একা তারা গুনতে নেই পর্ব-৮+৯

0
251

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৮
ভয়ে মিলা পরপর কয়েকটা ঢোক গিলল। মুবিন ঐ বইটাই খুঁজছে না তো? পড়ার টেবিল থেকে আড়চোখে ওর দিকে তাকাল মিলা। মুবিন পুরো বুকশেলফ চষে ফেলছে। ওর বইয়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহ দারুণ। মিলা জিহ্ব দিয়ে ঠোঁট ভেজাল। বুকটা দুরুদুরু করছে। মুবিন এবার অধৈর্য্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “প্রডিজি বইটা পাই না কেন, মিলা?”
মিলা কেঁপে উঠল। জামা টেনে বুকে থুথু দিয়ে বলল, “কী যেন জানি না তো।”
মুবিন মেঝেতে বসে নীচের তাক হাতাতে লাগল। একদম কোণায় বইটি পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে, “পেয়েছি।”
আতঙ্কে জমে গেল মিলা। মুবিনের চোখে যেন না পড়ে তাই একদম শেষের তাকে রেখেছিল সে। মুবিন বইটা খুলে দেখবে না তো? আশঙ্কায় মিলা আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগল।
যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যে হয় প্রবাদটিকে শতভাগ সত্য করে দিয়ে মুবিন বইটি খুলে দেখল। বইয়ের মাঝ থেকে দুটো পাতা খসে পড়ল মেঝেতে। বইয়ের পাতা ছেঁড়া! পরমুহূর্তেই ছোটখাটো একটা বিস্ফোরন ঘটে গেল। মুবিন উঠে এসে মিলাকে মারল। মিলাও হাতাহাতি লেগে গেল, কিন্তু মুবিনের সাথে পারা কঠিন। শেষটায় ব্যাথায় কুঁকড়ে গিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠল। ধাক্কা দিয়ে ভাইকে সরিয়ে বলল, “ছাড়।”
“ভালো করেই ছাড়ছি তোকে।” মুবিন রোষানলে জ্বলে উঠে আবার তেড়ে গেল।
“এত গুন্ডা কেন তুই?”
“সত্যি সত্যি বল কেন ছিঁড়লি? আমাকে শায়েস্তা করতে? হ্যাঁ? তোর স্যার বিদায় হয়ে যাওয়ার আমার বই ছিঁড়ে ক্ষোভ দেখিয়েছিস?”
“আরে না। সুহাকে দিয়েছিলাম।”
“আমার বই তুই আমার কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া ছাড়াই নিজের বান্ধবীকে দিয়ে দিলি? আর তোর বান্ধবী বই পড়তে নিয়ে একদম ছিঁড়েই ফেলল!”
“ও করেনি। ওদের বাসায় মেহমান এসেছিল। মেহমানের ছোট বাচ্চা ছিল। বাচ্চাটা ছিঁড়ে ফেলেছে।”
“আমার বই কাউকে দেওয়া নিষেধ না? বল নিষেধ না? আমি আমার জানের জিগার বন্ধুদেরও বই দেই না। তুই তা খুব ভালো করেই জানিস।” মুবিন চেঁচাচ্ছে। মিলা কী বলবে? চুপ করে রইল। মুবিন বলল, “একদম চুপ করে থাকবি না। বল নিষেধ কিনা?”
“নিষেধ।” মিলা চোখ মুছল।
“তো কেন দিলি?”
“ও চেয়েছিল।”
“ও চেয়েছিল! ও চাইলেই কী দিতে হবে? ও কী তোর নিজের জানের চেয়েও প্রিয়?”
মিলা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “হ্যাঁ, নিজের জানের চেয়েও প্রিয়। কী করবি মেরে ফেলবি এখন?”
