এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে অধরা,পাশে তার মা বা দুজনেও। আশরাফুল রহমান মেয়ের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে-
-“ আমরা খুব শীগ্রই যাবো। তুমি ঠিকঠাক মতো পৌঁছে ফোন দিয়ে জানাবে কেমন?
অধরা মুচকি হাসলো। চোখের ইশারায় বুঝালো সে জানাবে। আয়েশা রহমান অধরার মাথায় হাত রাখে। কপালে চুমু খায়। এরমধ্যে ভেতর থেকে ইতালি যাওয়ার প্লেনের এনাউন্সমেন্ট কানে বাজে। অধরা ফোনে সময় দেখে নেয়। বেশি সময় নেই। বাবা মা কে দেশের মাটিতে শেষ বারের মতো জড়িয়ে ধরে ল্যাগেজ টা নিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে। আয়েশা রহমান আর আশরাফুল রহমান মেয়ের যাওয়ার পানে তাকালো। অধরা কে যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণে চেয়ে রইলো। চোখের সীমানার বাহিরে চলে যেতেই তারা এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় চলে যায়।
অধরা প্লেনে নিজের জায়গায় ঠিকঠাক মতো বসে পড়ে। মিনিট কয়েক পর প্লেন যখন আকাশ পথে উড়াল দিলো তখন অধরা প্লেনের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকায়। কুয়াশায় ঢাকা আবছা আকাশ টাকে খুব ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করলো। সব ইচ্ছে চাইলেও পূরণ করার সামর্থ্য থাকে না। ইচ্ছে টাকে দমিয়ে রাখলো অধরা। চোখ টা বন্ধ করে নিলো মুহূর্ত গুনছে কখন ইতালির মাটিতে পা রাখবে। আর ভুলে যাবে অযৌক্তিক, ছন্নছাড়া, অনুভূতি।
চিত্রা সপরিবার সহকারে বাবা, চাচা, রায়ান বাদে শপিং মলে এসেছে। সামনে বিয়ে সেজন্য শপিং করতে। শপিং মলের সামনে তারা দাঁড়িয়ে আছে। মূলত তুষারের জন্য। তুষার আসা মাত্রই সবাই শপিং মলে ঢুকে যায়। চিত্রা ঠাই দাঁড়িয়ে রয়। তুষার গাড়ি থেকে নেমে চিত্রার সামনে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ যাওয়া যাক তাহলে?
চিত্রা মাথা নাড়ায়। তুষার চিত্রার হাত ধরে শপিং মলে ঢুকে।
যে যার মতো শপিং করছে,চিত্রার শপিং তুষার নিজে করবে জানিয়েছে। সেজন্য চিত্রা কে নিয়ে প্রথমে শাড়ির দোকানে গেলো। দোকান দার কে শাড়ি বের করতে বলে বউ ভাতের রিসেপশনে আর গায়ে হলুদে পড়বে এমন। দোকান দার প্রায় ১৪-১৫ টা শাড়ি তুষার চিত্রার সামনে রাখে। চিত্রা শাড়ি গুলোর দিকে একবার তাকায়। তুষার চিত্রা কে মন মতো পছন্দ করতে বলে। চিত্রা ভেবে পায় না কোনটা ছেড়ে কোনটা নিবে। তুষার চিত্রা কে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে-
-” এই দোকানের শাড়ি পছন্দ হচ্ছে না? আচ্ছা চলো অন্য দোকানে যাওয়া যাক।
তুষারের কথা শুনে দোকানদারের মুখ টা চুপসে যায়। এতো গুলো শাড়ি তাও নাকি পছন্দ হচ্ছে না।চিত্রা দোকানদারের চুপসে যাওয়ার মুখের দিকে একবার চেয়ে বলে-
-” শাড়ি গুলো এতো সুন্দর যে আমি বিভ্রান্ত হচ্ছি কোনটা রেখে কোনটা নিবো সেটা ভেবে।
সত্যি শাড়ি গুলো মারাত্মক লেভেলের সুন্দর। তুষার মুচকি হেসে দোকানদার কে বলে সব গুলো শাড়ি প্যাক করে দিতে। চিত্রা তুষারের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকালো।
-“ আরে এতো শাড়ি দিতে বলছেন কেনো?
দোকান দার শাড়ি গুলো প্যাক করতে করতে বলে-
-“ আফা বারন করেন ক্যা ভাইরে৷ ভাই তো আপনের জন্য ই নিচ্ছে।
চিত্রা তুষারের দিকে তাকালো। তুষার ইশারায় বুঝালো চুপ থাকতে। চিত্রা চুপ হয়ে গেলো। টাকা বেশি হয়েছে তেনার, তাই খরচ করার মতো জায়গা পাচ্ছে না দেখে এখানে খরচ করছে। এমনটা ভেবে নিলো চিত্রা।
তুষার বিল পে করে চিত্রা কে নিয়ে লেহেঙ্গার দোকানে গেলো। ব্লাক কালারের একটা লেহেঙ্গায় চোখ আটকে যায় চিত্রার। বিয়েতে সে ব্লাক পড়তে চাচ্ছিল না কিন্তু এই ব্লাক কালারের লেহেঙ্গা টা থেকে চোখ সরানো দুষ্কর। ব্লাকের উপর গোল্ডেন কালারের কারুকাজ সত্যি মারাত্মক লাগছে।
এদিকে তুষার, রেড,ব্লু,অরেঞ্জ, টিয়া,গোল্ডেন সব কালারের লেহেঙ্গা নাড়িয়ে নাড়িয়ে দেখছে আর বলছে কোনটা নিবে। চিত্রা কে চুপ থাকতে দেখে তুষার চিত্রা কে বলে-
-“ কি হলো চয়েস করো কোনটা নিবে।
চিত্রা সামনে ঝুলতে থাকা ব্লাক কালারের লেহেঙ্গার দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ আমি ঐ ব্লাক লেহেঙ্গা টা নিবো।
তুষারের কপালে দু ভাজ পড়ে।
-“ তোমার না ব্লাক পছন্দ না?
-“ ভালোবাসার মানুষ টা যেখানে আস্ত ব্লাক লাভার সেখানে আমি হেটার্স হই কি করে।
-“ সত্যি ওটা নিবে?
-“ হ্যাঁ।
তুষার ব্লাক কালারের লেহেঙ্গা টা প্যাক করতে বলে দোকানদার কে। চিত্রা কে নিয়ে জুয়েলারির দোকানে গিয়ে নিজ পছন্দের কয়েকটা জুয়েলারি কিনে নেয় তুষার। বেশি নেয় নি,কারন তুষারের মা অলরেডি মেয়ে আর ছেলের বউয়ের জন্য জুয়েলারি বানিয়ে রেখেছেন। অতঃপর জুতা আর কসমেটিকস কিনে নিলো।
চিত্রা শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তুষারের কার্যকলাপ দেখলো। তার তো একা নিজের বিয়ে নয়। শুধু তারই শপিং করলো। চিত্রা কোমড়ে হাত গুঁজে বলে-
-“ আপনার শপিং কখন করবেন?
তুষার প্যাক গুলো এক এক করে গাড়ির ভেতরে রেখে গাড়িটা লক করে বলে-
-“ আমার শপিং করা আছে।
-“ কই আমাকে তো দেখানো দূরে থাক বলেন ও নি।
-“ এটা নিয়ে এখন তর্কাতর্কি না করে চলো ভেতরে ক্ষিদে পেয়েছে তো।
চয়নিকা বেগম, রিক্তা বেগম,তানিয়া বেগম,রিয়া নিজেদের মতো কেনাকাটা করছে। তৃষ্ণা ঘুরেঘুরে দেখছে। রাফি চট করে তৃষ্ণার হাত ধরে সাইডে নিয়ে একটা দোকানে ঢুকে। দোকানদার কে ডার্ক রেড কালারের লেহেঙ্গা বের করতে বলে। দোকানদার লেহেঙ্গা বের করে । তৃষ্ণা লেহেঙ্গার দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ লেহেঙ্গা দিয়ে কি করবেন আপনি? এগুলো তো বিয়ের লেহেঙ্গা।
-“ হ্যাঁ তোমার আর আমার বিয়ের।
-” আমাদের বিয়ে হতে মাস কয়েক দেরি আছে। এখনই কিনে রাখবেন কেনো? আরো নতুন ডিজাইনের বের হবে তখন।
রাফি বিরক্ত হলো।
-“ অনুষ্ঠান পড়ে হবে কিন্তু কাবিন তো পরশুই হচ্ছে ব্রো আর চিতার বিয়ের দিন।
তৃষ্ণা অবাক হয়ে বলে-
-“ কাবিনের জন্য তাই বলে লেহেঙ্গা!
-“ হ্যাঁ, আমার ইচ্ছে এখন সেটাকে ফুলফিল করার রেসপন্সিবিলিটি তোমার।
-“ তা আপনিও কি শেরওয়ানী পড়বেন?
-“ হোয়াইট কালারের পাঞ্জাবি পড়বো।
রাফি লেহেঙ্গার প্যাক টা নিয়ে তৃষ্ণার হাতে ধরিয়ে দেয়। যেভাবেই হোক বিয়ে তাই বলে তারা সাজবে না এটা আবার হয় নাকি?
সবার কেনাকাটা শেষে মলের ফোর ফ্লোরে গিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে খেতে বসে সবাই। খাওয়া দাওয়া শেষ করে গাড়ির সামনে এসে দরজা খুলে প্যাক গুলো রাফির গাড়িতে দেয়। তৃষ্ণা আর তানিয়া বেগম তুষারের গাড়িতে উঠে বসে। তুষার চিত্রার খোলা চুল গুলো সবার অগোচরে কানে গুঁজে দিয়ে বলে-
-“ বাসায় পৌঁছে ফোন দিবে।
চিত্রা সম্মতি জানায়। রাফিকে ইশারায় বলে সাবধানে যাবি। রাফিও ফের সেম ইশারা দিয়ে বলে-
-“ তুমিও সাবধানে যাবে। অমূল্য রত্ন রয়েছে আমার তোমার গাড়িতে।
তুষার স্মিত হেঁসে রাফির কাঁধে একবার হাত রেখে চলে যায়। রাফি চিত্রা কে গাড়িতে বসতে বলে নিজেও ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি চালানো শুরু করে।
বাড়িতে আয়োজনের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। বিয়েতে মাঝারি আকারে হচ্ছে। খুব বড় ও না আবার খুব ছোট ও না। বাড়ির ছাঁদে পেন্ডেল সাজানো হয়েছে। চিত্রা সবেই পার্লার থেকে বাড়ি ফিরেছে। গায়ে তার লাল পাড়ের হলুদ শাড়ি। শরীর জুড়ে তাজা ফুলের গয়না। সোফার এক কোনায় চোখ যেতেই দেখে রাতুল তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। চিত্রা দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। বিষয় টা বাজে লাগছে তার। হাতে থাকা মুঠোফোন টা বেজে উঠায় চিত্রা ফোনটা মুখের সামনে ধরে দেখে তুষার ভিডিও ফোন দিয়েছে।
চিত্রা ফোনটা রিসিভ করে ব্যাক সাইড ক্যামেরা অন করে রুমে চলে যায়। তুষার হঠাৎ ক্যামেরার সামনে চিত্রা কে না দেখে বলে-
-” এই মেয়ে ক্যামেরার সামনে নেই কেনো তুমি?
চিত্রা ক্যামেরার সামনে নিজের মেহেদী রাঙা হাত টা নাড়িয়ে বলে-
-“ আপনি আমায় দেখার জন্য ফোন দিয়েছেন কিন্তু আমি তো দেখা দিবো না।
-“ কেনো?
-“ আমার ইচ্ছে তাই।
-“ ফেসই তো দেখতে চাচ্ছি কুইক সামনে আসো।
-“ নো নেভার।
-“ আমি চলে আসবো তাহলে।
-“ তাতে আমার কি?
-“ লজ্জায় ফেলে দিয়ে আসবো।
-“ কেটে দিবো কল তাহলে।
-” এই না। বলছি কি একটু আসো সামনে তোমাকে ফুলের সাজে দেখতে ইচ্ছে করছে।
-“ বললাম না দেখা দিবো না।একদম কাল এসে দেখবেন।
-“ কালকের জন্য তুষার অপেক্ষা করতে পারবে না। তুষার চলে আসলো বলে।
কথাটা বলেই তুষার ফোন কেটে দেয়।
(হয়তো দু এক পর্বে গল্পটা শেষ হয়ে যাবে। আজ চেষ্টা করবো বোনাস পার্ট দেওয়ার। হ্যাপি রিডিং)
একদিন যায়, দুইদিন যায়, পরপর নয়টা দিন চলে যায়। নিজের ছোট্ট মেয়েটাকে পাগলের মতো খুঁজেও তার কোনো সন্ধান পায় না সিরাত। দিশেহারা মা তার ছানাকে না পেয়ে ক্লান্ত পথিকের ন্যায় বসে থাকে তার পথ চেয়ে। মেয়েকে হারিয়ে যখন সে পাগলপ্রায় তখনই তার জীবনে ঘটে আরেক অঘটন। যে মানুষটা বটবৃক্ষের মতো তার ছায়া হয়ে ছিল সেই বাবা নামক বটগাছটা তাকে ছেড়ে চলে যায় বহুদূরে। এতটাই দূরে যেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না। পুরো পরিবারে কীভাবে যেন অন্ধকার নেমে আসে। বাড়িতে থাকতেও আর ইচ্ছা করে না। মায়ের চোখের পানি দেখতে দেখতে দমবন্ধ হয়ে আসে সিরাতের। তার বন্ধুমহলের সকলে তার পাশে থাকলেও মানসিক শান্তির দেখা সে আর পায় না। একলা বাড়িতে মা-মেয়ের দিন কাটে কেবল অশ্রু ঝরিয়ে।
“তারপর কী হলো মাম্মা?”
মেয়ের কথায় সিরাত বিষণ্ণ মনে উত্তর দেয়,
“তোমাকে খুঁজে পেয়েছিলাম প্রায় একুশ দিন পর। নিমু তোমাকে এক দম্পতির কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। আমার বন্ধুরা পাশে ছিল বলেই হয়তো তোমাকে আবার নিজের কোলে ফিরে পেয়েছি। ইভান আমাকে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে সাহায্য করেছে। বলতে পারো শেষ মুহূর্তে সেই ছেলেটা বাজিমাত করে দিয়েছিল। নিজের জানপ্রাণ এক করে তোমাকে খুঁজে বের করেছিল সে। তোমাকে ফিরে পেয়ে আমি আর তোমার নানুমনি নতুন করে বাঁচার কারণ খুঁজে পেয়েছি। জানো আম্মু? তোমার নানুমনি বেঁচে আছে শুধুই তোমার আর আমার জন্য। কখনো যদি আমার কিছু হয়ে যায়, তুমি কিন্তু নানুমনিকে যত্নে রাখবে। সামান্য কষ্টও যেন তাকে স্পর্শ করতে না পারে। পারবে তো?”
পনেরো বছর বয়সী নাবিহা মায়ের হাতের উপর হাত রেখে কথা দেয়,
“এ দেহে প্রাণ থাকতে আমি তোমাকে আর নানুমনিকে একটুও কষ্ট পেতে দিব না মাম্মা। আমার জগতে যে তোমরা ছাড়া আর কেউ নেই। তোমাদের তো ভালো থাকতেই হবে। আর তোমাদের ভালো রাখব আমি। কথা দিলাম তোমাকে।”
মেয়ের কথায় সিরাত সযত্নে তাকে নিজের বুকের মাঝে আগলে নেয়। মা-মেয়ের এমন সুন্দর মুহূর্তের সাক্ষী হতে সেখানে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ হাতে হাজির হয় মিসেস ইতি ইসলাম। নাতনির পাশে বসে তিনি বলেন,
“আমাদের ছোট্ট নাবিহা আজ কত বড়ো হয়ে গেল!”
নাবিহা নানুমনিকে দেখে হেসে তাকে জড়িয়ে ধরে।
“নানুমনি আমি তো ছোট-ই আছি।”
কিছু একটা ভেবে নাবিহা সিরাতকে প্রশ্ন করে,
“আচ্ছা মাম্মা আমাকে যে তোমার কাছ থেকে কেঁড়ে নিয়েছিল পরবর্তীতে তার কী হয়েছে?”
মেয়ের এহেন প্রশ্নে সিরাত এক বাক্যে উত্তর দেয়,
“হয়তো সে আজও শাস্তি পাচ্ছে!”
ফোনের রিংটোনের আওয়াজে সিরাত ফোন হাতে নেয়। দীর্ঘ সাড়ে চার বছর পর চিরচেনা সেই নাম্বার থেকে কল আসতে দেখে সিরাত উঠে চলে যায় নিজের ঘরে। অতঃপর কল রিসিভ করে বলে,
“হ্যালো!”
“ভালো আছ?”
“যেমন থাকার কথা তেমনই আছি।”
“আমাদের মেয়ে কেমন আছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছে।”
“তার কি বাবার কথা একবারও মনে পড়ে না?”
“কি জানি!”
“আচ্ছা একটা প্রশ্ন করব তোমাকে?”
“হুম।”
“তুমি কেন আমার এত বড়ো ক্ষতি করলে তার কারণটা কাউকে জানালে না কেন?”
“তোমার জীবন থেকে সবাই হারিয়ে গিয়েছে। হাতে গোনা কয়েকজন তোমার পাশে থেকেছে। এসব জানলে তারাও ঘৃণার চোখে তাকিয়ে থাকত তোমার দিকে। অনেক তো কষ্ট পেলে। আজও কষ্ট পাচ্ছ। স্ত্রী হিসেবে বাকি কষ্টটুকু নাই-বা দিলাম তোমাকে। বেঁচে থাকার জন্য মানসিক শান্তির ভীষণ দরকার। সেটাই যদি না থাকে, তাহলে তুমি বাঁচবে কীভাবে? এই যে গুমরে গুমরে ম*রছ এটাই তোমার সবচেয়ে বড়ো শাস্তি। বুঝলে?”
“হুম বুঝলাম। শুধু তোমাকেই বুঝতে পারিনি কখনো। এই আফসোস আমার আজন্ম থেকে যাবে।”
“রাখি এখন?”
“মেয়ের সাথে একটু কথা বলিয়ে দিতে পারবে?”
মাহতাবের আবদারে সিরাত নাবিহার কাছে গিয়ে বলে,
“তোমার বাবা তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে।”
এর উত্তরে নাবিহা বলে,
“বাবা? কে বাবা? যে বাবা আমার মা’কে কষ্ট দিয়েছে তাকে আমি ঘৃণা করি। বাবা শব্দটার প্রতি আমার কেবল ঘৃণা আছে, কোনো ভালোবাসা নেই!”
ফোনের ওপাশ থেকে এই কথা শুনে মাহতাবের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। ফোন কেটে দিয়ে সে ভাবে,
ঘড়ির কাঁটায় যখন রাত একটা বেজে সাইত্রিশ মিনিট, তখন সিরাত স্মৃতিচারণ করতে ব্যস্ত। তার সামনে পড়ে আছে একটা খোলা ডায়েরি। যেখানে লেখা,
“জীবন থেকে বারোটি বছর পেরিয়ে গেল। ছাব্বিশ বছর বয়সে তেজস্বিনী রূপে ধরা দেওয়া আমি আজ আটত্রিশ বছর বয়সী একজন পূর্ণ নারী। এই আটত্রিশ বছরে কী পেলাম আর কীই-বা হারালাম তা জানা নেই আমার। শুধু এটুকু জানি, সবকিছু মিলিয়ে ভালোই আছি। জীবন দিব্যি চলে যাচ্ছে।”
স্মৃতিচারণ করতে করতেই রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে যায়। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে সিরাত বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। ঘন্টা খানেকের রাস্তা পেরিয়ে একটা বাড়ির ভেতরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা আটকে দেয় সিরাত। তাকে দেখে নার্স সুমি বলে,
“আপু আপনি আজ আসবেন সেটা বলেননি তো।”
“তুরাগের ঠিকমতো খেয়াল রাখছ তো তুমি?”
“হ্যা আপু। সেটা তো রাখছি। কিন্তু ওনার খেয়াল রেখেই বা কী লাভ? সে তো জীবন্ত লা*শ হয়ে বেঁচে আছে।”
“শেষ দিন অবধি ওর এভাবেই বাঁচতে হবে। যাইহোক, এখানে পঞ্চাশ হাজার টাকা আছে। তোমার দুই মাসের অগ্রীম বেতন।”
“আপনার মতো মানুষ আমি আর একটাও দেখিনি আপু। আমার দুঃসময়ে আপনি যেভাবে পাশে দাঁড়িয়েছেন তা আমি কখনো ভুলব না। আপনার জন্যই আমি আমার পরিবারের হাল ধরতে পেরেছি।”
“তুমি নিজ যোগ্যতার জন্য এই টাকা পাচ্ছ। এটা তোমার পারিশ্রমিক। তার জন্য ধন্যবাদ দিতে হবে না। শুধু মনে রেখো, হালাল পথে উপার্জন করবে। কখনো অসৎ পথ অবলম্বন করবে না। তাহলেই তুমি সফল হতে পারবে।”
“আপনার প্রতিটা কথা আমি মেনে চলার চেষ্টা করব আপু। সব সময় হালাল পথে উপার্জন করব ইনশাআল্লাহ।”
“এখন আমাকে যেতে হবে৷ আসি আমি।”
“আচ্ছা।”
ঘরে গিয়ে এক নজর তুরাগকে দেখে বেরিয়ে আসে সিরাত। এখন তাকে আরেক জায়গায় যেতে হবে। পথিমধ্যে কল আসায় সিরাত নিজ গন্তব্য পরিবর্তন করে বাড়িতে চলে আসে।
সিরাতকে দেখে সিয়াম এগিয়ে এসে বলে,
“এত সকালে কোথায় গিয়েছিলে আপু?”
“একটা কাজ ছিল। তোরা কখন এলি? আজ যে আসবি সেটা বলবি না আমাকে?”
“নিতু নাবিহাকে দেখতে চাইছিল। তাই নিয়ে এলাম।”
“ভালো করেছিস। নিতু কোথায়?”
“নাবিহার ঘরে। ওদের দু’জনের কাজই তো গল্প করা।”
“করুক না, সমস্যা নেই।”
“আপু!”
“হুম বল।”
সিয়াম লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলে,
“সেদিন যদি আমার রিকশায় তুমি না উঠতে তাহলে হয়তো আমার জীবনটা এত সুন্দর হয়ে উঠত না।”
“তোর ভাগ্যে ভালো কিছু বলেই তুই এসব পেয়েছিস।”
“সবটা এত সহজ হতো না যদি তুমি আমার পাশে এসে না দাঁড়াতে। আমি আজ সেলস এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে কাজ করতে পারতাম না। পড়াশোনা শেষ না করে হয়তো রিকশাচালক হয়েই বাঁচতে হতো আমাকে। বাবা চলে যাওয়ার পর পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারতাম না। সবকিছু তো তোমার জন্যই হয়েছে। এমনকি নিতুর মতো একজনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছি তোমার জন্যই। আমাকে আপন ভাইয়ের থেকে কখনো কম ভালোবাসা দাওনি তুমি।”
“আল্লাহ চেয়েছে বলেই তুই এত সুন্দর একটা জীবন পেয়েছিস। সবকিছুর জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় কর। আমিও খুব ভাগ্যবতী যে তোর মতো একজনকে ভাই হিসেবে পেয়েছি। আমাদের দুঃসময়ে তুই আর খালামনি পাশে থেকেছিস। এটাই বা কয়জন করে?”
“আপু!”
সিরাতকে জড়িয়ে ধরে সিয়াম বলে,
“তোমার মতো মেয়ে যেন ঘরে ঘরে জন্ম নেয়। তাহলে আমাদের পৃথিবী অন্যরকম সুন্দর হয়ে উঠবে।”
“ধুর বোকা, কেউ কারোর মতো হতে পারে না। তবে হ্যা, নিজেকে এমনভাবে গড়ে তোলা উচিত যেন তাকে দেখে আরও দশটা মানুষ বেঁচে থাকার উৎসাহ পায়।”
“সেদিক থেকে তো তুমি সফল। তোমার জন্য শতশত মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে। নীলাদ্রির অধিকাংশ কর্মচারী তো মেয়ে। তাছাড়া তুমি তো একজন সমাজসেবক। প্রতিনিয়ত কত মানুষের উপকার করো তার হিসেব নেই।”
“আচ্ছা হয়েছে। আমি এখন ঘরে যাচ্ছি। ফ্রেশ হয়ে এসে তোদের সাথে গল্প করব।”
ঘরে এসে সিরাত ফ্রেশ হয়ে নেয়। কেন জানি না আজ বন্ধুদের কথা খুব মনে পড়ছে তার। ছবির একটা অ্যালবাম বের করে সেখানে হাত বুলিয়ে দেয় সে। একের পর এক ছবিগুলো দেখে মনে একটা প্রশান্তি কাজ করে। তারিন, অথৈ, মাওয়া এদের তিনজনের একসাথে বিয়ে হয়েছে একই মঞ্চে। এখন তারা সবাই সুখে আছে। অভি আর মাওয়ার যমজ মেয়ে হয়েছে। অথৈ আর নাবিলের ছেলের বয়স এখন প্রায় দশ বছর। তারিন একজন ডাক্তারকে বিয়ে করে বেশ সুখেই আছে। তাদেরও মেয়ে হয়েছে। তামান্না এখন ইতালিতে থাকে তার স্বামীর সাথে। পারিবারিকভাবে বিয়ে হওয়ার পরেও তারা দু’জন ভীষণ ভালো আছে। নকশি আর ফারহান তাদের দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে এখন লন্ডন প্রবাসী। উর্মি এখন সিরাতের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গায় ভালো আছে। হয়তো ইভানও ভালো আছে। নাবিহাকে পাওয়ার পর সেই যে সে উধাও হলো, আজও তার খোঁজ পায়নি সিরাত। অনেক বার চেষ্টা করেছিল যোগাযোগ করার। কিন্তু পারেনি।
অ্যালবামের ভাজে ভাজে সব স্মৃতিরা ছুটে বেড়ায় প্রতিনিয়ত। সবার সাথে যোগাযোগ থাকলেও ইভানের জন্য মন কেমন করে সিরাতের। সবার সাথে তো বছরে একবার হলেও দেখা হয়। কিন্তু ইভানের সাথে গত বারো বছরে একবারও কথা হয়নি তার। সিরাতের খুব জানতে ইচ্ছা করে, কেমন আছে ইভান? সে কি নতুন করে জীবন শুরু করেছে? সেই জীবনে ভালো আছে তো ছেলেটা? সিরাত মনেপ্রাণে চায় ইভান যেন খুব ভালো থাকে।
দিন পেরিয়ে যায়, সিরাতের বয়স বাড়ে। কিন্তু অন্যায় দেখলে সে আজও তেজস্বিনী রূপে ফিরে আসতে দু’বার ভাবে না।
অন্ধকারাচ্ছন্ন এক ঘরে প্রবেশ করে সিরাত ডাকে,
“নিমু? কোথায় তুমি? সামনে এসো আমার।”
জীর্ণশীর্ণ শরীরে সিরাতের সামনে এসে দাঁড়ায় নিমু। তার চোখগুলো একদম ভেতরে ঢুকে গিয়েছে৷ চোয়াল ভেঙে গিয়েছে। চেহারায় আগের মতো আর উজ্জ্বলতা নেই। ভাঙা গলায় নিমু বলে,
“আমাকে ছেড়ে দাও সিরাত। দীর্ঘ বারো বছর যাবত আমি এই বদ্ধ ঘরে আটকে আছি। আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। খুব কষ্ট হয় আমার।”
“এটুকু শাস্তি কি তোমার প্রাপ্য নয়? আমার সাথে তুমি যা যা করেছ তারপর তো তোমাকে বাইরে ছেড়ে রাখা যেত না। আমি তোমাকে শারীরিকভাবে একটুও আঘাত করিনি। শুধুমাত্র এই বদ্ধ ঘরে বন্দী করে রেখেছি তোমাকে। তোমার দেখভালের জন্য এখানে সর্বদা দু’জন থাকে। তাছাড়া খাবার থেকে শুরু করে দৈনন্দিন সবকিছুই তো তুমি ঠিক সময়ে পেয়ে যাচ্ছ। তাহলো সমস্যা কোথায়? একটা কথা মনে রেখো, বেঁচে থাকাকালীন সময়ে তুমি আর কখনো বাইরের দুনিয়া দেখতে পারবে না। এটাই তোমার শাস্তি।”
সিরাত চলে যাওয়ার আগে নিমুকে বলে,
“তোমার বাবা-মা ভালো আছে। তোমার ভাই এখন আর নে*শা করে না। জানো? তোমার ভাই নাফির বিয়ে হয়েছে। আমি নিজে দায়িত্ব নিয়ে ওকে ভালো পথে ফিরিয়ে এনেছি। যা কিছু তোমার করার কথা ছিল সেই সবকিছু আমি দায়িত্ব নিয়ে সম্পূর্ণ করেছি। বিনিময়ে এবার অন্তত আমার প্রতি একটু কৃতজ্ঞ হও।”
কথাটা বলে সিরাত বের হয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়। বাইরে থেকে সে নিমুর কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। কিন্তু এই আওয়াজ তাকে একটুও ব্যথিত করে না।
ব্যস্ত রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সিরাত বলে,
“এই ব্যস্ত শহরে সবারই না বলা কিছু গল্প থাকে। আমারও আছে। এই যে আমি এতজনের মাঝে থেকেও পরিপূর্ণ মানসিক শান্তি পাই না। রোজ রাতে নিয়ম করে কাঁদতে হয়। অতঃপর ভোর হলে হাসিমুখে ঘরের দরজা খুলতে হয়। বদ্ধ ঘরে আমি কেমন থাকি সেই গল্পটা কেউ জানে না। আমার গল্পটা কেবল আমি জানি। আমি ভালো আছি নাকি ভালো নেই তা জানি না। শুধু এটুকু জানি, তেজস্বিনীদের কখনো ভেঙে পড়তে হয় না। তাদের বাঁচতে হয়। তাদের সমাজকে দেখিয়ে দিতে হয়, চুপ করে সহ্য করা আর নয়। বাঁচতে হলে প্রতিবাদ করে বাঁচতে হবে। স্বাধীনভাবে বাঁচতে হবে। সর্বোপরি বেঁচে থাকার মতো করে বাঁচতে হবে। কারণ, তেজস্বিনীরা কখনো মা*থা নত করে ম*রতে পারে না। তেজস্বিনীরা মা*থা উঁচু করে বাঁচে, বীরের মতো ম*রে।”
অন্ধকারাচ্ছন্ন বদ্ধ কুটিরে হিমশীতল এক স্থানে বেঁধে রাখা হয়েছে দু’জনকে। ঠাণ্ডায় জমে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে তাদের। একে তো ঠাণ্ডার মাঝে টেকা মুশকিল, তার উপর হাত, পা বাঁধা। চিৎকার করার উপায়টুকু নেই। মুখ যে বাঁধা কালো কাপড়ে। দীর্ঘ দুই ঘন্টা যাবত এখানে বন্দী হয়ে আছে মাহতাব আর তুরাগ। কখনো ঠাণ্ডার পরিমাণ কমে গিয়ে তাদের স্বস্তি দিচ্ছে তো কখনো পরিমাণ বেড়ে গিয়ে তাদের মা*রতে উদ্যত হচ্ছে। কথা বলার শক্তিটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছে তারা।
ঘরের দরজা খুলে ধীর পায়ে ঘরে প্রবেশ করে এক মানবী। চোখেমুখে তার উপচে পড়া রাগ লক্ষণীয়। চোখ বাঁধা না থাকায় তাদের দু’জনের বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না যে এটা সিরাত। তুরাগ তো আগে থেকেই জানত এবার সিরাতের হাতে পড়লে তার আর রক্ষা নেই। কিন্তু মাহতাব! সে তো তার প্রাক্তন স্ত্রীর কঠিন রূপ আজও নিজ চোখে দেখেনি।
সিরাতের পাশাপাশি ঘরে প্রবেশ করে তার বন্ধুমহলের সবাই। শেষে ফারহান এসে দরজা আটকে দেয় ভেতর থেকে। নাবিলের হাতে একটা ব্যাগ দেখে তুরাগের নিঃশ্বাস যেন আটকে আসে।
সিরাত হাসিমুখে তাদের কাছে এগিয়ে যায়। দুজনকে বরফের মাঝে আটকে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি পুরো ঘরে এয়ার কুলার আর হিটার সেট করা।
একটা চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে সিরাত। আজ তাকে চিনতে খানিকটা বেগ পেতে হয়েছে মাহতাবের। কারণ স্ত্রীকে এমন রূপে আগে কখনো সে দেখেনি। গায়ে একখানা কালো রঙের হুডি জড়ানো। চুলগুলো উঁচু করে বাঁধা। হাতে একটা ঘড়ি। আর পায়ে কালো রঙের জুতা। যেন সে মা*রামা*রি করার জন্য একদম প্রস্তুত হয়ে এসেছে।
“কী? অবাক হয়ে যাচ্ছ আমাকে দেখে? ভেবেছিলে আমাকে মে*রে মাটির নিচে রেখে আসবে। কিন্তু ভাগ্যের কি খেলা দেখো। আমি দিব্যি সুস্থ হয়ে তোমাদের সামনে বসে আছি। আর তোমরা বন্দী অবস্থায় ছটফট করছ আমার সামনে। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে আমি তোমাদের জায়গায় চলে এসেছি। আর তোমরা আমার জায়গায় চলে এসেছ। ব্যাপারটা সুন্দর না?”
হাসিমুখে কথাগুলো বলে সিরাত দু’জনের মুখের বাঁধন খুলে দেয়। এতক্ষণে যেন দু’জন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে সক্ষম হলো।
“তোমাদের জন্য এত সুন্দর ঠাণ্ডা একটা জায়গা কেন নির্ধারণ করেছি জানো? কারণ তোমাদের শরীরে অনেক তেজ। মা*থা সব সময় গরম হয়ে থাকে। এখন একটু ঠাণ্ডা হাওয়া দরকার তোমাদের। পায়ের নিচে বরফ থাকায় আমার পাচ্ছ না? দাঁড়াও, তোমাদের আরাম আরেকটু বাড়িয়ে দিচ্ছি।”
কথাটা বলে সিরাত মাওয়াকে ইশারা করে এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিতে। তাদের প্রত্যেকের গায়ে শীতবস্ত্র রয়েছে। কেবল মাহতাব আর তুরাগের শরীরে একটা প্যান্ট এবং টিশার্ট জড়ানো। ঠাণ্ডার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মাহতাব কাঁপতে কাঁপতে বলে,
“দয়া করে এসব বন্ধ করো। অনেক ঠাণ্ডা লাগছে। সহ্য করতে পারছি না আমরা।”
“এটা কোনো কথা হলো? এত অল্পতেই তোমাদের শরীরে তেজ সব গায়েব হয়ে হলো? কেমন পুরুষ মানুষ তোমরা হ্যা?”
সিরাতের কথায় অভি মুচকি হেসে বলে,
“আরে কা*পুরুষ বল। এদের পুরুষ বলে আমাদের পুরুষ জাতিকে অপমান করিস না।”
“হুম সেটাও ঠিক। আচ্ছা এদের দু’জনের সাথে কী কী করা যায় বল তো? একে তো এরা দু’জন মিলে আমার আর মাওয়ার জীবন নষ্ট করেছে। আমার মেয়েটা এদের জন্য অনেক কষ্ট পেয়েছে। আমার সবচেয়ে কাছের একজনের শরীর থেকে এরা র*ক্ত ঝরিয়েছে। বাকি রইলাম আমি। আমাকে যে কষ্ট এরা দিয়েছে এটা তো ম*রার আগ পর্যন্ত আমি ভুলব না। এত এত অন্যায়ের শাস্তি তো সেরকমই হওয়া উচিত তাই না?”
পাশ হতে তারিন আর উর্মি একত্রে বলে ওঠে,
“অবশ্যই।”
“আজকে যা যা হবে সেটাও কী লাইভে দেখাব?”
ইভান কিছু একটা ভেবে উত্তর দেয়,
“না, আজকের এসব লাইভে দেখানোর দরকার নেই। পরবর্তীতে থানা, পুলিশ হতে পারে। আজকে যা যা হবে তা শুধু আমাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।”
“আচ্ছা। তাহলে এক কাজ করি আমরা। উর্মি আর তামান্না ভিডিয়ো করবি। বাকিরা আমাকে সাহায্য করবি।”
সবাই সিরাতের কথায় সম্মতি দিলে সিরাত নাবিলকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“নাবিল ব্যাগ থেকে ব্লে*ড আর লবণের প্যাকেট বের কর।”
ব্যাগ থেকে এসব বের করে সিরাতের হাতে দিলে সিরাত প্রথমে তুরাগের কাছে এগিয়ে যায়৷ তুরাগের মা*থার চুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ করে একটু জোরে টান দিয়ে বলে,
“তোমার মা*থা তো সব সময় গরম থাকে তাই না? ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা করছি।”
কথাটা বলে আলতো হাতে তুরাগের মা*থার চুলগুলো কেটে ফেলে সিরাত। শেষে গিয়ে কয়েক জায়গায় ইচ্ছাকৃতভাবে কেটে ফেলে। ফলস্বরূপ মা*থার বিভিন্ন জায়গা থেকে র*ক্ত ঝরতে শুরু করে। এর মাঝে মুঠোভরতি লবণ নিয়ে সযত্নে তুরাগের সম্পূর্ণ মা*থায় লবণ মাখিয়ে দেয়। তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করতে শুরু করে তুরাগ। সিরাতের এমন রূপ দেখে আত্মা শুকিয়ে যায় মাহতাবের। ভয়ার্ত চোখে সে তার প্রাক্তন স্ত্রীর দিকে তাকালে সিরাত হেসে বলে,
“দীর্ঘ পাঁচ বছর একসাথে সংসার করেছি আমরা। তোমার মনে আছে? তোমার সিল্কি চুলগুলো আমার ভীষণ প্রিয় ছিল। চলো, এখন তোমাকে একটু ভালোবেসে কাছে টেনে নিই।”
মাহতাবের কাছে গিয়ে তার চুলে আলতো হাতে বিলি কেটে দেয় সিরাত। অন্য সময় হলে মাহতাব সময়টা উপভোগ করত। কিন্তু আজ তার ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে। সে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে,
“সিরাত আমার সাথে এমন করো না। আমি আর কখনো তোমার কোনো ক্ষ*তি করব না। দয়া করে আমাকে ছেড়ে দাও। আর তোমাকে মা*রার পরিকল্পনা আমার ছিল না। এসব তুরাগের পরিকল্পনা ছিল।”
“আহারে আমার নিরীহ স্বামী! তুমি তো দুধে ধোয়া তুলশী পাতা। তুমি তো কোনো অন্যায় করতেই পারো না তাই না?”
কথাটা বলে মাহতাবের চুলগুলো খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরে সিরাত। ব্যথায় আহ্ শব্দ করে চোখ বন্ধ করে নেয় মাহতাব। সিরাত একইভাবে মাহতাবের চুলগুলো কেটে সম্পূর্ণ মা*থায় লবণ মাখিয়ে দেয়।
তামান্না কৌতুহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“তুই কি ওদের জানে মা*রবি?”
“আরে না। ওদেরকে মা*রব কেন আমি? আমি কি খু*নি নাকি?”
“তাহলে কী করবি? আমাদের তো তুই আগে থেকে কিছুই জানালি না।”
ফারহানের প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয় না সিরাত। কেবল মুচকি হেসে এগিয়ে যায় নাবিলের দিকে।
“এই ব্যাগে সবকিছু আছে তো?”
“হ্যা, তুই যা যা আনতে বলেছিলি সবকিছু এনেছি আমি।”
সিরাত পুনরায় মাহতাবের কাছে ফিরে যায়। হাসিমুখে বলে,
“আমি তোমাদের ছেড়ে দিব। তবে এমনভাবে ছাড়ব যেন আজীবন তোমরা আমাকে মনে রাখতে পারো।”
ঠোঁটের কোণে হাসি থাকলেও সিরাতের চোখে ভয়ং*কর রাগ খেলা করছে। ব্যাগ থেকে সার্জিক্যাল কিছু জিনিস বের করে সিরাত বাকিদের বলে,
“মেয়েরা বের হয়ে যা। আমার সাথে শুধু ইভান আর অভি থাকবে। নাবিল তুই ফারহানকে নিয়ে মেয়েদের সামলাবি।”
সিরাতের কথায় উর্মি অবাক হয়ে বলে,
“কী করতে চাইছিস তুই?”
“এখন কোনো প্রশ্ন করিস না। অভির হাতে তোর ফোন দিয়ে বের হয়ে যা।”
সবাই ভয়ে ভয়ে বের হয়ে যায়। ইভান সিরাতের পরবর্তী পরিকল্পনা বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করে,
“এটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না?”
“আর কোনো মেয়ের জীবন যেন নষ্ট না হয় তার জন্য এটুকু তো আমাকে করতেই হবে।”
ইভান আর কিছু বলে না। কিন্তু অভি জিজ্ঞেস করে,
“জানি তুই কী করতে চাইছিস। কিন্তু তুরাগ তো আগে থেকেই,”
অভিকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে সিরাত নিজেই বলে,
“আমি কেবল মাহতাবের সাথে এমনটা করব। তুরাগের সাথে নয়। ওর জন্য অন্য ব্যবস্থা করেছি আমি।”
কথাটা বলে চোখের ইশারায় ইভানকে মাহতাবের কাছে এগিয়ে যেতে বলে সিরাত। ইভান মাহতাবের কাছে গিয়ে পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে পাশের একটা জায়গায় শুইয়ে দেয়। এরপর পুনরায় পা বেঁধে দেয়। পরবর্তীতে মাহতাবের প্যান্ট খুলতে গেলে মাহতাব চিৎকার করে ওঠে। নিজের বিপদ বুঝতে পেরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“সিরাত দয়া করে আমার সাথে এমন করো না। আমি তোমার স্বামী সিরাত। তোমার সন্তানের বাবা আমি। আমাকে মাফ করে দাও। দয়া করো আমার উপর।”
সিরাতের চোখের কোণ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। তার বুকের ভেতর অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে। কিন্তু এটা যে তাকে করতেই হবে। অন্য সবকিছু বাদ, এই শাস্তিটা কেবল পর*কীয়ার জন্য।
একটু একটু করে মাহতাবের কাছে এগিয়ে যায় সিরাত। তার সম্পূর্ণ শরীর কাঁপছে। চোখ বন্ধ করে সে বলে,
“আমাকে আপনি মাফ করে দিন আল্লাহ। এছাড়া আমার কাছে আর কোনো উপায় নেই। কারোর জীবন নেওয়ার অধিকার আমার নেই। কিন্তু এদের ছেড়ে দিলে সমাজের বাকি পুরুষেরা সাহস পেয়ে যাবে। মেয়েদের কষ্ট কখনো ফুরাবে না। যার জন্য পুরুষ মানুষ বহু নারীতে আসক্ত হয় সেটাই যদি না থাকে তাহলে তারা কীভাবে ঠকাবে তাদের স্ত্রীদের? আর শুধু পুরুষ নয়। কোনো মেয়েও যদি এমন করে তার সাথেও একই কাজ করা উচিত বলে আমি মনে করি।”
নিজ মনে কথাগুলো বলে মনে একরাশ সাহস সঞ্চার করে চোখ বন্ধ করে নিজের কাজ করে নেয় সিরাত। মাহতাবের চিৎকারে কেঁপে ওঠে সবাই। তুরাগ ভয়ে আৎকে ওঠে সিরাতের এমন কাজে। বাকিরা দৌড়ে ভেতরে এসে সিরাতের র*ক্তাক্ত হাত দেখে চমকে ওঠে। মেয়েরা লজ্জায় চোখ বন্ধ করে নেয়। মাহতাবকে গলা কা*টা মুরগির মতো ছটফট করতে দেখে সিরাত দূরে সরে যায়। কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ে সে। ইভান মাহতাবের শরীরের উপর একটা চাদর দিয়ে দেয়।
“ওকে এখন এখান থেকে নিয়ে যা। অন্য ঘরে নিয়ে গিয়ে রাখ।”
“আচ্ছা।”
অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর এবার পালা আসে তুরাগের। তুরাগ সিরাতের দিকে তাকিয়ে একদম নিশ্চুপ হয়ে আছে। তার গলা দিয়ে আজ কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। সিরাত মাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
“ওকে তুই নিজ হাতে শাস্তি দিবি।”
“আমি?”
“হুম, তুই শাস্তি দিবি ওকে।”
কথাটা বলে ব্যাগ থেকে একটা ইনজেকশন বের করে মাওয়ার হাতে তুলে দেয় সিরাত।
“কীসের ইনজেকশন এটা?”
“তুরাগ বাঁচবে। কিন্তু এমনভাবে বাঁচবে যেন আর কখনো কারোর ক্ষতি করতে না পারে।”
“মানে?”
“এই ইনজেকশন ওর শরীরে পুশ করার ফলে তুরাগ প্যারালাইজ্ড হয়ে যাবে।”
“হ্যা?”
“হুম। আর কিছু ভাবিস না। যা পুশ করে দে।”
মাওয়া ভয়ে ভয়ে তুরাগের কাছে এগিয়ে যায়। তার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
“জীবনে প্রথম তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু তুমি আমার ভালোবাসার মর্যাদা দিতে পারোনি৷ এরপরেও তোমাকে বাঁচার একটা সুযোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি কী করলে? নিজ হাতে নিজের বিপদ ডেকে আনলে। মাফ করে দিয়ো আমায়। তোমার জন্য এটুকু শাস্তি তো প্রাপ্য।”
লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে তুরাগের হাতে ইনজেকশন পুশ করে দেয় মাওয়া। তুরাগের চিৎকারে চোখ বন্ধ করে নিলে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে মাওয়ার চোখ থেকে।
সিরাত নিজের র*ক্তাক্ত হাতের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমি ভালো থাকতে চেয়েছিলাম। খুব বেশি চাওয়া তো আমার ছিল না। সুখে, শান্তিতে স্বামী আর সন্তানকে নিয়ে বসবাস করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি এটা কী করলে মাহতাব? আমার সাথে যা করেছ সেসব মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু আমার মেয়েকে নিয়ে তুমি যে পরিকল্পনা করছিলে সেটা কিছুতেই মানতে পারতাম না আমি। আমার কাছ থেকে তুমি আমার মেয়েকে কেঁড়ে নিতে চাইছিলে। হাসপাতালে থাকাকালীন তোমার পরিকল্পনার বিষয়ে সবকিছু জেনে গিয়েছিলাম আমি। তাই তোমাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। বাকিটা জীবন তুমি কষ্টে কাটাবে। তোমার পাপের ফল এটা!”
কিছু মুহূর্তের মধ্যে সবাই নীরব হয়ে যায়। নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মেঝের উপর পড়ে থাকা সিরাতের দিকে।
হুইলচেয়ারে নিজের ছেলেকে বসে থাকতে দেখে মারজিয়া শেখ অবাক নয়নে সদর দরজার পানে তাকিয়ে থাকে। আজ মাহতাবের মুখে কোনো কথা নেই। চোখে কোনো রাগ নেই। কেমন যেন নিষ্প্রাণ হয়ে গিয়েছে সে। সিরাত মাহতাবকে নিয়ে মারজিয়া শেখের সামনে এসে দাঁড়ায়। তন্মধ্যে নজরুল শেখ ও এসে হাজির হয়। তিনি ছেলের এমন অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করেন,
“কী হয়েছে আমার ছেলের?”
সিরাত নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দেয়,
“পাপের শাস্তি পেয়েছে।”
“মানে?”
সিরাত কিছু বলার আগেই মাহতাব হুইলচেয়ার ঠেলে নিজের ঘরের দিকে অগ্রসর হয়। নীরব থাকার দীর্ঘ এক বিরতির পর সিরাত সবকিছু বিস্তারিত বলে তাদের। মারজিয়া শেখ ছেলের এমন দশা মেনে নিতে পারেন না। মা*থা ঘুরে পড়ে যান মেঝের উপর। যে মানুষটা সিরাতকে নিজের মেয়ের মতো দেখত সেই মানুষটা আজ এমন একটা কাজ করে বসে যার জন্য সিরাত কখনোই প্রস্তুত ছিল না। সিরাতের গালে ক*ষে এক থা*প্পড় বসিয়ে দিয়ে নজরুল শেখ হুংকার দিয়ে ওঠেন।
“কী করেছ এটা তুমি? তোমার করা সবকিছু মেনে নিয়েছিলাম আমি। কিন্তু এটা? তুমি কি মানুষ!”
সিরাত কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে একই জায়গায়। তার মনের ভেতর যে কোন ঝড় বইছে তা কেউ হয়তো কখনো কল্পনা করতেও পারবে না।
“তুমি আমাকে আমার শত্রুদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সেই ঋণ তো আমি কখনো ভুলে যাইনি। সেদিন যদি তুমি সঠিক সময়ে পৌঁছে সবার সাথে ল*ড়াই করে আমাকে না বাঁচাতে তাহলে হয়তো আজ আমি বেঁচে থাকতাম না। সেটা হলেই বোধহয় ভালো হতো। নিজ চোখে আমার সন্তানের এই সর্বনা*শ দেখতে হতো না।”
সিরাতকে এখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি পুনরায় বলেন,
“এই মুহূর্তে তুমি বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে। আর কখনো যেন আমি তোমার মুখ না দেখি।”
সিরাত নির্বাক দৃষ্টিতে তার দিকে এক পলক তাকিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে পেছন থেকে ডেকে ওঠে মাহতাব।
“সিরাত দাঁড়াও!”
পেছন ফিরে তাকায় সে। মাহতাব তাকে ঘরে আসতে বলে। সাথে এটাও বলে,
“ওকে কেউ কিছু বলবে না। যা বলার আমি বলব।”
নজরুল শেখ কিছু বলতে যেয়েও ছেলের এহেন কথায় চুপ করে যায়।
রোবটের মতো সিরাত সেই ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় যেটা এক সময় তার ঘর ছিল। আজ সেসব শুধুই অতীত!
মাহতাব কাঁপা কাঁপা গলায় সিরাতকে প্রশ্ন করে,
“তুমি অর্ষার কথা সব জানতে?”
সিরাত নিষ্পলক চেয়ে থাকে মাহতাবের দিকে। তার দিক থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে মাহতাব পুনরায় বলে,
“সবটা জানতে তুমি?”
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর মুখ খোলে সিরাত। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া বাঁধ ভাঙা পানিকে উপেক্ষা করে সে উত্তর দেয়,
“হাসপাতালে থাকাকালীন সময়ে ভেবেছিলাম তোমাকে ছেড়ে দিব। আর কত যুদ্ধ করব? হাজার হোক, একটা সময় তো তোমাকে ভালোবেসে তোমার হাত ধরে সংসার জীবন শুরু করেছিলাম। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস দেখ, বাড়ি ফেরার দুই দিনের মধ্যে একটা অচেনা কল আসে আমার নাম্বারে। কল রিসিভ করলে একজন মেয়ে আমাকে বলে, আপনার লাইভ আমি দেখেছি। এতদিন আমি চুপ করে ছিলাম। কারণ গরীবের পক্ষে তো আইন রায় দেয় না। কিন্তু আজ আমার মনে হচ্ছে আপনি পারবেন আমাকে উপযুক্ত বিচার দিতে। মেয়েটার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। সদ্য হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে শরীরটাও তেমন ভালো ছিল না। তাই তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এসব বলার মানে কী? তখন সেই মেয়ের উত্তর কী ছিল বলতে পারবে? জীবনের সবচেয়ে বড়ো ধাক্কা তো আমি তখন খেলাম যখন জানতে পারলাম আমি এতদিন একজন ধ*র্ষকের সাথে সংসার করেছি। ঐ মুহূর্তে আমার ম*রে যেতে ইচ্ছা করছিল। আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল কষ্টে। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এই দেখ না, এখনও কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার!”
সিরাতকে অস্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে দেখেও মাহতাব কিছু বলতে পারে না। সে সবকিছু বলার ভাষা একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে। সিরাত লম্বা শ্বাস টেনে বলে,
“মেয়েটা নিজের নাম বলল, অর্ষা। একই কলেজে পড়াশোনা করতে তোমরা। গ্রাম থেকে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে শহরে আসা মেয়েটা তখনও শহুরে আদবকায়দার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি। এই অচেনা শহরে তার কোনো বন্ধু ছিল না। সহজসরল মেয়েটার বন্ধু হয়ে ওঠার চেষ্টা করলে তুমি। বন্ধুদের সাথে বাজি ধরেছিলে, ওই মেয়েকে নিজের বিছানায় নিয়ে যাবে তুমি। নতুবা মেনে নেবে, তুমি ব্যর্থ এক পুরুষ। কী সুন্দর তাই না? সহজসরল মেয়েটার প্রথমে বন্ধু হয়ে উঠলে। তারপর নিজের প্রেমের জালে খুব সূক্ষ্মভাবে আটকে নিলে তাকে। জীবনের প্রথম প্রেমের স্বাদ পেয়ে মেয়েটাও তখন আনন্দিত। কিন্তু সে কখনো তোমার কাছাকাছি আসতে চায়নি। তার হাত ধরাটাও বারণ ছিল তোমার। মেয়েটা যখন তোমাকে মনেপ্রাণে ভালোবেসে ফেলেছে তখনও তোমার মনে একটাই চাওয়া। তাকে বিছানা অবধি নিয়ে যেতে হবে। বন্ধুদের সামনে নিজের পুরুষত্ব দেখাতে হবে। একদিন সেই কাজে সফল হয়েও গেলে তুমি। নিজের জন্মদিনের কথা বলে তাকে এক বন্ধুর বাড়ি নিয়ে গিয়ে সফট ড্রিংকস বলে ম*দ খাওয়ালে। আর তারপর!”
মেঝের উপর বসে পড়ে সিরাত। তার মা*থা ঘুরছে ভীষণ। চোখের সামনে সব অন্ধকার লাগছে। তবুও তার কথা বলা থামে না।
“মেয়েটার সর্বস্ব লু*টে নিয়ে তার গোপন ভিডিয়ো ধারণ করে ভয় দেখালে। গ্রামের মেয়ে হওয়ায় সম্মানের ভয় বড্ড বেশিই ছিল তার। তবুও মনে সাহস জুগিয়ে সে থানায় গেল। কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হলো না। তোমার বাবা নিজের অর্থের প্রভাব দেখিয়ে ছাড়িয়ে নিল তোমাকে। মেয়েটার সুন্দর জীবন নিমিষেই কালো আঁধারে ছেয়ে গেল। লোকে বলতে লাগল, সে ধ*র্ষিতা! পরিবার, আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শি কেউ তার পাশে দাঁড়াল না। বরং তার বেঁচে থাকার ইচ্ছাকে সযত্নে মে*রে ফেলতে লাগল। তবুও মেয়েটা এখনও বেঁচে আছে। কেন বেঁচে আছে জানো? যেন সে ম*রার আগে তার ধ*র্ষকের শাস্তি নিজ চোখে দেখে যেতে পারে। একা একা বাঁচার লড়াই সে এখনো লড়ে যাচ্ছে। বদ্ধ ঘরে এক কঠিন জীবনযাপন করছে সে। মেয়েটা ভালো নেই। অবশেষে সে আমাকে বলল,”
থেমে যায় সিরাত। তার নিঃশ্বাস আটকে আসছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন তার গলা খুব শক্ত করে চেপে ধরেছে।
“সমাজে একজন ধ*র্ষিতা নারী যখন বদ্ধ ঘরে বন্দী তখন ধ*র্ষক বুক ফুলিয়ে হেঁটে চলে বাংলার রাজপথে। তাদের কোনো শাস্তি হয় না। কারণ তারা তো ছেলে। তারা স্বভাবতই একটুআধটু দুষ্টুমি করে। এতে তাদের কোনো পাপ হয় না। তারা তো মুক্ত, স্বাধীন। সব শাস্তি তো কেবল মেয়েদের জন্য। তাই তো কিছু না করেও আমার মতো মেয়েদের নামের পাশে যুক্ত হয় ধ*র্ষিতা শব্দ। তাদের জন্য বেঁচে থাকাটাই যেন এক মহান যুদ্ধ!”
মেঝের উপর দাঁড়িয়ে টালমাটাল পায়ে সিরাত এগিয়ে যায় মাহতাবের কাছে৷ তার সামনে দুই হাঁটু মুড়ে বসে বলে,
“শেষে মেয়েটা আমায় বলল, আপনিও তো এক কন্যা সন্তানের মা। আপনার মেয়ের সাথে যদি কেউ এমন করে তবে আপনি কি তাকে ছেড়ে দেবেন? আপনাকে সবাই তেজস্বিনী বলে ডাকে। তেজস্বিনীরা কি কেবল নিজের স্বার্থে তেজস্বী হয়? আপু আপনি পারবেন আমার সাথে যে অন্যায় করেছে তাকে শাস্তি দিতে? বলুন না, পারবেন? আমি যে এই আশাতেই আজও বেঁচে আছি। আমার বেঁচে থাকাটা স্বার্থক করবেন আপনি? তার এহেন প্রশ্নে আমি তখন নির্বাক ছিলাম। কী বলতাম আমি? আমি যে কিছু বলার মতো অবস্থাতেই ছিলাম না। আমার দুনিয়াটা তখন আমার চোখের সামনে উল্টে যাচ্ছিল। আমাদের মেয়ের দিকে তাকিয়ে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। পুরো একটা রাত আমার দমবন্ধ অবস্থায় কাটল। অবশেষে ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম একজন স্ত্রী হিসেবে নয়, বরং একজন নারী হিসেবে আমি সেই মানুষটাকে শাস্তি দিব যার জন্য একটা জীবন্ত ফুল ফোটার আগেই ঝরে গিয়েছে।”
মাহতাবের পায়ের কাছে বসে অঝোরে কাঁদে সিরাত। কাঁদতে কাঁদতে জামার একাংশ খামচে ধরে বলে,
“আমি একজন স্ত্রী হিসেবে এমন কাজের জন্য অনুতপ্ত। কিন্তু একজন নারী হিসেবে এমন কাজের জন্য আমি গর্বিত। ধ*র্ষণ, পরকীয়া, বহু নারীতে আসক্ত হওয়া, এসবের ফলে যে একজন মেয়ের জীবনে কতটা বিরূপ প্রভাব পড়ে তা কি তোমরা জানো? একজন স্ত্রী হিসেবে আমি তোমার কাছে মাফ চাইছি। তবে একজন নারী হিসেবে তোমার প্রতি আমার আজন্ম ঘৃণা জন্মেছে। তা আর কখনো মিটবার নয়। আমি এখন সবার চোখে দোষী। কারণ তারা আসল কারণটা জানে না। চিন্তা করো না। তোমার এই অতীত আর কেউ জানবে না। তার জন্য আমি না হয় হলাম সকলের চোখে অপরাধী।”
ঠোঁট কাম*ড়ে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করে সিরাত উঠে দাঁড়ায়। এক পা, দুই পা করে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। শেষবারের মতো পেছন ফিরে তাকালে সে লক্ষ্য করে মাহতাব নিষ্পলক চেয়ে আছে তার দিকে। যাওয়ার আগে সিরাত শেষবারের মতো বলে,
“তোমার সাথে আমি যা করেছি তার জন্য যদি তুমি আমায় শাস্তি দিতে চাও তাহলে থানায় যেতে পারো। আমি সবকিছুর জন্য প্রস্তুত। আর রইল আমাদের মেয়ের কথা। নাবিহা আমার মেয়ে। তেজস্বিনীর মেয়ে কখনো ভেঙে পড়তে পারে না। পুরো পৃথিবীর সাথে লড়াই করে সে ঠিক বাঁচতে পারবে। আসি!”
ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যায় সিরাত। মাহতাব চেয়েও কিচ্ছু বলতে পারে না।
বাইরে বেরিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসে সিরাত। সবাই গাড়িতে বসে তার জন্য অপেক্ষা করছিল।
“চল।”
পথিমধ্যে অনেকে অনেক প্রশ্ন করলেও তার কোনো জবাব দেয় না সিরাত। একটা ফাঁকা মাঠের পাশ দিয়ে গাড়ি গেলে সিরাত আচানক বলে ওঠে,
“গাড়ি থামা। ইভান তোর সাথে আমার কথা আছে। তুই আমার সাথে এখানে থাক। বাকিরা চলে যা।”
সিরাতের মানসিক অবস্থা খানিকটা বুঝতে পেরে আর কেউ কোনো প্রশ্ন করে না। নাবিল কিছু বলতে চাইলেও অথৈ তার হাত ধরে থামিয়ে দেয় তাকে। সিরাত আর ইভানকে রেখে বাকিরা চলে যায়।
পড়ন্ত বিকেলে খোলা মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে ইভান প্রশ্ন করে,
“কী বলবি আমাকে?”
মাঠের একপাশে ঘাসের উপর বসে সিরাত বলে,
“আমাকে যখন তোর বাবা দেখল তখন পছন্দ করেছিল ঠিকই, কিন্তু আমার পরিবার মধ্যবিত্ত শুনে তোর বাবা আর চাচ্চু আমার বাবাকে যে অপমান করেছিল তা প্রাপ্য ছিল না আমাদের। তোর চাচি যখন আমাকে সুযোগসন্ধানী বলল তখনও তুই ছিলি একেবারেই নীরব। আচ্ছা একটিবার কি তাদের কথার প্রতিবাদ করা যেত না ইভান?”
ইভান মা*থা নত রেখে জবাব দেয়,
“ঐ মুহূর্তে বাবার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস আমার ছিল না।”
কথাটা শুনে সিরাতের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে।
“অথচ এখন তোর ভয়ে বাড়ির সবাই তটস্থ থাকে তাই না?”
“তোকে হারানোর পর অনেকটা পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম আমি। আমাকে সামলানো কঠিন হয়ে গিয়েছিল। পড়াশোনার বাইরে আর কোনোকিছুর প্রতিই আগ্রহ ছিল না আমার। কারণ তুই আমাকে বলেছিলি, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে মানুষের কথার জবাব দিতে হয়। আজ আমি সফল একজন মানুষ। কিন্তু আফসোস! সফল হয়েও শখের নারীকে পাওয়া হলো না আমার।”
“আজও বিয়ে করিসনি কেন? আমার অপেক্ষায় আছিস?”
“যদি বলি, হ্যা!”
“যে পুরুষ তার শখের নারীকে যোগ্য সম্মান দিয়ে নিজের করে নিতে পারে না তার প্রতি আমার এক জন্ম ঘৃণা জন্মাক!”
“সিরাত!”
“অনেক তো হলো এসব। এবার একটু শান্তি চাই আমি। নিজের বাবা-মা আর সন্তানকে নিয়ে শান্তিতে বাঁচতে চাই। যদি আমার অপেক্ষায় থাকিস তাহলে বলব এই অপেক্ষা নিরর্থক। আমাকে ভুলে অন্য কাউকে আপন করে নে।”
“যদি সেটা না পারি?”
“তাহলে আজীবন চিরকুমার হয়ে থাক। ভাবিস না আমি ডিভোর্সি বলে আমাকে পাওয়ার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিস তুই। হয়তো তুই এখন সুপুরুষ। কিন্তু আমার চোখে কা*পুরুষ হয়েই থেকে যাবি সব সময়। আমি আর যাইহোক, কোনো কা*পুরুষের সাথে জীবন শুরু করতে পারব না।”
নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষটার চোখে নিজের জন্য এক আকাশ সমান ঘৃণা দেখে ইভানের হৃদয়ে আঘাত লাগে। মেয়েটাকে কিছু বলেও তো লাভ নেই। দোষটা যে তার নিজেরই। নিজের ভুলেই সে তার শখের নারীকে হারিয়েছে চিরতরে।
হঠাৎ ফোনের কাঁপা-কাঁপি দেখে সিরাত ফোন হাতে তুলে নেয়। কল রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে ভেসে আসে তার মায়ের ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর,
“সিরাত নাবিহাকে নিয়ে তোমার বাবা একটু বাইরে গিয়েছিল। সেই সময় নাবিহাকে কেউ একজন নিয়ে গিয়েছে। ওকে কোত্থাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!”
আপনাআপনি ফোনটা তার হাত থেকে পড়ে যায়। পাথরের মতো শক্ত হয়ে সিরাতকে বসে থাকতে ফোনটা তুলে নিজের কানে নেয় ইভান। সবটা শুনে বাকরূদ্ধ অবস্থায় ইভান ভাবে,
ইতি ইসলাম একটা চেয়ারের উপর বসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সিরাতের বাবা মেয়ে আর তার বান্ধবীর এমন অবস্থার খবর শুনে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মালিহা আর তুবা মামার কাছে রয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে মাওয়ার বাবা-মা চলে আসে। ইতি ইসলামের পাশে বসে মাওয়ার মা মিসেস রেনু মন্ডল বলেন,
“আপা আমাদের মেয়েরা ঠিক হয়ে যাবে তো?”
ইতি ইসলাম কিছু বলতে পারেন না। নির্বাক দৃষ্টিতে কেবল তাকিয়ে রয় অসহায়ের মতো।
মাওয়ার বাবা অভির কাছে গিয়ে চিৎকার করে বলে ওঠে,
“সব সময় বাহাদুরি দেখাতে যাও হ্যা? আজ তোমাদের জন্য আমার মেয়ের এই অবস্থা। পুলিশ ছিল না? সিরাতকে তো পুলিশ উদ্ধার করতে পারত। তোমরা কেন এসব করতে গেলে? তোমরা গিয়েছ ভালো কথা। আমার মেয়েকে নিয়ে গিয়েছ কেন? ওর যদি কিছু হয় তাহলে আমি তোমাদের কাউকে ছেড়ে দিব না বলে দিলাম।”
পাশ থেকে তারিন বলে,
“আংকেল আপনি একটু শান্ত হন প্লিজ। এখন রাগারাগির সময় নয়। আমরা সবাই বিধ্বস্ত অবস্থায় আছি। আমি বুঝতে পারছি আপনার মনের অবস্থা। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমরা সবাই ওদের দু’জনকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। সিরাতের পরিবারের দিকে একবার তাকান। ওর ছোট্ট মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখুন, মা’কে ছাড়া মেয়েটার কী অবস্থা!”
নাবিহার নিষ্পাপ চাহুনি দেখে মাওয়ার বাবা মিস্টার আরাফাত শিকদার কিছুটা দমে গেলেও রাগ তার কমে না। চেয়ারে বসে মেয়ের চিন্তায় ভাজ পড়ে তার কপালে।
মিনিট বিশেক পর ডাক্তার বের হলে নাবিল দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ডাক্তার সিরাত আর মাওয়া এখন ঠিক আছে তো?”
“মাওয়ার শরীর থেকে অনেক র*ক্ত ঝরেছে। তবে ওকে র*ক্ত দেওয়া হয়েছে। বিপদ কেটে গিয়েছে। আশা করছি আজকের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে।”
“আর সিরাত?”
“ওর অবস্থা অনেকটাই খারাপ। ডান হাতে অনেক বেশি ব্যথা পেয়েছে। তাছাড়া পুরো শরীরেই অসংখ্য আঘাতের দাগ রয়েছে। ওর সেড়ে উঠতে সময় লাগবে।”
কথাটা শুনে ইতি ইসলাম শব্দ করে কেঁদে ওঠে। তাকে সামলানোর জন্য রেনু মন্ডল বলেন,
“আপা কাঁদবেন না। আমাদের সিরাত ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের সবার দোয়া ওর সাথে আছে। আমার মেয়েটা যখন বেঁচে আছে তখন সিরাতেরও বাঁচতেই হবে। ওদের কিছু হতে পারে না। মায়ের বুক খালি করে ওরা কোত্থাও যেতে পারে না।”
“তাই যেন হয়। বিয়ের পর থেকে আমার চঞ্চল, প্রাণবন্ত, হাসিখুশি মেয়েটা কেমন শান্ত হয়ে গেল। আগে যদি জানতাম ওই অমানুষ ছেলেটা আমার মেয়েকে এত অত্যাচার করে তাহলে কবেই ওই ন*রক থেকে ওকে নিয়ে আসতাম আমরা।”
“যা হওয়ার তা তো হয়ে গিয়েছে। এখন আল্লাহর কাছে ওদের সুস্থতা কামনা করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারব না আমরা।”
এক দুর্বিষহ ভোর কাটিয়ে যখন সকালের সূর্যোদয় হয় তখনই যেন সকলের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য জ্ঞান ফিরে আসে মাওয়ার। প্রথমে মাওয়ার বাবা-মা দেখা করে করে আসে। তারপর সিরাতের মা মাওয়ার কাছে গিয়ে বলেন,
“আমার মেয়ের বন্ধুদের আমি সব সময় নিজের ছেলেমেয়েদের মতো করে দেখেছি। কিন্তু তুমি আজ যা করলে মা সেই ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারব না।”
পেটের ব্যথায় বারংবার আর্তনাদ করে ওঠা সত্ত্বেও মাওয়া বলে,
“এভাবে বলবেন না আন্টি। ছোট থেকে আমাদের সবার বিপদে সিরাত সবার আগে এগিয়ে এসেছে। সেই মেয়েটাকে নিজের চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে কীভাবে দেখি বলুন তো? সিরাত যে আমাদের বন্ধুমহলের প্রাণ। আচ্ছা ও ঠিক আছে তো?”
“এখনো মেয়েটার জ্ঞান ফেরেনি।”
“সে কি! বিপদ কাটেনি?”
দরজা ঠেলে অভি ভেতরে এসে বলে,
“বিপদ কেটে গিয়েছে। তবে অনেক আঘাত করা হয়েছে তো। তাই জ্ঞান ফিরতে সময় লাগছে। তুই চিন্তা করিস না।”
মাওয়া মন খারাপ করে বলে,
“ওর সাথে যারা এমন করেছে তাদের শাস্তি পেতে হবে। এই অভি, মাহতাব আর তুরাগকে হাসপাতালে আনা হয়েছে?”
“হুম ইভান নিজ দায়িত্বে ওদের হাসপাতালে ভর্তি করেছে।”
“বেঁচে আছে তো?”
“কই মাছের প্রাণ ওদের। বাঁচবে না আবার?”
অথৈ এর কথায় মাওয়া হালকা হেসে বলে,
“কোথায় আছে এখন ওরা? ওদের সাবধানে রাখবি যেন পালাতে না পারে।”
“নাবিল আর ফারহান ওদের সাথে আছে। সব ঘটনা শুনে ফারহান ভোরেই চলে এসেছে।”
“আচ্ছা অনেক কথা হয়েছে। এখন তুই বিশ্রাম নে। অসুস্থ শরীরে এত কথা বলা ঠিক না।”
“হ্যা মা তুমি এখন বিশ্রাম নাও। আমরা বাইরেই আছি। কিছু লাগলে ডাক দিয়ো।”
কথাটা বলে মিসেস ইতি ইসলাম বাকিদের নিয়ে চলে যায়। অভি বাইরে যেতে চাইলে মাওয়া পেছন থেকে ডেকে বলে,
“অভি একটু আমার কাছে আয়।”
অভি কাছে গেলে মাওয়া ওকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলে,
“কেঁদেছিস মনে হচ্ছে। আমাকে হারানোর ভয় পাচ্ছিলি বুঝি?”
অভিমানের সুরে অভি উত্তর দেয়,
“আমি কাঁদলে তোর কী? তুই তো আর আমাকে ভালোবাসিস না।”
প্রতিত্তোরে মাওয়া কিছু না বললে অভি এক পলক তাকিয়ে বের হয়ে যেতে চায়। মাওয়া বেশ মজা পায় তার এমন চেহারা দেখে। কিছুক্ষণ থেমে বলে,
“বাউণ্ডুলে ছেলেটাকে মাওয়া ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে। তার ঘরণী হওয়ার জন্য মাওয়া প্রস্তুত!”
মাওয়ার এমন কথা শুনে অভির পা থেমে যায়। অবাক চোখে মাওয়ার দিকে তাকালে সে খেয়াল করে মেয়েটার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি বিরাজমান। এই হাসিটা যে সত্যিকারের হাসি তা বুঝতে একটুও দেরি হয় না অভির। সে কিছু না বলে মুচকি হেসে বের হয়ে যায়।
“যাহ্! চলে গেল ছেলেটা। আমি যে আমার মনের কথা বললাম তার উত্তর না দিয়েই চলে গেল। ফাজিল ছেলে একটা হুহ।”
মাওয়ার জ্ঞান ফেরার আনন্দে সবার চোখমুখ উজ্জ্বল হলেও সিরাতের চিন্তায় উজ্জ্বল মুখগুলো কালো আঁধারে ছেয়ে যায়। মেয়েটার এখনো কেন জ্ঞান ফিরছে না এই ভেবে অস্থির হয়ে যাচ্ছে সবাই।
হাসপাতালের করিডরে ইভানকে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেদিকে এগিয়ে যায় তামান্না।
“কষ্ট হচ্ছে খুব তাই না? তোর কী একবারও মনে হয় না এসব কিছুর জন্য কোথাও না কোথাও তুই দ্বায়ী?”
তামান্নার কথায় ইভান অসহায় কণ্ঠে বলে,
“আমি দ্বায়ী?”
“হ্যা, তুই দ্বায়ী৷ রাত কেন এত তাড়াতাড়ি বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেটা তো আমাদের কারোর অজানা নয়। তুই একাই যে রাতকে ভালোবেসেছিস তা তো নয়। রাতও তো তোকে ভালোবেসেছিল। তোর সাথে ঘর বাঁধতে চেয়েছিল। যেদিন তুই ওকে ভালোবাসার কথা বললি সেদিন রাত বলেছিল ওকে বিয়ে করতে। রাত বিয়ের আগে প্রেম, ভালোবাসায় বিশ্বাসী ছিল না। তুই ওকে কথা দিয়েছিলি যথাযথ সম্মান দিয়ে নিজের জীবনসঙ্গী বানাবি। কিন্তু তা তো হয়নি। বরং তোর বাবা আর তোর দাদুবাড়ির সবাই ওকে অপমান করেছিল। তুই নিশ্চয়ই সেইসব ভুলে যাসনি? সেদিন যদি তুই প্রতিবাদ করে রাতের হাত শক্ত করে ধরতিস তাহলে আজ এসব হয়তো হতো না। ওর জীবনটাও এভাবে নষ্ট হয়ে যেত না।”
“আমি নিরুপায় ছিলাম তামান্না। চাইলেও ওই মুহূর্তে ওর হাত ধরা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি যদি সবার বিরুদ্ধে গিয়ে ওকে বিয়ে করতাম তাহলে বাবা আমাকে ত্যাজ্যপুত্র করে দিত।”
“সেটাই। বাবার ছেলে হয়েই থাক তুই। রাতকে কাছে পাওয়ার চিন্তা আর কখনো করিস না ইভান। ও যেমন মেয়ে তাতে আমি এটুকু জোর দিয়ে বলতেই পারি যে ও কখনোই আর ফিরে আসবে না তোর কাছে। ওর আত্মসম্মানবোধ আমাদের সবার চেয়ে অনেক বেশি৷ যে ছেলেটা ওর সম্মান রক্ষা করতে পারে না সে আর ওকে কী ভালো রাখবে!”
তামান্নার শেষ কথাটা শুনে যেন ইভানের বুকের ভেতর অসহনীয় ব্যথা শুরু হয়। সে কিছু না বলে চুপচাপ চলে যায়। তার চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে তামান্না দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবে,
“কেবল ভালোবাসলেই হয় না। ভালোবাসার মানুষটার সম্মান রক্ষা করা, তাকে আগলে রাখা, তার বিশ্বাস অক্ষুণ্ণ রাখা, ভরসার জায়গা হয়ে ওঠা, এই সবকিছু অর্জন করতে হয়। নতুবা নিজের থেকে বেশি ভালোবেসেও প্রিয় মানুষটাকে আটকে রাখা যায় না। সে পাখি হয়ে উড়ে যায় অন্য খাঁচায় বন্দী হতে। তখন সত্যিকারের ভালোবেসেও আর কোনো লাভ হয় না। দু’জন মানুষ একে-অপরকে ভালোবেসেও চিরজীবনের জন্য আলাদা হয়ে যায়। হয়তো কেউই সুখী হয় না। কেবল সুখে থাকার চেষ্টা করে। কিংবা সুখে আছি কথাটার উপর ভিত্তি করে দিনের পর দিন ভালো থাকার অভিনয় করে যায়। তাই দিন ফুরাবার আগেই ভালোবাসার মানুষটাকে যথাযথ সম্মান দিয়ে নিজের করে নিতে হয়। নয়তো সারাজীবন শুধু আফসোস করতে হয়। না পাওয়ার যন্ত্রণায় ছটফট করতে হয়।”
জ্ঞান ফেরার পর সিরাত সর্বপ্রথম এই প্রশ্ন করায় অভি উত্তর দেয়,
“তোদের দুই বান্ধবীর ওদেরকে নিয়ে এত চিন্তা কীসের? নিজেরা মৃ*ত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলি। অথচ ভাবছিস ওই অসভ্যগুলোর কথা!”
“দুই বান্ধবী মানে? আর কার কী হয়েছে?”
ইভান অভিকে ইশারায় চুপ করতে বলে নিজে উত্তর দেয়,
“তুই এখনো অনেকটা অসুস্থ। আগে সুস্থ হ। তারপর সব শুনিস।”
“না, এখনই বল আমাকে। আর কে অসুস্থ?”
পাশ হতে অথৈ জবাবে বলে,
“মাওয়া অসুস্থ। তুরাগ যখন তোকে মা*রতে পারল না তখন মাওয়াকে আঘাত করেছে। ওর পেটে ছু*রি ঢুকিয়ে দিয়েছিল।”
অথৈ এর কথা শুনে সিরাত উত্তেজিত হয়ে গেলে ইভান শান্ত স্বরে বলে ওঠে,
“শান্ত হ রাত। মাওয়া এখন ঠিক আছে। তাছাড়া মাওয়া তুরাগ আর মাহতাবকে গু*লি করেছে। ওরা ওদের শাস্তি অবশ্যই পাবে।”
সিরাত চিন্তিত হয়ে যায় ইভানের কথা শুনে। মুখ গম্ভীর করে বলে,
“ওরা দু’জন বেঁচে আছে তো?”
“হ্যা, বেঁচে আছে। আমাদের হেফাজতে আছে। তুই চিন্তা করিস না।”
বন্ধুদের কথার মাঝে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করেন ইতি ইসলাম। তার কোলে নাবিহা ঘুমিয়ে আছে। মেয়েটার মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। সুন্দর চেহারাটা যেন কয়েক দিনের মাঝেই মলিন হয়ে গিয়েছে। মা আর মেয়ের এমন বিষণ্ণ চেহারা দেখে সিরাতের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে।
“মা!”
মেয়ের মুখে এতদিন পর ‘মা’ ডাক শুনে আত্মা শান্ত হয় মিসেস ইতি ইসলামের। ঘুমন্ত নাতনিকে উর্মির কোলে দিয়ে মেয়ের পাশে বসে পরম যত্নে তার সম্পূর্ণ মুখে হাত বুলিয়ে হু হু করে কেঁদে ওঠেন ইতি ইসলাম।
মায়ের হাতের উপর হাত রেখে সিরাত বলে,
“কেঁদো না মা। দেখো আমি একদম ঠিক আছি। সুস্থ আছি।”
“আমার মেয়েটার হাতে এত মোটা ব্যান্ডেজ, কপালে র*ক্ত জমে আছে, ঠোঁট কেটে র*ক্ত জমে আছে। এসব দেখেও আমি কীভাবে শান্ত থাকি? আমার বুকটা যে ফেটে যাচ্ছে আম্মু।”
“আমি ঠিক হয়ে যাব। হার মেনে নেওয়ার মেয়ে তো আমি না। তোমার দোয়া আমার সাথে আছে৷ মায়ের দোয়া সাথে থাকলে কি কেউ খারাপ থাকতে পারে মা?”
মায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে সিরাত আবদার করে,
“আমার মা*থায় একটু হাত বুলিয়ে দাও না মা। কতদিন হলো তোমার কোলে শুয়ে তোমার আদর খাই না। মায়ের কোলে শুয়ে যে শান্তি পাওয়া যায় তা পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না।”
সিরাতের কথা শেষ হওয়ার আগেই তার মা*থায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দেয় মা। এর মাঝে নাবিহার ঘুম ভেঙে যায়। মা’কে শুয়ে থাকতে দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সে।
“মাম্মা মাম্মা!”
মেয়ের মুখ থেকে এতদিন পর কাঙ্ক্ষিত সেই ডাক শুনে চোখের কোণে পানি জমে যায় সিরাতের। ডান হাতে ব্যথা থাকায় বাম হাত দিয়ে মেয়েকে নিজের কাছে ডাকে সে। উর্মি নাবিহাকে সিরাতের পাশে বসিয়ে দিলে মেয়েকে বুকে আগলে নিয়ে নিরবে অশ্রু ঝরায় সিরাত। মেয়ের সম্পূর্ণ মুখে অসংখ্য চুমু এঁকে দেয়। ছোট্ট ছোট্ট হাত দু’টো ধরে হাতের পিঠেও চুমু এঁকে দেয়।
“মা আমার, তুমি ঠিক আছ? নানুমনির কাছে লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে ছিলে তো?”
“নাবিহা আমার থেকে বেশি তারিনের কাছে ছিল। ওর কাছেই এই কয়েকদিন থেকেছে। মেয়েটা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। নাবিহাকে তো ওই দেখে রেখেছে।”
মায়ের মুখে এমন কথা শুনে সিরাত তারিনের দিকে তাকায়। সে চুপচাপ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে।
“এই মেয়ে তুই এভাবে কাঁদছিস কেন হ্যা? আমার মেয়েটাকে নিজের মেয়ের মতো দেখে রাখলি। তার জন্য তো আমি তোর কাছে চির ঋণী হয়ে গেলাম।”
“একটা মা*ইর দিব তোকে। তোর মেয়ে মানে আমাদের সবার মেয়ে। ওর দেখভাল করা আমার দায়িত্ব। তার জন্য আবার কীসের ঋণ রে? খুব পর ভাবিস আমাকে তাই না?”
“তুই আমার কাছে আয়।”
তারিন সিরাতের কাছে এগিয়ে গেলে সিরাত ওর হাত ধরে বলে,
“আমি হয়তো স্বামী সুখ পাইনি। কিন্তু চরম পর্যায়ের ভাগ্যবতী না হলে তোদের মতো বন্ধু পাওয়া যায় না রে। একজন আমার জন্য জীবন বাজি রাখল। আরেকজন আমার মেয়েকে এত যত্নে রাখল। বাকিরা সবাই প্রাণপণ চেষ্টা করে আমাকে উদ্ধার করল। তোরা না থাকলে হয়তো আমি আজ বেঁচে ফিরতে পারতাম না। তেজস্বিনীদেরও হেরে যেতে হয়। কিন্তু তোরা আমাকে জিতিয়ে দিয়েছিস। জীবনে প্রকৃত বন্ধু থাকা কতটা প্রয়োজন সেটা তোরা খুব ভালোভাবে প্রমাণ করেছিস। আমার মা, আমার পরিবার, আমার মেয়ে, আমার বন্ধু, সবাইকে খুব ভাগ্য করে পেয়েছি আমি। এক জীবনে তো সব পাওয়া যায় না। আমি ভালো স্বামী পাইনি তো কী হয়েছে? বাকি সব তো পেয়েছি। এই আমার পরম সৌভাগ্য!”
“তোর কথা শেষ হয়েছে? তাহলে এবার বিশ্রাম নে।”
ইভানের কথায় সিরাত বায়না ধরে বসে।
“আমি এক্ষুণি মাওয়ার কাছে যাব। আমাকে নিয়ে চল।”
“এই অবস্থায় তোর কোথাও যাওয়া যাবে না।”
“আমি এতকিছু জানি না। হয় আমাকে ওর কাছে নিয়ে চল, নয়তো ওকে আমার কাছে নিয়ে আয়।”
“আজব তো!”
“তোরা কিছু করবি? নাকি আমি এই শরীর নিয়ে উঠব?”
নাবিল হন্তদন্ত হয়ে এসে বলে,
“তোরা কী যমজ বোন?”
সিরাত ভ্রূদ্বয় সংকুচিত করে বলে,
“কী হয়েছে?”
“এখানে তুই জেদ ধরেছিস। ওখানে মাওয়া পারলে এখনই তোর কাছে ছুটে চলে আসে।”
“আত্মার সম্পর্ক এটা বুঝলি?”
“খুব বুঝেছি ম্যাডাম। তাই তো এত এত ঝামেলা করে মাওয়াকে তোর কেবিনে নিয়ে এলাম। এখন থাক দুই বান্ধবী একসাথে।”
ফারহানকে দেখে সিরাত খুশি হয়ে বলে,
“তুই কখন এলি?”
“আমি আজ ভোরে এসেছি। নকশির থেকে সবকিছু শুনে আমি আর থাকতে পারিনি। আরো আগেই আসতাম। কিন্তু এই হারামির দল আমাকে প্রথমে কিছুই বলেনি।”
“তোকে আর আমরা আলাদা করে চাপ দিতে চাইনি দোস্ত।”
“হ্যা ভাই তোরা তো আমার খুব বড়ো উপকার করে ফেলেছিস এটা করে।”
ফারহান আর নাবিলকে থামিয়ে দিয়ে সিরাত বলে,
“তোরা একটু থাম। আমি এখন মাওয়ার সাথে একা থাকব। বাকিরা বের হয়ে যা।”
নকশি সরু চোখে তাকিয়ে বলে,
“একজনকে পেয়ে বাকিদের ভুলে যাবি তুই? এটা তোর থেকে আশা করিনি হুহ।”
“ওরে আমার অভিমানিনী পরে অভিমান করিস। এখন বের হ সবাই।”
মা আর মেয়েকে একটু আদর করে দিয়ে বাকিদের সাথে পাঠিয়ে দেয় সিরাত। কেবিনে কেবল থেকে যায় সে আর মাওয়া। মাওয়াকে একদম সিরাতের পাশাপাশি রাখা হয়েছে। সিরাত এক হাত এগিয়ে দিয়ে বলে,
“এখন কেমন আছিস তুই?”
মাওয়া ডান হাত দিয়ে সিরাতের হাত ধরে বলে,
“তোকে সুস্থ হতে দেখে আমি কি খারাপ থাকতে পারি?”
“এত বড়ো ঝুঁকি না নিলেও পারতি।”
“চুপ কর তো তুই। বেশি কথা বলবি না একদম।”
“আচ্ছা আমার একটা অনুরোধ রাখবি?”
“অভির কথা বলবি তাই তো?”
“হুম। দেখ অনেক তো হলো ভুল বোঝাবুঝি। এবার তোরও জীবন নিয়ে ভাবতে হবে। আর অভির থেকে বেশি ভালো তোকে অন্য কেউ বাসতে পারবে না।”
“আমি আজ ওকে বিয়ের জন্য হ্যা বলেছি।”
“এহ্?”
সিরাতকে অবাক হতে দেখে মাওয়া হেসে বলে,
“বাকিরা এখনো কিছুই জানে না। আগে সুস্থ হই। তারপর বলব।”
“কীভাবে হলো এসব?”
“আসলে তুই যেদিন নিখোঁজ হলি সেদিন আমি ওর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ফোন বন্ধ করে দু’জন নদীর পাড়ে বসে ছিলাম কতক্ষণ। সত্যি বলতে আমিও অভিকে অনেক ভালোবাসি। কিন্তু আমি সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। বাবা ওকে পছন্দ করে না। তাকে মানানোর জন্য সময়ের প্রয়োজন ছিল আমার। সেদিন বাবার সাথে ঝগড়া করেই বের হয়েছিলাম। জানিস? অভি আমাকে প্রপোজ করেছে ওইদিন। ওর মনের কথাগুলো শোনার পর ওকে আর দূরে সরিয়ে রাখতে ইচ্ছা করছিল না আমার। আমি তোকে সবকিছু জানানোর জন্যই ফোন অন করেছিলাম। তখনই নাবিল কল করে বলে তুই নিখোঁজ। এরপর তো তোকে খুঁজতে খুঁজতে অস্থির হয়ে গেলাম আমরা। ওকে আর মনের কথা বলতে পারিনি। অবশেষে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ওকে মনের কথা বললাম।”
“তা কী বলেছিস শুনি?”
“ভালোবাসি!”
কথাটা বলার সময় মাওয়াকে ব্লাশ করতে দেখে সিরাত মুচকি হেসে বলে,
“যাক, সবার ভালোবাসা একে একে পূর্ণতা পাচ্ছে তাহলে!”
মাওয়া সিরাতের কথা শুনে বলে,
“সবার ভালোবাসা তো পূর্ণতা পায়নি রাত।”
“মানে?”
“ইভান আর তোর ভালোবাসা যে অপূর্ণ রয়ে গেল।”
“আজ থেকে প্রায় ছয় বছর আগে যা হয়নি সেটা এখন হবে ভেবে থাকলে ভুল করবি তোরা। আর কিছুদিন পর নাবিহা চার বছরে পা দেবে। আমার বিয়ের বয়সও প্রায় ছয় বছরের কাছাকাছি। যারা আমাকে ছয় বছর আগে মেনে নেয়নি তারা এখন আমাকে মেনে নেবে বলে মনে হয় তোদের? আর যেখানে আমার আত্মসম্মানে আঘাত লাগে সেখানে তো আমি কখনোই যাব না। ইভান ভালো বন্ধু হতে পারে। ভালো সন্তান হতে পারে। হয়তো ভালো বাবাও হতে পারবে। কিন্তু ভালো স্বামী কিংবা ভালো প্রেমিক কখনোই হতে পারবে না!”
“জীবনকে কি দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া যায় না?”
“অবশ্যই যায়। কিন্তু তেজস্বিনীরা কখনো আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে পারে না। আমি আর কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারব না। ইভানকে ভালোবেসে আমি কষ্ট ছাড়া কিছু পাইনি। একটা কথা কি জানিস তো? বন্ধুত্ব বন্ধুত্ব অবধিই সুন্দর। অন্তত আমার ক্ষেত্রে তো তাই।”
“একা কী বাঁচা যায়?”
মাওয়ার এমন প্রশ্নে সিরাত খুব সুন্দর করে বলে,
“ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবে বর্তমান নষ্ট করা বোকামি। এখন বর্তমান নষ্ট হলে ভবিষ্যতে গিয়ে আমাদের অতীতও আমাদের কষ্ট দেবে। আমরা কতদিন বাঁচব তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই অনিশ্চিত জীবনে জীবনসঙ্গী ছাড়া বাঁচা যাবে না এটা কোথাও লেখা নেই। আমার মেয়েকে নিয়ে আমি বাঁচার চেষ্টা তো অন্তত করি। একজন জীবন থেকে যেতে না যেতেই অন্যজনকে নিয়ে ভাবার তো প্রয়োজন নেই। মাঝে মাঝে একা বেঁচে থাকার স্বাদও নিতে হয়। তেজস্বিনী শব্দটার মানে তো তোর অজানা নয়। আমি সমাজের সেই সকল মেয়েদের জন্য কিছু করতে চাই যারা স্বাধীনভাবে বাঁচতে চেয়েও বাঁচতে পারছে না। এবার আমিও একটু একা বাঁচতে চাই। ভবিষ্যতে কী হবে সেটা না হয় তখন ভাবা যাবে। বৃদ্ধ বয়সের কথা চিন্তা করে এখনই কোনো সিদ্ধান্ত আমি নিতে চাই না। এমনও তো হতে পারে, হয়তো বৃদ্ধ হওয়ার আগেই আমি চলে যাব এই দুনিয়া ছেড়ে। তাহলে সেই বৃদ্ধ বয়সের কথা ছাব্বিশ বছর বয়সে এসে আমি কেন ভাবতে যাব? এই ভাবাটাও আমার কাছে অপচয়!”
মাওয়ার কথায় ফোনের অপরপাশ থেকে ইভান অসহায় কণ্ঠে বলে,
“আমি চেষ্টা করছি মাওয়া। কিন্তু কোনোভাবেই ওর কোনো খবর পাচ্ছি না।”
“দেখ এভাবে ওর খবর পাওয়া যাবে না। আমি তুরাগের একটা বন্ধুকে চিনি। ওর থেকে কোনোভাবে তুরাগের নাম্বার নিতে পারলে লোকেশন ট্র্যাক করে সহজেই ওকে ধরতে পারব আমরা।”
“নাম কী ওর বন্ধুর?”
“শিহাব, আমার কাছে ওর ফেসবুক আইডি আছে। তুই যেভাবেই হোক ওর সাথে দেখা করে তুরাগের খবর নে।”
“যদি শিহাবের কাছে তুরাগের কোনো খবর না থাকে?”
“আরে ভাই নয় দিন আগেই ওরা একসাথে ছবি তুলেছে। আমি শিহাবের আইডিতে দেখেছি সেই পোস্ট।”
এদিকে সিরাতের অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। অনেকটা সময় যাবত ওয়াশরুমে না যাওয়ার ফলে পেটে ব্যথা শুরু হয়ে গিয়েছে তার।
“বাইরে কেউ আছ? একটু ভেতরে এসো।”
দুই/তিনবার ডাকার পর তুরাগ ভেতরে ঢুকে বেশ ককর্শ গলায় জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে?”
“আমি ওয়াশরুমে যাব। আমার অনেক সমস্যা হচ্ছে। এখন ওয়াশরুমে যেতেই হবে।”
“ওয়াশরুমে যাওয়ার নাম করে পালিয়ে যেতে চাও হ্যা?”
“তোমরা কি আমাকে পালিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় রেখেছ? পুরো শরীর ব্যথায় অবশ হয়ে যাচ্ছে আমার।”
তুরাগ ভালোভাবে খেয়াল করে দেখে, সত্যিই সিরাতের অবস্থা ভালো না। সে ঠিকমতো চোখ মেলে তাকাতেও পারছে না।
“তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে নিয়ে চলো আমাকে। আমি আর পারছি না এভাবে বসে থাকতে।”
“বাঁধন খুলে দিচ্ছি। কিন্তু ভুল করেও পালানোর কিংবা চালাকি করার চেষ্টা করবে না। তাহলে কিন্তু তোমার কপালে দুঃখ আছে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। কিছু করব না আমি।”
তুরাগ ধীরে ধীরে সিরাতের হাত, পায়ের বাঁধন খুলে দেয়। এতক্ষণে যেন সিরাত একটু শান্তি পায়। নিজে থেকে উঠতে গিয়ে সে বুঝতে পারে পায়ের ব্যথায় ঠিকমতো দাঁড়ানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। তুরাগ সেটা বুঝতে পেরে এক হাতে সিরাতের হাত আর অন্য হাতে সিরাতের কোমড় চেপে ধরে। অতঃপর আলতোভাবে পা ফেলে সে প্রথমবারের মতো বন্দী ঘর থেকে বের হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো সম্পূর্ণ জায়গায় অন্ধকারাচ্ছন্ন। ওয়াশরুমের পাশে দাঁড়িয়ে সিরাতের গা গুলিয়ে ওঠে। প্রচন্ড শরীর খারাপ নিয়ে যখন সিরাত ঠিকমতো দাঁড়াতেও অক্ষম ঠিক সেই মুহূর্তে সে অনুভব করে তার শরীরে কেউ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে স্পর্শ করছে। চমকে ওঠে সে। পাশ ফিরে লক্ষ্য করে তুরাগের নোংরা দৃষ্টিভঙ্গি। রাগে তার হাতের মুঠ শক্ত হয়ে আসে। কিন্তু এই মুহূর্তে ল*ড়াই করে নিজেকে রক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই চুপচাপ ওয়াশরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয় সিরাত।
চারপাশে তাকিয়ে ছোট্ট একটা জানালা দেখতে পেয়ে তার মনে আশা জাগে, হয়তো এবার এই বন্দী জীবন থেকে বের হওয়ার কোনো রাস্তা খুঁজে পাবে সে। কিন্তু নিয়তি হয়তো এটা চায় না। তাই তো মেয়েটার সকল আশায় পানি ঢেলে তাকে বুঝিয়ে দেয়,
“এই ল*ড়াই বড্ড কঠিন। নিজেকে বাঁচাতে হলে আবারও তোকে তেজস্বিনী হতে হবে। নিজেকে দুর্বল ভেবে বসে থাকলে তুই হেরে যাবি সিরাত। হেরে যাবি বাস্তবতার মঞ্চে। সাথে হেরে যাবে সেই সকল মেয়ে যারা তোকে দেখে সাহসী হতে চেয়েছে। হতে চেয়েছে তেজস্বিনী!”
এসব ভেবে দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়ে সিরাত। কান্নাগুলো আজ ধরা দিতে চাইছে না তার চোখে। আর কত কাঁদবে সে? কাঁদতে কাঁদতে যে তার চোখের নোনাপানি শুকিয়ে গিয়েছে।
ওয়াশরুমের বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে চোখেমুখে পানি দিয়ে খানিকটা পানি খেয়ে নেয় সে। আয়নার সামনে নিজেকে দেখে মায়া হয়। মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে কী থেকে কী হয়ে গেল সে!
“আমাকে ভেঙে পড়লে চলবে না। কিছু একটা তো আমাকে করতেই হবে। হাতে সময় বেশি নেই। এই ছোট্ট জানালা দিয়েই আমাকে যা করার করতে হবে।”
আনমনে কথাটা ভেবে জানালার কাছে চলে যায় সিরাত। কিন্তু শত চেষ্টা করেও জানালার নাগাল পায় না। চারপাশে তাকিয়ে কিছু খুঁজেও পায় না যার সাহায্যে সে উপরে উঠতে পারবে।
“আর কতক্ষণ লাগবে? শোনো, পালানোর চেষ্টা করো না। কারণ সেটা কখনোই হবে না। বরং এটা করলে নিজের ক্ষতি নিজেই করবে তুমি। তাড়াতাড়ি বের হও।”
তুরাগের কণ্ঠস্বর শুনে সিরাত মুখে হাত দিয়ে ভাবে কী করা যায়!
কিছু একটা ভেবে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে ভীষণ জোরে একটা চিৎকার দিয়ে ওঠে সিরাত। আশেপাশে আরো অনেকগুলো বিল্ডিং থাকায় বিব্রত হয় তুরাগ। জোরে জোরে দরজা ধাক্কিয়ে বলে,
“খবরদার আমার সাথে চালাকি করার চেষ্টা করবে না। নয়তো এর ফল ভালো হবে না সিরাত।”
অবস্থা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে ভেবে ধীরে ধীরে ওয়াশরুমের দরজা খুলে বের হয় সে। তুরাগ কিছু বলার আগেই মা*থা ঘুরিয়ে পড়ে যায় মেঝের উপর।
“আরেহ্ কী হলো? এই মেয়ে একদম নাটক করবে না। ওঠো বলছি।”
মাহতাব বাইরে থেকে খাবার কিনে এনে সিরাতের এই অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে ওর? এভাবে পড়ে আছে কেন?”
“আরে ভাই ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে যাচ্ছিল। তাই নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে।”
অজানা ভয় বাসা বাঁধে মাহতাবের মনে। ভয়ে ভয়ে বলে,
“বেঁচে আছে তো? সিরাত এভাবে ম*রে গেলে আমরা দু’জন খুব বাজেভাবে ফেঁসে যাব ভাই!”
তুরাগ সিরাতের পালস্ চেক করে বলে,
“বেঁচে আছে। আগে ঘরে নিয়ে যাই। তারপর দেখছি বাকিটা।”
“আমি নিয়ে যাচ্ছি।”
কথাটা বলে মাহতাব সিরাতকে কোলে তুলে নেয়। ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানার উপর শুইয়ে দিয়ে বলে,
“ওর যা অবস্থা তাতে করে পালাতে পারবে না। আপাতত এখানেই শুয়ে থাকুক। জ্ঞান ফিরলে হাত, পা বাঁধা যাবে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে জীবন ঝুঁকি হতে পারে। তখন আমাদের বিপদ বাড়বে।”
“আচ্ছা দরজা, জানালা সবকিছু বন্ধ করে আমরা বাইরে চলে যাই চল।”
দু’জন মিলে ঘরের জানালাগুলো লক করে দিয়ে দরজা বাইরে থেকে আটকে বের হয়ে যায়৷ একদিকে সিরাত বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। অন্যদিকে তারা দু’জন খাবার খেতে ব্যস্ত।
দু’জন বেরিয়ে গেলে সিরাত চোখ মেলে তাকায়। চারপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে সে এখন কোথায় আছে।
“অজ্ঞান হওয়ার নাটক করে হাত, পায়ের বাঁধন খুলতে পেরেছি এটাই অনেক। এখন আমাকে কিছু ভাবতে হবে। ইশ্! কোনোভাবে যদি বন্ধুদের মধ্যে কারোর সাথে যোগাযোগ করতে পারতাম!”
সিরাতের মনের ইচ্ছা পূরণ করতেই যেন সকলের ফোনে একটা ম্যাসেজ আসে।
“তুরাগের ঠিকানা পাওয়া গিয়েছে। সবাই দ্রুত বড়ো রাস্তার মোড়ে আয়।”
ম্যাসেজটা পাঠিয়ে ইভান শিহাবকে ছেড়ে দেয়। থানা থেকে বের হওয়ার আগে কঠোর ভাষায় বলে,
“যদি তুরাগকে কিছু জানাস, তাহলে কালকের সকালটা আর দেখতে পাবি না। কথাটা ভালো করে মনে রাখ। নিজের ভালো চাইলে মুখ একদম বন্ধ রাখবি। বুঝেছিস?”
শিহাব ভয়ে ভয়ে উত্তর দেয়,
“আমি কাউকে কিচ্ছু বলব না। কিচ্ছু বলব না।”
“এইতো ভালো ছেলের মতো কথা। এখন বের হয়ে যা থানা থেকে।”
শিহাব চলে গেলে দ্রুত পা চালিয়ে ইভান বড়ো রাস্তার মোড়ে চলে যায়। সেখানে গিয়ে সবাইকে অস্থির চিত্তে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,
“তোরা চিন্তা করিস না। আমরা আজকেই সিরাতকে উদ্ধার করব। তুরাগের ঠিকানা শিহাবের কাছ থেকে পেয়ে গিয়েছি আমি। নাম্বারও আছে আমার কাছে।”
“তুরাগ এখন কোথায় আছে?”
“শহর থেকে কিছুটা দূরে একটা বাড়ি আছে। খুব সম্ভবত ওটা একটা পরিত্যক্ত বাড়ি। ওখানেই আছে তুরাগ।”
“আমাদের এক্ষুণি বের হতে হবে। চল তোরা।”
অভির কথায় সহমত জানিয়ে সবাই বেরিয়ে পড়ে। ঘন্টা দুয়েকের পথটা যেন আজ সবার কাছে অনেক বেশি লাগছে।
“মেয়েটা ঠিক আছে তো? আমার না খুব ভয় হচ্ছে।”
“ভয় পাস না উর্মি। আমাদের বন্ধুর কিচ্ছু হবে না। ওর কিছু হতে পারে না। সিরাতের কোনো ক্ষতি হলে যে আমরা সবাই হেরে যাব।”
ইভান নিজে ড্রাইভ করেও শান্তি পাচ্ছে না। এত জোরে গাড়ি চালিয়েও পথ যেন কিছুতেই শেষ হতে চায় না।
অন্যদিকে সিরাত পুরো ঘর ঘুরেও কিছু পায় না। জানালা খোলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তার এখন মনে হচ্ছে সে অনেক বড়ো একটা গোলকধাঁধার মাঝে আটকে পড়েছে।
দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে দ্রুত বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে সিরাত। তুরাগ একটু একটু করে সিরাতের কাছে এসে ওর চোখ কাঁপতে দেখে হেসে বলে,
“অভিনয়ে তুমি অনেক কাঁচা সিরাত। অজ্ঞান হওয়ার ভান করে আমাদের থেকে বেঁচে যাবে ভেবেছ? যদি এটাই ভেবে থাকো তাহলে ভুল ভেবেছ।”
মাহতাব অবাক হয়ে বলে,
“এসব কী বলছিস তুই?”
