এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-২৭

0
288

#এক_আকাশ_দূরত্ব (২৭)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

– “এই বউ আমাকে বিয়ে করবে!”

আচমকা এইরকম কথা শুনে নাজিয়া হকচকিয়ে তাকাল। কন্ঠস্বর’টা আবরারের কিন্তু কথাটার অর্থ ঠিক ধরতে পারল না, তাই জিজ্ঞেস করল

– “এইসব কি বলছ?”
– “কি বলছি!”
– “বউকে বলছ বিয়ে করার কথা, মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেছে!”

আবরার মুখটা কাঁচুমাচু করে বলল,
– “মাথা খারাপ আমার নই বাড়ির সবার হয়ে গেছে।”
– “মানে?”
– “সবাই মিলে ঠিক করেছে শান্ত আর শ্রেয়ার সাথে সাথে আমাদেরও বিয়ে দেবে।”

বিষয়টা বুঝতে নাজিয়ার একটু সময় লাগল, যখন বুঝল তখন কি রিয়াকশন দেবে বুঝতে পারল না। লজ্জা পাবে! খুশি হবে, নাকি আবরারের মতো বিরক্ত হবে!

আবরার নাজিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– “আমাদের গল্পটা অবশেষে পুর্নতা পেল বলো।”
– “হুম।”

—-

বিয়ের আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। যেহেতু দুটো বিয়ে একসাথে হবে তাই সবাই মিলে ঠিক করে একটা রির্সোট ভাড়া করা হয়েছে। রির্সোটটা শ্রেয়া ও আবরারের বাড়ির মাঝামাঝি পজিশনে নেওয়া হয়েছে, যাতে চার পরিবারের আত্মীয় স্বজন সহজেই আসতে পারে। আবির বিয়ের সমস্ত আয়োজন দক্ষ হাতে সামলাচ্ছে, বড়ো দাদা বলে কথা তার কাঁধে অনেক দায়িত্ব।

হলুদের অনুষ্ঠানের ড্রেস থিম সবুজ রাখা হয়েছে। শুধুমাত্র বর-কনের ড্রেস হলুদ রঙের থাকবে, এখন সবাই এক রঙের ড্রেস পড়ে কোনটা আসল বর-কনে সেটাই বুঝতে পারা যায় না।

শ্রেয়া সম্পূর্ণ রেডি অনুষ্ঠানের জন্য। শ্রেয়া হলুদ ও লাল রঙের কম্বিনেশনের একটা শাড়ি পড়েছে, সাথে হলুদ ফুলের গহনা। আর নাজিয়া!

নাজিয়া শাড়িটা কোনরকমে পড়ে প্রানকে সামলাতে ব্যস্ত। হঠাৎ করেই প্রান বাবু ক্ষেপে গেছে, কিছুতেই কারোর কাছে থাকছে না তাই নাজিয়া সাজগোজ ছেড়ে ছেলেকে সামলাচ্ছে।

বেশকিছুক্ষন পর, প্রানকে শান্ত করে ঘুম পাড়িয়ে নাজিয়া রেডি হয়ে নিল। নাজিয়ার শাড়িটা হলুদ ও সবুজের কম্বিনেশনে সাথে ফুলের গহনাটাও দুই কালারের। সব মিলিয়ে শ্রেয়া নাজিয়া দুজনকেই খুব সুন্দর লাগছে।

অন্যদিকে,

– “এই ভাই বউকে দেখব না!”

আবরারের জ্বালায় অতিষ্ঠ শান্ত। এই ছেলে কবে থেকে এতটা বউ পাগল হলো কে জানে, খালি কথায় কথায় বউ আর বউ।

– “এই তুই একটু চুপ করবি! সব কথাতে বউ বউ করিস কেন?”
– “বিয়েটা কর, তারপর বুঝবি বউ কি জিনিস।”
– “আবার বউয়ের কথা!”

আবরার উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
– “এই তুই যাবি না তো! আমি একাই নাজিয়ার সাথে দেখা করে আসছি বাই।”

শান্ত আবরারের হাত টেনে ধরে বলল,
– “আরে রাগ করছিস কেন? আমি কি একবারো বলেছি যাবো না!”

আবরার শয়তানি হেসে বলল,
– “লাইনে আসো বাছাধন। এতক্ষন কি বলছিলিস! আমি বউ বউ করি। আমার বউ হয়েছে তাই বউ বউ করছি কিন্তু আপনার এত দরদ কেন হবু বউয়ের প্রতি।”

শান্ত বুঝল আবরার ওকে নাকানিচুবানি খাওয়ানোর প্ল্যান করছে, তাই বলল,
– “সরা কান ধরছি। প্লিজ একটাবার শ্রেয়ার সাথে দেখা করার সুযোগ করে দে।”
– “নো চান্স। বিয়ের আগে নো দেখাদেখি।”

শান্ত কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,
– “তুই আমার বন্ধু হয়ে এইটা করতে পারবি!”
– “এতক্ষন তুমি আমাকে বউ নিয়ে বলার জন্য ক্ষ্যাপাতে পারো, আর আমি এইটা করতে পারব না! তুই থাক আমি দেখা করে আসি।”

আবরার শিষ বাজাতে বাজাতে চলে গেল। শান্ত মুখটা করুন করে আবরারকে কয়েকটা গালি ছুঁড়ে দিল।

আবরার ভাব নিয়ে মেয়েদের সাইটে পা বাড়াতেই ওর কাজিন হেনা ওর হাতটা টেনে ধরল।

– “কি হলো হাত টানছিস কেন?”
– “কোথায় যাচ্ছো এইদিকে?”
– “তোকে বলতে হবে কেন? হাতটা ছাড় বলছি।”
– “সেটা তো‌ হবে না।এইদিকটা গার্ল সাইড তোমার ওখানে যাওয়া বারন।”

আবরার বিরক্ত হয়ে বলল,
– “আমার একটু দরকার আছে ছাড় বলছি।”
– “তোমার দরকার মানে তো নাজিয়া ভাবির সাথে দেখা করা, কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না। বিয়ের আগে দুজন দুজনের মুখ দেখাদেখি বন্ধ।”

আবরার মনে মনে বেজায় চটছে, কিন্তু তবুও মুখে হাসি রেখে বলল,
– “তোকে কে বলল আমি নাজিয়ার‌ সাথে দেখা করতে যাচ্ছি?”
– “আমি বোকা না ওকে, আমি খুব ভালো করেই জানি তুমি এইদিকে কি করতে যাচ্ছো।”
– “কি করতে যাচ্ছি?”
– “নাজিয়া ভাবির সাথে দেখা করতে কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না।”
– “আরে আমি তো শ্রেয়ার কাছে যাচ্ছি, সর সামনে থেকে।”

হেনা নাছোড়বান্দা কিছুতেই যেতে দেবে না, আবরার ওর সাথে কথাতে না পেরে বলল,
– “কত দিলে রাস্তা ছাড়বি বল।”
– “খুব বেশি না, ২দাও তাতেই চলবে।”
– “শয়তানের নানি” (বিরবির করে)

হেনা কথাটা ঠিক করে শুনতে পায়নি তাই জিজ্ঞেস করল,
– “কি বললে?”
– “কি বলেছি সেটার খোঁজ না করে, টাকাটা কি নিবি!”
– “হ্যাঁ দাও তাড়াতাড়ি।”
– “দেব তো বটে কিন্তু একটা শর্ত আছে।”
– “কি শর্ত!”
– “নাজিয়ার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।”
– “তাহলে আরো ১বেশি লাগবে।”

অন্যসময় হলে আবরার হেনার বারোটা বাজিয়ে ছাড়ত, কিন্তু এখন বউয়ের সাথে দেখা করাটা জরুরি তাই সবকিছু সহ্য করে যেতে হচ্ছে। কথাতে বলে না, হাতি কাঁদায় পড়লে চামচিকাতেও লাথি মারে।

আবরার হেনাকে ৩হাজার টাকা ঘুষ দেবার বিনিময়ে বউয়ের সাথে দেখা করার সুযোগ পেল। নাজিয়া তো কিছুই বুঝতে পারছে না, হেনা কেন ওকে আলাদা করে সাইডে নিয়ে আসল।

নাজিয়া হেনাকে জিজ্ঞেস করল,
– “আরে হেনা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?”
– “তুমি এখানে একটু ওয়েট করো, আমি আসছি।”

হেনা নাজিয়াকে দাঁড় করিয়ে রেখে চলে যায়। নাজিয়া এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, তখনি ওর চোখটা কেউ একজন চেপে ধরল। আচমকা এইরকম হওয়াতে কিছুটা ভয় পেয়ে যায়, কিন্তু চিরচেনা গায়ের গন্ধ আর স্পর্শে বুঝতে বেশিক্ষণ সময় লাগে না মানুষটা আসলে কে!

– “তুমি এইখানে!”

আবরার নাজিয়ার চোখ ছেড়ে দিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
– “ইয়েস, বউকে দেখতে আসলাম।”

নাজিয়া আবরারকে ভেংচি দিয়ে বলল,
– “ঢং দেখলে বাঁচি না, যতসব।”

আবরার নাজিয়াকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে নাক ঘষতে লাগল। নাজিয়া আবরারের পেটে কনুই দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল,
– “আরে কি হচ্ছে ছাড়ো, কেউ চলে আসবে তো।”
– “কেউ আসবে না, আর আসলেও কি আমি আমার বউয়ের কাছে এসেছি।”
– “আহ্ কত ভালোবাসো।”
– “অনেক ভালোবাসা গো।”

আবরার নাজিয়াকে ছেড়ে দিয়ে কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়ে বলল,
– “আমার বউকে পুরো হলুদ পরী লাগছে, নজর না লাগুক।”
– “তোমার নজর তো লেগেই গেছে।”

আবরার নাজিয়ার কথা শুনে দাঁত বের করে বলল,
– “আমার নজর লাগলে কিছু হবে না, তুমি তো শুধু আমার।”

নাজিয়া মৃদু হাসল, আবরারের পাগলামী দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। ছেলেটা এত বউ পাগল কবে হলো!

—-

হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে, সবাই শ্রেয়া আর নাজিয়ার গায়ে হলুদ ছোঁয়াচ্ছে। আবরার আর নাজিয়া দের হলুদের জায়গা আলাদা করা হয়েছে, প্রথমে আবরারদের হলুদ ছুঁইয়ে দিয়ে নাজিয়াদের হলুদ ছোঁয়ানোর কাজে ব্যস্ত সবাই। আর আবরাররা এখন কাজিনমহলের হাতে বন্দি…

আবিরের মা শ্রেয়ার গায়ে হলুদ ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,
– “খুব সুখে থাকিস।”
– “দোয়া করো মামনি।”

শ্রেয়াকে হলুদ ছোঁয়ানোর পর আবিরের মা নাজিয়ার গায়ে হলুদ দিয়ে বলল,
– “অনেক অন্যায় করেছি তোমার সাথে তার জন্য মাফ চাইব না। তবে একটা জিনিস চাইব, আমার পরিবার’টাকে আজীবন আগলে রেখো।”

নাজিয়া ওনার হাতটাকে শক্ত করে ধরে বলল,
– “আমি আমার সবোর্চ্চটা দিয়ে চেষ্টা করব। আপনি শুধু আমার ও আমাদের জন্য দোয়া করবেন।”
– “সবসময়েই করি।”

একে একে সবাই হলুদ ছোঁয়াল, আবির শ্রেয়া আর নাজিয়ার কপালে হলুদ দিয়ে বলল,
– “দোয়া করি আমার দুইবোনই যেন সুখের চাদরে মোড়া থাকে।”

নাজিয়া মৃদু হেসে বলল,
– “তোমার মতো দাদা থাকলে প্রতিটা বোনই সুখে থাকবে।”

—-

আবরার আর শান্তকে হলুদে ভূত সাজিয়ে দিয়েছে ওদের কাজিনগুলো।আবরার বিরক্ত হয়ে বলল,
– “আরে আর কত মাখাবি, এইগুলো তুলতে গেলে তো আমি শেষ।”

হেনা আবরারের মুখে আরো কিছুটা হলুদ মাখিয়ে দিয়ে বলল,
– “আরে দুইবার বিয়ে করছ, একটু বেশি করে না মাখলে হয় নাকি।”
– “যতসব।”

আবরার রাগে একাই স্টেজ থেকে উঠে চলে যায়, কাজিনমহল ওর কান্ডে হেসে উঠল। এতদিনে ব্যাটাকে জব্দ করতে পেরেছে এতে কাজিনমহলের খুশির শেষ নেয়।

অনুষ্ঠান হইহই করে শেষ হয়ে যায়। নাজিয়া নিজের বরাদ্দকৃত রুমের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে। এখানে সবাই আছে কিন্তু নাজিয়ার খুব কাছের একজন মানুষ নেই। ছোট থেকে যার সাথে বেড়ে উঠা, সময় কাটানো সুখ -দুঃখ ভাগ করে নেওয়া, মনখারাপের সঙ্গী হওয়া, আনন্দগুলো একসাথে কাটানোর মানুষটাই নাজিয়ার জীবনের এতবড়ো দিনে মানুষটা ওর পাশে থাকতে পারল না। হয়তো কোথাও না কোথাও আছে, আর ঠিকই দেখে চলেছে নাজিয়াকে।

নাজিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে অশ্রুভেজা চোখে বলল,
– “একা একা খুব ভালো আছিস তাই না! জানিস দিদি আজ তুই থাকলে কত আনন্দ করতিস, হইচই করে নিজের দেবর আর বোনের বিয়ে দিতিস। আজ তুই নেয়, তবে আমাদের মনে ঠিকই আছিস। যেখানেই থাকিস খুব ভালো থাকিস, আর দোয়া করিস।”

#চলবে…

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে