Friday, July 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 372



নিভৃতে তেজস্বিনী পর্ব-১৭

0

#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_১৭
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

“মিস্টার মাহতাব শাহরিয়ার শেখ আপনাকে এই মুহূর্তে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে।”

ঘুম থেকে উঠে বাসায় পুলিশকে দেখে যে অবাক মাহতাব হয়েছিল তার ঘোর কাটার আগেই নতুন করে অবাক হলো সে।

“আমাকে থানায় যেতে হবে? কিন্তু কেন? কী অপরাধ আমার?”

“আপনার নামে ফাইয়াজ রাহমান কেস করেছেন। বাকি কথা থানায় গিয়ে হবে। চলুন আমাদের সাথে।”

“কিন্তু অফিসার আমি কী করেছি? সেটা তো বলুন।”

“এত কথা আমরা এখানে বলতে পারব না। আপনি আমাদের সাথে থানায় চলুন। বাকি কথা ওখানেই জানতে পারবেন।”

মাহতাব আর কিছু বলতে পারে না। মাঝে নিমু এসে অনেক কিছু বললেও কোনো কাজ হয় না। পুলিশ জোর করে মাহতাবকে ধরে নিয়ে যায়।

সিরাত দূর থেকে সব দেখে মুচকি হাসে। নিমু মন খারাপ করে সোফায় বসে পড়ে।

থানায় গিয়ে মিস্টার ফাইয়াজ রাহমানকে বসে থাকতে দেখে মাহতাব দ্রুত বলে ওঠে,

“মিস্টার রাহমান এসবের মানে কী? আপনি কেন আমার নামে থানায় অভিযোগ করেছেন?”

“আপনার জন্য আমার কোম্পানির দশ লক্ষ টাকা লস হয়েছে। অর্ডার নিয়েও যথাসময়ে আপনি ডেলিভারি করেননি। আমাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েও এমন করার কারণে আপনার নামে আমি কেস করতে বাধ্য হয়েছি।”

“আপনার ম্যানেজার নিজে কল করে আমাকে ডেলিভারি দিতে মানা করেছে। লস তো হয়েছে আমার।”

“মিথ্যা বলছেন আপনি। আমার ম্যানেজার আপনাকে কল করে এসব বলেছে তার কোনো প্রমান আছে আপনার কাছে?”

“আমার ফোনে সব রেকর্ড করা আছে। এখনই দেখাচ্ছি আপনাকে।”

কথাটা বলে ফোন বের করে সবগুলো কল রেকর্ড চেইক করেও মিস্টার তৌহিদের সাথে কথা বলার রেকর্ড খুঁজে পায় না মাহতাব। হতাশ হয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়ে সে।

“আমার ফোনে কল রেকর্ড ছিল। এখন খুঁজে পাচ্ছি না।”

“যে কথা হয়ইনি তার রেকর্ড পাবেন কীভাবে?”

“আমি মিথ্যা বলছি না। আপনারা ইচ্ছা করে আমাকে ফাঁসাচ্ছেন!”

“আপনার মতো সাধারণ একজনকে ফাঁসিয়ে আমার লাভ কী? এসব কথা বন্ধ করুন৷ হয় আমার দশ লক্ষ টাকা আমাকে ফেরত দিন, নতুবা আপনাকে জেলে যেতে হবে।”

“মিস্টার ফাইয়াজ রাহমান ঠিকই বলেছে। আপনার কাছে এখন এই দুইটা উপায় আছে। যেকোনো একটা করতে হবে।”

পুলিশের কথা শুনে ঘাবড়ে যায় মাহতাব৷ এমনিতেই তার সময় খারাপ যাচ্ছে। ব্যবসা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে দশ লক্ষ টাকা জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব তার কাছে।

“কী হলো? চুপ করে আছেন কেন আপনি? টাকা ফেরত দেবেন নাকি জেলে যাবেন?”

“আচ্ছা আমাকে সাত দিন সময় দিন। আমি কথা দিচ্ছি এর মধ্যে আপনার সব টাকা আমি দিয়ে দিব।”

“মুখের কথায় তো আমি আপনাকে বিশ্বাস করব না।”

ফাইয়াজ রাহমান একটা কাগজ বের করে মাহতাবের সামনে রেখে বলে,

“এখানে সই করে দিন। সাত দিনের মধ্যে যদি আপনি দশ লক্ষ টাকা আমাকে না দেন তাহলে আমি আপনার বিরুদ্ধে লিগ্যাল অ্যাকশন নিতে বাধ্য হব।”

মাহতাব ভয়ে ভয়ে কাগজে সই করে দেয়। সে এখন সবদিক থেকে ফেঁসে গিয়েছে। যেদিকেই যাক না কেন, বিপদ তার পিছু ছাড়বে না এখন!

বাসায় ফিরে কারোর সাথে কোনো কথা না বলে ঘরে গিয়ে চুপচাপ দরজা লাগিয়ে দেয় মাহতাব। সিরাত কলে ফাইয়াজ রাহমানকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে।

নাবিহাকে কোলে নিয়ে একটা রেস্তোরাঁয় বসে আছে সিরাত। বিশেষ একজনের জন্য সে এখানে অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পর কাঙ্খিত মানুষটিকে আসতে দেখে হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে।

“আসসালামু আলাইকুম।”

“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আপনিই সিরাত?”

“জি আমিই সিরাত। বসুন প্লিজ।”

দু’জন মুখোমুখি বসে পড়ে। সিরাত তাদের জন্য দুই কাপ কফি আর একটা মিল্কশেক অর্ডার দেয় নাবিহার জন্য।

“মিস্টার রাফি, সরাসরি কাজের কথায় আসি আমরা?”

“জি অবশ্যই। আমাকে আগে বলুন তো, আপনি নিমুকে কীভাবে চেনেন?”

“সেই প্রশ্নের উত্তর পরে জানাব আপনাকে। আগে আপনি বলুন, নিমুর সাথে আপনার সম্পর্ক কী?”

“আমাদের বিষয়ে না জেনে নিশ্চয় আপনি আমার সাথে দেখা করতে আসেননি?”

“আমি সবকিছুই জানি। কিন্তু আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।”

“নিমু আমার প্রাক্তন স্ত্রী।”

“পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছিল আপনাদের?”

“না, আমরা দু’জন একে-অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম।”

“কতদিনের সম্পর্ক ছিল আপনাদের?”

“প্রেম আর বিয়ে মিলিয়ে এক বছর নয় মাসের সম্পর্ক ছিল।”

“আপনাদের বিবাহবিচ্ছেদ কেন হলো?”

“নিমুর ভাষ্যমতে আমি শারীরিকভাবে অক্ষম৷ তাই সে আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে।”

“সে ডিভোর্স চাইল আর আপনি ডিভোর্স দিয়ে দিলেন?”

“না দিয়ে উপায় ছিল না। এসব নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছে। কিন্তু আপনি এতকিছু জানতে চাইছেন কেন?”

“কারণ নিমু আমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী!”

সিরাতের কথা শুনে রাফি চমকে ওঠে। তার এমন চাহুনি দেখে সিরাত বলে,

“চার মাস হয়ে গেল আমার জীবনে এক ফোঁটা শান্তি নেই। এই চার মাসে একটা দিনও আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি। ওই মেয়েকে একা দোষ দিব না আমি। আমার স্বামী না চাইলে সে কিছুই করতে পারত না৷ এক হাতে তো আর তালি বাজে না। কিন্তু নিমু মাহতাবের কাছে যে পরিচয় দিয়ে বিয়ে করেছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। সে নিজের অতীত লুকিয়ে মাহতাবকে বিয়ে করেছে। আমি এসব কিছুই জানতে পারতাম না যদি না নিমুর বিষয়ে খোঁজ নিতাম। শুরু থেকেই ওই মেয়ের উপর সন্দেহ ছিল আমার। আর আজ সব সন্দেহ দূর হয়ে গেল।”

“নিমু আমাকে কখনোই ভালোবাসেনি। কেবল আমার অর্থ দেখে আমাকে বিয়ে করেছিল। কিন্তু করোনার সময় আমি চাকরি হারাই। আমার সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছিল ওই সময়। তখনই সে হাজার রকমের বাহানা দেখিয়ে আমার থেকে দূরে সরে গেল।”

“আপনি হয়তো ওর বিষয়ে আরো একটা কথা জানেন না যেটা আপনার জানা জরুরি।”

“কী কথা?”

“নিমু যখন আপনাকে ডিভোর্স দেয় তখন সে দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল। সে বাচ্চা চায়নি। বাচ্চা হলে আপনার সাথে ওর বিবাহবিচ্ছেদ হতো না। তাই সে বাচ্চাকে নষ্ট করে ফেলে। তার প্রমাণ আমার কাছে আছে।”

সিরাতের কথাটা যেন রাফি মেনে নিতে পারে না। তার মুখ থেকে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। রাফিকে হঠাৎ অস্বাভাবিকভাবে কাঁপতে দেখে সিরাত তাকে এক গ্লাস পনি এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ঠিক আছেন আপনি? প্লিজ শান্ত হন। এখন রাগ করার সময় নয়। আমাদের ঠাণ্ডা মা*থায় ওদের শাস্তি দিতে হবে। রাগ করলে আপনারই ক্ষতি হবে। আপনার সাথে যে মানুষটা অন্যায় করেছে সে কিন্তু দিব্যি ভালো থাকবে। তাই যা করবেন ভেবেচিন্তে করুন।”

ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে নেয় রাফি। রাগে তার মস্তিষ্ক কাজ করছে না।

“আমি ওই মেয়েকে ছাড়ব না। প্রথমে আমার জীবন নষ্ট করেছে। আর তারপর আমার নিষ্পাপ বাচ্চাটা দুনিয়ার আলো দেখার আগেই তাকে মে*রে ফেলল!”

“আপনি এই বিষয়ে কিছুই জানতেন না তাই না?”

“না, আমি কিচ্ছু জানতাম না। আমার বাচ্চা ওর গর্ভে বড়ো হয়ে উঠছিল আর আমি সেটা কখনো জানতেই পারিনি। জানলে হয়তো আমার বাচ্চাকে আমি এভাবে শেষ হতে দিতাম না!”

কথাটা বলে বাচ্চাদের মতো কেঁদে ওঠে রাফি। সিরাত তাকে স্বান্তনা দেওয়ার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। একজন মা কীভাবে তার সন্তানকে শেষ করতে পারে সেটা বুঝে উঠতে পারে না সে!

“আমি বুঝতে পারছি আপনার মনের অবস্থা। কিন্তু এই মুহূর্তে ভেঙে পড়া কোনো সমাধান নয়। আমিও এক বাচ্চার মা। বাচ্চা হারানোর কষ্ট কেমন হতে পারে সেটা অনুভব করতে পারি আমি। নিমুর মতো মেয়েরা কেবল টাকা আর আভিজাত্য বোঝে। আমি নিশ্চিত, আমার স্বামী ওর এসব বিষয় জানে না। জানলে কখনোই ওকে বিয়ে করত না। তাই ওই মেয়ে যা যা অন্যায় করেছে তার জন্য মারাত্মক শাস্তি প্রাপ্য ওর!”

চলবে??

নিভৃতে তেজস্বিনী পর্ব-১৬

0

#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_১৬
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

“মেয়েরা হলো টিস্যুর মতো। ব্যবহার শেষে ছুঁড়ে ফেলতে হয়। এক মেয়ের সাথে সম্পর্ক ততদিনই রাখা উচিত যতদিন না সেই মেয়েকে বিছানা অবধি নিয়ে যাওয়া যায়। কাজ শেষ তো ছুঁড়ে ফেলে দাও। আর যারা বিছানা অবধি যাবে না তাদের তিলে তিলে শেষ করা উচিত আমাদের বীরপুরুষের মতো ছেলেদের সময় নষ্ট করার জন্য!”

সিরাতের কথা শুনে উপস্থিত সবাই অবাক চোখে তাকায় তার দিকে৷ তুরাগের গালে হাত দিয়ে সিরাত আদুরে কণ্ঠে বলে,

“কী? তাই না তুরাগ? আরে তুরাগের মতো ছেলেদের তো তুলনা হয় না। একজন ছেলে একসাথে এতজন মেয়ের সাথে সময় কাটাতে পারে, এটা তো গর্বের বিষয়। অনেকে একজনকেই সামলাতে পারে না। সেখানে সে এক নয়, দুই না, তিন তিনজন মেয়ের সাথে সম্পর্কে যুক্ত। ব্যাপারটা সুন্দর না?”

সিরাতের কথায় তুরাগ চমকে ওঠে। আরেকজনের কথা এই মেয়ে কীভাবে জেনে গেল!

মাওয়া সিরাতের কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,

“তিনজন মানে? এসব কী বলছিস তুই?”

“তোরা কেউ আমার কথা বুঝতে পারছিস না তাই না? আচ্ছা আমি বুঝিয়ে বলছি। তোরা এক কাজ কর, প্রত্যেকে ফোনের ক্যামেরা অন কর। ইভান, নাবিল আর অভি তোরা তিনজন সামনের গ্যারেজে গিয়ে কিছু পে*ট্রল আর সাইকেলের চেইন নিয়ে আয় যা।”

“এসব দিয়ে তুই কী করবি?”

“আহা নাবিল এত প্রশ্ন করছিস কেন? যা বলছি সেটা কর।”

ইভান, নাবিল আর অভি সিরাতের কথামতো গ্যারেজে চলে যায়। সিরাত তুরাগের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে,

“তরুলতার কথা মনে আছে তুরাগ?”

তুরাগ চোখ বড়ো করে তাকায় সিরাতের দিকে। ঢোক গিয়ে বলে,

“তরুলতা কে?”

“ওমাহ্ এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন স্যার? কিছুদিন আগেই না তরুলতাকে বললেন তাকে আপনি ভীষণ ভালোবাসেন। তাকে বিয়ে করতে চান।”

তুরাগ কিছু না বলে চুপ করে থাকলে সিরাত পুনরায় বলে ওঠে,

“এখনো মনে পড়ছে না? আচ্ছা আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। গত দুই মাস আগে অনলাইনে আপনার একজনের সাথে পরিচয় হয়েছিল। আপনারা দু’জন বেশিরভাগ সময় একে-অপরের সাথে কথা বলে সময় কাটাতেন। এইতো সতেরো দিন আগে আপনি তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিলেন। আপনাদের তো আগামী শনিবার দেখা করারও কথা ছিল। এখন মনে পড়ছে কিছু?”

“তুমি এতকিছু জানলে কীভাবে?”

“যাক, ভুলে যাননি তাহলে। আমি সবকিছু জানি। কারণ সেই তরুলতা আর কেউ নয়, আমি নিজেই ছিলাম স্যার।”

ভয়ে দুই পা পিছিয়ে যায় তুরাগ। সিরাত মুচকি হেসে এগিয়ে যায় তার দিকে।

“ভয় পেলেন স্যার? আসলে আপনার উপর আমার শুরু থেকেই সন্দেহ ছিল। আমি মাওয়াকে অনেক বার বলেছিলাম আপনার থেকে দূরে থাকতে। কিন্তু মাওয়া শোনেনি আমার কথা। সে ভালোবাসার টানে আমার কথা অগ্রাহ্য করেছিল। অবশ্য এতে ওর কোনো দোষ নেই। আমাদের বয়সটাই এমন আবেগের। আমার বান্ধবী যেহেতু আমার কথা শোনেনি তাই পরীক্ষা করার জন্য আমি নকল তরুলতা সেজে আপনার সাথে কথা বলা শুরু করি। আমার কণ্ঠস্বর চিনতে পারেননি, কারণ আমি কণ্ঠ বদলাতে পারি। আর রইল ছবির কথা। সেই ছবিগুলো আমার ছিল না। আমার পরিকল্পনা তেমন শক্তপোক্ত ছিল না। তবুও আপনি আমার পাতা ফাঁদে পড়েই গেলেন।”

সবকিছু শুনে তুরাগের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না আঠারো বছর বয়সী ছোট্ট একটা মেয়ে তাকে এভাবে ঘোল খাইয়ে দিল!

মাওয়া ধীর পায়ে এগিয়ে আসে সিরাতের দিকে। অতঃপর কান্নাগুলো চেপে রাখার বৃথা চেষ্টা করে তাকে প্রশ্ন করে,

“তুই যদি সব আগে থেকেই জানতিস তাহলে আমাকে কেন বললি না?”

“শনিবারে প্রমাণসহ দেখাতে চেয়েছিলাম তোকে। কিন্তু তার আগেই নকশি অন্য একজনের সাথে একে দেখে ফেলল।”

“আমরা এসে গিয়েছি।”

সবকিছু নিয়ে অভিদের আসতে দেখে সেদিকে এগিয়ে যায় সিরাত। নাবিলের হাত থেকে সাইকেলের চাবি নিয়ে হাতে পেচিয়ে তুরাগকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“মেয়েদের কেবল বিছানাতেই মানায় তাই না? তারা তো ভোগ করার বস্তু আপনার মতো ছেলেদের কাছে।”

কথাটা বলে মুহূর্তের মধ্যেই পরপর তিনবার সাইকেলের মোটা চেইন দিয়ে সজোরে আঘাত করে তুরাগের শরীরে। ব্যথায় চিৎকার করে ওঠে সে। আশেপাশের প্রত্যেকের চোখ ততক্ষণে স্বাভাবিকের চেয়ে বড়ো হয়ে গিয়েছে। আরো তিন/চারবার আঘাত করার পর তুরাগ ব্যথায় রাস্তার মাঝে শুয়ে পড়ে। সিরাত রাগে কাঁপতে কাঁপতে হাঁটু গেড়ে বসে তুরাগের গাল চেপে ধরে।

“মেয়েরা মায়ের জাত। তাদেরকে সম্মান করতে হয়, শ্রদ্ধা করতে হয়, ভালোবাসতে হয়। অসভ্যতামি করে কিংবা প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে বিছানা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া কোনো বীরপুরুষের কাজ নয়। তোদের মতো ছেলেরা যদি এই পৃথিবীর বুকে বেঁচে না থাকে তাহলেই বোধহয় সবচেয়ে বেশি ভালো হয়।”

কথাটা বলে আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে তুরাগের বিশেষ জায়গায় ইচ্ছামত লাত্থি দিতে শুরু করে সিরাত। মাওয়া ভয় পেয়ে ছুটে গিয়ে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করে সিরাতকে। কিন্তু তাকে কিছুতেই আটকানো যায় না। অভি গিয়েও সামলাতে পারে না তাকে। বাধ্য হয়ে ইভান তারিনকে ইশারা করে সিরাতের কাছে যাওয়ার জন্য। এখন সে নিজে গেলে সিরাতের কাছে গেলে সে আরো বেশি রেগে যাবে।

তারিন গিয়ে কোনোরকমে টেনেহিঁচড়ে সরিয়ে নেয় সিরাতকে। তুরাগ প্রচন্ড ব্যথায় কাতরাতে থাকে রাস্তার মাঝে।

“এদের মতো ছেলেদের জন্য মানুষ ভালোবাসতে ভয় পায়। আমরা মেয়েরা একা বাইরে বের হতে ভয় পাই। এদের জন্যই পর*কীয়ার মতো জঘন্য একটা বিষয় তরতরিয়ে বাড়ছে। এরা পৃথিবীতে বসবাস করার অযোগ্য।”

চিৎকার করে কথাগুলো বলে থেমে যায় সিরাত। তার হাত বেয়ে র*ক্ত পড়ছে। সাইকেলের চেইন এত জোরে চেপে ধরার ফলে হাত কেটে গিয়েছে। সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। সে নিজ মনে বলে যায়,

“চরিত্রহীন পুরুষেরা তখনই বেশি সাহস পায় যখন মেয়েরা নিজেদের সতিত্ব নির্দ্বিধায় বিসর্জন দেয় এদের কাছে। আরে মেয়ে, তুমি কেন বিয়ের আগে প্রেমিকের সাথে ঘনিষ্ঠ হবে? তুমি কেন তোমার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ তার হাতে তুলে দেবে যে কি-না ভালোবাসার নামে সুযোগ নেয়। তুমি কি এতটা সস্তা যে বিয়ের আগে সতিত্ব হারিয়ে প্রেমিক দূরে সরে গেলে আত্মহ*ত্যা করবে? এই যদি হয় মেয়েদের অবস্থা তাহলে আমি বলব, আফসোস সেই বাবা-মায়ের জন্য যারা তোমাদের মতো মেয়েদের জন্ম দিয়েছে। তোমরা তো মেয়ে হওয়ারই যোগ্য না। মেয়েদের কখনো নরম তুলা হতে হয় না। মেয়েদের হতে হয় সূর্যের মতো প্রখর। মেয়েদের হতে হয় তেজস্বিনী। তবেই না তুমি হবে আদর্শ মেয়ে!”

উপস্থিত প্রতিটা মেয়েকে মা*থা নত করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সিরাত র*ক্তলাল হাতে চোখের পানি মুছে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর একজন এসে সিরাতের হাতে একটা ফাইল দিলে সেটা নিয়ে পুনরায় তুরাগের সামনে গিয়ে বলে,

“এখানে তোর সমস্ত সার্টিফিকেট আছে। তোর মতো ছেলে কোনো পেশায় যাওয়ার যোগ্য নয়। তাই এসব রেখেও কোনো লাভ নেই।”

সিরাত ফাইল থেকে সমস্ত কাগজ বের করে তুরাগের সামনে রাখে। তারপর পে*ট্রল দিয়ে জ্বা*লিয়ে দেয় সবকিছু। তুরাগ চেয়েও আটকাতে পারে না তার সর্বনা*শ!

মাওয়া কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে নিজের গালে থা*প্পড় দেয়। সিরাত পাশে বসলে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“আমাকে মাফ করে দে দোস্ত। আমি মিথ্যা ভালোবাসার মোহে আটকে তোকে ভুল বুঝেছিলাম। নিজের এত বড়ো ক্ষতি করে ফেলেছি কেবল তোর কথা শুনিনি বলে। আমাকে মাফ করে দে তুই।”

শেষ হয়ে যায় ভিডিয়ো। মাহতাব নিষ্পলক চেয়ে আছে ল্যাপটপের দিকে। তার কাছে মনে হচ্ছে সে এতক্ষণ কোনো অ্যাকশন মুভি দেখছিল। একজন মেয়ের এমন রূপ বাস্তবে এর আগে সে কখনোই দেখেনি। আর আজ যখন দেখল তখন জানতে পারল মেয়েটা তার নিজের স্ত্রী!

“সিরাত সেদিন আমার সাথে যা করেছিল তার জন্য আমি আমার পুরুষত্ব হারিয়েছি। হারিয়েছি পরিবার, হারিয়েছি মানসম্মান, হারিয়েছি চাকরি, হারিয়েছি ভালোবাসা, হারিয়েছি বেঁচে থাকার কারণ। আমি আজও বেঁচে আছি শুধুমাত্র সিরাতের মুখোমুখি হওয়ার জন্য। সেদিনের পর আমি বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ছিলাম। তারপর সুস্থ হয়ে তন্নতন্ন করে সিরাত আর মাওয়াকে খুঁজেছি। কিন্তু ওদের কোথাও পাইনি। একবার যখন সিরাতকে পেয়েছি তখন আমি নিশ্চিত মাওয়াকেও পাব। আর তারপর ওদের কাউকে আমি ছাড়ব না।”

“মানে? কী করবি তুই?”

“মাহতাব তুই না ভীষণ বোকা। আরে যে মেয়ে বান্ধবীর জন্য এমন করতে পারে সে তোকে এমনি এমনি ছেড়ে দেবে যখন তুই ওর স্বামী?”

“কী বলতে চাইছিস তুই?”

“আমি যতদূর সিরাতকে চিনি, ওই মেয়ে তোকে এমনি এমনি ছেড়ে দেবে না। তোর জীবন ধ্বং*স না করে থামবে না।”

“কিন্তু সিরাত তো এখনো চুপচাপই আছে।”

“এটাই তো সমস্যা। ওই মেয়ে চুপচাপ আছে মানে তোর জন্য খুব খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে।”

“তাহলে আমি এখন কী করব?”

“ওর থেকে বাঁচতে হলে ওকে বাঁচতে দেওয়া যাবে না।”

তুরাগের কথায় মাহতাব অবাক হয়ে বলে,

“মানে?”

“সিরাত বেঁচে থাকা মানে তোর মৃ*ত্যু। তাহলে তোকে বাঁচার জন্য কী করতে হবে? ভেবে দেখ!”

“ভাই সিরাত আমার সন্তানের মা। আমি ওকে মা*রতে পারব না। এসব দয়া করে আমাকে বলিস না।”

কথাটা বলে চলে যায় মাহতাব। তুরাগ চুপচাপ পেনড্রাইভ ঘুরিয়ে আপনমনে বলে,

“আমি যখন ফিরে এসেছি তখন তো সিরাতের বেঁচে থাকা কঠিন মাহতাব। তুই চাইলেও আমাকে আটকাতে পারবি না ভাই!”

চলবে??

নিভৃতে তেজস্বিনী পর্ব-১৫

0

#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_১৫
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

“কী ব্যাপার তুরাগ? তুই এভাবে আমাকে ডাকলি কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে?”

তুরাগ কপালে হাত ঠেকিয়ে শান্ত স্বরে প্রশ্ন করে,

“তোর প্রথম স্ত্রীর নাম কি মুমতাহিনা ইসলাম সিরাত?”

মাহতাব সাতপাঁচ না ভেবে উত্তর দেয়,

“হ্যা, কেন কী হয়েছে?”

তুরাগ এক দৃষ্টে মাহতাবের দিয়ে চেয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর পুনরায় প্রশ্ন করে,

“সিরাত থাকতে তুই দ্বিতীয় বিয়ে কীভাবে করলি? ওই মেয়ে এখনো তোকে বাঁচিয়ে রেখেছে?”

“এসব কী বলছিস তুই? বাঁচিয়ে রাখবে না কেন? আর এক মিনিট, তুই কি কোনোভাবে সিরাতকে চিনিস?”

“শুধু সিরাতকে নয়, ওর পুরো বন্ধুমহলকে চিনি। খুব ভালো করেই চিনি।”

“কীভাবে চিনিস?”

তুরাগ কোনো উত্তর দেয় না। তার চোখমুখ অস্বাভাবিকভাবে লাল হয়ে আছে। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে সে। মাহতাব বন্ধুর এমন অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করে,

“এই কী হয়েছে তোর? পুরো বিষয়টা পরিষ্কার করে বল তো আমাকে।”

লম্বা শ্বাস নিয়ে তুরাগ বলে,

“তখন আমি অনার্স শেষ করে সবেমাত্র চাকরি করা শুরু করেছি। ভালো পড়াশোনার জন্য সবার পছন্দের ছিলাম। অনার্স তৃতীয় বর্ষে থাকাকালীন সময়ে আমি মাওয়ার প্রেমে পড়ি। ওর পুরো নাম তাসফিয়া তাবাসসুম মাওয়া। আমি একটা কোচিং সেন্টারে পড়াতাম। সেখানে মাওয়া কোচিং করত। পরিচয়ের সূচনা সেখান থেকেই হয়েছিল। ওর চঞ্চল স্বভাব, কথা বলার ধরণ আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। ধীরে ধীরে বুঝতে পারি, আমি ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পরেছি। এক সময় অনেক সাহস করে ওকে প্রেমের প্রস্তাব দিই। প্রথমে মাওয়া রাজি হয়নি। প্রায় মাস তিনেক পর আমার প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছিল মাওয়া। সেই থেকে প্রেমের শুরু। সবকিছু ভালোই যাচ্ছিল। প্রায় সাত মাস ভালোভাবে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর!”

থেমে যায় তুরাগ। মাহতাব কৌতুহলী কণ্ঠে বলে,

“তারপর?”

“সাত মাস পর থেকে আমার আর ওকে ভালো লাগত না। আমি ওর সাথে সম্পর্কে থাকাকালীন সময়ে আরেকজন মেয়ের সাথে জড়িয়ে পড়ি। ওই মেয়ের সাথে শারীরিক সম্পর্ক অবধি তৈরি হয়েছিল আমার। এসবের কিছুই মাওয়া জানত না। বেশ কিছুদিন আমি দুইটা সম্পর্ক সমানতালে চালিয়ে যাই। কিন্তু এসব বিষয় বেশিদিন গোপন থাকেনি। একদিন উর্মি আমাদের একসাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলে। মুহূর্তের মধ্যে মাওয়া এবং ওর বন্ধুমহলের সবার কাছে এই খবর পৌঁছে যায়।”

“ভাই তুই মেয়েটাকে ঠকালি কেন?”

“বললাম না? মাওয়ার প্রতি আর কোনো অনুভূতি কাজ করছিল না আমার।”

“আচ্ছা তারপর কী হলো?”

“আমার এখনো মনে আছে দিনটা ছিল বুধবার। সন্ধ্যাবেলা আমি আমাদের আড্ডার জায়গায় বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। কোথা থেকে যেন সিরাত এসে কোনোকিছু না বলেই আমাকে একের পর এক থা*প্পর দিতে শুরু করে। থা*প্পড়ের জোর এত বেশি ছিল যে আমার ঠোঁট কেটে র*ক্ত বের হচ্ছিল। আমি কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে সিরাতকে থামিয়ে প্রশ্ন করি, আমাকে এভাবে আঘাত করার কারণ কী? তখন পাশ থেকে মাওয়া উত্তর দেয়, আমাকে ঠকানোর কি খুব দরকার ছিল তুরাগ? মাওয়ার কথা শুনে আমি ঘাবড়ে যাই। বুঝে গিয়েছিলাম মাওয়া সব জেনে গিয়েছে। আমি তৎক্ষণাৎ পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করি। কিন্তু পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়। চারপাশে প্রচুর মানুষ জমে যায়। আমি সেদিন সিরাতের হিং*স্র রূপ দেখেছিলাম। দেখেছিলাম বন্ধুমহলের এক অন্য রূপ। জানিস? আমি আজও সেই দিনটা ভুলতে পারিনি। আমার সাথে সেদিন যা হয়েছে তার জন্য আজও ভুগছি আমি। আমার পুরো জীবনটা শেষ হয়ে গিয়েছে ওদের জন্য।”

“কী হয়েছিল সেদিন? আমাকে সবকিছু বিস্তারিত বল।”

“ওই ঘটনার সবটুকু এখনো ভিডিয়ো আকারে আমার কাছে আছে। ভিডিয়ো ভাইরাল হয়েছিল তখন প্রচুর বাজেভাবে। দেখবি তুই?”

মাহতাব কোনোকিছু না ভেবেই উত্তর দেয়,

“হ্যা দেখব আমি।”

“তাহলে আমার বাড়িতে চল।”

“আচ্ছা।”

তুরাগ মাহতাবকে নিয়ে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। অন্যদিকে সিরাত এসেছে মাওয়ার সাথে দেখা করতে।

“মাওয়া চুপ করে থাকবি না। সেদিনের পর কী হয়েছিল? বল আমায়।”

মাওয়া নাক টেনে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করে বলে,

“তুরাগের সাথে ঝামেলার পর বাবা আমার বিয়ে দিতে চায়। পাত্র ঠিক হয়ে গিয়েছিল সেটা তোরা জানিস। বিয়ের জন্য কুষ্টিয়ায় আমাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যাই আমরা। বাবা খুব কড়াভাবে নিষেধ করে দিয়েছিল যেন তোদের সাথে আর কোনো প্রকার যোগাযোগ না রাখি আমি। বাধ্য হয়ে কাউকে কিচ্ছু জানাতে পারিনি। কিন্তু বিয়েটা আমি মন থেকে মানতে পারছিলাম না। বাবা-মাকে অনেক বুঝিয়ে, অনুরোধ করে আমি বাইরে পড়তে যাওয়ার জন্য রাজি করাই। সেখানেও তারা শর্ত দেয়, ভালোভাবে পড়াশোনা করে তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে না পারলে আমাকে আর মেয়ে হিসেবে মানবে না। এমনিতেই আমার জন্য তাদের অনেক সম্মানহানি হয়েছে। আমি সব মেনে নিয়ে চলে যাই বাংলাদেশ ছেড়ে। এরপর টানা পাঁচ বছর বলা যায় বন্দী জীবন কাটিয়েছি আমি।”

কথা বলা শেষ হওয়ার আগেই মাওয়া ডুকরে কেঁদে ওঠে। সে আর পারছে না কষ্টগুলো নিজের মধ্যে চেপে রাখতে। দীর্ঘ পাঁচটি বছর নিজের সাথে লড়াই করে আজ সে ক্লান্ত, ভীষণ ক্লান্ত!

মাওয়াকে জড়িয়ে ধরে সিরাত বলে,

“আঙ্কেলকে হাজার বার বুঝিয়েও আমি তোর আর অভির সম্পর্কের কথা আগাতে পারিনি। আমি চেয়েছিলাম আঙ্কেলকে আগে রাজি করাতে। তারপর তোকে বলতে চেয়েছিলাম, অভি তোকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু আমি এসব কিছুই করতে পারিনি। তারপর আমি নিরুপায় হয়ে অভিকে বোঝাই, তোকে যেন ভুলে যায়। তোদের সম্পর্ক হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ফলস্বরূপ অভি ভেবে নেয় আমি হয়তো নিজেই চাইনি, তোদের মাঝে সম্পর্ক হোক। এভাবে দিনের পর দিন ভুল বুঝে অভি দূরে সরে গেল আমার থেকে। আর এরপরের গল্পটা তোদের সবারই জানা।”

“আমার জীবন তো নষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু তুই হটকারিতায় এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললি যার জন্য নিজের সাথে সাথে তোর মেয়ের জীবনও এখন ঝুঁকির মুখে।”

“আমি মা হয়ে কখনোই চাইব না যে আমার মেয়ের জীবনটা নষ্ট হয়ে যাক!”

“আচ্ছা সিরাত তোর মাহতাবকে বিয়ে করার কারণ কী ছিল?”

“আমি পরিবারের পছন্দে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। মাহতাবের বাবা আমাকে আগে থেকেই চিনত। সেই সুবাদে বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। আমার পরিবারের সবাই রাজি হয়ে যায়। আর আমারও মাহতাবের সাথে কথা বলে ওকে ভালো লেগে যায়। তাই এত না ভেবে বিয়েটা করে ফেলি।”

“এখন কী করতে চাইছিস তুই?”

“আমার কথা বাদ দে। তুই বল এভাবে আর কতদিন চলবে? জীবনটা কি এভাবেই কাটিয়ে দিবি? বিয়ের কথা ভাববি না?”

মাওয়া তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,

“আর বিয়ে!”

“অভিকে কি একটা সুযোগ দেওয়া যায় না মাওয়া?”

মাওয়া সিরাতের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসে। অতঃপর কিছু না বলে সিরাতের কাছ থেকে উঠে চলে যায়। সিরাত বসে থেকে এক নজরে মাওয়ার চলে যাওয়া দেখে। কিন্তু হাজার চেয়েও আটকাতে পারে না তার চলে যাওয়াকে।

“আমরা প্রত্যেকে আমাদের জীবনে এমন অনেক ভুল করি যার খেসারত জীবনের শেষ সময় অবধি দিতে হয়। জীবনের কোনো কোনো সিদ্ধান্ত যদি ভেবেচিন্তে তারপর নিতাম তাহলে হয়তো বর্তমানে এসে অতীতের জন্য আমাদের আফসোস করতে হতো না। আমরা পেতাম একটা সুন্দর জীবন। আমরা পেতাম একটা সুন্দর বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ!”

চলবে??

নিভৃতে তেজস্বিনী পর্ব-১৪

0

#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_১৪
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

“আমরা আর আপনার ফ্যাক্টরিতে কাজ করব না স্যার।”

“হঠাৎ করে কেন তোমরা এমন করছ?”

“আপনি নিয়মিত আমাদের পারিশ্রমিক দেন না। তাছাড়া আমাদের সাথে ভালো ব্যবহারও করেন না। এমন মানুষের সাথে আমরা কোনো কাজ করব না।”

“আজ থেকে আমরা আপনার সাথে কাজ করা বন্ধ করে দিলাম। আগে নিজের ব্যবহার ঠিক করুন। তারপর ব্যবসা করতে আসবেন। আসি স্যার!”

শ্রমিকদের কোনো কথায় যেন বুঝতে পারে না মাহতাব। তারা মা*থা ঘুরছে। কোনো রকমে চেয়ারে বসে সে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। আজ থেকে তার ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ এখানে তো আর কোনো শ্রমিকই নেই। কীভাবে চলবে এই ফ্যাক্টরি!

গত এক মাস যাবত তার সাথে যা হচ্ছে সব খারাপ হচ্ছে। ব্যবসায় একের পর এক লস, এরপর শ্রমিকদের দল বেঁধে চলে যাওয়া। সবকিছু মিলিয়ে মাহতাব মুহূর্তের মধ্যেই যেন মিশে গেল মাটির সাথে।

সারাদিন আর বাসায় ফেরে না মাহতাব। একটা বারে বসে ম*দ্যপান করে ঘন্টার পর ঘন্টা। পাশেই তার কয়েকজন বন্ধু বসে আছে। তুরাগ নামের একজন প্রশ্ন করে,

“হঠাৎ করে তোর এমন দুরাবস্থা হলো কীভাবে?”

মাহতাব মা*তাল কণ্ঠে উত্তর দেয়,

“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না রে। কয়েক মাস আগেও সব ঠিক ছিল। আমি নিমুকে বিয়ে করার পর থেকেই আমার জীবনে নেমে এলো বিপর্যয়।”

“কিন্তু তুই তো বলেছিলি তোর বউ অনেক ভালো। তোদের তো একটা মেয়েও আছে।”

“নিমু আমার দ্বিতীয় স্ত্রী!”

“কী বলছিস তুই? দ্বিতীয় স্ত্রী মানে? তুই আরেকটা বিয়ে করলি কবে?”

“এই বিয়েটা এক প্রকার বাধ্য হয়েই করেছি আমি।”

মাহতাবের কথার মানে কেউই বুঝতে পারে না। রবিন নামের একজন জিজ্ঞেস করে,

“ঘটনা কী বল তো?”

“শোন তাহলে। প্রায় দেড় বছর আগে অনলাইনে নিমুর সাথে পরিচয় হয় আমার। প্রথম প্রথম তেমন কথা হয়নি। একদিন ওর ছবি দেখে প্রশংসা করি আমি। সেই থেকে নিয়মিত কথা শুরু হয় আমাদের। সিরাত আমার প্রথম স্ত্রী। ওর সাথে আমার সম্পর্ক ভালোই ছিল। কিন্তু তারপরেও আমি নিমুর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ি। নাবিহা হওয়ার পর সিরাতের মনমেজাজ প্রায় সময় খিটখিটে হয়ে থাকত। আমার কাছে আসতে চাইত না সহজে। ফলে ওর প্রতি ক্রমশ আগ্রহ হারিয়ে ফেলি আমি। নিমু রাজশাহীর মেয়ে। একদিন ওকে আমি দেখা করার কথা বলি। নিমুও রাজি হয়ে যায়। আমি সিরাতকে অফিসের কাজের কথা বলে চলে যাই রাজশাহী। প্রথম দেখাতেই আমরা একে-অপরের অনেকটা কাছাকাছি চলে আসি। এরপর প্রায়ই ওর সাথে দেখা করতে যেতাম আমি। এভাবে কয়েক মাস কেটে যায়। এক রাতে নিমু আমাকে কল দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ওর বাসায় ঘনঘন ছেলে মানুষকে আসতে দেখে বাড়িওয়ালা এবং পাড়াপ্রতিবেশি ঝামেলা করছে। এখন ওকে বিয়ে না করলে ওর বাঁচা কঠিন হয়ে যাবে। আমি যদি ওকে ভালোবাসি, তাহলে যেন বিয়ে করি। আবেগের বশবর্তী হয়ে আমিও ওকে বিয়ে করে ঢাকায় নিয়ে আসি। এসবের কারণে সিরাতের সাথে আমার সম্পর্ক প্রায় শেষ হয়ে যায়। তার উপর বাবা রাগ করে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। আমার ব্যবসার উপরেই সংসার চলছিল। এখন ব্যবসাও বন্ধ। আমি তো পথে বসে গেলাম!”

বিরতিহীনভাবে কথাগুলো বলে থেমে যায় মাহতাব। অতিরিক্ত নে*শার ফলে ঠিকমতো চোখ মেলে তাকাতেও পারছে না সে। সব শুনে তুরাগ বলে,

“সুখে ছিলি, সেটা পছন্দ হলো না তোর। তাই খাল কেটে কু*মির আনলি ঘরে।”

মাহতাব কিছুই শুনতে পায় না। ঢলে পড়ে রবিনের গায়ে। তুরাগ সেদিকে তাকিয়ে বলে,

“চল ওকে ওর বাসায় দিয়ে আসি।”

“তুই মাহতাবের বাসা চিনিস?”

“একদিন ঠিকানা দিয়েছিল। আগে কখনো যাইনি।”

“ঠিকানা যখন আছে তাহলে চল।”

বাসার সামনে এসে কলিংবেল বাজাতেই নিমু এসে দরজা খুলে দেয়। সিরাত রান্নাঘরে ছিল। মাহতাবকে মা*তাল অবস্থায় দেখে নিমু জিজ্ঞেস করে,

“ওর এই অবস্থা হলো কীভাবে? আর আপনারা কে?”

নিমুর প্রশ্নের জবাবে তুরাগ বলে,

“আমরা মাহতাবের বন্ধু। আসলে আজকে বেশি খেয়ে ফেলেছে। এজন্য নিজেকে সামলাতে পারেনি। তাই আমরা নিয়ে এলাম ওকে।”

“আচ্ছা ওকে ঘরে নিয়ে চলুন। আসুন আমার সাথে।”

মাহতাবকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসে দু’জন।

“আপনাদের ওয়াশরুম কোনদিকে? একটু চোখেমুখে পানি দিতাম।”

নিমু তুরাগকে ওয়াশরুম দেখিয়ে দিলে সে গিয়ে চোখেমুখে পানি দেয়। ওয়াশরুমের পাশেই রান্নাঘর। তুরাগ বের হওয়ার সময় রান্নাঘরে সিরাতকে দেখে চমকে ওঠে। তাড়াতাড়ি রবিনকে নিয়ে বের হয়ে যায় বাসা থেকে। যাওয়ার আগে নিমুকে বলে যায়,

“মাহতাবকে বলবেন আমার সাথে যেন আগামীকাল দেখা করে৷”

এত তারাহুরো করে বাসা থেকে বের হতে দেখে রবিন তুরাগকে প্রশ্ন করে,

“কী হলো? এভাবে বেরিয়ে এলি কেন?”

“মাহতাব আগামীকাল দেখা করুক। তারপর একসাথে বলব তোদের।”

“এই হঠাৎ করে কী হলো তোর বল তো?”

“বললাম তো এখন কিছু বলতে পারব না। আগামীকাল বলব। এখন চল তো এখান থেকে।”

তুরাগের এমন ব্যবহারের কারণ বোধগম্য হয় না রবিনের। অগত্যা সে চুপচাপ হেঁটে নিজের বাড়ি চলে যায়।

সকালে সূর্যোদয় হওয়ার পর গোসল করে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নেয় সিরাত। পাশাপাশি মেয়েকেও তৈরি করে দেয়। সিরাতের চুলগুলো কোমড়ের নিচ অবধি হওয়ায় চুল শুকাতে সময় লাগে। এদিকে হিজাব ছাড়া বের হয় না সে। তাই ভেজা চুলগুলো বেঁধে নেয়। তার উপর হিজাব বেঁধে নিজের ব্যাগ হাতে নিয়ে নাবিহাকে কোলে নিয়ে বের হয়ে যায় সে। এত সকালে সিরাতকে বের হতে দেখে নিমু অবাক হয়। কিন্তু কিছু বলে না।

ঘড়ির কাঁটা যখন আটটার ঘরে, তখন সিরাত বসে আছে আলিশান এক বাড়িতে। আসার সাথে সাথে তাকে কফি দেওয়া হয়েছে। বাচ্চার জন্য খাবার দেওয়া হয়েছে। সিরাত কফির কাপে চুমুক দিয়ে অপেক্ষা করে একজনের জন্য। কিছুক্ষণ পর কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখে উঠে দাঁড়ায় সে। সালাম দিয়ে বলে,

“আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?”

“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন তো?”

“আলহামদুলিল্লাহ।”

“দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন প্লিজ।”

সিরাত সোফায় বসলে ঠিক তার মুখোমুখি বসে ব্যক্তিটি। কিছু একটা ভেবে সিরাত মুখে হাসির রেখা টেনে বলে,

“মিস্টার ফাইয়াজ রাহমান আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে সাহায্য করার জন্য।”

ফাইয়াজ রাহমান নিজের জন্য রাখা কফিটা হাতে নিয়ে বলে,

“ঠিক কীসের জন্য?”

“মাহতাবের ব্যবসায় লালবাতি জ্বা*লানোর জন্য।”

সিরাতের কথায় হো হো করে হেসে ওঠে ফাইয়াজ। ঠোঁটের কোণে হাসি বজায় রেখে বলে,

“তার মতো একজনের জন্য তো এমন কিছুই প্রাপ্য তাই না?”

“ওর কাজের সূত্র ধরেই আমি আপনাকে চিনি। কিন্তু কখনো ভাবিনি আমার হয়ে কাজ করবেন আপনি। আপনার এই সাহায্যের কথা আমি সত্যিই ভুলব না।”

“মিস্টার ফাইয়াজ রাহমান লাভ ছাড়া এক পা আগায় না। আপনি আমার ব্যবসায় সফলতা আনতে সাহায্য করেছেন। তাই আপনার বিপদে পাশে দাঁড়ানো আমার দায়িত্ব। এখানে ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই।”

“আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনা সম্পর্কে আপনি অবগত তো?”

“হ্যা হ্যা নিশ্চয়। চিন্তা করবেন না সিরাত। আমি আপনার পাশে আছি।”

“আমরা তাহলে আগামী সাত দিনের মধ্যেই কাজ শুরু করি?”

“যেমনটা আপনার ইচ্ছা।”

“আজ তাহলে উঠি। আমাকে এখান থেকে আরেক জায়গায় যেতে হবে।”

“আপনি চাইলে সকালের নাস্তা আমরা একসাথে করতে পারি।”

“আজ নয়, অন্য একদিন নাস্তা করব। আসি।”

ফাইয়াজ রাহমানের সাথে দেখা করে বের হওয়ার সময় সিরাত নাবিহার কপালে চুমু খেয়ে বলে,

“তোমার মাম্মা যা করছে তাতে হয়তো তুমি তোমার মাম্মাকে সাময়িক সময়ের জন্য ভুল বুঝবে। কিন্তু বড়ো হয়ে একদিন অবশ্যই আমাকে ধন্যবাদ দেবে।”

চলবে??

নিভৃতে তেজস্বিনী পর্ব-১৩

0

#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_১৩
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

গোসল করার সময় মাহতাব আর নিমুকে একসাথে চিৎকার করতে দেখে সিরাত আপনমনে চানাচুর চিবোতে থাকে। পাশেই নাবিহা ক্লে দিয়ে খেলছে। বাবার চিৎকারের আওয়াজ শুনে সে মা’কে প্রশ্ন করে,

“বাবা এভাবে চিৎকার করছে কেন মাম্মা?”

“তোমার বাবা পঁচা তো, শীতকালে গোসল করতে চায় না। ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করতে হচ্ছে তো তাই এমন করছে।”

“আন্টি চিৎকার করছে কেন? আন্টিও কি পঁচা?”

“হ্যা সোনা, তোমার আন্টিও পানি দেখলে ভয় পায়। তুমি ওদিকে পাত্তা দিয়ো না আম্মু।”

মেয়েকে এমন কথা বললেও সিরাত জানে আসল ঘটনা কি!
নাবিহাকে ঘরে রেখে দরজা কিছুটা চাপিয়ে দিয়ে বাইরে বের হয়ে আসে সিরাত। মাহতাব ভেজা শরীরে ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে একটা চেয়ার টেনে বসে। সাথে ফ্যানও ছেড়ে দেয়।

“এই শীতকালে তোমার গরম লাগছে? গন্ডা*রের চাম*ড়ায় পরিণত হলো নাকি তোমার শরীর?”

সিরাতের কথায় দাঁত কিড়মিড়িয়ে তাকায় মাহতাব। হলদে ফর্সা শরীরের বিভিন্ন জায়গায় লালচে দাগ পড়েছে। পিঠ, হাত, বুক, সবখানে ছোপ ছোপ লালচে দাগ। শরীরে হাত বুলাতে বুলাতে মাহতাব ভীষণ রাগী কণ্ঠে বলে,

“গোসলের পানি এত গরম কীভাবে হলো?”

“ওমাহ্ সেটা আমি কীভাবে জানব?”

“তুমি আসার পর থেকেই গোসলে যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছিলে আমাদের। এসব ইচ্ছে করে করেছ তাই না?”

“আমি তো একটু আগেই বাসায় আসলাম। এসব করব কখন? সবসময় আমাকে দোষ দেওয়া বন্ধ করো তুমি। কিছু হলো কি হলো না, সব দোষ আমার!”

আচানক নিমু এসে পেছন থেকে ধাক্কা দেয় সিরাতকে। আকষ্মিক ঘটনায় সিরাত ছিটকে গিয়ে টেবিলের এক কোণার সাথে পা লেগে ভীষণ ব্যথা পায়। ব্যথায় চোখ বন্ধ করে নিয়ে মৃদু আওয়াজ করে ওঠে সে। বেশ কিছুক্ষণ পর কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে নিমুর দিকে তাকায়। নিমুর মুখের একাংশ ভীষণ লাল হয়ে আছে। চোখে তার তেজি ভাব। সিরাতের দিকে তাকিয়ে আঙুল নাচিয়ে বলে,

“আমি জানি এসব তুমি ইচ্ছাকৃতভাবে করেছ। দিন দিন তোমার অত্যা*চার বেড়েই চলেছে। অনেক সহ্য করেছি, আর না। এরপর একদম ছাড় দেব না বলে দিলাম।”

নিমুর এমন ব্যবহার মোটেই মেনে নিতে পারে না সিরাত। কোনোকিছু না বলে নিমুর গালে হাতের পাঁচ আঙুলের ছাপ বসিয়ে দেয় সে। তার এমন ব্যবহারে হতভম্ব হয়ে যায় মাহতাব। সে কিছু বলার আগেই সিরাত বলে ওঠে,

“এই ভুল দ্বিতীয় বার করার চেষ্টাও করবে না। আমার গায়ে সামান্য আঘাত লাগলেও আমি তার চেয়ে তিনগুণ পরিমাণ বেশি আঘাত ফিরিয়ে দিতে জানি। এতদিন চুপ করে আছি তার মানে এই নয় যে আমি কিছু বলতে পারি না। আমি সহজে কারোর উপর হাত তুলি না। কিন্তু একবার হাত উঠে গেলে আমাকে সামলানো কঠিন হয়ে যায়। আজ কেবল একটা থা*প্পড় খেয়েছ৷ এরপর আমার সাথে লাগতে এলে কতগুলো খাবে সেটার হিসেব কিন্তু আমার কাছেও নেই। তাই বলছি, সাবধান হয়ে যাও।”

ব্যথায় ফুলে যাওয়া পা নিয়ে ঘরে চলে যায় সিরাত। ডান পায়ের বুড়ো আঙুল বেশ খানিকটা ফুলে গিয়েছে। পা নাড়াতেও কষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে নিমুর গালেও বেশ ভালো রকমের ব্যথা শুরু হয়েছে। মাহতাবের পাশে বসে নিমু কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,

“আমাকে এভাবে ওই মেয়েটা মা*রল, আর তুমি কিছু বললে না?”

“তোমারই বা ধাক্কা দেওয়ার কি দরকার ছিল?”

“এখন সব দোষ আমার তাই না? আগের বউয়ের প্রতি প্রেম বেড়েছে তোমার। এখন সব দোষ তো আমারই দেখবে তুমি।”

“আমি তোমাকে দোষ দিচ্ছি না। সিরাতের থেকে দূরে থাকায় ভালো। কারণ ওর নতুন রূপের সাথে আমি নিজেই মানিয়ে নিতে পারছি না।”

“আমার মুখের বারোটা বেজে গেল। আমাকে ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ো। আমি ফেসিয়াল করতে যাব।”

“ত্রিশ হাজার টাকা? এত টাকা দিয়ে কী করবে তুমি?”

“ফেসিয়াল করব বললামই তো।”

“আমার কাছে এখন টাকা নেই।”

“আমি টাকা চাইলেই তোমার কাছে টাকা থাকে না। টাকা নেই তো আমাকে বিয়ে করেছ কেন? এভাবে কষ্ট দেওয়ার জন্য?”

“রাগ করো না নিমু। আচ্ছা আমি টাকা দিলে খুশি হবে তো? আগামীকাল পেয়ে যাবে।”

“সত্যি বলছ?”

“হুম সত্যি।”

নিমুর চোখেমুখে খুশির আমেজ দেখা দেয়। মাহতাবকে জড়িয়ে ধরে সে বলে,

“এজন্যই আমি তোমাকে এত্ত ভালোবাসি।”

“এখন ফ্রেশ হয়ে নাও। আমিও ভালোভাবে গোসল করে আসি। শরীর এখনো জ্ব*লছে গরম পানির জন্য।”

“তোমার ওই বউকে একটা উচিত শিক্ষা দিয়েই ছাড়ব আমি।”

মাহতাব কিছু না বলে উঠে যায়৷ নিমু গুটি গুটি পায়ে রান্নাঘরে গিয়ে খাবার খোঁজে। কিন্তু আজ বাসায় কিছুই রান্না করা হয়নি। ক্ষুধার জ্বালায় ফ্রিজ থেকে বাসি রুটি আর তরকারি বের করে খেয়ে নেয়। আর কিছুটা খাবার মাহতাবের জন্য রেখে দেয়।

রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ঘরে যাওয়ার সময় দরজার সামনে পা পিছলে পড়ে গিয়ে কোমড়ে আঘাত পেয়ে মাটিতে বসে পড়ে নিমু। তার চিৎকারে তড়িঘড়ি করে গোসল সেরে বের হয় মাহতাব। নিমুর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“কী হলো আবার? চিৎকার করছ কেন?”

“কে যেন দরজার সামনে তেল ফেলে রেখেছে। এটা নিশ্চয়ই সিরাতের কাজ। এই মেয়েকে আমি খু*ন করে ফেলব বলে দিলাম।”

“আচ্ছা আচ্ছা তুমি শান্ত হও। তোমার আওয়াজ আশেপাশের সবার কানে পৌঁছালে যাচ্ছে তাই কাণ্ড ঘটে যাবে।”

“কোমড়ে এত ব্যথা পেয়েছি যে এখন নড়তেই পারছি না। তুমি ওই মেয়েকে কিছু বলবে? নাকি আমিই ওর একটা ব্যবস্থা করব।”

“আগে তোমাকে ঘরে রেখে আসি। তারপর ওর সাথে কথা বলছি।”

নিমুকে বিছানার উপর বসিয়ে দিয়ে মাহতাব সিরাতের ঘরের সামনে গিয়ে কড়া নাড়ে। একটু পর দরজা খুলে দিলে মাহতাব সিরাতের দিকে তেড়ে এসে বলে,

“সমস্যা কী তোমার? নিমুর পেছনে এভাবে লেগেছ কেন? মেয়েটা কত কষ্ট পেয়েছে কোনো ধারণা আছে তোমার?”

সিরাত মাহতাবের দিকে এক ধ্যানে চেয়ে মলিন হেসে বলে,

“আধ ঘন্টা আগে আমিও পায়ে ভীষণ ব্যথা পেয়েছি। কই? তুমি তো আমার খোঁজ নিলে না একবারও৷ আমি কতটা ব্যথা পেয়েছি, ওষুধ খেয়েছি কি-না এসব তো জানতে চাইলে না তুমি। নিমু কষ্ট পেয়েছে এটা তোমার কাছে এত বড়ো হয়ে গেল যে আমার কষ্টের কথা বেমালুম ভুলে গেলে তুমি? আরে আমি তো তোমার সন্তানের মা। আমি ছাড়া নাবিহার যত্ন নেওয়ার মতো কেউ নেই এখানে। এমন অবস্থায় আমার কষ্ট একবারও ভাবাল না তোমায়? এতটা স্বার্থপর কবে হলে তুমি?”

“এত ন্যাকামি করছ কেন? ঘরে তো ওষুধ আছে। ওষুধ খেয়ে নিলেই ব্যথা দূর হয়ে যাবে। আর শোনো, সারাক্ষণ আমাদের পেছনে পড়ে না থেকে বাচ্চাকে সময় দাও। সেটা বেশি ভালো হবে তোমার জন্য।”

কথাটা বলে চলে যায় মাহতাব। সিরাত দরজার কোণ ঘেঁষে বসে পায়ে হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

“তোমাকে যেমন ভালোবেসে আগলে রাখতে জানি, প্রয়োজনে সেভাবেই ভেঙে চু*রমা*র করতেও জানি আমি। মেয়েদের ভালোবাসা খুব তীব্র হয়। কিন্তু একবার সেই ভালোবাসা ঘৃণায় পরিণত হলে সেটাও ভীষণ তীব্র হয়। আমাকে তুমি যতটা কষ্ট দিয়েছ তার চেয়ে বহুগুণ বেশি কষ্ট আমি তোমাকে ফিরিয়ে দেব কথা দিলাম। আজ অবধি যা যা করেছি তা ট্রেইলার ছিল। আগামীকাল থেকে আমি যা যা করব সেটাই হবে আসল খেলা। মিস্টার মাহতাব শাহরিয়ার শেখ তুমি যেভাবে আমার জীবন নিয়ে খেলছ আমি ঠিক সেভাবেই তোমার অস্তিত্ব নিয়ে খেলব। তৈরি হও তার জন্য।”

চলবে??

নিভৃতে তেজস্বিনী পর্ব-১২

0

#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_১২
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

“সিরাত তোমার সমস্যা কোথায় বলো তো? তুমি নাবিহাকে নিয়ে বের হয়েছ ভালো কথা। কিন্তু আমাকে আর নিমুকে ঘরের মধ্যে রেখে সদর দরজায় তালা লাগিয়ে বাসার পানির লাইন, ইলেক্ট্রিসিটির লাইন সব বন্ধ করে দিয়েছ কেন?”

ফোনের ওপাশ থেকে মাহতাবের বিরক্তিতে ভরা কণ্ঠস্বর শুনে সিরাত বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে উত্তর দেয়,

“এপার্টমেন্ট এর সবাই জানে বাসায় কেউ নেই এখন। এজন্য তালা দিয়ে এসেছি।”

“বাসায় কেউ নেই মানে? আমরা তো বাসায় আছি।”

“এটা তো সবাই জানে না। শোনো, এখন যদি তুমি চিৎকার করো কিংবা দরজায় শব্দ করো তাহলে সবাই জেনে যাবে ভেতরে তোমার সাথে নিমু আছে। নিমু আমাদের আত্মীয় এটাই জানে সবাই। এখন সব সত্যি জানলে কী হবে জানো তো? তাছাড়া তুমি সবাইকে উল্টাপাল্টা বুঝ দিতে পারবে না। কারণ যা রটে তার কিছু তো বটে। এই প্রবাদ বাক্য শুনেছ তো?”

“এসবের কোনো মানে হয় সিরাত? তুমি কেন এমন করছ?”

“ভালো কাজই তো করেছি। তোমাদের রোমান্স করার সুযোগ দিলাম। আমি আর আমার মেয়ে বাসায় নেই। এই সুযোগে যদি তোমরা আমাদের বিপদে ফেলার জন্য কিছু করো তখন কী হবে? তোমাদের একটুও বিশ্বাস নেই। তাই এটা করতে হলো আমাকে।”

“সারাদিন আমরা না খেয়ে থাকব?”

“একদিন না খেলে কেউ ওপরে চলে যায় না। তাই এত ন্যাকামি করার কিছু নেই। চুপচাপ বসে থাকো। আমাদের ফিরতে রাত হবে। আর হ্যা, বারবার কল দিয়ে বিরক্ত করবে না আমাকে।”

কল কেটে দেয় সিরাত। তার মুখে শয়তানি হাসি বিরাজ করছে এখন।

“সবে তো শুরু। এখনো অনেক কিছু দেখা বাকি তোমাদের। আর কয়েকটা দিনের অপেক্ষা। তারপর তোমাদের ভালো থাকার দিন শেষ!”

আপনমনে কথাগুলো বলে নাবিহার কাছে যায় সিরাত। মাওয়ার কোলে বসে খেলছে নাবিহা। এটা দেখে সিরাত মাওয়ার পাশে বসে বলে,

“বাচ্চাদের ভালোই সামলাতে পারিস মনে হচ্ছে। তা তুই বাচ্চা নিবি কবে?”

“এখনো বিয়েই করলাম না। আর তুই আছিস বাচ্চা নিয়ে।”

“বিয়ে করিসনি মানে?”

“এত অবাক হচ্ছিস কেন?”

“তোর আর ইভানের কাহিনি ভুলে গেলি? তোদের দু’জনের ঝামেলার জন্য আমি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় চলে আসি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েও আমি ভর্তি হই ড্যাফোডিল এ। এরমাঝে আমার বিয়ে হয়ে যায় মাহতাবের সাথে। বিয়ের পর আমি সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। আর তোদের সাথে যোগাযোগও বন্ধ করে দিলাম। পরপর দু’টো ঝামেলার কারণে সবাই আমাকে ভুল বুঝল। বিশেষ করে অভি আর ইভান!”

“আমি বিয়ে করিনি রাত। আমার সাথে যা হয়েছে তারপর ওকে বিয়ে করা সম্ভব ছিল না। আমি তোদের থেকে দূরে চলে গিয়েছিলাম ঠিকই, তবে বিয়ের জন্য নয়। আমাকে বাবা বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। চাইলেও তোদের কারোর সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি আমি।”

“অভিকে সব বলেছিস?”

“না বলিনি। আর তুইও বলবি না।”

“কেন মাওয়া? তুই তো সব জানিস। অভি আজও আমায় ভুল বুঝে যাচ্ছে। যে ছেলেটা সবসময় আমার পাশে থেকেছে, আমাকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করেছে আজ সে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে চারটে ভালো কথা বলে না। আমাকে দেখলেই যেন ওর ভেতরে ঝড় বয়ে যায়। ওর অভিযোগের দৃষ্টি আমি নিতে পারি না। কষ্ট হয় আমার।”

“অভি তো জানে না যে আমি সব জানি। ওকে ওর মতো থাকতে দে। পুরোনো কথা টেনে কষ্ট পাওয়ার দরকার নেই।”

“চিঠিটা কবে পেয়েছিলি তুই?”

“বাইরে চলে যাওয়ার পর পেয়েছিলাম।”

“দেরিতে হলেও তো পেয়েছিলি। আর কারোর সাথে না হোক, একটা বার অভির সাথে যোগাযোগ করতে পারতি।”

“ইচ্ছে হয়নি।”

“মাওয়া!”

মাওয়া মলিন হাসে। সিরাত আর কিছু না বলে নাবিহাকে নিয়ে অন্য পাশে সরে যায়। পেছন থেকে অভি ডেকে বলে,

“তুই আমাকে যে কাজ দিয়েছিলি সেটা হয়ে গিয়েছে।”

“সব খোঁজখবর পেয়েছিস?”

“হ্যা, এই খামের ভেতরে সব আছে। দেখে নিস।”

সিরাত খাম নিয়ে ব্যাগের ভেতর রেখে অভিকে ডাক দেয়।

“অভি আজও ভুল বুঝে মুখ ফিরিয়ে রাখবি ভাই? কথা বলবি না আমার সাথে?”

“ভুল বোঝার তো কিছু নেই। বরং যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। এতদিন পর সবাই একসাথে হয়েছি। পুরোনো কথা ভেবে মন খারাপ করিস না।”

সিরাত বলার মতো আর কিছু পায় না। তিক্ত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সবার মাঝে মিলিয়ে যায়। আসার পর থেকে ইভান ঠিকভাবে একবারও সিরাতের দিকে তাকায়নি। শুধু নাবিহাকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলেছিল।

রাত আটটা বাজার সাথে সাথে সিরাত সবার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,

“আমার এখন যেতে হবে। বাচ্চাকে নিয়ে বেশি রাত অবধি বাইরে থাকি না আমি। আবার সবার সাথে দেখা হবে৷ আজকের মতো আমাকে বিদায় দে তোরা।”

নকশি সিরাতের কাছে এসে বলে,

“এখনই চলে যাবি? আর একটু থাক না।”

“না রে, আজ আর থাকতে পারব না। সবার সাথে দেখা হলো তো। আবার দেখা হবে আমাদের। চিন্তা করিস না। বাকি কথা পরে হবে। আজ আসি।”

“আচ্ছা আমি এগিয়ে দিয়ে আসি চল।”

নাবিল নাবিহাকে কোলে নিলে সিরাত সবার থেকে বিদায় নিয়ে নেয়। তারপর বেরিয়ে যায় নাবিলের সাথে। রাস্তায় নাবিলকে প্রশ্ন করে,

“অথৈ এর সাথে সব ঠিক করা যায় না?”

“আমি অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে আমার সাথে কথা বলতে নারাজ।”

“তোকে আমি একবার একটা কথা বলেছিলাম। মনে আছে তোর?”

“কোন কথা?”

“মেয়েদের ভালোবাসা খুব তীব্র হয়। কিন্তু তার থেকেও বেশি তীব্র হয় ঘৃণা। মেয়েরা শত অবহেলার পরেও থেকে যায় বলে তাদের বারংবার কষ্ট দেওয়া বোকামি। কারণ তারা একবার মুখ ফিরিয়ে নিলে তাদের আর ফেরানো যায় না!”

“হুম মনে আছে।”

“আমার কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল তো?”

“এতগুলো বছর পেরিয়ে গেল। অথৈ না তো আমার সাথে সব ঠিক করল। আর না তো অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী হলো।”

“এতদিনেও যখন বিয়ে করেনি তখন শেষ একটা চেষ্টা কর।”

“আমি কীভাবে কী করব? কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। ওকে না পেয়ে আমিও ভালো নেই রাত। কিন্তু সেটা ওকে কে বোঝাবে?”

“আমি বোঝাব, আমরা সকলে মিলে ওকে বোঝাব। আপাতত তুই ফিরে যা। গাড়ি পেয়ে গিয়েছি। আমরা আসি।”

“সাবধানে যা। আর গিয়ে একটা কল দিস।”

“আচ্ছা।”

বড়ো রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে নাবিল ভাবে,

“তোর কথার গুরুত্ব আরো আগে দিলে হয়তো আজ আমরা আলাদা হতাম না রাত। বড্ড ভুল করে ফেলেছি আমি!”

বাসায় ফিরতে প্রায় নয়টা বেজে যায় সিরাতের। দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই ইলেক্ট্রিসিটি চলে আসে। একইসাথে পানির লাইনও চলে আসে। সকাল থেকে না খেয়ে থেকে মাহতাব আর নিমুর চোখমুখ শুকিয়ে গিয়েছে। সিরাত দু’জনের এমন চেহারা দেখে ভীষণ মজা পায়। মজার ছলে বলে,

“আহারে এ কি অবস্থা তোমাদের! সকাল থেকে কিছু খাওনি তোমরা?”

মাহতাব রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,

“মজা নেওয়া বন্ধ করো। সব সময় এসব ভালো লাগে না। আমাদের সাথে কেন এমন করছ তুমি? একটু তো ভালো থাকতে দাও আমাদের।”

“ভালো থাকতেই তো দিয়েছি। আর কত ভালো থাকতে চাও?”

“এটাকে ভালো থাকা বলে? প্রতিদিন একটা না একটা ঝামেলা করছ। তুমি কী বাচ্চা?”

“এখন এত কথা না বলে গোসল করতে যাও তোমরা। প্রতিদিন গোসল করা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।”

নিমু এতক্ষণ চুপচাপ সবকিছু দেখছিল। মাহতাবের সাথে উঠে চলে যাওয়ার সময় সিরাতের দিকে রাগী চোখ নিয়ে তাকালে সিরাত হেসে বলে,

“যাও যাও তাড়াতাড়ি গোসল করে এসো। তোমার শরীর থেকে কেমন বিদঘুটে গন্ধ বের হচ্ছে।”

কথাটা বলে নাকে হাত দিয়ে সিরাত নিজের ঘরে চলে যায়। পেছন ফিরে না তাকিয়েও সে বুঝতে পারে, নিমুর চোখমুখ রাগে লাল হয়ে আছে।

চলবে??

নিভৃতে তেজস্বিনী পর্ব-১১

0

#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_১১
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে চার/পাঁচজন ছেলেকে ইচ্ছামত মা*রছে সিরাত। রাগে তার পুরো মুখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে। পাশে একটা মেয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

“মেয়েদের দেখলেই জ্বালাতন করতে মন চায় তাই না? আজ তোদের সব শখ আমি মিটিয়ে দেব। পরিবার থেকে কোনো সুশিক্ষা পাসনি তাই না? নিজের মা, বোনের সাথেও এমন করিস? বোনের হাত ধরে বলিস, তোকে অনেক হ*ট লাগছে? কাছে টানতে ইচ্ছা করছে? বলিস না তো। তাহলে অন্যের বোনের দিকে কুনজর দিস কোন জ্ঞানে?”

আচমকা একজন সিরাতের হাত ধরে ফেলে। একজন ছেলের শক্তির সাথে সিরাত আর পেরে উঠছে না। সমস্ত শক্তি যেন শেষ হয়ে গিয়েছে এতক্ষণ যাবত ম*রামা*রি করে। হাতে ব্যথা অনুভব করে চোখ বন্ধ করে নেয় সিরাত।

“অনেকক্ষণ ধরে তোর বাড়াবাড়ি দেখছি। তুই একা আমাদের কুপোকাত করবি? এত সহজ নাকি? আগে তো শুধু ওই মেয়েকে ধরেছিলাম। এখন তোকেও নিয়ে যাব। চল আমাদের সাথে।”

সিরাত শত চেষ্টা করেও হাত ছাড়াতে পারে না। তার হুডির পকেটে সে সবসময় কিছু সেইফটি পিন রাখে। কায়দা করে অন্য হাতে সেই পিন বের করে ছেলেটার হাতে গেঁথে দেয়। ব্যথায় চিৎকার করে ওঠে সেই ছেলে।

“তোর এত বড়ো সাহস আমাদের সাথে লাগতে আসিস। এই তোরা ধর তো এটাকে।”

কথাটা বলে অন্য একজন সিরাতের কাছে এসে তার গায়ে হাত তুলতে গেলে পেছন থেকে কেউ সজোরে লাথি দেয় তার পিঠে। তার পেছন থেকে বেরিয়ে আসে অভি। সিরাত দু’জনকে দেখে দেহে প্রাণ ফিরে পায়। শক্তি ফিরে পায় শরীরে। আগন্তুক মেয়ের কাছে গিয়ে বলে,

“তোমাকে যারা যারা বাজে ভাষায় বাজে ইঙ্গিত দিয়েছে প্রত্যেককে নিজ হাতে শাস্তি দেবে তুমি। চলো আমার সাথে।”

ইতোমধ্যেই ছেলেগুলোর অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে অভি আর তার বন্ধু মিলে। সিরাত মেয়েটাকে সামনে এনে ব্যাগ থেকে স্টিলের স্কেল বের করে তার হাতে দিয়ে বলে,

“শুরু করো।”

মেয়েটা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সিরাতের দিকে। অতঃপর চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভেবে ইচ্ছামতো স্কেল দিয়ে আঘাত করে ছেলেগুলোর শরীরে। একদিকে ছেলেগুলোর চিৎকার অন্যদিকে উৎসুক জনগণের ভীড়। সবকিছু মিলিয়ে পরিবেশটা অন্যরকম হয়ে গিয়েছে।

নিজের রাগ মিটিয়ে মেয়েটা সিরাতকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে। কৃতজ্ঞতার সুরে বলে,

“ধন্যবাদ আপু। এখানে এতজন থাকা সত্ত্বেও কেউ প্রতিবাদ করেনি। কেবল আপনিই এগিয়ে এসেছেন। আপনার এই উপকার আমি কখনো ভুলব না।”

“কান্না বন্ধ করো। তুমি কেন কাঁদছ? যারা অন্যায় করেছে তারা কাঁদবে। একটা কথা মনে রাখবে, নিজেকে কখনো দুর্বল ভাববে না। তুমি নারী, তুমি নিজেকে বাঁচানোর ক্ষমতা নিজের মধ্যেই লুকিয়ে রেখেছ। যেকোনো পরিস্থিতিতে ভয় না পেয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে জানতে হবে। আজ যেমন ভয় পেয়ে জড়োসড়ো হয়ে ছিলে এমনটা আর কখনো করবে না। নিজের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত প্রতিবাদ করবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে।”

“আপনার কথাগুলো আমি মনে রাখব আপু।”

“আচ্ছা নাম কী তোমার?”

“পুষ্প।”

সিরাত পুষ্পকে পাশে রেখে আশেপাশের মানুষজনের দিকে তাকিয়ে কঠোর কণ্ঠে বলে,

“বিনা টিকেটে সার্কাস দেখা শেষ? ভিডিয়ো করেছেন তো অনেকেই। এসব ভিডিয়ো অনলাইনে কী ক্যাপশন দিয়ে ছাড়বেন? একজন মেয়ের এমনই হওয়া উচিত। এভাবেই প্রতিবাদ করা উচিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে। এসবই লিখবেন তো? নাকি একজন মেয়ে কতটা উশৃংখল হলে ছেলেদের সাথে এভাবে মা*রামা*রি করতে পারে সেটা দেখুন আপনারা, এমন ক্যাপশন দিবেন? না মানে আপনাদের যোগ্যতা তো এটুকুই। আপনারা বিনা আমন্ত্রণে সার্কাস দেখতে চলে আসেন। কিন্তু প্রতিবাদ করার সময় হয়ে যান ভেজা বিড়াল। এই যে এখানে এতজন ছেলে আছেন, প্রত্যেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু এই অসভ্য ছেলেগুলোর অসভ্যতামি দেখলেন। একজনেরও সাহস হলো না প্রতিবাদ করার। এমন মেরুদণ্ডহীন কা*পুরুষ হওয়ার থেকে আপনাদের জন্ম না হলেই বোধহয় ভালো হতো তাই না?”

সবাইকে চুপ করে থাকতে দেখে রাগে শরীর কাঁপে সিরাতের। অভি তার কাছে এসে বলে,

“শান্ত হ, এখানে আর কোনো ঝামেলা করিস না। পুলিশ আসছে। এবার যা করার ওরা করবে। তুই আমাদের সাথে চল।”

“একটু দাঁড়া।”

পায়ে ব্যথা লাগায় হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে সিরাতের। তবুও পুষ্পর কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে বলে,

“একা বাড়ি যেতে পারবে তো?”

“হ্যা পারব। সামনের দুইটা মোড় পার হলেই আমার হোস্টেল।”

“হোস্টেলে থাকো তুমি?”

“হ্যা।”

“আচ্ছা সাবধানে চলাফেরা করবে। তুমি প্রথম বর্ষে পড়ো তাই না?”

“হ্যা আপু।”

“আমাকে আপু ডাকতে হবে না। আমি তোমার সমবয়সী।”

সিরাতের কথা শুনে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে পুষ্প। এই অবাক হওয়ার কারণ সিরাত জানে। তাই মুচকি হেসে বলে,

“এভাবে তাকাতে হবে না। যাও হোস্টেলে ফিরে যাও।”

ধীরে ধীরে রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায়। অভি সিরাতের কাছে এসে বলে,

“এখন তুই বাড়িতে চল।”

“আমি না ঠিকমতো হাঁটতে পারছি না। ডান পায়ে খুব ব্যথা করছে।”

কথাটা বলা শেষ হওয়ার আগেই তৎক্ষনাৎ একজন সিরাতকে কোলে তুলে নেয়।

“আরে ইভান, কী করছিস তুই? নামিয়ে দে আমাকে।”

“একদম চুপ করে থাকবি। রোমান্স করার জন্য কোলে তুলে নেইনি তোকে। হাঁটতে পারছিস না। তাই বাধ্য হয়ে তোকে স্পর্শ করতে হলো। নয়তো কখনেই তোকে স্পর্শ করতাম না।”

এতক্ষণ যাবত স্মৃতিচারণ করছিল সিরাত। সেদিন প্রথমবারের মতো কোনো ছেলে তাকে স্পর্শ করেছিল। ভেতরে সংকোচবোধ থাকলেও সেদিন সিরাত ইভানকে কিছুই বলেনি। কারণ সে জানত, ইভান কখনো তার অসম্মান করবে না। বিয়ের আগে সেই স্পর্শ ছিল সিরাতের জীবনে প্রথম এবং শেষ স্পর্শ। ঘটনার প্রায় ছয় বছর পার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আজও সিরাত কিছুই ভুলতে পারেনি।

“ভালো আছিস?”

পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে চমকে ওঠে সিরাত। এতদিন পর সেই মানুষটার কণ্ঠ শুনে পেছন ফিরে তাকায় সে। অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে,

“ইভান!”

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে তাকিয়েও কোনো এক অজানা কারণে চোখ সরিয়ে নেয় সিরাত। স্বাভাবিক কণ্ঠে উত্তর দেয়,

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?”

“সব সময় যেমন থাকি। বিন্দাস!”

“একাই এসেছিস? নাকি পরিবারসহ?”

“তুই হয়তো রুলস ভুলে গিয়েছিস। আজ এখানে শুধুমাত্র বন্ধুদের ডাকা হয়েছে। তাদের পরিবারসহ ডাকা হয়নি।”

“ওহ্ হ্যা মনে ছিল না।”

“এত তাড়াতাড়ি বুড়ি হয়ে গেলি?”

“স্মৃতিশক্তি কমে গিয়েছে। এত স্মৃতি মনে রেখে কী হবে বল?”

দু’জনের কথার মাঝে একজন দৌড়ে এসে সিরাতকে জড়িয়ে ধরে।

“দোস্ত কেমন আছিস তুই? জানিস তোকে আমি অনেক মিস করেছি। অবশেষে তোর সাথে আবার দেখা হলো আমার।”

সিরাত হাসিমুখে বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“আমি খুব করে চাইছিলাম যেন আজ তোর সাথে দেখা হয় আমার। তোর সাথে আমার দেখা হওয়াটা ভীষণ জরুরি ছিল মাওয়া।”

পুরোনো বন্ধুদের ফিরে পেয়ে প্রত্যেকের মুখেই আজ তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠেছে। এগারো জন বন্ধু আজ আবার এক হয়েছে। একে একে প্রত্যেকে এক জায়গায় এসে দাঁড়ায়। অতঃপর স্ক্রিনে বড়ো করে ভেসে ওঠে একটা ভিডিয়ো। সাথে ভেসে আসে সিরাতের কণ্ঠস্বর।

“ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ, সময়টা ২০১৩ সাল। জেএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য ভর্তি হলাম রেটিনায়। পড়াশোনা করতে এসে পরিচয় হলো একঝাঁক নতুন মুখের সাথে। একেকজনের একেকরকম ব্যক্তিত্ব। কেউ হাসিখুশি তো কেউ গম্ভীর। কেউ চঞ্চল তো কেউ শান্ত। নয়জন নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হয় আমার এবং মাওয়ার। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে আমাদের মাঝে। সে কি শক্ত বন্ধন আমাদের! মাত্র কয়েক মাসে আমরা সবাই হয়ে উঠি একে-অপরের জানের জান দোস্ত। আমি আর মাওয়া তখন ভিন্ন স্কুলের বাসিন্দা। ফলস্বরূপ তাদের থেকে আলাদা হওয়ার ভয় কাজ করা শুরু করল মনে। দু’জনে মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম ওদের স্কুলে ভর্তি হব। এরমাঝে জেএসসি পরীক্ষা হয়ে গেল। পরীক্ষার পর সবাই মিলে একসাথে মিলিত হলাম ডিসেম্বরের ১৭ তারিখে। সেই দিনকেই আমাদের বন্ধুমহলের জন্মদিন হিসেবে ঘোষণা করলাম আমরা। সিরাত, তারিন, মাওয়া, উর্মি, নকশি, তামান্না, অথৈ, নাবিল, ইভান, অভি, ফারহান, এই এগারো জনের সংমিশ্রণে তৈরি হওয়া বন্ধুমহলের আমরা নাম দিলাম ওয়ার্ল্ড অফ স্টার!
দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল ওয়ার্ল্ড অফ স্টার এর দশ বছর। এই দশ বছরে সবার জীবনের গল্প পাল্টেছে। তবে পাল্টায়নি শুধু আমাদের বন্ধুমহলের গল্প। আমরা বড়ো হয়ে গিয়েছি ঠিকই, তবে আমাদের বন্ধুত্ব আজও টিকে আছে। অস্তিত্বের লড়াইয়ে টিকে আছে ওয়ার্ল্ড অফ স্টার এর গল্প।”

চলবে??

নিভৃতে তেজস্বিনী পর্ব-১০

0

#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_১০
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

মাঝরাতে কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সিরাত। ঘড়ির কাঁটায় জানান দিচ্ছে, রাত একটা ছুঁই ছুঁই। এমন সময় কে কলিংবেল বাজাচ্ছে সেটা বোধগম্য হয় না সিরাতের। এক পা, দুই পা করে এগিয়ে দরজা খুলে মাহতাবকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে ভ্রূদ্বয় সংকুচিত হয়ে আসে তার।

“তুমি ড্রিংক করেছ মাহতাব?”

মাহতাবের চোখগুলো ভীষণ লাল হয়ে আছে। শার্টের কয়েকটা বোতাম খোলা, চুলগুলো এলোমেলো। সিরাতকে দেখে তার দিকে তাকিয়ে বলে,

“তুমি এখানে কী করছ? নিমু কোথায়?”

“তোমার বউ কোথায় সেটা জানার মতো অযথা সময় আমার কাছে নেই। এত রাত অবধি বাইরে ছিলে। তার উপর ড্রিংক করে ফিরেছ। সমস্যা কী তোমার?”

আচানক হু হু করে কান্না শুরু করে মাহতাব। সিরাত কিছু বুঝে ওঠার আগেই দরজার পাশ ঘেঁষে মেঝের উপর বসে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নেয় সে। সিরাত চুপচাপ মাহতাবের পাশে বসে তাকে পর্যবেক্ষণ করে। কিছুক্ষণ পর শান্ত স্বরে প্রশ্ন করে,

“কী হয়েছে তোমার? তোমাকে গত কয়েকদিন যাবত লক্ষ্য করছি আমি। কোনো সমস্যা হয়েছে?”

“গত নয় দিনে আমি বড়ো বড়ো তিনটা অর্ডার হারিয়েছি। একেকজন একেক রকম বাহানা দিচ্ছে। একদিকে ব্যবসার অবস্থা খারাপ হচ্ছে, অন্যদিকে বাবা আমাকে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সবদিক থেকে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। এভাবে চলতে থাকলে খুব শীঘ্রই আমি পথে বসে যাব।”

“নতুন বউ আসতে না আসতেই তোমার অবনতি শুরু হলো? তোমার কথা ভেবে আসলেই আমার খারাপ লাগছে!”

মাহতাব সিরাতের দিকে তাকিয়ে বলে,

“মজা করছ তুমি?”

“এসব বাদ দাও। আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো।”

“কী প্রশ্ন?”

“নিমুর সাথে তোমার পরিচয় কীভাবে হয়েছিল?”

“ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিল আমাদের।”

“নিমু কি শুরু থেকেই জানত যে তুমি বিবাহিত?”

“না, আমি তো অন্য অ্যাকাউন্ট থেকে কথা বলতাম। সেখানে সবাই জানত আমি অবিবাহিত।”

কথাটা শুনে সিরাতের চোখের কোণে পানি জমে যায় রাগে। হাতের মুঠ শক্ত হয়ে আসে। সে আরো কিছু প্রশ্ন করতে যাবে তার আগেই মাহতাব সিরাতের কাঁধে মা থা রেখে ঘুমিয়ে যায়। সিরাত মাহতাবের হাত ধরে তাকে টেনেহিঁচড়ে ভেতরে নিয়ে যায়। চুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“অন্য মেয়েদের সাথে সম্পর্ক গড়ার খুব শখ তোমার তাই না? এই শখ যদি আমি না ঘুচিয়েছি তো আমার নামও সিরাত নয়।”

কিছু একটা ভেবে সিরাত মাহতাবকে নিজের ঘরে নিয়ে যায়। নাবিহার থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বিছানায় শুইয়ে দেয়। অতঃপর মাহতাবের ফোনটা হাতে নিয়ে তার আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে লক খুলে ফোন চেক করতে শুরু করে। নিমুর সাথে মাহতাবের কীভাবে পরিচয় হয়েছিল, কীভাবে তারা সম্পর্কে জড়ায় সবকিছু পেয়ে যায় অন্য একটা আইডিতে। ভাগ্যক্রমে সেই আইডি লগইন করা ছিল মাহতাবের ফোনে। ফোনের প্রাইভেট স্পেস এ মাহতাবের সাথে নিমুর ঘনিষ্ঠ অবস্থার একটা ভিডিয়ো দেখে আপনাআপনি সিরাতের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে । মেঝের উপর বসে অঝোরে কাঁদে সে। একজন নারী সবকিছু পারে। কিন্তু নিজের স্বামী কিংবা প্রিয় মানুষের আশেপাশে অন্য নারীকে সহ্য করতে পারে না। সে যত কঠিন মনের মানুষই হোক না কেন!

প্রথম যেদিন মাহতাবের সাথে সিরাতের দেখা হয় সেদিন মাহতাব বলেছিল,

“আমার কিন্তু সংসারী মেয়ে পছন্দ। তুমি বিয়ের পর লেখাপড়া করবে তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। তুমি তোমার মতো করে থাকতে পারবে। কিন্তু আমি যতক্ষণ বাড়িতে থাকব কিংবা তোমার সাথে থাকব ততক্ষণ আমি ব্যতিত আর কোনোদিকে মনোযোগ দিতে পারবে না তুমি। বেশি বন্ধুবান্ধব বানানোর প্রয়োজন নেই। আমিই হব তোমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু। যদি আমার ইচ্ছার মর্যাদা তুমি রাখতে পারো তাহলে কথা দিচ্ছি, তোমাকে ভালবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখব আমি।”

সিরাত সেদিন মাহতাবের কথা রেখেছিল। মানুষটার ইচ্ছার মর্যাদা দিয়েছে সে। তবে মাহতাব কথা দিয়ে কথা রাখেনি।

“তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে মাহতাব, আমাকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখবে। কিন্তু তুমি কথা রাখলে না। আমি সারাজীবন ভালোবাসা, বিশ্বাস আর সম্মান ছাড়া তোমার কাছে কিচ্ছু চাইনি। যেখানে আমার পুরো দুনিয়া জুড়ে তুমি ছিলে সেখানে তোমার দুনিয়ায় আমি কোথাও নেই। বিয়ের আগে আমি যেমন ছিলাম তেমন সিরাতকে তুমি চাওনি। সেজন্য নিজেকে পাল্টে ফেলেছিলাম। তুমি চেয়েছিলে, বিয়ের পর আমার কোনো ছেলে বন্ধু থাকা চলবে না। বেশি বাইরে যাওয়া যাবে না। সংসার সামলাতে হবে মনোযোগ দিয়ে। আমি মেনে নিয়েছিলাম তোমার সকল শর্ত। বিনিময়ে চেয়েছিলাম শুধু তোমাকে। কিন্তু তুমি কথা দিয়ে কথা না রাখা মানুষ। এমন মানুষের প্রতি আমার আজন্ম ঘৃণা জন্মাক। যে পুরুষ আমি ব্যতিত অন্য নারীকে ছুঁয়েছে স্বেচ্ছায়, সেই পুরুষ আর কখনো আমার না হোক। আমি তোমাকে ভালোবাসি না মাহতাব, ভালোবাসি না তোমাকে!”