“আমি ঠিকই বলছি। ও অজ্ঞান হয়নি। সবটাই নাটক।”
সিরাত সবকিছু শুনেও নিরবে শুয়ে থাকে। মাহতাব ওর কাছে এসে দুই বাহু শক্ত করে ধরে বলে,
“যতই চেষ্টা করো, তুমি বাঁচতে পারবে না।”
“ওকে মুখে বলে কিছু হবে না। এইবার কাজে করে দেখাতে হবে।”
তুরাগ হাতে একটা লোহার রড নিয়ে সিরাতের কাছে এসে ওর ডান হাত বরাবর খুব জোরে আঘাত করে। প্রচন্ড ব্যথায় চিৎকার করে ওঠে সিরাত। একের পর এক আঘাতে মনে হয় তার হাতের সমস্ত হাড় ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গিয়েছে। হাত থেকে শুরু করে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রডের আঘাতে ক্ষ*তবিক্ষ*ত হয়ে যায় সিরাত।
“একদিন এভাবেই আমিও চিৎকার করেছিলাম। তোমার জন্য সব হারিয়েছি আমি। তোমার শান্তিতে বেঁচে থাকা আমি দেখতে পারব না। যেদিন সব হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম তোমাকে আমি এক কঠিন মৃ*ত্যু উপহার দিব। আর আজ সেই কাঙ্ক্ষিত দিন।”
তুরাগের এমন অস্বাভাবিক রূপ দেখে মাহতাব বলে,
“ভাই মেয়েটা ম*রে যাবে৷ এবার থাম প্লিজ।”
“কেন? থামব কেন? ওকে তো আমরা মা*রতেই চাই। এই তুই কি ভয় পাচ্ছিস? একদম ভয় পাস না। আমার এই ঠিকানা ওর বন্ধুরা কখনোই জানবে না। পুলিশও জানতে পারবে না। সবাই জানার আগেই ওকে মে*রে মাটির নিচে পুঁতে দিব। কেউ কখনোই ওর হদিস পাবে না।”
তুরাগের কথা শুনে মাহতাবের গলা শুকিয়ে আসে। শেষমেশ নিজের স্ত্রীকে খু*ন করবে সে!
“এসব জানাজানি হলে আমরা শেষ হয়ে যাব। আমাদের জ্যন্ত মে*রে ফেলবে সবাই। এখন সিরাতের ফ্যান, ফলোয়ার্স অনেক বেড়ে গিয়েছে৷ হাজার হাজার মানুষ ওকে ফলো করে। আমাদের পেলে সবাই জ্যন্ত মাটিতে পুঁতে দেবে।”
“আরে এত ভয়ের কিছু নেই। আজই ওর জীবনের শেষ দিন।”
কথাটা বলে নিজের পকেট থেকে একটা ছু*রি বের করে সিরাতের গলার কাছে ধরে তুরাগ। এটা দেখে মাহতাব ভয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। তুরাগ যেই মুহূর্তে সিরাতের গলার মাঝে ছু*রি দিয়ে আঘাত করতে যাবে ওই মুহূর্তে গু*লির আওয়াজে চমকে ওঠে দু’জন। পাশ ফিরে সামনে তাকিয়ে র*ক্ত লাল চোখে ইভানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তুরাগের হাত থেকে আপনাআপনি ছুরি পড়ে যায়। তাড়াতাড়ি করে ছুরিটা তুলে নিয়ে ইভানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“প্রেমিকার জন্য এত চিন্তা যে কুকুরের মতো গন্ধ শুঁকে এখানে চলেই এলি। এক বাচ্চার মায়ের প্রতি এত দরদ? যাক এসে ভালো করেছিস৷ এখন তোর সামনেই তোর প্রেমিকাকে মা*রব আমি।”
মাওয়া দৌড়ে দরজার সামনে এসে সিরাতের র*ক্তাক্ত শরীর দেখে স্তব্ধ হয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে তুরাগ সিরাতের গলায় পুনরায় ছু*রি ধরলে ইভান কিছু করার আগেই ওর হাত থেকে গান নিয়ে কোনোকিছু না ভেবে চোখ বন্ধ করে তুরাগের পিঠ বরাবর গু*লি ছুঁড়ে দেয় মাওয়া। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে ওঠে সবাই।
মাহতাব ভয় পেয়ে দূরে সরে যেতে চাইলে তার দুই পায়ে পরপর দুইটা গু*লি করে গান ফেলে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সিরাতের দিকে এগিয়ে যায় মাওয়া। তুরাগ ব্যথায় মাটিতে বসে পড়ে। মাওয়া সিরাতের কাছে গিয়ে তাকে ডাকতে শুরু করে। অসহ্য ব্যথায় চোখ দু’টো বন্ধ করার আগে তুরাগ নিজের শেষ চালটা দিয়েই দেয়।
“এক বন্ধুকে মা*রতে না পারি, আরেকটাকে তো পারব।”
কথাটা বলে মুহূর্তের মধ্যেই মাওয়ার পেটে ছু*রি ঢুকিয়ে দেয় তুরাগ। কোনো আওয়াজ না করে নির্বাক দৃষ্টিতে মাওয়া কেবল চেয়ে থাকে তুরাগের দিকে। আলতোভাবে পেটে হাত দিলে সে বুঝতে পারে তার হাত র*ক্তে মাখামাখি হয়ে গিয়েছে। মাওয়ার চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। সিরাতের হাতের উপর হাত রেখে সে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।
একটা ঘরের মাঝে চারজন মানুষ নিষ্প্রাণ হয়ে শুয়ে আছে। ইভান সবকিছু দেখে চলার শক্তি হারিয়ে ফেলে। হাটু গেঁড়ে মাটিতে বসে পড়ে। বাকিরা এসে এমন দৃশ্য দেখে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে রয়। অথৈ শব্দ করে কান্না করে ওদের দিকে এগিয়ে যায়। মাওয়ার পাশে বসে তাকে ডাকতে থাকে। উর্মি এসে বসে পড়ে সিরাতের পাশে। চুলের মাঝে বিলি কেটে বলে,
“রাত তুই না সেদিন আমাকে সাহস দিলি? তাহলে আজ তুই নিজে কেন এভাবে নিষ্প্রাণ হয়ে শুয়ে আছিস? তোর র*ক্তাক্ত শরীর দেখে তোর মেয়ে কী বলবে? তুই তো এভাবে চলে যেতে পারিস না। তোকে বাঁচতে হবে। সবাইকে বাঁচার কথা বলে তুই ম*রতে পারিস না। এই মেয়ে চোখ খোল। চোখ খোল বলছি। রাত!”
হাজার ডাকেও হয়তো সিরাত আর সাড়া দেবে না। উঠে বলবে না,
“এই দেখ আমি একদম ঠিক আছি। তোদের বন্ধুর কখনো কিছু হতেই পারে না। আমি তো অনেক সাহসী। হার না মানা এক তেজস্বিনী আমি।”
অথৈ মাওয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে। অভি আবেগশূন্য চোখে দু’জনের দিকে তাকিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে আসে। মাওয়ার পাশে বসে বলে,
“সেদিন যখন আমরা দেখা করলাম, তখন তুই আমাকে কথা দিয়েছিলি আমাকে নিয়ে ভাববি। আমি যে তোর মুখ থেকে একটা বার ভালোবাসি কথাটা শোনার জন্য বহুকাল ধরে অপেক্ষা করছি। তুই আমাকে এভাবে ফাঁকি দিয়ে চলে যেতে পারিস না। তোর এখনো অনেক কাজ বাকি। আমাকে ভালোবাসা বাকি। আমার ভালোবাসা গ্রহণ করা বাকি। আমার বউ হওয়া বাকি। আমি তোকে ছাড়া বাঁচতে পারব না। একটা বার চোখ খোল। দেখ, কেউ একজন তোর জন্য বুক পেতে রেখেছে। আমার বুকে মা*থা রাখবি না তুই? আমাকে ভালোবাসবি না? এই মেয়ে, তাকা আমার দিকে। বল না, ভালোবাসিস আমায়!”
না, মাওয়া সাড়া দেয় না। অভির চোখ যায় সিরাতের দিকে। সিরাতের ডান হাত থেকে অঝোরে র*ক্ত ঝরছে। সেই হাত স্পর্শ করে সে বলে,
“তুই না আমার বেস্ট ফ্রেন্ড? কতগুলো দিন তোর সাথে অভিমান করে কথা বলিনি আমি। এই দেখ, আমি নিজে থেকে তোর সাথে কথা বলছি। আমি তোকে কথা দিচ্ছি, আর কখনো তোর উপর অভিমান করে কথা বন্ধ করব না। এই বাবু, তাকা না আমার দিকে। তুই না সবসময় বলিস, আমি তোর ভাই। ভাইয়ের কষ্টে কষ্ট হচ্ছে না তোর? আমার যে বুক ফেটে যাচ্ছে রাত। আমার সবচেয়ে প্রিয় দু’জন মানুষ আমারই চোখের সামনে নিষ্প্রাণ হয়ে শুয়ে আছে। তোরা চলে গেলে আমি কীভাবে বাঁচব? এই পৃথিবীতে বন্ধুরা ছাড়া আমার তো আর কেউ নেই। আমাকে এতটা কষ্ট দিস না প্লিজ। এত কষ্ট নিয়ে আমি বাঁচতে পারব না রে। এই আমাকে একবার ভাই বলে ডাক না রাত। তোর মুখ থেকে আমি অনেক দিন হলো ভাই ডাক শুনি না। বোন আমার, একটা বার আমাকে ডাকবি প্লিজ!”
“তোরা শান্ত হ, ওদের এক্ষুণি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। অভি তুই মাওয়াকে নিয়ে আয়। আর ইভান তুই,”
নাবিল বাকি কথা বলার আগেই ইভান সিরাতের কাছে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নেয়। ছেলেটার চোখে কোনো পানি নেই। কেমন নির্জীব হয়ে আছে সে। সিরাতের মুখপানে তাকিয়ে বলে,
“দ্বিতীয় বারের মতো তোকে কোলে তুলে নিলাম। রাগ করবি না তো? শোন মেয়ে, তোর শত রাগ সহ্য করতে রাজি আছি আমি। শুধু তোকে হারাতে রাজি নই। তুই আমার উপর অভিমান করলি। সেটা তো মেনে নিয়েছি আমি। আমার ভালোবাসাকে গ্রহণ না করে তুই অন্য একজনের বউ হলি। সেটাও হাসিমুখে মেনে নিয়েছি। আমি কখনো তোকে জোর করিনি আমার হওয়ার জন্য। তোর সিদ্ধান্তকে সাদরে গ্রহণ করেছি। নিষিদ্ধ তোর প্রতি কখনো অধিকার খাটাতে চাইনি। আমি কেবল চেয়েছি তোর ভালো থাকা দেখতে। এই আমি শুধু তোর হাসিমুখ দেখতে চাই। তোর ভালো থাকা দেখেই তো এতদিন বেঁচে আছি আমি। আমার মনের কথাগুলো না জেনে তো তুই চলে যেতে পারিস না। আমি জানি, তুই ফিরবি। তোকে ফিরতেই হবে।”
তেজস্বিনী কি আর কখনো ফিরবে? বন্ধুর জন্য জীবন বাজি রাখা মাওয়া কি ফিরবে তার ভালোবাসার মানুষটার কাছে? হয়তো ফিরবে। কিংবা হার না মানা নারী হয়ে সমাজের বুকে এক অনন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে তারা দু’জন রয়ে যাবে নীলাভ আকাশের বুকে!
চোখের ঘুম নিমিষেই হারিয়ে যায় ইভানের চোখ থেকে। ভোর ছয়টা বেজে সাইত্রিশ মিনিটে এমন কোনো খবর শোনার জন্য সে একদমই তৈরি ছিল না। কণ্ঠে উত্তেজনা রেখে ইভান প্রশ্ন করে,
“কী বলছিস এসব তুই? সিরাতকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে কী? আমাকে সবকিছু বিস্তারিত বল তামান্না।”
“গতকাল সন্ধ্যায় সিরাত একটা কাজে বাইরে যায়। ওর রাত নয়টার মধ্যেই ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু এখনো বাড়ি ফেরেনি সিরাত। সিরাতের আম্মু কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। এদিকে নাবিহাকে রাত থেকে হাজার রকমের চেষ্টা করেও কেউ কিচ্ছু খাওয়াতে পারেনি। আমি এই খবর পেয়েই তারিনকে নিয়ে সিরাতদের বাড়িতে এসেছি। ভাই, তুই তো এখানকার থানার এসআই। তুই কিছু একটা কর। যেভাবেই হোক সিরাতকে খুঁজে বের কর।”
“আচ্ছা তুই শান্ত হ। আমি আধ ঘন্টার মধ্যে আসছি।”
ফোন রেখে কোনোরকমে ফ্রেশ হয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ে ইভান। তার মা*থা কাজ করছে না। রাস্তায় বের হয়ে একটা গাড়িও খুঁজে পায় না সে। দিশা না পেয়ে ইভান দ্রুত পা চালিয়, এক প্রকার দৌড়ে মিনিট কুড়ির মাঝেই সিরাতদের বাড়িতে চলে আসে। সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকার সময় ছোট্ট নাবিহার কান্নার আওয়াজ শুনে থেমে যায় ইভান। কিছু একটা ভেবে দ্রুত কল করে অভিকে। দুইবার কল দেওয়ার পরেও অভিকে না পেয়ে নাবিলকে কল দেয়। কল রিসিভ করে ঘুম জড়ানোর কণ্ঠে নাবিল বলে,
“কি ভাই এত সকালে কেউ কল দেয়? কী হয়েছে বল?”
“রাখ তোর ঘুম। এদিকে সিরাতকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আর তুই এখনো ঘুমাচ্ছিস? তাড়াতাড়ি ওদের বাড়িতে আয় তুই।”
“সিরাতকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে? এই সকাল বেলা তুই আমার সাথে ফাজলামি করছিস ভাই?”
“দিব এক থা*প্পড়। তোর মনে হয় আমি এত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে মজা করছি? এত কথা বলার সময় নাই। তুই তাড়াতাড়ি এখানে আয়। রাখছি আমি।”
“আরে শোন তো আমার কথা!”
নাবিলের আর কোনো কথা না শুনেই কল কেটে দেয় ইভান। ভেতরে গিয়ে তারিনের কাছ থেকে নাবিহাকে কোলে নিয়ে বলে,
“কী হয়েছে আম্মু? তুমি কাঁদছ কেন?”
নাবিহা কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দেয়,
“আমি মাম্মার কাছে যাব।”
“হ্যা যাবে তো সোনা। মাম্মা খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে। এখন তুমি কিছু খেয়ে নাও। নয়তো মাম্মা বাড়ি ফিরে এসব শুনলে কিন্তু খুব কষ্ট পাবে।”
“না, আমি খাব না। আমাকে মাম্মার কাছে নিয়ে চলো।”
“আচ্ছা আমি তোমাকে প্রমিস করছি, আমি খুব দ্রুত তোমার মাম্মাকে তোমার কাছে নিয়ে আসব।”
“সত্যি?”
“তিন সত্যি। কিন্তু তার আগে তোমাকে খেতে হবে। তুমি আমার কথা না শুনলে কিন্তু আমি তোমার মাম্মাকে এনে দিব না।”
ইভানের কথায় নাবিহা অল্প পরিমাণে খাবার খেয়ে নেয়। খুব বেশি খায় না। তবে যেটুকু খেয়েছে এই মুহূর্তে এটাই যথেষ্ট ভেবে আর কেউ বাচ্চাকে জোর করে না খাওয়ার জন্য।
ইতি ইসলাম ইভানের কাছে এসে ভেজা গলায় বলে,
“বাবা আমার মেয়েকে আমার কাছে এনে দাও তুমি। মেয়েটা আমার সারারাত বাড়ি ফেরেনি। কে জানে কি বিপদ হলো মেয়েটার। ওর বাবা সকাল থেকে খোঁজ নিচ্ছে। চেনাজানা সবাইকে কল দেওয়া শেষ। কেউ জানে না ওর খবর। শাহেদ চিন্তায় চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমি একা হাতে কত দিক সামলাব বলো?”
“আন্টি আন্টি আপনি একটু শান্ত হন। আমার উপর বিশ্বাস রাখুন। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, যেভাবেই হোক সিরাতকে সুস্থ অবস্থায় বাড়ি ফিরিয়ে আনব আমি।”
“শুধু তুই কেন? আমরা সবাই মিলে আমাদের বন্ধুকে খুঁজে বের করব। আমরা কিচ্ছু হতে দিব না ওর।”
নাবিলকে হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ির ভেতর ঢুকতে দেখে ইভান সেদিকে এগিয়ে যায়। পেছন পেছন নকশি আর উর্মিও চলে আসে। ইভান বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তোরা এত সকালে আসতে গেলি কেন?”
“এটা কোনো প্রশ্ন হলো ভাই? আমাদের বন্ধু নিখোঁজ। আর আমরা বাড়িতে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমাব হ্যা?”
উর্মির কথায় ইভান বলে,
“আচ্ছা এসে ভালো করেছিস। এখন ভেতরে আয়। তোদের সাথে আলোচনা করব আমি কিছু বিষয় নিয়ে।”
“একটু অপেক্ষা কর। অথৈ রাস্তায় আছে। ওও আসুক।”
নাবিলের কথায় ইভান সরু চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
“সবাইকে খবর দিয়েছিস তুই? তা অভি আর মাওয়াকে জানাসনি?”
“অভিকে কলে পাওয়া যাচ্ছে না। আর মাওয়ার ফোন বন্ধ।”
“এই দুইটার আবার কী হলো!”
“ওদের সাথে পরে যোগাযোগ করে নিচ্ছি। আগে সিরাতের খোঁজ নিতে হবে।”
এর মাঝেই অথৈ চলে আসে। ইভান সবাইকে নিয়ে বসে বলে,
“আন্টি সিরাত সন্ধ্যায় কী কাজে বেরিয়েছিল?”
“আমাকে বিশেষ কিছু বলেনি৷ একটা ফোন কল এলো। দুই মিনিটের মতো কথা বলে আমাকে বলল, আম্মু তুমি নাবিহার খেয়াল রেখো। আমি একটু বের হচ্ছি। ঘন্টা দুয়েকের মাঝে ফিরে আসব।”
“আপনি কোনো প্রশ্ন করেননি যে সিরাত কোথায় যাচ্ছে?”
“জিজ্ঞেস করেছিলাম। শুধু বলল, খুব জরুরি একটা কাজে বের হচ্ছি। তোমাকে ফিরে এসে সব বলব।”
“তারপর কী হলো?”
“ওর তো নয়টার মধ্যে ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু এগারোটা বাজার পরেও যখন ফিরল না তখন আমার চিন্তা হচ্ছিল। আমি একের পর এক কল দিয়েই যাচ্ছিলাম। কল যাচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু কেউ রিসিভ করেনি। অস্থিরতা নিয়েই বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। কিন্তু এতক্ষণ পরেও যখন ফিরল না তখন ওর বাবা আশেপাশে গিয়ে খোঁজ নিল। কিন্তু সেখানেও আশানুরূপ কোনো ফল আমরা পাইনি।”
তারিন নাবিহাকে ফিডার খাওয়াতে খাওয়াতে বলে,
“ওকে কল কে দিয়েছিল? আমাদের আগে এটা জানতে হবে।”
“কোনোভাবে কলটা ওকে মাহতাব দেয়নি তো?”
তামান্নার কথায় সবার মনে অজানা এক ভয় বাসা বাঁধে। নকশি আতঙ্কিত হয়ে বলে,
“মাহতাবের সাথে সিরাতের এভাবে দেখা করতে যাওয়ার কারণ কী হতে পারে? তাছাড়া যদি মাহতাবের সাথেই দেখা করতে গিয়ে সিরাত নিখোঁজ হয় তাহলে তোরা ভাবতে পারছিস এরপর কী হবে?”
“শুধু ভাবতে পারছি না, বুঝতেও পারছি। মাহতাব সিরাতের উপর অনেক ক্ষেপে আছে। সিরাত ওর সাথে যা যা করেছে তারপর তো রেগে যাওয়া স্বাভাবিক। আর রেগে গিয়ে যদি ওই ছেলে সিরাতের কোনো ক্ষতি করতে চায় তাহলেও আমি খুব একটা অবাক হব না। কারণ এদের মতো ছেলেদের পক্ষে সবকিছুই সম্ভব।”
ইভানের কথায় সবার গলা শুকিয়ে আসে ভয়ে। তাদের প্রাণের চেয়েও প্রিয় বন্ধুটার বড়ো কোনো ক্ষতি হয়ে যায়নি তো? এসব ভেবেই সবার শ্বাস নেওয়ার গতি ভারি হয়ে আসে।
অন্ধকার এক ঘরের মধ্যে চেয়ারের সাথে খুব শক্ত করে হাত, পা বেঁধে রেখেছে সিরাতের। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকিয়ে হাতে ভীষণ ব্যথা অনুভব করে মৃদু আওয়াজ করে ওঠে সিরাত। মা*থাটা ভীষণ ব্যথা করছে তার। গলা শুকিয়ে এসেছে। ধীর কণ্ঠে সে বলে,
প্রথমে কয়েক বার ধীরে বললেও কেউ আসে না। তাই বাধ্য হয়ে যথাসম্ভব চিৎকার করে সিরাত বলে,
“আমাকে এভাবে বেঁধে রাখার মানে কী? কেউ আছেন এখানে? সামনে আসুন আমার।”
কথাটা শোনার সাথে সাথে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে একজন ব্যক্তি। অন্ধকারের মাঝে তার চেহারা ঠিক স্পষ্ট দেখতে পায় না সিরাত। খানিক্ষণ পর ব্যক্তিটি ঘরের আলো জ্বালালে সিরাত চমকে ওঠে। তার কণ্ঠস্বরে আপনাআপনি ভেসে আসে একজনের নাম।
“তুরাগ!”
সিরাতের মুখে নিজের নাম শুনে মুচকি হেসে তুরাগ বলে,
“বাহ্! এতদিনেও আমাকে ভুলতে পারোনি তাহলে। মাওয়ার সাথে সাথে তুমিও আবার আমার প্রেমে পড়ে যাওনি তো?”
“মুখ সামলে কথা বলো। তোমার মতো অত্যন্ত নিকৃষ্ট একজনের প্রেমে পড়ার মতো নোংরা মানসিকতা আমার নয়। কেন আটকে রেখেছ আমাকে? এতদিন পর ফিরে এসে আমার কাছে কী চাও তুমি?”
“আরে কুল কুল। সব সময় এত রেগে গেলে চলে নাকি হ্যা?”
সিরাতের গলা একেবারে শুকিয়ে যাওয়ায় সিরাত ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না। তুরাগের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমাকে একটু পানি দাও।”
“পানি খাবে তুমি? দাঁড়াও, আনছি।”
ঘরের এক কোণ থেকে এক বোতল পানি এনে সিরাতের সামনে ধরে তুরাগ।
“তোমার হাত তো বাঁধা। কীভাবে পানি খাবে তুমি? আমিই খাইয়ে দেই কেমন?”
কথাটা বলে বোতলের মুখ খুলে সিরাতের মুখের সামনে বোতল নিয়ে যায় তুরাগ। সিরাত পানি খাওয়ার জন্য মুখ খুললে তুরাগ ওর চোখের সামনে বোতলের সবটুকু পানি মেঝের উপর ফেলে দেয়। সিরাত হতভম্ব চোখে তুরাগের দিকে তাকালে সে ভ্রূ নাচিয়ে বলে,
“এত কষ্ট করে তোমাকে এখানে ধরে এনেছি কি আদর, আপ্যায়ন করার জন্য? আমি তো তোমার কষ্ট দেখতে চাই সিরাত। তুমি তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাবে। আর সেটা দেখে আমি মানসিক শান্তি পাব। হাহাহাহাহ!”
তুরাগের এই হাসি সিরাতের কাছে অসহনীয় লাগে। একরাশ বিরক্তি আর রাগ নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে সে।
টানা ছত্রিশ ঘন্টা একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে বন্দী থেকে সিরাত নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। তার দেহে আর এক ফোঁটা শক্তি নেই নিজ পায়ে উঠে দাঁড়ানোর মতো। এতগুলো ঘন্টায় এক ফোঁটা পানি সে পায়নি পান করার জন্য। তার তৃষ্ণার্ত চোখগুলো এক ফোঁটা পানির আশায় এখনো বন্ধ হয়নি। বুকের ভেতর হাহাকার শুরু হয়েছে কেবল একটুখানি পানি পান করার জন্য। চক্ষুদ্বয় যেন এবার তাকিয়ে থাকার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলছে। ধীরে ধীরে সিরাতের নিস্তেজ শরীরটা নুইয়ে পড়ে। যেন এক লজ্জাবতী গাছ লজ্জায় নুইয়ে পড়েছে। এতটা সাহসী এবং বুদ্ধিমতী হওয়ার পরেও যখন কারোর কাছে বন্দী হয়ে থাকতে হয় তখন তা নিজের কাছে লজ্জারই বটে!
ঘরের দরজা ঠেলে এক বলিষ্ঠ যুবক প্রবেশ করে ঘরে। সে সাথে করে একরাশ আলো নিয়ে এসেছে। কিন্তু এই আলো যে ক্ষণস্থায়ী। যে নিজেই আঁধার, তার দ্বারা কি কারো জীবন আলোকিত হতে পারে? এ যে অসম্ভব!
হাতে একটা পানির বোতল নিয়ে এক পা, দুই পা করে আগন্তুক এগিয়ে যায় সিরাতের দিকে। এক বোতল পানির সম্পূর্ণটা সিরাতের চোখেমুখে ছুড়ে দেয় সে। আচমকা পানির ঝাপটায় চমকে ওঠে সিরাত। তার নিস্তেজ শরীরটা যেন আরো বেশি করে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। নিভু নিভু চোখে সামনে তাকিয়ে সিরাত অবাক হয় না। অথচ এখন তার ভীষণভাবে চমকানোর কথা!
কণ্ঠস্বর থেকে আওয়াজ বের হতে না চাইলেও সিরাত নিজের উপর জোর দিয়ে হেসে বলে,
“আর কত নিচে নামবে তুমি? যাকে ভালোবেসে একদিন বাহুডোরে আগলে নিয়েছিলে আজ তাকেই নিজ হাতে মা*রতে চাইছ? কী আমার অপরাধ বলতে পারো তুমি? অন্যায় করলে তুমি। অথচ শাস্তি পেতে হচ্ছে আমাকে!”
সিরাতের কথায় কর্ণপাত না করে মাহতাব পাশ থেকে একটা চেয়ার নিয়ে তার মুখোমুখি বসে পুরো মুখে হাত বুলিয়ে বলে,
“আমার সুন্দরী বউটার চেহারার এ কি বেহাল দশা! চোখের নিচে কালচে দাগ, ঠোঁট জোড়া শুকিয়ে র*ক্ত জমেছে। চেহারার উজ্জ্বলতা হারিয়ে এখন কেবলই মলিনতার ছাপ স্পষ্ট। কোথায় গেল তোমার সৌন্দর্য? কোথায় গেল তোমার তেজস্বী রূপ? নিভৃতে তেজস্বিনী আজ হেরে গেল তবে?”
“হাহ্! তেজস্বিনী রূপ সবখানে মানায় না সিরাত। নিজের স্বামীর সাথে তুমি যে অন্যায় করেছ তার শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে জান। মনে আছে? বিয়ের পর প্রথম ছ’মাস আমরা চুটিয়ে প্রেম করেছি। কত-শত বার আমি তোমাকে জান বলে ডেকেছি। আমার স্পর্শে তুমি লজ্জাবতী লতার মতো নুইয়ে পড়েছ আমার বুকে। আমি তো সেই লাজুকলতার প্রেমে পড়েছিলাম। তোমার এই তেজস্বী রূপ আমার মোটেই পছন্দ হয়নি সিরাত। নারীদের হতে হয় তুলার মতো কোমল। কিন্তু তুমি হতে চেয়েছ সূর্যের মতো প্রখর। কী দরকার ছিল এসবের? এত বেশি সাহসী না হলে আজ তুমি বেঁচে যেতে। আর পাঁচটা মেয়ের মতো সংসারী হয়ে স্বামীর সাথে সুখে সংসার করতে পারতে।”
“মেয়েরা তুলার মতো কোমল হলে তোমাদের মতো ছেলেরা সহজেই তাদের ছিঁড়ে ছিঁড়ে খে*তে পারবে বলে এমন মেয়ে ভালো তাই না? নিজেদের রক্ষা করার জন্য হলেও প্রত্যেকটা মেয়ের তেজস্বিনী হওয়া উচিত। নয়তো তোমাদের মতো কাপুরুষদের শাস্তি দেবে কীভাবে?”
“কী লাভ হলো এত তেজস্বিনী হয়ে? সেই তো আজ তুমি আমার হাতের মুঠোয় বন্দী।”
“সেদিন যদি তুমি কলে আমার মেয়েকে নিয়ে বাজে কথাগুলো না বলতে তাহলে আমি কখনোই তোমার মুখ দেখতাম না। আমি তো মা৷ আমার মেয়েকে কেউ তুলে নিয়ে গিয়ে পাচার করে দিতে চাইবে, আর সেটা জেনেও আমি চুপ করে থাকব? তুমি খুব ভালো করেই জানতে যে এমন কথা শুনলে আমি হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে তোমার সাথে দেখা করতে যাব। আর তাই এই নোং*রা চাল চাললে তুমি। তুমি কেমন বাবা বলো তো? নিজের স্বার্থসিদ্ধি করার জন্য নিজের আপন মেয়েকেও ব্যবহার করলে তুমি। ছিঃ!”
“আরে তোমার ছিঃ তোমার কাছেই রাখো। তুমি তোমার মেয়ের কথা ভেবেছ? ভাবলে তার বাবার সাথে এতটা অন্যায় করতে পারতে না। আজ তোমার জন্য আমি পথের ভিখারি হয়ে গিয়েছি। এরপরেও তোমাকে ছেড়ে দেওয়া যায়?”
“তো কী করতে চাও আমার সাথে?”
“তোমাকে তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে মা*রতে চাই। আমার সুখের জীবন তো শেষ। সুতরাং তোমার সুখের জীবনও শেষ! একটা কথা জানো তো? টিট ফর ট্যাট।”
হাত, পা, ঘাড়, মা*থা, সর্বোপরি পুরো শরীরের ব্যথায় কাবু হয়ে আসে সিরাত। তার চোখ থেকে নিরবে অশ্রু ঝরে। বহুকষ্টে সিরাত মাহতাবকে বলে,
“আমাকে একটু পানি দেবে প্লিজ?”
“মৃ*ত্যুর আগে তুমি এক ফোঁটা পানিও পাবে না। কেন জানো? কারণ তোমার জন্য আমাকে তিনটা রাত না খেয়ে থাকতে হয়েছে। পেটের ক্ষুধার জ্বালায় আমি ছটফট করেছি প্রতিনিয়ত। কিন্তু পকেটে একটা টাকা ছিল না আমার। রাজপ্রাসাদে বড়ো হওয়া ছেলেটার যখন এমন অবস্থা হয় তখন তার অন্যায়কারীকে তো কঠিন শাস্তি দিতেই হবে।”
সিরাত বুঝে যায় এদের কাছে এক ফোঁটা পানি চেয়েও কোনো লাভ নেই। সে ভেবে পায় না এই বন্দী জীবন থেকে কীভাবে ছাড়া পাবে। কে বাঁচাবে তাকে? আচ্ছা, তার ছোট্ট মেয়েটা মা’কে ছাড়া কেমন আছে? ভালো আছে তো? তার বয়স্ক মা-বাবা তার চিন্তায় অসুস্থ হয়ে যায়নি তো? এমন হাজারো কথা ভেবে ঠোঁট ভেঙে কান্নায় ভেঙে পড়ে সিরাত।
সম্পূর্ণ একটা দিন বন্ধুরা সবাই মিলে শত চেষ্টা করেও সিরাতের কোনো খোঁজ পায়নি৷ হতাশ হয়ে প্রত্যেকে মা*থা চেপে ধরে বসে রয় এক স্থানে।
কোথা থেকে যেন অভি আর মাওয়া একসাথে এসে হাজির হয় বাকিদের সামনে। তাদের এমন হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখে উর্মি জিজ্ঞেস করে,
“কোথায় ছিলি তোরা? আর এখন আমাদের খোঁজই বা পেলি কোথায়?”
মাওয়া অস্থির চিত্তে প্রশ্ন করে,
“আমাদের কথা বাদ দে। তোদের খবর আমাদের তারিন দিয়েছে। তারিন তো নাবিহার সাথে আছে এখন। আমাদের আগে বল, সিরাতের কী হয়েছে? ছত্রিশ ঘন্টা পেরিয়ে গেল। এখনো মেয়েটা নিখোঁজ!”
“আমরা তো আমাদের দিক থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। ইভান সিরাতের ফোন ট্র্যাক করারও চেষ্টা করেছে। কিন্তু ফোন বন্ধ। আশেপাশের সবগুলো সিসিটিভি ফুটেজ চেক করা শেষ। কোথাও কোনো ক্লু পাইনি আমরা। মাহতাবের খোঁজও করেছি। কিন্তু ওই ছেলের কোনো খবর এখনো পাইনি আমরা।”
তামান্নার কথায় ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে মাওয়া। দীর্ঘক্ষণ নিরব থাকার পর অভি বলে ওঠে,
“আচ্ছা সিরাতের ফোনের লাস্ট লোকেশন কোথায়?”
ইভান চটজলদি উত্তর দেয়,
“নিউ ফরেস্ট স্টেশন নামের একটা একুরিয়ামের দোকানের সামনে ওর লাস্ট লোকেশন দেখাচ্ছে।”
“ওখানকার সিসিটিভি ফুটেজ দেখেছিস তোরা?”
“হ্যা, দেখেছি। ওই জায়গা অবধি সিরাত পৌঁছাতেই পারেনি। ওই দোকানের পাশে একটা ডাস্টবিন আছে। সেখানেই ওর ফোন পাওয়া গিয়েছে।”
নকশির কথায় অভি কিছু একটা ভেবে বলে,
“ওই জায়গা থেকে কিছুটা পেছন দিকে গেলেই একটা বুকশপ আছে। আর সিরাত কিন্তু বই পড়তে অনেক ভালোবাসে৷ এমনও তো হতে পারে যে ওখানেই সিরাত মাহতাবের সাথে দেখা করেছে। যেহেতু বুকশপটা মেইন রোড থেকে কিছুটা ভেতরে তাই ওখানকার সিসিটিভি ফুটেজ হয়তো তোরা দেখিসনি।”
“আরেহ্ তাই তো! আমরা তো ওই বুকশপের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম।”
নাবিলের কথায় অথৈ ইভানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ভাই যত দ্রুত সম্ভব তুই ওখানকার সিসিটিভি ফুটেজ দেখার ব্যবস্থা কর। এত বড়ো একটা ক্লু আমাদের সামনে ছিল৷ আর আমরা সেটা দেখিইনি!”
“তোরা আমার সাথে ওখানে চল। আমি সিসিটিভি ফুটেজ দেখার ব্যবস্থা করছি।”
বন্ধুরা সবাই মিলে দ্রুত ‘কবিতার শহর’ নামক সেই বুকশপে চলে যায়। ইভান নিজের পরিচয় দেওয়ার সাথে সাথেই দোকানের মালিক সিসিটিভি ফুটেজ দেখার অনুমতি দিয়ে দেয়। এই দোকানে মোট দুইটা সিসিটিভি লাগানো আছে। একটা ভেতরে, আরেকটা বাইরে। সবাই প্রথমে ভেতরের ফুটেজ দেখে। কিন্তু সিরাত এই দোকানের ভেতর অবধি আসেইনি। এরপর ইভান বাইরের সিসিটিভি ফুটেজ বের করে। দোকান থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে সিরাত বারবার ফোনের দিকে তাকাচ্ছে। এখানে সিরাতকে দেখে সকলের মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটে ওঠে। অবশেষে মেয়েটার দেখা তো পাওয়া গেল।
প্রায় পাঁচ মিনিট একই জায়গায় দাঁড়িয়ে সিরাত কারোর জন্য অপেক্ষা করছিল। এরইমাঝে একটা হুডি পরিহিত ছেলে এসে দাঁড়ায় তার সামনে। তাদের মধ্যে কী কথা হয় তা বুঝতে পারে না কেউ। ছেলেটা সিরাতের মুখে কিছু একটা স্প্রে করার সাথে সাথে মুহূর্তের মধ্যে সিরাত লুটিয়ে পড়ে ছেলেটার বুকে। হুডির আড়ালে মুখ ঢাকা থাকায় কেউ তার মুখ দেখতে পায় না।
“এতদূর অবধি এসেও কি আমরা কিচ্ছু করতে পারব না?”
মাওয়ার কান্না জড়িত কণ্ঠে পুনরায় সবাই আশাহত হয়। ছেলেটা সিরাতকে কোলে নিয়ে মিনিটের মধ্যেই আড়াল হয়ে যায়। মাওয়া কিছু একটা দেখে চিৎকার করে বলে,
“ইভান একটু পোজ কর ছেলেটার ডান হাতে।”
ছেলেটার ডান হাতে আঁকা একটা তীরের ছবি দেখে উত্তেজিত হয়ে মাওয়া বলে ওঠে,
“আমি এই চিহ্নটা চিনি।”
অভি অবাক হয়ে বলে,
“চিনিস মানে?”
“আরে এটা তুরাগের হাত। ওর হাতে এই একইরকম চিহ্ন আঁকা ছিল।”
“কী বলছিস তুই? তুরাগ এখানে আসবে কীভাবে?”
উর্মির প্রশ্নের উত্তরে মাওয়া বলে,
“আরে ভাই আমি এতকিছু জানি না। কিন্তু এটা যে তুরাগের হাত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি ওর হাতে আঁকা এই চিহ্ন খুব ভালো করে চিনি। সুতরাং এটা যে তুরাগ সে বিষয়ে আমি শতভাব নিশ্চিত। তার মানে সিরাতের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে তুরাগের হাত আছে।”
“মুঠোভরা সিঁদুরের ছোঁয়ায় যেদিন আমার সিঁথি রাঙিয়ে দিল উৎসব, সেদিন ভাবিনি বিয়ের কথাটা সবাই জানার আগেই আমি বিধবা হয়ে যাব৷ জানিস? আমরা দু’জন দু’জনকে ভীষণ ভালোবাসতাম। আমি আজও ওকে ভালোবাসি। সবার আড়ালে আমরা দু’জন সংসারও শুরু করেছিলাম। কিন্তু সুখের সংসার আমার ভাগ্যে বেশিদিন লেখা ছিল না। মাত্র সাত মাসের মা*থায় আমাকে সম্পূর্ণ একা করে দিয়ে সে চলে গেল। লাল বেনারসি গায়ে জড়ানোর আগেই আমাকে পরতে হলো সাদা শাড়ি!”
উর্মির কথায় বাকি সবাই স্তব্ধ হয়ে নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তার দিকে। এগারো জন বন্ধুর মাঝে একমাত্র উর্মি সনাতন ধর্মী। কিন্তু এটা কখনো বাকিরা অনুভব করেনি। উর্মি মেয়েটা একটা সময় ভীষণ প্রাণোচ্ছল ছিল। সকলের সাথে সহজেই মিশে যেত। সেই মেয়েটা যে নিজের মধ্যে এক আকাশ সমান কষ্ট বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে এটা যেন বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে বাকিদের।
সিরাত উর্মির কাঁধে হাত রাখলে এক পলক তাকিয়ে সে পুনরায় বলতে শুরু করে,
“আমার আর উৎসবের সম্পর্কটা আমাদের পরিবার থেকে মেনে নেয়নি। উৎসব ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের ছোট ছেলে। আর আমি উচ্চবিত্ত পরিবারের একমাত্র মেয়ে। আমার বড়ো দুই দাদা উৎসবকে অনেক অপমান করেছিল ওদের পারিবারিক অবস্থা নিয়ে। চার বছর আগে আমাদের সম্পর্ক শুরু হয়৷ সম্পর্কের দুই মাসের মধ্যে সবাই আমাদের বিষয়ে সবকিছু জেনে যায়। আমার পরিবার থেকে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়, আমি আর উৎসবের সাথে যোগাযোগ করতে পারব না। আমি রায় বংশের মেয়ে। যার তার সাথে তো আর আমার বিয়ে হতে পারে না৷ কিন্তু ভালোবাসা কী এসব মানে? আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারতাম না। তাই ছয় মাসের মধ্যে আমরা দু’জন পালিয়ে বিয়ে করি। সবকিছু ঠিকই ছিল। আমাদের ছোট্ট সংসার সাজিয়েছিলাম আমরা। আমাদের সংসারে অভাব ছিল। তবে কষ্ট ছিল না। অভাবের সংসারে আমরা বেশ ভালোই ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ একদিন আমাকে কাঁদিয়ে আমার ভালোবাসার মানুষটা বহুদূরে চলে গেল। স্বার্থপর ছেলেটা একবারও আমার কথা ভাবলো না।”
সকলের চোখেই পানি জমেছে। তাদের এত কাছের বন্ধুটার জীবনে এতকিছু ঘটে গেল, অথচ তারা কেউ কিছু জানতেই পারল না!
তামান্না ধীর পায়ে উর্মির পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
“রাতের খাবার খাওয়া শেষে আমি সবকিছু গুছিয়ে ওর পাশে বসলাম। ওও আমাকে বলল, আমার বুকের উপর শুয়ে আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবে প্লিজ? আমি ওর কথামতো বুকের উপর শুয়ে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। তারপর সে আমার কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলল, ভালোবাসি মহারাণী। আমি কিছু না বলে মুচকি হাসলাম। অতঃপর সে নিশ্চুপ হয়ে গেল। আমি ভাবলাম, হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘন্টা খানেক এভাবেই কেটে গেল। হঠাৎ খেয়াল করলাম ওর হৃৎস্পন্দনের গতি একদম কমে এসেছে, নেই বললেই চলে। মনের মধ্যে অজানা ভয় বাসা বাঁধল। আমি ধীরে ধীরে ওর বুকের উপর থেকে উঠে মুখের কাছে হাত নিয়ে কয়েক বার ডাকলাম৷ সে কোনো সাড়া দিল না। আতঙ্কে বুক কাঁপছিল আমার। অনেক্ক্ষণ যাবত ডাকার পরেও যখন উৎসব সাড়া দিল না তখন বুঝে গেলাম ছেলেটা ঘুমিয়ে তো গিয়েছে, কিন্তু এই ঘুম আর ভাঙবে না। জানিস? সেদিন আমার বুক ফেটে কান্নার আওয়াজ পুরো এলাকা শুনেছে। আমি তো ওর আশায় বাড়ি ছেড়েছিলাম। কিন্তু ওই ছেলে আমার কথা একবারও না ভেবে আমার হাতটা চিরদিনের মতো ছেড়ে দিল!”
“কী দোষ ছিল আমার? আমি তো তাকে ভালোবেসে তার সাথে ঘর বেঁধেছিলাম। তবুও কেন আমাকে ছেড়ে গেল সে? উৎসব চলে যাওয়ার পর আমি পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলাম। বাবা কোনোভাবে এই খবরটা পেয়ে আমাকে ওই ছোট্ট ভাড়া বাসা থেকে নিয়ে এসেছিল। আমি জীবন্ত লা*শের মতো বাঁচতে শুরু করি। এভাবেই সপ্তাহ খানেক পার হয়ে যায়। স্বামী হারানোর শোক কাটানোর আগেই বুঝতে পারি আমি অন্তঃসত্ত্বা। এটা শোনার পর আমি নতুন করে বাঁচার জন্য কিঞ্চিৎ আশা পেয়েছিলাম। কিন্তু আমার সেই আশায় ভাটা পড়ল। আমার মাতৃত্বের স্বাদ আর গ্রহণ করা হলো না রে। আমার সন্তানও আমাকে ছেড়ে চলে গেল। দুনিয়ার আলোও দেখল না অভিমান করে। বাবার কাছে চলে গেল সে। তিনটা বছর পেরিয়ে গেল। তিনটা বছর ধরে জীবন্ত লা*শ হয়ে বেঁচে আছি আমি। আমি এতটাই অভাগী যে না পেলাম স্বামী সুখ, আর না পেলাম সন্তান সুখ!”
সিরাত নিজেকে সামলাতে পারছে না কোনোভাবেই। মুখে দুই হাত চেপে হু হু করে কেঁদে ওঠে সে। তারও যে সন্তান আছে। সন্তানের সামান্য জ্বর হলেও ছটফট করে সে। সেখানে পরপর এতগুলো ধাক্কা মেয়েটা কীভাবে সামলে উঠল কে জানে!
উর্মি নিজের বুকের কাছে হাত নিয়ে আহাজারির সুরে বলে,
“এখানটায় না বড্ড যন্ত্রণা হয়। রাতে ঘুমাতে পারি না আমি। দম বন্ধ হয়ে আসে। মনে হয় কেউ বোধহয় আমার ক’লি’জা টেনে বের করে নিচ্ছে। মৃ*ত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করি প্রতিনিয়ত। কিন্তু কেউ আমার কষ্ট বোঝে না। এই সমাজে যার কষ্ট সেই শুধু বোঝে। বাকিরা তো গল্প খোঁজে!”
আচমকা অথৈ নাবিলকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে। এমন কিছুর জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। সবাই খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। নাবিল পাথরের মতো ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে একই জায়গায়।
“আমি তোকে হারাতে চাই না নাবিল৷ তুই আরও দশটা মেয়ের সাথে হেসে হেসে কথা বল, ঘুরতে যা। আমার কোনো আপত্তি নেই। শুধু আমাকে ছেড়ে যাস না। আমি যে তোকে বড্ড ভালোবাসি রে। হয়তো অভিমান করে দূরে আছি। তবে কী জানিস? আমি প্রতিটা মুহূর্তে গুমরে গুমরে ম*রি। তোকে না পাওয়ার কষ্ট আমাকে শান্তিতে দুদণ্ড ঘুমাতে দেয় না। আমার বুকটা কেমন খালি খালি লাগে। উর্মির উৎসবের মতো তুই এতটা স্বার্থপর হবি না তো? আমাকে একা ফেলে কোথাও চলে যাবি না তো? পরাণ রে, আমি যে তোরে ছাড়া কিচ্ছু ভাবতে পারি না পরাণ!”
অথৈ এর এমন কাজে সবাই ‘থ’ বনে গিয়েছে। অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সেদিকে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সে আপনমনে বলে যায়,
“যেদিন তোকে অন্য একজনের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখলাম সেদিন আমার পুরো দুনিয়া ওলট-পালট হয়ে গিয়েছিল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, আমার ভালোবাসা হেরে গেল। আমি জানি সেদিন তোকে ফাঁসানো হয়েছিল। তবুও কেন যেন মেনে নিতে পারিনি আমি। তুই তো শুধু আমার। তোর বুকে অন্য কেউ কেন মা*থা রাখবে বল? তোর বুকে শুধু এবং শুধুই আমি মা*থা রাখব। এটা আমার অধিকার। অনেক হয়েছে অভিমানের পর্ব, আর না। অনেকগুলো দিন আমি তোকে ছেড়ে বাঁচার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি তোকে ছাড়া একটা দিনও ভালো থাকতে পারিনি।”
“আচ্ছা বাবা শান্ত হ তুই। আমি কোত্থাও যাব না তোকে ছেড়ে। এই আমিটা তো তোরই।”
“সত্যি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবি না তো?”
“তোকে ছেড়ে যদি চলে যাওয়ারই হতো তাহলে এতদিনে আমি বউ নিয়ে ঘুরতাম বুঝলি?”
“নাহ্ তোর কথা আমি বিশ্বাস করি না৷ তুই এক্ষুণি আমার সাথে কাজি অফিসে চল। আজই আমরা বিয়ে করব।”
“এহ্ এখনই বিয়ে করব মানে কী হ্যা?”
“যদি আবার তুই হারিয়ে যাস? আবার কেউ তোকে আমার থেকে কেঁড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে?”
“আচ্ছা সবাইকে সাক্ষী রেখে তোকে কথা দিচ্ছি, দুই পরিবারকে জানিয়ে যত দ্রুত সম্ভব তোকে আমার ঘরণী করে আনব।”
ওদের দু’জনের এমন কান্ড দেখে সিরাত হতাশ কণ্ঠে বলে,
“আজ নাকি তোরা আমার মন ভালো করার জন্য এতসব আয়োজন করেছিলি? এখানে তো দেখছি বিয়ের পাকা কথা চলছে।”
মাওয়া সিরাতের এমন হতাশ চেহারা দেখে হেসে উত্তর দেয়,
“ভালোই তো হলো। তোর জন্য একজন নিজের মনে জমে থাকা দুঃখের কথা বলতে পারল। অন্যদিকে দু’জন ভালোবাসার মানুষ অভিমান ভুলে আবার এক হলো।”
সিরাত মাওয়ার কথায় পাত্তা না দিয়ে উর্মির কাছে চলে যায়। উর্মির মা*থায় হাত বুলিয়ে দেয় পরম যত্নে।
“আমার জীবনের গল্পটা হয়তো অনেক মেয়েকে স্বাধীনভাবে বাঁচতে উদ্বুদ্ধ করবে। কিন্তু তোর গল্পটা সেই মানুষদের বাঁচতে সাহায্য করবে যারা কঠিনভাবে ভালোবেসে মারাত্মকভাবে হেরে গিয়েছে। তোর মধ্যে যে তেজস্বী রূপ আছে সেটাকে এবার মেলে ধর উর্মি। জীবন কখনো থেমে থাকে না। যে কষ্ট তুই পেয়েছিস তা জয় করা সহজ নয়। সমাজ কী বলবে? অন্যরা কী বলবে? এসব না ভেবে বেঁচে থাকার মতো করে বেঁচে থাক। তোর যা করতে ভালে লাগে সেটাই কর৷ প্রয়োজনে জবাব দিতে শেখ। ঘরকুনো হয়ে লুকিয়ে থাকা কোনো সমাধান নয়। জানি তুই নতুন করে আর কারোর সাথে জীবন শুরু করতে পারবি না। তাতে কী? একা বাঁচতে শেখ তুই। এমনভাবে বাঁচ যেন তোকে দেখে আর পাঁচটা মানুষ বেঁচে থাকার শক্তি পায়, উৎসাহ পায়।”
উর্মি অশ্রুসিক্ত নয়নে সিরাতের দিকে তাকালে সে চোখের ইশারায় তাকে বোঝায়,
“আমার বাড়িতে তোমার কোনো জায়গা নেই। বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে।”
বাবার কথায় হতভম্ব হয়ে যায় মাহতাব। এতদিন সে সিরাতের সাথে যেখানে ছিল সেটা ভাড়া বাসা ছিল৷ যেহেতু সিরাত সেখানে নেই, আর সম্পূর্ণ বাসা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে তাই মাহতাব সেই বাসা ছেড়ে বাবার কাছে এসেছে। কিন্তু বাড়ি ফিরে এমন কিছু শোনার জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না।
মারজিয়া শেখ স্বামীর কাছে এসে নরম কণ্ঠে বলেন,
“শোনো না, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে। ওকে এখন বের করে দিয়ো না। তাছাড়া তোমার সম্পত্তিতে তো মাহতাবের ভাগ আছে।”
মারজিয়া শেখের কথায় নজরুল শেখের ভ্রূদ্বয় সংকুচিত হয়ে আসে।
“ভাগ? কীসের ভাগ? মাহতাবের কোনো ভাগ নেই আমার সম্পত্তিতে।”
“এসব কী বলছ তুমি? ভাগ নেই মানে?”
“যা শুনেছ তা ঠিকই শুনেছ। কেন মাহতাব, সিরাত তোমাকে কিছু জানায়নি?”
বাড়ি ফিরে খাবার টেবিলে বসে সবেমাত্র খাবার মুখে নিয়েছিল মাহতাব৷ বাবার এহেন কথায় তার গলা দিয়ে আর কোনো খাবার নামে না। কাঁপা কাঁপা গলায় সে প্রশ্ন করে,
“কী জানানোর কথা বলছ তুমি?”
“তুমি যে মুহূর্তে সিরাতকে ডিভোর্স দিয়েছ সেই মুহূর্ত থেকে আমার সম্পত্তিতে তোমার আর কোনো ভাগ নেই। সেই সম্পত্তির সম্পূর্ণ টাকা সিরাতের কাছে চলে যাবে। না, সে এই টাকা ভোগ করবে না। গরীব, অসহায় মানুষদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেই এই টাকাগুলো তার প্রয়োজন। মেয়েটা এত ভালো যে একটা টাকাও নিতে চায়নি। কিন্তু আমার কথা রাখতে সে রাজি হয়েছে। প্রায় সত্তর লক্ষ টাকা আমি গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দেব। আমার কষ্টে অর্জিত টাকার এক অংশ ও তুমি পাবে না।”
মাহতাবের যেন পায়ের তলার মাটি সরে যায় বাবার কথা শুনে। এমনিতেই তার মা*থার উপর দশ লক্ষ টাকার দেনা। তার উপর সে এখন বেকার। এই মুহূর্তে বাবা তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে রাস্তায় রাত কাটানো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না তার কাছে!
“বাবা তুমি আমার সাথে এমন করতে পারো না। আমি তোমার ছেলে। তোমার সম্পত্তির উপর আমার পূর্ণ অধিকার আছে।”
“তুমি কি ডিভোর্স পেপারে সই করার সময় কাগজের লেখাগুলো পড়নি মাহতাব? ওখানে তো আমার করা এই উইল এর কাগজ ছিল। সেখানে তুমি সই করে দিয়েছ। সুতরাং তোমার কোনো অধিকার নেই আমার সম্পত্তির উপর।”
“বাবা!”
“আর একটা কথাও বলবে না তুমি। এই মুহূর্তে তুমি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও।”
রাগে, কষ্টে, দুঃখে মুখের ভাত রেখে উঠে পড়ে মাহতাব। তার চোখ থেকে যেন আজ র*ক্ত ঝরছে। ছেলেকে উঠতে দেখে দ্রুত ছেলের দিকে এগিয়ে আসে মারজিয়া শেখ।
“বাবা তুই মুখের ভাত রেখে উঠে যাস না। অন্তত খাবারটুকু খেয়ে নে।”
“এই ভাত আমার গলা দিয়ে নামবে না মা!”
এক থালা ভাতের মধ্যে হাত ধুয়ে খাবার টেবিল ছেড়ে চলে যায় মাহতাব। যাওয়ার আগে বাবার দিকে একবার তাকিয়ে বলে যায়,
“তুমি যার জন্য আমার সাথে এমন করলে তাকে আমি কিছুতেই সুখে থাকতে দিব না বাবা।”
ছেলের চলে যাওয়া মেনে নিতে পারেন না মারজিয়া শেখ। স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
“তুমি মানুষ নও, তুমি পাষাণ। আমার ছেলেটার মুখের ভাত কেঁড়ে নিলে তুমি। ওই এক বাইরের মেয়ের জন্য তুমি আমার ছেলের সাথে যা করলে সেটার জন্য একদিন পস্তাতে হবে তোমাকে। মিলিয়ে নিয়ো আমার কথা।”
স্ত্রীর কথায় কর্ণপাত করেন না নজরুল শেখ। নিজের করা ছোট্ট লাইব্রেরিতে এসে তিনি কয়েক বছর আগের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।
“ওই বাইরের মেয়েটা না থাকলে আজ আমি বেঁচে থাকতাম না। সেদিন যদি উপরওয়ালা ওই মেয়েটাকে আমাকে বাঁচানোর জন্য না পাঠাত তাহলে যে এতদিনে আমি মাটির নিচে শুয়ে থাকতাম। সিরাত ছিল বলেই আমি আজও বেঁচে আছি। সেই মেয়েটার কষ্ট আমি চুপচাপ কীভাবে দেখব? আমার ছেলে আসল হিরা চিনতে পারেনি সেটা তার ভুল। কিন্তু যে আমার জীবন রক্ষা করেছে তার কষ্টের কারণকে এমনি এমনি ছেড়ে দিতে পারি না আমি। ছেলের জন্য আমারও মন কাঁদে। তবে তাকে যে মানুষের মতো মানুষ করতে পারিনি আমি। তার প্রায়শ্চিত্ত তো আমাকে করতেই হবে। সেটা না-হয় এভাবেই করলাম।”
বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাহতাব পাগলের মতো ছুটে যায় তুরাগের কাছে। তুরাগের বাড়িতে গিয়ে তাকে বলে,
“তুই সিরাতকে মা*রতে চাস না? আমি তোর পাশে আছি। ওই মেয়ের মৃ*ত্যু আমি নিজের চোখে দেখতে চাই।”
তুরাগ মাহতাবের দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“শান্ত হ মাহতাব। আগে বল তো তোকে এমন অশান্ত লাগছে কেন?”
গ্লাসের সম্পূর্ণ পানি ঢকঢক করে খেয়ে নিয়ে মাহতাব তুরাগের দিকে তাকায়।
“তুই কি সেদিনের লাইভ দেখিসনি?”
“দেখব না কেন? লাইভ তো এখন ভাইরাল। আমার মনে হয় এতক্ষণে বাংলাদেশের সবাই ওই লাইভ দেখে ফেলেছে।”
“আমার সম্মানহানি যে করল তাকে কি এমনি এমনি ছেড়ে দিতে পারি আমি? তাছাড়া কেবলমাত্র সিরাতের জন্য আমার বাবা আমাকে তার সমস্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছে। আমার মেয়ের থেকেও আমাকে দূরে করে দিয়েছে। আজ আমি সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি তুরাগ। আমার জীবন থেকে যে মেয়েটা সবকিছু কেঁড়ে নিয়েছে তাকে আমি ছাড়ব না।”
“আচ্ছা শোন, আমাদের ঠাণ্ডা মা*থায় সবকিছু করতে হবে। সিরাত যেমন আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছে, তেমনই তোর জীবনও নষ্ট করেছে। আমরা দু’জন মিলে ওকে ভয়া*নক মৃ*ত্যু দিব।”
একদিকে মাহতাব আর তুরাগ সিরাতের জন্য মৃ*ত্যুর নীলনকশা তৈরি করছে, অন্যদিকে নিমু হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ছক কষছে কীভাবে সিরাতের ক্ষতি করা যায়।
নিজের সাজানো সংসার ছেড়ে চলে আসার দুই দিন পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু নিজেকে এখনো স্বাভাবিক করতে পারেনি সিরাত। যতই হোক, নিজের হাতে গড়ে তোলা সংসার তো!
সিরাতের মন ভালো করার জন্য বন্ধুরা সবাই মিলে পরিকল্পনা করে ওকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য তারিনের বাসায় নিয়ে এসেছে। প্রথমে সে আসতেই চায়নি। কিন্তু সবার জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে ঘর থেকে বের হয়েছে সে।
সিরাতের চোখ হাত দিয়ে ঢেকে উর্মি একটা ঘরের সামনে এসে থামে। অতঃপর নকশিকে চোখের ইশারায় দরজা খুলতে বলে।
“কী শুরু করেছিস তোরা বল তো? আর কতক্ষণ এভাবে আমার চোখ ঢেকে রাখবি?”
“এইতো হাত সরিয়ে নিচ্ছি।”
উর্মি হাত সরালে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায় সিরাত। সম্পূর্ণ ঘরটা বিভিন্ন রঙের বেলুন আর ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। মেঝের উপর গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লেখা,
“নীলাদ্রির মুখে হাসি মানায়, বিষন্নতা নয়।”
টেবিলের উপর ফুল দিয়ে সাজানো একটা কেক রাখা। কেকের উপর গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,
“তোর বন্ধুরা সব সময় তোর পাশে আছে রাত!”
এসব দেখে আপনাআপনি সিরাতের চোখে পানি চলে আসে। সবার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই ইভান তার দিকে একটা টিস্যু এগিয়ে দেয়।
“চোখের পানি মুছে নে। তোর চোখে পানি মানায় না। তোর চোখে তেজস্বী ভাবটাই মানায়।”
এক পলক ইভানের দিকে তাকিয়ে টিস্যু নিয়ে চোখের পানি মুছে নেয় সিরাত। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বলে,
“ভালোবাসি, তোদের ভীষণ ভালোবাসি আমি। সেই ছোট থেকে তোরা আমার পাশে আছিস। আমার ভালো সময়ে পাশে না থাকলেও খারাপ সময়ে আমার মনে সাহস যোগানোর জন্য তোরা সদা প্রস্তুত থাকিস। আমি কি সত্যিই এতটা ভাগ্যবতী? যে তোদের মতো বন্ধু পেয়েছি!”
অথৈ সিরাতের কাছে এসে তাকিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,
“তোর মতো একজন মেয়ে আমাদের বন্ধু এটা তো আমাদের সৌভাগ্য রাত। তোর থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে দোস্ত।”
“শুধু তাই নয়। জানিস রাত? তোকে দেখে আমি প্রতিনিয়ত বাঁচার উৎসাহ পাই। আমার জীবনের গল্পটা ভীষণ জটিল। সেই জটিল গল্পে আমি আজও টিকে আছি তোকে দেখে।”
উর্মির কথায় অবাক হয় সবাই। সিরাত তার কাছে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে,
“কী হয়েছে তোর? তুই তো আগে এমন উদাসীন ছিলি না উর্মি। হঠাৎ করে কী এমন হলো যে তুই এতটা পরিবর্তন হয়ে গেলি?”
“আমার গল্পটা তোরা সবাই শুনবি?”
“হ্যা শুনব, বল তুই।”
তামান্নার কথায় টুপ করে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে উর্মির চোখ থেকে।
লাইভ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রচুর মানুষ দেখতে শুরু করে। সিরাত লাইভের ক্যাপশন দিয়েছে,
“পর’কীয়ার সাইড এফেক্ট!”
একদিকে তো নিমু ব্যথায় ছটফট করছে, অন্যদিকে মাহতাব নিজের চুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ করে চেয়ারে বসে আছে। সিরাত রাফিকে নিজের পাশে দাঁড়াতে বলে কথা শুরু করে।
“আমাদের চারপাশে হাজারো মানুষ আজ পর’কীয়ায় জড়িয়ে আছে। পর’কীয়া শব্দটা যেন আমাদের ব্যক্তি জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রতিটা পরিবারে একটা করে এমন পর’কীয়ার ঘটনা লুকিয়ে থাকে। কেউ তা প্রকাশ করে, কেউ আবার সম্মানের ভয়ে প্রকাশ করে না। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? আমরা কেন চুপ করে বসে আছি? আমাদের চোখের সামনে এত বড়ো অন্যায় হচ্ছে, অথচ আমরা নিশ্চুপ? নাহ্, আমাদের আর চুপ করে থাকলে চলবে না। এবার আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে।”
একজনের মন্তব্য দেখে সিরাত চুপ হয়ে যায়৷ কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে মন্তব্য পড়ে সিরাত মুচকি হেসে উত্তর দেয়,
“কেউ একজন লিখেছেন, আজকালকার মেয়েরা বড্ড বেহায়া হয়ে গিয়েছে। ছেলেদের চার বিয়ে সুন্নত। সেখানে অন্য বউকে এভাবে নি*র্যাতন করা অন্যায়। বাহ্! আমাদের মুসলিম ভাইয়েরা কত ভালো। তারা চার বিয়ে সুন্নত এটা জানে। কিন্তু কীভাবে সুন্নত? সেটা জানে না। আচ্ছা, আপনারা যে এত ফরজ, সুন্নত মানেন তো পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করেন কয়জন? ভাই, বিয়ের কথাটা ঠিকই মস্তিষ্কে গেঁথে থাকে আপনাদের। কিন্তু আসল ফরজ কাজগুলো আপনারা ভুল করেও মানেন না। যে ছেলেদের একজনে হয় না, তাদের মতো অত্যন্ত কুৎসিত মস্তিষ্কের মানুষের সাথে কথা বলতে আমার রুচিতে বাঁধে। তাই বলব, আমার এই লাইভ আপনাদের জন্য নয়। আর যে এই মন্তব্য করেছেন তাকে সামনে পেলে আমি বুঝিয়ে দিব, সুন্নত কত প্রকার আর কী কী!”
পাশ থেকে রাফি সিরাতকে শান্ত হতে বলে। এখন রেগে গিয়ে কিছু বললে ভালোর চেয়ে খারাপই বেশি হবে।
“সিরাত রাগ করে কিছু বলবেন না। এখন যদি আপনি রেগে যান তাহলে আপনার লাইভ করার আসল কারণটা অজানা থেকে যাবে।”
রাফির কথা শুনে সিরাত লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলে ওঠে,
“আমি এমন একজন মেয়ে যে তার স্বামীর যোগ্য বউ হওয়ার জন্য সবকিছু করেছে। বিয়ের আগের জীবন বিসর্জন দিয়ে আমি আমার স্বামীর মনের মতো হয়ে ওঠার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে বিয়ের পাঁচ বছরের মাঝেই দ্বিতীয় বিয়ে করে নিয়ে আসে নিমু নামক এই মেয়েকে। অবশ্য আমার বাচ্চা হওয়ার আগে থেকেই তার অন্য মেয়েদের প্রতি আসক্তি আমি টের পেয়েছিলাম৷ কিন্তু কিচ্ছু বলিনি। বললে হয়তো আজকের এই দিনটা আসত না। সে তখন লুকিয়ে সম্পর্কে চালিয়ে যেত। কখনো আমার সামনে দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে আসার সাহস হতো না তার।”
সিরাতের এহেন কথা শুনে মাহতাব অদ্ভুত চোখে তাকায় তার দিকে। কণ্ঠে জড়তা রেখে প্রশ্ন করে,
“তুমি আগে থেকেই সব জানতে?”
“হ্যা জানতাম। আমি আগে থেকেই সবকিছু জানতাম। কিন্তু তোমাকে কিছু বলিনি। আমি তোমাকে এসব নিয়ে কথা শোনালে তুমি লুকিয়ে সম্পর্ক চালিয়ে যেতে। এখন আমি জনসম্মুখে সবকিছু বলতে পারছি। তখন সেটা পারতাম না। তোমার কী মনে হয়? তুমি আমার অগোচরে অন্য কারোর সাথে সম্পর্ক রাখবে আর সেটা আমি বুঝতে পারব না? তাহলে এটা তোমার বোঝার ভুল। আমি মুমতাহিনা ইসলাম সিরাত এত বোকা নই। তোমার এই সম্পর্কের কথা আমি যেমন আগে থেকেই জানতাম, তেমনই তোমাদের বিয়ের কথাও আমি আগে থেকেই জানতাম। চাইলেই আমি তোমাদের বিয়ে আটকাতে পারতাম৷ কিন্তু সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করেছি আমি। তুমি যেমন আমার সাথে অভিনয় করেছ আমিও তেমন অভিনয় করেছি।”
এসবের জন্য যেন মাহতাব মোটেই প্রস্তুত ছিল না। তার পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে এমন অনুভূতি হচ্ছে। সিরাত নির্দ্বিধায় সব কথা বলছে। তার মধ্যে কোনো কষ্ট দেখতে পাচ্ছে না মাহতাব। এসব দেখে তার মনে প্রশ্ন জাগে, মেয়েরা কী তবে এমনই হয়?
সিরাত হয়তো বুঝতে পারে মাহতাবের মনের কথা। খানিকটা হেসে তাই উত্তর দেয়,
“ব্যক্তিগত মানুষটা আর ব্যক্তিগত না থাকলে মেয়েরা বড্ড কঠিন হয়ে যায়। মেয়েদের নরম মনে তখন পাথরের পাহাড় তৈরি হয়। শত কষ্ট তাদের মনকে আর আঘাত করতে পারে না। পাষাণ চেনো পাষাণ? শখের পুরুষ ঘৃণার পুরুষে পরিণত হলে মেয়েরা পাষাণ হয়ে যায়।”
যথারীতি এমন চমকপ্রদ লাইভে লাখ লাখ মানুষ যুক্ত হয়। এক লাখ সাত হাজার মানুষ যুক্ত হয়ে যায় মাত্র একুশ মিনিটে। এতজনকে যুক্ত হতে দেখে সিরাত ধন্যবাদ জানিয়ে বলে,
“ধন্যবাদ আপনাদের মূল্যবান সময় ব্যয় করে আমার সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য। এখন তাহলে আসল কথায় আসি। আমার স্বামী যে পর’কীয়ায় জড়িত সেটা আমি অনেক আগে থেকেই জানতাম। তবুও চুপচাপ সব মেনে নিয়ে সংসার করেছি। আমাদের কিন্তু সাড়ে তিন বছর বয়সী একটা ছোট্ট পুতুল আছে। আমাদের মেয়েটা পুতুলের মতোই সুন্দর। কিন্তু ওর সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠা নিয়ে মা হিসেবে আমি ভীষণ সন্দিহান। আমার মেয়েটা আজও জানে না তার বাবা অন্য একজনকে ভালোবেসে তার মাকে অবহেলা করেছে। আমি সেই মেয়ে যার সামনে কেউ কখনো অন্যায় করে রেহাই পায়নি। আমি সেই মেয়ে যে নোংরা মানসিকতার মানুষদের জীবনের চেয়েও বেশি ঘৃণা করে। আজ সেই আমিই দীর্ঘদিন ধরে নিজের স্বামীর অন্যায় চুপচাপ সহ্য করেছি। না, ছেড়ে দেওয়ার জন্য নয়। আমি এতদিন নিজেকে তৈরি করেছি তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য।”
সিরাতের সব বন্ধুরা এই লাইভ দেখছে। পাশাপাশি তাকে শক্ত থাকার পরামর্শ দিচ্ছে। মাওয়ার একটা মন্তব্য দেখে চোখ আটকে যায় সিরাতের। সে লিখেছে,
“যে মানুষ ভালোবাসাকে সম্মান করতে পারে না তার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। হোক সে নারী কিংবা পুরুষ। অপরাধের শাস্তি সকলের জন্যই সমান হওয়া উচিত। তোর মতো লড়াকু মেয়েকে দেখে যেন এই সমাজে আরো হাজার খানেক সিরাত জন্ম নেয় আমি মন থেকে সেটাই চাই।”
সিরাত মাওয়ার মন্তব্য পড়ে উত্তর দেয়,
“সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে এমন বহু মাহতাবকে মেয়েরা ছেড়ে দেয়। তবে এতে কি কোনো লাভ হয়? যে পুরুষ নিজের স্ত্রী এবং সন্তানের কথা না ভেবে অন্য নারীতে আসক্ত হয় সেই পুরুষ তো আদর্শ বাবা হতে পারে না। তবে কেন আমরা সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে চুপ করে থাকব? এতে করে যে এমন মাহতাবেরা আরো বেশি অন্যায় করার সাহস পেয়ে যায়। সন্তানকে যখন আমাদের একাই মানুষ করতে হবে তাহলে এমন পুরুষদের তো ছেড়ে দেওয়া যাবে না।”
রুমি হাসান নামের একজন মন্তব্য করেছে,
“আমার স্বামী পর’কীয়ায় আসক্ত। শুধু তাই নয়, সে যখনতখন আমার গায়ে হাত তোলে। আমার চার বছর বয়সী মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে চুপচাপ সহ্য করছি এসব। মাঝেমধ্যে মনে হয়, বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই। এই জীবনটা আমার কাছে এখন অভিশাপের মতো।”
“কেন আপু? আপনি কেন বাঁচতে চান না? আপনাকে বাঁচতে হবে৷ যে বা যারা আপনার সাথে অন্যায় করেছে ম*রলে তারা ম*রবে।”
আরেকজনের মন্তব্য দেখে সিরাত বেশ খুশি হয়। সে লিখেছে,
“আপনার মতো মেয়েদেরই প্রয়োজন এই সমাজে। তাহলে আর কেউ এমন নোংরা কাজ করার সাহস পাবে না।”
আরো বেশ কিছু মন্তব্য পড়ে নেয় সিরাত। কেউ তার এমন কাজের জন্য তাকে বাহবা দিচ্ছে। কেউ আবার গালি দিচ্ছে। সবকিছু উপেক্ষা করে সিরাত বলে,
“আমি যখন আমার স্বামীর বিরুদ্ধে সব প্রমাণ হাতে পেলাম সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম তাকে আমি শান্তিতে বাঁচতে দিব না। এজন্য তার প্রেমিকাকে প্রয়োজন ছিল আমার। যে মেয়েটা এখন মাটিতে শুয়ে ছটফট করছে সে আমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী। এই মেয়ে আমার সংসার ভাঙার জন্য নিজের সন্তানকে পর্যন্ত পৃথিবীর আলো দেখতে দেয়নি। এমন মেয়েদের কি সত্যিই বেঁচে থাকার অধিকার আছে? যারা স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রীকে দেখে নিজের সংসার ছেড়ে চলে যান তারা চরম বোকা। ছেড়ে যদি যেতেই হয় সবকিছু শেষ করে তারপর যান। আমি পড়াশোনায় খুব বেশি ভালো ছিলাম না কখনোই। কিন্তু আমি কারোর বোঝা হয়ে থাকতে চাইনি। তাই নিজের স্বল্প মেধাকে কাজে লাগিয়ে কলেজ জীবনেই শুরু করেছিলাম ছোট্ট একটা ব্যবসা। মাত্র চার হাজার টাকা দিয়ে আমি পাঁচটা জামা বানিয়ে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করি। প্রথম প্রথম তেমন ভালোভাবে সবকিছু করতে পারছিলাম না। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। টানা এক বছর পরিশ্রম করে আমি নিজের ব্যবসা দাঁড় করিয়েছি। আমার এই কাজের কথা কেউ জানত না। কেবল আমার মা জানত। আজ সবার সামনে আমি নিজের জীবনের গল্প বলছি। মাত্র চার টাকা পুঁজি করে যে ব্যবসা আমি শুরু করেছিলাম আজ সেই ব্যবসা থেকে আমি মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করি। এটা কিন্তু একদিনে সম্ভব হয়নি। ছয়/সাত বছরের পরিশ্রমের ফল এটা। নিজে ডিজাইন তৈরি করে সেলাই মেশিনে সেলাই করে আমি আমার ছোট্ট ব্যবসা শুরু করেছিলাম। আজ সেখানে শত-শত মেয়ে আমার আন্ডারে কাজ করে। বাংলাদেশের নামকরা এক ফ্যাশন আইকনের নাম নীলাদ্রি। কে সেই নীলাদ্রি তা কি আপনারা জানেন? সকলের আড়ালে থাকা সেই মেয়েটা আমি নিজে। এই যে নিজের একটা পরিচয় তৈরি করেছি আমি, এর ফলে আমাকে কারোর উপর নির্ভর করে বাঁচতে হবে না। আমি প্রতিটা মেয়েকে বলব, আগে নিজের পায়ের তলার জমিন শক্ত করুন। তার নতুন জীবনে পা রাখুন। যেন বিশ্বস্ত মানুষটা হারিয়ে গেলেও আপনি বাঁচতে পারেন। বাঁচার মতো করে বাঁচতে পারেন।”
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থেমে যায় সিরাত। ‘নীলাদ্রি’ একটা ব্র্যান্ড এর নাম। যেখানে চোখ ধাঁধানো সব সুন্দর সুন্দর জামার রাজ্য রয়েছে। সবাই জানে এটার মালিক একজন মেয়ে। কিন্তু সেই মেয়ে কখনো কারোর সামনে আসেনি। সিরাত বরাবরই চেয়েছে সাধারণ একজন হয়ে বাঁচতে। এতদিন সকলের অগোচরে ব্যবসা সামলেছে সে। তবে আজ সবাইকে সবটা বলার দরকার ছিল। মেয়েরা যেন আবেগের বশবর্তী হয়ে বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ না হয় তার জন্যই নিজের এই গল্পটা বলা।
“সিরাত থেকে নীলাদ্রি হওয়ার গল্পটা কিন্তু সহজ ছিল না আমার জন্য। কঠোর পরিশ্রম করে আমি সিরাত থেকে এই নীলাদ্রি হতে পেরেছি বলেই আমার সন্তানকে নিয়ে আমার চিন্তা নেই। তাকে একা হাতে বড়ো করে তোলার জন্য আমি প্রস্তুত। প্রত্যেক মাকে বলব এভাবে প্রস্তুত হওয়ার জন্য। আল্লাহ আমাদের সবাইকে পরিপূর্ণ জ্ঞান দিয়েছেন। সেই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। বাবা-মা, স্বামী, সন্তান কারোর উপর যেন আমাদের মেয়েদের নির্ভরশীল হতে না হয়। আমরা যেন নিজেদের পরগাছা মনে না করি। নতুবা বেঁচে থাকার আসল মানে আমরা কখনোই বুঝতে পারব না। আমরা এক বুক কষ্ট নিয়েই মৃ*ত্যুর কোলে ঢলে পড়ব। এভাবে তো মেয়েদের হেরে যাওয়া যাবে না।”
সিরাত মাহতাবের সামনে চলে যায়। আপাদমস্তক তাকে দেখে নিয়ে বলে,
“এই মানুষটা দীর্ঘ পাঁচ বছর আমার সাথে ভালো থাকার অভিনয় করেছে। নিঃসন্দেহে তাকে পাক্কা অভিনেতা বলা যায়। আচ্ছা সে যে আমাকে আর আমার সন্তানকে এত কষ্ট দিল তাকে কি এমনি এমনি ছেড়ে দেওয়া যায়? উহু, যায় না তো। আমিও তাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিইনি। প্রথমে তার ব্যবসা কেঁড়ে নিয়েছি। এরপর তাকে পথে বসিয়েছি। তার সম্মান নিয়ে আমি খেলেছি বটে। এখন তার কাছে কিছুই নেই। পথের ভিখারি বললেও ভুল হবে না। আমার শ্বশুর মশাই আমাকে খুব ভালোবাসে। তাকে বলে আমি এমন একটা উইল করিয়েছি যেখানে লেখা আছে, মাহতাব কখনো আমাকে ডিভোর্স দিলে সে তার বাবার সমস্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে। আর আমি ঠিক সেটাই করব। এক সময় সে রাজা ছিল। আজ সে ফকির। এর পেছনে সম্পূর্ণ কৃতিত্ব আমার। কেবল তো তাকে পথে বসিয়েছি। এরপর জেলের ভেতরেও ঢোকাব। বিশ্বাস ভঙ্গকারীদের জন্য এটুকু শাস্তি তো প্রাপ্য তাই না?”
কথাগুলো বলে সিরাত গা কাঁপিয়ে হাসে। মাহতাব অপলক তাকে দেখে যাচ্ছে। নিজের জীবনের শেষ সময়টা কতটা করুণ হবে তা যেন এখন থেকেই সে উপলব্ধি করতে পারছে।
এক পা, দুই পা করে নিমুর দিকে এগিয়ে যায় সিরাত। তার পাশে বসে চোখের কোণে কিঞ্চিৎ পানি এনে বলে,
“সমাজের আরেক কীট এই নিমুর মতো মেয়েরা। হাসিখুশি একটা পরিবারকে নিমিষেই ধ্বংস করে দিতে পারে এরা। এদের শাস্তি আরো গভীর হওয়া উচিত। আমি আমার সতিনের জন্য কি কি করেছি এখন সেটা বলি। প্রথমে তার মা হওয়ার রাস্তা বন্ধ করেছি। যে মেয়ে অন্য পুরুষের সাথে রাত কাটানোর জন্য নিজের সন্তানকে নষ্ট করতে দু’বার ভাবে না তার তো মা হওয়ার অধিকার নেই। তাই আমি পরম যত্নে তার মাতৃত্ব নষ্ট করেছি। আর এই মেয়ে শুধু নিজের সন্তানকে নষ্ট করেনি। আমার সন্তানকে মা*রার চেষ্টাও করেছে। সেইসব প্রমাণ আমার কাছে আছে। সুতরাং নিমুর জেলে যাওয়া কেউ আটকাতে পারবে না। এখানেই শেষ নয়। তার পরবর্তী জীবনে যেন এক ফোঁটা সুখ না থাকে সেটাও নিশ্চিত করেছি আমি।”
কথাটা বলে রাফির হাতে মোবাইল দিয়ে এবার ক্যামেরার সামনে আসে সিরাত। দুই হাতে চুনকালি মাখিয়ে নিমুর সমস্ত মুখে লেপ্টে দেয় সে। ধীরে ধীরে নিমুর চুলগুলো কাঁচির সাহায্যে কাটতে কাটতে ঘাড়ে এনে ফেলে। তারপর এক হাতে নিমুর গাল ধরে বলে,
“বাহ্যিক সৌন্দর্যের মাধ্যমে ছেলেদের আকৃষ্ট করে তাদের সংসার ভেঙে দেওয়া মেয়েদের মূলে যে সৌন্দর্য আছে সেটা শেষ করে দেওয়া উচিত। নতুবা এমন মেয়েরা কখনো ভালো হবে না।”
বুকের মাঝে অসীম কষ্ট চাপা রেখে বাইরে থেকে নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত রেখে আজ নিজের নামের পাশে ডিভোর্সি তকমা লাগাতে চলেছে সিরাত। মেয়েকে কোলের মাঝে আগলে নিয়ে সোফার এক কোণে বসে আছে সে। গতকাল সেই লাইভের পর সবাই এক এক করে সিরাতের বাসায় এসে হাজির হয়েছে। বেশিরভাগ মানুষ তাকে স্বান্তনার বাণী কিংবা বাহবা দিলেও মাহতাবের মা, বোন আসার পর থেকে সিরাতকে কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। অন্য সময় হলে হয়তো সে জবাব দিত। তবে আজ বাড়তি একটা কথা বলার মতো ধৈর্য অবশিষ্ট নেই সিরাতের মাঝে। ইতোমধ্যে সিরাতের পরিবারের লোকজন, বন্ধুবান্ধব সবাই চলে এসেছে। বাসার মধ্যে ছোটখাটো ল*ড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে দুই পক্ষের মাঝে। সবাইকে শান্ত হতে বলে সিরাত মাহতাবের কাছে এগিয়ে যায়।
“আমি আর কোনো ঝামেলা চাই না। আমাদের দীর্ঘদিনের সংসারের ইতি টানার সময় এসে গিয়েছে মাহতাব। দয়া করে আর কোনো তর্ক করো না। বিনাবাক্যে ডিভোর্স পেপারে সই করে দাও।”
মাহতাব লজ্জায় মা*থা নিচু করে বসে আছে। গতকাল থেকে সকলের তিক্ত কথা শুনতে শুনতে সে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এখন সবাই জেনে গিয়েছে, মাহতাব ছেলেটা বাজে, ভীষণ বাজে!
“সিরাত নতুন করে কি সব ঠিক করা যায় না? আমি জানি, আমি ভুল করেছি। কিন্তু আমাদের মেয়ের কথা ভেবে সবকিছু নতুন করে শুরু করা যায় না? জীবনকে তো দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া উচিত বলো?”
সিরাতের ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে। অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে সে উত্তর দেয়,
“মেয়ের কথা ভাবলে কি আর তুমি এমন কিছু করতে পারতে? তবে আজ কেন মেয়ের বাহানা দিচ্ছ? আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। ডিভোর্সি কথাটা সহ্য করে নিতে পারব। কিন্তু এতকিছুর পরে তোমার স্ত্রী হয়ে আমি থাকতে পারব না। আর আমাদের মেয়ে তো বড়ো হয়ে সবকিছু জানবে৷ তখন ওর সিদ্ধান্ত আমি মেনে নিব। মেয়ে যদি চায় তাহলে আমি কথা দিচ্ছি ওকে তোমার কাছে দিয়ে যাব। যতদিন না নাবিহা বড়ো হচ্ছে ততদিন অবধি ওও আমার কাছেই থাকবে।”
সিরাতের শাশুড়ী মারজিয়া শেখ রাগে গজগজ করতে করতে বলেন,
“আমার ছেলের মানসম্মান তো সব শেষ করে দিয়েছ। তারপরেও যে মাহতাব তোমাকে রাখতে চাইছে এটা তো তোমার সৌভাগ্য। ছেলেদের এমন একটুআধটু সমস্যা থাকেই। তাই বলে কি সংসার ভাঙতে হবে?”
“আরে মা আমার তো মনে হয় সিরাতের অন্য কোথাও সম্পর্ক আছে৷ নাহলে আমার ভাইয়ের পেছনে এভাবে লাগত নাকি?”
মাহতাবের বড়ো বোন তিশার কথা শুনে সিরাতের শরীর কেঁপে ওঠে রাগে। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করে সে বলে,
“আপু আপনি যদি বয়সে আমার থেকে ছোট হতেন না? তাহলে এখানে সবার সামনে আপনার দুই গালে আমি চারটে থা*প্পড় লাগিয়ে বুঝিয়ে দিতাম কোথায় কীভাবে কথা বলতে হয়। আপনার মা আপনাকে নূন্যতম সুশিক্ষায় বড়ো করতে পারেনি। তার প্রমাণ আজ নিজেই দিয়ে দিলেন আপনি।”
“সিরাত!”
“চিৎকার করবেন না। নতুবা আমি ভুলে যাব আপনি আমার স্বামীর বড়ো বোন৷”
এতক্ষণ যাবত সবকিছু চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল নজরুল শেখ। অবশেষে তিনি নিজের সমস্ত নিরবতা ভেঙে বলেন,
“সিরাত তোমার মতো মেয়েকে নিজের বউমা হিসেবে পেয়ে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম মা। কিন্তু আমার নির্বোধ ছেলেটা আসল হিরা চিনতে পারল না৷ হিরা ভেবে এতদিন কাঁচের পেছনে ছুটেছে বলেই আজ ক্ষ*তবিক্ষ*ত হয়ে গিয়েছে। আমার তোমাকে এই সংসারে থেকে যাওয়ার কথা বলার সাহস নেই। তুমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছ তাতে আমি দ্বিমত পোষণ করব না। এমন কুলাঙ্গার ছেলের সাথে থাকার থেকে সারাজীবন একা থাকা ভালো। তুমি নতুন করে তোমার জীবন শুরু করো মা।”
এই একজনের উপর সিরাত কখনো রাগ করে থাকতে পারেনি। মানুষটা যে তাকে বড্ড ভালোবাসে। নিজের মেয়ের মতো করে এতদিন সিরাতকে ভালোবেসেছে নজরুল শেখ। কথাগুলো বলার সময় তার চোখে পানি চিকচিক করছিল তা সিরাতের দৃষ্টিগোচর হয়নি।
“বাবা এই পরিবারের আর কারোর সাথে সম্পর্ক না রাখলেও আমি আপনার সাথে যোগাযোগ রাখব। আপনার মতো শ্বশুর খুব ভাগ্য করে পাওয়া যায়। আপনি কখনো আমাকে বাবার অভাব বুঝতে দেননি শ্বশুর বাড়িতে। ধন্যবাদ বাবা আমাকে এভাবে ভালোবাসার জন্য।”
সিরাতকে জড়িয়ে ধরে নজরুল শেখ কাঁদেন। তার মতো শক্ত মানুষটাও কাঁদছে ভেবে অবাক হয় সবাই। মেয়েটার কষ্ট তিনি অনুভব করতে পারছেন। ফলস্বরূপ একটু একটু করে নিজের ছেলের উপর ঘৃণা তৈরি হচ্ছে তার।
“কাঁদবেন না বাবা। আমার ভাগ্যে যা ছিল সেটাই হয়েছে। এতে আমার কোনো দুঃখ নেই। আপনি দয়া করে নিজেকে অপরাধী ভাববেন না। যা হয়েছে তাতে আপনার কোনো দোষ নেই।”
চোখের পানি মুছে নজরুল শেখ নিজের ছেলের কাছে এগিয়ে যায়। ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,
“তোর শরীরে আমাদের শেখ বংশের র*ক্ত বইছে সেটা ভাবতেও আমার লজ্জা হচ্ছে। আমাদের পরিবারের মানসম্মান কিচ্ছু রাখলি না তুই। তোর মতো ছেলের বাবা হওয়ার থেকে সারাজীবন নিঃসন্তান থাকা ভালো ছিল।”
“বাবা!”
“বাবা বলে ডাকবি না তুই আমাকে। তোর বাবা ম*রে গিয়েছে। আমাকে বাবা বলে ডাকবি না একদম।”
শাহেদ ইসলাম মেয়ের কাছে এসে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নেয়। একমাত্র মেয়ে হওয়ায় জন্মের পর থেকে ভীষণ আদর করে বড়ো করেছেন তিনি মেয়েকে। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও মেয়ের গায়ে অভাবের আঁচ আসতে দেয়নি কখনো। সেই মেয়ের বুকভরা কষ্ট নিজের চোখে দেখতে পারছেন না তিনি।
বাবার বুকে মা*থা রেখে সিরাত বলে,
“তুমি কষ্ট পেয়ো না বাবা। আমি ঠিক আছি। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। আমি ঠিক আমার মেয়েকে একা হাতে সামলাতে পারব। ওকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলব দেখে নিয়ো তুমি।”
“আমি জানি আমার মেয়ে একটা রত্ন। আমার মেয়ে সাহসী, উদ্যমী, পরিশ্রমী। তোমার উপর আমার ভরসা আছে মা। কিন্তু আমি যদি আর একটু ভাবতাম তোমার বিয়ে নিয়ে তাহলে হয়তো তোমার জীবনটা এমন হতো না।”
“ওহ্ বাবা এসব একদম ভাববে না তুমি। যা হবে সব ভালো হবে।”
মেয়েকে নিজের দিকে এগিয়ে নিয়ে ইতি ইসলাম কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলেন,
“আমি সত্যিই রত্নগর্ভা রে মা। তোর মতো মেয়েকে জন্ম দিয়েছি বলেই হয়তো আমি পৃথিবীর সেরা মা। এমন সাহসী আর বুদ্ধিমতী মেয়ে কয়জনের হয় বল? তুই পারবি, এই সমাজে মা*থা উঁচু করে ঠিক বাঁচতে পারবি।”
“হ্যা মা আমি পারব। আমাকে পারতেই হবে। শুধু মেয়ের জন্য নয়, আমাকে নিজের জন্যেও পারতে হবে।”
দীর্ঘ আলাপের পর অবশেষে সেই সময় চলেই আসে। প্রথমে সিরাত নিজেই ডিভোর্স পেপারে সই করে দেয়। এরপর সকলের চাপে মাহতাব বাধ্য হয়ে নিজেও সই করে দেয়। তারিন সেখানেই উপস্থিত ছিল। দু’জন সই করে দেওয়ার পর কাগজটা একটা ফাইলে ঢুকিয়ে নেয় সে।
নিমুকে গতকাল রাতেই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার অবস্থা বিশেষ ভালো না। মজার বিষয় হলো সিরাতের তেমন কিছু করতে হয়নি৷ যা করার নিমুর প্রাক্তন স্বামী আর বর্তমান স্বামীই করেছে।
সবশেষে চলে যাওয়ার সময় আসে। দীর্ঘদিনের সংসার জীবনের ইতি ঘটিয়ে নিজের হাতে গড়ে তোলা সংসার ছেড়ে আজ চলে যেতে হবে সিরাতকে। বাসার প্রতিটা দেওয়ালে পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দেয় সিরাত। তার বুকের ভেতর ভীষণ ব্যথা অনুভব করছে সে। চোখ উপচে পানি গড়িয়ে পড়ছে অনর্গল। চিৎকার করে কাঁদতে চেয়েও সে চিৎকার করতে পারে না। চুপচাপ কান্নাগুলোকে গিলে নেয়। নিজের ঘরে গিয়ে বেলকনিতে রাখা গাছগুলোতে হাত বুলিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সিরাত। আজ তার চোখের পানি বাঁধ মানছে না। এইতো সেই ঘর, সেই বেলকনি যা সে খুব যত্নে সাজিয়ে তুলেছিল। এইতো সেই গাছগুলোর চারা, যেগুলোকে ভালোবেসে বড়ো করে তুলেছিল সে। আজ সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হবে তাকে।
বাসার প্রতিটা দেওয়াল যেন আজ সিরাতকে বলছে,
“আমাদের ছেড়ে যেও না। তুমি আমাদের ছেড়ে গেলে যে আমরা অযত্নে, অবহেলায় রয়ে যাব। তোমার মতো করে আমাদেরকে আর কেউ ভালোবাসবে না। থেকে যাও তুমি, আমাদের সাথে রয়ে যাও!”
ঘরের প্রতিটা কোণা যেন সিরাতকে দেখে হাহাকার করে ওঠে৷ গভীর রাতে সিরাতের কান্নার সাক্ষী যে এরা!
ঘরের এক কোণে অবহেলায় পড়ে থাকা ছোট্ট পুতুলটাও যেন বলে,
“তুমি ভালো থেকো মেয়ে৷ তোমার জীবনের সমস্ত কষ্ট দূর হয়ে যাক৷ জীবনের নতুন অধ্যায়ে তুমি ভালো থেকো তোমার জীবন্ত পুতুলটাকে নিয়ে।”
এক পা, দুই পা করে ধীরে ধীরে ঘরের দেওয়ালগুলোতে হাত বুলিয়ে, পুরো বাসায় নিজের পায়ের চিহ্ন ফেলে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে আসে সিরাত। সদর দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় তার পা যেন আর চলতে চাইছিল না। পেছন ফিরে পুরো বাসাটা একবার দেখে নেয় সে। এটাই যে শেষ দেখা!
চলে যেতে যেতে সিরাতের মন চিৎকার করে করে বলে ওঠে,
“যখন থেকে এখানে আর আমার পায়ের চিহ্ন পড়বে না সেদিন তোমরা বুঝে নিয়ো, তোমাদের ছেড়ে চলে যাওয়া এই আমার কাছে মৃ*ত্যু যন্ত্রণার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। ও বাড়ি, তুমি মনে রেখো আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি। তিল তিল করে গড়ে তোলা আমার সোনার সংসার, তুমি জেনে রেখো তোমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কষ্টে আমার বুক ফেটেছে বারংবার। আমার কান্নার সাক্ষী হয়ে থাকা দেওয়াল, তোমরা কখনো আমাকে ভুলে যেয়ো না। তোমাদের ছেড়ে বহুদূরে চলে যেতে আমার যে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। আমার বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কান্নারা চিৎকার করে বলতে চাইছে, আমি তোমাদের ছেড়ে যেতে চাই না। আমার নিয়তি বাধ্য করেছে তোমাদের ছেড়ে যেতে। তোমরা মনে রেখো, আমি তোমাদের নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। তোমরা যে আমার নিজের চেয়েও বেশি প্রিয়, আপন!”
শেষ বারের মতো বাইরে থেকে দেওয়ালগুলোকে ছুঁয়ে দিয়ে গাড়িতে উঠে বসে সিরাত। যেতে যেতে পেছন ফিরে সবকিছু দেখে নেয়। যতক্ষণ না সবকিছু দৃষ্টিগোচর হয় ততক্ষণ পর্যন্ত গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে থাকে সিরাত।
একটা সংসার গড়তে যতটা কষ্ট হয় তার থেকেও বহুগুণ বেশি কষ্ট হয় সেই সংসার ছেড়ে চলে যেতে। প্রতিটা মেয়ের জন্যই হয়তো এই কষ্টটা মৃ*ত্যু সমতুল্য!
“নিজের বাচ্চাকে শেষ করতে একবারও ভাবলে না তুমি? এরপরেও নিজেকে মানুষ হিসেবে এখনো পরিচয় দিতে লজ্জা করে না তোমার?”
সিরাতের কথায় চমকে ওঠে নিমু। ঠাণ্ডার মধ্যেও সে ঘামছে। তার এমন অবস্থা দেখে সিরাত একটা টিস্যু এগিয়ে দেয়।
“এই ঠাণ্ডার মাঝেও ঘামছ কেন? ভয় পাচ্ছ বুঝি আমাকে?”
“এসব কী বলছ তুমি? তোমাকে কেন ভয় পেতে যাব আমি? আর কোন বাচ্চার কথা বলছ তুমি হ্যা?”
“২০২১ সালের নভেম্বর মাসের তিন তারিখ তুমি তোমার অনাগত সন্তানকে হ*ত্যা করেছ। যে ডাক্তারের কাছে তুমি সেবা নিয়েছ সে নিজে আমাকে সবকিছু বলেছে। তুমি যখন তোমার প্রথম স্বামীর কাছ থেকে ডিভোর্স নিয়েছ তখন তুমি অন্তঃসত্ত্বা ছিলে। কিন্তু সেটা তোমার প্রাক্তন স্বামী জানত না। তার থেকে এত বড়ো সত্যিটা গোপন করে তুমি ডিভোর্স নিয়েছ। কি ঠিক বলছি তো?”
নিমুর শ্বাস নেওয়ার গতি মুহূর্তের মধ্যেই বেড়ে যায়। সিরাত দুই হাত দূর থেকেও যেন তার শ্বাস-প্রশ্বাস এর শব্দ শুনতে পায়। এই মুহূর্তে বাসায় নিমু আর সিরাত ছাড়া কেউ নেই। সকালেই নাবিহাকে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে সে৷ তুবা এসেছে নিয়ে গিয়েছে নাবিহাকে। মাহতাবকে রাফি ডেকে নিয়েছে ঘন্টা খানেক আগে৷ বাসায় রয়ে গিয়েছে কেবল সিরাত আর নিমু।
অনেক্ক্ষণ যাবত নিমুকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে সিরাত বলে,
“তোমার ছোট ভাইয়ের নাম তো নাফি তাই না?”
নিমুর যেন এখন জান যায় যায় অবস্থা হয়ে গিয়েছে। সে নিজ মনে ভাবছে,
“এই মেয়ে এসব জানল কীভাবে!”
নিমুর মনের কথাটা যেন বুঝতে পারে সিরাত। তাই নিজে থেকেই বলে,
“ভাবছ তো যে আমি এসব কীভাবে জানলাম? আসলে পাপ কখনো চাপা থাকে না৷ আমি তোমাকে তোমার বান্ধবীর সাথে কথা বলতে দেখে ফেলেছিলাম একদিন। সেদিন তোমার কথা শুনে আমার সন্দেহ হয়েছিল। তাই সুযোগ বুঝে আমি আমার এক বন্ধুর কাছে যাই তোমার বিষয়ে সবকিছু জানার জন্য। সে একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। তাই তোমার বিষয়ে সবকিছু জানতে আমার খুব বেশি সময় লাগেনি। তোমার সমস্ত অতীত তো আমি অনেক আগেই জেনে গিয়েছিলাম। এতদিন চুপ করে শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে আজ সেই দিন এসেই গেল।”
আচানক নিমু সিরাতের দিকে তেড়ে আসে৷ দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“আমার বিষয়ে এতকিছু জানতে তোমাকে কে বলেছে হ্যা? এত বেশি জেনে তুমি একদম ঠিক করোনি সিরাত। এবার তোমার জীবন নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যাবে।”
সিরাত হেসে পাল্টা প্রশ্ন করে,
“যে নিজের অনাগত সন্তানকে মা*রতে পারে সে চাইলে সবকিছুই করতে পারে। এই যে তুমি কিছুদিন আগে নাবিহার ক্ষতি করতে চেয়েছিলে। কী ভেবেছিলে? আমি কিচ্ছু বুঝতে পারব না? আমার মেয়ে আমার পৃথিবী। তার কেউ ক্ষতি করতে চাইবে আর সেটা আমি মা হয়ে বুঝব না? এটা তো হতে পারে না তাই না? সেদিন ইচ্ছাকৃতভাবে তুমি আমার মেয়ের খাবারে অতিরিক্ত মাত্রায় ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলে কৌশলে। তো তোমাকে একটা কথা জানিয়ে রাখি। এই বাসার সর্বত্র গোপন ক্যামেরা লাগানো আছে। কাজটা আমিই করেছি। তাই এই বাসায় কখন কি হয় সবকিছু আমি ঘরে বসেই জানতে পারি। সেদিন ভাগ্যক্রমে আমার মেয়ে বেঁচে গিয়েছে। কিন্তু তুমি চাইলেও বাঁচতে পারবে না!”
সিরাতের কথা বলার মাঝেই কলিংবেল বেজে ওঠে। সিরাত নিমুর কাছে এসে কানের কাছে ফিসফিস আওয়াজে বলে,
“তোমার জীবনের শেষ সময়ের গণনা শুরু করে দাও।”
কথাটা বলে সিরাত সদর দরজা খুলে দেয়। মাহতাবকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে সে কিছুই বলে না। পাশে রাফিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,
“ভেতরে আসুন আপনারা।”
এতক্ষণ যতটুকু শক্তি নিজের মাঝে অবশিষ্ট ছিল রাফিকে দেখে সেটুকু শক্তিও যেন বিলীন হয়ে যায় নিমুর। নিজের প্রাক্তন স্বামীকে দেখে দু’পা পিছিয়ে যায় সে।
রাফি কোনো কথা না বলে নিমুর কাছে গিয়ে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে নিমুর দুই গালে পরপর ছয়/সাতটা থা*প্পড় বসিয়ে দেয়। নিজেকে সামলাতে না পেরে নিমু মেঝের উপর পড়ে যায়৷ তার ঠোঁট কেটে অনর্গল র*ক্ত পড়ছে। রাফি পুনরায় তাকে আঘাত করতে গেলে সিরাত থামিয়ে দেয়।
“শান্ত হন। আগেই বলেছি উত্তেজিত হয়ে কিছু করবেন না। এতে ক্ষতি আপনারই হবে।”
সিরাতের কথা শুনে রাফি থেমে গেলেও মাহতাব থামে না। নিমুর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বিধ্বস্ত গলায় প্রশ্ন করে,
“কেন করলে এমন? আমাকে কেন ঠকালে? আমি তোমার জন্য কী করিনি? সবকিছু করেছি তোমার সুখের জন্য। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করেছি তোমার পেছনে। যতটা আমি সিরাতের জন্য গত পাঁচ বছরেও খরচ করিনি, তার চেয়েও বেশি বিগত দেড় বছরে তোমার জন্য খরচ করেছি। ভালোবাসা, সুখ, আভিজাত্য সবকিছু দিয়েছি তোমাকে। রাণী করে রেখেছি। আর সেই তুমি আমাকে এভাবে ঠকালে?”
নিমু কোনো উত্তর দিতে পারে না। চুপচাপ গালে হাত রেখে কাঁদতে থাকে। মাহতাব ধীরে ধীরে নিজের বেল্ট খুলে হাতে পেচিয়ে নেয় সযত্নে। অতঃপর চোখ বন্ধ করে বিরতিহীনভাবে নিমুর গায়ে একের পর এক আঘাত করে। নিমুর চিৎকারে কেঁপে ওঠে সিরাত। মাহতাবকে আজ প্রচন্ড অশান্ত লাগছে। বিয়ের এত বছরে এর আগে কখনো মাহতাবের এমন রূপ দেখেনি সিরাত। তার চোখে আজ ভয়ংকর রাগ দেখতে পাচ্ছে সে। কিন্তু এভাবে মা*রলে যেকোনো মুহূর্তে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও সিরাত মাহতাবের কাছে যায়।
“মাহতাব একটু শান্ত হও। এভাবে ওকে মে*রো না। মেয়েটা ম*রে যাবে মাহতাব৷ প্লিজ থামো তুমি।”
অনেক চেষ্টা করেও মাহতাবকে থামাতে পারে না সিরাত। শেষে বাধ্য হয়ে চিৎকার করে বলে,
“ওকে তিলে তিলে শেষ করার জন্য সব ব্যবস্থা আমি আগে থেকেই করে রেখেছি। এবার তো থেমে যাও!”
সিরাতের এমন কথা শুনে সত্যি সত্যিই থেমে যায় মাহতাব। বেল্ট দূরে ছুঁড়ে দিয়ে বলে,
“মানে? কী করেছ তুমি?”
“কেন? এখন থামলে কেন? কখন থেমে তোমাকে শান্ত হতে বলছি। কথা কানে যায় না তাই না?”
মাহতাব সিরাতের দুই বাহু ঝাঁকিয়ে বলে,
“কী করেছ তুমি ওর সাথে?”
সিরাত কিছু বলে না। নিমু মেঝের উপর শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছে। সেদিকে কারোর ধ্যান নেই। মাহতাব, রাফি দু’জনের ধ্যান এখন সিরাতের দিকে। তাদের দু’জনকে অপলক দৃষ্টিতে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সিরাত বলে,
“আমাকে যতটা শান্তশিষ্ট এবং ভালো মেয়ে মনে হয় আমি ততটা ভালো মেয়ে নই। ছোট থেকেই আমি ভীষণ জেদি। চোখের সামনে অন্যায় হলে মেনে নিতে পারি না আমি। নিমু আমার সাথে যা করেছে সেইসব চুপচাপ মেনে নেওয়া আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব ছিল না। নিমু শুধু আমার সংসার ভাঙেনি। ওই মেয়ে আমার সন্তানকে মা*রার চেষ্টা করেছে। ওর পরিকল্পনা অনেক গভীর ছিল। শেখ পরিবারের মালকিন হতে চেয়েছিল সে। কিন্তু বেচারি হয়তো জানত না বাপেরও বাপ থাকে। আমি তার থেকে দুই কাঠি উপরে চলি এটা সে বুঝতেই পারেনি। যেদিন দেখলাম আমার সন্তানকে মা*রার জন্য সে প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ওকে আমি শান্তিতে বাঁচতে দিব না। আর তাই!”
“আর তাই?”
“বাংলাদেশে থেকে অপরাধীর যোগ্য শাস্তি নিজের চোখে দেখাটা স্বপ্ন হয়েই রয়ে যাবে। তাই আমি আইনের উপরেও আস্থা রাখতে পারিনি। আমি হয়তো চাইলে অনেক কিছু করতে পারতাম। কিন্তু আমার মতো একই অবস্থায় হাজারো মেয়ে আছে। সবার এত ক্ষমতা নেই। তাই বলে কি তারা তাদের অন্যায়কারীদের শাস্তি দিতে পারবে না? অবশ্যই পারবে। আজ আমার মতো একজন সিরাত জন্ম নিয়েছে। আগামীকাল যেন আমার মতো আরো দশজন সিরাত জন্ম নেয় সেটাই চাই আমি। বাকি গল্পটা না-হয় পুরো দেশবাসী জানুক!”
নিজের ফোন বের করে ফেসবুকে গিয়ে লাইভ চালু করে সিরাত।