Friday, July 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 376



একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-১৮+১৯

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ১৮
জায়গাবদল হওয়ায় ভোরের দিকে দীপার ঘুম ভেঙে গেল। এমনিতে এক ঘুমে সে রাত এমনকি সকাল আর দুপুরও নিশ্চিন্তে পার করে দিতে পারে। নড়েচড়ে চোখ মেলতেই তার চোখ জলে ভরে গেল। কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল বালিশে। ঘুমের মাঝে হাত – পা তুলে দেওয়ার অভ্যাস তার। কাদিনের উপর পা তুলে রেখেছে সে। হাতটাও কাদিনের বুকে। কাদিন অবশ্য হাত দিয়ে কপাল ঢেকে চিন্তা করতে করতে যেভাবে শুয়েছিল সেভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছে। দীপা উঠে বসল। তার পাশে তো এই মানুষটি থাকার কথা নয়। যাকে গোলাপের পাঁপড়ি ছিঁড়তে, খোঁপায় ফুল গুঁজতে, বৃষ্টিতে ভিজতে এতটা কাল ধরে ভেবে এসেছে তার থাকার কথা। থাকার কথা তার যার সাথে বিগত বর্ষাগুলোয় পিঁচঢালা পথে হেঁটেছিল। ডুবেছিল যার চোরাবালিতে। বিছানা ছেড়ে নেমে গেল সে। বারান্দার দরজা খুলে বারান্দার দাঁড়াল। চারদিক পাখিদের কিচিরমিচিরে মুখোরিত হচ্ছে। অন্ধকার খানিকবাদেই কেটে যাবে। আর দীপার কান্না? কখনো কি থামবে? দোলনায় বসে চোখ বুজল সে। তাহমিদ গতকাল তার বিয়েতে এসেছিল তাও প্রেমিকা সহিত। না ঠিক তার বিয়েতে নয়, নিজের বন্ধু কাদিনের বিয়েতে। কাদিন নাকি তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের একজন। অথচ, দীপাকে কখনো সে কাদিনের নামটুকুও বলেনি। শুধু কাদিন কেন? কোনোদিন তাহমিদ তার অন্য কোনো বন্ধুদের সাথেও তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়নি। না দিয়ে দিয়েছে তার পরিবারপরিজনেরর সাথে পরিচয় করিয়ে। অথচ, দীপা গতকাল খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে যে তাহমিদের নতুন প্রেমিকা তার বন্ধুমহলে বেশ সুপরিচিত। শুধু সুপরচিত’ই নয় ভাবি বলে পরিচিত। কাদিনও মেয়েটাকে ভাবি বলে কথা বলছিল!
সে যে এতদিন বোকার স্বর্গে বাস করছিল তাতে আর কোনো সন্দেহ রইল না তার। বোকাই ত সে। ঘুম ভাঙা চোখে যে মেয়ে তার স্বামীকে মানতে পারে না, যে এখনো চোখ মেলে তার প্রতারক প্রেমিককে দেখার জন্যে, সে বোকা ছাড়া আর কিছুই নয়।
.
কাদিন আর কাইয়ূমের ঘরের বারান্দা পাশাপাশি। রিমা তার বারান্দায় সকালে কি একটা কাজে যেন এল। পাশের বারান্দায় চোখ পড়তেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল। দীপা বারান্দার দোলনায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে কেন? নতুন বউকে কি সারারাত বারান্দায় রেখেছিল কাদিন? এ কেমন কথা? হলুদ সন্ধ্যা থেকেই কাদিনকে চিন্তিত লাগছিল। কোনো সমস্যা হয়নি তো? রিমা চুল বাঁধতে বাঁধতে কাদিনের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিলো। রিমার জায়গায় অন্য কেউ হলে দেবর আর জায়ের মধ্যকার বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতো না। কিন্তু সে ভিন্ন। সে কাদিনের বড় বোনও। ধীর গলায় দরজা ধাক্কে কাদিনকে ডেকে তুলল। কাদিন আড়মোড়া ভেঙে দরজা খুলতেই রিমা ঘরের ভেতর ঢুকে দরজা আটকে ফেলল। বলল, “এসব কি হচ্ছে, কাদিন?”
কাদিন কাঁচা ঘুম থেকে উঠায় অনেককিছুই ধরতে পারছে না সে। তাই প্রশ্ন করল, “কি হবে?”
“দীপা বারান্দায় কি করছে? রাস্তা থেকে বারান্দা স্পষ্ট দেখা যায়। মানুষজন কি বলবে, কাদিন?”
কাদিনের এতক্ষণে খেয়াল হলো দীপা বিছানায় নেই। সে বারান্দার দিকে হেঁটে গেল। রিমাও পেছন পেছন গেল। বারান্দার ঠাণ্ডা বাতাসে আরাম পেয়ে দীপা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। কাদিন রাস্তার দিকে তাকিয়ে আতঙ্কিত হয়ে গেল। নীচ থেকে কেউ দেখে ফেলেনি তো? আর পাশের বাসার ওরা?
কাদিন প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে ডাকল, “দীপা? অ্যাই দীপা? উঠো। উঠো বলছি। তুমি এখানে কি করছ? দীপা?”
কাদিন এবার দীপার কাঁধ ধরে ঝাঁকুনী দিলো। দীপা ঘুম থেকে উঠে হকচকিয়ে গেল। রিমা ভাবি অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন। দীপা ঘাবড়ে গিয়ে উঠে দাঁড়াল। কাদিন বলল, “তুমি বারান্দায় ঘুমাচ্ছিলে! আশ্চর্য!”
দীপা বলল, “গরম করছিল বলে বাতাস খেতে বসেছিলাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টেরই পাইনি।”
কাদিন রাগে কিছু বলতে পারল না। রিমা বলল, “কাদিন তোমায় উল্টাপাল্টা কিছু বলেছে? কোনো ঝামেলা হলে আমাকে বলো, লুকিয়ো না।”
দীপা বলল, “না, না তেমন কিছু না। আপনি কি করে জানলেন আমি এখানে?”
“তোমার পাশের ঘরটা আমার আর তোমার পাশের বারান্দাটাও।”
কাদিন আর নিজেকে সামলাতে পারছে না বলে সেখান থেকে সরে এল। এই মেয়ে জাস্ট রিডিকিউলাস! রিমা আপুকে প্রশ্ন করছে আপু কি করে দেখল। কোনো আক্কেল নেই। কত গাধী এই মেয়ে! কখনো, কোথায়, কি বলতে হবে সে সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞানও তার নেই।
.
কাদের সাহেব ঠিক করলেন বড় ছেলের মত মেজো ছেলের বউভাতের অনুষ্ঠানটাও তিনি নিজের গ্রামের বাড়িতেই করবেন। দীপাকে নাশতার টেবিলে বললেন, “তোমাদের বাড়ির লোকদের অসুবিধে হবে না তো, মা?”
দীপা বলল, “না, বাবা। অসুবিধা কেন হবে?..”
দীপা হয়তো আরো কিছু বলত। কিন্তু তার আগেই কাদিন খপ করে টেবিলের নীচে দীপার হাত চেপে ধরল। পাঠক, এই হাত চেপে ধরাকে কোনো প্রকার রোমান্টিসিজমের বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করার দরকার নেই। এই হাত চেপে ধরার অর্থ, দয়া করে এখানেই থামো। বেশি বেশি বলো না তুমি। তুমি মুখ খুললেই আমি বিপদে পড়ব। দীপা এই হাত ধরার মানে কি বুঝল কী যেন! তবে হকচকিয়ে উঠল। দ্রুত হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চুপ হয়ে গেল। কায়েস এসে একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, “দীপা ভাবিকে জানালার পাশের চেয়ারটা দাওনা তোমরা।”
রিমা এই কথা শুনে হাসতে হাসতে কড়ির উপর ঢলে পড়ল। কড়িও ঠোঁট টিপে হাসছে। কাদের সাহেবও না হেসে পারলেন না। কাইয়ূম নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল, “দীপা, নাও বোন তুমি এটায় বসো।”
দীপা লজ্জায় মাথা নীচু করে জিহ্ব কাটল, “ভাইয়া প্লিজ বসুন।”
কাদিনের মুখ থমথম করছে। সে চুপচাপ মুখে লোকমা তুলল।
কাণ্ডজ্ঞান ছাড়া বউ তার।
.
নাঈম সকালের নাশতা করতে মেস থেকে বেরুচ্ছিল। ইমাদ পিছু ডাকল, “নাঈম?”
নাঈম হাসতে হাসতে ইমাদের কাছে ফিরে গেল, “কি খবর, ইমাদ?”
“ভালো। একটা ভালো টিউশনীর সন্ধান আছে। তুমি চাইলে পড়িয়ে দেখতে পারো।”
নাঈমের চোখ চকচক করে উঠল, “কোন ক্লাস? কত দিবে?”
“দিবে ভালোই। রেসকোর্সের দিকে পারবে?”
“পারব, পারব আলবত পারব। বড় উপকার করলে ভাই।”
ইমাদ প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করতে করতে বলল, “গার্ডিয়ানের নাম্বারটা মেসেজ করে দিচ্ছি। তুমি আগে কথা বলে দেখো।”
নাঈম ইমাদের কাঁধ চেপে ধরল, “নাশতা করেছ? এসো না একসাথে যাই।”
ইমাদ নাশতা করেনি তবুও বলল, “করে ফেলেছি। আরেকদিন।” সে নাঈমের কাছ থেকে ট্রিট নিতে নারাজ।
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ১৯
মঈনকে রিলিজ দেয়া হয়েছে। সে আপাতত বাসায়’ই আছে। ডান হাতে আঘাত পাওয়ায় নিজে নিজে খেতে পারে না সে। শিল্পী’ই খাইয়ে দেয়। খাওয়ানোর সময়টায় শিল্পীর চেহারা দেখে মঈনের মনে হয় প্রতি লোকমায় সে এক ফোঁটা করে বিষ মিশিয়ে দিচ্ছে। কারণও আছে। সেদিন সে মঈনকে কলে কথা বলতে শুনে ফেলেছিল। ডিভোর্স এর বিষয়াদি নিয়ে উকিলের সাথে কথা হচ্ছিল। শুনে সে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। চুপ করেছিল। মঈন তা দেখে ভেবেছিল শিল্পী বুঝি তাদের আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা এতদিনে মেনে নিতে পেরেছে। কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। সেদিনের পর থেকে শিল্পী মঈন ছাড়া আর বাদদবাকি সবার প্রতি, সবকিছুর প্রতি খুব বেশি ক্রুদ্ধ আর নির্মম। যা সচরাচর ঘটে না, কয়দিন ধরে তাই ঘটছে। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে শিল্পী মুবিন, মিলা দুজনকেই ধরে ধরে মারছে। বাসার এটাসেটা ইচ্ছে করে ভাঙছে। এ যেন মঈনকে আর নিজেকে আঘাত করার এক নান্দনিক উপায়। তবে এতকিছুর পরও মঈনের দেখাশুনায় কোনো ঘাটতি নেই। সে যখন রাতে পাশ ফিরতে ব্যথায় গোঙিয়ে উঠে, কাতরায় তখন শিল্পী’ই অস্থির হয়ে উঠে। উঠে বসে ব্যাকুল হয়ে। মঈনের হাত চেপে ধরে বলে, “বেশি কষ্ট হচ্ছে না তো? কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলো তো।”
সম্পর্কগুলো কত দুর্বল আবার দৃঢ়ও। চাইলেও ধরে বেঁধে রাখা যায় না তা যেমন সত্য, ইচ্ছে হলেই সম্পর্ক ছিন্নও করা যায় না। এ এক অদ্ভুত সুঁতোর খেলা।
থালার শেষ লোকমাটা মাখতে মাখতে শিল্পী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মঈন হঠাৎ বলে উঠল, “আমার খাবারে বিষ মিশিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে যে তোমার হয় তা আমি জানি। নিজের উপর মানসিক অত্যাচার করে আমার সেবা করার কোনো দরকার নেই। আমি দেখি একটা লোক রাখব কদিনের জন্য।”
শিল্পী খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, “মেয়েলোক রেখো। তোমার সুবিধা হবে।”
শেষ লোকমাটা হাতে নিয়েই প্লেট সহ শিল্পী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
.
মিলার পরীক্ষা ভালো হয়েছে। ২ ঘণ্টার পরীক্ষা ছিল। সকাল আটটা থেকে দশটা পর্যন্ত। সুহার পরীক্ষা মোটামুটি হয়েছে। অত ভালো না। তা নিয়ে অবশ্য সুহার কোনো মাথাব্যথা নেই। সুহা বলল, “মিলা, চল না, ডিএসপি দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাই।”
ডিএসপি মানে ধর্মসাগরপার। লোকজন পণ্ডিতী করে ইংরেজী বানানের প্রথম অক্ষরগুলি নিয়ে ধর্মসাগর পাড়কে ডিএসপি বানিয়ে ফেলেছে। মিলা বলল, “না আজ না। আরেকদিন। আজ হাতে ভালো সময় আছে। দুই তিন ঘণ্টা পড়লেও এক, দুইটা চ্যাপ্টার রিভাইস দেয়া যাবে। স্কুলে যেহেতু যাওয়াই হয়নি সময়টা নষ্ট করা যাবে না।”
সুহা বিরক্ত হলো খুব। মিলা তবুও গেল না। গলি থেকে বেরিয়ে মূল রাস্তায় এসে দুজনই অটোতে উঠে বসল। সুহা সামনেই নেমে যাবে। তার বাসা কাছাকাছি। অটোটা একটু চলেই সুহার বাসার কাছে যাওয়ার আগে আগেই একবার থামল। অটোচালকের পাশের সিট খালি না হওয়ার তখনি অটোতে তাদের সিটের ঠিক উল্টোপাশে চিত্তগ্রাহী এক পরিণত যুবক উঠে বসল। দোহারা গড়নের লম্বাটে চেহারার ছেলে। উচ্চতায়ও বেশ। মেদহীন চিবুকের প্রশস্ততা এবং দৈর্ঘ্য চোখে পড়ার মত। পোশাকআশাক মলিন। সাদা শার্ট, কালো জিন্সের প্যান্ট। পায়ের গোড়ালির কাছে প্যান্ট ফেঁসে আছে। পায়ে বাটার স্যান্ডেল। সুহা খেয়াল করল মিলা সাথে সাথে কেমন জড়সড় হয়ে গেছে। হাত পা আরো গুটিয়ে বিনম্র ভঙ্গিতে বসার চেষ্টা করছে। নত গলায় সালামও দিলো। পরিচিত নাকি? ছেলেটি সালামের উত্তর দিয়ে জানতে চাইল, “স্কুলে যাওনি আজ?”
মিলা বিনয়ের সাথে বলল, “স্যার, প্রাইভেটে আজ মডেল টেস্ট ছিল।”
“আচ্ছা।”
এরপর আর কোনো কথা হয়নি। নেমে যাওয়ার আগে ইমাদ শুধু বলে গেল, “ভালো করে পড়ো। ইউ আর আ জিনিয়াস।”
মিলা একবার ভাবল বলবে, স্যার, আপনার কাছে আবার পড়তে চাই। কিন্তু সাহসে কোলায়নি। তাই বলল, “দোয়া করবেন, স্যার।”
ইমাদ মিলার মাথায় হাত রেখে চলে গেল। অটো আবার চলতে শুরু করেছে। সুহা প্রায় লাফিয়ে উঠে মিলার হাত চেপে ধরল, “এটা তোর স্যার? মাই গশ! আ’ম ডেড। দোস্ত মারাত্মক লেভেলের ক্রাশিত আমি।”
মিলা বিরক্তিতে চোখ উল্টে বলল, “শিক্ষকরা পিতা সমতুল্য হয় মেয়ে।”
“রাখ তোর পিতা সমতুল্য। ওসব বাপের বয়সী স্যারদের জন্য বলা কথা। উনি কি আমার বাপের বয়সী? তাছাড়া, উনি তোর স্যার। আমার না।” মিলা অবাক হয়ে সুহার দিকে তাকিয়ে রইল। সুহার চোখেমুখে অস্থিরতা।
.
কাদিন বারান্দায় উদাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দীপার কেন যেন খুব মায়া হয় লোকটার জন্য। বারবার মনে হয় ইশ উনার প্রেমটা কেন টেকেনি? সে নাহয় পোড়াকপালী। কিন্তু কাদিনের প্রেমটাও রক্ষা হলো না? কড়িরও ত সেই একই কষ্ট। আচ্ছা সব প্রেম শুধু ভেঙে যায় কেন? প্রেম বোধহয় কাঁচের শিশিতে রাখা বিষ। শিশি ভেঙে হয় টুকরো টুকরো, আর আকণ্ঠ বিষের জ্বালা। দীপার কাদিনের সাথে গল্প করতে ইচ্ছে হলো। লোকটা এত কম কথা বলে! সে পায়ে পায়ে গিয়ে কাদিনের পেছনে দাঁড়াল। কাদিন বারান্দার রেলিং এ দুহাতের কনুই রেখে ঝুঁকে ছিল বাইরের দিকে। দীপা বলল, “আপনার বন্ধুবান্ধব খুব কম, তাইনা?”
কাদিন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “বোধ হয়।”
“আপনি কি সবসময় এত কম কথা বলেন?”
কাদিন উত্তর করল না। দীপা বলল, “আপনার বোধহয় মন খারাপ। কেন বলুন তো?”
কাদিন দীপার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। চোখে চোখ পড়ে গেল দুজনের। দীপা চোখ সরিয়ে নিলো। তবে থামল না। সে আজ জেনেই ছাড়বে কাদিন সাহেবের কাহিনী কি! তাই বলল, “আচ্ছা আপনার কোনো মেয়ে বন্ধু নেই?”
“মানে?” কাদিন একটু অবাক। তার ভ্রুজোড়া বেঁকে গেছে।
দীপা কথা ঘুরিয়ে ফেলল, “না, বিয়েতে শুধু আপনার বন্ধুদের দেখেছি। কোনো বান্ধবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেননি তাই বলছিলাম আরকি।”
কাদিন আবার সামনের দিকে তাকাল। মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে। সে বলল, “কোনো বান্ধবী নেই আমার।”
দীপা বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে ফেলল, “বলেন কি! স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি কোথাও কোনো মেয়ে বন্ধু হয়নি আপনার?”
“না।”
“কলিগদের মাঝেও কেউ না?”
“না।”
“আমি কিন্তু আপনার প্রেমিকা টেমিকার কথা জানতে চাইনি। অমনি বান্ধবীর কথা জানতে চেয়েছি। আমার সাদা মনে কাদা নেই।”
কাদিন ছোট করে বলল, “জি, বুঝতে পেরেছি।”
দীপা নিজের গালে হাত রেখে বলল, “অবাককাণ্ড! আপনার সাথে আমার এত মিল কি করে!”
“মিল?” কাদিন এবার রেলিং ছেড়ে পুরোপুরি ঘুরে তাকাল।
“হ্যাঁ।”
“মিল কি করে হয়? বিয়েতেই তো তোমার বন্ধুদের দেখলাম।”
“হ্যাঁ মিল’ই তো। আপনারো এ জীবনে কোনো মেয়ে বন্ধু নেই, আর আমারো।”
কাদিন হতাশায় ডানেবায়ে মাথা নাড়তে নাড়তে আবার বারান্দার রেলিং ধরে বাইরের দিকে ঘুরে দাঁড়াল।
.
নাঈমের জন্য নিজের টিউশনিটা ছেড়ে দিয়ে ইমাদ একটু বিপাকেই আছে। একটামাত্র টিউশনীতে ওর হয়না। অন্তত দুইটা না হলে না’ই হয়। আগে তিন জায়গায় পড়াত সে। মিলা, মুবিনেরটা ছেড়ে দেওয়ার পর হাতে ছিল দুটো টিউশনী। নাঈমের জন্য একটা ছেড়ে দিয়ে এখন কি করবে তাই ভাবছে। সরু, অন্ধকার গলির ভেতর দিয়ে হেঁটে মেসে ফিরছিল সে। পাশেই একটা ডাস্টবিন। দুটো ছোট কুকুরছানা ডাস্টবিনের ময়লায় খেলা করছে। একটা বাদামী রঙের, অন্যটা সাদার মাঝে কালো কালো ছোপ। আহ্লাদে ঘেউ ঘেউ করতে করতে গড়িয়ে পড়ছে একটা অারেকটার উপর। বলা হয় নিঃশ্বাস আটকে মানুষ মরে! কিন্তু ইমাদ জানে এখান দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ভুলেও কেউ নিঃশ্বাস ফেললে নিশ্চিত তার মৃত্যু হবে। হাতের পাঁচ আঙুলে নাক চেপে ধরে ইমাদ দ্রুত পা ফেলল সামনের দিকে। পকেটে মোবাইল বাজছে। মোবাইল হাতে নিয়েও রিসিভ করল না সে। অচেনা নাম্বার। গলিটা পেরিয়ে তারপর নাহয় কলব্যাক করা যাবে। এখানে কথা বলতে গেলে শহীদ হতে হবে! কিন্তু, মোবাইল বেজেই চলেছে। বারবার কল আসছে। অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু হতে পারে ভেবে ইমাদ হাঁটা বাদ দিয়ে দৌড়ে গলি থেকে বের হয়ে এল। নাক থেকে হাত সরিয়ে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে কল রিসিভ করল সে, “হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।”
ওপাশ থেকে রিনরিনে একটা মেয়েলী গলা ভেসে এল, “ইমাদ বলছেন?”
“জি, ইমাদ বলছি। স্যরি, আপনি কে বলছেন?”
সুহা নিজের পরিচয় লুকিয়ে বলল, “আমার নাম নেই। আমি অনামিকা।”
চলবে…

একা তারা গুনতে নেই পর্ব-১৬+১৭

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ১৬
কাদিন তাহমিদের কথা শুনল না। সে মেহেদীকে চুপচাপ সালামী দিয়ে দিলো। মেহেদী সেই সালামী নিয়ে হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইল তাহমিদের দিকে। ভয়ে তার বুক কাঁপছে। আপুর এখন কি হবে? আর কত কাঁটা বিছানো পথে হাঁটতে হবে তার আপুকে? কখনো কি কৃষ্ণচূড়ার লাল গালিচা ভাগ্যে জুটবে না আপুর?
ইমাদ আর নিলয়ের মনেও একই অনুভূতি ভিন্ন ভিন্ন শব্দে ডানা মেলছিল। দীপার মা’ই শুধু সেই মুহূর্তে কমিউনিটি সেন্টারের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে আনন্দাশ্রু মুছছিলেন। তাঁর মেয়ে আবারো যে এক নতুন বেড়াজালে আটকা পড়ছে সে সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণাই নেই।
লালচে সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে দীপার বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এল। দীপার মা মেয়েকে জড়িয়ে হুহু করে কাঁদছিলেন। আর দীপা? কান্নারচোটে ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার দশা! মায়ের বুক ছাড়ছিল না ও। রিমা টেনে ছাড়িয়ে নিলো। দীপা আবার মেহেদীকে জড়িয়ে ধরল। মেহেদীও দু’হাতে বোনকে আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। ভাই – বোনের কান্নাকাটি চলতেই লাগল। কাইয়ূম মেহেদীকে বুঝিয় বলল, “ভাইয়া, তুমি এমন করে কাঁদলে তোমার আপুর কান্নাও বন্ধ হবে না।”
মেহেদী একহাতে বোনকে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে চোখ মুছল। ঠোঁটে হাসি টেনে বলল, “তুমি একটা ঝামেলা, আপু। তাড়াতাড়ি বিদায় হও।”
দীপাকে হাসাতে চেয়েছিল সে। দীপা না হেসে আরো বেশি কাঁদতে লাগল। নিলয় চেষ্টা করে ধমক দিলো, “কী করছিস, দীপু? যাবি না নাকি? মত পাল্টে গেছে? আমরা কিন্তু আর রাখব না তোকে।”
দীপা এবার মেহেদীকে ছেড়ে নিলয়ের হাত দুটো ধরে নিজের কপালে ঠেকাল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। নিলয় দীপার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। কড়ি পাশে দাঁড়িয়ে সবটা দেখতে দেখতে আশেপাশে তাকিয়ে ইমাদকে খুঁজল। কোথাও নেই কেন উনি? দীপা ভাবি এখনি তো নিলয়কে ছেড়ে উনাকে খুঁজবেন। কড়ি ভিড় ছেড়ে বেরিয়ে এল। এদিকওদিক তাকাতে তাকাতে ইমাদকে খুঁজে পেল কমিউনিটি সেন্টারের ভেতরে। শূণ্য চেয়ারগুলোর একটা দখল করে বসে আছে সে। দীপুর ওখানে এখন যাবে না। বড় আপুর বিদায়ের সময়ও গাড়ির আশেপাশে এক মাইলেও ছিল না সে। বড় আপুকে নিয়ে যে ভয় ছিল তাই হয়েছিল। বড় আপু সংসার জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আগের মত সবকিছু এখন আর অত সহজ নয়। আপুর সাথে দেখা করতে ইচ্ছে হলেও কত দিনক্ষণ দেখে দেখা করতে যেতে হয়। খালি হাতে আপুর শ্বশুরবাড়িতে যাওয়া যায় না বলে হুটহাট দেখা করা যায় না। পকেটে টাকা থাকতে হয়, নিজেরও সময় থাকতে হয়, আপুরও সময় করতে হয়। তারপর এই একটু দেখা। এরপর আবার আপু যখন বাড়িতে বেড়াতে আসে তার আবার ছুটি থাকে না। দেখা যায় নিজের পরীক্ষা নাহয় স্টুডেন্টের পরীক্ষা। এক সঙ্গে ঈদ করা হয় না ক বছর হলো?
“শুনছেন?”
ইমাদ মোটেও শুনেনি বুঝতে পেরে কড়ি আবার ডাকল, “শুনছেন?”
ইমাদ সম্বিৎ ফিরে পেল। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল, “জি বলুন।”
“দীপা ভাবি আপনাকে খুঁজছেন।”
ইমাদ কিছু একটা বলতে ঠোঁট নাড়ছিল। কড়ি বলল, “আচ্ছা বলতে হবে না। চলুন।”
ইমাদ বলল, “আমি আসছি আপনি যান।”
“এখনি চলুন।”
“আমার এদিকে একটু কাজ আছে। সেড়ে আসছি।”
“এদিকে আপনার এখন কোনো কাজ নেই।” কড়ির দৃষ্টি এবং কণ্ঠ উভয়ই স্থির। ইমাদও কড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। তার দৃষ্টি স্থির। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে নিজের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করল। ইদানিং সে বড্ড অনুমেয় এবং সহজবোধ্য হয়ে যাচ্ছে। বড্ড বাজে বিষয় এটা। সে কঠিন করে বলল, “আপনি কি করে জানেন আমার এখানে কোনো কাজ নেই?”
“আমি জানি।”
ইমাদ সাধারণত খুব একটা রাগে না। তবে এই মুহূর্তে সে ক্রুদ্ধ। নিজের উপরেও, সামনে দাঁড়িয় থাকা এই মেয়েটির উপরও। স্বভাবসুলভ সে তার রাগ চেপে শান্ত থেকে বলল, “কাজ আছে তো।”
কড়ি এবার হেসেই ফেলল, “বিদায় মুহূর্ত মেয়েদের জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সব মেয়েরা ঐ সময়টায় প্রিয়জনদের সান্নিধ্য চায়। আবেগজনিত কারণে এখানে একলা বসে থাকবেন না।”
ইমাদ এবার উঠে দাঁড়াল। এই মেয়ে বাজেভাবে তাকে ধরে ফেলছে। এভাবে চলতে দেওয়া যাবে না। সে এখন দীপুর কাছে যাবে এবং একটুও আবেগপ্রবণ হবে না। ইমাদ কড়িকে বুঝাতে একজন ওয়েটারকে ডেকে ইনিবিনিয়ে একটু কথা বলে বুঝাল সে সত্যিই ব্যস্ত ছিল এখানে। তারপর কড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “চলুন।”
ইমাদ গাড়ির কাছের জটলাটায় গিয়ে দাঁড়াল। ইমাদকে দেখে মেহেদী বলল, “ইমাদ ভাইয়া, কোথায় ছিলেন আপনি? আপু বারবার খুঁজছিল আপনাকে। আপনাকে না দেখে গাড়িতে উঠছেই না।”
ইমাদ বলল, “ভেতরের দিকটা দেখছিলাম।”
এতক্ষণে সে এসেছে বলে দীপা কেমন অভিমানী চোখে তাকাল। অবিরত কাঁদছে সে। ইমাদ দীপার তাকানো দেখে মুচকি হাসল। দীপার কান্না থামার কোনো নাম নেই। চক্রবৃদ্ধি হারে ক্রমে ক্রমে তা বেড়েই চলেছে। একেওকে ধরে কাঁদছে ও। কেউ ওকে গাড়িতে টেনে আনতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত ইমাদ সফল হলো। সে দীপাকে টেনে আনতে সক্ষম হলো। কাদিন গাড়িতে উঠে বসতেই ইমাদ বলল, “দীপু, এবার উঠ।”
দীপা কাঁদতে কাঁদতেই বলল, “এখানে আর কেউ উঠবে?”
রিমা অবাক হয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমি বা কড়ি উঠব।”
কড়ি বলল, “আপু তুমি’ই উঠো।”
দীপা এতগুলো মানুষকে একইসাথে অবাক করে দিয়ে কান্নাভাঙা গলায় বলল, “আমি মাঝে বসব না। আমি জানালার পাশে বসব।”
দীপার মা কান্না বন্ধ করে মেয়ের দিকে কটমট করে তাকালেন। কেউ কেউ সশব্দে হেসে উঠল। রিমা হাসতে হাসতে বলল, “কাদিন, নাম তুই। ওকে ঐ পাশে বসতে দে। তুই মাঝে বস।”
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ১৭
দীপা বুঝছিল না কি করবে। এভাবেই ঘোমটা দিয়ে বসে থাকবে? না কিছু বলবে? কাদিন এভাবে বালিশে হেলান দিয়ে কপালে হাত রেখে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে কেন? ক্লান্ত তো ওর হওয়ার কথা। এত ভারি শাড়িটা! তার উপর ম্যাকআপ। অসহ্য লাগছে। আর কথা না বলে থাকা যাচ্ছে না। দীপা বলেই ফেলল, “আমাকে আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকতে হবে?”
কাদিন চোখ বন্ধ রেখেই বলল, “বসে থাকতে হবে না।”
ঘোমটার নীচেই দীপা কয়েক সেকেন্ডের জন্য ভ্রু কুঁচকে ফেলল। সমস্যা কি এই লোকের? সেও কি ছ্যাকাট্যাকা খেয়েছে নাকি? জিজ্ঞেস করতে মনটা আকুপাকু করে উঠল। পরে ভাবল না থাক বেচারাকে বিরক্ত করা ঠিক হবেনা। ভয়াবহ শোকেজর্জরিত মনে হচ্ছে। দীপা ইচ্ছে দমন করে ঘোমটা ফেলে ফুলের বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। লাগেজ টেনে এনে বিছানার উপর তুলে রাখতেই কাদিন চোখ খুলে অস্থির হয়ে বলল, “নামাও নামাও। লাগেজে ময়লা কত! চাদরে ময়লা লাগবে।”
দীপা বিছানা থেকে লাগেজ নামিয়ে নীচে রাখল। সালোয়ার কামিজ বের করে বাথরুমে চলে গেল সে। বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখল কাদিন বিছানার চাদর পাল্টাচ্ছে। দীপা অবাক হয়ে গেল। ও বাবা! এ কার সাথে এসে পড়ল সে! কাদিন বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল এক পাশে। দীপাও উল্টোদিকে শুয়ে পড়ল। ক্লান্ত থাকায় দীপা সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ল। কাদিন ঘুমালো না। তার কিছুতেই ঘুম আসছে না। সারাটা জীবন মেয়েদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলে এসেছে। জীবনে কোনোদিন প্রেম পিরিতির ধারে কাছেও ঘেঁষেনি। সবসময় শুধু পড়াশুনা এবং নিজের ক্যারিয়ার নিয়েই মজে ছিল। নিজেকে সম্পূর্ণ যত্নসহকারে তোলে রেখেছিল নিজের ভবিষত স্ত্রীর জন্য। সেও এমনি একজনকে আশা করেছিল জীবনে। আর তার জীবনেই কিনা জুটল এমন কেউ? বিয়ের আগের রাতে এসে বিয়ে ভাঙাটা ঠিক মনে হয়নি তার। দুপক্ষের সকল আত্মীয়স্বজন, তার সব বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী সবাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি ভর্তি এত এত মেহমান রেখে পরিবারের মান ক্ষুণ্ন করার কথা আর ভাবতে পারেনি সে। তাছাড়া, এই মেয়ে একবার জমের ঘর থেকে ফিরে এসেছে। নতুন করে বিয়ে ভাঙার কারণে যদি কিছু করে বসত! সর্বনাশ হয়ে যেত। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল বিয়েটা না করলে অন্যায় হতো। তাই সে শেষ পর্যন্ত নিজের মনের বিরুদ্ধাচার করে হলেও বিয়েটা করেছে। কিন্তু এ কাকে বিয়ে করল সে? এই মেয়ের মাঝে কোনো শিষ্টাচার নেই। ভদ্রতা নেই। গাড়িতে উঠার সময় হুট করে কেমন একটা কথা বলে ফেলল সে। লজ্জায় তার মাথা কাটা যাচ্ছিল। কায়েস আর তার বন্ধুরা সারাটা পথ হাসাহাসি করেছে। অসহ্য!

রাত বাড়ছে। এলার্ম ঘড়িটা বিদঘুটে শব্দ তুলতেই মিলার ঘুম ভাঙল। টেবিল থেকে মাথা তুলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল দুটো বিশ বাজে। ঘুমে চোখ দুটো জ্বলছে। কিন্তু চ্যাপ্টারটা আজ রাতের মাঝেই শেষ করবে। সে প্রায়ই এমন করে। সারারাত ধরে পড়ে। তার পড়াটা অবশ্য একটানা নয়। সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত একটানা পড়ে। তারপর থেকে শুরু হয় আধা ঘণ্টা পড়া আর বিশ মিনিট ঘুমানো। আধা ঘণ্টা পর পর বিশ মিনিটের ঘুম দেয় সে। তখন এলার্ম দিয়ে রাখে। এলার্ম বাজতেই আবার পড়তে বসে। মিলার শরীরটা খুব খারাপ লাগছিল। রান্না করতে গিয়ে ওর সব এনার্জি শেষ। তবুও উঠে বইয়ে ঝুঁকে গুনগুন করে পড়া শুরু করল সে।
রাজপ্রাসাদে থেকেও সবাই রাজকন্যা হয় না। কেউ কেউ অতি সাধারণ হয়ে অক্লান্ত আর অচিন্তনীয় পরিশ্রম করে। মিলা তেমনি একজন। এর চাইতে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা সুহার জীবন বড় বেশি শান্ত আর প্রশান্তিময়। তবে ক্ষতি নেই। মিলা এতদিনে বুঝে গেছে সে রেশমের বিছানার কিংবা ফুলের বারান্দার রাজকন্যা হতে জন্মায়নি। সে জন্মেছে নিজের তৈরী সিংহাসনের মাথা উঁচু করা এক সম্রাজ্ঞী হতে।

ঠিক পাশের ঘরেই বাতি নিভিয়ে মুবিন তখন মোবাইল হাতে নেশাগ্রস্তের মত ফ্রি ফায়ার গেইম খেলছে। মোবাইলের আলো তার অস্থির চোখে মুখে জেঁকে বসে আছে। ওর অন্ধকার ঘরের দরজায় দাঁড়ালে মোবাইলের আলোতে কিশোর মুখটাকে দেখা যায়। যেন মনে হয় অন্ধকার আকাশের উজ্জ্বল কোনো নক্ষত্রের পতন ভেবে বিভ্রম হয়।
.
ইমাদ এত রাতেও মেসে ফিরেনি। সে পদুয়ার বাজারের ফুট ওভার ব্রিজটা ধরে বিভোর হয়ে হাঁটছিল। একটু পর পর নীচ দিয়ে মালবাহী বিরাটাকার ট্রাকগুলো দৌড়ে যাচ্ছে। খানিক আলো জ্বেলে, কেমন একটা শব্দ করে ট্রাকগুলো নিজেদের আগমণের, প্রস্থানের জানান দিয়ে যাচ্ছে। সব আগমণের’ই কি এমন আগমনবার্তা থাকে? আর প্রস্থানের? ইমাদ নিজের গায়ের হালকা গড়নের চাদরটা খুলে ফুট ওভারব্রিজটির কিনারা ঘেঁষে যে মধ্যবয়সী লোকটি হাত – পা গুটিয়ে ঘুমিয়ে আছেন, তাঁর গায়ে জড়িয়ে দিলো। তারপর নিঃশব্দে পায়ে পায়ে ব্রিজটির সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। কড়ি মেয়েটি কি সত্যিই তার আশেপাশের সবাইকে বুঝতে পারে? কিছুটা হয়তো পারে, তবে পুরোপুরি নয়। এ জগতে নিজেকেও নিজে পুরোপুরি বুঝা অসম্ভব। মজার বিষয় হলো কড়ি সম্পর্কে সে দারুণ হাস্যকর একটি সত্য আবিষ্কার করতে পেরেছে। কড়ি আসলে যতটুকু বুঝে তার চাইতেও বেশি প্রকাশ করে ফেলে। অথচ, ইমাদ তা করে না। সে কাউকে বুঝলেও কখনো তা প্রকাশ করে না। এই যে কড়িকেও সে বুঝে কই কখনো তো সে কড়ির কাছে তা প্রকাশ করেনি? ইমাদ মুচকি হাসল। রাত হঠাৎ করেই আরো অন্ধকার আর রহস্যময় হয়ে উঠল। কড়ি তাকে যতটুকু বুঝে তার চাইতে কড়িকে সে খানিকটা বেশিই বুঝে। শুধু বলা হয়নি। তবে কড়ি যদি এবার তাকে বুঝবার শক্তি নিয়ে খেলতে চায় তবে সেও সেই খেলায় মেতে উঠবে।
চলবে…

একা তারা গুনতে নেই পর্ব-১৪+১৫

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ১৪
ইমাদ বলল, “চল।”
নিলয় ক্লান্ত হয়ে বলল, “দীপুর মাথা খারাপ। ও সত্যিই স্টেজ থেকে নেমে যেতে পারে।”
ইমাদ কিছু বলল না। তবে নিলয়ের হাত টেনে ধরে নিয়ে চলল ওকে। ওদের আসতে দেখেই দীপা কটমট করে চোখ বড় করে তাকাল। ইমাদ কোনোরকম গুরুত্ব দিলো না। সে গিয়ে দীপার একপাশে বসল। নিলয় আরেকপাশে বসল। দীপা কিছু বলতে যাবে তখনি ইমাদ ওকে হলুদ ছুঁইয়ে দিলো। দীপা রাগে গড়গড় করতে করতে টিস্যু হাতে নিয়ে বলল, “এখন মুছে ফেলব আমি। এখনি। একদমি রাখব না। কেন ছুঁয়ালি তুই?”
ইমাদ সামনে হলুদের সাজানো ফলগুলোর দিকে তাকাল। ময়ূরাকৃতির আঙুরের ঝাঁক থেকে টুপ করে আঙুর তুলে নিলো। দীপা বলল, “আমি তোদের হাতে কিছু খাব না।”
ইমাদ দীপার দিকে তাকালও না। সে টপাটপ কয়েকটা আঙুর মুখে দিলো। ফ্রুট কার্ভিং এত অসাধারণ কেন? একদিন চেষ্টা করে দেখতে হবে পারা যায় কিনা। আপেলের তৈরী হাঁসটা দেখে তার এত ভালো লেগেছে যে সে হাস আকৃতির আপেলটা প্লেট থেকে তুলে হাতে নিয়ে ফেলল। দীপা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, “তুই এখানে নিজে খেতে এসেছিস নাকি আমাকে খাওয়াতে এসেছিস?”
ইমাদ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হাতের জিনিসটা দেখতে দেখতে মিনমিন করে বলল, “আপেল না খেলে কিছু হবে না তোর। এটা আমি নিয়ে যাই।”
ইমাদ আপেলটা দেখতে দেখতেই স্টেজ থেকে নেমে গেল। দীপা নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “ইমি একটা বিষ্ঠা, হাঁসের বিষ্ঠা ও।”
নিলয় ভয়ে ভয়ে দীপাকে হলুদ ছুঁয়াল, “দোস্ত, নামিস না কিন্তু।”
দীপা আরো একটা টিস্যু টিস্যুবক্স থেকে তুলে নিতে নিতে বলল, “এখনি নাম। আমি তোরটাও মুছব। তোদের হলুদে আমার গাটা জ্বলে যাচ্ছে। সামনে থেকে সর তোরা।”
নিলয় গন্ডগোল হওয়ার ভয়ে উঠে যাচ্ছিল। দীপা ধমক দিয়ে বলল, “তুইও ফল খাওয়াবি না? এসব কি হচ্ছে আমার সাথে? বিয়ের ভিডিওতে সবাই দেখবে আমার বন্ধুরা একেকটা ফল ফকির।”
নিলয় মাথা চুলকে হেসে দিলো। দীপার মুখে একটার পর একটা কমলা ঠুসে দিয়ে বলল, “নে নে খেয়ে খেয়ে ঢোল হয়ে যা। কাল নড়তেও পারবিনা।”
দীপা এতগুলো ফল মুখে নিয়ে আর কথা বলতে পারল না। চোখ বড় বড় করে আগুন ঝাড়ল। নিলয় ভেঙচি কেটে নেমে গেল। দীপা টিস্যু দুটো ফেলে দিলো। ওর বন্ধুরা ওকে হলুদ ছুঁইয়েছে। সে হলুদ কি সে মুছে ফেলতে পারে?
.
শিল্পী একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকুরী করে। ব্যাংক থেকে বেরুতে বেরুতে আজ একটু দেরি হয়ে গেছে। কান্দিরপারের জটলাটায় সে রিকশা নিয়ে আটকে ছিল। তখন খেয়াল হলো ব্যাংকে অনেকবার মঈনের নাম্বার থেকে কল এসেছিল। ব্যস্ত ছিল বলে ধরা হয়নি। মোবাইল বের করে কলব্যাক করল সে। ওপাশ থেকে একটা নারী কণ্ঠ ভেসে আসল। সাথে সাথে বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠল। চোখগুলো ধ্বক করে জ্বলে উঠল। মুহূর্তেই সেই জ্বলন চোখের জলে রূপও নিয়ে নিলো। চোখে জল নিয়েই ক্ষোভের সাথে বলল, “আমার স্বামীর মোবাইল আপনার কাছে কি করছে? কে আপনি?”
ভদ্রমহিলা প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে দিগুণ ধমকে তাকে জানালেন মঈনের বাইক অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। তিনি হাসপাতালের নার্স। মঈন এখন টাউয়ার হাসপাতালে ভর্তি।
শোনার সাথে সাথে শিল্পীর হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে গেল। জ্যামে আটকে থাকা পাশের লোকটা ভরকে গিয়ে তাকাল। শিল্পী ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে করতে রিকশা থেকে লাফিয়ে নামল। জ্যামে এই রিকশা ঘুরতে অনেক সময় লাগবে। ওর এখন এত সময় নেই, আর না আছে ধৈর্য্য। যা আছে তা হলো চোখের জলের ফোঁয়ারা। পূবালী চত্ত্বরের রাস্তাটা দিয়ে সে অনেকটা দৌড়েই গেল। সারা শরীর কাঁপছে ওর। চারপাশটা একটু পর পর দুলছে। রাতের অন্ধকার এখন আরো বেশি অন্ধকার।
.
কালিয়াজুরি নিবাসী মোহাম্মদ কাদের এর দ্বিতীয় পুত্র মোস্তফা কাদিনের সহিত হাউজিং নিবাসী মরহুম আবুল খায়ের এর একমাত্র কন্যা ইসরাত জাহান দীপার পাঁচ লক্ষ টাকার দেনমোহরে পঞ্চাশ হাজার টাকা নগদ ও দুই লক্ষ টাকার গয়না উশুল বাবদ বিবাহ ধার্য করা হইয়াছে। এই বিয়েতে আপনার সম্মতি থাকিলে বলুন কবুল। কাদিন জবাবে বলল, “কবুল।”
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ১৫
সাল ১৯৯৬। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিতীলতা হল। হলটি বিভিন্ন কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত হল। বছর তিনেক আগেই হলটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় অন্য হলের চাইতে সুযোগ সুবিধা বেশি। চারিদিকে প্রকৃতির সাজসজ্জারও শেষ নেই। শিল্পীর তখনও বিশ্বাস হয়নি সে এই হলে উঠতে পেরেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আর কোনো হলে বারান্দা নেই। কিন্তু এটায় আছে। তার রুম নাম্বার ৪০৩। চারতলার শেষদিকের একটি ঘর। ঘরে চারটে চৌকি। শিল্পীর চৌকিটা দরজা ঘেঁষে ডান পাশে। সাথে ছোট একটা টেবিল। টেবিলে পড়তে পড়তে চেয়ারে দুলছিল ও। হঠাৎ করেই চা খেতে মনটা আনচান করে উঠল। চেয়ার ছেড়ে উঠে চৌকির নীচ থেকে চায়ের ডেকচি বের করল। গুনগুন করতে করতে রান্নাঘরে গেল চা করতে। রান্নাঘরে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থেকে দশ মিনিট পরেই চুলা পেল। কাপে চা ঢেলে ঘরের পাশের ছাদে গিয়ে দাঁড়াল সে। অন্ধকারও বুঝি এত সুন্দর হয়? আকাশে তারা, আশেপাশে কোথাও ছেলেদের গানের আসর। কানে বাজছে,
“চলনা ঘুরে আসি অজানাতে
যেখানে নদী এসে থেমে গেছে…”
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হলের সামনের পাহাড়ে হারিয়ে গেল সে। হারিয়ে গিয়েছিল বলেই পাহাড়ের পাদদেশে রাস্তার উপরে থাকা ইটের তৈরী আসনে স্থির বসে থাকা মঈনকে সেদিন সে দেখতেই পায়নি। দেখতে পায়নি আরো কত কত দিন! এরপর যেদিন প্রথম দেখতে পেল, মঈনের দিকে তাকাল সে। ভয়ে মঈন একদম পাথর বনে গেল। উপর থেকে দেখেও সে ঠিক বুঝেছিল মঈন নিঃশ্বাসটুকুও ফেলছে না আর। শ্বাস রুদ্ধ করে জমে আছে ও। আজো কি নিঃশ্বাস বন্ধ করে জমে আছে মঈন? হাত- পা বরফ শীতল হয়ে যায়নি ত আবার? এসব ভাবতে ভাবতেই গতরাতে শিল্পী হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছুলো। মঈন ঠিক আছে। হাতে পায়ে প্রচুর জখম তবে মারাত্মক কিছু নয়। শিল্পী মঈনের বেডের পাশে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আঁচলে মুখ চেপে অনেক অনেকক্ষণ কাঁদল।

মিলা রান্না-বান্না খুব একটা পারে না, সুহা পারে। সুহার কাছে মোবাইলে শুনে শুনে মিলা যা পারল তাই রাঁধল। মা সব ছেড়ে ছুড়ে সেখানে পড়ে আছেন। দিন দুনিয়ার হুঁশ নেই। খাননি বোধহয়। দুপুরে মিলা খাবার নিয়ে হাসপাতালে ছুটে গেল। কিন্তু মুবিন গেল না। সে সোজা সাইকেল নিয়ে ঈদগাহ মাঠে চলে গেল। আজ একটা ক্রিকেট ম্যাচ আছে ওদের।
.
একটু আগে দীপা আর কাদিনের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। এখন তাদের দুজনকে একসাথে খেতে বসানো হয়েছে। কড়ি দূরে দূরে থাকছিল। রিমা আর অন্যরা কড়িকে ডেকে নিয়ে এল। বলল, “কিরে তুই বসিস না কেন? ওদের শুরু করতে হবে না? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।”
কড়ি মিথ্যে বলল, “আমি খেয়ে নিয়েছি।”
রিমা বলল, “খেলে খেয়েছিস। বসবি না একটু? দশটা না পাঁচটা একটা মাত্র ছোট বোন তুই। একটু বসবি না? কাদিনের ভালো লাগবে এতে। না খেলেও বস।”
কড়ি কাদিনের পাশের চেয়ারটায় বসল। কাদিন নিজের প্লেট থেকে আস্ত মুরগীর অর্ধেকটা অংশ ভেঙে কড়ির প্লেটে তুলে দিলো। থমথম গলায় বলল, “খেয়ে নে।”
রিমা, কায়েস, কাইয়ূম বাকিরাও এতক্ষণে খেতে বসল। অন্য আত্মীয়রা খেলেও বর আর কনের সবচেয়ে কাছের মানুষরা ওদের সাথেই খেতে বসল। নিলয় আর ইমাদও দীপার পাশের চেয়ারেই। দীপার কিছু কাজিনও আছে। দীপার ছোট ভাই মেহেদী শুধু খেতে বসল না। সে এই টেবিলে নজরদারি করছিল। সবাই ঠিকঠাক সব পাচ্ছে কিনা খেয়াল রাখছিল ও। ইমাদ প্লেট রেখে উঠে গেল। মেহেদীর কাছে গিয়ে বলল, “তুমি খেতে বসো আমি দেখছি।”
“ভাইয়া আপনি বসুন। সব ত আপনি আর নিলয় ভাইয়াই দেখছেন। ঝামেলাটা একেবারের জন্য বিদেয় হচ্ছে। ওর বিদায়ে আমার অবদান না থাকলে হবে নাকি!” বলতে বলতে তার চোখ টলমল করে উঠল। লজ্জা পেয়ে গেল সে। ইমাদ ওকে জোর করে খেতে বসাল। তারপর নিজে খাওয়া ছেড়ে দাঁড়িয়ে রইল। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বড় এই টেবিলটা পরখ করছিল। নিলয় মেহেদীকে কানে কানে বলল, “তুমি তোমার দুলাভাইকে হাত ধুয়াবে না? হাত ধুইয়ে টাকা নিতে বোকা ছেলে। তুমি না থাকলে ত আমিই এই কাজে লেগে পড়তাম। আমি ভেবেছিলাম তুমি হাত ধুয়াবে তাই আমি আর মাথা ঘামাইনি।”
মেহেদীর মন খারাপ থাকায় সে হাত ধুয়ানোর কথা ভুলেই গিয়েছিল। এখন আরো মন খারাপ হয়ে গেল তার। নিলয় ফিসফিস করে বলল, “সমস্যা নেই। খাওয়া শেষে ধুয়াবে।”
মেহেদী তড়িঘড়ি করে কাদিনের আগে খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল। তারপর কাদিনের খাওয়া শেষ হতেই হাত ধুয়ালো কাদিনকে। হাসি হাসি মুখ করে হাত পেতে দাঁড়াল সালামির জন্য। কাদিন শেরওয়ানির পকেট থেকে ওয়ালেট বের করছিল। ওর বন্ধু দূর থেকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে ওর হাতটা ধরে ফেলল। বলল, “তোর শালা ত খাওয়ার আগে হাত ধুয়াল না। কিসের টাকা দিস?”
বলেই ওয়ালেটটা খপ করে নিজের হাতে নিয়ে নিলো। ইমাদ, নিলয় আর মেহেদী এক সঙ্গে চমকে তাকাল তাহমিদের দিকে। শুধু দীপাই মন দিয়ে বসে জর্দা খাচ্ছে। সে তাহমিদের দিকে ফিরেও তাকালো না।
.
মিলাকে একা দেখেই শিল্পী প্রশ্ন করল, “মুবিন আসেনি?”
মিলা না – বোধক মাথা নাড়ল। শিল্পী অধীর হয়ে বলল, “মুবিন খেয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
“সকালে কি খেয়েছে?”
“জ্যালি পাউরুটি খেয়েছে।” মিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“আর দুপুরে?”
“এখানে যা আছে সেসবই।”
শিল্পী পার্স থেকে মোবাইল বের করে সাথে সাথে মুবিনকে কল করল। কিন্তু মুবিন কল ধরল না। বরং, মায়ের কল পেয়ে বিরক্ত হলো। মোবাইল বন্ধ করে পকেটে রেখে দিলো সে। রোদে পুড়ে পুড়ে সাইকেলে মস্ত বড় ঈদগাহ মাঠটায় চক্কর দিচ্ছে সে। ক্রিকেট ম্যাচটা আজ হয়নি। খেলতে গিয়ে মহাপ্রলয় ঘটিয়েছে সে। আউট হয়নি সে তবুও বলে কিনা আউট! নোউ- বলে মানুষ আউট হয় কি করে শয়তানগুলাকে আজ হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দিয়েছে।
.
মঈনের কাছে মিলাকে বসিয়ে রেখে শিল্পী হাসপাতালের বিল সেকশনে গেল বিল চেক করতে। মঈনকে এক মুহূর্তের জন্যও একা রাখতে চায় না সে। মিলা থাকতে থাকতে এই কাজগুলো শেষ করে ফেলবে। বিল সেকশনের কাজ মিটিয়ে
বেরুতেই মিসেস রহমানকে দেখল শিল্পী। সাথে তাঁর ছেলে রিফাত। রিফাতের মাথা চুইয়ে রক্ত পড়ছে। মিসেস রহমান দুহাতে ছেলের মাথা চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে ডাক্তার আর নার্সদের খুঁজছেন। রিফাত মুবিনের সাথেই পড়ে। এইটুকু একটা বাচ্চা ছেলে। এত কষ্ট হচ্ছিল শিল্পীর! রিফাতকে এই অবস্থায় দেখে শিল্পী ছুটে গেল ওদের কাছে। শিল্পীকে দেখে মিসেস রহমান তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। ক্ষোভে ফেটে পড়ে বললেন, “আপনি এখানে কি করছেন? বাসায় যান। নিজের ছেলেকে শিক্ষা দিন।”
“মানে? কি বলছেন এসব?” শিল্পী কিছুই বুঝল না।
রিফাত কাঁদতে কাঁদতে বলল, “মুবিন মেরেছে আমায়। ওর ব্যাট দিয়ে মেরেছে।”
চলবে…

একা তারা গুনতে নেই পর্ব-১২+১৩

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ১২
রিমা রান্নাঘরে ছিল। তরকারিতে পাঁচ ফোঁড়ন দিতেই কাইয়ূম পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। রিমা হেসে বলল, “ঢঙ্গে ধরেছে?”
কাইয়ূম বলল, “আমাকে ত কেউ ধরেনি, তোমাকে ধরেছে।”
রিমা কপট রাগ দেখাল, “তোমাকে এখন ধরবার সময় নেই। যাও নিজের কাজে যাও। বাসা ভর্তি মানুষ। কেউ একজন এসে পড়বে এরপর কেলেঙ্কারি।”
“আর কদিন পর এই রান্নাঘর আর তোমার আমার থাকবে নাগো। এখন এভাবে বিদায় করো না। তখন কাদিনের বউয়ের জন্য আমাদের রোম্যান্সে ভাটা পড়বে।”
“সে বহু দেরি। তোমার ভাইয়ের আর ইহ জনমে বিয়ে হবে কিনা সন্দেহ।”
“কেন? কেন?”
“কোনো সিদ্ধান্তেই সে আসতে পারে না। কতগুলো মেয়ে দেখলাম আমরা। সে এখনও কিছুই জানায় না। শেষে কড়ির সাথের মেয়েটাকেও দেখে এলাম। আমার ত দিব্যি পছন্দ হয়েছে।”
“ওর পছন্দ হয়নি, না?”
“কাদিন আর কাদিনের আল্লাহই ভালো জানে। হ্যাঁও বলে না, নাও বলে না। সবকটা মেয়ে দেখে এসেই এমন একটা অবস্থা করে সে। তার জন্য বেচারা কায়েসকে না আয়বুড়ো থাকতে হয় পরে। তোমার ভাগ্য ভালো তুমি কাদিনের বড়।”
কাইয়ূম রিমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দুলতে দুলতে আহ্লাদে ভেসে গিয়ে বলল, “আমার বলছ কেন? আমাদের ভাগ্য ভালো বলো না।”
পরমুহূর্তেই বুয়ার ডাক ভেসে এসে ওদের দুজনকে দুদিকে ছিটকে দিলো। বুয়া জোরে জোরে ভাবি ডাকতে ডাকতে রান্নাঘরের দিকেই আসছে।
কাইয়ূম বলল, “আমি যাই।”
রিমা ধমকে বলল, “না আরো থাকো।”
.
মেসে ইমাদদের পাশের ঘরটায় নাঈম থাকে। বন্ধুত্ব ততটা গভীর না হলেও যথেষ্ট উষ্ণ। আসতে যেতে ওদের দেখলেই নাঈম চওড়া হেসে অভর্থ্যনা কিংবা বিদায় জানায়। কাছে থাকলে পিঠও চাপড়ে দেয়। ইমাদ নির্বিকার থাকে। কখনো কখনো ইচ্ছে করে নাঈমের হাসি হাসি মুখটার দিকে তাকায়ও না। ব্যস্ততম হয়ে ছুটে চলে, কিন্তু ছুটতে ছুটতে সে প্রার্থনা করে মেসে ফেরবার সময়টায় নাঈম যেন মেসেই থাকে। ওকে দেখেই যেন হাসি হাসি চেহারায় তাকায়। প্রার্থনা কখনো প্রাণ পায়, কখনো আবার পায় না। তবে নাঈম মেসে থাকলে কখনো ওর হাসির এদিকওদিক হয় না।
ইমাদ নাঈমের দরজায় কড়াঘাত করল, “আসতে পারি?”
নাঈম বিছানায় শুয়ে শুয়ে সিগারেট টানছিল। জানালা দিয়ে সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে উঠে বসল, “ইমাদ যে! এসো, এসো।”
ইমাদ নাঈমের পাশে বসল, “ভালো আছো?”
“বিন্দাস আছি। তোমার খবর বলো।”
“বিন্দাস থাকলে হাসো না যে?”
“এই তো হাসছি।”
ইমাদ নাঈমের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ওর দৃষ্টি পলকহীন। নাঈম ইমাদের পিঠ চাপড়ে বলল, “তুমি তাহলে খেয়ালও করো। আমি ত ভাবতাম তুমি আমাকে দেখোই না।”
“কী হয়েছে?”
নাঈম বিষণ্ন গলায় বলল, “তেমন কিছু নারে ভাই। টিউশনী নিয়ে প্যারায় আছি। দুটো টিউশনীই হাতছাড়া হয়ে গেছে। মহাবিপদে আছি।”
“আচ্ছা।”
“টিউশনী গিয়ে ভালোই হলো। তুমি যে এক পিস জানা হলো।”
ইমাদের আর বসতে ইচ্ছে হলো না। সে উঠে চলে এল। নাঈম একা একা হাসতে হাসতে মাথা নাড়ল। এই দুনিয়ায় মানুষ চেনা বড্ড কঠিন। প্রতিনিয়ত মেসের যে মানুষগুলো ওর হাসির বদলে হাসি দিয়ে গেছে, তারা কেউই আজ তার খোঁজ নিতে আসেনি, কিন্তু যে মানুষটা কখনো হাসির বদলে একবারো হেসে তাকায়নি, যাকে অহঙ্কারী বলে মনে মনে গাল বকেছে, সে মানুষটাই আজ অসময়ে তার পাশে এসে দু দন্ড বসেছে।
.
স্কুলের করিডোরে রেলিং ধরে মিলা আর সুহা দাঁড়িয়ে আছে। রাগে সুহার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেছে। সে ধমকে বলল, “তুই আন্টিকে কিছু বলিসনি কেন?”
“কি বলতাম আমি?”
“কি বলতিস মানে? তুই বলতিস এই পাখাটাও তুমি খুলে নিয়ে গিয়ে তোমার ছেলের ঘরে লাগাও। তোমার ছেলে দুটো পাখার বাতাস হা করে করে গিলুক।”
“কিছু বললে মুবিন বলবে ওকে হিংসে করি। কথাটা আমার সহ্য হবে না। আরো কয়বার নানান বিষয়ে প্রশ্ন তোলায় মুবিন মন খারাপ করে ফেলেছে। বলেছে আমি নাকি ওকে হিংসে করি।”
“কিছু মনে করিস না। তোর ভাই আরেকটা শয়তান।”
মিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীচের মাঠটার দিকে তাকিয়ে রইল। অসংখ্য ছেলে মেয়ে মাঠটায় জড়ো হয়েছে। সবাই সবার বন্ধুদের সঙ্গে ব্যস্ত। কেউ কেউ খেলছে, কেউবা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। কেউ বসে আছে একা। শব্দের কোলাহলে কান ভারি হয়ে আসছে।
সুহা হাত বাড়িয়ে মিলাকে শক্ত করে আগলে ধরল, “একদম মন খারাপ করবি না। একদম না। ভালো করে পড়। তোর অবস্থান, সফলতায় তুই তোর জবাব দিবি।”
“আমিন।” মিলা অবহেলার হাসি হাসল।
সুহা বলল, “তাই হবে দেখে নিস।”
“জানিস, সামনে মুবিনের জন্মদিন। মা অনেক বড় করে অনুষ্ঠান করবেন।” বেদনার হাসি মিলার ঠোঁটে চেপে বসল।
সুহা দাঁতে দাঁত পিষল। কিছু বলল না ও। সাথে সাথে ঠিক করে ফেলল মিলার জন্মদিনে সে তার জমানো টাকা থেকে আয়োজন করবে। একটা ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক, আর ওদের প্রিয় ফুচকা পার্টি।
.
আকাশে অর্ধচন্দ্র জেঁকে বসেছে। চারিদিকে বেড়েছে নিস্তব্ধতা। জানালা ঠিকরে কড়ির মুখে জোছনা ঝরছে। বাবা – ভাইদের ঠকিয়েছে সে। প্রতিনিয়ত ঠকাচ্ছেও। ভালোবাসা মানুষের বিবেকবোধ, চিন্তা করবার শক্তি কেঁড়ে নিয়ে পঙ্গু করে নিজেই হয়ে উঠে পরম আশ্রয়। শেষে কড়ির মতন প্রতারিত মানুষদের জীবনভর নিঃসঙ্গ থাকতে হয়।
কড়ি জানে সে আজ কতটা একলা। পরিবারের মানুষগুলোর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না ও। সবাই মিলে আড্ডা দিতে বসলে ও উঠে চলে যায়। বারবার মনে হয় ও তাদের মাঝে বসবার যোগ্য নয়। খেতে বসে অধিকারবোধ থেকে ভাইদের প্লেট থেকে মুরগীর কলিজা, মাছের ডিমটা জোর করে তুলে আর খেয়ে ফেলতে পারে না।
এই মানুষগুলোর বিশ্বাস, আস্থা, তাকে নিয়ে করা গৌরব সে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। তাঁদের অজান্তেই তাঁদের সে শেষ করে দিয়েছে। চুলের মাঝে হাত গলিয়ে কপালে হাত রেখে বসে ফুঁপাচ্ছে ও।
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ১৩
ইমাদ বালিশে মাথা রেখে এপাশ ওপাশ করছে। মিলাদের ওখানে নাঈমকে পাঠালে কেমন হয়? না, না তা করা যাবে না। এ ত নিজের এঁটো অন্যকে খাওয়ানোর মতন। যে জায়গায় নিজে আর কখনো যাবে না, সেখানে সে কী করে অন্য একজনকে পাঠাতে পারে? যা তার নিজের জন্য পছন্দ নয়, তা অন্যের জন্য বাছাই করা অন্যায়। নাঈমের জন্য অন্য কোনো ব্যবস্থা করতে হবে। সামান্য একটা টিউশনীকে ওর মত মানুষের মুখ থেকে হাসি মুছে ফেলবার মত শক্তিশালী করে তোলা যাবে না।
.
অবশেষে, অসংখ্য ভাবনা-চিন্তার অবসান ঘটিয়ে কাদিন বিয়েতে মত দিয়েছে। মতামত ইতিবাচক। দীপাদের পক্ষ থেকেও কোনো সমস্যা ছিল না। সমস্যা থাকলেও দীপার মা সম্ভবত এখানেই মেয়ে দিতেন। মেয়ে যে রাজি হয়েছে এতে তিনি হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন। বড় করে বিয়ের আয়োজন শুরু হলো দু’দিক থেকেই। দীপার মা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে একলাই সব দিক দেখছিলেন। ইমাদ আর নিলয় দুজনের একজনও এই বিয়েতে আনন্দিত না হওয়া সত্ত্বেও দুজন নিজ থেকেই এগিয়ে এল। কমিউনিটি সেন্টার ঠিক করা থেকে শুরু করে অনেক ঝামেলাই তারা মেটাল। তবে দুজনেই দীপার সাথে রাগ! কেউ কথা বলছে না। দীপা নিলয়কে নানান ছুঁতোয় ডাকলেই নিলয় কটমট করে তাকাচ্ছে। জবাবে ধমক দিচ্ছে। পিঞ্চ মেরে মেরে কথা বলছে। আর ইমাদ ফিরেও তাকাচ্ছে না। দুই বন্ধুর এমন আচরণে দীপা বেশিক্ষণ কান্না চেপে রাখতে পারল না। কেঁদেকেটে শেষ হয়ে গেল সে। ক্রোধে মাকে ডেকে বলল, “নিলয় আর ইমি যেন আমাকে হলুদ ছোঁয়াতে না আসে। এলেই আমি স্টেজ থেকে নেমে যাব।” বলতে বলতে চোখ মুছল সে। কাজল লেপ্টে গেল হাতে।
.
বাড়ির মূল গেইট থেকে শুরু করে গলির মুখে গিয়ে মরিচা বাতির যাত্রা থেমেছে। বিয়ে কমিউনিটি সেন্টারে হলেও কাদিনের হলুদ সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়েছে বাসার ছাদে। রিমা আর কড়ি একই পাড়ের একই হলুদ শাড়ি পড়েছে। সবাই ভীষণ ব্যস্ত হয়ে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছে। কাদিন হলুদের জন্য স্টেজে এসে উঠল। একে একে সবাই হলুদ ছোঁয়াচ্ছিল। তখনি কাদিনের মোবাইলে একটা কল এল। কাদিন মোবাইল রিসিভ করে কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। চোয়াল শক্ত হয়ে মুখটা থমথমে হয়ে উঠল। তারপর বহু কষ্টে স্টেজে বসেছিল সে। ইচ্ছে করছিল সব ভেঙে নেমে আসতে। তবুও সে হলুদ ছোঁয়ানোর পালা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল। পরে নেমে এসে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। পাঞ্জাবী খুলে, হাত – মুখ ধুয়ে কপালে হাত রেখে শুয়ে রইল বিছানায়। মাথা ব্যথা করছে। আঙুলগুলো কপালে বুলাতে বুলাতে উঠে বসল। দরজা খুলে বেরিয়ে এসে কড়িকে এদিকওদিক খুঁজল। রিমিকে পেয়ে বলল, “আপু, কড়ি কোথায়?”
“ও বোধহয় এখনও উপরে। গান টান হচ্ছে ত। নামেনি এখনও।”
“কায়েসকে বলে একটু ডেকে আনতে পারবে? দরকার ছিল।”
“কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?”
“পরে বলব।”
গানের শব্দে কাদিনের মাথা ফেটে যাচ্ছে। এত জোরে জোরে গান বাজানোর কোনো মানে হয়! কাদিন তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে ফিরে এল। কড়ি এল এর খানিক পরই, “ডেকেছিলে, মেজো ভাইয়া?”
“হ্যাঁ।” কাদিনের কণ্ঠটা গমগম করে উঠল।
কড়ি তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল, “কি হয়েছে?”
“দরজা বন্ধ করে বস।”
কড়ি কাদিনকে দেখতে দেখতে দরজা বন্ধ করল। কাদিনের সামনে এসে দাঁড়াল সে। কাদিন বিছানা থেকে আরেকটু এগিয়ে বসল। বলল, “দীপা, সুইসাইড এটেম্প নিয়েছিল।”
কড়ি খানিক চুপ করে থেকে বলল, “হুম।”
কাদিন অবাক চোখে তাকাল, “তুই আগে থেকে জানতিস?”
“হ্যাঁ।”
“আমার কাছে লুকিয়েছিস কেন?”
“লুকাইনি তো।”
কাদিন উঠে দাঁড়াল, “লুকাসনি?”
“তোমার কাছে কেউ কিছু লুকাতে যাবে এও কি সম্ভব!”
“কেন সুইসাইড করতে চেয়েছিল তা নিশ্চয়ই জানিস না।”
“জানি।” কড়ির কণ্ঠ স্থির।
“কি জানিস?”
“ওর এক্স ওকে অন্য একটা মেয়ের জন্য ধোঁকা দিয়েছিল।”
“সবকিছু জেনেও তুই কি করে আমার সাথে এমনটা করতে পারলি?”
কড়ি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কাদিন’ই আবার বলল, “ওর আগে একটা সম্পর্ক ছিল এটা কোনো সমস্যা না। অনেকেরই থাকে। সমস্যা হলো এটা যে ও সেই সম্পর্কটার জন্য আত্মহত্যার পথ পর্যন্ত চলে গিয়েছিল।”
“তোমার কথা পরিষ্কার না, মেজো ভাইয়া।”
“তুই এখন বড় হয়েছিস, কড়ি। একটা সম্পর্কে কতটুকু নির্ভরতা, কতটুকু বিসর্জন থাকলে মানুষ এ ধরনের পথ বেছে নেয়?”
“একটা মানুষ অন্য একটা মানুষকে কতটুকু ভালোবাসলে এ পথ বেছে নেয়? এমন করে কেন ভাবতে পারোনি?”
“ওহ গড!” কাদিন বিরক্ত হয়ে গেল।
সে আরো বলল, “আচ্ছা চল তোর মত করেই ভাবি। তোর কথাটাই ধরি। সে যদি আরেকজনকে এত বেশি ভালোবাসে তবে আমাকে কি করে মেনে নিবে?”
“মন দিয়ে চাইলেই ভালোবাসা আদায় করা যায়। যে মেয়েটা ভালোবাসার আবেগে মরতে রাজি হয়ে যায় সে যাকে আবার ভালোবাসবে সে কতটা লাকি তুমি, আমি তা কল্পনাতে ভাবতেও অপারগ।”
“রিডিকিউলাস।” রাগে, বিরক্তিতে কাদিনের মুখ তেতো হয়ে এল।
কড়ি নরম গলায় বলল, “দীপার জায়গায় আমি থাকলেও কি এসব ভাবতে?”
“আমার বোন এমন কোনো কাজ কখনো করতেই পারে না।”
সাথে সাথে কড়ির ভেতরটা পুড়ে কয়লা হয়ে গেল । চোখ নামিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। এঁদের না বলে পালিয়েছিল সে? এঁদের? একবার যদি টের পেত কি হত তাঁদের? কান্নার দলাটা গিলে ফেলল কড়ি। গলায় কাঁটার মত বিঁধছিল আর শুধু যন্ত্রণা দিচ্ছিল।
কাদিন জানালা খুলে গ্রিলে দু’হাতে ভর দিয়ে দাঁড়াল। ঘাড় নীচু করে রেখেছে সে। কড়ি ভাইয়ের দিকে না তাকিয়েই বলল, “আমি এখন আসি।” সে আর দাঁড়াতে পারছে না। শক্তিতে, সাহসে কুলাচ্ছে না তার।
কাদিন বলল, “আমি এ বিয়ে করব না।”
.
দীপার হলুদের অনুষ্ঠান এখনও শেষ হয়নি। জাঁকজমকপূর্ণ আলোর ঝলকানিতে দীপাকে ছোট একটা হলদে পাখির মত দেখাচ্ছে। যে পাখি ডানা মেলে নতুন ঠিকানায় উড়ে যাচ্ছে। ইমাদ দূর থেকে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করল, “সে ঠিকানা খাঁচার না হোক। ঠিকানাটুকু হোক নীল স্বচ্ছ এক আলোর আকাশ। দীপুর ঠিকানা আকাশ হোক। দীপুর ঠিকানা আকাশ হোক।”
নিলয় পাশে এসে দাঁড়াল, “ইমাদ?”
ইমাদ চোখ বন্ধ রেখেই বলল, “হুম।”
“আমাদের ত স্টেজে উঠা নিষেধ।”
ইমাদ চোখ মেলল। নিলয় বলল, “আন্টি বললেন দীপুর কড়া নিষেধ।”
“আচ্ছা।”
নিলয় কিছু বলল না আর। ইমির সাথে কথা বলা আর না বলা একই। সে হয়রান হয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়ল। ইমাদ ওর হাতটা টেনে ধরল। নিলয় বলল, “কি?”
চলবে…

একা তারা গুনতে নেই পর্ব-১০+১১

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ১০
দীপা সময় নিয়ে চুড়ি পরা শেষ করল। তারপর কপালে টিপ দিতে দিতে বলল, “আমার বিয়ে হচ্ছে।”
নিলয় দ্রুত পায়ে এসে ইমাদের পাশে বসল। চিন্তিত গলায় দীপাকে বলল, “তোর মাথা ঠিক আছে?”
“বিয়ের বয়সে বিয়ে না হলে মাথা কী আর ঠিক থাকে বন্ধু?”
দীপা টুল ছেড়ে উঠে ঘুরে ঘুরে নিজেকে দেখল। সে কলা পাতা রঙের সিল্কের একটা শাড়ি পরেছে। বন্ধুদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “দেখ ত কেমন লাগছে? পছন্দ করবে না আমায়?”
ইমাদ চোখ মেলে সোজা হয়ে বসে দীপার দিকে মুখ তুলে তাকাল, “ছেলেটা কে?”
“কড়ির ভাই। কড়ি ত সুন্দর। ওর ভাইও দেখতে ভালোই হবে, তাইনা বল?”
নিলয় বলল, “কড়ির ভাই তা তো আমরাও জানি।”
ইমাদ প্রশ্ন করল, “কেন বিয়ে করছিস তুই?”
“ডার্টি আনসার আসছে মাইন্ডে। ডোন্ট আস্ক মি ব্রো।”
নিলয় বলল, “ফাইজলামি রাখ তোর। কী হয়েছে কেন এসব করছিস প্লিজ খুলে বল। তোকে আমরা চিনি না? কেন বিয়েতে রাজি হয়েছিস এখনি বলবি তুই। তাহমিদের বেলায় কিছু শুনিস নি, বলিসনি। এবার সে কাজটা করিস না দয়া করে। আমাকে আর ইমাদকে সব বল।”
দীপা শাড়ির আঁচলটা পেছন দিয়ে টেনে এনে মুখের সামনে বাতাস করতে করতে বলল, “উফ এত নার্ভাস লাগছে! আমাকে যদি পছন্দ না হয়? যদি রিজেক্ট করে দেয়? ডান চোখের আই লাইনার আর বাম চোখেরটা মেলেনি তাইনা? চোখ একটা ছোট, একটা বড় লাগছে। উফ।”
দীপা আবার ড্রেসিংটেবিল এর কাছে গিয়ে আয়না দেখে দেখে টিস্যুতে আই লাইনার তুলছে।
ইমাদ আয়না দিয়ে দীপার দিকে তাকাল, “টিপ ঠিক মত বসেনি।”
দীপা টিপ খুলে নতুন করে পড়ে বলল, “ঠিক আছে না?”
“হুম।”
“সুন্দর দেখাচ্ছে?”
নিলয় বলল, “পেত্নীর মত লাগছে।”
দীপার মুখ থেকে অস্ফুটে আর্তনাদ বেরিয়ে এল, “আসলেই? কী করব? খোঁপা খুলব? লিপস্টিকটা মুছে ফেলব?”
নিলয় ধমকে উঠে হাত দেখাল, “এক থাপ্পরে তোর সব দাঁত ফেলে দিব। বল এসবের পেছনের মোটিভ কী?”
দীপা বলল, “ধুর! এখন জ্বালাস না তো। এমনিতেই টেনশনে আছি।”
দীপা নতুন করে আর সাজবার আর সুযোগ পেল না। ওকে দেখতে মেহমানরা চলে এল। দীপার মা দীপাকে শক্ত করে বলে দিলো, “দোহাই লাগে কথা কম বলবি তুই। আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যাবি না। যা জানতে চাইবে শর্টকাটে আনসার দিবি।”
“ওকে ডান।”
কাদিনের সাথে তার পুরো পরিবার এসেছে। দীপার পরিবারের তুলনায় কাদিনদের পরিবার বেশ বড়। দীপার বাবা নেই। মা আর ছোট ভাই ব্যস। দীপার মা ওদের নাশতা দিয়ে বসালেন। এরপর দীপাকে নিয়ে যেতে এলেন। দীপা মহা দুশ্চিন্তা নিয়ে প্রশ্ন করল, “ঘোমটা দিলে ভালো নাকি না দিলে?”
“কী আশ্চর্য! ঘোমটা দিবি না?”
“ঘোমটা দিলে ক্ষ্যাত বলবে না ত? আজকাল কেউ ঘোমটা টেনে যায় নাকি?”
তিনি একটু ভেবে বললেন, “আচ্ছা, তাহলে দিস না।”
“কিন্তু ঘোমটা না দিলে ত বউ বউ লাগবে না।”
“এখন কিন্তু মার খাবি।”
দীপা শেষ পর্যন্ত ঘোমটা ছাড়াই মায়ের সাথে চলল। ড্রয়িংরুমে গিয়ে দীপা বিভ্রান্ত হয়ে গেল। পাত্র কোনটা? তিনজন একাধারে বসে আছে। ও কড়ির দিকে তাকাল। কড়ি দুই আঙুল তুলে দেখাল। তার মানে মাঝের জন। দীপা আরেকটা সোফায় গিয়ে বসল।
.
মুবিন আজ স্কুলে যায়নি। তাই মিলা একাই স্কুলে গেল। ছুটির পর বাসায় ফিরে এসে অবাক হয়ে গেল। তার ঘরের পাখাটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই নতুন পাখা কিনে আনা হয়েছে। কিন্তু সে পাখা তার ঘরে লাগানো হয়নি। মুবিনের ঘরের পুরাতন পাখাটা খুলে এনে তার ঘরে ফিট করা হয়েছে। আর নতুন পাখাটা মুবিনের ঘরে লাগান হচ্ছে। মিলা হতভম্ব হয়ে তাকাল। মিস্ত্রি ঠিকঠাক পাখা লাগাচ্ছে কিনা শিল্পী মুবিনের ঘরে দাঁড়িয়ে তদারকি করছে। মিলা ছুটে নিজের ঘরে চলে গেল। দরজা বন্ধ করে কাঁধ থেকে স্কুল ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলল। চুলের ফিতা, রাবার ব্যান্ড খুলেও ছুঁড়ে ফেলল এখানে সেখানে। বেণুণী খুলে হাত দিয়ে মাথার চুল যত পারল এলোমেলো করল, দু’হাতে টেনে ছেড়বার চেষ্টাও করল। উঠে গিয়ে পাখার সুইচ বন্ধ করে দিলো। পাখার গতি ক্রমান্বয়ে কমে আসছে, যা বাড়ছে তা হলো অবহেলা।
.
রিমা অনেকক্ষণ দীপাকে এটাসেটা জিজ্ঞাসা করল। এরপর দীপার মাকে বলল, “আন্টি কিছু মনে না করলে কাদিন আর ও আলাদা একটু কথা বলুক?”
দীপার মা সম্মতি দিলেন, “অবশ্যই, অবশ্যই।”
দীপার ভাই দীপাকে আর কাদিনকে আলাদা ঘরে দিয়ে চলে গেল। ইতোমধ্যে দীপাকে কাদিনের মন্দ লাগেনি। হালকা – পাতলা গড়নের ছিমছাম চেহারার মেয়ে। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা তবে হাসিটা ভালো। হাসলে দাঁতের মাড়িগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠে। চেহারায় মিষ্টি মিষ্টি একটা ভাব চলে আসে। রিমা আপুর সাথে যখন হেসে হেসে কথা বলছিল তখন ভালোই লাগছিল। এখন ঝটপট মেয়েকে কিছু প্রশ্ন করে ফেলা দরকার।
কাদিন গলা খাঁকাড়ি দিয়ে বলল, “ভালো আছেন?”
“জি। আপনি?”
পাল্টা প্রশ্ন করে দীপার মনে হলো প্রশ্নটা না করাই ভালো ছিল। মা পইপই করে কম কথা বলতে বলে দিয়েছিলেন।
কাদিন উত্তর দিলো, “জি ভালো। আপনার কোনো প্রশ্ন আছে?”
একটা প্রশ্ন করতে দীপার পেটটা মোচড় দিয়ে উঠল, কিন্তু এই প্রশ্ন করেছে জানলে মা ওকে ঝাড়ুপেটা করবে। প্রশ্নটা হলো, “আপনি কোন পারফিউম ইউজ করেন? গন্ধটা ভালো। এটা কী দেশে আছে? থাকলে আমার ভাইকে কিনে দিব। গাধাটা কী একটা পারফিউম যে দেয় গন্ধে মাথা ভোঁ ভোঁ করে।”
মনের বিরুদ্ধে গিয়ে দীপা না – বোধক মাথা নাড়ল। কাদিন প্যান্টের দু পকেটে দু হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনি কিছু মনে না করলে আমি কি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে পারি?”
“জি।”
“আপনি বসুন না, বসুন।”
“না ঠিক আছে।”
“যৌথ পরিবার নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাইছি। মানে যৌথ পরিবারে কোনো অস্বস্তি আছে কি?”
“কোনো অস্বস্তি নেই।”
শুনে কাদিন উপর নীচ মাথা নাড়ল। খানিক থেমে জানতে চাইল, “এই আয়োজনে আপনার মত আছে? আপনার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু হচ্ছে না তো?”
“না, আমার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু হচ্ছে না।”
“আমি যদি এ ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলি আপনার কি তাতে কোনো আপত্তি থাকবে?”
দীপা মনে মনে বলল, “মানুষটাতো সেই বোরিং! পৃথিবীতে এত ধরনের প্রশ্ন থাকতে তিনি বেছে বেছে কীসব প্রশ্ন করছেন! যাচ্ছে তাই একটা!”
মুখে বলল, “না।”
“আচ্ছা। ভালো থাকবেন। আসছি।”
কাদিন ঘুরে বেরিয়ে আসছিল। দীপা হঠাৎ বলে বসল, “আপনার আবার কথায় কথায় আচ্ছা বলার অভ্যাস নেই তো?”
কথাটা বলেই সে জিহ্ব কাটল। উফ শেষ পর্যন্ত নিজের কথার উপর সে আর নিয়ন্ত্রন রাখতে পারেনি। কী লাভ হলো এত কষ্ট করে! সব ঐ ইমিটার দোষ। আচ্ছা শুনেই মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গেছে। কাদিন দরজার নব ধরে রেখেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, “না, সে অভ্যাস নেই।”
তারপর দরজা খুলে চলে গেল। দীপা নিজের ঘরে গিয়ে ইমাদের উপর চড়াও হলো, “তোর জন্য সব গোলমাল হয়ে গেছে। তোর জন্যে, শুধু তোর জন্যে।”
ইমাদ আর নিলয় কিছুই বুঝল না। দীপা মুখ ভোঁতা করে বসে রইল। ওরা কতবার কত প্রশ্ন করল কোনো উত্তরই দিলো না সে। কাদিনরা চলে গেল। হ্যাঁ, না কিছুই বলল না। দীপাকে শুধু উপহারসরূপ কিছু বই দিয়ে গেল। দীপার মন খারাপ। শেষ প্রশ্নটা কেন করল সে? ধ্যাত!
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ১১
ইমাদ কোটবাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে উঠল। সবুজের সমারোহকে সাই সাই করে পেছনে ফেলে বাসটা ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে কুমিল্লা শহরের দিকে। সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। বাসের তালে তালে তার শরীরটাও দুলছে। সে নির্বিকারভাবে দেখছে শহরের টানে প্রকৃতিকে ফেলা আসার এই ক্লান্তিমাখা যাত্রা। একইসাথে অনেকক্ষণ ধরে একটা বিষয় মনে করার চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছে না। একটু পরই কড়ির সাথে ওর দেখা হবে। কিন্তু কোথায় যেন? কড়ি কী উজির দীঘির পাড় বলেছিল নাকি রাণীর দীঘির পাড়? আবার ধর্মসাগর দীঘির ওখানে নয় ত? নানুয়া দীঘির পাড়ও হতে পারে। এজন্যই ত কুমিল্লাকে লোকে দীঘির শহর বলে। এই শহর ত জলের কুটুমবাড়ি। শহরের বুকে এত এত জলাধার। কী আশ্চর্য! এই শহরেই সে থাকে অথচ, বিষয়টা এর আগে কখনো ভাবায় হয়নি! হ্যাঁ, এই তো মনে পড়েছে। নানুয়া দীঘির পাড়ের কথা হয়েছিল। সকালে সেই কড়িকে ফোন করেছিল, “আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
“আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলার ছিল।”
“জি বলুন।”
“এভাবে না, সামনাসামনি কথা বলতে চাইছি। বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ।”
“কী বিষয়ে?”
“দীপুর বিষয়ে।”
কড়ি একটু ভেবে বলল, “ঠিক আছে।”
“কখন? কোথায়?”
“রেস্টুরেন্টে আমি বেশিক্ষণ বসতে পারি না।”
“আচ্ছা।”
“অন্য কোথায় দেখা করলে ভালো হয়।”
“আচ্ছা।”
“নানুয়া দীঘির পাড় আসতে পারবেন?”
“জি পারব।”
“আপনি আপনার সুবিধামত সময় বলতে পারেন। আমার ব্যস্ততা নেই।”
“পাঁচটার দিকে হলে আমার জন্য ভালো হয়।”
“ওকে।”
নানুয়া দীঘি শান্ত জলের জলাধার। যার চারিদিক জুড়ে বিশাল বিশাল সব দালানকোঠা। তবে জায়গাটা কোলাহলমুক্ত। এখানে এলে সময় যেন থমকে যায়। আকাশ হয়ে উঠে সাদা মেঘেদের ঠিকানা। আর বাতাসে বয়ে বেড়ায় মিষ্টি গন্ধ।
বিশাল দীঘির প্রতিটি পাড়েই বসবার জন্য একটি করে পাকা করে গড়ে তুলা বেঞ্চের মতন জায়গা আছে। কড়ি দক্ষিণ পাড়ে বসে ইমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ইমাদকে অন্য পাড় দিয়ে হেঁটে আসতে দেখল সে। ইমাদ এসে ওর মুখোমুখি হয়ে উল্টোদিকের জায়গাটায় বসল। কড়ি বলল, “বলুন কী বলবেন।”
“দীপু এ বিয়েটা কেন করছে?”
কড়ি ভ্রু কুঁচকে তাকাল, “এ বিষয়ে কথা বলতে চাইছেন?”
“জি এ বিষয়ে কথা বলতে চাইছি।”
“আপনি কী কিছুই জানেন না?” কড়ি সামান্য অবাক হলো।
“না।”
“তারমানে দীপা আপনাকে কিছুই বলেনি।”
“কিছুই বলেনি।”
“আর আপনি সেটাই জানতে এসেছেন?”
“জি।”
“আপু না বললে আমি কী করে বলতে পারি?”
“ও আমাকে বলেনি তার মানে হলো ও জানে কাজটায় আমি সায় দিব না এবং বাধা দিব। আর আমি বাধা দিব মানে ঘটনা নিশ্চয়ই ওর অনুকূলে নয়।”
“আপু বিয়েতে রাজি হয়েছে। জীবনে এগিয়ে যাচ্ছে। আপনি শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছেন।”
“সে বিয়েতে এমনি এমনি রাজি হয়নি।”
“জি এমনি এমনি রাজি হয়নি। কেন রাজি হয়েছে আপনাকে বলতে আমার কোনো আপত্তি ছিল না। তবে উনি যেহেতু লুকাচ্ছেন আমি নিশ্চয় সে কথা আপনাকে বলে দিতে পারি না?”কড়ি চলে যেতে উঠে দাঁড়িয়ে ভ্যানিটি ব্যাগ কাঁধে চড়াল। সেই আবার বলল, “দুঃখিত, আমি আসছি।”
সে চলে যেতে পা বাড়াতেই ইমাদও উঠে দাঁড়াল। বলল, “আপনি কেন যেচে পড়ে নিজের ভাইয়ের সাথে এমন একটা মেয়ের বিয়ে দিতে চাইছেন যে কিনা তার এক্সকে পাগলের মতন ভালোবাসে?”
কড়ি ফিরে তাকাল, “আপনি জবাবদিহি চাইছেন?”
“বিষয়টা একটু কেমন হয়ে গেল না?”
কড়ি আবার নিজের জায়গায় বসল, “কেমন হয়ে গেল?”
ইমাদও আবার নিজের জায়গায় বসল, “নিজের ভাইয়ের প্রতি অন্যায় হয়ে গেল না? বন্ধুদের সাথে এমন অন্যায় মানুষ করতে পারে, কিন্তু নিজের ভাইয়ের সাথে না।”
কড়ি হাসল, “আপনার বোধহয় মনে হচ্ছে এর পেছনে আমার নিজস্ব কোনো স্বার্থ আছে।”
ইমাদ নিশ্চুপ। কড়ি জবাব দিলো, “কোনো স্বার্থ নেই।”
“আচ্ছা।”
“আমি অতটা খারাপ কেউ নই যে স্বার্থের কারণে আপনার বন্ধুর সাথে আমার ভাইয়ের বিয়ে দিব। আমার ভাইয়ের মাঝে কোনো ঘাটতি আছে বলে সন্দেহ করবেন না। আবার, আমি অতি মহান কেউও নই। অতি মহান হলে দীপাদের বাসায় আরো আগেই বিয়ের প্রস্তাব যেত। ভাইয়ার জন্য ত অনেকদিন ধরেই পাত্রী খুঁজছি আমরা। আমাদের বাসায় দীপাকে দেখে বাবা পছন্দ করে ফেলেন। এখন আমি নিশ্চয়ই এতটাও খারাপ নই যে দীপার সব জানি বলেই বিয়েতে বাধা দিয়ে বসব। যেখানে আমিও ওর মতই ভোক্তভোগী।”
ইমাদ নির্লিপ্ত গলায় বলল, “আচ্ছা।”
কড়ি উঠে বিদায় নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। সন্ধ্যে নেমে আসছে। বড় বড় দালানগুলোর সাঁঝবাতির প্রতিফলন দীঘির পানিতে টলটল করছে। কড়ি পাড় ধরে নীরবে বাসার দিকে হেঁটে যাচ্ছে। বাতাসে ওর চুলগুলো উত্তাল হয়ে উড়ছে। সেও নিশ্চয়ই সারাজীবন ঐ প্রতারকের জন্য বসে থাকবে না? সময় এলে সেও বিয়ে করব। সংসার করবে এবং অনেকবছর পর এক্সের সাথে দেখা হয়ে গেল আমার বাচ্চাকাচ্চার সাথে মামা বলে পরিচয়ও করিয়ে দিবে। সেও ত রামিমকে পাগলের মতন ভালোবাসে। এখন তার বিয়ের সময় যদি কেউ একই কারণে বাধা দেয়! তখন কেমন লাগবে ওর? একটা মেয়ে হয়ে কেন আরেকটা মেয়ের সুখে বাধা দিতে যাবে সে?
ইমাদ এক পায়ের উপর ৯০ ডিগ্রী এঙ্গেলে অন্য পা তুলে একই জায়গায় বসে আছে। সে এখনো উঠেনি। কড়িকে এখন উত্তরপাড়ে দেখা যাচ্ছে। চেহারা স্পষ্ট নয়, শুধু হেঁটে চলাই চোখে পড়ে।
চলবে…

একা তারা গুনতে নেই পর্ব-৮+৯

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৮
ভয়ে মিলা পরপর কয়েকটা ঢোক গিলল। মুবিন ঐ বইটাই খুঁজছে না তো? পড়ার টেবিল থেকে আড়চোখে ওর দিকে তাকাল মিলা। মুবিন পুরো বুকশেলফ চষে ফেলছে। ওর বইয়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহ দারুণ। মিলা জিহ্ব দিয়ে ঠোঁট ভেজাল। বুকটা দুরুদুরু করছে। মুবিন এবার অধৈর্য্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “প্রডিজি বইটা পাই না কেন, মিলা?”
মিলা কেঁপে উঠল। জামা টেনে বুকে থুথু দিয়ে বলল, “কী যেন জানি না তো।”
মুবিন মেঝেতে বসে নীচের তাক হাতাতে লাগল। একদম কোণায় বইটি পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে, “পেয়েছি।”
আতঙ্কে জমে গেল মিলা। মুবিনের চোখে যেন না পড়ে তাই একদম শেষের তাকে রেখেছিল সে। মুবিন বইটা খুলে দেখবে না তো? আশঙ্কায় মিলা আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগল।
যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যে হয় প্রবাদটিকে শতভাগ সত্য করে দিয়ে মুবিন বইটি খুলে দেখল। বইয়ের মাঝ থেকে দুটো পাতা খসে পড়ল মেঝেতে। বইয়ের পাতা ছেঁড়া! পরমুহূর্তেই ছোটখাটো একটা বিস্ফোরন ঘটে গেল। মুবিন উঠে এসে মিলাকে মারল। মিলাও হাতাহাতি লেগে গেল, কিন্তু মুবিনের সাথে পারা কঠিন। শেষটায় ব্যাথায় কুঁকড়ে গিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠল। ধাক্কা দিয়ে ভাইকে সরিয়ে বলল, “ছাড়।”
“ভালো করেই ছাড়ছি তোকে।” মুবিন রোষানলে জ্বলে উঠে আবার তেড়ে গেল।
“এত গুন্ডা কেন তুই?”
“সত্যি সত্যি বল কেন ছিঁড়লি? আমাকে শায়েস্তা করতে? হ্যাঁ? তোর স্যার বিদায় হয়ে যাওয়ার আমার বই ছিঁড়ে ক্ষোভ দেখিয়েছিস?”
“আরে না। সুহাকে দিয়েছিলাম।”
“আমার বই তুই আমার কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া ছাড়াই নিজের বান্ধবীকে দিয়ে দিলি? আর তোর বান্ধবী বই পড়তে নিয়ে একদম ছিঁড়েই ফেলল!”
“ও করেনি। ওদের বাসায় মেহমান এসেছিল। মেহমানের ছোট বাচ্চা ছিল। বাচ্চাটা ছিঁড়ে ফেলেছে।”
“আমার বই কাউকে দেওয়া নিষেধ না? বল নিষেধ না? আমি আমার জানের জিগার বন্ধুদেরও বই দেই না। তুই তা খুব ভালো করেই জানিস।” মুবিন চেঁচাচ্ছে। মিলা কী বলবে? চুপ করে রইল। মুবিন বলল, “একদম চুপ করে থাকবি না। বল নিষেধ কিনা?”
“নিষেধ।” মিলা চোখ মুছল।
“তো কেন দিলি?”
“ও চেয়েছিল।”
“ও চেয়েছিল! ও চাইলেই কী দিতে হবে? ও কী তোর নিজের জানের চেয়েও প্রিয়?”
মিলা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “হ্যাঁ, নিজের জানের চেয়েও প্রিয়। কী করবি মেরে ফেলবি এখন?”
মুবিন ব্যঙ্গ করে উঠল, “বাবা!!! সিনেমা! বান্ধবী নাকি জানের চেয়েও প্রিয়! সর সামনে থেকে। আর কোনোদিন আমার শেলফে হাত দিবি না। সোজা হাত ভেঙে দিব।”
মিলা হিসহিসিয়ে বলল, “একশবার দিব। সুহা আবার বই চাইলেই বই দিব। ও যেটা চাইবে আমি সেটাই দিব।”
“দিতে হলে নিজের বই দে গিয়ে। অামারগুলায় ভুলেও আর হাত দিবি না।” মুবিন ধমকে উঠল।
“আমি এতসব বোরিং জিনিসপত্র পড়ি না। আমার থাকলে আমারটাই দিতাম। তোর মতন এত ছোট আত্মাওয়ালার বইয়ের দিকে ফিরেও তাকাতাম না। মনটা একটু বড় কর।”
“তোর সুহা কী আমার হবু বউ লাগে যে ওর জন্য আমার আত্মা, মন বড় করে ওকে আমার বই দিতেই হবে?”
“তোর মতন গুন্ডার কোনোদিন সেই সৌভাগ্য হবেও না।”
মুবিন মুখ খিঁচিয়ে আঙুল তাক করে বলল, “শোন আমার বই আর কখনো দিবি না কাউকে।”
“আর কাউকে ত দিইও না। সুহাকে শুধু দিই, আর দিবোও।”
“ওর জন্য এত পিরিতি কেন আপনার?”
“এত পিরিতি কারণ একমাত্র ও আমার কেয়ার করে। আর কারো কাছে আমার কোনো গুরুত্ব নেই। তোর মা – বাবার কাছেও আমি নোবডি। তোরা যখন আমায় কষ্ট দিস তখন ওর কাছে গিয়েই কাঁদি।”
“এক প্যাঁচাল পেয়েছে। সবসময় টেনেহিঁচড়ে সেটাই নিয়ে আসে।”
“তোর কাছেও আমার গুরুত্ব নেই। সামান্য একটা বইয়ের জন্য আমাকে মেরেছিস তুই। মনে রাখলাম।”
“যা, যা মনে রেখে যা করবার করিস। যাহ্।” হাত নাড়াতে নাড়াতে বলতে বলতে চলে গেল মুবিন। তারপর সারা দুপুর নিজের ঘরে পড়ে ঘুমাল। দুপুরের খাবার ছেড়ে দিলো মিলা। খাবে না সে! মুবিন বিকেলে ঘুম থেকে উঠে খেতে বসে গলা উঁচিয়ে ডাকল, “এই মিলা খাবি না?”
“তোকে খাব।” মিলার রাগের জবাব।
“সাহস থাকলে আয় না, আয়।”
“মাথা ব্যাথা আমার। বিরক্ত করিস না।”
“সারাদিন ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদলে মাথা ধরবেই। পান থেকে চুন খসতেই ভ্যাঁ ভ্যাঁ! আমার কী! না খেলে না খাবে।”
বিড়বিড় করতে করতে একলাই খেয়ে নিলো সে। তারপর মাঠে খেলতে চলে গেল। খেলায় মন বসল না তার। মা-বাবার ডিভোর্স আর কার কাছে মিলা থাকবে এই নিয়ে এমনিতে সারাক্ষণ মিলার মন খারাপ থাকে। অসহনীয় যন্ত্রণায় আর চিন্তায় নিঃশেষ হতে থাকা তার মাথায় পরীক্ষার সিলেবাস শেষ করবার নতুন দুশ্চিন্তা দেখে মুবিনের অপরাধবোধ হতে লাগল। তার উপর আজ সে মেরেছেও।
বাসায় ফেরবার আগে ইমাদ স্যারের মেসে যাবার সিদ্ধান্ত নিলো সে। স্যারের মেসের ঠিকানা তার জানা ছিল। মা অধিক সচেতনায় প্রথম দিনই ঠিকানা জেনে রেখেছিলেন। মা ইমাদ স্যারকে অনেক জুরাজুরি করবার পরও তিনি আর কখনো পড়াতে যাননি। এর মাঝে আরেকজন টিউটরও পেয়েছিল ওরা, কিন্তু ইমাদ স্যারের মতন অত ভালো পড়ান না বলে মিলা বাদ দিয়ে দিয়েছে।
ইমাদ মেসে ছিল না, নিলয় ঘুমাচ্ছিল। দরজায় মুবিনের ধাক্কার পর ধাক্কায় নিলয় বিরক্ত হয়ে দরজা খুলল, “কাকে চাও, বাবু?” তার কণ্ঠ এখনো ঘুমে ভার হয়ে আছে।
“ইমাদ স্যারের কাছে এসেছি।”
নিলয় ভালো করে তাকাল। নীল থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট আর বেন টেন এর চিত্রখচিত সবুজ গেঞ্জি পড়ুয়া নাদুসনুদুস এক ছেলে। চুলগুলো খাঁড়া খাঁড়া। লম্বায় নিলয়কে প্রায় ছুঁই ছুঁই করছে। নিলয় মুখের সামনে হাত নিয়ে হামি তুলে বলল, “ও এখন নেই।”
মুবিন কাঁধ ঝাকাল, “কখন আসবেন?”
“ক’টা বাজে এখন?” বলে নিজেই ঘাড় ঘুরাল। দেয়ালে লেপ্টে থাকা সোনালী রঙা বড় ঘড়িটা দেখে বলল, ” এসে পড়বে বিশ, পঁচিশ মিনিট।”
“আমি তাহলে বসি।”কোনো প্রকার অনুমতির অপেক্ষা ছাড়াই মুবিন ঘরে ঢুকে গেল। নিলয় বিড়বিড় করতে করতে নিজের চৌকিতে ফিরে গেল আবার, “দেশ এই ধরনের পোলাপানদের হাতে পড়লে সর্বনাশ। রসাতলে যাবে।”
নিলয় হাত দিয়ে কপাল ঢেকে শুয়ে রইল। ইমাদ এসে দেখল মুবিন তার চৌকিতে বসে আছে। অনবরত পা নাড়াচ্ছে আর গেইমস খেলছে মোবাইলে। সে কাঁধের ব্যাগটা চৌকিতে রেখে বাথরুমে গিয়ে হাত- মুখ ধুলো। গামছায় মুখ মুছতে মুছতে বেরুতেই মুবিন উঠে দাঁড়াল, “স্যার, আমাদের পুরো সিলেবাস বাকি।”
“হুম।” ইমাদ শার্ট খুলে দড়িতে ঝুলাল।
মুবিন খানিক ইতঃস্তত করে বলল, “স্যরি স্যার।”
“ইটস ওকে।”
“অন্তত মিলার জন্যে পড়াতে আসুন।”
“আচ্ছা।”
মুবিন প্রফুল্ল হয়ে উঠল। চোখের তারায় হাসির ঝিলিক ফুটে উঠল। সবকটা দাঁত বের করে হেসে বলল, “থেঙ্ক ইউ, স্যার।”
ইমাদ কিছু বলল না। পকেট থেকে মোবাইল বের করে চার্জে দিয়ে টেবিলে রাখল। মুবিন বলল, “তাহলে নেকস্ট মঙ্গলবার থেকে আবার পড়ব, স্যার।”
“আচ্ছা।”
“আসি স্যার?”
ইমাদ হ্যাঁ- সূচক মাথা নাড়ল। মুবিন ঘুরে চলে যাচ্ছিল। ফিরে এল আবার। ইমাদ মুখ তুলে প্রশ্নবোধক চোখে তাকাল।
“পাথরের এই মূর্তিটা কী কেনা?” মুবিন আঙুল তাক করে দেখাল।
“না।”
“হ্যাঁ, দেখেই মনে হচ্ছিল। এখনও তো অসম্পূর্ণ।”
ইমাদও ভালো করে তাকাল। মুবিন আবার প্রশ্ন করল, “এটি কার?”
“ওর।”
“বানাচ্ছে?”
“হুম।”
“কী করে?”
“ওকে জিজ্ঞাসা করো।”
মুবিন নিলয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াল, “ভাইয়া আপনি ত দারুণ।”
নিলয় কপাল থেকে হাত না সরিয়েই বলল, “থেঙ্কস।”
মুবিন মূর্তিটার দিকে এগিয়ে যেতেই নিলয় ধমকে বলল, “ধরো না ওটা।”
মুবিন বিড়বিড় করল, “কী ভাব!” তারপর গটগট করে চলে গেল সে, কিন্তু ইমাদ আর কখনো ওদের পড়াতে গেল না।
চলবে….

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৯
কড়ি আর দীপার বন্ধুত্বটা ভালোই যাচ্ছে। দীপার খুব একটা বান্ধবী নেই। বন্ধু আছে অনেক। স্কুল, কলেজ থেকেই ওর ছেলেদের সাথে ঝট করে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। উল্টোদিকে, মেয়েরা ওকে কোনো এক অজানা কারণে সহ্য করতে পারে না। এই প্রথম একটা মনের মতন বান্ধবী জুটেছে। বয়সে যদিও কড়ি ছোট তবুও খাতিরটা জমে ক্ষীর। কড়ি ইমি আর নিলয়ের মত না। দীপার সব কথাই ও মনোযোগ দিয়ে শুনে। যেখানে অন্যরা দীপার কথার ঝড়ে কানে আঙুল চেপে বসে থাকে সেখানে ওর এই বকবকে কড়ির অবিশ্বাস্য আগ্রহ। এত মনোযোগী শ্রোতা পেয়ে দীপারও আনন্দের শেষ নেই। যেখানেই যায় কড়িকে সাথে নিয়ে যায়। এই যেমন আজ সে একটা হাত ঘড়ি কিনবে বলে কড়িকে ফোন করে মার্কেটে নিয়ে এল। খুব সুন্দর একটা কালো চেনের ঘড়ি কিনল সে। এরপর ফুচকা খেতে খেতে বলল, “তোমার বাসায় নিবে না আমায়? আজকে চলো তোমার বাসায় যাই।”
কড়ি ঠোঁটে হাসি টেনে বলল, “বাসায় যাবে?”
“বন্ধুদের বাসায় গিয়ে আড্ডা দেওয়ার মজাই আলাদা। নিলয় আর ইমির মেসে ত আর যেতে পারি না। যদিওবা, ওরা আমার বাসায় আসে। তবুও আমার ত আর যাওয়া হয় না।”
ব্যস হয়ে গেল। কড়ি দীপাকে নিয়ে নিজের বাসায় চলে এল। তবে বিপত্তি বাঁধল রিকশা থেকে নেমে। রিকশাওয়ালা পাঁচটাকা ভাঙতি নেই বলে পঁচিশ টাকার জায়গায় ত্রিশ টাকা রেখে দিতে চাইল। ওদের কাছেও ভাঙতি ছিল না। অথচ, দীপা স্পষ্ট দেখেছে রিকশাওয়ালা যখন টাকা গুনছিল তার মাঝে পাঁচ টাকার নোট আছে। সে লেগে গেল ঝগড়া, “পাঁচ টাকা বেশি রাখতে চান বললেই হলো। মিথ্যে বলছেন কেন? আপনার টাকাগুলো দেখান ওখানে পাঁচ টাকার নোট আছে। এখনি, এখনি বের করুন।”
কায়েস চেঁচামেচি শুনে দু’তলার বারান্দা থেকে উঁকি দিলো। নীচে কড়িকে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি করে নেমে এল, “কী হয়েছে, কড়ি?”
“তেমন কিছু না, ছোট ভাইয়া।” কড়ি দীপার হাত টেনে ধরল। ফিসফিস করে বলল, “শশশশশ্ বাসায় চলো, প্লিজ। বাসার সামনে চেঁচামেচি না।”
দীপা বিরক্ত হয়ে কড়ির দিকে তাকাল। কায়েস কিছু বলল না আর। অদ্ভুত চোখে দীপার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেল। রিমা বাসায় ছিল না বলে কড়ি দীপাকে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে নিজেই নাশতা তৈরী করতে চলে গেল।
কাদের সাহেবও বাসায় ফিরলেন তখন। আজ ফিরতে একদম দেরি হয়ে গেছে! দুপুরে খাওয়াও হয়নি। ডায়াবেটিস এর রোগী তিনি। শরীর কাঁপছে রীতিমত। তাই কাপড় বদলে আগে খেতে বসলেন। ঔষধের বক্স নিয়ে এসে ইনসুলিন বের করলেন। ডাইনিং আর ড্রয়িংরুমের মাঝে টানানো পর্দাটা সরান ছিল। দীপা ড্রয়িংরুম থেকে দেখল এটা। সে নিজ থেকে উঠে এসে বলল, “দিন আমি দিয়ে দিই, আঙ্কেল।”
“না, না আমি নিজে নিজেই দিতে পারি। নিজের কাজ নিজে করে অভ্যস্ত।”
দীপা তার স্বভাব অনুযায়ী বারণ শুনল না। সিরিঞ্জ হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সে নিজেই ইনসুলিন দিয়ে দিলো। আর একটানা কথা বলেই গেল, “আমার আব্বাকে ত আমিই দিতাম। আপনি কত ভালো। একটুও জ্বালাতন করেন না। একদম শান্ত একটা বাচ্চা ছেলে। আর আমার বাবা যে কী ছিলেন! নিজে দিবেন ত দূরের কথা সিরিঞ্জ ভয় পেতেন। হা হা হা।” দীপা একাই কথা বলল। একাই হাসল। কাদের সাহেব চুপ রইলেন। এমনকি ধন্যবাদও দিলেন না। কিছু কিছু মানুষের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। তাদের কথা শুনতেই পরাণ জুড়ায়।
দীপা চলে যাওয়ার পর কাদের সাহেব কড়িকে ধরলেন, “মেয়েটা কী তোর বান্ধবী?”
“হ্যাঁ।”
তারপর আরো কিছু কথা জানতে চাইলেন। কড়ি অন্যকিছু ভাবল না। তবে চমকে গেল রাতের টেবিলে খেতে বসে। সবাই এক সাথে খেতে বসেছে তখনি কাদের সাহেব কথাটা তুললেন,
“আজকে কড়ির সাথে যে মেয়েটা এল ওকে কাদিনের জন্য আমার খুব পছন্দ হয়েছে, কড়ি। মেয়েটার কোনো ছবিটবি থাকলে কাদিনকে দেখাস।”
কড়ি লুকমা মুখে তুলে নিতে গিয়ে থেমে গেল। মুখের সামনে লুকমাসহ হাত স্থির হয়ে রইল অনেকক্ষণ। দীর্ঘ সময় পর ছোট করে বলল, “ঠিক আছে।”
কাদিন কিছু বলল না। রিমা বলল, “কে এসেছিলরে কড়ি?”
“নতুন বান্ধবী তুমি চিনবে না।”
“তাই নাকি!”
“হুম।”
কড়ির বড় ভাই আব্দুল কাইয়ূম বলল, “তোর সাথে পড়ে নাকি?”
“না, না সিনিয়র। অন্যভাবে বন্ধুত্ব।”
কায়েস মিটিমিটি হাসছিল। রিমা সেটা খেয়াল করল। খাবার শেষে কায়েসকে গিয়ে ধরল, “সেসময় হাসছিলি কেন?আমাকে না বললে কিন্তু হবে না।”
কায়েস আবার হেসে ফেলল, “ঐ মেয়ে রিকশাওয়ালার সাথে ঝগড়া করছিল! ভাবা যায়! মিস্টার মোস্তফা কাদিনের বউ ভবিষতে অলিতেগলিতে, সবজিওয়ালা, দোকানদার, রিকশাওয়ালা সবার সাথে ঝগড়া করে বেড়াবে। উফ সিনেমার মত দৃশ্যটা চোখে ভাসছে! হায় হায় হায় বাবা এতদিনে একটা কাজের কাজ করতে যাচ্ছে।” কায়েস হাত দিয়ে রোল, ক্যামেরা অ্যাকশন এর মতন দেখাল।
“অ্যাহ? বলিস কী!” রিমাও হেসে কুটিকুটি।
কায়েস বলল, “খবরদার বড় ভাইয়াকে বলো না যেন! ও তাহলে কাদিন ভাইয়াকে ঝগড়ার কথা বলে দিবে।”
“আরে না ওকে বলব না, কিন্তু মেয়েটা এমনিতে ভালো তো?”
“কড়ির বান্ধবী যেহেতু অবশ্যই ভালো। তবে মোস্তফা কাদিনের অতিরিক্ত ইমেজ সচেতনতাকে দুই মিনিটে পা দিয়ে পিষিয়ে ফেলতে যথেষ্ট। আর ঝগড়াটে মেয়েগুলো খারাপ হয় কে বলল তোমায়? ওরা আরো ভালো হয়। একদম পিওর হার্টের। মনে যা মুখেও তা। তোমার বড় দেবরের মতন ভালো মানুষ সেজে থাকে না।”
“অ্যাহ আমার দেবরকে কিছু বলবি না তুই। ও হলো আদর্শ ছেলে।”
“হ্যাঁ, জানি তো ওই তোমার প্রিয় দেবর।”
“ও আমার প্রিয় দেবর হলে তুই আমার প্রিয় ভাই।”
“কলা দিয়ে আর ছেলে ভোলাতে হবে না।”
“আমি ভাবছি ভিন্ন কথা।”
“কী কথা?”
“ভাবছি কাদিনের জন্য এমন মেয়ে নিয়ে আসলে তোর জন্য কেমন মেয়ে খুঁজব? তোর বেলায় তাহলে গম্ভীর একটা হুতুম পেঁচা নিয়ে আসব।”
“কবে আনবে, আপু? আনো না। আর তো সহে না।” কায়েস বিছানায় কাত হয়ে শুলো।
“এত লাফিও না। তোমার বিয়ের অনেক দেরি! আগে কড়ি তারপর তুমি!”
“না মানি না, মানব না।” কায়েস হাত উঁচু করে আন্দোলন করার ভঙ্গি করতে লাগল।
“করতে থাক আন্দোলন, অনশন, হরতাল। আমি গিয়ে ঘুমাই।” রিমি হেসে চলে গেল।
.
একেকবার দীপার জন্য একেকটা বিয়ের সম্বন্ধ আসে আর দীপার মায়ের কান্নাকাটির রোল পড়ে। দীপার কাছে কেঁদেকেটে লাভ হয় না বলে মেয়ের বন্ধুদের কাছে কাঁদতে বসেন। উদ্দেশ্য একটাই, মেয়েকে কোনোভাবে কেউ যদি বিয়েতে রাজি করিয়ে দেয়, কিন্তু আজ পর্যন্ত কখনো কেউ তা পেরে উঠেনি। দীপার মা তবুও হাল ছাড়েন না। যতবারই নতুন নতুন সম্বন্ধ আসে ততবারই যুদ্ধে নেমে পড়েন। কাদিনদের পক্ষ থেকে সম্বন্ধ আসার পরও তাঁর মেয়ের প্রতিক্রিয়া একই। বিয়ে করবে না, না, না মানে না। তিনি সববারের মতন এবারেও নিলয় আর ইমাদের কাছে কল করে কান্নাকাটি করলেন। দীপার মায়ের অসহায় কান্না শুনে ব্যর্থ হবে জেনেও ওরা দুজন ছুটে এসেছিল দীপাকে বিয়েতে রাজি করাতে, কিন্তু এসে বিস্ময়ের চরম সীমানায় পৌঁছে গেল। দীপা বিয়েতে রাজি। রাজি মানে বিয়ে করতে একদম উতলা হয়ে গেছে। দীপার মাও অবাক। খুশিতে তিনি পাগল পাগল হয়ে ওদের দুজনকে একটু পর পর ধন্যবাদ দিচ্ছেন। তিনি ধরে নিয়েছেন ওরাই রাজি করিয়েছে। অপরদিকে, ওরা কিছুতেই কিছু বুঝে উঠছে না। সকালে কল করে বিয়েতে রাজি হতে বলায় দীপা অনেক রাগারাগি করল। এমনকি ওদের কাছে কড়িকেও বকাঝকা করল। কড়িকে খুঁজে নিয়ে আসায় ইমাদের উপরও সেই ঝড় গেল। আর দুপুর গড়িয়ে বিকেলেই সব দৃশ্য এমনভাবে পাল্টে গেল!
দীপা ড্রেসিংটেবিল এর সামনে ঘাড় কাত করে বসে চুড়ি পরছে। ইমাদ আর নিলয় প্রায় একইসাথে সমস্বরে প্রশ্ন করে উঠল, “হচ্ছেটা কী?” নিলয়ের কণ্ঠ উত্তেজিত, ইমাদের স্বর হিমশীতল।
নিলয় অস্থির হয়ে ঘরময় পায়চারি করছিল আর ইমাদ চোখ বন্ধ করে কাউচে হেলান দিয়ে বসে আছে। দুজনের মাথাই চিন্তায় ফেটে যাচ্ছে।
চলবে…

একা তারা গুনতে নেই পর্ব-৬+৭

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৬
দীপা তড়িঘড়ি করে এড্রেসটা মেসেজ করল। এরপর আবার কলও করল, “পেয়েছ?”
“হ্যাঁ।”
“শুনো রিকশা ভাড়া ৩০ টাকার বেশি একদম দিবে না।”
“আচ্ছা।”
“কত দিয়ে ঠিক করলে?”
কড়ি হেসে দিলো, “পঁয়ত্রিশ”
“ইশশিরে হায় হায় করলেটা কী! আমি বাসার গেইটে এসে দাঁড়াচ্ছি। রিকশাওয়ালাকে আজকে ধুলাই দিয়ে সারব। লোক ঠকানো! ওরা না এমনি করে। সবসময়। একবার আমার সাথেও এমন হয়েছে। সেবার আমি…..”
দীপা কথা বলতে বলতে বাসার গেইটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কড়ি এসে পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত মোবাইলে অনর্গল কথা বলেই গেল। কড়ি চুপ করে শুনছিল শুধু। আর ভাবছিল যে ছেলেটা তাকে ডিচ করেছে তার সঙ্গেও নিশ্চয়ই সে এভাবেই বকবক করতো। এই এতদিনে ছেলেটার কানের কাছে তার শব্দদূষণ নেই। এত কথা বলা একটা মানুষকে হুট করে জীবন থেকে বাদ দিয়ে ফেলল। শূণ্যতা কিংবা কোনো হাহাকার কী ছেলেটার মাঝে একবারের জন্যও কাজ করে না? করে না বোধহয়। বরং মাছির ভনভন থেকে মুক্তি পাবার আনন্দে সুখময় দিন পার করবার সম্ভাবনাই বেশি। যাঁরা ছেড়ে যেতে ভালোবাসে তাঁদের শুধু বাহানা প্রয়োজন। আর কিছু নয়।
গলির মুখে রিকশাটা প্রবেশ করতেই দীপা হাত উঁচু করে ডাকল, “হেই!!!! এদিকে।”
কড়ির চমক ভাঙল। কল ডিসকানেক্ট করে রিকশাচালককে বলল, “ভাই ঐ দিকে। লাল গেটটার সামনে।”
ভাড়া মেটানোর সময় দীপা আচ্ছা মতন রিকশাচালককে বেশি ভাড়া নেওয়ায় ধরল। কড়ি হাসতে হাসতে টেনে নিয়ে এল তাকে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে দীপা বলল, “উফ, নিয়ে এলে কেন?”
কড়ি শুধু হাসল। দীপা কড়িকে সোজা নিজের ঘরে নিয়ে গেল। কড়ি ও ঘরে গিয়ে প্রথমেই যেটা বলল, “কেমন আছ?”
“হুম ভালোই। আমার কথা তোমার এখনও মনে আছে!”
“এক গোয়ালের গরু বলে কথা!”
কড়ি আর দীপা আবার হেসে ফেলল। কড়ি বলল, “তাহমিদের কথা মনে পড়ে তোমার?”
“পড়ে। তোমার বফ কী যেন নামটা? ভুলে গেলাম।”
“রামিম।”
“হ্যাঁ, রামিমের কথা কী একটুও মনে পড়ে না তোমার?”
“কে বলল পড়ে না?”
“যখন মনে পড়ে তখন কী করো?”
“তুমি কী করো?”
“যখন মনে পড়ে তখনই নিজেকে অসহ্য লাগে।” দীপার গলার স্বর ভারি হয়ে এল।
“ওর দেওয়া জিনিসপত্র সব পুড়িয়ে ফেলো, দীপা। আমিও পুড়ে ফেলেছি। ওসব দেখলেই বেশি বেশি মনে পড়ে।”
“আমি পারব না। সেগুলো আমাদের শেষ স্মৃতি।”
কড়ি ভ্রু কুঁচকে অবাক চোখে দীপার দিকে তাকাল। হতভম্ব গলায় বলল, “যে হারিয়ে যায় তার স্মৃতি রাখতে হয়। আর যে ছেড়ে যায় তাকে নিজের স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে হয়, মিস দীপা।”
দীপার চোখে জল চলে এলো। সে চোখ মুছতে মুছতে বলল, “আমার কথা বাদ দাও। রামিমকে পেলে? কেন চলে গেল জানতে পারলে?”
“হুম। ওর বাসায় গিয়েছিলাম।”
“ওকে পেয়েছ?”
“না। ওর মায়ের সাথে দেখা হয়েছে।”
দীপা হকচকিয়ে গেল, “তিনি তোমাকে চিনতেন?”
কড়ি বড় করে নিশ্বাস ওরফে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে পর্দা সরিয়ে দিলো। বিকেলের নরম হাওয়া চোখে মুখে মিশে গেল। হাওয়ার তালে উড়ল তার টকটকে লাল ওড়না। ঠোঁটে হাসি টেনে বলল, “তিনি আমায় চিনবেন কী করে? রামিম ত কখনো তাঁর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়নি। সবসময় আমাকে ওর পরিবার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। তাছাড়া, ওর বাড়ি দিনাজপুর।”
“তাহলে তুমি কী করে খুঁজে পেলে ওদের? ঠিকানা জানতে?”
কড়ি চুপ হয়ে গেল। রামিমকে খুঁজে বের করতে সে আবার ঢাকা গিয়েছিল। রামিমের মেসে গিয়ে রামিমকে পেল না সে। রামিম কোথায় আছে, রামিমের বাড়ি কোথায় মেসের কেউ বলতে পারল না। তাই সে ক্যাম্পাসে ছুটে গেল। ক্যাম্পাসে গিয়ে সবার আগে আশরাফ ভাইকে খুঁজল। আশরাফের মাধ্যমেই রামিমের সাথে তার পরিচয়। আশরাফ ভাই তার কোর্সমেট ছিল। তখনি ওদের পরিচয়টা হয়। আশরাফ ভাইকে সে ডিপার্টমেন্টে খুঁজে না পেলেও তার এক বন্ধুকে পেল। সেই মারফতে খবর পেল আশরাফ আজ ভার্সিটিতে আসেনি। আশরাফের ঠিকানা নিয়ে কড়ি সেখানে গেল। আশরাফ তার বন্ধুদের সাথে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে। দরজা খুলে কড়িকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেল সে। ভরকে যাওয়া গলায় বলল, “তুমি? তুমি এখানে?”
“কেমন আছেন ভাইয়া?”
“এই তো ভালো।”
“আপনি এভাবে ঘামছেন কেন?”
“না, আমার শরীরটা তেমন ভালো না আজ। তাই ক্লাসেও যেতে পারিনি।”
“শরীর কী বেশি খারাপ? একটু কথা বলতে চেয়েছিলাম।”
আশরাফ হাতের উল্টোপিঠে কপালের ঘাম মুছে বলল, “না বলো।”
“ভেতরে এসে কথা বলি।”
আশরাফ দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। কড়ি চট করে ভেতরে ঢুকে এ ঘর ও ঘর যেতে লাগল। তার ধারণা রামিম এখানেই আছে। আশরাফ অধীর হয়ে পড়ল। বলল, “করছ কী? করছ কী?”
কড়ি জবাব দিলো না। সে অনেকটা ছুটে ছুটেই পাঁচ রুমের এই ফ্ল্যাটটা ঘুরে রামিমকে খুঁজল। বাথরুম আর বারান্দাও বাদ রাখল না। রান্নাঘরেও দেখে ফেলল, কিন্তু রামিম নেই। কড়ি হতাশ হয়ে বিছানায় বসল। বলল, “রামিম কোথায়?”
আশরাফ রূঢ় কণ্ঠে বলল, “ও কোথায় আমি কী করে জানব?”
“ওর বাড়ি দিনাজপুর না?”
“হ্যাঁ।”
“বাসার ঠিকানাটা আমার একটু লাগবে।”
“আমি ওর বাসার ঠিকানা কী করে জানব?”
“আপনি তো ওকে দিনাজপুর থেকেই চিনেন। আপনিও সেখানকার। বেস্টফ্রেন্ড এর বাসার ঠিকানাও জানেন না?”
“না, জানি না। সে নিজের পরিবার থেকে সবাইকেই দূরে রাখে। তুমি তা খুব ভালো করেই জানো।”
কড়ি দু’হাতে মুখ ঢেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আশরাফ কড়িকে বিদায় করতে বলল, “আমি এখন বেরুবো।”
কড়ি মুখ থেকে হাত সরিয়ে আশরাফের দিকে তাকাল। তার চোখের দৃষ্টি শীতল আর স্থির। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আশরাফ তাড়া দিয়ে উঠল, “কিছু মনে না করলে এখন তুমি আসতে পারো।”
কড়ি উঠতে যাবে তখনি কলিংবেল বেজে উঠল। আশরাফ দরজা খুলতে চলে গেল। দরজা খুলে দেখলো মুনিরা এসেছে। মুনিরার হাতে স্টিলের বড় টিফিন ক্যারিয়ার। আশরাফ অবাক, “আজ হঠাৎ এখানে?”
মুনিরা আশরাফের কপালে হাত দিয়ে জ্বর মাপতে মাপতে বলল, “তোমার জন্য রান্না করে নিয়ে এসেছি। জ্বর হলে এমনি মানুষ কিছু খেতে পারে না। তার উপর তোমাদের বুয়ার রান্নার যে প্রশংসা শুনেছি তোমার মুখ থেকে!”
মুনিরা আশরাফকে হাত দিয়ে ঠেলে দরজা থেকে সরাল। ভেতরে ঢুকল সে। এই বাসায় ড্রয়িংরুম, ডাইনিংরুম বলতে কিছু নেই। সবকটা ঘরকেই ছেলেরা শোবার ঘর বানিয়ে রেখেছে। কড়ি আশরাফের ঘরে বসেছিল। সে মুনিরার কথা আগে শুনেছে তবে পরিচয় নেই। ফেসবুকে আশরাফ আর মুনিরার ছবিও দেখেছে। কড়ি চট করে গায়ের ওড়নাটা খুলে ফেলল। ওড়না পাশে রেখে চুলের খোঁপা খুলল। চুল সামনে এনে নিজেকে আবৃত করে ঝিম মেরে বসে রইল। মুনিরা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে এ ঘরে এসে হতভম্ব হয়ে গেল। আশরাফ দরজা বন্ধ করে মুনিরার পেছনে এসে দাঁড়াতেই খেয়াল করল টিফিন ক্যারিয়ার মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কড়ি আর মুনিরা দুজন দুজনার মুখোমুখি। দুজনেই নির্বাক, স্তব্ধ। মুনিরার চোখ বিস্ফারিত, চাহনী জুড়ে রাজ্যের অবিশ্বাস। আশরাফ একবার মুনিরার দিকে তাকাল, একবার কড়ির দিকে। সে কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তখনি মুনিরার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়তে শুরু করল। আশরাফ তড়িঘড়ি করে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করল, “আরে আরে তুমি ভুল বুঝছ, মুনিরা। ও কড়ি। আমার বন্ধু রামিমের….”
বাকিটুকু আর বলে শেষ করতে পারল না সে। তার আগেই মুনিরা সপাটে চড় বসাল তার গালে। কড়ি বিছানায় রাখা ওড়নাটা নিয়ে গায়ে চরাল। এই দৃশ্য দেখে আশরাফের চোখ কপালে উঠে গেল। সে গালে হাত চেপে রেখে কড়িকে প্রশ্ন করল, “তুমি কী পাগল, কড়ি?”
কড়ি বলল, “মেয়েদের কত সুন্দর করে তোমরা ধোঁকা দাও, আশরাফ।”
“আশ্চর্য! এভাবে কথা বলছ কেন? আমি তোমার সিনিয়র।”
“ওহ্ ক্লাস বাঙ্ক করে জুনিয়রদের বাসায় নিয়ে এসে ফস্টিনস্টি করার অপর নাম জ্বর, অসুস্থতা তাই না? এত অসুস্থ তুমি আর তোমার মানসিকতা!” মুনীরার সারা শরীর কাঁপছে। চোখে – মুখে আগুনের লেলিহান।
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৭
আশরাফ মুনিরাকে শান্ত করতে ওর কাঁধে হাত রাখল, “দয়া করে, আমার কথা শুনো।”
মুনিরা ত্বরিত আশরাফের হাত সরিয়ে দিল, “ছুঁবে না আমায়।”
আশরাফ ছটফট করে উঠল, “ভুল বুঝছ আমায়। ও মিথ্যে বলছে।”
“ও ত কিছু বলেনি। যা দেখার আমার চোখ দেখেছে। যা বুঝার আমি বুঝেছি।”
আশরাফ মুনিরার দিকে এগিয়ে গেল। মুনিরা আশরাফের বুকে দু’হাতে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে বেরিয়ে গেল। আশরাফ কড়ির দিকে অগ্নিদৃষ্টি ছুঁড়ে দিলো, “আমি তোমাকে ছাড়ব না, কড়ি। আই ওন্ট স্পেয়ার ইউ।” “আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।” কড়ির ঠোঁটের কোণায় স্মিত হাসি।
আশরাফ দাঁতে দাঁত পিষল। আঙুল তুলে বলল, “তোমাকে আমি পড়ে দেখ নিব।”
তারপর মুনিরার পিছন পিছন ছুটে বেরিয়ে গেল। মুনিরাকে যে কোনো মূল্যে বুঝাতে হবে এসব মিথ্যা, বানোয়াট। কিছুই সত্য নয়। প্রাণটা হাতে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নামল সে। মুনিরা একদম শেষ সিঁড়িটায় বসেছিল। ওর পা চলছে না। পাগুলো সর্বশক্তি হারিয়ে এখানেই পড়ে রয়েছে। শরীরটা বয়ে নিয়ে যাওয়ার অবস্থাতেও সে আর নেই। রেলিং এ মাথা ঠেকিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে সে। চোখের কোলে জলের অভাব না থাকলেও বুকের ভেতর ফেটে চৌচির। আশরাফ গিয়ে মুনিরার সামনে হাঁটু ভেঙে বসল। দু’হাতে মুনিরার মুখটা তুলে ধরে চোখে চোখ রাখল, “বিশ্বাস করো মুনিরা, দয়া করে বিশ্বাস করো। প্লিজ বিশ্বাস করো। দোহাই লাগে বিশ্বাস করো।”
আশরাফের জ্বরমাখা উষ্ণ হাতের ছোঁয়ায় মুনিরা যেন আরো পুড়ে গেল। পুড়ে ছাই হয়ে গেল। ওর হাত সরিয়ে টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। কাঁচি গেইটটার দিকে এগিয়ে গিয়েই পড়ে গেল। আশরাফ উঠাতে সাহায্য করতে চাওয়ায় বলল, “প্লিজ দূরে থাকো।”
আশরাফ সর্বশক্তি দিয়ে গেইটটায় একটা লাথি বসাল। এরপর সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল আবার। বাসায় গিয়ে কড়িকে বলল, “এই মেয়ে শুনো রামিম কোথায় আমি জানি না। তবে ওর বাড়ির ঠিকানা আমি তোমায় দিতে পারি।”
“আমাকে রামিমের কাছে নিয়ে চলো, আশরাফ।”
আশরাফ গলা ফাঁটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “ডোন্ট কল মি আশরাফ। সে আশরাফ ভাইয়া।”
“পৃথিবীতে আপনিই বোধহয় একমাত্র ছেলে যে কিনা কেঁদেকেটে ভাইয়া শুনতে চাইছেন।” কড়ি হেসে ফেলল।
“এক থাপ্পরে সব হাসি বের করে দিব বেয়াদব মেয়ে।”
“ভদ্রভাবে কথা বলুন।” কড়ি সতর্ক করে দিলো।
আশরাফ হাত মুঠো করে আত্মসংবরণ করল। তারপর অনুনয়ের গলায় বলল, “কড়ি, লিসেন টু মি। তুমি আমায় মেরে ফেললেও আমি ওর খবর দিতে পারব না। কারণ আমি সত্যি বলছি সে কোথায় জানি না।”
কড়ি আশরাফের দিকে কেমন করে যেন তাকাল। বিশ্বাস হলো কথাটা। তাই বলল, “এড্রেস লিখে দিন।”
“তুমি আগে মুনিরাকে সব সত্য বলো।”
“আগে ঠিকানা তারপর বাকিসব।”
“পরে যদি তুমি ওকে সত্য না বলো?”
“কথা দিলাম বলব।”
আশরাফ মোবাইল বের করে ঠিকানাটা মেসেজ করল কড়িকে। কড়ি মেসেজটা চেক করে বলল, “যদি ঠিকানা ভুল হয় তবে আমার চাইতে খারাপ আর কেউ হবে না, আশরাফ ভাইয়া।”
“ভুল না।”
“মুনিরা আপু কোথায়?”
“নীচে।”
কড়ি দ্রুত নীচে নামল। কড়ির পেছন পেছন আশরাফও নামল। মুনিরা নীচে নেই। আশরাফ গেইট থেকে বেরুলো। মুনিরা রিকশায় উঠে গেছে। আশরাফ লাফ দিয়ে রিকশায় মুনিরার পাশে উঠে বসে মুনিরা হাত চেপে ধরল। মুনিরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই কড়ি ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “স্যরি আপু। আমি আসলে আশরাফ ভাইয়ার বন্ধু রামিমের এক্স। রামিমের সাথে বাসা থেকে পালিয়েছিলাম। রামিম আমার গয়নাগাটি নিয়ে আমাকে ফেলে চলে গিয়েছে। ওকে খুঁজছি আমি। আশরাফ ভাইয়ের কাছ থেকে ওর ঠিকানা আদায় করতে বাধ্য হয়ে এসব করেছি। আপনি আশরাফ ভাইয়াকে ভুল বুঝবেন না। উনি সত্যি বলছেন। আপনার জন্যে উনি সমগ্র ছেলে জাতির বিপক্ষে গিয়ে ভাইয়া ডাক শুনবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। আপনাদের একসাথে ভালো দেখায়। সবসময় একসাথে থাকুন। তবে চোখে চোখে রাখবেন। সঙ্গদোষে লোহা ভাসে। রামিমের মতন অসভ্যদের সাথে মিশতে দিবেন না।”
একটানা কথাগুলো বলে কড়ি ঘুরে হাঁটা শুরু করল। রোদ বাড়ছে। চোখে, মুখে রোদ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে বলে কড়ি ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে সানগ্লাসটা বের করে চোখে দিলো। মুনিরা হা করে সেদিকে তাকিয়ে আছে। সে থ বনে গেছে।
দীপা তাড়া দিলো, “এরপর? এরপর?”
“এরপর আর কী?”
কড়ি জানালার ধার থেকে সরে এলো। দীপা উদগ্রীব হয়ে বলল, “আরে এরপর রামিমের বাড়ি যাওয়ার পর কী হলো?”
“সে এক বিশাল কাহিনী। পড়ে একদিন বলবনে তোমায়। এখন ইচ্ছে করছে না।”
“উফ আমার এখনি শুনতে ইচ্ছে করছে।”
“পরে শুনো, সুন্দরী।”
“না, না এখনি।” দীপা ঘ্যানঘ্যান করতে লাগল। তবুও শেষ পর্যন্ত সে কড়িকে কড়ির ইচ্ছের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলাতে পারল না। কড়ি একসময় বলল, “আচ্ছা বলব তবে একটা শর্ত আছে।”
“কী শর্ত?” দীপা অস্থিরতার শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছে। কোনো কথা অর্ধেক শুনে বাকিটা আর জানতে না পারলে ওর জীবনে অক্সিজেনের ঘাটতি ঘটে। শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়।
“তাহমিদ এর সাথে জড়িয়ে থাকা সবকিছু এখন এই মুহূর্তে আমার সামনে তোমার পুড়িয়ে ফেলতে হবে। ওর ছবি থেকে শুরু করে সব।”
দীপা ধপ করে নিভে গেল। গাল ফুলিয়ে ফেলল চট করে। তবে জানবার ইচ্ছা আর দমিয়ে রাখতে পারল না। বলল, “আচ্ছা এসো পুড়িয়ে ফেলি।”
কড়ি দেখলো দীপা ড্রেসিংটেবিল এর লক খুলে একটা বড় কাঠের বাক্স বের করল। কড়ি বাক্সের মুখ খুলে দেখল বিভিন্ন ডিজাইনের কানের দুল, মালা, চুড়ি, ব্রেসলাইট দিয়ে বাক্স বোঝাই করা। দীপাকে প্রশ্ন করল, “এগুলো সব গিফ্টস?”
“হ্যাঁ, ও দিয়েছিল। আরো আছে।” বলেই আলমারির নীচের তাকে রাখা কম্বলের নীচ থেকে একটা আইস্ক্রিমের বক্স বের করল। কড়ি বলল, “এটায় কী?”
“ওর আর আমার ছবি। আমি ছবি তুলতে প্রচন্ড ভালোবাসি আর ওয়াশ করাতেও। আইস্ক্রিমের বক্সে রেখেছি যেন কেউ দেখতে না পায়।”
সে বক্স খুলে ছবিগুলো উল্টে মেঝেতে ফেলল। এরপর ম্যাচের বক্সে দেশলাইকাঠি ঘষে আগুন জ্বালল। কাঠিটা ছবিগুলোর উপর ফেললেও আগুন জ্বলছে তার বুকে। দীপা কাঁদছিল খুব। কড়ি স্বান্তনা দেবার ভঙ্গিতে দীপার পাশে দাঁড়িয়ে দীপার কাঁধ চেপে ধরল। আর তখনি তার চোখ আটকে গেল আগুন ধরে যাওয়া একটা ছবিতে। দীপাকে ছেড়ে দিলো সাথে সাথে। ঝুঁকে পড়ে ছবিটা হাতে তুলে নিলো। চোখ বড় বড় হয়ে কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার দশা হলো প্রায়। ভ্রু কুঁচকে অবিশ্বাসের গলায় বলল, “এ কে?”
দীপা বলল, “যার জন্য মরতে বসেছিলাম সে।”
আগুনের আঁচে কড়ির হাত জ্বলছিল তবুও ছবিটা কিছুতেই ছাড়তে পারল না। শেষে যখন একদম আগুন আঙুলে পৌঁছে যাচ্ছিল তখন হাত ফসকে পড়ে গেল ছবিটা। কড়ি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না।
চলবে…

একা তারা গুনতে নেই পর্ব-৪+৫

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৪
নিলয় আর ইমাদ একই মেসে একই রুমে থাকে। ইমাদের চৌকিটা জানালা ঘেঁষে রাখা। বৃষ্টির ছাটে চৌকির চাদর আর নীল শার্টে ঢাকা ইমাদের পিঠ ভিজে যাচ্ছে। নিলয় বলল, “জানলা লাগিয়ে নে না।”
ইমাদ জানালার গ্রিলে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে। তার চোখ দুটো বন্ধ। বন্ধ চোখের পাতার ভেতরে বারবার দীপুর মুখটা ভেসে আসছে। দীপু এখন কী করছে? সে ডাকল, “নিলয়?”
নিলয় বিছানায় আঁটা মশারীর ভেতর থেকে মাথা বের করে বলল, “ইয়েস।”
“তোর কোনো কাজ আছে এখন?”
“না। বারোটা পর্যন্ত ফ্রি।”
“তাহলে চল একটু ঘুরে আসি।”
“কই যাবি?”
ইমাদ ততক্ষণে বিছানা ছেড়ে নেমে গেছে। জানালা টেনে বন্ধ করে দরজার দিকে যেতে যেতে বলল, “তোর ছাতাটা নিয়ে আয়। আমারটা ভেঙে গেছে।”
নিলয় ঝিমোতে ঝিমোতে ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত টানানো দড়ির দিকে উঠে গেল। এলোমেলো কাপড়ের এর স্তূপ থেকে নিজের একটা শার্ট টেনে গায়ে চড়াল। দেয়ালে আঁটা পেরেক থেকে লম্বা হাতলের ছাতাটা নিয়ে ইমাদের পেছন পেছন বেরুলো। ইমাদ বিল্ডিং এর কার্নিশের নীচে দাঁড়ানো। নিলয় এসেই একটা রিকশা ডাকল। হুড ফেলে দুজন রিকশায় উঠল। নিলয় ছাতা ধরে রাখল। ইমাদ হাতেরর ভাঁজে হাত গুটিয়ে বসে রিকশাচালককে হাসপাতালে যেতে বলল। নিলয় বলল, “ওহ দীপুর কাছে যাচ্ছি।”
ইমাদ চুপচাপ বৃষ্টি দেখছে। সে নিলয়ের কথায় শুধু মাথাটা উপর নীচ নাড়ল।
ছাতা চুপসে পড়া পানিতে আধভেজা হতে হতে দুই বন্ধু হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছুল। সেখানে দীপার মায়ের সাথে তাদের দেখা হয়ে গেল। ইমাদ দীপার মাকে সাথে নিয়ে রিসিপশনে খানিকক্ষণ কথা বলল। তারপর উপরে দীপার কেবিনে গিয়ে বলল, “হ্যালো।”
দীপা দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়েছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে ইমাদ আর নিলয়কে দেখে হাসার চেষ্টা করল। ইমাদ বলল, “তোকে নিতে এসেছি।”
দীপা উঠে বসে বলল, “আম্মু কোথায়?”
নিলয় বলল, “আন্টির সাথে দেখা হয়েছে। গ্রাউন্ডফ্লোরে অপেক্ষা করছেন।”
দীপাকে নিয়ে ওরা দুজন নীচে নেমে এল। ইমাদ দীপার মাকে বলল, “আন্টি দীপু আমাদের সাথে আসুক?”
“তোমরা পৌঁছে দিবে বাসায়?” তিনি খানিক বিভ্রান্ত।
“হ্যাঁ। আপনি চিন্তা করবেন না।”
দীপার মা যেতে চাইলেন না। নিলয় জোর করে একটা রিকশা ডেকে দীপার মাকে উঠিয়ে দিলো। এরপর ফিরে এসে চোখে প্রশ্ন নিয়ে ইমাদের দিকে তাকাল। ইমাদ বলল, “কী?”
নিলয় জানতে চাইল, “এরপর কী?”
“আমরা হেঁটে ফিরব। পারবি না হাঁটতে?” দীপার দিকে তাকাল ইমাদ।
ওরা তিনজন হেঁটে বাড়ি ফিরছে। নিলয় আর ইমাদ একটা ছাতার নীচে হাঁটছে। দীপা ওদের সামনে। দীপা একা একা ভিজছে আর দুলতে দুলতে হাঁটছে। ইমাদ পেছনে থাকায় দীপার চোহারাটা ঠিকঠাক দেখতে না পারলেও সে জানে তাহমিদ ছাড়া দীপু যদি আর কিছু পাগলের মত ভালোবেসে থাকে তা হলো বৃষ্টি। বৃষ্টি এলেই সে কেমন উথালপাতাল হয়ে যায়।
.
দীপার বারান্দায় বসার আয়োজনটা বেশ। মেঝেতে বড় বড় তিন চারটে কুশন বিছানো। হেলান দিয়ে বসার জন্য ছোট ছোট কুশনও রাখা। চারিদিকে ফুলের টব। নিলয় আর ইমাদ আরাম করে বসে আছে। দীপা মাথায় টাওয়াল বেঁধে বারান্দায় এসে বসতে বসতে বলল, “আমি বোধহয় তাহমিদের চেয়ে ঝড়বৃষ্টিকেই বেশি ভালোবাসি। শুধু শুধু মরতে যাচ্ছিলাম। মরে গেলে আর কখনে বৃষ্টি ভেজা হতো না।”
নিলয় ইমাদের দিকে তাকাল। ইমাদের ঠোঁটের কোণায় শিশিরকণার মতন ছোট প্রায় নাই নাই একটি হাসি লেগে আছে। নিলয় ওর দিকে তাকাতেই হাসিটা মুছে ফেলল চট করে। নিলয় হেসে ফেলল। বলল, “ইমির বাচ্চা বহুত শেয়ানা।”
দীপা ইমাদের গাল টেনে দিতে হাত বাড়াল। ইমাদ দূরে সরে গেল। গমগম করা গলায় বলল, “তোর ভাই ইলাভেনে পড়ে না? ওর ম্যাথ বইটা একটু নিয়ে আয়। আর সাথে একটা কাগজ আর কলম। সন্ধ্যেয় টিউশনীতে যেতে হবে। স্টুডেন্ট এর পরীক্ষা নিব বলেছিলাম। প্রশ্নটা তৈরী করে ফেলি।”
দীপা ইমাদকে ভেঙচি কেটে ছোট ভাইকে ডাকল। দীপার ভাই বই, কাগজ আর কলম দিয়ে গেল। সাথে গরম গরম খিচুড়ি। ইমাদ সবার আগে খিচুড়িটা খেয়ে নিলো। এরপর বই খুলে প্রশ্ন তৈরীতে লেগে পড়ল। দীপা আর নিলয়ের এখনও খাওয়া শেষ হয়নি। ওরা খেতে খেতে গল্প করছে। দীপা গড়গড় করে বলছে, “তোর সাথে ত কড়ির দেখা হয়নি। দেখা হলে বুঝতিস কী ডেঞ্জারাস মেয়ে!”
“ডেঞ্জারাস বলছিস কেন?” নিলয়ের প্রশ্ন।
“সে একজনকে পাগলের মতন ভালোবাসতো। তাকে ভালোবেসে বাবা- ভাইদের ঠকাল। তার হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল।”
“তারপর?”
“তারপর সেই ছেলেটা তাকে ফিলিং স্টেশনে একা ফেলে, রাতের অন্ধকারে তার গয়নাগুলো নিয়ে চলে গেছে।”
নিলয় চোখেমুখে বিরক্তি নিয়ে বলল, “এই মেয়ে এত বলদ কেন?”
“বলদ বলছিস কেন?” দীপার মুখটা কালো হয়ে গেল।
“বলদই তো। বুদ্ধি থাকলে কেউ বাড়ি থেকে পালায়? তাও আবার গয়না সমেত!”
“না, না। মেয়েটা গয়না নিয়েছে অন্য কারণে।”
“কী কারণে?”
“ওর মা উত্তরাধিকারসূত্রে নিজের দাদীর কাছ থেকে অনেক গয়না পেয়েছিলেন। তার মা ছিলেন দুই প্রজন্ম পর হওয়া একমাত্র মেয়ে সন্তান। তাঁদের বংশ হলো ছেলের কারখানা।মেয়ে নেই। তাই ওর মা বিয়ের সময় অনেক গয়না পেয়েছিলেন। ওর মায়ের বাপ-চাচারা একমাত্র মেয়েকে স্বর্ণে মুড়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়েছিলেন। কড়ির মা করেছিলেন কি তার সব গয়নাগাটি তার চার ছেলে মেয়ের জন্য সমান ভাগে ভাগ করে রেখে গিয়েছিলেন।”
“জায়গাজমির মত গয়নাগাটিরও উইল আছে নাকি?” নিলয় ঠাট্টা করে হেসে ফেলল।
দীপা ব্যাখা করল, “তিনি আসলে অনেকদিন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়েছিলেন ত তাই আগেভাগেই মৃত্যুর রূপ দেখে ফেলেছিলেন। তাই নাকি গয়নাগাটি ভাগ করেছিলেন।”
“ওহ বুঝতে পেরেছি, কিন্তু ঐ মেয়ে গয়নাগাটি সাথে নিলো কেন?”
“মায়ের শেষ স্মৃতি হিসেবে নিয়েছিল। ওর বাবার রাগ খুব। মেয়ে পালিয়েছে শুনলে মেয়েকে তিনি আর কখনো বাড়িতে ফিরতে দেবেন না। আর না কখনো তার মায়ের রেখে যাওয়া শেষ স্মৃতিগুলো ছুঁতে দেবেন।”
“মেয়েটা পালাল কেন? বাড়িতে মেনে নেয়নি?”
“হ্যাঁ, ওর বাবা মানেননি।”
“ফর হোয়াট?”
“ছেলেটা ড্রপ আউট করা ছাত্র। অনার্স এ ভর্তি হয়েও থার্ড ইয়ারে উঠে ছেড়ে দিয়েছিল। ইন্টার পাশ ছেলের কাছে কে মেয়ে দিবে? কড়ির বাবা আবার পড়াশুনা নিয়ে খুব কঠোর। ভালো ছাত্রদের সুনজরে দেখেন।”
“আচ্ছা।” নিলয় সুর তুলে টেনে টেনে বলল।
দীপা নিলয়ের হাতে খামচে দিলো, “তুইও ইমির মত আচ্ছা আচ্ছা শুরু করলি? আচ্ছা শুনলেই আমার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে। দেখ না ফাজিলটা কেমন! অামাদের আড্ডায় কখনো ওকে পাই না আমরা। এই তুই বই রাখ বলছি। এখনি রাখ।” দীপা বইটা ইমাদের সামনে থেকে সরিয়ে নিলো। ইমাদ জোর করে বইটা ফিরিয়ে নিয়ে আবার নিজের কাজে মনোযোগী হলো।
দীপা ইমাদের চুল টেনে দিলো রাগে। নিলয় হাসতে হাসতে বলল, “রোবটাকে এবার ক্ষ্যামা দেরে, দীপু। ওকে ওর কাজ করতে দে। তুই আমায় বাকিটা বল। ও তো সেদিন সেখানে তোদের সাথেই ছিল। সব শুনেছে না একবার? এক কথা কয়বার শুনবে?”
“আমি এক কথা বারবার বলি?” দীপা রেগে আগুন।
নিলয় বলল, “না, না তা বলিনি। আচ্ছা আচ্ছা এরপর বল নারে মা। উফ তুই আরেকটা।”
ইমাদ অবশ্য সেদিন কিছুই শুনেনি। পাশে বসে থাকলেও নিজের ভাবনার জগতেই সে বিচরণ করছিল। তবে আজ সে সবই শুনছে। দীপারা অতসব বুঝে না।
ইতোমধ্যে দীপা আধা বিরক্তি আধা উৎসাহ নিয়ে আবার নিজের কথারভান্ডার খুলে বসেছে, “কড়ি যখন টের পেল ছেলেটা তাকে ছেড়ে চলে গেছে সে কী করেছে জানিস?”
“না বললে জানব কী করে?”
দীপা বিস্ময় ভরা চোখ নিয়ে অবিশ্বাসের গলায় বলছে, “সে কান্নাকাটি না করে সুন্দর মত তার বাসায় ফিরে গেছে। বাসায় ফিরে গিয়ে আবার ভাইদের কলও করেছে। বলল, বাসায় চুরি হয়েছে। বাসায় তেমন টাকা পয়সা ছিল না। তাই চুরি হলে তো গয়নাই চুরি হবে। সন্দেহ জন্মাবার কোনো পথ থাকবে না।”
“সে যে পালিয়েছে তার বাবা আর ভাইয়েরা তখনো টের পায়নি না?”
“না। ওর ভাগ্য ভালো ছিল। ওঁরা ওর চাচাতো ভাইয়ের বিয়েতে ছিল।”
“আরিব্বাস!” নিলয়ের মাথায় হাত।
দীপা বাকিটা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ল। সে উতলা হয়ে বলল, “বড় ভাইয়ের ভাগের অংশ তার বউয়ের কাছেই। আর বাকিসব তার বাবার আলমারিতে ছিল। সে তার ভাগের গয়না নিয়ে পালিয়েছিল,কিন্তু বাকি দুই ভাইয়ের ভাগের গয়নাগুলি ত ছিলই। সে ওগুলোও লুকিয়ে ফেলল। নাহলে ত ধরা খাবে।”
“ইয়েস চোর নিলে শুধু ওরগুলোই কেন নিবে?” নিলয় শব্দ করে এক হাত দিয়ে নিজের অন্য হাতে চাপড় মেরে উঠল। সে আরো বলল, “ভাবা যায়! তুইও মেয়ে আর এই মেয়েও মেয়ে। অন্য একটা মেয়ের জন্য তোর বয়ফ্রেন্ড তোর সাথে ব্রেকআপ করায় তুই দুই দুইবার হাতটাত কেটে সুইসাইড এটেম্প নিয়ে ফেলেছিস।”
দীপা একমত হয়ে গালের দুপাশে হাত ছুঁয়াল। তওবা কাটতে কাটতে বলল, “সেটাই তো। আর না বাবা। আর না। ওকে দেখে শিক্ষা নিলাম।”
নিলয় ইমাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “অ্যাই, ইমি। ওকে পেলি কই তুই?”
ইমাদকে উত্তর দিতে হলো না। দীপাই বলে দিলো, “ইমি সে রাতে ওই ফিলিং স্টেশনেই ছিল। ওর কী একটা কাজে যেন গিয়েছিল। পরে কড়িদের দেখতে পায়। আর আমার আউলাবাউলা মাথাটা ঠিক করতে কড়িকে খুঁজে নিয়ে আসে।”
“রোবট বহুত কাজের।” নিলয় গর্বের হাসি হাসছে।
দীপা একটা দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিশিয়ে দিলো। বলল, “তোরা না থাকলে আমার যে কী হতো!”
নিলয় বলল, “তুই না থাকলে আমাদেরই চলে না। তুই হলি আমাদের নিউজরিডার। সবখানের সব খবর তোর কাছেই ত ফ্রিতে পাওয়া যায়।”
দীপা হঠাৎ আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেল। নিলয়ের ডাকে সম্বিৎ ফিরল তার, “হু ডাকছিলি?”
“হ্যাঁ। কড়ির বফ ওকে ছেড়ে কেন চলে গেল এ বিষয়ে কিছু বললি না যে?”
“কড়ি নিজেও জানে না কেন ওকে ছেড়ে চলে গেল।”
“গয়নার জন্য হতে পারে।”
“না গয়নার জন্য হবে না। ও বড় লোকের ছেলে।”
“মিথ্যে বলেনি ত আবার?”
“না। এটা সত্যি যে ও বড়লোকের ছেলে। শুধু গয়নার জন্য ওকে ছেড়ে দিবে বিষয়টা কেমন না?”
“হুম তা ঠিক।”
“কড়ি বলেছে ও কেন এই কাজটা করল তা কড়ি জেনেই ছাড়বে।”
“ছেলেটার কোনো ক্ষতিটতি হলো না তো। লাইক এক্সিডেন্ট জাতীয় কিছু বা কেউ ধরে নিয়ে গেল?”
“কী জানি কতকিছুই হতে পারে।”
ইমাদ এর প্রশ্ন তৈরী করা শেষ। সে বইটা বন্ধ করে সৃজনশীল প্রশ্নগুলোতে আরো একবার চোখ বুলাল। কী ভয়ানক! সব প্রশ্ন ভুল! আবার সে ভুল করে ফেলেছে।
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫
শিল্পী ড্রেসিং টেবিল এর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিল। সে কী বুড়িয়ে যাচ্ছে? আর মঈন? আয়নার মধ্য দিয়েই সে বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে বই পড়তে থাকা মঈনের দিকে তাকাল। মঈনের চুলের জুলফি সাদা হতে শুরু করেছে। তার ঝরঝরে উশকোখুশকো চুলের মাঝেও এই কবছরে কতশত শুভ্র চুল গজিয়েছে। চামড়াও ঝুলে পড়তে শুরু করলো বলে! চোখে জুটেছে চশমাও। তবুও ওকে এত অপরূপ দেখায় কেন? পুরোনো টগবগে যুবকের মতই তাকে এত ভালোবাসে কেন শিল্পী? তার ভালোবাসা মরচে পড়ে পুরোনো হতে পারে না? পুরোনো হতে হতে একদম ঝাপসা হয়ে সব স্মৃতি মুছে যেতে পারে না? সেইসব স্মৃতি যেসবে আটকে আছে সে আর মঈন। না মঈন ত আটকে নেই! সে আবারো ভুল ভাবতে বসেছে। আজীবন শুধু ভুলই ভেবে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে টুলে বসল। হাতে, গলায় লোশন মাখতে মাখতে ডাকল, “মঈন?”
প্রত্যুত্তরে মঈন বিরক্তির একটা শব্দ করল। শিল্পী নিঃশব্দে হাসল। বলল, “ঐ মেয়েটা তোমার নাম ধরে ডাকলেও কী তুমি এভাবে বিরক্ত হও?”
“আমি তুমি ছাড়া আর কিছুতে বিরক্ত নই।” মঈন বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল।
“আমি না ভুলেই গিয়েছিলাম।”
শিল্পী মঈনের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। ভেবেছিল মঈন কিছু বলবে, কিন্তু কিছুই বলল না। শিল্পীই অনেকটা সময় পর বলল, “কী ভুলে গিয়েছিলাম জানতে চাইবে না?”
মঈন বইটা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। স্পষ্ট এড়িয়ে গেল তাকে। শিল্পী তবুও বলল, “আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে তুমি বলেছিলে জীবনে যদি আবার কাউকে দ্বিতীয়বারের মতন ভালোবাসতে পারো তবে আমায় ছেড়ে যাবে। কথাটা বহুকষ্টে ভুলেছিলাম। কেন মনে করিয়ে দিলে আবার?”
মঈন হাত বাড়িয়ে এবার টেবিলল্যাম্পটা নিভিয়ে দিলো। শিল্পী বসে রইল অন্ধকারে। ভেতরটা এত ছটফট করে! কেন করে? সে হাত দিয়ে মুখ ঢাকল। আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে ঝরে পড়ল তার শব্দহীন অশ্রু, অসহায়ত্ব। একটা সময় পর বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে এল সে। মঈনের পাশে লাশের মত একদম সোজা হয়ে শুয়ে পড়ল। দৃষ্টি নিবদ্ধ সিলিং এ।
কান্নারুদ্ধ গলায় জানতে চাইল, “কার জন্য আমায় ছেড়ে যাচ্ছ?”
“দিস ইজ নান অফ ইউর বিজন্যাস।”
“জানতাম এখনও ঘুমাওনি।”
মঈন আরো বিরক্ত হলো।
শিল্পী থেমে থেমে বলল, “আমায় আরো আগে ছেড়ে চলে যেতে? প্রথমেই ডিভোর্স নিতে। এই এতগুলো বছর পর এসে কেন এমন করছ? সত্যটা তো আর আজ জানোনি। বহু আগেই জেনেছ।”
“সত্য জানবার কথা বললে আমি বলব বিয়ের আগে থেকেই সব জানতাম আমি।”
শিল্পী হতবুদ্ধি হয়ে উঠে বসল, “কী বললে?”
“হ্যাঁ, আমি জানতাম। সব জানতাম।”
“সব জানতে তাহলে বিয়ে করলে কেন?”
“তোমায় শাস্তি দিতে।”
শিল্পী দু’হাতে নিজের মাথা চেপে ধরল। কান্না থেমে গেছে তার। মঈন তাহলে এজন্য বিয়ে করেছিল তাকে! এজন্যে? বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো না তার। বুকের ভেতরটা ভেঙে গেল। চোখের সামনে দ্রুতগামী ট্রেনের মতন দাপটে বেড়াতে লাগল বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলি। পুরোনো মঈন যে ট্রেনের একমাত্র যাত্রী সে ট্রেন বুকের মাঝে ছুটার শব্দ শিল্পী আর নিতে পারছে না। ভেতর পিষে স্মৃতিরা এমনভাবে ছুটে চলছে কেন? অসহ্য!
শিল্পী বলে উঠল, “মুবিন আমার কাছেই থাকবে। আমার ছেলে আমার কাছে থাকবে। তুমি যেদিকে ইচ্ছে চলে যাও। যার কাছে ইচ্ছে চলে যাও। আমি তোমায় আর কখনো আটকাব না, কিন্তু আমার ছেলে আমার কাছে থাকবে।”
মঈনও এবার উঠে বসল, “মুবিন আমার কাছে থাকবে।”
“মিলা তোমার সাথে থাকবে।”
“না। আমি মুবিনকে কোথাও নিয়ে যেতে দিব না। মিলাকে রাখতে না চাইলে রেখো না। মিলা, মুবিন দুজনই আমার সাথে থাকবে।”
“ওয়াও। আজো তুমি সেলফিস’ই রয়ে গেছ। একদম আগের মতন! আজো শুধু নিজেরটাই ভাবো। তুমি দুজনকেই রেখে দিলে আমি কাকে নিয়ে থাকব?”
“কেন তুমি তোমার প্রেমিকাকে নিয়ে থাকো। আমাকে আর আমার সন্তানদের তো তোমার দরকার নেই, মঈন।”
“রাগাবে না, শিল্পী। একদম রাগাবে না আমায়।” ভয়াল কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল সে।
শিল্পী হিসহিস করে উঠল, “এত রাতে চিৎকার করবে না। বাচ্চারা ঘুমাচ্ছে।”
“মুবিন আমার কাছেই থাকবে। আমার ছেলে আমি নিয়ে যাব। বাধা দিতে এসো না। তাহলে মেয়েকেও হারাবে।” মঈন বালিশ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। গেস্টরুমে ঘুমাবে সে। দরজা খুলতেই মিলাকে দেখতে পেল। নরম গলায় জানতে চাইল, “এখনো জেগে আছ?”
“পড়ছিলাম, বাবা।”
“তাহলে এখানে কী করছ? যাও নিজের ঘরে যাও।”
“পানি খেতে এসেছিলাম।”
মিলার হাতে পানির গ্লাস। মিলা পানি সহ গ্লাসটা ডাইনিং টেবিলে রেখে নিজের ঘরে চলে গেল। পানি খেতে আর ইচ্ছে করছে না তার।
মঈন অনেকক্ষণ দরজা ধরেই দাঁড়িয়ে রইল। শিল্পী চোয়াল শক্ত করে বলল, “যাচ্ছ না কেন? দরজা খোলা থাকলে আমি ঘুমোতে পারি না।”
মঈন অনেক বেশি শব্দ করে দরজাটা বন্ধ করে বেরিয়ে গেল। সে শব্দে শিল্পী কেঁপে উঠে দু’হাতে কান চেপে ধরল।
.
“হ্যালো, কে বলছেন?” দীপার ঘুমঘুম কণ্ঠ।
“আমি কড়ি বলছি। তোমার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। তুমি রিলিজ নিয়েছ জানতাম না।”
“তুমি এখন হাসপাতালে?” দীপা ঝট করে উঠে বসল। ঘুম কেটে গেছে তার।
“হ্যাঁ।”
“তুমি আমার বাসায় এসে পড়ো। তোমার সাথে দেখা করতে পারলে সত্যিই আমি অনেক খুশি হবো।”
“উমমম হাসপাতাল থেকে বেশি দূরে না তো?”
“না, না বেশি দূরে না। আমি এড্রেসটা দিয়ে দিচ্ছি। তুমি একটা রিকশা নিয়ে চলে এসো প্লিজ।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
চলবে…

একা তারা গুনতে নেই পর্ব-২+৩

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ২
দিপু শেষ পর্যন্ত মরেনি। ইমাদ দিপুর সাথে দেখা করতে হাসপাতালে এল তিনদিন পর। দিপু হাসপাতালের বেডে শুয়ে অসহায় চোখে ইমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। ইমাদ চেয়ার টেনে বসতে বসতে গলা উঁচিয়ে ডাকল, “আপনি কী একটু ভেতরে আসবেন?”
“দোস্ত, তাহমিদ এসেছে?” দিপু চাতকিনীর মতন ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করতে করতে এই আধমরা অবস্থাতেও উঠে বসল।
ইমাদ কিছু বলল না।
দিপু চোখ ঘুরিয়ে দরজায় তাকাল। না তাহমিদ ত আসেনি। সে দেখল লম্বা বেণুণী সামনে ফেলে রাখা, বড় বড় বিড়াল চোখের একটা মেয়েটা ভেতরে এল। পাতলা গোল মুখ,ভাসা ভাসা চোখ। দিপু ক্লান্ত স্বরে ইমাদকে বলল “আমিও কী পাগল তাইনা বল? ও আসবে কেন?” দিপু আবার শুয়ে পড়ল। মেয়েটি কোনো ভূমিকা না করে সোজা এসে দিপুর মাথার কাছে বেডেই বসল। ইমাদ পরিচয় করিয়ে দিলো, “ও হলো আমার বন্ধু দিপা। আমরা সবাই দিপু ডাকি।”
কড়ি দিপার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি কড়ি। আপনার কাছে আমার একটু দরকার আছে।”
“দরকার?” দিপা অবাক হল। এখনও দরকার ফুরিয়ে যায় নি তার!
কড়ি সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, “আমিও কী আপনাকে দিপু ডাকতে পারি?”
দিপা বিভ্রান্ত হয়ে ইমাদের দিকে তাকাল। ইমাদ মনোযোগ দিয়ে কমলা খাচ্ছে। একটু আগে দিপার বড় খালা দিপাকে দেখতে এসে এতসব ফলফ্রুট দিয়ে গেছেন। ইমাদ সেই প্যাকেট খুলেই কমলা খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। ওর দিকে না তাকিয়েই বলল-
“উনি তোর দলেরই লোক।”
“আমার দলের মানে?”
কড়ি তাদের কথায় বাগড়া দিলো, “আপনার কাছে ধার চাইতে এসেছি। কিছু সাহস আর দুঃখ ধার দিবেন? আপনার বড্ড সাহস। দুঃখেরও শেষ নেই।”
দিপা ভ্যাবলাকান্তের মতন হা করে কড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। এই বিষণ্ন সময়ে এত সব নাটকীয়তা তার পছন্দ হচ্ছে না।
ইমাদ এখন কমলা রেখে আঙুরে মন দিয়েছে। একটা বাটিতে আঙুর ভিজিয়ে রেখে টুপটুপ করে মুখে দিচ্ছে। আঙুরের দাম বেশি। দীপুর জন্য আঙুর আনার কথা সে ভাবতেই পারেনি। কমলা আনতে চেয়েছিল। দাম করল। ১৪০ টাকা কেজি শুনেই উল্টোপথে হাঁটা ধরেছে। জিনিসপাতির দাম শুনলেই তার ইচ্ছে করে বইয়ের পাতায় ডুব দিয়ে শায়েস্তা খানের আমলে চলে যেতে। এক টাকায় আট মণ চাল!
আচ্ছা এই বকবকে, কথা না শোনা, ফ্যাচফ্যাচে কাঁদুনি দীপুটাকে নিয়ে সে যাবে কোথায়! দীপু বোধহয় তার মাথাটা নষ্ট করে দিয়ে এরপর শান্তি হবে। কখনো কোনো কথা শুনেছে মেয়েটা? শুনবে কেমন করে? নিজে বলেই ত শেষ করতে পারে না। কতবার সে আর নিলয় বুঝাল তাহমিদ ছেলেটা ভালো না। শুনলই না। ব্রেকআপের পর আবার মরতে বসল। আরেকটুর জন্য তার আত্মা উড়ে যাচ্ছিল। কিছু যদি হয়ে যেত দীপুর! তাও ভালো কড়ি নামের এই মেয়েটিকে গত তিনদিন ধরে বহু আরাধনা করার পর পেয়েছে সে। কাজিনের বিয়েতে গিয়ে বসেছিল মেয়েটা। আর সে এদিকে তার বাড়ির সামনে রাতদিন ঘুরঘুর করেছে। দোকানদারের সন্দেহ দূর করতে মিথ্যে বলেছে। বলেছে এই এলাকায় টিউশনী করে। অথচ, এই এলাকায় সে এর আগে….
আচমকা শার্টের আস্তিনে টান পড়ায় ইমাদের চমক ভাঙল। দীপু হাত ধরে টানছে, “ইমাদ, তুই ওকে কোথা থেকে আবিষ্কার করলিরে?
আঙুর খাওয়ায় ব্যাঘাত ঘটায় ইমাদ মনে মনে বিরক্তির শেষ সীমানায় পৌঁছে গেল। তবে চেহারায় সেই বিরক্তির কোনো প্রকাশ নেই। সে অস্ফুট গলায় বলল, “ফুডপাণ্ডায় অর্ডার করলাম।”
দিপা ইমাদ থেকে বাটিটা কেড়ে নিলো। কড়ির দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, “নাও কড়ি আঙুর খাও।”
কড়ি আঙুরের বাটির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি টিয়া আঙুর খাই না।”
“কালো আঙুর খাও?”
“খাই।”
দিপা ইমাদের হাতে বাটিটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “ডানদিকের প্যাকেটটায় কালো আঙুর আছে। কালো আঙুর দে ওকে।”
ইমাদ বলল, “আচ্ছা।”
কড়ি আর দীপা আবার কথায় মন দিলো। একটু পর দীপা আবার রুষে উঠল, “ইমাদ!”
ইমাদ আঙুর খেতে খেতে ইমাদ মুখ তুলে বলল, “কী?”
“তোকে বলেছিলাম ওকে আঙুর ধুয়ে দিতে।”
“ও আচ্ছা।” ইমাদের আচ্ছা দীপুর ক্লান্তি আর বিরক্তি আরো বাড়িয়ে দিল। এত বিরক্ত হলো দীপা! শরীরটা ভালো থাকলে এখনি সে ইমাদের মাথা ফাটিয়ে দিতো।
ইমাদ চেয়ার ছেড়ে উঠল। আরেকটা বাটিতে কালো আঙুর ধুয়ে হেঁটে এসে কড়িকে দিয়ে গেল। কড়ি বলল, “ধন্যবাদ।”
ইমাদ ফিরে এসে আবার চেয়ার বসল। এবার সে আনারের প্যাকেটের দিকে হাত বাড়াল। তার খাওয়ায় ফের ব্যাঘাত ঘটল আধ ঘণ্টা পরই। এবার কড়ি ডাকল। উঠে এসে বলল, “আমি আসছি।”
ইমাদ ধীর গতিতে উঠে দাঁড়াল, “আচ্ছা।”
কড়ি দিপার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল, “টাটা।”
দিপা বলল, “তোমায় যেতে দিতে ইচ্ছে করছে না।”
“তাই?”
দিপা উপর নীচ মাথা নাড়ল, “একদম তাই। আবার এসো।”
কড়ি তার কানের কাছে বেণুণীতে গুঁজা ফুলটা খুলে দিপার কানের কাছে গুঁজে দিলো। হেসে বলল, “সুন্দর লাগছে।”
“থেঙ্ক ইউ।”
“নট এট এল।” কড়ি ডানদিকে হাতটা প্রসারিত করে সুর তুলে বলল।
তারপর দরজার দিকে এগুলো। ইমাদও কড়িকে এগিয়ে দিতে পেছন পেছন যাচ্ছিল। দিপা পিছু ডাকল, “ইমি?”
ইমাদ ঘাড় ঘুরতেই দীপা বলল, “আই লাভ ইউ দোস্ত।”
ইমাদ খেয়াল করল দীপুর আগের সেই ক্লান্ত স্বর এখন কিছুটা সতেজ। সে তার স্বভাবসুলভ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “আচ্ছা।”
দিপা সাথে সাথে সাইডে থাকা টেবিল থেকে স্টিলের গ্লাসটা ইমাদের দিকে ছুঁড়ে ফেলল, “শালা, আরেকবার আচ্ছা বললে আমি আবার হাত কাটব।”
ইমাদ সেদিকে না তাকিয়েই হেঁটে করিডোরের দিকে চলে গেল। নীচে নেমে কড়িকে একটা রিকশা ঠিক করে দিলো। কড়ি রিকশায় উঠে চলে গেল। ইমাদ একটু সামনে হেঁটে একটা অটোতে উঠল। ড্রাইভারের পাশের সিটটায় বসতেই অবাক হয়ে দেখল কড়ির রিকশাটা একটু সামনে গিয়েই থেমে গেছে। রিকশা এদিকেই ফিরে আসছে আবার। কড়ির রিকশাটা এসে ওর অটোর সামনেই থামল। কড়ি হুড তোলা রিকশার মাঝ থেকে মাথা বের করে ইমাদকে বলল, “আপনি এখন শান্ত হতে পারেন। আপনার বন্ধু ঠিক হয়ে যাবে। ”
“আমি তো শান্তই আছি।”
“তাই?”
“জি।”
কড়ি অনেকক্ষণ চুপ করে ইমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর একসময় বলল, “আপনি আমাকে যাওয়ার সময় ধন্যবাদটুকুও বলেননি। আপনি স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। এতটা অশান্ত হবেন না। দিপু এখন থেকে ভালো থাকবে।”
ইমাদ ব্যস্ত ভঙ্গিতে অন্যদিকে মুখটা ঘুরিয়ে অটোচালককে বলল, “ভাই চলুন।”
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
#পর্বঃ৩
#লামইয়া_চৌধুরী
কলিংবেল বাজতেই মিলা দুতলার বারান্দা থেকে নীচে উঁকি দিলো। ইমাদকে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুবিনকে ডাকল, “মুবিন, স্যার এসেছেন। নীচে গিয়ে গেইট খোল।”
মুবিন সোফার উপর চিত হয়ে শুয়ে রুবিক্স কিউব মেলাতে মেলাতে বলল, “তুই খোল। স্যারটা কী আমার একার?”
“তুই অনেককিছু বুঝিস না, মুবিন। যা গিয়ে গেইট খোল।”
মুবিন না উঠেই বলল, “কী বুঝি না আমি? আমি সবই বুঝি।”
মিলা বিরক্ত হয়ে গেল। কথা বাড়াল না আর। নীচে গিয়ে গেইট খুলে ইমাদকে সালাম দিলো। ইমাদ গেইটে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
মুবিন আর মিলা ভাই-বোন। দুজন দশম শ্রেণীতে পড়ে। মুবিন বছর খানেকের বড় হলেও একই ক্লাসে দুইবার থাকায় এখন দুজন সহপাঠী। ইমাদ তাদের বিজ্ঞান বিভাগের বিষয়গুলো পড়ায়। মিলা খুব মনোযোগী ছাত্রী। পড়াশুনায় অসাধারণ, অধ্যবসায়ী, শান্তশিষ্ট মেয়ে। উল্টোদিকে, মুবিন দুরন্ত এবং উদ্যত। পড়াশুনায় কোনো মন নেই। দুজনকে একসাথে পড়াতে গিয়ে ইমাদকে হিমশিম খেতে হয়। দেখা যায় মিলার যে চ্যাপ্টারটা এক সপ্তাহে শেষ হয়ে যায়, মুবিনের জন্য তা বারবার পুনরাবৃত্তি করতে হয়। ইমাদ তাদের মায়ের সাথে এই বিষয়ে কথা বলেছিল। বলেছিল, “আন্টি, মিলা আর মুবিনকে আলাদা পড়ালে ভালো হয়। দুজনের পড়া আয়ত্ত করার ক্ষমতা ভিন্ন। একসাথে পড়ালে মুবিনের জন্য হয় মিলা পিছিয়ে থাকে নতুবা, মুবিন পড়া বুঝে না।”
তাদের মা মিসেস শিল্পী জবাবে বললেন, “তুমি একসাথেই পড়াও। মিলা এমনিতেই পারবে। তুমি মুবিনের দিকে নজর দাও।”
ইমাদের এরপর আর কিছু বলার থাকে না। তাই সে বলেওনি।
ইমাদ মিলাকে বলল, “মুবিন কোথায়?”
“ভেতরেই।”
“আমি এসেছি জানেনা?”
মিলা মিথ্যে বলল, “না স্যার ওর আসলে মাথা ব্যথা করছিল ত তাই শুয়ে আছে। আমি ভয়ে ডাকিনি।”
ইমাদ টেবিল থেকে উচ্চতর গণিতের বইটা টেনে এনে বলল, “যাও ডেকে নিয়ে এসো।”
মিলা ঘরে গিয়ে মুবিনকে বলল, “স্যার ডাকেন। এখনও আসিসনি কেন তুই? তোর জন্য আমাকে মিথ্যে বলতে হয়েছে।”
“কে বলেছে তোকে মিথ্যে বলতে?”
মিলা ভাইয়ের হাত টেনে ধরে ভাইকে সোফা থেকে টেনে তুলল, “প্লিজ চল। সময় নষ্ট হচ্ছে। স্যার এক ঘণ্টার বেশি এক মিনিটও পড়ান না।”
“কেন? তোর কী উনার কাছে সারা দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই পড়তে ইচ্ছে করে?”
“বাজে কথা বলবি না। চল।”
“যাব না। কী করবি?”
“উফ কিছুই করব না। অনুরোধ করছি প্লিজ চল।”
মুবিন গায়ে গেঞ্জি চড়াতে চড়াতে বলল, “যা তুই। আমি আসছি।”
“না তোকে না নিয়ে যাব না।”
মুবিন মুখ দিয়ে বিরক্তির শব্দ করে আগে আগে চলল। মিলা মুবিনের পেছনে পেছনে এসে চেয়ারে বসল। ইমাদ মাঝে দুইজন দুই দিকের চেয়ারে। সে ঠাণ্ডা চোখে মুবিনের দিকে তাকাল, “বাড়ির কাজ করেছ?”
“না।”
“কেন করোনি?”
মুবিন বলল, “এমনি।”
ইমাদ টিউশনীটা ছেড়ে দিত। বাজে ছাত্রদের পড়ানো যায়, বেয়াদবদের নয়। কিন্তু টাকা? এখানে হেরে যেতে হয় ইমাদদের। সে মুবিনের সাথে কথা বলা বাদ দিয়ে মিলার দিকে তাকিয়ে বলল, “আজকে কোন চ্যাপ্টার করবে?”
“ত্রিকোণমিতি করি, স্যার?”
ইমাদ দুজনের ব্যবহার দেখে মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আপন ভাই-বোন দুজন অথচ, দুজনের মাঝে কত তফাত! ইমাদ স্বভাবসুলভ ভাবেই বলল “আচ্ছা।” খাতা খুলে অঙ্ক কষতে কষতে তার হঠাৎ মনে হলো বড় আপু ছাড়া এই প্রথম সে কারো কাছে ধরা পড়ে গেল। কড়ি! মেয়েটা তার মনের ঝড়টা বুঝে ফেলল! দীপুর জন্য আসলেই সে পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিল। এত ভালো একটা মেয়ে দীপু! কথা একটু বেশি বলে এই যা। এই এত ভালো মেয়েটার সাথে এমন হতে হলো? তাহমিদকে শায়েস্তা করতে পারল না? ঐ তাহমিদই কী সব জীবনে? এই যে ওরা বন্ধুরা কী কেউ নয়? তাহমিদ না থাকলে মরে যেতে হবে? পরিবার আর বন্ধুদের নিয়ে থাকা যায় না? কিন্তু কড়িকে কেন তার ভেতরের ঝড়টা বুঝে ফেলতে হবে? তার বুকের গহীনের ঝড়টুকু একমাত্র তার বড় আপুই বুঝতে পারে। এটুকুই যথেষ্ট নয় কি? তার অতি মূল্যবান অনুভূতিগুলো কেউ বুঝুক সে তা চায় না। বড় আপুর বুঝে ফেলাতেও সে মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়। অার কোথাকার কোন অচেনা একটা মেয়ে তাকে বলে গেল বিচলিত হবেন না! আনমনেই মুচকি হাসল ইমাদ। মনে মনে বলল, “নাহ, এতটা সহজ হতে দেবে না সে নিজেকে।”
কড়িকে নিয়ে আকাশপাতাল সব ভাবতে ভাবতে আচমকা সে খেয়াল করল কলম চলছে না তার। সূত্রগুলো সব তালগোল পাকিয়ে গেছে। বইয়ের পাতা উল্টে সূত্র দেখে নিলো একবার। সূত্র বসিয়েও অঙ্কটা মিলাতে পারছে না। না পারছে না, কিছুতেই পারছে না। মুবিন হঠাৎ বলে উঠল, “স্যার দেখি আটকে গেলেন?”
ইমাদ মুবিনের দিকে স্বাভাবিকভাবে তাকাল। মুবিনের মুখে ঠাট্টা মিশ্রিত হাসি। মিলা ইশারায় ভাইকে চুপ থাকতে বলল। মুবিন অঙ্ক গাইডটা খুলে সেই অঙ্কটা খুঁজে বের করে ইমাদের সামনে দিলো। বলল, “নিন স্যার আপনার হেল্প হবে।”
ইমাদ মিলার দিকে তাকিয়ে বলল, “ক্যামিস্ট্রি বই বের করো।”
মিলা তাড়াতাড়ি করে মুবিনের খুলে রাখা গাইডটা নিজের কাছে টেনে নিয়ে বন্ধ করল। রসায়ন বই খুলতেই ইমাদ বলল, “কোন চ্যাপ্টার পড়বে?”
মিলা কিছু বলার আগেই মুবিন ঠেশ দিয়ে বলল, “স্যার, আপনিই বলেন কোন চ্যাপ্টারে ভালো প্রস্তুতি আছে আপনার। নাহয় আবার আটকে যাবেন।”
ইমাদ মুবিনের দিকে আর তাকাল না। মিলাকে বলল, “তোমাদের আম্মু বাসায় আছেন?”
মিলা ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে বলল, “না স্যার।”
“আচ্ছা আমার আজ মাথা ধরেছে। আমি আসছি।”
ইমাদ উঠে চলে গেল। বাইরে বেরিয়েই সে তাদের মায়ের নাম্বারে কল করে জানিয়ে দিলো সে আর তাদের পড়াবে না। গত মাসের বেতনটা যেন বিকাশ করে দেন।

ইমাদ বেরিয়ে যেতেই মিলা মুবিন এর উপর চড়াও হলো, “এভাবে বলার কী দরকার ছিল তোর?”
“যা সত্য তাই বললাম। অঙ্ক মেলাতে পারছেন না আর ভাব ধরেন।”
“শোন স্যার অনেক ভালো। স্যারের জায়গায় আমি হলে তোকে মেরে বসতাম। স্যার ভালো বলেই চুপচাপ উঠে চলে গেলেন।”
“ভালো বলে চলে গেলেন না। উনার টাকা দরকার তাই চুপচাপ চলে গেলেন। আমরা পে করি। ওকে?”
“পে তো সব টিচারকেই করা হয়। তবুও তোর জন্য কেউ টেকে? ইমাদ স্যারও আর আসবেন না। দেখে নিস।”
“না এলে না আসবে।”
“হ্যাঁ, তুই তো এটাই চাস। কোনো টিচারকেই তোর পছন্দ হয়না।”
“ভুল বললি। আমার যেই টিচারকে পছন্দ হয় সেগুলো তোর পছন্দ হয় না।”
“হবে কী করে? তুই নিজে যেমন ফাঁকিবাজ তেমন ফাঁকিবাজ টিচারই তোর পছন্দ হয়।”
“ইমাদ স্যার চলে যাওয়ার এত ভয় কেন তোর? প্রেমেটেমে পড়লি নাকি?”
“একদম বাজে কথা বলবি না। আমি এমন নাকি?” বিস্ময়ে, রাগে মিলার চোখ দুটো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল।
মুবিন বুঝল এবার বেশি বেশি বলে ফেলেছে, “স্যরি।”
“তোর স্যরি প্লিজ তোর কাছেই রাখ। সামনে পরীক্ষা। তোর জন্য এই মুহূর্তে টিচার হারালে আমার রেজাল্ট খারাপ হবে। আর এরকম করে করে তোর জন্য আমিও জীবনে কিছু হতে পারব না।”
“তো মা – বাবাকে বল তোর জন্য আলাদা টিচার রাখতে। আমার সাথে আর পড়িস না। তুই তোর সাধু সাধু টিচারের কাছেই পড়িস।”
মিলার গলার স্বরটা নেমে এল। কান্নামিশ্রিত গলায় বলল, “মা- বাবার কাছে আমার কোনো মূল্য নেই, মুবিন। ওদের শুধু তোকে দরকার। তাঁদের ডিভোর্সের পর দুজনেই শুধু তোকেই নিজেদের কাছে রাখতে চায় দেখিস না তুই? আমাকে না বাবা রাখতে চান আর না মা। সেখানে আমার পড়াশুনা নিয়ে ওদের মাথা ব্যথা থাকতে যাবে কেন?”
মুবিন আমতা আমতা করতে লাগল। মিলা ও ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নিজের ঘরে এসে কেঁদে ফেলল সে। পৃথিবী কত অদ্ভুত।
.
কড়ি নাশতার টেবিলে বসে বলল, “বাবা, আমি এই সেমিস্টার ড্রপ দিতে চাই।”
কাদের সাহেব খেতে খেতে বললেন, “হঠাৎ?”
“এমনি একটা ব্রেক দরকার। না করো না, বাবা।”
কাদের সাহেব কিছু সময় ভেবে বললেন, “আচ্ছা।”
নাশতা করা শেষে কড়ি নিজের ঘরে বসে চা খাচ্ছিল। কাদের সাহেব এসে পাশে বসলেন। কড়ি বলল, “চা খাবে, বাবা? আনব?”
“নিয়ে আয়।”
কড়ি বেডসাইড টেবিলে নিজের আধ খাওয়া চা সহ কাপ নামিয়ে রেখে বাবার জন্য চা করে নিয়ে এল। কাদের সাহেব জানালা দিয়ে আকাশ দেখছিলেন। সেই ঘনিয়ে আসা কালো মেঘের আকাশের এক ফোকরে এক কাপ চা সহ একটা হাত উঁকি দিলো। কাদের সাহেব আকাশ দেখতে দেখতেই বললেন, “তুই খেয়েনে। আমার খাওয়া হয়ে গেছে।”
কড়ি বেড সাইড টেবিলে রেখে যাওয়া নিজের চায়ের কাপটায় চোখ দিলো। বাবা তার বাকি চাটুকু খেয়েছে নিয়েছেন। সে বাবার পাশে বিছানায় বসতে বসতে বলল, “নাও তুমি একটু খেয়ে দাও। তারপর আমি খাচ্ছি।”
কাদের সাহেব বললেন, “সিগারেটের গন্ধ করবে। তুই খেতে পারবি না।”
“করুক।”
“আমি সিগারেট ছেড়ে দিব।”
“যখন দিবে দিও। এখন চায়ে একটা চুমুক দাও।” কড়ির গলার স্বর কঠিন।
কাদের সাহেব চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে পুরো এককাপ ধুয়া উঠা গরম চা একটানে সাবাড় করে দিলো। পুড়া ঠোঁট আর জিহ্বা নিয়ে তিনি বললেন, “বললাম ত সিগারেট ছেড়ে দিব।”
কড়ি বলল, “হয়েছে আর মিথ্যে বলতে হবে না।”
“আমি কখনো মিথ্যে বলি না।”
“বাবা – মায়েরাই সবচেয়ে বেশি মিথ্যে বলে। আর ওদের মিথ্যেগুলো সত্য থেকেও বেশি সুন্দর আর আদর আদর।”
কাদের সাহেব মেয়ের দিকে ঘুরে বসলেন, “তুই আমায় কেমন মিথ্যে বলিস?”
“কেমন বলতে?” কড়ির ঠোঁট হাসি হাসি।
“কেমন বলতে বেশি না কম?”
“কম কম বলি। বেশি মিথ্যে বলি না।”
কাদের সাহেব মেয়ের একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিলেন। অসহায় হয়ে বললেন, “সত্যি সত্যি বল ত সেদিন যে তুই একটা ছেলের কথা আমায় বলেছিলি ওটা কি মজার ছলে বলেছিলি নাকি আমি রেগে যাওয়ায় মজা বলে চালিয়েছিস?”
কড়ি ঠোঁটের কাছে হাত নিয়ে অভিনভ ভঙ্গিতে শব্দ করে হেসে উঠল। যেন কোনো শিশুর ঝুনঝুনির শব্দ। পুরো ঘরটাও তার হাসির শব্দের সাথে ঝনঝন করে উঠল। সে হাসতে হাসতেই বলল, “ওহ বাবা তুমিও না পারো। তোমার কী মনে হয় আমি সত্যি সত্যি প্রেম করলে তোমাকে এসে বলতে পারতাম? মেয়েরা বাবাকে এসব বলতে পারে? প্রেমটেম করি না বলেই মজা করে বলতে পেরেছিলাম।”
“এই ধরনের মজা আর কোনোদিন করবি না। আর কখনো না, নেভার।” কাদের সাহেব ক্রোধের গলায় বললেন এবং বলতেই থাকলেন। বলতে বলতে উঠে চলে গেলেন। কড়ি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। মেঘগুলো হালকা হয়ে পৃথিবীতে নেমে আসছে। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। সাথে যোগ হলো ঘূর্ণি হাওয়া। কড়ি বিড়বিড় করে উঠল, “আমি কখনো মিথ্যে বলি না, বাবা। আমি শুধু কুৎসিত সত্যগুলো চাপা রাখি।” কড়ি কাঁদছে। বৃষ্টি এলেই সে কাঁদবে বলেছিল।
চলবে…

একা তারা গুনতে নেই পর্ব-০১

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
১.
কড়ি জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা গত রাতে করে ফেলেছে। বাড়ি থেকে পালিয়েছিল সে। তাও গয়না সমেত। মাঝপথে রামিম তাকে ফিলিং স্টেশনে একা ফেলে গয়নাগাটি সব নিয়ে পগারপার। কড়ি তার ব্যাগটা রামিম এর হাতে দিয়ে টয়লেটে গিয়েছিল। ফিরে এসে দেখল রামিম নেই। নেই মানে কোথাও নেই। আকাশের ঐ বাঁকা চাঁদও যেন তার দিকে তাকিয়ে হাসছিল। ওহ এই রামিম হলো তার প্রেমিক। একা স্টেশনে, রাতের অন্ধকারে, প্রতারিত কড়ি একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে নিজের জন্য খুব সুন্দর একটা সান্ত্বনার বাণী খুঁজে ফেলল। গয়না গেলে গেছে, অসভ্যটা তাকে ত পায়নি। জীবনটা তার একটুর জন্য বেঁচে গেল। বড় করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে কড়ি সিএনজি ডাকল। সিএনজি ঠিক করে বাসায় ফিরে এসে দেখল বাড়ির কেউ এখনো ফিরেনি। তার পার্সটাও ঐ অসভ্য নিয়ে গেছে। সিএনজিওয়ালাকে দাঁড় করিয়ে সে পাশের বাড়িতে গেল। গিয়ে বলল আসার সময় তার পার্স চুরি হয়ে গেছে। তারপর তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সিএনজি চালককে ভাড়া মিটিয়ে বাসায় ঢুকল এবং টিএনটি থেকে বড় ভাইয়ের নাম্বারে কল করল। হতভম্ব গলায় বলল, “তোমরা কই? তাড়াতাড়ি বাসায় এসো। বাসায় ত চুরি হয়েছে। গয়না, টাকা কিছু নেই।”
ভাইয়া বলল, “তুই বাড়িতে!”
“হ্যাঁ, তোমাদের সারপ্রাইজ দিতে এসেছিলাম। এসে আমি নিজেই সারপ্রাইজড।”
“বলিস কী! আচ্ছা আচ্ছা সাবধানে থাক আমরা আধ ঘণ্টার মাঝেই আসছি।”
তাঁরা আসতে আসতে কড়ি বাসার সব এলোমেলো করে দিলো। আলমারি খুলে রাখল। আলমারির চাবি ছুড়ে নীচে ফেলল। আলমারির অবশিষ্ট গয়না একটা ওড়নায় বেধে নিজের ঘরের বড় ফুলদানিটার মাঝে লুকিয়ে রাখল। তারপর ড্রয়িংরুমের সোফায় আসন গেঁড়ে বসে রিমোট হাতে টিভি অন করল। একটু পরই বাসার সবাই এসে পড়ল। কড়ির বাবা কাদের সাহেব গম্ভীরভাবে বাসায় ঢুকলেন। পেছন পেছন যথাক্রমে কড়ির বড় ভাই কাইয়ূম, মেজ ভাই কাদিন এবং ছোট ভাই কায়েস বাসায় ঢুকল। হতভম্ব চোখে তিন ভাই একেক ঘরে ছুটে গেল। গিয়ে দেখল সব এলোমেলো। তাদের আলমারিও খোলা। তবে আলমারির ভেতরটা আর দেখল না তারা। তাদের আলমারিতে কাপড় ছাড়া কিছুই থাকে না। বাবার ঘরে ছুটে গেল। কাদের সাহেব বিছানায় বসে দরদর করে ঘামছেন। কাইয়ূম পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, “তোর মায়ের সব গয়না নিয়ে গেছে। সব মানে সব। একটা কিছু নেই।”
কায়েস কোমরে হাত রেখে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে বলল, “কথা হলো চোর বাড়িতে ঢুকল কী করে!”
কাইয়ূম বলল, “বাবা, রিমাকে চলে আসতে বলব?”
কাদের সাহেব মেঝের দিকে তাকিয়ে হাত তুলে বললেন, “না, থাক ওর ভাইয়ের বিয়ে। ও থাকুক সেখানে।”
কাদিন বলল, “বড় কোনো অ্যামাউন্টের টাকা পয়সা বাড়িতে থাকে না বলে বড় বাঁচা বাঁচলাম।”
কাইয়ূম সাহেব আফসোস করে বললেন, “টাকা গেলে যেত! তোর মায়ের গয়নাগুলো যদি বেঁচে যেত! ওগুলো তো তার শেষ স্মৃতি। ভাগ্যিস রিমার গয়নাগুলো রিমা পরে গিয়েছিল। নাহয় সেগুলোও যেত।”
কড়ি ট্রেতে করে বাবা আর ভাইদের জন্য লেবুর শরবত নিয়ে ঘরে ঢুকল। মনে মনে বলল, “রিমা আপুর গয়নাগুলো থাকলেও আমি নিতাম না, বাবা। মায়ের বলেই নিয়েছিলাম।”
তারপর বাবা আর ভাইদের হাতে গ্লাস তুলে দিতে দিতে বলল, “আফসোস খুব খারাপ জিনিস। মানুষের অর্ধেক জীবন চলে যায় চলে যাওয়া মানুষ কিংবা জিনিস নিয়ে আফসোস করতে করতে। আফসোস করতে নেই। গেলে গেছে। যা….”
কড়িকে বাকিটা বলতে না দিয়ে তার তিন ভাই একসাথে সুর তুলে টেনে টেনে বলল, “যা হয় ভালোর জন্যই হয়।”
কড়ি ঘাড় নাড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ তাই। ধরো আমি যদি আরেকটু আগে এসে পড়তাম আর চোররা বাসায় থেকে যেত তবে আমার যেকোনো ধরনের ক্ষতিই তারা করতে পারত। তোমাদের উচিত টাকা, গয়নার জন্য আহাজারি বাদ দিয়ে আমার সুস্থতা নিয়ে ছোটখাটো একটা পার্টি করে ফেলা।”
কাইয়ূম বোনের কাঁধে হাত রেখে বলল, “ঠিক বলেছিস। আল্লাহর কাছে হাজারো শুকরিয়া।”
কড়ি এমনি। কড়ির জীবনে ব্যথা আছে কিন্তু দুঃখ নেই। কারণ সে রক্তাক্ত ঘটনাগুলোকেও রঙধনুর সাত রঙের এক রঙ লাল দেখতে পায়। যেমন তার মায়ের মৃত্যুর সময় সে কলেজ পড়ুয়া। বড় ভাই কাইয়ূম মা ঘেঁষা ছেলে। মায়ের অকস্মাৎ মৃত্যুতে মুষড়ে পড়েছিল। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে দিনের পর দিন পাথর হয়ে ঘরে বসে থাকতো। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। যেন একটা ননির্বাক পুতুল। সেবার আর মাস্টার্স পরীক্ষা দিবেনা বলেও ঘোষণা দিলো। বড় ভাইয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কড়ি একদিন বলেছিল, “মা থাকলে রিমা আপুর সাথে তোমার সম্পর্কটা কখনোই মেনে নিতেন না। সব ব্যাথাই অন্য কোনো ব্যাথার ঔষধ। কিংবা সব ঔষধই নতুন কোনো জ্বালাপোড়ার কারণ। যা হয় ভালোর জন্য হয়।”
এ কথায় বড় ভাই পরীক্ষা দিলো। পরীক্ষা শেষে ভালো চাকুরী পেল, রিমাকে বিয়ে করল।
যাইহোক, কড়ি সবকিছুরই একটা ভালো দিক খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। এবারেও তাই করল। রাতে নিজ হাতে রান্না করে বাবা- ভাইদের নিয়ে এক টেবিলে বসে খেলো। রিমার সাথেও ফোন করে কথা বলল। আশ্বস্ত করল রিমাকে। রিমা বলল, “কড়ি, তুই না বললি তোর পরীক্ষা? এই জন্য ভাইয়ার বিয়েতেও আসবি না বললি।”
“এমনি বলেছিলাম। তোমাদের সারপ্রাইজ দিব বলে আগে বলিনি। ভেবেছিলাম হলুদের রাতে এসে আচমকা হাজির হয়ে তোমাদের চমকে দেব।”
“তাহলে তুই সরাসরি আমাদের বাসায় এলি না কেন?”
“বাসায় আমার সবচেয়ে পছন্দের ড্রেসটা রাখা। তাই আগে তোমাদের বাসায় না গিয়ে বাসায় এসে ঐটা পরে তারপর হলুদে যেতে চেয়েছিলাম।” কড়ি কী সুন্দর করে যে বলল!
রিমার অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। কড়ি সোজাসুজিভাবে কিছু করে অভ্যস্ত নয়। সবকিছু অন্যরকম, আলদারকম করতে ভালোবাসে সে। পাগলাটে সব কাজই কড়ি দারুণ মন দিয়ে করে। রিমা বলল, “কাল তো বিয়ে। আসবি না?”
“আসব ত। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো, আপু।”
“আচ্ছা।”
রিমার সাথে কথা শেষ করে কড়ি ডায়েরী নিয়ে বসল। লেখার জন্য না, ছেঁড়ার জন্য। আগুন জ্বালিয়ে পোড়াবে বলে রামিমকে নিয়ে লেখা পাতাগুলো ছিঁড়ে রাখল। সাথে কানে বাজবে পছন্দের গান। ফুলতোলা লাল ব্লাউজের সাথে সাদা শাড়ি পড়ল। সাথে গলায় গোলাকৃতির কাঠের গয়না। গয়নায় গোটা গোটা অক্ষরে লেখা “আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন”
কুঁচি ঠিক করতে করতে আয়নায় লেখাটার দিকে চোখ পড়তেই সে নিজের খোঁপা খুলে দিলো। চুলগুলো স্বাধীন হয়ে তার অঙ্গে ঝরল। মানাচ্ছে বেশ! ঠোঁটে লাল টকটকে লিপস্টিক দিয়ে ছাদের দিকে রওনা হলো সে।
সুনসান পূর্ণিমা রাত। চারিদিকে জোছনার ঢেউ। কড়ি ছাদের আনাচেকানাচে পড়ে থাকা পাতা জড়ো করে দেশলাই দিয়ে আগুন জ্বালল। গান বাজছে, “যে কটা দিন তুমি ছিলে পাশে, কেটেছিল নৌকার পালে চোখ রেখে….”
সাবধানে আগুনের পাশে বসতে বসতে কানে ইয়ার ফোন গুঁজল। একটা একটা করে ডায়েরীর পাতাগুলো আগুনে ফেলল। কী শান্তি! কী শান্তি! বুক শীতল করা প্রশান্তি।
সবকিছু নান্দনিকভাবে করবার একটা আনন্দ আছে। কড়ি সে আনন্দটুকু পেতে পছন্দ করে। এমন করেই আগুনের পাশে বসে তার বিভৎস এই রাতটি নান্দনিক এক রজনী হয়ে উঠল।
কড়ি ছাদ থেকে নামল ফজরের আজানের সময়। কাঁদেনি সে। সে কাঁদবে আয়োজন করে। যেদিন বৃষ্টি আসবে সেদিন। কান্নাটা তোলা রইল। আজ রইস ভাইয়ের বিয়ে।
.
ইমাদ কাল রাত থেকেই বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে। এক চুলও নড়েনি সে। যে করে হোক মেয়েটার সাথে তাকে দেখা করতেই হবে। খুব দরকার তার, খুব। সে ভালো করে বাড়িটার দিকে তাকাল। বাড়ির নাম “কড়ির কুটির”। আচ্ছা মেয়েটির নাম কী কড়ি হতে পারে? হতেই পারে। বাড়ির নামগুলো সাধারণত দুই প্রকার হয়। এক প্রকার হলো, শান্তি নিকেতন, ক্ষণিকালয়, মা ইত্যাদি। অন্যদিকে, বিভিন্ন ভিলা, কুটির, কটেজ, প্যালেস। আর এগুলোর আগে বাড়ির মালিকের নাম কিংবা, বাড়ির মালিকের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির নাম জুড়ে দেওয়া হয়। মেয়েটির নাম কী তবে কড়ি?
ইমাদ মাথার হ্যাডস্কার্ফটা খুলে নতুন করে খুব সুন্দর করে মাথায় বাঁধতে বাঁধতে একবার ভাবলো বাড়ির ভেতরে যাবে। পরক্ষণেই মত পাল্টাল। না ভেতরে যাওয়া ঠিক হবে না। মেয়েটা বিপদে পড়ে যাবে। তারচেয়ে বরং অপেক্ষা করাই ভালো। সে বাড়ির সামনে থেকে নড়ল না। বরং, উল্টোদিকের রাস্তাটায় পায়চারি করতে লাগল।
কাল রাত থেকে কিছু খাওয়াও হয়নি। পেটের ভেতর ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। বাড়ির সামনে কোনো দোকানপাটও নেই। আসার সময় দেখেছিল গলির মুখে একটা দোকান আছে। সেখান থেকে কিছু কিনে খাওয়া যেতে পারে।
ইমাদ খানিক সামনে এগিয়ে দোকান থেকে পাউরুটির প্যাকেট আর দুটো কলা কিনলো। প্যাকেট ছিঁড়ে দাঁড়িয়েই খেতে শুরু করে দিলো। তখনি কড়ি বাড়ি থেকে বেরুলো। তবে একা নয়। সাথে বাবা আর ভাইদের সহ। রিকশা দিয়ে চলে যাচ্ছিলো। রিকশার উপর নজর পড়তেই ইমাদ দোকানদারকে আঙুলের ইশারায় দেখিয়ে বলল, “তাদের বাড়িতে গতকাল কী কোনো অঘটন ঘটেছিল?”
“হ্যাঁ, চুরি হয়েছিল।” দোকানদার ব্যথিত।
“কেউ ছিল না বাসায়?”
“না। বিয়েতে গিয়েছিল। আর মেয়েটা ঢাকা থেকে বিয়েতে এসেছিল। এসে দেখে বাসায় চুরি হলো!”
“আচ্ছা।”
দোকানদার একটু কেমন করে তাকালেন। একটা মানুষ শুনল চুরি হয়েছে অথচ, কী চুরি হয়েছে, কেমন করে হয়েছে কিছুই জানতে চাইল না। এমনকি আহারে, ইশশিরে, বলেন কী জাতীয় কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখাল না। বড়ই নির্বিকার এই লোক! দোকানদার ইমাদের এই নিঃস্পৃহতায় বড্ড বিরক্ত হলেন। এই ধরনের মানুষগুলো হয় ভয়ানক এবং নিষ্ঠুর। মানুষ খুন করতেও তারা দ্বিধা করে না। তাদের গ্রামে ছিলেন কালা ব্যাপারী। কালা ব্যাপারী এমন নির্বিকার গোত্রের মানুষ ছিলেন। এখন তিন তিনটা খুনের দায়ে হাজতে। তাই তিনি খুবই বিরক্ত গলায় বললেন, “আপনাকে ত এর আগে এলাকায় দেখিনি কখনো?”
ইমাদ বিচলিত হলো না। খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, “আমি এই পাড়ায় নতুন টিউশনী নিয়েছি।”
“ওহ তাই বলুন। তবে আপনি কীভাবে অঘটনের কথা জানলেন?”
“আমার ছাত্রর মুখ থেকে শুনেছি।”
তবুও দোকানদারের সন্দেহ দূর হলো না। ইমাদ আর কথা বাড়াল না। বাড়িটি মেয়েটির বাড়ি। যত যাই হোক দিনশেষে মেয়েটিকে এখানেই ফিরতে হবে। এইটুকু নিশ্চিত হয়ে ইমাদ রিকশা ডাকল। রিকশায় বসতেই নিলয়ের ফোনটা এল। ইমাদ রিসিভ করতেই নিলয় ভীত কণ্ঠে বলল, “দিপু মরে যাচ্ছে, দোস্ত দিপু মরে যাচ্ছে।”
ইমাদের কোনো হেলদোল নেই। সে শুধু বলল, “ওহ আচ্ছা।”
“তুই কী শুনতে পাচ্ছিস আমি কী বলছি? তুই শুনতে পাচ্ছিস?” নিলয় রাগে চিৎকার করে উঠল।
ইমাদ স্থির, শান্ত গলায় পাউরুটি খেতে খেতে বলল, “হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি।”
নিলয় এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “তুই এমন কেন, ইমাদ? তুই এমন কেন?”
“কেমন?”
“তুই একটা পাথর।”
“হ্যাঁ, পাথর ভালো জিনিস। পাথর আরাধ্যের।”
নিলয় অসহ্য হয়ে মোবাইলটা হাসপাতালের করিডোরে ছুঁড়ে ফেলল। ভেঙে চুরচুর হয়ে গেল মোবাইল।
চলবে…