একা তারা গুনতে নেই পর্ব-১৬+১৭

0
256

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ১৬
কাদিন তাহমিদের কথা শুনল না। সে মেহেদীকে চুপচাপ সালামী দিয়ে দিলো। মেহেদী সেই সালামী নিয়ে হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইল তাহমিদের দিকে। ভয়ে তার বুক কাঁপছে। আপুর এখন কি হবে? আর কত কাঁটা বিছানো পথে হাঁটতে হবে তার আপুকে? কখনো কি কৃষ্ণচূড়ার লাল গালিচা ভাগ্যে জুটবে না আপুর?
ইমাদ আর নিলয়ের মনেও একই অনুভূতি ভিন্ন ভিন্ন শব্দে ডানা মেলছিল। দীপার মা’ই শুধু সেই মুহূর্তে কমিউনিটি সেন্টারের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে আনন্দাশ্রু মুছছিলেন। তাঁর মেয়ে আবারো যে এক নতুন বেড়াজালে আটকা পড়ছে সে সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণাই নেই।
লালচে সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে দীপার বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এল। দীপার মা মেয়েকে জড়িয়ে হুহু করে কাঁদছিলেন। আর দীপা? কান্নারচোটে ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার দশা! মায়ের বুক ছাড়ছিল না ও। রিমা টেনে ছাড়িয়ে নিলো। দীপা আবার মেহেদীকে জড়িয়ে ধরল। মেহেদীও দু’হাতে বোনকে আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। ভাই – বোনের কান্নাকাটি চলতেই লাগল। কাইয়ূম মেহেদীকে বুঝিয় বলল, “ভাইয়া, তুমি এমন করে কাঁদলে তোমার আপুর কান্নাও বন্ধ হবে না।”
মেহেদী একহাতে বোনকে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে চোখ মুছল। ঠোঁটে হাসি টেনে বলল, “তুমি একটা ঝামেলা, আপু। তাড়াতাড়ি বিদায় হও।”
দীপাকে হাসাতে চেয়েছিল সে। দীপা না হেসে আরো বেশি কাঁদতে লাগল। নিলয় চেষ্টা করে ধমক দিলো, “কী করছিস, দীপু? যাবি না নাকি? মত পাল্টে গেছে? আমরা কিন্তু আর রাখব না তোকে।”
দীপা এবার মেহেদীকে ছেড়ে নিলয়ের হাত দুটো ধরে নিজের কপালে ঠেকাল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। নিলয় দীপার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। কড়ি পাশে দাঁড়িয়ে সবটা দেখতে দেখতে আশেপাশে তাকিয়ে ইমাদকে খুঁজল। কোথাও নেই কেন উনি? দীপা ভাবি এখনি তো নিলয়কে ছেড়ে উনাকে খুঁজবেন। কড়ি ভিড় ছেড়ে বেরিয়ে এল। এদিকওদিক তাকাতে তাকাতে ইমাদকে খুঁজে পেল কমিউনিটি সেন্টারের ভেতরে। শূণ্য চেয়ারগুলোর একটা দখল করে বসে আছে সে। দীপুর ওখানে এখন যাবে না। বড় আপুর বিদায়ের সময়ও গাড়ির আশেপাশে এক মাইলেও ছিল না সে। বড় আপুকে নিয়ে যে ভয় ছিল তাই হয়েছিল। বড় আপু সংসার জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আগের মত সবকিছু এখন আর অত সহজ নয়। আপুর সাথে দেখা করতে ইচ্ছে হলেও কত দিনক্ষণ দেখে দেখা করতে যেতে হয়। খালি হাতে আপুর শ্বশুরবাড়িতে যাওয়া যায় না বলে হুটহাট দেখা করা যায় না। পকেটে টাকা থাকতে হয়, নিজেরও সময় থাকতে হয়, আপুরও সময় করতে হয়। তারপর এই একটু দেখা। এরপর আবার আপু যখন বাড়িতে বেড়াতে আসে তার আবার ছুটি থাকে না। দেখা যায় নিজের পরীক্ষা নাহয় স্টুডেন্টের পরীক্ষা। এক সঙ্গে ঈদ করা হয় না ক বছর হলো?
“শুনছেন?”
ইমাদ মোটেও শুনেনি বুঝতে পেরে কড়ি আবার ডাকল, “শুনছেন?”
ইমাদ সম্বিৎ ফিরে পেল। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল, “জি বলুন।”
“দীপা ভাবি আপনাকে খুঁজছেন।”
ইমাদ কিছু একটা বলতে ঠোঁট নাড়ছিল। কড়ি বলল, “আচ্ছা বলতে হবে না। চলুন।”
ইমাদ বলল, “আমি আসছি আপনি যান।”
“এখনি চলুন।”
“আমার এদিকে একটু কাজ আছে। সেড়ে আসছি।”
“এদিকে আপনার এখন কোনো কাজ নেই।” কড়ির দৃষ্টি এবং কণ্ঠ উভয়ই স্থির। ইমাদও কড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। তার দৃষ্টি স্থির। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে নিজের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করল। ইদানিং সে বড্ড অনুমেয় এবং সহজবোধ্য হয়ে যাচ্ছে। বড্ড বাজে বিষয় এটা। সে কঠিন করে বলল, “আপনি কি করে জানেন আমার এখানে কোনো কাজ নেই?”
“আমি জানি।”
ইমাদ সাধারণত খুব একটা রাগে না। তবে এই মুহূর্তে সে ক্রুদ্ধ। নিজের উপরেও, সামনে দাঁড়িয় থাকা এই মেয়েটির উপরও। স্বভাবসুলভ সে তার রাগ চেপে শান্ত থেকে বলল, “কাজ আছে তো।”
কড়ি এবার হেসেই ফেলল, “বিদায় মুহূর্ত মেয়েদের জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সব মেয়েরা ঐ সময়টায় প্রিয়জনদের সান্নিধ্য চায়। আবেগজনিত কারণে এখানে একলা বসে থাকবেন না।”
ইমাদ এবার উঠে দাঁড়াল। এই মেয়ে বাজেভাবে তাকে ধরে ফেলছে। এভাবে চলতে দেওয়া যাবে না। সে এখন দীপুর কাছে যাবে এবং একটুও আবেগপ্রবণ হবে না। ইমাদ কড়িকে বুঝাতে একজন ওয়েটারকে ডেকে ইনিবিনিয়ে একটু কথা বলে বুঝাল সে সত্যিই ব্যস্ত ছিল এখানে। তারপর কড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “চলুন।”
ইমাদ গাড়ির কাছের জটলাটায় গিয়ে দাঁড়াল। ইমাদকে দেখে মেহেদী বলল, “ইমাদ ভাইয়া, কোথায় ছিলেন আপনি? আপু বারবার খুঁজছিল আপনাকে। আপনাকে না দেখে গাড়িতে উঠছেই না।”
ইমাদ বলল, “ভেতরের দিকটা দেখছিলাম।”
এতক্ষণে সে এসেছে বলে দীপা কেমন অভিমানী চোখে তাকাল। অবিরত কাঁদছে সে। ইমাদ দীপার তাকানো দেখে মুচকি হাসল। দীপার কান্না থামার কোনো নাম নেই। চক্রবৃদ্ধি হারে ক্রমে ক্রমে তা বেড়েই চলেছে। একেওকে ধরে কাঁদছে ও। কেউ ওকে গাড়িতে টেনে আনতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত ইমাদ সফল হলো। সে দীপাকে টেনে আনতে সক্ষম হলো। কাদিন গাড়িতে উঠে বসতেই ইমাদ বলল, “দীপু, এবার উঠ।”
দীপা কাঁদতে কাঁদতেই বলল, “এখানে আর কেউ উঠবে?”
রিমা অবাক হয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমি বা কড়ি উঠব।”
কড়ি বলল, “আপু তুমি’ই উঠো।”
দীপা এতগুলো মানুষকে একইসাথে অবাক করে দিয়ে কান্নাভাঙা গলায় বলল, “আমি মাঝে বসব না। আমি জানালার পাশে বসব।”
দীপার মা কান্না বন্ধ করে মেয়ের দিকে কটমট করে তাকালেন। কেউ কেউ সশব্দে হেসে উঠল। রিমা হাসতে হাসতে বলল, “কাদিন, নাম তুই। ওকে ঐ পাশে বসতে দে। তুই মাঝে বস।”
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ১৭
দীপা বুঝছিল না কি করবে। এভাবেই ঘোমটা দিয়ে বসে থাকবে? না কিছু বলবে? কাদিন এভাবে বালিশে হেলান দিয়ে কপালে হাত রেখে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে কেন? ক্লান্ত তো ওর হওয়ার কথা। এত ভারি শাড়িটা! তার উপর ম্যাকআপ। অসহ্য লাগছে। আর কথা না বলে থাকা যাচ্ছে না। দীপা বলেই ফেলল, “আমাকে আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকতে হবে?”
কাদিন চোখ বন্ধ রেখেই বলল, “বসে থাকতে হবে না।”
ঘোমটার নীচেই দীপা কয়েক সেকেন্ডের জন্য ভ্রু কুঁচকে ফেলল। সমস্যা কি এই লোকের? সেও কি ছ্যাকাট্যাকা খেয়েছে নাকি? জিজ্ঞেস করতে মনটা আকুপাকু করে উঠল। পরে ভাবল না থাক বেচারাকে বিরক্ত করা ঠিক হবেনা। ভয়াবহ শোকেজর্জরিত মনে হচ্ছে। দীপা ইচ্ছে দমন করে ঘোমটা ফেলে ফুলের বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। লাগেজ টেনে এনে বিছানার উপর তুলে রাখতেই কাদিন চোখ খুলে অস্থির হয়ে বলল, “নামাও নামাও। লাগেজে ময়লা কত! চাদরে ময়লা লাগবে।”
দীপা বিছানা থেকে লাগেজ নামিয়ে নীচে রাখল। সালোয়ার কামিজ বের করে বাথরুমে চলে গেল সে। বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখল কাদিন বিছানার চাদর পাল্টাচ্ছে। দীপা অবাক হয়ে গেল। ও বাবা! এ কার সাথে এসে পড়ল সে! কাদিন বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল এক পাশে। দীপাও উল্টোদিকে শুয়ে পড়ল। ক্লান্ত থাকায় দীপা সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ল। কাদিন ঘুমালো না। তার কিছুতেই ঘুম আসছে না। সারাটা জীবন মেয়েদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলে এসেছে। জীবনে কোনোদিন প্রেম পিরিতির ধারে কাছেও ঘেঁষেনি। সবসময় শুধু পড়াশুনা এবং নিজের ক্যারিয়ার নিয়েই মজে ছিল। নিজেকে সম্পূর্ণ যত্নসহকারে তোলে রেখেছিল নিজের ভবিষত স্ত্রীর জন্য। সেও এমনি একজনকে আশা করেছিল জীবনে। আর তার জীবনেই কিনা জুটল এমন কেউ? বিয়ের আগের রাতে এসে বিয়ে ভাঙাটা ঠিক মনে হয়নি তার। দুপক্ষের সকল আত্মীয়স্বজন, তার সব বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী সবাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি ভর্তি এত এত মেহমান রেখে পরিবারের মান ক্ষুণ্ন করার কথা আর ভাবতে পারেনি সে। তাছাড়া, এই মেয়ে একবার জমের ঘর থেকে ফিরে এসেছে। নতুন করে বিয়ে ভাঙার কারণে যদি কিছু করে বসত! সর্বনাশ হয়ে যেত। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল বিয়েটা না করলে অন্যায় হতো। তাই সে শেষ পর্যন্ত নিজের মনের বিরুদ্ধাচার করে হলেও বিয়েটা করেছে। কিন্তু এ কাকে বিয়ে করল সে? এই মেয়ের মাঝে কোনো শিষ্টাচার নেই। ভদ্রতা নেই। গাড়িতে উঠার সময় হুট করে কেমন একটা কথা বলে ফেলল সে। লজ্জায় তার মাথা কাটা যাচ্ছিল। কায়েস আর তার বন্ধুরা সারাটা পথ হাসাহাসি করেছে। অসহ্য!

রাত বাড়ছে। এলার্ম ঘড়িটা বিদঘুটে শব্দ তুলতেই মিলার ঘুম ভাঙল। টেবিল থেকে মাথা তুলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল দুটো বিশ বাজে। ঘুমে চোখ দুটো জ্বলছে। কিন্তু চ্যাপ্টারটা আজ রাতের মাঝেই শেষ করবে। সে প্রায়ই এমন করে। সারারাত ধরে পড়ে। তার পড়াটা অবশ্য একটানা নয়। সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত একটানা পড়ে। তারপর থেকে শুরু হয় আধা ঘণ্টা পড়া আর বিশ মিনিট ঘুমানো। আধা ঘণ্টা পর পর বিশ মিনিটের ঘুম দেয় সে। তখন এলার্ম দিয়ে রাখে। এলার্ম বাজতেই আবার পড়তে বসে। মিলার শরীরটা খুব খারাপ লাগছিল। রান্না করতে গিয়ে ওর সব এনার্জি শেষ। তবুও উঠে বইয়ে ঝুঁকে গুনগুন করে পড়া শুরু করল সে।
রাজপ্রাসাদে থেকেও সবাই রাজকন্যা হয় না। কেউ কেউ অতি সাধারণ হয়ে অক্লান্ত আর অচিন্তনীয় পরিশ্রম করে। মিলা তেমনি একজন। এর চাইতে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা সুহার জীবন বড় বেশি শান্ত আর প্রশান্তিময়। তবে ক্ষতি নেই। মিলা এতদিনে বুঝে গেছে সে রেশমের বিছানার কিংবা ফুলের বারান্দার রাজকন্যা হতে জন্মায়নি। সে জন্মেছে নিজের তৈরী সিংহাসনের মাথা উঁচু করা এক সম্রাজ্ঞী হতে।

ঠিক পাশের ঘরেই বাতি নিভিয়ে মুবিন তখন মোবাইল হাতে নেশাগ্রস্তের মত ফ্রি ফায়ার গেইম খেলছে। মোবাইলের আলো তার অস্থির চোখে মুখে জেঁকে বসে আছে। ওর অন্ধকার ঘরের দরজায় দাঁড়ালে মোবাইলের আলোতে কিশোর মুখটাকে দেখা যায়। যেন মনে হয় অন্ধকার আকাশের উজ্জ্বল কোনো নক্ষত্রের পতন ভেবে বিভ্রম হয়।
.
ইমাদ এত রাতেও মেসে ফিরেনি। সে পদুয়ার বাজারের ফুট ওভার ব্রিজটা ধরে বিভোর হয়ে হাঁটছিল। একটু পর পর নীচ দিয়ে মালবাহী বিরাটাকার ট্রাকগুলো দৌড়ে যাচ্ছে। খানিক আলো জ্বেলে, কেমন একটা শব্দ করে ট্রাকগুলো নিজেদের আগমণের, প্রস্থানের জানান দিয়ে যাচ্ছে। সব আগমণের’ই কি এমন আগমনবার্তা থাকে? আর প্রস্থানের? ইমাদ নিজের গায়ের হালকা গড়নের চাদরটা খুলে ফুট ওভারব্রিজটির কিনারা ঘেঁষে যে মধ্যবয়সী লোকটি হাত – পা গুটিয়ে ঘুমিয়ে আছেন, তাঁর গায়ে জড়িয়ে দিলো। তারপর নিঃশব্দে পায়ে পায়ে ব্রিজটির সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। কড়ি মেয়েটি কি সত্যিই তার আশেপাশের সবাইকে বুঝতে পারে? কিছুটা হয়তো পারে, তবে পুরোপুরি নয়। এ জগতে নিজেকেও নিজে পুরোপুরি বুঝা অসম্ভব। মজার বিষয় হলো কড়ি সম্পর্কে সে দারুণ হাস্যকর একটি সত্য আবিষ্কার করতে পেরেছে। কড়ি আসলে যতটুকু বুঝে তার চাইতেও বেশি প্রকাশ করে ফেলে। অথচ, ইমাদ তা করে না। সে কাউকে বুঝলেও কখনো তা প্রকাশ করে না। এই যে কড়িকেও সে বুঝে কই কখনো তো সে কড়ির কাছে তা প্রকাশ করেনি? ইমাদ মুচকি হাসল। রাত হঠাৎ করেই আরো অন্ধকার আর রহস্যময় হয়ে উঠল। কড়ি তাকে যতটুকু বুঝে তার চাইতে কড়িকে সে খানিকটা বেশিই বুঝে। শুধু বলা হয়নি। তবে কড়ি যদি এবার তাকে বুঝবার শক্তি নিয়ে খেলতে চায় তবে সেও সেই খেলায় মেতে উঠবে।
চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে