Friday, July 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 375



একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-৩৮+৩৯

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৩৮
নিলয় আর ইমাদ রাস্তার পাশের টঙ দোকানে মুখোমুখি দুটো বেঞ্চে বসে আছে। ইমাদের হাতে চায়ের গ্লাস, নিলয়ের ঠোঁটে সিগারেট। সে সিগারেটে টান দিয়ে বলল, “এই মেয়েকে ভুলে যা, ইমাদ।”
ইমাদ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, “আচ্ছা।”
নিলয় হাতের সিগারেট ছুঁড়ে ফেলল। উঠে এসে ইমাদের বেঞ্চিতে বসে ইমাদের কাঁধ জড়িয়ে ধরল, “সত্যি সত্যি আচ্ছা বল।”
ইমাদ নিশ্চুপ। নিলয় হতাশামিশ্রিত গলায় বলল, “তুইও দীপুর মতই করছিস। আমরা দুজনে মিলে তখন দীপুটাকে না করেছিলাম। ও তো অবুঝ, বুঝেনি। কিন্তু তুই তো এমন না।”
ইমাদ এবারেও চুপ। মুখে কোনো রা নেই। সে তাকিয়ে আছে টঙ দোকানের লাইটের দিকে। যেখানে কয়েকটা পোকা দল বেঁধে আছে। নিলয় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, “বুঝলাম প্রেমে পড়লে সবাই এমন। একই!”
ইমাদ তখনও কথা না বলায় নিলয় বলল, “তোর পেট ফেটে যায় না কেন? আর কিছু লুকাচ্ছিস না তো? এমন চুপ করে কেন?”
“না লোকাচ্ছি না।”
“বিশ্বাস নেই তোর। কতকিছু যে লুকাস তুই! আমি যদি সেদিন তোকে কড়ির জানালার সামনে না দেখতাম আর আজ ডিএসপিতে একসাথে তাহলে তো কিছুই জানা হতো না আমার! সেদিন অবশ্য জানালার সামনে দেখেও ঠাহর করতে পারিনি।”
“আচ্ছা।”
নিলয় ইমাদের দিকে তাকিয়ে ওর হাবভাব বোঝার চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুই বুঝল না। তবুও আন্দাজে বলল, “তুই বুঝতে পারছিস না মেয়েটা খুবই অদ্ভুত? লোভীও।”
ইমাদ এবার মুখ খুলল, “লোভী না।”
নিলয় বলল, “গেছে তোর মাথাটাও গেছে।”
ইমাদ বলল, “আমাকে বাজাতে চাইছে। পরীক্ষা।”
নিলয় কিছু একটা বলতে নিচ্ছিল তার আগেই ইমাদ উঠে দাঁড়াল। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করতে করতে বলল, “তোর কথাটা শুনে আরেকটা জিনিস মনে হলো।”
নিলয় বলল, “কী?”
ইমাদ দোকানদারকে টাকা মিটিয়ে বলল, “তুই যা ভাবছিস বা সবাই শুনে যা ভাববে তা সে আমাকেও ভাবাতে চাইছে। দূর করবার ফন্দিও হতে পারে।”
নিলয় বলল, “তা এখন কী করবি? যদি মেনেও নিই সে লোভী না তবুও তোর কী করার আছে?”
“যা চায় তাই দিব।”
“এত টাকা কোথায় পাবি? কেমনে সম্ভব?”
“জানি না।”
নিলয় খুবই হতাশ। দীপুর সুখ আসতে না আসতেই ইমির ঝামেলা শুরু। ওর মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
.
কড়ি লাগেজ টেনে ঘর থেকে বেরুলো। কাইয়ূম লাগেজটা ধরে বলল, “রিকশা বাইরে দাঁড়ানো। তুই আয়, আমি যাচ্ছি।”
কড়ি বলল, “তোমার যেতে হবে না।”
“আমার যেতে হবে নাকি হবে না সেটা আমি জানি।”
“একা ঢাকা যেতে পারব আর বাস স্টপ পর্যন্ত যেতে পারব না? তুমি অফিসে যাও, অফিসের দেরি হবে।”
রিমা বলল, “তোর বড় ভাইয়া শুধু বাসে উঠাতে যাচ্ছে না, ঢাকা পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে।”
কড়ি হেসে বলল, “হে পারলে কোলে করে নিয়ে যেতে বলো এত বড় মেয়েকে।”
কাদের সাহেব বললেন, “ব্রেক নিয়েছ আশা করি এই সেমিস্টারে মন দিয়ে পড়াশুনা করবে।”
“ইনশাআল্লাহ, বাবা।”
দীপার মুখটা খুবই মলিন। ও পারলে কেঁদে দিতো। কাদিনের জন্য কাঁদতে পারছে না। কাঁদলে আবার কী না কী বলে! কড়িকে বলল, “তোমাকে অনেক মিস করব।”
কড়ি হেসে দীপাকে জড়িয়ে ধরতে গেল। দীপা বলল, ” না, না ধরো না। ধরলেই কেঁদে দিব।”
সবাই হাসল একমাত্র কাদিন ছাড়া। কায়েস বলল, “কেঁদো না মেজভাবি, আমি আছি না তোমার জন্য? শুধু তোমার জন্য…..” শেষের দিকে সুর করে বলল।
দীপা এবার নিজেও হেসে ফেলল। কাদিন বলল, “দেরি হয়ে যাচ্ছে, কড়ি।”
কড়ি সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এল। বাসে বসতেই কড়ির মোবাইল টুং করে উঠল। কড়ি পার্স থেকে মোবাইল খুলল। রিমার মেসেজ। মেসেজে লিখা, “তোর বড় ভাইয়া কাল রাতে আমাকে বলছিল হয়তো এটাই বোনের সাথে আমার শেষ এমন যাত্রা। পরে তো ও সবসময় ওর বরের সাথেই আসা যাওয়া করবে। বা আমার সাথে কোথাও গেলেও কতকিছুই বদলে যাবে। পাশের সিটটা তখন ওর বরের হয়ে যাবে। ওর কিছু খেতে ইচ্ছে করলে আমাকে কখনই বলবে না। বরকে বলবে কিনে দাও। ওর ব্যাগ টানবে সেই লাকিম্যান। তাই আমি কাল ওর সাথে ঢাকা যাব। কবে বোনটার বিয়ে হয়ে যায় ঠিক নেই।”
মেসেজটা পড়ে কড়ি হাসবে না কাঁদবে তা নিয়ে দোটানায় পড়ে গেল। রিমাকে রিপ্লাই লিখল, “তুমি আমার কাছে একটা ট্রিট পাওনা রইলে, আপু। থেঙ্ক ইউ।”
তারপর সাথে সাথে পাশের সিটে বসা কাইয়ূমের হাত ধরে বলল, “বড় ভাইয়া, আমার না আচার খেতে ইচ্ছে করছে। এনে দাও।”
কাইয়ূম বলল, “কিসের?”
“প্রাণের আমের আচারটা আনবে। অনেকগুলো।”
কাইয়ূম বলল, “উফ আগে বলবি না? এখন বাস ছাড়বার সময় হয়েছে। এখন এলি বিরক্ত করতে।”
বলতে বলতে কাইয়ূম বাস থেকে নামল। কড়ি হাসল। তার একেক ভাই তাকে একেকরকম আদর করে। কাইয়ূমের আদর মা মা আদর। মায়ের মত সবসময় মায়া আর মায়া। যেন মা যে নেই সেটা সে কোনোভাবেই কড়িকে বুঝতে দিতে নারাজ।আর কাদিন ঠিক বাবার মতন। আসার সময় হাতে কতগুলো টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, “সাবধানে।”
কিন্তু কখনোই জড়িয়ে ধরবে না, আবার কখনো ধমকও দিবে না। কিন্তু কড়িকে সবকিছুই অঢেল দিতে পারলেই সে শান্তি পায়। আর কায়েসের আদর পৃথিবীর সেরা ভাইদের আদরের মতন। জড়াজড়ি, ধমকাধমকি, শাসন, মজা, আদর, স্নেহর ফুলপ্যাকেজ। কড়ি মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ্‌ বলল। এবং সে যা করেছে তা যে ঠিকই করেছে তা নিশ্চিত হলো। এই বাবা – ভাইদের ইচ্ছা আর সাধের চাইতে অধিক মূল্যবান কিছু নেই। ইমাদের কাছে গয়নার চ্যালেঞ্জ ছু্ঁড়ে দেয়া দারুণ একটি কাজ হয়েছে। ইমাদ এখন নিশ্চয়ই তাকে লোভী ভাববে এবং তার প্রতি থাকা অনুভূতিগুলোও মলিন হয়ে যাবে। এইরকম লেইম কথাবার্তা বলা মেয়েদের প্রতি ভালোবাসা ধরে রাখা অসম্ভব। আর যদি কোনোভাবে ইমাদ বিষয়টা ধরতে পারে তাতেও সমস্যা নেই। ইমাদের পক্ষে কতটুকু কী করা সম্ভব, ওর পরিবারের আর্থিক অবস্থা কেমন সব সম্পর্কেই কড়ি দীপার কাছ থেকে ইনিবিনিয়ে সব জেনে নিয়েছে। দীপা ত সহজসরল টেরও পায়নি। সব শুনে কড়ির মনে হয়েছে ইমাদ কখনই এত গয়না যোগাড় করতে পারবে না। আর ইমাদ যেধরনের মানুষ গয়না দিতে না পারলে জীবনে কড়িকে আর মুখও দেখাবে না। সহজ সমাধান। কড়ি নিজের আঙুলে থাকা রামিমের মায়ের দেয়া আঙটি ঘুরাতে ঘুরাতে হাসল। বিড়বিড় করল, “থেঙ্কস আন্টি। আপনার দোয়া আর দাওয়া দুটোই কাজে লাগল! মায়েদের দোয়ার অনেক ক্ষমতা!”
.
দীপার সারাদিন অসম্ভব মলিন হয়ে রইল। একে তো কাদিন ওর সাথে এমন করে, তারপর আবার কড়িও চলে গেল। মায়ের জন্যও মন পুড়ছে। কিন্তু জিদ দেখিয়ে কাদিনকে বলেছে সে না গেলে ও যাবে না। সবদিক মিলিয়ে মন খুবই থমথমে। দুপুরে ভালো মত খেলোও না। কিছু ভালো লাগে না তার। তাই ছাদে এসে বিকেলের নরম রোদে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। এরপর হঠাৎ মনে হলো কেউ বোধহয় তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। দীপা মনে মনে বলল, “হুম জীবনে এখন ভূতপেত্নী আসাটাই বাকি আছে।”
ভাবতে ভাবতে ফিরে তাকিয়েই দেখল ভূত নয়, কাদিন। সে বলল, “ওহ আপনি। আজ এত তাড়াতাড়ি?”
দীপা আবার সামনে তাকাল। কাদিন পেছনে দাঁড়িয়েই বলল, “যাওনি কেন?”
“এমনভাবে বলছেন যেন মনে হচ্ছে আপনি জানেন না!” দীপা ঠেশ দিয়ে বলল।
কাদিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “যাও ঘুরে এসো।”
“আমি জাহান্নামে যেতে রাজি কিন্তু বাপের বাড়ি আর কোনোদিন যাব না। কেউ মরলেও যাব না।” অভিমানে দীপার কণ্ঠ ভেজা ভেজা।
খানিক পরে নিজেই আরো যোগ করল, “হাসপাতালে দেখে নিব।”
কাদিন কথা না বাড়িয়ে নীচে নেমে গেল। দীপা ছাদে বসতে গিয়েও বসল না। ছাদে এভাবে বসলে কাদিন ওকে আবার গোসল করাবে নিশ্চিত। দরকার নেই। পাগলের সাথে বিয়ে হয়েছে তার। আর দাঁড়িয়েও থাকা যাচ্ছে না। পা ব্যাথা করছে তাই সেও নীচে নেমে গেল। ড্রয়িংরুম পাড় করে তারপর ভেতরে ঢুকতে হয়। দীপা সেদিক দিয়েই আসছিল, কাদিন ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “কালকে নিয়ে যাব।”
দীপা আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেল। অতিআনন্দে কাদিনের শার্ট খামচে ধরে আচমকা তার গালে চুমু খেয়ে ফেলল। কাদিন বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে এদিকওদিক তাকিয়ে বলল, “দীপা! এসব কী?”
চুমুটা সে ইচ্ছে করেই খেয়েছে। সুযোগ খুঁজছিল এমন কিছু একটার। নিজের ভুল শুধরাতে আর কাদিনের রাগটা যেন কেটে যায়, তাই আরকি। কিন্তু, কাদিন খুশি হওয়ার বদলে ক্ষেপে যাবে সেটা দীপা ভাবেনি। রাগে, লজ্জায় মেঝের দিকে তাকিয়ে কোনোমতে বলল, “স্যরি, ভুলে দিয়ে ফেলেছি।”
কাদিন দীপাকে ধাক্কা দিয়ে সরে গেল। দীপা ধাক্কা খেয়ে পাশে থাকা সোফায় বসে পড়ল। হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কাদিনের চলে যাওয়ার দিকে। কাদিনও হতভম্ব! কী বলে এই মেয়ে? সে ভুলে চুমু খেয়েছে? কাদিন প্রথমে বিরক্ত হয়েছিল এই ভেবে যে, যে কেউ দেখে ফেলতে পারতো! এটা ড্রয়িংরুম। কিন্তু ভুলে কথাটা শুনে কাদিনের মেজাজটা চড়ে গেল।
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৩৯
গাড়িটা ছুটে যাচ্ছে চিটাগাং রোডে। বাইরে ভোর হচ্ছে। মঈন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। চট্টগ্রাম ওর আসতে ইচ্ছে করে না। গাড়িটা রাস্তা দিয়ে নয় ওর বুকের উপর চলছে। কী অসহ্য যন্ত্রণা। শ্বাস নিতে ইচ্ছে করে না। পাশে তাকাল সে। শিল্পী শক্ত হয়ে বসে আছে। কোনো নড়াচড়া নেই। ঘাড়টা অস্বাভাবিক রকমের নুয়ে আছে। মঈন ভ্রু কুঁচকে ফেলল। শিল্পীর কাঁধে হাত রেখে ঝাঁকুনী দিয়ে বলল, “অ্যাই?”
শিল্পী বিদ্যুতের মত ঘাড় তুলে ওর হাত সরিয়ে দিলো। বলল, “দূরে থাকো।”
মঈন একটু সময় তাকিয়ে রইল। এরপর আবার জানালা দিয়ে বাইরের তাকাল। গাড়ির কাঁচ নামাল। বাতাস হেলেদুলে ওর চোখে মুখে পড়ছে। পুলিশ ধারণা করছে ওরা মুবিনকে পেয়েছে। ছেলেটা মুবিন কিনা নিশ্চিত করতেই ওরা দুজন ছুটেছে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। ছেলেটা কী তার উপর রাগ করে চলে গেল? নাকি চলে গেছে লজ্জায়? জন্মদিনে নতুন মা পেয়ে ওর বোধহয় আর বাড়িতে মন টেকেনি। কী লজ্জা! কী লজ্জা! নিজের মায়ের কীর্তি শুনলে এই ছেলে কী করে বসবে আল্লাহই ভালো জানে। ও বোধহয় বিশ্বাসই করতে পারবে না যে ওর মা এমন জঘন্য কাজ করতে পারে। সে নিজে কী বিশ্বাস করতে পেরেছিল? আহ শিল্পী কেন এমন করলে তুমি? তুমি ত এমন হওয়ার কথা ছিলে না। মঈন সিটে হেলান দিলো। চোখ বন্ধ করল। চোখ জ্বলছে। তারচেয়ে চোখ খোলাই থাকুক। আবার চোখ মেলল সে। ছুটে যাওয়া রাস্তার মত করে স্মৃতিগুলোও এদিকওদিক চোখের সামনে ছুটছে। সময়টা বেশ কয়েক বছর আগের। রাঙামাটির পেদা টিং টিং রেস্টুরেন্টে হঠাৎ জোহরার সাথে ওদের দেখা। পেদা টিং টিং যে একটা রেস্টুরেন্টের নাম এটা প্রথমে মঈনরা জানতো না। ভেবেছিল এমনি শুধু ঘুরবার জায়গা। পরে শুধু ঘুরবার জন্য গিয়েই দেখতে পেল একি এখানে ত ভোজনরসিকদের আড্ডা। ব্যস ওরা বসে গেল ব্যাম্বো চিকেন নামক অমৃত খেতে। খাওয়া দাওয়া শেষে ওরা পেছন দিকের সবুজের মাঝে হারিয়ে গিয়েছিল। বাচ্চারা খেলছিল। শিল্পী আর মঈন বসেছিল তৈরী করা বসার জায়গায়। ক্লান্ত শিল্পী মঈনের বুকে মাথা এলিয়ে আঁচলে বাতাস করছিল। এটা সেটা নিয়ে কথা বলছিল, গল্প করছিল দুজন। ঠিক তখন ছায়াটা ওদের সামনে পড়ল। কার ছায়া ঘুরে দেখতেই অবাক হয়েছিল তিনজোড়া চোখ। মুখোমুখি জোহরা, মঈন আর শিল্পী। কয়েকটা মুহূর্ত গেল তারপর জোহরা বলল, “আপু না?”
শিল্পী উঠে দাঁড়াল। দুজন ঝাঁপিয়ে পড়ল দুজনের উপর। মঈন স্মিত হাসল। তারপর জোহরা আর শিল্পীর কত কথা। কেমন যাচ্ছে দিনকাল, কার কয় বাচ্চা, কে কোথায় আছে এসব। মুবিনরা কী একটা দেখে অবাক হয়ে মাকে ডাকছিল। মাকে দেখিয়ে জানতে চাইবে এটা কি? শিল্পী ভাবল কী না কী তাড়াতাড়ি করে ছুটে গেল। মঈন বসে রইল চুপচাপ। জোহরাও নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল। এক সময় জোহরা বলল, “মঈন ভাই, আপনাদের দুজনকে একসাথে দেখে অনেক ভালো লাগছে আমার। কেমন একটা প্রশান্তি অনুভূত হচ্ছে।”
মঈন বলল, “শিল্পী খুব ভালো মেয়ে। আমি সুখী।”
জোহরা বলল, “হ্যাঁ, আপু খুব ভালো। ভালো বলেই তো বুকে পাথর চেপে চিঠিটা আমার কাছে নিয়ে ছুটে এসেছিল।”
মঈন তাকাল জোহরার দিকে, “বুকে পাথর চেপে মানে?”
জোহরা অবাক হলো, “আপনি কী কিছুই জানেন না, মঈন ভাই?”
মঈন উঠে দাঁড়াল, “কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না।”
“আপু আপনাকে ভালোবাসত, প্রথম থেকেই। এখনও জানেন না?”
“মানে?”
জোহরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “মানে আপু আপনাকে এখনও কিছুই বলেনি। প্রথম থেকেই আপনাকে ভালোবাসত আমি জানতাম। আর আমি ভাবতাম আপনিও তাই। এজন্য কখনো নিজের ভালো লাগার কথা বলে আপনাদের মাঝে আসবার কথা চিন্তা করিনি। বাবা বিয়ে ঠিক করায় নাও করিনি। পরে আপনি যখন আমাকে চিঠি দিলেন আপু খুব কষ্ট পেল। তবুও আমার কাছে চিঠি নিয়ে এসেছিল। হেরে যাওয়া মানুষের মত বলেছিল, “জোহরা, একটা ভুল হয়ে গেছে। মঈন আমাকে নয় তোকে ভালোবাসে। বিয়েটা ভেঙে দে। ও তোর জন্য পাগল।”
জোহরা হাসবার চেষ্টা করে আরো বলল, “কিন্তু আমার আকদ হয়ে গিয়েছিল। তাই আপুকে বলেছিলাম, তোমার ভালোবাসার শক্তি আমাদের ভালোবাসার শক্তির চাইতে অনেক বেশি। আমরা এক হতে পারব না, কিন্তু তোমরা হলে আমি খুব খুশি হবো।”
মঈন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়েছিল। জোহরার ডাক পড়ায় ও চলে গেল। শিল্পী এসে জোহরাকে না পেয়ে বলল, “কী ব্যাপার ও চলে গেল নাকি?”
মঈন কোনো কথা না বলে আচমকা শিল্পীকে জড়িয়ে ধরল।
নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল তার। একটা মানুষ তাকে এতটা ভালোবাসে তবুও বছরের পর বছর পাশে থেকেও প্রকাশটুকু পর্যন্ত করেনি। সন্ধ্যা নেমে আসছিল। জোহরা একটু পরেই আবার ফিরে এল। ওদের ডেকে বলল, “আজ আমার আর আমার হাজবেন্ডের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি। এখানে কাটবে বলে ও কেক নিয়ে এসেছে। তোমরাও এসো না?”
কেক নিয়ে জোহরার স্বামী অপেক্ষা করছিল। হাতে হাত রেখে দুজন কেক কাটার সাথে সাথে করতালিমুখর হয়ে উঠে আশপাশ। জোহরা সবাইকে কেক দিচ্ছিল। মঈন কেক খাচ্ছিল। আচমকা পাশ থেকে কে একজন তার পাশের মানুষটাকে ভারি গলায় জিজ্ঞেস করল, “আজ কত তারিখ?”
পাশেরজন বলল, “৯ জুলাই।”
মঈন চমকে উঠলে, “৯জুলাই?”
জোহরার বিয়ে ৯ জুলাইয়ে হয়েছে? আর ও চিঠি দিয়েছিল ৬ জুলাই। মঈন জোহরাকে ডেকে বলল, “একটু কথা ছিল।”
“জি।”
“তোমার বিয়ে ৯ জুলাই হয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
“শিল্পী কত তারিখ তোমার ওখানে যায়?”
“আমার বিয়ের পরদিন। ১০ জুলাই।”
মঈন দীর্ঘশ্বাসে হাসল, “আমি ৬ জুলাই চিঠি দিয়েছিলাম। ভাগ্য আসলেই আমাদের চায়নি।”
জোহরা এবার অবাক হলো, “৬ তারিখ দিয়েছিলেন, চিঠি? আপনার ঠিক ঠিক মনে আছে?”
“হ্যাঁ অবশ্যই মনে আছে। কিছু কিছু দিন মানুষ আজীবন চেষ্টা করেও ভুলতে পারে না। ভুল করেও না।”
জোহরা মৃদু হাসল, “অথচ, ৭ তারিখ তো আমি আবার ক্যাম্পাসে আসি। আমার কী একটা কাজ ছিল ভার্সিটিতে খুব জরুরি। বাধ্য হয়ে যেতে হয়েছিল। তখন আমি আমার বিয়ের কার্ডও আপুকে দিয়ে এসেছিলাম। সেদিনও যদি আমাদের দেখা হতো কিংবা আমি আপনাকেও আমার বিয়ের কার্ড দিতাম! যাইহোক সৃষ্টিকর্তার এটাই ইচ্ছা ছিল।”
মঈন খানিক চমকে বলল, “কি বললে?”
জোহরা তাকাল, কিছু বুঝল না। মঈন প্রশ্ন করল, “তুমি ৭ তারিখ এসেছিলে?”
“হ্যাঁ।”
মঈন স্তব্ধ হয়ে গেল। জোহরা বলল, “কি হলো?”
মঈন অনেকক্ষণ কথা বলতে পারল না। অনেকক্ষণ বাদে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, “শিল্পী তাহলে তোমাকে সেদিন কেন বলেনি? তখনি তো বলতে পারত, চিঠিটাও দিতে পারত!”
জোহরাও থমকে গেল। যা বুঝার বুঝল। হঠাৎ তার মনে হলো দেখাটা না হলেই ভালো হতো। তারপর অনেকটা তড়িঘড়ি করেই চলে গেল। কিন্তু মঈন যেতে পারল না। দাঁড়িয়ে রইল বজ্রাহতের মত। কোথায় যাবে সে? প্রতারক বড় বোনসম রুমমেটকে রেখে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু প্রতারক স্ত্রীকে রেখে কী করে চলে যাবে, মঈন? যে শিল্পীর জন্য কয়েক মুহূর্ত আগে সম্মানে, ভালোবাসায় বুক ভরে উঠেছিল, সে শিল্পীর জন্যই মুহূর্তের ব্যবধানে দু নয়নে হেমলক জমছিল।
.
দীপা আর কাদিন দীপার বাবার বাড়িতে এসেছে। খেতে বসে কাদিন খানিক উশখুশ করছিল। দীপা সেটা লক্ষ্য করে বলল, “আমি রেঁধেছি সব।”
কাদিন নিশ্চিন্ত হলো। খেতে খেতে ওর মনে হলো দীপা বোধহয় ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। আজকাল ওকে একটুআধটু বুঝে। খাওয়া শেষে কাদিন ড্রয়িংরুমে বসেছিল। দীপা এসে বলল, “আপনি কি একটু ঘুমাবেন?”
কাদিন বলল, “না।”
দীপা বলল, “আমি চাদর পাল্টে দিয়েছি। নতুন চাদর বিছিয়েছি।”
কাদিন অ্যাকুরিয়াম থেকে চোখ সরাল। দীপার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি গিয়ে রেস্ট নাও।”
কাদিনের খারাপ লাগছিল। বিয়ের পর বাপের বাড়িতে বেড়াতে এসেও যদি রান্নাঘরে ঢুকতে হয় তবে এ আর কেমন বেড়ানো? ওর জন্য দীপাকে এসেই রান্না করতে হলো।
দীপা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমার ঘরে কেউ থাকে না। আমি চলে গেলেও ফাঁকাই ছিল। মেহেদী আর মা নিজেদের ঘরে থাকে।”
কাদিন দীপার দিকে তাকিয়ে রইল। দীপা বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে আমি যাই। আপনাকে বোধহয় বিরক্ত করছি।”
দীপা চলে যাচ্ছিল। কাদিন বলল, “তোমার ঘর কোনটা?”
দীপা বলল, “এদিকে। আসুন।”
কাদিন উঠে দীপাকে অনুসরণ করল। দীপা কাদিনের সামনে বিছানা আবার ঝাড়ু দিয়ে দিলো। বলল, “বালিশের কভারও পাল্টে দিয়েছি।”
কাদিন আস্তিনের কাফলিঙ্ক খুলতে খুলতে বলল, “হুম থেঙ্কস।”
দীপা বেরিয়ে গেল। কাদিন শুয়েছিল। মেহেদী পাশের ঘরে জোরে জোরে পড়া মুখস্ত করছিল। খানিক পর মেহেদীর পড়ার শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। কাদিন বুঝল ওর ঘুমাতে সমস্যা হবে বলে দীপা মেহেদীকে শব্দ করে পড়তে নিষেধ করেছে। কাদিনের ঘুমটা এত আরামের হলো! ঘুমিয়ে উঠে খুব ফুরফুরে লাগছিল তার। মুখে পানি ছিটিয়ে সে ঘর থেকে বেরুলো। দীপাকে এদিকওদিক তাকিয়ে খুঁজে পেল না। মেহেদীকেও দেখল না। দীপার মা নিজ থেকে বললেন, “ভাই-বোনেতে মিলে ছাদে গেছে। আমি ডেকে দিচ্ছি, বাবা।”
কাদিন বলল, “না আমি যাচ্ছি।”
কাদিন চেয়েও মা বলতে পারল না। মা থাকলে মা বলা সহজ। কিন্তু মা না থাকলে কাউকে মা ডাকা অনেক বেশি কঠিন। সিঁড়ি বেয়ে কাদিন যখন উঠছিল ওর হঠাৎ মনে হলো, ওর যেমন মা নেই, দীপারও তেমন বাবা নেই। কিন্তু দীপা তো দিব্যি ওর বাবাকে বাবা ডেকে ডেকে জান দিয়ে দিচ্ছে। কড়ির পর বাবাকেই দীপা এত বেশি পছন্দ করে। দীপার মনটা স্বচ্ছ। ওর মতো অত জটিল নয়। দীপার বাবা নেই তাই ও আরেকটা বাবা খুঁজে নিয়েছে। অপরদিকে, ওর মা নেই তাই উল্টো শাশুড়িকে মা বলে ডাকতে পারে না। কেমন যেন লাগে! মানুষে মানুষে বহুত তফাৎ। ভাবনা-চিন্তা, জীবনযাপন, অনুভূতি, প্রতিক্রিয়া, প্রকাশ সবকিছুতেই একেকজন একেকরকম। কারো সাথে কারো মিল নেই। এই মিল আশা করাও বোকামো।
ছাদে উঠেই কাদিন দেখতে পেল দীপা মেহেদীর পিঠে চাপড় দিতে দিতে হোহো শব্দ করে হাসছে। লুটোপুটি খাচ্ছে কিছু একটা বলতে বলতে। মেহেদীর মুখখানা বিরক্তিমাখা। ও বারবার বোনের হাত সরাতে সরাতে বলছে, “উফ আমায় মারছিস কেন? এজন্য তোকে আমি সুখে দেখতে পারিনা। তুই সুখে থাকলেই আমার পিঠের ছাল উঠে যায়।”
আমোদ পেয়ে দীপার হাত আর হাহাহিহি দ্বিগুণ বেড়ে গেল। কাদিন এগিয়ে যেতেই কাদিনকে দেখে দীপা মুহূর্তেই হাসি থামিয়ে দিলো। সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কাপড় ঝারতে শুরু করল। মেহেদী বলল, “ঘুম হলো ভাইয়া?”
কাদিন বলল, “হ্যাঁ।”
“আমি যাই। মা আমাকে খুঁজবে।”
মেহেদী চলে যেতেই কাদিন বলল, “তোমার ভাইয়ের বুদ্ধি ভালো। খুব বোঝদার।”
দীপা বলল, “হ্যাঁ, আমার মত বেকুব না।”
কাদিন নিঃশব্দে হাসল। দীপা প্রশ্ন করল, “আমাকে কী এখন আবার গোসল করতে হবে? কাপড় পাল্টে ফেললে হবে?”
“হবে না। আর কখনো যেখানে সেখানে বসো না।”
দীপা মুখ কালো করে বলল, “ঠিক আছে।”
কাদিন বলল, “এরপর থেকে মোড়া নিয়ে এসো।”
“ঠিক আছে।”
কাদিন কপাল কুঁচকাল, “তুমি দেখি তোমার ঐ বন্ধুটার মত হয়ে যাচ্ছ।”
“কোন বন্ধুটা?” বন্ধুদের কথা শুনতেই দীপার চোখ মুখ আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠল।
কাদিন বলল, “ঐ যে কথায় কথায় আচ্ছা আচ্ছা বলে ওর মত।”
“ওওওওও আমাদের ইমি!” দীপার ঠোঁট হাসছিল।
কাদিন বলল, “সব কথায় ঠিক আছে বলছ।”
দীপা হাসি বন্ধ করে চুপ হয়ে গেল। কাদিন বলল, “শুনো তোমাকে আমি হাসতে নিষেধ করিনি। শুধু অন্যদের তোমার উপর হাসিয়ো না। আমার বউকে নিয়ে কেউ হাসাহাসি করুক তা আমার ভালো লাগে না। তুমি তোমার ভাইয়ের সাথে একা একা যত ইচ্ছা হাসো। আমাকে দেখে চুপসে যেয়ো না।”
কাদিন এইটুকু বলে চলে গেল।
এই ভর সন্ধ্যায় ছাদ থেকে নেমে দীপাকে গোসল করতে হলো। নিজেকে নিজে বলল, “দীপা খুব শীঘ্রই তোর নিউমোনিয়া হতে চলল। তোর স্বোয়ামি আসলে এটাই চায়। ব্যাটা মন মত বউ পায়নি তো, তাই বারবার তোকে গোসল করিয়ে তোর নিউমোনিয়া করিয়ে ছাড়বে। এরপর তুই নিউমোনিয়ায় মরে যাবি। আর ও ওর মন মত কোনো মেয়েকে আবার বিয়ে করবে। অযথা বেদনায় দীপা বেশি সময় ধরে গোসল করল। ঝরনার নীচে দাঁড়িয়ে কেঁদে কেঁদে চোখও লাল করল। তারপর যখন বাথরুম থেকে বেরুলো ওর লাল টকটকা চোখ দেখে কাদিন বলল, “তোমার কী জ্বর এসেছে?”
দীপা মনে মনে বলল, “আমার কপাল জ্বরের না, সতীনের কপাল। নিউমোনিয়ায় মেরে ফেলার ফন্দি করিস ব্যাটা আবার জানতে চাস জ্বর কীনা!”
কিন্তু মুখে বলল, “না।”
রাতে ঘুমানোর সময় কাদিন দীপার কপালে হাত দিলো, “না, জ্বর নেই।”
দীপা কিছু না বলে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল। একসময় ঘুমিয়েও পড়ল। কাদিন দীপার কাঁধে ঝাঁকুনী দিয়ে বলল, “উঠো তো উঠো।”
দীপা ঘুমের মাঝেই কিসব বলে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। কাদিন এবার দীপাকে কাঁচা ঘুম থেকে টেনে তুলল। দীপা ঘুমঘুম চোখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কাদিন প্রশ্ন করল, “তুমি কি সত্যিই স্যরি?”
দীপা হা করে তাকিয়েই রইল। কাদিন আবার বলল, “কি হলো বলো। তুমি কি সত্যিই স্যরি?”
দীপা কোনোমতে বলল, “হু।” তারপর আবার শুয়ে পড়ল।
“আবার স্যরি বলো।”
দীপা ঘুমে বিরক্ত হয়ে বলল, “স্যরি।”
কাদিন বলল, “যাও মুখ ধুয়ে এসো।”
দীপা বোধহয় ঘুমে শুনলোও না। কাদিন ঝুঁকে আবার ডাকল, “অ্যাই, অ্যাই?”
দীপা চোখ বন্ধ রেখেই বলল, “কি?”
“এসো, এসো মুখ ধুবে।”
কাদিন উঠে বাতি জ্বালাল। দীপাকে আবারো টেনে তুলল, “যাও মুখ ধুয়ে এসো।”
দীপা আড়মোড়া ভেঙে অবাক হয়ে বলল, “কেন?”
“গ’না কিস।”
দীপা চোখ বড় বড় করে একদম শক্ত কাঠ হয়ে গেল। কাদিন হাত ধরে ওকে টেনে নিয়ে গেল বাথরুমে। টুথব্রাশ হোল্ডার থেকে টুথব্রাশ নিয়ে ব্রাশে টুথপেস্ট নিলো। দীপার হাতে ব্রাশ ধরিয়ে দিয়ে বলল, “দাঁত মাজো।”
দীপা বিহ্বল, হতভম্ব। কাদিন তাড়া দিয়ে, ঠেলে, ধাক্কে জোর করে ব্রাশ করাল দীপাকে। দীপা কুলকুচা করে, মুখে মাথায় পানি দিতে দিতে বলল, “আমার মাথা ঘুরাচ্ছে, আমার মাথা ঘুরাচ্ছে।”
কাদিন পানির কল বন্ধ করে দীপাকে হ্যাচকা টানে ঘরে নিয়ে যেতে যেতে বলল, “ঘুরাক।”
দীপার সারা শরীর ঝিমঝিম করে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এল।
চলবে…

একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-৩৬+৩৭

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৩৬
ইমাদ ভেতরে ভেতরে ঘেমে গেল। হায় হায় এখনো প্রেম শুরুই করতে পারল না, তার আগে নাইন টেনে পড়ুয়া বাচ্চাকাচ্চার মত ধরা খেলো! খুবই লজ্জাজনক! এখন কি হবে? কড়ির বোধহয় খুব ঝামেলা হয়ে গেল! ঝামেলাটা দীপুর উপর না বর্তালেই হয়। দীপুর বন্ধুর ঝাল দীপুর উপর মেটান হবে না তো? বুকের ভেতর সুনামি নিয়ে ইমাদ শান্ত দীঘির মত জমে বসে রইল। ভাগ্যিস ইমাদ উল্টোদিকে মুখ করে বসেছিল! এখন না দেখলেই হয়। কড়ি অবশ্য একটুও ঘাবড়াল না। সে স্বতঃস্ফূর্ত এবং যথেষ্ট সাবলীল গলায় বলল, “উমা, ছোট ভাইয়া যে? প্রেমিকা নিয়ে এলে নাকি?”
কায়েস কড়ির মাথায় গাট্টা মেরে বলল, “এমন একটা দিব না!”
“আরে মারছ কেন? এদিকে তাকাও, বেয়াই সাহেবও প্রেমিকা নিয়ে ঘুরতে এসেছিলেন। প্রেমিকা সহ একদম হাতেনাতে ধরলাম। দীঘির দিকে মুখ করে দুজন পা ঝুলিয়ে বসেছিল। আমি দেখে ফেলায় তাড়াতাড়ি উনাকে বিদায় করলেন। এখন আমড়া কিনে দিয়ে আমার মুখ বন্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে।”
ইমাদ ঘাড় ঘুরিয়ে কায়েসের দিকে তাকিয়ে হাসবার চেষ্টা করলেও হাসি তার এল না। এই মেয়ে তো মেয়ে নয়, শয়তানের উড়োজাহাজ, ঢপের টাইটানিক। কায়েস সহাস্যমুখে ইমাদের দিকে হ্যান্ডশ্যাক করতে হাত বাড়িয়ে দিলো, “আরে আমার জানালা ভাবির বন্ধু দেখি! হোয়াট আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ।”
ইমাদ হ্যান্ডশ্যাক করতে করতে বলল, “আপনাকেও আমড়া কিনে দিই?”
কায়েস বলল, “না, না ভাই। অনেক ধন্যবাদ।”
কড়ি ভ্রু উপরনীচ করতে করতে বলল, “তোমার এদিকে কি হু? কথার পাশ কাটো কেন? কার সাথে দেখা করতে এসেছ?”
“বলার হলে রিমা আপুকে বলব। তোকে কেন বলব?”
“বাসায় যাবে এখন? গেলে আমিও যাব।”
“না, তুই চলে যা। আমি জিলা স্কুলের সামনে যাচ্ছি। আড্ডা মারব কতক্ষণ।”
“তাহলে তুমি যাও। আমি বেয়াই সাহেবের সাথেই কিছুক্ষণ আড্ডা মারি।”
কায়েস কড়িকে বলল, “আমি যাই।”
তারপর হাত উঁচু করে তুলে ইমাদকে দেখাল, “ইমাদ ভাই, বাসায় আসেন না একদিন।”
“আচ্ছা।”
বলে কায়েস চলে গেল। ইমাদ বলল, “আমাকে প্রেমিকাসহ হাতেনাতে ধরেছেন, তাইনা?”
কড়ি বলল, “শশশশ্ অন্য কথা বলুন। ছোট ভাইয়া আবার ফিরে আসবে।”
কায়েস সত্যি সত্যি আবার ফিরে এল। কড়ির হাতে ফুচকার দুটো হাফপ্ল্যাট ধরিয়ে দিয়ে বলল, “টাকা দিয়ে গেলাম।”
কড়ি বলল, “থ্যাংক ইউ, ছোট ভাইয়া।”
কড়ি ইমাদের হাতে একটা হাফ প্ল্যাট বাড়িয়ে দিলো। নিঃশব্দে শেষ হলো ফুচকা খাওয়ার পর্ব। ইমাদ হাফ প্ল্যাটটা পাশে রাখতে রাখতে কথা শুরু করল, “আপনি এত বুদ্ধি নিয়ে ঘুমান কি করে?”
“বুদ্ধি বেশি নেই। উপস্থিত বুদ্ধিটা ভালো আর সাহস আছে। ঘাবড়াই না সহজে। অত বুদ্ধি থাকলে নিশ্চয়ই জুয়াড়ি ছেলের সাথে প্রেম করতাম না।”
“এভাবে কেন বলছেন? আপনি কি জানতেন নাকি জুয়া খেলে?”
“না, তা জানতাম না। পরে ওর মায়ের কাছ থেকে শুনেছি। ও যে বখে যাওয়া বুঝা উচিত ছিল না আমার?”
“আমরা ছেলেরা কিছুটা শিকারি গোছের। এমনসব কৌশল আমরা জানি, আর এমনকিছু টোপ আমাদের কাছে আছে যেগুলো দিয়ে চাইলেই আমরা এক কড়িকে কেন? ফোর্বস ম্যাগাজিনের তালিকায় থাকা ক্ষমতাধর নারীদেরও ইম্প্রেস করে ফেলতে পারি। মেয়েরা ভালোবাসার কাঙাল। আর এই সুযোগটাই আমরা কাজে লাগিয়ে ফেলি। আমরা যা করি! আপনারা না পটে যাবেন কই? আমরা হলাম ভেলকি দেখানো জাদুকর।”
“শুনতে ভালো লাগছে।”
“কিন্তু আর দশটা সাধারণ মেয়ের সাথে ক্ষমতাধর নারীদের পার্থক্য হলো ক্ষমতাধর নারীদের কাছে আমাদের মুখোশ উন্মোচন হয়ে গেলে তাঁরা আমাদের লাথি মেরে চলে আসতে জানে। ক্ষমতাধর, বুদ্ধিদীপ্ত, সফল নারী হতে ফোবর্স ম্যাগাজিনের তালিকায় নাম থাকতে হয় না। আমাদের মতন কাউকে ল্যাং মেরে সামনে এগিয়ে যেতে পারলেই হয়।”
“হুম।” কড়ি উদাস ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল।
“দীপু আর আপনি মোটামুটি একই ধাঁচের ঝামেলায় পড়েছিলেন। দীপু নিজের ক্ষতি করল, আর আপনি ভুল বুঝতে পেরে যথাসম্ভব সবকিছু শুধরালেন। আপনার কাছে বুদ্ধির আসল সংজ্ঞা কি জানি না। তবে আমি বুদ্ধি বলতে এটুকুই বুঝি।”
কড়ি উঠে দাঁড়াল। ইমাদ কথা বন্ধ করে তাকিয়ে রইল। কড়ি এবার ইমাদের মত করে দীঘির দিকে পা ঝুলিয়ে বসল। ইমাদ বলল, “পড়ে যাবেন।”
কড়ি বলল, “পড়লে পড়ব।”
ইমাদ ওর চিরাচরিত নিয়মে বলল, “আচ্ছা।”
কড়ি বলল, “আমার ভাইয়া আমাকে কতটা অন্ধ বিশ্বাস করেন দেখলেন? যতই চালাকি করে এটাসেটা বলি না কেন অন্য কোনো ভাই হলে ঠিকই সন্দেহ করত। দু’গালে দুটো দিতোও।আমি কত বড় প্রতারক!”
ইমাদ বলতে গিয়েও কিছু বলল না। মাগরিবের আজানে ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখোরিত হচ্ছে। নীল আকাশ ধীরে ধীরে লাল থেকে কালো হলো। পাখিরা সব ফিরে যাচ্ছে ঘরে, কিন্তু কড়ি অক্ষত দীর্ঘশ্বাস বুকে নিয়ে এখানেই বসে রইল। ধীরে ধীরে মানুষের ভিড় কমল। আকাশে জ্বলে উঠল তারা। চাঁদের আলো দীঘিতে ভাসছে। সে আলোর সাথে অট্টালিকার ঠিকরে আসা আলো প্রতিযোগিতা করতে নেমেছে। দীঘির পাশের সড়কবাতিগুলোও জ্বলে উঠল। রাস্তায় ছায়াদানকারী কাঠবাদাম গাছের পাতার ফোকরে বসানো বাতিও জ্বলতে বাকি নেই। এই কাঠবাদাম গাছগুলোই রোদের সাথে নেচে নেচে রাস্তায় নকশা এঁকেছিল। এখনও তারা আলোঝরা রাস্তায় পাতার ছায়ায় নকশা গড়ছে। হেঁটে যাওয়ার সময় মনে হবে পথে পড়ে আছে কালো ফুলেরা। পা দিয়ে মাড়িয়ে ফেলতে বুক দুরুদুরু করবে। ইমাদের মনে হলো কড়ি মন দিয়ে বসে তারা গুনছে। সে সুদীর্ঘ এই সময়কে অনুভব করতে করতে গভীর আবেগে বাঙালি উচ্চারণে ইংরেজীতে বলে গেল,
“Don’t count stars alone.
I am here my moon.
To snatch all the clouds from your sky.
To make myself thy.
By the time you and me are we.
I am here for thee.
Don’t cry alone,
As the world is our love zone.”
রাতের পরশে হাওয়া আরো ঠাণ্ডা হয়েছে। একটু একটু শীত লাগছে। কড়ি দু’হাত একসাথে ঘষতে ঘষতে প্রশ্নবোধক চোখে ইমাদের দিকে তাকাল। ইমাদ কড়ির দিকেই তাকিয়েছিল। এবার চোখে চোখ রাখল। অনর্গলভাবে সনেটের ষষ্টকের লাইনগুলো বলল,
“Why do you count the sky’s stars?
Aren’t they enough in my eyes?
If you have courage,
Come here and take your stage.
Please count my emotions.
I love you from your head to toes.”
কড়ি বিমুগ্ধ হয়ে বলল, “বাহ, এই কবিতা কার লেখা?”
ইমাদ বলল, “সনেট।”
“কার লেখা?”
ইমাদ নীচের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল শুধু, কিছু বলল না। কড়ি বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে বলল, “আপনার লেখা?”
ইমাদ এবারও নীরব। কড়িও জলেরধারা দেখতে দেখতে হাসল। মুহূর্তখানিক পর মুখ তুলে ইমাদের দিকে তাকাল তারপর আবার হাসল। বলল, “আপনার ভাবেসাবে মনে হয় আপনি আমায় ভালোই বুঝেন। এত বোঝা ভালো না। আমি বিরক্ত হই।”
ইমাদ জবাবে বলল, “কিছু কিছু উপন্যাসের বই আছে, যখনি আপনি নতুন করে পড়বেন কিছু না কিছু নতুন করে বুঝবেন যা আগে পড়ে বুঝেননি। অনেকটা হ্যারিপটার সিরিজের মত। যতবার পড়বেন ততবার নতুন কোনো রহস্য আবিষ্কার করতে পারবেন। আবার বেশিরভাগ মানুষের জীবনেই অন্তত একবার না একবার এমন একটা বই হাতে পড়ে, যেটি বারবার পড়তে মন কেমন করে উঠে। শুধুমাত্র সেই প্রিয় অনুভূতিগুলো বারবার অনুভব করতে মানুষ সেই বই পাগলের মত পড়ে। বারবার পড়ে। বৃষ্টি এলেই পড়ে, জোছনায় রাত উজাড় হলে পড়ে, মন খারাপের দিনে পড়ে, সুখের দিনে পড়ে, শরৎ এর মেঘ দেখলে পড়ে, সুন্দর কোনো পথ দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরলেও পড়ে। মনে পড়লেই পড়ে। আমার ক্ষেত্রে এই বইটি হলো “দ্যা কাইট রানার।” আমার সবচেয়ে প্রিয় বই, যত্নের বই।”
ইমাদ খানিক থামল। একসাথে এত কথা বলে তার অভ্যাস নেই। একটু জিরিয়ে বলল, “আমি আপনার জন্য হ্যারিপটার সিরিজের মত, আর আপনি আমার “দ্যা কাইট রানার।” উই আর আনকোশ্চেনেবলি মিস্টার রাইট এন্ড মিস রাইট। আর আপনি কখন থেকে নানানভাবে আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন আমরা একে অপরের জন্য না? হাস্যকর!”
কড়ি প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, “তো মিস্টার রাইট আপনার জন্য আমি কতকাল অপেক্ষা করব? পরে যদি এমন হয় আপনি পড়াশুনা শেষ করে চাকুরী নিয়ে সেটেল হয়ে অন্য কোনো পাখির সাথে ফুরুৎ? আর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আমার চেহারায় তখন বয়সের ছাপ পড়ে যাবে, চেহারার লাবণ্য ক্ষয়ে যাবে। তখন তো আমার জন্য কেউ এত পাগল পাগল থাকবে না! আমাকে নিয়ে আমার পরিবারকেই হেসেল পোহাতে হবে।”
“কি করলে আমাকে খাঁচাবন্দি গন্য করবেন?”
“আমাকে কমপক্ষে ১৫ ভরি সোনার গয়না দিতে হবে। তাহলে আমি নিশ্চিন্তে অপেক্ষা করতে পারি। বিয়ের সময় গয়না উসুল বাবদ দেনমোহর ধার্য করবেন। আর যদি শেষমেষ আমাকে বিয়ে না করেন তবে এই গয়না আর ফেরত পাবেন না।”
“আচ্ছা।” ইমাদ মনে মনে হতভম্ব হয়ে গেল।
“এই হলো মর্টগেজ। আমার সিকিউরিটি।”
“আচ্ছা।” গলার স্বর নির্লিপ্ত।
কড়ি বলল, “আচ্ছা বললে হবে না। কখন দিবেন বলুন।”
ইমাদ নিজের বিস্ময় লুকাতে লুকাতে বলল, “আপনি কখন চান?”
“বেশিদিন তো সময় দেয়া যাবে না। এখন পারলে এখন দিন।”
“সম্ভব না। আমি এত গয়না কি করে দিব? আমার মায়েরও তো অতো গয়না নেই। যা ছিল তা বড় বোনের বিয়েতে দিয়ে দেয়া হয়েছে। বাবার হাতেও এত টাকা নেই।”
“বোনের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে আসুন। আপনার বউয়ের ভাগ আছে না?”
ইমাদ ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, “বড় আপুরগুলো সহ নিয়ে এলেও পনেরো ভরি গয়না হবে না।”
“তাহলে তো কথা এখানেই শেষ। আমি তাহলে উঠি।”
ইমাদ কড়ির আচরণে এত অবাক হলো! তবুও সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে বলল, “এজন্য দেখা করতে চেয়েছিলেন?”
কড়ি ঘুরে বসে উঠে দাঁড়িয়ে পোশাক ঝারতে ঝারতে বলল, “জি এজন্যই।”
ইমাদ বসে থেকেই বলল, “আমাকে কিছুদিন সময় দিন।”
কড়ি বলল, “এক মাস?”
ইমাদ শুধু তাকিয়ে রইল। কড়ি আবার বলল, “দু’মাস? তিন মাস? চার মাস?”
ইমাদ বলল, “আপনার যত মাস ইচ্ছা।”
কড়ি বলল, যান ছমাস দিলাম। এরপর গয়না দিতে না পারলে আমাদের পথ আলাদা।”
ইমাদের মাথার ভেতরটা দপদপ করছে, কান শাঁ শাঁ শব্দ। ঝিম ধরা গলায় তবুও সে বলল, “আচ্ছা।”
“রাত বাড়ছে। আমি চলি।” কড়ি চলে গেল। ইমাদ হতবাক, চোখের দৃষ্টি শূণ্য। মাথা ব্যাথা ঘাড় বেয়ে উঠে চিরিক দিলো।
চলবে.

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৩৭
মিলা দরজা ধাক্কে মুবিনের ঘরে ঢুকল। একটু আগে বাবার কল এসেছিল। একটা কালো কাঁচবন্ধ গাড়ি নাকি আটজন শিশুকে কিডন্যাপ করে কুমিল্লা শহর ছেড়েছে। ছেলেমেয়েগুলোর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। থানায় নাকি আরো অনেক বাবা- মাই আহাজারি করছে, কাঁদছে, চিৎকার করছে। মিলা মুবিনের বুকশেলফের বইগুলোয় হাত বাড়াল। ঠিক তখনি মুবিনের চিৎকার, “তোর ঠ্যাং ভাঙব, মিলা। খবরদার আমার বইয়ে ধরবি না। তোর বান্ধবীটাকে শুদ্ধ মেরে ফেলব। খবরদার!”
মিলা চমকে তাকাল পাশে। না মুবিন নেই। পুরোনো স্মৃতি! মিলা আবার বুকশেলফটার দিকে তাকাল। দুর্ধর্ষসব রোমাঞ্চকর বই। মুবিন অ্যাডভেঞ্চারের বইগুলো পড়তে খুব ভালোবাসে। মিলা এ ধরনের বই পড়েনি, তাই অত ধারণা নেই। মুবিন নিশ্চয়ই কোনো অ্যাডভেঞ্চারে ব্যস্ত। ওকে কোনো কালো গাড়িতে আটকে রাখা অসম্ভব। যা একরোখা আর গুঁয়ার! তাছাড়া, এই বইগুলোতে নিশ্চয়ই বিপদ থেকে বাঁচবার নানান কৌশল লেখা আছে! যদিওবা, কিডন্যাপ হয়ে থাকে তবুও সে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো বুদ্ধি করে কিডন্যাপারের নাকের ডগা দিয়ে পালিয়ে যাবে, আর নয়তো এমন জ্বালাতন করবে যে কিডন্যাপার নিজেই ওকে ছেড়ে দিয়ে বলবে, “এই ছেলে, তুই যা। পেছনে তাকাবি না। তাকালে একদম গুলি করে দিব।”
মিলা বুকশেলফ থেকে সেবা প্রকাশনীর একটা অ্যাডবেঞ্চার বই টেনে নিয়ে মেঝেতে বসল। ও এখন পড়ে দেখবে ভালো কোনো কৌশল বইগুলোতে লেখা আছে কিনা। মুবিনটা এসব পারবে তো?
শিল্পী রাতের খাবার গরম করে মিলাকে ডাকল, “আয় খেতে আয়। মুবিন কোথায়? ওকে ডাক।”
মিলা মুখ তুলে তাকাল। মা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। মিলা কী বলবে ভেবে পেল না। মা আবার ধমক দিলেন, “অ্যাই কানে শুনিস না? ডাক তোর ভাইকে। খেয়ে মুক্তি দে। সারাদিন দুটোই বোধহয় কিছুই খাসনি।”
মিলা উত্তর দিলো যন্ত্রের মত, “মুবিন নেই।”
“নেই মানে? এত রাতে কই সে? কতদিন বলব এতরাতে বাড়ির বাইরে না যেতে? পড়া নেই ওর?”
মিলার মনে হলো মায়ের মাথা মোটামুটি খারাপ হয়ে গেছে। সে বলল, “মা, মুবিন বাড়ি থেকে পালিয়েছে। সকালেই বলেছি। তুমি অনেক ক্লান্ত, মা। যাও রেস্ট নাও।”
বলতে বলতে মিলা দেখল মা যেন টলছেন। দেয়াল ধরেও ব্যালেন্স রাখতে পারছেন না। মিলা উঠে যেতে যেতে শিল্পী কাঁচের পুতুলের মত ভেঙে পড়ল মেঝেতে। মিলা দৌড়ে গিয়ে মুখে পানি ছিটাল। শিল্পী উঠল, কাঁদল, চেঁচাল। জানতে চাইল, মঈন কোথায়?

থানায় বসে মঈনের নিজেকে এত অসহায় লাগছে! ওরা শুধু বাজে খবরগুলো বলছে। মঈন একা একা আর পারছে না। ছেলেটার জন্য মন কাঁদছে। কোথায় গেল ওর কলিজার টুকরাটা? শিল্পী হন্য হয়ে থানায় এসে হাজির হতেই ওকে দেখে মঈন যেন ধীরে ধীরে তার ফুরিয়ে আসা শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার শক্তি ফিরে পেল। এই সময়ে শিল্পী ছাড়া কিছুই সম্ভব না।
.
কাদিন বাসের টিকিট দুটো হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে!দেখল। টিকিট দুটোতে আঙুল বোলাতে বোলাতে আচমকা একটানে ছিঁড়ে ফেলল টিকিট দুটো। তারপর ঝুড়িতে ফেলে দিলো। হানিমুনের টিকিট । ভেবেছিল গ্রাম থেকে ফিরে এসে দীপাকে নিয়ে হানিমুনে যাবে। আর হানিমুন!
ল্যাপটপ নিয়ে বসল সে। একটু পর দীপা এসে পাশে দাঁড়াল, “একটা কথা বলার ছিল।”
“বলো।” কাদিন দীপার দিকে তাকাল না। দীপা বলল, “মায়ের জন্য মন কেমন করছে। মাকে দেখতে যাব?”
“হুম যাও।”
“আপনি কাল ফ্রি থাকলে কাল যাই?
কাদিন কপাল কুঁচকে তাকাল, “কালিয়াজুড়ি থেকে হাউজিং তোমায় নিয়ে যেতে হবে?”
“একা আমি হজারবার যেতে পারব। কিন্তু বিয়ের পর এই প্রথম যাচ্ছি। আপনাকে ছাড়া গেলে সবাই কি ভাববে?”
আরো কপাল কুঁচকে গেল কাদিনের। আচ্ছা! দীপা এখন সবার ভাবনা চিন্তা নিয়েও ভাবে!
দীপা বলল, “কি হলো কিছু বলেন না কেন?”
“আমি যেতে পারব না। তুমি যাও।”
দীপা কাদিনের হাত ধরে বলল, “প্লিজ, চলুন না। মাকে অনেক মনে পড়ছে। দুপুরের জন্য স্যরি।”
কাদিন হাত ছাড়িয়ে নিলো, “আমার কাজ আছে।”
দীপা কষ্টে নীল হয়ে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। আমার আর যেতে হবে না।”
কাদিন বলল, “সে তোমার ইচ্ছে।”
দীপা মুখ ঝামটা মেরে চলে গেল। যাবে না সে, মরে গেলেও যাবে না। শয়তান লোক! পরে ঘর ঝাড়ু দিয়ে ঝুড়িতে ময়লা ফেলতে গিয়ে দীপা টিকিট দুটো দেখল। মাঝখান দিয়ে ছেঁড়া। দীপা টিকিট দুটো ঝুড়ি থেকে তুলে হাতে নিয়ে ডেইট দেখে অবাক হয়ে গেল। সেখানে বসেই কাদিনকে প্রশ্ন করল, “এটা কিসের টিকিট? ডেইট তো কয়েকদিন পরের। ছেঁড়া কেন?”
কাদিন দীপার দিকে তাকিয়ে প্রায় লাফিয়ে উঠল। কোল থেকে ল্যাপটপ সরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ছিঃ দীপা তুমি ময়লার ঝুড়িতে হাত দিয়েছো। ইয়াক!”
কাদিন হাত দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরল যেন ওর এখনি বমি চলে আসছে। দীপা হাসিতে ফেটে পড়ল। কিছুক্ষণ আগের কাদিনের না বলা ভুলেই গেল। হাসতে হাসতে বলল, “ওলে ওলে এত নাখড়া বাবুর! ঝুড়ি তো পরিষ্কার। এই টিকিট দুটো ছাড়া আর কিছু নেই।”
“উঠো উঠো বলছি। যাও হাত ধুয়ে এসো।”
দীপা হঠাৎ মজা পেয়ে গেল। দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরে উঠে দাঁড়াল। হাতগুলো কাদিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে রহস্যময় গলায় বলল, “এখন যদি আপনার গালগুলো টেনে দিই। কেমন হয় বলেন তো?”
কাদিন কয়েক কদম পেছনে গিয়ে বলল, “হাত কেটে ফেলব, দীপা। আমাকে তুমি চেনো না।”
দীপার কোন ভাবান্তর নেই দেখে
কাদিন এবার নরম গলায় বলল, “প্লিজ, দীপা না।”
দীপ চওড়া হাসি হেসে উপর নীচ মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, প্লিজ।”
কাদিন বলল, “আমি কিন্তু কখনো তোমায় ক্ষমা করব না, দীপা।”
হাসতে হাসতে এবার দীপার মরে যাবার মত অবস্থা হলো। কাদিন বলল, “অনুরোধ করছি আমি।”
দীপা বলল, “আচ্ছা, বাবা, আচ্ছা। ভয় দেখালাম। ভয় পাওয়ার দরকার নেই।”
কাদিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, “ভালো করে হাত ধুয়ে এসো। আর কখনো ময়লার ঝুড়িতে হাত দিবে না।”
দীপা বলল, “কিন্তু টিকিট দুটো কিসের?”
কাদিনের চেহারায় একটা মেঘখন্ড এসে জুড়ে গেল। গম্ভীর গলায় সে বলল, “বাসের টিকিট।”
“তা তো দেখতেই পাচ্ছি কিন্তু ছেঁড়া কেন?”
“আমাদের হানিমুনের টিকিট ছিল।”
“তবে ছিঁড়লেন কেন?”
কাদিন এবার খুব শক্ত করে বলল, “হানিমুনে গিয়ে করবটা কি? শুধু ঘুরতে যেতে হলে তো আমি কোনো ট্রাভেলস গ্রুপের সাথেও ঘুরতে যেতে পারি। আমার মা একটা প্রবাদ বলতেন।
থাকতে দিয়েছ কামরাঙা পাটি আর মরলা দিবে শীতলপাটি। এভাবেই বলতে হয় এখানে পাই কামরাঙা পাটি আর হানিমুনে পাব শীতলপাটি!”
“আপনি এভাবে কেন কথা বলছেন?”
“আর কীভাবে কথা বলব? লুচ্চারা এর চেয়ে ভালো করে কথা বলে নাকি??
কাদিন হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে গেল। দীপা এখন খুব ভালো করে বুঝল এজন্যই এভাবে দীপার সাথে গাল ফুলিয়ে থাকা হচ্ছে। কিন্তু দীপা তো স্যরি বলেছে। আর কীভাবে বলবে?

