Friday, July 25, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 394



আরেকটি বার পর্ব-৩৫+৩৬

0

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৩৫
#Esrat_Ety

“একটা কথা আপনি একেবারে ঠিক বলেছেন শর্মীর পাপা। আমি বরাবর আমার ভালো থাকাটাকে প্রাধান্য দিয়েছি। বরাবর। আমি যে আপনার মতো স্বার্থহীন মানুষ নই,যে দুহাত ভরে অন্যকে শুধু দিয়েই যায়। আমি শুধু পেতে ভালোবাসি,যতটুকু পেলে একটা জীবন নিয়ে ভালো থাকা যায়। তাই যখন টের পেয়েছি একটা ভুল মানুষের সাথে জরিয়ে গিয়েছি আমি,যার সাথে আর যাই হোক একটা সুস্থ সম্পর্ক আসা করা যায়না। টের পাওয়া মাত্রই তার কাছ থেকে সরে আসতে চেয়েছি। শুধুমাত্র ভালো থাকার জন্যই। তারপর যখন ধ*র্ষিত হলাম, সুই’সা’ইড করার বদলে তখনও আমার মাথায় চলছিলো কিভাবে ভালো থাকা যায়, সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি ভালো থাকতে। যখন টের পেলাম আমি অন্তঃসত্ত্বা, তখনও মরার কথা না ভেবে চেষ্টা করেছি ভালো থাকতে। ঐ পরিস্থিতিতে ভালো থাকার মানে ছিলো উচ্ছাসকে বিয়ে করে নেওয়া,বাচ্চাটাকে পিতৃপরিচয় দেওয়া। তাই ভালো থাকতে নিজের আত্মসম্মান দাফন করে একজন রে’পিস্টের কাছে গিয়েছিলাম তাকে বিয়ে করতে। কিন্তু ভালো থাকা তো আমার কপালে লেখা নেই। উচ্ছাসের জেল হলো। আমার উচিৎ ছিলো তখনই আ*ত্মহত্যা করা। কিন্তু আমি যে ভালো থাকার কাঙাল। তাই করলাম কি, পেটের বাচ্চাটাকে মারলাম,অথচ নিজে মরলাম না। কারন আমার ভালো থাকতে হবে। এই ভালো থাকার জন্য কি কি করেছি এই সাতটা বছর আপনি জানেন? আপনাকে বলা হয়নি। কিন্তু থাকিনি ভালো। কত লোকের গঞ্জনা সহ্য করেছি, লাঞ্ছনা সহ্য করেছি দীর্ঘ সাতটা বছর। সাত বছর শর্মীর পাপা। তারপরও আমি হেদিয়ে ম’রেছি একটু ভালো থাকার জন্য। এই পৃথিবীতে কে ভালো থাকতে না চায় বলুন তো? তারপর হঠাৎ করে কিভাবে কিভাবে যেনো একটা জ্যাকপট পেয়ে গেলাম,আমি আপনাকে পেয়ে গেলাম। এতো এতো দিলেন আমায় আপনি। আপনার পরিবার। আরো আরো ভালো থাকার লোভ পেয়ে বসলো আমাকে। এটাও সত্যি যেটুকু আমি সবার জন্য করেছি তাও আমার স্বার্থে, সবকিছুর মধ্যে আমি আমার ভালোথাকা খুজে নিয়েছি। আমি দেখতাম মায়ের যত্ন করলে আমি ভালো থাকছি,তাই মায়ের যত্ন করতাম, দেখতাম শর্মীকে আদর করলে আমি ভালো থাকছি তাই শর্মীকে আদর করতাম,আমি দেখতাম নাবিল শায়মীর মনে নিজের জন্য একটু যায়গা করতে পারলেই আমি ভালো থাকবো,তাই সেই চেষ্টা করতাম। সবকিছুই আমার নিজের ভালোথাকার জন্য। ঠিক বলেছেন আপনি,আমি চাইনি আমার নোংরা অতীত গণহারে সবাই জানুক,তাই উচ্ছাসকে সবার সামনে আসতে দিইনি। লুকিয়ে গিয়েছি। সবটাই ভালো থাকতে। খান বাড়ির সবার চোখে কি পরিমান অযাচিত ভালোবাসা আমি দেখেছি আমার জন্য,ঐ চোখ গুলোতে আমি আমার জন্য ঘৃণা না দেখার চেষ্টা করে গিয়েছি।
আমি চাইনি সাত বছরের ইতিহাসের আমার জীবনে পুনরাবৃত্তি হোক। আবারও দম আটকে রেখে দিন পার করি। ভীষণ দুর্বিষহ ছিলো ঐ দিন গুলো শর্মীর পাপা। গোটা জীবনটাই আমার কে’টেছে কিছু ভুল সিদ্ধান্তে। এখানে অন্য কারো কোনো দোষ নেই। ভুল গুলো করেছি শুধুমাত্র নিজে ভালো থাকতে। নিজের কথাই ভেবেছি শুধু। কিন্তু স্বার্থপরেরা যে ভালো থাকতে পারেনা শর্মীর পাপা।

আপনি ভাবতে পারেন যে চরিত্র ত্রিশেও উন্নত হয়না তার আর কি হবে?
আমার ম’রতে বরাবর ভীষণ ভয় হতো, আজ হঠাৎ নিজেকে খুব সাহসী লাগছে। সাথে আনন্দও হচ্ছে, আমার জীবনের ভুল গুলো আমার জীবনের ফুলগুলোর কষ্টের কারণ হবেনা আর। কারন আমি তো আমি। আমায় ঘৃণা করুন শর্মীর পাপা,আমি চাই আপনি করুন।”

রক্তের ছোপ ছোপ দাগ লেগে থাকা কাগজটায় চোখ বুলিয়ে রাওনাফ কাগজটা দলা পাকিয়ে হাতের মুঠোয় নেয়। তারপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে জানালার বাইরে তাকায়। পাশের এরিয়াতে একটা শপিং মল নির্মাণাধীন। নির্মাণ কাজের শব্দে রাওনাফ বিরক্ত হয়ে কপাল কুঁচকে ফেলে। তার রীতিমতো মাথা ব্যাথা করছে শব্দে।

“স্যার আসবো?”

রাওনাফ হাতের কাগজটা বিনে ছুঁড়ে ফেলে মাথা ঘুরিয়ে হেড নার্সের দিকে তাকায়,ম্লান হেসে বলে,”এসো।”

আফরিন হাতের ফাইলগুলো রাওনাফের টেবিলের ওপর রেখে বলে,”স্যার রিপোর্ট গুলো।”

রাওনাফ হাত বাড়িয়ে রিপোর্ট গুলো দেখতে থাকে। নার্স আড়চোখে রাওনাফকে দেখছে। তারপর নিচুস্বরে বলে,”স্যার আজ ও.টি. করবেন?”

_হু,কেনো নয়।
রিপোর্টে চোখ বোলাতে বোলাতে বলে রাওনাফ।

_না মানে স্যার,এই পরিস্থিতিতে…

_আফরিন রোগীর জীবন আগে। তারপর সবকিছু।
দৃঢ়ভাবে জবাব দেয় রাওনাফ।

আফরিন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে,
_আপনার খুব ধৈর্য্য স্যার।

রাওনাফ মৃদু হাসে,বলতে থাকে,”আফরিন জানো,আমার বাচ্চাগুলোকে আমি কখনো ডাক্তারি পড়াবো না। এই পেশাটা একজন মানুষকে মানুষ থাকতে দেয়না,পাথর বানিয়ে দেয়। একটা স্টোন।”

আফরিন চুপ করে থাকে, তারপর বলে ওঠে,”স্যার কফি পাঠাবো?”

_হ্যা,সেটাও জিজ্ঞেস করছো? কড়া করে। যাও নিয়ে এসো।

আফরিন চলে যেতেই লামিয়া ভেতরে ঢোকে। রাওনাফ হেসে বলে,”গুড মর্নিং! কোথা থেকে এলো! আজ তো তোমার ও.টি নেই সকালে।”

লামিয়া বসতে বসতে বলে,”এলাম। তোমার হালচাল দেখতে। হসপিটালটা তো পুরো পারিবারিক হসপিটাল বানিয়ে ফেললে।”

রাওনাফ জবাব দেয়না। লামিয়া বলে,”শর্মীর কেবিন থেকে এলাম। তোমার দুই শ্যালিকার কাছে নালিশ করছে তাকে ন্যাড়া কেনো করা হয়েছে। তার লম্বা লম্বা চুল গুলোর জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।”

রাওনাফ হাসে। লামিয়া বলে,”মেয়েটাকে একটু সুস্থ দেখতে কি যে শান্তি লাগছে রাওনাফ। গত পনেরো টা দিন আমি ঘুমাতে পারিনি ঠিকভাবে তুমি জানো!”

রাওনাফ উঠে দাঁড়ায়, ম্লান হেসে মৃদু স্বরে বলে,”জানি। আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে আমি চিনি।”

_কোথাও যাচ্ছো তুমি?
লামিয়া রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে। রাওনাফ বলে,”হু। চারশো একে।”

লামিয়া সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়। বলে,”আমিও যাবো।”

_না। আমি একাই যেতে চাচ্ছি লামিয়া।

লামিয়া দাঁড়িয়ে যায়। রাওনাফ বলে,”আগে আমার বোঝাপড়া করা দরকার। তোমরা পরে যেও‌।”

লামিয়া মাথা নাড়ায়। রাওনাফ বলে,”আফরিন এলে তাকে কফি নিয়ে চারশো একে পাঠিয়ে দিও। আমি আসছি।”

****
মেডিসিনের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে এসে লাগছে। গন্ধটা সহ্য করা যাচ্ছে না। উর্বী চোখ পিট পিট করে তাকাচ্ছে। সে বুঝতে পারছে না সে কোথায়। তার কি হয়েছিলো।‌ সমস্ত ব্যাপারটা তার কাছে লম্বা সময়ের একটা ঘুমের মতো লাগছে। সে কি ঘুমিয়েছিলো?
ঘড়ির কাঁটা টিক টিক শব্দ করে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। চোখ খুলে সিলিংয়ের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে এটা তার রুম নয়। তার ঘরের দেয়ালের পেইন্ট ধবধবে সাদা,আকাশী নয়।

উর্বী নড়চড়ে উঠে ডান পাশে মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। দেখতে পায় রাওনাফকে। রাওনাফ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ওদিকে ফিরে কফি খাচ্ছে সম্ভবত।
উর্বী চিন্তিত ভঙ্গিতে আশেপাশে তাকায়। সে কি হসপিটালে? এটা কোন রুম! দরজা খোলা। জানালা থেকে আসা মৃদুমন্দ বাতাসে দরজার সাদা রঙের ফিনফিনে পাতলা পর্দা সমান তালে নড়ছে,উড়ছে।
উর্বী উঠে বসতে যায়। বাম হাতে ভর করে উঠতে গিয়ে হঠাৎ বাম হাতের কব্জিতে প্র’চন্ড ব্যাথা অনুভব করে। তাকিয়ে দেখে তার বাম হাতের কব্জিতে ব্যান্ডেজ। তৎক্ষণাৎ উর্বী মাথা ঘুরিয়ে রাওনাফের দিকে তাকায়।

রাওনাফ এক পলক উর্বীর দিকে তাকিয়ে আবারও ঘুরে জানালার বাইরে দৃষ্টি রেখে কফির মগে চুমুক দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বলে ওঠে, “আমি তোমার সাহস দেখে ইম্প্রেসড। সত্যিই মৃদুলা উর্বী,আ’ম রিয়ালি ইম্প্রেসড!
ইউ আর আ জিনিয়াস! না মানে,সুই’সাই’ড করার এতো এতো আরামদায়ক পদ্ধতি থাকতে তুমি র’ক্তার’ক্তির পথ বেঁছে নিলে।

স্লিপিং পিলস খেতে পারতে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ম’রে যেতে। কিন্তু তুমি যে প্রোডাক্টিভ তা বোঝাতে চেয়েছো। আর হাতটাও কেটেছো দারুন ভাবে। একেবারে সোজা করে। আমি স্কেল দিয়ে মেপেছি। দেড় ইঞ্চি। না কম না বেশি! হাউ পারফেক্ট! রিয়ালি ইম্প্রেসিভ!”

উর্বী ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে। রাওনাফ ঘুরে উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী এলোমেলো দৃষ্টি দিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে ধীরে ধীরে নিজের পেটে হাত দেয়।

রাওনাফ সেদিকে তাকিয়ে বলে,”ও ঠিক আছে। আর খবরদার ! ওর কথা তোমার ভাবতে হবে না। ওর জন্য আমি আছি।”

রাওনাফের এই কথাতে উর্বী রাওনাফের মুখের দিকে তাকায়। রাওনাফের এই কথাটিতে তীব্র অভিমান নয়তো ঘৃণা মিশে আছে যা উর্বী টের পাচ্ছে।

উর্বী মাথা নিচু করে বসে থাকে। রাওনাফ দাঁতে দাঁত চেপে ধ’ম’কে বলে ওঠে,”ও আমার বাচ্চা। তোমার কাছে ওর কোনো মূল্য না থাকতে পারে। আমার কাছে আছে।‌‌”

উর্বী মাথা তুলে ফুঁপিয়ে ওঠে, আটকে আটকে বলে,”আমি…আমি অনেক বড়ো ভুল করে ফেলেছি। আমি আবারও অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি শর্মীর পাপা।”

উর্বীর কান্না রাওনাফকে বিচলিত করে না। সে গিয়ে কেবিনের দরজা ভেতর থেকে লক করে দেয়। তারপর এসে উর্বীর বেডে,উর্বীর মুখোমুখি বসে। উর্বী চোখের পানি মুছে বলে,”ভুল করেছি আমি।”

রাওনাফ উর্বীর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে ঠান্ডা গলায় বলে,”এখন যে কাজটা করতে চাচ্ছি তাতে পরে অনুশোচনা হয়তো করবো , অ’প’রা’ধ বোধে হয়তো ভুগবো মৃদুলা উর্বী, কিন্তু বর্তমানে আমার মানসিক শান্তির জন্য কাজটা করতেই হচ্ছে আমাকে। তাই আগেই সরি বলে নিচ্ছি।”

উর্বী ঝাপসা চোখে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”কি!”

উর্বী শব্দটা বলে শেষ করার আগেই রাওনাফ সজোরে তার ডান গালে একটা চ’ড় বসিয়ে দেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব উর্বী নিজের ডানগালে হাত চেপে ধরে মাথা ঘুরিয়ে অবাক চোখে রাওনাফের দিকে তাকাতেই রাওনাফ তার বাম গালে আরেকটা চ’ড় মারে, সজোরে।
উর্বী দুইগালে হাত চেপে রাওনাফের চোখের দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার গাল দুটো ব্যাথায় টনটন করছে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। রাওনাফ ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে,”হাত নামাও গাল থেকে। কিছুই হয়নি তোমার। এতো বড় একটা ব্লান্ডার করেও এখানে নির্লজ্জের মতো বসে আছো জীবিত,সুস্থ শরীরে, তার এই দু’টো থাপ্পড়ে কিছুই হয়নি। হাত নামাও।”

কিছুসময় রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থেকে উর্বী মাথা নিচু করে ফেলে। রাওনাফ চেঁ’চি’য়ে ওঠে,
_ভুল? এটা তোমার কাছে ভুল ছিলো? নি’র্দয় মহিলা!

উর্বী গাল থেকে হাত সরায় না, না রাওনাফের দিকে তাকায়। চোখ বেয়ে আপনা আপনি পানি ঝরছে তার। রাওনাফ এগিয়ে গিয়ে উর্বীর থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে তুলে ক্ষ্যাপা কন্ঠে চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”স্টপ। আই সেইড স্টপ! এসব ফালতু আবেগ আমার সামনে ঝরিয়ে আর পার পাবে না তুমি! আই সেইড স্টপ।”

উর্বী পুনরায় ফুঁপিয়ে ওঠে, আটকে আটকে বলে,”ভুল করেছি!’

রাওনাফ সে কথায় পাত্তা না দিয়ে বলতে থাকে,”তুমি স্ত্রী হিসেবে কতটা অযোগ্য তা তো প্রমাণ করেই দিয়েছো। আর আজ প্রমাণ করে দিয়েছো মা হবারও তোমার কোনো যোগ্যতা নেই। তুমি একজন অযোগ্য মানুষ। একটা অপাত্র তুমি। কত বড় সাহস! কত বড় ধৃষ্টতা! তোমার মধ্যে যে আছে সে তোমার একার নয়, আমারও অংশ। কতবড় ধৃষ্টতা তুমি দেখিয়েছো হার্টলেস কোথাকার।”

চেঁচাতে থাকে রাওনাফ।

উর্বী নিজের পেটে হাত রাখে। রাওনাফ উর্বীর হাতটা তার পেট থেকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে চেঁ’চি’য়ে বলে,”খবরদার বলেছি তো। ওর কথা আর মাথায়ই আনতে হবে না তোমার। তোমার এই ফেক কনসার্ন তুমি ভুলেও আর দেখাবে না। না আমার প্রতি,না আমার বাচ্চার প্রতি। দেখাবে না তোমার এই ফেক কনসার্ন ।”

ঘনঘন নিশ্বাস নিয়ে রাওনাফ বলতে থাকে,”কি শত্রুতা তোমার আমার সাথে? আজ আমাকে একেবারে সন্তান হারাই করে দিতে চাইলে! বলো কি শত্রুতা!”

উর্বী নিস্তেজ কন্ঠে বলতে থাকে,”আমার কি হয়ে গিয়েছিলো আমি জানিনা শর্মীর পাপা….”

_কি হয়ে গিয়েছিলো জানোনা? কচি খুকি তুমি! অথচ ঠান্ডা মাথায় বিশ লাইনের একটা চিঠি লিখে ফেললে!

উর্বী হাপাচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,”শুধু মনে হচ্ছিলো ঐযে দরজার বাইরে পা রেখে চলে গেলেন। ঐ চলে যাওয়াটাই একেবারের জন্য দূরে যাওয়া, আমার থেকে, আমার বাচ্চার থেকে।”

রাওনাফ বেডের একপাশে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে পরে,উর্বীর সে কথার উত্তর না দিয়ে বলতে থাকে,”একটা উপকার করবে দয়া করে।”

_কি।
উর্বী অস্ফুট স্বরে বলে। রাওনাফ নিস্তেজ হয়ে বলতে থাকে,”এই বাচ্চাটিকে আমাকে দাও। সে অবধি কষ্ট করে থাকো। তারপর তোমার এই সব “মনে হওয়া” আবেগ অনুভূতি নিয়ে জা’হা’ন্নামে যাও। শুধু দয়া করে আমার বাচ্চাটাকে মেরো না। আমার এটা মনে হয়,আমার ওটা মনে হয়, এসব মনে হওয়া তুমি তোমার কাছেই রেখো!”

উর্বী চুপ করে থাকে। রাওনাফ একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,”কি ভীষণ খুশি হয়েছিলাম যেদিন হসপিটালে রেডিওলজি বিভাগের প্রধানের থেকে জানলাম আমি বাবা হতে যাচ্ছি আবারও। আমি চাইতাম আমার আর তোমার ভালোবাসায় কেউ জন্মাক। যার কাছ থেকে তুমি মা ডাক শুনতে পারো। একটু সময় নিতে চাচ্ছিলাম যাতে তুমি শারীরিক ভাবে একটু ফিট হও। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছে ছিলো তাই আগেই দিয়েছেন। আল্লাহর এই উপহার আমি অতি সানন্দে গ্রহণ করেছিলাম উর্বী। আর তোমার কাছে সে এতটাই তুচ্ছ হয়ে গেলো!
আরে আমি কাকে কি বলছি! একজন পাষন্ডী নাটকবাজ মহিলাকে,যার কাছে দুনিয়ার লোকজন তাকে কি দিলো, কি বেশি দিলো কি কম দিলো ,সে কার কাছ থেকে কি পেলো শুধু সেটাই ম্যাটার করে আর সে অন্যকে কি দিলো না দিলো তা নিয়ে কখনো ভাবেই না।”

কথাগুলো বলতে বলতে রাওনাফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে, রাওনাফ এবার সরাসরি উর্বীর চোখে চোখ রেখে নরম গলায় বলে,”দয়া করে বাচ্চাটা জন্মানো পর্যন্ত অপেক্ষা করো কষ্ট করে। তারপর আমি সম্মানের সাথে তোমার সব বর্বরতাকে মেনে নেবো।

তারপর ভুলে যাবো আরেকটিবার আমার জীবনে কেউ এসেছিলো।”

উর্বী রাওনাফকে জরিয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ওঠে। তার চোখের পানিতে রাওনাফের শার্ট ভিজে যাচ্ছে। রাওনাফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলতে থাকে,”কতটা নিঃস্ব লাগছিলো নিজেকে। আমি তো এই মেয়েটিকে আকরে ধরিনি উর্বী। আমি আকরে ধরেছিলাম কোমল হৃদয়ের একজন নারীকে। এই মেয়েটিকে নয়, যার আমার প্রতি কোনো ভালোবাসা নেই। আমাদের বাচ্চার প্রতি কোনো ভালোবাসা নেই। যে শুধু নিজের ভালো থাকাটাকে প্রাধান্য দেয়।”

একটু থেমে রাওনাফ আবারও বলে,”একজন স্ত্রীর ভুল হোক বা অন্যায় হোক, একজন স্বামী অভিযোগ তুলবে না? স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে এটাও একটা অধিকার! তুমি জানো? তুমি তো আমাকে সেই অধিকারও দিলে না। ভাবতাম তুমি আমাকে সম্মান করোনি,কিন্তু না ভুল আমি। তুমি আমাকে স্বামী বলেই স্বীকার করোনি।”

উর্বী কেঁদে যাচ্ছে। রাওনাফ বলে,”প্রথমে শিমালা এসে চলে গেলো! তারপর তুমি এই স্টেপ নিলে। তোমরা জীবনে আসো কেন বলো তো!”

কথাটা বলতে গিয়ে রাওনাফের গলা কেঁপে ওঠে। উর্বী মাথাটা ঠেকিয়েই রাখে দুহাতে খামচে ধরে মোচরাতে থাকে রাওনাফের শার্ট। রাওনাফ বলতে থাকে,”শর্মী, শুধু বলে যাচ্ছে আন্টি কোথায়। আন্টি কেনো আসছে না। আন্টি ঠিক আছে তো! তুমি একটিবার ওর কথাও ভাবলে না, তোমাকে স্বার্থপর বললেও তো কম বলা হয় উর্বী।”

উর্বী কাঁপছে। রাওনাফ বলতে থাকে,”আমি বলেছি আমার প্রতিটা সন্তানের সুস্থতা চাই আমি। আর তুমি! কত বড় দুঃসাহস দেখিয়েছো একজন বাবার থেকে তার সন্তানকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তুমি বি’কৃত মস্তিষ্কের মহিলা। যে একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ডিজার্ভই করে না। তোমার উপযুক্ত স্থান পাগলা গারদ।”

উর্বী নিশ্চুপ। রাওনাফ বলে,”ভুল হয়ে গিয়েছে। সত্যিই ভুল হয়ে গিয়েছে। অন্ধের শহরে আয়না বিক্রি করেছি আমি এতদিন। ভুল করেছি। আর তার মাশুল গুনছি আমি।”

একটু থেমে আবারও বলে,”এতটাই ব্যার্থ আমি উর্বী?”

উর্বী রাওনাফের চোখে চোখ রাখে, রাওনাফ কন্ঠে পুনরায় কাঠিন্যতা এনে বলতে থাকে,”কি ভেবেছিলে! আমার সাথে একটার পর একটা অন্যায় করে ভিক্টিম কার্ড প্লে করে পার পেয়ে যাবে? এই ইনোসেন্ট চেহারা,এই চোখের পানি এগুলো দিয়ে কাজ হবেনা উর্বী। আমার তোমার সাথে বোঝাপড়া আছে। তার আগে কোথাও পালাতে পারবে না তুমি। অনেক হয়েছে তোমার ভালো থাকা না থাকার হিসাব। এখন তুমি আমাকে হিসেব দাও। তুমি জীবনে যতটুকু ভালো থাকোনি,তুমি অন্যকে কি রেখেছো? হিসেব দাও আমাকে।”

উর্বী চোখের পানি মোছে। রাওনাফ উর্বীর থুতনি উপরে তুলে বলতে থাকে,”কি চাই তোমার? একটা জীবনে ভালো থাকতে, মানসিক ভাবে সুস্থ থাকতে আর কি চাই? জানি বলতে পারবে না। কারন তুমি পাগল,ব্রেইনলেস মহিলা। তোমার ইনটেনশনই হচ্ছে তুমি তোমার দুঃখের সাগরে সাঁতার কাটতে থাকবে। কেউ তোমাকে উদ্ধার করতে গেলে তাকে বলবে,”আরেকটু থাকি!”

তুমি কি চাও তুমি নিজেও জানো না। তবে আমি জানি আমি কি চাই। আমি আমার সন্তান চাই উর্বী। আমি হাতজোড় করছি তোমার কাছে! আমার প্রতি এতোটা নির্দয় হয়ো না।‌
ওটাই প্রথম,ওটাই শেষ। আর কখনো কোনো অধিকারের ভিত্তিতে তোমার প্রতি অভিযোগ তুলবো না,কথা শোনাবো না, নিজের অনুভূতি জানাবো না, খারাপ লাগা ভালো লাগা শেয়ার করবো না এবং আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে একজন স্বার্থপর স্ত্রীকে তার নিজের মতো করে ছেড়ে দেওয়ার। শুধু বিনিময়ে আমি আমার সন্তানের সুস্থতা চাচ্ছি। একজন বাবা তোমাকে রিকোয়েস্ট করছে,আমার বাচ্চার ক্ষতি করার চেষ্টাও করবে না তুমি।”

চলমান….

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৩৬
#Esrat_Ety

দু’জনে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুসময়ের জন্য পুরো কামরা নিস্তব্ধ হয়ে আছে। ভেজা গাল দুটো অস্বস্তি দিচ্ছে উর্বীকে।উর্বী হাতের পিঠ দিয়ে গাল মুছে নেয়।

বাইরে থেকে দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হয়। রাওনাফ মাথা ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকায়। দরজার বাইরে একজন জুনিয়র নার্স দাড়িয়ে,বলে ওঠে,”স্যার ম্যাম….”

“ম্যাম একেবারেই ঠিক আছে আফসানা। তুমি যাও।”

আফসানা রাওনাফের কথায় চলে যায়। কেবিনের বাইরে ইমার্জেন্সি ডেস্কে বসা দুজন নার্স মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। একজন চাপা স্বরে অপরজনকে বলছে,”দরজা বন্ধ করে কি করছেন স্যার!”

আরেকজন নার্স গলা খাঁকারি দিয়ে নিচু গলায় বলে,”হয়তো স্যার তার ওয়াইফকে জীবনমুখী শিক্ষা দিচ্ছে।”

রাওনাফ ঘা’ড় ঘুরিয়ে উর্বীর দিকে তাকায়। তারপর ঠান্ডা গলায় বলতে থাকে,”আমাকে দেখে একটুও অবাক হয়ো না তুমি। এখন আমি হা’র্ট সা’র্জন রাওনাফ করীম খান নই। আমি মৃদুলা উর্বীর স্বামী রাওনাফ করীম খান। এই বন্ধ কামরার ভেতরে আজ কোনো অ’ভিজ্ঞ ডাক্তার কিংবা পে’শেন্ট নয় বরং দুজন স্বামী স্ত্রী আছে উর্বী। কোনো ডাক্তার তোমার সাথে কথা বলছে না,তোমাকে দেখছে না, একজন ডাক্তারের চোখে তুমি সহানুভূতি ডিজার্ভ করো এই অবস্থায়, কিন্তু একজন স্বামী নিজের বিধ্বস্ত অনূভুতি পাশে সরিয়ে রেখে তোমাকে দেখবে না। এতোটা মহান ভেবো না আমাকে। বোঝাপড়া দুজন স্বামী স্ত্রীর হচ্ছে, অনুভূতির দ্বন্দ দুজন স্বামী স্ত্রীর হচ্ছে।”

উর্বী চুপ করে আছে। রাওনাফ বলতে থাকে,”চলো হিসেব শুরু করি। তুমি গত সাত বছরে অনেক কিছু সহ্য করেছো উর্বী। আমি জানি! যেগুলোর সিকিভাগও আমি সহ্য করিনি জীবনে। গত কয়েকদিনে তোমার ওপর দিয়ে কি বয়ে গিয়েছে আমি সব জানি উর্বী। কোনো কিছুই আমার অবগতি, উপলব্ধির বাইরে নয়।

কিন্তু তুমি জানো না উর্বী,এতো কিছু সহ্য করার পরেও যে মেয়েটা কখনো সুই’সা’ইডের কথা মাথায় আনেনি সে মেয়েটা শুধুমাত্র কিছু ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করে,কিছু ভুল ধারণাকে আকরে ধরে নিজের জীবনটা খোয়াতে বসেছিলো। শুধু নিজের জীবন নয়,সাথে আরো একটা প্রাণ।

উর্বী তোমার ধারণা গুলো যদি সত্যি হতো তাহলে আমি বিন্দুমাত্র আফসোস করতাম না,কিন্তু তোমার ধারণা সব ভুল উর্বী। ওটা বিতৃষ্ণা ছিলো না মৃদুলা উর্বী, ওটা একজন স্বামীর অধিকারবোধ ছিলো স্ত্রীর প্রতি। অধিকারবোধ কখনো বিতৃষ্ণা হতে পারে না। আমি তো প্রশ্ন তুলেছিলাম কেনো আমাকে ভরসা করতে পারলে না। সেটা কিভাবে তুমি বিতৃষ্ণা ধরে নিলে? উর্বী আমি একটা রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। আমি যদি তোমার মনের মতো প্রতিক্রিয়াই দিই তবে আমার স্বকীয়তা কোথায়? একজন মানুষ কখনও আরেকজন মানুষের মনের মতো সাডেন রিয়াক্ট চাইলেও করতে পারে না,তবে অপর মানুষটা চাইলেই বোঝার চেষ্টা করতে পারে। যেটা তুমি করোনি।

কি? এখন নিশ্চয়ই এটা বলবে যে আমি কেবল আমার বাচ্চার কথাই ভেবেছি, বাচ্চার কথা ভেবে তোমার জন্য কষ্ট পেয়েছি । কারন আমি শুধু বাচ্চার প্রতিই কনসার্ন দেখাচ্ছি। তোমার এই পরিস্থিতিতেও আমি শুধু বাচ্চা বাচ্চা করছি। বাচ্চাটা না থাকলে এতটা কনসার্ন দেখাতাম না। এটাই বলবে তো তাইনা? বলো ,বলো, ট্রাস্ট মি উর্বী! আমি একটুও অবাক হবো না তুমি এখন এমন বললে। কারন তোমার চরিত্র অনুযায়ীই তো তুমি বলবে।”

উর্বী চুপ করে থাকে। রাওনাফ বলতে থাকে,”হ্যা,এটা যদি তুমি বলো তাহলে ঠিকই বলবে,কারন সত্যিই আমার কনসার্ন শুধু আমার বাচ্চার জন্যই। আমি কোনো মৃদুলা উর্বীকে নিয়ে ভাবিই না। আমি খুব খারাপ একজন স্বামী,যাকে ভরসা করা যায়না।”

উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়, নীরবতা ভেঙে বলে ওঠে,”আমি এমন কিছু ভাবিই নি। আমি তো বললাম, চিঠিতে লিখলাম, আমি বেঁচে থাকলে এমন ভুল হতেই থাকবে, আর আমার জীবনের ফুলগুলো কষ্ট পাবে তাই….”

_আর মরে গেলে? মরে গেলে ফুলগুলো আর কষ্ট পাবে না? অতঃপর তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল। এমন হবে? তাইতো?

উর্বী রাওনাফের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে কিছু বলতে যাবে তখনই রাওনাফ উর্বীকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“শর্মী….উর্বী শর্মীর কষ্ট তোমার জন্য, তোমার ভুলের জন্য হয়েছে কি হয়নি সেই যুক্তিতর্কে যেতে চাচ্ছি না। আমি শুধু জানি শর্মীর এই অবস্থার জন্য মৃদুলা উর্বী কিছুটা হলেও দায়ী থাকলেও একজন মা কখনও দায়ী নয়। উর্বী আমি তো অনেকদিন আগে থেকেই এমন ভেবে ফেলেছি। তুমি ভাবতে বাধ্য করেছো। সেখানে আমি একজন মা উর্বীকে কিভাবে দোষারোপ করবো? এতোটা ধৃষ্টতা আমার নেই! আমি তো অভিযোগ করেছি আমার স্ত্রী উর্বীকে! সেটুকু কি আমার অধিকারের মধ্যে পরেনা উর্বী?”

উর্বীর দু’চোখ বেয়ে দুফোঁটা তরল গড়িয়ে পরে। মাথা নাড়িয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,”পরে।”

_অভিযোগের ধরনটা ভুল ছিলো,নাকি তোমার বোঝাটা ভুল সেগুলো নিয়েও যুক্তিতর্কে যাবো না। কিন্তু উর্বী,তুমি গোটা ব্যাপারটা যাস্ট “আমি আবারও ভুল করেছি শর্মীর পাপা!” বলে শেষ করে দিলে!

তোমার একটা ভুলে,আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো উর্বী। পুরোটা সময় ছ’ট’ফ’ট করেছি,বলেছি উর্বী শুধু আমাকে ভুল বুঝে যেও না। তোমার কাছে আমার অসহায় অনুভূতির সমর্পণকে তুমি আমার বিতৃষ্ণার বহিঃপ্রকাশ ভেবে চলে যেও না। আমি কখনো অভিযোগ তুলবো না,যত ইচ্ছে বোকামি করো!”

উর্বী পুনরায় ফুঁপিয়ে ওঠে। মাথাটা রাওনাফের গায়ে ঠেকিয়ে বলতে থাকে,”ক্ষমা চাচ্ছি।”

রাওনাফ একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে নিজের হাতের দিকে তাকায়। তারপর বলে,”একটা সময় মনে হয়েছে তুমি নেই! চলে গিয়েছো। সব শেষ,আমি হারিয়ে ফেলেছি তোমাকে!”

রাওনাফের সে কথায় উর্বী টের পায়,কি প্রগাঢ় ভালোবাসা উর্বী হারাতে বসেছিলো অভিমানের বসে। পোড়াকপালি। কপাল তো আজীবনেরই পোড়া। সে নিজেই কি না বাকি টা শেষ করে দিচ্ছিলো। তার সাথে যে তার মধ্যে বেড়ে উঠছিলো,তাকেও কি না! আবারো সেই একই মহাপাপ। সে কত জঘ’ন্য!

উর্বী হাউমাউ করে কেঁদে বলতে থাকে,”পাপ করেছি আমি। মহাপাপ।”

রাওনাফ উর্বীর গাল দুটো ধরে,নরম গলায় বলে,”কাঁদতে হবে না। এবার একটু থামো! এটা ছাড়া কি আর কিছুই পারো না তুমি? থামো এবার। থামো! ”

রাওনাফ পুনরায় নিজের হাতের দিকে তাকায়। তারপর অসহায়ের মতো উর্বীর দিকে তাকায়। তারপর বলে,”আমি কঠোর হয়ে থাকতে পারিনা উর্বী। চাইলেও পারিনা। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি,আর কখনো কোনো ধরণের অধিকারবোধ দেখাবো না,যা তোমাকে অস্বস্তি দেয়। ”

উর্বী বেডের চাদর খামচে ধরে। কন্ঠে আকুতি নিয়ে বলে,
_কেনো দেখাবেন না! একশো বার দেখাবেন! হাজার বার দেখাবেন! আমি ক্ষমা চাইছি তো!

রাওনাফ তাকিয়ে থাকে। উর্বী বলতে থাকে,”ক্ষমা করে দিন আমাকে! ক্ষমা করে দিন না। আমি প্রমিজ করছি, আজকের পর থেকে আমি আর কোনো ভুল করবো না যা আপনাকে কষ্ট দেয়! আমার জীবনের ওপর আপনার,আপনাদের পূর্ণ অধিকার আছে! আপনারাও এই জীবনের দাবিদার। প্রমিজ করছি আপনাদের অনুমতি ব্যাতীত এই জীবনকে আর কষ্ট দেবো না আমি।”

রাওনাফ চোখ সরিয়ে নেয়। অবিশ্বাস আর অভিমানে। উর্বী তা বুঝতে পারে। দু হাতে রাওনাফের গাল আগলে ধরে মুখটাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। তারপর কাতর কন্ঠে বলে,”শর্মীর পাপা!”

রাওনাফ হাত মুঠো করে ফেলে। ভেতরটা অনুভূতি তোলপাড় করলেও বাইরে কাঠিন্যতা বজায় রেখে চুপ করে থাকে। উর্বী পুড়ছে। অ’প’রা’ধ বোধ হচ্ছে তার ভীষণ। নরম গলায় বলে,”একজন সুই’সা’ইডের পেশেন্টকে চ’ড় মারা,এখন তার থেকেই মুখ ঘুরিয়ে থাকা। অযোগ্য ডাক্তার ,আপনিও যে খুব হৃদয়হীন। আমার মতো হৃদয়হীনার সাথে পাল্লা দিতে চাচ্ছেন নাকি!”

রাওনাফ নিজের গাল থেকে উর্বীর হাত সরিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”সাত বছর। সাতবছর তুমি মানুষের গঞ্জনা শুনে কাটিয়েছো উর্বী। আর গত চব্বিশটা ঘন্টা আমি নিজে নিজেকে গঞ্জনা দিয়েছি। ঐ সাত বছর আর এই চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই উর্বী!”

উর্বী ঢোক গিলে নেয়। রাওনাফ ধীরে ধীরে নিজের হাতটা উর্বীর গালে রাখে। কাঁপা গলায় বলে,”তুমি মুখে বললেও তুমি এখনও এটাই মানো তুমি তোমার জীবনের একক দাবিদার। সেখানে অন্যকারো কোনো অংশ নেই!”

_না মানি না,যখন আপনি আমাকে চ’ড় মেরেছেন। ঠিক সেই মুহূর্তে আমি আপনার প্রতি করা আমার অবিচারের পরিমাণ উপলদ্ধি করেছি। আমি একটুও নারাজ হইনি ঐ সময়টায়। বরং আমি আমার স্বামীকে অনুভব করতে পেরেছি।

রাওনাফ উর্বীকে কাছে টানে । দু’হাতে আঁকড়ে ধরে দুই গালে অগণিত চু’মু দিতে থাকে। পরম স্পর্শে শিক্ত হয়েও উর্বী স্বস্তি পাচ্ছেনা। মানুষটা তাকে ক্ষমা করতে পেরেছে তো! দু’চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলতে থাকে,”নিজেকে আরেকটি বার শুধরে নিতে আপনার সাহায্য দরকার। কথা দিচ্ছি, নতুন উর্বীকে পাবেন।”

রাওনাফ চু’মু দিয়ে ভরিয়ে দেয় উর্বীর দুই গাল। তারপর উর্বীর দুই গাল হাত দিয়ে আগলে ধরে উর্বীর চোখে চোখ রাখে,বলে,”বাড়িয়ে ছিলাম হাত সাহায্যের জন্য। তুমিই নিলে না। এখন একা একাই করতে হবে তোমাকে।”

উর্বী আহত হয়, রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”তবে কেন বলেছিলেন “আমি আছি,আমি থাকবো!”

রাওনাফ বলে,”সেটা এখনও বলছি। বরাবর বলবো,”আমি আছি, আমি থাকবো।” কিন্তু পুরনো উর্বীকে ভাঙতে হবে তোমায় নিজের,গড়তে হবে নিজের।”

উর্বী নিজের অসহায় অনুভূতি ঢাকতে শুকনো হাসি হাসে। মানুষটার এহেন আচরণ অস্বাভাবিক কিছু নয়। উর্বী বুঝতে পারছে উর্বীকে একটা লম্বা জার্নি শেষ করতে হবে উর্বীর জীবনে মানুষটার গুরুত্ব কতখানি এটা মানুষটাকে বোঝাতে। তার জীবনে মানুষটার দাবি আছে,অংশের মালিকানা আছে এটা মানুষটাকে বোঝাতে তাকে কাঠখড় পোড়াতে হবে।

উর্বী চোখ মোছে। রাওনাফ গাল থেকে হাত সরিয়ে নেয়,উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”এ কদিনে বেশ বুড়ো হয়ে গেছেন আপনি শর্মীর পাপা।”

রাওনাফ ম্লান হাসে। বলে,”তোমাকেও কোনো তেইশের তরুণী লাগছে না মৃদুলা উর্বী।”

উর্বী হাসে। একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে নেয়। বাইরে থেকে আবারও দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হয়। রাওনাফ বলে,”আফসানা তোমাদের ম্যাম ঠিক আছে।”

_স্যার, আপনার মা এসেছে।

রাওনাফ উঠে দাঁড়ায়। উর্বী তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাওনাফ বলতে থাকে,”সবাইকে তোমার নিজের ফেস করতে হবে। আমার কিছু করার নেই। আমি চাই তুমি অ’প’রা’ধ বোধে ভোগো।”

রাওনাফ উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয় কেবিনের। রওশান আরা কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। তার সাথে মোহনা এবং অন্তরা। রাওনাফ তাদের কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

****
রওশান আরা উর্বীর মুখোমুখি বসে আছে। উর্বী মাথা নিচু করে বসে আছে। তার এই মুহূর্তে তার শাশুড়ির দিকে তাকানোর সাহস নেই।

অন্তরা আর মোহনা তাদের শাশুড়ি ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।

রওশান আরা উর্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে অন্তরাকে ডাকে,”ছোটো বৌমা।”
অন্তরা দ্রুত উত্তর দেয়,”জ্বী মা।”

“তুমি আজ কালের মধ্যেই সামিউলের ওখানে চলে যাবে। ছেলেটা একা পরে আছে। এখানটা বড় বৌমা দেখবে। সে তো সুস্থ হয়ে গিয়েছে। মেজো বৌমা তুমিও চট্টগ্রাম চলে যাবে। তোমার বড় জা পুরোপুরি সুস্থ।”

অন্তরা তার শাশুড়ির মুখের দিকে তাকায়,”মা ভাবীর এই সময়ে আমি….?”
_এই সময়ে মানে? পোয়াতি হয়েছে। তাতে কি হয়েছে? আমরা বাচ্চা পেটে নিয়ে সংসার দেখিনি? এখনকার যুগের বৌরা আরাম পেয়ে পেয়ে উচ্ছন্নে যাচ্ছো। বেশি আরামে থাকলে অলস মষ্তিস্কে শয়তান বাসা বাধে। তোমার বড় জা এর ক্ষেত্রে ঠিক সেটাই হয়েছে। তুমি কালই রাজশাহী যাবে। মেজো বৌ চট্টগ্রাম।‌এদিকটা বড় বৌমা দেখবে।

উর্বী তার শাশুড়ির দিকে তাকায়, নরম গলায় বলে,”মা….”

রওশান আরা তার উত্তর না দিয়ে রাওনাফকে ডাকে।

“এই রাওনাফ,বাড়ি নিবি কখন বৌমাকে। তোর হসপিটালে তো রোগীর চেয়ে তোর ফ্যামিলির লোকজনই আস্তানা গেরে বসে থাকে বারো মাস। এই রাওনাফ,বৌমা কি খাবে ? আমার নাতির তো খাওয়ার সময় হয়েছে নাকি!”

উর্বী আবারও ডাকে,”মা।”

রওশান আরা শুনেও না শোনার ভান করে চুপ করে থাকে। উর্বীর ডাকে সাড়া দেয় না। উর্বী আকুল হয়ে ডাকতে থাকে,”মা। আপনি অন্তত এমন করতে পারেন না।”

_আর তুমি করতে পারো বৌমা?

উর্বীর দিকে সরাসরি তাকিয়ে রওশান আরা বলে। উর্বী শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে, রওশান আরা বলতে থাকে,”তোমার জন্য আমার কষ্ট হয়েছে ভেবো না। আমার শুধু আমার নাতী-নাতনির জন্য কষ্ট হয়েছে। আমার নিজের জন্য কষ্ট হয়েছে। একদিন তোমাকে এ বাড়িতে এনে আমি যাদের কষ্ট দিয়েছি, তারা আজ আবারও কষ্ট পাচ্ছে তুমি চলে যাচ্ছিলে বলে। আমি সেই নাতনিদের জন্য কষ্ট পাচ্ছি।”

এ পর্যন্ত বলে রওশান আরা থামে। তারপর দরজার দিকে তাকিয়ে বলে,”দাদু ভেতরে এসো।”

উর্বী দরজার দিকে তাকায়। দরজার পর্দাটা ধীরে ধীরে সরিয়ে মাথা নিচু করে ভেতরে ঢোকে শায়মী। ধীরপায়ে হেঁটে এসে সে বেডের সামনে দাঁড়ায়। রওশান আরা উঠে দাঁড়ায়, মোহনা আর অন্তরা শাশুড়িকে ধরে ধরে নিয়ে যায়।

শায়মী মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে আছে। সে চোখ তুলে তাকায় না উর্বীর দিকে। উর্বী নরম গলায় বলে,”শায়মী তাকাও।”

শায়মী তবুও দাঁড়িয়ে থাকে মাথা নিচু করে। উর্বী আবারও বলে,”তাকাও শায়মী।”

শায়মী এবার ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকায়। তার দু’চোখ ভর্তি পানি। উর্বী একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শায়মী চোখ বন্ধ করে ফেলে। পানি গড়িয়ে পরে বন্ধ চোখের কার্নিশ বেয়ে। উর্বী কিছু বলেনা, তার ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।
কিছুসময় দু’জনেই চুপচাপ, উর্বী বলে,”শাস্তি দেবে পাপা আর দাদুর মতো? মুখ ঘুরিয়ে রেখে আমার থেকে?”

শায়মী ছুটে গিয়ে উর্বীকে জরিয়ে ধরে। ক্লান্ত শরীরে উর্বী শক্তি ফিরে পায়। ডানহাতে আগলে ধরে অভিমানী সপ্তদশীকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। শায়মী কাঁদছে, শব্দহীন কান্না। একটু পরপর কেঁপে কেঁপে উঠছে সে।

****
শেফালী নিজের ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ওয়ার্ড বয় এসে উচ্ছাসকে একটা শার্ট পরিয়ে দিয়ে যায়। উচ্ছাস বেডে হেলান দিয়ে বসে আছে।
শাখাওয়াত চৌধুরী জানালার কাছ থেকে সরে আসে। শেফালী হাতের খাবারটা ছেলের মুখের সামনে তুলে ধরে,বলে,”তোর মনে আছে আমার হাতের হালুয়া খাওয়ার জন্য তুই সবসময় কেমন পাগলামি করতিস!”

উচ্ছাস ম্লান হেসে খাবারটা মুখে নিয়ে খায়। শাখাওয়াত চৌধুরী একটা চেয়ার টেনে উচ্ছাসের সামনে বসে। উচ্ছাস বাবার দিকে তাকায়। শাখাওয়াত চৌধুরী বলতে থাকে,”সামনের সপ্তাহে রায় ঘোষণা হবে।”

উচ্ছাস অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে বলে,”ভালো কথা।”

শেফালী আগের মতো হুহু করে কেঁ’দে ওঠে না,খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিজের নিয়তিকে মেনে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়, শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের আদরের ছেলের মুখ মুছিয়ে দিতে থাকে।

শাখাওয়াত চৌধুরী ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”কেনো করলে!”

উচ্ছাস বাবার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে, মুহূর্তেই বুকের ডান পাশে যন্ত্রনা অনুভব করে। হাত দিয়ে ব্যান্ডেজ চেপে ধরে যন্ত্রনাটুকু হজম করে। খানিক বাদে নিজেকে ধাতস্থ করে বলে ওঠে,”কখনও ভালো ছেলেও হতে পারিনি, না হতে পেরেছি ভালো প্রেমিক। ভাবলাম সেরা খারাপ মানুষ হই।”

উচ্ছাস হাসতে হাসতে হেলান দিয়ে দু’চোখ বন্ধ করে ফেলে। শাখাওয়াত চৌধুরী অসহায়ের মতো ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। শেফালী ছুটে কেবিন থেকে বেরিয়ে শাড়ির আঁচল মুখে চে’পে ধরে কাঁদছে।
কেবিনের বাইরে পাহারা দিতে থাকা কনস্টেবল দু’জন তাকে দেখছে তাকিয়ে তাকিয়ে।

***
“ম্যাম আপনি এখানে!”
নার্সের ডাকে উর্বী পিছু ফিরে তাকায়। নার্স মেয়েটা উর্বীর কাছে এগিয়ে এসে বলে,”ম্যাম কোথায় যাচ্ছেন আপনি!”

উর্বী আশেপাশে তাকিয়ে বলে,”তিনতলায়। শর্মীর কাছে।”

_ক্ষেপেছেন ম্যাম? স্যার জানতে পারলে আমি বকা খাবো। আপনি কেবিনে চলুন।

_কিচ্ছু হবে না। তোমার স্যারের সব বকা আমি খেয়ে নেবো। আমি একটু যাই শর্মীর কাছে।

নার্স উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। উর্বীর কন্ঠে অনুরোধের সুর।

“এখন কেন যেতে চাইছো!”

রাওনাফের কন্ঠস্বর শুনে চমকে ওঠে দু’জনেই। রাওনাফ দাড়িয়ে আছে তাদের পেছনেই। উর্বী মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। রাওনাফ নার্সের দিকে একপলক তাকায়। নার্স চলে যায়। মাথা ঘুরিয়ে উর্বীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে রাওনাফ। তারপর বলে,”এখন কেনো শর্মীকে দেখতে যেতে চাইছো!”

উর্বীর অভিমান হয়। টানা একটা দিন কঠিন কঠিন কথা শুনিয়েও মন ভরেনি। এখন রাতদুপুরে এসেছে কথা শোনাতে। উর্বীর ইচ্ছে করলো দুটো কথা শুনিয়ে দিতে, ইচ্ছে করলো বলতে, হার্ট সার্জন আপনার নিজের হার্ট কই? কিন্তু সে বললো না,নিজেকে শুধরে নিয়ে নিজেকে নিজে বললো,”মেনে নে উর্বী। তুই দোষী। এই গোস্বা টুকু মেনে নে।”

চোখ সরিয়ে নিচু গলায় উত্তর দেয়,”মরলে তো সব চুকেই যেতো। যেহেতু মরিনি তাই আমি আমার মেয়ের কাছে যাচ্ছি।”

কথাটা বলেই উর্বী ধীরপায়ে হেঁটে চলে যায়। রাওনাফ দাড়িয়ে থাকে চুপচাপ।

চলমান…….

আরেকটি বার পর্ব-৩৪

0

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৩৪ ( ১ম অংশ)
#Esrat_Ety

[১ম অংশ]

ইন্স’পে’ক্টর দীপঙ্কর রাওনাফের নীরবতা দেখে উঠে দাঁড়ায়। জাহাঙ্গীরের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি আসছি। খোজ নেবো আবার।”

জাহাঙ্গীর মাথা নাড়ায়। দীপঙ্কর কনস্টেবল নিয়ে চলে যেতেই জাহাঙ্গীর তার স্ত্রী মিতা আর আশিকের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করে। তারা দুজন এসে নাবিল শায়মীকে টেনে মেঝে থেকে উঠিয়ে নেয়। মেঝে থেকে তাদের তুলে বেঞ্চিতে এনে বসিয়ে মিতা দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।

লামিয়া রাওনাফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে গিয়ে মেঝেতে রাওনাফের পাশে বসে পরে। রাওনাফ মাথা তুলে সরাসরি উর্বীর দিকে তাকায়। ধীরে ধীরে তার দৃষ্টি উর্বীর পেটের দিকে এসে থেমে যায়। উর্বী পেটে হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে তার দিকেই দৃষ্টি দিয়ে। রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে নীরবতা ভেঙে নিস্তেজ কন্ঠে লামিয়াকে বলে,”ওর একটা ইউএসজি করো। কেবিনে নিয়ে যাও।”

লামিয়া বলে,”করেছি। বেবি ঠিক আছে। কেবিনে থাকতে চাইছে না। থাকুক না এখানে। ফার্স্ট এইড করা হয়েছে। তুমি শান্ত হও। এতো দিকের চিন্তা তোমার করতে হবে না। আমরা আছি তো!”

রাওনাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেয়,কাতর কন্ঠে বলতে থাকে,”কোন পাপের শাস্তি পেলাম লামিয়া।”

_সব ঠিক হয়ে যাবে রাওনাফ। ভেঙে পরো না এভাবে,শায়মী নাবিল ভয় পাচ্ছে তোমাকে দেখে।

রাওনাফ চুপ করে থাকে। খানিকবাদে মাথা ঘুরিয়ে আবারও উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বীও একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

আড়াই ঘণ্টার সার্জারি শেষ করে ডক্টর নাজমুল হুদা ও.টি. থেকে বেরিয়ে আসে। তার পিছু পিছু ট্রলিতে করে শর্মীকে পোস্ট অপারেটিভ রুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য বের করে দুজন সিস্টার। তাদের পেছনে ডক্টর শুভাশীষ রায় এবং তারিন মাহমুদা বেরিয়ে আসে।

রাওনাফ উঠে ছুটে যায় সেদিকে, শুভাশীষ এসে রাওনাফের হাত ধরে আটকে দেয়। নরম গলায় বলে,”যেও না রাওনাফ। যাস্ট রিল্যাক্স। ইনজুরিটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে।”

নাবিল শায়মী গিয়ে তাদের পাপাকে পেছন থেকে ধরে। লামিয়া শুভাশীষ রায়ের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”আর কোনো চিন্তার….”

_এখনও নিশ্চিত করে আমরা কিছু বলছি না। তবে কোমায় যাওয়ার কোনো আশংকা নেই,স্টেবল হতে যতটুকু সময় লাগে আরকি!

উর্বী শুভাশীষ রায়ের মুখের দিকে ঘোলাটে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে।
তারিন মাহমুদা ওয়েটিং রুমের সবার দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনাদের বুঝতে হবে এটা হসপিটাল। প্লিজ। কান্নাকাটি বন্ধ করুন।”

রাওনাফ তাকিয়ে আছে পোস্ট অপারেটিভ রুমের দিকে। শর্মীকে একটা আলাদা কেবিনে রাখা হয়েছে, সম্পূর্ণ সাবধানতার সাথে। রাওনাফ ধীরপায়ে এগিয়ে যায় সেদিকে, জাহাঙ্গীর রাওনাফকে টেনে ধরে। রাওনাফ কাতর কন্ঠে বলে,”ছাড় আমাকে! দেখবো মেয়েটাকে। দূর থেকে।”

_সুস্থ হলে দেখবি। আয় এদিকে।
রাওনাফকে জোর করে টেনে এনে একটা বেঞ্চিতে বসিয়ে দেয় জাহাঙ্গীর। তারিন মাহমুদা উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”আপনিও যে আহত ‌। এখানে দাঁড়িয়ে কেনো! কেবিনে যান, বিশ্রাম করুন।”

উর্বী ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। জাহাঙ্গীর আজমেরী,রুমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”তোরা এভাবে ভে’ঙে পরলে ওদের কিভাবে সামলাবি? রাওনাফের এই অবস্থা। চাচী আম্মার অবস্থা ভালো নেই,উর্বী ঠিক নেই। নাবিল শায়মীকে নিয়ে বাড়িতে যা। হসপিটালে এতো লোক থাকার প্রয়োজন নেই। যা বলছি।”

_আমরা কোথাও যাবো না,আমরা পাপার সাথে এখানেই থাকবো। এখানেই।

নাবিল শায়মী চেঁ’চি’য়ে বলতে থাকে।
লামিয়া তাদের বোঝাতে থাকে। রাওনাফ চুপ করে আছে। এক পর্যায়ে লামিয়া অনেক বুঝিয়ে,জোর করে শায়মী নাবিলকে আজমেরী আর রুমার সাথে পাঠিয়ে দেয় বাড়িতে।

প্রায় সকাল হয়ে এসেছে তখন। উর্বীর জীবনের কাল রাত এখনও কাটেনি,তা উর্বী জানে। সে নির্লিপ্ত হয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার একটা হাত তার পেটে।
মানুষ আসছে, মানুষ চলে যাচ্ছে,সবাই কাঁদছে। কিন্তু কাঁদতে পারছে না উর্বী।

আগামী আটচল্লিশ ঘন্টা না পেরোলে কিছু বলা যাচ্ছে না। বিধ্বস্ত, শংকিত একটা মন নিয়ে বসে আছে একজন বাবা। অপেক্ষায় আছে ভাইবোন, অপেক্ষায় আছে ফুপি,খালারা, আত্মীয়স্বজন। অপেক্ষায় আছে আরো একজন, যার সাথে শর্মীর কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই।

সুমনা এগিয়ে যায় রাওনাফের কাছে। মনটাকে শক্ত করে রাওনাফকে ডাকে,”দুলাভাই!”

রাওনাফ মাথা তুলে তাকায় সুমনার দিকে। ধরা গলায় বলে,”তোমার আপার আমানত আমি অ’ক্ষত রাখতে পারিনি সুমনা। শিমালা মৃ’ত্যুর সময়েও মেয়েকে আঁকড়ে ধরে ছিলো যাতে মেয়েটা চো’ট না পায়। বুকের মধ্যে আগলে রেখেছিলো। আর দেখো আজ,মেয়েটার কি অবস্থা করেছি আমি। সামান্য হাত কে’টে গেলেও মেয়েটা ঘা’ব’ড়ে যেতো। আর আজ! আমার মামনী কষ্ট পাচ্ছে,বাবা হয়ে আমি সেই কষ্টের ভাগ নিতে পারছি না।”

উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনছে। তার চোখের দৃষ্টি এলোমেলো।

ঝুমুর এগিয়ে এসে রাওনাফের কাঁধে হাত রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলে,”কিচ্ছু হবে না দুলাভাই,আমাদের শর্মীর কিচ্ছু হবে না।”

****
উচ্ছাসের কেবিনের বাইরে পাহারা দিচ্ছে দুজন কনস্টেবল। শেফালী কাঁচ দিয়ে উকি দিয়ে দেখছে ছেলেকে। তার চোখের পানি শুকিয়ে গালের সাথে লেপ্টে আছে। শাখাওয়াত চৌধুরী দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে সে দৃশ্য। আজ এই পরিস্থিতির জন্য কাকে দায়ী করবে সে বুঝতে পারছে না। হসপিটালে আসা আগন্তুকেরা সবাই শাখাওয়াত চৌধুরীর দিকে সহানুভূতির দৃষ্টি দিয়ে তাকায়। যে দৃষ্টি শাখাওয়াত চৌধুরীকে আরো ক্ষত বিক্ষত করে।

শেফালী ঘুরে স্বামীর দিকে তাকায়। ধীরপায়ে এগিয়ে এসে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে ওঠে,”ও বেঁচে যাবে তো! শুধু প্রানে বেঁচে থাকুক। আর কখনও দেখতে চাইবো না ওকে। সারাজীবন জেলে থাকুক। কিন্তু শুধু প্রানে বেঁচে থাকুক।”

***
চুলগুলো এলোমেলো, গাঁয়ের পোশাক অগোছালো, সাদার ওপর ব্ল্যাক স্ট্রাইপের শার্টটা কুঁ’চ’কে আছে কলারের কাছটাতে, বিধ্বস্ত চেহারা, ক্লান্ত দুটো চোখ নিয়ে বসে আছে রাওনাফ। শর্মীকে আইসিইউতে শিফট করা হয়েছে। চব্বিশ ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও কোনো রেসপন্স করেনি এখন অবধি মেয়েটা। হসপিটালে রাওনাফ একাই থাকছে রাতে। কেউ পারেনি তাকে বুঝিয়ে নিয়ে যেতে। সামিউল, শাফিউল সবাই ঢাকায় এসে পৌঁছে গিয়েছে। তাদেরকেও থাকতে দেয়নি রাওনাফ। তার মেয়ের কাছে সে থাকবে। আর কেউ না।

রাত তখন দেড়টার কাছাকাছি। হসপিটাল নিস্তব্ধ হয়ে আছে পুরো। নিউরো বিভাগে পেশেন্ট কম থাকায় এই এরিয়াটা একটু বেশিই নিস্তব্ধ। রাওনাফ উঠে দাঁড়ায়, তিনতলার নামাজের স্থানে গিয়ে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করে নেয়, তারপর হেঁটে সোজা চলে যায় রওশান আরার কেবিনে। গিয়ে দেখতে পায় রওশান আরা ঘুমাচ্ছে। এখন অবধি জানতে পারেনি সে শর্মীর অ’পা’রেশনের ব্যাপারে। তাকে জানানো হয়নি। রাওনাফ কিছুক্ষণ মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কেবিন থেকে বের হয়। তারপর সোজা হেঁটে চারতলায় চলে যায়। উর্বীর কেবিন নাম্বার চারশো পাঁচ। ধীরে ধীরে কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখে উর্বী কেবিনে নেই। রাওনাফ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দ্রুতপায়ে তিনতলায় নেমে আসে। সোজা চলে যায় আইসিইউর সামনে। গিয়ে দেখে উর্বী দাড়িয়ে আছে দরজার কাচের ভেতরে দৃষ্টি দিয়ে। রাওনাফ সামনে এগিয়ে যায়। উর্বীর পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে,”কি করছো।”

উর্বী ঘুরে তাকায় রাওনাফের দিকে। রাওনাফ উর্বীর পা থেকে মাথা অবধি দেখে। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে,”অসুস্থ তুমি। কেবিনে যাও। বিশ্রাম করো।”

উর্বী আবারও আইসিইউর ভেতরে তাকিয়ে রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। উর্বী বলে ওঠে,”এখানে থাকি আমি! একা কেবিনে মনে হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে মেয়েটা আমাকে ডাকছে।”
উর্বীর কন্ঠে আকুতি। রাওনাফ উর্বীর পেটের দিকে একপলক তাকিয়ে তার মুখের দিকে তাকায়, তারপর বলে,”এমন শারীরিক অবস্থায় তুমি নেই। আমি আমার প্রতিটা সন্তানের সুস্থতা চাই।”

উর্বী রাওনাফের মুখের দিকে তাকায়। তারমানে লোকটা জানে উর্বী মা হতে চলেছে। উর্বী জানে না রাওনাফ কিভাবে জেনেছে,অথচ একদিন আগেও এই দিনটা নিয়ে কত জল্পনা কল্পনা করে রেখেছিলো উর্বী।
রাওনাফের দিকে তাকিয়ে উর্বী অনুরোধ করে বলে ওঠে,”একটু থাকি!”

দুজন নার্স এসে দাঁড়ায়। রাওনাফ উর্বীর কথার কোনো জবাব না দিয়ে নার্স দুজনের দিকে তাকায়। নার্স দুজন মাথা নেড়ে উর্বীকে এসে ধরে। উর্বীকে অনুরোধ করে বলে,”প্লিজ ম্যাম চলুন কেবিনে। আপনাকে একটা স্যালাইন দিতে হবে।”

উর্বী যাবে না। রাওনাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উর্বীর হাত ধরে। তারপর টানতে টানতে নিয়ে যায় কেবিনে। কোনো কথা না বলে উর্বীকে শুইয়ে দিয়ে নিজে স্যালাইন লাগিয়ে দিয়ে একজন নার্সকে বসিয়ে রেখে উর্বীর কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। উর্বী একদৃষ্টে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে।

তিনতলায় নেমে রাওনাফ আবারও গিয়ে আইসিইউর সামনে চেয়ার টেনে বসে থাকে চুপচাপ।

***
“সিটি মেডিকেয়ার হসপিটালের চেয়ারম্যান ডক্টর রাওনাফ করীম খানের বাড়িতে স্বনামধন্য রাজনীতিবিদ শাখাওয়াত চৌধুরীর ছেলে শাহরিয়ার উচ্ছাস চৌধুরীর হাতে ডক্টর রাওনাফ করীম খানের ছোটো মেয়ে আহত। পুলিশের তদন্তে জানা গিয়েছে ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। ভিকটিমের অবস্থা গুরুতর।আসামীও পুলিশের গুলিতে আহত।”

গোটা শহরের জন্য খবরটা এরকম হলেও বাতাসে কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে ডক্টর রাওনাফ করীম খানের ওয়াইফের সাথে আসামির পূর্বের প্রেমের সম্পর্কের জের ধরে আসামি এই ঘটনা ঘটায়।

আত্মীয় স্বজন সবাই উর্বীকে আড়চোখে দেখছে। খবরটা রীতিমতো সর্বত্র ছড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাতে আপাতত কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই খান বাড়ির লোকদের। তারা নিজেদের শোক কাটিয়ে উঠতে ব্যস্ত। শর্মীর জন্য উৎকণ্ঠায় সবাই নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। তারা অন্য কোনো কিছুই শুনতে বা জানতে আগ্রহী নয়।

শর্মীর অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। জ্ঞান ফেরা তো দূরে থাক, অবস্থার অবনতি হচ্ছে আরো। হসপিটালের আইসিইউতে শুয়ে শুয়ে কষ্ট পাচ্ছে একটা ফুল,উর্বীর জীবনের ফুল।

উর্বীর শারীরিক অবস্থা আগের থেকেও খারাপ। তার প্রেগন্যান্সির খবরটা এখনও খান বাড়িতে জানানো হয়নি। সবাই যে এলোমেলো পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তাতে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। রাওনাফ আজ তিন রাত্রি বাড়িতে যায়নি। সে হসপিটালে মেয়ের কাছেই ছিলো। রওশান আরাকে বাড়িতে পাঠানো হয়েছে।

****
একটা দূর্ঘটনায় জীবনের কোনো কিছুই থেমে থাকে না,জীবন নদীর শ্রোতের মতোই বহমান। কিন্তু এবাড়ির মানুষদের থেমে আছে।‌ খাওয়া দাওয়া নেই, ঘুম নেই। শুধু হাহাকার। অন্তরা ঘুরে ঘুরে সবাইকে খাওয়ানোর জন্য মানানোর চেষ্টা করছে। কেউ সাড়া দেয়না। সবাই যেন নির্জীব হয়ে আছে।

উর্বীর শরীরটা খুবই দুর্বল হয়ে পরেছে। সে শুধু বসে থাকে শূন্যে তাকিয়ে। শর্মীর কাছে যাওয়ার জন্য ছটফট করে কিন্তু যেতে পারছে না। তাকিয়ে থাকে দেয়ালের ছবিটার দিকে। রাওনাফ-শর্মী-উর্বীর একটা সেলফি। যেটা রোজার আগে শর্মী তুলেছিলো এবং বাঁধিয়েও এনেছিলো।

রাওনাফ বাড়িতে এসে ঘন্টাখানেকের মতো থেকে চলে যায়। আজকেই তার ব্যাতিক্রম হয়েছে। রোজা রেখে এতো ধকল সামলাতে সামলাতে সেও কিছুটা ক্লান্ত, শাফিউল আর মোহনা হসপিটালে তাই খুব ভোরে বাড়িতে এসে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়েছিলো কিছুসময়ের জন্য।

বাড়িতে আবারও পুলিশ এসেছে। বাড়ির সবাই লিভিং রুমে আসে। রাওনাফ আমীরুনের কাছে খবরটা পেয়ে নিচে নামে। উর্বীও ধীরে ধীরে হেঁটে লিভিং রুমের একপাশে গিয়ে দাঁড়ায়। পুলিশের লোকগুলো এবাড়ির লোকদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাদেরও খারাপ লাগছে।

রাওনাফ দীপঙ্করের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে ,”তোমরা! দেখো আমি বলেছি ঐ স্কা’উন্ড্রেলের সর্বোচ্চ শা’স্তি আমি দেখতে চাই। ও গুলি খেয়ে পরে থাক আর যাই করুক। আমার মেয়ে,আমার মা এবং ওয়াইফ যতটুকু কষ্ট পেয়েছে তার সবটা উসুল করবো আমি দীপঙ্কর।”

দীপঙ্কর রাওনাফকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
_আমরা এসেছি অন্য একটি ব্যাপারে। টেকনাফ মডেল থানার ওসি আমাদের সাথে যোগাযোগ করেছে। চার মাস আগে সেন্টমার্টিনে যে মা’র্ডার টা হয়েছে তার ব্যাপারে।

রাওনাফ বলে,”তোমার মনে হয় দীপঙ্কর এখন ওসব নিয়ে কথা বলার পরিস্থিতিতে আমরা আছি? আমার মেয়েটা হসপিটালে পরে আছে। একটা স্বস্তির খবর পাইনি এখন অবধি।”

_কারন রাওনাফ এটা গুরুত্বপূর্ণ। ওখানে যে মা’র্ডারটা হয়েছে সেটা শাহরিয়ার উচ্ছাস করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে,আর তাদের তথ্য অনুযায়ী তার একমাত্র সাক্ষী ছিলো তোমার ওয়াইফ।

রাওনাফ অবাক হয়ে দীপঙ্করের দিকে তাকিয়ে থাকে,তারপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে উর্বীর মুখের দিকে তাকায়। উর্বী তার দিকেই তাকিয়ে আছে।

উর্বী ধীরপায়ে হেঁটে সামনে আসে। দীপঙ্কর বলে ওঠে,
“তোমার স্ত্রীকে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে রাওনাফ। এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করবো।”

সামিউল বলে ওঠে,”দীপঙ্কর ভাই আপনি অন্তত বুঝুন এখন এসবে আমরা জড়াতে চাই না। আমাদের বাড়ির পরিস্থিতি সেরকম নেই।”

রাওনাফ শুধু উর্বীর দিকে তাকিয়েই থাকে। উর্বী বলে ওঠে,”আমি যেতে চাই। চলুন।”

দীপঙ্কর বলতে থাকে,”আমি বুঝতে পেরেছি রাওনাফ। কিন্তু এটুকু করতেই হবে। কিছু সময়ের ব্যাপার। তোমার স্ত্রীকে আমাদের সাথে যেতে হবে। তুমিও আসতে পারো চাইলে।”

***
উর্বী বসে আছে। তার সামনে বসে আছে দীপঙ্কর এবং আরো একজন পুলিশ অফিসার। মাঝখানে এক টেবিল দূরত্ব। রাওনাফ কিছুটা দূরে একটা চেয়ারে বসে আছে।

পুলিশ ইন্স’পে’ক্টর উর্বীকে জিজ্ঞেস করে,”সেন্টমার্টিনে যে মা’র্ডার টা হয়েছিলো আপনি তার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী,এটা কি ঠিক?”

উর্বী মাথা নাড়ায়।

_আপনি ভি’কটিমকে চিনতেন?

_জি না।
অস্ফুট স্বরে জবাব দেয় উর্বী।

_আসামি?

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী মাথা তুলে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থেকে পুলিশ ইন্সপেক্টরকে বলে,”জি।”

_শাহরিয়ার উচ্ছাস চৌধুরী?

_জি।

রাওনাফ তাকিয়েই থাকে উর্বীর দিকে। দীপঙ্কর বলে ওঠে,”তো টেকনাফ মডেল থানার ওসির কাছে আপনি জবানবন্দি দিয়েছিলেন আপনি ভি’কটিম বা আ’সামি কাউকে চেনেন না। আপনি জানেন আপনার নামে এখন তথ্য গোপন করার কেস ফাইল হতে পারে?”

উর্বী দীপঙ্করের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,”জানি।”

দীপঙ্কর বলে,”সেদিন কি ঘটেছিল? খু’নটা কেন হয়েছিলো? এতে কি আপনার হাত আছে?”

উর্বী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”আমার ওপর এটাক করেছিলো ভি’কটিম,আমাকে বাঁচাতে…”

দীপঙ্কর আরেকজন পুলিশ অফিসারের সাথে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। রাওনাফ একদৃষ্টে দেখতে থাকে উর্বীকে। দীপঙ্কর বলে ওঠে,”যে আপনাকে সেদিন বাঁচাতে একটা খু’ন করলো আর গত পরশু সে নিজেই আপনার মাথায় রিভলবার ঠেকিয়েছিলো। কি অদ্ভুত!”

পাশের পুলিশ অফিসার বলে ওঠে,”আপনাকে এখানে আনা হয়েছে সত্যতা যাচাই করতে। টেকনাফ মডেল থানার ইন্সপেক্টর তদন্ত করে বের করেছে আসামি কে। তবে এই কাজ টা আপনি একদম ঠিক করেননি মিসেস খান,এভাবে অপরাধীর সম্পর্কে তথ্য লুকিয়ে আপনি তাকে আরো অপরাধ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। যার প্রমান আপনি পেয়েছেন। আপনি, আপনার শাশুড়ি,ডক্টর খানের ছোটো মেয়ে মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছেন।”

উর্বী চুপ করে মাথা নিচু করে বসে থাকে। রাওনাফ চুপচাপ উর্বীকে দেখতে থাকে। তার সবকিছু এলোমেলো ঠেকছে।

পুলিশ ইন্স’পে’ক্টর বলতে থাকে,”আপনি সন্তানসম্ভবা। তাই আপনার ভালোর জন্য,যাতে আপনাকে ডেইলি ডেইলি কোর্টে চক্কর দিতে না হয় সেজন্য ভালোভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। লিখিত বয়ান দেবেন।”

উর্বী বয়ান লিখে দিতে থাকে। দীপঙ্কর বলতে থাকে,”উচ্ছাসের সাথে আপনার কি সম্পর্ক ছিলো?”

উর্বী কোনো কথা বলে না। দীপঙ্কর বলে ওঠে,”ওকেহ আই আন্ডারস্ট্যান্ড! উচ্ছাস আপনাকে বিরক্ত করতো? হুমকি দিতো কোনো?”

উর্বী দীপঙ্করের দিকে তাকায়,মাথা নেড়ে অস্ফুট স্বরে বলে,”জি।”

রাওনাফ চেয়ারের হাতলের ওপর হাত রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দীপঙ্কর বলতে থাকে,”তবু কেন স্টেপ নেননি?”

উর্বী চুপ করে থাকে। পাশের পুলিশ অফিসার বলে,”আজ আপনার এতো ভোগান্তি আপনার নিজের জন্য ম্যাম। যাই হোক,উচ্ছাস প্রাণে বেঁচে গিয়েছে,ওর উপযুক্ত শাস্তি অবশ্যই দেওয়া হবে,তার জন্য আপনার একটা স্বচ্ছ এবং পোক্ত বয়ান দরকার। আশাকরি আগের মতো আইনকে ধোঁয়াশায় রাখবেন না। আর হ্যা,যদিও শাখাওয়াত চৌধুরীকে আমরা চিনি। তিনি কোনো অন্যায় করবেন না তবুও যদি আপনাকে বা আপনার পরিবারকে কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ করে ক্ষমতার বলে তাহলে অবশ্যই আইনকে জানাবেন।”

উর্বী বয়ান লিখে সই করে দিয়ে রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ চোখ সরিয়ে নেয়।

দীপঙ্কর বলতে থাকে,”আমরা আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি তাই অনুগ্রহ………..ম্যাম আর ইউ ওকে!”

কথা থামিয়ে উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে দীপঙ্কর। উর্বীর থেকে কোনো জবাব নেই। চোখের পলকেই রাওনাফ দেখতে পায় মেঝেতে লুটিয়ে পরেছে সে।

চলমান……

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৩৪ (২য় অংশ)
#Esrat_Ety

উর্বীকে পুলিশের সহায়তায় সিটি মেডিকেয়ারে নিয়ে যাওয়া হয়। তার জ্ঞান এখনও ফেরেনি। রাওনাফ উর্বীর বিছানার পাশে একটি চেয়ারে বসে আছে। সে দুহাত মুঠি করে তার কপাল ঠেকিয়ে রেখেছে।

উর্বীকে দেখছে লামিয়া। উর্বী চেক আপ শেষে বলে,”স্ট্রেস বেশি হয়ে গিয়েছিলো। সামলাতে পারেনি। জ্ঞান ফিরবে দ্রুতই। মা আর বাচ্চা দুজনেই সেইফ। তবে এরকম হলে সমস্যা হবে রাওনাফ,ওর হেল্থ কন্ডিশন তো জানোই। মি’স’ক্যারেজের সম্ভাবনা আছে।”

রাওনাফ মাথা তুলে লামিয়ার মুখের দিকে তাকায়। তারপর চোখ ঘুরিয়ে উর্বীর মুখের দিকে তাকায়।

লামিয়া বলে,”ওর জ্ঞান ফিরলে আমিও তোমাদের সাথে তোমাদের বাড়িতে যাবো। চাচী মাকে দেখবো। সেদিনের পর আর যাওয়া হয়নি তোমাদের বাড়িতে।”

****

উর্বীকে ধরে আছে লামিয়া। উর্বীর গায়ে জোর নেই। লামিয়া তাকে ধরে ধরে সদর দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢোকাচ্ছে। রাওনাফ পাশেই।

লামিয়া উর্বীকে একা সামলাতে পারছিলো না, রাওনাফ গিয়ে উর্বীকে ধরে। উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ তার দিকে তাকায় না। সে সোজা হাটছে।

অন্দরমহলে পা রাখতেই নাবিলের গলা শোনা যায়,”ওখানেই দাঁড়িয়ে যাও। আর ঢুকতে হবে না।”

রাওনাফ তার ছেলের দিকে তাকায়। নাবিল অগ্নিমুর্তি ধারন করেছে।

উর্বীর কোনো ভাবান্তর নেই। সে একদৃষ্টে নাবিলের দিকে তাকিয়ে আছে। নাবিল এগিয়ে আসে, রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি যাস্ট অবাক হচ্ছি পাপা। তোমার মেয়েটা প্রায় মৃত হয়ে পরে আছে হসপিটালে আর তার এই অবস্থা যার জন্য হয়েছে সেই মহিলাকে তুমি হাত ধরে বাড়িতে ঢুকাচ্ছো? শেম অন ইউ পাপা।”

উর্বীর চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে উঠেছে। তার শরীরটা খুবই খারাপ লাগছে।
সোফাতে সবাই বসে আছে বাড়ির। উর্বীর ভাই ভাবী এসেছে। তারা দেখছে তাদের বোনকে। তাদের মন ছোটো হয়ে আছে। তাদের বোনের জীবনটা আবার ওলটপালট হয়ে যাবে নাতো?

নাবিল এসে উর্বীর থেকে রাওনাফের হাত ছাড়িয়ে নেয়। বলতে থাকে,”আমি বলতাম আমার পাপা ওয়ার্ল্ডস বেস্ট পাপা। কিন্তু না, তুমি কখনও ভালো পাপা ছিলেই না।”

রাওনাফ ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। নাবিল বলতে থাকে,
“তুমি ওনাকে এক্ষুনি বের করে দাও পাপা, এক্ষুনি। নয়তো আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।”

লিভিং রুমে বাড়ির সবাই হতভম্ব হয়ে নাবিলের কথা শোনে। রাওনাফ ঠান্ডা গলায় বলে,”নাবিল স্টপ ইট। এখন এসব করো না প্লিজ। আমার মন মেজাজ ভালো নেই। আমি ক্লান্ত খুব।”

নাবিল উর্বীকে বলে,”শান্তি হয়েছে আপনার? হয়েছে না আমার ফুলের মতো বোনটাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে? আমি আপনাকে শুরুতে খারাপ ভাবতাম,পরে ধীরে ধীরে মনে হলো আপনি ভালো, হয়তো আমিই ভুল, কিন্তু না, আপনি একটা জ’ঘন্য মহিলা।
আচ্ছা আপনার লজ্জা হচ্ছে না? চলে কেনো যাচ্ছেন না আমাদের লাইফ থেকে? আপনার বাড়ির লোক এসেছে,তাদের সাথে আপনি চলে যান। আমি আপনাকে সহ্য করতে পারছি না।”

উর্বী দুলছে। মনে হচ্ছে সে আবারও পরে যাবে। রাওনাফ গিয়ে উর্বীকে ধরে।

নাবিল চেঁ’চি’য়ে ওঠে,
“ছাড়ো তুমি ওনাকে। ছাড়ো পাপা। নাটক করছে উনি।”

নাবিল উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে,”এইজন্য এতো ভালোমানুষী? নিজের প্রেমিকের সাথে মিলে আমার বোনটাকে শেষ করতে চেয়েছিলেন! আচ্ছা এরপর কে? আমি নাকি শায়মী? নাকি পাপা? কাকে খাবেন আপনি?”

“নাবিল তুমি চুপ করো, তোমার আন্টি অসুস্থ।”
বলে রাওনাফ।

শায়মী মাথা নিচু করে সোফায় বসেছিলো রুমাকে জরিয়ে ধরে। সে একবারের জন্যও মুখ তুলে তাকায়নি উর্বীর দিকে।

নাবিল রাওনাফকে বলতে থাকে,”কি হয়েছে ওনার? এই মহিলা ভয়ংকর পাপা। তুমি জানো না! উনি নাটক করছে।”

পাশ থেকে আজমেরী বলে,”কি হয়েছে উর্বীর? ভাইয়া?”

রাওনাফ একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে মৃদু স্বরে বলে,”উর্বী প্রেগন্যান্ট।”

বাড়ির সবাই তাকিয়ে থাকে। অন্য সময়ে হলে এই খবরটাতে তারা উন্মাদের মতো আনন্দ করতো। চেঁ’চি’য়ে উল্লাস করতো। কিন্তু এই সুখবরটা তাদের কাউকে আনন্দ দিতে পারছে না এই মুহূর্তে,কেউ অনুভব করতে পারছে না আনন্দ।

নাবিল উর্বী আর রাওনাফকে দেখে তাচ্ছিল্যর একটা হাসি দেয়। অস্ফুট স্বরে বলে,”গ্রেট!”

লামিয়া বলে ওঠে,”ওর একটু বিশ্রাম দরকার। ওকে কেউ ঘরে নিয়ে শুইয়ে দাও। প্লিজ। এখন সিনক্রিয়েট করার সময় না।”
আমীরুন এসে উর্বীকে ধরে। ছুটে আসে তহুরা,ছুটে আসে অন্তরা।

তারা ধরে ধরে উর্বীকে উপরে নিয়ে যায়।
বাড়ির সবাই চুপচাপ। কারো মুখে কোনো কথা নেই।‌

নাবিল ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রুমা তাকে আটকাতে যায়। নাবিল কোনো কথা বলে না। রাওনাফ রুমার দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি শর্মীর কাছে যাচ্ছি। এদিকটা দেখিস!”

****
আজ উনিশ রোজা। সে খবর এবাড়ির কেউ রাখেনি। শর্মীর জ্ঞান ফিরেছে কিন্তু অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শুধু সবার মুখের দিকে । রাওনাফ দুদিন হলো চেম্বারে বসা শুরু করেছে। দিনের বেশিরভাগ সময়ই শর্মীর সাথে কাটায় সে। রাতে বাড়ি ফেরে। উর্বী তখন ঘুমিয়ে যায়। উর্বীর শরীরটা দিনকে দিন বেশ দুর্বল হয়ে পরেছে। অবশ্য রাওনাফ কখনো তার দায়িত্ব পালনে কোনো কার্পণ্য করে না। কোনো অভিযোগের যায়গা রাখেই না সে।

আজমেরী,রুমা যে যার শশুরবাড়িতে ফিরে গিয়েছে। শাফিউল চট্টগ্রাম, সামিউল রাজশাহী। মোহনা আর অন্তরা রওশান মঞ্জিলে থেকে গিয়েছে। মোহনা শাশুড়ির সেবাযত্নে ব্যাস্ত,অন্তরা উর্বীর দেখাশোনা করে।
এই সময়ে উর্বীকে এভাবে একা ফেলে যেতে তার মন সায় দেয়নি। সে যখন অসুস্থ ছিলো,উর্বী সারাদিন তার যত্ন নিতো,বড় বোনের মতো। এখন এই দায়িত্ব তার। সে এতোটাও অকৃতজ্ঞ নয়।

নাবিল ইদানিং ঘর থেকে বের হয়না। প্রয়োজন ব্যাতীত সে সবসময় নিজেকে ঘরে বন্দি করে রাখে। আসলে সে উর্বীর মুখটা দেখতে চায়না। উর্বী তা বোঝে,সে তাই নিজেই নিচে আসে না খুব একটা।

উর্বীর দিন কাটে চার দেয়ালের মধ্যে নিজেকে বন্দি করে। সে এই ঘর থেকে বেরোয় না। শুধু দেয়ালে টাঙানো ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। খুব ইচ্ছে করে তার মেয়েটাকে ছুয়ে দেখতে। কিন্তু শরীর তাকে সাপোর্ট করছে না। তার হাঁটাচলা করা একেবারেই বারণ। পঙ্গুর মতো বসে থাকে বিছানায় সারাদিন। গতকাল শর্মীর ক্লাস টিচার এসে শর্মীর মিড-টার্মের রেজাল্ট কার্ড দিয়ে গিয়েছে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে এবার শর্মী ফোর্থ হয়েছিলো। রেজাল্ট কার্ডটা আগলে ধরে রাওনাফ বুকের সাথে মিশিয়ে রেখেছিলো, তারপর ছুটে গিয়েছিলো হসপিটালে শর্মীকে দেখাতে।

উর্বী সে দৃশ্য দেখে কেঁদেছিলো সারাটাদিন। তারও যে মেয়েটিকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে। কবে ফিরবে তার মেয়ে তার কোলে,কবে আবার তাকে আন্টি বলে ডাকবে মেয়েটা!

কাঁদলে উর্বীর শরীরটা খারাপ হয়ে যায়। তাই কাঁদতেও পারে না ইচ্ছে করলে। গুমরে মরে।

অন্তরা কিছু ফল নিয়ে ঘরে ঢোকে।

_ভাবী আসবো?

_এসো।
উর্বী অস্ফুট স্বরে জবাব দেয়।

_মা পাঠিয়েছে। আপনাকে খেয়ে নিতে বললো।

উর্বীর বুকটা হুহু করে ওঠে। তার শাশুড়ি মা আগের মতো তার কাছে আসে না। সে গর্ভবতী, সেজন্য যতটুকু দায়িত্ব তার রয়েছে শাশুড়ি হিসেবে সে সেটুকু করে দূর থেকে। অবশ্য এসব তো হবারই ছিলো। কেনো উর্বী কষ্ট পাচ্ছে!

অন্তরা বলে,”কিছু লাগলে আমায় ডাকবেন ভাবি।”

শর্মীর ঘরে শর্মীর ময়না পাখিটা শর্মী শর্মী করে ডাকতে থাকে। উর্বী কান চেপে ধরে।

অন্তরা বলে,”কি হয়েছে ভাবি? ”
উর্বী কাঁদছে। মেয়েটা কতো চাইতো পাখিটা তাকে ডাকুক।
সে অন্তরাকে বলে,
“তুমি ওটাকে প্লিজ ওই ঘর থেকে সরিয়ে নাও। আমার খুব কষ্ট হয় ওর ডাক শুনলে।”

এমন সময় রাওনাফ ঘরে ঢোকে। অন্তরা ভাসুরকে দেখে চলে যায়।

উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ সারাদিন অন্যমনষ্ক হয়ে থাকে যেনো উর্বীকে সে দেখতে পায় না, উর্বী যেনো তার সামনে নেই। অথচ ঠিকই টাইম টু টাইম উর্বীর যত্ন নেয়, সবকিছু করে দেয় উর্বীর। কিন্তু উর্বী বুঝতে পারে, রাওনাফ এগুলো করে তার দায়িত্ব থেকে। তার প্রতি রাওনাফের আগের মতো অনূভুতি অবশিষ্ট নেই।

রাওনাফ ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে বলে,” খাচ্ছো না কেনো? খাও ফলগুলো। সকালে ভাইটামিনস ক্যাপসুল নিয়েছিলে?”

উর্বী মাথা নাড়ায়। রাওনাফ নিস্তেজ কন্ঠে বলে,
“নিও মনে করে। আমি তো সবসময় বাড়িতে থাকি না।”

উর্বীর চোখ মুখ শুকনো দেখে রাওনাফ উর্বীর পাশে গিয়ে বসে।
উর্বীকে বলে,”খাওয়া দাওয়া করো ঠিক মতো। তুমি অত্যন্ত দুর্বল।”

উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”জানেন মা না আগের মতো আমাকে ডাকে না। আমার ঘরে আসে না।”

রাওনাফ বলে,”মা বুড়ো হয়েছে,মন মেজাজও ভালো নেই। তাই হয়তো। ”

উর্বীর চোখ দিয়ে পানি পরছে। রাওনাফ বলে,” কাঁদছো কেনো? এই শরীরে এতো চিন্তা মাথায় নেওয়ার প্রয়োজন তো আমি দেখছি না।”

উর্বী রাওনাফের মুখের দিকে তাকায়। মানুষটা তার সাথে কেমন ছাড়াছাড়া কথা বলছে।

রাওনাফ ফলের প্লেটটি নিয়ে একটা টুকরো উঠিয়ে উর্বীর সামনে ধরে,”নাও,এটা খাও।”

উর্বী রাওনাফের হাত সরিয়ে দেয়।
রাওনাফ ফলে,” সমস্যা কোথায় হচ্ছে? ”

উর্বী তার উত্তর দেয়না। শর্মীর ঘরে তুলতুল
শর্মী শর্মী বলে চেঁচাচ্ছে ।

রাওনাফ উঠে চলে যায় সেদিকে। আজ এটাকে সে বাইরে ছেড়ে দেবে।

উর্বী দেয়ালে শর্মী,রাওনাফ আর তার সেই সেলফি টার দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বীর চোখ বেয়ে টুপ টুপ পানি পরে। হঠাৎ তার পেটে ব্যাথা অনুভব হয়। সে পেটে হাত দেয়।

***
রাওনাফ তুলতুলকে ছেড়ে দেয় না। সে খাচাটা নিয়ে নিচের বারান্দায় রেখে আসে। তুলতুল একনাগাড়ে শর্মী বলে চেচিয়েই যাচ্ছে।

রাওনাফ ঘরে ঢুকে দেখে উর্বী মুখে কাপড় গুঁজে কাঁদছে। একটু পরপর তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। রাওনাফ দ্রুত উর্বীকে গিয়ে ধরে,”কি হয়েছে? এমন করছো কেনো? শরীর খারাপ করবে তো।”

উর্বী থামেনা। চোখ বন্ধ করে কাঁদছে।

রাওনাফ আবার বলে,”কি হয়েছে বলবে তো! না বললে আমি বুঝবো কি করে?”

উর্বী কান্না থামিয়ে নিঃশ্বাস নিয়ে নেয়। তারপর বলে,”কেনো অনূভুতি চেপে রেখে আপনি গুমরে মরছেন? অভিযোগ তোলার হলে তুলছেন না কেন! আমার দোষের শাস্তি আমি মাথা পেতে নেব।
আপনিও ভাবতে শুরু করেছেন যে আমি আপনার জীবনে না আসলে আপনার মেয়েটাকে কষ্ট পেতে হতো না তাইনা? সেটা বলে নিজেকে হালকা করুন শর্মীর পাপা। একবার বলুন আপনার ভুল হয়েছে আমাকে জীবনে জড়ানো। আমি কিছু মনে করবো না। বরং শান্তি পাবো!”

রাওনাফ এবার নিজের মেজাজ ঠিক রাখতে পারে না। ধ’ম’কে ওঠে,”আচ্ছা দু দন্ড শান্তি কি আমি ডিজার্ভ করি না? আমারো দমবন্ধ লাগে তুমি বোঝো? আমি কিরকম মুডে থাকবো,কি রকমের রিয়াক্ট করবো তা তোমরা ডিসাইড করে দেবে? এখন কি চাও বাড়ি আসাই বন্ধ করে দেই? অন্য কোথাও গিয়ে নিজের বাচ্চাদের জন্য দুশ্চিন্তা করি? হসপিটালে মেয়েটা আধমরা হয়ে পরে আছে,তোমার পেটে যে আছে তার জীবনের ঝুঁকি আছে। এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে করতে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি কিন্তু তোমার নাটক থামছে না। চালিয়ে যাচ্ছো তো চালিয়েই যাচ্ছো।”

উর্বী অবাক চোখে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাওনাফ একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে উর্বীর হাত দুটো ধরে, তারপর নরম গলায় বলে,”উর্বী এখন বন্ধ করো এসব। উর্বী তোমাকে আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে নেওয়া আমার ভুল না। আমি কোনো ভুল করিনি। তবে ভুল একটা ছিলো, তোমার ভুল ছিলো উর্বী । আমাকে সত্যিটা না জানানো ভুল ছিলো তোমার। সব সত্যি জানলে আমি কি আমার স্ত্রী সন্তানের নিরাপত্তা দিতে পারতাম না উর্বী? তোমার কি মনে হয়?

উর্বী তাকিয়ে আছে, রাওনাফ বলতে থাকে,”যে উর্বী কথার জালে পেঁচিয়ে রুপাকে মিথ্যা প্রমাণ করলো সেই উর্বীই এতো বড় একটা বোকামি করলো? কি ভেবেছিলে? উচ্ছাসের নাম বেরিয়ে আসলে কিংবা ওকে নিয়ে ঝামেলা বাঁধলে তোমার অতীত দুনিয়ার মানুষের সামনে খোলসা হয়ে যাবে? লাঞ্চিত হবে তুমি আবারও। এটা ভেবেছিলে? এখন কি হলো উর্বী? এখন কি সেসবের বাকি কিছু আছে? উল্টো শর্মীর এই অবস্থার জন্য তোমাকে দুষছে সবাই। যদি একটাবার বলতে উর্বী,আমি একটা স্টেপ নিতে পারতাম। আর দুনিয়ার লোকের কথাই বলো,আমি কি পারতাম না তোমার হয়ে তাদের ফেস করতে? আমাকে ভরসা করে এতোকিছু বলতে পারলে,আরেকটু ভরসা করতে পারলে না রাওনাফ করীম খানকে?

কি সম্মান দিয়েছো আমাদের এই সম্পর্ককে তুমি? কি দিয়েছো? উর্বী তুমি শুধু নিজের মতো করে এই সম্পর্কটাকে দিয়েছো,পুরোটা ঢেলে দাওনি নিজের। না কখনো ভরসা করেছো আমাকে না করেছো সম্মান,শুধু নিজে ভালো থাকতে এই সম্পর্ককে ব্যবহার করেছো তুমি, আমাদের ভালো রাখতে নয়। নিজের যন্ত্রনা ভুলতে আমাকে ব্যাবহার করেছো,আমাকে দিয়েছো নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী। এটা আমার কথা নয় উর্বী,এটা তোমার আচরণে তুমি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছো। আমি ব্যার্থ উর্বী। আমিই ব্যার্থ,তোমার স্বামী হতে পারলেও তোমার ভরসার যায়গাটা হতে পারিনি। আর আজ সেজন্য আমার মেয়েটা…..”

থেমে যায় রাওনাফ।
উর্বী একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে রাওনাফের দিকে, অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”আপনি……”

রাওনাফ উর্বীকে কিছু বলতে না দিয়ে বলে,”দয়া করো। দয়া করে নিজেও সুস্থ থাকো,আমাকেও সুস্থ থাকতে দাও। আমি ক্লান্ত উর্বী।”

উর্বী আর কিছু বলে না। রাওনাফ উঠে দাঁড়ায়,উঠে খুব দ্রুতই শার্ট পালটে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। উর্বী দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে।

রাওনাফকে হন্তদন্ত হয়ে নিচে নামতে দেখে অন্তরা আর মোহনা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে।

গাড়িতে চাবি দিয়ে রাওনাফ বসে আছে। নিজের প্রতি নিজের প্রচন্ড রাগ হয় তার। দুহাতে চুল গুলো পেছনে ঠেলে সজোরে গাড়ির দরজায় একটা ঘুষি মেরে দেয়। হাতের আঙ্গুল ফেটে রক্ত বের হবার উপক্রম। ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। মুখের সামনে উর্বীর মায়াবী মুখশ্রীটা ভেসে ওঠে। আর ঐ কথাগুলো কানের কাছে বারবার প্রতিধ্বনিত হয়,”যেদিন আপনার চোখে আমি আমার জন্য বিতৃষ্ণা দেখবো শর্মীর পাপা সেদিন আমি বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই হারিয়ে ফেলবো।”

রাওনাফ ঘা’ড় ঘুরিয়ে রওশান মঞ্জিলের দিকে তাকায়। তার দৃষ্টি দোতলার উত্তর পাশের জানালায় নিবদ্ধ।

চোখ সরিয়ে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকায় ,তার এতো অস্থির লাগছে কেনো সে বুঝতে পারছে না। বুকে অসহনীয় যন্ত্রনা হচ্ছে,কিছু একটা হারিয়ে ফেলার ভয় তার গলা টিপে ধরছে। আচমকা গাড়ির দরজা ঠেলে নেমে পরে রাওনাফ। তারপর দৌড়াতে থাকে রওশান মঞ্জিলের দিকে।

রওশান আরা লিভিং রুমে বসেছিলো। রাওনাফকে হন্তদন্ত হয়ে উপরে যেতে দেখে মোহনা দাঁড়িয়ে পরে।

“কি হয়েছে ভাইয়া ছুটছেন কেন? ”
রাওনাফ কিছু বলছে না। সে ছুটতে থাকে।

অন্তরা আর মোহনা তাদের ভাসুর কে এভাবে ছুটতে দেখে নিজেরাও তার পিছু পিছু যায়।

রাওনাফ গিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পরে। সে যে ভয়টা পেয়েছিলো,সেটাই হয়েছে। তার শরীর কাঁপছে।

সে উর্বীকে না ডেকে সরাসরি দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে।
এরপর সে সজোরে একটা লাথি বসায় দরজাতে। দরজার সিটকিনি ভেঙে দরজা খুলে যায়।
রাওনাফ ভেতরে ঢোকে। তার পিছু পিছু ঢোকে অন্তরা আর মোহনা।

উর্বী বিছানায় পরে আছে। দুচোখ বন্ধ তার। তার বাম হাত থেকে গলগল করে রক্ত ঝ’রছে। সাদা রঙের বিছানার চাদরে লাল রঙের রক্ত মিশে একটা নকশা তৈরি হয়েছে যেন। উর্বীর অন্যহাতে একটি সার্জিক্যাল ব্লেড মুঠি করে ধরে আছে। মায়া মায়া মুখটার দিকে তাকিয়ে রাওনাফের বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। উর্বীর চোখের পানি দু গালে লেপ্টে আছে। হয়তো তখনও কেঁদেছে। কান্না ছাড়া আর কিছু নেই এই মেয়ের জীবনে।

রাওনাফ ধপ করে বসে পরে। মোহনা বিকট একটা চিৎকার দিয়ে কান্নায় ভেঙে পরে,”ভাবী!”

অন্তরা বোকার মতো তাকিয়ে আছে। মানুষ এতো অদ্ভুত কেনো!

রাওনাফ উঠে ছুটে যায় উর্বীর কাছে,উর্বীর মাথাটা বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে দু’চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে চেঁচাতে থাকে,”উর্বী ওটা বিতৃষ্ণা ছিলো না। উর্বী প্লিজ চোখ খুলে দেখো। তাকাও উর্বী,বোকা মেয়ে‌। দয়া করো আমাকে। দয়া করো! দয়া করো প্লিজ দয়া করো‌।”

চলমান……

আরেকটি বার পর্ব-৩৩

0

#আরেকটি_বারন
#পর্বসংখ্যা_৩৩
#Esrat_Ety

উর্বী শর্মীর মাথাটা বুকের সাথে মিশিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে যাচ্ছে। রওশান আরা শর্মীর পায়ের কাছে বসে আহাজারি করছে। শর্মীর পুরো শরীরটা এর মাঝে একবার ঝাঁকুনি দিয়ে পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে যায়।

উচ্ছাস কিছুটা হতভম্ব হয়ে যায়। সে এটা ইচ্ছে করে করেনি। কয়েক মুহূর্ত নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে লম্বা লম্বা পা ফেলে নিচে নামতে থাকে সে, হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠে, সজীব ফোন দিচ্ছে।
সে ফোনটা রিসিভ না করে উর্বীর দিকে এগিয়ে যায়। উর্বীর হাত টেনে ধরে বলে,”চলো ওঠো।”

উর্বী উচ্ছাসের দিকে তাকায়। ক্রন্দনরত অবস্থায় চেঁ’চি’য়ে বলে ওঠে,”ব্যাথা দিলি। আমার মেয়েটাকে তুই ব্যাথা দিলি জা’নোয়ার।”

উচ্ছাস উর্বীর কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে উর্বীকে টানছে। উর্বী শর্মীকে ছেড়ে উচ্ছাসের দিকে হিংস্র দৃষ্টি দিয়ে তাকায়। তার চোখ দিয়ে আর পানি বেরোচ্ছে না, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে উঠে ছুটে চলে যায় ডাইনিং টেবিলের কাছে,ফলের ঝুড়ি থেকে ছুড়িটা এনে উচ্ছাসকে আঘাত করার চেষ্টা করতেই উচ্ছাস উর্বীর হাত ধরে ফেলে। একটানে উর্বীকে ঘুরিয়ে হাত থেকে ছুড়িটা ফেলে বলতে থাকে,”এতো বাড়াবাড়ি করো না। তোমার শরীর ঠিক নেই।”

উর্বী উচ্ছাসের হাত কা’মড়ে নিজেকে উচ্ছাসের হাতের বাঁধন থেকে আলগা করার চেষ্টা করেও পারলো না। শরীরে যে আর তার কোনো জোর নেই! উচ্ছাস বলতে থাকে,”যখন মন চাইবে আসবি,যখন মন চাইবে চলে যাবি তাইনা? আজ তোকে না নিতে পারলে তোর লা’শ নেবো আমি। তুই আমার না,তবে তুই কারো না।”

উর্বী অসহায়ের মতো শর্মীর দিকে তাকায়। কিভাবে অচেতন হয়ে পরে আছে মেয়েটা। ওকে হসপিটালে নিতে হবে, এক্ষুনি,এই মুহূর্তে। রওশান আরা নাতনিকে আগলে ধরে কেঁদে যাচ্ছে এখন। উর্বীদের দিকে তার কোনো খেয়াল নেই আর। তিনি নাতনি শোকে কাতর।

উর্বীর নিজের শারীরিক অবস্থাও খুব খারাপ। যেকোনো মুহূর্তে মাথা ঘুরে পরে যেতে পারে তবুও সে শরীরের সবটুকু শক্তি খরচ করে উচ্ছাসের থেকে ছাড়া পেতে চায়।
উচ্ছাস বলতে থাকে,”বারো ভা*তারী কোথাকার! এক পুরুষে হয়না তাইনা ? কেনো ছেড়ে যেতে চেয়েছিলি বল! বেশি ভালবাসতাম সেটা সহ্য হতো না? আমি জেলে যাওয়ার পরে কেন অপেক্ষা করলি না! নতুন পুরুষের স্বাদ নিতে বিয়ে করে নিলি!”

উর্বী কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করে এক সময় নিস্তেজ হয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে,উচ্ছাসের পা জরিয়ে ধরে বলতে থাকে,”উচ্ছাস দয়া করো। আমার মেয়েটা ম’রে যাবে। ওকে হসপিটাল নিতে হবে। দয়া করো।”

উচ্ছাস উর্বীকে টেনে দাঁড় করিয়ে চুলের মুঠি ধরে, চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে থাকে,”কেনো দয়া করবো? আমি তো কীট! কোনো দয়া হবে না।”

উর্বীর দম আঁটকে আসছে। তার কাতরতা দেখে উচ্ছাস হঠাৎ অন্যরকম হয়ে যায়,চুলের মুঠি থেকে হাত সরিয়ে নরম গলায় বলে ওঠে,”পাখি দেখো আমি তোমাকে একটুও ব্যাথা দিতে চাই না। তবুও বারবার দিয়ে ফেলি। আমি খারাপ। তুমি আমাকে মারো। মারো আমাকে।”

এই বলে উর্বীর হাত টেনে নিজের গালে নিজে চ’ড় মারতে থাকে উচ্ছাস, মুহূর্তেই মুখটা কঠিন করে ধ’ম’কে বলে ওঠে,”মে’রেছো? হয়েছে শান্তি? এখন চলো।”

উর্বী ঘুরে ছুটে যায় শর্মীর কাছে। পেছন থেকে উচ্ছাস আবারও শাড়ির আঁচল টেনে ধরতেই উর্বীর অর্ধেক শাড়ি খুলে যায়। উর্বী তবুও গিয়ে শর্মীকে ধরে। উচ্ছাস গিয়ে উর্বীর গাঁয়ে শাড়ির আঁচল জরিয়ে দিয়ে উর্বীকে টানছে। রওশান আরা একবার শর্মী একবার উর্বীকে দেখছে। উচ্ছাসের অমনোযোগের সুযোগ নিয়ে সে কোনমতে উঠে পেছন থেকে একটা ফুলদানি দিয়ে বাড়ি দেয় উচ্ছাসের মাথায়। কিন্তু এই দানবের কিছুতেই কিছু হয়না। উল্টো ক্ষে’পে রওশান আরাকে আবারও ধা’ক্কা মেরে ফেলে দেয়। উর্বী শর্মীকে জরিয়ে ধরে রেখেছে, চেঁ’চি’য়ে যাচ্ছে,”আল্লাহ আমার মেয়েটাকে বাঁচিয়ে নাও।”

বাইরে তখনও তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির শব্দে পুলিশের গাড়ির সাইরেন শুনতে পায়নি উচ্ছাস।

দুমিনিট পরে একটা গুলির আওয়াজ হয়। উর্বী চ’ম’কে ওঠে। উচ্ছাস ঘুরে সদর দরজার দিকে তাকাতেই পুলিশ ইন্সপেক্টর বলে ওঠে,”চুপ করে দাঁড়াও ওখানে।”

ইতিমধ্যে পুলিশের কিছু কনস্টেবল পুরো লিভিং রুমে ঢুকে উচ্ছাসকে ঘেরাও দিয়ে দাঁড়িয়েছে । উচ্ছাস এলোমেলো দৃষ্টি দিয়ে বাঁকা হাসি হাসে,তারপর প্যান্টের পকেট থেকে একটানে বেরেটা এম নাইন বের করে বলে ওঠে,”শা’লা তোমরা আইনের লোক হয়ে আমায় ভালো থাকতে দাওনা কেন?”

পুলিশ ইন্সপেক্টর কিছু বলার আগেই উচ্ছাস তার ব’লিষ্ঠ হাতে উর্বীর চুলের মুঠি ধরে টেনে উর্বীকে তুলে এক হাত দিয়ে জাপটে ধরে উর্বীর কপালে রিভলবার ঠেকিয়ে দেয়।

ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব পুলিশ ইন্সপেক্টর পিস্তল তাক করে ধরে রেখেই তিন পা পিছিয়ে যায়। উর্বী উচ্ছাসের এহেন কান্ডে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না,সে শুধু নিস্তেজ কন্ঠে বলতে থাকে,”আমার মেয়েটাকে বাঁচিয়ে নিন। আপনারা কেউ আমার মেয়েটাকে বাঁচিয়ে নিন।”

উচ্ছাস পুলিশ ইন্স’পে’ক্টরের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,”যেতে দিন আমাকে ওকে নিয়ে, নয়তো তিনমিনিটের মধ্যে প্রথমে ওকে মা’রবো তারপর নিজে সুই’সা’ইড করবো।”

উচ্ছাসের কন্ঠে কিছু একটা ছিলো, পুলিশ ইন্স’পে’ক্টর কিছুটা ঘা’বড়ে যায়। তবুও সে পিস্তল নামায় না। ওভাবেই তাক করে রাখে।

ইন্স’পে’ক্টর বলতে থাকে,”শাখাওয়াত চৌধুরীর ছেলে! কি ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনলে তুমি নিজের। সারেন্ডার করো। তোমার চিকিৎসা দরকার। সারেন্ডার করো!”

উচ্ছাস তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে রিভলবারটা পুরোপুরি মাথার সাথে চেপে ধরে উর্বীর।

উর্বী নীরবতা ভেঙে উন্মাদের মতো বিরবির করে বলতে থাকে,”মেরে ফেলো আমাকে তুমি। হ্যা সেটাই করো তবে। তুমি আমাকে যা দিয়েছো,তার মধ্যে মৃত্যু হবে সবথেকে সুন্দর কিছু। তবে জেনে নাও উচ্ছাস,তুমি কোনো উর্বীকে মারবে না,মারবে রাওনাফ করীম খানের স্ত্রীকে,তার অনাগত সন্তানের মাকে। পরস্ত্রী আমি। শুনে নাও তুমি। আমি আমার স্বামীকে ভালোবাসি,তোমাকে ঘৃণা করি! মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তোমাকে ঘৃণা করতে পেরেছি,এটাই আমার শান্তি!”
উচ্ছাসের প্রতি সমস্ত ঘৃণা কয়েকটা লাইনে উগ্রে দিয়ে দু’চোখ বন্ধ করে নেয় উর্বী। তার নাটকীয়তায় ভরা জীবনের শেষটাও নাটকীয় ভাবে হলো। শুধু আফসোস শর্মীর জন্য। মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে তার জন্য,তার জীবনে চমৎকার সুগন্ধি দেওয়া ফুলটা মেঝেতে পরে কষ্ট পাচ্ছে শুধু মাত্র উর্বীর জন্য।‌ উর্বী দায়ী,উর্বী দোষী,উর্বী পাপী। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে দৃষ্টি মেলে তাকানোর আগেই গু’লির আওয়াজ হয়।

****

“ম্যাম সরে যান। ম্যাম।”

নিউরো বিভাগের ল্যাবের সামনে দাঁড়িয়ে নার্স উর্বীকে বলে। উর্বী সরেনা। এক হাত দিয়ে শর্মীর হাত আকরে ধরে রেখেছে। শর্মীকে ট্রলিতে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এমআরআই আর সিটিস্ক্যানের জন্য।

নার্স মোসারাত উর্বীকে বলে,”প্লিজ ম্যাম ছাড়ুন হাতটা,আপনি এখানেই দাঁড়ান।”

একজন জুনিয়র নার্স এসে উর্বীর হাত থেকে শর্মীর হাত ছাড়িয়ে নেয় জোর করে। তারপর শর্মীকে নিয়ে ভেতরে চলে যায়। উর্বী ল্যাবের বাইরে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। উর্বীর সামনে দিয়ে ল্যাবে ঢোকে সিটি মেডিকেয়ারের নিউরো সার্জন শুভাশীস রায়। তার সাথে আরো দুজন বিশেষজ্ঞ।
একজন নার্স ছুটে এসে উর্বীর আঁচল ঠিক করে দিতে দিতে বলে,”একটু আমার সাথে আসবেন ম্যাম? আপনার প্রাথমিক চিকিৎসা দরকার।”

উর্বী উদভ্রান্তের মতো আশেপাশে তাকিয়ে বলে ওঠে,”আমার শাশুড়ি।”

_তার চিকিৎসা চলছে। স্বাভাবিক সবকিছু।

উর্বী আশেপাশে তাকায়, শায়মী নাবিলের কাঁধে মাথা রেখে কেঁদে যাচ্ছে। নাবিল বোনকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। তাদের পাশেই বসে আছে সুমনা ও ঝুমুর। তারাও নিরব অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে।

উর্বী সবার দিকে একে একে তাকিয়ে একটা বেঞ্চিতে ধপ করে বসে পরে।

****
দ্রুত পায়ে শাখাওয়াত চৌধুরী জেনারেল হসপিটালের লবি দিয়ে হেঁটে আসছে,তার দুই পাশে দুজন বডিগার্ড। হসপিটালের বাইরেই তিন তিনটা গাড়ি দাড় করিয়ে এসেছে সে। কেবিনের বাইরে তিনজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো, শাখাওয়াত চৌধুরীকে দেখেই টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়। শাখাওয়াত চৌধুরী সালামের উত্তর দিয়ে কেবিনের ভেতরে প্রবেশ করতে গেলেই পুলিশ অফিসার তার পথ আগলে ধরে,বলে,”স্যার আসামী আমাদের জিম্মায় এখন। আপনি দেখতে পারবেন না।”

শাখাওয়াত চৌধুরী আহত চোখে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলে ওঠে,”ছেলে আমার।”

_স্যার সে আসামী। এটেম্পট টু মা’র্ডা’র কেসের আসামী। উই আর সরি।

শাখাওয়াত চৌধুরী একটা গভীর নিঃশ্বাস নেয়, কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,”কোথায় লেগেছে গু’লি?”

_বুকে।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় পুলিশ ইন্সপেক্টর।

শাখাওয়াত চৌধুরীর মনে হলো কেউ তারই বুকে গু’লি মে’রেছে। পুলিশ অফিসারের মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চায়,
_কে মে’রেছে?

_আমি।
পুলিশ অফিসার উত্তর দেয়। শাখাওয়াত চৌধুরী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। নরম গলায় বলে ওঠে,”দয়া করে ভালো কোনো হসপিটালে নিতে দিন!”

_উই আর সরি। তাকে এখানেই রাখা হবে।

শাখাওয়াত চৌধুরী দু’চোখ বন্ধ করে ফেলে, তারপর আটকে আটকে বলে ওঠে,”বাঁচবে তো!”

_আশা করা যাচ্ছে।

****
পুরো সিটি মেডিকেয়ার হসপিটাল ভীষণ ব্যস্ত, তারা ভীষণ ব্যস্ত রাওনাফ করীম খানের ছোটো মেয়েকে নিয়ে। যে মেয়েটা রাওনাফ করীম খানের খুব আদরের।

নিউরো বিভাগের সামনে ওয়েটিং রুমে আহাজারি করে যাচ্ছে শর্মীর দুজন ফুপু এবং দুজন খালামনি। এখানে কেউ কাউকে সান্ত্বনা দিতে পারছে না। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত।

শায়মী আর নাবিল একে অপরকে জরিয়ে ধরে কাঁদছে। মনে হচ্ছে প্রত্যেকে আলাদা আলাদা দুনিয়া বানিয়ে নিয়েছে নিজের জন্য,যেখানে উর্বীর কোনো অস্তিত্ব নেই। উর্বী নিজেই নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পায়না। কিছুক্ষণ সবার মুখের দিকে তাকিয়ে ধীরপায়ে হেঁটে নার্সের বারণ সত্তেও শর্মীকে যে কেবিনে রাখা হয়েছে সেখানে ঢোকে।

আশ্চর্যজনক ভাবে নিজের শারীরিক যন্ত্রণা সে অনুভব করতে পারছে না।

লামিয়া রওশান আরার কেবিন থেকে বের হয়ে দেখে উর্বী শর্মীর কেবিনে ঢুকছে,সে বাঁধা দিতে গিয়েও দেয়না।

নিস্তেজ হয়ে পরে থাকা নরম, আদুরে শরীর, গোলগাল মুখটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে উর্বী। মনে হচ্ছে এখনি ঐ ঠোঁট নেড়ে বলবে,”আন্টি আমি আজ তোমার সাথে ঘুমাই? আন্টি আমার খুব ভয় করছে, আন্টি আমাকে মিষ্টি কিছু বানিয়ে দাও না! আন্টি পাপার কাছে তুমি প্লিজ এটা বলবে না!”

আশ্চর্য! উর্বীর চোখে এখন পানিও আসছে না। সে শর্মীর নরম হাতটা আকড়ে ধরে রেখেছে।

“স্যার আপনি শান্ত হোন….রাওনাফ ভাই দাড়া….ভেতরে যাসনা… রাওনাফ দাঁড়াও তুমি!”

বাইরে থেকে তিন চারজন ভিন্ন ভিন্ন পুরুষের গলার আওয়াজ শোনা যায়,উর্বী শর্মীর হাত ছেড়ে কেবিনের একপাশে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
বাইরে সবাই রাওনাফকে আটকাতে চাইছে। রাওনাফ কারো কথা না শুনে ঢুকে পরে কেবিনে।

চোখের পলকেই শর্মীর বেডের কাছে গিয়ে হাঁটু ভেঙে বসে পরে সে। শর্মীর হাত আগলে ধরে অজস্র চুমু খেতে খেতে কান্নায় ভেঙে পরে রাওনাফ। প্রত্যেকটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে আর্তনাদ করতে থাকে,”আমার মা। আমার মামনি।” বলে।

জাহাঙ্গীর আর লামিয়া রাওনাফকে টানছে। সে তার মেয়ের হাত ছাড়ছে না।

শর্মীকে হসপিটালে আনার দেড় ঘণ্টা পরে রাওনাফ এসেছে। এসেই জানতে পারে তার পুরো পৃথিবী নিস্তেজ হয়ে কেবিন নাম্বার তিনশো চারে পরে আছে।

উর্বী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে বাবা মেয়েকে। সে বুঝতে পারছেনা সে আদৌও জীবিত কিনা। তার কেনো কান্না পাচ্ছে না!

রাওনাফ নিজের মেয়েকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে যাচ্ছে। ডক্টর মেহেদী হাসান, আজমেরীর স্বামী হাফিজুর তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করছে। রাওনাফ ছোটো বাচ্চাদের মতো কাঁ’দছে। ছেলেমেয়েগুলো তার ঠিক কি সেটা তো কেবল রাওনাফ করীম খানই জানে। ওরাই যে তার অস্তিত্ব। নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে ব্যর্থ বাবা মনে হচ্ছে তার এখন। সে কিসের শাস্তি পেলো এটা! কোন দোষের! কোন পাপের!

রাওনাফকে দেখে আত্মীয় স্বজনের আহাজারি যেন বেড়ে গেলো। ডক্টরদের বারণ সত্তেও তিনতলা কাপিয়ে , বাতাস ভারী করে কেঁদে যাচ্ছে সবাই।

কেবিনের মধ্যে ট্রলি নিয়ে ঢোকে তিনজন নার্স এবং তাদের পেছনে ডক্টর শুভাশীষ রায় এবং তারিন মাহমুদা। নিউরো সার্জন। শুভাশীষ এসে রাওনাফের হাত ধরে টানে,কোমল কন্ঠে বলে,”ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। ভেঙে পরো না রাওনাফ।”

রাওনাফ কিভাবে শক্ত থাকবে! সেই মানসিক ক্ষমতা রাওনাফের নেই! সে তার মেয়েকে আকড়ে ধরে রেখেছে। কপালে চুমু দিয়ে ভরিয়ে দিচ্ছে মেয়ের।

সিস্টার দুজন এসে শর্মীকে ট্রলিতে উঠিয়ে নিতে চায়। রাওনাফ হাহাকার করে ওঠে,”কোথায় নিয়ে যাচ্ছো! আমার মামনিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো!”

উঠে দাঁড়ায় রাওনাফ।

শুভাশীষ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলতে থাকে,”সেরি’ব্রামের নিচের অংশে আঘাত পেয়েছে, সাথে স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি। ইমিডিয়েট সার্জারি প্রয়োজন। ডক্টর নাজমুল হুদা এসেছে।”

রাওনাফ ধপপ করে আবারও মেঝেতে বসে পরে। জাহাঙ্গীর আর আশিক এসে তাকে আগলে ধরে। রাওনাফ বোকার মতো শর্মীর মুখের দিকে তাকায়, তাকায় শুভাশীষ রায়ের মুখের দিকে।

উর্বী শুধু কেবিনের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। পেটে হাত চেপে এলোমেলো দৃষ্টি দিয়ে তাকাচ্ছে সে। আশেপাশের সব লোকজনকে দু’বার করে দেখছে সে। হঠাৎ একজন নার্স তার দিকে এগিয়ে আসে, উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”ম্যাম আর ইউ ওকে! একটু বসবেন আপনি?”

উর্বী উত্তর দেওয়ার আগেই মেঝেতে লুটিয়ে পরে।

****
চোখ মেলে তাকাতেই দেখে লামিয়া ঝুঁকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী আবারও দু’চোখ বন্ধ করে ফেলে। এবং কয়েক মুহুর্ত ওভাবে থেকে ধীরে ধীরে উঠে বসে। ডান হাতের পিঠে ব্যাথা অনুভব হয় তার, তাকিয়ে দেখে তার হাত ক্যানুলা লাগানো। সে দাঁতে দাঁত চেপে একটানে ক্যানুলা খুলে ফেলে।

লামিয়া বলে ওঠে,”কি করছো!”

উর্বী কোনো জবাব না দিয়ে আশেপাশে তাকায়। লামিয়া বলে ,”তুমি গাইনী বিভাগে। চারতলায়।”

উর্বী বেড থেকে নেমে দাড়ায়। লামিয়া কিছু বলার আগেই দুর্বল শরীর নিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে।

উচ্ছাসের কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে শেফালী দরজার কাচ দিয়ে তাকিয়ে আছে ভেতরে। উদোম, বলিষ্ঠ শরীরটায় বুকের ডানপাশের কিছুটা নিচে ব্যান্ডেজ করা। গুলি বের করা হয়েছে তার। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। বেডের পাশে মনিটরটায় কিছুক্ষণ পরপর যান্ত্রিক আওয়াজ হচ্ছে, যেন শেফালীকে বলছে,”তোমার ছেলে মরে যাবে শেফালী।”

শেফালী শাড়ির আঁচল মুখে চেপে ধরে অশ্রুবিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে। পেছন থেকে শাখাওয়াত চৌধুরী কাঁধে হাত রাখে। শেফালীর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। শাখাওয়াত চৌধুরী স্ত্রীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে,”ছেলের গায়ে যখন শাসন করার জন্য হাত তুলতাম তখন সহ্য করতে পারতে না,ছেলে আজ গু’লি খেয়ে পরে আছে,এখন কিভাবে সইছো?”

শেফালী ঘুরে স্বামীকে জরিয়ে ধরে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার,স্বামীর বুকে মাথা ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে,”ও প্রাণে বেঁচে গেলে ওকে যেনো কখনো আর জেল থেকে বের না করেন আপনি। কখনো চেষ্টাও করবেন না। কখনো না। কখনো না।”

উর্বী ছুটতে ছুটতে নামছে সিড়ি বেয়ে, অর্থোপেডিক বিভাগ পেরিয়ে তিনতলায় নিউরো বিভাগের ওয়েটিং রুমে এসেই থমকে যায় সে। আত্মীয় স্বজনে গিজগিজ করছে পুরো কামরা। উর্বী ধীরপায়ে এগিয়ে যায়। সবাই কিরকম চুপচাপ হয়ে আছে। কিন্তু সবাই নিরবে অশ্রুবিসর্জন বিসর্জন করে যাচ্ছে।

উর্বীর বুকটা হঠাৎ মোচড় দিয়ে ওঠে। উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে ওপারেশন থিয়েটারের বাতি জ্বলছে।

আরো দুকদম এগিয়ে গিয়ে উর্বী পিছিয়ে যায়। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সে তাকিয়ে থাকে সোজাসুজি। রাওনাফ লবির মেঝেতে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে এক হাঁটু ভাজ করে। তার দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। উর্বী সে দৃষ্টি পড়তে পারছে না। শায়মী নাবিল দুজন তাদের পাপার দু’পাশে বসে পাপাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে চুপচাপ। রাওনাফের দু’জন শ্যালিকা,দু বোন, তাদের স্বামী সবাই একপাশে বসে আছে। সামিউল-অন্তরা, শাফিউল-মোহনা সবাই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে ইতিমধ্যে।

মৃদু আওয়াজে কাঁদছে আজমেরী। রুমাও কাঁদছে। শায়মী নাবিল দু’জনেই কাঁদছে। সবাই কাঁদছে,শুধু কাঁদতে পারছে না উর্বী । কেনো কাঁদতে পারছে না সে জানেনা। সেও সবার মতো একটু কাঁদতে চায়। শর্মী তারও মেয়ে। সেও কাঁদবে।

থানা থেকে ইন্স’পে’ক্টর দীপঙ্কর সাহা দুজন কনস্টেবল নিয়ে এসেছে। তাকে দেখে আজমেরীর স্বামী হাফিজুর এগিয়ে আসে, এগিয়ে আসে জাহাঙ্গীর। দীপঙ্কর তাদের উদ্দেশ্য করে বলে,”এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। এদিকের কি অবস্থা?”

_সা’র্জারি লাগছে।
নিষ্প্রাণ হয়ে বলে হাফিজুর। দীপঙ্কর বলে,”একটু রাওনাফের সাথে কথা বলবো।”

জাহাঙ্গীর বাঁধা দিয়ে বলে,”বুঝতেই তো পারছো দীপঙ্কর। এখন থাক। তোমরা তোমাদের কাজ চালিয়ে যাও।”

_তবুও।

কথাটা বলে দীপঙ্কর এগিয়ে যায় রাওনাফের দিকে। রাওনাফের সামনে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেও মেঝেতে বসে,তারপর নরম গলায় বলে ওঠে,”তোমার ফোন পাওয়ার সাথে সাথেই বেড়িয়ে গিয়েছি রাওনাফ। একটুও বিলম্ব করিনি বিশ্বাস করো।”

রাওনাফ চুপ করে থাকে। দীপঙ্কর বলতে থাকে,”শাখাওয়াত চৌধুরীর ছেলে। তুমি চেনো শাখাওয়াত চৌধুরীকে। ছেলেটির নাম শাহরিয়ার উচ্ছাস চৌধুরী। এর আগে খুনের দায়ে দশবছরের জেলও হয়েছিল। ছয়বছর জেলে কাটিয়ে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পেয়েছিলো। ভয়ংকর অসুস্থ একটি ছেলে। জানিনা তোমার সাথে কি শত্রুতা ছিলো। তার মা বাবা জবানবন্দি দিয়েছে তোমার ওয়াইফের সাথে ঝামেলা ছিলো বলে এসব ঘটিয়েছে। বাকিটা তোমার ওয়াইফ বলতে পারবে।”

শায়মী পাপার কাঁধে মাথা রেখে কেঁ’দে যাচ্ছে। নাবিল মাথা তুলে দীপঙ্করের দিকে তাকায়। উর্বী তাদের সবাইকে নিশ্চুপ দেখতে থাকে। রাওনাফ মাথা তুলে তাকায় না, না কোনো জবাব দেয় দীপঙ্করের কথায়। সে মেঝের দিকে দৃষ্টি দিয়ে চুপচাপ বসেই থাকে।

চলমান…..

আরেকটি বার পর্ব-৩২

0

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৩২
#Esrat_Ety

উর্বী স্তব্ধ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। সে বুঝতে পারছে না সে কি করবে।
উচ্ছাস হাতের সিগারেটটা ফেলে পা দিয়ে পিষে দেয়, তারপর উর্বীর দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,”তোমার স্বামীর বাড়িটা চমৎকার। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মা’লদার পার্টি। এখন বুঝতে পারছি,এই সুখ,এই স্বাচ্ছন্দ্য রেখে যেতে ইচ্ছে হয়না তাইনা?”

উর্বী থরথর করে কাঁপছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। উচ্ছাস বাঁকা হাসি দিয়ে বলে,”আমি বেকার তো কি হয়েছে! আমার বাবারও তো অনেক টাকা! সবকিছু আমার। এর থেকে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য পাবে তুমি!”

উর্বী কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”তুমি এখানে!”

_হ্যা আমি। তোমাকে নিতে এলাম। চলো।
ঠান্ডা গলায় বলে উচ্ছাস।

উর্বী ভীত কন্ঠে বলে,”চলে যাও তুমি দয়া করে।”
তারপর উচ্ছাসের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিতে যায়। উচ্ছাস একহাত দিয়ে আটকায়,উর্বীর দিকে তাকি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। উর্বী অসহায়ের মতো শুধু এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তার দৃষ্টি এলোমেলো। ভয়াবহ বিপদের আশঙ্কা করে তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে।

শর্মী একবার তার আন্টির দিকে তাকায়, একবার উচ্ছাসের দিকে। কে এই লোক? আন্টি এমন করছে কেনো!

উচ্ছাস ধীরপায়ে সদর দরজা পেরিয়ে ঘরে ঢুকে পরে। উর্বী আ’ত’ঙ্কি’ত হয়ে বলে,”তুমি চলে যাও। প্লিজ চলে যাও। এখানে কিছু বাড়াবাড়ি করো না। আমার সুখের সংসার টা নষ্ট করে দিও না উচ্ছাস।”

উচ্ছাস উর্বীর দিকে এগিয়ে আসে। উর্বীর পা থেকে মাথা অবধি তাকায়। তারপর বলে,”কে কীট? কাকে কীট বলেছিলে সেদিন ফোনে? আমি কীট? এখন তবে কীটের মতোই আচরণ করবো!”

উর্বী কিছু না বলে হাতের ফোনটার দিকে তাকায়। এরমধ্যে ইলেক্ট্রেসিটি চলে আসে। উর্বী একপলক উচ্ছাসের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে রাওনাফের নাম্বার ডায়াল করে। উচ্ছাস ফোনটা কেড়ে নিয়ে আছাড় মে’রে ফোনটা ফ্লোরে ফেলে দেয়।

উর্বী মুখ চেপে ধরে তাকিয়ে থাকে সেদিকে, তারপর উচ্ছাসের দিকে তাকায়। উচ্ছাসের শীতল দৃষ্টি তার ভেতরটা নাড়িয়ে দিচ্ছে।

শর্মী চেঁ’চি’য়ে বলে ওঠে,”এই কে আপনি! আপনি আন্টির সাথে এমন করছেন কেনো। অভদ্র লোক কোথাকার। বেরিয়ে যান আমাদের বাড়ি থেকে।”

উচ্ছাস শর্মীর দিকে তাকায়, তারপর তাচ্ছিল্য মাখা হাঁসি দিয়ে উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমার পাতানো মেয়ে!”

শর্মী চেঁ’চি’য়ে বলতে থাকে,”বেড়িয়ে যান বলছি! আপনি জানেন আমার পাপা কে?”

উচ্ছাস হাসে। কিছুক্ষণ হেসে উর্বীর দিকে কঠিন দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে বলে,” চলো। ভালোয় ভালোয় বলছি।”

উর্বী পিছু এগোতে থাকে। মাথা নাড়িয়ে আ’ত’ঙ্কি’ত গলায় বলে,”দয়া করো,চলে যাও। আমি বিবাহিতা উচ্ছাস! আমি আমার স্বামীকে ভালোবাসি।”

উর্বী কথাটা শেষ করতে না করতেই উচ্ছাস এসে উর্বীর গলা চেপে ধরে। শর্মী ভয় পেয়ে “দাদু” বলে বিকট চিৎকার দেয়।

রওশান আরা মোনাজাতে ছিলেন। মোনাজাত শেষ করতেই শর্মীর চিতকার শুনে সে জায়নামাজ রেখে উঠে দাঁড়ায়।
নিচে শর্মী চেঁচাচ্ছে। তড়িঘড়ি করে রওশান আরা ঘর থেকে বেরিয়ে সিড়ির কাছে এসে দাঁড়ায়, নিচে তাকাতেই সে হতভম্ব হয়ে যায়। বৌমাকে কেউ গলা চেপে ধরেছে।
শর্মী ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে।

রওশান আরা দ্রুত সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকে। উচ্ছাসের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলতে থাকে,
“এই ছেলে কে তুমি? আমার বৌমাকে মা’রছো কেনো? এই ,ছাড়ো। আমি এক্ষুনি পু’লি’শকে ফোন করবো।”

উচ্ছাস উর্বীকে ছাড়েনা, দাঁতে দাঁত চেপে উর্বীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,”স্বামীকে ভালোবাসি,স্বামীকে ভালোবাসি,স্বামীকে ভালোবাসি। সেই এক কথা! একেবারে জানে শেষ করে ফেলবো।”

উর্বীর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। উচ্ছাসের হাত থেকে ছাড়া পেতে প্রানপন চেষ্টা করছে সে। রওশান আরা ছুটে এসে উর্বীকে উচ্ছাসের হাত থেকে ছাড়াতে যায়। বৃদ্ধা শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি ব্যায় করেও পারছে না। উচ্ছাস হিং’স্রতার সাথে রওশান আরাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। রওশান আরা সোফার উপর গিয়ে পরে। সোফার হাতলে কপালে বারি খেয়ে কপাল কে’টে যায় তার। মৃদু আর্তনাদ করে ওঠে রওশান আরা।

উর্বী উচ্ছাসের থেকে নিজেকে কোনোমতে ছাড়িয়ে নিয়ে “মা” বলে বি’কট চিৎকার দিয়ে রওশান আরার দিকে ছুটে যায়।

হাঁটু গেড়ে বসে কাঁদতে কাঁদতে বলে,”মা আপনার কষ্ট হচ্ছে?”

শর্মী মুখে হাত চেপে ডুকরে কেঁদে ওঠে। উর্বী উচ্ছাসের দিকে ঘৃণামিশ্রিত দৃষ্টি দিয়ে তাকায়। উচ্ছাস সেই দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে এসে উর্বীর চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে সদর দরজার দিকে নিতে চায়, চেঁ’চি’য়ে বলতে থাকে,”চল! চল আমার সাথে। বেশি বাড়াবাড়ি করবি তো আমিও বাড়াবাড়ি করে দেবো ।”

রওশান আরা কপালে হাত চেপে কাঁতরাতে কাঁতরাতে শর্মীকে বলে,”দাদু শিগগির তোমার পাপাকে ফোন দাও। শিগগিরই!”

শর্মী তাই করে, মেঝে থেকে ফোনটা উঠিয়ে রাওনাফের নাম্বার ডায়াল করে, রাওনাফ ফোন রিসিভ করে বলে “হ্যা মামনি বলো!”

শর্মী কেঁদে ওঠে,”পাপা।”

_কি হয়েছে মামনি??
রাওনাফের কন্ঠে উৎকণ্ঠা।

_একটা লোক বাড়িতে ঢুকে আন্টিকে মারছে। খুব মারছে আন্টিকে,জোর করে নিয়ে যেতে চাইছে।

_হোয়্যাট!
চেঁচিয়ে ওঠে রাওনাফ।

শর্মী আর কিছু বলার আগেই উচ্ছাস এসে শর্মীর হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে আবারও মেঝেতে ছুড়ে মেরে শর্মীকে সজোরে একটা চ’ড় মারে। শর্মী চ’ড়ের ধাক্কা সইতে না পেরে মেঝেতে পরে যায়।

উর্বী ছুটে এসে ওকে জরিয়ে ধরে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আম্মু তোমার লেগেছে? কোথায় লেগেছে!”

শর্মী গালে হাত চেপে উচ্ছাসের দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। তার মাথা ঝিমঝিম করছে।

উচ্ছাস উর্বীকে টানতে থাকে। উর্বী উঠে হাত বাড়িয়ে ছোটো টেবিলের ওপর থেকে একটা পেপার ওয়েট তুলে নেয়, ছুঁড়ে মা’রে উচ্ছাসের দিকে। উচ্ছাসের গায়ে পরলেও তাতে উচ্ছাসের কিচ্ছুটি হয়না। সে এসে আবারও উর্বীর চুলের মুঠি ধরে। উর্বী উচ্ছাসকে ধাক্কা দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে। তার গায়ে কোনো শক্তি খুজে পায়না সে। শরীরটা নিস্তেজ হয়ে পরছে।

উচ্ছাস উর্বীর পিছু পিছু ছুটে যায়। রওশান আরা বসে বসে কাতরাচ্ছে। খুব আহত হয়েছে সে। অতটুকু ধাক্কা তার বৃদ্ধ শরীরটাকে ঘায়েল করার জন্য যথেষ্ট।

শর্মী তার দাদুর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে ছুটে যায় দোতলায়।

মেঝেতে পরে থাকা ফোনে রাওনাফ ফোন দিয়েই যাচ্ছে। কেউ ফোন রিসিভ করছে না।

উর্বী তার ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। সে হাপাচ্ছে। সে এখন কি করবে ? সে বুঝে গিয়েছে উচ্ছাস তাকে ছাড়বে না। ও উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। উর্বী কি করবে এখন। শরীরটা তাকে আর সায় দিচ্ছে না, মেঝেতে লুটিয়ে পরে যেতে চাইছে শরীরটা।

উচ্ছাস দরজা ধাক্কাচ্ছে ! গলার স্বর এবার অত্যন্ত স্বাভাবিক করে বলে,
“পাখি। দরজা খোলো প্লিজ। দেখো এসব করে কোনো লাভ হবে না! আমি খালি হাতে ফিরে যেতে আসিনি আজ। এমন করো না, এতে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে। সোনা প্লিজ দরজা খোলো।”

উর্বী দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে কাঁদতে থাকে। উচ্ছাস দরজায় সজোরে লাথি মারতে থাকে। উর্বী কেঁপে কেঁপে উঠছে।

উচ্ছাস গলার স্বর পাল্টে পুনরায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে থাকে,”পাখি সেদিন তুমিই বোকামি করেছিলে পুলিশের কাছে আমার নাম না বলে। তোমার প্রত্যেকটা ভুলের শা’স্তি তুমি পাও। এতে আমার কি করার বলো? দরজা খোলো। ঠান্ডা মাথায় বলছি দরজা খোলো। চুপচাপ দু’জনে চলে যাবো। আমার পাখির বদনাম হোক এটা আমি চাই না। আমাকে খাটিও না। দরজা খোলো!”

উর্বী দরজায় ঠেস দিয়েই দাঁড়িয়ে থাকে। হাঁপাতে থাকে সে। পেটে হাত রেখে কাঁদতে থাকে সে।

রওশান আরা সিড়ির রেলিং ধরে ধরে কোনো মতে ওপরে ওঠে,শর্মী ছুটে এসে দাদুকে ধরে। রওশান আরা গিয়ে উচ্ছাসের হাত ধরে অনুরোধ করতে থাকে,
“বাবা তুমি দয়া করো,মেয়েটা অসুস্থ। তোমার ও তো মা বোন আছে। আমি বুড়ো মানুষ তোমার পায়ে পরছি। দয়া করো।”

উচ্ছাস সেকথা কানে নেয়না। সে দরজা ভাঙতে থাকে। রওশান আরা আহত,দুর্বল শরীরে উচ্ছাসকে টানছে। উচ্ছাস অগ্নিদৃষ্টিতে রওশান আরার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তার হাত ধরে টানতে টানতে পাশের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা বাইরে থেকে লক করে দেয়।

শর্মী ছুটে যায়। উচ্ছাস ঘুরে তার দিকে তাকাতেই শর্মী দমে যায়, থ’ম’কে দাঁড়িয়ে যায়। পা থেকে মাথা ঠকঠক করে কাঁপছে তার।

উচ্ছাস এসে পুনরায় উর্বীর ঘরের দরজায় লাথি দিতে থাকে।
শর্মী এক কোনায় জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে ভয়ে চুপসে গিয়েছে। চোখের পানি মুছে সে মনে মনে দোয়া করছে,”আল্লাহ আন্টিকে বাঁচিয়ে দাও। আমার আন্টিকে বাঁচিয়ে দাও।”

উচ্ছাস দরজা ভেঙে ফেলে। সিটকিনি ভেঙে দরজা খুলে যায়।

উর্বী চ’মকে ওঠে,ঘুরে উচ্ছাসের দিকে তাকিয়ে কেঁদে দিয়ে বলে,”প্লিজ উচ্ছাস। আমি আমার স্বামীকে ভালোবাসি। প্লিজ উচ্ছাস।”

উচ্ছাস এসে আবারও উর্বীর চুলের মুঠি ধরে, দাঁত খিচিয়ে বলে,”চরিত্রহীনা মেয়ে! যখন মন চাইবে জীবনে আসবি,যখন মন চাইবে চলে যাবি তাইনা? ভেবেছিস কি তুই? শোন,যেটা উচ্ছাসের সেটা উচ্ছাসেরই। একদম মে’রে ফেলবো! আমার না হলে একদম মে’রে ফেলবো। চিনিস তো আমাকে তুই বল! চিনিস না?”

উর্বী নিজেকে ছাড়াতে প্রানপন চেষ্টা করছে। উচ্ছাস উর্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে খানিকটা সদয় হয়। চুলের মুঠি ছেড়ে দিয়ে বলে,”সরি পাখি। দেখো তোমাকে আবার ব্যাথা দিয়ে ফেললাম। কতো খারাপ আমি। আচ্ছা আর করবো না এমন। এবার লক্ষি মেয়ের মতো চলো চুপচাপ। আচ্ছা আমি ছুয়েছি বলে তুমি এখনও রাগ করে আছো তাইতো? এই প্রমিজ করছি,এভাবে কখনো তোমাকে কষ্ট দেবো না। কখনো না।”

উর্বী কাঁদছে, বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। পালাবার পথ খুঁজছে। তারপর হুট করে উচ্ছাসকে ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে দরজার দিকে যেতে নিলে উচ্ছাস উর্বীর শাড়ির আঁচল টেনে ধরে। উর্বী পারেনা সামনে পা বাড়াতে। অসহায়ের মতো এদিক ওদিক তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দরজার পাশের টেবিলের ওপর থেকে ফুলদানি টা উঠিয়ে ছুড়ে মারে উচ্ছাসের দিকে। কিন্তু উচ্ছাসের গাঁয়ে লাগে না। উচ্ছাস ক্ষে’পে গিয়ে উর্বীকে টেনে নিজের কাছে এনে সজোরে একটা চ’ড় মারে।

উর্বী নিচে পরে যায়। উচ্ছাস উর্বীর চুল ধরে উঠিয়ে আবার একটা চড় মারে। উর্বীর ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরতে থাকে। এভাবে মারতেই থাকে উচ্ছাস। আর হিংস্র হয়ে বলতে থাকে,”তেজ দেখাস আমার সাথে! তেজ! ফালতু মেয়ে।”

উর্বী আর সহ্য করতে না পেরে “আল্লাহ” বলে বিকট চিৎকার দেয়। উচ্ছাস তবুও থামছে না। রেগেমেগে আরো একটা চ’ড় মারতেই উর্বী ছোটো একটি সেন্টার টেবিলের উপরে পরে যায়। যার ফলে পেটে ভীষণ আঘাত পায় উর্বী। ব্যাথায় কঁকিয়ে ওঠে সে।

শর্মী ছুটে গিয়ে দরজা খুলে ফ্লোরে পরে থাকা রওশান আরাকে ধরে। চিৎকার দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,”ও দাদু। তুমি ওঠো না। আন্টিকে খুব মারছে।”

রওশান আরা হাপাচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,”তুমি গিয়ে ফোনটা আনো। ত্রিপল নাইনে ফোন দিতে হবে। যাও দাদু।”

রাওনাফ শেষ বারের মতো উর্বী,শর্মী,রওশান আরার ফোনে ফোন দিতে চেষ্টা করে,শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে পুলিশ স্টেশনে ফোন লাগায়। তার হাত কাঁপছে। বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে। সামিউল এখনও বাড়িতে ফেরেনি। রাওনাফ দ্রুত ওয়ালেট তুলে পকেটে রাখে, অনলাইনে রাজশাহী টু ঢাকা প্লেনের টিকিট কেটে অন্তরাকে ডাকতে থাকে। অন্তরা ছুটে আসে । রাওনাফ লম্বা লম্বা পা ফেলে ফ্ল্যাটের সদর দরজার কাছে যেতে যেতে বলে,”আমি ঢাকা ফিরছি। ন’টা বিশে ফ্লাইট।”

_এই রাতে ভাইয়া!
অবাক হয় অন্তরা।

_ইটস আর্জেন্ট!
গলা কাঁপছে রাওনাফের। মস্তিস্ক কাজ করছে না তার। রুদ্ধশ্বাসে বেরিয়ে যায় ফ্ল্যাট থেকে,যেতে যেতে সবার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে থাকে সে।

উচ্ছাস উর্বীর যন্ত্রনায় নীল হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে থেমে যায় ‌। তারপর ক্ষণবাদেই এসে চুলের মুঠি ধরে, উর্বী উচ্ছাসের দিকে তাকিয়ে হাত জোর করে বলতে থাকে,”উচ্ছাস তুমি আমাকে এভাবে মেরো না,আমি মা হতে চলেছি উচ্ছাস,তুমি আমাকে এভাবে মেরো না।”

উচ্ছাস উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। উর্বী কাঁদছে, কাঁপছে, হাপাচ্ছে। ধীরে ধীরে উচ্ছাস উর্বীর চুলের মুঠি থেকে হাত সরিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”কি বললে!”

উর্বী ফুঁপিয়ে উঠে আঁটকে আঁটকে বলে,”আমি প্রেগনেন্ট।”

উচ্ছাস উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। উর্বী তার দিকে তাকিয়ে কাঁদছে, কেঁদে কেঁদে বলছে,”বাচ্চাটাকে অন্তত দয়া করো তুমি। তোমার দোহাই লাগে।”

উচ্ছাস কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উর্বীর পাশে বসে পরে। সে তার উর্বীকে দেখছে। তার উর্বী অন্য কারো বাচ্চার মা হতে যাচ্ছে!

উর্বী বলে,”চলে যাও তুমি উচ্ছাস। ছেড়ে দাও আমায়। আমাকে বাঁচতে দাও। বাচ্চাটাকে বাঁচতে দাও।”

উচ্ছাস একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বাঁকা হাসি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর উর্বীর হাত ধরে, এবং আবারও উর্বীর হাত ধরে টানতে থাকে, এবং অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় বলে,”সমস্যা নেই,তোর এই ভুলটাও ক্ষমা করলাম। এই আবর্জনা ন’ষ্ট করে ফেলবো আমরা।চল।”

উর্বী আহত চোখে উচ্ছাসের দিকে তাকায়। ঘৃণা মিশ্রিত কন্ঠে চেঁ’চি’য়ে বলে,”উচ্ছাস!”

উচ্ছাস উর্বীর দিকে তাকায়, দাঁত খিচিয়ে বলে,
_কেনো? বাচ্চা ন’ষ্ট করিসনি এর আগে? এটাও করবি । আমার বাচ্চা এ্যা’ব’র্শন করে এখন পরপুরুষের বাচ্চা পেটে নিয়ে বসে আছিস। চরিত্রহীনা মেয়ে।

একটু থেমে উচ্ছাস বলে,”এটা ন’ষ্ট করবি। তোকে বিয়ে করবো, তারপর যতগুলো বাচ্চা লাগবে তোর,দেবো। চল।”

উর্বী জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। শরীর তাকে আর কতক্ষন সাপোর্ট দেবে বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে এক্ষুনি সে পরে যাবে।

রওশান আরা নিজের ঘরে গিয়ে ফোন হাতরে খুজে বের করে ট্রিপল নাইনে ফোন দেয়। তাকে তার বৌমাকে বাঁচাতে হবে।

তারপর ঘর থেকে সে বেরিয়ে দেখে উচ্ছাস উর্বীকে টেনে হিচড়ে ঘর থেকে বের করছে।
উর্বী কেঁদে যাচ্ছে। কেঁদে কেঁদে আল্লাহ কে ডাকছে,”আল্লাহ আমার বাচ্চাটার যেনো কোনো ক্ষতি না হয়।”
উচ্ছাস তা শুনেও শুনছে না। হিং’স্রতা সবটুকু সে দেখিয়ে দিচ্ছে। বলিষ্ঠ হাতে দুর্বল উর্বীকে টানছে।

শর্মী গিয়ে তার আন্টিকে ছাড়াতে চায়। উচ্ছাসের শক্তির সাথে সে পেরে ওঠে না। রওশান আরাও যায়। তাকে আবারো উচ্ছাস ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।

এভাবে কিছুক্ষণ তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হতে থাকে।

ধস্তাধস্তি করতে করতে উর্বীকে উচ্ছাস সিঁড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসে।
শর্মী এসে আকরে ধরে থাকে উর্বী কে। সে কাঁদছে উর্বীকে আকরে ধরে। উর্বীর মাথা ঘুরছে, চোখের সামনে সবকিছু প্রায় ঘোলাটে দেখছে। শর্মী হঠাৎ উচ্ছাসের হাত খামচে ধরে তার হাত কামড়ে দেয়। এক পর্যায়ে উচ্ছাস শর্মীকে ধা’ক্কা মে’রে ফেলে দেয়। শর্মী টাল সামলাতে না পেরে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পরে। উর্বী আর্তনাদ করে উঠে তাকিয়ে থাকে নিচের দিকে। অতো উঁচু সিঁড়ি দিয়ে পরে যাওয়ায় শর্মী মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেয়ে সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে যায়।
উর্বী বিকট চিৎকার দিয়ে ওঠে,”শর্মী” বলে।
রওশান আরা “দাদু” বলে কান্নায় ভেঙে পরে।

উর্বী উচ্ছাসকে ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছে, চেঁ’চি’য়ে বলছে,”আল্লাহ তুমি আমার মেয়েটার কোনো ক্ষতি হতে দিওনা, আল্লাহ।”

রওশান আরাও নামছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে।

উর্বী শর্মীকে এসে ধরে। শর্মীর মাথার পেছনের দিক থেকে রক্ত ঝরছে। উর্বী শর্মীর রক্তাক্ত মাথাটা কোলে রেখে তরপাতে থাকে ‌। সে যেনো গলা কাটা মুরগী। গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে কাঁদতে থাকে। যেন তার কন্ঠনালী ছিঁড়ে যেতে চাইছে।

রওশান আরা রক্ত দেখে ধপ করে বসে পরেন। আল্লাহ তার মাসুম নাতনি টিকে এতো কষ্ট দিতে পারলেন!

চলমান….

আরেকটি বার পর্ব-৩১

0

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৩১
#Esrat_Ety

রাওনাফের বুক থেকে মাথা তুলে উর্বী বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকায় তার মুখের দিকে। রাওনাফ ফোন নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। উর্বী তার হাত থেকে ফোন টা কেড়ে নিয়ে দূরে রেখে আবারও রাওনাফের দিকে তাকায় । রাওনাফ হেসে ফেলে। উর্বী বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে আবারও শুয়ে পরে। রাওনাফ উর্বীর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম গলায় জানতে চায়,”শরীরটা এখন ঠিক লাগছে?”

উর্বী অস্ফুট স্বরে বলে,”হু।”

রাওনাফ বলতে থাকে,”তোমার বয়স মনে হচ্ছে আরো কমে গিয়েছে। অনেক রোগা লাগছে। খাচ্ছো ঠিক ভাবে?”

_হ্যা খাচ্ছি, সব খাচ্ছি,পানি খাচ্ছি, আনারের জুস খাচ্ছি……

রাওনাফ মৃদু হাসে। তারপর বলে,”আগামীকাল আমাকে রাজশাহী যেতে হবে। ওখানকার ম্যানেজমেন্টে একটু ঝামেলা হয়েছে। সামিউল একা সামলাতে পারছে না।”

_ঠিক আছে যাবেন!

দু’জনেই চুপ। রাওনাফ হঠাৎ বলে ওঠে,”কিছু বলতে চাও হাঁসের ছানা?”

উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়। সে কিছু বলতে চায় তা রাওনাফ কিভাবে বুঝলো!
নিচু স্বরে বলে,”চাই।”

রাওনাফ বলে,”বলে ফেলো। তবে ও বাড়ি যাওয়ার কথা বলো না। কারন মা মানবে না। মা রোজার মাসে বাড়ির বৌকে কখনো বাড়ি থেকে যেতে দেননা কোথাও, মায়ের সব অদ্ভুত নিয়মের মধ্যে এটাও অন্যতম। আজ পর্যন্ত মায়ের সাথে এই বিষয়ে তর্ক করে পারিনি। আজও হয়তো পারবো না। এক কাজ করবো,আমি রাজশাহী থেকে ফিরে এলে ঈদের শপিং করে ও বাড়ির জন্য পাঠাবো তখন না হয় যেও।”

উর্বী বলে,”ওবাড়ি যাওয়ার কথা বলতে চাচ্ছি না। আমার কোথাও যাওয়ার আগ্রহ নেই।”

_তাহলে কি? বলো?

উর্বী চুপ হয়ে যায়, কিছু সময় চুপ থেকে বলে,”আপনি রাজশাহী থেকে আসুন। তারপর বলবো।”

_চাকরী করতে চাও?

উর্বী বিরক্ত হয়। ইচ্ছে করছে বলে দিতে “তার মধ্যে ছোটো রাওনাফ এসেছে” । কিন্তু এখনি সে বলবে না। সে অপেক্ষা করছে দশ তারিখের। সেদিন রাওনাফের জন্মদিন। সে ঠিক করেছে সেদিনই বলবে। দুদিন অনুভূতি গুলো সে একাই সামলাক।

রাওনাফ বলতে থাকে,”কি হলো! চাকরী করতে চাও?”

_না।

_তাহলে কি চাও! আজ বিকেলে শর্মী শায়মী দুজন অনলাইনে দু’টো ড্রেস দেখিয়ে বললো তারা ঈদে নিতে চায়। তুমিও কি সেরকম কিছু চাও? কোনো এক্সপেনসিভ শাড়ি বা….

উর্বী মহাবিরক্ত হয়ে উঠে বসে, মুখে চ কারন্ত শব্দ করে বলে,”থামবেন আপনি? আমি বলতে চেয়েছি আমি ঘুমাতে চাই ব্যস! ”

উর্বী ওপাশ ফিরে শুয়ে পরে। রাওনাফ বোকার মতো তাকিয়ে আছে। খানিক বাদে উর্বী উঠে বসে। একপলক রাওনাফের দিকে তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে ছুটে ওয়াশরুমে ঢুকে হরহর করে বমি করে দেয়।
রাওনাফ উর্বীর পিছু পিছু গিয়ে উর্বীকে আগলে ধরে। এক হাতে উর্বীকে জরিয়ে রেখে অন্যহাতে উর্বীর কপাল চেপে ধরে,যাতে উর্বী মাথা ঘুরে পরে না যায়। উর্বী চোখে মুখে পানি দিয়ে হাপাচ্ছে। পুরোপুরি নেতিয়ে পরেছে সে। রাওনাফ শক্ত করে ধরে রাখে উর্বীকে, বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”গ্যাস প্রবলেম! এখন এসবের সাথেও বন্ধুত্ব করে ফেলেছো দেখছি।”

উর্বী অবাক হয়ে রাওনাফের মুখের দিকে তাকায়। আচ্ছা এতো লক্ষন দেখেও রাওনাফের মনে কোনো প্রশ্ন জাগছে না? কেমন সব বুঝেও না বোঝার ভান ধরে আছে। বিষয়টা পুরোপুরি এড়িয়ে যেতে চাইছে যেন! যেহেতু ডাক্তার,একটু হলেও তো বোঝার কথা উর্বীকে দেখেই। তাতে তো টেস্ট রিপোর্টের প্রয়োজন পরেনা। এ কি আদৌও ডাক্তার? এ পাশ করলো কিভাবে এমবিবিএস? নকল করে?

উর্বী পিটপিট করে তাকাচ্ছে। রাওনাফ দু্র্বল উর্বীকে কোলে তুলে নেয়, উর্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি হাঁসের ছানা হলেও তোমার ওজন হাঁসের একটা পালকের মতো।”

উর্বী কথা বলে না। সে গাঁয়ে কোনো জোর খুঁজে পাচ্ছে না। বমি করে শরীরের সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। উর্বীকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রাওনাফ ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত দেড়টা বেজে গিয়েছে প্রায়।

বিছানায় শুয়ে উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বলে,”আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না ডাক্তার। এখনই বলে দিতে ইচ্ছে করছে আমি আপনার সন্তানের মা হতে যাচ্ছি! দেখতে ইচ্ছে করছে আপনি কতটা খুশি হন,নাকি আদৌও হন না।”

রাওনাফ ওযু করে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতে দাঁড়িয়ে যায়।

উর্বী সেদিকে তাকিয়ে দেখছে। তার চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। পেটে একটা হাত রেখে একটা গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে দেয় সে। মনে মনে প্রার্থনা করে,যেই আসুক,এই লোকটার মতো কেউ আসুক।

কিছু সময় পরেই উর্বী ঘুমিয়ে যায়। রাওনাফ নামাজ আদায় করে টুপিটা কাবার্ডে রেখে বিছানায় একপাশে এসে বসে। তার দৃষ্টি ঘুমন্ত উর্বীর মুখের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রাওনাফ আনমনে হেসে ফেলে। ধীরে ধীরে হাতটা উর্বীর পেটে রেখে তার মুখের দিকে তাকায়,মনে মনে বলে ওঠে,”লুকোচুরি খেলছো আমার সাথে মৃদুলা উর্বী। তুমি বোকা উর্বী হতে পারো আমিতো বোকা ডাক্তার নই!”

হাত টা সরিয়ে পুনরায় উর্বীর মুখের দিকে তাকায়। কপালের কাছে এলোমেলো হয়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দীর্ঘসময় ধরে একটা চুমু খায় সে।
তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”পিতৃত্ব সবসময় একই রকমের আনন্দ দেয় মৃদুলা উর্বী, নির্ভেজাল,স্বর্গীয় সুখানুভূতি। হয়তো বয়স ভেদে অনূভুতি প্রকাশের ধরণ আলাদা হয়। এই ব্যাপার গুলো তোমার কাছে বোধগম্য হবে না বোকা উর্বী। টিপিক্যাল ইমোশনাল ফুল!”

উর্বীর গায়ে চাদর টেনে রাওনাফ পাশে শুয়ে পরে। তাকিয়ে থাকে উর্বীর ঘুমন্ত মুখের দিকে ।
উর্বীকে দেখেই সে কিছুটা আন্দাজ করেছিলো সকালে। তারপর সন্ধ্যায় যখন সেমিনার থেকে ফিরলো তখন হসপিটালের রেডিওলজি বিভাগের প্রধান রাওনাফকে কংগ্রাচুলেট করে। রাওনাফের আর জানতে বাকি নেই তার জীবনে নতুন কারো আগমনের খবর,
এ তার বাচ্চা,তার অংশ !

সে বুঝতে পারছে না এতো কেন লুকোচুরি করছে উর্বী বিষয়টা নিয়ে! নাকি উর্বী ভাবছে রাওনাফ খুশি হবে না। উর্বী কি করে জানবে পিতৃত্বের অনূভুতি কিরকম হয়, এই পৃথিবীতে যে প্রানীগুলো বাবা হয়েছে শুধু তারাই জানবে।
রাওনাফ দেখতে চায় উর্বী কবে জানায়,কিভাবে জানায় খবরটা। তার মন যা চাইছে করুক, স্বভাবে এতোটা বাচ্চামো মিশে আছে, অদ্ভুত মহিলা।

শিমালার কথা মনে পরে যায় রাওনাফের, প্রেগ’ন্যা’ন্সির কথা রাওনাফকে জানাতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলো। উর্বী কি করবে! রাওনাফও দেখতে চায়, অপেক্ষা করছে সে। দুদিন লুকোচুরি চলুক! তার ধেরে খুকি বৌ নিজের ইমোশনকে নিজে টর্চার করুক দুদিন।

****
ঘন্টা খানেকের জন্য চোখের পাতা লেগেছিল রাওনাফের। তারপর শুনতে পায় পাশের মসজিদে বলছে,”সেহরি খাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে।”

উঠে বসে উর্বীর দিকে তাকায়। ক্লান্ত শরীরটা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ডাকতে ইচ্ছে করছে না তবু মৃদু আওয়াজে ডাকে,”উর্বী ওঠো।”

তিনবারের বার ডাকতেই উর্বী ধরফরিয়ে উঠে বসে, উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে, “দেরী হয়ে গিয়েছে! আজান দিয়ে দিয়েছে!”

_না,অনেক সময় হাতে।

উর্বী চোখ ডলতে ডলতে বিছানা থেকে নামে। ওয়াশরুম থেকে ওযু করে বেরিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে যায়। সিঁড়ি দিয়ে একপ্রকার ছুটতে ছুটতে নামছিলো। রাওনাফ পেছন থেকে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”ধীরে। এখানে কোনো দৌড় প্রতিযোগিতা হচ্ছে না।”

উর্বী পায়ের গতি কমিয়ে দেয়। পরমুহূর্তেই মনে পরে তাকে তো এখন থেকে এভাবে হাঁটলে চলবে না। সে এবার বেশ পা টিপে টিপে নামতে থাকে। যেনো কোনো শব্দও না হয় মেঝেতে। রাওনাফ উর্বীর এহেন কান্ড দেখে পেছনে নিশ্চুপ হাসতে থাকে।

রাওনাফ করীমের তিনছানা ইতিমধ্যেই সেহরি খেতে টেবিলে বসে গিয়েছে। শর্মীর চোখ থেকে ঘুম এখনও কাটেনি। সে টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছে। শায়মী বারবার হাই তুলছে। রাওনাফ এগিয়ে যায়। শায়মীর দিকে তাকিয়ে বলে,”এখন একটু ওড়নাটা মাথায় তুলে দাও মামনী।”

শায়মী পাপার কথায় লাজুক হেসে মাথা ঢাকে। শর্মীও মাথা তুলে ওড়না পেঁচিয়ে দেয় মাথায়।
রওশান আরাও অসুস্থ শরীর নিয়ে এসেছেন নিচে সেহরি খেতে। উর্বী তাকে দেখে বলে,”মা আপনি কেন নামতে গেলেন। আমি খাবারটা ঘরে দিয়ে আসতাম।”

রওশান আরা হেসে বলে,”এই একটা বেলা ছেলে,বৌ,নাতী নাতনি নিয়ে খেতে বসা হয়। ইফতার তো রাওনাফ বাইরেই করে।”

উর্বী এগিয়ে যায় রান্নাঘরে। রওশান আরা বলতে থাকে,”কি একটা ঝামেলায় পরতে হলো। আমীরুনের বাবা অসুস্থ খুব। দু-চারদিনে মনে হয়না ফিরবে। একটা বিশ্বস্ত লোকও পাচ্ছি না বাড়িতে রাখবো। সময়-অসময়ের কাজ সব বৌমাকে একাই করতে হয়।”

রাওনাফ চেয়ারে না বসে কিচেনের দিকে এগিয়ে যায়। উর্বী তাকে দেখে অবাক হয়ে বলে,”এখানে কেন এলেন! যান গিয়ে বসুন। আমি সব গরম করে নিয়ে আসছি।”

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে উর্বীর হাত থেকে বাটি টেনে নিয়ে বলে,”তুমি গিয়ে বসো। আমি নিয়ে আসছি!”

উর্বী অস্ফুট স্বরে বলে,”আপনি….”

_যাও।
রাওনাফ উর্বীকে থামিয়ে দিয়ে বলে। উর্বী চুপ চাপ এসে চেয়ার টেনে বসে। তারপর রাওনাফকে দেখতে থাকে। রওশান আরা একবার উর্বীকে দেখে, একবার রাওনাফকে। তার তিন ছেলেই বৌয়ের প্রতি যত্নশীল। এসব কখনও তার জীবনে ছিলো না ‌। নিজের না পাওয়া সব কিছু তার ছেলের বৌয়েরা পাচ্ছে এটা তাকে আনন্দ দেয়।

****
সকালেই রাওনাফ বেরিয়েছে রাজশাহী যাবে বলে, যাওয়ার আগে উর্বীর গালে হাত রেখে বলেছে,”নিজের খেয়াল রেখো।”
রাওনাফের বলার ধরণটা আজ অন্যরকম লেগেছে, প্রতিদিনের মতো নয়।

উর্বীর মনটা খুব অস্থির লাগছে সকাল থেকে। শারীরিক কোনো যন্ত্রনা নেই কিন্তু মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই। ও বাড়িতে ফোন দিয়ে মায়ের খবর জেনেছে। লুৎফুন্নাহার ভালোই আছেন। তবুও অস্থিরতা কাটছে না।

রোজার দিনে দুপুর বেলা সচারচর হাতে কোনো কাজ থাকেনা। কিছুক্ষণ কোরআন তিলাওয়াত করে উর্বী উঠে দাঁড়ায়,ওরা তিন ভাইবোন বাড়িতেই আছে,প্রত্যেকের স্কুল কলেজ বন্ধ অথচ কারো টু শব্দটিও নেই। সবাইকে খুঁজতে খুঁজতে উর্বী তাদের শর্মী শায়মীর ঘরে পেয়ে যায়। তিনমাথা এক হয়ে বসে ফোনে কিছু একটা দেখছিলো। উর্বীর পায়ের শব্দ পেয়ে প্রত্যেকে মাথা তুলে তাকায়। উর্বী বলে,”কি হচ্ছে এখানে?”

শায়মী বলে,”আমরা প্ল্যান করছি!”

_কিসের প্ল্যান?
উর্বী অবাক হয়ে জানতে চায়। তারপর গিয়ে ওদের মুখোমুখি বসে। শায়মী বলতে থাকে,”দশ তারিখ পাপার বার্থডে তাই তার জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে গিফট কিনবো। সারপ্রাইজ দেবো পাপাকে।”

শর্মী ফোনটা উর্বীর কাছে নিয়ে এসে বলে,”আন্টি দেখো। এটা ভালো হবে না?”

উর্বী ফোনের স্ক্রিন তাকায়। একটা রিস্ট ওয়াচের ছবি।
শর্মী বলতে থাকে,”এটা আমি দেবো। পাপার অনেক ঘড়ির কালেকশন আছে। এটা হবে সবচেয়ে ইউনিক।”

উর্বী মাথা নাড়িয়ে বলে,”হ্যা। এটা সুন্দর।”

তারপর শায়মী নাবিলের দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমরা কি দেবে সারপ্রাইজ?”

শায়মী হেসে বলে,”আমাদেরটা এখন বলবো না। ওটা শুধু পাপার জন্য না,সবার জন্য সারপ্রাইজ!”

তারপর উর্বীকে প্রশ্ন করে,”তুমি কি দেবে আন্টি?”

উর্বী শায়মীর দিকে তাকায়। বলে,”কি দেবো?”

_সারপ্রাইজ দেবে না?

উর্বী ম্লান হাসে। সারপ্রাইজ তো সেও দেবে। অনেক বড় একটা সারপ্রাইজ।

শায়মী বলে,”কি হলো আন্টি! কিছু দেবে না?”

উর্বী হাসে, অস্ফুট স্বরে বলে,”দেবো।”

_কি দেবে?

উর্বী মাথা নেড়ে বলে,”এখন বলা যাবে না,তোমরাও পরে জানবে। দশ তারিখ”

শর্মী বলে,”অনেক বড় একটা সারপ্রাইজ!”

উর্বী লজ্জামাখা মুখে মাথা নাড়ায়। প্রসঙ্গ পালটে বলে,”আজ না তোমাদের সুমনা আপার বাড়িতে ইফতার পার্টিতে যাওয়ার কথা? যাবে না?”

শায়মী বলে,”যাবো। খালামনি গাড়ি পাঠিয়ে দেবে বলেছে। দুপুরের পর যাবো।”

_আজ রাতে ফিরবে না?

_না। আগামী পরশু ফিরবো। পাপার কাছ থেকে পারমিশন নিয়েছে খালামনি।

দুপুরের পরে শায়মী আর নাবিল চলে যায় সুমনাদের বাড়িতে। থেকে যায় শর্মী। হঠাৎ করে সে তার সিদ্ধান্ত পালটে ফেলেছে। তার নাকি যেতে ইচ্ছে করছে না।

****
রওশান আরা তার পুত্রবধুকে দেখছেন। দেখছেন বলতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন। উর্বী মাথায় ঘোমটা দিয়ে ইফতারি তৈরি করছে।
রওশান আরা তাকে দেখতে থাকে। লক্ষন দেখে তো তার সন্দেহই সত্যি বলে মনে হচ্ছে। বুড়ো তো এমনিই হয়নি সে। মেয়েদের এসব সে বুঝতে পারে। উর্বীকে কি জিজ্ঞেস করবে? না যদি লজ্জা পেয়ে যায়? সেরকম কিছু হলে তো সে জানবেই।
রওশান আরা দোয়া করতে থাকে। তার সন্দেহ যেনো সত্যি হয় ‌। তাহলে তার চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হবেনা।
উর্বী কাজ করতে করতে তার শাশুড়ির দিকে তাকায়। রওশান আরা চোখ নামিয়ে নেয়।
বলে,”হয়েছে? এতো বেশি আইটেম করতে হবে না। আমরা তো মোট তিনজন মানুষ। আর কিছু তৈরি করো না।”

উর্বী মাথা নাড়ায়। পরক্ষনেই দৌড়ে বেসিনের কাছে গিয়ে বমি করতে থাকে।
রওশান আরা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখ খুশিতে চকচক করছে। তার সন্দেহ সত্যিই মনে হচ্ছে!

****
সারাদিনে আজ ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পরলেও সন্ধ্যার পর থেকে মুশলধারে পরছে।
ইফতারের পরে রওশান আরা উর্বীর ঘরে ঢুকে দেখে সে কোরআন পাঠ করছে। সে খাটে মুগ্ধ হয়ে বসে তিলাওয়াত শোনে। যদিও কিছু কিছু জায়গায় উচ্চারণ কিছুটা ভুল হচ্ছে।

রওশান আরা উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটার প্রতি তার এতো মায়া কাজ করে কেনো! অবশ্য সে তা সবসময় বুঝতে না দেওয়ার চেষ্টা করে। বেশি লাই পেলে বৌ মানুষ নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু সে জানে উর্বী নষ্ট হয়ে যাওয়ার মেয়ে নয়।

উর্বী কোরআন পাঠ শেষ করে রওশান আরার দিকে তাকায়।
“মা কিছু লাগবে?”

_না,তোমাকে দেখতে এলাম। তোমার শরীর এখন কেমন?

_ভালো মা। শর্মী কোথায় মা?

_শর্মী ঘরে। পড়ছে।

উর্বী উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে,”ওকে কিছু একটা বানিয়ে দেই মিষ্টি টাইপের। ইফতারের সময় বললো খেতে ইচ্ছে করছে নাকি।”
রওশান আরা উর্বীকে থামিয়ে দেয়। বলে,

“ও ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম বের করে খেয়ে নিয়েছে। তুমি বসো।”

উর্বী বসে।
রওশান আরা বলে,”কোনো অসুবিধা হলে আমায় জানাবে। তোমার স্বামী ডাক্তার হোক শত,মেয়েদের সমস্যা মেয়েরাই ভালো বুঝবে। আমি তোমার মায়ের মতোই।”
রওশান আরা ঘর থেকে বের হতে যায়। উর্বী নিচু স্বরে ডাকে,”মা।”

রওশান আরা উর্বীর মুখের দিকে তাকায়। উর্বী কিছুটা সময় নিয়ে মাথা নিচু করে অত্যন্ত মৃদু স্বরে বলে,”আপনি আবারও দাদু হতে যাচ্ছেন মা।”

রওশান আরার ইচ্ছা করছে সে খুশিতে একটা চিৎকার দেবে। কিন্তু সে নিজেকে সামলে নেয়।
উর্বী মাথা উঠায় না। তার ভীষণ লজ্জা লাগছে।

রওশান আরা গলার স্বর অত্যন্ত স্বাভাবিক রেখে বলে,”আলহামদুলিল্লাহ। রাওনাফ জানে? ওকে জানিয়েছো? ”

উর্বী মাথা নাড়ায়। সে জানায়নি। মুখে বলে,”রাজশাহী থেকে ফিরলে জানাবো।”
রওশান আরা বলে,”ঠিক আছে। বিশ্রাম নাও।”

রওশান আরা উর্বীর ঘর থেকে বের হয়। তার ইচ্ছে করছে কিছুক্ষণ নাচতে। এতো সুখ। এতো আনন্দ সে কই রাখবে? বাড়িতে আবারো ছোট্টোসোনা আসবে। এই বাড়িটা তো আলোয় আলোয় ভরে যাচ্ছে!

***

উচ্ছাস গাড়িতে বসে আছে। সজীব ছাতা হাতে গাড়ির দরজায় টোকা দেয়। উচ্ছাস গাড়ির জানালার কাচ নামিয়ে দেয়।

সে বলে,”সব ঠিক আছে? দেখেছিস ভালো করে?”

“হু সব ক্লিয়ার। দাড়োয়ান টা তার কোয়ার্টারে শুয়ে ঝিমুচ্ছে। ড্রাইভার বাড়িতে। উর্বীর স্বামীকে রাজশাহী পৌঁছে দিয়ে দুদিনের ছুটি নিয়েছে।

উচ্ছাস বাঁকা হাসি হাসে। এতো সুযোগ একেবারে পেয়ে গেলো সে।

সজীব বলে,”ভাই।”

“হু।”
_ভাই আরেকবার ভেবে দেখেন। যে কাজটা করবেন তাতে কিন্তু…….। আগের বার একটুর জন্য বেঁচে গেছিলেন।”

উচ্ছাস সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলে,”আগের বার বেয়াদবটার প্রতি মায়া দেখিয়ে সফল হতে পারিনি, এইবার তা হবে না। উর্বী না আসলে ওর লা’শ নিয়ে ফিরবো আমি। তুই এখানে বসে থাক, বিপদ দেখলেই সংকেত দিবি। কোনো ভুল হলে তোকে আগে মা’রবো।”

সজীব মাথা নাড়ায়,”আচ্ছা ভাই। ভাই একটা কথা বলবো?”

“হু।”
_ভাই দাড়োয়ান বুড়ো মানুষ। তারে তেমন কিছু করবেন না। তার কাছ থেকেই তো সব খবরাখবর নিতাম ‌। বড্ড সরল,আলাভোলা। সে ছাড়া তার দুই মেয়েকে দেখার কেউ নাই।

উচ্ছাস সিগারেট ফেলে দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পরে। সজীব গাড়িতে উঠে বসে। তার হাত পা কাঁপছে।

উচ্ছাস ধীরে ধীরে রওশান মঞ্জিলের দিকে এগিয়ে যায়। সে নিজেও জানে না সে আগুন নিয়ে খেলছে যার পরিনতি ভয়াবহ।

****

রাওনাফের ফোন এসেছে। উর্বী ফোনটা রিসিভ করে। ওপাশ থেকে

রাওনাফের গলা,”কি করছো?”

_কিছু না। আপনি কি করছেন।

_এইতো ইফতার করে বিশ্রাম নিচ্ছি।

_কি কি দিয়ে ইফতার করা হলো?

_অনেক কিছু। অন্তরা এতো এতো আইটেম বানিয়ে দেয় সামনে। লোভে পড়ে খেয়ে ফেলেছি।

_ওরা ভালো আছে?
_হ্যা। তুমি বলো, তোমার শরীরের কি অবস্থা?

_ভালো।
উর্বী অস্ফুট স্বরে জবাব দিয়ে চুপ করে থাকে। রাওনাফ ডাকে,”উর্বী!”

“হু।”

_আসার সময় কিছু একটা বলতে চেয়েছিলে,বলোনি। এখন বলো।

কথাটা বলে রাওনাফ মিটিমিটি হাসছে। সে জানে উর্বী কখনোই ফোনে বলবে না কথাটা।

উর্বী বলে,”পরে বলবো। এখন থাক।”

_না বলো।

_বললাম না পরে বলবো।

_ও বাড়ি যেতে মন চাইছে? বলেছিলাম সেদিন কদিনের জন্য গিয়ে ঘুরে এসো। সেদিন শোনোনি, এখন মা যেতে দেবেন? আচ্ছা মন খারাপ করো না,আমি মাকে বুঝিয়ে বলবো।

উর্বী মনে মনে হাঁসে। বলে,
“আচ্ছা পরে দেখা যাবে।”

_শর্মী কি করছে? ও কেন যায়নি? সুমনা আমাকে ফোন দিয়ে নালিশ জানালো ওর নামে।

উর্বী হেসে বলে,”মিড টার্মের রেজাল্ট নিয়ে চিন্তিত বেশ। এবারও যদি আপনাকে হতাশ করে তাই ফাইনালের জন্য তৈরি করছে নিজেকে। ইফতার করেই পড়তে বসেছে।”

হঠাৎ বাড়িতে লোডশেডিং হয়। উর্বী চ’ম’কে ওঠে।

পাশের ঘর থেকে শর্মী চেঁচিয়ে ওঠে।
রাওনাফ ফোনের ওপাশ থেকে বলে,”শর্মীর কি হলো! ও কেন চেঁচালো?”

_লোডশেডিং হয়েছে। তাই বোধ হয় ভয় পেয়েছে। আমি রাখছি। ফিরে এসে ফোন করছি।

উর্বী কল কেটে ফোনের ফ্ল্যাশলাইট অন করে।

****
শর্মী “আন্টি” বলে চেঁচাতে থাকে।
সে অন্ধকার ভয় পায়।

পুরো বাড়ি অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। জেনারেটর চালু থাকা সত্ত্বেও কিভাবে পুরো বাড়ি বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো উর্বী সেটাই বুঝতে পারছে না! জেনারেটর রুমে কাকে পাঠাবে এখন!

উর্বী তাড়াতাড়ি শর্মীর রুমে যায়।

“আন্টি ঘর অন্ধকার হয়ে গেলো কেনো?”
উর্বীকে দেখে চেঁচাতে থাকে শর্মী।

_তা তো জানি না। হয়তো কোনো সমস্যা হয়েছে। জেনারেটর রুমে কাকে পাঠাবো এখন!

উর্বী দাড়োয়ান চাচাকে ফোন দিতে থাকে। কেউ ফোন ধরছে না।

উর্বী আর শর্মী ঘর থেকে বেরিয়ে রওশান আরার ঘরে যায়। রওশান আরা তারাবির নামাজ আদায় করছে। তারা সেখান থেকে বেরিয়ে নিচে নামে। এই বৃষ্টিতে দাড়োয়ান চাচার কোয়ার্টারে যাওয়া সম্ভব না।

ছাতা নিলেও ভিজে যেতে হবে। উর্বী আবারো দাড়োয়ানকে ফোন দিতে থাকে। কেউ ফোন ধরে না।

উর্বী তখন একটা ছাতা নিয়ে বের হবার সিদ্ধান্ত নেয়। এই আধো অন্ধকারে বসে থাকার চেয়ে একটু কষ্ট করা ভালো।

উর্বী হাতে ছাতা আর ফোনটা নিয়ে সদর দরজার দিকে যায়। শর্মী বলে,”কোথায় যাচ্ছো আন্টি?”

_আমি আসছি। তুমি বসো। তোমার আসতে হবে না। ভিজে যাবে।

কথাটি বলেই উর্বী সদর দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলতেই সে শিউরে ওঠে। দরজার ওপাশে উচ্ছাস দাঁড়িয়ে। তার মুখ হাসি হাসি।

চলমান……

আরেকটি বার পর্ব-৩০

0

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৩০
#Esrat_Ety

নাবিল এসে দরজার বাইরে দাঁড়ায়। সে প্রচন্ড দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছে। তারপর খানিকটা সময় নিয়ে নিচু স্বরে বলে,”আসবো আন্টি!”

উর্বী অবাক হয়ে ঘুরে তাকায়। দরজার বাইরে নাবিলকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,”এসো।”

নাবিল ভেতরে ঢোকে। নাবিলের পিছু পিছু ঢোকে শায়মী। উর্বী দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। নাবিল ধীরপায়ে এগিয়ে আসে। উর্বীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিনয়ী সুরে বলে ওঠে,”থ্যাংকস আন্টি!”

উর্বী কিছু বুঝতে পারছে না। সে বোকার মতো শায়মীর দিকে তাকায়। শায়মী এসে উর্বীকে জরিয়ে ধরে কেঁদে ফেলে,উর্বী উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”এই মেয়ে! কি হয়েছে! কাঁদছো কেন!”

শায়মী মুখ তুলে উর্বীর দিকে তাকায়। ফোপাতে ফোপাতে বলে,”লামু আন্টিকে ফোন দিয়েছিলাম আমি আর নাবিল। বলেছে লামু আন্টি! তোমার জন্য নাকি পাপার প্রবলেম সলভ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আন্টি বলেনি তুমি কি করেছো।”

অস্বস্তিতে উর্বীর মুখ ছেয়ে যায়। বাচ্চাগুলো কিভাবে টের পেলো এসব! উর্বী কিছু বলে ওঠার আগেই নাবিল বলে,”অনেক থ্যাংকস আন্টি!”

উর্বী নাবিলের দিকে তাকায়। অস্ফুট স্বরে বলে,”তোমরা…”

নাবিল মাথা নিচু করে ফেলে, তারপর বলে,”সকালে পাপা আর আপনার কথাগুলো আমি আর শায়মী শুনে ফেলেছিলাম।”

উর্বী চ’ম’কে ওঠে। চাঁপা স্বরে চেঁ’চি’য়ে বলে,”শর্মী!”

_ও কিছু জানে না। আর জানবেও না।

উর্বী ঘামছে! কি বিশ্রী একটা ব্যাপার ঘটে গেলো। মানুষটা যদি জানতে পারে এসব তাহলে খুব দুঃখ পাবে!

নাবিল বলে ওঠে,”আপনাকে থ্যাংকস জানাতে এসেছিলাম আন্টি। আপনি প্লিজ পাপাকে জানাবেন না আমরা জেনে গিয়েছি। প্লিজ আন্টি।”

শায়মী এগিয়ে এসে উর্বীর হাত ধরে বলে,”প্লিজ আন্টি! প্রমিজ করো।”

উর্বী কিছুক্ষণ বাচ্চাদুটোর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলে। তারপর বলে ওঠে,”আরো একটা সিক্রেট? তোমাদের তিন ভাইবোনের এতো এতো সিক্রেট পেটে জমা রাখতে রাখতে আমার পেটটা ফুলে গিয়েছে,আমি তো একদিন পেট ফে’টে ম’রে যাবো।”

নাবিল হেসে ফেলে। শায়মীও চোখের পানি মুছে উর্বীর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে।
তিনজনই হাসতে থাকে। এমন সময় রাওনাফ ঘরে ঢোকে। নাবিলকে উর্বী-শায়মীর সাথে হাসতে দেখে রাওনাফ রীতিমতো অবাক !

পাপাকে দেখে নাবিল শায়মী চুপ হয়ে যায়। তারপর “গুড নাইট পাপা” বলে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রাওনাফ সেদিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে উর্বীর দিকে তাকায়। তারপর ঘরের দরজা বন্ধ করতে করতে বলে,”কি নিয়ে হাসছিলে ওদের সাথে?”

উর্বী বলে,”কিছুনা,শর্মীকে নিয়ে হাসাহাসি করছিলো দুজন। আপনি কোথায় ছিলেন?”

_শর্মীর রুমে,ওর পড়া ধরতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি সে তুলতুলের সাথে আলাপচারিতায় ব্যস্ত। রীতিমতো ধমকাচ্ছে পাখিটাকে। ওকে শর্মী না ডেকে এখনও উর্বী কেন ডাকা হচ্ছে সেজন্য রাগ দেখাচ্ছে।

উর্বী হাসে। রাওনাফ বলে,”হাতে পায়ে বড় হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু একেবারে সেই ছোটো অবুঝ শর্মীই রয়ে গিয়েছে।”

উর্বী বলে,”দেখবেন আমাদের শর্মী অনেক ভালো মনের একটা মানুষ হবে। একেবারেই আলাদা হবে ও।”

রাওনাফ তাকায় উর্বীর দিকে। উর্বীর মুখে “আমাদের শর্মী” শব্দটা শুনে অদ্ভুত ভালোলাগায় মন ভরে যায় তার। এতো মায়া মায়া “আমাদের শর্মী” বলার ধরণটা! সত্যিই একমাত্র মেয়ে মানুষই পারে এভাবে মায়ায় জড়াতে।

উর্বী ঘরের জানালা বন্ধ করে দিতে দিতে বলে,”কিশোরের কি ব্যবস্থা করবেন? স্টেপ নিচ্ছেন না কেনো এখনও?”

রাওনাফ বলে,”হসপিটাল থেকে বের করা হয়েছে। আইনি পদক্ষেপ নিইনি কোনো।”

_ব্যস? এটুকুই?

রাওনাফ নিচুস্বরে বলে,”ওর ওয়াইফ অনা। আমরা একই ফ্রেন্ড সার্কেলের। সন্ধ্যায় আসলো। আমার পায়ে ধরা বাকি রেখেছে অনা মেয়েটা। আমি পারিনি কঠোর হতে উর্বী!”

উর্বী হাসে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে বলে,”জানতাম আমি। এরপর থেকে একটু কঠোর হবেন ডাক্তার! আজ তো শুনে এলাম হসপিটালে, আপনার নরম স্বভাবের ফায়দা ওঠায় অনেকেই। এই স্বভাবের জন্য আবার না কোনো বিপদে পরেন!”

রাওনাফ ম্লান হাসে। মজার ছলে বলে,”তুমি আছো যে। পরবো না।”

উর্বী আয়নায় রাওনাফের প্রতিবিম্বের দিকে তাকায়। রাওনাফ এগিয়ে যায়। পেছন থেকে উর্বীকে আগলে ধরে আয়নায় উর্বীর প্রতিবিম্বের দিকে তাকায়। উর্বী শিহরিত হয়,প্রজাপতিরা ডানা ঝাপটায়। রাওনাফ সন্তর্পনে উর্বীর নরম গালের সাথে নিজের রুক্ষ পুরুষালি গাল চেপে ধরে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,”হাঁসের ছানা।”

উর্বীর প্রজাপতি গুলো উড়তে শুরু করে। উর্বী মুখ ফুটে বলে না,কিন্তু রাওনাফের এই ডাকটা উর্বীকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় স্নিগ্ধ অনুভূতির সাগরে। রাওনাফ মাথা তুলে উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”আজ খুব ঘা’ব’ড়ে গিয়েছিলাম।”

উর্বী নরম গলায় বলে,”কিন্তু আমি ঘাবড়ে যাইনি। ভেবেছি হসপিটালে গিয়ে মেয়েটাকে চ’ড় থাপ্পড় মেরে সত্যিটা বের করবো কিন্তু হঠাৎ চোখে এ্যাপয়েনমেন্ট লেটার টা পরতেই মাথায় একটা অন্য প্ল্যান আসে। আমি একটুও ঘাবড়াইনি জানেন!”

রাওনাফ এক হাত দিয়ে উর্বীর ডান গাল আলতো করে ছুঁয়ে বলে,”আমি ভেবেছি স্ট্রেস নিতে না পেরে আবার তুমি জ্ঞান হারাও!”

কথাটি বলে রাওনাফ হাসে। উর্বীও হেসে ফেলে। উর্বী বলে,”হারালেও অসুবিধা নেই। ডাক্তার আছে যে।”

রাওনাফ উর্বীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,”হ্যাঁ। একজন পেশেন্ট এনে দিয়েছে রওশান আরা।”

_শুধু পেশেন্ট?
উর্বী নরম গলায় জানতে চায়। রাওনাফ মাথা নাড়ায়, উর্বীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,”একজন মৃদুলা উর্বী। মায়া মায়া। বড্ড আদুরে। হাঁসের ছানা।”

উর্বী চোখ বন্ধ করে ফেলে। রাওনাফ উর্বীর কোমর জড়িয়ে গালে চুমু খায় দীর্ঘসময় ধরে। উর্বী চোখ খোলে না। দু’জনের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস গভীর হয়। খানিক বাদে রাওনাফ বলে ওঠে,”মৃদুলা উর্বী। যাকে আমি পেয়েছি, ভুল করে। যে আমার কাছে আছে,এই উর্বী আর কারো কাছে নেই, কেউ পায়নি।”

উর্বী স্বামীকে আকরে ধরে তার বুকে মাথা ঠেকিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে বলে,”আর আমি ভাগ্যবতী, আরেকটি বার জীবনটা রঙিন হলো যার তার নয়, একজন শুদ্ধ পুরুষের স্পর্শে। যার স্পর্শে আমি শুদ্ধ হই। তখন আমার মনে হয়না কোনো কলঙ্ক আদৌও ছিলো এই শরীরে জানেন! মনে হয় জীবনটা এমনই ছিলো। এমনই। একটা পরিবার, মায়ের মতো একজন শাশুড়ি, নাবিল,শর্মী,শায়মীর মতো তিনটা চমৎকার ফুল যাদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই কিন্তু ওরা আমার জীবনে বিরাট ভূমিকা রাখছে যা অনস্বীকার্য। ওরা ভীষণ মায়া মায়া। আর আপনার মতো জীবনসঙ্গী,এতো যত্ন,একটু সময়,একটু আদর! জীবনটা খুব উপভোগ করছি আমি শর্মীর পাপা। সময়টা এখানেই থেমে যাক না। থেমে যাক! গোটা একটা জীবন উপভোগ করা বাকি আমার।”

রাওনাফ বলে ওঠে,”সময় থেমে যাবে বলছো? কি সর্বনাশ! আমার পেশেন্ট গুলোর কি হবে তাহলে!”

উর্বী হেসে ফেলে, তারপর বলে,”আমি আছি তো। আপনার পেশেন্ট।”

_হ্যা। যে কখনো কোনো ভিজিট দেয়না আমাকে।
মজার ছলে বলে রাওনাফ।

উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়। বলে,”কি ভিজিট দেবো আপনাকে? আপনিই তো আমাকে শুধু দিয়েছেন। আমি কি দেবো?”

_কি দিয়েছি আমি?

_স্বীকৃতি, পবিত্রতা, আর তিনটা ফুল। যাদের সুগন্ধে আমার জীবন পরিপূর্ণতা পাচ্ছে। জানেন আমার না মাঝে মাঝে মনে হয় ওরা আমারই, তেমন অধিকারবোধ দেখিয়ে ফেলি। আমি কি খুব বাড়াবাড়ি করে ফেলছি? স্বার্থপরতা করছি? অন্যায় করছি নাবিলের মাম্মার সাথে? তার স্বামীর ভাগ নিয়েছি এখন তার বাচ্চাগুলোর ভাগও পেতে চাচ্ছি,বেশি করে ফেলছি আমি? আমি খুব লোভী?

রাওনাফ কিছু বলে না। উর্বীকে জরিয়ে ধরে। উর্বী আর কথা বাড়ায় না, কিছুসময় পরে রাওনাফ বলে ওঠে,”তুমি লোভী নও। তুমি মায়াবী। মায়ায় বেঁধে ফেলছো সবাইকে।”

উর্বী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। অনুভূতি দেওয়া নেওয়ার চূড়ান্ত সময়ে উর্বীর খুব ইচ্ছে করলো রাওনাফকে বলতে,সে মা হতে চায়। সে চায় রাওনাফ-উর্বীর ভালোবাসার চিহ্ন পৃথিবীতে আসুক। উর্বীর পরিপূর্ণ জীবনটা আরো পরিপূর্ণতা পাক। কিন্তু উর্বী পারলো না বলতে,কিছু একটা তাকে আটকে দিলো। দ্বিধা হলো তার,সব দ্বিধা কাটিয়ে ওঠা যায়না। উর্বী ভাবলো,উর্বী হ্যাংলার মতো চাইবে না। না চাইতেও সব পাচ্ছে উর্বী। উর্বী চায় এই কথাটা রাওনাফই আগে বলুক। এমন যদি হয় রাওনাফ নিজেই চায় উর্বীর থেকে একটা বাচ্চা! সেদিন উর্বী ভীষণ খুশি হবে। উর্বী অপেক্ষা করতে চায়। উর্বী চায় সব অপ্রত্যাশিত সুখের মতো ঐ সুখটাও তার জীবনে আসুক।

ভাবতে ভাবতেই উর্বী টের পায় রাওনাফ তার দিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। উর্বী কিছু বলে ওঠার আগেই রাওনাফ অস্থির নিঃশ্বাস ফেলে নিচু স্বরে বলে,”সরি ইফ আই ইমব্যারেসড ইউ!”

উর্বী বিছানার চাদর খামচে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলে, উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে আটকে আটকে বলে ওঠে,”মোটেও না। এই ছোঁয়া আমাকে শুদ্ধ করে,স্বস্তি দেয়, অস্বস্তি কিংবা গ্লানি নয়। আপনি আমায় আদর করুন, শুদ্ধ করুন আমায় শর্মীর পাপা।”

****
চমৎকার প্রতিটা মুহূর্ত, চমৎকার প্রতিটা দিন, চমৎকার প্রতিটা সূর্যদয়, চমৎকার প্রতিটা সূর্যাস্ত। উর্বীর জীবনে যা ঘটছে সবকিছুই চমৎকার। এখানে কোনো গ্লানি নেই। আছে শুধু স্বস্তি,শান্তি,মায়া আর আদর।
প্রতিটা দিন উর্বী পরিপূর্ণ হয়,প্রতিটা দিন কাটে ভালোবাসায়, প্রাপ্তিতে।
সকাল বেলা রাওনাফের স্নেহমাখা পরশে ঘুম ভাঙে,ঘুমিয়ে পরে তারই আশ্লেষে-আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে, ডিপ্রেশনে ডোববার সুযোগ নেই তার,সে ডুবে থাকে রাওনাফের উন্মুক্ত বুকের মাঝে,রোজ রাতে। মাঝখানে সারাটাদিন কাটে ব্যস্ততায়। এই সংসার, রাওনাফ করীম খান নামের স্বচ্ছ ,যত্নশীল একজন লোক এবং তার তিনটা মিষ্টি ছানা। এদের নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত থাকে উর্বী। উর্বী যেমন রাওনাফ কিংবা তার তিনছানার কাছ থেকে মায়া পাচ্ছে। উর্বীও তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে সেগুলোর ঋণ শোধ করতে ।

কে’টে যায় দুমাস। এই দুই মাসে উর্বী আরো লোভী হয়ে উঠেছে। রাওনাফের তিনছানার প্রতি দিনকে দিন আরো দুর্বল হয়ে পরেছে। এই সুযোগটা অবশ্য ওরাই করে দিচ্ছে। নাবিল আগের মতো আর উর্বীকে এড়িয়ে চলে না,বেশ আন্তরিক। যেটুকু কথা বলে, খুবই বিনয়ী হয়ে বলে। একবার তো উর্বীর সাথে উর্বীর বাপের বাড়িতেও ঘুরে এসেছে ওরা তিন ভাইবোন।

উর্বী লোভী হচ্ছে সংসারের প্রতিও। প্রত্যেকটা জিনিস, আসবাবপত্র, দেওয়ালের ইটকে মায়ায় বেঁধে ফেলছে তার। সে চায় সবাই ওর মায়ায় পরুক।

রাওনাফ ইদানিং বেশ ব্যস্ত হয়ে পরেছে। রাত টুকু শুধু বাড়িতে কাটায়। সপ্তাহে এক রাত তো রাজশাহী যায়। সেখানে সামিউল অন্তরার জমজমাট সংসার, গুছিয়ে নিয়েছে সব, চট্টগ্রামে মোহনা-শাফিউলও ভীষণ ব্যস্ত নিজেদের সংসার নিয়ে। উর্বী ব্যস্ত তার জীবন নিয়ে, কাটাচ্ছে দিন এভাবে,আনন্দে।

আজ সকালটা উর্বীর জন্য খুব স্পেশাল। আজ রাওনাফ খানিকটা ফ্রি, অন্তত সকাল দশটা পর্যন্ত বাড়িতে থাকবে। একটু কথা বলা যাবে। এই সপ্তাহে রাওনাফ ভীষণ ব্যস্ত ছিলো। ঠিকঠাক ভাবে বসে দুটো কথা বলাই হয়ে ওঠে না। কাল রাতে উর্বী ঘুমিয়ে পরেছিলো তখন রাওনাফ এসেছে। সকালে রাওনাফই ফজরের ওয়াক্তে ঘুম থেকে তুলেছে উর্বীকে। ব্যস,কথা শুধু এটুকুই হচ্ছে।
বাইরের বাগানে রাওনাফ করীম খান এবং তার ছানাদের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। উর্বী তাদের রুমের বারান্দায় গিয়ে দৃষ্টি দেয় নিচে। এখন সকাল সাতটা, রাওনাফ আর তার বাচ্চারা বাগানে হাঁটাহাঁটি করছে,ঠিক হাঁটাহাঁটি নয়। কিছুক্ষণ ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করে বাগানে চা বিলাস করছে। উর্বী দাড়িয়ে দাড়িয়ে তাদের দেখছে। এদের বাবা-ছানাদের বন্ডিং-টা উর্বী খুব উপভোগ করে। যখন তারা একসাথে থাকে,উর্বী খুব কম সময়ই ঢুকে পরে এদের মাঝে।

সবাই কোনো একটা বিষয় নিয়ে খুব হাসাহাসি করছে। উর্বী চেঁ’চি’য়ে মজা করে বলে ওঠে,”ক্যান আই জয়েন?”

সবাই দোতলার বারান্দার দিকে তাকায়। শর্মী শায়মী চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”ইয়েস ইউ ক্যান! কাম!”

উর্বী হাসে। হাত নেড়ে বলে,”না। আমি কিচেনে যাচ্ছি। তোমরা এসো। খাবে।”

চুলে খোঁপা বেঁধে নিয়ে নিচতলায় নামতে থাকে উর্বী। হঠাৎ সে টের পায় তার মাথাটা সেই আগের মতো চক্কর দিয়ে উঠছে। এটা এই প্রথম না। পাঁচ-ছয়দিন ধরে বেশ খেয়াল করছে উর্বী। আগে যেমনটা হতো ঠিক সেরকম। হঠাৎ হঠাৎ মাথা ঘোরা।

রওশান আরা খাবার টেবিলে বসে চা খাচ্ছে। উর্বী শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়। ব্রেকফাস্ট তৈরি করে টেবিল সাজাতে না সাজাতেই রাওনাফেরা চলে আসে।

সবাইকে পরিবেশন করে দিয়ে উর্বী আবারও কিচেনে যায় একটু পায়েশ বেড়ে আনতে। আজ সে খুব শখ করে রেধেছিলো পায়েশ।

বাটিতে তুলে তাড়াহুড়ো করে ডাইনিং টেবিলের কাছে আসছিলো উর্বী।
হঠাৎ ঝনঝন শব্দ হতেই রাওনাফ মাথা তুলে তাকায়। পায়েশের বাটি ফ্লোরে টু’করো টু’করো হয়ে পরে আছে,পাশেই অচেতন অবস্থায় পরে আছে উর্বী।

রাওনাফ “উর্বী” বলে চেচিয়ে ওঠে,ছুটে যায় তার কাছে। শর্মী,শায়মী,নাবিলও ছুটে যায়।

****
উর্বীর জ্ঞান ফেরে খানিক বাদেই। টের পায় কেউ তার গাল স্পর্শ করে রেখেছে। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় সে। পুরো শরীর থেকে ঘাম বের হচ্ছে।
রাওনাফ তার দিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। ব্লাড প্রেশার চেক করে বলে,”খুবই খারাপ! খাওয়া দাওয়া করছো না ঠিকভাবে।”

ঘরের মধ্যে রওশান আরা,শর্মী,শায়মী, নাবিল, আমীরুন সবাই দাঁড়িয়ে আছে। সবার চেহারায় উদ্বিগ্নতার ছাপ স্পষ্ট। উর্বী খানিকটা অস্বস্তি বোধ করে। রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”ঠিক আছি আমি এখন। হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গিয়েছিলো। চিন্তা করবেন না। আপনি হসপিটালে যান।”

তারপর শর্মী শায়মী আর নাবিলের দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমাদের তো ক্লাসের টাইম হয়ে এসেছে। যাও।”

সবাই চলে যায়। রওশান আরা বসে আছে। উর্বী বলে,”মা আপনিও যান। নাস্তা করে নিন। যান।”

রওশান আরা চলে যায়। গিয়ে আমীরুনকে দিয়ে এক গ্লাস কমলার জুস পাঠিয়ে দেয়। আমীরুন রাওনাফের হাতে গ্লাসটা দিয়ে চলে যায়।

রাওনাফ উর্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। গ্লাসটা উর্বীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,”খেয়ে নাও!”

উর্বী গ্লাসটার দিকে তাকায়। তার রীতিমতো বমি পাচ্ছে। এমন অনুভূতি তার আরো একবার হয়েছিল। বহু আগে।

এ মাসের পিরিয়ড এখনও হয়নি। অবশ্য এটা উর্বীর কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার, তার পিরিয়ড অনিয়মিত। এ্যাবর্শনের পর থেকেই এমন হয়ে এসেছে। এজন্য অনেক গাইনী ডাক্তার দেখিয়েছে, কোনো লাভ হয়নি। রাওনাফকে বলে দেখবে? কিন্তু তারা তো এখনও কোনো প্ল্যান করেনি বেবির! রাওনাফই কখনও বেবির প্রসঙ্গ তোলেনি।

আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতেই রাওনাফ উর্বীর দু কাধ ধরে বলে ওঠে,”উর্বী!”

উর্বী তাকায়। রাওনাফ বলে,”আগামীকাল থেকে রোজা। এই শরীরে পারবে?”

উর্বী অবাক হয়ে বলে,”কেন পারবো না! আপনার কি আমাকে বাচ্চা মনে হয়!”

রাওনাফ হাসে,বলে,”মাঝে মাঝে মনে হয়। আচ্ছা আমি উঠছি। আজও ফিরতে দেরী হবে। সেমিনার আছে আমার। তারপর হসপিটালে যাবো। তবে সেহরির আগে ফিরবো। একসাথে সেহরি খাবো।”

উর্বী হাসে। রাওনাফ এগিয়ে উর্বীর গালে চুমু এঁকে দিয়ে বলে,”টেইক কেয়ার।”

রাওনাফ তাড়াহুড়ো করে চলে যায়। উর্বী তাকিয়ে আছে দরজার দিকে। এমন সময় তার ফোন বেজে ওঠে। যান্ত্রিক শব্দটা উর্বীকে বরাবর আতংকিত করে দেয়। কিন্তু যেহেতু এটা সম্পূর্ণ নতুন সিমকার্ড এবং রাওনাফ ব্যতীত অন্য কেউ নাম্বার টা জানে না তাই নিশ্চিন্তে রিসিভ করে অচেনা নাম্বারটা। কিন্তু ওপাশের পুরুষ কন্ঠটা তাকে মুহুর্তেই আতংকিত করে দেয়,উর্বী কাপা হাতে ফোনটা রেখে দিতে যাবে তখনই উচ্ছাস বলে ওঠে,”ফোন কাটবে না।”

উর্বী চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”তোমার লজ্জা নেই তাইনা? উচ্ছাস! আমি কিন্তু এবার আইনের সহায়তা নিতে বাধ্য হবো। সাবধান করে দিলাম তোমাকে!”

উচ্ছাস হাসে,হাসি থামিয়ে বলে,”বাপরে ছোটো পাখিটার দেখি খুব সাহস বেড়েছে! আইনের সহায়তা নেবে তুমি? কেস করবে আমার নামে? কি বলবে? আমি মার্ডারার,তোমাকে বিরক্ত করি! তারপর? তারপর কি হবে? উর্বী পৃথিবীর মানুষ যে জেনে যাবে , তোমার এক কুখ্যাত মার্ডারের সাথে সম্পর্ক ছিলো। শুধু সম্পর্ক না, গভীর সম্পর্ক! এতোটা গভীর যে তার বাচ্চা পর্যন্ত তোমার পেটে এসেছিলো। তখন কি হবে উর্বী সোনা? এলাকায় সবাই বলে বেরায় উর্বী রাজরানী হয়েছে। উর্বীর শশুরবাড়ির লোক খুব ভালোবাসে উর্বীকে। এসব শুনলে তো তারা তোমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে উর্বী! তাতে তো আমারই ভালো। কিছুদিন জেল খেটে বেরিয়ে তোমাকে বিয়ে করে নেবো, কাজটা অনেক সহজ হয়ে যাবে উর্বী। প্লিজ আমার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নাও,প্লিজ উর্বী।”

উর্বী চুপ করে থাকে,উচ্ছাস গলার স্বর পাল্টে বলে,”চরিত্রহীনা মেয়ে মানুষ। নতুন নতুন পুরুষ চাই না তোর? এজন্যই সেদিন আমার সাথে সম্পর্ক শেষ করেছিলি তাইনা? তোকে একবার বিয়ে করে নিই। তারপর দেখাবো তোকে অ’স’ভ্য মেয়ে। ”

_তুমি শুধু জঘন্য না। তুমি একটা কীট! একটা কীট তুমি।
চেঁ’চি’য়ে বলে উর্বী।

উচ্ছাস হাসছে। উর্বী ফোনটা কেটে সিমকার্ড বের করে ফোনটাকে দূরে ছুড়ে মারে। দেয়ালের সাথে বারি খেয়ে ফোনটা মেঝেতে পরে গিয়ে চুড়মার হয়ে যায়। এক দৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উর্বী উঠে দাঁড়ায়,সাথে সাথে মাথায় আবারও চক্কর দিয়ে ওঠে তার। ধপ করে বিছানার একপাশে বসে হাঁপাতে থাকে সে। তারপর ছুটে যায় বেসিনের কাছে।

****
দীর্ঘক্ষণ ধরে লামিয়ার কেবিনে বসে আছে উর্বী। রিপোর্ট গুলো নিয়ে লামিয়া এখনও ফেরেনি। উর্বীর খুবই অস্থির লাগছে। সকালে যখন প্রেগ’ন্যা’ন্সি টেস্ট কিট এনে টেস্ট করেছিলো তখন রিপোর্ট টা ব্লাইন্ড ছিলো, পজিটিভ নাকি নেগেটিভ উর্বী বুঝতে পারেনি। চলে এসেছে লামিয়ার কাছে।

কিছুক্ষণ পরে লামিয়া রিপোর্ট গুলো নিয়ে কেবিনে ঢোকে। উর্বী উঠে দাঁড়ায় তৎক্ষণাৎ। সে ভীষণ উত্তেজিত। লামিয়া হেসে বলে,”আরে বসো বসো।”

উর্বী বসে পরে, লামিয়া প্রফুল্ল চিত্তে বলে,”কংগ্রাচুলেশন ম্যাডাম! নতুন সদস্য আসছে খান বাড়িতে।”

উর্বীর কয়েক মুহূর্ত লাগলো প্রতিক্রিয়া দেখাতে। সে আনমনে তার পেটে হাত রাখে। এই অনুভূতি সে একা সামলাতে পারছে না। ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে রাওনাফকে জরিয়ে ধরতে।

লামিয়া বলতে থাকে,”রাওনাফ মহাখালী গিয়েছে সেমিনারে। দাঁড়াও ওকে ফোন করি।”

উর্বী লামিয়ার হাত ধরে। লামিয়া উর্বীর দিকে তাকায়। হেসে বলে,”কি? তুমি বলবে?”

উর্বী মাথা নাড়ায়। লামিয়া বলে,”সারপ্রাইজ?”

উর্বী মাথা নেড়ে হ্যা বলে। লামিয়া হেসে বলে,”হুম! ডাক্তারের বৌ আমার কাছে এসেছে প্রেগ’ন্যা’ন্সি টেস্ট করাতে তখনই বুঝেছি। ”

উর্বী চুপ করে থাকে, লামিয়া বলে,”ডিড ইউ প্ল্যানড্ ফর ইট?”

উর্বী মাথা নাড়ায়। লামিয়া হাসতে থাকে। উর্বী বলে,”হাসছেন কেন আপা?”

_হাসছি রাওনাফের কথা ভেবে। একটা বেবিও ও প্ল্যান করে নিতে পারলো না। হুট হাট হয়ে গেলো। আমার তো হাসিই থামছে না।

উর্বী মাথা নিচু করে বসে আছে‌। তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। কিভাবে কি হয়ে গেলো সে তো নিজেই জানে না!

লামিয়া হাসছে তো হাসছেই। উর্বী বলে,”আমিই ভুল করেছি হয়তো আপা।”

লামিয়া হাসি থামিয়ে বলে,”বেশ করেছো। তোমার এই ভুলটাকে আমি সাপোর্ট করছি। ইউ নো, তোমার বয়স বেড়ে যাচ্ছে আর আফটার থার্টি প্রেগ’ন্যা’ন্সি পিরিয়ডটা মেয়েদের জন্য বেশ রিস্কি আজকাল। খুব ভালো করেছো। ”

উর্বী চুপ করে থাকে। লামিয়া বলতে থাকে,”সারপ্রাইজ দিতে চাচ্ছো। অবশ্যই সারপ্রাইজ দেবে। ফার্স্ট বেবি নিয়ে মেয়েদের ইমোশন থাকে,আমি জানি। রাওনাফের এটা ফার্স্ট বেবি না হতে পারে,তোমার তো ফার্স্ট বেবি। তুমি তোমার ইচ্ছে মতো সেলিব্রেট করো।”

উর্বীর চোখ মুখ হঠাৎ বিষন্নতায় ছেয়ে যায়। লামিয়া বলে,”এই মেয়ে! কি হয়েছে?”

_আপা উনি কখনোই বেবির প্রসঙ্গ তোলেনি। কখনোই না। হতে পারে ওনার বেবি আছে তাই আর আগ্রহ নেই এসবে। যদি এমন টা হয় তাহলে আমি ভীষণ কষ্ট পাবো!

লামিয়া বিরক্ত হয়, বিরক্তি নিয়েই বলে,”এসব কোন ধরণের কথা? তুমি জানো রাওনাফকে? ও ভীষণ খুশি হবে! শিমালার বেলায় দেখেছি তো। পারলে তো ও বেবি গুলোকে নিজের ভেতর ক্যারি করতো নয় মাস।”

উর্বী ভাবে,শিমালা আর সে তো এক না! তাই ওরকম রিয়্যাক্ট কিভাবে আশা করে উর্বী। যেখানে কখনো রাওনাফ উর্বীকে বলেওনি সে উর্বীর থেকে বাচ্চা চায়। যদি এমনটা হয়,যে রাওনাফের বাচ্চা আছে বলে উর্বীর থেকে আর বাচ্চা চাইনা তার তাহলে সেদিন উর্বী চরম অসম্মানিত হবে। বাবা হবার খবর শুনলে রাওনাফ নিশ্চয়ই খুশি হবে,তবে উর্বী দেখবে রাওনাফের প্রতিক্রিয়ায় ধরণ। যদি উর্বী বিন্দুমাত্র টের পায় রাওনাফের আদৌও কোনো আগ্রহ ছিলো না তাহলে উর্বী ভীষণ কষ্ট পাবে ভীষণ!

চলমান…..

আরেকটি বার পর্ব-২৯

0

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_২৯
#Esrat_Ety

অনবরত হাঁচি দিয়েই যাচ্ছে উর্বী। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে রাওনাফ করীম খানের তিন ছানা এখনও ঠিকঠাক আছে অথচ তার মতো একটা ধেরে মহিলা বাড়িতে পা রাখতে না রাখতেই হাঁচি দিতে শুরু করেছে। উর্বী প্রচন্ড বিরক্ত। ভেজা শাড়ি পাল্টে কাবার্ড থেকে একটা কম্ফোর্টার বের করে গাঁয়ে জরিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে। রীতিমতো কাঁপছে সে। আজ ডাক্তার তাকে এভাবে দেখলে শাস্তি হিসেবে ঘর থেকে বের করে দেবে নির্ঘাত। রাত তখন ক’টা উর্বী জানে না। রাওনাফ ফোন ধরেনি এবং এখনও ফেরেনি দেখে খানিকটা বিচলিতও উর্বী।

কিছুক্ষণ ওভাবে বসে থাকার পর হুট করে সে শুয়ে পরতে চাইলো তখনই বাইরে থেকে রাওনাফের গাড়ির হর্ন বেজে ওঠে। বৃষ্টির শব্দেও স্পষ্ট শুনতে পেলো উর্বী।

উর্বী দুমিনিট বসে থেকে উঠে দাঁড়ায়। চেষ্টা করে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার। রাওনাফের সামনে হাঁচি দেওয়া যাবে না।

রাওনাফ ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত শরীরটা নিয়ে ধীরপায়ে ঘরে ঢোকে। তার পুরো শরীর ভেজা।
উর্বী ঘুরে রাওনাফের দিকে তাকাতেই ধাক্কার মতো খায়। রাওনাফের বিধ্বস্ত মুখটা দেখে মুহূর্তেই অস্থিরতায় ছেয়ে যায় তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত। এগিয়ে যায় সে,কন্ঠে উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”ভিজেছেন কিভাবে গাড়ি থাকতে? এতো রাত হলো কেন?”

রাওনাফ একপলক উর্বীর চোখের দিকে তাকায়। উর্বীর কথার জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকে। উর্বী একটা তোয়ালে এনে রাওনাফের মাথা মুছিয়ে দিতে দিতে বলে,”বললেন না বৃষ্টিতে ভিজলেন কিভাবে? বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছিলো তাহলে আমাদের সাথে জয়েন করতেন।”

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। উর্বী মাথা মোছানো থামিয়ে দিয়ে রাওনাফের চোখে চোখ রাখে। তারপর বলে,”কি হলো! কথা বলছেন না কেন? এতো দেরি হলো কেনো বলুন!”

এবার মুখ খোলে রাওনাফ, অস্ফুট স্বরে বলে,”হসপিটাল থেকে বেরিয়ে নাবিলের দাদা বাড়ি গিয়েছিলাম একটু।”

উর্বী অবাক হয়ে বলে,”সেখানে কি? হঠাৎ নাবিলের দাদাবাড়ি কি মনে করে?”

_সেখানে নাবিলের মাম্মার কবর।

রাওনাফের কথায় উর্বী রাওনাফের চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। সে টের পেলো মানুষটা ঠিক নেই,হয় মানুষটা অসুস্থ নয়তো মন খারাপ। আরো একটা ব্যাপার ঘটতে পারে। আত্মগ্লানিতে ভুগতে পারে লোকটা।
আত্মগ্লানির কথাটা ভেবে উর্বীর মনটা হঠাৎ বিষন্নতায় ছেয়ে যায়। যতোই নিজেকে নিজে বোঝাক,উর্বী এটা কখনো মানতেই পারবে না তার আর রাওনাফের সম্পর্কটা নিয়ে রাওনাফ এখনও মাঝে মাঝে গ্লানিতে ভোগে। কারন যেখানে উর্বীই প্রচন্ড শ্রদ্ধা করে শিমালাকে, রাওনাফ শিমালার সম্পর্ককে। উর্বী তো শিমালার স্থান নয়, চায় রাওনাফের জীবনে আলাদা তার স্থান। যেটা সে টের পায়, রাওনাফ দিয়েছে। তবে এখন কেন মনে হচ্ছে রাওনাফ আত্মগ্লানিতে ভুগছে!

উর্বী সরাসরি জানতে চেয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,”পোশাক পাল্টে নিন। আমি বিছানা ঠিক করছি।”

রাওনাফ ফ্রেশ হয়ে বের হয়। উর্বীর মন খচখচ করছে। সে কিছু বলার আগেই রাওনাফ বিছানার ওপর ধপ করে বসে পরে। উর্বীর ভালো লাগছে না। শান্ত মানুষটাকে কেমন অস্থির লাগছে। সে এগিয়ে যায়। রাওনাফের সামনে দাঁড়ায়। রাওনাফ মুখ তুলে তাকায়। উর্বী বলে ওঠে,”বলবেন না তো কি হয়েছে?”

রাওনাফ ধীরে ধীরে উর্বীর একটা হাত ধরে। তারপর বলে,”তুমি আমাকে ভুল বুঝবে না তো উর্বী।”

উর্বী অবাক হয়, অবাক ভঙ্গিতেই বলে,”ওমা কিসব বোকার মতো কথা এগুলো। ভুল বুঝবো কেন!”

রাওনাফ একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে বলে,”আমার নামে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের অভিযোগ তুলেছে আমার হসপিটালের এক জুনিয়র নার্স। কাল তদন্ত হবে।”

উর্বীর মনে হলো সে এইমাত্র তার জীবনের সবচেয়ে কুৎসিত কথাটা শুনে ফেলেছে। তার কান ঝাঝিয়ে উঠেছে,পুরো শরীর ঝিমঝিম করছে। তার ইচ্ছে করছে সামনের লোকটাকে অনেক বাজে কথা শুনিয়ে দিতে তার সাথে এমন জঘন্য একটা মজা করার জন্য। সে নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলে,”ছিঃ এসব কোন ধরনের মজা!”

রাওনাফ উর্বীর দু’টো হাত আগলে ধরে, মাথা নিচু করে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,”সত্যি উর্বী। উর্বী আমি শেষ। আমার নামের পাশে চরিত্রহীন ট্যাগ লেগে গেছে। আমি চরিত্রহীন নই।”

উর্বী বোকার মতো রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাওনাফ বসে থেকেই নিজের মাথা ঠেকিয়ে দেয় উর্বীর গায়ে। উর্বী আগলে ধরে রাওনাফকে,যদিও তার নিজের শরীর কাঁপছে। রাওনাফের চুলের মধ্যে উর্বীর হাতের আঙুল বিচরণ করছে,আলতো করে মাথাটা ধরে নিজের শরীরের সাথে মিশিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। রাওনাফ বাচ্চাদের মতো গুটি পাকিয়ে বসে থাকে। বলতে থাকে,”খুব বাজে ভাবে আহত আমি উর্বী। আমি অমন নই। নই আমি অমন।”

“চুপ করবেন আপনি।”
চাপা স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে উর্বী। রাওনাফ চুপ হয়ে যায়। উর্বী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”একটা লোক,যে কোনো বৈধ দাবি নিয়েও আমাকে ছুঁয়ে দেখেনি দীর্ঘ সময়, নিজের পুরুষ মনের চাহিদাকে প্রশ্রয় দেয়নি‌। তার চরিত্রের স্বচ্ছতা নিয়ে আমার অন্তত কোন সন্দেহ নেই।”

_উর্বী আজকের পর সবার সন্দেহ থাকবে। আমি নির্দোষ প্রমাণিত হবার আগেই মস্তিষ্কে গেঁথে গিয়েছে এটা সবার উর্বী। রাওনাফ করীম খান হয়তোবা চরিত্রহীন। নয়তো একটা মেয়ে শুধু শুধু মিথ্যা বলবে কেন!

_চুপ আমি আর কিছু শুনতে চাচ্ছি না,পারছি না আমি শুনতে।

উর্বী রাওনাফকে নিজের থেকে আলগা করে ধীরে ধীরে তার রুক্ষ পুরুষালি দুই গাল নিজের নরম দু’টো হাতে আগলে ধরে বলে,”ঘুমিয়ে পরুন আপনি। ঐ উপরে যিনি রয়েছেন তার ওপরে ভরসা আছে আমার। তিনি আর যাই করুক,এই মানুষটাকে অন্তত লাঞ্চিত করবে না, আর কারো কথা জানি না, তবে রাওনাফ করীম নামের স্বচ্ছ একজন পুরুষকে নিয়ে তার অন্তত এই পরিকল্পনা নেই! আপনি ভেঙে পরবেন না।”

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী এদিক ওদিক এলোমেলো দৃষ্টি দিচ্ছে। যে মানুষটা সবসময় উর্বীর হৃদয় প্রশান্ত করা কথা বলে আজ তার বিক্ষিপ্ত হৃদয় কিভাবে প্রশান্ত করবে উর্বী? কিভাবে শোধ করবে সে ঋণ?

উর্বী জোর করে রাওনাফকে টেনে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। জোর করতে গিয়ে সে আবিষ্কার করলো নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অন্য এক উর্বীকে। উর্বী পাশে শুয়ে খামখেয়ালি নিজের মাথাটা রাওনাফের বুকে রাখে। রাওনাফ নির্লিপ্ত হয়ে শুয়ে থাকে, খানিকবাদে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”ছেলে মেয়ে গুলো বড় হচ্ছে উর্বী! আমি কিভাবে ওদের ফেস করবো! লোকজন,সবাই হাসবে উর্বী!”

উর্বী রাওনাফের একটা হাত আকরে ধরে নরম গলায় বলে,”সেদিন রাতে আপনি আমায় কি বলেছিলেন? বলেছিলেন,”উর্বী পুরো পৃথিবীর কাছে নিজেকে স্বচ্ছ প্রমান করার দায় তোমার নেই! যদি তোমার কাছের মানুষগুলো তোমাকে নিয়ে খুশি থাকে, তোমার ওপর বিশ্বাস থাকে!”
এটাই বলেছিলেন না? তো হোক জানাজানি! আপনার কোনো দায় নেই প্রমান করার নিজেকে। আমি জানি আপনি কে, নাবিলের মা জেনে গিয়েছে আপনি কি, আপনার মা জানেন আপনি কি, আপনার ছেলেমেয়েরা জানে আপনি কি!”

রাওনাফ কোনো জবাব দেয়না। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেয় শুধু। উর্বী বুঝে যায় এসব কথায় এই মানুষটার মন শান্ত হবে না। সে চুপ হয়ে যায়। দু’চোখের কার্নিশ ভিজে ওঠে তার। তার জীবনেই একটার পর একটা ঝ’ড় উঠছে! এর শেষ কখন হবে!

রাওনাফকে আকরে ধরে উর্বী। আলিঙ্গন দৃঢ় হয়। কোমল কন্ঠে বলে ওঠে,”কিছুই হবে না কাল! আপনি আমায় খুলে বলুন তো, কোন মেয়েটা? ঐ মেয়েটা যাকে আপনি চাকরি দিতে যাচ্ছিলেন?”

রাওনাফ মৃদু আওয়াজে বলে,”হু।”

_চাকরী দিতে যাচ্ছিলেন কেন!

_উর্বী সেদিন রাতে মেয়েটি এমনভাবে ভেঙে পরেছিলো,আমাকে বললো প্রয়োজনে আমার সাথে রাত কাটাতে রাজি তবু যেন ওকে চাকরি থেকে বের না করি। আমার খুব মায়া হলো, ভাবলাম কতটা অসহায় হলে এমন কথা ভাবতে পারে একটি মেয়ে!

উর্বী চুপ হয়ে যায়। রাওনাফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে ওঠে,”অন্তত এই ব্যাপারে গোটা পৃথিবীকে ফেস করার মতো মানসিক শক্তি আমার নেই উর্বী! সত্যিই নেই!”

সে রাতে দুজনের একজনও দু’চোখের পাতা এক করেনি। শুধু ফেলে গেছে দীর্ঘশ্বাস। রাওনাফের অস্থিরতা স্থির থাকতে দেয়নি উর্বীকে। ছটফট করেছে সে সারারাত। মানুষটার এই ভঙ্গুর দশা উর্বীর কাম্য নয়। সে জেনে এসেছে অন্য রাওনাফকে, সে চায় অন্য রাওনাফকে,যে রাওনাফ উর্বীর অস্থিরতা কমিয়ে দেয়, দুঃখ ভুলিয়ে দেয়।

ফজরের আজান দিলে উর্বী সাথে সাথে উঠে বসে। এ কদিনে রাওনাফ উর্বীর অভ্যাস বদলে দিয়েছে। হাত ধরে টেনে উঠিয়ে দেয়, কখনো বা আগলে নিয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,”উঠবে না হাসের ছানা?” উর্বী অলস হয়ে পরে থাকেনা ফজরের ওয়াক্তে। উঠে নামাজ আদায় করে নেয়।

আজ উঠে সে রাওনাফের দিকে তাকায়। আজ যেনো রাওনাফ নির্লিপ্ত। উর্বী কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার হাতের ওপর হাত রেখে মৃদু আওয়াজে বলে,”আজান দিয়েছে শর্মীর পাপা!”

রাওনাফ তার দিকে তাকায়। দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থেকে কন্ঠে আক্ষেপ নিয়ে বলে,”আমি এভাবে লাঞ্চিত হতে পারবোনা উর্বী।”

_আল্লাহ পরীক্ষা নিচ্ছেন। আপনি উঠুন। দয়া করুন।

***
ব্রেকফাস্ট টেবিলে নাবিল,শর্মী,শায়মী বেশ অবাক হয়ে আশেপাশে তাকায়। শর্মী উর্বীকে বলে,”পাপা কোথায় আন্টি! মর্নিং ওয়াক থেকে ফেরেনি এখনও?”

উর্বী শুকনো গলায় জবাব দেয়,”উনি ঘরেই আছেন। তোমরা খেয়ে নাও।”

কথাটা বলেই উর্বী রাওনাফের জন্য একটা প্লেটে একটা স্যান্ডউইচ,একমগ কফি নিয়ে দোতলায় চলে যায়। নাবিল শায়মী মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। কিছুই বুঝতে পারছে না তারা।

রাওনাফ অগোছালো হয়ে বিছানার একপাশে বসে আছে। গাঁয়ের পোলো টি-শার্ট এলোমেলো হয়ে আছে কলারের দিকটা। দুহাত মুঠি করে কপালে ঠেকিয়ে বসে আছে সে। উর্বীর পায়ের অস্তিত্ব টের পেয়ে রাওনাফ মাথা তুলে তাকায়। উর্বী ধীরপায়ে এগিয়ে আসে। রাওনাফের পাশে বসে রাওনাফের দিকে তাকায়। খাবারের প্লেট টা একপাশে সন্তর্পনে রেখে ঘুরে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে তার অগোছালো চুল হাত দিয়ে ঠিক করে দেয়,ঠিক করে দেয় তার পোলো টি-শার্টের কলার। রাওনাফ ঘামছে,গলার এড্যাম’স এপেল বেগতিক ওঠানামা করছে।
উর্বী স্যান্ডউইচ টা তুলে রাওনাফের মুখের সামনে ধরে, খুবই ঠাণ্ডা গলায় বলে,”আপনি কোনো বাচ্চা নন। আপনি আমাদের অভিভাবক। প্লিজ সেরকম থাকুন।”

রাওনাফ স্যান্ডউইচ টা খেয়ে নেয় চুপচাপ। উর্বী বলে,”আপনার সহধর্মিণী সবসময় শ্রদ্ধার সাথেই আপনার বুকে মাথা রাখবে। এটুকু অন্তত জেনে রাখুন।”

রাওনাফ নেতিয়ে পরে,নরম গলায় বলে ওঠে,”ছেলে মেয়ে তিনটা বড় হয়ে গিয়েছে উর্বী ‌। ওরা সব বোঝে। ওরা যদি জানতে পারে ওদের পাপার নামে সে’ক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের অভিযোগ উঠেছে তাহলে? তাহলে কি হবে উর্বী? কিভাবে ফেস করবো আমি বাচ্চাগুলোকে! এর চেয়ে তো আমার মরাও ভালো!”

উর্বী রাওনাফের মুখের ওপর হাত রেখে দেয় আলতো করে। এর বেশি তার কান শুনতে পারবে না কিছু।

হাত থেকে কলেজের এডমিশনের কাগজগুলো ফেলে দিয়ে মুখ চেপে ধরে শায়মী। এইমাত্র সে যা শুনলো তাতে তার ইচ্ছা করছে দৌড়ে কোথাও পালিয়ে যেতে। কিন্তু আশ্চর্য সে নড়তে পারছে না। নাবিল বোকার মতো একবার শায়মীকে একবার ঘরের ভেতরে থাকা রাওনাফ উর্বীকে দেখছে। রাওনাফ উর্বী ওদিক ফিরে বসেছিলো বলে তখনও খেয়াল করেনি নাবিল শায়মীকে।
নাবিল মেঝে থেকে এডমিশনের কাগজগুলো তুলে নেয়। তারা এসেছিলো রাওনাফের থেকে সাইন করিয়ে নিতে। কাগজগুলো তুলে নিয়ে নিঃশব্দে শায়মীর হাত ধরে টানতে টানতে শায়মীদের ঘরে নিয়ে যায়।
শায়মী ডুকরে কেঁদে ওঠে। নাবিল বলে,”চুপ চুপ!”

শায়মী কাঁদতে কাঁদতে বলে,”এসব আমি কি শুনলাম নাবিল!”

_আমাদের পাপা গ্রেট,হি ইজ ইনোসেন্ট।

শায়মী চোখের পানি মুছে নেয়। ধরা গলায় বলে,”জানি তো! কিন্তু নাবিল এখন কি হবে! পাপা খুব কষ্ট পাচ্ছে নাবিল। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে!”

“চুপ একেবারে শায়মী। পাপা যদি টের পায় আমরা জেনে গিয়েছি পাপা আরো কষ্ট পাবে। ভীষণ কষ্ট পাবে। প্লিজ চুপ কর।”

শায়মী ফোপাচ্ছে। শর্মী হুরমুর করে ঘরে ঢুকতেই দুজন চুপ হয়ে যায়। শায়মী চোখের পানি মুছে ফেলে। শর্মী ভাইয়া আপুর মুখের দিকে তাকায়। নাবিল ধ’ম’ক দিয়ে বলে,”দেখছিস কি! স্কুলে যা! ভাগ!”

****
উর্বীর হাত পা কাঁপছে। রাওনাফ এই মাত্র বেরিয়েছে। আজ যদি কোনো অঘটন ঘটে ! ঐ ধরনের মেয়েকে দু’টো চ’ড় থাপ্পড় মারলেই সত্যিটা উগ্রে দেবে ঠিক,কিন্তু এতে তো রটনা হয়ে যাবে হয়তো ক্ষমতার বলে রাওনাফ নিজেকে নির্দোষ প্রমাণিত করেছে। ভি’ক্টিমকে ভয় দেখিয়ে।
উর্বীর শরীরটা অস্বাভাবিক দুর্বল লাগছে। তার ভীষণ ভ’য় করছে। এটা যেই সেই অভিযোগ নয়, যৌন হয়রানি। এই অপবাদ কিভাবে সইবে ঐ লোকটা! ইতিমধ্যে কতটা ভেঙে পরেছে সে! উর্বীর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।

উর্বী তার বিছানায় বসে আছে।‌ রওশান আরা ঘরে ঢোকে,”বৌমা। কিছু খাবে না।”

উর্বী তার শাশুড়ির দিকে তাকায়। শুকনো গলায় বলে,
“কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না মা।”

রওশান আরা ঘরে ঢুকে বসে,”দেখে তো শরীর খারাপ লাগছে তোমার! কিছু কি হয়েছে?”

উর্বীর চোখ যায় টেবিলের ওপর রাখা কাগজটাতে। সে কাগজটা উঠিয়ে দেখতে থাকে। কিছুক্ষণ পর উর্বী হুট করে বলে ওঠে,”মা আমি হসপিটালে যেতে চাই।”

রওশান আরা অবাক হয়ে বলে,”বৌমা তুমি এই শরীরে…”

_আমি ঠিক আছি মা। আপনি মনে করে দুপুরের ওষুধ টা খেয়ে নেবেন।

রওশান আরা কিছু বলে না।

উর্বী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার খোলা চুলগুলো খোঁপায় বেঁধে নেয়।

নাবিল এসে ঘরের বাইরে দাঁড়ায়। অনেকটা সংকোচ নিয়ে বলে,”আন্টি!”

উর্বী অবাক হয়ে ঘুরে তাকায়। তাকে নাবিল সচারচর আন্টিও ডাকে না। সে ঠান্ডা গলায় বলে,”কিছু বলবে?”

_পাপা কোথায় বেরিয়েছে?

_হসপিটালে! জরুরি কোনো দরকার? সকাল থেকে দেখছি ওনার খোঁজ করছো ‌!

নাবিল ইতস্তত করে বলে,”না মানে, এডমিশনের পেপার্স গুলোতে সাইন দরকার পাপার।”

উর্বী কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,”এখনি দরকার? আমি সাইন করে দিলে হবে?”

নাবিল কিছু বলে না, তাকিয়ে আছে উর্বীর দিকে। উর্বী পার্স ব্যাগ তুলে নিয়ে বলে,”দুপুরে ফিরবে তোমার পাপা।”

নাবিল বলে,”আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”

_হসপিটালে।

শায়মী এসে ঘরের বাইরে দাঁড়ায়। উর্বী বেরিয়ে যায়। নাবিল শায়মী দুজন দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

****
ম্যানেজমেন্ট রুমে মিটিং বসেছে। হসপিটালের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সব স্টাফ এবং ডক্টর রাও রয়েছেন। রয়েছেন আরো পাঁচজন সার্জন যাদের সাথে রাওনাফ এই হসপিটালের মালিকানা শেয়ার করে। ডক্টর মাহমুদউল্লাহ রুপার দিকে তাকিয়ে বলে “তো তুমি সেই অভিযোগকারীনি?”

রুপা মাথা নিচু করে বসে আছে। রাওনাফ একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রুপার সাহস নেই বড় স্যারের দিকে তাকানোর।

সে মাথা নেড়ে অস্ফুট স্বরে ডক্টর মাহমুদউল্লাহকে বলে,”জ্বি।”

মাহমুদুল্লাহ রাওনাফের দিকে তাকায়। বয়সে সে রাওনাফের জুনিয়র তাই স্যার বলে সম্বোধন করে,”স্যার সবই শুনলাম। আপনার কি বলার আছে?”

_আমি নির্দোষ। এসব মিথ্যা।
দৃঢ় ভাবে বলে রাওনাফ।

_কি প্রমান আছে?

_আমি যে দোষী তারও তো কোনো প্রমান নেই। শুধুমাত্র মৌখিক অভিযোগ!
ঠান্ডা গলায় বলে রাওনাফ।

মাহমুদুল্লাহ বলে,”পয়েন্ট। সেজন্যই তো আমরা তদন্ত করতে এসেছি।”
এরপর সে রুপার দিকে তাকিয়ে বলে,”বলো সেদিন রাতে কি হয়েছিলো, বড় স্যার তোমাকে কি বলেছিলো।”

রুপা কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তার হাত পা কাঁপছে। কি করতে যাচ্ছে এটা সে! কেনো জরিয়ে গেলো এসবে! নিজেকে ধাতস্থ করে বলতে থাকে,”সেদিন রাতে আমি বড় স্যারের…….”

রুপার কথার মধ্যেই একজন ওয়ার্ড বয় ঢুকে রাওনাফকে বলে,”স্যার ম্যাডাম এসেছে।”

রাওনাফ হতবাক হয়ে লামিয়ার দিকে তাকায়। লামিয়া দরজার দিকে চায়। উর্বী ম্যানেজমেন্ট রুমে ঢোকে। রাওনাফ তার দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী তার দিকে না তাকিয়ে কোনায় একটি চেয়ারে বসে।

রাওনাফ ঘামছে। উর্বী কেনো আসতে গেলো! সহ্য করতে পারবে এই হিউমিলিয়েশন!

উর্বীকে দেখে রুপা থেমে যায়। অস্বস্তিতে তার মন আর মস্তিষ্ক ছেয়ে যায়। উর্বী তার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে।

ডক্টর মাহমুদউল্লাহ রুপাকে বলে,”থামলে কেনো বলো।”

রুপা হালকা কেশে বলে,”আমি তো আমার বক্তব্য লিখেই দিয়েছি,আমাকে বারবার কেনো এসব জিজ্ঞেস করা হচ্ছে?”

_কেনো? বলতে অসুবিধা টা কোথায়? আমাদের তো জানতে হবে তোমার লিখিত স্টেটমেন্ট আর মুখের কথা এক কিনা। তুমি মিথ্যা বলছো কি না।”

_আমি মিথ্যা বলছি না। আচ্ছা বলছি, সেদিন রাতে স্যার আমাকে তার রুমে ডাকে। পরে আমাকে জানায় আমার চাকরি থাকবে না। কারন তার আগের দিনই আমার হাতে একটা দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিলো। তো আমি স্যারের পায়ে পরি,তখন স্যার আমার সাথে খারাপ আচরণ শুরু করে। এক পর্যায়ে সে জানায় আমার চাকরি পেতে হলে তার সাথে……”

উর্বী দু’চোখ বন্ধ করে নেয়। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে সে রুপাকে উদ্দেশ্য করে বলে,”ব্যাস এটুকুই?”

রুমের সবাই উর্বীর দিকে তাকায়। রাওনাফ আর লামিয়া মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।

উর্বী আবারো বলে,”তারপর কিছু হয়নি?”

ডক্টর মাহমুদুল্লাহ বলে,”আপনি কে?”

_আমি কে সেটা জানা জরুরী না। জরুরী হচ্ছে এখন এই মেয়ের কথাগুলো শোনা। বিস্তারিত। তো বলো মেয়ে, তারপর আর কিছু হয়নি?”
রুপার দিকে তাকিয়ে ধ’ম’কে ওঠে উর্বী।

রুপা থতমত খেয়ে বলে ,”না, এটুকুই!”

_কিন্তু আমার তো তা মনে হয় না। তুমি সেদিন তোমার স্যারের সাথে রাত কাটাতে রাজি হয়েছিলে। হওনি? বলো!

রাওনাফ হতবাক হয়ে উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী কিসব বলছে!

ডক্টররা হা হয়ে উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। পাশের একজন ডক্টর মাহমুদউল্লাহর কানে ফিসফিসিয়ে বলে,”ইনি হচ্ছেন বড় স্যারের স্ত্রী।”
মাহমুদুল্লাহ অবাক হয়।

উর্বী রুপাকে বলে,”বলো। আমি যা বলছি তা কি ঠিক না? তোমার বড় স্যার তোমাকে বাজে প্রস্তাব দিয়েছে এবং তুমি রাজি হয়েছো। রাত কাটিয়েছো তার সাথে।”

রুপা ক্ষে’পে যায়,”মিথ্যা কথা। এসব কিছুই হয়নি।”

_হয়েছে। অবশ্যই হয়েছে। তুমি তোমার স্যারের ডাকে সাড়া দিয়েছো। আমি নিশ্চিত। যা হয়েছে সব তোমার সম্মতিতেই হয়েছে।

রুপার চোখের কোনায় পানি।
“না, মিথ্যা বলছেন আপনি। এসব বানোয়াট। আমি এসব কিচ্ছু করি নি।”

আরেকজন ডক্টর,যার নাম মেহেদী হাসান সে জিজ্ঞেস করে উর্বীকে,”আপনি কিভাবে এতো জোর দিয়ে বলছেন? আপনার কাছে কি প্রমাণ আছে?”

_প্রমান আছে দেখেই বলছি।

উর্বী তার পার্স থেকে একটা কাগজ বের করে মেহেদী হাসানের দিকে এগিয়ে দেয়।
“এই যে নিন। এটা এই মেয়ের এপয়েনমেন্ট লেটার। ও সেদিন ওর স্যারকে খুশি করেছিলো বিধায় সেদিন রাতেই ওর স্যার ওকে অন্যত্র চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছে,তাও আবার বেশি বেতনে। আর এটা ভুয়া কাগজ নয়,চাইলে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।”

রুপা পুলিশের হাতের কাগজটির দিকে তাকায়। সে জোরে চেঁচিয়ে ওঠে,”মিথ্যা কথা। আমি এমন কিছুই করি নি। স্যারের সাথে আমার কিছুই হয়নি।”

_হয়েছে তো অবশ্যই। তোমার স্যারকে তো আমি পরে বুঝে নেবো, আমি আগে তোমায় দেখে নিতে চাই। তোমার স্যার এবং তুমি, তোমাদের দুজনের নামে আমি প্রতারনার কেস করবো।

রুপা কাঁদছে,”ম্যাম বিশ্বাস করুন। আমি এমন কিছুই করি নি। আমি ওই ধরনের মেয়ে নই।”

_করেছো করেছো , তোমার স্যার তোমাকে প্রস্তাব দিয়েছে এটা অর্ধেক সত্যি, তুমিও নষ্টা মেয়েদের মতো রাজি হয়েছো,এটা পুরো সত্যি।

রুপা চেঁচিয়ে ওঠে,”না রাজি হইনি। আমি কিছু করিনি।”

_তাহলে এই কাগজটি কিসের? তোমার স্যার তোমার প্রতি খুশি না হলে এতো উপকার কেনো করতে যাবে তোমার ? বাজারি মেয়ে কোথাকার বড়োলোক দেখলেই শুয়ে পরতে ইচ্ছে করে?

রুপা কেঁদে ফেলে,”না এমনটা কিছুই হয়নি। আমি খারাপ মেয়ে না। স্যারের সাথে আমার কিছুই হয়নি। আমি রাত কাটাইনি স্যারের সাথে!”
_বিশ্বাস করি না। আমি উঠছি। ডক্টর রাওনাফ করীম খান এবং তুমি। দু’জনেই পানিশমেন্টের জন্য তৈরি হও। তোমাকে আমি একটুও ছাড় দেবো না বিশ্বাস করো।

রাওনাফ বাকরুদ্ধ হয়ে উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। তার মাথা কাজ করছে না। লামিয়া রাওনাফের পাশ থেকে ফিসফিসিয়ে বলে,”রিল্যাক্স রাওনাফ। দেখতে দাও আমাকে।

উর্বী রুপাকে বলতে থাকে,”বাজারি মেয়ে। আত্মসম্মান নেই, প্রস্তাব দিলেই শুয়ে পরতে হবে তাইনা? বল কার কার সাথে শুয়েছিস এ পর্যন্ত? এই হসপিটালের সব ডাক্তারদের সাথে শুয়েছিস?

রুপা কান চেপে ধরে চেঁ’চি’য়ে বলে,
_ম্যাম,স্যারের সাথে আমার কিছুই হয়নি।

_কেন হয়নি ?
আরো চেঁ’চি’য়ে বলে উর্বী,

_কারন স্যার আমাকে কোনো বাজে প্রস্তাব দেয়ই নি।

রুমের সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। রুপা কেঁদেই যাচ্ছে।

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বীর মুখ হাসি হাসি।

সবার ঘোর কেটে গেলে উর্বী রুপার উদ্দেশ্য বলে,”অন্যের চরিত্রে দাগ লাগনো খুবই সহজ, কিন্তু সেটা যদি ঘুরে নিজের দিকেই আসে তখন খুব কষ্ট হয় তাই না?”

মাহমুদুল্লাহর মুখ থেকে,”ও মাই গুডনেস” বাক্যটি বের হয়।

উর্বী রুপার দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি তোমার খুব করুণ দশা করে ছাড়বো রুপা!”

সবাই উর্বীকে দেখতে থাকে। উর্বীর চোখ মুখে আগুন জ্বলছে।

কয়েকজন নার্স তখন সাহস করে বলে ওঠে,”আমরা বছরের পর বছর স্যারকে দেখছি। রাত দুটো হোক,তিনটে হোক নির্দ্বিধায় স্যারের কেবিনে গিয়েছি। একা একা। আমরা তো স্যারকে এমন ভাবতেই পারি না।

ডক্টর মেহেদী হাসান রুপাকে বলে,”তুমি তাহলে স্যারের নামে মিথ্যা অভিযোগ….”

উর্বী তাকে থামিয়ে রুপা কে বলে,”তোমার স্যার আমাকে বলেছে তার আর তোমার মধ্যে কি কথোপকথন হয়েছে। আমি তোমার সম্পর্কে খোজ খবর নিয়ে দেখেছি। তোমার বাবা তো আরেকটি বিয়ে করে তোমাদের আর দেখেন না। ভাই বোনকে নিয়ে তোমার সংগ্রাম করে বাঁচতে হয়। সেদিন তুমি তোমার স্যারের কেবিন থেকে চলে যাওয়ার পরে তোমার স্যার কি করেছে জানো, তোমাকে তার রাজশাহীর হসপিটালে নিয়োগ দিয়েছে, তোমার প্রতি তার মায়া হয়েছে। আর তুমি কি করলে? অকৃতজ্ঞ। তুমি তো চাইতে তোমার মা আর ভাইবোনকে নিয়ে না খেয়ে যেন মরতে না হয়। কিন্তু আমি তোমাকে তোমার পরিবার সহ রাস্তায় নিয়ে ফেলবো।”

উর্বী রাগে ফেটে পরে। কেউ কিছু বলছে না। রাওনাফ শুধু উর্বীকে দেখছে।

রুপা কাঁদতে থাকে,তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে,সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,”সরি ম্যাম।”

উর্বী খানিকটা দম নিয়ে বলে,”তোমার মতো একজন ছাপোষা নার্সের এতো সাহস হবার কথা না, নিশ্চয়ই কেউ ইন্ধন দিয়েছে তোমাকে! যদি তোমায় এ ব্যাপারে কেউ উষ্কে থাকে তুমি নামটা বলো। যদি তোমার বিন্দুমাত্র লজ্জা হয়ে থাকে তুমি নামটা বলে দাও।”

রুপা কাঁদছে। দীর্ঘক্ষণ কেঁদে সে চোখের পানি মুছে ডক্টর কিশোরের দিকে তাকায়। রুমের সবাই তা খেয়াল করে। রাওনাফ হতবাক হয়ে কিশোরের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিশোর মাথা নিচু করে বসে আছে।

মাহমুদুল্লাহ বলে,”আমাদের মনে হয় আমাদের কিছু করার নেই এখানে।”
তারপর রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”তবে স্যার আপনি চাইলে আমরা একশন নিতে পারি এখনই।”

রাওনাফ স্বাভাবিক ভাবে বলে,”তার আর দরকার নেই। আপনারা আসুন। ধন্যবাদ।”

ম্যানেজমেন্ট কমিটির সবাই চলে যায় । একে একে রুম থেকে সবাই বের হয়। রুমে থাকে শুধু রাওনাফ,উর্বী,লামিয়া,রুপা এবং ডক্টর কিশোর ‌।

রাওনাফ কাতর কন্ঠে ডক্টর কিশোরকে বলে,”কেনো কিশোর? আমার কি কোনো ভুল ছিলো? কখনো তোমার সাথে কোনো অন্যায় করেছি?”

কিশোর মাথা নিচু করে রাখে।

রুপা অনবরত কেঁদে যাচ্ছে। লামিয়া ধ’ম’কে বলে,”তুমি এখান থেকে এই মুহূর্তে বের হয়ে যাও। নয়তো পুলিশ ডাকবো!”

রুপা কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার সময় উর্বীর চোখে চোখ পরে রুপার। উর্বী চোখ ফিরিয়ে নেয়।

কিশোর নীরবতা ভেঙে রাওনাফকে বলে,”আমি আর তুমি একই অবস্থানে, দুজনেই ভালো ডাক্তার। তবু সবাই তোমাকে নিয়ে মাতামাতি করে, তোমার সুনাম বেশি। কারন তুমি হসপিটালের একজন মালিক….. এছাড়া তোমার কোনো বিশেষত্ব নেই রাওনাফ।”

রাওনাফ বলে,”শুধুমাত্র এই কারনে? আউট অফ জেলাসি? এই কারনে তুমি এমন ঘৃণ্য একটা চাল চেলেছো! আমাদের বন্ধুত্বের কোনো দাম নেই?”

লামিয়া বলে ওঠে,”তোমার বিরুদ্ধে এ্যাকশন নেওয়া হবে কিশোর। তুমি চিন্তা করো না, তোমার কর্মের উপযুক্ত ফল পাবে তুমি!”

কিশোর চুপ করে থাকে।

রাওনাফ চুপচাপ উঠে চলে যায়। উর্বীও উঠে রাওনাফের পিছু পিছু যায়।

লামিয়া বসে আছে,সে কিশোরকে উদ্দেশ্য করে বলে,”ছিঃ কিশোর। ছিঃ”

****
রাওনাফ কেবিনে এসে গায়ের ব্লেজার খুলে চেয়ারের উপর সজোরে ছুঁ’ড়ে মারে। হাত মুঠো করে টেবিলে সজোরে ঘুষি দেয়।
উর্বী এসে রাওনাফের হাত ধরে,”কি করছেন,ব্যা’থা পাবেন তো।”

রাওনাফ উর্বীকে ধরে,”মানুষ এতো অদ্ভুত কেনো উর্বী বলোতো? আমি তো বিশ্বাস করতে চাই না। আমি ভুলতে চাই। আমি কিশোরকে আমার শুভাকাঙ্ক্ষী ই ভাবতে চাই।”

উর্বী বলে,”আপনার কিছু ভাবতে হবে না। আপনি আমার সাথে বাড়িতে চলুন। সকাল থেকে ঐ স্যান্ডউইচ ছাড়া কিছুই খাননি। আমিও খেতে পারিনি। ”

লামিয়া দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কাশি দেয়। রাওনাফ আর উর্বী সেদিকে তাকায়। লামিয়ার সাথে আরো ডাক্তার এবং নার্স এসেছে। সবাই রাওনাফের সাথে কথা বলতে চায়।

লামিয়া বলে,”তোমার বৌয়ের প্রশংসায় তো থাকাই যাচ্ছে না রাওনাফ।”

রাওনাফ ম্লান হাসে।
লামিয়া বলে,”সি ইজ ব্রিলিয়ান্ট!”

রাওনাফ সবাইকে বলে,”তোমাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তোমাদের সাপোর্ট আমাকে অনেকটা শক্ত রেখেছে।”

লামিয়া বলে,”কিশোর কেবিন থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না রাওনাফ।”

রাওনাফ চুপ করে থাকে, লামিয়া বলতে থাকে,”এর আগে ও এই হসপিটালে যত সিন্ডিকেট করেছে তখনই তোমার উচিত ছিলো স্টেপ নেওয়া।”

_বাদ দাও লামিয়া,আমি আর ভাবতে চাচ্ছি না এসব কথা!

_ওর ব্যাপারে কি ব্যাবস্থা নেবে তুমি? কেস করো।

_পরে দেখা যাবে। পুরো ব্যাপারটা আমি আগে হজম করে নিই!

রাওনাফের সাথে তার সব কলিগরা কথা বলে চলে যায়। সবাই চলে যেতেই রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়।
“এভাবে এখানে আসতে গেলে কেনো?”

উর্বী রাওনাফের ডান হাত টেনে দুহাতে আগলে ধরে চুমু খায়। নরম গলায় বলে,”যে মানুষটা আমার কলঙ্কগুলোকে আগলে নিয়েছে। তার চরিত্রে কোনো মিথ্যা কলঙ্ক লাগুক,আমি মানতেই পারতাম না শর্মীর পাপা। কতটা ছ’ট’ফ’ট করছিলাম জানেন। এমতাবস্থায় আমি বাড়িতে বসে থাকতাম? আপনার মনে হয়?”

রাওনাফ তাকিয়ে আছে উর্বীর দিকে। উর্বীর ডান গালে হাত রেখে নিচু স্বরে বলতে থাকে,”শরীর ঠিক আছে তোমার?”

উর্বী মাথা নাড়ায়, অস্ফুট স্বরে বলে,”এখন ঠিক আছি।”

উর্বীকে টেনে রাওনাফ আগলে নেয়। উর্বী তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাওনাফ উর্বীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আদুরে গলায় বলে,”কে বলেছে এই উর্বী বোকা? এই উর্বী মোটেও বোকা উর্বী নয়!”

চলমান…

আরেকটি বার পর্ব-২৮

0

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_২৮
#Esrat_Ety

ব্রেকফাস্ট টেবিলে পিনপতন নীরবতা। ডক্টর রাওনাফ করীম খান নাস্তা খেতে খেতে তার ছোটো কন্যার দিকে তাকায়। শর্মী পাপাকে পাত্তা দিচ্ছে না। একমনে খাবার নাড়াচাড়া করছে। কালকের ঘটনায় সে এখনও রেগে আছে তার বাবার ওপর। আজ বাড়ির সবাই ব্রেকফাস্ট টেবিলে উপস্থিত আছে। আজমেরী আর রুমা আজ বিকেলে যার যার শশুরবাড়িতে ফিরে যাবে।
খেতে খেতে রাওনাফ সামিউলের দিকে তাকায়,জানতে চায় অন্তরার কথা।

সামিউল বলে,”ঘরে। খাবার ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

রাওনাফ বলে,”সব গুছিয়ে নিয়েছিস?”

সামিউল মাথা নাড়ায়। উর্বী বলে,”কেনো? ওরা কি কোথাও যাচ্ছে?”

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়। বলে,”তোমাকে বলা হয়নি। ওরা রাজশাহী যাবে। ওখানটা সামিউল সামলাবে,ওখানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ওকে নিয়োগ দিয়েছি।”

“আর ওনার বিজ্ঞাপন অফিসের চাকুরী?”

উর্বীর কথায় সামিউল তার দিকে তাকায়, নিচুগলায় বলে,”করছি না আর ভাবী।”

উর্বী সবার প্লেটে ডিমের পোচ তুলে দিতে দিতে বলে,”কবে যাচ্ছেন? ফ্ল্যাট দেখেছেন?”

_আমি দেখে সব ঠিক করেছি। সামিউলের সাথে অন্তরাও যাবে। ওরা ওখানেই থাকবে। বিকেলে যাবে আজ।
রাওনাফ জবাব দেয়।

উর্বী মলিন মুখে বলে,”বাড়িটা যে খালি হয়ে যাবে পুরো!”

রওশান আরা মাথা তুলে তাকায়। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে,”অন্তরা তার স্বামীর সাথে থাকবে। স্বামী অন্য শহরে পরে থাকবে আর সে এই সংসার সামলাবে এমন বৌয়ের আমার প্রয়োজন নেই। মোহনাকেও শাফিউলের সাথে পাঠিয়েছি। সামিউলও তার বৌকে সাথে নিয়ে যাবে। আর ঘর কেন খালি হবে? আমার বড় ছেলে,ছেলের বৌ,নাতী নাতনি। সবই তো আছে।

উর্বী শাশুরির কথায় ম্লান হেসে কিচেনে চলে যায়। রাওনাফ উঠে পরে। আজমেরী বলে,”ভাইজান আমরাও বিকেলে যেতে চাচ্ছি। তুমি তো রাতে ফিরবে,দেখা হচ্ছে না আর।”

রাওনাফ অবাক হয়ে তাকায়, বিষন্ন ভঙ্গিতে বলে,”চলে যাবি! গত পরশুই না এলি!”

রুমা হেসে বলে,”পরশু না। চারদিন হয়েছে ভাইয়া। আর এখন এতো মন খারাপ করছো কেন? তখন কত কেঁদেছি আমি আর আপা বিয়ে করবো না বলে। তখন তো শোনোনি। যেই সরকারি চাকরিজীবী পাত্র পেয়েছো অমনি ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়েছো। এখন কেন আটকে রাখতে চাও?”

রাওনাফ হেসে ফেলে। আজমেরী বলে,”বাচ্চাদের স্কুল আছে ভাইয়া। সামনের মাসে আসবো আবার। তাও তো এখন আসছি,বাড়িটা কেমন বাড়ি বাড়ি লাগে বড় ভাবী এসেছে বলে। গত দশবছর একটুও আসতে ইচ্ছে করতো না বাড়িতে।”

রাওনাফ হেসে আমীরুনকে ডাকে,”কফিটা আমার ঘরে দিয়ে যা। আমি বেরোবো এক্ষুনি।”

উর্বী শুনেছে রাওনাফের কথা। যেহেতু আমীরুনকে বলেছে তাই সে তার নিজের কাজ করতে থাকে। আমীরুন পাশে এসে দাঁড়ায় উর্বীর, নিচুগলায় বলে,”নিয়া যান ভাবী!”

_কি?
উর্বী জানতে চায়।

_কফি নিয়া যান। ভাইজান চাইছে তো।

_তো তুমি নিয়ে যাও। তোমাকে বললো যে। আমাকে তো বলেনি। আমি এদিকটা দেখছি।

আমীরুন হাসে। উর্বী বলে,”হাসছো কেন?”

আমীরুন হাসতে হাসতে বলে,”ভাইজান আপনারেই ইশারা দিছে ঘরে যাওয়ার জন্য। যান আপনে,গিয়া দেখেন জরুরি কথা থাকবার পারে। ডাইনিং টেবিলে বাড়ির সব মানুষ ছিলো তাই আপনারে সরাসরি ডাকেনাই।”

উর্বী অবাক হয়ে বলে,”তুমি কিভাবে বুঝলে?”

আমীরুন হাসে আর বলে,”সেই এইটুকুন বয়স থেকে ভাইজানরে দেখি। বড় ভাবীর সাথেও এমন করতো। আমি এইগুলা বুঝি!”

উর্বী লজ্জা পেয়ে যায়। আমীরুন কফির মগটা উর্বীর হাতে তুলে দিয়ে বলে,”যান। কফি ঠান্ডা হইয়া যাইবো।”

****
উর্বী ঘরে ঢুকতেই রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে আন্তরিক হাসি দিয়ে কফির মগটা নিয়ে নেয়। রাওনাফের হাসি দেখে উর্বী আমীরুনের কথার সত্যতা বুঝে যায়।
রাওনাফ কফির মগে চুমুক দেয়। কিন্তু কিছু বলে না। উর্বী রাওনাফের একটা ইস্ত্রি করা শার্ট বিছানার ওপর রেখে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে রাওনাফ ডাকে,”উর্বী।”

উর্বী দাড়ায়। রাওনাফ উঠে ড্রয়ার থেকে একটা খাম এনে উর্বীর হাতে দেয়। উর্বী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। রাওনাফ বলে,”কাল বলতে মনে ছিলো না। মুভি টিকিট। ওদের নিয়ে যেও সন্ধ্যায়। শর্মী খুব এক্সাইটেড ছিলো মুভিটা নিয়ে।”

উর্বী হাতের টিকিট গুলোর দিকে তাকিয়ে রাওনাফের দিকে তাকায়,বলে,”আর আপনি?”

রাওনাফ হেসে ফেলে,”আরে ধুর! আমার অত সময় আছে? ডাক্তারি ফেলে বাচ্চাদের এ্যানিমেশন মুভি দেখবো! তুমি ওদের তিন ভাইবোনকে নিয়ে যেও।”

_নাবিল যাবে?

_যেতে পারে। জিজ্ঞেস করে দেখবে। না গেলে ওদের দুবোনকে নিয়ে যাবে।

উর্বী বলে,”তো এতো টিকিট কেনো? বাড়িতে কেউ থাকছে না। সামিউলরাও চলে যাচ্ছে বিকেলে। এখানে মোট দশটা টিকিট।”

_ওগুলো শর্মী আর শায়মীর ফ্রেন্ডদের জন্য। আমি প্রতিবার সবার জন্য কিনি। ওরাও যায়।

উর্বী চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। রাওনাফ উর্বীর দিকে খানিকটা ঝুকে বলে,”চাকরি করবে না ঠিক আছে। নিজেকে গৃহবন্দী করার কোনো মানে নেই। ওদের সাথে ঘুরে এসো। ভালো লাগবে। বাচ্চাগুলো চমৎকার সব!”

রাওনাফ টাইয়ের নট বাঁধতে থাকে। উর্বী ঘর থেকে বেরোয় না। মুভি টিকিট গুলো রাখতে গিয়ে দেখতে পায় টেবিলের ওপর একটা এ্যাপয়েনমেন্ট লেটার। হাতে তুলে নিয়ে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”এটা কার এ্যাপয়েনমেন্ট লেটার? রুপা কে?”

রাওনাফ ঘুরে তাকায়। তারপর বলে,”এখানের একজন নার্স। সামহাউ চাকরি টা চলে গিয়েছে তাই রাজশাহী চাকরির ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। খুবই অভাবী পরিবার।”

উর্বী কথা না বাড়িয়ে কাগজটা রেখে দেয়। তারপর বলে,”ডাক্তারি রেখে সমাজ সেবা করতে শুরু করলেন নাকি! অবশ্য আপনি যে খুব মহান তা তো টের পেয়েছি। যার মনে দু’টো বৌয়ের জায়গা হয় তার মহানুভবতা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই!”

রাওনাফ টাইয়ের নট বেঁধে হাতে এ’প্রো’ন তুলে নিতে নিতে বলে,”খুবই দুর্বল ধরনের ব্যঙ্গ এটা মৃদুলা উর্বী। এ্যান্ড দিস ইজ ফর ইওর কাইন্ড ইনফরমেশন….আমি একটুও অফেনডেড হইনি! আমার আপনার এই ব্যঙ্গটা গায়েই লাগেনি।”

উর্বী শাড়ির আঁচল মুখে চে’পে ধরে হাসছে। রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়। হুট করে তার চোখ চলে যায় উর্বীর পায়ের দিকে, উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে ওঠে,”ওটা কি হয়েছে পায়ে!”

উর্বী নিজের পা লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে। রাওনাফ এগিয়ে গিয়ে উর্বীর হাত টেনে বিছানায় বসায়। তারপর নিজে ঝুঁকে বসে উর্বীর ডান পায়ের আঙ্গুলের কাছটাতে দেখতে থাকে। উর্বী চাপা স্বরে চেঁচিয়ে বলে,”ধরছেন কেনো! এমনি দেখুন। হাত সরান পা থেকে।”

রাওনাফ উর্বীর দিকে কপাল কুঁচকে তাকায়। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলে,”তোমরা বাঙালি মেয়েরা এতো ঢং করো কেনো? কোথা থেকে আসে এসব? পায়ে হাত দিলে কি হবে? তোমার পাপ হবে? হোয়্যাট দ্যা…….!”

প্রচন্ড বিরক্ত রাওনাফ। উর্বী চুপ। রাওনাফ বলে,”কেটেছে কিভাবে?”

_কিচেন নাইফ হাত থেকে পরে গিয়েছে সকালে।
লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে উর্বী।

রাওনাফ বলে,”ওহ হো হো! আমি তো ভুলেই গিয়েছি। আপনি মৃদুলা উর্বী। আপনি অক্ষত,সুস্থ শরীর নিয়ে দিন যাপন করবেন তা কি করে হয়! কোনো না কোনো অঘটন তো আপনাকে ঘটাতেই হবে। কথায় কথায় সেন্সলেস হওয়ার ব্যাপারটা কমেছে একটু। তাই এখন কাটাছেঁড়ার পথ বেছে নিয়েছেন। কারন আপনাকে তো পেশেন্ট হয়ে ঘুরতে হবে, বাড়িতে একজন ফ্রীতে ডক্টর পাচ্ছেন যে! ভিজিট তো দিতে হয় না, তার ওপর নার্সের কাজটাও করে দেয়!”

উর্বী মুখ ভার করে বলে,”আপনি আমায় অপমান করছেন! আমি বুঝি ইচ্ছে করে এসব করি?”

রাওনাফ উর্বীর কথার জবাব না দিয়ে পায়ের আঙুলে একটা ব্যান্ডেজ করে দিয়ে উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী বলে,”এতো কুইন ট্রিটমেন্ট দিচ্ছেন যে! অভ্যাস খারাপ করে দিচ্ছেন আমার!”

রাওনাফ বলে,”সবসময় কিং ট্রিটমেন্ট দাও আমাকে! ভাবলাম শোধ করি!”

উর্বী বলে,”হয়েছে? এবার তো পা থেকে হাত সরান। ডাক্তারি তো শেষ হলো!”

রাওনাফ হাত সরিয়ে নেয়। উর্বী উঠে দাঁড়ায়। রাওনাফ গিয়ে হাতে ব্যাগ আর এপ্রোন তুলে নিয়ে উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”আসছি। টেইক কেয়ার!”

উর্বী বলে,”হয়নি তো!”

রাওনাফ থেমে দাড়ায়। উর্বীর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। উর্বী রাওনাফের ডান হাত টেনে নিজের মাথায় বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”এভাবে! বলুন টেইক কেয়ার!”

রাওনাফ হেসে ফেলে। এগিয়ে যায় উর্বীর কাছে। উর্বী তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। রাওনাফ উর্বীর বা গালে একটা হাত রেখে আলতো করে চুমু খায় ডান গালে। উর্বী গুটিয়ে যায়। মুখ তুলে রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলে,”টেইক কেয়ার!”

রাওনাফ চলে যায়। থেকে যায় রাওনাফের পারফিউমের গন্ধ পুরো ঘরে,উর্বীর গালে। উর্বী লজ্জামাখা মুখটা তুলে দরজার দিকে তাকায়। হাত দিয়ে নিজের গাল ছুঁয়ে বিরবির করে বলে,”এতোটাও আশা করিনি ডাক্তার!”

****
শর্মী অনেকক্ষণ ধরে নাবিলের ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিচ্ছে। নাবিল খেয়াল করেছে, কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলে ওঠে,”কিছু বলার থাকলে বলে যা,ওখানে দাঁড়িয়ে তাকাঝাকা কেনো করছিস তোর ছোটোমার মতো?”

শর্মী ক্ষে’পে যায়। ভেতরে ঢুকে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,”আন্টিকে নিয়ে একটা বাজে কথা বলবে না।”

নাবিল ব্যঙ্গ করে বলে,”সরি সরি সরি। ভুল হয়ে গিয়েছে আমার। এখানে কেন এসেছিস?”

শায়মী ঘরে ঢোকে। শর্মীকে কিছু বলতে না দিয়ে বলে ওঠে,”মুভি দেখতে যাবো, যাবি তুই? পাপা টিকিট এনেছে। দশটা। ”

নাবিলের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। অবাক হয়ে বলে,”দশটা? কে কে যাবো?”

_আকিব,তুলি ওদের চারজনকে বলেছি। শর্মীর দুজন ফ্রেন্ড। আর আমরা চারজন। তুই,আমি,শর্মী আর আন্টি।

নাবিল মাথা তুলে তাকায়। বলে,”আন্টি?”

_হু।

_মানে পাপার বৌ?

_হু

_মানে দাদুর পুত্রবধূ?

_হু
বিরক্ত হয়ে জবাব দেয় শায়মী।

নাবিল হাসতে হাসতে বলে,”মানে তোদের ছোটো মা?”

শায়মী এবার প্রচন্ড ক্ষে’পে যায়। নাবিল হাসছে। শায়মী বলে সন্ধ্যা সাতটায় ফার্স্ট শো। যেতে চাইলে চল।

নাবিল হাই তুলতে তুলতে বলে,”আমি যাবো না। তোরা ছোটোমার সাথে ঘুরে আয়!”

শায়মীও গা ছাড়া ভাব দেখিয়ে বলে,”ঠিকাছে যাস না! ফাবিয়া আসবে! অনেক মজা হবে।”

নাবিল আড়চোখে শায়মীর দিকে তাকায়, নিচু স্বরে বলে,”ফাবিয়া আসবে!”

শায়মী হাসি চেপে রেখে বলে,”হ্যা। ওকে ইনভাইট করেছি। আসবে। যাই হোক! তুই তো যাবি না। থাক তাহলে!”

শর্মী আর শায়মী ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। উর্বী বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো। শর্মীকে দেখে ফিসফিসিয়ে বলে,”রাজি হয়েছে?”

শর্মী মাথা নাড়ায়। উর্বী শুকনো মুখে বলে,”ওহ।”

শায়মী বলে,”নাবিল যাবে। দেখে নিও। ওর ব্রেইন ওয়াশ করে দিয়ে এসেছি।”

উর্বী বলে,”কিভাবে?”

_বলেছি ফাবিয়া আসবে। ফাবিয়ার কথা শুনলেই ও একেবারে খুশিতে গদগদ হয়ে যায়।

উর্বী অবাক হয়ে বলে,”ফাবিয়া কে? নাবিলের গার্লফ্রেন্ড? ওর গার্লফ্রেন্ডও আছে?”

শায়মী বলে,”এই না না আন্টি। গার্লফ্রেন্ড না। তবে নাবিলের মনে লাড্ডু ফোটে ফাবিয়ার নাম শুনলে। কেমন ব্লাশ করে দেখো।”

উর্বী হেসে ফেলে। শায়মী বলতে থাকে,”এসব কথা পাপাকে প্লিজ বলে দিও না আন্টি। নাবিল আমাকে কাঁচা খেয়ে নেবে তবে।”

উর্বী মাথা নাড়ায়। হাসতে হাসতে বলে,”একদমই না। তোমাদের সব সিক্রেটের মতো এই সিক্রেট টাও গিলে ফেললাম।”

শায়মী হাসছে।
শর্মী নাক কুঁচকে বলতে থাকে,”আমার ফাবিয়া আপুকে একদমই পছন্দ নয়। একেবারেই নেকু টাইপ। ওর বাবা মিনিস্টার তাই এতো দেমাগ! ওকে কেনো তোমরা ফ্রেন্ড বানিয়েছো আপু!”

উর্বী শর্মীর কথায় অবাক হয়ে শায়মীর দিকে তাকিয়ে বলে,”বাবা মিনিস্টার? বাব্বাহ! রাওনাফ করীম খানের ছেলের তো কলিজা আছে!”

শর্মী উর্বীর কথাটার মানে ধরতে পারে না কিন্তু শায়মী ঠিকই হাসতে থাকে।

উর্বী হাসতে হাসতে বলে,”চলো,তোমরা রেডি হবে। আমি সামিউল অন্তরাকে ফোন করে দেখি ওরা পৌঁছালো কি না।”

শর্মী বলে,”আমাকে ফ্রান্স বেনী করে দেবে আন্টি?”

উর্বী হেসে বলে,”দেবো! দেবো!”

শায়মী বলে ওঠে,”আমাকেও দিও প্লিজ।”

***
রেডি হয়ে তিনজন সিড়ি বেয়ে নিচে নামতেই দেখে নাবিল রেডি হয়ে বসে আছে নিচতলার লিভিং রুমে। উর্বী,শায়মী,শর্মী তিনজনই তাদের হাসি চেপে রেখেছে। নাবিল কপাল কুঁ’চ’কে বসে আছে, বারবার হাত ঘড়িতে সময় দেখার ভান করছে। শায়মী বলে ওঠে,”এ কি রে নাবিল,তুই কোথায় যাচ্ছিস?”

নাবিল উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”তোদের সাথে।”

শায়মী বলে,”কেনো? বলেছিলি তো যেতে চাস না।”

_তোদের দেখেশুনে নিয়ে যাবো আমি।

শায়মী ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,”আমাদের দেখেশুনে নিয়ে যাওয়ার জন্য আন্টি আছে। তোর যেতে হবে না। যতোসব পাকনামো।”

নাবিল বলে,”উনি তো নিজেই নিজের দেখাশোনা করতে পারেন না। তোদের কি করবে!”

উর্বী বহু কষ্টে তার হাসি চেপে রেখেছে। শায়মী এবার বলতে থাকে,”আচ্ছা ঠিকাছে! চল, আর শোন ফাবিয়া যাচ্ছে না। ফোন দিয়েছিলো। আর কাকে ইনভাইট করা যায় বলতো?”

নাবিল অবাক হয়ে শায়মীর দিকে তাকিয়ে বলে,”ফাবিয়া যাচ্ছে না?”

শায়মী হাসি চেপে রেখে জবাব দেয়,”না।”

নাবিল চোখ মুখ কঠিন করে বলে,”তো আমার কি! চল দেরি হয়ে যাচ্ছে!”

গাড়িতে ওঠার আগে উর্বী শায়মীকে ফিসফিসিয়ে বলে,”ফাবিয়া সত্যিই আসছে না?”

শায়মী উর্বীর থেকেও নিচু স্বরে জবাব দেয়,”আসবে। নাবিলকে একটু ঘোল খাইয়েছি।”

উর্বী হাসে। হাসতে হাসতে নাবিলের দিকে তাকায়। গাড়ির সামনের সিটে চোখ মুখ কুঁচকে বসে আছে। বয়স সবে ষোলো, চেহারা থেকে বাচ্চা ভাবটাই যায়নি অথচ এই বয়সেই তার প্রেয়সীর জন্য হৃদয় ব্যাকুল। উর্বীর ইচ্ছা করছে উচ্চশব্দে কিছুক্ষণ হাসতে। ডক্টর রাওনাফ করীম খান শুনলে কি করবে!
অবশ্য পাপার রক্তই তো বইছে নাবিলের শরীরে। তার পাপাও তো ইচরে পাকা ছিলো। স্কুল জীবন থেকে নাকি শিমালার সাথে সম্পর্ক ছিলো! প্রেমিক পুরুষ বাবার ছেলে তো প্রেমিক পুরুষই হবে!

শায়মী ফিসফিসিয়ে বলে,”আন্টি এতো হেসো না তো। তোমাকে বলাটাই আমার ভুল হয়েছে।”

উর্বী নিজের মুখ চেপে ধরে। সে তবুও হাসছে।

***
ফাবিয়াকে দেখে উর্বীর হাসি মিলিয়ে যায়। সে শুধু মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে! মেয়েটিকে একটা পুতুল বললে কম হবে। কাঁচা হলুদের মতো গাঁয়ের রং,ছোটো খাটো আদুরে আনন, মিষ্টি মুখশ্রী,পাতলা দু’টো ঠোঁট নেড়ে নেড়ে আদুরে গলায় উর্বীর দিকে হাত বাড়িয়ে বলে,”হেলো আন্টি।”

উর্বী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে নাবিল শায়মী শর্মীর সব বন্ধুকে। সবগুলোই সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেমেয়ে। কিন্তু যথেষ্ট মিশুক, কথাবার্তায় অহংকারের ছিটেফোঁটাও নেই। উর্বীর সাথে খুব দ্রুতই যেন মিশে গেলো বাচ্চাগুলো। কিন্তু বেশভূষায় বেশ আধুনিক সবাই। রাওনাফ কখনো নিজের মেয়ে দুটোকে এতোটা খোলামেলা টপ পরতে দেয়না। শর্মী শায়মীরও আগ্রহ খুবই কম এসব পোশাকে। তারা কখনো ফ্রক নয়তো সালোয়ার কামিজ পরে, বড়জোর জিন্স আর শার্ট।

সিনেপ্লেক্সের অপজিটে বিরাট বড় রেস্তোরাঁয় তারা একটা বড় টেবিল বুক করে বসেছে। মাত্র কিছুক্ষণ আগে মুভি দেখে এখানে এসেছে তারা। এখন রাত সাড়ে নয়টা বাজে। প্রত্যেকটা ছেলেমেয়ের বাড়ির গাড়ি পার্কিং লটেই পার্ক করা।

উর্বী খাবার অর্ডার দিয়ে সবার মুখের দিকে তাকায়। বাচ্চাগুলো হাসছে,মুভি নিয়ে গসিপ করছে, শুধু চুপ করে আছে নাবিল। সে মাথা নিচু করে লজ্জা লজ্জা মুখ করে বসে আছে। উর্বী মনে মনে হাসে। সিনেপ্লেক্সের বাইরে যখন ফাবিয়া এসে নাবিলকে জিজ্ঞেস করে,”কেমন আছিস নাবিল।”

তখন থেকেই কেমন থম মে’রে আছে। মনে হচ্ছে লজ্জায় শ্বাস আটকে রেখেছে, ও নিঃশ্বাস নিলেই ফাবিয়া টের পেয়ে যাবে ওর মনের কথা। এতো ভীতু ছেলে!

উর্বী বাচ্চাগুলোকে খুব উপভোগ করছে। ধীরে ধীরে সবকিছু কেমন তার জীবনে সুগন্ধি ছড়িয়ে দিচ্ছে।

খাবার এসে যায়। খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাইকে বিদায় জানিয়ে উর্বী রাওনাফ করীমের তিন ছানা নিয়ে গাড়িতে ওঠে।

গাড়িতে মৃদু আওয়াজে “যাস্ট হাউ ফাস্ট দ্য নাইট চেইঞ্জেস” গানটা বাজছে। বাইরে হঠাৎ গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে ধীরে ধীরে মুশলধারে বৃষ্টি পরতে শুরু করে।

শর্মী শায়মী চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। উর্বী চ’ম’কে উঠে বুকে হাত চেপে বলে,”কি হয়েছে! চেচাচ্ছো কেন?”

_ভিজবো আন্টি। আংকেল গাড়ি থামাও।

আব্দুল গাড়ি থামিয়ে দেয়। উর্বী বিরক্ত হয়ে বলে,”ক্ষেপেছো? তোমাদের পাপা জানতে পারলে বকুনি খাবে।”

_কিভাবে জানবে পাপা?

উর্বী বলে,”আমি বলে দেবো।”

শর্মী শায়মী হেসে বলে,”কিন্তু পাপাকে তো আমরা বলবো তুমি আমাদের জোর করে ভিজিয়েছো।”

উর্বী বোকার মতো তাকিয়ে আছে মেয়ে দু’টোর দিকে। শর্মী শায়মী টেনে উর্বীকে গাড়ি থেকে নামায়।

মুহুর্তেই ভিজে যায় উর্বী। বৃষ্টির ফোঁটা গুলো তার গায়ে আছড়ে পরতেই উর্বী টের পেলো তার ভীষণ ভালো লাগছে। মেয়েগুলোর সাথে সাথে নিজেকেও সে একটা সপ্তদশী কিশোরী ভেবে ফেলে।

শায়মী ভিজতে ভিজতে গাড়ির জানালা দিয়ে উকি দিয়ে নাবিলকে ডাকে,”এই নাবিল, বৃষ্টিতে ভিজবি?”

_না। তোদের খেয়েদেয়ে কাজ নেই তাই ভিজতে থাক!
কঠিন গলায় বলে নাবিল।

শায়মী ফিরে যায় উর্বীর কাছে। প্রাইভেট কারের চালক,বাইক আরোহীরা রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে তাদের তিনজনকে দেখছে। রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে একজন ভদ্রমহিলা শাড়ি পরে তার সাথে দুজন ফ্রক পরে থাকা কিশোরী নিয়ে ভিজছে, খিলখিলিয়ে হাসছে। ব্যস্ত রাস্তায় সবার চোখে কৌতুহল। এদের এতো আনন্দ কেন! এরা কি অনেক সুখী?

কিছুক্ষণ পরে নাবিল গাড়ি থেকে নেমে তাদের দিকে এগিয়ে যায়। সেও পুরোপুরি ভিজে যায়। শায়মী হেসে বলে,”থাকতে পারলি না তো!”

নাবিল কপাল কুঁ’চ’কে বলে,”আমি তো তোদের ডাকতে এসেছি। লোকজন তোদের পাগল ভাবছে। চল।”

উর্বী হেসে কিছু বলতে যাবে তখনই গাড়িতে তার ফোন বেজে ওঠে। সে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। হাত মুছে ফোনটা রিসিভ করে। রাওনাফের গলা,”বাড়িতে ফিরেছো তোমরা?”

_না। আমরা রাস্তায়! আপনি কোথায়?

_আমি তো এইমাত্র চেম্বার থেকে হসপিটালে ফিরলাম। রাস্তায় কি করছো তোমরা? ওরা কোথায়?

_ওরা ভিজছে।

রাওনাফ অবাক হয়ে বলে,”ভিজছে মানে! কি আশ্চর্য। এই বৃষ্টিতে ভিজছে! তুমি বারণ করোনি কেনো!”

উর্বী হাসে আর বলে,”কারন আমিও ভিজছি।”

রাওনাফ একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”জ্বর বাধালে প্রত্যেককে শাস্তি পেতে হবে।”

_মঞ্জুর। এখন রাখুন তো! চাইলে আপনিও এসে পরুন। সবাই মিলে জ্বর বাধাই।

খিলখিলিয়ে হাসছে উর্বী। রাওনাফ হেসে ফোন কেটে দেয়। উর্বী নাবিলদের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,”মালাই চা খাবে তোমরা?”

শর্মী শায়মী সাথে সাথে মাথা নাড়ায়। উর্বী নাবিলের দিকে তাকায়, নাবিল বলে,”না। আপনারা খান। আমি এখানে দাড়িয়ে আছি।”

“ওকে।”

উর্বী ওদের দুবোনকে নিয়ে খুব কাছেই একটি টং-এর দোকানে চলে যায়। নাবিল কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে সেও এগিয়ে যায় সেদিকে। তারও খুব খেতে ইচ্ছে করছে মালাই চা।

****
রাওনাফ খেয়াল করছে হসপিটালের প্রায় সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে তাকাতেই সবাই মাথা নিচু করে ফেলছে। তার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। এদের সমস্যা টা কি আসলে?

আজ সারাদিন চেম্বারে রোগী দেখেছে রাওনাফ। এখন হসপিটালে তার পেশেন্ট গুলোকে দেখে বাড়ি চলে যাবে বলে ঠিক করে রাওনাফ। আজ তার কোনো ও.টি. নেই।

একটু পর একজন নার্স রাওনাফের কেবিনে আসে।
“স্যার আমায় ডেকেছিলেন?”
নিচু গলায় বলে হেড নার্স।

_বুঝলাম না। আজ তোমাদের সবাইকে অস্বাভাবিক লাগছে। কোনো সমস্যা হয়েছে? সেদিন যে দুর্ঘটনা হয়েছে তার জন্য রোগীর ফ্যামিলি মেম্বার রা ঝামেলা করেছে আবারও?

নার্স মুক্তার চোখে মুখে অস্বস্তি।
রাওনাফ বলে,”কি হলো। বলো! ”

_স্যার আপনি ম্যানেজমেন্ট রুমে যাননি?

ইতস্তত করে বলে নার্সটি।

_না তো! আমি তো সরাসরি কেবিনে এলাম। কি হয়েছে?

স্যার সেটা আপনি গেলেই বুঝতে পারবেন। কথাটি বলে নার্সটি চলে যায়। বড় স্যারকে আর কিছু খুলে বলার ক্ষ’মতা তার নেই।

রাওনাফ ম্যানেজমেন্ট রুমে ঢোকে। বাকি ডাক্তাররা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলো। তাকে দেখে সবাই চুপ হয়ে যায়। রাওনাফ লামিয়ার দিকে তাকায়। লামিয়া মাথা নিচু করে আছে।

একে একে সবাই তাকে সালাম দিয়ে চলে যায়।

লামিয়া বসে থাকে। রাওনাফ এসে দাঁড়ায়।

“কিছু হয়েছে লামিয়া? ইজ এভরিথিং ফাইন? সবাই এমন করছে কেন!”

লামিয়া একটি কাগজ রাওনাফের দিকে এগিয়ে দেয়। তার হাত কাঁপছে। চোখ মুখ শুকনো।

রাওনাফ কাগজটি হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে। রাওনাফের নাম উল্লেখ করে ম্যানেজমেন্টের কাছে যৌ’ন হয়রানির অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগ করেছে রুপা।
অভিযোগের বিষয় একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে রাওনাফ রুপাকে চাকরিচ্যুত করার হুমকি দেয় এবং পরে তার সাথে রাত কাটানোর প্রস্তাব দেয় এবং বলে তার কথা শুনলে তাকে তার চাকরিতে বহাল রাখা হবে। এবং মলেস্ট করার চেষ্টাও করা হয়।”

রাওনাফ কাগজটি সম্পুর্ণ পড়তে পারে না। সে ধপ করে চেয়ারে বসে পরে।
লামিয়া বলে,”রাওনাফ..!!”

রাওনাফ চেঁচিয়ে ওঠে,”আমি ইনোসেন্ট লামিয়া। আমি সত্যিই ইনোসেন্ট। ট্রাস্ট মি।”

লামিয়া বলে,”আই নো রাওনাফ। আই নো ইউ। তুমি চিন্তা করো না। এটা একটা সাধারণ অভিযোগ। কমিটি তদন্ত করতে আসবে। কোনো প্রমান পাবে না। তুমি ইনোসেন্ট রাওনাফ সেটা সবাই জানে। যাস্ট রিল্যাক্স।”

রাওনাফ কাগজটি কুটি কুটি করে ছিড়তে থাকে, চেঁ’চি’য়ে বলতে থাকে,”আমার ষোলো বছরের ডাক্তারি ক্যারিয়ারে তিল তিল করে গড়ে তোলা সম্মান,সব শেষ লামিয়া। সব শেষ।”

লামিয়া রাওনাফকে বলে,”কিচ্ছু শেষ না রাওনাফ। তুমি এক কাজ করো। বাড়ি চলে যাও। বাড়িতে গিয়ে আরাম করো। বাকিটা আমরা ম্যানেজমেন্টের লোক বুঝে নেবো। উর্বীকে গিয়ে বলো সব টা। ওর সাথে শেয়ার করো।”

রাওনাফ হতবাক হয়ে বলে,”কি বলছো তুমি লামিয়া? এসব আমি ওকে কিভাবে বলবো? কিভাবে ফেইস করবো ওকে আমি? ইউ নো হার। দুর্বলচিত্তের মহিলা। ক্ষণে ক্ষণে অসুস্থ হয়ে পরে! উর্বী এসব শুনলে শেষ হয়ে যাবে। সি ইজ ঠু মাচ সেন্সিটিভ। তুমি বলছো ওকে সব বলি? আর আমার বাচ্চারা! ওরা যদি এসব শোনে? ওরা বড় হয়েছে লামিয়া।”
গলা কাঁপছে রাওনাফের।

“না রাওনাফ। উর্বী খুবই বুঝদার একটি মেয়ে । সমস্যা তখন হবে যখন সে এসব কথা অন্য মানুষের থেকে শুনবে। তার চেয়ে ভালো তুমি নিজেই ওকে সবটা জানাও। আমি চাই তোমরা দুজনেই শান্ত থাকো। আমরা বিষয়টা দেখছি।”

রাওনাফ ভীত কন্ঠে বলে,”সব শেষ লামিয়া। কথাটা একবার উঠেছে তার মানে সবার মনেই সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। আমাকে সবাই ঐ চোখে দেখছে। সবাই সত্যতা প্রমাণিত হবার অপেক্ষায় নেই লামিয়া। আমাকে হয়তো ইতিমধ্যেই কেউ কেউ চরিত্রহীন ভেবে বসে আছে। কারন আমি পুরুষ। খুব সহজেই আঙ্গুল তোলা যায়।
রুপা মেয়েটা এমন কেনো করলো লামিয়া?”

লামিয়া শুকনো গলায় জবাব দেয়,”জানি না। তুমি প্লিজ শান্ত হও। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছি আমরা। যেখানে তুমি কিছু করোইনি সেখানে….তুমি প্লিজ বাড়ি যাও। প্লিজ রাওনাফ।”

রাওনাফ বসেই থাকে। উর্বী অনবরত রাওনাফের ফোনে ফোন দেয়। রাওনাফ ফোনটা রিসিভ করে না। খুব বিধ্বস্ত লাগছে তার নিজেকে। দুর্বল লাগছে খুব। এতোটা দুর্বল কখনোই লাগেনি নিজেকে।

চলমান…….

আরেকটি বার পর্ব-২৬+২৭

0

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_২৬
#Esrat_Ety

উর্বী ঘুমন্ত রাওনাফকে দেখছে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সেই তখন থেকে। চোখ ফেরায় না সে।

লোকটা কেমন বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টিয়ে ঘুমায়। ঘুমালে কি নিষ্পাপ দেখতে লাগে! ঘুমন্ত রাওনাফকে দেখে মনে হচ্ছে সে কোনো স্বপ্ন দেখছে। আচ্ছা কি স্বপ্ন দেখছে এই লোক? নিশ্চয়ই কোনো রোমান্টিক স্বপ্ন নয়। হয়তো দেখছে কারো অ’পারেশন করছে! অ’পারেশন থিয়েটারে নার্সদের ধমকা ধমকি করছে,”সিস্টার গজ কোথায়? স্টুপিড সিস্টার নাইফ কোথায়? আহাম্মক সিস্টার ব্লে’ড কোথায়?”
নিশ্চয়ই এসবই দেখছে,কপালটা কিরকম কুঁ’চ’কে আছে, স্বপ্নে সিস্টার আর ইনটার্ন ডক্টরদের ধমকাচ্ছে বলেই কুঁ’চ’কে আছে কপাল। দীর্ঘসময় পরে ধীরে ধীরে রাওনাফের কপালের সে রেখা বিলীন হয়। উর্বী ভাবে, অ’পারেশন নিশ্চয়ই সাকসেসফুল হয়েছে স্বপ্নে তাই কপাল আর কুঁ’চ’কে নেই!
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে উর্বীর হাসি পেয়ে যায়।

দৃষ্টি ঘুরিয়ে রাওনাফের গাঁয়ের দিকে তাকায় উর্বী। তাকাতেই লজ্জায় মিইয়ে যায় সে। গাঁয়ের চাদরটা কিছুটা সরে গিয়েছে, ফরসা, চওড়া, পুরুষালি উদাম লোমশ বুকের কিছুটা দেখা যাচ্ছে। উর্বী হাত বাড়িয়ে চাদরটা গলা অবধি টেনে দেয় ভালো করে। সে খেয়াল করলো এখন তার মধ্যে বিন্দুমাত্র সংকোচ নেই। নেই কোনো জড়তা। কেনোই বা থাকবে!
রাওনাফ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। উর্বীর একটু মানুষটার গালে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হলো হঠাৎ। ছুঁয়ে দেবে নাকি? না থাক। যদি রাওনাফের ঘুম ভেঙ্গে যায়!

তার হাত নিশপিশ করছে। সে ছুঁয়েই দেয়। আলতো করে গালে হাত রাখে। রাওনাফ মৃদু নড়তেই সে দ্রুত হাত সরিয়ে নেয়। রাতের সেই মধুর দৃশ্যগুলো তার চোখের সামনে পুনরায় দৃশ্যায়িত হয়, পুনরায় লজ্জায় গুটিয়ে যায় সে। রাওনাফের থেকে কিছুটা চাদর নিজের দিকে টেনে নিয়ে ঢেকে নেয় নিজের আলুথালু বেশ। এরপর অন্যপাশে ফিরে শোয়। চুপচাপ গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে জানালার দিকে দৃষ্টি দিয়ে। জানালাটা কাল রাতে বন্ধ করা হয়নি। পর্দাটাও একপাশে সরিয়ে রাখা। সকালের মিষ্টি কড়া রোদ এসে ঘরের ভেতর বেহায়ার মতো ঢুকে পরছে। অনুমতি নেয়না রাওনাফ-উর্বী দম্পতির।

রাওনাফের ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে উর্বী যখন তার গালে হাত রেখেছে তখনই। উর্বী ওদিক ফিরে শুতেই সে চোখ খুলে তাকায়। তারপর উর্বীর পিঠের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।

কিছুসময় পরে উর্বী উঠে বসে। রাওনাফ চোখ বন্ধ করে নেয়। বিছানায় অগোছালো হয়ে পরে থাকা উর্বীর বেগুনী রঙের সুতি শাড়ির আঁচল উঠিয়ে সে ভালো করে জরিয়ে নেয় নিজের শরীর। একটা মৃদু হাই তুলে অলস ভঙ্গিতে খোলা চুলগুলো খোঁপা করে নেয়। তারপর ঘুরে রাওনাফের দিকে একপলক তাকিয়ে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নামে। ঘরে পরার চপ্পলে পা ঢুকিয়ে আলমারির কাছে যায়,বেছে নেয় একটা পছন্দের শাড়ি।

কিচেনে হাসাহাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। উর্বী দোতলা থেকে কিছু শুনতে পাচ্ছে না। বাড়িতে তো মহিলা বলতে শুধু রওশান আরাই রয়েছেন। আমীরুনও বাড়িতে নেই। কারা কথা বলছে তবে!

উর্বী তাড়াহুড়ো করে সিড়ি ভেঙ্গে নামছে। ইতিমধ্যে সকাল সাড়ে নয়টা বেজে গিয়েছে। রাওনাফ আজ এগারোটায় চেম্বারে বসবে, রান্নাঘরের কি অবস্থা কে জানে! আমীরুন নেই,কাল উর্বীও বিকেল থেকে ঘরেই বন্দী হয়ে ছিলো। বাইরে এসে একটাবার দেখেওনি কেউ রাতে খেয়েছে কি না। শর্মীর আজ স্কুল ছুটি তাই তাকে টিফিন করে দেওয়ার ঝামেলা নেই তবে ছেলেমেয়েগুলো এতো সকাল অবধি না খেয়ে আছে ভেবেই কেমন অপরাধবোধ হতে থাকে উর্বীর। এখন ঝটপট করে সব করে নিতে হবে তার!

কিচেনের দিকে এগিয়ে যেতেই উর্বী দাড়িয়ে যায়। তার ননদেরা জায়েরা চারজনই রান্নাঘরে। উর্বী কিছুটা অবাক হয়ে তাকায় সবার দিকে। অন্তরা কিচেনে শুকনো মুখ করে একটা চেয়ারে বসে ছিলো। বাকি তিনজন কাজ করছে। উর্বীকে দেখে রুমা পাত্তা না দেওয়ার মতো করে বলে ওঠে,”উঠেছো ভাবী! তুমি আজ গ্রিলড পমফ্রেট করবে। সেদিন খেয়েছিলাম। কি যে ভালো করো ওটা!”

উর্বী অস্ফুট স্বরে বলে,”তোমরা?”

_ভাবছো আমরা কোত্থেকে উদয় হলাম তাইনা? আমি উদয় হয়েছি আমার শশুর বাড়ি থেকে,বড় আপা তার শশুরবাড়ি থেকে আর মেজো ভাবী আর অন্তরা চট্টগ্রাম থেকে উদয় হয়েছে। ভোর ভোর এসে পৌঁছালাম সবাই।

এক নাগাড়ে জবাব দেয় রুমা। উর্বী অন্তরার দিকে তাকায়। খুব মায়া লাগে ঐ মুখটা দেখলে। এগিয়ে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,”কেমন আছো? তোমার স্বামী আসেনি?”

অন্তরা মাথা নাড়ায়, অস্ফুট স্বরে বলে,”এসেছে। রেস্ট নিয়ে বাজারে গিয়েছে।”

উর্বী সবার দিকে তাকায়। মোহনা বলে,”শাফিউলের কলেজ থেকে ছুটি পায়নি। আমি কতদিন সবাইকে দেখিনা। অন্তরাও বারবার বলছে বাড়ি আসতে চায়, তাই জন্য এলাম হুট করে সবাই। ভাইয়া তোমায় কিছু বলেনি?”

উর্বী মাথা নাড়ায়। সে এসবের কিছুই শোনেনি। মোহনা উর্বীর দিকে এগিয়ে আসে। অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে উর্বীকে দেখে মিটিমিটি হাসে। তারপর বলে,”তোমাকে কি সুন্দর লাগছে ভাবী! একেবারেই স্নিগ্ধ লাগছে। আমার দাদী বলেন ভেজা চুলে রমনী যখন সুপ্রভাতে রান্নাঘরে পা রাখে,তখন রমনীর সেই স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে রান্নাঘরের সৌন্দর্য দ্বিগুণ বেড়ে যায়।”

উর্বী মোহনার কথা প্রায় এড়িয়ে গিয়ে থালাবাটি নাড়াচাড়া করতে থাকে। মোহনা হাসছে, মোহনার সাথে পাল্লা দিয়ে হাসছে রুমা। দু’জনেই প্রায় সমবয়সী কিনা।

আজমেরী চুলা থেকে চায়ের পাতিল নামিয়ে উর্বীকে উদ্দেশ্য করে বলে,”উর্বী…. দুঃখিত, ভাবী, তুমি যাও। আমরা এদিকটা দেখবো।তুমি গিয়ে দেখো ভাইজানের কি লাগবে,তার তো আজ চেম্বার আছে।”

মোহনা হাসতে হাসতে বলে ওঠে,”ভাইয়ার আবার কি লাগবে, ভাইয়ার যা লাগবে তা কাল….”

উর্বী মুখ চেপে ধরে মোহনার। আশেপাশে তাকিয়ে কন্ঠস্বর নিচু করে অনুরোধের সুরে বলে,”প্লিজ মোহনা, ওরা তিন ভাইবোন লিভিং রুমে পায়চারি করছে।”

সবাই চুপচাপ হয়ে যায়। উর্বী রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দোতলায় উঠতে থাকে। আজ ঘর থেকে বেরোবেই না সে।

ঘরের দরজার সামনে এসে উর্বী দাঁড়িয়ে যায়। ভেতরে আর পা রাখে না সে। অস্বস্তিতে পুরো মুখ ছেয়ে গেছে তার। ঘরের ভেতরে পা রাখবে কি রাখবে না তাই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে সে। রাওনাফ ফ্রেশ হয়ে বিছানায় একপাশে চুপচাপ বসে আছে। তার হাতে শিমালার ছবিটা। একদৃষ্টে ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে। মাথা নিচু করে রেখেছে বলে উর্বী তার দৃষ্টি পড়তে পারছে না। সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে দরজার বাইরে, এই সময়ে ঘরে ঢুকে ঐ মানুষটাকে অস্বস্তিতে ফেলতে সে ইচ্ছুক নয়, একেবারেই নয়।

“আন্টি ! এখানে দাঁড়িয়ে কি করছো!”
শর্মীর ডাকে উর্বী ঘুরে তাকায়। রাওনাফ মাথা তুলে তাকায়। উর্বী নিচুগলায় শর্মীকে বলে,”এমনিই দাঁড়িয়ে আছি। কিছু বলবে?”

_হ্যা। আজ বিকেলে আমি আর আপু শাড়ি পরবো। তুমি পরিয়ে দেবে?

উর্বী হেসে মাথা নাড়ায়। শর্মী চলে যায় নিজেদের ঘরের দিকে। রাওনাফ শিমালার ছবিটা রেখে উঠে দাঁড়ায়। ঘরের বাইরে এসে উর্বীর সামনে দাঁড়িয়ে বলে,”কি হয়েছে? এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

উর্বী নিচুগলায় বলে,”এইতো ঘরেই ঢুকছিলাম।”

রাওনাফ চারপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে উর্বীর হাত ধরে। তারপর ঘরের ভেতর নিয়ে যায়। উর্বী তার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। সে খেয়াল করেছে,এই মানুষটা তাকে ছুলেই সে নতুন করে তার অস্তিত্ব টের পায়। উর্বীর অস্তিত্বহীনতার জটিলতা কে’টে যায় এই মানুষটার স্পর্শে। সম্মোহিত হয়ে থাকে উর্বী।

ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে রাওনাফ উর্বীর হাত ছেড়ে দেয়। তারপর টেবিলের ওপর থেকে একটা কাগজ এনে উর্বীর হাতে দেয়। উর্বী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়, অস্ফুট স্বরে জানতে চায়,”কি এটা?”

_তোমাকে ডেকেছে এলজিডি থেকে, ইন্টারভিউয়ের জন্য!

_জব? কিন্তু আমি তো এপ্লাই করিনি! আগেরটাই তো স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলাম!

_আমি দিয়েছিলাম তোমার সিভি জমা।

উর্বী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”চাকরি বাকরি করতে চাচ্ছি না আমি আর!”

_কিন্তু কেনো? কোয়ালিফিকেশন আছে, এক্সপেরিয়েন্স আছে। তুমি তো নিজেও চাইতে। হঠাৎ কেন এই সিদ্ধান্ত?

উর্বী চুপ করে থাকে। রাওনাফ তাকিয়ে আছে তার দিকে। উর্বী একপলক রাওনাফের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে বলে,”অনেক আত্মনির্ভরশীল আত্মনির্ভরশীল খেলা খেলেছি। এখন আমি পুরোপুরি আপনার ওপর নির্ভরশীল থাকতে চাই। আমার স্বামীর ওপর। এই সংসার ছাড়া আর কিছুতে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই।”

কথাগুলো বলে উর্বী বারান্দায় চলে যায়। গিয়ে রাওনাফের কবুতরগুলোকে খাবার দেয়। খোলা দরজা দিয়ে তাকে দেখতে থাকে রাওনাফ।

****
উচ্ছাস গিয়ে চুপচাপ শাখাওয়াত চৌধুরীর পাশে বসে। শাখাওয়াত চৌধুরী নিউজপেপার থেকে চোখ সরিয়ে তার দিকে একপলক তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,”হেয়ারস্টাইল চেঞ্জ করেছো! দেখতে ভালো লাগছে। এখন কিছুটা সভ্য লাগছে!”

উচ্ছাস বাঁকা হাসি হাসে। বাবার কথার জবাবে বলে ওঠে,”কেনো ডেকেছো?”

_আসার পর থেকে ঘরে ঢুকে বসে আছো। সারাদিন ল্যাপটপ আর গিটার। সমস্যা কি তোমার?

_আর কি করবো তবে? খু’ন করবো?

উচ্ছাস বলতে বলতে হেসে ফেলে।‌ শাখাওয়াত চৌধুরী ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে,”সেন্টমার্টিন কেনো গিয়েছিলে বলো!”

_হাওয়া খেতে।
ঠান্ডা গলায় বলে উচ্ছাস।

_এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলো না।

উচ্ছাস আগের চাইতেও দৃঢ় গলায় বলে,”তাহলে শোনো। ওখানে গিয়েছিলাম একটা মা’র্ডা’র করতে। মেরে বালি চাপা দিয়ে এসেছি!”

শাখাওয়াত চৌধুরী একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”তোমার মেজো চাচার ছেলে তোমার বয়সী। সে বিয়ে করে বৌ বাচ্চা নিয়ে বাবার ব্যাবসা সামলাচ্ছে। আর আমিই এক হতভাগ্য পিতা যে কিনা ছেলে জেল থেকে ছুটবে কবে তার অপেক্ষায় এতদিন হেদিয়ে ম’রেছি। কি পাপ করেছিলাম কে জানে।”

উচ্ছাস চুপ। শাখাওয়াত বলতে থাকে,”তখন তোমার ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে শুনলাম সজীবের কাছে জানতে চাইছো উর্বীর খবর। কি চাইছো কি তুমি। উর্বী এখন বিবাহিতা উচ্ছাস।”

উচ্ছাস বাবার কথায় পাত্তা না দিয়ে একটা সিগারেট ধরায়, শাখাওয়াত সেদিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”বাবার সামনে সিগারেট খাচ্ছো!”

উচ্ছাস কিছুক্ষণ হাসে। হেসে বলে,”তুমি যেখানে জানো আমি এসব খাই সেখানে তোমাকে লুকিয়ে এসব খাওয়াটা ন্যাকামী। এসব ন্যাকামী উচ্ছাসের চরিত্রের সাথে যায়না।”

শাখাওয়াত চৌধুরী ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। উচ্ছাস সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে বলে,”কি? রিহ্যাবে দিতে চাচ্ছো আবার? দুইবার পাঠালে। ঠিক তো হলাম না!”

শাখাওয়াত চৌধুরী কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”রিহ্যাবে পাঠাবো না আর, সামনের মাসে ফ্রান্স চলে যাবে তুমি, ছেলে ভালো হবে এই আশা আমি আর করি না, ছেলে বেঁচে থাকুক শুধু এটুকুই চাই।”

****
ঘর গোছাতে গোছাতে একবার রাওনাফের দিকে আড়চোখে দেখে উর্বী। রেডি হয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসে পরেছে। উর্বী কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করেনা। শাড়ীর আঁচল কোমরে গুঁজে বিছানার চাদর ঠিক করে দেয়। রাওনাফ মাথা তুলে একপলক উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”ব্যস্ত নাকি!”

_না কিছু বলবেন?

_আমার ওয়ালেট থেকে আ’ই’ডিকার্ড টা দাও। একটু দরকার।

উর্বী হাত থেকে বালিশ রেখে গিয়ে টেবিলের ওপর থেকে রাওনাফের ওয়ালেট তুলে নেয়। ওয়ালেট থেকে রাওনাফের আ’ই’ডিকার্ড বের করতে গিয়ে দেখতে পায় ওয়ালেটে শিমালার বহু আগের একটা ছবি। রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী একদৃষ্টে রাওনাফের ওয়ালেটের দিকে তাকিয়ে আছে,অন্যদিকে কোনো খেয়াল নেই তার।
রাওনাফ ল্যাপটপ রেখে উঠে দাঁড়ায়। উর্বীকে ঘুরিয়ে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে তার হাত থেকে ওয়ালেট টা নিয়ে আ’ই’ডিকার্ড টা বের করে নেয়। উর্বীর দিকে একপলক তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলতে থাকে,”স্বভাবে একটু নেইভ ছিলো। চঞ্চল। সবসময় বলতো আমি কেন ওর ছবি ওয়ালেটে রাখি না। আক্ষেপ ছিলো ওর এটা নিয়ে। এই সব ব্যপার তখন আমার কাছে খুব কৃত্রিম লাগতো। এই ছবিটা ওর মৃত্যুর পর রেখেছি। ও দেখে যেতে পারেনি।”

উর্বী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”বেশ তো। আমি হুট করে মরে গেলে আমার ছবিটাও এভাবে রেখে দেবেন।”

রাওনাফ চ’ম’কে ওঠে। উর্বীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কপাল কুঁ’চ’কে ফেলে, দৃঢ় কিন্তু নিচু স্বরে বলে,”সবকিছু নিয়ে মজা করতে হয়না উর্বী।”

_আমি মজা করিনি। ম’রতেই তো পারি তাই না? মৃত্যু কি আমার হাতে? ওপর ওয়ালার ইচ্ছে হলে আজই….

উর্বী থেমে যায় রাওনাফের কঠিন দৃষ্টি দেখে। তারপর প্রসঙ্গ পালটে বলে,”ওনার মৃত্যু হয়েছে কিভাবে? এ’ক্সি’ডেন্টে শুনেছি। কিভাবে হলো?”

_ট্রাকের সাথে গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ। ও নাবিল শায়মীকে স্কুলে দিয়ে আমার হসপিটালে যাচ্ছিলো শর্মীকে নিয়ে, শর্মীর বয়স তখন তিন বছর। ড্রাইভার সেখানেই মারা যায়।
আমি তখন একটা ও.টি. তে ছিলাম। বের হয়ে দেখি সব শেষ। একটু সময় দিলো না আমাকে,একটু কথা বলার সুযোগ দেওয়া হলো না আমাকে। বোকার মতো ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ভাবছিলাম আমার সাথে সবাই হয়তোবা মজা করছে। মানুষটা সকালে আমার সামনে বাচ্চাগুলোকে খাওয়ালো,আমাকে জরিয়ে ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকলো, আমার টিফিন করে দিলো। তার নিথর দেহটা আমি তখন সত্যি মেনে নিতেই পারছিলাম না। খুবই আশ্চর্যজনক ভাবে ছোটো শর্মী সম্পূর্ণ অক্ষত ছিলো। সবথেকে কষ্টের বিষয় কি জানো উর্বী? আমি একটু কথা বলতে চেয়েছিলাম ওর সাথে। আমি ও.টিতে না থাকলে সম্ভবত সুযোগ পেতাম। আমার এই আফসোস কোনোদিনও মিটবে না। এই গ্লানি কখনও ঘুচবে না আমার।

কথাগুলো বলতে বলতে রাওনাফ আবেগতাড়িত হয়ে পরে। যেনো ভেঙেচুরে যাচ্ছে সে,আর কিছু বলার ক্ষমতা নেই। উর্বী অস্বস্তিতে পরে যায়,কেনো যে সে এই প্রসঙ্গটা টানলো!

খানিক বাদে রাওনাফ নিজেকে নিজে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলে,”আমি আসছি। টেইক কেয়ার!”
কথাটা বলে রাওনাফ উর্বীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে যায়। উর্বী একদৃষ্টে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ তারপর রাওনাফ যেখানে স্পর্শ করে দিয়ে গিয়েছে সেখানে হাত রাখে।

****
“সোজা হয়ে দাড়াও মেয়ে।”

শর্মী খিকখিক করে হাসছিলো আর নড়ছিলো। উর্বী শাড়ির কুচিগুলো ঠিকঠাক ভাবে দিতে পারছিলো না। উর্বীর ধ’ম’কে শর্মী চুপ হয়ে যায়।
শায়মী পাশে শুধু মাত্র পেটিকোট আর ব্লাউজ পরে দাঁড়িয়ে আছে। শর্মীকে শাড়ী পরানো হয়ে গেলে উর্বী তাকে পরিয়ে দেবে।

খানিক বাদে উর্বী বলে ওঠে,”তোমার চাচীরা আর ফুপিরা কোথায়? কোথাও বেরিয়েছে?”

_না তো। বাড়িতেই আছে। তারা নিচতলার লিভিং রুমে। ওখানে এক প্রতিবেশী দাদী এসেছে। আমরা বলি প্যাকপ্যাক দাদী। সারাদিন কথা বলে, ননস্টপ।

উর্বী হাসে। শায়মী বলতে থাকে,”তোমাকে একটা সাজেশন দিই আন্টি। নিচ থেকে যদি কেউ ডাকতে আসে তাহলে ভুলেও যাবে না। এই মাত্র দেখে এলাম অন্তরা আর মোহনা চাচীর মাথা ধরিয়ে দিয়েছে জ্ঞান দিতে দিতে।”

শর্মী সাথে সাথে বলে ওঠে,”আমাদের দাদী প্যাকপ্যাক দাদীর কাছে কিছুই না। এত্তো কথা বলে!”

উর্বী ধ’ম’ক দিয়ে বলে,”ছিঃ শর্মী! দাদুর নামে এভাবে বলতে হয়? বৃদ্ধারা একটু কথা বলে।”

শর্মী খিকখিক করে হাসছে। তারপর উর্বীকে হাসানোর জন্য অবিকল রওশান আরাকে নকল করে বলে ওঠে,”বড় বৌমা! আমার বড় খোকা এসেছে কি না দেখো তো!”

উর্বী শর্মীর শাড়ির কুচিগুলো কোমোরে গুজে দিয়ে অবাক হয়ে শর্মীর দিকে তাকায়। শায়মী আর শর্মী পেটে হাত চেপে হাসছে। শায়মী নাকি সুরে দাদীকে নকল করে বলে ওঠে,”বৌমা! তুমি এখন খেও না। আমার বড় খোকার সাথেই খেও।”

উর্বী দুই বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। শর্মী পুনরায় বলে ওঠে,”বৌমা আমার বড় খোকার ঠান্ডা লেগেছে তার সর্দি মুছে দাও!”

উর্বী কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে উচ্চশব্দে হেসে ফেলে। দুই বোনের মুখ ঝলমল করছে তৃপ্তিতে,উর্বীকে হাসাতে পেরে। উর্বী শর্মীর মাথায় গাট্টা মেরে বলে,”আমি তোমাদের দুটোকে ভুল বুঝেছিলাম। তোমরা আস্ত ফাজিল।”

শর্মী বলে,”আমি তোমারও মিমিক্রি করতে পারি। দেখবে আন্টি?”

_দেখাও।

শর্মী গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,”মা! আপনি ওষুধ খেয়ে নিন মা। মা আপনি চেচাবেন না মা। মা আপনি মিষ্টি খাবেন না মা,আপনার বারণ আছে।”

উর্বী হাসতে থাকে,শর্মী বলে,”এবার পাপার মিমিক্রি করবো।”

শায়মী বলে,”শর্মী পাপারটা আমি করবো প্লিজ।”

_আচ্ছা কর আপু।

শায়মী গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,”তুমি যা বলবে তাই হবে মা!
শর্মী আই ডিডন্ট এক্সপেক্ট দিস ফ্রম ইউ! যাও অংক বই নিয়ে এসো!
শায়মী তোমার ফোন আমার কাছে দাও,আর গিয়ে পড়তে বসো।
নাবিল জেদ করবে না! আমার কথা শোনো।
মা তুমি শান্ত হও,আমি তোমার কথা শুনবো মা!”

উর্বী মুখে শাড়ির আঁচল চে’পে ধরে হাসছে। শর্মী বলতে থাকে,”এবার ভাইয়াকে নকল করবো………”

কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে শর্মী বলে ওঠে,”আমাকে কেউ ভালোবাসে না। পাপা ভালোবাসে না,দাদু ভালোবাসে না,তোরা ভালোবাসিস না। কেউ ভালো বাসে না। কেউ না কেউ না কেউ না।”
নাবিলের বাচনভঙ্গি অবিকল নকল করে শর্মী বলে।

উর্বী মেয়ে দুটোর দুষ্টুমিতে মেতে উঠেছে। শায়মীকে শাড়ি পরিয়ে দিতে দিতে বলে,”আরো নকল করে দেখাও।”

শায়মী বলে,”ছোটো চাচ্চুকে করি?”

_করো।

শায়মী বলে ওঠে,”অন্তু! অন্তু আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি অন্তু।”

উর্বী হেসে বলে,”আর অন্তরা কি করে?”

শায়মী অন্তরাকে নকল করে বলে,”সামিউল! আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি সামিউল।”

উর্বীর হাসি থামছেই না। শায়মী বলতে থাকে,”ছোটো চাচ্চু আর ছোটো চাচী সারাদিন এই একটা বাক্য ছাড়া আর কিছু বলে না। তাই আর কি নকল করবো?”

উর্বী বলে,”আমার উচিৎ ছিলো এসব ভিডিও করে রাখা। তোমরা যে কি বিচ্ছু! সবাইকে দেখানো উচিত।”

শায়মী লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসে। উর্বী বলে,”এবার আমি মিমিক্রি করি তোমাদের?”

দুই বোন উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী শর্মীর দিকে তাকিয়ে শর্মীকে নকল করে বলে,”আন্টি! আমার খুব হিসি চেপেছে। কিন্তু আমার খুব ভয় করছে। তুমি একটু ওয়াশরুমের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে?”

এরপর উর্বী শায়মীর দিকে তাকাতেই শায়মী উর্বীর মুখ চেপে ধরে বলে,”প্লিজ আন্টি আমাকে রোস্ট করবে না।”

উর্বী শায়মীর হাত নামিয়ে হাসতে হাসতে বলে,”ঠিকাছে। করবো না।”

শায়মী উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি শাড়ি পরবে না আন্টি?”

_আমি তো শাড়ি পরেই আছি।

_আরে এটা না। পাপা যেটা দিয়েছিলো সেটা। আমরা তো আজ পাপাকে দেখাবো বলে পরেছি। তুমি দেখাবে না?

উর্বীর মুখ ছেয়ে যায় লজ্জায়। দুই কিশোরী সেই লজ্জার গভীরতা বুঝতে পারেনা। তারা নিজেরা নিজেরা কথা বলছে। শর্মী বলতে থাকে,”আমাদের তিনজনের শাড়িই সবুজ রঙের দেখেছো আন্টি,দেখে মনে হচ্ছে আমরা বাংলাদেশের পতাকা।”

উর্বী হাসছে। শর্মী বলে,”স্বাধীনতা দিবসের প্রোগ্রামে এই শাড়িটা পরে নাচবো, পাপা সেজন্যই এনেছে সম্ভবত এই রঙটা। পাপা খুব দেশপ্রেমী।

“একাত্তরের মা জননী! কোথায় তোমার মুক্তি সেনার দল!”

গানের লাইনটা বলে শর্মী হাত দিয়ে মিছিল দেওয়ার মতো মুদ্রা করে দেখাতে থাকে। উর্বী দেখতে থাকে সহজ সরল কিশোরী দুটোকে। কত চঞ্চল! কত স্নিগ্ধ ! উর্বী ভাবে তার জীবনের পরিপূর্ণতায় এই কিশোরী মেয়ে দুটির অবদানও অনস্বীকার্য!

****
“স্যার রিপোর্ট গুলো এনেছি!”

_রেখে যাও।

নার্স টেবিলের ওপর রিপোর্ট গুলো রেখে চলে যায়। রাওনাফ ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত এগারোটা বেজে গিয়েছে। আজ কথা ছিলো বাড়ির সবার সাথে ডিনার করবে কিন্তু ব্যস্ততার জন্য পারেনি। আজমেরী,শায়মী ফোন দিয়েছিলো। তারপর ফোন দিয়েছে শর্মী,বলেছে তার জন্য সারপ্রাইজ আছে। কিন্তু রাওনাফ যেতে পারেনি। রেগে গিয়েছে দু’টো মেয়ে‌।

মেসেজের টুং টাং আওয়াজে রাওনাফ ফোনটা হাতে তুলে নেয়। উর্বীর মেসেজ,”আপনার কি দেরী হবে? শর্মী শায়মী আপনাকে দেখাবে বলে শাড়ি পরেছিলো। এখন রাগ করে খুলে ফেলেছে।”

রাওনাফ ম্লান হাসে, একদৃষ্টে মেসেজটার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। প্রকৃতিতে সব ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। তার জীবনে হচ্ছে।
পুরনো দিনগুলো নতুন করে,নতুনরুপে ফিরে আসছে তার জীবনে। ২০১৪ সালের কথা। শিমালাও এভাবে বার্তা পাঠিয়ে দিতো হুট হাট। ছেলে মেয়ে গুলোর কথা জানানোর অযুহাতে। রাওনাফ উত্তরে লিখতো,”আর তাদের মাম্মা কি করছে?”
সবকিছু কেমন রিপিট হচ্ছে। রাওনাফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একই ভাবে একটা উত্তর লিখে দেয়,”আর তাদের আন্টি কি করছে?”

মেসেজ টা পাঠিয়ে রাওনাফ বসে থাকে। খানিক বাদে উর্বীর থেকে রিপ্লাই আসে। রাওনাফ রিপোর্ট দেখতে দেখতে হাত বাড়িয়ে ফোনটা নেয়,উর্বীর জবাব,”তাদের আন্টি পানি খাচ্ছে।”

রাওনাফ হাসে। অতীতের পুনরাবৃত্তি দেখে হাসে। দুজন রমনী একই রকমের। চঞ্চল,স্বভাবে রয়েছে বাচ্চামো, খুনশুটি কিন্তু আদুরে।

হসপিটালে নিজের কেবিনে গা এলিয়ে দিয়ে মেসেজ দেখে হাসছে রাওনাফ। আর তার গৃহে,তার বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিজের পাঠানো মেসেজটার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে উর্বী।

চলমান……

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_২৭
#Esrat_Ety

বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে ছিলো সে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় রাত প্রায় বারোটা বেজে গিয়েছে। ডাক্তার এখনও ফেরেননি। তবে খুব সম্ভবত কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরবেন।
উর্বী অলসতা কাটিয়ে উঠে বসে। ধীরপায়ে হেটে সে আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আলমারি খুলে রাওনাফের দেওয়া শাড়িটা বের করে হাতে নেয়। শায়মী বিকেলে যখন বলছিলো শাড়িটা পরতে উর্বীর তখনই শাড়িটা পরে নিতে মন চাচ্ছিলো কিন্তু তার দস্যি ননদ আর জা’দের জালাতনের কথা কল্পনা করে তখন পরেনি। তবে এই রাতে,যখন সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে তখন তো একটু সাজাই যায়!

উর্বী শাড়িটাতে হাত বোলাতে বোলাতে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। কি লাভ! ডাক্তার থোরাই তাকে খেয়াল করে দেখবে! শুধু মুখের দিকে তাকিয়ে বলবে,”আনারের জুস খেয়েছিলে? দেখে তো মনে হচ্ছে না।”
দেখবে কি! সে হয়তোবা ভুলেই গিয়েছে এই শাড়িটা সে কিনেছিলো উর্বীর জন্য পছন্দ করে।

উর্বী তবুও শাড়িটা পরবে। সে ডাক্তারকে দেখানোর জন্য পরছে না। সে পরছে নিজের জন্য। তার স্বামীর দেওয়া প্রথম উপহার সে গায়ে জরিয়ে রাখবে।

****
রাওনাফ বুঝতে পারছে না সে কি করবে। তার পা ধরে বসে থাকা তরুণী তাকে ছাড়ছে না। রাওনাফ নিজের পা ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। একসময় সে ধ’ম’কে ওঠে।
“স্টপ রুপা। পা ছাড়ো বলছি। যা বলার ওখানে বসে বলো। ”

রুপা উঠে বসে। রাওনাফ খুবই বিব্রত বোধ করছে। রুপা নামের মেয়েটি নিজের চোখের পানি মুছে ফেলে, বলে,”স্যার আমি চাকরি টা হারাতে চাই না। আমি শেষ হয়ে যাবো স্যার। আমার ফ্যামিলি শেষ হয়ে যাবে। ”

_দেখো এখন তো আমি কিছু করতে পারবো না রুপা। তোমার জন্য আজ দুজন রোগীর জীবন যেতে বসেছিলো। রোগীর ফ্যামিলি রীতিমতো মামলা করতে গিয়েছিলো হসপিটালের নামে। এটা আমার হসপিটালের ইমেজের ব্যাপার রুপা।

মেয়েটি কাঁদতে থাকে। রাওনাফ বুঝতে পারছে না তার কি করা উচিৎ।
মেয়েটি ফোপাতে থাকে। “স্যার আমি এই ভুল আর দ্বিতীয়বার করবো না। আমার চাকরি টা আমি চাই। প্লিজ আমাকে বের করে দিবেন না।”

রাওনাফ চুপ করে আছে।
মেয়েটি বলে,”আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো। বলুন কি করতে হবে। প্রয়োজনে আপনার সাথে রাত কাটাতেও আমি রাজি কিন্তু দয়া করে আমার চাকরি টা আপনি কেড়ে নেবেন না স্যার।”

রাওনাফ রুপা মেয়েটির দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে।‌ মুহুর্তেই দাঁতে দাঁত চেপে সে টেবিলে সজোরে একটি চাপর দেয়।

রুপা লাফিয়ে ওঠে।
রাওনাফ ধ’ম’কে বলে,”আউট! যাস্ট গেট লস্ট। আই সেইড আউট!!”

রুপা কাঁদতে কাঁদতে বেড়িয়ে যায়।

রাওনাফ কিছুক্ষণ থম মে’রে বসে থেকে দু হাত দিয়ে চুল গুলো পেছনে ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ১৬ বছরের ডাক্তারি জীবনে এই জ’ঘন্য অভিজ্ঞতা তার কখনোই হয়নি।

****
উর্বী শাড়ির আঁচল গায়ে তুলে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে আয়নায়। সব ঠিকঠাক। তবে সমস্যা হচ্ছে তার গাঁয়ের ব্লাউজটা লাল রঙের। সবুজ রঙের শাড়ি,সাথে লাল রঙের ব্লাউজ। উর্বীর কাছে নিজেকে বাংলাদেশের পতাকা লাগছে,যেমনটা শর্মী বলেছিলো। কিন্তু তার কাছে সবুজ রঙের ব্লাউজ নেই। এই শাড়ির সাথে আর কোন রঙটা যাবে সেটাও সে বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ আয়নায় নিজেকে দেখে উর্বী কপাল কুঁ’চ’কে চলে যায় কাবার্ডের কাছে,কাবার্ড খুলে সে এবার বেছে বেছে একটা সাদা রঙের ব্লাউজ বের করে। তার হঠাৎ মনে হলো সাদা রঙটা সব একরঙা শাড়ির সাথেই মানায়। ব্লাউজ পাল্টে সে শাড়ির আঁচল ঠিক করে আবারও আয়নায় নিজেকে দেখে। কিন্তু এইবার সে নিজেকে দেখে রীতিমত হতাশ! সাদা-সবুজের সংমিশ্রণে এখন তাকে একটা পাকিস্তানের পতাকার মতো লাগছে। উর্বী প্রচন্ড বিরক্ত হয়। সে দ্রুত গিয়ে সাদা রঙের ব্লাউজ পাল্টে লাল রঙের ব্লাউজটাই পরে নেয়। পাকিস্তানের পতাকা হওয়ার চাইতে বাংলাদেশের পতাকা হওয়া ভালো। উর্বী দেশপ্রেমী!
এসব করতে করতেই উর্বীর আধাঘণ্টা কেটে যায়। তখন ঘড়িতে সময় রাত সাড়ে বারোটা।

বাইরে রাওনাফের গাড়ির হর্ন বেজে ওঠে। উর্বী দোতলার জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে, তারপর গিয়ে বিছানায় চুপচাপ বসে থাকে। এতো রাতে ডাক্তার যদি দেখে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নটাঙ্কি করছে সেটা উর্বীর কাছে খুবই লজ্জার। তবে সে খুব করে চাচ্ছে রাওনাফের দেওয়া শাড়িটাতে রাওনাফ তাকে দেখুক,খেয়াল করুক, সে তো আর নিজে নিজে বেহায়াদের মতো বলতে পারবে না,”শুনছেন? আমাকে কেমন লাগছে!”

রাওনাফ ক্লান্ত মুখ নিয়ে ঘরে ঢুকতেই উর্বী বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। রাওনাফ চোখ তুলে উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বীর ঠোঁটে ছেয়ে আছে স্বামীর প্রতি আন্তরিক হাসি। রাওনাফ হঠাৎ টের পেলো ঐ হাসিতে তার সারাদিনের ক্লান্তি,গ্লানি,বিরক্তিভাব হঠাৎ কোথায় যেন মিলিয়ে গেলে। কেমন স্বস্তি লাগছে খুব। চারপাশটা অদ্ভুত প্রশান্তিদায়ক ঠেকছে। ঐ যে কথায় বলেনা? “ইটস্ মাই প্লেস!” সেরকম প্রশান্তিদায়ক ঠেকছে এই চারদেয়ালের কামড়াটা। যেটা দীর্ঘ দশ বছর তাকে খুব একটা স্বস্তি দিতো না। দিনের শেষে বাধ্য হয়ে ঢুকতো এখানে। হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নির্ঘুম রাত্রি যাপন করতো। বিছানাটাকে,এই ঘরটাকে তার কাছে একটা অন্ধকার মরুভূমি মনে হতো,যেখানে সে পরে থাকতো একটা বিন্দুর মতো।

রাওনাফ এগোনোর আগেই উর্বী গিয়ে তার হাত থেকে ব্যাগ আর এপ্রোন নিয়ে নেয়। রাওনাফ তার দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী রাওনাফের দৃষ্টি ধরতে না পেরে বোকার মতো বলে ওঠে,”কি দেখছেন! আমি আনারের জুস খেয়েছি কিছুক্ষণ আগে!”

রাওনাফ হেসে ফেলে তারপর হাই তোলার ভান করে বলে,”শাড়িটাতে ভালো লাগছে তোমাকে। মোটেও গাছের মতো লাগছে না।”

উর্বী ঘুরে দাঁড়ায়। তার ঠোঁট প্রশ্বস্ত হয় হাসিতে। মানুষটা তাহলে খেয়াল করেছে!

রাওনাফ ফ্রেশ হয়ে বের হয়। ওয়ারড্রব থেকে টুপি বের করে। উর্বী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাওনাফকে দেখে বলে ওঠে,”মুড অফ আপনার?”

_না তো! একটু স্ট্রেসড্ !

আজ জামাতে এশার সালাত আদায় করতে পারেনি। দেরী হয়ে গেছে অনেক। উর্বী বিছানায় বসে বসে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। সালাত আদায় করে উঠে দাঁড়াতেই উর্বী বলে,”কিছু খাননি তো বোধ হয়।”

_হু,সময় পাইনি। আজ মেন্যুতে কি কি ছিলো?

_গ্রিলড পমফ্রেট, ভেজিটেবল চিকেন, চিকেন রোস্ট আর বিফ।

_এতোকিছু! কে রেঁধেছে? তুমি?

_হ্যা।

রাওনাফ হাসে। বলে,”ওরা তোমাকে দিয়ে বড্ড খাটায় তাই না?”

উর্বী মাথা নাড়ায়, অস্ফুট স্বরে বলে,”আমার খাটতে ভালো লাগে।”

রাওনাফ বলে,”ঠিকাছে। এতো রাতে আমি কিছু খাবো না আর। এক গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পরবো। আর তুমিও রোজ রোজ এতো রাত অবধি জেগে থেকো না। যাও শুয়ে পরো।”

_আমি আপনার জন্য ডাব চিংড়ি করেছিলাম।
আটকে আটকে কথাটা বলে উর্বী।

রাওনাফ প্রথমে শুনতে না পেয়ে বলে,”কি?”

_ডাব চিংড়ি।
নিচুস্বরে বলে উর্বী।

রাওনাফ কিছুক্ষণ উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। আচার আচরণ, কথাবার্তা, সবকিছুতে তরুণী বধুদের মতো সংসারের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ পায়, এই আগ্রহ টুকু উপেক্ষা করা কোন পুরুষের সাধ্যি?

তারপর একটা নির্মল হাসি দিয়ে বলে,”চলো। তবে ভাত খাবো না। শুধু মাছটা খাবো।”

উর্বী মুচকি হেসে মাথা নাড়ায়।

খাবার টেবিলে রাওনাফকে খাবার বেড়ে দিয়ে পাশের একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে। রাওনাফ খেতে খেতে বলতে থাকে,”তুমি আজ স্বামীকে ফেলে খেয়ে নিলে, তোমার শাশুড়ি মা কিছু বলেনি?”

কথাটা বলে রাওনাফ হাসে। উর্বী হেসে জবাব দেয়,”মা নিজেই আজ জোরাজুরি করেছে সবার সাথে খেতে।”

রাওনাফ বলতে থাকে,”এতো বাধ্যতা। এতো জোরাজুরি। হাঁপিয়ে ওঠো না?”

উর্বী মাথা নেড়ে জবাব দেয়,”আমার বাধ্য হতে আপত্তি নেই যদি বাধ্য করার মানুষ গুলো এমন হয়!”

রাওনাফ হাসে। মুখে কিছুই বলে না । উর্বী উঠে কিচেনে চলে যায়। টেবিলের ওপর ঢেকে রাখা সব খাবারের বাটি গুলো ফ্রিজে তুলে রাখে।

রাওনাফ খেতে খেতে উর্বীর সাথে টুকটাক কথা চালিয়ে যেতে থাকে। উর্বীর এই জিনিসটা খুব ভালো লাগে ইদানিং। লোকটা এমন ভাবে অতি সাধারণ টপিক গুলো নিয়ে উর্বীর সাথে কথা বলবে যেন মনে হয় উর্বী গুরুত্বপূর্ণ কেউ, উর্বীর সাথে এই জিনিস গুলো নিয়ে আলোচনা করা উচিত ।

রাওনাফ কথা বলছে। উর্বী যদিও হু হা তে উত্তর দিচ্ছে কিন্তু সে মনে মনে হাসে। বাচ্চাগুলো একেবারেই লোকটার মতো হয়েছে। এতো কথা জানে অথচ প্রথমে মনে হতো বোমা পরলেও একটা কথা বেরোয় না মুখ থেকে।

“শর্মীর আপডেট কি!”

রাওনাফের প্রশ্নে ঘোর কাটে উর্বীর। তারপর বলে,”ক্লাস টেস্টে ইয়া বড় বড় দুইটা জিরো পেয়েছে। আপনাকে দেখাবে না তাই আমাকে দিয়ে সাইন করিয়ে নিয়েছে টেস্ট পেপারে আর তুলতুল এখনও শর্মীকে উর্বী বলে কেন ডাকে সেটা নিয়ে তার আফসোসের শেষ নেই।”

রাওনাফ হাসে। উঠে বেসিনে হাত ধুয়ে টিস্যু পেপারে ভেজা হাত টা মুছে নিয়ে উর্বীর দিকে এগিয়ে যায়। পেছন থেকে বলে,”ময়দা দিয়ে কি হবে!”

উর্বী ময়দা দিয়ে ডো বানাচ্ছিলো। মৃদু স্বরে বলে,”ডো বানিয়ে রেখে দেবো। একটা নাস্তা বানাবো সকালে।”

রাওনাফ খুবই মনযোগী হয়ে দেখতে থাকে। উর্বীর মাথায় হঠাৎ করে দুষ্টু বুদ্ধি চাপে,সে আড়চোখে রাওনাফকে একপলক দেখে পাশের বক্স থেকে এক মুঠো ময়দা নিয়ে রাওনাফের মাথায় দিয়ে দেয়।

রাওনাফ হতভম্ব হয়ে যায় পুরো। উর্বী কিশোরী মেয়েদের মতো খিলখিলিয়ে হাসছে। রাওনাফ হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠে মাথা ঝাড়া দিয়ে আবারও উর্বীর দিকে তাকায়। সে রীতিমতো অবাক ত্রিশোর্ধ ভদ্রমহিলার এমন কিশোরীসুলভ আচরণে!

নাবিল পানি খাওয়ার জন্য উঠেছিলো। দরজা খুলে সে উর্বী আর রাওনাফকে একসাথে দেখে। উর্বীর এমন কান্ড দেখে নাবিল খেয়াল করলো নাবিলের বিরক্ত লাগছে না, তার বরং হাসি পাচ্ছে। সে কয়েক মূহুর্ত দু’জনকে দেখে ঘরের দরজাটা আবারও লাগিয়ে দেয়।

দরজা লাগানোর শব্দে রাওনাফ আর উর্বী চ’ম’কে ওঠে। তারপর যে যার নিজেদের কাজ করতে ব্যস্ত হয়ে পরে!

***
রাত দুইটা তেরো মিনিট। পুরো এরিয়া ঘুমে আচ্ছন্ন কিন্তু রওশান মঞ্জিলের দোতলার উত্তরপাশের ঘরটিতে বাতি জ্বলছে।

রাওনাফ সেই তখন থেকে হাঁচি দিচ্ছে। এতো রাতে শ্যাম্পু করে গোসল করার ফলে রীতিমতো হাঁচি দিতে শুরু করেছে। তার পাশেই অ’প’রা’ধীর মতো তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে আছে উর্বী। একটু পরপর সে তোয়ালে দিয়ে রাওনাফের মাথা মোছাতে উদ্যত হয় আর কাঁচুমাচু মুখ করে বলে,”ভুল হয়েছে। আ’ম সরি!”

রাওনাফ মাথা তুলে উর্বীর দিকে তাকায়। বলে,”আনবিলিভেবল তোমার বয়স ত্রিশ। আচরণে মনে হচ্ছে বাইশ-তেইশের কোনো তরুণী। যে নিজেও জানে না সে কি করতে যাচ্ছে।”

উর্বী তোয়ালে ফেলে রাওনাফের পাশে বসে পরে। তারপর বিষন্ন ভঙ্গিতে বলে,”আমি বাইশ-তেইশের সেই উর্বীই। মাঝখানের আট বছর নেই। আমার জীবনটা ওখানেই আঁটকে ছিলো,এখন চলতে শুরু করেছে!”

রাওনাফ তাকায় উর্বীর দিকে। উর্বী আবারও হেসে ফেলে । খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে। রাওনাফ মুগ্ধ হয়ে সে হাসি দেখে বলে ওঠে,”ইউ ডিজার্ভ বেটার মৃদুলা উর্বী!”

উর্বী হাসি থামিয়ে রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফের কথার মানে সে বুঝতে পারে না। রাওনাফ উর্বীর একটা হাত নিজের হাতে বন্দী করে বলতে থাকে,”মানে দেখতেও তোমাকে বাইশ-তেইশের কোনো মেয়েই লাগে। তোমার পাশে আমাকে মানাচ্ছে না। ইউ ডিজার্ভ বেটার! কোন হ্যান্ডসাম ইয়াং…।”

উর্বী প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। রাওনাফ হাসি চেপে রেখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী আয়নায় সামনে গিয়ে হাতে ট্যালকম পাউডারের কৌটা নিয়ে পাউডার বের করে নিজের মাথায় লাগিয়ে সামনের চুলগুলো সাদা সাদা করে ফেললো। রাওনাফ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে উর্বীর দিকে। উর্বী ঠান্ডা গলায় বলতে থাকে,”হ্যা। আপনি বুড়ো। কি আর করা,আপনার বয়সটা তো আর কমাতে পারবো না। তাই নিজের বয়সটাকে আরেকটু বাড়িয়ে দু’জনকে মানানসই করে নিলাম। দেখুন এখন ঠিকাছে না?”

রাওনাফ হেসে ফেলে। উর্বী তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাওনাফ উঠে এসে উর্বীর সামনে দাঁড়ায়। তারপর উর্বীর চুল পরিষ্কার করে মুছিয়ে দিয়ে উর্বীর কপালে চুমু খেয়ে বলে,”না। এই চঞ্চল উর্বীই ঠিকাছে।”

উর্বী নরম গলায় বলে,”ইউ ডিজার্ভ বেটার। আমিই আপনার যোগ্য নই…..”

রাওনাফ উর্বীর ঠোঁটে আঙুল রেখে উর্বীকে চুপ করিয়ে দেয়। উর্বী চুপ হয়ে দেখে মানুষটাকে। সে ধীরে ধীরে নিজের কোমরে রাওনাফের বা হাতের স্পর্শ টের পায়। সে এই স্পর্শে কোনো মলিনতা খুঁজে পায়না। অত্যন্ত প্রশান্তিদায়ক ঠেকছে এই স্পর্শ। রাওনাফ উর্বীকে ঘুরিয়ে নিয়ে আলতো করে তার কাঁধ থেকে চুল গুলো সরিয়ে উন্মুক্ত কাঁধে চুমু খায়। উর্বী দু’চোখ বন্ধ করে নেয়। রাওনাফ উর্বীর কানের কাছে মুখ নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলতে থাকে,”তুমি বেটার নও,কিন্তু একজন বিধ্বস্ত রাওনাফ করীমের জন্য যথেষ্ট মৃদুলা উর্বী।”

সামান্য কথা! সামান্য স্বীকারোক্তি! তবুও উর্বী শিহরিত হয়। পুলকিত হয়। অদ্ভুত ভালোলাগার অনুভূতি ছড়িয়ে পরে তার শিরা উপশিরায়। চোখ বন্ধ রেখেই ঘুরে রাওনাফের বুকে ঝাঁপিয়ে পরে।
রাওনাফ আগলে নেয় উর্বীকে। তার পিঠের কাছের টি-শার্ট খামচে ধরে রেখেছে উর্বী। ছাড়ছেই না। খানিকবাদে অনুভূতির সাথে চুক্তি করে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিচু স্বরে বলে,”আর আপনি যথেষ্ট নন, আপনি আমার কাছে তার থেকেও বেশি শর্মীর পাপা। আপনি আমার ন’ষ্ট জীবনের ভজন শুনে কান না পচিয়ে ফেলা লোক।”

উর্বীকে নিজের থেকে আলগা করে হাত ধরে বিছানায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেয়। উর্বী সম্মোহিত দৃষ্টিতে শান্ত,গোছালো, দায়িত্ববান, কেয়ারিং মানুষটাকে দেখতে থাকে।
রাওনাফ বিছানায় শুয়ে উর্বীর গায়ে চাদর টেনে দেয়। উর্বী সব সংকোচ সরিয়ে নির্দ্বিধায় রাওনাফের বুকে মাথা রাখে। যেন এটা তার বহু বছরের অভ্যাস।
বুক থেকে মাথা না তুলে নিচু স্বরে বলতে থাকে,”আপনি আমার ক্ষ’ত ভুলিয়ে দেওয়া স্বস্তি।”

রাওনাফ ম্লান হেসে দুহাতে উর্বীকে আগলে নেয়। নিজের বাহুবন্ধনে উর্বীকে পুরোপুরি আবদ্ধ করে নিয়ে বলে ওঠে,”আর তুমি একটা আদুরে হাঁসের ছানা।”

উর্বী হেসে ফেলে। হাসতে থাকে রাওনাফও। নির্মল, স্নিগ্ধ হাসি। রাত তখন তিনটা প্রায়। শেষ রাতের পাখিটাও ঘুমে ঢুলুঢুলু করছে, তখন কোনো দম্পতি “বেচারা” দু’টো মন নিয়ে রচনা করে যাচ্ছে মহা-মিলনের এক অদ্ভুত সুন্দর গাথা। তারা ব্যস্ত, ভীষণ ব্যস্ত। একে অপরের মাঝে খুঁজে পেতে ব্যস্ত-আশ্রয়,নির্ভরতা, বিশ্বস্ততা,ভরসা, ভালোবাসা,সুখ আর আরেকটিবার নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার অনুপ্রেরণা।

ভালোবাসা-বাসির এই সময়টিতে উর্বীর এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়নি সে রাওনাফের জীবনে বাড়তি কেউ। বরং সে আপ্লুত হচ্ছে এটা টের পেয়ে , সে একটা বিশেষ স্থান পেয়েছে ঐ মনে। ঐ হৃদস্পন্দন,ঐ স্পর্শ,ঐ ব্যকুলতা তাকে জানান দিচ্ছে এসব শুধু শরীরী টান নয় বরং এটা সমর্পণ। এই পরম স্পর্শে শরীর থেকে সেই যন্ত্রনাদায়ক স্পর্শের চিহ্ন যেন মিলিয়ে যাচ্ছে,একটু একটু করে,উর্বী শুদ্ধ হচ্ছে। আবেশে চোখ বন্ধ করে উর্বী। আবেগ গড়িয়ে পরে তার বন্ধ দু’চোখ থেকে। যা রাওনাফের দৃষ্টিগোচর হয়না। সযত্নে,পরম স্নেহে,অতি সাবধানতার সাথে মুছিয়ে দেয় সেই আবেগ। যেন উর্বী নামের এই ভাঙাচোরা মেয়েটির স্ত্রী সত্তা অসম্মানিত না হয়।

দু’হাতে দুই গাল আগলে ধরে উর্বীর চোখে চোখ রেখে ঘোর লাগা কন্ঠে রাওনাফ বলে,”হাঁসের ছানা!”
উর্বী কেঁদে ফেলে, নিজেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ,দামী কেউ আবিষ্কার করতে পারার খুশিতে। ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গিয়েছে,ফোপাতে ফোপাতে রাওনাফের হাতের ওপর একটা হাত আলতো করে রেখে দেয়,রাখে না! একপ্রকার আঁকড়ে ধরে রাওনাফের হাত। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে,”আমাকে আপনি আগলে রাখুন। আমার খুব দরকার আপনাকে। প্লিজ আগলে রাখুন আমায় শর্মীর পাপা।”

চলমান…..

আরেকটি বার পর্ব-২৫

0

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_২৫
#Esrat_Ety
১ম অংশ

মানুষ টা যাওয়ার নয় ঘন্টা হয়ে গেছে। গিয়ে পৌঁছিয়েছে নাকি পৌঁছায়নি উর্বী জানে না। একটাবার ফোন দিয়ে বলতে হয়না বুঝি?
উর্বীকেই ফোন দিয়ে জানতে হবে? তার ফোনে কি উর্বীর নাম্বার নেই ? নাকি উর্বীকে জানানোটা গুরুত্বপূর্ণ নয়‌। উর্বী আজ দেখবে তার কখন সময় হয়। আজ উর্বী কোনোভাবেই ঐ লোকটাকে ফোন দেবে না।
উর্বী ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। পুরো বিকেলটা অলসতায় কেটেছে। হাতে কোনো কাজ নেই। বাড়ি ভর্তি মেহমান। উর্বীর ননদেরা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে একদিনের জন্য এসেছে বেড়াতে।

রাওনাফ গিয়েছে রাজশাহী। খুব সম্ভবত রাত ফিরবে,নাও ফিরতে পারে।
বাড়ির সবাই উর্বীকে ধরেছিলো যাওয়ার জন্য। উর্বী যায়নি।

উর্বী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উঠে দাঁড়ায়, একটু অন্তরাকে দেখে আসা যাক। বেচারী হাঁটাচলা করতে পারে না। হাত পা ফুলে গেছে।

***
রাওনাফ রাজশাহী এসে কাজে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। ফোনের দিকে তাকানোর সময় নেই। তবু সে মাঝে মাঝে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে কেউ ফোন দিয়েছে কি না, বিশেষ করে উর্বী। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার উর্বীর থেকে একটি কলও আসেনি আজ।
শর্মী দুবার ফোন দিয়েছে, মা একবার, নাবিল একবার। উর্বী একবারও ফোন দেয়নি।

***
ফ্রাইং-প্যানে একটা বড় সাইজের রূপচাঁদা মাছ ছেড়ে দিয়ে উর্বী চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সবাই মিলে হাতে হাতে রাতের রান্নাটা সেরে ফেলছে। রুমা আর আজমেরী আড়চোখে উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বীর চোখে চোখ পরতেই উর্বী হেসে বলে,”এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?”

আজমেরী বলে,”দেখছি।”

_কি দেখছো?

_বলা যাবে না।

উর্বী রান্নায় মনোযোগী হয়। রুমা বলে,”ব্যস রান্না তো সব হয়েই গেলো। তুমিও খেতে চলে এসো ভাবী। একসাথে খাবো।”

উর্বী ফ্রিজ থেকে চিংড়ি মাছ নামাতে নামাতে বলে,”তোমরা বসো। আমি একটু পরে বসবো।”

আজমেরী বলে,”এখন আবার কি রাধছো? চিংড়ি তো কেউ খাবে না। চিংড়ি কেনো রাধছো?”

উর্বী মাথা নিচু করে বলে,”উনি খুব সম্ভবত রাতে ফিরবেন। যা রান্না করেছি, উনি তো খাবেন না সেসব। তাই চিংড়িটা করে রাখছি।”

আজমেরী আর রুমা মিটিমিটি হাসে। উর্বী তাকিয়ে বলে,”এভাবে হাসছো কেন?”

_তোমার পরিবর্তন দেখে হাসছি ভাবী।

_কি পরিবর্তন?
উর্বী জানতে চায়। আজমেরী বলে,”ধীরে ধীরে খান বাড়ির বড় বৌ থেকে রাওনাফ করীমের স্ত্রী হয়ে উঠেছো সেটাই চোখে পরছে।”

কথাটা বলে দুজনে চলে যায়। উর্বী ম্লান হেসে পাতিলে মশলা কষাতে থাকে।

****
নাবিল খাবার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। সে আশেপাশে তাকাচ্ছে। টেবিলে খাবার দেওয়া। কিন্তু কেউ নেই। আজ একটা ক্রিকেট ম্যাচ ছিলো তাই সে টেবিলে সবার সাথে খেতে পারেনি।
এখন হাত ধুয়ে সে খেতে বসে। একটা একটা করে ঢাকনা উঠায় আর নাবিল অবাক হয়। এতকিছু কেনো রান্না হয়েছে‌ !

উর্বী মাথায় ঘোমটা তুলতে তুলতে আসে। নাবিল চুপচাপ খেতে বসে।

উর্বী নাবিলের প্লেটে খাবার বেড়ে দেয়। তারপর নিজেও একটা প্লেট নিয়ে বসে পরে।

“আপনি এখনো খাননি?”
নাবিল অবাক হয়ে জানতে চায়।

_ নাহ।
_কেন?
_ভাবলাম তুমি একা খাও না। তাই।

নাবিল চুপচাপ খেতে থাকে, কিছুক্ষণ পরে খুবই স্বাভাবিক গলায় বলে,
“যদি আমি এখন আট নয় বছরের বালক হতাম তবে আপনার মহানুভবতা দেখে অবশ্যই সারাদিন ছোটো মা ছোটো মা বলে আপনার আঁচল ধরে ঘুরতাম। কিন্তু আমি ছোটো বালকটি নই।”

উর্বী হাসে।

“কি হলো। হাসছেন যে!”

_একটা সত্যি কথা বলবো নাবিল? আমার কাছে তোমাকে আট বছরের ছেলেটিই মনে হয়। যাকে দেখলে স্নেহ করতে ইচ্ছে করে। মাথায় গাট্টা মেরে কিংবা নাক টিপে দিয়ে। তুমি আমায় অপছন্দ করলেও আমি কিন্তু তোমায় ভীষণ পছন্দ করি। আমি শর্মী,শায়মী আর তোমাকে ভয়ংকর পছন্দ করে ফেলেছি।”

নাবিল খাওয়া রেখে উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। উর্বী একমনে খাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর সে নাবিলের দিকে তাকিয়ে তার দিকে কালাভুনার প্লেট এগিয়ে দেয়। বলে,
“এটাও নাও। তোমার জন্য রেধেছি। শুনেছি তোমার পছন্দ। তোমার মায়ের মতো না রাঁধতে পারলেও খাওয়ার যোগ্য। আর এতে কিছু মেশাইনি। স্নেহ ছাড়া।”

নাবিল হাত বাড়িয়ে বাটিটা নেয়। তার অস্বস্তি হচ্ছে। আজ এই মহিলার অযাচিত স্নেহে তার বিরক্তি আসছে না কেন?

****
বাচ্চারা চেঁচিয়ে ওঠে।
“বড়মামা এসেছে।”

উর্বী শুনেছে। সে বই রেখে উঠে দাঁড়ায়।

নিচে তাকে ডাকা হচ্ছে। ডাকছে আজমেরী।

উর্বী ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে লিভিং রুমে উকি দেয়।

রাওনাফকে ঘিরে ছোটো খাটো জটলা।
রাজশাহী থেকে রাওনাফ বাড়ির মেয়েদের জন্য শাড়ি নিয়ে এসেছে। প্রত্যেকের জন্য একটি করে।

উর্বীকে দেখে রুমা এসে তাকে টেনে নিয়ে যায় নিচে।

রাওনাফের সুটকেস থেকে আজমেরী একটা একটা করে শাড়ি বের করছে। শর্মী এবং শায়মীর জন্যও শাড়ি এনেছে তাদের বাবা। দুজন কিশোরী প্রচন্ড উচ্ছসিত পাপার থেকে প্রথম শাড়ী উপহার পেয়ে। দু’জনে কখনোই শাড়ি পরেনি। তবুও তারা খুবই এক্সাইটেড। চোখে আনন্দ ঝলমল করছে।

রুমা অবাক হয়ে বলে,”বাপরে। আজ সূর্য কোনদিক থেকে উঠলো ভাইয়া? তুমি কিনেছো মেয়েদের শাড়ি? মানে সত্যি?”

রাওনাফ হাসে,”আরে,ওখানে ডক্টর কিশোর আর তার ওয়াইফ গিয়েছিলো। ওরা টেনে নিয়ে গেলো তাতীবাজার। জামদানি শাড়ি তৈরির সবথেকে বিশাল বাজার। আমি তো যেতেই চাইনি। জোর করে নিয়ে গেলো। কিশোরের ওয়াইফ শাড়ি কিনবে। শাড়ি গুলো সুন্দর। একেবারে অথেন্টিক ম্যাটেরিয়াল। ভাবলাম আমিও কটা নেই। বাড়িতে তো নারীদের অভাব নেই। বাড়িটাই তো নারী শাসিত।”
কথাটি বলে রাওনাফ তার মায়ের দিকে তাকায়।

রওশান আরা বলে,”সেজন্যই আমার বাড়িটা এতো শান্তিময়। তোর হাতে থাকলে সংসার টা এতদিনে উচ্ছন্নে যেতো। আমি মরার আগে সব দায়িত্ব আমি বড় বৌকে দিয়ে যাবো।”

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়। তার চোখে পরে উর্বীর মুখটা শুকনো লাগছে বেশ!

সবাই শাড়ি পছন্দ করছে। শর্মী আর শায়মী খুবই আগ্রহের সাথে যে যার শাড়ী বেছে নিয়েছে। রাওনাফ বলে দিচ্ছে কোন শাড়িটা কার জন্য কেনা হয়েছে।
অন্তরার জন্য আনা শাড়িটা অন্তরা হাতে ধরে বসে থাকে। তার এত্তো খুশি লাগছে যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
আজমেরী শাড়ি নিয়ে বলে,”এই সবুজ শাড়ি টা কার? কচি কলাপাতা রঙের জামদানিটা। ভাইয়া?”

রাওনাফ ইতস্তত করে বলে,”এটা উর্বীর..”

রুমা অবাক হয়ে বলে,”কেনো? এটা পরলে ভাবিকে গাছের মতো লাগবে। কলাগাছের মতো। ভাবী কি গাছ? তুমি ভাবীর জন্য অন্য রঙ দেখতে পারলে না? দাঁড়াও আমি আমার শাড়িটা ভাবিকে দিচ্ছি। বৌ মানুষ,একটু লালচে রঙের শাড়ি পড়বে না?”

রাওনাফ সংকোচের সাথে ধীরে ধীরে বলে,”উর্বীর গায়ে এই রঙটা বেশ মানায়, গাছের মতো লাগে না….”

এ পর্যন্ত বলে থেমে যায় রাওনাফ।
তারপর বলে,”ওর পছন্দ না হলে অন্য রঙ দেখতে পারে। অনেকগুলো আছে তো শাড়ী।”

উর্বী সবার দিকে তাকায়। সবাই তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে তার প্রতিক্রিয়া জানতে।
সে হাত দিয়ে শাড়ীটা নেয়,বলে,”আমি এটাই নেবো। অন্য রঙ লাগবে না।”

রওশান আরা তার পুত্রবধুর দিকে তাকিয়ে থাকে। উর্বীর চোখ মুখ দিয়ে চাপা আনন্দ ছড়িয়ে পরেছে। রওশান আরা তা দেখতে পান।

***
উর্বী ঘরে ঢুকে শাড়ীটা আলমারিতে তুলে রাখতে রাখতে শাড়ীটায় হাত বুলিয়ে দেয়। মুখ তার প্রশ্বস্ত হয়ে আছে হাসিতে, খুশিতে।

রাওনাফের পদধ্বনি শুনে উর্বী তাড়াতাড়ি আলমারি বন্ধ করে বই হাতে বসে পরে।

রাওনাফের উপস্থিতি টের পেয়েও সে বই থেকে মুখ তুলছে না।

রাওনাফ কাশি দিয়ে উর্বীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। উর্বী মাথা তুলে রাওনাফের দিকে তাকায়।

রাওনাফকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব ক্লান্ত। পরিশ্রান্ত। উর্বীর বড্ড মায়া হয়।

রাওনাফ বিছানায় বসে পরে।

উর্বী বলে,”আপনার কি শরীর খারাপ?”

_বুঝতে পারছি না। একটু জ্বর জ্বর লাগছে।

_সেকি! হঠাৎ জ্বর কেনো?

_হতে পারে ওয়েদার চেঞ্জ তাই।

_দাড়ান মেপে দেখছি।

উর্বী দৌড়ে গিয়ে রাওনাফের টেবিল থেকে থার্মোমিটার নিয়ে আসে।

রাওনাফ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”তুমি জানো থার্মোমিটার প্রথম কবে আবিষ্কার হয়েছিল?”

উর্বী অবাক হয়ে বলে,”তা আমি কিভাবে জানবো? এটা তো আপনার জানার কথা!”

_যদিও বিভিন্ন সময়ে এর সংস্করণ হয়েছে। তবে খুব সম্ভবত ১৭১৪ সালের দিকে। অবশ্য একেবারে নিখুঁত সংস্করণ হয়েছে ১৯৬৬ সালে।

_হু। তো কি হয়েছে? এসব কেনো বলছেন?
উর্বী অবাক হয়ে জানতে চায়।

রাওনাফ উর্বীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,”থার্মোমিটার আবিষ্কারের আগে স্ত্রীরা তাদের স্বামীর কপালে হাত দিয়ে ছুঁয়ে জ্বর দেখতো…”

স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অত্যন্ত সরল একটি আহ্বান।

উর্বী লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখে। তার প্রজাপতি গুলো কি আস্কারা পেলো মানুষটার থেকে!

রাওনাফ স্বাভাবিক ভাবে বলে,”বসো এখানে।”
উর্বী বসে,লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে,”আপনার জ্বর নেই তাই না? ভান করছিলেন কেনো?”

_একটু সহানুভূতি পেতে চাচ্ছিলাম। আমি একজন ডাক্তার, সারাদিন
অন্যদের সেবা দেই। আমারো ইচ্ছা করলো,কেউ আমার সেবা করুক ‌।

উর্বী বলে,”এভাবে মিথ্যা সহানুভূতি পেতে চাইতে নেই।
রাখালের কাহিনীটা জানেন না?”

রাওনাফ উর্বীকে দেখে, উর্বীর চোখে মুখে সংকোচ,লজ্জা। রাওনাফ বলে,”কি হয়েছিলো? চোখ মুখ শুকনো ছিলো কেন?”

উর্বী তাকায়। বলে,”কই না তো। কি হবে! আপনার এমন টা কেনো মনে হলো!”

“তখন তোমাকে নোটিস করলাম!”

_আপনি আমায় নোটিস করেন?
খুবই নিচুস্বরে কিন্তু দৃঢ়ভাবে উর্বী জানতে চায়। রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”মনে তো হচ্ছে করি।”

উর্বী চুপ হয়ে যায়। রাওনাফ কিছু বলতে যাবে তখনই ‌দরজায় টোকা পরে। আজমেরী ডাকছে। অন্তরা পা পিছলে ওয়াশরুমে পরে গিয়েছে। তাকে হসপিটালে নিতে হবে।
***
ওয়েটিং রুমে দাড়িয়ে রওশান আরা কাঁদছে। উর্বী সবার মুখের দিকে তাকায়। সবাই বিষন্ন মুখে মেঝের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বসে আছে। এমন পরিস্থিতি আসবে খান বাড়িতে কেউ কি ঘুনাক্ষরেও টের পেয়েছিলো?
অন্তরার মি’স’ক্যারেজ হয়ে গিয়েছে। চেষ্টা করেও কিছু করতে পারেনি ডাক্তাররা।

উর্বী সবাইকে ঘুরে ঘুরে দেখে রওশান আরার দিকে এগিয়ে যায়। কাঁধে একটা হাত রাখতেই রওশান আরা মুখ তুলে তার দিকে তাকায়। উর্বী বলে,”কাঁদবেন না মা। এই সময়ে অন্তরার আমাদের প্রয়োজন। ও আমাদের থেকে ভরসা নেবে। আপনি কাঁদবেন না।”

রওশান আরা শাড়ীর আঁচল দিয়ে চোখ মোছে। তারপর ধরা গলায় বলে,”আমি খারাপ শাশুড়ি হতে পারি বৌমা তবে মোনাজাতে কখনো ওর খারাপ চাইনি। চেয়েছি যেন সুস্থভাবে আমার নাতী নাতনিকে দুনিয়ায় আনতে পারে আর নিজেও যেন সুস্থ থাকে।”

উর্বী বলে,”আপনি যান। ওর কাছে যান। ওর শারীরিক যন্ত্রনার ভাগ তো আমরা কেউ নিতে পারবো না। ওকে দু’টো কথা বলে ওর মানসিক যন্ত্রনা ভুলিয়ে দিতে চেষ্টা করুন। আপনি যান মা। মেয়েটা তো কখনও মায়ের আদরও পায়নি শুনেছি।”

রওশান আরা উর্বীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধীরপায়ে অন্তরার কেবিনের দিকে এগিয়ে যায়।

সামিউলের শার্ট খামচে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে অন্তরা। সামিউল শক্ত করে আগলে ধরে বসে আছে অন্তরাকে। অন্তরা কোনো কথা বলতে পারছে না। কেঁদেই যাচ্ছে। সামিউল অন্তরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”প্লিজ এভাবে ভে’ঙে পরো না অন্তু,প্লিজ।”

_আমি কি পাপ করেছিলাম সামিউল। কেনো আমার সাথে এমন হলো। বলো না!

_আল্লাহর ইচ্ছে অন্তু। তুমি একদম ভেঙে পরো না। আমাকেও ভেঙে দিও না। ডক্টর বলেছে,আমরা ছয় মাস পরেই আবার বেবীর জন্য চেষ্টা করতে পারবো।

_তাতে কি হবে সামিউল? অন্য কাউকে পাবো আমরা। আর যে চলে গিয়েছে তাকে? নাই বা চোখে দেখলাম তাকে, তবে সে তো আমার ছিলো সামিউল। আমার সন্তান!

কাঁদতে থাকে অন্তরা। রওশান আরা কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে শুনতে থাকে। সে ভেতরে ঢোকে না। সামিউলের মতো করে সে নিশ্চয়ই সান্ত্বনা দিতে পারবে না।

অন্তরা কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে,”আচ্ছা সামিউল। মা কি আবার আমাকে দূরে ঠেলে দেবেন? বলো না। আমার সাথে কেন হলো এসব।”

রওশান আরা শুনছে সেসব কথা। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

***
অন্তরাকে দুদিন হয় বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। শরীরটা অনেকটাই সুস্থ তবে মানসিক ভাবে পুরোটাই বিধ্বস্ত। উর্বী সবসময় চেষ্টা করেছে তাকে আগলে রাখার, মানসিক ভাবে সাপোর্ট দেওয়ার।

বিষাদের সময় কাটতে না কাটতেই রওশান মঞ্জিলে একটা খুশির সংবাদ এসেছে। শায়মী নাবিলের মাধ্যমিকের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। শায়মী গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পেলেও নাবিলের গোল্ডেন মিস গিয়েছে।
ডক্টর রাওনাফ করীম খান ছেলে মেয়ের রেজাল্টে ভীষণ খুশি। পুরো হসপিটালে,শায়মী-নাবিলের স্কুলে মিষ্টি বিলি করেছে। নিজে গিয়ে নাবিল শায়মীর নানা বাড়ি, দাদা বাড়িতে মিষ্টি দিয়ে এসেছে। এরপর সুমনা আর ঝুমুরদের বাড়ি হয়ে সোজা রওশান মঞ্জিলে ঢুকেছে।

পাপাকে দেখে শায়মী ছুটে যায়। রাওনাফ মেয়েকে আগলে নেয়। দোতলা থেকে বাবা মেয়ের এই সুন্দর মুহূর্ত উপভোগ করতে থাকে উর্বী।
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে রাওনাফ বলে,”ভীষণ খুশি হয়েছি মামনী। ভীষণ!”

শায়মী হাসে। রাওনাফের চোখ খুঁজছে নাবিলকে। শায়মী বলে,”কাকে খুজছো?”

_সে কোথায়? গোল্ডেন পায়নি বলে মন খারাপ?

_জানিনা। দেখে তো মনে হয়নি।

রাওনাফ নাবিলের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। তারপর দরজা ধাক্কাতে থাকে। খানিক বাদে নাবিল দরজা খুলে দেয়। রাওনাফ ছেলেকে দেখে, তারপর নরম গলায় বলে,”বাবা এসব রেজাল্ট….”

_আই নো পাপা,তোমার কাছে ম্যাটার করে না। আমি মন খারাপ করে নেই পাপা, মোটেও নেই। আমি বিন্দাস আছি। আমি তোমার ছেলে! চিল!

রাওনাফ হাসে, ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,”প্রাউড অফ ইউ বেটা!”

উর্বী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। সে যত দেখছে এই পরিবারটিকে ততই মুগ্ধ হচ্ছে। বাবা-সন্তানদের কি চমৎকার সম্পর্ক। উর্বীর যখন পাঁচ বছর বয়স, উপমার তখন এক বছর। তার বাবা হঠাৎ স্ট্রোক করে মা’রা যান। উর্বী ঠিক জানেই না বাবা কেমন হয়। রাওনাফের তার ছেলেমেয়েদের প্রতি অগাধ স্নেহ দেখলে উর্বীর মন ভরে যায়, সবসময়। উর্বী রাওনাফ করীম খানের এই রুপটাকেও ভীষণ পছন্দ করে, ভীষণ।

***
অন্তরার মন ভালো করার জন্য রাওনাফ একটা পদক্ষেপ নিয়েছে। সে সামিউলকে আর অন্তরাকে চট্টগ্রাম পাঠিয়েছে মোহনা আর শাফিউলের কাছে। যায়গা পরিবর্তন করলে মন ভালো হবে তাই। অবশ্য এই উদ্যোগটা রাওনাফ নিয়েছে রওশান আরার কথায়। তা অবশ্য কেউ জানে না। রওশান আরা বলতে দেয়নি। শুধু উর্বী জানে।

এই বাড়ির সব মানুষ গুলো কি আদুরে, কারো মধ্যে বিন্দুমাত্র অন্ধকার উর্বী খুঁজে পায় না। সবটা কি এতটাই সাদা? উর্বীর কালো অতীত নিয়ে জরিয়ে গিয়েছে এই সাদা মানুষগুলোর সাথে। কি অদ্ভুত!

হাত বাড়িয়ে উর্বী ফোনটা নেয়। ভেবেছে সে রাওনাফকে ফোন দেবে। ব্যস্ততায় রাওনাফ না দিক ফোন, সে দেবেই। তাতে যদি ডাক্তার তাকে হ্যাংলা মহিলা ভাবে,ভাবুক। স্বামীর নৈকট্য পেতে চাওয়া কোনো হ্যাংলামো নয়, এটা কোনো নির্দিষ্ট বয়সের ছকবাঁধা নিয়ম না। জীবনের সাতটা বছর অন্ধকার কারাগারের মতো জীবন কে’টেছে উর্বীর। এখন সে মুক্ত। বাইরের মানুষ কি বুঝবে মুক্তির আনন্দ? উর্বী আনন্দ প্রকাশ করবে না? সব মেয়ের মতো তারও মনের কোথাও সুপ্ত বাসনা ছিলো একটা সংসারের, আজ সেটা তার হয়েছে, সে মুক্ত স্বাধীন পাখির মতো হুটোপুটি করবে না?
ভাবুক উর্বীকে হ্যাংলা সবাই। উর্বী তার স্ত্রী হবার সব শর্ত পালন করবে এবং সব চাহিদা পো’ষণ করবে যা আর পাঁচটা সাধারণ স্ত্রী করে। এই জীবন উর্বীকে বাঁধতে চাইছে, উর্বীও লাই দেবে এই জীবনকে, তার চাহিদাকে, তার বাসনাকে। অবশ্যই দেবে।

ফোনের লক খুলে রাওনাফকে ফোন দেওয়ার আগেই টুং টাং আওয়াজে একটা নোটিফিকেশন চোখে পরে উর্বীর। সে কৌতুহলবশত মেসেজটি ওপেন করে। এই আ’ই’ডিটা কার উর্বী জানে না। কিছু ছবি পাঠানো হয়েছে উর্বীকে। ছবি গুলো দেখে উর্বীর হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। সে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। উচ্ছাস একটি বার্তাও পাঠিয়েছে,”সেদিন সম্ভবত গালাগাল করেছি তোমাকে। সরি পাখি। ভুল হয়েছে। আর করবো না। আর এই ছবিগুলো দেখো। কি সুন্দর লাগছে আমাদের।”

উর্বী সাথে সাথে আ’ই’ডিটাকে ব্লক করে দিয়ে বসে থাকে। খুঁজে খুঁজে ঠিকই পেয়ে গিয়েছে উচ্ছাস উর্বীকে। উর্বী কি করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। রাওনাফকে বলে দেবে! কিন্তু কি হবে! যদি কোনো স্টেপ নেয় তবে জানাজানি হবে আবারও। আবারও সবাই উর্বীর দিকে আঙুল তুলবে। সবাই তাকে নষ্টা বলবে, উর্বী চাইলেও পারবে না ঢাকতে তার কলঙ্ক। সবাই যে রাওনাফ নয়। সবাই উর্বীকে থু’তু দেবে। আবারও নেমে আসবে উর্বীর জীবনে সেই দুর্যোগের ঘনঘটা। কথা শুনিয়ে শুনিয়ে মে’রে ফেলবে উর্বীকে! কিভাবে সবটা ম্যানেজ করবে উর্বী!

উর্বীর শরীর কাঁপতে শুরু করে। সে নিজের ফেসবুক আ’ই’ডি টাকেই ডিলিট করে দেয়। কিছু ব্যবহার করবে না সে! সে গুটিয়ে নেবে এই সবকিছু থেকে। তার গন্ডি হবে শুধু এই বাড়ি, এই সংসার, এই মানুষগুলো, আর রাওনাফ। কেউ তার নাগাল পাবে না।

চলমান….

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_২৫
#Esrat_Ety

(২য় অংশ।)

নাবিল শর্মী আর শায়মীর ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ডাকে,”আসবো আমি?”

শর্মী পড়ার টেবিলে। শায়মী শুয়ে ছিলো। সে উঠে বসে,
“আয়।”

নাবিল ঘরে ঢোকে। তার হাতে একটি প্যাকেট।
শায়মী বলে,কি তোর হাতে ওটা?

_একটা হকি ম্যাচ জিতে আসলাম। ভাবলাম তোদের ট্রিট দেই।

শর্মী লাফিয়ে ওঠে। দ্রুত এসে নাবিলের হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে বলে,”কি এনেছো ভাইয়া? ”
_ ওয়েসক্যাফে থেকে বারবিকিউ চিকেন ফ্রাই আর বার্গার।

শর্মীর চোখ খুশিতে চকচক করে ওঠে। শায়মী বলে,”ঠিকাছে। তবে এখানে চারটা প্যাক কেনো? দাদু তো খায় না,পাপা তো বাড়িতে নেই। ছোটো চাচ্চু আর অন্তরা চাচী নেই, আমীরুন খালামনি নেই।

নাবিল ফোন হাতে নিয়ে গা ছাড়া ভঙ্গিতে বলে,”কেনো। তোদের ছোটো মা আছে না? সেও তো দাবী করে সে এই পরিবারের লোক। দিয়ে দিস একটা প্যাকেট।”

কথাটি বলে নাবিল মোবাইলে মনোযোগ দেয়। শায়মী আর শর্মী একে অপরের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।

নাবিল ওদের দিকে তাকায়।
ধ’ম’কে বলে,”অতো হাসতে হবে না! কিছু খেতে দেওয়া আর মা ভাবা এক না। যা গিয়ে দিয়ে আয়। ডেকে এখানে আনিস না আবার। আসলেই বকবক করে জ্ঞান দিতে দিতে আমার মাথা ব্যাথা করে দেবে। পাপার সাথে থাকতে থাকতে পাপার মতো হয়ে গিয়েছে।

শায়মী আর শর্মী হাসতেই থাকে। শায়মী শর্মীকে একটা প্যাকেট দিয়ে বলে,”যা গিয়ে দিয়ে আয়।”

শর্মী প্যাকেট টা নিয়ে চলে যায়। পাঁচ মিনিট পর আবার ফিরে আসে।
নাবিল বলে,”কি? আমার কথা শুনে নেয়নি?”

শর্মী মাথা নাড়ায়, শুকনো গলায় বলে,”দরজা দিয়ে উকি দিয়ে দেখি আন্টি শুয়ে শুয়ে কাঁদছে। আমি আর ডাকিনি।”

নাবিল শায়মী একে অপরের দিকে তাকায়। নাবিল অবাক হয়ে বিরবির করে বলে,”সমস্যা কি এই পাগল মহিলার!”

***
রওশান আরা লিভিং রুমে বসে আছে।
রাওনাফ আজ বেশ রাত করে ফিরেছে, মাকে দেখে বলে,”কি ব্যাপার! এতো রাতে এখানে বসে আছো যে! রাতে খেয়েছো সবাই?”

“হু। খেয়েছি। বৌমা খায়নি শুধু।”

রাওনাফ বলে,”কেনো?”

_জানিনা সন্ধ্যা থেকে ঘরে শুয়ে আছে। গিয়েছিলাম। বললো মাথা ব্যাথা। চোখ ফুলে আছে। দেখে তো মনে হয় কেঁদেছে।

রাওনাফ তার মায়ের দিকে তাকায়।
রওশান আরা বলে,”বৌমা তোর থেকে কষ্ট পাচ্ছে না তো!”

_কি বলছো মা তুমি। আমি কেনো কষ্ট দেবো?

_এইযে তুই দিনের ষোলো ঘন্টা বাইরে বাইরে থাকিস। বৌমার দিন কিভাবে কাটে জানতে চাস?

রাওনাফ উঠে দাঁড়ায়। সে উর্বীর কাছে যাবে।
রওশান আরা বলে,”বড় খোকা।”

রাওনাফ দাঁড়িয়ে পরে,”হু মা।”
_বৌমাটা বড্ড ভালো মেয়ে। অবহেলা করিস না। জানি তুই শিমালাকে ভালোবাসিস। কিন্তু উর্বীও তোর স্ত্রী।

রাওনাফ মায়ের কথার জবাব না দিয়ে চলে যায়।

দরজা খুলে রাওনাফ ভেতরে ঢোকে। উর্বী ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে।
রাওনাফ বাতি জ্বালিয়ে দেয়।
উর্বী উঠে বসে। তার চোখে মুখে সংকোচ। সে তার মুখ হাসি হাসি করার চেষ্টা করে।

রাওনাফ ফ্রেশ হয়ে একটা সাদা রঙের পাঞ্জাবি পরে। তারপর এসে তার কাছে এসে বসে। উর্বী তাকিয়ে বলে,”খেয়ে এসেছেন তাই না?”

“হু।”

“দাঁড়ান বিছানা গুছিয়ে দেই। ”

উর্বী উঠে দাঁড়ায়। রাওনাফ উর্বীর হাত টেনে ধরে বসিয়ে দেয়।

সরাসরি উর্বীর চোখে চোখ রেখে বলে,”কি হয়েছে? ”

_কই। কিছু নাতো !

_মা বললো তুমি অসুস্থ।

_হ্যা ঠান্ডা লেগে মাথা ধরেছে।

_ঠান্ডা লেগে মাথা ধরেছে নাকি কেঁদে কেঁদে মাথা ধরিয়েছো।

উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়।‌ সে কি বলবে কিচ্ছু খুঁজে পাচ্ছে না।
রাওনাফ বলে,”মা তোমার জন্য কত চিন্তা করছে তুমি জানো? মা ভাবছে আমি তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি।”

উর্বী চুপ। রাওনাফ বলতে থাকে,

“বলো আমাকে। কিসের জন্য কষ্ট পাচ্ছো ?”

আনরোমান্টিক রাওনাফ খুবই দরদ নিয়ে জানতে চায়। কিন্তু বোকা উর্বী বলে না সত্যিটা। সে শুধু রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”কখনো যদি আমি বুঝে যাই আপনার আমার প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মেছে সেদিন আমি বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই হারিয়ে ফেলবো। আমি ম’রে যাবো। এতো টা অসম্মানিত আমি কখনোই হতে চাইবো না।”

রাওনাফ তাকিয়ে থাকে। উর্বী চুপচাপ। রাওনাফ কিছুক্ষণ পর একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”ওঠো।”

উর্বী নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,”কোথায় যাবো?”

_ওযু করে এসো।

উর্বী তাকিয়েই থাকে। রাওনাফ গম্ভীর হয়ে বলে,”যাও বলছি!”

উর্বী চুপচাপ ওযু করতে চলে যায়। রাওনাফ ঘরের মেঝেতে দু’টো জায়নামাজ বিছিয়ে দেয়। উর্বী মাথায় ঘোমটা টেনে বেরিয়ে আসে। রাওনাফ বলে,”চলো দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করি।”

উর্বী চুপচাপ মাথা নাড়ায়। তারপর দাঁড়িয়ে যায় স্বামীর কিছুটা পেছনে বিছিয়ে রাখা জায়নামাজে। আদায় করে নেয় নফল নামাজ।
মোনাজাত শেষ করে রাওনাফ উর্বীর দিকে ঘুরে বসে। উর্বী তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাওনাফ বলে ওঠে,”অস্থিরতা কমেছে কিছুটা?”

উর্বী মাথা নাড়ায়। রাওনাফ বলে,”এবার বলো। এমন অস্থিরতায় কেন ভুগছো? তোমার কেন মনে হচ্ছে আমার তোমার প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মাবে?”

উর্বী চুপ করে থাকে। রাওনাফ বলতে থাকে,”সরাসরি বলবে। আমার আচরণে তোমার মনে হচ্ছে আমি তোমায় এভয়েড করি? উদাসীন, কিংবা এখনও আমি দোটানায় রয়েছি এই সম্পর্কটা নিয়ে। এমনটা মনে হচ্ছে?”

উর্বী কোনো জবাব দেয়না। রাওনাফ আবারও বলে ওঠে,”স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা ঠিক কিরকম জানো মৃদুলা উর্বী? একটা দালানের মতো। একটা উঁচু দালান তৈরি করতে যেমন শুরুতেই এর ভিতটা মজবুত করতে হয় তেমনি স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের বেলায়ও তাই। আর এই সম্পর্কের ভিত মজবুত করা মানে কি বোঝায় জানো? একে অপরের প্রতি নির্ভরতা তৈরি করা, বিশ্বাস জন্মানো, আস্থা জন্মানো। শরীরি ভালোবাসা সেখানে অনেক পরে আসে উর্বী। ঐ শারীরিক বন্ধন ঐ দালানে ঢালাইয়ের মতো কাজ করে। আমি অপেক্ষা করেছি আমাদের দুজনের ভিতটা তৈরি করার, মজবুত করে। তোমার প্রাপ্য অধিকার না দিয়ে তোমাকে আমি অসম্মান করতে চাইনি মৃদুলা উর্বী। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমি তোমাকে অসম্মান করেই ফেলেছি। আ’ম সরি!”

উর্বী উঠে দাঁড়ায়। জায়নামাজ গুছিয়ে রেখে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”ছিঃ ছিঃ। আমি কখনোই এমনটা ভাবি নি। কখনোই না।”

রাওনাফ তাকিয়ে আছে। উর্বী বলতে থাকে,”আমি আপনার মতামতকে সম্মান করি। আমিতো বরং সম্মানিত হয়েছি এটা ভেবে কেউ আমার মনটাকে সময় দিয়েছে, আমার শরীরটাকে প্রাধান্য দেয়নি। কেউ আমার মনটাকে আটকে ফেলেছে আমার শরীর না আটকানোর প্রয়াশ করেই।”

দু’জনেই চুপচাপ। রাওনাফ উর্বীর কিছুটা কাছে এগিয়ে আসে। উর্বী চোখ তুলে একবার রাওনাফের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। রাওনাফ বলে,”অনেকটাই সময় নিয়েছি আমি মন আটকাতে তাইনা?”

_হ্যা। ছয় মাস তিন দিন। আর আমি?
উর্বী জানতে চায়?

রাওনাফ ম্লান হাসে, হেসে বলে,”ছয় মাস তিন দিন।”

উর্বী চুপ। রাওনাফ ধীরে ধীরে বলে,”বলো। কি ভাবছো এখন!”

_নির্ভরশীল হয়ে পরেছি। ভিতটা খুব মজবুত ঠেকছে।

রাওনাফ হেসে উর্বীকে কাছে টানে। উর্বী চুপ। রাওনাফ বলতে থাকে,”আর?”

_জানতে পেরেছি আপনাকে।

_আমাকে?

_হু।

_কি? আমি কি?

উর্বী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাওনাফের চোখে চোখ রাখে। ঐ দু’টো চোখের সরল দৃষ্টি দেখে সে নির্দ্বিধায় বলতে থাকে,”আমার নষ্ট জীবনের ভজন শুনে কান না পচিয়ে ফেলা লোক, সবকিছু আমাদের ছিলো না,তবে আরেকটি বার সব আমাদের হোক।”

রাওনাফ হেসে বলে,”পোয়েট্রি?”

উর্বী মাথা নাড়ায়। অস্ফুট স্বরে বলে,”প্রেম বন্দনা। একটা আর্জি।”

রাওনাফ হেসে উর্বীকে কোলে তুলে নেয়। উর্বী আপ্লুত হয় আবেগে। তাকিয়ে থাকে সরল চিত্তের মানুষটার দিকে। মনের প্রজাপতি গুলো নির্বিঘ্নে উড়ে বেড়াচ্ছে। আজ কেউ তাদের আস্কারা দিচ্ছে। লাই দিচ্ছে তাদের। রঙ বেরঙের রঙিন স্বপ্ন চোখের সামনে ভাসছে। একটা সংসারের স্বপ্ন, ভালাবাসাময় সংসার। উর্বীর ভীষণ প্রত্যাশিত, ভীষণ কাঙ্খিত।
অতশত ভাবতে ভাবতেই মাথার নিচে বালিশ ঠেকে তার। বিছানার চাদর খামচে ধরে নিজের লজ্জামাখা মুখটা ঘুরিয়ে নেয়। এতক্ষণ যার চোখে সরাসরি চোখ রেখে কথা বলেছে, এখন পারছে না চোখ মেলাতে। আর এই অবাধ্য প্রজাপতি গুলো একটু বেশিই উড়ছে, বেসামাল। রাওনাফ উর্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে উর্বীর ডান হাত টেনে চুমু খায় হাতের পিঠে।
উর্বী আষ্টেপৃষ্ঠে রাওনাফকে জরিয়ে ধরে। মুখ লুকায় রাওনাফের বুকে। তার এই আবেগী মুহুর্তে সে লুকাতে চায় ঐ মুখটা ঐ প্রশস্ত, বিশ্বস্ত বুকে।

রাওনাফ হাত বুলিয়ে দেয় উর্বীর মাথায়। দৃষ্টি দিয়ে দৃষ্টি থেকে অনুমতি নেওয়া হয়, মন দিয়ে মন থেকে অনুমতি নেওয়া হয়।

পবিত্র ভালোবাসা-বাসিতে আবেশিত হওয়ার আগে রাওনাফের চোখে ভেসে ওঠে তরুণী শিমালার হাস্যোজ্জ্বল ছবিটা। খিলখিলিয়ে হাসি শুনতে পায় সে। মুহুর্তেই অস্বস্তিতে, আত্মগ্লানিতে ছেয়ে যায় তার মুখ। থেমে যায় সে। উর্বী চোখ মেলে তার দিকে তাকায়। রাওনাফ উঠে বসে। অস্বস্তি পুরো শরীরে ছড়িয়ে পরেছে।

উর্বী উঠে বসে। রাওনাফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বোকা উর্বী পড়ে ফেলে রাওনাফকে। পেছন থেকে আঁকড়ে ধরে নরম গলায় বলে,”ঠকাচ্ছেন না আপনি নাবিলের মাকে। ঠকাননি আপনি। প্লিজ নিজেকে ছোটো ভাববেন না। আমি ছোটো হবো তাতে।”

রাওনাফ ধীরে ধীরে ঘুরে উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাওনাফ বলতে থাকে,”যেটা শিমালার জন্য আছে সেটা শুধু শিমালার। আমি যেটা তোমায় দেবো সেটা শুধু তোমার থাকবে উর্বী। আমি শিমালা বা উর্বী কাউকেই অসম্মান করতে পারবো না।”

উর্বী হাসে। বলে,
“জানি তো। আপনি শিমালাকে অসম্মান করলে একজন নারী হিসেবে আমিও অসম্মানিত হতাম। ঠুনকো লাগতো এই সম্পর্ক। ”

কথাটা বলে উর্বী রাওনাফের হাত টেনে নেয়। হাতটা নিজের মাথায় রেখে নরম গলায় বলে,”আমি চাই আপনি নাবিলের মাকেও সম্মান করবেন। আর আমাকেও। আপনি আরো সময় নিন। আপাতত আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিন। এটুকুই যে অনেক সম্মানের।”

রাওনাফ তাকিয়ে আছে উর্বীর মুখের দিকে। বলে ওঠে,”তুমি আমায় জাজ করবে?”

_কখনোই না। সময় নিতে চান আরো?

রাওনাফ মাথা নাড়ায়, অস্ফুট স্বরে বলে,”আজ যদি আমি তোমাকে ফিরিয়ে দিই সেটা হবে তোমার প্রতি আমার চরম অসম্মান। আমি তো বললাম, আমি শিমালা বা তুমি কাউকেই অসম্মান করতে পারবো না।

উর্বী তাকিয়ে আছে। রাওনাফ উর্বীর মাথাটা নিজের বুকে ঠেকিয়ে বলে,
_দুজনেই আমার কাছে খুব সম্মানের।

উর্বী চুপ করে আছে। রাওনাফ ধীরে ধীরে উর্বীর কপালে চুমু খায়। উর্বীর গাল আগলে ধরতেই সে টের পায় তার হাত ভিজে গিয়েছে। উর্বীর চোখে পানি। রাওনাফ চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলে,”চলো বারান্দায় বসি।”

দু’জনে পাশাপাশি একটা বেঞ্চিতে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে। আকাশে ঝলমলে এক চাঁদ, দু’জনেই তাকিয়ে আছে সেদিকে। রাওনাফ এক হাত দিয়ে আগলে ধরে রেখেছে উর্বীকে। উর্বী ধীরে ধীরে এলিয়ে দেয় তার মাথাটা রাওনাফের কাঁধে। রাওনাফ মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”মন খারাপ করে দিয়েছি তোমার?”

_মন ভালো করে দিন তবে।

_কিভাবে?

_একটা গান গেয়ে।

_গান? আর আমি? এটা একটু বেশি আশা করে ফেললে না উর্বী।

_হ্যা করেছি। জানেন আমি দীর্ঘ ছয় বছর কোনো গান শুনিনি। ভালোবাসার গান।

রাওনাফ চুপ করে থাকে। উর্বী বলে,”প্লিজ গান। সত্যি বলছি, আমার মন ভালো হয়ে যাবে।”

_আমি বড্ড বেসুরো।

_দরকার নেই সুরের।

রাওনাফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সংকোচ কাটিয়ে গাইতে শুরু করে,”এখন অনেক রাত। আমার কাঁধে তোমার নিঃশ্বাস,আমি বেঁচে আছি তোমার ভালো বাসায়।”

উর্বী রাওনাফের কাঁধ থেকে মাথা উঠিয়ে রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে,”বলেছিলাম না আমি বেসুরো। বাদ দাও।”

উর্বী রাওনাফের হাত টেনে ধরে। ধ’ম’কের সুরে বলে,”গান বলছি।”

রাওনাফ হাতের দিকে তাকিয়ে উর্বীকে আগলে নেয়, তারপর গাইতে শুরু করে, “ছুঁয়ে দিলে হাত। আমার বৃদ্ধ বুকে তোমার মাথা চেপে ধরে টলছি কেমন নেশায়।”

উর্বী আকরে ধরে থাকে রাওনাফকে। রাওনাফ গাইতে থাকে,”কেন যে অসংকোচে অন্ধ গানের কলি,
পাখার ব্লেডের তালে সোজাসুজি কথা বলি।

আমি ভাবতে পারি নি,
তুমি বুকের ভেতর ফাটছো আমার
শরীর জুড়ে তোমার প্রেমের বীজ।”

বোকা উর্বীর চোখ বেয়ে পানি পরতে থাকে। প্রাপ্তির আনন্দে। রাওনাফ হাত বাড়িয়ে পরম যত্নে সেই পানি মুছিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে কবিতার মতো করে বলে ওঠে,
“আমি থামতে পারি নি,
তোমার গালে নরম দুঃখ
আমায় দুহাত দিয়ে মুছতে দিও প্লিজ।”

উর্বী আর অপেক্ষা করে না। রাওনাফকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁ’দে ওঠে। রাওনাফ একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। উর্বীর কান্না থামার অপেক্ষা না করেই উঠে তাকে কোলে তুলে নেয়। সমস্ত পিছুটান,গ্লানি কাটিয়ে শুরু করতে যাচ্ছে নতুন এক অধ্যায়। কপালে চুমু এঁকে উর্বীর ভেজা চোখের পাতায় চুমু খায়। উর্বীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,”কাঁদবে না। আমি আছি। আমি থাকবো।”

চলমান…..