#প্রিয়_চন্দ্রিমা
Sumon Al-Farabi
#৬ষ্ঠ_পর্ব( দ্বিতীয় সিজন)
এখন ভোর রাত,
চন্দ্রিমা গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। কিন্তু আমার দু-চোখেে যেন বিন্দু মাত্র ঘুম নেই। সারাটা সময় বিভিন্ন কিছু মাথায় এসে জুড়ে যাচ্ছে। কখনো হাতের এই চেইন, কখনো ছোট মা’র হঠাৎই আরশকে ছাড়াতে না বলার কারণ। আচ্ছা মায়ার গলার চেইনটা যদি আম্মু ওকে দিয়ে থাকে তবে এই চেইনটা নিশ্চয়ই ছোট মা’র। কারণ তারা দুজন একসময় খুব ক্লজ ছিলো। এটা তাদের পুরাতন ছবিগুলো দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু গত রাতে যে লোকটা চুপিচুপি বাসা থেকে পালিয়ে গেলো সে তো ছোট মা নয়। সে একজন পুরুষ ছিলো। তবে সে কি চুরি করতে আসছিলো! কিন্তু কিছু চুরি না করেই চলে গেলো! এসব বিভিন্ন ভাবনায় মাথায় প্রচন্ড বোঝ বাড়তে শুরু করলো।
সকালের সূর্য উঠবে সেই মুহুর্তে ঘুমিয়ে পড়ছি। হঠাৎই চন্দ্রিমার গলা শুনে চোখ খুললো। ও কাউকে বলছিলো – তুমি এখানে কি করো! তোমাকে এই রুমে আসতে কে বলেছে!
আমি চোখ খুলে চন্দ্রিমার আগুন ঝড়া চোখ দেখলাম ও দরজায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আমি তো ঘুমে ছিলাম তবে ও কাকে এসব বলছে!
আমার মাথার কাছে থেকে কেউ বললো- আমি ভাইয়াকে দেখতে এসেছিলাম। এভাবে বলছো মনে হচ্ছে আমি তোমার বর কে নিয়ে যেতে এসেছি।
এখন বুঝতে পারছি মাথার পাশে কেউ আছে।
অধরা আমার মাথার পাশে বসে আছে। এই জন্য চন্দ্রিমা রাগে ফোঁস ফোঁস করছে।
– তুমি বাইরে যাও আমরা এখন রেডি হবো।
অধরা বিরক্তিকর একটা ফেস নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। অধরা বের হতেই চন্দ্রিমা দরজা লাগিয়ে এসে আমায় বেডের সাথে চেপে ধরে বললো- তোমায় নিষেধ করছি না ওর ধারের কাছেও যেন না দেখি।
– আমি কি ওর কাছে গিয়েছিলাম নাকি! আমি তো ঘুমে ছিলাম । তুমি হয়তো দরজা খুলে রেখেছিলে তাই ও ভিতরে চলে আসছে।
– ওহ।
চন্দ্রিমা কিছুটা শান্ত হলো।
– বাইরে যাও। আন্টি ডাকছে। রাদিয়া আপুও আসছে ।
ফ্রেশ হয়ে বাইরে আসলাম। বাসার মোটামুটি সবাই আছে। সবার উদ্দেশ্যে বললাম – আপনারা সবাই তৈরি হয়েছেন!
মেজো চাচী অবাক হয়ে বললেন – তৈরি কেন হবো! কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাবে নাকি!
আমি ভেবেছিলাম ছোট মা সবাইকে বলেছে আরশের সাথে ঘুরতে যাওয়া কথাটা। কিন্তু উনি কাউকে বলেনি। ছোট মা আমার দিকে তাকিয়ে ইশারায় নিষেধ করছে কাউকে যেন না বলি।
আব্বু বললো- কোথাও যাবে তোমরা!
– শুধু আমরা না। বাসার সবাই যাবে।
ছোট চাচ্চু – কোথায়!
– আরশের সাথে দেখা করতে।
আরশের নাম শুনে সবাই চুপ হয়ে গেলো। কিন্তু এরমাঝে দাদু বলে উঠলেন – এই বাসায় আরশ নামের কেউ থাকে না।
– কেউ থাকে বা না থাকে এগুলো শুনতে চাইনি আমি। আমি বলেছি মানে সবাইকে যেতে হবে। বাসার একটা ছেলে এতোদিন ধরে কারাগারে আছে আপনারা কেউ তার খোঁজ নিতে যান নি। আপনারা তাকে একবার বোঝার চেষ্টা করেন নি। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা সেটাও যাচাই করেন নি। আজ আমরা সবাই আরশের সাথে দেখা করতে যাবো। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিন সবাই।
– তুমি কে যে তোমার কথা শুনতে হবে!
– আমি কে সেটা জানা বেশি জরুরি না। এখানে জিদ দেখানোর চেষ্টা করবেন না। মনে রাখবেন একই রক্ত শরীরে আছে। আজ যদি আমার সাথে না গিয়ে বাসায় বসে থাকেন তবে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত শান্তিতে বসতে দিবো না কখনো। আপনারা সবাই রেডি হয়ে নিন।
রুমে এসে রেডি হচ্ছি। রাদিয়া রুমে আসলো।
– ভাইয়া সত্যি আমরা আরশ ভাইয়ার সাথে দেখা করতে যাবো!
– হ্যাঁ। কিন্তু তুমি সকাল সকাল কিভাবে আসলে!
– আমি গতকাল শুনেছি তুমি আসছো তাই শুভ্র কে বলতেই ও নিষেধ করেনি।
– সংসার জীবন কেমন চলছে!
– মানুষটা অসম্ভব সুন্দর ভাইয়া। আমায় অনেক ভালোবাসে।
– সৌন্দর্য হারালে কয়েকদিন আফসোস থাকে কিন্তু ভালোবাসা হারানোর আফসোস সারাজীবন থাকে। এই জন্য খুব সহজে কখনো ভালোবাসাকে হারিয়ে যেতে দিতে নেই। শেষ অব্দি পাওয়ার চেষ্টা করতে হয় আর শুভ্র সেটাই করেছে।
– হ্যাঁ ভাইয়া। একটা কথা বলি!
– বলো।
– আমার মনে হয় না দাদু যাবে।
– দেখাই যাক না কি হয়। তুমি গিয়ে দেখো তোমার আম্মু চাচী উনারা কি করছে।
এখন রাত,
ছোট মা আজ আমায় জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন। আরশের সাথে দেখা করে এসে। আজ আরশ ও অনেকটা শান্তি পেয়েছে বাসার সবার সাথে একসাথে দেখা করে। বাসার সবাই কতটা ভালোবাসে তাকে।
– তুমি এই সময় ছাঁদে কি করছো!
ছোট মা’র কন্ঠ শুনে পিছনে ফিরলাম।
– তোমাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দিবো! আমি কখনোই ভাবিনি আরশের দাদুও যাবে দেখা করতে।
– আপনার এতোদিনের ইচ্ছে পূর্ণ করতে পেরেছি এটাই আমার কাছে অনেক বড় পাওয়া ধন্যবাদ লাগবে না।
– তোমার রুমে কেউ নেই। চন্দ্রিমা কোথায়!
– হয়তো অবন্তী আর মায়ার সাথে গল্প করছে।
একটা এলবাম আমার দিকে তুলে ধরে বললো- এখানে হয়তো তুমি তোমার বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর পাবে। তবে আমায় ক্ষমা করে দিও বাবা আমি আমার ভালোবাসাকে পেতেই তোমাকে তোমার পরিবার থেকে আলাদা করে দিয়েছি। এই এলবামে আমাদের সব ছবি আছে। অনেক দিন খুব যত্নে আগলে রেখেছিলাম। তোমার আম্মুর মৃত্যুর খবর শুনে প্রচন্ড কান্না এসেছিলো কিন্তু তবুও আমি কান্না করতে পারিনি। কারণ স্বার্থপর মানুষের চোখে কখনো পানি শোভা পায় না।
To be continue…
#প্রিয়_চন্দ্রিমা
Sumon Al-Farabi
#৫ম_পর্ব( দ্বিতীয় সিজন)
– তুমি তোমার বড় মা’র সাথে কিভাবে দেখা করলে! উনাকে খুঁজে পেলে কিভাবে!
– আব্বুর থেকে ঠিকানা নিয়েছিলাম।
– আমার সাথে দেখা করলে না যে!
– তুমি কি যেন কাজে শহরের বাইরে ছিলে তাই তোমার সাথে দেখা হয়নি।
– আচ্ছা । তুমি তোমার আম্মুর সাথে দেখা করো না কেন! উনি প্রতিবার এসে আবার ফিরে যায়। এতে উনি অনেক বেশি কষ্ট পায়।
– আমিও তো এখানে কষ্ট পাচ্ছি ভাইয়া। উনারা তো কেউ আমায় ছাড়াতে আসলো না। আমি বার বার করে বলেছিলাম আমি ঐ মেয়েকে চিনিই না, কখনো দেখিইনি। যখন কখনো দেখিইনি তাহলে খুন করবো কিভাবে ভাইয়া! আমি মানলাম আমি নেশায় ছিলাম কিন্তু তুমি ভাবো আমি যেখানে বসে নেশা করেছি সেখানে থেকেই পুলিশ আমায় গ্রেফতার করেছে। আশেপাশে অনেক দূর পর্যন্ত কোনো বাসা ছিলো না। তাহলে ঐ মেয়েকে আমি কোথায় থেকে কিভাবে নিয়ে আসবো সেখানে! তাছাড়া পরে জানতে পারি ঐ মেয়ে পাশের এলাকার। আমি যখন ঐ জায়গা থেকে উঠিইনি তাহলে কিভাবে পাশের এলাকায় গিয়ে মেয়েকে তুলে এনে শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করলাম! এই সামান্য কথাটুকু কারো মাথয় ঢুকলো না। বাসায় কেউ আমায় কখনো বোঝে নি বা বোঝার চেষ্টাও করে নি । এই জন্য আমি কারো সাথে দেখা করি না। জীবনের শেষ পর্যন্ত তো এই চার দেয়ালের মাঝেই পঁচে মরতে হবে তাই এখনেই নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছি।
আরশের চোখে যে কেউ তাকালেই বুঝতে পারবে ছেলেটা একটুও মিথ্যা বলছে না। মানুষের শব্দ মিথ্যা বললেও দৃষ্টি মিথ্যা বলে না। তার চাহনি এখনো নিষ্পাপ।
– আমি তোমার মামলা পুনরায় খুলবো। তবে আমি যেমনটা বলবো তুমি ঠিক তেমনটাই করবে। তুমি কি আমার সাথে একমত আছো!
আরশ কিছুক্ষণ নিরব থাকার পর বললো- আমি এখানে থেকে ছাড় পাবো তো ভইয়া!
– আমার কথা শুনলে অবশ্যই পাবে।
– আচ্ছা।
– তোমার ছোট বোন অবন্তীর কথা মনে আছে!
বোনের কথা বলতেই আরশের চোখে পানি চলে আসলো। প্রতিটা ভাই তাদের বোনের জন্য একটু বেশিই ভালোবাসা পুষে রাখে অন্তরে।
– সেই কবে পিচ্চি একটু দেখেছিলাম।
– আগামী কাল ও তোমার সাথে দেখা করতে আসবে। ভুলেও যদি মিস দাও তাহলে ও যে পরিমান অভিমানী তুমি এখানে থেকে বের হলেও হয়তো তোমার সাথে কখনো কথা বলবে না।
– তুমি চিন্তা কইরো না ভাইয়া আমি দেখা করবো।
সেদিনের মতো আরশের সাথে কথা শেষ করে ওর মামলা পুনরায় তদন্ত করার জন্য যা যা ফর্মালিটিস প্রয়োজন সব কিছু করলাম। রাফির বন্ধু এতে অনেক সাহায্য করলো।
রাতে বাসায় আসলাম। বাসায় ফিরতে বেশ কিছু সময় দেরিই হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সোফায় ছোট মা কে বসে থাকতে দেখে একটু অদ্ভুত লাগলো।
– আপনি এখনো ঘুমান নি!
– তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
– আমার জন্য কেন! চন্দ্রিমা কই! ও কি ঘুমিয়ে গেছে?
– চন্দ্রিমা এখানে বসে ছিলাে। আমি জোর করে ওকে রুমে পাঠিয়ে দিলাম। হয়তো শুয়ে পড়ছে।
– ওহ আচ্ছা।
– তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো আমি খাবার দিচ্ছি।
– আমি রুম থেকে আসছি।
রুমে আসলাম। চন্দ্রিমা রুমে নেই। আমি ফ্রেশ হয়ে খেতে চলে আসলাম।
আমার সামনে খাবার দিয়ে ছোট মা সামনে বসলো।
– আরশের সাথে দেখা হলো!
– হ্যাঁ। কথাও হয়েছে বেশ কিছু সময়।
– কি বললো!
– সে অনেক কথা। তবে আমার মনে হয় সেই সময় যদি আপনারা একজন ভালো উকিল দিয়ে মামলাটা লড়াতেন তাহলে হয়তো আরশের জেলে আটকে থাকতে হতো না।
– তুমি ওর সাথে কি কথা বললে!
– এই যে আগামী কাল ও আপনাদের সাথে দেখা করবে।
– সত্যি দেখা করবে!
ছোট মা যেন আনন্দতে কেঁদে ফেললেন। আচল দিয়ে চোখ মুছে বললেন – ওখানে কি ওকে খুব বেশি টর্চার করে!
– সেটা আপনি কাল ওকে জিজ্ঞেস করে শুনে নিবেন।
ছোট মা’র সাথে কথা বলতে বলতেই আমার খাওয়া শেষ হয়ে গেলো।
– আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন আমি ও চলে যাই। আরশের মামলা পুনরায় তদন্ত করার আবেদন করা হয়েছে। এবার ও বের হবে চিন্তা করবেন না।
ছোট মা কে এইটুকু বলে আমি চলে আসতে শুরু করলাম। কিন্তু ছোট মা’র কথা শুনে আমার পা থমকে গেলো। ছোট মা বললেন- আরশকে বের করার দরকার নেই। ও ওখানেই থাক। ওখানেই ভালো আছে।
– আপনি কি বলছেন এসব!
– আমি চাই না ও বাইরে আসুক। বের হয়ে আবার তো সেই নেশা করবে এর থেকে ভালো সেখানেই থাকুক।
ছোট মা দ্রুত সেখানে থেকে চলে গেলেন। আমায় দ্বিতীয়বার কথা বলার কোনো সুযোগ দিলেন না। পিছনে থেকে ডাকলাম কিন্তু তবুও শুনলো না।
ছোট মা তো গত কালও আরশের ছাড়া পাওয়া নিয়ে অনেক আগ্রহ দেখালো তবে এই এক রাতে কি এমন হলো!
সারাদিন অনেক ক্লান্ত ছিলাম তাই বেশি কিছু না ভেবে রুমে চলে আসলাম। এতোদিন ছেলে দেখা করেনি তো তাই বুঝি অভিমানে এসব বললো।
রুমে আসলাম, কিন্তু চন্দ্রিমা এখনো রুমে আসেনি। এতো রাতেও অবন্তীর রুমে কি করছে! অবন্তীর রুমের সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় নক করলাম। কয়েকবার নক করার পরও যখন দরজা খুললো না তখন ভাবলাম হয়তো ঘুমিয়ে গেছে তাই ফিরে রুমে আসছি। চন্দ্রিমা দরজা খুলে বের হয়ে আসলো। সদ্য কাঁচা ঘুম ভেঙে উঠে আসছে।
– তোমরা ঘুমিয়ে পড়ছো?
– কিছু বলবা!
– রুমে গিয়ে দেখলাম তুমি নাই তাই দেখতে আসলাম তুমি এখানে কি না!
– তোমার রুমে আমি কেন থাকবো! আমি আমার রুমে ঘুমিয়ে পড়ছি।
– আচ্ছা ঠিক আছে। গিয়ে শুয়ে পড়। মায়া ঘুমিয়েছে!
– সবাই ঘুমিয়ে গেছে।
ঘুমের ঘোরে মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে মনে হয়। রুমে এসে দরজা লক করে মাত্র শুইছি তখন দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনে উঠে দরজা খুলে দিলাম। চন্দ্রিমা দাঁড়িয়ে আছে।
– তুমি এখানে!
– তুমি আমায় নিয়ে আসলে না কেন?
– তুমি তো বললে তুমি তোমার রুমে ঘুমিয়ে পড়ছো। তাই নিয়ে আসিনি।
– আমি তো তখন ঘুমে ছিলাম। আচ্ছা বাজে কিছু বলেছি কি!
– না।
– ওয়াশ রুমে গিয়ে বুঝতে পারলাম তুমি আমায় ডাকতে আসছো। আজ কই কই ছিলে!
– আরশের সাথে দেখা করতে যাবে!
– ভাইয়া দেখা করবে!
– হ্যাঁ।
– তাহলে তো অবশ্যই দেখা করবো। তোমায় একটা জিনিস দেখাই। হয়তো তোমার থেকে পড়ে গিয়েছে।
– কি জিনিস!
গতকাল রাতে যে চেইনটা পেয়েছিলাম সেই চেইনটা চন্দ্রিমা আমার দিকে এগিয়ে দিলো। – এইটা তোমার!
– তুমি এটা কোথায় পেলো!
– মেঝেতে পড়ে ছিলো। প্রথমে মনে করছিলাম এটা মনে হয় অবন্তীর পড়ে মনে পড়লো আসার সময় মায়া আপুর গলায় এমন চেইন দেখেছি। তাই এটা উনাকে দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু গিয়ে দেখলাম উনারটা তো উনার গলায় আছে। পরে বুঝতে পারলাম এটা তোমার।
– মায়ার গলায় এমন চেইন আছে! তুমি ঠিক দেখেছ তো?
– হ্যাঁ। গতকাল দেখেছি তারপর আজ আবার দেখলাম। একদম একই রকম। বদলে নেওয়া যাবে কেউ বুঝতেই পারবে না কোনটা কার।
এই জন্য চেইনটা এতটা চেনা চেনা লেগেছিল। কিন্তু চেইনটা বিশেষ কারো জন্য বানিয়ে নেওয়া মনে হচ্ছিল তবে মায়ার চেইনের সাথে কিভাবে ম্যাচ করে!
আমার গভীর ভাবনায় ছেদ পড়লো চান্দ্রিমার কথায় – কি এতো ভাবছো!
– তেমন কিছু না।
– এখন গুরুত্বপূর্ণ কথা শোনো, অধরা এসেছে তোমাকে যেন ওর ধারের কাছেও না দেখি। দেখলে কিন্তু খুন করে ফেলবো।
চন্দ্রিমার দিকে অবাক চোখে তাকালাম। যখন বললো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবে ভেবেছিলাম কি না কি! মেয়েদের গুরুত্বপূর্ণ কথাও তাদের মনের মতোই। বোঝা বড়ই দুষ্কর।
#প্রিয়_চন্দ্রিমা
Sumon Al-Farabi
#৪র্থ_পর্ব( দ্বিতীয় সিজন)
ছোট মা আমার দিকে চা’য়ের কাপটা এগিয়ে দিলো – তুমি যে আরশের সাথে দেখা করতে আসছো সেটা কে কে জানে?
– আপনি আমি অবন্তী, চন্দ্রিমা, মায়া। কেন!
– এই বাসার কেউ জানে না?
– এখনো তো কারো সাথে কথাই হলো না।
– এ বাসার কাউকে জানানোর দরকার নেই কেমন!
– কেন! এই বাসার মানুষ জানলে সমস্যা কোথায়?
– এই বাসার সব মানুষ পাষাণ। কারো হৃদয়ে আমার ছেলের জন্য বিন্দু মাত্র ভালোবাসা নেই।
কথাগুলো বলতে বলতেই ছোট মা কেঁদে দিলো।
– আপনি কান্না করবেন না। আমি আগামী কাল আগে একা গিয়ে ওর সাথে দেখা করে আসবো। তারপর দেখা যাক কি করা যায়।
– আমায় সাথে নিয়ে যাবে?
– কাল আমি একাই যাবো। আপনাকে সাথে দেখলো যদি অভিমানে আমার সাথেই কথা না বলে তাহলে সমস্যা হবে।
– আচ্ছা, তুমি যেটা ভালো মনে করো।
ছোট মা চলে যাচ্ছে। আমি পিছনে থেকে ডাকলাম – আচ্ছা এই বাসার কেউ বাঁচাতে চেষ্টা করেনি সেটা বুঝলাম। কিন্তু আপনার যে ভাইয়া আপনার বিন্দু মাত্র কষ্ট দেখতে পারতো না সেই ভাইয়া কোথায়! উনার তো উচিত ছিলো আরশ কে কারাগার থেকে বের করা।
আমার কথায় ছোট মা’র মাথায় যেন বাজ পড়লো। উনি স্থির দাঁড়িয়ে রইলেন। কয়েক সেকেন্ডে পরে উনি আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন- কোন ভাই?
– অবন্তী যে বললো আপনার একজন বড় ভাইয়া আছে যে আপনার বিন্দু মাত্র কষ্ট সহ্য করতে পারে না। সে নাকি সব সময় আপনার সাথে সাথেই থাকছো ছোট বেলায়। উনি এখন কোথায়!
– আমার এমন কোনো বড় ভাই নেই। আমার বাবার আমরা দুজন সন্তান। আমি বড় এবং আমার ছোট একজন ভাই আছে।
– ওহ আচ্ছা।
ছোট মা কথাগুলো বলার সময় কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করছিলেন। মনে হচ্ছে অনেক বড় কোনো অপরাধ করছেন। তাছাড়া ছোট মা’র যদি এমন কোনো বড় ভাইয়া না থাকো তবে অবন্তী কি আমায় মিথ্যা বললো! অবন্তী আমায় মিথ্যা বলবে কেন! এমন সব আকাশ পাতাল ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এখানে আবার অন্য একটা কথা হঠাৎই মস্তিষ্কে প্রবল আঘাত হানলো। যদি উনার কোনো বড় ভাই না থাকে আর যদি উনারা মাত্র দুই জন সন্তান হন তবে চন্দ্রিমা কে!
” তুমি কি আর কিছু বলবে! ” ছোট মা’র কথায় আবার কল্পনা থেকে বাস্তবে আসলাম।
– তেমন কিছু বলার নেই। তবে ভাবছিলাম আমি যেহেতু সবার অগোচরে বিয়ে করেই ফেলেছি তখন কাল সময় পেলে নয়তো পরশু শ্বশুর বাড়ি থেকে ঘুরে আসবো।
– তোমার শ্বশুর বাড়ি কোথায় পাবে!
– কেন! আপনার বাবার বাড়ি তো আমার শ্বশুর বাড়ি।
– মানে! ( ছোট মা ছটফট করছেন) তোমায় কে বললো!
– কেন চন্দ্রিমা আপনার ভাইয়ার মেয়ে না?
– না।
– তাহলে ও কে?
– ওকে আমি এডপ্ট করেছিলাম।
– বাব্বাহ্। আপনার মেয়ে থাকতেও একই বয়সী আবার একটা মেয়ে এডপ্ট করলেন! যদি এডপ্ট এ করলেন তবে ও আপনাকে আন্টি ডাকতো কেন!
– না মানে, ওর আম্মু আমার পরিচিত ছিলো। অনেক দিন অসুস্থ থাকার পর মৃত্যুর আগে আগেই ওকে আমার হাতে তুলে দিয়ে যায়। তখন ও মোটামুটি বুঝতে পারে সব কিছু। এরপর ওকে বাসায় এনে অবন্তীর সাথে লালন পালন করি। বাসয় সবাই জিজ্ঞেস করায় ভাইয়ের মেয়ের পরিচয় দেই।
– আপনি সত্যিই অনেক মহান মনের মানুষ।
ছোট মা চলে গেলো। তবে ওনার চোখে তাকিয়ে যে কেউ খুব সহজেই বলে দিতে পারবে উনি এতক্ষণ যতগুলো কথা বললেন সেখানে অনেক সত্যি কথা লুকিয়ে আছে।
রাতে খাবার টেবিলে সবার সাথে দেখা হলো। তবে বড় ফুপি আর ছোট ফুপি নিজেদের বাসায় চলে গিয়েছে। আমি আসায় দাদু কিছুটা গম্ভীর হয়ে আছে।
রাতে প্রায় বারোটার দিকে আমি ছাদে পায়চারি করছি। হঠাৎই নজরে পড়লো একজন লোক চোরের লুকিয়ে মতো আমাদের বাসা বেরিয়ে যাচ্ছে। খুব সাবধানতা অবলম্বন করছে যাতে করে কেউ বুঝতে না পারে। আমি ছাঁদে থেকে বললাম – এই কে রে ওখানে!
আমার কন্ঠ শুনে দৌড়ে পালাতে গিয়ে সামনে থাকা কিছু একটাতে হোঁচট খেয়ে পড়ে কিন্তু তৎক্ষনাৎ আবার উঠে দৌড়ে পালিয়ে যায়। ততক্ষণে আমি ছাঁদ থেকে দৌড়ে নেমে আসি লোকটাকে ধরবো বলো কিন্তু তার আগেই পালিয়ে যায়। কিন্তু পুরো শরীর যে চাদরের আড়ালে ঢেকে রাখা ছিলো তাড়াহুড়োয় সেটা রেখেই দৌড় দেয়।
সেখানে থেকে আবার যখন বাসার ভিতরে এসে চাদর হাতে নিলাম সেখানে একটা গলার চেইন আটকে ছিলো আর চাদরে টা ডালিম গাছের একটা ভাঙা ডালে আটকে গিয়েছে তাই জন্য চাদরে খুলিয়ে নেওয়ার সময় পায়নি। চেইন টা খুব চেনা চেনা লাগছে। কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে। খুব কাছে থেকে দেখেছি।
পরদিন সকালের খাওয়া শেষ করে আমি সেন্ট্রাল জেলে গেলাম। সেখানে গিয়ে জেলারের সাথে কথা বলে ডিরেক্ট আরশের সেলে চলে আসলাম।
সাথের পুলিশ অফিসার কে বললাম – যদি কিছু মনে না করেন তবে আমি একটু ওর সাথে একা কথা বলতে চাই।
– অবশ্যই স্যার।
আরশকে কয়েকবার ডাকলাম কিন্তু ও শুধু মাথা তুলে আমার দিকে দুই বার তাকালো।
– এদিকে আসবে তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
অদ্ভুতভাবে আরশ আমায় চিনতো। ও সেলে বসে ছিলো সেখানে থেকে উঠে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো- তুমি সুমন ভাইয়া না!
আরশের প্রশ্নে আমি থ হয়ে রইলাম। কিছু বলবাে কিন্তু মুখে কোনো শব্দ আসছে না। কিছুক্ষণ নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- তুমি আমায় কিভাবে চেনো?
– আমি জেলে আসার কিছু দিন আগে বড় মা’র সাথে দেখা করেছিলাম সেখানে তোমার ছবি দেখেছিলাম।
– কিন্তু এতোদিন পর তুমি আমায় চিনলে কিভাবে!
– তোমার গলার দাগটা দেখা যাচ্ছিলো ওখানে থেকে। প্রথম বার তাকিয়ে চোখ পড়েছিলো তারপর আবার তাকিয়ে সিউর হয়ে নিয়েছিলাম ওটা কাটা দাগ কি না । এরপর কিছুক্ষণ ভেবে খুঁজে পেলাম তোমার গলায় কাটা দাগ আছে। দাদু তোমার গলায় ছুরি ধরেছিলো তখন কেটে গিয়েছিলো।
– দাদু আমার গলায় ছুরি ধরবে কেন!
– সেটা তো জানি না। তবে শুধু এতটুকু জানি গলা খুব বাজে ভাবে কেটে গিয়েছিলো। যে কারণে তুমি অনেক দিন হাসপাতালে ছিলে।
– এগুলো তুমি জানলে কি করে!
– বড় মা বলেছিলো।
সব কিছু শুধু আমারই অজানা ছিলো। আম্মু শুধু আমার থেকেই সব কিছু লুকিয়েছে। কিন্তু কেন! এমন অনেক কেন এর উত্তর আমায় খুঁজতে হবে।
To be continue…
#প্রিয়_চন্দ্রিমা
Sumon Al-Farabi
#দ্বিতীয়_সিজন(#৩য়_পর্ব)
অবন্তীর কল কেটে রাফিকে ডাকলাম আমার কেবিনে। কিছুক্ষণের মাঝেই রাফি আমার কেবিনে আসলো- আসবো স্যার!
– হ্যাঁ আসো।
– কিছু বলবেন!
– মায়া কোথায়!
– ওকে তো আমি আপনাদের বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসলাম কিছুক্ষণ আগেই।
– মায়াকে কল দাও।
রাফি মায়াকে কল দিলো। কিন্তু রাফির ফোন থেকে আমি মায়ার সাথে কথা বললাম – মায়া কোথায় তুমি!
– আমি তো ভাইয়া বাসার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।
– বাসার বাইরে কেন!
– অবন্তী বা ভাবী কেউ দরজা খুলছে না। আমি নাকি মায়া নই। তাই জন্য ভিতরে আসতেই দিচ্ছে না।
– আচ্ছা তুমি বাসার দরজার সামনেই থাকো। তুমি কি রং এর ড্রেস পড়ছো?
– কালো।
– আচ্ছা ।
রাফির হাতে ফোনটা দিয়ে আমি অবন্তীকে কল করলাম।
– ভাইয়া কোথায় তুমি! তুমি কি আসছো বাসায়?
– আচ্ছা বাসার সামনে যে মায়া আছে ও কি কালো রং এর ড্রেস পড়ে আছে!
– আমি তো ঠিক খেয়াল করিনি। একটু অপেক্ষা করো দেখে জানাচ্ছি।
অবন্তী জানালা একটু ফাক করে দেখলো- হ্যাঁ ভাইয়া। কালো একটা জামা পড়ে আছে।
– ঐটা তোমার মায়া আপু। দরজা খুলে দাও।
– সত্যি তো?
– হ্যাঁ।
– তাহলে ঐদিন কে ছিলো! যার সাথে আমরা এতো আনন্দ করলাম সময় কাটালাম।
– তোমরা আপাতত তোমাদের আপুকে ভিতরে নিয়ে আসো। আমি পরে তোমায় জানাচ্ছি।
কল কেটে দিলাম। রাফি আমার দিকে থ হয়ে তাকিয়ে আছে।
– কিছু হয়েছে কি?
– তুমি তো জানোই অবন্তী আর চন্দ্রিমা আমাদের বাসায় আসছে।
– হ্যাঁ ।
– আচ্ছা যেদিন অবন্তী আর চন্দ্রিমা আমাদের বাসায় আসছে ঐদিন মায়া কোথায় ছিলো?
– বাসাতেই ছিলো। আমার ঐ দিন কাজ অল্প ছিলো জন্য ওকে নিয়ে আমি একটু বাইরে ঘুরতে গিয়েছিলাম।
– মায়া ঐ দিন আমাদের বাসায় যায় নি?
– না। এটা বলার জন্য তো ও আপনাকে কয়েকবার কল করেছিলো কিন্তু আপনি তো কল উঠান নি।
– ঐদিন মায়ার নাম করে কেউ একজন আমাদের বাসায় এসেছিলো। আম্মুর রুমে কিছু খুঁজেছে।
– কি বলছেন?
– হ্যাঁ। তবে একটা বিষয় কিন্তু ক্লিয়ার হচ্ছে না।
– কি বিষয় স্যার!
– মায়া আমাদের বাসায় আসবে এটা হাতে গুনা আমরা কয়েকজন জানতাম। যে মহিলা বা মেয়ে মায়া নাম নিয়ে বাসায় এসেছিলো সে কিভাবে জানলো ঐ দিন মায়া বাসায় আসার কথা ছিলো কিন্তু মায়া বাসায় আসবে না।
– এটা তো ঠিক। বাসায় কি কোনো সমস্যা চলছে?
– বাসায় সব কিছু কেমন যেন একটু অদ্ভুত রকমের অগোছালো মনে হচ্ছে। তবে এটা খুব শীঘ্রই গুছিয়ে নিতে হবে নয়তো পরবর্তীতে অনেক বড় একটা ফাঁদে আটকে যাবো মনে হচ্ছে।
– আমার কোনো সাহায্য প্রয়োজন হলে অবশ্যই বলবেন।
– আচ্ছা। আপাতত তুমি আমার কাজ গুলো কভার করো। আমি কয়েকদিন একটু বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।
– সেখানে আমার বন্ধু আছে ডিউটি অফিসার। যদি সাহায্য লাগে তবে ওকে বললেই যে-কোন সাহায্য করবে।
– সেটার প্রয়োজন হবে না।
বাসায় আসলাম।
অবন্তী আর চন্দ্রিমা এক রুমে মায়া একাই আম্মুর রুমে বসে আছে।
– ভাইয়া আমার না যাওয়াই মনে হয় ভালো হবে।
– কেন!
– ভাবী অবন্তী দু’জনেই আমায় এখনো ভয় পাচ্ছে।
– আমি তো সিউর করলাম এটাই মায়া। এরপর ও ভয়ের কি আছে!
এতক্ষণে অবন্তীর ভয় কিছুটা কেটে গেলো – সরি আপু। আমাদের সাথে প্রথম দিনেই এমন হওয়ায় একটু বেশি ভয়ে ছিলাম।
– তোমরা কি শপিং শেষ করছো?
– শপিং কিভাবে করবো ওরা দুজন তো আমার সাথে কথাই বলেনি।
– ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছ?
– আমার ব্যাগ তো বাসা থেকেই গুছিয়ে এনেছি।
– আমাদের ব্যাগ ও গুছিয়ে রাখা আছে।
– রান্না হয়েছে নাকি সেটাও বন্ধ ছিলো!
কেউ কথা বলছে না চন্দ্রিমা অবন্তী দু’জন শুধু দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
– বুঝতে পারছি। ঠিক আছে বাইরে খেয়ে নিবো সবাই। আমি ফ্রেশ হতে গেলাম।
ফ্রেশ হয়ে আসলাম। সবাই আম্মুর রুমে গল্প করছে দেখে কাউকে ডাকলাম না। বারান্দায় গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পর মায়া চা নিয়ে হাজির হলো।
– তুমি চা করতে গেলে কেন!
– ভাবী তো নতুন আসছে। আমি তো ছোট থেকে আছি। ভাবী না জানলেও আমি তো জানি অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে তোমার চা প্রয়োজন হয়।
মায়ার হাত থেকে চা নিয়ে চুমুক দিতে দিতে বললাম- এখন আর সেই অভ্যাস নেই। অফিস থেকে এসে চা বানানোর মতো ধৈর্য হয় না।
– আচ্ছা ভাইয়া কি হচ্ছে এসব?
– আমি নিজেও সেটা বুঝতে পারছি না। সব কিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। তবে সব কিছুর মাঝে গভীর একটা গোলমেলে সম্পর্ক আছে মনে হচ্ছে।
পরদিন সকালে অবন্তীদের বাসায় এসে পৌঁছালাম। তবে গতবারের তুলনায় এইবার বাসায় ছোট মা’র ব্যাবহারে একটু ভিন্নতা লক্ষ করলাম। নিজে থেকে আমায় এগিয়ে নিতে এসেছে।
রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লাম। দুচোখের পাতায় কেবল ঘুম এসে ভাব জমিয়েছে। তখনই অবন্তী চন্দ্রিমা কে নিয়ে আমার রুমে আসলো।
– কি হয়েছে! ওকে এভাবে টেনে নিয়ে আসছো কেন?
– ভাইয়া তোমার বউকে তোমার কাছেই রাখো। ও আমার রুমে কেন যাবে?
– আমি তো এতোদিন ঐ রুমেই ছিলাম।
– তখন তোমার বর ছিলো না।
– আচ্ছা ঠিক আছে নিজেদের মাঝে ঝগড়া বাদ দাও। চন্দ্রিমা তুমি আমার কাছে আসো। এখন খুশি?
– হ্যাঁ। আমি আসি তাহলে।
– অবন্তী, মায়ার দিকে একটু খেয়াল রেখো।
– আচ্ছা ভাইয়া।
সেদিন তেমন আর কোথাও বের হওয়া হয়নি। সন্ধ্যায় চা হাতে ছোট মা রুমে আসলো। চন্দ্রিমা আমার পাশেই বসে ছিলো। ছোট মা কে দেখে উঠে দাঁড়ালো। – তুমি চা নিয়ে আসলে কেন! আমায় ডাকতে আমি আসতাম।
– আমি বানালাম তাই ভাবলাম নিয়ে যাই। তুমি অবন্তীর রুমে যাও। আমি সুমনের সাথে কিছু কথা বলবো।
ছোট মা’র কথা শেষ হবার আগেই চন্দ্রিমা চলে যেতে লাগলো। আজকেই ছোট মা’র থেকে জেনে নিতে হবে আম্মুর সাথে তার কি সম্পর্ক ছিলো এবং তাদের মাঝে দূরত্বের কারণ কি ছিলো।
#প্রিয়_চন্দ্রিমা
Sumon Al-Farabi
#দ্বিতীয়_সিজন (#২য়_পর্ব )
রাতে বারান্দায় বসে ফেসবুকিং করছিলাম, চন্দ্রিমা এক কাপ চা হাতে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। চা’য়ের কাপটা আমার হাতে এগিয়ে দিয়ে বললো- রাত তো অনেক হয়েছে, ঘুমাবে কখন?
– তুমি শুয়ে পড় আমি কিছুক্ষণ পরেই আসছি।
– শুনলাম তুমি নাকি আমাদের ঐ দিকে যাবে।
– হ্যাঁ। এখানে কিছু কাজ আছে সেগুলো শেষ করে পরশু হয়তো যাবো।
– কেন যাবে?
– অবন্তীকে ওর ভাইয়ার সাথে দেখা করাতে। আমিও আমার ছোট ভাইয়াকে দেখে আসবো।
– ওহ আচ্ছা। আমি কিন্তু যাবো না।
– কেন?
– আমি কিভাবে আন্টির সামনে গিয়ে দাঁড়াবো?
– তুমি কি এমন অপরাধ করছো যে উনার সামনে দাঁড়াতে পারবে না?
– আমি এই প্রথম উনার কথার অবাধ্য হয়েছি।
আমি উঠে দাঁড়ালাম- এতো কিছু চিন্তা করতে হবে না। আমরা সবাই যাচ্ছি। তাছাড়া আমি আছি তো তোমার সাথে। কোনো সমস্যা হবে না।
ছোট মা’কে নিয়ে কথা বলতে না বলতেই ছোট মা কল করছে। কিন্তু ছোট মা’র নাম্বার আমার ফোনে সেইভ ছিলো না। চন্দ্রিমা নাম্বার দেখে বললো এটা ছোট মা’র নাম্বার।
– হ্যালো।
– আমায় চিনছো?
– হ্যাঁ। চন্দ্রিমা নাম্বার টা চিনিয়ে দিলো।
– চন্দ্রিমার তাহলে আমার নাম্বার মনে আছে! আমি তো ভেবেছিলাম ভুলেই গেছে। নয়তো একদিন হলেও কল করতো।
– আসলে ও একটু ভয়ে আছে তাই কথা বলার সাহস পাচ্ছে না।
– শুনলাম তুমি নাকি অবন্তী কে আরশের সাথে দেখা করতে নিয়ে যাবে।
– হ্যাঁ।
– তুমি সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলে আমি সেন্ট্রাল জেলে কার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। মনে আছে!
– হ্যাঁ ।
– আমি আরশের সাথেই দেখা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার শুধু শুধু গিয়ে ওখানে অপেক্ষা করাই হয় আরশ আমার সাথে দেখা করে না।
– কেন!
– ও তোমার মতোই জেদি। বাসার কেউ ওকে বের করতে চেষ্টা করেনি জন্য ও কারো সাথে দেখা করে না। তুমি কিভাবে ওর সাথে দেখা করবে!
– আমি হয়তো আগামী পরশু রওনা দিবো। তখন গিয়ে যেভাবে দেখা করা যায় সেভাবেই দেখা করবো।
– তুমি আমার সাথে দেখা করিয়ে দিতে পারবে! ( ছোট মা’র কন্ঠ ভেজা ভেজা লাগছে। মনে হচ্ছে কান্না করছে)
– আচ্ছা ঠিক আছে। চেষ্টা করবো।
কিছুটা সময় নিরব থেকে নিজেকে সামলে নিলেন। তারপর চন্দ্রিমার সাথে কথা বলতে চাইলেন। কিন্তু চন্দ্রিমা কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। জোরপূর্বক চন্দ্রিমার হাতে মোবাইল টা দিলাম।
– এই মেয়ে এতো ভয়ের কি আছে! আমি কি তোমায় কখনো বকেছি! তুমি তোমার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করছো। ছেলে আমাদের পরিবারের। তুমি ছোট থেকে আমাদের পরিবারের একজন ছিলে এখন আরও গভীর ভাবে আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে গেলে।
চন্দ্রিমা কান্না করছে। কোনো কথাই বলতে পারছে না। আমি চন্দ্রিমার হাত থেকে ফোন নিয়ে নিলাম – আপনার সাথে পরশু দেখা হচ্ছে। এখন রাখলাম।
চন্দ্রিমা আমায় শক্ত করে জড়িয়ে আছে।
– এভাবে কান্না করতে করতে তুমি তো আমার টিশার্ট ভিজিয়ে দিবে। এবার তো কান্না থামাও।
কে শোনে কার কথা! চন্দ্রিমাকে কোলে তুলে নিয়ে রুমে চলে আসলাম।
পরের দিন সবটা সময় অফিসেই কেটে গেলো। সন্ধার দিকে চন্দ্রিমা কল করলো- বাসায় আসবে কখন?
– আজকে ফিরতে একটু দেরি হবে তুমি খাওয়া করে শুয়ে পড়।
– কতটা দেরি হবে!
– অনেক বেশি দেরি হতে পারে। আমি এখনো ক্রাইম জোনে আছি। এখানে থেকে অফিসে যাবো তারপর বাসায়।
কাজের চাপে মুখ ফশকে ক্রাইম জোন বলে দিয়েছি সেটা খেয়াল করিনি। চন্দ্রিমা যখন জথাটা রিপিট করলো- ক্রাইম জোন মানে! তুমি কিসের ক্রাইম জোনে আছো?
এতক্ষণে মনে পড়লো বাসায় কেউ আমার প্রফেশন সম্পর্কে অবগত নয়।
– তেমন কিছু না। তুমি খাওয়া করে শুয়ে পড় আমি বাসায় এসে কথা বলছি। এখন অনেক ব্যাস্ত আছি।
রাতে বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় একটা বেজে গেলো। দরজায় দুই বার নক করতেই দরজা খুলে দিলো।
– তুমি এখনো জেগেই আছো?
– ঘুম আসছিলো না।
– অবন্তী ঘুমিয়ে গিয়েছে?
– হ্যাঁ।
চন্দ্রিমার হাতে টিকেট গুলো ধরিয়ে দিলাম- কাল রাতে আমরা বাসে উঠবো।
চন্দ্রিমা হাতের টিকেট গুলো গুনতে শুরু করলো – এখানে চারটা টিকেট কেন! আমরা তো তিনজন।
– মায়া আমাদের সাথে যাচ্ছে। ওর হাসবেন্ড কিছু দিন খুব ব্যাস্ত থাকবে তো। তাই ও আমাদের সাথে গিয়ে ঘুরে আসুক। রক্তের না হোক কিন্তু আমাদের বাড়ির মেয়ে তো।
– যেমনটা আমি। তাই না!
– সব কিছুতেই নিজেকে টানবেন না বুঝলেন! আপনি তো এই বাড়ির রাণী।
– আর তুমি বুঝি রাজা!
চন্দ্রিমার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে বললাম – আমি রাজা জন্যই তো তোমায় রাণী করে রাখতে পারছি ।
– তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও আমি খাবার দিচ্ছি।
– তুমি খেয়েছ?
– একসাথেই খাবো জন্য অপেক্ষা করছি।
– আচ্ছা আমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
খাওয়া শেষ করে বারান্দায় সিগারেট জ্বলালাম। কিছুক্ষণ পর চন্দ্রিমা আসলো- তুমি আবার সিগারেট ধরিয়েছ?
– মাত্র জ্বলালাম।
– দিনে কয়টা লাগে?
– কতটা প্রেসারে থাকি সেটার উপর ডিপেন্ড করে।
– এটা যে ক্ষতিকর সেটা কি জানো?
– আমাদের ভালো লাগে এমন কাজের মাঝে বেশির ভাগ কাজেই আমাদের জন্য ক্ষতিকর। তুমি ভিতরে যাও নয়তো তোমার ও ক্ষতি হবে।
– আমারই তো ক্ষতি করছে। তুমি খাচ্ছো এটা আমার ক্ষতি না? তার থেকে আমিও কাল থেকে শুরু করবো যাতে একসাথে মরে যাই।
চন্দ্রিমার কথা শুনে অবাক হয়ে চন্দ্রিমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফিক করে হেসে দিলাম- তুমি এমন ছোট বাচ্চাদের মতো কথা বলছো কেন? আচ্ছা ঠিক আছে এই যে ফেলে দিলাম। চলো ঘুমিয়ে পড়বো।
চন্দ্রিমা আমায় জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ নিরবতার পর চন্দ্রিমা বললো- ঘুমিয়ে গিয়েছ?
– না। কিছু বলবা?
– তুমি রোজ অফিসে যাও। কিন্তু তুমি কি কাজ করো! সেটাই তো কখনো জানালে না!
– সেইটা জানা কি খুব জরুরি!
– অবশ্যই। আমার হাসবেন্ড আমি জানবো না তো কে জানবে?
– আমি একজন ডিটেকটিভ।
চন্দ্রিমা আমার কথা শুনে একটু জোরেই চিল্লিয়ে বললো- ডিটেকটিভ!
চন্দ্রিমার মুখে হাত চেপে ওকে শান্ত করলাম- অবন্তী ঘুমাচ্ছে ও জেগে যাবে।
– তুমি তো আরশ ভাইয়াকে বের করতে পারবে। পারবে না!
– চলো গিয়ে একটা শেষ চেষ্টা করে দেখি। আমারও তো ভাই। যদি নির্দোষ হয় তবে অবশ্যই বের করবো।
– আচ্ছা।
– কাল সকাল সকাল আমি বেরিয়ে যাবো। মায়া এগারোটার দিকে আসবে ও তোমাদের নিয়ে শপিংয়ে যাবে।
পরের দিন অফিসে যাওয়ার পর অবন্তী ফোন দিয়ে বললো- ভাইয়া একটা অপরিচিত মেয়ে এসে বলছে ও নাকি মায়া।
– কি বলো! তোমরা মায়া কে চিনো না! ওর সাথে তো তোমাদের দেখা হয়েছিল।
– হ্যাঁ। কিন্তু সেই দিন তো অন্য কেউ ছিলো। এই মেয়েকে আমি আজকেই প্রথম দেখলাম। কিন্তু এই মেয়ে বলছেন এই মেয়েই নাকি মায়া আপু।
অবন্তীকে মেঝে থেকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে হাতের কাগজটার দিকে লক্ষ করলাম কি এমন আছে এখানে লেখা যার জন্য অবন্তী হঠাৎই অজ্ঞান হয়ে গেলো।
কাগজে লেখা গুলো দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। চন্দ্রিমা অবন্তী পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমি কাগজে থেকে মুখ তুলে চন্দ্রিমার দিকে তাকালাম।
“চন্দ্রিমা, ছোট মা’র অবন্তী ছাড়াও একটা ছেলে আছে এটা তোমরা আমায় এতোদিন জানালে না কেন! আর এই সামান্য একটা লেখা পড়ে অবন্তী এমন অজ্ঞান হয়ে গেলো কেন! ”
আমার কথা শুনে মনে হচ্ছে চন্দ্রিমা শক লেগে গেলো।
– তোমাকে কিভাবে বলবো, আমরা নিজেরাই তো জানতাম না। হয়তো অবন্তীও আজকেই প্রথম জানলো। তাই জন্য সেই শক নিতে না পেরেই অজ্ঞান হয়ে গেছে।
– সেখানে গিয়ে কতদিন থাকলাম কেউ একবার ও সেই বাড়ির ছেলের ব্যাপারে বিন্দু মাত্র কোনো আলোচনা করলো না কেন?
– আমি তো সেখানে ছোট থেকেই আছি। আমি তো কোনো দিন কাউকে এমন কিছু আলোচনা করতে শুনিনি।
– তোমাদের ঐ বাড়িতে আর কতো অজানা কথা লুকিয়ে আছে! রাজা বাদশা আমলের মতো কোনো গোপন কক্ষ আছে নাকি যেখানে সব সিক্রেট জানতে পারবো।
– তুমি মজা নিচ্ছো? এতো বড় একটা বিষয় এতো বছর ধরে লুকিয়ে রেখেছে নিশ্চয়ই এর পিছনে কোনো বড় কারণ আছে।
– তার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই সব কিছু আম্মু জানতো কি করে! কে বলতো আম্মুকে!
দু’জনেই কিছু সময় নিরবতায় বসে আছি। এর মাঝেই অবন্তী চোখ খুললো। চোখ খুলতেই কান্না জুড়ে দিলো। – ভাইয়া তুমি বড় মা’র লেখা কাগজটা পড়ছো?
– হ্যাঁ পড়েছি। এখন এসব নিয়ে কথা বলা ঠিক হবে না। অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ো।
অবন্তী কান্না করেই যাচ্ছে। আমি অবন্তীর সামনে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চন্দ্রিমা কে বললাম- তুমি আর অবন্তী না হয় এখানেই ঘুমিয়ে পড়। আমি আম্মুর রুমে শুয়ে পড়ছি।
– না, আজ তোমাদের বাসর রাত। আমি এসে সব কিছু নষ্ট করে দিলাম। আমি ঐ রুমে যাচ্ছি তোমরা এখানে থাকো।
– তোমার একা থাকার দরকার নেই। নয়তো সারা রাত কান্না করবা। তার থেকে ভালো আমি যেটা বললাম সেটাই করো। এখানেই শুয়ে পড়।
আম্মুর রুমে পায়চারি করছি। সব কিছু কেমন গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে। আমার হাতের পেইজটা ভালো করে দেখছি এটা তো ঐ ডায়েরির পেইজ। হয়তো সেলাই খুলে কোথায় পড়ে ছিলো। আচ্ছা একবার কি আব্বু কে কল করবো! এতো রাতে কল করা উচিত হবে না।
আনমনে হেঁটেই চলছি। না হাটার অবসান হচ্ছে আর না ভাবনার। কোনো কিছুই নদীর কিনারায় নেই মনে হচ্ছে মাঝ নদীতে ভাসছে শুধু। তখনই চোখ পড়লো দরজার দিকে কেউ চন্দ্রিমা দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ চন্দ্রিমাকে দেখে হার্ট বিট কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল।
– তুমি এখানে! অবন্তী ঘুমিয়ে গেছে?
– হ্যাঁ।
– তুমি এখানে কি করছো?
– তুমি ঘুমিয়েছ কি না সেটা দেখতে আসছি।
– তুমি ঘুমিয়ে পড় আমার দেরি হবে।
– তুমি আমাদের সাথে ঘুমাবে চলো।
– সেটা কিভাবে?
– আমি মাঝে থাকবো তোমার কাছে। নয়তো তুমি একা একা এভাবেই হাঁটতে থাকবে ঘুমাবে না।
চন্দ্রিমা আমার হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে গেলো।
আমার বুকে মাথা রেখে আমায় শক্ত করে জড়িয়ে আছে।
– আজকের রাত নিয়ে আমার কতো ভাবনা ছিলো কিন্তু সব কিছু এভাবে হবে সেটা কল্পনাতেও আসেনি।
– হুম।
– তুমি এখনো এসব নিয়ে পড়ে আছো! আজ ঘুমাও যা ভাবার কাল ভেবো।
রাতে যতসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতেই কখন যেন ঘুমিয়ে গিয়েছি। এখন সময় ঠিক কত সেটা আন্দাজ করতে পারছি না। চন্দ্রিমা আমার সামনে চা হাতে দাঁড়িয়ে বসে আছে।
– অনেকটা বেলা হয়ে গেছে। এখন ঘুম থেকে ওঠো।
– ক’টা বাজে!
– প্রায় বারোটা।
– অবন্তী কোথায়!
– ও তো কোচিং গিয়েছে। কিছুক্ষণ পরেই হয়তো ফিরে আসবে।
– তুমি যাও নি!
– গতকাল কেবল বিয়ে করলাম তো আজকেই আবার পড়তে ভালো লাগবে! তাই যাই নি।
ফ্রেশ হয়ে বারন্দায় বসে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে রাদিয়াকে কল করলাম।
– ভাইয়া এতো দিন পর কেমন আছো!
– ভালোই। তুমি কেমন আছো?
– আমি তো ভালোই আছি।
– তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করলে তুমি কি সঠিক উত্তর দিবা?
– কি কথা ভাইয়া! তোমার কন্ঠ এমন শুকনো শুকনো লাগছে কেন!
– অবন্তীর কি আদৌও কোনো ভাই ছিলো!
রাদিয়া চুপ হয়ে গেলো।
– রাদিয়া, বলো।
– আমি জানিনা ভাইয়া।
– আমি তোমার থেকে আমার এই প্রশ্নের উত্তর টা আশা করছিলাম। কিন্তু তুমি নিরাশ করলে। ভলো থেকো আল্লাহ হাফিজ।
কল কাটাতে যাবো ঠিক তখনই রাদিয়া বললো- ভাইয়া একটু দাঁড়াও। অবন্তীর একটা বড় ভাই ছিলো। আরশ ভাইয়া। ও আমার থেকে মনে হয় কয়েক বছরের বড় হবে। তোমার বয়সের অথবা তোমার থেকে কিছুটা ছোট।
– সে কোথায় এখন! তার ব্যাপারে অবন্তীরা কেউ কিছু জানে না কেন?
– অবন্তী চন্দ্রিমা অধরা এরা যখন কেবল বুঝতে শিখছে সেই সময় একটা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ভাইয়া জেলে চলে যায়।
– কি দুর্ঘটনা?
– ভাইয়া মাদকাসক্ত ছিলো। বাসার সবাই হাজার নিষেধ করা সত্বেও সে কারো কথা শুনতো না। একদিন হঠাৎই জানতে পারি আরশ ভাইয়াকে পুলিশ আটক করেছে।
– মাদক নেওয়ার জন্য!
– না।
– তবে!
– মাদকাসক্ত হয়ে একটা মেয়েকে শারীরিক নির্যাতন এবং হত্যার অভিযোগে। কিন্তু ভাইয়া বিশ্বাস করো আরশ ভাইয়া নেশা করলেও ও মেয়েদের সাথে কখনো খারাপ ব্যাবহার করেনি।
– প্রবল নেশা মানুষের বিবেক কে বিকলাঙ্গ করে দেয়। বাসা থেকে ছাড়ানোর কোনো চেষ্টা করে নি?
– মেয়ে জাতীয় মামলা হওয়ার জন্য কেউ ভাইয়াকে ছাড়ানোর কোনো চেষ্টা করেনি। দাদুকে ভয় পেয়ে কেউ কখনো সে বিষয়ে কথা বলেনি। দাদুকে তো জানোই। এখন তো অনেক দিন কেটে গেছে সেটাও সবাই ভুলেই গিয়েছে প্রায়।
রাদিয়ার কল কাটলাম।
সবাই ভুলে গেলেও মা সে তো আর কখনো ভুলতে পারবে না। এই জন্য সেদিন ছোট মা কে সেন্ট্রাল জেলে দেখেছিলাম। কিন্তু আব্বু নিজের ছেলের প্রতি এমন অবিচার কিভাবে করলো? যে কিনা মেয়েকে অসম্ভব ভালোবাসে।
বিকেলে অবন্তীর সাথে বসে চা’য়ে চুমক দিচ্ছি।
– আমার ভাইয়া যদি আমার পাশে থাকতো তবে আমিও আম্মুর মতোই ভাগ্যবতী হতাম।
– কিভাবে!
– আম্মুর একজন ভাইয়া ছিলো একটু অস্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু আম্মুকে খুব ভালোবাসতো। আম্মুকে কেউ কষ্ট দিলে তাকে আচ্ছা শিক্ষা দিতো।
– ভালো তো। আচ্ছা অবন্তী তুমি তোমার ভাইয়াকে দেখতে চাইবে অবশ্যই।
– দেখতে তো অনেক ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমি তো অনেক দূরে।
– চলো একবার ঘুরে আসি তোমাদের বাড়ি থেকে। আমার শ্বশুর বাড়িটাও দেখে আসা হবে নাহয়।
– আচ্ছা।
সেখানে গিয়েই বাকী কি কি লুকিয়ে আছে এই চোখে দেখা সত্যির পিছনে সেইসব জেনে নিতে হবে। আমার রক্তে কখনো কলঙ্ক থাকতে পারে না।
দুইশো আট নাম্বার কেবিনের বদ্ধ কামরায় একটা বেডে টানটান হয়ে শুয়ে আছে উর্বী। তার দু’চোখ বন্ধ। এটি মূলত হসপিটালের রেডিওলজি বিভাগের কামরা। যেখানে সবসময় দুজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার থাকেন। তবে আজ রাওনাফ নিজেই উর্বীর ইউএসজি করছে। সে বসে আছে আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যানারের সামনে,তার সামনে থাকা মনিটরে নিজের সন্তানের উপস্থিতি অবলোকন করে রাওনাফ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে।
এই ব্যাপারটা সে প্রচণ্ড উপভোগ করেছে নাবিল-শায়মী আর শর্মীর বেলাতে। শিমালার ইউএসজি সবসময় সে নিজেই করতো।হসপিটালে আল্ট্রসাউন্ডের কামরায় সবসময় ওয়াইফের সাথে হাজবেন্ডকে থাকতে দেওয়া হয় রাওনাফের নির্দেশে। রাওনাফ বিশ্বাস করে নয়মাস ধরে একটা নারীই শুধু একটু একটু করে মা হয়না বরং একজন পুরুষও একটু একটু করে বাবা হয়। তাই দুজনে মিলে উপভোগ করা উচিৎ সবকিছু।
হাতের ট্রান্সডিউসারটা উর্বীর তলপেটের উপরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সন্তানের সার্বিক অবস্থা নিশ্চিত করছে সে।
কামরায় তারা দুজন ব্যাতীত আর কেউ নেই। রাওনাফই টুক টাক কথা বলছে,উর্বীর থেকে কোনো জবাব আসেনা।
“লোয়ার এবডোমেন খিচিয়ে থেকো না, আমার অসুবিধে হচ্ছে। বি ইজি।”
মনিটরে দৃষ্টি রেখে রাওনাফ বলে।
উর্বী হাত পা ছড়িয়ে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। রাওনাফ হাত থেকে ট্রান্সডিউসার টা সরিয়ে রেখে বেবির ইমেজ প্রিন্ট করে নেয় উর্বীকে দেখাবে বলে। চোখ থেকে রিডিং চশমা খুলে ফেলে সে। তারপর উর্বীর দিকে তাকায়, দু চোখ বন্ধ মেয়েটার। কোর্টে অচেতন হওয়ার পরে সরাসরি এখানে নিয়ে আসা হয়েছে,জ্ঞান ফিরেছে ঘন্টাখানেক হয়ে গিয়েছে অথচ এখন অবধি একটি কথাও বলেনি। রাওনাফ খেয়াল করেছে,এমনিতে সবসময় ঠিকই থাকে তবে অতীত সম্পর্কিত বিষয়ের মুখোমুখি হতে গেলেই মেয়েটা ভয়াবহ মানসিক চাপে পরে যায়, তারপর জ্ঞান হারায়।
রাওনাফ উঠে দাঁড়ায়,টিস্যু পেপার দিয়ে উর্বীর তলপেটে লেগে থাকা লিকুইড মুছিয়ে দিয়ে উর্বীর পেটিকোটের ফিতে ঠিক করে লাগিয়ে শাড়ির কুঁচিগুলো কোমরে গুজে দেয়। উর্বী চোখ মেলে রাওনাফকে দেখে। রাওনাফের মুখভঙ্গি শান্ত, বরাবরের মতো।
রাওনাফ উর্বীর একটা হাত ধরে আরেকটা হাত মাথার নিচে রেখে বলে,”এখন উঠে বসো, সরাসরি উঠবে না। আগে কাত হও খানিকটা, তারপর ওঠো, ধীরে ধীরে।”
উর্বী উঠে বসে। রাওনাফ একগ্লাস পানি দেয় উর্বীর হাতে। উর্বী গ্লাসের দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়,সরিয়ে নেয় হাত।
হাতের গ্লাসটা সরিয়ে রেখে রাওনাফ উর্বীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে উর্বীর থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে ধরে উর্বীর চোখে চোখ রাখে, তারপর একটা চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসে।
উর্বী তাকিয়ে আছে। রাওনাফ নিচুস্বরে বলে,”মাথার কোন পোকাটা কিলবিলিয়ে উঠলো? আমাকে বলো,সরিয়ে দিই।”
উর্বী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠে,”আমার সাত বছরের মৃত্যুযন্ত্রণা একটা শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা হলো। বেঈমান। ভালোবেসে আটকে রাখতে আরো অনেক উপায় আছে। সে বেছে নিলো প্রেয়সীকে কলুসিত করে তাকে বাধ্য করা থাকতে। সম্পর্কটাকে এতটাই সম্মান করতো যে প্রেয়সীর অসম্মান করতেও দু’বার ভাবেনি। তখন আমার বুক ফাটা আর্তনাদও তার কানে পৌঁছায়নি।”
রাওনাফ হাসে। উর্বী তার দিকে অবাক হয়ে তাকায়। রাওনাফ হাসি থামিয়ে বলে,”হাসছি কেনো জানো? তুমি বরাবর একই রকম থেকে যাবে। তোমার কোনো উন্নতি হবে না। যতখানি দোষ না তোমার ছিলো তার থেকে বেশি লাঞ্ছিত হয়েছো তুমি নিজের দোষে। এই যে আজও নিজের জবাব গুলো ওর মুখের ওপর দিয়ে এলে না, জ্ঞান হারিয়ে ফেললে আর এখন আমার সামনে নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করছো যেখানে আমার কাছে কোনো জবাবদিহিতার কোনো প্রয়োজন নেই।”
_সত্যিই কোনো দোষ আমার ছিলো?
প্রশ্নটি করে উর্বী তাকিয়ে আছে রাওনাফের দিকে। রাওনাফ শুকনো হাসি হাসে, তারপর বলে ওঠে,”তা তো আমি জানি না। উর্বী জানে। ঘটনাগুলো উর্বীর সাথে ঘটেছে।”
উর্বী চেঁ’চি’য়ে বলতে থাকে,
_না ছিলো না, কোনো দোষ ছিলো না। আমি চেয়েছিলাম তাকে শোধরাতে, চেষ্টা করেছিলাম। তারপর যখন ব্যর্থ হলাম তখন হাতটা ছেড়ে দিয়েছিলাম।
_তাহলে দোষ নেই।
ঠান্ডা গলায় বলে রাওনাফ। কিছুক্ষণ পরে আবারও বলে ওঠে,”এখন অস্বস্তি হলে চলো, ও এখনও পুলিশ কা’স্টডিতে আছে, জেলখানায় নেওয়ার আগে তোমার জবাব টা দিয়ে আসবে! সবসময় তো চুপ করেই থাকলে,আজ ওকে কিছু কথা শুনিয়ে দিয়ে আসবে চলো।”
উর্বী চুপ থাকে। রাওনাফ হাসতে থাকে। তারপর কিছুক্ষণ পর মুখটা শুকনো করে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”তোমাকে একজন মানুষ প্রশ্নবিদ্ধ করলো মাত্র। আর আমাকে রোজ,রোজ দুনিয়ার মানুষ প্রশ্নবিদ্ধ করে।”
উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ বলতে থাকে,”মানুষের চোখে তোমার প্রতি আমার অনুভূতি আসাটাকে শিমালার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ভালোবাসাকে পানসে করে দিয়েছে। সেদিন বন্ধুদের মধ্যেও একজন মজার ছলে বলে ফেলেছে। এরকম টা আমি সবসময় ফেস করি উর্বী। করতে হয়। করতে হবে। তাই বলে কি শিমালার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ভালোবাসা ফিকে হয়ে যাবে? মানুষ তোমাকে বিচার করবে উর্বী। কিন্তু যেহেতু নিজের অনুভূতি নিজেকে বয়ে বেড়াতে হয় সেহেতু নিজের অনুভূতির বিচার তুমি নিজে করে যে ফলাফল টা পাবে,সেটা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে। তুমি নিজের অনুভূতি বিচার করে দেখেছো তুমি উচ্ছাসের এই অবস্থার জন্য দায়ী নও,তাহলে তুমি দায়ী নও। মানুষ তো তোমাকে কাঠগড়ায় তুলবেই উর্বী। আমি রোজ উঠি, চেনা পরিচিত মানুষের চোখে, আমার অবুঝ ছেলেটির চোখে। আর এমনিতেও মানুষ শিমালার স্থানে নিজেকে বসিয়ে আমাকে অযোগ্য বেঈমান স্বামী বলবে,আর উর্বীর স্থানে নিজেকে বসিয়ে আমাকে যোগ্য স্বামী বলবে। কিন্তু একটাবার কেউ রাওনাফের স্থানে নিজেকে বসিয়ে দেখবে না। তাই নিজের অনুভূতি নিয়ে জবাবদিহিতা আমি মানুষকে করতে বাধ্য নই। তুমিও বাধ্য নও মানুষের কাছে কৈফিয়ত দিতে।”
রাওনাফ থামে। উর্বী তাকিয়ে আছে মানুষটার দিকে তারপর বলে ওঠে,”রাওনাফের সম্পর্কে অনুভূতি কি জানাবো?”
রাওনাফ বলতে থাকে,”তুমি জানো!”
_নিজেকে কার স্থানে বসিয়ে দেখবো? শিমালার?
_বলো।
_শিমালা খুব ভাগ্যবতী।
_কেনো বলছো! আমি তো অবিচার করেছি তার প্রতি, মানুষের চোখে।
_অবিচার করেও যার কাছে প্রতিদিন আপনি জবাবদিহিতা করেন। নিজের অজান্তেই এক সমুদ্র অ’প’রা’ধ বোধ নিয়ে বাচ্চাগুলোর সামনে তাদের মাম্মার গল্প বলেন। এমন প্রতারক স্বামী কজন পায়? যার দীর্ঘশ্বাস নাম জপে তার,যার সাথে সে অবিচার করেছে।
রাওনাফ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে উর্বীর দিকে। কিছুসময় পরে বলে ওঠে,”আর উর্বীর যায়গায় বসিয়ে কি দেখলে?”
_উর্বী এই লোকটাকে ডি’জার্ভ করে না। একদমই করে না। এই অসম সম্পর্কটি আদতেই একটি অসম সম্পর্ক। শুধু অসম বয়সের নয়, অসম মানসিকতার। একজন শুদ্ধ পুরুষকে ভাগ্যক্রমে পেয়ে গিয়েছে একজন আত্মকেন্দ্রিক, লোভী, স্বার্থপর মেয়ে।
কথাগুলো বলতে বলতে টপটপ করে উর্বীর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরতে থাকে। রাওনাফ বলতে থাকে,”আর রাওনাফের স্থানে নিজেকে বসিয়ে কি দেখতে পাচ্ছো।”
উর্বী নিশ্চুপ কেঁদে যাচ্ছে। রাওনাফ বলে,”বলো।”
উর্বী রাওনাফের বুকে ঝাঁপিয়ে পরে রাওনাফের শার্ট খামচে ধরে থাকে চুপচাপ। খানিক বাদে আটকে আটকে বলে,”ধৃষ্টতা নেই আমার এই মানুষটার স্থানে নিজেকে বসিয়ে তার অনূভুতি ব্যাখ্যা করার। শুধু বলবো মাথায়,মনে, যায়গা না হলেও পায়ে একটু স্থান চাই এই মানুষটার। আমার মতো স্বার্থপর মেয়েকে আপনার মতো করে শাস্তি কেউ দিতে পারবে না শর্মীর পাপা।”
রাওনাফ ম্লান হাসে। উর্বী কাঁদছে। একটু পরপর কেঁপে কেঁপে উঠছে। একহাত উর্বীর মাথায় রেখে রাওনাফ একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। উর্বীর মাথাটাকে বুকের সাথে চেপে ধরে বলতে থাকে,”স্বার্থপরতার শাস্তি পেতে চাও নিজের মনের মতো করে,আসলেই স্বার্থপর তুমি!”
****
মোট তিন হাজার আটশো সাইত্রিশ টাকা।
খুচরা টাকা গুলো পরপর তিনবার গুনেও অর্থের পরিমাণ বাড়ানো কিংবা কমানো গেলো না। মোট টাকা তিন হাজার আটশো সাইত্রিশ। শর্মীর অর্থায়ন। যা সে গত চার মাস ধরে,যবে থেকে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে সেদিন থেকে নিজের পকেট মানি থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে জমিয়েছে।
এই টাকা গুলো শর্মীর কাছে অনেক কিছু,কারন শর্মী একটা বিশাল পরিকল্পনা করেছে।
শায়মী হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকতেই শর্মী তার দিকে তাকিয়ে খিকখিক করে হেঁসে উঠে বলে,”তিন হাজার আটশো সাইত্রিশ টাকা।”
_হবে। আমার কাছেও পাঁচ হাজার আছে। আট হাজারেই হয়ে যাবে।
শর্মী তার চার ইঞ্চির মতো লম্বা চুল গুলোকে রাউন্ড হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে পেছনে ঠেলে রেখেছিলো। ব্যান্ড টাকে একটানে সরিয়ে মাথাটাকে এদিকে ওদিকে দুলিয়ে নিজের সিল্কি চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বলে,”আপু আমরা ভিডিও গেমস সেট কিনি? সেদিন ঝুমুর খালামনির ছেলে প্রান্তর জন্য ওর বাবা একটা নিয়ে এসেছে দেখলাম, লেটেস্ট একেবারে।”
শায়মী মুখে চ কারন্ত শব্দ করে বলে,”তোর মাথায় সবসময় গোবরই থাকবে মাথামোটা। বেবি কি জন্মেই ভিডিও গেমস দিয়ে খেলবে? কি খাস রে তুই!”
শর্মী লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,”তাও ঠিক! তবে আমরা দেবো টা কি! দাদু গোল্ড দেবে, চাচ্চু চাচীরা গোল্ড দেবে,ফুপিরা গোল্ড দেবে। আমরা কি দেবো? গোল্ড তো দেবো না।”
_তুই আমার কাছে টাকাটা দে। আমরা কি দেবো সেটা পরে দেখতে পাবি।
এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে নাবিল ওদের ঘরে ঢোকে। তাড়াহুড়ো করে শায়মীকে বলে,”আন্ডাবাচ্চা গুলো চিৎকার চেঁচামেচি করতে করতে মাথা ধরিয়ে ফেলেছে। আমার হেডফোন খুজে পাচ্ছি না কোথাও,তোরটা দে।”
শায়মী মাথা নেড়ে তার হেডফোন খুঁজতে থাকে। শর্মী টাকাগুলো নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। শর্মীর হাতে টাকাগুলো দেখে নাবিল বলে,”এসব কি!”
_আমার।
_দেখে তো মনে হচ্ছে ভিক্ষে করেছিস। সব খুচরা নোট।
কথাটা বলে নাবিল হেসে দেয়।
শর্মী তেতে উঠে বলে,”জমানো টাকা।”
_বুঝতে পেরেছি। চেচাচ্ছিস কেনো! অভদ্র হয়েছিস! এসব তোদের নতুন মায়ের শিক্ষা?
শর্মী কপাল কুঁ’চ’কে দাঁড়িয়ে থাকে। বিরক্তিকর একটা ছেলে,একবার নতুন ভাই পৃথিবীতে আসুক। শর্মী পাত্তাই দেবে না এই ভাইটাকে।
কথাটা বলে নাবিল শায়মীর হাত থেকে থাবা মেরে হেডফোন টা নিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
শর্মী আর শায়মী একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে মুখ শুকনো করে।
আজ তারিখ কত! পাঁচ না ছয়! এমন হচ্ছে গত তিন মাস থেকে। কিছু মনে রাখতে পারছে না উর্বী। যত সময় ঘনিয়ে আসছে ততই তার হুঁশ জ্ঞান হারাচ্ছে সে। সময়ের তাল খুজে পায়না,আজ কি বার মনে করতে পারে না। শুধু বিছানায় শুয়ে হাঁসফাঁস করতে থাকে। বেশিরভাগ সময় কাটে তার খোলা বারান্দায়।
হাত বাড়িয়ে টেবিলের ওপর থেকে ছোটো নকশি কাঁথাটা তুলে নেয় সে। এটা সে অর্ধেকটা সম্পূর্ণ করেছে, তারপর অলসতার জন্য করেনি। দু তিন দিন ধরে পরে আছে টেবিলের ওপর। অবশ্য রাওনাফ এসব দেখলে খুব রেগে যায়। তাই রাওনাফ বাড়িতে থাকাকালীন সময়টাতে উর্বী হাত লাগায়না এসবে।
বাড়ি থেকে তহুরা অসংখ্য নকশিকাঁথা সিলিয়ে পাঠিয়েছে। উর্বী হাত বাড়িয়ে ফোনটা তুলে নেয়। ও বাড়ির লোক গুলোর সাথে উর্বীর কথা হয়না অনেকদিন হয়ে গিয়েছে। তাই উর্বী ফোন লাগায় রেজাউলের কাছে। ওপাশ থেকে রেজাউল ফোনটা রিসিভ করেই বলে ওঠে,”ভুল করে ফোন দিলি!”
উর্বী হাসে,মুখে বলে,”হ্যা।”
রেজাউল বলতে থাকে,”মা খুব দেখতে চাইছে তোকে।”
_তো নিয়ে আসো। কেনো আসছো না এখনও তোমরা!
_মায়ের ইচ্ছে একেবারে নাতী নাতনির মুখ দেখবে গিয়ে। আর এদিকেও অনেক কাজ আছে। তোর শশুর বাড়ির জন্য এটা সেটা কত কিছু প্রস্তুত করছে নিয়ে যাবে বলে। নাতী নাতনির জন্য তার জমানো টাকা দিয়ে একটা আংটি গড়েছে।
_উনি রাগ করবে ভাইয়া শুনলে। ওসবের প্রয়োজন নেই।
_আছে। মা প্রথমবারের মতো নানী হচ্ছে। তার আনন্দটুকু বোঝ!
উর্বী হাসে। তহুরা রেজাউল কবিরের হাত থেকে ফোন নিয়ে অনেকটা দূরে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,”কোনো অসুবিধে বুঝিস?”
_ওনাকে কিছু জানাতে হয়না ভাবী। উনি আমার জানার আগেই সব কিছু জেনে যায়।
ফোনের ওপাশে থাকা তহুরা দেখলো না কথাটা বলতে গিয়ে উর্বীর চোখেমুখে কতরাজ্যের লজ্জা এসে ভীড় করেছে।
তহুরা জবাব দেয়,”হু। ডাক্তার স্বামী পেয়েছিস। আর এদিকে তোর ভাইকে দেখ। যদি বলি শুনছো,আমার শরীরটা কেমন করছে। বলে একটা নাপা খেয়ে নাও।”
উর্বী হাসে ভাবীর কথায়। হাসে তহুরাও। কথায় কথায় আটত্রিশ মিনিট কাটিয়ে ফোনটা কেটে দেয় উর্বী। ফোনের স্ক্রিনে আজকের তারিখ টা দেখে। আজ মার্চের সাত তারিখ। উর্বীর ভেলিভারির তারিখ ইউএসজির রিপোর্ট অনুযায়ী সতেরো তারিখ। এখনও হাতে দশদিন বাকি।
ফোনটা রেখে উর্বী ধীরে ধীরে নিজের পেটে হাতটা রেখে আয়নার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে নিজেকে। এতগুলো মাসে উর্বীর শারীরিক গঠন এবং চেহারার সাথে সাথে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। রাওনাফের তার প্রতি যত্নের পরিমাণ বেড়েছে দ্বিগুণ, শর্মী শায়মীর আন্তরিকতা বেড়েছে বহুগুণ। যেটা কখনও বদলায়নি সেটা হচ্ছে নাবিল উর্বীর সম্পর্ক। না উন্নতি ঘটেছে,না অবনতি।
উর্বী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দোতলার লিভিং রুমে আজমেরী আর রুমার বাচ্চারা হৈচৈ করে ক্যারাম খেলছে। গোটা রওশান মঞ্জিল গমগম করছে। চট্টগ্রাম থেকে মোহনা শাফিউল এসেছে, অন্তরা সামিউল এসেছে। মোহনার ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে এ বাড়ির সবাই নিমন্ত্রিত। তাই আজমেরী,রুমাও যার যার শশুরবাড়ি থেকে চলে এসেছে।
উর্বী আয়নার সামনে থেকে সরে দাঁড়ায়। আজ রাওনাফের লাঞ্চের আগেই বাড়িতে ফেরার কথা। এখনও ফেরেনি। দিন দিন লোকটা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য তাতে পরিবারকে সময় দেওয়ায় খুব একটা ব্যাঘাত ঘটে না।
উর্বী একটা সুতি কাপড়ের ম্যাটার্নিটি পোষাক পরে আছে। ঘর থেকে বেরোনোর আগে সে ও’ড়না দিয়ে পেটটাকে ভালো করে ঢেকে নেয়,এভাবে বাড়ি ভর্তি মানুষ,ননদদের স্বামীরা,দুজন দেবর, এদের সামনে হেঁটে বেড়াতে ভীষণ লজ্জা লাগে তার। তাই সে সকাল থেকে ঘর থেকে বেরোয় নি। কিন্তু এভাবে কতক্ষন ঘরে থাকা যায়! সবাই কিচেনে কত মজা করছে , হাসাহাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। সন্ধ্যায় বাড়িতে মেহমান আসবে মোহনাদের বাড়ি থেকে,সবাই কাল মোহনার বাপের বাড়িতে যাবে বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে,তাই সব পরিকল্পনা করে নিচ্ছে।
ওড়নাটা মাথায় টেনে উর্বী ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য দরজার দিকে যায়। উর্বী আর রাওনাফ দোতলা থেকে নিচতলায় নাবিলের ঘরের পাশের ঘরটিতে শিফট করেছে আরো তিন মাস আগে। এই অবস্থায় উর্বীর সিড়ি ভাঙা সেফ না তাই।
দরজার বাইরে পা রাখার আগেই রাওনাফ হুট করে ঘরে ঢুকে পরায় উর্বীর সাথে ধাক্কা লেগে যায় তার। মুহুর্তেই শক্ত হাতে উর্বীকে আগলে নেয় রাওনাফ। উর্বী হাপাচ্ছে। কিছুটা ভয় পেয়েছে সে। রাওনাফ উর্বীকে দাড় করিয়ে বলতে থাকে,”দৌড়াচ্ছো কেন?”
_দৌড়াচ্ছিলাম না তো।
কথাটা বলে উর্বী রাওনাফের ক্লান্ত মুখটার দিকে তাকায়। মার্চের গরমেই ঘেমে নেয়ে একাকার! রাওনাফ বরাবর ছিলো মেদহীন একজন পুরুষ,এই কমাসে স্বাস্থ্য যেন আগের থেকেও কিছুটা কমেছে। চেহারায় খানিকটা মধ্যবয়সী ছাপ তো আছেই কিন্তু বডি দেখে কখনোই রাওনাফের বয়স আন্দাজ করা যাবে না। যেসব পুরুষ খুব আরামে থাকে, চল্লিশের পরে তাদের মুটিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে ডক্টর খানের জীবনে আরাম বলতে তো কিছুই নেই,শুধুই ছোটাছুটি, পরিশ্রম। তার ওপর উর্বী নামের আস্ত একটা ঝামেলা কাঁধে তার! তাই সে ফিট।
রাওনাফ বলতে থাকে,”এক্ষুনি পরে যেতে!”
উর্বী বলে,”আমি ঠান্ডা ঠান্ডা শরবত নিয়ে আসছি। দুপুরে যা গরম পরতে শুরু করেছে। আপনি ফ্রেশ হোন।”
উর্বী ঘর থেকে বেরোতে গেলে রাওনাফ তার হাত টেনে ধরে। উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ টেনে উর্বীকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলে,”প্রয়োজন নেই। আপনাকে অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ।”
উর্বী হাসে। রাওনাফ উর্বীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,”তোমাকে এখন আর হাসের ছানা লাগছে না।”
উর্বীকে শুধরে দেয় রাওনাফ। রাওনাফের কথায় উর্বী মাথা নিচু করে মুচকি হাসে।
রাওনাফ টাইয়ের নট খুলতে গেলে উর্বী উঠে নিজে খুলতে থাকে। সে তাকিয়ে আছে উর্বীর দিকে। বলে,”মেয়েরা তাদের ভাইদের জন্য একটা টয় সেট অর্ডার করেছে। তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চাচ্ছে। ওরা যখন জানবে ওদের ভাই না,বোন আসবে তখন ওরাই সারপ্রাইজড হয়ে যাবে। আমাদের উচিত ওদের সাথে শেয়ার করা।”
উর্বী মাথা নেড়ে বলে,”না। বলবো না। দেখি দুটোতে কি করে!”
রাওনাফ হাসছে। হাসতে হাসতে বলে,”তোমার স্বভাব থেকে বাচ্চামো গেলো না।”
উর্বী বলে,”আপনার স্বভাবে এতো লাই মিশে আছে তাই!”
ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে রাওনাফ বলে,”আমি তিনদিন হসপিটালে যাচ্ছি না।”
_ওমা কেনো!
_মোহনার বাপের বাড়ি থেকে এতো করে বললো। সবার যাওয়া উচিত। আমি ভাবছি আমি থেকে যাবো বাড়িতে, তোমার কাছে। সবার আনন্দ কেন নষ্ট করবো!
_আর আপনার আনন্দ?
প্রশ্নটা করে উর্বী তাকিয়ে থাকে রাওনাফের দিকে,কয়েক মুহূর্ত পরে আবারও বলে,”আপনার আনন্দ?”
রাওনাফ ম্লান হাসে। একটা হাত বাড়িয়ে উর্বীকে বলে,”এদিকে এসো।”
উর্বী দরজা চাপিয়ে দিয়ে রাওনাফের কাছে এগিয়ে যায়। রাওনাফ আদুরে হাতে উর্বীকে আগলে নিয়ে তার একটা হাত উর্বীর পেটের ওপর রেখে বলে,”আমার আনন্দ এখানে।”
****
লিভিং রুমে সবাই আড্ডা দিচ্ছে। মোহনার বাপের বাড়ি থেকে তার মা এবং বড় বোন এসেছে সবাইকে নিয়ে যেতে।
উর্বী তার ঘরে শুয়ে আছে। শরীরটা খুব একটা ঠিক নেই। খানিকটা অস্বস্তি লাগছে।
লিভিং রুমে রওশান আরার সাথে মোহনার মায়ের তর্কাতর্কি চলছে। রওশান আরার কথা,তার বড় বৌয়ের এই অবস্থাতে সে কিছুতেই যাবেনা কোথাও। বাকিরা গেলে যাক।
মোহনার মা আর বোন আপত্তি জানিয়েছে ।শুধু তাই নয় তারা চায় উর্বীকেও সাথে করে নিয়ে যেতে।
রওশান আরা চোখ কপালে তুলে বলে,”খেপেছেন বেয়ান? বৌমার এই অবস্থায় ও যাবে বিয়ে খেতে? অসম্ভব।”
মোহনার মা আফসানা বেগম একপর্যায়ে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করে দেয়। রওশান আরা চিন্তায় পরে যায়।
রাওনাফ বলে,”মা তোমরা যাও না। উর্বী থাকুক। আর আমি তো আছিই। আমীরুন আছে। তোমরা না গেলে সাদিফ কষ্ট পাবে। আমাকে কিছুক্ষণ আগেও ফোন করেছিলো। দুটো দিনেরই তো ব্যাপার। খালাম্মা কষ্ট পাচ্ছেন।”
উর্বী ঘর থেকে বের হয়ে গুটি গুটি পায়ে লিভিং রুমে আসে। তার এভাবে আসতে ভীষণ লজ্জা লাগছে। তার পরনে একটি সুতি কাপড়ের ম্যাক্সি। ওরনা দিয়ে পেট ঢেকে রেখেছে।
আফসানা বেগম দেখে বলে,”ওই যে এলো বড় বৌ। আহারে! কি চাদপানা মুখটা একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। থাক ওকে আর কষ্ট দেবো না। একেবারে নাতী সহ বৌকে নিয়ে যাবো আমার বাড়িতে একদিন।”
রওশান আরা সাথে সাথে বলে,”আমিও থাকি বেয়ান। প্লিজ মনে কিছু নেবেন না। কখন কি হয়ে যায়, দুশ্চিন্তা হয়তো খুব।”
নাবিল এতক্ষন বসে ছিলো। উর্বীকে দেখে সে উঠে দাঁড়ায়। তারপর পাপার দিকে তাকায়। রাওনাফের মুখ হাসি হাসি। তাকে ভীষণ খুশি লাগছে। খুশি তো হবেই। তার আদরের বাচ্চা আসতে চলেছে। যাকে পেয়ে পাপা নাবিলকে ভুলে যাবে।
_না, তোমরা গল্প করো দাদু। আর হ্যা, সাদিফ মামাকে বলে দিও তার বিয়েতে না যেতে পেরে দুঃখিত আমি। আসলে এই ডিবেট কম্পিটিশন টা আমার কাছে খুব ইম্পরট্যান্ট। মামাকে বুঝিয়ে বলো।
নাবিল চলে যায়।
আফসানা রওশান আরার দিকে তাকিয়ে বলে,”ব্যাস হয়ে গেলো। কি আর করা, এখন আপনি আর বাড়ির সবাই সব গুছিয়ে নিন। বেশি না,মাত্র দু’দিন কষ্ট দেবো সবাইকে।
রওশান আরা চিন্তিত ভঙ্গিতে উর্বীর দিকে তাকায়। তার মন একটুও সায় দিচ্ছে না।
****
বাড়ির সবাই সকাল সকাল ঝুম বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে পরেছে। দশ তারিখে একটা বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা আছে তাই আবহাওয়া বৈরী কিছুটা। বাড়িতে আছে শুধু উর্বী, রাওনাফ, নাবিল এবং আমীরুন।
নাবিল নিজের ঘরে বসে পড়ছে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি পরছে, রাজধানীতে শুধু বৃষ্টিপাত হলেও দক্ষিনাঞ্চলের অবস্থা ভয়াবহ।
সন্ধ্যা পেরিয়ে প্রায় রাত হয়ে এসেছে।
রাওনাফ আর উর্বী তাদের ঘরে। উর্বীকে জরিয়ে ধরে রাওনাফ শুয়ে আছে।
উর্বী হাপাচ্ছে। রাওনাফ বলে,”কি হয়েছে? কষ্ট হচ্ছে?”
উর্বী মাথা নাড়ায়। সে রাওনাফের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে বসতে চায়।
রাওনাফ টেনে ধরে,”কোথায় যাচ্ছো।?”
_আপনাকে কিছু একটা বানিয়ে দেই। বৃষ্টি পরছে বাইরে। নাবিলকেও দেই।
রাওনাফ উর্বীকে জোর করে শুইয়ে দেয়, ধ’ম’কে বলে ওঠে,”বাড়াবাড়ি টা কম করলে হয়না?”
উর্বী উদাস ভঙ্গিতে তাকায়।
রাওনাফ উর্বীর কপালে চু’মু খেয়ে বলে,”আজ মনটা একটু খারাপ মনে হচ্ছে! কি হয়েছে?”
উর্বী মাথা নাড়ায়। কিছুই হয়নি তার। শুধু বৃষ্টি দেখলে তার ভালো লাগে না। বৃষ্টি তাকে সেদিনের কথা মনে করিয়ে দেয়।
রাওনাফ বলে,”আমার শাশুড়িকে ফোন করে আসতে বলেছি। দিন দুয়েকের মধ্যেই চলে আসবে। এখন ও মন খারাপ?
উর্বী মাথা নাড়ায়। মাথাটা রাওনাফের বুকে রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই মানুষটা তার জীবনে না এলে সে কি করতো! আদৌও কি এতদিন বেঁচে থাকতো! সেটাই ভাবছে সে।
রাওনাফ আর কোনো প্রশ্ন করার আগে তার ফোন বেজে ওঠে। সে বুক থেকে উর্বীর মাথাটা আলতো করে ধরে সরিয়ে দিয়ে উঠে ফোনটা রিসিভ করে।
কিছুক্ষণ পরে সে উঁচু গলায় ফোনে বলতে থাকে,”মানে টা কি? আমি তো আমার এস্কেজিউল ক্যানসেল করেছি আগে ভাগেই। আমার পক্ষে এখন সম্ভব না।”
ওপাশ থেকে লামিয়া বলছে,”বুঝতে পেরেছি রাওনাফ। তবে রোগীর অবস্থা খুব খারাপ। তারা এসে আমার হাতে পায়ে ধরছে। বড্ড মায়া লাগছে। তুমি ছাড়া এত বড় রিস্ক আমি নিতে পারবো না রাওনাফ। রোগীর পরিবার তোমার ভরসাতে আছে। প্লিজ রাওনাফ, বোঝার চেষ্টা করো।”
রাওনাফ ফোন কানে চেপে ধরেই উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী এদিকেই তাকিয়ে আছে।
ফোনের ওপাশ থেকে লামিয়া বলতে থাকে,”রাওনাফ একটু বোঝো! প্লিজ।”
_ঠিক আছে আমি জানাচ্ছি তোমাকে।
শুকনো গলায় জবাব দেয় রাওনাফ।
তারপর ফোন টা রেখে দিয়ে উর্বীকে ডাকে,”উর্বী!”
_জি। কি হয়েছে? কার ফোন ছিলো।
উর্বী পেটে হাত চেপে ধীরে ধীরে উঠে বসে।
রাওনাফ চিন্তিত ভঙ্গিতে তার পাশে গিয়ে বসে, উর্বী একটু ঝামেলায় পরে গেছি। আজ একটা পেশেন্টের ওপেন হার্ট সার্জারির কথা ছিলো। ক্রি’টিক্যাল কনডিশন। আজ অপারেশন টা না হলে হয়তো একটা অঘটন ঘটে যাবে। এটা ডক্টর মাহমুদের কেস ছিলো। ওর শাশুড়ি হঠাৎ মা’রা গিয়েছেন। এই মুহূর্তে পেশেন্টকে অন্য হসপিটালে শিফট করলে সেটা রিস্কি!
_সেকি কথা। আপনি যান এখনই।
রাওনাফ শুকনো গলায় বলে,”তোমার এই অবস্থায়!”
উর্বী রাগ দেখিয়ে বলে,”মানে টা কি! আজব লোক তো আপনি! মাত্র কিছু ঘন্টার ব্যাপার। আর এখনও হাতে ঢের সময়। আপনি এখনই এতো টেনশন শুরু করে দিয়েছেন। আরে আমি ঠিক আছি। এইযে দেখুন, একেবারে ঠিক।”
উর্বী উঠে টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে রাওনাফকে তার সুস্থতা দেখায়।
রাওনাফ ই’তস্তত করে।
উর্বী বলে,”রোগীর জীবনটা বেঁচে গেলে আল্লাহ খুশি হবেন আর সেটাতে আমাদের সন্তানদের ভালো হবে। আপনি যান। আমীরুন আছে না? ওকে ডেকে আমার রুমে পাঠিয়ে দিয়ে যান। আমি এখানেই শুয়ে থাকবো আপনি না আসা পর্যন্ত। একটুও নড়বো না,লাফাবো না,কথা দিচ্ছি।”
রাওনাফ বসে থাকে। উর্বী রাওনাফকে ঠেলতে ঠেলতে বলে,”যান বলছি!”
রাওনাফ একরাশ অনিহা নিয়ে,চিন্তিত ভঙ্গিতে রেডি হয়ে চলে যায়।
যাওয়ার সময় আমীরুনকে আলাদা ডেকে নিয়ে বলে,”সারাদিন উল্টো পাল্টা কিসব ভাবে আর দুশ্চিন্তা করে। একটু চোখে চোখে রাখিস।”
আমীরুন বলে ,”আপনে একটুও চিন্তা করবেন না ভাইজান। আমি ভাবীর কাছ থেকে নরুমই না।”
আমীরুন বসে। উর্বীকে দেখতে থাকে। হঠাৎ বলে ওঠে,”একদিন আমি বলছিলাম আপনি একদিন না একদিন ভাইজানের মায়ায় পইরা যাইবেন। কথাটা মিলছে নাকি বলেন। আইজ হের সন্তানের জন্য অপেক্ষা করতাছেন কত আনন্দ নিয়া।”
উর্বী চুপ করে থাকে। আমীরুন হাসতে হাসতে বলতে থাকে,”আমীরুনের কথা বাসি হইলে সত্য হয়।”
হঠাৎ লোডশেডিং হয়। উর্বী চ’ম’কে ওঠে। আজও বিদ্যুৎ এভাবে চলে গেলো। এটা কি কাকতালীয়?
অন্ধকারে উর্বীর ভীষণ ভয় লাগছে।
সে উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”কি হলো আমীরুন আপা। কি হলো?”
_জানি না ভাবি। দাড়ান আমি দেখতাছি।
_না তুমি যেও না। আমার ভ’য় করছে হঠাৎ। অস্থির লাগছে। যেওনা তুমি।
আমীরুন বসে থাকে।
বাইরে নাবিলের গলার আওয়াজ পাওয়া যায়। সে নিচের বারান্দায় দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে দা’ড়োয়ানকে ডেকে বলছে,”কি হলো দাদু? কোনো সমস্যা?”
_দেখতেছি আমি দাদুভাই।
দারোয়ান জবাব দিয়ে টর্চ জ্বেলে জেনারেটর রুমে চলে যায়।
অন্ধকারে উর্বীর ওয়াশ রুমে যেতে হবে। এতো ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ পায়। বড্ড হয়রান হয়ে গিয়েছে উর্বী। আমীরুনকে বলে,”একটু ওয়াশ রুমে দিয়ে এসো আমায়।”
আমীরুন তাই করে।
দশ মিনিট পরে বিদ্যুৎ চলে আসে। উর্বী স্বস্তি ফিরে পায়।
ও ঘর থেকে নাবিল আমীরুনকে ডাকে,”খালামনি ভাত খাবো। ভাত বেরে দাও তো।”
আমীরুন উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী বলে,”যাও তুমি। আমি ঠিক আছি।”
আমীরুন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায়।
কিন্তু হঠাৎ করে উর্বীর শরীরটা খারাপ লাগতে শুরু করে। আমীরুন নাবিলের কাছে যাওয়ার পরে আরো দুইবার সে ওয়াশরুমে গিয়েছে,একা একা। এমনও হয়েছে ওয়াশরুম থেকে বেরোনোর এক মিনিটের মাথায় পুনরায় বেগ এসেছে।
পেটে হাত দিয়ে বিছানায় পাচ মিনিট হলো বসেছে, হঠাৎ উর্বী খেয়াল করে তার উরুর নিচ টা ভেজা। পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পেরে উর্বী হতভম্ব হয়ে যায় পুরো।
আমীরুন নাবিলকে খাইয়ে উর্বীর কাছে আসে। উর্বী ভীত চোখে আমীরুনের দিকে চায়!
“কি হইছে ভাবি? কোনো সমস্যা?”
আমীরুন ছুটে এসে উর্বীকে ধরে।
“এদিকে একটু দেখো আপা।”
ককিয়ে উঠে উর্বী বলে।
আমীরুন উর্বীর উরুর দিকে দৃষ্টি দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,”হায় হায়। আপনার তো পানি ভাঙছে ভাবি। হায় হায়,ওখন আমি কি করুম।”
উর্বী ছ’ট’ফ’ট করতে শুরু করেছে । সে এখন কি করবে।
তলপেটে প্রচুর ব্যাথা করছে। উর্বী স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছে না।
আমিরুন ফোন খুঁজতে থাকে। উর্বী পেটে হাত চে’পে ধরে কোনোমতে বলে,”লাভ নেই আপা। উনি ওটিতে। ফোন বন্ধ ওনার।
আমীরুন এখন কি করবে! সে তবুও রাওনাফকে ফোন লাগায়। রাওনাফের ফোন বন্ধ,যেমনটা উর্বী বলেছে।
উর্বীর ব্যাথা বাড়তে থাকে। সে সহ্য করতে পারছে না।
এখন এই মুহূর্তে আমীরুন কি করবে? সে দৌড়ে নাবিলের ঘরে যায়।
নাবিল ডিনার সেরে বই নিয়ে বসেছিলো একটা। আমীরুন হাপাতে হাপাতে বলে,”নাবিল বাবা। বড় ভাবীর শরীরটা ভালো না। খুব অসুস্থ। ভাইজানের ফোন তো বন্ধ। কি করুম এখন? মাইয়াডা বেজায় কষ্ট পাইতেছে।”
নাবিল খুবই মনযোগ দিয়ে বই পড়ছিলো। অবাক হয়ে সে আমীরুনের দিকে তাকায়। সে কি করবে এখন? আশ্চর্য!
****
উর্বী যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে “মাগো !” বলে মৃদু চিৎকার দিয়ে ওঠে।
তারপর সে নিজের মুখ চেপে ধরে। পাশের ঘরে নাবিল আছে। সে এভাবে চেঁচাতে সংকোচ বোধ করছে। কিন্তু তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করার মতো ক্ষমতা তার নেই।
নাবিল উর্বীর চিৎকার শুনে বিব্রত হয়। এতো মহা মুশকিল! এখন সে কি করবে !
উর্বী হঠাৎ একটা বিকট চিৎকার দিয়ে ওঠে।
আমীরুন উর্বীর চিৎকার শুনে দৌড়ে উর্বীর কাছে আসে।
নাবিল ফোন বের করে একবার রাওনাফকে ফোন দেয়। রাওনাফের ফোন একই ভাবে বন্ধ। এখন তবে উপায়!
এই বৃষ্টির রাতে এভাবে একটা প্রেগন্যান্ট মহিলা পরে পরে কষ্ট পাবে? নাবিল তো এতোটাও বিবেকহীন নয়। কিন্তু সে কি করবে? কাকে ফোন করবে? বাড়ির লোক গুলোর বিবেক দেখে নাবিল বিরক্ত হয়। নাবিল ছোটো হয়েও বোঝে এই সময়ে অসুস্থ ব্যক্তিকে বাড়িতে রেখে যাওয়া উচিত না, তবুও নাচতে নাচতে চলে গেলো! বিয়ে খেতে! যত্তসব!
নাবিল কিছু একটা চিন্তা করে সিটি মেডিকেয়ারের রিসিপশনে ফোন লাগায়।
রিসিপশনের মেয়েটা ফোন তুলতেই নাবিল দ্রুত বলে,”হ্যালো। সিটি মেডিকেয়ার? আমি ডক্টর রাওনাফ করীম খানের ছেলে বলছি। কাইন্ডলি আমার পাপাকে ডেকে দিন।”
রিসিপশনের মেয়েটি অবাক হয়ে বলে,”ও আচ্ছা আচ্ছা। ”
তারপর দুমিনিট এদিক সেদিক কথা বলে নাবিলকে বলে,”সরি। বড় স্যার তো ওটিতে। স্যার ব্যস্ত। এই মুহূর্তে দেয়া পসিবল না।”
নাবিল বলে,”দেখুন। ইটস আর্জেন্ট। ওনার স্ত্রী হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পরেছে।”
নাবিলের মুখে “ওনার স্ত্রী” কথাটি শুনে রিসিপশনের মেয়েটি আরো অবাক হয়। তারপর বলে,”আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। তবে স্যারকে দিতে পারছি না। আপনি চাইলে লামিয়া ম্যামের সাথে কথা বলে দেখতে পারেন। সে আপাতত ডিউটি ফ্রি।”
_আচ্ছা তাই করুন। দিন আন্টিকে ডেকে।
দ্রুত জবাব দেয় নাবিল।
লামিয়া সব শুনে ফোনের ওপাশ থেকে বলে,”ও মাই গড। নাবিল আমি এখুনি অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দিচ্ছি। সাথে দুজন নার্স। ডোন্ট ওরি। রাওনাফ দু ঘন্টায়ও বের হতে পারবে না ওটি থেকে। সিরিয়াস কেস। আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি অ্যাম্বুলেন্স!”
নাবিল “আচ্ছা আন্টি” বলে রেখে দেয়। পাশের রুমে উর্বীর গোঙানির আওয়াজ নাবিল শুনতে পায়। সে বিছানার উপর বসে থাকে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে, এ কোন ঝামেলায় পরলো সে!
উর্বী ছটফট করছে। আমীরুন উর্বীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে,”ও ভাবী একটু ধৈর্য্য ধরেন। নাবিল বাবা বলছে অ্যাম্বুলেন্স আসতেছে। আরেকটু কষ্ট সহ্য করেন।
উর্বী হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,”ওনাকে ফোনে পাওয়া যায়নি তাই না আপা?”
আমীরুন বিষন্ন ভঙ্গিতে উর্বীকে দেখে। মেয়ে মানুষ তো এমনই। কঠিন সময়ে প্রিয় মানুষকে দেখার জন্য মন ছটফট করে।
****
অ্যাম্বুলেন্স এসে গিয়েছে। দুজন নার্স উর্বীকে ধরে ধরে অ্যাম্বুলেন্সে তোলে। আমীরুন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠে। নাবিল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ,এক হাত ট্রাউজারের পকেটে ঢুকিয়ে।
আমীরুন নাবিলকে বলে,”নাবিল বাবা,যাইবা না?”
নাবিল অবাক হয়ে বলে,”আমি?”
_হ তুমি। যাইবা না?
নাবিল একবার বাড়ির অন্দরমহলের দিকে চায় একবার অ্যাম্বুলেন্সের দিকে চায়। সে দ্বিধায় পরে গিয়েছে। হঠাৎ-ই সে বাড়ির মধ্যে ঢুকে বাড়ির চাবি নিয়ে আসে,দরজায় তালা লাগিয়ে নিজেও অ্যাম্বুলেন্সে উঠে পরে।
****
ও.টির মধ্যে রাওনাফের ভয়ে ইন্টার্ন ডক্টর এবং নার্স তটস্থ হয়ে আছে। আজ বড় স্যার একটু বেশিই রাগারাগী করছেন সবার সাথে। সাথে “গাধা,হাদারাম” বলে গালাগাল তো আছেই।
রাওনাফের প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে। বারবার উর্বীর মুখটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে শুধু। এর মাঝে একবার সার্জিক্যাল নাইফ দিয়ে নিজের আঙ্গুল কেটে ফেলেছে সামান্য। এতো অস্থিরতার কারণ সে বুঝতে পারছে না।
উর্বীর যন্ত্রনা বেড়েই যাচ্ছে। লামিয়া উর্বীকে চেক করে। বাচ্চার পজিশন ঠিক আছে। সব স্বাভাবিক একেবারেই। তবে হাতে সময় নেই। তাকে যা করার এখনি করতে হবে।
একজন সিনিয়র নার্স এসে বলে,”ম্যাম।”
_হু। সব রেডি করো।
তাড়াহুড়ো করে জবাব দেয় লামিয়া।
নার্স অবাক হয়ে বলে,”ম্যাম স্যার তো ও.টি. তে!”
_তোমাদের স্যার ও.টি.তে তো আমি কি করবো ফারিন? বাচ্চা প্রসব কি তোমাদের স্যার করবেন? কিচ্ছু করার নেই । আমাদের হাতে সময় নেই।
লামিয়া উঠে উর্বীর মাথার কাছে বসে। উর্বী কাতরাচ্ছে।
দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে,”আপা। উনি কি আসবেন না? ওনাকে খবর দেননি? উনি কখন আসবেন?”
লামিয়া বলে,”আসবে উর্বী। অবশ্যই আসবে। একটু ধৈর্য ধরো। ”
বলে সে উর্বীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
উর্বী কাঁদছে। তার শরীরের যন্ত্রনার থেকেও বেশি কষ্ট হচ্ছে রাওনাফকে না দেখতে পেয়ে। শুধু মনে হচ্ছে উর্বী আর রাওনাফকে দেখতে পাবে না।
সে ফোপাতে ফোপাতে লামিয়াকে বলে,”আপা সব বুঝি শেষ হয়ে গেলো। আমি ওনাকে একটিবার দেখতে চাই।”
লামিয়া খুব স্বাভাবিক ভাবে বলে,”এটুকু ধৈর্য্য না ধরতে পারলে মা হওয়া যায়না উর্বী। মনকে শক্ত করো। তোমার কিচ্ছু হবে না। তোমার এই বড়বোনের ওপর ভরসা রাখো।”
উর্বী স্থির হতে পারছে না। কিছু একটা হারিয়ে ফেলার ভয় ক্রমশ তাকে ঘিরে ধরছে। সে কাঁদতে কাঁদতে বলে,”আমার মনে হচ্ছে আমি মরে যাবো আপা।”
লামিয়া উর্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,”হ্যা তো অসুবিধা কি? তখন আমরা রাওনাফকে আবার বিয়ে করাবো।”
****
নাবিল একটা বেঞ্চিতে চুপচাপ বসে আছে। রাওনাফ এখনো ওটিতে। ওদিকে আমীরুন এক এক করে সবাইকে ফোনে জানিয়ে দিয়েছে। রওশান আরা কিছুক্ষণ পরপর নাবিলকে ফোন করছে। তারা বিয়ে বাড়ি রেখে রওনা দিয়ে দিয়েছে।
কিছুক্ষণ হলো সবার ফোনের যন্ত্রণা থেমেছিলো। হঠাৎ শায়মী ফোন দেয়। নাবিল কলটা রিসিভ করে এইবার বিরক্ত হয়ে বলে,”আবার ফোন দিলি কেনো?”
শায়মী বলে ,”কখন পৌঁছাতে পারি জানি না। বাবুর ছবি দিবি আমাকে। দেরি করবি না।”
নাবিল “হু” বলে ফোন রেখে দেয়।
শায়মীর উৎসাহ দেখে সে ভেবে পায়না এতো আনন্দের কি আছে! বেবিই তো আসছে একটা!
****
রাওনাফ পেশেন্টের স্টিচিং করছে। সে চায় খুব সাবধানে কাজটি করতে। কোনো অঘটন ঘটে গেলে সর্বনাশ। কিন্তু তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে। নিজের প্রতিই প্রচন্ড বিরক্ত সে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নার্সকে ধ’ম’কে বলে ওঠে,”ঘাম মোছো স্টুপিড! হা করে দাঁড়িয়ে আছো।”
নার্স কেঁ’পে উঠে টিস্যু পেপার দিয়ে রাওনাফের কপাল থেকে ঘাম মুছিয়ে দিতে থাকে।
রাওনাফ নিজেকে ধাতস্থ করে কাজে মনযোগ দেয়।
অন্যান্য ডাক্তার দুজন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। দ্যা গ্রেট রাওনাফ করীম খান আজ এতো অঘটন ঘটাচ্ছে! আজ কাজে মন নেই মনে হচ্ছে! এটাও আবার হয় নাকি।
রাওনাফ পেশেন্টকে পোস্ট অপারেটিভ রুমে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে হাত থেকে গ্লাভস খুলতে থাকে। কাজটা করছে সে অনেক দ্রুত।
****
উর্বীর আত্মা শুকিয়ে যাচ্ছে। সে গগন কাঁপানো চিৎকার দিতে থাকে।
লামিয়া নার্স দুটোকে বলে,”ওর হাত পা ম্যাসাজ করতে থাকো। ”
নার্স দুটো তাই করে।
লামিয়া চেষ্টা করছে ধীরে সুস্থে কাজটি করতে কিন্তু উর্বীর অধৈর্য্য আর চিৎকারে তারও টেনশন হতে শুরু করে।
বাচ্চা প্রসবের সাথে সাথেই উর্বী জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
ছোটো পুতুলের মতো মানুষটি ভুমিষ্ট হবার সাথে সাথেই হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে।
লামিয়ার কানে সেই কান্না পৌঁছায় না। সে উর্বীর দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। উর্বীর কি হয়েছে সে বুঝতে পারছে না!
লামিয়া নার্স দুটোকে ইশারা দিয়ে বাচ্চাটাকে নিতে বলে। সে এসে উর্বীকে ধরে। উর্বীর পালস রেট চেক করে।
তারপর আরেকজন নার্সকে ইশারা করে জলদি একটি ইনজেকশন দিতে বলে।
অন্য দুজন নার্স হাসিমুখে সেই পুতুলের মতো মানুষটিকে ওয়াশ করাতে থাকে। এ যে সে কেউ না। তাদের বড় স্যারের সন্তান।
****
নাবিল মাথা নিচু করে বসে ছিলো । এতক্ষণ ডেলিভারি রুমের ভেতর থেকে আসা উর্বীর আর্তনাদ শুনে সে বিব্রত। তার কাছে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে,তারও যথেষ্ট টেনশন হচ্ছে। সবার মতো। উর্বীর আর্তনাদের মৃদু আওয়াজে তার হাত পা রীতিমতো কাঁপছে।
হঠাৎ ডেলিভারি রুমের দরজা খুলে কেউ একজন বাইরে বের হয়। নাবিল সেদিকে তাকায়। একজন নার্স নরম কাপড়ে পেঁচিয়ে বাচ্চাটাকে এদিকে নিয়ে আসছে। তার মুখ হাসি হাসি।
নাবিল নিজের অজান্তেই উঠে দাঁড়ায়। একবার নার্সের মুখের দিকে তাকায়,একবার তার হাতের দিকে।
নার্স এসে আনন্দের সাথে নাবিলকে বলে,”বোনকে কোলে নেবে?”
নাবিল কিছু বলতে পারে না। সে বোকার মতো বাচ্চাটির মুখের দিকে তাকায়। কি চমৎকার গোলাপী আভা লেগে আছে ছোট্ট দুই গালে। রক্তিম ঠোঁট দুটো,মনে হচ্ছে এই মাত্র কেউ লাল রং লাগিয়ে দিয়েছে। নাবিল চোখ ফেরাতে পারে না।
নার্স আবারও বলে,”বোনকে কোলে নাও!”
নাবিল নার্সের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”বোন?”
_হ্যা। তোমার বোন।
নাবিল খানিকটা অবাক হয়,সে শুনেছিলো তার ভাই হবে।
আমীরুন দৌড়ে আসে। বাচ্চার মুখ দেখে চেঁ’চি’য়ে ওঠে,
“ওমাহ। মাশাআল্লাহ নাবিল বাবা। এইডা তো পুতুল।”
নার্স নাবিলকে বলে,”নাও হাত পাতো। বোনকে কোলে নেবে না?
নাবিল রোবটের মতো হাত বাড়িয়ে শিশুটিকে কোলে নেয়। যদিও তার বুক ধুকপুক করছে। আলতো করে কাপড়ের পুটলি টাকে আগলে নিয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে।
টুকটুকে পুতুলের মতো একখানা মুখ। ছোট্ট ছোট্ট চোখ দুটি পিটপিট করছে।
নাবিল খেয়াল করে তার বুকে সুক্ষ্ম আনন্দ হচ্ছে। তার মনে হচ্ছে এই শিশুটি তার অতি আপন। সে একদৃষ্টে শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে মুখে রাজ্যের মুগ্ধতা এসে ভীড় করেছে।
****
রাওনাফ অপারেশন থিয়েটার থেকে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বের হচ্ছে। তার মনটা কেমন জানি করছে। যার কারন সে বুঝতে পারছে না।
রাওনাফকে দেখে দুজন নার্স দৌড়ে আসে। রাওনাফ তাদের দিকে তাকায়।
একজন নার্স বলে ওঠে,”স্যার। আপনি ঠিক আছেন?”
_হ্যা,কেনো? আচ্ছা শোনো,আমি সব বুঝিয়ে দিয়েছি। ঘন্টা খানিক পরে পেশেন্টকে ইনজেকশনটা দিয়ে দিও। আর রুমিন কোথায়? ও.টি. তে ওকে “গাধা” বলেছি, ওকে সরি বলতে হবে। আমি এখন বাড়ি যাবো।
নার্স দুজন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। তারপর রাওনাফকে বলে,”স্যার। আমরা আপনাকে জানাতে পারিনি। দুঃখিত। ম্যাম অসুস্থ হয়ে পরায় তাকে হসপিটালে নিয়ে আসা হয়। এবং আপনি কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছেন স্যার।”
রাওনাফ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। এরা কি মজা করছে তার সাথে!
নার্স বলে,”কংগ্রাচুলেশন স্যার। বাচ্চা সুস্থ আছে। নরমাল ডেলিভারি। তবে ম্যাম একটু জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। লামিয়া ম্যাম দেখছেন। ডোন্ট ওরি।”
রাওনাফ কিছু বলে না। গায়ের এপ্রোন খুলে মাটিতে ফেলে সে হাঁটতে থাকে। সে নিজেকে নিজে কখনো মাফ করতে পারবে না।
নাবিল বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি ওই চাঁদ মুখ থেকে সরছে না। নাবিলের অদ্ভুত লাগছে। তার এতো আনন্দ হচ্ছে কেন! এমন তো হবার কথা ছিলো না!
আমীরুন খুশিতে একপ্রকার লাফাতে থাকে। সে একের পর এক ফোনকল রিসিভ করে কথা বলছে বাড়ির সবার সাথে।
রাওনাফ এসে গাইনী ওয়ার্ডের নরমাল ডেলিভারী রুমের লবিতে দাড়িয়ে পরেছে। নাবিলের দিকে একবার তাকিয়ে সে সেদিকে এগিয়ে যায়।
লামিয়া ডেলিভারি রুম থেকে বেরিয়ে এসে রাওনাফকে দেখে। তারপর উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে ওঠে,” মেয়ে একেবারে মায়ের মতো হয়েছে তাই না? সৃষ্টিকর্তা মায়ের রুপ ঢেলে দিয়েছে মেয়ের মধ্যে।”
রাওনাফ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছেনা,সে লামিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। লামিয়া বলে,”আমাকে শাড়ি দিতে হবে রাওনাফ।আমি তোমার মেয়ের ধাই মা।”
রাওনাফ ম্লান হেসে অস্ফুট স্বরে বলে,”উর্বী!”
_উর্বী ঠিক আছে। জ্ঞান ফিরেছে। তুমি এভাবে দাড়িয়ে থাকবে? মেয়েকে ধরবে না?
রাওনাফ তার উত্তর দেয়না। সে সোজা উর্বীর কাছে চলে যায়।
লামিয়া নাবিলের দিকে তাকায়,নাবিল বোনের দিকে তাকিয়ে হাসছে। লামিয়া এসে বাচ্চাকে কোলে তুলে নেয়। বাচ্চাকে খাওয়াতে হবে।
নাবিল লামিয়াকে বলে,”কোথায় নিচ্ছো লামু আন্টি!”
_বোন খাবে তোমার।
****
রাওনাফ উর্বীর পাশে গিয়ে বসে। তার মুখ শুকিয়ে একটুখানি হয়ে আছে। উর্বীর চোখের দিকে সে তাকায় না।
উর্বী রাওনাফের হাত নিজের কাছে টেনে নেয়। নরম গলায় বলে,”মেয়েকে দেখেছেন? ”
রাওনাফ মাথা নাড়ায়,মুখে কোনো জবাব দেয়না। উর্বী বলে,”আমি দেখিনি। ওকে নিয়ে আসুন না।”
রাওনাফ উর্বীর হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে উর্বীর দুহাত আকরে ধরে। ব্যাকুল কন্ঠে বলে ওঠে,
“তুমি আমার উপর রাগ করে আছো তাইনা? বিশ্বাস করো। আমি নিজেই নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না। কোনোদিনও না।”
উর্বী রাওনাফের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর হেসে ফেলে। বলে,
“ধুর। আমি রাগ করবো কেনো? আপনি বুঝি ইচ্ছে করে আমার কাছে আসতে পারেন নি?”
কথাটি বলতে বলতে উর্বীর মুখে বিষন্নতা এসে ভিড় করে । রাওনাফ তা খেয়াল করে।
উর্বী বলে,”তবে কি জানেন শর্মীর পাপা,একটা সময় আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমি আর আপনাকে দেখতে পাবো না।”
রাওনাফ উর্বীর কথায় চ’ম’কে উঠলেও নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,”কেনো! একদিন তো খুব সাহস দেখিয়ে আমাকে দেখবে না বলে চলে যাচ্ছিলে!”
উর্বী রাওনাফের কথায় ম্লান হাসে। দু’চোখের কার্নিশ বেয়ে তরল গড়িয়ে পরে। একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”এখানেও আমার লোভ আর স্বার্থপরতা কাজ করেছে শর্মীর পাপা। লোভ আপনার কোলে আমার মেয়েকে দেখার,আর স্বার্থপরের মতো ভেবেছি আপনাকে আরো ঝামেলা দিতে কিভাবে আপনার জীবনে থেকে যাওয়া যায়। আপনার থেকে শুধু নেওয়া যায়।”
রাওনাফ উর্বীকে জরিয়ে ধরে। উর্বী রাওনাফের বুকে মাথা রেখে কাঁদছে,শান্তিতে।
লামিয়া বাচ্চাটাকে এনে কেবিনে ঢোকে। তারপর উর্বীর পাশে শুইয়ে দেয়। উর্বী তার জীবনের নতুন ফুলটির দিকে তাকায়। তার গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পরছে। অস্ফুট স্বরে রাওনাফকে বলে,”কোলে নিন তো ওকে। একটু দেখবো।”
রাওনাফ হাত বাড়িয়ে উর্বীর চোখের পানি মুছিয়ে দেয়। তারপর মেয়েকে উর্বীর পাশ থেকে উঠিয়ে কোলে নিয়ে কপালে একটা চুমু খায়।
লামিয়া তাকিয়ে তাকিয়ে স্বামী স্ত্রীর সে অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্যটি দেখতে থাকে।
কিছুসময় পরে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠে,”অভিনন্দন রাওনাফ। আপনাদের বাপ বেটিকে দারুণ লাগছে।
রাওনাফ ম্লান হাসে, মেয়েকে উর্বীর কোলে তুলে দেয়। তারপর বলে,”সবকিছু তো নরমাল ছিলো। এরকমটা হবার তো কথা ছিলো না লামিয়া।”
_উর্বীর এংজাইটি থেকে প্রেশার বেড়ে গিয়েছিলো সম্ভবত রাওনাফ।
রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসছে। রাওনাফ মা মেয়ের থেকে চোখ সরাতে পারছে না।
****
রওশান আরা হসপিটালে পৌঁছেছেন। সে এসেই পুরো হসপিটাল মাথায় তুলে ফেলেছেন। তার নাতনি কোথায়।
রওশান আরার নাতনি নাবিলের কোলে। সে ভিডিও কলে সব বন্ধুদের দেখাচ্ছে। শর্মী শায়মী অবাক হয়ে বাচ্চাটাকে দেখছে। তাদের হতভম্ব ভাব কাটছে না। তাদের ভাই তাদের বোন হয়ে গেলো কি করে?
রাওনাফ কেবিনের বাইরে যায়না। সবাই বাইরে হৈ হুল্লোড় করছে। সে উর্বীর কাছে বসে আছে। সকাল হয়ে এসেছে প্রায়।
রওশান আরা এসে প্রায় থাবা মে’রে তার নাতনিকে কোলে তুলে নেয়। বাকিরা উঁকি দিচ্ছে। একজন আরেকজনকে সরিয়ে বাবুর মুখটা একটু বেশি দেখতে চাচ্ছে।
উর্বী আর রাওনাফ তাদের হাসাহাসির শব্দ শুনতে পায়। রওশান আরা বলে,সব ঠিক আছে। তবে নাকটা এমন কেনো? আমাদের বাড়ির কারো নাকতো বোচা না। বৌমার নাকও তো ঠিকঠাক!
নাবিল বলে ওঠে,”ও শর্মীর মতো হয়েছে। শর্মীর নাক তো বোচা দাদু,ভুলে গেলে।”
সবাই চুপ হয়ে যায়। রওশান আরা এতক্ষন খেয়াল করেনি বিষয়টি। আসলেই। এই মেয়ে পুরোপুরি শর্মীর ফটোকপি।
রওশান আরা নাতনিকে নিয়ে দুলতে দুলতে উর্বীর কাছে আসে,উর্বী শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি হাসে। রওশান আরা নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,
“রাগ করলে? তোমাকে না দেখতে এসে নাতনি নিয়ে পরে আছি তাই?”
উর্বী হেসে মাথা নাড়ায়।
রওশান আরা বলতে থাকে,”কি বলো তো। শাশুড়িরা এমনই।”
উর্বী ফিক করে হেসে দেয়। রওশান আরাও হাসতে থাকে।
শায়মী আর শর্মী কেবিনে ঢোকে। রওশান আরা ওদের দেখে উর্বীকে বলে,”নাও,তুমি তোমার মেয়েদের নিয়ে থাকো। আমি গেলাম।”
বলেই রওশান আরা তার ছোটো নাতনিকে উর্বীর পাশে শুইয়ে দিয়ে চলে যায় কেবিন থেকে। উর্বী শর্মী আর শায়মীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর শর্মীকে বলে,”বোনকে কোলে নেবে না?”
শর্মী মাথা নাড়ায়। এগিয়ে এসে বোনকে কোলে নেয়। শায়মীর হাত নিশপিশ করছে,সে শর্মীকে বলে,”তুই ফেলে দিবি। দে আমার কাছে দে।”
বোনকে জোর করে নিয়ে যায় শর্মীর কোল থেকে। উর্বী শর্মীর দিকে তাকিয়ে বলে,”মন খারাপ হয়েছে ভাই হয়নি বলে?”
শর্মী মাথা নেড়ে অস্ফুট স্বরে বলে,”না।”
_বোন বাবুকে কম ভালো বাসবে?
শর্মী খিকখিক করে হেঁসে ওঠে, তারপর বলে,”আরো বেশি ভালোবাসবো।”
উর্বী হাসে। শায়মী বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”আমি একটু কম ভালোবাসবো।”
শর্মী শায়মীর দিকে তাকিয়ে বলে,”তাহলে ওকে আমার কাছে দাও।”
শায়মী দেয়না। হাসতে থাকে। শর্মী তার ছোটো বোনকে টানছে শায়মীর কোল থেকে। দুইবোনের মধ্যে যু’দ্ধ লেগে গিয়েছে।
উর্বী মুগ্ধ চোখে সে দৃশ্য দেখতে থাকে।
****
নাবিলকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে লামিয়া এসে নাবিলের পাশে বসে। নাবিলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“কি ভাবছো নাবিল?”
নাবিল নড়েচড়ে বসে,বলে,”কিছু না আন্টি!”
_খুব ধকল গেছে তাই না নাবিল? আসলে সব দোষ আমার। রাওনাফকে আমিই ফোন করে জোর করেছি আসার জন্য। ও থাকলে ব্যাপারটা অন্যরকম হতে পারতো।
_না আন্টি। ইট ওয়াজ অ্যান এক্সিডেন্ট। এতে তোমার হাত নেই। দূর্ঘটনা ঘটার থাকলে ঘটবেই। আমরা চাইলেও,আগে থেকে জানলেও তা আটকাতে পারবো না।
লামিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে ,”সেটাই। দূর্ঘটনা ঘটার থাকলে ঘটবেই, আমরা চাইলেও আটকাতে পারবো না। শর্মীর সেই এ্যাক্সিডেন্ট টাও এরকম একটা দূর্ঘটনা ছিলো। হওয়ারই ছিলো।ওভাবে না হলে অন্যভাবে হতো। এতে উর্বীর হাত ছিলো না নাবিল। আমি এটাই বিশ্বাস করি।”
নাবিল কোনো জবাব দেয় না। সে চুপ হয়ে বসে থাকে ।
****
উর্বীকে আর তার মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। বাড়ি ভর্তি মেহমান। উর্বীর বাপের বাড়ি থেকে সবাই এসেছে।
সে সারাদিন রুমে বসে থাকে। সবাই বাচ্চাটাকে নিয়ে হৈ হৈ করে। উর্বী তাকে খুব একটা কাছে পায়না। শুধু ঘুমানোর সময় আর খাওয়ানোর সময়টাতে সে তার মেয়েকে ধরতে পারে। উর্বী বাধা দেয় না। এর মাধ্যমে যদি সবাই একটু ভালো থাকে খারাপ কি তাতে? সবচেয়ে বড় কথা, নাবিল তার বোনকে চোখে হারায়।
সে নিজেই উদ্যোগ নিয়ে তার বোনের নাম রেখেছে “রাহা”!
কি সুন্দর নাম! উর্বীর ভীষণ পছন্দ হয়েছে।
কখনো কখনো সব সম্পর্কের সমীকরণ মেলানো যায়না। সমঝোতাও হয় না। উর্বী আর নাবিলের সম্পর্কটা ঠিক সেরকম। তবে রাহা একটা বিরাট অবদান রাখতে পারে।
আজ দুপুরে যখন সবাই নিচে খাচ্ছিলো। উর্বী তখন ওয়াশ রুমে ছিলো। হঠাৎ রাহা কাঁদতে শুরু করলে উর্বী তড়িঘড়ি করে ওয়াশ রুমের দরজা খুলে দেখে নাবিল তার বোনকে কোলে তুলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। উর্বী আবার ওয়াশ রুমে ঢোকে। সে নাবিলের সামনে পরতে চায়নি । নাবিল লজ্জা পাবে। এমনিতেই নাবিলকে শর্মী আর শায়মী সারাদিন ক্ষেপাতে থাকে কারণ নাবিল একদিন বড় গলা করে বলেছিলো,”ঐ বেবীকে আমি একটুও আদর করবো না।”
এভাবেই উর্বীর দিনগুলো কেটে যাচ্ছে।
সে চায় তার জীবনটা যেন এভাবেই কেটে যায়। আর বেশি কিছু সে চায়না। আর বেশি কিছু যে চাওয়ারই নেই উর্বীর।
***
উর্বী রাহাকে খাওয়াচ্ছে। সারাদিন পরে এই একটু সে নিরিবিলি হয়েছে তার মেয়ের সাথে। রাহা সারাদিন তার তিন ভাইবোনের হাত বদল হতেই থাকে।
খাওয়ানো হয়ে গেলে উর্বী রাহার সাথে গল্প করতে থাকে। রাওনাফ ঘরে ঢুকে মা মেয়ের দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।
উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”ক্লান্ত খুব?”
“হু, আমার মাকে দাও।”
বলেই রাওনাফ রাহাকে টেনে নিয়ে নিজের বুকের উপর শুইয়ে দেয়। তার দু’চোখ বন্ধ করে থাকে।
উর্বী চেঁচিয়ে ওঠে,”এটা কি হলো? সারাদিন আমি মেয়েকে কাছে পাই? এভাবে নিয়ে নিলেন?”
“তবে কি আমি পাই?
রাওনাফ বিরক্ত হয়ে বলে।
উর্বী রাহাকে নিতে যায়। রাওনাফ দেয়না। দুজনের টানাটানির এক পর্যায়ে দরজায় টোকা পরে।
রাওনাফ বলে,”কে?”
_পাপা আমি নাবিল।
রাওনাফ উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। অবাক হয়ে বলে,
_কি হয়েছে বাবা?
নাবিল উর্বীর দিকে না তাকিয়ে রাওনাফকে বলে,
_বোনকে দাও।
উর্বী রাওনাফ একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। বাধ্য হয়ে উর্বী রাহাকে দিয়ে দেয়। নাবিল তাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে যায়। আজ সারাদিন সে বাড়ির বাইরে ছিলো,বোনকে কোলে নিতে পারেনি একটুও।
রাওনাফ দরজা লাগাতে লাগাতে বলে,”এই তিন ভাইবোন বড্ড বিরক্ত করছে।”
উর্বী হাসে।
রাওনাফ বলে,”তুমি জানো না। যখন শর্মী হয়েছিলো। তখন শর্মীকে নিয়ে এদের মধ্যে কি ঝগড়া! সারাদিন শর্মীর কাছে দুজন উবু হয়ে বসে থাকতো। স্কুলে যেতো না!”
উর্বী কিছু বলে না। রাওনাফ এসে উর্বীর পাশে বসে। উর্বী রাওনাফের কাধে মাথা রাখে।
রাওনাফ উর্বী মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বলে,”অন্তরা ফোন দিয়েছিলো?
_হু। ও প্রেগনেন্ট। আপনাকে জানাতে বললো।
_মোহনা আর ও কি বুদ্ধি করেছে নাকি! দু’জনেই একসাথে প্রেগনেন্ট!
উর্বী হাসে,বলে,”মা খুশিতে লাফাচ্ছে।”
পাশের ঘর থেকে নাবিল আর শর্মীর ঝগড়ার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।রাহাকে নিয়ে টানাটানি লেগে গিয়েছে তিনজনের মধ্যে।
শক্তিতে নাবিলের সাথে কেউ না পেরে হার মেনে নিয়ে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে রাহার দিকে।
শর্মী ঠোঁট উল্টে বলতে থাকে,”কখন দেবে?”
নাবিল বোনকে কোলে নিয়ে দোলাতে দোলাতে বলে,”আমার মন ভরে গেলে।”
শায়মী চেঁ’চি’য়ে বলে,”আর সেটা কখন?”
_কখনও না।
কথাটা বলে নাবিল ফিক করে হেসে দেয়। তারপর শর্মীর দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি খারাপ তাই ভাই চেয়েছিলি, আর দেখ আল্লাহ আমাকে বোন দিয়েছে কারণ তোরা দুইজন শাকচুন্নী।”
দোতলার লিভিং রুমে তিন ভাইবোন চেঁচামেচি করছে। ঘরের ভেতরে বসে রাওনাফ আর উর্বী হাসছে। উর্বী রাওনাফের কাঁধে মাথা রেখেই একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে রাওনাফের একটা হাত ধরে। রাওনাফ নিজের আরেক হাতে উর্বীর অন্য হাতটা আকরে ধরে। পাশাপাশি বসে দু’জনেই চুপচাপ তাকিয়ে আছে নিজেদের হাতের দিকে, একে অপরের হাতের দিকে। যে হাত তারা ধরেছিলো আরেকটি বার মায়ায় জড়াতে। আরেকটি বার লোভী হতে, জীবনের প্রতি। আরেকটি বার ভালোবাসতে।
রাওনাফ নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী তাকিয়ে আছে তার দিকে। হাত থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাওনাফ উর্বীর মুখের দিকে তাকায়। উর্বী আবারও অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”আরেকটা দিয়ে যান।”
রাওনাফ নিজের হাত সরিয়ে নিতে গেলে উর্বী হাত ছাড়ে না। ধীরে ধীরে উঠে বসে। রাওনাফের চোখে চোখ রেখে বলে ওঠে,”চু’মুটা খেয়েছেন কার কপালে?”
রাওনাফ নিশ্চুপ। উর্বী খোঁচা মেরে বলে ওঠে,”আমার কপালে চুমু খাওয়ার সাথে আপনার বাচ্চার সুস্থতার কোনো সম্পর্ক নেই। চু’মুটা খেলেন কেন?”
রাওনাফ আবারও বিছানায় একপাশে বসে পরে। দেখতে থাকে উর্বীকে। উর্বী বলতে থাকে,”এর থেকে আমায় আরো দু’টো চ’ড় মে’রে দিন। তবুও এমন করবেন না আর। ক্ষ’মা চেয়েছি তো! আর দেবো না নিজেকে কষ্ট,দেবো না আপনাকে কষ্ট,করবো না অসম্মান!”
_বুঝতে পেরেছি। ঘুমাও। এতো উত্তেজিত হওয়া ঠিক হচ্ছে না। আমার বেবির অসুবিধা হবে।
ঠান্ডা গলায় জবাব দিয়ে রাওনাফ পুনরায় উঠে দাঁড়াতেই উর্বী আবারও হাত টেনে ধরে রাওনাফের। রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে রাওনাফের দিকে। রাওনাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিচুস্বরে উর্বীকে বলে ওঠে,”কি? কেঁদে ফেলবে? কাঁদবে?”
কথাটা বলে রাওনাফ জোর করে উর্বীর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঘরের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থানরত ট্রি টেবিলের ওপর থেকে টিস্যু বক্স নিয়ে উর্বীর পাশে বসে। উর্বী দেখতে থাকে রাওনাফকে।
রাওনাফ উর্বীর হাতে টিস্যু বক্স ধরিয়ে দিয়ে উর্বীর চোখে চোখ রাখে। স্বাভাবিক গলায় বলতে থাকে,”নাও। এবার শুরু করো। পুরো বক্সটা ইউজ করবে আজ রাতে। দরকার পরলে আরেকটা এনে দেবো।”
উর্বী অস্ফুট স্বরে বলে,”কেনো করছেন!”
_কি করছি!
_কষ্ট দিচ্ছেন!
_আর তুমি কি করেছিলে!
_ক্ষমা চেয়েছি তো।
ব্যাকুলতা উর্বীর কন্ঠে।
_হয়ে গিয়েছে? আপনি ক্ষ’মা চেয়েছেন আর আমি ভুলে যাবো সে বিভীষিকাময় রাত টা! হসপিটালে বাচ্চা মেয়েটা আধমরা হয়ে পরে আছে আর এদিকে স্ত্রী আর অনাগত সন্তানের জীবন নিয়ে টানাটানি! আশেপাশে,গোটা পৃথিবীতে কেউ ছিলোনা আমাকে সামলানোর জন্য। একা একা সামলেছি নিজেকে। ভুলে যাবো আপনার সামান্য ক্ষ’মা চাওয়াতে?
_শা’স্তি দিচ্ছেন তো,শুধরে নেওয়ার চেষ্টাও তো করছি নিজেকে। আর কি করবো! যা শা’স্তি দেওয়ার একবারে দিয়ে দিন। আমি…আমি আমার স্বামীকে ফেরত চাই।
_আমি এটা চাই, আমি ওটা চাই। সবকিছু এখন থেকে আপনার চাওয়াতে হবে না। আমার যখন মনে হবে আপনি পুরোপুরি শুধরেছেন, আপনার মাথায়, মস্তিস্কে কিলবিল করতে থাকা পোকা গুলো নেমে গিয়েছে,যখন বুঝবো আপনার ব্রেইন আসলেই কাজ করতে শুরু করেছে তখন আপনি অবশ্যই আপনার স্বামীকে ফেরত পাবেন। এখন ঘুমান।
উর্বীর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরতেই রাওনাফ খামচা মেরে টিস্যু বক্স থেকে একদলা টিস্যু পেপার বের করে উর্বীর গাল মুছিয়ে দেয়। হাই তোলার ভান করে বলতে থাকে,”নিন! আমি উদ্ভোধন করে দিলাম। এখন শুরু করুন আপনার অশ্রু বর্ষণ। আর নিজের টা নিজে মুছে নিন অনুগ্রহ পূর্বক।”
একটু থেমে রাওনাফ বলে ওঠে,”ওয়েট ওয়েট। ব্যাপারটা জমছে না। আরেকটু ইন্টারেস্টিং করতে হবে।”
উর্বী অবাক চোখে তাকিয়ে আছে রাওনাফের কথা শুনে। রাওনাফ হাত বাড়িয়ে বেড সাইডের টেবিল থেকে ফোনটা তুলে নিয়ে প্লে লিস্ট থেকে “শ্রাবণের ধারার মতো,পরুক ঝরে।” গানটা ছেড়ে দেয়।
তারপর উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”নিন এবার কনটিনিউ করুন কান্না। চোখের সামনে শ্রাবনের ধারার মতো বিরতিহীন অশ্রুবর্ষণের এমন অভূতপূর্ব দৃশ্যের সাথে এই গানটি একেবারেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। নিন নিন শুরু করুন। আরেহ! আপনার চোখের আলগা পানি কোথায়! ফুরিয়ে গিয়েছে নাকি! এতো তাড়াতাড়ি!”
কথাটা বলে রাওনাফ আরেকটা টিস্যু পেপার বের করে উর্বীর হাতে দেয়। উর্বী এক ঝটকায় টিস্যু বক্স টাকে আর ফোনটাকে ঘরের মাঝ বরাবর মেঝেতে ছুড়ে মেরে রাওনাফের দিকে তাকায়। কাঁপা গলায় বলে ওঠে,”শর্মীর পাপা!”
_জি বলেন!
উর্বী বলতে থাকে,”আমি আমার স্বামীকে ফেরত চাই।”
_সময় হলে পাবেন।
উর্বীর ঠোঁট কাঁপছে। ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে। নাকের পেশী প্রসারিত আর সংকুচিত হচ্ছে। রাওনাফ একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে আছে। যদিও তার খুব হাসি পাচ্ছে , কিন্তু সে চেহারায় যথেষ্ট গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। আজ সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে,যদি এই মেয়ে কাঁদে তাহলে সে আরো কাঁদিয়ে ছাড়বে। যদি না কাঁদে তাহলে সমস্ত শা’স্তি মওকুফ করে বুকে টেনে নেবে।
উর্বী কিছু বলছে না, নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রানপন চেষ্টা করছে। কিন্তু শেষমেশ না পেরে কেঁ’দেই দেয়, ফুঁপিয়ে কাঁদছে। রাওনাফ একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। শাস্তি মওকুফ করা গেলো না এই ভদ্রমহিলার। আজ সারারাত কাদুক।
সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উর্বীর কান্নাকে পাত্তা না দিয়ে ওদিক ফিরে শুয়ে পরে। উর্বী প্রচন্ড আহত হয় রাওনাফের এমন আচরণে।
সাথে সাথে কান্না থামিয়ে দিয়ে সে চোখ মুছে নেয়। চোখ মুখ মুহূর্তেই কঠিন করে সে বিছানা থেকে নামে। রাওনাফ উর্বীর কর্মকাণ্ড আন্দাজ করার চেষ্টা করছে।
উর্বী বিছানা থেকে নেমে উঠে দাঁড়ায়। রাওনাফ বলতে থাকে,”ঘরে কোনো ধরণের নাইফ বা ব্লে’ড নেই যেটা দিয়ে নিজেকে আঘাত করা যায়। হাত কে’টে নকশা আঁকা যায়।”
উর্বী কপাল কুঁ’চ’কে ওপাশ ফিরে শুয়ে থাকা রাওনাফের দিকে একপলক তাকিয়ে ঘর থেকে বের হবার সিদ্ধান্ত নেয়। রাওনাফ সাথে সাথে উঠে বসে,দ্রুত পা ফেলে উর্বীর কাছে গিয়ে তার হাত টেনে ধরে। গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”কোথায় যাচ্ছো!”
_শর্মীদের ঘরে,এখন থেকে ওখানে শোবো।
_ওরা দুবোন একটা বেড শেয়ার করে।
_আমার যায়গা হবে।
_ওদের কষ্ট হবে।
_ঠিকাছে অন্য কোনো রুমে যাচ্ছি তবে।
রাওনাফ উর্বীর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে উর্বীকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয়। উর্বী প্রথমে চ’ম’কে উঠলেও সাথে সাথে কেঁ’দে ওঠে। রাওনাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওঠে,”আবার! এই আমি তোমাকে ছাদের স্টোর রুমে রেখে আসছি বরং।”
কথাটা বলে রাওনাফ ঘরের বাইরে পা রাখতে যাওয়ার আগেই উর্বী দুহাতে রাওনাফের গলা জড়িয়ে ধরে ফোপাতে থাকে। রাওনাফ দাড়িয়ে যায়। উর্বীর চোখের পানিতে তার গ্রীবাদেশ ভিজে যাচ্ছে।
উর্বীকে বিছানায় বসিয়ে দেয় রাওনাফ। কিন্তু উর্বী তার গলা ছাড়ছে না। শক্ত করে জরিয়ে ধরেই কাঁদতে থাকে। রাওনাফ ছাড়াতে চেষ্টা করেও পারেনা। হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে উর্বী।
দু’জনে ওভাবেই কিছুক্ষণ বসে থাকে। কেউ কোনো কথা বলেনা। উর্বী কান্না থামায় না। হঠাৎ রাওনাফের ঠোঁটের কোণে অস্পষ্ট হাঁসি ফুটে ওঠে। ধীরে ধীরে একটা হাত উর্বীর পিঠে এবং আরেকটা হাত উর্বীর মাথায় রাখে।
কিছুক্ষণ উর্বীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিচুস্বরে বলে ওঠে,”আর দেবে কষ্ট আমাকে?”
উর্বী জবাব দেয়না। কাঁদতে থাকে। রাওনাফ বলে,”কান্না না থামালে শাস্তির মেয়াদ বারবে।”
উর্বী সাথে সাথে কান্না থামিয়ে ঝটপট চোখের পানি মোছে। রাওনাফ হেসে ফেলে। উর্বীর মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে হাসতে হাসতে বলে ওঠে,”বোকা হাঁসের ছানা।”
উর্বী পুনরায় কেঁদে ওঠে,স্বস্তিতে। রাওনাফ ধ’ম’কের সুরে বলে,”আবার!”
উর্বী কান্না না থামিয়ে আঁটকে আঁটকে বলে ওঠে,
_এই শেষ! আর হবে না!
****
সকাল সকাল নাবিল উঠে গিয়েছে। সে ধীরপায়ে হেঁটে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে। গত দু’দিন ধরে হালকা সর্দি জ্বর ছিলো, এখন তার গায়ে একেবারেই জ্বর নেই। কিন্তু জ্বরের থেকেও ভয়ংকর কিছু এসেছে। তার গাল ফুলে গিয়েছে। অসহ্য যন্ত্রণা লাগছে। রাওনাফ দেখে বলেছে “মাম্পস”। প্রাথমিক কিছু ওষুধ দেওয়া হয়েছে। ঠিকমতো পরিচর্যা পেলেই সেরে যাবে। নাবিল একদিন যাবত কিছু গিলতে পারছে না। পানি খেতেও তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। পানি খাওয়া তো দূর কথা বলতেই তার জান বেড়িয়ে যাচ্ছে।
আয়নার সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়ে সে ঘাড়ে একটা মাফলার পেঁচিয়ে বসে আছে। তার দৃষ্টি তার টেবিলের ওপর ফটোফ্রেমটার দিকে। এটা খুব ছোটোবেলায় তুলেছিলো তার। তারা তিন ভাইবোন এবং মাম্মা পাপা। শর্মীর বয়স তখন দেড় বছর ছিলো।
ফোনের ভাইব্রেশনের শব্দে নাবিলের ঘোর কাটে। সে ফোনটা তুলে হাতে নেয়। ফ্রেন্ডরা সবাই গ্রুপ কল দিয়েছে। নাবিল কলটা রিসিভ না করে টেক্সট লিখে দেয়,”কান্ট টক! সামহোয়্যাট সিক!”
আমীরুন একবাটি বার্লি নিয়ে নাবিলের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়।
“নাবিল বাবা আসমু ?”
নাবিল মাথা নেড়ে আসতে বলে আমীরুনকে। আমীরুন ঘরে ঢুকে বাটিটা নাবিলের বিছানার পাশের টেবিলে রাখে। নাবিলের দিকে তাকিয়ে বলে,
“এই বার্লিডা কষ্ট কইরা খাও বাবা। নয়তো শরীরে জোর পাইবা না। এইটা ছাড়া তো অন্যকিছু খাইতেও পারবা না।”
নাবিল মাথা নাড়ায়। তার এখন খাওয়ার ইচ্ছা নেই।
আমীরুন জোর করতে থাকে,”খাও বাবা। ভাইজান শুনলে রাগ করবো!”
নাবিল খাবে না, বাটিটা সরিয়ে দেয়। আমীরুন মুখ ফসকে বলে বসে, “বড়ভাবী অসুস্থ মানুষ কত কষ্ট কইরা বানাইছে শান্ত বাবা,একটু খাইয়া নাও।”
কথাটা বলে আমীরুন জিভ কাটে। উর্বী দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কপাল চাপড়াতে থাকে। আমীরুনকে সে যেটা নিষেধ করে দিয়েছে বারংবার,আমীরুন সেটাই করেছে।
নাবিল আমীরুনের কথা শুনেই টেবিলের উপর থেকে বার্লির বাটি উঠিয়ে ফ্লোরে ছুরে মারতে উদ্যত হয়।
“খাবার ওটা। রাগ দেখানোর বস্তু নয়।”
উর্বী কথাটা বলতে বলতে ঘরে ঢোকে। নাবিল থেমে যায়। উর্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”নিজেকে নিয়ে ভাবুন আপনি। আমার কোনো কাজ করতে হবে না আপনার অসুস্থ শরীর নিয়ে।”
উর্বীর চোখের ইশারায় আমীরুন ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। উর্বী গিয়ে বিছানায় একপাশে বসে নাবিলের মুখের দিকে তাকায়। নাবিল নড়চড়ে বসে। উর্বী বলতে থাকে,”তোমার মনে হচ্ছে আমি তোমার পাপাকে তোমার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি?”
_দেননি ?
উর্বীর প্রশ্নের সাথে সাথে নাবিল পালটা প্রশ্ন করে কর্কশ কন্ঠে।
উর্বী ম্লান হেসে দৃঢ় ভাবে বলে ওঠে,”না। দিইনি।”
নাবিল উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। উর্বী বলতে,”আমিতো শুধু তোমার পাপার জীবন থেকে একটু খানি জায়গা নিয়েছি। যেরকম তোমাদের তিন ভাইবোনের জীবন থেকে একটু একটু যায়গা নিতে চাই!”
নাবিল চুপ করে আছে। উর্বী বলতে থাকে,”আমি রাওনাফ করীমের তিন ছানাকে ভয়ংকর পছন্দ করি,স্নেহ করি। কারন দে বিলংস টু রাওনাফ করীম। তাদের দূরে সরিয়ে দেবো?”
কথাটা বলে উর্বী উঠে দাঁড়ায়। বার্লির বাটিটা তুলে নিয়ে নাবিলের একটা হাত ধরে বাটিটা নাবিলের হাতে রাখতে রাখতে বলে,”বাবা,কিছু কিছু সম্পর্কের সমীকরণ কখনও মেলানো যায়না। তোমার আমার সম্পর্কটাও সম্ভবত সেরকম। খেয়ে নাও, নিশ্চিন্ত মনে খাও। তোমাদের পাপা তোমাদেরই আছেন। তিনি একজন শুদ্ধ মানুষ। কারো প্রতি অবিচার করেন না। তোমাদের মাম্মার প্রতিও করেননি। কাল সারারাত তোমাদের পাপা ঘুমাননি। নামাজ আদায় করেছেন, নিভৃতে। তার প্রার্থনায় কে ছিলো তা আমি জানি। তা তুমিও জানো।”
কথাটা বলে উর্বী চলে যায়। নাবিল হাতের বার্লির বাটির দিকে তাকিয়ে থাকে, একদৃষ্টে।
****
আদালত চত্বরে রাওনাফ গাড়ি থামিয়ে গাড়ি থেকে নেমে ঘুরে এসে দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে দেয় উর্বীর দিকে।
উর্বী আতঙ্কিত মুখে তারদিকে তাকিয়ে আছে। রাওনাফ তাকে চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করে বলে,”এসো।”
উর্বী অস্ফুট স্বরে বলে,”শর্মীর পাপা…..”
_আমি আছি।
উর্বীকে থামিয়ে দিয়ে রাওনাফ বলে। উর্বী রাওনাফের হাতে হাত রেখে গাড়ি থেকে নামে। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা পুলিশ ভ্যান এসে আদালত প্রাঙ্গণে থামে। আদালত প্রাঙ্গণে আজ প্রচুর ভিড়। অসংখ্য কেসের শুনানি আজ।
পুলিশ ভ্যানটাকে দেখে উর্বী চ’ম’কে উঠে রাওনাফের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। রাওনাফ উর্বীর ঘা’ব’ড়ে যাওয়া মুখটা অবলোকন করে পুলিশ ভ্যানের দিকে তাকায়। কনস্টেবল ভ্যান থেকে আসামি নামায়। রাওনাফ নিচু গলায় উর্বীকে বলে,”অন্য কেসের আসামি।”
উর্বী অসহায় ভঙ্গিতে রাওনাফের দিকে তাকায়, রাওনাফ ঠান্ডা গলায় বলতে থাকে,”মুখোমুখি হতেই হবে।”
কথাটা বলে রাওনাফ উর্বীর হাত ধরে এগিয়ে যায় দালানের দিকে।
এজলাসে প্রায় পঞ্চাশাধিক লোক। গরমে ঘেমে নেয়ে সবাই একাকার। মাথার ওপরে যে ফ্যানগুলো ঘুরছে সেগুলো বাতাস দিচ্ছে কম, আওয়াজ দিচ্ছে বেশি। উর্বীর প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে,ধীরে ধীরে অসুস্থবোধ করছে সে। উচ্ছাসকে এখনও এজালাসে হাজির করা হয়নি । তবে উচ্ছাসের বাবা এসেছে। চুপচাপ নিজের পেছনে দুজন দেহরক্ষী দাড় করিয়ে বসে আছে। মাথা তুলে উর্বীর দিকে এক পলক তাকিয়ে ছিলো,আর তাকায়নি।
বিচারক আসনের মাথার ওপর ফ্যানটা ঘুরছে ঘটরঘটর করে । বিচারক নেই। একাধিক আইনজীবী এবং অন্যান্য দাপ্তরিক কর্মচারী। বিচারকের টেবিল পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে তাদের আসন। একটি মামলার জন্যই একাধিক আইনজীবী। কে কোন পক্ষের বোঝা মুশকিল। উর্বী কিছুই জানে না। শুধু রাওনাফ একজনের সাথে হ্যান্ডশেক করে কিছুক্ষণ কথা বলেছিলো বিধায় উর্বী বুঝতে পারছে উনি বাদী পক্ষের।
আইনজীবীদের ত্রিপক্ষীয় হট্টগোলে গমগম করছে এজলাস। এমন সময় বিচারক হন্তদন্ত হয়ে এজলাসে প্রবেশ করে নিজ আসন গ্রহণ করে টেবিলে কলম দিয়ে ঠুকঠুক আওয়াজ তুলতেই পুরো এজলাস নিস্তব্ধ হয়ে যায়। দুজন আইনজীবী নিজেরা নিজেরা পরামর্শ করে পুলিশ ইন্স’পে’ক্টর দীপঙ্করকে ইশারা করে, দীপঙ্কর বেরিয়ে যায় এজলাস থেকে এবং কিছু সময় পরে দু’জন কনস্টেবলকে নিয়ে উচ্ছাসকে এনে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়।
উর্বী মুখ ঘুরিয়ে মাথা নিচু করে রাওনাফের হাত খামচে ধরে। হঠাৎ উর্বীর অস্বাভাবিক আচরণ দেখে রাওনাফ কাঠগড়ার দিকে তাকাতেই উচ্ছাসকে দেখতে পায়।
রাওনাফের দৃষ্টি শান্ত। সে উচ্ছাসকে কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে উর্বীর পিঠে একটা হাত রেখে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলে,”কোনো ভয় নেই।”
উচ্ছাস রাওনাফ আর উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে,চোখের দৃষ্টি কোনো অনূভুতি ব্যক্ত করছে না তার। খুবই শান্ত দু’চোখের চাহনি। পরনে তার সাদা টি-শার্টের ওপরে একটা নেভি ব্লু-শার্ট,বোতাম গুলো একটিও লাগানো নেই। চেহারা দেখে তার ক্লান্তি বোঝার কোনো উপায় নেই, দাঁড়িয়ে আছে টানটান হয়ে।
উর্বী ছ’ট’ফ’ট করছে,সে এখান থেকে যেতে চায়। একটিবারের জন্যও কাঠগড়ার দিকে দৃষ্টি দেয়না সে। রাওনাফ এক হাত দিয়ে আগলে ধরে তাকে।
সকল প্রমানাদি পেশ করা হয়। বিচারক খুবই মনযোগের সাথে ফাইল পড়েন। উচ্ছাসের নামে মোট তিনটি চার্জ ছিলো। হত্যা,হত্যার চেষ্টা এবং নারী নির্যাতন। সকল প্রমানাদি ছানবিন করে বিচারকের রায়ে উচ্ছাসের সর্বমোট ষোলো বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয় এবং তার সাথে অর্থ জরিমানা।
উচ্ছাস চুপ চাপ উর্বীর দিকে দৃষ্টি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শাখাওয়াত চৌধুরী দু’চোখ বন্ধ করে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে সাথে সাথে নিঃশব্দে কেঁদে ওঠে।
হঠাৎ করেই উচ্ছাস এজলাসের সবাইকে ভড়কে দিয়ে হেসে ওঠে পাগলের মতো। বিচারক নিজের কলম সরিয়ে উচ্ছাসের দিকে তাকায়। রাওনাফ চুপচাপ তাকিয়ে আছে উচ্ছাসের দিকে। উচ্ছাস কিছুসময় হেসে জজের দিকে তাকিয়ে খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে ওঠে,”আচ্ছা আপনাদের আইনে বেঈমানের শাস্তি কি? তারা পৃথিবীতে উন্মুক্ত ঘুরে বেড়ায়,সুখী হয় কেন?”
উর্বী মাথা তুলে উচ্ছাসের দিকে তাকায়। উচ্ছাস জজের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে উর্বীর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে ওঠে,”বেঈমানের কোনো শাস্তি হয়না?”
উর্বী কাঁপছে। রাওনাফ দাঁতে দাঁত চেপে উঠে দাঁড়ায়,ভরা এজলাসেই সবার সামনে চেঁ’চি’য়ে উচ্ছাসকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,”জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলবো স্কা’উন্ড্রেল!”
জজ টেবিলে কলম ঠুকে রাওনাফকে উদ্দেশ্য করে বলে,”ডক্টর খান এটা কোর্ট! বিহেভ ইওরসেল্ফ!”
রাওনাফ পুনরায় বসে পরে। উর্বী মাথা নিচু করে শাড়ির আঁচল চে’পে ধরে বসে আছে, তার মাথা ঘুরছে। রাওনাফ উর্বীকে আগলে ধরে। উচ্ছাস পুনরায় বলে ওঠে,”তুমি নিজেও জানো তুমি বেঈমান,তাই চোখ তুলে তাকানোর সাহস নেই তাইনা।”
উর্বী রাওনাফের হাত খামচে ধরে। রাওনাফ আবারও উচ্ছাসের ওপর চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”আফসোস! নিজের অ’সুস্থতা এখন পর্যন্ত উপলব্ধি করতে পারছো না তুমি! আমি আমার পরিবারকে ভালোবাসি নয়তো আমার স্ত্রী কন্যার গাঁয়ে হাত তোলার শা’স্তি আমি নিজে দিতাম!”
জজ রাওনাফকে চুপ করিয়ে দিয়ে কেসের শুনানি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। উচ্ছাস উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী রাওনাফের বাহুতে মুখ লুকিয়ে বসে আছে। রাওনাফ তার হাত ধরে আছে।
উচ্ছাস হঠাৎ ডুকরে কেঁদে ওঠে। এজলাসে উপস্থিত সবাই কিছুটা অবাক হয়ে উচ্ছাসের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কনস্টেবল দু’জন এসে উচ্ছাসকে কাঠগড়া থেকে নামিয়ে নেয়। উচ্ছাস বলতে থাকে,”খুব বেশি কষ্ট হয়ে যেতো আমার হয়ে থাকলে উর্বী?”
দীপঙ্কর উঠে গিয়ে উচ্ছাসকে ধরে। টানতে টানতে নিয়ে যায় এজলাসের বাইরে। শাখাওয়াত চৌধুরী উঠে দ্রুত ছেলের কাছে যায়,ছেলের সাথে মুক্ত বাতাসে শেষ সাক্ষাৎ করবে বলে।
উর্বী সেই যে মুখ লুকিয়েছে আর কোনো সাড়াশব্দ করেনি। রাওনাফ ভেবেছে ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছে তাই সেও ওভাবেই আগলে ধরে রেখেছে।
উচ্ছাসকে এজলাস থেকে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে রাওনাফ ধিমি আওয়াজে উর্বীকে ডাকে,”উর্বী।”
উর্বী সাড়া দেয়না। রাওনাফ দুহাতে উর্বীকে নিজের থেকে আলগা করে দুহাতে মুখ আগলে ধরে মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে উর্বী অচেতন হয়ে গিয়েছে।
অন্ধকার গলির মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে উর্বী। চারপাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। উর্বী হাতরে হাতরে হাঁটছে। উঁচু নিচু পথে আন্দাজ করে হাঁটতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তার। কর্ণ গহীনে পৌঁছায় নাকি কান্নার আওয়াজ,শিশুসুলভ আদুরে কন্ঠে কেউ তাকে ডাকছে,”মা। মা। এসো তাড়াতাড়ি। মা।”
উর্বীর পায়ের গতি বেড়ে যায়। অস্থির হয়ে ছুটতে থাকে, চেঁ’চি’য়ে বলতে থাকে,”এই তো জাদু। আমি আসছি।”
বাচ্চাটার কান্নার শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে। উর্বী ছ’ট’ফ’ট করে,দৌড়াতে থাকে দ্রুত। কানে আসে মৃদু আওয়াজ,”মা ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে মা।”
সামনে পা বাড়াতেই দেখে সামনে উঁচু প্রাচীর। কান্নার শব্দ দেয়ালের ওপাশ থেকে আসছে। উর্বী জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। ধাক্কা দিতে থাকে দেয়ালে। এতো উঁচু দেয়াল টপকানোর সামর্থ্য যে তার নেই!
দু’চোখ খুলে লাফিয়ে উঠে বসে উর্বী। এসির মধ্যেও তার শরীরটা কুলকুল করে ঘামছে। বেশ শব্দ করে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে সে। রাওনাফ তৎক্ষণাৎ উঠে বসে। উর্বীর দিকে তাকিয়ে তার দিকে কিছুটা এগিয়ে বসে। এমনটা গত তিনদিন ধরে হচ্ছে। ঘুমের মধ্যে আজেবাজে স্বপ্ন দেখে লাফিয়ে ওঠে, তারপর সারারাত নির্ঘুম কাটায়। ছ’ট’ফ’ট করে।
উর্বী হাপাচ্ছে। দুহাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে রাখে কিছুক্ষণ, তারপর হাত সরিয়ে নেয়। রাওনাফ উর্বীর পিঠে একটা হাত রেখে বলে,”রিল্যাক্স! স্বপ্ন ছিলো ওটা।”
উর্বী জানে ওটা স্বপ্ন ছিলো,যা তাকে রোজ বিরক্ত করে। তার ফিরে পাওয়া জীবনের নতুন অস্বস্তির কারণ। সে শাড়ির আঁচল টেনে মুখ মুছে নিয়ে রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ তাকে চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করে , তারপর উঠে গিয়ে একগ্লাস পানি আনে। পানিটা নিজে খাইয়ে দেয় উর্বীকে। তারপর গম্ভীর হয়েই বলে,”ফার্স্ট টাইমিস্টারে কিছু হরমোনাল ইমব্যালেন্সের কারনে কিছু চেঞ্জ আসে মায়েদের। একটু বিষন্ন লাগে,কান্না পায় ক্ষণে ক্ষণে,কারনে অকারণে, পুরো প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডেই হতে থাকবে এসব। ডিপ্রেসড লাগবে। আর তুমি তো এমনিও দুঃখের সাগরে ভাসতে থাকা মহারানী দুঃখেন্নেছা উর্বী, তোমার আরো বেশি লাগবে।”
উর্বী হাঁপাতে হাঁপাতে রাওনাফের দিকে তাকায়। খুব সুক্ষ্মভাবে খোঁচা দিয়েছে উর্বীকে, ইদানিং সুযোগ পেয়ে ভীষণ কথা শোনাচ্ছে। উর্বী পাত্তা না দিলে যেন আরো বেশি শোনাচ্ছে।
রাওনাফ উর্বীর দৃষ্টি উপেক্ষা করে ঘড়ির দিকে তাকায়, তারপর বলে,”সময়ে অসময়ে বেশি খারাপ লাগলে নফল নামাজ আদায় করে নেবে। অস্থিরতা কেটে যাবে।”
উর্বীর হঠাৎ খেয়াল আসে। সে উঠে ওযু করে নামাজ আদায় করে নেয়। রাওনাফ উঠে বিছানা ভালো করে ঠিক করে দেয়। ডিউটি থেকে বাড়িতে ফিরে দেখেছে উর্বী বিছানায় অগোছালো হয়ে ঘুমিয়েছিলো,মাথার নিচের বালিশটা পর্যন্ত ঠিক ছিলো না। ইদানিং কাহিল হয়ে হুটহাট ঘুমিয়ে যায়,শুরু থেকেই ভদ্রমহিলা অগোছালো। তার জীবন অগোছালো,তার আচরণ অগোছালো।
উর্বী নামাজ আদায় করে উঠে দাঁড়াতেই রাওনাফ বিছানা থেকে একটা বই হাতে নিয়ে বইটা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলে,”এমন বই পড়ার প্রয়োজন নেই এই সময়টিতে, মস্তিস্কে চাপ পরে। মাইন্ড রিফ্রেশ হয় এমন বই পড়বে।”
উর্বীর ভালো লাগেনা রাওনাফের এমন গম্ভীর কথাবার্তা। রাওনাফ বলে,”রাতের ক্যাপসুলটা নিয়ম করে খাবে। ওটা বাধ্যতামূলক। আলসেমি করবে না। নাও এখন শুয়ে পরো।”
উর্বী ঘুরে দরজার দিকে পা বাড়ায়। রাওনাফ তার দিকে তাকিয়ে বলে,”কোথায় যাচ্ছো?”
উর্বী দাঁড়িয়ে বলে,”শর্মীর কাছে।”
_দেখে এসেছি আমি।
উর্বী তবুও পা বাড়ায় সামনে। রাওনাফ বলতে থাকে,”ঘুমাচ্ছে। দেখে এসেছি।”
উর্বী মাথা ঘুরিয়ে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”সেটা তো আপনি দেখে এসেছেন। আমি তো দেখিনি।”
বলা মাত্রই উর্বী দরজার বাইরে পা রাখতেই ডান হাতে টান অনুভব করে। মুহুর্তেই সে দেখলো রাওনাফ তাকে টানতে টানতে বিছানার কাছে নিয়ে যায়।
কোনো কথা না বলে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে আসে।
উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে।
রাওনাফ এসে বিছানায় নিজের নির্দিষ্ট স্থানে শুয়ে দু’চোখ বন্ধ করে গম্ভীর কন্ঠে উর্বীকে বলে,”ঘুমাও। নিয়ম করে রাত জাগলে আমার বাচ্চার ক্ষতি হবে!”
****
মোহনা শাফিউলের সাথে চট্টগ্রাম ফিরে গিয়েছে। অন্তরাও সামিউলের সাথে রাজশাহী ফিরে গিয়েছে। বাড়িতে অবশিষ্ট রাওনাফ করীম খান এবং তার মাতা,স্ত্রী এবং তিন ছানা। তিনছানা নয়, চার ছানা।
শর্মীকে বাড়িতে আনার দুদিন হয়ে গিয়েছে। মেয়েটা সারাদিন ঘরে বসে থাকে,উর্বী যথেষ্ট চেষ্টা করে মেয়েটাকে একটু হাসিখুশি রাখতে। শর্মীর বেশি হাঁটাচলা করা বারণ,তাকে দুমাস বেড রেস্ট দিয়েছে ডক্টর। তাই সারাটাদিন কাটে বিষন্নতায়। কখনও কখনও বন্ধুরা এসে সঙ্গ দেয়, কখনো তার খালামনিরা। তবুও শর্মীর মনটা ছটফট করে বাইরের দুনিয়ায় যেতে না পেরে।
উর্বীর দিনগুলো কাটছে ব্যাস্ততায়। শারীরিক ভাবে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পরছে যদিও তবুও নিজেকে এ কাজে,সে কাজে ব্যাস্ত রাখে।
এরমাঝে রেজাউল কবির এসে বোনকে দেখে গিয়েছেন দুবার। নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিছুদিনের জন্যে যদিও,উর্বী যায়নি।
সারাদিনে তিনবেলা উর্বী নিচতলায় নামে,নয়তো তার সারাটাদিন রওশান মঞ্জিলের দোতলায় কেটে যায়। বাড়ির কাজের ধারেকাছে যাওয়ার তো দুঃসাহসও করে না সে। আরো একজন খালা রাখা হয়েছে সকাল থেকে সন্ধ্যা কাজের তদারকি করার জন্য।
দোতলার উত্তর পাশের বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল উর্বী,তার উদ্দেশ্যে নিচতলা। উল্টোদিক হতে হেঁটে আসছিলো নাবিল। ধূসর রঙের একটা ফুল স্লিভ টি-শার্ট আর একটা নেভি ব্লু রঙের ট্রাউজার। একহাত পকেটে গুজে আয়েশী ভঙ্গিতে হাঁটছে। মাথায় একটা লাল রঙের ক্যাপ ঘুরিয়ে পরেছে। উর্বীকে দেখে তার মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়। কপাল কুঁচকে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উর্বীকে দ্রুত এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টায় সে। উর্বী নাবিলকে দেখে নিজেই গুটিয়ে যায়, সচারচর সে নাবিলের আশেপাশে প্রয়োজন ব্যতীত এমনিতেই তার অস্তিত্ব পৌঁছায় না।
বারান্দার দুপাশে সাজিয়ে রাখা আগের আমলের কিছু বড় বড় পিতলের ফুলদানি। এক একটার উচ্চতা প্রায় তিনফুট। নাবিলকে আসতে দেখে উর্বী একপাশে সরে হাঁটতে গেলে বেখেয়ালে গায়ের ধাক্কা লেগে একটা ফুলদানি এলিয়ে পরে তার গায়ে।
ঘটনাটা নাবিলের চোখের সামনেই ঘটেছে। সে হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উর্বীর দিকে ছুটে যাওয়ার আগেই উর্বী ফুলদানি সহ সামলে নেয় নিজেকে।
নাবিল ঘুরে যায় তৎক্ষণাৎ। উর্বী মাথা তুলে নাবিলের দিকে তাকায়। নাবিল কপাল কুঁ’চ’কে হাঁটতে থাকে। পরে যায়নি, ঠিক আছে,ধরতে না গেলেও হবে। কোথাও লেগেছে কিনা এই প্রশ্ন করে এতো আন্তরিকতা দেখানোর তো কিছু নেই,চোখ কপালে তুলে হাঁটলে তো এমন হবেই! এমনিতেও যতটা ঘৃণা করা উচিৎ এই মহিলাকে নাবিল করতে পারেনি কোনো এক অজানা কারনে, এই মহিলার চোখে তার পাপার জন্য ভালোবাসা, উৎকণ্ঠা দেখে সে, শর্মীকেও সে যেটা দেয় তাতে নাবিল ইদানিং কোনো নাটক খুঁজে পায়না। সেই কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে পুরোপুরি ঘৃণা নাবিলের আসেনা। তবে এতো আন্তরিকতা দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই। এমনিতেও উর্বীকে নিয়ে নাচার জন্য এ বাড়িতে অনেক মানুষ আছে।
হন্তদন্ত হয়ে নাবিল গিয়ে তার পাপার স্টাডি রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয় ধপপ করে। উর্বী সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দোতলার সিঁড়ির কাছে যায়।
খাবার টেবিলে পিনপতন নীরবতা। দুজন মানুষ শুধু সকালের নাস্তা করতে বসেছে। রাওনাফ এবং উর্বী। বাকিরা সবাই সকাল সকাল করে নিয়েছে। রাওনাফ গিয়েছিলো কিছু প্রতিবেশী বন্ধুকে নিয়ে লেক পার্ক সংলগ্ন এরিয়ায় জগিং করতে। আজ সে সকাল এগারোটা পর্যন্ত বাড়িতে থাকবে।
উর্বী বসে চুপচাপ বাদাম গুলো খাচ্ছিলো। দুজনের মধ্যে কোনো কথা হচ্ছে না। রাওনাফ একটা নেভি ব্লু রঙের পোলো টি-শার্ট গায়ে চাপিয়েছে। মাথায় ছেলের মতোই একটা ক্যাপ পরেছে,তবে রংটা কালো। ফরসা মুখটায় মানিয়েছে বেশ।
রাওনাফ নিউজপেপার থেকে চোখ সরিয়ে আমীরুনকে ডাকে, আমীরুন কিচেন থেকে বেরিয়ে এসে রাওনাফের সামনে দাঁড়ায়। রাওনাফ একটা গ্লাস উঠিয়ে আমীরুনের হাতে তুলে দিয়ে বলে,”শর্মীকে দিয়ে আয়। না খেতে চাইলে একটা লম্বা ধ’ম’ক দিবি।”
আমীরুন হেসে মাথা নেড়ে চলে যায়। রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী প্লেটের ডিম দু’টোর দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। তারপর একটা ডিম নিয়ে একটা কামড় বসাতেই চোখমুখ খিচিয়ে ফেলে। তার রীতিমতো বমি পাচ্ছে। তবুও সে জোর করে খেতে থাকে।
রাওনাফ নিউজপেপারে দৃষ্টি রেখেই বলতে থাকে,”যতটুকু খেতে পারবে ততটুকুই খাবে। কিছুক্ষণ পর পর খাওয়ার চেষ্টা করবে। আমাকে দেখানোর জন্য ইচ্ছার বিরুদ্ধে খাওয়ার প্রয়োজন নেই।”
উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়। সবকিছু নিয়ে খোঁচা মেরে কথা বলতেই হবে?
রাওনাফ উর্বীর দিকে একটা গ্লাস ঠেলে দিয়ে বলে,”এটা খেয়ে নাও। ডিম রাখো। কাউকে দেখিয়ে খাওয়ার প্রয়োজন নেই, যেটুকু পেট নিতে চাইবে ততটুকু খাবে,পেট তোমার।”
উর্বী কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে ওঠে,”পেটের মধ্যে বাচ্চাটা তো আপনার! পরে বলবেন আপনার বাচ্চার পুষ্টি হচ্ছে না।”
কথাটা বলে উর্বী খুব দ্রুত ডিমটা শেষ করে,গ্লাসের জুসটুকু শেষ করে উঠে চলে যায়।
****
ঘরে ঢুকে রাওনাফ আশেপাশে তাকিয়ে উর্বীর উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। রুমে নেই উর্বী। রাওনাফ সোজা হেঁটে বারান্দায় চলে যায়, সেখানেও কেউ নেই। পা বাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সে শর্মীর রুমে গিয়ে উর্বীর খোজ করেও পায়না। রাওনাফ কপাল কুঁচকে ফেলে। যে ধরনের ইমোশনাল মহিলা তাতে রাওনাফের খাপছাড়া আচরণে শিক্ষা হওয়া তো দূর উল্টো হিতে বিপরীত হয়ে কেঁদে কেটে অস্থির না হয় আড়ালে আবডালে। সেটা রাওনাফের মোটেও কাম্য নয়। সে তো উপলব্ধি করাতে চাইছে উর্বীকে জীবনের মানে, তার উদ্দেশ্য এই অবস্থায় স্ত্রীকে কষ্ট দেওয়া নয়। কিন্তু এই মেয়েটা রাওনাফের অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা না করে উল্টো নিজের অভিমানের দেয়াল তুলছে। এটা আজীবনের মাথামোটাই থেকে যাবে।
রাওনাফ একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে সিড়ি বেয়ে ছাদে উঠতে থাকে। সে জানে উর্বী ওখানেই থাকতে পারে।
রাওনাফের ধারণা ঠিক,উর্বী ছাদেই ছিলো।
ছাদের রেলিং ধরে উর্বীকে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাওনাফ নিশ্চিন্ত হয়। আর যাই হোক,মন খারাপ করে নেই। অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে প্রকৃতিকে দেখছে। দূর থেকে উর্বীকে অবলোকন করে সিড়ির দিকে পা বাড়াতেই উর্বীর চোখে পরে যায় রাওনাফ।
উর্বী ঘুরে দাঁড়িয়ে রাওনাফকে এভাবে ছাদে দেখে বলে ওঠে,”হাওয়া খেতে এসেছিলাম।”
রাওনাফ গম্ভীর হয়ে বলে,”হ্যা। তোমার ইচ্ছে। আমাকে বলছো কেনো? এটা তো আমাকে জানানোর প্রয়োজন নেই।”
উর্বী কয়েক মুহূর্ত রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কোনো লুকোচুরি না থাকুক। আবার নাহলে কথা শোনাবেন,এটা কেন লুকিয়েছো,ওটা কেনো লুকিয়েছো। তাই সব বলবো এখন থেকে। আমি এখানে ছাদে হাওয়া খেতে এসেছি। গোপনে দুঃখবিলাস করতে নয়। তাই চিন্তিত হবার প্রয়োজন নেই। আমি দুঃখের সাগরে সাঁতার কাটছি না আর আপনার বাচ্চার ওপরেও কোনো প্রভাব পরছে না।”
একনাগাড়ে বলে উর্বী শেষ করে। রাওনাফ হাসি চেপে রেখে গম্ভীর হয়ে বলে,”ড্রামা খুব ভালোই করতে পারো!”
উর্বী কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে নিচে চলে যায় চুপচাপ। রাওনাফ ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আশেপাশের প্রকৃতি দেখতে থাকে।
****
আজ ২৯শে জুন। নাবিলের মায়ের এগারো তম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রত্যেক বছর এই দিনটায় রাওনাফ বাড়িতে ডেকে এনে মাদ্রাসার পাঁচশো এতিম খাইয়ে দেয়।
নাবিলের ফুপিরা এবং খালামনিরা প্রত্যেক বছর এই দিনটাতে রওশান মঞ্জিলে আসে। শিমালার মৃত্যু বার্ষিকীতে এতিমদের জন্য রান্নাবান্না করে বাড়ির লোকজন নিজ হাতেই পরিবেশন করে খাওয়ায়।
বাগানের খোলা যায়গাটিতে রান্নাবান্নার আয়োজন করা হয়েছিলো আর উত্তর পাশের বড় আমগাছটার নিচে তাবু খাটিয়ে বাচ্চাদের জন্য খাবারের স্থান তৈরি করা হয়েছে।
উর্বী আঁচল কোমরে গুঁজে প্লেট এগিয়ে দিচ্ছে। সবার বারণ সত্তেও সে কাজ করছে। উর্বী খেয়াল করে বাচ্চাদের জন্য কাজ করতে তার
একটুও কষ্ট হচ্ছে না। বরং সে সুস্থ বোধ করছে।
রাওনাফ পাঞ্জাবীর হাতা গুটিয়ে বাচ্চা গুলোর প্লেটে মাংস দিয়ে যাচ্ছে। আমীরুন এবং সুমনা তাঁদের সাহায্য করছে।
বাচ্চারা সবাই বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। সে দৃশ্য দেখে সবার চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে।
শর্মীকে নিচে আনা হয়নি। নাবিল শায়মীও পাপার সাথে কাজের তদারকি করছে।
সবাই কাজের ব্যস্ততায় উর্বীর দিকে কেউ খেয়াল করেনি। সে ছুটে কোথাও যাচ্ছিলো হঠাৎ।
শায়মী তা দেখে চেঁ’চি’য়ে ওঠে।
“আন্টি কি হয়েছে! আন্টি!”
রাওনাফ ঘুরে তাকায়। সবাই সেদিকে তাকায়। উর্বী মুখে হাত চেপে ছুটছে । রাওনাফ তার হাতের মাংসের বাটি আমীরুনের হাতে দিয়ে সেদিকে যায়।
বাড়ির সবাই তার পিছু পিছু যায়। উর্বী গিয়ে কিচেন সংলগ্ন বেসিনে বমি করতে থাকে। রাওনাফ গিয়ে পেছন থেকে উর্বীকে ধরে।
বাড়ির সবাই থমকে দাঁড়ায় লিভিং রুমে। তারা ভেবেছিলো অন্য কোনো অসুবিধা হয়েছে হয়তো। তাই সবাই উৎকণ্ঠা নিয়ে ছুটে এসেছে।
রাওনাফ উর্বীকে ধরে রেখেছে। নিচুস্বরে কি কি যেনো বলছে। এখান থেকে তা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না।
বাড়ির সবাই সেদিকে আড়ে আড়ে তাকাচ্ছে। এই যে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর যত্নশীলতার যে দৃশ্যটি। এটি হয়তোবা পৃথিবীর অন্যতম অদ্ভুত সুন্দর একটি দৃশ্য। যা দেখলে সবার মন ভরে যায়।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সবাই পুনরায় বাইরে তাঁবুর কাছে চলে যায়।
নাবিল আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সেদিকে,তার পাপা নতুন বেবিটা নিয়ে খুব এক্সাইটেড সে শুধু সেটাই দেখতে পাচ্ছে। তার সঠিক অনূভুতি সে ধরতে পারছে না। তার কি পাপার ওপর রাগ হওয়া উচিত? নাকি শর্মী শায়মীর মতো ভাই-বোন আসার খুশিতে আনন্দিত হওয়া উচিত! তার কি করা উচিৎ! দোটানায় কাটছে তার দিন। সে চোখ সরিয়ে উর্বীর দিকে তাকাতেই পুনরায় বিরক্তি ছেয়ে যায় চোখে মুখে তার। সোজা হেঁটে সে বাইরে চলে যায়।
উর্বীর দৃষ্টি ঝাপসা। ভীষণ গা গুলিয়ে উঠছে তার। রাওনাফ আগলে নিয়ে উর্বীর গালে হাত রেখে ডাকতে থাকে তাকে। উর্বী কোনো মতে বলে ওঠে,”একটু ঘরে দিয়ে আসবেন আমাকে। শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছে।”
একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে রাওনাফ বলতে থাকে,”কে বলেছিলো নিচে যেতে? যা করার প্রয়োজন নেই সেটা আগ বাড়িয়ে করতে যাও,যা করার প্রয়োজন সেটা করতে চাও না।”
উর্বীকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয় রাওনাফ। উর্বী অস্ফুট স্বরে বলতে থাকে,”কি করা প্রয়োজন আমার?”
রাওনাফ কথা বলে না। চুপচাপ সিড়ি ভাঙতে থাকে। উর্বী পিটপিট করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। যদিও উর্বীর গাঁয়ের ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় কম তবুও সিড়ি ভাঙতে বেশ কষ্ট হচ্ছে লোকটার। গলার এড্যাম এপেল ওঠানামা করছে দ্রুত। উর্বী ছুঁয়ে দিতে গিয়েও দেয়না। সে দু’চোখ বন্ধ করে নেয়,কতদিন পরে এভাবে মিশে আছে সে লোকটার সাথে। সেই পরিচিত গন্ধের সাথে মিশে আছে।
বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রাওনাফ উর্বীর ব্লাড প্রেশার চেক করে। উর্বী দু’চোখ বন্ধ করে রেখেছে। ধিমি আওয়াজে বলছে,”আপনি নিচে যান। নাবিল কষ্ট পাবে ওর মায়ের নামে মিলাদের দিনে আপনি আমাকে নিয়ে ব্যস্ত। আমি এটা ইচ্ছে করে করিনি। খুব চেষ্টা করেছি সুস্থ থাকার, হঠাৎ যে কি হলো!”
রাওনাফ উর্বীর দিকে কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ায়। তারপর জানালার পর্দা গুলো টেনে দিয়ে,এসির পাওয়ার কিছুটা বাড়িয়ে দিয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে বলে,”খাবার পাঠিয়ে দিলে চুপচাপ খেয়ে শুয়ে থাকবে।”
রাওনাফ চলে যায়। উর্বী দরজার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। দু’চোখ বন্ধ করে হিসেব মেলাতে থাকে। জীবনের পাওয়া না পাওয়ার হিসেব করতে গেলে উর্বী দেখতে পায় তার না পাওয়ার চেয়ে পাওয়ার সংখ্যা অনেক বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
****
গভীর রাত। নিস্তব্ধ পুরো কলোনি। এমনিতেও এই এরিয়া সবসময় কোলাহল মুক্ত। তার ওপর কিছু কুকুর মাঝে মাঝে শব্দ করে ডেকে উঠে রাতের সময় বুঝিয়ে দিচ্ছে।
রাওনাফ শর্মী আর শায়মীর ঘরে ছিলো। আজ অনেক দিন পরে মেয়ে দুটোকে কিছুটা সময় দিতে পেরেছে সে। আজ তাদের মাম্মার মৃত্যুবার্ষিকী ছিলো,মন খারাপের কথা তো পাপাকেই শোনাবে তারা।
দু’জনে ভীষণ কাঁদে এই দিনটাতে পাপাকে জরিয়ে ধরে। মেয়েদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তাদের মাম্মার স্মৃতিচারণ করে রাওনাফ, তাঁদেরকে শোনায় শিমালার চঞ্চলতার গল্প। যখন তারা মাম্মার গল্প শোনে, দু’চোখ তাদের চকচক করে আনন্দে। শর্মীর একেবারেই মনে নেই তাদের মাম্মার কথা,শায়মীর স্মৃতিতে কিছুটা ভেসে ওঠে মাম্মার সাথে কাটানো দিনগুলো।
নাবিল কখনও তাদের সাথে অংশ নেয়না। এই দিনটিতে সে একা একাই মাকে নিয়ে ভাবতে পছন্দ করে। রাওনাফও তাকে বিরক্ত করে না।
দু’টো মেয়ে পাপার বুকে মাথা ঠেকিয়ে নাক টানে। রাওনাফ মেয়ে দু’টোকে নিজের থেকে আলগা করে বলে,”চোখ মোছো।”
দুইবোন চোখ মোছে। রাওনাফ উঠে দাঁড়িয়ে ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত দেড়টা বেজে গিয়েছে। মেয়েদের সাথে কথা বলতে বলতে খেয়ালই করেনি সে। দুবোনকে গুডনাইট বলে সে ঘরের দরজা টেনে বেরিয়ে যায়।
আজ সারাদিনে উর্বীর শরীরের খোঁজ নেওয়া হয়নি। মূলত সন্ধ্যা অবধি ঘরেই ঢোকেনি রাওনাফ। আমীরুনের থেকে জেনে নিয়েছে উর্বী খেয়েছে। আর সন্ধ্যার পরে তো মেয়েদের সাথেই ছিলো। রাতের খাবারটাও উর্বীর জন্য ঘরে পাঠিয়েছিলো রাওনাফ।
ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ঘুরে উর্বীর দিকে তাকায়। হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে খোলা চুলে, অসম্ভব সুন্দর এই রমনীকে ঘুমন্ত অবস্থায় তিনগুণ বেশি সুন্দর লাগে, আর ইদানিং মুখটা একটু ফোলা ফোলা লাগে, চেহারায় একটা মায়েদের মতো ছাপ পরছে।
এক হাত উর্বী পেটের উপর দিয়ে রেখেছে। অন্যহাত কপালে রেখে ঘুমাচ্ছে।
রাওনাফ ফ্রেশ হয়ে পাঞ্জাবি পাল্টে টি-শার্ট পরে নেয়। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে তোয়ালেটা নির্দিষ্ট স্থানে রেখে ধীরপায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যায়। বিছানায় না উঠে যে পাশটাতে উর্বী শুয়েছে সেই পাশটাতে বসে উর্বীর মুখের দিকে তাকায়।
গাঁয়ের রং বরাবর নজরকাড়া ভদ্রমহিলার,কিন্তু এই সময়টিতে যেন আরো বেশি মোহনীয় লাগছে তাকে।
চোখ ঘুরিয়ে উর্বীর কপাল থেকে বাম হাত টেনে হাতের কব্জিতে নজর বোলায় রাওনাফ। ক্ষ’তটা সেরে উঠছে ধীরে ধীরে। কিন্তু দাগটা চোখে লাগার মতো থেকে যাবে সারাজীবন। থাকুক, যতবার ভদ্রমহিলা দেখবে ততবার যেনো তার বুক কেঁপে ওঠে ঐ ভয়ংকর দিনটির কথা মনে করে। এটাও একটি শাস্তি।
এমনিতেই শাস্তি অনেক কম দেওয়া হচ্ছে। রাওনাফ কি করবে? রাওনাফ পারেনা, তার মায়া লাগে।
কপালের কাছে এলোমেলো হয়ে থাকা চুলগুলো কানে গুজে দিয়ে উর্বীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে সে। তারপর হঠাৎ করেই উর্বীর কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় রাওনাফ।
একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে আরো কিছুক্ষণ উর্বীকে দেখে রাওনাফ উঠে দাঁড়ায়। তারও এখন শুয়ে পরতে হবে। রাওনাফ ঘুরে দাঁড়ায়। হঠাৎ তার হাতে টান অনুভব করে সে। কিছুটা চ’ম’কে উঠে মাথা ঘুরিয়ে উর্বীর দিকে তাকাতেই দেখে উর্বী শুয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
রাওনাফ মুখভঙ্গি গম্ভীর করার চেষ্টা করে। কিন্তু উর্বী তা পাত্তা না দিয়ে নিচু স্বরে বলে,”আরেকটা দিন।”
“তোদের জাংকুক আসবে সামনের ২৫ তারিখ বাংলাদেশে! জানিস তুই শর্মী?”
শর্মীর চোখ খুশিতে চকচক করে ওঠে। পরক্ষনেই অবিশ্বাসের নজরে নাবিলের দিকে চোখ সরু করে তাকিয়ে ধিমি আওয়াজে বলে,”যাও তো! বিরক্ত করো না। এমনিই আমার মুড ভালো নেই!”
নাবিল বলে,”সত্যি বলছি। পাপা তো তোর আর শায়মীর জন্য কনসার্টের টিকিট এনেছে রে! তোরা কি লাকি রে! অনেকেই পায়নি টিকিট!”
নাবিলের বলার ধরনে শর্মী একটু একটু বিশ্বাস করতে শুরু করলো যেনো। নাবিল শর্মীর দিকে তাকিয়ে চুকচুক শব্দ করে আফসোস প্রকাশ করে বলে,”লাভ কি! তুই তো ন্যাড়া! এই বেল মাথা নিয়ে নিশ্চয়ই জাংকুকের কনসার্ট দেখতে যেতে পারবি না! জাংকুক ন্যাড়া আর্মি কনসার্টে এলাউ করবে না তার।”
কথাটা বলেই নাবিল খিকখিক করে হাসতে থাকে। শর্মী ক্ষেপে গিয়ে বলে,”জানতাম তুমি মিথ্যা বলছো। যাও তো এখান থেকে ভাইয়া। বিরক্ত করো না।”
নাবিল হাসি থামায় না। বলতে থাকে,”তোকে এখন কেমন লাগছে জানিস? থাক বললাম না।”
ফাবিয়ার কথা শুনে নাবিল দমে যায়। উর্বী দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দুই ভাইবোনের খুনশুটিময় আলাপ শুনছিলো। নাবিলকে দেখে আর সে ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করে না। উর্বীর ছায়ামূর্তি কেবিনের ভেতরে দৃশ্যমান। শর্মীর চোখ পরতেই নিচু গলায় ডাকে,”কে ওখানে। কে!”
উর্বী কয়েকমূহুর্ত দাঁড়িয়ে থেকে কেবিনের ভেতরে প্রবেশ করে। নাবিল ঘুরে তাকায়। শর্মী উর্বীকে দেখেই চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”আন্টি তুমি এসেছো! আল্লাহ আমি কত বলেছি পাপাকে, কেনো আসোনি আন্টি এতদিন। একটা ফোন দাওনি, আমি সবাইকে কত করে বলেছি আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই ,আমি….”
“ব্যস ব্যস। থামো,এতো কথা বলো না তুমি।”
উর্বী গিয়ে শর্মীর এক হাত আকরে ধরে আরেক হাত শর্মীর মাথায় রাখে।
শর্মী বলতে থাকে,”তুমি ঠিক আছো তো আন্টি!”
উর্বী মাথা নাড়ায়, অস্ফুট স্বরে বলে,”একেবারেই ঠিক আছি আম্মু।”
নাবিল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। একপলক উর্বীর হাতের দিকে তাকিয়ে উর্বীর মুখের দিকে তাকায়। তারপর কপাল কুঁচকে নিচুস্বরে বলে,”আপনি বসুন।”
সংবেদনশীল বাবার সংবেদনশীল ছেলে বলে কথা। নিজের রাগ আর ক্ষোভকে পাশে রেখে খুবই বিনয়ী হয়েছে উর্বীর প্রতি।
নাবিল চেয়ারটা উর্বীর দিকে ঠেলে দেয়। উর্বী নাবিলের মুখের দিকে তাকায়, তারপর বসে চেয়ারটায়।
শর্মী উর্বীর থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে উর্বীর হাত আগলে ধরতেই দেখে উর্বীর হাতে ব্যান্ডেজ। সাথে সাথে চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”আন্টি ঐ লোকটা করেছে তাই না! ঐ লোকটা করেছে এমন..”
উর্বী মাথা নাড়ায়। চোখ ঝাপসা হয়ে উঠেছে তার। কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে বলে,”কিচ্ছু হয়নি মা।”
শর্মী কেঁদে ফেলে,মায়া মায়া ফরসা মুখটা রক্তিম হয়ে ওঠে মুহুর্তেই। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে থাকে,”বাজে লোক! একটা জঘন্য লোক!তোমাকে কোথাও নিয়ে যায়নি তো? যেতে পারেনি তো?”
ছোটোখাটো আদুরে শরীরটাকে আঁকড়ে ধরে উর্বী কপালে চুমু খেতে থাকে। মাঝখানে একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,”কোথাও নিতে পারেনি!”
_আর মেরেছিলো খুব আরো?
_নাহ মা।
উর্বী কেঁদে ফেলে।
_তবে এই ব্যান্ডেজ! কি করেছে? কে’টে দিয়েছে!
উর্বী কিছু না বলে শর্মীকে জরিয়ে ধরে ফোপাতে থাকে। শর্মী বলতে থাকে,”পাপা বলেছে। লোকটাকে ছাড়বে না। আর কোনো ভয় নেই।”
উর্বী কাঁদছেই। কোথায় সে চতুর্দশী মেয়েটাকে অভয় দেবে, উল্টো মেয়েটা তাকে অভয় দিচ্ছে। নিজের এতোটা মর্মান্তিক মুহুর্তেও শুধু উর্বীর ক্ষ’তি হওয়া নিয়ে ছটফটাচ্ছে। এই প্রগাঢ় ভালোবাসা সে কেন আরো আগে অনুভব করলো না! কেনো অনুভব করলো না তার জীবনের অংশীদার এই মেয়েটিকে! সে তার জীবনের একক দাবিদার ছিলোনা, অংশীদার ছিলো এই মেয়েটিও যার সাথে উর্বীর কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। মরে গেলে এসব তো কখনও জানা হতো না উর্বীর! জানা হতো না।
নাবিল উর্বী আর শর্মীর দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। তারপর কেবিনের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
শর্মী উর্বীর শাড়ি খামচে ধরে কাঁদতে থাকে, উর্বী শায়মীর চোখের পানি মুছিয়ে দেয়। আদুরে গলায় বলে,”আর কোনো ভয় নেই তো! আমি জানি তো! আমার শর্মী আছে। সে আমাকে প্রটেক্ট করবে! এতো শক্তি কোথায় পেলে সেদিন শর্মী? তোমার পাপার বানানো অরেঞ্জ জুস খেয়ে?”
শর্মী হেসে ফেলে। উর্বী আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শর্মীকে। মেয়েটাকে জরিয়ে ধরতে গিয়ে সে টের পেলো গত দিনগুলোর ঝক্কি,গ্লানি সব কর্পুরের মতো উবে যাচ্ছে। শর্মী নিজেকে আরো আরো মিশিয়ে দিচ্ছে উর্বীর গায়ে। বাচ্চাদের মতো আদুরে গলায় বলে,”আমি তোমার একটা সিক্রেট জানি আন্টি।”
উর্বী অবাক হবার মতো করে বলে,”কি সিক্রেট! আমি তো পড়া বাদ দিয়ে জাংকুকের লা’ইভ দেখিনি!”
শর্মী দুহাতে মুখ চেপে হাসছে উর্বীর কথায়। উর্বী বলতে থাকে,”গেটের বাইরে ফুচকার গাড়ি থামিয়ে চোরের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে ফুচকা খাইনি। আমি তো রেজাল্ট কার্ড পাপাকে দেখাবো না তাই আন্টিকে দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে সাইন করাইনি! আমি তো ডায়েরীতে জাংকুকের স্টিকার লাগিয়ে রাখিনি। আমার আবার কি সিক্রেট?”
শর্মী খিলখিলিয়ে হাসছে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে নাবিল নির্লিপ্ত হয়ে শর্মী আর উর্বীর কথোপকথন শুনছে।
শর্মী লজ্জায় মুখটা লাল লাল করে বলে ওঠে,”তোমার বাবু হবে আন্টি।”
উর্বী দারুণ ল’জ্জা পেয়ে চমকে ওঠে। অস্বস্তিতে ছেয়ে যায় তার চেহারা। মেয়েটা বড় হলেও উর্বীর কাছে বাচ্চাই মনে হয়। তাই অস্বস্তি একটু বেশি।
শর্মী লাল হতেই থাকে লজ্জায়, নিচুস্বরে বলতে থাকে,”লামু আন্টি বলেছে।”
উর্বী চুপ করে থাকে। শর্মী বলতে থাকে,”আরেকটা সিক্রেট বলি আন্টি?”
উর্বী অস্ফুট স্বরে বলে,”কি?”
শর্মী কিছু মুহূর্ত সময় নিয়ে নিচু স্বরে বলে ওঠে,
_আমার ছোটো বাবু খুব খুব পছন্দ।
উর্বীর ইচ্ছে করছে ছুটে কেবিন থেকে পালিয়ে যেতে। লজ্জা হচ্ছে খুব কিন্তু লজ্জা তো কাটিয়ে উঠতেই হবে। সে বলে,”অনেক পছন্দ?”
শর্মী মাথা নাড়ায়। নিচুস্বরে বলতে থাকে,”আমি খুব এক্সাইটেড ছিলাম অন্তরা চাচীর বেবীটা নিয়ে।”
উর্বী নীরব থাকে,শর্মী বলে ওঠে,”আরেকটা সিক্রেট বলবো?”
উর্বী বলে,”কি?”
শর্মী বলে,”আমার ভাই বাবু খুব পছন্দ। ভাই বাবু হলে বেশি ভালোবাসবো।”
উর্বী জ’ড়তা কাটিয়ে শর্মীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”বোন বাবু পছন্দ নয় কেন?”
_বোন তো আছে আমার।
_ভাইও তো আছে তোমার।
উর্বী বলে।
_ও ভালো না, আমাকে অনেক বিরক্ত করে। একটা ভালো ভাই লাগবে।
উর্বী হেসে ফেলে। শর্মীও হাসতে থাকে। বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেসব কথা শুনছে নাবিল। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। শর্মী তাদের থেকেও বেশি উর্বীর ক্লোজ এটা নাবিল টের পাচ্ছে।
পুরো মুখে অস্বস্তি ছেয়ে আছে তার। চোখের সামনে স্বপ্নের সেই দৃশ্যটা ভেসে ওঠে। পাপা ছোটো বাচ্চাটিকে পরম আদরে কোলে তুলে চুমু খায়,নাবিলের ডাক তার পাপা শুনতে পায়না। গতকাল রাতেও সে স্বপ্নটা দেখেছে। একটা দুঃস্বপ্ন। যেটা খুব শিগগিরই বাস্তব হতে চলেছে। পাপা পুরোপুরি দূরে সরে যাবে তাদের কাছ থেকে, পুরোপুরি। যেটা আবেগী আর মাথামোটা শর্মী বুঝতে পারছে না। নাবিল সিদ্ধান্ত নিয়েছে,যদি এমন কিছু হয় তাহলে সে অনেক দূরে চলে যাবে। অনেক দূরে।
শর্মী হাসতে হাসতে একপর্যায়ে মুখটা শুকনো করে ফেলে। তার হাত চলে যায় মাথায়। কন্ঠে বিরক্তি মিশিয়ে বলতে থাকে,”আগামী পরশু ঈদ আন্টি। আমি ন্যাড়া মাথা নিয়ে কিভাবে ঈদ করবো! ওরা এটা কিভাবে করে দিলো।”
উর্বী হেসে শর্মীর দিকে তাকায়, শর্মীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”এবারের ঈদটা একটু খারাপ হোক। সামনের ঈদে চুলগুলো লম্বা হয়ে যাবে।”
_আন্টি আমাকে ঈদের আগে বাড়িতে নেবে না? আমার ঈদ কি এই হসপিটালে হবে?
উর্বীর মনটা খারাপ হয়ে যায়। এই বিষয়ে সে তো ভালো বলতে পারবে না,ডক্টররা জানেন। বাড়িটা শর্মীকে ছাড়া বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
সে শর্মীকে আগলে রেখে বলতে থাকে,”তোমার ঈদ যদি হসপিটালে হয়,খান বাড়ির সবার ঈদ হসপিটালেই হবে।”
****
আজ ঈদের দিন। সকাল বেলাটা শর্মীর কাছে তার জীবনের সবথেকে বিদঘুটে সকাল বেলা। একরাশ বিরক্তি এবং হতাশা নিয়ে কেবিনে বেডে আধশোয়া হয়ে আছে সে। তার বেডের পাশেই একটা বাটিতে ভেজিটেবল স্যুপ আর অরেঞ্জ জুস রাখা। একরাশ অনিহা নিয়ে কয়েক চামচ স্যুপ খেয়ে নিয়েছে সে। নার্স এসে দু’টো ওষুধ খাইয়ে দিয়ে গিয়েছে। শর্মীর মনটা ক্রমে ক্রমে খারাপ হচ্ছে। আজ ঈদের দিন,সবাই বাড়িতে আর সে এই হসপিটালের কেবিনের মধ্যে থেকে ছ’ট’ফ’ট করছে। রাতে পাপা থাকেনি তার কাছে। না থেকেছে আন্টি,না বাড়ির অন্য কেউ।
পাপা,আন্টি,ভাইয়া,আপু,চাচ্চু-চাচীরা, খালামনিরা কেউ এখন অবধি আসেইনি। অন্যদিন গুলোতে কেউ না কেউ তার সাথে থাকতো। অথচ আজ সে সম্পূর্ণ একা। গায়ে একটা হসপিটালের আকাশী রঙের পোশাক,আকাশী শর্মীর সবথেকে অপছন্দের রং।
মুখ ভার করে বসে আছে সে। আজ যেই আসুক,সে কারো সাথেই কথা বলবে না। সবাই আনন্দ করুক। শর্মীর কথা কারো ভাবতেই হবে না।
ক্ষোভ প্রকাশের মাঝেই দরজার পর্দা সরিয়ে উঁকি দেয় উর্বী। শর্মীর চোখে চোখ পড়তেই শর্মী চোখ সরিয়ে নেয়। উর্বী ভেতরে ঢোকে। তার গাঁয়ে একটা নতুন শাড়ি শর্মী খেয়াল করেছে, তার পেছনে ভেতরে ঢোকে রাওনাফ। রাওনাফের গায়ে একটা সাদা রঙের পাঞ্জাবি। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে মাথায় রাওনাফ পাগড়ি ধরনের একটা বস্তু লাগিয়ে রেখেছে। শর্মী বিষয়টা খেয়াল করলেও পাত্তা দেয় না। রাওনাফের হাতে একটা টিফিন কেরিয়ার আর একটা শপিং ব্যাগ। সে সেগুলো কেবিনের মধ্যে থাকা একটা সেন্টার টেবিলের ওপর রেখে শর্মীর দিকে তাকায়। শর্মী মুখ ভার করে রেখেছে। স্বাভাবিক। সকালে ঈদের নামাজ আদায় করে তারপর এসেছে হসপিটালে তারা। একটু দেরীই হয়েছে সবকিছুর আয়োজন করতে গিয়ে।
আজ খানবাড়ির সবাই সিটি মেডিকেয়ারে ঈদ উদযাপন করবে বলে এসেছে। বাড়ির সবাই অন্য ওয়ার্ড গুলোতে ঈদের ফিরনি বিলি করছে,সাথে নানারকম খাবার। হসপিটালে ডিউটিরত নার্স গুলো তাদের সাহায্য করছে।
রাওনাফ শর্মী আর উর্বীর দিকে এক পলক তাকিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।
উর্বী ঘুরে শর্মীর দিকে তাকায়। গাল টেনে দিয়ে বলে,”রেগে আছো!”
_আমি ভেবেছি আমার কথা ভুলেই বসে আছো সবাই।
উর্বী হাসে। শপিং ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে শপিং ব্যাগ থেকে একটা ড্রেস বের করে শর্মীর সামনে ধরে। মুখ হাঁসি হাঁসি করে বলে,”তোমার পাপা কিনেছে কাল তোমার জন্য।”
শর্মী ড্রেসটা দেখে ভীষণ খুশি হয়। সে এক্সাক্টলি এই ড্রেসটাই পছন্দ করেছিলো কিন্তু স্টক আউট হয়েছিলো বলে অর্ডার করতে পারেনি। খুশি হয়ে ড্রেসটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে, তারপর নিজের গায়ে রেখে ঘুরে কেবিনের আয়নার দিকে তাকাতেই তার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়।
ন্যারা মাথা, মাথায় একপাশে ব্যান্ডেজ। নিজেকে কুশ্রী হিসেবে ভাবার জন্য এই দৃশ্যটিই যথেষ্ট।
উর্বী তা খেয়াল করে। এগিয়ে এসে শর্মীর ড্রেস টা তার হাত থেকে নিয়ে শর্মীকে বেডে বসায়। শর্মীর শুকনো মুখটা উঁচু করে তুলে ধরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শর্মীকে রেডি করিয়ে দিতে থাকে। জামা পাল্টে দিয়ে,হাত মুখ ধুইয়ে গালে ময়েশ্চারাইজার ক্রিম লাগিয়ে ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক লাগিয়ে দেয়। শর্মী চুপচাপ দেখছে,তার একটুও ভালো লাগছে না। উর্বী শর্মীর অনিহা পাত্তা না দিয়ে শর্মীর চোখে আইলাইনার লাগিয়ে দেয়, নখে নেইলপলিশ লাগিয়ে দেয়। সবশেষে উর্বী শর্মীর কপালে একটা টিপ পরিয়ে দেয়। তারপর শর্মীকে ঘুরিয়ে আয়নার সামনে দাড় করায়। শর্মী আয়নার দিকে তাকিয়ে নিস্তেজ কন্ঠে বলে ওঠে,”টয় স্টোরির মিসেস পটেটো লাগছে আমাকে।”
উর্বী হেসে বলে,”আমার কাছে শর্মীই লাগছে।”
সাজিয়ে দিয়ে শর্মীকে বসিয়ে,তাকে ঈদের ফিরনি খাইয়ে দিতে দিতে উর্বী বলে,”আজ সবাই হসপিটালে ঈদ করবে। আমাদের শর্মীর সাথে। সবাই এসেছে। হসপিটালের ডক্টরস রুম ফাঁকা করে সেটাকে একটা ছোটোখাটো মুভি থিয়েটার বানানো হয়েছে। সবাই মুভি দেখবে ঈদের দিন দুপুরটা।”
শর্মী অবাক হয়ে যায়। উর্বী বলে,”এতো বড় হা করো না মেয়ে। আরো অবাক হওয়া বাকি!”
রাওনাফ এর মাঝে দরজায় নক করে,উর্বী গিয়ে দরজা খুলে দেয়। রাওনাফ এসে শর্মীর সামনে দাঁড়ায়। শর্মী তার পাপার মাথার দিকে তাকিয়ে বলে,”পাগড়ির মতো ঐ বস্তুটা পরে আছো কেনো পাপা! তোমাকে অদ্ভুত লাগছে।”
উর্বী মুচকি মুচকি হাসছে। রাওনাফও হাসে। এর মাঝে কেবিনে ঢোকে শাফিউল আর সামিউল। তাদের পিছু পিছু নাবিল। শর্মী খেয়াল করে সবার মাথাতেই একই ধরণের পাগড়ি। শর্মী যারপরনাই অবাক হয়ে সবার মুখের দিকে তাকায়।
রাওনাফ ওঠে,”সারপ্রাইজ। ঈদ মোবারক মামনি!”
কথাটা বলেই রাওনাফ এক টানে পাগড়িটা খুলে ফেলে। শর্মী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে তার পাপার দিকে। একে একে সবাই নিজেদের মাথার পাগড়ির মতো বস্তুটা খুলে ফেলে। শর্মী বোকার মতো উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী মুখে শাড়ির আঁচল চে’পে ধরে হাসছে।
শর্মী বলে ওঠে,”এসব কি!”
রাওনাফ নিজের ন্যাড়া মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে,”আমরা সবাই শর্মী সেজেছি!”
রাওনাফ হাসে। মেয়েকে কাছে টেনে জরিয়ে ধরে বলে,”আমার মামনির জন্য করেছি।”
শর্মী কেঁদে ফেলে, তারপর পাপা,চাচাদের ও ভাইকে জড়িয়ে ধরে। কিছুক্ষণ পরে সবার দিকে তাকিয়ে শর্মী খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে,হাসতে হাসতে কুটিকুটি হয়। তার এখন আর নিজেকে কুশ্রী লাগছে না। উর্বী কেবিনের একপাশে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে সবাইকে। সবার এই সামান্য স্যাক্রিফাইস টুকু শর্মীকে আনন্দ দিচ্ছে। শর্মীর সেই আনন্দ, আনন্দ দিচ্ছে উর্বীকে।
রাওনাফ মেয়েকে ঈদ সালামি দেয়। শর্মী খপ করে টাকাটা নিয়ে পাপাকে জরিয়ে ধরে বলে,”এটা আমার লাইফের সবথেকে বেস্ট ঈদ পাপা। সবথেকে বেস্ট ঈদ।”
এটা সত্যিই অন্যরকম একটি ঈদ ছিলো শর্মীর জীবনে,খান বাড়ির সবার জীবনে। বিগত কয়েকদিনের ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে একটা প্রশান্তিদায়ক ঈদের সকাল।
হসপিটালে দায়িত্বরত নার্স এবং ডক্টররা যারা নিজেদের দায়িত্বপালনের পাশাপাশি ঈদটাকেও উপভোগ করতে পারছে। মোটামুটি সুস্থ রোগীদের ভীষণ উচ্ছসিত লাগছে। একঘেয়েমি ভাব কেটে গেছে সবার।
ডক্টরস রুমে ঈদের দুপুরে সিনেমা দেখার আয়োজন করা হয়েছে। যেটা শর্মীর জন্য ছিলো আরো একটা সারপ্রাইজ। তার মতো অনেক রোগীই এসেছে সিনেমা দেখতে। যারা হাঁটতে পারেন এবং মোটামুটি সুস্থ। রাওনাফের ঘোর আপত্তি থাকলেও পেশেন্টদের বিনোদনের আর্জি জানিয়ে উর্বী এই ব্যবস্থা করেছে।
সবাই পপকর্ন নিয়ে বসে গিয়েছে মুভি দেখতে। সবাই দেখছে হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত টেলিফিল্ম “নয় নাম্বার বিপদ সংকেত।”
দুজন ব্লগার এসে সিটি মেডিকেয়ারের ঈদ উপলক্ষে এই আয়োজন পুরোটা ভিডিও করে নিয়ে গিয়েছে।
সবাই খুব আনন্দিত। সবথেকে বেশি আনন্দিত উর্বী। শুধু শরীর নয়,মনটাও তার আগের থেকে বেশ ভালো লাগছে। সে প্রায় ছোটাছুটি করে সব আয়োজন করছে।
রাওনাফ আড়চোখে উর্বীকে দেখে। আগের মতো প্রানচঞ্চলতা খুঁজে পেয়েছে মেয়েটা তা রাওনাফের দৃষ্টিগোচর হয়নি।
মুভি দেখতে দেখতে সবাই মাঝে মাঝে বেশ শব্দ করে হেসে উঠছে। হাসছে শর্মীও। রাওনাফ শর্মীকে বলে,”এতো জোরে হেসো না মামনি। তুমি পুরোপুরি সেরে ওঠোনি।”
শর্মী মাথা নেড়ে মুভিতে মনোযোগ দেয়। উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়। দু’জনের চোখাচোখি হতেই রাওনাফ চোখ সরিয়ে নেয়। তারপর খানিকবাদে উর্বীকে বলে ওঠে,”আনন্দ করছো করো। এই শরীরে এতো লম্ফঝম্প করার তো কিছু নেই।”
উর্বী মুচকি মুচকি হাসছে। রাওনাফ অবাক হয়ে বলে,”হাসার কি বললাম?”
উর্বী গলা খাঁকারি দিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,”না মানে,কেউ একজন বলেছিলো স্বামী হিসেবে সে কোনো অধিকারবোধ দেখাবে না, কিন্তু সে বেখেয়ালে তার কথা রাখতে পারলো না। তাই হাসি পাচ্ছে আমার।”
কথাটা বলে উর্বী নকল হাই তোলার ভান করে। রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর কিছুসময় পরে অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে,”আমার বেবীর জন্য বলেছি। অধিকারবোধ দেখাইনি। আমি আমার বেবির প্রতি কনসার্ন।”
উর্বী আহত হয়, বিরক্ত হয়,রেগে যায়। রাওনাফ পাত্তা না দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। হসপিটালে ঈদ উপলক্ষে একটা মিলের আয়োজন করা হয়েছে দুপুরে,তার তদারকি করতে যেতে হবে। উর্বী ঠায় বসে থাকে শুকনো মুখে, এখনও হয়নি ডাক্তারের শাস্তি শাস্তি খেলা, এখনও পরেনি ডাক্তারের রাগ। আমীরুন ঠিক বলেছিলো সেদিন, তার ভাইজান আসলেই একটা জিনিস। উপরে উপরে দেখা যায়না। একজন ঠান্ডা মাথার খুনী।
উর্বী চুপচাপ বসে থাকে বিষন্ন ভঙ্গিতে। বিরবির করে বলে,”হৃদয়হীন ডাক্তার।”