এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-২৩

0
299

#এক_আকাশ_দূরত্ব (২৩)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

শ্রেয়াকে এখন এইসময়ে অফিসে দেখে হাসিব নিজেও খুব অবাক হলো।

– “তুমি এইখানে?”
– “কেন? কি ভেবেছিলেন আমি আর কখনো এই অফিসে আসব না তাই তো?”

হাসিব উত্তর দিল না। শ্রেয়া আবারো বলতে শুরু করল,
– “আচ্ছা আমি আপনার কি ক্ষতি করছিলাম যার জন্য আমার স’ম্মানহানি করার কথা চিন্তা করলেন? আপনি জানেন আপনার কারনে শুধুমাত্র আপনার কারনে আমি সুই-সাইড করতে গিয়েছিলাম, নিজের ভালোবাসার মানুষটির সাথে সম্পর্ক শেষ করেছি। এতকিছুর পরেও আপনি আমাকে ছাড়ছেন না।”

শ্রেয়াকে অবাক করে দিয়ে হাসিব বলল,
– “আই এম সরি। তোমার সাথে এইরকম করাটা আমার ঠিক হয়নি, আর এই কয়েকদিনে একটা জিনিস বুঝতে শিখেছি ‘কাউকে ভালোলাগা মানেই সেটা ভালোবাসা নয়। ভালোবাসা আসে মন থেকে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও কখন কে মনে জায়গা করে নেয় সেটা বোঝাও যায় না।’ তোমাকে আমার ভালো লাগত আর সেটাকে আমি ভালোবাসার সংজ্ঞা দিয়েছিলাম, যদি সত্যি তোমাকে আমি ভালোবাসতাম তাহলে তুমি রিজেক্ট করার পর প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওই অন্যায় কাজটা করতে পারতাম না।আমি সত্যি মন থেকে অনুতপ্ত।”

শ্রেয়া অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
– “আপনি সত্যি বলছেন?”
– “হুমম। আর ওই ভিডিওটা তুমি নিজের হাতে ডিলিট করো, এই নাও।”

হাসিব নিজের ফোন আগিয়ে দিল। শ্রেয়া তো একটার পর একটা ঝটকা খেয়েই চলেছে, মানুষটার মধ্যে এত পরির্বতন!

– “কি হলো ডিলিট করো।”
– “আমি কিভাবে আপনাকে বিশ্বাস করব! হতেও তো‌ পারে আপনি অন্য কোথাও ভিডিওটা রেখেছেন।”
– “অবিশ্বাসও তো করতে পারবে না!”
– “মানে?”
– “আমাকে অবিশ্বাস করার মতো কোনো কাজ আমি কিন্তু এখন করিনি। আর এইটা সত্যি তোমার ভিডিওটা শুধুমাত্র আমার ফোনেই আছে, তাই তুমি ডিলিট করে দিলে আমার কাছে আর্ কিছুই থাকবে না। আজকের পর আমি কখনোই তোমাকে ব্ল্যাকমেইল করব নাহ। আর তুমি চাইলে আগের মতো অফিসে জয়েন করতে পারো।”

শ্রেয়া ভিডিওটা সম্পূর্ণ ডিলিট করে, হাসিবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
– “যদি সত্যি নিজের মানসিকতা বদলাতে পারেন সেটা আপনার জন্যই ভালো। আর চাকরির কথা বলছিলেন! সেটার প্রয়োজন পড়বে না, আমার হবু স্বামীর যা আছে তাতে আমি বসে খেতে পারব।”
– “দোয়া করি সুখী হও।”
– “থ্যাঙ্ক ইউ। আজ তাহলে আসি, আবার কোনদিন দেখা হবে।”

শ্রেয়া যেভাবে এসেছিল সেইভাবেই চলে‌ গেল, কারোর সাথে কথা না বলে। হাসিব নিজের ফোনের সমস্ত খারাপ কিছু ডিলিট করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর মৃদু হেঁসে বলল,
– “ভালোবাসা মানুষ’কে কতই না বদলে দেয়!”

—-

শ্রেয়া ও হাসিবের কথোপকথন শুনে সবাই প্রচন্ড রকমের অবাক।যে ছেলেটা দুইমাস আগেও শ্রেয়ার সাথে রুমডেট করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল, আজ সেই ছেলেটাই শ্রেয়ার কাছে ক্ষমা চেয়ে ভিডিও ডিলিট করে দিয়েছে! এইটা সত্যি অবিশ্বাস্য। শ্রেয়া ভয়েস রেকর্ড অন করে রেখেছিল, যাতে হাসিবের ব্যাপারে কিছু প্রমান জোগাড় করতে পারে কিন্তু তার আর প্রয়োজন পড়ল না। হাসিব সবকিছু ডিলিট করে দিয়েছে, এইটা সবার কাছে খুশির খবর। নাজিয়া ও আবরার দেহে প্রান ফিরে পেল, আর নাটক করতে হবে না এইবার শান্তিতে সংসার করবে। কিন্তু তার আগে শান্ত আর শ্রেয়ার সম্পর্ক’টাকে স্বাভাবিক করতে হবে।

আবরার নাজিয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে নাক ঘষল।

– “কি মিষ্টার এত খুশি কেন আজ!”
– “ঝামেলা মিটছে এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে!”
– “হুমম। তবে এখনো বড়ো দুটো কাজ বাকি আছে।”
– “কি কাজ?”
– “শান্ত’দা আর শ্রেয়া’দির মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটানো আর দ্বিতীয় হলো হাসিব স্যারের‌ সাথে এই মিথ্যা সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসা।”
– “হুম।”

আবরার শান্তর নম্বরে ফোন করল, ছেলেটাকে আবারো বোঝাতে হবে শ্রেয়ার সাথে সবকিছু ঠিক করে নেবার জন্য। কতটা কি পারবে জানে না, তবে চেষ্টা তো করতেই হবে।

– “হ্যাঁ আবরার বল।”
– “কোথায় আছিস তুই?”
– “এই তো বাড়িতেই আছি।কেন?”
– “বলছিলাম শ্রেয়ার‌ ব্যাপারটা নিয়ে কি ভাবলি?”

শান্ত উদাসীন কন্ঠে বলল,
– “ভাবিনি কিছু।”

আবরারের মেজাজ খারাপ হলো। প্রায় ২টো মাস কেটে যাবার পরেও শান্ত এখনো শ্রেয়াকে নিয়ে সিরিয়াস হচ্ছে না, এইরকম চলতে থাকলে একটা সময় গিয়ে সম্পর্কটাই যে নষ্ট হয়ে যাবে।

– “তাহলে আর‌ কি শ্রেয়ার অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দিই?”
– “তুই বিয়ে দিবি কিভাবে!”
– “শালা আমার কথার খুঁত ভালোই ধরতে পারিস, কিন্তু আসল কাজটা করতে পারিস না।”
– “ভাই কি করব বল, শ্রেয়ার সাথে কথা বলার কথা শুনলেই আমার পুরানো সবকিছু মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায়, কিভাবে বিনাদোষে আমাকে ইগনোর করেছিল, আমার ভালোবাসাকে অবহেলা করেছিল।”

আবরার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল,
– “আমার মনে হয় তোদের এই মিথ্যা সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। দুজন মুখোমুখি হয়ে সম্পর্কটার ইতি টেনে দে। বেকার অপেক্ষা করে কি লাভ, শ্রেয়ার বয়স বাড়ছে বাড়ি থেকে বিয়ে দিতে চাইছে কিন্তু ওহ তোর কারনে অপেক্ষা করে আছে। তুই সম্পর্কটা ভেঙে দে, তারপর ওহ বিয়ে করে নিক সংসার করুক।”

শান্ত উত্তর দিল না, উদাসিন হয়ে বসে রইল। অভিমান জিনিসটা বড্ড খারাপ, একবার চেপে বসলে কিছুতেই ছাড়তে চায় না।

—–

নাজিয়ার ফোনে হাসিবের ফোনকল আসে রাত ১০:১৪ মিনিটে। হাসিবের নম্বর দেখেই আবরারের মেজাজ হয়ে যায়, দাঁত দাঁত চেপে আবারো সবকিছু সহ্য করতে‌হবে ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নাজিয়াও বিরক্ত হয়ে ফোনটা রিসিভ করল,

– “হ্যালো কেমন আছো?”
– “জ্বি ভালো। এখন কল করলেন! কিছু দরকার?”
– “তেমন কিছুই না। তবে তোমার সাথে কথা বলতে‌ ইচ্ছা করছিল তাই।”
– “আসলে আমি একটু ব্যস্ত আছি এখন।”
– “এতরাতে ব্যস্ত! কি করছো?”

নাজিয়া বিরবির করে বলল,
– “বরের সাথে রোমান্স করছি দেখবি আয়।”

হাসিব কথাটা বুঝতে পারল না, তাই জিজ্ঞেস করল,
– “কি বললে?”
– “তেমন কিছু না, বাচ্চাটাকে সামলাচ্ছিলাম আর কি।”
– “কোন বাচ্চা!”
– “ওই আমার বাচ্চা, না মানে বাড়ির বাচ্চাটা।”
– “ওহ।”
– “আচ্ছা কাল তো অফ ডে, বিকালের দিকে আমার সাথে দেখা করতে পারবেন?”
– “আচ্ছা কোথায় দেখা করতে হবে সেটা বলো।”

নাজিয়া ঠিকানা বলে ব্যস্ত থাকার বাহানায় কলটা কেটে দেয়। ফোনটা কাটতেই আবরার জিজ্ঞেস করল,
– “কাল দেখা করতে চাইলে কেন?”
– “আমার মনে হয় ওনাকে বলে দেওয়া উচিত আমার সত্যিটা। কোনো মানুষকে অন্ধকারে রাখার অধিকার আমাদের কিন্তু নেয়।”
– “দেখো কোনটা ভালো হয়। আর কিছুক্ষণ আগে কি বলছিলে আমি বাচ্চা! তো চলো বাচ্চামি শুরু করে দিই।”
– “এই না, প্রান আছে উঠে পড়বে।”
– “আমার বাবাই তার মা বাবাকে ডিস্টাব করবে না, এসো‌ তো।”

আবরার নাজিয়াকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল।

পরেরদিন বিকাল,

একই রেস্টুরেন্ট সবাই মুখোমুখি। একটা টেবিলে শান্ত -শ্রেয়া। একটা টেবিলে নাজিয়া -হাসিব আর একটা টেবিলে আবরার ও আবির প্রানকে নিয়ে বসে আছে। বাড়িতে কেউ নেয়, তাই বাধ্য হয়েই প্রানকে নিয়ে এইভাবে বের হতে হয়েছে।

শান্ত নিজের মন মন কফি খেয়ে চলেছে, যেন সামনে কেউ আছে সেটাই দেখতে পাচ্ছে না। শান্তর এইরকম ভাবসাব দেখে শ্রেয়ার প্রচন্ড মনখারাপ হয়, মলিন গলায় বলল,
– “আমাকে কি একটাবার মাফ করা যায় না?”

শান্ত তাচ্ছিল্যের হেসে বলল,
– “অনিইচ্ছাকৃত ভুলের ক্ষমা হয় কিন্তু ইচ্ছাকৃত ভুলের কোনো ক্ষমা হয় না।”

শ্রেয়ার প্রচন্ড অভিমান হলো, ভালোবাসার মানুষটাও ওকে ঠিকমতো বুঝতে পারল না! শ্রেয়া মনে মনে ঠিক করে নিল, আজ আর শান্তর কাছে নিজের মাথা নোয়াবে না, হতেও তো পারে ওইরকম একটা বিষয়ের পর শান্তর শ্রেয়ার সাথে সম্পর্ক রাখতে রুচিতে বাঁধছে তাই সম্পর্কটা থেকে বের হতে চাইছে।

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে