Friday, July 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 374



একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-৬৭+৬৮+৬৯

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্ব: ৬৭
খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও বরগুনার মাঝে ইমাদরা ঠিক করেছিল বাগেরহাটের মংলা দিয়ে সুন্দরবনে ঢুকবে। সে অনুযায়ী মংলা থেকে ২ রাত ৩দিনের শিপ বুকিং করা। যখন ওরা মংলা পৌঁছুলো তখন ভোর। মংলা বাসস্টপের কাছেই ফেরিঘাট। ফেরিঘাট থেকে ট্রলারে করে খানিক দূরে নোঙর করা শিপে পৌঁছে যে যার রুম বুঝে নিলো। রানা ট্যুর ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে আছে। সে নিলয় আর ইমাদকে ডাবলবেড উইদ বাঙ্কার এ্যাকোমোডেশনের একটা রুম দিয়ে বলল, “তোমরা হলে পার্ফেক্ট ফ্যামিলি৷ মাম্মি, ড্যাডি আর খোকা। তাই তোমাদের বাঙ্কার সহ ঘরটা দিলাম।”
নিলয় পুরো ঘেউ ঘেউ করে উঠল, “কি বললেন রানা ভাই? বাসে আমাদের কি কথা হয়েছিল? ওই বিচ্ছুর সাথে রুম শেয়ার যেন করতে না হয় সেজন্যই তো আমি সিটটা ছাড়লাম।”
“উপায় নেই৷ হুট করে এক্সট্রা কেবিন বুক করা যায় না। সব ফুল। আমরা কেবল আমাদের সংখ্যা গুনে ডাবল বেড এর কয়েকটা কেবিন নিয়েছিলাম। তাও ভাগ্য ভালো এই একটা কেবিনে বাঙ্কার পেয়েছি। তোমরা বেড এ থাকবে, বিচ্ছুটাকে বাঙ্কারে উঠিয়ে দিবে।” রানা বুঝালো।
নিলয় হাত নেড়ে বলল, “এতকিছু বুঝি না ভাই। আমাকে আর ইমাদকে অন্য কেবিন দিন। আপনার রুমমেট। আপনি থাকুন।”
মুবিন কাছেই দাঁড়িয়েছিল। রানা এবং নিলয়ের মধ্যকার এই সূক্ষ ঝামেলায় সে ভয়াবহ খুশি। দুজনেই ওর বর্তমান শত্রু। শত্রুরা নিজেরা নিজেরা কুরুযুদ্ধে নামলে তা তা থৈ থৈ তা তা থৈ থৈ। মুবিন পরিস্থিতির খুব মজা নিয়ে বলল, “চাবি দিন। আমি আমার বাঙ্কারে যাই। আপনারা বসে জুয়া খেলুন। যে হারবে চলে আসুন।”
মুবিন ঠোঁট উল্টে হাসছিল হালকা। নিলয় বলল, “ইমাদ তোর খোকাকে সামলা।”
মুবিন চটে গেল, “না সামলালে কি করবেন?”
নিলয় দিলো ধমক, “এখানেই ফেলে যাব।”
মুবিন লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এল,
“আপনি কি জানেন? আপনাকে তুলে শিপ থেকে ফেলে দিতে পারি?”
নিলয় মুবিনের দিকে তাকাল। ইয়া লম্বা, তাগড়া, স্বাস্থ্যবান মুবিনকে দেখে নিলয়ের মনে হলো তার সামনে বাদামী টিশার্ট, সাদা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরা মনুষ্যরূপী একটা ষাঁড় দাঁড়িয়ে আছে। সে একবার মিজের দিকেও তাকাল। মা ঠিক বলে, আসলেই ওর আরো খাওয়া দাওয়া করা দরকার৷ কত শুকিয়ে গেছে! এই ষাঁড়টা যদি সত্যি তাকে তুলে ফেলে দেয়? এজন্যই মায়ের কথা কানে তুলতে হয়।
সাঁতার সে জানে, শিপও এখনও ছাড়েনি, পানিও এখানে অতটা গভীরে নয়। কিন্তু, সে না ডুবলেও, পুচকে একটা ছেলে তাকে কোলে তুলে নদীতে ফেললে মান সম্মান তো ডুববেই। নিলয়কে ফ্রিজ হয়ে যেতে দেখে, মুবিনের গরম রক্ত ঠান্ডা হলো৷ সে শিষ বাজাতে বাজাতে রানার হাত থেকে খাবলা দিয়ে চাবি নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। দুতলার রুম। জানালা দিয়ে বাইরের নদী আর জঙ্গল দেখা যাবে। বাহ্ দারুণ তো। খানিক বাদে ইমাদ, নিমরাজি রানাকে সাথে নিয়ে ঘরে ঢুকল। নিলয় শেষ পর্যন্ত এই কেবিনে থাকতে রাজি হয়নি। রানাকে অগত্যা বাধ্য হয়ে আসতেই হলো। মুবিন বাঙ্কারে পা ঝুলিয়ে বাবলগাম চিবুচ্ছিল। রানাকে দেখে ভ্রু উঁচিয়ে টিটকারি মারল, “হ্যালো, মাম্মি। ওয়েলকাম টু আওয়ার হ্যাপি ফ্যামিলি।”
রানা টগবগ করে উঠল, “চুপ করো তো, মুবিন৷ বাজে কথা বলবে না।”
“আপনিই তো বাইরে এটাকে আমার ফ্যামিলি কেবিন বলেছিলেন। এখন আমি আপনার খোকা।”
রানা ফুঁসতে ফুঁসতে ইমাদের দিকে তাকাল, “ইমাদ, এসব বলতে তুই ওকে না করবি কিনা বলতো আমাকে?”
ইমাদ কিছু বলার আগেই মুবিন ঝম্প মেরে বাঙ্কার থেকে শীপের ফ্লোরে নামল, “মাম্মি, প্লিজ ড্যাডির সাথে ঝগড়া করো না। আমরা সুন্দর একটা ট্যুরে এসেছি। ড্যাডির কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করে ড্যাডিকে জ্বালাবে না।”
রানা বাকহারা! রাগে ওর কান দিয়ে ধোয়া বেরুচ্ছে। ইমাদ নির্বিকার। সে ব্যাগ থেকে তোয়ালে বের করে কেবিনের ভেতর থাকা অ্যাটাচ্ড বাথে ঢুকল ফ্রেশ হতে। আর মুবিন আপাতত সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার৷
.
“এক কাপ চা পাওয়া যাবে?” কাদিন বলল মিষ্টি গলায়।
দীপা তাকাল ভ্রু কুঁচকে, হাতের বইটা বন্ধ করে, “তুমি এখনও এখানে কি করছ? সকাল হয়েছে বাসায় যাও। কাল রাতে এসেছ। আমি না করা সত্ত্বেও শাশুড়ি তার কলিজার টুকরা জামাতাকে রেখে দিয়েছেন। চা খেতে মন চাইলে শাশুড়িকে বলবে। নতুবা, নিজে করে খাবে। এই বাসায় আমি রান্না করি না। তোমার শাশুড়িরও বয়স হয়েছে বলে এখন রান্নাঘরে যান না। প্রেশার বেড়ে যায়৷ বুয়া যা রাঁধে তাই খাওয়া হয়। তুমি যদি ভেবে থাকো আমি তোমাকে রেঁধেবেড়ে খাওয়াব তাহলে তোমার ধারণা ভুল। এই বাসায় বাঁচতে হলে তোমাকে বেয়ার গ্রিলস হতে হবে। ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড।”
কাদিন বিপদে পড়ে বিড়বিড় করল, “ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড ওম্যান।”
দীপা খেকিয়ে উঠল, “কি বললে তুমি? কি বললে?”
কাদিন বলল, “কিছু না। তেমন কিছু না।”
“না, কিছু একটা তো বলেছ। আমি শুনেছি।”
“কবুল বলেছি, কবুল। আলহামদুলিল্লাহ, কবুল।”
“আমার চোখের সামনে থেকে যাও।”
কাদিন সকালের নাস্তা না করেই অফিসে গেল। কপালে জুটল না সমান্য চাও। রাতে ঠিকঠাক ঘুমাতেও পারেনি। চোখে রাজ্যের ঘুম, পেটে ক্ষুধা আর স্মৃতিতে বিভৎস গতরাতে দীপার নৃশংসতা মনে করে অফিসের এক্সিকিউটিভ চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিলো। ঠিকই বলে সবাই, নারী নিষ্ঠুর, নির্মম, নির্দয়। বিশেষ করে দীপার মত সহজ, সরল কোমলমতী নারীরা। গতরাতে দীপা অমন একটা কাজ করতে পারল! সত্যিই দীপা করল! কীভাবে করল? এত বড় শাস্তি তার! সে ফিরে গিয়ে বলেছিল, “তুমি এখান থেকে না গেলে, আমিও যাচ্ছি না।”
দীপা জবাবে বলল, “ভেবে বলছ?”
“আমি এক কথার মানুষ।”
“আমি যদি সারাজীবন এখানে থাকি তুমিও থাকবে?”
“তুমি সারাজীবন এখানে থাকবে না।”
“থাকব।”
“পারবে না।”
“পারব।”
“তোমার মন পুড়বে, তুমিও গলবে।”
“কক্ষনো না।”
“কেন?”
“কারণ তুমি এমন কাউকে ডিজার্ভ করো যে তোমার মতই ম্যাচিউর, পার্ফেক্ট, অ্যাস্থেটিক।”
“আর তুমি কেমন মানুষ ডিজার্ভ করো?”
দীপা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “আমি এমন একজনকে ডিজার্ভ করি যে আমাকে আমার মতন করে মেনে নিবে। আমাকে বদলাতে চাইবে না। প্রেশারাইজ করবে না। নিঃশ্বাস নিতে দিবে। যার কাছে আমার দমবন্ধ লাগবে না।”
“তোমার ভালোর জন্য তোমাকে বদলাতে চেয়ে যদি আমার অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে আমাকে মাফ করে দাও।”
“তুমি তোমার স্ট্যান্ডার্ডের জন্য আমাকে বদলাতে চেয়েছ। আমার ভালোর জন্য নয়।”
“মেনে নিলাম।”
“তোমার মানা না মানা দিয়ে কিছু যায় আসে না।”
“কিসে যায় আসে বলো। সেটাই করব।”
“তুমি চলে যাও।”
“ঘুমাব দীপা। দু চোখ ভেঙে আসছে।” কাদিন ক্লান্ত।
দীপা বিতর্কে উপসংহার ছাড়া ইতি টানল। বিছানার সামনে থেকে সরে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। জনমানবশূন্য সুনসান রাস্তা। কাকপক্ষীও নেই, খালি দাঁড়িয়ে আছে হলুদ আলো মাথা নিয়ে ল্যাম্পপোস্ট৷ কাদিনও কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বলল, “একটা বিছানার চাদর দিবে?”
“বিছানায় চাদর দেয়াই আছে।”
“এটা তুলব।”
“এটা তোলা হবে না। থাকতে হলে এভাবেই থাকো।”
কাদিন শুলো ঠিকই কিন্তু সারারাত দু চোখের পাতা এক করতে পারল না। বিছানায় নতুন, ফ্রেশ চাদর না বিছিয়ে নতুন কোথাও গিয়ে সে ঘুমোতে পারে না। দীপা জানে৷ তবু করল এমন? সারারাত ছটফট করে সকালে উঠে নাশতাও করতে পারল না। কাদিন বাইরের কিংবা অন্যকারোর রান্না খেতে পারে না। দীপা জানে। তবু অভুক্ত রাখল! আহ্ নিষ্ঠুর প্রিয়া।
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্ব: ৬৮
অফিস থেকে ফিরেই কাদিন বাসায় চিৎকার চেঁচামেচি শুনলো। শু খুলে শো র্যাকে জুতা রাখতে রাখতে ক্রুদ্ধ মেহেদীর তীব্র বাক্যবাণগুলো সে খুব ভালো করে খেয়াল করল। তারপর এগিয়ে গেল দীপার ঘরের দিকে। ঘরে গিয়ে বুঝল ঘটনা কি। ঘটনা দীপা মেহেদীর হেডফোন এনেছিল। সেটা ভেঙে ফেলেছে। মেহেদীর ভাষ্যমতে এই হেডফোন সে তার বন্ধুর বড় ভাইকে দিয়ে দেশের বাইরে থেকে আনিয়েছিল। কাদিন যে কথাগুলো শুনলো সেগুলো অনেকটা এরকম “যত্ন করে রাখতে না জানলে অন্যের জিনিস তুই ধরিস কেন?”
“স্যরি। আমি তোকে আরেকটা এনে দিব।”
“সেটা তো তোকে অবশ্যই কিনে দিতে হবে৷ তবে নেকস্টটাইম আর কখনো আমার কোনো জিনিসে হাত দিবিনা।”
“আমি কি জানি এটা ভেঙে যাবে?”
“তুই জানিসটা কি? তোর হাতে পরলে কোনো জিনিস থাকেনা। এর আগেও তুই নানা ঝামেলা বাধিয়েছিস। তোর মাথায় ঘিলু নেই কোনো?”
দীপা করুণ মুখ করে মেহেদীর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে গেল। মেহেদী বিরক্ত হয়ে দীপার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “দূর হো। তুই একটা সমস্যা।”
কাদিন এই পর্যায়ে দরজায় দাঁড়িয়েই গমগম করে উঠল, “হোয়াট ইজ দিস, মেহেদী? আমি তো তোমাকে অন্যরকম ভাবতাম।”
মেহেদী বলল, “স্যরি ভাইয়া আপনি এসেছেন খেয়াল করিনি। আসুন ভেতরে এসে রেস্ট নিন।”
কাদিন ঘরের ভেতর গেল। মেহেদী বের হয়ে চলে আসছিল৷ কাদিন তাকে থামাল, “দাঁড়াও মেহেদি। সামান্য একটা বিষয়ে তুমি তোমার বড় বোনের সাথে এভাবে কথা বলতে পারো না৷ তুমি যেসব কথা বলেছ তার জন্য তোমার এখনই উচিত তোমার আপুকে স্যরি বলা।”
“এটাই প্রথমবার না, আপু এর আগেও আমার কত কত শখের ডিভাইস নষ্ট করেছে।”
“ডিভাইসের সাথে সাথে তুমিও নষ্ট হচ্ছ নাকি?”
“শী শ্যুড বি মোউর রেসপন্সিবল।”
“এন্ড ইউ শ্যুড রেসপেক্ট হার।” কাদিন পুরো ঘর কাঁপিয়ে ধমক দিলো মেহেদীকে।
দীপা বলল, “ওকে বকতে হবে না৷ ও নতুন না, একাও না। জগতের সবাই আমার সাথে এভাবেই কথা বলে। ইন্ক্লুডিং ইউ।”
মেহেদী আর কাদিন দুজনেই যেন বিদ্যুৎপৃষ্ট হলো। মেহেদীর ভাই সত্ত্বা কোথাও হতে বলে উঠল, “আমার বোনের সাথে এভাবে কথা বলে কাদিন ভাইয়া! ইটস আ মেন্টাল টর্চার।”
কাদিনের স্বামীর সত্ত্বা তো আগেই লড়ছিল দীপার ভাইয়ের সাথে। জগতে আমরা কেবল অন্যের ভুল ধরি৷ ঘরজুড়ে পিনপতন নীরবতা। বাজ পরা মুহূর্তটা কেটে উঠতেই মেহেদী মাথা নীচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
.
পশুর নদীর জলে সাঁতার কেটে শিপ এগুচ্ছে সুন্দরবনের দিকে। কিছুক্ষণের মাঝে চারিদিকে সবুজের ছোঁয়া লাগল। আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল অরণ্যের সবুজ গাছ গাছালি। সুন্দরবন সবুজ আর পশু, পাখির প্রাকৃতিক প্রাসাদ। এখানে সিংহ রাজা নয়৷ রাজা ডোরাকাটা হলুদ রাজকীয় পোশাক পরিহিত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। এখানে রহস্য, রোমাঞ্চ, অপার সৌন্দর্য্য যেমন আছে, তেমনি আছে ভয়, অশনি সংকেত, হুমকি,হিংস্রতা। প্রাকৃতিক সবুজ প্রাসাদের সর্বত্র বিচরণ জনসাধারণের জন্য নয়। জনসাধারণ কেবল বনবিভাগ থেকে অনুপ্রাপ্ত গুটি কয়েক অংশে পা রাখতে পারবে। হাড়বাড়িয়া, করমজল, দুবলারচর, কচিখালি, কটকা, হিরণস্পট এই কয়টি স্থান ছাড়া প্রাসাদের বাকি অংশ বিপজ্জনক এবং নিষিদ্ধ। ঘণ্টা দুয়েক চলার পর শিপটি ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রে নোঙর করল। ইমাদ জাহাজ থেকে নামার আগে মুবিন নেমেছে কিনা চোখ বুলিয়ে নিলো। শিপ ছাড়ার পর থেকে আর কেবিনে বসেনি। পুরো শিপ জুড়ে টৈ টৈ করেছে। ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রে সবাইকে ট্যুর গাইড স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিলো কোন স্পটে কতক্ষণ থাকবে, কোথায় কি করবে, কি করা যাবে, কি করা যাবে না। মুবিন খুব মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছিল। কিন্তু ইমাদ সহ বাকি সবাই সুনিশ্চিত ট্যুর গাইড এখানে যা যা বলছে মুবিন ঠিক তার উল্টো কাজগুলোই করবে।
.
অভ্র! প্রতিদিন কলম নিয়ে আসতে ভুলে যাওয়া ছেলেটি, পদার্থবিজ্ঞানের প্রাইভেটে কিচ্ছু না বুঝা ছেলেটি, প্রাইভেট শুরু হওয়ার এক ঘণ্টা আগে এসে, ছাদের কোণে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল চালাতে থাকা ছেলেটি ঝা করে মডেল টেস্টে ফার্স্ট হয়ে গেল। রেজাল্ট শুনে মিলার মাথা ভনভন করে উঠল। এটা কীভাবে সম্ভব? সে তার হা হয়ে যাওয়া মুখ কিছুতেই বন্ধ করতে পারছিল না৷ সে অনেকক্ষণ নীচু হয়ে বেঞ্চে মাথা দিয়ে রাখল। বিড়বিড় করে বারবার নিজের মনে আওড়াতে লাগল, অভ্র ফার্স্ট! আমি সেকেন্ড! সেদিন ফিজিক্স টিচার কি পরাল মিলা কিছু বুঝল না। কিছু শুনল না৷ কোনোমতেই, মনোযোগ ধরে রাখতে পারল না। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাতে লাগল৷ কখন সময় শেষ হবে? কখন ছুটি হবে? শেষ পর্যন্ত ছুটি হলো। মিলা একটা ঘোরের মধ্য দিয়েই বেরুচ্ছিল। গেটের সামনে অভ্র দাঁড়িয়ে৷ মিলাকে দেখে এগিয়ে এল, “রোদমিলা, থ্যাঙ্ক ইউ। কতগুলো টপিক আমি তোমার কাছ থেকে বুঝেছি। স্যারের চাইতে আমি তোমার কাছে ভালো বুঝি। তুমি বড় হয়ে টিচার হবে।”
মিলা ফ্যাকাসে চেহারা নিয়ে বলল, “মাই প্লেজার।”
অভ্র বলল, “কংগ্রেচুলেশন্স তোমাকেও।”
মিলা যন্ত্রের মত বলল, “হুম থ্যাঙ্কস। আমি যাই।”
অভ্র আবার পিছু বলল, “আমাকে তাড়িতচুম্বকের অংক গুলো একদিন বুঝিয়ে দিবে?”
মিলা ছোট করে বলল, “দেখি।”
তারপর খুব তাড়াহুড়া করে একটা রিকশা ডেকে চলে গেল। সারাদিন সে এই ভেবে বিরক্ত হয়ে রইল যে, এটা কীভাবে হলো! এটা কি হলো!
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্ব: ৬৯
সুন্দরবনে প্রথম যে স্পটে ওরা নামল সেটা হলো হাড়বাড়িয়া। সবাইকে বনের ভেতর যেতে হবে একটা কাঠের ট্রেলের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে। গাছের ফাঁকফোঁকর দিয়ে সূর্যের তীর্যক রশ্মি এসে ট্রেলের উপর পড়ছে। যেন সোনালি গালিচার আস্তরণ। দলবেঁধে সূর্যের আলোর পথে ট্রেলে নেমে পড়ল সবাই। ভয়ঙ্কর সুন্দর এই সবুজের অরণ্যে যত হারিয়ে যেতে থাকল তত ম্যানগ্রোভ গাছের শ্বাসমূল, গোলপাতা, জঙ্গলজুড়ে থাকা বিচিত্র গাছপালার আধিপত্য দেখা গেল। চোখ জুড়িয়ে যায়। এখানে একটা পদ্মপুকুর আছে। পুকুরের একপাশ দিয়ে ঘুরে আরেক পাশ দিয়ে বের হয়ে আসতে হয়। মুবিন মনে মনে ঠিক করল রানা কিংবা নিলয় দুজনের একজনকে সে এই পুকুরে ফেলবে। যাকে সুবিধা করতে পারবে তাকেই। ইমাদ চারিদিক দেখতে দেখতে ধীরে সুস্থে এগুচ্ছিল। সাথে নিলয়। বাকিরা সবাই দলবেঁধে আছে। আর মুবিন দৌড়োচ্ছে সবার আগে আগে। সে চারিদিকে দৃষ্টি ছুড়ে ছুড়ে কেবল পশুপাখি আর প্রাণের উৎস খুঁজছে। একটু পর পর বিভিন্ন পাখি ডেকে উঠলে মুবিনও শিষ বাজায়, পাখিদের পাল্টা জবাব দেয়। কিন্তু ট্রেলের উপর দিয়ে হেঁটে ওর ঠিক পোষাচ্ছিল না। ওর মন চাইছে ট্রেল থেকে লাফিয়ে নেমে সোজা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটতে। ইমাদ ব্যাপারটা দূর থেকে দেখেই বুঝতে পারল। কিঞ্চিৎ দুশ্চিন্তা থেকে দ্রুত বড় বড় পা ফেলে সবাইকে কাটিয়ে সে মুবিনের পাশাপাশি হাঁটতে লাগল সে। মুবিন তাকাল ভ্রু কুঁচকে। ইমাদ তাকাল না। মাঝে মাঝে পশুপাখিরও দেখা মিলছে। সামনে একটা ওয়াচ টাউয়ারটার। ওয়াচ টাউয়ার থেকে পুরো হাড়বাড়িয়া দেখা যাবে এক পলকে। ওয়াচ টাউয়ারের সিঁড়ি বেয়ে উপর উঠে বেশিরভাগ মানুষ ব্যাকগ্রাউন্ডে হাড়বাড়িয়ার অপার সৌন্দর্য নিয়ে ছবি তোলার প্রলোভন প্রতিহত করতে পারল না। ওরা ছবি তুলতে লাগল। মুহূর্তেই শান্ত পরিবেশটা গমগম করে উঠল। কোনো কোনো প্রেমিকযুগল ওয়াচ টাউয়ারের দেয়ালে নিজেদের নাম লিখে গেছে। নিলয় ইমাদের পেটে কনুই দিয়ে খোঁচা মেরে বলল, “লিখবি নাকি তুইও? কড়ি+ ইমাদ।”
কড়ির সাথে একটু কথা বলার তেষ্টাটা নিলয় যেন আরো বাড়িয়ে দিলো। ইমাদ একটু সাইডে গিয়ে মোবাইল হাতে নিলো। নাহ নেটওয়ার্কের অবস্থা ভয়াবহ খারাপ। ঠিক মত কল’ই যাবে না। আর কল গেলেও কড়ি যে কল রিসিভ করবে, কথা বলবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই। ওদিকে সুযোগ পেয়ে মুবিন নিলয়কে প্রায় ল্যাং মেরে ফেলেই দিচ্ছিল। নিলয় পড়ে যেতে যেতে কোনোমতে রেলিং ধরে ঝুলে থাকল। সবাই নিলয়ের চিৎকার শুনে দৌড়ে গেল। মুবিন এত ভয়ানক! এত ভয়ঙ্কর! টেনে তুলল ওরা নিলয়কে৷ সবাই মিলে চেপে ধরল মুবিনকে, “এটা তুমি কি করলে?”
মুবিন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “আমি কি করলাম?”
“তুমি নিলয়কে ল্যাং মারলে?”
“না, উনি ঐ দড়িতে পা বেজে পড়লেন।” মুবিন মাটিতে গড়িয়ে পড়ে থাকা একটা দড়ির দেখিয়ে হামি তুলল। কারো কিছু বলার আছে এখানে? কি’বা বলা যেতে পারে এই বিচ্ছুটাকে? কিছুই না।
.
হাড়বাড়িয়া ঘুরা শেষ করে শিপে ফেরত চলে এল সবাই। জঙ্গলঘেরা নদীর উপর দিয়ে চলতে চলতে শিপের খোলা ছাদের ডাইনিংয়ে বসে দুপুরের খাওয়া দাওয়া হলো। পরবর্তী গন্তব্য সুন্দরবনের আরেক রূপ কটকায়। শিপ চলছে নিরন্তর গতিতে মহা সমারোহে। কেউ কেউ খাওয়া দাওয়া শেষে খানিক বিশ্রাম নেবার অভ্যাসে চলে গেল নিজ নিজ কেবিনে। রানাও উঠে কেবিনের দিকে যাচ্ছিল।
ইমাদ ডাকল, “ঘুমোবেন?”
রানা কুঁড়ি মুড়ি দিয়ে বলল, “শিপে ঘুমাতে কেমন লাগে দেখতে চাই।”
“এখন থাকেন রানা ভাই। রাতে শিপেই ঘুমাতে হবে।”
“রাতে ঘুমানোর চিন্তা থাকলে মাথা থেকে সরাও। রাতে জম্পেশ আড্ডা হবে। ঘুমাতে দিব না একটি প্রাণীকেও।”
ইমাদ মাথা নাড়ল, “আচ্ছা।”
অনেকেই ইমাদের মত পড়ন্ত বিকেল উপভোগের প্রলোভনে বসে রইল শিপের ডেকে। এক কাপ চা হাতে সুন্দরবনের নদী আর বনের সূর্যাস্ত দেখে ভুলে গেল জীবনের যান্ত্রিকতা, মন ভাঙার গল্প, বুকপকেটে থাকা অতীত এবং দূরের ভবিষ্যৎ। নদী যেন কথা বলে।
মুবিনের একটু পর পর ক্ষুধা লাগে। তার ব্যাগভর্তি নানান ড্রাইফুড। সে খায় আর পুরো শিপ মুখস্থ করছে। কোথায় কি আছে, কে কি করছে সে সব জানে। এমনকি সে এক ফাঁকে শিপের রান্নাঘর থেকেও ঘুরে চলে এসেছে। এই শিপ নিয়ে তাকে যেকোনো পরীক্ষা নিতে এলে প্রশ্নকর্তা নিজে হয়রান হয়ে যাবে। বিকেল ঢেকে সন্ধ্যা যখন ঘোমটা তুলতে লাগল মুবিন ঝপাৎ করে সুইমিংপুলে লাফ দিলো। চিত সাঁতার, প্রজাপতি সাঁতার, বুক সাঁতার কাটল ইচ্ছেমত। চোখের পাতা বন্ধ, কানে কি নৈসর্গিক শব্দ। আহা জীবন। আহা জল। মুবিন প্রশান্তি খুঁজে বেড়ায়। এই ঠান্ডা জলে, নীল গগণে, সবুজ বনে, এখানে ওখানে। কোথায় শান্তি? কোথায় একটু শান্তি?
অনেকক্ষণ পর সুইমিংপুল থেকে উঠে এসে চুপচাপ ভেজা কাপড়েই বসে ছিল ও। তারপর এক কাপ চা খেল। এখানে যখন ইচ্ছা যত ইচ্ছা, তত চা খাওয়া যায়। ও যদি চা-খোর হতো ভালোই হতো। লোকে বলে চায়ের নেশা বড় নেশা। যারা নেশা করে, ওরা যতক্ষণ না নেশা করতে পারে ততক্ষণ পাগলের মত করতে থাকে। নেশা করার পর ওরা শান্তি পায়। শান্তি! নেশা করলে যদি একটু শান্তি পাওয়া যায়। মুবিন রাতের দিকে কেমন ঢুলছিল। ইমাদ অনেকভেবে চিন্তে এগিয়ে গেল। মুবিনের কাঁধে হাত রাখল, “কি হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন?”
মুবিন এক ঝটকায় কাঁধ থেকে হাতটা সরিয়ে দিলো। ওর চোখ ঢুলুঢুলু।
চলবে…

একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-৬৪+৬৫+৬৬

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী
পর্ব: ৬৪
ইমাদ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল কিছু না বলে। মুবিন উঠে চলে যাচ্ছিল। ইমাদ ডেকে বলল, “থ্যাঙ্কস, মুবিন।”
মুবিন কপাল কুঁচকে বলল, “কিসের?”
ইমাদ আর উত্তর দিলো না। মুবিন যেখানে বসেছিল ও গিয়ে সেখানে বসল। অন্যদিকে মুখ করে তাকিয়ে রইল চুপচাপ, নির্লিপ্তভাবে। একটা দুইটা কাক কা কা করছে। দুপুরের রোদ প্রকট। মুবিন শিষ বাজাতে বাজাতে চলে গেল নিজের কাজে। এরপর খাওয়া দাওয়া করে ইচ্ছামত টৈ টৈ করল। বিকেলে মেসের গেটে ঢুকতে গিয়ে চোখ পড়ল ছাদে। তার ভ্রু উঁচু হয়ে গেল। স্যার এখনও ছাদে! নামেননি! কাঁধ ঝাঁকাল মনের অজান্তেই। তাতে তার কি? সন্ধ্যার দিকে বেশ শোরগোল শোনা গেল। বের হয়ে দেখল স্যারের বন্ধু নিলয় স্যারকে ছাদে দাঁড়িয়ে কিছু বুঝানোর চেষ্টা করছেন। মুবিনের কেন যেন মনে হলো কিছু একটা হয়েছে। আর সেটা তার বলা তখনকার কথাগুলোর জন্য কিনা তা শোনার প্রয়োজনবোধ করল। আড়ি পেতে কথা সে কোনোকালেই শুনে না। এবারেও শুনবে না। সে ছাদে উঠে ছাদের পিলারে হেলান দিয়ে ওদের সামনেই দাঁড়িয়েই শুনতে লাগল, “যা হয়েছে হয়েছে। কতক্ষণ বসে থাকবি এখানে?”
ইমাদ বলল, “এখানে আমার ভালো লাগছে।”
“না তোর লাগছে না।”
এর মাঝে ইমাদ মুবিনকে দেখে নিজের স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে ধমকে উঠল, “তুমি এখানে কি করছ?”
মুবিন বলল, “মেসে তো আপনাদের চিৎকার চেঁচামেচির জন্য থাকাই যাচ্ছে না।”
ইমাদ বলল, “তাহলে বাড়ি যাও।”
“সেটা আপনাকে বলে দিতে হবে?” মুবিন ক্ষেপে গেল।
নিলয় বলল, “প্লিজ থামো। ওকে এখন বিরক্ত করো না, মুবিন। আজকে ওর ব্রেকআপ হয়েছে।”
ইমাদ বলল, “ব্রেকআপ হয়নি, আমি করেছি।”
মুবিন বলল, “আমি বিরক্ত করছি না, আপনারা মেসের সবাইকে বিরক্ত করছেন।”
মুবিন চলে গেল গটগট করে, ইমাদও নামল বিরক্তির একটা ভাব নিয়ে। কেবল নিলয় ভাবতে লাগল, “ইমাদ এসব কি করছে? কেন করছে? আর তাকেই’বা এসব বলতে শেখাচ্ছে কেন? আর এসবে কড়ি কেমন করে চলে এল? ও না এত বড় শর্ত দিয়ে রাখল ইমাদকে। ঐ মেয়েই তো বলল, প্রেম করতে গয়না লাগবে, গয়না। এখন গয়না ছাড়া ওদের ব্রেকআপ কীভাবে হলো? প্রেম এল কোথা থেকে? নিলয় মাথা চুলকাতে লাগল।
.
দীপা ঘুমাচ্ছিল। কাদিন দীপার পায়ের কাছে বিছানায় বসে দীপাকে দেখছিল। হঠাৎ দীপার পা জোড়া নিজের কোলে টেনে নিলো। দীপা পায়ে একটা আংটি পরে। আংটিটা সুন্দর। কাদিন আংটিটা একবার খুলল তারপর আবার পরিয়ে দিলো। আবাট খুলল, আবসর পরালো। এমন করতেই থাকল। দীপার ঘুমটা ছুটে গেল। সে চোখ কচলে তাকিয়ে দেখল কাদিন এখনও যায়নি। ওকে না বিদায় হতে বলল এখান থেকে? দীপা বলল, “আমার কথার কি কোনে মূল্য নেই, কাদিন? তুমি কি কখনই আমার কথাকে গুরুত্ব দেবে না?”
“দিব তো।”
“তাহলে যাও এখান থেকে।”
“চলে যাব।” বলেও কাদিন আরো বসে রইল। দীপা বলল, “আমার তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে না।”
“বাতি নিভিয়ে দিব?”
দীপা বলল, “আমাকে রাগাবে না, কাদিন।”
কাদিন বলল, “তোমার পায়ে এত ময়লা কেন?”
দীপা অনেকক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল কাদিনের দিকে। তারপর দুঃখে কষ্টে, রাগে পা সরিয়ে নিয়ে বলল, “যে মেয়েদের পা সুন্দর তাদের পায়ে গিয়ে চুমু খাও।”
কাদিন নাকি সুর করে বলল, “ছিইইই।”
দীপা বলল, “নাটক করবে না। যাও তুমি।”
কাদিন উঠল। বাতি নিভিয়ে, দরজা টেনে দিয়ে বলল, “যাই।”
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্ব: ৬৫
দিন ধূসর। চারিদিকে মেঘজমা বৃষ্টি উপচে পড়ছে। একটু পর পর মেঘের গুড়গুড় শব্দ। মাত্র বাজ পরল কোথাও। বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে মসজিদ অন্ধকার হয়ে গেল নিমিষেই। কুরআন শিখতে আসা শিশুদের কিচিরমিচির শুরু হয়ে গেল। বাইরের আলো বৃষ্টিতে ধুয়ে মুছে গেছে যেন। অন্ধকারে ইমাম সাহেব সবাইকে চুপচাপ বসিয়ে রেখেছিলেন। ঠিক তখনই সুযোগ বুঝে মুবিন তার প্রধান শত্রুকে ঘায়েল করল। আজকাল ইমাদ স্যার’ই সব নয়। ইমাদ স্যারকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে মুবিনের প্রধান শত্রু হিসেবে জয়ী মেসের উল্টাপাশে থাকা বেটে ভুড়িওয়াল ভদ্রলোক। তিনি এলাকায় নতুন। মুখোমুখি দালানে পরিবার সমেত থাকেন। ভুড়ি আর মাথার টাক ছাড়া দুটো মেয়ে এবং একটি স্ত্রীও আছে। মুবিনের সাথে এই লোকের যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল ঠিক তখন যখন মুবিনের বল ঐ মেয়ে দুটোর ঘরের জানালা দিয়ে গিয়ে ওদের বিছানায় পড়েছিল। কেন মুবিনের বল ওদের ঘরেই যাবে? ভুঁড়িওয়ালা রেগেমেগে বলল, “মেয়ে মানুষের জানালা দেখলেই আর হুঁশ থাকেনা এইসব ছেলেদের।”
মুবিনেরও তো ধৈর্য্য নেই। উত্তরে বলেছিল, “বড়লোকের ছেলে দেখলে এইসব মেয়েদের বাপেদেরও আর হুঁশ থাকে না।” ব্যাস! তারপর তো ধুন্ধুমার। ভদ্রলোক চড় মেরে বসেছিল মুবিনকে। মুবিন কোনোদিক দিয়েই ভদ্র ছেলে নয়৷ সেও কলার চেপে ধরে লোকটাকে শাসিয়েছিল, “এখানে আর আপনার থাকা হচ্ছে না। শান্তিতে বাঁচতে চাইলে মেয়েদের নিয়ে এলাকা ছাড়ুন।”
ভদ্রলোক স্তম্ভিত হয়ে চেয়েছিল শুধু৷ এইটুকু একটা ছেলে কি তার ব্যবহার, কি তার দৌরাত্ম্য। ভদ্রলোকের বড় মেয়েটি মুবিনদের বয়সী হলেও ছোট মেয়েটি বেশ ছোট। টু, থ্রীতে পড়ে হয়তো। প্রতিদিন ভোরে কাছের মসজিদে আমপারা নিয়ে পড়তে যায়। মুবিন ওঁত পেতে থাকে। অনেক অনেক ভোরের ঘুম বলি দিয়ে প্রতিদিন মসজিদে ঘাপটি মেরে থাকার পর অবশেষে আজ সুযোগ এসেছে। মেয়েটা কিছু বুঝার আগেই মেয়েটার বাবা যেভাবে তাকে চড় মেরেছিল ঠিক সেভাবেই মেয়েটাকে আচমকা আধো আলো, আধো অন্ধকারে সে চড় মারল। মেয়েটা ভয়ে চিৎকার করে উঠল। ইমাম সাহেব কোনোভাবেই খুঁজে বের করতে পারলেন না চড়টা কে দিয়েছে। প্রচন্ড ভয়ে অন্য ছেলেমেয়েগুলো পুরো এলাকায় গল্প ফাঁদল। ওরা বলে বেড়ালো কোনো মানুষ না, এর পেছনে নিশ্চয়ই অন্য কিছু। সে রাতে মেয়েটার প্রচন্ড জ্বর উঠেছিল৷ খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল। মেয়েটা স্বাভাবিক হতে পারবে এই আশায় ভুড়িওয়ালা এবং তার পরিবার শেষ পর্যন্ত এলাকা ছাড়ল। ওদের আর এই এলাকায় দেখা যায়নি। তারপরও প্রতি ভোরে মুবিন নিয়ম করে মসজিদে গিয়ে এক কোণায় ঘাপটি মেরে বসে থাকতো। ভুড়িওয়ালার মেয়ে আসবে, তাকে আবার মারবে এ কারণে নয়। সে বসে থাকতো অযথা, অকারণে কিংবা, অভ্যাসে। প্রথমদিকে যারা আরবি পড়ে তাদের ছুটি পর্যন্ত এবং পরবর্তীতে যতক্ষণ বসে থাকা যায় ঠিক ততক্ষণ। তবুও আসেই। এসে আর কিচ্ছু নয়, বসে থাকে। আসার সময় কিছু না কিছু কিনে নিয়ে আসে। খায় আর তামাশা দেখে। একটা সময় এমন হলো মুবিন এই মসজিদে আসা নিয়মিত, অনিয়মিত সবাইকে চিনে। এখানে সবাই অসহায়। সবাই কাঁদে। ওর ভালো লাগে। ও একলা কেবল অসহায় না। পৃথিবীর সবাই অসহায়। ও অসুস্থ নয়, হিংসুটেও নয়, ও আসলে দুঃখী। একটা লোক আসত। প্রতিদিন। লোকটা হাউমাউ করে কাঁদত না। লোকটার কেবল চোখ ভিজে থাকতো। মুবিনের দেখতে ভালো লাগতো। কেন কাঁদত কে জানে? তারপর একদিন লোকটার কান্না বদলে গেল। সে এসে দু’হাত তুলে হাউমাউ করে কাঁদল। সেই প্রথম মুবিনের মনে হলো লোকটা কষ্টে কিংবা আল্লাহর কাছে কোনো কিছু চেয়ে কাঁদছে না। লোকটা কাঁদছে অতি আনন্দে। সে জানে না, লোকটার কি চাওয়া ছিল, লোকটা কি পেয়ে গেল। শুধু জানল, এইখানে কষ্টকান্নার সাথে সাথে আনন্দাশ্রুরও স্বাক্ষী হতে হয়। আরেকজন বৃদ্ধ এসে সরবে তার কোনো এক সময়ে করা বিরাট কোনো পাপের জন্য ক্ষমা চাইতে থাকত। লোকটা মারা গেল মসজিদেই। সেই প্রথম মুবিন কাউকে চোখের সামনে মরতে দেখল। নামাজে দাঁড়িয়ে হঠাৎ ঢলে পড়ল লোকটা। তারপর আর নেই। মুবিন ভয় পেল না। সে কোনোকিছুতে ভয় পায় না। সে কেবল মজা পায়। তারপর একদিন মসজিদ থেকে বেরুবার সময় দেখল ইমাদ স্যার মসজিদে ঢুকল। মুবিন যেন সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গেল। আবার ফিরে গেল ভেতরে। ইমাদ স্যার কি করে সে দেখবে। না স্যার কাঁদেননি, কেবল মনটা খুব খারাপ হয়ে ছিল তার। যাঁর চেহারায় কখনো কোনো রকম অনুভূতির প্রকাশ নেই তার চেহারায় এত কিসের মনখারাপি? কি সমস্যা স্যারের? স্যারের সমস্যা কড়ি নন তো?
.
জড়োসড়ো বিকেলে কড়ি বাবার ডাকে একদিনের জন্য কুমিল্লা এল। কড়ির সাথে কথা বলতে চান তিনি। কড়ি জানে কাদের সাহেব কি বলবেন। তবু কিছু বুঝিনা, জানি না ধরনের একটা মুখ বানিয়ে কড়ি ঢাকা থেকে বাসায় চলে এল। দুপুরের রাজভোজ, সন্ধ্যার টক, ঝাল, মিষ্টি নাশতা এবং রাতের শাহী খানাপিনা শেষে কড়ি অপেক্ষা করছিল বাবার জন্য। বাবা কখন ডাকবেন, কখন কথা বলবেন আর কখন সে তার সিদ্ধান্ত জানাবে। ডাক এল না। কাদের সাহেব ঘুমিয়ে পড়লেন। কড়ি রিমার ঘরে গিয়ে বসল আলাপ চালাতে,
“রিমা আপু, মেজ ভাইয়া আর ভাবির মাঝে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“হয়েছে বোধহয়।”
“কিছু জানো?”
“কাদিন কিছু বুঝতে দেয়ার মানুষ?”
“তাহলে বুঝলে কীভাবে?”
“বুঝা যায়। তুই যেভাবে বুঝেছিস।”
“কথা বলেছ এ নিয়ে?”
“হ্যাঁ।”
“কি বলল?”
“থ্রি ম্যা কিপ আ সিক্রেট, ইফ টু অফ দ্যাম আর ড্যাড।”
কড়ি হেসে উঠে পড়ল। এজন্যই বোধহয় মেজ ভাইয়া রিমা আপুর ভক্ত। তবে তার এখানে ছোট একটা প্রশ্ন আছে। প্রশ্নের উত্তরটা পাওয়া যাবে মেজো ভাইয়ার কাছ থেকেই।
কাদিন শুয়ে পড়েছিল। এত রাতের কলিংবেল এর তিক্ত শব্দ হঠাৎ বড় মধুর হয়ে উঠল। কাদিন ফট করে এক লাফে উঠে পড়ল। দীপা এসেছে। গেল পরে ফিরিয়ে দিলো আর এখন নিজেই না থাকতে পেরে চলে এল।
ও মানুষটা আসলে খুব ভালো। চলে এলো তো। আর থাকতে পারল না। কিন্তু এই অসুস্থ শরীর নিয়ে একা না এলেও হতো। তাকে একটা কল করলেই সে গিয়ে নিয়ে আসত। দরজা খোলার আগে সে নিজের গায়ের টি-শার্টটা খুলল। তারপর খুলল আলমারি। আলমারি থেকে খুঁজে টুঁজে নতুন কেনা সাদা রঙের টি-শার্টটা পরে, পারফিউম স্প্রে করতে করতে দীপা তার দরজায় চলে এল। এইবার দরজায় কড়া নাড়ছে। কাদিন আরেকবার হাসল নিজে নিজেই। তারপর দরজা খুলে কাদিনের মুখ রক্তশূণ্য। কড়ি! তাহলে কলিংবেলটা কিসের?
কড়ি বলল, “আসব?”
কাদিন বলল, “এত রাতে কলিংবেল?”
“ভাড়াটিয়াদের মেহমান এসেছে। মেহমানদের সাথে আসা বাচ্চারা দুষ্টামি করছে।”
“ওহ।”
“ভেতরে আসি?”
কাদিন কড়ির গালে হাত রেখে হাসল, “ওয়েলকাম।”
কড়ি কাদিনের হাতটা ধরল। ভেতরে এসে বলল, “বসব না। মেজ ভাবি কোনদিন আসবে?”
“কিছু বলেনি।”
“কি হয়েছে?”
কাদিন মুহূর্তেই অন্য ভাষায় কথা বলে উঠল। যে ভাষায় আমি তাকে ভালোবাসিকে রূপান্তর করলে হয়,
“ও কিছু করেনি।”
কাদিন ঠিক এ কথাটাই বলল। কড়ি কয়েক সেকেন্ড এর জন্য স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কথাটা মেজ ভাইয়া বলল? কড়ি জানে না কি হয়েছে। তবে এটুকু বুঝে, যা কিছু হয়েছে তাতে ভুলটা দীপার, দোষটা কাদিনের। মাথা পেতে সকল দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়ে নেয়ার মত মানুষ কাদিন না৷ তবু নিলো। তার মানে বউকে ভালোবাসে। প্রেমটা কেবল নেই। কড়ি মুখ টিপে টিপে হাসল। কাদিন বলল, “বাবার সাথে কথা হয়েছে?”
“কোন বিষয়ে?”
“তারমানে হয়নি। বাবাই বলুক।”
“অফ টপিক। আমার একটা প্রশ্ন আছে।”
“কর।”
“রিমা আপুকে তুমি নিজের অনেক কিছুই বলো যা আর কাউকেই বলো না। কেন?”
“আপুর কাছে সব রহস্য রহস্যই।
“আপু ছাড়াও এ বাড়ির আরো অনেকেই রহস্যকে রহস্য রাখতে জানে।”
কাদিন স্মিত হাসল, “যেমন তুই।”
“তাহলে এবার আমকে বলো তোমাদের মাঝে কি হয়েছে।”
কাদিন বলল, “রহস্যকে রহস্য বলা যায় না।”
আচমকা কড়ির বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল, “মানে?”
“রহস্যের বই পড়ে রহস্য জানতে হয়। আর রহস্য লিখতে হয় গোপন ডায়েরীতে। রিমা আপু গোপন ডায়েরী। আর তুই রহস্যের বই।”
কড়ি কাদিনের দিকে তাকিয়ে রইল, “আর মেজ ভাবি?”
কাদিন গিয়ে বিছানায় বসল, “দীপা? দীপা সাদা কাগজ।”
কড়ি প্রশ্ন করল, “কেন?”
কাদিন গাঢ় গলায় বলল, “ভালোবেসে যা ইচ্ছে তাই লেখা যায়।”
“তুমি কি লিখেছ?”
“কবিতার মত কিছু একটা লিখেছিলাম। কিন্তু কাটাকুটি ছিল বলে মুচড়ে ফেলেছি।”
“এখন কি করবে?”
“হারিয়ে ফেলা সেই কাগজ খুঁজে বের করব। তারপর যত্ন করে রাখব।”
“বেস্ট অব লাক।”
.
এক উষ্ণ বিকেলে টেবিল চেয়ারে বসে পড়তে পড়তে মিলার ঝিমুনি এসে যাচ্ছিল। হঠাৎ হোস্টেলের খালা এসে ডাকলেন। তার সঙ্গে নাকি কেউ দেখা করতে এসেছেন। মা কিংবা সুহা ছাড়া আর কেউ ত কখনো আসেনা? কে এল? ওরা এত আসে যে চেনা জানা হয়ে গেছে। অনুমতির অপেক্ষা করতে হয় না। সোজা ভেতরেই চলে আসে। মিলা নিচে নেমে দেখল তার বাবার প্রেমিকা তার জন্য ফুল হাতে দাঁড়িয়ে। মিলা খানিকটা বিরক্ত হয়ে বাংলায় বিড়বিড় করে যা বলল সেসবের কিছুই মিশেল বুঝল না। সে ইংরেজিতে হেসে বলল, “কেমন আছো? তুমি কি আমার সাথে ইংরেজীতে কথা বলবে?”
মিলা ইংরেজীতে কঠোর গলায় জিজ্ঞেস করল, “আপনি এখানে কেন এসেছেন?”
“তোমার সাথে দেখা করতে।”
“কেন?”
“কারণ তুমি মঈনের মেয়ে। ফুলগুলো তোমার জন্য। প্লিজ নাও।” মিশেল ফুলগুলো বাড়িয়ে ধরল।
মিলা বলল, “স্যরি। আমার ফুল পছন্দ না।”
“ঠিক আছে। তাহলে নিতে হবে না। তোমার জন্য আমি একটা বিশেষ উপহার এনেছিলাম। কিন্তু দেওয়ার সুযোগ হয়নি।”
“কি এনেছেন?”
“মিস ডায়র পারফিউম।”
“আমার পারফিউম পছন্দ না।”
“তুমি কি আমার উপর রাগ করে আছো?”
“না।”
“তাহলে?”
“আমি আমার বাবার উপর রাগ করে আছি।”
“সে গাড়িতেই আছে। ডাকব?”
“প্লিজ না।”
মিলা ফুল, উপহার না নিয়েই চলে গেল উপরে। পড়ার বইটা খুলে বসে গেল পড়তে। মিলা চলে যাবার পরেও অনেকক্ষণ মিশেল দাঁড়িয়ে ছিল গেটের ভেতর। অনেক পরে সে গাড়িতে ফিরে এসে মঈনকে বলল, “আমি মুবিনের সাথেও দেখা করতে চাই।”
.
মুবিনকে মেসে নিজের ঘরে খুব কমই পাওয়া যায়। সারাদিন সে যে কোথায় থাকে কেউ জানে না। শুধু ভোরের দিকে কয়েক ঘন্টা মসজিদটায় তাকে বসে থাকতে দেখা যায়। মিশেল আর মঈন এসেছে বিকেলে। তাই মুবিনকে ওরা পায় নি। মুবিনের রুমমেট রানাকে মুবিনের বাবার পরিচয় দিতেই রানা মঈন আর মিশেলকে ঘরে এনে বসিয়েছে। মিশেল এত সুন্দর যে রানা মিশেলের দিকে হা করে তাকিয়েছিল। মুবিনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে রাত হলো। এর মাঝে মঈন বেশ কবার মুবিনকে কলও করেছিল। মুবিন প্রতিবারই কল কেটে দিয়েছে৷ সে যখন মেসে ফিরল তখন রাত আটটা নটা। সে বোঝেনি তার বাবা এখানে এসে তাকে কল দিয়েছে। ওঁদের দেখে দরজায় একটা লাথি মারল। তারপর উল্টা ঘুরে সোজা ইমাদের ঘরে চলে গেল। ইমাদ তার এক ছাত্রের পরীক্ষা নিবে বলে বিছানায় হেলান দিয়ে শোয়ে প্রশ্নপত্র তৈরি করছিল। মুবিনের দিকে একবার ঘাড় তুলে তাকাল। তারপর আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মুবিন ঘাড় শক্ত করে ঝাড়ি দিয়ে বলল, “ওদের বিদায় করেন।”
ইমাদ শীতল কণ্ঠে বলল, “আচ্ছা।”
“এখনও বসে রইলেন কেন?”
“আমি তোমাদের ব্যক্তিগত বিষয়ে কি করতে পারি?”
“কি করবেন সেটা আপনি জানেন।”
“আচ্ছা।”
তারপর উঠে গায়ে শার্ট চড়িয়ে ও ঘরে যাবে ঠিক তখনি মঈন আর মিশেল মুবিনকে খুঁজতে খুঁজতে এখানেই চলে এল। মঈন বলল, “এ কেমন ব্যবহার মুবিন? আন্টিকে স্যরি বলো।”
মুবিন কিছু বলবে তার আগেই ইমাদ বলল, “স্যরি মঈন সাহেব, মুবিন স্যরি বলবে না।”
“এক্সকিউজ মি! আপনি আমাদের মাঝে কথা বলছেন কেন?”
“মুবিনের এই পরিস্থিতির জন্য আপনারাই দায়ী। আপনার ওকে স্যরি বলা উচিত।”
মঈনের রক্ত চাউর হয়ে গেল। সে ইমাদকে ঘুষি মারল, “দুই টাকার মাস্টার তুই বলে দিবি আমি কি করব?”
ইমাদ বাঁকা হয়ে নাক চেপে ধরল। শান্ত ইমাদ সময় নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনার এখন আমাকেও স্যরি বলা উচিত।”
মঈন এক সেকেন্ডও দেরি না করে দ্বিগুণ শক্তিতে, ইমাদকে দ্বিতীয় ঘুষিটা মারল এবং বলল, “এই নে তোর স্যরি।”
মুবিন এবং মিশেল কিছু বুঝে উঠার আগেই ইমাদ তীব্র ব্যথায় টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে গেল৷ মুবিন দৌড়ে গিয়ে ইমাদকে মেঝে থেকে টেনে তুলল। তারপর রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “বাবা, স্যারকে স্যরি বলো।”
“বাপকে শেখাস? বেয়াদব ছেলে। তোর মা তোকে পুরা নষ্ট করে ফেলেছে।”
মুবিন দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “হয় তুমি এখনি স্যারকে স্যরি বলবে নতুবা..”
“নতুবা কি?”
মুবিন সাপের মত ঠান্ডা চোখে চেয়ে বলল, “নতুবা, আমি এই মহিলাকে মারব। আজ হোক, কাল হোক, এখানে হোক, বাইরে হোক, দেশে হোক, বিদেশে হোক, দশ বছর পর হলেও আমি মারব।”
মঈন ছেলের বেয়াদবি আর স্পর্ধা দেখে নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেল। পরে বলল, “তোমার মা তোমাকে এগুলোই শিখিয়েছে না?”
“তুমি শিখিয়েছ।”
“তুমি কি জানো না ও তোমার আরেকটা মা? তুমি এ ধরনের কথা আর কখনো বলবে না।”
“আসল বাপ মাকেই গুনিনা আর তুমি বলো নকলটার কথা।”
মঈন ছেলেকে চেনে। তার ছেলে কিচ্ছু মানে না, কাউকে মানে না। কথার আগে হাত উঠে। আস্ত বেয়াদব এই ছেলে দ্বারা সবই সম্ভব। তাই এক কথায় ইমাদকে স্যরি বলে মিশেলকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ওরা চলে যেতেই ইমাদ বলল, “তুমি যে কথাটা বলেছ সেটা বলা মোটেও ঠিক হয়নি।”
মুবিন ইমাদকেও ঝাড়ি মারল, “আপনি বলে দিবেন আমি কি বলব?”
তারপর বেরিয়ে চলে গেল। ইমাদ নাকের ব্যথায় অস্থির হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। হাত দিয়ে বারবার দেখছে রক্ত পড়ছে কিনা। না পড়ছে না৷ একটা সময় ব্যথা নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ল সে। ঘুম ভাঙল মুবিনের ডাকে, “উঠুন, উঠুন। আমি কি আপনাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলার চাকুরী নিয়েছি?”
“বলো।”
“আমি কিছু বলব না। আপনি উঠুন৷ এখানে দুই প্যাকেট কাচ্চি আর এক বোতল বোরহানি রাখা আছে। উঠে খেয়ে নিন।”
“আচ্ছা।”
“আর মলম টলম লাগবে?”
“একটা কলম লাগবে।”
“কলম কোথায়?”
“আমার টেবিলের উপর রাখা কলমদানিতেই আছে।”
“পারব না।”
“আচ্ছা।”
মুবিন চলে গেল। ঘণ্টা খানেক পর আবার এল। ইমাদ তখন আবারো সেই অর্ধেক করা প্রশ্নপত্র নিয়ে বসেছিল। মুবিন আসতেই বলল, “বলো।”
মুবিন সহজ গলায় বলল, “কড়ি আমাকে ওসব বলেনি।”
ইমাদ উপর মীচ মাথা নাড়ল, “আচ্ছা।”
মুবিন বলল, “আপনি আমার দেয়া মোবাইলের বদলে টাকা দিয়েছিলেন বলে আমি রেগে গিয়েছিলাম।”
“আচ্ছা।”
“স্যরি।”
ইমাদ বলল, “আচ্ছা।”
মুবিনের মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। সে ইমাদের চৌকিতে একটা লাথি মেরে চৌকি নাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আমার স্যরি আমি ফেরত নিলাম।”
ইমাদ আবারো বলল, “আচ্ছা।”
.
ক্যালেন্ডারের পাতা বদলেছে। আজ নতুন মাসের এক তারিখ। কাদিন গত পনেরো দিন ধরে দীপাদের বাসায় প্রতিদিন নিয়ম করে ঔষুধ খাওয়ার মত দু’বেলা আসে। অফিস যাওয়ার পথে একবার, অফিস থেকে ফিরে আরেকবার। সকালে বলে যায়, “ব্যাগ গুছিয়ে রেখো।”
রাতে এসে বলে, “চলো না।”
দীপা দু’বারই ক্ষেপে, “তুমি আর এখানে আসবে না।”
কাদিন চেষ্টা চালিয়ে যায়। কোনো কিনারা পায় না।
কাদিনের শাশুড়ি কাদিনকে একটা কিনারায় তুলে দিতে চেষ্টা করে। দীপা সোজাসাপটা বলে, “তুমি ওকে জোর করে নিয়ে যাও।”
“জোর করে কীভাবে নিয়ে যাব?”
“আমরা ওকে দিয়ে দিব।”
“আপনারা কীভাবে দিয়ে দিবেন।”
“যখন দিব তখন দেখো।”
কাদিন অস্বস্তি বোধ করে, “দীপাকে এখানে থাকতে দিবেন না?”
“ওকে সেটাই বুঝাব।”
কাদিন রাজি হয় না, “দীপার নরম মন৷ ও কষ্ট পাবে।”
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্ব: ৬৬
হাওয়ায় হাওয়ায় চন্দ্রমল্লিকা দুলে ছাদ-বাগানে। গোলাপ হেসে উঠে হঠাৎ। নীলকণ্ঠ কাঁধ এলিয়ে দেয়। পাতাদের নাচন তালে লয়ে। সন্ধ্যার পর দীপার ছাদে বসে থাকতেই ভালো লাগে। এক কোণে একটা দোলনা আছে৷ সে দোলনায় পা তুলে বসল। পালা করে ফুল আর আকাশ দেখে উদাস হলো। তারপর উঠে এসে চন্দ্রমল্লিকার টবের কাছে দাঁড়াল। উবু হয়ে চন্দ্রমল্লিকাটা ধরে মুগ্ধ হয়ে দেখল। মুখটা আরো কাছে নিয়ে চন্দ্রমল্লিকায় নাক ঘঁষল। চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস ভরে ঘ্রাণ নিলো। চন্দ্রমল্লিকাও তাকে আদর করে দিলো। সোহাগ করল তার গালে, চোখে, ঠোঁটে। দীপা চোখ মেলে দেখল চন্দ্রমল্লিকা কাদিনের হাতের মুঠোয়। কাদিনই এতক্ষণ দীপার গালে চন্দ্রমল্লিকা বুলাচ্ছিল৷ দীপা ঝা করে কাদিনের হাতটা সরিয়ে দিলো। চন্দ্রমল্লিকা ছিটকে পড়ল আশেপাশেই। দীপা রুঢ়ভাবে বলল, “সরো। এইসব নাটক আমার ভালো লাগেনা।”
কাদিনের চেহারা রক্তবর্ণ ধারণ করল,”এত কঠিন ত তুমি নও দীপা।”
“তোমারো তো এত প্রেম নেই।”
কাদিন ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে, “ব্যাগ গুছাও তো দীপা। আমার আর এসব ভালো লাগছে না৷”
“কখনো শুনেছ যমের বাড়ি যেতে কেউ ব্যাগ গুছোয়!”
“এভাবে বললে!”
“যা সত্য তাই বললাম।”
“এখন তুমি আমায় মানসিকভাবে অত্যাচার করছো, দীপা।”
“বাহ্! কখনো বিরক্ত, কখনো মানসিকভাবে অত্যাচারিত। আমাকে নিয়ে এতই যখন অভিযোগ কি দরকার আমাকে? বাদ দিয়ে দাও।”
কাদিন আহত হলো, “আমি এভাবে বলিনি। আমি বলতে চেয়েছি তোমার জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে।”
“আমার জন্য কারো কখনো কষ্ট হয়না। আমার এই কপাল নেই।” আর দাঁড়াল না। নেমে গেল ছাদ থেকে। কাদিনও নামল পিছু পিছু। ড্রয়িংরুমে রাখা অফিসের ব্যাগটা নিয়ে নিঃশব্দে চলে গেল। দীপা অনেকক্ষণ পরে ছাদে গিয়ে ফুলটা তুলে এনে ধুলো ঝেড়ে যত্ন করে রেখে দিলো।
“থাকোগো ফুল, থাকো কাছে।
মোর সখা হৃদয়ে যেথায় আছে।
প্রিয়তমেষুর পুষ্প সোহাগে
ছুঁলো বলে কিযে দমবন্ধ লাগে!”
কাদিন দীপাদের বাসা থেকে বেরিয়ে রিকশায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল উদ্দেশ্যহীনভাবে। যেন তাড়া নেই বাড়ি ফেরার। যেন অসহ্য বাসা। যেন থাকা যায় না ও ঘরে৷ যেন অফিস ছুটিই মিছিমিছি। কতক্ষণ থম মেরে বসে থেকে এখানে ওখানে ঘুরে কাদিন রিকশাওয়ালাকে বলল, রিকশা ঘুরাতে। সে বাসায় যাবে। যে বাসায় তার বউ আছে। সে যেখান থেকে এসেছে সেখানেই ফিরে যাবে। দীপার কাছে।
“মন যে ভাঙতে জানে।
মানও তো সেই ভাঙাবে।
বিদায় দিলেও, ফিরে ফিরে যাবে।
ফুলের বেদনায়, ফের ভালোবাসা হবে।”
.
মুবিন একা একা বসে কেরাম খেলছিল। রানা হুড়োহুড়ি করে ঘরে ঢুকতে গিয়ে কেরাম এর সাথে সংঘর্ষে মুবিনের সব গুটি নাড়িয়ে ফেলল। মুবিন চটে গেল, “কি সমস্যা আপনার? চোখ পকেটে নিয়ে ঘুরেন?”
রানা বলল, “তুমি এখানে ঘরের মাঝখানে কেরাম নিয়ে বসলে কেন?”
“আমার ইচ্ছা।”
রানা মুবিনের দিকে চোখ গরম করে তাকাল। মুবিন রানার দিকে তাকাল চোখ বড় বড় করে। রানার এত রাগ হলো, তবু সে এই মুহূর্তে কোনো তর্কে না গিয়ে চট জলদি নিজের ব্যাগ গোছালো। তারপর মুখ কালো করে পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। প্রায় সাথেই সাথেই আবার চার্জার, চার্জার করতে করতে ফিরে এল। রানা যখন চার্জারটা খুঁজছিল মুবিন দেখল সেটা কোথায় আছে। চার্জার রানার টেবিলের পাশে এক কোণায় পড়েছিল। রানা যখন হন্য হয়ে চার্জারটা খুঁজছিল, মুবিন এক ফাঁকে পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে টেবিলের নীচে ঠেলে দিলো। রানা আর পায় না চার্জার। ওদিকে ওর দেরি হয়ে যাচ্ছে। মুবিন বসে বসে আরামসে কেরাম খেলছে। পাশের ঘরের অনেকেই এসে একটু পর জড়ো হয়ে গেল, “রানা ভাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
“আরে মিঞা চার্জার পাই না।”
একজন বলল, “লাগবে না। পাওয়ারব্যাঙ্ক আছে। চলেন, চলেন।”
রানা বলল, “দাঁড়াও আরেকটু খুঁজি।”
এইবার ইমাদ আর নিলয়ও এসে দাঁড়াল, “হলো?”
রানা বলল, “থাক পাই না। চলো।”
মুবিন জটলার দিকে তাকিয়ে দেখল, মেসের সবাই এখানে। সবার কাঁধে, পিঠে ব্যাগ। ওর ভ্রু কুঁচকে গেল, “আপনারা সবাই কোথায় যাচ্ছেন?”
ভিড়ের মাঝে কেউ একজন ব্যস্ত হয়ে উত্তর দিলো, “ট্যুরে যাচ্ছি।”
“কিসের ট্যুর?”
“এমনি ট্যুর।”
“কোথায় যাচ্ছেন?”
“সুন্দরবন।”
মুবিন উঠে দাঁড়াল, “আমিও যাব।”
“তুমি কীভাবে যাবে?”
মুবিন দৃঢ়তার সাথে বলল, “যেভাবে আপনারা যাচ্ছেন। আমিও তো এই মেসে থাকি। আমাকে ফেলে যাওয়া যাবে না।”
“তুমি ছোট মানুষ। তুমি যেতে পারবে না।”
যে কথাটা বলল তার নাম রওনক। মুবিন তার দিকে এগিয়ে গেল। হাত দিয়ে হাইট মেপে দেখাল, “আপনার চেয়ে বড়।”
আরেকজন বলল, “দেখো, বাবু তোমাকে নেয়া যাবে না।”
“কেন?”
“আমরা যে যার মত ঘুরব। তোমাকে দেখবে কে? তুমি হারিয়ে গেলে?”
মুবিনের মাথা গরম হয়ে গেল। তাকে আবার দেখবে কে? সে কেন হারাবে? মনে মনে বলল, “একবার ট্যুরে যেতে দে, তোকেই ফেলে আসব।” কিন্তু, রাগটা সে পরে উসুল করবে বলে রেখে দিলো। আঙুল তুলে ইমাদকে দেখিয়ে বলল, “ঐযে, ইমাদ স্যার আমার গার্জিয়ান। স্যার দেখবেন আমাকে।”
সবাই একসাথে ইমাদের দিকে তাকাল। ইমাদ ভাবলেশহীন। কোনোপ্রকার প্রতিক্রিয়া নেই। নিলয়ের চারিদিক অন্ধকার হয়ে এল, “এই মুসিবত সঙ্গে যাবে নাকি! তসর উপর আবার তার আর ইমাদের সাথে থাকবে! অসম্ভব।”
কেউ রাজি নয়। পাল্টাপাল্টি যুক্তিতর্ক। মুবিন একটা বললে, ওরা আরেকটা বলে। ওরা দুইটা বললে, মুবিন পাঁচটা বলে। জান দিয়ে মুবিনের যাওয়া ঠেকাতে চেষ্টা করল যে দুজন তারা হলো রানা, আর নিলয়। অন্যরাও চেষ্টা করল। তবে রানা, আর নিলয়ের যেন জীবন-মরণের এটা প্রশ্ন। তবে শেষ পর্যন্ত মুবিনকে না নিয়ে ওরা এক পাও নড়তে পারল না। মুখ কালো করে সবার মুবিনকে সঙ্গে নিয়েই বেরোতে হলো। বাসে উঠে মুবিন কার পাশে বসবে তা নিয়ে আরেক গ্যাঞ্জাম। রানার রুমমেট বলে রানার পাশে মুবিনের সিট বরাদ্দ করতেই রানা দু’হাত তুলে সাফ সাফ জানিয়ে দিলো, “না, না। রুমমেট টুমমেট বুঝিনা। যার খোকা তাকে সঙ্গে নিতে বলো। যাও যাও মুবিন, তুমি তোমার গার্জিয়ান ইমাদ স্যারের পাশে বসো।”
নিলয় প্রতিবাদ করল, “আরে আমি কেন উঠব? আমি আর ইমাদ একসাথে যাচ্ছি।”
রানা নিলয়কে সাইডে ডেকে এনে বুঝাল, “ঝামেলা করিস না। এই বাচ্চা খতরনাক। বেশি বাড়াবাড়ি করলে পরে বলবে তোর সাথে বসবে। তারপর হোটেলেও তোর তার সাথে রুম ভাগ করতে হবে। আমার রুমমেট। আমি জানি এই বেদনা।” রানা নিজের বুকে হাত দিয়ে বড় কাতর হয়ে আরো বলল, “আমার কলিজাটা প্রতিদিন নুনমরিচ লাগিয়ে খায়।”
নিলয় আর একটা কথাও বলল না। চুপচাপ অন্য সিটে গিয়ে বসল। পেছন থেকে কেউ একজন সান্ত্বনা দেয়ার ভঙ্গিতে টিটকারি দিয়ে বলল, “ধরে নিন আপনার বন্ধুর পাশে তার গার্লফ্রেন্ডকে বসতে দিচ্ছেন।”
বাসের সবাই হো হো করে বাস কাঁপিয়ে হেসে উঠল। সেই থেকে মুবিনের নাম পড়ল, “ইমাদের খোকা।”
চলবে…

একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-৫৮+৫৯+৬০

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫৮
দীপা- কাদিন ডিনার থেকে ফিরল একটু রাত করে। কাদের সাহেব তাদের জন্য ড্রয়িংরুমে বসে অপেক্ষা করছিলেন। তাদের দেখেই তিনি বললেন, “তোমার জিনিস এনেছি বাবা।”
দীপা আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়াল, “কই দেখি?”
কাদের সাহেব পাঞ্জাবীর পকেট থেকে দুটো চকোলেট কোকোলা ওয়েফার রোল বের করে দিয়ে বলল, “বলেছিলাম না এগুলো এখনও আছে৷”
কাদিন না থাকলে দীপা এখন আনন্দে দুটো লাফ দিতো। কাদিন পাশে থাকায় দীপার আনন্দ শুধু চেহারাতেই ঝলমল করতে পারল। দীপা খপ করে দুটো চকোলেট ওয়েফার রোল নিয়ে বলল, “এগুলো খুব ছোটবেলায় স্কুলের পাশের এক দোকানে পেতাম। আমি ভাবতাম আর নেই, হারিয়ে গেছে।”
কাদের সাহেব বললেন, “খুঁজে বের করেছি।”
দীপা বলল, “আচ্ছা এগুলোর নাম কি? আমি নাম জানি না। ছোটবেলায় শুধু খেয়েছিই।” বলে কাদের সাহেবের পাশে বসে ওয়েফার মুখে দিলো। তারপর চোখ বন্ধ করে খেতে খেতে বলল, “আগেরটা আরো বেশি মজা ছিল।”
কাদের সাহেব বললেন, “এটার নাম চকোলেট ওয়েফার রোল।”
দীপা চোখ খুলে হাতে থাকা অবশিষ্ট আরেকটা ওয়েফার রোল কাদের সাহেবকে হাসতে হাসতে খাইয়ে দিলো। কাদের সাহেব হাসতে হাসতে কাদিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই মেয়ে আমায় মেরে ফেলবে৷ এমনি মিষ্টি খেতে দেয় না আর এখন ওয়েফার রোল ঠুশে ঠুশে খাওয়াচ্ছে।”
দীপা হাত ঝেরে বলল, “ইশ শেষ। আরো থাকলে আরো খাওয়াতাম।”
কাদের সাহেব হাসতে হাসতে উঠে গিয়ে আস্ত দুটো বয়াম নিয়ে এসে বললেন, “অনেক আছে।”
দীপা বয়াম দুটো নিয়ে মনের আনন্দে ঘরে ফিরে এলো। জামা কাপড় না বদলে বয়াম খুলে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসল। কাদিন গেল ফ্রেশ হতে। পা দোলাচ্ছিল, আর খাচ্ছিল দীপা। বাথরুমের দরজার খোলার শব্দ হতেই সে পা দোলানো বন্ধ করে দিলো। কাদিন সেটা দেখল। বলল, “আমাকে বলোনি কেন?”
দীপা উত্তর দিলো না। কাদিন পাশে বসে একটা ওয়েফার নিলো। দীপার মুখ কুঁচকে গেল। মনে মনে বলল, “এই জিনিসটায় ভাগ বসাতে হলো তার! এখন তার শরীরে ক্ষতি হয় না?”
কাদিন ওয়েফারে ছোট কামড় দিয়ে খেল। বলল, “আহামরি কিছু না।”
দীপা বলল, “আহামরি না হলে খাচ্ছ কেন? বাকিটা ফেরত দাও।”
কাদিন দীপার হাতে অবশিষ্ট অংশ ধরিয়ে দিয়ে বলল, “নাও, নাও। অবস্থা দেখো! তুমি এই কোকোলা ওয়েফারের বদলে স্বামীও বিক্রি করে দিবে।”
দীপা বলল, “ফালতু কথা।”
কাদিন শুয়ে পড়ে বলল, “সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।”
দীপা উত্তর কি দিবে ভেবে পেল না৷ ও কথা জানে না কেন? অসহ্য!
কাদিন আবার বলল, “আর খেও না।”
“হে তখন তো মোটা হয়ে যাব৷ তোমার জন্য সমস্যা।”
কাদিন ওপাশ ফিরে চোখ বন্ধ করল। দীপা উঠে শাড়ির পিন খুলে শাড়ি খুলল। কাদিন হঠাৎ ঘুরে অবাক হয়ে গেল। লাফ দিয়ে উঠে চাপা চিৎকার দিলো, “দীপ!”
দীপা ভড়কে গিয়ে বলল, “কি?”
কাদিন অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে বলল, “দরজা, জানালা সব খোলা।”
দীপা হকচকিয়ে উঠল, “আমি খেয়াল করিনি।”
তারপর দ্রুত বাথরুমে ঢুকে গেল। কাদিন উঠে বারান্দার দরজা বন্ধ করল। জানালা বন্ধ করে, পর্দা টানল। এ কেমন মেয়ে? এ কেমন ছন্নছাড়া আচরণ?

অনেকক্ষণ পর দীপা ভয়ে ভয়ে বেরুলো। কাদিন রুষে গিয়ে বলল, “তুমি দরজা, জানালা সব খুলে শাড়ি খুলে ফেলেছ।
তোমার কি মাথা কাজ করেনা? তুমি কি পাগল?”
দীপা মিনমিন করে বলল, “আমার খেয়াল ছিল না।”
“এখন আমি না থাকলে কি হতো?”
দীপা আবারো বলল, “আমার খেয়াল ছিল না।”
কাদিন শক্ত গলায় বলল, “সারাক্ষণ কথা বলতে থাকলে খেয়ালটা হবে কখন? মানে কি করে না করে কিচ্ছু ঠিক নেই।”
দীপা বলল, “সারাক্ষণ কোথায় কথা বলি? হিসাব করে করে চলতে চলতে তোমার বাসায় আমার দমবন্ধ হয়ে আসে।”
কাদিন বলল, “কি বললে?”
দীপা বলল, “বলেছি তোমার সাথে সংসার করা অসম্ভব। তোমার সাথে আর একদিনও না।”
“তুমি ভুল করলে আবার তুমিই মেজাজ দেখাচ্ছো?”
“শক্ত শক্ত কথা খালি তুমিই বলতে পারো? আর কেউ আমরা পারি না?”
“এখন কি আমার রাগারাগি করার কথা না?”
“না তুমি কেন রাগবে? নিঃশ্বাস ফেলার আগেও আমাকে ভাবতে হয় নিঃশ্বাস নিলে তুমি আবার কি মনে করো।”
কাদিন বলল, “আরে এই মেয়ে তো বদ্ধপাগল।”
দীপা বলল, “আমি পাগল তাই আমি চলে যাচ্ছি। অনেক সহ্য করেছি। তুমি ম্যাচিওর বুড়া দাদী বিয়ে করে নিয়ে থাকো। আমি তো ছোটোখাটো পাতলা মানুষ, ইরান থেকে ইরানী সুন্দরী নিয়ে এসো। যার হাতে বড় হ্যান্ড ব্যাগ মানাবে। পারলে বোবা, কথা বলতে জানে না এমন একটা বউ খুঁজো।”
কাদিন বলল, “তুমি বোবাদের ছোট করে কথা বলছ। তোমার বুঝা উচিত আল্লাহ তাদের বাকশক্তি দেননি। সোউ মিন।”
“আমার কপাল এত খারাপ?” দীপা আলমারির উপর থেকে লাগেজ নামাল৷ লাগেজ আছড়ে ফেলে আলমারি থেকে জামা কাপড় বের করে লাগেজ গুছাতে শুরু করল৷ কাদিন বলল, “এরকম ধুমধাম শব্দ করবে না। রাত হয়েছে মানুষ ঘুমাচ্ছে।”
দীপা বলল, “এজন্যই আমি আর তোমার সাথে থাকব না। এখানেই সব শেষ।”
কাদিন বলল, “কালকে যাবে না এখনি?”
দীপা চিৎকার করে বলল, “এখনি, এখনি, এখনি, একশোবার এখনি।”
কাদিন উঠে হাত দিয়ে দীপার মুখ চেপে ধরে বলল, “চুপ। চিৎকার করে সিনক্রিয়েট করবে না। লাগেজ গোছাও। আমি নিজেই তোমায় দিয়ে আসব।”
দীপা কান্নাচোখে তাকিয়ে বলল, “আমি একা যেতে পারব।”
“একা কেন যাবে? একা এসেছ এ বাসায়? আমি যখন নিয়ে এসেছি, আমি আবার ফেরত দিয়ে আসব।”
দীপা বলল, “যথা আজ্ঞা।”
দীপা লাগেজ গুছাতে লাগল। কাদিন চুপচাপ বসে রইল। সে একসাথে কয়েকটা বড় ধরনের ভুল করে ফেলেছে। প্রথমত, সে দীপাকে বিয়ে করেছে। দ্বিতীয়ত, নারীসঙ্গহীন সে প্রথম কোনো নারীর সান্নিধ্য পেয়ে অল্পতেই এই আবোলতাবোল মেয়েকে ভালোবেসে ফেলেছে। এখন তাকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হবে। যাইহোক, অশান্তির চেয়ে আলাদা থাকা ভালো।
.
মুবিনের সাথে কথা বলে কড়ি অনেকক্ষণ মোবাইল হাতে বসে রইল। তার ভ্রু ধনুকের মত বেঁকে আছে। সেই বেঁকে যাওয়া ভ্রু নিয়েই সে ইমাদকে কল করল। ইমাদও যেন অপেক্ষায় বসে ছিল। খপ করে মোবাইল কানে ধরল। কণ্ঠ তবু স্পৃহাহীন, “কি হলো?”
“কথা হলো।”
“পরে?”
কড়ির ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল, “আনপ্রেডিক্টেবল।”
“কি মনে হয়?”
“মুশকিল।”
“আচ্ছা।”
কড়ি বলল, “শাট আপ।”
ইমাদের হাসি পেয়ে গেল। সে মাথা চুলকে বলল, “মুবিনের সাথে কথা বললে প্রথম প্রথম এমনই হয়।”
কড়ি বলল, “স্যরি।”
“ইটস টোটালি ওকে। ছাত্রের মেজাজ গরম হলেও স্যার খারাপ না।”
“উফরে আবার ফ্লার্টিং।” কড়ি পুরা বিরক্ত হয়ে গেল।
ইমাদ নিঃশব্দে হাসছিল। ঘরে বাইরে কেউ নেই, কড়িও সামনে কই? এখন হাসলে কি ক্ষতি? কড়ি’ই আবার বলল, “একসাথে একজন বিরক্ত করলে সহ্য করা যায়। পালা করে পেছনে পড়লে খারাপ হবে। একজনকেও ছাড়ব না। স্যারকেও না, ছাত্রকেও না।”
ইমাদ দুঃখিত হয়ে বলল, “খুব জ্বালাল?”
কড়ি বলল, “এই পিচ্চি খুবই ডেঞ্জারাস।”
“এজন্যই চাইছিলাম ওর সাথে কথা না বলুন।”
কড়ি শান্ত হয়ে বলল, “সমস্যা নেই। ওর সাথে ঠাণ্ডা মাথায়ই কথা বলেছি।”
“আচ্ছা।”
কড়ি হতাশ কণ্ঠে বলল, “সে আপনার পক্ষ নিয়ে একটা কথাও বলেনি। আমাদের পুরো পরিকল্পনাকে এক মিনিটে নাস্তানাবুদ করে দিয়ে বলেছে আপনি নাকি সারারাতই ঐ মেয়ের সঙ্গে কথা বলেন। এর মানে আপনার জন্য ওর মনে কোনো সফট কর্ণারই তৈরী হয়নি। সে আপনার সাহায্য করতে কল করেনি। কত বড় বিচ্ছু!”
“সফটকর্ণার আপনারও হয়নি। তবু লেগে আছি। ওর বেলায়ও থাকব।”
“আমি ভেবেছিলাম আমরা সিরিয়াস কথা বলছি।”
“আপনার কথা বলছি মানে আমি সিরিয়াস।”
কড়ি বলল, “যাইহোক, অপরপক্ষকে দূর্বল ভাবা অনেক বড় ভুল। আমি তাকে আবার কল করব। ওর মস্তিষ্ক অনেক দ্রুত চলে। আরো সাবধানী হব।”
“আমি কি একটি পরামর্শ দিতে পারি?”
“জি অবশ্যই।”
“মুবিনকে বলতে পারেন আপনি আমাকে হাতেনাতে ধরে শায়েস্তা করতে চান। সে আপনাকে প্রমাণ বের করে দিতে পারবে কিনা।”
কড়ির বিড়ালাক্ষী চোখে একটা ঝিলিক বয়ে গেল, “দারুণ বলেছেন৷ কি বুঝাতে চাইছেন বুঝেছি।”
ইমাদ বলল, “আচ্ছা।”
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫৯
মিলার পরপর দুটো প্রাইভেটের মধ্যে এক ঘণ্টার গ্যাপ ছিল। আবার বাসায় না গিয়ে এক ঘণ্টা আগেই সে পরবর্তী প্রাইভেটে এসে পড়ল৷ অন্য একটা ব্যাচের পড়া চলছিল বলে সে উপর তলায় ছাদে উঠার সিঁড়িতে উঠে বসে রইল। কয়েকটা সিঁড়ি উপরে অভ্র বসেছিল একদম ছাদ বন্ধ করা গেইটটার কাছে। দুপুরের রোদ আর অভ্র মুখোমুখি। ওর নিশ্চয়ই এমন কিছুই হবে। মিলা ব্যাগ থেকে বই খুলে কোলের উপর রেখে গুনগুন করে পড়তে লাগল। পড়ার তালে তালে দুলছে ও। অভ্র ভ্রু কুঁচকে বলল, “তুমি কি সারাক্ষণ’ই পড়ো?”
মিলা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, “থ্যাঙ্কস।” তারপর আবার বইয়ে ঝুঁকে পড়তে শুরু করল। অভ্র বিস্মিত হয়ে বলল, “কিসের থ্যাংঙ্কস?”
মিলা আবার ফিরে তাকিয়ে ধীর গলায় বলল, “সবসময় পড়ি বলায় থ্যাঙ্কস বললাম।”
অভ্র ভাবুক হয়ে চেয়ে বলল, “এটা তো কমপ্লিমেন্ট না। প্রশ্ন?”
“ও। মনে হয় পড়ি।”
অভ্র মাথা ঝাঁকাল৷ আগের ব্যাচের ছুটি হয়ে গেলে মিলা উঠে দাঁড়াল। কাঁধে ব্যাগ, হাতে বই নিয়ে সে সিঁড়ি দিয়ে সাবধানে নেমে গেল। অভ্র উঠল না। মেয়েরা সামনে বসার পর তারপর ছেলেদের বার জায়গা। এখন গেলে বারবার উঠে মেয়েদের সামনে বসবার জায়গা দিতে হবে। তারচেয়ে শেষে যাওয়া ভালো। সে রোদ আর ছায়া দেখছিল। হঠাৎ মিলা আবার উঠে এল। অভ্র জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল, “কি হয়েছে নীচে?”
মিলা খানিক আমতা আমতা করে বলল, “আমার ছোট্ট একটা হেল্প লাগবে।”
বিস্ময়ে অভ্রর চোখ বড় বড় হয়ে গেল, “পড়াশুনার বিষয়ে?”
“না।”
অভ্র মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “আমিও তো বলি পড়াশুনার হেল্প কেন লাগবে তোমার!”
মিলা একটু কেশে বলল, “ছুটির সময় তুমি সবার জুতায় পাড়া দিয়ে ময়লা করে দৌড়ে নামো। প্রায়দিন আমাদের জুতার উপর জুতা পায়ে দাঁড়িয়েও থাকো। জুতা ময়লা হয়ে গেলে বাজে দেখায়৷ একটু খেয়াল করে নেমো।”
অভ্র বলল, “তোমার জুতা কোনগুলো দেখি।”
মিলা তার সাদা লংস্কার্ট খানিক উঁচিয়ে ধরল। অভ্র জুতার চেয়ে বেশি দেখল মিলার পায়ের পাতা। পায়ের পাতায় ছোট্ট তিল।
.
ব্যাংকে শিল্পীর কাছে একজন গ্রাহক ঋণ নেবার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে উঠে গেলেন। আরেকজন চলে আসবার আগেই শিল্পী কম্পিউটার স্ক্রিনে চোখ রেখেই ডাকল, “জুয়েল সাহেব।”
জুয়েল সাহেব পাশের ডেস্ক থেকে ভয়ে ভয়ে তাকালেন, “জি বলুন।”
শিল্পী বলল, “আপনার বন্ধু যাকারিয়া সাহেবের নাম্বারটা আছে?”
জুয়েলের আতঙ্কিত চেহারা মুহূর্তেই আলোকিত হলো। তিনি আগ্রহ নিয়ে বললেন, “জি, জি আছে তো। লাগবে নাকি?”
শিল্পী ক্লান্ত ভঙ্গিতে কিছু কাগজে সিল মারতে মারতে বলল, “লাগবে বলেই তো বললাম।”
জুয়েল সাহেব আন্তরিক ভঙ্গিতে নিজের সবকাজ ফেলে রেখে রঙিন কাগজ নিলো। কমলা একটা ছোট কাগজে নীল কলমের কালিতে যাকারিয়া সাহেবের নাম্বার লিখে শিল্পীর দিকে বাড়িয়ে ধরল। শিল্পী কাগজটা হাতে নিয়ে হাসল। পরিস্কার গলায় সাবলীলভাবে বলল, “জুয়েল সাহেব, আপনি ভালো মানুষ।”
জুয়েল সাহেব দু’হাত গুটিয়ে একদম লজ্জিত হয়ে গেলেন। জিহ্বে কামড় বসিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “কি যে বলেন!”
.
কড়ি খাতা কলম নিয়ে বসল। মুবিনকে সে যতটা সহজ ভেবেছিল ততটা সে নয়। ছেলেটা প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন। অপরিপক্ব তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন মুবিনের সাথে কথা বলার আগে কড়ি খাতার মাঝখানে একটা লাইন টানল। একপাশে সে কি কি বলবে সেগুলোর বুলেট পয়েন্টগুলো লিখল। অন্যপাশে লিখল মুবিনের কথা বলার ধরন এবং তার সাথে কথা বলার সময় যে যে বিষয়ে দৃষ্টি রাখতে হবে সে বিষয়গুলো। তারপর সময় নিয়ে এক কাপ চা খেয়ে মুবিনকে কল করল।
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৬০
মুবিন কল ধরে চোখ উল্টে বলল, “আবার কি?”
কড়ি বলল, “আপনার সাথে একটা পরামর্শ করতে চাই।”
“আমি কোনো অ্যাজেন্সি না।” মুবিন মুখের উপর বলল।
কড়ি বলল, “আমি ইমাদকে হাতেনাতে ধরব। ওকে আমি ছাড়ব না।”
মুবিন বলল, “হোয়াটএভার।”
কড়ি একটু কঠিন হয়ে বলল, “মুবিন সাহেব, আপনি প্রমাণ দিতে পারবেন কিনা সেটা বলুন।”
মুবিন আরো কঠিন হয়ে বলল, “কেন আমি প্রমাণ দিব?”
কড়ি এবার মোলায়েম হয়ে গেল। বলল, “ইটস ওকে মুবিন সাহেব। আই টোট্যালি আন্ডারস্ট্যান্ড। আপনি আসলে ইমাদের সাথে পেরে উঠবেন না। সে ধুরন্ধর। সারাক্ষণ এত চুপচাপ থেকে সে কি করে জানেন? বসে বসে বুদ্ধি বের করে। মাথার ভেতর শুধু শয়তানী বুদ্ধি।”
মুবিন কর্কশ কণ্ঠে বলল, “আপনি কি সোজা কথা বুঝেন না?”
কড়ি মিষ্টি করে বলল, “স্যরি। আমি বুঝিনি।”
মুবিন রেগে গিয়ে বলল, “কেন আমি আপনাকে প্রমাণ বের করে দিব? প্রয়োজনটা কি আমার? আমার এত সময় নেই।”
কড়ি বলল, “রেগে যাচ্ছেন কেন? রাগ করবেন না।”
মুবিন বলল, “ন্যাকামো বন্ধ করুন। মেয়েরা এত ন্যাকা হয় কি করে?”
কড়ি সুযোগ পেয়ে বলে বসল, “আপনার গার্লফ্রেন্ডও ন্যাকা?”
মুবিন শক্ত গলায় বলল, “আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই।”
“উমা! কি বলেন! কেন নেই?” কড়ি যেন ভীষণ অবাক।
মুবিন বলল, “আমার আপনাদের ভালো লাগে না। তাই নেই।”
“কেন? আমরা মেয়েরা কি করি? স্বাধীনতায় বাধা দিই? বন্ধুদের সাথে ফূর্তি করতে সময় দিই না?”
মুবিন বলল, “আমি একাই এনাফ। আমার কোনো বন্ধুর প্রয়োজন নেই ”
কড়ির মুবিনের জন্য হঠাৎ এত মায়া হলো! আহারে ওর কোনো বন্ধুও নেই। এই বয়সেই তার বন্ধু নেই! অথচ, খাঁটি বন্ধু পাওয়ার বয়স চলে যাচ্ছে। যত বড় হতে থাকবে, তারপর যাদের সাথে দেখা হবে সবাই হবে স্বার্থপর। বন্ধু আর ভরসার জায়গা বড় হয়ে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। বড় হলে মানুষ দুনিয়াদারি শিখে যায়। তখন আর কাউকে বিশ্বাস করা মুশকিল। হয় আশেপাশের মানুষকে ব্যবহার করতে হয় নতুবা, তাদের দ্বারা ব্যবহৃত হতে হয়। কমবয়সের লেনদেন ভালো। সে আফসোস ঢেকে রেখে বলল, “পারবেন না বললেই হয়। আমার ব্যবস্থা আমিই করব। আমার কাছে সাহসী ছেলেপেলের অভাব নেই।”
মুবিন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “করুন ব্যবস্থা।”
তারপর কল কেটে দিলো। কড়িও মুবিনকে সময় দিলো। টিনএজারদের উপর কিছু চাপিয়ে দিতে নেই। তাদের ভাবতে সময় দিতে হয়। মুবিনকে সময় দেয়া হলো।
.
শিল্পী অফিস থেকে ফেরার সময় খাবার কিনে নিয়ে এল। আজকাল রান্না করতে ইচ্ছে করে না আর। প্যাকেট খুলে যে খাবে সেটা করতেও রাজ্যের অলসতা। নিঃশব্দে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। খেতে হবে না। এক রাত না খেলে মরবে না সে। চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকল মুবিন মিলা সাথে থাকলে নিশ্চয়ই সে আজ রাঁধত। কি রাঁধত? কি কি খাবার রাতের জন্য রান্না করার সম্ভাবনা ছিল সেগুলো ভাবতে ভাবতেই তন্দ্রা লেগে গিয়েছিল। গালে মশা নামের যন্ত্রণাটা এসে বসতেই ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে এলোমেলো চুলগুলোতে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে উঠল সে। অন্ধকার হাতড়ে বাতি জ্বালল। খাবারের প্যাকেট ফ্রিজে রেখে কয়েল ধরাল। কয়েল খাটের পাশে রেখে বসবার কয়েক মুহূর্ত কাটতেই সে ঝুঁকে কয়েলটা ফের হাতে নিলো৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলে কয়েলটা মেঝেতে চেপে ধরে নিভিয়ে দিলো। মশা না যাক। একা ঘরগুলোতে পর্দা নেচে উঠতেই সে নিঃসঙ্গতায় ডুবে মরে। অন্তত মশারা থাকুক। দমবন্ধ না লাগুক। বুজের ভেতর শূণ্যগা নিয়ে ব্যাগ থেকে জুয়েল সাহেবের দেয়া নাম্বারটা বের করল। দ্বিধাহীনভাবে কত রাত হয়েছে সে পরোয়া না করে কল করল। যাকারিয়া কল ধরলেন। শিল্পী বলল, “আসসালামু আলাইকুম। যাকারিয়া সাহেবকে চাইছিলাম।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। যাকারিয়া বলছি।”
“শিল্পী বলছিলাম। জুয়েল সাহেবের কাছ থেকে নাম্বার সংগ্রহ করেছি।”
“জি জুয়েল আমাকে বলেছে।”
“এত রাতে কল করবার জন্যে দুঃখিত।”
“সমস্যা নেই। সারাদিন হয়তো ব্যস্ত থাকেন।”
“ধন্যবাদ৷ আমি আপনার কাছে আমার ছেলের ব্যবহারের জন্য খুবই স্যরি। আচমকা এসে আমাদের একসাথে দেখে রিঅ্যাক্ট করে ফেলেছে।”
“ছোট মানুষ। আমি কিছু মনে করিনি।”
“ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।” শিল্পী মোবাইল রেখে দিচ্ছিল। যাকারিয়া বললেন, “আমাদের বিষয়টা ভেবে দেখবেন।”
শিল্পী হেসে বলল, “আমার কাছে আমাদের বলতে এখন শুধু আমি আর আমার ছেলেমেয়ে। আমরা তিনজন’ই আমাদের।”
“পরে খুব একা লাগবে। আমি আগে ভাবতাম বিয়ে না করলে কি হবে? এখন বুঝি, একা লাগে।”
“আপনার ছেলেমেয়ে নেই তাই একা লাগে। আমি মা। আমি একা না।”
“তবু একবার ভেবে দেখবেন। ছেলেমেয়ে বড় হলে ঠিকই বুঝবে। এখন হয়তো সাময়িকভাবে অভিমান করতে পারে।”
“ওদের চাওয়া তো পরের কথা। আমি’ই চাই না। আমি কল করেছি আমার ছেলের হয়ে ক্ষমা চাইতে৷ আর কিছু না। ভালো থাকবেন।”
“জি আপনিও।”
শিল্পী মোবাইল রেখে বাতি নেভাল। এই একাকিত্বের কিছু একটা করতে হবে৷ এভাবে আর হবে না।
.
কাদের সাহেব টিভিতে সংবাদ শুনছিলেন। কায়েস পাশে বসে বলল, “বাবা খেলা চলে।”
কাদের সাহেব কায়েসের হাতে রিমোট দিয়ে উঠে যেতে যেতে বললেন, “দেখ।”
কায়েস বলল, “যাচ্ছ কোথায়? বাংলাদেশের খেলা চলে। দেখবে না?”
কাদের সাহেব বললেন, “না তুই দেখ।”
“শরীর খারাপ নাকি?”
“না বাসাটা খালি খালি। রিমা সারাক্ষণ কাজে ব্যস্ত থাকে। তোরা তো বাসায়ই থাকিস না।”
কায়েস বলল, “মেজো ভাবিকে কল করে বলি চলে আসতে?”
“না, না। কতদিন পর মায়ের কাছে গেল। কাদিন বলল রাতে মাকে মনে পড়ায় রাতেই চলে গেছে। ইচ্ছেমতো মায়ের কাছে থেকে আসুক।”
“ওকে।” কায়েস হাত দিয়ে থামস আপ দেখাল। কাদের সাহেব নিজের ঘরের দিকে গিয়েও আবার ফিরে এসে কাদিনের ঘরে গেলেন। কাদিন কিছু ফাইলপত্র নিয়ে বসেছিল। কাদের সাহেব দরজায় নক করতেই সে বিছানা থেকে বিনয়ী হয়ে উঠে দাঁড়াল। ফাইলপত্র বিছানা থেকে সরিয়ে বাবার জন্য বসবার জায়গা করে দিতে দিতে হেসে বলল, “বসো বাবা।”
কাদের সাহেব বললেন, “না বসব না। দীপার সাথে ভিডিয়ো কলে কথা বলবার ব্যবস্থা করে দে তো। কথা বলি।”
“এখনি দিচ্ছি।”
কাদের সাহেব এসে বসলেন। কাদিন ল্যাপটপ অন করল। কাদের সাহেব হেসে বললেন, “মেয়েটা একটা বাবু। ও থাকলে মনে হয় বাসায় একটা না, কয়েকটা বাচ্চা আছে।”
কাদিনও হাসল। দীপার সাথে বাবাকে ভিডিয়ো কলে বসিয়ে দিয়ে সে ফাইলপত্র নিয়ে অন্য ঘরে চলে এল। সেখানে বসে মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে লাগল। দীর্ঘদিন দীপার সঙ্গে থেকে সেও দীপার মত শিশুসুলভ আচরণ শুরু করেছিল। কথায় কথায় ঝগড়া করা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই ছিল তার বোকামো৷ দীর্ঘদিন একসঙ্গে থেকে সেও দীপার মত হয়ে যাচ্ছিল৷ সে ভেবেছিল দীপাকে রেখে এসে তার একা থাকতে কষ্ট হবে। কোনো কষ্টই হচ্ছে না। সবসময় সে যেমন থাকে তেমনি আছে। কোনো ফারাক নেই। মুদ্রার উল্টোপিঠে দীপা কেঁদেকেটে ইতোমধ্যে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে শোকাহত, মর্মাহত৷ সারাদিন কাঁদে, সারাদিন। কাদিনের কি ওকে একটু মনেও পড়ে না?
চলবে…

একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-৫৫+৫৬+৫৭

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫৫
ইমাদ কড়ি কলে কথা বলছিল। একটা সময় কড়ি মনে করে বলল, “আমি ছেলেটাকে চিনেছি। আপনি যেন ট্রেনে উঠতে না পারেন রেলস্টেশনে আপনার ব্যাগ টেনে ধরে রেখেছিল। বিচ্ছু ছেলে।”
ইমাদ চুপ করে রইল। কড়ি বলল, “আমি ওর সাথে কথা বলতে চাই।”
“না।”
“কেন না?” কড়ি একটু অবাক’ই হলো।
ইমাদ বলল, “মুবিন খুব বাজে ব্যবহার করে। আপনার কথা বলার প্রয়োজন নেই।”
কড়ি হেসে বলল, “উফ এখানেও আপনার ফ্লার্ট করতে হবে।”
ইমাদ বলল, “এটাকে ফ্লার্ট করা বলে?”
“তাহলে কি বলে?”
“কি বলে সেটা আপনিও জানেন।”
কড়ি বুঝল ইমাদ এটাকে নিজের ভালোবাসা মানে। কিন্তু বলল, “জানি না।”
“তাহলে বাদ দিন। আসল কথায় আসি। আপনার অনেক সময় নষ্ট করছি আমি।”
“আমি তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ নই যে আমার সাথে দু মিনিটের জায়গায় চার মিনিট কথা বললে পৃথিবী উচ্ছন্নে যাবে।”
“পৃথিবী উচ্ছন্নে যাওয়া না যাওয়া দিয়ে আমার কি? বেশি কথা বললে আমিই এলোমেলো হই।”
কড়ি বলল, “এইবার বেশি বেশি হচ্ছে।”
“স্যরি।”
“যদি মুবিনের সঙ্গে আমাকে কথা বলতেই না দিন তবে আমার কাছে কেন?”
“মুবিনকে নিয়ে চিন্তিত।”
“দীপা ভাবিকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে আমার প্রেমে পড়ে গেলেন। এখন মুবিনকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে আবার কোন মুশকিলে পড়েন! সাবধানে।”
“এখন কি আপনি ফ্লার্ট করছেন? সাবধানে।”
“অবাককান্ড! আপনাকে দেখলে ভালো মানুষ মনে হয়।”
ইমাদ আশেপাশে তাকিয়ে পরখ করে নিলো কেউ তাকে হেসে ফেলতে দেখে ফেলল না তো!
কড়ি বলল, “যাই হোক কি করতে চান?”
“মুবিনকে সাহায্য করতে চাই।”
“মুবিনকে সাহায্য করতে যাবেন? উল্টো মুবিনের কাছে সাহায্য চাইতে হবে আপনার।”
“আচ্ছা।”
মুবিন রগচটা, জেদী ছেলে। কাউকে পরোয়া করে না। ইমাদকে তো পছন্দই করে না। তাই ইমাদই ওর কাছে ধরনা দিবে। সে নিজেকে বড় আর শক্তিশালী ভাবতে ভালোবাসে। তার কাছাকাছি যাওয়ার এই একটাই পথ৷
.

মুবিন সিঁড়িতে অন্ধকারে টর্চ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার একটা পা সামনের দিকে দেয়ালে ঠেশে ধরা। গেইটের শব্দ হলেই সে সিঁড়িতে টর্চ মেরে দেখছে কে এসেছে। একটু পর পর মেসে অনেকজনই ঢুকল। ইমাদ এলো অনেক পর৷ অনেকগুলো টিউশন ছিল তার৷ এসে গেইটে ঢুকতেই মুবিন টর্চ জ্বালল। ইমাদকে দেখে টর্চ আর নিভাল না। মুবিন গটগট করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই ইমাদ নিজের স্বভাবের বাইরে গিয়ে গলা হাঁকিয়ে বলল, “মুবিন একটা বিপদ হয়েছে।”
মুবিনের টান টান হয়ে থাকা ঘাড় কিছুটা শীতল হলো। সে সরু চোখে তাকিয়ে বলল, “মরে গেছে নাকি আপদটা? নাকি কেঁদেকেটে পুলিশে নালিশ করেছে?”
ইমাদ খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল। এগিয়ে এসে সিঁড়িতে উঠে চট করে মুবিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “ঐ মেয়ের কিছু হয়নি। আমার একটু ঝামেলা হয়ে গেছে। হেল্প করো, প্লিজ।”
মুবিন বিরক্ত হয়ে ইমাদের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “আমি এখানে আপনাকে ওয়ার্নিং দিতে দাঁড়িয়ে আছি, হেল্প করতে না৷ আপনি আমার বিষয়ে নাক গলাতে আসবেন না৷ সকালে যা করেছেন তা যেন আর না হয়। দূরে থাকুন৷ আপনি আপনার রাস্তায়, আমি আমার রাস্তায়৷”
মুবিন সিঁড়ি ভেঙে নিজের ঘরে চলে গেল। ইমাদ সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই কড়িকে মেসেজ করল, “ও তো শুনলই না। বলল আমি আমার রাস্তায়, সে তার রাস্তায়।”
কড়ি সাথে সাথে উত্তর পাঠাল, “আবার যান। একেবারেই কি কিছু হয় নাকি?”
“আচ্ছা।”
কড়ি আবার লিখল, “ও যে ছোট বলে সমস্যাটা বুঝতে পারছে না এমন কিছু একটা বলতে পারেন। মনে হয় কাজে আসবে।”
“আচ্ছা।”
ইমাদ মুবিনের ঘরে গেল। মুবিন হাউকাউ করে উঠল, “কি সমস্যা আপনার? এখানে কি?”
ইমাদ মুবিনের বিছানায় বসে পড়ল। বলল, “ছোট মানুষ বলে তুমি বুঝতে পারছ না৷ তুমি যদি বড় ছেলে হতে তাহলে বুঝতে। এ ধরনের সমস্যাগুলোয় আসলে সব ছেলেরাই একে অপরকে সাহায্য করে।”
কথাটা বোধহয় কাজে লাগল। মুবিন বলল, “কি এমন হয়েছে আপনার?” মুবিনের চোখে একটা কৌতূহল।
ইমাদ বলল, “থাক বাদ দাও। গার্লফ্রেন্ডের প্যারা। তুমি এসব বুঝবে না।”
মুবিন বলল, “না বুঝলে আমাকে বলতে এলেন কেন? নিজের ঘরে যান।”
“রাগ করছ কেন? তুমিও ওর মতই। কথায় কথায় রাগ করে ফেলো। আমি কি বলছি শুনতেই চাও না।” ইমাদের কণ্ঠ শীতল তবে শব্দগুলো দ্রুত।
“ওর মত মানে আপনার গার্লফ্রেন্ডের মত?”
ইমাদ চুপ করে রইল। মুবিন মজা করে বলল, “কি দোষ করলেন, স্যার?”
ইমাদ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “বলব?”
“বলতে না চাইলে চলে যান। আমার সময় নষ্ট করছেন কেন?”
“আমি খেয়ে আসি। অনেক ক্ষুধা লেগেছে। সারাদিন খাওয়া হয়নি।”
ইমাদ হেঁটে চলে যাচ্ছিল। মুবিন ডাকল, “দাঁড়ান।”
সে নিজের জন্য কেনা কাচ্চির প্যাকেট থেকে একটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “খেতে পারেন। আমি অনেক বেশি খাই তাই দুটো এনেছিলাম।”
ইমাদ এর আগেও খেয়াল করেছে মুবিন আসলে অনেক বেশি খায় এবং অনেক বেশি ঘুমায়৷ সাধারণত ডিপ্রেশনে থাকা মানুষরা এমন হয়৷ সে বলল, “না আমার জন্যে মেসে রান্না করা হয়৷ আমি সময়ের জন্য খেতে পারিনি।”
“আপনার ইচ্ছা।”
ইমাদ কি একটা ভেবে বলল, “আচ্ছা।”
মুবিন বলল, “আচ্ছা মানে হ্যাঁ, নাকি না?”
“হ্যাঁ।”
মুবিন কাচ্চির প্যাকেটটা ইমাদকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আপনার গার্লফ্রেন্ড আপনার আচ্ছা, আচ্ছা সহ্য করে কীভাবে কে জানে! আমার সাথে আচ্ছা আচ্ছা করবেন না। আমার এসব সহ্য হয় না, স্যার। আমার আপনার প্রতি প্রেম নেই যে এসব সহ্য করব। আপনাকে বিদেয় করার অন্যতম একটা কারণ ছিল আপনার এই আচ্ছা, আচ্ছা।”
ইমাদ আবার বলল, “আচ্ছা।”
মুবিনের মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। সে তার চৌকিতে একটা জোরে লাথি মেরে বলল, “যন্ত্রণা।”
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫৬
ইমাদ খেতে খেতে মুবিনকে কি কি বলা যেতে পারে গুছিয়ে নিলো। খাবার শেষ করে বলল, “থ্যাংক্স।”
মুবিন চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “আচ্ছা।”
ইমাদ মুবিনকে ইশারায় এ ঘরের অন্য বাসিন্দা আলিকে দেখাল। ফিসফিস করে বলল, “আলি ভাই। বাইরে যাবে? তোমার যদি সমস্যা না থাকে।”
মুবিন হামি তুলে এবারেও বলল, “আচ্ছা।”
ইমাদ উঠেও মুবিনের জন্য দাঁড়িয়ে রইল। মুবিন বসে পা নাচাতে নাচাতে আরো একটু ভাবল। এরপর ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়াল। ইমাদ নিজে আগে না গিয়ে মুবিনকে সামনে হাঁটতে দিলো। কোথায় দাঁড়িয়ে কথা বলবে কিছুই বলল না। সবটা মুবিন আর তার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিলো। মুবিন সিঁড়িতে বসে বলল, “কথা প্যাঁচাবেন না।”
ইমাদও মুবিনের পাশে সিঁড়িতে বসল। মুবিন ইমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। ইমাদ তাকাল না। সে অন্ধকার গেইটের দিকে চেয়ে বলল, আমাকে বেশ কমাস ধরে একটা মেয়ে অনবরত মেসেজ করে। কলও করে। মেয়েটা কে আমি এখনও জানি না। এটা নিয়েই আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে আমার ঝামেলা।”
বিরতি নিয়ে ইমাদ মুবিনের দিকে তাকাল। মুবিন ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “আচ্ছা।”
ইমাদ বলল, “আমার গার্লফ্রেন্ড এখন আমাকে সন্দেহ করে।”
“মিচকা শয়তান বলে?” মুবিন ঠ্যাশ দিয়ে বলল।
ইমাদ আহত হলো। তবুও জোর করে ঠোঁটে হাসি টেনে এনে বলল, “আজকে আবার তোমার সাথের মেয়েটাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আরো বিপদে পড়েছি।”
“বাসায় পৌঁছে দিয়েছেন?”
“হাত দিয়ে রক্ত ঝরছিল।”
আচ্ছা।” মুবিন লম্বা করে মাথা নাড়াল।
ইমাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এখন আমাকে উদ্ধার করো।”
মুবিন বিরক্ত মুখে চেয়ে রইল। ইমাদ না চাইতেও বলল, “আমি ওকে বলেছি আমি মেয়েটাকে চিনি না। তোমার সাথে ঝগড়া বাঁধায় এগিয়ে গিয়েছি। বিশ্বাস করছে না। তোমার সাথে কথা বলতে চায়।”
মুবিন আবার হামি তুলল। ইমাদ বলল, “তোমার ঘুম নষ্ট করলাম।”
“জি।” উঠে দাঁড়াল সে। দুমদাম করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল। ইমাদও উঠে দাঁড়াল। আবার বলল, “ও তোমার সাথে কথা বলতে চায়।”
মুবিন না থেমে বলল, “আচ্ছা।”
ইমাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “আচ্ছা মানে কি হ্যাঁ নাকি না?”
“ভাবুন, ভাবুন। আচ্ছা মানে কি ভাবতে থাকুন।” মুবিন টগবগ করে চলে গেল।
ইমাদ পড়ে গেল মুশকিলে। নীচে গিয়ে কড়ির সাথে কথা বলল। কড়ি শুনে শব্দ করে হেসে ফেলল। পরে বলল, “ছেলেটাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে।”
“আমাকে ভুগাল বলে?”
কড়ি রহস্য করে বলল, “কি মনে হয়?”
ইমাদ কথা ঘুরিয়ে বলল, “ও কথা বলবে বলে মনে হয়?”
“এখনও বলা যাচ্ছে না।”
ইমাদ চিন্তায় পড়ে গেল। এই আচ্ছা মানে কি কথা বলবে নাকি বলবে না? তখনও দুজনের কানে ফোন ধরা। কড়ি হঠাৎ বলল, “কথা বলবে।”
“কেন মনে হলো?”
“খুব সোজা৷ বলব?”
“জি।”
“গোলাপের পাঁপড়ি গুণে বের করেছি।” বলে সে আবার হেসে ফেলল।
ইমাদ বলল, “পাঁপড়িগুলো ছিঁড়ে ফেলেছেন?”
“কষ্ট হলো?”
ইমাদ বলল, “গোলাপ তো আমার দেওয়া নয়। কষ্ট কেন পাব?”
“গোলাপ আপনার দেওয়া নয় এটাই তো কষ্ট।”
“আচ্ছা।”

পরদিন ভোরে ইমাদ গেল ফুলের দোকানে। শুধু শুধু টাকা জলে ফেলে এক মুঠো গোলাপ কিনল। কড়িকে দেওয়ার জন্য নয়। পাঁপড়ি ছিঁড়ে গুণে দেখবে সে। কড়ির গয়না দিতে পারবে নাকি পারবে না পরখ করার জন্য। সেই ভোরেই কড়ি বেরুলো বইয়ের দোকানে। ঢাকা শহরের বইয়ের দোকানগুলোর আনাচকানাচে সে কিশোরকিশোরীদের উপর লেখা বিভিন্ন সাইক্যোলজির বই, ম্যাগাজিন, খুঁজতে লাগল।
.
রিমা দরজা খুলে একগাল হাসল, “এতদিন কোথায় ছিলে? ভুলেই গেলে মনে হলো।”
তাহমিদ বলল, “এখন কি তাই শাস্তি দিবে? ভেতরে আসতে দিবে না?”
রিমা সরে বলল, “এসো ভাই এসো।”
দীপা শ্বশুরকে সকালের নাশতা দিচ্ছিল। ওড়নায় হাত মুছে আসতে আসতে বলল, “কে এসেছে, রিমা আপু?”
রিমা যতক্ষণে বলল কাদিনের প্রিয় বন্ধু তাহমিদ এসেছে ততক্ষণে দীপা ড্রয়িংরুমের দরজায়। তাহমিদকে দেখে সে সরে পড়ছিল। তার আগেই রিমা বলল, “এসো পরিচয় করিয়ে দিই।”
তাহমিদ দীপার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা পরিচিত।”
“পরিচিত?”
দীপা বিস্ময়, ক্রোধ আর ভয় মিশ্রিত চোখে চেয়ে রইল। তাহমিদ দীপার চোখে চোখ রেখে হেসে বলল, “বিয়েতে পরিচয় হয়েছে।”
দীপা মুহূর্তটা থেকে মুক্তি পেল কাদের সাহেবের বদৌলতে। কাদের সাহেব দীপাকে ডাকছেন। দীপা বলল, আসছি, বাবা।”
কাদের সাহেবের কাছে গেল সে। রিমা গেল তাহমিদের জন্য চা নাশতার ব্যবস্থা করতে। সব ট্রেতে সাজিয়ে সে ট্রে নিয়ে এল দীপার কাছে। বলল, “নিয়ে যাও৷ আমি সব গুছিয়ে আসছি।”
দীপা ঢোক গিলল একটা। ট্রে হাতে নিয়ে বলল, “আমি গুছাই।তুমি যাও গল্প করো।”
রিমা বলল, “তুমি ছোট মানুষ। এত কাজ করতে হবে না তো।”
দীপা এই ঘাবড়ে যাওয়া অবস্থাতেও হেসে ফেলল। আদুরে গলায় বলল, “তুমি কি আমার শাশুড়ি নাকি?”
“ওরকমই ভেবে নাও। তটস্থ থাকবে ভয়ে।”
দীপা হাসতে হাসতে ট্রে নিয়ে ড্রয়িংরুমে গেল। তাহমিদ বলল, “কি অবস্থা, দীপা? মনে হচ্ছে ভালোই আছো।”
দীপা বলল, “অনেক ভালো আছি।”
তাহমিদ চায়ে চুমুক দিলো। দীপা চলে আসছিল। তাহমিদ নীচু গলায় বলল, “ভাবি ডাকব নাকি তোমাকে?”
দীপার এত রাগ হলো যে ও বলল, “আপু ডাকলে বেশি খুশি হব।”
তাহমিদ হেসে বলল, “তুমি বদলাওনি।”
“আমি তো খারাপ না যে বদলে যাব? পারলে তুমি নিজেকে শুধরে নিও।”
“কাদিন অফিসে?”
“এ সময়ে আর কোথায় থাকবে?”
“হ্যাঁ, ও আবার খুব জ্যান্টেলম্যান। পড়াশুনা, কাজ এসব ছাড়া অন্যকিছুতে নেই। আসলে সবকিছুরই অভিজ্ঞতা থাকা ভালো। নাহয় শেষে এমনটাই হয়।”
“এমনটা হয় মানে?”
“সব বলব। একদিন দেখা করি চলো।”
“তোমার মাথা ঠিক আছে?” দীপা চটে গেল।
তাহমিদ বলল, “রেগে যাচ্ছ কেন? তোমাকে নিয়ে ভেগে যাচ্ছি না। তোমাকে আমিই ছেড়েছিলাম।”
“খুব ভালো করেই সব মনে আছে। কতটা কষ্ট দিয়েছিলে তুমি।”
“এখানে আর কথা না। ঐযে রিমা আপু আসছে৷ আমরা বরং একদিন দেখা করি। তোমার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আছে আমার।”
“আমার তোমার সাথে কথা বলার রুচি নেই। ভ্যারি স্যরি।”
দীপা উঠে চলে গেল। তাহমিদ দাঁতে দাঁত পিষল।
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫৭
অফিসে সাইন দিয়ে ফাইল বন্ধ করতে গিয়ে কাদিন থমকাল, তার মুখ কুঁচকে গেল। পিয়ন কাম দারোয়ানকে ডেকে বলল, “একটা ফ্লুইড কিনে নিয়ে আসুন৷”
পিয়ন ফ্লুইড কিনে আনতে গেলে কাদিন টেবিলের উপর থাকা ফাইলগুলোর দিকে তাকাল। কি করেছে সে! হাত দুটো একত্র করে টেবিলের উপর রেখে সেখানে মাথা ঠেকাল। প্রতিটা ফাইলে নিজের নাম স্বাক্ষরের বদলে দীপা! দীপা! দীপা! শিট! এখানে দীপার কি আছে? সকালে আসার সময়ও তো দীপা তার সাথে কথা বলেনি। মুখ ঘুরিয়ে শুয়েছিল।

ফ্লুইড পেয়ে ব্লান্ডার করে দেয়া কাজ আবার ঠিক করতে বসল কাদিন। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দীপার সহ্য ক্ষমতা ভালোই। গত রাতে এবং আজ সকালে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তার মানে কাদিন সত্যিই বাড়াবাড়ি করে ফেলছে। কিন্তু সে ঠিক ইচ্ছে করে এমনটা করে তাও নয়। সে সহজে কিছু ভুলতে পারে না। একবার তাকে কেউ অনুচিত কথা বললে সে রেশ তার মাঝে আজীবন থেকে যায়। সে অনুচিত কিছু করে না। তাই কেউ তার সাথে করলেন সেও মেনে নিতে পারে না। তার সঙ্গে দীপার সম্পর্ক আর পাঁচটা স্বামী স্ত্রীর মতই। মাঝে মাঝে তারচেয়েও বেশি মধুর। কিন্তু যেই মুহূর্তে দীপা আবেগে টইটম্বুর, খুব রোমান্টিক মুডে থাকে তখন তার মনে একটা ঝামেলা বাঁধে। দীপার মুড নষ্ট করার ঝামেলা। দীপা কেন তাকে লুচ্চা বলবে? কেউ তাকে লুচ্চা বলবে এই দিনও তাকে দেখতে হলো! সেই কেউটা আবার অন্য কেউ নয়। বরং তার স্ত্রী! এমনও নয় যে সোহাগ করে বলেছে। এখন তাকে হাজারবার লুচ্চা বললেও সে ক্ষ্যাপত না। যখন ঝামেলা চলছিল তখন কেন বলল? সম্পর্কের গোড়ার দিকে এসব বলা! অবিশ্বাস্য!
.
মুবিন স্কুলে যাবার জন্য রিকশা ডাকতে গেটের সামনে দাঁড়াতেই ইমাদ বারান্দা থেকে তাকে ডাকল। উপর থেকে বলল, “কথা আছে। দুমিনিট।”
মুবিন ঘাড় উঁচিয়ে তাকাল৷ বলল, “আচ্ছা।” ইমাদ হুড়মুড়িয়ে নীচে নামল, কিন্তু নীচে এসে দেখল মুবিন চলে গেছে। সে আবার মেসে ফিরে যেতেই মুবিন অন্য বিল্ডিংয়ের আড়াল থেকে দাঁত ক্যালিয়ে হাসতে হাসতে বেরুল। কিন্তু ইমাদও কম কিসে? সেও আবার মেস থেকে বের হয়ে মুবিনকে খপ করে ধরে ফেলল। সেও গেটের ভেতর দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় ছিল। মুবিনকে সে খুব ভালো করে চেনে। মুবিন থতমত খেয়ে বলল, “কি?”
ইমাদ বলল, “আরে ভাই আসলেই বিপদে আছি আমি। আর তুমি মশকরা করো? কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ।”
মুবিন বলল, “কোথায় মশকরা করলাম? আপনার জন্য কি আমি খোলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্যান্টের চেইন ঠিক করব? আপনি করেন নাকি?”
ইমাদ সেসবে কান না দিয়ে বলল, “কথা বলবে?”
মুবিন বলল, “আচ্ছা।”
“এটা কোন আচ্ছা? হ্যাঁ, আচ্ছা নাকি না আচ্ছা।”
“কি মনে হয়?”
ইমাদ খানিক ভেবে ইচ্ছে করে বলল, “নাসূচক আচ্ছা।”
এবং মুবিন প্রায় সাথে সাথেই শুধু ইমাদকে ভুল প্রমাণ করতে বলল, “কী অদ্ভুত! এটা হ্যাঁসূচক আচ্ছা।”
.
কাদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে শার্ট খুলতে খুলতে বলল, রাতে একটা দাওয়াত আছে।”
কাদিনের জন্য তিনদিন পর পর বালিশের কভার বদলাতে হয়। এমন না করলে নাকি চুলের ক্ষতি হয়। দীপা বালিশের কভার খুলে নতুন কভার লাগাচ্ছিল। সে চুপচাপ নিজের কাজ করতে থাকল। কাদিন তাকিয়ে দেখল এখনও দীপা গাল ফুলিয়ে রেখেছে। সে ফ্রেশ হতে চলে গেল। অনেকক্ষণ পর বাথরুম থেকে গলা উঁচিয়ে বলল, “টাওয়াল আনতে ভুলে গেছি।”
দীপা টাওয়াল নিয়ে বাথরুমের দরজায় নক করলে কাদিন দরজা খুলে টাওয়াল সহ দীপার হাত ধরে টেনে বলল, “এসো।”
দীপা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “না যাব না। সেদিন কেন ওমন করেছিলে তুমি? তোমার ইচ্ছাই শেষ কথা না।”
কাদিনও হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে।” সে টাওয়াল নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। ফ্রেশ হয়ে এসে আলমারি খুলে দীপা কোন শাড়িটা পরবে, শাড়ির সাথে কি কি ম্যাচিং করে পরবে সব সময় নিয়ে স্যাট করে গেল দীপাকে ডাকতে। দীপা রিমার সাথে রিমার ঘরে বসে গল্প করছিল। কাদিন রিমার দরজায় নক করে বলল, “আপু আসব?”
রিমা ঠাট্টা করে বলল, “বউকে নিতে এলি? যা ভাই নিয়ে যা তোর বউ।”
কাদিন বলল, “একটা ডিল সাকসেসফুল হওয়ায় বস সব এমপ্লয়িদের ট্রিট দিচ্ছেন। বউসহ দাওয়াত।”
“অবিবাহিতদের কি হবে?”
“প্রেমিকাসহ যেতে চাইলে যাবে।”
“আর প্রেমিকা না থাকলে একা যাবে?”
“সেরকমই। দীপা, তৈরী হও। দেরি হচ্ছে আমাদের।”
দীপা বলল, “আমার তৈরী হতে দশ মিনিট। আমি তৈরী হয়ে বসে থাকত পারব না।”
কাদিন মনে মনে প্রচন্ড বিরক্ত হলো। এই মেয়ে কি একবার তার দিকে তাকাবেও না? কত সুন্দর কেতাদুরস্ত হয়ে সে তৈরী হয়ে এসেছে! বউই যদি না তাকায় কি লাভ এই টিপটপ থাকার? রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে একশোটা মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মত গুছানো ছেলে পুরো কুমিল্লা শহরে আর একটা থাকলে সে তার নাম বদলে ফেলবে। আর এই অন্ধ মেয়ে তাকে বলে তৈরী হতে! আর কি তৈরী হবে সে? এতক্ষণ কি তাহলে সে নেচেছে? কাদিন বিরক্তিতে কাঁদা হয়ে বলল, “আমি রেডি।”
দীপা উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। খুব দ্রুত শাড়ি পরে সেজেগুজে সে বের হয়ে এল। অন্যদিন এসে কাদিনকে জিজ্ঞেস করে, “সব ঠিকঠাক? তুমি তো এসব ভালো বুঝো। দেখো তো ভালো করে।”
কাদিনও নিখুঁতভাবে তার ফিডব্যাক জানায়। আজ এসবের কিছুই বলল না দীপা। তাই কাদিনই বলল, “এত বড় হ্যান্ডব্যাগ! তুমি ছোটখাটো, পাতলা মানুষ৷ ছোট কোনো হ্যান্ডবাগ নিলে ভালো হয়।”
দীপা ঘরে ফিরে গেল। কাদিনও পিছু পিছু গিয়ে দেখলো দীপা হ্যান্ডব্যাগ উল্টে ব্যাগের সব জিনিসপত্র ড্রেসিংটেবিলে ফেলল। তারপর জরুরি যা কিছু তা ছোট হ্যান্ডব্যাগে নিয়ে নিলো। ঠোঁটে হাসির ছিঁটা পর্যন্ত নেই। গাল দুটো থমথম করছে। দাওয়াতে গিয়েও এই অবস্থা বহাল রইল। অন্যদিন কাদিন দীপার অনর্থক বেশি কথা বলা, এবং হাসাহাসি করা নিয়ে আতঙ্কিত থাকে। বারবার ইশারায় এটাওটা বুঝিয়ে বলে। আজ যে কথাটুকু না বললেই নয় দীপা ওটুকুও বলতে চাইল না। এমন দীপাকে কাদিন চেনেই না!
.
কড়ি কাপে চা ঢালতে ঢালতে গুনগুন করল, “এখন তো সময় চা খাওয়ার,
চা আর কড়ির কাছে আসার।
চা যে একা, আমিও যে একা
লাগে যে ভালো,
ও চা… ও চা….
মহানন্দে সে কাপ নিয়ে আয়েশ করে বসল। জানালা দিয়ে হাওয়া আসছে। সবটা মন দিয়ে সে চায়ে চুমুক দিলো। এই সময়ের নাম চায়ের সময়। চা পান করার সময়টা সে যতটা পারে দীর্ঘ করে। তবে আজ খুব দ্রুত ইতি টানতে হলো। কারণ ইমাদের নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে, “মুবিন কথা বলবে। ওর নাম্বার ০১*********। কাইন্ডলি কল হিম।”
কড়ি দেরি করল না। চা বাদ রেখে সে সাথে সাথে মুবিনকে কল করল। দেরি করা ঠিক হবে না। ছেলেটা মত পাল্টে ফেলার আগেই তার সাথে খাতির জমাতে হবে।
মুবিন আইপ্যাডটা স্তূপীকৃত তার নামকাওয়াস্তে টেবিলে সাজিয়ে রাখা গাইড বইগুলোর উপর হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে হাতে বার্গার নিয়ে বসল। বার্গারে মস্ত বড় বড় কামড় বসিয়ে সে অ্যানিমেটেড ইংরেজী সিনেমা দেখছে। এরমাঝে মোবাইল বেজে উঠায় সে মোবাইল বন্ধ করে ছুড়ে ফেলে আইপ্যাডে ফিরে এল। পুরো সিনেমা দেখা শেষ করে সে আবার পেস্ট্রি খেল। তারপর যখন তার মন চাইল তখন মোবাইল খুলে সেই নাম্বারটায় কল করে বড়দের মত বলল, “কাকে চান?”
কড়িও বলল, “আমি মুবিন সাহেবকে চাইছি।”
মুবিনের বড় হতে ইচ্ছে করে। অনেক বড়। কড়ি তাকে ত্রিশ সেকেন্ডে ছোট্ট মুবিন থেকে মুবিন সাহেব করে দিলো। মুবিনের মনে হলো ইমাদ স্যারের গার্লফ্রেন্ডকে কিছু সময় দেয়াই যায়।
চলবে…

একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-৫২+৫৩+৫৪

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫২
স্কুলের মাঠে সুহা একদল মেয়ে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। মিলাও সঙ্গে ছিল। মুবিন সুহাকে ইশারায় কিছু বলল। সুহা চেঁচিয়ে আঙুল উঁচিয়ে বলল, “ইশারা করো কেন? যা বলার সামনে এসে বলো।”
গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েদর দলটা মুবিনের দিকে ঘুরে তাকাল। মুবিন মাথা উঁচু করে গম্ভীর ভঙ্গিতে হেঁটে এগিয়ে এল। মিলা অবাক হয়ে বলল, “কিছু বলবি?”
মুবিন সুহার দিকে আঙুল তাক করে বলল, “ওর সাথে কথা।”
সুহা মুখ বাঁকিয়ে বলল, “বলুন, জনাব।”
মেয়েরা হাসতে গিয়েও মুবিনের ভয়ে কেউ হাসল না। মুবিন বলল, “আমার সুহার সাথে কথা আছে।”
মিলা বাদে সবাই সরে গেল। মুবিন মিলার দিকে তাকাল। মিলা বলল, “আমি যাব না।”
মুবিন চোখ উল্টে বিরক্ত হয়ে বলল, “আচ্ছা সুহা শুনো। দোষ তোমারও৷ বলো সন্দেহ করোনি আমাকে?”
“ভালো করেছি সন্দেহ করেছি। তুমি সন্দেহ করার মত পাবলিক।”
মিলার কোটর থেকে চোখজোড়া বের হওয়ার উপক্রম হলো। সে ঘন ঘন চোখের পলক ফেলে বলল, “মানে কি? কিসের সন্দেহ? তোরা একজন আরেকজনকে ডেইট করছিস?”
মুবিন সুহা দুজনই একসাথে মিলার দিকে তাকিয়ে ঝারি মেরে বলল, “তুই চুপ থাক।”
মিলা মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মুবিন বলল, “তুমি আমাকে বিশ্বাস করে তোমার সবগুলো প্র্যাক্টিকেল খাতা একেবারে দাওনি বলে ক্ষেপেছিলাম। মাথা ঠান্ডা হওয়ার পর ধন্যবাদ দিতেই কেকটা পাঠিয়েছি। টাকার গরম মনে করার কিছু নেই।”
সুহা আবার মুখ বাঁকাল। মিলা বলল, “কিসের কেক? কিসের প্র্যাক্টিকেল খাতা? তোরা কি নিয়ে কথা বলছিস?”
মুবিন বলল, “এক থাপ্পরে দাঁত ফেলব মিলা।’
সুহা বলল, “অ্যাই, আমার বান্ধবীকে ধমকাবে না তুমি। খবরদার।”
মুবিন বলল, “যাকগে থ্যাংকস।”
সুহা বলল, “আচ্ছা আমিও স্যরি।”
“এই তো লাইনে এসেছ।”
সুহা খুব ভাব নিয়ে বলল, “এখন ফুটো।”
মুবিন বলল, “আমি তারিখ লিখতে ভুলে গেছি।”
সুহা বলল, “আজ তো আনিনি কাল নিয়ে আসব।”
“আজই লাগবে। এমনিতে অনেক দেরি হয়ে গেছে।”
সুহা একটু ভেবে বলল, “তুমি ছুটির সময় আমার সাথে এসো। এখন খাতা বাসায়।”
“তোমার বাসায় সমস্যা হবে না?”
“তা একটু হবে। আম্মু ঝামেলাবাজ। সমস্যা নেই আমি সামলে নিব।”
মিলা এতক্ষণে বুঝল। মুবিনের প্র্যাক্টিকেল খাতা দরকার৷ সে বলল, “তুই আমারগুলো নিয়ে নে। উফ আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
“তোর খাতা তোর কাছেই রাখ। আমাকে কখনো দিতে আসবি না।” মুবিন ঘাড় শক্ত করে বলল।

স্কুল ছুটি হলে মুবিন সাইকেলে বসে একটা পা রাস্তায়, অন্য পা প্যাডেলে রেখে অপেক্ষা করছিল। ভিড়ের মাঝে মুবিনকে খুঁজে বের করতে সুহার কষ্ট হলো। পেয়ে বলল, “ধুর মিঞা তুমি গেইটের বাইরে এসে পড়েছ। আর আমি ভিতরে খুঁজতে খুঁজতে শেষ।”
মুবিন কথা বলার প্রয়োজনবোধ করল না। মেয়েরা ফাউ কথা বেশি বলে। সুহা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রিকশা নেওয়ার চেষ্টা করল। দামাদামিতে বনছে না তার। মুবিন অন্যদিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে করতে বলল, “ভাড়া তো ত্রিশ টাকাই।”
সুহা বলল, “বলেছে তোমাকে! আমি প্রতিদিন পঁচিশ টাকা দিয়েই যাই।”
মুবিন বিরক্ত হলেও কিছু বলল না। কিছু বললে বলবে টাকার গরম।
অনেকটা সময় পর যখন বেশিরভাগ ছাত্র ছাত্রীরাই চলে গেল। রাস্তা ফাঁকা হলো তখন সুহা পঁচিশ টাকা দিয়ে রিকশা ঠিক করল। মুবিন রিকশা অনুসরণ করে সুহার পেছন পেছন গেল। বাসায় পৌঁছে সুহা রিকশা থেকে নেমে মুবিনকে বলল, “বাসায় এসো।”
“না।”
“আচ্ছা দাঁড়াও তুমি।”
সুহা এক দৌড়ে ভেতরে গিয়ে তার প্র্যাক্টিকেল খাতাগুলো খুঁজে নিয়ে এল। মুবিনকে খাতাগুলো দেওয়ার সময় বারান্দা থেকে সুহার মা ওদের দুজনকে দেখল। সুহাও খেয়াল করল মা তাকিয়ে আছে। মুবিন চলে গেলে সে বাসায় গেল। মা কিছু একটা বলতে চাইছিলেন তার আগেই সুহা হাত দেখিয়ে মাকে থামাল, “শুনো শুনো ঐ পুঁচকে পোলাপানের সঙ্গে আমি আর যাই করি প্রেম করব না। যাও নাকে তেল দিয়ে ঘুমাও।”
.
ইমাদ রাতে মুবিনের রুমমেটের সাথে দেখা করবার ছুঁতোয় মুবিনের ঘরে ঢুকল, “আলি ভাই আপনার কাছে স্ক্রু ড্রাইভার আছে?”
মুবিন উগ্র চোখে তাকাল একবার। পরে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ইমাদ কথা বলতে বলতে মুবিন কি করছে লক্ষ্য করে চিন্তিত হয়ে পড়ল। সে টেবিলে একটার পর একটা প্র্যাক্টিক্যাল খাতা তুলছে আর শরীরে সর্ব শক্তি দিয়ে পাতাগুলো মাঝখান থেকে ছিঁড়ে ফেলছে। প্রতিটা পাতা ছিঁড়বার সময় তার ঠোঁটে ক্রুর হাসি।

.
সুহা অনেক রাতে ইমাদকে কল করল। ইমাদ কল ধরল না। সুহা মেসেজে লিখল, “আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায়? কয় ভাই বোন আপনারা? আপনি কি আমার সাথেই এত চুপচাপ? নাকি সবার সাথে এমন? আমার কণ্ঠটা সুন্দর না? কল ধরুন।”
ইমাদ রিপ্লাইয়ে লিখল, “আপনি কে?”
সুহা লিখল, “আমি খুবই মিষ্টি দেখতে দুষ্টু একটা মেয়ে। সবাই বলে আমার চোখজোড়া কথা বলে। আমার চুল কালো, লম্বায় কাঁধ পর্যন্ত। আর আমি লম্বায় একদম আপনার বুকের কাছে পড়ব। পড়াশুনায় মোটামুটি। নাচতে জানি। মাঝে মাঝে মেঘলা দিনে ছাদে উঠে নাচি। তবে লুকিয়ে লুকিয়ে। মা দেখলে পিঠের ছাল তুলবেন৷ ভালো লাগে আপনাকে। অন্যায় এবং টাকার গরম অপছন্দ করি। ঠাশ ঠাশ কথা বলা বদভ্যাস (মায়ের দৃষ্টিতে)। বন্ধু হিসেবে আমি সেরা। এই ছিল আমার জীবনবৃত্তান্ত।”
ইমাদ লিখল, “আপনার নাম কি?”
সুহা লিখল, “আমার নাম নেই। আমি অনামিকা। কল ধরুন৷ আপনার সঙ্গে কথা আছে।”
ইমাদ লিখল, “আগে নাম বলুন।”
“বলব না।”
“আচ্ছা।”
সুহা কল দিলো। ইমাদ মোবাইল বন্ধ করে ফেলল।
চলবে ইনশাআল্লাহ….

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫৩
শিল্পী মিলার সাথে দেখা করতে এসেছে। প্রায়দিনই আসে৷ আজ মিলার বিছানায় শুয়ে নেতিয়ে রইল। বলল, “আর কদিন একা থাকলে আমি মরে যাব৷ একা বাসায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।”
মিলা বলল, “তুমিও কোনো কর্মজীবী হোস্টেলে উঠে যাও।”
শিল্পী বালিশ থেকে মাথাটা তুলে মিলার দিকে তাকাল। মিলা পড়ার টেবিলে। কিছু একটা লিখছে। শিল্পী নরম গলায় বলল, “তবুও বললি না যে মা আমি তোমার সঙ্গে থাকব।”
মিলা লিখতে লিখতেই বলল, “আমার পরীক্ষা যে… বারবার এদিকওদিক হলে পড়ায় মন বসে না।”
“তাহলে এ কদিন নাহয় কষ্ট করি৷ এরপর তুই আমার কাছে চলে আসবি।”
“সম্ভব হবে না, মা। আমি ঢাকা গিয়ে হলিক্রসে ভর্তি হব। কুমিল্লা আর থাকব না।”
শিল্পী উঠে বসল, “আমি বদলি হয়ে তোর সাথে ঢাকা যাব।”
“মুবিনের কি হবে?”
“ওকেও ঢাকার কোনো কলেজে ভর্তি করাব।”
মিলা খাতা বন্ধ করে বলল, “ও রাজি হবে না।”
“নাহলে এখানেই থাকুক। ইমাদ যতদিন আছে সমস্যা হবে না।”
“তুমিও এখানে থাকো।”
শিল্পী বিছানা থেকে উঠে এসে মিলার পাশে দাঁড়াল। মিলার মুখটা দুহাতে তুলে ধরে বলল, “আমার উপর তোর অনেক রাগ, মিলা।”
মিলা মায়ের হাত ধরে হেসে বলল, “কই না তো!”
“তোকে জোর করব না। সবসময় তোকেই জোর করি। কাজটা ঠিক না। আজীবন তোর বাবা, আর মুবিনের কাছ থেকে কষ্ট পেয়ে পেয়ে সেই রাগ আমি তোর উপর ঝেরেছি। লক্ষী ছিলি যাই করতাম, বলতাম বিনা তর্কে মেনে নিতিস।” শিল্পীর গলা ধরে এল।
মিলা বলল, “শুয়ে থাকো, মা। তোমার শরীরটা ভালো না।”
শিল্পী গিয়ে শুয়ে রইল। মিলার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু বইয়ের পাতায় পড়ল। সে অযথাই বই খুলে রেখেছে।
জানালা দিয়ে দল বেঁধে বিকেলের মশাগুলো ঢুকছে। মিলা উঠে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করল। কয়েলের প্যাকেট থেকে কয়েল বের করে ধরিয়ে শিল্পীর পায়ের কাছে রাখল। শিল্পী হঠাৎ বলল, “মুবিন কিছু বলেছে তোকে?”
“কি বলবে?”
“ওর সাথে কথা হয়না?”
“ওকে তো চিনো, মা।”
শিল্পী দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে বলল, “মুবিন আমাকে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখেছে।”
মিলা দাঁড়িয়ে থেকেই জানতে চাইল, “পরে?”
শিল্পী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ও আমাকেও ওর বাবার মত ভেবেছে।”
“তুমি কখনোই বাবার মত না। তুমি একজন অনেক ভালো মা।” মিলার প্রতিক্রিয়া।
শিল্পী অন্যদিকে মুখ করেই ফুঁপিয়ে উঠল।
.
যে ছেলেটা সুহার চিঠি মুবিনকে দিয়ে ঘুষি খেয়েছিল সে ছেলেটিকে দিয়েই মুবিন মিলার ছেঁড়া প্র্যাক্টিকেল খাতাগুলো পাঠিয়েছে। সাথে খাতা থেকে হুট করে ছিঁড়ে নেয়া ছোট একটা এবড়োথেবড়ো সাদা কাগজে বাজে হাতের লেখায় লিখা, “স্টুপিড।”
খাতাগুলো উল্টেপাল্টে দেখে সুহার চোখে পানি চলে এল। এখন এই শেষ মুহূর্তে এসে সে পড়বে নাকি এসব করবে? আর সাইন! দোকান থেকে করিয়ে আনলেও স্যার, ম্যাডামরা কেউ সাইন করবেন না নতুন করে। হাতে পায়ে ধরে করালেও অনেক অনেক বকুনিঝকুনি। মিলা সুহার কাঁধে হাত রাখল। খুবই লজ্জিত হয়ে বলল, “স্যরি, সুহা। আমার খুবই খারাপ লাগছে। আমি তোকে সব লিখে দিব।”
সুহা ধরে আসা গলায় বলল, “আমি মুবিনকে মেরে ফেলব।”
মিলা একইসাথে বিস্মিত ও হতাশ হয়ে বলল, “ও কেন এমন করল?”
সুহা সে উত্তর দিলো না৷ ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, “ও কোথায়?”
ছেলেটা বলল, “মুবিন খাতাগুলো আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেছে। স্কুল ড্রেস পরে আসেনি৷ বাইরের পোশাক ছিল। গেইট থেকেই চলে গেছে।”
স্কুলের অ্যাসেম্বলি এখনও শুরু হয়নি। সুহা চট করে সিঁড়ি বেয়ে ক্লাসে গেল। ডেস্ক থেকে স্কুল ব্যাগটা টেনে নিয়ে কাঁধে তুলে দৌড়ে নীচে নেমে স্কুল থেকে বেরিয়ে গেল। মিলা পেছন থেকে অনেক ডাকল। সে শুনলই না। বের হয়ে খানিক সামনে হেঁটে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করল। স্কুলে সে লুকিয়ে মোবাইল নিয়ে আসে। কেউ জামে না। মুবিনের নাম্বারে কল করল সে। মুবিন কল হতে না হতেই ধরে ফেলল। বিশ্রী আনন্দে বলল, “অপেক্ষা করছিলাম। এত দেরি কেন?”
সুহা সোজা তুইতোকারি শুরু করল, “তুই কোথায় গিয়ে লুকিয়ে আছিস? সাহস থাকলে আমার সামনে আয়।”
মুবিন মোবাইলটা কাঁধ দিয়ে কানে চেপে ধরে বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, “আমি তোর মত মেয়ের পিছনে ঘুর ঘুর করব কোন দুঃখে? তোর দরকার হলে তুই আমার পেছনে আয়।”
সুহা ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, “আমি তোর নামে মামলা করব।”
মুবিন কায়দা করে বাদাম শূণ্যে উড়িয়ে মুখে নিয়ে বলল, “প্র্যাক্টিকেল খাতা নষ্ট করবার মামলা? ভেরি গুড।”
“নাহ ইভিটিজিং এর মামলা।”
“তোর কোনো চেহারা আছে? তোকে কে করবে ইভটিজিং?”
সুহা হিসহিসিয়ে উঠল, “মোবাইলে বাহাদুরি করা বন্ধ করে সামনে আয়। তোকে আমি নিজ হাতে শায়েস্তা করব।”
মুবিন বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্টে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া বাদামের খোসাগুলো ঝেরে বলল, “মেসের ঠিকানা দিচ্ছি। মরতে মন চাইলে চলে আয়।”

সুহা ঠিক ঠিক মেসে গেল। মেসের সামনে দাঁড়িয়ে মুবিনকে আবার কল করে বলল, “আমি তোর মেসের সামনে। তুই আয়।”
মুবিন কল কেটে দিয়ে হেলেদুলে মেসের গেইট থেকে বেরুলো। মুবিনকে দেখার সাথে সাথে সুহা মুবিনকে মারতে গেল। মুবিন সুহার হাত ধরে মুচড়ে দিলো। ব্যথায় ককিয়ে উঠল সুহা। ইমাদ তখন মেসে ছিল না। সে গিয়েছিল পাউরুটি আর কলা কিনতে পাশের গলির দোকানে। সে পাউরুটি কলা নিয়ে হেঁটে এসে হতভম্ভ হয়ে গেল। হ্যাংলা পাতলা মেয়েটি মুবিনকে ধাক্কা দেয়ার চেষ্টা করতেই মুবিন মেয়েটিকে এক ধাক্কায় নীচে ফেলে দিলো। মেয়েটি রাস্তায় পড়ে কনুই ছিলে ফেলল। মানুষজন হেঁটে যেতে যেতে বারবার তাকাচ্ছে, হাসছে। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে মোবাইলে দৃশ্য ধারণ করছে কিন্তু কেউ এগিয়ে এসে দুজনকে ফেরানোর প্রয়োজন মনে করল না। ইমাদ হাতের পাউরুটি কলা ফেলে দ্রুত গিয়ে মুবিনকে সামনে থেকে জাপটে ধরল, “মুবিন শান্ত হও৷ ভেতরে চলো।”
মুবিন শরীর বাঁকিয়ে ইমাদের হাত থেকে বেরিয়ে যেতে চাইল। বলল, “আপনি সরুন। ছাড়ুন আমাকে।”
সুহা রক্তঝরা কনুই চেপে ধরে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে করতে দেখল তাকে খলনায়ক মুবিন থেকে উদ্ধার করতে স্বয়ং নায়ক ইমাদ স্যার চলে এসেছেন৷ ইমাদ মুবিনকে ঠেলে ভেতরে নিয়ে বাইরে থেকে গেইট আটকে দিলো। সুহার দিকে তাকিয়ে সুহার হাত ধরল। বলল, “রক্ত পড়ছে। চলো আমার সাথে।”
সুহার মনে হলো সে এখনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। হাত থেকে রক্ত ঝরছে এজন্য নয়, ইমাদ তার হাত ধরেছে তাই। মুবিন ভেতর থেকে ষাঁড়ের মতন গেইটে এলোপাথাড়ি লাথি বসাচ্ছে। সুহা সে শব্দে বিরক্ত হলেও মুবিনকে ইমাদের ওয়াস্তে মাফ করে দিলো। ইমাদ তার হাত ধরেছে! এর জন্য আরো হাজারটা প্র্যাক্টিকেল খাতা লিখা যায়, নষ্ট করা যায়, জলে ফেলা যায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫৪
সুহাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ইমাদ সাইকেলটা একটা সাইড করে রাখল। কিছুক্ষণ একা দাঁড়িয়ে রইল। কত বয়স হবে মুবিনের? এক ক্লাসে দুইবার পড়লেও ষোলো সতেরোর বেশি বয়স হবে না। মিলা অবহেলিত-উপেক্ষিত ছিল বলে তার দুঃখ হতো। অথচ, মুবিনকে ঘুণপোকারা খেয়ে ফেলছে। মিলাকে নিয়ে চিন্তা নেই। মিলা খুব ভালো করবে, একদিন ভালো থাকবেই। কিন্তু তছনছ হয়েছে মুবিন। মুবিনকে সে বুঝেনি, কেউ বুঝেও না। ইমাদ অনেক চিন্তা করল। যদি কিছু একটা করতে পারত ওর জন্য! সেখানে দাঁড়িয়েই সে একটা মেসেজ লিখল। মেসেজে লেখা “এইবার সত্যিই খুব জরুরি কথা।” প্রাপক কড়ি।

সুহা জানালা দিয়ে দেখল ইমাদ স্যার এখনও তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে। এখনও যাননি৷ বাসায় এনে এক কাপ চা খাওয়াতে ইচ্ছে করছে। কতবার বলল সে, ইমাদ স্যার এলেন না। সুহাও কম না। চট করে চা বানাতে চলে গেল সে। রান্নাঘরে গিয়ে চা করল। চায়ের কাপ হাতে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল ইমাদ স্যার নেই। বিড়বিড় করল, “হুম অদৃশ্যমানব!”
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বাসায় ফিরে গেল। ধরে নিলো, সে চা পান করা যে কথা, ইমাদ স্যার পান করাও একই কথা। সে কি আলাদা নাকি! মন থেকে সে এখন ইমাদ স্যারের সাথে মিলেমিশে একাকার। নিজের ভাবনায় নিজেই হাসতে হাসতে বাসার সিঁড়িতে গরম চা ফেলল। তারপর সে চায়ে পিছলে পড়ে আবার ব্যথা পেল। কাপ ভাঙল, মা উপর থেকে চেঁচিয়ে উঠল। তবুও সে হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল। আজ খুশি খুশি দিন। ইমাদ স্যার তাকে নিয়ে ফার্স্ট এইড ব্যান্ডেজ কিনেছে। তারপর নিজ হাতে সেঁটে দিতে দিতে তার দিকে তাকিয়েছে। সেও ইমাদ স্যারের দিকেই তাকিয়েছিল। তিনি তাকাতেই অন্যদিকে চোখ সরিয়ে ফেলেছিল। তিনি শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, “বাসা কোথায়?”
উত্তর দেবার বাহানায় সে সুযোগ পেয়ে গেল। সুযোগ হাতছাড়া না করে কিশোরীর চঞ্চল চাহনি ছুঁড়ে দিয়ে ঠিকানা বলল। তিনি হঠাৎ রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা একটি পাউরুটির প্যাকেট আর কলা তুলে সুহার হাতে দিলো। সুহা বলল, “না, না লাগবে না।”
তিনি শুধু তাকালেন, কিছু বললেন না। সেও বুঝল তিনি তাহলে সত্যি সত্যি কথা কম বলেন৷ আরো জানতে চায় সে। আরো, আরো এবং আরো৷
পরে তিনি আরো বললেন, “তোমার সাথে আসছি।” তিনি রিকশাও ডাকলেন। সুহা আনন্দে বাকরুদ্ধ হয়ে ছিল। কী হচ্ছিল তার সাথে? ইমাদ স্যার পথ চলতে সঙ্গী হবেন? একটা ঘোরের মাঝে সে রিকশায় উঠল, কিন্তু হায় ইমাদ স্যার ভেতর থেকে সাইকেল নিয়ে এলেন! সে ফুঁস হয়ে গেল। এক রিকশায় এলে কি এমন হতো? সে নাহয় একটু শান্তি পেত, আরেকটু অস্থির হতো।
.
অফিসের কাজ করতে করতে কাদিনের মাথাটা ধরে গিয়েছিল। তাই ডেস্কের চেয়ারটা টেনে বারান্দায় নিয়ে গেল। দীপা ঘরে বসে তার নিজের পড়া পড়ছিল। সে বই বন্ধ করে এসে বারান্দায় উঁকি দিয়ে বলল, “কি হয়েছে?”
কাদিন কপালে হাত রেখে বলল, “মাথা ব্যথা।”
দীপা ঘাড় দুলিয়ে বলল, “ম্যাসাজ করে দিব?”
কাদিন বলল, “না।”
“চলে যাবে।”
“এসব অভ্যাস হয়ে যায়।”
“তাহলে একটা আদা দিই। চিবিয়ো। সাথে সাথে মাথা ব্যথা চলে যাবে।”
কাদিন নাকে হাত চেপে ধরে বলল, “অসম্ভব, আমি এখনি গন্ধ পাচ্ছি।”
দীপা শশব্যস্ত হয়ে বলল, “তাহলে লবঙ্গ একটা তাওয়ায় গরম করে এনে দিই। রুমালে রেখে ঘ্রাণ নিবে।”
“লাগবে না। তুমি বসো।”
দীপা ঠাট্টা করে বলল, “ভয় পেও না আমার রুমাল দিব না, বাবু।”
কাদিন অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “আগে কায়েস বিরক্ত করত এখন তুমিও।”
দীপা কাদিনের মুখটা ধরে বলল, “তোমাকে নিয়ে কোথায় যাই বলো। চা- কফিও তো খাও না। সবকিছুতে তোমার অভ্যাস হয়ে যাবে এই এক ভয়।”
কাদিন দীপার হাত সরিয়ে বলল, “গুনী স্বামী পেয়েছ। কদর করো। গিয়ে নিজের বান্ধবীদের জিজ্ঞেস করো। বরের জন্য চা- নাশতা বানাতে বানাতে দিন ফুরোয় ওদের।”
দীপাও ক্যাটক্যাট করে বলল, “আর আমার দিন ফুরোয় তোমার ঘর পরিষ্কার করতে করতে।”
কাদিন চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, “কথা বলে বলে আরো মাথা ব্যথা করে ফেলছ।”
দীপা কোমরে হাত রেখে বলল, “যত দোষ দীপা ঘোষ।”
কাদিন চুপ হয়ে গেল। দীপা বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে অন্তত পানি খাও। পানি খেলেও মাথা ব্যথা কমে।”
কাদিন বলল, “তুমি চুপ করে বসলেই আমার মাথা ব্যথা কমবে৷ চুপ করো।”
দীপা থমথম করে উঠল। বারান্দায় নীরবতার হৈ হৈ। আর একটাও কথা না বলে সে ঘরে চলে যাচ্ছিল। কাদিন চোখ বন্ধ করে আছে। তার চোখে পড়বে না বলে দীপা কিছুটা গিয়ে থেমে দাঁড়াল। ফ্লোরের সাথে পা ঘঁষে ঘঁষে শব্দ তুলে যেতে যেতে কাদিনকে চোখ খুলবার কারণ তৈরী করে দিলো। পায়ের শব্দে কাদিন বুঝল দীপা চলে যাচ্ছে। চোখ খুলে বলল, “চলে যাচ্ছ যে?”
দীপা খুবই বিরক্ত হয়েছে ভান করে বলল, “আহা তোমার জন্য আমি একটু পড়াশুনাও করতে পারব না নাকি?”
“চুপ করতে বললাম সেটা শুনলে, রাগ করলে। অথচ, চুপ করে যে আমার পাশে একটু বসতে বললাম সেটা কানে গেল না, ভালো লাগল না।” কাদিন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল।
দীপা হেসে ফেলল। বলল, “তাহলে ঠিক আছে।”
“চেয়ার নিয়ে এসো যাও।”
“চেয়ার লাগবে কেন?” বলতে বলতে দীপা কাদিনের গলা জড়িয়ে ধরে তার কোলে বসে পড়ল৷ কাদিন দীপাকে ধরতে গিয়েও ধরল না। হাত গুটিয়ে নিয়ে আচমকা রেগে গেল, “বললাম মাথা ব্যথা।” দীপাকে ঠেলে উঠিয়ে দিলো। দীপার খুব গায়ে লাগল, “কাদিন, তোমার সমস্যা কি?”
“কয়বার বলব মাথা ব্যথা?”
শক্ত গলায় কথা বলা দীপার দ্বারা হয় না। তার কণ্ঠ ভিজে এল। কষ্ট পেয়ে বলল, “আমাকে নিয়ে তোমার সমস্যা কি সেটা বলো।”
“তোমাকে বললাম চুপ করো।”
“তুমি খুবই ডমিনেটিং কাদিন৷ সবসময় তোমার কথামত কেন চলতে হবে?” দীপার কণ্ঠ নড়বড়ে।
“ঠিক আছে। কিছু বলব না।”
“তোমার যখন ইচ্ছে কাছে আসবে। অথচ, আমি এলে তুমি আমাকে এভাবে অপমানিত করো। সবসময়।”
কাদিন কিছু বলবার প্রয়োজন মনে করল না। তাই দীপাও বলল, “আমি আর থাকব না।”
চলবে…

একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-৪৯+৫০+৫১

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৪৯
সুহা বটি নিয়ে বসেছে। পেয়ারা কাটছে। প্রায় বিকেলেই তার পেয়ারার নেশা উঠে। পেয়ারা কাটা শেষ। লবণ মরিচ দিয়ে পেয়ারা খেতে যাবে তখনি ঠিক কলিংবেলটা বাজল। সে মহাবিরক্ত! শান্তি বলতে পৃথিবীতে কিছু নেই।
সুহার মা নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখলেন সুহার হাতে কেক। কেকের উপর বড় করে লেখা, “থ্যাংক ইউ।”
তিনি চোখ সরু করে তাকালেন, “কি এটা?”
সুহা বলল, “কেক এটা। চকোলেট কেক।”
“কেক যে আমিও তা দেখতে পাচ্ছি। টাকা কি গাছে ধরে? কোনো জন্মদিন না, উপলক্ষ না কিসের কেক?” তিনি প্রায় হুঙ্কার দিলেন।
সুহা বিরক্ত হয়ে বলল, “আহা, মা। গিফ্ট এসেছে। তোমার টাকা যায়নি।”
“গিফ্ট! কিসের গিফ্ট?”
“একজনকে আমার প্র্যাক্টিকেল খাতা দিয়েছিলাম তাই…” “একজনটা ছেলে না মেয়ে?”
“ছেলে হলে কি হবে আর মেয়ে হলে কি হবে?”
“ছেলে হলে তোর পা ভেঙে দেয়া হবে আর মেয়ে হলে মেয়েটাকে একদিন নিয়ে আসবি বাসায়। এত ভালো মেয়ে! কৃতজ্ঞতার মত সহজ গুণ সবার থাকে না।”
সুহা বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে নিয়ে আসব ওকে।”
“কি নাম ওর?”
সুহা একটু ভেবে মুবিনের বদলে মিলার নাম বলে দিলো। সুহার মায়ের ভ্রু কুঁচকে গেল। এত ভালো ছাত্রী সুহার কাছ থেকে দেখে লিখে? অসম্ভব। মেয়ে কিছু একটা লুকাচ্ছে। কিন্তু এখন তিনি আর কিছু বলবেন না। মেয়ে ডালে ডালে চললে, মাকে চলতে হয় পাতায় পাতায়।
.
সুহা নিজের ঘরে এসে পায়চারি করতে করতে মুবিনকে কল করল। মুবিন কল ধরল না। সুহা বারবার করতে থাকল। সে বিফল নয়। মুবিন বলল, “হ্যালো।”
সুহা তার রিনরিনে গলায় ঝগড়া করে উঠল, “কেক ফেরত পাঠাচ্ছি তোমার ঠিকানা বলো।”
“কেক চাই না? ঝাল কিছু খাবে? আমার আগেই বুঝা উচিত ছিল ঝগড়াটে মেয়েরা মিষ্টি খেতে পারে না। তাদের ডায়রিয়া হয়।”
“কি বললে তুমি? কি বললে?” সুহা রেগে বোম্ব।
মুবিন বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ বলেছি।”
“তুমি থ্যাঙ্ক ইউ বলোনি। তুমি শো-অফ করেছ। টাকার গরম দেখিয়েছ।”
“সবকিছুতেই তুমি টাকার গরম পাও। তোমার মাথায় সমস্যা আছে।”
“আমার ইচ্ছা আমি তোমাকে খুন করব।”
“আমারো একই ইচ্ছা। ভাবছি লোক দিয়ে খুন করাব। টাকার গরম দেখাব।”
মুবিন লাইনটা কেটে দিলো। মেয়েটা বেশি বেশি। ফোন কেটে দেয়ার পরও সুহা আরো কল দিতে থাকল। কাজ হলো না। মুবিন ধরল না। সুহা তাই মেসেজ লিখতে মেসেজবক্সে গেল। মেসেজেই ধুয়ে দিবে মুবিনকে আজ। কিন্তু মেসেজ বক্সের দখিন হাওয়া সুহাকে মুহূর্তেই শান্ত করে দিলো। দখিন হাওয়ার নাম ইমাদ। সুহা গতরাতে ইমাদকে বলেছিল, “কে আপনি বলা ছাড়া আপনার কি কোনো কথা নেই? আমি কে এত জানতে হবে না আপনার। শুধু জেনে রাখুন, আমি ভাত খেতে বসলে আপনি খেয়েছেন কিনা সে চিন্তায় গলা দিয়ে আমার ভাত নামে না। বৃষ্টি নামলে আপনি ঘরে না বাইরে সেটাই ভাবি। ভ্যাপসা গরমে হাত পাখা নিয়ে আপনার কাছে দৌড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে। আপনি ঘুমোবেন আমি বাতাস করব।”
জবাবে ইমাদ লিখেছে, “আচ্ছা।”
সুহা বুকে কোল বালিশ জড়িয়ে আনন্দে কতক্ষণ গড়াগড়ি খেল। বুকের ভেতরের ধুকপুক।
.
অফিস শেষে শিল্পী প্রায়ই বাসা খুঁজতে বের হয়। এখন যে বাসাটা নিয়েছে সেটি অফিস থেকে দূর হয়ে যায়। অফিসের কাছাকাছি একটা বাসা নেওয়ার ইচ্ছা তার। তাই প্রতিদিনই বাসা খুঁজে বেড়ায়। আজ বাসা খুঁজতে বেরিয়ে একটা ঘটনা ঘটল। শিল্পী যে বিল্ডিং এ ফ্ল্যাট দেখছিল সে বিল্ডিংয়েই জুয়েল সাহেব থাকেন। শিল্পী জানতো না। বাড়ি ওয়ালার পাশের ফ্ল্যাটে জুয়েল সাহেব সপরিবারে বাস করেন। শিল্পী বাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা শেষ করে বেরিয়েছে। জুয়েল সাহেবের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে গেল। শিল্পী অবাক। এ বাসায় জুয়েল সাহেব থাকেন! জুয়েল সাহেব বাজারের ব্যাগ হাতে বেরুচ্ছিলেন। শিল্পীকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, “আরে আপনি এখানে?”
শিল্পী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “জি এখানে। ভাবির সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।”
জুয়েল সাহেব চমকালেন, “কি কথা?”
“কথা তো আপনার সাথে না। ভাবির সাথে।”
“ও বাসায় নেই।” বলেই জুয়েল সাহেব তড়িঘড়ি করে বাসায় ঢুকে গেলেন। ভেতর থেকে দরজা আটকে ফেললেন। শিল্পী হেসে ফেলল। জুয়েল সাহেব আজ আর বাজারে যাবেন না। বউকে শিল্পীর কাছ থেকে আগলে রাখবেন। বউয়ের কাছে তার কীর্তিকলাপ ফাঁস করে দেবার ভয় দেখাতে চেয়েছিল শিল্পী। তিনি পুরোদস্তুর আতঙ্কিত। হায়রে নষ্টা পুরুষদের দল!
চলবে ইনশাআল্লাহ….

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫০
ব্যাংকের সামনে রিকশা’টা এসে অলসভাবে থামল। শিল্পী ভ্যানিটি ব্যাগে খুচরা টাকা খুঁজছিল। রিকশাচালকের কাছে ভাংতি নেই। শিল্পী রিকশা থেকে নেমে কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে বলল, “আপনার কাছে ভাংতি হবে?”
লোকটা বলল, “জি হবে। কত টাকা লাগবে?”
“একশো টাকার ভাংতি হলেই হবে।”
লোকটা মানি ব্যাগ বের করে টাকা দিলো। শিল্পী বলল, “ধন্যবাদ।”
লোকটা বলল, “আমি আপনার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছি।”
“জি বলুন।”
“আমি জুয়েলের পুরোনো বন্ধু।”
শিল্পীর চোখ মুখ শক্ত হয়ে এল। রুক্ষ গলায় বলল, “আপনি জুয়েল সাহেবের বন্ধু। আপনার আমার সাথে কি?”
লোকটা একটু ঘাবড়ে গেল। সকাল সকাল শিল্পীর দিনটাই খারাপ হয়ে গেল। জুয়েল সাহেব তাঁর বন্ধুদের সাথেও তাকে নিয়ে আলোচনা করছেন। কতটা নির্লজ্জ, বেহায়া এই লোক! শিল্পী ঠিক করল সত্যি সত্যি জুয়েল সাহেবের স্ত্রীকে বিষয়টা জানাবেন। মহিলার জানার দরকার আছে! বিশ্বাস করবেন কিনা সন্দেহ আছে। কিন্তু কষ্ট পাবেন নিশ্চিত। রাতের ঘুম উড়ে যাবে। আর তাদের সন্তানগুলো…। আর ভাবতে চায় না সে। সে এইসব অনুভূতির সাথে পরিচিত। আজকাল তো এই অনুভূতিগুলোই তার রাতের সঙ্গী। ছেলে তার সাথে দেখা না করলেও অনুভূতিগুলো ঠিকই রোজ তাকে একবার এসে দেখে যায়। মেয়ে তার সঙ্গে অভিমান করলেও এই অসহায় উপলব্ধিগুলোর কোনো আত্মসম্মান নেই। যতই দূর দূর করে তত জাপটে ধরে। ঘায়েল, নিঃসঙ্গ শিল্পী এলোমেলো পায়ে দরজা ঠেলে ব্যাংকে ঢুকল। গার্ড সালাম দিলো। শিল্পী শুনলও না। লোকটা যে তাকে অনুসরণ করে ভেতরে আসছে তারও খেয়াল নেই। কানে বাজল, “আপনার সাথে কথা বলতে চাই। বেশিক্ষণ সময় নিব না। আমার আবার আরেক জায়গায় যেতে হবে।”
শিল্পী থমকে দাঁড়াল। ভ্রু কুঁচকে ফিরল। অনেকটা ধমকে বলল, “আমার সাথে কি কথা আপনার?”
লোকটা আশেপাশে তাকিয়ে বলল, “কথাটায় জুয়েল ইনভলবড তো। এখানে বলা ঠিক হবে না।”
শিল্পীর এখন একটাই ইচ্ছা। উপরতলায় গিয়ে জুয়েল সাহেবকে কষিয়ে একটা চড় দেওয়া। শিল্পী বলল, “তাহলে জুয়েল সাহেবের বাসায় চলুন। কাছেই তো। উনার বাসায় বসে কথা বলাটাই সবচেয়ে ভালো। ভাবি আমাদের চা নাস্তাও খাওয়াবেন নিশ্চয়ই।”
লোকটার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। শিল্পী দরজা ঠেলে বাইরে বের হয়ে এল। কর্মস্থলে ঝামেলা করা ঠিক হবে না। এমনিতেই ডিভোর্সী বলে সবাই আমোদ পেয়ে আছে।
শিল্পী কাছেই একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসল। লোকটা কেশে কথা শুরু করল, “আমি যাকারিয়া করিম। জুয়েল আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। খুবই অমায়িক মানুষ। কারো সঙ্গে তার কোনো দ্বন্দ্ব নেই। আপনিও তো এত বছর ধরে একসাথে কাজ করছেন। আপনারো জানার কথা সে কতটা ভালো মানুষ।”
“জি আমি জানি তিনি কতটা ভালো মানুষ।” শিল্পীর চোখের দৃষ্টি শীতল, গলার স্বর তীক্ষ্ণ।
যাকারিয়া নড়েচড়ে বসে বললেন, “আসলে আপনি যা ভাবছেন ব্যাপারটা তা না।”
“ব্যাপারটা কি বলার জন্য আপনার কাছে বেশি সময় নেই। পাঁচ মিনিট আছে।”
“আপনি জুয়েলের বাসায় গিয়েছিলেন?”
“আপনার বন্ধুকে বলে দিবেন আমাকে বিরক্ত করার ফল খুবই খারাপ হবে।”
“আ… আসলে কয়েকদিন আগে জুয়েলের সঙ্গে দেখা করতে আমি ব্যাংকে গিয়েছিলাম। তখন আপনাকে দেখেছি। আপনার সম্পর্কে সব শুনেছিও। ভাবলাম জুয়েলের কলিগ আপনি। সে যদি আমাদের পরিচয়টা করিয়ে দেয় খুবই ভালো হয়। এখানে জুয়েলের কোনো দোষ নেই। আপনি ভাবির কাছে যাওয়ায় বেচারা খুবই ঘাবড়ে গেছে। আমি চাইনা তাদের মাঝে কোনো ঝামেলা হোক।”
“তাহলে আপনার বাসার ঠিকানাটা দিয়ে যান। এখন তো আমার আপনার স্ত্রীর কাছে যেতে হয়।”
“আমার স্ত্রী নেই।”
“ছাত্র জীবনে পরীক্ষার সময় বহুবার স্যার ম্যাডামদের কাছে দাদী নানীকে এভাবেই মেরেছি।”
“জি না আপনি ভুল বুঝছেন। আমি অবিবাহিত।”
শিল্পী বিরক্ত আর অধৈর্য্য হয়ে চোখ ফেরাল। তখন’ই চমকে গেল। আতঙ্কে জমে উঠল সে।
.
ঝুম ঝুম শব্দ। পানিগুলো কাদিনকে ছুঁয়ে নীচের দিকে ছুটে চলেছে। কাদিনের চোখে মুখে সাবানের তুলতুলে সাদা ফেনা। বাইরে থেকে দীপা দরজায় ধাক্কা দিলো। কাদিন হাতের সাবানটা খুব যত্ন সহকারে কেইসে রাখল। যেন সাবান ব্যথা পাবে। সে না খেয়ে থাকতে পারবে, কিন্তু সাবান ছাড়া একদিনও না। তারপর ঝরনা বন্ধ করে বলল, “বলো, দীপা।”
দীপা বলল, “আমিও আসি?”
কাদিন শক্তভাবে বলল, “না।”
দীপা দুষ্টু গলায় বলল, “এত লজ্জা কিসের তোমার? তোমাকে তো আগেই শেষ করে দিয়েছি ছেলে।”
কাদিন কোনো উত্তর না দিয়ে আবার ঝরনা ছেড়ে দিলো। দীপা বলল, “পরে তোমার আফসোস হবে, মিস্টার স্বামী।”
কাদিন কঠিনস্বরে ডাকল, “বলেছি না।”
দীপার মুখটা ছোট হয়ে গেল। কাদিন প্রায়’ই এমন করে। কেন করে দীপা বুঝতে পারে না।
চলবে ইনশাআল্লাহ…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫১
শিল্পীর দৃষ্টি অনুসরণ করে যাকারিয়া উচ্চতায় লম্বা, নাদুসনুদুস একদম কম বয়সী একটা ছেলেকে পাশের টেবিলে বসে থাকতে দেখল। ছেলেটা অনবরত পা নাচাচ্ছে। যাকারিয়া শিল্পীকে বলল, “কি হয়েছে? কোনো সমস্যা? আপনাকে এরকম দেখাচ্ছে কেন?”
শিল্পী কিছু বলার আগেই মুবিন চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে শিল্পীদের টেবিলের সামনে দাঁড়াল। যাকারিয়াকে বলল, “আমি দুটো বারবিকিউ স্যান্ডউইচ খেয়েছি। সাথে একটা মিল্ক শ্যাক। বিল পে করে দিন।”
যাকারিয়া হা হয়ে তাকিয়ে রইল, “আমি কেন তোমার বিল পে করব?”
মুবিন একগাল হেসে বলল, “মাগনা কেউ বাপ ডাকে না।”
শিল্পী ধমকে উঠে বলল, “বিহেভ ইউরসেল্ফ, মুবিন।”
মুবিন শিল্পীর দিকে তাকালোও না। সে যাকারিয়ার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে শীতল হাসি বজায় রাখল। বলল, “কনগ্রাচুলেশন্স টু বোউথ অফ ইউ।”
মুবিন গটগট করে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এল। ডানে বায়ে তাকিয়ে কোন পথে যাবে ভাবল। একবার কি মিলার কাছে যাবে? মিলাকে বলবে মাও বাবার মতন? দুজনের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। মাও তাদের কথা ভাবেননি? না, না মিলার কাছে যাওয়া যাবে না। মিলা তাকে বুঝে? মিলার কাছে সে মিলার সুখশান্তিতে ভাগ বসানো দৈত্য ছাড়া বেশি কিছু তো না। রাস্তায় মানুষের মাথা গুনতে বসলে তারা গুনবার দশা হয়। অথচ, দুটো কথা রাখা যায় এমন একটা মানুষের আকাল পড়েছে। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা সুপারশপ চোখে পড়ল মুবিনের। কয়েক বছর আগেও কুমিল্লায় সুপারশপ ছিল বিরল। এখন অভাব নেই। সুপার শপটিতে প্রবেশ করবার আগে মানুষজন টোকেন নিয়ে শপিংব্যাগ গার্ডের কাছে রেখে যাচ্ছে। গার্ডটি নির্দিষ্ট টোকেনের মালামাল নির্দিষ্ট লকারেই রাখছেন৷ ক্রেতারা ফিরে এলে টোকেন দেখিয়ে নিজের জিনিসপাতি বুঝে ফেরত নিচ্ছেন। বিশ্বস্ত জায়গা। মুবিনের খুব ইচ্ছা গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি কথা রাখেন? তাহলে একটা টোকেন দিন৷ আমার কিছু কথা আছে। আপনাকে বলি।”
.
ভোরে কাদিন কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে৷ ভোরের বাতাস স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী৷ দীপা উঠে দেরি করে। সকালের ঘুম তার খুব প্রিয়৷ শীতল বাতাস গায়ে মেখে কাদিন দালান ও বাড়ির গেইটের মাঝে থাকা ছোট পথটায় পকেটে হাত রেখে হাঁটছিল। কয়েকটা রঙ্গন গাছ পাশে দাঁড়িয়ে। নাম জানা কোনো পাখি চেনা ডাকে ডাকছে। পাশের বাড়িতে কোনো এক সুরেলা কণ্ঠী গানের রেওয়াজ ধরেছে। হারমোনিয়ামের সুরের সাথে কণ্ঠ দুলছে। গাইছে,
“আমার গানের মালা
আমি করবো কারে দান
মালার ফুলে জড়িয়ে আছে
করুণ অভিমান ।”
কাদিনের ঠোঁটে ম্লান হাসি, মনে সূক্ষ অভিমান। তবুও গান শুনে নিজেকে ধরে রাখত পারল না সে। বাসায় গিয়ে দীপাকে ডেকে তুলল। দীপা ঘুমে ঢুলে ঢুলে বলল, “আমি ঘুমাব, আমি ঘুমাব।”
কাদিন বলল, “না, চলো বাইরে হাঁটি।”
“না।” দীপা আবার শুয়ে পড়ল। কাদিন আদুরে গলায় ডেকে বলল, “আরে চলো না৷ পাশের বাসার মেয়েটা গান গাইছে। দুজনে গান শুনব।”
পাশের বাসার মেয়ের কথা শুনে দীপা চোখ খুলল। উঠে বসে বলল, “চলো।”
ব্রাশ করে, চোখে মুখে পানি দিয়ে কাদিনের সাথে চলল সে। মেয়েটা অন্য আরেকটা গান ধরেছে,
“ছিল মন তোমারই প্রতীক্ষা করি
যুগে যুগে দিন রাত্রি ধরি,
ছিল মর্মবেদনাঘন অন্ধকারে,
জন্ম জনম গেল বিরহ শোকে
বঁধু কোন আলো লাগলো চোখে”
কাদিন হাঁটতে হাঁটতে দীপার হাতটা ধরল, “কী সুন্দর গায় শুনলে?”
দীপা কাদিনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “প্রতিদিন গায়?”
“হ্যাঁ, প্রতিদিন।” কাদিন তাকিয়ে আছে ডালে ঝুলে থাকা একটা রূপসী লালচে পাতার দিকে। দীপা হঠাৎ কাদিনের হাত টেনে ধরল, “ঘরে চলুন।”
“মাত্রই তো এলাম।”
“চলুন।”
“আরে কি হলো?”
“আপনি আর এখানে হাঁটবেন না। হাঁটতে হলে বাইরে যাবেন।”
কাদিন তাকিয়ে দেখল দীপার ভ্রু কুঁচকে আছে। প্রশ্ন করল, “কি হয়েছে তোমার?”
দীপা ঝাড়ি মেরে হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল, “কি হবে আমার?”
কাদিন বলল, “আমি মেয়েটাকে চিনিও না।”
দীপা বলল, “চেনার বোধহয় শখ আছে! প্রতিদিন গান শুনতে চলে আসে! রুনা লায়লার প্রতিবেশী উনি।”
কাদিন দীপার নাক টেনে বলল, “কি কিউট তুমি!”
দীপা রেগেমেগে চলে এল। কাদিন পেছনে পেছনে এসে বলল, “আচ্ছা যাও আর এখানে হাঁটব না। পার্ক থেকে ঘুরে আসব।”
দীপা সিঁড়িতেই ঘুরে কাদিনের গলা জড়িয়ে ধরল, “আর এই মেয়ের গান শুনবেন না।”
কাদিন বলল, “শুনব না।”
দীপা গলা ছেড়ে কাদিনের বাহু ধরে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বলল, “আপনি অনেক ভালো।”
কাদিন হাসল, কিছু বলল না। দীপা বলল, “কিন্তু মাঝে মাঝে কেমন যেন হয়ে যান।”
কাদিন এখনও চুপ।
.
শার্ট থেকে সসের দাগ ইমাদ তুলতে পেরেছে। আধভেজা ইমাদ সাদা ফকফকা ভেজা শার্টটা বারান্দায় ঝুলিয়ে এসে ঘরে বসল। তারপর প্রায় সাথে সাথে আবার উঠে বারান্দায় গেল। বারান্দায় শুকোতে দেরি হবে এবং মুবিন সুযোগে কিছু করবে ভয়ে দড়ি থেকে শার্টটা নামিয়ে রান্নাঘরে নিয়ে গেল সে। চুলার উপর ঝুলে থাকা রসিতে কাপড় শুকাতে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যতক্ষণ না শার্টটা শুকাল সে এক পাও নড়ল না৷ বাড়িয়ে দেয়া আগুনের আঁচে শার্ট শুকাতে বেশিক্ষণ লাগল না। শার্ট শুকিয়ে যেতেই ঘরে এনে ইস্ত্রি করল। তারপর ভাঁজ করে তুলে রাখল। এই শার্ট আর কোনোদিন পরবে না সে। যদি নষ্ট হয়ে যায়! মনে মনে সে মরেই যাবে!
শার্ট ভাঁজ করে রেখে কড়িকে একটা কল করল। ধরলে বোনাস না ধরলেও ক্ষতি নেই। কড়ির ঠান্ডা লেগেছে। গলা বসে গেছে। ধরা গলায় সে মোবাইল কানে চেপে ধরে বলল, “জরুরি কিছু হলে বলুন।”
“আচ্ছা।” ইমাদ কল কেটে দিলো। জরুরি কিছু তো নয়। কি কথা বলবে সে?
তবে কড়ি কলব্যাক করল, “ঠিক আছে। প্রথম ও শেষবারের মতন অজরুরী কথা বলে ফেলুন।”
ইমাদ নিস্তরঙ্গ গলায় বলল, “আপনার কণ্ঠ শোনার তেষ্টা পেয়েছিল।”
কড়ি কলের ওপাশে নখ খুটতে খুটতে বলল, “আপনি এর আগে কখনো প্রেম করেছেন?”
ইমাদ বলল, “জেনে কি করবেন?”
“ঠিক আছে বলতে হবে না। আপনার কি মন খারাপ?”
ইমাদ বলল, “আপনার মন খারাপ।”
কড়ি হেসে বলল, “আমি যদি আপনাকে এখন আমার মন খারাপের কারণটা বলি আপনি কি ভেবে নিবেন আমি আপনার প্রেমে পড়েছি?”
“জি ভাবব।”
কড়ি নিঃশব্দে হাসল, “মন খারাপে কারণ শুনবেন না?”
“শুনব।”
“কিন্তু আমি তো এখন আর বলব না।”
“আচ্ছা।”
“আপনি খুবই সৎ।”
“আচ্ছা।”
“আমার মন খারাপের কারণ শুনতে আপনি মিথ্যের আশ্রয় নেননি। আপনি একজন সৎ মানুষ৷ আপনার সঙ্গে আমার আগে দেখা হলে আমি সম্ভবত আপনার প্রেমেই পড়তাম।”
“আচ্ছা।”
কড়ি বলল, “রাখি?”
“আচ্ছা।”
“এই আচ্ছার অর্থ কি রাখুন নাকি ইচ্ছে হয় না?”
ইমাদ উত্তর দিলো, “রাখতে ইচ্ছে হয় না।”
“আমার ইচ্ছে আমায় ঠকিয়েছে। তাই ইচ্ছেরা এখন মূল্যহীন।” কড়ি কল কেটে দিলো।
চলবে ইনশাআল্লাহ…

একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-৪৬+৪৭+৪৮

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৪৬
নাঈম রিকশা ঠিক করে উঠে পড়েছিল। ইমাদকে হেঁটে আসতে দেখে রিকশাচালকের কাঁধে হাত রেখে হেসে বলল, “একটু দাঁড়ান।”
নাঈম রিকশা থেকে নেমে মেসের গেটে দাঁড়াল। ইমাদ আরো কাছাকাছি এলে নাঈম চোখ উজ্জ্বল করে হাসল, হাত নাড়ল। ইমাদও তাকে দেখল। তবে হাসির বিনিময়ে হাসল না, নাঈমকে দেখে হাঁটার গতিও বাড়াল না। সে যেভাবে হেঁটে আসছিল ওভাবেই এল। একদম কাছাকাছি যখন চলে এল নাঈম এগিয়ে গিয়ে ইমাদের কাঁধ চাপড়ে বলল, “কি ভাই! কেমন আছো তুমি? আমি যখন মেসে থাকি, তুমি থাকো না। আর রাতে তোমায় বিরক্ত করতে চাই না। তুমি ব্যস্ত থাকো।”
“আচ্ছা।” ইমাদের চাহনিতে প্রাণ নেই।
“আমি চলে যাচ্ছিলাম। তোমাকে আসতে দেখে দাঁড়ালাম। এই দেখো রিকশা ঠিক করা।”
ইমাদ আগেই দেখেছে। তবুও রিকশার দিকে তাকাল। বলল, “আচ্ছা। কিছু বলবে?”
নাঈম মুখ অন্ধকার করে ফেলল, “তোমার কি মনে হয়? আমি কি কোনো দরকার আছে বলে দাঁড়িয়েছিলাম? কারণ ছাড়া দেখাসাক্ষাৎ হয় না মানুষে মানুষে?”
নাঈম প্রশ্ন করে আবার সে নিজেই মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে উত্তর দিলো, “হয়, হয়। মানবসমাজে কারণ ছাড়াও দেখাসাক্ষাৎ হয়। কেউ কেউ আমার মত কারণ ছাড়াই হাসে। আবার কেউ কেউ তোমার মত হাসেই না।”
“আচ্ছা।” নাঈমের সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ ইমাদের চোখ চলে গেল মেসের বারান্দায়। সেখানে মুবিন ওর শার্ট রসিতে মেলে দিচ্ছে। সাদা শার্ট নীল হয়ে গেছে। মুবিন শার্ট রেখে আবার ঘরের ভেতর গেল। চোখের পলকে ফিরেও এলো। ওর বোধহয় মনের বাসনা এখনও মেটেনি। হাতে লাল প্লাস্টিকের সসের বোতল। সে শার্টের বুকে ইচ্ছে মতো সস ঢালছে। নাঈম এইদিক দিয়ে বলছে, “কোনো সমস্যা নেই। তোমাকে হাসতে হবে না। যে মানুষের মন হাসে তাকে না হাসলেও চলে। তোমাকে দেখে অহঙ্কারী মনে হয়। আর তুমি’ই আমাকে আমার বিপদে সাহায্য করেছ। নিজের টিউশনী আমায় দিয়ে দিয়েছ। তুমি ভেবেছ আমি কখনো জানব না? টের পেয়ে গেছি আমি। খুব রাগ করেছি। এখন তোমাকে আমার রাগ ভাঙাতে হবে। অন্তত, এক মগ কফি খাও আমার সাথে। রিকশায় উঠো।”
বারান্দা থেকে চোখ নামিয়ে ইমাদ নাঈমের দিকে তাকাল, “আরেকদিন।”
ইমাদকে জোর করা অরণ্যে রোদন। নাঈম মলিন মুখেই রিকশায় উঠে চলে গেল। ইমাদকে একদিন সে বস্তায় ভরে নিয়ে গিয়ে হলেও ট্রিট দিবে।
নাঈম চলে যাওয়ার পরও ইমাদ অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। মুবিনকে যতক্ষণ না সন্তুষ্ট মনে হলো ততক্ষণ সে অপেক্ষা করল। মুবিনের ক্রোধ মেটানো সম্পূর্ণ হবার পর সে মেসে প্রবেশ করল। সাথে সাথেই বারান্দায় গেল না। নিজের অন্যান্য কাজ সাড়ল, খাওয়া দাওয়া করল। পরে গেল বারান্দায়। দড়ি থেকে শার্টটা নামিয়ে, হাতে নিয়ে নিঃশব্দে এসে নিজের ঘরে চৌকিতে বসল। খুব মন খারাপ হয়েছে তার। শার্টটার সাথে তার জীবনের বিশেষ মানুষটি জড়িত। কড়িকে প্রথম দেখেছিল পূর্ণিমা রাতে। ইমাদ গিয়েছিল তার গ্রামে। ভেবেছিল সপ্তাহব্যাপী থাকবে। থাকা হলো না। দীপুর আত্মহত্যার চেষ্টার খবর পেয়ে অবিলম্বে কুমিল্লা আসতে রওনা দিলো। বাস কুমিল্লা বিশ্বরোডে এসে ফিলিং স্টেশনে ঢুকল। দীপুর জন্য দুশ্চিন্তিত, বিধ্বস্ত ইমাদ ক্লান্ত হয়ে জানালা দিয়ে আলো, অন্ধকারের মিলমিশ দেখতে দেখতে আহত হচ্ছিল। আলোদের কাছে অন্ধকার কেন এত আকর্ষণীয়? আলোরা কেন ছুটে যায় অন্ধকারে? দীপু কেন ছুটল তাহমিদের কাছে? ইমাদের মাথা ব্যথায় ফেটে যাচ্ছিল। ও বাসের জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে দিলো। এদিকওদিক তাকিয়ে ঔষুধের দোকান আছে কিনা দেখতে লাগল। দেখল না। বাসের পাশ দিয়ে কে একজন যাচ্ছিল। ইমাদ ডাকল ফ্যাকাশে গলায়, “ভাই, এখানে কোনো ঔষুধের দোকান দেখেছেন?”
লোকটা ঘাড় উঁচু করে বাসের জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে রাখা ইমাদকে বলল, “জি ঐপাশে দেখেছি।”
“ধন্যবাদ।”
ইমাদ মাথা ব্যাথার ঔষুধ কিনতে বাস থেকে নামল। এক কাপ চাও খেল। চা খাওয়া শেষ করে উঠে বাসের দিকেই যাচ্ছিল। চায়ের দোকানের বেঞ্চি থেকে উঠার সময় হোঁচট খেল। পাশে বসা মেয়েটি ছেলেটিকে বলল, “ব্যাগটা ওভাবে কেন রেখেছ? চলতে ফেরতে মানুষের পায়ে ঠেকবে তো।”
ছেলেটি ব্যাগটা সাইড করে রাখতে রাখতে ইমাদকে স্যরি বলল। মেয়েটি বলল, “ওখানে রেখো না।”
ছেলেটি হেসে বলল, “কেন? গুপ্তধন নাকি?”
মেয়েটি বলল, “বেশি কথা বলো।”
“তোমার সাথে কথা বলতে আনচান করি।”
ইমাদ দূরে চলে আসায় বাকি কথা আর কানে আসেনি। বাসে উঠে বাস ছাড়ার অপেক্ষা করছিল। ফিলিং স্টেশনে গাড়ির ইয়া বড় লাইন লেগে আছে। আরো দেরি হবে। আচমকা সে দেখল সেই ছেলেটি ব্যাগ হাতে একটা সিনএনজিতে উঠল। সঙ্গে মেয়েটি নেই। ইমাদের নজর তীক্ষ্ণ হলো। ছেলেটি একাই চলে গেল। খানিক বাদে মেয়েটাকে দেখা গেল। সে প্রথমে শান্তভাবে, পরে দিশেহারা হয়ে ছেলেটাকে খুঁজল। মানুষজনকে জিজ্ঞাসাও করল। তারপর কতক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। একটুও কাঁদল না এবং কতক্ষণের মাঝে বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে স্বাভাবিক হয়ে গেল। সিএনজি ডাকল। ইমাদও সাথে সাথে বাস থেকে নেমে গেল। দীপুর মেয়েটাকে একবার হলেও দেখা দরকার। সে সিনএনজি ডেকে কড়ির সিএনজির পিছু নিলো। তারপর’ই দীপুর কাছে কড়িকে নিয়ে আসা। সেদিন ইমাদ এই শার্টটিই পরেছিল।কাকতালীয়ভাবে, যেদিন সে কড়িকে ট্রেনে প্রপোজ করল সেদিনও তার গায়ে ছিল এই শার্ট। ইমাদ চোখ বন্ধ করল। সুখকর সেই মুহূর্তর্টি সে আবার দেখছে। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। ট্রেন ধরতে দৌড়োচ্ছে। কড়ি তার দিকে হাত বাড়াল, কিন্তু সে ধরল না। শেষে, কড়ি’ই তার শার্টের হাতা খামচে ধরে তাকে ট্রেনে তুলল। এই শার্টটার হাতা’ই খামচে ধরেছিল!
চলবে ইনশাআল্লাহ্….

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৪৭
দীপা গালে হাত দিয়ে বসে আছে। আয়নার সামনে কাদিন। দীপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কিগো, তোমার হলো?” ওর কণ্ঠে ক্লান্তি। আর কতক্ষণ?
কাদিন বলল, “দু’মিনিট।”
“আর কতক্ষণ ধরে দু’মিনিট দু’মিনিট করবে তুমি?”
কাদিন কিছু বলল না। সে নিজেকে তৈরী করতে ব্যস্ত। রিমা বাইরে থেকে দরজায় কড়া নেড়ে ঠাট্টায় মাতল, “দীপা, দ্রুত তৈরী হও। কাদিন বেচারাকে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করাবে? বেশিরভাগ দাম্পত্যকলহ স্ত্রীর সাজগোছ নিয়েই কিন্তু হয়। এত সময় নিয়ে সাজা স্বামীরা পছন্দ করে না, বোন।”
দীপা ঘন ঘন চোখ পিটপিট করে আয়নার ভেতর দিয়ে কাদিনকে দেখতে দেখতে বলল, “স্যরি, কাদিন। রাগ করো না। এই তো আমার হয়ে যাবে। আর দু’মিনিট।”
রিমা দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল, “জানো, দীপা কড়ি বলছিল বাবাকে বলে কান্দিরপাড় একটা দোকান নিতে। দোকানের নাম কাদিন কসমেটিক্স। দোকান নাকি সেই চলবে?”
দীপা বলল, “কড়ি যেহেতু বলেছে নিশ্চয়ই চলবে। আমরা অবশ্যই নিব।”
রিমা বলল, “আচ্ছা আমি গিয়ে বাবার সঙ্গে আলাপটা পাড়ি।”
হাসতে হাসতে চলে গেল রিমা। দীপার মোবাইলটাও বেজে উঠল। ইমাদের কল। দীপা হাসিমুখে লাফিয়ে উঠে ফোন ধরল, “হে ইমাদ বল।”
ইমাদ জানতে চাইল, “সাদা শার্ট থেকে সসের দাগ কীভাবে তুলতে হয় জানিস?”
দীপা বলল, “ডিটার্জেন্ট দিয়ে ধুয়ে ফেল, উঠে যাবে।”
“হচ্ছে না।”
” হচ্ছে না? তাহলে আর কীভাবে? ব্লিচিং পাউডার? ব্লিচিং পাউডার দিয়ে দেখ।”
কাদিন প্রশ্ন করল, “কি পরিষ্কার করতে চাচ্ছে ও?”
দীপা ফোন কানে চেপেই বলল, “সসের দাগ।”
কাদিন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “ডিটারজেন্ট, ঠাণ্ডা পানি, স্পঞ্জ আর সাদা ভিনেগার নিতে বলো। প্রথমে সসের দাগ লাগা জায়গাটায় ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ভিজিয়ে ডিটারজেন্ট দিবে। তারপর দশ/পনেরো মিনিট রেখে দিতে হবে। এরপর সাদা ভিনেগারে স্পঞ্জ ভিজিয়ে সেই স্পঞ্জটা দিয়ে দাগটা আবার ঘষবে। ঘষবার পর সাধারণ নিয়মে ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে নিবে। দ্যাটস এনাফ।”
দীপা কাদিনের বলা প্রক্রিয়াটা ইমাদকে বুঝিয়ে বলল। ইমাদ বলল, “আচ্ছা।”
ফোন রেখে দিলো সে। দীপা কাছে এসে পেছন থেকে কাদিনকে জড়িয়ে ধরল। কাদিনের পিঠে মাথা রেখে বলল,
“রূপ লাগি আঁখি ঝুরে, গুণে মন ভোর,
প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে, প্রতি অঙ্গ মোর।
হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে,
পরাণ পিরিতি মোর থির নাহি বান্ধে।।”
কাদিন স্মিত হাসল, “কোথায় শুনেছ?”
দীপা বলল, “শুনিনি, পড়েছি।”
কাদিন অবাক, “তুমি বৈষ্ণব পদাবলী পড়েছ?”
দীপা বলল, “বৈষ্ণব পদাবলী পড়তে যাব কেন? ইমাদের ডায়েরীতে পড়েছি।”
কাদিন হাতের আঙুলে আংটি পরতে পরতে বলল, “অনুমতি ছাড়া পড়োনিতো?”
দীপা মনে মনে জিহ্ব কাটল। সে অনুমতি ছাড়া পড়েছে। কিন্তু কাদিনকে তা বলা যায় না। মুখে বলল, “না, না। অনুমতি ছাড়া পড়তে যাব কেন? তাছাড়া, ওর ডায়েরীতে তেমন কিছু নেইও। ইমির ডায়েরী ইমির মত’ই রোবট রোবট।”
প্রথমটুকু মিথ্যে হলেও শেষ কথাটা সত্য। ইমাদের ডায়েরীতে এরকম ছড়ানো ছিটানো কিছু সংগৃহীত লাইন ছাড়া কিছুই নেই। কাদিন হাতঘড়ি পরে বলল, “রোবট রোবট না। অনুভূতি আছে বলেই লাইনগুলো টুকে রেখেছে। প্রেমিকার জন্য টুকেছে।”
দীপা শব্দ করে হেসে ফেলল, “কি বললে তুমি? কি বললে? ধুর ইমির আবার প্রেম, প্রেমিকা!!! আমি হাসি থামাতেই পারছি না।”
“এটা পড়ার পরও এ কথা বলছ?”
“এমন লাইন টুকে রাখলেই নাকি মানুষ প্রেমিক হয়ে যায়। ইমি হবে প্রেমিক?” দীপা বিরতিহীন হাসছে। হাসতে হাসতে কাদিনের পিঠে ঢলে পড়ছে। কাদিন ধীরে সুস্থে গায়ে পারফিউম মেখে ঘুরে দাঁড়াল। দীপার কপাল থেকে চুল সরিয়ে গালে আঙুল বুলাল। চোখে চোখ ডুবিয়ে বলল, “মাই ইনোসেন্ট লাভ।”
দীপা তখনও হাসছে। হাসি নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন।
চলবে ইনশাআল্লাহ….

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৪৮
নরম হাওয়ার রোদেলা সকাল। শিল্পী দ্রুত রিকশা খুঁজছে। সে ঘড়ি দেখল। মিলার স্কুলের এবং তার ব্যাংকের সময় হয়ে যাবার আগেই তাকে মিলার হোস্টেলে গিয়ে পৌঁছুতে হবে। শিল্পী হাঁটা ধরল। রিকশা পাওয়া মুশকিল।
মিলা ভোরে উঠেই পড়তে বসে। রসায়নের বিক্রিয়া লিখে লিখে পড়ছিল সে। শিল্পীকে দেখে বই রেখে উঠল। লেবুর শরবত বানাল। শিল্পী বলল, “কিছু করতে হবে না। পড়ছিলি পড়।”
মিলা শিল্পীর হাতে গ্লাস দিয়ে বলল, “ঠাণ্ডা পানি নেই।”
শিল্পী গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, “এখানে থাকতে হবে না তোকে। আমার সাথে থাকবি।”
মিলা বলল, “আমি এখানেই ভালো আছি।”
শিল্পী বলল, “আমি একা ভালো নেই। তুই আমার সাথে থাকলে আমি হয়তো ভালো থাকব।”
মিলা বলল, “স্যরি, মা। বারবার জায়গাবদল করলে আমার পড়ার ক্ষতি হয়। আমি যাব না।”
“তুই যাবি। তুই আমার উপর রাগ করে আছিস। তাই এমন করছিস।”
মিলা একবার ভাবল বলবে, “রাগ করাটাই কি স্বাভাবিক না?”
কিন্তু বলল না। মাকে কষ্ট দিতে ওর কষ্ট হয়। বলল, “রাগ করে নেই, মা। পড়াশুনার কথা ভেবেই বলছি। আমার এসএসসির পর আমি তোমার কাছে চলে আসব।”
শিল্পী হাতের গ্লাসটা রেখে চড় মারবার ভঙ্গি করে বলল, “একটা চড় মারব। বাপের মত ধুরন্ধর হয়েছিস সবকটা। এসএসসির পর যে তুই ঢাকায় যাবি বলে ঠিক করে রেখেছিস, সেটা কি আমি জানি না? কলা দিয়ে ছেলে ভোলানো হচ্ছে? সবগুলা স্বার্থপর।”
মিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “মুবিনকে নিয়ে যাও, মা।”
শিল্পী বলল, “কথা যে শোনে তাকেই বলেই কাজ হলো না। অবুঝটা কি বুঝবে?”
“আমাকে জোর করো না, মা। আমি একা’ই থাকব। পারলে তোমার ছেলেকে জোর করো।”
শিল্পী ওড়নায় চোখ মুছে বলল, “মায়ের কষ্ট বুঝলি না।”
মিলা ঘাড় কাত করে বলল, “আরেক গ্লাস শরবত করে দিই?”
শিল্পী বলল, “কর, করে তোর বাপ আর তোর বাপের প্রেমিকাকে দিস। মা ভালো না। মা খারাপ। সৎ মা অনেক আদর দিবে।”
“বসো, মা। যেও না।”
“তাহলে আমার সঙ্গে চল।”
“স্যরি মা।”
শিল্পী কষ্ট নিয়েই ফিরে গেল। মিলা হোস্টেলের জানালা ধরে দাঁড়াল। মাকে যতক্ষণ দেখা যাবে ততক্ষণ সে দাঁড়িয়ে থাকবে।
শিল্পীর আশেপাশে অনেক খালি রিকশা টুংটাং শব্দ করে যাচ্ছে। কোনো কোনো রিকশাচালক নিজ থেকেই বলছেন, “আফা, কই যাইবেন?”
শিল্পী কোনো উত্তর দিচ্ছে না।
.
কড়ির সঙ্গে যে ছেলেটি দেখা করতে এসেছে তার নাম মৃন্ময়। মৃন্ময় ধানমন্ডি লেকের কাছে কড়ির অপেক্ষা করছিল। কড়িকে দেখে বলল, “তুমি বড় হয়ে গেছ।”
উত্তরে কড়ি বলল, “আসসালামু আলাইকুম।”
মৃন্ময় বলল, “ওয়ালাইকুম আসসালাম। চলো কোথাও বসা যাক।”
কড়ি বলল, “না বসব না। আমার একটু তাড়া আছে। আসলে ক্লাস আছে। ক্লাসটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি মিস করতে চাই না।”
“ওহো, স্যরি। আচ্ছা, তোমার নাম্বারটা দাও। তোমার নাম্বার না থাকায় কাদিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে আসতে হয়েছে।”
কড়ি নাম্বার বলল। মৃন্ময় নাম্বার সেভ করে বলল, “ঠিক আছে ভালো থেকো। তুমি যখন ফ্রি থাকবে দেখা করব।”
কড়ি তড়িঘড়ি করে চলে এল। তার কপালে চিন্তার রেখা। মেজো ভাইয়ার পছন্দের পাত্র হলে তো গজব। ইমাদকে দেয়া সময় পর্যন্ত বিয়ে আটকাবার জন্য কোনো ছুঁতো খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে।
.
ক্লান্ত, অবসন্ন শিল্পী নিজের চেয়ারে বসল। হেঁটে আসায় ব্যাংকে আসতে আসতে দেরি হয়ে গেছে। পাশ থেকে জুয়েল সাহেব বললেন, “আজ এত দেরি কেন, শিল্পী?”
শিল্পী যন্ত্রের মত বলল, “কাজ ছিল।”
“কি কাজ?”
শিল্পী বিরক্ত হয়ে বলল, “অফিসিয়াল কোনো কাজ না।”
“আপনাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।”
শিল্পী চুপ করে রইল। এই লোকটাকে আজকাল অসহ্য লাগে তার। জুয়েল সাহেব নিজেই আবার বললেন, “কি হয়েছে, বলুন তো? আপনি সাধারণত দেরি করে আসেন না।”
শিল্পী কম্পিউটার চালু করতে করতে বলল, “জুয়েল সাহেব, আমি ব্রাঞ্চটা চেঞ্জ করতে চাচ্ছি না। আমার অসুবিধা হয়ে যাবে। আপনি এরকম করতে থাকলে আমি বদলি হয়ে যেতে বাধ্য হব।”
জুয়েল সাহেব আত্মপক্ষ সমর্থন করে কিছু বলতে চাচ্ছিলেন। শিল্পী সে সুযোগ দিলো না।
.
মুবিন সুহার শেষ প্র্যাক্টিকেল খাতাটা ফেরত দিয়ে চলে যাচ্ছিল। সুহা ডেকে বলল, “অ্যাই মুবিন শুনো।”
মুবিন চলে যেতে যেতে ঘুরে তাকাল। সুহা ভ্রুকুটি করে বলল, “ধন্যবাদ দিলে না যে?”
মুবিন স্থির গলায় বলল, “অনেক সময় নষ্ট করেছ আমার। আমাকে সবগুলো খাতা একেবারে দিলে সুবিধা হতো। একটা একটা করে দেয়ায় খাতা নিতে প্রতিদিন স্কুলে আসতে হয়েছে। নাহয় ঐ সময়টায় বাসায় বসে প্র্যাক্টিকেলগুলো করলে আরো তাড়াতাড়ি শেষ হতো।”
“কি বলছ তুমি?”
মুবিন প্রশ্ন করল, “বয়রা নাকি?”
সুহার মুখ শক্ত হয়ে গেল, “তুমি আমাকে এখনি ধন্যবাদ বলবে। এখনি।”
মুবিন বলল, “বলব না।”
সুহার মুখ লাল হয়ে গেল, “বলবে না?”
মুবিন ঘাড় শক্ত করে বলল, “বলব না। তুমি আমাকে বিশ্বাস করোনি।”
মুবিন অবশ্য ঠিকই বলেছে। সুহা তাকে বিশ্বাস করেনি। সন্দেহ ছিল খাতা নিয়ে ফেরত দিবে কিনা। তাই সব খাতা বোকার মত একেবারে দিয়ে দেয়নি। একটা একটা করে দিয়েছে। গেলেও একটা যাবে। অথচ, মুবিন সুহার প্রতিটা খাতাই খুব যত্ন সহকারে ফেরত দিয়েছে। সুহা খাতা খুলে দেখেছেও। একটুও নষ্ট হয়নি।
ঘণ্টা বেজে উঠল। ঢং ঢং ঢং। অ্যাসেম্বলির সময় হয়ে গেছে। মুবিনকে কড়া কথা বলবার অবকাশ না পেয়ে সুহার সারা অঙ্গ জ্বলে গেল।
চলবে ইনশাআল্লাহ….

একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-৪৪+৪৫

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৪৪
বাতাসের দাপট বেড়েছে। বাইরে বৃষ্টি আসি আসি করছে। কড়ি জানালা ধরে বাইরে তাকিয়ে রইল। বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা অন্ধকারে খুঁজে পাওয়া যায় কিনা চেয়ে দেখবে। অজানা কারণে বৃষ্টি এলো না, হয়তো ইমাদের কল আসবে বলে! ইমাদের কল পেয়ে কড়ি প্রচন্ড বিরক্ত হলো। বিরক্ত হলেও ফোন ধরল, “হ্যালো।”
ইমাদ বলল, “জি হ্যালো।”
কড়ি স্বাভাবিকভাবেই বলল, “বলুন।”
ইমাদ শান্তস্বরে বলল, “কথা বলার সময় হবে?”
কড়ি উত্তর দিলো, “জরুরি কথা বলার সময় হবে।”
“আমার জরুরি তলব আপনার কাছে জরুরি নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে?”
“কি বলবেন বলে ফেলুন।”
“দীপুর সাথে আজ জুয়েলারি শপে গিয়েছিলাম।”
কড়ি হোঁচট খেল। মেজো ভাবি তাদের সব বলে দিলো? কড়িকে চুপ থাকতে দেখে ইমাদ বলল, “দীপু আমাদের কাছে কিছু লুকায় না। তবে চিন্তার কোনো কারণ নেই। কাদিন ভাইয়া এবং অন্যরা কখনো কিছুই জানবে না।”
কড়ি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল, “ঠিক আছে।”
কড়ি জানালা ছেড়ে বিছানায় এসে বসল। ফোনের ওপাশের ইমাদ বিছানা ছেড়ে জানালায় হেলান দিলো, “আপনার ভাই আর দীপুর যখন বিয়ের কথা হচ্ছিল তখন আমি আপনাকে সন্দেহ করেছিলাম। মনে আছে?”
কড়ি প্রশ্ন করল, “ভুলব কেন?”
ইমাদ নিঃশব্দে হাসল, “স্যরি।”
“স্যরি বলবার মত কিছু হয়নি। আপনার জায়গায় আমি থাকলেও সেটিই করতাম।”
“তাহলে এ কথা বললেন যে?”
“কি কথা বললাম?”
“ভুলব কেন!”
“আপনার সাথে কঠিন করে কথা বলবার চেষ্টা করছি।”
ইমাদের শান্ত কণ্ঠ আরো শান্ত হলো। রাতের মত গভীর আর গাঢ় হলো,”কেন?”
কড়ির জ্বলন্ত ভাষা আরো খানিক প্রখর হলো, “যেন আপনি কখনো আমাকে আর কল করবার সাহস না পান।”
“আমি কি আপনাকে সহসা কল করি?”
“সুযোগ দিতে চাই না।”
ইমাদ বলল, “আচ্ছা।”
তারপর আবার সাথে সাথেই বলল, “আমি ক্লাস টেনে পড়ুয়া প্রেমিক না। যাই হোক, যে জন্য কল করেছিলাম সেটা বলি।”
“জি বলুন।”
“কাদিন ভাইয়ার ভাগের গুলো নাহয় দীপুকে বুঝিয়ে দিলেন। কায়েস ভাইয়ার গুলো কি করবেন?”
“ঠাট্টা করছেন নাকি মজা নিচ্ছেন?”
“দুটোই।”
“এই আপনার জরুরি তলব?”
“আপনার সাথে বলা যেকোনো কথাই আমার জন্য জরুরি তলব।”
কড়ি তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “আমি ক্লাস সিক্সে পড়া প্রেমিকা নই। পুনশ্চ, আমি আপনার প্রেমিকা নই।” কড়ি কল কেটে দিলো। ইমাদ মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কোথায় পাবে সে কড়ির গয়না?
.
মিশেল জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে দেখতে মদের গ্লাসে চুমুক দিলো। তার ঠোঁটের কোণে হাসি। সবুজ চোখের দৃষ্টিতে বৃষ্টি দেখার ঘোর। মঈন বসে আছে কাউচে। মিশেল দেখছে বৃষ্টি আর মঈন দেখছে মিশেল। বাইরের ঝুম ঝুম বৃষ্টিতে মিশেল পুরোপুরি হারিয়ে গেছে। কিছু সময় এভাবেই চলে গেল। একসময় মিশেল মঈনের দিকে না তাকিয়েই ফরাসী ভাষায় বলে উঠল, “তোমার দেশের তুষারপাতও কি এত বেশি মোহনীয়?”
মঈন হেসে হেসে ইংরেজীতে বলল, “তুমি বোধহয় ভুলে গেছ আমি ফরাসী ভাষা জানি না।”
মিশেল ঘুরে তাকাল। মদের গ্লাস হাতে হেঁটে এসে মঈনের পাশে বসল। পায়ের উপর পা তুলতেই তার কালো গাউনের কাটা পাশটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গোলাপী আভা রঞ্জিত নগ্ন পা দুটো এখন দৃশ্যমান। সে ইংরেজীতে বলল, “তোমার দেশের তুষারপাতও কি এত বেশি মোহনীয়?”
“আমাদের দেশে তুষারপাত হয় কে বলল তোমায়?”
“হয়না?”
“উঁহু। তবে আমাদের বৃষ্টির কাছে পৃথিবীর যেকোনো দেশের বৃষ্টি নস্যি। আর তোমার আদরের কাছে, যাবতীয় সবকিছু তুচ্ছ।” মঈন মিশেলের দিকে এগিয়ে গেল।
.
মাঝে মাঝে শিল্পীর মনে হয় ব্যাংকে আবার মানুষরা কাজ করে নাকি? ব্যাংকে কাজ করে রোবটরা। কম বয়সী এক মেয়ে এল তার বাবাকে নিয়ে। টাকা এফডিআর করেছিল। মেয়াদ নাকি উত্তীর্ণ হয়েছে তাই টাকা তুলবে। শিল্পীর হয়ে গেল মেজাজ খারাপ। ডেইট দেখে আসবে না? টাকা রেখেছে ১৪ মাসের জন্য আর এসে বলছে এক বছরের জন্য টাকা রেখেছিল! কি আশ্চর্য! বাবাটি পরে বলল, “আমি ত আর করিনি। ও ওর মাকে নিয়ে এসে করেছিল। আর এখন কাগজপত্রও হারিয়ে ফেলেছে।”
শিল্পী মেয়েটাকে কঠিন মুখ করে বলে দিলো, “এত আলাভোলা হলে হয়?”
মেয়েটি লজ্জা পেয়েছে, বাবাও নিশ্চয়ই বাসায় গিয়ে অনেক বকবে! মেয়েটি চলে যাওয়ার পর শিল্পীর মনে হলো ওভাবে না বললেও হতো! পাশের টেবিল থেকে জুয়েল সাহেব বললেন, “কিছু মনে করবেন না। আজকাল হুটহাট সবার সাথে রেগে যান। এত উত্তেজিত হবেন না। স্ট্রোক করে বসবেন!”
শিল্পী বলল, “বয়স হচ্ছে তো তাই ধৈর্য্য কমে যাচ্ছে।”
“আমি তো বয়স দেখি না। আপনি এখনও ইয়াং। অ্যাইজ ইজ জাস্ট আ নাম্বার!”
শিল্পী কম্পিউটার থেকে চোখ সরিয়ে জুয়েল সাহেবের দিকে তাকাল। কথাটা ওর পছন্দ হয়নি।
চলবে ইনশাআল্লাহ্…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৪৫
বাসায় ঢুকে কাদিন রিমার হাতে একটা প্যাকেট দিলো। রিমা অবাক হয়ে বলল, “তুই এসব এনেছিস?
কাদিন বলল, “বাবা কি ঘুমাচ্ছেন, আপু?”
রিমা বলল, “না, চাচ্চু বাইরে হাঁটতে গেছেন। কেন?”
“তেমন কিছু না। মিন্টুকে মনে আছে?”
কায়েস সোফায় শুয়ে শুয়ে মোবাইল দেখছিল। সে একটু উঠে বসে কাত হয়ে বলল, “আমার বন্ধু, মিন্টু?
“হ্যাঁ, আজকে হঠাৎ দেখা হলো। মিন্টুর বড় ভাইয়ের জন্য ওরা কড়ির কথা বলছিল।”
রিমা মাথা নেড়ে বলল, “ভালোই তো। চাচ্চুর সাথে কথা বলে দেখ।”
কায়েস একটা ভ্রু উপরে তুলে বলল, “এগুলো ও এনেছে, আপু? ওর কি ফল দোকানদারের সাথে ঝগড়া হয়েছে?
রিমার মুখের প্রতিক্রিয়া বলল, সেও অবাক।
কাদিন বলল, “সুস্বাস্থ্য নিয়ে যেহেতু কারো মাথা ব্যথা নেই, তাহলে আমার আর কি করার? এখন এনেছি বেশি করে খাও। আমি খাচ্ছি না।”
কায়েস বলল, “ভাবটা এমন যেন ও আনে না বলে ইহজীবনে আমরা ফাস্টফুড খেতে পাই না।”
রিমা কাদিনকে বলল, “মাঝে মাঝে ফাস্টফুড খেলে কেউ মরে যায় না, ভাই।”
“মরে নাকি না মরে সেটা বয়স হলে বুঝবে।”
দীপা নিজের ঘরে চুল বাঁধছিল। কাদিনের কণ্ঠ শুনে চুল না বেঁধেই তীরের ফলার মত ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ঝলমল করে হেসে বলল, “আসলে তুমি? আজ এত দেরি যে?”
কাদিন দীপার দিকে তাকিয়ে বলল, “রাস্তায় কায়েসের বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছিল। কথা বলতে বলতে দেরি হয়ে গেল।”
দীপা হেসেই বলল, “ওহ তাই বলো।”
দীপার চোখ রিমার হাতের দিকে আটকে যেতেই ওর চাহনিরা আনন্দে নেচে উঠল। উচ্ছ্বাস চেপে ধীর পায়ে রিমার দিকে এগিয়ে এল সে। মুচকি হেসে বলল, “এ তো দেখি আমার প্রিয় রেস্টুরেন্টের পার্সেল। কে এনেছে? তাড়াতাড়ি খোল, আপু। এখনি খেতে না পারলে মরে যাব।”
রিমা কাদিনের দিকে তাকাল। পাশের চেয়ারটায় হেলান দিয়ে কায়দা করে দাঁড়িয়ে বলল, “ওহ তাইতো বলি আমাদের কাদিন সাহেবের হঠাৎ ফলের দোকানদারদের সাথে আড়ি কেন?”
কাদিন মনে মনে বলল, “উফ দীপা! তুমি কেন এত বেশি কথা বলো?” দ্রুত ঘরের দিকে এগুতে এগুতে সবাইকে বলল, “আমি ফ্রেশ হব।”
কায়েস কাদিনকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, “ফাস্টফুড নয় বিবাহ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।”
.
“শিল্পী, আমি কি তোমাকে কষ্ট দিই?” মঈন মিশেলের দিকে তাকিয়ে বলল।
মিশেল মঈনের নগ্ন বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে।
মিশেলকে সরিয়ে উঠে বসল সে। মিশেল একটু নড়েচড়ে আবার ঘুমে শান্ত হয়ে গেল। মঈন হাঁটুতে হাতের কনুই রেখে দু’হাত মুঠো করে বিছানার কিনারে বসল। মনে মনে সে শিল্পীর সাথে কথা বলছে, “আমি বোধহয় আমাকেই কষ্ট দিই।”
শিল্পী নেই তাই ওর দিক থেকে মঈন শুনতে পায়নি কিছুই। সে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুমন্ত মিশেলের দিকে তাকাল। সে মিশেলকে কথায় কথায় সুযোগ এলেই বলে, “তোমার রূপের কাছে যাবতীয় সবকিছু নস্যি। আদরের কাছে বাকিসব তুচ্ছ। তোমার সাথে পুরো পৃথিবী সুন্দর। তুমি প্রশান্তি, তোমার কাছে আনন্দ আর আনন্দ।”
কথাগুলো সে কাকে বলে? মিশেলকে না নিজেকে? মঈন হাত দিয়ে ঠেলে সাইডটেবিলের গ্লাসটা ফেলে দিলো। ভেঙে গেল গ্লাসটা। এলার্মঘড়িটাও তুলে মেঝেতে ফেলল। ঘড়িটা ছিটকে পড়ে উল্টো হয়ে রইল। মঈন বিড়বিড় করে উঠল, “ভাঙেনি কেন এটা?”
সে উঠে গিয়ে ঘড়িটা হাতে তুলল। একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর পেশীর সর্বোচ্চ শক্তিতে ঘড়িটা দেয়ালে ঠুকতে লাগল। তীব্র শব্দে মিশেল ঘুম থেকে উঠে পুরোপুরি হকচকিয়ে গেল, “কি করছ, মঈন?”
মঈনের হাত থেমে গেল। সে বলল, “বিগত মুহূর্তগুলোকে কবর দিচ্ছিলাম। বারবার বিরক্ত করে।”
মিশেলের চোখে উদ্বেগ। সে বলল, “কি বলছ? আবার বলো। ইংরেজীতে আবার বলো।”
মঈন মিশেলের দিকে তাকিয়ে এতক্ষণে ইংরেজীতে বলল, “তোমার সাথে সময় অতি দ্রুত চলে যায়। আমার ভালো লাগে না। তাই ঘড়িটাকে নষ্ট করছিলাম। দুঃখিত, প্রিয়তমা তোমার ঘুমটা ভেঙে গেল।”
.
মেসের বুয়া রিনার মা শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এসে মুবিনের পাশে দাঁড়াল। তিনি সারাক্ষণ পান চিবুতে থাকেন বলে পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও কেমন একটা কটকটে গন্ধ পাওয়া যায়। গন্ধটা মুবিনের খুব একটা পছন্দ না। সে নাকে হাত দিলো। রিনার মা বললেন, “আমার কাম শেষ। আমি যাইগ্গাই।”
মুবিন বলল, “আমাকে কেন বলছেন?”
“পুরা মেস খালি। আমি আর কারে কইয়া যামু?”
“আপনি এই মেসে অনেকদিন ধরে কাজ করেন, তাইনা?”
“হো মেলা দিন। বছরেরও বেশি। আগেও একবার জিগাইছিলেন।”
“মনে পড়ল।”
“আমনের ভাত বাড়ছি। ঢাকা আছে। খাইয়া ফেলান।”
রিনার মা চলে যাচ্ছিলেন। মুবিন ডেকে বলল, “আপনি কি আপনার বাসায়ও এভাবেই রান্না করেন?”
“না বাসায় আমি রান্দি না। সময় কই? আমার মাইয়া রিনা রান্দে।”
“রিনা কি আপনার কাছে রান্না শিখেছে?”
“হো।”
“ওকে দ্রুত সব ভুলতে বলুন।”
রিনার মা অবাক, “কি কন আমনে? কিয়ারে?”
“কারণ আপনার রান্না বিষের মত।”
রিনার মার যথেষ্ট হাসি হাসি মুখটা মুহূর্তেই থমথম করে উঠল। তিনি বিষচোক্ষে মুবিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মুবিনও রিনার মার দিকে তাকাল। রিনার মা স্টিলের থালাবাটির মত কানে ঝনঝন তুলে বললেন, “আল্লাহ আল্লাহ তামান ইবলিশ, পোলা। বেদ্দ…” বলতে বলতে নিজেকে কোনোমতে থামালেন তিনি। রাগে কাঁপতে কাঁপতে দরজার দিকে এগুলেন। মুবিন বলল, “আপনি এই মেসে আমার মতই নতুন, রিনার মা। আর আপনাকে আমার মা এখানে রেখেছেন।”
রিনার মা হকচকিয়ে গেলেন। ভয়ও পাচ্ছেন। হায়হায় কি হবে এখন? পোলা জানি টের না পায় হেই কতা অইছিল। মুবিন বলল, “আপনি এখন যান।”
রিনার মা গেলেন না। দাঁড়িয়ে রইলেন। মুবিন সুহার প্র্যাক্টিক্যাল খাতা খুলে পড়ার টেবিলে বসতে বসতে বলল, “আপনার রান্না ভালোই। মূলা সাধারণত আমি খাই না। তবুও আপনি রাঁধলে খেতে ইচ্ছে করে।”
রিনার মা প্রশংসাবাক্য শুনেও এখন আর খুশি হতে পারছেন না। ধরা পড়ায় তাঁর চাকুরী শেষ।
তিনি ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলেন, “আমনে কেমনে জানলেন?”
মুবিন একগালে বিকৃত হাসি হাসবার চেষ্টা করল। কতটুকু পারল সে জানে না। বলল, “আমার মা আপনাকে এখানে পাঠিয়েছে বলেই আমাকে বেশি কিছু বলার সাহস আপনার হয়নি। রাগ ধামাচাপা দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন।”
রিনার মা বিস্ময়ে মুখ হা করে রইলেন। পোলা এত সেয়ানা!
মুবিন ভারি এবং গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “আমি এখন পড়ব। আপনাকে দেখলেই আমার রাগ হয়। রেগে গেলে আমি পড়তে পারিনা। আপনি এখন যান। কালকে মূলার তরকারি রাঁধবেন।”
শেষ বাক্যটি শুনে রিনার মা দম ফেললেন। তাঁর চাকুরীটা এখনও বেঁচে আছে। তিনি মাথা কাত করে ছোট বাচ্চামেয়ের মত বলতে থাকলেন, “ঠিকাছে, ঠিকাছে।”
মুবিন বলল, “আমার মাকে জানিয়ে দিবেন আমি হাঁদা না।”

রিনার মা চলে যাওয়ার পর মুবিন উঠে আরো একটা কাজ করল। মেসের বারান্দায় ইমাদের ঝুলতে থাকা সাদা শার্টটা পানিতে নীল গুলিয়ে ইচ্ছামত চুবাল। তাকে পাহারা দেয়া হচ্ছে? তার উপর নজরদারি? সে ইমাদ স্যারকে দেখে নিবে!
চলবে ইনশাআল্লাহ…..

একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-৪২+৪৩

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৪২
মুবিন,
তুমি কি বড় হয়ে গুন্ডা হতে চাও? স্যরি, স্যরি তুমি অলরেডি
সন্ত্রাস। সমস্যা কি তোমার? গতকাল হৃদয়ের সাথে তুমি আবার মারামারি করেছ। ওর আঙুল থেতলে দিয়েছ, তুমি। আগামী সপ্তাহে যে আমাদের প্র্যাক্টিকেল খাতা সাইন করানোর লাস্ট ডেইট, তুমি জানো না? এখন ও কি করবে? ওর খাতা কে লিখে দিবে, তুমি? অ্যাই, তুমি না মাত্র গত সপ্তাহে হাসপাতাল থেকে ফিরলে? হাসপাতাল থেকে ফিরে বড় বড় জালেমরাও ভয়ে ভালো মানুষ হয়ে যায়। আর তুমি? তোমাকে দেখে বুঝলাম কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয় না। আচ্ছা তোমার কিসের এত অহঙ্কার, মুবিন? আমাকে বলো। বলতেই হবে। প্রিটেস্টে উচ্চতর গণিতে একই সাথে দুই দুইটা রসগোল্লা পাওয়া লাড্ডু তুমি। ডাবল জিরো! রসায়নে পেয়েছ ১৫, পদার্থে ৮, জীববিজ্ঞানে ৩৬, সাধারণ গণিতে ২। এই ধরনের নাম্বার পাওয়া ছেলের এত অহঙ্কার আসে কোথা থেকে? তোমার মা-বাবাই তোমাকে লাই দিয়ে দিয়ে নষ্ট করেছে। উনারা আরেক চিজ। তাঁদেরকে আমি একদিন মিনা কার্টুনের সিডি কিনে না পাঠালে না আমার নামও সুহা না। মিলার প্রতি তাঁদের আচরণ দেখে আমি শকড। আর তুমিও কমকিছু নও। আস্ত একটা স্বার্থপর তুমি। লজ্জা করে না তোমার মিলার জন্য কিনে আনা নতুন পাখা নিজের ঘরে নিয়ে যেতে? লজ্জা করে না প্রতিবছর শুধু নিজের জন্মদিন সেলিব্রেট করতে? লজ্জা করে না মা-বাবার ঝগড়ার সময় এতগুলো মেহমানের সামনে নিজের ছোট বোনকে একা রেখে দরজা আটকে বসে থাকতে? লজ্জা করেনি এভাবে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে? লজ্জা করে না তোমার টু টু করে ঘুরে এক ক্লাসে দুইবার পড়তে? ছিহ কি নির্লজ্জ তুমি! সমানতালে কাপুরুষও। কাপুরুষ না হলে কেউ আত্মহত্যা করতে যায়? তুমি যেসব সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছ মিলাও ত সেই একই সমস্যাগুলোই ফেস করছে। তুমি সমস্যা দেখলে পালিয়ে যাও, আর ও পারুক না পারুক সমস্যার সমাধান করবার চেষ্টা করে। একই পরিস্থিতে থেকে মিলা যদি ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল হতে পারে তাহলে তুমি কেন ফেইল করে ছোটবোনের সাথে এক ক্লাসে পড়ো? সমস্যা তোমার পারিবারিক সমস্যায় না। সমস্যা তোমার মাঝে। তুমি কোথায় তোমার এই অস্বাভাবিক পরিবারের জীবনটাকে স্বাভাবিক করে তুলবার চেষ্টা করবে, তা না করে আরো কঠিন করে ফেলছ। ওহো কিচ্ছু বুঝো না তুমি, আর নাহয় বেশি বেশি বুঝো। তুমি ভালো হবে না মরবে এগুলো তোমার বিষয়, কিন্তু আমার বান্ধবীর সাথে কোনোপ্রকার অন্যায় করার আগে দশবার ভাববে। আমি তোমাকে ছাড়ব না। অনেক সহ্য করেছি, আর না। ফেইল মারো আর পাশ করো তা তুমি জানো। গুন্ডার মত রাস্তাঘাটে মারামারি করলেও করো। মা-বাবার সাথেও তোমার ব্যাপার তুমিই মেটাও, কিন্তু ভাইয়ের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন তোমাকে করতেই হবে। না করলে তোমার খবর আছে। তুমি কি জানো মিলা কত কষ্টে থাকে? কত কাঁদে? তুমি ত একা একাই মা – বাবার সব আদর নিয়ে নাও। ওকে কে আদর করবে? তুমি একটু আদর করতে পারো না? ও শক্ত বলে, নিজেকে সামলাতে পারে মানে কি এমন যে ওকে এই কষ্টগুলো পেতেই হবে? এখন থেকে ওর জন্মদিন তুমি পালন করবে, ওর খেয়াল তুমি রাখবে। আর শুনলাম হোস্টেলে উঠেছ। ভালো ভাই হও, ভালো থাকো।”
ইতি,
“সুহা।”
পুনশ্চঃ এই চিঠির জন্য যদি মিলাকে মারো কিংবা কিছু বলো তারপর হবে… মিলা কিচ্ছু জানে না। মাইন্ড ইট।

মুবিন চিঠিটা ভাঁজ করে পকেটে রাখল। তারপর যে ছেলেটা চিঠিটা নিয়ে এসেছে তার নাক বরাবর ঘুষি মারল। ছেলেটা থুবড়ে পড়ল মাটিতে। মুবিন এগিয়ে গিয়ে কলার ধরল তার। নাক ফুলে গেছে ছেলেটার। ব্যথায় মুখ কুঁকড়ে যাচ্ছে বারবার। বিস্ময় আর ভয় মিশ্রিত চাহনি নিয়ে সে বলল, “সুহা বলেছিল চিঠিটা দিতে।”
মুবিন চুইঙ্গাম চিবুতে চিবুতে বলল, “কোথায় সে?”
ছেলেটা নিজের কলার থেকে মুবিনের হাত সরিয়ে বলল, “আমি জানি না। দু’তলার সিঁড়িতে দেখা হয়েছিল।”
মুবিন ঠাশ করে আরেকটা চড় মারল ছেলেটাকে। তারপর ঘুরে দু’তলার দিকে গেল।
.
মুবিন এসময়ে স্কুলে থাকায় মেসের যে ঘরটায় সে থাকে, ইমাদ সে ঘরটায় গেল। এখনি সুযোগ। গিয়ে মুবিনের সবকিছুতে একবার চোখ বুলাল। বিছানা উল্টে দেখল সেখানে ছারপোকা আছে কিনা। মেসে সাধারণত ছারপোকাদের রাজত্ব। মুবিন আয়েশি ছেলে। ছারপোকার কামড় খেতে খেতে ঘুমানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। যা ভেবেছিল তাই। ছারপোকাদের ডিম তোশকের কোণায় এঁটে আছে। এগুলো ফুটলে সর্বনাশ। তোশক রোদ দেয়ার মত জায়গা এখানে নেই। ইমাদ তাই নিজের ঘর থেকে ইস্ত্রী নিয়ে এল। চাদর উঠিয়ে বিছানায় উঠে বসল। তোশক টেনে ধরে ছারপোকার ডিম পাকিয়ে আছে এমন জায়গাগুলোতে ইস্ত্রী চেপে ধরল। গরম তাপে মরবে সব। ছেলেটাকে নিয়ে কি করবে সেটাই ভাবছে ও। কত যে মায়া লাগে। ওরকম বয়সের একটা ছেলে কি করে মরবার কথা চিন্তা করে? ওর তো এখন উড়ে বেরানোর কথা। আর মিলা? মিলা কেমন আছে? মিলার সাথে একবার দেখা করতে পারলে ভালো হতো। আচ্ছা, কড়ির সাথে কি মুবিনকে নিয়ে কথা বলা যায়? সবচেয়ে ভালো হতো কড়ি যদি একটু মুবিনের সাথে কথা বলতো। মুবিন এখানে আসবার পর থেকে যদিও একদিনও ইমাদ আর ওর কথা হয়নি তবুও ইমাদ দূর থেকে চেয়ে দেখেছে। পড়াশুনা তো দূরের কথা সে ঠিকমত খাওয়া-দাওয়াটা পর্যন্ত করে না। সবই খেয়াল করে। তবে সমস্যা হলো মুবিন যথেষ্ট বেয়াদব। ওর সাথে কথা বলতে যাওয়া মানে যেচে পড়ে চরম অপমানিত হতে যাওয়া। কড়ি কিছু বলতে গেলেই দেখা যাবে মুবিন কড়ির সাথেও বেয়াদবি করে বসবে। ইমাদের সেটা সহ্য হবে না। থাক কড়িকে এ বিষয়ে টেনে আনবার কোনো প্রয়োজন নেই। ওর কাজ শেষ। ইস্ত্রী গুছিয়ে ও উঠে চাদর বিছিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আজকে অনেকদিন পর দীপুর সাথে ওর আর নিলয়ের বেরুনোর কথা। দীপুকে আজকাল সাথে পাওয়া মুশকিল। পড়াশুনা, সংসার, শ্বশুরবাড়ি সব সামলাতে সামলাতে নাভিশ্বাস ওর। আজ বহুদিন পর আবার ওরা তিনজন একটু একসাথে ঘুরবে, আড্ডা দিবে। যদিও বিশেষ একটা কাজেই ওরা বেরুচ্ছে তবুও শুধু তিন বন্ধুর সময় এটা। নতুন কোনো স্মৃতি তৈরী হবে আজ। প্রিয়জনদের সাথের ছোট থেকে ছোট, প্রতিটা মুহূর্ত খুব দামি।
ইমাদ আর নিলয় কথা মতো দীপুকে ছাতিপট্টি পেয়ে গেল। ছাতিপট্টির রাস্তার দু’পাশ জুড়ে শুধু জুয়েলারির দোকান। কুমিল্লা শহরের বেশিরভাগ জুয়েলারি দোকান এই এলাকায়। দীপু আকাশী রঙের সেলোয়ার কামিজ পরে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসে ওর সাদা ওড়না আর চুলগুলো উড়ছে। ও বারবার বিরক্ত হয়ে কানের পেছনে চুল গুঁজছে। বিয়ের পর দীপু আরো সুন্দর হয়েছে। তারমানে ভালো আছে ও। ইমাদ মনে মনে আশ্বস্ত হলো। যাক তার মানে ও শুধু শুধু ভয় পেয়েছিল। অবশ্য ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণও ছিল। দীপুর সব জেনেশুনে কোন মেয়ে তার ভাইয়ের জন্য শুধু শুধু কোনো স্বার্থ ছাড়া তো আর বিয়ের কথা বলতে পারে না। ইমাদের ধারণা ভুল ছিল না। কড়িরও স্বার্থ ছিল তাই এ বিয়েকে স্বাগত জানিয়েছে, তবে ইমাদ যেরকম স্বার্থ ভেবেছিল সেরকম স্বার্থ নয়, অন্য কারণ।
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৪৩
দীপা ইমাদ আর নিলয় প্রথমে গেল লুতু ভূঁঞা জুয়েলার্সে। সেখানে গিয়ে দীপা অনেকগুলো দারুণ দারুণ পুরোনো গয়না বের করল। তারপর সেগুলো ভেঙে নতুন গয়না গড়ার অর্ডার দিয়ে তিনজনে গেল পাশের ডায়না হোটেলে। হালিম অর্ডার করে একটা টেবিলে বসল ওরা। নিলয় বলল, “বাপরে! কি ভারি ভারি গয়না!”
দীপা মন খারাপ করে বলল, “হ্যাঁরে সব আমার শাশুড়ির। এগুলো ভেঙে নতুন গয়না গড়তে আমার মন ভেঙে যাচ্ছে।”
“তাহলে ভাঙছিস কেন? আমি তো ভাবলাম তোর নতুন ডিজাইন লাগবে।”
“তোর আমাকে এমন মনে হয়?”
নিলয় বলল, “কেঁদে ফেলছিস নাকি? মারে মা মাফ কর। তুই এমন না। তুই ঐ বংশের সবচেয়ে লক্ষী বউ।”
দীপা বেজায় মন খারাপ নিয়ে বলল, “কড়ির ভাগেরগুলো নিয়ে ঐ হারামি পালিয়ে যাওয়ার পর কড়ি নিরুপায় হয়ে ওর দুই ভাইয়ের ভাগেরগুলোও লুকিয়ে ফেলেছিল। রিমা ভাবিরগুলো উনার কাছেই ছিল। তাই সমস্যা হয়নি। কিন্তু বাকিগুলো? চোর সব না নিয়ে শুধু ওরটা নিলে তো সমস্যা। ও ধরা পড়ে যেত না? তাই এখন আমাকে কাদিনের ভাগেরগুলো বুঝিয়ে দিয়ে বলেছে যেন এগুলো ভেঙে নতুন গয়না গড়ে বলি আমার বাপের বাড়ির গয়না এসব। নাহয় সব ফাঁস হয়ে যাবে।”
ইমাদ টেবিলের উপর রাখা লবণদানিটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওটার নকশা দেখছিল। নকশা দেখতে দেখতেই কারো দিকে না তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “তার মানে তোর বরও জানে না এসব?”
“না। কড়ি ওয়াদা নিয়েছে। কাউকে কিছু বলা যাবে না।”
ইমাদ মনে মনে হাসল। ওহ এই তাহলে দীপাকে বিয়ে করিয়ে নেবার পেছনে কড়ির মূল উদ্দেশ্য! বিশ্বস্ত ভাবি হলেই শুধুমাত্র এই গয়নাগুলো এভাবে বুঝিয়ে দেয়া সম্ভব। অন্যথায়….! কড়ি মেয়ে বটে একটা! এক পিস। ইমাদ মনে মনে তিনবার মারাহাবা বলল। মাশাআল্লাহ বলতেও ভুলল না।
.
মুবিন দু’তলার করিডোরে একা দাঁড়িয়ে চিঠিটা আবার পড়ল। পড়তে পড়তে মুচকি হাসল। একটা চড়ুই লাফিয়ে এলো। ওকে আর একা থাকতে দিলো না। চড়ুইটাকে সঙ্গে নিয়ে রেলিং এ সে হেলান দিলো। এরপর ডুবে গেল ভাবনায়। চারিদিকে ঘণ্টা বাজার ঢং ঢং শব্দ। ক্লাস শুরু হবার সংকেত। মুবিন রেলিং ছেড়ে ক্লাসে গেল। ইশারায় মিলাকে কাছে ডাকল। মিলা অবাক হয়ে উঠে এলো, “কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?”
মুবিন মিলার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “ক্লাসের সব ছেলেরা যে আমায় প্রচন্ড ভয় পায় তা কি তুই জানিস?”
“এটা কেমন প্রশ্ন?”
মুবিন এবার খেঁকিয়ে উঠল, “জানিস কিনা?”
মিলা মুবিনের চেহারা পড়বার চেষ্টা করল, ব্যর্থ হলো এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “হ্যাঁ জানি। সব ছেলেরা তোকে ভয় পায়।”
মুবিন আবারো বোনের কানের কাছে মুখ নিয়ে গেল, “আর মেয়েরা?”
মিলা চমকে উঠে ভাইয়ের দিকে তাকাল, “মুবিন?”
“কি?”
“কার কথা বলছিস তুই? লুকাস না। কি শুরু হয়েছে সত্যি করে বল।”
মুবিন রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসল, মাথা দুলাল তারপর বলল, “বল না সবাই কি আমাকে ভয় পায়?”
মিলা ভ্রু কুঁচকে বলল, “বেশিরভাগ’ই। এ ক্লাসের কেন এই স্কুলের একটা মেয়েও তোর দ্বারা পটবে না। সবাই জানে তুই মারামারি করে বেড়াস। মেয়েরা ভালো ছেলে পছন্দ করে।”
মুবিন বলল, “ঘণ্টা! মেয়েরা ব্যাড বয়দের পছন্দ করে।”
“সব মেয়েরা না।”
“কোন মেয়েরা করে? যাঁরা বেশি সাহসী তাঁরা?”
মিলা বিরক্ত হয়ে বলল, “ধ্যাত! তোর সাথে কথা বলা মানেই সময় নষ্ট! আমি কি এসবে পিএইচডি করে রেখেছি নাকি? স্যার আসছেন আমি যাই।”
মিলা গিয়ে নিজের বেঞ্চে বসল। মুবিন মুখের পুরোনো চুইংগামটা জানালা দিয়ে থু করে ফেলল। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে মিলার পেছনে বসা সুহার দিকে তাকাল। সুহা মিলার অগোচরে লুকিয়ে লুকিয়ে মিলার সাদা ওড়নায় কলম দিয়ে আঁকিবুঁকি করছে আর মিটিমিটি হাসছে। মুবিনে ওদিকে তাকিয়ে হাসল।
ছুটির পর মিলা কখনো দাঁড়ায় না। খুব দ্রুত বাসায় চলে যায়। তাই মুবিন ছুটি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল। ছুটির পর সুহা স্কুলের মাঠে তার অন্য বান্ধবীদের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। মুবিন এসে ওদের পাশে দাঁড়াতেই সব ক’টা মেয়ে ভড়কে গেল। এই ছেলেটা ছেলেদের সাথে মারামারি করে, স্যার ম্যাডামদের সাথে বেয়াদবি করে। সবসময়! তবে যা কখনো করে না তা হলো কোনো মেয়ের সাথে কথা বলা। এমনকি নিজের বোন মিলার সাথেও স্কুলের সময়ে কখনো তাকে বেশি একটা কথা বলতে দেখা যায়নি। তবুও সব মেয়েরা ওকে মোটামুটি ভয় পায়। মুবিন বলল, “হ্যালো, সুহা।”
বাকি মেয়েরা এতক্ষণে হালকা হলেও স্বাভাবিক হলো। মুবিন মিলার ভাই তাই সুহার সাথে কথা থাকতেই পারে।
সুহা বলল, “কি দরকার?”
মুবিন খসখসে গলায় বলল, “আমি জানতাম না আমাদের প্র্যাক্টিকেল খাতা সাইন করবার ডেইট আগামী সপ্তাহে। আমি হৃদয়ের প্র্যাক্টিকেল খাতাটা করে দিতে চাই।”
সুহা মেজাজ দেখিয়ে বলল, “হ্যাঁ, তোমার উচিতও।”
“কিন্তু কীভাবে করব?”
সুহা ধমকাল, “কীভাবে করবে মানে? হাত দিয়ে করবে।”
অন্য মেয়েরা সবাই থ বনে গেল। সুহা এগুলো কি করছে? এই ভয়ঙ্কর ছেলেটার সাথে এভাবে কথা বলছে! শাসিয়ে, শাসিয়ে!
মুবিন আমতা আমতা করে বলল, “আমি ত নিজেরটাও করিনি। আমারটা মিলা করে দেয়। আমার কাছে পুরোনো কোনো প্র্যাক্টিকেল খাতাও নেই। না আছে প্র্যাক্টিকেল বই। আমার কোনো বন্ধুও নেই যার কাছ থেকে এসব চেয়ে নিব।”
“মিলারটা দেখে করে দাও।
মুবিন শ্লেষাত্মক গলায় বলল, “ওকে জিজ্ঞাসা করে দেখো আমাকে ওর খাতাটা দিবে কিনা। আমার গল্পের বইগুলো চুরি করে নিয়ে তোমাকে ঠিকই দিতে পারে। কিন্তু ওর বই, প্র্যাক্টিকেল খাতা এসব আমাকে ছুঁতেও দেয় না। তুমি তো জানোই। তোমাকে দেয় নাকি?”
সুহা বলল, “না, তা দেয় না। বইখাতা ওর বয়ফ্রেন্ড। এসব নিয়ে ও যথেষ্ট পজেসিভ।”
মুবিন বলল, “আমি এখন কি করব? আচ্ছা এক কাজ করা যায় দোকান থেকে করিয়ে আনি।”
সুহা বলল, “খবরদার! নিজে করবে। টাকার গরম দেখিয়ে প্রায়শ্চিত্ত হয় না।”
মুবিন কাঁধ নাচিয়ে বলল, “আর কি করব আমি?”
সুহা বলল, “আমি কি করব সেটা বলো।”
“তোমার তো অনেক বন্ধুবান্ধব কারো কাছ থেকে নিয়ে দাও।” সুহা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, “আমার খাতাগুলো দিচ্ছি। ওগুলো দেখে করো।”
মুবিন বলল, “না তোমার খাতা নেব না।”
সুহা অবাক হলো, “কেন?”
“আমার ইচ্ছা। অন্য কারোটা কালেক্ট করে দাও।”
সুহা এবারে নরম হলো। বলল, “কেন নেবে না? নাও। রাগ করেছ নাকি? আমি তো তোমাকে প্রথমে অনেক অনেক ভালো চিঠি লিখেছি। বুঝিয়ে চিঠি লিখেছি। তুমিই তো ওসব পাত্তা দাওনি। তাই অবশেষে রেগেমেগে একটা চিঠি লিখলাম। দেখলে তো? এখন ঠিকই শুনলে। সোজা আঙুলে ঘি কখনোই উঠে না।”
মুবিন কর্কশভাবে প্রশ্ন করল, “কখন?”
“তোমার গল্পের বইগুলো পড়ে ফেরত দেবার সময় প্রতিটার মাঝে একটা করে চিঠি দিয়েছি। তুমি কি একটাও দেখোনি?”
“ওহ। না দেখিনি।”
“তাই বলো। আচ্ছা শুনো প্র্যাক্টিকেল খাতাগুলো আমি কালকে স্কুলে আসার সময় নিয়ে আসব।”
“ঠিক আছে।” মুবিন হনহন করে হেঁটে চলে গেল।
চলবে…

একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-৪০+৪১

0

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৪০
মিলা মুবিনের দিকে তাকিয়ে আছে। মুবিনকে মা – বাবা খুঁজে নিয়ে এসেছেন। ও এখনও তার বালুমাখা পোশাক বদলায়নি। ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে রাখা ম্যাজিকবল ভরতি কাঁচের বোতল নিয়ে খেলছে ও। মিলা ভেবেছিল মুবিন এলেই মুবিনকে জড়িয়ে ধরবে, অনেক বকবে সাথে স্যরিও বলবে। অথচ, সে ভেবে রাখা কিছুই করতে পারেনি। মুবিনও ওর দিকে একবারো তাকায়নি।
“যতদ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা করো।” শিল্পী বলল।
শিল্পীর কণ্ঠস্বর শুনে মিলা মুবিনের উপর থেকে দৃষ্টি সরাল। মা- বাবার দিকে তাকাল এবার।
বিধ্বস্ত মঈন টাই ঢিল করতে করতে বলল, “কিসের ব্যবস্থা?”
“সেপারেশনের।”
মঈন ছোট করে বলল, “ওহ।”
শিল্পীর কথা শেষ। ও উঠে চলে যাচ্ছিল। মঈন বলল, “মুবিন অবশ্যই আমার কাছে থাকবে।”
শিল্পী থামল। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার ছেলে কিংবা মেয়ে কাউকেই আমি তোমার মত নীচু প্রকৃতির মানুষের কাছে বড় হতে দিব না।”
“আমি মানব কেন?”
“আদালত পর্যন্ত যেতে না চাইলে মানবে।”
মঈন হা হা করে অট্টহাসি হাসতে লাগল। যখন থামল তখন বলল, “তোমাকে যেন কেস মামলায় যেতে নাহয় এজন্য এতদিন ধরে বুঝাতে চেষ্টা করলাম। মিলাকে তোমার কাছে রাখব এটাও বললাম। এসবের জন্য ডিভোর্সটাও এক এক করে অনেকগুলো দিন পেছাল। তবুও তুমি যখন মানলে না আমার আর কিছু করার নেই। আদালতেই চলো।”
শিল্পী বলল, “তুমি যা মানুষ নিজের স্বার্থের বাইরে এক পাও হাঁটো না। আদালতে গেলে শূণ্যহাতে ফিরবে বলেই এতদিন আমাকে বুঝাতে চেষ্টা করেছ। কথা বলার আগে ভেবে কথা বলবে।”
“আমি কোনো নীল নকশাকারী নই যে ভেবেচিন্তে কাজ করব, ভেবেচিন্তে কথা বলব।”
শিল্পী সরে এসে এবার সোফায় বসল। বলল, “কি বলতে চাইছ?”
“তোমার মত অত ভেবে কাজ করার মত বুদ্ধি আমার কখনো ছিলও না, আর হবেও না।”
“যা বলবার সরাসরি বলি।”
মঈন একগালে হাসল, “বাচ্চাদের সামনে তোমাকে ছোট করতে চাই না।”
শিল্পী কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। পরে বলল, “আমি আমার ছেলেমেয়েদের ছুঁয়ে বলতে পারব যে আমি জোহরার বিয়ের কার্ড সেদিন পাইনি। জোহরা আমাকে কোনো কার্ড দেয়নি। জোহরা সেদিন এসেছিল হলে, কিন্তু আমি কোনো বিয়ের কার্ড পাইনি।”
মুবিন প্রসঙ্গটা ধরতে না পারলেও মিলা জোহরার নাম শুনে চমকে উঠল। মায়ের কাছে ও শুনেছে। কিন্তু মা তো বিয়ের কার্ড নিয়ে কোনো কথা ওকে বলেননি!
মঈন হাহা করে হাসতে হাসতে বলল, “ওহ কাম অন। এইসব ছোঁয়াছুঁয়িতে আজকাল কে বিশ্বাস করে? তুমিও করো না। তাই বলতে পারছ। জাস্ট ফরগেট ইট। যা করেছ শাস্তি পাচ্ছো। সাফাই গাইবার চেষ্টা করো না।”
“আমি কিচ্ছু করিনি। করার মধ্যে তোমার কথায় তোমাকে বিয়ে করেছি, তোমার দুঃসময়ে পাশে থেকেছি। আর আজ তার প্রতিদান পাচ্ছি।”
মঈন সিগারেট ধরিয়েছে। আঙুলের ফাঁকে সিগারেট চেপে ধরল সে। ঠোঁটে দেয়নি। পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসে বলল, “ওসব কীর্তন আমায় শুনিয়ো না। জাস্ট গোউ টু হেল।”
শিল্পী শক্ত জবাব, “জাহান্নামে তো তুমি যাবে। আর যাবে তোমার জোহরা। যাকে আমি লুকমা তুলে খাইয়েছি অথচ, ও আমার সংসার ভেঙেছে।”
মঈন সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বলল, “জোহরাকে দোষ দিতে লজ্জা করছে না একটুও?”
“বেহায়াপনা করে বেরানোর পুরুষমানুষ আমাকে লজ্জার পাঠ না শেখালেই আমি খুশি হব।”
“শাট আপ, শিল্পী। ছেলেমেয়ের সামনে কি করে কথা বলতে হয় তাও জানো না। ক্লাসলেস মহিলা কোথাকার।” মঈন হুংকার দিয়ে উঠল।
শিল্পী হিসহিস করে বলল, “ওদের কি চোখ নেই? ওরা যথেষ্ট বড়। আমি ওদের সামনে না বললেও ওরা বুঝে গেছে যে ওদের বাবা বেহায়াপনা করে বেড়ায়, মেয়ে নিয়ে ফূর্তি করে। আমার মনে হয় না ওরা কেউই তোমার কাছে থাকতে চাইবে।”
মিলার এসব শুনতে একটুও ভালো লাগছিল না। ও চলে যাচ্ছিল। মঈন ডাকল, “মিলা যেও না। আমারটা যখন জেনেছ তোমার মায়েরটাও জেনে যাও। তোমার মা একজন প্রতারক, মিথ্যেবাদী, হিংসুটে মহিলা। আমি যা করেছি শুধু ওকে শাস্তি দিতে করেছি।”
শিল্পী সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল। নিঃশব্দে হেসে শ্বাস ফেলল ধীরে ধীরে। মঈন অস্থির হয়ে বলল, “মুবিন, মিলা লিসেন টু মি। আমি যা বলতে চাইছি মনোযোগ দিয়ে শুনো। মুবিন বোতল রাখো। আমার দিকে তাকাও। কথা শুনো। তোমাদের মা আমার সাথে কি করেছে শুনলে তোমরা কখনো আমায় ছেড়ে যাবে না।”
মুবিন বোতল রাখল না। মঈন সোফা ছেড়ে উঠে এসে ছেলের মুখটা দু’হাতে তুলে ধরে বলল, “বাবা, তাকাও আমার দিকে। এটা রাখো। প্লিজ।”
মুবিন বোতলটা রেখে উঠে দাঁড়াল। তারপর খুব শান্ত অথচ কঠিন এবং দৃঢ়প্রত্যয়ী কণ্ঠে ঘোষণা করল, “আমি কারো কাছে থাকব না। একা থাকব। ”
মঈন মুবিনের কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে বলল, “চুপ করো, মুবিন। কি বলছি শুনো আগে।”
মুবিন ওয়ালশেলফ থেকে ম্যাজিক বল ভরতি বোতলটা হাতে নিয়ে মেঝেতে ফেলে দিলো। নানা রঙের রঙিন কিছু বল রঙিন শৈশব ছেড়ে ছুটে গেল দিক্বিদিক। রঙিন শৈশব আর ধারণ করবার বোতল বাধ্য হয়ে হয়ে উঠল মরণাস্ত্র। মুবিন ঝুঁকে সেই আধভাঙা কাঁচের বোতল হাতে তুলে নিজের অন্য হাত বরাবর চালিয়ে দিলো। ফিনিক ফোঁটা লাল জোছনা গড়িয়ে পড়ল হাত থেকে। শিল্পী সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একটা চিৎকার দিলো।
.
দীপার মা জানতে চাইলেন, “কিরে জামাই এই দুপুরে কোথায় গেল? খাওয়ার সময় যে চলে যাচ্ছে।”
দীপা মুখ ভরতি বার্গার নিয়ে কথা বলতে পারছে না, তবুও কোনোমতে বলল, “বাসায় নাকি কি কাজ আছে তাই গেল।”
“কি এমন কাজ যে অত পাগল পাগল হয়ে গেল?”
দীপা বলল, “আমাকেও কিছু বলেনি যে, মা।”
“উমাহ তুই জানতে চাইবি না?”
“জানতে চাইবার সুযোগই হয়নি। বসে বসে টিভি দেখছিল। আচমকা উঠে দাঁড়াল। বলল, আমি একটু বাসায় যাচ্ছি।”
দীপার মা চিন্তিত হয়ে বিড়বিড় করলেন, “জামাই তো ফিটফাট না হয়ে নীচের দোকানটায়ও যায় না, ছাদেও যায় না। কি যে হলো কোনোমতে দৌড় দিল! দীপার সাথে কিছু হয়নি তো!” একটু ভেবে তিনি বলেই ফেললেন, “সত্যি সত্যি বল তো জামাই তোর উপর রাগ করেছে? রাগ করে চলে গেছে?”
দীপা মায়ের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ল, “আরে না।”
“দেখ লুকাবি না। ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে যাচ্ছে। তোর যা স্বভাব! যে কোনো মানুষকে দশ মিনিটে বিরক্ত করে তুলিস, রাগিয়ে দিস।”
দীপা বলল, “আরে না, মা। বিশ্বাস করো আমি কিছুই করিনি।”
“তুই যে কখন কি করিস নিজেও বুঝিস না। চুপ থাক। তুই আমার সামনে কল দে তো দেখি। আমার সামনে কাদিনের সাথে কথা বলবি।”
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৪১
মায়ের কথায় বাধ্য হয়ে দীপাকে কল করতে হলো। কাদিন ফোন ধরে বলল, “চলে এসেছি। এই তো আর পাঁচ দশ মিনিট।”
দীপা ফোন রেখে মাকে বলল, “হলো তো? কিছুই হয়নি কাদিনের সাথে। চলে আসছে। আমাকে কেউ বিশ্বাস করে না। সব দোষ দীপার।” কারেন্ট চলে গেল হঠাৎ। দীপা বলল, “এখন বলো কারেন্টও আমার জন্য চলে গেছে।”
বলেই ফুঁসতে ফুঁসতে চট করে উঠে দাঁড়াল। দীপার কোলের উপর রাখা পিরিচটা ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল মেঝেতে। দীপার মা চোখ লাল করে তাকিয়ে বলল, “এখন বল পিরিচ ভাঙায় তোর দোষ নেই?”
দীপা চোখ বন্ধ করে জিহ্বা কাটল। তারপর চোখ খুলে অপ্রস্তুত হয়ে হেসে বলল, “আরেকটা কিনে দিব তোমায়? ঐ যে ছোট ছোট রজনীগন্ধা আঁকা…”
দীপার মা কঠিন ধমক দিয়ে বললেন, “সামনে থেকে সর তুই।”
দীপা ধমক খেয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে পালাচ্ছিল। ওর মা আরো রেগে গিয়ে বললেন, “কাঁচের টুকরাগুলো কে পরিষ্কার করবে? আমি?”
দীপা বলল, “না, না আমিই করছি।”
ও দৌড়ে এসে কাঁচের টুকরোগুলো তুলে ঝুড়িতে ফেলল। তারপর ঝাড়ু হাতে নিয়ে মেঝে পরিষ্কার করতে শুরু করতেই কলিংবেল বেজে উঠল। চোখের পলকে দীপা হাতের ঝাড়ু ফেলে বলল, “মা, কাদিন এসে গেছে। এখন আমার হাতে ঝাড়ু দেখলে অগণিতবার হাত ধুয়াবে আমায়। বাকিটা তুমি করো। কোথায় বিয়ে দিয়েছ আমায়? কী যন্ত্রণা!” বলতে বলতে দীপা গিয়ে দরজা খুলল। কাদিনকে দেখে মিষ্টি করে হাসল। কাদিন ইশারায় কি যেন বুঝাল দীপা বুঝল না। সে বিরক্ত হয়ে বলল, “মুখে বলুন না। কিসব ইশারামশারা শুরু করেন।”
কাদিন অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে বুঝতে পেরে দীপার মা’ই সরে গেলেন। কাদিন খুব নীচু লয়ে বলল, “আমার সাথে ঘরে আসতে বলছিলাম।”
দীপা বলল, “তো জোরে বলেন না। এত ফিসফিসের কি আছে?”
কাদিন মিনমিন করে বলল, “আল্লাহ আমায় ধৈর্য্য দাও।”
নিঃশব্দে চলে এল সে ভেতরে। দীপাও এল পেছন পেছন। কাদিন পকেট থেকে কালো রঙা ছোট একটা ভেলভেট রিং বক্স বের করে বলল, “এটা তোমার জন্য।”
দীপা অবাক চাহনি নিয়ে হেসে বলল, “আপনি না বললেন বাসায় যাচ্ছেন?”
কাদিন বক্স খুলে আংটি বের করতে করতে বলল, “হ্যাঁ, বাসায় গিয়েছিলাম। বিয়ে ঠিক হওয়ার পরপর’ই প্রথম রাতে উপহার দিব বলে কিনেছিলাম।”
দীপা উশখুশ করতে করতে জিজ্ঞাসা করেই ফেলল, “দিননি কেন?”
কাদিন দীপার হাত ধরে আঙুলে রিংটা পরিয়ে বলল, “তখন প্রয়োজন মনে করিনি। আজ প্রয়োজন মনে হলো তাই মনে পড়ার সাথে সাথে যাঁরটা তাকে বুঝিয়ে দিলাম।”
“এখন কিসের প্রয়োজন? লাগবে না যান।”
কাদিন হালকা হাসল, “রেগে ছিলাম।”
হুহ রাগ খালি উনার সম্পত্তি। আর আমার রাগ হয়না, না?” মুখে এক ছটাক কালো মেঘের বসতি নিয়ে দীপা সরে আসছিল।
কাদিন দীপার ওড়না টেনে ধরল, “তাহলে এসো রাগ ভাঙিয়ে দিই।”
দীপা রেগে বলল, “আমি এখনি এটা খুলে ফেলব। লাগবে না আমার।”
কাদিন বলল, “আচ্ছা ওড়না তুমি খুলবে? খুলো।”
দীপা থতমত খেয়ে গেল। বলল, “আমি আংটির কথা বলেছি।”
কাদিন বলল, “কে জানে তুমি কোনটার কথা বলেছ?”
দীপা টান দিয়ে কাদিনের হাত থেকে ওড়না ছাড়িয়ে ঝাঁজাল কণ্ঠে বলল, “শয়তান লোক একটা!”
ছাড়িয়ে নিলে কি হবে? কাদিন আবারো ওড়না টেনে ধরল, সাথে দীপাকেও।
.
এই ভর দুপুরে দরজা খুলে শিল্পীকে দেখে ইমাদ অবাক হলেও বলল, “আসুন।”
শিল্পী বলল, “ভেতরে আসার নিয়ম আছে?”
“জি।” ইমাদের ছোট উত্তর।
শিল্পী ভেতরে এল, “কেমন আছো?” ওর কণ্ঠস্বর ক্লান্ত, হাঁটার সময় টলছেও।
ইমাদ টেবিলের পাশের চেয়ার টেনে এনে বলল, “বসুন।”
শিল্পী বসল। ইমাদ বসল চৌকিতে। শিল্পী বলল, “অসময়ে তোমায় বিরক্ত করলাম। কিছু মনে করোনি তো?”
“সমস্যা নেই।”
শিল্পী হাতের ব্যাগটা নামিয়ে রাখল, “মুবিনকে নিয়ে কথা বলতে এসেছি।”
“আচ্ছা।” ইমাদ দেখল শিল্পীর চোখ অসম্ভব রকমের লাল। সেই লাল চোখের নীচে গভীর কালি। শিল্পী কেঁদে ফেলল, “ইমাদ, আমার ছেলেটা এখন হাসপাতালে।”
“কেমন আছে?”
“আগের চেয়ে ভালো।”
“আচ্ছা।”
শিল্পী ভেবেছিল মুবিনের কি হয়েছে ইমাদ জানতে চাইবে, কিন্তু সে নিঃশব্দ। শিল্পী ওড়নায় চোখের জল মুছে বলল, “মুবিন, সুইসাইড করতে চেয়েছিল।”
ইমাদের নিশ্চল দৃষ্টি কয়েক সেকেন্ডের জন্য চঞ্চল হলো, “কেন?”
শিল্পী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমি আর ওর বাবা ডিভোর্স নিচ্ছি।”
“আচ্ছা।”
“মুবিনের উপর খুব বাজে ইফেক্ট পড়েছে এটার। ও বাসা থেকেও পালিয়েছিল। একা একা কাউকে না বলে কক্সবাজার চলে গিয়েছিল।”
“আচ্ছা।”
“সেখান থেকে টেকনাফ যাওয়ার পথে পুলিশ ওকে আইডেনটিফাই করতে পারে।” শিল্পী অনেক চেষ্টা করে স্বাভাবিকভাবে কথা চালিয়ে নিচ্ছে।
ইমাদ প্রশ্ন করল, “পরে?”
“বাসায় নিয়ে আসবার পরেই…” বাকিটা শেষ করতে পারল না সে। কষ্টে ওর দম বন্ধ হয়ে আসার সাথে সাথে কথাও বন্ধ হয়ে এল।
ইমাদ জানতে চাইল, “মিলা?”
শিল্পী বলল, “আল্লাহর রহমতে মিলা নিজেকে সামলে নিতে জানে। মুবিনকে নিয়ে কি করব কিছু বুঝি না। কোনো উপায় না পেয়ে তোমার এখানে এলাম।”
“আচ্ছা।”
“আমি জানি মুবিন প্রচন্ড বেয়াদব। এজন্যই তুমি আর পড়াতে যাও না। তবুও এলাম।”
ইমাদ বলল, “আমার খুব টাইট শিডিউল চলছে। নতুন টিউশনী নিয়ে ফেলেছি।”
শিল্পী বলল, “পড়াতে বলছি না, ও কথা বলবার মুখও নেই। মিলার কাছ থেকে শুনেছি ও তোমার সাথেও বেয়াদবি করেছে।”
“কি করতে পারি?”
“মুবিন আমার কিংবা ওর বাবার কারো কাছেই থাকবে না বলে দিয়েছে। ছেলেটার যে অবস্থা জোর করে ওর উপর কিছু চাপিয়ে দেয়ার মত সাহস আর আমাদের নেই। ওকে আমি তোমার কাছে দিতে চাইছি। ধরো তোমার সাথে এই মেসেই থাকল। তুমি ওকে দেখে রাখবে। ফর দ্যাট আ’ল অনার ইউ।”
ইমাদ নিঃসঙ্কোচে বলল, “মুবিন আমাকে যথেষ্ট অপছন্দ করে। ওর এখন এমন কারো কাছে থাকা উচিত যাকে ও পছন্দ করে, যাঁর কাছে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।”
শিল্পী মরিয়া হয়ে বলল, “মুবিন সবাইকেই অপছন্দ করে। এমন কেউ নেই যাঁর কাছে আমার ছেলেটা একটু শান্তিতে থাকবে।”
“তাহলে আমি হোস্টেল প্রেফার করব। এই বয়সী একটা ছেলে মেসের চাইতে হোস্টেলে ভালো থাকবে।”
“হোস্টেলের ধরাবাঁধা নিয়মের সাথে ও কখনো নিজেকে মানিয়ে নিবে না। অবস্থার আরো অবনতি হবে। ও স্বাধীনচেতা। তাছাড়া হোস্টেলে কতরকমের ছেলেপেলে থাকে। আরো বখে যাবে।”
“আমার কাছেই কেন?”
“যথেষ্ট বয়স হয়েছে আমার। মানুষ দেখলে আজকাল চিনতে পারি। মা হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য, সৎ কোনো মানুষকে ছেলের জন্য বেছে নেয়াটাই স্বাভাবিক।”
ইমাদ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। ওকে থামিয়ে শিল্পী হাত জোড় করে বলল, “আমার জায়গা থেকে একবার ভেবে দেখো। আমি যতটা পারব তোমার জন্য করব।”
“ওর আমার সাথে থাকাটা ঠিক হবে না। আর ও হয়তো থাকতে চাইবেও না।”
“আর কোনো উপায় না দেখলে হয়তো থাকবে।”
শিল্পীর কাতর অনুনয়ে ইমাদ অনেক ভেবে বলল, “আমার ঘরে রাখতে পারব না। তবে ও যদি এই মেসে থাকে আমি নাহয় ওর উপর চোখ রাখলাম।”
শিল্পী সাথে সাথে এই প্রস্তাব লুফে নিলো। আপাতত এইটুকুই অনেক।
চলবে…