কাদিন খুব রাত করে ঘরে এলো। দীপা দরজা ভেজিয়ে শুয়ে ছিল। কাদিন এসে পাশে শুতেই জড়িয়ে ধরল। কাদিন ভাবল দীপা ওর অভ্যাস মতই বোধহয় ঘুমের ঘোরে জড়িয়ে ধরেছে। কাদিন দীপাকে সরিয়ে দিলো। দীপা এবার রাগে দাঁত ঘঁষে ওপাশ ফিরে শুয়ে মনে মনে কাদিনকে বকে বলল, “অ্যাই ব্যাটা আমি আর কি করমু?”
দীপা ওপাশ ফিরতেই কাদিনের টনক নড়ল! দীপাকে ঘুমের ঘোরে যতবারই সরিয়ে দেয়া হোক কোনো কাজ হয় না। সে ঘুরে ফিরে আবারো জাপটে ধরে। আজ আর ধরেনি, তারমানে ও জেগে আছে!
.
মুবিনের ইচ্ছে করে হুট করেই অনেক বড় হয়ে যেতে। ও ওর ঘরে একা থাকতে চায়। আর চায় মা – বাবাকে বৃদ্ধ বয়সে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে, যেখানে বাবা- মায়ের দীর্ঘশ্বাসগুলো ও কখনই শুনবে না। যেমনভাবে তাঁরা কখনো ওদের দুই ভাই – বোনের কান্নার আওয়াজ শুনেন না, ঠিক তেমনভাবে। শোনেন না কখনোই। মুবিন জানে মিলার জীবনের সুন্দর এক উদ্দেশ্য আছে। বাবা মায়ের ওর প্রতি অবহেলার জবাব দেয়া। কিন্তু ওর উদ্দেশ্যটা খুব ভয়ঙ্কর। একটা ছেলে বড়ই হচ্ছে এই ভাবনা নিয়ে যে বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবে! কি দীর্ঘ কালো স্বপ্ন! কি অদ্ভুত!
মুবিন কখনোই ভালো রেজাল্ট করে না, না করে কারো সাথে ভালো ব্যবহার। এজন্য ওর কোনো বন্ধুও নেই। ও আসলে চায় না ওর ভালো রেজাল্ট, বা ওর ভালো যা কিছু আছে তা নিয়ে এই ধরনের বাবা- মায়ের মুখ উজ্জ্বল হোক। ও এরকম বাবা- মাকে কখনো গর্বিত করতে চায় না। কারণ ওর মতে তাঁরা কখনোই তা ডিজার্ভ করে না। হাসি হাসি মুখে শিক্ষকদের প্রশংসা শুনে এরা গর্বিত হবে – দৃশ্যটা মুবিনের কাছে অসহ্য। ও চায় না মিলাও ভালো করুক। মিলাও ওর মত হলে দুজনে মিলে আচ্ছা করে এদের ডুবানো যেত।
কিন্তু ও বোঝে মিলার ভালো করবার দরকার আছে। মুবিনকে নিয়ে মা-বাবা দুজনে রশি টানাটানি খেলছে, ওদিকে মিলার জুটছে অবহেলা। তবুও মুবিনের মনে হয় মিলা ওর চেয়ে ভালো আছে। মিলা ওর নিজস্ব অভিমান নিয়ে একদিকে পড়ে আছে, কিন্তু মুবিনের মত ওর ভাঙচূড় হচ্ছে না। একই ঘটনা মিলাকে করছে শক্ত আর ওকে পিশে ফেলছে, করছে চূড়চূড়।
মিলার নিজস্ব একটা পৃথিবী আছে। সেই পৃথিবীতে সুহার মত একটা বন্ধু আছে, আছে শিক্ষকদের বাহবা আর সাবাসি। মিলার চাইতে কম মার্ক পাওয়া কতজোড়া চোখের জ্বলেপুড়ে যাওয়াও আছে। কিন্তু মুবিনের দুনিয়া থেমে আছে এক বৃদ্ধাশ্রমে। সে এখন বসে আছে কক্সবাজার কলাতলী বিচের সমুদ্রতীরে। থ্রি কোয়াটার প্যান্ট এর নীচের খোলা পা দুটো বালিতে মাখোমাখো। সমুদ্রের ছুটে আসা সাদা ফেণা দৌড়ে এসে মুবিনের পা ধুয়ে আবার পালিয়ে গেল। তার হাতে কাঁকড়া ভাজা। অন্ধকারে বসে বসে ও কাঁকড়া ভাজায় কামড় বসাল। রাত বাড়লেও ভিড়ের কমতি নেই। অন্ধকার সমুদ্র গান গাইছে, গুনগুন করা গান নয়। গলা ছেড়ে মাঝিমল্লারের গানের মত গান। যেন বলছে,
“মুবিন এসো, হেঁটে যাও
কিসে তুমি ডরাও
কি তোমায় থামায়?
মুবিন এসো, ছুঁয়ে নাও।
যা যা তুমি চাও।
কেউ দেখে না তোমায়।”
মুবিন কাঁকড়া ভাজাটা শেষ করে উঠে দাঁড়াল। পেটের কাছে গেঞ্জিতে হাত মুছে আনন্দে কয়েকটা ডিগবাজি খেল। তারপর হাসি হাসি মুখ করে সমুদ্রের কাছে গেল। কাছে যেতে যেতে কোমর পর্যন্ত সমুদ্রের যে ঢেউগুলো হয় সেগুলোর সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলল। চোখ বন্ধ করে পানি হাতাতে লাগল। কি ঠাণ্ডা, আর মায়া মায়া পানি। মুবিন চোখ খুলল। সমুদ্রের বালিগুলোতে পায়ের ছাপ ফেলে একটা বড় ছেলে আর সুন্দর একটা বড় মেয়ে হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাচ্ছে। মুবিন সেদিক থেকে চোখ সরাতেই দেখল একজন আঙ্কেল তাঁর দুই মেয়েকে দু’পাশে নিয়ে ওদের হাত ধরে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের গর্জন শুনছেন। একটু দূরে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রমহিলা ওদের ডাকছে, “আর কতক্ষণ? চলো না হোটেলে ফিরি। অনেক রাত হয়েছে। বেশি কাছে যেও না কিন্তু।”
ইতোমধ্যেই দুটো আলুথালু রুক্ষ চুলের দশ, এগারো বছর বয়সী মেয়েকে ঘিরে একটা জটলা তৈরী হয়ে গেছে। জটলার কারণ ওরা গলা ছেড়ে গান গাইছে। মুবিনের একটু আগের
সমুদ্রের গানের ন্যায় বিভ্রমময় গান নয়। সত্যি সত্যি গান,
“আমি তো ভালা না ভালা লইয়া থাইক…”
সাথে হাত হাত ঘষে কেমন একটা তালও তুলছে ওরা। মুবিন গান শুনতে শুনতে মাথা দুলাতে লাগল।
চলবে…

একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-৩৪+৩৫

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৩৪
কুমিল্লা শহরে থাকবার জন্য ভালো মানের হোটেল পাওয়া খুবই দুষ্কর। যেগুলো আছে তাদের মাঝে হোটেল কিউ প্যালেসটাকেই মিশেল মোটামুটি পছন্দ করল। মঈন সেখানেই মিশেলের থাকবার ব্যবস্থা করে দিয়ে বলল, “কিছু খেয়ে নিও। প্লিজ। আমাকে বাসায় যেতে হবে।”
এই বলে বেরিয়ে এল সে। তারপর থেকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। রাত থেকে শুরু করে সকাল, সকাল থেকে দুপুর অবধি সিগারেটের প্যাকেট কটা শেষ করেছে এখন আর মনে করতে পারছে না। কিছু একটা খেতে হবে। কাল সন্ধ্যার পর থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। পেট এর ভেতর গ্যাস্ট্রিকের সমস্যাটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। মঈন একটা রিকশা ডেকে কান্দিরপাড় চলে এল। সিটি মার্কেট এর ২য় তলায় ক্যাফে এভেনজার্স এর বাইরে চেয়ার টেনে বসল সে। ভেতর থেকে ওয়েটার এসে বলল, “স্যার, ভেতরে টেবিল খালি আছে।”
মঈন বলল, “লাগবে না। মেন্যুটা দিয়ে যান।”
মঈন মেন্যু দেখে খাবার অর্ডার দিলো। ওয়েটার বলল, “স্যার বিশ, ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে।”
মঈন পায়ের উপর কনুইয়ের ভর রেখে দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে রইল। ক্লান্তি ওর শরীর বেয়ে উপচে পড়ছল। শিল্পীকে চূড়ান্ত কষ্ট দিতেই তো সে চেয়েছিল। এখন তা দেওয়া হয়ে গেল, কিন্তু বিপরীতে সে নিজে কি পাচ্ছে? উত্তর হলো যন্ত্রণা। তবুও শিল্পীর এ কষ্ট প্রাপ্য ছিল। বন্ধু ভেবেছিল শিল্পীকে। শিল্পী তার এই বন্ধুত্বের, ভরসার সুযোগ নিয়েছে। জোহরাকে এক পলক দেখবার জন্য সে যখন হলের সামনে চড়কির মত ঘুরঘুর করত তখন শিল্পী একদিন ওকে দেখে ভরসার হাসি হেসেছিল। মঈন ধরে নিয়েছিল শিল্পী মঈনের বিষয়টা ধরতে পেরেছে। যে ওকে বুঝে তার সাথে বন্ধু্ত্ব করতেই হয়। এজন্যেই মঈন এগিয়ে গিয়েছিল। তারপর কখন যে দুজন এত বেশি ভালো বন্ধু হয়ে গেল, টেরই পেল না সে। প্রয়োজনে তো লোকে বন্ধুর কাছেই যায়। সেও গিয়েছিল, আর অবশেষে বন্ধু কি করল? প্রতারণা!
খাবার এসে পড়েছে। ওয়েটার আবার জিজ্ঞাসা করল, “স্যার আপনি চাইলে কিন্তু ভেতরে আসতেই পারতেন।”
“চাইছি না।”
ওয়েটার খাবার পরিবেশন করে চলে গেল। মঈন চামচ তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে রেলিং এর নীচে তাকাল। নীচে তাকিয়ে রিকশার সুন্দর জ্যাম, আর ব্যস্ত মানুষ দেখতে দেখতে সে খাবার মুখে তুলল। অনেকের কাছে মনে হতে পারে জ্যাম আবার সুন্দর কি করে হয়? ঢাকা ছাড়া পৃথিবীর সব জ্যামই মার্জিত এবং সুন্দর জ্যাম। মঈন অবজ্ঞার হাসি হাসল! এখন আবার তাকে বলে সে নাকি ওকে ব্যবহার করেছিল! কক্ষণো না। শুধু ভরসা করেছিল! ভরসা করতে করতে নিজেকে পর্যন্ত তুলে দিলো। ভুল করেছিল। ভাগ্যিস জোহরার সাথে দেখা’টা হলো! আবার কখনো কখনো মনে হয় দেখা না হলেই ভালো হতো। শিল্পীকে এই কষ্টগুলো পেতে হতো না। ওদের সংসারটা এভাবে শেষ হয়ে যেত না। বাচ্চাগুলোরও এই দুর্দশা হতো না। সত্যি বলতে শিল্পীকে কষ্ট দিতে গিয়ে সে আনন্দের চাইতে বেশি বেদনা’ই কুড়ায়। কিন্তু এখানে মূখ্য বিষয়টি হলো শিল্পীকে কত বেশি কষ্ট ফিরিয়ে দেয়া যায়, এটি করতে গিয়ে ওকে কতটা যন্ত্রণা পেতে হয়, কি কি খোয়াতে হয় তা ধর্তব্য নয়। মঈন হাতের গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রাখতে না রাখতেই মিলার কলটা এলো। মঈনের লজ্জায় কলটা ধরতে ইচ্ছে করছে না। বাচ্চাদের সামনে কি করে মুখ দেখাবে সে এখন? ওদের বাবার এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার চলছে। এতদিন আকারে ইঙ্গিতে ওদের মা ওদের যা বলছিল, ওরা যা বিশ্বাস করতে চাইছিল না তাই ওদের সামনে খোলাশা হয়ে গেল। প্রমাণ হয়ে গেল। মিলা কেন কল করছে? কলটা ধরলেই হয়তো বলে বসবে, “বাবা আমরা তোমাকে অনেক ঘৃণা করি।” এরকম কিছু বলতেই কি কল করছে? কলটা বেজে নিজে নিজেই কেটে গেল। সবকিছুর’ই একটা সময় থাকে। সময় ফুরালে সবকিছু এমন করেই ফুরিয়ে হয়ে যায়। এই যে সে এখন যা ভাবছে তা ভাবা পুরোপুরি অনর্থক। বাচ্চাদের কথা তো ওর আরো আগে ভাবা উচিত ছিল। মঈন মোবাইলটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল। মিলা আবারো কল করল। এইবার মঈনের মনে হলো মিলা খুবই লক্ষী মেয়ে। ও কখনো এমন কিছু বলবে না। বললে মুবিন বলতে পারে। মুবিনের খুব রাগ, জেদও বেশি। একদম ওরই মতন। মিলা যেহেতু কল করছে অবশ্যই জরুরি কিছু। শিল্পী? শিল্পী ঠিক আছে তো? কিছু করেটরে বসেনি তো? কথাটা মনে হতেই দ্রুত টেবিল ছেড়ে ক্যাফের ভেতর গিয়ে বিল মেটাল। তারপর ব্যস্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মিলাকে কলব্যাক করল, “বলো, মিলা।”
মিলা কিছু বলছিল না। মোবাইলের ওপাশে শুধু কান্নার শব্দ। মঈন একটা রিকশায়য় উঠে রিকশাওয়ালাকে আঙুল দিয়ে পথ দেখাল। এখন কথা বলার মত সময় তার নেই। রিকশাওয়ালা বলল, “আমি ঐদিকে যামু না।”
মঈন ক্ষেপে গিয়ে বলল, “আরে মিয়া যাও তো।”
রিকশা ওয়ালা বিড়বিড় করতে করতে রিকশা টান দিয়ে বলল, “এই দুনিয়াত গজব পড়ত না তো কোন দুনিয়াত পড়ব? বড়লোকের বাহাদুরি আল্লাহ ছুটাইব।”
মঈন এসবে কান না দিয়ে মোবাইলে আবারো বলল, “কি হয়েছে, মা? এভাবে কাঁদছ কেন?”
“আমার জন্য সব হয়েছে।”
“কি হয়েছে? তোমার মা ঠিক আছে?”
“হু।”
মঈন একটু ইতঃস্তত করে বলল, “কি করছে ও? তোমাদের কি খুব মেরেছে?”
“না, মা ঘুমাচ্ছেন।”
“তাহলে?”
মিলা এক মুহূর্ত একটু থামল। থেমে বলল, “বাবা, মুবিন চলে গেছে।”
“চলে গেছে মানে?”
“ওকে রাগ করে উল্টাপাল্টা কথা বলেছিলাম। তাই ও বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে জানি না। চিঠি দিয়ে গেছে।”
“কখন গিয়েছে?” মঈন মুহূর্তেই ঘেমে গেল।
“জানি না। তবে সকালে টের পেয়েছি।”
“সকালে টের পেয়েছ আর তুমি এখন বলছ আমাকে? এতক্ষণে?” মঈন ধমকে উঠল।
মিলা চোখ মুছে কিছু বলতে চাইছিল। তার আগেই মঈন বলে উঠল, “তোমার মাকে কেন বলোনি?”
“বলেছি, সকালেই বলেছি।”
“মুবিনের খোঁজে এখনও বের হয়নি?”
“না।”
“কি বলল?”
মা বলেছিলেন, “শুনেছি তোমাদের বাবাও নাকি এই বয়সে একবার বাড়ি ছেড়ে সুনামগঞ্জ পালিয়ে গিয়েছিল। সময়মতো আবার ফিরেও এসেছে। তোমার ভাই তো আর ভালো হয়নি। হয়েছে বাপটার মতই বদমাইশ। সেও আমাকে জ্বালিয়ে অঙ্গার করার কোনো পথ’ই আর বাকি রাখবে না। এখন যাও সামনে থেকে যাও। সারারাত ঘুমাইনি, ঘুমাতে দাও।”
মিলা বুঝে মার মাথা এখন ঠিক নেই। আর সে খুব ভালো করেই জানে কতটুকু বলতে হতো, তাই বলল, “শুনে মায়ের শরীর খারাপ হয়ে গেছে। তাই জোর করে ঘুম পারিয়েছি।”
মঈনের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল। সে কঠিন গলায় বলল,
“আমার ছেলে সকাল থেকে বাসায় নেই, আর সে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে? পৃথিবীতে অনেক জঘন্য মহিলা দেখেছি, কিন্তু তোমার মায়ের মতন আর একটি জঘন্য মহিলা কখনো আমার চোখে পড়েনি।”
.
অপেক্ষা করা হচ্ছে ইমাদের জন্য। অপেক্ষা’টা করছে কড়ি। অপেক্ষা করবার স্থান ধর্মসাগর পাড়। সে বসে আছে ধর্মসাগর পাড় জুড়ে থাকা কৃত্রিম দীর্ঘ আসনে। যে আসন পুরো দীঘিটাকে আগলে রেখেছে নিজের গহীনে, বুকের ঠিক ভেতরে।
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৩৫
ইমাদ বাদুরতলার কুমিল্লা মহিলা মহাবিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে হেঁটে আসতে আসতে কড়িকে কল করল, “কোনদিকে?”
কড়ি ঘাড় উঁচু করে ইমাদকে দেখতে পেল। বলল, “দেখেছি আপনাকে। আরেকটু এগিয়ে আসুন। সবুজ জামা।”
ইমাদ কল কেটে সামনের দিকে এগুলো। কড়ি তীক্ষ্ণ চোখে ইমাদকেই লক্ষ্য করছে। ইমাদ ইটের রাস্তা দিয়ে নির্বিকারভাবে হেঁটে আসছে। দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো রাস্তায় ছায়ার যোগানদাতা। বাহারি পাতাগুলো নরম রোদ আর নির্মল হাওয়ার সাথে নাচতে নাচতে রাস্তায় নানান ধরের নকশা আঁকছে। এই রাস্তাটা ডানে মোড় নেয়ার জায়গাটায় গোল করে চারিদিক মুক্ত এক ঘরের আদল তৈরী করা। নাম তার অবকাশ। কয়েকটা ছেলেমেয়ে সেখানে চেয়ার পেতে বসে পিকনিক টেবিলে হাতের তালে শব্দ করতে করতে সমস্বরে গান গাইছে,
“বন্দে মায়া লাগাইছে পিরিতি শিখাইছে,
বন্দে মায়া লাগাইছে পিরিতি শিখাইছে
দেওয়ানা বানাইছে,
কী যাদু করিয়া বন্দে মায়া লাগাইছে…”
তার ঠিক সামনেই এক কোণায় এক বৃদ্ধ বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তার সামনে একটা বোর্ড। বোর্ডে নানান রঙের বেলুন সাঁটা। নানান বয়সী মানুষজন এসে এসে বন্দুক দিয়ে বেলুন ফুঁটাচ্ছে। এই বৃদ্ধে রোজগার জমজমাট।
ইমাদের মাঝে কোনো উৎকণ্ঠা নেই। চাহনিতে নেই কোনো আগ্রহ। অনেকেই এভাবে হেঁটে আসছে। কেউ চলে যাচ্ছে সোজা রাস্তায় আর কেউ’বা অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুদের দেখে ঝাপিয়ে পড়ছে, বসে থাকা প্রেমিকাকে দেখে মিষ্টি করে হাসছে, দুষ্টু চোখে তাকাচ্ছে। কিন্তু ইমাদ! সে এক বিস্ময়! অন্য পথচারী যাঁদের মঞ্জিল এখানে নয়, শুধু রাস্তাটা শর্টকাট বলেই এখান দিয়ে চলা, তাঁদের মতই তার মুখের অভিব্যক্তি। এটা যেন ওর পথ, সামনেই যে কেউ তার জন্য অপেক্ষা করছে, তাকে যে এখন ঐ মানুষটিকে খুঁজে বের করতে হবে, তাকে দেখে তার কোনো আঁচ’ই পাওয়া যায়না। সে তার মতই হেঁটে এসেছে। এদিকওদিক তাকিয়ে কড়িকে খুঁজেনি, দেখার পর হাসেওনি, না ছুঁড়ে দিয়েছে অন্যরকম কোনো চাহনি। শুধু এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। কড়ি নিজের বিস্ময় লুকাতে লুকাতে বলল, “বসুন।”
ইমাদ বসল তবে কড়ির মত পথের দিকে মুখ করে নয়। সে দীঘির দিকে পা ঝুলিয়ে বসল। কড়ি বলল, “আপনি আমাকে এত পছন্দ কেন করেন?”
“আপনি অনেক আন্ডারস্ট্যান্ডিং।”
“তার মানে আমি আপনাকে ভালো বুঝি।”
“জি।”
“আমি যদি আপনার জায়গায় থাকতাম তবে কখনো প্রপোজ’টা করতাম না।”
“আচ্ছা।”
কড়ি বলল, “প্রশ্ন করুন, কেন?”
ইমাদ বলল, “কেন?”
“সম্পূর্ণ পড়া হয়ে যাওয়া, পুরোপুরি বুঝা হয়ে যাওয়া বই যতই সুন্দর হোক সেটি বুকশেলফেই পড়ে থাকে। ধুলাবালি জমে। দাগ পড়ে! মানুষও এমন। মানুষকে হতে হয় আধা পড়া উপন্যাসের মত। আজীবন ধরে একটু একটু করে যে আমায় পড়তে পারবে, প্রতিদিন যে নতুন করে আগ্রহী হবে তাকে বিয়ে করার কথা ভাবা উচিত।”
“তার মানে আপনি এখনও সেরকম কোনো প্রিয় বই খুঁজে’ই পাননি।”
“হতে পারে। আবার অনেক প্রিয় বই আছে, যেটা কালেকশনে নেই ওটার জন্য ঠিকই মন আনচান করে। কিন্তু নিজের কাছে থাকলে সেটার দিকে ফিরে তাকানোর সময়ও হয় না। কিছু কিছু মানুষ শুধু দূর থেকেই আরাধ্য।”
“বুঝলাম!”
কড়ি আগ্রহভরে বলল, “কি বুঝলেন?”
ইমাদের ঠোঁটে মুচকি হাসি, “আপনি বুঝাতে চাইছেন আমাদের রিলেশন বা বিয়ে কোনোটাই ওয়ার্ক আউট করবে না।”
কড়ি ইমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। অনেকক্ষণ! ইমাদ তাকাচ্ছে না। সে হাওয়ায় তিরতির করে কাঁপা দীঘির জলে চেয়ে আছে। দীঘির চারিদিকে কত কত গাছ। ঐ পাড়ে একটা লাল বোট ভাসছে। পাশে কি একটা ফুল গাছ। কিছু ফুল জলে স্নান করছে। বাতাসের শীতল ঝাপ্টায় বুক ভরে প্রশান্তি নিতে নিতে একসময় ইমাদ বলল, “আপনার একটা ভুল ভাঙার দরকার আছে।”
কড়ি একটু অবাক হলো, “কি ভুল?”
“আপনি আমাকে অন্যদের তুলনায় ভালো বুঝেন, কিন্তু পুরোপুরি বুঝেন না।”
কড়ি ইমাদকে ব্যঙ্গ করে মজার ছলে বলল, “আচ্ছা।”
ইমাদ এইবার কড়ির দিকে তাকাল। খুব স্বাভাবিক, শীতল চাহনি, “যদি সৎ উত্তর দিবেন বলে আশ্বাস দিন তাহলে আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।”
কড়ি ঠাট্টার গলায় বলল, “কি ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করব?”
ইমাদ বলল, “আমায় ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলেই হবে।”
কড়ি চোখ ছোট ছোট করে ইমাদের দিকে তাকাল। ইমাদ বলল, “আমিও ঠাট্টা করলাম।”
“এমন ঠাট্টা করবেন না।”
“আচ্ছা।”
“বলুন কি বলছিলেন।”
“আমি আপনাকে ভালোবাসি তা আমি বলার আগে বুঝেছিলেন?”
“ভালোবাসি না বলে পছন্দ করেন বললে আমার ভালো লাগবে।”
“আচ্ছা।”
“উহুঁ খেয়াল করিনি।”
“আপনি যেদিন শাড়ি পরলেন সেদিন আমি যে দূরে দূরে থেকেছি খেয়াল করেছেন?”
কড়ির ভ্রু কুঁচকাল, চোখে কৌতূহল জমল। মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “উমম, হ্যাঁ করেছিলাম।”
“নিশ্চয়ই কিছু ভেবেছেন?”
“হ্যাঁ কিছু একটা ভেবেছিলাম।”
“কি ভেবেছিলেন?”
“বলতেই হবে?”
“জি বলতে হবে।” ইমাদ কড়ির চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
কড়ি মনে করতে করতে বলল, “ভেবেছিলাম আমার বিয়ের কথা শুনে আপনি পিছু হটে গেছেন।”
ইমাদ মুখ ঘুরিয়ে দীঘির ওপাশের গাছ আর গাছগুলোর পেছনে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা কুমিল্লার বড় বড় অট্টালিকাগুলো দেখতে দেখতে বলল, “আমি সেদিন দূরে দূরে থাকছিলাম অন্য কারণে।”
“কি কারণ?”
“বলব না।” ইমাদ হাসল। ওর হাসির কোনো শব্দ নেই।
কড়ি শুনতে মরিয়া হয়ে গেল, “এখন বলব না বললে তো হবে না। বলতেই হবে।”
ইমাদ কড়ির কথায় কান না দিয়ে তার পরবর্তী প্রশ্নে চলে গেল, “আমি যখন এদিকটায় হেঁটে আসছিলাম, আমাকে দেখে আপনার মাথায় ঠিক কি চলছিল?”
কড়ি থমথমে গলায় বলল, “আমিও বলব না।”
ইমাদ শান্ত গলায় বলল, “প্লিজ।”
কড়ি কিছু একটা ভাবল। তারপর বলল, “ভাবছিলাম আপনি একবারো আমি কোথায় আছি খুঁজে দেখছেন না কেন?”
ইমাদ বলল, “কিছু খাবেন?”
কড়ি বলল, “না, থেঙ্ক ইউ।”
“আপনার ঝাল পছন্দ নাকি মিষ্টি?”
“বললাম তো কিছু খাব না।”
“প্লিজ।”
“আপনি একটু পর পর এরকম প্লিজ প্লিজ করবেন না তো।”
ইমাদ বলল, “ঝাল নাকি মিষ্টি?”
কড়ি বিরক্ত হয়ে বলল, “টক পছন্দ। যান টক কিছু কিনে নিয়ে এসে আমায় উদ্ধার করুন। আর দয়া করে বাকি কথাটুকুও শেষ করুন।”
ইমাদ চট করে ঘুরে বসে বসার জায়গাটা ছেড়ে উঠল। উঠে গিয়ে কড়ির জন্য আমড়া কিনে ফিরে এল। কড়ির হাতে কাগজটা দিয়ে আবার আগের মত করে বসল, “আমি আগে আপনাকে সেখানে দাঁড়িয়ে খুঁজে বের করেছি। তারপর কল করেছি।”
কড়ি প্রচন্ড অবাক হয়ে বলল, “আসলেই?”
ইমাদ চুপ করে রইল। কড়ি আমড়া খেতে খেতে বলল, “আচ্ছা কেন এটা অন্তত বলুন।”
ইমাদ নির্লিপ্ত গলায় বলল, “চট করে আপনার সামনে এসে দাঁড়ালে অপ্রস্তুত হতে পারেন। আগেভাগে জানিয়ে দিলাম যে আমি এসে গেছি। একটু পরেই আপনার সামনে আসব।”
কড়ি ভ্রু কুঁচকাল। তারপর আমড়া খেতে খেতে চোখ উল্টে ইমাদের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকা করে হাসল। কড়ির এই দৃষ্টি, এই হাসি দেখে ইমাদ মনে মনে নিজেকে শুনাল, “অতি সুন্দর! অতি সুন্দর!”
কিন্তু সামনাসামনি ওকে দেখলে যে কেউ বলবে কই? ও তো তাকাল না পর্যন্ত! কড়ি বলল, “ভালো লাগল। ধন্যবাদ।”
ইমাদ বলল, “আপনি আমাকে মোটামুটি বুঝেন। সবটুকু বুঝেন না।”
রসায়নের অনেক দুর্বোধ্য কোনো বিক্রিয়া বুঝবার পর ক্লাসের ছাত্রীরা যেমন করে মাথায় দোলাায়, কড়ি সেভাবে মাথা দোলাতে দোলাতে বলল, “হ্যাঁ, এখন বুঝলাম।”
ইমাদ আবারো বলল, “আসলে আপনি আমাকে বুঝবার চেষ্টা করেন। এইটুকুই যথেষ্ট। আমার আশেপাশের কেউ সাধারণত আমাকে বুঝবার চেষ্টা করে না। ধরুন এই যে আমি আপনাকে খুঁজিনি আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলে মনে মনে ভাবত আমার ভাব বেশি, বা আমার ওর প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু আপনি আর যাই ভেবে থাকেন না কেন অন্তত এটা ভাবেননি।”
“এর মানে আপনি বলতে চাইছেন…”
কড়ি পুরো বাক্যটা শেষ করবার আগেই কায়েস এসে সামনে দাঁড়াল, “কিরে, কড়ি? তুই এখানে?”
এই হলো কুমিল্লা শহরের সমস্যা। আপনি বাসা থেকে বের হবেন, এক জায়গায় যাবেন আর আপনার পরিচিত কেউ আপনাকে দেখে ফেলবে না বা, আপনি কাউকে দেখবেন না আর যাই হোক তা হয়না। কুমিল্লায় সূর্য রাতে উঠতে পারে, কিন্তু আপনি বেরুবেন আর এইধরনের সাক্ষাতের মুখোমুখি হবেন না, তা হয় না। আসলেই তা হয় না। অনেকে আবার একে কুমিল্লা শহরের জাদুও বলে।
চলবে…

একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-৩২+৩৩

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৩২
মিশেল দেখল মুবিন হলঘর থেকে বিভিন্নজনের নিয়ে আসা উপহারগুলো একসাথে যতগুলো পারা যায় নেয়ার জন্য বুকের মাঝে দু’হাতে চেপে ধরল। তারপর একটা ঘরে নিয়ে গেল। ফিরে এল, আবার বাকিগুলো একই কায়দায় নিলো।
আবার এলো, আবার নিলো। এমন করে করে পুরো হলঘরটা খালি করল সে। মিশেল বসে থাকতে থাকতে বোর হয়ে যাচ্ছিল। তখনি মঈন বের হয়ে এল। মিশেলকে বলল, “চলো।”
মিশেল বলল, “কোথায়?”
“তোমার জন্য হোটেল বুক করতে।”
“তোমার ছেলে মেয়ে দুটো ভীষণ সুন্দর।”
মঈন মিশেলের লাগেজ টেনে ধরে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরুলো, “এভাবে তোমার চলে আসটা ঠিক হয়নি।”
মিশেল মঈনের পেছন পেছন যেতে যেতে বলল, “তোমাকে না দেখে আর থাকতে পারছিলাম না, হানি।”
“তোমাকে বলেছিলাম আমি এখন সুস্থ আছি।”
“বিশ্বাস হচ্ছিল না। খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। মনে হচ্ছিল আমার কাছে মিথ্যে বলছ। তুমি ঠিক নেই।”
“চলে আসার আগে একবার অন্তত আমাকে জানানো উচিত ছিল।”
“আমি সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।”
“অন্তত, আমার বাসায় আসা উচিত হয়নি তোমার।”
“কেন? কি সমস্যা? তুমি ত তোমার স্ত্রীকে তালাক দিচ্ছোই।”
মঈন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না আর।
.
বিশাল বড় এক অন্ধকার, দম বন্ধ করা রাতের শেষে সকালে মিলা ঠিকই সময়মত স্কুলে যেতে তৈরী হয়ে গেল। কিছু খেল না অবশ্য, টিফিন নেবারও ইচ্ছে নেই। মিলা স্কুল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে মুবিনের ঘরের দরজায় টোকা দিলো, “মুবিন দেরি হচ্ছে আমাদের।”
ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে মিলা আবারো বলল, “মুবিন! আমার আজকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্লাস আছে। একদম দেরি করবি না।”
মুবিন তবুও কোনো জবাব দিলো না। মিলা বিরক্ত হয়ে এক ধাক্কায় দরজা খুলে বলল, “ফাইন, তোকে ফেলেই চলে যাচ্ছি আমি।”
কিন্তু কোথায় মুবিন? ঘরে নেই কেন? ওয়াশরুমে? মিলা ওয়াশরুমেও মুবিনকে পেল না। আরো বেশি বিরক্ত হয়ে গেল সে। এবার সত্যি সত্যি একা চলে যাবে। এত যন্ত্রণা আর ভালো লাগে না! ওরাও জ্বালাবে আবার ওদের ছেলেও জ্বালাবে! ঘুরে চলে যাচ্ছিল সে তখনি মনে হলে বিছানায় গিফ্টের বাক্সগুলোর মাঝখানে একটা বড় সড় কাগজ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মিলা ফিরে এসে কাগজটা হাতে নিলো। বড় বড় করে সেখানে মুবিনের বাজে হাতের লেখা শোভা পাচ্ছে। লিখা আছে, “সব গিফ্ট তোর, রোদমিলা। আমি চলে গেলাম। মা – বাবার সব আদরও তোর।”
কাগজ হাতে নিয়ে মিলার হাত – পা দুটোই কাঁপতে শুরু করে দিলো। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সে মার ঘরে দৌড়ে গেল। শিল্পী সারারাত এক ফোঁটাও ঘুমায়নি। ওর অবস্থা আরো বেশি নাজেহাল।
.
কাদিন ছুটির দিন পেয়ে দুপুরে ঘুমাচ্ছিল। দীপা এ সময়টায় সাধারণত টিভি দেখে। টিভির ভলিয়্যুমের শব্দে কাদিনের ঘুম ভেঙে গেল। সে চোখ মেলে ঘাড় উঁচু করে টিভি চলছে দেখে অবাক হয়ে গেল। কিন্তু কিছু বলল না। দীপা বলল, “কি হয়েছে? এভাবে কি দেখছেন? ক্যাটরিনাকে দেখেন? আপনার প্রিয় নায়িকা?”
দীপা দেখল কাদিন বালিশে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে কি যেন বিড়বিড় করল। সে কাদিনের দিকে ঝুঁকে এসে বলল, “কি বিড়বিড় করছেন?”
কাদিন বলল, “কিছু না।”
“আরে কিছু না বললে ত হবে না। ক্যাটরিনাকে ফিসফিস করে কি বললেন? বলুন না, বলুন না। রাগ করব না। অনেক ভালো বউ আমি।”
কাদিন উঠে গেল। বিছানা ছেড়ে যেতে যেতে বলল, “একে তো টিভির এত সাউন্ড তার উপর আবার ঘ্যানঘ্যানানি একটা মানুষ ঘুমাবে কি করে? ধ্যাত ছুটির দিনটাই বরবাদ। কেউ ঘুমিয়ে থাকলে কি করে আরেকজন এমন ভলিয়্যুমে টিভি দেখতে পারে আমার বুঝে আসে না।”
দীপার এত মন খারাপ হলো যে সে টিভি বন্ধ করে দিয়ে রিমোট খুঁটতে লাগল। গ্রাম থেকে ফিরে আসবার পর থেকেই তো সে কাদিনের মন বুঝে চলবার চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু যেই লাউ সেই কদু। কিচ্ছু পারছে না সে, কিচ্ছু হচ্ছে না। কোলের উপর থেকে বালিশটা সরিয়ে ও বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। কাদিনের পেছনে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “স্যরি, আমি টিভি অফ করে দিয়েছি। আপনি শুয়ে পড়ুন।”
“বন্ধ করতে হবে না। যাও টিভি দেখো গিয়ে। এখন আর ঘুমাতে পারব না।”
“আপনি যদি এখন না ঘুমান আমি আর কোনোদিন টিভি দেখব না।” কথাটায় যে দীপার নিজের প্রতি নিজের কতটা বিরক্তি মিশেছিল, কতটা অভিমান জমেছিল তা কাদিন বুঝেও বলল, “আমাকে এখন বেরুতে হবে।”
কাদিন চলে গেল। দীপা আর কি করবে? কি করবে সে? আল্লাহ কেন এত ক্রিটিকাল, এত বেশি জটিল একটা মানুষের সাথেই ওকে জুড়ে দিলো? আর যেহেতু জুড়ে দিলোই তাহলে ওকে কেন একটু বোধবুদ্ধি দিলো না? নিজেকে আজকাল আরো বেশি অসহ্য লাগে দীপার। কাদিন চলে যেতেই শব্দ করে ঘরের দরজা বন্ধ করে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বালিশে মুখ গুঁজল সে। মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করছে!
.
জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত অনেক বেশি অনিশ্চিত কড়ি তা আগে থেকেই জানতো। কিন্তু এত বেশি অপ্রত্যাশিত তা ওর বিয়েটা ভেঙে যাওয়ার আগে ভাবতেও পারেনি। ও তো এমনি এমনি ইমাদকে কষ্ট দিতে চায়নি বলে বলেছিল কিছু করা যায় কিনা দেখছে। সে জানতো কিছুই করা যাবে না। কিন্তু কেমন করে সব হয়ে গেল? এখন ত সমস্যা আরো বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে! বিয়ে একটা ভাঙলে কি হয়েছে? একবার যখন দেখা শুরু হয়ে গেছে একটার পর একটা দেখতেই থাকবে সবাই। তারপর হুট করে আবার আরেকটা ঠিক হয়ে যাবে। অন্যদিকে, বেচারা ইমাদ সাহেবের মনে আশার বাতি আরো প্রগাঢ় হয়ে জ্বলে উঠেছে। যত বেশি আলো জ্বলবে, আশার প্রদীপ নিভে গেলে জীবন তত বেশিই অন্ধকার হয়ে যায়। আগের বিয়েটা হয়ে গেলেই ইমাদের জন্য ভালো ছিল। কষ্ট কম হতো। এখন কষ্টটা আরো বাড়বে! কড়ি পাশ উল্টে শুলো। একটা প্রজাপতি এসে জানলা দিয়ে ঘরের দেয়ালে বসেছে। প্রজাপতির ডানাগুলো বেগুনী। এত সুন্দর প্রজাপতি সে আর কখনো দেখেনি। এই সুন্দর প্রজাপতিটা যখন উড়ে এসে কড়ির বাহুতে বসল কড়ি চোখ বন্ধ করে ফেলল। জীবন সুন্দর। প্রজাপতির ওই ডানা দুটোর মত সুন্দর। আর জীবনে সুখও খুব সহজ একটা বিষয়। যে জীবনে আকাশে সুন্দর একটা চাঁদ উঠলেই অন্ধকার কেটে যায়, গোধূলী বেলায় জানালায় একটা চড়ুই বসলেই একাকিত্ব কেটে যায়, প্রজাপতি উড়ে এলেই রঙিন হয়ে যায়, সে জীবন নিয়ে আবার চিন্তা কিসের? ইমাদের জীবনও সুন্দর হতে হবে। ও থাকুক আর নাই থাকুক। কারো জন্য কি কারো জীবন থেমে থাকে? আর কষ্ট আসলে আমাদের নিজেদের তৈরী করা বিশেষ চাহিদা। যা আমরা পেতে চাই না বললেও আসলে সবসময় শুধু ওটাই খুঁজে বেড়াই। পাশ দিয়ে সুখ হেঁটে গেলেও ফিরে তাকাই না। তবুও সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে যেন ইমাদ কোনোভাবে কষ্ট না পায়।
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৩৩
মিলা আতঙ্কে নীল হয়ে বলল, “মা, মুবিন চলে গেছে।”
শিল্পী হাঁটু থেকে চিবুক তুলল, “বস।”
মিলা কিছু বুঝতে না পেরে বলল, “কি?”
শিল্পী মেঝেতে পাশে হাত রেখে ইশারায় জায়গা দেখিয়ে দিলো। মিলা কান্না রোধ করে অস্থির হয়ে বলল, “মা, মুবিনের চিঠি…।”
শিল্পী বলল, “কি লিখেছে?”
“ও চলে গেছে, মা। সব দোষ আমার। আমি কেন ওকে এগুলো বলতে গিয়েছিলাম!” মিলা কপালে হাত রাখল। সারা শরীর দরদর করে ঘামচে ওর। হাত কাঁপছে।
শিল্পী বলল, “বাপ চলে গেছে, ছেলেও যাক।”
মিলা এবার কেঁদে ফেলল, “মা এমন কেন করছো?”
“তুইও কি চলে যাবি? আচ্ছা তাহলে যা, যা।” শিল্পী হাত দিয়ে চলে যাওয়ার ইশারা করতে করতে বলল।
মিলা বলল, “এসব কি বলছ, মা?”
“আমি তোদের সব বলতে চাই। সব শুনে মনে হয় না আমার কাছে আর থাকবি। আগে চলে গেছে ভালোই হয়েছে।”
মিলা হাঁটু মুড়ে বসে মাকে জড়িয়ে ধরতে চাইল কিন্তু ওর হাত দুটো ওর কোলের উপরই পরে রইল। চাওয়া এবং অপারগতার দোটানা বোধহয় একেই বলে। শিল্পী টলতে টলতে মেঝে থেকে উঠে বিছানায় কাত হয়ে শুলো। মিলা ঘাড় তুলে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। শিল্পীর মুখ দেয়ালের দিকে ফেরানো, মিলার দিকে পিঠ দেয়া। সে বলল, “আমার দিকে তাকাস না তো।”
মিলা বিছানায় হেলান দিয়ে দু হাঁটু একসাথে জড়ো করে ঘুরে বসল। শিল্পী বলতে শুরু করল,
আমি আর মঈন তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। একই বিষয়, একই ব্যাচ। ওকে চিনতাম কিন্তু কখনো কথা হতো না। এক রাতে খেয়াল করলাম ও আমার হলের বাইরে বসে আছে এবং প্রতি রাতেই নির্দিষ্ট একটা সময় জুড়ে বসে থাকে। আমি হলের ছাদ থেকে প্রায়ই ওকে দেখতাম। বুকের মধ্যে যে কেমন করে উঠত তখন! কিন্তু কোনোদিন সাহস করে জিজ্ঞাসা করতে পারিনি যে, কি চাও? কেন বসে থাকো এখানে? শুধু আমিও পড়া ফেলে ঐ সময়টায় ছাদে হাঁটাহাঁটি করতাম। হলের সামনের পাহাড় দেখার ভান করতে করতে আসলে পাহাড়ের নীচে রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে থাকা কিংবা ইটের আসনে বসে থাকা মঈনকে দেখতাম। এর বেশি কিছু করার মত খুঁজে পাইনি তখন। পরে একদিন ছাদ থেকেই আমাদের চোখাচোখি হয়ে গেল। শ্বাস রুদ্ধ করে জমে গেল সে। মাথা চুলকাতে চুলকাতে হাসবার চেষ্টা করল। কি যে নার্ভাস ছিল! আমি ওর নার্ভাসনেস কাটাতে আমার হাসি ছুঁড়ে দিলাম। পরদিন থেকেই আমাদের কথা শুরু হয়ে গেল। আমরা একসাথে প্রচুর ঘুরাঘুরি করতাম। আমার এখনও মনে আছে আমি তখন চোখ মারতে জানতাম না। একদিন ওকে বললাম, “মঈন?”
“আমাকে চোখ মারা শেখাবে?”
ও হাসতে হাসতে বলল, “শেখালে কি দেবে?”
আমি ওর মুখ থেকে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম, “কি চাও তুমি? আমার কাছে কি চাও?”
ও নীচের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “সময় এলে বলি?”
আমি শ্বাস বন্ধ করে জানতে চাই, “সময় বলতে তুমি কি বুঝো, বন্ধু?”
ও আকাশের দিকে মুখ তুলে রোদকে আরাম দিতে দিতে বলে,
“সময় হলো আমাকে গ্র্যাজুয়েট করার মন্ত্র, সময় হলো আমার চাকুরীর জাদু।”
আমি হাসি, মিটিমিটি, লজ্জায় লাল হওয়া হাসি। তারপর মঈন আর আমি চবির ২১০০ একর জুড়ে দাপিয়ে বেড়াই। পাহাড়ি এবং সমতল ভূমিগুলোকে স্বাক্ষী রেখে নিজেদের রঙীন দিনগুলোর স্বপ্ন বুনতে বুনতে এগিয়ে চলি। তারপর একদিন সময় আসার আগেই সময় ফুরিয়ে যায়। মঈন এক বিকেলে হাঁপাতে হাঁপাতে আমার কাছে ছুটে আসে। ওর কপাল চুইয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছিল। কিন্তু আমার হাতে ও যখন চিঠিটা গুঁজে দিলো তখন ওর ঠান্ডা হাতের ছোঁয়া আমাকে থমকে দিয়েছিল। ও কোনোমতে বলল, “শিল্পী, তোমার দায়িত্ব। জোহরাকে চিঠিটা যে করে হোক পৌঁছে দিও। ওর বিয়ে ঠিক হয়ে যাচ্ছে।”
মিলা চমকে উঠে প্রশ্ন করল, “জোহরা কে?”
শিল্পী সোজা হয়ে শুয়ে হাত দিয়ে কপাল ঢাকল। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমার রুমমেট। জুনিয়র ছিল। আমার বড় আদরের। আপু আপু ডেকে জান দিয়ে দিতো। আমার পরীক্ষা থাকলে নিজে চা করে এনে দিয়ে বলত, চা খাও, আপু। ঘুম আসবে না।”
ও অসুস্থ হলে আমি ওর সব কাপড়চোপড় ধুয়ে দিতাম। বেশিরভাগ সময় আমরা একসাথেই খেতাম। হলের খাবার খাওয়ার মত ছিল না। তাই নিজেরা রেঁধে খেতাম। ও রাঁধলে আমাকে আর রাঁধতে দিতো না। আমি রান্না করলেও ওকে সাথে নিয়ে খেতাম। যেখানে ঘুরতে যেতাম সাথে করে নিয়ে যেতাম। মঈন আর আমি ক্লাসের পর যখনই একসাথে হতাম সাথে জোহরাও থাকত। জোহরা ছিল বাড়ি থেকে দূরে থাকা আমার একমাত্র আপনজন, সঙ্গী। ওকে ফেলে কোথাও যাওয়া হতো না।”
মিলা ঘাড় নীচু করে বলল, “বাবা কি উনাকে আগে থেকেই চিনতেন?”
শিল্পী কষ্টের হাসি হাসল। বলল, “ওর জন্যই হলের বাইরে বসে থাকত। ওর জন্যই আমার সাথে বন্ধুত্ব করেছিল।”
“পরে?”
“আমি চিঠিটা পড়ে হলের বাথরুমে মুখ চেপে ধরে বসে পাগলের মত কাঁদি। আমার কান্না থামেনা, কোনোমতেই না। মানতে পারছিলাম না। আমি শুধু ওর বন্ধু। না বন্ধুও না, আমি শুধু তোমাদের বাবার জন্যে ছিলাম তার ভালোবাসার মানুষের রুমমেট, বড় আপু। কাঁদতে কাঁদতে মানসিকভাবে আমি শেষ হয়ে যাই। যতদিনে নিজেকে সামলাই, সামলে চিঠিটা নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে যাই, জোহরার বাসায়, ততদিনে তিনবার সূর্য ডুবে গেছে।”
মিলা উঠে এসে বিছানায় বসল, মায়ের কাছে। জড়িয়ে ধরল মাকে। শিল্পী মেয়ের বুকে ঢলে পড়ল। তার শ্বাস প্রশ্বাসও বড় ক্লান্ত। খুব আস্তে আস্তে সে বলল, “গিয়ে শুনি জোহরার আকদ হয়ে গেছে।”
মিলা মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “কি লেখা ছিল, চিঠিতে?”
“বলতে ইচ্ছে করছে না তবুও বলছি। জোহরার প্রতি ভালোবাসার কথা লেখা ছিল। আর লেখাছিল ও ভেবেছিল চাকুরী পেয়ে যোগ্য হয়ে জোহরা সামনে দাঁড়াবে। জোহরা অনেক বড় ঘরের মেয়ে। সে তুলনায় মঈনের কিচ্ছু নেই। তাই না শোনার ভয়ে কখনো কিছু বলতে পারেনি। কিন্তু যখন শুনলো বিয়ে ঠিক হয়ে যাচ্ছে তখন নিজের অক্ষমতা, অযোগ্যাতা এসব নিয়ে পড়ে থাকবার কথা কল্পনাও করতে পারেনি।”
মিলা চুপ করে রইল। ওর মাথায় হাজারটা প্রশ্ন এলোমেলোভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে। ওর মনে হলো এই মুহূর্তে মুবিন যদি পাশে থাকত তাহলে এসব শোনা এতটা কঠিন মনে হতো না। মিলা চোখ বন্ধ করে মনে মনে মুবিনকে ডাকল, “মুবিন কোথায় তুই? মুবিন? আমি একা কেন এসব শুনব? তোকেও শুনতে হবে। মুবিন?”
মিলার মনে হলো মা কিছু একটা বললেন। সে চোখ মেলল। শিল্পী বলল, “বিশ্বাস কর আমি ইচ্ছে করে করিনি। আমি ইচ্ছে করে করিনি।” শিল্পীর গলা ভেঙে এল। চোখের পাতা ভারি হয়ে এল কিন্তু সে কাঁদল না। মিলার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে সোজা হয়ে বসল। আরো বলল, “অনুশোচনায় নিজেকে তোদের বাবার কাছ থেকে পুরোপুরি দূরে সরিয়ে ফেললাম। কোনোমতে, শুধু এইটুকু বলতে পেরেছিলাম যে, “আমাকে ক্ষমা করে দিও। জোহরার বিয়ে হয়ে গেছে।”
শিল্পী আবারো চুপ। খানিক বাদে নিজেই আবার ভারি নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, “কিন্তু বেশিদিন দূরে সরে থাকতে আমি পারিনি। ও ক্লাসে আসা ছেড়ে দিয়েছিল এমনকি পরীক্ষা পর্যন্ত দেয়নি। খোঁজ নিয়ে দেখলাম ও হল ছেড়ে বাড়ি চলে গেছে। আমি নিজেকে আর আটকে রাখতে পারিনি। ওর এক বন্ধুর কাছ থেকে ওর বাড়ির ঠিকানা যোগাঢ় করে পরীক্ষা শেষে একা, একটা মেয়ে অচেনা এক গ্রামে চলে গেলাম ওর খোঁজ করতে করতে। ওর বাড়ি গিয়ে ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আবার ফিরিয়ে আনলাম। আমি এখনও তোদের মরহুম দাদীর আমার হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পড়া ভুলতে পারিনি। ওর ঐ কঠিন সময়টায় কি করে আমি ওর পাশে না থাকি? আর আমার জন্যই তো তার ওরকম অবস্থা হয়েছিল।”
মিলা আচমকা বলে উঠল, “তোমার কোনো দোষ নেই, মা।”
শিল্পী মেয়ের কথায় কান না দিয়ে বলল, “তোর বাবার পাশে থাকতে থাকতে, ওকে সামলাতে গিয়ে একসময় আমরা সত্যিকার বন্ধু হয়ে উঠি। মঈন একসময় জোহরার জন্য আমার বন্ধু হয়েছিল। পরে সে নিজের জন্যই আমাকে বন্ধু হিসেবে বেছে নিয়েছিল। আমি সবসময় ওর প্রতি নিজের অনুভূতিগুলো চেপে রাখার চেষ্টা করেছি। কখনো প্রকাশ করতে চাইনি। কতটুকু পেরেছিলাম তোদের বাবাই ভালো বলতে পারবেন।”
মিলা প্রশ্ন করল, “তোমাদের বিয়েটা কি দাদী দিয়েছিলেন?”
“নাহ, ও নিজেই আমাকে চেয়েছিল। বলেছিল বন্ধুকে আজীবন পাশে চাই। পাশে পেতে যা যা করতে হবে সব করতে চাই।” হঠাৎ করে কান্নার দলায় শিল্পীর কণ্ঠ রোধ হয়ে এল। কান্নায় দমবন্ধ হলো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, “আমি মনে করি এইটুকুই আমার দোষ ছিল। লোভী হয়ে উঠেছিলাম। আমি ওকে না করতে পারিনি।”
মিলার গলা ব্যাথা করছিল। ঢোক গিলে ও ভেজা কণ্ঠে শুধু বলতে পারল, “কেঁদো না, মা। প্লিজ কেঁদো না।”
শিল্পী যেন কান্নায় আরো ডুবে গেল। দু’পা একসাথে জড়ো করে দুলতে দুলতে কাঁদল, গুনগুন করতে করতে কাঁদল। মিলা শুধু অসহায়ের মত তাকিয়ে রইল। একটু পর বলল, “পানি দিব, মা?”
শিল্পী আঁচলে নাক মুছতে মুছতে বলল, “দে।”
মিলা এক গ্লাস পানি এনে দিলো। পানি ঢালবার সময় মিলা বুঝল ওর খুব শরীর খারাপ। মাথা ব্যাথায় ফেটে যাচ্ছে। চোখ পর্যন্ত টনটন করছে। শিল্পী পানির গ্লাসটা হাতে নিলো ঠিকই, কিন্তু খেলো না। চুপচাপ ছুঁড়ে ফেলে দিলো দেয়ালের শরীরে। মিলা ভয়ে চোখ বড় বড় করে চিৎকার করে উঠল, “মা!” দেয়ালের অশ্রু মেঝেতে গড়িয়ে পড়তে লাগল। শিল্পী সেদিকে তাকিয়ে বলল, “তোদের নিয়ে যেবার রাঙামাটি বেড়াতে যাই তখন জোহরার সাথে এত বছর পর আমাদের আবার দেখা হয়ে যায়। তখনি সব শেষ।”
মিলার মনে পড়ে গেল ঘটনাটা। ওরা আগে ত ভালোই ছিল। পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা শেষে ওরা যখন ঘুরতে যাওয়ার আবদার করেছিল, তখন বাবা ওদের সবাইকে রাঙামাটি নিয়ে গিয়েছিলেন। আর সেই ট্যুর থেকেই মা – বাবা কেমন বদলে গেলেন! বাড়িটা আর বাড়ি রইল না।
শিল্পী এলোমেলো, রুক্ষ চুলগুলো খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে বলল, “তখন কেন আমি ওর পাশে ছিলাম তা ভাবলে অনেকগুলো উত্তর পাই। একবার মনে হয় যাকে ভালোবাসি ওকে ক্ষয়ে যেতে দিতে চাইনি। আবার মনে হয় ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে বোধহয় চেয়েছিলাম। তবে ওর তা মনে হয় না। ওর মনে হয় আমি ইচ্ছে করে ওকে আর জোহরাকে আলাদা করেছি। আর এরপর নিজে ওর ঘাড়ে উঠে বসেছি।”
চলবে…

একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-৩০+৩১

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৩০
বাইরে দাঁড়িয়ে ইমাদ কড়িকে কয়েকবার কল করল। কড়ি প্রতিবারই কল কেটে দিয়েছে। শেষে কোনো উপায় না পেয়ে কড়ির ঘরের পেছনের জানালায় ইমাদ ধাক্কা দিলো। জানালা ভেতর থেকে বন্ধ না থাকায় চট করে খুলে গেল। কড়ি উপুড় হয়ে বালিশে মাথা রেখে শুয়েছিল। ভড়কে উঠল সে, “আপনি? এখানে?”
ইমাদ বলল, “স্যরি আমি বুঝিনি জানালা খোলাই ছিল। কড়া নাড়তে ধাক্কা দিতেই খুলে গেছে।”
“আপনি এখানে কি করছেন?” কড়ি কঠিন করে বলল।
“কথা বলতে এসেছি। অনেকবার কল করেছিলাম। কেটে দিয়েছেন।”
“যেহেতু কল কেটে দিয়েছি আপনার বোঝা উচিত যে আমি কথা বলতে চাইছি না।”
“আচ্ছা।”
কড়ি এগিয়ে এসে জানালা বন্ধ করে দিলো। পরে রাতে খাওয়ার সময় ইমাদকে কেউ খুঁজে পেল না। সবাই হয়রান হয়ে গেল। নিলয় অনেকবার কল করার পরও ইমাদ কল ধরল না। দীপা কল করতেই রিসিভ করল সে। দীপার কল কেটে দিলে ও কেঁদেকেটে মরে যাবে। তাই বলল, “তোরা খেয়ে নে।”
দীপাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিলো। কড়ি খাওয়া দাওয়া শেষে ঘরের দরজা আটকে জানালা খুলে দেখল ইমাদ সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। কড়ি হতাশ হয়ে বলল, “কি যে করি আপনাকে নিয়ে! শুনেননি আমার বিয়ের তারিখ ঠিক করছেন, বাবা?”
ইমাদ বলল, “শুনেছি।”
“তাহলে?”
“এজন্যই এখানে।”
“আপনি শার্টের বোতাম লাগান। এভাবে কথা বলতে অড লাগছে।”
ইমাদ শার্টের বোতাম লাগিয়ে বলল, “স্যরি।”
কড়ি তাড়া দিয়ে বলল, “তারপর?”
“আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।”
“কথাটা আমার বাবাকে গিয়ে বলুন।”
“আপনার সাথে যার বিয়ে ঠিক হয়েছে উনি কি করেন?”
“পুলিশ অফিসার।”
“ভয় দেখাচ্ছেন?”
কড়ি মাথায় হাত রেখে বলল, “আরে না সত্যি।”
ইমাদ বিড়বিড় করে বলল, “একবার চোর, আরেকবার সোজা পুলিশ! আমার মতন সাধারণ মানুষদের কি চোখে পড়ে না?”
কড়ি সরু চোখে তাকিয়ে বলল, “কি বললেন?”
“কিছু না।”
“আমি শুনেছি।”
“আচ্ছা।”
কড়ি কিছু বলল না আর। ইমাদ প্রশ্ন করল, “আপনার বাবার কাছে আপনার রেফারেন্স দিতে পারি?”
“রেফারেন্স বলতে?”
“রেফারেন্স বলতে এরকমটা যে আপনিও আমাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক এই ধরনের কিছু আঙ্কেলকে বলা গেলে তিনি আমাকে সুযোগ দিলেও দিতে পারেন।”
কড়ি সাফ সাফ মানা করে বলল, “কখনো না।”
“আমার এখন যে অবস্থা যেকোনো গার্ডিয়ান লাভ ম্যারেজ হলে মেনে নিবে কিন্তু অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে মানবে না। পড়াশুনায় ভালো, কর্মঠ বেকারকে মেয়ে পছন্দ করে ফেললে এক কথা। অন্যথায় আঙ্কেল কেন কেউ’ই মানবেন না। আমার পড়াশুনা এখনো শেষ হয়নি। চাকুরী নেই। কেন মানবেন তিনি?”
“বুঝতে যেহেতু পারছেন তাহলে আর এখানে আমার কাছে কি?”
“আপনার রেফারেন্স চাই। আমার হয়ে একটু সুপারিশ করুন।”
“মজা পেলাম। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি চাকুরী চাইতে যাচ্ছেন।”
“আপনার কাছে হয়তো বিষয়টা মজার হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে এটা কোনো মজার বিষয় না।”
ইমাদের এমন বেহাল দশা দেখে কড়ির মায়া হলো। ছেলেটা নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করলেও ভেতরে ভেতরে খুব অসহায়বোধ করছে। কিন্তু ওর ত আসলে কিছু করার নেই।
ইমাদ’ই আবার বলল, “নাহয় ক’টা বছর অপেক্ষা করুন আমার জন্যে। আমি প্রতিষ্ঠিত হয়ে আঙ্কেলের কাছে আমি আর আমার পরিবার যাব। আঙ্কেল ফিরিয়ে দিলে আপনাকে আর কখনো বিরক্তও করব না। কিন্তু এইটুকু সুযোগ অন্তত আমাকে দিন।”
কড়ি বলল, “আপনি আমার পছন্দেরও না আবার অপছন্দেরও না। তাই আমার রেফারেন্সটুকু আপনি পাবেন না। এমনকি আমি যদি আপনাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুকও হতাম তবুও বাবাকে বলতাম না, আর না আপনাকে বলতে দিতাম। আমি এমন একটা মেয়ে যে এই অধিকারটুকু নিজের অপরাধে হারিয়ে ফেলেছি। এখন আমার পরিবারই আমার প্রথম এবং একমাত্র প্রায়োরিটি। তবুও অবস্থা কেমন আমি দেখছি কথা বলে। এখনো আমি জানি না বাবা পাকা কথা দিয়ে তারিখ ঠিক করে ফেলেছেন কিনা। যদি করে থাকেন তাহলে আমার হাতে করার মত আর কিছুই থাকবে না।”
“আচ্ছা।”
ইমাদ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। কড়ি বাবার ঘরে গিয়ে বাবাকে পেল না। দেখল সবাই ড্রয়িংরুমে আলোচনায় বসেছে। কড়ি ইতঃস্তত করে বলল, “আসব?”
কাইয়ূম হাতের ইশারায় নিজের কাছে ডাকল। কাইয়ূমের পাশে বসতেই কাইয়ূম এক হাতে বোনকে জড়িয়ে ধরে বলল, “কিছু বলবি?”
“না।”
“কিছু বলার থাকলে বল।”
“কি কথা হচ্ছিল?”
“ঐ তোর বিয়ের তারিখ নিয়ে। রিমার কাছে শুনেছি তোর কোনো আপত্তি নেই। ওরাও আকদ করিয়ে ফেলতে চাইছে। ওটা নিয়েই আলোচনা করছিলাম।”
“আমার একটু ঢাকা যাওয়ার কথা ছিল। তারিখ মিলে গেলে বোধহয় যেতে পারব না, তাইনা?” কড়ি ঘুরিয়ে প্রশ্নটা করল।
কাদের সাহেব কাশতে কাশতে বললেন, “কয় তারিখ যেতে চাইছিস?”
তার মানে তারিখ এখনও ঠিক হয়নি। কড়ি বাবার দিকে তাকিয়ে কি বলা যায় দ্রুত ভাবতে লাগল।
কাইয়ূম বলে উঠল, “হ্যাঁ, তারিখ তো এখনও ফিক্সড হয় নি। কয় তারিখ ঢাকা যাবি ওটা বল। ঐ তারিখ আর আশেপাশের দুই তিনদিন বাদ দেওয়ার কথা মাথায় রেখে তারিখ বসাব।
কাদিন অসহিষ্ণু গলায় বলল, “আমি যাই।”
কাদের সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, “কি হয়েছে তোর?”
“আমার কথা তো কেউ কানেই তুলছে না। আমার মনে হয়না আমার কোনো প্রয়োজন এখানে আছে।”
রিমা ধমক দিয়ে বলল, “কোথাও যেতে হবে না। বস এখানে।”
কাদিন অনিচ্ছাসত্ত্বেও বসল। বলল, “বাড়িতে একটা বিয়ের অনুষ্ঠান সবে হলো। এখনি আবার আকদ কিসের? কি দরকার অত তাড়াহুড়ো করার?”
কাইয়ূম বলল, “শুভ কাজে দেরি করতে নেই। উভয়পক্ষই যেহেতু রাজি এখানে দেরি করবার কি আছে?”
“হুট করে কিছু করতে নেই। আমাদের উচিত আরো খোঁজ খবর নেয়া।”
“খোঁজ খবর নিয়েছি। নিয়েই তো এগুচ্ছি।”
“আমার কেন যেন মন টানছে না।”
“কেন কি সমস্যা?” কাদের সাহেব প্রশ্ন করলেন।
“ছেলে পুলিশ। এইসব পেশার মানুষদের রিস্ক বেশি। জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। কখন কি হয়!”
কায়েস বলল, “রিস্ক ভাই সবকিছুতেই। এই যে তুমি বাইকে করে অফিস করতে যাও। আল্লাহ না করুক তোমারও বাইক অ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে। তো এটা ভেবে কি মেজো ভাবির পরিবার তোমাকে তাদের মেয়ে দেয়নি?”
“এই ছেলের মাঝে আরো সমস্যা আছে। ছেলেকে ভালো করে দেখেছিস তুই? শু পরতে হয় বেল্টের সাথে ম্যাচ করে। এটাও জানে না। এই ছেলে শু পড়েছে প্যান্টের সাথে ম্যাচ করে। পারফিউমের ঘ্রাণটাও কড়া ছিল। কেমন যেন সস্তা পারফিউম! ড্রেসিং সেন্স ভালো না। এমন ছেলের সাথে কড়ির বিয়ে আমি দিব না।”
দীপা ফ্যালফ্যাল করে কাদিনের দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটার মাথায় সমস্যা আছে নাকি? দীপা পাশে বসা রিমার কানে ফিসফিস করে বলল, “আপু, আপনার ভাই ছোটবেলায় কোথাও পড়েটরে গিয়ে মাথায় কোনো আঘাত পেয়েছিল?”
রিমা বলল, “এইটুকু দেখেই এ কথা বলছ তাহলে ওর বেলায় ও মেয়ে দেখে এসে কি কি বলত শুনলে কি বলবে? আমাদের ভাগ্য ভালো শেষ পর্যন্ত তোমাকে পেয়েছি। ভাগ্যিস তোমার উপর ওর কুনজর পড়েনি! কি জাদু করেছিলে ওকে বলো তো!” রিমা দুষ্টু হাসি হেসে কনুই দিয়ে ধাক্কা দিলো দীপাকে। দীপার আচমকা এত লজ্জা লাগল! কায়েস দু’হাত একসাথে জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে বলল, “নিজের বেলায় যে অত্যাচার করেছ! তবুও তোমার হয়নি না? আবার শুরু হয়েছে তোমার এই অত্যাচার! ক্ষ্যামা দাও না, আমাদের। আর কত জ্বালাবে?”
কাদিন দমল না। উল্টো বলল, “তোর বোধহয় বিয়ে করতে বেশি মন চাইছে। এজন্যই কড়ির বিয়ের এত তাড়া তোর! এত মন চাইলে তোর বিয়ে তুই সেড়ে ফেল। আমাদের কোনো সমস্যা নেই।”
কায়েস থতমত খেয়ে একদম চুপ হয়ে গেল। বেচারা লজ্জায় শেষ!
কাদিন কাদের সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাবা, এত তাড়া কিসের আমাদের? একটাই তো বোন, তাইনা? আমরা আরো ভাবি, আরো দেখি। একটা কেন দশটা বিয়ে দেখে এরপর বেস্টটা দিব।”
কাইয়ূম বাগড়া দিয়ে বলল, “তোর পছন্দ হওয়ার আশায় বসে থাকলে দশটা কেন দশ হাজারটা দেখার পরও কড়ির আর বিয়ে হবে না। তুই তোর উস্তাদি কলম চালাতেই থাকবি আর একেকটা বিয়ে ভাঙতেই থাকবি। তুই যেসব কারণ দর্শালি একটাও ধরার মতন না।”
কাদিন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই কাদের সাহেব ডাকলেন, “কাদিন?”
কাদিন বিনম্র গলায় বলল, “জি, বাবা।”
“রিস্ক এর কথাটা বলে তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছ। এখনি বুক ধড়ফড় করছে। আমি এখানে আর মেয়ে দিতে পারব না। আর দিলেও দুশ্চিন্তায় আমি টিকতে পারব না। কাজটা ঠিক করোনি।” উঠে গেলেন তিনি। কড়িও উঠল। সে বুঝে গেছে এই বিয়ে ভাগ্যক্রমে বাতিল হয়ে গেছে। অবাক লাগছে তার!
কাইয়ূম দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “আহারে! কত ভালো সম্বন্ধটা ছুটে গেল !”
রিমারও মন খারাপ। কড়ির বিয়েতে কোন শাড়িটা পরবে এটাও সে ঠিক করে ফেলেছিল! কায়েস বেচারা যে লজ্জা পেয়েছে এরপর চুপচাপ ঘর ছেড়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ওর নেই। দীপা আর কাদিনও নিজেদের ঘরে চলে এল। বিয়েটা শেষ পর্যন্ত না হওয়ায় কাদিনের ভালো লাগছে। এই সম্বন্ধটা ওর মনমত হয়নি। দীপা আচমকা বলল, “আমাকে কেন বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলেন?”
কাদিন দীপার দিকে ঘুরে তাকাল, “জেনে কি করবে?”
দীপা বলল, “আমার ত দোষের শেষ নেই তাই আরকি।”
কাদিন বিছানা ঝাঁট দিতে দিতে ঠেশ দিয়ে বলল, “লুচ্চা উপাধী পেতে তোমাকে বিয়ে করেছিলাম।”
দীপা এতক্ষণে কাদিনের রেগে থাকার কারণটা ধরতে পারল। এতক্ষণ আসলে বুঝতে পারছিল না ঠিক কোন কারণটায় কাদিন ওর উপর এত ক্ষেপে আছে। দীপা মিনমিন করে নীচু গলায় বলল, “স্যরি।”
কাদিন ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি চুমু খেতে বলেছিলে। এরপরই আমি এগিয়েছিলাম। কোন হিসেবে আমাকে লুচ্চা বললে তুমি?”
দীপা কি বলবে? কাদিন তো ঠিকই বলেছে। দীপা তাই চুপ করে রইল। কাদিন বলল, “কেন বলেছ?”
দীপা কঠিন জেরার মুখে পড়ে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, “স্যরি বললাম তো! এরপরেও এমন শক্ত শক্ত কথা কেন বলছেন?”
কাদিন বলল, “যাও বললাম না আর।”
শুয়ে পড়ল ও। দীপাও ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। কাদিনের ধমকাধমকিতে মন খারাপ নিয়েই ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল ও। ঘুমের ঘোরে সবসময়ের মতই পাশ উল্টে কাদিনের উপর হাত পা তুলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল কাদিনকে। কাদিন বিরক্ত হয়ে সরিয়ে দিলো দীপাকে।
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৩১
শিল্পী বলল, “তোর বান্ধবীদের আসতে বলেছিস তো?”
মিলা চুলের কাটা খুলে, চুলে দুই ঝুঁটি করতে করতে বলল, “হু।”
শিল্পী বলল, “নীল স্কার্টটা পর না। এটা কেন?”
মিলা মায়ের দিকে তাকিয়ে জোর করে হেসে বলল, “ঠিক আছে।”
শিল্পী যেতেই দরজা আটকে মিলা পোশাক বদলে নীল স্কার্ট পরল। সুহাকে কল করল সে, “আসছিস তো?”
সুহা বলল, “না।”
“কেন?”
“তোর জন্মদিন যদি কেউ কোনোদিন পালন করে তবে সেদিন যাব।”
“আহ এমন করিস না তো।”
“আমি গেলে কিছু একটা উল্টাপাল্টা বলে ফেলব, দেখিস।”
“আয় না।”
“না।” সুহা খট করে মোবাইল রেখে দিলো।
.
মুবিন আজ এত খুশি যে ওর অপছন্দ হওয়া সত্ত্বেও মায়ের পছন্দের ডেনিম শার্ট এবং নীল জিন্স পরল। শিল্পী খুশি হয়ে মুবিনকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখল। মুবিন খানিক লজ্জা পেল। শেষটায় ধৈর্য্যহারা হয়ে বলল, “আর কতক্ষণ মা? ছাড়ো না।”
“না, ছাড়ব না। তোর বুকে অনেক শান্তি বাপ! কি লম্বা হয়ে গেছিস! মাশাআল্লাহ্।”
মঈন ঘরে ঢুকে মা ছেলেকে একসাথে দেখে নিজেও এগিয়ে গেল, “দেখি আমার চেয়ে লম্বা কিনা তোমার ছেলে?”
মুবিন উৎসাহে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বাবার কাঁধের সাথে কাঁধ মেলাল, “এই তো আর একটু।”
“একটু না অনেকটুকু। এখন কানের দুল খোল।” মঈন হাত বাড়িয়ে দিলো।
মুবিন বিনাবাক্যে কান থেকে দুল খুলে বাবার হাতে দিলো। আজ বাবাকে খুব ভালো লাগছে। বাবা- মা সবসময় এমন থাকতে পারেন না? একঅপরের সাথে যুদ্ধ কেন করেন? এই সুখী বাবা, মায়ের সাথে একটা ছবি তুলে ফেললে কেমন হয়? ছবিটায় ওরা হাসতে থাকবে। বাবা মুখ মেঘকালো করে রাখবেন না, মায়ের চোখ দীঘির মত কান্না টলমলে হবে না। আর মিলা? মিলা কোথায়? মুবিন বলল, “একটু দাঁড়াও, একটা ছবি তুলব আমরা। মিলাকে ডেকে নিয়ে আসি।”
মুবিন দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। মেহমানরা ধীরে ধীরে আসতে শুরু করেছে। মিলা ড্রয়িংরুমে হাসি মুখে সবাইকে অভ্যর্থনা জান্নাচ্ছে। সে হাসি উদারতার হাসি। হাসিতে কষ্ট মিশে আছে, তবে হিংসে নেই। বেদনা আছে, জ্বলন নেই। মুবিন পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “একটা ছবি তুলব। আয় তো।”
মিলা বলল, “পরে।”
“না, এখনি।”
মুবিন ঘরে গিয়ে ছবি তুলবার উদ্দেশ্যে মা – বাবার মাঝে দাঁড়িয়ে মিলার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। মিলা বেশ সময় নিয়েই এল। ঘরের ভেতরে আসার পরিবর্তে ও ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে মোবাইল হাতে ওদের ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, “বাবা, তোমার টাইটা বাঁকা হয়ে আছে।”
মঈন মুবিনের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে টাই ঠিক করে দাঁড়াল। মিলা একটা ক্লিক নিয়ে নিলো। মুবিন অবাক হয়ে বলল, “তুই সহ, স্টুপিড।”
“না আমার ছবি তুলতে ইচ্ছে করে না।”
“শুধু পড়াশুনা করে বড় বড় মার্কস নিয়ে এলেই স্মার্ট হওয়া যায় না।” মুবিন রাগে শুধু এটুকুই বলতে পারল!
মিলা হাসল, “আমি অত স্মার্ট নারে।”
মুবিন বলল, “মিথ্যে কেন বলছিস? নিজের ফ্রেন্ডের সাথে ত সারাদিন’ই সেলফি তুলিস। আমার সাথে ছবি তুলবি না এটা বল।”
মিলা দেখল মুবিন রাগ করে ফেলছে। আসলে স্টুপিড ও নয়, স্টুপিড মুবিন। ওকে সাথে নিয়ে ছবি তুলবার প্রয়োজনটা কি? মা-বাবাকে তাদের ছেলের সাথেই মানায়। ওকে ক্যামেরাম্যানের চরিত্রে দেখতে তাঁদের খুব একটা খারাপ নিশ্চয়ই লাগবে না। বরং মুবিনকে মাঝে দাঁড় করিয়ে শুধু তিনজনের আকাঙ্ক্ষিত একটি ছবি খুব সহজেই তাঁরা পেয়ে যাবে। মিলা নিজের মুখকে সংবরণ করল। নাহয় সে খুব সহজেই বলতে পারত যে, “আমি সহ তুলতে গেলে যে সমস্যা হয়ে যাবে, আমার অতি প্রিয় বোকা ভাই। তোকে ছবিতে কে পাশে পাবে তা নিয়ে যে তর্কাতর্কি, রক্তারক্তি কোনো কান্ড ঘটবে না তার নিশ্চয়তা কি তুই দিতে পারবি? আমি চাই না তোর জন্মদিন ভেস্তে যাক।”
মুবিন অপেক্ষা করতে করতে স্বভাবসুলভ ধৈর্য্যহারা হয়ে উঠল এবং রেগে গিয়ে বলল, “যাহ তুই, তোর ছবি তুলতে হবে না।”
মিলা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “উফ, মুবিন আমার মেকআপ এখনও বাকি, তাই তুলতে চাইছিলাম না।”
মুবিন সরে এসে মিলাকে ধাক্কা দিয়ে পিছনে ঠেলে দিয়ে বলল, “চুপচাপ দাঁড়া এখানে। গর্দভ একটা!”
মিলা একটুও রাগ করল না। বরং প্রশস্ত হাসি হেসে মা – বাবার মাঝে দাঁড়িয়ে তাঁদের চারজনের জীবনের একসাথের শেষ এবং চিরস্মরণীয় ছবিটি তুলল। ছবিটি তাঁদের সবচেয়ে প্রিয় ছবির দলে যোগ দিলো, কিংবা যুক্ত হলো অন্যতম কুৎসিত এক ফ্রেমেবন্দি স্মৃতি হয়ে। কারণ এর কিছুক্ষণ পর’ই এক ফরাসী নারী বিনা আমন্ত্রণে মুবিনের অভূতপূর্ব সেই জন্মদিনে অতিথি হয়ে এল। তাঁর পরিচয় সে মুবিন এবং মিলার বাবা মঈনের প্রেয়সী। সে মঈনের অসুস্থতার খবর পেয়ে সুদূর ফ্রান্স থেকে ছুটে এসেছে তাকে শুধু এক নজর দেখবার জন্য। তাঁর নাম মিশেল, মিশেল উড।
.
মিশেলকে স্বচক্ষে দেখে শিল্পী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। মেহমানের ভয়ে মঈনকে ছেড়েও কথা বলেনি, “এই সেই রূপসী, মঈন? আমার ধারণা তাহলে ভুল ছিল না।”
মঈন শিল্পীর হাত ধরে তাকে হলঘর থেকে নিজেদের শোবার ঘরে টেনে নিয়ে যেতে চাইল। শিল্পী হাত ছাড়িয়ে বলল, “খবরদার ছুঁবে না আমায়। এখন এত লজ্জা কিসের? জানুক লোকে!”
মঈন বলল, “আই ক্যান এক্সপ্লেন!”
“না, তুমি পারো না।”
“ঠিক আছে ঘরে চলো।”
শিল্পী যেতে চাইল না। মঈন জোর করে টেনে নিয়ে গেল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল ওদের ঘরের, কিন্তু দাম্পত্যকলহের কোলাহল ছড়িয়ে পড়ল হলঘরের প্রতিটি কোণায় কোণায়, প্রতিটি নিমন্ত্রিত লোকের কোল্ডড্রিঙ্কসের গ্লাসে গ্লাসে, কেকের টুকরো বহনকারী নকশাকৃত পিরিচে পিরিচে। শিল্পী আর মঈনের চেঁচামেচি, ফুলদানির ভাঙন, মিশেলের উপস্থিতি ইত্যাদি চারিদিকে গুঞ্জন আর রঙতামাশা দেখা এমন কিছু চাহনির সৃষ্টি করল, যেসব চাহনি দেখে মুবিন দৌড়ে চলে গেল নিজের ঘরে। সে একা থাকতে চায়। মিলা মেহমানদের কাছে দায়িত্ব নিয়ে ক্ষমা চাইল। মুবিনের জন্য নিয়ে আসা উপহারসামগ্রী রেখে মেহমানরা চলে যেতেই মিশেল মিলাকে একা পেয়ে ইংরোজীতে বলল, “তোমার নাম মিলা?”
মিলা দাঁতে দাঁত ঘঁষে শুদ্ধ বাংলায় বলল, “আর তুমি নিশ্চয়ই কোনো ডাইনী।”
জানালা দিয়ে সব মেহমানদের চলে যেতে দেখে মুবিন নিজের ঘর থেকে বের হয়ে এল। সে বলল, “এই মহিলাকে বলে কি হবে? বলতে হলে তোর মা – বাবাকে বল।
মিশেল আবারো ইংরজীতে প্রশ্ন করল, “কি বলছ তুমি?”
মিলা এইবার ইংরেজীতে বলল, “নাথিং এন্ড প্লিজ লিভ আস এলোউন।”
মিলা নিজের ঘরে চলে গেল। মুবিন মিলার পেছন পেছন গিয়ে বলল, “দেখলি তোর মা – বাবার কাণ্ডটা? পরে কথা বলা যেত না? সবার সামনেই বলতে হবে? মার এভাবে সবার সামনে রিএক্ট করা ঠিক হয়নি। সবাই কি বলছিল? আমি কাল থেকে আর স্কুলেই যাব না। ক্লাসে গোসিপ করার নতুন খোরাক পেয়য়ে গেল ওরা।”
মিলা বলল, “যাস না। তুই স্কুলে গিয়ে করিসটাই’বা কি? পড়াশুনা ত আর করিস না।”
“তুই আমার সাথে এমন করে কেন কথা বলছিস?”
মিলা বলল, “তুই এখন এখান থেকে যা।”
মুবিনও চটে গেল, “না গেলে কি করবি? আমি যাব কেন?”
“মেহমানদের মাঝে থেকে যেভাবে পালিয়ে গিয়েছিলি এখন এমন গলাবাজি করতে লজ্জা করে না!”
মুবিন বড্ড অপমানিত বোধ করল। সে উপর নীচ মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “ওহ এখন বুঝেছি। তোর তো আনন্দ হচ্ছে। মা – বাবা আমার জন্মদিন পালন করেছে সে হিংসেই তুই জ্বলে যাচ্ছিলি। এখন সব ভেস্তে গেছে তাই খুব খুশি তাইনা?”
মিলা অবজ্ঞার হাসি হেসে বলল, “আমি জীবনেও তোর মত আর একটা স্বার্থপর ছেলে দেখিনি। মা – বাবার সংসার ভেঙে যাচ্ছে, বাড়িতে এক অপরিচিতা মহিলা আর তুই পড়েছিস কে কি বলল তা নিয়ে!”
“আমি স্বার্থপর? আমি?” মুবিন চেঁচিয়ে উঠল।
মিলা স্বাভাবিক গলাতেই বলল, “হ্যাঁ তুই স্বার্থপর। সবসময় নিজের কথাই ভাবিস। না ভাবিস মা – বাবার কথা আর না ভাবিস আমার কথা! প্রতিবার মা – বাবা যখন শুধু তোর জন্মদিন পালন করেন আর আমার বেলায় ওদের তারিখটা পর্যন্ত স্মরণ থাকে না তখন তুই তা দেখেও না দেখার ভাণ করে থাকিস। মা যখন আমার ঘরের পাখা নষ্ট হয়ে গেলে নতুন পাখাটা কিনে তোর ঘরে লাগায় আর তোর পুরোনো পাখাটা আমার ঘরে নিয়ে আসে তখনও তুই চুপ। আর আমায় এসে বলিস আমি হিংসুটে! আমি যদি হিংসুটে হয়ে থাকি তবে তুইও স্বার্থপর।”
চকিতে মিলাকে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দিলো মুবিন। মিলা উঠে বসল, দাঁড়াল না, মেঝেতেই বসে রইল। রাগান্বিত মুবিনের চোখ লাল, জল টলমলে। পকেটে হাত রেখে ও মিলার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই আমাকে এত হিংসা করিস, রোদমিলা? এত?”
মিলা চুপ করে রইল। মুবিন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
চলবে…

একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-২৮+২৯

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ২৮
ইমাদ ব্যাগ থেকে দীপা আর কাদিনের বিয়ের উপহার বের করল। দুজনের জন্য দুটো ঘড়ি। গিফ্টবক্সটা হাতে নিয়ে দীপার ঘরের দিকে যেতেই আবার কারেন্ট চলে গেল। ইমাদ থমকে দাঁড়াল। পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফ্ল্যাশ লাইটের আলোতে পা এগুতেই দেখল পেছন থেকে কড়ি দ্রুত হেঁটে ওকে ক্রস করে সামনের দিকে গেল। ইমাদ মোবাইল উঁচু করে ধরে কড়ির পথে আলো দিলো। এ বাড়িতে কড়িকে চোখ বন্ধ করে ছেড়ে দিলেও কড়ি দৌড়ে দৌড়ে চলতে পারবে। কোনো সমস্যা নেই। তাই সে পেছনে না তাকিয়েই বলল, “আমার আলো লাগবে না। আপনি সাবধানে হাঁটুন।”
বলতে না বলতেই কড়ির পেছনে ইমাদ ঘরের দাওয়ায় হোঁচট খেয়ে পড়ল। কড়ি পেছন ফিরে তাকাল। ইমাদের হাত থেকে লাল র্যাপিং পেপারে মোড়ানো সুন্দর একটা গিফ্টবক্স ঘরের মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল। শক্ত করে ধরে রাখায় মোবাইলটা হাত থেকে পড়ল না। মোবাইলের আলোতে কড়ি দেখল গিফ্টবক্সের উপর লেখা “টু দীপু এন্ড কাদিন ভাইয়া।” ইমাদ উঠে দাঁড়িয়ে বক্সটা তুলল। কাদিন ডাকছিল তাই কড়ি চলে এল।
“কিরে কিসের শব্দ হলো? ঠিক আছিস?”
“মেজো ভাবির ফ্রেন্ড হোঁচট খেয়ে পড়েছে।”
ইমাদ বলল, “আসব?”
কাদিন বলল, “হ্যাঁ অবশ্যই।”
“চোখ দুইটা কই ছিল তোর? আয় বস।” দীপা সরে জায়গা করে দিলো।
ইমাদ দীপার পাশে বসতেই কাদিন বলল, “একটু চা করে আন, কড়ি। কতক্ষণ ধরে রিমা আপুকে খুঁজছি, পাই না। ওরাও আছে একসাথে খাব।”
দীপা বলল, “আরে ওকে বলছেন কেন? এই গরমে ও এখন রান্নাঘরে চা করতে যাবে? খোকার মা না কে যেন আছেন ওই খালাকে বললেই ত হয়।”
কাদিন বলল, “আমি বাইরের কারো হাতে কিছু খাই না।”
দীপা ফিক করে হেসে ফেলল, “হোটেলে, রেস্টুরেন্টে, দাওয়াতে গেলে কি করেন? ঐগুলাও কি রিমা আপু আর কড়িই রান্না করে দিয়ে আসে?”
কাদিন বলল, “বাইরের খাবার খাই না।”
“দেখি কি করে আজ না খেয়ে বাঁচেন! এই কড়ি তুমি কোথাও যাবে না। এখানেই বসো। আমি চা করে নিয়ে আসি। না খেলে জোর করে খাওয়াব তোমার ভাইকে।”
কড়ি মিটিমিটি হাসতে হাসতে বসল, “আচ্ছা ঠিক আছে।”
দীপা চা করতে চলে গেল। কাদিন দীপার পিছু নিয়ে রান্নাঘরে এল। রান্নাঘর ফাঁকা পেয়ে কাদিন রাগের স্বরে বলল, “তোমাকে করতে হবে না। সরো তুমি। আমি করছি।”
“কেন? কেন? এত নকশা কেন আপনার? এই অভ্যাস ছাড়েন।”
“তোমার বুঝা উচিত যে আমি তোমার হাতের চা খাব না বলেই কড়িকে ডেকেছি। নাহয় তোমাকেই বলতাম।”
“চা আমার হাতের কি করে হয়? চা তো হবে চা পাতার। আমাকে কি চা পাতা মনে হয়?”
কাদিন বলল, “তোমার যা ইচ্ছা তাই করো। আমার চা খাওয়ার শখ মিটে গেছে।”
দীপা হঠাৎ খুব কষ্ট অনুভব করল। মনমরা হয়ে মুখভার করে বলল, “আমাকে কেন এত ঘেন্না করেন আমি বুঝে পাই না।”
কাদিন দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “তুমি কিচ্ছু বুঝো না, দীপা। কিচ্ছু না! রাগও বুঝো না। সবকিছু তোমাকে এক্সপ্লেন করতে হয়। নিজ থেকে কিছু বোঝার ক্ষমতা আল্লাহ তোমার এই ফাঁকা মাথাটায় দেয়নি।”
দীপা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল বলে কাদিনের আরো রাগ হলো। সে কঠিন গলায় বলল, “এখনো বুঝোনি? আরো খুলে বলতে হবে? আরো? ওকে ফাইন। তাহলে শুনো। রিমা আপু, কড়ি আর তুমি বাদে আর সবাই বাইরের লোক। তোমার উপর রেগে আছি তাই তুমি এখন চা করে দিলেও খাব না। এখন প্লিজ বলো না যে কেন রেগে আছি তা তুমি জানো না।”
কাদিন এমনভাবে তাকিয়ে, এত শক্ত করে কথাগুলো বলল যে দীপার চোখে জল এসে যাচ্ছিল। এখন মোটেও কাঁদা যাবে না। কেঁদে ফেললে কাদিন আরো বেশি রাগ করবে। কিন্তু দীপা কি করবে? ওকে কেউ একটু কড়া করে কথা বললেই কান্না এসে যায়। না কান্না করা যাবে না। দীপা ঢোক গিলে কান্না আটকাল। কাদিন বলল, “তুমি এখন এখান থেকে যাও।”
দীপা অনেক কষ্টে বলল, “আচ্ছা।”
দীপা চলে যাচ্ছিল। কাদিন বিরক্ত হয়ে গেল, “এখন যেও না। দাঁড়াও এখানে। এখন চা না নিয়ে গেলে তোমার বন্ধুরা কি বলবে?”
কাদিন নিজেই ডেকচিতে পানি বসাল।
দীপা রান্নাঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। নীচের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নখ দিয়ে দরজা খুটছে। কাদিন ফিরে তাকিয়ে বলল, “চেহারা এরকম বানিয়ে রেখেছ কেন? তোমাকে আমি এমনকিছু বলিনি যে এরকম থোতা নামিয়ে রাখতে হবে। আর নখ দিয়ে দরজা খুটছ কেন? এগুলো কোনধরনের অভ্যাস? নিজের বয়স দেখেছ? আমার ছোটবোন কড়ি থেকেও তুমি কত সিনিয়র অথচ, আচরণ পনেরো ষোলো বছরের টিনএজারদের মতন। আমার বাচ্চাকাচ্চাগুলো যেন অন্তত তোমার মত নাহয়। হলে মুহূর্তে মুহূর্তে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাবে।”
দীপা এবার কেঁদেই ফেলল। কাদিন বুঝে উঠার আগে অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে চোখ মুছে ফেলল সে। চা হয়ে যাওয়ার পর কাপে চা ঢেলে ট্রেটা দীপার হাতে দিলো কাদিন। বলল, “নিয়ে যাও। ওদের আবার বলো না যে আমি করেছি।”
দীপা পা বাড়াতেই কাদিন বলল, “সাবধানে।”
কারেন্ট চলে এল। কাদিন বলল, “ভালো হয়েছে। যাও তুমি, আমি আসছি।”
দীপা মাঝপথেই ট্রে হাত থেকে ফেলে দিলো। সবগুলো কাপ ভেঙে গেল। গরম চায়ের কিছু পড়ল দীপার শাড়িতে, পায়ে আর বাকিটুকু মেঝেতে ভেসে গেল। দীপার পা পুড়ে গেল। তবুও টু শব্দ সে করল না। কাদিন রান্নাঘর থেকে দ্রুত এল। দীপা ভাঙা কাপ তুলতে তুলতে অসহায়ের মতন ঘাবড়ানো গলায় বলল, “স্যরি, স্যরি, স্যরি, কীভাবে যেন পড়ে গেছে। স্যরি।”
কাদিন দীপার হাত টেনে ধরে ওকে সরিয়ে আনল, “কিছু হবে না। এগুলো ছাড়ো। দেখি তোমার পায়ে পড়েনি তো?”
কাদিন ঝুঁকে দীপার পায়ের পাতা দেখল। ফোসকা পড়ে গেছে। বাড়ির সবাই শব্দ শুনে ছুটে এল। কাদের সাহেব বললেন, “এখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস কেন? বৌমাকে ঘরে নে।”
দীপা ঘরে যেতেই কড়ি দ্রুত টুথপেস্ট এনে দিলো। দীপাকে দেখে ইমাদ আর নিলয় ভীষণ অবাক হলো! পায়ে ফোসকা পড়ে গেছে অথচ, দীপা একদম চুপ। একবারো মরে যাচ্ছি, মরে গেলাম, আহ আমি শেষ জাতীয় কিছু কিংবা চিৎকার চেঁচামেচি, কান্নাকাটি কিছুই করছে না। ঝড়ে কুঁকড়ে যাওয়া পাখির মতন চুপসে বসে আছে। নিলয় ত বলেই ফেলল, “দোস্ত, কি হয়েছে তোর?”
দীপা বলল, “কই কিছু না।”
এভাবে থাকলে নিলয়রা সব বুঝে ফেলবে তাই দীপা মজা করার চেষ্টা করে বলল, “ভাবছিলাম তোরা দুইটা কত বড় কিপ্টা হলে আমার বিয়ের গিফ্ট এখনও আমাকে দিসনি। ছিহ্ শেইম অন ইউ। তোরা মরতে পারিস না? মর। কলা গাছে ফাঁসি দিয়ে মর। এক গ্লাস পানিতে ডুবে মর।”
নিলয় দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “স্যরি দীপু। এই মাসটায় আমি অনেক প্যারায় আছিরে। খুব টানাটানি অবস্থা। তাই তোর বিয়ের গিফ্ট কিনতে পারিনি। ভালো একটা কিছু দিতে চাই। তাই দুই তিন মাস সময় নিচ্ছি।”
কাদিন আরেকদফা বিরক্ত হলো দীপার উপর। যত ভালো বন্ধুই হোক মজার ছলেও এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি ওর। যেহেতু গিফ্ট দেয়নি সেহেতু নিশ্চয় কোনো একটা সমস্যা আছে সেটা তার বুঝা উচিত ছিল। আবার বলল তো বলল কড়ি আর তার সামনে বলল। ছেলেটা লজ্জা পেলো না? আহা অবুঝ বউটা তার!
দীপা কথাটা বলে নিজেও বিপদে পড়ে গেল। এখন কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। ইমাদ বলল, “আমারো একই হাল।” কড়ি চমকে তাকাল। সে নিজ চোখে গিফ্টবক্স দেখেছে। কড়ি ইমাদের পকেটের দিকে তাকাল। বক্সটা এখনও পকেটে।
নিলয় হেসে দিলো, “হায়রে দীপু তোর ভাগ্য বহুত খারাপ। গরীব গরীব সব বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরিস তুই।”
দীপা বলল, “প্লিজ তুই এইসব ফালতু কথা বলবি না তো। আমাকে চিনিস না? আমি অনেককিছু বুঝি না। মজার ছলে বলেছিলাম।”
ইমাদ বলল, “রেস্ট নে তুই। আমরা যাই।”
ইমাদ আর নিলয় বেরিয়ে যেতেই কড়িও ইমাদের পেছন পেছন গেল। নিলয় সাথে থাকায় ইমাদকে ডাকতে গিয়েও ডাকল না। নিজের ঘরে গিয়ে মোবাইল থেকে মেসেজ লিখল, “একটু বাইরে আসতে পারবেন?”
ইমাদ লিখল, “আচ্ছা।”
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ২৯
ইমাদ বাইরে এসে দেখল কড়ি কোথাও নেই। সে মোবাইল বের করে মেসেজ পাঠাল, “কোথায়?”
কড়ির অন্ধকারের গহীন থেকে বেরিয়ে এল, “ভালো আছেন!”
ইমাদ বলল, “জি।”
“উহু ভালো আছেন কিনা জানতে চাইনি। বলেছি আপনি ভালো আছেন। মানে আপনি মানুষ ভালো।”
“আচ্ছা।”
কড়ি প্রশ্ন করল, “উনার মন খারাপ হবে বলেই ত গিফ্টটা দেননি, তাইনা?”
ইমাদ কড়ির দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল। কিছু বলল না।
কড়ি ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল, “আপনি এত সাধু কেন বলুন তো? শুনেছি অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ।”
ইমাদ কড়ির দিকে দু’কদম এগিয়ে এল। রহস্যময় গলায় বলল, “কী চুরি করলাম?”
কড়ি দু’কদম পিছনে গিয়ে বলল, “দয়া করে এই ধরনের সস্তা ফ্লার্ট আপনি করবেন না। এসব আপনার সাথে যায় না। আপনার ব্যক্তিত্বের অপমান হয়।”
ইমাদ হেসে ফেলে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলল। বলল, “সাধু সেজে থাকা চোরদের আবার ব্যক্তিত্বও থাকে নাকি?”
“আপনাকে বান্ধবীর জন্য পাগলপারা হয়ে অচেনা একটা মেয়ের পিছু নিতে দেখতে ভালো লাগে, সবার সামনে নিজেকে পরোয়ানাবিহীন দেখানো অথচ, সবচেয়ে বেশি সবার পরোয়া করা মানুষ হিসেবে আপনাকে বেশ লাগে। বন্ধু গিফ্টট দিতে পারেনি বলে, গিফ্ট এনেও লুকিয়ে রাখা আপনাকে দারুণ লাগে। কিন্তু সদ্য ছ্যাকা খাওয়া একটা মেয়েকে সাডেন প্রপোজ করা আপনাকে বিরক্ত লাগে, ফ্লার্ট করা আপনার উপর রাগ হয়, প্রেমিকা থাকা সত্ত্বেও আমার উপর লাইন মারা আপনাকে নিন্দা না করে পারা যায় না। কেন এমন করেন?”
ইমাদ কিছুই বুঝতে না পেরে বলল, “এক্সকিউজ মি?”
কড়ি হেসে হেসে বলল, “অনামিকার প্রতারক প্রেমিক হিসেবেও আপনাকে মানায় না। প্রতারক শব্দটা কেটে অনামিকার শুধু প্রেমিক হতে পারেন না?”
“আচ্ছা।” ইমাদ নিজের প্যান্টের দু’পকেটে হাত রাখল। নীচে তাকিয়ে দু’দিকে মাথা নাড়তে নাড়তে ঠোঁট টিপে শব্দহীন হাসতে লাগল।
কড়ি বলল, “ভালো আছেন, ভালো থাকুন।”
ইমাদ পা দিয়ে মাটির রাস্তাটা খুঁড়তে খুঁড়তে বলল, “তারপর কি করব? আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখব?”
এখনো ইমাদের চোখে মুখে হাসি খেলা করছে। কড়ি চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল, “ভাইরে ভাই এই আপনাকে দেখলে আমার মনমেজাজ খারাপ হয়ে যায়।”
ইমাদ মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে উঠল, “ভাই টাই বলবেন না।”
“হোউপলেস!” কড়ি বিরক্ত হয়ে চলে যাচ্ছিল। ও ভেবেছিল ওর বিয়ে ঠিক হয়ে যাচ্ছে শুনে ইমাদ পিছু হটেছে। তাই এখন কথা বলাই যায়। কিন্তু এই ছেলে তো আগের মতই আছে। এত ভালো একটা মানুষ সমানতালে এত বেকার কি করে হয়! কড়ি অবাক। ওর মন সায় দিচ্ছিল না তাই কথা বলে বিষয়টা পরিষ্কার করতে এসেছিল। কিন্তু না এই ছেলের সাথে কথা বলার উপায় নেই।
ইমাদ ডাকল, “কড়ি, শুনুন।”
কড়ি চাপা ক্রোধে জবাব দিলো না। পিছনেও তাকাল না। ইমাদ এবার একটু জোরেই ডাকল, “কড়ি?”
কড়ি বিরক্ত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল, “বলে আমায় উদ্ধার করুন।”
“অাপনি একটু দাঁড়াবেন? অনামিকাকে নিয়ে কথা বলতে চাই।”
“দুঃখিত, আমার কাজ আছে ভেতরে।”
“প্লিজ?”
কড়ি কয়েক সেকেন্ড কি যেন ভাবল। তারপর বলল, “আচ্ছা তাড়াতাড়ি বলুন।”
ইমাদ পকেট থেকে মোবাইল বের করল। ওর মোবাইলে কল রেকর্ডার অ্যাপস আছে, “একটু এদিকে আসুন।”
কড়ি হেঁটে গেল আগের জায়গায়। ইমাদ বলল, “অনামিকা নামের রেকর্ডিংগুলো চ্যাক করুন একটু। চাইলে আমার কল লিস্টের অন্য রেকর্ডিংগুলোও চেক করতে পারেন।”
কড়ি মোবাইল হাতে নিলো। ইমাদ বলল, “আমি কখন, কার সাথে, কি কথা বলি সব আছে। এমনকি অনেক অনেক পুরোনো কলের রেকর্ডিংও আছে। আপনার সাথে ঐ যে নানুয়া দিঘীর পাড় দীপুকে নিয়ে কথা বলার জন্য যে কল দিয়েছিলাম সেটা পর্যন্ত আছে। অবশ্য ওটা অত আগেরও না।”
কড়ি ভলিয়্যুম কমিয়ে রেকর্ডিং অন করল। অনামিকার সাথে সবগুলো রেকর্ডিং শুনলো সে। সবগুলোই প্রায় একইরকম। অনামিকা একতরফাভাবে এটাসেটা বলে যায়। আর ইমাদ বারবার জিজ্ঞাসা করে আপনি কে? কে বলছেন? আপনাকে কি আমি চিনি? ব্যস এইটুকুই।
কড়ি ইমাদের হাতে মোবাইলটা ফিরিয়ে দিলো। ইমাদ মোবাইল পকেটে রাখতে রাখতে বলল, “মেয়েটা আমাকে মেসেজও করে। সময়মত খাওয়া দাওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আকাশে মেঘ করলে লিখে, কি মনে হয় বৃষ্টি হবে আজ? চাঁদ দেখা না গেলে লিখে, চাঁদ কি আপনি কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন? বেশি রোদের দিনে লিখে, এত রোদ আজ! বের হওয়ার দরকার নেই।”
কড়ি শেষ কথাটা শুনে হাসতে লাগল। ইমাদ বলল, “আপনি কি করে এই বিষয়টা জানলেন তা জানার প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি আসলে জানি না মেয়েটা কে। না জানা পর্যন্ত ব্লকও করব না। আগে জানব মেয়েটা কে, তারপর ব্লক করব।”
কড়ি হাসতে হাসতেই বলল, “কণ্ঠ শুনে মনে হয় বাচ্চা মেয়ে। অত বেশি বড় না। তবে রোমান্টিক আছে! ব্লক করার দরকার নেই। চালিয়ে যান। কিছু একটা হলেও হতে পারে।”
“আমার যা হওয়ার হয়ে গেছে। আর হওয়া সম্ভব না।”
কড়ি এত মজা পেল কথাটায় যে ইমাদ ঠিক যেমন করে নির্লিপ্ত গলায় আচ্ছা বলে সেও ঐ ভঙ্গিতেই বলল, “আচ্ছা।”
ইমাদ কড়ির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কড়ি বলল, “শুনুন আপনার কোনো স্টুডেন্ট হতে পারে। টিউশনি করান না?”
“জি।”
“হ্যাঁ, তাহলে আপনার কোনো ছাত্রী হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।”
“আচ্ছা।”
“আমি আসলে স্যরি। এজন্যই তো বলি আপনার সাথে না ঠিক এসব যাচ্ছিল না। তাই আপনার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম। শুধু শুধু একটা মানুষকে আজীবন মনে মনে ভুল বুঝার চেয়ে জিজ্ঞাসা করে নেওয়া ভালো। তাছাড়া, মানুষটা যদি আপনার মত হয় তাহলে তো তা অবশ্যই করতে হয়।”
“আচ্ছা।”
কড়ি ঘুরে যেতে যেতে বলল, “আমি আসছি আর আবারো স্যরি।”
ইমাদ ভাবলেশহীনভাবে বলল, “আমার যা হওয়ার আপনার সাথে হয়ে গেছে। আর হবে না।”
কড়ির হাসি হাসি মুখটা আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল। কড়ি থমকে দাঁড়াল। যেখানে ছিল সেখানে দাঁড়িয়েই বলল, “আপনি খুব ভালো করেই আমার অবস্থাটুকু জানেন। এখন আমার কাছ থেকে এমন কিছু আশা করে থাকলে আপনি বোকামি করছেন। আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি আমার পরিবারের কথার বাইরে এক পাও দিব না। বাবার পছন্দ করা ছেলেকেই বিয়ে করব। আমাকে ভালো না বাসার অনুরোধ রইল। আর বেসে থাকলে আমি আপনার অনুভূতির সম্মান করি। আমাকে ক্ষমা করুন।” কড়ি দু’হাত এক সাথে জড়ো করে ক্ষমা চেয়ে চলে গেল। এই প্রথম ইমাদ দায়সারাভাবে আচ্ছা বলতে পারল না।
ঘরে যেতেই নিলয় বলল, “কোথায় ছিলি, বন্ধু?”
“এদিকেই।”
“আমাদের কুমিল্লা যাওয়া দরকার না? আমার ছাত্রর পরীক্ষা ভাই।”
“আচ্ছা।”
নিলয় মাথা চুলকে বলল, “কাল চল, ফিরে যাই।”
“আচ্ছা।”
“কিন্তু সমস্যা হলো দীপুর শ্বশুর না ছাড়তে চাইছেন না। আমরা চলে যাব জানাতেই শক্ত করে না, না করে উঠলেন। কি করে যে বুঝাই! বলছেন একেবারে উনার মেয়ের বিয়ে খেয়ে যেতে।”
ইমাদ শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল, “আচ্ছা।” পরক্ষণেই হাত থমকে গেল ওর! চোখের মণি স্থির! মেয়ের বিয়ে? কড়ির পরিবার বিয়ে ঠিকও করে ফেলেছে! সর্বনাশ। তিন চারটে বোতাম খোলা অবস্থাতেই ইমাদ আবার ঘর থেকে বের হয়ে গেল। শার্টের বোতাম লাগিয়ে বের হওয়ার মতন অবস্থা তার এখন নেই।
চলবে…

একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-২৬+২৭

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ২৬
কড়ি আজ যে শাড়িটা পরেছে সেটি ওর মায়ের। বার্গান্ডি রঙের জামদানি। কড়ির কানে, গলায় মুক্তোর দুল আর মালা। রামিম বলতো এই শাড়িটায় কড়িকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর দেখায়। এত সুন্দর দেখায় যে বিয়ে করে ফেলতে ইচ্ছে হয়। এ কারণেই শাড়িটা আজ পরা। গতরাতে কড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিল। রিমা দরজা ধাক্কে তুলে বলল, “আজ তোর সাথে থাকি।”
ঘুমে আড়ষ্ট কড়ি বলল, “থাকলে থাকো, আমার যেমন দাদীর ঘর, তোমারও দাদীর ঘর। তোমার আবার একইসাথে দাদী শাশুড়িও।”
রিমা হেসে দরজা আটকাল। কড়ির পাশে কনুইয়ে ভর দিয়ে কাত হয়ে শুয়ে বলল, “অ্যাই শোন না, তোর সাথে কথা আছে।”
“কি বলবে?”
রিমা নিজের গলার চেইনটা আঙুল দিয়ে খুটতে খুটতে বলল, “তোর কোনো পছন্দ টছন্দ আছে?
কড়ি দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল, “উহুঁ।”
“তাহলে আমরা তোর জন্য বিয়ে দেখি?” খুশিতে রিমার চোখ চকচক করে উঠল।
কড়ি বলল, “এখনি বিয়ে দিয়ে দিবে?”
“সমস্যা কি? তোর কি কেউ আছে?”
“না, তা নেই।”
“তাহলে আর বাধা দিস না।”
কড়ি চুপ করে রইল। রিমা বলল, “নাসিমা ফুপুকে চিনিস?”
“হ্যাঁ।”
“নাসিমা ফুপুর ভাসুরের ছেলের জন্য পাত্রী খোঁজা হচ্ছে। ফুপুই চাচ্চুর কাছে প্রস্তাব দিলেন। চাচ্চুর কাছে মন্দ মনে হয়নি। চেনাজানার মাঝে হলেই ত ভালো। তাই আমাকে পাঠালেন তোর দ্বিতীয় কোনো মত আছে কিনা জেনে নিতে।”
“ওহ্।”
“ছেলে পুলিশ অফিসার। খুব অনেস্ট নাকি। কাল বৌভাতের অনুষ্ঠানে তো আসবেই। তখন দেখতে পারবি। কথা বলতে চাইলে সে ব্যবস্থাও করে দিতে পারব।”
“কথা বলতে হবে না। বাবা যা বলবেন তাই।”
“কী সোনালক্ষী বোন আমার!” রিমা কড়িকে আদর করে দিলো।
কড়ি মনে মনে তীব্র অপরাধবোধে মরে গিয়ে বলল, “স্বর্ণ পুড়ে যেমন খাঁটি হয় তোমার বোনও পুড়েই সোনালক্ষী বোন হয়েছে। নয়তো সে তোমাদের মুখে চুনকালি মাখবার সব ব্যবস্থাই সুন্দরমত করে ফেলেছিল।”
রিমা বলল, “কি ভাবছিস?”
“কই ভাবছি?”
“কাল কিন্তু সুন্দর করে সাজিস।”
এজন্যই কড়ি আজ এত সুন্দর করে সেজেছে। রামিম যে শাড়িতে তাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করত সেটা পরেই সে পাত্রপক্ষের সামনে যাবে। নিজের পরিবারের পছন্দে বিয়ে করে পরিবারকে খুশি করবে। এতে যদি খানিক প্রায়শ্চিত্ত হয় তার! এতকাল একটা চোরের জন্য সেজে এসেছে। আজ পুলিশের জন্য সাজবে। তার জীবনে, মরণে, মনে,মস্তিষ্কে কোথাও সেই চোরের জন্য কোনোপ্রকার জায়গা রাখবে না। কড়ি আঙুলে রামিমের মায়ের ফিরিয়ে দেয়া সেই আংটিখানাও পরল।
.
মুবিন এক কান ফুঁড়িয়েছে। কানে দুলও পরেছে। আয়নায় নিজেকে দেখে মুবিন প্রসন্ন। কানে দুল পরার বহুদিনের শখ ছিল তার। বাবার ভয়ে কান ফুঁড়াতে পারছিল না। আজ রাগে শেষ পর্যন্ত ফুঁড়িয়েই ফেলেছে। হাতে পরার জন্য একটা ব্রেসলেটও কিনে এনেছে। ব্রেসলেটটা পরে মায়ের সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে মা আঁতকে উঠবেন। মুবিন সেটাই চায়। বাঁকা হাসল সে। কানে দুল, হাতে ব্রেসলেট পরে নিজের ঘর থেকে বেরিয়েই সে লিভিং রমের টিভিটা চালু করে আরাম করে বসল। পাশেই বাবা পত্রিকা পড়ছেন। এখনি নিশ্চয়ই গম্ভীর গলায় বলে উঠবেন, “টিভি বন্ধ করো, মুবিন। দেখছ না পত্রিকা পড়ছি?”
মঈন এখনও কিছু বলছে না। মনোযোগ সহকারে পত্রিকা পড়ে যাচ্ছে। মুবিন কপাল কুঁচকে বাবার দিকে তাকাল। কি ব্যাপার? কিছু বলছেন না কেন? মুবিন ঘাড় কাত করে বাবাকে দেখতে দেখতে টিভির ভলিয়্যুম আরো বাড়িয়ে দিলো। চ্যানেল পাল্টে গানের চ্যানেল দিলো। ধুম ধারাক্কা হিন্দি গান বেজে উঠতেই মঈন বিরক্ত হয়ে উঠল, “আহা মুবিন, তোমার মায়ের ঘরে যাও। সেখানে গিয়ে টিভি দেখো।”
মুবিন শয়তানি হাসি হাসল। না সে উঠল, না চ্যানেল বদলাল আর না সে বন্ধ করল টিভি। মঈন মুখের সামনে থেকে পত্রিকা সরাতেই মুবিন চট করে ঠোঁট থেকে হাসি মুছে ফেলল। বাবার চেহারা থেকে চোখ সরিয়ে টিভিতে চোখ রাখল। মঈন ধমকে উঠে বলল, “টিভি বন্ধ করো, মুবিন।”
মুবিন মনে মনে বলল, “কানের দুলটা দেখে না কেন?”
মঈনের দৃষ্টি দুলে আটকাতে মুবিন কান চুলকে বলল, “পারব না।”
মঈন রাগে থমথম করে উঠল। চোখ বড় বড় করে তাকাতেই মুবিনের কানে চোখ চলে গেল। সাথে সাথে বলল, “হোয়াট ইজ দিস, মুবিন?”
মুবিন অলস ভঙ্গিতে রিমোট রেখে উঠে দাঁড়াল। মঈন কঠোর গলায় বলল, “কখন করেছ এসব?”
মুবিন জবাব দিলো না। মঈন দ্বিগুণ ধমকে বলল, “এখনি খুলো।”
“না।”
মঈন উঠে এসে মুবিনের কানে হাত দিলো, “দেখি, আমি খুলে দিচ্ছি। এই বয়সে এসব পরতে নেই।”
মুবিন বাবার হাত সরিয়ে পিছিয়ে গেল, “বললাম না খুলব না।”
মঈন রেগে গেল। মুবিনও একগুঁয়ে, কোনোভাবেই খুলবে না। বাপ ছেলের চেঁচামেচি শুনে শিল্পী এদিকটায় এল। মুবিনের কানে দুল, হাতে ব্রেসলেট দেখে চট করে মেজাজ বিগড়ে গেলেও চুপ করে রইল। মঈন ওকে দেখে বিচার দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, “এসব করার বয়স তোমার ছেলের এখন হয়েছে?”
শিল্পী কাটাকাটা গলায় বলল, “কোন বয়সে কি করতে হয় তা তোমার কাছ থেকে আমার ছেলের শিখতে হবে না।”
মঈন বলল, “কি বললে?”
শিল্পী বলল, “তোমারোতো এই বয়সে প্রেম করার কথা না। তুমি যেহেতু করতে পেরেছ, তোমার ছেলেও বয়স মানবার কথা না, তাইনা?”
মুবিন এই ফাঁকে দৌড়ে পালাল। বর্তমানে শিল্পীর কাছে ছেলের সুশিক্ষার চাইতে ছেলের বাপকে অপদস্ত করাই যেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
.
কড়িকে দেখে দীপা প্রায় চিৎকার করে উঠল, “আরে তোমাকে দেখি আমার চেয়ে বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে।”
“মোটেও না।”
দীপা বলল, “সত্যি বলছি, কড়ি।”
কড়ি দীপার পাশে বসে কানের কাছে মুখ নিয়ে গেল। ফিসফিস করে বলল, “যে কোনো ছেলে দেখলেই কি পছন্দ করে ফেলবার মতন সুন্দর দেখাচ্ছে?”
দীপা ঘন ঘন চোখের পাপড়ি ফেলে, মাথা নেড়ে জোর দিয়ে বলল, “জি ম্যাডাম। যে কোনো ছেলের মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতন সুন্দর দেখাচ্ছে। তোমার আঙটিটাও খুব সুন্দর। রামিমের মা এটাই ফিরিয়ে দিতে এসেছিলেন, তাইনা?”
“হ্যাঁ।”
“যাক মায়ের আংটিটা অন্তত পেয়েছ। শান্তি লাগছে আমার।”
কড়ি নিজের হাতের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, উঁহু এটা তো ওর মায়ের না। রামিমের মা আসলে রামিম থেকে কোনো গয়নাই উদ্ধার করতে পারেননি। তিনি হয়তো ওর মোবাইলে ছবিটবি দেখে এটা বানিয়েছেন। বানিয়ে তাকে মিছেমিছি সান্ত্বনা দিতেই এটা দিয়ে গেছেন। প্রথমে সে বুঝতেই পারেনি। পুরোপুরি মায়ের আংটির প্রতিচ্ছবি এটি। আংটিটা ফেরত পেয়ে অনেক বেশি খুশি হয়ে গিয়েছিল। মায়ের একই যে আংটিটা ছিল সেটা ওর অনামিকা আঙুলে হতো না। মধ্যমা আঙুলে পরতে হতো। খানিক বড় ছিল। পরে ট্রেনে উঠে আঙুলে দিতেই এই আংটিটা মধ্যমায় লাগেনি, লেগেছে অনামিকায়। একদম খাপে খাপ। তখন বুঝল এটা মায়ের না। এজন্যই ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে রামিমের মাকে জড়িয়ে ধরতে বাধ্য হয়েছে। মানুষটা বড় ভালো আর অসহায়। উনার সাধ্যে থাকলে সম্ভবত সবগুলোই উনি নতুন করে গড়ে দিতেন। কিন্তু যত টাকাই থাকুক অত গয়না একসঙ্গে গড়ে দেওয়া অসম্ভব। আর টাকা তো উনার না, রামিমের বাবার। রামিমের বাবা কঠিন মানুষ। রামিমের পিছনে বহু টাকা খুইয়েছেন তিনি। ছেলে তার সহায়সম্পত্তি কম নষ্ট করেনি! আর বোধহয় খোয়াতে চাইবেন না। কড়ির ধারণা রামিমের মা নিজের জমানো আধুলি থেকেই কড়িকে এই আংটিখানা দিয়ে গেছেন। কড়ি যে বুঝতে পেরেছে এটি সেই আংটি না, তা সে দিব্যি চেপে গেছে। কি দরকার একজন মায়ের স্বস্তি নষ্ট করবার? থাকুক নাহয় এই আংটিখানা আরেক মায়ের আশীর্বাদ হয়ে।
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ২৭
মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হলো ভুলকে আঁকড়ে ধরে থেকে ভুল করা। আর মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় মিথ্যা হলো হাসি। দীপার হাসি হাসি মুখটা দেখে কড়ির খুব কষ্ট হলো। দীপা আসলে ভালো নেই। সে তাহমিদকে দেখে কষ্টে ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। চাপা ক্রোধে, কষ্টে ঝাঁঝড়া হয়ে সে প্রায় শরীর ঘেঁষে কাদিনের আরো কাছাকাছি বসল। কাদিন চমকে তাকাল।
দীপার ঠোঁট হাসছে কিন্তু চোখ? চোখজোড়া বিষণ্ন, টলটলে। কাদিন একবার ভাবল কি হয়েছে জানতে চাইবে। পরক্ষণেই মত পাল্টাল। থাক দরকার নেই। তাহমিদকে দীপা আর কাদিনের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে কড়ি দ্রুত পা চালাল। কাদিনের আগে গিয়ে দীপার হাত শক্ত করে ধরে বলল, “মেজো ভাবিকে আকবর চাচার ছেলের বউয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে আনি একটু।”
কাদিন বলল, “যা করিয়ে আন।” তারপর দীপার দিকে তাকিয়ে বলল, “একটু বুঝেশুনে কথা বলবে, প্লিজ।”
দীপা অবাক হয়ে কাদিনের দিকে তাকাল, “সে আবার কি উল্টাপাল্টা বলবে?
কড়ি দীপাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল, “আজকে এত সুন্দর করে সেজেছি কারণ আজ আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। আমি তোমার মতন দুঃখিনী না। আমার সুখ দরকার। বাবা- ভাইদের ক্ষমা দরকার। তাই তাদের পছন্দে বিয়ে করে সুখী হতে যাচ্ছি। সত্যিকার সুখী। তোমার মাথায় কিছু ঢুকল?”
দীপা বলল, “হুম।”
কড়ি হতাশ হয়ে বলল, “তোমাকে সুখী থাকার ভাণ করে তাহমিদ ভাইয়াকে অনুশোচনায় পোড়াতে বলিনি। বুঝিয়েছিলাম সত্যিকার সুখী হয়ে তাহমিদ ভাইয়াকে তার জায়গাটা দেখিয়ে দাও। আর তুমি কি করছ! আমি সত্যিই হতাশ।”
দীপা বলল, “ঐ মেয়েটাকে নিয়ে এখানেও এসছে দেখলে?”
“জাহান্নামে যাক ঐ মেয়েকে নিয়ে। তুমি শুধু আমার ভাইয়ের দিকে নজর দাও।”
দীপা বলল, “তুমি ভালো আছ, কড়ি? বলা যতটা সহজ, জীবনে প্রয়োগ করা ততটাই কঠিন। এখনো রামিমের জন্য নির্ঘুম রাত কাটাও। এই সেমিস্টারটাও তো ওর বিরহেই ড্রপ দিয়েছ। মিথ্যে বলো না আমায়।”
“ওর জন্য নির্ঘুম রাত কাটানোর আগে মরে যাওয়া মন্দ না। রাত জেগে আমি শুধু নিজের বোকামির কথাই ভাবি। রামিম কি করে আমাকে ফাঁদে ফেলতে পারল সেই উত্তর খুঁজে ফিরি। কাঁদলেও নিজের জন্য কাঁদি। রামিমের জন্য নয়। আমি ত কখনোই অতটা বোকা ছিলাম না! তাহলে রামিম কি করে আমায় বোকা বানাতে পারল। এই ভাবতে ভাবতেই রাত পার হয়ে যায়। আর সেমিস্টার ব্রেক দিয়েছি বাবা আর ভাইয়াদের সাথে কদিন থাকতে চাই বলে। ওদের আমি ঠকিয়েছি।” কড়ি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
কড়ি থেমে আরো বলল, “আমার ভাই একটু মুডি কিন্তু খারাপ না। ভালো বললাম না প্রশংসা হয়ে যাবে বলে। আমি প্রশংসা করতে চাই না। তুমি সত্যি সত্যি মন থেকে ওকে মেনে নাও। তোমাকে মেনে নিতে হবে। আর না মানতে পারলে বিয়ে কেন করলে?” কড়ি খানিক রাগ দেখিয়েই বলল।
দীপা মন খারাপ করা গলায় বলল, “স্যরি।”
“স্যরি তুমি আমার ভাইকে বলবে। ও থাকতেও তোমার মন তোমার প্রাক্তনকে নিয়ে মাতম করতেই ব্যস্ত।”
দীপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কড়ি বলল, “এখন যাও গিয়ে আমার ভাইয়ের পাশে দাঁড়াও। এই প্লাস্টিক হাসি মুছে, স্বাভাবিক হও।”
দীপা গিয়ে কাদিনের পাশে দাঁড়াল। এবার আর শরীর ঘেঁষে দাঁড়াল না। তবে কষ্ট কষ্ট ভাবটা ছুঁড়ে ফেলে বলল, “স্যরি।”
কাদিন আৎঁকে উঠে আহত গলায় বলল, “কেন? আবার কি করলে, দীপা?”
দীপা এবার হেসে ফেলল। মিথ্যে কোনো হাসি নয়। সত্য এবং সুন্দর হাসি। বলল, “স্যরি বলেছি, আই লাভ ইউ বলিনি যে আঁৎকে উঠবেন।”
“স্যরিটা কিসের?”
“এমনি বললাম।”
“এমনি এমনি কেউ স্যরি বলে?” কাদিন বিরক্ত।
দীপা বলল, “কেউ বলে না বলে কি আমারো বলা মানা?”
কাদিন হাল ছেড়ে দিলো। এই মেয়েকে বোঝা এবং বোঝানো দুটোই অসম্ভব।
.
নিলয় আর ইমাদ ছবি তুলছে। ওদের দুজনের মাঝে দীপা আর কাদিন। চারজনের প্রশান্তবদন এর খুব সুন্দর একটা ছবি তুলতে ব্যস্ত ক্যামেরাম্যান। কড়ি জর্দা খেতে খেতে স্যুট, টাই পরা ইমাদের তীব্র নিন্দা করতে করতে ধরেই নিয়েছিল ইমাদ আজ আরো বেশি ফ্লার্ট করবে। ভাবতে ভাবতেই ইমাদের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। কড়ি লক্ষ্য করল ইমাদ সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিলো। কড়ি খানিক অবাক’ই হলো। চোখ সরিয়ে নিলো কেন? ব্যাপার কি? এই ফ্লার্টিং মাস্টার আজ বদলে গেল কি করে? জাদু! পরক্ষণেই হিসাব মিলিয়ে ফেলল। দীপার কাছ থেকে হয়তো ওর বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে শুনে শুধরে গেছে। দীপা যে ধরনের মেয়ে দিনে কতবার নিঃশ্বাস নেয় তাও গুনে গুনে বন্ধুদের বলে। হ্যাঁ এটাই হবে। নাসিমা ফুফু কড়িকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। কড়ি কাছে যেতেই কড়ির সাথে এক ভদ্রমহিলার পরিচয় করিয়ে বললেন, “আমার ভাইয়ের মেয়ে।”
কড়ি ভদ্রমহিলার সাথে কুশল বিনিময় করতে করতে ভদ্রমহিলার পাশে দাঁড়ান তাঁর ছেলেকেও দেখে নিলো। বাবা আর পরিবারের উপর ভরসা করে ভুল করেনি সে। সে তার বাবাকে ঠকালেও বাবা তাকে ঠকায়নি। ছেলে দেখতে ভালো। ক্লিন শেভ, ভদ্র চাহনী। চুলগুলো শুধু একটু বেশি ছোট করে ছাঁটা। তা ডিফেন্সের লোকদের চুল এমন করে ছাঁটাই থাকে। কোনো সমস্যা নেই। কথায় আছে মাছের রাজা ইলিশ, বাত্তির রাজা ফিলিপস আর স্বামীর রাজা পুলিশ।
.
অনুষ্ঠান শেষে সন্ধ্যার পর বেশিরভাগ মেহমানরাই চলে গেল। বাড়িটা ফাঁকা আর শান্ত হয়ে উঠতেই ইমাদ উঠোনে একা একটা চেয়ার পেতে ৯০ ডিগ্রী এঙ্গেলে পায়ের উপর পা তুলে বসল। আজ আকাশে তারার রাজত্ব, চাঁদ মুখ লুকিয়ে আছে। নীলচে কালো রাতের সুনসান নীরবতা। মাঝে মাঝে রান্নাঘর থেকে কাঁচের থালা বাসন, কাপ পিরিচের সংঘর্ষের শব্দ আসছে। রান্নাঘরে বাড়ির মেয়ে বউরা বাসনকোসন গোছাতে ব্যস্ত। ইমাদ যে জায়গাটায় বসে আছে সেখান থেকে রান্নাঘর স্পষ্ট দেখা যায়। তবে উঠোনে অন্ধকার থাকায় ভেতর থেকে ইমাদকে দেখা অসম্ভব। তাই ইমাদ নিশ্চিন্তে বসে ব্যস্ত কড়িকে দেখতে লাগল। ইমাদ একটা বিষয় নিয়ে খুব অবাক হয়েছে। বিস্ময় তাকে ছাড়ছেই না। কড়িকে সবসময় তার কাছে একইরকম লাগে। এই যে কড়ি সাধারণ একটা কামিজ পরে, পাঞ্চক্লিপে চুল আটকে কাজ করে যাচ্ছে, আর যেই কড়ি দিনের বেলায় লাল গোলাপ সেজে ঘুরছিল দুই কড়ি তার কাছে একই। কড়ির বাড়াবাড়ি সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করেনি কেন? তার ভালোবাসার মানুষটাকে এত সুন্দর দেখাচ্ছিল অথচ, তার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠেনি, চোখে ঘোর লেগে যায়নি, সে থ বনে যায়নি। এমন ত নয় যে কড়িকে তার সাজগোজে ভালো লাগেনি। ভালো লেগেছে, সুন্দরও লেগেছে তবে পাগল হয়ে যায়নি। অথচ, যেকোনো প্রেমিকের ঐ অবস্থায় নাই নাই হয়ে যাওয়ার কথা। তবে কি সে কড়িকে ভালোবাসে না? এই দ্বিধায় সে আজ কড়ির চোখে চোখ পর্যন্ত রাখতে পারেনি। অন্যায় হয়ে গেল না তো! সে আজীবন স্বচ্ছ থেকেছে। এক্ষেত্রেও সে তাই থাকতে চায়। হঠাৎ রান্নাঘরে কিসের একটা শব্দ হলো। ইমাদ ভাবনার জগত থেকে বেরুতেই বুঝতে পারল কড়ির হাত থেকে গ্লাস পড়ে ভেঙে গেছে। কড়ি নীচু হয়ে ঝুঁকে কাঁচের টুকরো হাতে তুলছে। সাথে সাথে ইমাদ অস্থির হয়ে গেল। কাঁচের টুকরো কড়ি কেন তুলছে? হাত কেটে যাবে তো! আচমকা তার মনে হলো সত্যিই সে কড়িকে ভালোবাসে। তার কোনো ভুল হয়নি। আসলে তার ভালোবাসা তাকে এতটা অন্ধ করে রেখেছে যে কড়ির বাড়াবাড়ি সৌন্দর্য তার চোখে পড়েনি। অতিরিক্ত আলো একসাথে চোখে এসে পড়লে মানুষ যেমন দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে, চোখে মমেলে তাকাতে পর্যন্ত পারে না, তেমনি অতিরিক্ত ভালোবাসায় তারও দেখার ক্ষমতা, মুগ্ধ হওয়ার ক্ষমতা কড়ি কেঁড়ে নিয়েছে। সে উপলব্ধি করতে পারল, ভালোবাসার মানুষকে সবসময়ই চূড়ান্ত সুন্দর দেখায়। ঠিক ততটা সুন্দর যতটা সুন্দরের চেয়ে বেশি সুন্দর কখনো হওয়া সম্ভব না। তা সে যাই পরুক, যতই সাজুক, যেভাবেই থাকুক। তাই ইমাদের কাছে কড়ি হলো ধ্রুবকের মতন, যার মান কখনো পরিবর্তন হয়না। সবসাজেই, সকল রূপেই কড়ি তার কাছে অনন্য।
চলবে…

একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-২৪+২৫

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ২৪
বৈদ্যুতিক সংযোগ চলে গেছে। কতক্ষণে ফিরে আসবে জানা নেই। কাদিন হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে হয়রান হয়ে গেল। একটুর জন্য হাতপাখা হাতছাড়া হলেই ঘেমে যাচ্ছে। বাইরেও যেতে পারছে না। গ্রামের রাস্তাঘাট তার ভালো লাগে না। এখানে গর্ত, ওখানে কাঁদা! বিরক্তিকর! বেরুলেই প্যান্টে ধুলোবালি লাগার ভয়। বড় বিপাকে সে। টি -শার্ট ঘামে ভিজে শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। এটাও তার সহ্য হচ্ছে না। ঘামে ভেজা পোশাক সে গায়ে রাখে না। টি- শার্ট একটানে খুলে ফেলতেই দীপা এসে ঘরে ঢুকল। কাদিন দীপার সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজছিল, “গরমে মরে যাচ্ছি।”
দীপা বলল, “সব ছেলেরা বাইরে বসে আড্ডা দিচ্ছে। এমনকি বাবাও সেখানে। আপনি ঘরে বসে নিজেকে বউ পাগলা প্রমাণ করতে চান?”
কাদিনের চেহারা থমথম করে উঠল, “এখানে ত আর নতুন আসিনি। সবাই জানে আমি কেমন। ধুলোবালি, আবর্জনা এড়িয়ে চলি আমি।”
“ন্যাকা।” দীপা নাকে টেনে বলল।
কাদিন চোখ মুখ শক্ত করে আরো বলল, “কত বউ পাগলা তা নিশ্চয়ই তোমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না।”
দীপা স্পষ্ট খোঁচার আভাস পেয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমিও ত আবর্জনাই। এড়িয়ে চলুন, আরো ভালো করে এড়িয়ে চলুন।”
কাদিন দীপার সাথে দূরত্ব ঘোচাতে চেয়েছিল। দীপাকে তার আবারো ভালো লাগতে শুরু করেছে। তাই বলল, “রাগ করে আছ নাকি?”
দীপা বলল, “তো আপনি আর কি আশা করেন? আপনার জন্যে কড়িকে আমি কথা শুনিয়েছি। এখন কড়ি যতই বলুক রাগ করেনি কিন্তু আমি জানি সে রাগ করে আছে।”
“কথা শুনিয়েছিলে?”
“হ্যাঁ, আপনার জন্য। দোষ আপনার।”
“আমাদের মধ্যকার বিষয়াদি তুমি আমার বোনের সাথে আলোচনা করো?”
“তো করব না? ও কেন আপনাকে সব জানায়নি? এরপর দোষটা কার হলো? আমার না?”
কাদিন ফোঁস করে শ্বাস ফেলল, “ওর সাথে আর আলোচনা করবে না।”
“না, আরো করতে হবে। ওর রাগ ভাঙাতে হবে আমার। বুঝাতে হবে দোষটা আমার না, দোষটা ওর ভাইয়ের। রাগ হলে ও ওর ভাইয়ের উপর রাগ হবে।”
“কড়ি রেগে নেই। কড়ি রেগে থাকলে অন্যরকম হয়ে যায়। আমি বুঝি।”
“সত্যি?”
“মিথ্যে কেন বলব?”
দীপা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। আপনমনে কিসব ভাবল। পরে বলল, “ঠিকই ত। আমার মত নিষ্পাপ মানুষের প্রতি কেন রেগে থাকবে?”
অন্যসময় হলে কাদিন দীপার এ কথায় বিরক্ত হতো। এখনি বলছে এটা, আবার দু মিনিটে বদলে যাচ্ছে। কোনো স্থিরতা নেই। না আছে দু পয়সার কোনো বুদ্ধি। কিন্তু সে চেয়েও বিরক্ত হতে পারল না। বরং দীপার সাথে তাল মিলিয়ে বলল, “হু তোমার মত নিষ্পাপ মানুষের উপর কেন রেগে থাকবে, কড়ি?”
“আপনার কি ধারণা? আমি নিষ্পাপ নই? আমি রুমডেট করা ফাজিল ক্যাটাগরির মেয়ে?” দীপার গলার স্বর আচমকা বদলে গেল।
কাদিন অবাক হয়ে বলল, “কি বলছ?”
দীপার ঠোঁট কাঁপছে, “আপনি যা চক্ষুলজ্জায় বলতে পারছেন না আমি সেটাই বলে দিলাম।”
কাদিন কঠোর গলায় বলল, “আমি এধরনের কিছুই ভাবিনি।”
“অবশ্যই ভেবেছেন।”
“বললাম না ভাবিনি।”
“ভয় পাচ্ছেন কেন?”
কাদিনের কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল, “তুমি বেশি বুঝো, দীপা।”
দীপা কাদিনকে এক সমুদ্র বিস্ময়ে ডুবিয়ে দিয়ে বলল, “তাহলে এখনি আমাকে চুমু খান।”
কাদিন অদ্ভুত দৃষ্টিতে দীপার দিকে তাকাল। দীপা চার্জার লাইটের আলোআঁধারিতে কাদিনের দিকে এগিয়ে এল, “কি হলো চুমু খান। আপনি নিশ্চয়ই সাধু সন্ন্যাসী না। কোনো মহাপুরুষও না যে বউয়ের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকবেন। তাহলে চুমু খাচ্ছেন না কেন?” দীপা কাদিনের উপর ঝুঁকে এল। কাদিন হতভম্ব। সে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, “দীপা!”
দীপা হাসি হাসি মুখ করে বলল, “আমি দেখেছি আপনি ঢেকে রাখা পানির গ্লাসেও মুখ দেয়ার আগে পানি পরিষ্কার কিনা দেখে নেন। প্লেট একজন ধুয়ে টেবিলে রাখলেও আপনি আবার সে প্লেট ধুয়ে তারপর তাতে খাবার নেন। বউটা শুধু শূচি হলো না। তাই রুচে না।”
কাদিন হাত দিয়ে ঠেলে দীপাকে সরিয়ে উঠে চলে গেল।
বাইরে আকাশ বুকে অগণিত তারা নিয়ে মাথার উপর ছাদ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার নীচে হারিকেন এর আলোয় দাবা খেলতে বসেছেন নিলয় এবং কাদের সাহেব। কায়েস, কাইয়ূম, রিমা, ইমাদ, মেহেদী ওরা তাঁদের ঘিরে বসে খেলা দেখছে। কাদিন গিয়ে চেয়ার টেনে ওদের পাশে বসল। খেলায় টান টান উত্তেজনা। কাদের সাহেব দাবা খেলায় ঝানু লোক। নিলয়ও কম যায় না। দুজনেই বুদ্ধির প্রতাপ দেখিয়ে লড়াই করছে। কড়ি বসে আছে একটু দূরে, সামনের পুকুরপাড়ে। একটু পর পর ঝুঁকে পানিতে হাত ছোঁয়াচ্ছে সে। কাদিন বসার কিছুক্ষণ পর কাদের সাহেব রহস্যময় গলায় বলে উঠলেন, “চ্যাকমেট।”
নিলয়কে শেষ পর্যন্ত অভিজ্ঞ কাদের সাহেবের কাছে হারতেই হলো। কায়েস বলল, “এবার আমি খেলব।”
কাদের সাহেব বললেন, “তো আয়।”
“উহুঁ, বাবা তোমার সাথে খেলব না। আমি হারতে চাইছি না।”
কাদের সাহেব হৈহৈ করে মহানন্দে হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। দাবা খেলায় জিতে যাওয়ার যে আনন্দ, সে আনন্দ রাজ্যাভিষেকের সম্রাটেরও নেই। কায়েস তার বাবার জায়গায় বসল। নিলয় হামি তুলতে তুলতে বলল, “নাহ আমার মনটাই ভেঙে গেছে। জিততে জিততেও হারলাম।”
কায়েস বলল, “আরে ধুর মিঞা বাবার কাছে সবাই হারে। আমরা দুজন খেলে দেখি হালচাল কি হয়।”
নিলয় আড়মোড়া ভেঙে উঠতে উঠতে বলল, “না ভাই আমি খেললে আবার আঙ্কেলের বিপরীতেই খেলব আর জিতবও।”
ইমাদ তার আগ্রহহীন চোখে কায়েসের দিকে তাকাল, “মে আই?”
কায়েস বলল, “অফকোর্স, অফকোর্স।”
ইমাদকে কায়েসের সাথে খেলতে বসতে দেখে কড়ির ঠোঁটের কোণায় রহস্যময় হাসি দেখা গেল। কয়েক মুহূর্ত মুচকি হেসে কি যেন ভাবল সে। তারপর আস্তেধীরে উঠে দাঁড়িয়ে দাবা খেলার আসরটার দিকে এগিয়ে গেল। ইমাদ এবং কায়েস যখন পুরোপুরি খেলায় ডুবে যাচ্ছিল তখন কড়ি দুজনের মাঝে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি খেলতে চাই।”
ইমাদ মুখ তুলে তাকাল না। চুপচাপ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কড়ি বলল, “আপনি মেহমান মানুষ, আপনি কেন উঠছেন? ছোট ভাইয়া উঠবে।”
ইমাদ নির্বিকার গলায় বলল, “না আপনারা খেলুন, আমি আসছি।”
ইমাদ চলে যাওয়ায় কায়েস কড়িকে ধমক দিলো, “এটা কোনো কাজ করলি, কড়ি? বেচারা খেলতে বসেছিল। তুই মাঝে এসে খেলবি বলে উঠিয়ে দিলি। মেহমান না আমাদের? একদম বাচ্চাদের মত করলি।”
“আমার খেলতে ইচ্ছে করছে। তুমি তোমার চেয়ার ছাড়ো। উনাকে ডেকে নিয়ে আসি।”
কড়ি ইমাদের পেছন পেছন গেল।
ইমাদ বাড়ির পেছনের সুপারিবাগানে এসে পড়েছে। এক হাতের ভেতর অন্যহাত গুটিয়ে সুপারি গাছে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে দাঁড়াল। কড়ি এসে পাশে দাঁড়িয়ে বলল “চলে এলেন কেন? আপনার সাথেই খেলতে গিয়েছিলাম।”
ইমাদ বলল, “আচ্ছা।”
“আমি জানি আপনি আমার সম্মতিতে আমার সাথে দাবা খেলতে চান এবং আজীবন খেলে যেতে চান। এরপরও আপনার সাথে খেলতে চাইছি।”
কড়ির কণ্ঠের স্পষ্ট টিটকারি টের পেয়ে ইমাদ চোখ ঘুরিয়ে কড়ির দিকে তাকাল। চোখ রাখল কড়ির চোখের দিকে। এই অন্ধকারেও মেয়েটার চোখ জ্বলজ্বল করছে। বিড়ালের মত চোখ বলেই কি? নাকি মেয়েটার প্রতি তার প্রবল অনুভূতিই আলো হয়ে জ্বলজ্বল করছে? ইমাদ বুঝে উঠতে পারল না। ধীর গলায় বলল, “আপনার সাথে দাবা খেলার প্রশ্নই উঠে না।”
“তাই?”
ইমাদ কিছু বলল না, চুপ করে রইল। কড়ি কপালে ভ্র উঁচিয়ে একগালে হেসে বলল, “ভয় কিসের?”
ইমাদ আবার আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল। তার চাহনী এবং মুখের অভিব্যক্তির কোনো পরিবর্তন নেই। সে নির্বিকার কণ্ঠে বলল, “আপনি কেমন খেলেন জানা নেই। ভালো খেলেন, খারাপ অথবা, মোটামুটি যাইহোক জিতলে মনে করবেন আপনার কাছে নিজেকে জাহির করে আপনাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছি আর হারলে বলবেন হেরে গিয়ে ইমপ্রেস করছি।”
“ওহ আচ্ছা এই ভয়।”
ইমাদ নিশ্চুপ। কড়ি সংশয় কাটাতে বলল “চলুন কিছুই মনে করব না।”
“আচ্ছা।” ইমাদ চট করে হাঁটতে শুরু করল। কড়ি আর ইমাদ মুখোমুখি বসতেই কারেন্ট চলে এল। উঠোনের লাইট দুটো ওদের দুজনের মুখে আলোর জোয়ার ভাসিয়ে জ্বলে উঠল। চোখাচোখি হলো দুুজনের। কড়ি ইমাদের চোখের দিকে তাকিয়েই তার কালো সৈন্যকে এগিয়ে দিলো। ইমাদ চালল তার চাল। তার গুটি সাদা রঙের।
কাদিন গরম অনেক সহ্য করেছে। আর পারছে না। কারেন্ট আসায় পাখার বাতাসের লোভে ঘরের দিকে এগুলো সে। থমকে গেল ঘরের ভেতর গিয়ে। দীপা বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে পা দুলাচ্ছে। এতক্ষণে বাল্বের আলোয় দীপার পান খাওয়া লাল ঠোঁট চোখে পড়ল কাদিনের। কাদিন দ্রুত পায়ে ওর দিকে এগিয়ে গেল। দীপাকে থরথর করে কাঁপিয়ে দিয়ে চুমু খেতে গেল। দীপা নিজের মুখ সরিয়ে ধাক্কা দিয়ে ওকে দূরে সরিয়ে ফোঁসফোঁস করতে করতে বলল, “লুচ্চা কোথাকার!”
দীপার মাথা গিয়ে লাগল খাটের স্ট্যান্ডে। মুহূর্তেই কপাল ফুলে গেল। কাদিন হতবাক! এইনা বলল চুমু খেতে! এখন আবার সে লুচ্চা হয়ে গেল!
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ২৫
কড়ির শেষ ঘোড়াটা ইমাদ তার নৌকা দিয়ে ঠেলে ফেলল।
মেহেদী পিনপতন নীরবতাকে পা দিয়ে মাড়িয়ে সিটি বাজিয়ে উঠল। নিলয় গলার কাছে হাত রেখে জিহ্বা বের করে মরে যাওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “হায়হায় ইস কামবাখাতনে বেয়াইন সাহেবাকো মারডালা।”
কড়ির রাজা ছাড়া আর কোনো গুটি অবশিষ্ট নেই। সে ইমাদের গুটিগুলো এক পলক দেখে নিলো। রাজা, রাণী আর নৌকো। চিন্তিত ভঙ্গিতে কপাল কুঁচকে তার পরবর্তী চালটা চালল সে। ইমাদ তার রাণীকে কয়েক ঘর কোণাকুণি সরাল। কড়ির রাজাকে আবারো ইমাদের রাণী আর নৌকার আক্রমণ থেকে পালাতে হলো। রিমা টানটান উত্তেজনা নিয়ে দাবার বোর্ডে ঝুঁকে দেখল পরের চালেই কড়ির চেকমেট হয়ে যাবে। ইমাদ খুব ধীরে সুস্থে তার রাণীর চাল চালল। কড়ির হাতে দুটো চাল আছে। কিন্তু দুটোর একটাও সে চালতে পারছে না। কারণ কড়ি যে দুইদিকে যেতে পারছে তার একদিকে ইমাদের নৌকা ঐ ঘরগুলো দখল করে আছে। আর অন্যদিকে চাল চাললে ইমাদের রাণীর চেকের কারণে সে সেই ঘরটিতেও যেতে পারছে না। এদিকে তার উপর এখন কোনো চেকও নেই। ব্যস হয়ে গেল স্টেলমেট। কড়ির ঠোঁট হেসে বলল, “ইট’স ড্র।”
ইমাদ হকচকিয়ে উঠল, “ড্র?”
নিলয় এবার দু’হাতে তালি বাজাতে বাজাতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ওয়েহোয়ে বেয়াইনসাহেবা হামকো মারডালা।”
কড়ি সবার সামনেই ইমাদকে হাসতে হাসতে চোখ মেরে বলল, “জি বেয়াই সাহেব ড্র হয়ে গেল। আপনি জিতে গিয়ে ইমপ্রেস করতে পারলেন না। আর না পারলেন বেয়াইনের কাছে হেরে গিয়ে তাকে ইমপ্রেস করতে।”
রিমা মজা করে বলল, “অনেক আগে আমাদের গ্রামে একবার উত্তরপাড়ায় দাবা খেলা নিয়ে ঝগড়া করে মাথা ফাঁটাফাঁটি পর্যন্ত হয়ে গেল। এখন আবার তোমরা শুরু করো না যেন। বিয়ে বাড়ি মনে রেখো, বাচ্চারা। পরে গ্রামবাসী বরপক্ষ আর কনেপক্ষের ঝগড়ার ঘটনা পুরো ইউনিয়নে ছড়িয়ে দিবে। হা হা হা। ”
ইমাদ কড়ির রাজা হাতের আঙুলে চেপে ধরে নিঃস্পৃহ গলায় বলল, “আমি তো আর আমার গুটির রাজা ছিলাম না। রাজা ছিলাম বেয়াইন সাহেবার সৈন্যদলের। বেয়াইন সাহেবার হয়েই খেলেছি। এই যে আমি।”
এরপর অন্যহাতে নিজের রাণী কড়ির রাজার পাশে ঠেলে দিয়ে আরো যোগ করল, “আর এইতো আমাদের বেয়াইন সাহেবা, আমার রাণী। আমরা একজন আরেকজনের বিপক্ষে না খেলে একে অপরের জন্য খেলেছি। আমাদের মধ্যে বড়ই মিল মহব্বত। মাথা ফাটাফাটির প্রশ্নই আসে না।”
সবাই ইমাদের রসিকতায় একসাথে হো হো করে হেসে উঠল।
কড়ি কটমট করে তাকাল। দাঁতে দাঁত ঘষে শ্লেষাত্মক হাসি হেসে বলল, “বেয়াই সাহেব দেখছি ফ্লার্টিং মাস্টার। গার্লফ্রেন্ড কয়টা আপনার?”
এ কথায় একেকজন হাসতে হাসতে একে অপরের উপর গড়াগড়ি পর্যন্ত খেল। ইমাদ কিছু বলল না। কড়ির চোখে চোখ রেখে মুচকি হাসল। কড়িও সোজা ইমাদের চোখের দিকেই তাকিয়ে রইল। দুজনের কেউ’ই চোখ সরাচ্ছিল না। দীপা এসে তাদের চোখাচোখিতে বাগড়া দিলো, “এখানে এত হাসাহাসি কেন? আমাকে ত সবাই ভুলেই গেছে।” দীপা এমন একটা ভাণ করল যেন ওর কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে।
ইমাদ কড়ি থেকে চোখ সরিয়ে দীপার দিকে তাকাল। নিলয় দীপাকে ক্ষ্যাপিয়ে বলল, “তুই এখানে কি করিস? নতুন বউদের হাসাহাসি মানা। নতুন বউ হয়েছিস, মুখে আঁচল চেপে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদ। লজ্জাশরম কিছুই নেই মেয়েটার।”
দীপা রাগে ফোঁস ফোঁস করে উঠল। ইমাদ বলল, “আমি একটু ঘুরে আসি।”
দীপা বলল, “হ্যাঁ, আমি এসেছি না, এখন ত তোকে যেতেই হবে।”
ইমাদকে দেখে মনে হলো সে দীপার কথা শুনতেই পায়নি। একা ঘুরতে চলে গেল সে। মন খারাপ করে দীপা বলল, “ধুর আমার আসাই ঠিক হয়নি।”
দীপা চলে যাচ্ছিল। কায়েস পিছুডেকে বলল, “মেজো ভাবি, যাচ্ছ কোথায়? জানালা নেই বলে বসবে না, নাকি? এখন উঠোনে আমি তোমার জন্য জানালা কি করে ব্যবস্থা করি বলো তো।”
দীপা ঘাড় ঘুরিয়ে লাজুক গলায় বলল, “যাহ দুষ্টু।”
কায়েস বুকের বা’পাশে দু’হাত চেপে বলল, “ইশ্ কি মিষ্টি!”

এই গ্রামের বাজারে ক’টা পর্যন্ত দোকান খোলা থাকে কে জানে! ইমাদ দ্রুত পা বাড়াল। নাহ্ শেষ পর্যন্ত বাজারে দু একটা দোকান খোলা ছিল। ইমাদ একটা আইস ললি কিনল। আইস ললি হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে দীপার ঘরের দরজায় কড়া নাড়ল।
দীপা বলল, “কে?”
ইমাদ প্রশ্নের উত্তরে গম্ভীর গলায় ডাকল, “দীপু?”
দীপা একা একা মুখ ভেঙাল। তারপর বলল, “দরজা খোলাই আছে। ভেতরে আয়।”
ইমাদ দরজা ঠেলে ভেতরে এসে আইস ললির প্যাকেটটা দীপার কপালে চেপে ধরল। দীপার চোখ ভিজে উঠল। সে যখন একটু আগে বাইরে গিয়েছিল তখন সবাই’ই তো ছিল। সে যে ব্যাথা পেয়েছে কেউ’ই খেয়াল করেনি। এই একটুখানি ফুলেছে, চোখে পড়ার মত তো নয়। ইমি এত ভালো কেন! ঐ যে কি একটা গান আছে না? “তুমি মায়ের মতই ভালো!” ইমি ঠিক তেমন। ইমিকে একদিন বলতে হবে, “তুই মায়ের মতই ভালো, তুই বাবার মতই ভালো, তুই ভাইয়ের চেয়েও ভালো।”
ইমাদকে দূর থেকে দীপার ঘরে ঢুকতে দেখে নিলয় দৌড়ে চলে এল, “এই আমাকে ছাড়া এখানে কিসের ফুসুর – ফাসুর হচ্ছে?”
বলতে বলতে থেমে গেল সে। দীপু বিছানার এক কোণে বসে আছে। ইমাদ খাটের পাশে দীপুর কপালে ঠাণ্ডা বোতল চেপে ধরে দাঁড়ানো। নিলয় আঁৎকে উঠে ওদের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, “কি হয়েছে দীপুর?”
দীপা বলল, ” অন্ধকার ঘরে কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি খাটের স্ট্যান্ডে আমার মাথা ঠুকে গেল।”
নিলয় অবাক হয়ে চোখ বড় করে বলল, “খাটের স্ট্যান্ডে লেগে এই অবস্থা! আর তুই কি বাচ্চা নাকি?”
দীপা ফোঁস করে জ্বলে উঠে বলল, “তা আমি বড়ই’বা ছিলাম কবে?”
হ্যাঁ গাধী দীপা এটা অবশ্য ঠিক বলেছে। দীপা যে কোন কালেই বড় ছিল না তা নিয়ে কারো কোন সন্দেহ নেই।
নিলয় গুরুজনদের মত ভাব নিয়ে বলল “দীপু, তোর এখন বিয়ে হয়েছে। তোকে হরলিক্স খেয়ে এখন তাড়াতাড়ি বড় হতে হবে।”
নিলয়ের কথার ভাবে ইমাদও একটু না হেসে পারল না।
এদিকে কাদিন তখন বরফকুচি নিয়ে আসতেই তিন বন্ধুর হাসাহাসির শব্দ শুনল। ওর মেজাজটা চটে গেলে আরও। তাকে লুচ্চা বলে এখন বন্ধুদের সাথে হাসা হচ্ছে! সে গিয়েছিল দীপার জন্য বরফকুচি জোগাড় করতে। বাড়িতে থাকা হয়না বলে ফ্রিজ নেই। পাশের বাড়ির হাশেম চাচাদের ফ্রিজ থেকে বরফকুচি আনতে গিয়ে সেখানেও পেল না। আরো কয়েকঘর খুঁজে তারপর আনতে আনতে দেরি হয়ে গেল। ঘরের ভেতর প্রবেশ করল না আর। বরফকুচি নিয়ে সোজা সে উল্টোপথে হাঁটা ধরল। আসলে দীপা গাধী নয়, সে নিজে গাধা। শুধু গাধাই না, উচ্চমানের মস্তবড় গাধা। গাধা না হলে কেউ দীপার মত মেয়েকে বিয়ে করে না।
.
পুরোনো টিয়া রঙের পাঁচ তলা বাড়ি। একেকটা সিঁড়ি ইয়া চওড়া আর উঁচু। উঠতে নামতে দম বেড়িয়ে আসে সবার।
মুবিন আর মিলা একসাথে এখানে চারতলায় ব্যাচে পড়ে। পাঁচতলায় ছাদ। সামনের অর্ধেক বেঞ্চ মেয়েদের জন্য বরাদ্দ। আর শেষের বাকি বেঞ্চগুলো ছেলেদের। যারা তাড়াতাড়ি আসে তারা সেগুলো দখল করতে পারে। তারপর বাকি ছেলেমেয়েরা টুল নিয়ে বসে পড়ে। এত বেশি ভিড় এখানে! ঘরটার একটাই দরজা এবং সেটি পেছনের দিকে হওয়ায় ছুটির সময় আগে পেছনে বসা ছেলেরা বের হয়। এরপর সামনে বসা মেয়েরা। আর প্রবেশ করার সময় মেয়েরা আগে আগে প্রবেশ করে। ছেলেরা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। মিলার অবশ্য কখনোই মেয়েদের সাথে মেয়েদের বেঞ্চগুলোতে বসার সৌভাগ্য হয়না। মুবিনের ঢিলেমির কারণে প্রতিদিনই দেরি হয়ে যায়। তখন বেঞ্চে বসার জায়গাটুকু সে আর পায়না। ছেলেদের পাশাপাশি টুল নিয়ে বসে ক্লাস করতে হয়। আজ মুবিন আসেনি বলে মিলা তাড়াতাড়ি আসতে পেরেছে। অনেক বুঝিয়েছিল মিলা, কিন্তু মুবিন মায়ের উপর জেদ দেখিয়ে আসলই না। মিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আগের ব্যাচের এখনও ছুটি হয়নি। সে একটু তাড়াতাড়িই এসে পড়েছে। তাই পাঁচতলার চিলেকোঠার পাশে সিঁড়িতে বসে রইল। আচমকা সিঁড়িতে দপদপানির আওয়াজ হলো। মিলা গলা উঁচিয়ে তাকাতেই দেখল একটা ছেলে লাফিয়ে লাফিয়ে ইয়া বড় বড় দুই তিনটে সিঁড়ি একসাথে টপকে উপরে উঠে আসছে। ছেলেটাকে সে চিনতে পারল। ছেলেটার নাম অভ্র। এই ছেলেটা গত বৃহস্পতিবার ক্লাসের বাইরে রাখা মিলার জুতা জোড়ার উপর জুতা পায়ে দাঁড়িয়েছিল। কি আশ্চর্য! ফাঁকা জায়গা দেখে দাঁড়াবে না? কারো জুতার উপর দাঁড়িয়ে থাকা এ কেমন অভদ্রতা! তাও আবার জুতা পায়ে! মিলা চোখমুখ কুঁচকে স্বাভাবিক গলায় বলেছিল, “সরো।”
অভ্র প্রথমে বুঝতেই পারেনি, কোথায় সরবে সে? কেন সরবে? মিলা ফের বলল, “আমার জুতা।”
অভ্র তখন গিয়ে বুঝল। নীচে তাকিয়ে বিব্রত হয়ে গেল। দ্রুত সরে দাঁড়াতেই মিলা বিরক্ত ভঙ্গিতে জুতা পায়ে দিলো। ওর জুতাগুলোর অবস্থা ময়লায়, ধূলোয় এমন হয়েছিল যে পায়েই দেয়া যাচ্ছিল না।
চলবে…

একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-২২+২৩

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ২২
কড়ি ট্রেনের এক দরজা দিয়ে উঠে, অপর দরজা দিয়ে বেরিয়ে বিপরীত প্ল্যাটফর্মে নেমে গেল। ভিড়ের মাঝে ওড়না দিয়ে মুখ আড়াল করে সাবধানে পেছনের দিকে চলে গেল। রামিমের মা তার জন্য অপেক্ষা করছেন। ভোরের দিকে তিনি কল করেছিলেন। ভাগ্য ভালো আজই তিনি এসেছেন নতুবা এতদূর আসা পুরোটাই বৃথা যেত। কড়ি চলে যেত গ্রামের বাড়িতে। দেখাটুকু আর হতো না। আলাদা করে দেখা করার মত সময় কড়ির হাতে নেই। তাই সোজা রেলস্টেশন চলে আসতে বলেছে। কেন এসেছেন তিনি? কিজন্যে? কড়ি সোজা চলে গেল ওয়েটিংরুমে। রোকসানা বেগম একটা চেয়ারে বসে মাথা কাত করে কি যেন লিখছিলেন। কোলের উপর কালো চামড়ার হ্যান্ডব্যাগ। ব্যাগের উপরে একটা কাগজ রেখে লিখছেন। কড়ি সামনে গিয়ে দাঁড়াল, “আন্টি!”
তিনি লিখা শেষ করে মাথা তুললেন। ক্লান্ত ভঙ্গিতে কড়ির হাত আঁকড়ে ধরে উঠে দাঁড়ালেন, “ট্রেন ছুটে যাবে না ত আবার?”
কড়ি বলল, “খুব বেশি দেরি করা যাবে না।”
রোকসানা বেগম হাতের কাগজটা ভাঁজ করে কড়ির হাতে দিলেন। হ্যান্ডব্যাগ থেকে কাপড়ে প্যাঁচানো একটি ছোট বক্সও তুলে দিলেন সাথে। বললেন, “সাবধানে যেও।”
কড়ি দাঁত দিয়ে ওড়না চেপে মুখ আরো ঢেকে মাথা ঝাঁকাল, “আসছি।”
ট্রেনে উঠে কড়ি এক কোণায় দাঁড়িয়ে চিঠিটা পড়ল।
কড়ি মা জননী,
“তোমার নিকট ক্ষমা চাহিয়া এই পত্র। আমার পুত্র দুদিনের জন্য বাড়ি আসিয়াছিল। তাহাকে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া এই অসহায় মাতা জানিতে পারিয়াছে তোমার মাতার সকল গহনাগাঁটি সে বিক্রয় করিয়া ফেলিয়াছে। আমি শুধুমাত্র এই আংটিখানাই উদ্ধার করিতে পারিলাম। তোমার ট্রেন ছুটিয়া যাইবে, বেশিক্ষণ কথা বলিতে পারিব না এই আশংঙ্কায় ওয়েটিংরুম বসিয়া সংক্ষিপ্ত একখানা চিঠি লিখিয়া রাখিলাম। সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই তোমার মঙ্গল করিবে।”
ইতি,
এক কুপুত্রের ব্যর্থ জন্মদাত্রী।

বাঁশি বাজানো হয়ে গেছে। ট্রেন এখনি ছেড়ে দেওয়া হবে। কড়ি এমন সময়ে লাফ দিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে গেল। যাত্রীরা ট্রেনে উঠে যাওয়ায় স্টেশন বেশ ফাঁকা। কড়ি দৌড়ে ওয়েটিং রুমের দিকে গেল। রোকসানা বেগম এখনও চলে যাননি। ক্লান্ত থাকায় চেয়ারেই মাথা এলিয়ে ঘুমোচ্ছেন। মাত্রই চোখটা লেগেছিল তার। কড়ি গিয়ে শক্ত করে জাপটে জড়িয়ে ধরল তাঁকে। ঘুমের মধ্যেই তিনি ভয় পেয়ে গেলেন। ঘুম ছুটে গেল। কড়ি বলল, “আমি আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে শেষ করতে পারব না, আন্টি।”
তিনি ব্যাথা পাচ্ছেন। বোরকার নীচে হাতে জঘন্য আঘাত। পুত্রের দেয়া আঘাত! লজ্জায় আহটুকুও করলেন তিনি। বললেন, “ফিরে এলে কেন আবার? যাও। তোমার বাবা, ভাইয়েরা চিন্তা করবেন।”
কড়ি বলল, “জি আসছি।”
ট্রেন ইতোমধ্যে ছেড়ে দিয়েছে। ওয়েটিংরুম থেকে বেরিয়ে দৌড়ে ট্রেনে উঠে গেল কড়ি। হাঁপাচ্ছে সে। তখনি ইমাদকে দেখা গেল। একটা কিশোর ইমাদের কাঁধের ব্যাগটা টেনে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কিশোরটিকে দেখে বেশ স্বাস্থ্যবান এবং শক্তিশালী মনে হচ্ছে। কিশোরটির নাম মুবিন। যাঁর ইচ্ছেঘুড়ি ধর্মপুর রেলগেইটে আটকে গেলেও শুধু সমিলের ছেলে দুটোকে প্রতিদিন দেখার লোভে সে রেললাইন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে সরে দাঁড়ানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে। ভাগ্যিস সরে দাঁড়িয়েছিল। নাহয় ইমাদ স্যারের সাথে দেখা হতো না। এখন এই “আচ্ছা, আচ্ছা” ব্যাটার উপর সে জন্মের শোধ তুলবে। তাকে পড়াতে আসবে বলে এলো না! স্যরি বলার পরও এল না! এখন তো তাকে মুবিন যেত দিবে না। মুবিন শয়তানি হাসি হেসে মনে মনে বলল, “গেলে যান না, ব্যাগ রেখে যান। আপনার ব্যাগের জিনিসপাতিতে দাঁড়িয়ে আমি পি করব। আপনার ট্রেন আমি ছুটাব।”
ইমাদের সাথে মুবিন বেশিক্ষণ পারল না। ইমাদ হেঁচকা টানে ব্যাগ ছাড়িয়ে নিয়ে দিলো ভোঁ দৌড়। কড়ি সাহায্য করতে হাত বাড়িয়ে দিলো। ইমাদ কড়ির হাত ধরল না। ট্রেনের গতি হঠাৎ বেড়ে গেল। প্ল্যাটফর্মও শেষ হওয়ার পথে। কড়ি ইমাদের শার্টের হাতা খামচে ধরে টেনে তুলল ইমাদকে। ইমাদের হাঁপ ধরে গেছে। বড় বড় শ্বাস ফেলছে। কড়ি বলল, “হাত ধরলে আপনার প্রেমিকা নিশ্চয়ই আপনাকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলত না।”
ইমাদ বলল, “আপনি মনে করেন আপনি সব বুঝেন কিন্তু আপনি অনেককিছুই বুঝেন না। আপনার হাতটা ধরলে আপনার কাছে তা সাহায্য হিসেবে মনে হলেও আমার মাথায় সাহায্য হিসেবে গণ্য হতো না।”
“মানে?”
“মানে আমি আপনাকে অন্যচোখে দেখি। তাই এভাবে হাত ধরতে চাইনি। আমি কেমন চোখে দেখি তা যদি বুঝতেন তবে এই হাত বাড়িয়ে দিতেন না। যেহেতু দিতেন না তাই আমিও এ হাত ধরতে চাইনি। আমি আপনার সম্মতিতে আপনার হাত ধরতে চাই এবং ধরে থাকতে চাই।”
কড়ি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেল। ইমাদ নির্বিকার। ময়লা শাড়ি পরা দু তিনটে মহিলা চিনির বস্তা টেনে এনে ট্রেনের দরজায় ফেলছে। কড়ি সরতে গিয়ে পড়ে যেত নিলো। ইমাদ দ্রুত হাতে কড়ির ডান বাহু খামচে ধরল এবং সাথে সাথে বলল, “স্যরি।”
কড়ি সোজা হয়ে দাঁড়াল। ইমাদ হাত সরিয়ে কাঁধের ব্যাগটা দু’কাঁধে ঝুলিয়ে কেবিন নম্বর খুঁজতে চলে গেল। কড়ি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। সে বিরক্ত, এবং স্তম্ভিত।

দুটো কেবিন এর জন্য টিকিট কাটা হয়েছে। একটায় কাদের সাহেব, কাইয়ূম, রিমা আর কায়েস। অন্যটায় কাদিন, দীপা, দীপার ভাই মেহেদী আর নিলয় বসেছে। দীপার পরবর্তী ফরমায়েশ ছিল তার সাথেই সে তার ছোট ভাই আর বন্ধুদের নিয়ে আসবে। ইমাদ দীপাদের কেবিনে গিয়ে কড়া নাড়ল। কাদিন উঠে এসে দরজা খুলে দিলো, “ভালো আছেন?”
ইমাদ বলল, “ভালো আছি। আপনি?”
“জি আলহামদুলিল্লাহ্‌।”
“আচ্ছা।” ইমাদ কেবিনের ভেতর ঢুকল।
নিলয় বলল, “কই ছিলি তুই? এতক্ষণ লাগল।”
ইমাদ বলল, “হুম।”
দীপা ফুঁসে উঠল, “হুম আবার কি? কই ছিলির উত্তর কি হুম? তোর কথার উপর কি সরকার ট্যাক্স বসিয়েছে? প্রশ্ন করলে স্পষ্টভাবে প্রশ্নের উত্তর দিবি।”
ইমাদ বলল, “আচ্ছা।”
“তোকে যদি আমি এখন ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে না দিই তবে আমার নাম ইসরাত জাহান দীপা না।”
ইমাদ আবারো বলল, “আচ্ছা।”
দীপার গা’টা জ্বলে গেল। কড়ি চলে গেল তার বাবার কেবিনে।
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ২৩
শিল্পী দাঁড়িয়ে আছে তাদের বাসার ডাইনিং টেবিলের সামনে। তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি বেশ উদ্ধত, গলার স্বর ঠাণ্ডা, “মুবিন?”
মুবিন পিজা খেতে খেতে বিরক্তিতে বলল, “হু।”
শিল্পী বলল, “আমি তোকে খুব সহজ একটা শাস্তি দিয়েছিলাম। এক সপ্তাহ কোনোপ্রকার ফাস্টফুড খেতে পারবি না।”
মুবিন বলল, “তো?”
শিল্পী বলল, “পিজাটা রাখ। রুটি আছে রুটি খা।”
মুবিন বলল, “মা, ঘাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থেকো না। যাও এখান থেকে।”
শিল্পী কখনো ছেলের গায়ে হাত তুলে না। ছেলে যখন বড় বড় অপরাধ করে, ছেলেকে ফাস্টফুড, আইসক্রিম না দেয়ার মত তুচ্ছ শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করে সে। তবে আজ হাত তুলল। সপাটে মুবিনের গালে চড় বসাল। মুবিনের হাত থেকে পিজা খসে পড়ল প্লেটে। ঘাড় শক্ত হয়ে উঠল। শিল্পী বলল, “পঁচা রক্ত শরীর কেটে ধুয়ে ফেললেও শুধরানো যায় না। রক্তের দাগ রয়েই যায়। বাপ কোন দেশের ফেরেশতা যে ছেলে বস্তি হবে না। মারামারি, স্কুল পালানো, ফেইল এর উপর ফেইল করা আর কোনটা বাকি রেখেছে এই ছেলে! লজ্জা হয় এমন ছেলে পেটে ধরেছি।”
মুবিন চেয়ারে লাথি দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে অবজ্ঞার স্বরে বলল, “তোমাদের ছেলে বলে আমারো লজ্জা হয়।”
এ কথা শুনে শিল্পী নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। তেড়ে এসে মারতে শুরু করল মুবিনকে। মুবিন সরল না। জমাট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মারুক যত পারুক। তার মা – বাবার সো কল্ড আদরের চাইতে তাদের মার খাওয়া ভালো। ফেরানোর মত কেউ নেই মুবিন জানে। মিলা মাকে ভয় পায়। দূরে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে একটু পর পর কেঁপে কেঁপে উঠছে। বোধহয় কাঁদছে। মুবিন তার বাবার ঘরের দরজার দিকে তাকাল। দরজা দিয়ে তাকালে স্পষ্ট বাবার বিছানা দেখা যায়। বাবা এখন শুয়ে শুয়ে আয়েশ করে সিগারেট টানছেন। তাকিয়ে আছেন সিলিং এর দিকে ছুটে যাওয়া সিগারেটের ধোঁয়ার দিকে। তাঁর ঠোঁটে হাসি। মুবিন নিশ্চিত তার বাবা
এখন আসবেন না। তিনি অপেক্ষা করছেন মায়ের রাগ নামার এবং মুবিনের মার খাওয়া শেষ হওয়ার। তিনি এখন মনে মনে যুক্তি সাজাবেন। পরে তাঁর এই সম্পূর্ণ যুক্তির ঢল নামবে মায়ের বিপরীতে। একটু পরে এসে তাঁর প্রথম কথাটা অনেকটা এমন হতে পারে যে “আমি থাকতেই আমার ছেলের গায়ে তুমি হাত তুলো। ছেলে আমি কোনোভাবেই তোমাকে দিব না। ইন ইউর প্রেজেন্স মাই সান ইজ নট সেইফ।”

মুবিনের মার খাওয়া শেষ হয়েছে। ঠোঁট ফুলে গেছে। পিঠে স্কেলের দাগ পড়েছে। মঈন এতক্ষণে উঠে এল এবং একইসাথে করুণ এবং হিংস্র মুখ করে বলল, “মাই সান ইজ নট সেইফ উইথ ইউ এট অল। তুমি ত আমার ছেলেকে মেরেই ফেলবে। তুমি পুরোপুরিভাবে একজন সাইকো মহিলা। আমার ছেলে থাকবে তোমার কাছে? অসম্ভব।”
বলতে বলতে মঈন এসে আগলে ধরল মুবিনকে। মুবিন জোরে ধাক্কা দিয়ে বাবাকে দূরে সরিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। রাস্তা পেরিয়ে কাঠের সমিলের স্তূপকরা কাঠের গুঁড়ির উপর বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে ঢুকরে কেঁদে উঠল মুবিন। তার কান্নায় আকাশ থেকে জোছনা নেমে এল। পরম আদরে পিঠে আলো বুলিয়ে দিলো। মুবিন স্পষ্ট শুনতে পেল রাস্তার পাশে ঝিম ধরে শুয়ে থাকা কালো কুকুরটা জিহ্ব বের করে তাকে বলছে, “কেমন লাগে মুবিন? কেমন লাগে? মা – বাবার লড়াই শেষের ট্রফি হতে দারুণ লাগে?”
.
কড়ি তার মরহুম দাদীর ঘরের পালঙ্কে বসে পান খাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। একসময় সে জানালা দিয়ে মুখের পান ছুঁড়ে ফেলল। দীপা এসে পাশে দাঁড়াল, “অ্যাই কি করছ?”
কড়ি বিস্বাদ মুখে বলল, “পান খাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। খুবই বাজে স্বাদ।”
“পাতা ছাগলদের খাদ্য। তুমি কেন পাতা খাবে? দাও পান আমাকে দাও। আমি খাই। কারণ আমি ছাগল।”
কড়ি অবাক হয়ে দীপার দিকে তাকাল। দীপা পানের বাটা থেকে পান তুলে নিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল, “তুমি কেন আমাদের কেবিনে বসোনি? আ’ম স্যরি, কড়ি। আমি তো ছাগল। মাথা আউলে গিয়েছিল তাই তোমাকে উল্টাপাল্টা কথা শুনিয়েছিলাম। তুমি আমার সাথে এভাবে রেগে থাকলে আমি কেঁদে ফেলব।”
কড়ি যে রাগ করেনি সে কথাটুকু বলার সুযোগ কড়ি পেল না। তার আগেই মুখ ভর্তি পান নিয়ে দীপা কেঁদে ফেলল। কড়ি দু’হাঁটু একসাথে জড়ো করে বসেছিল। এখন হাঁটুর উপর কনুই রেখে গালে হাত রেখে তাকিয়ে তাকিয়ে দীপার কান্না দেখতে দেখতে হেসে ফেলল। অপরাধবোধ মুহূর্তেই দীপার রাগ হয়ে গেল। রেগেমেগে সে বলল, “আমি কাঁদছি আর তুমি হাসছ? একটু নাহয় এটাসেটা বলেছি তাই বলে তুমি আমার কান্না দেখে হাসবে? ভাইটা যেমন শয়তান, বোনটাও খারাপ।”
কড়ি হা হা করে হেসে উঠল। ঝুনঝুনির শব্দের মত সে হাসি সারা ঘরে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল। কড়ি আছে দারুণ ফূর্তিতে। ফূর্তির পেছনের সম্পূর্ণ অবদান ইমাদের। ট্রেনের ঘটনার পর ইমাদের প্রতি খুব বিরক্ত ছিল সে । দীপার জন্য নয়, ইমাদ ঐ কেবিনে ছিল বলেই সে সেখানে যায়নি। পরে খুব মজা পেয়ে গেল। মজা পাওয়ার কারণ হলো একটু আগে দখিনের বড় ঘরটায় সে তার মোবাইল চার্জ দিতে গিয়েছিল। সেখানে চার্জ দিতে সুবিধা বেশ। প্লাগ ইন করে মোবাইলটা মিটসেফ এর উপর রেখে দেয়া যায়। অন্য ঘরগুলোতে মোবাইল রাখতে হয় নীচে। কখন কে পা দিয়ে ভেঙে ফেলে এই ভয়ে সবাই দখিনের ঘরেই চার্জ দিতে যায়। কড়ি চার্জ দিতে গিয়ে দেখল সেখানে আরেকজন চার্জ দিয়ে রেখেছে। চার্জ ফুল হয়েছে কিনা দেখার জন্যে কড়ি মোবাইল খুলে দেখল। মোবাইল লক করা, চার্জ ৮৮%, স্ক্রিনে ইমাদের ছবি। সাথে একটা মেয়ে বাবু। বাবুটা ইমাদের গালে চুমু দিচ্ছে। ইমাদের ভাবভঙ্গি ভাবলেশনহীন, চোখের দৃষ্টি ঠাণ্ডা, ঠোঁটে হাসির চিহ্ন মাত্র নেই। অথচ, বাবুটা পরীর মত হাসছে। কথা সেটা না। কথা হলো সেখানে অনামিকা নামে কারো মেসেজ ভাসছিল। মেসেজে লেখা “খেয়ে নাও।”
কড়ি মুচকি হেসে আপনমনে বিড়বিড় করল, “হায়রে হায়নার দল! তোরা সবগুলোই এক গোয়ালের গরু।”
সে মোবাইল জায়গামত রেখে চলে এল। হয় হায়না নাহয় গরুর তালিকায় রামিম এবং তাহমিদের পাশাপাশি নতুন করে যুক্ত হলো ইমাদের নাম। এতক্ষণ ইমাদের কথাগুলো মনে পড়লেই মেজাজ খিটখিট করত আর এখন আরো বিনোদন পাচ্ছে। সামনে ইমাদ যা যা বলবে তাতেও মজা পাবে। কড়ি সেজন্যই প্রফুল্ল। তার প্রফুল্লচিত্তের এই হাসির শব্দটুকু ছুটে গেল পাশের ঘরেও। ইমাদ ভার্সিটি অথরিটির কাছে মোবাইলে একটা মেইল লিখছিল। সে ভুল করে সেই মেইল পাঠিয়ে দিলো তার এক কাজিনকে। এই এক সমস্যা। কড়ি আশেপাশে থাকলে সবকিছুতে সে ভুল করে ফেলে। ইমেইল আবার নতুন করে ফরোয়ার্ড করল, কাজিনকেও স্যরি লিখে মেইল করতে হলো।
চলবে…

একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-২০+২১

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ২০
ইমাদ অবাক হয়ে বলল, “স্যরি?”
সুহা কি বলবে সাথে সাথে ভেবে পেল না। কয়েকটা মুহূর্ত নিরবে কেটে গেল। তারপর সুহা কথা পেয়ে গেল, “আপনি কি খুব বেশি ব্যস্ত? তাহলে পরে কল করি?”
ইমাদ বলল, “আগে বলুন আপনি কে? কেন ফোন করেছেন?”
“আমি কে তা জানতে হবে না। আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয়েছিল তাই কল করেছি।”
“মানে?” ইমাদের চোখ, মুখ বিরক্তিতে কুঁচকে গেছে।
“মানে কিছু না।” সুহা কল কেটে দিলো। ইমাদ কান থেকে মোবাইল সরিয়ে চোখের সামনে ধরে রাখল। কার নাম্বার এটা?
.
কাদিন আর দীপার মাঝে ভয়াবহ ঝগড়া এবং কথাকাটাকাটি হয়েছে। ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে কাদের সাহেবের ইনসুলিন প্রয়োগ থেকে। দীপা শ্বশুরকে ইনসুলিন দিতে দিতে নাকি বলেছিল, “বাবা, আমরা ট্রেনে করে গেলে কেমন হয়?”
কাদের সাহেব এক পৃথিবী বিস্ময় নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। বললেন, “কোথায় যাওয়ার কথা বলছ?”
“আমাদের গ্রামের বাড়িতে।”
“আমাদের গ্রামের বাড়িতে?”
দীপা ঘাড় নাড়তে নাড়তে বলল, “জি, বাবা।”
কাদের সাহেবের ইনসুলিন দেয়া শেষ। তিনি চিন্তিত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন, “কি বলছ কী!”
দীপা চট করে কাদের সাহেবের হাত টেনে ধরে তাঁকে আবার সোফায় বসাল, “বাবা, বসুন না। কথা বলি।”
তারপর নিজে হাঁটুর উপর ভর দিয়ে কাদের সাহেবের মুখোমুখি মেঝেতে বসল। বলল, “বাবা, আমি না কোনোদিন ট্রেনে চড়িনি। কোনোদিন না। আমরা এবার ট্রেনে করে যাই? সবাই মিলে? পিকনিকের মত লাগবে।”
কাদের সাহেব থতমত খেয়ে অনেকক্ষণ দীপার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ধীরে ধীরে তাঁর চেহারা শক্ত হয়ে আসছে। এই মেয়ে বলে কী! বলার আগে নিশ্চয়ই ভেবে কিছু বলে না। আবদার আর ছাগলামির মাঝে ফারাক আছে। চোয়াল শক্ত করে কাদের সাহেব না করতে যাচ্ছিলেন তার আগেই দীপা ঘাড় নত করে বলল, “স্যরি, বাবা। ভুল হয়ে গেছে। বুঝিনি যে এভাবে যাওয়া ঠিক হবে না।”
কাদের সাহেব বললেন, “হ্যাঁ আসলেই এভাবে যাওয়া ঠিক হবে না।”
দীপার মন খারাপ হলো তিনি বুঝতে পারলেন। তবুও অসঙ্গত প্রশ্রয় দিলেন না। উঠে চলে গেলেন। ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারত কিন্তু হলো না। রাতে ফিরে কাদিন দীপার উপর ক্ষেপে গেল, “এগুলো কোন ধরনের কথা, দীপা? তুমি নতুন বউ। তুমি ট্রেনে করে বউভাতের জন্যে আমাদের বাড়িতে যাবে? মানুষ কি বলবে?”
দীপা অবাক হয়ে বলল, “কই যাব? যাব না তো। শুধু আবদার করেছিলাম। পরে নিজেই ত না করে দিয়েছি।”
“বাবা সত্যি সত্যি ট্রেনের টিকিট কেটে বসে আছেন।”
“তাই নাকি?” দীপা খুশিতে বিছানা থেকে লাফিয়ে নামল।
আরো বলল, “উমা বাবা কী ভালো! আমি গিয়ে একটা থেঙ্কস দিয়ে আসি।”
দীপা আনন্দে আত্মহারা হয়ে ছুটে যেতে চাইল। কাদিন দেয়ালের মত সামনে দাঁড়িয়ে দীপাকে বাধা দিলো। দীপার দু’বাহু খামচে ধরে বলল, “আমার বউ এত উন্নত শ্রেণীর গাধী হতে পারে ভাবতেও পারছি না।”
তাহমিদও দীপাকে কথায় কথায় গাধী বলত। দীপা রাগে কেঁদে ফেলল, “আমি আর আপনার সাথে থাকব না।”
“যতসব, ধ্যাত।” কাদিন দীপাকে ছেড়ে দিয়ে তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। সে রাতে দীপা খেল না। খাওয়ার সময় সবাই ডাকলেও খেতে গেল না। রাগে কাদিনের চোখ লাল আর মুখ তেতো হয়ে গেল। কড়ি ডাকতে গেলে দীপা চোখ মুখ শক্ত করে কঠিন গলায় বলল, “তোমার ভাই যে মেয়ের জন্য দিওয়ানা সেই মেয়েকেই বিয়ে করাতে। শুধু শুধু তাহমিদকে শিক্ষা দিতে এই বিয়েটা না হলেও চলত।”
কড়ি বিস্ময়ের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেল, “মেজো ভাইয়ার আবার কবে পছন্দের কেউ ছিল?”
“ছিল না? না থাকলে সে এত দেবদাস কেন?”
কড়ি দীপার কান্নামোছা ফোলা মুখটার দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল। দীপা রেগে গেল, “কি হলো চুপ করে আছো কেন?”
“কি বলব তাই ভাবছি।”
“দীপা ঘরের দরজা বন্ধ করে দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়াল, “তোমার ভাইয়ের যদি আমাকে মনে নাই ধরে তবে আমায় বিয়ে করল কেন? তোমরা কেন জুরাজুরি করে এ বিয়ে করিয়েছ?”
কড়ি ভেবে দেখল সবকিছু খোলাসা করে বললেই ভালো। মিহি স্বরে বলল, “দেখো ভাবি, মেজো ভাইয়ার পছন্দের কেউ কখনোই ছিল না। ওর কাউকে পছন্দই হতো না। ও এত বেশি খুঁত ধরে মানুষের তার চোখে কেউ কখনো আটকে যেতে পারেনি। তার কাছে কারো হাসি সুন্দর ত, চোখ ভালো না। আরেকজনের নাকটা ভালো, ভ্রুগুলো যেন কেমন। এই মেয়ের হাঁটার ধরন ভালো না, ঐ মেয়ে বসতে হয় কি করে সেটা জানে না। এসব বলতে বলতেই ওর জীবন অর্ধেক কেটে গেল।”
“দেখো কড়ি একদম মিথ্যে বলবে না। তাৎক্ষণিক গল্প বানাতে তুমি অনেক পটু তা আমার জানা আছে।”
“মিথ্যে নয়। ভাইয়ার কখনো প্রেম ছিল না তা শতভাগ সত্য। ভাইয়া হলুদের রাত থেকেই ডিস্টার্বড। তাই হয়তো কেমন হয়ে আছে।”
“ডিস্টার্বড কেন?”
“কে যেন মোবাইল করে তোমার কথা বলে দিয়েছে।”
“আমার কথা?”
“হ্যাঁ।”
“কি কথা?”
“তোমার একটা প্রেম ছিল আর সেই প্রেমিকের জন্য তুমি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছ। তবে সেই প্রেমিক যে তার নিজেরই বন্ধু সেটুকু জানে না।”
দীপা স্তব্ধ হয়ে গেল। ওহ কাদিন সাহেব এজন্যই ত তার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকছে। দূরে থাকছে এতে সে যথেষ্ট আপ্লুত। এ যেন মেঘ না চাইতে বৃষ্টি। তবে এর পেছনের কারণটা জেনে রাগে তার শরীরের সবকটা লোম পুড়ে যাচ্ছে। দীপা শান্ত গলায় কড়িকে বলল, “সবাইকে বলে দিও আমার শরীর ভালো লাগছে না। তাই খাব না।”
কড়ি কথা বাড়াল না। খাবার টেবিলে গিয়ে বলল, “ভাবি ঘুমিয়ে পড়েছে তাই আর ডাকিনি। থাক ঘুমাক।”
কাদিন তখনি মনে মনে ঠিক করে ফেলল, “এই মেয়েকে সে উচিত শিক্ষা দিবে। খাওয়াটা শুধু শেষ হোক।”
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ২১
কাদের সাহেব খুব দুঃখ পেলেন। আহারে মেয়েটা না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল! বড্ড আহ্লাদী এই মেয়ে। তাঁর সবকটা ছেলেমেয়ে ছেলেবেলা থেকেই বয়সের চেয়ে বেশি বুঝতো। কখনো কোনো অন্যায় আবদার ত দূরে থাক আবদার’ই করেনি। এটা কিনে দাও, ওখানে নিয়ে যাও জাতীয় কথা কখনো তাঁকে শুনতে হয়নি। গর্ব যেমন হয় তাদের নিয়ে, মাঝে মাঝে আফসোসও হয়। বাবা মানেই ত আলাদিনের চেরাগ। সন্তানেরা চেরাগ ঘষবে আর নিজের খায়েশ বলবে। বাবা সেটা পূরণ করবে, নাহয় পূরণ করতে না পারার অক্ষমতা নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। এই ত পিতৃত্বের স্বাদ। বায়না না ধরা ময়নাদের কি ভালো লাগে? কাদের সাহেব মৃদু হাসলেন। তাঁর মেজোপুত্রবধূ দীপা হলো বায়না ধরা ময়না। এই ময়নার আবদার ফেলার কোনো মানে হয় না। পৃথিবী যাক ভেসে যাক।
.
বাতাসে গাছের পাতা দুলতেই চাঁদটা দেখা গেল। বাসটাও শব্দ করে দুলে উঠল। রামিমের মা রোকসানা বেগম জরুরি ভিত্তিতে কড়ির সাথে দেখা করতে চাইছেন। শুধু তার সাথে দেখা করতেই তিনি আজ দিনাজপুর থেকে কুমিল্লা যাচ্ছেন। এতদূর তিনি কখনো একা কোথাও যাননি। ভয় হচ্ছে। শুনেছেন কুমিল্লা নাকি অনেকদূর! আজ রাতে রওনা হলে কাল সকালের কোনো এক সময় গিয়ে পৌঁছাবেন তিনি। সারারাত বাস চলবে। বুঝাই যাচ্ছে দিনাজপুর আর কুমিল্লার দূরত্ব তাকে হাঁপিয়ে তুলবে।
.
কাদিন ঘরে ঢুকার আগেই দেখল দীপা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কাদিন বিরক্তিতে বলল, “এমন ভূত হয়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন? সরে দাঁড়াও।”
দীপা ফুঁসতে থাকা গলায় বলল, “আমাকে কেন বিয়ে করেছেন?”
কাদিন হাত দিয়ে ঠেলে দীপাকে ভেতরে নিয়ে নিজেও ঘরে এল। দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “খেতে যাওনি কেন? দোষ করবেন আপনি আবার রাগও দেখাবেন আপনি। বাব্বাহ্।”
“আমাকে কেন বিয়ে করেছেন?”
“তোমাকে একটা উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য।” রাগে কাদিন দাঁতে দাঁত ঘঁষল। এই মেয়ের উচিত শিক্ষা কি হতে পারে সেটাই সে খুঁজে পাচ্ছে না। ল্যাপটপ নিয়ে বিছানায় পা ছড়িয়ে বসল সে। এর চাইতে নিজের কাজ নিয়ে পড়ে থাকা ভালো। দীপা এসে ঠাশ করে ল্যাপটপটা বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলল। কাদিন থ বনে গেল। দীপা এবার চেঁচাল, “কি শিক্ষা দিবেন আপনি আমাকে? আমিও দেখি কেমন শিক্ষা আপনি আমাকে দিতে পারেন।”
কাদিন উঠে দাঁড়িয়ে দীপার মুখ চেপে ধরল, “চেঁচাবে না। আমার বাসায় এমন চিৎকার চেঁচামেচি অ্যালাউড না।”
দীপা জোর খাটিয়ে মুখ থেকে কাদিনের হাত সরাল, “আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিন তাহলে।”
কাদিন চাপাস্বরে বলল, “শুনতে যেহেতু চাও বলছি। দুই পরিবারের কথা ভেবে বিয়েটা করেছি। একে ত এত বড় সত্য লুকিয়েছে তার উপর গলা উঁচু করে কথা বলছ।”
“কি সত্য লুকিয়েছি আমি? আপনার বোন ত সবই জানত।” দীপা বিস্ময়ে কথার খেই হারিয়ে ফেলল।
কাদিন বলল, “তুমি আমায় বলেছ?”
“আমি কি বলব আপনাকে? আমায় ত প্রশ্ন করেননি। আমি ভেবেছি কড়ি যেহেতু সব জানে আপনার কাছেও আর অজানা কিছু নেই।”
কাদিন ভেবে দেখল হ্যাঁ তাই তো। দোষটা ত দীপার নয়। দীপার এমনটা ভাবাই স্বাভাবিক। তাই এখানেই কথার ইতি টানল। বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। দীপা অন্ধাকারে ডুবন্ত ঘরটার ঠিক মাঝখানে ধপ করে বসে পড়ল। কাদিন ওপাশ ফিরে শুয়ে রইল। কারো মুখ দেখা দেখি নেই। দীপা শুধু জানতে চাইল, “আপনার ধারণা আমার প্রেমিক আমাকে ভোগ করে ছেড়ে দিয়েছে বলেই আমি আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলাম। আপনারা সব ছেলেরাই এত নীচু মনমানসিকতার কি করে হোন?”
কাদিন থমথমে গলায় বলল, “তোমাকে এ ধরনের কোনো কথা বলেছি বলে আমার মনে পড়ছে না।”
“সবকিছু বলতে হয়না। আর আপনাদের আমি হারে হারে চিনেছি। পুরুষ মানুষের চিন্তার প্রসার কতটুকু কি তা আর বুঝতে বাকি নেই।”
কাদিন একদম চুপ হয়ে গেল। নিরবতার আড়ালে নিজেকে লুকাল। দীপা মেঝেতেই শুয়ে রইল। চোখের জলে মেঝে ভেসে যাচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে রাত।
মাঝরাতে কাদিন বাতি জ্বেলে উঠে বসল। দীপা মেঝেতে ঘুমিয়ে সাবাড়। কাদিন বিছানা ছেড়ে নামল। পাঁজাকোলা করে দীপাকে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। বাতি নিভিয়ে নিজে গিয়ে বসে রইল বারান্দায়।
.
গেস্টরুমের বারান্দা থেকে নীচে তাকালে কিছু কাঠের সমিল দেখা যায়। মুবিন প্রতিদিন নিয়ম করে যেমন গেইমস খেলে তেমনি নিয়ম করে এই ঘরের বারান্দায় এসেও দাঁড়িয়ে থাকে। সমিল দেখে না, সে দেখে সমিল এর স্তূপ করে রাখা কাঠের উপর দাঁড়িয়ে পলিথিন দিয়ে খেলতে থাকা ছেলে দুটোকে। বয়সে তার চেয়ে ছোট মনে হয়। আবার বড়ও হতে পারে। ছেলে দুটো খুব হ্যাংলা যেন বাতাসে উড়ে। আলুথালু, ছেঁড়া প্যান্ট পরা। গায়ে কোনো গেঞ্জি বা শার্ট নেই। রোদে পুড়ে পুড়ে ছাই কালো দুজন। মুবিন উৎসুক হয়ে এই দুই ভাইয়ের খুনসুটি দেখে। মাঝে মাঝে দুই ভাই যখন ঝগড়া করে ও তাতেও মজা পায়। আর মন খারাপি নিয়ে ভাবে ওদের ঝগড়া গুলো কেন ওমন হয় না? ঘরের বাইরে মিলার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “মুবিন আয় না। স্কুলের দেরি হচ্ছে।”
মুবিন জবাব দিলো না। সে বিড়বিড় করল, “আচ্ছা ঐ পলিথিন দুটোতে খুব সুখ তাই না?”
দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে মিলা নিজেই বারান্দায় চলে এল। তাড়া দিল, “মুবিন ব্যাগ কাঁধে নে তো।”
মুবিন ব্যাগ কাঁধে নিলো। স্কুলে গিয়েও তৃতীয় ঘণ্টায় ক্লাসের পেছনের দরজা দিয়ে লুকিয়ে বের হয়ে গেল। সোজা চলে গেল পেছনের দিকে। আশেপাশে তাকিয়ে মুবিন স্কুল ব্যাগটা দেয়ালের উপর থেকে ছুঁড়ে মারল। ব্যাগ গিয়ে দেয়ালের বাইরে পড়ল। ব্যাগকে অনুসরণ করে মুবিনও সতর্কতাসহিত দেয়াল টপকে নীচে নামল। মাটিতে পড়ে থাকা স্কুল ব্যাগটা তুলল সে। হাত দিয়ে ধূলো ঝাড়তে ঝাড়তে শিষ বাজাতে শুরু করল। গোবিন্দ স্যারের জীববিজ্ঞান ক্লাসে কোনোমতেই বসবে না সে। ব্যাটা একটা ঘুমের পিল, কিঞ্চিৎ অশ্লীলও। মেয়েদের নিয়ে উনার যত আগ্রহ! মুবিন হেঁটে চলল যেখানে দুচোখ যায়, পাতারা নাচে উল্লাসে আর ইচ্ছেরা ঘুড়ি উড়ায়। তার ইচ্ছে ঘুড়ি শেষ পর্যন্ত আটকাল ধর্মপুর রেলগেটে। দুহাত প্রসারিত করে রেললাইনের পাতের উপর কাকতাড়ুয়া হয়ে হাঁটছে সে। রেলগেটে সিগন্যাল পড়েছে। লাল সিগন্যাল। গেটম্যান রেলগেইট বন্ধ করে দিয়েছেন। মুবিন ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। শব্দ হচ্ছে। ট্রেন আসছে। রেললাইন থেকে তার এখন সরে দাঁড়ানো উচিত। কিন্তু ইচ্ছেঘুড়ি যে এখানেই আটকে আছে!
.
ট্রেন স্টেশনে এসে পৌঁছুতেই স্টেশনে একটা হুলস্থূল পড়ে গেল। পিঁপড়ের মত চারিদিক থেকে মানুষ এসে জমতে লাগল। কুলিদের ডাক পড়ছে। বাবা- মায়েরা ট্রেনের দরজার বদলে জানালা দিয়ে ব্যাগপত্র আর নিজেদের পাঁচ থেকে দশ বছর বয়সী বাচ্চাদের ট্রেনের ভেতর ঠেলে দিচ্ছে। তারপর নিজেরা দরজার কাছের ভিড়ের মাঝে যুদ্ধ করছে। দীপা মুখ হাঁ করে প্ল্যাটফর্মের ব্যস্ততা গিলছিল। তার মনে হচ্ছিল ট্রেন নয়, গোটা প্ল্যাটফর্মই বোধহয় কোথাও যাবে। কাদিন দীপার হাত ধরল। হেঁচকা টানে দীপাকে নিজের সাথে টেনে নিয়ে গেল। ভিড় ঠেলে নির্দিষ্ট বগিতে, নির্দিষ্ট কেবিনে পৌঁছে দিলো নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে। কড়ি আগেই উঠে পড়েছে। অন্যরাও নিজের মত করে ফাঁকফোকড়ে উঠে গেল।
চলবে…