চোখের পানি শুকানোর আগেই রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে যায়। আজ আর ঘুমাতে পারে না সিরাত। ওয়াশরুমে গিয়ে ঝর্ণা ছেড়ে তার নিচে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদে সে। ভোর রাতে ঠাণ্ডা পানি শরীরে লাগার ফলে কেঁপে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে। প্রচন্ড ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে গোসল করে বের হয় সিরাত। তার সকল দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা রাতের আঁধারের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে। প্রতিটা দিন একটু একটু করে ভেতর থেকে শেষ হয়ে যাচ্ছে সে। কিন্তু বাইরের মানুষকে এসব দেখানো যাবে না। কারণ মানুষগুলো বড্ড স্বার্থপর। অন্যের কষ্টে আনন্দ পায় তারা। ঠাট্টা করে, উপহাস করে, হাসাহাসি করে। এমন স্বার্থপর দুনিয়ায় নিজের কষ্টগুলো কাউকে দেখাতে নেই।

সকালে তীব্র মা থা ব্যথা নিয়ে ঘুম ভাঙে মাহতাবের। চোখ মেলে পাশে মেয়েকে দেখে তার দিকে এগিয়ে যেতে ধরলে সিরাত মেয়েকে কোলে তুলে নেয়। কঠোর কণ্ঠে বলে,

“তুমি ড্রিংক করেছ গতকাল। এই অবস্থায় মেয়েকে ছুঁতে পারবে না তুমি। নিজের ঘরে গিয়ে গোসল করে নাও যাও।”

“আমি সারারাত এখানেই ছিলাম?”

“হ্যা এখানেই ছিলে।”

“তুমি ঘুমাওনি? আর এত সকালে গোসল করেছ কেন তুমি? চুল ভেজা কেন? রাতে কি আমাদের মাঝে কিছু হয়েছিল?”

মাহতাবের প্রশ্নে সিরাত রাগে চিৎকার করে বলে,

“কী হবে আমাদের মাঝে হ্যা? তোমার মতো একজনের সাথে এক বিছানায় থাকতে রুচিতে বাঁধে আমার। তাই সারারাত না ঘুমিয়ে মেঝের এক কোণ বসে ছিলাম। এসবের কারণে মা থায় যন্ত্রণা হচ্ছিল। তাই গোসল করেছি।”

“স্বাভাবিক একটা প্রশ্ন করেছি। তার জন্য এত রেগে যাচ্ছ কেন?”

“তোমার কাছে যা স্বাভাবিক সেটাই আমার কাছে ভীষণ অস্বাভাবিক। এখন কথা না বাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাও।”

মাহতাবকে তবুও বসে থাকতে দেখে সিরাত পুনরায় বলে,

“কী হলো? বেরিয়ে যাও!”

বিরক্তি নিয়ে বের হয়ে যায় মাহতাব। সিরাত মেয়েকে নিয়ে বিছানার উপর বসে চুপচাপ বসে থাকে।

“গুড মর্নিং মাম্মা”

“গুড মর্নিং বাবু। ঘুম কেমন হলো?”

“ভালো।”

“চলো তোমাকে দাঁত ব্রাশ করিয়ে দিই।”

“মাম্মা আজ আমাকে সাজিয়ে দিবে?”

“হঠাৎ সাজতে ইচ্ছে করছে কেন?”

“এমনি।”

“আচ্ছা আজ আমরা দু’জনেই সাজব। শাড়ি পরব কেমন?”

“আচ্ছা।”

“এখন তাড়াতাড়ি চলো। ফ্রেশ হয়ে এসে খেতে হবে তো।”

মেয়েকে দাঁত ব্রাশ করিয়ে দিয়ে ভালোভাবে চোখমুখ ধুয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে গালে চুমু এঁকে দেয় সিরাত।

“এই মেয়েটা একদম আমার মতো হয়েছে। শুনেছি ছোটবেলায় আমিও এমন ছিলাম। সাজগোজ নিয়ে আমার মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ কাজ করত। মেয়েটা মায়ের মতো হয়েছে এই ভালো। বাপের মতো হলে তো চরিত্র নিয়ে সন্দেহ থাকত। আমার লক্ষ্মী মেয়েটা সব সময় যেন আমার মতোই থাকে।”

আনমনে কথাটা ভেবে সিরাতের মুখে হাসি ফুটে ওঠে।

চলবে??

নিভৃতে তেজস্বিনী পর্ব-০৯

0

#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_৯
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

জরুরি একটা কাজে মাহতাবের সাথে কথা বলার জন্য তার ঘরে এসে মেঝের এক কোণে গাইনী ডাক্তারের ভিজিটিং কার্ড পড়ে থাকতে দেখে ভ্রূদ্বয় সংকুচিত হয়ে আসে সিরাতের। কার্ডটা হাতে নিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে লক্ষ্য করে ঘরে মাহতাব কিংবা নিমু কেউই নেই। চারপাশে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সিরাত।

ফোন হাতে নিয়ে একটা নাম্বারে ডায়াল করে অপরপাশ থেকে কল রিসিভ হওয়ার অপেক্ষা করে সিরাত।

“হ্যালো কে বলছেন?”

“আসসালামু আলাইকুম। আমি সিরাত বলছি। ডাক্তার আফিফা আফরোজ কি আজ রোগী দেখবেন?”

“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আজকে ম্যাম আসবেন না। আগামী চার দিন ম্যাম ছুটিতে থাকবেন। এরপর রোগী দেখা শুরু করবেন পুনরায়।”

“আচ্ছা আপনি আমার সিরিয়াল নাম্বারটা লিখে রাখুন। ম্যাম এলেই আমাকে জানাবেন।”

“ঠিক আছে।”

কথা বলা শেষে কল কেটে দিয়ে সিরাত নাবিহার পাশে শুয়ে তাকে ফিডিং করায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েটা ঘুমিয়ে যায়। একদম ছোট থেকেই নাবিহা ঘুম কাতুরে স্বভাবের মেয়ে। মেয়ের পাশে শুয়ে কখন যেন সিরাতের চোখ লেগে আসে ঘুমে। ইদানীং রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না তার। অনিয়মিত ঘুমের কারণে শরীরও কেমন ক্লান্ত লাগে। ফোনের রিংটোনের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় সিরাতের। গ্রুপ কল দেখে সাথে সাথে কল রিসিভ করে সিরাত। চিরচেনা মানুষগুলোর ছবি দেখে আপনাআপনি ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে তার।

“আসসালামু আলাইকুম।”

“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কী অবস্থা ম্যাম আপনার?”

তামান্নার কথার প্রতুত্তরে সিরাত বলে,

“এতদিন পর আমার কথা মনে পড়ল তোদের?”

“একদম আমাদের দোষ দিবি না। আমাদের কারোর সাথে কোনো যোগাযোগ রেখেছিলি নাকি তুই? তারিন ছাড়া কারোর সাথেই তো যোগাযোগ রাখিসনি।”

“অথৈ তুই আজকাল রাগ করতে শিখেছিস? কবে থেকে তোর এত উন্নতি হলো?”

“সবারই উন্নতি হয়েছে। শুধু তোর অবনতি হচ্ছে, যা আমরা মেনে নিতে পারছি না।”

ফারহানের কথায় মুখ শুকিয়ে আসে সিরাতের। প্রায় পাঁচ বছর পর সবার সাথে কথা হচ্ছে তার। কিন্তু এখানে দুইজন নেই। এটা দেখে সিরাত প্রশ্ন করে,

“আগে বল বাকি দু’জন কোথায়? কলে আমরা নয়জন আছি। ওদের দু’জনের সাথে কি তোদের কারোর কোনো যোগাযোগ নেই?”

“ওদের কেন খুঁজছিস তুই? তুই কি কারোর কথা ভাবিস? ভেবেছিস কখনো?”

অভির এমন উত্তরে সিরাত কিছু বলতে যাবে তার আগেই উর্মি বলে ওঠে,

“এই খবরদার তোরা দু’জন এখন একদম ঝগড়া করবি না। সিরাত আর অভি, দু’জন ভালো করে শোন আমার কথা। আজ তোরা ঝগড়া শুরু করলে তোদের বাড়িতে গিয়ে মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে আসব বলে দিলাম।”

এতক্ষণ ধরে খুব মনোযোগ দিয়ে সবার কথা শুনছিল নকশি। বোনের পাশে গালে হাত বসে দিয়ে নাবিল বলে,

“আমাদের ভাই-বোনকে সবাই ভুলে গিয়েছে। কেউ একবারও আমাদের কথা বলল না।”

“আরেহ মিস্টার প্লেবয় যে!”

সিরাতের মুখে পুরোনো সেই ডাকনাম শুনে নাবিল উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে,

“সুন্দরী তুই ভুলে যাসনি আমাকে?”

“তোকে কীভাবে ভুলব বল? তোর মতো প্লেবয় আমাদের বন্ধুমহলে আর একটাও তো নেই ভাই।”

কথাটা বলে হেসে ওঠে সিরাত। স্কুল, কলেজের প্রায় অর্ধ শতাংশ মেয়ের সাথে এই ছেলের ভাব ছিল। মেয়েদের কাছে সে “নাবিল ভাইয়া” নামেই পরিচিত ছিল। কত মেয়ে যে তাকে ভাইয়া থেকে প্রেমিক বানাতে চেয়েছে তার নির্দিষ্ট হিসাব সিরাত কিংবা বাকি বন্ধুদের কাছে নেই। অন্যদিকে নাবিলের যমজ বোন নকশি সম্পূর্ণ বিপরীত। শান্তশিষ্ট মেয়েটার প্রধান কাজই ছিল পড়াশোনা করা। অন্যরা যেখানে আড্ডা দিতে ব্যস্ত তখন নকশি বইয়ে মুখ গুঁজে পড়তে ব্যস্ত। পড়ুয়া এই মেয়ের প্রেমে পড়ে পড়াশোনা বিমুখ ছেলে ফারহানও বই পাগল হয়ে উঠেছিল। পুরোনো কথাগুলো মনে পড়ে সিরাতের বিষন্নতা কেটে যায়।

“প্লেবয় ভাইকে মনে রাখলি। কিন্তু শান্ত মেয়েটার কথা ভুলে গেলি বল?”

তারিন মজা করে বলে,

“নকশি পিঠা খাব। বানিয়ে নিয়ে আয়।”

নকশি কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দেয়,

“সিরাত তো এখন পাক্কা গৃহিণী হয়ে গিয়েছে। আমাদের এখন রান্না করে খাওয়ানোর দায়িত্ব ওর। কিরে নকশি পিঠা বানাতে পারিস তো?”

“না পারলেও তোদের জন্য শিখে নেব। তোরা কবে আসবি শুধু সেটা বল।”

“এজন্যই তো সবাইকে একসাথে কল দিলাম আমি। আগামী সতেরো তারিখ আমাদের বন্ধুমহল তৈরি হওয়ার দশ বছর পূর্ণ হবে। সেদিন আমরা সবাই একসাথে দেখা করব। আজ ডিসেম্বর মাসের দুই তারিখ। তার মানে আমাদের হাতে সময় আছে মাত্র পনেরো দিন। তারপর আমরা সবাই আবার একত্রিত হব। সকল মান-অভিমান ভুলে আমরা প্রত্যেকে সেই দশ বছরের পুরোনো আমি রূপে ফিরব।”

তারিনের কথায় সিরাত শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“ওরা আসবে তো?”

“হ্যা, সবাই আসবে।”

“তুই নিশ্চিত তারিন? ওদের সাথে যোগাযোগ হয়েছে?”

“না, তবে আমি কথা দিচ্ছি ওদের দু’জনকে আমি যেভাবেই হোক সেদিন নিয়ে আসব।”

“কোথায় দেখা করতে চাচ্ছিস তোরা?”

তামান্নার প্রশ্নের উত্তরে তারিন বলে,

“সেটা এখনো ঠিক করা হয়নি। ঠিক হলে তোদের জানাব।”

“উফ্ আমার তো ভেবেই আনন্দ হচ্ছে। আমরা এগারো জন আবার একসাথে হব।”

এটুকু বলে অথৈ নিজে থেকেই গান গাওয়া শুরু করে। এই মেয়ের গানের গলা অসাধারণ। দিন নেই, রাত নেই, অথৈ এর কাছে সব সময় গান শোনার আবদার করত বাকিরা। অথৈ খুশিমনে সবাইকে গান শোনাত। অন্যদের মতো না না বলে ন্যাকামি করত না কখনোই।

অথৈ এর সাথে গলা মেলায় নাবিল। এই দু’জন বেশ কয়েকবার জুটি বেঁধে গান গেয়েছে। স্কুলের বিদান অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে কলেজের নবীন বরণ অনুষ্ঠান, সবখানেই গানের জন্য প্রশংসিত হয়েছে তারা। একটা সময় তাদের বন্ধুত্ব প্রেমে রূপ নিয়েছিল। তাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক কেন যেন পূর্ণতা পায়নি। বাকি বন্ধুরা শত চেষ্টা করেও তাদের এক করতে পারেনি। বন্ধুত্ব ঠিকই ছিল, কেবল বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল প্রেমের।

গান শেষে সিরাত নকশিকে জিজ্ঞেস করে,

“তোর তো ফারহানের সাথে বিয়ে হয়েছে। তাহলে তোরা এখন আলাদা কেন?”

“আরে ওর তো অন্য জেলায় পোস্টিং হয়েছে। আমি ওর সাথেই থাকি। কিছুদিনের জন্য বাবার বাড়িতে ঘুরতে এসেছি। কয়েকদিন পর চলে যাব।”

“এখন আর একা একা আসতে হবে না তোমার। আমি তো সতেরো তারিখের আগেই যাব। সবার সাথে দেখা করে একেবারে চলে আসব দু’জন।”

“আচ্ছা।”

“আমাদের মেয়েদের বেশিরভাগেরই তো বিয়ে হয়ে গেল। তামান্না, উর্মি আর অথৈ তোরা তিনজন কি বিয়ে করবি না?”

“অথৈ এবং উর্মির কথা জানি না। কিন্তু আমার কাবিন হয়েছে৷ আগামী বছরের শুরুতে উঠিয়ে নেবে।”

“পাঁচ বছরে সবকিছু বদলে গেল তাই না? ছোট ছোট আমরা আজ বড়ো হয়ে গিয়েছি। আগে আমাদের সামলাত সবাই। আর এখন আমরা কেউ কেউ একাই গোটা সংসার সামলাচ্ছি। কেউ বা সংসার সামলানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ছেলেরা চাকরি করতে ব্যস্ত। আর মেয়েরা বউ হতে ব্যস্ত। সময়গুলো এত দ্রুত কেন চলে যায় বল তো?”

সিরাতের কথায় সবাই পুরোনো দিনের কথা ভাবলেও অভি খোঁচা দিয়ে বলে,

“তুই আগের কথা ভাবছিস কেন? বিয়ের জন্য তো পাগল হয়ে গিয়েছিলি। সুখে থাকার জন্য সবকিছু ছেড়ে বিয়ে করলি। এখন খুব সুখে আছিস তো?”

“আহ্ অভি! এমনিতেই মেয়েটা ভালো নেই। এসব বলে ওর কষ্ট আর বাড়িয়ে দিস না।”

“ওকে বলতে দে তারিন। পুরোনো সব রাগ জমিয়ে রেখেছে তো। আজ সেসব উজাড় করে দিক।”

“জানি অভির সাথে যা হয়েছে সেটা ঠিক হয়নি৷ কিন্তু এতে তোর একার দোষ নেই। তোরা তিনজন সমানভাবে দায়ী। তোরা দু’জন তো ঝগড়ায় মেতেছিস। আরেকজনের কোনো খোঁজই পাওয়া যাচ্ছে না।”

অথৈ কথা শেষ করার আগেই উর্মি বলে ওঠে,

“এসব বাদ দে। অতীত ভেবে বর্তমানের সময়গুলো নষ্ট করিস না। পাঁচ বছর তো এভাবেই কেটে গেল। এখন সবাই নতুন করে ভাব সবকিছু।”

চলবে??

নিভৃতে তেজস্বিনী পর্ব-০৮

0

#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_৮
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

“মিস্টার শাহরিয়ার মাহতাব শেখ, আমরা দুঃখিত। কারণ আপনার কোম্পানির সাথে আমাদের কোম্পানি আর কখনো চুক্তিবদ্ধ হবে না। আপনার থেকে আমরা আর কোনো ধরনের পোশাক নেব না। আপনারা নিজেদের কোয়ালিটি ধরে রাখতে পারছেন না। এভাবে চললে আপনাদের সাথে কাজ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।”

কথাটা শুনে মাহতাব যেন বড়সড় রকমের ধাক্কা খায়। নিজেকে কোনোরকমে সামলে নিয়ে ফোনের এপাশ থেকে উত্তেজিত স্বরে বলে,

“এসব আপনি কী বলছেন মিস্টার তৌহিদ? আপনাদের সাথে আমাদের পরিচয় তো দুই/একদিনের নয়। তিন বছর ধরে একসাথে কাজ করছি আমরা। আপনাদের থেকে এবার দশ লক্ষ টাকার অর্ডার নিয়েছিল আমার কোম্পানি। আমার কোম্পানি থেকে ইতোমধ্যে সবগুলো পোশাক বানানো হয়ে গিয়েছে। আজই তো ডেলিভারি হওয়ার কথা।”

“স্যরি মিস্টার শেখ, উপরমহল থেকে যা বলা হয়েছে আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য। আর কখনো আপনার কোম্পানির সাথে আমরা কাজ করতে পারব না।”

কল কেটে যায়। মাহতাব হতাশ হয়ে চেয়ারে বসে পড়ে। তার মা*থা কাজ করছে না। দশ লক্ষ টাকা তো কম নয়। এখন এতগুলো টাকার পোশাক সে কী করবে? এই ভেবেই নিশ্বাস আটকে আসছে তার।

মাহতাবের অফিস কক্ষের পাশ থেকে কেউ একজন সরে যায়। অতঃপর কল করে একজনকে জানায়,

“অর্ডার ক্যান্সেল হয়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায় কোম্পানিকে অনেক লসের সম্মুখীন হতে হবে।”

অপরপাশ থেকে আগন্তুকের বলা কথাগুলো শুনে কল কেটে দেয় সে।

মাহতাব বিষন্ন মনে বাসায় ফিরে সিরাতকে দেখে অসহায় চোখে তাকায় তার দিকে। সেদিন সিরাতের গায়ে হাত তোলা ঠিক হয়নি ভেবে চোখ নামিয়ে নেয়। বাবা, মা আর শ্বশুরবাড়ির সবাই চলে গেলে মা থা য় জিদ চেপে যায় মাহতাবের। এতদিন সিরাতের সব কথা শুনেছে কেবল বাবার ভয়ে। এরপরেও তার বাবা যখন সব জেনে গিয়েছে তখন সিরাতকে সহ্য হচ্ছিল না মাহতাবের। রাগের বশবর্তী হয়ে সিরাতের গায়ে হাত তুলে ফেলেছিল এই কারণে। বিয়ের পর এটাই ছিল প্রথম গায়ে হাত তোলা। মেয়েটা সেদিনের পর থেকে আর কোনো কথায় বলেনি। দেখলেও কেমন যেন এড়িয়ে যায়।

“কী হয়েছে তোমার? তোমাকে এমন অস্থির লাগছে কেন?”

নিমুর প্রশ্নের উত্তরে মাহতাব ছোট্ট করে জবাব দেয়,

“কিছু হয়নি।”

নিমু পুনরায় জিজ্ঞেস করে,

“মিথ্যা বলছ কেন? কিছু তো অবশ্যই হয়েছে।”

“নিমু আমাদের কোম্পানির অনেক বড়ো ক্ষতি হয়ে গেল। দশ লক্ষ টাকা লস খেতে বসেছি আমরা।”

“কী বলছ তুমি? দশ লক্ষ টাকা? কীভাবে হলো এসব?”

“আমি নিজেও জানি না। কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।”

“এই এসবের জন্য তোমার কোম্পানি পথে বসবে না তো? তাহলে তো তুমিও পথে বসে যাবে। আমাদের সংসার চলবে কীভাবে তাহলে? আমি কিন্তু তোমার সাথে অভাবের সংসার করতে পারব না।”

নিমুর প্রশ্নে অবাক হয় মাহতাব। এই মেয়েটা নিজের স্বার্থ ছাড়া কি আর কিছুই ভাবতে পারে না!

“তোমার সাথে এই বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না আমি। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।”

চলে যায় মাহতাব। নিমু একমনে ভাবে,

“আমি বিয়ে করে আসতে না আসতেই এই ছেলের সমস্যা শুরু হয়ে গেল। এরচেয়ে তো বিয়ে না করে প্রেমিকা হয়ে থাকায় ভালো ছিল। না চাইতেই সব পেয়ে যেতাম।”

মাহতাব বাসায় আসার পরপরই মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে যায় সিরাত। তারিনের সাথে দেখা করে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিয়ে চলে যায় অন্য একজনের সাথে দেখা করতে।

রাস্তার পাশে ছোটখাটো একটা বাড়ি। বেশ পুরোনো বাড়ি বলা চলে। এই বাড়িতে অভি একাই থাকে। বছর দুয়েক আগে মা’কে হারিয়েছে। আর ছোটোবেলায় হারিয়েছে বাবাকে। বাড়ির দরজায় আওয়াজ করতেই বেরিয়ে আসে অভি। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, চুলগুলো কোঁকড়ানো। মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আর চোখে উদাসীন ভাব। এই ছেলেটার এমন রূপ দেখে সিরাত বরাবরই হাসে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। মুখে হাসি রেখে ভেতরে ঢুকে বলে ওঠে,

“আজও একইরকম রয়ে গেলি।”

অভি চুলের মাঝে হাত দিয়ে মুচকি হেসে উত্তর দেয়,

“বোকা প্রেমিকেরা কখনো পাল্টায় না। তারা আজীবন একই রয়ে যায়।”

“আর কতকাল এভাবে একা থাকবি শুনি? বিয়ে-শাদি করবি না নাকি?”

“তোর মতো এত বিয়ের শখ নাই আমার। তোর তো সুখে থাকতে ভালো লাগছিল না। তাই এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করে বাচ্চার মা হয়ে গেলি।”

“আমাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলে এখনো শান্তি লাগে?”

“জানি না। তো এতদিন পর আমার কথা মনে পড়ল হঠাৎ?”

“কেন? মনে পড়া বারণ নাকি?”

“ছেড়ে চলে গেলি তো নিজেই। আমাদের সবাইকে ছেড়ে অজানায় পারি জমালি। আমার না খুব জানতে ইচ্ছে করে, ভালো আছিস তো তুই?”

সিরাত মলিন হেসে জবাব দেয়,

“আমি ভালো নেই রে। একদম ভালো নেই। বাস্তবতার সাথে সাথে লড়াই করতে করতে আমি ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি।”

“তেজস্বিনীর মুখে এমন কথা মানায় না।”

“আগের আমি সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছিলাম বিয়ের পর। তবে এখন পুনরায় সেই রূপে ফিরতে হবে।”

“কী হয়েছে তোর? আমাকে সব বিস্তারিত বল।”

“অভি তোকে আমার হয়ে একটা কাজ করতে হবে। বাকি সবকিছু পরে বলব। আপাতত এই দু’টো ছবি রাখ। এদের বিষয়ে সবকিছু জানতে চাই আমি। আর এক্ষেত্রে গোপনে একমাত্র তুই আমাকে সাহায্য করতে পারবি।”

সিরাতের হাত থেকে ছবি দু’টো নিয়ে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে অভি জানায়,

“এদের খোঁজ নিয়ে তুই কী করবি?”

“বললাম না? সবকিছু পরে বলব। তুই যত দ্রুত সম্ভব এদের খোঁজ নিয়ে আমাকে জানাবি।”

“আচ্ছা জানাব।”

“আজ তাহলে উঠি।”

“মেয়েকে নিয়ে এই প্রথম এলি। এক কাপ চা খেয়ে যা।”

“বাচ্চাকে নিয়ে রাতের বেলা বাইরে বের হই না আমি। এখন বাড়িতে যেতে হবে। খুব শীঘ্রই তোর সাথে আমার আবার দেখা হবে। ভালো কথা, যার কথা ভেবে আজও উদাসীন তুই, সে কিন্তু বিবাহিত। ভুলে যাওয়া সহজ নয় জানি। তবুও বলব, ভুলে যা সব। নতুন করে জীবন শুরু কর। যে তোর হবে না তার জন্য আর অপেক্ষা করিস না।”

দরজার সামনে এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে অভি বলে ওঠে,

“এক জীবনে ক’জনকে ভালোবাসা যায় রাত? আমি একতরফা ভালোবেসে ভালো আছি। তোর আমার কথা না ভাবলেও চলবে। তুই বরং নিজেকে নিয়ে ভাব।”

সিরাত অসহায় চোখে পেছন ফিরে তাকায়। অভি মুখ ঘুরিয়ে নেয়। চোখের কোণে জমে থাকা তরল পদার্থ মুছে চলে যায় সিরাত।

“মাম্মা তুমি কাঁদছ?”

মেয়ের কথায় সিরাত হাসার চেষ্টা করে বলে,

“না সোনা, আমি কাঁদছি না।”

“তোমার চোখ লাল হয়ে আছে।”

“গতকাল ঠিকমতো ঘুম হয়নি তো তাই এমন লাগছে।”

ছোট্ট মেয়েটাও হয়তো মায়ের কষ্ট বোঝে। মায়ের কোলে চুপটি করে বসে বুকে মা থা রাখে। মেয়েকে বুকের মাঝে আগলে নিয়ে রাতের শহর দেখে সিরাত।

এইচএসসি পরীক্ষার আগের তিন মাস প্রতিদিন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সন্ধ্যায় প্রাইভেট পড়ে রাস্তার পাশে থাকা টং দোকানে চা খাওয়া, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা, মাঝেমধ্যে হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের উপর গড়াগড়ি খাওয়া, রাস্তার মাঝে উদাসীন হয়ে চলাফেরা করা, এসবই ছিল সিরাতের নিত্যদিনের কাজকর্ম। এগারো জনের বন্ধুমহল ছিল তাদের। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভবঘুরে ছিল সিরাত। মেয়ে হয়েও তার সকল কাজকর্ম ছিল ছেলেদের মতো। মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছেলেদের সাথে মা*রা*মা*রি করা থেকে শুরু করে যেকোনো ঝামেলায় সবার আগে সিরাতকে পাওয়া যেত। সে যে অন্যায় সহ্য করতে পারত না একদমই। তবে যেকোনো বিপদে একে-অপরকে বাঁচানোর জন্য সবাই একসাথে এগিয়ে আসত। বিশেষ করে সিরাতকে রক্ষা করার জন্য সর্বদা ওর সাথে ছিল অভি আর..

“ম্যাডাম নামবেন না? বাড়ির সামনে চলে আসছি।”

রিকশাওয়ালা ছেলেটার কথা শুনে সিরাতের ঘোর কাটে। রিকশা থেকে নেমে একশো টাকার একটা নোট এগিয়ে দেয় সিরাত।

“আমার কাছে ভাঙতি নাই এখন।”

“সমস্যা নেই, বাকিটা ফেরত দিতে হবে না। আচ্ছা, তোমার বয়স কত? দেখে তো বেশি বয়স মনে হচ্ছে না।”

“আমার বয়স উনিশ বছর।”

“পড়াশোনা করো?”

“হ্যা, এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেব।”

“তাহলে পড়াশোনা বাদ দিয়ে রিকশা নিয়ে বের হয়েছ কেন এখন?”

“আসলে গত সপ্তাহে আমার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। এখন অবস্থা তেমন একটা ভালো না। তাই বাবার হয়ে আমি রিকশা নিয়ে বের হয়েছি।”

“আচ্ছা তোমার ফোন আছে?”

“হ্যা আছে।”

“তোমার নাম্বারটা আমাকে দিয়ে যাও। প্রয়োজনে আমি তোমাকে কল করব। আমার বাসা তো চিনেই রাখলে। এরপর কোথাও যাওয়ার হলে আমি তোমাকে কল করব। ফ্রি থাকলে চলে এসো।”

ছেলেটার থেকে নাম্বার নিয়ে বাসার ভেতরে চলে যায় সিরাত। নাবিহা রাস্তায় ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘরে ঢুকে আগে মেয়েকে ভালোভাবে শুইয়ে দেয় সে। তারপর ঘরের দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে দিয়ে নিজে ফ্রেশ হতে চলে যায়।

চলবে??