Saturday, July 19, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 378



এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-২৫

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (২৫)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

– “আমার ভালোবাসার এই প্রতিদান দিলে তুমি!”

নাজিয়া পেছন ফিরে বলল,
– “আসলে কি বলুন তো, আপনার মতো মানুষ কাউকে সত্যিকারের ভালবাসতে পারে এই বিষয়টা আমাদের মাথাতেই আসেনি। আপনাকে আপনার পথে মাত দেবার জন্যই এই পথ অবলম্বন করতে হয়েছে।”

হাসিব মলিন হাসল। তারপর বলল,
– “অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি আমি তোমাকে সত্যি ভালোবেসে ফেলেছি। তোমার কারনে নিজেকে বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কিন্তু দ্যাখো তার আর কোনো প্রয়োজন পড়বে না।”

নাজিয়া হাসিবের মুখের দিকে তাকাল, ছেলেটার মুখে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মনের ব্যথাগুলো। হয়তো সত্যি নাজিয়াকে ভালোবেসে ফেলেছে। নাজিয়া পুনরায় চেয়ারে বসল, তারপর হাসিবের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলতে শুরু করল,

– “জানেন ভালোবাসা মানে কি? ভালোবাসা হলো এমন একটা অনুভুতি যেটা না চাইতেও হয়ে যায়, হাজার বারন সত্ত্বেও আমাদের মনে অন্য মানুষের বসবাস হয়ে যায়। কাউকে ভালোবাসার প্রথমদিনের অনুভূতি’গুলো বড্ড সুন্দর, কিন্তু দিন যত আগিয়ে যায় অনুভুতি গুলো নানান কারনে বিষাক্ত হতে শুরু করে। কখনো হয় আমরা যাকে ভালোবাসি সে আমাদের ভালোবাসে না। আবার দুজন দুজনকে ভালোবাসলে পরিবারের মত থাকে না, মানে সমস্যা একটা না একটা লেগেই থাকে। ভালোবাসলে স্বার্থপর হলে চলে না, ভালোবাসতে জানলে ত্যাগ করতেও জানতে হয়। ভালোবাসা মানে অপর মানুষটিকে সুখী দেখা, তাকে ভালো থাকতে দেখা।”

হাসিব আহত গলায় বলল,
– “ভালোবেসে আমিও বদলে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি সেই সুযোগটা দিলে না।”
– “বাহ্ এই আপনার ভালোবাসা!”
– “মানে?”
– “আমাকে ভালোবেসে বদলে যেতে চেয়েছিলেন, আর আমাকে পাননি বলে বদলাবেন না খারাপ মানুষটাই থাকবেন! তাহলে আমাকে ভালোবাসলেন কোথায়?”

হাসিবের চোখে মুখে কৌতুহল। নাজিয়া কি বলতে চাইছে?

– “আপনি যদি আমাকে সত্যি ভালোবেসে থাকেন তাহলে একজন সৎ মানুষ হয়ে দেখান।অন্যের চোখের পানিতে কখনোই সুখী হওয়া যায় না।”

হাসিব মৃদু হেসে বলল,
– “তাহলে তো তুমিও কখনো সুখী হতে পারবে না।”
– “অভিশাপ দিচ্ছেন?”
– “না তোমার কথার প্রেক্ষিতেই বলছি।”

নাজিয়া মৃদু হাসল। আবরারকে পাবার লড়াইটা কম ছিল না, নিয়তির জোরে দুজন এক হয়ে হয়েছে আর সুখেও আছে। বিধাতা ছাড়া ওদের আলাদা করবে কে!

নাজিয়ার মুখে হাসি দেখে হাসিবের কৌতুহল আরো বেড়ে গেল।

– “তুমি হাসছ কেন?”
– “ভাগ্যের কথা ভেবে।ভাগ্যে‌ থাকলে কি না হয়, যেমন আমাকেই দেখুন না যার কাছে নিজের ভালোবাসার করব না বলে ৫বছর নিজের পরিবার পরিজন ছেড়ে হোস্টেলে গিয়ে থাকলাম শেষে ভাগ্যও তার সাথেই জড়িয়ে গেল।”
– “বুঝলাম না।”
– “কি গল্প অজানাই থাকুক, কখনো যদি দেখা হয় তখন না হয় আমাদের “এক আকাশ দূরত্ব” এর গল্পটা আপনাকে বলব। আজ আসি, ভালো থাকবেন আর পারলে ভালো মানুষ হয়ে উঠুন।”

নাজিয়া আর পেছন ফিরে তাকাল না। হাসিব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, মনে মনে খুব করে চাইছিল নাজিয়া একটাবার পেছনে ফিরে তাকাক কিন্তু সেটা হয়নি। নাজিয়ার কোনো পিছুটান নেয় তাই ফিরে তাকানোর কথাও আসছে না।

****

মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন। সবকিছু এখন স্বাভাবিক ভাবেই চলছে, সবাই ভালোই আছে।আবির,আবরার নাজিয়া নিজেদের বাড়ি ফিরে এসেছে। আল ওইদিকে, শ্রেয়া আর শান্তর বিয়ের কথা চলছে। একটা নির্দিষ্ট দিনে শান্তর পরিবার শ্রেয়াকে দেখতে যাবার সিদ্ধান্ত হয়েছে।সেটা নিয়ে শান্ত আবরারকে খুঁচিয়ে চলেছে।

আবরার প্রানকে নিয়ে দুষ্টুমি করছিল, আর নাজিয়া পাশে বসে ওদের কান্ড দেখছে। তখনি আবরারের ফোন বেজে উঠল।

– “কে ফোন করেছে দ্যাখো তো।”

নাজিয়া ফোনটা নিয়ে দেখল শান্তর নম্বর।

– “শান্ত’দা।”
– “ফোনটা রিসিভ করে স্পিকারে দাও।”

ফোনটা রিসিভ করে স্পিকারে দিতেই ওপাশ থেকে শান্তর গলা ভেসে আসলো।

– “হ্যালো ভাই।”

আবরার শয়তানি করে বলল,
– “এটা কোনো ভাইয়ের নম্বর না। আপনি কোন ভাই’কে খুঁজছেন?”
– “এই শালা শয়তানি বন্ধ করবি।”

আবরার ফিসফিস করে বলল,
– “এতদিনে ঠিক সম্বোধন করেছিস।‌ সাব্বাস।”
– “এই বলছিস? শুনতে পাচ্ছি না তো।”
– “কিছু না তুই বল।”
– “ভাই আমার খুব টেনশান হচ্ছে। কাল কি হবে?”

আগামীকাল শ্রেয়াকে দেখতে যাবার কথা, সেটা নিয়ে প্রচন্ড টেনশনে আছে শান্ত। শ্রেয়ার বাবা যদি বেঁকে বসে তো!

– “কি আর হবে? যাবি খাবি কথা বলবি।”
– “আমার খুব টেনশান হচ্ছে কিন্তু।”
– “এত টেনশান করার কি আছে? কিছু হবে না।”
– “ওই হিটলার যদি না মানে তো।”

হিটলার! সেইটা আবার‌ কে? আবরার বুঝতে না পেরে বলল,
– “এই হিটলার’টা কে?”
– “ওই শ্রেয়ার বাপ। যন্ত্রর পিস মাইরি, মেয়ের রিলেশন আছে জানার পরেও বোনপোর সাথে বিয়ে দিতে চাইছিল।”

ওদের কথা শুনে নাজিয়া মুখ চেপে হাসছে। শান্ত এখনো আবরার আর শ্রেয়ার সম্পর্কের কথা জানেনা, ওরা সারপ্রাইজ দেবে বলে বলেনি। আবরার শান্তকে ইচ্ছা করে খোঁচা দিয়ে বলল,
– “তাহলে বিয়ে ভাঙল কিভাবে?”
– “শ্রেয়ার ফুপাতো ভাই অন্য একজনকে পছন্দ করত শেষে তার সাথেই বিয়ে হয়। ভাগ্যিস তার অন্য কেউ ছিল নাহলে আমি বিয়ের আগেই বিধবা হয়ে যেতাম।”
– “বিধবা!! ছেলেরা আবার বিধবা হয় নাকি?”
– “ঐই বাদ দে এইসব টপিক। আসল কথাতে আসি।”
– “বলুন দুলাভাই।”

শান্ত কপাল কুঁচকে বলল,
– “কে দুলাভাই? কার দুলাভাই?”
– “আরে তুই একটু আগে শালা বললি তাই বললাম।”
– “ওহ সেটাই বল। আচ্ছা শোন কাল তুই আমার সাথে শ্রেয়াদের বাড়ি যাবি।”
– “পাগল নাকি ভাই, আমি কি করতে যাবো।”
– “আরে তুই গেলে আমি একটু সাহস পাবো, প্লিজ চল না।”

আবরার নাজিয়ার দিকে তাকাল, নাজিয়া হ্যাঁ বলতে বলে। কিন্তু আবরারের মাথাতে তো অন্যকিছু ঘুরে চলেছে,তাই সে বলল,
– “যেতে পারি তবে কী দিবি বল।”
– “আমার বউ বাদে যা চাইবি তাই দেব। প্লিজ চল।”

আবরার হেসে উঠল, ওর জীবনে এই সময় গুলো আসেনি কিন্তু তবুও শান্তর এক্সসাইটেড দেখে বুঝতে পারছে ভালোবাসার মানুষটিকে পরিবার নিয়ে দেখতে যাবার অনুভূতি কেমন হয়।

পরেরদিন, যথাসময়ে আবরার, শান্ত ও শান্তর পরিবার শ্রেয়ার বাড়িতে উপস্থিত হলো। শান্ত প্রচন্ড নার্ভাস, সেটা নিয়ে আবরার মজা নিয়ে চলেছে। শান্ত আবরারের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে বলল,
– “তোর কপাল ভালো তোর বিয়ে হয়ে গেছে,আর বিয়ের সময়ে আমি ছিলাম না। নাহলে আমার সাথে মজা করার শখ তোর মিটিয়ে দিতাম।”

আবরার হেঁসে উঠল, সেটা দেখে শান্ত ও ওর পরিবার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। শান্ত আবরারকে ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
– “এই তুই কি করছিস, আমার বিয়ে ভাঙবি নাকি?”
– “আরে চিল…

আবরার কথাটা শেষ করে শিষ বাজাতে বাজাতে ভেতরে চলে গেল। শান্ত আর ওর পরিবার হতভম্বের মতো তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে, আসলে হচ্ছেটা কি!

#চলবে….

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-২৪

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (২৪)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

শ্রেয়া মৃদু হেসে বলল,
– “এই বছরটা আমাকে অনেককিছুই দিয়েছে। এমনকি আংশিক মৃ’ত্যুর স্বাদটাও পেয়েছি, এখন মনে হচ্ছে সেইদিন ম’রে গেলেই ভালো….

কথাটা শেষ করার আগেই শ্রেয়ার গালে থাপ্পর পড়ল। শ্রেয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, আর শান্ত! নিজের ভালোবাসার মানুষটির মৃ’ত্যু কামনা কি কেউ করতে পারে! না সহ্য করতে পারে! শান্তও পারল না। বসা থেকে উঠে গিয়ে শ্রেয়াকে আগলে নিল, শ্রেয়াও শান্তর কোমড় জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। অভিমানের কারনে সম্পর্কটা কিরকম ফিকে হয়ে গিয়েছিল।

– “মরার কথা বললে, ঠাটিয়ে গাল লাল করে দেব। তোমাকে মরতে দেব বলে কি এতকিছু করলাম।”

শ্রেয়া ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
– “তো কি করব! তুমি তো আমার উপরে অভিমান করে কথায় বলছিলে না।”
– “অভিমান করাটা কি স্বাভাবিক না।”

শ্রেয়া কিছু না বলে চুপ করে রইল। শান্ত মলিন কন্ঠে বলল,
– “জানো তোমার এড়িয়ে যাওয়া, হঠাৎ করে ব্লক দেওয়া আমাকে ঠিক কতটা মানসিক অশান্তিতে রেখেছিল। প্রতিটা মুহূর্তে নিজের সাথে লড়াই করে চলেছিলাম, একটা কথা খুব করে বুঝেছিলাম তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না। তোমাকে পাগলের মতো খুঁজে চলেছিলাম, যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু পারিনি। যখন তোমার সত্যিগুলো জানতে পারলাম তখন তোমার উপরে বড্ড অভিমান হলো, তুমি যদি একটাবার আমাকে সবটা খুলে বলতে তাহলে এতকিছু সহ্য করতে হতো না।”
– “সরি। আসলে সেই পরিস্থিতিতে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল সেইটা বিচার করার ক্ষমতা আমার ছিল না।প্লিজ একটা শেষ সুযোগ দাও, কথা দিচ্ছি আর কখনো এইরকম করব না।”
– “আর সুযোগই দেব না এইরকম করার।”

শ্রেয়ার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। তাহলে কি শান্ত ওকে মাফ করবে না!

– “বলো বাড়িতে কবে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবো।”

শ্রেয়া চমকে উঠে শান্তর মুখের দিকে তাকায়, শান্তর মুখে হাসি। শ্রেয়া বলল,
– “সত্যি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবে!”
– “হুম।”

শ্রেয়া নিজের প্রান ফিরে পেল। যাক অবশেষে শান্তর অভিমান ভাঙাতে পেরেছে এইটাই অনেককিছু।

***

আবরার আবিরকে খোঁচা দিয়ে বলল,
– “এই দাদা ওইদিকে কি হচ্ছে বল তো!”
– “আমি কিভাবে বলব! তুই যেখানে আমিও সেইখানেই আছি।”
– “আমার কিন্তু অনেক টেনশন হচ্ছে। ওই হাসিবকে নাজিয়া কিভাবে হ্যান্ডেল করবে কে জানে।”
– “টেনশান করিস না, নাজু ঠিক সামলে নেবে। তবে সামনে আমাদের কিন্তু অনেক কাজ।”

আবিরের কথার অর্থ আবরার বুঝল না। কাজ! কি কাজ? আবরার আবিরকে জিজ্ঞেস করল,
– “কি কাজ?”
– “আরে শান্ত আর শ্রেয়ার‌ বিয়ে লাগবে, আর আমরা ওর বড়ো‌দাদা তার জন্য আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে না।”
– “হ্যাঁ সেটা তো বটেই। আমরা আমাদের বোনের বিয়ে ধুমধাম করে দেব, তবে শান্তর অভিমান এত সহজে ভাঙলে হয়।”
– “নারীর ভালোবাসার কাছে পুরুষের অভিমান ভাঙতে বাধ্য। শ্রেয়া ঠিক শান্তকে মানিয়ে নেবে তুই এত টেনশান নিস না।”
– “হু।”

—-

নাজিয়া আর হাসিব দুজন দুজনের মুখোমুখি বসে আছে। হাসিব নাজিয়াকে দেখতে ব্যস্ত, আজ ওকে অন্যরকম লাগছে। চোখে চশমা নেয়, সাজটাও অনেকটাই আলাদা যেন এক অন্য নাজিয়া ওর‌ সামনে বসে আছে। অন্যদিকে নাজিয়া উশখুশ করছে, সত্যিটা আজকে ক্লিয়ার করতেই হবে কিন্তু তারপর হাসিব কি রিয়াক্ট করবে সেটাই বুঝতে পারছে না।

– “কি নাজিয়া চুপ করে আছো কেন? কি বলবে বলছিলে।”
– “আসলে।”
– “আচ্ছা তোমারটা পড়ে শুনব, তোমার জন্য একটা গুড নিউজ আছে।”
– “কি নিউজ।”
– “আমি মাকে তোমার কথা বলছিলাম, মা বলেছে তোমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবে।”

হাসিবের কথা শুনে নাজিয়ার চোখ চড়কগাছ। সর্বনাশ! এই ছেলে তো দেখি বিয়ে পর্যন্ত চলে গেছে। না আজ যে করেই হোক সত্যিটা বলতেই হবে।

হাসিব নাজিয়াকে বলল,
– “তুমি তোমার বাড়ির ঠিকানা’টা দাও।”
– “তার আর কোনো দরকার নেয়।”
– “কেন?”
– “আপনার আর আমার বিয়ে হওয়া পসিবল না।”

হাসিবের কপালে ভাঁজ পড়ল। নাজিয়ার কথার অর্থ কিছুই বুঝতে পারছে না, মেয়েটা কি সব বলছে!

– “কেন? কি সমস্যা।”
– “কারন আমি বিবাহিত।”
– “হোয়াট?”
– “হ্যাঁ আমি বিবাহিত আর আমার একটা ছেলেও আছে।”

হাসিব বিরক্ত হয়ে বলল,
– “নাজিয়া ফাজলামি বন্ধ করো, এইসব মজা আমার একদম পছন্দ না।”

নাজিয়া সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
– “আপনার সাথে আমি কোনো মজা করছি না। সত্যিটা বললাম।”

হাসিব এখনো‌ নাজিয়ার কথা বিশ্বাস করেনি, ওহ ভাবছে নাজিয়া ওর সাথে‌ প্রাঙ্ক করছে। তাই সিরিয়াস না হয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
– “ওকে। এটাই যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে তুমি নিজের স্বামী সন্তান ছেড়ে আমার সাথে রিলেশনে গিয়েছ কেন?”

নাজিয়া কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর বলল,
– “আপনাকে শাস্তি দেবার জন্য।”

এইবার হাসিবের কপালে ভাঁজ পড়ল। নাজিয়া কোন শাস্তির কথা বলছে! বিষয়টা কেন যেন হাসিবের কাছে আর মজা লাগল না, এইবার মনে হলো নাজিয়া সত্যি বলছে। তাই জিজ্ঞেস করল,
– “কিসের শাস্তি! কি অন্যায় করেছি আমি?”

নাজিয়া তাচ্ছিল্যের হেসে বলল,
– “একটা মেয়ের প্রাইভেট ভিডিও করে তাকে ব্ল্যাকমেইল করার পরেও বলছেন কি অন্যায় করেছি!”

হাসিব চমকে উঠল। নাজিয়া বিষয়টা জানল কিভাবে? আমতা আমতা করে বলল,

– “কি সব বলছ তুমি? এইসব তু-মি কিভাবে জানলে?”
– “কেন অবাক হচ্ছেন আমি কিভাবে জানলাম? শুধুমাত্র আপনার জন্য শ্রেয়া’দি সুই-সাইড করতে গিয়েছিল। আর একটু দেরি হয়ে গেলে, মানুষটাকে আর বাঁচানো যেত না।”

হাসিব মাথা নিচু করে নিল। প্রথমদিকে নিজের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলেও নাজিয়ার সাথে পরিচয় হবার‌ পর নিজের অতীতের কাজগুলো নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছিল না। মনের মধ্যে একটা অপরাধবোধ জেগে উঠছিল, মনে‌ হচ্ছিল অন্যায় করেছে। তার জন্য শ্রেয়ার‌ কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য ফোনও করেছিল কিন্তু শ্রেয়াকে ফোনে পায়নি। কাল যখন নিজে থেকে শ্রেয়া এসেছিল তখন সবকিছু মিটিয়ে নতুন করে‌ সবকিছু শুরু করতে চেয়েছিল কিন্তু কি হলো?

নাজিয়া হাসিবের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল,
– “আপনার সাথে আমার পার্সোনাল কোনো শত্রুতা নেই। শুধুমাত্র শ্রেয়া’দির ভিডিওটা ডিলিট করার জন্য আমি আপনার ক্লোজড হতে‌ বাধ্য হয়েছি। এটা সত্যি আমি বিবাহিত, আর‌ আমি আমার স্বামীকে খুব ভালোবাসি। আজকের পর আপনি আমার সাথে‌ যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেন না প্লিজ।”

হাসিব এইবার অধৈর্য হয়ে উঠল,
– “হ্যাঁ আমি মানছি আমি শ্রেয়ার সাথে অন্যায় করেছি কিন্তু তোমাকে আমি ভালোবাসি এই আমার জীবনের চরম সত্যি। প্লিজ নাজিয়া আমাকে এইভাবে ফেলে চলে যেও না।”
– “মাফ করবেন সেটা সম্ভব না। আমি আপনার জন্য আমার নিজের মানুষটাকে ঠকাতে পারব না। দোয়া করব, আপনার জীবনে সঠিক মানুষটার আগমন ঘটুক। ভালো থাকবেন।”

নাজিয়া বসা থেকে উঠে চলে যেতে যাবে তখনি হাসিবের একটা কথায় থমকে দাঁড়াল।

#চলবে

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-২৩

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (২৩)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

শ্রেয়াকে এখন এইসময়ে অফিসে দেখে হাসিব নিজেও খুব অবাক হলো।

– “তুমি এইখানে?”
– “কেন? কি ভেবেছিলেন আমি আর কখনো এই অফিসে আসব না তাই তো?”

হাসিব উত্তর দিল না। শ্রেয়া আবারো বলতে শুরু করল,
– “আচ্ছা আমি আপনার কি ক্ষতি করছিলাম যার জন্য আমার স’ম্মানহানি করার কথা চিন্তা করলেন? আপনি জানেন আপনার কারনে শুধুমাত্র আপনার কারনে আমি সুই-সাইড করতে গিয়েছিলাম, নিজের ভালোবাসার মানুষটির সাথে সম্পর্ক শেষ করেছি। এতকিছুর পরেও আপনি আমাকে ছাড়ছেন না।”

শ্রেয়াকে অবাক করে দিয়ে হাসিব বলল,
– “আই এম সরি। তোমার সাথে এইরকম করাটা আমার ঠিক হয়নি, আর এই কয়েকদিনে একটা জিনিস বুঝতে শিখেছি ‘কাউকে ভালোলাগা মানেই সেটা ভালোবাসা নয়। ভালোবাসা আসে মন থেকে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও কখন কে মনে জায়গা করে নেয় সেটা বোঝাও যায় না।’ তোমাকে আমার ভালো লাগত আর সেটাকে আমি ভালোবাসার সংজ্ঞা দিয়েছিলাম, যদি সত্যি তোমাকে আমি ভালোবাসতাম তাহলে তুমি রিজেক্ট করার পর প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওই অন্যায় কাজটা করতে পারতাম না।আমি সত্যি মন থেকে অনুতপ্ত।”

শ্রেয়া অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
– “আপনি সত্যি বলছেন?”
– “হুমম। আর ওই ভিডিওটা তুমি নিজের হাতে ডিলিট করো, এই নাও।”

হাসিব নিজের ফোন আগিয়ে দিল। শ্রেয়া তো একটার পর একটা ঝটকা খেয়েই চলেছে, মানুষটার মধ্যে এত পরির্বতন!

– “কি হলো ডিলিট করো।”
– “আমি কিভাবে আপনাকে বিশ্বাস করব! হতেও তো‌ পারে আপনি অন্য কোথাও ভিডিওটা রেখেছেন।”
– “অবিশ্বাসও তো করতে পারবে না!”
– “মানে?”
– “আমাকে অবিশ্বাস করার মতো কোনো কাজ আমি কিন্তু এখন করিনি। আর এইটা সত্যি তোমার ভিডিওটা শুধুমাত্র আমার ফোনেই আছে, তাই তুমি ডিলিট করে দিলে আমার কাছে আর্ কিছুই থাকবে না। আজকের পর আমি কখনোই তোমাকে ব্ল্যাকমেইল করব নাহ। আর তুমি চাইলে আগের মতো অফিসে জয়েন করতে পারো।”

শ্রেয়া ভিডিওটা সম্পূর্ণ ডিলিট করে, হাসিবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
– “যদি সত্যি নিজের মানসিকতা বদলাতে পারেন সেটা আপনার জন্যই ভালো। আর চাকরির কথা বলছিলেন! সেটার প্রয়োজন পড়বে না, আমার হবু স্বামীর যা আছে তাতে আমি বসে খেতে পারব।”
– “দোয়া করি সুখী হও।”
– “থ্যাঙ্ক ইউ। আজ তাহলে আসি, আবার কোনদিন দেখা হবে।”

শ্রেয়া যেভাবে এসেছিল সেইভাবেই চলে‌ গেল, কারোর সাথে কথা না বলে। হাসিব নিজের ফোনের সমস্ত খারাপ কিছু ডিলিট করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর মৃদু হেঁসে বলল,
– “ভালোবাসা মানুষ’কে কতই না বদলে দেয়!”

—-

শ্রেয়া ও হাসিবের কথোপকথন শুনে সবাই প্রচন্ড রকমের অবাক।যে ছেলেটা দুইমাস আগেও শ্রেয়ার সাথে রুমডেট করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল, আজ সেই ছেলেটাই শ্রেয়ার কাছে ক্ষমা চেয়ে ভিডিও ডিলিট করে দিয়েছে! এইটা সত্যি অবিশ্বাস্য। শ্রেয়া ভয়েস রেকর্ড অন করে রেখেছিল, যাতে হাসিবের ব্যাপারে কিছু প্রমান জোগাড় করতে পারে কিন্তু তার আর প্রয়োজন পড়ল না। হাসিব সবকিছু ডিলিট করে দিয়েছে, এইটা সবার কাছে খুশির খবর। নাজিয়া ও আবরার দেহে প্রান ফিরে পেল, আর নাটক করতে হবে না এইবার শান্তিতে সংসার করবে। কিন্তু তার আগে শান্ত আর শ্রেয়ার সম্পর্ক’টাকে স্বাভাবিক করতে হবে।

আবরার নাজিয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে নাক ঘষল।

– “কি মিষ্টার এত খুশি কেন আজ!”
– “ঝামেলা মিটছে এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে!”
– “হুমম। তবে এখনো বড়ো দুটো কাজ বাকি আছে।”
– “কি কাজ?”
– “শান্ত’দা আর শ্রেয়া’দির মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটানো আর দ্বিতীয় হলো হাসিব স্যারের‌ সাথে এই মিথ্যা সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসা।”
– “হুম।”

আবরার শান্তর নম্বরে ফোন করল, ছেলেটাকে আবারো বোঝাতে হবে শ্রেয়ার সাথে সবকিছু ঠিক করে নেবার জন্য। কতটা কি পারবে জানে না, তবে চেষ্টা তো করতেই হবে।

– “হ্যাঁ আবরার বল।”
– “কোথায় আছিস তুই?”
– “এই তো বাড়িতেই আছি।কেন?”
– “বলছিলাম শ্রেয়ার‌ ব্যাপারটা নিয়ে কি ভাবলি?”

শান্ত উদাসীন কন্ঠে বলল,
– “ভাবিনি কিছু।”

আবরারের মেজাজ খারাপ হলো। প্রায় ২টো মাস কেটে যাবার পরেও শান্ত এখনো শ্রেয়াকে নিয়ে সিরিয়াস হচ্ছে না, এইরকম চলতে থাকলে একটা সময় গিয়ে সম্পর্কটাই যে নষ্ট হয়ে যাবে।

– “তাহলে আর‌ কি শ্রেয়ার অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দিই?”
– “তুই বিয়ে দিবি কিভাবে!”
– “শালা আমার কথার খুঁত ভালোই ধরতে পারিস, কিন্তু আসল কাজটা করতে পারিস না।”
– “ভাই কি করব বল, শ্রেয়ার সাথে কথা বলার কথা শুনলেই আমার পুরানো সবকিছু মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায়, কিভাবে বিনাদোষে আমাকে ইগনোর করেছিল, আমার ভালোবাসাকে অবহেলা করেছিল।”

আবরার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল,
– “আমার মনে হয় তোদের এই মিথ্যা সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। দুজন মুখোমুখি হয়ে সম্পর্কটার ইতি টেনে দে। বেকার অপেক্ষা করে কি লাভ, শ্রেয়ার বয়স বাড়ছে বাড়ি থেকে বিয়ে দিতে চাইছে কিন্তু ওহ তোর কারনে অপেক্ষা করে আছে। তুই সম্পর্কটা ভেঙে দে, তারপর ওহ বিয়ে করে নিক সংসার করুক।”

শান্ত উত্তর দিল না, উদাসিন হয়ে বসে রইল। অভিমান জিনিসটা বড্ড খারাপ, একবার চেপে বসলে কিছুতেই ছাড়তে চায় না।

—–

নাজিয়ার ফোনে হাসিবের ফোনকল আসে রাত ১০:১৪ মিনিটে। হাসিবের নম্বর দেখেই আবরারের মেজাজ হয়ে যায়, দাঁত দাঁত চেপে আবারো সবকিছু সহ্য করতে‌হবে ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নাজিয়াও বিরক্ত হয়ে ফোনটা রিসিভ করল,

– “হ্যালো কেমন আছো?”
– “জ্বি ভালো। এখন কল করলেন! কিছু দরকার?”
– “তেমন কিছুই না। তবে তোমার সাথে কথা বলতে‌ ইচ্ছা করছিল তাই।”
– “আসলে আমি একটু ব্যস্ত আছি এখন।”
– “এতরাতে ব্যস্ত! কি করছো?”

নাজিয়া বিরবির করে বলল,
– “বরের সাথে রোমান্স করছি দেখবি আয়।”

হাসিব কথাটা বুঝতে পারল না, তাই জিজ্ঞেস করল,
– “কি বললে?”
– “তেমন কিছু না, বাচ্চাটাকে সামলাচ্ছিলাম আর কি।”
– “কোন বাচ্চা!”
– “ওই আমার বাচ্চা, না মানে বাড়ির বাচ্চাটা।”
– “ওহ।”
– “আচ্ছা কাল তো অফ ডে, বিকালের দিকে আমার সাথে দেখা করতে পারবেন?”
– “আচ্ছা কোথায় দেখা করতে হবে সেটা বলো।”

নাজিয়া ঠিকানা বলে ব্যস্ত থাকার বাহানায় কলটা কেটে দেয়। ফোনটা কাটতেই আবরার জিজ্ঞেস করল,
– “কাল দেখা করতে চাইলে কেন?”
– “আমার মনে হয় ওনাকে বলে দেওয়া উচিত আমার সত্যিটা। কোনো মানুষকে অন্ধকারে রাখার অধিকার আমাদের কিন্তু নেয়।”
– “দেখো কোনটা ভালো হয়। আর কিছুক্ষণ আগে কি বলছিলে আমি বাচ্চা! তো চলো বাচ্চামি শুরু করে দিই।”
– “এই না, প্রান আছে উঠে পড়বে।”
– “আমার বাবাই তার মা বাবাকে ডিস্টাব করবে না, এসো‌ তো।”

আবরার নাজিয়াকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল।

পরেরদিন বিকাল,

একই রেস্টুরেন্ট সবাই মুখোমুখি। একটা টেবিলে শান্ত -শ্রেয়া। একটা টেবিলে নাজিয়া -হাসিব আর একটা টেবিলে আবরার ও আবির প্রানকে নিয়ে বসে আছে। বাড়িতে কেউ নেয়, তাই বাধ্য হয়েই প্রানকে নিয়ে এইভাবে বের হতে হয়েছে।

শান্ত নিজের মন মন কফি খেয়ে চলেছে, যেন সামনে কেউ আছে সেটাই দেখতে পাচ্ছে না। শান্তর এইরকম ভাবসাব দেখে শ্রেয়ার প্রচন্ড মনখারাপ হয়, মলিন গলায় বলল,
– “আমাকে কি একটাবার মাফ করা যায় না?”

শান্ত তাচ্ছিল্যের হেসে বলল,
– “অনিইচ্ছাকৃত ভুলের ক্ষমা হয় কিন্তু ইচ্ছাকৃত ভুলের কোনো ক্ষমা হয় না।”

শ্রেয়ার প্রচন্ড অভিমান হলো, ভালোবাসার মানুষটাও ওকে ঠিকমতো বুঝতে পারল না! শ্রেয়া মনে মনে ঠিক করে নিল, আজ আর শান্তর কাছে নিজের মাথা নোয়াবে না, হতেও তো পারে ওইরকম একটা বিষয়ের পর শান্তর শ্রেয়ার সাথে সম্পর্ক রাখতে রুচিতে বাঁধছে তাই সম্পর্কটা থেকে বের হতে চাইছে।

#চলবে….

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-২২

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (২২)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

হাসিব উত্তরের আশায় নাজিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। নাজিয়া নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে কিন্তু ততবারই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

– “কি হলো নাজিয়া উত্তরটা দাও।”

নাজিয়া কাঁপা গলায় বলল,
– “আমি রাজি।”

হাসিবের মুখে হাসির রেখা দেখা গেল, নাজিয়ার দমবন্ধ লাগছে। মিথ্যা নাটক করে হোক আর যে কারনেই হোক আবরার ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পুরুষের সাথে প্রেমের নাটক করতে হবে এইটা ভাবতেই একটা বাজে অনুভুতি হচ্ছে। নাজিয়ার জীবনে আবরার ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পুরুষের স্থান আগেও ছিল না, আর কোনোদিন হবেও না। নাজিয়া শুধু এবং শুধুমাত্র আবরারের।

হাসিব খুশি হয়ে বলল,
– “আমি জানতাম তুমি আমাকে ফেরাতে পারবে না। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ এন্ড লাভ ইউ। আমি তোমাকে রানি করে রাখব আই প্রমিস।”

নাজিয়ার গা রাগে, ঘৃনায় রি রি করে উঠল। অন্য পুরুষের কাছ থেকে এইসমস্ত শুনে নিজের উপরেই ঘৃনা হচ্ছে, ইচ্ছা করছে হাসিবকে ঠাটিয়ে দুটো চড় দিতে কিন্তু নিরুপায়। শ্রেয়াকে কথা দিয়েছে, ওর সম্মানহানী হতে দেবে না, অপরাধীকে শাস্তি দেবে। নিজের ওয়াদা রাখতে এইসব কিছু সহ্য করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

নাজিয়া হাসিবের দিকে তাকিয়ে মেকি হেসে বলল,
– “স্যার আমি কি এখন বাড়ি যেতে পারি?”
– “কেন?”
– “আসলে একটু শরীরটা খারাপ লাগছে।”
– “খুব খারাপ লাগছে? আমি পৌঁছে দিয়ে আসি।”
– “নাহ্ স্যার তার কোনো দরকার নেই, আমি একাই যেতে পারব।”
– “ওকে বাট সাবধানে যাবে।”
– “ওকে।”

নাজিয়া নিজের ডেস্কে থেকে ব্যাগ নিয়ে বের হতে হতে আবরারকে কল লাগল। ফোনটা বাজার সাথে সাথেই রিসিভ হলো।

– “হ্যালো বলো।”
– “কোথায় আছো তুমি?”
– “এই তো বাড়িতেই আছি।”
– “একটু আসতে পারবে!”

আবরারের কপালে ভাঁজ পড়ল। চিন্তিত গলায় বলল,
– “তুমি ঠিক আছো তো?”
– “হুমম। একটু আসো প্লিজ।”

আবরার বিছানা ছেড়ে উঠে শার্ট পড়তে পড়তে বলল,
– “আচ্ছা কোথায় আসব বলো।”

নাজিয়া ঠিকানা’টা দিয়ে রাস্তার ধারে ফুটপাতে বসে পড়ল। সবকিছু বড্ড এলোমেলো লাগছে ওর কাছে, এতদিন সবটা ঠিক ছিল কিন্তু এখন! হাসিব যদি ওর ক্লোজ হতে চাই তো! তখন নাজিয়া কি করবে? সবকিছুর চিন্তায় মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে আবরার’কে ঠকানো হচ্ছে না তো!

আবরার যতটা তাড়াতাড়ি পেরেছে নাজিয়ার দেওয়া ঠিকানায় উপস্থিত হয়েছে। প্রিয়তমা’কে রাস্তার পাশে‌ ফুটপাতে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে আবরারের চিন্তা আরো বাড়ল। এক ছুটে নাজিয়ার সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
– “এই নাজু আর ইউ ওকে!”

নাজিয়া সামনে তাকিয়ে নিজের ভালোবাসার মানুষ, নিজের অর্ধাঙ্গকে দেখে যেন দেহে প্রান ফিরে পেল। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আবরারকে, যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। আবরার নাজিয়াকে নিজের বুকের সাথে আগলে সবটা স্বাভাবিক হবার সময় দিল।

ভালোবাসার মানুষের সংস্পর্শে আসলে অশান্ত মনটা নিমিষেই শান্ত হয়ে যায়। নাজিয়ার অশান্ত মনটাও ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসল, আবরার সেটা বুঝে বলল,
– “চলো।”
– “কোথায়?”
– “গেলেই দেখতে পাবে। চলো তো।”

নাজিয়ার বর্তমান অফিস ও ফ্ল্যাটের মধ্যে একটা পার্ক পড়ে। আবরার নাজিয়াকে নিয়ে সেইখানেই আসলো। পার্কের মধ্যে থাকা লেকের পাশে বসল দুজন। নাজিয়া আবরারের কাঁধে মাথা রেখে সময়টাকে উপভোগ করতে লাগল। দুজন ভালোবাসার মানুষ পাশাপাশি বসে আছে অথচ তাদের মুখে কোনো কথা নেয়, দুজন দুজনকে অনুভব করে সময়টাকে উপভোগ করতে ব্যস্ত।

এইভাবে বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে যায়। আবরার নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখল, নাজিয়া উদাসীন মনে লেকের পানির দিকে তাকিয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে নামমাত্র তাকিয়ে আছে, মাথায় অন্য কিছু ঘোরাঘুরি করছে।

– “নাজু।”

অনেকদিন পর আবরার নাজিয়াকে নাজু বলে ডাকল। একদিন নাজিয়া নিজেই এই ডাকে ডাকার অধিকার কেড়ে নিয়েছিল কিন্তু আজ আর কোনো অধিকার আলাদা করে দিতে হয়নি। যেখানে পুরো মানুষটাই তার নিজস্ব সেখানে ডাকনাম বলাতে অধিকার দেওয়া লাগে কি!

– “হু বলো।”
– “কি হয়েছে? মনখারাপ কেন! হাসিব কি কিছু বলেছে?”
– “নাহ্। তবে আমার বড্ড ভয় লাগছে, মনে হচ্ছে কাজটা ঠিক হচ্ছে না কারোর মন নিয়ে খেলার অধিকার আমার নেই।”
– “মনখারাপ করো না। জানি আমাদের পথটা সঠিক না, কিন্তু এটা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই। তোমাকে নিয়ে আমার কত চিন্তা হয়, অফিসে ঠিকমতো কাজ করতে পারি না। ওই লোকটার সাথে তোমাকে রাখতে আমারও যে বড্ড ভয় করে।”

নাজিয়া আবরারকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তারপর মলিন গলায় বলল,
– “ভয় লাগে যদি তোমাকে হারিয়ে ফেলি তো!”

আবরার নাজিয়ার হাতকে নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল,
– “কিছু হবে না। মৃত্যু ব্যতিত আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না।”

নাজিয়া ঘাড় নাড়ল। মুখে আশ্বাস দিচ্ছে ঠিকই কিন্তু ভয় দুজনের মনেই আছে।

—-

১সপ্তাহ কেটে যায়।
হাসিব আর নাজিয়ার সম্পর্ক আগের থেকে স্বাভাবিক। হাসিব নাজিয়াকে ফোন করে খোঁজখবর নেয়, গল্প করে। এইসব দেখে আবরার সামনে চুপচাপ থাকলেও মনে মনে ফুলছে। আর রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক নিজের বউয়ের সাথে অন্যের প্রেমালাপ কার ভালো লাগে ভাই!

নাজিয়া আবরারকে একটু রাগিয়ে দেবার জন্য ফোনটা স্পিকারে দিয়ে বলল,
– “কি করছেন আপনি?”
– “এই তো বসে‌ বসে তোমার কথা ভাবছি।”
– “পাম দেবার আর জায়গা পাননি! বেকার কেন মিথ্যা বলছেন?”
– “আরে না গো সত্যি বলছি।”
– “আচ্ছা বিশ্বাস করলাম। তবে একটা কথা জানার ছিল।”
– “কি বলো।”
– “আমাকে কবে থেকে পছন্দ করেন?”
– “প্রথমদিন থেকে। যেদিন তোমাকে প্রথম দেখি সেইদিন থেকে তোমাকে আমার ভালো লাগে।”

আবরার আর সহ্য করতে না পেরে নাজিয়াকে দাঁড়ানো থেকে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের কোলের উপর বসিয়ে দেয়। আচমকা এইরকম হওয়াতে নাজিয়া আহ্ বলে চেঁচিয়ে উঠে।

হাসিব জিজ্ঞেস করল
– “কি হলো নাজিয়া? তুমি ঠিক আছো তো!”
– “হ্যাঁ। আপনি বলুন।”

হাসিব গল্প করতে শুরু করল, নাজিয়া একটা কথে উত্তর দিচ্ছে। আর ওইদিকে আবরারের দুষ্টুমির মাত্রা বাড়িয়েই চলেছে। নাজিয়ার পেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে সাইড করতে লাগল, নাজিয়া ছাড়ার জন্য খোঁচা দিয়ে চলেছে কিন্তু আবরার তো ছাড়ার পাত্র না। নাজিয়ার পিঠ থেকে চুলগুলো সরিয়ে পিঠে ঠোঁটের পরশে দিতে লাগল। নাজিয়া পরেছে ফ্যাসাদে, না পারছে কিছু বলতে আর না পারছে সহ্য করতে।

আবরারের দুষ্টুমির‌ সাথে না পেরে বলল,
– “হাসিব আমি আপনার সাথে পড়ে কথা বলব কেমন।”
– “এনি প্রবলেম?”

নাজিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
– “একটা বাচ্চা অনেকক্ষন ধরে জ্বালাচ্ছে, তাকে একটু সামলাতে হবে।”
– “বাচ্চা! বাচ্চা কোথা থেকে আসলো?”
– “আমাদের বাড়ির বাচ্চা। আচ্ছা তাহলে রাখছি বাই।”

নাজিয়া ফোনটা কেটে দিয়ে স্বস্তির‌ নিঃশ্বাস নিল। আবরার নাজিয়াকে বিছানায় ফেলে মুখে ভালোবাসার পরশ দিতে লাগল।

– “এইগুলো কি হচ্ছে?”
– “আদর হচ্ছে, তুমি বুঝবে না।”
– ‘তাই!!”
– “হুমম। এখন চুপ করে থাকে, আমাকে আদর করতে দাও।”

দুজন ভালোবাসার আদর-চাদরে ভেসে গেল।

—–

পরেরদিন সকালটা স্বাভাবিক ভাবে হলেও অফিসের জার্নিটা স্বাভাবিক হলো না নাজিয়ার জন্য। আজ ওহ একা নয় শ্রেয়াও অফিসে যাবে। তাই আবরার আজ বের হতে পারবে না, প্রানকে সামলাবে।

প্রান প্রথম প্রথম কান্নাকাটি করলেও এখন গুড বয় হয়ে গেছে, আগের মতো বেশি আর কান্নাকাটি করে না একটু খাইয়ে দিলে চুপচাপ নিজের মতো খেলতে থাকে। তবে যখন ঝোঁক ধরে থামাতে গেলে পাগল হয়ে যেতে হয়, তখন নাজিয়া ছাড়া কেউ সামলাতে পারে না।

নাজিয়া আর শ্রেয়া একসাথে বাড়ি থেকে বের হলেও অফিসে কিন্তু একসাথে ঢুকল না। নাজিয়া ঢোকার ঠিক ৩০মিনিট পর শ্রেয়া অফিসে ঢুকল। এতগুলো দিন পর শ্রেয়াকে দেখে সবাই খুব অবাক হলো। শ্রেয়া কাউকে কিছু না বলে সোজা হাসিবের কেবিনের দিকে পা বাড়াল। নাজিয়ার প্রচন্ড টেনশান হচ্ছে, এরপর কি হবে!

#চলবে…..

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-২১

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (২১)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

– “মেয়েটার নাম ছিল শ্রেয়া। জানো খুব ভালো ছিল,কি সুন্দর ব্যবহার কিন্তু হঠাৎ করে কোথায় হারিয়ে গেল কে জানে।”

শম্পা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নাজিয়া বলল,
– “যোগাযোগ করার চেষ্টা করোনি?”
– “করেছিলাম কিন্তু পায়নি।”
– “ওহ্।”

তারপর শম্পা আর নাজিয়া দুজনেই নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নাজিয়ার একটা সাইনের দরকার ছিল, তাই হাসিবের কেবিনে টোকা মারল।

– “মে আই কাম ইন স্যার।”
– “হ্যাঁ নাজিয়া এসো, তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”
– “আমার জন্য! কিন্তু কেন?”
– “অফিস শেষে আমার সাথে একটু বের হতে পারবে?”
– “কেন স্যার?”
– “একচুয়ালী আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই।”

নাজিয়া কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর বলল,
– “ওকে স্যার।”
– “তাহলে সবাই অফিস থেকে চলে যাবার পর তুমি আর আমি বের হবো একসাথে।”
– “আচ্ছা।”

অফিস শেষে সবাই বেরিয়ে যায়। নাজিয়া কাজ আছে এই বাহানায় অফিসে হাসিবের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, হাসিব কেবিন থেকে বেরিয়ে নাজিয়ার ডেস্কের কাছে এসে বলল,
– “চলো তাহলে।”
– “চলুন।”

গাড়িটা একটা বিলাসবহুল ফাইভস্টার হোটেলের সামনে থামল। হাসিব নাজিয়াকে নিয়ে ভেতরে গেল, নাজিয়া চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখছে সেটা দেখে হাসিব বলল,
– “জায়গাটা পছন্দ হয়েছে?”
– “হুমম খুব সুন্দর জায়গা।”
– “আচ্ছা বলো কি খাবে।”
– “আপনি যা খাবেন তাই খাবো।”

হাসিব মৃদু কন্ঠে বলল,
– “তাহলে একটা ছোটখাটো হয়ে যাক!”

ওর কথার অর্থ নাজিয়া বুঝল না, তাই ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– “মানে?”
– “আরে মজা করে বললাম। খাবে নাকি মদ!”
– “ছিঃ এইসব আবার মানুষ খায় নাকি!”

হাসিব অভিজ্ঞ মানুষদের মতো করে বলল,
– “তাহলে কি আমি মানুষ না!”
– “না সেটা কেন হতে যাবেন? আমি তো বলেছি যারা মদ খায় তারা মানুষ না। এইসব আমার একদম পছন্দ না।”
– “আচ্ছা তাহলে আজ থেকে সব বাদ।”
– “কি!!”
– “আজ থেকে আমি আর কোনোরকমের নেশা করব না, প্রমিস।”

নাজিয়া চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইল‌ হাসিবের দিকে, ওহ কি ভুল কিছু শুনছে!

– “আপনি আমার কথা শুনবেন কেন?”
– “বিকজ আই লাভ ইউ।”

নাজিয়ার বিস্ময়ে মুখটা হাঁ হয়ে গেল।

– “স্যার আপনি এইসব কি বলছেন?”
– “স্যার না শুধু হাসিব, তোমার হাসিব।আমি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে দেখার পর থেকে আমি আর কোনো কিছুতে মন বসাতে পারছি না, নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে।”
– “স্যার আপনি এইসব কি বলছেন? আপনি অফিসের বস আর আমি সাধারন একজন কর্মচারী।”
– “ভালোবাসা কি স্ট্যাটাস দেখে হয়?”

নাজিয়া কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল,
– “আমি ভেবে আপনাকে সিদ্ধান্ত জানাব, আজ আসি।”

হাসিবকে আর কিছু বলতে না দিয়ে নাজিয়া তড়িৎ বেগে উঠে চলে গেল। হাসিব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– “নাজিয়া আমাকে এক্সসেপ্ট করবে তো!”

নাজিয়া আড়ালে এসে প্রানভরে শ্বাস নিল। এতক্ষন মনে হচ্ছিল বাঘের ডেরায় বসে আছে, আর ক্ষুধার্ত বাঘকে বলছে আমাকে‌‌ খাবি! নাজিয়া হাসিবের কথাগুলো বিরবির করছিল আর মুখ ভেংচি কাটছিল তখনি পেছন থেকে ওকে কেউ জড়িয়ে ধরে, আচমকা এইরকম হওয়াতে প্রচন্ড রকমের ভয় পেয়ে চেঁচাতে যাচ্ছিল। আবরার নাজিয়ার মুখটা চেপে ধরে বলল,
– “আরে বউ আমি, আমাকে কি গনপিটুনি খাওয়াতে চাও নাকি!”

নাজিয়া কনুই দিয়ে আবরারের পেটে একটা ঘুষি দিয়ে বলল,
– “এইভাবে কেউ আচমকা ধরে! আমার তো এখুনি হার্ট এ্যাটাক হয়ে যেত।”
– “কিছু হতো নাহ, আমি আছি তো।”

নাজিয়া আবরারকে জড়িয়ে ধরল। আবরার নিজের স্ত্রীর চুলে ঠোঁট ছোঁয়ালো, আজ ৮দিন পর দুজনের দেখা হলো তাই একটু ইমোশনাল হয়ে পড়েছে দুজন।

– “এই ছাড়ো এইটা পাবলিক প্লেস।”
– “ছাড়তে ইচ্ছা করছে না তো।”
– “চলো বাড়ি চলো।”
– “হুমম চলো।”

নাজিয়া ও আবরার ফ্ল্যাটে আসে। গত একমাস ধরে ওরা এই ফ্ল্যাটেই আছে, ফ্ল্যাটটা শান্তর। দরজায় কলিং বেল বাজাতেই শ্রেয়া দরজা খুলে দিল।

নাজিয়া ভেতরে যেতে যেতে বলল,
– “প্রান কি করছে?”
– “এইমাত্র ঘুমাল। বাবা তোমার ছেলেকে সামলাতে আমাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।”

নাজিয়া মৃদু হাসল। শ্রেয়া ওকে আর আবরারকে পানি এগিয়ে দিল।

– “আবরার তুমি কখন আসলে?”
– “বউকে ছেড়ে আর কতদিন থাকব তাই চলে এসেছি।”

শ্রেয়া মলিন কন্ঠে বলল,
– “আমার কারনে তোমাদের কত কি সহ্য করতে হচ্ছে। সবকিছুর জন্য আমি দায়ী তাইনা।”

আবরার শ্রেয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
– “ধূর পাগলি তোর জন্য আমাদের কিছুই সহ্য করতে হচ্ছে না। আর বোনের জন্য এইটুকু করতে না পারলে আমরা কিসের দাদা!”
– “নাজিয়া ওই লোকটার আশেপাশে থাকছে আমার খুড ভয় লাগছে, ওহ যদি নাজিয়ার কিছু ক্ষতি করে দেয় তো!”

আবরার মলিন হাসল, চিন্তা তো ওরও হচ্ছে কিন্তু কিছু করার নেয় হাসিবকে মাত দিতে হলে এইভাবেই দিতে হবে।

নাজিয়া শ্রেয়াকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
– “চিন্তা করো না আমার কিছু হবে না। তুমি বরং শান্ত’দার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করো, ছেলেটা কিন্তু এখনো তোমার উপরে অভিমান করে আছে।”
– “কি রাগ ভাঙাব, আমার সাথে তো‌ ঠিকমতো কথাই বলে না।”
– “রাগ অভিমান বেশি বাড়তে দিস না, সম্পর্কটা দূর্বল হয়ে পড়বে।”

শ্রেয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– “চেষ্টা তো করছি কিন্তু শান্ত তো আমার সাথে কথাই বলছে না, কিভাবে কি করব!”
– “চেষ্টা করতে থাক, ঠিক হয়ে যাবে।”

নাজিয়া ফ্রেশ হয়ে প্রানকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল। এই সবকিছুর মাঝে ছোট প্রানকে সময় দিতে পারছে না, সারাদিন শ্রেয়ার কাছেই প্রান থাকে।

১মাস আগে বাড়ির সবাইকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে নাজিয়া এইখানে আসে। আবিরের মা কিছুতেই রাজি ছিলেন না, বাধ্য হয়ে নাজিয়া ওনাকে সবটা বলেন। উনি নাজিয়াকে এত বড়ো রিস্ক নিতে বারবার বারন করেন, কিন্তু সবকিছু ঠিক করা হয়ে গিয়েছিল ফেরার কোনো পথ নেয়। নাজিয়া ও শ্রেয়া শান্তর ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করে, নাজিয়া শান্তকে শর্ত দেয় ওহ যতদিন এই ফ্ল্যাটে থাকবে ততদিন শান্ত এইখানে আসতে পারবে না। শান্ত অবাক হয় এইরকম কথা শুনে, তারপর ভাবে হয়তো নাজিয়া ভয় পাচ্ছে তাই আর কথা বাড়ায় না রাজি হয়ে যায়।

আবরার প্রতি সপ্তাহে নাজিয়ার কাছে আসে, আবিরও মাঝেমধ্যে দেখা করে যায়। আর নাজিয়ার পেছনে একজন গার্ড সবসময়ে থাকে, সে সবকিছু আপডেট শান্তকে জানায়।প্ল্যানমতোই সবকিছু আগিয়ে চলেছে, দেখা যাক সামনে কি হয়।

আবরার ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল নাজিয়া প্রানকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। কি সুন্দর একটা মুহূর্ত, মা ছেলের ভালোবাসার দৃশ্য। আবরার দৃশ্যটা ক্যামেরাবন্ধি করে নেয়।

– “এই কি করছো তুমি?”
– “মা ছেলের সুন্দর মুহূর্তটা ক্যামেরাবন্ধি করে নিলাম।”
– “দেখি দাও।”

আবরার নিজের ফোনটা নাজিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিল, নাজিয়া ছবিটাকে ভালো করে দেখতে লাগল।

– “কি সুন্দর হয়েছে, আমাকে পাঠিয়ে দাও তো ফোনের ওয়ালপেপার করব।”

আবরার মজা করে বলল,
– “আমার সবকিছুতেই প্রান ভাগ বসিয়ে দিচ্ছে।”

নাজিয়া চোখ পাকিয়ে বলল,
– “ওইটুকু একটা বাচ্চার সাথে হিংসুটেপনা করতে লজ্জা লাগে না!”
– “ছেলেকে হিংসা করব, এতটাও খারাপ বাবা আমি না।”

নাজিয়া হঠাৎ করেই আনমনা হয়ে গেল, নিসা থাকলে সবকিছু অন্যরকম হতো। হয়তোবা নাজিয়া আর আবরার এক হতো না, প্রান ওর‌ নিজের বাবা মায়ের কাছেই থাকত।

– “এই কি ভাবছ?”
– “দিদি থাকলে সবকিছু অন্যরকম হতো তাই না!”

আবরার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– “হয়তো। তবে মনখারাপ করো না, যেটা হয় আমাদের ভালোর জন্যই হয়।”
– “হুমম।”

আবরার নাজিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– “এখন চুপ, আমি ঘুমাব বড্ড টার্য়াড।”

নাজিয়া মৃদু হেসে আবরারের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকল।

***
আজকে অফিসে নাজিয়া একটু ভয়ে ভয়েই এসেছে। হাসিবের মুখোমুখি হতে হবে, এবং উত্তরটা দিতে হবে। নাজিয়া তো ওর উত্তর বলবে, কিন্তু তারপর কি হবে?

ভয়টাকে সত্যি করে পিওন জানাল হাসিব নাজিয়াকে ডাকছে। নাজিয়া নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে হাসিবের কেবিনে গেল।

– “কেমন আছো?”
– “আলহামদুলিল্লাহ ভালো আপনি?”
– “আলহামদুলিল্লাহ। তা কালকের উত্তরটার কথা কিছু ভাবলে?”
– “আসলে স্যার….

#চলবে…

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-২০

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (২০)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

“এখন শ্রেয়া যদি নিজের মুখে সবটা বলে আর তোকে বিয়ে করতে চায় তো?”

শান্ত কোনো উত্তর দিল না দেখে আবরার বুঝল অভিমানের পাল্লাটা অনেকটাই ভারি হয়ে গেছে। যেটা ভাঙতে শ্রেয়াকে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হবে।

– “অভিমান করেছিস ভালো কথা, তবে দেখিস অভিমানের পাল্লাটা এতটাও ভারি করে ফেলিস না যাতে ভালোবাসার মানুষটি হারিয়ে যায়।”

শান্ত তাচ্ছিল্যের হেসে বলল,
– “যে যাবার সে তো যাবেই, জোর করে কি কাউকে আগলে রাখা যায়! আর যে থাকার সে ঠিকই থাকবে।”
– “উঁহু ভুল বললি, কখনো-সখনো পরিস্থিতির শিকার হয়ে মানুষ অনেক বড়ো‌ সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। পরিস্থিতির কাছে হার মেনে ভালোবাসার মানুষটিকে ছেড়ে দেয়, দোষ না করেও দোষী হতে হয় সমাজ এবং ভালোবাসার মানুষটির কাছে। তাই বলব, যেটা করবি ঠান্ডা মাথাতে ভেবে করবি। ভুল করা খুব সহজ কিন্তু ভুলটা শুধরে নেওয়া খুব কঠিন।”

২দিন‌ পর,
আজ‌ আবারো সবাই একত্রিত হয়েছে। আবির আবরার শান্তর জন্য অপেক্ষা করছে। শান্ত কিছু কথা বলার জন্য আবিরকে ডেকে পাঠিয়েছে, সাথে আবরারকেও বলেছে‌ আসার জন্য। নাজিয়া ইচ্ছাকৃতভাবেই আসেনি, হয়তো নাজিয়া থাকলে শান্ত কথা বলতে দ্বিধা করতে পারে তাই ওরা একা যাওয়াটাই শ্রেয়।

– “সরি ফর লেট।”

শান্ত তড়িঘড়ি চেয়ারে বসতে বসতে বলল। আবির, আবরার দুজন ওর দিকে তাকাল শান্ত ঘামছে, দেখে মনে হচ্ছে তাড়াহুড়ো করে এসেছে।

– “পানি খা একটু।”
– “হু।”

শান্ত পানিটা খেয়ে কিছুটা দম নিল। তারপর আবরারের দিকে তাকিয়ে বলল,
– “ভাবি আসেনি?”
– “নাহ্। কেন?”
– “ভাবিকে আমার একটা হেল্প করতে হবে।”
– “কি হেল্প?”

শান্ত আবির আবরারকে সবটা বুঝিয়ে বলল। আবির সবটা শুনে চিন্তিত গলায় বলল,
– “বিষয়টা একটু বেশি রিস্ক হয়ে যাচ্ছে না?”
– “একটু তো রিস্ক আছেই, দ্যাখ আবরার আমি আমার প্ল্যান বলেছি এখন সিদ্ধান্ত তোর আর ভাবির।”

আবরার আবিরের দিকে তাকাল, আবির চোখের ইশারায় বোঝাল শান্ত মাথায় চিন্তা করার জন্য।

শান্ত আবরারের দিকে তাকিয়ে বলল,
– “চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিস।”

আবরার কিছু না বলে নাজিয়ার নম্বরে কল লাগাল।

– “হ্যালো।”
– “হ্যাঁ বলো।”
– “কোথায় আছো তুমি?”
– “এই তো প্রানকে নিয়ে ঘরেই আছি।”
– “আশেপাশে কেউ আছে?”
– “নাহ্ বলো।”

আবরার নাজিয়াকে কিছু একটা বলল, নাজিয়া কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল,
– “আমি রাজি, আমার কোনো আপত্তি নেই।”
– “ওকে।”

আবরার কলটা কেটে শান্ত’র দিকে তাকিয়ে বলল,
– “নাজিয়া রাজি। তুই প্ল্যান সাজা…

***

একটা বড়ো অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নাজিয়া। এই অফিসে জবের জন্য এসেছে। রিসেপশনে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– “ইন্টারভিউ’টা কোথায় হচ্ছে?”
– “সামনে গিয়ে ডানদিকে।”

নাজিয়া ধীর পায়ে এগিয়ে গেল, বড্ড টেনশন হচ্ছে যেভাবেই হোক চাকরিটা ওকে পেতেই হবে।অনেকেই জবের জন্য এসেছে, নাজিয়া একপলক সবার দিকে তাকাল। এত জনের মধ্যে চাকরিটা কি আদৌও পাবে!

একে একে নাজিয়ার পালা আসল। নাজিয়া নিজের চোখের চশমাটা পেছনের দিকে ঠেলে কেবিনের দরজায় নক করল,
– “মে আই কাম ইন স্যার।”
– “ইয়েস…

নাজিয়া দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল, ভেতরে তিনজন ছেলে বসে আছে। সবাই নাজিয়ার দিকে নজর দিল, পরনে সাধারন থ্রি-পিস, চোখে চশমা সব মিলিয়ে সাধারন একটা মেয়ে।

নাজিয়া নিজের ডকুমেন্টস জমা দিল, ওর নম্বর ভালোই ছিল। তিনজনের মধ্যে একজন বলল,
– “আপনার নম্বর তো ভালোই কিন্তু আপনার মাঝে অনেককিছুর কমতি আছে। আপনি নিশ্চয় জানেন স্মার্টনেস একটা জবের ক্ষেত্রে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।”
– “জ্বি স্যার। স্যার চাকরিটা আমার খুব দরকার, প্লিজ আপনারা একটু দেখুন। আর আমাকে একটু সময় দিলে আমি সবকিছু শিখে নেব।”

তিনজন নিজেদের মধ্যে কিছু একটা আলোচনা করলেন। তারপর একজন বললেন,
– “আপনি একটু বাইরে গিয়ে বসুন, আমরা জানাচ্ছি আপনাকে।”

নাজিয়া ঘাড় নাড়িয়ে বাইরে চলে গেল। তিনজন লোক নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগল,

– “মেয়েটার রেজাল্ট ভালোই আছে, রাখা যেতে পারে।”
– “কিন্তু মেয়েটা স্মার্ট না, আর আগে চাকরির কোনো অভিজ্ঞতা নেয়। এইরকম মেয়েকে কি নেওয়া ঠিক হবে? হাসিব তুই কি বলিস?”
– “আমার কাছে তো মেয়েটাকে ভালোই লেগেছে।না মানে বলছিলাম, তিনমাসের জন্য মেয়েটাকে রেখে দাও। তিনমাস পর পারফরমেন্স দেখে চাকরি ফাইনাল করবে।”
– “এটা খারাপ বলিস নি।তবে সেটাই হোক।”

নাজিয়াকে ডেকে সবটা জানিয়ে দেওয়া হয়।

– “তিনমাস মন দিয়ে কাজ করো, এই তিন মাসের কাজের উপরেই তোমার চাকরি নির্ভর করছে।”
– “থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।”

তিনজন স্যার নাজিয়ার সাথে হ্যান্ডশেক করে চলে গেল। তারা নাজিয়া’কে জানায় কাল থেকেই ওর জয়েনিং।

——

পরেরদিন, সঠিক সময়ে নাজিয়া অফিসে উপস্থিত হয়। একজন মেয়ের সাথে ওর ভালোই পরিচয় হয়, মেয়েটার নাম শম্পা অনেকদিন যাবত এই অফিসেই কাজ করছে।

– “আচ্ছা এই অফিসের এমডি কে?”
– “এমডি তো হাসিব স্যার।”
– “ওহ।”

আরো কিছু টুকটাক কথা আলোচনা হতে থাকল, নাজিয়া অফিসের মোটামুটি সবার সম্পর্কে জানতে পেরেছে শম্পার কাছ থেকে। হাসিব স্যার কেবিনে আসার কিছুক্ষণ পর, একজন মোটামতো লোক দেখে মনে হচ্ছে পিওন টাইপের কিছু একটা কাজ করে। সে এসে বলল,
– “নাজিয়া’কে স্যার নিজের কেবিনে যেতে বলল।”

শম্পা নাজিয়াকে বলল,
– “যাও স্যার ডাকছে।”
– “হুম।”

নাজিয়া নিজের চশমাটা ঠিক করে পড়ে কেবিনের দরজায় টোকা মারল। হাসিব অফিসের মেইল চেক করছিল, দরজায় টোকা মারার শব্দে ভেতরে আসতে বলল।

– “স্যার আমাকে ডেকেছিলেন?”

হাসিব নাজিয়াকে একনজর পুরো পর্যবেক্ষন করে বলল,
– “হ্যাঁ, বসো।”

নাজিয়া হাসিবের সামনে‌ বসতেই হাসিব মিষ্টি হেসে বলল,
– “আজকে তো প্রথমদিন তো কেমন লাগছে?”
– “খুব ভালো স্যার। আমি তো কাজ নিয়ে খুব এক্সসাইটেড।”
– “আই হোপ তুমি পারবে।”
– “নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করব স্যার।”
– “ইয়েস, এই স্পিডটাই তো দেখতে চায়।”

কিছুক্ষন কথা বলার পর হাসিব ম্যানেজারকে ডেকে বলল,
– “নাজিয়াকে নিজের কাজগুলো বুঝিয়ে দাও। আর নাজিয়া বেস্ট অফ লাক।”
– “থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।”

—–

সময় পানির মতো এগিয়ে চলেছে, আজ নাজিয়ার অফিসে জয়েনিং এর ১মাস পূর্ণ হলো। নাজিয়া পুরোদমে নিজের বেস্টটা দেবার চেষ্টা করে চলেছে, আর কিছুটা সফলও হয়েছে। হাসিবের সাথেও একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, সবকিছু মিলিয়ে নাজিয়ার জীবন ভালোই কাটছে।

নাজিয়া রোজকার মতো অফিসে গিয়ে নিজের ডেস্কে আসতেই শম্পা বলল,
– “কি নাজিয়া কি খবর।”
– “এই তো সবকিছু আলহামদুলিল্লাহ, তোমার।”
– “আলহামদুলিল্লাহ ভালোই। স্যারের সাথে দেখলাম ভালোই ভাব হয়েছে।”

নাজিয়া কিছুটা লজ্জা পাবার ভান করে বলল,
– “ওই আর কি।”
– “থাক আর লজ্জা পেতে হবে না।‌ লেগে থাকো, হয়ে যেতেও পারে।”
– “আরে দূর তুমি কি বলো না।”

শম্পা হেসে দিয়ে বলল,
– “বুঝি বুঝি সব বুঝি গো।”

নাজিয়া কথার টপিক অন্যদিকে নিয়ে যাবার জন্য বলল,
– “শম্পা’দি হাসিব স্যারের পার্সোনাল পি.এ নেয় কেন?”

শম্পার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। কিছুটা মনখারাপ করে বলে,
– “তুমি জয়েন করার ১মাস আগে পর্যন্ত একজন মেয়ে ছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই মেয়েটা চাকরি ছেড়ে দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়।
– “নাম কি মেয়েটার?”
– “শ্রেয়া।”

#চলবে…

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-১৯

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (১৯)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

– “তুই হঠাৎ করে এইসব জিজ্ঞেস করছিস কেন?”

শান্ত আবরারকে প্রশ্ন করল, আবরার নাজিয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে বলল,
– “এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম।”

কথাটা কেন যেন শান্তর কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না, তবুও কিছু না বলে গল্প করতে লাগল।

– “এক্সকিউজ মি।”

ওরা তিনজন মাথা তুলে তাকাল। আবির দাঁড়িয়ে আছে,

– “এখানে শান্ত কে?”
– “আমি কেন?”
– “আমি আবির তোমাকে কল করছিলাম।”
– “কিন্তু আমি তো আপনাকে কল করে বললাম আজকে মিট করতে পারব না।”

আবির বিজ্ঞদের মতো বলল,
– “শোন ছেলে কথা দিলে কথা রাখতে হয়। তুমি একজনকে কথা দিয়েছ আজ তার সাথে দেখা করব, কিন্তু দেখা করার কিছু মুহূর্ত আগে বলছ দেখা করতে পারবে না। এইটা কিন্তু ঠিক না।”

শান্ত মাথা নিচু করে নিল, আসলে অনেকদিন পর বন্ধুকে পেয়ে ভুলে গিয়েছিল বিষয়টা।

– “সরি। আপনি বসুন না, কি বলতে চান বলতে পারেন এরা আমার ফ্রেন্ড।”

আবির আয়েশ করে বসে কিছু বলতে যাবে তার আগে ওয়েটার কফি তিনটে দিয়ে গেল। আবির কোল্ড কফিটা নিয়ে চুমুক দিয়ে বলল,
– “কফিটা দারুন টেস্টি।”

শান্ত বিরক্ত হলো আবিরের কাজে। লোকটা আসল কথা না বলে পেঁচিয়ে চলেছে, এর আসল উদ্দেশ্যে কি? কেন ডেকে পাঠিয়েছে?

আবির শান্তর দিকে তাকিয়ে বলল,
– “জানি মনে মনে অনেক গালাগালি দিচ্ছিস, দে দে এখন তোদেরই বাজার।”

তুই’ সম্বোধন’টা একদম আপন, সমবয়সী, বন্ধু, ছোট ভাইবোনকে বলা যায়। কিন্তু অচেনা মানুষকে বলা যায় এটা শান্ত জানত না! আবিরের মুখে তুই সম্বোধন’টাই প্রচন্ড রকমের অবাক হলো, কি রিয়াক্ট করা উচিত সেটাই বুঝতে পারল ষা। অচেনা একজন ব্যক্তি তুই বলেছে বলে তার সাথে ঝামেলা করবে! নাকি চুপচাপ সবটা দেখবে সেটাই বুঝল না।

শান্ত আবিরের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
– “আপনি কি বলতে চাইছিলেন! কাইন্ডলি কথাটা বললে উপকৃত হতাম।”

আবির নড়েচড়ে বসল, আবরারের দিকে ইশারা করল বলার জন্য কিন্তু আবরার ওকে পাত্তা না দিয়ে বলল,
– “হ্যাঁ আপনার কি বলার আছে বলে ফেলুন, হেঁয়ালি না করে।”

আবির ওদের তিনজনের দিকে একপলক তাকিয়ে বলল,
– “আমি শ্রেয়ার ব্যাপারে তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।”

শ্রেয়া! নামটা শুনে শান্ত চমকে উঠল। আবির শ্রেয়াকে চিনল কেমন করে?

– “আপনি শ্রেয়াকে চেনেন?”
– “হুমম, খুব ভালো করেই চিনি। তোমাকে আজকে কিছু জানানোর জন্য ডেকেছি, একটু ধৈর্য নিয়ে কথাগুলো শুনবে তারপর ঠিক -ভুল বিচার করবে।”

শান্ত থাকতে চাইলেই কি শান্ত থাকা যায়। আবিরের কথাগুলো শান্তর ভেতরে এলোমেলো করে দিচ্ছে, শ্রেয়ার ব্যাপারে লোকটা কি বলবে? খারাপ কিছু কি?

আবির আবরারের দিকে তাকাল, ওহ চোখের ইশারায় সবটা বলতে বলল। আবির নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলল,
– “একসপ্তাহ আগে শ্রেয়া সুই-সাইড করার চেষ্টা করেছিল।”

শান্ত চমকে উঠল, শ্রেয়া সুই-সাইড করার চেষ্টা করেছে বিষয়টা শোনার পর উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
– “এইসব আপনি কি বলছেন? শ্রেয়া ঠিক আছে তো!”
– “হুমম ঠিক আছে। তুমি শান্ত হও, এখনি ভেঙে পড়লে চলবে না এখনো অনেক ধাক্কা নিতে হবে।”
– “অনেক ধাক্কা মানে!”

আবির শান্তকে বিস্তারিত বলল। শান্ত নিরুত্তর ভাবে আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আবির ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
– “এইবার তোমার মতামত বলো।”

শান্ত সেই উত্তরটা না দিয়ে আবিরকে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল,
– “আপনি শ্রেয়ার কে হন?”
– “সেটা সময় হলেই জানবে, এখন উত্তরটা দাও।”
– “আমি আপনাকে কিভাবে বিশ্বাস করব, যে আপনি সত্যি কথা বলছেন? হতেই তো পারে আপনি মিথ্যা বলছেন!”

আবির‌ মাথা নাড়িয়ে বলল,
– “আমি তো মিথ্যা বলতেই পারি, কিন্তু তোমার মনে‌ কি প্রশ্ন জাগছে না শ্রেয়া হঠাৎ করে তোমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিল কেন? কেন তোমাকে সবজায়গা থেকে ব্লক করে দিল?”
– “আপনি এইগুলো জানলেন কিভাবে?”
– “দেখছ তো‌ সবকিছুই জানি, তাহলে বিশ্বাস করতে পারছ না কেন? আর শ্রেয়ার নামে মিথ্যা বলে আমার লাভ কি!”
– “লাভ-লোকসন আমি জানি না। তবে শ্রেয়া যদি একটিবার আমাকে সবকিছু খুলে বলত, আমি নিজে ওকে হেল্প করতাম।”
– “তাহলে এখন করো। এখন করতে অসুবিধা আছে?”

শান্ত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কিছু একটা ভাবতে লাগল, আবরার শান্তর দিকে দেখছে।ছেলেটার মধ্যে কি চলছে?

– “কি হলো? চুপ করে গেলে যে! ভালোবাসা বুঝি ফুরিয়ে গেল।”

আবিরের খোঁচা মারা কথা শুনে শান্ত মৃদু হেসে বলল,
– “আমার ভালোবাসা এতটাও তুচ্ছ নয় যে এই সামান্য কারনে ফুরিয়ে যাবে। আবার এতটাও সস্তা নয় যে কারোর অবহেলার পরেও তার কাছে বারবার ফিরে যাবো। আপনার কথাগুলো যদি সত্যি হয় তাহলে আমি আমার সবটা দিয়ে শ্রেয়ার সম্মান রক্ষা করব তবে শ্রেয়া না চাইলে আমি আর ওর জীবনে আর‌ ফিরব না।যে হারাতে চাই, তাকে হারিয়ে যেতে দেওয়াটাই শ্রেয়। জোর করে আর যাইহোক ভালোবাসাটা হয় না।”

শান্তর কন্ঠে স্পস্ট অভিমান। শ্রেয়ার এড়িয়ে চলা, অকারনে ব্লক দেওয়া সবটাই বড্ড আঘাত পেয়েছে ছেলেটা। অভিমান করেছে ভালোবাসার মানুষটার উপর। অন্যদিকে, শ্রেয়া নিজের এলোমেলো জীবন নিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে আসল মানুষটাকেই বড্ড আঘাত দিয়ে ফেলেছে, ফলে দুজনের মাঝে দুরত্ব তৈরি হয়েছে। আচ্ছা এই দূরত্ব কি মিটবে, নাকি অভিমানের পাল্লা ভারী হতে‌ হতে ‘এক আকাশ দূরত্ব’তে পরিনত হবে!

– “তোর মাথায় কি ঘুরছে? কি করবি!”

আবরার এতক্ষনে মুখ খুলল। শান্ত আবরারের দিকে তাকিয়ে বলল,
– “আমার একজন ডিটেকটিভ ফ্রেন্ড আছে, আমি তাকে বলব ওই লোকটার বিষয়ে খোঁজখবর নিতে। যদি সন্দেহজনক কিছু পায় তারপর সিদ্ধান্ত নেব।”
– “আমি কি কিছু হেল্প করব?”
– “প্রয়োজন পড়লে আমি নিজে চেয়ে নেব।”

সেদিনের কথাবার্তা এইখানেই শেষ হয়। আবির-আবরার, নাজিয়া বাড়ি ফিরে আসে, শান্ত তখনও জানে না ওদের আসল পরিচয়। শ্রেয়ার সাথে ওদের কি সম্পর্ক। অনেকগুলো প্রশ্ন মাথায় উঁকি দিচ্ছে কিন্তু তার উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। শান্ত ডিটেকটিভ বন্ধুকে ফোন করে শ্রেয়ার অফিসের বসের ব্যাপারে খোঁজ নিতে বলল, ওই লোকটার চরিত্র জানলেই সবকিছু পরিস্কার হয়ে যাবে।

***

শান্ত একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে চলেছে, সাধারনত ওহ স্মোক করে না মাঝেমধ্যে বন্ধুদের তালে পড়ে একটান দিয়ে দেয়, কিন্তু শ্রেয়ার বিষয়টি জানার পর থেকে নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা তার মাঝে পড়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, আর ততই শ্রেয়ার উপরে রাগ-অভিমান তীব্রতর হয়ে উঠছে। মেয়েটা একটাবার ওকে সবকিছু খুলে বলতে তো‌ পারত, কিন্তু কেন বলল না! কেন এইভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল!

শান্তর ফোন বেজে উঠল, স্কিনে আবরারের নামটা ভেসে উঠেছে। কফিশপে বসে দুজন দুজনের নম্বর আদানপ্রদান করেছিল।

– “হ্যালো বল।”
– “কি করছিস?”

শান্ত সিগারেটে একটান দিয়ে বলল,
– “সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছি।”
– “কবে থেকে ধরলি?”
– “আজ থেকে।”

আবরার শয়তানি করে বলল,
– “বউয়ের মার খাবার জন্য রেডি থাকিস। শ্রেয়া কিন্তু স্মোক করা ছেলেদের একদম পছন্দ করে না।”

প্রথম কথাতে শান্ত হেসে উঠলেও দ্বিতীয় কথাটাতে ভ্রু কুঁচকে বলল,
– “তুই কিভাবে জানলি শ্রেয়া স্মোক করা পছন্দ করে না।”

আবরার আমতা আমতা করে বলল,
– “আরে ভাই বেশিরভাগ মেয়েরা তো স্মোক করা পছন্দ করে না, তাই বললাম। আচ্ছা বল কি জানতে পারলি।”
– “আপাতত কিছু খবর পায়নি। খোঁজ চালাচ্ছে, দেখা যাক কি খবর পায়‌।”
– “একটা প্রশ্ন ছিল।”
– “কি বল।”
– “তুই তো চাইলেই বিষয়টা খতিয়ে না দেখে লোকটার কথা বিশ্বাস করে কোনো স্টেপ নিতে পারতিস? কিন্তু সেটা না‌ করে এইসব করছিস কেন?”

শান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– “এযুগে দাঁড়িয়ে কাউকে বিশ্বাস করা মানেই বোকামি। আমি তো নিজেকেই নিজে বিশ্বাস করি না আর অন্য কাউকে তো দূর। ঘটনাটা যদি আমি সরাসরি শ্রেয়ার মুখ থেকে শুনতাম, তাহলে আমার এতটা খতিয়ে দেখার দরকার ছিল না। কিন্তু শুনেছি কোথা থেকে? একজন অচেনা মানুষের কাছ থেকে, যে আদৌও সত্যি বলছে কিনা সেটাও জানি না। এমনকি মানুষটা কে! শ্রেয়ার কে হয়, বিষয়টা কিভাবে জানল সেইসবের কিছুই জানি না। তার কথা বিশ্বাস করে, একজন প্রভাবশালী মানুষের সাথে ঝামেলা করতে যাওয়া মানে বোকামী।তাই আগে সবটা জানব, তারপর ভাবব কি করব।”

– “এখন শ্রেয়া যদি নিজের মুখে সবটা বলে আর তোকে বিয়ে করতে চায় তো?”

#চলবে….

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-১৮

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (১৮)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

নাজিয়া আবরারকে সবকিছু খুলে বলল, সবটা শুনে আবরার প্রচন্ড রেগে যায়। শ্রেয়াকে সববসময়ে বোনের নজরে দেখেই বড়ো হয়েছে, শুধুমাত্র মাঝের কয়েকটা বছর বিয়ের কথা উঠাতে আবরার শ্রেয়াকে এড়িয়ে চলত।

আবরারকে উত্তেজিত হয়ে পড়তে দেখে নাজিয়া বলল,
– “মাথা গরম করলে কিছুই হবে না। আমাদেরকে খুব শান্ত মাথাতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
– “কিন্তু আমি যে শান্ত হতে পারছি না। একটা মানুষ এতটা নীচ কিভাবে হয়?”
– “দুনিয়ার সবার মানসিকতা এক হলে তো‌ হয়েই যেত। বাদ দাও সে তার হিসাব দেবে, এখন আমাদেরকে ভাবতে হবে কিভাবে শ্রেয়া’দির ভিডিওটা ডিলিট করা যায়।”
– “দাদাকে সবটা বলি, তারপর সবাই মিলে একসাথে বসে আলোচনা করব।”
– “হুমম সেটাই ভালো হবে।আর শোন তোমাকে আর একটা কাজ করতে হবে।”
– “কি কাজ?”
– “শ্রেয়া’দির বয়ফ্রেন্ড শান্তের সাথে মিট করতে হবে, আমার মনে হয় ওর সবটা জানা জরুরী।”
– “হুমম, আমারও তাই মনে হয়। তবে সেইসব হবে তার আগে দাদাকে সবটা বলতে হবে।”
– “হুমম।”

***

নাজিয়া প্রানকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে আবিরের রুমের দিকে পা বাড়াল। আবরার সেখানেই আছে, দুই ভাইয়ে আলোচনা করছে কিভাবে কি করা যায়।

– “আসবো?”
– “আয়।” (আবির)
– “কি সিদ্ধান্ত হলো? কিভাবে অই করবে?”
– “সেটাই তো বুঝতে পারছি না, একজন এতবড়ো বিজনেসের সাথে আমরা সাধারন মানুষ পেরে উঠব কিভাবে?”
– “সবটা বুঝতে পারছি কিন্তু কিছু না করলে তো শ্রেয়া’দির জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে।”

আবির -আবরার প্রচন্ড চিন্তিত। কিভাবে কি করা যায় সেটাই ভেবে পাচ্ছে না।আইনি ব্যবস্থা নিয়েও কোন লাভ নেয়, ওদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমানে কোনো প্রমান নেয় আর বিষয়টা জানাজানি হলে শ্রেয়ার নামে বদনাম রটে যাবে তাই বিষযটাকে কোনো ভাবেই আইনি আওতায় আনা যাবে না। নাজিয়া ওদের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল,
– “আমার মাথায় একটা প্ল্যান আছে।”
– “কি প্ল্যান?”
– “শ্রেয়া’দি লোকটার সাথে ক্লোজড হয়ে যদি ভিডিওগুলো ডিলিট করে দেয় তো।ক্লোজড মানে বলতে চাইছি, রিলেশনশিপে গিয়ে।”
– “সেটা মনে‌ হয় না হবে, এমনিতেই শ্রেয়া যে পরিমান ভেঙে পড়েছে তাতে কিছুতেই এতটা নাটক করতে পারবে না। আর লোকটা শ্রেয়ার সাথে রুমডেট করতে চাইছে, শ্রেয়া ওর ক্লোজ হওয়া মানে সে রুমডেট করতে চাইবে।”

আবার সমস্যা! কিছুতেই মাথা থেকে বের হচ্ছে না উপায়গুলো।

নাজিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– “একটার পর একটা সমস্যা এসেই চলেছে, কিভাবে কি করব বলো তো! আচ্ছা শান্ত’দার সাথে যোগাযোগ করার কথা কি ভাবলে?”
– “নাজু তুই যেভাবেই হোক শ্রেয়ার ফোন থেকে শান্তর নম্বরটা জোগাড় কর, তারপর আমরা ওর সাথে বলছি।ওহ জানুক সবটা, তারপর কি করবে সেটা ওর ব্যাপার।”
– “ছেলেটা যদি সত্যি শ্রেয়াকে ভালোবেসে থাকে, তাহলে ওর‌ বিপদে হাতটা ঠিকই ধরবে।” (আবরার)

২দিন কেটে যায়, এখনো কোনো উপায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। একটার পর একটা প্ল্যান করছে কিন্তু সেখানে যেকোন একটা সমস্যা হাজির হয়ে যাচ্ছে। আজ শান্তের সাথে মিট করার কথা, নাজিয়া শপিং করতে যাবার নাম করে আবরারের সাথে বেরিয়েছে, আবির অফিস থেকে আসবে। আর প্রান বাড়িতেই আছে শ্রেয়ার কাছে।

– “কি হলো এতো টেনশান করছ কেন?”
– “শান্ত বলে ছেলেটা যদি সবটা জানার পর শ্রেয়াকে ভুল বোঝে?”
– “এত টেনশান করার কিছু নেয়, এতে কিছু খারাপ হবে না উল্টো ভালো হবে। শ্রেয়ার জন্য ছেলেটা কতটুকু যোগ্য সেটা আমরা বুঝতে পারব,বুঝলে।”
– “হু।”

আবরার নাজিয়া কফিশপে এসে দেখল শান্ত অলরেডি চলে এসেছে। নাজিয়া শান্তকে না চিনলেও আবরার কোনো ভাবে চিনত, তাই ওর কোনো অসুবিধা হয়নি।

– “এক্সকিউজ মি।”

চেনা কন্ঠস্বর শুনে শান্ত মাথা তুলে তাকাল। সামনের মানুষটিকে দেখে অবাক না হয়ে পারল না, বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরল।

– “হোয়াটস এ সারপ্রাইজ ব্রো। কতদিন পর তোর সাথে দেখা হলো, কেমন আছিস?”

আবরার হেসে ফেলল শান্তর উত্তেজনা দেখে।

– “আরে ভাই আসতে। এত তাড়াতাড়ি বললে উত্তর দেব কিভাবে?”
– “তোকে এতদিন পর দেখলাম, কি যে আনন্দ লাগছে বোঝাতে পারব না।”

আবরার শয়তানি হেসে বলল,
– “মেয়েদের মতো আচরন করছিস কেন? আবার…

শান্ত আবরারের পিঠে দুটো কিল বসিয়ে দিল। তারপর দুই বন্ধু মিলে হেসে উঠল, নাজিয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের কান্ড দেখে চলেছে ছেলেটা কে সেটা এখনো বুঝতে পারছে না।

শান্তর চোখ পড়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নাজিয়ার দিকে। বন্ধুকে খোঁচা দিয়ে বলল,
– “কিরে গার্লফ্রেন্ড নাকি?”

আবরার নাজিয়ার দিএক তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলল,
– “নাহ আমার বিয়ে করা একমাত্র বউ নাজিয়া।
– “তুই বিয়েও করে নিলি?”
– “হুমম। তোর তো পাত্তাই নেয়, সেই যে উচ্চমাধ্যমিকের পর হারালি কত খুঁজলাম তবুও তোকে পেলাম না।”
– “বাবা বদলি হয়ে চলে গেলেন, সেখানে গিয়ে নতুন পরিবেশ, সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিতে নিতেই বছর কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না।”
– “বাড়ির সব কেমন আছে?”
– “মা মোটামুটি ভালোই আছে, আর বাবা ২বছর আগে মারা গেছেন। এখন সব দায়িত্ব আমার উপরে, সবকিছুর মধ্যে পুরানো আমিটাকে আর খুঁজে পাইনা।”

বাবার মৃত্যুর খবর শুনে আবরারের মনটা খারাপ হয়ে যায়,
– “সরি ভাই, আমি বুঝতে পারিনি।”
– “আরে কিছু না বাদ দে তো। তোর খবর বল কেমন আছে সব।”
– “চলছে আলহামদুলিল্লাহ ভালোই।”
– “আচ্ছা তোরা একটু বস, আমি একজনকে কল করে মিটিং-টা ক্যানসিল করে দিচ্ছি। তারপর তোদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দেব।”
– “ওকে।”

শান্ত ফোনটা নিয়ে সাইডে চলে গেল, নাজিয়া আবরারকে জিজ্ঞেস করল,
– “কে ছেলেটা?”
– “শান্ত।”
– “কে শান্ত?
হঠাৎ করেই নাজিয়ার মনে পড়ে যায় শ্রেয়ার বয়ফ্রেন্ডের নামও শান্ত তারমানে কি এই সে? নাজিয়া আবরারের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে ওহ ইশারা করে বোঝাল ওর আন্দাজটাই সঠিক।

– “তুমি আগে থেকে জানতে?”
– “আমাদের বিয়ের কিছুদিন আগেই জেনেছিলাম সবটা। শান্তর সাথে যোগাযোগ করার আগেই সবটা এলোমেলো হয়ে যায়।”

নাজিয়া কিছু বলতে যাবে তার আগে শান্ত সেখানে চলে আসে।

– “তো কি খাবি বল?”
– “কফি ঠিক আছে।”
– “আর কিছু!”
– “নাহ।”
– “আর ভাবি?”
– “আমার কোল্ড কফি।”
– “ওকে।”

শান্ত ওয়েটারকে ডেকে দুটো হট কফি আর একটা কোল্ড কফি অর্ডার দিল। নাজিয়া শান্তকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল কিন্তু আবরার ইশারায় থামিয়ে দিল।

আবরার শান্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করল,
– “তুই এখানে কি করছিস?”
– “আসলে বিষয়টা একটুখানি গন্ডগোলের।”
– “কেন?”
– “কালকে একজন হুট করে ফোন করে দেখা করতে চাইল, প্রথম আমি না করে দিয়েছিলাম পরে অনেক ভেবে রাজি হয়েছি।”
– “তা দেখা করবি না?”
– “পরে করব, তোর সাথে কতদিন পর দেখা হয়েছে আমার। এখন আড্ডা দেব শুধু।”

আবরার মৃদু হাসল, ছেলেটা এখনো বদলানো না।আবির আবরারকে ফোন করছে, শান্ত যে দেখা করাটা ক্যানসিল করে দিয়েছে এটাতে বেজায় ক্ষেপে গেছে আবির।

আবরার ফোনটা রিসিভ করে শুধুমাত্র একটা কথাই বলল,
– “কফিশপে চলে আসো, ফাস্ট।”

বিষয়টা আবির বুঝল না, কিন্তু যখন ডাকছে তখন তো যেতে হবে। আবির কফিশপের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

আবরার শান্তকে ইচ্ছাকৃত খোঁচা দিয়ে বলল,
– “তাহলে তুই বিয়ে করবি কবে?”
– “আর বিয়ে!”

শান্তর কন্ঠে স্পষ্ট তাচ্ছিল্য। আবরার ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
– “কেন? কি হযেছে?”
– “একজনকে ভালোবাসলাম কিন্তু সে হঠাৎ করেই কিছু না বলে সবজায়গা থেকে আমাকে ব্লক করে দিয়েছে।”
– “মেয়েটার ব্যাপারে খোঁজ নিসনি? জানতে চাসনি মেয়েটা কেন এইরকম করল?”
– “অনেকবার ফোনে ট্রাই করেছি, অন্য নম্বর দিয়েও কর করেছি। দেখা করার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু দেখা পায়নি। এই কয়েকটা দিন আমার যে কিভাবে কাটছে আমিই জানি।”
– “যদি শুনিস মেয়েটা আর এই পৃথিবীতে নেয় বা মৃ-ত্যুর পাথে লড়াই করছে তখন কি করবি?”

শান্ত আঁতকে উঠল, করুন কন্ঠে বলল,
– “ভাই প্লিজ এইসব বলিস না।ওর কোনো ক্ষতি আমি সহ্য করতে পারব না, সে আমার না হলেও ভালো থাকুক। প্রয়োজনে আমার আয়ু ওর হোক।”

আবরার মৃদু হেসে নাজিয়ার দিকে তাকাল, নাজিয়াও আবরারের দিকে তাকাল। দুজনে স্পষ্ট শান্তর চোখে খাঁটি ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু সবটা জানার পর ভালোবাসা’টা থাকবে তো?

#চলবে….

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-১৭

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (১৭)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

– “আমি সে’ক্সুয়াল হ্যারাস-মেন্টের শিকার।”

নাজিয়া চমকে উঠল, শ্রেয়া এইসব কি বলছে? শ্রেয়ার চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি গড়িয়ে পড়ছে, ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না কান্নার কারনে।

– “কে করেছে এইসব? একটাবার তার নামটা বলো। তোমার বয়ফ্রেন্ড নয় তো?”

শ্রেয়া নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলল,
– “শাহ শান্ত এইসবের কিছুই জানে না।”
– “তাহলে?”
– “আমার অফিসের বস।”

পড়াশোনা শেষ করার পর শ্রেয়া একটা কোম্পানিতে চাকরি করতে শুরু করে, প্রথম প্রথম পার্ট টাইম করলেও এখন ফুল-টাইম জব করে। আর বর্তমানে সেই অফিসেরই এমডির পার্সোনাল সেক্রেটারী হিসাবে জব করে।নাজিয়া কিছুই বুঝতে পারছে না, সবকিছু মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। অধৈর্য হয়ে শ্রেয়াকে জিজ্ঞেস করল,

– “শ্রেয়া’দি প্লিজ সবটা খুলে বলো।”
– “আমাদের যিনি এমডি স্যার উনি আমাকে পছন্দ করতেন, আমাকে প্রোপজও করছিলেন কিন্তু আমি সরাসরি না বলে দিই এমনিতেই আবরারের সাথে আমার বিয়ের কথাটা শোনার পর থেকে অস্থির ছিলাম শান্তর কথা বাড়িতে কিভাবে বলব সবকিছু নিয়ে ঝামেলার মধ্যে ছিলাম আর সেইদিন স্যার আবারো আমাকে প্রোপজ করেন এবং আমি না বলাতে অসভ্যতামি করার চেষ্টা করেন আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে একটা থাপ্পর দিয়ে দিই আর সেইটাই আমার জীবনের সবথেকে বড়ো ভুল।”
– “ঠিক করছ থাপ্পর দিয়েছ, আমি হলে আরো দু -চারটে দিয়ে দিতাম।”
– “মারতে পারলে তো আমিও অনেক আগেই দিতাম। কিন্তু আমি যে নিরুপমা, ওই শয়তান গোপনে আমার কিছু ভিডিও করেছে।”

শ্রেয়া আবারো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, নাজিয়ার মনে প্রশ্ন জাগল। ভিডিও! কিন্তু কিভাবে?

– “শ্রেয়া’দি শান্ত হও, প্লিজ।”

শ্রেয়া নিজের কান্না থামানোর পর নাজিয়া বলল,
– “তোমার অফিসের বস তোমার ভিডিও করেছে? কিন্তু কিভাবে?”
– “একদিন আমাদের অফিসে একটা পার্টির আয়োজন করা হয়, সেইখানে আমরা সবাই ঠিক করি অফিস শেষ করার, অফিসের ওয়াশরুমেই চেঞ্জ করে রেডি হয়ে নেব। আর সেইদিনই আমার চেঞ্জের ভিডিও করে নেয় শয়তানটা।”
– “এইসব কবে হয়েছে?”
– “অনেকদিন আগে কিন্তু আমি এখান থেকে যাবার পর জানতে পারি বিষয়টা। ওই শয়তানটা আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছে যদি ওর কথা শুনে ওর সাথে রাত না কাটায় তাহলে আমার ভিডিওটা ভাইরাল করে দেবে।আমাকে কয়েকবার বাজে ভাবে স্পর্শ করেছে, আমি ওর ভয়েই অফিস বন্ধ করে দিয়েছিলাম কিন্তু তারপরেও আমার পিছু ছাড়ছে না, ফোন মেসেজ করে রুমডেট করার কথা বলছে। আমি সবকিছু সহ্য করতে না পেরে সুই’সাইড করার চেষ্টা করি।”

শ্রেয়ার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, একজন মেয়ের কাছে তার সম্মানটাই আগে। সেইখানে এইভাবে হ্যারাস-মেন্টের শিকার হতে এলে তার মন- মানসিকতার কি অবস্থা হয় সেটা একমাত্র সেই জানে। প্রতিটা ক্ষন নিজের সাথে লড়াই করছে, নিজেকে বড্ড তুচ্ছ মনে হচ্ছে।

অন্যদিকে, সবটা শোনার পর নাজিয়ার রাগে মাথা ফেঁটে যাচ্ছে। একজন অফিসের মালিক যদি এইরকম কাজ করে তাহলে মহিলা কর্মী’রা কিভাবে কাজ করবে? এর একটা বিহিত করা দরকার।

– “শ্রেয়া’দি তুমি চিন্তা করো না, ওই শয়তানকে আমি উচিত শিক্ষা দেবোই।”
– “কিন্তু নাজিয়া তুমি কিভাবে লড়াই করবে ওই লোকটার সাথে? ওরা অনেক ধনী, সমাজ ওদের কেই বিশ্বাস করবে আমাদের মতো সাধারন মানুষকে কেউ পাত্তাই দেবে না।”

শ্রেয়ার কথাতে নাজিয়াও চিন্তিত হলো, সত্যি তো ওহ একজন সাধারন মেয়ে হয়ে কিভাবে এত ধনী একজন ব্যবসায়ীকে শাস্তি দেবে! আমাদের সমাজের বহু প্রভাবশালী মানুষ আছে, যারা অন্যায় করেও কোনোপ্রকার শাস্তি না পেয়েই রাজার হালে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখনো বহু জায়গায়, বহু ক্ষেত্রে নারীদের সে’ক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের শিকার হতে হয়। লড়াই ও ন্যায় চাইতে গেলেই হয় অকালে প্রা’ন হারাতে হয়, নাহয় আবারো নির্যাতিত হতে হয়।আমরা শুধুমাত্র মুখেই বলি আমরা উন্নত হয়েছি, সমাজ উন্নত হয়েছে। কিন্তু আদৌও কি সেইসব কিছু হয়েছে! বর্তমানে রাস্তা-ঘাট, অফিস-কলেজ কোথাও মেয়েরা সেফ না, সুযোগ পেলেই কিছু নোংরা মানসিকতার মানুষ ফায়দা লুটে নিতে চাই।

শ্রেয়া হতাশ কন্ঠে বলল,

– “নাজিয়া আমরা কখনোই ওদের সাথে পারব না, ওরা ধনী, অর্থ আছে। ওরা হাজার একটা অন্যায় করলেও কেউ কিছু বলতে পারবে না, কেউ কিছু বলতে গেলেই হয় প্রা’ন হারাবে না হয় টাকার নিচে ন্যায় চাপা পড়ে যাবে।”
– “আমি সবটা বুঝতে পারছি। কিন্তু ওই লোকটার কাছ থেকে ভিডিওটা ডিলিট করা জরুরি।”
– “কিন্তু কিভাবে করবে?”
– “তুমি চিন্তা করো না, আমরা ঠিক একটা না একটা ব্যবস্থা করেই ফেলব।”

শ্রেয়া হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল, নাজিয়াকে বিশ্বাস করতে মন চাইছে কিন্তু মস্তিস্ক বলছে কিছু লাভ নেই।কি হবে? কিভাবে ভিডিওটা ডিলিট করাবে? কিভাবেই বা শ্রেয়া আবারো স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে?

নাজিয়া চলে যাবে বলে পা বাড়াচ্ছিল হঠাৎ একটা কথা মধে পড়ে যাওয়াতে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল,
– “শ্রেয়া’দি শান্ত’দা কি সবটা জানে?”
– “নাহ। আমি চাই না আমার অভিশপ্ত জীবনের সাথে ওর জীবনটা জুড়ে যাক তাই ওকে সব জায়গা থেকে ব্লক দিয়েছি আর সম্পর্কটাও শেষ করে দিয়েছি।”

শ্রেয়া কথাগুলো শান্ত গলাতে বললেও কথাগুলোর মধ্যে অনেক চাঁপা কষ্ট লুকিয়ে আছে। নিজের জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে বলে ভালোবাসার মানুষটির হাতটাই ছেড়ে দিচ্ছে এইটা কি কম বড়ো ত্যাগ!

– “পাগল হয়ে গেছ তুমি? শুধুমাত্র ওই কারনে সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছ?”
– “তো কি করব? আমি ভালো করেই বুঝে গেছি ওই লোকটা আমাকে বাঁচতে দেবে না, এক আমাকে যেভাবেই হোক ভোগ করবে আর না হলে দুনিয়া থেকেই আমার নামটা মুছে দেবে। এই পরিস্থিতিতে আমি কিভাবে একটা সহজ সাধারন ছেলেকে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে ছেলেটার জীবনটাকে শেষ করে দেব?”
– “শ্রেয়া’দি আবেগ দিয়ে বিচার করো না, এমনও তো হতে পারে সবটা শোনার পর সে তোমাকে হেল্প করছে?”
– “আমি কিভাবে শান্তকে কথাগুলো বলব বলতে পারো! সেইদিনের পর থেকে ওর সাথে কথা বলতে আমার লজ্জা লাগছে, নিজেকে বড্ড ছোট ছোট লাগছে। তাই সম্পর্কটা শেষ করে দিয়েছি।”

শ্রেয়ার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়েই চলেছে। একদিকে নিজের ওহ নিজের পরিবারের মানসম্মান আর অন্যদিকে নিজের ভালোবাসা সবকিছু নিয়ে ডিপ্রশনে চলে যাচ্ছে শ্রেয়া আর তার ফলশ্রুতি সুই’সাইড করার চেষ্টা।

নাজিয়া কি বলে শ্রেয়াকে শান্তনা দেবে বুঝতে পারল না, শ্রেয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। সবকিছু শোনার পর ওর নিজেরই অসহায় লাগছে, কিভাবে কি করবে সেটাই বুঝতে পারছে না আর সেখানে সবকিছুর শিকার হয়ে শ্রেয়ার কি অবস্থা!

আত্মহত্যা মানুষ এমনি এমনি করে নাহ, যখন সবকিছু হাতের বাইরে চলে যায়। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, অসহায়ত্ব ঘিরে ধরে তখনই মানুষ আ’ত্মহ’ত্যা’কে বেছে নেয়। তবুও বলব, আ’ত্মহ’ত্যা কখনোই কোনো কিছুর সমাধান হতে পারে না।লড়াই করে বেঁচে থাকার নামই হলো জীবন, প্রতিটা মূহুর্তে লড়াই করতে হবে, সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

নাজিয়া কি পারবে শ্রেয়াকে সঠিক বিচার পাইয়ে দিতে? অন্যায়-কারীকে শাস্তি দিতে!

#চলবে…

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-১৬

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (১৬)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

শ্রেয়ার সুই-সাইড করার খবর তড়িৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়ল। মেয়েটা হঠাৎ করেই এইরকম সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছে, সেটাই কেউ বুঝতে পারছে না।

আবির ও আবরার খবর পাওয়া মাত্রই রওনা দিয়েছে, নাজিয়াও যেতে চাইছিল কিন্তু প্রানকে নিয়ে এতটা পথ জার্নি করা সম্ভব না তাই যেতে পারেনি। আবিরের মা কান্নাকাটি করছেন, উনি শ্রেয়াকে নিজের মতো ভালোবাসেন তার এইরকম কথা শুনে প্রচন্ড ভেঙে পড়েছেন। নাজিয়া ওনাকে সামলাচ্ছে।

আবির ও আবরার শ্রেয়ার বাবা-ভাইয়ের সাথে কথা বলে জানতে পারল কিছুদিন থেকেই শ্রেয়ার মন খারাপ ছিল, সারাদিন মনমরা করে বসে থাকত কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে কিছুই বলত না।কাল রাত্রিরে কিছু না খেয়েই নিজের ঘরে দরজা আটকে দিয়েছিল, পাশেই ওর ছোটভাইয়ের রুম। সে ঘর থেকে চাঁপা কান্নার আওয়াজ শুনতে পাই সাথে কিছু একটা পড়ে যাবার আওয়াজ পেয়ে শ্রেয়ার ঘরের দরজায় টোকা মারে। অনেকক্ষণ হয়ে যাবার পরেও দরজা না খুললে সন্দেহ হয়, বাবা মাকে ডেকে দরজা ভাঙার পর দেখা যায় শ্রেয়া ঘুমের ওষুধ সাথে আরো অনেককিছুর ট্যাবলেট খেয়ে সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে। তড়িঘড়ি করে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়, ডাক্তাররা ওয়াশ করে ওষুধ গুলো বার করে দিয়েছে এখন শ্রেয়া কিছুটা স্বাভাবিক।

শ্রেয়ার জ্ঞান ফিরেছে। আবরার ওর সাথে একা দেখা করতে চাই, সব কথা শুনে ও আন্দাজ করতে পারছে কেন শ্রেয়া এই কাজটা করেছে।

আবরার শ্রেয়ার পাশে বসে বলল,
– “শ্রেয়া।”

শ্রেয়া কোনো উত্তর দিলো না, আবরার শ্রেয়ার কপালে হাত বুলিয়ে বলল,
– “কিরে কথা বলবি না আমার সাথে?” আচ্ছা তুই এতবড়ো সিদ্ধান্ত কিভাবে নিলি বল তো? একটাবার নিজের পরিবারের কথা চিন্তা করলি না।”

শ্রেয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আবরার শ্রেয়ার মাথাতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
– “সুই-সাইড করতে গিয়েছিলিস! জানিস না আত্মহ’ত্যা মহা পা-প।”
– “তো কি করতাম আমি!”

শ্রেয়া কেঁদে উঠল। নিজের মনের কষ্টগুলোকে নিজের মধ্যে রাখতে রাখতে হাঁপিয়ে উঠেছে, আর পারছে না।
– “শ্রেয়া কি হয়েছে বোন আমার সবকিছু আমাকে বল।”

শ্রেয়া নিজেকে সামলে নিল, চোখের পানিটা মুছে নিয়ে বলল,
– “আমার কিছু হয়নি আমি ঠিক আছি। তুমি যাও।”

তারপরেও আবরার শ্রেয়াকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করল কিন্তু ওহ উত্তর দিল না। আবরার ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেল। কেবিনের বাইরে আসতেই আবির জিজ্ঞেস করল,
– “কিরে কিছু জানতে পারলি?”
আবরার ঘাড় নাড়িয়ে না বলল, আবির হতাশা হল। পরক্ষনেই কিছু একটা মনে পরতেই বলল,
– “একজনই পারবে শ্রেয়ার কাছ থেকে সত্যিটা জানতে।”
– “কে?”
– “নাজিয়া।”
– “কিন্তু ওহ কিভাবে আসবে?”
– “সেইসব চিন্তা তুই করিস না, আমি সবটা দেখছি।”

আবির কথাটা বলে চলে গেল, আবরার নাজিয়াকে ফোন করে এদিকের খবর দিল। বাড়িতে সবাই চিন্তা করছিল শ্রেয়াকে নিয়ে, শ্রেয়া ঠিক আছে এইটা জানার পর সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

– “মামনি শ্রেয়ার জ্ঞান ফিরেছে, এখন ওহ ঠিক আছে।”
– “যাক আলহামদুলিল্লাহ ভালো। কিন্তু মেয়েটা হঠাৎ করে এইরকম করল কেন বলত?”
– “জানি না, কিছুই বুঝতে পারছি না।”

সবার মনেই একটা প্রশ্ন শ্রেয়া ঠিক কি কারনে এতবড়ো একটা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিল?

—-

আবির ওর‌ মামাকে বুঝিয়ে শ্রেয়াকে ওদের বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য রাজি করিয়েছে। যদিও এইটার জন্য ওকে কম কাঠ-খড় পোড়াতে হয়নি, শ্রেয়ার বাবা এই অবস্থায় মেয়েকে অন্য কোথাও পাঠাতে রাজি নয় আর আবিরও কিছুতেই ছাড়বে না। ওহ শ্রেয়াকে নিয়ে তবেই যাবে, এই সময়ে শ্রেয়াকে একা থাকতে দেওয়া মানেই বিপদ। আর তার থেকেও বড়ো কথা, শ্রেয়ার হঠাৎ এইরকম কাজের কারন কি সেইটা জানতে হবে।

৩দিন পর,
আজ আবির ও আবরার শ্রেয়াকে নিয়ে ওদের বাড়িতে ফিরছে। শ্রেয়ার বোন আসার কথা ছিল কিন্তু ওর‌ পরীক্ষা তাই আসতে পারেনি শ্রেয়া একাই যাচ্ছে।

শ্রেয়া আগের থেকে একদম চুপচাপ হয়ে গেছে, কারোর সাথেই কথা বলছে না। আবির আর আবরার ওকে হাসানোর অনেক চেষ্টা করে চলেছে, কিন্তু ওহ হাসছে না। ‘যার মনেই সুখ নেই তার মুখে কি হাসি আসে?’

শ্রেয়াকে দেখা মাত্রই আবিরের মা আদরে আদরে ভরিয়ে দিলেন, মেয়েটা সবেমাত্র মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে এটা কি কম বড়ো কথা।

– “শ্রেয়া মা তুই ঠিক আছিস তো?”

শ্রেয়া মেকি হেসে বলল,
– “চলছে।”

নাজিয়া দাঁড়িয়ে শ্রেয়াকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে, মেয়েটার মুখে সেই আগের মতো চাঞ্চল্যতা, লাবন্য কোনটাই নেয়। কিরকম একটা শুকিয়ে গেছে, কিন্তু কেন?

শ্রেয়াকে রেস্ট নিতে বলে নাজিয়া নিজেদের ঘরে আসতেই আবরার পেছন দিক থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে নাক ঘষলো।

– “ছাড়ো, ফ্রেশ হবে তো।”
– “হবো, কিন্তু আগে মাইন্ড ফ্রেশ করি।”
– “এইভাবে কে মাইন্ড ফ্রেশ করে?”
– “আমি করি। কারন তুমি আমার মানসিক শান্তি, তোমাকে জড়িয়ে ধরলে যে পরিমান শান্তি লাগে আর অন্য কিছুতে লাগে না। (নাজিয়ার কাধে হালকা দাঁত বসিয়ে বলল, ‘বুঝলে বউ।”

– “আহ্, লাগল তো।”
আবরার শয়তানি হেসে বলল,
– “এতেই লাগছে!!”
– “দিনকে দিন শয়তান হয়ে যাচ্ছো। যাও ফ্রেশ হমে আসো, আমি খাবারের ব্যবস্থা করি।”
– “শ্রেয়া কোথায়?”
– “রুমে আছে।”
– “ওর দিকে একটু খেয়াল রেখ, আর তোমাকেই কিন্তু ওর মুখ থেকে সত্যিটা জানতে হবে।”
– “কিন্তু আমি কি পারব!”
– “পারতে তোমাকে হবেই।একটা মানুষের কথাবার্তা, ব্যবহার দিয়ে অন্য মানুষের ভেতরকার সবকিছুই জানা যায়, তুমি ওর‌সাথে আগের মতো বন্ধুর মতো মেশো দেখবে ওহ ঠিক বলবে।”
– “শ্রেয়া ‘দি আগের থেকে বদলে গেছে।”
– “হুমম, সময় ও পরিস্থিতি মানুষকে বদলে দেয়।”
– “হুম।”

আজ শ্রেয়ার এই বাড়িতে আসার দুইদিন, নাজিয়া সবসময়ে ওর কাছে কাছেই থাকে। গল্প করে কিন্তু এইসব বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে পারে না, মেয়েটা আবারো যদি ডিপ্রেশনে চলে গিয়ে কিছু করে ফেলে তো তখন হিতে-বিপরীত হয়ে যাবে। কিন্তু আর কতদিনই বা এইভাবে চলবে? নাজিয়া ঠিক করল আজকে যেভাবেই হোক শ্রেয়ার কাছ থেকে সত্যিটা জানবে।

নাজিয়া শ্রেয়ার রুমের দরজায় নক করল, শ্রেয়া বারান্দায় বসে আপন-মনে কি ভেবে চলেছে। দরজায় টোকা মারার শব্দ ওর কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি।নাজিয়া দরজাটা ঠেল দিয়ে দেখল খোলা আছে, ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকে দেখল শ্রেয়া বারান্দায় বসে আছে। নাজিয়া শ্রেয়ার পাশে‌ বসে বলল,
– “শ্রেয়া ‘দি।”

আচমকা ডাকে শ্রেয়া থতমত খেয়ে যায়, পাশে তাকিয়ে দেখল নাজিয়া বসে আছে ওর পাশে।

শ্রেয়া মেকি হেসে বলল,
– “তুমি কখন আসলে?”

নাজিয়া শ্রেয়ার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উল্টে প্রশ্ন করল, – “কাঁদছ কেন?”

শ্রেয়া নিজের চোখে হাত দিয়ে দেখল পানি, পুরানো কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখের কোনে পানি জমা হয়েছে সেটা বুঝতে পারেনি। চোখটা ভালো করে মুছে নিয়ে বলল,
– “কই কাঁদি’নি তো। অনেকক্ষণ এইদিকে তাকিয়ে ছিলাম তাই হয়তো।”
– “আমার কাছে মিথ্যা বলে লাভ নেই, আযি জানি তোমার বড়ো কিছু একটা হয়েছে, নাহলে এতবড়ো একটা সিদ্ধান্ত তুমি নিতে না।”

শ্রেয়া চুপ করে আছে। নাজিয়া আবারো বলতে শুরু করল,
– “শ্রেয়া ‘দি নিজের মনের কথাগুলো, কষ্টগুলো আমার সাথে শেয়ার করো দেখবে হালকা লাগবে।”

শ্রেয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে নাজিয়াকে জড়িয়ে ধরল। শ্রেয়া কেঁদেই চলেছে নাজিয়া ওকে শান্তনা দিচ্ছে নানান ভাবে,

– “শ্রেয়া’দি বলো কে কি বলেছে, কি হয়েছে কেন তুমি সুই-সাইড করার মতো এতটা নিকৃ’ষ্ট কাজের সিদ্ধান্ত নিলে? বলো আমাকে…

শ্রেয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল,
– “আমি সে’ক্সুয়াল হ্যারাস-মেন্টের‌ শিকার।”

#চলবে…..

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।