মুবিন ব্যঙ্গ করে উঠল, “বাবা!!! সিনেমা! বান্ধবী নাকি জানের চেয়েও প্রিয়! সর সামনে থেকে। আর কোনোদিন আমার শেলফে হাত দিবি না। সোজা হাত ভেঙে দিব।”
মিলা হিসহিসিয়ে বলল, “একশবার দিব। সুহা আবার বই চাইলেই বই দিব। ও যেটা চাইবে আমি সেটাই দিব।”
“দিতে হলে নিজের বই দে গিয়ে। অামারগুলায় ভুলেও আর হাত দিবি না।” মুবিন ধমকে উঠল।
“আমি এতসব বোরিং জিনিসপত্র পড়ি না। আমার থাকলে আমারটাই দিতাম। তোর মতন এত ছোট আত্মাওয়ালার বইয়ের দিকে ফিরেও তাকাতাম না। মনটা একটু বড় কর।”
“তোর সুহা কী আমার হবু বউ লাগে যে ওর জন্য আমার আত্মা, মন বড় করে ওকে আমার বই দিতেই হবে?”
“তোর মতন গুন্ডার কোনোদিন সেই সৌভাগ্য হবেও না।”
মুবিন মুখ খিঁচিয়ে আঙুল তাক করে বলল, “শোন আমার বই আর কখনো দিবি না কাউকে।”
“আর কাউকে ত দিইও না। সুহাকে শুধু দিই, আর দিবোও।”
“ওর জন্য এত পিরিতি কেন আপনার?”
“এত পিরিতি কারণ একমাত্র ও আমার কেয়ার করে। আর কারো কাছে আমার কোনো গুরুত্ব নেই। তোর মা – বাবার কাছেও আমি নোবডি। তোরা যখন আমায় কষ্ট দিস তখন ওর কাছে গিয়েই কাঁদি।”
“এক প্যাঁচাল পেয়েছে। সবসময় টেনেহিঁচড়ে সেটাই নিয়ে আসে।”
“তোর কাছেও আমার গুরুত্ব নেই। সামান্য একটা বইয়ের জন্য আমাকে মেরেছিস তুই। মনে রাখলাম।”
“যা, যা মনে রেখে যা করবার করিস। যাহ্।” হাত নাড়াতে নাড়াতে বলতে বলতে চলে গেল মুবিন। তারপর সারা দুপুর নিজের ঘরে পড়ে ঘুমাল। দুপুরের খাবার ছেড়ে দিলো মিলা। খাবে না সে! মুবিন বিকেলে ঘুম থেকে উঠে খেতে বসে গলা উঁচিয়ে ডাকল, “এই মিলা খাবি না?”
“তোকে খাব।” মিলার রাগের জবাব।
“সাহস থাকলে আয় না, আয়।”
“মাথা ব্যাথা আমার। বিরক্ত করিস না।”
“সারাদিন ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদলে মাথা ধরবেই। পান থেকে চুন খসতেই ভ্যাঁ ভ্যাঁ! আমার কী! না খেলে না খাবে।”
বিড়বিড় করতে করতে একলাই খেয়ে নিলো সে। তারপর মাঠে খেলতে চলে গেল। খেলায় মন বসল না তার। মা-বাবার ডিভোর্স আর কার কাছে মিলা থাকবে এই নিয়ে এমনিতে সারাক্ষণ মিলার মন খারাপ থাকে। অসহনীয় যন্ত্রণায় আর চিন্তায় নিঃশেষ হতে থাকা তার মাথায় পরীক্ষার সিলেবাস শেষ করবার নতুন দুশ্চিন্তা দেখে মুবিনের অপরাধবোধ হতে লাগল। তার উপর আজ সে মেরেছেও।
বাসায় ফেরবার আগে ইমাদ স্যারের মেসে যাবার সিদ্ধান্ত নিলো সে। স্যারের মেসের ঠিকানা তার জানা ছিল। মা অধিক সচেতনায় প্রথম দিনই ঠিকানা জেনে রেখেছিলেন। মা ইমাদ স্যারকে অনেক জুরাজুরি করবার পরও তিনি আর কখনো পড়াতে যাননি। এর মাঝে আরেকজন টিউটরও পেয়েছিল ওরা, কিন্তু ইমাদ স্যারের মতন অত ভালো পড়ান না বলে মিলা বাদ দিয়ে দিয়েছে।
ইমাদ মেসে ছিল না, নিলয় ঘুমাচ্ছিল। দরজায় মুবিনের ধাক্কার পর ধাক্কায় নিলয় বিরক্ত হয়ে দরজা খুলল, “কাকে চাও, বাবু?” তার কণ্ঠ এখনো ঘুমে ভার হয়ে আছে।
“ইমাদ স্যারের কাছে এসেছি।”
নিলয় ভালো করে তাকাল। নীল থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট আর বেন টেন এর চিত্রখচিত সবুজ গেঞ্জি পড়ুয়া নাদুসনুদুস এক ছেলে। চুলগুলো খাঁড়া খাঁড়া। লম্বায় নিলয়কে প্রায় ছুঁই ছুঁই করছে। নিলয় মুখের সামনে হাত নিয়ে হামি তুলে বলল, “ও এখন নেই।”
মুবিন কাঁধ ঝাকাল, “কখন আসবেন?”
“ক’টা বাজে এখন?” বলে নিজেই ঘাড় ঘুরাল। দেয়ালে লেপ্টে থাকা সোনালী রঙা বড় ঘড়িটা দেখে বলল, ” এসে পড়বে বিশ, পঁচিশ মিনিট।”
“আমি তাহলে বসি।”কোনো প্রকার অনুমতির অপেক্ষা ছাড়াই মুবিন ঘরে ঢুকে গেল। নিলয় বিড়বিড় করতে করতে নিজের চৌকিতে ফিরে গেল আবার, “দেশ এই ধরনের পোলাপানদের হাতে পড়লে সর্বনাশ। রসাতলে যাবে।”
নিলয় হাত দিয়ে কপাল ঢেকে শুয়ে রইল। ইমাদ এসে দেখল মুবিন তার চৌকিতে বসে আছে। অনবরত পা নাড়াচ্ছে আর গেইমস খেলছে মোবাইলে। সে কাঁধের ব্যাগটা চৌকিতে রেখে বাথরুমে গিয়ে হাত- মুখ ধুলো। গামছায় মুখ মুছতে মুছতে বেরুতেই মুবিন উঠে দাঁড়াল, “স্যার, আমাদের পুরো সিলেবাস বাকি।”
“হুম।” ইমাদ শার্ট খুলে দড়িতে ঝুলাল।
মুবিন খানিক ইতঃস্তত করে বলল, “স্যরি স্যার।”
“ইটস ওকে।”
“অন্তত মিলার জন্যে পড়াতে আসুন।”
“আচ্ছা।”
মুবিন প্রফুল্ল হয়ে উঠল। চোখের তারায় হাসির ঝিলিক ফুটে উঠল। সবকটা দাঁত বের করে হেসে বলল, “থেঙ্ক ইউ, স্যার।”
ইমাদ কিছু বলল না। পকেট থেকে মোবাইল বের করে চার্জে দিয়ে টেবিলে রাখল। মুবিন বলল, “তাহলে নেকস্ট মঙ্গলবার থেকে আবার পড়ব, স্যার।”
“আচ্ছা।”
“আসি স্যার?”
ইমাদ হ্যাঁ- সূচক মাথা নাড়ল। মুবিন ঘুরে চলে যাচ্ছিল। ফিরে এল আবার। ইমাদ মুখ তুলে প্রশ্নবোধক চোখে তাকাল।
“পাথরের এই মূর্তিটা কী কেনা?” মুবিন আঙুল তাক করে দেখাল।
“না।”
“হ্যাঁ, দেখেই মনে হচ্ছিল। এখনও তো অসম্পূর্ণ।”
ইমাদও ভালো করে তাকাল। মুবিন আবার প্রশ্ন করল, “এটি কার?”
“ওর।”
“বানাচ্ছে?”
“হুম।”
“কী করে?”
“ওকে জিজ্ঞাসা করো।”
মুবিন নিলয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াল, “ভাইয়া আপনি ত দারুণ।”
নিলয় কপাল থেকে হাত না সরিয়েই বলল, “থেঙ্কস।”
মুবিন মূর্তিটার দিকে এগিয়ে যেতেই নিলয় ধমকে বলল, “ধরো না ওটা।”
মুবিন বিড়বিড় করল, “কী ভাব!” তারপর গটগট করে চলে গেল সে, কিন্তু ইমাদ আর কখনো ওদের পড়াতে গেল না।
চলবে….

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৯
কড়ি আর দীপার বন্ধুত্বটা ভালোই যাচ্ছে। দীপার খুব একটা বান্ধবী নেই। বন্ধু আছে অনেক। স্কুল, কলেজ থেকেই ওর ছেলেদের সাথে ঝট করে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। উল্টোদিকে, মেয়েরা ওকে কোনো এক অজানা কারণে সহ্য করতে পারে না। এই প্রথম একটা মনের মতন বান্ধবী জুটেছে। বয়সে যদিও কড়ি ছোট তবুও খাতিরটা জমে ক্ষীর। কড়ি ইমি আর নিলয়ের মত না। দীপার সব কথাই ও মনোযোগ দিয়ে শুনে। যেখানে অন্যরা দীপার কথার ঝড়ে কানে আঙুল চেপে বসে থাকে সেখানে ওর এই বকবকে কড়ির অবিশ্বাস্য আগ্রহ। এত মনোযোগী শ্রোতা পেয়ে দীপারও আনন্দের শেষ নেই। যেখানেই যায় কড়িকে সাথে নিয়ে যায়। এই যেমন আজ সে একটা হাত ঘড়ি কিনবে বলে কড়িকে ফোন করে মার্কেটে নিয়ে এল। খুব সুন্দর একটা কালো চেনের ঘড়ি কিনল সে। এরপর ফুচকা খেতে খেতে বলল, “তোমার বাসায় নিবে না আমায়? আজকে চলো তোমার বাসায় যাই।”
কড়ি ঠোঁটে হাসি টেনে বলল, “বাসায় যাবে?”
“বন্ধুদের বাসায় গিয়ে আড্ডা দেওয়ার মজাই আলাদা। নিলয় আর ইমির মেসে ত আর যেতে পারি না। যদিওবা, ওরা আমার বাসায় আসে। তবুও আমার ত আর যাওয়া হয় না।”
ব্যস হয়ে গেল। কড়ি দীপাকে নিয়ে নিজের বাসায় চলে এল। তবে বিপত্তি বাঁধল রিকশা থেকে নেমে। রিকশাওয়ালা পাঁচটাকা ভাঙতি নেই বলে পঁচিশ টাকার জায়গায় ত্রিশ টাকা রেখে দিতে চাইল। ওদের কাছেও ভাঙতি ছিল না। অথচ, দীপা স্পষ্ট দেখেছে রিকশাওয়ালা যখন টাকা গুনছিল তার মাঝে পাঁচ টাকার নোট আছে। সে লেগে গেল ঝগড়া, “পাঁচ টাকা বেশি রাখতে চান বললেই হলো। মিথ্যে বলছেন কেন? আপনার টাকাগুলো দেখান ওখানে পাঁচ টাকার নোট আছে। এখনি, এখনি বের করুন।”
কায়েস চেঁচামেচি শুনে দু’তলার বারান্দা থেকে উঁকি দিলো। নীচে কড়িকে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি করে নেমে এল, “কী হয়েছে, কড়ি?”
“তেমন কিছু না, ছোট ভাইয়া।” কড়ি দীপার হাত টেনে ধরল। ফিসফিস করে বলল, “শশশশশ্ বাসায় চলো, প্লিজ। বাসার সামনে চেঁচামেচি না।”
দীপা বিরক্ত হয়ে কড়ির দিকে তাকাল। কায়েস কিছু বলল না আর। অদ্ভুত চোখে দীপার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেল। রিমা বাসায় ছিল না বলে কড়ি দীপাকে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে নিজেই নাশতা তৈরী করতে চলে গেল।
কাদের সাহেবও বাসায় ফিরলেন তখন। আজ ফিরতে একদম দেরি হয়ে গেছে! দুপুরে খাওয়াও হয়নি। ডায়াবেটিস এর রোগী তিনি। শরীর কাঁপছে রীতিমত। তাই কাপড় বদলে আগে খেতে বসলেন। ঔষধের বক্স নিয়ে এসে ইনসুলিন বের করলেন। ডাইনিং আর ড্রয়িংরুমের মাঝে টানানো পর্দাটা সরান ছিল। দীপা ড্রয়িংরুম থেকে দেখল এটা। সে নিজ থেকে উঠে এসে বলল, “দিন আমি দিয়ে দিই, আঙ্কেল।”
“না, না আমি নিজে নিজেই দিতে পারি। নিজের কাজ নিজে করে অভ্যস্ত।”
দীপা তার স্বভাব অনুযায়ী বারণ শুনল না। সিরিঞ্জ হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সে নিজেই ইনসুলিন দিয়ে দিলো। আর একটানা কথা বলেই গেল, “আমার আব্বাকে ত আমিই দিতাম। আপনি কত ভালো। একটুও জ্বালাতন করেন না। একদম শান্ত একটা বাচ্চা ছেলে। আর আমার বাবা যে কী ছিলেন! নিজে দিবেন ত দূরের কথা সিরিঞ্জ ভয় পেতেন। হা হা হা।” দীপা একাই কথা বলল। একাই হাসল। কাদের সাহেব চুপ রইলেন। এমনকি ধন্যবাদও দিলেন না। কিছু কিছু মানুষের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। তাদের কথা শুনতেই পরাণ জুড়ায়।
দীপা চলে যাওয়ার পর কাদের সাহেব কড়িকে ধরলেন, “মেয়েটা কী তোর বান্ধবী?”
“হ্যাঁ।”
তারপর আরো কিছু কথা জানতে চাইলেন। কড়ি অন্যকিছু ভাবল না। তবে চমকে গেল রাতের টেবিলে খেতে বসে। সবাই এক সাথে খেতে বসেছে তখনি কাদের সাহেব কথাটা তুললেন,
“আজকে কড়ির সাথে যে মেয়েটা এল ওকে কাদিনের জন্য আমার খুব পছন্দ হয়েছে, কড়ি। মেয়েটার কোনো ছবিটবি থাকলে কাদিনকে দেখাস।”
কড়ি লুকমা মুখে তুলে নিতে গিয়ে থেমে গেল। মুখের সামনে লুকমাসহ হাত স্থির হয়ে রইল অনেকক্ষণ। দীর্ঘ সময় পর ছোট করে বলল, “ঠিক আছে।”
কাদিন কিছু বলল না। রিমা বলল, “কে এসেছিলরে কড়ি?”
“নতুন বান্ধবী তুমি চিনবে না।”
“তাই নাকি!”
“হুম।”
কড়ির বড় ভাই আব্দুল কাইয়ূম বলল, “তোর সাথে পড়ে নাকি?”
“না, না সিনিয়র। অন্যভাবে বন্ধুত্ব।”
কায়েস মিটিমিটি হাসছিল। রিমা সেটা খেয়াল করল। খাবার শেষে কায়েসকে গিয়ে ধরল, “সেসময় হাসছিলি কেন?আমাকে না বললে কিন্তু হবে না।”
কায়েস আবার হেসে ফেলল, “ঐ মেয়ে রিকশাওয়ালার সাথে ঝগড়া করছিল! ভাবা যায়! মিস্টার মোস্তফা কাদিনের বউ ভবিষতে অলিতেগলিতে, সবজিওয়ালা, দোকানদার, রিকশাওয়ালা সবার সাথে ঝগড়া করে বেড়াবে। উফ সিনেমার মত দৃশ্যটা চোখে ভাসছে! হায় হায় হায় বাবা এতদিনে একটা কাজের কাজ করতে যাচ্ছে।” কায়েস হাত দিয়ে রোল, ক্যামেরা অ্যাকশন এর মতন দেখাল।
“অ্যাহ? বলিস কী!” রিমাও হেসে কুটিকুটি।
কায়েস বলল, “খবরদার বড় ভাইয়াকে বলো না যেন! ও তাহলে কাদিন ভাইয়াকে ঝগড়ার কথা বলে দিবে।”
“আরে না ওকে বলব না, কিন্তু মেয়েটা এমনিতে ভালো তো?”
“কড়ির বান্ধবী যেহেতু অবশ্যই ভালো। তবে মোস্তফা কাদিনের অতিরিক্ত ইমেজ সচেতনতাকে দুই মিনিটে পা দিয়ে পিষিয়ে ফেলতে যথেষ্ট। আর ঝগড়াটে মেয়েগুলো খারাপ হয় কে বলল তোমায়? ওরা আরো ভালো হয়। একদম পিওর হার্টের। মনে যা মুখেও তা। তোমার বড় দেবরের মতন ভালো মানুষ সেজে থাকে না।”
“অ্যাহ আমার দেবরকে কিছু বলবি না তুই। ও হলো আদর্শ ছেলে।”
“হ্যাঁ, জানি তো ওই তোমার প্রিয় দেবর।”
“ও আমার প্রিয় দেবর হলে তুই আমার প্রিয় ভাই।”
“কলা দিয়ে আর ছেলে ভোলাতে হবে না।”
“আমি ভাবছি ভিন্ন কথা।”
“কী কথা?”
“ভাবছি কাদিনের জন্য এমন মেয়ে নিয়ে আসলে তোর জন্য কেমন মেয়ে খুঁজব? তোর বেলায় তাহলে গম্ভীর একটা হুতুম পেঁচা নিয়ে আসব।”
“কবে আনবে, আপু? আনো না। আর তো সহে না।” কায়েস বিছানায় কাত হয়ে শুলো।
“এত লাফিও না। তোমার বিয়ের অনেক দেরি! আগে কড়ি তারপর তুমি!”
“না মানি না, মানব না।” কায়েস হাত উঁচু করে আন্দোলন করার ভঙ্গি করতে লাগল।
“করতে থাক আন্দোলন, অনশন, হরতাল। আমি গিয়ে ঘুমাই।” রিমি হেসে চলে গেল।
.
একেকবার দীপার জন্য একেকটা বিয়ের সম্বন্ধ আসে আর দীপার মায়ের কান্নাকাটির রোল পড়ে। দীপার কাছে কেঁদেকেটে লাভ হয় না বলে মেয়ের বন্ধুদের কাছে কাঁদতে বসেন। উদ্দেশ্য একটাই, মেয়েকে কোনোভাবে কেউ যদি বিয়েতে রাজি করিয়ে দেয়, কিন্তু আজ পর্যন্ত কখনো কেউ তা পেরে উঠেনি। দীপার মা তবুও হাল ছাড়েন না। যতবারই নতুন নতুন সম্বন্ধ আসে ততবারই যুদ্ধে নেমে পড়েন। কাদিনদের পক্ষ থেকে সম্বন্ধ আসার পরও তাঁর মেয়ের প্রতিক্রিয়া একই। বিয়ে করবে না, না, না মানে না। তিনি সববারের মতন এবারেও নিলয় আর ইমাদের কাছে কল করে কান্নাকাটি করলেন। দীপার মায়ের অসহায় কান্না শুনে ব্যর্থ হবে জেনেও ওরা দুজন ছুটে এসেছিল দীপাকে বিয়েতে রাজি করাতে, কিন্তু এসে বিস্ময়ের চরম সীমানায় পৌঁছে গেল। দীপা বিয়েতে রাজি। রাজি মানে বিয়ে করতে একদম উতলা হয়ে গেছে। দীপার মাও অবাক। খুশিতে তিনি পাগল পাগল হয়ে ওদের দুজনকে একটু পর পর ধন্যবাদ দিচ্ছেন। তিনি ধরে নিয়েছেন ওরাই রাজি করিয়েছে। অপরদিকে, ওরা কিছুতেই কিছু বুঝে উঠছে না। সকালে কল করে বিয়েতে রাজি হতে বলায় দীপা অনেক রাগারাগি করল। এমনকি ওদের কাছে কড়িকেও বকাঝকা করল। কড়িকে খুঁজে নিয়ে আসায় ইমাদের উপরও সেই ঝড় গেল। আর দুপুর গড়িয়ে বিকেলেই সব দৃশ্য এমনভাবে পাল্টে গেল!
দীপা ড্রেসিংটেবিল এর সামনে ঘাড় কাত করে বসে চুড়ি পরছে। ইমাদ আর নিলয় প্রায় একইসাথে সমস্বরে প্রশ্ন করে উঠল, “হচ্ছেটা কী?” নিলয়ের কণ্ঠ উত্তেজিত, ইমাদের স্বর হিমশীতল।
নিলয় অস্থির হয়ে ঘরময় পায়চারি করছিল আর ইমাদ চোখ বন্ধ করে কাউচে হেলান দিয়ে বসে আছে। দুজনের মাথাই চিন্তায় ফেটে যাচ্ছে।
চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে