এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-১৯

0
296

#এক_আকাশ_দূরত্ব (১৯)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

– “তুই হঠাৎ করে এইসব জিজ্ঞেস করছিস কেন?”

শান্ত আবরারকে প্রশ্ন করল, আবরার নাজিয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে বলল,
– “এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম।”

কথাটা কেন যেন শান্তর কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না, তবুও কিছু না বলে গল্প করতে লাগল।

– “এক্সকিউজ মি।”

ওরা তিনজন মাথা তুলে তাকাল। আবির দাঁড়িয়ে আছে,

– “এখানে শান্ত কে?”
– “আমি কেন?”
– “আমি আবির তোমাকে কল করছিলাম।”
– “কিন্তু আমি তো আপনাকে কল করে বললাম আজকে মিট করতে পারব না।”

আবির বিজ্ঞদের মতো বলল,
– “শোন ছেলে কথা দিলে কথা রাখতে হয়। তুমি একজনকে কথা দিয়েছ আজ তার সাথে দেখা করব, কিন্তু দেখা করার কিছু মুহূর্ত আগে বলছ দেখা করতে পারবে না। এইটা কিন্তু ঠিক না।”

শান্ত মাথা নিচু করে নিল, আসলে অনেকদিন পর বন্ধুকে পেয়ে ভুলে গিয়েছিল বিষয়টা।

– “সরি। আপনি বসুন না, কি বলতে চান বলতে পারেন এরা আমার ফ্রেন্ড।”

আবির আয়েশ করে বসে কিছু বলতে যাবে তার আগে ওয়েটার কফি তিনটে দিয়ে গেল। আবির কোল্ড কফিটা নিয়ে চুমুক দিয়ে বলল,
– “কফিটা দারুন টেস্টি।”

শান্ত বিরক্ত হলো আবিরের কাজে। লোকটা আসল কথা না বলে পেঁচিয়ে চলেছে, এর আসল উদ্দেশ্যে কি? কেন ডেকে পাঠিয়েছে?

আবির শান্তর দিকে তাকিয়ে বলল,
– “জানি মনে মনে অনেক গালাগালি দিচ্ছিস, দে দে এখন তোদেরই বাজার।”

তুই’ সম্বোধন’টা একদম আপন, সমবয়সী, বন্ধু, ছোট ভাইবোনকে বলা যায়। কিন্তু অচেনা মানুষকে বলা যায় এটা শান্ত জানত না! আবিরের মুখে তুই সম্বোধন’টাই প্রচন্ড রকমের অবাক হলো, কি রিয়াক্ট করা উচিত সেটাই বুঝতে পারল ষা। অচেনা একজন ব্যক্তি তুই বলেছে বলে তার সাথে ঝামেলা করবে! নাকি চুপচাপ সবটা দেখবে সেটাই বুঝল না।

শান্ত আবিরের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
– “আপনি কি বলতে চাইছিলেন! কাইন্ডলি কথাটা বললে উপকৃত হতাম।”

আবির নড়েচড়ে বসল, আবরারের দিকে ইশারা করল বলার জন্য কিন্তু আবরার ওকে পাত্তা না দিয়ে বলল,
– “হ্যাঁ আপনার কি বলার আছে বলে ফেলুন, হেঁয়ালি না করে।”

আবির ওদের তিনজনের দিকে একপলক তাকিয়ে বলল,
– “আমি শ্রেয়ার ব্যাপারে তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।”

শ্রেয়া! নামটা শুনে শান্ত চমকে উঠল। আবির শ্রেয়াকে চিনল কেমন করে?

– “আপনি শ্রেয়াকে চেনেন?”
– “হুমম, খুব ভালো করেই চিনি। তোমাকে আজকে কিছু জানানোর জন্য ডেকেছি, একটু ধৈর্য নিয়ে কথাগুলো শুনবে তারপর ঠিক -ভুল বিচার করবে।”

শান্ত থাকতে চাইলেই কি শান্ত থাকা যায়। আবিরের কথাগুলো শান্তর ভেতরে এলোমেলো করে দিচ্ছে, শ্রেয়ার ব্যাপারে লোকটা কি বলবে? খারাপ কিছু কি?

আবির আবরারের দিকে তাকাল, ওহ চোখের ইশারায় সবটা বলতে বলল। আবির নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলল,
– “একসপ্তাহ আগে শ্রেয়া সুই-সাইড করার চেষ্টা করেছিল।”

শান্ত চমকে উঠল, শ্রেয়া সুই-সাইড করার চেষ্টা করেছে বিষয়টা শোনার পর উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
– “এইসব আপনি কি বলছেন? শ্রেয়া ঠিক আছে তো!”
– “হুমম ঠিক আছে। তুমি শান্ত হও, এখনি ভেঙে পড়লে চলবে না এখনো অনেক ধাক্কা নিতে হবে।”
– “অনেক ধাক্কা মানে!”

আবির শান্তকে বিস্তারিত বলল। শান্ত নিরুত্তর ভাবে আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আবির ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
– “এইবার তোমার মতামত বলো।”

শান্ত সেই উত্তরটা না দিয়ে আবিরকে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল,
– “আপনি শ্রেয়ার কে হন?”
– “সেটা সময় হলেই জানবে, এখন উত্তরটা দাও।”
– “আমি আপনাকে কিভাবে বিশ্বাস করব, যে আপনি সত্যি কথা বলছেন? হতেই তো পারে আপনি মিথ্যা বলছেন!”

আবির‌ মাথা নাড়িয়ে বলল,
– “আমি তো মিথ্যা বলতেই পারি, কিন্তু তোমার মনে‌ কি প্রশ্ন জাগছে না শ্রেয়া হঠাৎ করে তোমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিল কেন? কেন তোমাকে সবজায়গা থেকে ব্লক করে দিল?”
– “আপনি এইগুলো জানলেন কিভাবে?”
– “দেখছ তো‌ সবকিছুই জানি, তাহলে বিশ্বাস করতে পারছ না কেন? আর শ্রেয়ার নামে মিথ্যা বলে আমার লাভ কি!”
– “লাভ-লোকসন আমি জানি না। তবে শ্রেয়া যদি একটিবার আমাকে সবকিছু খুলে বলত, আমি নিজে ওকে হেল্প করতাম।”
– “তাহলে এখন করো। এখন করতে অসুবিধা আছে?”

শান্ত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কিছু একটা ভাবতে লাগল, আবরার শান্তর দিকে দেখছে।ছেলেটার মধ্যে কি চলছে?

– “কি হলো? চুপ করে গেলে যে! ভালোবাসা বুঝি ফুরিয়ে গেল।”

আবিরের খোঁচা মারা কথা শুনে শান্ত মৃদু হেসে বলল,
– “আমার ভালোবাসা এতটাও তুচ্ছ নয় যে এই সামান্য কারনে ফুরিয়ে যাবে। আবার এতটাও সস্তা নয় যে কারোর অবহেলার পরেও তার কাছে বারবার ফিরে যাবো। আপনার কথাগুলো যদি সত্যি হয় তাহলে আমি আমার সবটা দিয়ে শ্রেয়ার সম্মান রক্ষা করব তবে শ্রেয়া না চাইলে আমি আর ওর জীবনে আর‌ ফিরব না।যে হারাতে চাই, তাকে হারিয়ে যেতে দেওয়াটাই শ্রেয়। জোর করে আর যাইহোক ভালোবাসাটা হয় না।”

শান্তর কন্ঠে স্পস্ট অভিমান। শ্রেয়ার এড়িয়ে চলা, অকারনে ব্লক দেওয়া সবটাই বড্ড আঘাত পেয়েছে ছেলেটা। অভিমান করেছে ভালোবাসার মানুষটার উপর। অন্যদিকে, শ্রেয়া নিজের এলোমেলো জীবন নিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে আসল মানুষটাকেই বড্ড আঘাত দিয়ে ফেলেছে, ফলে দুজনের মাঝে দুরত্ব তৈরি হয়েছে। আচ্ছা এই দূরত্ব কি মিটবে, নাকি অভিমানের পাল্লা ভারী হতে‌ হতে ‘এক আকাশ দূরত্ব’তে পরিনত হবে!

– “তোর মাথায় কি ঘুরছে? কি করবি!”

আবরার এতক্ষনে মুখ খুলল। শান্ত আবরারের দিকে তাকিয়ে বলল,
– “আমার একজন ডিটেকটিভ ফ্রেন্ড আছে, আমি তাকে বলব ওই লোকটার বিষয়ে খোঁজখবর নিতে। যদি সন্দেহজনক কিছু পায় তারপর সিদ্ধান্ত নেব।”
– “আমি কি কিছু হেল্প করব?”
– “প্রয়োজন পড়লে আমি নিজে চেয়ে নেব।”

সেদিনের কথাবার্তা এইখানেই শেষ হয়। আবির-আবরার, নাজিয়া বাড়ি ফিরে আসে, শান্ত তখনও জানে না ওদের আসল পরিচয়। শ্রেয়ার সাথে ওদের কি সম্পর্ক। অনেকগুলো প্রশ্ন মাথায় উঁকি দিচ্ছে কিন্তু তার উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। শান্ত ডিটেকটিভ বন্ধুকে ফোন করে শ্রেয়ার অফিসের বসের ব্যাপারে খোঁজ নিতে বলল, ওই লোকটার চরিত্র জানলেই সবকিছু পরিস্কার হয়ে যাবে।

***

শান্ত একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে চলেছে, সাধারনত ওহ স্মোক করে না মাঝেমধ্যে বন্ধুদের তালে পড়ে একটান দিয়ে দেয়, কিন্তু শ্রেয়ার বিষয়টি জানার পর থেকে নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা তার মাঝে পড়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, আর ততই শ্রেয়ার উপরে রাগ-অভিমান তীব্রতর হয়ে উঠছে। মেয়েটা একটাবার ওকে সবকিছু খুলে বলতে তো‌ পারত, কিন্তু কেন বলল না! কেন এইভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল!

শান্তর ফোন বেজে উঠল, স্কিনে আবরারের নামটা ভেসে উঠেছে। কফিশপে বসে দুজন দুজনের নম্বর আদানপ্রদান করেছিল।

– “হ্যালো বল।”
– “কি করছিস?”

শান্ত সিগারেটে একটান দিয়ে বলল,
– “সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছি।”
– “কবে থেকে ধরলি?”
– “আজ থেকে।”

আবরার শয়তানি করে বলল,
– “বউয়ের মার খাবার জন্য রেডি থাকিস। শ্রেয়া কিন্তু স্মোক করা ছেলেদের একদম পছন্দ করে না।”

প্রথম কথাতে শান্ত হেসে উঠলেও দ্বিতীয় কথাটাতে ভ্রু কুঁচকে বলল,
– “তুই কিভাবে জানলি শ্রেয়া স্মোক করা পছন্দ করে না।”

আবরার আমতা আমতা করে বলল,
– “আরে ভাই বেশিরভাগ মেয়েরা তো স্মোক করা পছন্দ করে না, তাই বললাম। আচ্ছা বল কি জানতে পারলি।”
– “আপাতত কিছু খবর পায়নি। খোঁজ চালাচ্ছে, দেখা যাক কি খবর পায়‌।”
– “একটা প্রশ্ন ছিল।”
– “কি বল।”
– “তুই তো চাইলেই বিষয়টা খতিয়ে না দেখে লোকটার কথা বিশ্বাস করে কোনো স্টেপ নিতে পারতিস? কিন্তু সেটা না‌ করে এইসব করছিস কেন?”

শান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– “এযুগে দাঁড়িয়ে কাউকে বিশ্বাস করা মানেই বোকামি। আমি তো নিজেকেই নিজে বিশ্বাস করি না আর অন্য কাউকে তো দূর। ঘটনাটা যদি আমি সরাসরি শ্রেয়ার মুখ থেকে শুনতাম, তাহলে আমার এতটা খতিয়ে দেখার দরকার ছিল না। কিন্তু শুনেছি কোথা থেকে? একজন অচেনা মানুষের কাছ থেকে, যে আদৌও সত্যি বলছে কিনা সেটাও জানি না। এমনকি মানুষটা কে! শ্রেয়ার কে হয়, বিষয়টা কিভাবে জানল সেইসবের কিছুই জানি না। তার কথা বিশ্বাস করে, একজন প্রভাবশালী মানুষের সাথে ঝামেলা করতে যাওয়া মানে বোকামী।তাই আগে সবটা জানব, তারপর ভাবব কি করব।”

– “এখন শ্রেয়া যদি নিজের মুখে সবটা বলে আর তোকে বিয়ে করতে চায় তো?”

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে