ডাকপিয়নের ছুটি নেই পর্ব-০৫

0
334

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_০৫

চোখে আর ঘুম ধরা দিলোনা কারোরই। বেশ অনেকক্ষণ হলো, বিছানা ছেড়ে উঠে গেছে শ্রাবণ। ইশা উঠে বসেছে তার পরক্ষণেই। বাকিরা সবাই ঘুমে কাদা। তানির পিঠের নীচ থেকে ওড়নাটা বের করে গায়ে জড়িয়ে উঠে গেলো একরাশ অস্থিরতা নিয়ে। ছাদে পা রাখতেই শীতল বাতাসটা এসে জড়িয়ে গেলো সর্বাঙ্গে। বুকের ভেতরটায় এক অন্যরকম অনুভূতির মেলা বসলো ঠিক তখনই। দুরুদুরু কাঁপছে অন্তরের অন্তস্তল। দূর থেকেই দেখতে পেলো উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। চন্দ্রমা মেঘের আড়ালে লুকিয়েছে। আকাশে কেবল সহিষ্ণু কালো মেঘ। ইশা পা গুনে হাঁটতে লাগলো। শ্রাবণ সিগারেট জ্বা*লালো। বাতাসে তীব্র গন্ধ ছড়িয়েছে ক্ষণেই। ইশা নাক কুঁচকালো। কাছাকাছি আসতেই সিগারেটের গন্ধে পেটে মোচড় দিলো ওর। সেই সাথে কাশি শুরু হলো। ইশার কাশির শব্দ আঘাত হানলো শ্রাবণের বক্ষঃপিঞ্জরে। সঙ্গে সঙ্গে জ*লন্ত সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো অদৃশ্যে। সম্মুখে উড়তে থাকা ধোঁয়া টুকুন চটজলদি হাতের সাহায্যে উড়িয়ে দিয়ে মুখ মুছে পেছন মুড়ে তাকালো। ততক্ষণে ইশা এসে দাঁড়িয়ে তার সামনে। এই সেই ইশা, যার এক কথায় শ্রাবণ তার সব বদঅভ্যাস গুলোর বলি দিতো। তারপর, একদিন সময় বদলে গেলো। এই সেই ইশা, যার হাজার বারনেও আর শ্রাবণের কোনো মাথা ব্যাথা হলোনা!

কিন্তু আজ, আজ যেন একটু ভিন্ন হতে চাইলে তার অবাধ্য হৃদয়। নিজেকে বোঝাতে চাইলো, ইশাকে ক*ষ্ট দিলে সে নিজেও ভালো থাকবেনা! মোটেও ভালো থাকবেনা।

“সিগারেট খাচ্ছিলে?;

“তুই এখানে কি করছিস?;

“ঘুম আসছেনা!;

“তো আমি কি করতে পারি? আমাকে দেখে নিশ্চয়ই ঘুমের ঔষধ ডেলিভারি দেওয়া ডেলিভারি বয় লাগছেনা!;

শ্রাবণের ত্যাড়া ত্যাড়া জবাবে উত্তর খুঁজে পেলোনা ইশা। নিশ্চুপ হয়ে রইলো কিছুক্ষন। অতঃপর ধীর গলায় পূণরায় কথা পাড়লো,

“তুমি ঘুমালে না কেন?;

“আমার কাউকে কৈফিয়ত দিতে ভালো লাগেনা। খুব ভালো করে জানিস তুই!;

“কৈফিয়ত চাইছি না। শুধু জিজ্ঞেস..;

“ভেতরে যা। এতো রাতে কেউ দেখলে বদনাম রটাবে। আর তুই তো বদনামে খুব ভ*য় পাস।;

“শ্রাবণ ভাই! আমরা কি আর আগের মতো কথা বলতে পারিনা?;

“তখনও তোকে বলেছি, আর এখনও বলছি! অতীত নিয়ে পড়ে থাকিসনা।;

“তার মানে, তুমি সত্যি বদলে গেলে?;

শ্রাবণ নিজের জবাবটাকে স্থগিত রাখলো। যেন, ইশার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলোনা। কতক্ষণ নীরব থেকে পূণরায় বলল,

“দাঁড়িয়ে আছিস কেন! ভেতরে যেতে বললাম তো?;

