Saturday, July 19, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 379



এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-১৫

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (১৫)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

“আমি এই বিয়ে মানি না।”

আবরারের কথাতে সবাই চমকে উঠল, কমবেশি সকলেই জেনে গেছে আবরার নাজিয়াকে ভালোবাসে তাই চমকানোর মাত্রাটা একটু বেশিই ছিল।

আবির আবরারকে ধমক দিয়ে বলল,
– “এখন ঝামেলা না করে সাইনটা করে দে।পরে বসে সবকিছু ঠিকঠাক করা হবে।”
– “কখনোই না”

আবির বিরক্ত হয়ে বলল,
– “বাচ্চাদের মতো কি শুরু করেছিস বল‌ তো! বিয়ে পড়ানো হয়ে গেছে, ইসলাম মতে নাজু আর তুই স্বামী-স্ত্রী তাহলে সামাজিক বৈধতা দিতে এতটা নাটক করছিস কেন?”
– “এই বিয়েতে আমার অনুমতি নিয়েছ?”

সকলের মুখটা থমথমে হয়ে যায়। আবরার সকলের দিকে তাকিয়ে বলল,
– “তোমরা অই কেউ একটাবার আমার দিকটা ভেবে দেখছ! অন্য কারোর‌ সাথে বিয়ে হবে ভেবে আমার কি অনুভূতি হয়েছে, সেটা কি কেউ একটাবার ভেবেছ? এতটা নাটক আমার সাথে না করলেও পারতে।”

আবরার রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করে দিয়ে চলে গেল, বসার ঘরের সকলের মুখ থমথমে হয়ে আছে। আবির মনে মনে অনুশোচনা করল, ছেলেটাকে এতটা ট্রেস না দিলেও হতো। আবির নাজিয়ার কাছে গিয়ে চাপা স্বরে বলল,
– “যা রগচটা বর’টার রাগ ভাঙা।”

নাজিয়া উশখুশ করতে লাগল, এত মানুষের সামনে দিয়ে কিভাবে যাবে! আবির বিষয়টা বুঝতে পেরে শ্রেয়াকে ইশারা করল নাজিয়াকে নিয়ে যাবার জন্য, শ্রেয়া ওকে নিয়ে সকলের আড়ালে এসে বলল,
– “আবরার‌ প্রচন্ড রেগে গেছে সামলাও ওকে গিয়ে।”

নাজিয়া মৃদু হেসে বলল,
– “ওহ রাগ করেনি, অভিমান করেছে সবার উপরে। ওর মনে হয়েছে, সবাই ওর‌ সাথে মজা করেছে, ওকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পেয়েছে তাই রিয়াক্ট করে ফেলেছ।”

শ্রেয়া নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে শয়তানি হেসে বলল,
– “বাবা বিয়ে না হতে হতেই কত দিকে খেয়াল। যাও বরের কাছে যাও।”

নাজিয়া মৃদু হেসে ছাদের দিকে পা বাড়াল, ওহ জানে এই মূহুর্তে আবরার ছাদে ছাড়া অন্য কোথাও থাকতে পারে না। আর ওর সন্দেহটাই ঠিক হলো, আবরার ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। নাজিয়া আবরারের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
– “ভাগ্য কতই অদ্ভুত তাই না!”

আবরার উত্তর দিল না, এমনকি পাশ ফিরে দেখলেও না। নাজিয়া আবরারের দিকে আর একটু সরে এসে বলল,
– “আমিই মনে হয় প্রথম বউ, যে বাসর রাতে না গিয়ে নিজের পায়ে হেঁটে বরের রাগ ভাঙাতে ছাদে এসেছে।”
– “তোমাকে কে আসতে বলেছে? চলে যাও।”
– “কেউ বলেনি নিজেই এসেছি, একটা গুড নিউজ দেবার ছিল।”

আবরার গম্ভীর গলায় বলল,
– “কি?”
– “আমি তোমার বউ হয়ে গেছি।”

কথাটা বলার সময়ে নাজিয়ার কন্ঠে অন্যকিছুর আভাস পাওয়া গেল। কিছুটা লজ্জা, কিছুটা আনন্দের মিশ্রনে এই অনুভূতি। এতগুলো দিন, বছর একপ্রকার একতরফা ভালোবাসার পর অবশেষে তাকে পেল এর থেকে আনন্দের অনুভূতি আর‌ কি হতে পারে?

আবরার নিজেকে সামলে রাখতে পারল না, হুট করে নাজিয়াকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে।

– “আরে আসতে লাগছে তো।”

আবরার আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
– “আমারও লাগত এতদিন।”
– “আর এখন?”
– “অনেক…. শান্তি লাগছে।”

নাজিয়া ফিক করে হেসে দিল। আবরার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নাজিয়ার মাথায় ভালোবাসার পরশ দিল। এতদিনের অপেক্ষার পর ভালোবাসার মানুষটি আজ ওর একান্ত নিজের ব্যক্তিগত।‌উফ্ অনুভূতিটাই একদম আলাদা।

বর্তমানে শ্রেয়া আর আবরারের ঝগড়া চলছে, শ্রেয়া বলছে নাজিয়া ওর সাথে থাকবে আর আবরারের দাবি সে কিছুতেই তার বউকে অন্য কারোর কাছে দেবে না। আর এইদিকে ওদের ঝগড়া শুনে নাজিয়া লজ্জায় শেষ। আবির এতক্ষন এইখানে থাকলেও এদের ঝগড়া শুনে‌ পালিয়ে গেছে, যতই হোক বড়ো‌ দাদা তো। এরা যা ঠোঁট কাটা কখন কি বলে ফেলে কে জানে, তাই আগে- ভাগেই চলে গেছে। প্রান আজ ওর দাদু- দিদুনের কাছে থাকবে যদিও নাজিয়া বলেছিল ওর কাছে রাখার জন্য কিন্তু বড়োরা রাখতে দেয়নি অত্যন্ত আজকের দিনটা ওরা নিজেদের মতো করে কাটাক।

– “দ্যাখ শ্রেয়া এইটা কিন্তু ঠিক না, আমার বিয়ে করা বউ আর আমার কাছেই থাকবে না!”
– “আজকের দিনটা আমার কাছে থাকুক না।”
– “সারাদিন তোর‌ কাছেই ছিল, এখন আমার কাছে থাকবে পালা এইখান থেকে।”
– “ঠিকাছে যেতে পারি কিন্তু…
– “আবার কিন্তু কি?”
– “পাঁচ হাজার টাকা দাও।”
– “এ্যাঁ!!”
– “এ্যাঁ নয় হ্যাঁ। তোমার বউকে এত সুন্দর করে সাজিয়ে দিলাম ফ্রিতে, আবার এখন তোমাদের প্লেস করে দিচ্ছি তো পাওনা একটা তো থাকেই তাই না!”

আবরার বুঝল এই মেয়ে কিছু না ধিয়ে কিছুতেই যাবে না, তাই বলল,
– “দুই দিই?”
– “দুই তে কি হবে? আমার পাঁচ লাগবে আর না যদি দাও তাহলে আজকে সারারাত আমি এইখানেই থাকব।”

আবরার নড়েচড়ে দাঁড়াল, এই মেয়ে এইখানে থাকবে মানে‌ কি!

– “কি হলো? কি করবে বলবে তো!”

আবরার করুন চোখে নাজিয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে, শ্রেয়ার হাতে তিনহাজার টাকা গুঁজে দিয়ে বলল,
– “বইন প্লিজ মাফ কর। আমি আর পারব না।”

শ্রেয়া টাকাটা গুনে নিয়ে বলল,
– “এইবারের মতো ছাড় দিলাম, পরের বার..

আবরার পুরোটা বলতে না দিয়ে বলল,
– “আবার পরের বার কি! আমি কি বছর বছর বিয়ে করব নাকি?”
– “সে সময় হলে দেখা যাবে। এখন বাই, বেস্ট অফ লাক।”

শ্রেয়া একছুটে রুমের বাইরে চলে যায়। আবরার যেন দম ফেলে বাঁচে, ওই মেয়ে যদি সত্যি সত্যি এই ঘরে থাকত তো!

আবরার দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসে বলল,
– “এই ওযু করে আসো তো, একসাথে নামাজ পড়ব।”

দুজন নামাজ আদায় করে, নিজেদের নতুন জীবনের জন্য দোয়া করল।

আবরার নাজিয়ার হাতটাকে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
– “আমাদের জীবনে কতকিছুই হয় তাই না!”
– “হুম। জীবন খরস্রোতা নদীর মতো, কখনো জোয়ার আবার কখনো ভাটা।‌কখনো ওঠা আবার কখনো পরা দুইয়ের মিশ্রনেই জীবন।”
– “আজ থেকে আমি তোমাকে নাজি বলে ডাকব।”
– “নাজি!”
– “হুমম। আমার নাজি।”

নাজিয়া মৃদু হাসল। আবরার নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
– “তোমার পরিবর্তন আমাকে ভাবিয়েছিল, আমি অনেক ভেবেও তোমার বদলে যাবার কারন খুঁজে পাইনি। অবশেষে আমাদের মধ্যেকার “এক_আকাশ_দূরত্ব’টা” মিটল।

নাজিয়া মনে মনে বলল,
– “আর সেটা কখনো তুমি জানতেও পারবে না। আমি চাই না, আমার কারনে তোমাদের মা- ছেলের সম্পর্কে কোনো আঁচ আসুক। মা ছেলের সম্পর্ক সুন্দর সম্পর্ক, সেটা আজীবন সুন্দর থাকুক এইটুকুই চাই।”

আবরার নাজিয়াকে ডেকে বলল,
– “কি ভাবছ?”
– “কিছু না। বলছি ঘুমাবে না?”

আবরার শয়তানি হেসে বলল,
– “বাসর রাতে কে ঘুমায়? সবাই তো বলে বাসর রাতেই বিড়াল মারতে হয়।”

নাজিয়া লজ্জা পেয়ে আবরারের বুকে মুখ লোকায়। আবরার হেসে উঠে প্রিয়তমার কান্ডে। দুটি মন,প্রান ভালোবাসার সাগরে একে অপরের সাথে মিশে গেল। ভালো থাকুক ভালোবাসারা।

সময় বহমান। দেখতে দেখতে কেটে গেছে একটা মাস। নাজিয়া নিজের নতুন সংসারে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। আবিরের মা নিজের কথা রেখেছেন, নাজিয়ার বন্ধু হয়ে উঠেছেন। সংসারের কাজ সেরে একসাথে আড্ডা দেওয়া, গল্প করা সবকিছুই চলে বউ-শাশুড়ির মধ্যে। প্রান ছোটমা আর দিদুনের আদর-যত্নে বেড়ে উঠছে। আবরার নিজের অফিস পরির্বতন করে নিয়েছে, সকালে বের হয় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায় আবিরেরও সেম অবস্থা। বাড়ি ফিরে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে পরিবারের সকলে মিলে একটা আড্ডায় মেতে উঠে, হইহই করে সময় কেটে যায়। সবকিছুর মধ্যে আবিরের বারবার নিসার কথা মনে পড়ে, সে থাকলে সবকিছু পূর্ন হতো।

দিনশেষে সবাই নিজেদের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়লে আবির বড্ড একা হয়ে পড়ে। প্রানটাও খুব ছোট, ওকে একা সামলে রাখতে পারবে না বলে নিজের কাছে রাখা হয়না। আবির জানে নাজিয়া কোনো অযত্ন করবে না তার ছেলের তবুও..

আবির নিসার ছবির উপর হাত বুলিয়ে বলল,
– “জানো নিসা আমাদের পরিবারটা আগের মতো পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে কিন্তু আমি অসম্পূর্ণ। তোমাকে ছাড়া আমি বড্ড নিঃস্ব, একা। দিনশেষে মাথায় হাত বুলিয়ে দেবার জন্য তুমি নেই, ক্লান্ত মনটাকে স্থির করার জন্য তোমার কাঁধটা নেই, মনখারাপের সময়ে আগলে রাখার জন্য তোমার বুক নেই, হাত নেই। আমি বড্ড একা হয়ে গেছি, তোমার আর আমার মাঝের দূরত্বটা এক আকাশ সমান হয়ে গেছে। আচ্ছা তুমি খুব ভালো আছো তাই না! আমি কষ্ট পাচ্ছি, সেইগুলো দেখতে তোমার খুব আনন্দ লাগছে তাই না!”

আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলল, দিনকে দিন একাকিত্ব আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে। সারাদিনের ব্যস্ততা, দিনশেষে বাড়ি ফিরে সকলের সাথে আড্ডায় ব্যস্ত থাকাতে কিছুই মনে হয় না কিন্তু রাত বাড়লেই স্মৃতিগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। এই রুম, রুমের প্রত্যেকটা জিনিসে নিসার‌ স্মৃতি জড়িয়ে আছে, সেইগুলো কিভাবে ভুলবে!

নিসার ছবি নিজের বুকে জড়িয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে, সেইদিকে খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙে ফোনের রিংটোনের আওয়াজে। আবির ঘুমঘুম চোখে ফোনটা কানে ধরতেই চমকে উঠল,

– “আবির বাবা সর্বনাশ হয়ে গেছে। শ্রেয়া সুই-সাইড করার চেষ্টা করেছ, অবস্থা খুব খারাপ হসপিটালে ভর্তি করানো‌ হয়েছে।”

আবিরের ঘুম উড়ে যায়। শ্রেয়া সুই-সাইড করার চেষ্টা করেছে? কিন্তু কেন!!!

#চলবে…

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-১৪

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (১৪)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

“আমি এই বিয়েতে রাজি হয়েছি কারন!

এতটুকু বলে আবিরের মা নাজিয়ার মুখের দিকে তাকালেন, ওর চোখেমুখে কৌতুহল সাথে চিন্তার ছাপ। আবিরের মায়ের এই প্রথম নাজিয়াকে দেখে মায়া হলো, ভালো করে নজর দিয়ে দেখলেন মেয়েটা দেখতে মাশাল্লাহ বেশ সুন্দর। এতদিন জেদ করে মেয়েটা ভালো করে খেয়াল করাই হয়নি, মনে মনে আফসোস করলেন। কয়েক বছর আগে যদি এই ভুলটা বুঝতে পারতেন তাহলে হয়তো এতকিছু হতো না।

নাজিয়াকে অবাক করে দিয়ে উনি এগিয়ে এসে নাজিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
– “এই কয়েকদিনে একটা কথা খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছি, এই পরিবার, আবরারের জন্য তোমার থেকে যোগ্য কেউ হতেই পারে না।”

নাজিয়া অবাক নয়নে ওনার দিকে তাকিয়ে আছে, বিশ্বাস করতে পারছে না। যে মানুষটা ওকে সব থেকে বেশি অপছন্দ করে আজকে সেই মানুষটা তার ছেলের জন্য যোগ্য মনে করেছে!!

– “জানি আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি, নিজের জেদ-ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তোমাকে কষ্ট দিয়েছি সাথে নিজের ছেলে’কেও। তোমার কাছে আমি মাফ চাইব না, শুধু অনুরোধ করব আমার বর্তমান ও অবর্তমানে আমার সংসার’টাকে আগলে রেখো।”

নাজিয়া হঠাৎ করেই ইমোশনাল হয়ে গেল, আবিরের মাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। এতদিন, এতটা বছর একটা জিনিসই চেয়েছে আবিরের‌ মা ওকে মেনে নিক কিন্তু সেটা হয়নি। আর আজ সেই ইচ্ছাটা পূরণ হয়েছে, এর থেকে আনন্দের আর‌ কি হতে পারে!!

আবিরের মা নাজিয়াকে আগলে নিলেন, এতদিন মেয়েটাকে অনেক কষ্ট দিয়েছেন আর দিতে চান না। মন থেকে দোয়া করলেন, ছেলে আর ছেলের বউ যেন খুব ভালো থাকে।

আবিরের মা দুইদিন আগের ঘটনার স্মৃতিচারণ করলেন,

অতীত…

– “আবরার আর নাজিয়ার বিয়ে দিতে চাই।”

আবিরের মা চমকে উঠে ছেলের মুখের দিকে তাকালেন।

– “তুই এইসব কি বলছিস আবির?”
– “হ্যাঁ মা। আবরার আর নাজিয়া একে অপরকে ভালোবাসে, শ্রেয়ার সাথে আবরারের বিয়ে হওয়া মানে একসাথে তিনটে জীবন নষ্ট করে দেওয়া।”
– “তুই সব জানিস?”
– “হ্যাঁ মা। আমি সবকিছু জানি, আর নাজিয়াকে এই বাড়িতে নিয়ে আসার পেছনে শুধু নিসাই একমাত্র কারন ছিল না। আমি আবরার আর নাজিয়াকে এক করতে চেয়েছিলাম।”

আবিরের মা একটার পর একটা চমক পাচ্ছেন। কি সিদ্ধান্ত নেবেন সেইটাই বুঝে উঠতে পারছেন না, আবির ওর মায়ের হাতটা ধরে বলল,

– “মা জোর করে সংসার করা যায় না, তুমি প্লিজ এই বিয়েতে রাজি হয়ে যাও।”

আবিরের মা কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন। তারপর ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– “কিন্তু আবির আমি যে তোর মামাকে কথা দিয়েছি শ্রেয়াকে এই বাড়ির বউ করব।”
– “মা যেখানে ছেলে-মেয়েদের মত নেই সেইখানে জোর করাটা কি উচিত হবে?”
– “শ্রেয়ার মত নেই?”
– “না মা। শ্রেয়াও অন্য একজনকে ভালোবাসে। এখন তুমিই বলো ওদের বিয়ে দেওয়া কি ঠিক হবে?”

আবিরের মায়ের মুখ থেকে চিন্তার ভিড় সরে গেল, শ্রেয়ার কথা ভেবেই এতক্ষন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। এখন যেহেতু শ্রেয়ার মত নেই তাই বিষয়টা এইখানে থামিয়ে দেওয়াই ভালো। কখনো কখনো সন্তানদের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে হয়।

– “আচ্ছা আমার কোনো আপত্তি নেই। তোর বাবাকে বলেছিস?”
– “হুমম। বাবা অলরেডি নাজিয়ার বাবা মায়ের সাথে কথাও বলে নিয়েছেন ওনারাও রাজি আছেন। শুধুমাত্র তোমার মতের অপেক্ষায় ছিলাম।”

আবিরের মা অমত করার মতো আর কিছুই পেলেন না, সবাই রাজি আর উনিও এই কয়েকদিনে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন তাই দুজন ভালোবাসার মানুষকে এক করে দিলে মন্দ হয় না। তারপর হঠাৎ করেই দুইদিন পর বিয়ে ঠিক করা হয়, সেইদিন রাতে আবিরের বাবা আবরারের উদ্দেশ্যে বললেন,

– “আগামী পরশু তোমার বিয়ে।”

আবরার সবেমাত্র ভাত গালে দিয়েছিল‌ বাবার কথা শুনে বিষম খেয়ে যায়। নাজিয়া পাশে দাঁড়িয়ে সবাইকে বেড়ে দিচ্ছিল, আবরারকে বিষম খেতে দেখে পানি এগিয়ে দিল তারপর পিঠে হাত বুলিয়ে লাগল। আবরারের প্রতি কেয়ার দেখে সবাই মৃদু হাসল।

আবরার নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
– “আমার বিয়ে মানে?”
– “বিয়ে মানে বিয়ে। আগামীকাল শ্রেয়াকে নিয়ে গিয়ে বিয়ের কেনাকাটা করতে যাবে আর এইটাই আমার ফাইনাল ডিসিশন।”

বাবার মুখের উপর কিছু বলতে না পেরে আবরার খাবার রেখে দিয়ে চলে গেল। নাজিয়াও ঠিকমতো খেতে পারেনি সেইদিন।

নাজিয়ার ডাকে আবিরের মা ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে। উনি নাজিয়ার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললেন,
– “আর কান্না নয়, অনেক কান্না করছ এইবার থেকে সবসময়ে হাসি-খুশি থাকবে। মনে থাকবে!”
– “হুমম।”
– “তুমি এইখানে ওয়েট করো, ওদের হয়ে গেলে তোমাকে নিয়ে যাবে।”
– “আন্টি প্রানকে খাওয়ানোর ছিল।”
– “সেটা তোমাকে চিন্তা করতে হবে না, আমি প্রানকে খাইয়ে দিয়েছি। আর শোন মেয়ে, এইসব আন্টি-টান্টি বলা যাবে না আমাকে মামনি বলে ডাকবে আমাকে। আমি কখনোই তোমার মায়ের জায়গা নিতে পারব না, মা ডাকটা তোমার মায়ের জন্যই থাকুক। আমি না হয় বন্ধুর মতো শাশুড়ি হবো!”

নাজিয়া ওনাকে আবারো জড়িয়ে ধরল। মানুষটা খারাপ না, কিন্তু কিছু জেদ-অভিমানের ভীড়ে ভালো মানুষটা চাপা পড়ে গিয়েছিল যেটা পুনরায় প্রকাশিত হচ্ছে।

বিয়ে ইশার নামাজের পর পড়ানোর কথা থাকলেও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। মাগরিবের পর বিয়ে পড়ানো হবে, সেই কারনেই শ্রেয়া তাড়াতাড়ি নাজিয়াকে রেডি করিয়ে দিয়েছে। আবরার সাদা রঙের একটা পাঞ্জাবী-পায়জামা পড়ে সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছে, একবারের জন্যও মাথা তুলে তাকাচ্ছে না। কাজি সাহেব আসতেই কনেকে নিয়ে আসার জন্য তাড়াতাড়ি করতে লাগল। শ্রেয়া নাজিয়াকে নিয়ে এসে আবরারের মুখোমুখি বসিয়ে দিল, আবরারের দৃষ্টি তখনও মাটিতে। আর নাজিয়া! সে তো ভয়েই শেষ, কি হবে! প্রচন্ড রকমের নার্ভাস লাগছে কি করবে?

কাজি সাহেব বিয়ে পড়াতে শুরু করলেন, আবরার নিজের ধ্যানে এতটাই মগ্ন ছিল যে খেয়াল করতেই ভুলে গেছে পাত্রীর নাম কি বলল।‌ হয়তো খেয়াল করলে বুঝে যেত, অন্য কেউ নয় ওর প্রিয় মানুষটাই ওর সহধর্মিনী হতে চলেছে।

আবরার আর নাজিয়ার বিয়ে সম্পন্ন হয়। রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করার সময়ে হঠাৎ করেই আবরারের চোখ আটকায় পাত্রীর নামের জায়গায়, চমকে ওঠে! নাজিয়া!! আবরার সাইন না করে সামনে তাকাতেই আরেকদফা চমক খেল। নাজিয়া বিয়ের সাজে বসে আছে আর শ্রেয়া নর্মাল ড্রেসাপে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আবরারের সবকিছু এলোমেলো লাগল, বিয়ের কথা শুনে কি পরিমান টেনশনে ছিল সেটা একমাত্র ওই জানে। আবির, শ্রেয়া উভয়ের কাছে বারবার গেছে কিন্তু ওরা প্রতিবারই ফিরিয়ে দিয়েছে নানান বাহানা দিয়েছে ‌ তারমানে সবকিছু সবার সাজানো প্ল্যান ছিল! ওর পরিবার – নাজিয়া ওর সাথে গেম খেলেছে কথাটা ভাবতেই মাথাটা গরম হমে উঠল। রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন না করেই বলল,
– “এইসবের মানে কি? শ্রেয়ার জায়গায় নাজিয়া কেন?”

আবির শান্ত কন্ঠে বলল,
– “কারন বিয়েটা তোর আর নাজুর তাই।”

আবরার উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
– “আমি এই বিয়ে মানি না।”

উপস্থিত সকলের মাথাতে আকাশ ভেঙে পড়ল। আবরার বিয়ে মানে না মানেটা কি??

#চলবে…

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-১৩

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (১৩)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

আজ আবরার আর শ্রেয়ার বিয়ে। সকাল থেকে জোর কদমে আয়োজন চলছে, আত্মীয়রা ইতিমধ্যেই চলে এসেছেন। আত্মীয় বলতে আবাররের মামা বাড়ির লোকজন এবং নাজিয়ার বাবা মা।

অনেকদিন পর মাকে দেখামাত্রই নাজিয়া আবেগী হয়ে পড়েছিল, জড়িয়ে ধরে দুজনের সেকি কান্না। সদ্য এক মেয়েকে হারিয়ে নাজিয়ার মাও বড্ড একা হয়ে গেছেন, মেয়ের শশুর বাড়িতে আসতেই কষ্টগুলো তাজা হয়ে উঠছে।মেয়ের সংসারের গল্পগুলো স্মৃতিচারণ করতে লাগলেন, আবিরের সাথে কথা বললেন কিছুক্ষণ তারপর প্রানকে মনভরে আদর করলেন। ছেলেটা তার মেয়ের শেষচিহৃ, তাদের সকলের প্রান।

সবাই সবার মতো ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ঈশার নামাজ পর বিয়ে পড়ানো হবে ঠিক করা হয়েছে, তারপরে সবাই খাওয়া দাওয়া করবে তার জন্য দুপুরের খাবার পর থেকেই আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। দুপুরে খেতে বসে নাজিয়া আবরার কেউই ঠিকমতো খায়নি, গলা দিয়ে খাবার নামছে না আর কিভাবেই বা নামবে! নাজিয়ার বি’ষাক্ত কিছু অনুভূতি হচ্ছে, ইচ্ছা করছে‌ সবকিছুর বাঁধন খুলে আবরারের কাছে চলে যেতে কিন্তু সেটা যে আর সম্ভব না।

আবরার মনখারাপ করে বসে আছে দেখে আবির ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
– “কিরে এইভাবে বসে আছিস কেন?”
– “তো! কি করব?”
– “জীবনে একবারই বিয়ে করবি, কোথায় আনন্দ করবি তা না এইভাবে মনখারাপ করে বসে আছিস?”
– “ভালোবাসার মানুষটাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করব কথাটা ভাবতেই আমার বুক ফেঁটে যাচ্ছে, আর তুমি আনন্দের কথা বলছ!!” কথাটা নিজের মনে মনে বলল আবরার, আবিরের সামনে আর প্রকাশ করতে পারল না।

আবির আবরারের কাঁধে হাত দিয়ে বলল,
– “ভাই বিয়েটা কোনো ছেলে খেলা নয়, এইটা একটা সম্পর্ক সাত জনমের বন্ধন। বিয়ের পর মানিয়ে নেওয়া ও মেনে নেওয়া জীবন সুন্দর হয়ে উঠে।”

আবরার বিরক্ত হয়ে বলল,
– “আমাকে এইসব বলছ কেন?”
– “কারন আজকে তোর বিয়ে।”

আবরার মেকি হেসে বলল,
– “কিছু পারি আর না পারি মানিয়ে ও মেনে নিতে খুব ভালোই পারি।”

আবরার উঠে চলে যায়, ওর যাবার দিকে তাকিয়ে আবির মৃদু হাসল।

বিকাল ৩টের দিক করে, প্রানের জন্য দুধ গরম করতে গিয়ে নাজিয়ার চোখ পড়ে নিজের হাতের মেহেন্দির দিকে। কালকে রাতে শ্রেয়া একপ্রকার জোর করেই পড়িয়ে দিয়েছে। মেহেন্দির রং গাঢ় লাল হয়েছে দেখে নাজিয়া মেকি হেসে মনে মনে বলল,
– “মেহেন্দির লাল হয়েই বা কি হবে! ভালোবাসার মানুষটি আজ অন্য কারোর হতে চলেছে।”

কিছু অনুভূতি সকলের সামনে প্রকাশ করা যায় না, নিজের মধ্যে রেখে গুমড়ে মরতে হয়। নাজিয়াও আজ গুমড়ে মরছে, না পারছে কাউকে কিছু বলতে আর না পারছে সবকিছু সহ্য করে যেতে।’ভালোবাসার মানুষটিকে অন্য কারোর হয়ে যেতে দেখার সৌভাগ্য কারোর না হোক’ এর থেকে অসহনীয় যন্ত্রনা আর একটাও হয় না। তবুও নাজিয়া চাই আবরার আর শ্রেয়া ভালো থাকুক।

– ‘নাজিয়া নাজিয়া।”

শ্রেয়ার ডাক শুনে নাজিয়া নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে, কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখের কোনে পানি জমা হয়েছে সেই খেয়াল নেই। নাজিয়া নিজের চোখ মুছে, শ্রেয়ার কাছে যাবে বলে বের হচ্ছিল তখনি সেখানে শ্রেয়া চলে আসে।

– “তুমি এইখানে? আর আমি গোটা বাড়ি তোমাকে খুঁজে চলেছি।”
– “কেন কি হয়েছে?”
– “অনেক কিছু। চলো এইবার”
– “কোথায়? ”
– “আহ্ গেলেই দেখতে পাবে চলো তো।”

শ্রেয়া নাজিয়াকে টেনে ওর‌ঘরে নিয়ে আসল। রুমের মধ্যে শাড়ি, গহনা ফুল এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ে আছে, নাজিয়া প্রথমে ভাবল শ্রেয়া ওকে সাজিয়ে দিতে বলবে কিন্তু ওর ভাবনাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমানিত করে শ্রেয়া বলল,
– “এইবার চুপ করে বসে পড়ো তো তোমাকে সাজিয়ে আবার নিজে সাজব।”
– “আমি কেন সাজব?”
– “আমি বলছি তাই, কি আমার কথা রাখবে না?”

নাজিয়া কিছু বলতে পারল না, মেয়েটা সত্যি ভালো মনের মানুষ। সবকিছুতেই মুখে হাসি লেগে থাকে।

বেশ অনেকটা সময় পর..
শ্রেয়া নাজিয়াকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে, নাজিয়া তো বসে বসে বোর হয়ে যাচ্ছিল। শ্রেয়া এত কি সাজাচ্ছে সেটাই বুঝতে পারছে না।

শ্রেয়া নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
– “সব সাজ কমপ্লিট এইবার শুধু শাড়িটা পড়ানোর পালা।”
– “কি এতো সাজাচ্ছ আমাকে?প্লিজ আমাকে ছেড়ে দাও, আমার প্রচন্ড রকমের অস্বস্তি হচ্ছে।”
– “কোনো ছাড়াছাড়ি নেই। আজকের দিনে একটু সাজবে না তো‌ কবে সাজবে?”

নাজিয়া মেকি হেসে বলল,
– “নিজের বিয়ের দিন সাজব।”

শ্রেয়া নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হেসে বলল,
– “আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে একবার দ্যাখো, বুঝে যাবে সবকিছু।”

নাজিয়ার কৌতুহল জাগল, গুটি গুটি পায়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই চমকে উঠল। সাজটা একেবারে ব্রাইডালদেল মতো, গায়ে বেনারসী থাকলে পুরো বউ বউ লাগবে। নাজিয়া পেছন ফিরে বলল,
– “এইসব কি শ্রেয়া ‘দি?”
– “এখনো বুঝতে পারছ না?”
– “মানে? কি বুঝব!
– আমি জানি তুমি আর আবরার দুজন দুজনকে ভালোবাসো কিন্তু কোনো কারনে তুমি আবরারকে এক্সসেপ্ট করছিলে না। বড়ো দিদি হিসাবে একটা কথা বলছি তোমাকে, ভালোবাসা আগলে রাখতে হয়, এইভাবে অবহেলা করতে নেয়। সবার কপালে সত্যিকারের ভালোবাসা জোটে না, তোযার কপালে এসেছে আবরার তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে আর তুমি কি করছ! বারবার ওকে ফিরিয়ে দিয়েছ, ওর জায়গায় অন্য কোনো ছেলে হলে কবেই তোমাকে ভুলে অন্যকাউকে আপন করে নিত কিন্তু ওহ! আজও তোমার অপেক্ষায় আছে, তুমি যদি এখন একবার বলো ওকে বিয়ে করতে চাও ওহ পরিবারের সবার বিপক্ষে গিয়ে তোমাকে বিয়ে করবে”

নাজিয়া মাথা নিচু করে নিল, শ্রেয়ার কথাগুলো একটাও মিথ্যা নয়। কিন্তু এইখানে নাজিয়ার দোষ কোথায়! ওহ তো দুই পরিবার ও নিসা -আবিরের সম্পর্ক ঠিক রাখার জন্য নিজের ভালোবাসাকে ত্যাগ করেছে।

শ্রেয়া নাজিয়ার গালে হাত দিয়ে বলল,
– “যাকে ভালোবাসো তাকে আগলে রাখতে শেখো, দেখবে জীবন সুন্দর হয়ে উঠবে।”

নাজিয়া আহত কন্ঠে শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
– “শ্রেয়া’দি তুমি এইসব কি বলছ? আজকে তোমাদের বিয়ে!”
– “হু, তোমাদের নয় বলো আমাদের।”
– “মানে?”
– “আজকে তোমার আর আবরারের বিয়ে নাজিয়া।”

নাজিয়া চমকে উঠল, ওর আর আবরারের বিয়ে মানে!! শ্রেয়ার কথা ওর কাছে মজা মনে হলো, কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

– “তুমি এইসব কি বলছ?”
– “ঠিকই বলছি। দুই পরিবারের সকলে মিলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তোমাদের জানানো হয়নি সারপ্রাইজ দেবার জন্য”

নাজিয়ার তখনও বিশ্বাস হচ্ছে না কথাগুলো, সত্যি কি দুই পরিবার মিলে ওদের বিয়ে ঠিক করেছে!! নাকি শ্রেয়া ওর সাথে মজা করছে? কিন্তু এই বিষয়ে মজা করে লাভ কি!!

নাজিয়াকে আনমনা থাকতে দেখে শ্রেয়া বলল,
– “নাজিয়া এখন চলো শাড়িটা পড়িয়ে দিই।”
– “হু।”

নাজিয়ার মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, নিজেকে কিরকম একটা কাঠের পুতুলের মতো লাগছে কি রিয়াকশন দেওয়া উচিত সেটাই বুঝতে পারছে না। একদিকে ভালোবাসার মানুষটার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে শান্তি লাগছে আবার আবরারের মায়ের অমতের বিষয়টা ভেবে অস্বস্তি হচ্ছে। নাজিয়ার ভাবনার মাঝে শ্রেয়ার সাজানো কমপ্লিট। নাজিয়াকে খুব মিষ্টি লাগছে, শ্রেয়া শয়তানি করে বলল,
– “আজকে নাজিয়াকে দেখে আবরার শিওর হার্ট এ্যাটাক করবে।”

না চাইতেও লজ্জায় নাজিয়ার গাল দুটো রক্তিম আভা ধারন করল, ইচ্ছা করছে মাটি ফাঁক করে ঢুকে যেতে।

শ্রেয়া নাজিয়ার সাথে টুকটাক মজা করছে, তখনি দরজায় টোকা মারার শব্দ হয়। শ্রেয়া দরজা খুলে দেখল আবিরের মা দাঁড়িয়ে আছেন।

– “মামনি তুমি? ভেতরে এসো না।”
– “সাজানো কমপ্লিট?”
– “হুমম।”
– “আচ্ছা তুই যা ওর সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

শ্রেয়া রুম থেকে বের হয়ে যেতে আবিরের মা দরজাটা লক করে দিলেন। নাজিয়ার হঠাৎ করেই একটা ভীতি কাজ করছে, যে মানুষটা ওকে পছন্দই করেনা সে কেন এই বিয়েতে রাজি হয়েছে? নাকি তার এই বিয়েতে মত নেয়!!

– “এতক্ষনে নিশ্চয় জেনে গেছ, আবরার আর তোমার বিয়ের কথা।”
– “জ্বি।”

আবিরের মা গম্ভীর গলায় বললেন,
– “আপনি কেন এই বিয়েতে রাজি হয়েছি জানো?”

নাজিয়া মাথা তুলে ওনার দিকে তাকাল, ওনার এই বিয়েতে রাজি হবার কারন কি?

#চলবে…

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-১২

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (১২)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

বাড়িতে বিয়ের আয়োজন চলছে কিন্তু দুজন মানুষের মনে খুশি নেই। একজন আবরার আর একজন নাজিয়া, কথাতে আছে না যার বিয়ে তার হুঁশ নেই পাড়া-পড়শির ঘুম নাই এই দশা আবরারের। ওর বিয়ে অথচ ওর কোনো হেলদোল নেই, আর থাকবেই বা কিভাবে! ভালোবাসার মানুষটাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে হবে ভাবতেই সবকিছু কিরকম এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ করেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।আগামীকাল বিয়ে তারজন্য আজকে শপিং করতে যেতে হবে আবির সবাইকে তাড়া দিচ্ছে তাড়াতাড়ি করার জন্য।

– “এই তোরা আসবি? দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।”

আবরার রেডি হয়ে সোফাতে বসে পড়ল, মন-মেজাজ ভালো নেই তার উপর আবার শপিং করতে যেতে হবে ভাবতেই নিজের মাথা ফাঁটিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে । শপিং এ যাবার পেছনে আবরারের একটা প্ল্যান তো অবশ্যই আছে, আর সেটা হলো নাজিয়ার সাথে একা কথা বলা। মেয়েটা তো ওকে দেখলেই পালাই পালাই করে, আর এখনো করে চলেছে। ওর যে অন্য কারোর সাথে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে সেইদিকে নাজিয়ার কোনো খেয়ালই নেয়, সে নিজের মতো ব্যস্ত। আবরার শেষবারের মতো নাজিয়ার সাথে কথা বলবে বলে ঠিক করেছে, নাজিয়া রাজি থাকলে ওহ আর কিছুই শুনবে না সোজা বিয়ে করে নেবে কিন্তু নাজিয়াই যে রাজি না।

সবাই মিলে শপিং এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। সবাই বলতে আবির আবরার, নাজিয়া আর শ্রেয়া। নাজিয়া আস্তে চাইছিল না প্রানকে ছেড়ে আবির একপ্রকার জোর করেই নিয়ে যাচ্ছে। প্রান ওর দাদুর কাছে আছে।

আবির -আবরার সামনে বসেছে আর নাজিয়া শ্রেয়া পেছনে বসেছে, দুজনের মধ্যে টুকটাক কথা চলছে। বিয়ের জন্য কি দিলে ভালো হবে সেইসব আলোচনা চলছে। শ্রেয়ার আগ্রহ দেখে আবরার মনে মনে ওর গুষ্টির উদ্ধার করে ছাড়ছে..

– “মেয়ের ফূর্তি দেখ যেন ভালোবাসার মানুষটির সাথে বিয়ে হচ্ছে। এর নাকি বয়ফ্রেন্ড আছে, তারপরেও আমাকে বিয়ে করার জন্য এত লাফালাফি করছে কেন!!”

শপিং মলে প্রথমেই শাড়ি কিনতে এসেছে, প্রথমে বিয়ের শাড়ি নেওয়া হবে তারপর বাকি সবকিছু। শ্রেয়া একের পর এক শাড়ি ঘেঁটে চলেছে কিন্তু ওর পছন্দ হচ্ছে না, বিরক্ত হয়ে আবরার কে বলল,

– “এই আবরার একটা শাড়ি পছন্দ করে দাও না।”

আবরার কিছু বলতে যাবে তার আগে আবিরের চোখ পাকানো দেখে কিছু না বলে চুপচাপ শাড়ি পছন্দ করে দিলো। মেরুন কালারের কাতান বেনারসি চয়েস করে শ্রেয়ার হাতে দিল।

– “ওয়াও কি সুন্দর শাড়ি, তোমার পছন্দ আছে বলতে হবে।”
– “হু।”

শ্রেয়া শাড়িটা প্যাক করে দিয়ে নাজিয়াকে বলল একটা শাড়ি চয়েস করে দিতে। আবরার ভ্রু কুঁচকে বলল,

– “আবার শাড়ি কি হবে?”
– “কেন বৌভাত আছে তো।”

এই মূহুর্তে আবরারের মুখ দিয়ে ভালো কিছু কথা বের হয়ে আসতে চাইছিল কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে চুপচাপ সহ্য করে যেতে লাগল। নাজিয়া রয়েল ব্লু কালারের একটা শাড়ি চয়েস করে দিল, এই শাড়িটাও বেশ সুন্দর।

– “হয়েছে!” (আবরার)
– “আরে কি হয়েছে হয়েছে করছ! এই তো শুরু এখনো অনেকগুলো শাড়ি কিনতে হবে, ততক্ষনে তোমরা অন্য কিছু কেনাকাটা করো যাও।”

শ্রেয়ার কথাতে আবরার বিরবির করে বলল,
– “মেয়ে মানুষ মানেই প্যাচাল। কেন যে আসতে গেলাম!”

আবরার কথাটা আসতে বললেও আবিরের কান পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ওহ হেসে দিয়ে আবরারের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
– “ভাই এই তো সবে শুরু, বিয়েটা হতে দে বুঝবি তারপর মেয়ে মানুষ কতটা প্যাচালে।”

আবরার কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
– “দাদা আমি বিয়ে করব না, প্লিজ!”

আবির আর কিছু না বলে হলে গিয়ে দাঁড়াল, এই ছেলেকে পাত্তা দিলে চলবে না। শ্রেয়া শাড়ি পছন্দ করেই চলেছে, মেয়েটা শপিং করতে খুব ভালবাসে আর আবির বলেছে ওর যত ইচ্ছা তত শপিং করতে এতে তো ওর সোনায় সোহাগা ইচ্ছামতো কেনাকাটা করেই চলেছে। যদিও একার জন্য নয় নাজিয়া ও আবিরের মায়ের জন্যও করেছে।

নাজিয়াও শাড়ি নাড়াচাড়া করছে একটা সাদা শাড়ি ভালো লেগেছে, কিন্তু নেবে কিনা বুঝতে পারছেনা। বিষয়টা আবিরের খেয়ালে আসে, নাজিয়ার মাথাতে টোকা দিয়ে বলল..
– “কি রে পেত্মী!! তোকে কি আলাদা করে বলতে হবে নিজের পছন্দমতো কেনাকাটা করার জন্য? শাড়িটা যদি পছন্দ হয়ে যায় নিয়ে নে।”

নাজিয়া মৃদু হাসল। আবিরের সাথে সম্পর্কটা সেই আগের মতোই আছে। ছোট থেকে নাজিয়ার আফসোস ছিল একটা বড়ো দাদার, আবিরের সাথে পরিচয় হবার পর থেকে নাজিয়া সেই আফসোসটা করার সুযোগ পাইনি। ওর ছোট বড়ো সকল আবদার বড়ো দাদার মতো মিটিয়েছে আবির, ঠিক যেমন এখন করল।

আবরার বেচারা বসে বসে বোর হয়ে যাচ্ছে মেয়েদের শপিং চলতেছে তো চলতেছে। ওহ নাজিয়ার সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজে চলেছে, কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না। কি করবে সেটাই ভাবছিল তখনি নাজিয়া বলল,

– “আবির’দা আমি প্রানের জন্য কয়েকটা জামা নিতাম।”
– “যা নে কে বারন করেছে?”
– “তাহলে আমি ওইদিকে আছি।”

নাজিয়া কিছুটা হেঁটে যেতেই একটা হাত ওকে টেনে নিয়ে আড়ালে চলে যায়। নাজিয়া প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেও পরে বুঝল মানুষটা অন্য কেউ নয় আবরার।

– “এইসবের মানে কি? আপনি আমাকে এইভাবে নিয়ে আসলেন কেন?”
– “নাজু প্লিজ আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা করো। প্লিজ একবার স্বীকার করো আমাকে ভালোবাসো, আমি সবকিছু ঠিক করে নেব।”

নাজিয়া তাচ্ছিল্যের হেসে বলল,

– “কি ঠিক করবেন? আগামীকাল আপনার অন্য একজনের সাথে বিয়ে আর আপনি এখন আমাকে বলেছেন সব ঠিক করে নেবেন!”

আবরার আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
– “প্লিজ ট্রাস্ট মি আমি সবকিছু ঠিক করে নেব, এখনো সময় আছে। প্লিজ তুমি একবার বলো আমাকে ভালোবাসো।”

নাজিয়ার চোখ ছলছল করছে, এতদিন নিজের মনের কথাগুলো চাপা দিয়ে রাখলেও আবরারের বিয়ের কথা শুনে সেইগুলো ছাই চাঁপা আগুনের মতো জ্বলে উঠছে। এতদিন দূরত্ব থাকলেও, অনুভূতির প্রকাশ না করলেও দুজন দুজনের জন্য ছিল কিন্তু কালকের পর থেকে আবরার অন্য কারোর স্বামী হয়ে যাবে। তখন নাজিয়ার কি হবে!

আবরার নাজিয়ার হাতটা স্পর্শ করতেই ওহ হাতটাকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
– “আমার হাত ধরার অধিকার আপনার নেই মিষ্টার আবরার আহমেদ। আগামীকাল থেকে আপনি অন্য কারোর হয়ে যাবেন তাই তাকে নিয়ে ভাবাটাই আপনার জন্য ভালো‌ হবে।”
– “কিন্তু আমি যে তোমাকে নিয়ে ভাবতে চাই! তোমাকে ভালোবেসে আগলে রাখতে চাই, প্লিজ একটিবার সেই অধিকারটা আমাকে দাও।”

নাজিয়ার বুক ফেঁটে কান্না আসছে, তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

– “সেইটা সম্ভব নয়।”

আবরারের প্রচন্ড রাগ হলো, মেয়েটাকে মানিয়ে নেবার তো কম চেষ্টা করল না কিন্তু মেয়েটা এতটা জেদি কেন! আবরার নাজিয়ার দুই কাঁধ শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
– “এই তোমার এত জেদ কেন? কেন বারবার আমার ভালোবাসাকে দূরে ঠেলে দাও! কেন আমাকে এতটা অবহেলা করো, উত্তর দাও।”

নাজিয়া অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
– “কারন আমি আপনাকে ভালোবাসি না।”

আবরারের তাচ্ছিল্যের হেসে বলল,
– “আচ্ছা ভালোবাসো না! এই কথাটা একবার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো তো, বলো!”

নাজিয়া নিজেকে ছাড়ানোর জন্য উশখুশ করতে লাগল, কিন্তু প্রতিবার ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে।

– “আমাকে ছাড়ুন আমার‌ লাগছে।”
– “আমারও প্রচন্ড লাগছে, (নাজিয়াকে ছেড়ে দিয়ে বলল.. কিন্তু আফসোস তুমি সেইটা বুঝেও না বোঝার ভান করলে। আমাকে ভালোবাসো না তাই না! তাহলে তোমার চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে কেন?”

নাজিয়া নিজের চোখের পানিটা মুছে নিয়ে বলল,
– “আপনার ধরাতে ব্যথা পেয়েছি তাই।”
– “মিথ্যা ভালোই বলতে পারো! তুমি যখন আমাকে চাও না তাহলে তাই হোক, আমি কাল শ্রেয়াকেই বিয়ে করব। কিন্তু তুমি সেটা নিজের চোখের সামনে সহ্য করতে পারবে তো?”

নাজিয়া উত্তর না দিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল, আবরার ব্যথিত হয়ে মৃদু হেসে চলে যায়। নাজিয়া আবরারের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বিরবিরিয়ে বলল,
– “তোমার আমার মাঝের ‘এক আকাশ দূরত্ব’টা আজ সত্যি সত্যি আকাশ ছুঁলো। আর কখনো এই দূরত্ব মিটবে না, ভালো থেকো আবরার।”

#চলবে…

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-১১

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (১১)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

দিন কাটতে লাগল, শ্রেয়াকে নিয়ে আবিরের মা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। শ্রেয়া ঠিকমতো করে কিছুই সামলাতে পারছে না, সংসারের কথা না হয় বাদই দিলাম কিন্তু প্রানকে! তাকে তো সামলানোর জন্য একটা লোকের দরকার আর সেটা শ্রেয়া সামলে উঠতে পারছে না। প্রানের ঠান্ডা লেগে গেছে গুরতর ভাবে, ছোট শিশুটা সারাদিন কেঁদে কেঁদেই দিন‌কাটাচ্ছে। সবকিছু নিয়ে আবিরের মায়ের চিন্তা আকাশ ছোঁয়া।

আনমনে, চিন্তায় মগ্ন থাকা অবস্থাতে সিঁড়ি থেকে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়েন আবিরের মা।

শ্রেয়া রান্নাঘরে প্রানের জন্য খাবার করছিল, এর মধ্যে মামনির চিৎকার শুনতে পেয়ে তড়িঘড়ি এসে দেখল সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেছে। আবিরের মা সেন্সলেস হয়ে গেছেন, কপালের কিছুটা অংশ কেটে গেছে। শ্রেয়া কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না, একদিকে প্রান খিদেতে কেঁদে চলেছে, আর অন্যদিকে মামনির এই অবস্থা। শ্রেয়া কোনদিকে যাবে! বুঝতে পারছে না। কিছু না বুঝতে পেরে আবরারকে কল লাগায়..

– ‘হ্যালো আবরার
– ‘কি হয়েছে তোমার গলা এইরকম লাগছে কেন?’
– ‘মামনি, মামনি সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমি এখন কি করবো?’
– ‘আমি রাস্তায় আছি দশমিনিটের মধ্যে যাচ্ছি। তুমি মায়ের জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করো ফাস্ট…

আবরার বাড়ির পথেই ছিল, শ্রেয়ার কথা শুনে বাইকের গতি বাড়িয়ে দিল।

আবরারের মাকে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়েছে। অতিরিক্ত চিন্তায় ওনার প্রেশার একদম তলানীতে চলে গিয়েছিল সেই কারনেই মাথা ঘুরিয়ে সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছেন। ভালোমতোই জখম হয়েছেন, ডাক্তার জানিয়েছে আপাতত এখন সম্পূর্ণ বেড রেস্টে থাকতে হবে।

নাজিয়ার বাবাই -মা আবিরের মায়ের এইরকম রকম খবর শোনামাত্রই দেখতে এসেছেন। পরিস্থিতি খারাপ দেখে নাজিয়ার মা আবিরের মায়ের কাছে থাকতে চেয়েছিলেন কিন্তু স্বামী সংসার ফেলে অন্য জায়গায় থাকাটা ওনার মতো গৃহিনীর পক্ষে সম্ভব নয় তাই নাজিয়াকে রেখে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটা নিয়ে অবশ্য নাজিয়ার ঘোর আপত্তি, এতকিছুর পর আবার ওই বাড়িতে থাকতে মন করছে না কিন্তু বাবা মায়ের মুখের উপর কিছুই বলতে পারছে না।

৩দিন‌ পর…

আজকে আবিরের মায়ের বাড়ি ফেরার দিন। এই তিনদিন নাজিয়ার মা ওনার সাথে থেকেছিলেন, হসপিটালে একটা যুবতী মেয়েকে রাখার সাহস ওনার হয়নি তাই কষ্ট করে নিজেই থেকেছিলেন। আবিরের মায়ের যখন জ্ঞান ফেরে তখন নাজিয়ার মাকে সবক্ষন নিজের পাশে পেয়ে অবাক হন। তার সেবা, যত্ন সবকিছু দেখে মুগ্ধ হন। আজকে তো মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন, সেখানে তো ওনার আপন মানুষগুলো একবারের জন্যও আসেননি। কথাতে বলে না, বিপদে পড়লেই মানুষ চেনা যায়, আবিরের মাও চিনেছে।

নিজেল সাথে নাজিয়াকে আহমেদ ভিলাতে ফিরতে দেখে আবিরের মা একটু অবাক হন। স্বামীকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন,
– ‘নাজিয়া কোথায় যাবে?’
– ‘আমাদের বাড়ি।’
– ‘কেন?’
– ‘তোমার ভাই মেয়ে তো সবকিছু একা হাতে সামলাতে পারছে না, তাই নাজিয়াকে কাজের মেয়ে করে নিয়ে যাচ্ছি।’

খোঁচা মেরে কথাটা বললেন আবিরের বাবা। বিষয়টা আবিরের মায়ের কাছে কিরকম একটা শুনতে লাগল, চুপচাপ সবকিছু গিলে নিয়ে ঠাঁই বসে থাকল।

নাজিয়াকে উনি প্রথম থেকে অপছন্দ করেন বিষয়টা এইরকম না। আসলে কিছু কারনের জন্য নাজিয়া ওনার চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে।

তখন আবির সবেমাত্র কলেজ শেষ করে চাকরিতে জয়েন করেছে, আবিরের মা বেজায় খুশি ওনার এতদিনের ইচ্ছা ভাইয়ের মেয়ে শ্রেয়াকে আবিরের বউ করে আনবে। আসলে ইচ্ছাটা ছিল ওনার মায়ের, আবিরের মা নিজের মাকে বড্ড ভালোবাসতেন। মা শখ করেছিলেন আবিরের সাথে শ্রেয়ার বিয়েটা দেখে যাবেন কিন্তু তার আগেই উনি মারা যান, মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরন করতে পারবে এর থেকে আনন্দের কি হতে পারে!

আবিরের মা বিয়ের কথা তুলবেন তার আগেই আবির জানায় একটা মেয়েকে ভালোবাসে। বিষয়টা উনি মানতে নারাজ, স্বামীকেও বলেছিলেন, এই সম্পর্ক মানলে উনি এই সংসার ছাড়বেন। ফ্যাসাদে পড়ে স্বামীও কোনো সিদ্ধান্ত জানান দেননি। তখনি নাজিয়া কিভাবে যেন আবিরের বাবাকে বিয়ের জন্য রাজি করিয়ে ফেলে, আবিরের মায়ের সব রাগ গিয়ে পড়ে নাজিয়া ও নিসার উপর। যদিও সবটা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যায়, আবিরের মা নিজের সিদ্ধান্ত বদল করে শ্রেয়ার সাথে আবরারের বিয়ের কথা ভাবেন। মানে উনি শ্রেয়াকে এই বাড়ির বউ করবেনই এইরকম একটা ব্যাপার।

নিসার ব্যবহার যত্ন সবকিছু আবিরের মায়ের মন জয় করে নেয়। নিসাকে আবিরের বউ হিসাবে মেনে নেয়, সবকিছু ভালোই চলছিল হঠাৎ করেই আবরারের কিছু ব্যবহার ওনার নজর কাড়ে। উনি বুঝতে পারেন ছেলে প্রেমে পড়েছে, ওনার প্রচন্ড রকমের রাগ হয় এইবারেও কি উনি কথা রাখতে পারবেন না!

ছেলের আচার-আচরন দেখে উনি খুব সহজেই ধরে ফেলেন আবরার কার প্রেমে পড়েছে। তখন সমস্ত রাগটা ওনার নাজিয়ার উপর গিয়ে পড়ে, ওর কারনেই সবকিছু হয়েছে। তীব্র রাগ-ক্ষোভ নিয়ে উনি নাজিয়ার মুখোমুখি হন।

– ‘নাজিয়া।’
– ‘জ্বি আন্টি বলুন..
– ‘আবরারকে পছন্দ করো?

নাজিয়ার মুখটা হাঁ হয়ে যায়। একজন মা তার ছেলের ব্যাপারে কাউকে এইরকম প্রশ্ন করতে পারে বলে নাজিয়ার ধারনা ছিল না।

– ‘মুখের দিকে না তাকিয়ে উত্তর দাও।’
নাজিয়া ছোট থেকেই মুখচোরা স্বভাবের, যা বলার সোজাসুজি বলে দিতে ভালোবাসে। তাই কথাটা গোপন না করে বলল,
-জ্বি।

নাজিয়ার সোজাসুজি উত্তর শুনে আবিরের মায়ের রাগটা আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেল,
– ‘বেয়াদব মেয়ে। নিজের মুখে আবার বলছো!’
– ‘আন্টি আপনিই কিন্তু জিজ্ঞাসা করেছিলেন। আমি তো শুধু উত্তর দিয়েছি।’
– ‘শোনো মেয়ে আমার সাথে বেশি পাকামো করতে এসো না। আর আবরারের থেকে দূরে থাকো, ওর বিয়ে আমার ভাতিজির সাথে ঠিক করা আছে।’

নাজিয়া চমকালো, বিষয়টা সম্পর্কে ওহ অবগত ছিল না। নাজিয়া কিছু বলতে যাবে তার আগেইই আবিরের মা আবারো বললেন,

– ‘আমার বারন করার পরেও যদি আবরারের সাথে সম্পর্ক স্থাপন বা যোগাযোগ করার চেষ্টা করো তাহলে কিন্তু বড্ড ভুল করবে। ভুলে যেও না এইটা তোমার দিদির সংসার তোমার করা ছোট ভুল তোমার দিদির সংসারটাকে শেষ করে দিতে পারে। তাই সাবধান।’

দিদির সংসারের প্রসঙ্গ আসতেই নাজিয়া দমে গেল। ওহ ভালো করেই জানে নিসা আর আবির দুজন দুজনকে ঠিক কতটা ভালোবাসে, ওহ কখনোই নিজের জন্য ওদের সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করতে পারবে না।

আবিরের মায়ের কথা শুনে, দিদির সংসারককে শান্তিপূর্ণ রাখতে নাজিয়া আবরারের জীবন থেকে সরে আসে। আবরারের সাথে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বন্ধ করে পড়াশোনার জন্য হোস্টেলে চলে যায় তারপর আবারো নিসার প্রেগন্যান্সির সূত্রে দুজন মুখোমুখি হয় তারপরেরটা সবারই জানা।

ওনার ভাবনার মাঝে গাড়ি বাড়ির সামনে চলে আসে। আবরার ওর মাকে ধরে ভেতরে নিয়ে যায়। নাজিয়া সবকিছু গুছিয়ে ওনার ঘরে রেখে আসেন।

যত্ন-আত্তিতে ওনার দিন ভালোই কাটতে লাগল। আবিরের মা নিজের করা ভুলগুলোকে বুঝতে পেরেছেন, হয়তো এই এক্সিডেন্টটা না হলে উনি ওনার ভুল বুঝতে পারতেন না। কিন্তু বড্ড সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। একদিকে ছেলে একজনকে ভালোবাসে আর অন্যদিকে একটা মেয়েকে কথা দিয়েছেন বাড়ির বউ করবেন এই পরিস্থিতিতে ওনার কি করা উচিত সেটাই ভেবে উঠতে পারছেন না।

আমাদের সমাজে কিছু মানুষ আছে, যাদের কাছে নিজের ওয়াদার দাম অনেক। যদি কোন একটা কথা কাউকে দিয়ে থাকেন তো, সেটা যেকোন মূল্যে যেকোন ভাবে পূরণ করার চেষ্টা করেন। ঠিক তেমনি আবিরের মা, নিজের মায়ের শেষ ইচ্ছা রাখতে গিয়ে অনেক অন্যায় করেছেন। দুটো ভালোবাসার মানুষকে আলাদা করার চেষ্টা করেছেন তার জন্য কম শাস্তি তো পাননি। আদরের ছোট ছেলে কর্মসূত্রে বাইরে চলে গেল, তারপর মেয়েতূল্য বউমাকে হারালেন, সংসার নামক বোঝাটা আবারো ঘাবড়ে এসে বসল, স্বামী- সন্তানদের সাথে সম্পর্কে তিক্ততা আসলো। ভাইয়ের মেয়েকে বাড়িতে এনে পরীক্ষা করতে গিয়ে বুঝলেন, মেয়েটা তার সংসারের দায়িত্ব নিতে পারলেও প্রান’এর দায়িত্ব নিতে পারবে না। আর সবশেষে নিজে আঘাত পেয়ে হসপিটালে ভর্তি হলেন। তার পরিবার, প্রিয়জন তাকে ছাড় দিলেও উপরওয়ালা ওনাকে ছাড় দেননি শাস্তি ঠিকই দিয়েছেন।

আবিরের মা নিজের ঘরে বিছানায় আধশোয়া হয়ে আনমনে নিজের করা কাজগুলোর কথা ভেবে চলেছেন। কতই না খারাপ ব্যবহার করেছে নাজিয়ার সাথে অথচ মেয়েটা এখন ওনারই সেবা করে চলেছেন। মনে মনে বড্ড অনুতপ্ত উনি, নাজিয়ার কাছে ক্ষমা চাইতে চান কিন্তু কিভাবে চাইবেন সেটাই বুঝতে পারছেন না।

– ‘মা আসবো?’

ছেলের কন্ঠস্বর শুনে আবিরের মা ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসলেন। দরজায় আবির দাঁড়িয়ে আছে,

– ‘আয় বাবা ভেতরে আয়।’

আবির মায়ের পাশে বসে মায়ের শরীরের খোঁজ খবর নিয়ে বলল,
– ‘মা তোমার সাথে আমার একটা কথা বিষয়ে কথা ছিল। ‘
– ‘বল।’
– ‘আমি আবরার আর নাজিয়ার বিয়ে দিতে চাই।’

#চলবে…

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-১০

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (১০)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

আজকে শ্রেয়া আবিরদের বাড়িতে আসব, কেন হঠাৎ করেই ডেকে পাঠানো হয়েছে সেটা শ্রেয়ার অজানা। মামনি কথামতো চলে এসেছে।

– ‘আসসালামু আলাইকুম মামনি, কেমন আছো?’
– ‘ওমা আলাইকুমুস সালাম। আর ভালো! তুই কেমন আছিস?’
– ‘কেন! কি হয়েছে?’
– ‘তোকে পরীক্ষা দিতে হবে।’

শ্রেয়ার ভ্রু কুঁচকে গেল। ওকে আবার কি পরীক্ষা দিতে হবে!

– ‘কি পরীক্ষা!’
– ‘এই বাড়ির যোগ্য বউ হবার পরীক্ষা।’
– ‘কিন্তু আমি তো এখনো এই বাড়ির বউ হয়নি!’
– ‘তার জন্যই তো পরীক্ষা দিতে হবে।’
– ‘মানে?’

শ্রেয়ার সবকিছু মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। আবিরের মা সবকিছু বুঝিয়ে বলতে শ্রেয়ার মাথায় হাত, একটা বাচ্চাকে কীভাবে সামলাবে ওহ! তার উপর আবার এই সংসার! ওর এখন মনে হচ্ছে এখানে না আসলেই বরং ভালো হতো।

– ‘দ্যাখ শ্রেয়া তোকে সবকিছু পারতেই হবে, আমার মানসম্মানের প্রশ্ন এইটা। তুই পারবি তো মা!’

মামনির মুখের দিকে তাকিয়ে শ্রেয়া আর কিছু বলতে পারল না, ঘাড় নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে দিল। কিন্তু মনে মনে ভয়েই শেষ, যে মেয়ে কুটোটি নাড়ে না সে কিভাবে একটা সংসারের দায়িত্ব নেবে!

অনেক মেয়েই থাকে যারা বিয়ের আগে সংসারের কোনো কাজ করে না, কিন্তু বিয়ের পর গুছিয়ে সংসার করে। তখন নিজের সংসার, নিজেকেই করতে হবে কিছুই করার থাকে না। সেখানে দাঁড়িয়ে শ্রেয়া একজন অবিবাহিত মেয়ে, এই সংসারটাও ওর নিজের নয় ওহ কি পারবে সবকিছু গুছিয়ে নিতে!

—-

আবিরের মা প্রান’এর ব্যাপারে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছে শ্রেয়াকে। নাতির দায়িত্ব শ্রেয়ার উপরে দিয়ে উনি কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন, বয়সকালে এত ধকল নেওয়া যায় নাকি!

শ্রেয়া প্রান’কে দুধ খাওয়াতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। ওহ কিছুতেই খেতে চাইছে না, খালি কান্না করে দিচ্ছে।

– ‘দূর এইভাবে হয় নাকি! কি করবো আমি? মামনিকে ডাকব! তাই ডাকি না হলে একে খাওয়াব কিভাবে?

শ্রেয়া আবিরের মাকে ডেকে আনেন প্রানকে খাওয়ানোর জন্য। প্রথম প্রথম এইরকম হতেই পারে ভেবে আবিরের মা কিছু বললেন না, শ্রেয়াকে দেখিয়ে দিলেন কিভাবে খাওয়াতে হয়।

অন্যদিকে…

আজ নাজিয়ার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। অদ্ভুত ভাবে প্রতিটা পরীক্ষা দিনই সেই টোটো ওয়ালা’টা ওর জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করত, বিষয়টা প্রথম দুইদিন কাকতালীয় ভাবে নিলেও পরে নাজিয়া র মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। আর সেই সন্দেহের বশেই লোকটিকে চেপে ধরতেই নাজিয়া আসল সত্যিটা জানতে পারে।

– ‘এই আপনি সত্যি করে বলুন তো, আপনাকে রোজ কে আসতে বলে?’
– ‘আরে ম্যাডাম আমাকে কে বলবে, আমি তো রোজ এই রাস্তা দিয়েই যায় আর আপনাকে নিয়ে যায়।’
– ‘দেখুন আমার সাথে মিথ্যা বলার চেষ্টা করবেন নাহ আপনি যদি সত্যি এই রাস্তা দিয়ে রোজ যাতায়ত করতেন তাহলে আমি বাদে অন্য কাউকে টোটোতে তুলতেন কিন্তু না আপনি প্রতিদিন শুধুমাত্র আমাকেই নিয়ে যান সত্যি বলুন? সত্যি না বললে আপনার নামে পুলিশ কেস করবো আমি।’

অনেক ভয় দেখানোর পর লোকটি মুখ খোলে,
– ‘আসলে ম্যাডাম একটা স্যার আমাকে টাকা দিয়ে বলেছে আপনাকে প্রতিদিন ঠিকমতো পৌঁছে দিতে। তাই ..

নাজিয়ার ভ্রু কুঁচকে যায়। কোন ছেলে কাজটা করেছে ভাবতেই প্রথমেই আবরারের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠে। নিজের মোবাইল ঘেঁটে আবরারের একটা ছবি লোকটির সামনে ধরে বলল,
– ‘এই কি সে?’
– ‘হুম।’

নাজিয়ার কাছে সবকিছু স্পস্ট হয়ে যায়। রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে হোস্টেলে ফিরে এসে আবরারকে কল লাগায়। দুই-বার রিং হবার পরেও আবরার কলটা রিসিভ করেনা দেখে নাজিয়ার রাগটা আরো বেড়ে যায়। কিছুক্ষন পর, আবরার ঘুরিয়েকল করে। নাজিয়া কলটা রিসিভ করেই চেঁচিয়ে উঠে,

– ‘এই আপনি আমাকে কি পেয়েছেন বলুন তো?’

আচমকা আক্রমনে আবরার হকচকিয়ে যায়। ফোন কানে নিয়ে এই কথা কেউ আশা করে না, তাও আবার প্রিয় মানুষটার কাছ থেকে। কোথায় বলবে ভালো আছেন! তাই না চেঁচামেচি করছে! আবরারের এই মুহূর্তে নিজেকেই সবথেকে অসহায় মনে হলো, এহ কাকে ভালোবাসল!!

– ‘কি হলো চুপ করে আছেন কেন? আপনি কি আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দেবেন না নাকি?’
– ‘আরে এতো চেঁচামেচি করছ কেন? আমি কি করেছি!’
– ‘আপধি কেন আমার যাতায়তের জন্য গাড়ি ঠিক করে দিয়েছেন? আমি কি আপনাকে বলেছি একবারো!’
– ‘কিছু কথা বলতে হয় না, নিজ থেকেই করে দিতে হয়।’
– ‘দেখুন আপনি কিন্তু আপনার লিমিট ক্রস করছেন। আপনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই, আগে তবুও ছিলেন দিদির দেবর কিন্তু সেই সম্পর্কটাও আজ মৃত। তাই আমার বিষয়ে নাক গলানোর চেষ্টা করবেন না।’
– ‘নাজু প্লিজ আমাকে বোঝার চেষ্টা করো, আমি তোমাকে…

নাজিয়া আবরারকে পুরো কথাটা বলতে না দিয়ে বলল,
– ‘আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নেবেন না মিস্টার আবরার আহমেদ, অনেক সহ্য করেছি কিন্তু আর নয়। আমার ব্যাপারে আপনাকে ভাবতে হবে না, আমি আমার জন্য যথেষ্ট। রাখছি, যোগাযোগ করার চেষ্টাও করবেন না।’

নাজিয়া কল কেটে দিতে আবরারকে ব্লক করে দেয়। এই দূরত্ব কি আদৌও মিটবে!

দিন এগিয়ে যেতে লাগল। আবরার বাড়ি ফিরে এসেছে, এতেই আবিরের মা ভীষন রকমের খুশি। শ্রেয়া রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে প্রান’কে সামলাতে। ইদানিং প্রান রাতের দিকে প্রচন্ড কান্না করছে, শ্রেয়া সারারাত ঠিকমতো ঘুমাতে পারছে না তার জন্য সারাদিন ঘুমে ঢলতে থাকে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। আবিরের মা প্রচন্ড চিন্তায় পড়ে গেছেন সবকিছুর মধ্যে, ওনার মনে প্রশ্নের উদয় হয়েছে শ্রেয়া কি আদৌ পারবে ওনার সংসারটাকে আগলে রাখতে!

আবরার এক কাপ কফি বানিয়ে শ্রেয়ার সামনে ধরল। ঘুমে ঝিমিয়ে যাওয়া শ্রেয়া কফি দেখে কিছুটা খুশি হয়ে যায়।

– ‘থ্যাঙ্কস, এইটার দরকার ছিল।’
– ‘তোযার সাথে একটা কথা ছিল।’
– ‘কি কথা!’
– ‘তোমার বয়ফ্রেন্ড তোমার সাথে দেখা করতে চাইছে।’

শ্রেয়া সবেমাত্র কফিটাই চুমুক দিয়েছিল আবরারের কথাতে সেটাতেই বিষম লেগে গেল। চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছে, চমকানোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

– ‘আমার বয়ফ্রেন্ড মানে?’
– ‘আমি সব জানি। আমার কাছে কিছু লুকাতে হবে না। ‘

শ্রেয়ার মুখটা ছোট হয়ে যায়। ভালোবাসায় কখনোই কারোর হাত থাকে না সেটা মন থেকে আসে। শ্রেয়ার বিয়ে ঠিক করা আছে জেনেও সে অন্য কাউকে ভালোবাসে এইটা সকলের কাছে অন্যায় কিন্তু ওর কাছে!

– ‘দ্যাখো শ্রেয়া তুমি যেমন অন্য কাউকে ভালোবাসো আমিও তেমন অন্য কাউকে ভালোবাসি। ভালোবাসায় কারোর হাত থাকে না, সেটা হয়ে যায়। এই বিয়েটা হলে আমরা কখনোই সুখী হতে পারবে না, আর কিভাবেই বা সুখী হবো বলো যেখানে আমাদের মনে অন্য কারোর বাসস্থান।’
– ‘কিন্তু আবরার আমাদের পরিবারকে কিভাবে সেটা বোঝাবে বলো! বাবা মা তো আমার কথাই শুনতে চাইছে না, তাদের এক কথা তারা মামনিকে কথা দিয়েছে সেই কথা তারা যেকোন মূল্যে রাখবে। এমনকি আমাকে কসম দিয়েছে, যাতে আমি এই বিয়েটা করি।’

শ্রেয়া ডুকরে কেঁদে উঠল, নিজেকে আজকাল বড্ড অসহায় লাগে। না পারছে ফ্যামিলিকে বুঝিয়ে ভালোবাসার মানুষটাকে আপন করে নিতে আর না পারছে সবকিছু সহ্য করতে। ফ্যামিলির জেদের কাছে হার মেনে নিজের জীবনটাকেই কিরকম একটা করে ফেলেছে। যেখানে মত থাকে না সেখানে জোর করে ভালো থাকার কতই বা অভিনয় করবে!

আবরার শ্রেয়াথ দিকটা বুঝতে পারল, সেও তো ওই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। শ্রেয়ার ভালোবাসার মানুষটা তো তবুও ওর পক্ষে আছে কিন্তু ওর! সে তো বুঝেও না বোঝার অভিনয় করে আরো দূরে চলে যাচ্ছে। দুজনের মধ্যেকার দূরত্বটা আরো বিরাট আকার ধারণ করছে।

– ‘আমি তোমার দিকটা সবটাই বুঝতে পারছি। তুমি চিন্তা করো না, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। ‘
– ‘কি ঠিক হবে?
– ‘শ্রেয়া তুমি হয়তো ভুলে গেছ মা কিন্তু তোমাকে পরীক্ষা করানোর জন্য এইখানে নিয়ে এসেছে। আর তোমার কি মনে হয় তুমি পাশ করতে পারবে!’

শ্রেয়া আমতা আমতা করে বলল,
– ‘সংসারটা হয়তো গুছিয়ে নিতে পারব কিন্তু প্রান’কে কিভাবে সামলাব সেটাই বুঝতে পারছি না।’
– ‘চিন্তা করো না, তুমি নিজের মতো সামলাও। মা নিজেই এই বিয়ে ভেঙে দেবে।’
– ‘মামনি বিয়ে ভাঙবে! কিভাবে?’
– ‘সেটা সময় বলবে। তুমি চিন্তামুক্ত থাকো, আমি তোমার বড়ো ভাইয়ের দায়িত্বে তোমার ভালোবাসার মানুষটির সাথে তোমার বিয়ে দিয়ে দেব।’

শ্রেয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠল। মনে হলো বুকের উপর বড়ো কোনো পাথরের বোঝা নেমে গেছে। আবরারও মৃদু হাসল, এইবার ওর ভালোবাসার মানুষটিকে মানাতে পারলেই শান্তি।

#চলবে…

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-০৯

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (৯)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

আজ থেকে নাজিয়ার এক্সাম শুরু। নাজিয়া হোস্টেলে ফিরে গেছে, বাবা মাকে ছেড়ে যাবার কোনো ইচ্ছা ছিল না কিন্তু সবার জোরাজুরিতে গেছে। আবির আগের তুলনায় কিছুটা স্বাভাবিক, অফিসে যাওয়া শুরু করেছে। আবরারের কাজ পড়ে যাওয়া’তে ওহ ফিরে গেছে। গোটা বাড়িতে সারাদিন আবিরের মা আর প্রান। ছোট প্রানকে সামলাতে আবিরের মাকে ভালোই হিমশিম খেতে হচ্ছে।

– ‘খালাম্মা আমি বলি কি একটা বউ নিয়ে আসুন সেই না হয় আমাদের প্রানকে সামলাবে।’

কাজের লোকের কথা শুনে আবিরের মা চমকে উঠলেন, বিরক্ত কন্ঠে বললেন..
– ‘কি সব বলছিস? নিসা মারা গেছে এখনো একমাস হয়নি

আবিরের মাকে পুরোটা বলতে না দিয়ে কাজের মেয়েটা বলল,
– ‘আরে খালাম্মা আমি বড়ো দাদার বিয়ের কথা বলছি না।’
– ‘তাহলে?’
– ‘আমি তো ছোট দাদার কথা বলছি।’

আবিরের মায়ের মুখটা চকচকে হয়ে উঠল। সবকিছুর মধ্যে আবরারের বিয়ের কথাটা মাথা থেকে বের হয়ে গেছে। মনে মনে ঠিক করলেন আজকেই স্বামীর সাথে কথা বলবেন।

নাজিয়া কলেজের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে, এক্সামের সিট পড়েছে হোস্টেল থেকে কিছুটা দূরে তার জন্য তাড়াতাড়ি বের হয়েছে তার উপর আজকে প্রথমদিন। কিন্তু একটাও অটো, টোটো পাচ্ছে না। নাজিয়া বিরক্ত হয়ে বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে, তখনি সামনে একটা বাইক দাঁড়াল। নাজিয়া বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে চোখ করে নিল।

– ‘বাইকে উঠে বসো।’

চেনা কন্ঠস্বর শুনে নাজিয়া সামনে তাকিয়ে দেখল বাইক নিয়ে আসা ছেলেটি আবরার।

– ‘আবরার আপনি?’
– ‘হুমম আমি। এখন বেশি কথা না বলে উঠে বসো, কলেজ যেতে হবে তো!’
– ‘আমি যাই হোক কিছু নিয়ে চলে যাবো। আমি চলে যান।’
– ‘আমি চলে যাবার জন্য এতটা পথ জার্নি করে আসিনি। বেশি কথা না বলে ওঠো তাড়াতাড়ি।’
– ‘কেন জোরাজুরি করছেন? আমি বলছি তো আমি আপনার সাথে যাবো না।’
– ‘সেইদিনের ঘটনার জন্য তুমি এখনো আমার উপরে রেগে আছো তাই না!’
– ‘আমি কোনো কিছুই মনে রাখিনি। আর অন্যের বাড়িতে থাকাটা দৃষ্টিকটু, এই বিষয়ে কারোর উপরে রাগ করার কোনো কারন খুঁজে পাইনি আমি।’

নাজিয়ার শান্ত বলা কথাগুলো শুনে আবরারের বুঝতে অসুবিধা হলো না, বিষয়টা নিয়ে ওর মনখারাপ হয়ে আছে।

– ‘প্লিজ নাজিয়া চলো আমার সাথে, আমি শুধু মাত্র তোমাকে পৌঁছে দেব।’

নাজিয়া রাগে চেঁচিয়ে উঠল..
– ‘আমি একটা কথা আপনাকে কতবার বলবো! বলছি তো আমি আপনার সাথে যাবো না।’

আশেপাশের মানুষ ওদের দিকে কেমন চোখে তাকাল, আবরারের মনটা খারাপ হয়ে যায়। নাজিয়াকে আর কিছু না বলে বাইক নিয়ে চলে গেল। নাজিয়া আবরারের যাবার দিকে তাকিয়ে রইল, চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। আবরারের সাথে এইরকম ব্যবহার করতে চাইনে কিন্তু ওকে ওই কথাগুলো না শোনালে আবরার কখনোই ওর পেছন ছাড়ত না।

কিছুক্ষন পর, একটা টোটো ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

– ‘দিদি কোথায় যাবেন?’
– ‘… কলেজ।’
– ‘উঠে বসুন।’

টোটোতে বসে নাজিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, যাক কিছু একটা পেল। নাহলে সত্যি যেতে দেরি হয়ে যেত।

নাজিয়ার এক্সাম মোটামুটি ভালোই হয়েছে, যে খারাপ প্রিপেরশন ছিল তাতে যেটা হয়েছে সেটাই অনেক কিছু। নাজিয়া এক্সাম শেষ করে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে তখনি সে টোটো’টা ওর সামনে এসে বলল,
– ‘দিদি যাবেন?’

টোটো ড্রাইভারকে দেখে নাজিয়া চমকে গেলেও বিষয়টাকে কাকতালীয় ভাবেই নিল। হয়তো উনি এই লাইনে গাড়ি চালায়, নাজিয়া বেশি কিছু না ভেবে উঠে‌ বসল এখন ভালো ভাবে হোস্টেলে ফিরতে পারলেই শান্তি।

রাতে খাবার টেবিলে আবিরের মা গুনগুন করেই চলেছেন, কিন্তু আসল কথা বলে উঠতে পারছেন না। উনি ভালো করেই জানেন ওনার কথা শুনে স্বামী ও ছেলে কিরকম রিয়াক্ট করবে, তারপরেও ওনাকে যে কথাটি বলতেই হবে।

বিষয়টা আবিরের নজর পড়ল তার মা কিছু একটা বলতে চাই সেটা ভালো করেই বুঝল। তাই মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
– ‘মা তুমি কি কিছু বলবে?’
– ‘হ্যাঁ আসলে..
– ‘বলো?’
– ‘আমি আবরার আর শ্রেয়ার বিয়েটা দিয়ে দিতে চাইছি।’

আবিরের বাবা খাওয়া থামিয়ে দিয়ে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল, চোখ মুখে বিস্ময়। কিন্তু আবির স্বাভাবিক যেন এইরকম একটা কথা আশা করেছিল, এইটা না বললে বরং অবাক হতো।

আবিরের বাবা রেগে কিছু একটা বলতে যাবেন তার আগেই আবার বলল,
– ‘আমার কোনো আপত্তি নেই তবে একটা শর্ত আছে।’

আপত্তি নেই কথাটিতে খুশি হলেও শর্ত আছে কথাটাই আবিরের মায়ের ভ্রু কুঁচকে গেল।

– ‘কি শর্ত?’
– ‘বিয়ের আগে একমাস শ্রেয়া এই বাড়িতে এসে থাকবে।’
– ‘কেন?’
– ‘আরে পরীক্ষা করতে হবে না, শ্রেয়া কতটা যোগ্য।’

ছেলের কথার ধরন বুঝতে না পেরে আবিরের মা বললেন,
– ‘মানে?’
– ‘তুমি শ্রেয়ার বউ করতে চাইছ কেন? তোমার সংসারটা গুছিয়ে রাখার জন্য তো!’
– ‘হুমম।’
– ‘সংসার গুছিয়ে রাখার মধ্যে আমার ছেলের দায়িত্বটাও পড়ছে কিন্তু।’

আবিরের মায়ের মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট বোঝা গেল, হ্যাঁ উনি নিজের সংসারকে গুছিয়ে রাখার জন্য শ্রেয়াকে নিয়ে আসতে চাইছেন, আর তার মধ্যে প্রানকে দেখে রাখাও একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। কিন্তু শ্রেয়া কি সেটা করতে পারবে!

আবিরের বাবা বুঝলেন স্ত্রী ভালোই গ্যারাকলে আটকে পড়েছেন, এই সুযোগে ওনাকে জব্দ করা যাবে। চাই আবিরের কথাতে সমর্থন করে বললেন,
– ‘আবিরের শর্তে আমি রাজি। তুমি শ্রেয়াকে আসতে বলো।’

আবিরের মা কি করবেন কিছুই বুঝতে পারলেন না, তবুও মনে মনে নিজেকে শান্তনা দিলেন শ্রেয়া সবকিছু ঠিক সামলে নেবে। কিন্তু ঠিক কতটা সামলাবে, সেটাই দেখার বিষয়।

রাতের খাবার পর, আবির নাজিয়ার সাথে ফোনে কথা বলে আবরারকে কল করল। আবরার সবেমাত্র হাতের কাজটা সেরে ল্যাপটপটা রেখেছে তখনি আবিরের ফোন আসলো।

– ‘হ্যাঁ দাদা বলো।’
– ‘কেমন আছিস?’
– ‘ আলহামদুলিল্লাহ চলছে। তুমি কেমন আছো? আর প্রান কেমন আছে?’
– ‘আমি ভালো আছি কিন্তু প্রান কেমন আছে সেটা জানি না, বেশিরভাগ সময়েই দেখছি কান্নাকাটি করছে।’

কথাটা বলার সময়ে আবিরের গলা কিরকম একটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। নিজের প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারিয়ে আবির নিঃস্ব হয়ে গেছে তার উপর আবার সদ্য জন্মানো ছেলেটা মায়ের স্মেহ ছাড়া বেড়ে উঠছে। আবরার বিষয়টা বুঝল কিন্তু কি বলে শান্তনা দেবে সেটাই বুঝতে পারল না, মায়ের জেদের কাছে হার মেনে নাজিয়া একা ফিরে গেছে, তবুও ওর কাছে থাকলে কিছুটা নিশ্চিন্তে থাকা যেত। মায়ের বয়স হচ্ছে, ওনাকে সামলাতেই একটা লোকের দরকার হয়, আর উনি এই বয়সে এসে কিনা বাচ্চা সামলাবেন, জেদ বলিহারি!

আবির নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
– ‘আবরার শ্রেয়া আমাদের বাড়িতে আসছে।’
– ‘কেন?’
– ‘মা তোর আর শ্রেয়ার বিয়ে দিতে চাইছে। তুই যতটা তাড়াতাড়ি পারিস বাড়িতে ফিরে আয়।’
– ‘আমি শ্রেয়াকে বিয়ে করতে পারব না।’
– ‘তোকে বিয়ে করতেই হবে।’
– ‘দাদা!’

#চলবে….

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-০৮

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (৮)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

নাজিয়া আবরারের রুমে গিয়ে ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এই মূহুর্তে আবরার ছাড়া অন্য কোনো বিশ্বস্ত স্থান খুঁজে পেল না। আচমকা এইরকম হওয়াতে আবরার চমকে যায়, ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

– ”কি হয়েছে? এইভাবে কাঁদছ কেন?’
– ‘আবির-দা।’
– ‘দাদার কি হয়েছে? বলো‌ আমাকে!’
– ‘আবির’দা দিদিকে এতটা কেন ভালোবাসত! এত ভালো না বাসলে তো কষ্টটা কম পেত। দিদি তো চলে গেছে কিন্তু আবির’দাকে পুরো শে-ষ করে দিয়েছে আমি আর সহ্য করতে পারছি না। ‘

আবরার চুপ করে থাকল, নিসার চলে যাওয়াটা ওদের কাছে যতটা না কষ্টের তার থেকে দ্বিগুন কষ্টের আবিরকে ছন্নছাড়া অবস্থায় দেখা। মৃত মানুষ এবং জীবিত থেকে মরার মতো বেঁচে থাকার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। মানুষগুলো না পারে প্রানভরে নিঃশ্বাস নিতে আর না পারে সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে, সবকিছু সহ্য করে তিলে তিলে শেষ হয়ে যায়।

নাজিয়া কিছুক্ষন কান্নাকাটি করার পর শান্ত হয়। ওকে শান্ত হতে দেখে আবরার বলে,

– ‘তোমার এক্সাম কবে?’
– ‘জানি না, এক্সাম দেব না আমি।’
– ‘পাগলামী বন্ধ করো, এক্সাম না দিলে তোমার একটা বছর নষ্ট হয়ে যাবে। আর এইটাই তো তোমার শেষ, প্লিজ নিজের লাইফটাকে নষ্ট করো না।’
– ‘আপনি কথাটা কিভাবে বলছেন? আমার এইরকম অবস্থাতে আমি কিভাবে এক্সাম দেব!’

আবরার নাজিয়ার দুই গালে হাত রেখে নরম গলায় বলল,
– ‘দ্যাখো নাজিয়া আমরা কেউই অমর নয়, আমাদের সকলেই মরতে হবে কেউ আগে কিংবা কেউ পরে। ভাবি আমাদের সকলের প্রিয় ছিল, ওনার মৃত্যুটা আমাদের কারোর জন্যই স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেওয়া সম্ভব নয় কিন্তু দ্যাখো তাতে কি আমাদের জীবনটা থেমে গেছে! সময় কিন্তু এগিয়ে চলেছে, আর তাতে আমাদেরও তাল মিলিয়ে চলতে হবে। প্লিজ নাজিয়া এক্সামটা দাও তুমি.

নাজিয়া আবরারের বলা কথাগুলো চুপ করে শুনে চলেছে, দুজন দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে ভালোবাসার আদানপ্রদান করতে ব্যস্ত। নিজেদের মনের না বলা কথাগুলো প্রকাশ করতে ব্যস্ত তখনি কারোর পায়ের শব্দ শোনা যায়, আবরার নাজিয়ার থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। হয়তো ওরা শুধুমাত্র কথাই বলছিল কিন্তু কেউ দেখলে খারাপ ভাববে, আর আবরার চাই না নাজিয়ার দিকে কেউ আঙুল তুলুক।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ওই ঘরের দরজায় আবরারের মা দাঁড়াল। নাজিয়া আর আবরারকে একসাথে এক রুমে থাকতে দেখে মনে মনে বেজায় বিরক্ত হলেন।

– ‘আবরার!’
– ‘জ্বি মা বলো।’
– ‘আমার রুমে আসো কথা আছে।’

আবরারের মা আর দাড়ালেন না। কথাটা বলেই স্থান ত্যাগ করলেন, আবরার মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আর নাজিয়া তাচ্ছিল্যের হাসল।

আবরার মায়ের রুমে এসে দেখল তিনি গম্ভীর হয়ে বসে কিছু একটা ভেবে চলেছেন। পাশেই আবরারের বাবা ও চিন্তিত হয়ে বসে আছেন।

– ‘মা আমাকে ডেকেছিলে?’
– ‘হ্যাঁ আসো।’

আবরারের মা আবরারের মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে বললেন,

– ‘কথাটা বললে হয়তো তুই আমাকে খারাপ ভাববি, ভুল বুঝবি কিন্তু কি জানিস মা বাবা কখনোই সন্তানদের খারাপ চাই না।’
– ‘কি বলতে চাইছ সেটা বলো।’
– ‘নাজিয়াকে ওর বাড়ি ফিরে যেতে বল।’

আবরার চমকে উঠল। মায়ের কাছ থেকে এই কথাটা শুনবে সেটা আশা করেনি, কিছু বলতে যাবে তার আগে উনি বললেন,

– ‘দ্যাখ আবরার নাজিয়া একটা অবিবাহিত যুবতী মেয়ে আগে বউমার বোন হিসাবে এই বাড়িতে ছিল, বউমার সাথে ছিল তাতে আমাদের কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু এখন বউমা নেই সমাজের পাঁচটা মানুষ পাঁচ ধরনের কথা বলছে সেগুলো আমাদের শুনতে ভালো লাগছে না, তুই ওকে চলে যেতে বল।’
– ‘বাহ মা বাহ। যখন ভাবি ছিল তখন নাজিয়ার সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিল আর এখন ভাবি নেই তো সম্পর্ক শেষ? আর দাদা যে নাজিয়াকে নিজের ছোটবোনের মতো ভালোবাসে সেটা বুঝি কোনো সম্পর্ক না! তার কোনো দাম নেই তোমার কাছে?’
– ‘আবরার তুই আমাকে ভুল বুঝছিস, বাড়িতে একটা যুবতি মেয়ে তারপর তোরা দুটো ছেলে আছিস আশেপাশের মানুষ বিষয়টা ভালো চোখে দেখছে না। ‘
– ‘সমাজের মানুষের মানসিকতা বদলানোর দায় আমাদের নয়। আর আমরা তো কোনো অন্যায় করছি না তাহলে কেন মেনে নেব!’

আবরারের রাগ বেড়ে চলেছে, এই সমাজ- সমাজের মানুষের জন্য মানুষকে কতকিছু সহ্য করে যেতে হয়। কেউ তোমার উপকার করবে না কিন্তু অপকার ঠিক করবে।

আবরারের বাবা এতক্ষন চুপ করে ছিলেন, ছেলের রেগে যাওয়া দেখে তিনি মুখ খুললেন,
– ‘আবরার তোর মায়ের সাথে আমিও এই বিষয়টিতে একমত।’

আবরার বাবার কথা শুনে হতাশ হলো, কিন্তু কিছু বলল না রাগে চুপ করে রইল।

– ‘দ্যাখ নাজিয়া একজন যুবতী মেয়ে, এইভাবে অন্য কারোর বাড়িতে থাকাটা দৃষ্টিকটু লাগে। ওর মা বাবাও চাইছে ওকে নিয়ে যেতে কিন্তু নাজিয়ার পরিস্থিতি দেখে কিছু বলতে পারছেন না আমরা কেউই ওকে সরাসরি কিছু বলতে পারছি না, তাই তোর সাহায্য চাইছি।’

আবরার কি উত্তর দেবে ভেবে পেল না। ঠান্ডা মাথায় কিছুক্ষণ ভাবার পর মা বাবার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
– ‘বাবু কোথায় থাকবে?’

আবরারের মা বাবা একে অপরের মুখের দিকে তাকাল, সত্যি তো নাজিয়া যদি এই বাড়ি থেকে চলে যায় তাহলে বাবু কোথায় থাকবে? আবরারের মা বললেন,

– ‘আমাদের নাতি আমাদের বাড়িতেই থাকবে।’
– ‘ঠিকাছে চাই হোক। আমি নাজিয়াকে দুইদিনের মধ্যে ওই বাড়িতে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করছি তোমরা চিন্তা করো না।’

আবরার বেরিয়ে যেতে গিয়ে মা বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দিলো।‌ মাথাতে অনেককিছু ঘুরছে, সবকিছু ঠিকঠাক হলে হয়।

নাজিয়া বাড়ি ফিরে গেছে আজ দুইদিন, সেইদিন আবরারকে আর কিছু বলতে হয়নি নাজিয়া নিজেই বাড়ি ফেরার কথা জানিয়েছিল। বুঝেছিল ওর বাড়িতে থাকা নিয়ে কিছু একটা প্রবলেম হচ্ছে, কি দরকার নিজের কারনে অন্যের ঝামেলা করার। নাজিয়া ফেরার সময়ে আবিরকে যথেষ্ট পরিমানে বুঝিয়ে এসেছে আর আবরারকে বলেছে সবাইকে দেখে রাখতে। নাজিয়া চেয়েছিল প্রান’কে নিয়ে আসতে কিন্তু আবরারের মা সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন তিনি প্রান নাজিয়ার সাথে যেতে দিতে রাজি নয়, প্রান আহমেদ বাড়িতেই থাকবে। নাজিয়া শূন্য হাতে ফিরেছে, বাড়ি ফিরে খুব কেঁদেছিল তারপর কিছুটা শান্ত হয়েছে মা বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে।

আবরারের মা সদ্য জন্মানো প্রানকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। বয়সের সাথে সাথে শরীরের শক্তিও কমে গেছে, সাথে ধৈর্য শক্তিও।

– ‘কি গো আবিরের মা নাতিকে কেমন সামলাচ্ছে?’

স্বামীর কথাতে আবিরের মা মেকি হেসে বললেন,
– ‘এখন আর কি বাচ্চা সামলানোর বয়স আছে নাকি! তোমার নাতিকে সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাকে।’
– ‘এখন তোমার নাতি! আর যখন নাজিয়া ছেলেটাকে নিয়ে যেতে চাইল তখন তো আমার নাতি আমার কাছে থাকবে বলে আটকে দিলে।’

কিছুটা বিরক্ত হয়ে কথাটা বললেন আবিরের বাবা, নাজিয়া চলে যাবার পর থেকে প্রান ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করছে না এইরকম চলতে থাকলে দুধের শিশুটা কিভাবে বাঁচবে!

– ‘তুমি কি বলতে চাইছ আমার নাতিকে আমি ওই বাইরের মেয়ের হাতে তুলে দেব!’
– ‘আবিরের মা ভুলে যেও না নাজিয়া কিন্তু নিসার বোন, বোনের ছেলের উপরে ওর কিন্তু অধিকার আছে।’
– ‘মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি।’ (মুখ বেঁকিয়ে বললেন)
– ‘নিসা থাকলে নাজিয়া যদি এই আদর-দরদ দেখাত তখন কথাটা বললে সাজত কিন্তু এখন এইসব কথা বলার কোনো মানে হয় না। তুমি কিন্তু অযথা নাজিয়ার নামে উল্টোপাল্টা বলছো।’
– ‘ওই বাইরের মেয়ের জন্য তোমাদের কত দরদ আর আমাকে তোমাদের ভালো লাগে না তাই তো।’ (ন্যাকা কেঁদে)

আবিরের বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, স্ত্রী এতটা অবুঝ কেন বুঝতে পারলেন না। মনে মনে স্ত্রীকে শিক্ষা দেবার একটা পরিকল্পনা করলেন।

#চলবে…

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-০৭

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (৭)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

‘আপনারা নিজেদের সামলান, আমরা অনেক চেষ্টা করেও প্রেসেন্ট’কে বাঁচাতে পারিনি। সি ইজ নো মোর ভেরি সরি…

একটা দমকা হাওয়া সবটা এলোমেলো করে দিলো। কাউকে সন্তান হারা, কাউকে বোন হারা, আবার কাউকে মা হারা করে দিলো। আবির কথাটা শোনার পর থেকে পাথর হয়ে গেছে, আবরার নাজিয়া আর আবিরকে একসাথে সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে চলেছে। বাধ্য হয়েই ওর বাবাকে এবং নিসার বাবাকে তাড়াতাড়ি হসপিটালে আস্তে বলল।

আবরার আবিরের কাঁধে হাত রাখতেই ওহ পাগলের মতো প্রলাপ বকতে লাগল।
– ‘এই আবরার ডাক্তারটা কি পাগল নাকি! দ্যাখ কিসব উল্টো পাল্টা কথা বলে গেল তোর ভাবি নাকি আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। দূর এইটা হতে পারে নাকি! তোর ভাবি আমাকে কথা দিয়েছে আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না, একসাথে আমরা সংসার করব। বাবুকে মানুষের মতো মানুষ করব আর ডাক্তার’টা কিসব বলে গেল বল তো!’

দাদার কথাগুলো শুনে আবরারের নিজেরই দমবন্ধ করা অনুভূতি হচ্ছে। নিসাকে ওহ বড়ো বোনের মতো ভালোবাসত, ওর মৃত্যুটা সবার জন্যই একটা বড়ো যন্ত্রনার। নাজিয়া বাচ্চাটাকে আঁকড়ে ধরে কেঁদেই চলেছে, বাচ্চাটাকে একটুও আলাদা করছে না এইটা যে ওর দিদির শেষ চিহ্ন তাকে কিভাবে নিজের থেকে আলাদা করবে!

দুইদিকে দুইটা মানুষ পাগলের মতো আচরন করে চলেছে, আবরারের নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। কাকে ছেড়ে কাকে সামলাবে বুঝতে পারছে না। হসপিটালের ফর্ম পূরণ করতে হবে তবে নিসার লাশকে নিয়ে ফিরতে পারবে অনেক কাজ করতে হবে কিন্তু একা হাতে আর কতদিক সামলাবে!

আবরারের বাবা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। বাবাকে দেখা মাত্রই আবরার উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরল, চোখ নিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, এতক্ষন নিজেকে সামলে রাখতে পারলেও আর পারল না। ছেলেকে বিধ্বংস্ত দেখে উনি বললেন,

– ‘কি হয়েছে! সবকিছু ঠিক আছে তো?’
– ‘না বাবা কিছু ঠিক নেই। ভাবি আর আমাদের মাঝে নেই, দাদার অবস্থা পাগল প্রায়, একা একা থাকা বলে চলেছে আর নাজিয়া তো কেঁদেই চলেছে আমি কি করব বাবা।’

আবিরের বাবা বড়ো একটা ধাক্কা খেলেন। নিসা ওনার বাড়িতে পুত্রবধূ হয়ে আসার পর থেকে নিসাকে মেয়ের নজরেই দেখে এসেছেন। মেয়ে না থাকার আক্ষেপটা নিসার দ্বারাই পূর্ন করতে চেয়েছিলেন আর নিসাও নিজের সবটা দিয়ে মেয়ে হয়ে উঠেছিল। বিয়ের এত বছরেও বেবি না হওয়া নিয়ে ওনার কোনও আক্ষেপ ছিল না আর যখন নিসা প্রেগনেন্ট শুনলেন তখন খুব খুশি হয়েছিলেন প্রানভরে দোয়া করেছিলেন। মেয়ে তূল্য বউমা আর পৃথিবীতে নেই এইটা তিনি মানতে পারছেন না। আর এইদিকে আবরারের কথা শুনে আরো ভেঙে পড়েছেন। কে কাকে সামলাবে সেটাই কেউ বুঝতে পারছেন না। সবার মনটাই চূর্ন- বিচূর্ণ হয়ে উঠেছে।

নিসাকে ওর শশুর বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে ‌।‌নাজিয়ার মা মেয়ে হারানোর শোকে কাঁদতে কাঁদতে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। আবিরের মা অনুভূতিহীন হয়ে নিসার লাশের দিকে তাকিয়ে আছেন, নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে সেইদিন উনি ঝামেলা না করলে হয়তো নিসা এই বাড়িতেই থাকত আর জীবিত থাকত।

নিসার বাবা এককোনে বসে চোখের পানি ফেলে চলেছে , একজন বাবার কাছে তার সন্তানের লাশ কতটা ভারী সেটা একমাত্র তিনিই জানেন‌ । আবিরের বাবা ওনার কাছে বসে আছে ওনার চোখেও পানি।

আবরার আবিরের কাছে আছে, আবির কিরকম একটা গুম মেরে গেছে। আর নাজিয়া! সে তো নিজের মধ্যেই নেই এত কান্নাকাটি, লোকজনের ভীড় অথচ নাজিয়া এইখানে উপস্থিত নেই ওহ নিজের ঘরে বাবুকে নিয়ে খেলতে, গল্প করতে ব্যস্ত। নাজিয়া যেন অন এক জগতে বসবাস করছে, যেখানে কোনো দুঃখ নেই কোনো অনুভূতি নেই।

নিসার দাফন কার্যের সময় চলে আসে। সবাইকে শেষ বারের মতো নিসাকে দেখানো হয়, নিসার বাবা মা, আবিরের বাবা মা আবির সবশেষে নাজিয়াকে নিয়ে আসা হয়। নাজিয়ার কোলে ছোট বাবুটা যে মায়ের আদর পাবার আগেই মাকে হারিয়ে ফেলেছে। নাজিয়া নিসার দিকে তাকিয়ে আছে, সাদা দুধের মতো ফর্সা মুখটাই গোলাপী ঠোট চোখগুলো বন্ধ করা যেন মনে হচ্ছে নিসা মুখ চেপে নিজের হাসি আটকে রাখছে। নাজিয়া মুগ্ধ নয়নে নিসার দিকে তাকিয়ে রইল। কম্পিত হাতটা নিসার মুখমন্ডল স্পর্শ করার জন্য বাড়াতেই কয়েকজন স্পর্শ করতে বারন করল। নাজিয়া হাতটা গুড়িয়ে দিয়ে বাবুর দিকে তাকিয়ে বলল,
– ‘দেখছছিস সোনা ওরা তোর মাকে আমাকে ছুঁতে দিলো না। কিন্তু দ্যাখ না আমার না বড্ড লোভ হচ্ছে তোর মায়ের সুন্দর মুখশ্রীটা স্পর্শ করার। দ্যাখ সোনা তোর মা তোর দিকে তাকিয়ে হাসছে তুইও একটু হেসে দে।’

বাবুটা কি বুঝল কে জানে হাত পা ছড়িয়ে হাসতে লাগল। নাজিয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠল,
– ‘দেখেছিস দিদি তোর ছেলে কিন্তু আমার কথা সব শোনে, আজ থেকে ওহ তোর ছেলে নয় ওহ আমার ছেলে আমার প্রান।’

নাজিয়া বাবুর কপালে চুমু এঁকে দিলো। সবাই অবাক চোখে নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। আবরার সহ আরো কিছুজন নিসার লাশটাকে জানাযার জন্য নিয়ে চলে গেল। নিসার লাশটা নিতে চলে যাবার পরপরেই নাজিয়া ঢুকরে কেঁদে উঠল, পাগলের মতো আচরন করতে লাগল। নাজিয়ার এক কাজিন ওর কোল থেকে বাবুকে নিয়ে চলে গেল। নাজিয়ার কান্না গোটা বাড়িকে কাঁপিয়ে তুলেছে, একটু আগেই যে মেয়েটা উল্টো পাল্টা কথা বলছিল, হাসছিল এখন সেই মেয়েটাই পাগলের মতো কেঁদে চলেছে। এতক্ষন ঠিক কতটা কষ্ট বুকে চেপে ছিল সেটা সকলের ধারনার বাইরে।

নাজিয়া ওর মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বল- –

-‘ওহ মা ওরা আমার দিদিকে কোথায় নিয়ে গেল! ওই অন্ধকার কবরে দিদি থাকবে কি করে মা! মা আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, দিদিকে একবার ফিরে আসতে বলো না আমি আর কখনো ওকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। মা গো আমি যে দিদির জীবিত মুখটা শেষবারের জন্য দেখতে পারলাম না, আমি দিদিকে ছাড়া কিভাবে থাকব! দিদির সাথে কথা বলে আমি যে থাকতে পারি না মা। ওহ মা দিদিকে একবার ফিরতে বলো না..

নাজিয়াকে কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যায়। নাজিয়ার কান্না, আজাহারি সবার কষ্টকে আরো দ্বিগুন করে তুলেছে। নিসা বিহীন জীবন সবার কেমন হতে চলেছে!

আজ নিসার মৃত্যুর দুইদিন। বাড়িটা সেই আগের মতোই নীরব হয়ে আছে, আবির নাজিয়া নিজেদের মতো জীবনযাপন করছে, যেন ওরা এই পৃথিবীতে নেই। আবিরের মা ছেলের অবস্থা দেখে কাঁদতে কাঁদতে শেষ হয়ে যাচ্ছেন । নাজিয়া এই বাড়িতেই আছে, বাবুর দেখাশোনা করছে কারোর সাথে কোনোরকমের কথা বলছে না।

নাজিয়া নিজের ঘরে বাবুকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল তখনি আবরার দরজায় টোকা মারল।

– ‘আসবো?’
– ‘হ্যাঁ।’

আবরার নাজিয়ার রুমে এসে কিছু একটা বলার জন্য উশখুশ করতে লাগল কিন্তু কিছু বলতে পারল না। সেটা বুঝতে পেরে নাজিয়া বলল,
– ‘কিছু বলতে চাও?’
– ‘বলছি বাবুর নাম কিছু ঠিক করলে! বার্থ সার্টিফিকেট তৈরি করতে হবে তো।’
– ‘ওর নাম আনাস আহমেদ প্রান।’
– ‘শেষে প্রানটা দিতে হবে? অনেকটা বড়ো হয়ে গেল না।’
– ‘না প্রানটা দেবে, ওহ আমার প্রান,আমাদের প্রান।
– ‘আচ্ছা দেব। আর একটা কথা।’
– ‘কি?’
– ‘দাদাকে সামলাতে পারছি না আমরা কেউ। তুমি কি একটু চেষ্টা করে দেখবে!’
– ‘আচ্ছা দেখছি।’

নাজিয়া প্রানকে ঘুম পাড়িয়ে আবিরের ঘরের দিকে পা বাড়াল। কিছুদিন আগেই এই ঘরটা ওর দিদির ছিল আজ সবকিছুই অতীত। নাজিয়া শুধুমাত্র প্রানকে আগলে রাখার জন্য এই বাড়িতে পড়ে আছে, নাহলে এইখানে ওর দমবন্ধ লাগছে নিসার স্মৃতিগুলো বড্ড তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আবির প্রানকে একবারের জন্যও কোলে তুলে নেয়নি, ছেলেটার মুখটাও ভালো করে দেখেনি।

নাজিয়া আবিরের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল, আবির নিসার ছবি বুকে জড়িয়ে নিজের মনে মনে কথা বলে চলেছে, নাজিয়ার দমবন্ধ’কর অনুভূতি হলো। আবির তো নিসাকে কম ভালোবাসত না, তাহলে তাদের ভালোবাসার এই করুন পরিনতি কেন হলো!

– ‘আবির’দা।’

আবির নাজিয়ার দিকে মুখ তুলে তাকাল, পরিপাটি ছেলেটা সেইদিনের পর থেকে কিরকম একটা এলোমেলো হয়ে আছে। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করে আর না অফিস যায়না আড্ডা দেয়না। যেন জীবনের আসল মানেটাই ভুলে গেছে।

– ‘নাজূ তুই আয় ভেতরে আয়।’

নাজিয়া ভেতরে যেতে যেতে আবিরকে প্রশ্ন করল,
– ‘কি করছো?’
– ‘তোর দিদির সাথে কথা বলছি কিন্তু দ্যাখ না তোর দিদি আমার উপর রাগ করে আছে কিছুতেই কথা বলছে না। তুই একটা বুদ্ধি দে না।’

নাজিয়ার কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে যেতে লাগল, নিজেকে সামলে নিয়ে এসেছিল কিন্তু আবিরের কথাতে সামলাতে পারল না। আগে যখনি নিসার রাগ হতো তখনি আবির নাজিয়াকে ফোন করে বুদ্ধি চাইত কিভাবে বউয়ের রাগ ভাঙাবে। এখন সত্যি সত্যি নিসা রাগ করে চলে গেছে, নাজিয়া যে আর কোনও বুদ্ধিতেই নিসাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।

– ‘কিরে নাজু বল না।’

নাজিয়া নিজেকে সামলে নিল, না ভেঙে পড়লে চলবে না। আবিরকে আবারো স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে নাহলে ছেলেটা যে পাগল হয়ে যাবে।

– ‘আচ্ছা বলব তার আগে তুমি গোসল করে খেয়ে নাও তো, আমি হবার জন্য খাবার বানাচ্ছি তাড়াতাড়ি নীচে আসো।’
– ‘আগে বল আমার বউয়ের রাগ ভাঙাব কিভাবে?’
-‘না আমার কথা আগে শুনতে হবে তবেই বলব।’

আবির বাচ্চাদের মতো মাথা নাড়িয়ে বলল,
– ‘আমি তোর সব কথা শুনব।’

নাজিয়া আর সহ্য করতে পারল না। আবিরকে কিছু না বলেই বেরিয়ে গেল কাঁদতে কাঁদতে, মানুষটা কিভাবে বাঁচবে নিসাকে ছাড়া!

#চলবে…

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-০৬

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (৬)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

“নাজু তাড়াতাড়ি হসপিটালে আয়, নিসাকে ভর্তি করানো হয়েছে।’

– ‘আমি এখুনি আসছি।’

নাজিয়াকে উত্তেজিত হতে দেখে হিরক বলল,
– ‘এনিথিং রং নাজিয়া!’
– ‘দিদিকে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়েছে, আমাকে এখুনি যেতে হবে।’
– ‘আমার কাছে বাইক আছে চল পৌঁছে দিয়ে আসি।’

নাজিয়া ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিল। এখন হিরক’কে না বলা মানে বোকামী, এই মুহূর্তে ওর নিসার কাছে পৌঁছানো’টাই আসল উদ্দেশ্য।

কলেজ থ হসপিটালের দূরত্বটা অনেকটাই। তবুও বাইকে করে পৌঁছেছে বলে দ্রুত পৌঁছে গেছে, নাহলে যেতে অনেকটা সময় চলে যেত। নাজিয়া হসপিটালের সামনে এসে হিরক’কে কিছু না বলে দৌড়ে ভেতরে চলে যায়।

নাজিয়া ভেতরে এসে দেখল, আবির বিধ্বংস্ত হয়ে বসে আছে। আবিরের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। নাজিয়া এলোমেলো পায়ে আবিরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল

– ‘আবির’দা আমার দিদি কেমন আছে?’

আবির নাজিয়ার দিকে মাথা তুলে তাকাল কিন্তু কিছু বলতে পারল না। চোখগুলো ছলছল করে চলেছে,মনে হচ্ছে ওর উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। আবিরের দিকে তাকিয়ে নাজিয়ার বুকটা কেঁপে উঠল, মনের কোনে ভয়ের সঞ্চার হলো দিদির কোনো ক্ষতি হয়ে গেল না তো! ভয়- ভীতির মধ্যে নিজেকে সামলে রাখতে পারল না, ডুকরে কেঁদে উঠল নাজিয়া।

আবরার দূরে দাঁড়িয়ে সবটাই খেয়াল করছিল, নাজিয়া এতটা তাড়াতাড়ি কিভাবে আসলো সেটা ওকে বারবার ভাবাচ্ছে। নাজিয়ার কান্না দেখে নিজেকে সামলে রাখতে পারল না, ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে নিজের বুকে টেনে নিল। একটা আশ্রয় স্থান পেয়ে নাজিয়ার কান্নার গতি আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেছে, আবরার তার প্রেয়সীর কান্না নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।

বাইক পার্ক করে, কেবিন খুঁজতে গিয়ে হিরকের আসতে অনেকটা সময় লেগে যায়। ও.টি রুমের সামনে আসতেই দেখে নাজিয়া একটা পুরুষের বুকে মাথা রেখে কেঁদে চলেছে, আর পুরুষটি পরম যত্নে নাজিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে চলেছে। হিরকের বুকটা ধ্বক করে উঠল, নিজের প্রিয় মানুষটাকে অন্যকারোর বুকে দেখে মনটা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। নাজিয়াকে আগলে রাখা পুরুষটির আগলে রাখার ধরন বলে দিচ্ছে নাজিয়ার সাথে তার সম্পর্ক কতটা গভীর। আর নাজিয়া! সেও বিশ্বস্ত মানুষ পেয়ে নিজের মনের কষ্টটা ঝেড়ে ফেলছে।

– ‘এই নাজু কান্না থামাও প্লিজ। দ্যাখো তুমি না গুড গার্ল, তোমাকে তো স্ট্রং থাকতে হবে তাই না। তুমি কান্নাকাটি করলে আন্টিকে কে সামলাবে।’
– ‘আবরার আমার খুব ভয় লাগছে, দিদি ঠিক হয়ে যাবে তো! আর পুচকু ঠিক থাকবে তো?’
– ‘ ইনশাআল্লাহ সব ঠিক থাকবে তুমি আল্লাহ তায়ালার উপর ভরসা রাখো।’
– ‘হুমম।’

আবরার নাজিয়ার হাতটাকে শক্ত করে ধরে রাখল, যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। এইদিকে হিরকের বুকের ব্যথাটা বেড়েই চলেছে। নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে অন্য কারোর সাথে দেখার ভাগ্য কারোর না হোক, এ যে এক অসহনীয় ব্যথা। যা সহ্য করার ক্ষমতা কোনো প্রেমিক পুরুষ রাখে না।

আরো বেশ কিছু সময় পর একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে পাওয়া গেল, সকলের প্রানে কিছুটা ফিরে এসেছে। নতুন একটা প্রান সবার মাঝে আসতে চলেছে এর থেকে আনন্দের কি হতে পারে। আবির অধৈর্য হয়ে পায়চারি করে চলেছে, আবরার নাজিয়ার হাতটা ছেড়ে আবিরের কাছে যায়।

– ‘দাদা চিন্তা করিস না, দেখবি সব ভালো হবে।’
– ‘আমার খুব টেনশান হচ্ছে কিছুতেই শান্ত হতে পারছি না রে।’

কিছুক্ষন পর নার্স সাদা তোয়ালেতে করে একটা ছোট পুতুলকে নিয়ে বাইরে আসল। নাজিয়া দৌড়ে গেল বাচ্চাটাকে দেখার জন্য, পুচকু’কে দেখার জন্য কতশত অপেক্ষা করছে ফাইনালি অপেক্ষার অবসান ঘটল।

– ‘ কনগ্রাচুলেশন আপনাদের ছেলে হয়েছে।’
– ‘ আলহামদুলিল্লাহ।’

নাজিয়া নার্সকে বলল,

– ‘আমি কি বাবুকে কোলে নিতে পারব!’
– ‘নিন।’

ছোট রাজপুত্র’টাকে নাজিয়া নিজের হাত দিয়ে আগলে ধরল। ছোট ছোট হাত-পা নরম তুলতুলে শরীর, অনুভূতিটাই অন্যরকম। বাবুকে কোলে নিয়ে নাজিয়ার নিসার কথা মাথাতে আসে
– ‘নার্স আমার দিদি কেমন আছে?’

নাজিয়ার প্রশ্নে আবিরের ধ্যান ফেরে, এতক্ষন ছোট বাবুটাকে দেখতে ব্যস্ত ছিল। ওর বিশ্বাস হচ্ছে না, ওর ভালোবাসার অংশ ওর সামনে। আবির কিছু মুহূর্তের জন্য অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছে, ওর কি করা উচিত সেটা প্রায় ভুলতে বসেছিল।

– ‘আসলে প্রেসেন্টে’র অবস্থা খুব একটা ভালো নয়, অতিরিক্ত ব্লাড যাচ্ছে। প্রেসেন্টের যেকোন সময়ে যা কিছু হতে পারে।’

সময়টা মনে হয় সেইখানেই থমকে গেল। আবির এক পা পিছিয়ে পড়ে যেতে গেলে আবরার সামলে নেয়। নাজিয়া বাবুকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে, মনের ভয়টা আরো তীব্রতর হয়ে উঠছে। বারবার আল্লাহ কে ডাকছে যাতে নিসা সুস্থ হয়ে যায়। নিসার কিছু হয়ে গেলে আবির পাগল হয়ে যাবে আর এই বাচ্চাটার বা কি হবে!

বাচ্চাটাকে নিয়ে সবার এত এত আনন্দ ছিল সেটা নিমিষেই হারিয়ে গেল। নিসার চিন্তায় সবাই প্রায় ভুলতে বসেছে নতুন একটা প্রান, সদস্য ওদের মধ্যে উপস্থিত আছে। বাচ্চাটা মায়ের সঙ্গ না পেয়ে কেঁদে উঠল, নাজিয়া আগে কখনোই কোনো বাচ্চাকে কোলে নিয়ে সামলাই নি বাবুকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। নাজিয়ার বেহাল অবস্থা দেখে হিরক এগিয়ে আসতে যাবে তার আগেই আবরার নাজিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়।

– ‘কি হয়েছে বাবু কাঁদছে কেন?’
– ”জানিনা, কিছু বুঝতে পারছি না। তুমি একটু দেখবে!’
– ‘দাড়াও আমি দেখছি।’

আবরার চলে গেল কিছুক্ষণ পর একজন নার্সকে নিয়ে ফিরে আসলো। নার্স বাবুকে দেখে বলল,
– ‘বেবির খিদে পেয়েছে। আপনারা ওকে ওর মায়ের কাছে দিন।’
– ‘আসলে নার্স আমাদের প্রেসেন্ট এখনো অসুস্থ তাই..
– ‘ওকে, আমি একটা মিল্কের নাম লিখে দিচ্ছি এইটা একটু কিনে এনে কষ্ট করে বেবিকে খাইয়ে দিন।’
– ‘ওকে।’

বেবিকে কিভাবে খাওয়াতে হবে সবটাই নার্সটা’ সব বলে দেয়। আবরার তাড়াতাড়ি করে মিল্ক ও ফিটার কিনে এনে খাবার রেডি করে নাজিয়ার হাতে দেয়। অনেক কষ্টের পর দুজন মিলে বাবুকে থামাতে সক্ষম হয়। (নোট- সদ্য জন্মানো বেবী কেমন হয়, কি খেতে দিতে হয় তা সম্পর্কে আমার সঠিক কোনো ধারনা নেই। তাই কিছু ভুল হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)

হিরক দূর থেকে দাঁড়িয়ে নাজিয়া আবরার ওহ বাবুকে দেখে চলেছে, ওর কাছে মনে হচ্ছে বাচ্চাটা নাজিয়া আর আবরারে’রই ওরা যেভাবে আদর যত্ন করছে তাতে অন্য মানুষের কাছে সেটাই মনে‌ হবে। বিষয়টি শুধু হিরক নয় আবিরও খেয়াল করেছে আবরার আর নাজিয়ার জায়গায় নিজেকে এবং নিসাকে অনুভব করতেই চোখটা পানিতে ভরে উঠছে। কথা ছিল তো দুজন একসাথে বেবী’কে আদর করবে, বেবি হয়েছে আর নিসার কথা মতো ছেলেই হয়েছে অথচ নিসা এখনো নিজের ছেলেটাকে একপলক দেখতে পারল ন, আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে পারল না। বেডে শুয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে চলেছে, আবিরের ভেতর থেকে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।

আবির আবরার ওহ ওর বাবাকে নিসার হসপিটালে ভর্তির কথা জানালেও ওর মাকে জানায়নি। নিসার বাবা নিসাকে ভর্তি করিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন, বাড়িতে নিসার মা একা আছেন, আবরার জোর করেই ওনাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। ওনারা এখনো‌ জানেন না নিসার কোনো খবর।

সময় যত এগিয়ে যেতে লাগল সবাই তত অধৈর্য হয়ে উঠেছে। বেশকিছুক্ষন সময় কেটে যাবার পরেও নিসার কোনো খবর পাওয়া গেল না। আবির আর নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না নাজিয়া আবরারও অধৈর্য হয়ে পড়েছে। নাজিয়া ও আবরারকে একসাথে সহ্য করতে না পেরে হিরক নাজিয়াকে কিছু না বলেই বেরিয়ে গেছে আর বলেই বা কি হতো! নাজিয়ার কি আদৌও ওর কথা মনে আছে!

ডক্টর বেরিয়ে আসতেই আবির অধৈর্য স্বরে বলল,
– ‘ডক্টর আমার ওয়াইফ কেমন আছে, ওহ ঠিক আছে তো।’
– ‘আপনারা নিজেদের সামলান, আমরা অনেক চেষ্টা করেও প্রেসেন্টকে বাঁ’চাতে পারিনি। সি ইজ নো মোর ভেরি সরি…

#চলবে….