“নিজের ব্যক্তিগত মানুষটাকে আমরা যখন অন্য কারোর সংস্পর্শে দেখি তখন না আমাদের পুরো দুনিয়া থমকে দাঁড়ায়। একজন স্ত্রীর পক্ষে এই বিষয়টা মেনে নেওয়া যে কত বেশি যন্ত্রণার তা কেবল সেই জানে যে এই মুহূর্তের সম্মুখীন হয়েছে। কোনো মেয়েই পারে না তার স্বামীর ভাগ অন্য কাউকে দিতে। কিন্তু শত অপমান, অবহেলা, লাঞ্ছনা সহ্য করে মাটি কামড়ে পড়ে থাকার কোনো মানে হয় না। আমরা মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের সস্তা বানিয়ে ফেলি। অথচ আমাদের হওয়া উচিত তেজস্বিনী। যে আমাদের তেজের কারণে পুরো পুরুষ জাতির নত হওয়ার কথা সেখানে আমরা তাদের কাছে হয়ে উঠি খেলনা পুতুল। এমনটা কেন হয় বলতে পারিস তারিন? কেন বারবার আমাদেরই পরীক্ষা দিতে হয়? জীবন এতটা জটিল করা উচিত নয় যেখানে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যায়।”
একটা কফিশপে মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে আছে সিরাত। সামনেই তার কলেজ জীবনের বান্ধবী তারিন বসে আছে যে কিনা পেশায় একজন আইনজীবী। আজ অনেক দিন পর তারা দু’জন দেখা করল। সিরাত নিজেই ডেকেছে তারিনকে।
সিরাতের মুখ থেকে উপরিউক্ত কথাগুলো শুনে তারিন হতাশ স্বরে বলে,
“তোর সাথে কখনো এমন হতে পারে সেটা হয়তো আমরা কেউই কোনোদিন কল্পনা করিনি রে। যে মেয়েটা পুরো এলাকা কাঁপিয়েছে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিটা ক্ষেত্রে যার পদচারণ ছিল চোখে পড়ার মতো সেই মেয়েটা আজ কাঁদছে? তোর চোখে তো পানি মানায় না রাত। তোর তেজি রূপ কোথায় হারিয়ে গেল? কেন তুই এখনো চুপ করে আছিস?”
চোখের পানি মুছে সিরাত মলিন হেসে উত্তর দেয়,
“আমি এমনি এমনি চুপ করে নেই তারিন। এর পেছনে কারণ আছে। দেখ, রাগের বশবর্তী হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া বোকামি। আমি যদি এখন রাগ করে ওই বাসা ছেড়ে চলে আসি কিংবা বিবাহবিচ্ছেদের কথা ভাবি তাহলে আমি ওদের শা’স্তি দিতে পারব না।”
“ওই অসভ্য ছেলের সাথে থেকে কী করবি তুই? তোর বয়স ই বা কত? সবে তো সাতাশে পা দিলি। তুই চাইলেই আবার নতুন করে সবটা শুরু করতে পারিস।”
“বাচ্চা আছে তোর?”
সিরাতের এমন প্রশ্নে তারিন স্বাভাবিকভাবে উত্তর দেয়,
“না। আমার বিয়েই তো হলো দেড় বছর আগে। এখনো এসবের পরিকল্পনা করিনি আমরা।”
“শোন, তোকে আজ কিছু কথা বলি। মনোযোগ দিয়ে শুনবি কিন্তু।”
“আচ্ছা বল।”
“আমাদের দেশে প্রায় প্রতিদিনই অনেক ডিভোর্স হচ্ছে। এটা এখন খুব স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। একসাথে থাকতে না পারলে ডিভোর্স নেওয়া অন্যায় নয়। তবে যাদের সন্তান আছে তারা যখন বিবাহবিচ্ছেদের পথে পা বাড়ায় তখন কি একবারের জন্য হলেও সন্তানের কথা ভাবে? আমি সংসার করতে পারছি না। আমার স্বামীর সাথে আমি থাকতে পারছি না৷ তাই ডিভোর্স একমাত্র সমাধান। ঠিক আছে, ডিভোর্স হয়ে গেল। এরপর আমি নতুন করে জীবন শুরু করলাম অন্য একজনের সাথে। আমার প্রাক্তনও বিয়ে করে সুখেই আছে। মাঝখান থেকে সমুদ্রের মাঝে আটকে গেল নিষ্পাপ সন্তানেরা। মা-বাবার বিবাহবিচ্ছেদ দেখা, তাদের নতুন করে জীবন শুরু করতে দেখা, সবকিছুই দেখে বাচ্চাগুলো। কিন্তু এসবের জন্য নিষ্পাপ বাচ্চাগুলো মানসিকভাবে কতটা ভেঙে পড়ে তা কেউ জানে না। আরে ভাই, আমি যদি বাচ্চা জন্ম দিয়ে তাকে ঠিকভাবে বড়ো করে তুলতেই না পারি তাহলে আমার বাচ্চা নেওয়ার কী দরকার? বাচ্চার বাবা সন্তানের কথা ভাবেনি বলে আমিও মা হয়ে ভেবে দেখব না আমার বাচ্চা কীসে ভালো থাকবে? তাহলে আমি মা হলাম কেন? আজীবন যদি নিজের কথা ভেবেই চলতে হয় তাহলে তো বাচ্চা জন্ম দেওয়ার দরকার নেই।”
“মানছি তোর কথাগুলো ঠিক। কিন্তু বাচ্চার কথা চিন্তা করে নিজের জন্য একটুও ভাববি না তুই?”
“আচ্ছা ধরে নে, তোদের কথা মেনে নিয়ে আমি মাহতাবকে ডিভোর্স দিলাম। এরপর অন্য একজনকে বিয়ে করলাম। সে বিয়ের আগে কথা দিল, আমার মেয়েকে নিজের মেয়ের মতো করেই আগলে রাখবে। কিন্তু বিয়ের পর যদি সে বদলে যায়? আমার মেয়েকে যদি নিজের মেয়ে ভাবতে না পারে? যদি বলে মেয়েকে হোস্টেলে দিয়ে দাও? অথবা এমন হলো যে সেই সংসারেও আমি সুখী হলাম না। তখন তোরা কী বলবি? একেও ডিভোর্স দিয়ে দে। আবার নতুন করে জীবন শুরু কর। এটাই বলবি তো?”
তারিন কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করে বসে থাকে। তাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে সিরাত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“তুই তো আইনজীবী। তোর কাছে তো ডিভোর্স এর কেসই সবচেয়ে বেশি আসে। তুই যাদের ডিভোর্স করিয়েছিস তাদের মধ্যে কারোর যদি বাচ্চা থাকে তাহলে একদিন তার সাথে দেখা করে জিজ্ঞাসা করিস, তুমি ভালো আছ তো? আমি ১০০% নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি সেই বাচ্চার উত্তর হবে, আমি ভালো নেই। নিজের বাবা-মা ছাড়া আমি ভালো নেই। আমার বাবা-মা আমার কথা একবারও ভাবেনি। আমি ওদের ঘৃণা করি। হ্যা, বেশিরভাগ সন্তানই বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর তাদের ঘৃণা করতে শুরু করে। আমি চাই না আমার মেয়েও আমাকে ঘৃণা করুক। আমার দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলুক, মাম্মা তুমিও আমার কথা ভাবলে না। নিজের জীবন সুন্দর করে সাজাতে গিয়ে আমাকে একা করে দিলে। আই হেইট ইউ মাম্মা!”
নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে সিরাতের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় তারিন। কাঁধে হাত রেখে সাহস যোগায় তাকে।
“তুই চিন্তা করিস না। আমরা আছি তোর পাশে। শুধু আমি না, আমাদের পুরো বন্ধুমহল পাশে আছে তোর। তুই যা ভাবছিস সেটাই কর৷ আমাদের বিশ্বাস আছে তোর উপর। অন্যায় দেখেও চুপ করে থাকার মেয়ে তুই না। ডিভোর্স দিবি কি-না এটা সম্পূর্ণ তোর বিষয়। তবে যেকোনো সাহায্যের প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবি।”
“এজন্যই আজ তোকে এখানে ডেকেছি। আমার এখন তোকে প্রয়োজন।”
“বল কী সাহায্য দরকার তোর?”
“তোর ননদ ল্যাবে কাজ করে না?”
“হ্যা রাবেয়া ল্যাবে কাজ করে।”
“আমার দু’টো জিনিস দরকার যেটা শুধুমাত্র রাবেয়া দিতে পারবে।”
“কী লাগবে?”
সিরাত কিছু একটা ভেবে ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে বলে,
“এর ভেতরে সব লেখা আছে। যেভাবেই হোক, আগামী সাত দিনের মধ্যে আমার এগুলো চাই।”
“আচ্ছা আমি ওকে বলব। তুই সময়মতো তোর জিনিস পেয়ে যাবি।”
“আজ তাহলে উঠি। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। আবার দেখা হবে আমাদের।”
“সাবধানে যা।”
তারিন নাবিহাকে কোলে নিয়ে আদর করে হাতে একটা উপহারের প্যাকেট দিয়ে বিদায় জানায় তাদের। বান্ধবীর থেকে বিদায় নিয়ে কফিশপ থেকে বের হওয়ার সময় কিছু একটা দেখে থেমে যায় সিরাত। একজনকে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। নিজের ফোনের ক্যামেরা অন করে সেই ব্যক্তির কিছু ছবি তুলে নিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে।
অন্যদিকে নিমু আজও তুলির সাথে দেখা করতে এসেছে। একটা খাম তুলির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
“এখানে পঁচিশ হাজার টাকা আছে। তুই ভাইকে দিয়ে দিস।”
“আচ্ছা দিয়ে দেব। কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলবে নিমু? তোর ভাই তোকে ব্ল্যাকমেইল করে দিনের পর দিন টাকা নিচ্ছে। আর তুই কোনো স্টেপ নিচ্ছিস না কেন? কী এমন জানে সে তোর বিষয়ে যার জন্য এভাবে ভয় পাচ্ছিস তুই?”
“এখন এসব কথা থাক। তোকে আমি সব বলব সময় করে। আপাতত এই বিষয় নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না।”
নিমুকে ঘাবড়ে যেতে দেখে তুলি আর কিছু না বলে টাকাগুলো নিয়ে চলে যায়। তুলি চলে গেলেও নিমুর ভয় দূর হয় না। ঠাণ্ডার মাঝেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে তার।
“নিজের সুখের জন্য আমি যা যা করেছি তা জানাজানি হয়ে গেলে আমি শেষ হয়ে যাব। আমার অতীত সামনে আসা যাবে না। মাহতাবকে কিচ্ছু জানতে দেওয়া যাবে না। তার জন্য যা করার দরকার আমি সব করব।”
চোখের কোণে পানি আর চোখে ভ*য়ংকর রাগ নিয়ে সিরাত একমনে চেয়ে আছে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে। রাগে হাতের মুঠো শক্ত হয়ে এসেছে তার। তবুও চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে না সে।
“তুমি আমার গায়ে হাত তুললে মাহতাব?”
“হ্যা তুললাম। তোমাকে আমি অনেক ভালো ভেবেছিলাম। মনে করেছিলাম তুমি আমাকে ভালোবাসো। তোমার উপর বিশ্বাস ছিল আমার। কিন্তু আজ তুমি আমার সমস্ত বিশ্বাস ভেঙে দিলে। এতদিন তোমার সমস্ত কথা মেনে নিয়েছিলাম বাবার কথা ভেবে। আমার পরিবারে একমাত্র বাবা তোমাকে পছন্দ করে৷ আমার মা কিংবা আমার বোন, কেউই তোমাকে সহ্য করতে পারে না। আসলে তোমার মতো মেয়েকে সহ্য করা যায় না।”
“ওহ্ তাই? আচ্ছা তুমি কী ভেবেছিলে বলো তো? তুমি আমাকে ঠকিয়ে, আমাদের সন্তানের কথা না ভেবে অন্য একজনকে বিয়ে করে বাসায় তুলবে আর আমি তোমাদের সাদরে বরণ করে নেব? বিশ্বাসের কথা তো তোমার মুখে মানায় না মাহতাব। যে পুরুষ ঘরে বউ রেখে বাইরে অন্য নারীদের সাথে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটায় সে আর যাইহোক বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। যে নিজেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে জানে না সে কোন মুখে বিশ্বাসের কথা বলে হ্যা?”
সিরাতের চিৎকারে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয় নিমু। মাহতাব অবাক চোখে সিরাতের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার চোখগুলো অস্বাভাবিক রকমের লাল হয়ে আছে। রাগে পুরো মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। ওষ্ঠদ্বয় অনবরত কাঁপছে। এর আগে কখনো সিরাতের এমন রূপ দেখেনি মাহতাব। ভীষণ অস্বাভাবিক লাগছে মেয়েটাকে।
দু’হাতে চুল মুষ্টিবদ্ধ করে লম্বা শ্বাস ছেড়ে সিরাত মাহতাবের কাছে এগিয়ে যায়।
“মিস্টার শাহরিয়ার মাহতাব এতদিন আপনি আমার শান্তশিষ্ট রূপ দেখেছেন। দেখেছেন অতি সাধারণ একজন মেয়ের তার স্বামীর প্রতি অগাধ ভালোবাসা। আজ আমি মুমতাহিনা ইসলাম সিরাত কথা দিচ্ছি, ঠিক এই মুহূর্ত থেকে আপনি প্রতি পদে পদে অনুভব করবেন জীবন কতটা কঠিন। আমি যদি আপনার জীবন ন*র*ক বানিয়ে না ছেড়েছি তো আমি চলে যাব। হ্যা, আপনার জীবন থেকে আমি বহুদূরে সরে যাব যদি আপনার ভালো থাকা আমি কেঁড়ে নিতে না পারি।”
আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না সিরাত। চোখের পানি মুছে ঘরে চলে যায়। বিছানার উপর নাবিহা ঘুমিয়ে আছে। ঘন্টা খানেক আগেই ঘুমিয়েছে। এখন তার ওঠার সময় হয়ে গিয়েছে। মেয়ের পাশে বসে চুলে হাত বুলিয়ে দেয় সিরাত। তার ডান গালে এখনো কিঞ্চিৎ ব্যথা করছে। বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে লাল হয়ে আছে গালের একপাশে।
“মাম্মা!”
মেয়ের ডাকে সিরাত ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলে,
“আমার লক্ষ্মী মেয়েটার ঘুম হয়েছে?”
নাবিহা এপাশ-ওপাশ গড়াগড়ি খেয়ে বলে,
“হুম।”
“ক্ষুধা লেগেছে তোমার আম্মু?”
“হুম মাম্মা।”
কথাটা বলার সময় নাবিহা ঠোঁট উল্টিয়ে ফেলে। ক্ষুধা লাগলে সে বরাবরই এমন করে। মেয়ের এমন চেহারা দেখে সিরাত তাকে কোলে তুলে নিয়ে গালে চুমু খেয়ে বলে,
“আমার মেয়েটা অনেক সুন্দর মাশাআল্লাহ। তুমি আমার অনেক লক্ষ্মী মেয়ে আম্মু।”
“মাম্মা আমি বেরু করতে যাব।”
“এখন তো সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। আমি আগামীকাল তোমাকে নিয়ে বের হব।”
“আমি নানুমনির কাছে যাব।”
“আজই তো এসেছিল সবাই। আচ্ছা, আমরা কয়েকদিন পর গিয়ে সবার সাথে দেখা করে আসব ঠিক আছে?”
“ওকে মাম্মা।”
“তুমি এখন এখানে চুপটি করে বসে খেলা করো। আমি কয়েক মিনিটের মধ্যে তোমার জন্য খাবার বানিয়ে আনছি।”
মেয়েকে রেখে সিরাত রান্নাঘরে চলে যায়। মেয়ে আর নিজের জন্য খাবার বানানোর সময় রান্নাঘরে নিমুর আগমন ঘটে। নিমুকে দেখেও সে না দেখার ভান করে নিজের মতো কাজ করতে থাকে।
“আজ তো কেবল একটা থা*প্পড় খেয়েছ। এরপর আমার সাথে লাগতে আসলে ফল ভালো হবে না মনে রেখো।”
নিমুর কথাটা যেন একদমই পছন্দ হয় না সিরাতের। কিন্তু মুখে কিছু না বলে সে আপনমনে কাজ করে। কড়াইয়ে তেল দিয়ে তার মধ্যে ইচ্ছে করেই দূর থেকে সবজি ছেড়ে দেয়। পাশেই ছিল নিমু। গরম তেল ছিটকে গিয়ে পড়ে নিমুর শরীরে। আচমকা এমন কিছুর জন্য হয়তো প্রস্তুত ছিল না সে। সাথে সাথে চিৎকার করে ওঠে। সিরাত নিমুর কাছে দাঁড়িয়ে কানের পাশে মুখ নিয়ে ফিসফিস আওয়াজে বলে,
“জ্ঞানী ব্যক্তি কখনো নির্বোধের সাথে তর্কে জড়ায় না। সে নিজের কাজ দিয়ে নিজের যোগ্যতা এবং ক্ষমতা প্রমাণ করে। কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী আমি। অযথা আমার সাথে লাগতে গেলে ফল কেমন হবে সেটা আশা করি বুঝতে পেরেছ।”
খাবার বেড়ে নিয়ে ফ্রিজ থেকে এক বোতল পানি বের করে ঘরে চলে যায় সিরাত। নিমুর হাতের একপাশে বেশ ভালো রকম তেল ছিটকে এসেছে। ফলস্বরূপ প্রচন্ড জ্বা*লাপো*ড়া শুরু হয়েছে সেই স্থানে। বেসিনে পানি ছেড়ে দিয়ে সেখানে হাত রেখে রাগে ফুঁসতে থাকে নিমু।
“তোমাকে আমি ছাড়ব না সিরাত। তুমি জানো না আমি কে! তুমি কার জীবন নষ্ট করবে সেটা নিয়ে আমার কোনো মা*থা ব্যথা নেই। তবে তোমার জীবনের ভালো সময়গুলো খুব দ্রুত শেষ হতে চলেছে।”
ঘরে এসে বাচ্চাকে খাইয়ে দিয়ে সিরাত নিজেও খেয়ে নেয়। এরপর রান্নাঘরে গিয়ে সবকিছু ধুয়ে পরিষ্কার করে আবার ঘরে চলে আসে। নাবিহার সাথে বেশ কিছুক্ষণ খেলে তাকে বিছানার উপর রেখেই আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। নিজেকে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে সে। মুখে হাত দিয়ে লক্ষ্য করে, মুখটা কেমন মলিন হয়ে আছে। অনেক দিন হলো নিজের যত্ন নেওয়া হয় না তার। কোমড় ছাড়িয়ে যাওয়া চুলগুলো কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে আছে। চোখের নিচে কালো আস্তরণ পড়েছে। ঠোঁটগুলো কালচে রং ধারণ করেছে। নিজেকে দেখে ভেতর থেকে কেবল দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে সিরাতের।
“কত-শত দিন পেরিয়ে গেল নিজের যত্ন নেওয়া হয় না আমার। আগের আমি নিয়ম করে দুই বেলা নিজের যত্ন নিতাম। অথচ এখন নিজের দিকে তাকানোরও সময় হয় না আমার। মা হওয়ার পরেও এতটা উদাসীন ছিলাম না, যতটা এই কয়েক দিনে হয়ে গিয়েছি। না, এবার আমার নিজেকে নিয়ে ভাবতে হবে। আমার মেয়েটাকে নিয়ে ভাবার সাথে সাথে নিজের ভালোমন্দের কথাও ভাবতে হবে আমাকে।”
ওয়াশরুমে গিয়ে মুখ ভালোভাবে ক্লিনজার দিয়ে ধুয়ে একটা ক্লে মাস্ক লাগিয়ে নেয় সিরাত। মিনিট বিশেক সেটা রেখে ধুয়ে ফেলে। অতঃপর ঘরে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মুখে, হাতে, পায়ে ক্রিম লাগিয়ে নেয়। ঠোঁটে একটা স্লিপিং মাস্ক লাগিয়ে চুলে হাত দেয় সে। চিরুনি দিয়ে ভালোভাবে চুল আঁচড়িয়ে বিনুনি গাঁথে চুলে।
“এখন থেকে এভাবেই একটু একটু করে নিজের যত্ন নিতে হবে। অন্য সবার কথা ভাবার আগে এখন থেকে আমি নিজেকে নিয়ে ভাবতে চাই। হ্যা, আজ থেকে সিরাত সবার আগে নিজের কথা ভাববে। নিজের মেয়ের মেয়ের কথা ভাববে। বাকি সবকিছু চুলোয় যাক৷”
ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে উঠে একটা আচারের বোয়াম নিয়ে মেয়ের পাশে বসে আচার খেতে শুরু করে সিরাত। হঠাৎ ডাইনিং টেবিলের পাশ থেকে চিৎকার শুনে সিরাত বোঝার চেষ্টা করে বাইরে হয়েছে কি!
“এসব কী রান্না করেছ তুমি? লবণ আর মরিচের মাঝে মাছ ডুবিয়ে রেখেছ? কোনো মানুষ এটা খেতে পারবে? আজকাল মন কোথায় থাকে তোমার? ঝালে জীবন বেরিয়ে যাচ্ছে আমার।”
রাগে চিৎকার করে কথাগুলো বলে ওঠে মাহতাব। ঘর থেকে সিরাত স্পষ্ট শুনতে পায় কথাগুলো।
“আমি তো ঠিকভাবেই রান্না করেছি। তুমি এমন করছ কেন?”
“নিজেই খেয়ে দেখো কেমন রান্না করেছ তুমি!”
নিমু চামচের মধ্যে একটু মাছের ঝোল নিয়ে মুখে দিতেই ইয়াক করে ফেলে দেয় সব। মুখে হাত দিয়ে বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তরকারিতে মারাত্মক লবণ আর মরিচের স্বাদ ছাড়া কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না৷
সিরাত এসব শুনে আমের আচার চিবোতে চিবোতে গুনগুনিয়ে গায়,
“ভুল বুঝছি আমি? তাহলে ঠিক কোনটা? তুমিই বলো আমাকে।”
মাহতাব কোনোকিছু না বলে এক ধ্যানে সিরাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। স্বামীর এমন চেহারা দেখে সিরাত নজরুল শেখের কাছে এগিয়ে এসে বলে,
“বাবা আপনার ছেলের কাছে এই মুহূর্তে বলার মতো কিছুই নেই। সে এই মেয়েকে বিয়ে করে এই বাসায় নিয়ে এসেছে প্রায় দশ/বারো দিন হয়ে গেল। এতদিন আমি চুপ ছিলাম। কিন্তু আজ আপনার ছেলে আমাকে কী বলেছে জানেন?”
“কী বলেছে?”
“সে বলেছে, আমি তোমাকে কেন ভয় পাব? আমার তো টাকার অভাব নেই। আমি চাইলেই টাকা দিয়ে সবার মুখ বন্ধ করে দিতে পারি। তোমার যা ইচ্ছা করে নাও। আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে এই বাসাতেই থাকব। এসব শোনার পরেও কি আমার চুপ করে থাকা ঠিক হতো বাবা?”
সিরাতের কথা শুনে নজরুল শেখের রাগ তরতরিয়ে বেড়ে যায়। রাগ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য সিরাত বলে,
“আমি সহজসরল বলে নাকি তার আমাকে আর ভালো লাগে না। মানে ভালো জিনিস আপনার ছেলের ঠিক পছন্দ হয় না। তার সেসবই পছন্দ যেসব জিনিস আগেই ব্যবহার করা হয়ে গিয়েছে।”
নিমুর মুখ রাগে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। এর মাঝেই কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে সিরাত দরজা খুলে দেয়। তার বাবা, মা, ফুপি, আর দু’জন বোন এসেছে।
“ভেতরে এসো তোমরা।”
ভেতরে এসে সিরাতের থেকে চার বছরের বড়ো ফুপাতো বোন মাহতাবের কলার ধরে চিৎকার করে বলে,
“তোমার সাহস হলো কীভাবে আমার বোনকে ঠকানোর? এত স্পর্ধা কোথায় পেলে তুমি?”
“আহা আপু শান্ত হও তুমি। ওর কলার ছেড়ে দাও।”
বোনের মুখে এমন কথা শুনে অবাক হয় মালিহা। মাহতাবের কলার ছেড়ে দিয়ে বোনের কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,
“তুই শান্ত আছিস কীভাবে রাত? এই ছেলে তোর মতো একজনকে ঠকিয়ে আরেকটা বিয়ে করল আর তুই চুপচাপ সব মেনে নিচ্ছিস?”
“কে বলল মেনে নিচ্ছি? সে হয়তো আমাকে চেনে না। কিন্তু আমার বাড়ির মানুষজন তো আমাকে চেনে। আমি কি সত্যিই মেনে নেওয়ার মতো মেয়ে আপু?”
“না!”
“আজকে তোমাদের সবাইকে আমি বিশেষ একটা কারণে ডেকেছি।”
“কী কারণ?”
শাশুড়ি মারজিয়া শেখের প্রশ্নে সিরাত উত্তর দেয়,
“আপনার ছেলে যে আমাকে ঠকিয়ে অন্য একজনকে বিয়ে করল তার শাস্তি দিতে হবে না বলুন মা?”
“এসব কী বলছ তুমি বউমা? আমার ছেলেকে কী শাস্তি দিতে চাও তুমি?”
“আমি ভাবছি এখন এখানে পুলিশ ডাকব। আপনার ছেলে আমাকে বলেছে পুলিশকে নাকি তার পকেটে নিয়ে ঘোরে সে। আমিও দেখতে চাই কতজন পুলিশকে সে নিজের পকেটে রাখে।”
“শান্ত হও তুমি। নিজের স্বামীকে এখন জেলে ঢোকাবে তুমি? কেমন মেয়ে তুমি হ্যা? মানছি আমার ছেলে ভুল করেছে। কিন্তু এই সমাজে দুই বউ নিয়ে অনেক মানুষ সংসার করছে। তার জন্য কি এখন আমার ছেলেকে জেলের ভাত খেতে হবে নাকি?”
“মারজিয়া!”
স্বামীর চোখ রাঙানো দেখে চুপ হয়ে যায় মারজিয়া শেখ। কিন্তু সিরাত চুপ করে থাকে না। শাশুড়ি মায়ের কাছে গিয়ে বলে,
“এটা বড়ো কোনো অন্যায় নয় তাই না মা? তাহলে আমি এক কাজ করি। বাবাকে আরেকটা বিয়ে করিয়ে দিই। এমনিতেও আপনার সাথে এক বাড়িতে এতগুলো বছর ধরে বাবা যে অনেক কষ্টে সংসার করছে এটা আমি জানি। আপনি এমন একজন মানুষ যার জন্য মাত্র এক বছরের সন্তানকে কোলে নিয়ে আমাকে আমার শ্বশুর বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। কেবল আপনার জন্য আমাকে আলাদা বাসায় থাকতে হয় এখন। নতুন শাশুড়ি মা এলে আমারই ভালো হবে।”
ছেলের বউয়ের মুখে এমন কথা শুনে মারজিয়া শেখ বিরক্তিকর চাহুনি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আপনমনে বলে ওঠে,
“অসভ্য মেয়ে একটা!”
“এতক্ষণ চুপ করে সবকিছু দেখলাম। কিন্তু আর নয়। আমার মেয়েকে আমি কিছুতেই এখানে আর থাকতে দিব না। আমার একমাত্র মেয়ে কষ্ট পাবে আর আপনার ছেলে ভালো থাকবে সেটা কিন্তু আমি হতে দিব না বেয়াই সাহেব।”
শাহেদ ইসলামের কথায় সহমত জানায় সিরাতের মা ইতি ইসলাম। বাবা-মায়ের এমন অবস্থা দেখে সিরাত বলে,
“তোমাদের আমি এই কারণে এখানে ডাকিনি মা যে তোমরা আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে।”
“মানে কী রাত? আমার মেয়ে দিনের পর দিন এখানে থেকে কষ্ট পাবে আর আমরা চুপচাপ দেখব?”
“না মা, আমি জানি তোমাদের খারাপ লাগছে। কিন্তু আমি তো আমার সংসার ছেড়ে কোথাও যাব না।”
“আপু তুই এখনো এসব বলছিস? এটা কি আর তোর সংসার আছে?”
“তুবা সংসার কিন্তু আমারই। আমি একটু একটু করে আমার এই সংসার সাজিয়েছি। আমার পাঁচ বছরের শ্রম আছে এই সংসারে। আমার ছোট্ট এই সংসার নিয়ে আমি কত স্বপ্ন বুনেছি তুই জানিস? সেই সংসার ছেড়ে তো আমি কোথাও যাব না।”
“তোর সুখের সাম্রাজ্যে যে এখন নতুন রাণী এসেছে রাত।”
“তাতে কী হয়েছে আপু? উটকো এক ঝামেলার জন্য আমি নিজের সাম্রাজ্য ছেড়ে দিব কেন? দুই দিনের এই মেয়ে এসে আমাকে আমার সংসার থেকে বের করে দেবে। আর আমি অসহায় মেয়ের মতো মুখে কাপড় গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে যাব এই বাসা ছেড়ে? তা তো হবে না।”
“তাহলে কী করতে চাইছ তুমি?”
“ফুপি মা আমি আজ তোমাদের এখানে ডেকেছি আমার একটা সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য।”
“কী সিদ্ধান্ত?”
বাবার প্রশ্ন শুনে সিরাত কিছুক্ষণ চুপ থেকে লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে বলে,
“আজ থেকে মাহতাবের সাথে যা যা হবে তার জন্য কেউ আমাকে দায়ী করতে পারবে না। কিন্তু আমার সামান্য ক্ষতি হলেও তার সমস্ত দায়ভার নিতে হবে মাহতাবকে। মাহতাবের নিমুকে ডিভোর্স দিতে হবে না। কিন্তু সে ভুল করেও আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা ভাবতে পারবে না। যদি আমার উপর সে এবং তার দ্বিতীয় স্ত্রী কোনো প্রকার অত্যা*চার করে তাহলে সেই মুহূর্তে তাদের বিরুদ্ধে আমি যেকোনো স্টেপ নিতে পারব। এতে করে কেউ আমার কাছে এসে কৈফিয়ত চাইতে পারবে না। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো মাহতাব নিমুকে নিয়ে অন্য কোথাও যেতে পারবে না। ওদের এখানেই থাকতে হবে। নতুবা আমি ওদের বিরুদ্ধে মা*মলা করব।”
“এসব কী বলছ তুমি? আমি কি তোমার দাস?”
“একদমই না, তুমি আমার দাস নও। তবে আমার কথা না শুনলে তোমার বাবার সম্পত্তি থেকে তুমি বঞ্চিত হবে।”
“মানে?”
“মানেটা আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলছি। তুমি যদি সিরাতকে ডিভোর্স দাও কিংবা ওর কোনো ক্ষতি করো তাহলে তোমার জন্য বরাদ্দ আমার সমস্ত সম্পত্তি ট্রাস্টে চলে যাবে।”
“বাবা!”
“সিরাতকে আমি এমনি এমনি শেখ পরিবারের বউ করে আনিনি। এই মেয়েটা আমার জীবন বাঁচিয়েছিল। নিজের জীবন ঝুঁকির মাঝে রেখে আমাকে বাঁচিয়েছে। সে শুধু আমার বউমা নয়, সে আমার মেয়ে। তোমরা অনেক কিছুই জানো না সিরাতের বিষয়ে। আমি চেয়েছিলাম আমার ছেলের সাথে মেয়েটা সুখে থাকুক। কিন্তু মাহতাব, তুমি আজ আমার সমস্ত বিশ্বাস ভেঙে ফেললে।”
বাবার কোনো কথায় যেন বোধগম্য হয় না মাহতাবের কাছে। কী বলছে এসব তার বাবা!
“বাবা আমি তোমার কোনো কথায় বুঝতে পারছি না।”
“বুঝতে হবে না তোমাকে। তুমি শুধু আমার কথা বুঝলেই হবে।”
কথাটা বলার সময় সিরাতের ঠোঁটে আপনাআপনি হাসি ফুটে ওঠে।
“আহা তুমি রেগে যাচ্ছ কেন? আমাদের তো ব্যাংক থেকে এখন টাকা তোলার প্রয়োজন নেই। আর আমি শুনলাম, তুমি আজকাল একটু বেশিই টাকা খরচ করছ। আমাদের মেয়ের একটা ভবিষ্যৎ আছে না? এভাবে টাকা খরচ করলে জমাবে কী?”
“তাই বলে তুমি আমাকে না জানিয়ে এমন একটা কাজ করে ফেললে?”
“অযথা কাজে টাকা ব্যয় করা আমার পছন্দ নয় মাহতাব। এই কথাটা তো তুমি আগে থেকেই জানো। যাইহোক, কার্ড যেহেতু আমরা দু’জনই ব্যবহার করতে পারি এবং তুমি আমার নামে ঐ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছিলে আমাদের বিয়ের পর, তাই আমি চাই টাকাগুলো আমাদের মেয়ের কাজে লাগুক। প্রতি মাসে তোমার হাতে যে টাকা আসে সেখান থেকে কিছু টাকা ব্যাংকে রেখে বাকি টাকা তো তুমিই খরচ করো। আপাতত ব্যাংক থেকে আর কোনো টাকা তোলার দরকার নেই।”
“কিন্তু আজকে আমার কিছু টাকা লাগবে যেটা ব্যাংক থেকেই তুলতে হবে।”
“কত টাকা লাগবে?”
“পঁচিশ হাজার টাকা।”
“এত টাকা কেন লাগবে?”
মাহতাব কিছুক্ষণ থেমে জবাব দেয়,
“নিমুর দরকার ছিল আর কি!”
“ওই মেয়ের জন্য তুমি আমাদের মেয়ের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করতে চাও? এমনিতেও তোমাকে ভরসা নেই। কবে না জানি আমাদের মেয়েকেও ভুলে যাও তুমি তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।”
“আমি নাবিহাকে অনেক ভালোবাসি সিরাত। ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমিও যথেষ্ট চিন্তা করি।”
সিরাত তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,
“যদি তাই হতো তাহলে তুমি অন্য নারীতে আসক্ত হতে পারতে না। মেয়ের কথা চিন্তা করে হলেও আমার সাথে সুখে-শান্তিতে সংসার করতে। যে পুরুষ বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যেই অন্য নারীর প্রতি দুর্বল হয়ে যায় সে আর যাইহোক কাউকে মন থেকে ভালোবাসতে পারে না। আমার প্রতি ভালোবাসা তোমার এত দ্রুত শেষ হয়ে গেল? তাহলে তো বলতেই হয়, দুই দিন পর নাবিহাকে ভুলে যেতেও সময় লাগবে না তোমার।”
“তোমার সাথে এসব বিষয়ে আমি এখন কোনো তর্ক করতে চাই না। আচ্ছা শোনো, আজকের মতো টাকা তুলতে দাও সিরাত। নয়তো আরেকটা ঝামেলার সৃষ্টি হবে।”
“ঝামেলা হলে হোক, তাতে আমার সমস্যা নেই। কিন্তু আমি কোনো উটকো ঝামেলার পেছনে তোমাকে এভাবে টাকা খরচ করতে দিতে পারব না।”
“তোমার কি মনে হচ্ছে না তুমি বাড়াবাড়ি করছ?”
“করলে করছি, আমাদের মেয়ের জন্য করছি। আশা করি, এতে তোমার কোনো সমস্যা নেই।”
মাহতাব আর কিছু না বলে বিরক্তিকর চেহারা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। সিরাত সেদিকে তাকিয়েও কিচ্ছু বলে না।
ঘরে এসে নিমুর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় মাহতাবকে।
“টাকা তুলেছ? আমার কিন্তু আজ দুপুরের মধ্যেই টাকাগুলো লাগবে।”
“এতগুলো টাকা তুমি কী করবে?”
“আমার একটু দরকার আছে বলেছি তো।”
“কী দরকার? সেটা তো বলোনি।”
“তুমি আমাকে এত প্রশ্ন কেন করছ? তোমার এত এত টাকার মধ্যে থেকে মাত্র পঁচিশ হাজার টাকা তুমি আমাকে দিতে পারছ না?”
“আজকে আমি টাকা দিতে পারব না তোমাকে।”
“কেন?”
“আমার কাছে এই মুহূর্তে টাকা নেই।”
“ঢাকা শহরে তোমার বাবার দুইটাটা পাঁচ তলা বিল্ডিং আছে। তোমাদের নাম করা একটা রেস্তোরাঁ আছো। প্রতি মাসে সেখান থেকে টাকা তো আসেই। তার উপর তোমার নিজস্ব একটা ফ্যাক্টরি আছে। আমি তো কোনো গরীব, ভিখারিকে বিয়ে করিনি মাহতাব। যেখানে প্রতি মাসে তুমি লাখ লাখ টাকার ব্যবসা করো, সেখানে আমাকে মাত্র পঁচিশ হাজার টাকা দিতে তোমার হাত কাঁপছে?”
“আমি কি তোমাকে টাকা দিই না? প্রতি মাসে তোমার জন্য আমি ত্রিশ হাজার করে টাকা পাঠিয়েছি। যখন যা চেয়েছ তাই দিয়েছি। কিন্তু দুই/একবার সমস্যা থাকতেই পারে। আমি টাকার মেশিন নই যে তুমি যখন টাকা চাইবে তখনই টাকা দিতে বাধ্য থাকব আমি।”
কথাটা বলে মাহতাব ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা বাইরে চলে যায়। নিমু রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বিছানার উপর বসে চাদর খামচে ধরে। সিরাত দূর থেকে এসব দেখে মুচকি হাসে।
“এটা তো কেবল শুরু। এই সিরাত যে তোমাদের সাথে আরো কী কী করবে সেটা ভাবতেও পারবে না তোমরা। আমি ভালোর ভালো, আর খারাপের য*ম!”
“তুমি এখানে বসে খেলনা দিয়ে খেলতে থাকো। আমি এক্ষুণি তোমার জন্য খাবার বানিয়ে আনছি।”
ছোট্ট মেয়েটা মায়ের কথায় সম্মতি জানিয়ে খেলতে শুরু করে। মেয়ের মুখে হাসি দেখে সিরাত পরম শান্তি অনুভব করে। মেয়েকে বুকের মাঝে আগলে নেয় সযত্নে।
“তোমার জন্য আমি সব করতে পারি সোনা মা আমার। তুমি যেন সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে পারো তার জন্য তোমার মা সবকিছু করতে রাজি আছে।”
দুপুরে নিজের মতো রান্না করে খেয়ে ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নেয় সিরাত। এমন সময় তৈরি হয়ে নিমু বেরিয়ে পড়ে তুলির সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে। কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছে বান্ধবীকে দেখে খুশিতে আলিঙ্গন করে তাকে। এরপর একটা জায়গায় বসে তুলি জিজ্ঞেস করে,
“কী অবস্থা তোর? কেমন আছিস?”
“আর অবস্থা! ওই মেয়ে তো আমাকে জ্বা*লিয়ে মা*রছে।”
“কার কথা বলছিস?”
“মাহতাবের প্রথম স্ত্রী সিরাত।”
“ওই মেয়ে আবার কী করেছে?”
“মাহতাব তো আমাকে বলেছিল ওর স্ত্রী খুব ভালো। ওর সব কথা শোনে। অনেক নাকি ভালোবাসে ওকে। অথচ আমি গিয়ে দেখলাম ওই মেয়েই মাহতাবের উপর ছু*রি ঘোরায়। শুধু হুকুম আর হুকুম!”
“আরে ছাড় তো ওই মেয়ের কথা। তুই যে কারণে মাহতাব ভাইয়াকে বিয়ে করেছিস সেদিকে মনোযোগ দে। আর টাকা এনেছিস?”
“কীভাবে আনব? মাহতাব আমাকে টাকা দেয়নি।”
“টাকা দেয়নি মানে? আমাদের তো টাকার প্রয়োজন ভাই!”
“জানি আমি। এই প্রথম মাহতাব আমাকে একটা টাকাও দিল না। আচ্ছা বাবা-মা কেমন আছে?”
“তারা তো ভালো আছে। কিন্তু তোর ভাই টাকার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে।”
“আমার তো কিছু না ভাই। তোকে তো গতকাল রাতেই কল করে সব বললাম। তোর ভাইয়ের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আমাকে রাত প্রায় এগারোটার দিকে কল করে বলল, আপুকে বলো আমার জন্য তাড়াতাড়ি টাকা পাঠাতে। তোকে নাকি কল করেছিল?”
“হ্যা গতকাল আমাকে কল করেছিল। আমি রেগে ছিলাম ওই সময়। তাই বলেছিলাম টাকা দিতে পারব না।”
“আচ্ছা এসব বাদ দে। তোর কি রাফির সাথে কথা হয়?”
রাফির কথা শুনে নিমুর মুখ শুকিয়ে যায়। শান্ত কণ্ঠে বলে,
“যোগাযোগ করতে চেয়েছিল। আমি ইচ্ছা করেই যোগাযোগ করিনি।”
“তুই ওর সাথে যা করেছিস, আমার তো মনে হয় না যে রাফি তোকে এত সহজে ছেড়ে দেবে।”
“যা করার করুক। আমি ওকে ভয় পাই না।”
“আচ্ছা শোন, আমাকে এখন যেতে হবে। আমি পরে তোর সাথে কথা বলব ঠিক আছে?”
“আমি কল করব তোকে। দেখা করার প্রয়োজন হলে তারিখ আর সময় জানিয়ে দিব। সাবধানে যা তুই।”
“ভালো থাকিস।”
নিমু হাসিমুখে বান্ধবীকে বিদায় জানিয়ে বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে গাড়িতে ওঠে। রাফির নামটা শোনার পর থেকেই তার বুক কাঁপছে। সে কোনোভাবেই তার অতীত মনে করতে চায় না। তবুও কেন যেন বারংবার তার অতীত কোনো না কোনোভাবে তার সামনে চলে আসে।
“দণ্ডবিধি আইন ১৮৬০-এর ৪৯৪ বিধান অনুযায়ী, প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ব্যতিত যদি কোনো ব্যক্তি দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন তাহলে এই ধারার বিধানমতে স্ত্রী ফৌজদারি মা ম লা করতে পারবেন। এমন অবস্থায় স্বামীর অপরাধ প্রমাণিত হলে সাত বছর পর্যন্ত কা*রাদ*ণ্ড ও অর্থদ*ণ্ডে দ*ণ্ডিত হবেন।”
ঘরে প্রবেশ করার আগ মুহূর্তে সিরাতের মুখে এমন কথা শুনে থেমে যায় মাহতাব৷ বিষ্ময়কর চাহুনি নিয়ে সে তাকিয়ে থাকে মেয়েটার দিকে। স্বামীর এমন চাহুনি দেখে মুচকি হাসে সিরাত।
“আরে তুমি কখন এলে? আসলে আমি আমার এক বান্ধবীর সাথে কথা বলছিলাম। সে আবার উকিল। অনেক দিন পর আমাদের কথা হলো।”
মাহতাব সিরাতের কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,
“এসব কী বলছিলে তুমি?”
“কোন সব?”
“মা ম লা নিয়ে কথা বলছিলে শুনলাম।”
“ওহ্ এই ব্যাপার। তুমি আমার অনুমতি ব্যতিত দ্বিতীয় বিয়ে করেছ না? তাই আর কি ওকে সব বিস্তারিত জানালাম। তখনই এসব বলল।”
মাহতাব আচানক সিরাতের হাত ধরে নরম স্বরে বলে,
“আমি তোমার আর আমাদের মেয়ের সব রকম ভরণপোষণের দায়িত্ব নিব। কোনো অবহেলা করব না। তুমি দয়া করে রাগের বশবর্তী হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ো না।”
“হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত তো আমি নিব না। শোনো, তুমি আমার কথামতো চললে আমি চুপ থাকব। কিন্তু আমাকে রাগালে বিষয়টা তেমন একটা ভালো হবে না।”
“কী চাও তুমি?”
“আমার প্রথম শর্ত হলো তুমি আর নিমু যে স্বামী-স্ত্রী এটা বাইরের কাউকে জানানো যাবে না। কারণ আমি চাই না আমার মেয়ের সামনে কেউ বলুক, তোমার বাবা তো তোমার জন্য সৎ মা এনেছে নাবিহা। নাবিহা জানবে নিমু আমাদের বাসায় কিছুদিনের অতিথি হয়ে এসেছে। তোমার একটা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আমার সন্তানের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হোক এটা আমি কখনোই চাইব না। আমার কথা বুঝতে পেরেছ?”
“তারপর?”
“আমার দ্বিতীয় শর্ত হলো তুমি নিমুকে অন্য কোথাও রাখতে পারবে না। ওকে এখানেই থাকতে হবে। এবং ওকে আমার কথামতো চলতে হবে।”
“নিমু কেন তোমার কথামতো চলবে?”
“কারণ আমার কথা না শুনলে তোমরা ভালো থাকতে পারবে না। তুমি তো আমার ভালো থাকার কথা একবারও ভাবোনি। কিন্তু আমি তোমাকে ভালো থাকার একটা সুযোগ দিলাম। দ্বিতীয় বিয়ে করেছ না? এক নারীতে তো আসক্ত থাকতে পারলে না। সুতরাং তোমার ভালো থাকার মেয়াদ এমনিতেও ফুরিয়ে আসছে। তাই আমাকে শান্ত রাখলে তোমার জন্যই সেটা কল্যাণকর হবে।”
“আর কোনো শর্ত আছে?”
“আমার তৃতীয় শর্ত হলো তুমি ভুলেও আমার কাছে আসতে পারবে না। স্বামীর অধিকার তো মোটেই ফলাতে পারবে না। আমার কোনো কাজে বাঁধা দিতে পারবে না। যদি আমার উপর জোর করো তাহলে আমার পুলিশকে কল করতে এক মিনিট সময়ও লাগবে না।”
“এগুলো কী রকম শর্ত তোমার?”
“আমার এই তিনটা শর্তে যদি তুমি রাজি না হও তাহলে তোমার ভালো থাকার দায়িত্ব কেবল তোমার। পরবর্তীতে তোমার সাথে যা যা হবে তার জন্য তুমি আমাকে দায়ী করতে পারবে না।”
মাহতাব চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
“ঠিক আছে। আমি তোমার সব শর্তে রাজি।”
“তবে হ্যা, নাবিহার সামনে আমরা স্বাভাবিক থাকব। কারণ পারিবারিক সমস্যার কারণে ওর মনে কোনো প্রভাব পড়ুক তা আমি চাই না।”
“তুমি যা বলবে তাই হবে।”
কথাটা বলে মাহতাব ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সিরাত জানে, মাহতাব এত সহজে সব মানবে না৷ সেটার জন্য দ্বিতীয় পরিকল্পনা তৈরি আছে তার। কথাটা ভেবে মুচকি হাসে সে।
নিমুর কাছে এসে মাহতাব বসতেই সে বলে ওঠে,
“তুমি কি ওই মেয়ের কোনো ব্যবস্থা করবে না?”
“করব, কিছুটা সময় দাও আমাকে।”
“সময় দাও মানে? আর কত সময় চাও তুমি? ওই মেয়েকে নাকি তুমি ভালোবাসো না? তাহলে ওর হাতে তালাকনামা কেন ধরিয়ে দিতে পারছ না?”
“সব কিছু এত সহজ নয়। একে তো আমি ওকে না জানিয়ে তোমাকে বিয়ে করেছি। তার উপর সিরাত যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। এই মুহূর্তে যদি আমি ওর হাতে তালাকনামা ধরিয়ে দিতে চাই তো ওই মেয়ে আমার হাতেই হাতকড়া পরিয়ে দেবে।”
“তাহলে কি তুমি এখন ওকে ভয় পেয়ে চুপ করে থাকবে?”
“ভুলে যেও না নিমু, আমাদের একটা সন্তান আছে। আমার সিরাতের প্রতি আর কোনো আগ্রহ না থাকলেও সন্তানের প্রতি ভালোবাসা আছে। আমি আমার মেয়েকে অনেক ভালোবাসি। এখন যদি সিরাত আমার কাছ থেকে আমার মেয়েকে দূরে সরিয়ে দেয় তখন কী হবে? তোমার কথা শুনে আমি এত দ্রুত তোমাকে বিয়ে করলাম। এটা করেই তো ঝামেলার সৃষ্টি হলো।”
“ওহ্ তাই? তাহলে তুমি কী চাইছিলে? বিয়ে ছাড়াই দিনের পর দিন আমার সাথে থাকতে চাইছিলে? বিয়ের আগে আমাদের মধ্যে অনেক কিছু হয়েছে। আমরা একসাথে থেকেছি। এসবের জন্য আমার সমস্যা হয়েছে। তাই বিয়ের জন্য তোমাকে চাপ দিয়েছি। ভুলটা কী করেছি আমি?”
“বিয়ে করেছি তো? তাহলে পুরোনো কথা কেন তুলছ?”
“কারণ তুমি আমাকে দোষারোপ করছ তাই।”
“এখন আমার তর্ক করতে ভালো লাগছে না। আমি ফ্রেশ হতে যাচ্ছি।”
মাহতাব ফ্রেশ হতে গেলে নিমু ফোন হাতে নিয়ে তুলিকে কল দেয়। কল রিসিভ করলে সে বলে,
“হ্যালো তুলি?”
“হ্যা নিমু বল।”
“আগামীকাল দুপুরের পর আমি তোর সাথে দেখা করব। আমরা যেখানে সব সময় দেখা করি ওখানে তিনটার মধ্যে চলে আসিস।”
“আচ্ছা।”
কল কেটে দিয়ে নিমু মোবাইলে ফেসবুক স্ক্রল করতে শুরু করে। মাহতাব ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বলে,
“এসবের মানে কী নিমু? আমার খাবার আগে নাকি তোমার এই নাটক দেখা আগে?”
“আরে বাবাহ তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন? নিজের খাবারটুকু নিজে নিয়ে খেলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?”
স্ত্রীর এমন ব্যবহারে বেশ অবাক হয় মাহতাব। বিয়ের আগে প্রায় সময় নিমু মাহতাবের জন্য রান্না করত। মাহতাব গেলে নিজে হাতে সবকিছু নিয়ে এসে খাইয়ে দিত। আর আজ সেই মেয়ে তার খাওয়ার গুরুত্ব দিচ্ছে না। এসব ভেবে ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার।
রান্নাঘরে গিয়ে নিজের খাবার নিয়ে চেয়ারে বসে খেয়ে নেয় মাহতাব। খাওয়ার সময় তার মনে পড়ে, আগে সে খাওয়ার সময় সিরাত পাশে বসে থাকত। তার কখন কী লাগবে সবদিকে নজর ছিল মেয়েটার। মাহতাব ভেবেছিল, হয়তো নিমুও এমন হবে। বিয়ের আগের নিমুর সাথে এখনকার নিমুর কোনো মিল খুঁজে পায় না সে।
খাওয়া শেষে মাহতাব মেয়ের কাছে যায়। মেয়েকে এখনো জেগে থাকতে দেখে সিরাতকে প্রশ্ন করে,
“মামনি এখনো ঘুমায়নি যে?”
“সন্ধ্যা থেকেই কান্না করছে। না তো খাচ্ছে, আর না তো ঘুমাচ্ছে। একটু আগে ঘুমিয়েছিল। আবার উঠে গিয়েছে।”
মাহতাব মেয়েকে কোলে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করে। বাবার কোলে উঠে মেয়ের কান্না থেমে যায়। বাবাকে পেয়ে সে যেন ভীষণ খুশি হয়েছে। কান্না থেমে গিয়ে তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে নিমিষেই।
“কী ব্যাপার সিরাত? সকাল দশটা বাজতে চলল। তুমি এখনও কিছু রান্না করলে না কেন?”
মাহতাবের কথা শুনে লম্বা হাই তুলে বিছানার উপর বসে সিরাত উত্তর দেয়,
“আজকে আমার শরীরটা কেমন যেন করছে। বিছানা থেকে উঠতেই ইচ্ছা করছে না। তার উপর আমাদের মেয়ে নাবিহা আমাকে একদমই ছাড়তে চাইছে না আজ।”
“তাহলে আমরা কি না খেয়ে থাকব?”
“তা কেন? তুমি তোমার নতুন বউকে বলো আজকের রান্নাটা করে ফেলতে।”
সিরাতের কথা শেষ হতেই নিমু খানিকটা চেঁচিয়ে বলে,
“আমি রান্না করতে পারব না। আমার বাবার বাড়িতে আমি নিজের হাতে খাবার বেড়ে নিয়েও খাইনি কখনো।”
“স্বামীর ঘর করতে এসেছ, আর এখন এসব বলছ? আমিও বাবার বাড়ির সবার কাছে ভীষণ আদুরে ছিলাম। নিজের সংসারে এসে সবাইকেই মানিয়ে নিয়ে কাজ করতে হয়। বিয়ে সম্পর্কে বিন্দু মাত্র জ্ঞান না রেখে বিয়ে করে ফেললে?”
“এই চুপ করো তো তুমি। তোমার থেকে কোনো পরামর্শ চাইনি আমি।”
“তোমার মতো মেয়ের সাথে কথা বলার জন্য বসে নেই আমি বুঝলে?”
“এই তোমার মতো মেয়ে মানে কী হ্যা?”
“বিবাহিত পুরুষের সাথে সম্পর্ক করা মেয়েদের কী বলে জানো না?”
“সিরাত চুপ করো। কেন সকাল সকাল ঝগড়া করছ তুমি?”
মাহতাবের এমন কথায় সিরাতের চোখেমুখে ফুটে ওঠে বিরক্তির ছাপ।
“ঝগড়া আমি আগে শুরু করিনি মাহতাব। তাই ভুলেও আমাকে কিছু বলবে না তুমি।”
“আচ্ছা ভুল হয়েছে আমার। এখন কথা না বাড়িয়ে রান্নাঘরে যাও। আমরা দু’জন খেয়ে বের হব।”
“এক মিনিট! আমাকে কি তোমার নতুন বউয়ের কাজের লোক মনে হয়? আমি রান্না করব, আর সে খেয়ে পটের বিবি সেজে ঘুরবে? শখ তো মন্দ না!”
“তুমি কী চাচ্ছ বলো তো?”
“নাবিহা এখন ঘুমাচ্ছে। একটু আগেই ঘুমিয়েছে আমার মেয়েটা। ওকে রেখে এখন আমি কোথাও যাব না।”
“আগে তো নাবিহাকে ঘুমিয়ে রেখেই সব কাজ করতে।”
“তখন আমাদের বাসায় আর কেউ ছিল না। কিন্তু এখন তো আছে। শুনে রাখো, আমি তোমার এই উটকো ঝামেলার কোনো কাজ করতে পারব না।”
“সিরাত!”
“একদম চিৎকার করবে না। এখনো আশেপাশের কেউ তোমার খবরটা জানে না৷ তুমি চাইলে আমি নিজ দায়িত্বে সোসাইটির সবাইকে খবরটা জানাতে পারি। জানাব?”
“তুমি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ?”
“একদমই না। তুমি যা করেছ তাতে ভয় দেখানোর কিছু নেই। আর তুমি কি ছোট বাচ্চা যে আমি ভয় দেখাব আর তুমি ভয়ে কাঁপবে? তুমি নিজেও জানো যে তুমি অন্যায় করেছ। তাই বলছি আমাকে বেশি রাগিয়ো না। এর ফল ভালো হবে না।”
“ধুর তোমার সাথে কথা বলাই বেকার। নিমু আজকের রান্নাটা তুমি করে নাও।”
“এসব তুমি কী বলছ মাহতাব? রান্না আর আমি? আমি আগে কখনো রান্না করিনি।”
নিমুর কথায় মাহতাব চোখ বন্ধ করে কয়েকবার শ্বাস ছেড়ে তাকে পাশে নিয়ে গিয়ে বলে,
“এখন বেশি ঝামেলা করো না। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গেলে আমি আর সামলাতে পারব না।”
“মাহতাব তুমি কি ভয় পাচ্ছ? তোমার যদি এতটা সমস্যা থাকে তাহলে আমাকে বিয়ে করলে কেন? তবে কি তুমি আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করোনি? বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছ?”
“বিষয়টা এমন নয় নিমু। আমি ভেবেছিলাম সিরাত তেমন ঝামেলা করবে না। করলেও ওকে সামলে নিতে পারব আমি। কিন্তু সিরাত এখন যা করছে সেটা আমার কল্পনার বাইরে ছিল।”
“তুমি আমাকে বলেছিলে তোমার প্রথম স্ত্রী অনেক শান্ত, ভদ্র। সহজে তর্ক করে না। তোমার সব কথা মেনে চলে। কিন্তু আমি তো সব বিপরীত দেখছি।”
“সিরাতের এমন রূপ দেখে আমিও অবাক হয়েছি। ওও এতদিন এমন ছিল না।”
“অথচ আমাকে দেখে এমন হয়ে গেল তাই না? এভাবে চললে ওই মেয়ের সাথে এই বাসায় একসাথে আমি থাকতে পারব না।”
“এখন মেজাজ খারাপ করে কোনো লাভ নেই। আমার একটা কাজ আছে। আমি বাইরে যাচ্ছি। বিকালে ফিরে আমরা এসব নিয়ে আলোচনা করব। এই সময়টুকু তুমি ওর সাথে কোনো ঝামেলা করো না। এটা আমার অনুরোধ। আর সিরাত যদি কিছু বলে তাহলে সেটা চুপচাপ মেনে নেবে। কারণ এই মেয়ে এখন যা আচরণ করছে তাতে আমাদের সাথে যা কিছু করে ফেলতে পারে।”
“তার মানে আমি ওর সব কথা মেনে চলব তাই তো? তুমি কি আমাকে তোমার স্ত্রী আর মেয়ের দেখভাল করার জন্য বিয়ে করেছ?”
“না, আপাতত যা বলছি সেটা করো। বিকালে বাসায় এসে আমি নিজে সিরাতের সাথে কথা বলব। তুমি চিন্তা করো না।”
নিমু রাগ নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। মাহতাব সিরাতের কাছে এগিয়ে এসে মেয়ের পাশে বসে কপালে চুমু দেয়। অতঃপর সিরাতের উদ্দেশ্যে বলে,
“আমি একটা কাজে বাইরে যাচ্ছি। জানি তুমি আমার উপর অনেক রেগে আছো। কিন্তু এই মুহূর্তে নিমুর সাথে আর কোনো ঝামেলা করো না সিরাত। আমি বাসায় ফিরে একটা সিদ্ধান্ত নেব। ততক্ষণ পর্যন্ত একটু চুপচাপ থেকো।”
সিরাত শান্ত স্বরে বলে,
“কী সিদ্ধান্ত নেবে তুমি? আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত?”
মাহতাব কিছু না বলে এক পলক সিরাতের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সিরাত দরজার পানে চেয়ে মুচকি হাসে। চোখের কোণে পানি জমলেও এবার সে আটকে নেয় সেই পানি। চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে দেয় না।
“পাঁচ বছর তোমার সাথে সংসার করেছি আমি। পাঁচটি বছর নিজের পুরোনো রূপ ভুলে শুধুমাত্র তোমার জন্য নতুন রূপে নিজেকে সাজিয়েছি আমি। চারপাশে এত এত বিবাহবিচ্ছেদ দেখে আমি ভয় পেয়েছিলাম। তাই তোমার মনের মতো হওয়ার চেষ্টা করেছি সব সময়। কিন্তু ছেলেদের তো একজনে বেশি দিন মন টেকে না। সমস্যা নেই মাহতাব। তুমি যে সিরাতকে সহজসরল বলে অবজ্ঞা করেছ এবার সেই সিরাতের আসল রূপ দেখবে। আমি এমন একজন হব যাকে দেখে এই সমাজের অনেক মেয়ে নিজেদের পাল্টানোর উৎসাহ পাবে। তুমি ভুল জায়গায় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ মাহতাব!”
ঘরের মাঝে পায়চারি করছে নিমু। রাগে তার শরীর জ্ব*লে যাচ্ছে। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে পাশের টেবিলে শব্দ করে সে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
“আমি এমনি এমনি মাহতাবকে বিয়ে করিনি। সিরাত, তুমি ভাবছ তো যে আমার উপর হ*ম্বিত*ম্বি করবে? তাহলে ভুল ভাবছ তুমি। আমি অবিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও মাহতাবকে বিয়ে করেছি। তার পেছনে অবশ্যই কারণ আছে। যদিও ভেবেছিলাম তুমি তেমন ঝামেলা করবে না। কিন্তু একবার যখন ঝামেলা করে ফেলেছ তখন তোমাকে তো আমি ছেড়ে দিব না।”
আপনমনে কথা বলে নিজের ফোনটা হাতে নেয় সে। একটা নাম্বারে কল দিয়ে অপেক্ষা করে অপর পাশের ব্যক্তির হ্যালো বলার আশায়।
“হ্যালো”
কাঙ্ক্ষিত মানুষের কণ্ঠ শুনে নিমু বলে ওঠে,
“কেমন আছিস?”
“ভালো থাকি কীভাবে বল? তুই আমাদের কাউকে কিছু না বলে বিয়ে করে ফেললি। একবার জানাবি তো নাকি?”
“রাগ করিস না তুলি। আমি আসলে কাউকে জানানোরই সময় পাইনি। হঠাৎ করেই আমি আর মাহতাব বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাই তেমন কাউকে জানানো হয়নি।”
“বিয়ের প্রথম রাতে কোথায় বরের সাথে থাকব, সেটা না করে সতীনের বাচ্চার জন্য ফিডার তৈরি করতে হচ্ছে।”
রান্নাঘরে থাকা নতুন বউয়ের রাগী চেহারা দেখে ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা ফুটে ওঠে সিরাতের। তিন বছরের বাচ্চা মেয়েকে কোলে নিয়ে সে বিছানার মাঝখানে বসে আছে। ঘর থেকে রান্নাঘর সরাসরি দেখা যায়। পাশেই অবাক চোখে দাঁড়িয়ে আছে মাহতাব। স্ত্রীর এমন রূপের সাথে সে মোটেই পরিচিত নয়।
“সিরাত সমস্যা কী তোমার? নিমু আমার স্ত্রী। ওকে দিয়ে তুমি এভাবে কাজ করাতে পারো না।”
“তাহলে আমি কে?”
“তুমিও আমার স্ত্রী।”
“ঘরে বউ, বাচ্চা রেখে আরেকজনকে বিয়ে করার কোনো মানে হয় মাহতাব?”
“তোমার সাথে পাঁচ বছর তো মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। তোমার প্রতি আমার কোনো অনুভূতিই কাজ করে না। এতে দোষ কী আমার?”
“অনুভূতি কাজ করে না? অথচ প্রতি রাতে আমার কাছে ঠিকই আসতে পারো। অনুভূতি যদি না থেকে থাকে তাহলে আমার কোলে তোমার বাচ্চা এলো কীভাবে? কাছে আসার সময় অনুভূতি ঠিকই জন্মায়। কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার বেলায় অনুভূতি শেষ?”
কথাগুলো বলার সময় রাগে সিরাতের চোখের কোণে পানি জমা হয়। বাচ্চাকে আঁকড়ে ধরে সে এক নজরে তার সামনে থাকা মানুষটাকে দেখে যাচ্ছে। এই মানুষটাকে তার কাছে বড্ড অচেনা লাগছে আজ।
মাহতাব সিরাতের পাশে এসে বসে শান্ত স্বরে বলে,
“আমি তোমার বা আমাদের সন্তানের দায়িত্ব অস্বীকার করছি না। কিন্তু নিমুর প্রতিও আমার একটা দায়িত্ব আছে। ওকে বিয়ে করে এই বাসায় এনেছি আমি। এখন চাইলেই ওকে বাসা থেকে বের করে দিতে পারব না আমি।”
“ভালো তো। বের করতে হবে না। থাকুক এখানেই সে।”
“আমি তোমার মতো মেয়ের সাথে এক বাসায় কিছুতেই থাকতে পারব না।”
নিমুকে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে সিরাত স্বাভাবিকভাবে বলে,
“তাহলে বেরিয়ে যাও। এই বাসা আমার, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাও আমার। তুমি কোথা থেকে আসলে হ্যা?”
“মাহতাব আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে।”
“সে বিবাহিত জেনেও সম্পর্কে কেন জড়ালে তুমি? তুমি কেমন মেয়ে বলো তো? পরিবার থেকে কোনো সুশিক্ষা পাওনি তাই না?”
“খবরদার আমার পরিবার তুলে কথা বলবে না তুমি। তুমি কেমন মেয়ে যে নিজের স্বামীকে ধরে রাখতে পারোনি?”
নিমুর চিৎকারে বিরক্তি নিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয় সিরাত। নিমুর হাত থেকে ফিডার নিয়ে বাচ্চাকে খাইয়ে দিতে দিতে বলে,
“মাহতাবের কথা অনুযায়ী, আমি অনেক সহজসরল একজন। তো আমি কতটা সহজসরল সেটা তো ওকে দেখাতে হবে। ওসব নিয়ে তুমি চিন্তা করো না৷ তুমি আপাতত নিজের কথা ভাবো।”
সিরাতের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে নিমু মাহতাবকে প্রশ্ন করে,
“আজ আমাদের বিয়ে হয়েছে। এই রাতটা আমাদের জন্য বিশেষ একটা রাত। তুমি কি সারারাত তোমার প্রথম স্ত্রীর সাথেই থাকবে?”
মাহতাব লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে সিরাতকে উদ্দেশ্যকে করে বলে,
“তুমি বাচ্চাকে নিয়ে অন্য ঘরে যাও৷ আগামীকাল নিমুর জন্য অন্য ঘরের ব্যবস্থা করব আমি।”
“রাত বাজে এখন এগারোটা বেজে ছাব্বিশ মিনিট। এখন যদি আমি পুলিশকে কল করি সেটা কি ভালো দেখাবে মাহতাব?”
“সিরাত!”
“অবাক হওয়ার কিছু নেই। তুমি হয়তো জানো না বিয়ের আগে আমি কেমন ছিলাম। আমাকে বেশি ঘাটানোর চেষ্টা করো না। ফল ভালো হবে না। এখন বের হয়ে যাও ঘর থেকে।”
মাহতাব আর কোনো কথা না বলে নিমুর হাত ধরে বের হয়ে যায় ঘর থেকে। অন্য ঘরে নিয়ে যায় তাকে। সিরাত ধীর পায়ে দরজার সামনে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়। তার পা যেন আর চলতে চাইছে না। বিছানার উপর বসে তিন বছর বয়সী ছোট্ট মেয়েটাকে বুকের মাঝে আগলে নেয় সে। এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা নোনাপানির স্রোত চোখ বেয়ে উপচে পড়ে। চোখ বন্ধ করে সে আনমনে ভাবে,
“বিয়ের আগে আমি এমন ছিলাম না মাহতাব। তোমার সাথে যখন আমার বিয়ে হলো তখন থেকে আমি ভালো বউ হওয়ার চেষ্টা করেছি। তোমার যেন আমাকে নিয়ে কোনো অভিযোগ না থাকে সেই চেষ্টা করে গিয়েছি প্রতিনিয়ত। লক্ষ্মী বউ হওয়ার চেষ্টা করেছি। তুমি সব সময় আমাকে বলতে, ভালোবাসো। আমাকে ছাড়া নাকি তুমি আর কাউকে নিয়ে ভাবতেই পারো না। অথচ সেই তুমিই আজ অন্য একজনকে বিয়ে করে সেই বাসায় এনে তুললে যেখানে তোমার প্রথম স্ত্রী আর সন্তান উপস্থিত।”
অনেক চেষ্টা করেও সিরাত নিজেকে সামলাতে পারে না। কোন মেয়েই বা সহ্য করে পারে এমন কিছু!
“পাঁচ বছরে একটা দিনও তুমি আমাকে বুঝতে দাওনি তোমার আরেকজনের প্রতি ভালো লাগা, ভালোবাসা জন্মেছে। গতকাল অবধিও তুমি আমার সাথে ছিলে। ভালোবেসে নিজের বুকের মাঝে আমাকে আগলে নিয়ে ঘুমিয়েছিলে। এক মুহূর্তের মাঝে ভালোবাসা এভাবে কীভাবে বদলায়? আমার পাঁচ বছরের ভালোবাসা কেন এভাবে হেরে গেল মাহতাব? তোমাকে ভালোবাসার জন্য কোনো কমতি তো আমি রাখিনি!”
আনমনে কথাগুলো ভাবার সময় সিরাতের মনে পড়ে ঘণ্টা দুয়েক আগের কথা। যখন সদর দরজা খুলে মাহতাবের সাথে নিমুকে দেখেছিল সে।
কলিংবেলের আওয়াজে সদর দরজা খুলে দেয় সিরাত। হাসিমুখে দরজা খুলে মাহতাবের পাশে বিয়ের সাজে সজ্জিত এক নারীকে দেখে নিমিষেই তার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। অবাক চোখে সে প্রশ্ন করে,
“এসব কী মাহতাব?”
মাহতাব নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দেয়,
“আমি নিমুকে বিয়ে করেছি। আজ থেকে সে আমার সাথে এই বাসায় থাকবে।”
কথাটা শুনে দুই পা পিছিয়ে যায় সে। কাঁপা কণ্ঠস্বরে সামনে থাকা মানুষটার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
“কেন করলে এমন?”
“তোমার মতো এত সরল একজনকে আমার স্ত্রী হিসেবে আমার পাশে মানায় না সিরাত। বিয়ের পাঁচ বছর পরেও তুমি একই রকম আছ। আমি বিরক্ত হয়ে গিয়েছি তোমার উপর। তাই আমি নিমুকে বিয়ে করেছি। আমি ওকে ভালোবাসি। তোমার যদি নিমুর সাথে থাকতে সমস্যা হয় তাহলে তুমি চলে যেতে পারো।”
মাহতাবের কথাগুলো যেন কাঁটার মতো বিঁধে যায় সিরাতের শরীরে। পাঁচ বছরের সংসারে নিজের সবটুকু দেওয়ার পরেও সে তার স্বামীর মন পায়নি ভেবেই অবাক হয় সে। আজ তার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। কান্নাগুলো সব দলা পাকিয়ে যাচ্ছে গলার মাঝে। তবুও সে জিজ্ঞেস করে,
“এই পাঁচ বছরে আমার প্রতি কি তোমার একটুও ভালোবাসা জন্মায়নি মাহতাব?”
মাহতাব খানিক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“হয়তো ভালোবাসি। কিন্তু আমি নিমুকে ছাড়তে পারব না।”
“ঘরে আমাদের তিন বছরের মেয়েটা ঘুমাচ্ছে। সে ঘুম থেকে উঠে যখন জিজ্ঞেস করবে কে এই মেয়ে তখন কী জবাব দেবে তুমি তাকে?”
এই প্রশ্নের কোনো জবাব মাহতাব দিতে পারে না। আদৌও কি এই প্রশ্নের কোনো উত্তর আছে তার কাছে?
“কী হলো? আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।”
“আমি এত কিছু জানি না। এই মুহূর্তে আমি তোমার সাথে আর কোনো কথা বলতে চাই না।”
কথাটা বলে মাহতাব নিমুকে নিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকলে সিরাত বেশ শক্ত কণ্ঠে বলে,
“দাঁড়াও মাহতাব। তোমরা তো এভাবে ভেতরে যেতে পারবে না।”
“মানে?”
“এই মুহূর্তে যদি আমি পুলিশকে কল করে জানাই যে আমার স্বামী আমার উপর অ*ত্যা*চার করে। এমনকি আমাকে বাসায় রেখে অন্য নারীদের সাথে সম্পর্কে রেখে দিনের পর দিন আমাকে ঠকিয়েছে। আর আজ সে অন্য একজনকে বিয়ে করে এনেছে। এরপর যদি বাসায় পুলিশ আসে সেটা কি ভালো হবে?”
“এসব কী বলছ তুমি? পাগল হয়ে গিয়েছ?”
“এমন কিছু হোক সেটা যদি তুমি না চাও তাহলে আমি যা বলব সেটাই করবে তুমি।”
কুয়াশা ভেদ করে সূর্য্যি মামা তার রশ্মি ছড়িয়েছে আকাশে। চারপাশ সূর্যের আলোয় ঝলমলে করছে। আজ বাদে কাল নিউ ইয়ার৷ ২০২৩ সাল কে বিদায় দিয়ে ২০২৪ সালকে বরণ করে নিবে সবাই৷ রাফি বলে দিয়েছে তারা এবার থার্টি ফার্স্ট নাইট সেলিব্রেট করবে ধুমধাম করে। ধুমধাম করে থার্টি ফার্স্ট নাইট সেলিব্রেট করার ও কারন আছে। ২০২৪ সাল জীবনের কিছু মোড় পাল্টে দিবে। সিঙ্গেল জীবন কে ছুটি দিয়ে মিঙ্গেলে পরিনত হবে। সেটা ভেবেই ২০২৪ সালকে বেস্ট করে শুরু করবে।
সোফায় বসে রাফি আর রিয়া এটা ওটা প্ল্যান করছে। সাহেল আহমেদ খবরের কাগজ পড়ছে আর রাসেল আহমেদ চা খাচ্ছে। রায়ান গ্রামে গিয়েছে তার দাদা আর দাদি কে আনতে। দাদা দাদির তাদের সাথে সেদিন আসার কথা থাকলেও কোনো এক কারনে আসা হয় নি। চিত্রা কফি হাতে শরীরে চাদর জড়িয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রোদ পোহাচ্ছে। হঠাৎ নিচের দিকে তাকিয়ে খুব পরিচিত মুখ দেখে মাথা টা বেলকনির রেলিঙের বাহিরে নিয়ে ঝুঁকল। একবার ফোনের দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো। ১০ টা বেজে ২৪ মিনিট। এই সময় মানুষ টাকে এখানে দেখে বেশ অবাক হলো চিত্রা।
তুষার গাড়িতে থাকাকালীন ই নজরে পড়েছে চিত্রা কে। গাড়ি থেকে নেমে চিত্রার দিকে আড়চোখে একবার তাকালো। গাড়ির পেছন সিট থেকে তানিয়া বেগম আর তৃষ্ণা নামলো। তারা বাড়ির ভেতর ঢুকতেই তুষার চিত্রার বেলকনির ঠিক নিচে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ ওভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?
চিত্রা সোজা হয়ে দাঁড়ালো। কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল-
-“ আচমকা আপনাকে দেখে অবাক হলাম তাই তাকিয়ে ছিলাম।
কথাটা বলে নিচের দিকে তাকাতেই দেখে তুষার নেই। চিত্রা আবার মাথা বাড়িয়ে এদিক ওদিক নিচে তাকিয়ে দেখলো। না তুষার নেই। লোকটা মুহূর্তের মাঝে চলে গেলো। একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে পিছু ঘুরতেই সুঠাম দেহের অধিকারি প্রশস্ত এক বুক এর সাথে ধাক্কা খায় চিত্রা। হাতে থাকা কফির মগটা ফ্লোরে পড়ে এক ঝনঝন শব্দ সৃষ্টি করে। চিত্রা পড়ে যাবে ভেবে ভয়ে চোখমুখ খিঁচে আছে। আচমকা এমন ধাক্কা খেলে ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক।
তুষার চিত্রার খিঁচে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটাকে সহজে ভয় পেতে দেখা যায় না। ভিষণ শক্ত মনের অধিকারী এই নারী। তুষার ফু দিয়ে চিত্রার চোখ মুখে উপচে পড়া চুল গুলো কে উড়িয়ে দেয়।
হঠাৎ মুখে গরম বাতাস পেয়ে চোখ মেলে তাকায় চিত্রা। সামনে তুষার কে দেখে কপালে দু ভাজ পড়ে। ফ্লোরে পড়ে থাকা মগটার দিকে একবার তাকিয়ে বলে-
-“ এভাবে কেউ আসে?
তুষার বেলকনির দরজায় হেলান দিয়ে বুকে দু হাত গুঁজে বলে-
-“ কিভাবে আসতে হয় তাহলে?
চিত্রা কফির মগটা উঠায়।
-“ শব্দ করে আসতে হয়। আপনি আসছেন ওপর পাশে থাকা ব্যাক্তি যেনো বুঝে।
-“ উমম শব্দ করে আসে কিভাবে?
-“ দরজায় টোকা বা গলা ঝেড়ে।
-“ থাক আমি এসব পারবো না,আমি আচমকা এসে তোমাকে এভাবেই ভয় পেতে দেখতে চাই।
চিত্রা তুষার কে পাশ কাটিয়ে রুমে আসে। মগ টা খাটের পাশে থাকা টেবিলে রেখে বলে-
-“ তা আপনার আজ অফিস নেই?
-“ এক মাসের ছুটি নিয়েছি বাবার থেকে।
চিত্রা অবাক হয়ে তাকায় তুষারের দিকে। তুষার রুমে ঢুকে চিত্রার থেকে দুরত্ব নিয়ে বিছানায় বসে।
-“ এক মাসের ছুটি নিয়েছেন!
-“ হ্যাঁ কম নিয়েছি তাই না? আমি সারা রাস্তা ভাবতে ভাবতে আসলাম দুই মাসের নেওয়া উচিত ছিলো।
-“ আপনি এতো ছুটি কেনো নিয়েছেন?
-“ সামনে বিয়ে না সেজন্য।
তুষারে সহজসরল কথা শুনে চিত্রা মুখ টা হা হয়ে গেলো। সামনে বিয়ে সেজন্য ছেলে এক মাসের ছুটি নিয়েছে ভাবা যায়!
-“ আপনি কি পাগল হয়েছেন? কোথাও দেখেছেন বিয়ের জন্য মানুষ এক মাস ছুটি নেয়?আর বিয়ের ডেট ১৫ তারিখে আর আজ ৩০ তারিখ। আপনি এতো আগেই অফিসের কাজ টাজ ফেলে ছুটি নিয়েছেন।
তুষার ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল-
-“ এক মাস কমই মনে হলো আমার কাছে,বিয়ে রিসিপশন ,হানিমুন এক মাসে হবে না। বাড়িয়ে নিতে হবে আরো।
চিত্রা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে কড়া গলায় বলল-
-“ আপনি কি এসব বলার জন্য এসেছেন এখানে?
-“ আরে না আজ তো আমরা নাইট পার্টি করবো।
-“ কিসের নাইট পার্টি?
-“ থার্টি ফার্স্ট নাইট পার্টি।
-” ওহ্ তাহলে নিচে গিয়ে যারা করবে তাদের সাথে আড্ডা দিন।
-“ বাহ রে আমি আমার হবু বউ ছেড়ে অন্যদের সাথে আড্ডা দিবো কেনো।
-” কারন আপনার হবু বউয়ের এসবে ইন্টারেস্টেড নেই।
-“ তার তো তুষারের প্রতি ও কোনো ইন্টারেস্ট দেখি না।
-“ এটা কেনো মনে হলো?
-“ মন বললো তাই মনে হলো।
-” আপনার মন মিথ্যা ধারণা ও দেয় দেখছি আজকাল ।
-“ মন রা কখনও মিথ্যে বলে না।
-“ কিন্তু আপনার মন তো বললো মিথ্যা।
-“ তাহলে সত্য টা তুমিই বলে দাও।
-“ আচ্ছা আচ্ছা বলবো নি সময় হোক। এখন নিচে চলুন।
তৃষ্ণা ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছে। রাফি এক এক করে ছাঁদ টাকে সুন্দর করে ডেকোরেশন করছে। মাঝেমধ্যে এটা ওটা চাচ্ছে আর তৃষ্ণা সেটা রাফির হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে। ছাঁদের ডেকোরেশন শেষ হলে রাফি লম্বা শ্বাস ফেলে তৃষ্ণার পাশে দাঁড়ায়। ছাঁদের ডেকোরেশনের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ এই চাতক দেখো তো সব ঠিকঠাক কি না?
তৃষ্ণা একনজর তাকালো সেদিক টায়। সব ঠিকঠাক ই আছে।
-“ হ্যাঁ ঠিকঠাক ই আছে।
-“ নেক্সট ইয়ার এই দিনে তুমি আর আমি মিলে সাজাবো ওকে?
-“ আজ তো আমি আর আপনিই সাজালাম।
-“ কোথায় তুমি সাজালে?সাজালাম তো আমি,তুমি তো শুধু এটা ওটা আগিয়ে দিলে।
-“ তো এটা তো পুরো কাজেরই একটা পার্ট।
-“ হয়েছে চাপা ছাড়া বন্ধ করো। আজ রাতে সুন্দর করে সেজেগুজে রেডি হয়ে থাকবে। তোমাকে নিয়ে আজ লং ড্রাইভে যাবো।
তৃষ্ণা আগ্রহ নিয়ে বলল-
-“ কোথায় নিয়ে যাবেন?
-“ বলা যাবে না।
-“ বলেন না।
-“ বললাম তো বলা যাবে না।
-“ আচ্ছা।
-“ কি আচ্ছা?
-“ বলতে হবে না।
-“ ওকে এবার নিচে চলো রেডি হতে হবে তো।
-“ কি ব্যাপার তানিয়া তামিম আসলো না যে?
তানিয়া বেগম মিষ্টি মুখে নিতে নিতে বলে-
-“ ভাইজান উনাকে তো চিনোই সারাক্ষণ কাজে ডুবে থাকে।
রাসেল আহমেদ লম্বা শ্বাস টানলেন। তামিম খান সচারাচর আসেন না এ বাড়ি। বোনের জামাই থেকে এখন বেয়াই হতে যাচ্ছে এখন তো আসা যাওয়ার মাত্রা টা বাড়ানো উচিত। চয়নিকা বেগম একটা ছোট্ট বক্স এনে তানিয়া বেগমের সামনে রাখলেন। তানিয়া বেগম বক্সের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে- কি?
চয়নিকা বেগম মৃদু হেসে বললেন-
-“ আপনার ভাই আপনার জন্য এটা নিয়ে এসেছে।
তানিয়া বেগম বক্স টা খুললেন। বক্সে খুব সুন্দর এক জোড়া হেয়ার রিং রয়েছে। তানিয়া বেগম হেয়ার রিং টা হাতে তুলে বলে-
-“ খুব সুন্দর তো।
-“ হ্যাঁ আপনার আমার ভাবি আর রিয়ার জন্য নিয়ে এসেছে চার জোড়া। আজ তো বছরের শেষ দিন তাই।
তানিয়া বেগম দুল জোড়া কানে পড়ে নিলো।
সন্ধ্যার৷ দিকে রায়ান সজল আহমেদ আর সানজিদা বেগম কে নিয়ে আসে। ছাঁদের একপাশে ছোটখাটো একটা ভোজের আয়োজন করে বাড়ির ছেলে সদস্য রা। চিত্রা, তৃষ্ণা, রিয়া কাঠে জ্বালানো আগুনে হাতে আলতো তাপ নিচ্ছে। চিত্রার পড়নে ব্লাক শাড়ি,রিয়া মেরুন রঙের শাড়ি পড়েছে আর তৃষ্ণা পার্পল রঙের। রিমি রিক্তা বেগমের কোলে। রায়ান আর তুষার বড়দের খাবার সার্ভ করছে। চিত্রা আড়চোখে বারবার তাকাচ্ছে তুষারের দিকে। লোকটার পড়নে ব্লাক শার্ট তার উপর ব্লাক হুডি। চিত্রা তুষারের সাথে মেচিং করেই ব্লাক পড়েছে। চিত্রা ভেবে পায় না একটা মানুষ এতো ব্লাক লাভার হয় কি করে?
বিয়েতেও না জানি ব্লাক শেরওয়ানি পড়ে আসে। চিত্রা মনে মনে ভেবে নেয় তুষার যদি ব্লাক ড্রেস চয়েস করে তাহলে ব্লাক রঙের বালতি তে চুবিয়ে আনবে। বড়দের খাওয়া দাওয়া শেষ হলে বাড়ির ছোট সদস্য রা বসে। চিত্রা চেয়ার টেনে বসতেই তুষার চিত্রার পাশে চেয়ার টেনে বসে পড়ে। অলস ভঙ্গিতে বলে-
-“ ভাইয়া তুমি আর রাফি সার্ভ করো আমার শরীরে শক্তি নেই।
রাফি আড়চোখে তুষারের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ ব্রো জানো আমি একটা কথা শুনেছিলাম।
তুষার ভ্রু কুঁচকে বলে-
-“ কি?
-“ শুনেছিলাম আশেপাশে ভালোবাসার মানুষ থাকলে নাকি এনার্জি বেড়ে যায় কিন্তু তোমার তো চিতা কে দেখা মাত্রই শরীরের শক্তি চলে গেলো।
তুষার বিরক্তি নিয়ে রাফির পানে চেয়ে বলে-
-“ বেশি সাধু সাজতে যেয়ো না,আমি মুখ খুললে মানসম্মান থাকবে না।
রাফি চুপ হয়ে গেলো। রায়ান আর রাফি খাবার সার্ভ করে দেয় সবাই কে। তুষার খাবার মুখে দিতে দিতে ফিসফিস করে বলে-
-“ আজ ম্যাচিং ম্যাচিং কিয়া বাত হ্যা!
চিত্রা বিষম খায়। তৃষ্ণা পানির গ্লাস আগিয়ে দেয়। চিত্রা পানি টা খেয়ে বলে-
-“ তো এতে অবাক হওয়ার কি আছে? কাপল আমরা পড়তেই পারি।
-“ হ্যাঁ তা অবশ্য ঠিকই। তোমাকে ব্লাক কালারে লাগছে জাস্ট লুকিং লাইক অ্যা ওয়াও।
-“ বাট আপনাকে একটু ও সুন্দর লাগছে না। প্রতিদিন ব্লাক কালার পড়তে বিরক্ত লাগে না?
তুষার মাংসে কামড় দিয়ে বলে-
-“ না।
-“ বাট আমার লাগে।
-“ তো?
-“ প্রতিদিন ব্লাক পড়বেন না। লোকে ভাববে আপনার ড্রেস নেই ফকির।
-“ তাতে আমার কি লোকে কি ভাবলো না ভাবলো।
-“ আপনার সাথে তর্ক করা মানে দেওয়ালে নিজের মাথা বারি দেওয়া একই।
রাফি তুষার আর চিত্রা কে বিরবির করতে দেখে বলে-
-“ আজকাল আমার কানে ময়লা হয়েছে নাকি মানুষের মুখেরই আওয়াজ কমে গেছে বুঝতে পারছি না।
তৃষ্ণা নাক মুখ কুঁচকে নিয়ে বলে-
-“ খাওয়ার সময় কিসব বলছেন এসব।
রাফি গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলে-
-“ কি বললাম?
-” এই যে কানে ময়লার কথা বলছেন।
তুষার রাগী দৃষ্টি নিয়ে রাফির দিকে তাকাতেই রাফি চুপ হয়ে যায়। রায়ান আর রিয়া খেয়ে দেয়ে নিজেদের রুমে চলে যায় রিমিকে ঘুম পাড়াতে। মেয়ে টা যে এখনও ঘুমায় নি এটা শিওর।
তুষার চিত্রার খাওয়া শেষ হলে ছাঁদের একপাশে কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। তুষার ঘড়িতে সময় দেখে নেয়। বারো টা বাজতে আর দশ মিনিট বাকি আছে। তুষার চিত্রার সোজাসুজি দাঁড়ায়। চিত্রার দু হাত নিজের দু হাত দিয়ে ধরে। চিত্রা তুষারের ভাবগতিক বোঝার চেষ্টা করছে। তুষার লম্বা শ্বাস টেনে বলে-
-“ ২০২৪ সাল আসতে আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। বছর ঘুরবে মাস শেষে, দিন পাল্টাবে চোখের নিমিষে কিন্তু তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কখনো বদলাবে না। তোমাকে ফিরতি জানাই #আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ , আমার শহর তুমি বিহীন এক আঁধার ঢাকা আমাবস্যা, পুর্নিমার জ্যোৎস্নায় পুরো শহরতলী কে আলোকিত করার জন্য তোমাকে আমার শহরে আসতে হবে। তুমি জ্যোৎস্না হয়ে আমার শহর কে সামলাবে আর আমি সূর্য হয়ে। পারবে না সামলাতে?
চিত্রা মুচকি হাসলো। তুষারের বা পাশের বুকেটায় হাত রেখে বলে-
-“ আপনি পাশে থাকলে চিত্রা সব পারবে। আপনার আমন্ত্রণ চিত্রা সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছে।
তুষার চিত্রার কপালে চুমু খেলো। আর তখনই আকাশের জ্বল জ্বল করে উঠলো হ্যাপি নিউ ইয়ার ২০২৪।
চিত্রা তুষার দুজনই আকাশের পানে চাইলো। তুষার দু এক হাতে চিত্রা কে জড়িয়ে আছে আর চিত্রা মাথাটা ঠেকিয়ে রেখেছে তুষার বুকে। দুজন দুজনের দিকে একবার তাকিয়ে বলল-
-“ বিদায় ২০২৩ ওয়েলকাম ২০২৪।
নিচে বাগানে রাফি তৃষ্ণা কে নিজের বাহুডোরে নিয়ে কানে ফিসফিস করে বলে-
-“ হ্যাপি নিউ ইয়ার মিস চাতক এন্ড লাভ ইউ মাই লাভ।
তৃষ্ণা কেঁপে উঠলো প্রথম বার প্রিয়তমের মুখে ভালোবাসার কথা শুনলো। ভালোবাসার মানুষটার মুখে ভালোবাসার কথা শোনার মতো সুন্দর অনুভূতি হয়তো আর একটাও নেই। তৃষ্ণা রাফির মুখে থাকা চাপ দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলে-
-“ লাভ ইউ অলসো মি.হ্যান্ডসাম।
#চলব?
( দেরি হবার জন্য দুঃখিত। ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিবেন। সবাইকে হ্যাপি নিউ ইয়ারের শুভেচ্ছা। নতুন বছর সবার আনন্দে কাটুক। গল্প নিয়ে মন্তব্য করবেন। হ্যাপি রিডিং)
#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী
শেষ পর্ব : প্রথম অংশ।
সময় কি? সময় কোথায়? সময় কার? সময় প্রেমিকের হাত ধরে প্রেমে পলায়নকারী ঘরের মেয়ে। রাতের অন্ধকারে যে চৌকাঠ পেরিয়ে যায়, কাউকে না জানিয়ে। সময়ের পদবী বদলায়। আজ থেকে গতকাল হয়ে যায়। সময় অবুঝ কনের বেখেয়ালি ভুলচুকে লেগে থাকা মেহেদীর ঘ্রাণে। সময় বিশ্বস্ত বন্ধুর শক্ত করে ধরে রাখা হাতের মাঝে। সময় বেপরোয়া পুত্রের অবাধ্যতায়।
সময় প্রাক্তনের। সময় নিঃসঙ্গতায়, সময় সফলতায়। সময়ের খুব তাড়া। আকাশের তারা গুনা শেষ হবার আগেই সময়ের সময় শেষ হয়ে যায়। এক লহমায়, ঠিক যেন চোখের পলকে। যেভাবে শেষ হয়েছে সবার উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া মুবিনের সুন্দরবন ট্যুর। ঠিক সেভাবেই ফুরিয়ে এসেছে কড়ির বেঁধে দেয়া ইমাদের গয়না কেনার সময়। শেষ হয়েছে মিলার পরীক্ষা। হয়েছে শ্বশুরালয় হতে কাদিনের বিদায়। ফুরিয়েছে মিশেলের মুগ্ধ চোখে পুরো বাংলাদেশ ভ্রমণ। মিশেল যেদিন ব্যাগ গোছাচ্ছে, ফিরে যাবে বলে, সেদিন মিলার সাথে একবার দেখা করার খুব চেষ্টা করল। মিলার হোস্টেলে গেল। কিন্তু মিশেল এসেছে শুনে মিলা কিছুতেই নামল না। মিশেল অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিল। মিলার নাম্বার যোগাড় করে কল করল। মিলা কল রিসিভ করে কণ্ঠস্বর শুনেই কল কেটে দিচ্ছিলো, তখনই মিশেল বলল, “ফ্রান্সে চলে যাচ্ছি। আমার দেশে।”
মিলা কয়েক মিনিট চুপ থেকে কলটা কেটে দিলো। নীচে নামল তারপরই। কেন নামল? বাবার জন্য? বাবা চলে যাবেন বলে? এতক্ষণ কেন নামেনি? মায়ের জন্যে? মা দুঃখ পাবে বলে? মিলা ঠিক জানে না। বাবার জন্য, না মায়ের জন্য ও সত্যিই জানে না। প্লাজো আর টি-শার্ট পরা, মাথায় উঁচু করে পনিটেল বেঁধে রাখা ভীষন পড়ুয়া মিলাকে দেখে মিশেল মিষ্টি করে হাসল, “কেমন আছো, মিলা?”
মিলা হাসল না। শুধু তাকিয়ে রইল। মিশেল বলল, “ভেবেছিলাম তোমার সাথে কোথাও বসে কফি খাব। কিন্তু আমার হাতে একদমই সময় নেই।”
মিলা বলল, “আমার হাতেও সময় নেই। আপনি কি কিছু বলবেন?”
“হ্যাঁ, আমি আমার দেশে ফিরে যাচ্ছি। একেবারের জন্য। তোমার বাবার অবশ্য ফ্রান্সে সেটেল হতে সমস্যা নেই কোনো।”
মিলার কলিজাটা অযথাই মোচড় দিয়ে উঠল৷ অযথাই তো। ওর বাবা বিদেশে চলে গেলেই বা কি? এখানে থেকেও বা আছে কই? আর এখানে থাকলেই মিলার কি? ওর বাবার কাছে ওর খুব একটা মূল্য নেই। মিশেল’ই আবার বলল, “আমিও চাইলে এ দেশে থাকতে পারি। একটা থ্রিল কাজ করে। কিন্তু আমি এ দেশে থাকব না। তোমার বাবাকেও আমার দেশে আসতে বলব না। আমরা আলাদা হয়ে যাচ্ছি।”
মিলা ছোট করে বলল, “ওহ্।”
“কদিন বাদেই তোমার এসএসসির রেজাল্ট দিবে। এখানে আর থেকো না। রেজাল্ট পেয়েই তুমি আমার কাছে ফ্রান্সে চলে এসো। বাকি পড়াশুনা ওখানে করবে। তোমার সবকিছু আমি দেখব। যা প্রয়োজন, যেভাবে চাও, সব পাবে। পূর্ণ স্বাধীনতা, মানসম্মত পড়াশুনা, সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, আর তোমার পরিবার থেকে মুক্তি।”
“মুক্তি!”
“হ্যাঁ, মুক্তি। তোমার মত প্রতিভাবান একটা মেয়ের কদর ওরা করতে পারেনি। ওরা মানবিকভাবেও তোমার প্রতি অন্যায় করেছে।”
“আমি আপনার কাছে কেন যাব?” মিলা ভ্রু কুঞ্চিত কপাল নিয়ে তাকিয়ে রইল।
“তুমি আমার কাছে কেন আসবে সে কারণ আমি তোমায় দিতে পারব না। তুমি যদি আমার কাছে আসার কোনো কারণ খুঁজে পাও তবেই এসো। তাছাড়া, ঠিক আমার কাছেও নয়। তুমি যাবে তোমার আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নের কাছে। আমি তোমার মঞ্জিল নই, মা নই, পরিবার নই। আমি তোমার বন্ধু। তোমাকে পথ দেখাব। তুমি ওখানে ভালো থাকবে।” মিশেল ঘড়ি দেখতে দেখতে বলল।
মিলা বলল, “আমাদের দেশে বাবার প্রেমিকা কখনো বন্ধু হয় না।”
“আমি এখন আর তোমার বাবার প্রেমিকা নই।”
“কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করব?”
“অবশ্যই মিষ্টি মেয়ে।”
“কেন চলে যাচ্ছেন আপনি?”
“কার জন্য থাকব?”
“কার জন্য এসেছিলেন? কেন এসেছিলেন এখানে?” মিলার চোখ জ্বলে উঠল।
মিশেল একটুও রাগল না। ওর মুখ থেকে মিষ্টি হাসিটাও গেল না। বলল, “এসেছিলাম মঈনের জন্য৷ কিন্তু ওকে এখন আর আমি নিতে পারছি না।”
“কেন?”
“কদিন আগে তোমার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম৷ তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে।”
“হ্যাঁ, আছে।”
“আমি মুবিনের সাথেও দেখা করতে গিয়েছিলাম। ওর জন্যেও কিছু গিফ্ট এনেছিলাম। তোমার এখানে এসে তোমার বাবা গাড়ি থেকেই নামেননি। তোমার সাথে একটাবার দেখাও করতে চায়নি। ওদিকে ছেলের মেসে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা উৎসাহ নিয়ে অপেক্ষা করেছে। ফলাফল যে খুব সুখকর ছিল তা নয়। এরকম ছোটোখাটো অনেক অন্যায় আমি দেখেছি। তোমার মা এবং বাবার মুবিনকে নিয়ে লড়াই এবং তোমার প্রতি অবহেলা। মঈনের চিন্তা-ভাবনা আমার বিরক্তির কারণ। ওর সঙ্গে আমার ঠিক যায় না৷ চিন্তা চেতনায় মিল না থাকলে, সম্মান করতে না জানলে আমরা একসঙ্গে এক মুহূর্তও থাকতে পারি না। এটা আমাদের সংস্কৃতি।”
মিলা তাজ্জব বনে গেল। কি বলবে বুঝে উঠল না। মিশেল একটা কার্ড এগিয়ে দিলো, “এটা রাখো। আমার ঠিকানা, পরিচয় এবং কনাক্ট নম্বর। তোমার ভালো লাগলে যোগাযোগ রেখো। আসতে ইচ্ছে হলে চলে এসো।”
মিশেল রোদচশমা মাথা থেকে নামিয়ে চোখে দিলো৷ তারপর মিলার গালে গাল স্পর্শ করে চুমু খেয়ে বলল, “বিদায়।”
মঈন অত সহজে এ বিদায় মানতে পারছিল না। ও শেষ পর্যন্ত মিশেলকে আটকে রাখার চেষ্টা করল৷ ভালোবাসায় আদরে, প্রলোভনে, অনুতাপে, মিনতিতে এবং করুণায়। মিশেল আটকাল না কোনো হুকেই। সে পাখির মত ছটফট করে বলল, “তোমার সাথে আমার যায় না, মঈন৷ তোমাকে আমার আর ভালো লাগছে না।”
“কি চাও তুমি? বলো কি চাও? কোথায় স্যাটেল হতে চাও?”
“স্যরি, মঈন তোমার সাথে আমি কোথাও থাকছি না।”
“কেন? কি হয়েছে তোমার হঠাৎ?”
“সংকীর্ণতা আমাকে ভোগায়।”
“আমি তো তোমাকে বদলাতে চাইনি। কিসের সংকীর্ণতার কথা বলছ তুমি?”
“না তুমি আমাকে বদলাতে চাওনি। কিন্তু তুমি খুবই সংকীর্ণমনা। আর আমিও তোমাকে বদলাতে চাই না।”
“তাই পথ বদলে নিচ্ছো?”
মিশেল মঈনকে কাছে টেনে নিলো। একটা গাঢ় আলিঙ্গন, প্রগাঢ় চুম্বন। তারপর, “ভালো থেকো।”
রুক্ষ মঈন মিশেলকে দূরে ঠেলে দিলো। আক্রোশে বলল, “ভালো থেকো বললেই কি ভালো থাকা যায়? তোমার জন্য আমি আমার ঘর -সংসার, ছেলে -মেয়ে স্ত্রী, সব ছেড়েছি।”
“মিথ্যে বলো না, মঈন। তুমি আমার জন্য কিছুই ছাড়োনি। তুমি ওদের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েই আমার কাছাকাছি এসেছিলে। তুমি তোমার অতীতের জন্য ওদের ছেড়েছ। আমি তোমার অতীত নই। ভবিষৎ হলেও হতে পারতাম। আমি হবো না।”
মঈন রাগে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল। ওর চোয়াল শক্ত, হাত মুঠো করা। মিশেল চলে গেল। সে কিছুই করতে পারল না।
.
হাজারটা পাত্রকে, তুচ্ছ, তুচ্ছ কারণে বাদ দিয়ে, পুরো রাষ্ট্র খোঁজে, সবদিক দিয়ে অসাধারণ একজনকে নিজের বোনের জন্য পাত্র হিসেবে নিয়ে এসেছে কাদিন। ছেলেটার নাম মৃন্ময়। কাদিনের পূর্ব পরিচিত। মৃন্ময় চাকুরী করছে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে। মোটা অঙ্কের বেতন। পাত্রের ফ্যাশন সেন্স ভালো। কাদিন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। বেল্টের রঙের সাথে মিলিয়েই শু পরে। কালার কম্বিনেশন বুঝে। সেন্স অব হিউমার ভালো। ইজি গোয়িং, আর মিশুক। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন, শান্ত স্বভাবের পরিশ্রমী ছেলে মৃন্ময়। মুখে সারাক্ষণ হাসি লেগেই থাকে। বাড়ির সবারও একই মত। কড়ির সাথে খুব মানাবে। না, কাদিন নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়নি কড়ির উপর। কেবল বলেছে, “আমার খুব পছন্দ মৃন্ময়কে৷ তোর কেমন লাগে? ঢাকায় তোর সাথে দেখা করার জন্যে একবার ওকে পাঠিয়েছিলাম।”
কড়ি বলেছে, “দেখা হয়েছে। কয়েকবার কথা বার্তাও হয়েছে।”
“তোরা আরো কথা বল। ভাব, ভেবে উত্তর দিস।”
“ঠিক আছে। তোমার আর মেজো ভাবির কি হলো?”
কাদিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চলে যায়। কিছু বলে না। কড়ি কিছুক্ষণ বাদে ডাইনিংয়ে পানি খেতে গিয়ে দেখল কাদিন সামনের বারান্দায় গ্রিলে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। কড়ি পাশে দাঁড়াল, “চলে এলে ভাবিদের বাসা থেকে?”
“রাখলো না আমায়।”
“আবার যাবে?”
“বাহানা খুঁজছি।”
“আমার বিয়ের বাহানায় ভাবিকেই নিয়ে আসো না।”
“উঁহু হবে না। ও এত কঠিন বুঝতেই পারিনি।”
“হিসাবটা ঠিক মিলছে না।”
“কিসের হিসাব?”
“তোমাদের হিসাব। আমি তোমাকে চিনি ভাইয়া।
জঘন্য কোনোরকম অপরাধ তুমি কখনই করবে না। ভুল করতে পারো। তার বেশি নয়। আমি মেজো ভাবিকেও চিনি। ভাবির, অত রাগ নেই। খুব ইমোশনাল একটা মানুষ। আর যাইহোক, আপনজনদের উপর সে দীর্ঘমেয়াদে রাগ ধরে রাখতে পারে না। চট করে সব ভুলে যায়। এমনকি যাই ঘটতে থাকুক সবকিছুতে শুধু নিজের দোষ খোঁজে। সবসময় ভাবে সব ওর ভুল। সব ওর জন্য হয়েছে।”
কথাটা কাদিনের মাথায় গেঁথে গেল। সে খুব ভাবলো এবং সেই ভাবনা ধীরে ধীরে ডাল-পালা গজাতে লাগল।
.
নিলয়ের আজ জীবনানন্দ দাশের মত বলতে ইচ্ছে হলো, “ওইখানে যেওনাকো তুমি, বোলোনাকো কথা ওই যুবতীর সাথে; ফিরে এসো ইমাদ …”
নিলয় কয়েকবার দীপাকেও মনে মনে বলল,
“সখী, ভাবনা কাহারে বলে। সখী, যাতনা কাহারে বলে।
তোমরা যে বলো দিবস- রজনী
‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’
সখী, ভালোবাসা কারে কয়! সে কি কেবলই যাতনাময়।’
আহা প্রেম! দানব প্রেম নিলয়ের দুই বন্ধুর জীবন তছনছ করে দিলো। চোখ মেলে যেদিকেই তাকাচ্ছে কেবল ধ্বংসযজ্ঞ। কোথাও দীপার ধ্বসে যাওয়া ঘর, কোথাও ইমাদের নির্বাক আর্তনাদ।
নিলয় নিশ্চিত একদিন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাবে তার দুই বন্ধুর প্রেমের জন্যই। একদিকে বোকা দীপা আর বেচারা ইমাদ। অন্যদিকে, হিটলার কাদিন এবং নাৎসি কড়ি। প্রেম ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ, নিলয় বাকরুদ্ধ। দীপার হৃদয়ঘটিত গ্যাঞ্জাম একটা সাইকোলজিক্যাল ডিফ্রেন্স। হিটলার কাদিন দীপাকে বুঝে না। বেচারি দীপা হিটলার কাদিনকে মানে না। আর ইমাদের হৃদয়ঘটিত গ্যাঞ্জামটুকু অর্থমন্ত্রণালয়ের আওতাধীন। নাৎসি কড়ি ইমাদের কাছ থেকে প্রেমের ট্যাক্স চায়। ইমাদের ট্যাক্স জমা দেয়ার সময় শেষ। কড়ির দেয়া ছয় মাস ছুঁ মন্তর। তন্ময় নামে এক পাত্রকে নিজের জন্য বাছাই করে ফেলেছে সে। তাদের শেষ টেলিফোনকথন নিলয় জানে। ইমাদ কলটা করেছিল রুমের ভেতরেই। সে সুবাদে নিলয় কিছুটা শুনেছে৷ ইমাদের কল পেয়ে কড়িকে মোটেও উত্তেজিত শোনায়নি। সে ঢাল তলোয়ার নিয়ে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল, “হঠাৎ কল দিলেন। কিছু বলবেন?”
ইমাদ নিরবতা ভেঙে বলল, “দীপা বলল।”
“কি বলল?” কড়ির গা-ছাড়া জবাব।
ইমাদ হঠাৎ চুপ হয়ে গেল। কড়ি বারবার হ্যালো, হ্যালো করছিল, “হ্যালো, শুনতে পাচ্ছেন? হ্যালো লাইনে আছেন? হ্যালো আমি কিছু শুনতে পাচ্ছি না।”
ইমাদ কথা বলল, “আপনার বিয়ে ঠিক হয়ে যাচ্ছে?”
কড়ি বলল, “আগেই শুনে ফেললেন? আমি আপনাকে কার্ড পাঠাতাম।”
ইমাদ শান্তভাবে বলল, “আমাদের মাঝে একটা চুক্তি হয়েছিল।”
“মনে আছে।”
“আমি এখনও চুক্তিতে হেরে যাইনি।”
“এখনও জিতে যাননি। আর সময় নেই। শেষ।”
“আচ্ছা।”
“আর কিছু বলবেন?”
ইমাদ সময় নিয়ে বলল, “কোনো চুক্তিনামা নেই বলে আফসোস হচ্ছে।”
কড়ির সোজাসাপ্টা জবাব, “আমাদের মাঝে কোনো চুক্তি হয়েছিল বলে আপনার এই ধারণটাই ভুল।”
“তাহলে কি হয়েছিল?”
“আমার জন্য আপনি আপনার জীবনে আসা ভালোবাসা পাননি এই দায়ভার নিতে চাই না। পাবেন কি পাবেন না সেটা আপনার সক্ষমতা কিংবা, ব্যর্থতা।”
“ভালো যে বাসি বুঝেছেন। এখন একটু ভালো লাগছে।”
“আমি ভালোবাসা চেনায় পারদর্শী না।”
“কিন্তু আমি ভালোবাসায় পারদর্শী। পরশু একবার দেখা করুন।”
“না।”
“খাজনা নিবেন না, রাণীসাহেবা?”
কড়ি মোবাইল কানে ধরে স্তব্ধ হয়ে গেল। ইমাদের ঠোঁটের কোণে মিটিমিটি হাসি।
সেরাতে এবং পরের রাতে কড়ি ঘুমাতে পারেনি। ইমাদ তার করা অপরাধের চাক্ষুশ স্বাক্ষী৷ ধরা পড়ার ভয়ে, নিশ্চিত শাস্তি থেকে বাঁচতে প্রত্যক্ষ স্বাক্ষীর সাথে কোনোরকম ঝামেলায় সে যেতে চায়নি। সেইফ খেলতে চেয়েছে। কড়ি ইমাদকে ইমাদের জন্য সময় দেয়নি। সময় দিয়েছিল নিজের জন্য। ইমাদ তার গোপন কথা জানে। সে পালিয়েছিল, গয়না সমেত। প্রেমিকের সাথে। তার প্রেমিক ভেগেছিল গয়না সমেত তাকে ফেলে। তারপর ফিরে আসে কড়ি। ঘটনা ধামাচাপা দেয়। কোনোরকম বিপদে সে পড়তে চায় না। ইমাদ প্রত্যাখিত হয়ে তার সকল ঘটনা ফাঁস করে দিবে বলে একটা আশঙ্কা ছিল! কড়ি কাউকেই এখন আর বিশ্বাস করতে পারে না৷ বাসায় জানিয়ে দিলে সব শেষ হবে। তাই সরাসরি প্রত্যাখান না করে, ইমাদকে দিতে চেয়েছিল শুভঙ্করের ফাঁকি। কিন্তু ইমাদ তার দাবার চাল পাল্টে দিয়েছে। চারদিক থেকে রাণী ঘেরাও৷ এখন কেবল চেকম্যাট! কড়ি দি কুইন অব চেজ।
দেখা করার দিন রাণীরদীঘির দক্ষিণ পাড় কড়ি দাঁড়িয়েছিল। পরনে কালো সেলোয়ার-কামিজ। একটু পর পর কেমন ঠান্ডা একটা হাওয়া আসছিল বলে ওড়না দিয়ে কান পেঁচিয়ে রেখেছে। ইমাদ এলো হঠাৎ করে। রিকশা থেকে নামল না। রিকশায় বসেই বলল, “গয়না আনতে পারি নি। আপনার নতুন জীবনের জন্য শুভ কামনা।”
কড়ি তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলল, “সেদিন তো অন্যরকম কথা বলছিলেন।”
ইমাদ বলল, “কথায় চিড়া ভিজে না। ভালো থাকবেন।”
ইমাদের রিকশাটা হাওয়ার গতিতে এসে, ঝড়ের গতিতে চলে গেল। ইমাদ চলে যাবার পরেও কড়ি কতক্ষণ চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল। ছেলেটা আবার কিছু করে ফেলবে না তো? না হাতের রগ কাটবে, গলায় দড়ি দিবে, ডিপ্রেশনে দরজা বন্ধ করবে এসব কিছুর কথা সে বলছে না৷ সে যে কিছু করার কথা ভাবছে সে কিছু হলো বাসায় কোনো খবর লিক করে দেয়া, তন্ময়কে কানপড়া দেয়া অথবা, অন্যভাবে কোনো সিনক্রিয়েট করা। এটা কি কোনো রকমের ব্যাকআপ প্ল্যান? কড়ি রাণীর দীঘির পাড় একটা জায়গা খুঁজে বসে ঠান্ডা মাথায় ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর ইমাদকে কল করল। ইমাদ কল ধরছে না। নাহ এভাবে সে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। সেদিন এক কথা বলল, আজ আরেক কথা! সেদিনের কথা শুনে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল ইমাদ গয়নার ব্যবস্থা করে ফেলেছে। আজ এ কথা কেন? ঘটনা যাইহোক কড়ির সবটা জেনে রাখা ভালো। যেহেতু, ঘটনাটা তাকে নিয়েই। সে চট করে একটা রিকশা ঠিক করে ইমাদের মেসের দিকে রওনা হয়ে গেল। ইমাদ এখন মেসে আছে কিনা তা বলা যাচ্ছে না। তবে এখন না এলেও একটু পরে ত আসবে। তাকে পেতে হলে যেতে হবে ওখানেই।
মেসের গেটের মুখে মুবিনের সাথে কড়ির দেখা হয়ে গেল। কড়ি হেসে বলল, “হাই মুবিন। আমি কড়ি। চিনতে পেরেছ?”
মুবিন মহাবিরক্ত। কলে তাকে কড়ি মুবিন সাহেব বলছিলেন। আপনি করে বলছিলেন। এখন তুমি করে বলছে! সে কি অনুমতি দিয়েছে? না উনি অনুমতি নিয়েছেন? মুবিন কর্কশ গলায় জবাব দিলো, “না, চিনিনি।”
কড়ি বুঝল। তাই আর ঘাঁটাল না৷ বলল, “তোমার স্যার কোথায়? জরুরি বিষয়ে এসেছি।”
“আছে ঘরেই।” মুবিন চোখ উল্টে জবাব দিলো।
কড়ি ভেতরে চলে গেল। ইমাদের ঘরের দরজা খোলা। বাইরে থেকে ইমাদকে দেখা যাচ্ছে। একটা চেয়ার বসে আছে। হা়ঁটুর উপর কনুই রেখে দু’হাতে মুখ ঢাকা। কড়ি বাইরে দাঁড়িয়ে দরজায় নক করল, “আসতে পারি?”
ইমাদ চমকে মুখ তুলল, “আপনি!”
ইমাদের চেয়েও বেশি চমকাল কড়ি, “আপনার কি হয়েছে? চেহারার অবস্থা এমন কেন? কোনো সমস্যা?”
ইমাদ রক্তবর্ণ চোখ দুটো সরিয়ে নিলো, “শরীর খারাপ।”
“নাকি মন খারাপ?”
“না।”
“আমার মনে হয় কিছু একটা হয়েছে৷ সেটা কি আমি কি জানতে পারি?”
ইমাদ চুপ করে রইল। কড়ি জেরা করল, “কি হলো কথা বলছেন না কেন?”
“কি বলব?”
“কি হয়েছে বলুন।”
“কিছু হয়নি।”
“আমি কি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব?”
ইমাদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, “স্যরি। আসুন।”
কড়ি এসে চেয়ারটায় বসল। ইমাদ বসল খাটের এক কোনায়। ওর এলোমেলো চুল, একপাশে ইন খুলে যাওয়া শার্ট, রক্তবর্ণ চোখ সবকিছুই কোনোকিছুকে ইঙ্গিত করছে। সেটা কি? কড়ি ধরার চেষ্টা করছে। পারছে না। কড়ি প্রশ্ন করল, “এটা স্পষ্ট যে আপনি গয়না যোগাড় করতে পারেননি বলার জন্য নিশ্চয়ই আমার সাথে দেখা করতে চাননি। বরং যোগাড় করেছিলেন বা করতে পারবেন ভেবেই সেদিন ঐ কথা বলেছিলেন। আমাকে সত্যিটা বলুন।”
“হাতের মোয়া?”
“আমাকে সত্যিটা বলুন আমি চলে যাব।”
ইমাদ এক মিনিট চুপ থেকে বলল, “আমি একটা জিনিস বিক্রি করেছিলাম৷ ভেবেছিলাম ওটার দামে হয়ে যাবে।”
“তারপর?”
“হলো না।”
“কি বিক্রি করেছিলেন?”
“পাথরে খোদাই করা মূর্তি।”
কড়ি বিস্ফারিত চোখে চেয়ে বলল, “পাথরে খোদাই করা মূর্তি আপনি কোথায় পেলেন?”
“আমি বানিয়েছিলাম।”
“আপনি!”
ইমাদ চুপ করে রইল। কড়ি বলল, “দেখতে কেমন?”
ইমাদ ব্যথাতুর কণ্ঠে বলল, “ছবি ডিলিট করে দিয়েছি।”
“কেন?”
“আমি দুঃখ পুষি না।”
“দুঃখ কি করেন?”
“ভুলে যাই।”
“যদি বিক্রি করে আপনার উদ্দেশ্য হাসিল না করতে পারেন তবে বিক্রি করলেন কেন?”
ইমাদ ঘরের একটা কোণে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। জায়গাটা ফাঁকা৷ কড়ি আরো কিছুক্ষণ বসে ছিল। তারপর একটা সময় উঠল। বলল, “যাচ্ছি। আমি বোধহয় আপনার সর্বনাশ করে ফেললাম।”
ইমাদ হাসার চেষ্টা করল। পারল না৷ কেবল বলল, “আপনি কিছু করেননি।”
“আই হোউপ সো।”
কড়ি চলে যাচ্ছিল। ইমাদ ভদ্রলোকের মত উঠে বলল চলুন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি। কড়ি বলল, “লাগবে না৷”
“রিকশা ঠিক করে দিচ্ছি৷ এ সময়ে রিকশা পাওয়া মুশকিল।”
ইমাদ দরজাটা ভেজিয়ে কড়ির সাথে বেরুচ্ছিল মুবিন হাজির হয়ে বলল, “ভেতরে যান কথা আছে।”
ইমাদ বলল, “ব্যস্ত আছি। পরে।”
মুবিন বলল, “আমাকে ব্যস্ততা দেখাবেন না। আপনার ভালোর জন্যে আপনাকে একটা গুরুতৃবপূর্ণ ইনফরমেশন দিতে এসেছি।”
ইমাদ বলল, “শুনতে চাচ্ছি না।”
“আপনার ঐ মূর্তিটার বিষয়ে।”
“কারো ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আঁড়ি পেতে কথা শুনতে নেই মুবিন।”
কড়ি থামাল, “কি বলতে চাইছে শুনুন না।’
ইমাদ বলল, “বললাম তো আমি ব্যস্ত।”
মুবিন কাঁধ ঝাঁকাল, “ঠিক আছে।”
ইমাদ কড়িকে একটা রিকশায় তুলে দিয়ে নিজেও বের হলো। মেসে ফিরল রাতে। এসে প্রচন্ড অবাক হলো। কারণ কড়ি এখনও এখানে। সে যায়নি৷ কড়ি বসেছিল মুবিনের সাথে, মুবিনের ঘরে৷ ইমাদকে দেখে বেরিয়ে এল। মনে মনে প্রচন্ড বিরক্ত হলো ইমাদ, “আপনি এখনও যাননি!”
“যাই নি। আপনার বন্ধু নিলয় কোথায়?”
“ও বাড়ি গেছে।”
“বাড়ি যায়নি। পালিয়েছে। রাসকেল।” মুবিন গাল বকল।
ইমাদ কড়া চোখে চেয়ে বলল, “মুবিন!”
কড়ি বলল, “মূর্তিটা নিলয় বিক্রি করে দিয়েছে।”
ইমাদ ছোট করে বলল, ‘আচ্ছা।”
“মুবিনের বাবার গার্লফ্রেন্ডের কাছে।”
“আচ্ছা।”
“মুবিন নিজ চোখে দেখেছে।”
“আচ্ছা।”
“মহিলার নাম মিশেল উড৷ উনি মূর্তিটা নিয়ে ফ্রাঞ্চে চলে গেছেন।”
“আচ্ছা।”
“নিলয়কে পঞ্চাশ লাখ টাকার চেক দিয়েছে।”
“আচ্ছা।”
“উনি ভেবেছেন মূর্তিটা নিলয়ের।”
“আচ্ছা।”
“মুবিন নিজ চোখে দেখেছে।”
“আচ্ছা।”
“মুবিনও ভেবেছে ঐ মূর্তি নিলয়ের।”
“আচ্ছা।”
এবার মুবিন বলল, “স্যারের বোধহয় বিশ্বাস হয়নি। আপনি স্যারের গার্লফ্রেন্ড হলে কি হয়েছে, ঐ নিলয় উনার বউ।”
কড়ি বলল, “হাসিও না মুবিন। বিষয়টা সিরিয়াস।”
“আমি কোনো জোকস বলিনি। ফ্যাক্ট বলেছি। আপনার আমার কথা বিশ্বাস করছে ভেবেছেন?”
ইমাদ বলল, “আর কিছু বলবেন?”
“হ্যাঁ, ওকে খুঁজে বের করার ব্যবস্থা করুন।”
“প্রয়োজন নেই।”
মুবিন চেঁচাল, “দেখলেন? উনি বিশ্বাস করেন নি।”
“মুবিন তুমি সত্যি বলছো তো?” কড়ির একটু সন্দেহ হলো।
মুবিন এইবার ক্ষেপল, “মিথ্যে বলে আমার লাভ?”
“কোনো প্রমাণ দিতে পারবে তোমার স্যারকে?”
“পারব। একশবার পারব৷ ঐ মহিলার সাথে যোগাযোগ করব। উনার মুখ থেকেই সব শুনে নিয়েন। উনি মিলাকে ঠিকানা দিয়ে গেছেন। আমি এখনই মিলার কাছ থেকে ঠিকানা নিচ্ছি।” মুবিন পকেট থেকে নিজের মোবাইলটা বের করছিল।
ইমাদ বলল, “লাগবে না।”
মুবিন গোঁ ধরল, “লাগবে।”
ইমাদ বলল, “আমি জানি তুমি সত্যি কথা বলছো।”
“আপনি জানেন না। আপনার কলিজার বন্ধু কত সাধু সেটা আমি আপনাকে দেখাব। ওয়াচ টাউয়ারে শয়তানটাকে ল্যাং মারায় তো খুব রাগ করেছিলেন।”
ইমাদ বলল, “দেখাতে হবে না। আমি আগেই দেখেছি।”
কড়ি অবাক, “দেখেছেন? কীভাবে?”
ইমাদ বলল, “মূর্তির দু চোখে দুটো ছোট্ট ক্যামেরা ফিট করা আছে। নিলয় সেটা জানতো না।”
মুবিন বিস্ফারিত চোখে চেয়ে বলল, “আপনি জানতেন?”
ইমাদ চুপ করে রইল। মুবিন চেঁচাল, “আপনি শয়তানটাকে হাতেনাতে ধরেননি কেন? শয়তানটা পালিয়েছে।”
কড়ি বলল, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না মিশেল উডের কাছে নিলয় ওটা বিক্রি করল কি করে?
ইমাদ বলল, “মিশেল উড মুবিনের সাথে একদিন দেখা করতে এসেছিলেন। তখন আমাদের ঘরে মূর্তিটা দেখেছেন৷ মুবিনের সাথে সেদিন তাঁদের ঝামেলা হয়েছিল৷ পরে আরেকদিন উনি এসেছেন মূর্তিটার জন্য। আমি সেদিন ছিলাম না। নিলয় ছিল ঘরে। মূর্তি বিক্রি হবে কিনা জিজ্ঞেস করেছেন। ও বলেছে, পরে জানাবে। আমি আসার পর আমাকে জানায়। টাকার অ্যামাউন্টটা বলে৷ আমি রাজি হয়নি।”
“কেন?”
“বিক্রি করতে চাইনি।”
“পরে কখন ঠিক করলেন বিক্রি করবেন?”
“সেদিন রাতে।”
“যখন আমাকে বললেন গয়নার টাকা যোগাড় করতে পারবেন তখন?”
“হ্যাঁ।”
“আপনার কাছ থেকে না কিনে নিলয়ের কাছ থেকে কিনল কেন?”
“কারণ উনি জানতেন না মূর্তিটা কার।”
“আপনি কেন সরাসরি উনার সাথে যোগাযোগ করেননি?”
“কারণ আমি উনার কাছে বিক্রি করতে চাইনি।”
“আপনি কোথায় বিক্রি করছিলেন?”
“অন্য কোথাও। এটা কেনার আরো কয়েকটা অফার ছিল।”
“সেখানে আরো বেশি পেতেন?”
“না, কম আরো।”
“তাহলে?”
“ওতে আপনায় গয়না কেনার টাকা হয়ে যেত।”
“উনার কাছে কেন বিক্রি করতে চাননি?”
ইমাদ চুপ করে রইল। উত্তরটা দিলো মুবিন, বিস্ময়ে, “আপনি আমার জন্য উনার কাছে বিক্রি করতে রাজি হননি!”
ইমাদ তখনও চুপ।
“কেন?”
“কষ্ট পেতে।”
“আপনি অনেক টাকা পেতেন।”
মুবিন স্তব্ধ হয়ে রইল। পরে বলল, “আমি ঐ নিলয়কে খুঁজে বের করে জানে মেরে ফেলব।”
ইমাদ বলল, “অসম্ভব।”
কড়ি বলল, “খুঁজে বের করা সম্ভব।”
ইমাদ বলল, “আমি খুঁজব না।”
“কেন?”
“ভুলে যান।”
“এটা ছোট কোনো ইস্যু না। চাইলেই বাদ দেয়া যায় না।”
“ইস্যুটা আমার আর আমার বন্ধুর।”
“বন্ধু! ও আপনার বন্ধু! এখনও বন্ধু বলছেন?” কড়ি অবাক।
মুবিন বলল, “আপনাকে পাগলাগারদে আর আপনার বন্ধুকে পুলিশে দেয়া উচিত।”
“তোমাদের কি সমস্যা মুবিন? বিষয়টা আমার ব্যক্তিগত৷ আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে আমি তোমাদের হস্তক্ষেপ পছন্দ করব না।”
মুবিন বলল, “উনি আপনার গার্লফ্রেন্ড। উনি অবশ্যই কথা বলবেন।”
কড়ি বলল, “মুবিন আপনার স্টুডেন্ট। ওরও উচিত আপনার জন্য চেষ্টা করা। এটা একটা গুরুদক্ষিণা হতে পারে।”
ইমাদ বলল, “না আপনি আমার গার্লফ্রেন্ড, না মুবিন আমার স্টুডেন্ট। মুবিন কখনও আমাকে টিচার ভাবেনি। আপনিও কখনও আমাকে নিয়ে অন্যভাবে ভাবেননি। ওর কোনো বিষয়ে আমাকে নাক গলাতে দেয়নি। বলো মুবিন দিয়েছো? না আমি হস্তক্ষেপ করেছি? ও আমাকে টিচার হিসেবে গণ্য করে না।”
মুবিন বলল, “আপনার গার্লফ্রেন্ডের কথা শুনোন।”
ইমাদ বলল, “আমাদের মাঝে কিছু নেই।”
মুবিন বলল, “আপনাদের ব্রেকআপ?”
ইমাদ আর একটা কথাও না বলে নিজের ঘরে গিয়ে ওদের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো। কড়ি কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। সে মুবিনের দিকে একবার তাকাল। মুবিনের চোখ মুখ রাগে লাল। হাতের পেশি শক্ত হয়ে আছে। সে বলল, “তোমার স্যারকে তোমার কেমন লাগে, মুবিন?”
“আমার কাউকেই ভালো লাগে না।”
“ইমাদকে খারাপ লাগে?”
“না।”
“মুবিন সাহেব আপনার কি মনে হয়? আপনার স্যারের সাথে আমার প্যাচআপ করে ফেলা উচিত?”
“কোনো হাফ মেন্টাল মেয়েই হবে যে সুযোগ হাতছাড়া করবে।”
“ক্যান ইউ গিভ মি লজিকস?”
“স্যার কখনো ঝগড়া করবে না। ঝগড়া একটা ফ্যামিলিতে অনেক বড় ইস্যু। ছেলেমেয়েরা অনেক চাপে থাকে। স্যারের সাথে ঝগড়া করা ইম্পসিবল। আমি যেহেতু পারিনি জগতের কেউই পারবে না। স্যারের বউ যত যাই বলুক স্যার বলবেন আচ্ছা। ঝগড়া হবে কি করে?”
“সব মেনে নিয়ে তো আচ্ছা বলে না।”
“হ্যা, করবে যেটা উনার ইচ্ছা সেটাই। তবে নিজের পার্টনারকেও ইচ্ছে অনুযায়ী চলতে দিবে। সহ্য ক্ষমতা ভালো। ঠান্ডা মাথার মানুষ। পরোপকারী। অন্যের কথা ভাবে খুব। প্রায়োরিটি নিজে না৷ তাঁর প্রায়োরিটি ফ্যামিলি, পার্টনার, ফ্রেন্ডস। আর ক্যারেকটার ভালো। ম্যাসেজের বিষয়টা একতরফা। স্যার ওসবে জড়িত না। আমার বোনকে পড়িয়েছে, আমি এদিকটা খেয়াল করেছি। আত্মসম্মানবোধ আছে৷ ট্যালেন্ট আছে, পড়াশুনা আছে, পটেনশিয়াল আছে। ফ্যামিলি কেমন জানি না। তবে স্যার জোস।”
“সব পজিটিভ বললে। নেগেটিভ বলো।”
মুবিন সোজাসুজি বলল, “বলব না।”
“কেন? তোমার স্যার কি একশোতে একশো?”
মুবিন ফিচেল হেসে বলল, “আপনি একশোতে একশো?”
কড়িও হাসল, “তোমার স্যারেরটা জানি না৷ তবে তোমাকে যে বিয়ে করবে তার খবর হবে।”
মুবিন চোখ উল্টে বলল, “হোয়াটএভার।”
.
মানুষের জীবনে কখনো কখনো এমন রাত আসে যে রাতে ঘুম আসে না, প্রেমিকা কথা বন্ধ করে দেয়, প্রেমিক প্রেম ভুলে যায়৷ মানুষের জীবনে এমন অনেক ভালোবাসা আসে যেসব ভালোবাসা রাতের পর রাত সৃষ্টিকর্তার কাছে কেঁদেও হারিয়ে ফেলতে হয় অথবা, কখনও পাওয়াই হয় না। আবার কখনও কখনও এমন রাত আসে যেখানে ভালোবাসা যেন না আসে আমরা নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে প্রার্থনা করি। জীবনে আর প্রেম না আসুক। যাকে ভালো লাগে তার চেহারাও দেখতে চাই না। আমরা আর ভালোবাসা চাই না। কেবল চাই একটু শান্তি। যে ভালোবাসা ভালোবাসা করে পাগল করে দেয় তার কাছ থেকে দূরে চলে যাই। এই প্রার্থনাও কাজে আসে না। আমরা আবার প্রেমে পড়ি। ভালোবাসার দিকে হেঁটে যাই। সৃষ্টিকর্তা কেন আমাদের প্রার্থনার উল্টোটাই করেন, কড়ি বুঝে পায় না। খুব ভোরে নাস্তার টেবিলে গিয়ে সে খুব সহজ গলায় বলল, “আমার একজনকে পছন্দ হয়েছে। তাকে বিয়ে করতে চাই।”
কাদের সাহেব থতমত খেয়ে গেলেন। রিমা নড়েচড়ে বসল। কায়েস বলল, “তুই প্রেম করিস!”
কাদিনের গুরুগম্ভীর জিজ্ঞাসা, “কবে থেকে?”
কাইয়ূম প্রশ্ন করল, “কাকে?”
কড়ি জবাব দিলো দাঁড়িয়ে থেকেই, “ইমাদকে। তবে প্রেম না।”
“দীপার বন্ধু ইমাদ?” কাদিনের চোখেমুখে বিস্ময়। কড়ি বলল, “হ্যাঁ।”
রিমা একটু কড়া গলায় বলল, “এসব কখন হলো?”
“গতকাল সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
“গতকাল কি এমন হয়েছে?”
“ইমাদের ব্যক্তিগত বিষয়। বলা যাচ্ছে না।”
“সিমপ্যাথি!” কায়েস ফোঁড়ন কাটল।
“রেসপেক্ট।” কড়ির জবাব।
“তুই কি আমাদের ডিসিশন জানাতে এসেছিস?” কাইয়ূম গমগমে গলায় বলল।
কড়ি বলল, “আমার পছন্দ জানালাম।”
“দুটোর মাঝে পার্থক্য কোথায়, কড়ি?” কাদের সাহেব প্রশ্ন করলেন।
কড়ি চুপ করে রইল। কাদের সাহেব আবার বললেন, “ছেলে কি করে?”
“আমি ওকে একদিন আসতে বলব। তুমি সরাসরি কথা বলো।”
একেকজন নাশতা না করেই উঠে চলে যাচ্ছিল। কারো মনে ক্রোধ, কারো দুশ্চিন্তা, কারো বিস্ময়। কড়ি ওদের থামাল, “কথা শেষ করে যাও তোমরা।”
কাদিন ধমকে উঠল, “কথা বলার মত কোনো জায়গা রেখেছিস তুই? তন্ময়ের চাইতে ইমাদকে বেশি পছন্দ হলো তোর?”
কড়ি অকপটে স্বীকার করল, “হ্যাঁ।”
“দীপা জানতো এসব?”
কড়ি বলল, “জানে না। জানলে খুশি হবে।”
কায়েস মুখ বিকৃত করে বলল, “পছন্দ করেছে! প্রেম করেনি! শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায়?”
কাইয়ূম বলল, “মিথ্যে কথা কেন বলছিস? প্রেম তুই করিসনি?”
কড়ি কম্পিত গলায় বলল, “করেছি। তবে ইমাদের সঙ্গে না। তোমরা একটু শান্ত হয়ে বসো। তোমাদের সবকিছু বলছি।”
সবকটা চোখ বিস্ময়ে দিশেহারা। কড়ি জানে এখন সে যা যা বলতে যাচ্ছে তা শুনে এই চোখগুলো ক্রোধে লাল হবে।
তবু সে বলবে। আজ সে সব বলবে। কেন বলবে? ইমাদের জন্য? বোধহয়। ইমাদকে বিয়ে করতে চাইলে সবাইকে সত্য বলে, প্রায়শ্চিত্ত করেই সে বিয়ে করবে। আর কোনো মিথ্যে নয়। কড়ি বলল। সেই প্রেমিক, পালানো, গয়না, কিছুই বাদ দিলো না।
.
দীপা প্রতিদিন বিছানার চাদর, বালিশের কভার পাল্টায়। বুয়ার ঝাড়ু দিয়ে যাওয়া ঘর আবার ঝাড়ু দেয়, নিজের কাপড় নিজে ধোয়, বুয়ার রান্না করা খাবার খাবে না বলে নিজে রাঁধে। একই প্লেট, গ্লাস হাজারবার ধুতে থাকে। এসব দেখে দীপার মায়ের বিপি হাই। ভাই ডেকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি পাগল হয়ে যাওনি তো?”
দীপা বলে, “আমি তো পাগল’ই।”
“স্যরি আপু।”
দীপা একটু অবাক হয়ে বলে, “কেন?”
“সেদিন তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করেছি খুব।”
“কিচ্ছু হবে না।”
“তোমার খারাপ লাগে না?”
“লাগে। কিন্তু যখন তোরা আমায় বকিস তখন খারাপ লাগে না।”
“তাহলে?”
“তোদের বারবার বিরক্ত করি তাই খারাপ লাগে। আই অ্যাম আ ম্যাস।”
“তুমিও এতটাও বিরক্ত করো না। স্যরি আপু। তুমি এমন হয়ে যাচ্ছিস কেন?”
“কেমন হয়ে যাচ্ছি?”
“দাদী নানীদের মত শুচিবায়ুগ্রস্ত!”
“শুচিবাই না, ভালেবাসাবাই।”
“অ্যাহ!”
দীপা হকচকিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে হাসে। বিস্মিত হয়। ওর কোনো শুচিবাই নেই। ওর হলো ভালোবাসার বাই। কাদিনকে সারাক্ষণ কাছে চায়, কাদিন এলে তাড়ায়, চলে গেলে তড়পায়। তাই আশেপাশে কাদিনের মত একটা পরিবেশ তৈরী করে রাখে সবসময় ইচ্ছে করেই। তাতে কাদিনের একটা ইলিউশন তৈরী হয়। মনে হয় এই তো কাদিন এখানেই, আছে আশেপাশেই। আরো নানাবিধ এমন কাজ সে করতেই থাকে। কিছু সবার চোখে পড়ে, কিছু পড়ে না। মেহেদীর ডাকে দীপা সম্বিৎ ফিরে পেল।
“কি হলো? কোথায় হারালে আপু?”
দীপা ডানে বায়ে মাথা নাড়ে, “কিছু না।”
সে নিয়ম করে প্রতিদিন একবার বিয়ের অ্যালবাম নিয়ে বসে। মেহেদী উঠে গেলেই সে বিয়ের অ্যালবাম নিয়ে বসবে। বিয়ের ছবি দেখতে ওর ভালো লাগে। আমরা যখন ভালোবাসি, তখন সারাক্ষণ ভাসার মানুষকে নিজের আশেপাশে বন্দী করে রাখতে চাই। নতুবা, নিজেরাই কয়েদী হয়ে যাই। কাদিনকে বন্দী করতে সে কখনই পারবে না। তাই নিজেই কাদিনের কয়েদী হয়ে আশেপাশে একটা জেলখানা বানায়। যে জেলখানায় সবসময় গুছানো থাকতে হয়। বারবার পরিস্কার জিনিসকে আবার পরিস্কার করতে হয়। সবসময় অন্যরা কি ভাবল তা নিয়ে তটস্থ থাকতে হয়। একটুও ভুল করা যায় না।
একটু পরই কাদিনের কলটা এলো। দীপা ধরল না। কাদিনের কল দীপা ধরে না।
কলিংবেল পাখির শিষ দেয়। কাদিন চলে আসে। মেহেদী হেসে সম্ভাষণ জানাল, “আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। কেমন আছেন?”
কাদিন কোনো খুব ঠান্ডা গলায় বলল, “ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
মেহেদী বলল, “ভাইয়া আপনি বসেন। মা আমাকে ডাকছেন। আমি যাই।”
মেহেদী চলে গেলে কাদিন বলল, “কড়ি ইমাদকে বিয়ে করতে চায়।”
“কিহ্!” দীপা আকাশ থেকে পড়ল। কাদিন প্রশ্ন করল, “ তুমি কড়ির ব্যাপারে সব জানতে?”
দীপা একটু ভড়কাল, “কোন ব্যাপার?”
“আমি কোন ব্যাপারে বলছি তুমি খুব ভালো করেই জানো।”
“না আমি বুঝতে পারছি না।
“কড়ি যার সাথে প্রেম করেছে সে ইমাদ না৷ অন্য কেউ। সে বাসা থেকে পালিয়েছিল। তোমার ভাগের গয়না তোমাকে বুঝিয়েও দিয়েছে। গয়না চুরি হয়নি। কিছু তোমার কাছে আছে। কিছু কড়ির কাছে আর কিছু কড়ির ওই প্রতারক প্রেমিক নিয়ে পালিয়েছে।”
দীপা আতঙ্কে নীল হয়ে গেল। কি বলবে ভেবে পেল না। কাদিন কাছে এসে কড়া চোখে দীপার দিকে তাকাল, আর কি কি লুকিয়েছ তুমি?”
দীপা বলল, “কড়ির গোপন কথা তোমাকে আমি কীভাবে বলব?”
“তোমাকে যেমন ভাবতাম তুমি তেমন না। তোমাকে আমি চিনতে পারিনি।”
“রাগ করো না, প্লিজ।” দীপা ভয়ে ভয়ে কাদিনের হাত ধরল।
কাদিন হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “তুমি এত সহজ না। সত্যি কথা বলো। আর কি কি গোপন করেছো?”
দীপা বলল, “আর কি বলব?”
“তুমি আর কিছু লুকাওনি?”
দীপা ঢোক গিলে বলল, “না।”
“শিউর?”
দীপা বুঝতে পারছে না কি বলবে। কি করা উচিত। সে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগল। কাদিন বলল, “চুপ করে থাকবে না। কথা বলো।”
“কিছু লুকাই নি।”
দীপার নীরবতা ও চোখমুখ দেখেই কাদিন স্পষ্ট টের পেয়েছে দীপা আরো অনেককিছু গোপন করেছে। সে দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “বিয়ের আগের তোমার প্রেম, কড়ির প্রেম, কড়ির পালিয়ে যাওয়া, গয়না লুকিয়ে নিজের কাছে রাখা আর কত দীপা? আর কত? তোমার আর একটাও মিথ্যে আমি অন্যের মুখ থেকে শুনলে, কোনোদিন তোমার চেহারা দেখতে ইচ্ছে করবে না।”
দীপা এবার কেঁদে ফেলল, “তুমি এমন করছো কেন আমার সাথে?”
কাদিন আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলো না। সে হাত দিয়ে সাইড টেবিলে রাখা টেবিল ল্যাম্প ফেলে দিয়ে বলল, “একদম ভিক্টিম প্লে করবে না। উল্টো কথা বলবে না।”
ল্যাম্পটা পড়ে ভেঙে যেতেই কাদিন নিজেকে সংযত করে ফেলল। ঝুঁকে ল্যাম্পটা তুলে টেবিলে রেখে বলল, “তোমার কাছ থেকে আমি বারবার ডিজাপয়েন্টেড হই। কড়ি, তুমি তোমরা দুজনেই প্রতারণা করেছো।”
দীপা বলল, “এভাবে বলো না। বিশ্বাস করো..”
কাদিন থামিয়ে দিয়ে বলল, “তোমাকে আমি আর বিশ্বাস করতে পারব বলে মনে হয় না।”
কাদিন ভাঙা ল্যাম্পটা হাতে নিয়ে বের হয়ে গেল, “ঠিক করে পাঠিয়ে দিবো।”
“শুনো কাদিন তুমি বসো। মাথা ঠান্ডা করো। বাসায় কি হয়েছে আমাকে একটু বলো।”
কাদিন আর একটা কথাও বলল না৷ দীপার কথা শুনলও না। ভয়াবহ অন্ধকার চেহারা করে যাওয়ার আগে শাশুড়ির ঘরে গিয়ে বলে এলো, “মেহেদীকে একবার পাঠাতে পারবেন বিকেলে? আমার হাত থেকে পড়ে গিয়ে ল্যাম্পটা নষ্ট হয়েছে। ঠিক করে দিব।”
দীপার মা বললেন, “তোমার ঠিক করতে হবে না বাবা। এটা রাখো। তোমার জন্য খাবার বেড়েছি। তুমি হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হও।”
“কাজ আছে।” কাদিন চলে গেল। দীপা ইমাদকে কল করল। কি হয়েছে জানার জন্য। ইমাদ সব শুনে হতবাক। সে এখনও জানেই না কড়ি তাকে বিয়ে করতে চায়। বাসায় সবার সাথে তার জন্য যুদ্ধ করছে কড়ি। ইমাদ বলল, “তুই রাগ করেছিস, দীপু?”
দীপা বলল, “না আমি না। রাগ হয়েছে কাদিন। আমি কেন রাগ করব?”
“কড়ির আর আমার বিষয়টা নিয়ে?”
“আমি খুব খুশি, ইমাদ। তুই কেন রাগ করার কথা বলছিস আমি সেটাই বুঝতে পারছি না।”
“কড়িকে পছন্দ করি তোকে যে জানাইনি।”
“বলে কি! ধুর আমি কবে এত প্যাঁচ ধরতে শিখলাম? আমি এত প্যাচ বুঝি?”
“নিলয়ও জানতো। তোকে জানাইনি কষ্ট পাস নি?”
“আরে না। তুই আর কড়ি একসাথে আমি তো ভাবতেই খুশিতে পাগল। তোদের কি যে মানাবে। মাশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ।”
“আমার জন্য তোর শ্বশুরবাড়িতে না কোনো সমস্যা হয়। কাদিন ভাইয়া আর তোর মাঝে ঝামেলা হোক চাই না।”
“আমার কথা বাদ দে আমার জীবনটাই ঝামেলা।”
ইমাদ বাদ দিলো নিলয়ের কথাটাও। সে দীপুকে পর্যন্ত বলে নি। ভালোবাসা হারানোর চেয়ে বন্ধু হারানোর ক্ষত অনেক বেশি। সে চায় না নিলয়কে কেউ চোর বলুক। ভালোবাসো চলে গেলে আত্মসম্মানে লাগে, আর বন্ধু গেলে বুকে লাগে।
#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী
শেষ পর্ব : বাকি অংশ।
দীপা একবার ভাবলো ঐ বাসায় যাবে। বাসার অবস্থা কি, কিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সবাই কেমন আছে জানতে ইচ্ছে করছে। সবাই ঠিক আছে তো? কড়িকে কয়েকবার করে কল করেছে। কড়ির মোবাইল সুইচড অফ। কাদিনকে কল করেছে। কাদিন কল ধরেনি। রিমা আপু কিংবা বাসার অন্য কাউকে কল করবার সাহস দীপার নেই। দুদিন ধরে পাগলের মতো কি করবে ভেবেছে সে। এত বড় একটা ঘটনায় সে যুক্ত। প্রথম থেকেই সব জানতো অথচ, গোপন করে রেখেছে। কি জবাব দিবে ওদের? রিমাই ফোন করলো তাকে। রিমার কাছ থেকে বাসার গুমোট পরিস্থিতি জেনে খুব কষ্ট হলো দীপার। বাবা কড়ির সাথে কথা বলা বন্ধ দিয়েছেন। কাইয়ূম, কাদিন, কায়েস কড়িকে উঠতে বসতে কঠিন কঠিন কথা শুনাচ্ছে। রিমা নিজেও রাগ। রিমা দীপাকে বলল, “কাদিন সবচেয়ে বেশি ক্ষেপেছে। তোমার উপরেও ক্ষ্যাপা। আর ওখানে পড়ে থেকো না। যা হওয়ার হয়েছে, চলে এসো।”
দীপা বলল, “আমি আসতে পারব না, আপু।”
“কেন আসতে পারবে না?”
“আপনাকে বলতে পারব না।”
“আমাকে কিছু বলো আর না বলো, কাদিনের কাছ থেকে আর কিছু লুকিয়ো না তুমি। ও খুব জটিল। আর যা যা লুকিয়েছো বলে দিও।”
টেবিল ল্যাম্পটা ঠিক করে কাদিন নিজেই ফেরত দিতে এলো। যেহেতু সে ভেঙেছে, তারই এটা ঠিক করা দিয়ে যাওয়া উচিত। সামজিকতা তার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। দীপার মা জোর করে তাকে খেতে বসালেন। ভদ্রতার কারণে কাদিনকে বসতে হলো। কোনোমতে দু লোকমা মুখে নিয়ে সে উঠল। খাওয়া শেষে বেসিনে হাত ধোয়ার সময় দীপা বলল, “কড়িকে মাফ করে দাও।”
কাদিন বলল, “লজ্জা থাকলে এ কথা বলতে না। নিজেকে নিজের কাছে ছোট মনে হচ্ছে। তোমরা দুজনেই আমাকে ঠকিয়েছ। আমার বোন, বউ দুজনেই আমাকে বোকা বানিয়েছে।”
দীপা বলল, “তুমি কি কখনই আর আমাদের বিশ্বাস করবে না?”
কাদিন মুখের উপর বলল, “না। তুমি আমার কাছে আরো অনেককিছুই লুকিয়েছ, লুকাবে। তোমাকে আমার চেনা হয়ে গেছে। প্রথমে ভেবেছিলাম তোমার মনে যা, মুখেও তা। ঘটনা কিন্তু তা না।”
“ঘটনা কি?”
“ঘটনা হলো আমি একটা ইডিয়ট। আর কিছু না।”
দীপা কান্নার দলা গলায় আটকে বলল, “তোমাকে কখনো বলতে চাইনি। আজ বলব। জানি শোনার পর যেটুকু বিশ্বাস বাকি আছে সেটুকুও আর থাকবে না। তবু বলে দিয়ে শেষ করি। তোমাকে ইডিয়ট ভেবে কোনোকিছু লুকাইনি। আমি ননসেন্স তাই আমার কান্ডকীর্তি তোমাকে বলতে চাই না।”
কাদিনের ভ্রু কুঁচকাল, “কি বলতে চাইছো?”
“ঘরে এসো।”
দীপা চোখে মুখে কান্না নিয়ে ঘরের দিকে গেল। কাদিনও পেছন পেছন গেল। দীপা দরজা বন্ধ করে এক নিশ্বাসে
বলল, “তোমার বন্ধু তাহমিদ আমার এক্স। ও আমাকে ডিচ করে। কড়ি এটা জানতো। বলতে নিষেধ করেছিল।”
কাদিন কতক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো। সে যা শুনছে সত্যিই দীপা তা বলছে তো? দীপা বলল, “কিছু বলবে?”
কাদিন বলল, “আর কি লুকিয়েছো?”
“তাহমিদ একদিন তোমার সাথে দেখা করতে বাসায় এসেছিলো। তুমি ছিলে না।”
“তারপর?”
“আমাকে সুযোগে কিছু কথা বলেছে।”
“কি কথা?”
“ছোটবেলা থেকেই তুমি ওর থেকে, সবার থেকে সবকিছুতে এগিয়ে ছিলে। পড়াশুনা, রেজাল্ট, গুড ইমেজ, চাকুরী। শেষ বেলায় এসে আমাকে বিয়ে করে ঠকে গেলে। যে মেয়েকে ও বিয়ে করতে রাজি হয়নি, সে মেয়েকে শেষ পর্যন্ত তোমার বিয়ে করতে হলো।”
“কবে বলেছে?”
দীপা তারিখ বলল। কাদিন মিলিয়ে দেখলো সেদিনই দীপা অন্য একটা ঝগড়ার ছুঁতোয় রাগ করে চলে এসেছে। কাদিন সাথে সাথে পকেট থেকে মোবাইল বের করল। দীপা বলল, “কাকে কল করছো তুমি?”
কাদিন বলল, “বোন, বউ, বন্ধু সবাই মিলে আমার সাথে কানামাছি খেললে। তোমাদের ধরেছি, তাহমিদকে ধরব না?”
তাহমিদ কল রিসিভ করল, “আরে বন্ধু কেমন আছিস তুই?”
কাদিন বলল, “ছোটবেলা থেকেই তুই আমার মত হতে চাইতিস। তোর সব জিনিস কেবল আমার হয়ে যায় চেয়েও কখনো কিছুই অর্জন করতে পারিস না। একাডেমিকালি, ফিনানশিয়ালি, গুড ইমেজ সবকিছুতে তুই আমার সাথে অযথা টক্কর দিতিস এবং
সব কিছুতে পিছিয়ে ছিলি। সব সময় তোর মাঝে ইনফিরিউরিটি কমপ্লেক্স কাজ করতো। তুই হীনমন্যতায় ভুগেছিস। আমাকে হিংসে করেছিস। রেজাল্ট, পড়াশোনা, চাকুরী সব আমার মত চাইতিস। যে অফিসে এখন চাকুরি করছি এখানেও দুজনে মিলে একসাথে ইন্টারভিউ দিলাম। আমার হলো, তোর হলো না। সবসময় আমার সাথে প্রতিযোগিতা করিস। আমি কখনো তোর সাথে প্রতিযোগিতায় নামিনি। আমার সাথে তোর কম্পিটিশনটা আমি বুঝি। কিন্তু কম্পিটিশনের দরকারটা কি আমি আজো বুঝিনি। তোর মত করে ভাবতে পারি না আমি। আমি কখনো তোর মত ভাববোও না, তোর মত হবোও না।
আর তুই চাইলেও আমার মত হতে পারবি না। আমার সাথে প্রতিযোগিতা করিস না, তাহমিদ। সবসময়ের মত হারবি। আজও তুই হারলি। দীপা তোর গার্লফ্রেন্ড ছিল। অথচ, দীপাকে বিয়ে করে ফেললাম আমি। দীপা তোর পিছনে পাগল ছিল। আমাকে পেয়ে তোকে ভুলেই গেল। তাই খুব লাগছে তাইনা? যার মত তুই আজীবন হতে চেয়েছিস, নকল করেছিস, হিংসে করেছিস, পেছনে পেছনে শত্রুতা করেছিস দীপা তাকেই বিয়ে করে ফেলল। যে দীপাকে তুই বিয়ে করিসনি তার বর আসলে তোর আইডল। একদিকে বুকে ছুড়ি বসল। যে বন্ধু সবসময় তোর থেকে সবকিছুতে এগিয়ে সে বন্ধু শেষ পর্যন্ত তোর গার্লফ্রেন্ডকেও বিয়ে করে নিলো। দীপাকেও রাখতে পারলি না। আরেকদিকে পিঠে তীর। দুদিকেই জ্বলছিস। তোর বুকে এখন শিখা অনিবার্ণ। বৃত্তি, চাকুরী, দীপা সব আমার। তুই আজীবন আমার মত হতে চেয়েছিস কিন্তু কখনো পারিস নি, পারবিও না। তোর দ্বারা আমার মত হওয়া সম্ভব না। যা তোর দ্বারা সম্ভব না তা কেন করতে চাস?”
তাহমিদ বলল, “অহঙ্কার করছিস?”
কাদিন হাসলো, “আমি কখনো অহঙ্কার করিনি। আজ করছি। দীপার মত এত লয়্যাল একটা মেয়েকে আল্লাহ তোর ঝুলি থেকে তুলে এনে আমার করে দিয়েছে। তুই দীপাকে যা বলেছিস, করেছিস সবটাই করেছিস হিংসায়। হিংসা মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। এজন্যই তোর দ্বারা কখনো ভালো কিছু হয় না। তুই জীবনে কিছুই করতে পারিসনি।”
তাহমিদ বলল, “দীপার মত আহাম্মককে আমি ছুঁড়ে ফেলেছি। তুই টোকাইয়ের মত ঘরে তুলেছিস।”
কাদিন জবাবটা দিলো তীরের ফলার মত,
“দীপা হাই মেনটেনেন্স। তোর মত আহাম্মকের দ্বারা সামলানো সম্ভব না। দীপাকে সামালাতে নিজে আহাম্মক হলে হয় না। বুদ্ধি লাগে। দীপার মত ব্র্যান্ড কেবল আমাকেই মানায়। তোর সাধ্যের বাইরে, ব্রো।” বলতে বলতেই কাদিন দীপাকে কাছে টেনে নিজের বাহুডোরে নিয়ে নিলো। যেন তাহমিদ ফোনের ওপাশেই দেখতে পাচ্ছে। বউকে নিয়ে খুব প্রাউড কাদিন।
তাহমিদ বলল, “আমি ভালো বলেই তোকে দীপার আর আমার পুরোনো প্রেম নিয়ে কিছু জানাইনি। আন্দাজ করছি দীপার কাছে থেকেই জেনেছিস। দীপা তোর কাছে ইনোসেন্ট সাজতে চায়। আজ বুঝতে পারলাম যতটা ইনোসেন্ট ওকে ভাবতাম ততটা ইনোসেন্ট ও না। তুইও একদিন বুঝবি।”
কাদিন দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “তোকে আমি ল্যাংটাকাল থেকে চিনি। তুই আমার বন্ধু। হাজারটা মেয়েকে তুই ঘুরিয়েছিস। হাজারটা মেয়েকে তুই নিজের ইশারায় নাচিয়েছিস, কষ্ট দিয়েছিস। অনেক না করেছি, বুঝিয়েছি। শুনিস নি। কখনো কারো সাথে সিরিয়াস হোসনি। তুই যদি পারতিস, দীপার নামে আমার কাছে অবশ্যই, অবশ্যই
উল্টাপাল্টা বদনাম করতিস। তুই এসব করিসনি কারণ জানিস আমি বিশ্বাস করব না। আমি তোকে হাড়ে হাড়ে চিনি। কত কত মেয়েকে কষ্ট দিয়েছিস আমি জানি। আমাকে বলে লাভ হবে না, তাই দীপাকে ফালতু, হাস্যকর একটা কথা বলে আমাদের মাঝে দূরত্ব তৈরী করার চেষ্টা করেছিস। হিংসায় জলে পুড়ে শয়তানি করেছিস। তুই যে আমার হিংসা করতিস ছোটবেলা থেকেই বুঝতাম। বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকতাম। তোকে আমি বারবার ক্ষমা করেছি। তবু নানান ভাবে, নানান সময়ে তুই আমার সাথে শত্রুতা করেছিস। অযথা, ভালো সাজার চেষ্টা করিস না। আমি দীপা না যে, তুই যা বলবি ওটা শুনেই প্রভাবিত হয়ে যাব৷ আমি কাদিন। আমার সাথে ভেবেচিন্তে, হিসেব করে কথা বলবি। আমি তোর পালস ওঠানামাও ধরতে পারি। আর কোনোদিন আমার সামনে আসবি না। তোকে চোখের সামনেও দেখতে চাই না।”
তাহমিদ বলল, “আমিও।” তারপর রাগে কলটা কেটে দিলো। মেবাইলে রেখে কাদিন এবার দীপার উপর ক্ষ্যাপল, “তুমি এ কারণে চলে এসেছো? এজন্যই তো আমি মিলাতে পারি না। তোমাকে কতবার৷ কতকিছু বকেছি, কত দোষ ধরেছি তুমি রাগ করোনি। তাহমিদের একটা কথায় চলে এলে? ওর কথায় উঠবস চলবে না।”
“ও বলেছে তোমার জন্য নাকি ওর আফসোস হয়। আমাকে বিয়ে করে তুমি ঠকেছো।”
কাদিন বলল, “ওর মাথা আর তোমার মুন্ডু। তোমাকে বিয়ে করে আমি জিতেছি।”
দীপা মুখ ঘুরিয়ে কান্না করে দিলো, “মিথ্যে কথা।”
কাদিন দীপার চিবুক ধরে নিজের দিকে মুখটা ঘুরিয়ে বলল, “ব্যাগ গুছাও।”
দীপা বলল, “না, আমি যাব না। ইউ ডিজার্ভ বেটার।”
কাদিন দীপার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, “আই স্যুয়ের, ইউ আর দ্যা বেস্ট অ্যাওয়ার্ড। অ্যান এবসিলিউট ট্র্যাজার। প্লিজ ব্যাগ গুছাও।”
দীপা নিজেকে কাদিনের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “একটু বসো।”
তারপর লাগেজ বের করল। আলমারি থেকে কাপড় বের করতে গিয়ে ভাঁজ করা কাপড় এলোমেলো করে ফেলল। সব নীচে পড়ে গেল। দুহাতে যতটুকু সম্ভব কাপড় আগলে ধরে তুলতে তুলতে কাদিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যরি, স্যরি আমি ঠিক করে নিচ্ছি।”
কাদিন এগিয়ে এসে দীপার হাত থেকে কাপড়গুলো নিয়ে বলল, “তুমি বসো। আমি ভাঁজ করছি।”
দীপা বলল, “না, না আমি পারব। আমি পারি।”
কাদিন বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে তুমি পারো। কিন্তু বসো চুপচাপ। আমি করছি।”
দীপাকে কাদিন জোর করে টেনে বসিয়ে রেখে নিজে কাপড় ভাঁজ করে করে সুন্দর করে লাগেজ গোছাচ্ছে। দীপা লাফিয়ে উঠে বলল, “ধুর, আমাকে তো ধরতেই দিচ্ছে না। আমি তাহলে তোমার জন্য এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আসি।”
কাদিন বলতে যাচ্ছিলো, “আচ্ছা।”
কিন্তু দীপা বলতে আর দিলো কই? তার আগেই বাচ্চাদের মত একটা দৌড় দিলো রান্নাঘরের দিকে। কাদিন প্রথমটায় হকচকিয়ে গেলেও শেষে সেদিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। সে ঠিক করেছে, দীপাকে গুছালো হতে হবে না। সে নিজে সব গুছিয়ে রাখবে। দীপাকে টিভির শব্দ কমাতে হবে না। সে কানে ইয়ারপ্লাগ গুঁজে ঘুমাব। কাপড় বদলাবার আগে দীপার ঘরের পর্দা টানার কথা মনে রাখতে হবে না। সেই টেনে দিবি। বিড়বিড় করল সে, “দীপা তুমি অগোছালোই সুন্দর।”
.
এসএসসি পরীক্ষা শেষ হবার পর থেকেই মিলা ইন্টারের পড়াশুনা শুরু করে দিয়েছে। ধুমসে পড়ছে। একটা কোচিংয়েও ভর্তি হয়ে গেছে। সেই কোচিংয়ে অভ্রও পড়ে। অভ্র একদিন এসে বলল, “আমাকে ভেক্টর বুঝিয়ে দিয়ো তো।”
মিলা বলল, “তার কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি আমার চেয়ে অনেক ভালো পারো।”
অভ্র বলল, “তোমার মত পারি না।”
“সবসময় তো আমার চেয়ে বেশি নম্বর পাও।”
“তুমি বুঝিয়ে দাও বলেই পড়তে সহজ হয়। ভালো করি।”
মিলা বলল, “দেখো, তুমি যা চাইছো তা হবে না।”
“আমি আবার কি চাইলাম?” অভ্র চোখ বড় বড় করে খুব অবাক হবার ভান করল।
মিলা সুন্দর করে বলল, “তুমি কি চাইছে সেটা খুব ভালো করেই জানো। অযথা আমার কাছে পড়া বুঝতে আসবে না।”
অভ্রর মনটা খারাপ হয়ে গেল। পরদিন মিলা তার খাতায় অভ্রর একটা লেখা পেল। তার খাতা কখন নিলো অভ্র? আবার কখন ফেরত দিলো? ক্লাসের ফাঁকেই হবে। অভ্র লিখেছে,
রোদমিলা,
তুমি ঠিক বলেছো আমার তোমার কাছে পড়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তোমার সাথে ভাব জমানোর জন্য তোমার কাছে পড়া বুঝতে যাই। সরাসরি আজকে বলেই দিলাম। আমি জানি তুমি মুবিন গুন্ডার বোন, তোমার মা – বাবার ডিভোর্স হয়ে গেছে, তোমার জীবনে নানা সমস্যা কিন্তু আমি তোমাকে বড় হয়ে বিয়ে করতে চাই। এইতো আর মাত্র কয়েক বছর। তোমার জীবনের সব সমস্যা আমি ছুমন্তর করে নাই করে দিব। দুজন একসাথে অনেক ভালো কিছু করব। উই বোউথ আর শার্প এন্ড ব্রিলিয়ান্ট। আমাদের একসাথে খুব যায়। উই উইল বি আ পার্ফেক্ট কাপল।”
লেখাটা একবার পড়েই মিলার মুখস্থ হয়ে গেল। তার মাথা ভালো। সে সাথে সাথে কাগজটা খাতা থেকে ছিঁড়ে সুন্দর করে একটা কাগজের প্লেন বানালো। তারপর সেটা হাওয়া উড়িয়ে দিলো। সে হবে পাইলট। স্বপ্ন তার ভালোবাসা, পড়াশুনা তার প্রেম। সফলতাই তার গন্তব্য। মা – বাবা একদিন সবাইকে গর্ব করে বলবে, আমার মেয়ে রোদমিলা দেশসেরা। তার পরিচয়ে পরিচিত হবে সবাই। পাইলট রোদমিলা।
এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট পেয়ে মুবিন সবাইকে ট্রিট দিলো। তার কোনো বন্ধু নেই। সুতরাং সে ট্রিট দিয়েছে মেসের সবাইকে। সবার হাতে হাতে ধরিয়ে দিলো হাজী বিরিয়ানীর প্যাকেট, ডায়নার হালিম আর ২৫০ মিলির কোকা কোলা। সবাই খুশি হয়ে জানতে চাইলো, “আরে গোল্ডেন নাকি? গোল্ডেন নাকি?”
মুবিন একগাল হেসে বলল, “না ফেইল।”
সবাই এ কথা শুনে হা হা করে হাসল৷ মুবিনের পিঠ চাপড়াল। কারণ কেউ ভাবতেই পারে না ফেইল করেও কেউ কেউ এভাবে সেলিব্রেট করতে পারে? এ পৃথিবীর কোথাও ব্যর্থতার কোন উদযাপন নেই। আসলেই নেই। মুবিনও তার ব্যর্থতাকে সেলিব্রেট করছে না। সে যে তার বাবা মায়ের নাম একটু হলেও ডোবাতে পেরেছে – এই তার আনন্দ, এই তার জয়। আজ তার ই সেলিব্রেশন!!
কেবল ইমাদ বুঝলো মুবিন সত্যি বলছে৷ সে নিজ চোখে মুবিনের রেজাল্ট না দেখলে অন্যদের মতোই ভাবতো মুবিন মজা করে এসব বলছে। কিন্তু সে মুবিনের রোল নাম্বারটা জানতো। চেক করে খুব দুঃখ পেয়েছে। কিন্তু হতাশ হয়নি। ইমাদ জানে না সে সত্যিকার অর্থে ঠিক কতটা ভালো শিক্ষক, কিন্তু সে শিক্ষক তা সে জানে। তার সে শিক্ষকের চোখ তাকে বলছে, “মুবিন জিনিয়াস। ওর সহজে থামা নাই।”
ওর হাতে বিরিয়ানির প্যাকেট, হালিমের বাক্স আর কোক দিয়ে চলে যাচ্ছিলো মুবিন। ইমাদ ডেকে বলল, “মুবিন, শুনে যাও।”
মুবিন চুপচাপ এসে দাঁড়ালো। এতক্ষণ হাসলেও এখন মাথা নিচু করে আছে,চোখেমুখে কষ্ট বা অনুতাপ নাই, কিন্তু আছে জেদ!!
ইমাদ শুধু বলল, “তুমি একদিন না চাইতেও হুট করে অনেক বড় কিছু হয়ে যাবে। তোমার মত জীবন সেলিব্রেট করতে পারা মানুষরাই পৃথিবী জয় করে।”
মুবিন ইমাদের কথায় ইমাদের মতো স্থির চোখে বলল, “আচ্ছা।”
তারপর শিষ বাজাতে বাজাতে চলে গেল। তার জীবনে কিচ্ছু হতে হবে না। কেবল মা – বাবার নাম ডুবাতে পারলেই, ওদের লজ্জায় ফেলতে পারলেই সে খুশি। কচু হবে সে। স্যার বললেই হলো! সে কিছু হতেই চায় না। জীবনে কিছু করতে চায় না। সে হবে বাউন্ডুলে, টো টো কোম্পানির সিইও। ইমাদ বুঝলো মুবিন তার কথা বিশ্বাস করেনি, কিন্তু ইমাদের তার উপর বিশ্বাস আছে।
.
কম্পিউটারের দোকানে গিয়ে মুবিনের রোল নাম্বারটা বসিয়ে রেজাল্ট শিট বের করে শিল্পী কষ্টে কেঁদে ফেলল। ছেলেটাকে মানুষ করতে পারলো না কোনোমতেই। শেষ পর্যন্ত ফেইল করলো? কোনো চেষ্টার কমতি তো সে রাখে না। ছেলের ভবিষ্যৎ কি হবে ভেবে বুকের ভেতরটা অজানা আশঙ্কায় শিউরে উঠল। গালে হাত দিয়ে দোকানেই একটা টুলে অনেকক্ষণ যাবত মূর্তির মত বসে রইল সে। ছেলেটার দ্বারা কি শেষ পর্যন্ত পড়াশুনা হবেই না? মুবিনের চিন্তায় হাহাকার করা বুক নিয়েই মিলার রোল নাম্বারটা দোকানীকে দিলো সে। মিলার রেজাল্ট দেখে চমকায়নি। গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। এটা তো হওয়ারই ছিল। মিলা পড়াশুনায় খুব ভালো। তবে মার্কশীট দেখে হতভম্ব হয়ে গেল সে। এতো এভারেস্টের সমান নম্বর! শিল্পীর দুঃখ কমলো। মেয়েটা তার খুব ভালো করছে। ফিউচার ব্রাইট। মায়ের মনটা লিলুয়া বাতাসে জুড়ালো। কিছু সময় যেতে না যেতেই জানা গেল, মিলা শুধু গোল্ডেন এ প্লাস পায়নি, পুরো কুমিল্লা বোর্ডে ফার্স্টও হয়েছে! আর সারা বাংলাদেশে তার স্থান নবম! শিল্পী খুশিতে কি করবে ভেবে পেল না। আত্মীয় – স্বজন, পাড়া – প্রতিবেশী, অফিসের কলিগ সবাইকে ফোন করে করে মেয়ের ফার্স্ট হবার কথা জানালো। পরদিন অফিসে তো মিষ্টিও নিয়ে গেল। সবাইকে মিষ্টিমুখ করালো। আর মিলাকে জড়িয়ে ধরে চুমুর পর চুমু খেল। মিলা এত আদর পেয়ে মায়ের বুকের সাথে লেপ্টে রইল। মা তাকে আদর করছেন। তার ভালো লাগছে৷ খুব ভালো লাগছে। মায়ের এমন আদরের জন্য সে শত রাত জেগে পড়তে পারবে। সে যদি জানতো এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্টের দিন সে এত আদর পাবে তবে আরো দু বছর আগেই দুই ক্লাস টপকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফার্স্ট হয়ে যেত। এই এটুকু আদরই তো সে আজীবন চেয়ে এসেছিল। মাকে সে খুব ভালোবাসে। সবচেয়ে বেশি। সবার চেয়ে বেশি।
মিলাকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিল মঈনও। মিলাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে শিল্পীকে বলল, “যা হয়েছে, হয়েছে। মিলার জন্য পেছনের কথা আমরা ভুলে যাই। আবার নতুন করে সব শুরু করি।”
মিলা উঠে চলে গেল। শিল্পী বলল, “মিলার দোহাই দিও না, মঈন। মিশেল তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমার কাছে এখন কি চাও? দুদণ্ড শান্তি? দেবদাস হলেই তোমার কেবল আমাকে লাগে। জোহরার পর একবার তোমার চন্দ্রমুখী হয়েছি৷ আর না৷ এইবার আমি পারু৷ আমাকে তুমি দেবদাস আর কখনো পাবে না।”
চন্দ্রমুখীরাও একটা সময় পারু হতে বাধ্য হয়। দেবদাসের জন্য মায়া হলেও ফিরে আর যায় না। দেবদাস মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। বেঁচে থাকলে চন্দ্রমুখীও একটা না একটা সময় পারুর মত নিজের অধিকার চাইতো। একতরফা ভালোবাসারও সংবিধান থাকে। ভালোবাসবে, জীবন দিবে, কিন্তু বিনিময়ে সম্পর্কের মৌলিক অধিকার চাই। ভালোবাসা নিলে, অধিকার দিতে হয়।
.
লোহার গেইটটা সরালেই সামনে ছোট ছোট ঢেউয়ের কুঞ্চন, স্বচ্ছ জলরাশি। গেটের দু’ধারে কিছু গাছ। এইতো কয়েক কদম এগুলোই জলে ডুব দেয়া যায়। ওপারে ধীরেন্দ্রনাথ স্টেডিয়াম। সাথে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কুমিল্লার নাক উঁচু বিল্ডিংগুলো। জায়গাটা পৌর পার্ক আর ধমর্সাগর সংলগ্ন কুমিল্লা নজরুল ইন্সটিটিউট। ইন্সটিটিউটের পেছন দিকের এই মনোহর দৃশ্য চোখের প্রশান্তি। কড়ি আর ইমাদ নজরুল ইন্সটিটিউটের পেছনের এদিকটায় এসে কিছুক্ষণ বসেছিল। পাশাপাশি। পুরো আঙিনা জুড়ে ধাপে ধাপে টাইলস দেয়া বসার জায়গা তৈরী করা। চারিপাশে বড়, ছোট টবে সবুজের রাজত্ব। বড় বড় গাছ অভিভাবকের মতন ছায়া দিয়ে রেখেছে। তার উপর আকাশ। ইনস্টিটিউটের ভেতরে সাহিত্য অনুষ্ঠান চলছে। সেখান থেকে ভেসে এলো নজরুলের অমর সৃষ্টি,
“বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে
দিসনে আজই দোল,
আজও তার
ফুল কলিদের ঘুম টুটেনি
তন্দ্রাতে বিলোল।”
ইমাদ গেটটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কড়ি দাঁড়ালো গেটে চিবুক ঠেকিয়ে। ওভাবেই সে ইমাদকে দেখছে। অনেকক্ষণ। ইমাদও তাকিয়ে আছে তার দিকেই। ইমাদ তাকিয়ে থেকেই বলল, “প্রেমে পড়ে গেলেন নাকি?”
কড়ি পাল্টা প্রশ্ন করল, “কার?”
“আমার।”
“না তো।”
“আচ্ছা।”
“আপনাকে দেখছি বলে বললেন?”
“জি।”
“দেখছি কারণ আপনাকে আমি বিয়ে করব।”
“কেন?”
“অনেকগুলো কারণ।”
“শুনি?”
কড়ি হাসল, “এবার আর আচ্ছা বললেন না?”
ইমাদ নিরবে হাসলো। কড়ি বলল, “আমার জন্য আপনি আপনার এত বছরের, এত সাধনার খোদাই করা মূর্তিটা বিক্রি করতে গেছেন।”
“এজন্য বিয়ে করবেন?”
“আরো একটা কারণ আছে।”
“আপনি আপনার চোর বন্ধুকে এত ভালোবাসেন, বউকেও ভালোবাসার কথা।”
“বাসায় আপনি সব সত্যি বলে দিলেন কেন? না বললেও হতো।”
“আমি প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।”
“আচ্ছা।”
“ভেবেছিলাম ওদের পছন্দে বিয়ে করে প্রায়শ্চিত্ত করব। তা তো আর হচ্ছে না। তাই সব বলে দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করলাম। বিবেক বলেও তো একটা কথা থাকতে হয়।”
“আপনার সাথে আঙ্কেল এখন কথা বলেন?”
“হ্যাঁ, এখন একটু আধটু বলেন। প্রথম দিকে অনেকদিন কথাই বলেননি।”
“আর ভাইয়ারা?”
“বড় ভাইয়ার মায়া বেশি। ভাইয়া ঠিক হয়ে গেছেন। ছোট ভাইয়া এখনও খোঁচা মারে।”
“কাদিন ভাইয়া?”
“মেজো ভাইয়ার রাগ কঠিন। সময় লাগবে।”
“আমার জন্যই আপনার বিপদ হলো।”
“কি রকম?”
“আমাকে বিয়ে করবেন বলেই সবাইকে সব বলেছেন। আমি না থাকলে বলতেন না। ওদের পছন্দে বিয়ে করতেন। সব ঠিক থাকতো।”
“কিছু পেতে হলে, সবকিছু হারাবার সাহস রাখতে হয়।”
“আপনি সত্যিই আমার প্রেমে পড়েননি?”
“উঁহু।”
“তাহলে?”
“আপনাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। প্রেমে পড়া এত সহজ নাকি?”
“কঠিন কেন?”
“অনুভূতি ক্ষত হয়ে আছে।”
“আচ্ছা।”
“আপনার মত এত ভালো একটা মানুষ আমি কোথায় পাব বলুন?”
“আমি ভালো কে বলল?”
কড়ি উত্তরটা ইচ্ছে করেই দিলো না, “দেরি হচ্ছে। আজ আসি।”
ইমাদ বলল, “এক মিনিট।”
কড়ি প্রশ্নাতুর চোখে তাকাল। ইমাদ বলল, “আপনার গয়না এনেছি।”
কড়ি বিস্মিয়ে বলল, “পাথরের খোদাই করা মূর্তি কি আরেকটা বিক্রি করলেন?”
“না আর নেই।”
“তাহলে?”
ইমাদ পকেট থেকে গয়নাটা বের করে হাত বাড়িয়ে দিলো, “আপনার জন্য কড়ির গয়না।”
কড়ি হাত বাড়িয়ে গয়নাটা ছুঁলো। তবে হাতে নিলো না। মুক্তার মালায় কড়ি বসানো। নিজের নামের কারণেই হোক কিংবা যে কারণেই হোক কড়ি তার খুব পছন্দ। সমুদ্রের ছোট ছোট সামুদ্রিক শামুকের শক্ত খোলসটাকে কড়ি বলে। অনেকটা পোর্সেলিনের মত। পোর্সেলিন শব্দটিও এসেছে ইতালিয়ান শব্দ পোর্সেলিনা থেকে। যার অর্থ কড়ি।
কড়ি মুগ্ধ হয়ে বলল, “কোথায় পেলেন?”
“মুক্তো, আর কড়ি সমুদ্র থেকে চুরি করেছি।”
“তারপর?”
“বানিয়েছি।”
“কোথা থেকে বানালেন?” ইমাদের মুঠো খোলা হাতে ছড়িয়ে থাকা কড়ির গয়নায় কড়ি নরম আঙুলে ছুঁয়ে দিতে দিতে বলল। গয়না ছুঁতে ছুঁতেই আচমকা লেগে যাচ্ছে ওদের আঙুলে আঙুল। ইমাদ কড়ির আঙুল আর নিজের হাতের দিকে মনোনিবেশ করে বলল, “আমি বানিয়েছি।”
“আপনি? আপনি আর কি কি পারেন?”
ইমাদ হাসলো। কড়ি বলল, “আপনি কি ফ্রুট কার্ভিংও পারেন?”
“আপনি কীভাবে জানলেন?”
“মেজো ভাইশা ভাবির হলুদের ডালার সাজানো ফলের ডিজাইন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন।”
“আপনার বুদ্ধি ভালো।”
“ফ্রুট কার্ভিং, পাথরে মূর্তি খোদাই, গয়না বানানো, ইংরেজী কবিতা লেখা আর কি কি জানা বাকি আমার?”
ইমাদ দুষ্টু গলায় বলল, “ফ্লার্টও তো করতে জানি।”
কড়ি শব্দ করে হেসে ফেলল। ইমাদ ঘুরে কড়ির পেছন দাঁড়িয়ে গয়নাটা কড়ির গলায় পরিয়ে দিলো। কড়ি বলল, “থ্যাঙ্কস।”
ইমাদ শুনালো তার লেখা আরেকটা ইংরেজী কবিতা,
“Do you know how to dance in the rain?
How to love in the pain?
Do you know how pretty stars are?
how to love beyond fear?
I can give you the clue
From dark to blue.
Are you ready to fall in love?
Follow me,
I’ll show you how to be
I am in love with you already.
Are you ready to fall
And rise in love with me?”
#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্ব: ৭০
মুবিন একটু পর ডেকের চেয়ারেই বেহুঁশের মত ঘুমিয়ে পড়ল। ইমাদ অনেকক্ষণ ডাকল। মুবিন কিছুতেই চোখ খুলতে পারল না। কি হয়েছে ছেলেটার? জ্বরটর হয়নি তো। ইমাদ দেখল। না, জ্বর নেই। তটস্থ হয়ে আড্ডাটাড্ডা ভুলে গিয়ে মুবিনের পাশেই চিন্তিত মুখে আরেকটা চেয়ারে বসে রইল। তাকিয়ে দেখল রাতের আকাশ। কি বিশাল এই বিশ্বব্রহ্মান্ড! কত ক্ষুদ্র আমাদের জীবন। তারা আছে আকাশে? গুনতে বসল ইমাদ৷ যদি আকাশকে একসাথে ভাগ করে নেয়া যেত। মানুষ কেবল আলাদা হয়ে যাবার ভাগ করে। একসাথে ভাগ হোক না আকাশ। এটুকুর তারা আমি গুনব, তুমি গুনবে ওটুকু। সে বাকিটুকু। তাহলে যদি শেষ হয় এই তারা, জীবনের দুঃখগুলো। গহীনের যাতনা, ভেতরের যন্ত্রনা, নিরুপায় বেদনা। নিলয়ের হাঁক শুনে ইমাদ আকাশ থেকে মাটিতে নেমে এল, “বল।”
নিলয় খ্যাক করে উঠল, “এখানে একলা বসে পুত্র পাহারা দিচ্ছ নাকি বন্ধু?”
ইমাদ নিরস ভঙ্গিতে কথায় রস ঢেলে দিয়ে বলল, “মুবিনের চাচা, বসো। কথা বলি।”
নিলয় মুখ বিকৃত করে, কণ্ঠে বিষ ঢেলে দিয়ে বলল, “এই বিচ্ছু ছেলের চাচা ফাঁচা আমি হব না। পুত্র পাল্টা।”
ইমাদ আবার আকাশের দিকে তাকাল, “বস না।”
নিলয় পাশে বসল। দুজনেই বসে থাকল। ওরকমভাবে কথা বলল না কেউ’ই। নিলয় একটু পর অস্থির হয়ে বলল, “তুই সবসময় কথা বলব বলে কোনো কথা বলিস না।”
“বলি।”
“কবে? কখন? কোন জনমে?”
“আমি মনে মনে বলি।”
“কড়ির সাথে তো মনে মনে কথা বলো না। ঠিকই ফ্লার্ট করো। বন্ধুর বেলায় কেন এই অবহেলা?”
“কড়িকে না বললে ও বুঝবে!” ইমাদের কি হিম গলা!
“আর আমাকে না বললে আমি বুঝব?”
“হুম” ইমাদের ছোট্ট উত্তর। এই ছোট একটা উত্তরের ভেতর লুকিয়ে থাকা মহাবিশ্বের সমান ভালোবাসা, নির্ভরতা, বন্ধুত্ব নিলয়কে নাড়িয়ে দিলো। সে বলল, “আমি কি বুঝি না জানিস?”
“কি?”
“তোর মত দুর্বোধ্য কাউকে আমি কি করে এত ভালো বুঝতে পারি আমি এটাই বুঝি না।”
ইমাদ তখন ঘুমন্ত মুবিনের দিকে তাকিয়ে, “বন্ধু কখনো দুর্বোধ্য হয় না। যে বন্ধু দুর্বোধ্য সে বন্ধু, বন্ধু নয়। বন্ধুর কাছে কেউ’ই দুর্বোধ্য না। বড়জোর নির্বাক হতে পারে।”
“তুই কি আমার কাছে পানির মত স্বচ্ছ, ইমাদ?”
“না, কিন্তু পরিচিত অন্ধকার। যে অন্ধকারে হাতড়ে তুই সবকিছু বের করে ফেলতে পারিস।”
নিলয় হাসল, “কড়িও তোকে বুঝে। আমি চাইনকড়ির সাথে তোর কিছু একটা হোক।”
“কড়ি আমাকে বুঝে। কিন্তু যতটুকু বুঝে তারচেয়ে বেশি বুঝে বলে মনে করে। আর তুইও আমাকে বুঝিস। কিন্তু যতটুকু বুঝিস তারচেয়ে কম বুঝিস বলে মনে করিস।”
ইমাদের নির্বাক বন্ধুত্বে নিলয় কতক্ষণ আবেগে ইমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর পিঠ চাপড়ে বলল, “দোস্ত, এই কথা শোনার পর আজ রাতে আমাকে সুন্দরবনের বাঘে খেয়ে ফেললেও আমি খুশি।”
ইমাদ চেয়ারে হেলান দিয়ে চুপ হয়ে কি যেন ভেবেই চলেছে। নিলয় বলল, “ধুর এখানে বসে বসে ডিম পারছিস কেন? উঠ। রানা ভাইরা তোকে খুঁজতে পাঠিয়েছে। আড্ডার জন্য ডাকতে এসে নিজেরা আড্ডা পাতিয়ে বসে আছি।”
“না তুই যা। আমি এখানে থাকি।”
“কেন? তুই এখানে একা বসে থাকবি কেন? বউয়ের সাথে হানিমুনে তো আসিসনি। এসেছিস ইয়ার বন্ধুদের সাথে। একা থাকাটাকা অ্যালাউ করি না।”
“আচ্ছা।”
আচ্ছা বলেও ইমাদ বসে রইল। নিলয় ইমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “ধুর এই বিচ্ছুর জন্য টেনশন করিস না তো। এই বিচ্ছুর কিছু হয়নি।”
তারপর চেয়ারটা আরেকটু কাছে টেনে গলারস্বর খাদে নামিয়ে সাবধানী গলায় ফিসফিস করে বলল, “কিচ্ছু হয়নি ওর। টেনশন নিস না। ওর চায়ে ঘুমের ঔষুধ দিয়েছি।”
“আচ্ছা।”
“তুই কি রাগ করেছিস?”
ইমাদ কোনো উত্তর দিলো না। নিলয় বলল, “খুব জ্বালায়। আজকে সবাই মিলে আড্ডা দিব। ও নির্ঘাত গ্যাঞ্জাম একটা বাধাবে এজন্য সাইজ করলাম।”
“আচ্ছা।”
ইমাদ উঠল না। নিলয় বলল, “ভুল হয়েছে। মাফ কর না।”
“আচ্ছা।”
“তোর পালক পুত্রকে তো ঘুমই পারিয়েছি। আফিম তো দিইনি।”
“আচ্ছা।”
“কড়িকে বলব তোর যে নতুন ছেলে হয়েছে?”
“আচ্ছা।”
“আমাকে মার।”
“আচ্ছা।”
“লাথি দিয়ে ফেলে দে শিপ থেকে।”
“আচ্ছা।”
“মুবিন যে আমায় ল্যাং মারল। তখন কেন ওর সাথে রাগ করিসনি?”
“আচ্ছা।”
“আরে ভাই তুই চুপ থাক।”
“আচ্ছা।”
নিলয় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর ইমাদের পাশে বসে রইল। ইমাদকে শেষ পর্যন্ত নিতে পারল না আড্ডা দিতে। তাই নিজেও গেল না। একটু পর হেলান দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমালো নিলয়। ইমাদ ঘুমন্ত নিলয়, মুবিনের দিকে তাকিয়ে ভাবল দুজনকে একসাথে সামাল দিবে কি করে সে? একজন তার পালক পুত্র অন্যজন পালক বন্ধু!
.
ক্লাসে বসে অঙ্ক নোট করছিল মিলা। অভ্র বেঞ্চের পাশে এসে দাঁড়াল, “গত ক্লাসে এসেছিলে?”
মিলা বলল, “হ্যাঁ, এসেছি।”
“তোমার খাতাটা একটু দিও তো। আমি আসতে পারিনি।”
মিলা বলল, “ওহহো স্যরি। খাতা আনতে ভুলে গেছি।”
“ঠিক আছে পরের দিন নিয়ে এসো।”
অভ্র ফিরে গেল নিজের জায়গায়। ছুটির সময় মিলা ব্যাগ গোছাচ্ছিল তখনই ব্যাগ থেকে ফিজিক্স খাতাটা পড়ল। অভ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মিলার দিকে। মিলার এত মেজাজ খারাপ হলো। খাতাটাকে কেন এখনই পড়তে হলো! তবু নিজেকে শান্ত রাখল। অপ্রস্তুতভাবে খাতাটা অভ্রর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, “খাতা তো ব্যাগেই ছিল। খেয়াল করিনি।”
অভ্র খাতাটা নিয়ে বলল, “ইটস ওকে, দোস্ত।”
মিলা মনে মনে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “তুই আমার দোস্ত কবে থেকেরে? তুই তো আমার শত্রু।”
চলবে…