Saturday, July 19, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 377



ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৮৯

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৮৯|
ছুটির দিনে একটি অঘটন ঘটিয়েছে অর্পণ স্যার। সাপ্তাহিক ছুটিতে মজার মজার রেসিপি তৈরি করে নিধি। আজও করছিল। অতীতে মেয়েটা মোটেই রান্নাবান্নায় পটু ছিল না। বিয়ের পর শাশুড়ি আর স্বামীর কাছেই শিখেছে। আর এখন তো তাদের থেকেও বেশি দক্ষ হয়ে গেছে সে। তার হাতের রান্না ছাড়া পেটে খিদে মেটে না অর্পণ স্যারের। আর না ভরে মন। বরের এই পছন্দ, ভালো লাগাকে গুরুত্ব দিয়ে ছুটির দিনের আয়োজন গুলো বেশ অন্যরকম ভাবে করে সে। আজও তার ব্যতীক্রম হয়নি। শাশুড়ি মা গিয়েছেন গ্রামের বাড়ি। আজ বাসায় মোটে তিনজন। তারা স্বামী-স্ত্রী আর সন্তান অনিরূপ। নিধি একা একাই সব রান্না করছিল। অর্পণ স্যার এসে টুকটাক হেল্প করে। সব কাজ শেষ প্রায়। শুধু সালাদ তৈরি করা বাকি। তাই নিধি বলে,

‘ স্যার আপনি সালাদ তৈরি করে ফেলুন। আমি ঝটপট অনিকে গোসল করিয়ে খাইয়ে দিই। লেট হয়ে গেলে ছেলেটা না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়বে। ‘

মাথা দুলায় অর্পণ। গুনগুনিয়ে গান করতে করতে এগিয়ে যায় ফ্রিজের দিকে। নিধি প্রায় দৌড়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়েও থেমে যায়। অর্পণের পানে তাকায় সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে। ওর থেমে যাওয়ায় পিছু ঘুরে অর্পণ স্যার। নিমেষে ভ্রু নাচিয়ে নিধি শুধায়,

‘ খুব মুডে আছেন মনে হচ্ছে? কাহিনি কী? ‘

রহস্যময় এক হাসি দেয় অর্পণ। নিধির বুক ধক করে উঠে ওই হাসি দেখে। ভ্রু কুঁচকে ফের প্রশ্ন করে,

‘ কী চলছে মনে? ‘

চশমার আড়ালে থাকা অর্পণের চোখ দুটোয় আনন্দেরা ছুটোছুটি করে৷ মুখে অমায়িক হেসে জবাব দেয়,

‘ ঠিক তোমার মনে যা চলছে তাই। ‘

মুখ হা হয়ে যায় নিধির। তার মনে কী চলছে উনি টের পেল কী করে? পরোক্ষণেই আবার মস্তিষ্কে তাড়া এসে হানা দেয়। সে মুখ ভেঙিয়ে সরে পড়ে ত্বরিত। অর্পণ স্যারের হাসি বিস্তৃত হয়। লম্বা একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে বিড়বিড় করে বলে,

‘ আমি যে ঠিক কতটা উদ্বিগ্ন হয়ে আছি নিধি! কখন বলবে তুমি? ধৈর্যরা যে আর বাঁধ মানছে না। ‘

ছেলেকে গোসল করিয়ে খাইয়ে ঘুম পাড়াচ্ছিল নিধি। ঘুমিয়ে গেলে অনিরূপকে শুইয়ে দিয়ে বুকে মৃদু থাপ্পড় দিচ্ছিল। হঠাৎ অর্পণ স্যারকে স্তম্ভিত মুখে ঘরে ঢুকতে দেখে। ডানহাতের বুড়ো আঙুলটা চেপে ধরা। নিমেষে চোখের পাতায় ধরা দেয় স্যারের আঙুলের ফাঁক বেয়ে টলটলে রক্তের ধারা! যে দৃশ্যে চমকে যায় সে। হতভম্ব হয়ে উঠে আসে। আতঙ্কিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে,

‘ হাত কে টে গেছে! কতটুকু কা টল? উফফ, আপনাকে বলছিলাম চাকু হাতে তিড়িং বিরিং করবেন না। ‘

কথাটা বলেই ছুটে চিকিৎসা বাক্স নিয়ে আসে। অর্পণ চুপচাপ গিয়ে বসে ডিভানে। নিধি খুব মনোযোগ দিয়ে ব্লাড পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেয়। সঙ্গে বোনাস হিসেবে দেয় বকাঝকা। ছুঁড়ে দেয় অহরহ সন্দিহান বাণী।

‘ কী সমস্যা আপনার? এত্ত আনন্দিত কী নিয়ে? একশবার করে বলছিলাম, সাবধানে, শান্ত হয়ে শষা কাটুন৷ বাহাদুরি দেখিয়ে বাম হাতে কে কাটাকুটি করতে বলেছে? ‘

ভদ্র, সভ্য, শান্ত প্রকৃতির ছেলে অর্পণ। ঠান্ডা মাথার জ্ঞানীগুণি মানুষ। তবু বউ বাচ্চার ব্যাপারে ছেলেমানুষী করে ফেলে ভীষণ। যেমন আজ করছে! নিধির পানে অপলকভাবে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে সে। তার কাছে মনে হয় রাগান্বিতা নিধিকে যতটা সুন্দর দেখায়। এত সুন্দর আর কক্ষনো দেখায় না। ওহ হ্যাঁ গোসল শেষে ভেজা চুলেও হার্ট টাচিং সুন্দরী লাগে।

‘ নির্লজ্জের মতো হাসছেন আবার? মন কোনদিকে ছিল আপনার? হাত কীভাবে কাটলেন। ডান হাত, তাও আবার বৃদ্ধা আঙুল! ভাবতে পারছেন? ‘

‘ আমি কি বাচ্চা ছেলে যে হাত কেটে এসে কান্নাকাটি করে বউয়ের আঁচলে চোখ মুছব? ‘

তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল নিধি। চিকিৎসা বাক্স নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ফোঁস ফোঁস করে বলল,

‘ একটুর জন্য সেলাই দিতে হলো না। আজ আপনার কী হয়েছে হ্যাঁ? কোন রমণী দেখে মাথা আওলাই গেছে শুনি? ‘

বা হাতে বুকের বা’পাশে চেপে ধরল অর্পণ স্যার। শরীর ছেড়ে বসে মুচকি হেসে বলল,

‘ ধুরর কী সব যে বলো না… যাও তো শাওয়ার নিয়ে এসো। খিদে পেয়েছে খুব। ‘

নিধি আর কিছু বলল না। একা একা তো আর ঝগড়া করা যায় না৷ এই লোকটার সাথে তার কখনোই ঝগড়া জমে না। সে ঝগড়া করবে, বকাঝকা করবে আর এই লোক হাসির বস্তা খুলে বসে থাকবে। তাও আবার যে সে হাসি না। মিটিমিটি, মুচকি মুচকি বদমায়েশি হাসি। শাওয়ার নিতে চলে গেল নিধি। ওয়াশরুমে ঢুকার পর আচমকা সে নিজেও হেসে ফেলল। এই পৃথিবীতে পুরুষ মানুষের মতো অসহায় আর কেউ আছে নাকি? দেশের প্রেসিডেন্ট হলেও বউয়ের কাছে নির্লজ্জ, বদমায়েশ হয়েই থাকতে হয়। বউয়ের চোখ রাঙানো, বকাঝকা মুখ বুঝে সহ্য করে হাসিখুশি থাকতে হয়। কারণ বউরা যে হয় হোম মিনিষ্টার। পুরো পৃথিবী জয় করা পুরুষরা ঘর জয় করতে বরাবরই অপারগ। এই অসীম ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা শুধু নারীদেরই দিয়েছেন বোধহয়।

কালো, নীল মিশ্রণে সূতি তাঁতের শাড়ি পরেছে নিধি। খিদে পেয়েছে প্রচণ্ড। তাই কোনো প্রকার প্রসাধনী না মেখেই খাবার খেতে চলে গেল। সঙ্গে এলো অর্পণ। নিধির মনে পড়ল স্যারের হাত কেটেছে। তাও আবার ডান হাতের বৃদ্ধা আঙুল। সে খাবার বাড়তে বাড়তে বলল,

‘ খাবেন কী করে এবার? ‘

অর্পণ গাঢ় চাউনিতে তাকাল একবার। ভেজা চুলে শাড়ি পরিহিত স্নিগ্ধ রমণীর থেকে দৃষ্টি ফেরানো দায়। তাই দৃষ্টি স্থির রেখেই চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,

‘ আল্লাহ পাক একটা ব্যবস্থা করবেনই। ‘

ছোটোছোটো চোখে তাকিয়ে বসল নিধি৷ প্লেটে খাবার বাড়তে বাড়তে বলল,

‘ আমি কাউকে খাইয়ে দিতে পারব না। ‘

‘ আমি কাউকে বলিনি খাইয়ে না দিলে অনাহারে মৃত্যুশয্যায় চলে যাব। ‘

চোখ মুখ শক্ত করে তাকাল নিধি। অর্পণ স্মিত হেসে বলল,

‘ স্বর্গ থেকে মর্ত্যে কেন এলেন দেবি? ‘

মনে মনে হাসি পেলেও মুখ কঠিন করে নিধি বলল,

‘ হয়েছে এত পাম দিতে হবে না। খাইয়ে দিচ্ছি। ‘

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল অর্পণ। নিধি নিজেও মৃদু হেসে নিজে খাওয়ার পাশাপাশি তাকে খাইয়ে দিল। খাওয়া শেষে অর্পণ যখন উঠতে উদ্যত হলে নিধি বলল,

‘ ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসুন। কথা আছে আপনার সাথে।’

অর্পণ যেন ঠিক এই একটি কথারই অপেক্ষায় ছিল। আর অল্পসময় অপেক্ষা মাত্র। সে চলে এলো ড্রয়িং রুমে। নিধি তার হাতের কাজ সেরে চলে এলো ত্বরিত। সে আসতেই অর্পণ উঠে দাঁড়াল। লজ্জা করছিল নিধির। তবু সুসংবাদটা তো জানাতেই হবে। প্রথমবারের সেই মুহুর্ত গুলো ঠিকঠাক সংরক্ষণ করতে পারেনি। কত জটিলতা, দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, মানসিক যন্ত্রণায় গিয়েছে। আজ কোনো দ্বিধা, দ্বন্দ্ব নেই। আর না আছে মানসিক অশান্তি। সে ভালো আছে। সুখী আছে এই মানুষটার সঙ্গে। আজ মন খুলে প্রাণ ভরে স্বীকার করতে পারে সম্মুখের এই ভদ্রলোককে সে ভালোবাসে। ভীষণ… সেই ভালোবাসার ফল সরূপ দ্বিতীয়বার তার গর্ভে এই ভদ্রলোকের সন্তান এসেছে। ফাস্ট বেবির দু বছর যেতে না যেতেই সেকেন্ড বেবি! আর সময় নেয় না নিধি। কয়েক পা এগিয়ে একদম কাছাকাছি চলে আসে। অর্পণ স্যারের বুক ঢিপঢিপ করছে। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে নিধিরও। উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের লম্বাটে মানুষটার মুখাবয়ব উদ্বিগ্ন ভীষণ। আর পীড়া দেয় না নিধি। তার দু’পায়ের ওপর নিজের দুপা রেখে একদম সমানে সমান হয়ে দাঁড়ায়। পড়ে যাওয়ার শঙ্কায় আলগোছে তার কোমর জড়িয়ে ধরে অর্পণ স্যার। নিধি প্রসন্ন চিত্তে দু-হাত বাড়িয়ে গলা জড়িয়ে ধরে প্রিয় পুরুষটার৷ মিষ্টি স্বরে কানে কানে বলে,

‘ অভিনন্দন অনির আব্বু। আমরা দ্বিতীয়বার বাবা, মা হতে যাচ্ছি। আওয়ার সেকেন্ড বেবি ইজ কামিং…’

‘ বুঝতে পারছিলাম আমি। জাস্ট তোমার মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছিলাম। অন্য কোনো রমণী নয় এই রমণী আর তার গর্ভাশয়ে আসা ছোট্ট অংশটাতেই বিভোর ছিলাম। ‘

আবেগাপ্লুত হয়ে গেল নিধি। অর্পণ স্যার আবেশে কোলে তুলে নিল ওকে। কপালে এঁটে দিল গভীর চুম্বন। এরপর খুশিতে পুরো বাসা জুড়ে ঘুরল বউকে কোলে তুলে। নিধি এতবার করে বলল নামাতে সে শুনছিল না। এমতাবস্থায় ফোন বেজে উঠল নিধির। তবু অর্পণ স্যার ওকে নামাল না। ঘরে গিয়ে ফোন নিয়ে নিধির হাতে দিল। আর সে ওকে সহ গিয়ে বসল ডিভানে। কী আর করার বরের কোলে বসেই শুনতে হলো বন্ধু আইয়াজের বাবা হওয়ার সুখবর!
.
.
সকাল থেকেই আইয়াজের স্নায়বিক অবস্থার বেহাল দশা। বাবা, মা হওয়া কী মুখের কথা? একজনকে শারীরিক, মানসিক উভয় যন্ত্রণা সহ্য করে মা হতে হয়। আরেকজনকে তীব্র মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করে হতে হয় বাবা। সেই ভয়ংকর, গা শিউরে উঠা সময়টুকুর কথা জীবদ্দশায় কখনো ভুলতে পারবে না আইয়াজ। ওটির ভেতর ফারাহর পাশেই ছিল সে। মানসিক ভাবে ফারাহ ভীত হলেও আইয়াজকে বুঝতে দেয়নি৷ এদিকে ডাক্তার হওয়া সত্যেও বউয়ের সিজার হচ্ছে এই দুঃশ্চিন্তায় তার ব্লাড প্রেশার বেড়ে যায়। সাধারণত ডেলিভারির পর বাচ্চা আর মাকে কিছুক্ষণের জন্য একত্র করা হয়৷ ওদের বেলায় হলো উল্টো। একদিকে সিজার হচ্ছে অপরদিকে ফারাহকে ভরসা দিচ্ছে আইয়াজ। কিন্তু নিজে যে দুঃশ্চিন্তা, ভয়ে ঘেমে-নেয়ে একাকার হুঁশ নেই। চোখ, মুখ লাল হয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা। হাত, পাও থরথর করে কাঁপছে৷ শুধু জ্ঞান হারানোই বাদ গিয়েছে ওর। ডাক্তার, নার্স উভয়ই তার অবস্থা দেখে বিস্মিত। তাই বাচ্চা দুটোর নাড় কে টে সঙ্গে সঙ্গেই আগে বাবার কোলে দিয়েছে। সাদা, লাল সংমিশ্রণে ছোট্ট দুটো দেহকে কোলে নিয়েই সে কি কান্না আইয়াজের। সে কান্নার শব্দে বদ্ধ চোখজোড়া খুলে যায় ফারাহর। চিৎ হয়ে শোয়া। নড়চড় করতে পারছে না৷ দেহের অর্ধেকাংশ অবশ। তাই আড়দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে দেখে স্বামী, সন্তানকে। নিমেষে দুচোখ উপচে অশ্রুঝড়ে তারও। ব্যস এইটুকু দৃশ্যই তারপর আবার চোখ বুঝে নেয়। এরপর যখন চোখ খুলে তখন সে কেবিনে। শাশুড়ি আর জা এর কোলে বাচ্চা দুটো। কেমন স্বরে কাঁদছে! ওই স্বর শুনে ওর বুকের ভেতর ধুকপুক করে উঠে। উতলা হয় মন একবার ওদের বুকে জড়িয়ে নেয়ার জন্য। তক্ষুনি
শুনতে পায় শাশুড়ি মায়ের গলা,

‘ দুধ খাওয়াতে হবো। আয়াজ নে তুই ওরে কোলে রাখ আমি দেখি বউয়ের বুকে দুধ নামছে কিনা। ‘

এরপর শাশুড়ি মা এগিয়ে আসে। ফারাহ হাত দুটো নাড়ানোর চেষ্টা করে পারে না৷ এদিকে শাশুড়ি মা কোনোকিছু না বলেই বুকের সামনে জামার চেইন খুলে ফেলে। হতভম্ব ফারাহ লজ্জিত হয়ে বাঁধা দিতে যায়। শাশুড়ি মা তখন নিচু গলায় বলে,

‘ ওমা! বাঁধা দেও কেন? পোলা দুইটা খিদায় ছটফট করতেছে৷ ডাক্তার, নার্স যাই বলুক যতই উন্নত মানের, পুষ্টি সমৃদ্ধ দুধ লিখুক। ওইসব আমি ওদের খেতে দিব না। আয়াজকে আনতেই দেই নাই। মায়ের বুকের দুধ ছাড়া কোনো নকল দুধ আবার নাতিরা খাবে না। ‘

বলতে বলতেই তীব্র লজ্জায় ফেলে দিল ফারাহকে। তার নাজেহাল অবস্থা দেখে ফের শাশুড়ি বলল,

‘ অতো লজ্জা করো কেন? এইখানে আমরা দুই মেয়ে মানুষ আর তোমার স্বামী ছাড়া আর কে আছে? ‘

নাক লাল হয়ে উঠল ফারাহর৷ আবার বাচ্চাদের কথা ভেবে নিজেকে সান্ত্বনাও দিল। বাচ্চা দুটোর খিদে মিটছিলই না। ভালোভাবে দুধ পাচ্ছিল না শুরুতে। তাই কান্নাকাটি করছিল খুব। সন্ধ্যার পর পর ওরা ঠিকঠাক দুগ্ধপান করতে পারল। ফলশ্রুতিতে ঘুমিয়েও পড়ল। কিন্তু ফারাহ খেয়াল করল ওরা বেশিক্ষণ ঘুমাচ্ছে না৷ একবার উঠে খাচ্ছে আবার কিছুক্ষণ ঘুমাচ্ছে। আবার খাচ্ছে আবার ঘুমাচ্ছে। যেন খিদে পেলেই জাগে, গলা ছেড়ে কাঁদে। খাবার পেলে খেয়ে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যায়। ওদের খাওয়া, ঘুম ছাড়া যেন আর কিচ্ছুটি করার নেই৷ কিচ্ছুটি না৷ সত্যিই তো তাই। কী করবে আর?

রাত দশটা। বাচ্চারা খেয়ে ঘুমাচ্ছে। আইয়াজ ফারাহর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

‘ ঘুমাও একটু। ‘

ফারাহ স্বচ্ছ দৃষ্টি মেলে তাকাল। মাথা থেকে আইয়াজের হাতটা ধরে মুখের কাছে এনে সন্তর্পণে একটি চুমু খেয়ে বলল,

‘ ভয় করছে। ‘

‘ কেন! কী নিয়ে ভয়?’

‘ আমি ঘুমালেই যদি ওরা উঠে যায়? কান্না করে। ‘

ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলল আইয়াজ। কেমন একটা অদ্ভুত সুখ ওদের চোখে, মুখে আর বুক জুড়ে ছন্দ তুলে বেড়াচ্ছে। ফারাহর এই মিষ্টি দুঃশ্চিন্তায় বিগলিত হলো আইয়াজ। কপালে চুমু দিয়ে বলল,

‘ উঠলে তো কান্না শুনে তুমিও উঠে যাবে। এ আবার চিন্তার কী? একটু ঘুমাও। ভীষণ টায়ার্ড লাগছে তোমাকে। ‘

‘ দু দু’টো জমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছি। এমন লাগবে না বলছ? ‘

হাসল আইয়াজ। বাচ্চাদের দিকে একবার তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ ওদের নাম কি রেখেছি শুনবে? ‘

মৃদু হেসে মাথা নাড়ল ফারাহ। আইয়াজ বলল,

‘ বড়োটার নাম, আইরাজ আহমেদ আনান আর ছোটোটা…’

ফারাহ ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

‘ ফাইরাজ আহমেদ ফানান। ‘

বিস্ময়াপন্ন হয়ে আইয়াজ বলল,

‘ কী করে জানলে! ‘

‘ ফোনের নোটসে লিখে রেখেছিলে। দেখে ফেলেছি দু’মাস আগেই! ‘

আশ্চর্য হয়ে আইয়াজ বলল,

‘ বুঝতেও দিলে না! ‘

‘ দিলে কি এই মুহুর্তটা পেতাম? ‘

ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্নটি করল ফারাহ। আইয়াজ বিমুগ্ধ হয়ে আচমকা ওর ঠোঁটে চুমু দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করল। আনান, ফানান এর চেয়ে ত্রিশ সেকেন্ডের বড়ো৷ আইয়াজ ভেবেই রেখেছিল যে আগে আসবে তার নাম হবে আনান। পরেরজন ফানান। বাবা মায়ের সঙ্গে মিলিয়ে সুন্দর সুন্দর দুটো নাম বাছাই করে রেখেছিল সে।
.
.
|চলবে|
® জান্নাতুল নাঈমা
সমাপ্তি পর্ব আসছে শিঘ্রই…।

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৮৮

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৮৮|
ভয়ে বুক ঢিপঢিপ করছে নামীর। নিজেকে চোর চোর লাগছে। চোরেরা কীভাবে চুরি করে? ঠিক কতখানি সাহস, কত বড়ো বুকের পাটা থাকলে চোরেরা চুরি করতে পারে? ভেবেই শরীর ঘেমে উঠল। চুরি করে সামান্য বরের পিছু নিয়েছে। এতেই তার অবস্থা যাচ্ছেতাই। হঠাৎ ভ্রু কুঁচকে গেল। সুহাস তো বাবা, মায়ের ঘরে যাচ্ছে! বুক ধক করে উঠল নিমেষে। অন্তঃকরণ এমন কিছু আঁচ পেল যাতে তার বুকের ভেতর চিনচিনে এক ব্যথার অনুভূতি হলো। ততক্ষণে
সুহাস ভেতরে ঢুকে গেছে। আর থমকে গেছে নামীর পা দুটো। আর কি এগুনো ঠিক হবে? বেচারা মানুষের সম্মুখে সারাদিন গুমরে থাকার পর মাঝরাতে হয়তো নিরিবিলিভাবে একটু হাঁপ ছাড়ে।
পরোক্ষণেই ভাবল, সে তো সুহাসের স্ত্রী। অথচ কতটা দূরত্ব তাদের। যে ওই মানুষটা তার সামনেও নিজেকে ভেঙেচুরে প্রকাশ করতে পারছে না। এই দূরত্বের পেছনে পুরোপুরি সুহাস দায়ী নয়৷ সে নিজেও দায়ী। তবে কেন ওর দুঃখের ভাগ নেবে না? সুহাস যতই সে দুঃখ আড়াল করার চেষ্টা করুক৷ সে জানতে পেরে পিছু হাঁটবে কেন? তার অবশ্যই এগিয়ে যাওয়া উচিত। পাশে থেকে কাঁধে হাত রেখে বোঝানো উচিত।’ চিন্তা করো না। আমি আছি, আমি থেকে যাব। শুধু হাতে হাত রেখে সসম্মানে গ্রহণ করো। ‘ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নামী৷ সে বুঝদার মেয়ে। তাই খুব সংগোপনেই বুঝে নিল সুহাসকে। পা বাড়াল শশুর, শাশুড়ির ঘরের দিকে। দরজা ভেতর থেকে আঁটকে রাখা কিনা জানা নেই।

অতিরিক্ত চঞ্চল প্রকৃতির মানুষদের জন্য ঠিকঠাক একটা ধাক্কাই যথেষ্ট। নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নেওয়ার জন্য। সুহাসের জীবনে যেন তাই ঘটেছে। মায়ের মৃত্যুতে বাবাকে পাশে পেয়ে নিজেকে যে সান্ত্বনা দিয়েছিল। বাবার মৃত্যুর পর সে সান্ত্বনা কোনোকিছুর বিনিময়েই মিলছে না৷ হাহ! তা কি আর মেলে? এতিম শব্দটা যে অনেক ভারী। এই শব্দের বোঝা শুধু কাঁধে নয় বুকেও বহন করতে হয়। সুহাসও করছে৷ সারাদিন সকলের সঙ্গে মিলে থাকে। মন, মস্তিষ্ক জুড়ে কত হাহাকার বয়ে যায় কেউ কি টের পায়? কাউকে টের পেতে দেয় না৷ লোকে বলে পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই। তাদের সবকিছু শক্ত হাতে অতিসহজে সামলে নিতে হয়৷ কিন্তু লোকেরা কি জানে? পাহাড়সম যন্ত্রণা বুকে পুষে পুরুষরা সবকিছু সামলে নিলেও দিনশেষে খুব জঘন্য ভাবে ভেঙে পড়ে? যেই ভেঙে পড়ার গল্প গুলো রয়ে যায় অজানাতে। সুহাসও ভাঙল। এই মধ্যরাতে। বাবা, মায়ের ঘরে এসে বিজনেসের ফাইলগুলো ঘেঁটেঘুটে দেখল৷ তাকে যে এখন এগুলো বুঝে নিতে হবে। এরপর সেগুলো গুছিয়ে রেখে পুরোনো একটি অ্যালবাম বের করল। বুকটা কেঁপে উঠল বাবা, মায়ের বিয়ের ছবি দেখে। শরীর ছেড়ে বসে পড়ল ফ্লোরে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দেখতে শুরু করল প্রতিটা ছবি। বাবা, মায়ের বিয়ে থেকে শুরু করে তার শিশুকাল। সিমরানের ছোট্টবেলাকারও অসংখ্য ছবি। নিশ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হলো। তরতাজা দুটো মানুষ আর দুনিয়াতে নেই! এই দুজন মানুষ তাকে আর বোনকে দুনিয়ায় এনেছে। এদের জন্যই তো আজ এতবড়ো পৃথিবীতে টিকে আছে। আজ এরা নেই। অথচ এ বাড়ি এ দুনিয়া থেকে কেউ তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে না৷ জীবন কী অদ্ভুত! একটু হেসে ফেলল সুহাস। চোখ বেয়ে ঝড়ল নোনাপানির ধারা। সবাই জানে সে মায়ের মৃত্যুতে কাঁদলেও বাবার মৃত্যুতে কাঁদেনি। সেই জানার বাইরে গিয়ে আজ নামী জানল, সুহাসের এক ভয়ংকর আর্তনাদ। ভেতর থেকে দরজা লাগানো নেই৷ তাই নিঃশব্দে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল নামী। সুহাস স্থবির হয়ে বসে আছে৷ কোলের ওপর ফ্যামিলি অ্যালবাম৷ শুধু মন খুলে কাঁদার জন্যই রোজ রাতে এখানে আসে না সুহাস। আরো কারণ রয়েছে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও ঘর থেকে এ ঘরে অর্থাৎ বাবা, মায়ের ঘরে শিফট করবে। বাবা, মায়ের ঘরটা হবে তার আর নামীর ঘর। আর ভবিষ্যতে তার ঘর হবে সুহৃদের। সিদ্ধান্ত নিয়েই এ ঘরটা নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছে। নামীকে কিছু বলেনি এখনো। আর কিছুদিন পর বলবে এ ব্যাপারে। রোজ ও ঘর থেকে এভাবে এ ঘরে এসে থাকার আরো একটা কারণ হচ্ছে, তার ফিজিক্যাল নীডস! স্বামী, স্ত্রী দীর্ঘদিন দূরে ছিল। এখন কাছাকাছি থাকা সত্যেও দুজনের মাঝেকার অদৃশ্য এক দেয়াল সরছেই না। বাবার মৃত্যুর শোকে তার মন এতটাই স্তব্ধ যে নিজে থেকে কাছে টানতে পারছে না নামীকে। জড়তা কাজ করছে। এসব ব্যাপারে নামী নিজে থেকে এগুবে তা আশা করাই বোকামি। তার পুরুষ মন, পৌরুষ চাহিদা নিয়ন্ত্রণ রাখতেই এভাবে দূরে সরে থাকা। আগুনের আশপাশে থাকলে তাপ লাগবে দূরে সরে থাকলে নিশ্চয়ই লাগবে না?

নামী যথেষ্ট পরিণত মস্তিষ্কের মেয়ে। তারা স্বামী-স্ত্রী। একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক মেনে নিতে তার কখনোই আপত্তি নেই। মেয়ে বলে স্বামীকে কাছে পাওয়ার তৃষ্ণা তার নেই এমনটাও নয়। কিন্তু বর্তমান যে সুহাসকে সে দেখছে, জানছে তার কাছে আসা নিয়েও দ্বিধায় ভুগছে। যদি দূরে সরিয়ে দেয়? সে কি লজ্জা পাবে না? শোকাবহ একটা পরিস্থিতিতে সুহাস ঠিক কতটুকু আগ্রহী এ ব্যাপারে তার ব্যাপারে সে অনিশ্চিত।

নামী ঘরে ঢুকেছে। টের পায়নি সুহাস। সে বাবার সঙ্গে তার খুনসুটি মুহুর্তের কয়েকটা ছবি দেখছে। পুরোনো স্মৃতিতে ভেসে বেড়াচ্ছে। ইশ! সেইদিন গুলো কি আবার ফিরে আসতে পারে না? তার মন, মস্তিষ্ক জুড়ে যখন এমনি একটা প্রশ্ন আসে। আবেগঘন হয়ে চোখ দিয়ে ঝড়ে অশ্রু৷ ঠিক সেই মুহুর্তে সম্মুখে দাঁড়ায় নামী৷ চকিতে মাথা তুলে সুহাস। ধূসর বর্ণ চোখদুটো রক্তলাল। চোয়াল বেয়ে নোনাপানি। নামী দুই হাঁটু গেড়ে বসে মুখোমুখি। হাত বাড়িয়ে চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলে,

‘ বাবাকে মিস করছ? ‘

আচমকা সুহাসের কী হলো কে জানে? প্রচণ্ড শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তাকে। টাল সামলাতে না পেরে শরীর ছেড়ে বসে পড়ল নামী৷ সুহাস উচ্চরবে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘ সেইদিন গুলো আর ফিরে আসবে না নামী। বাবা আর ফিরবে না। ফিরবে না বাবা, মা। ‘

অশ্রুতে ভরে গেল নামীর চোখও। যত্ন করে সুহাসের মাথাটা বুকে জড়িয়ে নিল। পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

‘ কে বলেছে ফিরবে না সুহাস? আমরা যা হারাই সবই ফিরে পাই। হয়তো ফিরে পাওয়াতে একটু পার্থক্য থাকে৷ এটা যে প্রকৃতিরই নিয়ম। আমাদের মেনে নিতেই হবে। ‘

কান্নার বেগ কমে সুহাসের। ধীরেধীরে শান্ত হয়। নামীকে ছেড়ে একটু সরে বসে। চোখ তুলে তাকায়। নামী ফের ওর চোখের জল মুছে দেয়। অ্যালবামের ছবির দিকে ইশারা করে বলে,

‘ সুহৃদ কি তার বাবার সঙ্গে এমন একটা ছবি তুলবে না? সুহৃদের মা কি এমনই একটি অ্যালবাম গিফট পাবে না তার বাবার কাছে? ‘

সুহাসের চোখ বেয়ে আবারো অশ্রু ঝড়ে। ওর অসহায় মুখাবয়ব দেখে নামীও কেঁদে ফেলে। সুহাসের মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলে,

‘ এত ভেঙে পড়ছ কেন সুহাস? আমি আছি তো তোমার পাশে। তোমার সব দুঃখের ভাগীদার হতে চাই আমি। আমার সঙ্গে দূরত্ব ঘুচাও তুমি প্লিজ। এভাবে কিচ্ছু ঠিক হবে না, কিচ্ছু না৷ নিজেকে আর গুমরে মেরো না তুমি। যারা চলে গেছে তাদের জন্য নিজেকে এভাবে ভেঙে দিলে যারা রয়ে গেছে তাদের কী হবে? আমার কী হবে সুহাস, আমাদের সুহৃদের কী হবে?’

থমথমে কণ্ঠে সুহাস জবাব দিল,

‘ তুমি তো শক্তিশালী নারী নামী। তোমার কিচ্ছু হবে না৷ তুমি ঠিক সামলে নিব সুহৃদকে। তুমি কি এই সুহাসকে পরোয়া করো? ‘

সব যন্ত্রণার ঊর্ধ্বে কি একরাশ অভিমান ছিল সুহাসের এই কথাটিতে? নামীর কান্না গাঢ় হলো। ছেড়ে দিল সুহাসকে। কিঞ্চিৎ সরে গিয়ে মুখোমুখি বসে বলল,

‘ এই পৃথিবী আর চারপাশের মানুষ গুলো আমাকে শক্ত হতে বাধ্য করেছে সুহাস। তাই বলে কি এই যে আমার কারো ভালোবাসা পাওয়ার মন নেই, অধিকার নেই। আমার পাশে কাউকে প্রয়োজন নেই? আমি তোমাকে ভালোবাসি সুহাস। সব রাগ, অভিমান, দম্ভ শেষে এই সত্যিটা তো অস্বীকার করতে পারি না আমি। ‘

পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল সুহাস। নামীর কান্নায় যেন ওর সংবিৎ ফিরল। হাত বাড়িয়ে মুছে দিল নামীর গাল বেয়ে পড়া অশ্রুজল৷ নিমেষে ওর হাতটা নিজের গালে শক্ত করে চেপে ধরল নামী। বলল,

‘ চোখের পানি মোছার দায়িত্ব নিলেই খুশি আমি। ‘

কান্নার মাঝেও হেসে উঠে সুহাস৷ আলগোছে কাছে টেনে নেয় নামীকে৷ বুকে জড়িয়ে রাখে দীর্ঘক্ষণ। ওদের অশান্ত দুটি হৃদয় যখন শান্ত হয়ে আসে। তখন বলে,

‘ এ ঘরে শিফট হয়ে যাব নামী। এখানে আলাদা একটা শান্তি পাই আমি। এই ঘরটা আমায় ভীষণ টানে ভীষণ। ‘

মাথা তুলে নামী। বলে,

‘ কালই চলে আসব। ‘

‘ সুহৃদ বড়ো হলে ও ঘরটা ওর জন্য সাজিয়ে, গুছিয়ে দিব। ‘

সাধারণ একটি ভবিষ্যত প্ল্যান করে ফেলল ওরা। দুজন মিলে অনেকটা সময় কাটাল। এরপর অ্যালবাম রেখে দিল যথাস্থানে। নামী দেখল, এ ঘরটা সুহাস নিজের মতোই গুছিয়ে নিয়েছে। ভেবেছিল ও ঘরে ফিরে যাবে। কিন্তু সুহাস ফেরার নাম নিল না। বরং কাছে এসে গাঢ় চাউনিতে বলল,

‘ সুহৃদ ঘুমাচ্ছে তো? ভোর হওয়ার আগে উঠার সম্ভাবনা নেই। ‘

দেয়াল ঘড়িতে তাকাল নামী। ফজরের ওয়াক্ত হতে আরো দেড় ঘন্টা। ছেলের অভ্যেস ভালো। এখন রাতে একবার জাগে বারোটা, একটায়। এরপর জাগে ভোরবেলা। তাই সে মাথা নেড়ে বুঝাল হ্যাঁ ঘুমাচ্ছে, উঠার সম্ভাবনা নেই। লম্বাচওড়া দেহের সুহাস তখন চট করে মাথা নিচু করে জিজ্ঞেস করল,

‘ শেষরাতটা এই অধমকে গিফট করা যায় না? ‘

সহসা শিউরে উঠল নামী। বুকের ভেতর কী যেন একটা কামড়ে ধরল তীব্রভাবে। এক পলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল লজ্জাভরে। এ আবার কেমন আহ্বান? অবশ্য নির্লজ্জতা ছেড়েছে। আগে তো চিল্লাচিল্লি করে ডাকত, ‘ কাছে আসো তোমাকে প্রয়োজন। ‘ সেই নির্লজ্জতা ছাড়বে নাই বা কেন? আগে শুধু ছেলে ছিল। এখন এক ছেলের বাপ। ভেবেই মনে মনে হাসল নামী। সুহাস ওর মুখশ্রী পড়ে নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে, মুখে জল ছিঁটিয়ে এলো। এরপর ইশারা করল তাকেও মুখ ধুয়ে আসতে৷ কান্নাকাটি করে একাকার মুখটা। নামী ফ্রেশ হতে গেলে সে গিয়ে জানালা, দরজা বন্ধ করে লাইট অফ করে ড্রিম লাইট অন করে দিল।

অনেকগুলো মাস৷ এক বছর পেরিয়ে দু বছরের কাছাকাছি সময়। ওরা দুজন আলাদা ছিল। কত দূরত্ব, মান, অভিমান শেষে এই কাছে আসা, ধরা দেওয়া? হিসেব আছে? হিসেবটা থাকুক বা না থাকুক। বোঝাপড়া হয়ে গেল বেশ। কী অধৈর্য্যতা, কী বেপরোয়া ভাবে তৃষ্ণা নিবারণ। বিয়ের দীর্ঘদিন পর যখন সম্পর্ক পূর্ণতা পায়। প্রথম ঘনিষ্ঠ একটা রাত আসে ওদের। সেই রাতেরই যেন পুনরাবৃত্তি ঘটল আজ। একই অনুভূতি, একই উন্মাদনা, তীব্র সুখ, আর অদ্ভুত যন্ত্রণায় টালমাটাল মন, শরীর উভয়ই। কত আদর, যত্ন মিশিয়ে আজ নামীর শরীরে আদর করে দিল সুহাস। সুখাশ্রুতে চোখের কার্ণিশ ভিজে উঠল নামীর৷ ওর কান্না টের পেয়ে মাথা তুলে সারা মুখে চুমুতে, চুমুতে ভরিয়ে তুলল সুহাস৷ ভারী নিঃশ্বাস ছেড়ে কপালে কপাল মিলিয়ে গভীর স্বরে বলল,

‘ সুহাসিনী? ‘

‘ হুহ? ‘

‘ ভালোবাসি। ‘

উত্তর দিল না নামী। শুধু শরীরের উপর থাকা ভারিক্কি শরীরটা দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। সুহাস উত্তরটা বুঝে নিল। অতঃপর ডুবে রইল বদ্ধ ঘরের নিস্তব্ধ রাতের প্রেম তরঙ্গে।
.
.
কিছু মাস পর:-

নামী আর সুহাসের পরিপূর্ণ একটি সংসার গড়ে উঠেছে ইতিমধ্যেই। সুহাস ঢাকা থেকে তারই শহরে ট্রান্সফারের আবেদন করেছে৷ নামী স্বামী, শশুরের প্রাইভেট হসপিটালেই জয়েন করেছে। স্বামী-স্ত্রী মিলে সংসারের দায়িত্ব, হসপিটালের দায়িত্ব সুন্দর করেই সামলে যাচ্ছে। আজ ছুটির দিন। তাই ওরা সুহৃদকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছে সিমরানের শশুর বাড়ি। সৌধ এখন চট্টগ্রামে। তাই বেচারি সিনুর মন খারাপ। এই মন খারাপ অবশ্য খুব বেশিদিন থাকবে না। কারণ সৌধ বলেছে তার ফাইনাল পরীক্ষা হতে হতে হয় সে ট্রান্সফার নিয়ে এখানে চলে আসবে। নয়তো তাকে ওখানে নিয়ে যাবে৷ নামীরা চৌধুরী বাড়িতে পৌঁছাতেই সুহাসের একটি ফোনকল এলো। জানতে পারল, ঘন্টাখানেক আগে, ফারাহর ডেলিভারি হয়েছে। মা এবং সন্তান তিনজনই সুস্থ। তারা সবাই মিলে যেন খুব তাড়াতাড়ি ঢাকা চলে আসে। আইয়াজ, ফারাহর জোর নিমন্ত্রণ।

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-৩৩ এবং শেষ পর্ব

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (৩৩ এবং শেষ)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

সময় এগিয়ে চলেছে। দেখতে দেখতে কেটে কেটে অনেকগুলো বছর।ঘড়ির কাঁটায় ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে আহমেদ ভিলার সমস্ত লাইট জ্বলে উঠল, একসাথে সবাই মিলে চেঁচিয়ে উঠল,

– “হ্যাপি অ্যানিভার্সারি।”

হ্যাঁ আজ নাজিয়া ও আবরারের ২৫তম বিবাহ বার্ষিকী। ওদেরকে কিভাবে সারপ্রাইজ দেবে সেটা ভাবতে ভাবতেই ছোটদের ১মাস কেটে গেছে কখন বুঝতেই পারেনি। আজকে সকালেও প্ল্যান নিয়ে প্রান আর আনহার মধ্যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে গিয়েছিল। কিছুদিন আগেই প্রান ২৫বছর ছুঁলো আর আনহার ১৯রানিং ২০ অর্থাৎ বুড়ি হবে হবে হচ্ছে।

আনহা একটা কেক নিয়ে এসে বলল,
– “মা বাবা চলো কেক কাটবে।”

ওরা কেক কাটতে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল তার আগেই প্রান আরো একটা কেক নিয়ে হাজির। ওদের পথ আটকে বলল,
– “মাম্মাম পাপা আমার আনা কেক কাটবে, তুই ওইটা নিয়ে ফট।”

আনহা মুখ ভেংচি দিয়ে বলল,
– “তুই ওইটা নিয়ে ফট। বললেই হলো নাকি! আমি আগে এনেছি তাই আমার কেকটাই কাটা হবে তুমি যাও তো এইখান থেকে।”

বাকিরা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল। এত সুন্দর একটা মুহূর্তেও এদের ঝগড়া করতে হবে! এরা বড়ো হলেও এদের ঝগড়া শুনলে মনে হবে এরা বাচ্চা, ক্লাস টু থ্রিতে পড়ে।

পরিস্থিতি জটিল হতে দেখে শাওন আবরার ও নাজিয়ার কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,
– “আঙ্কেল আন্টি তোমার থামাও নাহলে কিন্তু এখুনি বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাবে।”

নাজিয়া আনহাকে ধমক দিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল কিন্তু তার আগে আবরার ওর হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বলল,
– “আমরা দুজনে দুজনের কেকই কাটব। এখন ঝগড়া না করে কেকগুলো রেখে দাও।”

আনহা ভেংচি দিয়ে কেকটা রেখে দিল, প্রান রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,
– “এই তুই কথায় কথায় ভেংচি কাটিস কেন? আমি বলেছি না আমার সামনে ওইসব করবি না!”
– “আমার মুখ আমি যা ইচ্ছা করব।”

প্রান রাগে কটমট করে তাকাল যার অর্থ অনুষ্ঠানটা শেষ হোক তোর খবর করে ছাড়ব। আনহা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে সামনের চুলগুলো ফু দিয়ে উড়িয়ে দিল, যেটাতে প্রানের রাগ আকাশ ছুঁলো। কিন্তু এখন সবার‌ সামনে ওকে কিছু করতে পারবে না তাই চুপ করে রইল।

আবরার- নাজিয়া দুজনের আনা কেকটাই কাটল, তারপর দুজন দুজনকে খাইয়ে দিল। আবরার সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
– “কেকগুলো খেয়ে যে যার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে নাহলে কালকের পার্টি ক্যান্সিল।”

সবাই না বলে চেঁচিয়ে উঠল। একসাথে এতজনের আওয়াজে নাজিয়া আবরার কানে হাত দিতে বাধ্য হলো।

– “আরে আসতে কান খারাপ হয়ে যাবে।”
– “আমরা এখুনি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ছি, তোমরা প্লিজ কালকের পার্টিটা ক্যানসিল করার কথা ভাববেও না।” (আনহা)
– “ঠিকাছে।”

আনহা সবাইকে নিজের আনা কেকটা কেটে দিল শুধুমাত্র প্রানকে বাদ দিয়ে। সেইম একই কাজটা প্রানও করল। এদের এতো ঝামেলা কেন?

আবরার ও নাজিয়া রুমের বারান্দায় গিয়ে বসল। বিয়ের এতগুলো বছর পেরিয়ে গেল বুঝতেই পারল না, সময় কীভাবে কেটে যায়।

নাজিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
– “২৫বছর হয়ে গেল!”
– “আমার‌ বিশ্বাসই হয় না এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলাম, ২৫টা বছর একসাথে পথচলা। ছেলেমেয়েগুলো কত বড়ো হয়ে গেল তাই না।”
– “হুমম। আমরা বয়স্ক হয়ে গেলাম, মা, আঙ্কেল আন্টি সবাই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, ছেলে মেয়ে গুলো বড়ো হয়ে গেল সবটা কিরকম বদলে গেছে তাই না! ”
– “সময় যে কারোর জন্য থেমে থাকে না।”

নাজিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

– “কিন্তু আবিরদার জীবন থমকে গেছে, সেই দিদিতেই আটকে আছে। এতগুলো বছরে কাউকেই আর তার পছন্দ হলো না।”
– “ওইটা তো মাকে থামিয়ে রাখার জন্য বলেছিল। দাদা কখনোই ভাবির মায়া থেকে বের হতে পারবে না, ওদের গল্পটা ‘এক আকাশ দূরত্ব’ এর অনেক ভালোবাসা, মায়া কিন্তু তবুও কেউ কাউকে ছুঁতে পারবে না। আজীবন স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকবে, হয়তো এটাকেই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বলে।”

নাজিয়া কিছু না বলে আবরারের কাঁধে মাথা রাখল। নিসার অনুপস্থিতি ওদের কষ্ট দেয়, কাঁদায় ঠিকই কিন্তু একটা কথা অস্বীকার করা যায় না নিসার অনুপস্থিতি না ঘটলে নাজিয়া -আবরারের গল্পটা কখনোই পূর্নতা পেত না। নাজিয়া নিজের দিদির সংসার বাঁচানোর জন্য আবরারের সাথে দূরত্ব বাড়িয়েই যেত হয়তো একসময়ে শ্রেয়ার সাথে আবরারের বিয়েটাও হয়ে যেত।‌ সবকিছু অন্যরকম হতো, হয়তো ভালো কিংবা খারাপ। যা কিছু হয় ভালোর জন্যই হয়, সবকিছুর পেছনেই কিছু না কিছু কারন থাকে। যেটা হয়তো আমাদের মেনে নিতে কষ্ট হয়, তবে সেইটাই আমাদের জীবনে সুখ নিয়ে আসে।

আবির নিসার স্মৃতি আঁকড়ে ধরেই এতগুলো বছর কাটিয়ে দিল। প্রান সবকিছুই জানে, ওর কাছে কোনকিছুই অজানা না।এতে ওর কোনো আফসোস নেয়, নাজিয়া ওকে মাতৃস্মেহে বড়ো করে তুলেছে ষ, কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি এইটাই কম কি!

আবিরের মা, নাজিয়ার মা বাবা দুজনেই মারা গেছেন। পুরানো প্রজন্ম বলতে একমাত্র আবিরের বাবাই বেঁচে আছেন। উনিও সারাটাদিন নিজের ঘরে বসেই কাটিয়ে দেন, কখনো সখনো প্রানের‌ সাথে আড্ডায় বসেন নিজেদের পুরানো দিনগুলো নিয়ে। প্রান বিষয়গুলো খুব এনজয় করে। আনহাও দাদুর সাথে আড্ডায় বসে, ওর আড্ডার টপিক থাকে আবরার নাজিয়া, আবির নিসার প্রেমকাহিনী। এইগুলো আবার প্রানের ঠিক পোষায় না, তাই দুজন আলাদা আলাদা ভাবে আড্ডায় মেতে উঠে।

——

নাজিয়া ভাবনার মাঝে বলল,
– “এই প্রান আর আনহাকে নিয়ে কি করব বলো তো! দুজন আগে তো এইরকম ছিল না, এখন এইরকম করে কেন?”
– “আমিও তো সেইটাই বুঝি না। দিনকে দিন একে অপরের শত্রু হয়ে উঠছে।”
– “হুমম।”

কিছুদিন আগে পর্যন্ত প্রান ও আনহার মাঝে সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু গত ১বছর যাবত দুইজন দুইজনকে একটুও সহ্য করতে পারে না, একটুতেই ঠোকাঠুকি লেগেই থাকে দুজনের মধ্যে। এটা নিয়ে বড়োদের দুশ্চিন্তার শেষ নেয়। ওরা যে হারে যুদ্ধ শুরু করে তাতে চিন্তা না করে উপায় আছে?

—-

সবাই নিজেদের রুমে চলে গেলেও প্রান ও আনহা থেকে যায়। দুজন দুজনের দিকে ভয়ঙ্কর ভাবে তাকাচ্ছে, ঠিক যেমন দুটো বিড়াল লড়াই করার আগে প্রস্তুতি নেয় ঠিক সেইরকম।

আনহা নিজের কেকের অবশিষ্ট অংশটা হাতের মধ্যে নিয়ে প্রানের সারা মুখে লাগিয়ে দিল, প্রানও কম যায় না আনহার মুখেও কেকের অবশিষ্ট অংশটা লাগিয়ে দিল। বর্তমানে দুজনেই কেক মেখে ভূত। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল।

– “তোকে পুরোই পেত্মী লাগছে।”
– “আর তোমাকে পুরো ভূত লাগছে।”

প্রান ফোন বার করে আনহার কয়েকটা ছবি তুলে নিল,
– ‘এইগুলো তোকে ট্যাগ করে পোষ্ট করব।”

আনহা রেগে কটমট করে তাকাল। ওর কাছে ফোন না থাকায় প্রানের ছবি তুলতে পারল না, নাহলে ওকে মজা দেখাত।

– “আর ক্যাপশন দেব, কেক চুরি করে খেতে গিয়ে ধরা পড়ে যাবার পর অবস্থা।”

আনহা আঙুল উঁচিয়ে বলল,
– “দ্যাখো ভালো হবে না। আমি কিন্তু তোমাকে আনফ্রেন্ড করে ব্লক করে দেব।”

প্রান আনহার আঙুলটাকে ধরে বলল,
– “এই সাহসটা দেখানোর চেষ্টাও করিস না, তাহলে..
– “কি?”

প্রান বাঁকা হেসে বলল,
– “শখের আইডিটাই আর খুঁজে পাবি না।”

আনহা কিছু বলল না, কারন প্রান কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ওর কাছে একটা আইডি হ্যাক করা কিংবা নষ্ট করা কোনো ব্যাপার না। কিন্তু আনহা তো এতটা সহজে ছেড়ে দেবার পাত্রী না, প্রানের পায়ে প্যারা দিয়ে দিল ।

– “আহ্, এইটা তুই কি করলি?”
– “আনহা দূর্বল নয় ওকে।যে আমাকে দূর্বল ভাববে তার অবস্থা এর থেকেও খারাপ হবে মাইন্ড ইট।”

আনহা ভাব নিয়ে চলে গেল, প্রান করুন চোখে নিজের পায়ের দিকে তাকাল। তারপর বিরবির করে বলল,
– “জংলী বিড়াল কোথাকার।”

আনহা নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে লাগল।‌ নিজেকে অসুন্দর কিংবা অপছন্দ করার কোনো কারনই খুঁজে পেল না।
নিজের প্রতিবিম্বের উপর হাত বুলিয়ে বলল,
– “আমাকে কেন এতটা অপছন্দ করো প্রান! আমি তো তোমার প্রতি দূর্বল ছিলাম কিন্তু তুমি কি করলে! আমার দূর্বলতাটাকে ঘৃনায় পরিনত করতে বাধ্য করলে। একসময়ে যাকে আমি নিজের জীবনে চাইতাম, আজ তার সাথেই প্রতিনিয়ত ঝগড়া করি, তার মুখটাও দেখতে চাই না। এইসব তো হবার কথা ছিল না! কিন্তু হয়েছে, তোমার আর আমার মাঝে এখন ‘এক আকাশ দূরত্ব’ যে দূরত্বটা তুমি নিজের হাতে তৈরি করেছ। আর এই দূরত্ব কখনোই মিটবে না…

#সমাপ্ত

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-৩২

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (৩২)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

– “এই নাজিয়া বার্থ সার্টিফিকেটটা দ্যাখ সব ঠিক আছে কিনা।”

নাজিয়া সার্টিফিকেটটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগল। বেবির নাম “আনহা আহমেদ”। নামটা আবরার ঠিক করেছে দুইজনের নাম মিলিয়ে। নাজিয়ার কোনো আপত্তি ছিল নাহ তাই এই নামটাই সার্টিফিকেটে দেওয়া হয়েছে।

প্রান বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
– “বাবা ওইটা কি?”
– “ওটাকে বার্থ সার্টিফিকেট বলে।”
– “বাথ সারফিকেট কি?”
– “তুমি ছোট এইসব বুঝবে না।”

কিন্তু প্রান নাছোড়বান্দা, সে জেনেই ছাড়বে ওইটা আসলে কি। নাজিয়া মৃদু হেসে বলল,
– “প্রান সোনা আমার কাছে আসো। আমি বলছি এইটা কি।”

প্রান ওর বাবার কোল থেকে নেমে নাজিয়ার‌ পাশে বসে পড়ল।

– “বলো।”
– “বার্থ সার্টিফিকেট মানে হলো, যেখানে তোমার বেবি ডলের নাম, জন্মানোর তারিখ লেখা থাকে।”
– “আমারও আছে?”
– “হুমম।”

প্রান চুপ করে কিছু একটা ভাবল তারপর জিজ্ঞেস করল,
– “মাম্মাম মা মানে কি? আমাকে সবাই জিজ্ঞেস করে মায়ের কথা।”
– “তুমি কি বলো?”
– “আমি বলি আমার মা নেই, ওই আকাশের তারা হয়ে গেছে। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করে না সবাই বলে আমি নাকি মিথ্যা বলি, তুমিই নাকি আমার মা। কিন্তু তুমি তো আমার মাম্মাম মা না।”

নাজিয়া প্রানকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল। চোখ ছলছল করছে, আবিরের চোখটা জ্বালাপোড়া করছে। ছেলের মুখে ওইসব শুনে দাঁড়িয়ে থাকার অবস্থাতে থাকল না, নাজিয়ার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

প্রান কিছু বুঝল না, চুপচাপ নাজিয়ার গায়ের সাথে লেপ্টে থাকল। নাজিয়া নিরবে চোখের পানিটা মুছে নিয়ে, প্রানের কপালে চুমু দিয়ে বলল,
– “যখন কেউ তোমাকে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করবে, তখন তুমি বলবে আমার একটা মা আকাশের তারা হয়ে গেছে আর একটা মায়ের কাছে আমি থাকি যাকে আমি মাম্মাম বলে ডাকি।বুঝলে!”
– “তারমানে তুমিও আমার মা?”

নাজিয়াকে আবারো প্রানকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– “হুমম বাবা আমিই তোর মা।”

আবির বিছানায় বসে প্রানের কথাগুলো ভেবে চলেছে। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে, নিজেকে বাবা বলতে ও নিসাকে মা বলতে না শেখালেই হয়তো ভালো হতো। ছেলেটা এইভাবে দ্বিধায় ভুগত না।

আবির নিজের ফোনে নিসার একটা ছবি বার করে বলল,
– “খুব মজায় আছো তাই না! দেখছ ছোট প্রানও নিজের অজান্তে তোমার উপস্থিতি চাইছে, তুমি আমাদের ছেড়ে না গেলেও পারতে…

আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার নেয়, মানুষটা এমন জায়গায় চলে গেছে যেখান থেকে চাইলেও ফেরত নিয়ে আসা যায় না। আবিরের মা চেয়েছিলেন ছেলের একটা গতি করার, আবিরকে পুনরায় বিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলেন। নাজিয়া আবিরের দিকটা বিবেচনা করে ওনার সাথে সহমত প্রকাশ করেছিলেন কিন্তু আবরার একমত হতে পারেনি এই নিয়ে নাজিয়ার সাথে কিছুটা ঝামেলাও লেগেছিল…

– “আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না, তুমি কি বলতে চাইছ দাদা আর একটা বিয়ে করলেই সুখে থাকবে?”
– “সুখে থাকবে এইটার গ্যারান্টি তো দিতে পারব না, তবুও একটা চেষ্টা।”
– “যেখানে গ্যারান্টি দিতে পারবে না, সেখানে কথা বাড়ানোর কোনো দরকার নেয়। আর নাজিয়া তুমি কিভাবে রাজি হচ্ছো আমি সেটাই বুঝতে পারছি না, তুমি তো দাদা ভাবির ভালোবাসার সাক্ষী তাহলে…

নাজিয়া একটা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
– “হ্যাঁ আমি জানি দিদি আর আবিরদা একে অপরকে ঠিক কতটা ভালোবাসত। যেখানে বিয়ের পর বেবিনা হলে সমস্যার তৈরি হয় সেখানে আবিরদা এতগুলো বছর দিদিকে কোনো কথা না বলে, কোনরকমের ঝামেলা না করে সবকিছু মানিয়ে নিয়ে ছিল। দিদির চলে যাওয়াটা আবিরদা এখনো মেনে নিতে পারেনি, এখনো মনে মনে দিদিকেই ভালোবাসে। কিন্তু জীবন তো কোনো গল্প না, যেখানে একা একা সারাটাজীবন কাটিয়ে দেব। প্রতিটা মানুষেরই একটা সঙ্গীর দরকার হয়, আর আবিরদার বয়সই বা কত এখনো গোটা জীবনটা পড়ে আছে। ওনার একটা সঙ্গী দরকার তাই আমি আর মা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আবিরদার বিয়ে করাব।”

– “যা ইচ্ছা তাই করো, তবে আমি কখনোই দাদার পাশে অন্য কাউকে মেনে নিতে পারব না।”
– “আরে তুমি এইরকম বললে দাদাকে রাজি করাব কিভাবে?”
– “সেটা তোমাদের ব্যাপার।”

আবিরকে অনেক চেষ্টা করেও রাজি করানো যায়নি। যদিও এই দায়িত্বটা সম্পূর্ণ আবিরের মায়ের ছিল, নাজিয়া কখনোই আবিরকে দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলতে পারবে না। হ্যাঁ ওহ চায় আবিরের একজন সঙ্গী হোক, কিন্তু নিজের বন্ধুর মতো দিদির জায়গায় অন্য কাউকে মেনে নেওয়াটা খুব একটা সহজ বিষয় নয়। সবটা শুনে বুঝে আবিরের বিয়ে দিতে চাইলেও বেহায়া মন যে সেটা কিছুতেই মানতে চায় না, দিদির সংসার, ভালোবাসার মানুষটার উপরে অন্যকারোর অধিকার বিষয়টা ভাবলেই কিরকম একটা ব্যথা অনুভব হয় বুকের ভেতর। আবার একজন মায়ের চিন্তাকে ফেলে দিতেও পারে না।

আবিরকে রাজি করানোর জন্য ওর‌ মা সবরকমের চেষ্টাই করেছেন কিন্তু ফলাফল ব্যর্থ। আবির সোজাসুজি জানিয়ে দিয়েছিল,

– “যদি কখনো কাউকে দেখে আমার মনে হয়, আমি তার সাথে সারাজীবন থাকতে পারব তখন আমি নিজে এসে তোমার কাছে বিয়ের কথা বলব প্রমিস।”

আবিরের মা হতাশ হয়ে বললেন,
– “সেই দিনটা কি আদৌও আমি দেখতে পারব?”

আবির মৃদু হেসে উত্তর দিল,
– “জানি না।”

নিসাকে ছাড়া আবির বড্ড একা তবে সেই একাকিত্ব দূর করার জন্য নতুন সঙ্গীর প্রয়োজন নেয়, নিসার সাথে কাটানো স্মৃতিগুলোই যথেষ্ট। নিসার স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরে আবির বেঁচে আছে, আর বাকি দিনগুলো এইভাবেই কাটিয়ে দেবে অসুবিধা কি! আর যদি কখনো কাউকে ভালো লেগে যায়, তখন না হয় ভাবা যাবে এখন এইসব বন্ধ থাকুক।

আবির চলে যাবার আগে মায়ের উদ্দেশ্যে একটা কথা বলল,
– “আর একটা কথা, আমাকে সেকেন্ড বার বিয়ে নিয়ে কিছু বললে আমি এই বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হবো।”

আবিরের মা আতকে উঠলেন, ছেলে এইসব কি বলে?

– “কোথায় যাবি তুই?”
– “বিদেশ চলে যাবো, আর ফিরব না।”

আবিরের মা আর সাহস করেননি ছেলেকে ঘাটানোর। ওনার ছেলেরা বড্ড জেদি, জেদের বশে কিছু একটা সিদ্ধান্ত নিলে সেটার পরির্বতন হয় না। উনি শেষবয়সে ছেলেদের ছেড়ে থাকতে চাননা, তাই চুপ করে গেলেন।

তারপর থেকে বাড়িতে আবিরের বিয়ে নিয়ে কোনরকমের কথা উঠেনি। এতে আবির আবরার দুজনেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে।

প্রান নাজিয়া বুকে থাকতে থাকতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। নাজিয়া ওকে শুইয়ে দিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই শ্রেয়ার ফোন ঢুকল।

– “কেমন আছো?”
– “এইতো চলছে, তোমার।”
– “হুমম ভালো। বেবি কেমন আছে?”
– “ভালো।”
– “আবরার, আবিরদা, প্রান, মামনি সব কোথায়।”
– “আবরার অফিসে, আবির‌দা, মামনি রুমে আছে আর প্রান এইমাত্র ঘুমাল। তোমাদের পুঁচকে টা কেমন আছে কি করছে?”
– “ওর বাবার কাছে আছে। বাবা গো কি দুষ্টু হয়েছে কি বলব।”
– “বাচ্চারা একটু হয়।”
– “আমাদের প্রান কিন্তু গুড বয় বলো।”
– “হ্যাঁ, সে আর বলতে।”

নাজিয়া ও শ্রেয়া গল্প করতে লাগল। শ্রেয়া ও শান্তর ছেলে শাওন ৩বছরের। প্রচন্ড দুষ্টু, সারাটাদিন ওর পেছনেই ছুটতে ছুটতে শ্রেয়া শেষ।

দুজনে কথা বলার একটা পর্যায়ে শ্রেয়া বলল,
– “আজ একটু শপিং করতে গিয়েছিলাম, সেখানে হাসিবের সাথে দেখা হয়েছিল।”
– “ওহ্।”
– “জানো তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল, আমি বললাম তোমার মেয়ে হয়েছে তারপর ওহ কিছু না বলেই চলে গেল। কেসটা ঠিক বুঝলাম না।”
– “বাদ দাও তো। আচ্ছা হাসিব বিয়ে করেছে?”
– “না।ওকে বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করতে ওহ হেসে বলল, ‘যাকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম সে অন্যকারোর ছিল তাই আর বিয়ে করা হয়নি।’ জানো কথাটা শুনে খুব অবাক হয়েছিলাম, ওর মতো ছেলেও কাউকে ভালোবেসেছে আর তারজন্য এখনো বিয়েও করেনি!”

নাজিয়ার অস্বস্তি হচ্ছে। শ্রেয়া কথাগুলো না বুঝলেও ওর কাছে কোনো কিছুই অস্পষ্ট নয়। হাসিব যে ওর কথাই বলেছে সেটা শিওর, নাজিয়ার ভীষন মায়া হলো মনে মনে ভাবল,
– “আমরা সবসময়ে ভুল জিনিসটাকেই আমাদের জীবনে বেছে নিই, তারজন্য আমাদের আজীবন আফসোস করতে হয়।”

কয়েকদিন অফিসে না যাবার জন্য আবরারের অনেক কাজ জমা হয়ে গিয়েছিল, সেইগুলো করতে গিয়ে ফিরতে অনেকটা রাত হয়ে গেছে। আবিরের মা নাজিয়াকে জোর করে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছেন আর নিজে আবরারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।

সারাটাদিন খাটুনির পর বাড়ি ফিরে প্রিয় মানুষটার দেখা সকলেরই আশায় থাকে। আবরারও নাজিয়াকে আশা করছিল কিন্তু মাকে দেখে কিছুটা অবাক হলো।

– “মা তুমি?”
– “হুমম। নাজিয়ার এইসময়ে বেশি রাতজাগা ঠিক না, তাই ওকে খাইয়ে ঘুম দিয়ে দিয়েছি। তুই ফ্রেশ হয়ে আয়, একসাথে খাবো।”

আবরার কাজের চাপে একপ্রকার ভুলতেই বসেছিল নাজিয়া অসুস্থ। তাই তো দরজায় ওকে আশা করে বসেছিল। আবরার নিজের ঘরে ঢুকতে চোখটা আটকে গেল বিছানায়। দুইদিকে দুইজনকে নিয়ে নাজিয়া ঘুমাচ্ছে, আবরার মৃদু হাসল। জীবন সুন্দর।

#চলবে…

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-৩১

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (৩১)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

রাত ১০টা। হঠাৎ করেই নাজিয়ার পেইন শুরু হয়, যন্ত্রনায় এদিক ওদিক করতে থাকে। আবরার ল্যাপটপে অফিসের কিছু কাজ করছিল, নাজিয়াকে উশখুশ করতে দেখে ওর কাছে গিয়ে দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,

– “কি হয়েছে নাজু, ইউ ওকে?”

নাজিয়া কথা বলার মতো অবস্থায় নেই, যন্ত্রনায় চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। আবরারের হাতটাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে কোনমতে আটকে আটকে বলল,
– “আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।”

আবরার ঢোক গিলল। নাজিয়ার এই অবস্থা দেখে নিজের কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। নিজেকে কোনোরকমে সামলে আবিরের নম্বরে কল দিল। আবির সবেমাত্র অফিস থেকে ফিরে বিছানায় গা এলিয়েছে, বাড়িতে থেকে আবরারের ফোন পেয়ে কিছুটা অবাক হলো। ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই আবরার বলল,

– “দাদা তাড়াতাড়ি আমাদের ঘরে আয়, নাজিয়ার পেইন উঠেছে।”

আবির কোনরকমে বিছানা থেকে উঠে আবরারের ঘরের দিকে দৌড় দিল। নাজিয়া আবরারের হাতটাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে, আবির আবরারকে বলল,

– “আমি গাড়ি বার করছি, তুই নাজু’কে নিয়ে এখুনি আয়। আমাদের হসপিটালে যেতে হবে।”
– “হুমম।”

আবির যেতে গিয়েও কিছু একটা ভেবে দাঁড়িয়ে পড়ল। পেছন ফিরে আবরারকে বলল,
– “তুই উঠ, মাকে গিয়ে বল আমরা হসপিটালে যাবো। তারপর গাড়ি বার কর, আমি নাজু’কে নিয়ে যাচ্ছি।”

আবরার ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। নাজিয়ার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেল। আবির নাজিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
– “আর একটু ধৈর্য ধর। আল্লাহ তায়ালা কে ডাক সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”

নাজিয়া কিছু বলতে পারল না, চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। আবিরের সেই বীভৎস দিনের কথা মনে পড়ছে বারবার, বাচ্চা প্রসবের সময়েই নিসাকে হারিয়েছে। আবির নাজিয়াকে হারাতে চায় না, বারবার দোয়া করছে যাতে নাজিয়া ও বেবি দুজনেই সুস্থ থাকে।

আবরার এলোমেলো ভাবে মায়ের ঘরে ঢুকল। ওকে এইভাবে দেখে মা ও বাবা দুজনেই চমকে উঠলেন। মা আবরারের কাছে গিয়ে বলল,

– “আবরার বাবা কি হয়েছে? তোকে এইরকম লাগছে কেন!”

আবরার নিজের কান্না কোনোরকমে আটকে রেখে, মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– “মা নাজিয়ার পেইন উঠেছে। আমরা হসপিটালে যাচ্ছি, দোয়া করো।”

আবরার আর কিছু বলতে পারল না, চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। আবিরের মা আতকে উঠলেন, নাজিয়ার প্রেগন্যান্সি নিয়ে সবাই স্বাভাবিক ভাব করলেও নিসার ব্যাপারটার পর থেকে সবার কাছেই ওইটা একটা আতকের ব্যাপার। মনে মনে আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করেন বললেন,

– “আল্লাহ তুমি নাজিয়াকে সুস্থ রেখো। ওর কিছু হলে আমার আবরার শেষ হয়ে যাবে।”

আবিরের মা নাজিয়ার সাথে আবরারের বিয়ে হবার পর বুঝেছিলেন, ওরা একে অপরকে ঠিক কতটা ভালোবাসে। আবরার নাজিয়া একে অন্যকে ছাড়া অসম্পূর্ণ।

আবরার মা-বাবার কাছে দোয়া চেয়ে গাড়ি বের করতে চলে গেল। আবিরের মা নাজিয়ার ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই আবির নাজিয়াকে নিয়ে চলে আসে। আবির যাবার আগে বলে,

– “মা আমরা গেলাম দোয়া করো। আর প্রানকে দেখে রেখো।”

রাতটা সকলের কাছেই আতঙ্কের। জায়নামাজে দাঁড়িয়ে সকলের একটাই দোয়া নাজিয়া ও বেবি দুজনেই যেন সুস্থ থাকে। আবির নিজেকে সামলে আবরারকে সামলাতে ব্যস্ত। ছেলেটা বড্ড ভেঙে পড়েছে।

রাত পেরিয়ে ভোর হলো। ফজরের আযান দিচ্ছে, তখন এক নার্স এসে বলল,
– “কনগ্রাচুলেশন, আপনাদের প্রেসেন্টের মেয়ে হয়েছে।”

আবরার বসা থেকে উঠে জিজ্ঞেস করল,
– “আমার ওয়াইফ কেমন আছেন?”
– “উনিও সুস্থ আছেন, চিন্তার কিছু নেয়।”

আবির ও আবরার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আবির নিজের মা ও নাজিয়ার মাকে ফোন করে খুশির খবরটা জানিয়ে দিল। আবরার তখনও চুপচাপ বেঞ্চে বসে আছে, অনুভূতিটা’কে কিভাবে নেবে সেটাই বুঝতে পারছে না।

আবিরের খেয়াল হলো, ইসলাম ধর্ম অনুসারে সদ্য জন্মানো বাচ্চার কানে আযান দিতে হয়। আবির নার্সকে বলে বেবিকে নিয়ে আসতে বলল, তারপর ছোট সোনাটার কানে আযান দিয়ে আবরারের কোলে তুলে দিল।

– “মেয়েকে কোলে নিয়ে দ্যাখ, কেমন হয়েছে।”

আবরার কাঁপা হাতে ছোট পুতুলটাকে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরল। ছোট ছোট হাত-পা, আবরার মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বলল,

– “মাকে অনেক কষ্ট দিয়েছ, আর দিও না কেমন। একদম গুড গার্ল হবে কিন্তু।”

আবির‌ ফিক করে হেসে দিল আবরারের বাচ্চা বাচ্চা কথায়। ছেলেটা এখনো বড়ো হলো না।আবরার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল।আর‌ আবির চারিদিকে ছোটাছুটি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

সকাল না হতে হতেই হসপিটালে সবাই হাজির। প্রান ঘুম থেকে ওঠা থেকে মাম্মামের কাছে যাবার বায়না করেই চলেছে, বাধ্য হয়েই ওকে সঙ্গে নিয়ে আসতে হয়েছে। সবাই নাজিয়ার মেয়েকে আদর করতে ব্যস্ত, তখন প্রান ব্যস্ত নাজিয়াকে নিয়ে। নাজিয়ার সারামুখে চুমু দিয়ে বলল,

– “মাম্মাম তুমি এখানে কেন? জানো আমি যখন তোমাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না তখন কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
– “আমি এখানে তো একটা প্রিন্সেসকে আনতে এসেছি।”
– “প্রিন্সেস! কোন প্রিন্সেস মাম্মাম?”