ধমকে উঠলো শ্রাবণ। ইশা চমকে উঠলো। নিস্তব্ধ রাত বড্ড জোরে বাজালো শ্রাবণের উচ্চস্বর। ইশা ভীত চোখে তাকালো শ্রাবণের পানে। শ্রাবণ চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। যেন আরও বেশ কয়েকটা ধমক বাকি আছে ইশার কপালে।

“য্ যাবোনা! কি করবে?;

অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো শ্রাবণ। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“দেখ, রাত-দুপুরে এসব নাটক কিন্তু ভালো লাগছেনা!;

“আমি নাটক করছি?;

“হ্যাঁ করছিস! আরও কতকি করছিস, তুই নিজেও জানিসনা!;

“কি করেছি আমি? তুমি সব সময় আমার সাথেই কেন এমন করো? কি এমন করি আমি!;

জেদী গলায় প্রশ্ন ছুড়লো ইশা। শ্রাবণ রাগি চোখেই দেখছে ইশার জেদী মুখশ্রী!

“তুই কাজই এমন করিস যে, আমাকে না চাইতেও তোর সাথে খারাপ আচরণ করতে হয়!;

“আমি ভুল করলে আমাকে বলো শ্রাবণ ভাই, কিন্তু তারপরও আমার সাথে এমন করোনা, তোমার এই কঠোর ভাবমূর্তি একদিন আমাকে শেষ করে ফেলবে!;

বড্ড করুন শোনালো ইশার বলা শেষোক্ত কথাটা। শ্রাবণ ওর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অদূরে নিক্ষেপ করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। তবে তার সব চেষ্টার একটাও যদি কখনও সফল হতো! তাহলে তো সে ধন্য হয়ে যেতো!

“ভেজা শরীরটাকে তোর ঐ হবু বরকে দেখিয়ে বড্ড আনন্দিত হয়েছিস তো? আর কি চাই!;

স্তব্ধ হয়ে গেলো ইশা। কন্ঠনালীতে ক্ষনিকেই কোনো চাপ পড়লোনা কথা খরচ করার জন্য। এখানে দোষটা ওর। ও স্বীকার করছে নিজের কাছেই! কিন্তু, শ্রাবণের কানে সেই খবর কি করে এলো?

“তোর বিয়েটা এই মুহুর্তেই হয়ে যাওয়া উচিৎ। তুর্জ আমাকে নিজে এসে বলেছে তোদের বিয়েটা আরেকটু এগিয়ে আনার কথা! কারন, তোকে ছোঁয়ার জন্য তার যে তর সইছেনা।;

ইশার ভেতরটা মুচড়ে যেতে লাগলো। কি বলছে শ্রাবণ! তুর্জ কি সত্যিই এমনটা ভাবে ওকে নিয়ে? কথাটা ভেবে নিজেরই হাসি পেলো নিজের উপরে। আরও একবার প্রমাণ হলো,মেয়েদের সৌন্দর্য্য তাদের জন্য অভিশাপ!

“চলে যা ইশা, অনেক দূরে চলে যা! নয়তো একে একে অনেক গুলো জীবন ন*ষ্ট হয়ে যাবে। যা বোঝার ক্ষমতা তোর কোনোদিনই হবেনা!;

বড্ড কান্না পেলো ইশার। তুচ্ছ মনে হলো ওর নিজেকে! কেউই যে ওকে বোঝার চেষ্টা করছেনা! সবাই যে যার মত, অভিমান, অভিযোগ চাপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ওর উপর! কেউ বুঝছেনা ওকে!

“তুর্জ তোকে ভালোবাসেনা, বাসে তোর শরীরটাকে। এ’কথা বুঝিস তুই?;

আবারও বলে উঠলো শ্রাবণ। ইশার চোখের কোন গড়িয়ে জল পড়লো। কিছু বলতে চাইলেও কান্নার বেগ চেপে কিছুই বলতে পারলোনা। শ্রাবণ নিঃশব্দে উপলব্ধি করলো মায়াবতীর কান্না! বড্ড করুন হলেও, বড্ড নেশালো মনে হলো শ্রাবণের। সে চায়না এই কান্না থামুক। সে চায়, অনন্তকাল ব্যাপী মায়াবতীর কান্না বজায় থাকুক। তাহলেই সে শান্তি পাবে। এত বছরের তিল তিল করে গড়ে তোলা অনুভূতি গুলোকে এক লহমায় ধূলিসাৎ করে দেওয়ার শা/স্তি এই কান্নাগুলো। চলুক, যতদিন না সে তার ব্যর্থ হৃদয়কে পূণরায় প্রশান্ত করতে পারবে।

“আমার সামনে এসব ন্যাকামি চলবেনা। হয় তুই চলে যা, না হয় আমি চলে যাচ্ছি!;

এই বলে হাঁটা ধরতেই পেছন থেকে তার হাত টেনে ধরলো ইশা। কান্না ভেজা গলায় বলল,

“চলে যাবো আমি! একদিন অনেক দূরে চলে যাবো। তবুও, তুমি কোথাও যেওনা শ্রাবণ ভাই!;

“রুমে যা!; শান্ত স্বরে বলল শ্রাবণ।

ইশা শ্রাবণের হাত ছেড়ে চোখের জল মুছে চলে গেলো ভেতরে। শ্রাবণ ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়লো।

ভোরের আলো ফুটতেই হৈচৈ শুরু হলো বিয়ে বাড়িতে। বাচ্চাদের কান্নার আওয়াজ, বড়দের চিৎকার চেঁচামেচি! ৫টার দিকে চোখটা লেগে এলেও ছয়টার মধ্যে উঠে পড়তে হলো ইশাকে। পাশে বড় মামী নেই। নেই শ্রাবণও। হয়তো সারা রাত আর আসেনি সে। আরব ঘুমচ্ছে বেঘোরে। তুতুন এবং তানি জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে আছে। ইশা উঠতে উঠতে ওদের দু’বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দু’জনকেই চুমু খেয়ে উঠে গেলো। নিজের রুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নীচে নামতেই দেখা হলো আনোয়ারা বেগমের সাথে। আনোয়ারা বেগম খাবার টেবিলে বসে পান সাজাচ্ছেন। ইশাকে দেখতেই ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন,

“দিদি ভাই, ঘুম কেমন হলো?;

“আর ঘুম!;

“সেকি রে, জায়গা মেলেনি?;

“জায়গা মিলেছে। তবে ঘুম মিলেনি জানপাখি! তোমার মতো একজন বুড়ো পেলে তো সারা রাত তার বুকে মাথা রেখেই পার করে দিতাম।;

নানীর গাল টেনে কথাটা বলে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। আনোয়ারা বেগম হাত উল্টে একটা মা*র দিলেন ইশাকে। লজ্জা পাওয়া গলায় বললেন,

“পাজি মেয়ে একটা!;

ইশা ফিক করে হেসে দিলো। অতঃপর নানীকে ছেড়ে তার পাশের চেয়ারটায় বসতে বসতে আশেপাশে নজর বুলালো। মা-কে খুঁজছে। বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে। ক্ষিদেয় যেন পেটের ভেতর ইঁদুর দৌড়াচ্ছে।

“মা কি রান্না ঘরে নানু?;

“হ্যাঁ। তোর জন্য নাস্তা তুলে রাখতে বললাম। রাতে তো কিছু না খেয়েই চলে গেলি!;

গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো ইশা। মাথা চুলকে বলল,

“না গিয়ে উপায় ছিলো? মা বলল, এতো মেহমানকে খাবার দিতে দিতে খাবারই শেষ! আমি আর ভাগে পেলাম না!;

“কি বিশ্রী কান্ড! যা এখন জলদি গিয়ে নাস্তাটা সেরে নে। গরম গরম খেতে ভালো লাগবে।;

“তুমি খেয়েছো বুড়ি?;

“হ্যাঁ, তোর বুড়োর সাথে মাত্রই নাস্তা খেয়ে উঠলাম।;

“বাহ্, এটা কিন্তু মন্দ করোনি।;

গলা উঁচিয়ে কথাটা বলতে বলতে রান্না ঘরে ঢুকলো ইশা। মা,বড় মামি এবং ছোট মামি ছাড়াও আরও বেশ কয়েকজন অপরিচিত কাজের লোককে দেখা গেলো। এদেরকে ইশা না চিনলেও মুচকি হেসে কথা বলল সবার সাথে। মেয়েকে দেখে মরিয়ম বিবি নাস্তার প্লেটটা তুলে দিলো ঝটপট। আগে ক্ষমা চেয়ে বলল,

“রাতের জন্য মায়ের উপর রেগে থাকিসনা মা! বুঝিসই তো, এতো মানুষজন! কেউ কেউ তো ২বারও খেলো।;

শেষোক্ত কথাটা গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন মরিয়ম বিবি। আফিয়া বেগম এবং নুপুর বেগম কথাটা শুনে মুখ টিপে হাসলেন। অতঃপর আফিয়া বেগম বললেন,

“রাক্ষস বাপু! এদিকে আমাদের ছেলেমেয়েরা খেতে পায়না, আর ওদিকে তারা দু’বার করে খায়। কোনো বিবেক নাই।;

নুপুর বেগম মুখে আঁচল চেপে আস্তে করে বললেন,

“থাক আপা, বাদ দাও। মা ওখানে বসে আছে। শুনতে পাবে।;

আরও অনেক কথা হলো তিন ননদ-ভাবীর মধ্যে। ইশা শুনেও শুনলোনা। নিজের খাবার নিয়ে চট জলদি খেতে বসলো। খাওয়া যখন মাঝামাঝি হয়ে এলো, ঠিক তখনই দেখতে পেলো শ্রাবণকে। এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করতে করতে এদিকেই হেঁটে আসছে। পরনের লাল টি-শার্টটা বেকায়দায় কুঁচকে আছে। সেটাও টেনেটুনে ঠিক করলো। ইশাকে সে দূর থেকেই দেখতে পেয়েছে। তবে ভাবখানা এমন যে, সে ইশাকে কেন, সামনের দেয়ালটাকেও দেখেনি!

“মা, নাস্তা দাও জলদি! খেয়ে বের হতে হবে।; (গলা উঁচিয়ে ডাকলো মাকে)

“কই যাবি এতো ভোরে?;

সুপারি কাটতে কাটতে শুধালেন আনোয়ারা বেগম। শ্রাবণ চেয়ার টেনে বসলো। গ্লাসে পানি ঢেলে আগে খেয়ে অতঃপর দাদীর প্রশ্নের জবাব দিলো।

“ফুল কম পড়েছে। বাবা বলল।;

“সেটা এখন মনে পড়লো?;

“রাতেই বলেছে। কিন্তু মাঝরাতে ফুল কোথা থেকে জোগাড় করতাম বলো?;

“সেও তো কথা। একা যাবি?;

“হ্যাঁ, বাইক নিয়ে চলে যাবো। দেখি, আর কাউকে পাই কিনা!;

“ইশাকে নিয়ে যা।;

নিজের নামটা উঠতেই হঠাৎ বিষম খেলো ইশা। কাশি উঠতেই চমকে গেলেন আনোয়ারা বেগম। শ্রাবণের আধখাওয়া পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে চিন্তান্বিত গলায় বলে উঠলেন,

“কি হলো, দেখে খা বাপু!;

নানীর থেকে পানিটা নিয়ে ঢকঢক করে গিলে খেলো ইশা। এক পর্যায়ে বিষম থেকে রেহাই পেয়ে আবারও খাবারে মনোযোগী হলো। দাদীর কথার পিঠে হ্যাঁ না কোনো কিছুই বললনা শ্রাবণ।

“মা? খাবার কি পাবো আজ?;

পূণরায় গলা উঁচিয়ে মাকে ডাকলো শ্রাবণ। কিন্তু এবারেও কারোর সাড়া নেই। তাই সে বির*ক্ত হয়ে উঠে যেতে নিলে আঁটকালো দাদী। ইশাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“ও ইশা, শ্রাবণের খাবারটা এনে দে না! ছেলেটার তো ক্ষিদে পেয়েছে। রান্না ঘরে সবাই ব্যস্ত। যা তুই গিয়ে নিয়ে আয়!;

ইশা অসহায় নেত্রে তাকালো নানীর পানে। বোকা গলায় প্রশ্ন করলো,

“আমি?;

“হ্যাঁ, যা জলদি।;

ইচ্ছে না থাকলেই নানীর কথা ফেলতে পারলোনা ইশা। চুপচাপ উঠে গেলো শ্রাবণের জন্য খাবার আনতে। মিনিট দুয়েক বাদে খাবার নিয়ে আবারও ফেরত এলো। শ্রাবণের সামনে দিয়ে, নানীর কথা মতো গ্লাস ভর্তি করে পানিও ঢেলে দিলো। অতঃপর পূণরায় বসে পড়লো নিজের বাকি খাবারটুকু শেষ করতে।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে