুদ। নীচতলায় হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। সব কিছু গুছিয়ে রাখা হলেও আসল জিনিসটাই কারোর মাথায় নেই।

“ইব্বানি এখানে? আমি আরও মেয়েটাকে খুঁজে ম*র*ছি! এই ইব্বু, হলুদটাই তো নেওয়া হয়নি! তুই একটু নিয়ে… সেকি রে! ছোট? কি হয়েছে ওর?;

তাড়াহুড়ো করে ঢুকলে ইব্বানির এলোমেলো অবস্থা সে দেখতে পায়নি প্রথমে। তবে কথা বলতে বলতে হঠাৎ চোখে পড়লো তার আদরের ইব্বুকে। বিধ্বস্ত লাগছে যে পুরো।

“জানিনা গো। দেখোনা, কিছুই তো বলছেনা!;

হলুদের বাটিটা নুপুর বেগমের হাতে তুলে দিয়ে ইব্বানিকে নিজের কাছে টেনে নিলেন আফিয়া বেগম। ওর দু’গালে হাত রেখে আদুরে গলায় ডাকলেন,

“ও ইব্বু? আমার সোনা মেয়ে-টার কি হয়েছে? কে কি বলেছে! ওমা? তোকে কেউ কিছু বলেছে?;

“না মামি। কেউ কিছু বলেনি!;

“মিথ্যে বলিসনা! কেউ কিছু বললে আমাকে বল মা? কোনো ছেলে.. কোনো ছেলে কিছু বলেছে? বল আমাকে!;

“না। দাও হলুদের বাটি দাও। আমি গিয়ে রেখে আসি।;

“আগে দাঁড়া তুই, জবাব দিয়ে যা। কোনো ছেলে কিছু বললে বল, এক্ষনি শ্রাবণকে বলে তার ব্যবস্থা করাবো। আমাদের কোনো আত্মীয়…;

যাকে দিয়ে ব্যবস্থা করাবে, আ*ঘা*তটা যে সর্বদা সেই করে!’ কথাটা ভীষণ ভাবে বলতে ইচ্ছে করলো ইব্বানির। কিন্তু আঁটকে গেলো কন্ঠনালীতে। বড় মামির কোনো প্রশ্নই আর কানে উঠলোনা তার। ছোট মামির হাত থেকে হলুদের বাটিটা নিয়ে প্রস্থান করলো আবার। আফিয়া বেগম এবং নুপুর বেগম বিহ্বলিত নয়নে চেয়ে রইলো ওর যাওয়ার পানে।

শাড়ির আঁচল মেঝেতে লুটিয়ে ধীরপায়ে হেঁটে এসে স্টেজের সামনে দাঁড়ালো ইব্বানি। হলুদের বাটি রাখার ট্রেটা কাছে টেনে সেখানে হলুদের বাটিটা রেখে ফুল দিয়ে সাজিয়ে ট্রে-টা আবার জায়গা মতো রেখে দিলো। আশেপাশে ভালো করে আরেকবার দেখে নিলো কিছু আবার কম পড়লো কিনা। নাহ্, এবার সব ঠিকই আছে। কিছুই কম পড়েনি।

তিতিরকে সাজানো হচ্ছে হলুদের জন্য। তুতুন এবং তানিও সাজছে বোনের সাথে। সাথে সাজগোজের পালা চলছে বাকি মেহমানদেরও। মেয়েরা বাদে বাকি ছেলেরা এবং গুরুজনদেরই দেখা যাচ্ছে আশেপাশে। কারোর সাথে চোখে চোখ পড়ে গেলে ভদ্রতাসূচক হেসে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে ইব্বানি। কিন্তু আপাতত সেটুকুনও করছেনা। কারন, ওর মন ঠিক নেই।

“তোর দুঃসাহস দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি আমি! এখনও শাড়ি পড়ে ড্যাংড্যাং করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস।;

একখানা গম্ভীর গলা তখনকার মতো আবারও হোঁচট খাওয়ালো ইব্বানি। চমকে উঠে পেছনে তাকাতেই আবিষ্কার করলো সেই রাগি রাগি নেত্রদ্বয়। যা দেখতেই আত্মা অব্দি কেঁপে যায় ইব্বানির।

“ক্ কি!;

“তুই এতো নির্লজ্জ কবে থেকে হয়েছিস বলতো?;

ধমকের সুরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল শ্রাবণ। ফের কেঁপে উঠে চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেললো ও। পরক্ষণেই চোখ মেলে তাকালো শ্রাবণের দিকে। অসহায় নেত্রে বলল,

“ব্ বড় মামি হলুদের জন্য আমাকে শাড়িই দিয়েছে! ছ্ছোট মামিও…;

“চুপ! (দাঁতে দাঁত চেপে) আর একটাও বাড়তি কথা শুনতে চাইনা আমি! হয় এই শাড়ি পোড়াবি না হয়, বিয়ে হওয়ার আগ পর্যন্ত ঘর থেকে বের হবিনা!;

“শ্রাবণ ভাই…;

“জিন্দা পুতে ফেলবো মাটিতে!;

ধমকের উপর ধমক ছেড়ে চলে গেলো শ্রাবণ। ইব্বানির ভেতরটা ফাটতে লাগলো শ্রাবণের এহেম আচরণে। তুতুন আর তানির সঙ্গে তো সে এমন করেনা সে, আর না আরব আর তিতিরের সাথেও! তাহলে ওর সঙ্গেই কেন তার এমন আচরণ করতে হবে?

আকস্মিক মাথায় গাট্টা পড়তেই শ্রাবণের দেওয়া দুঃখ কষ্ট ভুলতে হলো ইব্বানিকে। মাথায় হাত ডলে রাগি চোখে পাশ ফিরে তাকাতেই আবিস্কার করলো আরবকে। আরব কোমরে হাত চেপে চোখ মুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছে। ইব্বানিও ঠিক তার মতোই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। কেউ কোনো কথা বলছেনা। শুধু তাকিয়ে আছে। তাকানোর পালা শেষ হতে আরবই আগে মুখ খুললো।

“তোর হবু জামাইয়ের ডাক পড়লে এমনে ভাইরে রাইখা পালাবি? কোনো মায়াদয়া নাই নাকি তোর?;

ইব্বানি বুঝলোনা আরবের কথার মানে। ভ্রু কুঞ্চিত রেখেই পাল্টা প্রশ্ন করলো,

“মানে?;

“তখন ফুল গুলা নীচে ফেলে পালিয়েছিলি কোথায়? ডাকতে ডাকতে গলার রগ মোটা হয়ে গেছে আমার!;

আরবের কথায় ঘটনা চক্রটি পূণরায় মনে পড়লো ইব্বানির। তাই তৎক্ষনাৎ দাঁত কেলিয়ে হেসে ভাইকে মানাতে চেষ্টা করে বলল,

“সরি ভাইয়া! আসলে..;

“হু হইছে, এখন শুরু হবে নতুন ড্রামা!;

“শোনোনা ভাইয়া, রাগ করোনা প্লিজ! সত্যি একটা কাজ পড়ে গেছিলো।;

“কি কাজ? তুর্জ কল দিয়েছে?;

‘তুর্জ’ ইব্বানির হবু বরের নাম। মাস খানিক আগেই যার সাথে ইব্বানির বিয়ের কথা ফাইনাল হয়েছে। অনার্স শেষে তিতির মতোই তারও বিয়ের পিড়িতে বসতে হবে।

তুর্জর নামটা শুনতেই ফকফকা দাঁতের হাসি থেমে গেলো ইব্বানির। বিষন্ন হলো হৃদয়। শান্ত স্বরে বলল,

“না! অন্য কাজ। বাদ দাও ওসব। ফুল লাগানো হয়েছে? আর লাগাতে হবে?;

“না। অলমোস্ট ডান। শোন, তু্র্জকে কল করে আরেকবার আসতে বল? বাবাই বারবার বলছিলো কিন্তু।;

“হু বলবো।;

“ও কি আসবে বলেছে?;

“জানিনা। কথা হয়নি।;

“তুই কেমন বউ রে? ছেলেটার একটু খোঁজ খবর রাখবিনা?;

তুর্জর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে কোনো কিছুই ভাবতে পারেনা ইব্বানি। সেখানে নিজেকে তার বউ ভাবাটা অনেক বড় শা*স্তি ওর জন্য।

“ছাড়োনা ওসব কথা। আপুকে স্টেজে আনতে হবেনা? দেখো মেহমান কিন্তু ভরে যাচ্ছে ক্রমে। শাকিল ভাইয়ার বাড়ি থেকেও সবার আসার সময় হয়ে গেছে।;

“হ্যাঁ, হ্যাঁ। ভালো কথা মনে করিয়েছিস। চল, তিতিরকে নিয়ে আসি।;

“হু, চলো।

#চলবে?

প্রিয় চন্দ্রিমা ২ পর্ব-১৪ এবং শেষ পর্ব

0

#প্রিয়_চন্দ্রিমা
Sumon Al-Farabi
#শেষ_পর্ব( দ্বিতীয় সিজন)
আমি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতেই ছোট মা যখন চা’য়ের ট্রে হাতে নিয়ে তাদের জন্য চা নিয়ে গেলো সেটা দেখে আরও অনেক বেশি অবাক হয়ে গেলাম। একটা মানুষ রাতের আঁধারে চুপিচুপি বাসায় আসলো তাকে আবার আপ্যায়ন করা হচ্ছে। কে উনি!

অবন্তীর রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে নক করলাম।
– দরজা খোলাই আছে।
আমায় ভিতরে যেতে দেখে অবন্তী কাঁথা পুরো শরীরে ঢেকে শুয়ে পড়লো।
– খুব বেশি রাগ করছো!
– আমি কেন রাগ করবো! আমি তো তোমার পরিবারের কেউ নই। তোমার পরিবার তো ঐ মায়া আপু আর চন্দ্রিমা।
– আমার ভুল হয়েছে তো। রাগের মাথায় কি থেকে কি বলে ফেলেছি। তুমি তো জানোই আমি তোমায় কতটা ভালোবাসি, তাই না!
– কচু বাসো।
– আচ্ছা বাবা ক্ষমা করার জন্য কি ঘুষ দিতে হবে!
– আইসক্রিম।
জানতাম এই ঔষধে কাজ হবে।
– কিন্তু এতো রাতে কি দোকান খোলা পাওয়া যাবে!
– পাড়ার মোড়ের দোকানটায় অনেক রাত অব্দি খোলা পাওয়া যায়।

অবন্তী এবং আমি রাস্তায় হাঁটছি। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় হাঁটতে অদ্ভুত এক ভালো লাগা মিশে থাকে।
– অবন্তী একটা কথা বলি!
– কি কথা!
– তখন আমার কথাটা খুব খারাপ লেগেছে তোমায় তাই না!
অবন্তী চুপচাপ, শুধু একবার আমার দিকে তাকালো।
– তুমি যখন জানতে পারো তোমার বাবা জীবিত আছে কিন্তু তিনি কখনো তোমাদের খোঁজ করে নি তখন তুমিও আমার মতোই কথা বলতে। এখানে একটা কথা তুমি বলতে পারো পরিস্থিতি! দিনে ছোট মা সব সময় উনার সাথে ছিলো না। একটা কল করে দু-চার মিনিট কথা বললে পৃথিবীতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যেতো না। আমিও নিজেকে বোঝাই যে উনি পরিস্থিতির শিকার কিন্তু পরক্ষণেই এসব মনে আসে। প্রকৃত পক্ষে উনার কখনো ইচ্ছেই কাজ করেনি আমার সাথে কথা বলার। নয়তো আম্মুর সাথে দেখা করতো কখনো আমার সাথে দেখা করেনি।
– তুমি কান্না করছো!
– কান্না করছি না। জমানো কথাগুলোর মাঝে যেগুলো মুখে প্রকাশ করতে পারছি না সেগুলো চোখ বেয়ে পড়ছে।
হঠাৎই অবন্তী বললো- ভাইয়া ঐ লোক দুজন আমাদের বাসার দালানের সামনে কি করে!
– কথা বলবে না, আমি চুপি চুপি গিয়ে দেখছি।

খুব সাবধানে এগিয়ে গিয়ে দু’হাতে দুজনের হাত ধরে ফেললাম। কিন্তু সেখানে থেকে একজন আমার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে পালালো। কিন্তু অন্য জন পালাতে পারে নি। যিনি পালিয়ে যায় উনি পুরুষ ছিলো কিন্তু আটকে পড়েন যিনি তিনি একজন মহিলা।
অবন্তী দৌড়ে এসে তাকে শক্ত করে ধরে ফেললো। মুখটা ঢাকা আছে অবন্তী মুখ খুলেই থ হয়ে গেলো – ভাইয়া ইনিই সেই মেয়ে যিনি মায়া আপু হয়ে বাসায় এসেছিলো।
মেয়েটা কি একটা স্প্রে আমাদের দু’জনের চোখেই দেওয়ার চেষ্টা করে।

পরদিন সকালে,
খাওয়া শেষ করে ছোট মা’কে জিজ্ঞেস করলাম গতকাল লোকটা কে ছিলো!
উনি খুব সাধারণ ভাবেই উত্তর দিলো – উনি উকিল, তোমার দাদুর সম্পত্তির ভাগ করার জন্য উনাকে ডাকেন।
– উনি তো সেটা দিনেও করতে পারেন তবে রাতের অন্ধকারে কেন!
– সেটা উনিই ভালো বলতে পারবেন।
ছোট মা আজ বিন্দু মাত্র কিছু লুকানোর চেষ্টা করেননি। কারণ তার কথায় আজ কোনো জড়তা নেই।

তখন বেলা বারোটা নাগাদ হবে, অবন্তী রুমে আসলো – চন্দ্রিমা, মায়া আপু রুমে একা আছে উনার কাছে যাও একটু।
চন্দ্রিমা বাকা চোখে অবন্তীর দিকে তাকালো।
– আচ্ছা বাবা ঠিক আছে, ভাবী প্লিজ মায়া আপুর কাছে যাবপন একটু।
– বার বার মনে করিয়ে দিতে হবে কেন শুনি।
– আর হবে না। এখন যাও।
– তোমাদের ভাই বোনের মাঝে এতো কি গোপন কথা শুনি!
– ভাইয়াকে আর একটা বিয়ে দিয়ে দিবো।
– আমি কোথাও যাবো না।
আমি তাদের দুজনের কর্মকান্ড দেখে মুচকি হাসছি।
– ভাইয়া তুমি কিছু বলছো না কেন!
– চন্দ্রিমা তুমি যাও।
চন্দ্রিমা আর কিছু না বলে উঠে হনহন করে চলে গেলো।
– ভাইয়া মেয়েটাকে কি করবো!
– সকালে খাবার দিয়েছিলে!
– হ্যাঁ।
– ঐ রুমে কেউ যায় না তো শিউর!
– আমি কখনো কাউকে যেতে দেখিনি।
– আচ্ছা চলো। মেয়েটার সাথে কথা বলি।
– এখন যদি চিল্লায় তবে সবাই জেনে যাবে।
– চলো আগে যাই।

অবন্তীর সাথে বাসার বাইরে একটা পরিত্যক্ত রুম আছে অনেক আগের সেটাতে চলে আসলাম। গতরাতে মেয়েটি অনেক পালানোর চেষ্টা করেও পালাতে পারেনি। তাকে আমরা এই রুমে বেঁধে রেখেছিলাম।
– দেখুন আপনি যদি ভদ্র ভাবে আমাদের সাথে কথা বলতে রাজি হন তবেই আমি আপনার মুখ খুলে দিবো।
মেয়েটি শান্ত হয়ে বসে আমার কথা শুনলো। অবন্তী কে উনার মুখ খুলে দিতে বললাম।
– এতো রাতে আপনি এখানে কি করছিলেন এবং সাথের উনি আপনার কে!
মেয়েটি কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো- উনি আমার বাবা।
– আপনারা চোরের মতো চুপি চুপি এই বাড়িতে ঢুকতে চেষ্টা করছিলেন কেন! এর আগেও তো ঢুকেছিলেন মনে হয়।
– আমি কখনো ঢুকি নি। তবে বাবা মনে হয় ঢুকেছিলো এর আগেও।
মেয়েটি অবন্তীর গলার চেইনটা দেখে অবন্তীকে জিজ্ঞেস করে – এটা তোমার বাবার চেইন তাই না!
– হ্যাঁ ।
– আমার বাবার ও এমন একটা চেইন আছে ।
মেয়েটির কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম – ঠিক এমনই চেইন আছে!
– হ্যাঁ।
– উনি সেটা কোথায় পেয়েছেন!
– সেটা কখনো বলেনি।
– আপনি আমার বাসায় গিয়েছিলেন কেন!
– বাবা পাঠিয়েছিলো আপনার আম্মুর রুমে ভালো করে খুঁজতে।
– কি খুঁজতে গিয়েছিলেন!
– সেটা বলবো না। তবে আমি আপনাদের সকলকেই চিনি। বাবা সব সময় বলতেন আপনারা আমাদের আত্মীয় কিন্তু আপনাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক কি সেটা এখনো বলেনি।
– আপনার বাবাকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে! তারপর উনার থেকেই শুনবো আপনি আমাদের কেমন আত্মীয়।
– আমি জানি না।
– গতকাল আপনারা কেন এসেছিলেন!
– এই বাসায় কারো সাথে দেখা করতে। কিন্তু কার সাথে দেখা করতে সেটাও আমার অজানা।
– অবন্তী উনার মুখ বেঁধে দাও। উনি যখন কিছুই জানে না তবে উনার মুখ খোলা রেখে কি কাজ!

অবন্তীকে সাথে নিয়ে বাসার পাশের একটা টং দোকানে চা খাচ্ছি।
– ভাইয়া মেয়েটাকে কি ওখানেই রেখে দিবো!
– হ্যাঁ। বাসার বাইরের রুমে থাক তবে কাল সকালে উনাকে এমন জায়গায় শিফট করবো যেটা কেউ জানতে পারবে না।
চা’য়ের বিল দিয়ে হাঁটতে লাগলাম।
অবন্তী জিজ্ঞেস করলো- আমি তোমায় এতো ধীরে বললাম কিন্তু তুমি এতো লাউডলি বললে কেন!
– আমাদের পিছনে সব সময় স্পাই থাকবে এখন। তাই জন্য সেটার একটা সুযোগ নিতে চাচ্ছি আজ।
– কেমন সুযোগ!
– সময় আসলে ঠিক বুঝতে পারবে। শুধু একটু অপেক্ষা করো। তবে অবন্তী তোমার কি মনে হয় তোমার বড় মামা এখনো বেঁচে আছেন! তোমার আম্মু আমাদের মিথ্যা বলছেন বার বার।
– কিভাবে!
– তোমার গলার চেইন। যেটা পাঁচ জনের কাছে ছিলো কিন্তু চারজন আছে একজন নেই সেটাই তোমার বড় মামা। আবার এই মেয়ে বলছে উনার বাবার কাছে এমন চেইন আছে। যেটা শুধু মাত্র তোমার মামার কাছে থাকার কথা।
– এতো ডিপলী তো চিন্তা করিনি।
– তোমায় আর একটা কথা বলবো!
– কি কথা!
– তোমার গলার চেইনটা খোলো।
অবন্তী চেইনটা খুলে আমার হাতে দিলো – এই যে পাঁচটা পাথর আছে না! কিন্তু পঞ্চম যে চেইনটা, যেটা এখন আমার কাছে আছে তার একটা পাথর নেই। যে পাথরটা সুনয়নার নখের মাঝে থেকে উদ্ধার করা হয়। এর থেকে কি কিছু বুঝতে পারলে!
– মানে এই মেয়ের বাবা অর্থাৎ আমার বড় মামা আপুকে হত্যা করছে!
– আমার ধারণা আপাতত সেটাই।

রাতে খুব সাবধানে ছাঁদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে ঘরটার দিকে নজর রাখছি। রাফির বন্ধুকে আগে থেকেই জানিয়ে রেখেছিলাম।
রাত তখন প্রায় বারোটা হবে।
সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সেই সময় একটা শব্দ কানে আসলো। কেউ একজন ধুম করে মাটিতে পড়ে গেলো। আমি দৌড়ে নিচে চলে আসলাম। আমার ধারণাই ঠিক। লোকটা আমার পাতানো জালে ধরা দিয়েছে।
ঘরের মাঝে আসা যাবে এমন সবগুলো পয়েন্টেই খুব নিখুঁত ভাবে অজ্ঞান করার স্প্রে সেটআপ করে রেখেছিলাম। কারণ আমার ধারণা ছিলো মেয়েকে বাঁচাতে বাবা অবশ্যই আসবে । চা’য়ের দোকানে এতগুলো মানুষের ভীড়ে কেউ না কেউ আমাদের কথা শুনছিলো।
রাফির বন্ধু চলে আসলো, দু’জন মিলে উনাকে শক্ত করে বেঁধে ফেললাম।
– স্যার, কতক্ষণ লাগবে জ্ঞান ফিরতে!
– প্রায় এক ঘন্টা। তুমি চাইলে বাসা যেতে পারো।
– না স্যার। আমি এক অদ্ভুত মামলার সাক্ষী হতে চাই। আপনি শিউর তো উনিই খুনি!
– সেটা উনার থেকেই শুনে নিবো।

বেশ কিছু সময় অপেক্ষার পর জ্ঞান ফিরতে শুরু করলো। কিছুক্ষণের মাঝেই শরীরের শক্তি ফিরে আসলো। নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য প্রচন্ড শক্তি অপচয় করছে।
– এতটাও সহজ হবে না। খুব শক্ত করে বাঁধা আছে।
– সুমন ভালোই ভালোই আমায় ছেড়ে দাও।
– স্যার, উনি আপনার নাম ও জানে।
– উনি আমাদের আত্মীয়। নাম জানবে এটাই স্বাভাবিক।
লোকটা রেগে গিয়ে বললো- আমার মেয়ে কোথায়! ও ঠিক আছে তো!
– সেটা ডিপেন্ড করবে আপনার উত্তরের উপর। সুনয়নাকে হত্যা করেছেন কেন!
– আমি কাউকে হত্যা করিনি। তাছাড়া আমি কেন ওকে হত্যা করবো!
– আপনার টার্গেট পূর্ণ করতে।
– কিসের টার্গেট স্যার!
– সেটাও উনি বলবে। এই চেইনটা আপনার! যেটা গতদিন এই বাসায় ঢুকে হারিয়ে ফেলেছিলেন।
– এমন চেইন আরও পাঁচটা আছে। এটা দিয়ে কিভাবে প্রমাণ হয় আমি খুনি!
– আরও পাঁচটা! কিভাবে!
– তোমার দাদী এটা আমায় বানিয়ে দিয়েছিলো। তোমার দাদুর দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলো আমার মা। কিন্তু উনি সেটা অস্বীকার করেন। কখনো আমাদের খোঁজ নিতেন না। তবে বড় মা খুব ভালো ছিলো। উনি তোমার বাবার কাছে এই চেইন দেখে একই চেইন আমাকে দিয়েছিলো। এরপর উনিই আমাকে বিদেশে যাওয়া টাকা দেয়।
– তাহলে এই চেইন আপনার! তবে তো আপনি হত্যা করেছেন।
– এ থেকে কিভাবে প্রমাণ হয় আমি খুনি!
– সুনয়নার শরীরে যে ড্রাগস পাওয়া যায় সেই ড্রাগস এই পুরো এলাকায় শুধু মাত্র আপনার কাছেই আছে।
– উনি ড্রাগসের বিজনেস করেন স্যার!
– না। উনি ঐ ড্রাগসে আসক্ত। উনি বিদেশে ছিলেন অনেক দিন সেখানে থাকা সময়ে থেকে উনি এই ড্রাগস পুস করেন নিজের শরীরে। দেখুন আপনার মেয়ে সবটাই বলে দিয়েছে। আপনি শুধু শুধু সময় অপচয় করলে আপনারই কষ্ট হবে ।
– আমি কিছুই বলবো না। আমি খুন করি নি।

লোকটার মুখ বেঁধে বাইরে চলে আসলাম।
– স্যার আপনি জানতেন উনি সম্পর্কে আপনার চাচা হয়!
– হ্যাঁ । এটা আমি আম্মু এবং ছোট মা জানতাম। এখন দাদু জানে। কারণ দাদু সেখানে বেশি দিন ছিলেন না। কিন্তু দাদী সবটা খেয়াল রাখতো।
-আপনি এতো কিছু কিভাবে জানলেন
– ভুলে যেও না আমি একজন ডিটেকটিভ।
– কিন্তু স্যার উনি তো কিছুই শিকার করছেন না। উনার মেয়েকে উনার সামনে এনে টর্চার করি?
– সব কিছুরই একটা লিমিট থাকে। কিন্তু নেশার লিমিট পেরিয়ে গেলে অবস্থা গুরুতর হয়ে যায়।
– বুঝতে পারি নি।
– উনার সামনে উনার মেয়েকে নিয়ে যতোই টর্চার করো মুখ খুলবে না। কিন্তু উনার ড্রাগস নেওয়ার সময় হলে যদি ড্রাগস না পায় তবে মৃত্যু যন্ত্রণা উনাকে কুঁড়ে কুঁড়ে ব্যাথা দিবে। সেই সময়ের জন্য অপেক্ষা করো। হয়তো আর মাত্র দুই এক ঘন্টা। তোমাকে যেটা নিয়ে আসতে বলেছিলাম সেটা এনেছো!
– হ্যাঁ স্যার।

কিছুক্ষণ পরেই ঘরের ভিতরে ছটফট করতে শুরু করলো।
– হয়তো সময় ঘনিয়ে এসেছে।
আমরা দুজন আবার ঘরের মাঝে ঢুকলাম। লোকটা প্রচন্ড ছটফট করতে শুরু করলো।
– আপনি যদি সত্যিটা বলেন তবেই আপনার ঔষধ আপনি পেয়ে যাবেন। যেটা এখন আমার হাতে আছে। নয়তো আপনার কি অবস্থা হবে সেটা আপনি ভালো করেই জানেন।

বেশ কয়েকবার বলার পর বলতে রাজি হলো।
ড্রাগস পুস করার কিছুক্ষণ পর লোকটা স্বাভাবিক হলো।

– এখন বলুন, নয়তো পরবর্তী সময় আর এটা পাবেন না। কারণ আপনার রিজার্ভে যতটুকু ছিলো সবটাই আমার কাছে। আমি যতদূর জানি নতুন করে নিয়ে আসার জন্য যে টাকার দরকার সেটা আপনার কাছে নেই। যেটার জন্য আপনি দাদুকে প্রেসার দিচ্ছেন।
– তোমার দাদুকে আমার মা বলেছিলো আমায় কিছু সম্পত্তি দিয়ে দিতে। কিন্তু উনি আমায় সন্তান হিসাবে স্বীকৃতি দেন নি। বিদেশ থেকে বাসায় আসার পর বিজনেস শুরু করি। হঠাৎ জুয়ার জগতে চলে গিয়ে সবটাই হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাই। কিন্তু তোমার দাদু তো আমায় সম্পত্তি দিবে না। তাই রাগে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এই পরিবারের সবাইকে এক এক করে শেষ করবো পরে আইনত সব কিছু আমার হবে । কেউ জানতেই পারবে না সবাই কিভাবে মারা গিয়েছে। সবাই জানবে স্বাভাবিক মৃত্যু।
– কাকে কাকে এখন পর্যন্ত খুন করছেন!
– সুনয়নাকে দেখার জন্য গিয়ে ওদের খাবার পানিতে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দেই। এরপর ওকে তুলে নিয়ে আরশের কাছে যাই। গিয়ে সেখানে ড্রাগস পুস করি। ভেবেছিলাম এক ঢিলে দুই পাখি মারবো। কিন্তু এতোবছর পর তুমি আবার সেই পুরাতন জিনিস বের করবে কখনোই কল্পনা করিনি।
– শুধুই সুনয়না কে মেরেছিলেন!
– হ্যাঁ।
– আচ্ছা ঠিক আছে। আপনার সাথে অন্য কোথাও দেখা হবে।

আমরা দুজন বাইরে চলে আসলাম।
– এই ভিডিও টা তোমায় সেন্ড করছি। শুনানির দিন দেখাবে।
– স্যার, আপনার ছোট মা কি তবে উনার দলে!
– না। তাহলে উনি যে আরশকে ছাড়াতে না করলো।
– এই ভদ্রলোক দাদুকে হুমকি দিয়েছিলো যদি আরশ বাইরে আসে তবে উনি ওর ক্ষতি করবে। কিন্তু মায়েরা কি আর সন্তানের ক্ষতি হতে দিতে চায়।
– মায়ার উপরেও কি উনি হামলা করেছিলেন!
– না। মায়ার উপর হামলাটা ছোট মা’র সাজানো নাটক ছিলো যাতে আমরা ভয় পেয়ে যাই।
– শুধুমাত্র সম্পত্তির জন্য কত কিছু।
– লোকটা যদি আমার বোন কে না মারতো তবে উনাকে না ধরিয়ে দিয়েই আমি আরশকে ছাড়াতাম। কিন্তু উনি আমার বোনকে মেরেছেন।

পরের শুনানিতে উনার বক্তব্যে আরশ মুক্তি পায়।

সময় গড়িয়ে গেলো। আমার ঘর আলো করে একটা রাজকন্যা জন্ম নিলো।
– চন্দ্রিমা, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও আজ একজন কে দেখতে যাবো।
– আচ্ছা।
– মায়া ও আসছে।

সেন্ট্রাল জেলে আসলাম। আমার বোনের খুনিকে দেখতে।
– তুমি কাকে দেখতে আসছো!
– সুনয়নার খুনি কে।
– তুমিই দেখা করো আমরা করবো না।
– আচ্ছা। তোমরা আমার থেকে কিছুটা দূরে থেকো।
ওদের সাথে নিয়ে আসলাম। ওরা রুমের বাইরে। কিন্তু রুম থেকে ওদের স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
– তুমি এখানে কেন!
– আপনাকে দেখতে আসলাম দেখাতে আসলাম।
– কি!
– আপনি আমার পরিবার কে শেষ করতে চেয়েছিলেন না! ঐ দেখুন আমার পরিবার কোলে হাসছে। সব থেকে মজার বিষয় কি জানেন! ঐ কোলটা আপনার মেয়ের।
– মানে!
– আপনার স্ত্রী তিনজন কন্যা জন্ম দেন জন্য আপনি তাকে ডিভোর্স দিয়ে বড় মেয়ে কে নিয়ে উনাকে ছেড়ে গিয়েছিলেন। ঐ দেখুন মেজো মেয়ে মায়া এবং ছোট মেয়ে চন্দ্রিমা। তারা জানে না আপনি তার বাবা। জানলে হয়তো ঘৃণায় সুইসাইড এ করতে পারে।

লোকটার চোখে পানি চলে আসছে।
আমি লোকটার কানে কানে বললাম – আপনি যে মহিলা কে খুন করেছিলেন সেই মহিলাই আপনার রক্তকে খুব যত্নে মেয়ের আদরে বড় করেছে। খুব কি দরকার ছিলো আমার নিষ্পাপ মা টাকে মেরে ফেলার! যাই হোক আপনার মেয়ের কোলেই আমার নতুন মা এসেছে। আপনার মেয়ের কোলেই আমার পরিবার বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু আপনি কখনো কোনো দিন বাবার পরিচয়ে সামনে যেতে পারবেন না। ভালো করে দেখুন ঐটা আমার চন্দ্রিমা। আমার মেয়ের আম্মু। আপনার মেয়ে।

(#সমাপ্ত)

প্রিয় চন্দ্রিমা সিজন-০১ পড়তে লেখাটি উপর ক্লিক করুন।

প্রিয় চন্দ্রিমা ২ পর্ব-১৩

0

#প্রিয়_চন্দ্রিমা
Sumon Al-Farabi
#১৩তম_পর্ব( দ্বিতীয় সিজন)
আরশের বন্ধুকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য যখন ডাকা হলো তখন তাকে প্রথমেই পাবলিক প্রসিকিউটর প্রশ্ন করলো- আপনি আরশ সাহেবের কেমন বন্ধু!
– খুবই কাছের।
– তাহলে তো এই মামলায় আপনিও জড়িত থাকতে পারেন।
– এই মামলায় আমি কেন! আরশ নিজেও জড়িত নেই।
– কিভাবে! আচ্ছা আপনি এতটুকু নিশ্চিত করুন একজন মানুষ মাতাল অবস্থায় যে কোনো অপরাধ করতে পারে তাি না!
– হ্যাঁ।
– তাহলে আপনি কি করে বলছেন আপনার বন্ধু নিরপরাধ!
ক্রিমিনাল লইয়ার- আমায় একটু প্রশ্ন করার সুযোগ দিলে হয়তো আমি প্রমাণ করতে পারতাম উনি কিভাবে দাবি করছে উনার বন্ধু নিরপরাধ।
– অবশ্যই। সেই অপেক্ষায় তো আছি।
ক্রিমিনাল লইয়ার আরশের বন্ধুকে প্রশ্ন করলো – আপনি এবং আরশ বেশির ভাগ সময় একসাথেই ঐ কুঁড়ে ঘরটায় নেশা করতেন তাই না!
– হ্যাঁ। তবে ঐ দিন আমার ছোট বোনের বিয়ে ছিলো তাই বিয়ে উপলক্ষে আমি ওকে বিয়ার ট্রিট দেই। আর ঘুমের ঔষধ গুলো ওর নিজের ছিলো।
– বিয়ারের সাথে ঘুমের ঔষধ সেবন করার পর কি শরীরের শক্তি বেড়ে যায়!
– না, তবে শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এবং তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। তবে এর রেশটা দীর্ঘ সময় থাকে।
– মাননীয় বিচারক, যদি শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে তবে ঐ মেয়েকে কাঁধে তুলে নিয়ে আসা অসম্ভব। আর মেয়ে নিশ্চয়ই হেঁটে আসে নি।
পাবলিক প্রসিকিউটর- কে বললো মেয়ে হেঁটে আসছে! উনাকে জোর করে জবরদস্তি তুলে নিয়ে এসেছে।
– আপনি সেই ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন কি না জানি না তবে আমি গিয়েছিলাম। চারপাশে ছিপছিপে পানি প্রায় সব সময়ই থাকে। যদি কাউকে জোর করে নিয়ে আসা হয় তবে তার শরীরে একটু হলেও কাঁদা পানি লেগে থাকবে। কিন্তু সেই সময়ে পত্রিকা বা পুলিশের ফাইলে পাওয়া ছবি কোথায় মেয়েটির শরীরে বিন্দু মাত্র কাদা পাওয়া যায় নি।
– এ থেকে আপনি কি বোঝাতে চাচ্ছেন!
– একজন শক্তি সামর্থ লোক মেয়েটিকে অজ্ঞান করে কাঁধে করে ঘটনাস্থলে নিয়ে এসেছে এবং তার শরীরে ড্রাগস পুস করেছে।
ক্রিমিনাল লইয়ার আরশের বন্ধু কে আবার জিজ্ঞেস করলো- আরশ সাহেবের কাছে কি কোনো ড্রাগস ছিলো ঐ দিন! বা উনার কোনো বন্ধু কি বিদেশ থেকে ড্রাগস পাঠিয়েছিলো!
– না। তাছাড়া ওর খুব কাছের শুধু মাত্র আমি ছিলাম।
– আরশ সাহেবের কি ঐ মেয়ের সাথে কোনো প্রকার সম্পর্ক ছিলো!
– না। ও মেয়েদের থেকে নিজেকে দূরে রাখতো। সব সময় একটা কথা বলতো নেশার হাতে জীবন ধ্বংস করবো তবুও কোনো মেয়ের হাতে জীবন তুলে দিবো না।
– মাননীয় বিচারক, এখন তো পরিস্কার যে আরশ সাহেবে হত্যা করে নি৷। তাছাড়া একজন মানুষ সুস্থ মস্তিষ্কে বা মাতাল অবস্থায় শুধু তার উপরেই আক্রমণ করে যার প্রতি তার ক্ষোভ থাকে। কিন্তু এই মেয়ের সাথে তার কোনো প্রকার পারিবারিক বা প্রেমের সম্পর্ক ছিলো না।

ক্রিমিনাল লইয়ার এর এমন প্রশ্নে পাবলিক প্রসিকিউটর যে উত্তর দিলো সেটা শোনার পর আমাদের পরিবারের সবাই থ হয়ে যায় -আপনি হয়তো মামলা নিয়ে তেমন একটা পড়াশোনা করেন নি। মেয়েটার সাথে তার কোনো সম্পর্ক ছিলো না এটা আপনাকে কে বলছে! আরশ সাহেবের বাবা জনাব কাশেম সাহেব এর প্রথম স্ত্রীর মেয়ে ছিলেন ঐ মেয়ে। যার নাম তো শুরুতে সুনয়না ছিলো কিন্তু পরবর্তীতে তার নানি সেই নাম পরিবর্তন করে স্নেহা নাম রাখেন। সাধারণত কেউ নিজের সৎ বোনকে সহ্য করতে পারে না। তাই এমনটা করা খুব সাধারণ।

অদ্ভুত এক কথায় শিহরণ তুলে দিলেন আমাদের সকলের শরীরে। এই একটা কথায় আমাদের পরিবারের প্রায় সকলের চোখেই পানির উপস্থিতি লক্ষ্য করলাম।

সেদিনের মতো শুনানি শেষ। এর পরের শুনানিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত শোনানো হবে।
সবাই বাসা চলে গিয়েছে। আমি এবং রাফির বন্ধু বসে চা হাতে চিন্তা করছি। কথা বলতে বলতেই একটা সিগারেট জ্বলালাম।
– আপনাকে আজ খুব বেশি চিন্তিত দেখাচ্ছে।
– উনি যে মেয়েটার কথা বললো সে আমার জমজ বোন। যাকে এতোদিন মৃত বলেই জানতাম। তবে একটা বিষয় তো পরিস্কার যে এইসব কাজ করছে সে ভালো করেই জানতো সুনয়না বেঁচে আছে এবং সে আমার বোন। ঐ রাতে মায়ার উপর হামলা করে।
– তাহলে কারণ টা কি দাড়াচ্ছে! এমন কেউ এসবের সাথে জড়িত যে আপনার পরিবারকে ঘৃণা করে। আপনার পরিবার কে শেষ করতে চায়।
– হুম।
– আমার মনে হয় স্যার, আপনার ছোট মা’র সেই ভাই এখনো জীবিত আছে। আমাদের একবার ভালো করে খোঁজা উচিত।
– সে কথাও এখনো বিশ্বাস করে উঠতে পাচ্ছি না।
– কেন স্যার!
– উনি আমার পরিবার কে ঘৃণা করবেন কিন্তু আরশ তো আমাদের পরিবারের কেউ না। আরশ তো উনার ভাগ্নে। তাহলে উনি আরশ কে কেন ফাঁসাবেন!
– সব কিছুই কেমন যেন গড়মেলে। তবে ঐ চেইনটা কার!
– এদিকে তো মনে হয় উনি বেঁচে আছেন। নাহ্, এভাবে হচ্ছে না। আমার প্রচন্ড মাথা ব্যাথা হচ্ছে। মনে হচ্ছে মস্তিষ্কে প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তবে আমার বোনটাকে যদি একবার দেখতে পারতাম! আচ্ছা রাত হয়ে গেছে চলো বাসায় চলে যাই।
– আমার বাইকে করে আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি চলুন।

এখন আমরা দু’জনেই আমাদের বাসার সামনে।
– তো স্যার, আপনি গিয়ে রেষ্ট করুন। আগামী সপ্তাহে তো আবার শুনানি আছে।
– তুমি আমার একটা কাজ করতে পারবে!
– কি কাজ!
– মেয়েটা সত্যি আমার বোন কি না সেটার খোঁজ নিতে পারবে!
– আমি আমার সাধ্য মতো চেষ্টা করবো।

বাসার সবাই ড্রয়িং রুমে বসে আছে। সবার মুখেই গম্ভীর ভাব।
– আপনারা এখনো ঘুমিয়ে পড়েন নি?
আব্বু আমায় জিজ্ঞেস করলাে- তুমি কি জানতে মেয়েটা সুনয়না ছিলো!
– আমিও আজকেই শুনলাম।
– আমি যদি একটু দায়িত্বশীল হয়ে খোঁজ নিতাম তবে হয়তো আমার মেয়েটা বেঁচে থাকতো আর আমার ছেলেও বাসায় থাকতো।
আব্বু চোখ মুছতে লাগলো।
– আপনার উচিত ছিলো কিন্তু সেটা তো আপনি করেন নি। আপনার চারজন সন্তানের মাঝে শুধু অবন্তীর জন্য আপনি একজন আদর্শ পিতা হতে পারেন কিন্তু বাকি তিনজনের কাছে আপনি একজন ব্যার্থ পিতা। চন্দ্রিমা মায়া দু’জনেই রুমে আসো।

ওদের দুজন কে নিয়ে রুমে আসলাম।
আমি বেডে বসে আছি। চন্দ্রিমা এসে জিজ্ঞেস করলো- তুমি খাবে না!
– না। ইচ্ছে করছে না। তোমরা দুজনেই সাবধানে থেকো। হয়তো পরবর্তী কোনো আক্রমণ হলে সেটা তোমাদের উপর আসতে পারে। কারণ যে এই কাজ গুলো করছে তার টার্গেট আমার পরিবার।

“আমরা তো তোমার পরিবার নই” – দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে অবন্তী বললো।
– তুমি কখন আসলে!
– তুমি যে আব্বু কে এসব বললে, তুমি জানো আব্বু কে আমি কতদিন কান্না করতে দেখেছি তোমাদের জন্য! বড় মা’র জন্য! হয়তো উনি পরিস্থিতির জন্য তোমাদের পাশে থাকতে পারেনি এই জন্য তুমি উনাকে ব্যার্থ পিতা বলতে পারো না। আমি অন্তত তোমার থেকে এমন কিছু আশা করিনি ভাইয়া।
অবন্তী আমায় কথা বলার সুযোগ না দিয়েই চোখ মুছে দৌড়ে চলে গেলো।
– ভাইয়া, অবন্তী তোমায় অনেক বেশি ভালোবাসতে। সেটা তুমি জানো। কিন্তু তুমি আজ সত্যি ওকে অনেক আঘাত করছো। তুমি তো জানোই মেয়েরা তার বাবার সম্পর্কে কোনো কটু কথা সহ্য করতে পারে না। তাদের হৃদয় কেঁপে উঠে।
– তখন তো মাথায় অনেক প্রেসার ছিলো কি বলতে কি বলে দিয়েছি। কিন্তু এখন কি করবো!
– তোমার উচিত সময় থাকতেই ওর রাগ ভাঙ্গানো। সময়ের সাথে সাথে শুধু রাগ না, রাগ করার কারণে দূরত্ব ও বেড়ে যায়।

রুম থেকে বের হলাম। কিন্তু সেদিনের সেই অদ্ভুত মানুষটা কে আজ আবার দেখলাম। চারদিকে চোরের মতো করে তাকাচ্ছে। এখনই কি ধরে ফেলবো! না, আগে দেখা যাক কার রুমে যায়।
যেটা আমি কখনোই ভাবিনি সেটাই দেখতে হচ্ছে। লোকটা চুপিচুপি দাদুর রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।

To be continue…..

প্রিয় চন্দ্রিমা ২ পর্ব-১২

0

#প্রিয়_চন্দ্রিমা
Sumon Al-Farabi
#১২তম_পর্ব( দ্বিতীয় সিজন)
– আজ সবাই কোর্টে উপস্থিত ছিলো। আপনি কেন বাসায় বসে ছিলেন! আপনার মনে কি বিন্দু মাত্র মায়া নেই!
বাসায় ফিরেই দাদুর রুমে এসে দাদুকে কথাগুলো বললাম।
– আমি গিয়ে কি করবো! তোমরা সবাই তো সেখানে ছিলেই।
– শুনেছিলাম আপনার আদরেই আরশকে বিগড়ে দিয়েছে। বিশ্বাস করুন ও বের হয়ে সব থেকে বেশি ঘৃণা আপনাকেই করবে।
– তুমি তো ঘৃণা করোই। এরপর থেকে না হয় আরশ ও করবে।
– ঘৃণা! আমি! সেটাও আপনাকে! হাহাহা। অসম্ভব, এমন কিছু কখনো কল্পনাও করবেন না। আপনি মানুষটা আমার জীবনের সব থেকে নিকৃষ্টতর মানুষ। যে ঘৃণার ও অযোগ্য। শুধু মাত্র রক্তের সম্পর্ক জন্য কথা বলতে না চেয়েও কথা বলি। নয়তো যেদিন সবটা শুনেছি ঐ দিনই আপনার জন্য পৃথিবীর আলো বাতাস নিষিদ্ধ করে দিতাম। তবে দশদিন পর দ্বিতীয় শুনানি ঐদিন যেন আপনাকে সেখানে দেখি। আমি চাই না এরপর এই পরিবারে বিন্দু মাত্র কোনো বিভেদ থাকুক।

রুমে চলে আসলাম। সাধারণত কোনো বিষয় নিয়ে আমরা যখন খুব চিন্তিত থাকি, আমাদের মস্তিষ্ক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না ঠিক সেই সময় আমাদের এমন কাউকে প্রয়োজন পড়ে যাকে আমরা ইচ্ছে অনুযায়ী কিছু কথা শুনিয়ে দিতে পারি। এতে যে খুব বেশি কিছু উপকার হয় তেমন কিছু না। সাময়িক একটু পৈশাচিক শান্তি পাওয়া যায়। একটু আগেও সেটাই হলো।

দু’হাতে মাথা চেপে বসে আছি। চন্দ্রিমা রুমে কখন আসছে সেটা খেয়াল করিনি।
– এভাবে বসে আছো কেন!
– মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে।
“আরশ ভাইয়াকে নিয়ে তুমি একটু বেশিই চিন্তা করছো তো তাই এমনটা হচ্ছে “- কথাগুলো বলতে বলতেই চন্দ্রিমা আমার মাথা টিপে দিতে লাগলো।
আমি শক্ত করে চন্দ্রিমার কোমড় জড়িয়ে ধরে আমার মাথা সেখানে চেপে ধরলাম।
– তুমি শুয়ে পড়। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। কিছুটা আরাম হবে।

চন্দ্রিমা হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মাঝে মাঝে একটু একটু চুল টানছে। অদ্ভুত এক প্রশান্তি।
– কিছুটা কমলো কি!
– হ্যাঁ কমছে ধীরে ধীরে।
– তোমায় একটা কথা বলি!
– কি কথা!
– আম্মুর চেইন টা মায়া আপুকে দিয়েছে। আন্টির চেইনটা অবন্তী নিয়েছে আজ।
– হ্যাঁ , তো!
– তোমার কাছেও তো একই রকম একটা চেইন আছে ঐটা আমায় দিবে!
– তোমার বালিশের নিচেই আছে নিয়ে নাও।
চন্দ্রিমা তাত্ক্ষণিক বালিশের নিচে হতে চেইনটা বের করলো- তুমি পড়িয়ে দিবে নাকি আমি পড়বো!
– তুমি নিজেই পড়ো।
আমি এতক্ষণ চোখ বন্ধ করেই কথাগুলো বললাম। কিন্তু হঠাৎই চন্দ্রিমা বললো- এই চেইনটাতে একটা পাথর কম আছে।
চন্দ্রিমার কথা শুনে চোখ খুললাম – কি বলছো এসব! চেইনের মাঝে আবার পাথর কোথায় পেলে!
– তুমি দুই মিনিট অপেক্ষা করো আমি আসছি।
চন্দ্রিমা দৌড়ে বাইরে গেলো। একটু পরেই আবার অবন্তী কে নিয়ে রুমে আসলো। আমি তখনও চোখ বন্ধ করেই শুয়ে আছি।
– এই চোখ মেলো।
– কি হয়েছে!
– এখানে তাকাও, এই দেখো এই চেইনে পাঁচটা হীরের মতো চকচকে পাথর বসানো। কিন্তু এটাতে চারটা। মানে একটা নেই। তুমি এই একটা পাথর বসিয়ে এনে দিবা।
তড়িঘড়ি করে উঠে বসলাম। চন্দ্রিমার হাত থেকে চেইনটা নিয়ে সোজা ছোট মা’র রুমে চলে আসলাম।
– তুমি এমন নক না করেই হনহন করে রুমে চলে আসলে কেন!
– আপনি আরশ কে ছাড়ানোতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না কেন!
– কারণ বাইরে ওর বিপদ আছে তাই।
– আপনি কিভাবে বুঝলেন ওর বিপদ আছে! বিপদ কি নিজে এসে আপনাকে বলে গিয়েছে?
– কি বলতে চাচ্ছো তুমি?
– সত্যি করে বলবেন, আপনার বড় ভাই যে একটু এবনরমাল ছিলো, উনি কি সত্যি মারা গিয়েছে! নাকি এখনো বেঁচে আছে?
– তুমি একজন মৃত মানুষ কে নিয়ে এভাবে কথা বলছো কেন!
– কারণ আমার ধারণা যদি সত্যি হয় তবে ঐ মৃত মানুষই কিছু দিন আগে রাতে চোরের মতো চুপিচুপি আপনার কছে এসে আপনাকে ভয় দেখিয়ে গিয়েছে।
– এমন কিছুই হয় নি। আমার কাছে কেউ আসে নি।
– এইরকম চেইন আপনারা পাঁচ টি বানিয়েছিলেন। আম্মুটা মায়ার কাছে এবং বাকী চারটা আপনাদের চারজনের কাছেই আছে। তবে আমি গত দিন চাদরসহ যে চেইনটা পেলাম সেটা কার! বাকী তো থাকে শুধু আপনার মৃত ভাই। তাহলে ঐদিন উনি এসেছিলো। তবে উনি জীবিত আছেন। আপনারা সকলকে মিথ্যা জানিয়েছেন।
– এমন কিছু না। ও মারা গিয়েছে আজ অনেক বছর হলো।
– তবে এটা কার!
– আমি জানি না। আমার ভাই তো সাতার জানতো না। পানিতে পড়ে মারা গিয়েছে। ওর চেইন নদীতেই পড়ে গিয়েছে।
– আর বাহানা বের করতে হবে না। তবে আমি উনাকে খুঁজে বের করবোই। আপনি যতোই লুকিয়ে রাখুন না কেন।

সেদিন রাতে কারো সাথেই কথা হয়নি তেমন। পরের দিন সকাল সকাল রাফির বন্ধুর কাছে চলে আসি। গতবার যখন এসেছিলাম আরশের ফাইলটা দেখতে সেখানে একটা এমন পাথর ছিলো যেটা মেয়েটার নখের ভিতর থেকে পাওয়া গিয়েছে।
– তোমার কি মনে হয় এই পাথর এখানে সুট করবে!
– স্যার, এখানে সুচ করবে না শুধু এই সাদা পাথরটা এই জায়গাতেই ছিলো।
– সব কিছু তো ঠিক আছে তবে উনারা মিথ্যা বলছেন কেন! যে উনি মারা গিয়েছে।
– স্যার ঐ হত্যার আগে মারা গিয়েছে নাকি পরে!
– মে বি পড়ে।
– তাহলে তো হয়েই গেলো। কিন্তু স্যার একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে!
– কি কথা!
– লোকরার সাইকো সমস্যা ছিলো এই জন্য হত্যা করছে মানলাম। কিন্তু এতটা এক্সপেন্সিভ ড্রাগস কোথায় পাবে উনি!
– এমনিতেই অনেক চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তুমি আর নতুন করে মাথায় প্রেসার দিও না।
– ঠিক আছে স্যার। তবে বিষয়টা ভেবে দেখবেন।
– সে ভাবা যাবে, তবে এতটুকু তো শিউর যে আরশ হত্যা করে নি তাই না!
– জ্বি স্যার। আপনিও এতোদিন কনফিউশানে ছিলেন!
– নেশার ঘোরে মানুষ কত কিছুই তো করে পরে আবার ভুলে যায়।

সেখানে থেকে বাসায় ফেরার পথে কয়েকবার ভাবলাম ” একজন অস্বাভাবিক মানুষ এতো এক্সপেন্সিভ ড্রাগস কোথায় পাবে! আসলেই তো। তাছাড়া যতদূর জানি উনাকে বাইরে তেমন বের হতেও দেওয়া হতো না। তবে কি ছোট মা সত্যি বলছে! নাকি তিনি মিথ্যা বলছেন! কিন্তু মায়ের কাছে তো সন্তান সব থেকে আগে। তবে তিনি মিথ্যা কেন বলবেন!

দেখতে দেখতেই শুনানির দিন চলে আসলো। রোজকার নিয়মে কোর্টের কাজ শুরু হলো।বিচারক মহোদয় প্রথমেই লইয়ারকে সর্তক করে দিলেন আজ উপযুক্ত সাক্ষী পেশ করতে না পারলে মামলা ক্লোজড করে দিবেন।
ক্রিমিনাল লইয়ার- সেটার প্রয়োজন হবে না মাননীয় বিচারক। কারণ আজ আমি এমন একজন কে পেয়েছি যে একাই সবটা মিটমাট করে দিতে পারবে।

ভাগ্যগুনে সেই সময় আরশের যে সব বন্ধু ছিলো সবাইকে আমরা ইনফর্ম করি এবং সেদিন আরশের সাথে থাকা একজন বন্ধু আমাদের ডাকে সারা দেয়। যে নিজের জীবীকার জন্য শহরের বাইরে ছিলো দীর্ঘদিন।

To be continue….

প্রিয় চন্দ্রিমা ২ পর্ব-১১

0

#প্রিয়_চন্দ্রিমা
Sumon Al-Farabi
#১১তম_পর্ব( দ্বিতীয় সিজন)
ছোট মা ভিতরে আসলো- কবে যাচ্ছো!
– এখনও ঠিক করা হয়নি।
– কেন! তোমায় যে বললাম আজ চলে যেতে।
– যে কাজটা শুরু করেছি সেটা শেষ না করে কিভাবে চলে যাই বলুন!
– কি কাজ শুরু করেছো তুমি!
– আরশ হয়তো আবার নতুন করে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার স্বপ্ন দেখছে। ওর স্বপ্নটা আর নষ্ট হতে দিবো না।
– আমি তোমায় বলেছি না, ওকে বের করতে হবে না। ও যেখানে আছে সেখানেই অনেক ভালো আছে ।
– তার আগে আপনি আমায় বলুন , একজন মা হয়ে কিভাবে ছেলের মুক্তির পথে বাঁধা হচ্ছেন!
– সেটা অবশ্যই আমি তোমায় বলবো না। আমার ছেলেকে আমি বের করবো কি না সেটা আমার ব্যাপার।
– তাহলে আপনার ও এটা জানা উচিত আমার ছোট ভাইকে আমি বের করবোই। সেটা যেভাবেই হোক।
– তোমার আম্মুর মতো জিদ তোমার। কিন্তু আমার ছেলের কোনো ক্ষতি হলে তবে তোমার ভালো হবে না।

ছোট মা চলে গেলো। দেখতে দেখতে শুনানির তারিখ ও চলে আসলো। এর মাঝে আরশের কথায় কয়েকজনের সাথে দেখা করলাম। কিছু মানুষ শহরের বাইরে থাকায় তাদের সাথে দেখা হলো না।

আজ শুনানি।
প্রথমেই পাবলিক প্রসিকিউটর বলতে শুরু করলো – মাননীয় বিচারক, একটা মামলা যেটার রায় অনেক দিন আগেই হয়ে গিয়েছে। সেটা আবার পুনরায় আপিল করে তদন্ত করার কি আছে! আসামি তো সেই সময়েই নিজের অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছিলো।
ক্রিমিনাল লইয়র- সেই সময় কি আসামির পক্ষের কোনো উকিল ছিলো? ছিলো না। যখন তার হয়ে কথা বলার মতো কোনো উকিল ছিলো না তখন সেখানে মিথ্যা অপবাদ স্বীকার করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না।
– তার পরিবার কেন কোনো লইয়ার ঠিক করে নি! কারণ তারা জানতো তাদের ছেলে অপরাধী।
– মাননীয় বিচারক এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।
বিচারক: আপনারা নিজেদের মাঝে বাকবিতন্ডায় সময় নষ্ট না করে নিজ নিজ সাক্ষ্য প্রমাণ প্রদান করুন।

পাবলিক প্রসিকিউটর আরশের কাছে গিয়ে সেই সময় তার অবস্থার কথা জানতে চাইলো – আপনি সেই সময় রোজ নেশা করতেন তাই তো!
– হ্যাঁ।
– অতিরিক্ত নেশা করার জন্য আপনাকে একবার রিহ্যাবে পাঠানো হয়েছিল, এটা কি ঠিক!
– হ্যাঁ।
– মাননীয় বিচারক, উনি মাত্রাতিরিক্ত নেশা করার কারণে তার পরিবার তাকে রিহ্যাবে পাঠায়, সেখানে থেকে এসে সে কিছু দিন স্বাভাবিক হয়ে চললেও এরপর থেকে আবার সেই নেশার জগতে পা বাড়ায়। আমরা সকলেই জানি নেশার ঘোরে থাকা মানুষের ব্রেইন ঠিক মতো কাজ করে না। তাই সে নেশার ঘোরে মেয়েটাকে তুলে নিয়ে আসে শ্লীলতাহানি করার জন্য এবং হত্যা করে। পরে যখন পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে তখন তার নেশা কেটে যায় এবং নেশা অবস্থায় করা তার অপকর্মের কথা ভুলে যায়।
আরশ: এমন কিছুই হয়নি।
ক্রিমিনাল লইয়ার: আচ্ছা আপনার সব গুলো কথা মেনে নিলাম। এখন আপনি আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিবেন দয়া করে, ১ম প্রশ্ন ” যে জায়গায় খুন হয় তার আশেপাশে প্রায় তিন কিলোমিটারের মাঝে কোনো বাসা নেই। না মানুষ চলাচল করার মতো কোনো রাস্তা আছে। একটা নদীর কিনারা যেখানে সন্ধ্যার পর নেশাখোর মানুষ ছাড়া কেউ যায় না। তবে ও মেয়েটাকে ওখানে আসলো কিভাবে!
– সে মেয়েকে তুলে নিয়ে এসেছে।
– ২য় প্রশ্ন ” আপনি বললেন নেশা অবস্থায় তার সেন্স কাজ করে নি তাই সে মেয়েকে তুলে এনে শ্লীলতাহানি করার চেষ্টা করে অতঃপর হত্যা করে। আপনি কি জানেন এই মেয়ের বাসা সেখানে থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে।
– হ্যাঁ তো!
– মাননীয় বিচারক, খুব সাধারণ ভাবে একটা বিষয় খেয়াল করুন, আমি জানিনা আমার প্রতিপক্ষ বন্ধুর মাথা ঠিক মতো কাজ করছে কি না। উনার বক্তব্য , আরশ সাহেব নেশায় মাতাল হয়ে নিজের সেন্স হারিয়ে মেয়েটাকে হত্যা করেন। কিন্তু মাতাল হবার পরও তার এই সেন্স টা কাজ করছিলো জন্য নেশা করে দশ কিলোমিটার পথ গিয়ে মেয়েটাকে সেখানে হত্যা না করে আবার সেখানে থেকে তুলে তার জায়গায় নিয়ে এসে খুন করলেন। আচ্ছা ঠিক আছে সেটা মেনেও নিলাম। কিন্তু এই দীর্ঘ পথ পারি দিতে সময় মেয়েটা নিজেকে বাঁচানোর একটুও চেষ্টা করলো না?
– কেন চেষ্টা করেন নি! অবশ্যই চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আপনার ক্লাইন্ট তাকে সফল হতে দেয় নি।
– আমরা সাধারণত নিজেকে কারো থেকে বাচাতে হলে প্রতিপক্ষকে আঘাত করার চেষ্টা করি যাতে সে ব্যাথা পায় এবং আমরা পালাতে পারি, সেইফ জোনে যেতে পারি। কিন্তু পুলিশ আইডেন্টিটিতে সেই সময় না আরশ সাহেবের শরীরে কোনো ক্ষত ছিলো আর না তার পোশাকে কোনো টানাহেঁচড়ার চিহ্ন ছিলো।
বিচারক – এটা কি আপনি প্রমাণ করতে পারবেন! কারণ আইডেন্টিটি তো শরীরের হয়, পোশাকের নয়।
– সেই সময় যে অফিসার দায়িত্বে ছিলেন এটা তার বক্তব্য। তার ট্রান্সফার হয় কিন্তু আমরা তাকে আজ এখানে নিয়ে এসেছি।
অফিসার এসে উকিলের বক্তব্য স্বত্তায়িত করে। মামলা প্রায় আমাদের দিকেই।
ক্রিমিনাল লইয়ার- আমার শেষ প্রশ্ন ” আপনি বললেন শ্লীলতাহানির জন্য নিয়ে আসা হয়, কিন্তু পোস্টমর্টেম রিপোর্ট টা হয়তো আপনি দেখেন নি। মেয়ের প্রাইভেট পার্টস্ এ কোনো প্রকার সেরকম সিনর্ডম পাওয়া যায় নি।
– হতে পারে সে নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করে বিরক্ত হয়ে হত্যা করে দেয়।
– তার নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করার উত্তর আমি আপনাকে একটু আগেই দিয়েছি।

পাবলিক প্রসিকিউটর আরশের দিকে যায় – আপনি সেদিন রাতে কি কি নেশাজাত দ্রব্য সেবন করেন! মনে আছে কি তেমন কিছু!
– বিয়ার সাথে ঘুমের ঔষধ ছিলো।
– মাননীয় বিচারক, ঐ মেয়েটার পোস্টমর্টেম রিপোর্টে তার রক্তে অতিরিক্ত পরিমাণ ঘুমের ঔষধ এবং এক ধরনের বিষাক্ত ড্রাগস পাওয়া যায়, যা ইনসুলিন দিয়ে পুস করতে হয়। ৫ mm এর বেশি যদি কোনো সাধারণ মানুষের শরীরে পুস করা হয় তবে সে কিছুক্ষণ পরেই মারা যাবে এবং রোজ সেবন করা মানুষ এই ড্রাগস সর্বোচ্চ ১৫ mm পর্যন্ত নিতে পারে। এটা এতটাই ভয়ানক আর ঘুমের ঔষধ আরশ সাহেবের পকেটেই ছিলো প্রায় ২৫ টার মতো। এখন আমার প্রতিপক্ষ মহোদয় কি বলবেন! এখনও কি বলবেন আপনার ক্লাইন্ট নিরপরাধ!

আমার কাছে এই ড্রাগসের ইনফরমেশন ছিলো না। যার ফলে এই বিষয় নিয়ে আমি কোনো রিসার্চ করি নি। আমার লইয়ার আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

সেদিন বিচারক এক দশ দিনের জন্য সময় দেন। কিন্তু আরশ বিয়ার এবং ঘুমের ঔষধ একসাথে খেয়েছে। মেয়েটাকে প্রথমে ঘুমের ঔষধ খাওয়ানো হয়েছে তারপর সুযোগ বুঝে ড্রাগস পুস করছে।

কোর্ট থেকে বের হয়ে রাফির বন্ধুর সাথে দেখা করলাম।
– তুমি কি এই ড্রাগস সম্পর্কে কিছু জানো!
– আসলে স্যার এটা আমাদের দেশে Available না। যেকোনো কায়দা করে বাইরের দেশ থেকে নিয়ে এসেছে যে এই কাজটা করছে।
– এখন কি করা যায়! কে হতে পারে এই আসামি!
– ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করুন। তবে আমার মনে হয় আপাতত হত্যা কারী না খুঁজে আপনার ভাইকে নিরপরাধ প্রমাণ করা বেশি জরুরি। আগে উনাকে ছাড়িয়ে নিন। তারপর হত্যাকারীকে খোঁজা যাবে।

চলবে।

প্রিয় চন্দ্রিমা ২ পর্ব-১০

0

#প্রিয়_চন্দ্রিমা
Sumon Al-Farabi
#১০ম_পর্ব( দ্বিতীয় সিজন)
রাতে আর ঘুমানো হলো না। সারা রাত যত সব চিন্তাতেই কেটে গেলো।
এখন শেষ রাত, চারদিকে একটু একটু করে আলো ফুটতে শুরু করছে। ফোনটা হাতে নিয়ে ফেসবুকে গেলাম। এই সময় অবন্তী অনলাইন!
– তুমি ঘুমাও নি!
প্রায় দুই মিনিট পরে রিপ্লাই আসলো – ঘুমিয়েছিলাম ভাইয়া। কিছুক্ষণ হলো ঘুম ভাংলো। তুমি ঘুমাও নি!
– ঘুম আসলো না, তাই জেগেই আছি।
– ওহ আচ্ছা। হাঁটতে যাবে বাইরে!
– এই সকাল সকাল!
– হ্যা। ভোরের আবহাওয়াটা অনেক সুন্দর লাগে। ফ্রেশ তাজা বাতাস।
– আচ্ছা ঠিক আছে ফ্রেশ হয়ে বের হচ্ছি।
– ভাবী কি ঘুমাচ্ছে!
– হ্যাঁ।
– মায়া আপু!
– দু’জনেই ঘুমাচ্ছে।
– আচ্ছা আসো আমি ড্রয়িং রুমে আছি। তাড়াতাড়ি আসবা আমার কিন্তু ভয় করবে।

ফ্রেশ হয়ে বের হলাম।
ভেবেছিলাম এতো ভোরে মানুষ এখনো ঘুম থেকে উঠেই নি। কিন্তু রাস্তায় অনেক লোকের সমাগম দেখে আমার ধারণা বদলে গেলো।
– এতো মানুষ হাঁটতে আসে সকালে!
– হ্যাঁ। এনাদের মাঝে বেশিরভাগ মানুষই ডায়াবেটিস রোগের শিকার।
– ওহ আচ্ছা।
– অবন্তী কাল যে লোকটা তোমাদের বাসায় এসেছিলো তাকে কি তুমি চিনতে পেরেছিলে!
অবন্তী থেমে গেলো। এরপর কিছুক্ষণ ভাবলো – না ভাইয়া। আমি চিনি নি। তবে লোকটা আমায় চিনতো আমার নাম জানতো।
– কারণ লোকটা তোমার আশেপাশের কেউ ।
– আমার আশেপাশের!
– হ্যাঁ। তুমি তোমার একজন মামার কথা বলেছিলে আমায় মনে আছে! যে তোমার আম্মুকে খুব ভালো বাসতো!
– হ্যাঁ।
– চন্দ্রিমা কি উনার মেয়ে!
– সেটা তো ঠিক জানি না ভাইয়া। আমি ছোট থেকে জেনে এসেছি ও আমার মামাতো বোন। কিন্তু কোন মামার মেয়ে সেটা জানি না। কখনো জিজ্ঞেস ও করা হয় নি।
– ওহ আচ্ছা। তোমার ঐ মামাও নাকি মারা গিয়েছে।
– সেটা আমি জানি। কিন্তু তোমায় কে বললো!
– গতকাল রাতে আব্বু বললো।
– ওহ আচ্ছা। ভাইয়া ঐদিকে চলো সকালে এখানে অনেক সুন্দর চা পাওয়া যায়। আগে চন্দ্রিমা আমি লুকিয়ে লুকিয়ে হাঁটতে বের হতাম সকাল করে।
– লুকিয়ে কেন!
– দাদু বের হতেই দিতো না। চলো চা খাবো।

সূর্যের আলোর পরিমাণ একটু বাড়তেই আমরা বাসায় ফিরে আসি। ততক্ষণে বাসার প্রায় সবাই জেগে গিয়েছে। অধরা সোফায় বসে আছে । আমি গিয়ে ওর পাশে বসলাম – কি অবস্থা এখন তোমার!
অধরা আমায় জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো- আমার প্রচন্ড ভয় করছে এখনো। ভুত কি আবার আসবে!
– আসলেও ও তোমার কোনো ক্ষতি করবে না।
– কেন!
– কারণ তুমি নিজেই তো পেত্নীর মতো দেখতে ভুত নিজেই না ভয় পেয়ে যাবে।
অধরার কান্নার শব্দ বেরে গেলো।
– পাগলী মেয়ে মজা করলাম তো।
চন্দ্রিমা আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলবে জন্য হয়তো মনস্থির করছে কিন্তু আমি ইশারায় কিছু বলতে নিষেধ করলাম।
– আচ্ছা তুমি এখন নাস্তা করো কেমন আমি একটু শুয়ে পড়বো।
– এখন শুইবে কেন!
– রাতে ভুত তাড়াইছি না! তাই দিনে ঘুমাবো।
অধরাকে রেখে রুমে চলে আসলাম। মায়া ফোনে মনে হয় রাজের সাথে কথা বলছে। মায়াকে ইঙ্গিতে নিষেধ করলাম গতকাল রাতের ঘটনা রাজ কে যেন না বলে। শুধু শুধু ছেলেটা চিন্তা করবে।
চন্দ্রিমা আমার পিছনে পিছনে রুমে আসলো। মায়ার কথা শেষ হতেই মায়াকে নাস্তা করার জন্য বাইরে পাঠিয়ে দিলো।
– কোথায় গিয়েছিলে তুমি!
– বাইরে হাঁটতে।
– কে ছিলো সাথে! অধরা?
– অধরা কেন থাকবে! অবন্তী ছিলো।
– অধরার সাথে এতো ক্লোজড হয়ে বসে কেন সান্ত্বনা দিতে হবে শুনি!
– ও তো আমার বোন তাই না!
– সেটা তো ওর মনে থাকে না। তোমায় নিষেধ করছি না ওর কাছে না যেতে!
– গতরাতে ওর সাথে এমন বাজে একটা ঘটনা ঘটে গেলো আমি ওকে সান্ত্বনা দিবো না! ওর শরীরের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবো না!
চন্দ্রিমা এতক্ষণ আমার সামনে দাঁড়িয়ে সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছিলো আর কথা বলছিলো কিন্তু এবার আমার কাছে এসে গলা চেপে ধরলো – ওর শরীর স্বাস্থ্য জিজ্ঞেস করার জন্য বাসায় অনেক মানুষ আছে। তোমার ওকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করতে হবে না। বুঝতে পারছো!
– মেরে ফেলবে নাকি!
আমার গলা থেকে হাত সরালো- দরকার পড়লে তাই করবো তবুও কারো পাশে যেন না দেখি।
– থাক বাবা আমি এতো তাড়াতাড়ি পৃথিবী থেকে যেতে চাচ্ছি না। আমি এখন একটু ঘুমাবো আর কিছু বলবা!
– না। শুধু যা বলেছি সেটা মনে রাখলেই হবে।

সকালে রোদ থাকলেও সারাদিন আকাশ কিছুটা মেঘলা ছিলো।
এখন বিকেল, মেঘলা দিনের বিকেল গুলো অসম্ভব সুন্দর হয়। মনোরম একটা পরিবেশ পাওয়া যায়। চন্দ্রিমাকে চা বানিয়ে ছাঁদে নিয়ে আসতে বলে আমি ছাঁদে চলে আসলাম। কিছুটা সময় পর ছোট মা চা’র কাপ হাতে ছাঁদে আসলো।
– এই নাও তোমার চা।
– আপনি চা নিয়ে আসলেন কেন! চন্দ্রিমা কোথায়!
– ও আসছিলো আমি ওর থেকে নিয়ে আসলাম। তোমার সাথে একটু কথাও ছিলো।
– কি কথা!
– তোমরা ফিরে যাবে কবে!
– কোথায়!
– ঢাকায়।
– আরশের মামলা পুনরায় তদন্ত শেষ করে ওকে বাসায় নিয়ে এসে।
– সেটার প্রয়োজন নেই। আরশ যেখানে আছে সেখানেই থাক। সেখানেই ও ভালো আছে।
– ওহ আচ্ছা। ঠিক আছে তবে ।
– তোমরা আগামী কালই রওনা দিবে।
– দিতে পারি তবে সত্যি করে একটা কথা বলতে হবে।
– কি কথা!
– চন্দ্রিমার বাবা মা বেঁচে আছে!
কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিলো- বাবার কথা জানি না তবে মা বেঁচে আছে।
– আমি উনার সাথে দেখা করতে চাই।
– কেন!
– আমার শ্বাশুড়ি আমি দেখা করতেই পারি। তাছাড়া চন্দ্রিমার ও তো ইচ্ছে থাকতে পারে ওর আম্মুর সাথে দেখা করার।
– আচ্ছা ঠিক আছে। আমি ঠিকানা দিবো গিয়ে দেখা করে এসো।
ছোট মা চলে যাচ্ছে। আমি চা’য়ে একটা চুমুক দিয়ে বললাম – কয়েকদিন পর পর রাতের আঁধারে আপনার সাথে যে দেখা করতে আসে সে কে! আপনার অতি আপন কেউ!
আমায় কথায় ছোট মা থ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো – কি, কি বলছো তুমি! আমার সাথে কে দেখা করতে আসবে!
– আপনি দেখি ঘাবড়ে গেলেন। আমি তো মজা করলাম।
– এমন মজা আমার একদম পছন্দ নয়।

পরের দিন ছোট মা’র দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে চন্দ্রিমার মা’র সাথে দেখা করি। আমি ভেবেছিলাম হয়তো সেখানে কিছু না কিছু তথ্য পাবো। কারণ আমার মনে হচ্ছিল এই সব কিছুর সাথে চন্দ্রিমার পরিবারের একটা গভীর সম্পর্ক আছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে চন্দ্রিমার মা’র সাথে কথা বলে আমার সম্পূর্ণ ধারণা বদলে গেলো।
সেখানে থেকে সোজা আরশের সাথে দেখা করতে চলে গেলাম। আরশের থেকে সেদিনের যেটুকু ঘটনা ওর মনে আছে সেটুকু শুনলাম।

এখন বিকেল এবং সন্ধ্যার মাঝে একটা সময়। রাজের বন্ধুকে নিয়ে সেই ছোট কুঠুরি ঘরে আছি যেখানে থেকে আরশকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো।
– স্যার কি গন্ধ ঘরটায়।
– এটা এখনো নেশা করার কাজেই ব্যবহার করা হয়। আচ্ছা আমাদের মামলার যে উকিল উনি কি ভালো, আমি বোঝাতে চাইছি ওনার প্রেজেন্টেশন কি গোছানো!
– আপনার কথা মতোই নতুন একজন উকিল ঠিক করেছি। উনার অতীত রেকর্ড চেক করা নেই তো।
– উনাকে যা শিখিয়ে দেওয়া হবে উনি শুধু সেগুলো গুছিয়ে প্রেজেন্ট করতে পারলেই হয়তো আমরা জিতে যাবো।
– এইটুকু তো পারবেই নয়তো উকিল কিসের।
– আগামী সপ্তাহে মামলার শুনানি তাইনা!
– হ্যাঁ স্যার।
– হয়তো এর মাঝে তোমায় আর একটু জ্বলাবো।
– সমস্যা নেই স্যার। আমি সব সময় প্রস্তুত থাকবো।

রাতে শুয়ে শুয়ে শুনানির দিনের চিন্তা করছি।
– টিকেট কেটেছো!
ছোট মা’র কন্ঠ শুনে মাথা তুলে তাকালাম। ছোট মা দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।

To be continue….

প্রিয় চন্দ্রিমা ২ পর্ব-০৯

0

#প্রিয়_চন্দ্রিমা
Sumon Al-Farabi
#৯ম_পর্ব( দ্বিতীয় সিজন)
-তোমার আম্মু এবং ছোট মা গার্লস্ স্কুলে একসাথে পড়তো। তাদের বন্ধুত্ব স্কুল জীবন থেকে। এরপর ওরা যখন কলেজে ভর্তি হয় তখন ওদের সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তোমার ছোট মা’র সাথে আগে থেকেই পরিচয় ছিলো। ও মাঝে মাঝে ওর আব্বুর সাথে আমাদের বাসায় আসতো। ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষে তোমার আম্মুর সাথে আমার বন্ধুত্বের বাইরেও নতুন করে ভালোবাসার সম্পর্ক শুরু হয়। এটা আমাদের দুজনের মাঝেই থাকে। তোমার আম্মু বা আমি কেউ তোমার ছোট মা কে জানাই নি। পরীক্ষা শেষ রেজাল্ট হলো এরপর আমরা তিনজনই ঢাকার একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই। সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিলো।
– বাহ্ ভালো তো। তাহলে হঠাৎ কি হলো!
– অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে আমরা বিয়ে করি।
– ছোট মা আর আম্মু যেহেতু বান্ধবী তবে তারা একসাথেই ছিলো। ছোট মা তাহলে তো আপনাদের বিয়ের বিষয়ে সবটা জানতো!
– না, ও কিছু জানতো না। তোমার ছোট মা ওর এক আত্মীয় বাসায় ছিলো আর তোমার আম্মু ছিলো হোষ্টেলে। তাই এই বিষয় টা ওর অজানা থাকে।
– এতো দিন আপনারা উনার আসেপাশে থেকে নতুন একটা সম্পর্ক ক্যারি করলেন উনি কিছুই বুঝতে পারলো না!
– আমরদ তিনজন যখন একসাথে ছিলাম তখন তোমার ছোট মা’র সাথে বেশি কথা বলতাম। এটা তোমার আম্মুরই পরামর্শ ছিলো। আমাদের দুজনের মাঝে তখন শুধু চোখাচোখি হতো।
– ওহ আচ্ছা। এরপর!
– অনার্স ফাইনাল ইয়ারে তুমি এবং সুনয়না গর্ভে আসো। তুমি কি সুনয়নার ব্যাপারে জানো!
– খুব বেশি কিছু জানি না। তবে কিছুটা জানি।
– ওহ আচ্ছা। তখন তোমার ছোট মা বিষয়টা জানতে পারে। আমি জানতাম না ও আমায় ভালোবাসতো এবং এটাও জানতাম না তোমার দাদু আর ওর আব্বু নিজেদের সম্পর্ক মজবুত করতে আমাদের বিয়ে ঠিক করে রেখেছিলো। কিন্তু তোমার ছোট মা সবটা জানতো।
– না জানিয়ে বিয়ে ঠিক করে রেখেছিলো?
– সেই সময়ে এমনটাই হতো মেক্সিমাম সময়। এরপর বাসায় অনেক ঝামেলা হয়। আমি বাসা ছেড়ে একবারে শহরে চলে যাই। তুমি আমার লাকি চ্যাম্প ছিলে অনার্স শেষ হতে না হতেই আমি মোটামুটি ভালো একটা জব পেয়ে যাই।
– তাহলে আপনি আবার এখানে ফিরে আসলেন কেন!
– তখন তোমাদের বয়স তিন – চার বছর হবে। তোমাদের আম্মু কে নিয়ে এই বাসায় এসেছিলাম তোমার মেজো চাচ্চুর বিয়েতে। সেই সময়টাই আমার গুছিয়ে নেওয়া জীবনটা এলোমেলো করে দেয়।
– কেন!
– যেদিন আমরা আসি তার পরের দিন তোমার ছোট মা’র পুরো পরিবার আমাদের বাসায় আসে। ওর একজন বড় ভাই ছিলো কিছুটা সাইকো টাইপ। উনি এসে তোমার দাদুর সাথে বিভিন্ন ভাবে ঝামেলা বাড়াতে থাকে। উনার দুর্বল পয়েন্ট ছিলো তোমার ছোট মা। ওকে উনি নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতেন। আমায় না পেয়ে নাকি অনেকটা পাগল প্রায় হয়ে যায়। সেদিন তোমার দাদু আর উনার মাঝে একটু হাতাহাতি হয় যার ফলে উনার মাথায় বড় একটা আঘাত লাগে।
– আপনার জীবন তো ফিল্মী।
– জীবন নাটকের থেকেও অনেক বেশি নাটকীয় হয়।
– তারপর কি হলো!
– মেজোর বিয়ের পর যেদিন আমরা চলে আসবো তার আগের দিন রাতে ঐ সাইকো আবার বাসায় আসে। এসে তোমার দাদুকে পুলিশের ভয় দেখায়। সেই সময়ের মানুষ পুলিশ কে প্রচুর ভয় পেতো। জেলে যাওয়ার ভয়ে উনি তোমার গলায় ছুরি ধরে তোমার আম্মুকে অপশন দিয়েছিল স্বামী এবং সন্তানের মাঝে একজন কে বেছে নিতে।
– পুলিশ ভয় পায় অথচ আমায় খুন করতে প্রস্তুত ছিলো!
– যদি তোমার আম্মু আমায় বেঁচে নিতো তবে তো উনাকে জেলে যেতেই হতো তাই উনার বক্তব্য ছিলো জেলে যেতেই যদি হয় তবে
– থাক বুঝতে পারছি। কিন্তু সুনয়নার কি হয়েছিলো!
– সুনয়নার বিষয় ঠিক জানি না। ঐরাতেই তোমার আম্মু তোমায় আর সুনয়নাকে নিয়ে হাসপাতালে যায়। আমি এতটাই বাজপ ভাবে বন্দী ছিলাম যে তেমায় নিয়ে হাসপাতালেও যেতে পারিনি। নিজেকে সেই সময় পৃথিবীর সব থেকে নিকৃষ্টতর পিতা মনে হচ্ছিল। তোমার ছোট চাচ্চু তোমাদের সাথে গিয়েছিলো হাসপাতালে। সেখানে নাকি তোমার নানু এসেছিলো এসে তোমার আম্মুকে বাসায় নিতে চেয়েছে। কিন্তু ও যেতে রাজি না হওয়ায় সুনয়নাকে নিয়ে চলে গেছে।
– তাহলে তো সুনয়না সুস্থ থাকার কথা।
– শুনেছিলাম ঐ রাতেই তাদের এক্সিডেন হয়। পরে তোমার আম্মুকে নাকি কল করে বলেছেন সুনয়না মারা গিয়েছে। পৃথিবীর এক অভাগা মা। ঐ রাতে তোমার আম্মু নিজের জীবনদশায় সব থেকে কষ্টদায়ক সময় কাটিয়েছে। কিন্তু তোমার আম্মু প্রচুর জেদি ছিলো। যার কিছু কিছু বিষয় তোমার মাঝে দেখতে পাই মাঝে মাঝে ।
– এতো সুন্দর করে ফিল্মী স্টাইলে আমাদের জীবন ধ্বংস করা হয়েছিল!
আব্বু চোখের পানি মুছেছে। আমি পকেটে থেকে চেইনটা বের করে দেখালাম – এটা কি আপনি চিনেন!
– হ্যাঁ। চিনবো না কেন! এটা তো ইন্টারে থাকতে বানিয়েছিলাম। আমার কাছেও আছে।
– পাঁচটা বানানো হয়েছিল। কে কে পাঁচজন!
– আমি তোমার ছোট্ট মা এবং ওর সাইকো ভাই, তোমার আম্মু এবং তোমার আম্মুর একজন বান্ধবী। আমার আর তোমার ছোট মা’র টা একসাথে রাখা আছে।
– ছোট মা কে জিজ্ঞেস করায় উনি উনার সাইকো ভাইয়ের কথা বলে না কেন! উনি তো বলে উনার শুধু মাত্র একজন ভাই।
– সেই সাইকো মতো ভাইটা মারা গিয়েছে আজ বেশ কিছু বছর হলো। তখন আরশ ছোট ছিলো।
– আপনাদের জীবনের গল্প নিয়ে উপন্যাস লেখা হলে নিঃসন্দেহে আপনাদের জীবনের উপন্যাস এওয়ার্ড পেতো।
– ঐ যে বললাম না জীবন কিছু কিছু সময় নাটকের থেকেও অনেক বেশি নাটকীয় হয়।

– রাত অনেক হলো ঘুমোতে যান।
– তুমি কি আরশকে ছাড়াতে পারবে!
– যদি আপনারা সাহায্য করেন হয়তো পারবো।
– কোনো সাহায্য প্রয়োজন হলে আমায় বলবে।
– আচ্ছা।

আব্বু রুমে যাচ্ছে। আব্বু এতক্ষণ যা বললো সেগুলো আমি আম্মুর ডায়েরি থেকেই জেনেছি। তবে কিছু বিষয় জানা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো যেগুলো হয়তো আব্বুকে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে।

রুমে আসলাম। মায়া চন্দ্রিমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে।
– মায়া কখন ঘুমালো!
– একটু আগেই।
– তুমি ঘুমাও নি!
– তেমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
– আচ্ছা ঘুমিয়ে পড়।

আমি শুয়ে পড়লাম। চন্দ্রিমা মায়া কে ঠিক করে শুইয়া দিয়ে আমার বুকে মাথা রাখলো – মায়া আপু এতক্ষণ ঐ লোকটার ব্যাপারে কথা বলছিলো।
– কোন লোকটা!
– ঐ যে ভূত।
– কি বললো!
– উনি নাকি হাতে ছুরি নিয়ে মায়াকেই মারতে আসছিলো। লোকটা অবন্তীকে সরে যেতে বলেছিলো।
– কি বলছো এসব!
– আমার মনে হয় লোকটা মায়া আপুকে টার্গেট করে এসেছিলো।
– এই নতুন এলাকায় মায়াকে কেন কেউ টার্গেট করে আসবে! তাছাড়া ওকে তো কেউ চিনবেও না এখানের তাই না।
– আমি ঠিক জানি না। তবে এটা শোনার পর থেকে আমার খুব ভয় করছে। ঘুমানোর জন্য চোখ বুঝলেই মনে হচ্ছে কেউ আসছে রুমে।
– তুমি ঘুমিয়ে পড়।
চন্দ্রিমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু ভাবনায় তো কিছুটা রেশ থেকেই যায়। সত্যি যদি এমন কিছু হয়ে থাকে তবে লোকটা এমন কেউ যে অবন্তীর কাছের বা পরিচিত , তাহলে মায়াকে কেন আক্রমণ করবে!

To be continue….

প্রিয় চন্দ্রিমা ২ পর্ব-০৮

0

#প্রিয়_চন্দ্রিমা
Sumon Al-Farabi
#৮ম_পর্ব( দ্বিতীয় সিজন)
আমার হোয়াটসঅ্যাপে একটা ছবি আসলো। যেখানে একটা মেয়ের পাশে আরশ শুয়ে আছে এবং আরশের হাত মেয়ের কোমড়ে। মেয়ে নিথর হয়ে পড়ে আছে। পাশেই বড় বড় অক্ষরে লেখা ” নেশাগ্রস্ত অবস্থায় শারীরিক চাহিদা পূর্ণ করে বালিকার হত্যা এরপর সেই লাশের সাথেই রাত্রি যাপন ”
যে নাম্বার থেকে ছবিটা আসলো সে রাজের বন্ধু। আমি কিছু বলার আগেই সে আবার বললো- স্যার এটা সেই সময়ের নিউজপেপার।
– আচ্ছা ঠিক আছে এটা নিয়ে আমরা রোববারে কথা বলবো কেমন!
– জ্বি স্যার।
নিউজপেপার গুলো যাচ্ছেতাই ছাপিয়ে দেয়। যেখানে আরশ শুধু হত্যার জন্য কারাগারে আছে সেখানে নিউজপেপার সবাইকে নিকৃষ্টতর কারণ রটিয়ে দিয়েছে।
চন্দ্রিমা পাশে এসে বসলো- কি হলো ফোনের দিকে তাকিয়ে কোথায় হারিয়ে গেলে!
– তেমন কিছু না। আজ কি আর কোথায় যাবে!
– আর কোথায় যাবো! প্রায় তো সন্ধ্যা হয়ে আসলো।
– এখুনি বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছে না।
আমার কথার উত্তর হিসাবে অধরা বললো- আমারও বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছে না। আপুরা বরং বাসায় চলে যাক। তুমি আমি মিলে কিছুটা হেটে আসি কেমন!
– তোমাদের কাউকে হাঁটতে হবে না। বাসায় গেলে সবাই একসাথেই বাসায় যাবো। হাটলেও সবাই একসাথেই হাটবো।
– তোমরা সবাই বাসায় ফিরে যাও রাদিয়া তুমি আমায় ঐ জায়গাটায় নিয়ে যাবে!
– কোন জায়গায় ভাইয়া?
– আরশকে যেখানে থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো।
– শুনেছি সেটা এখানে থেকে বেশ দূরে। ঐখানে একটা নদী আছে সেই নদীর পাশেই।
– তুমি যাওনি কখনো!
– দাদুর ভয়ে শুধু কলেজ থেকে বাসা এবং বাসা থেকে কলেজ ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার সুযোগ হয়নি।
– আচ্ছা চলো বাসায় ফিরে যাই।

এখন প্রায় রাত এগারোটা বাজে।
হঠাৎই অবন্তী,মায়া জোরে চিৎকার করে ভুত ভুত বলে উঠলো। চন্দ্রিমা তখন আমায় জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। চন্দ্রিমা প্রায় ঘুমিয়ে পড়ছে। অবন্তী এবং মায়ার চিৎকার শুনে ওর ঘুম ভেঙে গেলো। দুজনেই উঠে দৌড়ে তাদের রুমে আসলাম। তারা একজন অন্য জনকে জড়িয়ে ধরে ভয়ে কাঁপছে।
– কি হয়েছে মায়া!
– ভাইয়া রুমে ভুত এসেছিলো।
– রুমে কিভাবে ভুত আসবে!
– জানি না। তবে কালো কাপড়ে পুরোটা মুড়িয়ে ছিলো।
হঠাৎ নজরে পড়লো মেঝেতে অধরা পড়ে আছে। দৌড়ে গিয়ে অধরাকে আগে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলাম।
এর মাঝেই বাসার সবাই এসে জমা হলো অবন্তীর রুমে।
– অধরা অজ্ঞান হলো কিভাবে!
– ঐ ভুত করেছে। সাদা পাউডারের মতো কি সব ফু দিয়েছে। আমরা কাঁথা দিয়ে শরীর ঢেকে নিয়েছি কিন্তু ও বাইরে ছিলো ওর শরীরে সব পড়ে ও অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে।
ছোট মা’র অবন্তীকে জড়িয়ে ধরে আছে। চোখে আবছা পানি দেখা যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর সবাই নিজেদের রুমে চলে গেলো। ছোট মা অবন্তী কে নিয়ে উনার রুমে গেলো। আমি চন্দ্রিমা কে বললাম মায়াকে আমাদের রুমে নিয়ে আসতে।
প্রায় ঘন্টা খানেক পর দরজায় ঠকঠক শব্দ। মায়া শক্ত করে আমায় হাত জড়িয়ে ধরলো।
– কে!
– আমি, তোমার আব্বু।
মায়া আস্বস্ত হলো। হাতটা কিছাটা হালকা করলো। চন্দ্রিমা উঠে দরজা খুলে দিলো।
– কিছু বলবেন!
– খুব বেশি ভয় পেয়েছো!
– হঠাৎ করেই সামনে চলে আসে তো তাই। অধরার কি অবস্থা এখন!
– ও রাদিয়ার সাথে আছে। পড়ে গিয়ে মাথায় একটু আঘাত পেয়েছে। তোমাকেই দেখতে আসলাম কি অবস্থা এখন তোমার। আচ্ছা ঘুমিয়ে পড়।
– আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে, বাইরে একটু দাড়ান আমি আসছি।
মায়া শক্ত করে আমায় টেনে ধরলো – ভাইয়া যেও না প্লিজ।
– আমি তো রুমের সামনেই আছি পাগলী। তাছাড়া তোমার ভাবী তো আছেই।
– আমার নিজেরই তো ভয় করছে।
– তুমি ওর সাহস জোগাও। শুধু কিছুক্ষণের তো ব্যাপার। আমি আসছি।
ওদের রুমে রেখে আমি বেরিয়ে আসলাম। আব্বু রুমের সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন।
– কি কথা আছে বলো।
– আপনাদের বাসা থেকে কি গত কিছু দিনের মাঝে কিছু জিনিস চুরি গেছে!
– কই না তো। কেন!
– আমি জানি আজ যে এসেছিলো সে ভুত না। কারণ গত দুই দিন আগেও আমি একজন কে রাতের আধারে পালিয়ে যেতে দেখেছি এই বাসা থেকে।
– তাকে ধরতে পারোনি!
– তার আগেই পালিয়ে যায়। বাসার সবাইকে একটু সাবধানে থাকতে বলবেন। বাসায় মেয়ে মানুষ আছে।
– আচ্ছা।
আব্বু চলে যাচ্ছে। তখন পিছনে থেকে বললাম – কাকে বেশি ভালোবাসতেন! আম্মু নাকি ছোট মা!
আব্বু স্থির হয়ে গেলো। পিছনে ফিরে জিজ্ঞেস করলো- হঠাৎ এই প্রশ্ন!
– জানতে ইচ্ছে হলো।
– তোমার আম্মু ছিলো আমার ভালোবাসা আর তোমার ছোট মা হচ্ছে আমার দ্বায়িত্ব।
– ঠিক বুঝলাম না।
– চা খাবে!
– এতো রাতে! কে বানাবে?
– আমি খুব সুন্দর চা বানাতে পারি। তোমার আম্মুর থেকে শিখেছি।
– রুমে ওরা একা আছে ভয় করবে।
– করবে না। আমরা তো ড্রয়িং রুমেই থাকবো।

রান্না ঘরে আব্বু চা বানাচ্ছে। আমি পাশে দাঁড়িয়ে আছি।
– তোমার আম্মু আমায় যা জ্বালাতন করতো। দুই এক দিন পর পর ওর মাথা ব্যাথা হতো তখন আমায় চা বানিয়ে ওকে দিতে হতো।
– আম্মুর মাইগ্রেন ছিলো জানতাম না তো!
– বোকা ছেলে এটা মাইগ্রেন না।
– তাহলে!
– সরাসরি যদি বলতো চা বানিয়ে দিতে তাহলে তো দিতাম না। তাই ছলনার আশ্রয় নেয়। তোমার আম্মু অনেক ছেলেমানুষী করতো।
লোকটা আম্মুকে সত্যি অনেক ভালো বাসতো। কথা গুলো বলতে সময় উনার মুখে হাসি যেন কেউ লেপে দিয়েছে।
এক কাপ চা আমার দিকে এগিয়ে দিলো – এই নাও চা। খেয়ে দেখো কেমন লাগছে!
চা’য়ে চুমক দিলাম। আম্মুর হাতের চা হঠাৎই মনে পড়ে গেলো। ছেলেরা পৃথিবীর সব কিছু ভুললেও মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ ভুলতে পারে না। সে চা হোক বা বিরিয়ানি।
– এখন মনে হচ্ছে আম্মু আপনাকে খুব যত্নে চা বানানো শিখিয়েছে।
– শুধু চা নয়! আমাকে রান্নাও শিখিয়েছিলো। বাসায় কখনো রান্না করিনি তাই হয়তো এতোদিনে ভুলে গিয়েছি। তবে তোমার মায়ের সাথে থাকলে সপ্তাহে একদিন রান্না করতেই হতো।
– তাহলে তো ভালোই হয়েছে আপনাকে তো আর রান্না করতে হচ্ছে না।
– সেই রান্না আবেগ অনুভূতি ভালোবাসা ছিলো যা এই চারদেয়ালে রাজার বেশে বসে থাকায় নেই।
– আমার নানু বাড়ি কোথায়!
– দুই গ্রাম পড়েই। আমি কখনো সেখানে যাইনি। তবে দুই তিন বছর আগে শুনেছি ঐ পরিবারের আর কেউ বেঁচে নেই। তাদের একমাত্র মেয়ে ছিলো তোমার আম্মু। তাদের আর সন্তান ছিলো না।
– ছোট মা’র বাবার বাসা কোথায়!
– তোমার ছোট মা তোমার দাদুর বন্ধুর মেয়ে।
– ওহ আচ্ছা। ছোট মা’র আর কোনো ভাই বোন নেই!
– ওরা তিন ভাইবোন। দুই জন ভাই এবং তোমার ছোট মা।

ছোট মা’র দুই জন ভাই! তবে ছোট মা আমায় মিথ্যা কেন বললো! অন্য জনের কথা কেন গোপন করলো!

– আচ্ছা আব্বু আমি তো এখন ছোট নেই। আপনি প্লিজ বলবেন ঠিক কি হয়েছিলো! আম্মু এবং ছোট মা’র দুজনের বিষয়ে আমি জানতে চাই।
আব্বু মাথা নিচু করে নিজের চা’য়ের কাপে তাকিয়ে রইলো।

To be continue….

প্রিয় চন্দ্রিমা ২ পর্ব-০৭

0

#প্রিয়_চন্দ্রিমা
Sumon Al-Farabi
#৭ম_পর্ব( দ্বিতীয় সিজন)
ছোট মা চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলো। আমিও ছোট মা’র পিছনে পিছনে রুমে আসলাম।
একটার পর একটা পাতা উল্টে ছবিগুলো দেখছি। এই ছবি থেকে বুঝতে পারছি আম্মু এবং ছোট মা খুব ভালো বান্ধবী ছিলো। মাঝে মাঝে কিছু কিছু জায়গা ফাঁকা। সেখানে থাকা ছবিগুলো হয়তো বের করে নিয়েছে।
আমি তখনও আধশোয়া হয়ে ছবিই দেখছি। অবন্তী আর চন্দ্রিমা রুমে আসলো। চন্দ্রিমা এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার পাশে আধশোয়া হয়ে বসে পড়লো। অবন্তী আমাদের সামনে বসে কিছু সময় চন্দ্রিমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো- একটু তো লজ্জা পাওয়া উচিত। সামনে আমি বসে আছি আর তুমি আমার ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে আছো।
– তুমি আমার সামনে তোমার বর কে জড়িয়ে থেকো আমি কিছু বলতে আসবো না। তুমি আমার বরের সাথে কি করবো সেটাতে কেন বলতে আসবে!

দু’জনেই নিজেদের মাঝে কথা বলছে। দুজনের কেউ আমার হাতের এলবামটায় খেয়াল করে নি। দুজনের ঝগড়া শেষে অবন্তী খেয়াল করলো – তোমার হাতে ঐটা কি ভাইয়া! ঐটা তো আম্মুর এলবামের মতো দেখাচ্ছে।
– হ্যাঁ। এটা তোমার আম্মুর এলবাম।
– ওটা তো আম্মু কাউকে দিতো না। সব সময় আলমারিতে রাখতো। তুমি কোথায় পেলে!
– তোমার আম্মুই দিলো। এখানে আম্মু আর ছোট মা’র তোলা ছবিগুলো আছে। তারা একসাথে পড়ালেখা করার জন্য শহরে গিয়েছিলেন। আম্মু ছোট মা এবং আব্বু। তাদের গল্পটা সেখানেই শুরু হয়।
– আচ্ছা ভাইয়া তোমার নানু বাসা কোথায়!
অবন্তীর প্রশ্নে কিছুটা ভাবনায় পড়লাম। এতোদিনে কখনো নানুর বাসা নিয়ে কোনো ভাবনা মাথায় আসে নি। আম্মু নিজেও কখনো সে বিষয়ে আমায় কিছু বলেনি।
– আমি তো জনাি না। কখনো আম্মু কে জিজ্ঞেস করা হয় নি।
– যেহেতু আম্মু বড় মা এবং আব্বু একসাথে শহরে পড়তে গিয়েছে তাহলে বড় মা’র বাসা এখানেই আশেপাশে কোথাও হবে হয়তো।
– এটা ঠিক। হয়তো আব্বু বলতে পারবে। কিন্তু নানু বাড়ি খোঁজাটা এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ না।
অবন্তী আমার থেকে এলবাম নিয়ে নিজে ছবিগুলো দেখছে। আমি চন্দ্রিমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। হঠাৎই অবন্তী বললো- ভাইয়া এই কয়েকটা ছবিতে তুমি কি কিছু খেয়ল করছো!
অবন্তীর হাত থেকে এলবাম নিলাম – কই দেখি! কি খেয়াল করবো?
– মনে হচ্ছে না ছবিগুলো একপাশে থেকে কম আছে। একজন বা দুজন চরিত্র কে কেটে ফেলা হয়েছে!
– তেমনি তো লাগছে। হয় না এমন যে বন্ধুদের মাঝে কারো সাথে ঝগড়া হলে আমরা নিজেদের কাছে থাকা গ্রুপ ফটোতে তাদের মুখে কালি লাগিয়ে দেই। তেমনি ছোট মা ও মনে হয় কেটে ফেলেছে।
– হবে হয়তো।
– মায়া কি করছে!
– আপুর মাথা ব্যাথা হচ্ছে জন্য শুয়ে পড়ছে।
– তুমিও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। আর হ্যাঁ, গতবারে এসেও তো তোমাদের এলাকা ঘোরা হলো না। কাল তো শুক্রবার বিকেলে একটু ঘুরতে নিও আমাদের।
– আমায় বলছো কেন! তোমার বউকে বলো যে তোমার সাথে এমন আঠার মতো লেগে আছে। লজ্জা সব পানিতে গুলিয়ে খেয়েছে।
অবন্তী চন্দ্রিমাকে ভেংচি কেটে চলে গেলো।
– তোমার বোন একটা হিংসুটে।
– কেন! ও তো ঠিকই বলেছে। ওর সামনে এমন আঠার মতো লেগে থাকার কি দরকার ছিলো!
– খুব নিজের বোনের পক্ষ নিয়ে কথা বলা হচ্ছে তাই না! আচ্ছা ঠিক আছে আমি সরে যাচ্ছি।
চন্দ্রিমা আমার থেকে দূরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে- কি হলো!
– কি হবে!
– আমি তোমার থেকে সরে যাচ্ছি তুমি আমায় আটকাচ্ছ না কেন!
– তুমি সরে গেলে আমারই তো ভালো হবে। কেমন জানি চাপা চাপা লাগছে তখন মুক্ত লাগবে ।
– তাই না! যাবোই না। আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকবে।
চন্দ্রিমা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো।

পরদিন সকাল থেকে সব কিছু ঠিকই চললো। বিকেলে হাঁটতে বের হবো জন্য তৈরি হচ্ছি।
– এতো সাজুগুজু করছো কেন! মনে হচ্ছে মেয়ে দেখতে যাচ্ছো!
– রাস্তায় তো কম বেশি মেয়ে দেখাই হবে। তাছাড়া একটু স্মার্ট না দেখালে কেমন হবে না বলো! হাজার হলেও তো তোমার বর। লোকে কি বলবে! চন্দ্রিমার বর টা কেমন যেন আনস্মার্ট। তখন ভালো লাগবে শুনতে!
– ওহ আচ্ছা। এতো কিছু ভেবে আপনি সাজুগুজু করছেন সেটা তো বুঝতে পারি নি।
চন্দ্রিমা এসে আমার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো – একদম এমন এলোমেলো থাকবে, যাকে কেউ না তাকায়। আমার বর কেমন সেটা আমি জানলেই হবে অন্য কারো সামনে স্মার্ট হতে হবে না।
– টি-শার্ট এ থাকবে নাকি পাঞ্জাবি পড়বো!
– এটাতেই সুন্দর দেখাচ্ছে টি-শার্টই থাক।
দরজায় নক করে অধরা ভিতরে আসলো। অধরা কে দেখে চন্দ্রিমার শরীরে যেন আগুন জ্বলে গেলো – তুমি এখানে কেন!
– সবাই অপেক্ষা করছে তোমাদের জন্য।
– আচ্ছা তুমি যাও আমরা আসছি।
অধরা যেতে গিয়েও ফিরে এসে বললো- এমন উষ্কখুষ্ক এলোমেলো চুলে তোমায় কিন্তু বেশ লাগছে। টি-শার্ট টা ও দারুন মানিয়েছে।
-ধন্যবাদ। এটা তো চন্দ্রিমার পছন্দ।
-আগে বলতে আমিও ম্যাচিং করে জামা পড়তাম। আচ্ছা তাড়াতাড়ি আসো।

চন্দ্রিমা অগ্নি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
কিছু কিছু মানুষ প্রচন্ড রেগে গেলে নিজের অজান্তেই কেঁদে দেয়। চন্দ্রিমাও তাদের মাঝে একজন। দুচোখে পানি ছলছল করছে। এই বুঝি চোখের পলক ফেললেই দুফোঁটা মুক্ত কণা গড়িয়ে পড়বে।
বলতে না বলতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে।
– এই পাগলী কান্না করছো কেন!
– তুমি আমায় ধরবে না। তুমি ওকে ঘুরতে যাওয়ার জন্য বলছো কেন?
– আমি তো বলিনি হয়তো অবন্তী বলছে। আচ্ছা আমি এখনই টি-শার্ট খুলে ফেলছি। তুমি শাড়ি পড়ছো আমিও পাঞ্জাবি পড়ছি কেমন!
বউয়ের মন রাখতে একজন পুরুষ কে যে কতশত ত্যাগ শিকার করতে হয় সেটা শুধু একজন পুরুষই জানে।
অতঃপর বের হলাম।
রুম থেকে বের হওয়ার আগে চন্দ্রিমার সোজাসাপটা ঘোষণা যদি অধরাকে আমার কাছে দেখে তাহলে আমার সাথে আর কখনো কথা বলবে না। এইজন্য অধরাকে কিছুটা এড়িয়ে চলছি।
– অনেক দিন পর আবার সবাই একসাথে এভাবে হাঁটতে বের হলাম তাই না অবন্তী!
রাদিয়ার প্রশ্নে মুচকি হেঁসে হ্যাঁ বললো অবন্তী।
– শুধু সুমন ভাইয়া আসলেই আমাদের এমন হাঁটা হয়। গতবার ও আপুর বিয়েতে হেঁটেছিলাম মনে আছে! ভাইয়া এখানে থেকে গেলেই পারে।
অধরার কথায় চন্দ্রিমা ফিসফিস করে বলছে – হ্যাঁ, এখানে থেকে যাই আর তুমি দিন রাত পিছু লেগে থাকো বেদ্দপ মহিলা।

কিছুটা হাঁটার পর রাস্তার পাশের টং দোকানে বসলাম সবাই। আমরা সবাই চা নিলাম কিন্তু মায়া উঠে গিয়ে একজন মহিলার সাথে দিব্যি হেঁসে হেঁসে কথা বলছে।
মায়া এখানে কাউকে কিভাবে চিনবে! আমি চায়ের কাপ হাতে মায়ার কাছে গেলাম।
– তুমি এখানে কি করছো! উনি কে?
– আন্টি ভাইয়ার সাথে তো আপনার কখনো দেখা হয়নি। এই যে সুমন ভাইয়া।
– ওকে আমি দেখেছি কিন্তু ও কখনো আমায় দেখেনি।
মহিলার গলায় সেই চেইন। কিন্তু এই চেইন এই মহিলার গলায় কেন!
– ভাইয়া উনি আম্মুর খুব কাছের বান্ধবী।
– ওহ আচ্ছা। আন্টি আপনার গলার চেইনটা আমার খুব পরিচিত মনে হচ্ছে।
– এই চেইন তো তোমার আম্মু আমায় উপহার দিয়েছিলো। ওরা এই একই রকম পাঁচটা চেইন বানিয়ে নিয়েছিলো।
– এই ডিজাইনের চেইন কি সচরাচর বাজারে কিনতে পাওয়া যায়!
– আমার চোখে তো আজ পর্যন্ত কখনো পড়ে নি। এটা ইউনিক ডিজাইন কারন তোমার মায়ের পছন্দ সব সময় ইউনিক ছিলো।
এসব কথা বলতে বলতেই অবন্তী এসে হাজির।
– তাহলে আজ আমি আসি। অবন্তী তুমি তো আমার বাসা চেনো। তাহলে সময় করে ওদের নিয়ে এসো। আসি রে মা ( মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে উনি চলে গেলো)

একই রকমের চেইন পাঁচটা। আম্মুর একটা, ছোট মা’র একটা, এই আন্টির একটা। তবে আর দুইটা কার জন্য! আমার কাছে যেটা আছে সেটা কার! ছোট মা’র নাকি অন্য দুজনের মাঝে একজনের! যদি ছোট মা’র না হয় তবে সেই অন্য জন রাতের আধারে কেন বাসায় এসেছিলো! নিশ্চয়ই চুরি করতে নয়। উনি অন্য কোনো কাজে এসেছিলো।
– এখানে মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কি এমন গভীর ভাবনায় ডুবে গেলে! চলো ওরা সবাই বসে আছে।
অবন্তীর কথায় আবার এসে তাদের সাথে জয়েন করলাম।

To be continue…