নাজিয়া মুচকি হেসে ওর মায়ের কোল থেকে ছোট প্রিন্সেসকে নিয়ে বলল,
– “এই সেই প্রিন্সেস। লিটল প্রিন্সেস।”

প্রান চোখ গোল গোল করে তাকাল। ওর কাছে সদ্য জন্মানো বেবীটাকে পুতুলের মতো লাগল,
– “বেবি ডল।”

নাজিয়া হেসে দিল। ছেলের প্রিন্সেস নামটা পছন্দ হয়নি, তাই নিজেই নাম দিয়ে দিল বেবি ডল।

– “মাম্মাম আমাকে দাও না বেবি ডলকে।”
– “আচ্ছা তুমি বসো একটুও নড়াচড়া করবে না কিন্তু। আমি বোনকে দিচ্ছি।”

প্রান বুঝল না, তাই ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
– “বোন কে?”
– “এই তো বোন।”
– “নাহ এইটা আমার বেবিডল।”
– “আচ্ছা তাই বেবি ডল, এখন চুপ করে বসো‌ আমি কোলে দিচ্ছি।”

বেবিটাকে প্রানের কোলে দিতেই বেচারী কেঁদে উঠল। প্রানের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়, বেবি ডল এইরকম করল কেন?

– “মাম্মাম বেবি ডল আমার কোলে এসে কাঁদল কেন? ওর কি আমাকে ভালো লাগেনি!”
– “না বাবা সেইরকম কিছু না। ওহ ছোট তো তাই এইরকম কাঁদছে।”

প্রান মুখটা কালে করে বলল,
– “ওহ।”

যেহেতু নাজিয়ার নরমাল ডেলিভারি হয়েছে তাই ২দিন পরেই রিলিজ করে দিলো। নাজিয়ার মা ওকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু আবিরের‌ মা রাজি হননি। উনি ওনার নাতনী, বউমাকে ছেড়ে কিছুতেই থাকবেন না অগত্যা নাজিয়ার মা মেয়ের কাছে কিছুদিন থাকার সিদ্ধান্ত নেন।

নাজিয়া বিছানায় আধশোয়া হয়ে মেয়েকে ঘুম পাড়াচ্ছে, আর তার পাশে বসে প্রান ওদেরকে দেখছে।

– “কি দেখছ?”
– “দেখছি তুমি বেশি সুন্দর না বেবি ডল বেশি সুন্দর।”
– “তা কি দেখলে?”

প্রান কিছুক্ষণ ভাবার ভান করে বলল,
– “আমার মাম্মাম ইজ বেস্ট।”

নাজিয়া মুচকি হাসল, প্রানের মুখেও হাসি। সেইসময়ে আবির নাজিয়ার সাথে দেখা করতে এসেছিল, মূহুর্তটা দেখে থমকে দাঁড়াল। মা ও দুই সন্তানের সুন্দর মুহূর্তটা চোখ ভরে দেখল। নিসা বেঁচে থাকলে ওর জীবনটাও এইরকম সুন্দর সাজানো গোছানো হতো কিন্তু আফসোস তার কিছুই হয়নি।

প্রানের চোখ পড়ে আবিরের দিকে, বিছানা থেকে উঠে বাবা বলে দৌড়ে কোলে উঠে পড়ে। প্রান আবিরকে বাবা বলেই ডাকে, নাজিয়া ও আবরার প্রানকে নিজের সন্তানের মতো বড়ো করে তুললেও আবির কিংবা নিসাকে নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চায়নি। তাই ছোট থেকে নাজিয়াকে মাম্মাম, আবরারকে পাপা, আবিরকে বাবা এবং নিসাকে মা বলতে শিখিয়েছি। ওরা কেউই চায়না, প্রান নিজের পরিচয় নিয়ে সংকোচে থাকুক। ওরও জানার অধিকার আছে ওর মা বাবা কে। যখন ক্লাসে ওকে কেউ ওর বাবা মা কথা জিজ্ঞেস করে উত্তরে ওহ বলে,
– “আমার বাবা আছে, মা নেই। কিন্তু আমার পাপা, মাম্মাম আছে।”

ছোট প্রান এখনো বোঝে না মা বাবা কাকে বলে, কাদের বলে।এখন নাজিয়া ও আবরারকে ছাড়া কিছুই বোঝে না কিন্তু যেদিন বড়ো হয়ে যাবে সেদিনও কি নাজিয়া ও আবরারের প্রতি একই ভালোবাসা থাকবে?

#চলবে…

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-৩০

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (৩০)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

কয়েকদিন থেকে নাজিয়ার শরীরটা বড্ড খারাপ, কিছুই খেতে পারছে না, আর খেলেও বমি বমি লাগছে। প্রানকে স্কুলের জন্য রেডি করাতে করাতে নাজিয়ার বমি বমি ভাব লাগে দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে যেতে প্রানও পেছন পেছন যায়।

– “মাম্মাম তোমার কি হয়েছে!”

নাজিয়া কিছু বলতে পারে না তার আগেই গড়গড় করে বমি করে দেয়। ৫বছরের প্রান প্রচন্ড ভয় পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাইরে চলে আসে।

আবিরের মা প্রানকে কাঁদতে কাঁদতে আসতে দেখে চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
– “কি রে কাঁদছিস কেন?”
– “দিদুন মাম্মামের শরীর খারাপ বমি করছে তুমি তাড়াতাড়ি চলো।”

প্রানের কথা শুনে আবিরের মা দ্রুত নাজিয়ার ঘরে আসেন। বমি করার পর নাজিয়ার শরীর অনেকটা নেতিয়ে পড়েছে, উনি ওর চোখেমুখে পানি দিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলেন। অভিজ্ঞ চোখে কিছু একটা আন্দাজ করতে পারছে তবে নাতির সামনে কিছু বললেন না।

– “তুই বিছানায় শুয়ে রেস্ট নে, উঠার দরকার নেয় ওদিকটা আমি সামলে নেব।”
– “কিন্তু মামনি!”
– “কোনো কিন্তু না, চুপচাপ শুয়ে থাক।আর প্রান তুই তোর মাম্মামের কাছে থাক, দেখবি বিছানা থেকে না উঠে।”

প্রান ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। আবিরের মা ঘর থেকে চলে যেতে প্রান নাজিয়াকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।

– “কি হয়েছে আমার প্রানের! কাঁদছ কেন?”
– “তোমার কষ্ট হচ্ছিল তাই না!”
– “না বাবা কিছু হয়নি। তুমি কান্না থামাও নাহলে কিন্তু মাম্মামের সত্যি সত্যি কষ্ট হবে এইবার।”

প্রান চটপট কান্না থামিয়ে চোখ মুছে বলল,
– “না আমি কান্না থামিয়েছি।”

নাজিয়া ছেলের কান্ডে ফিক করে হেসে ফেলল। প্রান শান্তশিষ্ট একটা বাচ্চা যদিও দুষ্টুমি করে তবে নাজিয়ার খুব বাধ্য ছেলে।

সন্ধ্যায় আবরার অফিস থেকে ফিরলে আবিরের মা বললেন,
– “কাল নাজিয়াকে নিয়ে একবার ডাক্তারের কাছে যাস তো।”
– “কেন? ওহ ঠিক আছে তো!”
– “হুমম, সেটা দেখার জন্যই যেতে বলেছি।”

আবরার ওনার কথা না শুনে দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকল। তখন নাজিয়া প্রানকে পড়াচ্ছে। নাজিয়াকে সুস্থ দেখে কিছুটা স্বস্তি পেল।

– “প্রান।”

প্রান দৌড়ে আবরারের কোলে উঠে যায়।
– “বাবাই।”

আবরার প্রানের গালে চুমু দিয়ে বলল,
– “একটু দিদুনের কাছে যাও তো সোনা, মাম্মামের সাথে আমার একটু দরকার আছে।”

প্রান বাধ্য ছেলের মতো ঘর ছাড়তে আবরার নাজিয়ার পাশে বসে বলল,
– “শরীর ঠিক আছে তো!”
– “হুমম।”
– “সত্যি করে বলো! মা কেন কাল ডক্টরের কাছে যেতে বলল?”
– “একটু বমি হয়েছে, হয়তো অ্যাসিডিটি হয়ে গিয়েছিল।”

আবরার কিছু না বলে নাজিয়াকে জড়িয়ে ধরল। বিয়ের ৫বছরে আবরারের ভালোবাসার কোনরকমের পরির্বতন হয়নি, উল্টে ভালোবাসা আরো বেড়েছে, পাগলামী বেড়েছে। এককথায় আবরার নাজিয়াকে এখনো চোখে হারায়।

পরেরদিন,
আবরার নাজিয়াকে নিয়ে একজন মহিলা ডক্টরের কাছে এসেছে। নাজিয়া আসতে চাইছিল না, শাশুড়িমা জোর করে পাঠিয়েছেন এমনকি কোন ডক্টরের কাছে যাবে এটা উনিই ঠিক করে দিয়েছেন।

নাজিয়া একাই ভেতরে ডক্টরের সাথে কথা বলছে, আবরারকে বাইরে বসতে বলা হয়েছে।নাজিয়া ডক্টরের কাছে গিয়ে নিজের সমস্যাগুলো বলার পর উনি জিজ্ঞেস করলেন,
– “আপনার পিরিয়ড নিয়মিত হচ্ছে?”
– “নাহ, কয়েকমাস একটু প্রবলেম হচ্ছে।”
– ” আপনাদের বিয়ে কতদিন হলো।”
– “৫বছর।”

ডক্টর কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
– “বিয়ের এতবছর হয়ে গেছে আপনারা বেবি নেননি কেন?”

নাজিয়া উশখুশ করে বলল,
– “একচুয়ালী ডক্টর…
– “পার্সোনাল কিছু?”
– “না আসলে আমার বোন মারা যাবার পর তার ছেলেকে আমি মানুষ করতে শুরু করি। তার কেয়ারের জন্য আমরা বেবি নিইনি।”

ডক্টর কিছুটা চিন্তিত স্বরে বললেন,
– “তাহলে হয়তো আপনার জন্য বিষয়টা একটু রিস্কের আছে।”
– “কেন ডক্টর?”
– “আপনি প্রেগন্যান্ট।”

নাজিয়া চমকে উঠল। একটা মেয়ের প্রেগন্যান্সির খবরটা তার জন্য কতটা আনন্দের সেটা একমাত্র সেই জানে। নাজিয়ার মুখের এক্সপ্রেশন দেখে ডক্টর আর কিছুই বলতে পারল না, একজন মেয়ে হয়ে তার বুঝতে অসুবিধা হলো না নাজিয়ার অনুভূতিটা।

ডক্টর একজনকে বলল আবরারকে ভেতরে পাঠানোর জন্য। আবরার ভেতরে আসতে ডক্টর মৃদু হেসে বলল,
– “কনগ্রাচুলেশন মিস্টার। আপনি বাবা হতে চলেছেন।”

সেইম একই অনুভূতি আবরারেরও কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর দিনের কথা মনে‌ পড়তেই আবরার আঁতকে উঠল। নাজিয়ার হাসিমাখা মুখের দিকে তাকাতেই ওর বুকটা ধ্বক করে উঠছে। হাসিমাখা মুখটায় হঠাৎ অমাবস্যার ঘন কালো মেঘ দেখে ডক্টর কিছূটা অবাক হলেন,
– “কি হলো মিষ্টার! আপনি খুশি হননি?”

আবরার ঢোক গিলল, একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে। ওহ কিছুতেই নাজিয়াকে হারাতে চাইনা।

– “ডক্টর আমরা বেবি চাই না।”

নাজিয়া ও ডক্টর দুজনেই চমকে উঠলেন। সদ্য পিতা হবার সংবাদ পেয়ে কোনো বাবা যে এইরকম সিদ্ধান্ত নিতে পারে এইটা ওনার ধারনার বাইরে ছিল। আবরারের প্রতি ওনার ক্ষোভের সৃষ্টি হলো।

– “আপনি এইসব কি বলছেন? ভেবে বলছেন তো!”

নাজিয়া এখনো শকের মধ্যে আছে, একটার পর একটা ধাক্কা সামলাতে কষ্টকর হয়ে উঠেছে। একটু আগে মা হবার খবর পেয়ে খত খুশি ছিল আর এখন আবরার এইসব কি বলছে!

আবরার নিজের জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
– “আমি ভেবেচিন্তেই বলছি।”

নাজিয়া ফুঁসে উঠল,
– “এই তুমি এইসব কি বলছো! আমাদের প্রথম সন্তান আসছে আর তুমি বলছো ওকে আমাদের চাইনা! পাগল হয়ে গেছো তুমি?”

– “হ্যাঁ পাগল হয়ে গেছি। একটা সন্তানের জন্য আমি ভাবির মতো তোমাকে হারাতে দিতে পারব না।দাদার মতো জীবন আমার চাই না। আমার তোমাকে চাই।”

নাজিয়া আর কিছু বলতে পারল না, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ডক্টর কিছুই বুঝতে পারছে না, একবার নাজিয়া আর একবার আবরারের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। আবরারের চোখের কোনে পানির উপস্থিতি জানান দিচ্ছে নাজিয়ার প্রতি ভালোবাসা ঠিক কতটা।

– “আপনারা প্লিজ শান্ত হন। অসুবিধা না থাকলে আমার সাথে সবটা শেয়ার করতে পারেন।”

আবরার কিছু বলল না।‌ নাজিয়া কান্না থামিয়ে বলল,

– “আমার দিদি আর ওর দাদা হাসবেন্ড ওয়াইফ। ডেলিভারির সময়ে দিদি মারা যায়, সেই কারনে ওহ আমাকে বেবি নিতে দিতে চাই না।”

ডক্টর অবাক হলেন। এখনকার যুগে যেখানে বাচ্চা না হলে পরিবারের অশান্তি হয় সেখানে স্ত্রীর লাইফ রিস্ক আছে বলে বেবি নিতে চাইছে না, এইরকম ভালোবাসা পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার।

– “দেখুন মিষ্টার জন্ম মৃত্যু বিধাতার হাতে লেখা। আপনি আপনার স্ত্রীর লাইফ রিস্কের জন্য বেবি নিতে চাইছেন না, বেবিটাকে ন’ষ্ট করে দিতে চাইছেন। বাবা হয়ে সন্তানকে শে’ষ করে দিতে আপনার কষ্ট হবে না!”

আবরার উত্তর না দিয়ে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে দিল। বাবা হবে শুনে কতটা খুশি হয়েছে সেটা কাউকে বোঝাতে পারবে না, কিন্তু ওহ নাজিয়ার লাইফ রিস্ক নিতে চাই না।

– “উপরওয়ালার উপর বিশ্বাস রাখুন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।বাড়ি যান, স্ত্রীর ঠিকমতো যত্ন নিন ইনশাআল্লাহ্ আপনার স্ত্রী সন্তান উভয়েই সুস্থ থাকবে।”
– “আসছি।”

আবরার নাজিয়াকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ডক্টর মনে মনে ওদের জন্য দোয়া করলেন, ওনার কাছে অনেক প্রেসেন্টই আসেন তবে আবরার ও নাজিয়ার মতো কাপল জীবনে খুবই কম দেখেছেন। ভালো থাকুক আবরার, নাজিয়া ও ওদের সন্তান।

আবরার নাজিয়াকে নিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় আসে। দুজন দুজনকে অনেককিছুই বলতে চাইছে কিন্তু অদৃশ্য দেয়াল বারবার আটকে দিচ্ছে। আবরার অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করার পর সমস্ত দেয়াল সরিয়ে নাজিয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। নাজিয়াও আঁকড়ে ধরল আবরারের শার্ট। বেশকিছুক্ষন সময় কেটে যাবার পর নাজিয়া নিজের ঘাড়ে পানির অস্তিত্ব অনুভব করল, বুঝতে অসুবিধা হলো না আবরার কাঁদছে।

– “সরি নাজিয়া। জানি তুমি আমার কথা শুনে কষ্ট পেয়েছে। জানো যখন শুনলাম আমি বাবা হবো, ঠিক কতটা খুশি হয়েছি বোঝাতে পারব না। কিন্তু যখনি সেই বীভৎস দিনের কথা মনে পড়ে যায় আমার‌ সাহস হয়নি তোমাকে ওই অবস্থায় দেখার, তাই হুট করে ওই কথা বলে ফেলেছি প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও। কথা দিচ্ছি আমি থাকতে তোমার আর আমাদের সন্তানের কিছু হবে না।”

আবরার ওর নিজের কথা রেখেছে। ৯টা মাস নাজিয়ার আদর যত্নের কোনো অভাব হয়নি। দুটো মা, দুটো বাবা, দাদা, স্বামী সবার আদর যত্নে আছে নাজিয়া ও নাজিয়ার অনাগত সন্তান। আবরার নাজিয়ার সামনে নিজেকে খুব শক্ত দেখায় কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রতিনিয়ত টেনশান করে চলেছে, উপরওয়ালার কাছে প্রতিনিয়ত নাজিয়া ও সন্তানের সুস্থতা কামনা করছে।

#চলবে…

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-২৯

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (২৯)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

– “আপনি!”

হাসিব মৃদু হেসে ওদের দিকে আগিয়ে গেল। নাজিয়া ও শ্রেয়া একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে, হাসিবের আগমন কেউই আশা করেনি।

– “অবাক হলে‌ আমাকে দেখে! অবাক হবারই কথা, আসলে আমিই বিনা নেমন্তন্নে চলে এসেছি।”

বিনা নেমন্তন্নে‌ চলে এসেছে! নাজিয়া ও শ্রেয়ার বিস্ময়ে মাত্রা আরো কিছুটা বাড়ল, হাসিব এইখানে কেন এসেছে! আবার কিছু ঝামেলা করবে না তো!

ওদের মনোভাব বুঝতে পেরে‌ হাসিব মৃদু হেসে বলল,
– “ভয় পাবার কিছু নেই। একজনের কথাতে ভেতরের ভালো মানুষটাকে বদলে ফেলে আবার খারাপ মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি।”

নাজিয়ার ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি ফুটে উঠল, শ্রেয়া অবাক চোখে হাসিবের দিকে তাকিয়ে আছে। হাসিব শ্রেয়ার হাতে গিফটের একটা প্যাকেট দিয়ে বলল,
– “আমার তরফ থেকে ছোট একটা উপহার, আর নতুন জীবনের শুভেচ্ছা রইল দোয়া করি ভালো থেকো।”

শ্রেয়া গিফটটা নিয়ে মৃদু হাসল। হাসিব নাজিয়ার হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বলল,
– “এটা তোমার জন্য, সুখে থেকো আজীবন।”

নাজিয়া হাসিবের দিকে তাকাল, দুজনের চোখাচোখি হলো। হাসিবের চোখে নাজিয়া স্পষ্ট কিছু দেখতে পাচ্ছে যেটা ওর জন্য নিষিদ্ধ। নাজিয়া তাড়াতাড়ি নিজের চোখটা সরিয়ে নিল, হাসিব ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
– “আসছি ভালো থেকো।”

হাসিব চলে গেল।‌নাজিয়া ও শ্রেয়া অন্য গেস্টদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। হাসিব যাবার পথে পেছনে ফিরে নাজিয়ার হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল,
– “তোমার হাসির কারন হতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। তোমার দুঃখের কারন হয়ে নিজেকে অপরাধী বানাতে চাই না। আমার জীবন সবটুকু সুখ উপরওয়ালা তোমাকে দিক, ভালো থেকো নাজিয়া।”

—–

অবশেষে সেই ক্ষন। আবরার-নাজিয়া ও শান্ত -শ্রেয়া মুখোমুখি বসে আছে কিন্তু মাঝখানে চাদর টানা। দুই ছেলেই একেবারে ভদ্র হয়ে আছে, বউদের দেখার কোনরকমের চেষ্টা করছে না। শ্রেয়া একটু নার্ভাস হয়ে আছে সেইজন্য নাজিয়া ওর হাতটাকে শক্ত করে ধরে বসে আছে।

কাজিসাহেব প্রথমে শ্রেয়া ও শান্তর বিয়ে পড়াতে শুরু করলেন। শ্রেয়াকে কবুল বলতে বলার সময়ে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল হেনা ও ওর‌ টিম।

– “শান্ত’দা আমাদের দাবি না মানলে শ্রেয়া’দি কবুল বলবে না।”

আবির ওদেরকে ধমক দিয়ে বলল,
– “এই এখন সর, আগে বিয়েটা মিটুক তারপর সব হিসাব নিকাশ করবি।”

ধমক খেয়ে হেনা ও ওর টিম মুখটাকে কাঁচুমাচু করে ফেলে, এখন বেশি বাড়াবাড়ি করতে যাওয়া মানেই বড়োদের কাছে ধমক খাওয়া তাই চুপ থাকাটাই শ্রেয়।

শান্ত ও শ্রেয়ার বিয়ে পড়ানোর পর, দ্বিতীয়বারের মতো নাজিয়া ও আবরারের বিয়ে পড়ানো হয়। অনেক ঝড় পেরিয়ে শান্ত ও শ্রেয়া একে অপরের সঙ্গে বেঁধে যায়, ভালো থাকুক ভালোবাসার।

বিয়ের সময়ে বড়ো অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে পেরে হেনার টিমের মাথায় আরো কিছু শয়তানি বুদ্ধি চলছে। অনুষ্ঠান শেষ হবার পর বাসর রাতের জন্য শ্রেয়া ও নাজিয়াকে নিজেদের ঘরে রেখে দিয়ে আসে। শান্ত নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই ওর উপর আক্রমন হয় হেনা ও ওর সঙ্গপাঙ্গদের।

– “জিজু এখুনি ২০হাজার টাকা দাও, নাহলে এইখানে দাঁড়িয়ে রাত কাটাও।”
– “দ্যাখো শ্যালিকারা আমি গরীব মানুষ এত টাকা কোথায় পাবো!”
– “নাটক কম করে তাড়াতাড়ি দিয়ে দে।”

কন্ঠস্বরের মালিককে দেখে সবার‌ চোখ কপালে। আবরার! শান্ত অবাক হয়ে বলল,
– “আবরার তুই?”
– “হ্যাঁ। তোর বউ আমার থেকে টাকা হাতিয়েছিল, এখন আমি তোর থেকে হাতাব।”
– “তুই না আমার বন্ধু! আর বন্ধু হয়ে এইরকম করবি?”
– “এখন আমি তোর শ্যালক। তাই আমাকে আমার প্রাপ্যটা বুঝিয়ে দে।”

শান্ত বুঝল এদের থেকে ছাড় পাওয়া কষ্টের বিষয়। কিন্তু এতগুলো টাকা ওর কাছে এখন নেয়।

– “এতোগুলো টাকা আমার কাছে নেই তো।”
– “তোর কার্ডটা আমার কাছে জমা দে, যখন টাকা দিবি তখন কার্ড পাবি।”

শান্ত ভাবল আবরার ওকে বাঁচানোর জন্য এইরকম করছে, তাই খুশিমনে কার্ডটা আবরারের হাতে দিয়ে দিল। আবরার শয়তানি হেসে বলল,
– “টাকা না দেওয়া পর্যন্ত কার্ড আমার, ওই তোরা ওকে ছেড়ে দে।”

শান্তকে ছেড়ে দিল কিন্তু আবরারকে কি আদৌও ছাড়বে!
হেনা কোমড়ে হাত দিয়ে বলল,
– “খবরদার আমাদের সাথে চালাকি করার চেষ্টা করবে না, ফলটা কিন্তু ভালো হবে না।”

আবরার ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিতেই ওদের টনক নড়ল।

– “এই আবরার’দা তো চলে গেল সবকিছু নিয়ে।না পেলাম শান্তদার টাকা আর না আবরার’দার টাকা।”

এতবড়ো ধোঁকাবাজী! হেনা রাগে গজগজ করতে করতে চলে যায়, বাকিরাও ভীষন ক্ষেপে গেছে আবরারের উপর। সুযোগ পেলে বেচারার খবর আছে।

আগামীকাল বৌভাতের অনুষ্ঠান, তারপরের দিন মেয়েরা নিজেদের বাপের বাড়ি ফিরবে আর বাকিরাও নিজেদের বাড়ি চলে যাবে।

শ্রেয়া শান্তকে সালাম করতে গেলে শান্ত সালাম করতে দেয়নি, কারন ইসলামে পা ছুঁয়ে সালাম করা নিষিদ্ধ। শ্রেয়াকে নিজের বুকে আগলে নিয়ে বলল,
– “স্ত্রীর স্থান স্বামীর হৃদয়ে। আর পা ছুঁয়ে সালাম করতে নেয় এইটা জানো না!”
– “হুমম ভুল হয়ে গেছে।”

শান্ত শ্রেয়ার কপালে ভালোবাসার চুম্বন দিয়ে বলল,
– “ভুলগুলো শুধরে নেবার দায়িত্ব নিলাম আমি, কথা দিলাম আমাদের মাঝে কখনো ভুল বোঝাবুঝি আসতে দেব না। সবসময়ে আগলে রাখব।”

শ্রেয়া শক্ত করে জড়িয়ে ধরল শান্তকে। অনেকটা লড়াই করার পর শান্তকে নিজের করে পেয়েছে, কখনোই হারাতে চায় না। শান্তও শ্রেয়াকে আগলে নিয়ে বলল,

– “তোমার সাথে মিশে যেতে চাই, দেবে কি সেই অধিকার।”

শ্রেয়ার সম্মতি পেয়ে শান্ত আর অপেক্ষা করল না। ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে দিতে থাকল ভালোবাসার মানুষটিকে। ভালো থাকুক শান্ত ও শ্রেয়া।

অন্যদিকে, বিয়ের শাড়ি, সাজগোজ পাল্টে সাধারন একটা সুতির শাড়ি পড়ে নাজিয়া বিছানায় বসে ঢুলছে। নাজিয়ার অবস্থা দেখে আবরারের চোখ কপালে, বউকে বউ সাজে দেখবে তা না বউ গিন্নি সাজে সজ্জিত হয়ে বসে আছে।

– “এই নাজু।”

নাজিয়া ধরফর করে সোজা হয়ে বসল। আবরারকে সামনে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
– “ওহ তুমি আমি ভেবেছিলাম কে না কে।”
– “তোমার সাজের এই দশা কেন?”
– “প্রচুর কষ্ট লাগছিল। মনে হচ্ছিল দম ফেঁটে যাবে তাই চেঞ্জ করে নিয়েছি। ভালো করেছি না!”

আবরার মুখটা ফ্যাকাশে করে বলল,
– “হ্যাঁ খুব ভালো করেছো। কত শখ করেছিলাম বউকে বউ সাজে দেখব। আমার বউকে আমি ছাড়া সবাই দেখেছে।”

নাজিয়া এতক্ষনে আবরারের বিষয়টা বুঝল। মজা নেবার জন্য বলল,
– “বিয়েতে অনেক ছবি তুলেছি, ওইখান থেকে দেখে নিও।”

আবরার মুখটা কালো করে বলল,
– “বউও মজা নিচ্ছে, কি যুগ আসলো।”

নাজিয়া খিলখিল করে হেসে উঠল। আবরার নাজিয়ার হাসিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি দিল, মেয়েটার মুখে এইরকম হাসি আজীবন লেগে থাকুক।

নাজিয়া হাসি থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
– “কি দেখছ!”
– “আমার হ্যাপিনেসকে।”

নাজিয়া মৃদু হেসে আবরারের বুকে মাথা রাখল। আবরার পরম যত্নে নিজের প্রিয়তমাকে আগলে নিয়ে চুলে ঠোঁটের পরশ দিয়ে বলল,
– “ভালোবাসি।”

৭দিন পর,

বৌভাত, বাপের বাড়ি ঘুরে আসার পর নাজিয়া পুরোপুরি সংসারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রান আগের থেকে দূরন্ত হয়েছে, আবিরের মা নাতির সাথেই সারাটা দিন কাটান।

নাজিয়া রান্নাঘরে ছিল, তখনি শাশুড়ির কন্ঠস্বর শুনতে পেল,
– “এই নাজি দ্যাখ তোর ছেলে আমাকে মে’রে রাখছে না।”

নাজিয়া বসার ঘরে এসে দেখল প্রান আবিরের মায়ের চুলগুলো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে খেলা করছে আর হাসছে। নাজিয়া তাড়াতাড়ি প্রানকে সরিয়ে আনলো, আবিরের মা প্রান ফিরে পেলেন।

– “বাবু দিদুন হয় তো এইরকম কেউ করে!”

প্রান কি বুঝল কে জানে, নাজিয়ার মুখে হাত বোলাতে বোলাতে হাসতে লাগল।

আবরার অফিস থেকে ফিরতে নাজিয়া পানি এগিয়ে দিল।

– “প্রান কোথায়?”
– “ঘুমাচ্ছে। জানো তোমার ছেলে আজ কি করেছে!”
– “কি করেছে?”
– “মামনির চুল ধরে মেরেছে। সাহস কত হয়েছে দেখছ।”

আবরার নাজিয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– “মায়ের মতো গুন্ডা হয়েছে।”
– “এই আমি গুন্ডা।”
– “না তো আমার বউ গুন্ডা।”

নাজিয়া কিছু বলতে গিয়েও ফিক করে হেসে ফেলল। আবরারও মৃদু হেসে নাজিয়ার কাঁধে নাক ঘষলো।

#চলবে…

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-২৮

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (২৮)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

শান্ত বিছানায় গাল ফুলিয়ে বসে আছে, আবরার নাজিয়ার সাথে দেখা করতে পারলেও ওহ কিন্তু শ্রেয়ার সাথে দেখা করতে পারেনি এমনকি কাল থেকে শ্রেয়া ফোনটাও রিসিভ করছে না। আর করবেই না কিভাবে ফোনটা ওর কাছে থাকলে তো। শয়তান কাজিনগুলো শ্রেয়া ও নাজিয়ার ফোন নিজেদের কাছে আটকে রেখেছে ওদের একটাই কথা, আগে প্রচুর প্রেম করছ আমরা কেউই বাঁধা দিইনি এখন দুইদিন প্রেম- ট্রেম বাদ। শ্রেয়া ফোন দেওয়া নিয়ে বকাবকি করলেও নাজিয়া লজ্জায় কিছু বলতে পারেনি। শ্রেয়ার অনেক বলার পরেও ফোন ফেরত পায়নি এইটা নিয়ে বেচারীর ভীষন মনখারাপ।

হেনা শ্রেয়ার পাশে বসে বলল,
– “দ্যাখ শ্রেয়া’দি বরের সাথে আজীবন প্রেম করতে পারবি, কথা বলতে পারবি কিন্তু বল আমাদের কি আর এইভাবে একসাথে পাবি!”

শ্রেয়া রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,
– “তোদের মতো কাজিন থাকলে জীবনে আর শত্রুর প্রয়োজন হবে না।”

হেনা কিছুটা ভাব নিয়ে বলল,
– “তাহলে ভাব আমরা কতটা স্পেশাল।”

শ্রেয়ার ইচ্ছা করছে হেনাকে দুচারটে ধরিয়ে দিতে, এই মেয়েটাই সবার লিডার। কিন্তু প্রচুর আত্মীয় স্বজন আছে, এখন যদি হবু বরের সাথে কথা বলার জন্য বোনের সাথে মারামারি করে তাহলে আর কারোর সামধে মুখ দেখাতে হবে না। মানসম্মানের ভয়ে শুধু চুপ করে আছে।

হেনা শ্রেয়ার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
– “সন্ধ্যায় সারপ্রাইজ আছে।”

সারপ্রাইজ! আবার কি সারপ্রাইজ দেবে কে জানে।

সন্ধ্যাবেলা,
নাজিয়া ও শ্রেয়ার হাতে মেহেন্দি পড়ানো হচ্ছে। ওইদিকে আবরার আর শান্ত মেহেন্দি পড়তে নারাজ। শান্ত তবুও বা রাজি হয়েছিল কিন্তু আবরার ওহ কিছুতেই পড়বে না।

– “আমি মেয়েদের মতো হাতে মেহেন্দি দিয়ে বসে থাকতে পারব নাহ, তোরা ফট এইখান থেকে।”

হেনা মুখ ভেংচি দিয়ে বলল,
– “মেহেন্দি না পড়লে বউয়ের দেখাও পাবে না।”

আবরার নড়েচড়ে বসে পাশে থাকা শান্তর দিকে তাকাল।

– “বউয়ের দেখা পাবো না মানে?”
– “শুনে কি লাভ! তোমরা তো বলেই দিয়েছ মেহেন্দি পড়বে না।”
– “পড়ব না বলছিলাম কিন্তু এখন তো রাজি হতেও পারি।কি বলবি ভনিতা না করে বলে ফেল।”
– “আমরা ঠিক করেছি মেহেন্দি অনুষ্ঠানের পর সবাই মিলে ছাদে একটু আড্ডা দেব, এটা নিয়ে বড়োদের পারমিশনও নেওয়া হয়ে গেছে।সেখানে বর-কনেরাও থাকবে, কিন্তু তোমরা মেহেন্দি না পড়লে তোমাদের যাওয়া হবে না।”

আবরার হেনার দিকে বাঁকা হেসে বলল,
– “মেহেন্দি পড়লে বউয়ের হাত থেকেই পড়ব, সেটা যদি ম্যানেজ করতে পারিস তো মেহেন্দি করব। আর যদি ভাবিস আমাদের ছাড়াই আড্ডা দেবার প্ল্যান করবি তাহলে ছাদ থেকে সবকটাকে ছুঁড়ে নীচে ফেলে দেব।”

শেষের কথাটা রাগ নিয়ে বলল, এদের অত্যাচার আর সহ্য করা যাচ্ছে না। আবরার ভালো করেই জানত ওর কাজিনমহল এইরকম করবে তাই তো বিয়েতে রাজি হচ্ছিল না।

হেনা সহ বাকিরা আর কিছু বলল না, কাল থেকে ওদেরকে কম জ্বালাচ্ছে না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে ঝামেলা হয়ে যাবে আর তখন বকুনিটা ওরাই খাবে তাই চুপ থাকাই ভালো বলে মনে হলো।

রাতের খাওয়া দাওয়া পর্ব শেষ করার পর দুই বউকে নিয়ে হেনাদের টিম ছাদে উপস্থিত হলো। আড্ডা দেবার বিষয়টা নাজিয়া ও শ্রেয়া জানত না ওটা ওদের জন্য সারপ্রাইজ ছিল।

ছাদে এসে দুই বরকে দেখে ওরা সত্যিই সারপ্রাইজড হলো, যে কাজিনমহল ঠিক করে ফোনেই কথা বলতে দিতে নারাজ তারাই আবার ছাদে এনেছে এর পেছনে কিছূ মতলব নেয় তো!

নাজিয়া ও শ্রেয়াকে আবরার আর শান্তর মুখোমুখি বসানো হলো। বাকিরা ওদের পাশাপাশি গোল হয়ে বসল।হেনা বক্তৃতা দেবার মতো ভান করে বলল,
– “গাইস আমরা এখন ট্রুথ ও ডেয়ার খেলব। যাকে যা দেওয়া হবে তাকে কিন্তু সেইটা কমপ্লিট করতে হবে।”

কেউ দ্বিমত পোষণ করল না। ট্রুথ ডেয়ার শুরু হলো, প্রথমেই দান পড়ল আবরারের।

– “ডেয়ার।”

হেনা শয়তানি হেসে বলল,
– “তোমার ডেয়ার হচ্ছে এখুনি নিজের বেডরুম থেকে ঘুরে আসবে।”

আবরার বসা থেকে উঠতে উঠতে বলল,
– “এটা তো কোনো ব্যাপার না।”

আবরারের আরেক কাজিন টুসি বলল,
– “আরে আবরার’দা তোমার এই বেডরুম না, তোমার বাড়ির নিজস্ব বেডরুম।”
– “কি! এইটা কিভাবে পসিবেল?”

হেনা শয়তানি হেসে বলল,
– “ডেয়ার কমপ্লিট করতে না পারলে ১হাজার টাকা ফাইন।”

আবরার মুখ কুঁচকে ফেলল, ভালো মতোই বুঝল এরা পকেট ফাঁকা করার প্ল্যান নিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন তো বেডরুমে যাওয়া সম্ভব না তাই বাধ্য হয়ে ১হাজার টাকা দিতে হলো। আবরারের করুন মুখ দেখে নাজিয়ার প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে কিন্তু সবার সামনে হাসতেও পারছে না।

পরের দান অন্য এক কাজিনের হলো। তাকে ডেয়ার দেওয়া হলো গান করার জন্য। এইভাবে খেলা চলার মাঝে শ্রেয়ার দান পড়ল, শ্রেয়া ডেয়ার নিতেই আবরার চেঁচিয়ে উঠল,
– “এই আমি ডেয়ার দেব।”

শ্রেয়া মনে মনে ঢোক গিলল। না জানি আবার কি বাঁশ দেয়।

– “শ্রেয়ার ডেয়ার হচ্ছে এখন এইমুহুর্তে শান্তকে আমাদের সবার সামনে প্রোপজ করতে হবে।”

বাকিরা চেঁচিয়ে উঠল, শ্রেয়া কিছুটা লজ্জা পেল। একটা মেয়ে হয়ে এতজনের সামনে প্রোপজ করতে হবে! সবাই শ্রেয়াকে করার জন্য বলছে, আবরার শ্রেয়া আর শান্তকে ওদের গোলের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দেয়। শ্রেয়া শান্তর দিকে কিছুক্ষন চুপ করে তাকিয়ে থাকে তারপর হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
– “আমার হাতটাকে ধরে রাখার সিদ্ধান্ত তো অনেক আগেই নিয়েছ, নতুন করে হাত ধরার কথা আর বলব না। বারবার মুখে ভালোবাসি কথাটা বলার জন্যও অনেকখানি আবদার করব না, শুধু একটা জিনিস চাইব কখনো কোনো কারনে আমাকে অবিশ্বাস করো না। ভুল করলে রাগ না দেখিয়ে শুধরে দিও, প্রয়োজনে শাসন করো তবুও অবহেলা করো না আমি মেনে নিতে পারব না। অবশেষে বলব ভালোবাসতাম, ভালোবাসি আর আজীবন ভালোবাসব।”

সবাই হইহই করে উঠল। শান্ত নিজেও হতবাক। শ্রেয়ার সামনে হাঁটুগেড়ে বসে হাতদুটোকে শক্ত করে ধরে বলল,
– “জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তোমার সাথে বাঁচতে চাই। কথা দিলাম, তোমাকে নিয়ে ছোট সুখের ঘর বাঁধব যেখানে কোনো ভুল বোঝাবুঝির ঠাঁই থাকবে না। আমিও বলব, ভালোবাসতাম, ভালোবাসি আর আজীবন ভালোবাসব।”

শ্রেয়া ইমোশনাল হয়ে শান্তকে জড়িয়ে ধরল। মুহূর্তটা ক্যামেরাবন্দি করতে ভুলল না কাজিনমহল।

আবরার শান্তর পিঠ চাপড়ে বলল,
– “ভাই পুরো ফাঁটিয়ে দিয়েছিস।”

শান্ত লাজুক হাসল। খেলা আবারো শুরু হলো, নাজিয়ার দান আসলে ওহ ডেয়ার নেয় কারন এদের বিশ্বাস নেয় কখন কি করতে বলে কে জানে।

হেনা কিছুটা ভাবুক হয়ে বলল,
– “আবরার’দার কি দেখে তোমার ভালো লেগেছিল?”
– “জানি না।”
– “জানো না! তবুও কিছু বলো কিছু তো একটা দেখে প্রেমে পড়েছিলে?”

নাজিয়া আবরারের দিকে একপলক তাকিয়ে হেনার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
– “আমি তার প্রেমে পড়িনি বরং ভালোবেসেছি।”

ওওওওও কাজিনমহলের সবাই আবারো চেঁচিয়ে উঠল। শান্ত আবরারকে খোঁচা দিয়ে বলল,
– “আহা গো কত ভালোবাসা দেখেছিস!”

আবরার উত্তর না দিয়ে মৃদু হেসে নাজিয়ার দিকে তাকাল। মেয়েটা যে ওকে বড্ড ভালোবাসে এটা বুঝতে অসুবিধা নেয়।

এইবার ভাগ্যক্রমে দান পড়ল হেনার কাছে। আবরারের মুখে শয়তানি হাসি লেগে আছে। শয়তানি হেসে বলল,
– “কি নিবি বল! আর তুই যা ভীতু ডেয়ার নিতেই পারবি না।”

হেনা নাক ফুলিয়ে বলল,
– “নাও ডেয়ারই নিলাম।”

আবরারের মুখের হাসি আরো কিছুকা চওড়া হলো, বাঁকা হেসে বলল,
– “তুই এখন এই মুহূর্তে আমাদের সবার সামনে কান‌ ধরে ১০০টা উঠবস করবি।”
– “কি!”
– “ইয়েস। অনেক জ্বালিয়েছিস এইবার বোঝ।”

শ্রেয়াও বলল,
– “হ্যাঁ হেনা শুরু কর।”

কাঁদো কাঁদো মুখ করেও হেনা আবরার আর শ্রেয়ার মন গলাতে পারল না। কান ধরে উঠবস করতে লাগল, ওর গ্যাং এর বাকিদের মুখটা চুপসে গেছে। আবরার যে এইভাবে প্যাচে ফেলবে সেটা বুঝতে পারেনি। হেনা ২০টার মতো উঠবস খাবার পর আবরার ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
– “থাক আর করতে হবে না। এইবারের মতো ছেড়ে দিলাম, পরেরবার আমার সাথে লাগতে এলে সাবধানে আসবি।”

হেনা মুখ বেঁকিয়ে বলল,
– “তোমাকে দেখে নেব।”

আড্ডা ওইখানেই শেষ হয়ে যায়। পরেরদিন সকালে অনেক কাজ আছে তাই সবাই ঘুমাতে চলে গেল।

—-

পরেরদিন,

বিয়ের আয়োজন পুরোদমে চলছে। শ্রেয়া আর নাজিয়াকে বউ সাজানো হচ্ছে। আর ওদিকে শান্ত আর আবরাররাও রেডি হচ্ছে।

– “এই ভাই আমার কিরকম একটা লাগছে।”

আবরার ভ্রু কুঁচকে বলল,
– “কীরকম!”
– “অন্যরকম, প্রচন্ড নার্ভাস লাগছে কি হবে?”
– “আরে চিল মুডে থাক কিছু হবে না।”
– “শালা তোর তো এইটা দুই নম্বর বিয়ে তোর আর কি টেনশান!”

আবরার ভাব নিয়ে বলল,
– “তাহলে ভাব আমি কতটা লাকি!”

আবরার আর শান্ত দুজনেই হেসে উঠল। সময় পেরিয়ে গেল, শ্রেয়া আর নাজিয়াকে স্টেজে বসানো হয়েছে। লোকজন আসতে শুরু করে দিয়েছে, শ্রেয়া ও নাজিয়া স্মাইল দিতে দিতে গাল ব্যথা করে ফেলেছে।

শ্রেয়া নাজিয়াকে খোঁচা দিয়ে বলল,
– “এই আর কতক্ষন এইভাবে থাকব! বিয়ে কখন হবে?”
– “কে জানে। দাঁত বার করতে করতে আমার গাল ব্যথা হয়ে যাচ্ছে।”

ওদের দুজনের কথার মাঝে একটা চেনা কন্ঠস্বর শুনে দুজনে মাথা তুলে তাকিয়ে চমকে উঠল। শ্রেয়া ও নাজিয়া একসাথে বলে উঠল,
– “আপনি!”

#চলবে…

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।‌

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-২৭

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (২৭)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

– “এই বউ আমাকে বিয়ে করবে!”

আচমকা এইরকম কথা শুনে নাজিয়া হকচকিয়ে তাকাল। কন্ঠস্বর’টা আবরারের কিন্তু কথাটার অর্থ ঠিক ধরতে পারল না, তাই জিজ্ঞেস করল

– “এইসব কি বলছ?”
– “কি বলছি!”
– “বউকে বলছ বিয়ে করার কথা, মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেছে!”

আবরার মুখটা কাঁচুমাচু করে বলল,
– “মাথা খারাপ আমার নই বাড়ির সবার হয়ে গেছে।”
– “মানে?”
– “সবাই মিলে ঠিক করেছে শান্ত আর শ্রেয়ার সাথে সাথে আমাদেরও বিয়ে দেবে।”

বিষয়টা বুঝতে নাজিয়ার একটু সময় লাগল, যখন বুঝল তখন কি রিয়াকশন দেবে বুঝতে পারল না। লজ্জা পাবে! খুশি হবে, নাকি আবরারের মতো বিরক্ত হবে!

আবরার নাজিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– “আমাদের গল্পটা অবশেষে পুর্নতা পেল বলো।”
– “হুম।”

—-

বিয়ের আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। যেহেতু দুটো বিয়ে একসাথে হবে তাই সবাই মিলে ঠিক করে একটা রির্সোট ভাড়া করা হয়েছে। রির্সোটটা শ্রেয়া ও আবরারের বাড়ির মাঝামাঝি পজিশনে নেওয়া হয়েছে, যাতে চার পরিবারের আত্মীয় স্বজন সহজেই আসতে পারে। আবির বিয়ের সমস্ত আয়োজন দক্ষ হাতে সামলাচ্ছে, বড়ো দাদা বলে কথা তার কাঁধে অনেক দায়িত্ব।

হলুদের অনুষ্ঠানের ড্রেস থিম সবুজ রাখা হয়েছে। শুধুমাত্র বর-কনের ড্রেস হলুদ রঙের থাকবে, এখন সবাই এক রঙের ড্রেস পড়ে কোনটা আসল বর-কনে সেটাই বুঝতে পারা যায় না।

শ্রেয়া সম্পূর্ণ রেডি অনুষ্ঠানের জন্য। শ্রেয়া হলুদ ও লাল রঙের কম্বিনেশনের একটা শাড়ি পড়েছে, সাথে হলুদ ফুলের গহনা। আর নাজিয়া!

নাজিয়া শাড়িটা কোনরকমে পড়ে প্রানকে সামলাতে ব্যস্ত। হঠাৎ করেই প্রান বাবু ক্ষেপে গেছে, কিছুতেই কারোর কাছে থাকছে না তাই নাজিয়া সাজগোজ ছেড়ে ছেলেকে সামলাচ্ছে।

বেশকিছুক্ষন পর, প্রানকে শান্ত করে ঘুম পাড়িয়ে নাজিয়া রেডি হয়ে নিল। নাজিয়ার শাড়িটা হলুদ ও সবুজের কম্বিনেশনে সাথে ফুলের গহনাটাও দুই কালারের। সব মিলিয়ে শ্রেয়া নাজিয়া দুজনকেই খুব সুন্দর লাগছে।

অন্যদিকে,

– “এই ভাই বউকে দেখব না!”

আবরারের জ্বালায় অতিষ্ঠ শান্ত। এই ছেলে কবে থেকে এতটা বউ পাগল হলো কে জানে, খালি কথায় কথায় বউ আর বউ।

– “এই তুই একটু চুপ করবি! সব কথাতে বউ বউ করিস কেন?”
– “বিয়েটা কর, তারপর বুঝবি বউ কি জিনিস।”
– “আবার বউয়ের কথা!”

আবরার উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
– “এই তুই যাবি না তো! আমি একাই নাজিয়ার সাথে দেখা করে আসছি বাই।”

শান্ত আবরারের হাত টেনে ধরে বলল,
– “আরে রাগ করছিস কেন? আমি কি একবারো বলেছি যাবো না!”

আবরার শয়তানি হেসে বলল,
– “লাইনে আসো বাছাধন। এতক্ষন কি বলছিলিস! আমি বউ বউ করি। আমার বউ হয়েছে তাই বউ বউ করছি কিন্তু আপনার এত দরদ কেন হবু বউয়ের প্রতি।”

শান্ত বুঝল আবরার ওকে নাকানিচুবানি খাওয়ানোর প্ল্যান করছে, তাই বলল,
– “সরা কান ধরছি। প্লিজ একটাবার শ্রেয়ার সাথে দেখা করার সুযোগ করে দে।”
– “নো চান্স। বিয়ের আগে নো দেখাদেখি।”

শান্ত কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,
– “তুই আমার বন্ধু হয়ে এইটা করতে পারবি!”
– “এতক্ষন তুমি আমাকে বউ নিয়ে বলার জন্য ক্ষ্যাপাতে পারো, আর আমি এইটা করতে পারব না! তুই থাক আমি দেখা করে আসি।”

আবরার শিষ বাজাতে বাজাতে চলে গেল। শান্ত মুখটা করুন করে আবরারকে কয়েকটা গালি ছুঁড়ে দিল।

আবরার ভাব নিয়ে মেয়েদের সাইটে পা বাড়াতেই ওর কাজিন হেনা ওর হাতটা টেনে ধরল।

– “কি হলো হাত টানছিস কেন?”
– “কোথায় যাচ্ছো এইদিকে?”
– “তোকে বলতে হবে কেন? হাতটা ছাড় বলছি।”
– “সেটা তো‌ হবে না।এইদিকটা গার্ল সাইড তোমার ওখানে যাওয়া বারন।”

আবরার বিরক্ত হয়ে বলল,
– “আমার একটু দরকার আছে ছাড় বলছি।”
– “তোমার দরকার মানে তো নাজিয়া ভাবির সাথে দেখা করা, কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না। বিয়ের আগে দুজন দুজনের মুখ দেখাদেখি বন্ধ।”

আবরার মনে মনে বেজায় চটছে, কিন্তু তবুও মুখে হাসি রেখে বলল,
– “তোকে কে বলল আমি নাজিয়ার‌ সাথে দেখা করতে যাচ্ছি?”
– “আমি বোকা না ওকে, আমি খুব ভালো করেই জানি তুমি এইদিকে কি করতে যাচ্ছো।”
– “কি করতে যাচ্ছি?”
– “নাজিয়া ভাবির সাথে দেখা করতে কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না।”
– “আরে আমি তো শ্রেয়ার কাছে যাচ্ছি, সর সামনে থেকে।”

হেনা নাছোড়বান্দা কিছুতেই যেতে দেবে না, আবরার ওর সাথে কথাতে না পেরে বলল,
– “কত দিলে রাস্তা ছাড়বি বল।”
– “খুব বেশি না, ২দাও তাতেই চলবে।”
– “শয়তানের নানি” (বিরবির করে)

হেনা কথাটা ঠিক করে শুনতে পায়নি তাই জিজ্ঞেস করল,
– “কি বললে?”
– “কি বলেছি সেটার খোঁজ না করে, টাকাটা কি নিবি!”
– “হ্যাঁ দাও তাড়াতাড়ি।”
– “দেব তো বটে কিন্তু একটা শর্ত আছে।”
– “কি শর্ত!”
– “নাজিয়ার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।”
– “তাহলে আরো ১বেশি লাগবে।”

অন্যসময় হলে আবরার হেনার বারোটা বাজিয়ে ছাড়ত, কিন্তু এখন বউয়ের সাথে দেখা করাটা জরুরি তাই সবকিছু সহ্য করে যেতে হচ্ছে। কথাতে বলে না, হাতি কাঁদায় পড়লে চামচিকাতেও লাথি মারে।

আবরার হেনাকে ৩হাজার টাকা ঘুষ দেবার বিনিময়ে বউয়ের সাথে দেখা করার সুযোগ পেল। নাজিয়া তো কিছুই বুঝতে পারছে না, হেনা কেন ওকে আলাদা করে সাইডে নিয়ে আসল।

নাজিয়া হেনাকে জিজ্ঞেস করল,
– “আরে হেনা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?”
– “তুমি এখানে একটু ওয়েট করো, আমি আসছি।”

হেনা নাজিয়াকে দাঁড় করিয়ে রেখে চলে যায়। নাজিয়া এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, তখনি ওর চোখটা কেউ একজন চেপে ধরল। আচমকা এইরকম হওয়াতে কিছুটা ভয় পেয়ে যায়, কিন্তু চিরচেনা গায়ের গন্ধ আর স্পর্শে বুঝতে বেশিক্ষণ সময় লাগে না মানুষটা আসলে কে!

– “তুমি এইখানে!”

আবরার নাজিয়ার চোখ ছেড়ে দিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
– “ইয়েস, বউকে দেখতে আসলাম।”

নাজিয়া আবরারকে ভেংচি দিয়ে বলল,
– “ঢং দেখলে বাঁচি না, যতসব।”

আবরার নাজিয়াকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে নাক ঘষতে লাগল। নাজিয়া আবরারের পেটে কনুই দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল,
– “আরে কি হচ্ছে ছাড়ো, কেউ চলে আসবে তো।”
– “কেউ আসবে না, আর আসলেও কি আমি আমার বউয়ের কাছে এসেছি।”
– “আহ্ কত ভালোবাসো।”
– “অনেক ভালোবাসা গো।”

আবরার নাজিয়াকে ছেড়ে দিয়ে কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়ে বলল,
– “আমার বউকে পুরো হলুদ পরী লাগছে, নজর না লাগুক।”
– “তোমার নজর তো লেগেই গেছে।”

আবরার নাজিয়ার কথা শুনে দাঁত বের করে বলল,
– “আমার নজর লাগলে কিছু হবে না, তুমি তো শুধু আমার।”

নাজিয়া মৃদু হাসল, আবরারের পাগলামী দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। ছেলেটা এত বউ পাগল কবে হলো!

—-

হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে, সবাই শ্রেয়া আর নাজিয়ার গায়ে হলুদ ছোঁয়াচ্ছে। আবরার আর নাজিয়া দের হলুদের জায়গা আলাদা করা হয়েছে, প্রথমে আবরারদের হলুদ ছুঁইয়ে দিয়ে নাজিয়াদের হলুদ ছোঁয়ানোর কাজে ব্যস্ত সবাই। আর আবরাররা এখন কাজিনমহলের হাতে বন্দি…

আবিরের মা শ্রেয়ার গায়ে হলুদ ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,
– “খুব সুখে থাকিস।”
– “দোয়া করো মামনি।”

শ্রেয়াকে হলুদ ছোঁয়ানোর পর আবিরের মা নাজিয়ার গায়ে হলুদ দিয়ে বলল,
– “অনেক অন্যায় করেছি তোমার সাথে তার জন্য মাফ চাইব না। তবে একটা জিনিস চাইব, আমার পরিবার’টাকে আজীবন আগলে রেখো।”

নাজিয়া ওনার হাতটাকে শক্ত করে ধরে বলল,
– “আমি আমার সবোর্চ্চটা দিয়ে চেষ্টা করব। আপনি শুধু আমার ও আমাদের জন্য দোয়া করবেন।”
– “সবসময়েই করি।”

একে একে সবাই হলুদ ছোঁয়াল, আবির শ্রেয়া আর নাজিয়ার কপালে হলুদ দিয়ে বলল,
– “দোয়া করি আমার দুইবোনই যেন সুখের চাদরে মোড়া থাকে।”

নাজিয়া মৃদু হেসে বলল,
– “তোমার মতো দাদা থাকলে প্রতিটা বোনই সুখে থাকবে।”

—-

আবরার আর শান্তকে হলুদে ভূত সাজিয়ে দিয়েছে ওদের কাজিনগুলো।আবরার বিরক্ত হয়ে বলল,
– “আরে আর কত মাখাবি, এইগুলো তুলতে গেলে তো আমি শেষ।”

হেনা আবরারের মুখে আরো কিছুটা হলুদ মাখিয়ে দিয়ে বলল,
– “আরে দুইবার বিয়ে করছ, একটু বেশি করে না মাখলে হয় নাকি।”
– “যতসব।”

আবরার রাগে একাই স্টেজ থেকে উঠে চলে যায়, কাজিনমহল ওর কান্ডে হেসে উঠল। এতদিনে ব্যাটাকে জব্দ করতে পেরেছে এতে কাজিনমহলের খুশির শেষ নেয়।

অনুষ্ঠান হইহই করে শেষ হয়ে যায়। নাজিয়া নিজের বরাদ্দকৃত রুমের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে। এখানে সবাই আছে কিন্তু নাজিয়ার খুব কাছের একজন মানুষ নেই। ছোট থেকে যার সাথে বেড়ে উঠা, সময় কাটানো সুখ -দুঃখ ভাগ করে নেওয়া, মনখারাপের সঙ্গী হওয়া, আনন্দগুলো একসাথে কাটানোর মানুষটাই নাজিয়ার জীবনের এতবড়ো দিনে মানুষটা ওর পাশে থাকতে পারল না। হয়তো কোথাও না কোথাও আছে, আর ঠিকই দেখে চলেছে নাজিয়াকে।

নাজিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে অশ্রুভেজা চোখে বলল,
– “একা একা খুব ভালো আছিস তাই না! জানিস দিদি আজ তুই থাকলে কত আনন্দ করতিস, হইচই করে নিজের দেবর আর বোনের বিয়ে দিতিস। আজ তুই নেয়, তবে আমাদের মনে ঠিকই আছিস। যেখানেই থাকিস খুব ভালো থাকিস, আর দোয়া করিস।”

#চলবে…

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-২৬

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (২৬)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

শান্তর মা ছেলের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন,
– “এই তোর বন্ধু এইসব কি করছে? আমাদের মান-সম্মান ডোবাবে নাকি!”

শান্ত কিছু বলতে পারল না। ওহ নিজেই বুঝতে পারছে না, আবরারের এইরকম ব্যবহারের কারন কি!

শ্রেয়ার বাবা সহ বাড়ির বড়োরা উপস্থিত হয়ে শান্তর‌ পরিবারের‌ সাথে আলাপ করতে লাগলেন। কিন্তু শান্তর সেইদিকে নজর নেয়, বারবার ওদিক সেদিক উঁকি দিয়ে আবরারকে খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হচ্ছে।

আবির শান্তর পাশে বসে নিম্নস্বরে বলল,
– “কি ব্যাপার এদিক ওদিক তাকাচ্ছ, বউয়ের জন্য তর সইছে না বুঝি!”

শান্ত চিন্তিত কন্ঠে বলল,
– “একচুয়ালী সেটা নাহ। আবরার ভেতরে কোথায় চলে গেল অনেকক্ষণ হলো তাই খুঁজছিলাম।”

আবির কিছু না বলে মৃদু হাসল। দুই পরিবারের মধ্যে কথাবার্তা চলছে, সবাই রাজি। আবরার আর আবির আগে থেকেই সবাইকে সবকিছু বলে রাজি করিয়ে রেখেছিল, তাই আর হিটলার হিটলার গিরি করতে পারল না।

কিছুক্ষন কেটে যাবার পর, আবরার একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসার ঘরে আসলো। শান্ত বোঝার চেষ্টা করছে বাচ্চাটা আসলে কে! শান্তর পরিবার একটু বিরক্ত হচ্ছে আবরারের কান্ডে, ওনারা রীতিমতো উশখুশ করছেন আবরারকে দু-চারটে কথা শুনিয়ে দিতে পারলে শান্তি হতো। অচেনা জায়গায় পাত্রী দেখতে এসে পাত্রপক্ষের কেউ এইভাবে কিভাবে ঘোরাঘুরি করে!!

শ্রেয়ার বাবা আবিরের উদ্দেশ্যে বললেন,
– “আবির শ্রেয়াকে নিয়ে আসতে বলো তো একটু।”
– “জ্বি মামা।”

আবির উঠে ভেতরে চলে যায়। শ্রেয়ার বাবার চোখ পড়ে আবরারের উপর, মৃদু হেঁসে বলল,
– “আরে আবরার কখন আসলে? সেই কখন থেকে তোমার জন্য ওয়েট করছিলাম।”
– “এই তো কিছুক্ষন আগে আসলাম।”

সবকিছু শান্তর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। আসলে এইখানে হচ্ছেটা কি!!

ওইদিকে,

নাজিয়া শ্রেয়াকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে। কিন্তু শ্রেয়া প্রচন্ড নার্ভাস।

– “এই নাজিয়া আমার খুব ভয় লাগছে।”
– “আরে ভয় কিসের। শান্ত’দা আর ঐর পরিবারই তো।”
– “তবুও আমার অনেকটা টেনশন হচ্ছে।”
– “কুল থাকো।”

আবির দরজায় নক করল,
– “এই নাজু শ্রেয়াকে নিয়ে বসার ঘরে আয়।”
– “চলো ডাক পড়ে গেছে।”
– “ভয় লাগছে।”
– “চলো তো।”

নাজিয়া শ্রেয়াকে জোর করে বসার ঘর পর্যন্ত নিয়ে এসে বসিয়ে দেয়। শান্তর চোখ কপালে, এইখানে নাজিয়া!! শান্ত মনে মনে বলল,
– “নাজিয়া আবরার এইখানে, আসলে হচ্ছেটা কি!”

শান্তর সাথে ওর এক আন্টিও এসেছিল তার চোখ আটকায় নাজিয়ার দিকে।শ্রেয়ার সাথে শান্তর মা কথা বলে, তারপর শ্রেয়া আর শান্তকে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে পাঠানো হয়।

ছাদে চারজন দাঁড়িয়ে আছে, শান্ত শ্রেয়ার সাথে কথা ধা বলে আবরারের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,

– “এই সত্যি করে বল তো কেসটা কি! তুই আমাদের সাথে আসলি তারপর হাওয়া হয়ে গেলি। তারপর ফিরলি একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে। আবার শ্রেয়ার বাবাও তোকে চেনে, নাজিয়াও এইখানে। বল‌ কেসটা কি?”

আবরার হা হা করে হেসে উঠল, শান্তর রাগ বাড়ছে এতটা সিরিয়াস মুমেন্টে ওহ হাসছে কিভাবে?

—-
বিয়ের আলোচনার একটা পর্যায়ে শান্তর আন্টি জিজ্ঞেস করল,
– “শ্রেয়ার সাথে যে মেয়েটা এসেছিল সে কে হয় আপনাদের?”
– “নাজিয়া আমার বোনপোর বউ।”
– “বউ!”

একটা বড়ো ঝটকা খেলেন উনি। আশা করেছিলেন নাজিয়াকে নিজের বউমা বানাবেন কিন্তু কপাল খারাপ।

শ্রেয়ার বাবা মুচকি হেসে বললেন,
– “হ্যাঁ নাজিয়া আমাদের আবরারের বউ। আপনারা তো আবরারকে চেনেন।”

ওনারা অবাক হলেন, আর অবাক হবারই কথা আবরারের পরিচয় ওনাদের কাছে অজানা ছিল। আবরার এই বাড়ির ছেলে সেই কারনেই এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছিল।

সবাই আবার ভুল টপিক শ্রেয়াও শান্তর বিয়েতে ফিরে গেল। ওইদিকে, আবরারের উপরে বেজায় ক্ষেপে গেছে শান্ত। ছেলেটা যত ক্ষেপে যাচ্ছে আবরার ততই ক্ষেপিয়ে দিচ্ছে মাঝখান থেকে নাজিয়া আর শ্রেয়া মজা নিতে ব্যস্ত।

শান্ত বিরক্ত হয়ে বলল,
– “ভাবি তুমি তো অন্তত বলো কেসটা কী।”

নাজিয়া নিজের হাসিটাকে চেপে রেখে বলল,
– “তোমাদের দুজনের মধ্যে হচ্ছে আমি এইখানে থার্ড পারসন হতে পারব না।”

শান্ত মুখটা বিকৃতি করল, ওরা দুজন না থাকলে আবরারকে কয়েকটা গালি দিয়ে দিত। কিন্তু ওদের সামনে দিতেও পারছে না, ইচ্ছা করছে মাথাটা ফাটিয়ে দিতে।

আবরার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে বলল,
– “শ্রেয়ার ফুপাতো ভাইকে যদি কখনো সামনে পাস তুই কি করবি?”

শান্ত মুখ দিয়ে কিছু শব্দ ব্যবহার করতে গিয়েও গিলে নিল। তারপর বিরক্ত হয়ে বলল,
– “খু’ন করতে পারলে শান্তি পেতাম।”

আবরার নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে, সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
– “আমিই শ্রেয়ার ফুপাতো ভাই।”
– “ওহ…. কি!!”

শান্তর চোখে মুখে বিস্ময়, শ্রেয়ার দিকে তাকাতে ইশারায় বোঝাল হ্যাঁ আবরারই সেই ব্যক্তি। ভাগ্যিস শান্ত স্ট্রং হার্টের মানুষ নাহলে নির্ঘাত হার্ট এ্যাটাক করে ফেলত কথাটা শুনে।

– “তুই সে! তাহলে এতদিন বলিস নি কেন?”
– “সারপ্রাইজ দেব বলো।”
– “বাই দ্যা ওয়ে, বাচ্চাটা কে?”
– “সারপ্রাইজ।”

শান্ত মুখটা বিকৃতি করে হাত জোড় করে বলল,
– “থাক ভাই আর সারপ্রাইজ দেওয়া লাগবে না তোর।”

সবাই হেসে উঠল। সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে এইটাই তো শান্তি।

—–

শান্ত আর শ্রেয়ার বিয়ের ডেট ফাইনাল করা হয়েছে সামনের মাসের ২৪তারিখ। দুই পরিবারের সকলের মতামত নিয়েই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, আবির এর মাঝে বলল,
– “আমার একটা প্রস্তাব ছিল।”
– “কি প্রস্তাব?” (শ্রেয়ার বাবা)
– “শান্ত আর শ্রেয়ার সাথে সাথে আবরার আর নাজিয়ার বিয়ের অনুষ্ঠানও আরেকবার করতে চাই।”

শান্তর পরিবার বিষয়টা বুঝতে পারলেন না, তাই শান্তর বাবা জিজ্ঞেস করলেন,
– “ওরা তো বিবাহিত তাহলে?”
– “একচুয়ালি আঙ্কেল ওদের বিয়েটা হুট করেই হয়েছিল, অনুষ্ঠান করার মতো সুযোগ ও পরিস্থিতি কোনটাই ছিল না তাই আমরা সবাই ওদের বিয়েটা আনুষ্ঠানিক ভাবে দিতে চাই। আপনাদের কোনো অমত না থাকলে তাহলে বিয়ের অনুষ্ঠানটা একসাথে করতাম।”
– “না অমত করার কি আছে, আমাদের কোনো আপত্তি নেই।”

—-

আবরার গালে হাত দিয়ে বসে আছে, আর আবির বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

– “এই তুই এইভাবে গালে হাত দিয়ে বসে আছিস কেন?”
– “তো কি করব?”
– “বিয়ে হবে কোথায় নাচানাচি করবি তা না চুপচাপ বসে আছিস কেন?”
– “তুমি তো সব গন্ডগোল করে দিলে।”
– “আমি আবার কি করলাম!”
– “কি করলাম মানে! কোথায় ভাবলাম শান্ত আর শ্রেয়ার বিয়েতে আনন্দ করব। আমার সাথে করা সমস্ত অন্যায়ের শোধ তুলব কিন্তু না এখন আমাকেই বর হয়ে বসে থাকতে হবে।”

আবির ভ্রু কুঁচকে বলল,
– “তোর সাথে কে আবার কি অন্যায় করল?”
– “আমার বিয়ের সময় তোমরা কি করছ আমি কিন্তু কিছু ভুলিনি। দাদা বিয়েটা কি করতেই হবে!”

আবির বিরক্তিতে গজগজ করতে করতে চলে গেল। ছেলেটা মনে হয় অতি খুশিতে পাগল হয়ে গেছে, যতসব।

#চলবে…

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।